Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1362



প্রজাপতির রং পর্ব-২১+২২

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_21+22
#Writer_NOVA

বিস্ফোরিত চোখে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী ঘুরছে।এমন কিছুও যে আমাকে দেখতে হবে তা জীবনেও কল্পনা করিনি।তাজকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একটা নারীর অবয়ব।চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।সামনের দেয়াল ধরে নিজের ব্যলেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করছি।তারা দুজন আমাকে দেখার আগেই দৌড়ে দরজার সামনে থেকে চলে এলাম।নিজের ডেস্কে এসে দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম।কার জন্য আমি পাগলামি করি?সে তো অন্য কাউকে নিয়ে ভালোই আছে।

আমিঃ এর জন্য আড়াই বছর আমার খোঁজ নেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করোনি।তোমার তো আমাকে কোন দরকার নেই। আমিই শুধু শুধু পাগলামি করলাম তোমার জন্য। সেদিন তো পারলে আমায় সবকিছু খুলে বলতে পারতে।তাও করোনি।চেহারার বদলের সাথে সাথে আমার মানুষটারও যে বদল হয়ে গেছে তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি।নতুন কাউকে নিয়ে তো ভালোই ছিলে তাহলে কেন আমার জীবনে আবার ফিরে এলে।আমি তো তোমার স্মৃতি নিয়ে ভালোই ছিলাম।কেন সবকিছু এলোমেলো করে দিলে, কেন? আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবো না এনাজ।কিছুতেই না।আমি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।এবার আমার খোঁজ কেউ পাবে না।সত্যি আমি ছেলে নিয়ে সবার চোখের আড়ালে চলে যাবো।তুমি থাকো তোমার মতো সবাইকে নিয়ে ভালো।আমার কি তাতে?

নিজের মনে কথাগুলো বলতে বলতে ডেস্কের ওপর মাথা রেখে কান্না করতে লাগলাম।হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে গেলাম।জলদী করে চোখের পানি মুছে মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে পেছনে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি আদর আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।

আমিঃ কিছু বলবেন মিস্টার আদর?

আদরঃ কি হয়েছে আপনার ম্যাম?

আমিঃ কই কিছু না তো।আমার আবার কি হবে? আমি একদম ঠিক আছি।

আদরঃ মিথ্যে কেন বলছেন ম্যাম? আমি আপনার কান্নার আওয়াজ শুনেই এখানে এসেছি। কি হয়েছে বলুন না?

আমিঃ আমার কিছু হয়নি।দেখুন এই যে আমি হাসছি।

আদরঃ এটা তো মিথ্যে হাসি।আমাকে ভাই মনে করে বলতে পারেন।আপনার কি এখানে চাকরী করতে কষ্ট হচ্ছে? কিংবা এই অফিসের কোন কর্মচারী আপনাকে কিছু বলেছে? অথবা কেউ কোন অসভ্যতামী,বাজে বিহেভ করেছে? যদি এমনটা হয় তাহলে তার নামটা বলুন।আমি তার কি অবস্থা করি তা আপনি দেখেন।(কঠিন গলায়)

আমিঃ আপনি বলছেন তাতেই আমি খুশি হয়েছি ভাই।কারো সাহস নেই আমাকে কিছু বলার।কারণ আমি তার উচিত জবাব দিতে জানি।আর যেখানে আপনার মতো একটা ভাই আছে সেখানে কেউ কি আমাকে কিছু বলতে পারে বলুন।

আদরঃ ভাই, বলে যখন ডেকেছেন তাহলে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে দিন।কি হয়েছে বলুন ম্যাম?

আমিঃ আপনি আমায় বারবার ম্যাম বলে লজ্জা কেন দিন বলুন তো? আমি বয়সে আপনার থেকে ছোট। তারমধ্যে কাজের ক্ষেত্রেও আপনার জুনিয়র। কিন্তু আপনি ম্যাম ডেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিন।আমাকে নাম ধরে ডাকলে খুশী হবো।

আদর মুচকি হেসে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো।

আদরঃ হ্যাঁ,আপনি আমার বয়সে ও কর্মক্ষেত্রে জুনিয়র। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে আপনি আমার বড়।আপনাকে যদি আমি নাম ধরে ডাকি তাহলে হয়তো আপনাকে আমার অসম্মান করা হবে না ঠিক।কিন্তু অন্য কাউকে যে অসম্মান করা হবে।আর আমি তাকে কখনোই অসম্মান করতে চাই না।

আমি চোখ,মুখ কুঁচকে আদরের দিকে তাকালাম।আদর কি জানে তাজ আমার হাসবেন্ড এনাজ? নয়তো এসব কথা কেন বললো? আমার মনে হচ্ছে আদর জানে।কিন্তু আন্দাজে ঢিল মেরে তো লাভ নেই।
আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে আদরকে জিজ্ঞেস করলাম।

আমিঃ কাকে অসম্মান করতে চাইছেন না?

আদরঃ ম্যাম,থাকুক ওসব কথা। পরে একদিন খুলে বলবো।আপনার কি হয়েছে তাই বলেন?

আমিঃ কথা ঘুরিয়ে ফেললেন।আচ্ছা, বলতে যখন চাইছেন না জোর করবো না। আপনি কি আমার একটা উপকার করতে পারবেন আদর?

আদরঃ কি উপকার ম্যাম? আপনি শুধু হুকুম করুন বান্দা হাজির আছে আপনার সেবায়।

আমিঃ আমার না অনেক খারাপ লাগছে।আমি কি আজ বাসায় চলে যেতে পারি।আপনাকে বললাম,আপনি না হয় আপনার স্যারকে বলে দিবেন।

আদরঃ কি হয়েছে ম্যাম? আপনার কি শরীর খারাপ? স্যার কে ডাকবো?(ব্যস্ত হয়ে)

আমিঃ না না তেমন কিছু নয়।আপনি ব্যস্ত হয়েন না।আমার এমনি ভালো লাগছে না তাই বাসায় চলে যেতে চাইছি।

আদরঃ কিন্তু ম্যাম,স্যারের অনুমতি ছাড়া কেউ তো ওয়ার্ক টাইমে বাসায় যেতে পারে না। আপনি স্যারের থেকে অনুমতি নিবেন প্লিজ। আমি আপনাকে অনুমতি দিতে পারবো না। আই এম এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম।

আমিঃ আপনি একটু ম্যানেজ করে নিয়েন ভাই। আমি আজ এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারাই যাবো।আর আপনার স্যারের মুখোমুখি আমি হতে চাইছি না।

আদর কিছু সময় চুপ করে কি জানি ভাবলো।বেচারাও পরে গেছে বিপাকে।তাজ এক সপ্তাহ পর আজই অফিসে এসেছে। আজই কোন ঝামেলা হোক তা আদর চাইছে না,তা আমি বুঝতে পারছি। অপরদিকে আমাকে বলেছে যে কোন সাহায্য করবে।কিছু সময় ভেবে বললো।

আদরঃ আচ্ছা ম্যাম,আপনি যান।আমি সবকিছু সামলে নিবো।

আমিঃ অনেক অনেক শুকরিয়া ভাই।

আদরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি একমিনিটও দেরী করলাম না।দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে লিফটে উঠে গেলাম।লিফটে উঠে দেখি তখনকার ঐ মেয়েটা।যে তাজকে জড়িয়ে ধরেছিলো।দেখে ভদ্রই মনে হচ্ছে। পরনেও ভদ্র মেয়েদের পোশাক।খুব মনোযোগ সহকারে মোবাইল কিছু একটা দেখছে।যার কারণে পাশে কে আছে সেদিকে নজর নেই।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।

🦋🦋🦋

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে আমি থম মেরে বসে আছি। কখন থেকে তায়াং ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কি হয়েছে আমাকে বল, কিন্তু আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না। একসময় তায়াং ভাইয়া আমার দুই বাহু ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বললো।

তায়াংঃ ঐ নোভা কি হয়েছে তোর? তুই এমন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে আমাকে বলবি তো? কি সমস্যা?

আমি তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলে আবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।মানুষটা আমার জন্য পাগল হয়ে যায়।সবসময় আমাকে ছায়ার মতো আগলে রাখে।অফিস থেকে বেরিয়ে সবার প্রথমে আমি ওকে কল করে এখানে আসতে বলেছি।আমার বলতে দেরী কিন্তু ওর আসতে দেরী হয়নি।হুট করে আমি তায়াং ভাইয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।এতে তায়াং ভাইয়া আরো বেশি অবাক হলো।

তায়াংঃ কি হয়েছে তোর? আমায় বলবি না বোইন।

আমিঃ হুম।

তায়াংঃ তাহলে বল কি হয়েছে?

আমিঃ (নিশ্চুপ)

বরফও যেমন উষ্ণ ছোঁয়া পেলে গলে যায়।তেমনি আমি সারা পৃথিবীর কাছে কঠিন থাকলেও এই মানুষটার কাছে গলে যায়। এই ভাইটা যে আমাকে আমার নিজের থেকে ভালো বোঝে।তায়াং ভাইয়া আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।হয়তো আমাকে কাঁদতে দিলো।কান্না করলে মন হালকা হয় তাই হয়তো আজ কান্না করতে মানা করেনি।কিছু সময় পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হলাম।তায়াং ভাইয়াকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালাম। তায়াং ভাইয়া আমার হাত ধরে সামনের বেঞ্চে নিয়ে বসালো।তারপর তার এক হাত আমার গালে আলতো করে রেখে বললো।

তায়াংঃ এবার বল কি হয়েছে?

আমি এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আমাকে আশ্বস্ত করে তায়াং ভাইয়া বললো।

তায়াংঃ আমাকে বল না রে শাঁকচুন্নি কি হয়েছে তোর? আমি সব ঠিক করে দিবো।

আমি চোখ মুছে তখনকার ঘটনা খুলে বলতে লাগলাম।

ফ্লাশব্যাক………..

অফিসে এসেই শুনতে পেলাম আজ অফিসে তাজ এসেছে। ওর ইংল্যান্ডের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ শেষ। আমি তাতে খুশি বা বেজার কোনটাই হলাম না।তবে সাবধান হয়ে গেলাম এর থেকে আমাকে এখন থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।এর সামনেও আমি যেতে চাই না।ডেস্কে বসে ফাইল উল্টেপাল্টে দেখছিলাম।সামনের সপ্তাহে কতগুলো বিদেশি ক্লায়েন্ট আসবে তাদের প্রোডাক্ট নিতে।সেগুলোর চেক দিচ্ছিলাম।হঠাৎ আমার এক কলিগ এসে বললো।

—- মিসেস নোভা, আপনাকে তাজরান স্যার ডাকছে।ফাইলগুলো সে একবার চেক দিবে।বুঝতেই তো পারছেন বিদেশি ক্লায়েন্টের বিষয়। কোন ভুল স্যার করতে চাইছে না।

আমিঃ আপনি কি একটু নিয়ে যেতে পারবেন?

—- আপনাকেই যেতে হবে নোভা।আপনার ফাইল আমি নিয়ে গেলে স্যার চটে যেতে পারে। তাছাড়া কোথাও ভুল হলে সেটাও তো শুধরে দিবে।সেটা সরাসরি আপনাকে দিলেই ভালো হবে।এতে আপনি আপনার ভুলগুলো বুঝতে পারবেন।পরবর্তীতে আর এরকম ভুল করবেন না।প্লিজ, কিছু মনে করবেন না।স্যার যেহেতু আপনাকে যেতে বলেছে সেহেতু আপনাকেই যেতে হবে।

আমিঃ ওহ্ আচ্ছা। শুকরিয়া বুঝিয়ে বলার জন্য।

— আপনাকেও।

আমার কলিগ চলে গেলো।আমি ফাইলগুলো গুছিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। একবার ভাবি যাবো,আরেকবার ভাবি এর সামনে ভুলেও যাবো না। অবশেষে মনকে রাজি করিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম।বাইরে আসতেই ঝড়ের গতিতে কেউ একজন দৌড়ে যেতে নিলে তার সাথে ধাক্কা খেয়ে ফাইলগুলো পরে যায়।সামনে তাকিয়ে দেখি ২২ বা ২৩ বছরের একটা যুবতী মেয়ে। আমার দিকে না তাকিয়েই ফাইল তুলতে বসে পরে।

—- আই এম সো সরি।আমি আসলে খেয়াল করিনি। প্লিজ কিছু মনে করেন না।

কথাগুলো বলতে বলতে তাড়াহুড়ো করে ফাইল তুলতে লাগলো।তারপর ফাইলগুলো আমার হাতে দিয়ে আবার সামনের দিকে দৌড় দিলে।অথচ সে আমার দিকে একটুও তাকায়নি।মনে হচ্ছে খুব তাড়ার মধ্যে আছে। আমি তার কান্ডে মুচকি হাসলাম।তারপর ধীর পায়ে তাজের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই চমকে উঠলাম।ঐ মেয়েটা তাজকে জড়িয়ে ধরে আছে।তাজের এক হাত ওর মাথায়।তারপরের ঘটনা তো জানাই আছে সবার।

ফ্লাশব্যাক এন্ড…………..

🦋🦋🦋

আমার কথা শুনে তায়াং ভাইয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।হাত মুঠ করে সে রাগ কন্ট্রোল করছে।কপালের রগ ফুলে উঠেছে। আমি ওর হাতের ওপর হাত রেখে বললাম।

আমিঃ শান্ত হো ভাই।তুই এত রাগছিস কেন?

তায়াংঃ ওর এতবড় সাহস কি করে হতে পারে?ওর বউ থাকতে অন্য মেয়ের সাথে কিসের এতো ঢলাঢলি?তুই এর জন্য কাঁদছিলি। তোর চোখ দিয়ে গত আড়াই বছর ধরে শুধু পানি ঝড়াচ্ছে।আর আমি রাগবো না। ওকে আমি ছাড়বো না। জিন্দা কবর দিবো।ওর সমস্যা কি?

আমিঃ আমিও জানি না। ওর ফ্যামেলীর খোঁজ নিয়েছিস?

তায়াংঃ হুম।

আমিঃ আমার দিকে তাকা।তুই এখন না রেগে ওর বায়োডাটা বলতো আমায়।

তায়াংঃ আমার এখন বলার মুড নেই।

আমিঃ প্লিজ ভাই বল না রে।

তায়াংঃ হু বলছি।

তায়াং ভাইয়া নিজেকে কিছুটা ঠান্ডা করে আমার দিকে ঘুরলো।ওর চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। এখন তাজকে সামনে পেলে যে দু-চার ঘা উত্তমমধ্যম দিতো তা আমি জানি।

তায়াংঃ তাজই এনাজ।কারণ এই তাজের নাকি বছর দুই আগে একটা বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে।ওদের ফ্যামেলীতে যারা আছে তারা এক বছর আগে এই নতুন বাসায় উঠেছে। তাদের আগের বাসা কোথায় তা কেউ বলতে পারে না। আশেপাশের লোকের থেকেও কোন খবর নিতে পারিনি।তবুও অনেক কষ্টে তাজের পালিত বাবার এক বন্ধুর খবর জোগাড় করেছিলাম।সে প্রথমে তাজের বিষয় মুখ খুলতে চায়নি।পরবর্তীতে অনেক কষ্টে তার মুখ খুলতে পেরেছি। সে জানালো তাজ নাকি মুরাদ সাহেবের ছেলে নয়।আড়াই বছর আগে তাজকে পেয়েছে। তারপর ওর চিকিৎসা করিয়ে নিজের ছেলের পরিচয়ে তার সাথেই রেখে দিয়েছে। তাজ যে তার ছেলে নয় সেটা জেনো কেউ জানতে না পারে তার জন্য বাসাও পাল্টে ফেলেছেন।

আমিঃ কিন্তু কেন? একটা অচেনা, অজানা ছেলের জন্য এতকিছু তারা কেন করবে? কোনভাবে ঐ মুরাদ সাহেব কোন স্বার্থের কারণে তাজকে ব্যবহার করছে না তো। আমার কিন্তু বিষয়টা গন্ডগোল মনে হচ্ছে।

আমার কথা শুনে তায়াং ভাইয়া কপাল কুঁচকে আমাকে বললো।

তায়াংঃ কথাটা তো মন্দ বলিস নি।আমি তো এমন করে ভেবে দেখিনি।

আমিঃ দেখ ভাইয়া, আমার মনে হচ্ছে এনাজ নিশ্চয়ই বড় কোন বিপদে আছে।নয়তো কেউ ওকে কোন স্বার্থ ছাড়া কেন নিজের ছেলে পরিচয়ে বড় করবে? যদি মুরাদ সাহেব স্বার্থ ছাড়াও ওকে নিজের ছেলে পরিচয়ে রাখে তাহলে এনাজ কেন এতদিন আমাদের কাছে ধরা দেয়নি? এটাও কিন্তু ভাবার কথা।

তায়াংঃ আচ্ছা চল , আমরা আগামীকাল ঐ বাসায় যাই।যদি তোর কথা তাজ ওর বাসার সবাইকে বলে তাহলে তারা তোকে চিনে ফেলবে।যদি কোনভাবে কোন ক্লু পেয়ে যাই তাজ কেন এতদিন আমাদের সামনে আসেনি।কিংবা ও কোন বিপদে আছে কিনা।

আমিঃ হুম তাই চল।কাল তোর সময় হবে?

তায়াংঃ তোর কাজের জন্য আমি সবসময় ফ্রী। যদিও একটু কাজ আছে। তবে সমস্যা নেই। পরে করে নিবো।

আমিঃ বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হবো।মাথা ঘুরাচ্ছে।চল আমাকে দিয়ে আয়।

তায়াংঃ আচ্ছা চল।

প্রথমে এনাজের ওপর ক্ষোভ থাকলেও এখন সেটা নেই।কেন জানি মনে হচ্ছে এনাজ হয়তো কোন সমস্যায় আছে।নয়তো আমার কাছ থেকে এতদূরে তো সে কখনোই থাকবে না। আর মেয়েটাই বা কে হতে পারে। সেই তথ্য খুঁজতে এখন আমাকে তাজের বাসায় যেতেই হবে।তায়াং ভাইয়া প্রথমে রাগলেও এখন পুরো স্বাভাবিক আছে। ভাইয়ার বাইকে উঠতেই সে স্টার্ট দিলো।

🦋🦋🦋

বাসার কোলিংবেল বাজাতেই পাশের বাসার এক চাচী এসে দরজা খুলে দিলো।তার হাত ধরে নাভানও এসেছে।আমাকে দেখে নাভান ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলাম।চাচীকে আমাদের বাসায় দেখে বেশ অবাক হলাম।হিমিও ততক্ষণে আমার সামনে চলে এসেছে।

হিমিঃ এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসলি যে?

আমিঃ ভালো লাগছিলো না।তাই চলে এলাম।

হিমিঃ ওহ্।ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি কিচেনে একটু আয়।আমি একা এতকিছু সামলাতে পারবো না। কতকিছু রান্না বাকি আছে এখনো।আমি একটু পর তোকে এমনিও কল করতাম।

আমিঃ কেন?বাসায় কি কেউ এসেছে? ছেলেদের জুতা দেখলাম বাইরে? এই সময়ে কে এসেছে? চাচীও আমাদের বাসায়।ঘটনা কি?

নাভানঃ এট্টা(একটা) আন্কেল এসছে।

আমিঃ কোন আঙ্কেল বাবা?

নাভানঃ আমি চিনি না।

আমিঃ ওহ্।তুমি তাকে কখনো দেখছো?

নাভানঃ না দেখি নাই।

আমিঃ ওহ্।

নাভানঃ জানো আম্মু,আমাল (আমার) জন্য এত্তগুলা তকলেট(চকলেট) আনছে আন্কেলটা।আমরে অনেক আদর করছে।

নাভানের কথা শুনে আমি হিমির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

হিমিঃ এরিন কোন একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছে। আমি তাকে চিনি না। চাচীকে আমিই ডেকেছিলাম।পোলাও রান্নায় পানির পরিমাণটা আমি বুঝি না।তাই তাকে ডেকে আনলাম।মেহমান এসেছে তার জন্য তো ব্যবস্থা করতেই হয়।তুই যখন এসে পড়েছিস তাহলে আর কোন চিন্তা নেই।

আমিঃ ওহ আচ্ছা।

আমি চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললাম।এরিন আবার কোন ছেলেকে বাসায় এনেছে। কোনভাবে সেটা রোশান তো নয়।রোশানকে তো হিমি চিনে না। যেদিন রোশান আমাদের বাসায় এসেছিলো সেদিন হিমি ঘুম থেকে উঠার আগেই রোশান চলে গিয়েছিল।যার কারণে রোশানকে হিমি দেখেনি।আমি জুতা জোড়া দরজার পাশে রেখে নাভানকে নিয়েই ভেতরে ঢুকলাম। নাভান শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।হিমি আর চাচী কিচেনে চলে গেল।

আমিঃ আমার নাভান সোনা কি ঠিকমতো খাবার খেয়েছে?

নাভানঃ হুম।

আমিঃ খালামণিদের কে জ্বালাওনি তো আজকে?

নাভান এক চোখ বন্ধ করে ডান হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে এক চিমটি পরিমাণ দেখিয়ে বললো।

নাভানঃ এট্টু জ্বালাইছি।

ওর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে আমি হেসে উঠলাম।একদম বাপের মতো কান্ড করে। এর হাসি দেখলেই আমার সারাদিনের ক্লান্তি শেষ। এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব ভুলে যাই। মাঝে মাঝে রাগের বশে একে মারলেও পরে কলিজা ছিঁড়ে যায়।তারপর জড়িয়ে ধরে যখন কান্না করি,তখন বড় মানুষের মতো ছোট ছোট হাত দুটো বাড়িয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, “আম্মু কাঁদে না”। তখন কেন জানি নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়। আমার ছেলে তো আমাকে বুঝে।ও থাকলেই হবে আমার।আর কাউকে লাগবে না।

নাভানঃ আম্মু তকলেট খাইবা?আমাল অনেক গুলো তকলেট আছে।তোমাকে দিবোনি হে।

আমিঃ আচ্ছা বাবা।গোসল করছো?

নাভানঃ না।

আমিঃ আমরা এখন গোসল করবো তাহলে।বলো ওকে। ওকে বলো।

নাভানঃ না।

আমিঃ ছি: বাবাই।গোসল না করলে তো সবাই তোমাকে পঁচা ছেলে বলবে।সবাই কি বলবে জানো?

নাভানঃ কি?

আমিঃ সবাই বলবে নাভান নোংরা ছেলে। ঠিকমতো গোসল করে না।গোসল শেষ হলেও তো বাথটাব থেকে উঠতে চাও না।আর এখন গোসল করতে মানা করো কে? চলো, চলো, আমরা জলদী জলদী করে গোসল করে আসি।তোমাকে গোসল করিয়ে আম্মু কিচেনে যাবে কাজ করতে।ততক্ষণ তুমি গুড বয়ের মতো করে থেকো।নয়তো ঐ আংকেলটা তোমাকে কি বলবো জানো? বলবে নাভান বেড বয়।তোমার সাথে আর কথা বলবে না। তোমার জন্য চকেলটও আনবে না।পাশের বাসার নীরবের জন্য আনবে।কিন্তু তোমাকে দিবে না। তখন কি ভালো হবে বলো।

নাভানঃ না আমাকে দিবে।

আমিঃ তাহলে তো তাড়াতাড়ি গোসল করতে হবে।গোসল করে আমার বাবা সুন্দর প্যান্ট-শার্ট পরবে।তাহলে সবাই আমার বাবাইকে ভালো বলবে।ইয়েহ,কি মজা!!! গোসল করলে কেউ আমার বাবাইকে বেড বয় বলতে পারবে না। চলো হাইফাইভ করি।হাত দেও জলদী করে।

নাভান হাসিমুখে ওর ছোট হাত বাড়িয়ে দিলো।আমি ওর হাতের সাথে আমার হাত মিলিয়ে দিলাম।এতে সে আরো খুশি হয়ে আমার গালে চুমু খেলো।

আমিঃ আমার বাবা এখন গোসল করবে তাই না?

নাভানঃ হুম।নাভান গুসুল করবে।

আমিঃ ওকে চলো তাহলে।

নাভানঃ ওকে।

নাভানের সাথে সোফায় বসে একদফা কথা বলেলাম।আজকাল ছেলেটাকে সময়ই দিতে পারি না। সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে যাওয়ার আগেই অপর রুম থেকে এরিনের ডাক আসলো।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সেদিকে পা বাড়ালাম।

এরিনঃ নোভা এদিকে আয়।দেখে যা কে এসেছে?

আমি ধীর পায়ে পর্দা সরিয়ে রুমে ঢুকলাম। এরিন খুশি মনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো।

এরিনঃ দেখ কে এসেছে?

আমিঃ কে?

এরিন সামনে থেকে সরতেই আমি সেই মানুষটাকে দেখতে পারলাম।তাকে দেখেই আমি অবাক।সেও যে আমাকে দেখে অবাক হয়েছে তা তার চোখ, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এ এখানে কি করছে???

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-২০

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_20
#Writer_NOVA

পূর্ব দিগন্তে রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে। কিছু সময় পর সূর্য তার রশ্মি ভুবনে ছড়িয়ে দিবে।অন্ধকার তখন লেজ গুটিয়ে পালাবে।চাইলেও সে তার অস্বস্তি গেড়ে বসে থাকতে পারবে না।সূর্যের আলোক রশ্মির কাছে তাকে হার মেনে নিতে হবে। সবকিছুর কত সুন্দর একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। চাইলেও কেউ তার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করতে পারবে না।

বারান্দায় নাভানকে কোলে নিয়ে পূর্ব দিগন্তে তাকিয়ে আছি। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটাকে ইচ্ছে করছে চিমটি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে।নিজের এই অদ্ভুত ইচ্ছের কথা ভেবে নিজেই একদফা হাসলাম।নাভান গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা দিয়ে রেখেছে। চুপচাপ আছে। যেকোনো সময় আবার ঘুমিয়ে যেতে পারে। চোখ দুটোও আজকাল বৈঈমান হয়ে গেছে। পানি পরতে চায় না। এর মধ্যে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। তাজের সাথে আমার আর কোন কথা হয়নি।হবে কি করে? ও নাকি ব্যবসায়ের কাজে ইংল্যান্ডে গেছে। আমি ভেবেছিলাম চাকরিটা আর করবো না। তাই পরেরদিন চাকরী ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু জয়েনিং লেটারের শেষ একটা লাইন দেখে ভীষণ রাগ উঠে গিয়েছিল। সেখানে স্পষ্ট লেখা ছিলো আমি জয়েন করার পর তিন মাসের মধ্যে চাকরীটা ছাড়তে পারবো না। আমি প্রথমে এই লেখাটা খেয়াল করিনি। নিজের চুল নিজেরী ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিলো তখন।মোবাইলের রিংটোনে হুশ ফিরলো। নাভানও ততক্ষণে মাথা তুলে ফেলেছে। আজ আমার কোন শো নেই। নাভানকে কোলে নিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আবার বারান্দায় ফিরে এলাম।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি স্ক্রিনে আমার ছোট বোন ইভার নাম।কপাল কুঁচকে গেলো।বাসার কারো কোন ক্ষতি হয়নি তো আবার।দুরুদুরু বুকে কলটা রিসিভ করলাম।

ইভাঃ হ্যালো বোইনে।কেমন আছো?

আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তোরা সবাই কেমন আছিস? বাসার সবকিছু ঠিক আছে তো?এত সকালে কল করলি যে।

ইভাঃ আলহামদুলিল্লাহ সবাই ঠিক আছে। এমনি তোমার সাথে কথা বলতে মন চাইলো তাই কল করলাম।

আমিঃ আমার সাথে কারো আবার কথা বলতেও মন চায়।(তাচ্ছিল্যের সুরে)

ইভাঃ এভাবে বলতাছো কেন?

আমিঃ তাহলে কিভাবে বলবো?

ইভাঃ নাভান কই? ওর কাছে একটু দেও না আমি কথা বলি। ও কেমন আছে?অনেক বড় হয়ে গেছে তাই না।

আমিঃ আমার কোলেই আছে।(নাভানের দিকে তাকিয়ে) নাভান, মণির সাথে কথা বলবে?তোমার মণি তোমার সাথে কথা বলছে বলবে।

নাভানঃ না।

আমিঃ একটু কথা বলো।

নাভানঃ না কতা(কথা) বলুম না।

ইভাঃ ওর কাছে দেও না।

আমিঃ ও কথা বলবে না। ঘুম হয় নাই তাই মনমর্জি করছে।মন ভালো থাকলে বলতো।

ইভাঃ ওহ্।

আমিঃ মন খারাপ করিস না।বিকালে আমি কল দিয়ে ওর সাথে কথা বলিয়ে দিবোনি।আব্বু-আম্মু কেমন আছে রে?

ইভাঃ তোমার জন্য আম্মু অনেক কান্না করে বোইনে।তুমি একবার নাভানকে নিয়ে আইসো প্লিজ। ওরে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি ভিডিও কল দেই।

আমিঃ কারেন্ট নেই। যার কারণে ওয়াইফাই নেই। আমি এক্সট্রা এমবি ভরি না।তাই সরি রে বোন।

ইভাঃ এর মধ্যে একবার আসো না। তুমি আসলে আম্মু-আব্বুর মনও ভালো হয়ে যাবে।নাভানরে দেখলে সবকিছু ভুলে যাবে।প্রায় তোমার আর নাভানের খবর তায়াং ভাইয়ার থেকে নেয়।আমার তো সেমিস্টার চলছে।নিশ্বাস নেওয়ার সময় পাই না।যার কারণে মোবাইল ধরা হয় না।কিন্তু তোমারে অনেক মিস করি বোইনে।তুমি আসো না প্লিজ!!!

আমিঃ তুই তো আসতে মানা করলি।আসবো কি করে?(দুষ্টমীর সুরে)

ইভাঃ তুমি মজা করতাছো😤।কবে আসবা বলো জলদী।আমাদের তো ভুলেই গেছো।তাই এখন আর খোঁজ খবর নেও না।তুমি অনেক বদলে গেছো বোইনে।আমার কথাও মনে করো না। আব্বু না হয় রাগ করে বলছে যে তোমার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তাই বলে কি তুমি তা ধরে বসে থাকবা।আব্বু-আম্মু তো কতকিছুই বলে।তা মনে কইরা কি তাদের ওপর রাগ করে থাকাটা কি ঠিক?

আমিঃ তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস ইভা।বড় বোনকে ঠিক, ভুল শিখাচ্ছিস।পরীক্ষা শেষ হলে সময় করে একদিন আমার কাছে আসে কয়েকদিন বেড়িয়ে যাস।তোর জন্য আমার বাসার দরজা সবসময় খোলা।

ইভাঃ কথা পাল্টে ফেললা।

আমিঃ আমার কারো ওপর রাগ নেই রে পুচকি।আমি শুধু নিজের ওপর রাগ করি।আম্মু,আব্বু কি করে?

ইভাঃ আব্বু এখনো ফজরের নামাজ পরে বাসায় আসে নাই।আম্মু নামাজ পরে একটু শুইছে।

হঠাৎ করে দুজনের মধ্যে একটা পিনপিনে নীরবতা বয়ে গেলো।আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালাম।সব অন্ধকার পারি দিয়ে আলোকিত হচ্ছে পৃথিবী।আচ্ছা, আমার জীবনের অন্ধকার যদি এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যেতো তাহলে কি খুব বেশি অপরাধ হয়ে যেতো।অপরপাশ থেকে ইভার ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে।নিশ্চয়ই পাগলীটা কাঁদছে। একটু বেশি ভালোবাসে আমায়।

আমিঃ তুই কেন আমার এতো ভালোবাসিস বলতো? আমি তো এগুলোর যোগ্য নই।

অপরপাশ থেকে ইভার কোন আওয়াজ আসলো না।ও এখনো নাক টেনে কাঁদছে। ওর কান্নার শব্দ আমার হৃৎপিণ্ডটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিলেও আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মনের প্রভাব নাকি মুখ দেখলে বোঝা যায়। কিন্তু কেউ এখন আমার মুখ দেখলে কিছুতেই মনের অবস্থা ঠাওর করতে পারবে না। নাভান হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। কারণ ওর হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। ইভার সাথে আরো কিছু টুকটাক কথা বলে রেখে দিলাম।নাভানকে রুমে এসে শুইয়ে দিলাম। কি নিষ্পাপ মুখটা।এর দিকে তাকিয়ে সারাজীবন পাড় করতে পারবো আমি।আর কাউকে প্রয়োজন নেই আমার।কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।বেড থেকে উঠে রওনা দিলাম কিচেনের দিকে। সকালের রান্না চড়াতে হবে তো।

🦋🦋🦋

ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো ছুটে যাচ্ছে তাদের কাজের পানে।কারো দিকে নজর দেওয়ার সময় কারো নেই। যে যার যার মতো নিজস্ব গতিতে ছুটছে।এই ব্যস্ত শহরে দেখা মিলে হাজার রকমের মানুষের। কারো সাথে হয়তোবা ঘুরো ফিরে দেখা হয়।কারো সাথে দেখা হয় না।তারপরেও ছুটে চলার গতিতে কত রকম মানুষের দেখা যে মিলে তা গুণে শেষ করা যাবে না।চারিদিকে কত ঝামেলা,কোলহল,বিরক্তিকর সবকিছু।কখনও কখনও এই কোলহলে বিরক্ত হয়ে যায় মানুষ। তারপরেও কেউ থেমে থাকে না।

দোতলা বিশিষ্ট এক ডুপ্লেক্স বাড়িতে একাই থাকে রোশান।তার পুরো পরিবার গ্রামে থাকে।বাসায় কয়েকজন সার্ভেন্ট ছাড়া কারো দেখা নেই। রোশানের সাথে বেশিরভাগ সময় ওর সেক্রেটারি তমালকে দেখা যায়।কতগুলো ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার মাঝখানে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে রোশান।দুপুর একটার দিকে আবার মন্ত্রীদের সাথে মিটিং আছে।ওর গ্রামের উন্নয়নের জন্য কতগুলো রাস্তা, ব্রীজের অনুমোদন লাগবে।সেগুলোই সুন্দর করে প্রেজেন্টেশন করছে।পাশে থাকা গরম কফির মগ থেকে ধোঁয়া উঠে বাতাসে মিলে যাচ্ছে। সেদিকে রোশানের খেয়াল নেই। সে এক ধ্যানে নিজের কাজে ব্যস্ত।বাইরের রাস্তায় দূর থেকে সবজিওয়ালা একঘেয়ে সুরে ডাক শোনা যাচ্ছে, “ঐ সবজি,ঐ সবজি”বলে। রিকশার টুংটাং শব্দও কানে এসে বারি খাচ্ছে। ওর বাসাটা মেইন রোডের থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় প্রতিদিন এসব শোনা যায়। রোশান যদিও বাইরে বেশি সময় থাকে।তবুও যেদিন বাসায় থাকে সেদিন পুরো বিরক্ত হয়ে যায়। এতো কোলাহল তার ভালো লাগে না।

তমালঃ বস, ডেকেছিলেন?

রোশান ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলো।

রোশানঃ হুম।

তমালঃ কোন দরকার?

রোশানঃ দরকার ছাড়া কি তোমাকে ডাকতে পারি না?

তমালঃ না বস,তেমন কথা নয়।

রোশানঃ কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। নতুন করে বানিয়ে নিয়ে এসো।

তমাল চোখ,মুখ কুঁচকে ফেললো। ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কফির মগ থেকে এখনো ধোঁয়া উঠছে।আর তার বস বলছে কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। এগুলো কি মানা যায়। তমাল কিছু সময় হাসফাস করে মৃদুস্বরে বললো।

তমালঃ বস, কফি তো এখনো ঠান্ডা হয়নি।দেখুন ধোঁয়া উঠছে।

রোশান ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠিয়ে তমালের দিকে দৃষ্টি দিলো।রোশানের চাহনীটা শান্ত হলেও তমাল তাতে ভয় পেয়ে গেল।ছেলেটার রাগের বিষয়ে তার ভালো আইডিয়া আছে।

রোশানঃ আমি তোমাকে কিছু বলেছি।

তমালঃ জ্বি বস।

তমাল মুখ কালো করে কফির মগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তমাল বের হতেই রোশান মিটমিট করে হাসতে লাগলো।মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই কারো সাথে রাগ দেখিয়ে ভয় পাওয়াতে ওর ভীষণ ভালো লাগে। তমাল কফির মগ দিয়ে বেশি সময় রইলো না। রোশানের মতিগতি বোঝা দুষ্কর। কখন আবার বলে বসে এটাও ঠান্ডা হয়ে গেছে নিয়ে আসতে আসতে।তাই কফির মগ রেখে দ্রুত কেটে পরলো।সেই বিষয়টা বুঝতে পেরে রোশান আরেক দফা হাসলো।তবে একটা ফোন কল এসে ওর হাসিটাকে স্থায়ী হতে দিলো না।এক হাতে ল্যাপটপে টাইপ করতে করতে আরেকহাতে কল ধরলো সে।চোখ দুটো ল্যাপটপের স্কিনে থাকায় কে কল করেছে তা আর দেখতে পেলো না।

রোশানঃ আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

—- অলাইকুমুস সালাম।কি খবর এমপি সাহেব?

রোশানঃ কে বলছেন?

—- এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? প্রতিবার কি আমায় সবকিছু মনে করিয়ে দিতে হবে?

রোশানঃ সরি, আমি চিনতে পারছি না।

—- আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাকে না চিনলেও চলবে আপনার।আপনিও তো আমার সাথে স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করলেন।

রোশানের লোকটাকে চিনতে একটু দেরী হলেও সে অবশেষে চিনতে পারলো।এটাই তো সে লোক যে রোশানকে বলেছিলো তায়াং কে মেরে ফেলতে।এতদিন কাজের চাপে সে এই বিষয়গুলো মাথা থেকে পুরো দমে ঝেড়ে ফেলেছিলো।কিন্তু এখন কি করবে?

রোশানঃ চিনতে পেরেছি।কি বলবেন বলুন?

—— আপনাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম।কিন্তু আপনি তা করেন নি।এর জন্য আপনার কি জরিমানা করতে পারি বলুন তো?

রোশানঃ আমি কাজটা করতে পারবো না। যে আমার কোন ক্ষতি করেনি তার কোন ক্ষতি আমি করবো না। আপনি আমার যতবড় উপকার কিংবা সর্বনাশই করুন।এর বিনিময়ে আপনি যত টাকা জরিমানা চান তা নিতে পারেন।

রোশানের কথা শুনে অপরপাশের মানুষটা হো হো করে হেসে উঠলো। এমন একটা পরিস্থিতি যেনো রোশান কত মজার এক জোকস বলেছে।তার হাসির কারণে রোশান কিঞ্চিত চটে গেল রোশান। তবে তা প্রকাশ করলো না।

রোশানঃ আশ্চর্য, হাসছেন কেন!!! আপনাকে জরিমানা কত দিতে হবে বলুন।আমি পাঠিয়ে দিবো।

—- টাকা দিয়ে আমায় কিনতে চাইছেন।আমাকে কেনার মতো টাকা আপনার নেই এমপি সাহেব। বরং আমি আপনার মতো হাজারটা রোশান দেওয়ানকে কিনে আবার বিক্রি করে দিতে পারবো।

রোশানঃ তাহলে আপনি কি চান?

—- জরিমানা হিসেবে আপনার পাখি ও পাখির বাচ্চাকেই না হয় দিয়ে দিন আমাকে।আমি এদের খাঁচায় বন্দী করে রাখবো।

রোশানের পিলে চমকে উঠলো। কি বলে লোকটা? জরিমানা হিসেবে নোভা আর নাভানকে কেন চাইছে? সে যে তার দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরে কি রোশান চুপ করে থাকবে।নাকি প্রতিবাদ করবে?তাও বুঝতে পারছে না।

রোশানঃ ওদের দিকে নজর দিবেন না।আপনার টাকা লাগলে বলুন আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

—- ওদের থেকে নজর আমার বহু আগের থেকে এমপি সাহেব। কথায় কথায় টাকার পাওয়ার দেখাবেন না আমায়।আপনি তো তায়াং-এর কোন ক্ষতি করবেন না।তাহলে আমার আর কি করার। আপনার পাখি আর পাখির বাচ্চাকেই শেষ করে দেই বরং।এরা দুজন শেষ হলেই সব ভেজাল শেষ। তৈরি হয়ে থেকেন তাদের লাশ হাতে পাওয়ার জন্য। আমি যেভাবে গুটি সাজিয়েছি তাতে সবাইকে ধরা দিতেই হবে।আর আমি আড়ালে বসে ছক্কা মারবো।আল্লাহ হাফেজ এমপি সাহেব। আপনাকে খবরগুলো জানানোর ছিলো তাই কল করেছিলাম।আর কোন দরকার নেই আমার।আপনি যদি তায়াং কে মেরে ফেলতেন তাহলে ওদের কোন সমস্যাই হতো না। কিন্তু আপনি তো তা করবেন না।তাই বাকি ব্যবস্থা আমিই করি। কি বলেন এমপি সাহেব?

রোশানঃ আপনি এমনটা………….. হ্যালো, হ্যালো। কলটা কেটে দিলো।

কল ব্যাক করেও লাভ হলো না। ততক্ষণে সিম বন্ধ করে ফেলেছে। বারবার অপরপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠেট মহিলাটা বলে যাচ্ছে “এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটু পর আবার ডায়েল করুন।” রোশান রাগে নিজের চুল মুঠ করে ধরে মোবাইলটাকে ফ্লোরে আছাড় মেরে কয়েক টুকরো করে ফেললো।তারপরেও রাগ কমেনি তার।এখন যদি ঐ লোকটাকে হাতের সামনে পেতো তাহলে খুন করে জেলে যেতেও ওর কোন সমস্যা নেই। ওর পাখির দিকে নজর দিয়েছে।এত সহজে কি সে ছেড়ে দিবে?মোটেও না।চোখ তুলে মার্বেল খেলবে সে।তবে এর জন্য তো ঐ লোকটাকে খুঁজে বের করতে হবে তার।
কিন্তু কিভাবে????

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_18
#Writer_NOVA

—- হ্যালো লিসেনার।গুড আফটারনোন।আপনারা টিউন করে আছেন ঢাকা এফএম 90.04 ।আপনাদের শো “লাভ কমপ্লেন” নিয়ে লাভ কুইন নোভানাজ আছি আপনাদের সাথে। ফিরলাম বিজ্ঞাপন বিরতির পরপরি।ভালোবাসা নিয়ে আপনাদের কি কি অভিযোগ আছে তা আমাকে জলদী জলদী করে টেক্সট বা কমেন্ট করে জানিয়ে দিন।আমি সেই অভিযোগ গুলোর সলিউশন দেওয়ার চেষ্টা করবো।তাহলে দেরী কিসের? ভালোবাসার বিরুদ্ধে কিংবা আপনার gf বা bf এর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো করে ফেলুন চটজলদি। কথা না বলে আমি এখন কতগুলো টেক্সট পরবো।রাজশাহী থেকে সুবর্ণা আছে আমাদের সাথে। সে বলেছে আপু,একজনকে আমি অনেক ভালোবাসি কিন্তু সে আমাকে বুঝতে চায় না।ওহ সো স্যাড সূবর্ণা।তুমি নিজেকে আরেকটু ফোকাস করো তার দিকে।তাকে বোঝাও যে তুমি তাকে ভালোবাসো।তাহলে হয়তো সে তোমায় বুঝতেও পারে।তার আগে খোঁজ নিয়ে দেখো সে অন্য কাউকে ভালোবাসে কিনা।ছেলেরা কিন্তু কাউকে সত্যিকারে ভালোবাসলে অন্য কোন মেয়ের দিকে নজর দেয় না।আই হোপ তুমি তার বিষয়ে খোঁজ নিবো।গাজীপুর থেকে চঞ্চল আছে।সে বলছে একজনকে অনেক ভালোবাসতাম আপু।কিন্তু সে আমার ভালোবাসাকে পাগলামি ভেবে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আর ভালোবাসার প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই। চঞ্চল ভাইয়া আপনাকে বলতে চাই একটা কথা। যা আমার তা কিন্তু আমারই।যা আমার নয় তা কখনো আমার ছিলো না আর কখনো হবেই না।আপনার ভালোবাসার মানুষটাও হয়তো আপনার নয়।তাই সে আপনার হয়নি।আর কে টেক্সট করছে আমাকে।আর কে আছে? পেয়েছি, ধানমন্ডি থেকে সজল আছে আমাদের সাথে। আপু তাকে অনেক ভালোবাসতাম।নিজের সবটুকু দিয়ে। কিন্তু সে আমাকে ঠকিয়েছে।আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে টাকাওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করে বিদেশে স্যাটেল হয়েছে। এখন ভালোবাসাটা সিগারেটের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছি।ভাইয়া কি বলবো খুঁজতেছি।অতিরিক্ত সবকিছুই অসহ্যকর।অতিরিক্ত কিছুই ভালো না।তেমনি ভালোবাসাটা অতিরিক্ত পেয়ে গেলে আমরা অবহেলা করি।যে আপনার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে অন্যকে বিয়ে করে সুখে আছে তাকে ভেবে নিকোটিনের ধূয়া টেনে নিজের ক্ষতি কেন করবেন ভাইয়া? দিস ইজ নট ফেয়ার।এটা কিন্তু ঠিক নয়।

গলা শুকিয়ে আসছে। বোতল খুলে গলা ভিজিয়ে নিলাম।বাপরে, এই রেডিও স্টেশনে বকবক করতে করতে আমার জীবন শেষ। সারাদিন অফিস করে কার ভালো লাগে আবার এত বকবক করতে।কিচ্ছু করার নেই স্বামী বিদেশ🤷‍♀️।ওফস সরি,আমার স্বামী বিদেশ নয়।আজ তাজ অফিসে আসেনি।ফ্যাক্টেরীতে প্রোডাক্ট দেখতে গেছে। তার জন্য শান্তিতে একটু কাজ করতে পেরেছি। কিন্তু ওকে ভীষণ মিস করেছি।শত হোক আমার জামাই বলে কথা।বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বকবক শুরু করলাম।

—- ভালোবাসা চার অক্ষরের একটা অপূর্ব শব্দ। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজার মান-অভিমান, ভালো লাগা,খারাপ লাগা, ভালোবাসার মানুষকে ঘিরে অন্যরকম অনুভূতি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম অনুভূতির মধ্যে সর্বপ্রথমে এটা আছে।আমি তো আগেই বলেছি ভালোবাসা হলো প্রজাপতির মতো।হালকা করে ধরলে উড়ে যাবে,শক্ত করে ধরলে মরে যাবে আর যত্ন করলে কাছে রবে।আর এই ভালোবাসা নামক প্রজাপতির রং গুলো হলো,, রাগ, মান-অভিমান, রেসপেক্ট, বিশ্বাস,জেলাসি ফিল করা,কেয়ার,সবকিছুতে অধিকার দেখানো ইত্যাদি ।প্রজাপতি যেমন তার রং ছাড়া অসম্পূর্ণ। তেমনি ভালোবাসা নামক বস্তুটাও এসব ছাড়া অসম্পূর্ণ। সবাই কিন্তু একভাবে ভালোবাসতে পারে না।একেকজন ভালোবাসাটা একেকভাবে প্রকাশ করে।কারো ভালোবাসা প্রকাশটা কেয়ারিং -এর মধ্যে। কারো বা শাসনের মধ্যে, কারো রাগের মধ্যে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে বুঝে নিতে হবে আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ঠিক কিভাবে ভালোবাসে।মেক্সিমাম মানুষ বুঝতে কিংবা ধরতে পারে না তার পার্টনার তাকে কোন এঙ্গেলে ভালোবাসে।যার কারণে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।সম্পর্কে ফাটল ধরে নষ্ট হয়ে যায়।সত্যি ভালোবাসার মানুষগুলো কখন তার ভালোবাসার অসম্মান করে না।হাজার চেষ্টা করবে আপনাকে তার করে রাখতে।তবে জানেন তো পৃথিবীতে একটা অদ্ভুত নিয়মে চলে।সেই নিয়মটা হলো,

” আমি যারে চাই, সে আমাকে চায় না।
যে আমাকে চায় তারে আমি চাই না। ”

এটা ১০০% সত্যি। আপনি যাকে ভালোবাসেন মন-প্রাণ দিয়ে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।আর যে আপনাকে ভালোবাসে তাকে আপনি ভালোবাসেন না।কিন্তু কি করার মনটা তো অন্য কাউকে দিয়ে বসে আছেন।চাইলেও ফেরাতে পারেন না।অনেক কথা হয়েছে। এখন কতগুলো কমেন্ট পরবো।আজকে এত কম টেক্সট ও কমেন্ট কেন আসছে।কেন কেন কেন আসছে হুম? আপনারা কি সবাই ঘুমিয়ে পরছেন? যদি ঘুমিয়ে পরেন তাহলে উঠুন জলদী করে আপনাদের অভিযোগ গুলো টেক্সট, কমেন্টও করে আমাকে জানিয়ে দিন।”পথহারা মুসাফির” নামক এক আইডি থেকে কমেন্ট করেছে।আপু, আজকাল ভালোবাসা হয় রূপ দেখে। কেউ গুণ দেখে করে না।কালো রংয়ের মানুষদের ভালোবাসতে মানা।গায়ের রং দিয়ে এখন ভালোবাসা বিবেচনা হয়।কালো রঙের বলে কেউ পছন্দ করে না।ফর্সা গায়ের রংটাই আজকাল সব।নব্বই দশকের সত্যিকারের ভালোবাসাটা এখন নেই আপু।

আপনি ছেলে না মেয়ে আই ডোন্ট নো। আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি একটা একটা করে দিচ্ছি। প্রথম প্রশ্নের উত্তর —ভালোবাসা কখনো রূপ দেখে হয় না।ভালোবাসতে কখনো কারণ লাগে না।কোন রূপ লাগে না। কারণে-অকারণেই ভালোবাসা যায়।যেই ভালোবাসা রুপ দেখে হয় সেটা কখনো সত্যিকারের ভালোবাসা হতেই পারে না। সেটা যাস্ট রূপে মুগ্ধ হওয়া কিংবা মিথ্যে ভালোবাসা।যে আপনাকে সত্যি ভালোবাসবে তার কাছে আপনার চেহারার গঠন,গায়ের রং নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। সে পুরোটা দিয়ে শুধু আপনাকে চাইবে।তবে আমরা বেশিরভাগ সময় মরিচীকার পেছনে ছুটি।সত্যি ভালোবাসা চিনতেই পারি না।দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথায় আকৃষ্ট হয়।কিন্তু সত্যি ভালোবাসার মানুষটার তেতো কথা হজম করতে পারি না।বুঝতে পারি না সে আমার ভালোর জন্য আমাকে শাসন করছে, তেতো কথা বলছে,উচিত কথাগুলো, পথগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল।

আরেকটা প্রশ্নের উত্তর —কে বলেছে আপনাকে ভালোবাসা গুণ দিয়ে হয় না? এটা আপনার ভুল ধারণা। যে আপনাকে মন-প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসবে সে আপনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে।আপনার গুণগুলোও সে হাজার দোষের ভিড়ে খুঁজে নিবে।ফর্সা গায়ের রং মোটেও সব নয়।যদি ফর্সা রংয়ে সব হতো তাহলে মানুষ রূপ ধুয়ে ধুয়ে পানি খেতো।পৃথিবীতে এত মেধা, গুণের কোন উৎসই থাকতো না। হ্যাঁ, এখন নব্বই দশকের প্রেম নেই।আমিও স্বীকার করি নেই। কেন নেই জানেন?কারণ এখন যুগ পাল্টিয়েছে।তার সাথে সাথে ভালোবাসার ধরণ, প্রকাশের ধরণও পাল্টে গেছে। ভালোবাসা নামক বস্তুটা যদি না থাকতো তাহলে কখনও আমরা টিকে থাকতে পারতাম না।যে আপনাকে ভালোবাসবে সে এমনি ভালোবাসবে।আপনার রূপে মুগ্ধ হয়ে নয়।বরং আপনার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েও হতে পারে।

সবশেষে আমি সবাইকে একটা কথা বলতে চাই। কেউ সবদিক থেকে ১০০% পারফেক্ট নয়।প্রত্যেকের মাঝে কিছু না কিছু খুঁত অবশ্যই আছে।তাই নিজেকে কখনো তুচ্ছ মনে করবেন না।আল্লাহর সৃষ্টি সবকিছু সুন্দর। গায়ের রংটা একটু চাপা হয়েছে তো কি হয়েছে? তাই বলে কি আমরা মানুষ নই।আপনার গায়ের রং কালো বলে আপনি মন খারাপ করবেন, বিষন্ন মনে থাকবেন।এটা কিন্তু ঠিক নয়। এতে তো আপনি আল্লাহর সৃষ্টিকে তুচ্ছ করছেন।তার সৃষ্টি কি কখনো খারাপ হতে পারে বলুন? উনি কত সুন্দর করে আমাদেরকে সৃষ্টি করেছে।আপনি যেরকম আছেন আল্লাহ আপনাকে যেরকম বানিয়েছেন তার জন্য বলুন আলহামদুলিল্লাহ। নিজেকে কখনো ছোট করে দেখবেন না।নিজেকে ছোট করা মানে আল্লাহর সৃষ্টিকে ছোট করে দেখা। আমিও কিন্তু সুন্দরী নই।আমার গায়ের রং শ্যামলা।তার জন্য আমি শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ। আমাকে এভাবে ভালো দেখাবে বলেই আল্লাহ এভাবে সৃষ্টি করছে।আমার এক ফুফাতো ভাইয়া আমাকে সবসময় বলতো, “নোভা, কখনও নিজেকে ছোট করে দেখবে না।তুমি এভাবেই পার্ফেক্ট বলে আল্লাহ তোমাকে এভাবে সৃষ্টি করেছে। তুমি নিজেকে কালো মনে করে শুধু শুধু নিজেকে অপমান করছো আর আল্লাহর সৃষ্টিতে অসন্তুষ্ট হচ্ছো।তুমি যেরকম আছো তার জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলো।কতটা নিখুঁতভাবে সে তোমাকে সৃষ্টি করছে। আর তুমি নিজেকে কালো বলে দাবী করছো।তুমি কাজটা ভুল করছো” আমিও ভেবে দেখলাম সত্যিই তো।ভাইয়া যা বলছে তা পুরোটাই সত্যি।

একবার ভেবে দেখুন তো, আপনাকে চাইলে আল্লাহ একটা হাত না দিতে পারতো,একটা পা না দিতে পারতো।কিন্তু তা সে করেনি।সে আপনাকে পুরো সুস্থ, স্বাভাবিক করে তৈরি করেছে। গায়ের রংটা নাহয় একটু চাপা তাতে কি হয়েছে? আপনি কি ফেলে দেওয়া বস্তু হয়ে গেছেন।বরং কালো রঙের বলে আপনাকে যে কিরকম মায়াবী লাগে তা কি আপনি জানেন? ফর্সা ত্বকের মানুষের থেকে শ্যাম বর্ণের মানুষের মুখে একটু বেশি মায়া দিয়ে ঘেরা থাকে।আপনার বিশ্বাস না হলে আপনি একজন শ্যাম বর্ণের মানুষের দিকে পাঁচ মিনিট মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে থেকেন।দেখবেন অন্য রকম একটা সৌন্দর্য খুঁজে পাবেন।তাই আমি বলবো নিজেকে তুচ্ছ করে দেখা বন্ধ করুন।আপনার গায়ের রংটা আপনার মেটার নয়।এট তো আপনি বানাননি।তাহলে কেন আপনি নিজেকে খারাপ ভাববেন?পৃথিবীর সব সৃষ্টিই সুন্দর। কারণ সবকিছুই মহান আল্লাহ তায়ালা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সৃষ্টি করেছে। গায়ের রং-এর দিকে না তাকিয়ে নিজের মনের দিকে নজর দিন।মনের দিক থেকে যে সুন্দর তাকেই সবাই ভালোবাসে।রূপ তো কিছু দিন কিন্তু ভালোবাসা চিরদিন।

দেস রাইট।আপনারা শুনছেন ঢাকা এফএম 90.04। চলছে লাভ কমপ্লেন।এবং চলবে বিকেল ৬ টা পর্যন্ত।প্রতিদিন ৪টা থেকে ৬টা অব্দি আমি আর জে নোভানাজ থাকি আপনাদের সাথে। আপনাদের শো লাভ কমপ্লেন নিয়ে। এখন সময় ৫ টা বেজে ৪৭ মিনিট।আর ১৩ মিনিট আছি আপনাদের সাথে। এখন ছোট একটা বিজ্ঞাপন বিরতি নিবো।ফিরছি বিজ্ঞাপনের পরপরি।কোথাও যাবেন না।আমার সাথেই থাকুন, ঢাকা এফএমের সাথে থাকুন।আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে অভিযোগগুলো মনের মধ্যে জমিয়ে না রেখে টাইপ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।আমি তার সলিউশন দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। ফিরছি বিজ্ঞাপন বিরতির পর।কোথাও হারিয়ে যেয়েন না কিন্তু আবার।

🦋🦋🦋

পরেরদিন…………..

দুপুরের প্রখর রোদে সবকিছু কিরকম ঝিমিয়ে গেছে। ক্যান্টিনে এসেছি দুপুরের খাবারের জন্য। মাথার ওপর চারটা ফ্যান ঘুরছে তারপরেও অসহ্যকর গুমোট একটা গরম অনুভূত হচ্ছে। ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তার সবটা দেখা যায়। রাস্তায় দুটো কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । সম্ভবত রিকাশার জন্য অপেক্ষা করছে।তারা একে অপরের সাথে হেসেখেলে কথা বলছে আবার কিছু সময় পরপর মেয়েটা ছেলেটাকে ইচ্ছে মতো পিঠে কিল,ঘুষি দিচ্ছে। ছেলেটা সুযোগ বুঝে মেয়েটার চুল টেনে দিচ্ছে। এদের দেখে তায়াং ভাইয়ার কথা মনে পরে গেলো।আমি আর তায়াং ভাইয়ার বন্ডিংটাও এমন ছিলো।এদের দেখে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পরে গেল।একবার তায়াং ভাইয়ার হাতে যেই ধাওয়া খেয়েছিলাম।ভাইয়া আমাকে খুব ধমকি-ধামকি দিয়ে মানা করেছিলো কলেজে যেনো কোন ছেলের সাথে কথা না বলি।কিন্তু আমি একবার একটা ছেলেকে পটাতে গিয়েছিলাম।তখুনি ভাইয়ার যেই ধাওয়া খাইছিলাম তারপর কানে ধরছিলাম যে কোন ছেলের আশেপাশে থাকবো না।

ফ্লাশব্যাক……. ❣️

সবার ক্রাশবয়ের আলভীর সাথে কথা বলছিলাম।আসলে কথা নয় পটানোর চেষ্টা করছিলাম।একে নাকি কেউ পটাতে পারে না।তাই বান্ধবীদের সাথে বাজি ধরে আমি আসছি পটাইতে।হঠাৎ দেখি রোডের দিক থেকে তায়াং ভাইয়া ক্রিকেট স্ট্যাম্প নিয়ে আমার দিকেই আসছে।

আমিঃ এই রে তায়াং ভাইয়া এদিকে আসছে কেন?ঐ মোটা স্টাম্প দিয়ে কি এখন দু-চার ঘা আমার পিঠে মারবে নাকি।এই পাঠারে নিয়া আর পারি না।সবসময় আমার কাজে বা হাত ঢুকাইতে বিনা দাওয়াতে চলে আসে।(মনে মনে)

আমি মনে মনে কথা আওড়াতে আওড়াতে তায়াং ভাইয়া সামনে চলে এলো।

তায়াংঃ কি রে তুই এখানে কি করছিস?(রেগে)

আমি ভাইয়াকে হেচকা টান দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেলাম।ভয়ে হাত-পা কাঁপা-কাঁপি করছে।তাও যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম।

আমিঃ আসলে ভাইয়া আমি ঐ ছেলেটাকে পটাচ্ছিলাম।হয়েছে কি…..

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তায়াং ভাইয়া হুংকার মেরে বললো।

তায়াংঃ তোকে না বলছি ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে।আর তুই নিজেই চলে এসেছিস ছেলে পটাতে।তোকে তো আজকে এই স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে সোজা করে ফেলবো।

আমিঃ ভাগ নোভা ভাগ।জানে বেঁচে থাকলে পরেও ঐ ক্রাশবয়কে পটাতে পারবি। আগে নিজের জীবন বাঁচা।

অবস্থা বেগতিক দেখে বেশ জোরে কথাগুলো বলে উল্টো দিকে দৌড় মারলাম।আমার পেছন পেছন তায়াং ভাইয়াও স্টাম্প হাতে দৌড়াচ্ছে। একবার পেছনে তাকিয়ে দৌড়ের স্প্রিড বারিয়ে দিলাম।দুপুর বেলা হওয়ায় রাস্তায় বেশি মানুষ নেই। তারপরও দু-একজন যারা আছে তারা আমাদের দিকে অবাক চোখ তাকিয়ে আছে। আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে জুতা জোড়া হাতে নিয়ে নিলাম।তারপর আবার ছুট।পেছন থেকে তায়াং ভাইয়া চেচিয়ে আমাকে থামতে বলছে।আমি কি পাগল নাকি যে থামবো।থামলেই তো ঐ মোটা স্টাম্প আমার ওপর ভাঙবে।

ফ্লাশব্যাক এন্ড………❣️

পুরোনো কথা মনে করে নিজের মনেই হেসে উঠলাম।ততক্ষণে ছেলে-মেয়ে দুটো চলে গেছে। একটা বার্গার অর্ডার করেছি সেই কখন, এখনো আসার নাম নেই। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে হিমিকে কল করলাম।

হিমিঃ হ্যাঁ বল।

আমিঃ নাভান কই?

হিমিঃ একটু খাওয়াতে বসছিলাম।কিন্তু এক লোকমাও মুখে তুললো না।

আমিঃ ও ইদানীং খাবার নিয়ে অনেক জ্বালায়।দেখিস কিছু করে খাওয়াতে পারিস কিনা।এরিন আসেনি?

হিমিঃ না ও এখনো আসেনি।নে তোর ছেলে তোর সাথে কথা বলবে।

আমিঃ দে ওর কাছে।

নাভানঃ হ্যালো আম্মু।কই তুমি? আসো। আমার জন্য বাজার থেকে চিপস,চকলেট আনো।

আমিঃ তোমার জন্য মোটা লাঠি আনবো।তুমি বেড বয় হয়ে গেছো।খাবার নিয়ে দুষ্টামী করো।

নাভানঃ না মারে না।আমি গুড বয়।

আমিঃ গুড বয় হলে চুপচাপ খাবার খেয়ে নেও।নয়তো চিপস, চকলেট কিছুই আনবো না।

নাভানঃ আচ্ছা আমি খাবো।কিন্তু তোমার হাতে।

আমিঃ এখন খালামণি খাইয়ে দিক।তার হাতে খেয়ে নেও মানিক।তুমি আমার গুড বয়।আম্মুর কথা তো শুনে নাভান তাই না?

নাভানঃ হুম।আম্মু,আমাল বাবা কো?বাবাকে নিয়ে আইসো।আমি আব্বুর সাথে খেলবো।

বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ইদানীং নাভান একটু বেশিই বাবার কথা জিজ্ঞেস করে। আমি চিন্তা করছি একদিন ওকে অফিসে নিয়ে আসবো।তাজকে দেখে যদি ঠান্ডা হয়।শত হোক ওর বাবাই তো।

আমিঃ তুমি দুষ্টুমী করো না আব্বু।আমি আসার সময় চিপস,চকলেট নিয়ে আসবো।

নাভানঃ বাবাকে নিয়ে আইসো।

আমিঃ তোমার খালামণিকে মোবাইল দেও।

হিমিঃ হ্যাঁ বল।

আমিঃ ওকে একটু দেখে রাখিস।আবার বাপের কথা মনে পরছে।সারাদিন গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।

হিমিঃ আচ্ছা।

আমিঃ রাখছি তাহলে।

কল কেটে বিষন্ন মনে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।তাজের কাছে এত সহজে আমি ধরা দিবো না।প্রত্যেকটা দিনের হিসাব নিবো আমি।কেন বেচে থাকতেও আমাকে সাদা কাপড় পরে থাকতে হয়? ছেলে,বউয়ের কোন খোঁজ নেয়নি।এমনি এমনি ছেড়ে দিবো নাকি আমি।অনেক হিসাব বাকি আছে। কেন সবকিছু এলোমেলো করে দিলো আমার।সে যখন বদলেই গেছে তাহলে আবার কেন আমার সামনে এলো।আমার স্বামীকে মৃত ভেবে আমি না হয় ছেলেটাকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।তার ওপর প্রচন্ড অভিমান ও ক্ষোভ জন্মেছে আমার।খুব সহজে এগুলো ভাংবে না।আজ অফিসে কতগুলো গেস্ট এসেছে।আমি তাদের দেখিনি।একজন কলিগের থেকে শুনছি। তাদের নিয়ে ব্যস্ত তাজ সাহেব।আমি এখন তার থেকে নিজেকে দূরেই রাখি।সে যখন পেরেছে আড়াই বছর আমার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে আমি কেন পারবো না।

আদরঃ একা একা বসে আছেন যে ম্যাম?

আমার মুখোমুখি চেয়ার টান দিয়ে বসতে বসতে কথাটা বললো আদর।আমি মুখে কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম।

আমিঃ সেই কখন একটা বার্গার অর্ডার দিয়েছি।এখনো আসার নাম নেই।

আদরঃ ওহ আচ্ছা।

আমিঃ কিছু বলবেন??

আদরঃ নাহ কিছু না।আপনি একা একা বসে আছেন তাই আরকি।

আমিঃ কোম্পানি দিতে এসেছেন?

আদরঃ তোওবা তোওবা। কি বলেন ম্যাম? আমি আপনাকে ছোট বোনের নজরে দেখি।

আমিঃ তাহলেই ভালো।

হঠাৎ আদরের হাতে থাকা মোবাইলে ভাইব্রেশন বেজে উঠলো।আদর আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা চওড়া করে উঠে যেতে যেতে বললো।

আদরঃ আচ্ছা ম্যাম থাকুন।আমি আসছি।

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই আদর কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে চলে গেল। ওয়েটার এসে বার্গার দিয়ে গেলো।আমি সেটা কোনরকম খেয়ে, বিল পে করে অফিসের দিকে চলতে লাগলাম।

নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিলাম।তখুনি এক জোড়া হাত এসে হেচকা টানে আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেল।আমি চিৎকার করতে নিলেই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে পেছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরলো।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_19
#Writer_NOVA

রক্তচোখে তাজ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে আমার তাকানোর সাহস নেই। আমাকে এখন বোধহয় খুনই করে ফেলবে।আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তাজ খুব শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো।

তাজঃ রোশান দেওয়ানের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? ওর সাথে এতো ঢলাঢলি কিসের?

তাজের এসব উল্টো পাল্টা কথা শুনে মাথায় চিনচিন করে রাগ উঠে গেলো।সবাই পেয়েছেটা কি?কোন ছেলের সাথে আমাকে দেখেলেই আজেবাজে মন্তব্য করছে।আমি কি এতটাই মূল্যহীন নাকি।মনের মধ্যে একটা ত্যাড়ামী ভাব চলে এলো।আমাকে এভাবে প্রশ্ন না করে অন্যভাবেও তো বলতে পারতো।আমি এখন কিছু বলবো না।

তাজঃ উত্তর দিচ্ছো না কেন? রোশান দেওয়ান কে হয় তোমার? ওর সাথে এক রুমে কি করছিলে? চুপ করে থাকবে না নোভা? আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে।

তার রাগ দেখে আমারো রাগ উঠলো।এত বছর খবর ছিলো না এখন এসে নজরদারি করা হচ্ছে। আমার খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।তা এই ভালোবাসাগুলো আগে কোথায় ছিলো? আড়াই বছর আমি ঠিক কতটা কষ্ট করেছি তাতো শুধুমাত্র আমিই জানি।তখন আমার তার ভালোবাসার হাতের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তখন তো আমি কাউকে পাইনি।আর এখন আড়াই বছর পর এসে আমার ওপর অধিকার দেখাচ্ছে। কিছু বলবো না আমি।দুই হাত মুঠ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি।রাগের সময় আমার আবার কোন হুশ থাকে না। কাকে কি বলি, কি করি তার কোন কিছুই আমি জানি না।

তাজঃ কথার উত্তর দেও নোভা? চুপ করে থেকে আমাকে রাগিয়ো না।তাহলে কিন্তু এর ফল ভালো হবে না। এন্সার মি।

তাজ টেবিলের ওপর থেকে ফুলদানিটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারতেই সেটা শব্দ করে ভেঙে এদিক সেদিক ছড়িয়ে পরলো।আমি কিছুটা চমকে উঠলেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।এনাজ অল্প কিছুতে রেগে যাওয়ার মতো ছেলে নয়।এখন যেহেতু রেগে আছে তার মানে আমার খবর আছে। অন্য সময় হলে আমি ভয় পেতাম।কিন্তু এখন যেহেতু আমার নিজেরই রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তাই ভয় পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।আমি আবার ছোটবেলা থেকে বিশ্ব ত্যারা।

তাজঃ তুমি চুপ করে এখনো কোন সাহসে আছো? আমার কথার উত্তর না দেওয়ার সাহস কোথা থেকে উদয় হলো তোমার? ও কি তোমার প্রেমিক?

আমিঃ রোশান দেওয়ান আমার যা খুশি তা হোক তাতে আপনার কি? কে হোন আপনি আমার?কোথা থেকে আপনি উদয় হয়েছেন? আমি তো আপনাকে চিনি না।আমার ওপর এত অধিকার খাটানোর সাহস আপনার কোথা থেকে আসে?

রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। তাজ তড়িৎ গতিতে আমার বাহু ধরে হেচকা টানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে থুঁতনি ধরে আমার মুখ উঠালে।

তাজঃ কি বললে তুমি?

আমিঃ কেন আপনি শুনতে পাননি? ছাড়ুন আমায়।আমাকে স্পর্শ করার কোন অধিকার আপনার নেই। ডোন্ট টার্চ মি।

তাজঃ এতকিছুর পরেও কি তোমাকে আমার খোলসা করে বলতে হবে আমি তোমার স্বামী এনাজ।আমি তোমার এনাজ।

আমি এক ঝাটকায় তার হাত ছাড়িয়ে হাত তালি দিতে দিতে বললাম।

আমিঃ ওয়াও, ওয়াও মিস্টার তাজরান তাজওয়ার। এখন নিজের মুখেই কথা পাল্টে ফেললেন।আপনি কিন্তু প্রথমদিন আমায় বলেছিলেন আপনি তাজ, এনাজ নয়।আপনি সত্যি আমার এনাজ নন।আমার এনাজ কখনও এমন করতে পারতো না। আমার এনাজ সেদিনই মারা গেছে। এখন যে আমার সামনে দাড়িয়ে আছে সে হলো এই কোম্পানির ওনার তাজরান তাজওয়ার। যাকে আমি চিনি না। আমার এনাজ কখনো আমাকে ছেড়ে আড়াই বছর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারতো না। আমাকে একা ফেলে চলে যেতো না।অন্য ছেলের সাথে দেখলে এরকম ব্যবহার করতো না। সো, ডোন্ট ক্রশ ইউর লিমিট।

তাজঃ আমিই তোমার এনাজ।(অসহায় মুখে)

আমিঃ আমি বিশ্বাস করি না।আমার এনাজ মারা গেছে। আপনি শুধু আমার অফিসের বস।

তাজঃ তুমি তো প্রথমদিনই আমাকে চিনে গিয়েছিলে।তারপরেও কেন এখন অস্বীকার করছো?

আমিঃ আমি তো ভেবেছিলাম চেহারা পাল্টে গেছে তো কি হয়েছে মানুষটাতো পাল্টায়নি।কিন্তু আমার ধারণা ভুল।এর মধ্যেও সে আমার খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।আমি কোথায় আছি,কি করছি, কি খাচ্ছি তার খবর নেওয়ার গুরুত্ব সেই মানুষটার নেই। আমিই বেহায়ার মতো তার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি।

তাজ অসহায় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ দুটো ছলছল করছে।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।এর দিকে তাকালে এখন ইমোশনাল হয়ে যাবো।শত হোক আমার স্বামীতো।এত সহজে আমার অভিমানের পাহাড় ভাঙ্গবে না।আমি ছোট বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে তো কম কষ্ট করিনি।সমাজের বিভিন্ন মানুষের কথায় মনটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যেতো।তাও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মুখ বুজে সহ্য করে নিতাম।সপ্তাহ খানিক আগেও তো নিজের চরিত্র সম্পর্কে বাজে কথা শুনতে হয়েছে। সে থাকলে কি কেউ এসব বলার সাহস পেতো।সমাজে সিঙ্গেল মাদারদের যে কতকিছু সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয় তা সে বুঝবে কি করে? যখন বৈধ ছেলেটাকে জারয সন্তান বলে তখন একটা অসহায় মায়ের বুকটা যে কি করে ফাটে তা সে বুঝবে কি করে? দিনরাত এক করে কোলে,পিঠে করে বাচ্চাটাকে বড় করেছি।সে থাকলে তো আমার জীবনটা সুন্দর হতো।কিন্তু তখন সে লাপাত্তা ছিলো।তার জন্য নিজেকে সাদা রঙে রাঙিয়ে নিয়েছি।তার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছি।তার সন্তান মানুষ করছি।আর সে এখন এসেছে দরদ দেখাতে।লাগবে না আমার কাউকে।

তাজঃ তুমি আমাকে এসব বলতে পারলে?

আমিঃ হ্যাঁ পারলাম।আরো কোন কথা আছে? যদি থাকে জলদী বলে ফেলুন।আমি আর আপনার কোম্পানিতে চাকরীটা করছি না।আপনার মুখটা আমি দেখতে চাই না।মুখও পাল্টে গেছে, মানুষটাও পাল্টে গেছে। আমি সত্যিই একটা বোকা।নয়তো এমন একটা মানুষের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করতাম না।

ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেছে। তাজের চোখ দিয়ে পানি পরছে। আমি নিজের চোখ দুটো নামিয়ে নিলাম।তাজ আমাকে ছেড়ে দূরে সরে গেলো।আমি জানি তাজ কাঁদছে। আমার কথায় সে অনেক হার্ট হয়েছে।কিন্তু এই কথাগুলো বলার প্রয়োজন ছিলো।আমি ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলাম।তাজ অন্য দিকে ঘুরে তাকিয়ে রইলো।এখানেও সে ইগো দেখালো।একবার আমাকে জড়িয়ে ধরে যদি বলতো আমাকে সবকিছুর জন্য মাফ করে দেও।তাহলে কি আমি করতাম না।সে কি জানে না তার সাথে আমি রাগ করে থাকতে পারি না।সে তো জানে আমি অনেক অভিমানী মেয়ে। আড়াই বছর ধরে তার প্রতি জমে থাকা অভিমান কি এত সহজে গলে যাবে? কিন্তু সে সব ভুলে আমাকে কাছে টেনে নিলে কি আমি ফিরিয়ে দিতাম? সে তো আমার বাচ্চার বাবা।নাভানের জন্য হলেও তো তাকে আমার প্রয়োজন। সেটাও সে বুঝলো না।বরং আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো।আমি আসবো না তো তার কাছে।থাকুক সে এভাবেই। লাগবে না আমার তাকে। এই চাকরীটাও আমি করবো না।

🦋🦋🦋

নিজের ডেস্কের সামনে এসে চুপ করে চেয়ারে বসে পরলাম।মাথাটা ঘুরছে।সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।আমি দুই হাতে মাথায় চেপে কিছু সময় আগের কথা মনে করতে লাগলাম।যার কারণে এতকিছু ঘটলো।

ফ্লাশব্যাক………..

নিজের কেবিনের দিকে যাচ্ছিলাম।তখুনি এক জোড়া হাত এসে হেচকা টানে আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেল।আমি চিৎকার করতে নিলেই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে আমার মুখ চেপে ধরলো।আমি সামনের ব্যাক্তিটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চমকে উঠলাম।ততক্ষণে সে আমার মুখ ছেড়ে দিয়েছে।

আমিঃ রোশান আপনি????

রোশানঃ হ্যাঁ আমি।

আমিঃ আপনি এখানে কি করছেন?

রোশানঃ আমারো সেম প্রশ্ন। তুমি এখানে কি করছো?

আমিঃ আমি এই অফিসে নতুন জয়েন করেছি দুই দিন আগে।

রোশানঃ ওহ আচ্ছা। আমি আজ এই অফিসে একটু কাজে এসেছিলাম।মুরাদ সাহেব আমার খুবই ক্লোজ। শুনলাম তার বড় ছেলে শেয়ার ব্যবসা শুরু করবে।যার জন্য আমাকে তার ছেলের সাথে একটু কথা বলতে বলেছিলো।আমার ছোট চাচ্চু আবার শেয়ার বিজনেস আছে অনেক।ছোট চাচ্চুর সাথে এসেছি।

আমিঃ আপনারাই তাহলে গেস্ট হিসেবে এসেছেন।আমি ভাবলাম কে না কে? কিন্তু আমাকে এভাবে এখানে আনার মানে কি?

রোশানঃ হুট করে তোমাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।তোমার সাথে কিভাবে কথা বলবো তার উপায় খুঁজছিলাম।তোমাকে ডাকলে তো কথা বলতে না।তাই এভাবে নিয়ে এলাম।

আমিঃ আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।কেউ এভাবে কাউকে হেচকা টান দেয়।

রোশানঃ সরি পাখি।অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেও।

রোশান কান ধরে ইনোসেন্ট ফেস করে আমাকে কথাগুলো বললো।ওর বলার ভঙ্গি দেখে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।ছেলেটা পুরো পৃথিবীর কাছে এক আর আমার কাছে আরেক। একে দেখলে আমার রাগ উঠলেও মাঝে মাঝে এর কান্ড দেখে ভীষণ ভালো লাগে। দুজন রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। একসাথেই হাঁটছিলাম আর টুকটাক কথা বলছিলাম।আসলে রোশানই কথার ঝুলি খুলেছে। আমি মাথা নেড়ে শুধু হু হা করছি।হঠাৎ পা বাঁকিয়ে জুতা উল্টে পরতে নিলেই রোশান আমার বাহু ধরে ফেললো।

রোশানঃ ঠিক আছো তুমি? কোথাও লাগেনি তো?

আমিঃ আমি ঠিক আছি।

রোশান আমাকে সোজা করে দাঁড়া করাতেই আমার চোর গেলো সামনের দিকে। তাজ তীক্ষ্ম চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তাজের চোখটা রোশানের হাতের দিকে।কারণ রোশান তখনও আমায় ধরে ছিলো।রাগে গটগট করে তাজ ওর কেবিনে চলে গেল।ঘন্টাখানিক পর রোশান চলে যেতেই আদর এলো।আমি তখন নিজের ডেস্কে কাজ করছিলাম।

আদরঃ স্যার আপনাকে ডেকেছে ম্যাম।

আমিঃ আসছি।

আমি আগে থেকেই জানতাম আমাকে তলব করা হবে। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছি।কিন্তু তারপরেও ভয় করছিলো।কিন্তু তার ঐসব উদ্ভট কথা শুনে আমারও রাগ উঠেছিলো।কেবিনে ঢোকার পর কি হয়েছে তাতো বললামই।

ফ্লাশব্যাক এন্ড……………

পরের সময়গুলো একদম অসহ্য গিয়েছে। কোন মতে কাজগুলো সেরে বাসার দিকে রওনা দিলাম।আজ শো করার মতো কোন মন-মানসিকতা নেই। বাসার দরজায় এসে কোলিং বেল বাজাতেই হিমি এসে দরজা খুলে দিলো।ওর সাথে সাথে নাভানও এসেছে।

হিমিঃ এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে? আজ শো করবি না?

আমিঃ না।

হিমিঃ তোর কি শরীর খারাপ? তোকে এরকম কেন দেখাচ্ছে? মুখ, চোখ শুকনো,চোখ লাল হয়ে আছে।

আমিঃ কিছু হয়নি।

ওদের পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম।হিমি আমার পিছু না এলেও নাভান আমার পিছু ঠিকই এলো।কারণ অন্য দিন বাসায় এলে ওকে কোলে তুলে নেই।

নাভানঃ আম্মু, বাবা কই?

তড়িৎ গতিতে ওর সামনে এগিয়ে গিয়েই গালের মধ্যে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।নবাবজাদার আবার বাবার কথা মনে পরে গেছে। নাভান কিছু সময় ঠোঁট উল্টে জোরে কান্না করে উঠলো।

আমিঃ বাবার জন্য আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে? সারাদিন খেটে মরি আমি আর তোমার দরদ হয় বাবার জন্য? আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে বাবার গুণগান গাওয়া।কই তোর বাবা তো একবারও তোর খবর নিলো না।একটি বার আমায় প্রশ্নও করলো না তুই কেমন আছিস? সে তো তোর কথা মনে করে না।তাহলে তুই কেন সারাদিন বাবার গান গাস?

নাভান গালে হাত দিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে। তা দেখে কেন জানি আরো রাগ উঠে গেল।নাভানের কান্না আর আমার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে হিমি ছুটে এলো।আমাকে একদফা বকে নাভানকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল।আমি খাটে ধপ করে বসেই মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পরলাম।আমার জীবনটা তো এমন না হলেও পারতো?

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_16
#Writer_NOVA

আজও একঘেয়েভাবে কানের কাছে টেবিল ঘড়িটায় এলার্ম বেজে যাচ্ছে।বালিশের ওপর হাতড়ে সেটাকে নিয়ে ঘুমের মধ্যেই বন্ধ করে দিলাম।ঘুমের রেশ কাটেনি।মাথাও ঝিমঝিম করছে।হাত-পাগুলো অবশ হয়ে আসছে।উঠতে চাইলেও উঠতে মন চাইছে না।বালিশে আবার মাথাটা হেলিয়ে দিতেই এলার্ম বেজে উঠলো।এই ঘড়ি আমাকে শান্তিতে ঘুমতে দিবে না। এবার বন্ধ না করে বালিশের নিচে মাথা দিয়ে দুই কান চেপে ধরলাম।এলার্ম বন্ধ না করলে কি ও থামবে।এক বস্তা বিরক্তি নিয়ে উঠে বসতেই হলো।ঘড়ি হাতে নিয়ে এলার্ম বন্ধ করলাম।আমি পরপর ৫ মিনিট পর চারটা এলার্ম দিয়ে রাখি।একটা শেষ হলেই আরেকটা শুরু হয়ে যায়।দূর থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে।ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম আমার পুত্রধন বালিশে পা দিয়ে মাথা পায়ের দিকে দিয়ে উল্টো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিলাম। এর কাজই হলো ঘুমের মধ্যে সারা খাট ঘুরা।চুলগুলো খোপা করতে করতে রওনা দিলাম ওয়াসরুমের দিকে।

এরিনঃ কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজ না তোর অফিসের প্রথম দিন।এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো দেরী হয়ে যাবে।রান্না করবি,শো করবি তারপর আবার অফিস।আজ থেকে আবার আরেকটা যুদ্ধ শুরু হলো তোর।নিজেকে শক্ত কেন তৈরি কর তার জন্য।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের ফ্রেশ বাতাস উপভোগ করছিলাম।নামাজ পরে বারান্দায় দাঁড়াতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। তখন চারিদিকে একটা আবছা আলোতে ঘিরে থাকে পৃথিবী। অন্ধকার বিদায় নিয়ে আলোর আগমন হয়। যেটা উপভোগ করতে আমার অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে।এরিন আমার পাশে দাঁড়িয়ে এসব কথা বললো।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে নিষ্পলক চোখে ওর দিকে তাকালাম।

এরিনঃ কি হয়েছে তোর?

আমিঃ আমার আবার কি হবে?

এরিনঃ তুই কি আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?ইদানীং তোকে প্রায় আপসেট দেখা যায়।

আমিঃ তুই আজ এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলি?হিমি কি ঘুমোচ্ছে? তোর ক্লাশ কয়টায়?

এরিনঃ কথা ঘুরিয়ে ফেললি।তুই আজকাল বড্ড অদ্ভুত হয়ে গেছিস।

আমি ওর কথার উত্তর দিলাম না।মুচকি করে হেসে বাইরের দিকে মন দিলাম।পূর্ব দিগন্তে রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যে সূর্যি মামাকেও হয়তো দেখা যাবে।আন্ধাকারের কোন রেশ থাকবে না। আমাদের জীবনটাও যদি এমন হতো।সূর্যের আলো দিয়ে সব অন্ধকার দূর করা যেতো।তাহলে হয়তো এতটা অসহ্যকর জীবন অতিবাহিত করতে হতো না।

এরিনঃ রান্না করবি না?

আমিঃ হুম।

এরিনঃ চল তোকে সাহায্য করি।আজ তোকে এমনি অনেক ধকল সহ্য করতে হবে।

আমিঃ আমি সামলে নিতে পারবো।তোর কিছু করতে হবে না।

এরিনঃ বেশি কথা বলিস না তো। চল আমার সাথে।

এরিন জোর করে আমাকে টেনে কিচেনের দিকে যেতে লাগলো।আজ বেশি কিছু করবো না। সকালের জন্য পাউরুটি টোস্ট, ডিম অমলেট ব্যাস শেষ। এই শর্টকাট রান্নার বুদ্ধিটা অবশ্য এরিনেরই।এই মেয়ে দুটো না আমাকে এতটা বুঝে যে ততটা আমিও বুঝতে পারি না।এরিন,হিমি আর তায়াং ভাইয়া না থাকলে যে আমি নাভানকে নিয়ে কোথায় থাকতাম তা একমাত্র আল্লাহ জানে।নিজেকে এদের জন্য খুব ভাগ্যবতী মনে হয়। মিনিট পনেরোর মধ্যে সব কাজ হয়ে গেলো।টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমি খেতে বসে পরলাম।আর এরিন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

এরিনঃ কি রে খাচ্ছিস না কেন?কখন থেকে খাবার নিয়ে বসে আছিস।খেয়ে তৈরি হয়ে নে।শো করতে কি যাবি না?

আমিঃ আমার কিছু খেতে মন চাইছে না। জানিস, এরিন আমার না মনে হচ্ছে আমার সাথে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। আমি আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছি। মনটা বড্ড আনচান করছে।

এরিনঃ আরে তেমন কিছুই না।সারাদিন নানা কিছু নিয়ে অযথা চিন্তা করতে থাকিস তাই এমন হচ্ছে। কাজে ব্যস্ত থাকলে দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমিঃ সেদিন রাতে নাভানকে নিয়ে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি। ওকে নিয়ে অনেক ভয় করছে। ওকে একটু সাবধানে রাখিস।গতকালে তায়াং ভাইয়া বললো ওকে নাকি গত দুইদিন ধরে কেউ ফোলো করছে।আমার ভীষণ ভয় করছে এসব চিন্তা করে।নাভান,তায়াং ভাইয়ার কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না রে।তোরা তো জানিস এই ভাইটা আমার জন্য কি কি করেছে। ও যা করেছে আজকাল আপন ভাইও এমন করে না।এনাজ মারা যাওয়ার পর আমাকে একমাত্র তায়াং ভাইয়া সামলিয়েছে।ও ছিলো বলেই আজ আমি ও নাভান বেঁচে আছি।এখনো সবার আগে আমাদের কথা ভাবে।নিজের জীবনের পরওনা না করে আমাদের জন্য পাগল হয়ে যায়।কোথাও যাতে আমার বা নাভানের কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল ওর।এতে যদি নিজের জীবনও বাজি রাখতে হয় তাতেও দ্বিধা করে না।যে আমাদের মা-ছেলের জন্য এতকিছু করছে তার বিপদে আমি কিছু করতে পারছি না। নিজেকে এখন ইউসলেস মনে হচ্ছে।

এরিনঃ তুই খামোখা চিন্তা করছিস।আল্লাহ আছে তো আমাদের সাথে। উনি যা ভালো মনে করবে তাই আমাদের সাথে ঘটবে।

আমিঃ হুম তাও ঠিক।আমি উঠছি।গোসল সেরে তৈরি হতে হবে।

এরিনঃ কিছুই তো খেলি না।আমি কি টিফিনবক্সে করো দিয়ে দিচ্ছি।শো এর মাঝে খেয়ে নিস।

আমিঃ আমার গলা দিয়ে কিছু নামছে না।আর মনে হয় না নামবে।

এরিনঃ চুপচাপ খেয়ে নিবি।চিন্তা করতে করতে নিজের কি হাল করেছিস দেখছিস।আমি টিফিনবাক্সে দিয়ে দিলাম।

আমি কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে এরিনকে জড়িয়ে ধরলাম।এই মেয়েটার আমার সবদিকে নজর।আমি কিসে ভালো থাকবে, কোনটাতে আমার ভালো হবে তার দিকে খেয়াল রাখবে।এরিনকে ছেড়ে ধীর পায়ে রুমের দিকে হাঁটতে লাগলাম।

🦋🦋🦋

—– আসসালামু আলাইকুম। হ্যালো লিসেনার।শুভ সকাল সবাইকে।আপনারা শুনছেন ঢাকা এফএম 90.4।আমি RJ নোভানাজ আছি আপনাদের শো ভোরের পাখি নিয়ে। সকাল ৭টা থেকে ১০ টা অব্দি আমি থাকছি আপনাদের সাথে। সবাই ভালো আছেন তো? দিনকাল কেমন কাটছে? আমার তো সবকিছু বোরিং লাগে।মুক্ত বাতাসে মনভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলে ও পাখির কিচিরমিচির শুনে ঘুমের থেকে উঠতে পারলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু এই ব্যস্ত নগরীতে সেই ফ্রেশ বাতাস তো নেই।সেখানে পাখির দেখা মেলাই ভার।গ্রামে থাকতে প্রতিদিন সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাংতো।সেই দিনগুলো ভীষণ মিস করি।শহরটাতো বড্ড মনমরা ও বিষন্ন। চারিদিকে বিভিন্ন দূষণে আজ আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেনও দূষিত হয়ে পরছে।এর পেছনে দায়ী কিন্তু আমরা।এই স্বার্থপর শহরে তো কোন পাখির দেখাও মিলে না।পাখির কিচিরমিচির যে নিমিষেই মন ভালো করে দিতে ক্ষমতা রাখে।এখানে শুধু কাকের দেখা পাবেন।সেখানে আমি এসে হাজির হয়েছি ভোরের পাখি নিয়ে। কেমন আছেন আপনারা? তা জলদী জলদী করে আমাকে টেক্সট ও কমেন্ট করে জানিয়ে দিন তো।আমাকে টেক্সট করতে হলে আপনাকে যা করতে হবে।আপনার ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে আপনার নাম, লোকেশন ও মনের কথা টাইপ করে পাঠিয়ে দিতে হবে ২৬৯৩৬৯ এই নাম্বারে।কমেন্ট করতে হলে জয়েন হতে হবে আমাদের অফিসিয়াল পেইজে। কথা না বলে চলুন ঘুরে আসি গানে।আপনাদের পছন্দের গানের কথাও কিন্তু আমায় জানিয়ে দিতে পারেন।আমি তা বাজিয়ে দিবো।সকাল সকাল এক কাপ চায়ের সাথে নিজের পছন্দের গান হলে কিন্তু মন্দ হয় না।কথা না বাড়িয়ে আমি গানে চলে যেতে চাইছি।কোন গানটা শোনা যায়?কোন গানটা? হুম পেয়ে গেছি।আমার প্লে লিষ্টে সবার আগে আমার প্রিয় একটা গানই আছে।এতক্ষণ পাখি নিয়ে কথা বলছিলাম।আর প্লে লিষ্টে দেখছি সর্বপ্রথমে বেলাল খান ও লিজার নিউ সং “পাখি” আছে।দেরী না করে চলুন শুনে আসি।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

মনের ঘরে বসত করে,ছোট্ট একটা পাখি
সেই পাখিরে যতন করে,মনেই বেঁধে রাখি।

উড়াল পাখি করে আমায় বড় জ্বালাতন
সেই জ্বালাতে ধিকিধিকি জ্বলে সারাক্ষণ
সুযোগ পেলে চতুর পাখি উড়াল দিতে চায়
মনটা আমার খা খা করে ভীষণ যাতনায়।

ও পাখি, পাখিরে তোরেই শুধু ডাকিরে
রোদে রাঙা ভোর, নিশি ঘনঘোর
তোরেই শুধু ডাকিরে

ও পাখি, পাখিরে তোরেই শুধু ডাকিরে
রোদে রাঙা ভোর, নিশি ঘনঘোর
তোরেই শুধু ডাকিরে

(বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।লিখতে ইচ্ছে করছে না।)

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

গান চলছে নিজের মতো করে। কিন্তু আমার সেদিকে মন নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিলাম।শো শেষ করে আবার অফিসে যেতে হবে এটা মনে হতেই কান্না আসছে।এত ঝামেলা আর ভালো লাগে না। আমি একটু শান্তি চাই। ঐ তাজের সাথে দেখা হওয়ার আগেই থেকে মানসিক অশান্তিতে ভুগছি।তারপর একটার পর একটা ঘটছে।দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে চট করে সেদিকে তাকালাম।

সাইমনঃ আসতে পারি মিসেস আহমেদ ?

আমিঃ হুম।

সাইমনঃ কফি!!!

আমিঃ আপনি কি ইদানীং আরজে ক্যারিয়ার ছেড়ে পিয়নে যোগ দিলেন নাকি মিস্টার সাইমন?

সাইমনঃ হঠাৎ এরকম কথা কেন?

আমিঃ না ইদানীং প্রায় খেয়াল করছি সকালের কফিটা আপনি সবাইকে দিয়ে যান।তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে। আপনি আরজে ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে অফিসের পিয়নের চাজরীটা লুফে নিলেন না তো।

সাইমনঃ আপমান করছেন?

আমিঃ একদম না। প্রশ্নই উঠে না।

সাইমনঃ আমার কিন্তু তেমনি মনে হচ্ছে।

আমি কথা না বলে কফির মগে চুমুক দিলাম।ছেলেটা ভীষণ ধুরান্দাজ।এর বায়োডাটার কিছুই আমি জানি না। শুধু আমি নই এই এফএম অফিসের কেউই জানে না। উনাকে জিজ্ঞেস করলেও নানা টালবাহানায় এড়িয়ে যায়।অন্যের পার্সোনাল বিষয় নিয়ে জীবনেও আমার মাথাঘামানোর প্রয়োজন পরেনি।আসলে আমার এই বিষয়টা ভালো লাগে না।তাই আমি এসব করি না।কিন্তু এই মানুষটাকে আমার মনে হয় অনেক বড় ঘাপলা আছে তার মধ্যে।

আমিঃ একটা কথা বলবো আপনাকে?

সাইমনঃ নিশ্চয়ই মিসেস আহমেদ।

আমিঃ আপনি নিজেকে যতটা বোকা প্রকাশ করেন আপনি কিন্তু মোটেও সেরকম নন।আপনি অনেক রহস্যঘেরা একটা মানুষ।এটা আমি ভালো করেই জানি।এবং আপনিও ভালো করে জানেন।তাই এসব বোকা ভাবটা না আমার সামনে প্রকাশ করবেন না।আমার এটা পছন্দ নয়।

সাইমনঃ আপনি সিবিআই অফিসারের বউ ম্যাডাম।আপনার স্বভাবটা তাই স্বামীর মতো হয়ে গেছে। সবকিছুতেই সন্দেহ করেন।

আমিঃ আপনি কথায় কথায় আমার স্বামীকে কেন টানেন বলেন তো? প্রত্যেকটা টপিকে ওর কথা আপনাকে বলতেই হবে।কিন্তু কেন?

সাইমনঃ আপনার স্বামীকে অনেক ভালোবাসতেন তাই না???

আমিঃ আগেও ভালোবাসতাম, এখনো বাসি আর ভবিষ্যতেও বাসবো।কিন্তু আপনি আমার কথা ঘুরানেন কেন?

সাইমনঃ নাহ্ তেমন কিছু না।আপনার মুখে আপনার স্বামীর অনেক কথা শুনেছি। তার ব্যক্তিত্ব আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। এমন একটা গুড পার্সোনালিটি মানুষের বউয়ের সাথে আমি কথা বলতে পারি তাতে আমি আনন্দিত।তাকে ভালো লাগে বলেই কথায় কথায় আমি তার নাম নেই।

আমিঃ আমি জিজ্ঞেস করলাম কি? আর আপনি উত্তর দিলেন কি?

সাইমনঃ আমি আসলে আপনার মতো এত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।শো করেন।আপনার লেট হচ্ছে।

কথাগুলো একদমে বলে দ্রুত বের হয়ে গেলো সাইমন।একে আমার দিনকে দিন রহস্যময় মনে হচ্ছে। এর মধ্যে বড় কোন ভেজাল নিশ্চয়ই আছে। আমি আর একে নিয়ে মাথা ঘামালাম না।এমনি টেনশনে শেষ। নতুন করে অন্য কোন টেনশন মাথায় নিতে চাই না। কফির মগে ধীরে সুস্থে চুমুক দিলাম। ব্যাকগ্রাউন্ডে নেহা কাক্করের “ইস ম্যে তেরা ঘাটা, ম্যারা কুছ নেহি যাতা” সং টা বাজছে।

🦋🦋🦋

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে লিফটের কাছে চলে এলাম।আজ অফিসে প্রথম দিন।একটা চাপা ভয় ও উত্তেজনা কাজ করছে।প্রথম দিনই অলরেডি পাঁচ মিনিট লেট।যামে পরেছিলাম।জয়েনিং লেটারটা সাইড ব্যাগেই আছে।এরিনের দেওয়া টিফিনবক্সটা যেভাবে দিয়েছিলো সেভাবেই আছে। ভুলেও খুলিনি।লিফটে এসে দেখলাম আগের থেকে মানুষ ছিলো।

আমিঃ আমাকেও নিয়ে যান।

লিফট মাত্রই বন্ধ হতে শুরু করেছিলো।আমার কথা শুনতেই একজন দরজার মাঝখানে হাত দিয়ে তা থামালো।আমি দ্রুত ভেতরে ঢুকে পরলাম।ঢুকতেই ২৬/২৭ বছরের একটা ছেলেকে দেখতে পারলাম।

—- হাই!!!!

অদ্ভুত তো।চেনা নাই, জানা নেই আমাকে হাত নাড়িয়ে হাই জানালো।আমি কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালাম।তার পরনে কোর্ট-প্যান্ট, চোখে চশমা।আর মুখে চুইংগাম নিয়ে গরুর জাবরকাটার মতো করে চাবাচ্ছে। মাঝে মাঝে জিহ্বা দিয়ে বাবল বানাচ্ছে। তার বাবলগুলো যখন ফাটছে তখন টাস টাস শব্দ সৃষ্টি করছে।যেটা আমার বিরক্ত লাগছে।কে জানে কে ছেলেটা?পুরো লিফটে সে আর আমি।আমি চোখ নামিয়ে সামনে দৃষ্টি দিলাম। আমি আল্লাহ আল্লাহ করছি যাতে অফিসের বস কিছু না বলে।তাজরানকে তো ভালো করেই চিনি।কিন্তু আরিয়ান যদি কোন ভেজাল করে।টুইং শব্দ করে লিফটের দরজাটা খুলে গেল।আমি আর সে একসাথেই লিফট থেকে নেমে গেলাম ৪র্থ ফ্লোরে। আমি দ্রুত পায়ে সেদিনের সেই হলরুমে চলে গেলাম।

আমিঃ আসতে পারি???

আমার কথা শুনে সবাই আমার দিকে নজর দিলো।আদর সবাইকে কিছু একটা বুঝাচ্ছিলো।আমার দিকে না তাকিয়ে সে মুখে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলো।কিন্তু আমার দিকে তাকাতেই তার বিরক্তি ফুস।হাসি মুখে আমাকে বললোো।

আদরঃ জলদী আসুন।নয়তো দেরী হয়ে যাবে।

আমিঃ শুকরিয়া।

আমি ভেতরে প্রবেশ করে একটা চেয়ার টেনে বসলাম।এখনো অনেকে আমার দিকে কিরকম করে যেনো তাকিয়ে আছে। আমি সেদিকে খেয়াল না করে সামনের দিকে মন দিলাম।আদর খুব মনোযোগ সহকারে কতগুলো প্রেজেন্টেশন বুঝিয়ে দিচ্ছে।

—– আদর, তোমাকে তাজরান ভাই ডাকছে।তুমি একটু শুনে আসো।ততক্ষণে আমি এদিকটা সামলাই।

মৃদুস্বরের একজন কণ্ঠ শুনে চট করে দরজার দিকে তাকালাম।লিফটের সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। সে শান্তপর্ণে ভেতরে ঢুকলো।

আদরঃ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।এ আমাদের কোম্পানির আরেক ওনার। উনার নাম আরিয়ান আজওয়ার।তাজ স্যারের ছোট ভাই। (আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে) স্যার, আপনি একটু এখানে থাকুন।আমি আসছি।

আমিঃ ওহ্ এই চুইংগাম খাওয়া জাবরকাটা গরুটাই তাহলে আরিয়ান।এটা কোনভাবে আমার দেবর এনাম নয় তো? চাল-চলনে তো মনে হয় না। আল্লাহ ভালো জানে।দুই ভাই চেহারা পাল্টিয়ে ঘুরছে কিনা।আমি এদের চক্করে পাগল হয়ে যাবো।(মনে মনে)

আদর মিনিট চারের মধ্যে ফিরে এলো।এসেই সামনের টেবিলে কতগুলো ফাইল এলোমেলো করতে লাগলো।একসময় সবুজ রঙের একটা ফাইল হাতে নিয়ে আমাকে ডাকলো।

আদরঃ মিসেস নোভা ইসলাম কে?

আমিঃ জ্বি আমি।(দাঁড়িয়ে)

আদরঃ আপনাকে তাজ স্যার ডাকছে।এই ফাইলটা নিয়ে উনার সাথে দেখা করে আসুন।

আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম।এই তাজ কি আমাকে বের করে দিবে নাকি? যদি বের করে দেয় তাহলে হাতেনাতে ধরবো কি করে আমার এনাজকে।আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা নিয়ে এগুতে লাগলাম। পেছন থেকে আদর ডাকলো।

আদরঃ ম্যাডাম শুনুন।

আমিঃ জ্বি বলুন।

আদরঃ এখানে একটা ছোট টুকরো কাগজ আছে। সেটাও নিয়ে যান।

আদরঃ জ্বি দিন।

আদরঃ ম্যাম, আপনি কিন্তু আবারো সেদিনের মতো ভয় পাচ্ছেন।এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার স্যার বাঘ বা ভাল্লুক নয় যে আপনাকে খেয়ে ফেলবে।

আমিঃ তেমম কিছু নয়।একটু নার্ভাস লাগছে।প্রথম প্রথম তো তাই।

আদরঃ অল দ্যা বেস্ট ম্যাম।

আমিঃ শুকরিয়া।

চার ভাজ করা কাগজের টুকরোটা নিয়ে আমি ভীরু পায়ে তাজের কেবিনের দিকে যেতে লাগলাম।যত এগুচ্ছি ততই আমার হৃৎপিণ্ডটা ধপধপ করছে।এত নার্ভাস হওয়ার তো কথা নয়।তবুও কেন হচ্ছি জানি
না। কে জানি এত ভয় এসে কোথা থেকে ভর করছে। আলতো হাতে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই যা হলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।ভেতরে যেতেই ___________

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_17
#Writer_NOVA

চোখ বন্ধ করে দুই হাতে জামা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি।তাজ আমার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার চোখ-মুখে উপচে পরছে।এখন আমার আর তাজের দূরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির।সারা শরীর কাঁপছে আমার।তাজের কোন শব্দ না পেয়ে পিটপিট করে ওর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম সে আমার দিকে ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটোতে আমি অন্যরকম একটা তৃষ্ণা দেখতে পাচ্ছি। বহুদিন পর আমাদের প্রিয় জিনিসটা যখন আমরা কাছে পাই তখন আমাদের চোখ, মুখে যেই উচ্ছ্বাসটা থাকে তাও খুঁজে পাচ্ছি তাজের মুখে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় তাকে বলে উঠলাম।

আমিঃ একটু সরুন আমি তো নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমার নিশ্বাস নেওয়ার অক্সিজেন তো আপনার বিশাল জলহস্তীর মতো দেহ দিয়ে আটকে রেখেছেন।

তাতেও তার হুশ নেই। সেই মাদকতার চোখে আমার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাব-ভাব আমার ভালো ঠেকছে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে আছে আমার।আর সে দুই হাত দেয়ালের দুই দিক দিয়ে আমাকে আটকে রেখেছে। চাইলেও আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না। ইচ্ছে তো করছে তার পায়ে টাইট করে, একটা পা দিয়ে মাড়িয়ে এখান থেকে ছুটে পালাতে।

আমিঃ মিস্টার তাজ🥶!!!!
তাজঃ হু।
আমিঃ আমাকে কেন ডেকেছিলেন?
তাজঃ হু।
আমিঃ আমি আপনাকে কিছু বলছি।
তাজঃ হু।
আমিঃ কি হু হু শুরু করছেন?(রেগে)
তাজঃ হু।

উফ, অসহ্যকর।আমি এতো কথা বলে যাচ্ছি আর উনি আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে হু হু করেই যাচ্ছে। এখন প্রচন্ড রাগ উঠছে। তখন ভেতরে ঢুকতেই এক ঝাটকায় আমাকে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে সেই যে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে এই অব্দি আমি দাঁড়ানো। তার চোখের সামনে আমি হাত নাড়ালাম। এতে তার কোন ভাবান্তর দেখা গেল না।সে আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকে গেলো।তার ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের দিকে বাড়িয়ে দিতেই আমি এক হাত দিয়ে আমার ঠোঁট আটকে,আরেক হাতে তাকে ধাক্কা দিলাম।এতক্ষণে মহাশয়ের টনক নরলো।দেয়ালের থেকে দুই হাত সরিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে গেলো।

আমিঃ লুচি,পরোটা বেডা।অফিসের কেবিনে ডেকে এনে লুচ্চামি শুরু করছে।আমার এনাজ না হলে এতক্ষণে গাল দুটো লাল করে ফেলতাম।সামান্য কমোন সেন্স নেই। এসব করতে আমাকে এখানে ডেকে আনছে।একদম চোখ তুলে লুচুগিরি ছুটায় ফালামু। এতদিন খবর ছিলো না।এখন বউয়ের ওপর ভালোবাসা উথলে উঠছে।(বিরবির করে)

বিরবির করে আপন মনে তাজকে বকছিলাম।সামনের দিকে তাকাতেই চুপ হয়ে গেলাম।কারণ তাজ আমার দিকে বাজপাখির নজরে তাকিয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে দমে গেলাম।কিন্তু সে আমাকে এক হাতে টেনে আবারো দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।

আমিঃ আশ্চর্য, সমস্যা কি আপনার? কি শুরু করছেন? কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরছেন।ছাড়ুন আমায়।(বিরক্তির সাথে)

তাজঃ আমি কিছু বলেছিলাম সেদিন।(শান্ত কণ্ঠে)

আমিঃ আপনি আমাকে ছাড়ুন।আমার লাগছে।

আমি নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করা শুরু করলাম।কিন্তু এই জলহস্তীরটার থেকে নিজেকে একচুলও সরাতে পারলাম না।আমার দুই হাত শক্ত করে সে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আছে।আমি জানি এটা এনাজ।কিন্তু আমার কাছে কোন শক্ত প্রমাণ নেই। তাই এর থেকে আমার এখন দূরে থাকাই ভালো।যদি আমার কোন ভুল হয়।এই ছেলে এনাজ না হয়।তাহলে তো আমি পরবো বিপদে। তবে আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি এটা আমার এনাজ।

আমিঃ আপনি কি অফিসে আসা প্রত্যেক নতুন কর্মচারীর সাথে এমনি করেন মিস্টার তাজ?

তাজঃ হোয়াট????

আমিঃ বয়রা নাকি।কানে কি কিছু শুনতে পান না?

তাজঃ আমি সেদিন সুন্দর করে একটা অনুরোধ করেছিলাম।কিন্তু তুমি সেটা রাখোনি কেন? ওহ আমি তো ভুলেই গেছিলাম।তুমি আবার ভালো কথা শোনার মানুষ নয়।তোমাকে আমার স্টাইলে বুঝাতে হবে।

আমিঃ আপনি কিসের অনুরোধের কথা বলছেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

তাজঃ তুমি আবার কেন সাদা রঙে নিজেকে সাজিয়েছো? আমি সেদিন বলেছিলাম এই রঙ পরবে না।কান দিয়ে কি ঢুকেনি সেটা?

আমিঃ আপনার কথা কেন শুনবো? কে হোন আপনি আমার? আমার স্বামী মারা গেছে তাই আমি সবসময় সাদা রঙের কাপড় পরে থাকি।আপনি আমাকে মানা করার কে?

তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য উপরোক্ত কথাগুলো বললাম।কিন্তু তার রিয়েকশনে আমি মনে মনে বেশ খুশি হলাম।কারণ সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠছে।চোখ মুখ শক্ত করে আমাকে বললো।

তাজঃ আমি কে? ওহ আচ্ছা। এখন আমায় খুলে বলতে হবে আমি কে?

🦋🦋🦋

রাগে কথাগুলো বলে আমার মুখের দিকে ঝুঁকে পরলো।আমি চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম।উনি আমার কানের সামনে মুখ এনে লো ভয়েজে বললো।

তাজঃ নিজের মানুষটার কাছে কখনও নিজের পরিচয় দিতে হয় না।কারণ সে আমায় ঠিক চিনে নিবে।যে মানুষটা পুরোটাই আমার,তাকে আমি হাজার বাহানায় ফাকি দিলেও কাজ হবে না।সে আমাকে ঠিক ধরে ফেলবে।যে আমায় চিনে ফেলেছে তার কাছে নিজের পরিচয় উল্লেখ করা নিত্যান্ত বোকামি ছাড়া কি অন্য কিছু মিসেস আহমেদ??

তার নিশ্বাস আমার কানে থেকে থেকে বারি খাচ্ছে। আমার অস্বস্তি লাগছে।তার কণ্ঠস্বর, তার বলার ভঙ্গি,সেই পুরোনো ভালো লাগার অনুভূতি আড়াই বছর পর এসে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছে। সে কথাগুলো শেষ করে আমার কানে হালকা করে একটা ফুঁ দিলো।তাতে আমি কেঁপে উঠলাম।আমার মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না। তাকে যে আমি নিজের থেকে সরাবো সেই শক্তিটুকুও আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

তাজঃ এরপরের থেকে সাদা রঙে নিজেকে রাঙিয়ে আসলে সারা শরীরে রং ঢেলে দিবো মিসেস এনাজ আহমেদ।সেটা প্রজাপতির রং ও হতে পারে অথবা দেয়ালের রং হতে পারে। মনে রেখো কথাটা।

প্রজাপতির রং বলতে উনি যে ভালোবাসার রং-এর কথা বলেছে সেটা আমি সিউর।কিন্তু এর মতিগতি ভালো ঠেকছে না আমার কাছে।আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম।

আমিঃ মানে??

তাজঃ মানেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো বাটারফ্লাই। যে না বুঝে তাকে বোঝানো যায়।কিন্তু যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে তো বোঝানো যায় না। তাহলে তোমাকে কি করে বুঝাই বলো?

বাটারফ্লাই ডাকটা শুনে সারা শরীরে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে গেলো। কত বছর পর সেই চিরচেনা ডাকটা শুনলাম।তাও আবার নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামীর মুখে। আমি মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই আমার ঠোঁট তার এক আঙুল দিয়ে আটকে বললো।

তাজঃ হিশশশশশশশ!!! আর একটা কথাও নয়।আমাকে মন ভরে তোমাকে একটু দেখতে দেও।সবসময় শুধু আমাকে জ্বালানোর ধান্দা তোমার।

বলেন তো এগুলো কি সহ্য হয়? নিজের কেবিনে ডেকে সে রোমান্টিক কথাবার্তা শুরু করে দিছে।সে এখন হেব্বি রোমান্সের মুডে আছে। কিন্তু কেউ দেখে ফেললে তো কেলেংকারী হয়ে যাবে।সেদিকেও খেয়াল নেই তার।আমি ধাক্কিয়েও তাকে সরাতেও পারছি না।

কানের কাছ থেকে মুখ এনে গালে টুপ করে একটা চুমু বসিয়ে দিলো।আমি ৪৪০ ভোল্টেজে শর্কড খেলাম।বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকাতেই সে এক চোখ মারলো।তারপর কোন ভুমিকা না করেই আমার ওড়না টেনে নিয়ে নিজের মুখের ঘামগুলো মুছে নিলো।আমি এর কান্ডে ফ্রিজের মতো জমে গেলাম।মুখ মোছা শেষ হতেই সেই ঘামের জায়গা দিয়ে আমার মুখ মুছে দিলো।আমার মুখ তো মুছলো না তার ঘামগুলো আমার মুখে মাখলো।ওয়াক ছিঃ🤢। এর এসব শয়তাইন্না অভ্যাস এখনো যায়নি।আমার ওড়নাটাই নষ্ট। এটাকে আজই ইচ্ছে মতো ধুতে হবে।কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে আমাকে রেখেই মুখ টিপে হাসতে হাসতে হনহন করে কেবিনের বাইরে চলে গেল। আমার এখন নিজের কাছে কিরকম খিটখিটে লাগছে।ওড়নাটা নাকের সামনে নিতেই ঘামের গন্ধ নাকে এসে বারি খেলো।খাচ্চোর বেডা।আগের সেই বদঅভ্যেসটা এখনো আছে। আগেও কোথা থেকে এলে ঘামে ভেজা শার্ট বা টি-শার্ট খুলেই আমার মুখে ছুড়ে মারতো।কখনো বা আমার ওড়নায় মুখের ঘাম মুছে সেই জায়গায় দিয়ে আমার মুখ মুছে দিতো।এর অন্যতম বদঅভ্যেস ছিলো এটা।আজ আবার সেই কাজটা করলো।আজকে আমার সারাদিন খিটমিট লাগবে।

আমিঃ ওয়াক🤮।আমার দিনটাই নষ্ট করে দিলো।এসব খাচরামি করার জন্য আমাকে কেবিনে ডাকছে।আমি এই কানে ধরছি ভুলেও এর সামনে আর আসবো না। কিসের জন্য ডাকছে তার খবর নেই। মাঝখান থেকে সে রোমান্স করে নিলো।আমি তোকে ছাড়বো না খাচ্চোর বেডা।ইস, আমার ওড়নাটাই নষ্ট।

ওড়নার অন্য সাইড দিয়ে মুখ ডলতে ডলতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলাম। বিরবির করে বকতে বকতে নিজের কাজের স্থানে চললাম।সারাদিনে ভুলেও এর সামনে আসিনি।নিজের মতো কাজ করে নিয়েছি।যথাসম্ভব এর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি নিজেকে।যদি আবার কোন বদমাশি করে সেই ভয়ে।যে কাজগুলো বুঝিনি সেগুলো আদরের থেকে বুঝে নিয়েছি।কিন্তু ভুলেও তাজের কেবিনমুখী হয়নি।যেচে ওর কাছে যাওয়ার কোন মানে হয় না।দিনটা আমার ভালোই কাটলো।কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেক দ্রুতই চলে গেল।বিকালের শো শেষ করে আর তায়াং ভাইয়ার সাথে দেখা করিনি।শরীরে কুলচ্ছিলো না।তাই তায়াং ভাইয়াকে আসতে মানা করে দিলাম।বাসায় গিয়ে কোনরকম ফ্রেশ হয়ে নাভানকে খাইয়ে নামাজ পরে নিলাম।তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজত্বে কখন যে হারিয়ে গেছি নিজেও জানি না। নাভানের বাকি কাজ আজ এরিন ও হিমি সামলাবে।আমি আর পারবো না। বহু ধকল গেছে শরীরের ওপর।আজ আমার সবকিছু থেকে ছুটি।

কিন্তু পরেরদিন ঘটলো এক বিপত্তি …………

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_14
#Writer_NOVA

— সরি, মিসেস এনাজ আহমেদ। আমরা আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না।

ডাক্তারের কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।আমি ধপ করে নিচে বসে পরলাম।আমার চারপাশ চরকির মতো ঘুরছে।শেষ পর্যন্ত আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটা আমি হারিয়েই ফেললাম।আমার নাভান আমাকে ছেড়ে চলেই গেলো। গগণ বিদারক এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম।তায়াং ভাইয়া আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখছে।কারণ অলরেডি আমি পাগলামি শুরু করে দিছি।ভাইকে জড়িয়ে ধরে আমি কান্না করছি।ভাইয়ার চোখেও পানি।

আমিঃ ও ভাইয়া দেখ না ওরা কি বলছে? আমার নাভান নাকি বেঁচে নেই। ওরা ভুল বলছে।আমার ছেলে আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেই না।আমার ছেলেকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে গেলো।ওরা সবাই মিথ্যে বলছে।নাভান আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না।ছাড় আমাকে,ছাড় বলছি।আমি আমার ছেলের কাছে যাবো।ও একা ভয় পাচ্ছে তো।তোকে ছাড়তে বলছি তায়াং ভাইয়া।

আমি তায়াং ভাইয়াকে ইচ্ছে মতো মারছি।কিন্তু তায়াং ভাইয়া আমাকে নাভানের কাছে যেতে দিচ্ছে না। এরিন,হিমিও মুখ চেপে কান্না করছে।তায়াং ভাইয়ার চোখেও পানি।আমি অনেক কষ্টে তায়াং ভাইয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিলাম নাভানের কাছে।আমার পিছু পিছু তায়াং ভাইয়া, এরিন, হিমিও আসছে।কেবিনে আসতেই দেখলাম সাদা কাপড়ে আমার ছোট ছেলেকে ঢেকে রাখছে।আমি এক টানে নাভানের মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

আমিঃ এই তো আম্মু চলে এসেছি। তোর কিছু হবে না। তোর আম্মু তোর কিছু হতেই দিবে না।এরা কি মানুষ? আমার জ্যন্ত ছেলেটাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিলো।ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো না।তায়াং ভাইয়া চল তো এখান থেকে। একটা ডক্টরও ভালো না।ওরা পড়াশোনা না করেই ডাক্তার হয়েছে। আমার জীবিত ছেলেটাকে মৃত ঘোষণা করে দিলো।দেখ, ও আমার দিকে কিরকম হাসি মুখে ঘুমোচ্ছে। আমি জানি একটু পরেই আমার কলিজার টুকরো ঠিক ভালো হয়ে যাবে। তুই ঠিক দেখিস।এরিন দেখ না ওর মুখটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে ঠিক যেনো রাজপুত্র। ও এখনো হাসছে।চেহারাটা কত নিষ্পাপ। হিমি তুই বল না রে। আমার নাভান তো বেঁচে আছে। নয়তো কেউ এভাবে হাসে।তোরা সবাই মিথ্যে বলছিস আমি জানি।আমার ছেলেকে তোরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছিস।আমি আমার ছেলেকে নিয়ে ভালো আছি তা তোদের ভালো লাগছে না।

তায়াং ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি নাভানের সারা মুখে অজস্র চুমু খেতে লাগলাম।শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখছি।

আমিঃ এই তায়াং ভাইয়া, নাভানের শরীর এতো ঠান্ডা কেন রে? ওরা কি আমার ছেলেকে শরীর ঠান্ডা করার কোন ঔষধ দিয়েছে? আচ্ছা, ও চোখ খুলছে না কেন? নাভান, এই নাভান, লক্ষ্মী বাবাই চোখ খুলো।আমি তোমাকে অনেকগুলো খেলনা কিনে দিবো।একবার চোখ খুলো।

তায়াংঃ নাভান আর নেই নোভা।ও আর কখনো চোখ খুলবে না। সারাজীবনের জন্য ও ঘুমিয়ে পরেছে। আর কখনো চোখ খুলে আমাদের দেখবে না। তোকে আম্মু বলে, আমাকে মামা বলে ডাকবে না।আমাদের ছেড়ে ও চলে গেছে। (কাঁদতে কাঁদতে)

আমিঃ তুই মিথ্যে বলছিস।আমি এসব বিশ্বাস করি না।সর তো আমার সামনে থেকে।

এরিনঃ তায়াং ভাইয়া ভুল বলছে নারে নোভা।নাভান আর কখনও ফিরবে না।

আমিঃ তোরা সবাই এক জোট হয়ে মিথ্যে বলছিস।একটাও আমার ছেলের কাছে আসবি না।যা তো এখান থেকে। জলদী যা।

হিমিঃ পাগলামি করিস না নোভা।একটু বোঝার চেষ্টা কর তুই।

আমিঃ আমি কিছু বোঝার চেষ্টা করবো না।আমার দুচোখের সামনে থেকে সর তো তোরা।তোদের আমার সহ্য হচ্ছে না।

★★★

——– নাভান!!!!!

একটা চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম।সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। শরীর থরথর করে কাঁপছে। কি অলুক্ষ্মেণে স্বপ্ন দেখলাম।হাত বাড়িয়ে লাইটের সুইচ অন করলাম।পাশে তাকাতেই দেখি নাভান আমার সাথে ঘুমিয়ে আছে। এতক্ষণে আমার কলিজায় পানি এলো।আমি তাহলে এত সময় স্বপ্ন দেখছিলাম।এটা একটা খারাপ স্বপ্ন ছিলো।আমি ঘুমন্ত নাভানকেই কোলে নিয়ে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলাম।ওর ঘুমন্ত মুখে ইচ্ছে মতো চুমু খেলাম।এতে নাভান কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো।কিন্তু আমি ওকে ছাড়লাম না।সেভাবেই শক্ত করে ধরে রাখলাম।হঠাৎ করে এত খারাপ স্বপ্ন দেখার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না।সামনে কি আমার ছেলের ওপর দিয়ে কোন ঝড় ঘনিয়ে আসছে? আমি ওকে এক মিনিটের জন্যও একা ছাড়বো না। সবসময় নিজের সাথে রাখবো।যদি আমার থেকে ওকে কেউ কেড়ে নিয়ে যায়।তাহলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে??

🦋🦋🦋

সময় এখন ভোর ছয়টা।তাজরান ও আরিয়ান জগিং সুট পরে বাইরে বেরিয়েছে।উদ্দেশ্য প্রায় এক ঘন্টা আজ জগিং করবে। ওদের বাসার থেকে মিনিট ২০ হাঁটলেই একটা পার্ক আছে। অবশ্য ঐটা পার্ক নয়।ছোট একটা ঘন গাছ-গাছালির বাগান।তবে সেখানে কতগুলো বসার জন্য বেঞ্চ আছে বলে প্রায় সময় সেখানে মানুষের আনাগোনা দেখা যায়।যার কারণে সবাই এটাকে ছোট পার্ক বলে। তাজরান ও আরিয়ান আজ জগিং করতে করতে এদিকেই এসেছে। তাজের কানে ইয়ারফোন গোঁজা। যদিও ওর ফেভারিট শো এখনো শুরু হয়নি তবুও সে রেডিও শুনছে।

আরিয়ানঃ ভাই, তুই এসব এফএম রেডিও কি শুনিস বল তো? আজকালকার দিনে কেউ এসব শুনে।সকাল, বিকেল যেখানে থাকিস যেই অবস্থায় থাকিস তোকে এফএম রেডিও শুনতেই হয়।কিন্তু কেন?

তাজ কোন উত্তর দিলো না।তীক্ষ্ম চোখে একবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে থামলো।ততক্ষণে পার্কের সামনে চলে এসেছে। কোন কথা না বলে হাত দুটো মেলে ব্যায়াম করতে লাগলো।আরিয়ান একটা নিশ্বাস ছেড়ে একটা বেঞ্চে বসে রইলো।ওর কানে হেডফোন গোঁজা। সেখানে গান চালু করে দিয়ে গানের তালে তালে হাত-পা বসে বসেই নাড়াতে লাগলো।তাজ খুব মনোযোগ সহকারে এক্সারসাইজ করছিলো।হঠাৎ ওর চোখ গেলো ওদের থেকে কিছুটা দূরে আরেকটা বেঞ্চের দিকে।সেখানে চুপ করে বসে আছে বছর দুয়েকের একটা বাচ্চা ছেলে। চেহারাটা অসম্ভব মায়াবী।তাজ গুটিগুটি পায়ে বাচ্চা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলো।

তাজঃ তোমার নাম কি বাবু?

নাভানঃ আমাল নাম বাবু না নাবান।

তাজঃ ওহ্ আচ্ছা 😅।তুমি এখানে একা বসে আছো কেন? তোমার সাথে কেউ নেই?

নাভানঃ আমাল আম্মু আছে।এট্টু ঐদিকে গেছে মানি(পানি) আনতে।

ছোট হাতের আঙুল দিয়ে উল্টো দিকে দেখিয়ে দিলো নাভান।তাজ মুগ্ধ চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিজের খুব চেনা।আজানা একটা টান অনুভব করছে।আরেকটা জিনিস খেয়াল করে তাজ ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে গেলো। তা হলো বাচ্চা ছেলেটার আর তার পরনে একই রং,ডিজাইনের জগিং সুট। এখন যদি কেউ ওদের দেখে তাহলে চোখ বুজে বাবা-ছেলে ধরে নিবে।

তাজঃ তুমি কি আমার কোলে আসবে?আমি তোমাকে অনেকগুলো চকলেট দিবো।

নাভানঃ না না।আম্মু বলছে কেউর থেকে কিছু না নিতে।আম্মু বকবে।

তাজ অবাক হয়ে গেলো।বাচ্চাটা যথেষ্ট ম্যাচিউর।এত ছোট বয়সে কেউ এতটা গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কিন্তু বাচ্চাটা চোখ, মুখ কুচকে টাস টাস কথা বলছে।কোন কথার উত্তর কি করে দিবে তা ও আগের থাকে যুগিয়ে রাখছে।পারবে নাই কেন? আট মাস থেকে তো নাভান কথা বলতে পারে। আর দুই বছর বয়সে সব কথাই বলতে পারে। আর নিজের ছোট ব্রেণ খাটিয়ে এমন এমন কথা বলে যা বড়রা শুনলে অবাক হয়ে যায়। মনে হবে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে। তাজ অপলক চোখে নাভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু সময় ভেবে আবার নাভানকে বললো।

তাজঃ আচ্ছা যাও তোমাকে চকলেট দিবো না। আমার কোলে একটু উঠো।তাহলেই হবে।উঠবে আমার কোলে?

নাভান কপাল কুঁচকে মুখে এক আঙুল দিয়ে বড়দের মতো করে কিছু একটা ভাবলো।তারপর ঘাড় কাত করে কোলে উঠতে সায় দিলো।তাতে তাজ খুব খুশি হয়ে নাভানকে কোলে তুলে নিলো।নাভানকে কোলে নিতেই তাজের সারা শরীরে একটা অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। তাজের মনে হচ্ছে ওর নিজের ছেলেকে কোলে তুলে নিয়েছে। মনটা নিমিষেই ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো।নাভানকে কোলে নিয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো।নাভান ভদ্র ছেলের মতো সব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলো।তাজ, নাভানের চোখের দিকে তাকিয়ে বরসর একটা ঝাটকা খেলো।চোখ দুটো তার খুব কাছের মানুষের মতো।তার প্রিয় মানুষটা আর এই বাচ্চা ছেলেটার চোখের এত মিল কি করে হলো? তাহলে কি কোন সম্পর্ক আছে তাদের?

আরিয়ানঃ তাজরান ভাই!!!! যাওয়ার সময় হয়ে গেছে আমাদের। এখন ফিরতে হবে।

আরিয়ানের ডাকে হুশ ফিরে তাজের।আরিয়ান দূর থেকে হাত নাড়িয়ে জোরে চেচিয়ে ওকে ডাকছে।তাজ একবার নাভানের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আরিয়ানের দিকে তাকালো।তাজের এখন এই বাচ্চা ছেলেটাকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।মন চাইছে ওকে নিজের সাথে সারাজীবনের জন্য রাখতে।কেন, তা নিজেও জানে না। ঐ যে নিজের রক্তের একটা ঘ্রাণ বলে কথা আছে তো।সেটার থেকে কি এত সহজে মুক্তি মিলে।না চাইতেও নাভানকে বেঞ্চে বসিয়ে দিলো।তারপর ওর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বিষন্ন মনে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।নাভান ওর যাওয়ার পানে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাজ অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আবার পেছন ফিরে তাকালো।নাভান এখনো সেম ভাবে তাকিয়ে আছে। তাজের চোখ দুটো নিজের অজান্তেই ছলছল করে উঠলো।সে আর পিছনে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে আরিয়ানেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাজ দৃষ্টির সীমানা পেরোতেই নোভা পানির বোতল নিয়ে চলে এলো।আজ নাভানকে নিয়ে সকাল সকাল হাঁটতে বের হয়েছিলো।পথিমধ্যে নাভানের পানির তেষ্টা পেয়েছিলো বলে নাভানকে এখানে বসিয়ে পানি আনতে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু ঐদিকটার রাস্তা ভালো নেই বলে নেয়নি।

আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।নোভা যদি নাভানকে নিয়ে যেতো তাহলে তো তাজের সাথে আজ দেখা হতো না। যদিও তারা জানে না সম্পর্কে তারা বাপ-বেটা। তবুও দুজন তাদের রক্তের টানের অনুভূতি টের পেয়েছিলো।সেটাই বা কম কিসের।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_15
#Writer_NOVA

রাত নয়টায় ডাইনিং টেবিলে গোল হয়ে বসে ডিনার করছে ঠিকানাবিহীন বাড়ির মানুষ।জুলেখা বেগম সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছে। আরিয়ান এক হাতে মোবাইল গুতাচ্ছে আরেক হাতে খাবার খাচ্ছে। মুসকান তীক্ষ্ম চোখে সবাইকে খেয়াল করছে।তাজের দিকে ওর চোখ যেতেই দেখলো তাজ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে খাবারের প্লেটে আঁকিবুঁকি করছে।ওর মন এখন এই জায়গায় নেই।

মুসকানঃ কি হয়েছে বড় ভাইয়া? তুই কিছু মুখে দিচ্ছিস না যে?

মুরাদঃ তাজরানের আবার কি হবে?

জুলেখাঃ কি রে তাজরান বাবা খাচ্ছিস না কেন?

কথাটা বলতে বলতে সেও তাজের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ফেললো।তাজের যেনো কোন হুশ নেই। কারো কোন শব্দ না পেয়ে মিনিট তিনেক পর তাজের হুশ ফিরলো।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে বেচারা একটু ইতস্ততায় পরে গেলো।

তাজঃ তেমন কিছু না।তোমরা খাও।

আরিয়ানঃ তাজরান ভাই, তোর আজ কি হয়েছে রে?সারাদিন ধরে দেখলাম তুই অন্যমনষ্ক হয়ে কি জানি ভাবছিস।আশেপাশের কোন হুশ নেই। হুট করে কি নিয়ে এতো সিরিয়াস হয়ে গেলি?

মুরাদঃ এনিথিং রং মাই সান?

তাজঃ নো ড্যাড😊।

জুলেখাঃ কি হয়েছে বাবা? আমাকে বল।তোর কি শরীর খারাপ? নয়তো তোকে তো এত বিষন্ন আর চিন্তিত দেখায় না।

মুসকানঃ ভাইয়া নতুন প্রেমে-টেমে পরছিস নাকি।পরলে বলতে পারিস।পুরো সেটিং করিয়ে দিবো।(মুখ টিপে হেসে)

জুলেখাঃ মুসকান কি হচ্ছে এসব?

আরিয়ানঃ তুই পুচকি ইদুর নিজের পড়াশোনায় মন দে।অন্যের প্রেম নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।

মুসকানঃ একদম কথা বলবি না তুই আমার সাথে। আমি কি তোকে কিছু বলেছি? সবসময় অন্যর বিষয় নাক গোলাতে আসে শয়তান বাঁদর। (মুখ ভেঙচিয়ে)

মুরাদঃ আরিয়ান,মুসকান থাম তোরা।

বাবার ধমকে আরিয়ান, মুসকান দুজনেই চুপ মেরে গেলো। তাজ চুপচাপ শুধু দুই লোকমা মুখে দিয়ে উঠে চলে এলো।তাজের আচরণে বাকি সবাই বেশ অবাক হলো। কারণ তাজ কখনো খাবার নষ্ট করে না।রুমে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। আজ ওর হঠাৎ করে অনেক সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে আগে প্রায় সময় বন্ধুদের সাথে দু-চারটা টান দিতো।কিন্তু বহু বছর ধরে খায় না।এই বাসার কেউ সিগারেট খায় না।তবে আরিয়ানের কাছে থাকতে পারে। কারণ ওকে মাঝে মাঝে লুকিয়ে সিগারেট খেতে দেখেছিলো তাজ।সকালে নাভানের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তাজের সবকিছু এলোমেলো আর অসহ্য লাগছে।ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ঐ বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিতে।

🦋🦋🦋

রাতের অন্ধকারটা আমাদের কাছে পুরো ধোঁয়াসা।দিনে তুমি যাকে এক রূপে দেখবে রাতে সেই মানুষটাকে আরেক রূপে আবিষ্কার করবে।কালো অন্ধকারে তুমি বেশিরভাগ সময় মুখোশধারী লোকের আসল রূপটা দেখতে পারবে।হিংস্র ও পশু সমতুল্য মানুষগুলো নিজের রূপটা রাতেই ধারণ করে।তবে পৃথিবীতে যদি খারাপ মনুষ্যত্বের ও অন্ধকার না থাকতো তাহলে কিন্তু ভালো মানুষ ও আলোর এতো গুরুত্ব থাকতো না। খারাপ আছে বলেই ভালোর এত কদর।ভালো, খারাপ দুটোই কিন্তু একে অপরের পরিপূরক। দুটোর প্রয়োজন ছিলো বলেই মহান আল্লাহ তায়ালা তা সৃষ্টি করেছেন।

আকাশে আজ বিশাল বড় এক চাঁদ উঠেছে। তার আলোতে চারিদিক আলোকিত।সম্ভবত পূ্র্ণিমা হবে।চাঁদের আলোকদূতি ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারকে ঠেলে ধাক্কিয়ে বহুদূর পাঠিয়ে দিয়েছে। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। পুরো একটা রোমান্টিক ওয়েদার।সেই ওয়েদারে একা দাঁড়িয়ে গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে রোশান।কপালে পরে থাকা চুলগুলো মৃদু বাতাসের তালে উঠানামা করছে।গভীর ভাবনায় মগ্ন সে।ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো এক ফোন কলে।টাউজার প্যান্ট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো আননোন নাম্বার। না চাইতেও রিসিভ করতে হলো।

রোশানঃ আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

—- রোশান দেওয়ান, রাইট।

রোশানঃ হুম আমি রোশান।কিন্তু আপনি কে?

—– এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন আমায়? আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

রোশানঃ সরি,চিনতে পারলাম না।

—– আপনার পাখির খবর যে আপনাকে দিয়েছিলো।আমি সেই শুভাকাঙ্ক্ষী।

রোশানঃ ওহ্ আপনি।হঠাৎ কি মনে করে আমায় স্মরণ করলেন?

—- নিশ্চয়ই কোন দরকার ছাড়া আপনাকে কল করিনি।

রোশানঃ তাতো নিশ্চয়ই। কি দরকার তাই বলুন।আপনি আমার পাখির খোঁজ দিয়েছেন। আপনি না থাকলে ওর কোন খোঁজও আমি পেতাম না কিংবা ওকে সেদিন তুলে নিতেও পারতাম না।তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

—- আমি নিজের স্বার্থ ছাড়া কোন কাজ করি না।আপনাকে এসব বলার পিছনে আমারও স্বার্থ ছিলো।

রোশানঃ কে আপনি বলুন তো?আপনাকে আমার খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে।

—- আমি নোভার খুব কাছের মানুষ। আবার দূরের মানুষও।আপতত আপনাকে আমার পরিচয় দিচ্ছি না।আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।আপনি কি এনাজের মৃত্যুর বিষয় কিছু জানেন?

রোশান কপাল কুঁচকে ফেললো। এই প্রশ্ন করার মানে কি? রোশান তো জানতোই না নোভার স্বামী কে? জীবনে এক পলক দেখেওনি।হ্যাঁ, এটা সত্যি সে নোভাকে ভালোবাসে।কিন্তু নোভার বিয়ের পর ওর কাছ থেকে পুরোপুরি সরে গিয়েছিল। নিজেকে ওর থেকে দূরে রাখার জন্য বিদেশে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এনাজের মৃত্যুর সাথে ওর তো কোনরকম কানেকশন নেই। তাহলে ওকে এসব প্রশ্ন করছে কেন?

—- হ্যালো মিস্টার রোশান দেওয়ান। শুনতে পারছেন?

রোশানঃ আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। এনাজের মৃত্যুর খবরও আমি পাইনি।আপনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন কছেন কেন?

—- সেটা আপনার না জানলেও চলবে। তবে এখন আপনার একটা হেল্প লাগবে।

রোশানঃ জ্বি বলুন।

—- নোভার একটা খালাতো ভাই আছে।তানভীর রহমান ওরফে তায়াং নাম।ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

রোশান আৎকে উঠলো।এই আগুন্তক বলছে কি? তায়াং যে নোভাকে নিজের বোনের মতো দেখে এই কথাটা যেদিন থেকে জেনেছে সেদিন থেকে তায়াং-এর ওপর নজরদারি বন্ধ করে দিয়েছে রোশান।তার পাখিকে দেখে রাখার জন্য একটা ভাই আছে সেটা জেনে সে খুশি হয়ে গিয়েছিলো।তাকে মারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না সে।যে নোভার ভালো চাইবে তার ক্ষতি তো রোশান করতে পারবে না।কিন্তু এই আগুন্তক বলছেটা কি???

রোশানঃ কি বলছেন আপনি?

—— আমি ঠিকই বলছি।আপনাকে এই তায়াং-কে মেরে ফেলতে হবে।

রোশানঃ আমি পারবো না। ওর সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই।

—- আপনার নেই কিন্তু আমার আছে।ওর কলিজা অনেক বড় হয়ে গেছে। ও আবার এনাজের মৃত্যুর ফাইল ওপেন করতে চাইছে।

রোশানঃ কোনভাবে আপনি এনাজের খুনী নন তো?

—- আপনাকে যা বলছি তাই করবেন।আমি তায়াং-এর লাশ চাই। যদি ওকে মারতে না চান তাহলে আপনার পাখি আর পাখির বাচ্চাকে মেরে তাদের লাশ আপনার কাছে পাঠিয়ে দিবো।

হো হো করে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে কল কেটে দিলো অপর পাশের পরিচয়হীন সেই আগুন্তক।রোশান স্তব্ধ হয়ে গেলো।কে হতে পারে এই লোকটা? তবে সে যে এনাজের মৃত্যুর জন্য জড়িত তাতে রোশানের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কপালের এক সাইড চিনচিন করে ব্যাথা উঠছে রোশানের।হুট করে মাইগ্রেনের ব্যাথাটা উঠে গেলো।ওর কপালেও কি শনি ঘনিয়ে আসছে??

🦋🦋🦋

পাক্কা আধ ঘন্টা ধরে খিচুড়ি নিয়ে বসে আছি। কিন্তু আমার মানিকচাঁদের খাওয়ার নামও নেই। হাত শুকিয়ে আঠা আঠা হয়ে গেছে। আর বাছাধন মুখে খিচুড়ি নিয়ে পানি পানি করে ফেলছে।কিন্তু গেলার নামও নিচ্ছে না ।সে এখন খুব মনোযোগ সহকারে খাতায় কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।খেতে বসলেই তার আবার পড়াশোনা করার কথা মনে হয়।ইচ্ছে করছে কষিয়ে পিঠের মধ্যে দুটো দিতে পারতাম তাহলে মনটা শান্তি লাগতো।সারাদিন কাজ করে কার মন চায় খাবার নিয়ে বসে থাকতে।আজকালের বাচ্চাগুলো খাবার নিয়ে বহুত জ্বালায়।তার থেকে নাভানও বাদ পরেনি।

আমিঃ নাভান জলদী খাবার গিল।নয়তো তোর পিঠে দুড়ুমদুড়ুম তাল পরবে বলে দিলাম।খাবার নিয়ে এতো জ্বালাস কেন বাপ? মুখে দিবো গিলে ফেলবি।তা না করে ঘন্টার পর ঘন্টা খাবার নিয়ে বসে থাকিস।কার ভালো লাগে এতক্ষণ মুখে খাবার রাখতে।ধ্যাতা পোলা।আমাকে একটুও শান্তি দিবো না।

মুখ ঝামটা মেরে বালিশের সাথে হেলান দিলাম।সাথে সাথেই ঘুমপরী এসে হাজির।চোখটা লেগে আসা মাত্রই নাভানের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো।

নাভানঃ আম্মু ফোন।আম্মু,আম্মু ফোন।

আমিঃ কি হইছে?

নাভানঃ তোমার ফোন।

মাথা ঝাড়া দিয়ে মোবাইল হাতে নিলাম।মোবাইল স্ক্রিনে তায়াং ভাইয়ার নামটা জ্বলজ্বল করছে।কল রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেলাম।

তায়াংঃ আসসালামু আলাইকুম, রহমতের কলাম।আপনি যার বান্দা আমি তার গোলাম।

আমিঃ আলাইকুমুস সালাম।কি ব্যাপার,মনটা আজ অনেক খুশি খুশি মনে হচ্ছে। ঘটনা কি?

তায়াংঃ কিছুই না।কেমন আছিস? আমার ভাগিনা কেমন আছে?

আমিঃ তোর ভাগিনা কি আমাকে ভালো থাকতে দিলো।সেই কখন থেকে ছোট এক বাটি খিচুড়ি নিয়ে বসছি।মাত্র দুই লোকমা খেয়েছে। আমার হাত আঠা আঠা হয়ে গেছে। তার গিলতে অনেক কষ্ট লাগে।তাই মুখে নিয়ে বসে থাকে।আর খাবার খেতে গেলেই পড়ালেখার কথা মনে পরে।আমার ব্রিলিয়ান্ট পোলা।

তায়াংঃ ও যেভাবে খায় সেভাবেই খাওয়াবি।এত কষ্ট লাগে কেন তোর? যদি বেশি কষ্ট লাগে আমাকে দিয়ে দে।আমি লালন-পালন করে বড় করবো তোকে লাগবে না।

আমিঃ এখন আসলের থেকে সুদের দরদ বেশি হয়ে গেছে।

তায়াংঃ আগামীকাল একটু দেখা করতে পারবি? তোর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। তাও ঐ তাজকে নিয়ে।

আমিঃ কি গুরুত্বপূর্ণ কথা? কলে বল।

তায়াংঃ না কলে বলা যাবে না। সমস্যা আছে। তুই একটু সময় বের করে আমায় কল করিস আমি চলে আসবো।

আমিঃ আগামীকাল তো অফিসে জয়েন হতে হবো।তার মধ্যে আবার দুইটা শো।আচ্ছা আমি ম্যানেজ করে নিবোনি।

তায়াংঃ দুই দিন ধরে না আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে ফোলো করে।

আমিঃ কি বলিস এসব?(ভয় পেয়ে)

তায়াংঃ আমি সত্যি বলছি।আমার এমনটাই মনে হচ্ছে। তুই ভয় পাস না।আমি এসব ঠিক সামলে নিবো।অনেক ঘুম পাচ্ছে। পরে কথা হবে আল্লাহ হাফেজ। আমার মামার গায়ে ভুলেও একটা ফুলের টোকা দিবি না বলে দিলাম।

আমিঃ তুই সাবধানে থাকিস।তোর মামার গায়ে ফুলের টোকা নয় তার চেয়ে বেশি কিছু পরবে।

তায়াং ভাইয়া কল কেটে দিলো। আমার মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো।ওকে নিয়ে ভয় হয় ইদানীং। আমার জন্য ওর কোন ক্ষতি যেনো না হয়। তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালাম।আজ আকাশে অনেক সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটা রাতের কথা মনে পরে গেলো।এমন পূর্ণিমা রাতে একদিন আমি ও এনাজ বাইরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম।সেদিন ফেরার পথে আমি হাঁটতে চাইনি বলে এনাজ কাঁধে করে আমাকে নিয়ে এসেছিলো।মানুষটাকে অনেক বেশি মিস করি।কথায় আছে না নাক থাকতে নাকের মর্ম বুঝি না আমরা।আমিও বুঝতে পারিনি।যখন পারলাম তখন তো সেই মানুষটা আর নেই। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বারান্দা থেকে চলে আসতে নিলাম।তখুনি আমার চোখ পরলো রাস্তার সাথে দেয়ালটাতে।সোডিয়ামের আলোয় মনে হলো একটা ছায়ামূর্তি দেয়ালের আড়ালে সরে গেল।আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে রুমে ঢুকে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলাম।

#চলবে

রি-চেইক দেওয়া হয়নি।ভূল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন😊😊।

প্রজাপতির রং পর্ব-১২+১৩

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_12
#Writer_NOVA

আমিঃ এনাজ!!!!!!

আমি এনাজ বলে ডাকতেই তাজরান কপাল কুঁচকে আমার দিকে ঘুরে তাকালো। সে আমার দিকে ঘুরতেই আমি আরেকটা বড়সড় ঝাটকা খেলাম। চেহারাতো এনাজের নয়। তাহলে এত মিল কি করে হতে পারে এনাজের সাথে।তাজ আমাকে দেখে কেঁপে উঠলো। আমি তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকালাম।তার চোখে একটা ছটফটানির ভাব দেখতে পেলাম।আর চোখ দুটো অবিকল এনাজের।কিন্তু আমি অঙ্ক মিলাতে পারছি না।

তাজঃ সরি, আপনি আমায় কি বলে ডাকলেন?

আমিঃ এনাজ!!!!

তাজঃ সরি, আমি তাজরান তাজওয়ার 😊।

কথাটা বলে এনাজের মতো ভ্রুর কিছুটা ওপরে চুলকালো তাজ।তারপর চেয়ারে বসে ল্যাপটপের দিকে নজর দিলো। এক হাতে ল্যাপটপে কাজ করছে আরেক হাতে কপালে স্লাইড করছে। যেমনটা এনাজ ল্যাপটপে কাজ করার সময় করতো।উনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো।

তাজঃ প্লিজ সিট ডাউন।

আমি তাজের সরাসরি চেয়ারে বসে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকে পর্যোবেক্ষণ করতে লাগলাম।উনি খুব অস্বস্থি বোধ করছে।সামনে থাকা কাচের গ্লাস থেকে একটু পরপর পানি খাচ্ছে। গ্লাস ধরার সময় তার হাত অসম্ভব কাঁপছিলো।

আমিঃ আর ইউ ওকে মিস্টার তাজ?

তাজঃ ইয়াহ।হোয়াট ইজ ইউর নেম?(ব্যস্ত হয়ে)

আমিঃ মিসেস এনাজ আহমেদ।

আমার নামটা শুনে উনি আবারো চমকে উঠলো। উনার চোখ দুটো খুব অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে সে এখন আমার থেকে পালাতে পারলে বেচে যাবে।মাত্র একবার আমার চোখে তার চোখ পরেছে।তারপর থেকে ভুলেও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।আমার সন্দেহটা আরো জড়ালো হলো।তাই আমি সামনে থাকা পেপার ওয়েট-টাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে তাজের সামনেই টেবিলের নিচে ফেলে দিলাম।আমার উদ্দেশ্য হলো তার হাত দেখা। এটা যদি আমার এনাজ হয় তাহলে তার ডান হাতের উপর দিকে কোণার কাছে একটা বড় তিল থাকবে।

আমিঃ আই এম সো সরি।আমি আসলে দেখতে পাইনি।এক্সট্রিমলি সরি।(ব্যস্ত হয়ে)

তাজঃ ইট’স ওকে।

আমার দিকে না তাকিয়ে উবু হয়ে পেপার ওয়েট উঠিয়ে যথাস্থানে রাখলো।আমিও চট করে তার হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক।হ্যাঁ,ডান হাতের কোণার দিকে বড় একটা তিল।উনি আবারো গ্লাস থেকে বেশ কয়েক ঢোক পানি খেলো।চেহারা এনাজের নয় ঠিক আছে। কিন্তু পেছনের দিক,চোখ, স্বভাব, হাতের তিল, কন্ঠস্বর,মুখের অঙ্গিভঙ্গি এক কি করে হতে পারে? মানুষ চেহারা পাল্টালেও এগুলো তো পাল্টাতে পারে না।আমার মন বলছে এটাই এনাজ।ওর চেহারা পাল্টিয়ে ফেলেছে। কিন্তু স্বভাবগুলো এখনো বদলাতে পারেনি।আমার হৃৎপিণ্ডটা ধপধপ করে লাফাচ্ছে।আচ্ছা, তাহলে কি এনাজ সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। আগুনে হয়তো ওর মুখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।তাই প্লাস্টার করে নতুন চেহারা দিতে হয়েছে।

তাজঃ আমি আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম।

আমিঃ আমি বলেছিলাম।

তাজঃ আপনার নাম বলেন নি।

আমিঃ নোভা ইসলাম। মিস্টার এনাজ আহমেদের ওয়াইফ।

এবারো উনি হালকা কেঁপে উঠলো। আমি যতবার এনাজের নাম নিলাম ততবারই এমন হলো।উনি আমার সার্টিফিকেট দেখায় মনোযোগ দিলেন।আর আমি আড়চোখে তার কার্যকলাপ।তখুনি চট করে আমার মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল।আমি ইচ্ছে করে টেবিলের পায়ার সাথে নিজের পা বারি দিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলাম।

আমিঃ আহ্ পা টা জ্বলে গেলো রে।এত শক্ত কেন টেবিলের পায়া।একটু নরম হলে কি হয়?

তাজঃ কি হয়েছে আপনার?

তাজ হন্তদন্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠতে নিয়েও আবার ধপ করে বসে পরলো।আমি তীক্ষ্ম চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তাজঃ ব্যাথা পেয়েছেন নাকি?

আমিঃ নাহ আমি ব্যাথা পাইনি।তবে টেবিল ব্যাথা পেয়েছে।

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বললাম।যে জন্য করলাম তাতো হলোই না উল্টো আমি ব্যাথা পেলাম।পা জ্বলে যাচ্ছে। ব্যাথাটা ভালোই পেয়েছি। তাজ আমার দিকে পানির গ্লাসটা বারিয়ে দিয়ে বললো।

তাজঃ পানি দিয়ে ব্যাথার জায়গায় হালকা করে ম্যাসেজ করে দিন। ব্যাথা কমে যাবে।

আমি পানির গ্লাসটা নিলাম না।ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার।গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। তাজ হয়তো আমার দিকে খেয়াল করেছে।কারণ ও একগালে মিটমিট করে হাসছে।সেইম এনাজের হাসি।এনাজও এভাবে একগালে হাসতো। যখন আমি ওর সাথে অভিমান বা রাগ করতাম।তখন একগালে অদ্ভুত রকম করে হাসতো।আমার এই হাসিটা ভীষণ পছন্দের ছিলো।এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ইতস্ততায় পরে গেলো।আমার দিকে না তাকিয়ে একের পর এক ব্যবসা সম্পর্কিত প্রশ্ন করতে লাগলো।আমি এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিতে লাগলাম।উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাকিয়ে যেই দেখতে পাচ্ছে আমি তার দিকে দুগালে হাত রেখে তাকিয়ে আছি। ওমনি সে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমি ফাঁকের মধ্যে মোবাইল বের করে ফ্লাশ বন্ধ করে দুটো ছবি তুলে নিলাম।তায়াং ভাইয়াকে দেখাতে হবে তো।মোবাইল ব্যাগে রেখে পূর্বের মতো স্বাভাবিক হলাম।মোবাইল বের করার সময় যে ব্যাগ থেকে আমার প্রিয় নীল মলাটের ডায়েরীটা বের করেছিলাম তা ব্যাগে ঢুকাতে ভুলে গেলাম।যার ফলে সেটা টেবিলে ফাইলের একপাশে পরে রইলো।কি মনে করে যেনো গতকাল ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু কাজের সময় ভুলে গেছি।তাজের চোখে এখনো অস্থিরতা লুকিয়ে আছে।ভুলেও আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। আমার মুখে হাসি ফুটে উঠছে।

তাজঃ আপনি এখন আসতে পারেন।আপনি যদি জবটা পান তাহলে আমরা আপনাকে রাতে কল করে জানিয়ে দিবো।আর দু-এক দিনের মধ্যে জয়েনিং লেটারও পেয়ে যাবেন।

আমিঃ শুকরিয়া।

তাজঃ আরেকটা প্রশ্ন ছিলো।যদিও সেটা প্রশ্ন নয় আমার অনুরোধ। সেটা আপনার পার্সোনালি বিষয় । তাও যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি অনুরোধটা কি করতে পারি?

আমিঃ হুম করতে পারেন।

তাজঃ আপনাকে সাদা রঙে একটুও মানায় না।এই রঙে নিজেকে আর রাঙাবেন না।আপনি সম্ভবত আগে অনেক শৌখিন ছিলেন।আমি আন্দাজে ঢিল মারলাম।জানিনা কতটুকু সঠিক।

আমি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলাম।হুট করে এনাজের ওপর একরাশ অভিমানের পাহাড় জমে গেলো।কি সুন্দর করে সে আমাকে এই অনুরোধটা করে দিলো।সে কি জানে এই অনুরোধটা যে আমার হৃৎপিণ্ডটাকে বিধ্বস্ত করে দিতেই যথেষ্ট। আমি শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলাম।

আমিঃ “যেখানে জীবনের রংটাই ফিকে
সেখানে শখ করা নিত্যান্ত মূল্যহীন”

চোখের পানিটা আড়ালে মুছে নিলাম।কথাটা বলে চেয়ার থেকে উঠে পরলাম।সার্টিফিকেট গুলো গুছিয়ে ফাইলে ভরে নিলাম।কিন্তু ডায়েরীটা একটুও খেয়াল করলাম না।তাজ আবারো উল্টো দিকে গিয়ে কাচে বাইরের ব্যস্ত নগরী দেখতে মনোযোগ দিলো।দরজার সামনে দাঁড়াতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম চিরচেনা একটা ডাক শুনে।

তাজঃ বাটারফ্লাই!!!!

বাটারফ্লাই, ডাকটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।এই নামে শুধু আমাকে এনাজ ডাকতো।তাজ কি তাহলে এখন স্বীকার করবে ও আমার এনাজ।খুশি মনে দৌড়ে তাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আমিঃ আপনি কি বললেন?

তাজঃ বাটারফ্লাই বললাম।

আমিঃ আপপপপনননি কি আআআমাককে বলললেন??( কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে)

তাজঃ আপনাকে কেন বলবো?আমিতো এই প্রজাপতিটাকে দেখে বললাম।

এক নিমিষেই আমার মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল।সামনে তাকাতে দেখলাম সত্যি কাচের বাইরে ছোট একটা প্রজাপতি। আবার আমার দু চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরেই গেলো।রাগে,অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম।

🦋🦋🦋

কফি হাউসে মুখ গোমরা করে বসে আছি। শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। তায়াং ভাইয়া খুটিয়ে খুঁটিয়ে আমার মোবাইলে তাজের ছবি দেখছে।অফিস থেকে বের হয়েই তায়াং ভাইয়াকে ইমিডিয়েটলি কল করে এখানে আসতে বলেছি।তারপর তাজের সব ঘটনা খুলে বললাম।সেই কখন থেকে তায়াং ভাইয়া তাজের ছবি দুটোকে পর্যোবেক্ষণ করছে।আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।

তায়াংঃ তুই সিউর এটা এনাজ?

আমিঃ হ্যাঁ,আমি সিউর।পুরো একটা বছর তার সাথে আমি সংসার করেছি।তাকে চিনতে আমি ভুল করবো না।

তায়াংঃ কিন্তু চেহারায় একফোঁটাও মিল নেই।

আমিঃ চোখ দুটো দেখ।অবিকল এনাজের চোখ।

তায়াংঃ হুম,চোখ দুটো মনে হচ্ছে। কিন্তু আর কিছু নয়।

আমিঃ তুই ছবিতে দেখে এসব বলছিস।কিন্তু সামনাসামনি দেখলে তুইও সিউর হয়ে যাবি এই তাজই এনাজ।একটা মানুষের চেহারা পাল্টাতে পারে,ধরলাম স্বভাবও পাল্টাতে পারে। কিন্তু কন্ঠস্বর কিংবা চোখ কি করে পাল্টাবে।তাছাড়া হাতের সেম জায়গায় বড় তিল, এটাও তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পেছন থেকে বডিও অবিকল একিরকম দেখতে।এনাজের মতো একগালে হাসিটাও।

তায়াংঃ তোর কথা শুনে তো আমারও সন্দেহ হচ্ছে এই তাজের ওপর।

আমিঃ আমি যতবার এনাজের নাম নিয়েছি ততবার কেঁপে উঠেছে ও।আমি সিউর এনাজ বেঁচে আছে। আর এই তাজই আমার বাচ্চার বাবা এনাজ।

তায়াংঃ তুই কি এনাজকে সেদিন আগুনে পুড়তে দেখেছিস? ভালো করে মনে করে তারপর বলবি।

আমিঃ না, আমি ওকে আগুনে পুড়তে দেখিনি।তবে ওর গায়ে যখন আগুন ছুঁড়ে মারলো।তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠেছিলো।তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।

তায়াংঃ এমন হয় নি তো।সেদিন ওকে কেউ বাঁচিয়ে নিয়েছিলো।আর ওর চেহারা আগুনে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্লাস্টিক সার্জারি করে ওকে নতুন চেহারা দিতে হয়েছে।

আমিঃ আমিও এমনটা ভাবছি।সেদিন কোনভাবে এনাজ বেঁচে গিয়েছিল। আর ওর চেহারা আগুনে পুড়ে যাওয়ায় প্লাস্টিক সার্জারি করে নতুন চেহারা দিয়েছে। যদি এটা এনাজ হয় তাহলে আমার থেকে কেন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে? ও তো জানতো আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম।ওর বাচ্চাকে কেন দেখতে এলো না। তুই তো জানিস এনাজ আমাকে কতটা ভালোবাসে।আমাকে না পেলে মরে যাবে এমনটা হুমকি দিয়েছিলো তোকে।যার জন্য তুই, আম্মু,আব্বু আমাকে জোর করে বিয়েটা দিয়েছিলি।

তায়াংঃ সেটা আমিও ভাবছি।এমনটাও তো হতে পারে যে, এনাজ সবার থেকে আড়ালে থেকে নিজের খুনীকে খুজছে।তবে আমি কি এই তাজের সাথে সামনাসামনি দেখা করবো?

আমিঃ না, এখন করিস না।তুই বরং এই তাজের খোঁজ-খবর নে।কোথায় থাকে? কি করে? বাসায় কে কে আছে? এখন থাকে কোথায়? আগে কোথায় ছিলো? কোন অতীত আছে কিনা।সবকিছুর তথ্য জোগাড় কর।এগুলো হাতে পেলেই আমরা বুঝতে পারবো এটা সত্যিই আমার এনাজ কিনা।আমার মন বলছে এটা আমার এনাজ।

তায়াংঃ আচ্ছা আমি সব খোঁজ নিচ্ছি। সাথে তাজকে ফোলো করবো।যদি কোন শক্ত প্রমাণ পেয়ে যাই।

আমিঃ এনাজের চেহারা পাল্টালেও স্মৃতি শক্তি হারায়নি।যদি স্মৃতি শক্তি না থাকতো তাহলে আমাকে দেখে ওভাবে চমকাতো না।আমাকে ও বাটারফ্লাই বলে ডেকেছে। এই নামে তো শুধু এনাজই আমাকে ডাকতো।আমি খুশি হয়ে ওর কাছে যেতেই ও বলে কাচের ওপর প্রজাপতি দেখে ও বাটারফ্লাই নাম নিয়েছে। কিন্তু আমি জানি ও আমাকে ডেকেছে। ওর চোখে আমি অপরাধী ভাব দেখেছি,অস্থিরতা দেখেছি। আমি যখন ব্যাথা পেলাম তখন আৎকে চেয়ার থেকে উঠতে চেয়েছিল।কিন্তু উঠেনি।যদি ধরা পরে যায়।আমার জন্য অন্য রকম কিছু অনুভব করতে দেখেছি।
ও যদি এনাজ হয় তাহলে অবশ্যই আমাকে চাকরীটা দিবে।এটাও আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি।

তায়াংঃ আর কিছু??

আমিঃ ও আমার চোখের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছিলো না।তুই তো জানিস আমার চোখ দুটো ওর সবচেয়ে বেশি পছন্দের ছিলো।আমার চোখের দিকে তাকালে ও নাকি সব গুলিয়ে ফেলে।আজ যেনো আমার সামনে নিজেকে গুলিয়ে না ফেলে তাই আমার চোখের দিকে তাকায়নি।

তায়াংঃ ও হয়তো অপরাধবোধে ভুগছিলো।যার কারণে তোর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলো না। চোখের দিকে তাকালে নিজের ওপর রাগ হবে তার জন্য।

আমিঃ হতে পারে। তোকে দায়িত্ব দিলাম।তুই এই তাজের পুরো বায়োডাটা বের করবি।আজ তাহলে উঠি।নাভানকে সকালে তাড়াহুড়ায় কিছু খাওয়ানো হয়নি।বাসায় গিয়ে খাওয়াতে হবে। জানি না এরিন,হিমি আদোও ওকে কিছু খাওয়াতে পেরেছে কিনা।

তায়াং ভাইয়া ও আমি কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গেলাম।ভাইয়া আমায় বাসায় পৌঁছে দিলো।রাতে কল এলো আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। দুদিন পর জয়েন হতে হবে।আমি খুশিতে এরিন ও হিমি কে জড়িয়ে ধরলাম।

পরেরদিন সকালে………

একটানা কোলিং বেল বেজে যাচ্ছে। নাভান ঘুমিয়েছে।এরিন সম্ভবত ওয়াসরুমে আর হিমি ঘুমে।আজ শো করতে যাইনি।সকালে উঠতে দেরী হয়ে গেছে। তাই আটটার দিকে উঠে রান্না বসিয়েছি।

আমিঃ এই অসময়ে আবার কে এলো?

কিচেন থেকে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে দরজার সামনে গেলাম।দরজা খুলতেই আমার মুখটা রাগে লাল হয়ে গেলো।দরজার ওপর পাশের ব্যাক্তিটাকে দেখে রাগে মাথা গরম হয়ে গেছে।কিন্তু সেই মানুষটা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে তার সাদা কোর্ট-প্যান্ট।কোর্টের ভেতরে গাঢ় বেগুনি কালার মখমোলের শার্ট।কোর্টের ওপর দিয়ে গলার দুই পাশে বেগুনি রঙের মখমোলের ছেলেদের ওড়না ঝুলানো।হাতে বিশাল এক ফুলের তোড়া।এক হাতে ফুলের তোড়া আরেক হাতে কোর্ট ধরে স্টাইল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তোড়ার ভেতরে দিকটা নীল গোলাপ আর চারিদিকে সাদা গোলাপের গোল ঘেরা দিয়ে তৈরি ।কিন্তু এই লোকটা আমার খোঁজ কি করে জানলো?

নীল রঙ আমার পছন্দ। কিন্তু নীল গোলাপ থেকে লাল গোলাপ আমার বেশি পছন্দ। তার থেকেও বেশি বকুল ফুল।এই বকুল ফুল দেখলে আমার হুশ থাকে না।বকুলের মালাও আমার ভীষণ পছন্দ। বকুলের ঘ্রাণ আমার অনেক অনেক ভালো লাগে ।আগে প্রায় এনাজ আমার জন্য বকুলের মালা নিয়ে আসতো।যদিও এটা পাওয়া অনেক কঠিন ছিলো।কিন্তু আমার জন্য সে এই কঠিন কাজটাও অনায়াসে করে নিতো। আমি ফুলের দিকে তাকিয়ে অন্য ধ্যানে চলে গিয়েছিলাম।সামনে থাকা ব্যাক্তিটা আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো।

— ভেতরে কি ঢুকতে দিবে না,পাখি? এভাবেই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে ?

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_13
#Writer_NOVA

— ভেতরে কি ঢুকতে দিবে না? এভাবেই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে পাখি?

রোশানের মুখে পাখি ডাকটা শুনে আরো রাগ উঠে গেল।কিন্তু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছি।আমার সামনে আর কেউ নয় রোশান দেওয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলবো তার আগেই এরিন এসে হাজির।

এরিনঃ কে আসছে রে নোভা? এতো সকাল সকাল কে আবার আমাদের স্মরণ করলো?

কথাগুলো বলতে বলতে দরজার সামনে আসতেই রোশানকে দেখে এরিন ভ্রু কুঁচকে ফেললো।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে নিলাম।

এরিনঃ কে উনি? উনাকে তো চিনতে পারলাম না।তোর পরিচিত কেউ নাকি?

আমিঃ হুম অনেক পরিচিত। (দাঁতে দাঁত চেপে)

রোশানঃ হাই শালিকা সাহেবা।আমি আপনাদের নতুন দুলাভাই। নোভার ভবিষ্যৎ জামাই।

এরিনঃ মানে???

আমিঃ আশায় থাকে কাউয়া,পাকলে খাইবো ডেওয়া।(বিরবির করে)

এরিনঃ এই নোভা কি বলে উনি? কি হয় তোর? এটা তো এনাজ নয়।তাহলে দুলাভাই কেন বলে?

আমিঃ এর কথায় তুই কিছু মনে করিস না।এই ব্যাটা পাগল।মাথায় একটু সমস্যা আছে। কয়েক মাস পাবনায় ভর্তি ছিলো।এই সপ্তাহে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু পাগলামি এখনো যায়নি।মনে হচ্ছে আবার ভর্তি করতে হবে।

এরিনঃ দেখে তো পাগল মনে হয় না।

রোশানঃ কি বললে তুমি পাখি? আমি পাবনায় ভর্তি ছিলাম।এমন কথা তুমি বলতে পারলে? অবশ্য তোমায় খুঁজে না পেলে সত্যি ভর্তি হতে হতো।যাক গে সেসব কথা। আমি কিছু মনে করি নি।মেহমান এলে কি এভাবেই দরজার কাছে দাঁড়া করিয়ে রাখো তোমারা?ভেতরে তো ঢুকতে দেও।পা ব্যাথা হয়ে গেলো।

আমি এরিনের সামনে কোন ধরণের সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না।তাই সৌজন্যতা রক্ষা করার জন্য বললাম।

আমিঃ ভেতরে আসুন।

এরিনঃ এই লোক কে তাতো বলবি।বলা নেই কওয়া নেই একজন অচেনা লোককে তো আমরা ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি না। এমনি আমাদের পেছনে শত্রুর অভাব নেই। এই দালানেই তো দুই কুটনি বুড়ি আছে।তারা যদি জানে আমরা কোন অপরিচিত ছেলেকে ঘরে ঢুকিয়েছি তাহলে তিলকে তাল বানিয়ে চরিত্রে দাগ লাগাবে।বাড়িওয়ালা তখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিবে।আমরা তিনটা মেয়ে থাকি।কোন ছেলে মানুষ নেই। এখন যদি কোন ছেলে দেখে তবে কেলেংকারী হয়ে যাবে।

আমিঃ যা বোইন তুই একটু পানি খেয়ে আয়।এতবড় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোর গলা শুকিয়ে গেছে। গলা ভিজিয়ে নে।আমি কাউকে এখন ভয় পাই না।তাই এতসব আমাকে বলে কোন লাভ নেই। (রোশানের দিকে তাকিয়ে) কি ভেতরে কি ঢুকবেন? নাকি বাইরে থেকে চলে যাবেন? বিনা দাওয়াতে যখন ডেং ডেং করে নাচতে নাচতে চলে আসতে পেরেছেন, তাহলে ভেতরে ঢুকতে এত শরম কেন?

রোশানঃ অপমান করছো পাখি? কোন সমস্যা নেই। তুমি আমাকে যা বলো বা করো তাতে আমার একটুও খারাপ লাগে না। কারণ তোমাকে সেই অধিকার আমি দিয়েছি।তুমি ছাড়া আর কারো সাধ্যি নেই এই রোশান দেওয়ানের সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার।আর অপমান তো অনেক দূরের কথাই।

রোশান ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো।ওকে সোফায় বসতে বলে আমি আর এরিন আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হলাম।শত হোক উনি এখন আমার অতিথি। তার আপ্যায়ন তো করতেই হয়।আর এরিন বা হিমি কাউকে আমি আমাদের বিষয় কিছু জানাতে চাইছি না।তাই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় আছি।ঘরে তিন আইটেমের ফল,বিস্কুট চানাচুর ছিলো।জলদী করে তাই বের করলাম।যদিও সকালবেলা ফল দিলে কিরকম দেখায়।কিন্তু ঘরে আপাতত এগুলো ছাড়া আর কিছু নেই।

মিনিট পনের পর খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে আমাদের ছোট ড্রয়িং রুমে আসতেই, আমি রোশানকে পেলাম না।ছোট টি-টেবিলে ফুলের তোড়া রাখা।কিন্তু রোশান নেই। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে রোশান ভেতরেই আছে।আমার রুমে উঁকি মারতেই আমার চোখ ছানাবড়া। রোশান নাভানকে কোলে তুলে ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।

আমিঃ আপনি আমার বেডরুমে কি করছেন?

রোশানঃ নাভান উঠে গিয়েছিলো।তাই আমি এসে কোলে তুলে নিলাম।

আমিঃ দিন, আমার কোলে দিন।

রোশানঃ থাকুক না একটু আমার কোলে।

রোশান পুরো ইনোসেন্ট ফেস করে কথাটা বললো। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মানা করতে পারলাম না।তাছাড়া নাভানও ওর কোলে চুপ করে আছে।

আমিঃ এদিকে আসুন।

রোশান ভদ্র ছেলের মতো আমার পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে এলো।নাভানকে কোলে নিয়েই সোফায় বসলো।কিছু সময় পর পর ওর গালে, কপালে চুমু খাচ্ছে। ওর সাথে হাত নাড়িয়ে খেলছে।নাভান খিলখিল করে হাসছে।রোশানের মুখেও হাসি।আমার কেন জানি এই চিত্রটা ভীষণ ভালো লাগলো।এনাজ থাকলে হয়তো এভাবেই নাভানের সাথে খেলতো।

আমিঃ মিস্টার রোশান, কিছু একটা খেয়ে নিন।

রোশানঃ শুধু শুধু এসব করতে গেলে পাখি।আমি এখন কিছু খাবো না। ব্রেকফাস্ট তোমার সাথে করতে চাই। যদি তুমি কিছু মনে না করো।

আমিঃ ব্রেকফাস্ট পরে করবেন।আগে কিছু তো একটু মুখে দিতেই হবে।

রোশানঃ আমার পাখি যখন বলছে তাহলে তো কিছু একটা মুখে দিতেই হয়।

হাত বাড়িয়ে এক পিস বিস্কুট নিয়ে মুখে পুরলো।তারপর আঙুরের থোকা থেকে কতগুলো আঙুর ছিঁড়ে একটু একটু করে নাভানকে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো।আশ্চর্য বিষয় হলো নাভান কোন ঝামেলা ছাড়া তা লক্ষ্মী ছেলের মতো করে খাচ্ছে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।খুব সহজে রোশান নাভানের সাথে মিশে গেছে। এরিন আবার পড়তে চলে গেছে।ওর একটা টিউটোরিয়াল এক্সাম আছে। হিমি এখনো ঘুমে।আমি নিশ্চিন্ত মনে কিচেনে চলে গেলাম।

রোশানকে কেন জানি এখন আমার একটুও খারাপ লাগছে না। কিচেন থেকে এখন আমি ওদের দুজনের হাসির ঝংকার শুনতে পারছি।উঁকি মেরে দেখতে পেলাম রোশান আর নাভান দুজনে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে একসাথে খেলছে।তাও নাভানের খেলনা দিয়ে। আমার কাছে দুটোকেই বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে। রোশানকে আমি অন্যরূপে আবিষ্কার করলাম।ওর চোখ, মুখে কোথাও নেই কোন ক্ষোভ বা হিংস্রতা।বরং একটা বাচ্চার সাথে খেলতে গিয়ে ও নিজেও বাচ্চা হয়ে গেছে। নাভানও ওর সাথে এমন আচরণ করছে না জানি কত আগের থেকে রোশান ওর চেনা।আমার মনটা খুশির সাথে সাথে নতুন এক আশংঙ্কা হানা দিচ্ছে। রোশান আবার নতুন কোন চাল চালবে না তো।নইলে হুট করে এভাবে আমার এখানে কেন?তবে ওর মধ্যে কোন ভেজাল আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তারপরেও নিজের মনটা তো ওকে বিশ্বাস করতে পারছে না।রোশান পলিটিশিয়ান।উদ্দেশ্য ছাড়া কোন কাজ করে না।ওর সব কাজের পেছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য জড়িত থাকে।আবার যদি কোন ঝামেলা পাকায়??

🦋🦋🦋

নিজের কেবিনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে তাজ।দুদিন ধরে কিছুই তার ভালো লাগছে না। নোভার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেদিন যখন টুম্পা নামের মেয়েটির থেকে বকুল ফুলের মালা কিনেছিলো।তখন সামনে তাকিয়ে নোভাকেই দেখতে পেয়েছিলো।ব্যাগ হাতে একা দাঁড়িয়ে আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকে খুজছিলো নোভা।ওকে দেখেই ওর হাত-পা ঠান্ডা হওয়া শুরু করছিলো।অন্যরকম একটা ফিলিংসের মুখোমুখি সে হয়েছিলো।আর গতকাল ওর সামনে ছিলো।তাহলে বুঝুন কতটা নার্ভাস সে ছিলো।যদিও উপরে উপরে তার কিছুই বুঝতে দেয় নি কাউকে। কোনকিছু ভালো লাগছে না তাজের।টেবিলে থাকা ফাইল ঘাটতে শুরু করলো।তখুনি ওর চোখ গেলো টেবিলে থাকা নীল মলাটের এক ডায়েরির দিকে।ডায়েরী হাতে নিয়ে ও সিউর হলো এটা নোভার।কারণ গতকাল নোভাকে এটা ব্যাগ থেকে বের করতে দেখেছিলো।

ডায়েরি খুলতে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো তাজ।অন্যের ডায়েরি না বলে ধরা উচিত নয়।আর সেখানে তাজ এটা পরবে।ডায়েরি খুলবে কি খুলবে না তা নিয়ে এখন দ্বিধাদ্বন্দে পরে গেছে।মস্তিষ্ক বলছে অন্যের ডায়েরি খোলা উচিত নয় তাজ।আর মন বলছে খুলে দেখ না কি আছে?তুই তো আর কোনকিছু চুরি করছিস না।অবশেষে মনের কথায় সায় দিয়ে ডায়েরিটা খুলেই ফেললো তাজ।খুলতেই নিচের লেখাগুলো পেলো।প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে ছন্দের আকারে লিখা।

“”ডায়েরির পাতায় পাতায়🍁
লিখা আছে তোর নাম🌹
আমি না হয়, হয়ে রইলাম🍃
তোর নামের বদনাম🍂🍂””

~~~~~~~ভালোবাসি এনাজ,খুব বেশি ভালোবাসি।তোমায় ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আরেকবার ফিরে আসো না আমার জীবনে।কথা দিচ্ছি আমি কোন দুষ্টুমি করবো না।আমি তো এখন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে গেছি।পরিস্থিতি সামলে নিতেও শিখে গেছি।তবুও কি তুমি ফিরে আসবে না। এক বাচ্চার মা হয়ে তো জীবন থেকে অনেক শিক্ষা পেয়ে গেলাম।এখনো কি আসবে না আমার জীবনে?আমার বিশ্বাস তুমি আসবে।আমার সাথে আর কত অভিমান করে থাকবে?আমার যে এখন তুমি হীনা দম নিতেও খুব কষ্ট হয়।পুরো পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি যে হাঁপিয়ে গেছি।আমি সত্যি ক্লান্ত হয়ে পরেছি।আর কত কষ্ট দিতে চাও আমায়?এবার চলে আসো না প্লিজ।আমি তোমার সব কথা শুনবো।~~~~~~~~~~

প্রথম পৃষ্ঠা পরে নিজের মনে বিরবির করে উঠলো তাজ।তার ভেতরটা কিরকম জানি ছটফট করছে।কিন্তু কিসের জন্য তা সে বুঝতে পেরেও আবার বুঝতে পারছে না।

ডায়েরির দিকে তাকিয়ে আবার পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো।তখুনি চোখ যায় আরেক জায়গায়। লেখাগুলো মনে হয় আগের।কারণ কালিগুলো কিরকম ছড়িয়ে গেছে।সম্ভবত লেখাটা নোভার বিয়ের আগের হবে।প্রথমে সম্ভবত বলে ধরে নিলেও পৃষ্ঠার কোণার দিকে তাকিয়ে তাজ সিউর হয়ে গেলো লেখাটা নোভার বিয়ের আগেরই।কারণ সাল লেখার জায়গায় আজ থেকে আরো চার বছর আগের সাল লেখা। চেয়ারে আরাম করে বসে পড়তে লাগলো তাজ।সেখানে নিচের কথাগুলো লিখা আছে।

🍂🍂🍂

একটু আগে একটা কাহিনি হয়ে গেছে।যেটা না লিখলে আমার পেটের ভাত হজম হবে না।তাই লিখতে বসে পরেছি।কথা না বলে কাহিণীতে ফেরা যাক।

আম্মু সবসময় পরার জন্য সিটি গোল্ডের দুটো চুড়ি কিনে আনছে।আগের গুলো পুরনো হয়ে রং নষ্ট হয়ে গেছে বলে।আম্মু বরাবরই নতুন কিছু আনলে আগে আমাদের দুই বোনকে দেখাবে।তারপর নিজে পরবে।হোক সেটা আমাদের দুই বোনের জন্য কিংবা আব্বু অথবা নিজের জন্য।যথারীতি আম্মু আমাদের দেখিয়ে নিজের হাতে চুড়ি দুটো পরছে।

আমার আবার একটা বাজে অভ্যাস আছে। আম্মু যখুনি আমার সামনে চুড়ি খুলবে তখুনি টুপ করে খুলে রাখা চুড়ি দুটো আমার দুই হাতে পরে নিবো।আমার এই কাজটা করতে ভীষণ ভালো লাগে।আমার মুঠ ভর্তি চুড়ি পরার থেকে দুই হাতে দুটো সিটি গোল্ডের চুড়ি পরা বেশি পছন্দ।কিরকম বিবাহিত বিবাহিত মেয়ে দেখা যায়।এই বিষয়টা আমি বেশ ইনজয় করি। তাই আম্মু চুড়ি খুললেই আমি টুপ করে পরে নেই।

তো সেই চুড়িগুলে সন্ধ্যা থেকে পরে ঘুরছি।মাঝে মাঝে হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি। ভালো লাগছিলো না,ভাবলাম এক কাপ চা খেলে ভালো লাগবে। তাই চা বানাতে চলে যাই।এক কাপ আম্মুকে দিয়ে আর দুই কাপ নিয়ে ছোট বোন ইভার কাছে চলে আসছি।আমরা দুই বোনের একটা অভ্যাস আছে।যেটা হলো চা খাওয়ার সময় কখন খাটের ওপর বসবো না।দুজনেই নিচে ফ্লোরে বসে, হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে চা খাবো।তো তোমনটা করেই বসে চায়ে বিস্কুট ভিজাচ্ছি। আমার বোন ওর পেছনে খাটে থাকা বালিশে হেলান দিয়ে রেখেছে।

বিস্কুট চায়ে ভিজিয়ে খেতে খেতে হঠাৎ ইভা বলে উঠলো,”বোইনে চুড়ি দুটো খোলো।”আমি বললাম “কেন?”ও বলে, “না তুমি চুড়ি দুটো খুলবা।”আমি বললাম, “যা ভাগ।”ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে চায়ে চুমুক দিলাম।কিন্তু ও চা না খেয়ে বিস্কুট হাতে নিয়ে ওর সামনে থাকা বালিশে মুখ গুঁজে বসে রইলো।আমি ভাবলাম হয়তো এমনি করছে।একটু পর ঠিক হয়ে যাবে।মাঝে মাঝে এরকম অদ্ভুত বায়না করে ও।তাই আমি এসবকে পাত্তা দেই না।

চা শেষ হতেই কাপটাকে ধুয়ে যথাস্থানে রেখে আবার ফিরে এসে দেখি ইভা এখনো বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছে। এবার একটু খোটকা লাগলো।ও তো কখনো এরকম করে এত সময় থাকে না।দুই হাত দিয়ে মাথাটা সামান্য উঁচু করতেই দেখতে পেলাম নাকের পানি, চোখের পানি এক করে ফেলেছে। কোনকিছু বলেই ওর মাথা উঠানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমার চুড়ি দুটো খুলতেই হলো।চুড়ি খোলার সাথে সাথে চোখ মুছে হাসি দিয়ে চা খেতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।আমি তো অবাক, এই মেয়ের কান্ড দেখে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “এমন করলি কেন?”তারপর যা বললো তাতে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।ও কান্না করছে এজন্য যে,আমি দুই হাতে চুড়ি পরলে ওর নাকি মনে হয় আমি ওকে ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবো।তাই চুড়ি খুলতে বলেছে।কথাগুলো বলতে বলতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে আবারো কাঁদতে লাগলো।এবার আমি হাসতে হাসতে ওকে রাগাতে লাগলাম।বললাম,”আমি চলে গেলেই তো তুই খুশি।সবসময় তো তুই বলিস আমাকে কবে তুমি শ্বশুর বাড়ি যাবা।আর কবে তোমার জ্বালা থেকে রেহাই পাবো।আর পুরো রুমটা আমার হবে।তাহলে এখন কাঁদছিস কেন?আমি চলে গেলেই তোর শান্তি।” এতে ওর সামান্য হেলদোলও দেখলাম না। ও তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। অবশেষে অনেক দুষ্টামী করে ওর কান্না বন্ধ করতে পেরেছি।

কিন্তু ইভার হঠাৎ এমন বিহেভিয়ারে আমি অনেক অবাক হয়েছি।সচারাচর ও এমন করে না।আমি জানি, আমি চলে গেলে ও প্রথম প্রথম অনেক কান্না করবে।কারণ আমি ছাড়া ওর প্রিয় বন্ধু আর কেউ নেই। সবকিছু আমার সাথে শেয়ার করবে।আমি শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে ও পুরো একা হয়ে যাবে।তখন হয়তো ওর সময় কাটানোর মানুষটাও থাকবে না।আম্মুর কাছে কিছু সময় পর পর আমার নামে বিচারও দিতে পারবে না। অবশ্য সময়ের স্রোত একসময় ঠিক মানিয়ে নিবে।কিন্তু প্রথম দিকে ওর খারাপ লাগবে মনে হলেই আমার মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়।

শত ঝগড়া, মারামারি, কিংবা মনমালিন্যর পর আমিই ওর সব।ইভার সাথে রাগ করে যেমন আমি থাকতে পারি না। তেমনি ইভাও পারে না।আমি একটু অসুস্থ হলে পাগল হয়ে যায়।কি রেখে কি করবে?একটা কাজও তখন করতে দিবে না। ও আমার বিশ্বস্ত একজন বন্ধুও।যে কথাটা আমি বলতে মানা করবো কখনো সেটা কাউকে বলবে না।কখনো বা আম্মু-আব্বুর বকার থেকে বাঁচিয়ে দিবে।আব্বু আমাকে বকলে ওর মুখ কালো হয়ে যাবে।আমার চোখে পানি দেখলে ও কেঁদে অস্থির হয়ে যাবে।মায়ের পর এই ছোট বোনটা আমার চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। আমার চোখে পানি আসতে দেরী।ওর আসতে দেরী নয়।কিন্তু আমার চোখের পানি পরার আগে ওর চোখের পানি আগে পরে যাবে।

মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ওর কাজে।মনে হয় আমি ওর বড় বোন নই।ও আমার বড় বোন।সত্যি নিজেকে আমি খুব ভাগ্যবতী মনে করি।নয়তো ওর মতো এতো কেয়ারিং, আমাকে বোঝে এমন একটা বোন পেতাম না।তবে আমি ওর মতো ভালোবাসার প্রকাশটা করতে পারি না।তবে নিরবে,ধমকে কিংবা শাসনে ওকে আমি ভালোবাসি।

🍂🍂🍂

ডায়েরিটা বন্ধ করলো তাজ।নীল মলাটের মোটা ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে চোখে আটকে যায় এক জায়গায় এসে।যেখানে লিখা ছিলো “বোন”।নোভা তার ছোট বোন ইভাকে নিয়ে একটা কাহিনি ও মনের অনুভূতি গুলো লিখে রাখছে।পড়তে পড়তে কখন যে চোখের কোণে পানি জমে গেছে তা নিজেও বুঝতে পারেনি তাজ।ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে পানিটুকু মুছে নিলো।তারপর আবার ডায়েরির পাতা উল্টোতে লাগলো।দুই বোনের জীবন গল্প পড়তে পড়তে নিজের ভাইয়ের কথা মনে পরে গেছিলো।তাই না চাইতেও চোখের কোণে জল এসে ভিড়ছে। কারো হাঁটার শব্দ পেয়ে দ্রুত ডায়েরিটা টেবিলে থাকা ফাইলের ভিড়ে লুকিয়ে ফেললো।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-১০+১১

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_10
#Writer_NOVA

হঠাৎ ঘুমের ঘোরে মনে হলো কেউ আমার ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার উপর পরছে।তার শরীরের ঘ্রাণটাও আমার বড্ড চেনা।চোখ খুলতেই আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখতে পেলাম।তড়িঘড়ি করে লাফিয়ে উঠলাম।হাতরে লাইটের সুইচ অন করলাম।কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে আমি অবাক।কেউ নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এখানে কেউ ছিলো।এটাকে আমি হ্যালুসিউশন ধরে নিলাম।কারণ এরকম আমার মাঝে মাঝে হয়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলাম।১০ টা বেজে ২২ মিনিট। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি টেরও পাইনি।ড্রেস পাল্টিয়ে এরিনদের রুমে গেলাম।

আমিঃ এরিন,হিমি কি করছিস? নাভান কি ঘুমিয়ে গেছে?

এরিনঃ একদম ধরবি না নাভানকে।ও আজকে আমাদের সাথে থাকবে।এভাবে কেউ ছোট বাচ্চাটাকে মারে।গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে।

হিমিঃ অনেক কষ্টে ঘুম পারিয়েছি। তোকে কতবার বলছি ছেলেটাকে এভাবে মারবি না।কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে গিয়েছিলো ছেলেটার।ও যদি বুঝতো তাহলে কি এসব জিজ্ঞেস করতো।রাগ উঠলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে কেন পারিস না?

আমিঃ জানি না রে।তখন এত কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে ও আবার মর্জি করছিলো।তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি।তোরা এসে না ধরলে আরো দুটো দিতাম।এবার আমার ছেলেকে দে।তোরা তো জানিস, ওকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারবো না।

এরিনঃ যা ভাগ।তোকে আমি নাভানকে নিতে দিবো না।মারার সময় মনে ছিলো না। এক রাত ওকে ছাড়া থাকলে তোর শিক্ষা হবে।পরেরবার থেকে মারার সময় নিজেকে সামলাতে পারবি।

আমিঃ বোইন এমন করিস না।আমার পোলাডারে দিয়া দে🥺।

হিমিঃ দিতে পারি তবে এক শর্তে।

আমিঃ আমার ছেলে আমি নিবো তাও আবার শর্ত লাগবে।

হিমিঃ শর্তে রাজী থাকলে বল। নয়তো ভাগ।

আমিঃ কি শর্ত বল?

হিমিঃ এরিন, কাগজটা দেখা তো।

আমিঃ কিসের কাগজ?

এরিন বসা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করে নিয়ে এলো।

আমিঃ কি এটা?

এরিনঃ পড়ে দেখ।

আমিঃ চাকরীর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমি কি করবো?

হিমিঃ এখানে তোকে চাকরী করতে হবে।আর এটাই হলো আমার শর্ত।তোর C.V আমরা আজ জমা দিয়ে এসেছি। আগামী পরশু ইন্টারভিউ। মার্কেটিং সম্পর্কে তোর যথেষ্ট ধারণা আছে। তাই তোকে না জানিয়ে তোর ড্রয়ার থেকে C.V নিয়ে আজ বিকেলে আমরা দুজন জমা দিয়ে এসেছি।

এরিনঃ তুই এবার ভালোয় ভালোই আগামী পরশু ইন্টারভিউ দিতে যাবি।আমার বিশ্বাস চাকরীটা তুই পাবি।কোম্পানিটা নতুন।তবে সবদিক দিয়ে ভালো আছে।

আমিঃ তোদের কে বলেছে এসব করতে? আমি তো এভাবেই ভালো আছি।

হিমিঃ দেখ নোভা, তোর আর আমাদের বিষয় কিন্তু এক নয়।তোর ছোট একটা ছেলে আছে।ও বড় হচ্ছে। ওরো তো একটা ভবিষ্যত আছে। ওর জন্য তোকে ভাবতে হবে।

এরিনঃ আর জে ক্যারিয়ারটা আমরা দুজন করি শখের বশে।পড়াশোনার পাশাপাশি হাত খরচ চলে আসে তার জন্য করি। কিন্তু তুই কিন্তু শখের বশে করিস না।তোকে করতে হয় ছেলের জন্য। যেহেতু তোর অনার্স কমপ্লিট আছে তাহলে সমস্যা কি? আমরা অবিবাহিত মেয়ে। আজ হোক কাল হোক আমাদের বিয়ে হবে।তখন হয়তো আমরা এই ক্যারিয়ারে আর থাকবো না।

আমিঃ আমি এতকিছু সামলাবো কি করে?

হিমিঃ সকাল দশটা থেকে বিকেল তিনটে অব্দি কাজ করবি।তাতে তোর শো করতেও কোন সমস্যা হবে না। তাছাড়া কোম্পানিটা আমাদের কাছাকাছিই।আগে ইন্টারভিউ দে।সেখানে টিকলে তারপর বাকি চিন্তা করবি।

আমিঃ কি করবো বুঝতে পারছি না।

এরিনঃ তোর কিছু বুঝতে হবে না। আগামীকাল শুক্রবার মানে আমাদের অফ ডে।সারাদিন ভাবার সময় পাবি।তবে পরশু সকালে তোকে ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে এটাই শেষ কথা।

আমিঃ আচ্ছা, দেখি কি করা যায়।

নাভানকে কোলে করে এনে আমার রুমে শুইয়ে দিলাম।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।হাতে থাকা বিজ্ঞপ্তির কাগজটা নিয়ে বারবার পরলাম। কোম্পানির নাম MAT । ওনারের নাম দুইটা।আরিয়ান আজওয়ার, তাজরান তাজওয়ার।নাম দুটো ভীষণ অদ্ভুত লাগলো আমার কাছে। তবে কেন জানি মনে হচ্ছে এবার অন্য কিছু ঘটতে চলেছে আমার সাথে। কিন্তু কি সেটা?

🦋🦋🦋

In Canada…………

কফির মগটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রোশান।তিন দিন যাবত সে কানাডা আছে।বড় এক মন্ত্রীর সাথে জরুরি মিটিং-য়ে এসেছে।রোশানের আসার কোন ইচ্ছে ছিলো না।কিন্তু মানা করতেও পারেনি। মন্ত্রী ওকে ভীষণ ভালোবাসে।প্রায় সব মিটিংয়ে ওকে রাখে।সেদিন রাতে তমালের সাথে কথা বলার পরই মন্ত্রীর কল আসে।সকালের ফ্লাইটেই কানাডা চলে আসতে হয়েছে। এই তিনদিন প্রচুর ব্যস্ত ছিলো।একটু দম ছাড়ার সময়ও সে পাইনি।আজ কাজের চাপ কম থাকায় সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরেছে।তারা এক আবাসিক হোটেলে উঠেছে। কফিতে চুমুক দিয়ে সামনের ব্যস্ত নগরী দেখায় মনোযোগ দিলো।বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে।আলোকোজ্জ্বল নগরীতে বৃষ্টির ফোঁটায় অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু রোশানের মন এখানে নেই। তার মনে পরে গেছে নোভার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিন।সেদিনও এরকম ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিলো।

অতীত……….

সকাল থেকে আকাশটা কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। হুটহাট করে হালকা ধারায় বৃষ্টি ঝরছে।রোশান এলাকার কলেজের ছাত্রনেতা।কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের হাতে প্রচুর কাজ জমে আছে। তাই সেরে বাসায় ফিরছিলো।তখুনি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো।বাধ্য হয়ে তাকে কলেজের দালানের নিচে দাঁড়াতে হলো।তার পরনে সাদা শার্ট।এই বৃষ্টিতে নির্ঘাত তিল পরে যাবে।তাই দালানের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

রোশানঃ এই বৃষ্টি যে কি শুরু করছে? ধূর, বিরক্তিকর। এখন এই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে গেলে আমার সাধের শার্ট-টা নষ্ট হবে।কি আর করার? একটু অপেক্ষা করে দেখি কমে কিনা।

মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এদিক সেদিক তাকালো।তখুনি ওর চোখে পরলো নোভার দিকে।বুকের বা পাশটা ধক করে উঠলো।না চাইতেও ভালো লাগায় তাকে ঘিরে ধরলো।নোভা ছাতা হাতে জামা-কাপড় থেকে পানি ঝারছে।ততক্ষণে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেছে। হিজাবের কারণে মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।তাই রোশান উকি ঝুকি মারছিলো।নোভার পরনে কলেজ ড্রেস। রোশান নোভাকে দেখে সিউর হলো ও ইন্টার ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী হবে।কারণ এর আগে ওকে দেখেনি।রোশান ধীর পায়ে নোভার পেছনে এসে দাঁড়ালো। সামনের থেকে মুখটা ওর কাছে স্পষ্ট হলো।হুট করে রোশনকে দেখে নোভা ভয় পেয়ে গেলো।চমকে দু পা পিছিয়ে গেল।

রোশানঃ আরে ভয় পেয়ো না।আমি কিছু করবো না।

কিন্তু নোভা বিশ্বাস করলো না। চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।তারপর আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।

রোশানঃ নাম কি তোমার?

নোভা কোন উত্তর দিলো না।আড়চোখে একবার রোশানের দিকে তাকালো।এমন একটা ভাব যেনো রোশানকে সে দেখেইনি।সামনের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিলো।

রোশানঃ আমার নাম রোশান দেওয়ান। আমি দেওয়ান বাড়ির মেজো ছেলে। তুমি নিশ্চয়ই এবার ইন্টার ১ম বর্ষের ছাত্রী? তোমাদের বাসা কোথায়? আমি কি একা বকবক করে যাবো? তুমি কি কথা বলতে পারো না নাকি? ও হ্যালো, আমি তোমাকে বলছি।তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? তুমি কি কানে কালা নাকি?

নোভার এতক্ষণ ভয় ভয় করছিলো।একটা অচেনা ছেলের সাথে বৃষ্টির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন মেয়ের ভয় করবে।তার মধ্যে আশেপাশে কোন মানুষ নেই। কিন্তু এখন নোভার রাগ উঠছে। কানের সামনে কি পটর পটর শুরু করছে।এই ছেলেকে কি তার বায়োডাটা দিতে বলেছে সে।তবে চুপচাপ ওর কথা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করে নিলো।একবার কটমট করে রোশানের দিকে তাকিয়ে আবার বৃষ্টি দেখতে মনোযোগ দিলো।

রোশানঃ তুমি আমাকে হয়তো বাঁচাল ছেলে ভাবছো।আসলে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তুমি যাতে বোর না হয়ে যাও তাই তোমার সাথে আড্ডা জমানোর চেষ্টা করতে চাইছিলাম।কিন্তু তুমি তো আমার কথা পাত্তাই দিচ্ছো না।

নোভা এবারো কোন উত্তর দিলো না। এদেরকে উত্তর দিলেই মাথায় চরে বসে। তাই খুব শান্তপর্ণে রোশানকে সাইড কাটিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। রোশানও ওর পিছু নিলো।অন্যদিকে এসে নোভা বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে দিলো।ওমনি মনটা অনেকটা ভালো হয়ে গেলো। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।রোশান তা কিছু দূর থেকে পিলারে হেলান দিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো।প্রথম দেখায় নোভাকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিলো রোশানের।যাকে বলে লাভ এট ফাস্ট সাইড।তাই নিজের অজান্তে মনে মনে বিরবির করে বলে উঠেছিলো।

রোশানঃ তোমাকে আমার চাই। আমি তোমাকে আমার করেই ছারবো।প্রথম দেখায় মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। শতচেষ্টা করে তোমাকে আমি হাসিল করেই নিবো পাখি।হ্যাঁ,তুমি আমার পাখি।

সেদিন রোশান, নোভা একসাথে এক ছাতার নিচে বাসায় ফিরেছিলো।নোভা অবশ্য ওকে নিয়ে আসতে চাইনি।কিন্তু রোশান ওকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে নিতে বাধ্য করেছে। এরপর থেকে নোভার পিছনে ঘোরা আরম্ভ হয়েছিল। সবসময় ওকে নজরে নজরে রাখতো।দুই বার প্রপোজ করেছিলো।কিন্তু নোভা একসেপ্ট করেনি।তবুও রোশান থামেনি।পাক্কা এক বছর ওর পিছু ঘুরেছে।এক বছর পর নোভার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলো রোশান।তখুনি ঘটলো এক অঘটন।ইলেকশনের ছোট একটা বিষয় নিয়ে দুইপক্ষের মারামারি লেগে যায়। সেই ঝামেলার মূল ছিলো রোশান।তাই রোশানের বিরুদ্ধে কেস করা হয়।সেই কেসের থেকে বাঁচানোর জন্য লুকিয়ে রোশানকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেয় ওর বাবা।দুই বছর পর যখন রোশান ফিরে তখন জানতে পারে মাসখানিক আগে নোভার বিয়ে হয়ে গেছে। প্রথমে পাগলামি করলেও পরে নিজেকে নোভার থেকে সরিয়ে নেয়।মাসখানেক দেশে থাকার পর আবার আমেরিকা চলে যায়। তারপর এক বছর পর আবার ফিরে আসে।ফিরেই মন্ত্রী পদের জন্য নমিনেশন জমা দেয়।ভাগ্যক্রমে বিপুল ভোটে জিতেও যায়।একদিন জানতে পারে নোভার স্বামী মারা গেছে। এটা শুনে যেনো রোশান ঈদের চাঁদ পেয়ে যায়।ওর বাচ্চাসহ ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায়।কিন্তু নোভা ওর বাচ্চা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।আবারো পাগলোর মতো খুঁজতে থাকে ওকে।একদিন খোঁজ পেয়েও যায়।কিছু দিন নোভার গতিবিধি লক্ষ্য করে। সুযোগ বুঝে তুলেও নিয়ে যায়।কিন্তু জরুরি মিটিং-এর ডাক পরে যাওয়ায় বিয়ের আগ মুহুর্তে তাকে চলে যেতে হয়।আর নোভা বাচ্চা নিয়ে ওর ডেরা থেকে পালায়।তারপরের ঘটনা তো আমাদের সবার জানা।

বর্তমান………

কফি ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে গেছে।সেদিকে কোন খেয়াল নেই। রোশান কখন যে অতীতের দিনে হারিয়ে গিয়েছিলো তাই জানে না।মোবাইলের রিংটোনে তার হুশ ফিরে আসে।ভাবনা থেকে ফিরে মোবাইল হাতে নেয়।তার বাবা কল করেছে। ইদানীং বাসা থেকে বিয়ের অনেক চাপ দিচ্ছে রোশানকে।কিন্তু তারা কেন বুঝে না নোভাকে ছাড়া যে তার চলবে না।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_11
#Writer_NOVA

এক দিন পর………

—–আসসালামু আলাইকুম। কি খবর সবার? হেই গাইস, দিস ইজ মি RJ নোভানাজ আছি আপনাদের সাথে। আপনাদের শো ভোরের পাখি নিয়ে। আপনারা শুনছেন, 90.4 ঢাকা এফএম। এখন বাজে ৯ টা বেজে ১৭ মিনিট। আমি আর ৪৩ মিনিট আছি আপনাদের সাথে। আপনাদের মনের মধ্যে থাকা যেকোনো কথা কিন্তু আমাকে শেয়ার করতে পারেন।তাছাড়া কোন গানটা আপনারা শুনতে চান তাও কিন্তু জানাতে ভুলবেন না।তাহলে দেরী কিসের?এখুনি টেক্সট করে আপনার নাম,লোকেশন ও যা আপনি বলতে চান টাইপ করে পাঠিয়ে দিন। কমেন্ট করতে চাইলে অফিসিয়াল পেইজে যুক্ত হয়ে যান।আপনার পছন্দের গানের কথাও টেক্সট করে কিংবা কমেন্ট করে জানিয়ে দিতে পারেন।আমি যথাসাধ্য তা বাজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।কথা না বলে গানে ফেরা যাক।আপনাদের পছন্দের গান বাজাবো এখন।দেরী না করে জলদী জলদী আপনার পছন্দের গানটির কথা জানিয়ে দিন আমাকে।আমি সেটা—–

আদরঃ স্যার, আজ এত তাড়াতাড়ি অফিসে চলে এসেছেন যে? এখনও তো কেউ আসেনি?

এক ধ্যানে মোবাইলে ইয়ারফোন লাগিয়ে জোরে সাউন্ড দিয়ে এফএম শুনছিলো তাজরান।আদরের কণ্ঠ শুনে এফএম রেডিও অফ করে ওর দিকে তাকালো।আজ খুলে জলদী অফিস চলে এসেছে সে।

তাজঃ আজ অফিসে ইন্টারভিউ আছে,সেটা কি তুমি জানো আদর?

আদরঃ জী, স্যার।

তাজঃ ইন্টারভিউগুলো সব আমায় নিতে হবে।আর আমি যদি জলদী না আসি তাহলে কে নিবে? ঢাকা শহরের যামের কথা তো জানো।যদি সাড়ে নয়টার দিকে রওনা দিতাম তাহলে আমি সাড়ে দশটায়ও পৌঁছাতে পারবো না।তাই নয়টার আগেই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি মাত্র নয়টা পাঁচ বাজে।তাই কি আর করবো? বসে বসে আমার ফেভারিট শো শুনছিলাম।তুমি এতো তাড়াতাড়ি?

আদরঃ আমিও ভাবলাম আজ তাড়াতাড়ি চলে আসি।যদি লেট হয়ে যায়।স্যার, আমাদের শেয়ার ব্যবসার কি খবর?

তাজঃ আবেদন করেছি।এখনো পাস হয়নি।

আদরঃ ওহ আচ্ছা। স্যার, চা বা কফি কিছু আনবো?

তাজঃ এক মগ কফি হলে খারাপ হয় না।

আদর কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো।তাজ কিছু একটা ভেবে আদরকে ডাকলো।

তাজঃ আদর!!!

আদরঃ জ্বী স্যার, কিছু বলবেন?

তাজঃ আজকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য কয়জন কে সিলেক্ট করা হয়েছে?

আদরঃ প্রায় ৩০ জন হবে।ডেট তো কমিয়ে ফেললেন।নয়তো আরো ১০০ জন হতো।১০০ এর কাছাকাছি হয়েছিল। তার থেকে ৩০ জন সিলেকশন করা হয়েছে। এখন এই ৩০ জন থেকে মাত্র ৩ জন নেওয়া হবে।আপনার যাকে মনে হবে তাকে সিলেক্ট করবেন।মাস্টার্স ও অনার্স পাস করা অনেক CV পেয়েছি আমরা।এর থেকে ২০ জন মাস্টার্স কমপ্লিট করা আর ১০ জন অনার্স পাস করা সিলেকশন হয়েছে।

তাজঃ আমাকে সিলেক্ট হওয়া ৩০ জনের CV দিয়ে যেয়ো।আমি একবার চেক করে নিবো।

আদরঃ ওকে স্যার।

তাজঃ আদর, আরেকটা কথা।

আদরঃ জ্বি বলুন।

তাজঃ কফিতে সুগার ১ চামচ।

আদরঃ ওকে।

আদর কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।তাজ কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো।হুট করে আজ আবার ঘাড় ব্যাথা করছে।গতরাতে বিজনেসের একটা বই নিয়ে একটু পড়তে বসেছিলো। সেটা তাকের ওপর রাখতে গিয়ে অসাবধানতাবশত ওর ঘাড়ের ওপর পরে যায়।তখন ব্যাথাটা টের না পেলেও এখন প্রচুর ব্যাথা করছে।তাজ বুঝতে পারছে না এতো হালকা একটা বইয়ে ওর ঘাড় এত ব্যাথা করছে কেন? হাত দিয়ে মেসাজ করার সময় টের পেলো থাড়ের রগের মাঝ বরাবরি ফুলে আছে।এটা অবশ্য বহু আগের থেকেই আছে।সেই জায়গাটাই আবার ব্যাথা করছে।ঘাড়ের পেছনে দুই হাত দিয়ে মাথা এদিক সেদিক করে সামান্য সময় ব্যায়াম করলো।তারপর আবার এফএম রেডিও ওন করে দিলো।ইদানীং ওর মন ভালো করার ঔষধ নোভানাজের শো দুটো হয়ে গেছে। মেয়েটার কণ্ঠ ওর ভীষণ প্রিয়। যুগ যুগ ধরে চেনা ও আপন মনে হয় তার কাছে।

🦋🦋🦋

আজকে ১৫ মিনিট আগে শো শেষ করে অফিস থেকে বের হওয়ার জন্য উঠলাম।ইন্টারভিউতে সিলেকশন হয়েছি।তাই ইন্টারভিউ দিতে যাবো।গতকাল অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভেবে দেখলাম কাজটা আমার সত্যি দরকার।নাভান বড় হচ্ছে। ওর তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।চাকরীটা পাওয়ার সর্বস্ব চেষ্টা করবো।তারপরেও যদি না হয় তাহলে আর কিছু করার নেই।
সাদা রঙের একটা বড় গাউন আর মাথায় সাদা হিজাব বেঁধেছি।শো-এর রুম থেকে বের হতেই সাইমনের সাথে দেখা।ওর সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই। তাই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম।

সাইমনঃ কোথাও যাচ্ছেন নাকি মিসেস এনাজ আহমেদ? পোশাক-আশাকে তো মনে হচ্ছে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছেন।

আমিঃ আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা কি আপনাকে কৈফিয়ত দিবো মিস্টার সাইমন?

সাইমনঃ তা নয়।কলিগ হিসেবে তো জিজ্ঞেস করতেই পারি।আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?

আমিঃ কলিগ হিসেবে হলে কাজের প্রশ্ন আমায় করবেন।আমার পার্সোনাল বিষয়ে নাক গলাবেন না।আমি এটা পছন্দ করি না।আমি কোথায় যাবো কি করবো তা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।তা নিয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে।

সাইমনঃ আপনি কিন্তু সামান্য কারণে রেগে যাচ্ছেন?

আমিঃ আপনি আমার বিষয়ে নাক না গোলালে আমি খুশি হবো।আপনার ওপর একটুও রাগবো না।আপনি নিজের চরকায় তেল দিবেন।আমাকে নিয়ে আপনার এতো বেশি মাতামাতি আমার ভালো লাগে না। অন্য কাউকে নিয়ে তো আপনি এতটা পসেসিভ নন।তাহলে আমার সবকিছু তে আপনি কেন যেচে বা হাত ঢুকান।

সাইমনঃ আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন।

আমিঃ আপনার মান-সম্মান আছে🤔? আমি তো জানতাম না।আপনার মান-সম্মান থাকলে না এসব অপমান আপনার গায়ে লাগতো।যদি আপমানগুলো আদোও আপনার গায়ে লাগতো তাহলে আমাকে নিয়ে আপনার এতো আগ্রহ থাকতো না।

সাইমনঃ আজ কিন্তু একটু বেশি বলছেন মিসেস নোভা ইসলাম।

আমিঃ লজ্জা থাকলে আমার সাথে যেচে আর কথা বলতে আইসেন না।অবশ্য আপনাকে তো আবার কুকুরের লেজের সাথেও তুলনা দেওয়া যায়।কুকুরের লেজ যেরকম হাজার টানলেও সোজা হয় না।তেমনি আপনাকে হাজার কথা শুনালেও সেই আমার পিছুই নিবেন।আপনার মতো বেহায়া লোক আমি দুটো দেখিনি।আজকের অপমান যদি মাথায় থাকে তাহলে আর আমার বিষয়ে কথা বলেন না।

সাইমনঃ সব কিছুর একটা লিমিট আছে।আমাকে এভাবে অপমান করার ফল কি হতে পারে তা তোমার ধারণায়ও নেই। মনে রাখবে পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।ইদানীং তুমিও অতিরিক্ত উড়ছো।দেখো, আবার পাখা যেনো কেউ ছাটাই করে না দেয়।

আমিঃ আমাকে নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে।আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি😊।ভবিষ্যতে কি হবে তা আল্লাহ ঠিক করে রেখেছে। তা নিয়ে এখন শুধু শুধু টেনশন করে ঘুম হারাম করার কোন প্রয়োজন নেই। আপনার শো শুরু করার সময় হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে না ভেবে শো তো সময় দিন।

কথাগুলো বলে চলে এলাম।সাইমন চোখ দুটো ছোট ছোট করে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিলো।
ঠোটে ছিলো এক রহস্যময়ী বাঁকা হাসি।যেটার মর্মার্থ বোঝার কোন ক্লু আমি পেলাম না।অফিস থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে ইন্টারভিউয়ের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলাম।

🦋🦋🦋

রিকশা এসে থামলো ৬ তালা একটা ভবনের সামনে।এই ভবনের ৩য়,৪র্থ,৫ম ফ্লোর নিয়ে একটা ছোট কোম্পানি। আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। লিফটে উঠে তিন নাম্বার বাটনে ক্লিক করলাম।তিন তালায় এসে রিসিপশনে থাকা মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমিঃ আসসালামু আলাইকুম আপু। আজ এই কোম্পানির ইন্টারভিউয়ের কথা ছিলো।দয়া করে আমাকে বলতে পারবেন তা কোথায় হচ্ছে?

—- আপনি ফোর্থ ফ্লোরে গিয়ে মিস্টার আদরের সাথে দেখা করুন।আদর হলো কোম্পানির ওনারের এসিস্ট্যান্ট।

আমিঃ আচ্ছা,শুকরিয়া আপু।

আবার লিফটে উঠে পরলাম।আমার সাথে এবার অনেকে ছিলো।সবাই সম্ভবত ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। কারণ সবার হাতে ফাইল ছিলো।আমরা লিফট থেকে বের হয়ে সামনের দিক যেতেই প্রায় ২৭/২৮ বছরের একটা ছেলে আমাদেরকে একটা রুমে বসতে বলে চলে গেল। সম্ভবত এই ছেলেটার নাম আদর।কারণ একটা লোক এসে তাকে আদর বলে ডাক দিতেই সে বেরিয়ে গেলো। আমি দরদর করে ঘামছি।অনেক নার্ভাস লাগছে।কিছু সময়ের মধ্যে ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু হয়ে গেলো।প্রায় ঘন্টাখানিক পর আমার নামে ডাক পরলো।আমি সাইড ব্যাগ থেকে ফাইল বের করে ধীর পায়ে ভেতরে এগিয়ে গেলাম।আমার সাথে আদর নামের ছেলেটি ছিলো।সে আমায় কেবিন দেখিয়ে দিচ্ছে।

আদরঃ এখান থেকে ডানে গিয়ে তিন রুমের পর শেষের রুমটায় আপনার ইন্টারভিউ নেওয়া হবে।আপনার আগে একটা ছোট ব্রেক গিয়েছে। তাই স্যার হয়তো বাইরেও থাকতে পারে। তবে পারমিশন নিয়ে ভেতরে ঢুকবেন।

আমিঃ আচ্ছা।

আদরঃ স্যারকে একটুও ভয় পাবেন না।উনি খুব ভালো মানুষ। আপনাকে খুব নার্ভাস লাগছে।তাই বললাম আরকি।

আমিঃ উনার নামটা কি? আসলে বিজ্ঞপ্তিতে দুটো নাম দেখেছিলাম। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আদরঃ তাজরান তাজওয়ার।

আদর চলে যাচ্ছিলো।আমি পেছন ফিরে তাকে ডাকলাম।

আমিঃ শুনুন।

আদরঃ জ্বি বলুন।

আমিঃ বলছিলাম কি, ইন্টারভিউ কয়জন নিচ্ছে? আমি জীবনের প্রথমে কোন কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে আসলাম।তাই কিছু জানি না।নাটক, সিনেমায় দেখেছি ইন্টারভিউতে অনেক মানুষ থাকে।যদি অনেক মানুষ থাকে তাহলে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করে নিবো।

আদরঃ আপনি মে বি ভয় পাচ্ছেন।ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। তাজরান স্যার একাই ইন্টারভিউ নিচ্ছে। অনেক মানুষ আছে এমনটা ভেবে ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই। আপনি কেবিনে গেলেই তাজরান স্যারকে পাবেন।

আমিঃ শুকরিয়া, সাহস দেওয়ার জন্য।

আদর আমাকে কেবিন দেখিয়ে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম।যত এগিয়ে যাচ্ছি তত ভয়টা জেঁকে ধরেছে। কেবিনের সামনে গিয়ে থুম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম।ভয়ে ইচ্ছে করছে উল্টো দিকে দৌড় দিতে।ভাবছি ভেতরে ঢুকবো কি ঢুকবো না।দোটানায় পরে গেছি।থাই গ্লাসের দরজায় কয়েকটা টোকা দিয়ে পারমিশন চাইলাম।

আমিঃ মে আই কাম ইন।

ভেতর থেকে কোন উত্তর এলো না।তাই আমি আবারো পারমিশন চাইলাম।এবার গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো।

— ইয়েস কাম ইন।

তার গলার স্বর পেয়ে আমার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ বয়ে গেলো।এই কণ্ঠ, এই কণ্ঠটা তো আমার চিরচেনা।আমি এই কণ্ঠের সাথে বহু আগের থেকে পরিচিত। আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।আমি ভেতরে ঢুকছি না বলে আবারো সে বলো উঠলো।

— ভেতরে আসুন।

না,এবার আমি ভুল শুনিনি।আমার চিরচেনা কন্ঠ। কোনরকম থাই গ্লাস ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।ছাই
রঙের কোর্ট-প্যান্ট পরিহিত এক লোক উল্টো দিকে ঘুরে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার বাইরের ব্যস্ত নগরীর দিকে।তার পেছন দিক দেখে আমি আরেকটা বড়সড় ঝাটকা খেলাম।চোখ দুটো আমার কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সেই চিরচেনা দাড়িয়ে থাকা স্টাইল, পেছনের চুলের কাটিং,পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ানো, পারফিউমের স্মেল। নাহ্ আমার ভুল হওয়ার কথা তো নয়।এটা কি করে সম্ভব??উনি সম্ভবত তাজরান তাজওয়ার। তার সবকিছুর সাথে তো মাত্র একজনের মিল আছে।তাহলে কি সে বেঁচে আছে। তাও বা কিভাবে?আমার হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো।আমি স্পষ্ট সুরে মুখ ফসকে শেষ পর্যন্ত তার নাম নিয়েই ফেললাম।

আমিঃ এনাজ!!!!!!

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০৯

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_09
#Writer_NOVA

—- হেই গাইস, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? আমি RJ নোভানাজ চলে এসেছি আপনাদের মাঝে আমার শো Love Complain নিয়ে।আমি লাভ কুইন থাকবো আপনাদের সাথে বিকেল চারটা থেকে ছয়টা।এখন সময় চারটা বেজে তিন মিনিট। তো কথা না বলে শুরু করা যাক আপনাদের শো লাভ কমপ্লেন।আপনাদের ভালোবাসার বিরুদ্ধে কিংবা প্রিয় মানুষটার বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ আছে তা করতে পারেন।আমি লাভ কুইন নোভানাজ যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তার সলিউশন দেওয়ার।আমাকে আপনি ম্যাসেজ করে বা অফিসিয়াল পেইজে কমেন্ট করে আপনার অভিযোগটি তুলে ধরতে পারবেন।এক্ষেত্রে আপনাকে যা করতে হবে।মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে আপনার নাম,আপনার লোকেশন এবং আপনার ভালোবাসার মানুষের বিরুদ্ধে করা অভিযোগটি টাইপ করে পাঠিয়ে দিবেন ২৬৯৫৬৯ এই নাম্বারে।আপনাদের বোঝার সুবিধার্থ আমি নাম্বারটি আবার বলছি ২৬৯৫৬৯। কমেন্ট করতে হলে আপনাকে আমাদের অফিসিয়াল পেইজে যোগ হতে হবে।www.dhakafm90.4bd এটা লিখে সার্চ দিলে চলে আসবে।তবে ৭লাখ ৭৯ হাজার ৫০০ এর উপরে লাইক যেই পেইজে আছে সেটাই আমাদের অফিসিয়াল পেইজ।অন্যগুলো আমাদের নয়।সেখানে আমি একটা পোস্ট করেছি একটা টপিক নিয়ে। যেটা হলো, “এক কাপ চায়ের সাথে তুমি কাকে চাও?” সেখানের কমেন্ট বক্সেও আপনার কথপোকথন লিখে পাঠাতে পারেন।অনেক বকবক হয়েছে। চলুন একটা গান শোনা যাক।আমার প্রিয় সিঙ্গার ইমরান মাহমুদুল ও পালাক মুছালের কণ্ঠে “সবাই চলে যাবে”গানটি শুনে আসি।আশা করি আপনাদেরও ভালো লাগবে।ফিরছি গানের পরপরি।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

সবাই চলে যাবে, একজনি পারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না(×০২)
মন ভালো নেই, জানি মন তবু হারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না
সবাই চলে যাবে, একজনি পারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না

একজনি কেউ ভালোবেসে যাবে,
থেকে থেকে দুঃখ শুধু পাবে।
করবো না কেউ হিসেব-নিকেশ
কার ধার ধারবে না।(×০২)
মন ভালো নেই, জানি মন তবু হারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না
সবাই চলে যাবে, একজনি পারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না

একজনি কেউ হৃদয় বুঝে নিবে
সাগর সেঁচে মুক্তো এনে দিবে
চাইলেও পাবে না চাইলেও
নিজের কথা ভাববে না।(×০২)
মন ভালো নেই, জানি মন তবু হারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না
সবাই চলে যাবে, একজনি পারবে না
একজন কেউ থাকুক, যে তোমাকে ছাড়বে না

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

—হ্যালো লিসেনার,আপনারা শুনছেন ঢাকা এফএম 90.4। আমি লাভ কমপ্লেইন নিয়ে লাভ কুইন নোভানাজ আছি আপনাদের সাথে। ফিরলাম গানের পরপরি। এই গানের মর্মটা কিন্তু অনেক গভীর।যদি মনোযোগ দিয়ে শুনেন তাহলে কিন্তু অনেক কথার উত্তর পাবেন।ওকে,কথা না বলে আমি কতগুলো ম্যাসেজ ও কমেন্ট চেক করে নেই। আপনারা কিন্তু ম্যাসেজ কিংবা কমেন্ট করতে ভুলবেন না। নরসিংদী থেকে আরিফা আছে আমাদের সাথে। সে জিজ্ঞেস করেছে আপু কেমন আছো? আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আরিফা।তুমি কেমন আছো? গাজীপুর থেকে সোহেল আছে আমাদের সাথে। আপু,তোমার দুটো শো আমার অনেক পছন্দ। আমি সবসময় তোমার শো দুটি শুনি অনেক ভালো লাগে। ধন্যবাদ সোহেল তোমাকে।সিলেট থেকে রাহুল লিখেছে, আপু তোমার ভয়েসটা অনেক কিউট। আমাকে বলবা এতো কিউট কেন? রাহুল ভাইয়া তুমি কিন্তু আমাকে পাম মারছো।আমার ভয়েস মোটেও কিউট নয়।খুব খুব বাজে।আমার থেকে কাকের ভয়েজ বেশি সুন্দর আমি জানি।ঢাকার সাভার থেকে লতা ম্যাসেজ করেছে আমাকে, সত্যি ভালোবাসা বলতে তুমি কি বুঝো আপু? আচ্ছা লতা তোমার উত্তরটা আমি একটু পরে দিচ্ছি। তার আগে আমি কতগুলো কমেন্ট চেক করে আসি।স্বপ্নের রাজকুমার কমেন্ট করেছে, হেই আপু হোয়াটসঅ্যাপ? আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? তোর জন্য পাগল নামক আইডি থেকে একজন কমেন্ট করেছে, আপু আমি একজনকে অনেক ভালোবাসি।কিন্তু সে আমায় প্রচুর সন্দেহ করে।এখন আমার করণীয় কি? আচ্ছা, আমি তার উত্তর দিচ্ছি। আপু নাকি ভাইয়া আমি তা জানি না। আপনার আইডির নাম দেখে বোঝার উপায় নেই। আপনাকে একটা কথা বলতে চাই,সন্দেহ নিয়ে ভালেবাসা যায় না। অতিরিক্ত সন্দেহ ভালোবাসা নষ্টের মূল কারণ। আমি আপনাকে সাজেস্ট করবো ঐরকম সন্দেহযুক্ত ভালোবাসা থেকে বেরিয়ে আসুন।তবে হুট করে বেরিয়ে আসবেন না।আগে তাকে বুঝাবেন।যদি সে না বুঝে তাহলে চলে আসুন।আশা করি আপনি আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন।আবু তালহা হোসেন কমেন্ট করেছে, সব মেয়েরাই ঠক,প্রতারক। ওরা কাউকে ভালবাসতে পারে না। এরা ছেলেদের মন নিয়ে খেলা করে।আহারে, বুঝতে পারছি ভাইয়া আপনি খুব বড়সড় একটা ছ্যাকা খেয়ে বেঁকা হয়ে গেছেন।তাই এসব পাগলের মতো কথা বলছেন।আরেকটা কথা ভাইয়া,আপনি সব মেয়ের কাছে যান কেন বলেন তো? যাক গে আপনার কথায় আমি কিছু মনে করিনি।আমার মেয়ে লিসেনাররাও কিছু মনে করবে না।কারণ আমরা পাগলের কথায় কিছু মনে করি না।আর হ্যাঁ তালহা ভাইয়া আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।মেয়েটা খারাপ হতে পারে, তবে মেয়েরা নয় তেমনি ছেলেটা খারাপ হতে পারে ছেলেরা নয়। এঞ্জেল তুলি প্রশ্ন করেছে “ভালোবাসার মানেটা তোমার কাছে কি আপু?” তামিম হাসান জিজ্ঞেস করছে, ভালোবাসা কি? ওকে, ওকে আমি তিনটা প্রশ্ন স্কিপ করে গেছি।সেই তিনটা প্রশ্নের উত্তর একসাথে দেই।

গলা শুকিয়ে আসছে আমার।সামনের ডেস্ক থেকে পানির বোতল নিয়ে খানিকটা পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম।তারপর আবার বলা শুরু করলাম।

—- ভালোবাসা শব্দটা শুনলেই আমরা ভাবি আসলে এটা কি? এটা দিয়ে কি হয়?আসলে ভালোবাসা একটা সুন্দর অনুভূতি। যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু মন দিয়ে অনুভব করা যায়।ভালোবাসা মানুষের জীবনে আশির্বাদ আবার অভিশাপও বটে।একমাত্র ভালোবাসাই মানুষকে বদলে দিতে পারে।ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরনের পাগলামি। এখানে ঢুকে গেলে হারাতে চাইলেও হারানো যায় না।ফিরাতে চাইলেও ফিরানো যায় না। চার অক্ষরের এই শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক অভিমান,খুনশুটি,রাগ,
ঈর্ষা,হিংসা নামক বস্তু। আমার হাসবেন্ড এনাজকে যদি আমি জিজ্ঞেস করতাম তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি? সে খুব সহজ সরল একটা উত্তর দিতো। যা আমার ভীষণ ভালো লাগতো। ও বলতো ভালোবাসা হলো একটা প্রজাপতির মতো। যদি শক্ত করে ধর মরে যাবে। যদি হালকা করে ধর উড়ে যাবে আর যদি যত্ন করে ধর কাছে রবে।আমিও তাই মনে করি।ভালোবাসা সত্যি একটা প্রজাপতি। আর রাগ,হিংসা,ঈর্ষা,অভিমান ইত্যাদি ইত্যাদি হলো প্রজাপতি একেকটা রং।যাদের ছাড়া প্রজাপতিটা অসম্পূর্ণ। প্রজাপতি ও তার রং নিয়েই ভালোবাসা।

কোথায় জানি একটা পোস্ট কিংবা কোন গল্পে দেখেছিলাম।আমার ঠিক মনে নেই। তবে তার মধ্যে সত্যি ভালোবাসা নিয়ে কথা ছিলো। কথাগুলো ছিলো এমন।

একসাথে অনেকগুলো প্রেম করে টাইম পাস করলে আপনি বেঁচে যাবেন।কিন্তু একজনকে সত্যি ভালোবাসলে আপনি মরে যাবেন।সত্যি মরে যাবেন।তাকে দেখার জন্য আপনার অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হবে।রাত-বিরেতে তার কন্ঠ শুনতে মন চাইবে।তার জন্য আপনার চিন্তা হবে।প্রেমে পরা আর ভালোবাসার মধ্যে অনেক তফাত আছে।প্রেমে সবাই পরে।রোজ ৪/৫ টা প্রেম করা এখনকার সময় কোন ব্যাপার না।কিন্তু একজনকে সত্যিই মন থেকে ভালোবাসা অনেক কঠিন।তার প্রতি ল্যায়াল থেকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য আপনাকে অনেক সেক্রিফাইস করতে হবে। এমনকি পরিবারের বিরুদ্ধেও যেতে হবে। সত্যি ভালোবাসা বলতে এগুলো বোঝায়।যারা ৪/৫ টা প্রেম করে জীবন কাটিয়ে দেয় তারা বেঁচে যায়।আর যারা সত্যি ভালোবাসে তারা ফেঁসে যায়।সারাজীবনের জন্য ফেঁসে যায় একজনের কাছে।তবে এই ফেঁসে যাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি আছে। যা শুধু সত্যি ভালবাসলে পাওয়া যায়।

কথাগুলো বলতে বলতে এক অজানা ঘোরে চলে গিয়েছিলাম।এনাজকে খুব মনে পরছে।যার কারণে চোখের কর্ণার বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে গাল বেয়ে।পানি মুছে আবারো মনোযোগ দিলাম শো করতে।

🦋🦋🦋

—– আহারে, বেচারী। একে তো অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছে। তার মধ্যে সকাল, সন্ধ্যায় কাজ করতে হয়।মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট গয় গো।স্বামী ছিলো
সি বি আই অফিসার।আর তাকে এখন রেডিও তে কাজ করতে হয়েছে। বুঝেছেন ভাবী একেই বলে কপাল।আল্লাহ কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না।স্বামী হারিয়ে সন্তান নিয়ে কষ্ট করছে।শ্বশুর-শাশুড়ি নেই। রাত-বিরেতে ফিরলেও কেউ কিছু বলে না।তাই এখন রাত করেই ফিরে।সবসময় তো সাদা কাপড়ে নিজেকে মুড়িয়ে রাখে।কিন্তু ভেতরে দেখেন গিয়ে ঠিকই রং লেগেছে। সেদিন দেখলাম সন্ধ্যা বেলায় এক ছেলে বাইকে করে দিয়ে গেলো।তুই বাপু বিধবা মেয়ে। তোর এতো ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি কি? কে জানে স্বামী সত্যিই মরেছে নাকি মেরে ফেলেছে। যাতে নাগরের সাথে রাত-বিরেতে দেখা করে ফিরতে পারে।

শো শেষ করে ফিরতে আজ একটু দেরী হয়ে গেছে। মাগরীবের আজান দিয়েছে বহু আগে। বাসার সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই পাশের ফ্ল্যাটের দুই ভাবীর কথা কানে আসলো।তারা যে এসব কথা আমাকে বলছে তার কোন সন্দেহ নেই। মানুষ কতটা নিচ মন-মানসিকতার হলে এসব কথা বলতে পারে আল্লাহ মালুম।এরা প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।উদ্দেশ্য হলো আমাকে নানা কথা শুনানো।এদের অভ্যাসই পুরো দালানের মানুষদের নিয়ে সমালোচনা করা। আমি তাদের কথা পাত্তা না দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালাম।তখুনি আরেকজন বলে উঠলো।

—- দেখছেন ভাবী দেখছেন।কিরকম বেয়াদব মেয়ে। এতগুলো কথা বললাম কোন উত্তর দিলো।যার শিক্ষার অভাব আছে সে কিভাবে রাত করে বাসায় ফিরবে না।ছেলেটাকে বাসায় রেখে কে জানে কোন ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে যায়।আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় এই মেয়ের বিয়ে হয়েছে নাকি।কে জানে কার পাপের ফসলে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এখন তো আমি সিউর ঐ বাচ্চাটা জারয সন্তান।আর এই মেয়ের চরিত্রে সমস্যা আছে। নষ্টা মেয়ে না হলে কি এতদিন বাপ-মা এসে দেখে যেতো না।স্বামী মারা গেছে এটা হলো ডাহা মিথ্যা কথা। বয়ফ্রেন্ডের কারণে হয়তো প্রেগনেন্ট হয়েছে। তারপর বয়ফ্রেন্ড বাচ্চা নিতে অস্বীকার করছে।তাই বাচ্চাসহ পালিয়ে আসছে।আমি এসব ভালো করেই জানি।ঐ তো সেদিন খবরে——-

আমিঃ স্টপ। (চিৎকার করে)

কানে দুই হাত দিয়ে চিৎকার করেই বলে উঠলাম কথাটা।আমি আর নিতে পারছি না।একটা মেয়ের বিষয়ে না জেনে এত বাজে কথা কি করে বলতে পারে মানুষ। ততক্ষণে এরিন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করলো।

এরিনঃ কি হয়েছে নোভা?

আমি এরিনের কথায় উত্তর না দিয়ে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

আমিঃ আপনারা কি কোন মেয়ে মানুষের কাতারে পরেন? না জেনে, আমার বিষয়ে কত নোংরা নোংরা কথা বললেন।আমি আপনাদের কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি।আমার সাথে যে আপনারা লেগেছেন।আমার কথা না হয় বাদই দিলাম আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে নিয়ে কথা বলতে আপনাদের মুখে বাজলো না।আমার বৈধ সন্তানটাকে কোন হিসেবে আপনারা জারয সন্তান বলেন? আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে সাহস আপনাদের কে দিয়েছে? মানুষের সাথে ঝগড়া করার জন্য কি সবসময় গলা চুলকায়? আমি একটা বিবাহিত মেয়ে। আমার সন্তান বৈধ।কোন পাপের ফসল নয়।আর আমি কষ্ট করে খেটে উপার্জন করি।শরীর দেখিয়ে পতিতা ব্যবসা করি না। আমার জীবনটা আপনাদের মতো আনন্দের নয়।সারাটা দিন আমায় বহু কষ্ট করতে হয়।আপনারা তা কি বুঝবেন?পারেন তো শুধু অন্যের বিষয় না জেনে বাজে বাজে কথা বলতে।নিজের স্বামীকে নিজের চোখের সামনে খুন হতে দেখেছেন? চোখের পলকে নিজের আপন মানুষগুলোকে বদলে যেতে দেখেছেন? আপনারা জীবনের মানে কতটুকু বুঝেন? হয়তো আপনারা আমার বয়সে বড়।কিন্তু আমি এই ২৪ বছর বয়সে যে শিক্ষা পেয়েছি তার ৫% ও আপনারা পাননি।আপনাদের মতো আমার জীবনটা হেসেখেলে পার করার মতো নয়।সমাজে সিঙ্গেল মাদার হয়ে বেঁচে থাকার মর্ম জানেন? রাত করে ভাইয়ের বাইকে ফিরলে একটা মেয়ে দুশ্চরিত্রা হয়ে যায়?আমার বিয়ে নিয়েও আপনাদের সমস্যা। ওকে বিশ্বাস না হলে আমার গ্রামের বাড়ি খোঁজ নিয়ে জেনে আসেন।আমার বাবা সারা গ্রাম দাওয়াত করে খাইয়ে, ধুমধাম করে আমার বিয়ে দিয়েছে।আর আমার ছেলেটাও বৈধ।কোন জারয সন্তান নয়।ওর বাবার পরিচয় আছে।কারো বিষয়ে কথা বলার আগে ভেবেচিন্তে বলবেন।আরেকদিন আমার কিংবা আমার ছেলের নামে এসব কথা বললে আমি বাড়িওয়ালার কাছে তো নালিশ করবোই।সাথে আপনাদের স্বামীদেরকেও আপনাদের এই কুকর্মের কথা জানাবো।চল এরিন।

এরিনঃ আপনাদের সমস্যাটা কি বলবেন? এই বাসায় আসার পর থেকে আমাদের সাথে লেগে আছেন।আমরা কি আপনাদেরটা খেতে যাই নাকি পরতে যাই।নাকি আপনাদের স্বামী ছিনিয়ে নিতে যাই।এতো কিসের সমস্যা আপনাদের? বলি,চুলকানির সমস্যা আছে নাকি? বাসায় কি সবসময় কচু রাখেন।এত চুলকানির সমস্যা থাকলে মলম কিনে ব্যবহার করবেন।তা যদি কেনার পয়সা না থাকে তাহলে আমাদের বলেন।আমরা আবার ভিক্ষুকদের ফিরিয়ে দেই না।যদি মলমে কাজ না হয় তাহলে অন্য ব্যবস্থা করবো।

হিমিঃ কি হইছে এতো চেচামেচি কেন?

আমিঃ কিছু হয় নাই।চল ভিতরে চল।তুই নাভানকে একা রেখে আসছিস কেন হিমি? এরিন এদের সাথে আর কথা বাড়াস না।এরা পরনিন্দা করার জন্য সবসময় ওত পেতে থাকে।মান-সম্মানের ভয় এদের নেই।

আমাদের কথা শুনে তারা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।আমরা তাতে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে চলে এলাম।দরজা আটকে বড় করে একটা শ্বাস নিলাম।

এরিনঃ টেনে নিয়ে আসলি কেন? আমি আরো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতাম।পাইছে টা কি? যখন সুযোগ পাবে কথা শুনিয়ে দিবে।ওদের কোন পাকা ধানে মই দেই আমরা।ফাউল মহিলা।মন চায় উষ্ঠা মেরে ড্রেনে ফেলে দেই।তারপর সেখান থেকে চুবিয়ে আনি।

হিমিঃ আমাকে কেউ বলবে হইছেটা কি?

আমিঃ এরিনের থেকে জেনে নিস।আমি আর এসব বিষয় কথা বলতে চাইছি না।

নাভানঃ আম্মু, বাবা কো? বাবা আসে না?

রুমে এসে ধপ করে চেয়ারে বসতেই নাভান পাশের রুম থেকে এসে প্রশ্নটা করলো।আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এরিন, হিমির দিকে তাকালাম।

নাভানঃ বাবা কই? বাবা, আসে না। বাবা আসবে?

আমিঃ এরিন,হিমি ও এসব কথা কার থেকে শুনলো? ওর ছোট মাথায় কে এসব ঢুকালো? ওর সামনে বাবা নিয়ে কথা না বললে তো ও এসব কথা জীবনেও বলবে না। আমি না বলছি ওর সামনে বাবা নিয়ে কোন কথা বলবি না।

এরিনঃ আমি কিছু বলিনি।

হিমিঃ সরি নোভা। আসলে আমি বিকালে বাবার সাথে কথা বলেছিলাম।তখন নাভান আমার সাথে ছিলো।ও হয়তো সেখান থেকে শুনে বলছে।

আমি নাভানের দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে দিতেই নাভান আমার কোলে এলো।আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে বললাম।

আমিঃ তোমার বাবা ঐ দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে। সেখান থেকে কিভাবে আসবে বলো?

নাভানঃ বাবা,আসতে বলো।

আমিঃ তোমার বাবা জীবনেও আসবে না।

নাভানঃ না, আমার বাবা লাগবে।আমি বাবার কাছে দাবো(যাবো)।

আমিঃ নাভান, মর্জি করো না।(ধমকের সুরে)

নাভানঃ আমি বাবার কাছে দাবো। না, আমি বাবার কাছে দাবো।

নাভান কোল থেকে নেমে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করতে লাগলো।আমার প্রচুর রাগ উঠে গেলো।একটু আগে এমনি মানুষের কথায় মেজাজ বিগড়ে গেছে। এখন আবার নাভানের মর্জি করায় রাগটা আরো বেড়ে গেলো।চট করে নাভানকে ফ্লোর থেকে তুলেই দুই গালে কষিয়ে দুটো চড় মারলাম।এতে নাভান আরো জোরে কাঁদতে লাগলো। এরিন,হিমি দুজনে এসে আমার থেকে নাভানকে সরিয়ে ফেললো।ওরা বুঝতে পারেনি আমি যে নাভানকে মারবো।

হিমিঃ কি করলে এটা? এভাবে কেউ মারে?

এরিনঃ অন্যের জিদ ছেলেটার ওপর দেখাস কেন?

আমিঃ ওকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যা।নয়তো ওকে আমি মারতেই থাকবো।সারাদিন ওর জন্য খেটে খেটে আমি মরি।আর তার এখন বাবাকে লাগবে।ও নাকি বাবার কাছে চলে যাবে।আমার থেকে এখন ওর বাবা বেশি হয়ে গেছে।

রাগে আমার সারা শরীর জ্বলছে। কিন্তু নাভান এখনো বাবা,বাবা বলেই চেঁচাচ্ছে।আমি রুমে গিয়ে লাইট অন না করে, ফ্যান চালু করে খাটে শুয়ে পরলাম।চোখ দিয়ে অনরবত পানি পরছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটো বুজে এলো।নাভান ওর খালামণিদের সাথে আছে।হঠাৎ ঘুমের ঘোরে মনে হলো কেউ আমার ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার উপর পরছে।তার শরীরের ঘ্রাণটাও আমার বড্ড চেনা।চোখ খুলতেই আমি________

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০৮

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_08
#Writer_NOVA

পরের দিন……….

মুরাদ সাহেব রুমালে মুখ মুছতে মুছতে কেবিনে প্রবেশ করলেন।গিয়ে দেখেন অলরেডি তার বড় ছেলে তাজ মিটিং-এর বন্দবস্ত শুরু করে দিয়েছে। সে প্রায় ১০ মিনিট লেট করে ফেলেছে। কোন কথা না বলে নিঃশব্দে সামনে থাকা চেয়ার টেনে বসে পরলেন।সারা কেবিনে হালকা নীল আলো জ্বলছে। তাও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টের। বিশাল বড় গোল টেবিলে প্রায় ১৬/১৭ জন বসে আছে।সবার দৃষ্টি এখন তাজের দিকে। মুরাদ সাহেব কিছুটা নড়েচড়ে বসতেই চেয়ারটা কিঞ্চিত কেচৎ শব্দ করে উঠলো।এতে বিদ্যুতের গতিতে সবাই তার দিকে তাকালো। কিন্তু তাজের কোন হেলদোল নেই। সে এখনো টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে হালকার উপর বসে ফাইল নাড়াচাড়া করছে।

আরিয়ানঃ মাহির ভাই, সবাই এসে পরেছে।এবার আমরা মিটিং শুরু করতে পারি।

ফাইলের থেকে চোখ না সরিয়ে তাজ মৃদুস্বরে বললো।

তাজঃ হুম।

ফাইলটা টেবিলের ওপর রেখে সবার দিকে একবার চোখ বুলালো তাজ।ওর সামনের চেয়ারে বসে আছে ওর এসিস্ট্যান্ট অাদর।বয়স খুব বেশি নয়।২৮ -এ পরেছে।এই কয় মাসে ছেলেটার সাথে ভালোই আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে তাজের।তাজ কখন কি প্রয়োজন তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে অাদর।সবসময় ছায়ার মতো ওকে ঘিরে রাখে।কাজ পাগল ছেলে অাদর।ওর মা অসুস্থ ছিলো বিধায় গত ৩/৪ দিন সেখানেই ছিল। আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে শুনে ছুটে চলে এসেছে। অবশ্য ওর মায়ের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো তাজ।সে জানে এখন তাকে বিশাল বড় রচনা বলতে হবে।

তাজঃ উপস্থিত সকল স্যার, আমার কর্মচারীবৃন্দ এবং কোম্পানি পরিচালনা কমিটির প্রত্যেক সদস্যকে প্রথমে জানাই আমার সালাম।আসসালামু আলাইকুম। আমি আজ নতুন এক ব্যবসার কথা বলতে আপনাদের সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রেখেছি।সবাইকে অনুরোধ মনোযোগ সহকারে আমার কথা শোনা।কথার মাঝে কোন ডিস্টার্ব আমি এখন এলাউ করবো না।আমার পুরো কথা শেষ না হওয়া অব্দি কেউ কেবিন থেকে বেরও হতে পারবেন না।আমার কথা বলার শেষে যার যার মতবাদ জানাবেন।তো শুরু করা যাক।

এতটুকু কথা বলে বেশ বড় একটা দম নিলো তাজ।
তার অনেক নার্ভাস লাগছে।যদি তার বাবা রাজী না হয় সেই ভয়ে।ছোটখাটো একটা ঢোক গিলে তার বাবার দিকে তাকালো। মুরাদ সাহেব বেশ উৎসুক চোখে তাজের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ছেলে কি এমন বলবে?যার জন্য এতো পরোয়ানা জারি করলো।

তাজঃ আমাদের ব্যবসাটা মোটামুটি আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে।তাই আমি এর পাশাপাশি শেয়ার ব্যবসা করতে চাইছি।আমাদের কোম্পানির মূলধনকে শেয়ার আকারে জনগণের কাছে বিলি করতে চাই।আমি জানি শেয়ার ব্যবসায় অনেক রিস্ক।কিন্তু তার চেয়ে বেশি লাভ।যদি সঠিকভাবে শেয়ারবাজার শেয়ার ছাড়তে পারি তাহলে আমাদের পিছু ফিরে তাকাতে হবে না।

শেয়ারের কথাটা শুনে মুরাদ সাহেবের চেহারার রং পাল্টে গেলো।এর জন্যই তাজ এত কড়াকড়ি করে সবাইকে বললো যেনো কেউ বেরিয়ে না যায়।তাজ কি জানে না এই শেয়ারের কারণে যে তার সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে। সে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। তারপরেও কিভাবে এরকম সিদ্ধান্ত নিলো সে।মুরাদ সাহেব ফুঁসতে লাগলেন।এই শেয়ারের ব্যবসা তার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। কত বড় মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি ছিলো তার।কিন্তু শেয়ার খাতে সব টাকা বিনিয়োগ করে সে পথে নেমে গিয়েছিলো।ব্যাংক থেকে চড়া সুদে লোন নিয়েছিলো।কিন্তু শেয়ার বাজার মন্দা যাওয়ায় বেশ বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়েছে তাকে।ব্যাংক ঋণের ভয়ে কত লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো জীবন-যাপন করেছে। সেই ভয়ংকর অতীত কি ভোলার মতো?এখনো মনে পরলে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।তাই সে এখন শেয়ারের নাম শুনলেই চটে যায়।

তাজ তার বাবার দিকে তাকিয়ে অনুমান করতে পারলো মুরাদ সাহেবের ভেতরে কি চলছে।রাগে তার নাকটা যে ফুলে উঠেছে তা আবছা আলোতেও তাজের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

আরিয়ানঃ মাহির ভাই,তুই এসব কি বলছিস?তুই শেয়ার ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা করছিস?তুই জানিস না আমাদের ওপর এই শেয়ারের কারণে কি ঝড় গিয়েছে। তুই আবার সেই বিপদ ডেকে আনার চেষ্টা করছিস। আমরা তো এভাবেই ভালো আছি। কি দরকার ঐ শেয়ার ব্যবসায়ের।তুই এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিলি আর আমাদের জানানোর প্রয়োজনও মনে করলি না। আমাকে না বলতে পারতিস।কিন্তু বাবাকে তো বিষয়টা জানাতি।

তাজঃ আরিয়ান, আমার কথার মাঝখানে কথা বলতে মানা করেছিলাম।আমি অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি তোকে বা বাবাকে এই জন্য বলিনি যে তোরা জানলে কখনোই আমাকে শেয়ারবাজারে নামতে দিবি না তাই।

পরিচালনা কমিটির সদস্য জাফর সাহেব কিছুটা ভয় নিয়েই বলে উঠলেন।

জাফরঃ সবই বুঝলাম তাজ বাবা,কিন্তু শেয়ার ব্যবসাটা অনেক ঝুকিপূর্ণ। এখন কাঁচা হাতে শেয়ার বাজারে নামলে, তো লেকসান গুনলে।এর জন্য দক্ষ হাত প্রয়োজন। কারণে শেয়ারবাজারে কখন কোন ধস নামে তা দক্ষ না হলে বোঝার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া আমরা যদি নতুন শেয়ার বিক্রি করতে নামি আমাদের থেকে শেয়ার কে কিনবে?কারণ নতুন কোন কোম্পানি থেকে শেয়ার কিনতে জনগণ ইচ্ছুক নয়।যেখানে নামীদামী কোম্পানিগুলো থেকে শেয়ার কিনে তারা লোকসান খাচ্ছে সেখানে নতুন, অপরিচিত কোম্পানি থেকে শেয়ার কেনা তো নিত্যান্ত বোকামি। এখন অব্দি শেয়ারবাজারে আমাদের কোন অস্তিত্ব নেই। প্রথমে আমাদের পরিচিত গড়তে হবে। তারপর বাজারে শেয়ার ছাড়তে হবে। নয়তো পুরো দেউলিয়া হয়ে গুলিস্তানে বাটি নিয়ে বসতে হবে।

তাজঃ আপনি ঠিক বলেছেন জাফর চাচা।আমাদের প্রথমে জনগণের কাছে নিজেদের পরিচিতি গেড়ে তারপর বাজারে শেয়ার ছাড়তে হবে। শেয়ার ব্যবসা অন্য সব ব্যবসা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।প্রত্যেকটা নামীদামী প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানির মূলধনের খুব বড় অংশ আসে শেয়ার বিক্রি করে।এই ব্যবসা যেমন ঝুঁকি আছে তার চেয়ে বেশি আছে লাভ।যদি আমরা সেটা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারি। নয়তো লোকসানের টাকা গুণে দেউলিয়া হয়ে সত্যিই গুলিস্তানে বাটি নিয়ে বসতে হবে।তবে ব্যবসার ক্ষেত্রে ইংরেজি বিখ্যাত প্রবাদটাও কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না। No risk No gain. যেখানে রিস্ক নেই, সেখানে সফলতাও নেই। আপনাকে সফলতার উচ্চ পর্যায়ে উঠতে চাইলে অবশ্যই ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে।আপনি যদি ঝুঁকি মোকাবিলা করতে না চান তাহলে কখনো সফলতার মুখ দেখবেন না।আমি রিস্ক নিতে খুব পছন্দ করি। তাই শেয়ার ব্যবসাটা বেছে নিয়েছি।আমার মনে হয় না এর থেকে বড় রিস্ক অন্য কোন ব্যবসায় আছে।আমি সবার সহযোগিতা চাইছি।তাই সবাইকে একসাথে মিটিং-এ ডাকা।

🦋🦋🦋

অাদর কিছু সময় ধরে হাসফাস করছিলো একটা প্রশ্ন করার জন্য। কিন্তু কিভাবে করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না।জাফর সাহেবের প্রশ্ন শুনে তাজকে রাগতে না দেখে মনে সাহস পেলো।তাই ফট করে সুযোগের স্বদ্যবহার করে বলে উঠলো।

অাদরঃ স্যার, আমার একটা প্রশ্ন ছিলো।

তাজঃ হুম করো।

অাদরঃ স্যার, নতুন ব্যাবসা করবো আমরা সেটা ভালো কথা।কিন্তু শেয়ার কি সেটাই তো আমি বুঝি না।তাহলে এটা নিয়ে ব্যবসায় হেল্প কি করে করবো?যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন।

তাজ গম্ভীর চোখে অাদরের দিকে তাকালো। অাদর তাতে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।অাদরের মুখ দেখে এই মুহুর্তে তাজের ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ও আজ অব্দি বুঝতে পারলো না সবাই ওকে এতো ভয় পায় কেন?তাজ কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলা তো দূরেই থাক কড়া গলার কথাও বলেনি।তারপরেও অফিসের সবাই ওকে প্রচুর ভয় পায়।

তাজঃ শুধু শেয়ার কি তা নয় বরং শেয়ার ব্যবসা কি করে করতে হয় তাও বুঝে যাবে অাদর।আমার সাথে কাজ করতে থাকো।তবে আমি এখন শেয়ার সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দিচ্ছি তোমাকে।প্রথমে শেয়ার নামটা শুনলে আমাদের মাথায় আসে এটা আবার কি জিনিস? খায় নাকি মাথায় দেয়।আসলে দুইটার একটাও নয়।পাবলিক কিংবা প্রাইভেট কোম্পানিগুলো তাদের মূলধনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভক্ত করে জনগণের মাঝে বিলি করে।এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকেই বলা হয় শেয়ার।শেয়ার অনেক প্রকারে আছে।তবে এর মধ্যে জনপ্রিয় হলো সাধারণ শেয়ার ও অগ্রাধিকার শেয়ার।আসলে পুরো মূলধন তো কেউ কিনতে পারবে না কিংবা কোম্পানি বিক্রি করতেই পারবে না।তাই একে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করা হয়।

থেমে কিছুটা দম নিলো তাজ।চোখ দুটো হালকা বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার ছারলো।তারপর অদরের দিকে তাকালো। আদর খুব মনোযোগ দিয়ে তাজের কথা শুনছে।তাজ এক গালে হালকা হাসলো।আবছা আলো থাকায় তাজের হাসি কারো চোখে পরলো না।আবার কথা বলার জন্য মনে মনে কথা গোছাতে লাগলো।মিনিট দুই সময় নিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলো।

তাজঃ ধরো,আমাদের মূলধন ২ লক্ষ টাকা।এই দুই লক্ষ টাকাকে ১০ টাকা করে ২০ হাজার শেয়ারে বিভক্ত করা হলো।এখন অনায়াসে সাধারণ জনগণ শেয়ার কিনতে পারবে।কারণ মাত্র ১০ টাকা।যার যতটুকু ইচ্ছে শেয়ার কিনবে।এক হাজার, দুই হাজার, পাঁচ হাজার ইত্যাদি। যার যার ইচ্ছে মতো।২০ হাজার শেয়ার বিক্রি হয়ে গেলে আমরা আমাদের মূলধন দুই লাখ টাকা হাতে পেয়ে যাবো।ঐ মূলধন শেয়ার বাজারের ওপর ভিত্তি করে বাড়বে কমবে।এর মাঝে কিন্তু আবলেখকের কমিশন আর ব্যাংক চার্জও আছে।কারণ পুরো শেয়ারটা আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দিবো।তাই ব্যাংক প্রতিটা শেয়ারের ওপর একটা নিদিষ্ট হারে চার্জ ধার্য করবে।আর অবলেখেক হলো তারা যারা আমাদের শেয়ারটাকে বাজারে বিক্রি করতে সহযোগিতা করবে।
তারা নির্দিষ্ট হারে কমিশনের বিনিময়ে শেয়ার বিক্রি করে দিবে।এখন মনে হতে পারে পুরো মূলধন যখন সাধারণ জনগণের তাহলে আমরা এই মূলধনের টাকা দিয়ে কি করবো?আমাদের লাভ বা কি?আমাদের লাভ হলো আমরা আমাদের মূলধনের টাকা জোগাড় করে ফেললাম।তবে সেটা সীমিত সময়ের জন্য। কারণ কোম্পানি লোকসানে পরলে তাদের টাকা আমাদের ফেরত দিতে হবে।আর যদি সেই মূলধন বিনিয়োগ করে লাভ হয় তাহলে সেই লাভের অংশ জনগণ নির্দিষ্ট হারে পাবে।তেমনি লোকসান হলে তারা সেটা বহন করবে।এখন যদি কেউ শেয়ার নিজের কাছে না রাখতে চায় তাহলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে গিয়ে সেটা বিক্রি করতে পারবে।এখন মনে নিশ্চয়ই আরেকটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করবে।এই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ আবার কি?এটার সম্পর্কে পরবর্তীতে ধারণা দিবো।আজ আর নয়।

বিশাল বড় রচনা বলে থামলো তাজ।সে নিজেও জানে না অাদরকে কতটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। তবে তার ধারণা মতে নিজের সবটুকু দিয়ে শেয়ারের বিষয়ে বুঝিয়েছে।চেয়ারে বসে পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে নিলো।রচনা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে এসেছে।

আরিয়ানঃ মাহির ভাই, আজকের মতো কি মিটিং শেষ? নাকি আরো বকবক করবি।যদি মিটিং শেষ হয় তাহলে আমরা উঠে পরি।

তাজ চোখ রাঙিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকাতেই আরিয়ান মুখ কুচোমুচো করে দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নিলো।তাজের বেশ অস্থির লাগছে।শান্ত দৃষ্টিতে মুরাদ সাহেবের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সে চুপচাপ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে যে তাজের ওপর রেগে আছে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ পুরো মিটিং-এ তিনি একটা টু শব্দও করেননি।বাসায় গেলে যে এই নিয়ে বাপ-বেটার দ্বন্দ্ব লাগবে তাতে তাজ সিউর হয়ে আছে।কিন্তু উপরে উঠতে হলে শেয়ার ব্যবসায় তাজকে হাত লাগাতেই হবে।গত দুই সপ্তাহ প্রচুর ভেবে সে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাজ সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো।

তাজঃ আজকের মতো মিটিং এখানেই শেষ। আপনারা যেতে পারেন।

কথাটা তাজের বলতে দেরী হলো কিন্তু মুরাদ সাহেবের বের হতে দেরী হলো না। তার পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে আরিয়ানও কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।ধীরে ধীরে সবাই কেবিন থেকে বের হলেও অাদর চুপ করে বসে রইলো।পুরো কেবিন ফাঁকা হতেই অাদর তাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

তাজঃ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

তাজের আদেশ পেয়ে হনহন করেই বের হয়ে গেলো অাদর।তাজ সেদিকে হালকা ঘাড় কাত করে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকালো।মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টে এখনো চায়নিজ ভাষায় কিছু লেখা আর কতগুলো চিত্র আঁকা আছে।তাজের দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০৭

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_07
#Writer_NOVA

আমি বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলাম।আবার সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে করতে হবে আমায়।যেটার কথা মাথায় এলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।নিজের চোখের সামনে স্বামীকে শেষ হতে দেখেছি।কিন্তু কিছু করতে পারিনি।চোখ দিয়ে অলরেডি পানি পরা শুরু হয়ে গেছে।

তায়াংঃ প্লিজ বল নোভা।

আমিঃ শোন তাহলে।সেদিন সকাল থেকে আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন ছিলো।এনাজের অফ ডে।আমি সকাল থেকে ওর সাথে খ্যাচখ্যাচানি শুরু করেছিলাম,বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য।আমি তখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। তুই জরুরি কোন কাজে বাইরে গেছিস।এনাজ যেতে চাইছিলো না।কারণ তুই নাকি কড়া করে বারণ করেছিলি আমাকে নিয়ে একা কোথাও বেরুতে।কোথাও যাওয়ার হলে তোকে যেনো নিয়ে যায়।আমি কোন কথাই শুনিনি।বরং জেদ করা শুরু করলাম।আমাকে বিকেলে ঘুরতে নিয়ে না গেলে আমি নিজের ক্ষতি করে দিবো।সেই ভয়ে এনাজ আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হলো।বোরখা পরে মাথায় হিজাব বাঁধলাম। এনাজ শেওলা রঙের একটা টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরলো।দুজন হাঁটতে বের হলো।বিকেল ৫ টা বাজে।কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত নেমছে। আসলে কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে।এনাজ ফিরে যেতে চাইলো।কিন্তু আমি আরেকটু থাকার জন্য ওকে রাজী করলাম।হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমাদের বাসার উত্তর দিকে যে ব্রিজটা আছে তার ওপর এসে থামলাম।চারিদিকে তখন ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে।আমি চোখ বন্ধ করে দুজন হাত মেলে দিয়ে সেটা অনুভব করলাম।হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ পেতেই সেদিকে তাকালাম।কিছু বুঝে উঠার আগে ১৫/১৬ জন মানুষ গাড়ি থেকে নেমে এলোপাতাড়ি এনাজকে মারতে লাগলো।আমাকেও দুইজন এসে আটকে দিলো।এতগুলো মানুষের সাথে এনাজ পারছিলো না।আর সবার হাতে ক্রিকেট স্টাম্পের মতো মোটা স্টীল জাতীয় লাঠি ছিলো।আমি চিৎকার করে ওদের থামতে বলছি।কিন্তু কেউ আমার কোন কথা শুনছিলো না।

এতটুকু বলে থামলাম।চোখের পানি অনরবত পরছে।তায়াং ভাইয়া উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপরের কাহিনি শোনার জন্য।

তায়াংঃ তারপর কি হলো?

আমিঃ আমাকে ধরে রাখার বলে আমি এনাজের কাছেও যেতে পারছিলাম না।ওরা অমানুষের মতো এনাজকে মেরেই যাচ্ছে। আমি জোরে চিৎকার করে কাঁদছি। কিন্তু আশেপাশে কোন মানুষ নেই যে সে আমার কান্না শুনবে।এনাজ বারবার ওদের বলছিলো, আমাকে ছেড়ে দিতে।আমাকে এখান থেকে যেতে দিতে।তারপর ওকে যতখুশি মারুক তাতে ওর সমস্যা নেই। আমাকেও বলছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে।কিন্তু আমি ওকে ছেড়ে কিছুতেই যাবো না। ওরা কয়েক মিনিটের জন্য মার থামালো।তারপর তাদের মধ্যে একজন কাউকে কল করে জিজ্ঞেস করলো এনাজকে মেরে ফেলবে কিনা আর আমাকে কি করবে। ততক্ষণে এনাজ উঠে দাঁড়িয়েছে।এক পা আমার দিকে দিতেই পেছন থেকে একজন সজোরে ওর ঘাড়ে বারি মারে।এনাজ মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।তারপরেও ওরা থামে না।ইচ্ছে মতো মারতে থাকে। রক্তে জায়গায়টা ভেসে যাচ্ছে। মুখের থেকেও রক্ত পরছে।ওর এই অবস্থা দেখে আমার চোখ ঝাপসা হতে লাগলো।আমার চারপাশের সবকিছু ঘুরছে।একসময় এনাজ নিস্তেজ হয়ে গেলো।একজন এনাজের নাকের সামনে হাত নিয়ে নিঃশ্বাস চেক করে বললো এনাজ বেঁচে নেই। তা শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো।কাঁদতে কাঁদতে বসে পরলাম।ওর কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলাম।কিন্তু আমাকে যে লোক দুটো ধরে রেখেছে তাদের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারলাম না। কাহিনিটা যদি এখানে শেষ হতো।তাহলে হয়তো আমি এনাজকে জড়িয়ে ধরে শেষবারের মতো কাঁদতে পারতাম।

কাঁদতে কাঁদতে আমার হেঁচকি উঠে গেছে। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

তায়াংঃ শান্ত হো তুই। চোখ দুটো মুছে নে।

কিছু সময় নিয়ে আবার বলা শুরু করলাম।নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার চেষ্টা করছি।কিন্তু পারছি না।তায়াং ভাইয়া আমার সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে,আমার হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরলেন।আমার গালে আলতো করে হাত রেখে বললেন।

তায়াংঃ কান্না থামা।তোর চোখের প্রতিটা ফোঁটা পানির দাম ওদের দিতে হবে।তার জন্য আবারো আমায় ঘটনাটা পুরো জানতে হবে।

আমিঃ আমি তখন নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিলো অজ্ঞান হয়ে যাবো।হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা পরছে।তবে ভিজে যাওয়ার মতো নয়।
আমার দুঃখে শামিল হতে তারাও আকাশ থেকে ঝড়ে পরছে।চোখের সামনে নিজের স্বামীকে নিস্তেজ হয়ে পরে থাকতে দেখলে কি বিষাক্ত অনূভুতি হয় তা নিজের সাথে না হলে কেউ বুঝতে পারবে না। লোকগুলোর মধ্যে তিনজন গিয়ে গাড়ি থেকে পেট্রোলের বোতল নিয়ে এলো।এনেই এনাজের শরীরে ঢালতে লাগলো।ততক্ষণে আমিও নিস্তেজ হয়ে গেছি।চোখ দুটোকে আর টেনে ধরে রাখতে পারলাম না।চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে লাগছিলো।অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখতে পেলাম মোটা কালো করে দেখতে একজন দিয়াশলাই বক্স থেকে কাঠি বের করে আগুন জ্বালালো।তারপর সেই জ্বলন্ত কাঠিটা এনাজের দিকে ছুঁড়ে মারলো।তারপর আমি কিছু জানি না।যখন জ্ঞান ফিরে তখন হসপিটালে।পরে জানতে পারলাম এনাজের লাশটা পাওয়া যায়নি।আরে পাওয়া যাবে কি করে? ও তো জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি নিজের চোখে ওর শরীরে আগুন ছুঁড়ে মারতে দেখেছি।

চোখ দুটো অসম্ভব জ্বলছে। মাথাটাও ভারী হয়ে আসছে।কান্না করলে এই জ্বালাগুলো ভোগ করতে হয়।তায়াং ভাইয়া থম মেরে বসে আছে। আমাকে থামতে দেখে বললো।

তায়াংঃ তাদের কাউকে তুই চিনতে পারবি?

আমিঃ না রে ভাইয়া।সেই আড়াই বছর আগের কথা। তাছাড়া আমি তাদের ওতটা খেয়াল করিনি।এনাজের দিকেই ছিলো আমার পুরো ধ্যান।তবে ওদের লিডারে যে কালো,মোটা করে লোকটা ছিলো।তাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে।তাকে ভুলি কি করে।সে যে আমার এনাজের শরীরে জ্বলন্ত দিয়াশলাইয়ের কাঠি ছুঁড়ে মেরেছে।

তায়াংঃ তোর স্বামী কোন জবে ছিলো তা কি তোর মনে আছে?

আমিঃ সি বি আই অফিসার।এটা আমি ভুলি কি করে? এই চাকরিজীবনের শত্রুতার রেশ ধরে যে কেউ ওকে হত্যা করেছে তা আমি সিউর।তবে জানিস ভাইয়া, ঐ লোকগুলো সম্ভবত কারো হুকুমে এনাজকে মেরেছে। কারণ ওকে এলোপাতাড়ি মারার পর মোটা করে লোকটা কাকে জানি কল করলো।কলের ঐপাশের ব্যক্তিটা বোধহয় এনাজকে মেরে ফেলতে বলেছে।তাই তার এক সঙ্গীকে হাতের ইশারায় মেরে ফেলতে বললো।এই পুরো ঘটনা টাকা দিয়ে তাদেরকে করিয়েছে। এটা আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি। বিয়ের একবছরের মাথায় আমাকে ওরা বিধবা বানিয়ে দিলো।

তায়াংঃ তোর স্বামী সি বি আই বলেই এখন ওর খুনীকে খুঁজতে টাফ হয়ে যাবে। কোন শত্রুতার রেশ ধরে খুনী এই কাজ করেছে তা বের করতে গিয়ে আমিও হাঁপিয়ে পরবো।

আমিঃ ছাড় না এসব।আমি এভাবেই ভালো আছি।এনাজকে হারিয়েছি কিন্তু তোকে আর নাভানকে হারাতে চাই না।গত দুই বছর তন্ন তন্ন করে খুঁজে পুলিশ,সি আই ডি, সি বি আই কিছু বের করতে পারলো না। আর তুই কি পারবি বল? তার চেয়ে এসব ভুলে গিয়ে নিজের কাজে ডুব দে।

তায়াংঃ যারা তোকে এই সাদা রঙে সাজিয়েছে তাদের কি করে ছেড়ে দেই বল? একদিন আগে হোক কিংবা একদিন পরে।আমি তাদের কে শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।

ভাইয়ার কথা শুনে নিজের দিকে তাকালাম।সাদা থ্রি পিস পরে আছি।নাক,হাত,কান সবকিছু খালি।যেই সাদা রং আমার সবচেয়ে অপছন্দ ছিলো, সেটাই আড়াই বছর ধরে পছন্দ হয়ে আছে।আমার এখন নিজেকে সাদায় রাঙিয়ে রাখতেই ভালো লাগে। ভাইয়ার দিকে তাকালাম।ভাইয়া আজও পুরো কালো রঙে সেজে এসেছে। ওকে কালো রঙে মারাত্মক সুন্দর লাগে।আমি মৃদুস্বরে বললাম।

আমিঃ সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত নামতে চললো।চল এখন উঠি।আর দেরী করা ঠিক হবে না।

তায়াংঃ হুম চল।

আমি ও তায়াং ভাইয়া দুজনেই পার্ক থেকে উঠে বাইরে চলে এলাম।গেইটের সামনে ভাইয়ার বাইক ছিলো।ভাইয়া উঠে স্টার্ট দেওয়ার আগে তার হেলমেট-টা আমার দিকে বারিয়ে দিলো।আমি মাথায় হেলমেট পরে ওর কাঁধে এক হাত রেখে বসে পরলাম।

#চলবে