Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1363



প্রজাপতির রং পর্ব-০৬

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_06
#Writer_NOVA

টেবিলের ওপর থাকা ঘড়িতে একঘেয়েভাবে এলার্ম বেজে যাচ্ছে। বিছানায় থেকে উঠে তা বন্ধ করতেও ইচ্ছে করছে না।আবার শুয়ে শুয়ে বিরক্তিকর এলার্ম শুনতেও ইচ্ছে করছে না।আমি পরে গেছি দোটানায়।শেষ পর্যন্ত আলসেমিকে দূরে ঠেলে বিছানা থেকে উঠতেই হলো।ওয়াসরুম থেকে ওযু করে এসে নামাজ আদায় করলাম।নামাজ শেষে করে অনেকক্ষণ ডেকে তারপর এরিন ও হিমিকে জাগাতে পারলাম।কোরআন তেলওয়াত করে বেশ কিছু সময় হাটাহাটি করলাম বারান্দায়।নাভান এখন উল্টো হয়ে ঘুমোচ্ছে। এরিনদের রুমে উঁকি মেরে আমি চলে গেলাম কিচেনে।

আমিঃ সকালের জন্য আজ কি করা যায়?(চিৎকার করে)এরিন, হিমি আজ কি খাবি সকালে?

হিমিঃ রুটি, ডিম ভাজি কর।

আমিঃ আচ্ছা। নাভানের দিকে একটু খেয়াল রাখিস।

চুলোয় গরম পানির পাত্র বসিয়ে দিয়ে আমি আটার ডিব্বা থেকে আটা নিলাম।ফ্রীজ থেকে ডিম বের করে সামনে রাখতেই নাভানের কান্নার আওয়াজ পেলাম।
আবারো কিচেন থেকে জোরে চেচিয়ে বাকি দুটোকে বললাম।

আমিঃ দেখ না, নাভান কাঁদছে কেন? কি রে শুনছিস? নাকি আবার ঘুমিয়ে পরেছিস?

এরিনঃ আমি দেখছি,তুই কাজ কর।

গরম পানির বলগ উঠছে।সেটাকে বন্ধ করে আমি বোলে আটা নিয়ে নিলাম।রুটির ডো বানানো শুরু করতেই নাভানকে কোলে তুলে এরিন এসে হাজির।

এরিনঃ কান্না থামছে না।তুই কোলে নিয়ে থামা।ক্ষিদে পেয়েছে ছেলেটার।তুই ওকে খাইয়ে আয়।আমি ততক্ষণে রুটি বেলতে থাকি।

নাভানঃ আমমুউউউউউ। (হাত বাড়িয়ে দিয়ে)

আমি আটা মাখানো হাতেই নাভানকে কোলে তুলে নিলাম।আমি কোলে নিতেই সে পুরো ঠান্ডা।

আমিঃ আমি পাশে নেই, টের পেলেই মহাশয়ের ঘুম ভেঙে যায়। এত কান্না কিসের হুম? আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি। ইস,নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে। ছেলে মানুষের এতো আলগা চোখের পানি হলে কি চলে? তুমি কি জানো না, সকালে উঠে মা-কে রান্না করতে হয়।আর তুমি পাঁজিপানা করো।এটা কি ঠিক বলো বাবাই।আমার লক্ষ্মী ছেলেটা কেন এমনটা করে? খুদু লেগেছে পাখিটার? চলো খাইয়ে নিয়ে আসি।(এরিনের দিকে তাকিয়ে)তুই একটু এদিকটা দেখ।আমি ওকে খাইয়ে নিয়ে আসি। ঘুমের থেকে উঠেছে তো এখন মন-মতলবি করবে।কোন কাজও ঠিকমতো করতে দিবে না।

এরিনঃ আচ্ছা তুই যা।

আমি রুমে চলে এলাম।নাভানকে ব্রেস্ট ফিডিং করিয়ে ওকে আবার ঘুম পারানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু আজ সে ঘুমাবে না বলে পণ করেছে। তাই ব্যর্থ হয়ে তাকে নিয়েই আবার কিচেনে যেতে হলো।

এরিনঃ কি ঘুমায়নি?

আমিঃ ও এখন ঘুমালে আমায় জ্বালাবে কে? হিমি ঘুমিয়ে পরেছে।নয়তো ওর কাছে রেখে আসা যেত।দে বেলুন,পিঁড়ি আমার দিকে দে।আমি রুটি বেলছি।তুই গিয়ে শুয়ে থাক।তোর তো এত সকালে উঠার অভ্যাস নেই। পরে আবার মাথা ধরবে।

এরিনঃ বেশি কথা বলিস না।গত তিন দিন ধরে সকালে উঠে আমিই তোর শো করেছি।তিন দিন সকাল সকাল জাগায় আমারও আজ ঘুম আসবে না। আমি রুটি বেলে দিচ্ছি। নাভানকে কোলে নিয়ে রুটি বেলতে তোর কষ্ট হবে।তার চেয়ে বরং তুই রুটি সেঁকে দে। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।

আমি কথা না বলে তাওয়ায় রুটি সাঁকতে লাগলাম।এক হাতে নাভানকে ধরে আরেক হাতে রুটি সাঁকতে লাগলাম।নাভান আমার কোলে চুপটি করে আছে।শরীরের সাথে লেপ্টে কাঁধে মাথা দিয়ে রাখছে।নাভান মাঝে মাঝে সকালে উঠে এমনটা করে।

🦋🦋🦋

সকালের নাস্তা সেরে কোনরকম রেডি হয়ে চলে এসেছি। আজ নাভানও মর্জি করে আমার সাথে চলে এসেছে। কিছুতেই এরিন,হিমির কাছে রেখে আসতে পারিনি।অগত্যা কি আর করার। ছেলে নিয়ে শো করতে আসতে হলো।নাভানকে কোলে নিয়ে অফিসের লিফটে উঠতেই সাইমনের সাথে দেখা।সাইমন আমাকে দেখে চমকে উঠলো।

সাইমনঃ নননননোভা তুমি!!!

আমিঃ হ্যাঁ, আমি।আমাকে দেখে এরকম চমকে গেলেন কেন?আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?

সাইমনঃ না, তেমন কিছু না।হুট করে তোমায় দেখেছি তো তাই ভয় পেয়ে গেলাম।

তার কথা আমার বিশ্বাস হলো না। চোখ দুটো ছোট ছোট করে তার কার্যক্রম পর্যেবেক্ষণ করতে লাগলাম।সে অনেকটা ছটফট করছে।আর তার হাব-ভাবে মনে হচ্ছে সে আমাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে। কিন্তু কারণটা খুঁজে পেলাম না।আমি হালকা করে মুখ বাঁকিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি দিলাম।তবে একটা বিষয় খোটকা লাগলো।আমি তিনদিন কোথায় ছিলাম সে বিষয় কোন প্রশ্ন করলো না। অন্য সময় তো একদিন না আসলে প্রশ্ন করতে করতে পাগল বানিয়ে ফেলে।

আমিঃ এভরিথিং ইস ওকে মিস্টার সাইমন?

সাইমনঃ হ্যাঁ সব ঠিক আছে। একদম ঠিক আছে। কোন ভুল হতে পারে নাকি।

শেষের কথাটা বিরবির করে বললেও আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি।

আমিঃ আমার কাছে তো সবকিছু ঠিক মনে হচ্ছে না। আপনি এরকম ছটফট করছেন কেন? মনে হচ্ছে বাঘের খাঁচায় আপনাকে আটকে রাখা হয়েছে। আর আমাকে এখানে আশা করেননি।

সাইমনঃ কি যে বলেন না।

আমিঃ আপনি এত সকালে এখানে কি করছেন?আমার জানা মতে আপনার শো সকাল দশটায়।আর তিন ঘন্টা আগে এখানে?

সাইমনঃ একটু দরকারে এসেছি।আমরা এসে পরেছি।

লিফটের দরজা খুলতেই সাইমন দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলো।আমি ভ্রু কুঁচকে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।এত সকালে তার আবার কিসের দরকার?সাইমন আমার কলিগ।কিন্তু ওর হাব-ভাবে আমি রহস্য রহস্য গন্ধ পাই।মাথা থেকে এসব ফালতু কথা ঝেড়ে ফেলে শান্ত পায়ে ভেতরে ঢুকলাম।ভেতরে ঢুকতেই নাভান নাক,মুখ কুঁচকে দাঁত বের করে বললো

নাভানঃ আমমমু সিস।

আমিঃ সিস দিবা, দিয়ে দেও।ডায়পার পরা আছো।তাই নো প্রবলেম😁।

নাভানঃ আত্তা(আচ্ছা)😁।

নাভানের কপালে চুমু খেয়ে শো করার রুমে চলে গেলাম।নাভানকে পাশের এক চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সাইড ব্যাগ থেকে কতগুলো চিপস,চকলেট বের করে ওর সামনে দিয়ে রাখলাম।এখন এগুলো খেতেই ব্যস্ত থাকবে।আমাকে শো করতে বিরক্ত করবে না। মাইক্রোফোন, সাউন্ড ঠিক করে নিলাম।এখন শুরু করতে হবে একটানা বকবক।

🦋🦋🦋

সন্ধ্যার আকাশটা দেখতে অপরুপ হয়।লাল রাঙা আকাশটা বিদায় দেয় সূর্যকে।সূর্যের অন্তিম আভায় আকাশ নিজেকে সাজায়।গোধূলির এই লগ্নটা দেখতে আমার মন্দ লাগে না। পার্কের বেঞ্চে বসে আছি। এখান থেকে খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে।আশেপাশের পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর। বিকেল হলেই এখানে বিভিন্ন বয়সের কাপলদের ভিড় দেখা যায়।সন্ধ্যা হলে অবশ্য কমে যায়।যার কারণে আশেপাশটা মানুষের আনাগোনা নেই ।বিকেলের শো টা শেষ করতেই তায়াং ভাইয়ার কল।এই কফি হাউসের লোকেশন দিয়ে বলে এখানে চলে আসতে।নাভানকে আনিনি।আকাশ দেখতে ব্যস্ত ছিলাম।হুশ ফিরে তায়াং ভাইয়ার কথায়।

তায়াংঃ নাভান কই?

আমিঃ বাসায় রেখে আসছি।সকালের শো টা ওকে নিয়ে করছি।তাই বিকেলে আর আনিনি।হুট করে এখানে আসতে বললি যে।

তায়াংঃ কিছু কথা আছে তোর সাথে।

আমিঃ জলদী বল।বাসায় যেতে লেইট হয়ে যাবে।

তায়াংঃ এমনভাবে বলছিস যেনো তোকে আমি এখানে ফেলেই চলে যাবো।

আমিঃ তা নয়। দেখ ভাই,ঘন্টা দুই অনর্গল ফাউ বকবক করে কার বা মন চায় এখন কথা বলতে?

তায়াংঃ কেন, তোর ঐ বকবকের জন্য কি তারা টাকা দিচ্ছে না।

আমিঃ হুম তা দিচ্ছে। কিন্তু এখন বিরক্ত লাগে।

তায়াংঃ ছেড়ে দে।

আমিঃ মা-ছেলের চলবো কি করে?আমি কারো দ্বারে হাত পাতবো না। নিজের ইনকামে সন্তানকে মানুষ করবো।(শক্ত গলায়)

তায়াংঃ খালামণি আমায় কল করেছিলো।বললো তুই নাকি বাসার কল উঠাচ্ছিস না।

আমিঃ কেন, আরেকটা বিয়ে করার জন্য ফোর্স করতে।কতবার বলছি আমি আর কোন বিয়ে করবো না। বাকি জীবনটা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিবো।তা কানে যাচ্ছে না কেন তাদের? তারাই তো এনাজের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছিলো।আমি তো পালিয়ে বিয়ে করিনি।সমাজে কি সিঙ্গেল মাদার হিসেবে কেউ তার সন্তানকে বড় করছে না? তারা আমার নিজের বাবা-মা হয়ে কি করে বলতে পারে আরেকটা বিয়ে করতে।আমি যে নাভানকে ছাড়া বাঁচবো না তা কেন বুঝে না ভাই।মানলাম উনারা আমার ভালো চায়।কিন্তু আমি তো এভাবেই ভালো আছি।তা কেন বুঝে না। কেন নতুন করে জাহান্নামে পাঠাতে চায় আমাকে? তারা যদি আমাকে না বুঝে তাহলে আমি কোথায় যাবো?

তায়াংঃ তোর যা ভালো মনে হয় তাই কর।আমি আর তোকে জোর করবো না।একবার জোর করে তোর জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।

চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। বাবা-মায়ের প্রতি ইদানীং অভিমানটা বড্ড বেশি জেঁকে ধরেছে। ছোট এক গ্রামের মেয়ে আমি।বাবা-মা আর ছোট বোন নিয়ে আমাদের সুখী পরিবার।বাবা কৃষি কাজ করেন।মা গৃহিণী। সারা বছর আমাদের জমিতে একের পর এক ফসল বোনা হয়।যার কারণে সারাবছরই কাজ লেগে থাকে আমাদের বাড়িতে।ছোট বোন এবার অনার্সে পরছে।আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার।বাবা কখনো কোন অভাব আমাদের বুঝতে দেইনি।আমরা দুই বোন ছিলাম বাবার আদরের রাজকন্যা।আমি আমার বাবা-মাকে কখনও ছেলের জন্য আফসোস করতে দেখিনি।তারা সবসময় বলতো, দুই মেয়ে বিয়ে দিয়ে দুটো ছেলে আনবো।এনাজের বাবা-মা কেউ নেই।ছোট বেলায় মারা গেছে। আপন বলতে বছর চারেক ছোট এক ভাই। এনাজের মৃত্যুর ছয় মাস পরেই ওর ছোট ভাই হুট করে উধাও হয়ে যায়।পরে জানতে পারি অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি।দেবরের হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ায় আমি অনেকটা অবাক হই।কিন্তু করার কিছু ছিলো না। তাই চুপ হয়ে যাই।

এনাজের মৃত্যুর কয়েক মাস পর থেকেই আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে। তাদের ধারণা বিয়ে করলে আমি ঠিক হয়ে যাবে। প্রথমে বিষয়টা আমলে নেইনি। কিন্তু দিনকে দিন তারা বিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামানো শুরু করে।নাভানের বয়স যখন দেড় বৎসর তখন হুট করে একদিন আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসে।এতে আমি অনেক রেগে যাই।ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি।মাসখানিক চাকরীর জন্য পাগলের মতো এদিক সেদিক ঘুরে আরজে ক্যারিয়ারে ঢুকি। প্রথম প্রথম সমস্যা হলেও আমি এখন মোটামুটি একটা ভালো অবস্থানে আছি।আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের কোন ছবি আপলোড দেই না।তাই কোন লিসেনার আমাকে চিনে না।

আমিঃ ভাইয়া, কি বলবি বল?

তায়াংঃ এনাজের মৃত্যুর ঘটনাটা আবার আমাকে বল।

আমিঃ প্লিজ ভাইয়া,সেই ঘটনা আর মনে করিস না।স্বামী হারিয়েছি, সন্তান হারাতে চাই না।

তায়াংঃ তুই কিডন্যাপ হওয়ার পর থেকে আমি এসব নিয়ে আবার ভাবা শুরু করেছি।তাই আমার আবারো খুটিনাটি জানা দরকার।

আমিঃ কিন্তু…

তায়াংঃ আমি তোর কোন কথা শুনবো না।

আমি বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলাম।আবার সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে করতে হবে আমায়।যেটার কথা মাথায় এলেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।নিজের চোখের সামনে স্বামীকে শেষ হতে দেখেছি।কিন্তু কিছু করতে পারিনি।চোখ দিয়ে অলরেডি পানি পরা শুরু হয়ে গেছে।

তায়াংঃ প্লিজ বল নোভা।

আমিঃ শোন তাহলে।সেদিন………….

#চলবে

রি-চেইক দেওয়া হয়নি।ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন😊😊।

প্রজাপতির রং পর্ব-০৫

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_05
#Writer_NOVA

আবছা অন্ধকারে পুরো শহরটা ছেয়ে গেছে। সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই। কাচের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন এক যুবক।তার অগোছালো চুলগুলো কপালে পরে আছে।পরন্ত বিকেলের আলোক রশ্মি তার কপালের চুলের ওপর পরেছে।যাতে কালো চুলগুলো লালচে ভাব এসে চিকচিক করছে। মুখে রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করেছে।প্রিয় মানুষটাকে আবারো হারানোর ভয়।যা তাকে খুব করে জেঁকে ধরেছে।এবারও কি সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে ব্যর্থ হবে।ছেলেটা আর কেউ নয়, রোশান দেওয়ান।রোশানের অপজিটে দাঁড়িয়ে তমাল তার বসের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। কখন থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তমালের যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা হয়ে আসছে।সেদিকেও খেয়াল নেই।অন্ততপক্ষে বসতে তো বলবে।তা না করে মনোযোগ সহকারে বাইরে তাকিয়ে আছে। এবার তমাল সাহস করে বলেই ফেললো।

তমালঃ স্যার কিছু বলতে ডেকেছিলেন?

রোশানের কানে তমালের কথা পৌঁছালো কিনা তা আল্লাহ জানে।কারণ সে এখনো এক ধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। তমাল আরেকটু সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।তার কাছে মনে হচ্ছে তার বস কিছু একটা বিরবির করে বলছে।

তমালঃ স্যার, কিছু বলছেন।

রোশানঃ হুম বলছিলাম।

তমালঃ আমাকে কিছু বলছিলেন?

রোশানঃ না তোমাকে নয়।আমার হার্টবিটকে বলছিলাম।

তমালঃ কি বলছিলেন স্যার?

রোশানঃ বলছিলাম, নোভা যদি আমার না হয় তাহলে আমি অন্য কারো হতে দিবো না।

তমালঃ কেন স্যার, আপনার হলে কি সবার হতে দিবেন নাকি😜?

বেক্কল মার্কা হাসি দিয়ে কথাটা বললো তমাল।কিন্তু তার বসের দিকে তাকিয়ে তার অন্তরত্মা শুকিয়ে গেলো।কারণ সে যে কতবড় ভুল কথা বলে ফেলেছে তা সে নিজেও জানে না।যার কারণে রোশান তার দিকে রাগী লুকে তাকিয়ে আছে। এখুনি বোধহয় তমালকে খুন করে ফেলবে।এই চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস তমালের নেই। দ্রুত সে দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে বড়সড় ঢোক গিলে আল্লাহর নাম জপতে লাগলো।আজ তার কপালে শনি আছে। রোশান কিছুটা রাগমিশ্রিত চোখে তমালের দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই তার মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। তমালের দিকে আবারো কড়া চাহনি দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো।

রোশানঃ হ্যাঁ নাঈম বলো।নতুন কোন আপডেট?

নাঈমঃ বস,আমি বিকেল থেকে নোভা মানে ভাবীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ভাবী একটু আগে বাসায় ফিরলো।তাও একটা ছেলের সাথে,বাইকে করে।

নোভা অন্য একটা ছেলের সাথে বাইকে করে ফিরেছে, এই কথাটা শোনার পর রোশান কপাল কুঁচকে ফেললো।সেই রাতে নোভা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে রোশান ওর বাড়ির সামনে নাঈম ও আরাফাতকে পাহারায় রেখেছে। আজ দুই দিন পর সে খবর পেলো নোভা ফিরেছে।

রোশানঃ ছেলেটার খবর বের করো? কোথায় থাকে, কি করে, নোভার সাথে কিসের পরিচয় সবকিছু।

নাঈমঃ আপনি চিন্তা করেন না। সব পেয়ে যাবেন।

রোশানঃ আপাতত ওর বাসার সামনে আর থাকতে হবে না। তোমরা রাতের মধ্যে ঐ ছেলের খবর নেও।তারপর সকাল হলে আবার নোভাকে ফলো করো।

নাঈমঃ ওকে বস।

রোশান কল কেটে চেয়ারে ধপ করে বসে পরলো।এক হাতে কপালে স্লাইড করতে করতে ভাবতে লাগলো নতুন করে এই ছেলেটা আবার কোথা থেকে আমদানি হলো।তমাল এক ধ্যানে রোশানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো হয়েছেটা কি।রোশানকে মোবাইলে কথা বলতে শুনলেও অপরপাশে থাকা নাঈমের কোন কথা সে শুনতে পায়নি।তাই ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝেনি।

তমালঃ স্যার, কোন সমস্যা?

রোশানঃ এক গ্লাস পানি দেও তো।আর সাথে একটা পেইন কিলার দিও।মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে।

তমাল আর কথা বাড়ালো না।রোশানের মাথাব্যথা ধরেছে।এখন যদি বেশি কথা বলে তাহলে কানের নিচে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিতে পারে।তাই চুপচাপ টেবিলের ড্রয়ারে পেইন কিলার খুঁজতে লাগলো।

🦋🦋🦋

ঘড়ির কাটায় রাত ৮ টা বেজে ১২ মিনিট। ফাঁকা রাস্তায় শো শো গতিতে সিলভার কালারের একটা প্রাইভেট কার চলছে। ভেতরে বসে ড্রাইভিং করছে তাজ।মুখটা তার গম্ভীর। আশেপাশে কোন দিকে দৃষ্টি না দিয়ে নিজের মতো করে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে।একসময় গন্তব্যে পৌঁছে গেল সে।”ঠিকানাবিহীন” নামের বাড়ির গেইটে এসে কয়েকবার হর্ণ বাজাতেই দারোয়ান গেইটে খুলে দিলো।গাড়িটা গ্যারেজে পার্ক করে বাসার ভেতরে ঢুকলো তাজ।ডাইনিং টেবিলে মাত্রই খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। খাবার টেবিলে মুরাদ সাহেব, আরিয়ান বসে আছে।জুলেখা বেগম প্লেটে খাবার বাড়ছে।তাজকে দেখে বললেন।

জুলেখাঃ ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আসিস।

মুরাদঃ এই তো চলে এসেছে আমার বড় পুত্র তাজরান তাজওয়ার।বাবা,ফ্রেশ হয়ে চলে আয়।আমরা ততক্ষণ ওয়েট করছি।

জুলেখাঃ আসার সময় তোদের আদরের বোন মুসকানকে কান ধরে টেনে নিয়ে আসিস।কখন থেকে ডাকছি,কিন্তু কানেই নিচ্ছে না।আসছি, আসছি বলে আধা ঘণ্টা পার করে দিয়েছে।

আরিয়ানঃ তাজরান ভাই, জলদী জলদী আসিস। খুব খিদে পেয়েছে। তুই না আসলে কিন্তু আমি একা একাই খেতে বসে পরবো।

সবার কথার বিনিময়ে তাজ মুচকি হাসলো।তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেল।আজকাল নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে তার ভালো লাগে না। ফ্রেশ হয়ে মুসকানকে ডেকে খাবারের টেবিলে গিয়ে বসলো তাজ।মুরাদ সাহেব সকালের ও রাতের খাবারটা তার তিন সন্তানের সাথে বসে খেতে ভীষণ পছন্দ করেন।বড় ছেলে তাজরান, ছোট ছেলে আরিয়ান ও একমাত্র মেয়ে মুসকান তার সব।তাজরানের বয়স ৩১ বছর।আরিয়ানের ২৬ আর মুসকানের ২২ বছর।মুসকান অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ছে।

মুরাদঃ খুলনার থেকে আসা ডিলটার কি খবর তাজরান?

মুরাদ সাহেব খেতে খেতে ছেলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।তারা একসাথে খেতে বসলেই ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া অন্য কথা নেই। এতে মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হয় জুলেখা বেগম ও মুসকান।যেমনটা আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

জুলেখাঃ ছেলেটা সারাদিন পর বাসায় ফিরেছে।কোথায় একটু শান্তিমতো দুটো খেতে দিবে।তা না করে এখানেও ব্যবসার পেঁচাল।

মুরাদঃ ব্যবসায়ীরা যখন সময় পায় তখুনি ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলে।তুমি এসব বুঝবে না। তাই আমাদের মাঝখানে কথা বলো না।

তাজঃ আমি ডিলটা ক্যান্সেল করে দিয়েছি বাবা।কাজটা আমার ততটা সুবিধার মনে হয়নি।তাছাড়া আমাদের কিছু লোকের প্রয়োজন আছে।৩য় বিভাগে কয়েকজন ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের হাতে নেই। তাই ক্যান্সেল করাই সমুচিত মনে করেছি।

আরিয়ানঃ আমরা কিছু ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থা করতে পারি।বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আগ্রহীদের ডেকে আনি।তাদের CV দেখে, ইন্টারভিউ নিয়ে যোগ্য লোক নিয়োগ করতে পারি।

তাজঃ আমিও সেটাই ভাবছি।এই নিয়ে ম্যানেজারের সাথে আমি কথাও বলে এসেছি।তাকে বলে দিয়েছি বিজ্ঞপ্তি দিতে।আগ্রহীরা CV জমা দিলে আমরা বাছাই করে ইন্টারভিউতে ডাকবো।তারপর এক মাসের একটা কোর্স কমপ্লিট করিয়ে নিয়োগ দিবো।

মুরাদঃ গুড আইডিয়া।

তাজঃ ৩য় বিভাগে ব্যবস্থাপকদের তো বেশি কাজ নেই। ব্যবস্থাপকের কাজের সাথে অন্য কোন পার্ট টাইম জবও করতে পারবে।এক সপ্তাহের বেশি সময় আমি এটার ক্ষেত্রে ব্যয় করবো না। এমনি ফ্রান্স থেকে ক্লায়েন্টরা সামনের মাসেই তাদের প্রোডাক্ট নিতে আসবে।তারা আসার আগেই সবকিছু তৈরি করে রাখতে হবে।যাতে তারা এসে একদিনোও দেরী না করে তাদের পণ্য নিয়ে ফেরত যেতে পারে।

মুরাদঃ তোর যেভাবে ভালো মনে হয় সেভাবে কর।আমি আমার সবকিছু তোদের দুই ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছি।তোরা যেভাবে ভালো বুঝবি সেভাবে করবি।

মুসকানঃ বাবা,বড় ভাইয়া,ছোট ভাইয়া। দয়া করে তোমরা তোমাদের এসব বিজনেসি কথা-বার্তা অফ করে চুপচাপ খেয়ে নেও। আমাদেরও একটু খেতে দাও।

জুলেখাঃ আমি কিছু বললেই তো দোষ হয়ে যায়।এবার নিজের বোনের কথায় একটু চুপ কর।তোর বাবার তো খেতে বসলেই যত কথা মনে পরে।

মুরাদ সাহেব চোখ দুটো ছোট ছোট করে জুলেখা বেগমের দিকে তাকালো।জুলেখা বেগম মুখ ঝামটা মেরে খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। তা দেখে মুসকান ও আরিয়ান মুখ টিপে হেসে উঠলো। আর তাজরান গম্ভীর মুখে কোনদিকে খেয়াল না করে চুপচাপ খেতে লাগলো।

🦋🦋🦋

খাওয়ার পর্ব শেষ করে যে যার রুমে শুয়ে পরছে।নোভা বিছানা করে নাভানকে নিয়ে শুয়ে পরলো।আগামীকাল আবার সকাল সকাল উঠে শো করতে যেতে হবে। ফজরের নামাজের পর তাড়াহুড়ো করে সবার জন্য রান্না করে কোনরকম একটু খেয়ে দৌড়াতে হয় শো করতে।প্রথম প্রথম অনেক হাঁপিয়ে পরতো।কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। ছোট দুটো রুমের এক রুমে তারা মা-ছেলে, আরেক রুমে এরিন, হিমি থাকে।সব কাজ তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া।সকালের রান্না নোভা,দুপুরের রান্না এরিন আর রাতের রান্না হিমি করে।এরিন, হিমি মাস্টার্সে পড়ার পাশাপাশি RJ ক্যারিয়ারের সাথে যুক্ত আছে।

গতকাল মোরশেদ ওয়াসিম সাহেব নাভানকে অনেক কিছু কিনে দিয়েছে।যাওয়ার আগে বেশ অনুরোধ করে বলে গেছে কোনদিন সময় পেলে যেনো নোভা তার ছেলেকে নিয়ে তার বাসায় বেড়াতে যায়।নোভাও তাকে বলেছে একদিন যাবে।লোকটাকে নোভার ভালোই লেগেছে।রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে তায়াং-এর বোনের বাসায় গিয়েছে। সেখান থেকে আজ সন্ধ্যায় ফিরেছে।তায়াং বাইকে করে বাসার গেইটে নামিয়ে দিয়েছে।

বিছানার সাথে শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার পর চোখটা যেই লেগে এসেছে তখুনি তায়াং-এর কল এলো।এতে বেচারীর বেশ রাগ হলো।বিরক্তি নিয়েই কলটা রিসিভ করলো নোভা।

তায়াংঃ একটা কল ধরতে এতক্ষণ লাগে।কি এমন কাজ করিস রে? আমার কলটা ধরার সময় হয় না।

তায়াং-এর কথায় নোভা আরো রেগে গেল।ঘুম ভাঙ্গিয়ে ইয়ার্কি হচ্ছে। বেশ চড়া গলায় সে বললো,

—- তোর কি নূন্যতম কমোন সেন্স নেই রে পাঠা? একজনের ঘুম ভেঙে ফেলছিস।তাতে তুই নিজে সরি না বলে তাকেই ঝাড়ি মারছিস।তোর সমস্যা কি হ্যাঁ? তোর জন্য কি একটু শান্তিমতো ঘুমাতেও পারবো না।সবেমাত্র চোখ দুটো লেগে এসেছিলো।দিলি তো ঘুমটা ভাঙিয়ে। (রেগে)

তায়াংঃ তুই তো এত তাড়াতাড়ি ঘুমাস না।তাই ভাবলাম তোর সাথে একটু খেজুরে আলাপ পারি।

—- তোর সাথে খেজুরে আলাপ পারার কোন ইচ্ছে বা সময় কোনটা আমার নেই। নে ফোন রাখ।রাত-বিরেতে কল করে সে খেজুরে আলাপ পারবে।এতোই যখন আলাপ পারতে ইচ্ছে করছে তোর গার্লফ্রেন্ড কে কল করে বল।আমি শুনতে পারবো না।

তায়াংঃ এর জন্য বলে উপকারিকে বাঘে খায়।তোকে কত কষ্ট করে আমি উদ্ধার করে আনলাম।দুই দিন নিজের বোনের কাছে তোকে রেখে এলাম।যাতে তোর কোন সমস্যা না হয়।আর তুই আমাকে এসব শুনচ্ছিস।এর জন্য বলে কারো ভালো করতে নেই।

—- দেখ ভাই, প্রচুর ঘুমে ধরছে।সকালে উঠে শো করতে হবে।এমনি তিনদিন অফ দিয়েছি।তার জন্য বেতন কেটে রাখবে।তোর সাথে যদি রাতভরে খেজুরে আলাপ পারি তাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং আমার ঘুম নষ্ট হবে।তার চেয়ে বরং তুইও ঘুমা।আর আমিও ঘুমাই।

তায়াংঃ আমার ভাগিনা ঘুমিয়ে গেছে?

—- হুম ঘুমালো একটু আগে।রাতে একটা ভাতও মুখে দেয়নি।তুই আর ঐ মোরশেদ ভাই যে চিপস, জুস হাবিজাবি কিনে দিয়েছিস সেগুলো খেয়েই আছে।একটু আগে ঘুমের মধ্যে একটু সুজি বানিয়ে ফিডারে করে খাইয়ে দিয়েছি।

তায়াংঃ তোর রুমমেটরা কিছু জিজ্ঞেস করেনি? এই কয়েকদিন কোথায় ছিলি, কি করেছিস এসব কিছু?

—- এরিন, হিমির কথা বলছিস।হ্যাঁ, ওরা জিজ্ঞেস করেছিলো।আমি বলেছি খালাতো বোনের বাসায় ছিলাম।হুট করে বোন অসুস্থ হয়ে গেছে তাই কাউকে কিছু বলে যেতে পারিনি।আর সেখানে গিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই কারো মোবাইল দিয়ে কলও করতে পারিনি।

তায়াংঃ এতবড় মিথ্যে কথা😳।

—- কিছুই করার নেই। ওদের বললে শুধু শুধু টেনশন করবে,ভয় পাবে। এত ভেজালের কি দরকার।তার থেকে আপাতত জানুক আমি খালাতো বোনের বাসায় ছিলাম সেটাই ভালো।পরে কোন সমস্যায় পরলে বলো দিবো সেই দিনের কাহিনি।

তায়াংঃ তোকে ওরা কিডন্যাপ করেছিল কিভাবে?

— বিকালের শো-টা শেষ করতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে যায়।ধরতে গেলে তো সন্ধ্যাই।তো সেদিনও শো শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম।এরিন,হিমির কোচিং ছিলো বলে আমি নাভানকে নিয়ে গিয়েছিলাম।ফেরার পথে রিকশা না পেয়ে আমি ও নাভান হেঁটে হেঁটেই ফিরছিলাম।দশ মিনিটের রাস্তা। আকাশটা বেশ মেঘলা।যার কারণে আশেপাশে মানুষ নেই। হঠাৎ বিশাল এক কালো হাইস এসে আমাদের সামনে থামলো।সেখানে থেকে মুখ ঢাকা কিছু লোক এসে আমাকে জোর করে হাইসে তুললো।নাভানকে একজন কোলে করে আমার পাশে বসলো।তারপর ক্লোরোফোম জাতীয় কিছু একটা স্প্রে করলো।আমার আর কিছু মনে নেই।চোখ খুলতে নিজেকে বিয়ের সাজে পাই।কে বা কারা আমায় তুলে নিয়ে গেছে তা আমি জানি না। কিংবা এর পেছনে কে আছে তাও জানি না।

তায়াংঃ তোর না জানলেও চলবে।কে আছে এর পেছনে তা না হয় আমি বের করবো।অনেক রাত হয়েছে ঘুমা শাঁকচুন্নি। এতো রাত জাগিস কেন?

—- নিজে ঘুম ভাঙিয়ে আবার নিজেই জ্ঞান বিতরণ করছিস। তোকে তো পাঠা…….

আরো কিছু বলার আগেই তায়াং কলটা কেটে দিলো।ওর যা জানার প্রয়োজন তা জেনে গেছে। এখন শুধু এর পেছনে থাকা কালপ্রিটকে ধরতে পারবে।এমনো তো হতে পারে নোভাকে যারা কিডন্যাপ করেছে তার সাথে এনাজকে মেরে ফেলার মানুষটার কোন সংযোগ আছে।সবাই না হয় এনাজের খুনীর খবর না নিয়ে থাকতে পারে।কিন্তু সে কি তার জানের জিগারের খুনীকে এত সহজে ছেড়ে দিবে নাকি।

তায়াং কল কেটে দেওয়ার পর নোভা “তায়াংইয়া পাঠা” বলে একটা চিৎকার দিয়ে বসে পরে।মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে লাইটের সুইচ ওন করে।সামনে থাকা টেবিল রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে নিলো।তারপর জগ,গ্লাস যথাস্থানে রেখে লাইট অফ করতে নিলে চোখ যায় টেবিলে থাকা একটা ছোট ফটো ফ্রেমের দিকে।হাত বাড়িয়ে ফটো ফ্রেমেটা নিলো।নোভা নাভানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আর নাভান দুই হাতে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।বেশ কিছুদিন আগের তোলা ছবিটা।ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছে বলে ফটো ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনেছে।ছবিটা যথাস্থানে রেখে নাভানের দিকে তাকালো সে।আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।নাভানের ঘুমন্ত চেহারাটা অসম্ভব মায়াবী দেখাচ্ছে। বেশি কিছু না ভেবে লাইট অফ করে এক হাতে নাভানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো নোভা।বেশি রাত জাগলে কাল আবার উঠতে দফারফা হয়ে যাবে।সেই চিন্তা করে চোখ দুটো
বুজলো সে।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০৪

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_04
#Writer_NOVA

—- গুড মর্ণিং ঢাকা।গুড মর্ণিং বাংলাদেশ। আমি আর জে এরিন আছি আপনাদের সাথে।আপনারা শুনছেন ঢাকা এফএম 90.4। আর এখন চলছে আপনাদের সবার ফেভারিট শো “ভোরের পাখি”। সকাল ৭ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত আমি এরিন থাকবো আপনাদের সাথে। এর মধ্যে চলবে গান,ফান ও জমজমাট আড্ডা। আমার সাথে যুক্ত হতে ও আপনার মনের অনুভূতি জানাতে SMS করুন ৭****৬ এই নাম্বারে।এবং কেমেন্ট করুন আমাদের ফেসবুক অফিসিয়াল পেইজে।কথা না বারিয়ে চলুন শুরু করা যাক।আপনারা জলদী জলদী করে এসএমএস এবং কমেন্ট করে আপনার পছন্দের গান জানিয়ে দিন।অনেকের হয়তো প্রশ্ন থাকবে আপনাদের প্রিয় আর জে নোভানাজের শো বিগত দুই দিন ধরে আমি কেন করছি? আসলে আপনাদের নোভানাজ একটু সমস্যায় আছে।তাই তার শো-টা আমাকেই চালাতে হচ্ছে। তবে ইনশাআল্লাহ আগামীকাল কিংবা পরশু থেকে তার শো সেই সামলাবে।কথা না বাড়িয়ে আমরা গানে চলে যাই।চলুন আপনাদের প্রিয় আর জে নোভানাজের প্রিয় সিঙ্গার ইমরান মাহমুদুলের ধোঁয়া গান টা শুনে আসি।ফিরছি গানের পর বিজ্ঞাপন বিরতির পরপরি।কোথাও যাবেন না। আমার সাথে ও ঢাকা এফএমের সাথেই থাকুন।ইনজয় দিস মিউজিক।

হাসিমুখে এক বিশাল রচনা বলে থামলো এরিন। গত দুই দিন থেকে সকাল-দুপুরে দুটো শো সামলাতে হচ্ছে তার।নিজের একটা আরেকটা নোভার।নোভার দুটো শো এর একটা সে আরেকটা হিমি সামলায়।সবার সামনে হাসিমুখে থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে অনেক টেনশনে আছে।কারণ দুই দিন ধরে নোভা ও তার বাচ্চাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।সেই চিন্তায় এরিনের ও হিমির রাতের ঘুম হারাম।এরিন,হিমি ও নোভা বলতে পারেন কলিজার টুকরো বান্ধবী। যদিও তিন জনের পরিচয় এই আর জে ক্যারিয়ারে এসে। তবে তারা এখন একে অপরের অংশ।একসাথে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।সবকিছু তিনজন মানিয়ে চলে।আর জে ক্যারিয়ারে সবাই নোভাকে চিনে নোভানাজ নামে।
এরিন গভীর চিন্তায় ডুব দিয়েছে। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে নোভার প্রিয় সিঙ্গার ইমরানের ধোঁয়া গানটা বাজছে।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

কি করে বলি,
কতটা ভালোবাসি আমি তোমাকে
এই দিনগুলি,
কি করি থাকি বলো একা এইভাবে
এই মুহুর্ত কাটে না, নিঃস্ব তুমি হীনা
পেতে চায় তোমারি ছোয়া
ধোয়াআআআআআআআআআ
এই শহরে যাই হারিয়ে, এই প্রহরে খুজি তোমাকে

পথে হলো দেখা, সেই পথেই কেন একা
আমি দুই হাতে ধরি শূন্যতা
তুমি শুধু পারো, যদি ছুঁয়ে দেও আবারো
তাতে পাবে সে সব পূর্ণতা
মন ভ্রান্ত এই সময় অশান্ত আজানায়
পেতে চায় তোমারি ছোয়া
ধোয়াআআআআআআআআআ
এই শহরে যাই হারিয়ে, এই প্রহরে খুজি তোমাকে

রাতে যদি হবে তবে আলো কে ছড়াবে
দুচোখে নিয়ে অন্ধকার
তুমি শুধু পারো, যদি ছুঁয়ে দেও আবারো
তাতে আলোকিত হবো আবার
মন ভ্রান্ত বেদনায়, অচেনা ঠিকানায়
পেতে চায় তোমারি ছোয়া
ধোয়াআআআআআআআআআ
এই শহরে যাই হারিয়ে, এই প্রহরে খুজি তোমাকে

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

গান শেষ হতেই এরিন বিজ্ঞাপন বিরতি নিলো। মাথায় দুই হাত দিয়ে ডেস্কের ওপর বসে আছে।এত সকালে ওঠার অভ্যাস নেই এরিনের।তার শো দুপুরের দিকে।তাই সকালে ঘুমিয়ে কাটায়।হিমির শো বিকেলে। মাথা ঝিমঝিম করছে।এই মুহুর্তে এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না।তখুনি কফি হাতে সেখানে প্রবেশ করলো সাইমন।সেও একজন RJ। এরিন ও হিমি দুজনের সাথে সাইমনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো তবে ততটা বেশি নয়। নোভার সাথে তো একদম ভালো নয়।কারণ সাইমনকে দেখতে সহজ সরল এক ছেলে মনে হলেও সে হলো গভীর জলের মাছ।আর নোভার কাছে সবসময় মনে হয় ছেলেটার ভেতরে ঘাপলা আছে।তাই যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলে নোভা।নিজে তো দূরত্ব রাখেই সাথে এরিন ও হিমিকেও এর থেকে দূরে থাকতে কড়া নিষেধ করেছে।কিন্তু সাইমন দেখতে খুব বোকা কিছিমের।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,হাতে ঘড়ি,গলা অব্দি বোতাম লাগানো টি-শার্ট পরহিত কেউ দেখলে তাকে যে কেউ বোকা উপাধি দিয়ে দিবে।তবে তাকে দেখে যতটা বোকা মনে হয় আসলে সে ততটা নয়।কফির মগ এরিনের সামনে রেখে টেবিলের ওপর হাত দিয়ে জোরে দুটো টোকা দিলো সাইমন।এতে এরিন মাথা উঠিয়ে তাকালো।

সাইমনঃ কফি😊😊।

এরিন মুচকি হাসি দিয়ে সাইমনের হাত থেকে কফির মগটা নিজের হাতে নিলো।তারপর মৃদুস্বরে বললো।

এরিনঃ ধন্যবাদ।

সাইমনঃ তুমি কি কিছু নিয়ে টেনশনে আছো এরিন?

এরিনঃ অনেক বড় টেনশনে আছি। নোভার জন্য অনেক বেশি টেনশন হচ্ছে। গত তিনদিন ধরে ওর কিংবা নাভানের কোন খোঁজ নেই। তাই প্রচুর টেনশনে আছি। আল্লাহ না করুক, কোন বিপদে পরেনি তো।ওর কোন ক্ষতি হলে আমি ও হিমি নিজেদের ক্ষমা করতে পারবো না।

সাইমনঃ চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।নোভা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে।যদি কোন বিপদে পরেও তাহলে ঠিক কাটিয়ে নিতে পারবে।আল্লাহ ওকে আর ওর ছেলেকে রক্ষা করুক।

এরিন চিন্তিত মুখে একের পর এক কফির মগে চুমুক দিতে লাগলো।সাইমন মগ হাতে নিয়ে টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার সামনের দিকে আবদ্ধ। হঠাৎ এরিনের চোখ সাইমনের দিকে যেতেই এরিনের মনে হলো সাইমন কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসছে।বিষয়টা স্বাভাবিক মনে হলো না এরিনের কাছে।তাই কফির মগ ডেস্কের ওপর রেখে চোখ, মুখ কুঁচকে সাইমনকে জিজ্ঞেস করলো।

এরিনঃ কি ভাবছেন মিস্টার সাইমন?মনে হচ্ছে আপনি খুব খুশি?

এরিনের কথায় কিছুটা বিষম খেয়ে উঠলো সাইমন।হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো।

সাইমনঃ তেমন কিছু নয়। পুরনো একটা হাসির কথা মনে পরে গিয়েছিলো।তাই না চাইতেও হাসি চলে আসছিলো।তাছাড়া তেমন কিছু নয়।

এরিনঃ কি এমন কথা?যার জন্য আমাকে চিন্তিত দেখেও আপনার মুখে হাসি ফুটে উঠছে।আমি জানতে পারি কি?

সাইমনঃ বললাম তো তেমন কিছু না।আচ্ছা, সরি তোমার কাজে ডিস্টার্ব করলাম।বিজ্ঞাপন বিরতি তো শেষ হওয়ার পথে।তুমি শো করো।আমি আসছি।

কথাগুলো প্রায় একদমে বলে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেলো সাইমন।এতে বেশ অবাক হলো এরিন।সাইমন যে ওর থেকে কথা ঘুরিয়ে এখান থেকে পালিয়ে গেলো তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সাইমন কেন এভাবে পালালো তার যুক্তি সে দাঁড় করাতে পারলো না।হয়তো সেই হাসির কথাটা সে এরিনকে জানাতে চায় না। এর জন্যই কথা কাটিয়ে পালিয়ে গেলো।এরিন আর বেশি কিছু ভাবলো না।বিজ্ঞাপন বিরতি শেষ হওয়ার আগেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে নিলো।আবার শো শুরু করতে হবে।

🦋🦋🦋

সময় এখন ৯ টা বেজে ৪৭ মিনিট।যামে আটকে গাড়িতে বসে বিরক্তির সাথে হাই তুলছে তাজ।ঢাকা শহরে এই একটাই ঝামেলা।আর তা হলো যাম।যামে পরলো জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে যায়।যদিও এটা নিত্যদিনের ব্যাপার।কিন্তু আজ তাজের অফিসে একটা জরুরি মিটিং আছে।সময় মতো যেতে না পারলে বড় লোকসানও হতে পারে। এখন নিজের ওপর রাগ উঠছে তাজের।কেন যে সকাল সকাল তার বাবা ও ছোট ভাইয়ের সাথে বের হলো না। বিরক্তি কমাতে রেডিও ওন করলো তাজ।তার প্রিয় শো “ভোরের পাখি”।মূলত নোভানাজের সকাল-বিকেল দুটো শো সে শুনে।একদিনও মিস দিবে না।যার কারণ হলো এই দুটো শো-এর আর জে নোভানাজের কন্ঠটা তার অনেক চিরচেনা মনে হয়।মনে হয় তার কাছের খুব প্রিয় মানুষ। তাই সে একটা দিনও মিস দেয় না।কিন্তু গত দুই দিন যাবত অন্য একটা মেয়ে শো করায় তার শুনতে ভালো লাগে না।

তাজঃ ড্যাম ইট।আমার বাবার সাথে চলে গেলেই ভালো হতো।এখন এই বিরক্তিকর যাম সহ্য করতে হবে।

হঠাৎ জানালায় টোকার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকালো।জানালার কাচ নিচে নামাতেই বকুল ফুলের ঘ্রাণ জানালা ভেদ করে তাজের নাকে এসে বারি খেলো।চোখ বন্ধ করে লম্বা করে ফুলের ঘ্রাণ নিলো।নিমিষেই বিরক্তি দূর হয়ে একরাশ ভালো লাগা ছেয়ে গেল।সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো একটা দশ বছরের মেয়ে নানারকম ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গোলাপ ফুল ভর্তি বালতিটাকে এক হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আর আরেক হাতে কতগুলো বেলি ফুল ও দুটো বকুলের মালা।

—- ভাইয়া, ফুল নিবেন? একদম তাজা ফুল আর ফুলের মালা।আজকেই বানাইছি।

ময়লা জামা পরিহিত উসকো খুসকো চুলের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তাজের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।যেই বয়সে মেয়েটার স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে রাস্তায় ফুল বিক্রি করছে।তাজ মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো।

তাজঃ নাম কি তোমার?

—- আমার নাম টুম্পা।

তাজঃ বাহ্ বেশ সুন্দর নাম তো।তা তোমার ফুলের দাম কত?

টুম্পাঃ গোলাপ ফুলের পিস ১০ টেকা।বেলি ফুলের মালা ২০ টেকা কইরা।আর বকুলের মালা ৫০ টেকা।এই বকুল ফুলের মালা আমারে ছাড়া আর কারো কাছে পাইবেন না।

তাজঃ কেন?

টুম্পাঃ আমি সকাল ভোরে অনেক দূরের এক বাগান থিকা কুড়ায় আনি।এহন(এখন) তো বকুল ফুলের গাছ কোনহানে দেহা যায় না। তাই এইডার দাম বেশি। আর আমি ছাড়া ঐ গাছের খবর কেউ জানে না। ঐ ফুল গাছটা জংলি গাছের ভিতরে তো।

তাজঃ স্কুলে যাও না কেন?

টুম্পাঃ ইস্কুলে গেলে টেকা ইনকাম করবে কে?

তাজঃ তোমার বাবা-মা করবে।

টুম্পাঃ বাবা ছুডু থাকতে মইরা গেছে। মায় মাইনষের বাড়ি কাম করে।আমি তো ইস্কুলে পড়তে চাইছিলাম।কিন্তু মায় কইছি আমগো গরীব মানুষের পড়ালেহা করতে হয় না।তার থিকা ফুল বেচলে নাকি টেকা আইবো।

তাজঃ অনেকে তো ভিক্ষা করে জীবন চালায়।

টুম্পাঃ ছি, ছি। মায় কইছে না খাইয়া থাকবো।তাও নিজে কারো কাছে হাত পাতবো না।আমারেও পাততে দিবো না।

টুম্পার এই কথায় তাজের মুখটা আনন্দে চকচক করে উঠলো।গরীব হয়েও টুম্পার মা তাকে সঠিক শিক্ষা দিয়েছে। এতটুকু বয়সের মেয়ে হয়ে সে নিজেও এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। অথচ মেক্সিমাম ৮০% শিক্ষিত মানুষের মনে সামান্যতম মানুষ্যত্ব নেই। আর গরীবের সন্তান হয়েও সে তার মায়ের কথা মেনে নিয়েছে।

টুম্পাঃ স্যার কি ফুল নিবেন? নিলে জলদী নেন।আমার আবার ঐদিকে যাইতে হইবো।দাড়ায় থাকলে আমার ব্যবসা লস।

তাজঃ আমাকে বকুল ফুলের মালা দুটো দেও।

টুম্পাঃ নেন স্যার।

তাজঃ কত হয়েছে বলো তো?

টুম্পাঃ ৫০ আর ৫০ তাইলে ১০০ টেকা।(হাত গুণে)

তাজঃ বাহ্, হিসাব তো ভালোই জানো।

তাজ মুচকি হেসে পকেট থেকে মানওব্যাগ বের করলো।সেখানে থেকে ৫০০ টাকার দুটো নোট টুম্পার দিকে এগিয়ে দিলো।

টুম্পাঃ স্যার এতো টেকা দিতাছেন কেন? আমার ১০০ টেকা দিলেই হইবো।বেশি টেকা আমি নিতে পারমু না।

তাজ অসহায় চোখে টুম্পার দিকে তাকালো। ওর কাছে সব পাঁচশত টাকার নোট।একশত টাকার কোন নোট নেই।

তাজঃ আমার কাছে ১০০ টাকার কোন নোট নেই। তুমি বিশ্বাস না করলে এই যে দেখ।

টুম্পা এগিয়ে এসে মানিব্যাগের দিকে তাকালো।সত্যি সেখানে সব ৫০০ টাকার নোট। সেও পরে গেলো বিপদে।বকুল ফুলের মালাগুলো ৫০ টাকা বলে কেউ নিতে চায়না।যাও একটা কাস্টমার পেলো।তার কাছেও ভাংতি টাকা নেই। টুম্পার মুখটা মলিন হয়ে গেলো।

তাজঃ তুমি এই দুটো নোট রাখো।আমি তোমাকে এগুলো ছোট বোন হিসেবে দিলাম।প্লিজ রাখো।

টুম্পাঃ না না আমি এগুলা নিবার পারুম না।বাড়িতে গেলে মায় যখন জিগাইবো তহন আমি কি কমু?মায় তহন আমারে মারবো।

তাজঃ আরে কিছু বলবে না। তুমি রাখতো। যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবে এক ভাইয়ার কাছে টাকা ভাংতি ছিলো না। তাই এগুলো দিছে।

টুম্পাঃ তাইলে একটা নোট দেন।আমি দুইটা নিতে পারমু না।

তাজ জোর করে টুম্পার হাতে নোট দুটো গুঁজে দিলো।টুম্পা বাকি ফুলগুলো দিতে চাইলে সেগুলোও তাজ নিলো না।অগত্যা তাজের জোড়াজুড়িতে টুম্পা টাকাগুলো নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।যাওয়ার আগে তাজকে বললো।

টুম্পাঃ আপনে অনেক ভালা ভাইজান।তয় সাবধানে থাকবেন।পৃথিবীতে ভালা মানুষরে বেশি দিন বাঁচতে দেয় না।শত্রুরা মাইরা ফালায়।নয়তো আল্লাহ নিয়া যায়।

তাজ টুম্পার কথার উত্তরে কিছুই বলেনি।বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টুম্পার গাল টেনে দিয়েছে।তাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে টুম্পার চোখ ছলছল করে উঠে ।মুখে তার আনন্দের হাসি।এই টাকা তার মা কে দিলে সে এই মাসের বাজার করতে পারবে।তখন বলবে গরুর কলিজা কিনে আনতে।কতদিন ধরে তার শখ জাগছে গরুর কলিজা ভুনা খাবে।বান্ধবী লাইলীর মুখে শুনেছিল গরুর কলিজা ভুনা নাকি অনেক মজা।লাইলির মা যেই বাসায় কাজ করে তারা একদিন একটু দিয়েছিলো।সেটা লাইলীর মা না খেয়ে আচলের তলায় লুকিয়ে লাইলীর জন্য নিয়ে এসেছে।সেই থেকে টুম্পার শখ জেগেছে গরুর কলিজা ভুনা খাওয়ার।কিন্তু তাদের তো আর সেই সামার্থ নেই। মায়ের কাছে এসবের কথা বললেই তার মা রাগারাগি করে।মাঝে মাঝে মারধর করে। একদিন মারতে মারতে বলেছিলো,,,

—“নবাবের বেটির এত শখ কে? কে কিইন্না খাওয়াইবো তোরে? দুইবেলা নুন দিয়া ভাত খাইতে পারি না।আর হেই গরুর কলিজা ভুনা খাইবো।গরীবের ঘরে জন্ম না নিয়া বড়লোকের ঘরে জন্ম নিতে পারলি না।তইলে তো তোরে একেকদিন একেক পদ দিয়া খাওয়াইতো।তোর বাপে তো মইরা খালাস হইছে।আর এহন যত জ্বালা হইছে সব আমার।”

সেদিন টুম্পার মা টুম্পাকে অনেক মেরেছিলো।যার কারণে টুম্পার জ্বর চলে আসে। পরে অবশ্য তার মা কেঁদে কেঁদে সারারাত জেগে সেবা করেছে। ময়েরা তো এমনি হয়।নিজেই শাসন করবে আবার নিজেই বুকে টেনে নিবে।

তাজ বকুল ফুলের মালা দুটো হাতে নিয়ে নাকের সামনে আনলো।বড় করে নিশ্বাস টেনে ঘ্রাণ নিলো।তার প্রেয়সীর খুব পছন্দের এই বকুল ফুল।আজ যদি সে এই মালা দুটো পেতো তাহলে যে কি খুশি হতো তা তাজ নিজেও জানে না। ফুল দুটোকে গাড়ির সামনের দিকে যত্ন সহকারে রাখলো।সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আবার সেই বিষাক্ত অতীত এসে তাকে ঘিরে ধরছে।সে তো চাইছে সব ভুলে নিজেকে মানিয়ে নিতে।কিন্তু তা পারছে না।অতীতের কথা মনে হতেই মুখটা আপনাআপনি বিষন্নতায় ঘিরে গেলো।হঠাৎ সামনের দিকে চোখ যেতেই তাজ চমকে উঠলো। ওর শরীর ঘামতে শুরু করলো।কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০৩

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_03
#Writer_NOVA

—–আরে মিসেস এনাজ আহমেদ যে!!কেমন আছেন?

তায়াং ভাইয়ার সাথে একটা রেস্টুরেন্টে বসে ছিলাম।হঠাৎ এক লোকের কথায় কিছুটা চমকে সেদিকে তাকালাম।৩৫ বছরের এক লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে আমি চিনি বলে আমার মনে হচ্ছে না।আমি তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালাম।তার মুখেও একি রিয়েকশন।

আমিঃ আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।

—- আমি মোরশেদ ওয়াসিম। এনাজ ভাইয়ের আন্ডারে কাজ করতাম।আমার কথা নিশ্চয়ই ভাইয়ের মুখে শুনেছেন।আসলে আপনার সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি। তাই আপনি আমায় চিনবেন না।কিন্তু এনাজ ভাইয়ের কাছে আপনার অনেক ছবি ছিলো।তাই আপনাকে আমি চিনি।এনাজ ভাই যদিও আমার স্যার।কিন্তু আমি ভাই করেই বলতাম।কাজের ক্ষেত্রে স্যার,কাজের বাইরে ভাই।তা কেমন আছেন ভাবী?

আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

মোরশেদ ভাই আমার কথার উত্তর না দিয়ে নাভানকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।

মোরশেদঃ এটা কি আমাদের এনাজ ভাইয়ের বাচ্চা?

নাভান ওর মামার কোলে চুপচাপ বসে বসে চিপস খাচ্ছিলো। আমি তার কথায় ছোট করে উত্তর দিলাম।

আমিঃ জ্বি।

মোরশেদঃ মাশাআল্লাহ, পুরো এনাজ ভাইয়ের মতো দেখতে হয়েছে। মুখের আদল,ভ্রু,নাক সবকিছু অবিকল বাবার মতো।নাম কি রেখেছেন?

আমিঃ জ্বি, এনান আহমেদ। ডাকনাম নাভান।

মোরশেদঃ মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ।বাবার নামের সাথে মিল রেখে নামটা খুব সুন্দর হয়েছে। তা আমি কি বলবো? নাভান নাকি এনান?

আমিঃ আপনার যা ইচ্ছা।

মোরশেদ ভাই এগিয়ে গিয়ে তায়াং ভাইয়ার কোল থেকে নাভানকে কোলে নিলো।মুগ্ধ চোখে সে নাভানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ খুশিতে উপচে পরছে।কিন্তু তার এত খুশির কারণটা আমি খুঁজে পেলাম না।

মোরশেদঃ ভাবী, উনাকে তো চিনলাম না?

আমিঃ আমার খালাতো ভাই তায়াং। উনাকে তো আপনার চেনার কথা।নাভানের আব্বুর জানে জিগার ফ্রেন্ড। হাইস্কুল, কলেজ,ভার্সিটি সব একসাথে কমপ্লিট করেছে।

মোরশেদঃ আসলে হয়েছে কি ভাবী, আমি এনাজ ভাইয়ের আন্ডারে মাত্র দুই মাস কাজ করতে পেরেছি। তারপর তো ভাই আমাদেরকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন।(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)থাক সেসব কথা। আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে এনান বলেই ডাকবো।এনাজ ভাইয়ের ছেলে এনান।

আমি বিনিময়ে মুচকি হাসলাম।নাভান আমাদের তিনজনের দিকে পালাক্রমে তাকাচ্ছে।চিপসের প্যাকেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।আমি সেটা নিয়ে টেবিলে রাখলাম। নাভান সবার সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারে। একদম বাবার মতো।চেহারা, গায়ের রং, স্বভাব সব ওর বাবার পেয়েছে। শুধু চোখ দুটো আমার মতো।মোরশেদ ভাইয়ের কোর্টের বোতাম নিয়ে মুখে দিচ্ছে।

আমিঃ ছি, নাভান বাবা।চাচ্চুর বোতাম মুখে দেয় না।তুমি না গুড বয়। চাচ্চু তো তোমায় পঁচা ছেলে বলবে।মুখের থেকে বের করো।(ধমকের সুরে)

মোরশেদঃ আহ্ ভাবী ধমকাচ্ছেন কেন? ও কি এসব বুঝে? থাক করুক।

তায়াংঃ তোর তো সাহস কম না, আমার ভাগিনাকে ধমক দিস।(চোখ রাঙিয়ে)

আমিঃ তোর জন্য কি আমি ছেলেকে শাসন করতে পারি।

তায়াংঃ পারবিও না।আমার সামনে ওকে একটা ছোট করে ধমকও দিতে পারবি না।

মোরশেদঃ ভাবী, একটা কথা বলি। যদি কিছু মনে না করেন। (মুখটা কুচোমুচো করে)

আমিঃ জ্বি বলুন।

মোরশেদঃ ওকে নিয়ে আমি একটু বাইরে যাই।বেশি দুরে নয় এই সামনেই থাকবো।

আমিঃ আমি জানি আপনি কেন যেতে চাইছেন। ওকে নিয়ে এখন দোকানে যাবেন।তারপর এত্তগুলা চিপস, চকলেট কিনে দিবেন।তার কোন দরকার নেই ভাই। একটু আগে ওর মামা পুরো এক দোকান তুলে এনেছে। দেখুন, কতকিছু কিনে পুরো টেবিল ভরে ফেলেছে।

মোরশেদঃ প্লিজ, ভাবী মানা করেন না।আবার কবে না কবে দেখা হয়।ততদিনে যদি মারা যায়।তাহলে আফসোস থাকবে।এত্তো কিউট একটা বাচ্চাকে যদি আমি কিছু কিনে না দেই তাহলে আমার খারাপ লাগবে।তাছাড়া ও আমাদের এনাজ ভাইয়ের শেষ স্মৃতি। ওকে কিছু দিতে না পারলে সত্যি আমার সারাদিন খুব বাজে যাবে।

আমিঃ দিলেন তো মন ঘুরিয়ে।আপনাদের ভাতিজা, ভাগিনাকে আপনারা দিবেন।আমি আর কি বলবো?এখন কিছু বললেও যে আপনি মানবেন না তাও আমি জানি।আর যদি কিনে দিতে মানা করি তাহলে ভাববেন আপনাদের ভাই বেঁচে নেই বলে আমি নিতে দিচ্ছি না।সবদিক থেকে জ্বালা।

মোরশেদঃ ধন্যবাদ ভাবী।আমি এই রাস্তার পাশে স্টলেই আছি।

মোরশেদ ভাই খুশিমনে নাভানকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালাম।তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো।

তায়াংঃ বিবাহিত ছেমরি পোলাডারে নিয়া দৌড়ায়ছিস কিভাবে?আমারে কইতি হিরোর মতো এন্ট্রি মাইরা তোরে নিয়ে আসতাম। পোলাডার কিছু হয় নাই তো?

আমিঃ হো তুই হিরোর মতো গিয়া বিলাইয়ের মতো মাইর খাইয়া আসতি।

তায়াংঃ কে আমাকে মারবে? কারো সাহস আছে।(ভাব নিয়ে)

আমিঃ হইছে, তোর ডায়লগ তোর কাছেই রাখ।

তায়াংঃ ধূর, এতো সাজ-গোজ করে কি লাভ হইলো?কি একটা হিরোর মতো লুক নিছালাম।কিন্তু ঐ খানেও কোন মেয়ে পেলাম না। এখানেও কোন মেয়ে দেখি না।শুধু শুধু সময় নষ্ট।

আমিঃ আহারে 🤣।

তায়াংঃ খুদায় ইঁদুরে পেটের ভেতরে ড্রাম পিটাইতাছে।কিন্তু এই রেস্টুরেন্টের ওয়াটারগুলি কি সব মরছে?কখন অর্ডার দিছি এখনো আসে না।

আমিঃ ওয়েটার তো বললো একটু দেরী হবে।তখন তো খুব বললি অপেক্ষা করতে পারবি। কিন্তু এখন কান্না করিস কেন?

তায়াংঃ তুই জীবনে আমার পক্ষে কথা বললি না।এখন চুপ থাক, আর কথা কইস না।

আমি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।তায়াং ভাইয়া আর আমি প্রায় ৭ বছরের ছোট-বড়। কিন্তু তার আমার বন্ডিং দেখে যে কেউ ভাববে আমরা পিঠাপিঠি ভাই-বোন। সম্পর্কে তায়াং ভাইয়া আমার আপন খালাতো ভাই। কিন্তু ওর আচার-ব্যবহার, কাজে যে কারো মনে হবে আমার আপন ভাই। ও আমার সাথে সবসময় লেগে থাকবে।কিন্তু আমি কোন বিপদে পরলে পাগল হয়ে যাবে।তায়াং ভাইয়া আর এনাজ জানে জিগার দোস্ত। কেউ কাউকে ছাড়া কখনো কোন কাজ করতো না। সবকিছুতে দুজনের দুজনকে লাগলো।কিন্তু এনাজের মৃত্যুর পর তায়াং ভাইয়া অনেক বদলে গেছে। কিন্তু আমাকে বুঝতে দেয়নি।বরং নিজের মনকে শক্ত করে আমাকে সামলিয়েছে।

তায়াংঃ আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। আমি যদি তোকে এনাজের সাথে বিয়েতে তোকে জোর না করতাম।তাহলে আজ তোকে এই দিন দেখতে হতো না।

আমিঃ কি উল্টো পাল্টা বকছিস? তুই জোর কবে করলি? আমাদের এরেঞ্জ ম্যারেজ।আমার ভাগ্যটা আল্লাহ এভাবে সাজিয়েছে। তুই নিজেকে অপরাধী ভাবিস না ভাইয়া।বরং অপরাধ আমার।আমি যদি সেদিন জেদ না করতাম।তাহলে সবকিছু হারাতাম না।

তায়াং ভাইয়া কোন কথা বললো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো।আমিও বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলাম।সকালে আলাকান্দি গ্রাম থেকে রওনা দিয়ে তিন ঘন্টা জার্নি করে অবশেষে ঢাকা এসে পৌঁছিয়েছি।আধা ঘন্টা ধরে রেস্টুরেন্টে বসে আছি। মাঝে তায়াং স্টল থেকে নাভানের জন্য একগাদা খাবার কিনে এনেছে। গতরাতের অভিজ্ঞতা আমি জীবনেও ভুলবো না।মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।আল্লাহ আমার জন্য চাচীর মন নরম করে দিয়েছিলো।তাইতো আমি সারা রাত নিশ্চিন্তে তাদের বাড়িতে কাটাতে পেরেছি।আসার সময় জড়িয়ে ধরে বলেছিলো সাবধানে থাকতে।তার ব্যবহারে আমার শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। আজ বাসায় যাবো না। তায়াং ভাইয়া বলছে কোথায় জানি নিয়ে যাবে।আজ বাসায় গেলে যারা আমায় আটকে রেখেছিলো তারা আবার আসতে পারে।এমনটা ধারণা তায়াং ভাইয়ার।ওর কথার ওপর আমি কোন কথা বলি না।কারণ এই একটা মানুষ আমাকে নিস্বার্থভাবে সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। ওর ঋণ আমি সারাজীবন ওর গোলাম হয়ে থাকলেও শোধ হবে না। সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে আমাকে ও আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওর কথা অমান্য করলে যে আমি নিজেই বৈঈমান হয়ে যাই।

🦋🦋🦋

আকাশটা আজ শুভ্র মেঘে সেজেছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই থোকা থোকা সাদা মেঘের ভেলা।আজ যে আকাশের দিকে তাকাবে সেই প্রেমে পরে যাবে।মন মাতানো এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে বহু আগে।চারিদিকে মিষ্টি রোদের আলো।চারিদিকের পরিবেশরা যদিও স্তব্ধ হয়ে আছে। তবুও খারাপ লাগছে না।

নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে দোতলা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি।সামনে ছোট একটা বাগান।গেইটের সাথে দেয়ালে নেমপ্লেটে লেখা আছে এক অদ্ভুত নাম “ঠিকানাবিহীন”।নামটা দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যাবে।এরকম নাম কেন? বাড়ির মালিক মুরাদ হোসেন শখের বশে নামটা রেখেছেন।

বারান্দায় বেতের চেয়ারে আরাম করে বসে পত্রিকা পড়ছেন মুরাদ সাহেব। আজ দুপুরের দিকে অফিস থেকে ফিরেছেন।বড় ছেলে ব্যবসা সামলানোর দরুন তার অবসর মিলেছে। তারপরও মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলো তাকে সামলাতে হয়।নিয়ম করে প্রতিদিন অফিসে যান তিনি।দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার।ছোট একটা বিজনেস চালান।হাতে ছোট ট্রে-তে দুই কাপ চা নিয়ে প্রবেশ করলেন জুলেখা বেগম। তার স্বামী পত্রিকা পড়তে পড়তে চা খেতে ভীষণ পছন্দ করেন।পত্রিকা হাতে নিলে তার চা লাগবেই। তাই জুলেখা বেগম আজ জলদী করে নিয়ে আসেছেন।নয়তো কখন চেচিয়ে বাসা এক করে ফেলে কে জানে?

মুরাদঃ জুলেখা, আমার……

চা বলে চিৎকার করার আগেই জুলেখা বেগম তার স্বামীর দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিলেন।

মুরাদঃ আজ কোন দিক দিয়ে সূর্য উঠলো? চা বলে চেঁচানোর আগে চা এসে হাজির।অন্যদিন তো সারা বাড়ি এক করে ফেললেও তোমার খবর থাকে না।

জুলেখাঃ ছেলে-মেয়ে তিনটার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এখনো কি আমার নাম ধরে ডাকবে? ওদের বিয়ের পর যখন নাতিনাতকুর আসবে তখন তো ওরাও তোনার মতো নাম ধরেই ডাকবে।

মুরাদঃ ডাকলে ডাকুক, সমস্যা কি? নাতিনের ঘরের ছেলে মেয়ে হয়ে গেলেও তোমাকে আমি নাম ধরেই ডাকবো।এই নাম ধরে ডাকার মধ্যে আমি যেই প্রশান্তি পাই তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না জুলেখা। আমার ভীষণ ভালো লাগে তোমাকে নাম ধরে ডাকতে।মনে হয় সেই আঠারো বছরের কিশোরী মেয়েটা।যাকে আমি বউ করে ঘরে তুলেছিলাম।

জুলেখাঃ হইছে আর বলতে হইবো না।খালি পাম মারেন। নেন কাপ ধরেন।চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

জুলেখা বেগম লজ্জায় আঁচলে মুখ ঢাকলেন।মাঝে মাঝে তার স্বামীর যে কি হয় তা তিনিও বুঝে উঠতে পারেন না।তবে এতটুকু বুঝতে পারেন তার স্বামীর মন ভালো।যেদিন মন ভালো থাকে সেদিন স্বামীর সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা খোশগল্পে মেতে থাকেন।আঠারো বছর বয়সে এই মানুষটার বউ হয়ে এসেছিলেন।আর এখন ৫০ এর উর্ধ্বে বয়স।কিন্তু তাদের ভালোবাসা যেন ছিটেফোঁটাও কমেনি।হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ পেয়ে মুরাদ সাহেব ও জুলেখা বেগম দুজনেই গ্রিল দিয়ে নিচের দিকে তাকালেন।

জুলেখাঃ এখন আবার কে এলো?

মুরাদঃ তোমার গুণধর ছোট ছেলে ছাড়া আর কে হবে? যেদিন থেকে ওর বড় ভাই অফিসে জয়েন করলো সেদিন থেকে ছোট জন যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। ওকেও তো বুঝতে হবে। ছেলেটা কি একা সব সামলাতে পারে। বছর তো এখনো হলো না,ছেলেটা কত বড় এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে ফিরলো।কোথায় সেই বড় ভাইকে হেল্প করবে।তা না করে সুযোগ পেলেই ফাঁকিবাজি।

জুলেখাঃ আহ কি শুরু করলেন? থামেন তো।আমি নিচে গিয়ে দেখছি কে আসলো?

মুরাদঃ মেয়ে কোথায়?

জুলেখাঃ ঘরে ঘুমুচ্ছে।

মুরাদঃ নামাজ পরতে ডাকোনি? আছরের আজান দিয়েছে সেই কোন বেলা? ঘুম থেকে উঠিয়ে নামাজ পরতে বলো।যদি ছোট ছেলে আসে তাহলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও।ওর সাথে আমার কথা আছে।

জুলেখাঃ আচ্ছা।

জুলেখা বেগম তার চায়ের কাপটা নিয়ে স্বামীকে পাশ কাটিয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেলো। বাড়িতে ঢুকেই গাড়িটা গ্যারেজে রেখে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো একটা ২৬ বছরের ছেলে।নাম আরিয়ান আজওয়্যার। মুরাদ সাহেবের ছোট ছেলে।আরিয়ান হাতে গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে শিস বাজিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো।তখনি পেছন থেকে তার মায়ের ডাক শুনলো।

জুলেখাঃ আরিয়ান!!!

আরিয়ান থেমে গেল।হাসি মুখে মায়ের দিকে ঘুরলো।

আরিয়ানঃ কিছু বলবে আম্মু?

জুলেখাঃ আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলি যে? আর তোর বড় ভাই কোথায়? ও কি আসেনি?

আরিয়ান মাথা চুলকিয়ে আপরাধীর ভঙ্গিতে মুখটাকে অসহায় করে বললো।

আরিয়ানঃ আসলে আম্মু হয়েছে কি? আসলে না, মানে বলছিলাম কি?

জুলেখাঃ আসলে, না মানে, হয়েছে কি এসব না বলে বল তোর ভাই কোথায়? আর তুই এই সময় বাড়িতে কেন?

আরিয়ানঃ ভাই তো অফিসে। আমার ভালো লাগছিলো না তাই আমি চলে এসেছি।

চোখ বন্ধ করে একদমে কথাটা বলে হাফ ছারলো আরিয়ান।কিন্তু পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো তার মা এখনো তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। যার মানে হলো, “তোকে দেখে দিব্যি সুস্থ মনে হচ্ছে। কিন্তু তুই কেন বললি তোর ভালো লাগছিলো না। ” আরিয়ান দাঁতগুলো সব বের করে বেআক্কল মার্কা এক হাসি দিয়ে তার মাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করলো।একসময় সফলও হলো।জুলেখা বেগম ছেলের কান্ডে ফিক করে হেসে উঠলেন।এমনি তিনি তার তিন সন্তানের এক সন্তানের সাথেও বেশি সময় রাগ করে থাকতে পারেন না।মাঝে মাঝে কঠিন খোলস ধারণ করলেও তার ছেলে-মেয়ে তা নানাকিছু করে ভেঙে ফেলে। যেমন এখন আরিয়ান করলো।

জুলেখাঃ উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।তোর বাবা ডেকেছে। ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছে যাবি।আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। বাবার কথা শুনে এসে খেয়ে নিবি।

আরিয়ান সিঁড়ি থেকে নেমে জুলেখা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন।

আরিয়ানঃ আমার লক্ষ্মী আম্মু।এই জন্যই তো তোমাকে আমি এতো ভালোবাসি।

জুলেখাঃ আমাকে পটিয়ে লাভ নেই। আমি তোর বাবার কাছে কিছু বলতে পারবো না। আমি তো ছেড়ে দিয়েছি।কিন্তু তোর বাবা আজ নির্ঘাত বকা দেবে।ছেলেটা কে কেন একা একা এভাবে ছেড়ে আসিস বল তো।ও তো একটা মানুষ। তাছাড়া কত বড় একটা এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে ফিরেছে তাতো তুই নিজের চোখেই সব দেখেছিস।তাহলে এরকম কেন করিস?

আরিয়ানঃ আমি তো ভাইকে বলেই আসলাম।ভাই চলে আসার অনুমতি দিয়েছে বলেই তো আমি এসেছি। নইলে কি আসতাম নাকি।

জুলেখাঃ ও তো বলবেই। তোরও তো বিষয়টা বুঝতে হবে।

আরিয়ান তার কথা বলেগাল ফুলিয়ে রাখলো।জুলেখা বেগম গাল দুটো টেনে দিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেলেন।

জুলেখাঃ এত বড় হয়েছিস তাও বাচ্চাদের মতো নাক কুঁচকানো, গাল ফুলানো কমাস নি।

আরিয়ানঃ আমি কমাবোও না।আমি তো সারাজীবন তোমাদের কাছে ছোট থাকবো।তাই আমি এই বাচ্চামোগুলো করবো।

জুলেখাঃ হুম আমার ২৬ বছরের বাচ্চা। যা ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।

আরিয়ান আবারো তার মায়ের দুই গালে টাইট করে চুমু খেয়ে উপরে উঠে গেলো।জুলেখা বেগম মুচকি হেসে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন।

জুলেখাঃ পাগল ছেলে।

জুলেখা বেগম কিচেনে চলে গেলেন। আরিয়ান ফ্রেশ হয়ে একটা টাউজার ও টি-শার্ট পরে নিলো।তারপর পা বাড়ালো বাবার রুমের দিকে। আজ যে সে তার বাবার কাছে আচ্ছা করে বকা খাবে তার কোনো সন্দেহ নেই।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০২

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_02
#Writer_NOVA

প্লেট হাতে নিয়ে গপগপিয়ে খেতে লাগলাম। খুব খিদে পেয়েছে। কয়েক লােকমা ভাত মুখে দিতেই বাইরে মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলাম।আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে।যেই মুহুর্তে চাচী জিজ্ঞেস করলো কে তখুনি বাইরের থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠের মানুষ বললো “আমি”।

আলেয়াঃ কেডায় নয়নের আব্বায়?

—- হো, দরজা খোলো।

আমি ভয়ার্ত চোখে চাচীর দিকে তাকালাম।চাচী আমাকে আশ্বস্ত হওয়ার চোখে বললো।

আলেয়াঃ ভয় পাইয়ো না।আমগো নয়নের আব্বায় আইছে।নয়ন হইলো আমার পোলার নাম।বিদেশে থাহে।আমি দরজা খুইলা দেই।

নাভানকে খাটে বসিয়ে দিয়ে তিনি দরজা খুলতে গেলেন।নাভান বসা থেকে উঠে আমার কোলে এসে ঘাপটি মেরে রইলো।আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে তাকালাম।ততক্ষণে ও আমার লেহেঙ্গার স্টোন নিয়ে খেলা শুরু করেছে।

আলেয়াঃ কহন থিকা জিগাইতাছি কেডা, কথা কোন না কে? কথা কইলেই তো বুঝতাম আপনে আইছেন।যান গিয়য় কলপাড় থিকা হাত-পা ধুইয়া আহেন।আমি ভাত বাড়তাছি।

রমিজ সাহেব কোন কথা বললেন না।চুপচাপ ঘরে ঢুকলেন।সামনে চোখ পরতেই কপাল ভাঁজ করে ফেললেন।নোভা আর নাভানকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আলেয়া বেগমের দিকে তাকালো।

আলেয়াঃ মাইয়াডা বিপদে পরছে।তাই আইজকের রাতডা আমগো বাড়িতে থাকবো।রাত হইয়া গেছে, কই থাকবো, কই যাইবো।আমিও ভাবলাম একলা একটা মাইয়া এত রাতে বাচ্চাডা নিয়া কই যাইবো।ঢাকার মাইয়া,এদিকের কিছু চিনে না।

আমি ভাতের প্লেটে হাত দিয়ে বসে আছি। ভীষণ লজ্জা করছে।আল্লাহ মালুম চাচা কি ভাবছে? আমি লজ্জায় তাদের দিকে তাকাতেও পারছি না।কিন্তু চাচা কিছু বললো না।ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।সম্ভবত কলপাড়ে হাত-পা ধুতে গেছে।

আলেয়াঃ আহো দাদুভাই, আমার কাছে আহো।মা- রে ভাত দুগা খাইতে দেও।

নাভান তার কোলে চলে গেল। আমি লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে ভাতের প্লেটে আঁকিবুঁকি করতে লাগলাম।চাচী বোধহয় আমার বিষয়টা ধরতে পারলেন।তাই গলা উঁচিয়ে বললেন।

আলেয়াঃ আরে মাইয়া লজ্জা পাইয়ো না। তোমার চাচা এহন ঘরে আইবো না।সিগারেট ধরাইয়া উঠানে বইছে।তুমি লজ্জা না পাইয়া খাও।

আমি লজ্জাকে সাইডে ফেলে খেতে লাগলাম।প্রচুর খিদে পেয়েছে। খাওয়া শেষ করে বাইরে গিয়ে হাত ধুয়ে আসলাম।চাচী গামছা এগিয়ে দিয়ে বললেন।

আলেয়াঃ এই ভারী জামায় কতক্ষণ থাকবা? আমি একটা শাড়ি দেই।পাল্ডায় ফালাও।এমনি যেই গরম তার মধ্যে এই জামায় তো অস্থির হইয়া যাইবা।

আমিঃ আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো তার ভাষা আমার জানা নেই। আপনি আমার সবদিকে খেয়াল রাখছেন।আমি যদি কখনো সুযোগ পাই তাহলে আমি এই ঋণের কিছুটা হলেও শোধ করার চেষ্টা করবো।

চাচী মুচকি হেসে ঘরের কোণা থাকা স্টিলের আলমারি খুলে একটা লাল তাঁতের শাড়ি, ব্লাউজ,পেটিকোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।

আমিঃ চাচী লাল রঙের শাড়ি ছাড়া অন্য কোন শাড়ি নেই। এটা তো পুরো নতুন। আমাকে পুরাতন একটা শাড়ি দিন।নতুন শাড়িতে তো বেশি গরম লাগে।তাছাড়া লাল রঙ আমার জন্য অভিশাপ।সাদা রঙের কোন শাড়ি হবে?

সাদা শাড়ির কথা শুনে চাচী কিছুটা চমকে আমার দিকে তাকালো।তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মাথা নামিয়ে নিচুস্বরে বললাম।

আমিঃ আমি বিধবা চাচী🙂।

আলেয়াঃ এই বাচ্চার বাবা বাঁইচা নাই?(বিস্ময় চোখে)

আমিঃ না, ও ছয় মাসের পেটে থাকতে মারা গেছে।

আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে দুই ফোঁটা পানি গরিয়ে পরলো।বুক ফেটে চিৎকার আসছে।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমার স্বামী মারা যায়নি।ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার কাছ থেকে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ও বেঁচে আছে। হ্যাঁ, আমার অস্তিত্বে ও বেঁচে আছে। নাভানের মাঝে ও বেঁচে আছে।

আলেয়াঃ কান্দিস না মা, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ।এত কম বয়সে বিধবা হয়ছিস।দেহিস আল্লাহ ঠিক তোর মুখের দিকে চাইবো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উনি লাল শাড়িটা নিয়ে আবার আলমারির কাছে গেল।সেখানে থেকে অনেক খুঁজে একটা অব হোয়াইট কাপড় নিয়ে এলো।

আলেয়াঃ এইডা ছাড়া আর কোন সাদার মধ্যে শাড়ি নাই।আমি তো এইসব কাপড় পরি।কিন্তু এইডা একটু পুরান।এর লগে ব্লাউজ, পেটিকোট আছে।তুমি ঐ ঘরে গিয়া দরজা লাগাইয়া পইরা আহো।তারপর তোমগো মা-বেটারে এই পাশে বিছনা কইরা দিমু নে।অপরপাশে আমরা থাকমুনে।কোন অসুবিধা হইবো না তো।

আমিঃ এক রাতের ব্যাপারই তো।কোন সমস্যা নেই।

ঘরের মাঝখানটায় টিনের পাটিশন দেওয়া।যার কারণে দুটো রুমের মতো হয়ে গেছে। আমি অপরপাশের চৌকাঠে গিয়ে আবার ফিরে এলাম।

আলেয়াঃ আর কিছু লাগবো?

আমিঃ চাচী, আপনাদের মোবাইল আছে? আমার মোবাইল বাসায়। খালাতো ভাইকে কল করে বলতাম, সকালে যাতে আমাকে এসে নিয়ে যায়।

আলেয়াঃ আমার তো নাই।তবে তোমার চাচার আছে। আমি নিয়া আইতাছি।

উনি বাইরে গিয়ে চাচার থেকে মোবাইল নিয়ে এলো।আমি আমার খালাতো ভাইকে কল করে জায়গার নাম,ঠিকানা,চাচার বাড়ির সন্ধান দিয়ে দিলাম।তারপর লেহেঙ্গা পাল্টে কাপড়টা পরে এলাম।আমাদের জন্য বিছানা করে দিয়ে অন্য পাশে চাচাকে ভাত বেড়ে দিলো।আমি মশারীর ভেতরে ঢুকে ছেলেকে নিয়ে শুয়ে পরলাম।নাভানকে ব্রেস্ট ফিডিং করিয়ে এক হাতে পিঠে আলতো চাপড় মেরে ঘুম পারানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।নাভান কিছু সময় পর ঘুমিয়ে পরলো।একসময় আমার চোখও লেগে এলো।তলিয়ে গেলাম অতল ঘুমের রাজ্যে।

🦋🦋🦋

নিজস্ব ডেরায় অগ্নিচোখে তার লোকের দিকে তাকিয়ে আছে রোশান।এই মুহুর্তে প্রত্যেকটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু রোশান ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে পছন্দ করে।তমাল,নাঈম,আরাফাত আরো অনেকে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।রোশানের এই শান্ত ভঙ্গি দেখে ওদের ভয়টা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।

রোশান দেওয়ান একজন নামকরা পলিটিশিয়ান।তাদের নিজস্ব জেলার ১ আসনের এমপি সে।পলিটিক্স আর রাগ দেওয়ান বংশের রক্তে মিশে আছে। দেওয়ান বংশের নাম শুনলেই তাদের এলাকার মানুষ ভয়ে কাঁপে।কারণ এই বংশের ছেলেরা দিনে দুপুরেও মানুষকে রাম দা নিয়ে কুপিয়ে মারতে পারে।মারামারি, খুনাখুনি এদের জন্য সামান্য হাতের ময়লা।কথার আগে হাত চলবে।এই দেওয়ান বংশকে ডাকাত বংশ বললেও কম হয়ে যাবে। পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালায় এরা।সেই বংশের মেজো ছেলে রোশান।কিন্তু রোশান হুটহাট করে রেগে যাওয়ার ছেলে নয়।তবে মাঝে মাঝে নিজেকে সামলাতে পারে না।

রোশানের এই শান্ত ভঙ্গিতে বসে থাকায় তমাল ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে। তমাল,নাঈম,আরাফাত একজন আরেকজনকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে ইশারায় রোশানের সাথে কথা বলতে বলছে।কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। এক সময় তমাল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো।

তমালঃ বস, আমরা আসলে বুঝতে পারি নি।এবারের মতো আমাদের মাফ করে দিন।

নাঈমঃ এবারি লাস্ট, আর হবে না। আমরা আবার ঐ মেয়েকে বাচ্চাসহ তুলে আনবো।

আরাফাতঃ বস শেষ সুযোগটা দেন।এই কানে ধরছি।এবার মিস্টেক হলে আপনার যা খুশি করেন।ঐ মেয়ে এই সপ্তাহের মধ্যে আপনার কাছে থাকবে।

রোশান এতক্ষণ হাত মুঠ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিলো।এবার যেনো তমলরা সেই রাগে ঘি ঢাললো।সামনে থাকা কাঠের চেয়ারটা নিয়ে দেয়ালে জোরে বারি দিতেই সেটা ভেঙে এদিক সেদিক ছিটকে পরলো।সবাই চমকে উঠলো।

রোশানঃ ঐ মেয়ে, ঐ মেয়ে কি হ্যাঁ? ভাবী বলতে কি কষ্ট লাগে? আমার পাখিকে এভাবে সম্বোধন করার সাহস তোদের কে দিয়েছে?

তমালঃ সসসসরররি ববববস।

রোশানঃ তোর সরির মায়রে বাপ।তুই সরি বললে কি এখন আমার নোভা আমার কাছে ফিরে আসবে? রাত ১২ টা বেজে ৪৭ মিনিট। এর মধ্যে তোরা আমার পাখিকে খুজে আনতে পারলি না।তোরা না বলেছিস নোভা এই গ্রামে আছে। তাহলে সারা গ্রাম চিরে ফেলেও কেন নোভা আর নাভানকে পেলাম না আমি।আর একটু সময়ের মধ্যে নোভার সাথে আমার বিয়েটা হয়ে যেতো।আর সারাজীবনের জন্য আমি পাখিকে খাঁচায় পুরতে পারতাম।কিন্তু তখন পার্টি থেকে কল আসায় আমাকে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হলো।এই এমপি হয়ে হয়েছে আরেক জ্বালা।বিয়ের সময়ও বিয়ে ফেলে পার্টির কাজ করতে হয়।আর তোদের মতো গাধার হাতে আমি আমার পাখি ও পাখির বাচ্চা দেখে রাখতে গিয়েছিলাম।আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো এই বেকুবগুলো ওদের দেখে রাখতে পারবে না। তাইতো পাখি তার বাচ্চা নিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালিয়েছে।

কথাগুলো বলে রোশান নিজের চুলগুলো জোরে খামচি দিয়ে ধরে হাঁটু মুরে বসে পরলো।ওর মাথা কাজ করছে না।এতদিনের কষ্ট যেই সফল হতে যাবে তখুনি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো।সারা গ্রাম খুঁজলেও গ্রামের শেষ প্রান্তে থাকা রমিজ সাহেবের বাড়ি রোশানের লোক যায়নি।নয়তো নোভাকে পেতে এক মিনিটও লাগতো না।আসলে ঐ বাড়িটা গাছ-গাছালিতে ঘেরা বলে বাড়িটা দূর থেকে দেখা যায় না। মনে হয় জঙ্গলের মতো।তাই সেদিকে পা বাড়ায়নি কেউ।

রোশান নিজেকে কিছুটা শান্ত করে অপরপাশের চেয়ারে বসে পরলো।ভেঙে পরলে চলবে না। তাকে আবার ঠান্ডা মাথায় সবকিছু সাজাতে হবে। নোভাকে যে তার চাই।বিরবির করে বলে উঠলো।

রোশানঃ কতদিন পালিয়ে বেড়াবে পাখি?তোমায় তো এই রোশানের খাঁচায় বন্দি হতেই হবে।তোমার স্বামী নেই তো কি হয়েছে? আমি তো আছি।যা আমার তা আমি জোর করে হলেও আদায় করে নেই। তাহলে তোমাকে কি করে ছেড়ে দেই।আমার যদি তোমার বাচ্চাসহ তোমাকে মেনে নিতে অসুবিধা না হয় তাহলে তোমার এতো অসুবিধা কেন? কত আদর-যত্ন করে বলেছিলাম, তোমার ছেলেকে আমার পরিচয়ে বড় করবো,কিন্তু তুমি মানলেই না।তোমার স্বামীর শেষ চিহ্ন নাকি তোমার ছেলে,তাকে তার পরিচয়ে বড় করবে।আমিও দেখবো তুমি সেটা কিভাবে করো?এবার এমন গুটি চালবো নিজে এসে আমার পায়ে লুটিয়ে পরে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে।

বিরবির করে নিজের মনের সাথে কথা বলে শয়তানি হাসি দিলো রোশান।এত সহজে হার ছাড়ার ছেলে রোশান নয়।যদি হতো তাহলে তো এমপি পদে পাস করতো না।তমাল, নাঈম,আরাফাত একে অপরের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে রোশানের মনে আসলে কি চলছে।

🦋🦋🦋

সূর্যি মামা তার লাল কুসুমের আভা নিয়ে পূর্ব দিগন্তে উঁকি মারছে।চারিদিকে পুরো ফাঁকা। রাস্তাঘাটে কোন মানুষ নেই। গ্রামের বাড়ির মানুষ যদিও তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে। তবুও আশেপাশে পুরো নির্জন।যতদূর চোখ যায় শুধু ফসলের মাঠ।প্রকৃতির এই রূপটা যেনো আল্লাহ নিজ হাতে সবুজ রঙে সাজিয়েছে।গাছের মধ্যে পাখি কিচিরমিচির করছে।শান্ত পরিবেশে হালকা হাওয়ায় দুলছে গাছের পাতা।

আলাকান্দি যাওয়ার তিন রাস্তার মোড়ে বাইকের ওপর সানগ্লাস পরিহিত এক যুবক বসে আছে।হাতে হেলমেট ধরা।বয়স ৩০ এর উর্ধ্বে।তবে তাকে দেখে এখনো ২৫ বছরের যুবক মনে হয়। পরনে তার ফুল ব্লাক।প্যান্ট, শার্ট, সানগ্লাস, বাইক,হেলমেট, হাতের ব্যাসলাইট সবকিছু ব্লাক।এক কানে একটা টপ আছে। সেটাও কালো। যে কেউ দেখে তাকে ব্লাক লাভার বলে খেতাব দিবে।ফর্সা শরীরে ব্লাক রংটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে।ছেলেটার নাম তানভীর রহমান।ডাকনাম তায়াং।

তায়াং আশেপাশে তাকিয়ে মানুষ খুজতে খুজতে পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের পেকেট-টা বের করলো।তারপর গ্যাস লাইট দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেটে টান দিলো।সিগারেটের প্যাকেটটা আবার পকেটে রেখে বাইকে আরাম করে বসলো।
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কাউকে পাওয়া যায় কিনা তাই দেখতে লাগলো।মিনিট দশ ধরে এই তিন রাস্তার মোড়ে বসে আছে। কিন্তু কোন মানুষের টিকিও দেখেনি।এবার সে বেশ বিরক্ত হয়ে গেলো।সামনে একটা ইটের রাস্তা আর বাকি দুটো মাটির কাঁচা রাস্তা। পাশেই বাঁকা হয়ে পরে আছে একটা সাইনবোর্ড। যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে “আলাকান্দি এই দিকে”।কিন্তু বাঁকা হয়ে পরে থাকায় তায়াং বুঝতে পারছে না আসলে কোনদিকে।এক সময় ওর বিরক্তির অবসান হলো।এক মধ্য বয়স্ক লোককে ঘাসের বোঝা নিয়ে এদিকেই আসতে দেখলো তায়াং।চট করে বাইক থেকে নেমে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

তায়াংঃ চাচা,আলাকান্দি যাওয়ার রাস্তাটা কোন দিকে?

লোকটা ঘাসের কারণে ভালো মতো চোখেও দেখছে না।চোখের সামনের থেকে কিছু ঘাস সরিয়ে তায়াংকে জিজ্ঞেস করলো।

—– কার বাইতে(বাড়িতে) যাইবেন?

তায়াংঃ রমিজ ব্যাপারীর বাড়িতে।

—- আপনে কি হোন তার?

তায়াং-এর রাগ উঠলো।এখন কি এই লোককে তার কুন্ডলী বলতে হবে। আচ্ছা ঝামেলা তো।অন্য কেউ হলে রাগটা ঝেড়ে ফেলতো।কিন্তু অচেনা মানুষের সাথে রাগারাগি করা ঠিক হবে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বিষয়টা হজম করে নিলো।

—- কি কথা কন না কে?কি হোন তার?

তায়াংঃ আপনি কি বলবেন তার বাসাটা কোনদিকে? আমার একটু তাড়া আছে।জলদী যেতে হবে।

—- দেহেন, এত সকাল সকাল কারো বাড়ি যাইবেন। তা ভালা কথা।কিন্তু দেইখেন চোর -ডাকাত কইয়া কেউ জানি ধোলাই না দেয়।

কথাগুলো বলে হো হো করে হেসে উঠলো লোকটা।তায়াং-এর মনে হচ্ছে এই লোকের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে। নয়তো এমন পাগল-ছাগল কথা বলতো না।তায়াং বিরক্ত হয়ে চলে যাওয়ার জন্য পথ ধরলো।ফালতু লোকের সাথে কথা বলে ওর মেজাজ পুরো বিগড়ে গেছে। তিন ঘন্টা লাগিয়ে ঢাকা থেকে এখানে এসেছে। গতকাল রাতে নোভার চিন্তায় ঘুম আসেনি।অপেক্ষার প্রহর গুণেছে।কখন সকাল হবে আর কখন এখানে থেকে নোভাকে নিয়ে যাবে।রাতে রমিজ ব্যাপারীর মোবাইল দিয়ে কল করে আলাকান্দি গ্রামে এই তায়াংকেই আসতে বলেছে নোভা।তায়াং তো পারলে তখুনি চলে আসে।কিন্তু নোভা বারণ করায় আসেনি।ফজরের নামাজ পরে এক মিনিটও দেরী করেনি।অর্ধেক রাস্তায় যাওয়ার পর লোকটা তায়াং কে ডাকলো।

—– আরে খাড়ান (দাঁড়ান)।

তায়াংঃ কি বলবেন জলদী বলেন? আপনার ফালতু কথা শোনার কোন টাইম আমার নেই। আর আমি কাউকে কৈফিয়ত দিবো না। (কড়া গলায়)

—– আরে মিয়া চেতেন কে? আমি তো আপনেরে পরীক্ষা করতাছিলাম।এই উত্তরের কাঁচা রাস্তা দিয়া গেলেই শেষ প্রান্তে দুইডা ঘর দেখবেন।হেইডাই (সেটাই) রমিজ ভাইয়ের বাড়ি।

তায়াংঃ থ্যাংন্কস।

ছোট করে ধন্যবাদ জানিয়ে তায়াং বাইকে উঠে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলো।পেছন থেকে লোকটা চেচিয়ে বলে উঠলো।

—- সাবধানে যাইয়েন।রাস্তা বেশি ভালা না।গাড়ি উল্টাইয়া পরতে পারেন।

লোকটা সম্ভবত আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো।কিন্তু ততক্ষণে তায়াং বহুদূরে চলে এসেছে। অনেক কষ্ট করে একসময় কাঙ্খিত স্থানে পৌঁছে গেল।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-০১

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_01
#Writer_NOVA

এক মণ ওজনের বিয়ের লেহেঙ্গা এক হাতে ধরে, অন্য হাতে শক্ত করে নিজের ২ বছরের ছেলেটাকে কোলে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি।আমাকে থেমে গেলে হবে না।নিজেকে বাঁচাতে হবে,সাথে ওকেও রক্ষা করতে হবে।আমার কলিজার টুকরোর জন্য হলেও নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে। আশেপাশটা পুরো নির্জন। পেছনে একদল কালো পোশাক পরিহিত লোক আমাদের ধাওয়া করেছে।সামনে একটা বিশাল বড় মেহগনি গাছ দেখতে পেয়ে তার আড়ালে লুকিয়ে পরলাম।লোকগুলো ততক্ষণে আমাদের পিছনে চলে এসেছে। গাছের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো।আমি আমার ছেলেকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যতটা সম্ভব গাছের সাথে লেপ্টে আছি।

—- মেয়েটা গেলো কোথায়? এদিকেই তো আসতে দেখলাম।

একজন হুংকার ছেড়ে তার সাথের লোকদের কে উপরোক্ত কথাগুলো বললো।আমি থরথর করে কাঁপছি। এই বোধহয় ধরা পরে গেলাম।

—- রাস্তাতো একটাই।মেইন রোডের দিকে গেলে তো দেখাই যাইতো।যেহেতু তারে দেখা যায় নাই তার মানে মাইয়া এদিকেই পলাইছে।

—– চারিদিকে খুজতে থাক।মাইয়া এই আশেপাশেই আছে।যদি বাই চান্স, ঐ বাচ্চা আর বাচ্চার মা আমগো হাতের থিকা পালায় যায় তাহলে আমগো বড় স্যার ঘার থিকা মাথা আলাদা কইরা ফালাইবো।

—- স্যার রে কি বিষয়টা জানাইবেন?

—- আরে ধূর, পাগল হইয়া গেছত।আগে মাইয়াডারে খুইজা নেই। তারপর না পাইলে জানামু।

—- ঐ রফিক,অারাফাত, তমাল কথা কম কো।মাইয়াডারে খোঁজ। নয়তো নিজের জীবন হারাবি।একদম জ্যন্ত কবর দিবো।

—- জলদী খোঁজ। কহন থিকা বকর বকর লাগাইছোত।প্রত্যেকটা গাছের পেছনে দেখ।

আমি জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছি।শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে।ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বুকফাটা চিৎকার আসছে।লোকগুলোকে অন্য দিকে সরে যেতে দেখে আমি হাফ ছারলাম।হঠাৎ আমার মনে হলো আমার ছেলে কোন রেসপন্স করছে না।আমি ওকে বেশ কয়েকবার গালে আলতো করে চড় মেরে ডাকলাম।

আমিঃ নাভান, নাভান। বাবা কি হয়েছে তোর?তুই কথা বলছিস না কেন? এই নাভান, নাভান। বাবা,চোখ খুলো।আম্মু ডাকছে তো তোমায়।তুমি না আমার গুড বয়।তুমি চোখ খুলবে না বলো।

চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমার ছেলে কোন রেসপন্স নেই। আমি আশেপাশে তাকিয়ে ওকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চোখ দিয়ে অলরেডি আমার টপটপ করে পানি পরছে। বর্তমানে ছেলেটা ছাড়া আমার জীবনে কেউ নেই। ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। তারপরও উঠে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকে দৌড় দিলাম।শুকনো পাতায় মড়মড় শব্দ হতেই লোকগুলো চেচিয়ে বলে উঠলো।

—- জলদী খোঁজ, মেয়ে এখানেই আছে।

–ঐদিক থেকে পাতার শব্দ আসছে।তার মানে মেয়েটা দক্ষিণ দিকেই আছে।জলদী চল।

দৌড়ে দক্ষিণ দিকে গিয়েও লাভ হলো না তাদের। কারণ তার আগেই নোভা অন্য দিকে ওদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে ।তমাল এবার রাগী চোখই আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললো।

তমালঃ তুই সিউর আরাফাত,মেয়েটা এদিক এসেছে।

আরাফাতঃ আমি মেয়েটাকে এদিকেই দৌড়ে আসতে দেখেছি।

রফিকঃ সিট, মেয়েটা পালিয়ে গেলো।

তমালঃ পালিয়ে যাবে কোথায়? পুরাটা এলাকা তন্নতন্ন করে চিড়ে ফেল।মেয়েটাকে আমাদের চাই।নয়তো লাখ টাকার চাকরীটা তো যাবেই, সাথে প্রাণপ্রিয় জীবন।

নাঈমঃ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল মিটিং না করে স্যারকে একটা কল করে সব বল।যদি অন্য কারো থেকে স্যার এসব জানতে পারে তাহলে আমরা শেষ।

নাঈমের কথা শেষ হতে না হতেই তমাল তাদের বস রোশানকে কল করলো।দুই বার রিং হতেই অপরপাশ থেকে রোশান খুব বিরক্ত সহকারে কলটা রিসিভ করলো।

রোশানঃ ড্যাম ইট।তোমাদের কি কান দিয়ে কথা ঢুকে না।আমি কতবার বলছি বিজি থাকলে কল করবে না।একটা কথাও কি তোমরা মনে রাখো না?

তমালঃ স্যার, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। তাই আপনাকে কল করছি।অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে।

রোশানঃ যদি নোভা তোমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ডেরা থেকে পালায়,তাহলে একটাকেও আস্ত রাখবো না আমি।আই উইল কিল এভরিওয়ান।(রেগে)

তমালঃ স্যার, মেয়েটা সত্যি পালিয়েছে।বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে পালিয়েছে। ওকে আমরা প্রায় একটুর জন্য ধরতে পারিনি।ও এখন এলাকার মধ্যেই আছে।আপনি টেনশন করেন না।আমরা ঠিক খুঁজে নিবো।

রোশানঃ তোমাদের কি আমি এর জন্য টাকা দিয়ে পুষছি? ইচ্ছে করছে মুখ খারাপ করে গালি-গালাজ করি।কিন্তু আমি এখন পাবলিক প্লেসে আছি বলে বেঁচে গেলে।নয়তো খাস বাংলা ছারতাম।এতগুলো লোকের চোখে ধুলো দিয়ে আমার পাখি পালালো আর তোমরা এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষছো? এতবড় ঘটনা ঘটেছে আমি টেনশন করবো না? আমি এক্ষুণি আসছি। একটাকেও জীবিত রাখবো না। জানে মেরে ফেলবো।আমার এতদিনের আশা-ভরসায় পানি ঢেলে দিয়েছো তোমরা।আর কিছু সময়ের মধ্যে নোভা আমার হতো।কিন্তু তোদের কারণে হলো না। এই দিনটার জন্য আমি কবের থেকে অপেক্ষা করছি।কিন্তু সব শেষ করে দিলি তোরা? একটাকেও ছারবো না আমি,একটাকেও না।আসছি আমি।

সামনে থাকা কাচের টেবিলটাকে লাথি মেরে রুম থেকে বের হয়ে গেলো রোশান।সেখানে থাকা উপস্থিত সব লোক হা করে রোশানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। অন্যদিকে তমালদের ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।রোশান আজ ওদের জ্যন্ত ছারবে তো?

🦋🦋🦋

নাভান এখনো কোন সাড়াশব্দ করছে না।আমার বুকে হাতুড়ি পেটা করছে।বারবার আল্লাহর নাম নিচ্ছি। আমার ছেলেটার যেনো কিছু না হয়।ওর কিছু হলে আমার এই জীবনযুদ্ধ করে কোন লাভ নেই। একবার পেছনের দিকে তাকাচ্ছি আরেকবার ছেলের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। দৌড়াতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটার পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।ছেলেটার দিকে তাকালেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে।লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না।তবুও আরেকবার তাকাতে গিয়ে গাছের শেকড়ের সাথে বেজে ধপ করে পরে গেলাম।উল্টো হয়ে পরায় নাভান কোন ব্যাথা পায়নি।কিন্তু আমার কুনই ছিলে গেছে অনেকখানি।খুব কষ্টে নিজেকে তুলে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম।আর দৌড়াতে পারবো না।নরম ঘাস হওয়ায় হাঁটতে ওতটা কষ্ট হচ্ছে না।

আমিঃ নাভান বাবা,আরেকটু অপেক্ষা করো।তোমার আম্মু তোমার কিছু হতে দিবে না। বাবা চোখটা খোল না?কোথায় যাবো,কি করবো আমি কিছু জানি না। এদিকে বিকেল গড়িয়ে পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে আসছে। কোথায় গিয়ে একটু আশ্রয় নিবো।আল্লাহ তুমি আমার প্রতি এত পাষাণ হয়ো না।সবই তো তুমি নিয়ে গেলে।আমার ছেলেটাকে না হয় ভিক্ষে দিয়ে দাও।আমার জন্য একটা রাস্তা দেখাও।আমি আর পারছি না।

মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে নাভানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম।হঠাৎ কাঁধে কিছুর স্পর্শ পেয়ে অনেকটা চমকে উঠলাম।একটা প্রজাপতি আমার কাঁধ ছুঁয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু না ভেবে আমি প্রজাপতির পিছু নিলাম।একসময় সেটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।কিন্তু আমি সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম।দোচালা বিশিষ্ট দুটো টিনের ঘর।আল্লাহ কি তাহলে আমার কথা শুনেছে। আমাকে সাহায্য করার জন্য ঐ প্রজাপতিটাকে পাঠিয়েছে? কিছু না ভেবে টিনের গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম।

আমিঃ কেউ আছেন বাড়িতে? কেউ আছেন?থাকলে প্লিজ একটু বের হোন।আমি অনেক বড় বিপদে পরে এখানে এসেছি। আমায় একটু সাহায্য করবেন। আমার বাচ্চাটার জন্য একটু সাহায্য করুন।

ভাঙা ভাঙা গলায় ডাক দিতেই টর্চ লাইট নিয়ে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা বের হলো।তাকে দেখে আমার চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো।আমি দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমিঃ চাচী,চাচী আমি খুব বিপদে পরে আপনার বাড়িতে এসেছি। প্লিজ আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান।ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো।

আলেয়া বেগম সবে মাত্র মাগরিবের নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরেছিলেন।এর মধ্যে একটা মেয়ালি কণ্ঠ পেয়ে তিনি টর্চ হাতে বের হয়ে এলেন।সচারাচর এদিকে বিপদে না পরলে কেউ আসে না।বিকেলের আগে বিদ্যুৎ চলে গেছে এখনো আসার নাম নেই। টর্চ নিয়ে বের হতেই ভারী লেহেঙ্গা সাজে এক মেয়েকে দেখতে পেলেন সে।চোখ মুখে তার ভয় আর বিষন্নতায় ঘেরা।কোলে বছর দুয়েকের একটা বাচ্চাকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে তার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আলেয়াঃ কেডা তুমি?

মহিলার মুখে কথা শুনে আমি এগিয়ে এসে বললাম।

আমিঃ আমার নাম নোভা।এ আমার ছেলে নাভান।আজ অনেক বড় বিপদে পরে আপনার দ্বারে এসেছি চাচী।আমায় ফিরিয়ে দিয়েন না প্লিজ।

আলেয়াঃ ছি,ছি সে কি কথা। কালী সন্ধ্যা বেলা ছোট বাচ্চা পোলাপাইন নিয়া বাইরে দাঁড়ায় থাকতে হয় না।তইলে বদ জ্বীনেরা বাচ্চার ওপর কুনজর দেয়।ভেতরে আহো।

আমি উনার পেছনে পেছনে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম।উনি আমার দিকে একটা বেতের মোরা এগিয়ে দিলেন।

আলেয়াঃ নেও এইখানে বহো।

আমিঃ চাচী এক গ্লাস পানি দিবেন।বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

আলেয়াঃ তুমি বহো আমি নিয়া আইতাছি।

উনি পানি আনতে চলে গেল।আমি ততক্ষণে নাভানের জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করছি।চাচী আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।আমি প্রথমে পানি না খেয়ে নাভানের চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলাম।কিন্তু নাভান চোখ খুলছে না। আমার ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।আমি নাভান বলে একটা চিৎকার দিলাম।

আলেয়াঃ ভয় পাইস না মা।ওর কিছু হয় নাই।দে আমার কাছে দে।বাচ্চা মানুষ হয়তো ভয় পাইছে।নিশ্বাস তো নিতাছে।

চাচী আমার কাছ থেকে নাভানকে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলেন।আমিও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।আমার কাছ থেকে পানির গ্লাস নিয়ে একটু বেশি করে পানির ছিটা মারলেন।এবার পানির স্পর্শ পেতেই নাভান পিটপিট করে চোখ খুললো।আমি ওকে কোলে নিয়ে জাপটে ধরে কান্না করে দিলাম।তখন আধো আধো ভাঙা কণ্ঠে নাভান বললো।

নাভানঃ আআআমমু তুমি আমাকে এথান থেকে নিয়ে চলো।ঐ চাচ্চুগুলো অনেক পতা।তোমার কাছে আসতে দেয় না।

আমিঃ নিয়ে যাবো বাবা।আমি আর কখনো তোমায় একা ছেড়ে কোথাও যাবো না।

আলেয়াঃ দেখে তো ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হয়। তা ছেলে রেখে কি আরেকটা বিয়া বইতাছিলা নাকি?

আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে ভাঙা গলায় বললাম।

আমিঃ চাচী, আরেক গ্লাস পানি দিবেন।

উনি আমার কথায় জলদী করে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন।আমি তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাস পানি শেষ করে দিলাম।দুদিন থেকে পেটে কিছু না থাকায় ঠান্ডা পানি গলা বেয়ে পেটে পরতেই পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।

আমিঃ যদি কিছু মনে না করেন,আজকের রাতটা আমাদের মা-ছেলেকে থাকতে দিবেন আপনার বাসায়।আমি এই ঋণ সারাজীবন মনে রাখবো।

আলেয়াঃ তোমায় দেখে বাপু ভালোই মনে হইতাছে। আমি কাউরে এই অবেলায় বিশ্বাস করি না।কিন্তু তোমার এই সোনার টুকরা পোলারে দেইখা মনডা মোচড় দিছে।তাই তোমগো সাহায্য না কইরা পারলাম না।তোমরা খুশিমনে এইহানে থাকতে পারো।

আমিঃ কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দিবো,তা আমার জানা নেই চাচী।তবে এর ঋণ আমি সারাজীবন মনে রাখবো।

আলেয়াঃ তা এমন চান্দের লাহান পোলার এমন দোসা কে?তুমিই বা বউয়ের সাজে কে?তোমার জামাই কই?এর তোমারে তো এই এলাকার মাইয়া মনে হইতাছে না।বাড়ি কই তোমার?

আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ছেলেকে আরো জোরে বুকে জড়িয়ে ধরে তার দিকে মিথ্যা হাসি দিয়ে বললাম।

আমিঃ আমি ঢাকা থাকি।ভাগ্য দোষে আজ এখানে।সবই আমার কপাল চাচী।যাকে বলে পোড়া কপাল।আমি সত্যিই অলুক্ষ্মিনী। সবাই ঠিকই বলে।নয়তো বাচ্চাটা ছয় মাসের পেটে থাকতে সব হরাতাম না।আর এই দিনও দেখতে হতো না।

আমি জানি উনি আমার কথা কিছু বুঝেনি। বিস্ময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা ইতস্তত করেই অসহায় কন্ঠে বললাম।

আমিঃ চাচী এক মুঠ ভাত দিবেন?দুদিন ধরে আমার পেটে কিছু পরেনি।ছেলেটা এখনো বুকের দুধ ছাড়েনি।এখন কিছু না খেলে একফোঁটা দুধও পাবে না।

উনি ভাতের জোগাড় করতে চলে গেলেন।অচেনা একটা মেয়ের জন্য কতকিছু করছে।শহরের মানুষ হলে জীবনেও করতো না। কিন্তু গ্রামের সহজ সরল গৃহবধূ হওয়ায় উনি বিন্দুমাত্র বিরক্ত হননি।বেশ কিছু সময় পর আলুভর্তা, ডাল দিয়ে এক প্লেট ভর্তি ভাত নিয়ে আসলেন।পানির জগটা পাশে রেখে আমার দিকে প্লেটটা এগিয়ে দিলেন।আমি মগে পানি নিয়ে বাইরে থেকে হাত ধুয়ে এলাম। উনি আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে নানা কথা বলছে।আমার ছেলে অনেক মিশুক। সবার কোলে যায়।তাই কোন অসুবিধা হয়নি।প্লেট হাতে নিয়ে গপগপিয়ে খেতে লাগলাম। খুব খিদে পেয়েছে। কয়েক লােকমা ভাত মুখে দিতেই বাইরে মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলাম।আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে।যেই মুহুর্তে চাচী জিজ্ঞেস করলো কে তখুনি____________

#চলবে

আমার শহরে তুমি পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0

#গল্পের_নাম_আমার_শহরে_তুমি
#লেখনীতে_Alisha_Rahman_Fiza
পর্বঃ২৬ অন্তিম পর্ব
,,,,,,,
,,,,,,,
রাত আমাকে দেখে বললো,
~ভাই আর ভাবি এখানে আসো
রাতের ডাকে আমরা দুজনই তার সামনে যেয়ে দাড়ালাম রাত রক্তিম আর আমার হাত ধরে বললো,
~আমি অনেক অপরাধ করেছি আর বার বার তোমরা আমাকে ক্ষমা করেছে।তার জন্য আমি তোমাদের যতো ধন্যবাদ দিবো তা কম আমার জীবনটাকে খুব সুন্দর ভাবে তোমরা সাজিয়ে দিচ্ছো অথচ আমি নিজে হাতে আমার জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছিলাম।সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ আর আমাদের যে ছোট মেহমান আসছে তার জন্য অনেক গুলো ভালোবাসা।
রাতের কথা শেষ হতেই রক্তিম তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
~ভুল সবাই করে জীবনে তার মানে এটা নয় সেই ভুল ধরে নিজের জীবন নষ্ট করে ফেলা।ভুল করা ব্যক্তি যদি নিজেকে সুধরাতো চায় তাহলে তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
এতটুকু বলে রক্তিম রাতকে ছেড়ে দিলো আমি বললাম,
~নতুন জীবনের জন্য আপনাকে অনেক শুভকামনা রইলো।
আমরা সবাই বের হয়ে গেলাম সাবিহার বাড়ির উদ্দেশ্যে।কিছুক্ষন পর আমরা সাবিহাদের বাড়ি পৌছে দেখলাম তাদের পুরো বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো সাবিহার বাবা আমাদের সবাইকে স্বাগত জানালেন আমরা সবার সাথে কুশলাদি করে যার যার আসনে বসে পরলাম।আমি সাবিহার কাছে যাওয়ার জন্য সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলাম রুমে ডুকতেই দেখি রাহি সাবিহাকে রেডি করে দিচ্ছে।আমি তাদের দেখে মুচকি হেসে বললাম,
~কেমন আছো?
রাহি আর সাবিহা আমার দিকে তাকিয়ে দুজনই একসাথে বললো,
~ভালো।
রাহি বললো,
~খুশির খবর শুনলাম কিন্তু মিষ্টিতো পেলাম না।
আমি বললাম,
~পাবে তো।
সাবিহা বললো,
~চাচী হওয়ার মজাই আলাদা।
রাহি আর আমি তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম আমি বললাম,
~এই মেয়েটা কোনোদিন ভালো হবে না।বাচ্চা স্বভাবেরই থেকে যাবে
সাবিহা বললো,
~তোমার দেবরকে এই বাচ্চামেয়েটাকেই সামলাতে হবে।
আমি বললাম,
~তা তো একদম সত্যি কথা।

সাবিহা আর রাতের বিয়ের কার্যক্রম শুরু হলো পুরো পরিবার অনেক খুশি কাজী সাহেব রাতকে কবুল বলতে বললো রাত কবুল বলে দেয়।এরপর সাবিহাকে বলতে বললে সে একটু সময় নিয়ে কবুল বলে দিলো।
অতঃপর সাবিহা আর রাতের বিয়ে হয়ে গেলো আমি তাদের কাছে গিয়ে বললাম,
~সবসময় সুখে শান্তিতে থাকো।আর সাবিহা তাড়াতাড়ি আমাকে চাচী হওয়ার মজা দিয়ো।
সাবিহা আমাকে বললো,
~বাচ্চামেয়ে আমি তুমি জানো না তোমার দেবর রোজ বলে।
সাবিহার কথা শুনে মুখ টিপে হেসে রাতের দিকে তাকাতেই সে সাবিহার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।রাত সাবিহাকে বললো,
~একদম বেশি কথা বলবেনা আজ তোমার বিয়ে একটু তো লজ্জাবোধ আনো।
সাবিহা বললো,
~আনতে পারছিনা।
সাবিহার কথা শুনে আরেকদফা হাসির রোল পরে গেলো।

বিদায়ের পালা শেষ করে আমরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাসায় পৌছে সাবিহাকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে রাতের দরজার সামনে দাড়িয়ে গেলাম।রাত আমাকে দেখে বললো,
~কী চাই?
আমি বললাম,
~আপনার একটা ক্রেডিট কার্ড হলেই চলবে আমার।
রাত বললো,
~এতো টাকা দিয়ে করবে?
আমি বললাম,
~শপিং
রাত আমার সাথে না পেরে তার মানিব্যাগ থেকে ১০০০০টাকা বের করে হাতে দিয়ে বললো,
~খুশি?
আমি মুখ বানিয়ে বললাম,
~চলবে।
তারপর দরজার থেকে সরে এসে রাতকে ডুকতে দিলাম।
রাতকে রুমে ডুকিয়ে আমি আমার রুমে চলে গেলাম চারপাশে চোখ বুলিয়ে রক্তিমকে খুজতে লাগলাম বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রক্তিম সেখানে দাড়িয়ে আছে।আমি পা টিপে টিপে তার পাশে গিয়ে দাড়ালাম সে আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে আলতো করে আমার জড়িয়ে ধরে বললো,
~শরীর খারাপ লাগছে?
আমি বললাম,
~না
রক্তিম বললো,
~তোমার সবসময় একটা প্রশ্ন ছিল আমি কেন ২বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম?
আমি রক্তিমের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে বললাম,
~এই কথাটি আজ উঠছে কেন?
রক্তিম মৃদু হেসে বললো,
~আজ উঠছে কারণ আমি তোমার মনে আর কোনো প্রশ্ন রাখতে চাচ্ছি না এখন তোমার রেস্ট করা দরকার মাথায় কোনো চিন্তা রাখা যাবে না আর এই সময় আজেবাজে চিন্তা বেশি আসে।
আমি বললাম,
~তাহলে বলেন কেন চলে গিয়েছিলেন?
রক্তিম বললো,
~আমার প্রিয়তমার জন্য।
আমি ভ্রুকুচকে বললান,
~আপনার প্রিয়তমা তো আমি তাহলে কী আমার জন্য?
রক্তিম বললো,
~তোমার সাথে আমার যেদিন প্রথম দেখা হয় রাত তোমাকে তার ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেয়।সেদিন তোমাকে আমি আমার ভাইয়ের ফ্রেন্ড হিসেবেই দেখেছিলাম কিন্তু দিন যত যেতে লাগলো তোমার মিষ্টি কথা বাচ্চাসুলণ আচরণ আমায় ততো মুগ্ধ করছিল।জীবনে প্রথমবার কেউ আমার মনে জায়গা করে নিচ্ছিল দিনরাত শুধু তোমার কথা চিন্তা করতাম হঠাৎ একদিন নিজেকে প্রস্তুত করলাম তোমাকে মনের কথা জানাবো কিন্তু আমি যখন রাতের রুমের পাশ কাটিয়ে যেতে নিবো তখনই একটা কথায় আমি থমকে যাই সেটা ছিল রাতের বলা কথা
অধরা তোমাকে আমি খুব তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের বউ করতে চাই।এই একটা কথা শুনে আমি সেখানে আর এক মূহুর্ত তো ও দাড়াতে পারিনি।
~নিজেকে খুব কষ্টে সামলিয়ে আমি আবার সব শুরু করি কিন্তু ওই যে বলে না নিজের ভালোবাসাকে কেউ অন্যের হতে দেখতে পারে না।তেমনি আমিও দেখতে পারিনি তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো।আর সেটাই করি চলে যাই এই দেশ ছেড়ে কিন্তু দেখো আল্লাহর কি ইচ্ছা ছিল ২বছর পর দেশে এসে দাদীমা আমাকে সব বলে দেয় আর তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই তোমাকেই বিয়ে করবো।

রক্তিমের কথা শেষ হতেই সে আমাকে ছেড়ে দিলো।আমি স্তব্ধ হয়েগেছি তার কথা শুনে রক্তিমের মনে যে এতো কিছু ছিল তা আমি জানতাম না আমি আর কিছু না ভেবে রক্তিমকে জড়িয়ে ধরলাম।আর বললাম,
~অনেক ভালোবাসি আপনাকে জীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা আপনি।
রক্তিম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
~#আমার_শহরে_তুমি এসেছিল অজানা হয়ে রয়ে গেলে আজীবন আমার আপন হয়ে।
আমি রক্তিমের বুকে মুখ গুজে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

৪ বছর পর,,,

~রাফি একদম দৌড়াবে না খাবার খেয়ে নেও।মাম্মামকে এতো কেন কষ্ট দিচ্ছো না
অধরা তার ছেলের সাথে কথা বলছে আর দৌড়াচ্ছে ছেলেকে খাওয়ানের জন্য এতো ব্যস্ততা।হ্যাঁ অধরার ছেলে হয়েছে তার বয়স ৪বছর সারাবাড়ি সে মাথায় তুলে রাখে রাফি গিয়ে তার চাচীর পিছে লুকিয়ে বললো,
~থাবো না মাম্মাম পতাঁ খাবার।
সাবিহা তার উঁচু পেট নিয়ে রাফিকে আগলিয়ে বললেন,
~ভাবি থাক না বাচ্চাটা খেতে চাচ্ছে না।
অধরা বললো,
~আমি কী করবো বলো খেতেই চায় না।
রাফিকে সাবিহার থেকে নিয়ে বললো,
~চাচীর কাছে এভাবে যাবে না বোনু ব্যাথা পাবে।
রাফি বললো,
~বোনু ব্যাতা পাতে না।আমি আততে করে গিয়েতি
রাফির কথায় অধরা হেসে দিলো সাবিহার বাবু হবে যে কোনো সময় তার ছোট্ট প্রাণ এই পৃথিবীতে আসতে পারে।
অধরা বললো,
~বাবা এসে বকবে খেয়ে নেও।
রাফি বললো,
~দাদী তাবো।
অধরা বললো,
~যাবো হবে বাবা
রাফি মাথা দুলিয়ে বললো,
~দাদী তাবো।
অধরা রাফিকে তার দাদীর কাছে নিয়ে গেলো রাফিকে দেখেই সাহারা রায়জাদা তাকে কোলে তুলে বললো,
~আমার ভাইটা কী করছে?
রাফি বললো,
~মাম্মাম পতা খাবাত দেয়।
সাহারা রায়জাদা অধরার হাত থেকে খাবার নিয়ে বললো,
~তুমি যাও খাবার দাও টেবিলে রক্তিমরা চলে আসবে।
অধরা চলে গেলো রান্নাঘরে সব খাবার গুছিয়ে রুমে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুপুর ৩টা।সে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে শাড়ি ঠিক করলো আয়নার সামনে দাড়িয়ে হঠাৎ কেউ তাকে পিছন দিক দিয়ে জড়িয়ে ধরলো অধরা হেসে বললো,
~এসেছেন আপনি যান ফ্রেশ হয়ে আসেন।খাবার টেবিলে দেওয়া আছে
রক্তিম বললো,
~তোমার ছেলের জন্য তোমার কাছেই আসতে পারি না।
তখনই পিছন থেকে রাফি বললো,
~পাপা মাম্মামতে ছাতো ধতবেনা মাম্মামতে
রাফির আওয়াজ শুনে রক্তিম অধরাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
~আরে বাপজান আমার। তোমার মাম্মাম আমার বউ তাকে তো ধরাই যায়।
রাফি আমার কোলে চরে বললো,
~পঁতা পাপা
রক্তিম ভেংচি কেটে চলে গেলো ওয়াশরুমে আর অধরা রাফিকে ঘুম পারাতে চলে গেলাম।কিছুক্ষন পর রক্তিম বের হয়ে দেখলো রাফি ঘুম তাই অধরা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রক্তিমের সাথে নিচে চলে গেলো।সবাই একসাথে খাবার খেলো অনেক গল্প করে উপরে চলে আসলো।রায়জাদা ভিলা এখন সুখের ভিলা সবাই এখন একসাথে। ভালোবাসা দিয়ে পুরো ভরপুর এই বাসা কোনো কমতি নেই কোনোকিছু তে

দুপুরের খাবারের পর অধরা সবকিছু গুছিয়ে চলে আসে রুমে। রুমে এসে দেখে রক্তিম রাফিক কোলে নিয়ে আছে রাফির মাথা রক্তিমের কাঁধে। রাফির চোখ বন্ধ হয়তো ঘুম সে অধরা বললো,
~ঘুমের ছেলেকে কোলে নিয়ে রেখেছেন কেন?
রক্তিম বললো,
~ঘুম থেকে উঠে গেছিলো তাই কোলে নিয়েছি।
এই বলে রক্তিম শুইয়ে দিলো রাফিকে।অধরাকে বললো,
~চলো বারান্দায় যাই।
অধরা আর রক্তিম বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়ে পরলো।অধরা রক্তিমের কাঁধে মাথা রেখে বললো,
~ভালোবাসি
রক্তিম হেসে বললো,
~অনেক ভালোবাসি।
অধরা বললো,
~#আমার_শহরে_তুমি আছো এক ভালোবাসার সাগর হয়ে।
রক্তিম অধরার হাত শক্ত করে ধরলো।
অধরা আর রক্তিমের জীবন এভাবেই সুখে থাকুক।শুধু অধরা আর রক্তিমই না ভালো থাকুক সকল ভালোথাকুক এই পৃথিবীর সকল ভালোবাসার মানুষ।

সমাপ্ত।।।

(পরিশেষেঃকেমন হয়েছে জানাবেন?ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো🥰🥰।Happy Reading 🤗🤗)

আমার শহরে তুমি পর্ব-২৫

0

#গল্পের_নাম_আমার_শহরে_তুমি
#লেখনীতে_Alisha_Rahman_Fiza
পর্বঃ২৫
,,,,,,
,,,,,,
৩মাস দেখতে দেখতে কেটে গেলো রাত আর সাবিহার বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে এসেছে আসলেই সময় কারোও জন্য অপেক্ষা করে না বাবার মৃত্যুর পর মা অনেকটাই ভেঙে পরেছিল কিন্তু এখন ততটাই সে নিজেকে মজবুত করে নিয়েছে।হয়তো আমাদের কথা ভেবে সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে মায়ের সাথে রোজই কথা হয় ভালোমন্দ সবই মা এখন দেখছে।
সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে আমরা সবাইকে রাতের সিদ্ধান্ত জানাই।সবাই অনেকটা খুশি হয় দাদীমা অনেক বেশি খুশি হয়েছে ইদানিং আমি সাহারা রায়জাদাকে মা বলে ডাকা শুরু করে দিয়েছি সে তো রাতের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে শেষ।কিন্তু রাত strictly বলে দিয়েছে সে কোনো আয়োজন চায় না তার বিয়েতে শুধুমাত্র কয়েকজন কবুল পরিয়ে সাবিহাকে বাসায় নিয়ে আসবে যদি এরকম না হয় তাহলে সে বিয়ে করবে না। আমরা সবাই তার কথায় রাজি হয়ে যাই কিন্তু সাবিহার বাবা কোনো ক্রমেই মেনে নিতে চাননি সাবিহা বুঝানোর পর সে রাজি হয়েছে।সারার বিয়ে হয়ে গেছে প্রতীকের সাথে সে আমাদের বাসায়ও এসেছিল রাত তাদের সাথে ভালো মতো কথা বলেছে কারো ভিতরই কোনো জড়তা ছিল না।
রক্তিম তার ভার্সিটি নিয়ে একটু ব্যস্ত কারণ ভাইয়ের বিয়ে বলে সে লম্বা ছুটি নিবে শুধু রাতের বিয়ের জন্যই না রক্তিম আমাকে নিয়ে পাহাড়ের রাজ্যে যেতে চায় রাতের বিয়ের পরই আমরা সেই ভ্রমনে বের হবো।

এসবের মধ্যে একটা কথা হচ্ছে ইদানিং আমার শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে মাথা ঘোরা,বমি হওয়া কোনো কিছু খেলে বমি হয়ে যায়।কেন জানি মনে হচ্ছে সুখবর আসতে যাচ্ছে তাইতো এসবের লক্ষণ দেখে শাশুড়ী মা আর মা দুজনই ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে চায়।আমি রক্তিমকে কিছু বলে নি উনি তো আমাকে প্রথমদিনই ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন আমিই যাইনি আর তাকে তো সারপ্রাইজ দিবো।
হঠাৎ রক্তিম আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই আমি নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসি।সে আমাকে বললো,
~কী ভাবছো এতো?
আমি বললাম,
~এইতো কিছু না।
রক্তিম বললো,
~গত ৭দিন ধরে তোমার শরীরটা ভালো না।ডক্টরের কাছে যেতে প্রবলেম কী?
আমি বললাম,
~যাবো তো পরে এখন আপনি যান ভার্সিটি।দেরি হচ্ছে না আপনার
রক্তিম বললো,
~হুমম আজকে পরীক্ষার খাতা জমা দিতে হবে। আজ থেকে ফ্রী হয়ে যাবো রাতের বিয়েরও মাত্র ২দিন বাকি।
আমি বললাম,
~হুম।
রক্তিম ভার্সিটির জন্য বের হয়ে যেতেই আমি, মা,আর শাশুড়ী মা বের হয়ে গেলাম ডক্টরের ক্লিনিকের জন্য।
প্রায় ২০মিনিট পর ক্লিনিকে পৌছালাম ডক্টরের সাথে দেখা করে নিজের সব প্রবলেম বললাম সে কিছু টেস্ট দিয়ে দিলো তা করিয়েই আমরা বাসায় চলে আসলাম।রির্পোট কালকে দিবে বাসায় গিয়ে দেখি আমার দুইভাই হাজির। আরিফ জারিফ কে দেখে আমি বললাম,
~তোরা এখানে?
আরিফ বললো,
~আপু ২দিন এখানে থাকবো।
আমি অনেক খুশি হয়ে গেলাম কতোদিন পর আবার সবাই একসাথে।আর আমি যেটা ভাবছি যদি সেটা হয় তাহলে তো আরো বেশি খুশি হয়ে যাবো।ওদের সাথে কিছুক্ষন আড্ডা মেরে রুমে এসে পরলাম মাথাটা ভার হয়ে আছে ঘুমের প্রয়োজন আমি ফ্রেশ হয়ে একটা আপেল খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

রক্তিম ভার্সিটির সবকাজ শেষ করে চলে যায় শপিং করতে অধরার জন্য সে নিজ পছন্দরের শাড়ি কিনে,তার সাথে ম্যাচিং করে চুড়ি, কানের দুল সবকিছুর বিল পে করে সে রওনা হলো বাসার উদ্দেশ্যে। বাসায় পৌছে দেখতে পায় সোফার রুমে আড্ডার জলসা সবাইকে দেখে রক্তিম অনেক খুশি হয় সে সবার সাথে কুশলাদি করে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সে অধরাকে খুজে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ আরিফ বললো,
~দুলাভাই,আপু তো উপরে এভাবে চারপাশ খুজে লাভ নেই।
আরিফের কথা শুনে রাত আর জারিফ হো হো করে হেসে দেয় আর বড়রা মুখ টিপে হাসছে। রক্তিম উঠে দাড়িয়ে বিনা লজ্জায় বললো,
~শালাবাবু নিজের বউকে খোজা কোনো অপরাধ না আর তোমার আপু ছাড়া আমার আবার চলে না তাই আমি উপরে চলে যাচ্ছি পরে কথা হবে।
রক্তিম কথা শেষ করে উপরের দিকে চলে গেলো বাকি সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার পাণে।
রক্তিম ঘরে ঢুকে দেখে অধরা গালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে রক্তিম মুচকি হেসে কার্বাড থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।কিছুক্ষন পর ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে সে অধরার পাশে শুয়ে পরলো তারপর অধরার দিকে ঘুরে একদৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।এভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর রক্তিম অধরার গালে তার ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো।ঘুমের মধ্যেই অধরা কপাল কুচকে বুঝালো তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে তা দেখে রক্তিমের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠে।অধরার চোখ পিটপিট করে খুলে রক্তিমকে এভাবে দেখে অবাক হয় পরক্ষনেই সে নিজেকে সামলে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়।

ঘুমের মধ্যে গালে স্পর্শ পেয়ে চোখ পিটপিট করে খুলে দেখি রক্তিম আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখে আমি বললাম,
~আপনি কখন আসলেন?
রক্তিম বললো,
~এইতো মাত্র আসলাম।তোমার শরীর কী বেশি খারাপ লাগছে।
আমি হেসে বললাম,
~না এখন ঠিক আছি।আজ আপনি একটু বেশিই ক্লান্ত তাই না?
রক্তিম বললো,
~তাতো বটেই।তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি দেখেতো পছন্দ হয় নাকি?
বলেঔ আলমারি থেকে দুটো শপিং ব্যাগ বের করে আমার সামনে রেখে দিলো আমি শাড়ি বের করে দেখলাম।আসলেই শাড়িটা অনেক সুন্দর আমি ঠোঁটের হাসিটা আরো চওড়া করে বললাম,
~অনেক সুন্দর।
রক্তিম গর্বের ভঙ্গিতে বললেন,
~দেখতে হবে না পছন্দটা কার?
তার কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম।রক্তিম আমার হাসি দেখে নিজেও হেসে উঠলো রাতের খাবারের পর যে যার ঘরে চলে গেলো আমি আর রক্তিম রুমে এসেই শুয়ে পরলাম আমি ভাবছি আগামীকাল রিপোর্টে কী আসবে?আমি কী সত্যিই মা হতে চলেছি একথাটি ভাবতেই আমার হাত পেটে চলে যায়।আগামীকালের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম

সকালে রেডি হচ্ছি রিপোর্ট আনতে যেতে হবে।রক্তিমকে সাথে করে নিয়ে যাবো সারপ্রাইজটা কীভাবে নিবে কে জানে?আমি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে পিছনে ঘুরে দেখলাম রক্তিম মোবাইল হাতে বসে আছে আমাকে দেখেই বললো,
~আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমি বললাম,
~গেলেই তো দেখতে পাবেন।
রক্তিম আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হলো আমিও তার পিছে পিছে বের হয়ে আসলাম যাওয়ার আগে আমার মা আর শাশুড়ি মা দুজনই বললেন সাবধানে যেতে।
আমি আর রক্তিম গাড়ির পিছনের সীটে বসে পরলাম গাড়ি ড্রাইভার চালাচ্ছে।কিছুক্ষন পর আমরা ক্লিনিকের সামনে চলে আসলাম রক্তিম অবাক হয়ে বললেন,
~এখানে কেন?
আমি বললাম,
~একদম চুপ।
আমি আর রক্তিম ডক্টরের সামনে বসে আছি তার হাতে আমার রিপোর্ট রক্তিম কিছু না বলে অবাক নয়নে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে আছে।ডক্টর রির্পোট চেক করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
~Congratulation mrs Odhora.you are pregnant
ডক্টরের এতটুকু কথায় আমার শরীরের পুরো রক্ত হিম হয়ে গেলো সত্যিই আমি মা হতে চলেছি ছোট এক অস্তিত্ব আমার মাঝে বেড়ে উঠছে আমাকে কেউ মা বলে ডাকবে।ভাবতেই তো কতো ভালো লাগে বাস্তবে যখন হবে তখন আমি কী করবো?
আমার সুখের মাঝে আমি রক্তিমের কথা ভুলে গেছি রক্তিমের দিকে তাকিয়ে দেখি সে চুপচাপ বসে আছে।তাকে নীরব দেখে আমি বললাম,
~কী হয়েছে?
রক্তিম আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~বাসায় যেতে হবে অধরা সবাই অপেক্ষা করছে।
বলেই আমার হাত ধরে অতিসাবধানে গাড়িতে গিয়ে বসিয়ে দিলো।ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিয়ে চলে যেতে বললো আর নিজে ড্রাইভ করতে শুরু করলো।রক্তিমের এমন নীরবতা আমার ভিতরে ভয় সৃষ্টি করছে সে কী এই বাচ্চা চায়না একথা ভাবতেই তো আমার আত্মা কেঁপে উঠে।রক্তিম একধ্যানে গাড়ি চালাচ্ছে তার মনে যে তুফান চলছে তা আর কেউ জানে না এই তুফান খুশীর তুফান বাবা হবে সে ছোট একটা প্রাণ তাকে বাবা বাবা বলে ডাকবে উফফ এই দৃশ্য ভাবতেই তো তার সুখের ঢেউ শুরু হয়ে যায়।রক্তিম গাড়িটা একজায়গায় দ্বার কড়িয়ে সীটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো,
~অধরা,ধন্যবাদ এতো বড় একটা উপহার তুমি আমায় দিচ্ছো।কোনো দিন ভাবিনি তোমায় পাবো কিন্তু এখন দেখো তুমি আমার সন্তানে মা হতে যাচ্ছো।
এতটুকু বলে চোখ খুলে অধরার দিকে তাকিয়ে অধরার চোখ দিয়ে পানি পরেই যাচ্ছে রক্তিমের প্রতিটা কথা তার মনকে ছুয়ে দিয়েছে।
রক্তিম তার দুইহাত প্রসারিত করে বললো,
~একটু বুকে আসো তো।
অধরা অপেক্ষা না করে ঝাপিয়ে পরে রক্তিমের বুকে অধরাকে পরম আবেশে তার বাহুডরে আবদ্ধ করে।

বাসায় আসতেই সবাই আমাদের দিকে অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে আছে।আমি তাদের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম সবাই বুঝে গেলো আমার কথা রক্তিম আর আমাকে অনেক অভিনন্দন জানালো।তারপর নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে পরি।অনেকটা ক্লান্ত লাগছে ক্ষুধাও লেগেছে তাই ফ্রেশ হতে চলে গেলাম শাওয়ার নিয়ে বের হতেই দেখি রক্তিম টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে আমাকে দেখে সে বললো,
~খাবারটা খেয়ে নেও।
আমি খাবার শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেম রক্তিম আমার পাশে শুয়ে বললো,
~রাতের বিয়েতে কোনো প্রকার দৌড়াদৌড়ি করবে না।যদি দেখেছি এখান থেকে সেখানে গেতে তোমার খবর আছে।
রক্তিমের থ্রেড শুনে আমি অসহায় মুখে মাথাদুলালাম সারাদিন আমার এভাবেই কেটে গেলো কেউ আমাকে কোনো কাজ করতে দিলো না আমি শুধু চেয়ে দেখলাম।

পরেরদিন সকালে সবাই ব্যস্ত রাতের বিয়ের জন্য আমি রুমে বসে বসে হাই তুলছি।শাশুড়ি মা এসে বললো,
~অধরা ক্ষুধা লেগেছে?খাবার আনবো?
আমি বললাম,
~আর কতো খাবো?পেট ফুলে যাবে
শাশুড়ি মা হেসে বললো,
~এই সময় বেশি বেশি খাবার খেতে হবে। শক্তি বাড়ে ফল বেশি করে খেতে হবে
আমি শুধু মাথাদুলালাম।
রাতে আমি রক্তিমের দেওয়া শাড়িটা পরে রেডি হয়ে বসে আছি।তখনই রাতের ঘরে যাওয়ার জন্য ডাক পরলো আমি আস্তে ধীরে উঠে রাতের ঘরে চলে গেলাম।রাত বরবেসে দাড়িয়ে আছে তাকে ঘিরে সবাই দাড়িয়ে আছে রাত আমাকে দেখে বললো,

চলবে।।।

( বিদ্রঃকেমন হয়েছে জানাবেন?ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো🥰🥰।Happy Reading 🤗🤗)

আমার শহরে তুমি পর্ব-২৪

0

#গল্পের_নাম_আমার_শহরে_তুমি
#লেখনীতে_Alisha_Rahman_Fiza
পর্বঃ২৪
,,,,,,
,,,,,
রক্তিম আর আমি রায়জাদা ভিলার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি।অনেকদিন পর আমি সে বাসায় যাচ্ছি মা আমাকে অনেক বললো আরো কয়েকটাদিন থেকে যেতে আমি মাকে বুঝিয়ে বললাম যে আমি আবার আসবো।আমি বাহিরে তাকিয়ে আছি কেন জানি এই ১৫দিন যাবত সবকিছু নির্জীব লাগছে।কোনো কিছুতে সজীবতা খুজে পাই না হয়তো আপনজন হারানোর দুঃখের কারণে।বাবার কথা প্রতি মূহুর্তে মনে পরে জীবনের সবচেয়ে বেস্ট মানুষটিই আজ আমার পাশে নেই।ভাবলেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে ইশশ কী কষ্টকর শ্বাসরুদ্ধকর এই পৃথিবী।হঠাৎ আমার হাতে কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখি রক্তিম আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন।আমি তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললাম,
~রক্তিম সব ঠিক হয়ে যাবে তো?মায়ের এমন মুখ দেখতে ভালো লাগে না।
রক্তিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
~অধরা,মা হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে নিজের সন্তানের জন্য সবকিছু সহ্য করতে পারে।তাই মাও তোমাদের জন্য এ শোক সহ্য করে নিবে কিন্তু তাকে সময় দিতে হবে দিনশেষে সেও একজন মানুষ তারও মন আছে অনুভূতি আছে।
রক্তিমের কথাশুনে মনে হচ্ছে আসলেই মাকে সময় দেওয়া উচিত। সময় সবকিছু হয়তো ঠিক করে দিবে আমারও নিজেকে সামলাতে হবে আমার পরিবারের জন্য।বাবাও আমাকে শিখিয়েছে সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাও।

বাসায় পৌছে যেই না ভিতরে ঢুকতে যাবো ভিতর থেকে অনেক চেঁচামেচির আওয়াজ কানে আসলো।এই আওয়াজ শুনে আমি আর রক্তিম ভিতরে গিয়ে দেখি রাত রাগী কন্ঠে বলছে,
~তোমাদের সাহস দেখে আমি অবাক হই বলেছিনা বিয়ে করবো না।তার উপর তোমরা এই বাচ্চা মেয়ে সাবিহাকে আমার জন্য দেখতে গিয়েছো আমাকে ছবিও দেখাচ্ছো।
রাতের কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ সাবিহাকে রাতের জন্য দাদীমা পছন্দ করেছে রাতের কথা শেষ হতেই দাদীমা বলে,
~সাবিহা কোনো বাচ্চা মেয়ে না তার বয়স ১৯বছর।আর মেয়ে হিসেবে ভালো যতদিন এবাসায় এসেছে কতো ভালো করে মিশে গেছে মেয়েটা।একদম অধরার মতো
দাদীমার কথা শুনে রাতের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে রাগে কটমট করতে করতে সে বললো,
~দাদীমা,সাবিহা কোনোদিনই আমার মতো ছেলেকে সে পছন্দ করবে না সে বরাবরই রক্তিম ভাইয়ের মতো ছেলে পছন্দ করবে।
রাত কথা শেষ করেই দরজার দিকে তাকায় আমাকে আর রক্তিমকে দেখে মাথানিচু করে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিবে তখনই দাদীমা বললো,
~যদি বলি সাবিহাই নিজে তোকে পছন্দ করেছে তাহলে কী বিশ্বাস করবি?
রাতের পা থেমে গেলো সে পিছে ফিরে দাদীমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থেকে হেসে বললো,
~সাবিহা হয়তো পরিবারের চাপে পরে এমনটা বলছে।আমি কোনো চাপে নেই তাই আমি কোনো মেয়ের জীবন আর নষ্ট করবো না।আর কারোও অভিশাপ আমি নিজের জীবনে নিতে চাই না

রাতের কথা শুনে আমার অনেক খারাপ লাগছে রাত অনেক অনুতপ্ত এটা তার কথায় বুঝা যাচ্ছে।এই অনুতপ্তের আগুনে সে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে এই ব্যাপারটা ভালো লাগছেনা জীবনে মানুষ অনেক ভুল করে কিন্তু ভুলের জন্য যদি অনুতপ্ত হয় তাহলে সেই ভুলের ক্ষমা রয়েছে।রক্তিম আর আমি দাদীমার কাছে গিয়ে দাড়ালাম রক্তিম রাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
~রাত আমরা আগামীকাল সাবিহার সাথে দেখা করতে যাবো।আর এই ব্যাপারে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না
রক্তিমের কথায় রাত হকচকিয়ে গেলো আর বললো,
~ভাই তুমি কী বলছো?সাবিহার সাথে দেখা করার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না আমি
রাতের বলা শেষ হতেই আমি বললাম,
~আপনি কেন বারবার একই কথা বলছেন?সাবিহা এমন মেয়ে নয় যে তাকে কেউ force করে কিছু করাতে পারবে।ওর মন যা বলে তাই সে করে
রাত বিরক্ত হয়ে বললো,
~বিয়ের ব্যাপারে অনেক সময় মেয়েরা দূর্বল হয়ে যায় পরিবারের কাছে এটা ভাবি আপনাকে বুঝাতে হবে না বলে মনে করছি।
রক্তিম কিছুটা রাগী কন্ঠে বললো,
~রাত আমি তোমার বড় ভাই আর আমি যা বলেছি তাই হবে।মা আর বাবার সাথে আমি কথা বলবো।
That’s final no more talk in this topic.
এতটুকু বলে রক্তিম রাতের পাশ কেটে হনহন করে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।আমিও রক্তিমের পিছে হাঁটা ধরলাম

রুমে এসে দেখি রক্তিম পায়চারি করছে তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।আমি আসতে করে বিছানার উপরে বসে ঠান্ডা কন্ঠে বললাম,
~রাতকে নিয়ে চিন্তিত?
রক্তিম পায়চারি বন্ধ করে আমার দিকে ফিরে বললো,
~ছেলেটা বড্ড বেশি বুঝে যেখানে সাবিহার কোনো আপত্তি নেই রাতের এতো মাথা ব্যাথা কেন?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
~রক্তিম, রাত কোনো সম্পর্ক গড়তে ভয় পাচ্ছে সে মনে করছে এবারো সে হেরে যাবে মাঝপথে ছেড়ে দেবে একটা সম্পর্ক এই ভেবে সে আগে বাড়ছে না।
রক্তিম আমার কথা শুনে বললো,
~রাতের ভয় বুঝতে পেরেছি কিন্তু
রক্তিমের কথা শেষ না করতে দিয়েই আমি বললাম,
~সাবিহার সাথে দেখা করে তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিবো।আর রাতকেও সময় দিতে হয়তো সে এখন বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেনি।
আমার কথা শেষ করে বিছানা ছেড়ে উঠে রক্তিমের কাছে গিয়ে চুলগুলো ঠিক করে বললাম,
~সব ঠিক হয়ে যাবে।আপনিই বলেন যে সময় সব কিছু পরিবর্তন করে দেয়।
রক্তিম মলিন হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আগামীকাল সাবিহার সাথে কথা বলতে হবে রাতকেও সাবিহার কথা শুনতে হবে দুজন যে সিদ্ধান্ত নিবে তাই সবার মানতে হবে।

পরেরদিন সকালে,
আমি আর রক্তিম রেডি হয়ে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি রাতের অপেক্ষায় সাবিহার সাথে দেখা করতে যাবো আমরা।আমি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছি রক্তিম বারবার হাত ঘড়ি দেখছে।কিছুক্ষন পর রাত মুখ গম্ভীর করে আমাদের সামনে চলে আসে রাতের এমন চেহারা দেখে রক্তিম বললো,
~তোকে আমরা যুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছি না তাই একটু হাসলে কোনো প্রবলেম নেই।
রাত বললো,
~ভাই আমার অনেক জরুরি মিটিং আছে যদি তুমি তাড়াতাড়ি করতে।
আমি বললাম,
~সব জিনিসে তাড়তাড়ি হয় না।
রাত বললো,
~ভাবি প্লিজ
রাতের কথা শেষ করতে না দিয়ে রক্তিম বললো,
~বাজে কথা ছেড়ে চল দেরি হচ্ছে।
আমরা গাড়িতে গিয়ে বসলাম রক্তিম ড্রাইভ করছে আমি সাবিহাকে ফোন করে বললাম যে আমরা রওনা দিয়েছি।
আমাদের গন্তব্যে পৌছে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পরলাম।রেস্টুরেন্টেই আমরা সাবিহার সাথে দেখা করবো আমি এদিকসেদিক চোখ বুলিয়ে সাবিহাকে খুজতে লাগলাম।হঠাৎ আমাদের সামনে শাড়ি পড়া এক সুন্দর রমনী এসে দাড়ালো আমি তাকে দেখে হা হয়ে গেলাম সাবিহাকে একদম পরী লাগছে হালকা মেরুন রঙের শাড়িতে দারুন লাগছে।আমি চোখ ফিরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি রাত হয়ে আছে।
রক্তিম আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
~সাবিহা বড় হয়ে গেছে এ কয়েকদিনে তাই না?
আমি রক্তিমের কথা শুধু হাসলাম।সাবিহা বললো,
~ভাবি সেই কখন থেকে আমি তোমাদের অপেক্ষা করছি।
আমি বললাম,
~তাই নাকি চলো আমরা কোথাও বসি?রাত চলো
আমার কথায় রাতের ধ্যান ভাঙ্গে তারপর বললো,
~জ্বী ভাবি।
রাতের অবস্থা দেখে সাবিহা মুখ টিপে হাসলো।রাত তার হাসি দেখে বললো,
~এতে হাসার কী হলো?
রাতের কথার জবাব না দিয়ে রক্তিমকে বললো,
~ভাইয়া ওই টেবিলটা খালি আছে ওখানে গিয়ে বসি।
রক্তিম বললো,
~চলো।
আমরা বসে পরলাম টেবিলে সাবিহা আমাদের সাথে বকবক করেই যাচ্ছে রাত মুখ গম্ভীর করে বসে আছে।
তাদের কথা বলার মতো পরিবেশ চাই তাই আমি বললাম,
~সাবিহা আমরা এখানে কীসের জন্য এসেছি তা তোমার অজানা নয় তাই তুমি আর রাত কথা বলো।আমরা ওই টেবিলে গিয়ে বসছি।
সাবিহা মাথাদুলালো আমি আর রক্তিম অন্য টেবিলে গিয়ে বসলাম।রক্তিম আমাকে বললো,
~অধরা কতদিন আমরা একসাথে সময় কাটাইনা আজকের পরিবেশটাও রোমান্টিক তাই আজকে শুধু তুমি আর আমি।
বলেই আমার হাতে তার ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো।আমি বললাম,
~অসভ্য সবাই দেখছে।
রক্তিম বললো,
~তোমার জন্যই তো আমি অসভ্য।
রক্তিমের কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।

রাত আর সাবিহা বসে আছে তাদের মাঝে পিনপতন নীরবতা। কেউই বুঝে উঠতে পারছে না কী থেকে শুরু করবে তাই আগে রাতের ঠোঁট নড়ে উঠলো সে বললো,
~দেখো সাবিহা আমি তোমাকে বিয়ে করতে
রাতের কথা শেষ হওয়ার আগে সাবিহা বললো,
~করতে পারবেন।
রাত ভ্রুকুচকে বললো,
~কী?
সাবিহা বললো,
~বিয়ে করতে পারবেন।
রাত বললো,
~একদম কথা বাড়াবে না ছোট বাচ্চা মেয়ে এখন কীসের বিয়ে?
সাবিহা ঠোঁট উল্টে বললো,
~এখনই তো বিয়ে করবো আমার স্বামী আমাকে লালন-পালন করবে।আর সেই স্বামীটা আপনি হবেন
সাবিহার কথা শুনে রাত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে। রাতের ভাবনার মাঝে সাবিহা বললো,
~দেখেন আপনাকে আমার ভালে লেগেছিল রাহি আপির বিয়ের সময় কিন্তু আমি জানতে পারি কোন সারা না পারার সাথে আপনার নিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
এই কথাটা বলতে সাবিহার গলা কাঁপছে সে সেই কাঁপা গলায় বললো,
~কিন্তু পরে জানতে পারি ভাবির কাছ থেকে ওই মেয়ে আপনাকে ভালোবাসে না সেদিন মনে মনে অনেক খুশি হই।তবুও একটা জড়তা কাজ করছিল ওইদিন যখন জিজ্ঞেস করছিলেন আমার কেমন ছেলে পছন্দ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল যে আপনি আমার পছন্দ।কয়েকদিন আগে বাবা আমার কাছে কয়েকটা ছবি এনে বলে এইখান থেকে ছেলে পছন্দ করতে আমি রাগের বসে সেই ছবি গুলো ফেলে দেই কিন্তু একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় সেটা ছিল আপনার।দৌড়ে সেই ছবি নিয়ে বাবার হাতে তুলে দেই বাবা আমার নীরবতা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

এতটুকু বলে সাবিহা থেমে যায় রাত স্তব্ধ আজ তাকে কেউ ভালোবাসতে পারে তাও এভাবে এটা সে জানতোনা।এতোটা ভালোবাসা সে ডির্সাভ করে না আচ্ছা সাবিহা কী ভাবির ব্যাপারটা জানে।হয়তো না তাই আমাকে ভালোবেসেছে ভাবির ব্যাপারটা জানলে হয়তো ঘৃণা করবে রাত তার ভাবনা শেষ করে বললো,
~সাবিহা তুমি অনেক ভালো মেয়ে আমি অতোটা ভালো না তুমি হয়তো জানোনা আমি ভাবির সাথে
এতটুকু বলতেই সাবিহা রাতকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
~অতীত চলে গেছে তাকে টানবেন না।ভালোবাসার পরিমাপ অতীত দিয়ে করবেন না বেশ বেমানান লাগে।
রাত আরো অবাক হলো সাবিহা বললো,
~আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি আপনি কী আমাকে আপনার মনে এক তিল পরিনাণ জায়গা দিতে পারবেন না।এতো কঠোর আপনি
সাবিহার চোখে পানি হয়তো ভালোবাসা পাওয়ার আকুলতা তার বেড়ে গেছে আর রাত সে তো ভাবছে তার জীবন তাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে একবার এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে দেখা যাক এর পরিণাম কী হয়। হয়তো সাবিহার ভালোবাসা তার জীবনকে সুন্দর করে তুলবে তাই সে এখন একটা ভয়াবহ কান্ড ঘটাবে রাত তার চেয়ার থেকে উঠে সাবিহার দিকে ঝুঁকে তার ঠোঁট সাবিহার গালে ছুয়িয়ে দিয়ে পুনরায় চেয়ারে বসে পরে সাবিহা গালে হাত দিয়ে রাতের দিকে তাকিয়ে আছে।রাত মুচকি হেসে ফোন বের করে রক্তিমকে ফোন করে বলে চলে আসতে
রক্তিম আর আমি কথা বলছিলাম সেই সময়ই রাত ফোন করে বললো চলে আসতে।আমি আর রক্তিম সেখানে পৌছে দেখি সাবিহা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রাত আমাদের দেখে বলে,
~ভাই ৩মাস পর বিয়ে হবে কোনো দেরি করা যাবে না।সাবিহার বাবার সাথে কথা বলো এখনই বিয়ে করে নিতাম কিন্তু সাবিহার পরীক্ষা আমি ওর পড়াশোনায় বাঁধা হতে চাই না।
এতটুকু বলে রাত চলে যায় আর আমরা তিনজন বলদ সেজে দাড়িয়ে রইলাম।

চলবে।।।

(বিদ্রঃকেমন হয়েছে জানাবেন?ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো🥰🥰।Happy Reading 🤗🤗)

আমার শহরে তুমি পর্ব-২৩

0

#গল্পের_নাম_আমার_শহরে_তুমি
#লেখনীতে_Alisha_Rahman_Fiza
পর্বঃ২৩
,,,,,
,,,,,
রক্তিম বিছানায় শুয়ে আছে মূলত সে অধরার জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের খাবারের পর রক্তিম রুমে আসলেও অধরা তার মাকে সাহায্য করবে বলে রান্নাঘরে চলে যায়।রক্তিম এভাবে শুয়ে থাকতে অনেক boring লাগছে তাই সে অধরার study table এর চেয়ারে বসে পরলো তারপর অধরার একেকটা পুরোনো খাতা দেখতে লাগলো অধরার লেখা দেখে রক্তিম মনে মনে বললো,
~এই মেয়ের লেখা তো দিনের দিন খারাপ হচ্ছে।কী যে করি এটাকে নিয়ে
এসব ভাবছিল তখনই কেউ রক্তিমের হাত থেকে খাতা টেনে নেয় রক্তিম মাথা উঁচু করে দেখে অধরা খাতা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে তার মুখে রাগ স্পষ্ট।
রক্তিম বললো,
~কী হয়েছে এমন মুখ করে রেখেছো কেন?
রক্তিমের প্রশ্ন শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার খাতা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে আর আমাকেই বলছে কী হয়েছে আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
~আপনি আমার খাতা কেন দেখছিলেন?
রক্তিম বললো,
~মনের সুখে দেখছিলাম আর তোমার লেখনী দেখে তো মন পুরো দুঃখে ভরে গেলো।ছি ছি কী অবস্থা?আমার অনেক ভালো একটা ছাত্রী আছে তার হাতের লেখা অনেক সুন্দর চাইলে তার থেকে ট্রেনিং নিতে পারো।
রক্তিমের কথায় আমার গা পিত্তি সব জ্বলে গেলো আমি রেগে গিয়ে তাকে কিছি না বলে খাতা টেবিলে রেখে চলে গেলাম বিছানায় অন্যপাশে মুখ করে শুয়ে পরলাম।অনেক কষ্ট লাগছে সে কীভাবে পারলো আরেকজনের সাথে আমাকে তুলনা করতে ব্যাটা খচ্চর কোনোদিন কথা বলবোনা।আমার চোখে পানি চলে আসলো।আসলে কেউই নিজের প্রিয় মানুষের মুখে অন্যজনের প্রশংসা শুনতে চায় না।কান্নার ফলে আমি বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছি
রক্তিম বুঝতে পেরেছে আজ তার মজাটা একদম ভুল পথে গিয়েছে তার প্রিয়তমা একটু বেশিই কষ্ট পেয়েছে।রক্তিম ধীরপায়ে অধরার পাশে শুয়ে পরলো তারপর তাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিসফিস করে বললো,
~হয়েছে তো আর কান্না করো না ভুল হয়েছে আমার
রক্তিম আমাকে এসে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কথা বলছেন আমি তার সাথে কথা বলবো না যা করার করে নেক।
রক্তিম আমাকে কোমড় জড়িয়ে ধরে তার দিকল ফিরাতে চেষ্টা করে কিন্তু আমার জন্য তা করতে পারছেন না অনেক চেষ্টার পর আমাকে তার দিকে ফিরাতে সক্ষম হলেন।আমি চোখ বন্ধ করে আছি দুচোখ দিয়ে পানি পরেই যাচ্ছে রক্তিম আমার দুচোখে ঠোঁট ছুয়িয়ে পানি গুলো মুছে দিয়ে বললো,
~আর কান্না করো না আমি ভুল করেছি। আর কোনো দিন এমন করবো না
আমি কোনো কথায় বলছি না তাই সে আমার ঘাড়ে মুখ গুজে রাখলো আমি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলে সে আমার হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
~কেন এমন করছো প্রিয়তমা?তুমি কী জানো না তোমার এই অধম যে তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারে না।
আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম,
~আপনি অন্য একজন মেয়ের সাথে আমার কীভাবে তুলনা করতে পারলেন?
রক্তিম বললো,
~আর করবো না সরি ময়না পাখি।
আমি আর কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে ফেললাম ঘুম প্রয়োজন আমার।রক্তিম আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলো
দুজনই ঘুমের রাজ্যে চলে গেলো এই বাসার সবাই সুখের ঘুম দিতে ব্যস্ত কিন্তু এই সুখের ঘুমের পর যে বিষাদের সকাল অপেক্ষা করছে তা হয়তো কেউ জানে না।

,,,,,
,,,,,,
ফজরের আযান কানে আসতেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।রক্তিমকে সরিয়ে আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে জায়নামাজ নিয়ে দাড়িয়ে পরি নামাজে।নামাজ শেষ করে বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি রক্তিম উবু হয়ে ঘুমিয়ে আছে।জায়নামাজ ঠিক জায়গায় রেখে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম রুমে ভালো লাগছিল না মা মনে হয় রান্নঘরে তাই রান্নাঘরে ছুটলাম কিন্তু মাকে কোথাও দেখলাম না। মা তো সবসময় নামাজ পরেই ভাইদের ডাকাডাকি করে তাহলে আজ কেন?আমি মায়ের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলাম ভিতর থেকে কোনো আওয়াজ আসলো না হয়তো ঘুম থেকে এখনি উঠে নাই।আমি দরজার সামনে থেকে সরে আসতে নিবো তখনই দরজা খোলার আওয়াজ শুনে পিছে ঘুরতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো।মায়ের কান্না দেখে আমার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো আমি বললাম,
~মা কী হয়েছে?
মা কোনো কথা না বলে কান্না করছে আমি মাকে ছাড়িয়ে ভিতরে গিয়ে দেখি বাবা চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছেন কোনো হেলদোল নেই আমি কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার হাত ধরলাম একদম ঠান্ডা আমি চিৎকার দিয়ে বললাম,
~মা আরিফ জারিফকে ডাকো বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে।
মা বললো,
~দেরি হয়ে গেছে অধরা,তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
বলেই ফ্লোরে বসে সে কান্না শুরু করলো আমি সেখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম বাবার হাতটা আমার হাতে রেখে বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম দুচোখ বেয়ে পানির বন্যা জড়ছে।
রক্তিমের ঘুম ভাঙ্গলো কারো চাপা কান্নার আওয়াজে সে ঘুমঘুম চোখে উঠে বসলো খেয়াল করলো রুমের দরজা খোলা এরমানে অধরা বাহিরে রক্তিম আর অপেক্ষা না করে বাহিরে চলে গেলো।বাহিরে এসে দেখতে পেলো অধরার বাবার ঘরের মেঝেতে বসে অধরার মা কান্না করছে।রক্তিম দেরি না করে রুমের ভিতর গিয়ে দেখে অধরা তার বাবার হাত ধরে বিছানার কাছে বসে।রক্তিম অধরার কাছে গিয়ে বললো,
~অধরা কী হয়েছে?
অধরা রক্তিমের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বললো,
~আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ আজ আমার থেকে অনেক দূরে চলে গেলো।
রক্তিমের আর বুঝতে বাকি রইলো না অধরার বাবা আর নেই।সে অধরাকে আগলিয়ে নিলো তখনই অধরার দুইভাই এসে হাজির তারা মায়ের কান্না আর বোনের স্তব্ধতা দেখে অনেক অবাক পরক্ষনেই বিছানার দিকে তাকাতে তাদের বুকে কেউ ছুরি ঢুকিয়ে দিলো বাবার লাশটাই হয়তো তার মা-বোনের কান্নার কারণ।আরিফ আর জারিফকে দেখে তার মায়ের কান্না আরো বেড়ে গেলো।ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
~আজ সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হয়।তাই তাড়াহুরা করে হাত-মুখ ধুয়ে যেই তোর বাবাকে ডাক দিতে যাবো তখনই দেখি তোর বাবার শরীর ঠান্ডা নিঃশ্বাস চেক করে দেখি তো তোর বাবা নেই।
এতটুকু বলে সে ঢুকরে কেঁদে উঠে মায়ের কান্না অধরাকে আরো কষ্ট দিচ্ছে সে একধ্যানে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে হয়তো এখনই চোখ খুলে ঠোঁট নাড়িয়ে বলবে,
~এই বোকারা তোরা কাদঁছিস কেন?
কিন্তু সেটা হয়তো আর হবে না কারণ একবার যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না।

,,,,,,,,
,,,,,,,,
আমি চোখ মুছে রক্তিমকে বললো,
~বাবাকে একদম নিষ্পাপ লাগছে তাই না?
রক্তিম বললো,
~অধরা নিজেকে সামলাও।তুমি বড় সন্তান তাদের দুভাইয়ের বড় বোন যদি তুমিই দূর্বল হও তাহলে কীভাবে হবে?
আমি কান্নারত অবস্থায় বললাম,
~কেন নিজেকে সামলাবো রক্তিম?ছোট থেকে এক কথা শুনে এসেছি তুমি বড় সন্তান তোমার দূর্বল হলে চলবে না কঠোর হতে হবে।আজ নিজেকে কীভাবে সামলাবো আপনি একটু বলবেন আমায়।
এতটুকু বলে আমি রক্তিমকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগলাম রক্তিম আমাকে বললো,
~এভাবে কান্না করতে হয় না এভাবে আহাজারি করো না আল্লাহ তা আলা নারাজ হবে।তুমি বাবার জন্য নামাজ পরে দোয়া করো এর থেকে ভালো আর কিছুই হবে না।
আমি রক্তিমের কথায় মাথাদুলালাম।রক্তিম আমাকে রেখে জারিফ আর আরিফকে সাথে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।আস্তে আস্তে বাবার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরতে লাগলো এলাকাবাসী আত্মীয়স্বজন সবাই চলে এসেছে।বাবার গোসল হয়ে গিয়েছে তাকে সাদা কাপড়ে আবদ্ধ করা হয়েছে একবার দেখার সৌভাগ্য হলো আমার বাবাকে।আর কোনো দিন বাবা বলে ডাকা হবে না এই চেহারাটা আর দেখে হবে না সেই নির্জন মাটির ঘরে তাকে রেখে আসবে।সবাই কান্না করছে এই কান্নার কোনো ফল নেই আমার বাবা ফিরে আসবে না।
বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সময় হলো খাটিয়াতে তাকে সুন্দর করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে রক্তিম,আরিফ জারিফ আর রাত বাবার খাটিয়া কাঁধে তুলে রওনা হলো গোরস্তানের পথে বাবা আর কোনোদিন এই রাস্তা দিয়ে ফিরে আসবে না আমি তাদের যাওয়ার পাণে তাকিয়ে রইলাম শেষ দেখা বাবার সাথে আমার।
বাসার ভিতরে ডুকে দেখি সবাই মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আমি ঢুলুঢুলু পায়ে মায়ের কাছে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলাম মা নিষ্প্রাণ ভাবে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ আমার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমি মাথা তুলে দেখি সাহারা রায়জাদা আমার হাত রেখে আছে সে আমার পাশেই বসে আছে।
তাকে দেখে মায়ের কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসে পরলাম।সাহারা রায়জাদা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
~অধরা,নিজেকে সামলাও বাবা হারানোর যন্ত্রণা অনেক তা আমি জানি কিন্তু তোমার মাকেও তো সামলাতে হবে।
আমি তার বুকে মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে উঠলাম।সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো

,,,,,,,,,
,,,,,,,,
সবাই চলে গেছে নিজ নিজ বাসায় আমি সোফার ঘরের ফ্লোরে বসে আছি বাবাকে কবর দিয়ে এসে রক্তিমও গোসল করে আমার পাশে বসে আছে।
রক্তিম আমার হাতের উপর তার হাত রেখে বললেন,
~দুপুর ৩টা বাজে কিছু খাবে না?
আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,
~মা খেয়েছে?আরিফ জারিফ আপনি খেয়েছেন?
রক্তিম বললো,
~চলো একসাথে খাবো আমরা সবাই।মা বাসা থেকে খাবার পাঠিয়েছে।
আমার হাত ধরে বসা থেকে দাড় করিয়ে টেবিলের সামনে নিয়ে গেলো।সবাই উপস্থিত কিন্তু আমার বাবা নেই এইটা ভাবতেই বুকটা ধুমরে মুচরে যাচ্ছে আপনজন হারানোর ব্যাথায় এতো কষ্ট।

বাবার মৃত্যুর আজ ১৫দিন। এই ১৫দিন আমি বেশিরভাগ আমার বাসায়ই কাটিয়েছি। কিছুদিন যাবত মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না হয়তো বাবার শোকে।মায়ের এখন চিন্তাটাও বেড়ে গেছে এই সংসার মায়ের এমন মুখ দেখলেই আমার খুব খারাপ লাগে।হঠাৎ রক্তিম এসে বললো,
~অধরা কী ভাবছো?
আমি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে বললাম,
~মায়ের কথা ভাবছিলাম।
রক্তিম বললো,
~অধরা তুমি মাকে বলো কোনো টেনশন নিতে মানা আল্লাহ যা ভেবেছে তাই হবে।
আমি বললাম,
~হুম
রক্তিম বললো,
~আজ বাসায় চলে যাবো আমরা।
আমি বললাম,
~হুম আজকে গিয়ে কয়েকদিনপর আবার আসবো।
রক্তিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে গেলো
আমি জানি রক্তিমও আমার মতো অনেক চিন্তিত কিন্তু আমাকে তা বুঝতে দিচ্ছে না।

চলবে।।।।

(বিদ্রঃকেমন হয়েছে জানাবেন?ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো🥰🥰।Happy Reading🤗🤗)