Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1361



প্রজাপতির রং পর্ব-৩৮+৩৯

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_38
#Writer_NOVA

সারা পার্টির পরিবেশটা একদম নিরব।সাধারণত পার্টির পরিবেশ যেরকম হৈ-হল্লোর থাকা উচিত। সেরকম নয়।একপাশে সফট মিউজিকে বাজছে।তার তালে তালে নাচছে কয়েকজন যুবক-যুবতী। তবে তারা সবাই বিদেশি। আরেকপাশে ড্রিংকসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেগুলোও বিদেশি ক্লায়েন্টদের জন্য। নাভান ওর বাবার হাত ধরে এদিক সেদিক ঘুরছে।আজ আমরা ফুল ফ্যামেলী কালো পরেছি।এনাজ কালো ব্লেজার,কালো প্যান্ট। নাভান কালো শর্ট প্যান্ট, কালো শার্ট সাথে কালো কোটি।আমার পরনে কালো গাউন।চুলগুলো ছেড়ে পেছন দিকে রেখেছি।ওড়নাটা গলায় প্যাচানো।আমি অসহায়ের মতো এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। এরিনকে সবার সাথে পরিচয় করে দিচ্ছে আরিয়ান।হিমি এসেছে ওর বয়ফ্রেন্ড রাজের সাথে। রাজ ও হিমিকে একটু আগে এদিকে দেখেছিলাম। কিন্তু এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। মুসকান কিসের জন্য যেনো রাগ করেছে। আদর সেই রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত আছে।তায়াং ভাইয়া এখনো আসেনি।সে কল করে বললো আমার জন্য নাকি সারপ্রাইজ আছে। কে জানে কি সারপ্রাইজ।সবাই ব্যস্ত শুধু আমি ছাড়া। জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে সবার কান্ড দেখছি।নিজেকে সিঙ্গেল মানুষ মনে হচ্ছে। হুট করে আমার পিঠে একটা তাল পরলো।আমি চিৎকার করে উঠলাম।

আমিঃ ও আল্লাহ গো!!! আমার পিঠ।

—- চুপ কর ছেমড়ি।চিল্লাইলে আরেকটা খাবি।

কারো শাসানো গলা পেয়ে আমার কপালে চিন্তার ভাজ পরলো।এটা তো নূর আপির গলা।কিন্তু সে এখানে আসবে কি করে? আমি পেছনে ঘুরে অবাক হয়ে গেলাম।আরে সত্যিতো নূর আপি। আমি নূর আপিকে জড়িয়ে ধরলাম।

আমিঃ নূর আপি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই!!!!

নূরঃ আস্তে বোইন।আমর কান ধরে গেলো।

আমিঃ তুমি এখানে? কার সাথে আসছো?

নূরঃ সারপ্রাইজ!!! তায়াং-এর সাথে আসছি।

আমিঃ ওহ্ তায়াং ভাইয়া তাহলে আমার জন্য এই সারপ্রাইজের কথা বলছে।

আমি নূর আপিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।সেটা দেখে পেছন থেকে তায়াং ভাইয়া চেচিয়ে বললো।

তায়াংঃ শাঁকচুন্নিরে, আমারে কি তোর চোখে পরে না।

আমিঃ যা ভাগ।তোর সাথে কথা বলে কে?

তায়াংঃ ওহ্ বোনকে পাইয়া আমারে এখন ভুইল্লা গেছিস।আবার আসিস আমার কাছে।চুল টেনে ছিঁড়বো তোর।

আমিঃ নূর আপি দেখো তোমার সামনে আমাকে বকছে।কিছু বলো এই পাঠারে🥺।

নূরঃ তোমার সাহস তো কম বড় না।আমার বোনুটাকে বকতাছে।এতটুকু বকলে কি হয়? আরো বেশি করে বকো।তুমি বকবা আর আমি পিঠে তাল ফেলবো।এতদিন আমাদের সাথে যোগাযোগ না রাখার শাস্তি এটা।ও লাপাত্তা কেন হয়েছিলো? সেই শাস্তিতো এখনো বাকিই আছে।

আমিঃ তোমারা হবু জামাই-বউ এই প্ল্যান করে আসছো?কথা নেই তোমাদের সাথে যাও।নূর আপি তুমি আমার ভাইরে পাইয়া আমার সাথে এমন করলা।যাও কারো সাথে কথা কমু না।আড়ি তোমাদের সাথে।

নূরঃ সর, তোর সাথে কথা নেই আমার।আমাকে তো ভুলেই গেছিস। কে হই আমি তোর? আমি তোর আপন কেউ হলে তো আমার সাথে যোগাযোগ রাখতি।

আমিঃ নূর আপি, প্লিজ রাগ করো না। তুমি আমার একমাত্র খালাতো ভাইয়ের একমাত্র হবু বউ। তুমি যদি আমার সাথে রাগ করে থাকো তাহলে কি বিষয়টা ভালো দেখায়,তুমিই বলো।

তায়াংঃ ওর সাথে কোন কথা বলবে না নূর।এই শাঁকচুন্নি মোটেও ভালো না।চলো আমরা অন্যদিকে চলে যায়।ও কে? ওকে আমরা চিনিই না।

আমিঃ পাঠারে😤!!!!! মাইর না খাইতে চাইলে সামনে থিকা সর কইতাছি।আসছে আমার ও নূর আপির সাথে প্যাচ লাগাইতে।

তায়াংঃ অামার সাথে এমন করলি না।যা থাকমুই না তোর সাথে। এখুনি আমি আমার বউ নিয়া পার্টি থিকা চইলা যামু।

আমিঃ এ্যাহ আসছে।যা ভাগ।তোরে ধইরা রাখছে কে? তুই থাকলে আমাদের আরো ৫ জনের খাবার বেশি লাগবো।তুই তো আবার ৫ জনের খাবার একসাথে শেষ করিস।এর জন্যই তো এমন হইছিস পাঠা।দেহটা দেখছিস তোর? এবার তোরে হাটে উঠাইলে ভালো দামে বেচতে পারতাম।

তায়াংঃ খবরদার পাঠা বলবি না শাঁকচুন্নি। (রেগে)

আমিঃ তাহলে কি বলবো? মাননীয় ব্লাক বেঙ্গল ছাগল মহাদোয়। এবার ঠিক আছে না।

তায়াংঃ তোরে আমি………..😤।(রেগে)

আমিঃ কিচ্ছু করতে পারবি না।তার আগেই আমি কি করবো জানিস?

আমাদের দুই ভাই-বোনের কান্ড দেখে নূর আপি হাসতে হাসতে পেট ধরে বসে পরেছে।আমি দুই হাত কোমড়ে রেখে ঝগড়া করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। তায়াং ভাইয়া লুচির মতো ফুলছে।নূর আপির সামনে তাকে এতকিছু বলায় বেচারার আত্মসম্মানে লেগেছে বোধহয়। তাতে আমার কি,হুহ😏।তায়াং ভাইয়া সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বললো।

তায়াংঃ কি করবি তুই?

আমিঃ পেছনের দিকে দৌড় লাগামু।ভাগ নোভা ভাগ।নয়তো তোরে মাননীয় ব্লাক বেঙ্গল ছাগল মহাদোয় গুঁতা মারবে।

আমার কথাটা বলতে দেরী কিন্তু দৌড় দিতে দেরী নয়।আমি উল্টো দিকে দৌড়ে অন্য দিকে চলে এলাম।হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলাম।আরেকটু সময় থাকলে আমি নির্ঘাত তায়াং ভাইয়ার হাতে মার খেতাম।বেচারাকে বেশ রাগানো হয়েছে।আরেকটু সময় থাকলে ওর মান-সম্মান ফালুদা বানিয়ে ফেলতাম।কিন্তু তা আর হলো না।আফসোস!!! ভালো করে তায়াং ভাইয়াকে পচাতে পারিনি বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আফসোস করছিলাম।তখুনি হুট করে কেউ একজন হাত ধরে টেনে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবাক।

আমিঃ আরে কে আপনি? আমার হাত ধরেছেন কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? ছাড়ুন বলছি। জলদী ছাড়ুন।নয়তো কামড় দিবো বলে দিলাম।

আমি গাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলাম।কিন্তু সে এসবে তোয়াক্কা না করে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো।পরনে তার হালকা পেঁয়াজ কালার ব্লেজার, সেই রঙের প্যান্ট।সারা পার্টিতে আবছা আলো জ্বলছে। সেই আলোতে এতটুকুই দেখতে পেরেছি।বাইরের ছোট বাগানের এনে সে আমাকে নিয়ে দাঁড়ালো। আমি ঝাড়া মেরে তার হাত সরিয়ে ফেললাম।

🦋🦋🦋

—– কেমন আছো পাখি?

আমি হাত ঝাড়া মেরে সরাতেই সে কথাটা বলে উঠলো।আমি চোখ, মুখ কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকালাম।একি!!! এ তো দেখছি রোশান।ও এখানে কি করছে? ওফস সরি। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।আজ এনাজের সকল বিজনেস ডিলারকে এই পার্টিতে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। শেয়ার ব্যবসার সুবাদে রোশান তো এখানে থাকবেই। রোশান আলতো করে তার হাতটা আমার গালে রাখলো।আমি তার হাত সরিয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম।

আমিঃ দেখুন রোশান, আমি একজনের স্ত্রী। তাই হুটহাট আমার হাত,গাল ধরা আমি নিশ্চয়ই টলারেট করবো না। আমার দুই হাত দূরে থাকুন।কাছে আসার একদম চেষ্টা করবেন না।

থেমে থেমে কথাগুলো বলে আমি ওড়নার কোণা মোচড়াতে লাগলাম।আমার অনেক অস্বস্তিকর লাগছে।কেউ আমাদের একসাথে দেখলে খারাপ ভাবতে পারে।এনাজ দেখলে তো আমার সাথে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে।রোশান নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা দম ছেড়ে আবার বলা শুরু করলাম।

আমিঃ আমার স্বামী, সন্তান আছে। আপনিও বিয়ে করে নিন।তাহলে সব ভুলে যাবেন।আমি চাই না আপনার কারণে আমাদের সংসার নষ্ট হোক।
আর আমার কারণে আপনি কষ্ট পান।আপনি হয়তো মানুষ হিসেবে কখনো চাইবেন না আপনার কারণে আমার সংসারে অশান্তি হোক।আমার সন্তানটা দুই বছর পর ওর বাবাকে পেয়েছে। প্লিজ ওর কাছ থেকে ওর বাবাকে দূরে সরিয়ে দিয়েন না।কাউকে বিয়ে করে নতুন সংসার গড়ুন।

রোশানঃ বিয়ে করলে তোমাকেই করবো।তুমি না করলে তোমার ছোট বোনকে করবো।

আমিঃ মানে?

কথাটা বলে আমাকে এক চোখ মারলো রোশান।তারপর পাগলের মতো হাসতে লাগলো।আমি এর কান্ডে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।একি আমার শোকে পাগল হয়ে গেলে নাকি?

রোশানঃ মানে বোঝো নাই।আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি।আসলে আমি মজা করছিলাম।তুমি সিরায়াসলি নিয়ো না।হয়েছে কি………

—- রোশান, তুমি এখানে।আর আমি তোমাকে সারা পার্টিতে খুঁজে খুঁজে মরছি।এখানে কি করছো তুমি?

পেঁয়াজ কালার নেটের শাড়ি পরা একটা মেয়ে এসে রোশানকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো।মেয়েটাকে আমি আগে কখনও দেখিনি।আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে তার দিকে তাকালাম।রোশান ওর কোমড় ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তাকে বললো।

রোশানঃ ওহ জারা সুইটহার্ট। তুমি আমায় খুঁজছিলে বুঝি? আমি তো তোমায় মনে মনে মিস করছিলাম।তোমার সাথে একজনের পরিচয় করিয়ে দেই।(আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)এই হচ্ছে মিসেস এনাজ আহমেদ।

জারাঃ মিসেস এনাজ আহমেদ???

রোশানঃ চিনতে পারোনি তো।ওর নাম নোভা।

জারা চমকে আমার দিকে ভালো করে তাকালো।তবে ওর চাহনিতে আমি বিরক্ত দেখতে পেলাম।কিন্তু ও আমাকে দেখে বিরক্ত কেন হচ্ছে তা খুঁজে পেলাম না।অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলো।

জারাঃ ওহ্ নোভা।

জারা এমন করে আমার নাম নিলো যেনো আমাকে কত আগের থেকে চিনে।কি হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। রোশান আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

রোশানঃ পাখি, ওর নাম জারা।আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। আমার হবু বউ।

আমিঃ হবু বউ!!!!

আমি কপাল কুঁচকে হবু বউ শব্দটা উচ্চারণ করলাম।রোশান মুচকি হেসে উত্তর দিলো।

রোশানঃ হ্যাঁ, আমার হবু বউ। আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসবো।

আমিঃ কথাটা শুনে খুশি হলাম।

হঠাৎ জারার মোবাইলে একটা কল এলো।জারা কথা বলতে অন্য দিকে চলে গেল।আমি মনে মনে বেশ খুশি হয়েছি।যাক, এমপি সাহেবের অবশেষে সুমতি হলো।আমি হাত বাড়িয়ে বললাম।

আমিঃ কংগ্রাচুলেশনস।

রোশানঃ Thank You।

রোশান হাত মিলিয়ে নিলো।তারপর একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসলো।হাতের উল্টোপিঠে শব্দ করে একটা চুমু খেলো। আমি তড়িৎ গতিতে হাত সরিয়ে নিলাম।হাত মুছতে লাগলাম।আমি যদি জানতাম রোশান এমন কিছু করবে তাহলে কখনো হাত মেলাতে দিতাম না।এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কেন যে এর সাথে হাত মেলাতে গিয়েছিলাম।আমার কান্ড দেখে রোশান মিটমিট করে হাসছে।

এনাজঃ এখানে কি করছো বাটারফ্লাই?

পেছন থেকে রাগী স্বরে কথাটা বলে উঠলো এনাজ।আমি ভয় পেয়ে গেলাম।এনাজ আবার সবকিছু দেখে ফেলেনি তো।তাহলে তো আরেক ঝামেলা।নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। এই ব্যাটার সাথে কেন যে আগ বাড়িয়ে হাত মিলাতে গেলাম।

রোশানঃ কিছুই হচ্ছে না।কথা বলছিলাম আমরা দুজন।এখন আপনিও চলে এসেছেন।আপনি চাইলেও যোগ দিতে পারেন।

এনাজঃ ওহ আচ্ছা। শুধু কথাই হচ্ছিলো নাকি অন্য কিছুও।

এনাজ রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে৷ দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বললো।আমি তো ভয়ে শেষ। এনাজ কাঠ কাঠ গলায় আমাকে বললো।

এনাজঃ ভেতরে চলো।বলেছিলাম না আমার আশেপাশে থাকতে।তুমি কার অনুমতি নিয়ে বাইরে এসেছো।তোমাকে আমি বলেছি বাইরে আসতে? কিংবা তুমি কি আমাকে বলে এসেছো?

আমিঃ না।(মাথা নিচু করে)

এনাজঃ তাহলে কেন এসেছো?( ধমকের সুরে)

রোশানঃ আপনি ওকে শুধু শুধু বকছেন।আমি ওকে নিয়ে এসেছি।

এনাজঃ আপনি চুপ থাকুন।আমি আমার ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করছি আপনাকে নয়।

রোশানঃ আপনি ওকে জিজ্ঞেস করছেন।কিন্তু এভাবে জিজ্ঞেস করতে পারেন না।

এনাজ রেগে আমার দিক থেকে রোশনের দিকে ঘুরে কঠিন গলায় জবাব দিলো।

এনাজঃ এখন আমার বউকে আমি কিভাবে জিজ্ঞেস করবো তাও কি আপনাকে বলে করতে হবে আমাকে? আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কথার মাঝখানে আপনি কথা বলার কে?

রোশানঃ আমি কেউ না।তবে একটা কথা ভালো করে শুনে রাখুন।আপনি ওকে কখনো কষ্ট দিতে পারবেন না।ওর কথা ভেবে আমি এবারের মতো ছাড় দিলাম।কিন্তু পরেরবার দিবো না।বাই চান্স যদি আপনার কারণে আমার পাখি একটু কষ্টও পায় তাহলে আমি কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দিবো না।জোর করে হলেও ওকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবো।একটু ভুলের কারণে নিজের স্ত্রী, সন্তানকে হারিয়েন না।আমি যদি কোনভাবে খবর পাই আমার পাখিকে আপনি কষ্ট দিয়েছেন। তাহলে সত্যি আমি ওকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে দ্বিতীয় বার ভাববো না।সো বি কেয়ারফুল মিস্টার এনাজ।নিজের জিনিস নিজের কাছে যত্ন করতে শিখুন। নয়তো হারিয়ে গেলে আফসোস করবেন।একববার ফিরে পেয়েছেন বলে যে ২য় বার পাবেন এমনটা কিন্তু কোথাও লিখা নেই। আর হ্যাঁ একবার ওকে আমি কেড়ে নিলে ওর কোন খোঁজ আপনি পাবেন না।কথাগুলো ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিন।

🦋🦋🦋

ইতিমধ্যে জারাও চলে এসেছে। সে মেবি রোশানের কথাগুলো শুনেছে। যার কারণে ওর মুখ কালো হয়ে আছে।এনাজ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।আমি ভয় পাচ্ছি। আমার কারণে না ওরা দুজন আবার মারামারি শুরু করে দেয়।কিন্তু আমার ধারণা ভুল করে দিয়ে এনাজ রাগে গটগট করে ভেতরের দিকে যেতে লাগলো।আমিও ওর পিছু পিছু নিলাম।তবে যাওয়ার আগে জারা ও রোশানের কিছু কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে গেলো।

জারাঃ তুমি এসব কি বললে? তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে না।

রোশানঃ আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।

জারাঃ তাহলে এনাজকে এসব কথা বললে কেন?

রোশানঃ তুমি কি করে বুঝলে এটা এনাজ?

জারাঃ নোভাকে নিয়ে এতটা কেয়ারিং তো তোমার ও এনাজেরই আছে। তুমিই তো গত পরশু বললে।তাই ছেলেটার মুখের রিয়েকশন দেখে আমি সিউর হয়ে গেলাম এটা এনাজ ছাড়া অন্য কেউ নয়।

রোশানঃ ওহ আচ্ছা।আমার বউ দেখছি ভেরী ইন্টেলিজেন্ট।

জারাঃ হয়েছে আর প্রশংসা করতে হবে না। এখন বলো এসব কথা কেন বললে?

রোশানঃ আসলে ওকে একটু ভয় দেখালাম। আমি কখনো ওর কাছ থেকে নোভাকে কেড়ে নিবো না। নোভাকে ছাড়া ও পুরো নিঃস্ব। আমার তো বাবা-মা, তুমি আছো।কিন্তু ওর তো নোভা ছাড়া কেউ নেই। নোভাও ওকে ছাড়া ভালো থাকবে না। কিন্তু এখন এই ভয়টা দেখানো দরকার ছিলো।এনাজ এখন থেকে ভেবেচিন্তে নোভার সাথে রাগ দেখাবে।ওর মাথায় সবসময় এটাই ঘুরবে।যদি সে নোভার সাথে খারাপ বিহেভ করে আর তাতে নোভা কষ্ট পায় তাহলে আমি নোভাকে নিয়ে যাবো।এই ভয় পেয়ে ওকে কখনো কষ্ট দিবে না। যদিও এমনিও এই ভয় দেখানোর কোন দরকার ছিলো না। তারপরেও আমি দেখালাম। যাতে সে তার প্রেয়সীকে হারানোর ভয়ে আরো বেশি ভালোবাসে।

জারাঃ এতো বুদ্ধি রাখো কোথায় তুমি?

রোশানঃ এমপি তো আর এমনি এমনি হয়নি ম্যাডাম।বুদ্ধি না থাকলে এই পদে টিকতে পারতাম না। এসব কথা বাদ।সামনের মাসে আমরা বিয়েটা করছি।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে এবার ভালোবাসা দিয়ে সেসব পুষিয়ে দিবো।

রোশানের কথা শুনে জারা লজ্জায় লাল টমেটো হয়ে গেলো।আমি মুচকি হেসে সেখান থেকে প্রস্থান হলাম। ওরা ওদের মতো কথা বলুক।আমি বরং আমার স্বামী মহাদোয়ের রাগ ভাঙাতে যাই।

In Party………..

একটা পিচ্চি ছেলেকে নাভান ভেবে কোলে নিতে গিয়েছিলাম।পরে দেখি একটা বিদেশি ছেলে।পরনে নাভানের মতো কালো ড্রেস। পেছন থেকে পুরো নাভানের মতো লাগে।

আমিঃ ওফস সরি বাবু।

—-ইট’স ওকে আন্টি।

আমিঃ হোয়াট ইজ ইউর নেম?

—- মাই নেম ইজ লিয়ন জ্যামস।

আমিঃ নাইস নেম।

লিয়নঃ Thanks.

আমিঃ হোয়ার আর ইউ ফোরাম?

লিয়নঃ ইংলেন্ড।

আমিঃ ইউ আর সো কিউট।

আমি ওর গাল টেনে দিয়ে কথাটা বলতেই দেখি আমার পুত্র মহাশয় অগ্নি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যার মানে হলো তুমি ঐ বাচ্চাকে আদর কেন করলে।আদরের হাত ধরে সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।বাচ্চাটা নাভানকে দেখে এগিয়ে গেলো।তারপর ওর গালে নিজের হাত দুটো রেখে সামনের একটা লোককে উদ্দেশ্য করে বললো।

লিয়নঃ ওয়াও সো কিউট বেবী।থ্যান্কুও ডেডি।হি লুকস সো কিউট।

বাচ্চার কথা শুনে আমি অবাক।বলে কি পিচ্চি ছেলে। নিজের বয়স বড়জোর ৩ বছরের একটু বেশি হবে।সেখানে নাভানকে বেবী বলে।নাভান বাচ্চাটাকে দেখে আমার পেছনে এসে লুকালো।ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা এক মহিলা হাত নাড়িয়ে ডাক দিতেই ওর বাবা লিয়নকে কোলে করে সে দিকে চলে গেল।

আদরঃ ভাবী,স্যার আপনাকে ডাকছে।

আমিঃ তোমার স্যার কোথায়?

আদরঃ উত্তর দিকে গেলেই পাবেন।আপনি যান। নাভানকে নিয়ে আমি একটু পর আসছি।

আদর নাভানকে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো। আমি উত্তর দিকে যেতেই দেখলাম এনাজ দাঁড়িয়ে কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।আমাকে দেখেই তার মুখের হাসি ফুস।রোশান তো আমার ভালো করলো না।উল্টো আমাকে আরেক ফ্যাসাদে ফেলে দিলো।এই মহাশয়ের রাগ ভাঙাতে না জানি কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয় আমার।এত রাগ যে আমার জামাই কোথা থেকে আমদানি করে আল্লাহ জানে।এনাজ লোকটাকে বিদায় দিয়ে আমার হাত ধরে ওয়াসরুমের বেসিনের কাছে নিয়ে গেল।তারপর রোশান যেই হাতে ঠোঁট ছুঁয়েছিলো সেই হাত ইচ্ছে মতো হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে ধুতে লাগলো।এই রে কাজ সেরেছে!! সে তাহলে দেখে ফেলেছে রোশান যে আমার হাতে ঠোঁট লাগিয়েছে।এমনভাবে হাত ডলছে মনে হচ্ছে আমার হাতের চামড়া উঠিয়ে ফেলবে।আমি মুখটাকে ইনোসেন্ট করে ভয়ে ভয়ে বললাম।

আমিঃ আরে আস্তে।আমি ব্যাথা পাচ্ছি তো।

এনাজঃ আমার জিনিসে অন্য কারো স্পর্শ আমি কিছুতেই সহ্য করবো না।আগেও করিনি,এখন করবো না। এমনকি ভবিষ্যতেও করবো না।কথাটা ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নেও। যতখন পর্যন্ত আমার মনে না হবে ঐ রোশানের ঠোঁটের স্পর্শ তোমার হাত থেকে চলে গেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার হাত ধুতেই থাকবো।

এনাজের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। আমি আর কিছু বললাম না।এমনি আইটেম বোম হয়ে আছে। তারপর আবার কিছু বললে সে বোম ফেটেই যাবে।চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।পাক্কা দশ মিনিট আমার হাতটাকে ডলে, মুছে,ধুয়ে তারপর শান্ত হলো।আমার হাতটা লাল হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার কান্না পাচ্ছে। টিস্যু দিয়ে হাত মুছিয়ে দিলো।তারপর হাত ধরে টেনে পার্টির জায়গায় নিয়ে গেলো।সেখানকার একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

এনাজঃ এখান থেকে এক পাও নড়বা না।যদি আমি এসে তোমাকে না পাই তাহলে কিন্তু অনেক খারাপ হয়ে যাবে। আর ঐ রোশানকে যেনো তোমার আশেপাশে না দেখি।যদি দেখি তাহলে এখানে কিন্তু রক্তারক্তি হয়ে যাবে।

আমাকে বেশ কিছু সময় শাসালো।তারপর অন্য দিকে চলে গেল। আমি মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে চেয়ারে বসে রইলাম।কিছু সময় পর নাভানকে কোলে নিয়ে ফিরে এলো।সাথে একজন ক্যামেরাম্যান।নাভানকে আমার কোলে বসিয়ে নিজে চেয়ার ধরে দাঁড়ালো। কি হচ্ছে তা বোঝার জন্য আমি একবার এনাজের দিকে তাকিয়ে সামনে ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকাতেই সে ফট করে ছবি তুলে ফেললো।বেশ কয়েকটা ছবি তোলার পর ক্যামেরাম্যান চলে গেল। হঠাৎ হলরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে একজন বলে উঠলো।

—- মে আই কাম ইন??

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_39
#Writer_NOVA

—- মে আই কাম ইন?

পরিচিত গলার স্বর পেয়ে চট করে সেদিকে তাকালাম। আবছা আলো থাকায় ভালো করে মানুষটার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।তবে এনাজের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখে একটা প্রশান্তির হাসি।বহুদিন পর হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পেলে আমরা যেমন খুশি হই তেমনটা।সে ভেতরে ঢুকতেই সারা হলরুমে সাদা উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো। তার ওপর ফুলের পাপড়ি পরতে লাগলো উপর থেকে।আমি মানুষটাকে দেখে চমকে উঠলাম।

আমিঃ এনাম!!!!

এনাজ কোন কথা না বলে আমাকে পাশ কাটিয়ে এনামের দিকে ছুটে গেল।তারপর সবার সামনে জড়িয়ে ধরলো। বেশ কিছু সময় হয়ে যাওয়ার পরেও তারা কেউ কাউকে ছাড়ছে না বলে সবাই কানাঘুষা করতে লাগলে।ছেলেটা আসলে কে? তাজরানের কি হয়? আমি কিন্তু ঠিক বুঝে গেছি। তারা দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। দুজন দুজনকে ছেড়ে দিলো।তারপর এনামের হাত ধরে এনাজ আমার কাছে নিয়ে এলো।

এনাজঃ দেখ তো চিনিস কিনা?

এনামঃ কি যে বলো না ভাইয়া!!! ভাবীকে আমি চিনবো না তো কে চিনবে?

এনাজঃ এই বাচ্চাটা কে তা বলতো?

এনামঃ এটা আমার একমাত্র ভাইয়ের একমাত্র ছেলে এনান আহমেদ। আমি কি ভুল বলেছি ভাইয়া?

এনাজঃ মোবাইলে বলেছি তাতেই চিনে গেছিস।এই না হলে আমার ভাই।

এনামঃ আসসালামু আলাইকুম ভাবী।কেমন আছেন?

আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

এনামঃ আমিও ভালো আছি।ভালো না থাকলে কি আজ বিকালের ফ্লাইটে দেশে আসতে পারতাম।

এনাম আমার কোলের থেকে নাভানকে নিজের কোলে নিলো।তারপর ওর গালে, কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে ওকে আদর করতে লাগলো।হঠাৎ আমার চোখ গেলো এনামের পেছনে একটা মেয়ের দিকে।মাস দুয়েকের একটা বাচ্চা নিয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণের ঘটনায় মেয়েটার দিকে ভালো করে খেয়াল করিনি।পরনে শেওলা রঙের জর্জেট শাড়ি।বেচারী সাধারণত শাড়ি পরতে বোধহয় অভ্যস্ত নয়।শাড়ি,বাচ্চা সামলাতে সে অনেকটা হাঁপিয়ে পরেছে।আমি মেয়েটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে এনামকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম।

আমিঃ ও কে এনাম? ওকে তো কখনও দেখিনি।

এনাম একহাতে মাথা চুলকে মুখ নিচু করে ইতস্ততভাবে বললো।

এনামঃ আসলে ভাবী ও আমার ওয়াইফ নীতুয়া।আর আমাদের ছেলে এনায়েত আহমেদ।

আমি বিস্মিত চোখে এনামের দিকে তাকিয়ে রইলাম।দেবরজী আমার একা আসেনি, সাথে বউ,বাচ্চা নিয়ে এসেছে। এনাজ এগিয়ে গিয়ে নীতুর থেকে এনায়েতকে কোলে তুলে নিলো।এনামের হাতের ইশারায় নীতু আমার সামনে এসে নিচুস্বরে সালাম দিলো।

নীতুঃ আসসালামু আলাইকুম ভাবী।

আমিঃ ওয়ালাইকুমুস সালাম।মাশাআল্লাহ!! আমার দেবরজীর পছন্দ আছে বলতে হবে।একদম পরীর মতো একটা মেয়ে পছন্দ করেছে। তা দেবরজী,
লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে বউ,বাচ্চা নিয়ে ফিরলে।এটা কি ঠিক হলো।আমি তো ভেবেছিলাম দেবরজী আসলে মেয়ে দেখা শুরু করবো।কব্জি ডুবিয়ে দেবরের বিয়ের পোলাও,মাংস খাবো।তা কতদিন হলো বিয়ের?

এনামঃ দেড় বছর। কারো সাথে যোগাযোগ ছিলো না বলে জানাতে পারিনি।তাছাড়া নীতুর বাবা ওর বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলছিলো।তাই একপ্রকার তাড়াহুরো করেই বিয়েটা হয়ে গেছে। বিয়ের দুই মাস পর ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ হয়।তখন ভাইয়াকে জানাই।

তায়াং ভাইয়া ও নূর আপিও এনামের আসার খবর শুনে অন্য দিক থেকে এদিকে চলে আসলো।তায়াং ভাইয়া এসে এনামকে জড়িয়ে ধরলো।

তায়াংঃ কি অবস্থা এনাম? আছিস কেমন? তুই তো ভাই বাজিমাত করে দিলি।বউ,বাচ্চাসহ এসে আমাদের তাক লাগিয়ে দিলি।তোর ভাই বিয়ে হয়ে একটা ছেলেও হয়ে গেলো।আর আমরা এখনো বিয়েও করতে পারলাম না।একেই বলে কপাল।

আমিঃ ভাইয়া তুই জানতি এনামের বিয়ে হয়েছে?

তায়াংঃ আমাকে এনাজ সেদিন বললো।তোকে বলেনি এই কারণে যে তোকে একটা সারপ্রাইজ দিবে তাই।

আমিঃ সত্যি অনেক বড় সারপ্রাইজ পেয়ে গেলাম।

নূরঃ কেমন আছেন এনাম ভাইয়া?

এনামঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপু।আপনি কেমন আছেন?

নূরঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ভাইয়া আমরা কিন্তু দুটো ট্রিট পাই আপনার কাছে। একটা বিয়ের জন্য। আরেকটা বাচ্চার জন্য। ট্রিটের কথা ভুলেন না কেমন? ভুললে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।

এনামঃ ইনশাআল্লাহ, দুটো ট্রিটই পাবেন।

আমিঃ এই যে নাভানের আব্বু।দেখি আমার ছোট ছেলেকে আমার কাছে একটু দেন।আপনি কি একা নিবেন নাকি?

🦋🦋🦋

এনাজ এগিয়ে এসে এনায়েতকে আমার কোলে তুলে দিলো।মাশাআল্লাহ, বাবুটা দেখতে অনেক কিউট।একটু গুলুমুলু দেখতে।অনেকটা ওর মায়ের মতো হলেও অনেক কিছু এনামের পেয়েছে। এনাজ, এনামকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে অপরপাশে নিয়ে গেলো।নূর আপি আমার কাছ থেকে এনায়েতকে নিয়ে কোলে নিলো।আমি নীতুর সামনে গিয়ে বললাম।

আমিঃ তুমি কি আনইজি ফিল করছো নীতু? লজ্জা পেয়ো না। আমাকে বড় জা মনে না করে বড় বোন ভেবে সব বলে দিবে।

নীতুঃ আসলে ভাবী কখনও শাড়ি পরিনি তো।তাই কিরকম জানি লাগছে।মনে হচ্ছে এদিক দিয়ে খুলে যাচ্ছে, ঐদিক দিয়ে আঁচল সরে যাচ্ছে। ছোট থেকে অস্ট্রেলিয়ায় বড় হওয়ায় টপস,প্যান্ট,কুর্তি এসবে অভস্ত্য হয়ে গেছি।শাড়ি শুধু বিয়ের দিন পরেছিলাম।

আমিঃ অসুবিধা যখন হবে তাহলে পরলে কেন? যেই পোশাকে কম্ফোর্ট ফিল করবে সেটা পরবে।দেখো না আমি তাই গাউন পরে এসেছি।

নীতুঃ আসলে বাংলাদেশে এসেছি কে কি ভাবে ঐসব পরা দেখলে।তাই শাড়ি পরে এসেছি।ফ্লাইট থেকে নেমে সোজা এখানে চলে এসেছি। যার কারণে চেঞ্জ করার সময়ও পাইনি।

আমিঃ তুমি যদি চাও আমি ড্রেসের ব্যবস্থা করে দেই।

নীতুঃ না না ভাবী।তার কোন দরকার নেই। এখন থেকে কোথাও গেলে শাড়িই পরবো।তাই আগের থেকে অভ্যাস করে নেই।

আমি,নীতু ও নূর আপি একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।এনাজ এসে নাভানকে আমার কাছে দিয়ে গেলো।এনায়েতকে দেখে নাভান এগিয়ে গিয়ে পুটুর পুটুর করে নিচুস্বরে কথা বলতে লাগলো।তখুনি জুলেখা আন্টি ও মুরাদ আঙ্কেল পার্টিতে এসে উপস্থিত হলো।কোন দিকে না তাকিয়ে আমার কাছে চলে এলো।কুশলাদি জিজ্ঞেস করে নাভানকে কোলে তুলে নিলো।দুজন তো পাগল হয়ে গেছে নাভানকে দেখে। উনারা যেমন করে আদর করছিলো নাভানকে ঠিক যেনো নাভানের আপন দাদা-দাদি। আমি তাদের সাথে নূর আপি ও নীতুর পরিচয় করিয়ে দিলাম।

তায়াংঃ এনাজ আঙ্কেল-আন্টি তো চলে আসছে।এবার পার্টি শুরু কর।

এনাজঃ হ্যাঁ করছি।আরিয়ান কোথায়?

আরিয়ানঃ এই তো ভাইয়া আমি এখানে।

এনাজঃ এনাউন্সমেন্টের স্পিকার কোথায়?

তায়াংঃ আমি সব ব্যবস্থা করেছি।তুই স্টেজে ওঠ।

এনাজ সামনের ছোট স্টেজে উঠে গেল।হাতে মাইক তুলে নিয়ে চেক করলো।ছোট স্টেজের পুরোটা হার্ট সেইপের লাল বেলুন দিয়ে সাজানো।নিচের ফ্লোরেও বেলুন ছড়ানো-ছিটানো।হুট করে এনাজের পায়ের সাথে বেজে একটা বেলুন ফেটে গেল।এনাজ ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। যেটা দেখে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।পুরো পার্টি শান্ত দেখে আমি সবার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পেলাম লজ্জা। নূর আপির পেছনে গিয়ে লুকালাম।আড়াল থেকে দেখলাম এনাজ মুখ টিপে হাসছে।তায়াং ভাইয়াও মাইক হাতে স্টেজে উঠে গেল। মাইকে কয়েকবার হাত দিয়ে বারি দিয়ে এনাজ সাউন্ড ঠিক করে নিলো।তারপর বলতে শুরু করলো।

এনাজঃ গুড ইভিনিং এভরিওয়ান।আজ আপনাদের সাথে আমি অনেকগুলো আনন্দ শেয়ার করার জন্য এই পার্টির আয়োজন করেছি।গত পরশু আমরা বিশাল বড় একটা ডিল পাস করেছি। তাছাড়া কিছুদিন আগে আমাদের শেয়ার পাস হলো।মূলত এই দুটো কারণে আমরা পার্টির আয়োজন করিনি।আরো কিছু আছে। সেটা হলো আগামী মাসের ৭ তারিখে আমাদের কোম্পানির আরেক ওনার আরিয়ান আজওয়ারের বিয়ের ডেট ফিক্স করা হয়েছে। সাথে কিন্তু আরেকটা জুটির বিয়ে হবে।

আরেক জুটির কথা শুনে আমরা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলাম।কেউ বুঝতে পারছি না আরেক জুটি কে হতে পারে?

আমিঃ আন্টি, আরেক জুটির বিয়ে মানে? কার কথা বলছে আপনাদের ছেলে?

জুলেখাঃ আমিও তো বুঝতে পারছি না।

মুরাদঃ ধৈর্য্য ধরো বউমা।এখুনি তাদের নাম এনাউন্সমেন্ট ঘোষণা করা হবে।

জুলেখাঃ এই তোমরা বাপ-বেটা মিলে আবার কি ফন্দি করেছো বলো তো? আমাদের তো কোনকিছু জানানোর প্রয়োজনই মনে করো না।

মুরাদঃ মাথা ঠান্ডা করো জুলেখা। দেখো তোমার ছেলে কার নাম ঘোষণা করে।

এনাজঃ সবাই একটু শান্ত হোন।আমাকে তাদের নামটা বলতে দিন।আগামী ৭ তারিখে আরিয়ান ও এরিন ছাড়া যাদের বিয়ে হবে তারা হলো……..

এতটুকু বলে আবার থামলো এনাজ। সবাই উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সেটা দেখে তার মনে নিশ্চয়ই দুষ্টু বুদ্ধি খুলে গেছে। তাই সে নাম দুটো বলতে এত সময় নিচ্ছে। মুসকান আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে মিনমিন সুরে বললো।

মুসকানঃ ও বড় ভাবী, বাবা আর ভাইয়রা কি আবার আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললো নাকি।তাদের হাব-ভাব তো আমার ভালো ঠেকছে না।যদি অন্য কারো সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে তাহলে কিন্তু আমি পিংক কালারের বিষ খেয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিবো।

আমিঃ আরে টেনশন নিও না।তেমন কিছুই হবে না। আমি আছি তো তোমার সাথে। সবকিছু সামলে নিবো।

এনাজঃ আরেকজন হলো আমাদের আদরের ছোট বোন মুসকান।আগামী ৭ তারিখে আমার দুই ভাই-বোনের বিয়ে একসাথে ফিক্সড করা হয়েছে।

🦋🦋🦋

এনাজের কথা শুনে মুসকান কান্না করেই দিলো।আমি মুসকানকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম।আদরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখ টলমল করছে।চোখ মুছে আদর অন্য দিকে চলে যেতে নিলেই এনাজের বাকি কথা শুনে আদরসহ সবাই টাসকি খেয়ে গেলো।

এনাজঃ আরে আরে অনেকে এত আপসেট হচ্ছো কেন? আমার বোনের হবু বরের নামটা শুনবে না।আমার বোনের হবু বরের নাম হলো আদর।

আদরের নাম শুনে সবাই আরেকদফা অবাক।মুসকান খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আদর অবিশ্বাস্য চোখে এনাজের দিকে তাকালো। এনাজ চোখ দিয়ে ওকে আস্বস্ত করতেই আদর দৌড়ে স্টেজে উঠে এনাজকে জড়িয়ে ধরলো।

মুসকানঃ ধন্যবাদ ভাবী।অনেক অনেক ধন্যবাদ। আজকে আমি অনেক খুশি।তুমি নিশ্চয়ই ভাইয়াকে রাজী করিয়েছো।তার জন্য এত্তগুলা ভালোবাসা।

আমিঃ আমি কিছু বলিনি মুসকান।আমার মনে হয় তোমার ভাই আগের থেকেই জানতো।সেই তোমার বাবাকে ও আরিয়ানকে রাজী করিয়েছে। তারা তিনজন প্ল্যান করে এতকিছু করলো।

মুরাদঃ একদম ঠিক ধরেছো বউমা।এমনটাই হয়েছে।

জুলেখাঃ আমাকে তো একটু বলতে পারতে।

মুরাদঃ তোমাকে বললে তো তুমি আবার মেয়েকে বলে দিতে।তাহলে কি আর মুসকান এতবড় সারপ্রাইজ পেতো।

জুলেখা আন্টি মুখ ঝামটা দিলো।মুসকান আমাকে ছেড়ে ওর বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরলো।

তায়াংঃ আমি– আরিয়ান,এরিন, মুসকান, আদরকে স্টেজে আসার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ওহ্ আদর তো এখানেই আছে। বাকি তিনজন চলে আসুন।আপনাদের আংটি বদল হবে এখন।ভয় পাবেন না। যারা ভাবছেন আপনাদের ফ্যামেলীর কেউ নেই। তারা ভালো করে একটু খেয়াল করুন।ফ্যামেলীর লোক খুজে পেয়ে যাবেন।

আমি আশেপাশে তাকিয়ে এরিনের বাবা-মা কে পেয়ে গেলাম।জুলেখা আন্টি ও মুরাদ আঙ্কেল এর মধ্য একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখে সামনে এগিয়ে গেলেন।পরে জানলাম উনি আদরের মা।একটু অসুস্থ। জুলেখা আন্টি তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।একে একে সবাই স্টেজে উঠে পরলেন।যেই মুহুর্তে দুই কাপল আংটি বদল করবে সেই সময় এনাজ সবাইকে থামিয়ে দিলো।

এনাজঃ এক মিনিট। সবাই অপেক্ষা করুন।আমি স্টেজে আরো দুটো কাপল ডাকবো।তারাও চলে আসুন।

তায়াংঃ আর কে বাকি আছে এনাজ?

এনাজঃ বাকি তো অবশ্যই আছে। নূর আপি চলে আসো।সাথে রোশান দেওয়ান আপনার হবু বউকে নিয়ে স্টেজে চলে আসুন।

রোশানের কথা শুনে আমি এদিক সেদিক তাকালাম।এতক্ষণের ভেজালে আমার মাথা থেকে রোশান ও জারার কথাটা একদম মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো।তায়াং ভাইয়া স্টেজ থেকে নেমে এসে নূর আপির দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো।নূর আপি লাজুক মুখে হাতটা ধরলো।আরেক হাতে গাউন ধরে স্টেজে উঠে গেল। রোশান আমার সামনে এগিয়ে এলো।আমি ভয়ে কিছুটা দূরে সরে গেলাম।এনাজ আংটি আনতে ভেতরের দিকে গেছে। রোশান আমার সামনে এসে লো ভয়েজে বলল।

রোশানঃ আবার যদি তোমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে চাই তাহলে কি করবে পাখি?

আমিঃ মানে, আপনি কি বুঝাতে চাইছেন?

রোশানঃ সেবার তো ছেলে নিয়ে পালিয়েছিলে বলে অল্পর জন্য আমার বউ হতে পারলে না।এবার যদি এমনটা হয়।তাহলে কি করবে?(ভ্রু নাচিয়ে)

আমিঃ তার মানে আপনি ছিলেন সেই লোকটা।যে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো বিয়ে করার জন্য।
(অবাক হয়ে)

রোশানঃ ইয়েস পাখি।আমি ছাড়া কি অন্য কারো সাহস আছে নাকি।

আমিঃ এই খবর যদি এনাজ জানে তাহলে আপনার অবস্থা কি হবে জানেন তো?

রোশানঃ ঐগুলো পাস্ট ছিলো।তা নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। সেগুলো ভুলে গেলে তোমারও মঙ্গল সাথে আমারও।তবে তুমি যদি এনাজকে এই বিষয়ে বলো তাহলে আমি সত্যি তোমাকে আবার তুলে নিয়ে যাবো।(শয়তানি হাসি দিয়ে)

রোশানের কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম।আমার ভয়ার্ত মুখটা দেখে রোশান ফিক করে হেসে উঠলো।

রোশানঃ আমি মজা করছি।তুমি সবকিছু এতো সিরায়াসলি নেও কেন? আমি জারাকে সত্যি বিয়ে করবো।আর তোমার জীবন থেকে সরে যাবো।তাই ভয় পেয়ো না। তুমি এত ভয় পাও বলে তোমাকে ভয় দেখাতে আমার এতো ভালো লাগে।

আমাদের কথার মধ্যে জারা চলে এলো।ততক্ষণে এনাজও স্টেজে চলে এসেছে। জারা রোশানকে জিজ্ঞেস করলো।

জারাঃ কি ফুসুরফাসুর করছো তুমি?

রোশানঃ কিছু না বেবি। চলো।

🦋🦋🦋

রোশান নিজের হাতটা এগিয়ে দিতেই জারা রোশানের
বাহু ধরে স্টেজে উঠলো।সবাই যখন আংটি বদল করবে তখন তায়াং ভাইয়া আবার থামিয়ে দিলো।

তায়াংঃ একটু ওয়েট করো সবাই। আমরা চার কাপল না হয় সামনে বিয়ে করবো তার জন্য আংটি বদল করছি।কিন্তু বিবাহিত দুই কাপল কেন বাদ যাবে।এনাম,নিতু,নোভা চলে আয় তোরাও।

এনাজঃ আমাদেরটা আবার কেন? আমাদের তো বিয়ে হয়েই গেছে। দুই ভাইয়ের দুই ছেলেও আছে।

তায়াংঃ চুপ কর তুই। আজ ছয় কাপল নতুন করে ভালোবাসার শপথ নিবো।সবাই চলে এসো।

এনাম এসে নীতুর হাত ধরে স্টেজে নিয়ে গেলো।নীতুর ছেলেকে জুলেখা আন্টি কোলে তুলে নিলেন।আর নাভানের হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলো।এনাজ ধীর পায়ে স্টেজ থেকে নেমে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে এক হাত বাড়িয়ে দিলো।

এনাজঃ আমার হাতটা আবার নতুন করে ধরবে বাটারফ্লাই। কথা দিচ্ছি এবার কিছুতেই ছাড়বো না। যত বাঁধা আসুক, যত ঝড় আসুক শক্ত করে তোমার হাতটা ধরে রাখবো।তোমার হাত ছেড়ে দিলে একটা পুতুল বেবী পাবো কোথা থেকে? একটা পুতুল বেবীর জন্য হলেও তোমার হাতটা সারাজীবন ধরে রাখবো।

আমি এনাজকে চোখ রাঙিয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে নিলাম।তারপর ওর হাতের ওপর হাত রাখলাম।এনাজ এক ঝাটকায় সবার সামনে আমায় কোলে তুলে নিলো।সাথে সাথে করতালি ও সিটি বাজানো শুরু করলো সবাই। আমি লজ্জায় এনাজের বুকের সাথে মিশে রইলাম।স্টেজের ওপর উঠে আমাকে নামিয়ে দিলো।তারপর সবাই একসাথে আংটি বদল করে নিলাম।এনাজ হাঁটু মুড়ে বসে আমার বাম হাতের অনামিকায় আংটি পরিয়ে দিলো।তারপর সেই হাতে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তখুনি পেছন থেকে রোশান বলে উঠলো।

রোশানঃ এনাজ সাহেব আপনি তো চুমু দিলেন।এবার কি আমি একটা দিবো?

বক্সে মৃদু শব্দে গান বাজছে বলে রোশানের কথাটা শুধু আমরাই শুনতে পেরেছি। যেহেতু আমাদের পরেই রোশান,জারা দাঁড়িয়ে আছে,তাই কথাটা আমরা বাদে অন্য কেউ শুনেনি। এনাজ চোখ দুটো ছোট ছোট করে রোশানের দিকে রাগী লুকে তাকালো।রোশান ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে বললো।

রোশানঃ আরে রাগছেন কেন? যাস্ট কিডিং।

জারাঃ রোশান এসব কি?

রোশানঃ কিছু না বেবী।তুমি আমাকে আংটি পরিয়ে দেও।এত দেরী কেন করছো?

ছেলেরা সবাই যার যার হবু বউকে আংটি পরিয়ে দিলো।এবার মেয়েদের পালা।আমাদের সবাইকে একটা মেয়ে এসে আংটির বক্স দিয়ে গেলো।সেটা খুলে আংটি বের করে আমরা মেয়েরাও যার যার ভালোবাসার মানুষটাকে পরিয়ে দিলাম।পুরো ঘটনাটাই ক্যামেরাবন্দি করা হলো।এখন ছবি তোলার পালা।এনাজ আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো।

এনাজঃ এই যে মিসেস এনাজ আহমেদ। অনেক তো আপনি করে বলেছেন। এখন থেকে কিন্তু তুমি করে বলতে হবে।

আমিঃ বয়েই গেছে আমার😏।আপনাকে আপনি করে বলতেই আমার ভালো লাগে।

এনাজঃ ভালো লাগলে হবে না। এখন থেকে অভ্যাস করতে হবে। আপনি শব্দটা আমার কাছে পর পর লাগে।প্লিজ বাটারফ্লাই এখন থেকে তুমি করে বলো।আমার নাভানের আম্মু, প্লিজ এই কথাটা রেখো।

আমিঃ ওকে নাভানের আব্বু চেষ্টা করবো।

এনাজঃ চেষ্টা নয় পারতেই হবে।

আমিঃ ওকে এনাজ সাহেব।আপনি যা বলবেন তাই হবে।

এনাজঃ আবার আপনি😤।

আমিঃ ওহ সরি।তুমি যা বলবে তাই হবে।

এনাজঃ এই তো আমার বউটা।

সবাই একেক পোজ নিয়ে ছবি তুলছে।আমাদের ছবি তুলতে ক্যামেরা ম্যান আমাদের দিকে আসতেই এনাজ দ্রুত পায়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল।তারপর নাভানকে কোলে তুলে স্টেজে চলে এলো।

এনাজঃ আমাদের একমাত্র ছেলেকে ছাড়া আমরা কি ছবি তুলতে পারি বলো? ও তো আমাদেরই ভালোবাসার অংশ।

আমি মুচকি হাসলাম।এনাজ নাভানের দুই গালে চুমু খেলো।তা দেখে নাভান তার বাবার গলা ধরে মাথা সামনে এনে গালে চুমু খেলো।

এনাজঃ এবার তোমার আম্মুকে দেও।

নাভানঃ আত্তা(আচ্ছা)।

আমি নাভানের দুই গালে হাত রেখে কপালে গাঢ় করে একটা চুমু দিলাম।তারপর এনাজের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম।এনাজের কথা শুনে নাভান ওর বাবার কোল থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালটাকে সামনে এনে গালে টাইট করে একটা চুমু দিলো।এই সুন্দর মুহুর্তটাকে ক্যামেরাবন্দি করতে ভুললো না ক্যামেরাম্যান।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-৩৬+৩৭

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_36
#Writer_NOVA

বর্তমানে আমি, এনাজ, নাভান এই তিনজন একটা কফি হাউসে বসে আছি।সাথে আদর,মুসকানও আছে। ওরা অন্য ফ্লোরে আছে। এনাজ ওদেরকে কল করে এখানে চলে আসতে বলেছে। আগামীকাল পার্টির জন্য শপিংয়ে এসেছি। আমি আসতে চাইনি এনাজ জোর করে নিয়ে এসেছে। নাভান ওর বাবার কোলে চুপটি করে বসে আছে। ঘন্টাখানিক শপিংমলে ঘুরে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছি।আমার কোন সমস্যা হয়নি।সব শপিং ব্যাগ ও ছেলেকে এনাজ সামলিয়েছে।এটা তার শাস্তি। আমাকে জোর করে কেন এনেছে। এবার বুঝুক মজা।

এনাজঃ খাচ্ছো না কেন?

আমিঃ ওরা আসছে না কেন?

এনাজঃ ওরা এখুনি চলে আসবে।

আমিঃ ওদের দুজনকে আপনি একা ছাড়লেন কেন? আমার কিন্তু কিছু একটা গোলমাল মনে হচ্ছে।আমার থেকে কি আপনি কিছু লুকাচ্ছেন?

এনাজঃ কোথায়? না তো।তোমার থেকে কি লুকাবো?

আমি এনাজের দিকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকালাম।তবে কিছু বললাম না।আমার কাছে আদর ও মুসকানকে একটু সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদের মাঝে রিলেশন আছে। কিন্তু আন্দাজে তো ঢিল মারা যায় না।তাই আমি চুপ হয়ে গেলাম।

আমিঃ কি হয়েছে আমার নাভান বাবার? চুপ করে আছো যে? শরীর খারাপ লাগছে।

নাভান আমার কথার কোন উত্তর দিলো না। চুপ করে ওর বাবার বুকে মাথা রাখলো।আমার কিছুটা খোটকা লাগলো।ব্যস্ত হয়ে ওর কপালে হাত রাখলাম।

এনাজঃ কি হয়েছে?

আমিঃ ওর শরীরটা তো জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে। কপালটা হালকা গরম।

এনাজঃ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো?

আমিঃ ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। বাসায় জ্বরের ঔষধ আছে। বাসায় গিয়ে খাইয়ে দিবো।এর জন্য আমার মানিক চুপ করে আছে। শরীর তো ভালো লাগছে না। সেটা তো আমাকে বলবে।

এনাজঃ ঔষধের নাম বলো।আমি নিচের ফার্মেসী থেকে নিয়ে আসি।বাসায় যেতে দেরী আছে।

আমিঃ এখন আনবেন? না মানে আপনি আবার কষ্ট করে নিচে যাবেন।

এনাজঃ এখন আনবো না মানে।তুমি পাগল হয়ে গেছো।বাসায় যেতে সে কত দেরী।এতক্ষণ আমার ছেলে অসুস্থ থাকবে।আমার কষ্টের থেকে আমার ছেলের কষ্ট আমার কাছে বেশি। তুমি আমাকে নাম বলো আমি নিয়ে আসি।

আমি আর কিছু বললাম না।চুপচাপ ঔষধের নাম বলে দিলাম।এনাজ নাভানকে কোলে নিয়ে নিচের ফ্লোরে যেতে লাগলো।আমি ততক্ষণে কফির মগে চুমুক দিলাম।একা বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিলাম।কফি শেষ করে মগটা রেখে উঠে গেলাম।

মুসকান রেগে দ্রুত পায়ে হাঁটছে। তার পেছন পেছন একগাদা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে আদর।মুসকানের সামনে এসে দুই হাত মেলে মুখটাকে ইনোসেন্ট বানিয়ে আদর বললো।

আদরঃ প্লিজ মুসু আমাকে একটু সময় দেও।আমি এখন সবাইকে আমাদের কথা কি করে বলি? আমাকে তো তোমার উপযুক্ত বানাতে হবে।তারপর তোমাদের বাসায় প্রস্তাব দিবো।

মুসকানঃ আমি কোন কথা শুনছি না। তুমি এখন যেই অবস্থায় আছো সেই অবস্থায় তোমাকে মানতে আমার কোন সমস্যা নেই। তাহলে তোমার এতো কিসের সমস্যা?

আদরঃ তুমি বিষয়টা বুঝতেই চাইছো না।আমি মিডেল ক্লাশ ফ্যামেলীর ছেলে।আমি যদি তোমার উপযুক্ত না হয় তাহলে তোমার ফ্যামেলী আমাদের বিয়ে কেন দিবে?

মুসকানঃ আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভালোবাসো।এর থেকে বড় আর কি হতে পারে?

আমিঃ কি হচ্ছে এখানে?

আমার কন্ঠ শুনে আদর,মুসকান দুজনেই ঘাবড়ে গেল।মুসকান ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো।

মুসকানঃ আরে ভাবী কখন এলে?

আমিঃ এসেছি অনেক আগে।তাকিয়ে তাকিয়ে তোমাদের কাহিনি দেখছিলাম।এখন আমাকে কি বলবে হচ্ছেটা কি?

আমার গম্ভীর কণ্ঠের কথা শুনে দুজন চমকে উঠলো। উপর দিয়ে গম্ভীর থাকলেও ভেতরে আমার পেট ফেটে হাসি আসছে।এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিলাম।এবার আমার সন্দেহ পুরো সত্যি হলো।আমি ওদের সব কথা শুনেছি। এরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে।আদর ভয়ে ভয়ে বললো।

আদরঃ তেমন কিছু না ভাবী।

আমিঃ কেমন কিছু তাহলে? তোমরা এতো ঘামছো কেন? মানুষ তো তখুনী ঘামে যখন সে মিথ্যে বলে নয়তো কিছু লুকাতে চায়।

মুসকানঃ গরম লাগছে তো ভাবী তাই।

আমিঃ ওহ আচ্ছা। তোমরা কি সোজাসাপ্টাভাবে আমাকে বলবে। নাকি অন্য ব্যবস্থা নিবো।আমাকে ভালোয় ভালোয় বলে দিলে তোমাদের সাহায্যও করতে পারি।নয়তো প্যাচ লাগিয়ে দিবো।

🦋🦋🦋

আমার কথা শুনে আদর,মুসকান দুজনে একসাথে চমকে উঠলো। আমি এবার হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।ফিক করে হেসে উঠলাম।এতে ওরা দুজন আমার দিকে একদফা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

আমিঃ আরে ভয় পেয়ো না। আমি বাঘ বা ভাল্লুক কেউ নই।আমি মজা করছিলাম।

মুসকান বুকে ফুঁ দিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর হালকা হেসে শাসিয়ে বললো।

মুসকানঃ ভাবী!!! তুমি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।

আদরঃ আমার তো মনে হচ্ছিলো কেউ আমার বুকের হৃৎপিণ্ডটার বরাবরি ছুড়ি চালিয়ে দিয়েছে।এখন জান ফিরে আসলো।

আমিঃ ঘটনা কি? কবের থেকে চলে এসব🤨?(ভ্রু নাচিয়ে)

মুসকানঃ আসলে ভাবী আমরা একে অপরকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু বাসায় ভয়ে বলতে পারছি না। এদিকে বাবা-মা আমার বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছে।আমাদের রিলেশন এক বছর ধরে। আদর যখন প্রথম জয়েন করছে তখন থেকে।কিন্তু এখন ভয় করছে। যদি বাবা-মা, ভাইয়ারা আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেয় তাহলে আমরা শেষ।

আমিঃ ওহ,এই ব্যাপার।আমিও এটাই সন্দেহ করেছিলাম।

হঠাৎ মুসকান আমার দুই হাত ওর দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে আমাকে অনুরোধের সুরে বললো।

মুসকানঃ ভাবী, তুমিই পারবে আমাকে সাহায্য করতে।তুমি বড় ভাইয়াকে প্লিজ আমাদের জন্য রাজী করাও।তুমি ছাড়া অন্য কেউ বড় ভাইয়াকে রাজী করাতে পারবে না। আর বড় ভাইয়া বললে বাবা ঠিক রাজী হয়ে যাবে।ভাইয়ার কথা বাবা কখনোই ফেলে না।আর বাবা রাজী মানে সবাই রাজী।

আমিঃ আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো।তোমরা ভয় পেয়ো না। দেখছি কি করা যায়।

আদরঃ Thanks ভাবী।

মুসকান হাত ছাড়িয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

মুসকানঃ এত্তগুলা Thanks। এর জন্য তো তুমি আমার কিউট ভাবী।

আমিঃ হয়েছে আর পটাতে হবে না। ঐদিকে চলো।তোমার ভাই আমাদের খুঁজবে।

আমরা তিনজন হাঁটতে লাগলাম। ওরা দুজন একসাথে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে গেছে। আমি কিছুটা পিছিয়ে গেলাম। হঠাৎ মনে হলো আমাকে কেউ ফোলো করছে।সাথে একটা হালকা পারফিউমের ঘ্রাণ পেলাম।ওড়নাটা নাকের সামনে ধরতেই পারফিউমের ঘ্রাণটা তীব্র হলো।এনাজ আজ এই পারফিউম দিয়ে এসেছে। সে যখন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো তখন হয়তো গায়ে লেগে গেছে। আমি জানি আমাকে কেউ ফোলো করছে না।মাঝে মাঝে আমার হ্যালুসিয়েশন হয়😵।যেমন হয়েছিল সেদিন রাতে(পর্ব-০৯)। সেদিন আমার সাথে কেউ ছিলো না।কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছিলো কেউ আমাকে ওপর থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে দেখছিলো।আর তার গায়ের ঘ্রাণ আমার বড্ড চেনা মনে হচ্ছিলো। আসলে সেখানে কেউ ছিলো না।মাঝে মাঝে আমার এরকম হ্যালুসিয়েশন হয়।

(কেউ বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। মাঝে মাঝে আমারও এমন হ্যালুসিয়েশন হয়।আমার সাথে কেউ নেই কিন্তু তারপরও মনে হয় কেউ আছে,কেউ আমাকে ফোলো করছে। যার গায়ের ঘ্রাণ আমি পাচ্ছি। সেই বিষয়টা আমি গল্পে উল্লেখ করছি।সত্যি সেদিন গল্পের নোভার আশেপাশে কেউ ছিলো না। এটা আমার আরো আগে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো।কিন্তু আমি ভুলে গেছি। তার জন্য এক্সট্রিমলি সরি। এর জন্য সত্যি ক্ষমাপার্থী আমি।)

পিছনে পরে গিয়েছিলাম বলে দ্রুত পায়ে মুসকানের পাশে এসে দাড়ালাম। কফি হাউসে এসে বসে রইলাম।শপিংমলের থার্ড ফ্লোরের পূর্ব পাশের জায়গা জুড়ে বিশাল কফি হাউস। সেখানে যেতেই দেখতে পেলাম এনাজ নাভানকে নিজ হাতে ঔষধ খাইয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমার চোখটা ছলছল করে উঠলো।ছোটবেলায় যখন ঔষধ খেতে না চাইতাম তখন আব্বুও আমাকে এভাবে খাইয়ে দিতো।আব্বুর কথা মনে হতেই চোখ দুটো থেকে আপনাআপনি পানি পরে গেলো।
আমি দ্রুত পানি মুছে নিলাম।

মুসকানঃ কি হয়েছে ভাবী? কাঁদছো কেন?

আমিঃ কোথায় না তো।চলো ভেতরে যাই।

ধীর পায়ে এনাজ যে টেবিলে বসেছে সেই টেবিলে বসে পরলাম।এনাজ আমাদের দিকে না তাকিয়ে বোতল খুলে পানি ঢেলে নিলো একটা খালি মগে।সেটা সাবধানে নাভানকে খাইয়ে দিলো।তারপর টিস্যু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলো।আমি এক ধ্যানে তাকে দেখতে লাগলাম।মনে মনে বললাম।

আমিঃ এভাবে বাচ্চা সামলানো ও কেয়ার করার জন্য হলেও তোমাকে আমার চাই😌।(মনে মনে)

আদরঃ কোথায় গিয়েছিলেন স্যার?

এনাজঃ তোমরা কোথায় গিয়েছিলে তাই বলো? তোমাদের খুঁজতে খুজতে হয়রান হয়ে গেছি আমি।

মুসকানঃ আমরা এদিকটাই ছিলাম ভাইয়া।

এনাজঃ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চললো।এখনো শপিং শেষ হলো না।মেয়েদের নিয়ে এলে এই একটা জ্বালা।এদের শপিং শেষ হওয়ার নামও নেয় না।

আমিঃ আমরা কি আসতে চেয়েছিলাম।আপনিই তো জোর করে নিয়ে এলেন।এখন নিয়ে এসে খোঁটা দেওয়া হচ্ছে। করবো না শপিং। মুসকান চলো তো।(রাগ দেখিয়ে)

মুসকানঃ হুম চলো ভাবী।

আমি উঠতে নিলেই এনাজ হাত চেপে ধরে কিছুটা রাগী কন্ঠে বললো।

এনাজঃ সাহস থাকলে এখান থেকে এক পা নড়ে দেখো।তারপর দেখো আমি কি করি? চুপচাপ এখানে বসে থাকো।এসেছো আমার ইচ্ছায় যাবেও আমার ইচ্ছায়।এই মুসকান বস।তোকে কি আলাদা করে কিছু বলতে হবে।

মুসকানঃ না ভাইয়া।আমি বসে রইলাম।(ভয় পেয়ে)

মুসকানের কথা শুনে আদর মিটমিট করে হাসতে লাগলো।এতে মুসকান চোখ রাঙানি দিলো।তাতে আদর ভদ্র ছেলের মতো ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বসে রইলো।বেশ কিছু সময় পর আমরা সেখান থেকে উঠে লেডিস ফ্যাশনে ঢুকে পরলাম।আমি ও মুসকান ড্রেস নেড়েচেড়ে দেখছি।আদর,এনাজ চুপ করে পাশের দুটো সিটে বসে আছে। নাভান এনাজের কোলে ঘুমিয়ে পরছে।

🦋🦋🦋

—- এই পিচ্চি মেয়ে। একটু এদিকে আসো তো।

এক ভদ্রমহিলার ডাক শুনে আমি ও মুসকান দুজনেই পেছনে ঘুরলাম।একটা মহিলা এই লেডিস ফ্যাশনে আসার পর থেকে আমাদেরকে ফোলো করছিলো।তার ডাক শুনে মুসকান জিজ্ঞেস করলো।

মুসকানঃ আমাদের কিছু বলছেন আন্টি।

—- তোমাকে নয়।তোমার পাশের ব্লু ড্রেস পরা পিচ্চি মেয়েকে বলছি।

আমি আহাম্মকের মতো মুসকানের দিকে তাকালাম।আমাকে কোন এঙ্গেলে পিচ্চি মেয়ে মনে হয়। বিয়ের আগেই আমাকে বিবাহিত মনে হতো।এখন তো একটা ছেলে আছে। ছেলে হওয়ার পর একটু গুলুমুলু হয়ে গেছি।আর উনি আমাকে পিচ্চি বলছে।আমার পরিচিত কেউ বললে এতক্ষণে সারা শপিংমল মাথায় তুলে ফেলতাম।কিন্তু অপরিচিত মানুষকে তো কিছু বলা যায় না। তাই চুপচাপ তার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

আমিঃ কিছু বলবেন আন্টি?

—- আসলে আমার মেয়েটা তোমার মতোই।তাই তোমার মাপে কিছু ড্রেস কিনতাম।তুমি একটু দাঁড়াও আমি মাপ নিচ্ছি।

আমি হাসিমুখে তার সাথে দাঁড়িয়ে রইলাম।মিনিট দশ হয়ে গেলো সে ড্রেসই পছন্দ করতে পারছে না।বরং আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছো।আমার পার্সোনাল প্রশ্ন করছে।আমার বাসা কোথায়?বাবা-মা কোথায় থাকে?আমরা কয় ভাই-বোন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেও হাসি মুখে কমবেশি উত্তর দিতে লাগলাম।আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এনাজ এগিয়ে গেলো।

এনাজঃ কোন সমস্যা বাটারফ্লাই?

আমিঃ না। উনি উনার মেয়ের জন্য ড্রেস কিনবে।কিন্তু তার মেয়েকে সাথে আনেনি।আমার মতোই নাকি তার মেয়ের বডির সাইজ।তাই মাপ নিচ্ছেন।

—- এটা কে হয় তোমার?

আমিঃ আমার হাসবেন্ড।

—- তুমি বিবাহিত!!!! (অবাক চোখে)

আমিঃ জ্বি আন্টি।শুধু বিবাহিত নই।আমার একটা ছেলেও আছে। এই যে এটা আমার ছেলে।

আমার কথা শুনে বিস্মিত চোখে মহিলা তাকিয়ে রইলেন। তারপর যা বললেন তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

—- আসলে মা আমি মনে করেছি তুমি অবিবাহিত। তোমাকে দেখতে পিচ্চি মনে হচ্ছিলো।আমার বড় ছেলেকে বিয়ে করাবো।ওর জন্য অনেক দিন ধরে মেয়ে খুজছি।তোমাকে দেখেই আমার ছেলের জন্য ভীষণ পছন্দ হয়েছিলো।তাই তোমার সাথে কথা বলার জন্য মেয়ের ড্রেসের কথা বলছি।এখন তো দেখছি তুমি বিবাহিত। সাথে বাচ্চাও আছে। আমাকে মাফ করে দিও।আমি আসলে বুঝতে পারিনি।(এনাজের দিকে তাকিয়ে) সরি বাবা।

এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে মহিলাকে বললো।

এনাজঃ ইট’স ওকে আন্টি।

মহিলা অন্য দিকে চলে গেল। তার ছেলের জন্য তো পছন্দ করেনি।আমাকে বিশাল বাঁশ খাইয়ে দিয়ে গেল।আমার স্বামী মহাদোয় তো হেব্বি চটে গেছে। কিন্তু আমার কি দোষ? আমি কি মহিলাকে সেধে গিয়ে বলেছিলাম আমাকে আপনার ছেলের জন্য পছন্দ করুন।

এনাজঃ বোরখা কোথায় তোমার?

আমিঃ বাসায়।

এনাজঃ বোরখা কি আলমারিতে সাজিয়ে রাখার জন্য কিনছো।এখুনি চলো।তোমাকে আমি আরেকটা কিনে দিবো।যেটা তুমি এখুনি পরবে।আর কখনো বোরখা ছাড়া বাসা থেকে বের হলে পা ভেঙে হসপিটালে ভর্তি করে রাখবো।

আমিঃ আজব তো!!!

এনাজ সামনে এসে আরেকদফা রাগ ঝাড়ালো।এক হাত দিয়ে আমার ডান হাত ধরে রেগে বললো।

এনাজঃ হাতের চুড়ি,নাকের নাকফুল কোথায়? তোমার স্বামী কি এখনো মৃতই আছে।

আমিঃ হুট করে যদি চুড়ি,নাকফুল পরি তাহলে লোকে সন্দেহ করবে।তখন আবার আমার চরিত্রে দাগ লাগাতে উঠেপড়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাই পরিনি।

এনাজঃ লোকের কথার গুষ্টি কিলাই।আমাকে পুরো উদ্ধার করে ফেলছো। কে কি বললো তাতে কানে দিবে না।চলো আমার সাথে।

এনাজ রেগে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।পেছনে তাকিয়ে দেখি মুসকান মুখে হাত দিয়ে মিটমিট করে হাসছে।আর আদর অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত ধরে একটা বোরখার স্টোরে এনে সেখান থেকে কালো রঙের বোরখা কিনে দিলো।তারপর ধমকি-ধামকি দিয়ে সেটা পরালো।তারপর গোল্ড জুয়েলারির শপ থেকে চিকন দুগাছি চুড়ি কিনে নিজ হাতে আমায় পরিয়ে দিলো।তার পছন্দ মতো গোল্ড ও ডায়মন্ড পাথরের মিশ্রিত একটা নাকফুল কিনলো।সেটাও নিজ হাতে নাকে পরিয়ে দিলো।

আমি ইনোসেন্ট ফেস করে রেখেছি।সারা শপিংয়ে আমি আর এনাজের সাথে কোন কথা বলিনি।শপিং শেষ হলো মগরিবের আজানের পরপর।আমাকে ও নাভানকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে এনাজ চলে গেল। আমি পেছনে না তাকিয়ে নাভানকে কোলে নিয়ে গটগট করে ভেতরে ঢুকে পরলাম।কথা নেই এই বেডার সাথে হুহ😏!!!

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_37
#Writer_NOVA

পূর্ব দিগন্তে সূর্য মামা উঁকি দিয়েছে বহু আগে । উঠবে উঠবে করে শেষ পর্যন্ত সূর্য উঠে তার কিরণে সারা পৃথিবীকে আলোকিত করে ফেলেছে ।বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাপ-বেটার জন্য অপেক্ষা করছি আমি। ঘন্টাখানিক হলো তারা একসাথে জগিং করতে বের হয়েছে। তায়াং ভাইয়ার সাথে মিনিট খানিক আগে কথা হলো।তারা নাকি তাদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। আজ তায়াং ভাইয়ার দাদীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।তার জন্য তায়াং ভাইয়ার বাবা-চাচা ও ফুপিরা মিলে গ্রামের বাসায় মিলাদের আয়োজন করছে।তায়াং ভাইয়া অবশ্য বিকালে চলে আসবে।আজ সন্ধ্যায় এনাজ যে পার্টির আয়োজন করছে সেখানে তায়াং ভাইয়া না থাকলে তো এনাজ পুরো তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে।তায়াং ভাইয়ার দাদীর কথা মনে হতেই চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। উনি মানুষ হিসেবে অনেক ভালো ছিলেন।আমি যখন তায়াং ভাইয়াদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতাম তখন প্রায় তিনি গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতেন।আমায় ও তন্বীকে কখনও আলাদা চোখে দেখেননি।তন্বী হলো তায়াং ভাইয়ার ছোট বোন।আমার থেকে এক বছরের ছোট তন্বী।আমার একটা মাত্র খালামণির একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। তানভীর রহমান ওরফে তায়াং ও তন্বী রহমান।তন্বীর বিয়ে হয়ে গেছে বছর দুই আগে।ওর হাজবেন্ড বেসরকারি এক ব্যাংকের কর্মকর্তা।ওর এক বছরের একটা মেয়েও আছে। দাদীর কথা মনে হতেই আমার স্মৃতির পাতায় ঝলমল করে উঠলো একটা দিন।

ফ্লাশব্যাক………….❣️

আজ সারা বাড়ি একটা গোছানো পরিবেশ।হবেই তো। আজ যে তায়াং ভাইয়ার দাদী আসেছে গ্রাম থেকে।উনি বেশিরভাগ সময় গ্রামেই থাকেন তার ছোট ছেলের সাথে। ডাক্তার দেখাতে কিংবা বেড়াতে মাঝে মাঝে আসেন।উনি মানুষটা খুব ভালো।অন্য দশজনের মতো খিটখিটে মেজাজের নয়।খালামণিকে অনেক ভালোবাসেন।তায়াং ভাইয়া আর তন্বী তো দাদী বলতেই অজ্ঞান।আমাকেও অনেক আদর করেন তিনি।তন্বী কলেজে গেছে।আমার আজ যেতে ইচ্ছে করেনি।তাই বাড়িতে।দাদী সোফায় বসে পান সাজাচ্ছেন। আমি খালামণির সাথে টুকটাক কাজে সাহায্য করছি।তখুনি কলিংবেল বেজে উঠলো।এখন নিশ্চয়ই তায়াং বজ্জাত ছেমরায় আসছে।ও ছাড়া আর কে হবে।দাদী সোফা থেকে হাঁক ছারলো।

দাদীঃ বড় বউমা,দেখো কে এসেছে? নিশ্চয়ই আমার দাদুভাই হবে।কতক্ষণ ছেলেটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।জলদী খুলে দেও।আমি তো একা উঠতে পারবো না। জানোই তো বাতের ব্যাথা।উঠলে বসতে পারি না। বসলে উঠতে পারি না।

খালামণিঃ দিচ্ছি মা।আমার হাতে রক্ত লেগে আছে।মুরগী কাটছি।(আমার দিকে তাকিয়ে) নোভা,যা তো গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে আয়।

আমিঃ যাচ্ছি খালামণি।

হাতের থেকে আলুর ঝুড়িটা রেখে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে দরজার সামনে গেলাম।সিটকিনি খুলে দিতেই দেখলাম,দরজার অপাশে তায়াং ভাইয়া হাতের আঙুলের ডোগায় বাইকের চাবি ঘুরাচ্ছে।এমন একটা ভাব যেনো কোন নবাবী কাজ সেরে নবাব পুত্তর এসেছে। সাথে মিস্টার আনাইজ্জা কলার দেখা পেলাম।এ লোকটা এখানে কি করছে?নিশ্চয়ই তায়াং ভাইয়ার মুখে শুনেছে বাসায় আজ ভালো-মন্দ রান্না হবে।ওমনি ছোচার মতো খেতে চলে এসেছে। একে নিয়ে আর পারি না বাপু।আসছে তো ভালো কথা।এখন তো বাটারফ্লাই, বাটারফ্লাই বলে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলবে।মাঝে মাঝে এদের ওপর ভিষণ রাগ হয় আমার।কিন্তু রেগেও লাভ নেই। এই দুটো হলো তিতা বেহায়া।

তায়াংঃ কি রে দরজা থেকে সরবি?নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শো অফ করবি?আমরা তোকে দেখতে ইচ্ছুক নয়।সামনে থেকে সর।ভেতরে ঢুকতে দে।মুখটাকে এমন পেচার মতো করে রেখেছিস কেন?

আমিঃ চোখের মাথা কি খেয়েছিস?আমি কখন মুখ পেচার মতো করে রাখলাম?তোরা ভেতরে ঢুকে যা।মানা করছে কে?

তায়াংঃ তোর মতো একটা হাতি পুরো দরজা দখল করে রাখলে ঢুকবো কোথা দিয়ে?

আমিঃ নিজেদের দিকে একটু তাকা।তাহলে দেখতে পারবি কে হাতি?

তায়াংঃ বকবক না করে সর তো।আমার ডার্লিংয়ের সাথে দেখা করতে দে।তোর জন্য ৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড দেরী হয়ে গেলো।আমার ডার্লিং কোথায়?

আমিঃ এ্যহ আইছে।সারা সকাল খবর ছিলো না। আর এখন আসছে ডার্লিং। দাদীকে তোর সাথে কথা বলতে মানা করবো।

তায়াংঃ যা করার কর।আমার ডার্লিং আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারবে না।

কথাগুলো বলে হাতের কনুই দিয়ে আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল তায়াং ভাইয়া।আমি হালকা একটু ব্যাথা পেয়েছি। সেদিকে ঐ বেডার খেয়াল নেই। সে নিজের মতো ভেতরে ঢুকে গেল। আমি হাত দিয়ে ব্যাথার স্থানে ডলতে ডলতে সামনে তাকালাম। এতক্ষণ আমাদের দুই ভাই-বোনের মাঝে এনাজ একটা কথাও বলেনি।চুপচাপ শুনছে আর মিটমিট করে হাসছে।সেও তায়াং ভাইয়ার পিছু পিছু চলে গেল।এতে আমি বেশ অবাক হলাম।সূর্য আজ কোনদিক দিয়ে উঠছে।মিস্টার আনাইজ্জা কলা আমাকে কিছুই বললো না। অন্যদিন হলে তো এই পাঁচ মিনিটে দশবার তার মুখে বাটারফ্লাই শব্দটা শুনে ফেলতাম।ধূর,যা খুশি তা করুক। আমার কি?মুখ ভেংচি মেরে রেগে দরজা আটকিয়ে ওদের সামনে গেলাম।সোফার কাছে যেতেই তায়াং ভাইয়া জোরে চিৎকার করে বললো।

তায়াংঃ ও সুন্দরী, কখন এলে?নতুন কোন প্রেমিক পাইছো নাকি সুন্দরী? এসে আমার খোঁজও নেও না।

কথাগুলো বলতে বলতে দাদীকে জড়িয়ে ধরলো।দাদী তায়াং ভাইয়ার কান টেনে বললো।

দাদীঃ আমি নতুন প্রেমিক পাইছি নাকি তুই নতুন প্রেমিকা পাইছিস দাদাুভাই?সেজন্য তো এই বুড়ির খবর নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করিস না।

তায়াংঃ আহ ছাড়ো।লাগছে তো।

দাদী ভাইয়ার কান ছেড়ে দিলো।কান ছেড়ে দিতেই ভাইয়া দাদীর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো।

তায়াংঃ নাগো ডার্লিং।তোমার মতো আজও কাউকে পেলাম না।তাই তো প্রেম করতে পারিনি।সুন্দরী তুমি কি যে বলো না।

আমিঃ ভাইয়া তুই কি বললি? আবার বল, আবার বল।তুই আজও কাউকে পাসনি🤨?

তায়াংঃ তুই এখানে কি করিস?যা কাজে যা।তুই হলি কুটনি বুড়ি। নির্ঘাত এখন আমার সাথে আমার সুন্দরীর ব্রেকআপ করার ধান্দায় আছিস।যা ভাগ।

আমিঃ সব শোধ তুলে রাখলাম।সময় হলে সুদসহ ফেরত দিবো।মনে রাখিস😏।

তায়াংঃ যা যা ভাগ।

🦋🦋🦋

এনাজ বহু বছর থেকেই এই বাসায় আসা-যাওয়া করে।তায়াং ভাইয়ার জানে জিগার দোস্ত বলে কথা।সেই সুবাদে বহু আগের থেকেই দাদী এনাজকে চিনে।তাছাড়া দাদীর সাথে এনাজের বেশ ভাবও আছে।আমি এগুলো সকালে খালামণির থেকে জেনেছি। কাজ করতে করতে এটা ওটা প্রশ্ন করতে করতে এনাজের কথা উঠেছিলো।তখন খালামণি বলেছে।

এনাজঃ আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো ডার্লিং?এক নাতি পেয়ে আমাকে দেখছি ভুলেই
গেছো😒? হুম ভালো ভালো।(মুখ গোমড়া করে)

দাদীঃ আরে আমার এনাজ ডার্লিং যে।তা কবে ফিরলে বিদেশ থেকে? তোমাকে কি আমি ভুলে যেতে পারি?আমার কত হ্যান্ডস্যাম বয়ফ্রেন্ডটা,একে ভুলে গিয়ে নিজে ঠকবো নাকি।

এনাজঃ হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।

আমিঃ দাদী তুমি ভালোই পাম মারতে পারো।জিও দাদী জিও।তোমার পাম মারার তারিফ করতে হয়।তবে চোখ দুটো আবার নষ্ট করো না। জঙ্গলের আনাইজ্জা কলাকে তুমি হ্যান্ডসাম বলছো।কি পরিমাণ তেল যে তুমি মাখতে পারো তা তুমি নিজেও জানো না। (মনে মনে)

মনে মনে কথা বলে নিজেই মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।এনাজ সামনে গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরলো। তায়াং ভাইয়া তো সে কখন টুপ করে দাদীর কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে সোফায় শুয়ে পরেছে।দাদী ওর মাথায় খুব যত্ন সহকারে বিলি কেটে দিচ্ছে।আমাকে হাসতে দেখে তায়াং ভাইয়া হুংকার ছারলো

তায়াংঃ তুই এখনো সরিস নি।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস?তোকে না এখান থেকে যেতে বলছি।নিশ্চয়ই আমাদের এভাবে দেখে হিংসে হচ্ছে। তাই মনে মনে শয়তানি বুদ্ধি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস।

আমিঃ হু হু আমার তো বয়েই গেছে। সবাইকে নিজের মতো ভাবিস না।তোর হিংসে হয় বলে যে আমার হবে এমন কোন কথা নেই। তাছাড়া তোর আগে আমি দাদীর আদর নিয়েছি।(দাদীর দিকে তাকিয়ে) দাদী, ওর চুলে বিলি না কেটে কয়েক গোছা চুল ছিঁড়ো তো।সবসময় আমার সাথে লেগে থাকে।মাথার চুল ছিঁড়লে যদি ঐ গোবর মাথায় একটু বুদ্ধি খুলে।আর সবাইকে নিজের মতো ভাবা বন্ধ করে।

দাদীঃ তোরা এখনো সেই ছোটবেলার মতো লেগে থাকিস?একটুও বদলাসনি।

তায়াংঃ এই শাঁকচুন্নি জীবনে বদলাবেও না।

আমিঃ একদম শাঁকচুন্নি বলবি না ভাইয়া।ভালো হবে না কিন্তু। (রেগে)

তায়াংঃ যা ভাগ চোখের সামনে থেকে। এখন তো তুই আরো দূর্বল হয়ে গেলি নোভা।আমাদের দলের আরো একজন সদস্য বেড়ে গেলো।আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া।(শয়তানি হাসি দিয়ে)

আমিঃ যা যা মুড়ি চাবা তুই। এই নোভা একাই একশো।কাউকে দরকার নেই আমার।আর দাদী কিন্তু বলে নি তোর দলে।তাই এতো খুশি হইস না।

তায়াংঃ আমার সুন্দরী আমার দলেই থাকবে।তা আর কষ্ট করে বলতে হবে না।তাই এখন তুই গিয়ে মনের দুঃখে মুড়ি চাবা।(শয়তানি হাসি দিয়ে)

আমিঃ হু হু😏।আসছে দল নিয়া।চল ফট এখান থেকে।

তায়াংঃ তুই ফট।

দাদীঃ থামবি তোরা।দুদিন পর বিয়ে হলে বাচ্চার বাবা-মা হয়ে যাবি।আর এখন নিজেরাই ঝগড়া করিস।

এনাজঃ কি শুরু করলা তোমরা?বাটারফ্লাই, যাও এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো তো।

আমিঃ ঠান্ডা পানি দিয়ে কি করবেন আপনি?

এনাজঃ দুটোর মাথায় ঢালবো।কি বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছো তোমরা দুজন।

আমিঃ ওরে আল্লাহ রে! কত ভালো মানুষ। দাদীর সামনে ন্যাকা সাজা হচ্ছে। কিছুই বুঝে না।উনি এমন একটা ভাব করছে, এই প্রথম আমাকে আর তায়াং ভাইয়াকে এভাবে লেগে থাকতে দেখলো।দুটোর একটাকেও আমি ছারবো না বলে দিলাম।সুযোগ আমারও আসবে।এখন শুধু দাদী আছে বলে আমিও ভালো মেয়ে সেজে আছি।(মনে মনে)

এনাজঃ কি বললাম, দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও।তোমাদের মাথায় ঢালার জন্য না আনো।আমার খাওয়ার জন্য তো এক গ্লাস পানি আনো।বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

তায়াংঃ কাকে কি বলছিস?ও নিজে এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় নাকি তার সন্দেহ। আর তুই ওকে পানি আনতে বলছিস।ওর আশায় থাকলে, তুই তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে মরবি।

আমি কটমট করে তায়াং ভাইয়ার তাকিয়ে কিচেনে চলে গেলাম।সেখান থেকে দুই গ্লাস লেবু শরবত বানিয়ে নিয়ে এলাম।টি-টেবিলের ওপর ট্রে রেখে তার পাশে দাঁড়ালাম।

তায়াংঃ আমি কি সঠিক দেখছি😮?তুই আমাদের জন্য শরবত করে এনেছিস।আল্লাহ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এনাজ আমাকে একটা চিমটি কাট তো।তবে আমি সিউর, নিশ্চয়ই তুই এর মধ্যে কিছু মিশিয়েছিস।নয়তো এনাজ একবার বলতেই ছুটে গিয়ে নিয়ে আসতি না।

আমিঃ দেখছো দাদী, দেখছো।এর জন্য বলে কারো ভালো করতে নেই। আমি ভালো বলে ওদের জন্য শরবত করে আনলাম।আর কুত্তাটা আমাকে সন্দেহ করছে।এসব কি সহ্য করা যায় তুমিই বলো।

দাদী কোন উত্তর দিলেন না।মিটমিট করে হাসতে লাগলেন।এনাজ ইতিমধ্যে গ্লাস খালি করে ফেলছে।গ্লাসের শরবত টুকু শেষ করে একটা ঢেকুর তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বললেন।

এনাজঃ তোমার হাতের লেবুর শরবত আর চায়ের কোন জুড়ি নেই। আমি সারাদিন খেয়ে থাকতে পারবো।তোমার হাতে সত্যি জাদু আছে বাটারফ্লাই।

তায়াংঃ হইছে এত সুনাম করিস না।অলরেডি ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। আরো ফুলালে ফেটে যাবে।এরকম শরবত না আমি চুটকি তেই বানাতে পারি।শরবত বানানো আহামরি কোন কাজ নয়।

আমার ইচ্ছে করছে তায়াং বজ্জাতটার মাথা ফাটাতে।ও নিজেই আমার হাতের বানানো জিনিস পছন্দ করে।কিন্তু জীবনে স্বীকার করে না।আর এনাজ তো আমার বানানো চা ও শরবত দুটোর পাগল।দুপুরে এলে মাস্ট ওর আমার হাতের শরবত,আর বিকেলে এলে আমার হাতের চা লাগবেই। যেই পর্যন্ত আমি না বানিয়ে খাওয়াবো।ততক্ষণ এই বাসা থেকে এনাজ যাবে না।

মনে মনে তায়াং ভাইয়াকে কতগুলো কথা শোনানোর প্রস্তুতি নিলাম।কিন্তু তার আগেই কিচেন থেকে খালামণির ডাক আসতেই আমি মুখ ঝামটা মেরে সেদিক চলে গেলাম।এই ছেমরা আমার মুডটাই নষ্ট করে দিছে।আমি চলে যেতেই তিনজন হো হো করে হেসে উঠলো। যার কারণটা আমি খুঁজে পেলাম না।হঠাৎ এদের কি হলো, আর কিসের জন্য হাসলো তা আমার জানা নেই। আমি জানতে চাইছিও না।মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে কিচেনের কাজে মনোযোগ দিলাম।

ফ্লাশব্যাক এন্ড………..❣️

চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো।মানুষটার স্মৃতি আছে কিন্তু মানুষ নেই। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিলাম।এরিন,হিমি এখনো উঠেনি।সকাল সকাল এনাজ এসে বলে সে নাকি ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে বের হবো।আমিও মানা করলাম না।বাবা-ছেলের এখন একসাথে থাকা উচিত। রাস্তার পাশে চোখ পরতেই দেখি দুজন জগিং করতে করতে এদিকেই আসছে।বাবা-ছেলের পরনে একিরকম জগিং স্যুট, একি রকম জুতো।নাভানের জিনিসপত্র এনাজ আসার সময় নিয়ে এসেছে। আমার কাছে দুজনকে মনে একজন সিনিয়র এনাজ আরেকজন জুনিয়র এনাজ।পাশাপাশি আসছে দুজন।দৃশ্যটা দেখে মুহুর্তে মনটা ভালো হয়ে গেলো। এক ধ্যানে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুজনকে একসাথে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে ।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-৩৪+৩৫

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_34
#Writer_NOVA

—- হ্যালো লিসেনার।কেমন আছেন সবাই?ফিরলাম বিজ্ঞাপনের পরপরি। আমি RJ নোভানাজ কিন্তু চলে এসেছি লাভ কমপ্লেন নিয়ে বহু আগে।আপনারা শুনছেন ঢাকা এফএম 90.04।এখন সময় ৫ টা বেজে ০৭ মিনিট।লাস্ট ঘন্টায় কিন্তু চলে এসেছি আমরা। যাওয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। যারা এখনো আমার সাথে এড হোননি তারাও জলদী করে চলে আসেন।কি অবস্থা সবার? দিনকাল যাচ্ছে কেমন? আমি কিন্তু বিন্দাস আছি।আল্লাহর রহমতে আলহামদুলিল্লাহ চলছে সব।আপনারা জলদী জলদী করে টেক্সট,কমেন্ট করে ফেলুন।এখন আপনাদের পছন্দের সব গান বাজিয়ে দিবো।তাই যত দ্রুত সম্ভব আপনাদের প্রিয় গানের কথা আমাকে জানিয়ে দিন।আপনারা জানাতে থাকেন ততক্ষণে আমি কি করি, কি করি? হুম পেয়েছি। কতগুলো টেক্সট, কমেন্ট পড়তে পারি।পুরান ঢাকা থেকে তিশান জিজ্ঞেস করেছে, আপু কেমন আছো? আলহামদুলিল্লাহ ভালো তিশান।আপনি কেমন আছেন? মানিকগঞ্জ থেকে সুপ্তি জিজ্ঞেস করেছে, আপু আজকে তোমাকে আজ অনেক খুশি খুশি লাগছে ঘটনা কি? এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি বলে প্লিজ কিছু মনে করো না।আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম।অন্য দিনের তুলনায় আজ তোমাকে বেশি খুশি লাগছে তো তাই।আরে সুপ্তি কিছু মনে করার নেই। আমি কিছুই মনে করিনি।আজকে আমি সত্যি অনেক খুশি।আমরা যখন আমাদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কিংবা মানুষকে হারিয়ে ফেলি।যেটা বা যাকে কখনো আর ফিরে পাবো না।কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেটা আবার আমাদের কাছে ফিরে আসে। তখন কতটা খুশি লাগে বল তো? সবকিছু একটা ঘোরের মতো লাগে।খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।আমিও আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটাকে পেয়েছি। তাই এত খুশি।আমার তো ইচ্ছে করছে উড়াধুরা ডান্স করতে।হি হি হি 😁।মিরপুর থেকে পারভেজ জিজ্ঞেস করছে, আপু তুমি কি ম্যারিড? ভাই আমার একটা দুই বছরের বেবী আছে। তাহলে এবার বুঝে নিন বিয়ে হয়েছে কিনা।কমেন্ট পরবো এখন। নিশাত জাহান লিখেছে, আপু আমার কমেন্ট পড়ো না কেন? কে বলেছে আপু পড়ি না।এই তো পড়ে ফেললাম।কষ্টের নদী আইডি থেকে একজন কমেন্ট করছে আপু আমার জন্য হৃদয় খানের কোন গান প্লে করে দিও।ভাইয়া কোন গান প্লে করে দিবো একটু বলে দিলে ভালো হতো।আপনি গান ডেডিকেট করে দিন।আমি অবশ্যই বাজিয়ে দিবো।আরিফ হাসান কমেন্ট করে জানিয়েছে তার জন্য আরফিন রুমির মন রাখো পাঁজরে গানটা বাজিয়ে দিতে।খুব সুন্দর একটা গান।আমারও খুব পছন্দ। আচ্ছা আমি বাজিয়ে দিবো।কি ব্যাপারা হুম? দুদিন শো করতে আসিনি বলে আপনারা আমাকে ভুলে গেছেন হুম।এটা কিন্তু ঠিক নয়।কমেন্ট,টেক্সট এত কম কেন? আড়ি দিয়ে দিবো কিন্তু সবার সাথে।নুসরাত টেক্সট করেছে।আপু প্লিজ আমার জন্য ইমরান মাহমুদুলের “তুই তো দেখিস না” গানটা প্লে করে দিবে।প্লিজ আপি, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।এতবার অনুরোধ। এতবার করে যেহেতু নুসরাত অনুরোধ করলো।আমি কি ফেলে দিতে পারি বলেন।চলুন শুনে আসি ইমরান মাহমুদুলের কন্ঠে তুই তো দেখিস না গানটি।গানের পরে পাঁচ মিনিটের বিজ্ঞাপন বিরতি নিবো।তাই কোথাও যাবেন না।আমার সাথেই থাকুন, ঢাকা এফএমর সাথে থাকুন।

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

তুই ছাড়া একেকটা দিন, কি যে যন্ত্রণা
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা(×২)
দুচোখ কি দহনে তুই তো দেখিস না
তুই ছাড়া একেকটা দিন, কি যে যন্ত্রণা
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা(×২)

চোখের ভেতর বৃষ্টি হয় হৃদয়টা হয়ে যেন নদী
তোর না থাকার একেকটা খন ছুঁয়ে দেখতি যদি(×২)
আমায় ছেড়ে কখনো দূরে যেতি না
তুই ছাড়া একেকটা দিন, কি যে যন্ত্রণা
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা(×২)

হাজার জনম চাই না তোরে একটা জনম শুধু চাবো
বুকপর ভেতর নিশ্বাস জুড়ে তোকেই শুধু পাবো।(×২)
এক জনমের প্রতিখনে আড়াল হবো না।
তুই ছাড়া একেকটা দিন, কি যে যন্ত্রণা
বুকের ভেতর অন্তহীন নীল নীল বেদনা(×২)

♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♥♥♥♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

গান প্লে করা শেষে বিজ্ঞাপন বিরতি দিলাম।বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইলের ভাইব্রেশনে শব্দ পাচ্ছিলাম।যদিও কানে হেডফোন থাকায় পাওয়ার কথা নয়।কিন্তু মোবাইলটা সামনে থাকায় একবার হাত পরেছিলো তার ওপর।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পেলাম আননোন নাম্বার থেকে তিনটা মিসড কল এসেছে। কে কল করতে পারে তা ভাবতে ভাবতেই আরেকবার ঐ নাম্বার থেকেই কল চলে এলো।রিসিভ করে কানে দিতেই জোরে চিৎকারের শব্দ পেলাম।

——– ভাবী-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই!!!!

আমিঃ মুসকান??

মুসকানঃ হ্যাঁ, ভাবী আমি মুসকানই।কোথায় তুমি? তোমার নামে বিচার আছে।

আমিঃ আমি আবার কি করলাম?

মুসকানঃ তুমি কি করো নি তাই বলো? আমাদের একটা গুলুমুলু ভাতিজা আছে তার কথা আমাদেরকে কেন বলোনি? এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।

আমিঃ তোমরা জিজ্ঞেস করোনি তাই আমি বলিনি।তোমরা যদি জিজ্ঞেস করতে তাহলে তো আমি বলতামই।

মুসকানঃ আমরা কি করে জানবো? তাজ ভাইয়া বলছে তার বেবী নাকি ছয় মাসে পেটে থাকতে মারা গেছে। তাই আমরাও সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছি।গতকাল রাতে এসে বলছে তোমাদের একটা দুই বছরের বাচ্চা আছে। ভাইয়া খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো।আমরা শুনে প্রথম ভেবেছি ভাইয়া বোধহয় তোমার শোকে পাগল হয়ে গেছে। পরে ভাইয়া তোমাদের তিনজনের ফ্যামেলী ফটো দেখালো।যেটা গতকাল তুলেছিলো।আম্মু তো পাগল হয়ে গেছে তোমাদের ছেলেকে বাস্তবে দেখতে।এখন তোমার শাস্তি হলো ছেলেকে নিয়ে সোজা আমাদের বাসায় চলে আসবে। কোন অযুহাত শুনবো না।

আমিঃ আজ তো আসা সম্ভব নয় মুসকান।আজ কোথাও যাবো না। শরীরটা ভালো লাগছে না।তাছাড়া সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

মুসকানঃ তাহলে আগামীকাল।

আমিঃ আগামীকাল তোমার ভাইয়ার অফিসে আজ বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং আছে। সব ফাইল আমার কাছে। আমি যদি না যাই তাহলে মিটিং হবে না।এতে কোম্পানির বিশাল লস হয়ে যাবে। অন্য একদিন যাবো।

মুসকানঃ আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।

আমিঃ কি???

মুসকানঃ তুমি এনানকে নিয়ে আগামীকাল অফিসে চলে আসো।আমিও ভাইয়াদের সাথে অফিসে চলে আসবো।তাহলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

আমিঃ আমি তো শো করতে এসেছি। আগামীকালও শো করতে হবে।তখন এখান থেকে বাসায় গিয়ে নাভানকে আনতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।

মুসকানঃ আগামীকাল মিটিং কয়টায়?

আমিঃ এগারোটার দিকে।

মুসকানঃ আগামীকাল দশটার দিকে বাসায় গিয়ে তুমি এনানকে বাসা থেকে নিয়ে আসবে।ওকে নিয়ে আসবে মানে নিয়ে আসবে।তুমি এগারোটার আগে চলে এসো।বাকি কিছু আমি সামলে নিবো।আর হ্যাঁ,আরেকটা কথা তোমাকে না ভাইয়া শো করতে মানা করেছে। তাহলে তুমি শো করতে আসছো কেন?

আমিঃ না মানে আসলে (ধূর কি বলি এখন? যেমন ভাই, তেমন বোন।কিছু তো একটা বলতে হবে।কি বলবো, কি বলবো? পেয়ে গেছি)বাসায় বোর হচ্ছিলাম তো তাই চলে আসছি।

মুসকানঃ তুমি যদি এনানকে না আনো তাহলে আমি বলে দিবো তুমি শো করতে এসেছো।কথাটা মনে রেখো।

আমিঃ ওরে পাঁজি মেয়ে।

মুসকানঃ হি হি জলদী চলে এসো কালকে।আমি রাখছি।

আমিঃ মুসকান একটা কথা ছিলো।

মুসকানঃ হ্যাঁ, ভাবী বলো।

আমিঃ আরিয়ান তো জানতো আমার ছেলে আছে। তাহলে তোমাদের বলেনি কেন?

মুসকানঃ এই ষাঁড় গরুর কথা আর বলো না ভাবী।আহাম্মক একটা। তোমাদের ছেলেকে দেখে মনে করছে এটা তোমার বান্ধবী হিমি নাকি এমি কি যেনো নাম। ওহ হ্যাঁ হিমি।হিমির ছেলে মনে করছে।গতকাল ভাইয়া ছবি দেখানোর পর আরিয়ান ভাইয়া বলছে, “আমি তো এই বাচ্চাকে আগেই দেখেছি। কিন্তু আমি ভাবছি হিমির ছেলে।যেহেতু ভাবীর বাচ্চা পেটে থাকতে মারা গেছে সেহেতু তার বাচ্চা আসবে কোথা থেকে? আর আমাদের ভাই তো এখানেই ছিলো।নতুন করে বেবী হওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না😶।ভাই ছাড়া নতুন বেবী পেটে আসবে কি করে?” ও কথাগুলো এভাবে বলছে জানো?এর বদমাশ মার্কা কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ।

আমিও হাসতে লাগলাম।আরিয়ান সত্যি অনেক ফাজিল ছেলে।ও ভাবছে নাভান হিমির ছেলে তাই সে কাউকে কিছু জানায়নি।আর ও জানতো আমার বাচ্চা পেটে থাকতে মারা গেছে। আর ওর ভাইতো গত আড়াই বছর ধরে ওদের কাছেই আছে। তাহলে আরেকটা বেবী হওয়ারো চান্স নেই। তাই সে ধরেই নিয়েছে নাভান হিমির ছেলে। আমি মুসকানের সাথে কথা শেষ করে কল কেটে দিলাম।বিজ্ঞাপন বিরতি শেষ হয়ে গেছে। আবার শো শেষ করতে হবে। এনাজ যদি জানে আমি শো করতে এসেছি তাহলে আমার খবর আছে। শো-টা বেশি দিন চালাতে পারবো বলে মনে হয় না।

🦋🦋🦋

সন্ধ্যা নেমেছে বহু আগে। পুরো পৃথিবী রাতের কালো আঁধারে ডুবে গেছে। এই আঁধারের সাথে সাথে আরেকজনের জীবনও আঁধারে ডুবে গেছে। সে আর কেউ নয়।রোশান দেওয়ান!!!বিষন্ন মনে একের পর এক সিগারেট ফুঁকছে রোশান।সারা রুম অগোছালো। মদের বোতলগুলো এদিক সেদিক পরে আছে।নেশায় বুদ হয়ে একপাশে পরে আছে রোশান।রোশানের চেহারার অবস্থা অনেক খারাপ।চুলগুলো অগোছালো, এলোমেলো। চোখ,মুখ লাল হয়ে আছে। পুরো বিধ্বস্ত লাগছে ওকে।কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তমাল তার বসকে পর্যবেকক্ষণ করছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে গোছালো ছেলেটা পুরো অগাছালো হয়ে গেছে। ওকে দেখলে এখন কেউ বিশ্বাস করতেই পারবে না এটা যে আগের রোশান।তমাল ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে রোশানের সামনে দাঁড়ালো। ভয়ে ভয়ে মৃদুস্বরে ডাকলো।

তমালঃ বস!!!

রোশানঃ হুম বল।

রোশান মাথা না উঠিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললো।এতে তমাল কথা বলার সাহস পেয়ে গেল।কোন ভনিতা ছাড়া বলে উঠলো।

তমালঃ এই পর্যন্ত আধা ঘণ্টার মধ্যে দুই প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলছেন।সারাদিনে মদ গেলাও হয়েছে কয়েক বোতল।আরো খেলে সমস্যা হবে। আপনার তো অভ্যাস নেই।

রোশান মাথা উঠিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।সেই হাসিতে তমাল স্পষ্ট চাপা কষ্টের দেখা পেলো।

রোশানঃ কিছু হবে না তমাল।আমার জন্য চিন্তা করো না।আমি ঠিক হয়ে যাবো।তবে কিছু দিন যাক তারপর। এত তাড়াতাড়ি ওকে ভুলতে পারবো না আমি।আমার একটু সময় লাগে।এবার তো কিছুই না।সেবার যখন আমার পাখির বিয়ে হয়ে গেলো তখন সারারাত সিগারেট টানতাম।নয়তো বারে গিয়ে পরে থাকতাম।তখন আমাকে একটা মেয়ে সামলিয়ে ছিলো।মেয়েটার নাম ছিলো জারা।বাবার বন্ধুর মেয়ে। বাবা ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে চেয়েছিলো।কিন্তু আমি মানা করে দেই।জারা আমায় খুব ভালোবাসতো জানো।কিন্তু আমি ওকে ঠকাতে চাইনি। ওর ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আবারো নোভার পেছনে ছুটেছিলাম।অনেক ভালোবাসি ওকে।ওর জায়গা আমি অন্য কাউকে দিতে চাই না।

তমালঃ ঐ জারা নামের মেয়েটা কোথায়?

রোশানঃ ইউরোপ কান্ট্রিতে আছে।

তমাল অবাক চোখে রোশানের দিকে তাকিয়ে রইলো। রোশান কখনো কাউকে নিজের কোন কথা বলে না।কতটা কষ্টে থাকলে কেউ এভাবে কথা বলে তা তমালের জানা নেই। এই মুহুর্তে তমাল মনে মনে আল্লাহর কাছে একটা দোয়া করছে।আর সেটা হলো সেই জারা মেয়েটা যেনো এখন ফিরে আসে। একমাত্র ঐ মেয়েটাই রোশানকে সামলাতে পারবে।তমাল মুখ খুলে কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার আগে বাসার কোলিং বেল বেজে উঠলো। তমাল দ্রুত পায়ে সদর দরজার দিকে চলে গেল ।

তমাল দরজা খুলতেই অবাক হয়ে গেলো।দরজার অপরপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। দেখতে,শুনতে সবদিক দিয়ে মাশাআল্লাহ। চেহারায় আছে লাবণ্যতা।পরনে নেভি ব্লু কালার হাটু অব্দি টপস,কালো কালার জিন্স, গলায় কালো রঙের ওড়না পেঁচানো। পায়ে নেভি ব্লু রঙের কেডস, হাতে ল্যাগেজ,চুলগুলো লাল রং করা।বয়স ২৪ না হলেও তার কাছাকাছি হবে।মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না তমালের।

তমালঃ কাকে চাই?

— রোশান আছে?

পিচ্চি মেয়ের মুখে রোশানের নাম শুনে কিছুটা রেগে গেল তমাল।এতটুকু মেয়ে নিজের থেকে বড় ছেলেকে নাম ধরে ডাকছে বিষয়টা পছন্দ হলো না তমালের।চোখ মুখে বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো।

তমালঃ হ্যাঁ,আছে।কিন্তু আপনি কে?

— আমি জারা রহমান।রোশানের বাবার বন্ধুর মেয়ে।

কথাটা শুনে চমকে তাকালো তমাল।নিমিষেই ওর মুখে থাকা বিরক্তি খুশিতে রূপান্তরিত হলো।আল্লাহ তাহলে তার দোয়া এত তাড়াতাড়ি কবুল করে নিয়েছে।এর জন্য বলে মন থেকে কিছু চাইলে আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দেয় না।তেমনি তমালের কথাও ফেলেনি আল্লাহ। মনে মনে আল্লাহর দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া জানালো তমাল।মুখে হাসি রেখেই খুশিতে গদগদ হয়ে বললো।

তমালঃ আরে ম্যাডাম আসুন।বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।

জারাঃ রোশান কোথায়?

তমালঃ আপনি কি বিদেশে থাকেন?

জারাঃ হুম।

তমালঃ আজ কি বিদেশ থেকে ফিরলেন?

জারাঃ হ্যাঁ, রোশানের বাবা গত পরশু কল করে আমাকে ওর বিষয় সবকিছু খুলে বললো।গতকালই চলে আসতাম।কিন্তু টিকিট পেতে দেরী হয়ে গেলো।রোশান কোন রুমে?

তমাল হা করে তাকিয়ে রইলো।একটা লোক তার ছেলের কথা বলতেই মেয়েটা সুদূর থেকে ছুটে চলে এলো।তাহলে নিশ্চয়ই মেয়েটা রোশানকে অনেক ভালোবাসে।না চাইতেও তমালের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। জারা তমালের চোখের সামনে তুড়ি বাজালো।

জারাঃ ও হ্যালো, কোথায় হারিয়ে গেলেন?রোশান কোন রুমে? আমায় নিয়ে চলেন।

তমালঃ হ্যাঁ, ম্যাম চলেন।

সিঁড়ি বেয়ে দুজনেই ওপরে গেলো গেল।জারাকে রুম দেখিয়ে তমাল চলে গেল। ওদের দুজনকে একটু স্পেস দেওয়া উচিত।জারা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মদের বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে লাগলো।জারা নাকে হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।পুরো রুমটা আবছা অন্ধকার করে রাখায় জারা কিছু দেখছেও না।পায়ের সাথে বারি খেয়ে মদের বোতলটা ঝনঝন শব্দ করে উঠলো।তাতে রোশান কথা বললো।

রোশানঃ তমাল,আমাকে একটু একা থাকতে দেও।

জারা কোন উত্তর দিলো না। সে অন্ধকারে হাতড়ে লাইটের সুইচ খুঁজতে লাগলো। একসময় পেয়েও গেল।লাইট অন করতেই সাথে সাথে রোশান চোখ বন্ধ করে চোখের ওপর হাত দিয়ে চেচিয়ে উঠলো।

রোশানঃ তমাল লাইট বন্ধ করো।আমার চোখে লাগছে।

অপর দিক থেকে কোন উত্তর না আসায় রোশান পিটপিট করে চোখ খুললো।সামনে তাকিয়ে কিছুটা চমকে উঠলো। চোখ দুটো ভালো করে ডলে আবার তাকালো।না সে ভুল দেখছে না।তার চোখের সামনে হাত গুঁজে জারা দাঁড়িয়ে আছে।

রোশানঃ আজ এত তাড়াতাড়ি নেশা হয়ে গেলো। আমি চোখের সামনে জারাকে দেখতে পাচ্ছি।

জারাঃ তুমি ভুল নয় ঠিকই দেখতে পাচ্ছো।

জারার শব্দ পেয়ে রোশান অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকালো। তারপর বসা থেকে উঠে দৌড়ে এসে জারাকে জড়িয়ে ধরলো। এতে জারা একটুও অবাক হলো না। ওর জানা ছিলো রোশান এমনকিছুই করবে।বেশ কিছু সময় পর রোশানের ফোঁপানোর আওয়াজ পেলো জারা।তার মানে রোশান কাঁদছে।

জারাঃ কাঁদো রোশান, বেশি করে কাঁদো। এটাই হবে তোমার শেষ কান্না। আমি তোমাকে আর কাঁদতে দিবো না।এখন থেকে তুমি শুধু হাসবে।অনেক কষ্ট পেয়েছো একতরফা ভালোবেসে।নিজেও পেয়েছো আমাকেও দিয়েছো।কিন্তু আর নয়।এবার তোমাকে নিজের করে সব কষ্ট ভুলেও যাবো,তোমাকেও ভুলিয়ে দিবো।সব ঠিক করে ফেলবো আমি।সব ঠিক করে ফেলবো।
(মনে মনে)

মনে মনে কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জারা।তবে তার চোখ দুটো চকচক করছে। নতুন আশায় যে সে দেশে ফিরেছে।এবার সে আশা পূরণ করবেই করবে।আর সেই আশাটা হলো রোশানের বউ হওয়া।রোশান এখনো জারাকে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে। জারা চোখ বন্ধ করে আলতো করে ওর দুই হাত রোশানের পিঠে রাখলো।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_35
#Writer_NOVA

পরের দিন…….

শো দশ মিনিট আগে শেষ করে আবার উল্টো বাসায় গেলাম।সেখান থেকে নাভানকে নিয়ে ফিরে এলাম অফিসে। কল করে হিমি ও এরিনকে আগেই বলে দিয়েছিলাম নাভানকে তৈরি করে বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।ওরা নাভানকে তৈরি করে রাখায় বেশি দেরী হয়নি।রিকশা নিয়ে গেইটেের সামনে থেকে নাভানকে নিয়ে চলে এসেছি।সাড়ে দশটার বেশি বেজে গেছে। তাড়াহুড়ো করে নাভানকে সাথে নিয়ে লিফটে ঢুকে পরলাম।

সেদিন রাতে অনেক সময় অব্দি এনাজ আমাদের সাথে ছিলো।নাভানও ওর বাবাকে ছাড়বে না।এনাজও নাভানকে ছাড়বে না।অবশেষে নাভান ঘুমানোর পর এনাজ চলে যায়। তখন রাত তিনটে বাজে।এদের বাপ-বেটার জন্য আমাকে রাত তিনটে অব্দি গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এনাজ যাওয়ার আগে বলেছে নতুন ফ্ল্যাট কিনে তবেই আমাদের দুজনকে এখান থেকে নিয়ে যাবে।এখন অন্যের বাসায় থাকছে সে।এখন যদি ঐ বাসায় আমাকে নিয়ে যায় তাহলে বিষয়টা কিরকম বাজে দেখায়।যদিও তারা কিছু মনে করবে না।কিন্তু এনাজের তো একটা আত্মসম্মান আছে। এরিন ও আরিয়ানের বিয়েও সামনে।এমতাবস্থায় এনাজ ঠিকানাবিহীন বাড়ি ছাড়লেও তো বিষয়টা খারাপ দেখায়।আমরা সবাই চলে গেলে হিমিও বা যাবে কোথায়? ওর ও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।এসব ডিসকাসড করেছি আমরা।সবশেষে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।এরিন ও আরিয়ানের বিয়ের পর আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে উঠবো।হিমির ও একটা ব্যবস্থা করে দিবো।ততদিন আমি আমার বাসায় ও এনাজ ঠিকানাবিহীন বাড়িতে থাকবে।বউ, ছেলে ছেড়ে থাকতে হবে বলে এনাজের মুখ কালো হয়ে ছিলো।কিন্তু আপাতত কিছু করার নেই।

গতকালের কথা ভাবছিলাম।তখুনি টুং শব্দে লিফটের দরজা খুলে গেল।আমরা ভেতরে প্রবেশ করতেই পার্টি স্প্রে দিয়ে পুরো ভূত হয়ে গেলাম।সামনে তাকিয়ে দেখি আরিয়াব,মুসকান,আদর আরো কতগুলো কলিগ দাঁড়িয়ে আছে পার্টি স্প্রে হাতে নিয়ে। সবার হাতে কতগুলো করে বেলুন।আমি চোখ মুছতে মুছতে নাভানকে নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। আদর,আরিয়ান,মুসকান কার আগে কে কোলে তুলে নিবো তা নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে। ফাঁকের মধ্যে মুসকান নাভানকে কোলে নিয়ে এনাজের কেবিনের দিকে দৌড় দিলো।মুসকানের পেছন পেছন আদর দৌড় দিলো।আরিয়ান ও আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলাম।বাকি কলিগরা আমাকে কংগ্রেস জানিয়ে যার যার কাজে চলে গেল।

আরিয়ানঃ আমি তো এটাকে হিমির ছেলে ভেবেছিলাম। গত পরশু রাতে জানতে পারলাম হিমির বিয়েই হয়নি।আর এটা আপনার ও ভাইয়ার ডাউনলোডকৃত ছেলে।

আমি মুখ টিপে হেসে আরিয়ানকে শাসনের সুরে বললাম।

আমিঃ আরিয়ান!!! মুখে লাগাম দেও।

আরিয়ানঃ আপনি আমার বড় ভাবী সাহেবা। আপনার সাথে বলবো না তো কার সাথে বলবো।বিশ্বাস করেন ভাবী, আমার মাথায় এটাই ছিলো যে আপনাদের বেবী পেটে থাকতে মারা গেছে। আর গত আড়াই বছর ধরে ভাইয়া আমাদের সাথে। আপনাকে খুঁজেই পাইনি।যদি খুঁজে পেতো তাহলে আরেকটা চান্স থাকতো।আমি ভাবতাম নতুন করে উপরওয়ালার থেকে চেয়ে ছেলে ডাউনলোড করেছে। কিন্তু তাও তো নয়।আমার ভাই আমাদের সাথে থাকলে বেবী পেটে আসবে কোথা থেকে বলুন তো? আমি শুধু এই কথাটা বলেছিলাম গতকাল।তারপর ভাইয়া আমাকে সারা বাড়ি চক্কর দিয়ে এনেছে।ধরতে পারেনি।ধরতে পারলে ভর্তা করতো।

এর কথা শুনে আমি লজ্জায় শেষ। এর মুখে কিছু আটকায় না।

আরিয়ানঃ লজ্জা পেয়েন না ভাবী সাহেবা। আমাদের কিন্তু আরেকটা মেয়ে বাবু লাগবে।তাই আগের থেকে প্রসেসিং শুরু করে দিন।আমার বিয়েটা হোক।তারপর জলদী করে একটা বেবী নিয়ে ফেলবো।যদি মেয়ে হয় তাহলে আপনার ছেলেকে আগে থাকতে বুকিং করে রাখলাম।আপনার ছেলের সাথে আমাদের মেয়ের বিয়ে দিবো।তবে আমাদের কিন্তু আরেকটা মেয়ে বেবী চাই চাই।কোন কথা শুনবো না। তাই এখন থেকে প্রস্তুতি নিয়ে নিন😉।

আরিয়ানের কথা শুনে আমি রিয়েকশন দিতেও ভুলে গেলাম।চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।আরিয়ান এক চোখ মেরে হাসতে হাসতে চলে গেল।আমি এখনো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছি।

মুসকানঃ ভাবী,আদর তোমাকে ডাকছে।

আমিঃ নাভান কোথায়?

মুসকানঃ আদরের কাছে।

আমি নিজের ডেস্ক থেকে ফাইলগুলো গুছিয়ে আদরের কাছে গেলাম।আদর ফাইলে কিছু করছে।আর নাভান টেবিলের ওপর বসে পা দুলিয়ে জুস খাচ্ছে। ওর সামনে খাবারের ভুর পরে আছে। আমি দরজায় মৃদু টোকা দিলাম।

আমিঃ আসবো?

আদরঃ আরে আসেন ভাবী।আপনার কি অনুমতি নিতে হয়।

আমিঃ নাভান কি করছো? চাচ্চুর সাথে দুষ্টুমী করো নি তো?

নাভানকে প্রশ্ন করতে করতে ভেতরে ঢুকলাম। নাভান হাত নাড়িয়ে আধো আধো কণ্ঠে বললো।

নাভানঃ না। নাভান গুড বয়।

আমিঃ গুড বয় থাকলেই ভালো।আদর ভাইয়া আমার ফাইলগুলো একটু দেখে দিন।

আদরঃ আচ্ছা।

আমিঃ আপনাদের স্যার কি ছেলেকে দেখেছে?

আদরঃ স্যার একটু ব্যস্ত আছে। তাই ঐদিকে নিয়ে যাইনি।আগামীকাল সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানির শেয়ার পাস হওয়ায় একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। স্যার সেই বিষয়ে সবার সাথে কথা বলছে।

আমিঃ ওহ আচ্ছা।

নাভানঃ বাবা যাবো।আম্মু, বাবা যাবো।তুমি বলতো
(বলছো) বাবা নিয়া যাবা।বাবা কই?

আমিঃ হ্যাঁ,একটু পর আমরা বাবার কাছে যাবো।একটু অপেক্ষা করো।

নাভানঃ আত্তা(আচ্ছা)।

আদরঃ ভাবী, সবকিছু ঠিক আছে। আপনি ফাইল ও ভাতিজাকে নিয়ে স্যারের রুমে যান।আপনাকে যেতে বলেছে।

আমিঃ কিন্তু সে তো কথা বলছে।

আদরঃ কোন সমস্যা হবে না। আপনাকে তো যেতে বলছে।আরেকটা কথা ভাবী।সবাই ভাবী বলছে বলে আমিও ভাবী বলছি।এতে আপনি কিছু মনে করেননি তো?

আমিঃ আরে না মনে করার কি আছে? আমি আসছি।

আদরঃ আচ্ছা। আপনি নাভানকে নিয়ে যান।আর এই খাবারগুলো আমি আপনার রুমে রেখে আসি।

আমি নাভানকে কোলে নিয়ে এনাজের কেবিনের সামনে চলে এলাম।দরজার কতগুলো টোকা দিলাম।কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। আমি দরজাটা খুলে নাভানকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম।আর আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমিঃ ভেতরে তোমার বাবা আছে। বাবাকে জোরে ডাক দিও না।আস্তে করে গিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।কোন দুষ্টুমী করবে না।

কিন্তু আমার কথা নাভান বুঝলো না। ভেতরে ঢুকে জোরে চেচিয়ে ডেকে উঠলো।

নাভানঃ বাবা।বাবা, ও বাবা। বাবা গো।

নাভান ডাকতেই সবাই উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকালো।এনাজ দ্রুত পায়ে এসে নাভানকে কোলে তুলে নিলো।নাভানের মুখে অসংখ্য চুমু খেলো।

এনাজঃ কার সাথে এসেছো বাবা?

নাভানঃ আম্মুর সাথে।

এনাজঃ তোমার আম্মু কোথায়?

নাভানঃ বাইরে চুপিচুপি দাঁড়ায় আছে।

নাভানের কথা শুনে আমার লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইছে। বাপের মতো শয়তান হয়েছে ছেলেটা।সবার সামনে কি লজ্জা দিলো।প্রথমে আরিয়ান এখন নাভান।সবগুলা একরকম।দ্রুত ঘুরে চলে যেতে নিলে এনাজের ডাকে থমকে দাঁড়ালাম।

এনাজঃ বাটারফ্লাই ভেতরে এসো।

🦋🦋🦋

আমি ফাইল দিয়ে মুখ ঢেকে দরজা দিয়ে ঢুকলাম।ফাইলের থেকে চোখ দুটো একটু বের করে দেখলাম নাভান শয়তানি হাসি দিচ্ছে। আমি চোখ রাঙালাম।তাতে সে দাঁতগুলো সব বের করে বাপের গলা জড়িয়ে ধরলো। সবাই মিটমিট করে হাসছে।এমনকি এনাজও।

আমিঃ দাঁড়া ব্যাটা।আজ তোকে পাই।বাবাকে পেয়ে আমার সাথে যড়যন্ত্র শুরু করছিস।তোর খবর আছে।
(মনে মনে)

এনাজঃ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমার ওয়াইফ মিসেস নোভা। আর আমাদের ছেলে এনান আহমেদ নাভান। আজকের মতো কথাবার্তা এখানেই শেষ। আপনারা আসতে পারেন।যেভাবে কাজ করতে বললাম সেভাবে করতে থাকুন।কালকে পুরো পার্টি নিখুঁতভাবে হওয়া চাই।

সবাই একে একে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।আমি যেখানে ছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এনাজঃ এদিকে এসো।

আমি গেলাম না।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।মনোযোগ সহকারে ফাইল দেখতে লাগলাম।এনাজ নাভানকে তার চেয়ারে বসিয়ে দিলো।হঠাৎ করে গলায় কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি গলায় একটা স্বর্ণের চেইন।যেটায় ছোট একটা লকেট আছে।তার মধ্যে N+A=NAলেখা।মানে হলো নোভা+এনাজ সমান নাভান, এনান।চেইনটা পেছন থেকে এনাজ পরিয়ে দিয়েছে।আমি মাথা উঁচিয়ে অবাক চোখে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এনাজঃ এটা তোমার গিফট।আমাকে একটা ছেলে উপহার দেওয়ার জন্য। নতুন বেবী হলে বেবী দেখে তো কিছু একটা গিফট করতে হয়।নাভান হওয়ার সময় তো আমি ছিলাম না।তাই কিছু গিফট করতে পারি নি।তাই এখন তোমাকে গিফট করলাম।ছেলেকে অন্য কিছু গিফট করে দিবো।ছেলেদের অলংকার পরতে নেই। এতে গুনাহ হয়।নয়তো ওকেও একটা চেইন গিফট করতাম।তবে আমার মনে হলো ছেলের থেকে আমার বউকে দেওয়া বেশি জরুরি। কারণ সে এত কষ্ট করে আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমাকে বাবা ডাক শুনতে সাহায্য করেছে।

কথাগুলো বলতে বলতে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেলো।আমি মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দিলাম।সব ছেলে যদি এমন করে মেয়েদের বুঝতো।তাহলে নারী নির্যাতন বলে কোন শব্দ থাকতো না।

এনাজঃ বাটারফ্লাই, ও বাটারফ্লাই। (মধুর সুরে)

আমিঃ হুম বলেন।

এনাজঃ আমার একটা মেয়ে বেবী লাগবে।দিবে না??

ছোট বাচ্চাদের মতো করে আবদারটা করলো এনাজ।আমি বিস্ফোরিত চোখে কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।তারপর ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম।

আমিঃ এর জন্য এত মধুর সুরে বাটারফ্লাই বলে ডাকা হলো? বলি দুই ভাই পেয়েছেন টা কি? মেয়ে বেবীর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন।আমি কিছু পারবো না। যান ভাগেন।ছাড়েন আমাকে।

এনাজঃ প্লিজ লক্ষ্মী বউ।একটা মেয়ে বেবীই তো চেয়েছি।প্লিজ,প্লিজ।

আমিঃ সরেন আমার সামনে থেকে। ছাড়েন বলছি, ছাড়েন।বাপ-বেটার জ্বালায় আমি শেষ। আবার আরেকটা।আমার তো খেয়ে-দেয়ে কোন কাজ নেই।

এনাজঃ কোন কাজ নেই বলেই তো বলছি।

আমিঃ এটা অফিস।এখানে সংসার করতে আসিনি।

আমি ঝাড়া মেরে এনাজকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলাম।কতগুলো ফাইল টেবিলে রেখে বাকিগুলো নিয়ে চলে আসতে নিলাম।এনাজ আমার থেকে সরে নাভানকে কোলে তুলে নিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো।

এনাজঃ নাভান বাবা।তোমার কি একটা পুতুল বেবী লাগবে?

নাভানঃ না, আমার পুতুল বেবী লাগবে না।

এনাজঃ চুপ বেডা।বল লাগবো।(হালকা ধমক দিয়ে)

নাভানঃ লাগবো না।

আমিঃ একদম ঠিক হয়েছে 🤣।

এনাজঃ খবরদার হাসবে না।চুপ করে থাকো।(রেগে)

আমিঃ 🤭

এনাজঃ ছোট বেবীটা তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে। তোমার সাথে খেলবে।তোমার কথা শুনবে।বলো একটা পুতুল বেবী লাগবে।তুমি যদি বলো তাহলে বাবাই তোমাকে অনেকগুলো খেলনা কিনে দিবে।তোমাকে নিয়ে খেলতে যাবে।

নাভানঃ আচ্ছা। আগে খেলনা দাও।

এনাজঃ দিবো তো।তার আগে বলো তোমার আম্মুকে পুতুল বেবী লাগবে।

নাভানঃ আম্মু, পুতুল বেবী লাগবে।এটটা(একটা) বাবু এনে দিও বাবাইকে।আমার লাগবো না।

এনাজঃ আবার বলে তার লাগবে না।বলো তোমার লাগবে। একটা পুতুল বেবী লাগবে।

নাভানঃ আত্তা(আচ্ছা)। আম্মু আমার পুতুল বেবী লাগবে। এনে দিও প্লিত(প্লিজ)।

আমিঃ বেবী আনলে কিন্তু তোমাকে আদর করবো না।ঐ ছোট বেবীটাকেই আদর করবো।তখন তোমাকে অনেক মারবো।তুমি যদি রাজী থাকো তাহলে নিয়ে আসবো।

নাভানঃ না না তাহলে লাগবো না।

এনাজঃ বউ ভালো হচ্ছে না কিন্তু। নেগেটিভ কথাবার্তা বলো কেন?

আমি উত্তর না দিয়ে হাসতে লাগলাম।পেট ফেটে হাসি আসছে আমার।এনাজ আমাকে হাসতে দেখে লুচির মতো ফুলছে।বেচারা!!! এনাজ নাভানকে কোলে নিয়ে আমার পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। তারপর ফুসুরফাসুর করে নাভানকে কি যানি বললো।

আমিঃ তোমরা বাপ-বেটা থাকো এখানে। আমি গেলাম।

নাভানঃ দাঁড়াও আম্মু।

পেছন থেকে আমার বাহু নাভান ওর ছোট ছোট দুই হাতে টেনে ধরলো।

নাভানঃ একটা পুতুল বেবী লাগবো আমার।

আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। নিশ্চয়ই আনাইজ্জা কলা তখন ছেলেটাকে এসব বলেছে। আমি কিছু বললাম না।নাভানের হাত ছাড়িয়ে রেগে দ্রুত পায়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলাম।বের হওয়ার আগে বাবা-ছেলের হি হি শব্দের হাসি শুনতে পেলাম।এখন কিছু বলবো না।দুটোকেই টাইট দিবো।বাবা-ছেলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এদের ষড়যন্ত্রে যদি আমি পানি না ফেলি তাহলে আমার নামও নোভা নয়।

#চলবে।

প্রজাপতির রং পর্ব-৩৩ + বোমাস পর্ব

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_33
#Writer_NOVA

এক দিন পর…….

পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি আলোয় আলোকিত এই ব্যস্ত শহর ঢাকা।দুপুরের দিকটা একটু নিরিবিলি থাকলে বিকেল নামলেই শুরু হয় মানুষের আনাগোনা।রিকশা, ভ্যানের টুংটাং আওয়াজে নীরব পরিবেশটা ভারী হয়ে যায়।শুরু হয় কর্মমুখর মানুষের ঘরে ফেরার পালা।সন্ধ্যার আগেই নিজ নিজ নীড়ে ফেরার জন্য চলে এক অদম্য উচ্ছাস। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে একটু স্বস্তির জন্য পাল্লা ধরে চলে মানুষ। কে আগে ফিরতে পারবে নিজে নিজ স্বস্তির জায়গায়।সবকিছু নিয়ম মাফিক চলে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ব্যস্তমুখর শহরটাকে দেখতে ব্যস্ত আমি।কিছু সময় পর সামনের ছোট রোড দিয়ে চলাচল করছে রিকশা,ভ্যান কিংবা মোটরসাইকেল। তাদের যান্ত্রিক শব্দে বিরক্ত আমি।এখন খুব করে কাছে টানছে শহর থেকে দূরে কোন নিরিবিলি পরিবেশ উপভোগ করতে।যেখানে থাকবে না কোন যানবাহনের শব্দ কিংবা এই ব্যস্ত নগরী।সেখানে থাকবে সবুজ গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ। গাছে গাছে দোয়েল তার লেজ উঁচিয়ে মিষ্টি সুরে গান গাইবে।এক ডালে বসে দুটো শালিক ঝগড়া বাঁধিয়ে দিবে।দূর থেকে ভেসে আসবে ফিঙে পাখির ডাক।কিন্তু এগুলো এখন কল্পনায় মানাবে। সেটা ভেবে বিশাল বড় একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালাম।নিজেকে আজ বড্ড বেশি একা লাগছে।

আজ অফিস কিংবা রেডিও স্টেশন কোথাও যাইনি।মনটা ভীষণ খারাপ।সেদিন এনাজ এতগুলো কথা শোনানোর পর থেকে নিজের ওপর একটু বেশি অপরাধবোধ কাজ করছে।মোবাইল হাতে নিয়ে কতবার যে এনাজের নাম্বারে ডায়াল করতে চেয়েছি।কিন্তু জড়তার কারণে পারিনি।কোথায় যেনো একটা বাঁধা পাই।হয়তো এতদিন পর হওয়ায় অনেক বেশি জড়তা কাজ করছে।এনাজও আমায় কল করেনি।হয়তো আমার ওপর অভিমান কাজ করছে ওর। নাভান,হিমি ও এরিনের সাথে আছে। মনের আকাশটা আজ বিষন্ন। কিন্তু বাইরের আকাশটা কি চকচকে!
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে ঘোর কাটে।তাকিয়ে দেখি এরিন দাঁড়িয়ে আছে।

এরিনঃ কি হয়েছে তোর? গত পরশু বাসায় ফেরার পর থেকে তোকে অনেক মনমরা লাগছে।তোকে তো কখনো এতটা আপসেট থাকতে দেখিনি।

আমিঃ আমার আবার কি হবে?আমি ঠিক আছি।তোরা শুধু শুধু টেনশন করিস।

এরিনঃ আমার চোখের দিকে তাকা নোভা।মিথ্যে কেন বলছিস?

আমিঃ আরে ধূর।কিছু হয়নি বাদ দে তো।হিমি কোথায়?

এরিনঃ ওর বয়ফ্রেন্ড রাজের সাথে ঝগড়া করে।এদের দুইদিন পর কি হয় আল্লাহ জানে! দুটো দিন যেতে দেরী হয় কিন্তু ঝগড়া করতে দেরী হয় না।ওদের এই রিলেশনটাকে না আমার রিলেশনই মনে হয় না।মনে হয় ঝগড়া কমিটির হেড অফিস।

আমিঃ ওদের কথা ছাড়।তোর বিয়ের খবর কি তাই বল? বিয়ের জল কতদূর গড়ালো।

এরিনঃ সেটা নির্ভর করছে তোর আর এনাজ ভাইয়ের ওপর।(কিছু সময় থেমে চাপা স্বরে বললো)তুই সত্যি আমাদের ফ্রেন্ড মনে করিস না, নোভা।

আমিঃ এমন কথা কেন বলছিস? (চমকে)

এরিনঃ এতবড় বিষয়গুলো আমাদের থেকে লুকিয়েছিস।আমরা কেন আরিয়ানের থেকে জানলাম? তুই তো সবকিছু বলতে পারতি।তোকে কিডন্যাপ করে পর্যন্ত নিয়ে গেলো।তার একবিন্দু কোনকিছু জানি নাআমরা।একবার ভেবেছিস ঠিক সময় তায়াং ভাইয়া, এনাজ ভাইয়া না গিয়ে বাঁচিয়ে আনতো তাহলে তোর কি হতো তোর কোন আইডিয়া আছে তোর? একবার নাভানের কথাও ভাবলি না।

আমিঃ আমি মরে গেলে নাভানকে তোরা লালন-পালন করে বড় করতি।(মুচকি হেসে)

এরিনঃ একটা চড় মারবো ফাজিল মেয়ে। আবার দাঁত বের করিস।সবসময় সবকিছুকে মজা ভেবে উড়িয়ে দিস।

সেদিন বাসায় আসার পর এরিন, হিমি কোনকিছু জিজ্ঞেস না করায় আমি বেশ অবাক হলাম।পরে জানতে পারলাম একদম প্রথম থেকে সবকিছু ওদেরকে আরিয়ান খুলে বলেছে।এর জন্য অনেক টেনশনে ছিলো।এনাজের কথাও সব বলেছে।এনাজ কি করে বেঁচে গেলো,কোথায় ছিলো এতদিন সবই বলেছে।এতে হিমি,এরিন প্রথম প্রথম খুব রাগ করেছিলো।পুরো একটা দিন লেগেছে ওদের রাগ ভাঙাতে।আসার পর থেকে নাভান আমার থেকে সরেনি।কোলের মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিলো।চোখও হারায়নি।ভেবেছে আবার যদি দূরে চলে যায়।

এরিনঃ নোভা!!!

আমিঃ হুম বল।

এরিনঃ একটা কথা বলবো।যদি তুই কিছু মনে না করিস।আসলে কথাটা সম্পূর্ণ তোর ব্যক্তিগত বিষয়ে।তাই অনুমতি চাইছি।

🦋🦋🦋

আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে এরিনের দিকে উৎসুক চোখে তাকালাম।কি এমন কথা বলবে এরিন?অবশ্যই সেদিনের ঘটনা সব বিস্তারিত আমি বলে দিয়েছি ওদের। এনাজের রাগারাগি করা, আমাকে থাপ্পড় মারা কোনকিছু লুকায়নি ওদের থেকে।কিন্তু এখন এরিনকে কুচোমুচো করতে দেখে আমি চিন্তায় পরে গেলাম।এরিন আসলে বলবেটা কি?

এরিনঃ আরে এত ভাবিস না।তেমন কিছু না।যদি তুই অনুমতি দিস তাহলেই বলবো।

আমিঃ হুম বল।

এরিনঃ দেখ, যত অভিমান সেটা শুধু তোর আর তাজ ভাইয়া আই মিন এনাজ ভাইয়ার মধ্যে। সেটা তোদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখ।মাঝ থেকে বাচ্চা ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন বল তো? তোর কথা মতো আমি যা বুঝলাম। তা হলো, এনাজ ভাইয়া জানেই না নাভান কে? তার মানে সে এটাও জানে না যে তার একটা ছেলে আছে। তাহলে তুই কেন বলছিস না তাকে? নাভানের থেকে কেন ওর বাবাকে দূরে রেখেছিস।ওকে ওর বাবার অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত করছিস? তোদের মনমালিন্যের প্রভাব কেন নাভানের ওপর পরছে? এই ছোট বাচ্চাটাও তো বাবার অভাবে অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। বাবা থাকতেও কেন ও শূন্যতায় ভুগবে? এতটুকু বয়সে ও কি বুঝে আমি জানি না। তবে আমি দেখেছি, কোন বাচ্চার বাবা ওর সামনে বাচ্চাকে আদর করলে করুন চোখে তা খেয়াল করে।তারপর ওর মুখটা মলিন হয়ে যায়।তোদের সম্পর্কের ভুক্তভোগী কেন এই ছোট বাচ্চাটা হবে আমাকে একটু বলবি? ওর কি দোষ বল? তোদের মধ্যে ওকে কেন টানছিস? কেন ওর কথা তুই এনাজ ভাইয়াকে বলছিস না।বলে দে না রে।আর কত অভিমান নিয়ে থাকবি?এত শক্ত হোস না যাতে নিজের আপন মানুষগুলো কে হারিয়ে ফেলিস।বাচ্চাটাকে আর কষ্ট দিস না।ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এবার না হয় মাফ করে দে।এটাই শেষবার।বাচ্চা ছেলেটাকে তার বাবার স্নেহ থেকে দূরে রাখিস না।অনেক তো হলো।এবার না হয় থেমে যা।

আমি মলিন মুখে এরিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।কি উত্তর দিবো তা আমার জানা নেই। কারণ আমি নিজ চোখেও দেখেছি যে পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চা ছেলেটার বাবা যখন তার ছেলেটাকে আদর করে,তখন নাভান এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।ওর প্রতি আমি সত্যি কি অন্যায় করে ফেলছি?? হিমি, নাভানকে কোলে নিয়ে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ও এরিনের সব কথাই শুনেছে। নাভান আমার দিকে তার ছোট ছোট হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো।আমি রোবটের মতো করে ওকে কোলে নিয়ে নিলাম।

হিমিঃ তোর জীবন, তোর ইচ্ছামতো চলবি।কিন্তু কখনও এমন কাজ করিস না যার জন্য পরবর্তীতে পস্তাতে হয়।ছেলেটার কথাও চিন্তা করিস। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু কিছু জিনিস মেনে নিতে না চাইলেও মেনে নিস।ওর সাথে কোন অন্যায় করিস না।তোদের সম্পর্ক টানাপোড়েনের প্রভাব ওর ওপর পরতে দিস না।এতে ছেলেটা সুস্থ মন-মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারবে না। ওর জন্য হলেও নতুন করে সব গুছিয়ে নে।আমার বিশ্বাস তোরা তিনজনই তাতে ভালো থাকবি।আমার বলার দরকার আমি বললাম।বাকিটা তোর ইচ্ছা।

এরিন,হিমি দুজন ওদের রুমে চলে গেল।আমি নাভানকে শক্ত করে আমার সাথে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে নজর দিলাম।আমি বুঝে গেছি কি করতে হবে আমায়।আমি চাই না আমার বাচ্চাটা আর কষ্ট পাক।ওর জন্য হলেও আমার সবকিছু স্বাভাবিক করতে হবে।হ্যাঁ,আমাকে করতেই হবে।এসব কিছুর প্রভাব ওর ওপর আর পরতে দিবো না আমি।

🦋🦋🦋

সন্ধ্যা শেষে রাত নেমেছে বহু আগে।রাতের খাবার খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি।আজকাল বারান্দায় বেশি ভালো লাগে।নাভান আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছে। বাইরে হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বেশ ভালোই লাগছে।দূরের টং দোকানটা এখনো খোলা। সেখনো অনেকগুলো লোক বসে আছে। হয়তো খোশগল্পে মেতে আছে। এদের বাড়ি ফেরার কোন তাড়া নেই। আকাশে আজ বিশাল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তার সাথে জ্বলছে মিটিমিটি তারা।সেদিকে তাকিয়ে আনমনে হেসে উঠলাম।তবে ভাবনার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটলো মোবাইল রিংটোন। উঠে গিয়ে টেবিল থেকে মোবাইলটা আনতে ঢেঢ় আলসেমী লাগছে।রিং বাজতে বাজতে অফ হয়ে গেলো।তাই গিয়ে আর আনলাম না।আবার আকাশ দেখায় মনোযোগ দিতে চাইলাম।কিন্তু আবারো ব্যাঘাত ঘটালো অসহ্যকর মোবাইলটা।একঘেয়ে সুরে বেজে উঠলো। আগত্যা ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও উঠতে হলো।মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আননোন নাম্বারে কল দেখে রিসিভ করবো কি করবো না তাই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি।হুট করে রিসিভ করেই ফেললাম।ওপাশ থেকে কারো কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।আমি হ্যালো বলতেই আপরপাশ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে সে বলে উঠলো।

—-গেইটের কাছে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি।জলদী চলে এসো।তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তোমার সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। এর থেকে বেশি দেরী হলে আমি নিজে এসে কোলে করে নিয়ে যাবো।কথাটা মাথায় রেখো।ইউর টাইম ইজ স্টার্ট নাউ।

টুট টুট করে কলটা কেটে গেল।অপরপাশের লোকটা এনাজ ছাড়া অন্য কেউ নয়।এত রাতে আমাদের বাসার সামনে কি করছে?আর তার এটা কি হুমকি ছিলো নাকি স্বাভাবিক কথা ছিলো আমি জানি না।তবে একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। যদি উপরে চলে আসে তাহলে সত্যি কোলে করে নিয়ে যাবে।এরিনদের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম দুজনেই বাতি বন্ধ করে মোবাইল চালাচ্ছে। আমি পা টিপে টিপে দরজা খুলে বের হয়ে গেলাম।যাওয়ার আগে দরজার ছিটকিনিটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলাম।দালানের সদর দরজায় এসে অবাক হলাম।অন্য সময় দরজা বন্ধ থাকে।কিন্তু আজ খোলা।বেশি কিছু না ভেবে বাইরে চলে এলাম। এসে দেখি এনাজ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে কিছুটা আৎকে উঠলাম। মানুষটাকে পুরো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। আমার দিকে করুন চোখে তাকালো।সেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমার নিজেরই অপরাধী মনে হচ্ছিলো।

আমিঃ এত রাতে এখানে কি করছেন?

এনাজঃ তোমাকে আমার কিছু বলার ছিলো।

আমিঃ জলদী বলুন।আমি এখানে বেশি সময় দাঁড়াতে পারবো না।কেউ দেখে ফেললে তিলকে তাল করে আমার নামে কুৎসা রটাবে।

এনাজঃ ভয় পেয়ো না। তোমাদের বাড়িওয়ালা জানে আমি তোমার হাসবেন্ড। আমি তাকে সবকিছু খুলে বলেছি।কেউ তোমার নামে নালিশ করলেও খাটবে না।কারণ বাড়িওয়ালা সবকিছু জানে।

আমিঃ হু বুঝলাম। কি বলবেন জলদী বলুন।

এনাজ হুট করে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো।ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা চমকে গেলেও নড়লাম না।মিনিট খানিক পর কাঁধে ঠান্ডা কিছুর পরশ পেতেই বুঝলাম সে কাঁদছে।কিন্তু কেন তা খুঁজে পেলাম না।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Extra_Part
#Writer_NOVA

এনাজ হুট করে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো।ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা চমকে গেলেও নড়লাম না।মিনিট খানিক পর কাঁধে ঠান্ডা কিছুর পরশ পেতেই বুঝলাম সে কাঁদছে। কিন্তু কেন তা খুঁজে পেলাম না।আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।তাকে থামানোর চেষ্টা করলাম না।কাঁদুক সে।তাহলে মন হালকা হবে।আমার চোখ বেয়েও নোনাজল গড়িয়ে পরছে।সেটাও মুছলাম না।আমাকে ছেড়ে কিছু দূর দাঁড়ালো। তারপরে চোখ মুছতে মুছতে বললো।

তাজঃ আজ আমি তোমাকে সব খুলে বলবো।আমার উচিত ছিলো আরো আগেই তোমাকে সবকিছু খুলে বলার।কিন্তু আমি আগে তোমার সাথে কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আমি দেখছি এটাই আমার ভুল হয়েছে।তোমাকে সব খুলে বললে হয়তো পরিস্থিতি এমন হতো না।তুমি কি জানো এই দেড়টা বছর তোমাকে আমি ঠিক কোথায় কোথায় খুঁজেছি? আমি সাত মাস কোমায় ছিলাম।আগুনে আমার চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাম গালের মাংস পুরে হা হয়ে গিয়েছিল। হাতের বাহু থেকে মাংস নিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়েছিলো।সব মিলিয়ে আমার স্বাভাবিক জীবনে আসতে পুরো একটা বছর লেগেছিল। যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরলাম তখন আমি হন্যি হয়ে তোমার বাড়ি,আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি চিরে ফেলেছিলাম।কিন্তু তোমাকে পাইনি।কেউ তোমার কোন খোঁজ দিতে পারেনি।এতে আমার মানসিক অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।ঘুমের ঘোরে আমি তোমার নাম নিয়ে চিৎকার করে উঠতাম।আর যখন তোমার কথা মনে হতো তখন আমি পুরো পাগল হয়ে যেতাম।যার কারণে ইংলেন্ডে আমাকে ট্রিটমেন্ট করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলো আমার পালিত বাবা।মানুষটা আমার জন্য অনেক করেছে,জানো।তারপর প্রায় পাঁচ মাসের মতো ট্রিটমেন্ট করে আমাকে আবার সুস্থ করেছে। বাকি দিনগুলো আমার ঐখানেই কাটতো।আমি ট্রমার মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।কারো সাথে বেশি একটা কথা বলতাম না।তোমার হাসিখুশি এনাজ পুরো চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। ছয় মাস আগে বাবার বিজনেসে বসলাম।কাজের চাপে সারাদিন ভালোই কাটতো।কিন্তু রাতটা আমার কাছে কিরকম বিষাক্ত ছিলো তা আমি বুঝাতে পারবো না তোমায় বাটারফ্লাই ।কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছি মাথা ব্যাথায় ছটফট করতে করতে। তা গুণেও শেষ করতে পারবো না। তোমার কথা মনে হলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না।গত ছয় মাসও তোমাকে এদিক সেদিক খুঁজেছি।কিন্তু তুমি আমার চোখের সামনে ছিলে তাও খুঁজে পাইনি।কারণটা হলো যে হারিয়ে যায় তাকে খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে তো খুঁজে পাওয়া যায় না।

লোকটার কথা শুনে আমি হা হয়ে গেলাম।এতটা কষ্ট সহ্য করেছে মানুষটা।আর আমি তাকে ভুল বুঝেই গেলাম।একবারও তার দিকটা বিবেচনা করলাম না।এতটা স্বার্থপর কবে হলাম আমি।নিজেকে মনে মনে ধিক্কার জানালাম।

এনাজঃ কিছু দিন আগে আমি ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম মনে আছে তোমার?সবাইকে বলেছিলাম আমি ব্যবসায়ের কাজে গিয়েছি।কিন্তু আমি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।আমার ঘাড়ে যে বারিটা মেরেছিলো ওরা তার জন্য প্রায় আমি অসহ্যকর মাথা ব্যাথা ও ঘাড় ব্যাথায় ভুগতাম তার ট্রিটমেন্ট করতে গিয়েছিলাম।আল্লাহর রহমতে এখন ভালো আছি।

কথাগুলো বলে থামলো এনাজ।তারপর আমার দিকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।যা শুনে আমি হতভম্ব।

এনাজঃ আচ্ছা, বাটারফ্লাই। আমার বাচ্চাটাকে ছয় মাসের পেটে থাকতে কি সত্যি মারা গিয়েছিলো? এই প্রশ্নটা না আমার মাথায় ইদানীং অনেক বেশি ঘুরছে।

আমি চোখ দুটো রসগোল্লা করে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম।কি বলে এই ছেলে?আমার বাচ্চা পেটে থাকতে মারা গেলে নাভান এলো কোথা থেকে?

আমিঃ কি বলছেন এসব?

এনাজঃ হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি।এক বছর পর যখন আমি একটু সুস্থ হলাম তখন তোমাদের গ্রামে গিয়েছিলাম তোমার খোঁজে, আমার সন্তানের খোঁজে। তখন সেখানকার হাশেম চাচার বউ বললো আমাদের সন্তান নাকি ছয় মাসের পেটে থাকতে মারা গেছে।তুমি নাকি ওয়াসরুমে পিছোল খেয়ে পরে পেটে ব্যাথা পেয়েছিলো।তার জন্য নাকি ওকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বিশ্বাস করো এই কথাটা যখন আমি শুনেছি আমার পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। আমার চারপাশ ঘুরতে শুরু করেছিলো।আমি শুধু পারিনি চিৎকার করে কাঁদতে।নিশ্চয়ই তোমার এর থেকে বেশি কষ্ট হয়েছে তাই না?তুমি তো ওকে ছয় মাস পেটে ধরেছিলে। আমাদের সন্তানের কথা ভেবে কতরাত যে নির্ঘুমে কাটিয়েছি।ও থাকলে এতদিনে দুই বছর হয়ে যেতো ওর তাই না? আমি তোমকে কথাটা জিজ্ঞেস করবো করবো ভেবেও করিনি।যদি তুমি কষ্ট পাও তাই।প্লিজ তুমি পুরনো কথা মনে পরে ভেঙে পরো না।আমারা বরং আবার একটা বেবী নিবো।

শেষের কথাটা অনেক আশা ও উচ্ছাস নিয়ে বললো।যা শুনে আমার অনেক হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আমি হাসলাম না।সিরিয়াস মুহুর্তে হাসা উচিত নয়।তবে
শুনো ছেলের কথা!!!আমি পিটপিট চোখে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার চোখ, মুখ উপচে পরছে আকুলতা।তাহলে ঘটনা এই।আমার স্বামী মহাশয় জানে তার সন্তান ছয় মাসের পেটে থাকতে মারা গেছে। তাই কখনও আমাকে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করেনি।যদি আমি কষ্ট পাই।নাহ,এই মানুষটাকে আর কষ্ট দেওয়া যাবে না।অনেক হয়েছে। এবার সব ঠিক করেই নিবো।করুন চোখে আকুল সুরে এনাজ আমাকে বললো।

এনাজঃ কি হলো বলো? আমি কি বাবা ডাকটা শুনতে পারবো না।দিবে না আমাকে একটা বেবী?

আমিঃ বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করার জন্য অন্য কোন মানুষ পাননি?ঐ হাশেম চাচার বউকেই জিজ্ঞেস করতে হলো? ঐ মহিলা তিলকে তাল বানিয়ে সারা গ্রামে ছড়ায়।আর আপনি গিয়ে তাকেই জিজ্ঞেস করেছেন😤?

এনাজঃ উনাকে জিজ্ঞেস করতেই সে এসব বললো।

হাশেম চাচার বউ হলো সারা গ্রামের লোকের বার্তাবাহক বলতে পারেন।তবে সেটা সঠিক নয়।সব আজগুবি আর ভুল খবর এর কাছে পাবেন।মহিলা একে ওপরের সাথে ঝগড়া লাগাতে বেশ পটু।এবাড়ির কথা ও বাড়ি লাগাবে।ও বাড়ির কথা এ বাড়ি।তাই সবাই তাকে এড়িয়েই চলে।এনাজের মারা যাওয়ার ঘটনার পর কিছুদিন আমি বাবার বাসায় ছিলাম।সেখানে একদিন ওয়াসরুমে সামান্য পিছল খেয়ে পরে গিয়ে পেটে ব্যাথা পেয়েছিলাম।সবাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছে বাচ্চার ক্ষতি হয়ে গেছে। তাই জলদী করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় আমার।যতটা ভয় পেয়েছিলাম সবাই ততটা কিছুই হয়নি।ডাক্তার বলে ছিলো বাচ্চা ঠিক আছে।

তখন এই মহিলা সারা গ্রামে ছড়িয়েছিলো আমার বাচ্চা মারা গেছে। নাভান হওয়ার আগে আমি আর বাসায় যায়নি।আর ঐ মহিলা এদিকে বেশি একটা আসতো না বলে সে জানতো আমার বাচ্চা মৃতই ছিলো।এই ঘটনাকে আমি ততটা পাত্তাই দেইনি।কিন্তু এখন দেখছি সেই সামান্য কথা কতবড় আকার ধরা করেছে। আমার স্বামীর কান অব্দি পৌঁছে গেছে। এটা কোন কথা? কি থেকে কি হলো?আমি ভাবনায় হারিয়ে গেছি।এনাজ আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো।

এনাজঃ এই কোথায় হারিয়ে গেলে?

আমিঃ কোথাও না।আপনার বেবী লাগবে তাই তো?

এনাজঃ হুম।একটা কিউট, গুলুমুলু বেবী।একদম তোমার মতো।

আমিঃ আপনি দাঁড়ান আমি এখুনি নিয়ে আসছি।

এনাজঃ আরে শোনো এখন কোথা থেকে আনবে? এই মেয়ে কি পাগল হলো নাকি?বাটারফ্লাই শোনো………

🦋🦋🦋

এনাজের কথা পুরোটা শোনার আগেই আমি সিঁড়ির দিকে ভো দৌড় দিলাম।সিঁড়ির সামনে এসে আমি হাঁপিয়ে গেলাম।এতটুকু দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছি।এখন কি আর আগের বয়স আছে। এক বাচ্চার মা হয়ে গেছি তো।ধীরে সুস্থে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।তারপর আস্তের ওপর দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকলাম। চোরের মতো পা টিপে টিপে রুমে ঢুকলাম।নাভানকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলে নিলাম।তারপর আবার পা টিপে টিপে বের হয়ে গেলাম।গাড়ির কাছে আসতেই এনাজ আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।

এনাজঃ এই বাচ্চা কার?

আমিঃ অনলাইন থেকে আপনার নামে অর্ডার করেছিলাম।বছর দুই আগে দিয়ে গেছে।

ব্যঙ্গ সুরে কথাটা বলে মিটমিট করে হাসতে লাগলাম।এনাজ বোকার মতো ফেস করে অবাক হয়ে বললো।

এনাজঃ অনলাইনে বাচ্চা অর্ডার করা যায়?

এনাজের কথা শুনে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। মুখ টিপে হেসে বললাম।

আমিঃ হ্যাঁ,যায় তো।আপনি জানেন না।

এনাজঃ কোথায় না তো।আমি তো এসব বিষয় কিছু জানি না।তা বাচ্চাটা তো এখনো ঘুমে।ওকে কেন নিয়ে এসেছো? কার না কার বাচ্চা।

আমিঃ অন্য কারো নয়।এটা আপনার বাচ্চা। যাকে আপনি ছয় মাসের পেটে রেখে গায়েব হয়েছিলেন।

আমার কথা শুনে বিস্মিত চোখে এনাজ আমার দিকে তাকালো।

এনাজঃ মমমমাননে???

আমিঃ মানে হলো এতদিন আপনি ভুল জানতেন।আপনার সন্তান ছয় মাসের পেটে থাকতে মারা যায়নি। এই যে আপনার সন্তান। আপনি এতদিন ভুল ইনফরমেশন জেনে এসেছেন। যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে তায়াং ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

এনাজ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চারিপাশটা বাতির আলোয় আলোকিত থাকায় সেটা দেখতে আমার অসুবিধা হলো না।এনাজ হাত দুটো বাড়িয়ে দিলো।তবে ওর হাত থরথর করে কাঁপছে। চোখে পানি টলমল করছে।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো।

এনাজঃ এটা আআআমার ছছেললে!!! তুমি ভুল বলছো না তো।আমার অংশ ও!!!

আমিঃ জ্বি না আমি ভুল বলছি না।এটা আপনার ছেলে নাভান।আর সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না নাভান কে? এই আপনার ছেলের নামই নাভান।অবশ্য রিয়েল নাম এনান আহমেদ। আমি চিন্তা করছি ওর নাম জন্ম নিবন্ধন কার্ডে এনান আহমেদ নাভান করে আনবো।

এনাজঃ ওকে একটু আমার কোলে দিবে?

আমিঃ দিতেই তো আনলাম।ওকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেই।

এনাজঃ না না ও ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।আমি তো ওকে কোলে নিবো শুধু। ঘুম ভাঙালে কান্না করবে তো।

আমিঃ কেন ওর মুখে বাবা ডাক শুনবেন না?

এনাজ চমকে উঠলো। তবে সেটা খুশিতে।মাথাটা উপর নিচ ঝাঁকিয়ে বুঝালো সে শুনতে চায়।আমি নাভানের ঘুম ভাঙানোর জন্য ওকে ডাকতে লাগলাম।

আমিঃ নাভান, এই নাভান। দেখো কে আসছে? তুমি না জিজ্ঞেস করতে বাবা কবে আসবে? এই যে দেখো তোমার বাবা এসেছে। এখন যদি ঘুম থেকে না উঠো তাহলে বাবা কিন্তু চলে যাবো।

এনাজঃ ও কথা বলতে পারে।

আমিঃ হুম সবকিছু বলতে পারে।

নাভান দু হাতে চোখ কচলে আমার কাঁধ থেকে মাথা উঠালো।তারপর আধো আধো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

নাভানঃ বাবা কো?

আমিঃ সামনে তাকাও। দেখো তোমার বাবা এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে।

নাভান পিটপিট চোখে সামনে তাকালো।এনাজ দু হাত বাড়িয়ে রেখেছে। নাভান আমার দিকে তাকালো সম্মতির আশায়।আমি মাথা নাড়িয়ে আস্বস্ত করে নাভানকে বললাম।

আমিঃ যাও বাবার কোলে যাও।এটাই নাভানের বাবাই।

আমার সম্মতি পেয়ে নাভান ওর বাবার কোলে চলে গেল। এনাজ ওকে কোলে নিয়ে দিকপাশ না তাকিয়ে সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো।সে এখন খুশিতে পাগলপ্রায়। কি থেকে কি করবে।তা সে নিজেই জানে না।ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে। নাহ এটা কোন কষ্টের নয়।বরং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখের।তাকে অনেকদিন পর এত খুশি হতে দেখলাম।চোখ,মুখে আনন্দ উপচে পরছে। যা দেখে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো আমার। হঠাৎ এনাজ নাভানের দিকে ভালো করে খেয়াল করে কিছুটা চমকে উঠে আমাকে বললো।

এনাজঃ ওকেই তো আমি পার্কে দেখেছিলাম।ওহ শীট,কি কপাল আমার।আমি নিজের ছেলেকেও চিনতে পারিনি।কখনও কল্পনাও করিনি এই ছেলে আমার রক্তের হতে পারে।

আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকাতেই এনাজ আমাকে পার্কের সব ঘটনা বললো।আমি বিস্মিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।আল্লাহ তাহলে বাপ-বেটাকে বহু আগেই মিলিয়ে দিয়েছিলো।নাভান শক্ত করে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। এনাজও নাভানকে শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছে।

আমিঃ নাভান।

নাভানঃ হুম।

আমিঃ বাবা কে বাবা বলে ডাক দাও।

নাভানঃ আচ্ছা।

আমিঃ বলো।

নাভানঃ বাবা,ও বাবা,বাবা।আমার বাবা।তুমি কই ছিলা বাবা?আমাদের ছেড়ে আর কোথাও যাইয়ো না।

নাভান বাবা বলে ডাক দিয়ে ওর বাবার গালে আলতো করে চুমু খেলো।এনাজ আবারো খুশিমনে ওকে জড়িয়ে ধরলো।

এনাজঃ আমি আর কখনো তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না।আবার বলো বাবা।আরেকবার বাবা বলে ডাক দেও আমাকে।

নাভানঃ বাবা।আমার বাবাই।

এনাজ আবারো বাচ্চাদের মতো চোখের পানি ফেলতে লাগলো।এই ছেলেটার বাচ্চামো দেখে আমি নিজেই অবাক।এক ছেলের বাবা হয়ে গেছে আর সে নিজেই বাচ্চামো করছে।কিছু সময় পরপর নাভানের কপালে,গালে,থুতনীতে চুমু খাচ্ছে।ও পুরো দিশেহারা হয়ে গেছে। এবার নাভানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে রাখলো।নাভান তো ওর বাবার গলায় ছাড়ছে না।কিরকম চুপ করে আছে।হয়তো নাভান ওর বাবার আদর,স্পর্শ, স্নেহগুলো উপভোগ করছে। একেই তো বলে নিজের রক্তের টান।আমি নিরব দর্শকের মতো তাদের বাপ-বেটার কান্ড দেখতে লাগলাম।আজ অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে আমার।অবশেষে বাবা-ছেলের দেখা হলো তাহলে।আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া। উনি আমার ছেলেকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাবা-ছেলের মিল দেখে নিজেকে আজ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।আলগোছে চোখের পানিটা মুছে নিলাম।আর কান্না নয়। আল্লাহ যদি চায় তাহলে এবার বোধহয় আমার সুখের দিন শুরু হবে।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-৩২

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_32
#Writer_NOVA

—- তায়াং ভাইয়া!!!!

আমি চিৎকার করে চোখ খুললাম।এনাজ,রোশান দুজন কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত জোরে চিৎকার করেছি যে আমার নিজেরই গলা ব্যাথা করছে।পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখি তায়াং ভাইয়া খাইয়া ফালামু লুক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

তায়াংঃ ঐ ছেমরি চুপ কর।গলা তো না,মনে হয় ফাটা বাঁশ। কানের পর্দা তো ফাটায় ফালালি।

আমিঃ ওরে পাঠা রে!! আমি তো মনে করছিলাম তুই মইরা গেছত।কেউ তোরে গুলি করে মাইরা ফালাইছে।

তায়াংঃ নাটকি বেগম।নাটক তো ভালোই পারিস শাঁকচুন্নি। ওরা দুজন তোকে নিয়া যা শুরু করছিলো তা থামাইতে উপরের দিকে গুলি করছি।

আমিঃ আর কইস না ভাই। দুইজনের আমার প্রতি ভালোবাসা একেবারে বাইয়া চাইয়া পরতাছে।আল্লাহ গো আমার কোমড় 😵।বসে থাকতে থাকতে কোমড় ধরে গেছে। একটু আগে উঠতে গিয়ে আবার পেলাম ব্যাথা।এমনি আমি সিজারের মানুষ। আর এরা যা শুরু করছে তা সহ্য করার মতো না।

আমার কথা শুনে এনাজ ও রোশান দুজনেই ব্যস্ত হয়ে গেলো।আমার দিকে দুজন এগিয়ে আসতে নিলেই আমি নিজের শরীরে একটু শক্তি জোগাড় করে ব্যাঙের মতো দুটো লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেলাম।

এনাজঃ কি হয়েছে তোমার? কোথায় ব্যাথা পাইছো বাটারফ্লাই?

রোশানঃ পাখি,তুমি ঠিক আছো তো?

আমিঃ থাম ভাই তোরা।এত দরদ দেখাইতে হইবো না। দুইজনে আমার দুই হাত টানাটানি কইরা আমার হাতের হাড্ডির জয়েন ঢিলা কইরা ফালাইছোত।হাত দুইটা মনে হয় আরেকটু হইলে ছুইট্টাই যাইতো।যেমনে টানাটানি শুরু করছিলি।আরেকটু সময় থাকলে আমি ছিড়াই যাইতাম।শোন ভাই,তোদের আমি ভালো একটা সলিউশন দেই।

এনাজঃ কি?

রোশানঃ কিসের সলিউশন?

আমিঃ আপনাদের দুজনেরই তো আমাকে লাগবো তাই না।তাহলে আপনারা দুজন মিলে আমাকে সমান দুই ভাগে ভাগ করেন।তারপর দুই ভাগ দুইজন নিয়ে যান।ব্যাস সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।

এনাজঃ আমি তোমার ভাগ আর কাউকে কখনো দিতে পারবো না বাটারফ্লাই। তুমি পুরোটাই আমার।তুমি আগেও আমার ছিলে,এখনও আছো আর ভবিষ্যতেও থাকবে।আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে অন্য কারো হতে কখনও দিবো না।

এনাজ রোশানের দিকে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো।রোশান রাগে লুচির মতো ফুলছে।আমি ভয় পাচ্ছি ওরা দুজন আমার জন্য আবার মারামারি না শুরু করে দেয়।দুজনেই একে অপরের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রোশান, এনাজকে আগে কখনও দেখেনি।এমন কি ছবিও না।যার কারণে সে বিশ্বাস করে নিয়েছে এটা এনাজ।তবে যদি বাই চান্স এনাজের আগের ছবি কিংবা ওকে যদি দেখতো তাহলে এখন এখানে কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতো।রোশান কিছুতেই বিশ্বাস করতো না এটা এনাজ।আমি ধপ করে চেয়ারে বসে পরলাম।তায়াং ভাইয়ার লোক চলে এসেছে। তারা মোরশেদ ও সাইমনের লাশটা নিয়ে গেলো।সাথে ওদের সাঙ্গপাঙ্গদেরও।ততক্ষণ সবাই চুপচাপ ছিলো।তায়াং ভাইয়া খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।

তায়াংঃ তোদের ড্রামা শেষ হয়েছে? এক নায়িকা নিয়ে দুই নায়কের তামিল মুভি শুরু করে দিছিলি।যদি শেষ হয় তাহলে দয়া করে এখান থেকে চল।

আমি তায়াং ভাইয়াকে খুড়িয়ে হাটতে দেখে চোখ দুটো ছোট ছোট করে ওর পায়ের দিকে তাকালাম।পা রক্তে ভিজে গেছে। বেল্টের জুতা রক্তে মাখামাখি। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া তোর পায়ে কি হয়েছে? তুই খুড়িয়ে হাঁটছিস কেন?

তায়াংঃ ঐ ছেমরি এত চিল্লাস কে? আস্তে করে কথা বলতে পারিস না।আমি কি তোর মতো বয়রা নাকি?

আমিঃ এর জন্য বলে কারো ভালো করতে নাই।আমি ভালো বলে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? আর তুই আমাকে ধমকাচ্ছিস।

তায়াংঃ বুঝতে পারতাছি না কি হলো। মারামারি করতে গিয়ে নিশ্চয়ই কোন ভারী কিছুর সাথে লেগে নখ উপরে গেছে। তখন টের পাইনি।একটু আগে ব্যাথা অনুভব করে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত মুছতে গিয়ে দেখি অনেকটা নখ উপরে গেছে। এখন অনেক ব্যাথা করছে।

আমিঃ গন্ডারের চামড়া তো টের পাবি কি করে?

এনাজঃ চল বের হই।

তায়াংঃ হুম চল।রোশান আপনিও আমাদের সাথে যেতে পারেন।

রোশানঃ No Thanks.

এনাজ রোশানকে সাইড কাটিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি কপাল কুঁচকে তার দিকে তাকালাম।কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে কোলে তুলে নিলো।আমার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এনাজ যে এমন কিছু করবে তা আমি ভাবতে পারিনি।আমি হাত-পা ছুঁড়ে নামার জন্য ছটফট করতে লাগলাম।

আমিঃ ঐ মিয়া, নামান কইতাছি।জলদী নামান।আপনার সাথে আমার কোন কথা নাই।জলদী নামান, নয়তো কামড় দিমু।

এনাজঃ যত খুশি দিতে থাকো।তবে আরেকবার নড়লে কোলের থেকে ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে দিবো।তায়াং চল।মিস্টার রোশান,আপনি চাইলে এখানে থাকতেও পারেন।আবার চলেও যেতে পারেন।পুরোপুরি আপনার ইচ্ছা। আমি আমার বউ নিয়ে গেলাম।

ফেলে দেওয়ার কথা শুনে আমি ভদ্র মেয়ে হয়ে গেলাম।সত্যি যদি ফেলে দেয় তাহলে আমার কোমড়ের হাড্ডি ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাবে।আমাকে যাতে ফেলে দিলে না পরি তার জন্য দুই হাতে এনাজের গলা জড়িয়ে ধরে রাখলাম।এবার আমাকে ফালাতে চাইলেও আমি পরবো না। রোশান রাগে ফেটে যাচ্ছে। বেচারার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। আহারে, বেচারা!!! রোশান কোন কথা না বলে গটগট করে আমাদের আগে বের হয়ে গেলো।

তায়াংঃ আহা, কি প্রেম!!! আমি হাঁটতে পারছি না।কোথায় আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাবে।তা না করে সে বউকে কোলে তুলে নিয়েছে। একেই বলে বন্ধুত্ব।

এনাজঃ চুপচাপ হেঁটে আয়।এতটুকু তে কি হয়?

তায়াংঃ চুপ শালা।

এনাজঃ আমি তোর বোন জামাই তায়াং।(আমার দিকে তাকিয়ে) একটু আগে তো কোলে উঠিয়েছি বলে ছটফট করছিলে।আর এখন একদম চুপচাপ। জানোই যখন আমার সাথে পারবে না। তাহলে মন-মতলবিগুলো কেন করো? আমার অবাধ্য না হলে কি তোমার ভালো লাগে না?

আমিঃ তায়াং ভাইয়া এই আনাইজ্জারে ভালো হইয়া যাইতে বল।এত দরদ দেখাইতে হইবো না। আমি একাই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি।কাউকে প্রয়োজন নেই।

তায়াং ভাইয়া আমার কথা শুনে এনাজের পাশাপাশি দাঁড়ালো। তারপর ওর পিঠে চাপর মারতে মারতে বললো।

তায়াংঃ ভালো হয়ে যাও এনাজ,ভালো হয়ে যাও।

তায়াং ভাইয়ার কথা শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।এনাজ আমাকে নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে সামনে তাকিয়ে হাঁটছে। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো।

এনাজঃ আবার মুখ খুলছো তো।তখুনি ফালায় দিবো।

আমিঃ না না।প্লিজ ফেলবেন না।

বাকি রাস্তা আমি চুপচাপ ছিলাম।গাড়িতে উঠিয়ে সামনের সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো এনাজ।তারপর গাড়ির থেকে এন্টিসেপটিক ও ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ নিয়ে তায়াং ভাইয়ার পায়ে লাগিয়ে দিলো।তায়াং ভাইয়া পেছনের সিটে বসলো।এনাজ আমার সাথে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

🦋🦋🦋

গাড়ি চলছে নিজস্ব গতিতে। জানলার কাচ খুলে বাইরে তাকিয়ে আছি।দুপুরের রোদের তেজটা আজ অন্য দিনের থেকে কম।বাতাসে চোখের সামনে বেবী চুলগুলো এসে বারবার ডিস্টার্ব করছে।হাত দিয়ে সেগুলো বারবার ঠিক করে দিচ্ছি। এনাজ ড্রাইভ করার মাঝে মাঝে আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। যা আমার নজর এড়াচ্ছে না।হঠাৎ আমার নাভানের কথা মনে পরলো।এত ভেজালের মধ্যে আমি ছেলেটার কথা পুরো ভুলেই গেছি।সেই যে গতরাত এখানে এসেছি। আর আজ দুপুরে ফিরছি।এর মধ্যে নিশ্চয়ই নাভান ওর খালামণিদের পাগল করে ফেলেছে আম্মু কো,আম্মু কো বলে।ঠিকমতো খাবারও তো খাবে না।আমার মোবাইল,ব্যাগের খোঁজ আমি নিজেও জানি না।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া আমার ব্যাগটা কোথায় রে?মোবাইলটা লাগবে।

এনাজঃ মোবাইল দিয়ে কি করবে?

আমিঃ আপনাকে কেন বলবো?

এনাজঃ সোজা কথা সোজা করে উত্তর দিতে পারো না। এতো ত্যাড়ামী করো কেন?(দাতে দাঁত চেপে)

আমিঃ আমার কাজই ত্যাড়ামী করা।আমি সোজাভাবে কিছু করতে পারি না। আর আমার কাজের জন্য আমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে পছন্দ করি না।আপনার মন মতো যখন আপনি চলেন।তখন কি আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাই?

এনাজঃ রাগিয়ো না আমায়।

আমিঃ কি করবেন রাগালে?কি করবেন? আড়াই বছর পর এসে দয়া দেখানো হচ্ছে। তার কোন দরকার নেই। আমি কারো দয়া বা অনুগ্রহে বাঁচতে চাই না। আড়াই বছর অনেক মানুষের অনেক কথা শুনে, নানারকম বাজে পরিস্থিতিতে পরে নিজেকে শক্ত করে ফেলেছি।এখন নিজের যেটা ভালো মনে হয় তাই করি।কারো কথা শোনার প্রয়োজন মনে করি না।আপনি যা করেছেন তা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়।আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না কখনো।

এনাজঃ এখন এসব কথা কেন উঠছে? আমি কি কিছু বলছি?

আমিঃ নাহ কিছু বলেন নি।তবে আচার-আচরণে তাই বুঝাচ্ছেন।আমার ওপর অধিকার দেখানো শুরু করছেন।আমাকে আপনার মন মতো চালাচ্ছেন। এগুলো আমি একদম সহ্য করবো না।

এনাজঃ তুমি শুধু শুধু ঝামেলা করছো।

আমিঃ আমি তো শুধু শুধুই করি।আর আপনি সব কারণে করেন।আপনি আপনার মতো চলুন।আমি আমার মতো।একদম আমার জীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা করবেন না।আমি একাই ভালো আছি।

এনাজঃ আমি একশো বার তোমার ওপর অধিকার দেখাবো।তোমার জীবনে আমিই আছি।আর আমিই থাকবো।

আমিঃ একটুও না।আপনি আড়াই বছর আগের এনাজ নন।আপনি এখন তাজ।এনাজের সাথে আপনার আকাশ-পাতাল তফাৎ।

এনাজঃ সামান্য বিষয় নিয়ে তুমি এমনটা না করলেও পারতে।

আমিঃ একদম কথা বলবে না আমার সাথে। আমি আপনার কেউ হই না।

আমার কেন জানি হুট করে রাগ উঠে গেলো। কেন তাও জানি না। এনাজের পুরনো কথা মনে পরে গেছে। তাছাড়া নাভানের কথাও একবারও জিজ্ঞেস করলো না।আমি নাভানের সাথে কথা বলবো বলে মোবাইল খুঁজছিলাম। সেটাতে কেন যেচে প্রশ্ন করলো।এই বিষয়টাতে যেনো আরো বেশি রাগ হলো তার ওপর।তাই এতো কথা শুনালাম।পেছন থেকে তায়াং ভাইয়া আমাদের দুজনকে ধমকে উঠলো।

তায়াংঃ কি শুরু করলি তোরা? গাড়ির মধ্যে এভাবে কেউ ঝগড়া করে? সবেমাত্র চোখ দুটো লেগে এসেছিলো।তাতেও শান্তি নেই।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া, আমার ব্যাগ কোথায় রে?

তায়াংঃ পেছনে। কেন?

আমিঃ আমার মোবাইলটা একটু দে তো।নাভানের খোঁজ নিবো।আল্লাহ জানে ছেলেটা কেমন আছে।

হঠাৎ করে বেশ জোরে এনাজ ব্রেক কষিয়ে গাড়ি থামালো।আমি সামনের দিকে হেলে পরলাম।সিট বেল্ট না থাকলে নির্ঘাত কপাল ফাটতো।আমি চেচিয়ে এনাজকে বললাম।

আমিঃ কি হলো? এভাবে গাড়ি থামালেন কেন? আরেকটু হলেই তো আমার কপাল ফাটতো।

এনাজঃ নাভান কে?

এনাজ নাক,মুখ কুঁচকে বিস্ময়ের ভঙ্গিতে কথাটা জিজ্ঞেস করলো।তার প্রশ্ন শুনে আমার মনে একটা জিদ চেপে গেলো।নাভানের কথা যদি সে নাও জানে তাহলে তাকে আমি বলবো না। বাহ্ কত ভালোবাসা তার।সে জানেই না নাভান কে।আমার তো মনে হয় সে বোধহয় এটাও জানে না যে আমার একটা ছেলে আছে। হয়তো এটাও ভুলতে বসেছে যে সে গায়েব হওয়ার আগে আমি ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলাম।আমি কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দিলাম।

আমিঃ আপনার কেউ না।আমার সব।

এনাজঃ মানে? তায়াং তোর বোন কি বলছে?ওর কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নাভান কে?

আমি হাতের আঙ্গুল মুখে নিয়ে ইশারায় তায়াং ভাইয়াকে চুপ থাকতে বললাম।তায়াং ভাইয়া আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললো।

তায়াংঃ সেটা তোর বউয়ের থেকে জেনে নে।তোদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার তোরা সলভ কর ভাই।মাঝে আমায় টানিস না।

এনাজঃ নোভা আমি জিজ্ঞেস করছি নাভান কে?

আমিঃ আমি জানি না।

এনাজ আর কোন কথা বললো না।রাগী মুখে ড্রাইভ করতে লাগলো।সারা রাস্তায় কারো সাথে কেউ কথা বললাম না।নাভানকেও কল করলাম না।এনাজের সামনে কথা বলতে চাই না তাই।তায়াং ভাইয়া অর্ধেক রাস্তায় নেমে গেলো। তার আবার অফিসে যেতে হবে কিসব ফর্মালিটি পূরণ করতে।গাড়িতে শুধু আমি ও এনাজ।এনাজের মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। তাতে আমার কিছু আসে যায় না।আজ তাকে মনের মতো কতগুলো কথা শুনাতে পেরেছি। তার জন্য মনটা খুশি খুশি লাগছে।আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরের গলিতে গাড়ি থামাতে বললাম।আমি চাই না সে বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দিক।কেউ দেখলে আবার নষ্টা মেয়ে উপাধি পাবো।তার কি দরকার। আমি গাড়ি থেকে নামতেই এনাজও সাথে সাথে নামলো।

আমিঃ আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। উপকারটা তুলে রাখলাম। যদি কখনো সুযোগ হয় তাহলে এই ঋণ শোধ করে দিবো।

আমার কথা শুনে এনাজ রক্তচোখে আমার দিকে তাকালো।এই চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস আমার নেই। আমি চোখ নামিয়ে ফেললাম।

এনাজঃ রেডিও স্টেশনের চাকরীটা ছেড়ে দিও।সাথে অফিসের জবটাও ছেড়ে দিবে।

আমিঃ ফাইজলামি পাইছেন।চাকরী ছেড়ে দিলে আমি চলবো কি করো?আমাকে না খেয়ে মরার বুদ্ধি দেন।আমি আপনার কথা শুনছি না। (রেগে)

এনাজঃ এই মাসের মধ্যে আমি নতুন ফ্ল্যাট কিনবো।সেখানেই উঠবো তোমাকে নিয়ে।তোমার খরচের কথা আর চিন্তা করতে হবে না। এখন থেকে সবকিছু আমি বহন করবো। তুমি একা থাকতে থাকতে বেশি উড়তে শুরু করেছো।তোমার উড়ার ব্যবস্থা কমাতে হবে।

আমিঃ আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো।আমার ইচ্ছায় একদম বা হাত ঢুকাতে আসবেন না।আমি খুব শীঘ্রই আপনার কাছে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো। তাতে সই করে আমাকে মুক্তি দিবেন।ডিভোর্স……….

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় পরলো।গালটা জ্বলে যাচ্ছে, সাথে বা কানটা তব্দা খেয়ে রইলো।গালে হাত দিয়ে এক মিনিট স্তব্ধ হয়ে রইলাম।চোখে সব অন্ধকার দেখছি।সারা মাথা ঝিম ঝিম করছে।সব শক্তি লাগিয়ে আমাকে থাপ্পড়টা মেরেছে এনাজ।আশেপাশের কোন শব্দ শুনছি না।শুধু এনাজের কথাগুলো কোনরকম কর্ণগোচর হচ্ছে।

এনাজঃ অনেকখন ধরে সহ্য করছি।কিছু বলছি না বলে সাহস বেড়ে গেছে? সহ্যের সীমা এবার অতিক্রম করে ফেলেছো।আরেকবার ডিভোর্সের নাম মুখে নিলে কণ্ঠনালি টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।তখন আমিও দেখবো ডিভোর্স শব্দটা উচ্চারণ করো কি করে? তুমি চাইলেও আমার সাথে থাকতে হবে,না চাইলেও । ডিভোর্স তোমাকে আমি জীবনেও দিবো না। ভালো কথায় থাকতে না চাইলে শিকল দিয়ে বেঁধে নিজের কাছে রেখে দিবো।তাও অন্য কোথাও যেতে দিবো না। আমার থেকে মুক্তি তোমার জীবনেও মিলবে না।ভালো লাগলেও আমার হয়ে থাকতে হবে, খারাপ লাগলেও আমরই থাকতে হবে। অনেক স্বাধীনতা দিয়েছি।কিন্তু এখন দেখছি এটাই আমার ভুল।এবার বাটারফ্লাইকে তার খাঁচায় বন্দী করার সময় হয়েছে।

আমি গালে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। পাগলটা কে অনেক রাগিয়ে ফেলছি।আমি তো এমনি ওকে ভয় দেখানোর জন্য ডিভোর্সের কথা বলেছিলাম।কিন্তু পাগলটা যে এতো রেগে যাবে তা কে জানে? আমি তো ওকে কখনো ডিভোর্স দিবো না। আমি চাই না আমার ছেলে বাবা ছাড়া বড় হোক।কিন্তু হীতের বিপরীত হবে তা কে জানতো।

এনাজঃ একবারো কি আমায় জিজ্ঞেস করেছো আমি এই আড়াই বছর কিভাবে পার করেছি? কিভাবে বেঁচে ছিলাম? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি।সেটা কি জানো তুমি?এমন কোথাও নেই যে তোমাকে খুঁজিনি।আর তুমি ভাবছো তোমাকে আমি একটুও খুজিনি।এই আড়াই বছর আমার ওপর দিয়ে কি ঝড় গিয়েছে তা কি তুমি জানো? এই এনাজটা না তোমার বিরহে পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিলো।হাসতে ভুলে গিয়েছিল। মাঝরাতে তোমার নাম নিয়ে চিৎকার করে উঠে পাগলের মতো করতো।তখন আমাকে সামলাতে কি কষ্ট হতো তা আমার পালিত পরিবার কে জিজ্ঞেস করে দেখো।কোথায় তোমায় খুঁজি নি বলো?তোমার বাসায় যে কতবার গিয়েছি তার কোন হিসেব নেই।তোমার বাসার কিংবা গ্রামের কোন লোকজন জানে না তুমি কোথায়?তায়াংদের বাসায়ও গিয়েছিলাম।কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনি তায়াংরা বাসা পাল্টে ফেলেছে।প্রতিটা রাত কাঁদতে কাঁদতে মাথাব্যথা উঠে যেতো আমার।রাতটা চোখের পানি নিয়ে পার করতে হয়েছে আমার।এই এনাজ জিন্দা লাশ হয়ে গিয়েছিল। তোমায় পেয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। একবারও তো জিজ্ঞেস করোনি আমি কেমন আছি,কোথায় ছিলাম এতদিন। হ্যাঁ, আমি মানলাম এই কয়েকদিন তোমার সাথে আমার সেরকম কোন কথা হয়নি।তোমার খোঁজ নেওয়া হয়নি।কিন্তু তুমি তো আমার চোখের সামনে ছিলে।ব্যবসার কাজে তোমার খেয়াল রাখা হয়নি।কিন্তু তুমি কি রেখেছো আমার খেয়াল? সবসময় নিজের দিকটা ভেবো না,বাটারফ্লাই।তোমার বিপরীতে থাকা মানুষটার পরিস্থিতিও বোঝার চেষ্টা করো।তাহলে হয়তো এই অভিমান থাকবে না। অভিমান অনেক খারাপ জিনিস বাটারফ্লাই। এই বস্তুটা তিলে তিলে একটা সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়।শুধু এতটুকু মনে রেখো, তুমি যেমন আমাকে ছাড়া ভালো ছিলে না।তেমন আমিও তোমাকে ছাড়া একবিন্দুও ভালো ছিলাম না।একবিন্দুও নয়।

কথাগুলো বলে এক মিনিটও দাঁড়ালো না এনাজ।
চোখ মুছতে মুছতে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে পরলো।তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের গন্তব্যের পথে ছুট লাগালো।আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি মাঝরাস্তায়।সত্যিই তো আমি তো কখনও এনাজের মতো করে বিষয়টা ভাবিনি।এখন নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সবসময় এত বেশি কেন বুঝি আমি!!!

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-৩১ + বোমাস পর্ব

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_31
#Writer_NOVA

—-হাত উপরে উঠা।নয়তো গুলি করে উপরে পাঠিয়ে দিবো।কি বললাম শুনতে পাসনি?হাত জলদী উঠা।

ধমক শুনে সাইমন ও মোরশেদ দুজনেই হাত উপরে তুলে ফেলে।মোরশেদ ওয়াসিম তাচ্ছিল্যের সুরে বলে।

মোরশেদঃ তানভীর রহমান তায়াং যে।তা গোয়েন্দা সাহেব একা এসেছেন নাকি জানে জিগার বন্ধু প্লাস বোনের জামাইকে সাথে নিয়ে এসেছেন?

তায়াংঃ কথা কম বল।নোভা কোথায়?

সাইমনঃ খুঁজে নে।আমরা কেন বলবো?

সাইমনের ত্যাড়া উত্তর দিতে দেরী কিন্তু ওর নাকের মধ্যে ঘুষি পরতে দেরী হলো না। সাইমন নাক ধরে দেখলো রক্ত পরছে।মোরশেদ ওয়াসিম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।

মোরশেদঃ তায়াং কাজটা ভালো করলি না।

সাথে সাথে মোরশেদ সাহেবের মুখেও একটা পাঞ্চ মারলো তায়াং।একের পর এক ডিসুম ডাসুম করে মেরেই চলছে ।মনের আশ মিটিয়ে মারছে তায়াং।খবর পাওয়ার সাথে সাথে এখানে চলে এসেছে সে।সাথে এনাজও এসেছে। বাইরের ঝামেলা এনাজকে সামলাতে দিয়ে সে পেছনের দেয়াল বেয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। ধুমছে মারামারি হচ্ছে। মারামারির এক পর্যায় তায়াং-এর হাত থেকে রিভেলভারটা পরে যায়।সাইমন ফাঁকের মধ্যে সেটা তুলে নিয়ে তায়াং-এর মাথায় ঠেকিয়ে ধরে।

সাইমনঃ হাত উঁচু করে সারেন্ডার কর।নয়তো মাথার খুলি উড়ে যাবে।

তায়াং হাত দুটো উঁচু করে ফেলে।মোরশেদ সাহেব ততক্ষণে ফ্লোরের থেকে উঠে শরীর ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।

মোরশেদঃ এটা কে নিয়ে ওর বোনের রুমে আটকে রাখ।এমনভাবে আটকাস যাতে ছুটতে না পারে।

সাইমনঃ অনুমতি দেও তো একে এখানেই শেষ করে দেই।

তায়াংঃ এত সাহস আছে নাকি তোর?

সাইমন খুব জোরে তায়াং-এর মুখে দুটো পাঞ্চ মেরে বলে।

সাইমনঃ আমার সাহস নিয়ে কথা বলিস না।তাহলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে।

তায়াং উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মনে হচ্ছে সাইমন বড় কোন জোকস বলেছে। এর মধ্যে সাইমনদের লোকেরা এনাজকে ধরে নিয়ে এসেছে। এনাজকে দেখে মোরশেদ সাহেব একটা শয়তানি হাসি দিলো।এনাজ সেই হাসির তোয়াক্কা না করে ওকে ধরে রাখা ছেলেগুলোকে ধমক দিয়ে শাসিয়ে বললো।

এনাজঃ আরে ব্যাটারা ছাড় তো।এত শক্ত করে কেউ ধরে।আমার হাড্ডিগুলো তো গুঁড়া গুঁড়া করে ফেললি।
ছাড় আমাকে।আমি এখন পালাবো না।

ঝাড়া মেরে নিজের দুই হাত ছাড়িয়ে নিলো এনাজ।লোকগুলো আবার ধরতে নিলেই মোরশেদ হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো।এনাজ পকেট থেকে দুটো চুইংগাম বের করে দুটোর প্যাকেট ছিড়লো।তারপর একটা তায়াং-এর দিকে ছুঁড়ে মারলো।তায়াং সেটা ক্যাচ ধরে মুখে পুরে দিলো।এনাজ বাকি চুইংগামটা মুখে নিয়ে ছাগলের মতো চাবাতে চাবাতে মোরশেদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মোরশেদ কালো সানগ্লাস পরা আছে। এনাজ সামনে এগিয়ে মোরশেদের সানগ্লাসে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে লাগলো। এনাজের এমন কান্ডে তায়াং,মোরশেদ ছাড়া বাকি সবাই অবাক হলো।তবে তখন যদি মোরশেদ সাহেব ভালো করে খেয়াল করতো।তাহলে দেখতো এনাজ পকেট থেকে কিছু একটা নিয়ে তার চুলের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে।চুল ঠিক করতে করতে এনাজ মোরশেদের লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বললো।

এনাজঃ যাঃ পোলাপাইন। আমার স্টাইল করা চুলগুলি সব এলোমেলো করে দিলি।তোদের কি আমি কিছু করছিলাম রে ভাই? শুধু একটু আমার পিছু পিছু দৌড়িয়ে তোদেরকে এক্সারসাইজ করছি।আর তোরা আমার সাধের চুলের স্টাইলটা নষ্ট করে দিলি।দিস ইজ নট ফেয়ার। এখন আমার বউ কি আমার দিকে তাকাবে? এমনি আমার ওপর যা রেগে আছে। যার জন্য এত সুন্দর করে সাজগোজ করে ইমপ্রেস করতে এসেছিলাম।আর তোরা সব নষ্ট করে দিলি।

এনাজের কান্ড দেখে সবাই আহাম্মক হয়ে গেলো। কোথায় ভেবেছিলো এনাজ সবার সাথে ফাইট করবে।তা না করে সে যত্ন সহকারে নিজের চুল ঠিক করছে।শুধু মোরশেদ ও তায়াং চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ তারা দুজন জানে এনাজ কারণ ছাড়া কোন ফালতু কাজে মনোনিবেশ করে না।এনাজ চুলগুলো ঠিক করে মোরশেদের সামনে থেকে সরে এলো।তারপর কালো দেখতে মোটা একটা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো।

এনাজঃ ঐ কালু,দেখ তো আমার চুলের স্টাইলটা কি এখন ঠিক আছে নাকি?

ছেলেটা অনেকটা বোকা টাইপের। মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি অনেক কম।সে ঠোঁট ফুলিয়ে মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বললো।

—- বস,আমার নাম শিপন।কালু না।

এনাজঃ ওহ আচ্ছা। তা শিপন ভাই আমার।আমার চুলের স্টাইলটাকি ঠিক আছে?

—- না বস,বাম দিকটা আরেকটু ঠিক করতে হইবো।

🦋🦋🦋

এদের কথা শুনে সবাই বিরক্ত হচ্ছে।এখন কি এসব করার সময়।সাইমন, শিপন নামের ছেলেটাকে জোরে একটা ধমক দিলো।

সাইমনঃ শালা,তোদের কি আমরা এসব করতে রাখছি? ওর চুলের স্টাইল ঠিক করতে কি তোদের এতগুলো টাকা দিয়ে ভাড়া করছি।হারামজাদা, ওদের হয়ে যদি আরেকটা কথা বলছিস ঘাড় থিকা মাথা ফেলে দিবো।(মোরশেদের দিকে তাকিয়ে)বড় ভাইয়া,তুমিও কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই পাগলের কান্ড দেখছো?ওকে ধরে আটকাও না কেন?

মোরশেদ কোন উত্তর দিলো না। সে তো এনাজকে ভালো করে লক্ষ্য করছে।এনাজ তার মুখের চুইংগামটা শব্দ করে মোরশেদের শরীরে ফেলে দিলো।
এতে মোরশেদ কোন প্রতিউত্তর করলো না। কিংবা দূরেও সরলো না।

এনাজঃ ওয়াক থু, চুইংগাম কোম্পানি আজকাল দুই নাম্বারি শুরু করছে। একটু চাবাইলে তিতা হয়ে যায়।

সাইমন তার ভাইয়ের চুপ থাকাটা মেনে নিতে পারছে না।তাই হুংকার ছেড়ে এনাজকে শাসিয়ে বললো।

সাইমনঃ তুই একটু বেশি করছিস কিন্তু। এসব ফালতু কাজে টাইম নষ্ট করার মতো টাইম আমাদের হাতে নেই। তাই চুপচাপ আমাদের সাথে চল।

এনাজ ওর কথার উত্তর না দিয়ে মোরশেদের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো।

এনাজঃ কি মোরশেদ সাহেব? আছেন কেমন? মৃত এনাজ তোর চোখের সামনে আসছে আর তোদের কোন ভাবান্তর নেই। ওফস সরি। আমি তো ভুলেই গেছিলাম।তুই তো আবার সব আগের থেকে জানিস।অবশ্য তোর চোখে আমি একটু ভয় দেখেছি। নিশ্চয়ই ভাবছিস আমি এতকিছু জানছি কি করে? তায়াং আমাকে সবকিছু খুলে বলেছে।ও তো আমার কেস পুনরায় ওপেন করেছিলো।তখন তোদের দুই ভাইয়ের পুরো কুকীর্তি সব জেনে গেছে। আমার না এখন খুব আফসোস হচ্ছে। জানিস কেন? সেদিন যদি তোর মেজু ভাইয়ের সাথে সাথে তোদের দুই ভাইকে শেষ করে দিতাম।তাহলে হয়তো আমার জীবন থেকে আড়াই বছর হারিয়ে যেতো না। কিংবা আজ এই দিন দেখতে হতো না।যে অন্যায় করে আর যে প্রশ্রয় দেয়,দুজনই তো সমান অপরাধী। সেই হিসেবে তোদের দুজনকে মারলে আমার কোন ভুল হতো না।বরং পৃথিবী থেকে দুটো নরকীট কমে যেতো। তবে সেদিন তোদেরকে ছেড়ে ভুল করলেও আজ করতে চাই না।দুজনকে মেরেই এখান থেকে বের হবো।

সাইমনঃ কি ফুসুরফাসুর করছিস?

তায়াংঃ তুই বাচ্চা ছেলে। তোকে কি বলবে বল তো?

সাইমনঃ চুপ, বেশি কথা বলবি না।

এনাজের কথা শুনে মোরশেদ হো হো করে হাসতে লাগলো।তা দেখে এনাজ মেটেও বিচলিত হলো না।ও জানতো মোরশেদের রিয়েকশন এমনি হবে।

মোরশেদঃ কে কাকে মারে তা একটু পর দেখবি এনাজ।আরেকজন এসে নেক।তাকেও তো আমার পাওয়ার দেখাতে হবে।

তায়াংঃ কে আসবে?

মোরশেদঃ তোর বোনের দিওয়ানা রোশান দেওয়ান।

এনাজঃ রোশান কেন এসবে?(রেগে)

সাইমনঃ আসলেই দেখতে পাবি।

মোরশেদঃ সবাইকে নিয়ে রুমে চল।

ভাড়া করা লোকগুলো এনাজকে ধরে ফেললো।তায়াং-কে রিভেলবার তাক করে পেছনে পেছনে সাইমন চলতে লাগলো।

এনাজঃ আরে ছাড়।আমি কি কোরবানির গরু নাকি যে আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে।আমি একাই যেতে পারি।

সবাইকে নিয়ে নোভা যে রুমে আছে সেই রুমে নেওয়া হলো।তায়াং,এনাজকে না বেঁধে লোকগুলো দিয়ে ঘেরা দিয়ে বন্দুক তাক করে রাখা হলো।মোরশেদ এগিয়ে গিয়ে ছোট টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোট সাইজের একটা গান বের করলো।সাইমন দুজনের দিকে রিভেলবার তাক করে আছে। কিন্তু ওদের দুজনের ভয়ের কোন রিয়েকশন নেই। বরং দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।

মোরশেদঃ সাইমন, নোভার জ্ঞান ফিরা।এত সুন্দর মোমেন্টটাকে ও কেন মিস করবে।নিজের ভাই ও স্বামীর মৃত্যুটা তো ওর নিজের চোখে দেখতে হবে। যেমন আমি দেখেছি।

সাইমন ভাইয়ের আদেশ পেয়ে রিভেলবার টেবিলে রেখে সেখান থেকে পানির বোতল হাতে নিলো।বোতলের খাপ খুলতে খুলতে নোভার সামনে এসে দাঁড়ালো। পানির বোতলটা উঁচু করে নোভার মুখের ওপর ঢালতে লাগলো।এরকম করে ঢালছে যে নাকে, কানেও পানি ঢুকে যাচ্ছে।তাছাড়া ওর নিশ্বাসেরও সমস্যা হতে পারে। যেটা দেখে এনাজের রাগ হলো।রেগে সামনে এগিয়ে আসতে নিলে তায়াং ওর হাত ধরে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।

🦋🦋🦋

মুখে পানির স্রোত বইতেই আমার জ্ঞান ফিরলো।কিন্তু পানির তোড়জোড়ের কারণে চোখ খুলতে পারছি না।কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে দেখলাম সাইমন বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে একটা শয়তানি হাসি দিলো।ওর হাসি দেখে আমার শরীর জ্বলছে। হাতের বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।আমি চেচিয়ে বলে উঠলাম।

আমিঃ তোকে যে এত অপমান করি, তোর কি শিক্ষা হয় না রে? আবার তোর ঐ বাঁদর মুখখানা দেখাতে চলে এসেছিস।আসলে কি জানিস, কুকুরের লেজ হাজার টানলেও তা বাঁকাই থাকবে।তোরা দুই ভাইও তেমন।কুকুরের জাত।

সাইমন প্রথমপ কোন উত্তর দিলো না। তবে রাগে ওর মুখটা লাল,নীল সিগনাল দিচ্ছে। কিছু সময় পর চেচিয়ে বলে উঠলো।

সাইমনঃ গলার সাউন্ড কমিয়ে কথা বল।একটু সামনে তাকিয়ে তো দেখ।

আমি কপাল কুঞ্চিত করে সামনে তাকাতেই তায়াং ভাইয়া ও এনাজকে দেখতে পেলাম।সাইমনদের বডিগার্ডরা ওদের দুজনের দিকে বন্দুক তাক করে রাখছে।আমি তাকাতেই এনাজ হাত নাড়িয়ে বললো।

এনাজঃ হাই বাটারফ্লাই 😘!!!

হাই বলেই ফালিং কিস ছুঁড়ে দিলো।আমি ভেংচি কেটে তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকালাম।

তায়াংঃ ঠিক আছিস তো তুই?

আমিঃ আমি ভালো আছি। তোরা কখন এলি?

এনাজঃ বেশি সময় হয়নি বাটারফ্লাই।

আমিঃ আমি আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করেছি।অন্য কাউকে নয়।তাকে তো আমি এখানে আসতে বলিনি।
সে কেন এসেছে? দরদ দেখাতে?

এনাজঃ ঢং😏😏!!!

এনাজের ভেংচি কেটে ঢং বলতে দেখে আমার রাগ উঠে গেলো।আমি তায়াং ভাইয়াকে চেচিয়ে বললাম।

আমিঃ ভাইয়া এই আনাইজ্জারে চুপ করতে কো।আমার এটারে সহ্য হইতাছে না।

তায়াংঃ কি শুরু করলি তোরা ভাই?এখন কি এসব করার সময়?

আমাদের কথা বলার মাঝে এনাজ একটা অদ্ভুত কাজ করলো।ওর সামনে থাকা লোকগুলোকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে আমার কাছে চলে এলো।তারপর কিছুটা উবু হয়ে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওর কান্ডে হতবাক।

সাইমনঃ আরে তোরা তাকিয়ে দেখছিস কি?নিয়ে আয় ওকে।

সাইমন ওদের লোকদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো।ততক্ষণে এনাজ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।ওর চোখ দুটো টলমল করছিলো। আমার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।তারপর লোকেরা ওকে ধরার আগেই চোখের পানি আড়ালে মুছে নিজের জায়গায় ফিরে গেল।এনাজের এমন কান্ডে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি।

মোরশেদঃ অনেক অভিনয় হইছে। এবার খেলা শুরু হয়ে যাক।

মোরশেদ ওয়াসিম টেবিলের ওপর এক পায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।কথাগুলো বলে গুটি গুটি পায়ে এনাজ ও তায়াং-এর দিকে এগুতে লাগলো।ওদের সামনে গিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

মোরশেদঃ তা ভাবীজী,কাকে প্রথমে মারবো? আপনার প্রাণপ্রিয় ভাইকে নাকি স্বামীকে?

সাইমনঃ ওকে জিজ্ঞেস করার কি আছে? তোমার যাকে ইচ্ছে হয় মেরে দেও।মারাটাই বড় কথা।তাছাড়া ও বা কত বড় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যে ওর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে?

মোরশেদঃ তুই শুধুই রাগছিস সাইমন।তার প্রিয়জন যেহেতু তাকেই তো জিজ্ঞেস করবো।

এতক্ষণ সাহস দেখালেও আমার এখন ভীষণ ভয় করছে।মোরশেদ এগিয়ে গিয়ে এনাজের কপাল বরাবর গান ঠেকালো।কিন্তু এনাজের চোখ, মুখে কোন ভয় নেই। সে জোরে চেচিয়ে বলে উঠলো।

—–আরে রোশান দেওয়ান যে!!!!

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Bonous_Part
#Writer_NOVA

—আরে রোশান দেওয়ান যে!!!!

রোশানের কথা শুনে সবাই দ্রুত গতিতে দরজার দিকে তাকালো।তাকিয়ে দেখলো সেখানে কেউ নেই। এনাজ ওদের বোকা বানিয়েছে।সেই ফাঁকে এনাজ মোরশেদের হাত থেকে গান কেড়ে নিয়ে পেছন থেকে একহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে মাথায় গান তাক করে ধরলো।

এনাজঃ কেউ কাছে আসার চেষ্টা করলে সোজা ওপরে পাঠিয়ে দিবো।

সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার রোশান সত্যি সত্যি এসে পুরো প্লানটাই চৌপট করে দিলো।বাইরে থেকে দৌড়ে এসে দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো।

রোশানঃ আমার নোভা কোথায়? তোমরা ওর কোন ক্ষতি করো না প্লিজ।

দরজা দিয়ে দ্রুত গতিতে ঢুকতে ঢুকতে রোশান কথাগুলো বললো।সবার নজর এখন রোশানের দিকে।সেই সুযোগে মোরশেদ ওয়াসিম সেম এনাজের মতো করে নিজেকে ছাড়িয়ে গান হাতে নিয়ে নিলো।তারপর এনাজের মাথায় ঠেকালো।সাইমন দৌড়ে গিয়ে রিভেলবার হাতে রোশানের মাথায় ঠেকালো।রোশান আগাগোড়া কিছু না বুঝে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।

এনাজঃ রোশান বাবু,আরেকটু পর এলে কি হতো?(রেগে)

তায়াংঃ দিলেন তো আমাদের সব প্ল্যানে জল ঢেলে।

রোশানঃ আমি কি করলাম? আর তোমরাই বা কে? ওহ্ তোমাকে তো চিনতে পেরেছি। মুরাদ সাহেবের বড় ছেলে তাজরান।কিন্তু তোমার সাথেরটা কে?

এনাজঃ আমি এনাজ।নোভার স্বামী। আর ও আমার বন্ধু প্লাস নোভার খালাতো ভাই তায়াং😊।

এনাজের নাম শুনে রোশানের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।অবিশ্বাস্য চোখে বললো।

রোশানঃ এনাজ তো মারা গেছে। তুমি মিথ্যে কেন বলছো?তুমি তো তাজ!!!

তায়াংঃ সত্য-মিথ্যের বিচার পরে হবে। আগে এদের সাথে লড়াই করেন।

কথাগুলো বলে তায়াং ভাইয়া ওর সামনে থাকা লোকটার পেটে একটা লাথি মারলো।এনাজ দুই হাত নাড়িয়ে অনেকটা কুংফু স্টাইলে মোরশেদের হাত থেকে গানটা ফেলে দিলো।রোশান কিছু সময় এদিক সেদিক তাকিয়ে বোকার মতো সাইমনের দিকে তাকালো। তারপর এক ঘুষিতে সাইমনকে দূরে পাঠিয়ে দিলো।সাইমনের নাকের তেরটা তো তায়াং আগেই বাজিয়ে ছিলো।নতুন করে রোশান বাজালো।সাইমন ভেবেছিলো রোশান ফাইট করতে পারে না।অথচ সাইমন তো জানে না রোশান ছোটবেলা থেকে এসবে দক্ষ।আমি চেয়ারে বসে বসে ওদের ফাইট দেখছি।এখন পপকর্ণ হলে খারাপ হতো না।বসে থাকতে থাকতে আমার কোমড়ের হাড্ডি বাঁকা হয়ে গেলো।হাত দুটো রশি দিয়ে বেঁধে রাখার কারণে অবশ হয়ে আসছে।কিন্তু আমাকে এখান থেকে ছুটানোর প্রয়োজন কেউ মনে করছে না।কিন্তু এর মধ্যে ঘটলো এক বিপত্তি। সাইমন সুযোগ বুঝে আবারো রিভেলবার তুলে এনাজের দিকে তাক করে বললো।

সাইমনঃ সবাই থেমে যাও।নয়তো একে শেষ করে দিবো।আমি বলছি থেমে যাও।

রোশান থেমে গিয়ে হাত দুটো ওপরের দিকে তুলে ফেললো।কিন্তু তায়াং ভাইয়া এখনো থামছে না।মোরশেদকে মেরেই যাচ্ছে। সেটা দেখে সাইমন আবারো হুংকার দিলো।

সাইমনঃ তায়াং থাম বলছি।নয়তো একে মেরে ফেলবো।

তায়াংঃ মারবি যখন মার।এত বারবার বলার কি আছে?

তায়াং ভাইয়ার এমন হেয়ালি মার্কা কথাবার্তা শুনে আমার ভয় করছে।যদি সত্যি এনাজকে মেরে ফেলে।
তাহলে এবার সত্যি সত্যি বিধবা হয়ে যাবো।আমার ছেলেটা পুরোপুরি বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে।আল্লাহ জানে নাভান কেমন আছে?আমার ছেলেটা ভালো থাকলেই চলবে।নাভান ভালো থাকলে আমি আজ এখান থেকে বেচে না ফিরলেও আমার কোন দুঃখ নেই।

সাইমন সিরিয়াস ভঙ্গিতে রিভেলবারের ট্রিগার চেপে ধরলো।আমি চোখ বন্ধ করে দরুদ পড়ছি আর আল্লাহ কে ডাকছি।গুলির শব্দ না পেয়ে পিটপিট করে তাকাতে দেখতে পেলাম সাইমন ট্রিগার চেপে গুলি করার চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছে না। সেটা দেখে এনাজ, তায়াং দুজনেই হাসছে।

তায়াংঃ সো স্যাড সাইমন বাবু।রিভেলবারে একটা বুলেটও নেই। সব বুলেট আমার পকেটে।

সাইমন পুরো আহাম্মক। রিভেলবারে একটা বুলেটও নেই আর সে এটা এতক্ষণেও টের পেলো না। আর তায়াং তখন থেকে এই রিভেলবার নিয়ে ওদের এরকম বোকা বানালো।এনাজ সাইমনের হাত থেকে রিভেলবার ফেলে এলোপাতাড়ি ওকে মারতে লাগলো।রোশানও ওদের লোকদের মারছে।এখন তায়াং ভাইয়া মোরশেদের হাতে মার খাচ্ছে। হঠাৎ সাইমন চিৎকার করে উঠলো।

সাইমনঃ ভাইয়াআআআআআআআ!!!

🦋🦋🦋

ওর চিৎকারে সবাই ওর দিকে তাকালো। আমার চোখ কপালে।সাইমনের গলা বেয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পরছে। আমি এনাজের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম ওর হাতে রক্তাক্ত ছোট একটা ধারালো ব্লেড।যেটা ও কিছু সময় আগে চুল থেকে বের করেছে।সাইমন ধপ করে নিচে পরে গেল।মোরশেদ দৌড়ে সাইমনের কাছে ছুটে এলো।সাইমনের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে পাগালোর মতো বলতে লাগলো।

মোরশেদঃ ভাই তোর কি হয়েছে? ভাই, কথা বল তুই। তোর কিছু হতে দিবো না আমি।তোর কিছু হবে না।

মোরশেদ সাহেব সাইমনের নাকের সামনে দুই আঙুল রেখে সাইমন বলে চিৎকার করে উঠলো।এনাজ ওর সামনে এক হাঁটু মুরে বসলো।

এনাজঃ তোর ভাই আর নেই রে।অনেক ভালো ছেলে ছিলো।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ওর জন্য।মন খারাপ করিস না।পৃথিবীতে কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না।কষ্ট পাস না।একটু পর তুইও ওর সাথে চলে যাবি।দুজন একসাথে দেখা করতে পারবি।তোর ভাই আগে গিয়েছে। তুই না হয় একটু পরে যা।

এনাজের এসব গা জ্বালানো কথা শুনে মোরশেদ রেগে কাঁদতে কাঁদতে চেচিয়ে বললো।

মোরশেদঃ তোকে জিন্দা ছাড়বো না আমি।

এনাজঃ আমি ওকে বেশি কিছু করিনি তো।যাস্ট একটা গলা বরাবরি ব্লেডটা দিয়ে পোঁচ দিয়েছি।সাথে সাথে পরপারে।তোর সানগ্লাসে চুল ঠিক করতে করতে যে চুলের মধ্যে ব্লেডটা লুকালাম তাও দেখতে পাসনি? এতো কাঁচা খেলোয়াড় হয়ে খেলতে কেন নেমেছিস?আমরা দুই বন্ধু তো তোদের দুই ভাইকে কিভাবে মারবো তার প্ল্যান করেই এসেছি।

মোরশেদঃ আমি তোকে ছাড়বো না এনাজ।(চিৎকার করে)

এনাজঃ কেন রে খুব কষ্ট হচ্ছে? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে? আমারো হয়েছিল। যখন তুই আমার ছোট ভাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলি।সেদিন তায়াং না থাকলে তো মেরেই ফেলতি।তাই তো ওকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিয়েছি আমি।নিজের ফ্ল্যাটটাও বিক্রি করে দিয়েছি।যাতে ওর কোন খোঁজ না পাস।আমার ভাই আড়াই বছর ধরে আমার চোখের আড়ালে।আমার স্ত্রীর থেকেও দূরে রেখেছিস।মরতে মরতে বেঁচে গেছি আমি।জিন্দা লাশ হয়ে ছিলাম।আমার ভেতরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছিলো।

এনামকে একবার কিছু লোক মেরে গুরতর আহত করে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিলো। ভাগ্যক্রমে তায়াং ভাইয়া সেদিন ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরছিলো।দূর থেকে কিছু ছেলেকে কাউকে মারতে দেখে দৌড়ে যায়।তায়াং ভাইয়াকে দেখে ওরা পালিয়ে যায়। তায়াং ভাইয়া গিয়ে দেখে সেটা এনাম।দ্রুত ওকে হসপিটালে ভর্তি করে।সেই মাসেই এনাম অস্ট্রেলিয়া চলে যায়।এসব কথা আমি আগে জানতাম না।কয়েক দিন আগে তায়াং ভাইয়া বলেছিলো।

সাইমনের গলার কাছ দিয়ে সরু রক্তের ধারা বইছে।আমার মাথা ঘুরাচ্ছে তা দেখে।নিজের চোখের সামনে এরকম মৃত্যু দেখলাম।তাও আবার আমার স্বামীর হাতে হয়েছে।সাইমন যতই খারাপ হোক।আমি ওর মৃত্যু এভাবে চাইনি।মোরশেদ সাহেব সাইমনকে ছেড়ে এনাজের সাথে ফাইট করা শুরু করলো।আমার এসব দেখতে আর ভালো লাগছে না। তাই আমি অন্য দিকে চেয়ে রইলাম।হঠাৎ একটা গুলির শব্দে সব নিশ্চুপ হয়ে গেলো।আমি ভয় পেয়ে চট করে সেদিকে তাকালাম।মোরশেদ ওয়াসিম মুখ থুবড়ে নিচে পরে গেলো।রোশানের হাতে থাকা গানের থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।তায়াং ভাইয়া,এনাজও অবাক।মোরশেদের সাঙ্গপাঙ্গরা দৌড়ে পালাতে নিলে সবকটা কে ধরে আচ্ছা পিটুনি দিলো। রোশান গানটা মোরশেদ ওয়াসিমের সামনে ফেলে দৌড়ে আমার কাছে এসে হাতের বাঁধন খুলতে লাগলো।

রোশানঃ তুমি ঠিক আছো তো? তোমার কোথাও লাগেনি তো? আমি পুরো পাগল হয়ে গেছিলাম।

তায়াংঃ কি করলেন আপনি এটা?

রোশানঃ আপনাদের যা করার দরকার ছিলো তা আমি করে দিলাম।

এনাজঃ আপনি মারলেন কেন? ওর সাথে শত্রুতা আমাদের,আপনার নয়।

রোশানঃ ও আমার পাখিকে এখানে আটকে রেখে কষ্ট দিয়েছে। তাই মেরে ফেলছি।আপনারা কোন টেনশন করো না। আমার আইনমন্ত্রীর সাথে ভালো সম্পর্ক আছে। আমি সব সামলে নিবো।

তায়াংঃ তার কোন দরকার নেই। আমিই ইনফর্ম করে দিচ্ছি দুই পক্ষ পাল্টা গোলাগুলিতে মোরশেদ নিহত হয়েছে।

🦋🦋🦋

তায়াং ভাইয়া সামনে থেকে সরে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো।তারপর তার আন্ডারে থাকা কর্মীদের কল করে এখানে চলে আসতে বললো।মোরশেদের বাকি সাঙ্গপাঙ্গরা একেকজন আহত হয়ে এদিক সেদিক পরে আছে। রোশান আমার বাঁধন খুলে হাত ধরে দাঁড় করালো।এনাজ এসে এক ঝাটকায় রোশানের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিজে ধরে নিলো।

এনাজঃ আমাদের সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। তবে আমার বউয়ের দিকে নজর না দিলেই খুশি হই।ওকে সামলানোর জন্য আমি আছি।

রোশানঃ নোভা,ও কি তোমার এনাজ?

দুজনের মুখেই রাগ স্পষ্ট। আমি একবার এনাজের দিকে তাকাই আরেকবার রোশানের দিকে।

রোশানঃ কি হলো বলো?

আমি উপর নিচ করে মাথা ঝাঁকালাম। রোশান তীক্ষ্ম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এনাজের মুখে বিজয়ের হাসি।

রোশানঃ সত্যি এটা তোমার এনাজ?

আমিঃ হুম।

রোশানঃ তাহলে এতদিন আমায় কেন বলোনি?

আমিঃ আমি নিজেই জানতাম না আপনাকে কি বলবো?(বিরবির করে)

রোশানঃ কি বিরবির করছো? স্পষ্ট করে বলো।(রেগে+ চিৎকার করে)

এনাজঃ আস্তে কথা বলুন।আমাদের সাহায্য করেছেন বলে যে আপনি আমার বাটারফ্লাইয়ের সাথে যা খুশি তা ব্যবহার করবেন তা কিন্তু আমি টলারেট করবো না।

রোশানঃ আপনি চুপ করুন।আমি আপনার সাথে কথা বলছি না।

এনাজঃ এ পাগল হয়ে গেছে। চলো তো বাটারফ্লাই।

এনাজ আমার এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।তখুনি আমার আরেক হাতে টান পরলো।আমি পেছন তাকিয়ে দেখি রোশান অন্য দিকে ঘুরে শক্ত করে আমার হাত ধরে আছে। আমি থেমে যাওয়ায় এনাজ চেচিয়ে উঠলো।

এনাজঃ কি হলো থামলে কেন?

আমিঃ আমার হাত।( মুখ কুচোমুচো করে)

এনাজঃ রোশান ওর হাতটা ছাড়ুন।

রোশানঃ আমি ছাড়বো না। দেখি আপনি ওকে আমার কাছ থেকে কি করে নিয়ে যান?

এনাজঃ আমি ওর হাসবেন্ড। আমার পুরো অধিকার আছে ওর ওপর।

রোশানঃ গত আড়াই বছর এই অধিকারবোধটা কোথায় ছিলো আপনার, মিস্টার এনাজ?

এনাজঃ সেই কৈফিয়ত আমি আপনাকে দিবো না। ওর হাত ছেড়ে দিন।

রোশানঃ আমি ছাড়বো না।

দুজন আমার হাত ধরে তর্ক শুরু করে দিয়েছে।আমি অসহায়ের মতো কিছুখন এনাজের দিকে কিছুখন রোশানের দিকে তাকাচ্ছি। বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই,আমার এখন “ফুল নেবো নাকি অশ্রু নেবো” মুভির ঐ গানটা অনেক মনে পরছে।”বিধি তুমি বলে দাও আমি কার?” মুহূর্তে কল্পনার জগতে চলে গেলাম।আমি এই গানটা গাইছি।

আমিঃ বিধি তুমি বলে দেও আমি কার? দুটি মানুষ একটি মনের দাবিদার।

রোশানঃ আমি পৃথিবীর এই বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিবো, তুমি যদি আমারি না হও।

এনাজঃ তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করো না প্রিয়া।আমি ছাড়া তুমি কারো নও।

হঠাৎ একটা গুলির শব্দে আমার কল্পানার জগৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।আমার তো কোনদিকে হুশ ছিলো না। হুট করে তায়াং ভাইয়ার কথা মনে পরলো।তায়াং ভাইয়া তো এখানেই ছিলো।সে কোথায় গেল?গুলির শব্দে তিনজন চমকে উঠলাম।আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে আৎকে উঠলাম।এনাজ, রোশানের থেকে হাত ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে চিৎকার করে বলে উঠলাম।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া!!!!

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-২৯+৩০

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_29
#Writer_NOVA

চোখ দুটো টেনে মেলতে পারছি না।মনে হচ্ছে কেউ সুপার গ্লু আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। তার সাথে মাথা ঝিম ঝিমানি তো আছেই। কারো উচ্চস্বরের কথা এসে কানে বারি খাচ্ছে। এত জোরে কেউ কথা বলে? বাপরে!!! আমার কান ধরে যাচ্ছে। মাথাব্যাথা আজ আমার অবস্থা খারাপ করে দিবে।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও চোখ দুটো পিটপিট করে খুললাম।এক ঝাঁক তীব্র আলো এসে চোখে লাগতেই সাথে সাথে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেললাম।কিন্তু লোকটার কথা থামছে না।আমাকে তো তাকিয়ে দেখতে হবেই সে কে?বিশাল বড় একটা রামধমক না দিলে শান্তি হবে না।কারো কানের সামনে এত জোরে চেচিয়ে বকবক করা কোন ধরনের ম্যানারের মধ্যে পরে? আবারো চোখ খোলার চেষ্টা করলাম।এবার আমি সফল হলাম।বিশাল বড় রুমের মতো একটা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম।দেয়ালগুলো বেশ পুরনো,জায়গায় জায়গায় থেকে চুন খসে পরেছে।তবে চারিদিকটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।হাই পাওয়ারের দুটো লাইট জ্বালানো।আমার থেকে কিছুটা দূরে একটা চেয়ার ও ছোট টেবিল রাখা।পুরো রুমে দুটো চেয়ার ও একটা টেবিল।টেবিলের ওপর ল্যাপটপ, পাওয়ার ব্যাংক আরো হাবিজাবি জিনিসপত্র রাখা।চেয়ারে বসে উল্টো দিকে ঘুরে সিগারেট টানতে টানতে মোবাইলে খোশগল্পে মেতে আছে একজন।দৃষ্টি যদিও তার সামনের ল্যাপটপে নিবদ্ধ।আপাদমস্তক কালো পোশাকে মোড়ানো।বুকটা ধুক করে উঠলো।এরকম সাজে তো আমি তায়াং ভাইয়াকে দেখেছিলাম।তাহলে কে এটা তায়াং ভাইয়া?

আমি আসলে কোথায়?কিছু সময় লাগলো সেটা বুঝে উঠতে।যখন পূর্বের সব কথা মনে হলো তখন ধরফরিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম।কিন্তু বিধি বাম!
হাত দুটো যে শক্ত করে বাঁধা আছে চেয়ারের মধ্যে। আমি নড়েচড়ে উঠতেই চেয়ারটা কিঞ্চিত শব্দ করে উঠলো।তখুনি সেই কথা বলা ব্যাক্তিটা আমার দিকে ঘুরলো।হাতে থাকা, শেষ হওয়া সিগারেটের অংশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো।

—-জ্ঞান ফিরলো তবে ভাবীজীর??

গলার কণ্ঠস্বরটা পরিচিত মনে হলো।চট করে তার দিকে তাকাতেই ৪৪০ ভোল্টেজে শর্কড খেলাম।কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শুধু উচ্চারণ করলাম।

আমিঃ সসসসাইমমন আপনি????

সাইমনঃ ইয়েস আই এম। মিসেস এনাজ আহমেদ। ওরফে আমার ভাবীজী।

আমিঃ তার মানে এই সবকিছুর পেছনে আপনি রয়েছেন??

সাইমনঃ আমি একটা বাচ্চা ছেলে। একা এতকিছু সামলাবো কি করে বলেন তো?আমার সাথে আমার বড় ভাই ও লোকরা আছে তো।

আমিঃ আমাকে এখানে কেন তুলে এনেছেন? (কঠিন গলায়)

সাইমনঃ কারণ ছাড়া তো আনিনি।নিশ্চয়ই কারণ আছে।জানেন,আপনাকে আমাদের আরো আগে তুলে আনা উচিত ছিলো।

আমিঃ আমাকে অজ্ঞান করার লোকটা তাহলে আপনি ছিলেন?

সাইমনঃ জ্বি হ্যাঁ।

আমিঃ আপনার সাথে আমার কি শত্রুতা?আপনাকে তো আমি ভালো করে চিনিও না।

সাইমনঃ আপনার সাথে আমাদের অনেক পুরনো শত্রুতা।আপনাকে সেই কবে মেরে ফেলতাম।শুধু ভাইয়ের কথায় সেদিন বাচিয়ে দিয়েছিলাম।আমি ঐদিনের কথা বলছি।যেদিন আপনার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে আপনার চোখের সামনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো আমাদের লোকেরা।আপনাকে তুলে আমাদের ডেরায় নিয়ে এসেছিলো।আপনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন বলে কেন জানি ভাইয়ের একটু দয়া হয়েছিলো।ভাইয়ার কোন বাচ্চা ছিলো না বলে আপনার ওপর দয়া করে,
আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিলো।এমনি আপনি বাকি জীবনটা জিন্দা লাশ হয়ে কাটাবেন।তাই এই মরাকে আমরা আর মারতে চাইনি।সহিসালামত আপনার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম।কিন্তু এখন দেখছি সেটাই আমাদের বিরাট ভুল।

আমিঃ আপনারা আমার এনাজকে মেরেছিলেন?

সাইমনঃ হ্যাঁ গো ভাবিজী।

সাইমনের মুখে বারবার ভাবী ডাক শুনে আমার রাগটা যেনো আরো বেড়ে গেল।তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে তুই-তুকারি করে রুক্ষ গলায় বললাম।

আমিঃ আমি তোর কোন রিস্তায় ভাবি লাগি? তোর ঐ পাপী মুখে আমাকে ভাবী বলে ডাকবি না।আরেকবার ডাকলে ঠোঁট সেলাই করে দিবো।ফালতু লোক কোথাকার,শয়তান বেডা।(রেগে)

সাইমনঃ আমার বড় ভাইয়ের ভাবী লাগেন বলে আমারও ভাবী হোন।আমার ডেরায় বসে আমাকেই গালিগালাজ করছেন।আপনার তারিফ করতে হয়।চাইলে আপনাকে মেরে আমি এতগুলো টুকরো করতে পারি যে কেউ আপনার হদিসও পাবে না।

আমিঃ তোর এতবড় সাহস আছে নাকি?তুই কিছু করতে পারলে এতক্ষণে করে ফেলতি।

আমার না একটুও ভয় করছে না।বরং কোথা থেকে যে এত সাহস আসছে আল্লাহ মালুম। অনেক হয়েছে। এবার এদের একটা ব্যবস্থা করা দরকার।সাইমন আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পারলে এখুনি চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।

সাইমনঃ মুখে খই ফুটছে দেখি।

আমিঃ বাইক থেকে আমার শরীরে পেট্রোল ছুঁড়ে মারা মানুষগুলোর মধ্যে একটা ছেলে তুইও ছিলি তাই না?

সাইমনঃ জ্বি।আমি ও আমার লোক ছিলাম।কিন্তু মাঝখান থেকে তায়াং ফেঁসে গেলো।আসলে তায়াংকে ফাঁসাতেই তায়াং-এর মতো গেটআপ নিয়েছিলাম আমরা।যাতে আপনার সন্দেহ হয়ে যায় সেটা তায়াং ছিলো।

আমিঃ আমার ভাইকে আমি তোদের থেকে বহুগুণ ভালো করে চিনি।ও এমন কাজ জীবনেও করতে পারে না।তাই তো আমার মনে হচ্ছিলো কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার।

সাইমনঃ আপনার পেছনে যে ছেলে দুটোকে আগুন নিয়ে ছুটতে পাঠিয়ে ছিলাম সেই লোকগুলোকে তায়াং মোটেও টাকা দিচ্ছিলো না।সেটাও সাজানো পুরো প্ল্যান ছিলো।ঐ লোকগুলো তায়াং-কে থামিয়ে কতগুলো বান্ডিলের টাকা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছিলো সেগুলো জাল নোট কিনা।তায়াং সেগুলো হাতে নিয়ে মস্তবড় ভুল করে ফেললো।সে বান্ডিলটা নেড়েচেড়ে উত্তর দিলো এটা আসল।আর যখুনি লোক দুটোকে টাকার বান্ডিল দুটো ফিরিয়ে দিচ্ছিলো তখুনি তুমি সরি আপনি দেখে নিলেন।আর তায়াং-কে ভুল বুঝে ফেললেন।এত ভালো ছেলেটাকে আপনি এমন ভাবলেন কি করে?

আমিঃ এসব করে কি লাভ হলো?এখন তো আমি জেনেই গেলাম যে তায়াং নির্দোষ।

সাইমনঃ লাভ তো অবশ্যই হয়েছে। আপনাকে একটু ভয় দেখালাম।কাছের মানুষটাকে একটু অবিশ্বাস করলাম।রিয়েলাইজ করালাম কাছের মানুষটা বিশ্বাস ঘাতকতা করলে কিরকম লাগে?অনেক বেশি কষ্ট হয় তাইনা।তেমনি আমাদের সাথেও আপনার গুণধর স্বামী কাছের মানুষ হয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আমিঃ কি বলছেন আপনি? আমার স্বামী কেন বিশ্বাস ঘাতকতা করবে আপনাদের সাথে?ওর কে হোন আপনারা?

সাইমনঃ অনেক কাছের মানুষও নই, আবার অনেক দূরের মানুষও নই। তা আপনার স্বামী এনাজের কি খবর?(ভ্রু নাচিয়ে)

আমিঃ মমমমাননে!!!(ভয় পেয়ে)

সাইমনঃ আরে ভাবীজী,এতখন তো বেশ তেজ দেখালেন।এখন চুপসে গেলেন কেন? আপনার স্বামী এনাজ ওরফে তাজরান তাজওয়ারের খবর চাইলাম,আর আপনি ভয়ে চুপসে গেলেন।গত দুই দিন আগে যে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিলো সকাল সকাল। আমি তো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবই দেখলাম।

আমিঃ তুই ছিলি দরজার আড়ালে?তোকে আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল। তুই যে গভীর জলের মাছ তা আমি বহু আগে বুঝে গেছি। জেনেই যখন গেছিস তাহলে লুকিয়ে লাভ কি? এবার না হয় তৈরি থাক নিজেদের পাপের শাস্তির জন্য। আমার স্বামী আর ভাই খুব শীঘ্রই তার ব্যবস্থা করবে।

সাইমনঃ কে কার ব্যবস্থা করে তা না হয় পরেই দেখবো।কান টানলে মাথা আসে।তাই তো ওদেরকে আনতে তোমায় এখানে নিয়ে এসেছি। এখানে এলে একসাথে না হয় মেরে দিবো।এর জন্যই এত কিছু করা।সেদিন তাজ ওরফে এনাজ রেডিও স্টেশনে না আসলে আমি তো জানতামই না যে এনাজ বেঁচে আছে। তাই তো দুই দিনে সব ইনফরমেশন জোগাড় করে আপনাকে টোপ হিসেবে বেছে নিলাম।

আমিঃ আমার স্বামী ও ভাইয়ের সাথে তোদের কিসের শত্রুতা?কেন ওদের জীবন নিয়ে পরেছিস?

সাইমনঃ অনেক বড় শত্রতা।তোমার স্বামীকে শুধু শেষ করতে চেয়েছিলাম।সেদিন শেষ করেই দিতো আমাদের লোক।শুধু বৃষ্টি এসে সব চৌপট করে দিলো। তারপর মুরাদ সাহেব তাকে বাঁচিয়ে দিলো।এই তায়াং-এর সাথে কোন শত্রতা নেই আমাদের। কিন্তু ও যেচে এসে আমাদের কাজে বিঘাত ঘটালো।পুনরায় এনাজের মার্ডার কেস ওপেন করলো।আমার ভাইকে সন্দেহ করা শুরু করে দিলো।সবকিছুতে ওর নজরদারি ওকে বিপদে ফেলে দিলো।তাই দুজনকে শেষ করে দিবো।বুঝতে পারছি না। আমার ভাইটা যে এত দেরী কেন করছে?

আমিঃ আপনার ভাই কে?

সাইমনঃ আসলেই দেখতে পাবে।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া একবার শুধু আমার খবরটা জানুক।দেখবি তোদের কি করে?

সাইমনঃ কি করে তা নাহয় পরেই দেখা যাবে।শুনলাম আপনার তায়াং ভাইয়া নাকি গোয়েন্দা সংস্থার লোক।সত্যি নাকি??

🦋🦋🦋

চোখ দুটো মার্বেল বানিয়ে সাইমনের দিকে তাকালাম।এরা দেখছি সব নারি-নক্ষত্র জেনে গেছে। আমি তো কখনও কাউকে ভুলেও বলিনি যে তায়াং ভাইয়া গোয়েন্দা সংস্থার লোক।আমি,এনাজ,তায়াং ভাইয়ার বাবা-মা, বোন ছাড়া এই কথাটা কেউ জানে না। তাহলে এরা জানলো কি করে?

আমিঃ কককে বললেছছে আপনাকে?(তুতলিয়ে)

সাইমনঃ সব খবরা-খবর রাখতে হয় ভাবীজী।তায়াং, এনাজ দুজনেই একসাথে আইন বিভাগে পড়াশোনা করছে।একজন যদি সিবিআই অফিসার হয় আরেকজন তো এই আইন সংস্থায় থাকবে।এটা কি খুজতে হয় নাকি?এটা তো কমোন সেন্স।

আমিঃ আমাকে ছেড়ে দেন এখান থেকে। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে।

আমার কথা শুনে সাইমন উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তারপর আফসোসের সুরে বললো।

সাইমনঃ জানো ভাবিজী,আমার না খুব ইচ্ছে ছিলো তোমার ছেলেটাকেও তোমার সাথে তুলে আনতে।কিন্তু ভাইয়ার নিজের কোন বাচ্চা নেই বলে সে বাচ্চাদের ওপর একটু বেশি দূর্বল।তাই তুলে আনতে দিলো না। মা-ছেলে কে একসাথে দেখতে মন্দ লাগতো না।

আমিঃ খবরদার,আমার ছেলের দিকে তাকাবি না।তাহলে তোর চোখ তুলে ফেলবো।শত্রুতা থাকলে সেটা আমার সাথে ওর বাবার সাথে আছে। কিন্তু তার মধ্যে ওকে টেনে আনবি না বলে দিলাম।

সাইমনঃ বড় ভাইয়াও তাই বলে।কিন্তু আমার তো আপনাদের পুরো ফ্যামেলীটাকেই ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হয়।ঠিক যেভাবে আপনার স্বামীর কারণে আমার পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে।

আমিঃ কিন্তু কিভাবে? আমার জানা মতে এনাজ কারো ক্ষতি কখনো করতেই পারে না।

সাইমনের চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। উল্টো দিকে ঘুরে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিলো। আমার কথা শুনে দ্রুত এসে আমার মুখ চেপে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

সাইমনঃ ন্যাকা সাজা হচ্ছে। কিছুই জানো না। আমার মেজু ভাইয়াকে তোমার স্বামী ইনকাউন্টার করে মেরে ফেলেছে। না হয় তাদের থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলো।তাই বলে এভাবে মেরে ফেলবে।আমার বড় ভাই তোমার এনাজের পায়ে অব্দি ধরেছিলো।যাতে আমার ভাই তুষারকে জানে না মারে।বড় ভাইয়ার বিশ্বাস ছিলো এনাজ, তুষার ভাইয়াকে আর যাই করুক জানে মারবে না।তাই সে নিশ্চিন্ত ছিলো।কিন্তু সেই রাতেই তুষার ভাইয়া পালানোর চেষ্টা করায় বড় ভাইয়ার চোখের সামনে ওকে সোজা ইনকাউন্টার করে দিলো।আমাদের বিশ্বাসটাকে ভেঙে চুরমার করে দিলো।তাই মাস দুই পরেই লোক দিয়ে তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে তোমার চোখের সামনে শেষ করে দিয়েছি।যাতে সেই কষ্টটা তুমিও অনুভব করতে পারো।নিজের চোখের সামনে নিজের প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা কিরকম হয়।কিন্তু সেবার ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও এবার বাঁচবে না।তোমার চোখের সামনে তোমার প্রাণপ্রিশ ভাই ও স্বামী শেষ। তা এবার সহ্য করতে পারবে তো??

সাইমন আমাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে। কিন্তু আমার মনে হয় না এনাজ কোন কারণ ছাড়া ওদের ভাইকে মেরেছে। ক্রিমিনাল না হলে তো মারবেই না। আমি আমার স্বামী কি খুব ভালো করেই চিনি।

আমিঃ আপনার তুষার ভাইয়া নিশ্চয়ই কোন বড় ক্রিমিনাল ছিলো।তাই মেরেছে।

সাইমনঃ কি এমন অপরাধ করেছিলো আমার ভাই? দুটো মেয়েকে রেপই তো করেছিলো।কোন মানুষকে তো খুন করেনি। এর থেকে বড় অপরাধ কেউ কি করে না?দুটো মেয়েকে রেপ করার কারণে মেরে ফেলতে হবে। অন্য সাজাও তো দেয়া যেতো।তাছাড়া আমরা ওর জামিনের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম।কিন্তু এনাজ সব বরবাদ করে দিলো।ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলো।মা ট্রমার মধ্যে চলে গেল।বছর না ঘুরতেই মা-ও আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেল। আমরা তিন ভাই ছিলাম।মেজু ভাইয়ার মৃত্যুতে আমরা দুই ভাইও জিন্দা লাশ হয়ে গেলাম। আমাদের পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেলো।তাই আমরা দুই ভাই শপথ করেছি এনাজকে জানে বাঁচতে দিবো না।

রেপ কেসের কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো।তার ভাই দুটো মেয়ের ইজ্জত শেষ করে দিয়েছে তারপরেও তাদের কাছে ফেরেস্তা হয়ে আছে। আমি জোরে চেচিয়ে বললাম।

আমিঃ তাহলে আমার স্বামী একদম ঠিক করেছে।ঐরকম নরকীটের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। একে বাচিয়ে রাখলে তো ঠিক টাকা দিয়ে বের করে নিতিস।না জানি আরো কত মেয়ের ইজ্জত শেষ করে দিতো ঐ মানুষরূপী জানোয়ারটা।ওকে মেরে অনেক ভালো করেছে।এতদিনে আমার মনে হচ্ছে আমার স্বামী কাজের কাজ করেছে। যে ধর্ষণ করবে সে বুক ফুলিয়ে স্বাধীনভাবল জীবন-যাপন করবে।আর যে ধর্ষিত হবে সে গলায় দড়ি দিবে।এটা তো হতে পারে না। তবে এখন সেটাই হচ্ছে। শুধুমাত্র টাকার জোরে পার পেয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ধর্ষক। আর আত্মহত্যা করতে হচ্ছে ধর্ষিতাদের।সব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীদের এনাজের মতো হওয়া উচিত। ধর্ষণের শাস্তি একমাত্র মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।

সাইমন এগিয়ে এসে আমার গালে জোরে দুটো থাপ্পড় দিলো ।২য় থাপ্পড়ের সময় চেয়ারের কোণার ওপর পরে গেলাম।যার কারণে ঠোঁটের কোণা কেটে গেলো।সাইমন এখন রেগে বোম হয়ে আছে।ওকে অন্য সময় দেখলে আমি নিশ্চয়ই ভয় পেতাম। কিন্তু এখন ভয়ের বিন্দুও খুঁজে পাচ্ছি না। আমার গলা চেপে ধরে বললো।

সাইমনঃ খুব বেশি বড় গলা হয়ে গেছে। এখন ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করছিস।তোকে আমি এখনি শেষ করে দিবো।আমার ভাইকে মেরে তোর স্বামী যখন ভালো কাজ করছে। তাহলে আমিও তোকে মেরে ভালো কাজ করে ফেলি।

আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো।উচিত কথা বললে তো তোদের রাগ উঠবেই। কিন্তু গলা চেপে ধরে রাখায় তা বলতে পারলাম না।এমনভাবে গলা চেপে ধরেছে যে আমার চোখ উল্টে আসছে।চোখ, মুখে অন্ধকার দেখছি।তখুনি একজনের গলার স্বর পেলাম।সাইমনকে শাসিয়ে বলছে।

—-সাইমন করছিসটা কি?ছেড়ে দে ওকে।মরে যাবে তো।

সাইমনঃ বড় ভাইয়া,ওকে আজ আমি মেরেই ফেলবো।কত বড় সাহস ওর।ও বলে আমার ভাইকে মেরে নাকি এনাজ ভালো কাজ করছে।

—-ওকে ছাড় বলছি।ও মারা গেলে তায়াং,
এনাজকে এখানে আনতে পারবো না।

আগুন্তক আমার গলার থেকে সাইমনের হাত দুটোকে টেনে সরিয়ে দিলো।সাইমন ফোঁস ফোঁস করছে।আবারও আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে আগুন্তক ওকে আটকে ফেললেন।আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।আমি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি।

—-সাইমন, রিলেক্স।অনেক কষ্ট করে এত প্ল্যান করেছি।সামান্য ভুলে সব নষ্ট করে দিস না।এই নোভার ওপর নজর রাখতেই তো তোকে রেডিও স্টেশনে কাজ করতে পাঠিয়ে ছিলাম।তা কি তুই ভুলে গেছিস?

সাইমনঃ একটুও ভুলিনি বড় ভাইয়া।কিন্তু ওকে আমার জ্যন্ত সমাহিত করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

—- মাথা ঠান্ডা কর।রোশানকে কল লাগা।এই এমপি সাহেবকে, আমি তোর থেকে নোভার খোঁজ খবর নিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে সব খবর দিতাম।ভেবেছিলাম একে দিয়ে তায়াংকে শেষ করবো।
দুইবার কল করে ভয় দেখিয়ে ছিলাম।কিন্তু সে আমার কথা শুনলোই না।তার ক্ষতি যে না করে তাকে মারে না। তাই তো বাধ্য হয়ে এতসব করতে হলো।এখন এই মেয়েকে মেরে ফেললে রোশানকেও হেনেস্তা করা যাবে না। তাই শান্ত হো।

আগুন্তকের কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় জানি শুনেছি। গলায় প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছি বলে এতক্ষণ সামনের দিকে তাকাইনি।চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলাম।যেহেতু সাইমন একে বড় ভাইয়া বলছে তার মানে আগন্তুকটা সবকিছুর মূলে। তাই তাকে তো আমার দেখতেই হবে।চোখ খুলে আমি যাকে দেখলাম, তাতে আমি জীবনেও ভাবতে পারি নি যে সবকিছুর পেছনে সে থাকতে পারে । স্পষ্ট সুরে আমার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বের হয়ে গেলো।

আমিঃ আআআআপপপপনি!!!!

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_30
#Writer_NOVA

——আআআআপপপপনি!!!!

সামনে থাকা মানুষটা দেখে আমি আৎকে উঠলাম। আমি তো কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি পুরো কাহিনীর পেছনে সে থাকতে পারে। তাকে তো ভালোর খেতাবি দিয়ে বসে ছিলাম।আমার চোখ, মুখে বিস্ময় দেখে সে কিছুটা এগিয়ে এসে বললো।

—– মনে হচ্ছে ভাবী আমাকে দেখে অনেক বেশি অবাক হয়েছেন।হওয়ারি কথা।আমরা সবসময় যা দেখি আর যা ভাবি তা কিন্তু ঠিক হয় না।

আমিঃ মোরশেদ ওয়াসিম ভাই!!!! আপনি ছিলেন সবকিছুর মূলে?

মোরশেদঃ জ্বি ভাবী।

আমিঃ অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন।এর মাশুল খুব বাজেভাবে দিতে হবে আপনাদের। একটু অপেক্ষা করুন।আমার ভাই ও স্বামীকে আসতে দিন।

সাইমনঃ তোমার ভাই,স্বামী ও প্রেমিক তিনজনই আসবে।তাদের সবাইকে আলাদা করে ইনভাইট করা হয়েছে। তুমি একটু অপেক্ষা করো।তাহলে সবার মৃত্যুটা নিজের চোখেই দেখবে।

আমিঃ রোশানের সাথে কি শত্রুতা আপনাদের? ওকে এসবে টানছেন কেন?

মোরশেদঃ বেশি ভালো সাজতে চেয়েছে সে।দুইবার কল করে হুমকি-ধমকি দিয়েও আমি ঐ এমপি সাহেবকে তায়াং-কে মারার জন্য রাজী করাতে পারিনি।ও যদি তায়াং-কে মারতে রাজী হতো তাহলে কি আমাকে এতকিছু করতে হতো?তাই ব্যাটাকে জানে না মারলেও এমন ডোজ দিবো, যাতে সারাজীবনের জন্য কোমায় চলে যায়।

আমিঃ দেখা যাক কি হয়?কে হারে কে জিতে?

আমি মোরশেদ ভাইয়ের কথা শুনে বেশ কয়েকবার হাই তুলে কথাগুলো বললাম।যার মানে তাদের কোন কথা আমি গুরুত্ব দেই নি।এতে সাইমন বেশ চটে উঠলো।হুংকার ছেড়ে তার ভাইকে বললো।

সাইমনঃ বড় ভাইয়া, দেখছো কি সাহস?একটুও ভয় পাচ্ছে না।ওকে তো আমরা এখন মেরে গুম করেও ফেলতে পারি। কিন্তু তার কোন ভাবান্তর নেই। আর তুমি আসার আগে কি বলেছে জানো?এনাজ নাকি তুষার ভাইয়াকে মেরে অনেক ভালো কাজ করছে। তুমি না আসলে এতক্ষণে আমি ওকে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।

আমিঃ আমার হাত দুটো যদি খোলা থাকতো না,তাহলে সবার প্রথমে তোকে কষিয়ে দুটো চড় মারতাম।তোর ভাই দুটো মেয়ের জীবন শেষ করে দিয়েছে আর তুই বলিস কোন অপরাধ করে নি তোর ভাই ।আমার স্বামী তোর ভাইকে মেরে একদম ঠিক কাজ করেছে। ঐরকম অমানুষের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

মোরশেদঃ মুখের বুলি দেখছি ভালোই ফুটছে।অবশ্য ফুটবেই তো।স্বামী সিবিআই অফিসার মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে,গোয়েন্দা ভাই আছে। এমপি প্রেমিক আছে। তাদের পাওয়ার তো আপনার মধ্যে মজুদ আছে তাই না।

সাইমনঃ ওকে তো আমি আজ মেরেই ফেলবো।ও আবারো তুষার ভাইয়াকে নিয়ে কথা বলছে।

সাইমন তেড়ে আমার কাছে আসতে নিলেই মোরশেদ ওয়াসিম তাকে আটকে ফেললো।

মোরশেদঃ ঠান্ডা হো ভাই। মাথা গরম করে কোন কাজের সমাধান হয় না।

আমিঃ কি রে অমানুষ, থামলি কেন? আমাকে মারবি তুই? আয় পারলে মার।আমিও দেখি তোর কত সাহস আছে। তোদের মরার সময় হয়েছে তো তাই এতো উড়ছিস।একটু অপেক্ষা কর।তোদের উপরে পাঠানোর জন্য লোক আসছে তো।

রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছে। এদের ওপর প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে। মানুষ কতটা নিচ মন-মানসিকতার হতে পারে তা এদের না দেখে বুঝতেই পারতাম না।মোরশেদ ওয়াসিম রেগে আমার সামনে এসে নিজের মুখে আঙ্গুল দিয়ে বললো।

মোরশেদঃ চুপ, একদম চুপ।ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করছি বলে পার পেয়ে গেছিস।গলায় পারা দিয়ে আওয়াজ বন্ধ করে দিবো।খুব সাহস বেড়েছে তোর তাই না।আরেকটু সময় পর তোর এই গলার সাউন্ড কোথায় যায় তা আমিও দেখবো।

আমিঃ আওয়াজ নিচে।আওয়াজ নিচু করেন মোরশেদ সাহেব।কুকুরের কাজ কি জানেন? এরা শুধু ঘেউ ঘেউ করতে পারে। তারা ভাবে বড় গলায় চেচিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে পারলে সে বড় হয়ে যাবে। আপনারা দুজনও না সেই কুকুর। সারাদিন ঘেউ ঘেউ করলেও কোন লাভ হবে না। পৃথিবীতে জয় সবসময় ন্যায়েরই হয়।চিল্লাইয়া মার্কেট পাবেন না।

কথা শেষ হতে দেরী কিন্তু আমার গালে সজোরে থাপ্পড় পরতে দেরী না।সামনে তাকিয়ে দেখি থাপ্পড়টা মোরশেদ সাহেবই দিয়েছে। রক্ত চোখে দুই ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পারলে এখুনি খেয়ে ফেলে।এদের রাগাতে পেরে মনের ভেতর একটা পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছি।তাই থাপ্পড়ের ব্যাথাটা গায়ে লাগেনি।আবারো জোরে চেচিয়ে বলে উঠলাম।

আমিঃ উচিত কথা কারোই ভালো লাগে না। তাই তোদের যে এই কথাগুলো গায়ে লাগবে তা আমি ভালো করেই জানি।

মোরশেদঃ একে চুপ করতে বল সাইমন।আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ও যদি চুপ না করপ তাহলে হয়তো আমি একে উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলতে পারি।

সাইমন এগিয়ে এসে জোরে আমার মুখ চেপে ধরলো। রাগে ওর মুখ লাল হয়ে আছে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

সাইমনঃ খুব বেশি ন্যায়বাদী হয়ে গেছিস তাই না?তোর ন্যায়বাদীতা ছুটাচ্ছি আমি।আবার অজ্ঞান হয়ে পরে থাক।যতদিন এখানে থাকবি খাবার তো দূরে থাক একফোঁটা পানিও পাবি না।তখন দেখবো কথার এতো জোর আসে কোথা থেকে।

সাইমন কথাগুলো বলতে বলতেই আমার নাকে তখনকার মতো টিস্যু চেপে ধরলো। আমি কিছুক্ষণ ওর হাত থেকে ছোটার জন্য ছটফট করতে করতে শক্তিহীন হয়ে গেলাম।ধীরে ধীরে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো।

🦋🦋🦋

মোরশেদ ওয়াসিম তখন ট্রান্সফার হয়ে নতুন করে এনাজের টিমে জয়েন করেছে।এনাজ ছিলো তার সিনিয়র অফিসার। তুষারের কেসটা প্রথমে পুলিশের কাছে ছিলো।মোরশেদ সাহেব বহু ছলচাতুরী করে সেটা নিজেদের আন্ডারে নিয়ে আসেন।সে ভেবেছিলো এসব ছোটখাটো ব্যাপারে এনাজ মাথা ঘামাবে না।বরং তার হাতে তুষারের ফাইল তুলে দিবে।যাতে করে সে অনায়াসে তুষারকে বাইরে বের করে ফেলতে পারবে।আর সব দোষ ঐ মেয়ে দুটোর দিয়ে দিবে।ঐ মেয়ে দুটো উশৃংখল ড্রেস পরে বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলাচল করতো।যার কারণে তাদের বয়ফ্রেন্ডের হাতে ধর্ষণ হয়েছে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে শুধু শুধু তার ভাইকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মোরশেদ সাহেব এনাজকে চিনতে ভুল করে ফেলছে। এনাজের কাছে কেস ছোট হোক কিংবা বড় সেটা দেখার বিষয় নয়। সে প্রত্যেকটা কেস কে সমান গুরুত্ব দেয়।তাই তুষারের কেসটাকে সে নিজের হাতে তুলে নেয়।

এতে মোরশেদ সাহেব কিছুটা দিশেহারা হয়ে যায়।এনাজের সাথের সহকর্মীদের থেকে জানতে পারে এনাজ সব কেস নিয়ে বেশ কড়াকড়ি। অপরাধী যেই হোক তাকে তার শাস্তি অবশ্যই দেয়।এসব শুনে মোরশেদ সাহেব চোখে মুখে অন্ধকার দেখা শুরু করে। তাই সে ভাবে এনাজের হাত-পায়ে ধরে টাকার লোভ দেখালে হয়তো সে রাজী হয়ে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।এনাজকে আলাদা ডেকে পায়ে ধরে টাকা দেখিয়ে নিজের দলে নিতে চায়।কিন্তু এনাজের মাথায় চলছিলো অন্য কিছু। সে এই সুযোগের স্বদ্যবহার করে মোরশেদ সাহেবের মুখ থেকে সত্যি ঘটনা স্বীকার করিয়ে নেয়।মোরশেদ সাহেব ভাবেন যদি সে এনাজকে সবকিছু খুলে বলে তাহলে হয়তো এনাজ ওকে হেল্প করবে।তাই সে জানিয়ে দেয় সব দোষ তার ভাইয়ের। সব শুনে এনাজ চুপ করে ছিলো।এতে মোরশেদ সাহেব ভেবে নেয় এনাজ তার কথায় গলে গেছে। এনাজ কিন্তু তখন অন্য ফন্দি আঁটছিলো।তাই সে মোরশেদ সাহেবকে বিশ্বাস করাতে টাকাগুলো নিয়েছিলো।যাতে মোরশেদ সাহেব বিশ্বাস করে নেয় এনাজ তুষারকে কিছু করবে না। এর মধ্যে মোরশেদ সাহেব তুষারের জামিনের ব্যবস্থা করার তোড়জোড় শুরু করে দেয়।

এনাজের কাছে সবসময় মনে হতো ধর্ষণের শাস্তি একমাত্র মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু নয়।তাই সে তুষারকে মেরে ফেলার প্ল্যান করে। কারণ একে ছেড়ে দিলো ভবিষ্যতে আরো অনেক মেয়ে তার সম্ভ্রম হারাবে।যার জন্য এনাজ নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না। তাই দিন দুই পর রাত ১০ টার দিকে তুষারকে ছেড়ে দিয়ে বলে পালিয়ে যেতে। আর সে মোরশেদের লোক।তুষার রিমান্ডে থেকে যেই পরিমাণ মার খেয়েছে তাতে সে ভয়ে পুরো আধপাগল হয়ে গিয়েছিল। পালানোর কথা শুনে কোনকিছু না ভেবে ছুট লাগায়।এনাজ তো এটাই চেয়েছিলো।এই একটা ক্ষেত্রে খুব সুন্দর করে একটা মিথ্যে বলা যায়। আসামি পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিয়ে নিহত।তারপর এনাজ নিজেই আবার মোরশেদ সাহেবকে খবর দেয় তুষার পালিয়েছে।তাকে এখন সেভ কোন জায়গায় নিতে হবে। তাই মোরশেদ ও এনাজ দুজন তুষারের পেছনে ছুটে।একসময় ওকে ধরেও ফেলে।আর কয়েক কদম এগিয়ে গেলে মোরশেদ সাহেব তুষারকে ধরে ফেলবে।কিন্তু তখুনি একঝাঁক বুলেট এসে তুষারের গা ঝাঝরা করে দেয়।ঘটনার আকস্মিকতায় মোরশেদ ওয়াসিম হতভম্ব হয়ে যায়।নিজের চোখের সামনে নিজের প্রাণপ্রিয় ভাইকে মারা যেতে দেখে। এনাজ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তুষারের মৃত্যুটা নিয়ে ততটা জল ঘোলা হয় না।এনাজ সব শান্তপর্ণে সামলে নেয়।মোরশেদ নানা কিছু করেও প্রমাণ করতে পারে না যে তার ভাইকে এনাজ মেরে ফেলছে।কারণ এনাজ সব এভিডেন্স নষ্ট করে ফেলে।

কয়েক দিন এটা নিয়ে তোলপাড় হলেও পরবর্তীতে শান্ত হয়ে যায়।তবে মোরশেদ সাহেব এনজকে শেষ করে দেওয়ার শপথ নেন।এনাজ তার দেওয়া টাকাগুলো ফেরত পাঠিয়ে জানায়।কেন সে টাকাগুলো গ্রহণ করেছিলো।শুধুমাত্র ওর মুখের থেকে সবকিছু জানতে ও এনাজকে বিশ্বাস করার জন্য যে এনাজ টাকাগুলো নিয়েছিলো তা শুনে রাগে ফেটে পরে।তবে সে পুরোপুরি চুপ হয়ে যায়।চুপ থেকে এনাজকে মেরে ফেলার ফন্দি আঁটে। সুযোগ খুঁজতে থাকে এনাজকে মারার জন্য। একদিন পেয়েও যায়।সেদিন নোভা ও এনাজ হাঁটতে বের হয়েছিল। ভাড়া করা লোক দিয়ে এনাজকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে।যদিও সেদিন ভাগ্যক্রমে এনাজ বেঁচে যায়।

মোরশেদ ওয়াসিমের নিজের কোন সন্তান নেই। তার স্ত্রী কখনো মা হতে পারবে না জেনেও সে তাকে এখনো ছাড়েনি।ভীষণ ভালোবাসে তার স্ত্রীকে।সব মানুষের ভালো-মন্দ দুটো দিক আছে। তেমনি মোরশেদের ভালো দিক এটা বলা যায়। রেস্টুরেন্টে সেদিন(পর্ব-০৩) নাভানকে দেখে তার পিতৃসুলভ মন জেগে ওঠে। তাই সে নাভানকে আদর করে নানাকিছু কিনে দেয়।অনেকটা গরু মেরে জুতা দান প্রবাদের মতো কাজটা করেন তিনি।তার এই ভালো মানুষী মন দেখে নোভা তাকে ভালোর দলে ফেলে দেয়। কিন্তু নোভা জানতো না এই লোকটাই তাকে সাদা রঙে রাঙিয়ে ছিলো।তার স্বামীকে তার কাছ থেকে তার বাচ্চার কাছ থেকে আড়াই বছর দূরে রেখেছে। এতকিছুর মধ্যে সাইমন তার বড় ভাইকে পুরোদমে সাহায্য করেছে।

তায়াং যখন পুনরায় এনাজের কেস ওপেন করেছিলো তখন বারবার সন্দেহটা মোরশেদ সাহেবের দিকে যাচ্ছিলো।এতে মোরশেদ সাহেব খুব ঘাবড়ে যায়।তাই রোশনকে বলে তায়াং-কে মেরে ফেলতে।সাথে তায়াং-এর ওপর নজর রাখার মানুষ রেখে দেয়।কিন্তু রোশান তায়াংকে মারতে রাজী হয় না।ততদিনে তায়াং বের করে ফেলে মোরশেদ সাহেবকে।ঠিকানাবিহীন বাড়িতে যেদিন যায় সেদিন একটা কল পেয়ে তায়াং তাড়াহুড়ো করে চলে আসে।বলে আর্জেন্ট একটা কাজ আছে। সেই আর্জেন্ট কাজটা ছিলো মোরশেদ সাহেব যে সবকিছুর পেছনে তার প্রমাণ জোগাড় করা।যেই ভাড়া করা লোকদের দিয়ে এনাজকে মেরেছিলো তাদের মধ্যে থাকা একজনকে তায়াং-এর আন্ডারে থাকা লোকজন খুঁজে পেয়ে যায়। তাকে আটকে রেখে তায়াংকে কল দেয়।আর তায়াং সেদিন কল পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে আসে।পৃথিবীর সবার কাছে যেহেতু এনাজ মৃত সেহেতু ওর খুনীকে হাতেনাতে ধরে সকল প্রমাণের ভিত্তিতে ওদের বড় সাজা হবে।সেটা মোরশেদ সাহেব ও সাইমন যখন সব জেনে যায় তখন নোভাকে গুটির চাল বানাতে তুলে আনে।জয় কার হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

🦋🦋🦋

সাইমন ও মোরশেদ সাহেব খুব মনোযোগ সহকারে সামনের সি সি টিভি ফুটেজে তাকিয়ে আছে। তাদের ধারণা এখনই রোশান,তায়াং,এনাজের মধ্যে কেউ একজন চলে আসবে।কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজের সামনে বসে থাকতে থাকতে তাদের কোমড় ধরে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু কারো দেখা নেই।

মোরশেদঃ তুই সবাইকে কল করে জানিয়ে দিয়েছিস তো? ওরা খবর পেলে তো এতক্ষণ চলে আসার কথা। তাহলে আসছে না কেন?

সাইমনঃ আমিও বুঝতে পারছি না। ওদের আসতে দেরী আছে। ততক্ষণে অন্য কাজ করি।সিসিটিভি ফুটেজের সামনে এভাবে ভ্যাবলাকান্তের মতো বসে থাকার কোন মানে হয় না।

সাইমনের মুখে স্পষ্ট বিরক্তি দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখে মোরশেদ সাহেব একটা মুচকি হাসি দিলেন।তবে সেই হাসিটা তার মুখে দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় সাইমনের দৃষ্টিগোচর হলো না। স্বাভাবিক কণ্ঠে মোরশেদ উত্তর দিলো।

মোরশেদঃ এরা প্রচুর চালাক।এদের বোকা ভেবে নিজে বোকা হস না।ওদের কে কাবু করতে হলে সাবধান থাকতে হবে। নয়তো আমাদের ফাঁসিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নোভাকে নিয়ে চলে যাবে।প্রত্যেকজন যদি ধূর্ত না হতো তাহলে এমপি, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা অফিসারের পদে কাজ করতে পারতো না।

সাইমনঃ তা ভুল বলো নি।এনাজের বউয়েরই জানের ভয় নেই। সাহস দেখে আমি অবাক।

মোরশেদঃ সত্যি কথা বলতে আমিও বিষয়টাই ভীষণ অবাক হয়েছি।আড়াই বছর আগে এনাজের মুখে নোভার যে বিবরণ শুনেছিলাম তার সাথে আজকের নোভার আকাশ-পাতাল পার্থক্য।অবশ্য ওকে দেখে আমার একটা কথা মনে হচ্ছিলো যে,শামুক যেমন প্রতিকূল আবহাওয়ায় নষ্ট না হয়ে যায়, তার জন্য তাকে শক্ত খোলস দেওয়া হয়েছে। তেমনি কিছু কিছু মেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নরম থেকে শক্ত হয়ে যায়।

সাইমনঃ হয়েছে ওর গুণগান গাইতে হবে না তোমাকে।একে আমি একটুও সহ্য করতে পারি না।রেডিও স্টেশনে সময়ে অসময়ে শুধু আমাকে অপমান করতো।ওর ওপর প্রচুর ক্ষোভ আছে আমার।ওর কোন ক্ষতি ছাড়া আমি এত সহজে ছাড়ছি না।

মোরশেদ ওয়াসিম খুব মনোযোগ সহকারে ভাইয়ের কথা শুনছিলো।সাইমন খুব একগুঁয়ে ও জিদ্দি টাইপের ছেলে।খুব সহজে রেগে যাওয়া এর জন্মগত অভ্যাস।কিন্তু গত ছয় মাস ধরে যে ও নোভার এত অপমান সহ্য করে রেডিও স্টেশনে কাজ কিভাবে করেছে সেটা আল্লাহ মালুম। কারণে অকারণে নোভা সাইমনকে শুধু অপমানই করতো না।সাথে সবার সামনে হেনেস্তাও আছে। তারপরেও গুপ্তচর হওয়ায় বেহায়ার মতো ওর সাথে লেগে থাকতো সাইমন।সেই পুরনো অপমানগুলো আজ মনে পরে গেছে। তাই মনের মতো করে দুটো চড় মেরেছিলো।আরেকটু হলে রাগের বশে নোভার গলা টিপে মেরেই ফেলতো।কিন্তু মোরশেদের কারণে তা সম্ভব হলো না।

সাইমনঃ ভাইয়া দেখো একটা ব্লাক কার এসেছে।

উৎফুল্ল মনে সাইমন চেচিয়ে উঠলো। মোরশেদ এতক্ষণ মন দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো।যার কারণে তার দৃষ্টি ছিলো শূন্যে।সাইমনের কথা শুনে চটজলদি সেদিকে তাকিয়ে বললো।

মোরশেদঃ এটা তো ওদের গাড়িই।দ্রুত আমাদের লোকদের তৈরি থাকতে বল।সবাই যাতে অস্ত্র নিয়ে ওদের ঘেরা দিয়ে ফেলে।

সাইমন দ্রুত গতিতে পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার লোকদের কল করতে শুরু করলো। মোরশেদ ওয়াসিম কিছুটা গভীরভাবে গাড়িটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।অনেক সময় হয়ে যাওয়ার পরেও গাড়ি থেকে কেউ বের হচ্ছে না। তাই সাইমন ও মোরশেদ দৌড়ে বাইরে বের হয়ে গেলো।বাইরে যাওয়ার পরই তারা দেখলো একজন আড়াল থেকে বের হয়ে ওদের সামনে এক হাতে রিভেলবার তাক করে দাঁড়ালো।

—-হাত উপরে উঠা।নয়তো গুলি করে উপরে পাঠিয়ে দিবো।কি বললাম শুনতে পাসনি?হাত জলদী উঠা।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-২৭+২৮

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_27
#Writer_NOVA

সময় এখন ৯ টা বেজে ৫০ মিনিট। যতদ্রুত সম্ভব অফিসে যেতে হবে।আদর কল করে জলদী যেতে বললো।সকালে যা কাজ করেছি তাতে আজ অফিসে যেতেই ইচ্ছে করছিলো না।কিন্তু চাকরী বাঁচাতে হলে এখন অফিসে যেতে হবে।তায়াং ভাইয়ার সাথে দুদিন ধরে কোন কথা হয়নি।সেই যে দুই নাম্বার শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরলাম।তারপর থেকে তায়াং ভাইয়া খুব ব্যস্ত থাকে।কি আর্জেন্ট কাজ ছিলো তাও বলেনি।ওর জন্য ঐ ঠিকানাবিহীন বাড়িতে সবার সাথে সময় কাটাতে পারলাম না।ওর ওপর হেব্বি রেগে আছি আমি।এখন তো আরো বেশি রাগ লাগছে।কোন রিকশা দেখছি না।গাড়ির হর্ণের শব্দে ধ্যান ভাঙলো।একটানা কেউ হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। রাগটা এবার সাত আসমানে উঠলো।পেছনে ঘুরে দেখি একটা কুচকুচে কালো প্রাইভেট কার।রাগটাকে হজম করে হাঁটতে লাগলাম। আবারো হর্ণ বাজাচ্ছে। এবার রাগটা হজম করতে পারলাম না।পেছনে ঘুরে দ্রুত গাড়ির সামনে গিয়ে জানলার কাচে টোকা দিলাম।

আমিঃ সমস্যা কি আপনাদের? রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কি নীরবে যেতে পারেন না।সবাইকে কি বাদ্য বাজিয়ে শুনাতে হয় যে আপনি এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন।এত হর্ণ বাজাচ্ছেন কেন?

গাড়ির কাচ খুলে গাড়ির মালিক আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কখন থেকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি একটানা তাকে বকেই যাচ্ছি। আর সে এক হাত গালে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দিকে নজর যেতেই আমি থমকে গেলাম।এতো দেখছি রোশান দেওয়ান। এই বেটা এখানে কি করে?

রোশানঃ আমার পাখি মনে হচ্ছে অনেক রেগে গেছে। কুল ডাউন বেবী।এত রাগ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।তবে তোমাকে রাগলে অনেক বেশি কিউট লাগে।একদম গুলুমুলু বাচ্চাদের মতো।

কেমনডা লাগে কন তো আপনারা?এমনি আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে এসব গা জ্বালানো পিরিতির আলাপ শুনলে কে বা ঠিক থাকে।রাস্তার মধ্যে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না।

আমিঃ হাতটা কি খুব বেশি নিসপিস করে? এতই যখন হাতটা পিড়পিড় করে তাহলে সেই হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেই তো পারেন।হর্ণ বাজিয়ে শব্দ দূষণ করার কি দরকার?কানটা পচিয়ে ফেললেন।

রোশানঃ কখন থেকে তোমাকে ডাকছি।কিন্তু তোমার কোন হুশ নেই। হাত নাড়িয়ে কি জানি বিরবির করছো।তাইতো বাধ্য হয়ে আমাকে এই ব্যবস্থা নিতে হলো।তা যাচ্ছো কোথায়?

আমিঃ মরতে, যাবেন।

রোশানঃ চুপ।(ধমক দিয়ে)

রোশান এতো জোরে ধমক দিয়েছে যে আশেপাশের যতলোক ছিলো সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোশান মরার কথা শুনে যে এতটা রেগে যাবে তা আমি বুঝতে পারিনি।ওর মুখটা রক্তিম হচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে মানে মানে কেটে পরতে চাইলাম।চলে যাওয়ার জন্য সামনে ঘুরলেই রোশান ডাকলো।আমি জিহ্বায় কামড় দিয়ে পিটপিট করে ওর দিকে তাকালাম।

রোশানঃ এসব কি ধরনের কথাবার্তা? এরপর থেকে উল্টো পাল্টা কথা বললে ভুলে যাবো তুমি আমার কি হও? যত্তসব ফালতু কথা।

রোশানের কথা শুনে আমি বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম।

আমিঃ আমি আবার আপনার কি হই?

রোশানঃ হবু বউ।

আমিঃ আশায় থাকে কাউয়া, পাকলে খাইবো ডেওয়া।এরে দেখলেই আমার এই প্রবাদ বাক্য মনে পরে যায়।আমার স্বামী বেঁচে না থাকলেই তোমাকে চান্দু বিয়ে করতাম না।আর এখন তো সে বেঁচেই আছে। আহারে, রসুন মহাশয়।আপনার জন্য অনেক খারাপ লাগছে। যেদিন জানবেন আমার জামাই বেঁচে আছে সেদিন আপনার রিয়েকশনটা কেমন হবে?সেটা ভেবে এখন মাথা নষ্ট করতে চাই না।(মনে মনে)

রোশান আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজালো।আমি চমকে হুশে ফিরলাম।

রোশানঃ তুমি হুটহাট কোথায় চলে যাও বলো তো?

আমিঃ কোথাও না।আমার যেতে হবে।দেরী হয়ে গেছে। (হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) আল্লাহ, ১০ টা ০৫ বেজে গেছে।

রোশানঃ চলো আমি তোমায় পৌঁছে দিচ্ছ।

আমিঃ না না লাগবে না। আমি চলে যেতে পারবো।

রোশানঃ আমি তোমার কোন কথা শুনছি না।জলদী গাড়িতে উঠো।নয়তো আমি সবার সামনে তোমাকে কোলে তুলে নিতে বাধ্য হবো।

এই পোলা বহুত রেগে আছে আমার ওপর।এরে দিয়া বিশ্বাস নাই।যদি কোলে তুলে ফেলে।তাই আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম।

আমিঃ আপনি শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করছেন।আপনার কাজ আছে তো।

রোশানঃ বর্তমানে তোমার থেকে বেশি ইম্পর্টেন্ট কাজ আমার নেই। চুপচাপ গাড়িতে উঠো।

এমনি দেরী হয়ে গেছে। তাই কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।গাড়ির সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।

রোশানঃ তুমি কি এখন অফিসে যাবে?

আমিঃ হুম।

রোশান কোন কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।ধীর গতিতে প্রাইভেট কারটা চলতে লাগলো আমার জামাইয়ের কোম্পানির দিকে।

🦋🦋🦋

রোশান আমাকে অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আমি একপলক ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে জলদী জলদী ভেতরে ঢুকে গেলাম।নিজের ডেস্কে এসে চেয়ারে বসে বোতল খুলে পানি খেলাম।তখুনি আদরের আগমন।

আদরঃ ম্যাম,স্যার আপনাকে ডাকছে।আজকে বিদেশী ক্লায়েন্টের সাথে কিছু ডিল করা আছে। সেই প্রেজেন্টেশন আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই ফাইলগুলো নিয়ে স্যারের কাছে যেতে বলেছে।

আমিঃ এসে বসতেও পারলাম না। শুরু হয়ে গেছে আমাকে জ্বালানো। একটু শান্তিতে থাকতেও দিবে না। আমাকে না জ্বালালে তার পেটের ভাত বোধহয় হজম হয় না।এতো জ্বালা আমার ভালো লাগে না। ধূর,সবকিছু অসহ্য।এখানে বাপ জ্বালায়, বাসায় ছেলে।দুজন আমার জীবনটা তেজপাতা করে দিলো।থাকবো না আর এখানে।(বিরবির করে)

আদরঃ ম্যাম কিছু বলছেন?

আমিঃ না না কিছু না ভাইয়া।আপনি যান, আমি এখুনি সবকিছু রেডী করে আসছি।

আদরঃ ম্যাম, ডিলটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট আমাদের জন্য। তাই আপনাকে জলদী করে আসতে বলেছিলাম।আপনি আবার আমার ওপর রাগ করেন নি তো?

আমিঃ আপনার ওপর রাগ করবো কেন?আমার যত রাগ সব তো আমার বজ্জাত জামাইয়ের ওপর।

আদরকে মিটমিট করে হাসতে দেখে আমার হুশ ফিরলো।কি বলছিলাম আমি!! নিজের মাথায় নিজেই একটা চাপর মেরে ইচ্ছে মতো নিজেকে বকলাম।

আদরঃ আচ্ছা ম্যাম।আপনি আসুন,আমি যাচ্ছি। তবে বেশি দেরী করেন না।

আমিঃ মিস্টার আদর।

আদর ঘুরে চলে যাচ্ছিলো।আমার ডাক শুনে পেছনে ঘুরে বললো।

আদরঃ জ্বি ম্যাম।

আমিঃ আপনার স্যারের মেজাজ আজ কিরকম? না মানে উনি কি স্বাভাবিক আছে নাকি রেগে আছে?

আদর কিছু সময় কপাল,নাক কুঁচকে স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো।

আদরঃ উনি তো স্বাভাবিক আছে ম্যাম।কেন কোন সমস্যা হয়েছে।

আমিঃ না না তেমন কিছু নয়।আপনি এখন আসতে পারেন।

আদরঃ ওকে ম্যাম।

আদর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমার ভীষণ ভয় করছে।তখন তো বেশ মজা নিয়েছিলাম।কিন্তু এখন কি হবে? এই খবিশ ব্যাটা তো আমাকে ছাড়বে না। আল্লাহর নাম নিতে নিতে ফাইল গুছিয়ে তাজের কেবিনের দিকে ছুটলাম।কেবিনের সামনে আসতেই হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে।আল্লাহ জানে ভেতরে গেলে কি করে?আমি থাই গ্লাসে কয়েকবার হাত দিয়ে বারি দিলাম।

তাজঃ কাম ইন।

দুই বার আয়াতুল কুসরী পড়ে বুকে ফু দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।উপর দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেছি।

তাজঃ দরজাটা আটকে দিন, মিসেস আহমেদ।

দরজা আটকানোর কথা শুনে ভয়টা আরো জরালো হলো।বড়সড় একটা ঢোক গিলে অসহায় দৃষ্টিতে তাজের দিকে তাকালাম।কিন্তু সে আমার দিকে ভুলেও নজর দেয়নি।কাচের দেয়ালের সামনে মুখ করে কি জানি পড়ছে।পড়ছে নাকি জানি না। কিন্তু পৃষ্ঠা উল্টাতে দেখছি।আমার দিকে হালকা করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো।

তাজঃ আমি কিছু বলেছি।

আমিঃ জ্বি।

তাজঃ তাহলে সেটা মানছো না কেন?

ওর শান্ত ভঙ্গির কথাতে নিজের বিপদের আভাস পাচ্ছি। অনিচ্ছা থাক সত্ত্বেও দরজা আটকিয়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ালাম।

আমিঃ এখানে সব ফাইল কমপ্লিট করা আছে।

তাজঃ টেবিলের ওপর রাখো।

🦋🦋🦋

আমি ফাইলগুলো টেবিলের ওপর রাখলাম।ওড়নার কোণা গিট মারতে মারতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম।তাজের কোন শব্দ না পেয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে উঁকি মারলাম।তাজ এখনো এক হাতের ওপর বইয়ের আকৃতির কিছু একটা নিয়ে আরেক হাতের মাধ্যমে তার পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে।সম্ভবত কিছু খুঁজছে। ভালো মতো খেয়াল করে দেখতে পেলাম সেটা আমার ডায়েরি। ইহিরে!!!আমার সব গোপনীয় তথ্য জেনে গেলো রে😖।

আমিঃ আমার ডায়েরি। এটা আপনার কাছে ছিলো।আমি সারা বাসা খুঁজে হয়রান হয়ে গেছি।দিন,আমার ডায়েরি দিন।

তাজঃ কে বললো এটা তোমার?

আমিঃ আমি!!!

তাজঃ এটা তোমার ডায়েরি প্রমাণ দেখাও।

আমিঃ দেখুন আপনার সাথে ফালতু পেচাল পারার কোন সময় আমার নেই। আমার ডায়েরি দিন।

তাজঃ রোশান দেওয়ানের সাথে আবার কেন দেখলাম তোমাকে? আমি না বলেছি ওর থেকে তোমাকে দূরে থাকতে।ওকে আমার বেশি সুবিধার মনে হয় না।

আমিঃ সুবিধার তো আমার আপনাকেও মনে হয় না।

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কথাগুলো বলে সামনে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম।তাজ রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

তাজঃ ইদানীং একটু বেশি উড়ছো দেখছি।আমার কথার ত্যাড়ামী না করলে তোমার হয় না।

আমিঃ আপনার ফাইল চেক করুন।আর আমার ডায়েরি দিন।আমার কাজ আছে।আজাইরা কথা বলার জন্য আপনার অনেক টাইম থাকতে পারে। কিন্তু আমার নেই।

তাজ রেগে সামনে এগিয়ে আসতেই আমি কেঙ্গারুর মতো দুটো লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেলাম।

তাজঃ আমার একটাই আফসোস।তুমি ভালো কথায় কোন কাজ করলে না।সকালে আমার ঠোঁট দুটোর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো।এখন আবার রোশানের সাথে এসে কথার বুলি ফুটাচ্ছো।

আমিঃ আমার যার সাথে মন চায় তার সাথে আসবো আপনার কি?আপনি আমার অফিসের বস, বসের মতো থাকেন।

তাজঃ কি বললে আবার বলো? আমি যখন তোমার বস তাহলে আমার বাসায় গিয়ে আমার খোঁজ কেন নিয়েছিলে?

আমিঃ আমি যেই কোম্পানিতে কাজ করি সেকি আসলেই ভালো নাকি লুচ্চা তা জানতে গিয়েছিলাম।

তাজঃ কি????

আমিঃ আজকাল কি কানে কম শুনেন নাকি?

তাজঃ রোশানের সাথে তোমাকে আমি যেনো আরেকবারও না দেখি।তাহলে আমিও কিন্তু ভুলে যাবো তুমি আমার স্ত্রী।

আমিঃ এ্যাহ আইছে😏!!!(মনে মনে)

তাজঃ সকালে কিন্তু বেঁচে গিয়েছিলে।এখন কে বাঁচাবে? এখন তো আমি তোমার ঠোঁটে চুমু খাবোই।

তাজ এগিয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বললো।আমি ভয় পেয়ে শুকনো ঢোক গিললাম।এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলাম।তাজ শয়তানি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসছে।তাজের সাথে আমার দুরত্ব মাত্র কয়েক ইঞ্চির তফাৎ।চট করে আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল।একটানে থাবা মেরে তাজের থেকে আমার ডায়োরিটা কেড়ে নিলাম।তারপর মাথার মধ্যে ডায়েরি দিয়ে জোরে একটা বারি মেরে আবার ভো দৌড়। দরজা খুলে সোজা বাইরে।আমাকে আর পায় কে?ঘটনার আকস্মিকতায় তাজ পুরো হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।বেচারা,বুঝতে পারেনি আমি এমন কিছু করবো।আমি তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছি।কিছু সময় বোকাবন থেকে ঘুরে এসে তাজ ফিক করে হেসে উঠলো। আজ ব্যাটাকে যা ডোজ দিয়েছি।তাতেই খুশি লাগছে।এখন আমার ঐ গানটা অনেক মনে পরছে।”আহা কি আনন্দ আকাশে, বাতাসে”। সেটাই এখন আমি ডায়েরি হাতে নিয়ে গুণগুণ করে গাইতে গাইতে আমার ডেস্কে যেতে লাগলাম।

★★

সারা সকালটা তাজের কাজ করতে করতেই গেলো।বিদেশি ক্লায়েন্টের সাথে ডিলগুলো ডিসকাসড করে দুপুরের লাঞ্চ টাইমে একটু অবসর পেলো।তাই ভাবলো লাঞ্চটা আজ নোভার সাথে করবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।কিন্তু নোভার ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।কারণ কাচের ওপর পাশের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নোভা ডায়েরির ওপর দুই হাত গুজে সেখানে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে।নিশ্চয়ই ডায়েরি লিখতে বসেছিলো। কতদিন পর নোভাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলো সে।তাই কাচে হাত দিয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে গভীরভাবে নোভাকে দেখতে লাগলো তাজ।একজন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। আরেকজন তা নিষ্পলক চাহনীতে পর্যবেক্ষণ করছে।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_28
#Writer_NOVA

এক দিন পর…….

আজকের সকালটা অন্য পাঁচটা দিনের মতো নয়।সারা আকাশ মুখ গোমরা করে কালো হয়ে আছে।আমাদের ছোট বেলায় মা যখন বকতো তখন মুখটা যেরকম কালো করে রাখতাম।ঠিক তেমনি আজকের আকাশ। ঠান্ডা বাতাস বইছে।আজ যে এক পশলা বৃষ্টি আসবে তা আকাশ দেখলে বলা যায়।তবে আমি তো সিউর করে বলতে পারি না।বৃষ্টির মালিক আল্লাহ।তার ইচ্ছায় সব হয়।আল্লাহর যদি ইচ্ছে হয় তাহলেই তো রহমতের পানি বর্ষিত হবে ভুবনে।আকাশের রং এর সাথে মেয়েদের মনের তুলনা করা হয়।তুলনাটা কিন্তু অযৌক্তিক নয়।মেয়েদের মন আর আকাশের রং বদলাতে কোন সময় লাগে না। এখন আকাশ মেঘলা দেখলে কিছু সময় পর দেখবেন ঝকঝকে রোদ উঠেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের ওয়েদার উপভোগ করতে আমার বেশ লাগে।সাথে এক কাপ চা হলে তো কোন কথাই নেই। আজ অফিসের অফ ডে।সকালের শো নেই। বিকেলের শো করতে হবে শুধু। আগামীকাল এরিন ও হিমির টিউটোরিয়াল এক্সাম। তাই দুজন আজ সকাল সকাল উঠে পড়তে বসেছে।ওদেরকে জ্বালাতে আমার গুণধর পুত্র তো আছেই। আজ নাভান ঘুম থেকে জলদী উঠে গেছে। ওদের রুম থেকে পড়ার শব্দ পেলেই তাকে এই রুমে আটকে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।সেখানে ছুটে যাবে।তার খাতা, কলম নিয়ে আঁকিবুঁকি করবে।আর মিনিটে মিনিটে এরিন ও হিমিকে জ্বালাবে।আমি জোর করে আনতে চাইলেও আসবে না। কান্না করে মামলায় জিতে যাবে।ঐ রুম থেকে এরিনের চেচামেচির আওয়াজ আসছে। নিশ্চয়ই ওকে জ্বালাচ্ছে। একদম বাপের কার্বন কপি।ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে হালকা শীত করছে।চুলগুলো সেই তালে মৃদু নড়ছে।

এরিনঃ এই নোভা,নোভা রে।নাভানকে কিছু বলে যা বোইন।আমার কথা শুনছে না।

ওপর রুম থেকে এরিনের ডাক শুনে দৌড়ে ওদের কাছে গেলাম।গিয়ে দেখি এরিন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হিমি মিটমিট করে হাসছে।নাভান তার সামনের দাঁতগুলো বের করে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।

আমিঃ কি রে কি হয়েছে?

এরিনঃ তোর পোলার আজকে কি হয়েছে? সেই কখন থেকে আমার সাথে লেগে আছে।

আমিঃ নাভান, খালামণিকে কি করছো?

নাভান তার ১৪ টা ছোট ছোট ইঁদুরের দাঁত দেখিয়ে আধো আধো কণ্ঠে বললো।

নাভানঃ কাম(কামড়) দিছি😁।

আমিঃ বজ্জাত পোলা।কামড় দিয়ে আবার দাঁত বের করে হাসা হচ্ছে। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন। এক থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দিবো।

হিমিঃ ওকে বকছিস কেন?

আমিঃ না কোলে তুলে নাচবো।ও এরকম দুষ্টু হচ্ছে কেন দিনকে দিন।

হিমিঃ ও কি বুঝে?

আমিঃ একদম কথা বলবি না। তোদের আশকারায় এরকম হচ্ছে। একটুও শাসন করতে দিস না আমায়।
এরিন কি হয়েছে ছিলো রে? ও তোকে কামড় কেন দিয়েছে?

এরিনঃ ও আমার বইয়ে মাছ আঁকবে। আমি আকতে দেইনি কেন?তার জন্য হাতটা সুন্দর করে টেনে নিয়ে গেল।আমি প্রথমে ভাবছি হয়তো আমাকে পটানোর জন্য চুমু দিবে।কিন্তু তা না করে জোরে কামড় বসিয়ে দিলো।এই যে দেখ, কি করেছে। ছোট ছোট দাঁতগুলো বসে লাল হয়ে গেছে।

এরিন ওর হাতটা সামনে বাড়িয়ে দেখালো।ওর ফর্সা হাতটা লাল হয়ে গেছে। ছোট মানুষের ছোট দাঁত হলে কি হবে। দাঁতে অনেক ধার আছে। মাঝে মাঝে ওকে ভাত খাইয়ে দেওয়ার সময় আমার আঙ্গুলেও কামড় দেয়।তখন আঙ্গুলটা জ্বলে যায়।মিনিট দুই আঙ্গুল নাড়াতে পারি না।এবার বুঝুন কি কামড় দেয়!!সারা শক্তি লাগিয়ে কামড় দেয়।

আমিঃ এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে হাতে বরফ ধর।নয়তো রক্ত জমে থাকতে পারে। আমি একা ওর কামড় খাবো কেন? তোরাও খেয়ে দেখ।আমাকে যখন কামড় দেয় তখন তো খুব বলতি ছোট বাচ্চা ছেলেটার কামড় সহ্য করতে পারিস না।এখন চিৎকার চেচামেচি করে সারা বাড়ি এক করলি কেন?

হিমিঃ আহারে এরিন!!! খুব লেগেছে।

হিমি মুখ চেপে হাসতে হাসতে কথাটা বললো।তাতে এরিন কটমট করে ওর দিকে তাকালো। তারপর মুখ ঝামটা মেরে বললো।

এরিনঃ তুই একটা খেয়ে দেখ।

আমিঃ নাভান, এদিকে আসো।

নাভান মুখ কালো করে, ঠোঁট ফুলিয়ে আমার সামনে এলো।আমি ওকে বকেছি তাই মুখের এরকম রিয়েকশন।ওর মুখ দেখে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু হাসলে বিষয়টা ফান ভেবে, ও পরেরবার কামড় দিতে সাহস পেয়ে যাবে।তাই কঠিন গলায় ওকে বললাম।

আমিঃ খালামণিকে সরি বলো।

নাভানঃ 😶

আমিঃ কি হলো বলো? নয়তো তোমাকে হায়নার কাছে দিয়ে আসবো।হায়নাটা তোমাকে থাবা দিয়ে নিয়ে যাবে।তখন আমি তোমাকে একটু আনবো না। হায়নাকে বলবো নাভান পঁচা ছেলেটাকে নিয়ে যাও তোমরা।আমি অন্য একটা বেবী নিয়ে আসবো।এই বেড বয় আমার লাগবে না। সরি বলো।

নাভানঃ সুরি।(আস্তে করে)

আমিঃ জোরে বলো।আমি শুনিনি।

নাভানঃ সুরি-ই-ই-ই-ই-ই-ই(চিৎকার করে)

আমিঃ হইছে,থাম রে বাপ।কানের পর্দা কি ফাটাবি?

হিমিঃ হয়েছে আর বলতে হবে না।

আমিঃ তুমি যদি খালামণিদের সাথে এমন করো তাহলে তো খালামণিরা তোমার কাছে তাদের মেয়ে বিয়ে দিবে না।তুমি না মাঝে মাঝে ওদের শ্বাশুড়ি বলো।

এরিনঃ এমন ছেলের কাছে আমার ভবিষ্যতের মেয়ের বিয়ে দিবো না।

নাভানঃ লাগবে না।(গাল ফুলিয়ে)

আমিঃ বিয়ে হলো না আর তোরা নিজেদের মেয়ের বিয়ের স্বপ্ন দেখিস।তাও আবার আমার হিরোর মতো ছেলের সাথে। যা ভাগ।আগে নিজেরা বিয়ে কর। তোদের মেয়ে হোক।তারপর না হয় আমরা ভেবে দেখবো।কি বলো বাবা?আমি কি ভুল বলেছি?

নাভানঃ হুম।

আমিঃ ঐ পোলা,আমি ভুল বলছি?

নাভানঃ না।

আমিঃ তাহলে হুম বললি কেন?

নাভানঃ এমিনি (এমনি)।

এরিনঃ নোভা, তুই হলি একটা সুবিধাবাদী।

হিমিঃ কতখন আমাদের পক্ষে থাকিস।আবার কতখন নাভানের পক্ষে থাকিস।তোর দল পাল্টাতে এক মিনিটও লাগে না।

আমিঃ 🤣

এরিনঃ হাসিস না।

নাভানকে আরো কতখন শাসালাম। তারপর ফ্রীজ থেকে বরফ এনে এরিনের হাতে ডলে দিলাম।মাঝে মাঝে আমার ছেলের মাথায় বাপের মতো শয়তানি বুদ্ধিতে খোঁচায়। তাই সামান্য কিছুতে বিরাট কান্ড করে বসে।আবার বড় কোনকিছুতে চুপচাপ থাকে।বাপ-বেটা দুইটাই মিচকা শয়তান।আমার জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে দিলো।

🦋🦋🦋

জীবনটা না বড় অদ্ভুত।জীবনের চলার পথে যখন আপনি পাশে কাউকে চাইবেন তখন একটা কাকপক্ষীও পাবেন না।আর যখন নিজেকে গুছিয়ে একা চলতে শিখে যাবেন তখন পাশে থাকা মানুষের ভিড় পরে যাবে।আমার জীবনটাও এখন এমন মনে হচ্ছে। যখন আমার নিজের মানুষের প্রয়োজন ছিলো তখন তায়াং ভাইয়া ছাড়া কাউকে পাইনি।এখন একা চলতে শিখে গেছি।এখন মানুষের আকাল নেই।

রোডিও স্টেশন থেকে বিকেলের শো শেষ করে একটা দোকান থেকে নাভানের জন্য চিপস, জুস ও কতগুলো চকলেট কিনে নিলাম।ধীর পায়ে রাস্তার কিনারা দিয়ে হাঁটছি। শরীরে কুলচ্ছে না।সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।শরীরটা ভালো লাগছে না। সারাটা দিন ভালোই ছিলো।দুপুরের পর থেকে খারাপ লাগছে।আকাশটা আজ অন্ধকারে ঘেরা।গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে।সন্ধ্যা নামতে আধা ঘণ্টা বাকি আছে। কিন্তু সবকিছু কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে। আশেপাশে একটা রিকশার দেখাও নেই।কিছু সময় পর পর বাস,সিএনজি, প্রাইভেট কার শো শো গতিতে আমাকে ক্রশ করে চলে যাচ্ছে।ছাতাও আনিনি।আজ নির্ঘাত আমার শরীর আরো বেশি খারাপ করবে।পরনে কালো গাউন বলে রক্ষা। সাদা জামা হলে তিল পরে যেতো। হঠাৎ কয়েকটা বাইক আমাকে ক্রশ করে যাওয়ার সময়, শরীরে পলিথিনে করে তরল জাতীয় কিছু ছুড়ে মেরে দ্রুত গতিতে চলে গেল।লোকগুলো আপাদমস্তক কালো পোশাকে মুড়ানো ছিলো।মুখে হেলমেট থাকার কারণে কিছুই বোঝা যায়নি।

আমিঃ কোন শয়তান বাঁদরে রে? রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এসব করে বেড়াস? আমার ড্রেসের মধ্যে কি ছুঁড়ে মারলো।ধূর, ড্রেসটাই নষ্ট। কি ছুড়ে মারলো এগুলো।সামনে পেলে কষিয়ে গালে দুটো চড় মারতাম।ফাজিল পোলাপাইন। বাইক তো চালায় না যেনো স্প্রিড বোট চালাচ্ছে। যত্তসব ফাউল লোক।

সারা শরীরে তরল ছিটছিটে একটা পদার্থ দিয়ে মাখামাখি। আমি ওড়ানাটা নাকের সামনে আনে তার গন্ধ শুঁকেই চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললাম।এগুলো তো পেট্রোল। কিন্তু আমার শরীরে পেট্রোল মারলো কেন? মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো।এখন যদি আবার ঐ লোকগুলো আবার এসে আমার শরীরে দিয়াশলাইের কাঠি ছুঁড়ে মারে।পেছনে তাকাতে মনে হলো কেউ আড়ালে সরে গেল।

আমিঃ হচ্ছেটা কি আমার সাথে? নতুন কোন শত্রুর আমদানি হলো আমার সাথে। আমারতো ভয় করছে।কি করবো এখন? কি করি?

মাথা কাজ করছে না।এদিকে পেট্রোলের গন্ধে ভেতর থেকে সব উল্টেপাল্টে আসছে।দ্রুত ব্যাগ হাতরে মোবাইল বের করে তায়াং ভাইয়াকে কল করলাম।তায়াং ভাইয়াও কল ধরছে না।

আমিঃ তায়াং ভাইয়া প্লিজ কলটা ধর।কলটা ধর না পাঠা।তোকে যখন আমার প্রয়োজন হয় তখুনি পাই না।আমাকে বাঁচা।

ভীরু পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কোন রিকশার দেখাও নেই।
আশেপাশে মানুষজন খুব কম।একটা টং দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দুটো লোককে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিলে চমকে গেল।দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম।পিছনে তাকিয়ে আৎকে উঠলাম। কারণ লোক দুটো আমার পিছুই আসছে।ততক্ষণে তায়াং ভাইয়া আমার কল ধরেছে।

আমিঃ হ্যালো ভাইয়া কোথায় তুই?

তায়াংঃ কেন কি হয়েছে?

আমিঃ তুই যেখানে আছিস জলদী আয়।

তায়াংঃ কি হয়েছে তাতো বলবি?

আমিঃ আমি বিপদে আছি।আমাকে বাঁচা।

তায়াংঃ কই তুই? জলদী বল কই তুই? তুই ভয় পাস না। আমি আছি তোর সাথে। তোর কিছু হবে না।বল তুই কোথায়? আমি আসছি।

আমিঃ আমি রোডিও স্টেশন থেকে একটু দূরে আছি। দুটো লোক আমার পিছু নিয়েছে। একটু আগে বাইকের থেকে একটা ছেলে পাতলা পলিথিনে করে পেট্রোল ছুঁড়ে মেরেছে। ভাইয়া ঐ লোকগুলো এখন দিয়াশলাই হাতে নিয়ে আমার দিকে আসছে।একজন কিছু সময় পরপর দিয়াশলাই থেকে কাঠি বের করে আগুন ধরাচ্ছে।

তায়াংঃ তুই ভয় পাস না। আমি আসছি।

আমিঃ ভাইয়া,আমার কিছু হয়ে গেলে আমার ছেলেটাকে দেখে রাখিস।ওর কোন ক্ষতি হতে দিস না।ওকে আগলে রাখিস।ওর বাবার কাছে ওকে দিয়ে
আসিস।

তায়াংঃ কিচ্ছু হবে না তোর।আমি আছি তো।এখুনি আসছি আমি।

আমি কানে মোবাইল ধরে দ্রুত পায়ে দৌড়াচ্ছি।তায়াং ভাইয়ার কলটা কেটে মোবাইল ব্যাগে ভরে নিলাম।আমি দৌড়াচ্ছি।পেছনে তাকিয়ে দেখলাম লোকগুলো আমার পিছু দৌড়াচ্ছে। আমি দৌড়ের বেগ আরো বাড়িয়ে দিলাম।শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি পাচ্ছি না।

বৃষ্টির বেগটা আগের থেকে একটু বেড়েছে।আমার ভীষণ ভয় করছে।কিছু দূর গিয়ে এক চিপা গলি দিয়ে ঢুকে আড়ালে লুকিয়ে রইলাম।লোক দুটো সেই গলিতে ঢুকেই আশেপাশে খুঁজতে লাগলো। আমি যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে রেখেছি।আমাকে না পেয়ে লোকগুলো গলি থেকে বের হয়ে গেলো।আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছারলাম।মাথাটা কচ্ছপের মতো করে একটুখানি বের করতেই আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠলো।তায়াং ভাইয়াকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খুশিটা বেশিকক্ষণ স্থির হলো না।তারপর যেটা দেখলাম তাতে চোখ দুটো আমার কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তায়াং ভাইয়া ঐ লোকগুলোর সাথে কথা বলছে।তায়াং ভাইয়ার পরনে তখনকার সেই বাইকের লোকগুলোর মতো আপাদমস্তক কালো পোশাক। তবে হেলমেটটা খোলা বলে তাকে চিনতে আমার কোন ভুল হয়নি।তায়াং ভাইয়া তাদের দিকে একটা টাকার বান্ডিল বাড়িয়ে দিচ্ছে।আমার থেকে তাদের দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত।যার জন্য আমি স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছি। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।তায়াং ভাইয়াকে এতো বিশ্বাস করতাম সেই ভাইয়া কি এসব করছে? সবকিছুর পেছনে তায়াং ভাইয়ার হাত নেই তো?মুখ চেপে কান্না করে উঠলাম।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।এ আমি কি দেখছি?নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসহায় মনে হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি না। আমার তায়াং ভাইয়া এমন হতেই পারে না।

—- কি ভাবীজী? সবকিছু নিজের চোখে দেখে কি অবাক হচ্ছেন?

পেছন থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ পেয়ে পেছনে তাকাতে নিলেই, একটা বলিষ্ঠ হাত এসে আমার মুখে টিস্যু চেপে ধরলো।আমি দুই হাতে তার হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করলাম।কিন্তু আমি ব্যর্থ।কারণ টিস্যুতে অজ্ঞান করার ঔষধ স্প্রে করে মেশানো ছিলো।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সারা পৃথিবী আমার ঘুরতে শুরু করেছে।ততক্ষণে পেছনের লোকটা সামনে এসে দাঁড়ালো।ঝাপসা চোখ নিজের সামনে একটা পুরুষের অবয়ব ঠিকই দেখতে পেলাম ।কিন্তু কে সে?তা আমি বুঝতে পারলাম না। তার আগেই তার বুকে ঢলে পরে গেলাম।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-২৫+২৬

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_25
#Writer_NOVA

—- সেদিন ছিল ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে ভালো মতো সবকিছু দেখা যাচ্ছিলো না।সামনে সাদা হয়েছিলো।এমন অবস্থায় ড্রাইভ করাও কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো আমাদের ড্রাইভার জামালের।ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরছিলাম।যেই রাস্তা দিয়ে সচারাচর আমরা বাসায় ফিরি সেটা প্রায় হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে যায়। তাই ভাবলাম দূরের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাসায় আসবো।ড্রাইভারকে বলতেই সে অন্য রাস্তায় মোড় নিলো।চারিদিকে বৃষ্টির কারণে কিছু দেখা যাচ্ছে না।সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা।ব্যাংক থেকে ডেকেছে বলে না যেয়েও উপায় নেই।যাওয়ার সময় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পরছিলো।আসার সময় যখন গাড়িতে উঠলাম তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছিলো।হুট করে ঝুপঝাপ বৃষ্টি নেমে গেলো।এত বৃষ্টি হবে জানলে কিছু সময় ব্যাংকে থেকে যেতাম।হঠাৎ আমাদের ড্রাইভার জামাল গাড়ি থামিয়ে দিলো।

এতটুকু বলে থেমে গেলেন মুরাদ সাহেব।তার মুখের দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে নোভা ও তায়াং।ওদের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলেন।তারপর ডুব দিলেন অতীতের স্মৃতির পাতায়।যেখানে এখনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে সেই ঝুম বৃষ্টির দিনটা।

ফ্লাশব্যাক………

বাইরে তাকিয়ে একমনে মুরাদ সাহেবে কিছু একটা ভাবছিলেন।পুনরায় আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে তার।সবকিছু তিনি গুছিয়ে নিয়েছেন।ড্রাইভারের হুট করে গাড়ি থামাতে সে সামনের দিকে ঝুঁকে গেলেন।যাতে তার হুশ ফিরলো।বৃষ্টির তোড়জোড় বেড়েই যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র কমার নাম নেই। কিছুটা বিরক্ত সহকারে ড্রাইভার জামালকে সে বলে উঠলেন।

মুরাদঃ কি ব্যাপার ড্রাইভার গাড়ি থামালে কেন?

জামালঃ স্যার, মনে হইতাছে ব্রীজের ওপর কেউ পইরা আছে।

মুরাদঃ কই কেউ নেই তো।আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।বৃষ্টির কারণে কিছু কি ভুলভাল দেখছো?তোমার কথাও ভালো করে শোনা যাচ্ছে না।একটু জোড়ে বলো।

জামালঃ স্যার,আমার মনে হইতাছে ব্রীজের ওপরে কেউ উপুড় হইয়া পইরা রইছে।(জোরে চিৎকার করে)

এত বৃষ্টি যে এক গাড়িতে বসে দুজন দুজনের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না।চারিদিকে শুধু বৃষ্টি পরার শব্দ। মুরাদ সাহেব জোর চেচিয়ে বললেন।

মুরাদঃ আমার চোখে কিছু পরছে না।

জামালঃ স্যার বাইর হইয়া কি দেখবেন কেডা পইরা রইছে। আমি কিন্তু অনেকটা স্পষ্ট দেখতে পাইতাছি একটা পোলা ব্রীজের ওপর পইরা রইছে।

মুরাদঃ চলো তো নেমে দেখি।

জামালঃ কিন্তু স্যার যদি কোন ডাকাতের লোক হয়।সিনেমায় তো বহুত দেখছি এমন কইরা রাস্তায় পইরা থাকে।যহন কেউ তার সাহায্য করতে যায় তহন আরো লোক বাইর হইয়া বড় বড় ছুরি দেখাইয়া লগের সবকিছু নিয়ে যায়।

মুরাদ সাহেবের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। জামাল কথা ভুল বলেনি।এই ছেলে ১৭ বছর থেকে তাদের ড্রাইভার হয়ে আছে। এখন বয়স ৩২ এর কোঠায়।মুরাদ সাহেব একে চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারে। ছেলেটা কিছুটা বোকা কিছিমের হলেও মানুষ হিসেবে ভালো।বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। চোখের চশমাটা ভালো করে মুছে সামনের দিকে তাকালো। এবার সেও দেখতে পেলো একটা পুরুষের অবয়ব রাস্তায় পরে আছে। মুরাদ সাহেব ভাবলেন হয়তো ডেড বডি হবে।যদি ডেড বডি হয় তাহলে তো সামনে গেলেই ফেঁসে যাবেন।তাই জামালকে গাড়ি সাইড কাটিয়ে নিয়ে যেতে বললেন।জামাল গাড়ি সাইড কাটালো।যখুনি স্টার্ট দিবে তখন মুরাদ সাহেব কিছু একটা ভেবে আবার বললেন।

মুরাদঃ জামাল গাড়ি থামাও।

জামালঃ কিন্তু স্যার আপনেই তো কইলেন গাড়ি সাইড কাটতে।তার লিগা আমি সাইড কাটলাম।

মুরাদঃ যা বলছি তা কর।

জামাল এক সাইডে গাড়ি থামালো।মুরাদ সাহেব ও জামাল মাথায় একটা পলিথিন ব্যাগ বেঁধে বাইরে এলেন।তাদের কাছে এখন ছাতা নেই। জুলেখা বেগম বারবার করে বলেছিলেন ছাতা নিয়ে যেতে।কিন্তু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দেখে মুরাদ সাহেব আনেননি।বাতাসের কারণে তারা সামনেও এগুতে পারছেন না।ঠান্ডা হিম শীতল বাতাসে তাদের কেমন জানি শীত শীত লাগছে।কোনমতে ছেলেটার সামনে গেল।গলায় হাত রাখলেন।তারপর হাতের পালস চেক করলেন।

মুরাদঃ জামাল, ছেলেটা এখনো বেঁচে আছে। ওর পালস চলছে।ওকে সোজা করতে আমায় হেল্প করো। আমি একা পারবো না। বৃষ্টিতে ভিজে অনেক ভারী হয়ে গেছে। তাছাড়া তাগড়া জোয়ান ছেলে। একে একা উঠানোও সম্ভব নয়।

জামালঃ আইচ্ছা স্যার।

মুরাদঃ শরীরের পোশাক জায়গায় জায়গায় পুরে গেছে। পেট্রোলের মৃদু গন্ধ পাচ্ছি। কেউ মেরে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিলো।

জামালঃ তাই তো দেখতাছি স্যার।আমি এদিকটা ধরি আপনে ঐদিক ধইরা ঠেলা দেন।

মুরাদ সাহেব ও জামাল মিলে ছেলেটাকে উল্টালো।বৃষ্টিতে ভিজে অনেক ভারী হয়ে গেছে। মুরাদ সাহেব দেখলেন বাম গালের মাংস পুরে হা হয়ে গেছে। ঐ গালের নিচে স্টীল জাতীয় কিছু একটা লেগে ছিলো।যার কারণে অনেকখন সেটায় আগুন ছিলো।সেই কারণে গালের মাঝখানটা পুরে মাংস ঝলসে হা হয়ে গেছে। স্টীল জাতীয় জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখলেন কোল্ড ড্রিংকসের ক্যান।বাম গাল পাকা ফ্লোরের সাথে লাগানো ছিলো।গাল আর ফ্লোরের মাঝখানে ক্যানটা ছিলো।মুরাদ সাহেব এতক্ষণ পোড়া গালটা পর্যবেক্ষণ করছিলো।যার কারণে ছেলেটাকে চিনতে পারেনি।অন্য পাশটা দেখে সে চমকে উঠলো।

জামালঃ কি হয়েছে স্যার?আপনে কি এরে চিনেন?

মুরাদঃ জামাল এতো অফিসার এনাজ আহমেদ। এর এই অবস্থা কে করলো?তুমি ওকে চিনতে পারোনি?

জামালঃ কোন অফিসার?এনাজটাই বা কে?

মুরাদঃ আমার যেবার শেয়ার ব্যবসায় বিশাল লস খাইলাম সেবার আমার নামে মিথ্যা মামলা করা হইছিলো।ঐ মামলায় আমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হইতো।কিন্তু তা হয় নাই। আমার কেসটা এনাজ নিজ দায়িত্বে নিয়ে গিয়েছিল। আর আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করে।ও না থাকলে আমি এখন কারাদণ্ডের চার দেয়ালে বন্দী থাকতাম।

জামাল মাথা চুলকালে।বছর খানিক আগের কথা এগুলো।কিন্তু তার মনে পরছে না।তার আবার ভুলে যাওয়ার রোগ আছে। এই বিষয়ে মাথা ঘামালেন না মুরাদ সাহেব।এক সাইড পুরে গেলোও এনাজকে চিনতে তার কষ্ট হয়নি।কি করে ছেলেটাকে ভুলে যাবে সে।যেই যুদ্ধ করে তাকে বাঁচিয়ে ছিলো।সেগুলো কি ভোলার মতো।এনাজের ওপর অনেক কৃতজ্ঞ সে।মিথ্যা মামলা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর খুশি হয়ে এনাজকে কিছু গিফট দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু তখন এনাজ বলেছিলো আমার জন্য দোয়া করবেন।আমি একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। তাকে যেনো পাই।আমার আর কিছু লাগবে না।কিন্তু মুরাদ সাহেব নাছোড়বান্দা। তিনি এনাজকে কিছু দিবেই।তখন এনাজ মাথা চুলকে বলেছিলো, যদি নিতান্ত কিছু দিতে চান তাহলে সেটা তুলে রেখে দিন।যাতে আমি পরবর্তীতে সেটা চেয়ে নিতে পারি।কে জানতো সেই ছেলেটাকে আজ এই অবস্থায় দেখবে।হয়তো আল্লাহ তার কাছে পাঠিয়েছে সেই উপহার ফেরত দেওয়ার জন্য। এনাজকে এই অবস্থায় দেখে মুরাদ সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো।ছেলেটার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো।কখনও কাউকে কষ্ট দিয়ে কোন কাজ বা কথা বলেনি।ডিপার্টমেন্টেও খুব নামডাক এনাজের।এর মধ্যে প্রায় এক বছর এনাজের সাথে দেখা হয়নি তার।তবে মাঝে মাঝে অন্য কারো থেকে এনাজের টুকটাক খবর নিতেন তিনি।

এবার আসল ঘটনা আপনাদের খুলে বলি।নোভা সেদিন কিন্তু তায়াং কে বলেছিলো, যেদিন এনাজকে মারা সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর বাতাস ছিলো।সে হাত মেলে সেটা উপভোগ করছিলো। লোকগুলো যখন এনাজকে পেট্রোল ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো তখন সেটা দেখে নোভা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।তারপর কি হয়েছে তা সে জানে না। এনাজকে চোখের সামনে আগুনে পুড়তে দেখে সে স্থির থাকতে পারেনি।লোকগুলো যখন এনাজের নিশ্বাস পরীক্ষা করছিলো তখন ওর দম আটকে ছিলো।যার কারণে এনাজকে ওরা মৃত ধরে নিয়েছে।
এনাজের শরীরে পেট্রোল ছুঁড়ে আগুন জ্বালানোর মিনিট পাঁচ পরেই ঝুম বৃষ্টি নেমে গিয়েছিল। সেকি বৃষ্টি!!! দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা ছিলো না।বৃষ্টির কারণে শরীরর পোড়া অংশগুলো ততটা ঘা হতে পারেনি।শুধু পোশাক পুরে গিয়েছিল। তবে গালের ওপাশটায় বৃষ্টির পানি পৌঁছাতে পারেনি বলে মাংস পুরে গলে গিয়েছিল। আগুন ধরিয়েই লোকগুলো সেখান থেকে কেটে পরেছিলো। ভেবেছিলো পরে এসে পোড়াদেহ নিয়ে গিয়ে গুম করে দিবে।কিন্তু বৃষ্টি থেমেছিল এশার আজানের পর দিয়ে। ততক্ষণে তারা এনাজের কথা ভুলেই গিয়েছিল। যখন মনে হয়েছে তখন তাড়াহুড়ো করে এখানে এসেও লাশ পাইনি।এই কথা তাদের বসকে বললে তো জ্যান্ত কবর দিয়ে দিবে।তাই সেটা খুব সাবধানে তাদের বসের থেকে লুকিয়ে গেছে। আল্লাহর শান বোঝার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। আল্লাহ যাকে বাঁচাতে চান তাকে যেকোন উপায় বাঁচিয়ে দেন।তাই তো সেদিন এনাজকে বাঁচাতে ঝুম বৃষ্টি নামিয়ে ছিলেন আর মুরাদ সাহেবকে এই রাস্তা দিয়ে আসতে বাধ্য করেছিলেন।

বৃষ্টির বেগ কমে গেছে। মুরাদ সাহেব পুরো চুপচুপে ভিজে গেছেন।কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে এনাজকে দেখে যাচ্ছে। পুরনো কথা মনে পরে গিয়েছিল। জামালের ডাকে ভাবনা থেকে ফিরে এলেন।

জামালঃ স্যার চলেন এরে হাসপাতালে নিতে হইবো তো।নয়তো কোন ক্ষতি হইতে পারে।

মুরাদঃ হুম চলো।দুজন একসাথে ধরাধরি করে নিয়ে যাই।আমি ওর কিছু হতে দিবো না।

জামালঃ হো স্যার।আমি এদিকটা ধরি। আপনি ঐদিকটা ধইরা কান্ধে উঠান।

দুজন ধরাধরি করে গাড়িতে উঠালো এনাজকে।সারা শরীর ভিজে দুজন মানুষের ওজন হয়ে গেছে। মুরাদ সাহেবের গাড়ির সিট ভিজে যাচ্ছে সেদিকের পরওয়ানা করলেন না।এনাজের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলেন।তার সারা শরীর ঠান্ডায় কাঁপছে। তড়িঘড়ি করে জামালকে বললেন সামনের বড় প্রাইভেট হসপিটালে যেতে।জামালও কথা না বলে হসপিটালের রাস্তা ধরলেন।

ফ্লাশব্যাক এন্ড…………

🦋🦋🦋

মুরাদ আঙ্কেলের চোখে দিয়ে পানিতে টলমল করছে,
যেকোন সময় গড়িয়ে পরবে । আমার চোখ দিয়ে অনরবত পানি পরছে।তায়াং ভাইয়া শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থম মেরে বসে আছে। আমার মাথা থেকে পুরোপুরি এই বিষয়টা চলে গিয়েছিল যে বৃষ্টিতে কোনভাবে এনাজ বেঁচে গেছে। আল্লাহ আমার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য কত সুন্দর করে আগের থেকে সব ভেবে রেখেছিলেন।তার দরবারে লাখো কোটি কোটি শুকরিয়া।

মুরাদঃ ওর মুখের অংশটা খুব বাজেভাবে পুরে গিয়েছিল।যা দিনকে দিন পচন ধরেছিলো।তাই এনাজের মুখ প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়েছে।বাহুর থেকে মাংস নিয়ে ক্ষতস্থানটা পূরণ করতে হয়েছে। তোমাদের কোন খোঁজ আমি জানতাম না যে এনাজের কথা তোমাদের বলবো।প্লাস্টিক সার্জারি করার সময় একটা মুখের আদলের দরকার ছিল। আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছি।আমার কাছে এনাজের কোন ছবিও ছিলো না। তাই ডাক্তারকে বলেছিলাম আপনাদের ইচ্ছে মতো একটা মুখের আদল দিয়ে দিয়েন।

আমিঃ আমি আপনাদের কি বলে ধন্যবাদ দিবো তার ভাষা আমার জানা নেই। তবে আপনাদের কাছে চিরজীবন ঋণী থাকবো আমরা।

মুরাদঃ আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি।ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছি।ওর যাতে কোন ক্ষতি না হয় তার জন্য ওর নাম পাল্টে ফেলেছি।ওকে নিজের ছেলে পরিচয়ে রেখেছি।ওর ওপর কেউ যাতে সন্দেহ না করে তার জন্য পুরাতন বাড়ি বিক্রি করে এই নতুন বাড়িতে উঠেছি।আমি সুস্থ, স্বাভাবিক আছি শুধুমাত্র এনাজের জন্য। ও সেদিন আমায় না বাঁচালে আমার স্ত্রী, সন্তান পথে বসতো।আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যত পার হতো।এই বাড়ি,গাড়ি, অফিস সবকিছু হয়েছে আল্লাহর রহমতে। আমি সারাজীবন এনাজের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেও ওর ঋণ শোধ হবে না।

আমি বিস্মিত চোখে মুরাদ আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে আছি। একটা মানুষ কতটা ভালো হলে এতকিছু করতে পারে।আর আমি এই লোকটার বিষয়ে না জেনে কত আজেবাজে কথা বলেছি।সেটা মনে হতেই নিজেকে ছোট মনে হলো।তায়াং ভাইয়ার মোবাইলে একটা কল আসতেই সে অন্যদিকে চলে গেল।তখুনি জুলেখা আন্টি ও মুসকান ট্রে ভর্তি করে আরো একগাদা খাবার নিয়ে হাজির।

জুলেখাঃ এ মা, তুই দেখি কিছু মুখে দিসনি বড় বউ?না খেয়ে, খেয়ে চেহারার কি হাল করেছিস দেখছিস?আমার ছেলেটার জন্য চিন্তা করতে করতে শরীরের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছিস।এখন একটু নিজের যত্ন নে।স্বামী তো চলে এসেছে।তাহলে আর কিসের চিন্তা।শোন,আজ কিন্তু দুপুরে না খেয়ে কিছুতেই যেতে পারবি না।

মুরাদঃ হ্যাঁ,একদম ঠিক কথা।দুপুরে না খেয়ে বাসা থেকে যেতে পারবে না।

মুসকানঃ ভাবী,এতদিন পর তোমাকে পেয়েছি। এত সহজে যেতে দিবো তা ভাবলে কি করে?(কানের কাছে এসে নিচুস্বরে)তোমাকে তো রাখবোই সাথে তোমার ঐ হ্যান্ডসাম ভাইকেও রাখবো।

আমিঃ নজর দিয়ে লাভ নেই ননদি।আমার ভাই বহু আগের থেকে আমার মামাতো বোন নূরের ওপর ফিদা হয়ে আছে।এরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে। এখন শুধু বিয়ের অপেক্ষা। (নিচু স্বরে)

নিচুস্বরে ওকে কথাগুলো বলতেই মুসকান চোখ দুটোকে রসগোল্লা বানিয়ে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে দুষ্টামীর ভঙ্গিতে বললো।

মুসকানঃ দিল টুট গ্যায়া💔।কোথায় ভাবলাম তোমার এই হ্যান্ডসাম ভাইয়ের সাথে লাইন মারবো। তা আর হলো না। এই কষ্ট আমি কোথায় রাখি?

মুসকানের কথা বলার ভঙ্গিতে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।মুসকানও আমার সাথে যোগ দিলো।তখুনি আমার দুই নাম্বার শ্বাশুড়ি মা (জুলেখা আন্টি আরকি)চোখ গোল গোল করে বললো।

জুলেখাঃ ভাবী,ননদ কি ফুসুরফুসুর করছিস?

মুসকানঃ তোমাকে কেন বলবো? এটা আমাদের সিক্রেট।

মুরাদঃ বউমা,আমি যতদূর তাজ মানে এনাজের মুখ থেকে শুনেছিলাম তুমি ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলে আড়াই বছর আগে। সেই বাচ্চা কোথায় তাহলে?

আমি মুরাদ আঙ্কেলের মুখে এই কথাটা শুনে ভীষণ অবাক হলাম।তাহলে কি আরিয়ান তাদের কে নাভানের বিষয় কিছু বলেনি।কে জানে বলেছে কিনা।নিশ্চয়ই বলেনি।বললে তো জিজ্ঞেস করতো দাদুভাই কে নিয়ে আসোনি কেন?আমি দুই হাত কচলে আমতাআমতা করে বললাম।

আমিঃ আসলে আঙ্কেল হয়েছে কি, আমার একটা…….

আমি নাভানের কথা বলার আগেই তায়াং ভাইয়া হন্তদন্ত হয়ে বাগানের ওপর পাশ থেকে এসে বললো।

তায়াংঃ নোভা,জলদী চল তো।আমাদের এখুনি বের হতে হবে।আমার একটা আর্জেন্ট কাজ পরে গেছে।

আমিঃ কি হয়েছে ভাইয়া? তোকে এত নার্ভাস লাগছে কেন? সবকিছু ঠিক আছে তো।কে কল করেছিলো তোকে?

তায়াংঃ তোকে যেতে যেতে সব বলবো এখন চল।

জুলেখাঃ সে কি কথা!!! দুপুরের খাবার না খেয়ে তোমরা দুজন কোথাও যেতে পারবে না।

মুরাদঃ এতদিন পর আমাদের বাড়িতে এলে।কিছু না খেয়েই চলে যাবে।এটা কি ভালো দেখায়?

তায়াংঃ সরি আন্টি,আঙ্কেল।আমাকে এখুনি যেতে হবে। আর নোভাকে আমি বাসায় পৌঁছে দিবো।

মুসকানঃ ভাবী তুমি না হয় থাকো।বিকালে চলে যাবে।

আমিঃ না গো। এখন নয়।( মুসকানের কানের কাছে মুখ নিয়ে)তোমার ভাইয়ের সাথে সবকিছু স্বাভাবিক হোক তারপর আসবো।ব্যাটাকে আচ্ছা করে শাস্তি দিতে হবে তো।আমার থেকে যাতে আর কখনো দূরে না থাকে।

আমার কথা শুনে মুসকান খিলখিল করে হেসে উঠলো। তায়াং ভাইয়া তাড়া দিতে শুরু করলো আমায়।আমিও সবার থেকে বিদায় নিয়ে তায়াং ভাইয়ার বাইকে উঠে বসলাম।আমাদের কে বিদায় জানাতে তারা তিনজন একসাথে গেইট অব্দি এলো।

জুলেখাঃ টেবিলে থাকা একটা খাবারও কেউ ধরিসনি।দুপুরে খেয়ে গেলে খুব খুশি হতাম।কি এমন হতো গরীবের ঘরে একবেলা খেয়ে গেলে।

আন্টি ছোট বাচ্চাদের মতো আমাদের কে অনুরোধ করলো।আমি মুচকি হেসে তাকে বললাম।

আমিঃ আরেকদিন এসে টানা ৭ দিন বেড়াবো।তখন ইচ্ছে মতো জ্বালিয়ে যাবো।যাতে বুঝতে পারেন কাদের কে বাসায় দাওয়াত করেছেন।

মুসকানঃ না আসলেই চলে। সোজা রিয়েকশন নিবো তখন।

মুরাদঃ দুপুরে একসাথে খেয়ে গেলে সত্যি খুশি হতাম।

তায়াংঃ মন খারাপ করবেন না আপনারা।সত্যি আরেকদিন এসে সারাদিন বেড়াবো।

জুলেখাঃ না আসলে পিঠের ছাল তুলবো বলে দিলাম।

তায়াংঃ আচ্ছা, কোন সমস্যা নেই।

আমিঃ আল্লাহ হাফেজ আঙ্কেল, আন্টি।আল্লাহ হাফেজ ননদী।আপনারা নিজেদের খেয়াল রাখবেন।

মুরাদঃ সাবধানে যেও।

তায়াং ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিলো।আমি ওর কাঁধে এক হাত রেখে আরেক হাত নাড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানালাম।মাত্র ঘন্টাখানিকের পরিচয়। অথচ তাদের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল না জানি কত বছরের চেনা পরিচিত আমরা।অনেক ভালো মন-মানসিকতা তাদের। যা আমাকে সত্যি মুগ্ধ করলো।কিন্তু তায়াং ভাইয়ার হঠাৎ কি হলো তা বুঝলাম না। কে কল করেছিলো তাকে?আর আর্জেন্ট কাজটাই বা কি?

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_26
#Writer_NOVA

—–গুড মর্ণিং ঢাকা।গুড মর্ণিং বাংলাদেশ। হ্যালো লিসেনার।দিস ইজ মি RJ নোভানাজ আছি আপনাদের সাথে। আপনারা শুনছেন ঢাকা এফএম 90.4 ।আমার শো ভোরের পাখি নিয়ে আমি কিন্তু হাজির হয়ে গেছি আরো আধা ঘণ্টা আগে। এখন সময় ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিট। ঘুম কেমন হলো সবার?সকালে উঠেই তো আবার যার যার কর্মস্থানে ছুটতে হবে।পুরো ঢাকা শহরটা কিছু সময়ের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পরবে।ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত পরিবেশটা কেমন লাগে আপনাদের? অনেকে হয়তো সকালের ধোঁয়া উঠা চায়ের সাথে এফএম শুনছেন।তা দিনকাল কেমন কাটছে আপনাদের? আপনার মনের যেকোনো কথা আমাকে টেক্সট কিংবা কমেন্ট করে জানতে পারেন।কিভাবে কমেন্ট বা টেক্সট করবেন তা কি পুনরায় বলে দিতে হবে? আচ্ছা আমি বলেই দিচ্ছি। আমাকে টেক্সট করতে হলে আপনার মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে আপনার নাম,লোকেশন ও মনের যেকোনো কথা লিখে পাঠিয়ে দিবেন ২৬৯৩৬৯ এই নাম্বারে। কমেন্ট করতে হলে আমাদের অফিসিয়াল পেইজে যুক্ত হতে হবে।ফেসবুকে এসে টাইপ করতে হবে www.dhakafm90.4.bd । তাহলে আমাদের অফিসিয়াল পেইজ চলে আসবে।সেখানে আমি একটা পোস্ট দিয়েছি।যেটা হলো,ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত পরিবেশ থেকে একটু দূরে সরলে কার কথা মনে পরে? সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে আপনারা কমেন্ট করতে পারবেন।বকবক তো অনেক হলো। চলুন একটা গান শুনে মনটা ফুরফুরে করে আসি।আজকের ওয়েদারটা কিন্তু জোস।কিরকম শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। এমন ওয়েদারে রবীন্দ্র সংগীত হলে খারাপ হয় না।আপনাদের পছন্দের গানের রিকোয়েস্টও কিন্তু করতে পারেন।আমার প্লে লিষ্টে থাকলে তা অবশ্যই বাজিয়ে দিবো।আর কথা নয় এখন আমরা শুনবো আমার খুব পছন্দের একটা রবীন্দ্র সংগীত। আমারো পরাণো যাহা চায়,তুমি তাই তুমি তাই গো।আমারো পরাণো যাহা চাই। আমার গানের গলা ভীষণ বাজে।এই কাকের কণ্ঠের গান শুনিয়ে আপনাদের অজ্ঞান করতে চাই না।চলুন সেরা শিল্পীদের কণ্ঠে শুনে আসি।

গান বাজিয়ে বড় করে একটা নিশ্বাস ছারলাম।আজকাল কথা বলতে অনেক বিরক্ত লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার চাকরীই এটা।কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে গলা ব্যাথা করে।ব্যাগ থেকে টিফিনবক্স বের করে দেখলাম দুটো স্যান্ডউইচ।আজ সকালের খাবার এরিন তৈরি করেছে। সামনে বিয়ে তাই টুকটাক রান্না শিখে নিচ্ছে। একটা স্যান্ডউইচ তুলে মাত্র একটা কামড় দিয়েছি।তখুনি রেডিও স্টেশনের পিয়ন এসে হাজির।

—- নোভানাজ ম্যাম, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।

আমিঃ আমার সাথে?? (অবাক হয়ে)

—– হ্যাঁ ম্যাম আপনার সাথে। বললো আপনার লিসেনার।আপনি উনার খুব পছন্দের RJ।

আমিঃ আগে কখনো অফিসে এসেছিলো?

—– না ম্যাম।উনাকে আগে কখনো দেখিনি।

আমিঃ আপনি উনাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলুন আমি এখুনি আসছি।

—-ওকে ম্যাম।

পিয়ন চলে যেতেই ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলাম।সাধারণত এই ভোর সকালে কোন লিসেনার আমার সাথে দেখা করতে কখনো আসেনি।তাই একটু অবাক হয়েছি।ভাবনার মধ্যে স্যান্ডউইচে আরেকটা কামড় দিয়ে বাকি অর্ধেকটা রেখে দিলাম।প্লে লিষ্টে পরপর তিনটে গান চালু করে রাখলাম।তারপর টিস্যু দিয়ে হাত,মুখ মুছতে মুছতে ওয়েটিং রুমের দিকে রওনা দিলাম।

রুমের সামনে গিয়ে দরজা সামান্য খুলে আগে উঁকি মারলাম।দেখলাম একটা ছেলে অফিসের ফর্মাল গেটআপে উল্টো দিকে ঘুরে তাকের মধ্যে থাকা বই নেড়েচেড়ে দেখছে। আমি ভালোমতো খেয়াল না করে ভেতরে ঢুকলাম।

আমিঃ আমি RJ নোভানাজ।কিছু বলার ছিলো আপনার?না মানে হঠাৎ করে এত সকালে দেখা করতে চলে এসেছেন তাই আরকি।

🦋🦋🦋

বেশ ইতস্ততায় কথাগুলো বললাম।নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। অচেনা কারোর সাথে হুট করে কথা বলতে পারি না। ছেলেটা পেছনে ঘুরতেই আমি মাথা তুলে চমকে উঠলাম।এতো দেখছি আমার স্বামী মহাশয়।কিন্তু সে এখানে কি করছে ? পিয়ন তো বললো একজন লিসেনার এসেছে।

আমিঃ আপনি!!!!!

তাজঃ আমাকে দেখে খুশি হওনি বউ?

আমিঃ আপনি এখানে কি করছেন?(রাগী কণ্ঠে)

তাজঃ আমিই তো তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। যাক বাবা অবশেষে আমার ধারণাই সঠিক হলো।

আমিঃ কিসের ধারণা?

তাজঃ বলছি, তার আগে বসো।

আমিঃ আমি বসতে পারবো না। আমার শো আছে।

তাজঃ তাহলে তো আমি বলবোও না।

এই ঘাড়ত্যাড়ার সাথে ত্যাড়ামি করে আমি জীবনেও পরবো না। তাই রেগে ধপ করে চেয়ারে বসে পরলাম।এনাজ ওরফে তাজ আমার পাশের চেয়ারে বসলো।

আমিঃ কি বলবেন জলদী বলুন?

তাজঃ তোমার শো দুটো আমার খুব পছন্দের।বলতে পারো, আমি তোমার শো-এর অনেক বড় লিসেনার আরকি।পিয়ন তোমাকে আমার কথাই বলেছে।যেদিন তোমার শো প্রথম শুনেছিলাম সেদিন আমি মনে মনে বলেছিলাম এটা আমার বউ ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না। তাই তো বউয়ের শো একটাও মিস করি না।তোমার কণ্ঠ, কথা বলার ভঙ্গি, হাসি সবকিছু আমার চেনা।তোমাকে দেখতে অনেক ইচ্ছে করছিলো।তাই সকাল সকাল চলে এলাম।আমার আজ সকাল করে একটা কাজে যাওয়ার কথা ছিল।সে সব ফেলে তোমার কাছে চলে এসেছি।

আমিঃ ইস,ভালোবাসা একদম উথলায় পরতেছে।
হুহ😏!! আমি এত সহজে গলছি না।যত ভালোবাসাই দেখাও।আগে তোমার শিক্ষা হোক তারপর বাকিসব।(মনে মনে)

মনে মনে কথাগুলো বলেই আমি কাঠ কাঠ গলায় তাজকে বললাম।

আমিঃ আপনার কথা শেষ হলে আমি আসতে পারি।

তাজঃ আশ্চর্য, যাওয়ার জন্য এমন শুরু করেছো কেন?তুমি তো তোমার……

তাজ পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ওর মুখ চেপে ধরলাম।তাজ বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আবার দরজার দিকে তাকালাম।আমার মনে হলো কেউ সেখান থেকে আড়ালে সরে গেলো।তাজ সেই সুযোগে আমার হাতে একের পর এক চুমু দিতে লাগলো।আমি হাত সরিয়ে টিস্যু দিয়ে জোরে জোরে ঘষতে লাগলাম।

আমিঃ আমার হাতটাকে নোংরা করে দিলো। আমার থেকে দূরে সরুন।

তাজ উত্তর না দিয়ে মিটমিট করে হাসছে।আমি বাই বলে চেয়ার থেকে উঠে গেলাম।তাজ পেছন থেকে হাত ধরে ফেললো।আমার হাত টেনে নিয়ে উল্টো পিঠে তার ঠোঁট ছোঁয়ালো।আমি হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলাম।

আমিঃ হাত ছাড়ুন।কেউ দেখে ফেললে খারাপ ভাববে।আমার চরিত্রে দাগ লাগাতে এক মিনিটও দেরী করবে না। আপনাদের ছেলেদের তো সাত খুন মাফ।এই সমাজে যত দোষ সবতো মেয়েদের।

তাজঃ আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।

আমিঃ অফিসে বাকি কথা বলেন।এখন আপাতত আমাকে ছাড়েন।কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে।একটু বোঝার চেষ্টা করুন।

আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে ছটফট করতে লাগলাম।তাজ শয়তানি হাসি দিয়ে বললো।

তাজঃ ছাড়তে পারি। তবে এক শর্তে।

আমিঃ আবার কিসের শর্ত?

তাজঃ তুমি নিজ ইচ্ছায় আমার ঠোঁটে একটা চুমু দিবে, তো তোমাকে ছাড়বো।

🦋🦋🦋

এক হাত দিয়ে ঠোঁট দেখিয়ে একগালে শয়তানি হাসি দিলো।তার এরকম উদ্ভট কথাবার্তা এবং লাগাম ছাড়া কান্ড-কারখানা দেখে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।

আমিঃ এ্যাহ, শখ কত।ভাগেন এখান থেকে। আপনার সাথে কোন কথা নেই আমার।আমি আপনাকে চিনি না। তাই এসব আবাদার আমার কাছে করবেন না।

তাজ হাতটা শক্ত করে ধরে হেচকা টানে আমাকে তার সামনে নিয়ে এলো।আমি তার হাত থেকে ছোটার জন্য ছটফট করছি।কিন্তু এই জলহস্তীর মতো শরীরের মানুষের হাত থেকে নিজের শুকনো হাড্ডিসমেত হাতটাকে কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

তাজঃ কি বললে তুমি আমাকে চিনো না?আমার সাথে কথা নেই তোমার?

আমিঃ যা বললাম তাতো শুনতেই পেয়েছেন।

তাজ কিছুটা রেগে গেলেও শয়তানি হাসি দিয়ে আমাকে বললো।

তাজঃ তুমি আমার ঠোঁটে চুমু না খেলে আমি কিছুতেই ছারবো না।এত দূর থেকে বউকে দেখতে এলাম।এর বিনিময়ে কিছু না নিয়ে চলে যাবো?তাতো হয় না।

আমিঃ বদমাশ বেডা।লাজ-শরম সব কি সকালের নাস্তার সাথে খেয়ে ফেলছেন নাকি?হাত ছাড়ুন।আমি কিন্তু চিৎকার করে সবাইকে ডাকবো।

তাজঃ ডাকো, ডাকো।তুমি যদি তোমার স্বামীকে গণধোলাই খাওয়াতে চাও তাহলে ডাকতেই পারো।আমি সেচ্ছায় সবার মার হজম করে নিবো।

এই বেডা আমাকে এখন কিছুতেই ছাড়বে না।কি আর করার এর শর্ত মেনে নিতেই হবে।আগত্যা আমি তার শর্তে রাজী হয়ে গেলাম।উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্ব জয় করা হাসি দিলো।

আমিঃ আমি চুমু খেতে পারি।তবে আমারও একটা শর্ত আছে?

তাজঃ তোমার আবার কিসের শর্ত🤨?(ভ্রু উঁচু করে)

আমিঃ আপনি চোখ বন্ধ না করলে আমি আপনাকে কিসি দিবো না।(লাজুক মুখে)

তাজঃ আমাকে বোকা পেয়েছো।তোমাকে কি আমি চিনি না।আমি চোখ বন্ধ করলেই তুমি আমাকে উল্টো পাল্টা কিছু করে এখান থেকে পালাবে।

আমিঃ একটুও না। আমার শর্তে রাজী থাকলে বলেন নয়তো আমি গেলাম।

আমি মনে মনে শয়তানি হাসি দিচ্ছি।পরাণের সোয়ামী,একটু পরেই টের পাইবা তোমার কি অবস্থা করি।তাজ কিছু সময় ভেবে বললো।

তাজঃ আচ্ছা, আমি রাজী।

আমিঃ তাহলে চোখ বন্ধ করুন।

তাজঃ ওকে করলাম।

ফাঁকের ওপর আমি ওর থেকে আমার হাত দুটো ছুটিয়ে নিলাম।তারপর তাজ চোখ বন্ধ করে তার ঠোঁট দুটো আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু আমার মনে তো শয়তানি বুদ্ধি খিচুড়ি পাকাচ্ছে।আমি ওর সামনে একটু হেলে ওর ঠোঁট দুটো, দুই আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে জোরে টান দিয়ে উল্টো দিকে হাসতে হাসতে দৌড় দিলাম।শখ কত,এতদিন খবর ছিলো না আর এখন আসছে।ওরে ভালুপাসা রে।একদম ঠিক করেছি আমি।এটা তার শাস্তি।

তাজঃ আহ্হহহ।ঠোঁট দুটো আমার ছিঁড়ে ফেললো। ভালো হলো না বাটারফ্লাই। এর শাস্তি তোমায় পেতে হবে।তৈরি থেকো তুমি।

আমিঃ কচু করবেন।

দরজার বাইরে থেকে মুখ বের করে হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছে মতো ভেংচি কেটে দৌড়ালাম শো করতে।এখানে বেশিখন থাকলে আমার কপালে শনি আছে। বেটাকে আচ্ছা করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। শখ কত,রোমান্স করতে এসেছিলো সে।ওরে আমার পরাণের সোয়ামীরে।এখন ঠোঁট ব্যাথায় মরো।আমি হাসতে হাসতে শো রুমে চলে এলাম।ভাবতেই খুশি লাগছে।কি বোকা বানিয়ে এলাম😝।আবার এসো এরকম উল্টো পাল্টা আবদার নিয়ে। সেবার অবস্থা এবারের থেকে আরো বেশি খারাপ হবে।মনটা খুশি খুশি লাগছে।

#চলবে

প্রজাপতির রং পর্ব-২৩+২৪

0

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_23
#Writer_NOVA

এরিন সামনে থেকে সরতেই আমি সেই মানুষটাকে দেখতে পারলাম।তাকে দেখেই আমি অবাক।সেও যে আমাকে দেখে অবাক হয়েছে তা তার চোখ, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এ এখানে কি করছে??? এ কি আজ অফিসে যায়নি।মনে হয় তো গেছে। নয়তো অফিসের ড্রেসআপে থাকতো না।আমি স্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম।

আমিঃ আরিয়ান আপনি?

এরিনঃ তুই একে চিনিস?

আমিঃ হ্যাঁ আমাদের কোম্পানির ওনারের ছোট ভাই। উনিও কোম্পানির ওনার। আরিয়ান আজওয়ার। কিন্তু তুই একে কি করে চিনিস?

এরিন মুচকি হাসলো।আমি ওর হাসির অর্থ বুঝতে না পেরে বিস্মিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।আরিয়ান এগিয়ে আসলো।

আরিয়ানঃ আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?

আমিঃ আলাইকুমুস সালাম।আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আপনি?

আরিয়ানঃ জ্বি, আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি।

আমিঃ কি রে এরিন বললি না উনাকে চিনলি কিভাবে?

আরিয়ানঃ আমি বলছি।আসলে আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। উনার সাথে সামনাসামনি কথা বলার প্রয়োজন ছিলো।একে অপরকে বিয়ের আগে জানাশোনার প্রয়োজন। তাই আমি আপনাদের বাসায় চলে এসেছি। কিছু মনে করেননি তো?

আমিঃ আরে না কি মনে করবো? এরিন তো আমাদের কিছুই বলেনি।তাই এরকম পরিস্থিতিতে পরতে হলো।

এরিনঃ আমি তোদের বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আরিয়ান বললো একেবারে বাসায় এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে।তাই আমিও কিছু বলেনি।কিন্তু আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছি।কিন্তু তোরা বুঝতে পারিস না।তাছাড়া তুই সারাদিন অফিস, শো করে এসে টায়ার্ড হয়ে যাস।ফ্রেশ হয়ে নাভানকে খাইয়ে ঘুমিয়ে পরিস।তোকে তখন কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।সারাদিনের ক্লান্ত মানুষটাকে বকবক করে বিরক্ত করতে আমার ইচ্ছে হয় না।

এরিনের ওপর প্রথম প্রথম একটু রাগ হলেও এখন আর নেই। ও তো ভুল বলেনি।সারাদিন অফিস, শো করে কার ভালো লাগে আবার বকবক শুনতে। আমি মুচকি হেসে এরিনকে জড়িয়ে ধরলাম।

আমিঃ শুভকামনা নতুন জীবনের জন্য। আমি সত্যি অনেক বড় সারপ্রাইজ পেয়েছি।

আরিয়ানঃ বিয়েটা কিন্তু আপনার ও আমার ভাইয়ার দেওয়া ডেটেই হবে।প্লিজ জলদী বিয়ের ডেট ফেলেন।বউ ছাড়া আর কত দিন থাকবো🥺।

আরিয়ানের কথা শুনে উচ্চস্বরেই হেসে উঠলাম।এরিন আরিয়ানের হাতে একটা চাপর মেরে লজ্জারাঙা মুখ করে বললো।

এরিনঃ যা: এভাবে বলে কেউ।

আমিঃ এরিন লজ্জা পেয়েছে। ওকে লজ্জা পেলে কিন্তু অনেক সুন্দর লাগে।গাল দুটো পিচ ফলের কালারের মতো রক্তিম হয়ে যায়।

আরিয়ানঃ একদম ঠিক বলছেন।তখন আমার কিন্তু জোড়ে একটা কামড় মারতে ইচ্ছে করে।

এরিনঃ চুপ করবেন।নোভা যে সামনে আছে সেটা কি চোখে দেখছেন?

আরিয়ানঃ উনি এসব বহু আগের থেকে জানে।তার দুই বছরের একটা ছেলে আছে।ছেলেটা নিশ্চয়ই অনলাইন থেকে অর্ডার করেনি।তাই না ভাবী
সাহেবা😉?? আমি কি কিছু ভুল বলেছি?

আরিয়ানের কথায় আমি মিটমিট করে হাসছিলাম।এই ছেলে এখন আমাকে ও এরিন দুজনকেই লজ্জা দিচ্ছে। তবে ভাবী সাহেবা ডাকটা শুনে আমি চোখ দুটো বড় বড় করে আরিয়ানের দিকে তাকালাম।

আমিঃ ভাবী সাহেবা কে?

আরিয়ানঃ আপনি।

আরিয়ানের সহজ সরল উত্তর শুনে আমি ও এরিন দুজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।আরিয়ান কি তাহলে জানে তাজের বউ আমি!!!!

এরিনঃ নোভা আপনার ভাবী কি করে হলো?

আরিয়ানঃ আমি এখন বানিয়ে নিলাম।আরে আরে তোমরা দুজন এতো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো কেন? আমি তো এমনি বললাম।নাভানের চাচ্চু আমি।তাহলে তো নোভা আপু আমার ভাবীই হবে।আমি তার হাসবেন্ডকে ভাই ডেকে নিলাম।ব্যাস হিসাব বরাবর।

এর ভাবী বলার যুক্তি শুনে আমি থ মেরে আছি।কি সুন্দর যুক্তি।সে হাত বাড়িয়ে আমার থেকে নাভানকে কোলে তুলে নিলো।

আরিয়ানঃ চাচ্চুটা কি করছে? চাচ্চু কি কিছু খেয়েছে? নাকি এমনি টো টো করে ঘুরছে।

আমি মুগ্ধ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।এনাম থাকলে হয়তো এমনি নাভানকে আদর করতো।যেদিন জানতে পেরেছিল আমি প্রেগন্যান্ট সেদিন সারা বাড়ি দুই ভাই মাথায় তুলে ফেলেছিলো।কে জানে কোথায় আছে ছেলেটা। আদো বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। তবে আমি চাই আল্লাহ ওকে বাচিয়ে ও ভালো রাখুক।শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে এনামের কথা ভাবছিলাম।আরিয়ান আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো।

আরিয়ানঃ কোথায় চলে গেলেন ভাবী সাহেবা?

আমিঃ কোথাও না তো।

আরিয়ানঃ কত কিছু বললাম।কিন্তু আমার তো মনে হলে আপনি কিছুই শুনেননি।হুটহাট কোথায় চলে যান ভাবী সাহেবা? এক মিনিট,, আমি বারবার ভাবী সাহেবা বলছি বলে আবার রাগ করছেন না তো?

আমিঃ আরে না রাগ করবো কেন? বরং খুশি হয়েছি।অনেক দিন পর কেউ ভাবী বলে ডাকলো।এরিন কোথায়? ও তো এখানেই ছিলো।

আরিয়ানঃ ও তো মাত্রই বাইরে গেলো আপনার সামনে দিয়ে। আপনি দেখেননি?

আমিঃ হয়তো খেয়াল করিনি।

আরিয়ানঃ তা করবেন কি করে আপনি তো মহাকাশে ছিলেন ভাবী সাহেবা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন।বসুন প্লিজ।

আমিঃ না বসে লাভ হবে না। নাভানকে গোসল করাতে হবে। তারপর কিচেনে যেতে হবে। আপনি বিশ্রাম নিন।আমি আসছি।

আরিয়ানের কোল থেকে নাভানকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।সবাই কে এখন রহস্যময় মনে হয়। আরিয়ানকেও রহস্যময় মনে হচ্ছে।কারণ নাভানকে ওর কোলের থেকে আনার সময় ওর মুখে অদ্ভুত রকমের একটা রহস্যময়ী হাসি দেখেছি আমি।কি জানি কিসের ছিলো ঐ হাসি।তাছাড়া হঠাৎ ও এখানে কেন এলো? এরিনের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে চাইলে তো কফি শপেই এলেই পারতো।কিন্তু সোজা বাসায়।বিষয়টা একটু ভাবার। আপাতত এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নাভানকে গোসল করাতে ওয়াসরুমে ঢুকে গেলাম।

🦋🦋🦋

বিকেলের পড়ন্ত আলোটায় সারা ভুবনে ছড়িয়ে একটা মায়াবী আবেশ তৈরি করে রেখেছে। মিষ্টি রোদের আলোয় অন্যরকম ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে। অফিস ছুটি হয়েছে মিনিট দশেক আগে। কিন্তু তাজ এখনো কেবিন থেকে বের হয়নি।সামনের কাচের দিকে তাকিয়ে বাইরের পরিবেশ উপভোগ করছে।এই মিষ্টি রোদটা তাজের বেশ লাগে।নেই কোন তেজ,নেই কোন অসহ্যকর গরমের অনুভূতি। বরং একরাশ ভালো লাগায় ঘেরা। সারাদিন বহু কাজের চাপ গিয়েছে।একটু দম নেওয়ার সময় ছিলো না।শেয়ার ব্যবসার জন্য অনুমোদন, চুক্তিপত্র,অবলেখক,ব্যাংক ঝামেলা করতে করতে সে পুরো টায়ার্ড।সারাদিনে নোভার একটু খোঁজও নিতে পারেনি।নিশ্চয়ই গাল ফুলিয়ে রেখেছে এখনো।মেয়েটা অনেক বেশি অভিমানী। এই কারণে তাজ ওকে বেশি পছন্দ করে। পূর্বের অনেক কথা ভেবে মিটমিট করে হাসছিলো তাজ।আদরের ডাকে ওর হুশ ফিরে।

আদরঃ স্যার, বাসায় যাবেন না?

তাজঃ হুম যাবো তো।

আদরঃ তাহলে চলুন একসাথে বের হই।

তাজঃ একটু পরে।তোমার ম্যাডাম কি বের হয়ে গেছে?

আদরঃ আসলে স্যার আপনাকে একটা কথা বলতে আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

তাজ চোখ দুটো ছোট ছোট করে আদরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আদর জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদর যে ওকে ভয় পাচ্ছে তা ভেবে মনে মনে হাসলো তাজ।তবে উপরে তা প্রকাশ করলো না। ছেলেটা শুধু শুধু ওকে ভয় পায়।আজ অব্দি কখনও তাজ ওর সাথে ধমক দিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক জোরে চেচিয়েও কথা বলে নি।তারপরেও ওকে যে কেন এতো ভয় পায় তার লজিক খুঁজে পায় না তাজ।

তাজঃ কি কথা?

আদরঃ আসলে স্যার হয়েছে কি?(ভয়ে আমতা আমতা করে)

তাজঃ কি হয়েছে নির্ভয়ে বলতে পারো।

তাজের আশ্বাস শুনে আদর কিছুটা স্বাভাবিক হলো।তারপর কোন ভনিতা ছাড়া বলে উঠলো।

আদরঃ আসলে স্যার, ম্যাম সকালে চলে গেছেন।তার নাকি শরীরটা ভালো লাগছিলো না।আমাকে বলে চলে গেছে। আমি বলেছিলাম আপনার সাথে কথা বলতে।কিন্তু সে নাকি আপনার সামনে আসবে না। তাই আমাকে বলেছে।

তাজঃ ওহ্ এই ব্যাপার।(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)

আদরঃ আপনাদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে?

তাজঃ আমাদের সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিকই হয়নি আর কি হবে বলো?

আদরঃ ম্যামকে সব সত্যিটা বলে দিন।তাহলেই তো সব ভেজাল কেটে যায়।

তাজঃ হুম তাই করতে হবে।ও অনেক অভিমানী মেয়ে, আদর।সামান্য কিছুতে গাল ফুলিয়ে ফেলে।সেখানে আড়াই বছর ওর থেকে দূরে থেকেছি আমি।ওর অভিমান জমে পাহাড়ের আকার ধারণ করেছে। এই অভিমান সামান্য কিছুতে ভাঙ্গবে না।

আদরঃ যেভাবে পারেন ভেঙে ফেলেন স্যার।নয়তো সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হবে।

তাজঃ দূরত্ব তো বহু আগেই সৃষ্টি হয়েছে। এখন আর নতুন করে কি সৃষ্টি হবে?

আদরঃ ম্যাম, আপনাকে অনেক ভালোবাসে স্যার।কিন্তু আপনার ওপর রাগ করে তা স্বীকার করে না।আপনাকে যদি সে ভালো না বাসতো তাহলে প্রথম দিন আপনাকে এক দেখায় চিনে ফেলতো না।

তাজঃ তা আমি জানি আদর।দেখি কি করা যায়।

আদর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।যাক বাবা,তাজ রাগেনি।নোভা যে তাজের স্ত্রী তা বহু আগের থেকে জানে আদর।তাজের মানিব্যাগে নোভার ছবি দেখেছিলো একদিন।আরেকদিন তাজের কেবিনের টেবিলের ড্রয়ার ভর্তি নোভার ছবি দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে ভয়ে তাজকে জিজ্ঞেস করেছিলো মেয়েটা কে? সেদিন তাজ ওর সব অতীত ওকে বলে দিয়েছিলো।তাজ, আদরকে অনেক বিশ্বাস করে। আর আদর সেই বিশ্বাসের মর্যাদাও রাখে।তারপর যেদিন চাকরীর CV চেক করেছিলো সেদিন আদর নোভার CV দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তাজকে দেখাতে তাজের চোখ,মুখ কুঁচকে ফেললোও মুখে ছিলো বিশ্ব জয় করা হাসি।তাই তো আদর ইন্টারভিউয়ের দিন নোভার দিকে আলাদা কেয়ার ও নজর রেখেছে। তাছাড়া নোভা জয়েন হওয়ার পর সারাদিন নোভার ওপর খেয়াল সে রাখে।আর সারাদিনের আপডেট কিছু সময় পরপর তাজকে দেয়।আজকে শুধু কাজের চাপে ভুলে গিয়েছিল।

আদরঃ স্যার,চলেন।

তাজঃ তুমি চলে যাও আদর।আমার একটা ফাইল কমপ্লিট করা বাকি আছে। একটু দেরী হবে।

আদরঃ আমি আরেকটু সময় অপেক্ষা করবো?

তাজঃ না,তার দরকার নেই। তুমি দুপুরে কিছু খাওনি।জলদী করে বাসায় গিয়ে কিছু খেয়ে নেও।

আদরঃ আমার খিদে নেই স্যার।আমি আপনার সাথে থাকতে পারবো।

তাজ ভ্রু কুঁচকালো।ছেলেটা একদম ওর ভক্ত। ওকে এক মিনিটের জন্যও একা ছাড়তে চায় না।না চাইতেও আদরের প্রতি ভালোবাসাটা বেড়েই যাচ্ছে তাজের।ওর সবদিকে খেয়াল আদরের।তাজ ওকে ভাগাতে চাইলো।সকালে অল্প কিছু খেয়ে চলে এসেছে। দুপুরেও খায়নি।এভাবে তো আদর অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই একটু রাগী স্বরে তাজ বললো।

তাজঃ আমি চলে যেতে পারবো আদর।তুমি বাসায় চলে যাও।যদি এখন আমার সাথে থাকতে চাও তাহলে কাল থেকে অফিসে আসার দরকার নেই।

তাজের কথায় কাজ হলো।ওর কথায় আদর ভয় পেয়ে গেলো।সে তো চাকরিটা হারাতে চায় না।মুখ গোমড়া করে বললো।

আদরঃ আচ্ছা স্যার, আমি চলে যাচ্ছি। তবে আপনি বেশি দেরী করবেন না।জলদী বাসায় চলে যাবেন।আপনি তো আবার কাজে ডুবে গেলে অন্য কিছুর ধ্যান থাকে না।

কথা শেষ করে আদর দ্রুত পায়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। তাজ মুচকি হেসে চেয়ার টেনে ফাইল নিয়ে বসে পরলো।আদর একটু বেশি কাজপাগল ছেলে।আর তাজ তো ওর সবকিছু।

তবে আদরের কথাই সঠিক হলো কাজ করতে করতে কখন যে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডুবে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই তাজের।কাজ করতে আজ কেন জানি ভালো লাগছিলো।তাই অনেকগুলো ফাইল কমপ্লিট করে ফেলেছে। মাগরীবের আজানের সুর না শুনলে তাজের হুশ ফিরতো না।হাতে থাকা এ্যাশ কালার চামড়ার ওয়াচের দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠলো।

তাজঃ আল্লাহ, এতো সময় চলে গেল কিভাবে?এই জন্য আদর আমাকে বারবার সাবধান করেছিলো।আমি কাজে ডুব দিলে অন্য দিকে খেয়াল দেই না।এখন উঠতে হবে।আর থাকা চলবে না।

পুরো অফিসের সব কিছু চেক করে লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালো। পিয়নও যে ওকে বলে চলে গেছে তখনও ওর খেয়াল ছিলো না।কাজের মধ্যে ডুবে থেকে সে নিজেই পিয়নকে চলে যেতে বলেছে।সবকিছু আবারো চেক দিয়ে এসেছে। লিফটে ঢুকে বাটন টিপে চুপ করে দাঁড়ালো। লিফট থামলো নিচের ফ্লোরে এসে।শব্দ করে লিফটের দরজা খুলে গেল।তাজ বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।তখুনি তাজ কিছু বুঝে উঠার আগে এক জোড়া হাত এসে তাজের গলা শক্ত করে চেপে ধরলো।

#চলবে

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_24
#Writer_NOVA

আমরা এখন তাজের বাসার সামনে বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।ভেতরে ঢোকার আগে গেইটের পাশের নেমপ্লেটের মধ্যে ঠিকানাবিহীন নামটা দেখে বেশ অবাক হলাম।এরকম নাম আমি কখনো দেখিনি। দারোয়ান গেইট খুলে দিতেই তায়াং ভাইয়া বাইক নিয়ে সোজা বাসার ভেতরে ঢুকলো।নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে দোতলা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি।সামনে ছোট একটা বাগান।পরিবেশটাও মনোমুগ্ধকর। ছোট বাগানের মাঝে ছোট একটা টেবিল পাতা।তার সাথে চারটা চেয়ার।সেখানে বসে আছেন মধ্যবয়স্ক এক লোক।আমি ধারণা করে নিলাম উনিই মুরাদ আঙ্কেল হবেন।তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন।এখন যদি সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় তাও বোধহয় উনি পত্রিকার থেকে চোখ সরাবেন না।বাইকের শব্দই তার ধ্যান ভাঙেনি অন্য কিছুতে ভাঙ্গবে বলে মনে হয় না। সামনে থাকা চায়ের কাপ থেকে খুব ধীরে ধোঁয়া উঠছে।সকাল ১১ টা বাজে চা খাওয়ার কোন লজিক আমি খুঁজে পেলাম না।সম্ভবত উনি প্রচুর চা-খোর টাইপের মানুষ হবে।তায়াং ভাইয়ার সাথে আমিও বাইক থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে গেলাম।তায়াং ভাইয়া বেশ জোরেই তাকে সালাম দিলো।

তায়াংঃ আসসালামু আলাইকুম।

মুরাদঃ অলাইকুমুস সালাম।

উনি পত্রিকার থেকে চোখ না তুলেই সালামের উত্তর দিলেন।এক ধ্যানে খবর পড়ার মাঝখানে তায়াং ভাইয়ার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো।

মুরাদঃ কি চাই?

তায়াংঃ জ্বি, আমাদের একটু দরকার ছিলো।

মুরাদঃ দরকার ছাড়া তো কেউ আসে না। কোন চাকরী-টাকরী লাগবে নাকি? যদি সেরকম কিছু হয় তাহলে আমার বড় ছেলের সাথে যোগাযোগ করুন।

উনার কথা শুনে তায়াং ভাইয়া আমার দিকে কটমট করে তাকালো।যার মানে হলো, উনি আমাদের কে ভাবছেন চাকরির খোঁজে আসা অসহায় মানুষ। আমি তায়াং ভাইয়াকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলাম।আমি দেখছি বিষয়টা।

আমিঃ আসলে আঙ্কেল আমরা কোন চাকরীর জন্য আসিনি।আমাদের কিছু জানার ছিলো।

মুরাদঃ কেন, তোমরা কি আইনের লোক নাকি?

এতক্ষণ পর উনি আমাদের দিকে তাকালো।অবশ্য আমার কণ্ঠ পেয়ে যে তাকিয়েছে সেটাই বুঝলাম।আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার পত্রিকায় ডুব দিতে নিয়েছিলো।কিন্তু কিছু একটা কপাল কুঁচকে ভেবে আবারো আমার দিকে তাকালো। তবে সেটা ছিলো বিস্মিত চাহনী।উনি আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে তা তার মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি একবার তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলাম।উনি হাতের পত্রিকা রেখে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো।

মুরাদঃ তোমরা? আরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো, বসো।আমি তোমাদের খেয়ালই করিনি।কই গো জুলেখা জলদী এসো।দেখে যাও কে এসেছে? তুমি এতদিন ধরে যাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিল সে আজ নিজে আমাদের বাসায় এসেছে। জুলেখা জলদী এসো।

আমি ও তায়াং ভাইয়া একে অপরের দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছি।তায়াং ভাইয়া আমার কানের সামনে এসে নিচুস্বরে বললো।

তায়াংঃ কি হচ্ছে বল তো?উনি আমাদের দেখে এত খুশি হচ্ছে কেন?এনাজকে যদি উনি সত্যি কোন স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতো তাহলে তো আমাদের দেখে ভয় পাবার কথা। কিংবা আমাদের না চেনার ভান করার কথা।

আমিঃ আমিও তো বুঝতে পারছি না।

উনি এত খুশি কেন হচ্ছে? তাহলে কি এই বাড়ির সবাই জানে আমি তাজের বউ।তায়াং ভাইয়া আর আমি চেয়ারে বসে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গেলাম।

মুরাদঃ কি খাবে তোমরা বলো? সকালের নাস্তা করেছো? না করলে এখানে করবে।দুপুরে না খেয়ে কোথাও যেতে পারবে না।

মুরাদ আঙ্কেল আবারো জুলেখা নাম ধরে ডাকলো।আমাদের কে দেখে তার চোখ খুশিতে চকচক করছে।বহুদিন প্রতিক্ষার পর আমরা যখন কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা পাই তখন আমাদের যেই খুশিটা লাগে আমিও মুরাদ আঙ্কেলের মুখে সেম হাসিটা দেখছি।যার মধ্যে নেই কোন ভেজাল কিংবা স্বার্থ।বরং নিখাঁদযুক্ত এক প্রশান্তির হাসি।

—- এত ডাকাডাকি কিসের তোমার? একটু আগেই তো চা করে দিয়ে গেলাম।এখন আবার কি লাগবে?সবেমাত্র রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম এর মধ্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা শুরু করলে।বলি,সারাদিন কি তোমার সাথে গল্পগুজব করে কাটালে চলবে?দুপুরের রান্নাটাও তো বসাতে হবে নাকি।

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ভেতর থেকে এক মহিলা বের হলো।উনি জুলেখা হবেন।আরিয়ানের মা আরকি।সুশ্রী মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো জানান দিচ্ছে উনি এতখন কিচেনে ছিলেন।গায়ে ছাই কালার পাড়ের হালকা ঘিয়া কালার শাড়ি।উনি যে যৌবনে অনেক রূপসী ছিলেন তা যে কেউ এক পলক দেখেই বলে দিতে পারবেন।আন্টি মুরাদ আঙ্কেলকে কথা শুনাতে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে আমাদের দিকে খেয়াল করেননি।

মুরাদঃ আরে থামো থামো।এখুনি কি সব বলে ফেলবে?কালকের জন্য কিছু জমিয়ে রাখো।সামনে তাকিয়ে দেখো কে এসেছে?

জুলেখাঃ কে আবার আসবে এখন………..

পুরো কথা শেষ করার আগেই উনি আমাকে দেখলেন।ওমনি তার মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো।ছুটে আমার কাছে এসে তার দুই হাত আমার গালে আলতো করে রেখে মুরাদ আঙ্কেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

জুলেখাঃ হ্যাঁ গো আরিয়ানের বাবা।আমি কি ঠিক দেখছি।যার খোঁজে আমরা পাগল হয়ে গেলাম।সে আজ নিজে আমাদের বাড়ি।আমি স্বপ্ন দেখছি না তো।

মুরাদঃ না গো স্বপ্ন নয় সত্যি। আমি নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখেছি।

সবকিছু আমার আর তায়াং ভাইয়ার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। মুখে হাসি রেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

আমিঃ আসসালামু আলাইকুম আন্টি।কেমন আছেন?

জুলেখাঃ আমি ভালো আছি রে মা।তুই কেমন আছিস? তোকে যে কত খুঁজেছি।আমার এখন নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না তুই আমাদের বাড়িতে এসেছিস।(তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)
তায়াং বাবা কেমন আছো?

তায়াং ভাইয়া নিজের নাম তার মুখ থেকে শুনতে পেয়ে বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকালো। তায়াং ভাইয়ার রিয়েকশন দেখে আমার পেট ফেটে হাসি আসছে।তায়াং ভাইয়া কোনরকম শব্দ করে বললো।

তায়াংঃ জ্বি আন্টি ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?

জুলেখাঃ এতক্ষণ ভালো না থাকলেও এখন ভালো আছি।আমার বড় ছেলের বউকে নিজের চোখের সামনে দেখে কি খারাপ থাকতে পারি?

এতক্ষণে আমাদের কাছে সব ক্লিয়ার হলো।তার মানে তারা জানে আমি তাজের বউ। কিন্তু তায়াং ভাইয়াকে কি করে চিনলো?

তায়াংঃ আমাদের চিনলেন কি করে আন্টি?

জুলেখাঃ শোনো ছেলের কথা।আমাদের তাজের জানের প্রাণের বন্ধু তুমি। তোমাকে চিনবো না তো কাকে চিনবো বলো।তাজ তো প্রায় তোমার কথা বলে।তাছাড়া তোমার আর তাজের আগের ছবি দেখেছি। সেখান থেকে চিনি।আর এই লক্ষ্মী মেয়েটা হলো আমার তাজের অর্ধাঙ্গিনী।আমাদের বড় বউ।

মুরাদঃ কথা না বলে ওদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করো।

জুলেখাঃ হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। মুসকানকেও পাঠিয়ে দেই।ওর কত ইচ্ছে তাজের বউকে নিজের চোখে দেখবে।(আমার দিকে তাকিয়ে) তুই এখানে থাক।আমি আসছি।

আমিঃ না না আন্টি কোন ঝামেলার দরকার নেই। আমাদের সাথে এখানে বসুন।

জুলেখাঃ এই প্রথম শ্বশুর বাড়িতে এসেছিস।আর আমি খালি মুখে যেতে দিবো কি করে ভাবলি?চুপ করে বসে থাক।আমি তোর শ্বাশুড়ি তুই নস।তোকে তুই বলছি দেখে আবার রাগ করিসনি তো।

আমিঃ রাগ করবো কেন?শ্বাশুড়ি মা তো তুই করে বলতেই পারে।

উনি আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে গাল দুটো টেনে দিলো।তারপর কিছু সময় শাসিয়ে ভেতরে চলে গেলো।আমি ও তায়াং ভাইয়া দুজনের কেউই এখনো বিস্ময়কর অবস্থা থেকে বের হতে পারিনি। আমরা দুজনে কি ভেবেছিলাম আর হচ্ছেটা কি?

🦋🦋🦋

—– বড় ভাবী-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই!!! অবশেষে তুমি আসছো।আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।

চিৎকার করে ভাবী বলে ডাকতে ডাকতে একটা মেয়ে এসে হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।মেয়েটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।মুরাদ আঙ্কেল ওকে ঝাড়ি মেরে উঠলেন।

মুরাদঃ মুসকান করছিস কি? আরে ছাড় মেয়েটাকে।এভাবে কেউ ধরে।মেয়েটা নিশ্বাস নিতে পারছে না।

— কতদিন পর ভাবীকে পেলাম।তাই খুশিতে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম।

মেয়েটা আমাকে ছেড়ে অপর চেয়ারে গিয়ে বসলো।আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো।

—- আমি মুসকান। তাজরান ও আরিয়ান ভাইয়ার একমাত্র বোন।

আমি মুসকানের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেললাম।এই মুসকানই তো ছিল সেদিন।যে তাজকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো।তাজকে ও বড় ভাই ভাবে।আর আমি কত হাবিজাবি ভেবে বসলাম।নিজের ওপর এখন রাগ হচ্ছে।

মুসকানঃ কি হলো ভাবী? কোথায় হারিয়ে গেলে?

আমিঃ তুমি সেদিন অফিসে গিয়েছিল? তাজকে জড়িয়ে ধরেছিলে।

মুসকানঃ হ্যাঁ আমি ছিলাম।আমাদের ভার্সিটি থেকে জাফলং ট্যুরে যাবে সামনের সপ্তাহে। কিন্তু বাবা যেতে দিবে না। তাই ভাইয়ার অফিসে গিয়েছিলাম।যাতে ভাইয়া বাবাকে কনভিন্স করে।ভাইয়া কনভিন্স করতে পেরেছিলো।বাবা যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলো।তাই খুশিতে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্তু তুমি এসব জানলে কি করে? তুমি আবার আমাদের একসাথে দেখে ভাইয়াকে খারাপ ভেবে বসোনি তো?

আমিঃ এই রে কি করেছি আমি😖।মেয়েটার সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই আমি এনাজকে খারাপ ধরে বসে আছি।এটা কি ঠিক হলো? আমি ভাবলাম কি করে এনাজ এমন কাজ করতে পারে? ভাই-বোন সম্পর্ক হিসেবে তো মুসকান এনাজকে জড়িয়ে ধরতেই পারে।কিন্তু আমি না জেনে কতকিছু ভেবে বসলাম।এসব জানলে তাজ কি আমায় ক্ষমা করবে?(মনে মনে)

মুসকানঃ ও ভাবী কোথায় হারিয়ে যাও?

আমিঃ তুমি আমায় চিনলে কি করে?

মুসকানঃ কি যে বলো না ভাবী?তোমার ছবি দেখতে দেখতে পুরো মুখস্থ হয়ে গেছে। তাছাড়া ভাইয়ার রুমে তোমার বিশাল বড় একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি টাঙানো আছে। সেটা দেখে যে কেউ তোমাকে চিনতে পারে।

আমিঃ ওহ্ এই কারণে আরিয়ান আমাকে ভাবী সাহেবা বলে সম্বোধন করেছিলো। (মনে মনে)

মুসকানঃ আমার যদি ভুল না হয় তাহলে আপনি তানভীর রহমান।নিক নেম তায়াং।এম আই রাইট।

তায়াংঃ জ্বি।

মুসকানঃ আপনার কথা বড় ভাইয়ার কাছে অনেক শুনেছি। আর ছবিতে আপনাকে দেখেছিও।আপনি ছবিতে দেখতে যতটা হ্যান্ডসাম, বাস্তবে তার থেকে অনেক বেশি।

আমিঃ আমাদের ছবি কোথায় পেলো তোমার ভাইয়া?

মুসকানঃ তোমাদের পুরনো ফ্ল্যাট বাসা থেকে। ভাইয়ার নিজস্ব যে ফ্ল্যাট-টা ছিলো সেখান থেকে নিয়ে এসেছে।

আমিঃ আমার জানা মতে সেটা তো আমার দেবর বিক্রি করে দিয়েছে।

মুসকানঃ বিক্রি করার আগে গিয়ে নিয়ে এসেছে ভাইয়া।তোমরা থাকো আমি একটু আসছি।আম্মু ডাকছে আমায়।

আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতাম।কিন্তু তার আগেই মুসকান উঠে চলে গেল। তায়াং ভাইয়া ও মুরাদ আঙ্কেল নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছিলো।

মুরাদঃ বড় বউমা কোথায় ছিলে এতদিন? তোমাকে খুজতে খুজতে আমরা হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম।তাজ ঠিকই বলেছিলো।যতদিন তুমি নিজ থেকে ধরা না দিবে ততদিন তোমাকে খুঁজে পাবো না।তাজ আরো বলেছিল, দেখেন বাবা আমার বউ নিজে একদিন এই বাসায় আসবে।আমার সব খোঁজ নিতে।তাই হলো।তুমি নাকি আমাদের কোম্পানিতে চাকরী নিয়েছো?তাজ বলেছিলো।তখন তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তাজ বলেছে কিছু দিন অপেক্ষা করুন।আপনাদের বউমা আপনাদের সাথে দেখা করতে আসবে।অনেক খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে।

আমিঃ আঙ্কেল আপনারা এনাজকে পেলেন কি করে?ওকে তো আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মুরাদঃ আমি জানতাম তুমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঠিক আসবে।আচ্ছা বলছি।তবে তুমি হয়তো ভাবতে পারো আমি তোমার স্বামীকে নিজের স্বার্থের জন্য বাঁচিয়েছি।কিন্তু তা নয়।আমি ওর ওপর কৃতজ্ঞ ছিলাম।সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশেই ওকে এখন অব্দি নিজের ছেলের পরিচয়ে রেখেছি। এনাজ যখন সিবিআই অফিসারের পদে ছিলো তখন বহু আগে একবার আমাকে জানে বাঁচিয়ে ছিলো।তার কৃতজ্ঞতা বোধে আমি ওকে নিজের ছেলে করে রেখেছি।

আমি উনার কথার মাথামন্ডু কিছুই বুঝলাম না।আঙ্কেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই তায়াং ভাইয়া থমথমে গলায় বললো।

তায়াংঃ নোভা একটু ঐদিকে আয়।তোর সাথে কথা ছিলো।

আমিঃ আঙ্কেল, আমি একটু আসছি।

মুরাদঃ আচ্ছা যাও।

তায়াং ভাইয়া ও আমি বাগানের অন্য পাশটায় চলে এলাম।তায়াং ভাইয়ার মুখে রাগ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কি কারণে তা খুজে পেলাম না।

আমিঃ কি হয়েছে তোর?এখানে নিয়ে এলি যে।

তায়াংঃ তুই সিউর এই মেয়েটাই সেদিন এনাজকে জড়িয়ে ধরেছিলো।

আমিঃ হ্যাঁ রে।এখন আমার নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝি।

তায়াংঃ তুই দুই লাইন নয় চার লাইন বেশি বুঝিস শাঁকচুন্নি। ইচ্ছে করছে তোর চুল ছিড়তে।

আমিঃ কেন আমি কি করলাম আবার?(অবাক হয়ে)

তায়াংঃ তোর এই দুই লাইন বেশি বোঝার কারণে আমি গতকাল সন্ধ্যায় তাজের গলা টিপে ধরছিলাম।

আমিঃ কি বলছিস তুই? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যদি ওর কিছু হয়ে যেতো?আর ওকে তুই পাইলি কোথায়?

তায়াংঃ গতকাল সন্ধ্যার আগে তাজের অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম।তখন ওর পিয়নকে দেখতে পাই।কি মনে করে পিয়নের কাছে তাজের কথা জিজ্ঞেস করলাম।সে বললো তাজ এখনো অফিসেই আছে।তখুনি মেজাজ বিগড়ে গেলো।রাগ নিয়ে তাজের অফিসে ঢুকে গেলাম।কিন্তু লিফটের কাছে এসে দেখলাম লিফট ওপর থেকে নিচে নামছে।আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো তাজাই নিচে নামছে।হলোও তাই।লিফট খুলতেই দেখলাম তাজ দাঁড়িয়ে। দিকপাশ না তাকিয়ে ওর গলা চেপে ধরলাম।ও প্রথমে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে আমাকে দেখে থেমে গেল।নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে।ইচ্ছে করছিলো ওকে শেষ করে দিতে।কিন্তু জানে জিগার দোস্ত তো। তাই কখনো সম্ভব নয় ওর ক্ষতি করা।ওর ওপর খুব রাগ হয়েছিলো জানিস।ও আমায় শক্ত করে কেন জড়িয়ে ধরেনি তার জন্য। আগে কখনও ওর গলা চেপে ধরলে হাত ছাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতো।ওর গলার থেকে হাত সরিয়ে দ্রুত বের হয়ে গিয়েছিলাম।আমার চোখ পানিতে টলমল করছিলো।ওর সামনে থাকলে কান্না করে দিতাম।ও পেছন থেকে অনেক ডেকেছে কিন্তু আমি পিছু ফিরে দেখিনি।

আমিঃ ওরে পাঠারে😤!!! হারামজাদা, আমাকে আবার বিধবা বানানোর ব্যবস্থা করছিলি তুই। আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।

তায়াংঃ আমার রাগ উঠছিলো তো আমি কি করবো?একে তোকে ও কষ্ট দিচ্ছিলো।দুইয়ে আমার সাথে কোন যোগাযোগ কেন করেনি?এই ছিলো ওর বন্ধুত্ব।

আমিঃ তোরে আমার ফ্রাই করতে মন চাইতাছে পাঠা।আমার জামাই মারার ষড়যন্ত্র করছিলি তুই।

তায়াংঃ ঝগড়া পরেও করতো পারবি।যে কাজে এসেছি সেই কাজ আগে করি।এনাজ কি করে বাচলো সেটা আমাদের জানার দরকার।

আমিঃ হুম চল।

আমি ও তায়াং ভাইয়া দুজনেই আবার মুরাদ আঙ্কেলের কাছে চলে এলাম।ছোট টেবিলটায় বাহারী খাবারের সমহার।মুসকান ভেতর থেকে ট্রে ভর্তি করে নানাকিছু নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রেখে যাচ্ছে।আরিয়ান বা তাজ কেউ বাসায় নেই।দুজনেই অফিসে। আমি আজ অফিসে যাইনি।সকালপর শো শেষ করে সোজা তায়াং ভাইয়ার সাথে এখানে চলে এসেছি।আমার পরনে আজ ফুল ব্লাক ড্রেস।সাদা পরে আসলে আমি নির্ঘাত আজ বিপদে পরতাম।মাঝে মাঝে কালো ড্রেস পরি বলে হিমি বা এরিন কারো কাছে জবাবদিহি দিতে হয়নি।

মুরাদঃ খাবার নেও তোমরা।

তায়াংঃ আঙ্কেল, আপনি ব্যস্ত হবেন না।আপনি বরং আমাদের সবকিছু খুলে বলুন।এনাজকে কি করে পেলেন?আর তারপর কি হয়েছিলো।

আমিঃ হ্যাঁ, আঙ্কেল বলুন আমাদের। কি করে বাচলো আমার স্বামী।

মুরাদ আঙ্কেল বড় করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আমাদের দিকে তাকালো।তার মুখটা থমথমে দেখাচ্ছিলো। কিছু সময় নিরব থাকলেন। তারপর বলতে শুরু করলো।

মুরাদঃ সেদিন ___________

#চলবে