প্রজাপতির রং পর্ব-২১+২২

0
957

#প্রজাপতির_রং🦋
#Part_21+22
#Writer_NOVA

বিস্ফোরিত চোখে আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী ঘুরছে।এমন কিছুও যে আমাকে দেখতে হবে তা জীবনেও কল্পনা করিনি।তাজকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে একটা নারীর অবয়ব।চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।সামনের দেয়াল ধরে নিজের ব্যলেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করছি।তারা দুজন আমাকে দেখার আগেই দৌড়ে দরজার সামনে থেকে চলে এলাম।নিজের ডেস্কে এসে দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম।কার জন্য আমি পাগলামি করি?সে তো অন্য কাউকে নিয়ে ভালোই আছে।

আমিঃ এর জন্য আড়াই বছর আমার খোঁজ নেওয়ার কোন প্রয়োজন মনে করোনি।তোমার তো আমাকে কোন দরকার নেই। আমিই শুধু শুধু পাগলামি করলাম তোমার জন্য। সেদিন তো পারলে আমায় সবকিছু খুলে বলতে পারতে।তাও করোনি।চেহারার বদলের সাথে সাথে আমার মানুষটারও যে বদল হয়ে গেছে তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি।নতুন কাউকে নিয়ে তো ভালোই ছিলে তাহলে কেন আমার জীবনে আবার ফিরে এলে।আমি তো তোমার স্মৃতি নিয়ে ভালোই ছিলাম।কেন সবকিছু এলোমেলো করে দিলে, কেন? আমি তোমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবো না এনাজ।কিছুতেই না।আমি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।এবার আমার খোঁজ কেউ পাবে না।সত্যি আমি ছেলে নিয়ে সবার চোখের আড়ালে চলে যাবো।তুমি থাকো তোমার মতো সবাইকে নিয়ে ভালো।আমার কি তাতে?

নিজের মনে কথাগুলো বলতে বলতে ডেস্কের ওপর মাথা রেখে কান্না করতে লাগলাম।হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে গেলাম।জলদী করে চোখের পানি মুছে মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে পেছনে তাকালাম।তাকিয়ে দেখি আদর আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।

আমিঃ কিছু বলবেন মিস্টার আদর?

আদরঃ কি হয়েছে আপনার ম্যাম?

আমিঃ কই কিছু না তো।আমার আবার কি হবে? আমি একদম ঠিক আছি।

আদরঃ মিথ্যে কেন বলছেন ম্যাম? আমি আপনার কান্নার আওয়াজ শুনেই এখানে এসেছি। কি হয়েছে বলুন না?

আমিঃ আমার কিছু হয়নি।দেখুন এই যে আমি হাসছি।

আদরঃ এটা তো মিথ্যে হাসি।আমাকে ভাই মনে করে বলতে পারেন।আপনার কি এখানে চাকরী করতে কষ্ট হচ্ছে? কিংবা এই অফিসের কোন কর্মচারী আপনাকে কিছু বলেছে? অথবা কেউ কোন অসভ্যতামী,বাজে বিহেভ করেছে? যদি এমনটা হয় তাহলে তার নামটা বলুন।আমি তার কি অবস্থা করি তা আপনি দেখেন।(কঠিন গলায়)

আমিঃ আপনি বলছেন তাতেই আমি খুশি হয়েছি ভাই।কারো সাহস নেই আমাকে কিছু বলার।কারণ আমি তার উচিত জবাব দিতে জানি।আর যেখানে আপনার মতো একটা ভাই আছে সেখানে কেউ কি আমাকে কিছু বলতে পারে বলুন।

আদরঃ ভাই, বলে যখন ডেকেছেন তাহলে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে দিন।কি হয়েছে বলুন ম্যাম?

আমিঃ আপনি আমায় বারবার ম্যাম বলে লজ্জা কেন দিন বলুন তো? আমি বয়সে আপনার থেকে ছোট। তারমধ্যে কাজের ক্ষেত্রেও আপনার জুনিয়র। কিন্তু আপনি ম্যাম ডেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিন।আমাকে নাম ধরে ডাকলে খুশী হবো।

আদর মুচকি হেসে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো।

আদরঃ হ্যাঁ,আপনি আমার বয়সে ও কর্মক্ষেত্রে জুনিয়র। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে আপনি আমার বড়।আপনাকে যদি আমি নাম ধরে ডাকি তাহলে হয়তো আপনাকে আমার অসম্মান করা হবে না ঠিক।কিন্তু অন্য কাউকে যে অসম্মান করা হবে।আর আমি তাকে কখনোই অসম্মান করতে চাই না।

আমি চোখ,মুখ কুঁচকে আদরের দিকে তাকালাম।আদর কি জানে তাজ আমার হাসবেন্ড এনাজ? নয়তো এসব কথা কেন বললো? আমার মনে হচ্ছে আদর জানে।কিন্তু আন্দাজে ঢিল মেরে তো লাভ নেই।
আমি চোখ দুটো ছোট ছোট করে আদরকে জিজ্ঞেস করলাম।

আমিঃ কাকে অসম্মান করতে চাইছেন না?

আদরঃ ম্যাম,থাকুক ওসব কথা। পরে একদিন খুলে বলবো।আপনার কি হয়েছে তাই বলেন?

আমিঃ কথা ঘুরিয়ে ফেললেন।আচ্ছা, বলতে যখন চাইছেন না জোর করবো না। আপনি কি আমার একটা উপকার করতে পারবেন আদর?

আদরঃ কি উপকার ম্যাম? আপনি শুধু হুকুম করুন বান্দা হাজির আছে আপনার সেবায়।

আমিঃ আমার না অনেক খারাপ লাগছে।আমি কি আজ বাসায় চলে যেতে পারি।আপনাকে বললাম,আপনি না হয় আপনার স্যারকে বলে দিবেন।

আদরঃ কি হয়েছে ম্যাম? আপনার কি শরীর খারাপ? স্যার কে ডাকবো?(ব্যস্ত হয়ে)

আমিঃ না না তেমন কিছু নয়।আপনি ব্যস্ত হয়েন না।আমার এমনি ভালো লাগছে না তাই বাসায় চলে যেতে চাইছি।

আদরঃ কিন্তু ম্যাম,স্যারের অনুমতি ছাড়া কেউ তো ওয়ার্ক টাইমে বাসায় যেতে পারে না। আপনি স্যারের থেকে অনুমতি নিবেন প্লিজ। আমি আপনাকে অনুমতি দিতে পারবো না। আই এম এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম।

আমিঃ আপনি একটু ম্যানেজ করে নিয়েন ভাই। আমি আজ এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারাই যাবো।আর আপনার স্যারের মুখোমুখি আমি হতে চাইছি না।

আদর কিছু সময় চুপ করে কি জানি ভাবলো।বেচারাও পরে গেছে বিপাকে।তাজ এক সপ্তাহ পর আজই অফিসে এসেছে। আজই কোন ঝামেলা হোক তা আদর চাইছে না,তা আমি বুঝতে পারছি। অপরদিকে আমাকে বলেছে যে কোন সাহায্য করবে।কিছু সময় ভেবে বললো।

আদরঃ আচ্ছা ম্যাম,আপনি যান।আমি সবকিছু সামলে নিবো।

আমিঃ অনেক অনেক শুকরিয়া ভাই।

আদরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি একমিনিটও দেরী করলাম না।দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে লিফটে উঠে গেলাম।লিফটে উঠে দেখি তখনকার ঐ মেয়েটা।যে তাজকে জড়িয়ে ধরেছিলো।দেখে ভদ্রই মনে হচ্ছে। পরনেও ভদ্র মেয়েদের পোশাক।খুব মনোযোগ সহকারে মোবাইল কিছু একটা দেখছে।যার কারণে পাশে কে আছে সেদিকে নজর নেই।আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।

🦋🦋🦋

প্রায় আধ ঘন্টা ধরে আমি থম মেরে বসে আছি। কখন থেকে তায়াং ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কি হয়েছে আমাকে বল, কিন্তু আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না। একসময় তায়াং ভাইয়া আমার দুই বাহু ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে বললো।

তায়াংঃ ঐ নোভা কি হয়েছে তোর? তুই এমন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে আমাকে বলবি তো? কি সমস্যা?

আমি তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলে আবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।মানুষটা আমার জন্য পাগল হয়ে যায়।সবসময় আমাকে ছায়ার মতো আগলে রাখে।অফিস থেকে বেরিয়ে সবার প্রথমে আমি ওকে কল করে এখানে আসতে বলেছি।আমার বলতে দেরী কিন্তু ওর আসতে দেরী হয়নি।হুট করে আমি তায়াং ভাইয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।এতে তায়াং ভাইয়া আরো বেশি অবাক হলো।

তায়াংঃ কি হয়েছে তোর? আমায় বলবি না বোইন।

আমিঃ হুম।

তায়াংঃ তাহলে বল কি হয়েছে?

আমিঃ (নিশ্চুপ)

বরফও যেমন উষ্ণ ছোঁয়া পেলে গলে যায়।তেমনি আমি সারা পৃথিবীর কাছে কঠিন থাকলেও এই মানুষটার কাছে গলে যায়। এই ভাইটা যে আমাকে আমার নিজের থেকে ভালো বোঝে।তায়াং ভাইয়া আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।হয়তো আমাকে কাঁদতে দিলো।কান্না করলে মন হালকা হয় তাই হয়তো আজ কান্না করতে মানা করেনি।কিছু সময় পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হলাম।তায়াং ভাইয়াকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালাম। তায়াং ভাইয়া আমার হাত ধরে সামনের বেঞ্চে নিয়ে বসালো।তারপর তার এক হাত আমার গালে আলতো করে রেখে বললো।

তায়াংঃ এবার বল কি হয়েছে?

আমি এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আমাকে আশ্বস্ত করে তায়াং ভাইয়া বললো।

তায়াংঃ আমাকে বল না রে শাঁকচুন্নি কি হয়েছে তোর? আমি সব ঠিক করে দিবো।

আমি চোখ মুছে তখনকার ঘটনা খুলে বলতে লাগলাম।

ফ্লাশব্যাক………..

অফিসে এসেই শুনতে পেলাম আজ অফিসে তাজ এসেছে। ওর ইংল্যান্ডের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ শেষ। আমি তাতে খুশি বা বেজার কোনটাই হলাম না।তবে সাবধান হয়ে গেলাম এর থেকে আমাকে এখন থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।এর সামনেও আমি যেতে চাই না।ডেস্কে বসে ফাইল উল্টেপাল্টে দেখছিলাম।সামনের সপ্তাহে কতগুলো বিদেশি ক্লায়েন্ট আসবে তাদের প্রোডাক্ট নিতে।সেগুলোর চেক দিচ্ছিলাম।হঠাৎ আমার এক কলিগ এসে বললো।

—- মিসেস নোভা, আপনাকে তাজরান স্যার ডাকছে।ফাইলগুলো সে একবার চেক দিবে।বুঝতেই তো পারছেন বিদেশি ক্লায়েন্টের বিষয়। কোন ভুল স্যার করতে চাইছে না।

আমিঃ আপনি কি একটু নিয়ে যেতে পারবেন?

—- আপনাকেই যেতে হবে নোভা।আপনার ফাইল আমি নিয়ে গেলে স্যার চটে যেতে পারে। তাছাড়া কোথাও ভুল হলে সেটাও তো শুধরে দিবে।সেটা সরাসরি আপনাকে দিলেই ভালো হবে।এতে আপনি আপনার ভুলগুলো বুঝতে পারবেন।পরবর্তীতে আর এরকম ভুল করবেন না।প্লিজ, কিছু মনে করবেন না।স্যার যেহেতু আপনাকে যেতে বলেছে সেহেতু আপনাকেই যেতে হবে।

আমিঃ ওহ্ আচ্ছা। শুকরিয়া বুঝিয়ে বলার জন্য।

— আপনাকেও।

আমার কলিগ চলে গেলো।আমি ফাইলগুলো গুছিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। একবার ভাবি যাবো,আরেকবার ভাবি এর সামনে ভুলেও যাবো না। অবশেষে মনকে রাজি করিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম।বাইরে আসতেই ঝড়ের গতিতে কেউ একজন দৌড়ে যেতে নিলে তার সাথে ধাক্কা খেয়ে ফাইলগুলো পরে যায়।সামনে তাকিয়ে দেখি ২২ বা ২৩ বছরের একটা যুবতী মেয়ে। আমার দিকে না তাকিয়েই ফাইল তুলতে বসে পরে।

—- আই এম সো সরি।আমি আসলে খেয়াল করিনি। প্লিজ কিছু মনে করেন না।

কথাগুলো বলতে বলতে তাড়াহুড়ো করে ফাইল তুলতে লাগলো।তারপর ফাইলগুলো আমার হাতে দিয়ে আবার সামনের দিকে দৌড় দিলে।অথচ সে আমার দিকে একটুও তাকায়নি।মনে হচ্ছে খুব তাড়ার মধ্যে আছে। আমি তার কান্ডে মুচকি হাসলাম।তারপর ধীর পায়ে তাজের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই চমকে উঠলাম।ঐ মেয়েটা তাজকে জড়িয়ে ধরে আছে।তাজের এক হাত ওর মাথায়।তারপরের ঘটনা তো জানাই আছে সবার।

ফ্লাশব্যাক এন্ড…………..

🦋🦋🦋

আমার কথা শুনে তায়াং ভাইয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।হাত মুঠ করে সে রাগ কন্ট্রোল করছে।কপালের রগ ফুলে উঠেছে। আমি ওর হাতের ওপর হাত রেখে বললাম।

আমিঃ শান্ত হো ভাই।তুই এত রাগছিস কেন?

তায়াংঃ ওর এতবড় সাহস কি করে হতে পারে?ওর বউ থাকতে অন্য মেয়ের সাথে কিসের এতো ঢলাঢলি?তুই এর জন্য কাঁদছিলি। তোর চোখ দিয়ে গত আড়াই বছর ধরে শুধু পানি ঝড়াচ্ছে।আর আমি রাগবো না। ওকে আমি ছাড়বো না। জিন্দা কবর দিবো।ওর সমস্যা কি?

আমিঃ আমিও জানি না। ওর ফ্যামেলীর খোঁজ নিয়েছিস?

তায়াংঃ হুম।

আমিঃ আমার দিকে তাকা।তুই এখন না রেগে ওর বায়োডাটা বলতো আমায়।

তায়াংঃ আমার এখন বলার মুড নেই।

আমিঃ প্লিজ ভাই বল না রে।

তায়াংঃ হু বলছি।

তায়াং ভাইয়া নিজেকে কিছুটা ঠান্ডা করে আমার দিকে ঘুরলো।ওর চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। এখন তাজকে সামনে পেলে যে দু-চার ঘা উত্তমমধ্যম দিতো তা আমি জানি।

তায়াংঃ তাজই এনাজ।কারণ এই তাজের নাকি বছর দুই আগে একটা বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে।ওদের ফ্যামেলীতে যারা আছে তারা এক বছর আগে এই নতুন বাসায় উঠেছে। তাদের আগের বাসা কোথায় তা কেউ বলতে পারে না। আশেপাশের লোকের থেকেও কোন খবর নিতে পারিনি।তবুও অনেক কষ্টে তাজের পালিত বাবার এক বন্ধুর খবর জোগাড় করেছিলাম।সে প্রথমে তাজের বিষয় মুখ খুলতে চায়নি।পরবর্তীতে অনেক কষ্টে তার মুখ খুলতে পেরেছি। সে জানালো তাজ নাকি মুরাদ সাহেবের ছেলে নয়।আড়াই বছর আগে তাজকে পেয়েছে। তারপর ওর চিকিৎসা করিয়ে নিজের ছেলের পরিচয়ে তার সাথেই রেখে দিয়েছে। তাজ যে তার ছেলে নয় সেটা জেনো কেউ জানতে না পারে তার জন্য বাসাও পাল্টে ফেলেছেন।

আমিঃ কিন্তু কেন? একটা অচেনা, অজানা ছেলের জন্য এতকিছু তারা কেন করবে? কোনভাবে ঐ মুরাদ সাহেব কোন স্বার্থের কারণে তাজকে ব্যবহার করছে না তো। আমার কিন্তু বিষয়টা গন্ডগোল মনে হচ্ছে।

আমার কথা শুনে তায়াং ভাইয়া কপাল কুঁচকে আমাকে বললো।

তায়াংঃ কথাটা তো মন্দ বলিস নি।আমি তো এমন করে ভেবে দেখিনি।

আমিঃ দেখ ভাইয়া, আমার মনে হচ্ছে এনাজ নিশ্চয়ই বড় কোন বিপদে আছে।নয়তো কেউ ওকে কোন স্বার্থ ছাড়া কেন নিজের ছেলে পরিচয়ে বড় করবে? যদি মুরাদ সাহেব স্বার্থ ছাড়াও ওকে নিজের ছেলে পরিচয়ে রাখে তাহলে এনাজ কেন এতদিন আমাদের কাছে ধরা দেয়নি? এটাও কিন্তু ভাবার কথা।

তায়াংঃ আচ্ছা চল , আমরা আগামীকাল ঐ বাসায় যাই।যদি তোর কথা তাজ ওর বাসার সবাইকে বলে তাহলে তারা তোকে চিনে ফেলবে।যদি কোনভাবে কোন ক্লু পেয়ে যাই তাজ কেন এতদিন আমাদের সামনে আসেনি।কিংবা ও কোন বিপদে আছে কিনা।

আমিঃ হুম তাই চল।কাল তোর সময় হবে?

তায়াংঃ তোর কাজের জন্য আমি সবসময় ফ্রী। যদিও একটু কাজ আছে। তবে সমস্যা নেই। পরে করে নিবো।

আমিঃ বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হবো।মাথা ঘুরাচ্ছে।চল আমাকে দিয়ে আয়।

তায়াংঃ আচ্ছা চল।

প্রথমে এনাজের ওপর ক্ষোভ থাকলেও এখন সেটা নেই।কেন জানি মনে হচ্ছে এনাজ হয়তো কোন সমস্যায় আছে।নয়তো আমার কাছ থেকে এতদূরে তো সে কখনোই থাকবে না। আর মেয়েটাই বা কে হতে পারে। সেই তথ্য খুঁজতে এখন আমাকে তাজের বাসায় যেতেই হবে।তায়াং ভাইয়া প্রথমে রাগলেও এখন পুরো স্বাভাবিক আছে। ভাইয়ার বাইকে উঠতেই সে স্টার্ট দিলো।

🦋🦋🦋

বাসার কোলিংবেল বাজাতেই পাশের বাসার এক চাচী এসে দরজা খুলে দিলো।তার হাত ধরে নাভানও এসেছে।আমাকে দেখে নাভান ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলাম।চাচীকে আমাদের বাসায় দেখে বেশ অবাক হলাম।হিমিও ততক্ষণে আমার সামনে চলে এসেছে।

হিমিঃ এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসলি যে?

আমিঃ ভালো লাগছিলো না।তাই চলে এলাম।

হিমিঃ ওহ্।ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি কিচেনে একটু আয়।আমি একা এতকিছু সামলাতে পারবো না। কতকিছু রান্না বাকি আছে এখনো।আমি একটু পর তোকে এমনিও কল করতাম।

আমিঃ কেন?বাসায় কি কেউ এসেছে? ছেলেদের জুতা দেখলাম বাইরে? এই সময়ে কে এসেছে? চাচীও আমাদের বাসায়।ঘটনা কি?

নাভানঃ এট্টা(একটা) আন্কেল এসছে।

আমিঃ কোন আঙ্কেল বাবা?

নাভানঃ আমি চিনি না।

আমিঃ ওহ্।তুমি তাকে কখনো দেখছো?

নাভানঃ না দেখি নাই।

আমিঃ ওহ্।

নাভানঃ জানো আম্মু,আমাল (আমার) জন্য এত্তগুলা তকলেট(চকলেট) আনছে আন্কেলটা।আমরে অনেক আদর করছে।

নাভানের কথা শুনে আমি হিমির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

হিমিঃ এরিন কোন একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছে। আমি তাকে চিনি না। চাচীকে আমিই ডেকেছিলাম।পোলাও রান্নায় পানির পরিমাণটা আমি বুঝি না।তাই তাকে ডেকে আনলাম।মেহমান এসেছে তার জন্য তো ব্যবস্থা করতেই হয়।তুই যখন এসে পড়েছিস তাহলে আর কোন চিন্তা নেই।

আমিঃ ওহ আচ্ছা।

আমি চোখ, মুখ কুঁচকে ফেললাম।এরিন আবার কোন ছেলেকে বাসায় এনেছে। কোনভাবে সেটা রোশান তো নয়।রোশানকে তো হিমি চিনে না। যেদিন রোশান আমাদের বাসায় এসেছিলো সেদিন হিমি ঘুম থেকে উঠার আগেই রোশান চলে গিয়েছিল।যার কারণে রোশানকে হিমি দেখেনি।আমি জুতা জোড়া দরজার পাশে রেখে নাভানকে নিয়েই ভেতরে ঢুকলাম। নাভান শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।হিমি আর চাচী কিচেনে চলে গেল।

আমিঃ আমার নাভান সোনা কি ঠিকমতো খাবার খেয়েছে?

নাভানঃ হুম।

আমিঃ খালামণিদের কে জ্বালাওনি তো আজকে?

নাভান এক চোখ বন্ধ করে ডান হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে এক চিমটি পরিমাণ দেখিয়ে বললো।

নাভানঃ এট্টু জ্বালাইছি।

ওর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে আমি হেসে উঠলাম।একদম বাপের মতো কান্ড করে। এর হাসি দেখলেই আমার সারাদিনের ক্লান্তি শেষ। এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব ভুলে যাই। মাঝে মাঝে রাগের বশে একে মারলেও পরে কলিজা ছিঁড়ে যায়।তারপর জড়িয়ে ধরে যখন কান্না করি,তখন বড় মানুষের মতো ছোট ছোট হাত দুটো বাড়িয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, “আম্মু কাঁদে না”। তখন কেন জানি নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়। আমার ছেলে তো আমাকে বুঝে।ও থাকলেই হবে আমার।আর কাউকে লাগবে না।

নাভানঃ আম্মু তকলেট খাইবা?আমাল অনেক গুলো তকলেট আছে।তোমাকে দিবোনি হে।

আমিঃ আচ্ছা বাবা।গোসল করছো?

নাভানঃ না।

আমিঃ আমরা এখন গোসল করবো তাহলে।বলো ওকে। ওকে বলো।

নাভানঃ না।

আমিঃ ছি: বাবাই।গোসল না করলে তো সবাই তোমাকে পঁচা ছেলে বলবে।সবাই কি বলবে জানো?

নাভানঃ কি?

আমিঃ সবাই বলবে নাভান নোংরা ছেলে। ঠিকমতো গোসল করে না।গোসল শেষ হলেও তো বাথটাব থেকে উঠতে চাও না।আর এখন গোসল করতে মানা করো কে? চলো, চলো, আমরা জলদী জলদী করে গোসল করে আসি।তোমাকে গোসল করিয়ে আম্মু কিচেনে যাবে কাজ করতে।ততক্ষণ তুমি গুড বয়ের মতো করে থেকো।নয়তো ঐ আংকেলটা তোমাকে কি বলবো জানো? বলবে নাভান বেড বয়।তোমার সাথে আর কথা বলবে না। তোমার জন্য চকেলটও আনবে না।পাশের বাসার নীরবের জন্য আনবে।কিন্তু তোমাকে দিবে না। তখন কি ভালো হবে বলো।

নাভানঃ না আমাকে দিবে।

আমিঃ তাহলে তো তাড়াতাড়ি গোসল করতে হবে।গোসল করে আমার বাবা সুন্দর প্যান্ট-শার্ট পরবে।তাহলে সবাই আমার বাবাইকে ভালো বলবে।ইয়েহ,কি মজা!!! গোসল করলে কেউ আমার বাবাইকে বেড বয় বলতে পারবে না। চলো হাইফাইভ করি।হাত দেও জলদী করে।

নাভান হাসিমুখে ওর ছোট হাত বাড়িয়ে দিলো।আমি ওর হাতের সাথে আমার হাত মিলিয়ে দিলাম।এতে সে আরো খুশি হয়ে আমার গালে চুমু খেলো।

আমিঃ আমার বাবা এখন গোসল করবে তাই না?

নাভানঃ হুম।নাভান গুসুল করবে।

আমিঃ ওকে চলো তাহলে।

নাভানঃ ওকে।

নাভানের সাথে সোফায় বসে একদফা কথা বলেলাম।আজকাল ছেলেটাকে সময়ই দিতে পারি না। সোফা থেকে উঠে নিজের রুমে যাওয়ার আগেই অপর রুম থেকে এরিনের ডাক আসলো।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সেদিকে পা বাড়ালাম।

এরিনঃ নোভা এদিকে আয়।দেখে যা কে এসেছে?

আমি ধীর পায়ে পর্দা সরিয়ে রুমে ঢুকলাম। এরিন খুশি মনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো।

এরিনঃ দেখ কে এসেছে?

আমিঃ কে?

এরিন সামনে থেকে সরতেই আমি সেই মানুষটাকে দেখতে পারলাম।তাকে দেখেই আমি অবাক।সেও যে আমাকে দেখে অবাক হয়েছে তা তার চোখ, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এ এখানে কি করছে???

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে