Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1080



চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০৬

0

#চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৬
Sadia afrin nishi
_________________

পাঁচ তলা বিশিষ্ট ফ্লাটের চর্তুথ ফ্লোরের সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে নীল আর সোহা। অপেক্ষা দরজা খোলার। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই এক সুন্দরী রমনী এসে দরজা খুলে দিল। অধরে তার মধুর হাসি। নীলকে দেখে সে হাসি আরও প্রগাঢ় হলো। হাসিমুখ অব্যাহত রেখেই সে বলল,

“হোয়াট এ গ্রেট সারপ্রাইজ? আসবি বলিস নি তো। তোর এই হঠাৎ আগমনে আই রিয়েলি সারপ্রাইজড। আয় ভেতরে আয়।”

নীলও মেয়েটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসল। ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

“ইফাজ কই? বাড়িতে নেই?”

মেয়েটির কপালে ভাঁজ পরল কয়েকটি। হতাশ কন্ঠে বলল,

“তোর বন্ধুর তো শুধু কাজ আর কাজ। সারাদিন কাজ নিয়েই পরে থাকে।”

নীল মেয়েটির গালে আলতো করে চড় মা’রা’র মতো করে বলল,

“ডোন্ট ওয়ারি বেইবি। টেনশন নিস না। দেখবি তোর মতো আর একটা বেবি হলে তখন আর একা ফিল হবে না। দু’জনে মিলে সারাক্ষণ বউ-পুতুল খেলবি। আর রাতে যখন ইফাজ বাড়ি ফিরবে তখন ওকে তোদের মিছিমিছি রান্না করা খাবারগুলো খেতে দিবি।”

কথা শেষ করেই নীল দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল। আর মেয়েটি রেগে গিয়ে নীলের পিঠে কয়েকটা কিল ঘুষি মে’রে দিল। সোহা নিরব দর্শকের মতো উপভোগ করছে সবটা। বেশি উপভোগ করছে নীলকে। নীলের প্রাণোচ্ছলতা তাকে ভীষণ মুগ্ধ করছে। এমন প্রাণোচ্ছল নীলকে সচরাচর দেখা যায় না। ওদের বন্ধুক্তের খুনসুটি শেষ হতেই মেয়েটির নজর পরল সোহার ওপর। সে সোহাকে ইঙ্গিত করে নীলের উদ্দেশ্য বলল,

“এই কী সে নাকি?”

নীল এক পলক দেখল সোহাকে অতঃপর মাথা চুলকে বলল,

“হুম”

মেয়েটি সোহার কাছে গিয়ে তার গাল স্পর্শ করে বলল,

“ভেরি প্রীটি। তবে ভীষণ পিচ্চি।”

নীল কিঞ্চিৎ হাসল। লজ্জামাখা হাসি। ছেলেদেরও লজ্জা পেতে আছে বুঝি? সোহাও হাসল তবে সীমিত।

___

আড্ডা বসল পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে। ইতোমধ্যে নীলের আরও চারজন ফ্রেন্ড এসে হাজির হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মেয়ে বাকি তিনজন ছেলে।নীলের এই নতুন আগমনকৃত ফ্রেন্ডদের মধ্যে ছেলে তিনজন বেশ ভালোই তবে মেয়েটা একটু কেমন জানি। মেয়েটার পরনে মিনি স্কার্ট। সাজগোজও একটু ওভার স্মার্ট। মেয়েটি এসেই নীলকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিল সোহাকে ঘিরে। কথাগুলো ঠিক এমন, এই পিচ্চির জন্য দিওয়ানা তুই? কী আছে ওর মাঝে যা আমার মধ্যে নেই? ওর থেকে আমি কোনো অংশে কম নই তবে কেন তুই ওকে পাবার জন্য এতটা ডেস্পারেট?” এসব কথা বলার কারণ বার করতে পারল না সোহা। সে চুপচাপ মুখ বুজে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে নীলের অগ্নিদৃষ্টিতে মুখে লাগাম পড়ল মেয়েটির।

সবার কথার ধরনে সোহা বুঝতে পারল যার বাসায় তারা এসেছে তার নাম লিসা এবং তার বরের নাম ইফাজ। আর পরবর্তীতে যে চারজন এসেছে তাদের মধ্যে মেয়েটির নাম জেসি। ছেলে তিনটির নাম ইমন, আসিফ, অনিল। এরা সকলেই নীলের কলেজ ফ্রেন্ড। বন্ধুক্ত চলমান সময়েই লিসা আর ইফাজ রিলেশন করে বিয়ে করে নিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এটুকুই বুঝল সোহা।

আড্ডার মাঝ পথেই ইফাজ চলে এলো। ইফাজ আসাতে যেন আড্ডা টা আরও মেতে উঠেছে। ছেলেটা বেশ মজাদার। এসে থেকেই তার প্রেয়সীর অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত সে। এই ব্যাপারটা সোহার ভীষণ ভালো লেগেছে। সোহা ওদের থেকে বয়সে অনেক ছোট তাই সে তেমন একটা কথা বলছে না। বেশ আন-কমফোর্টেবল ফিল হচ্ছে তার। আবার এসেছে স্কুল ড্রেস পড়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। দু পাশে দুই বিনুনি। সব মিলিয়ে পিচ্চি পিচ্চিই লাগছে তাকে। আড্ডাটা যখন বেশ জমে উঠেছে ঠিক তখনই সকলে নীলকে চেপে ধরল একটা গান গাওয়ার জন্য। নীল প্রথমে না করলেও কিছু একটা ভেবে রাজি হয়ে গেল। ইফাজ গিটার তুলে দিল নীলের হাতে। টুংটাং গিটারে সুর উঠছে সেই সাথে গান……….

“ভালবাসি হয়নি বলা তবু ভালবাসি
পাশাপাশি হয়নি চলা তবু পাশাপাশি

তোমায় নিয়ে ফুলে ফুলে
স্বপ্ন উড়াই আকাশ নীলে

তোমাতে বিভোর থাকি
আমি বারো মাস-ই”

(বাকিটুকু নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নেবেন)

পুরো টা গানই নীল সোহার চোখে চোখ রেখে গাইল। শুরুতে সোহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও পরে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সেও নীলের দৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যায়। ভেসে যায় অজানা অনুভূতির সাগরে।

___

সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে নীল আর সোহা। আজ নীলের মনটা খুশি খুশি লাগছে। সোহা মনে মনে ভাবছে,
আসলেই মানব জাতি বরই অদ্ভুত। যে মানুষটা ফ্যামিলিতে এতটা ঔধ্যত্ব নিয়ে চলে সেই মানুষটাই বন্ধু মহলে কতটা প্রাণোচ্ছল। ফ্রেন্ড সার্কেল এমন একটা জিনিস যেখানে সবকিছু করে ফেলা যায় অনায়াসে। পৃথিবীর সব সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুক্তের সম্পর্কের স্থানীয়ত্ব দীর্ঘকাল। সৎ সঙ্গে যেমন স্বর্গ বাস ঠিক তেমনই অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। নীল সাধারণত একদম গম্ভীর টাইপ ছেলে নয়। ফ্যামিলিতে সে সবার সঙ্গে হেসে খেলে কথা বললেও এতটা ফ্রী নয় যতটা সে তার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে। নীল যখন ওদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল সোহার পিচ্চি মনটা বারংবার সেই হাসিতে ক’ত’ল হচ্ছিল। সোহার এরুপ চিন্তাধারার মাঝেই নীলের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ,

“কেমন লাগল আজকের মুহূর্ত গুলো?”

সোহা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে বেশ বিচক্ষণ মস্তিষ্কে উত্তর দিল,

“ভীষণ ভালো। তবে কিছু কিছু প্রশ্ন অজানা আছে?”

“কী প্রশ্ন বলে ফেল?”

“এই যেমন তোমার ফ্রেন্ড লিসা আপু আর ইফাজ ভাইয়া তাদের কী লাভ ম্যারেজ?”

“হুম । ওরা কলেজ লাইফের শুরু থেকেই রিলেশনে আছে তারপর এই সাত মাস হলো বিয়ের।”

“ওই আপু,ভাইয়া টা ভীষণ ভালো। কিন্তু ওই একটা আপু ছিল না জেসি নামে। কেমন জানি একটা। কী সব অদ্ভুত কথা বলছিল তোমায়। আচ্ছা উনি ওগুলো কেন বলল?”

নীল থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,

“তোকে এসব বুঝতে হবে না। এখন বাকিদের কথা বল।”

“বাকিরাও ভালো ছিল। ইমন ভাইয়াকে বেশি ভালো লেগেছে। তার জোক্স বলার ধরণটা হেব্বি।”

নীল একটু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,

“হুম, সবার কথাই তো বললি এবার আমারটাও বল?”

সোহা উৎফুল্ল হয়ে বলতে চাইল অনেক কিছু। নীলের হাসিমাখা রুপ,তার সুরেলা গানের গলা, তার প্রাণোচ্ছলতা সবকিছুই গভীর ভাবে রেখাপাত করেছে তার মনে। কিন্তু বলতে গিয়েও কিছু কথা রয়ে গেল অজানা। অন্তঃকরণের গরাদে আটকে চাপা পড়ে রইল। সোহা মনের সমস্ত আহ্লাদী চাওয়াকে অগ্রাহ্য করে শুধু বলল,

“তুমি ভীষণ খারাপ, খুব খারাপ। তোমার নামের আমার কাছে একটাই সংজ্ঞা “নিষ্ঠুর”। তুমি ভীষণ রকম নিষ্ঠুর। ভীষণ রকম।”

সোহা থামল। নীল অবাক হলো। পথ চলতে চলতে তার ফের প্রশ্ন,

“কেন কী করেছি আমি? যার জন্য এতটা কঠিন অপবাদ নিতে হচ্ছে?”

সোহা কিছুটা দমে গেল। নিভু নিভু কন্ঠে বলল,

“ঠিক বুঝবে একদিন। কিন্তু সেদিন আর আমি থাকব না হারিয়ে যাব বহু দুরে।”

স্বজোরে বাইকের ব্রেক কষায় টাল সামলাতে অক্ষম হলো সোহা। এক হাতে খামচে ধরল নীলের শার্টের পেছন দিকটা। চোখ বন্ধ করে নিল। নীলের সেদিকে খেয়াল নেই। রাগে কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে। চোখ মুখ রক্তবর্ণ। তার গম্ভীর কণ্ঠে কেঁপে উঠল সোহা। ভয়টা আরও দ্বিগুণ হলো।

“বাইক থেকে নেমে পড়।”

সোহা চোখ তুলে চাইল। বাড়িতে পৌঁছে গেছে। সে এক মুহুর্ত সময় অতিবাহিত না করে ঝটপট নেমে পড়ল। নীলের মুখের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। নীলের দৃষ্টি সোজাসুজি। ভুলেও সোহার দিকে ফিরছে না। সোহা অনেক কষ্টে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলল,

“আমি কী কিছু ভুল……”

দেখা যাচ্ছে পুরো কথা শেষ করার আগেই নীল বাইকে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। একটানে মিলিয়ে গেছে অদুরে। সোহা দাড়িয়ে দেখল নীলের চলে যাওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইকটি দেখা গেল সে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল সেদিকে। সে কী এমন বলেছে যার জন্য এতটা রেগে যেতে হবে? আশ্চর্য….

চলবে,

চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০৫

0

#চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৫
Sadia afrin nishi
_________________

শুনশান নীরবতা বিরাজমান চারিধারে। বাইক চলছে নিরব গতিতে। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে শুধু নাক টানার আওয়াজ। নীল বাইকের মিররে বারংবার দৃষ্টি ফেলে দেখে নিচ্ছে তার গোলাপরানির মায়াবিনী রুপ। সোহার চোখ, মুখ দিয়ে লাল রক্তের ন্যায় আভা ঝড়ে পরছে। একদম পাকা টমেটো হয়ে আছে তার মুখশ্রী। নীল নিঃশব্দে কিঞ্চিৎ হাসল। তারপর সোজা তাকিয়ে বলল,

“এভাবে কান্না করার কী আছে? কেউ কিছু বলেছে কী?”

সোহা নিশ্চুপ। নীল আবারও সেইম প্রশ্ন করল। সোহা এবারেও নিশ্চুপ। নীলের হঠাৎ ভীষণ রাগ উঠল। স্বজোরে বাইকের ব্রেক কষল। টাল সামলাতে না পেরে সোহা ঝুঁকে পড়ল নীলের কাঁধের ওপর। নীল চটজলদি বাইক থেকে নেমে পরল। সোহাকেও টেনে নামিয়ে একদম তার সম্মুখে দাড় করিয়ে বলল,

“কী সমস্যা তোর? এমন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিস কেন? সেই থেকে দেখছি কেমন অদ্ভুত বিহেভ করছিস। কেউ কিছু বলে থাকলে আমাকে বল আমি দেখছি তার কী করা যায়।”

সোহা এখনো কিছুই বলছে না। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কান্নার গতি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। সোহার নিরবতা নীলকে প্রচন্ড ভাবাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবল, “নাহ, এভাবে হবে না। অন্য ওয়ে তে কথা বের করতে হবে।”

নীল একদম সোহার কাছাকাছি এসে দাড়াল। সোহা পেছতে চাইলে দেখা যাচ্ছে নীল তাকে আরও কাছে টেনে নিল। সোহার অভিমানী মন বুঝতে অক্ষম নীলের হাবভাব। সে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ততক্ষণাৎ নীল তার কোমল,তুলতুলে দু গাল নিজের হাতের তালুর বন্ধনে আবৃত করে নিল। সোহা এবারেও ছাড়াতে চেষ্টা করে বিফল হলো। অতঃপর স্থির রুপ ধারণ করল।

“এমন কেন করছিস গোলাপ রানি? কেউ কী কষ্ট দিয়েছে তোকে? নাকি আমি কোনো ভুল করেছি? বল কী হয়েছে? আই প্রমিস সবটা ঠিক করে দিব। শুধু একবার বল।”

সোহা তেঁতে উঠল। নীলের হাত নিজের মুখ থেকে ঝটকা মে’রে সরিয়ে দিয়ে অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

“তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। ভুল তোমার নয় ভুল হয়েছে আমার। এবার দুরে যাও আমার থেকে। বাড়িতে ফিরে যাব আমি।”

নীল এবার সোহাকে টেনে ধরে এক ঝটকায় নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিল। সোহা সঙ্গে সঙ্গে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। নীলের শার্টের কলার ধরে জোরে টেনে ধরল। তার এই মুহুর্তে নীলকে খু*ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে সেভাবেই কাঁদতে কাঁদতে নীলের বুকে মুখ গুজে দিল। নীল বুঝতে পারছে না কিছুই। সে আলতো হাতে সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“কী হয়েছে বল না প্লিজ?”

সোহা মুখ তুলে চাইল নীলের দিকে। অভিমানে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিল নীলকে অদুরে। অতঃপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

“কেন যাও তুমি আমার স্কুলের সামনে? নিশ্চয়ই সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের দেখতে যাও। সবাই তোমার নামে কত-শত কমেন্ট’স করে সেগুলো শুনতে বেশ মজা পাও তাই না? শার্টের বোতাম খুলে এভাবে নিজেকে শো অফ করতে বেশ লাগে তাই না? তোমার জন্য আমাকে কত কী সহ্য করতে হয় তা কী তুমি জানো?”

“ওহ তাহলে এটাই কারণ। আচ্ছা আমি মেয়েদের দেখতে যাই বা নিজেকে শো অফ করতে যাই তাতে তোর এত কিসে প্রবলেম বলত? তুমি কেন এতটা ডেস্পারেট হচ্ছিস?

সোহা থতমত খেয়ে গেল নীলের প্রশ্নে। নীল কি কিছুই বুঝতে পারছে না। অন্যের মুখে নীলের প্রশংসা শুনাটা যে সোহার ভীষণ অপ্রিয়। রাগে,দুঃখে আচমকা আবারও কাঁদতে শুরু করল সোহা।

নীল পুরোই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সোহা জেলাস তাকে। তার মানে সোহার মনেও তাকে ঘিরে কিছু আছে। নীলের আজ খুশির দিন। ভীষণ খুশির দিন। এবারে আর সে সোহার কান্নায় ব্যাঘাত ঘটালো না। অন্য সময় হলে সোহার কান্নায় তার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আজ ব্যাপারটা ভিন্ন। আজ সোহার চোখের পানি তার অন্তরে চরম প্রশান্তি বয়ে আনছে। এই অশ্রুই তো সে দেখতে চেয়েছিল এতদিন। হঠাৎই অজানা প্রশ্ন তার মাথায় নাড়া দিয়ে গেল৷ সোহাকে আদৌ বুঝতে পারছে সে নীলকে ঘিরে কিছু ফিল করে নাকি খামখাই এমন করছে? থাক এই মুহুর্তে এসব ঘাটবে না নীল। আপাততঃ যেটুকু জেনেছে এতেই সন্তুষ্ট সে। বেশি পাগল হলে শেষে দেখা গেল আম, ছালা দুটোই গেল।

___

বাইক রেখে ফাঁকা রাস্তায় আপন মনে হেঁটে চলেছে নীল আর সোহা। সোহার কান্নার গতি কমে আসলেও মুখটা এখনো গম্ভীর করে আছে। নীল ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে। আজ আলাদা আনন্দে বারংবার নেচে উঠছে নীলের অন্তঃস্তল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সে সোহাকে। সোহার দৃষ্টি একবারও নীলের দিকে ভিড়ছে না। সে তার অভিমান অব্যাহত রাখতে ব্যস্ত।

“গোলাপ রানি”

আচমকা ডাকটি শুনে পাশ ফিরে চাইল সোহা। সে সময়ও নীল একবার তাকে এ নামে ডেকেছিল। তখন অতটা খেয়াল না করলেও এবারে এই ডাকটি তাকে ব্যাপক ভাবাচ্ছে। সোহা ভ্রু সংকুচিত করে বলল,

“কে গোলাপ রানি?”

নীলের সাবলীল উত্তর,

“এখানে তুই ছাড়া নিশ্চয়ই আর কেউ নেই?”

সোহা এদিকে ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখল। সত্যিই তো আর কেউ নেই। পুরো রাস্তাই তো ফাঁকা। সোহা গলা ঝেড়ে বলল,

“তো আমাকে এ নামে ডাকার কী আছে? সোহা নামটা কী বেটার নয়?”

“বেটার তবে আমার ক্ষেত্রে স্পেশাল। তুই যেমন আমায় নীলাদ্রি বলিস ঠিক সেভাবেই আমি তোকে গোলাপ রানি বললাম।”

সোহা ফুঁসে উঠে বলল,

“আমি মোটেই তোমাকে নীলাদ্রি বলি না। আমি তো তোমায় নীলাদ্রি দা বলি।”

“ওই হলো এক।এখন বল আমার দেওয়া নামটা কেমন?”

“ভালোই”

“শুধু ভালোই।”

“উহুম,অনেক সুন্দর।”

নীলের ওষ্ঠে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে আচনকা সোহার এক হাত নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। হতভম্ব সোহা ভীতিগ্রস্ত কন্ঠে শুধাল,

“কী করছ টা কী? এভাবে হাত ধরছ কেন?”

নীল কোনো উত্তর দিল না। সোহার আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে হেঁটে চলেছে দুর নীলিমায়।

হঠাৎই সোহার মনে পড়ল নীলের তো জ্বর ছিল। সোহা থম মে’রে দাঁড়িয়ে পড়ল। নীলের উদ্দেশ্যে বলল,

“তোমার না জ্বর ছিল? এখন কেমন আছে শরীর? জ্বর কী কমেছে? নাকি জ্বর নিয়েই মেয়েদের পেছনে লাইন মা’র’তে চলে এসেছ?”

নীল কিঞ্চিৎ হাসল। যেই হাসিতে ঝড় বয়ে গেল সোহার অন্তরে। অন্তঃকরণে সুক্ষ্ণ অনূভুতির জন্য দিল।

“এতক্ষণে মনে পড়ল বুঝি?”

নীলের কথায় সোহা জিভে কামড় কাটল। অতঃপর বলল,

“ইয়ে মানে আসলে…. ”

“থাক আর কিছু বলতে হবে না। জ্বর কমেছে আমার। শরীরটাও এখন ঠিক আছে।”

“আলহামদুলিল্লাহ”

“গোলাপ রানি একটা জায়গায় যাবি আমার সঙ্গে?”

“কোথায়?”

“গেলেই দেখতে পাবি।”

“কিন্তু এখন তো বাড়িতে ফিরতে হবে নয়তো আম্মা টেনশন করবে।”

“আমি ফুপ্পিকে বলে দিয়েছি তুই আমার সঙ্গে। এখন বল যাবি কিনা?”

সোহা ভাবনায় পড়ে গেল।

চলবে,

চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০৪

0

#চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৪
Sadia afrin nishi
__________________

স্কুলে যাওয়ার আগে সোহা বারকয়েক চুপিচুপি নীলের ঘরে উঁকিঝুঁকি মা’র’ছে। এই দৃশ্য ঠিক দেখে নিয়েছে সূর্য। সূর্য এসে পেছন থেকে সোহার এক পাশের বিনুনি টেনে ধরে বলল,

“কী রে সুয়োরানী এভাবে ভাইয়ের ঘরে উঁকিঝুঁকি মা’র’ছিস কেন?”

সোহা চুলে টান অনুভব করে ‘আহহ’ বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। ঘরের ভেতর থেকে সেই আর্তনাদ কর্ণগোচর হলো নীলের। পরক্ষণেই নীলের কর্কশ কন্ঠে ধমকানি কর্ণগোচর হতেই সেখান থেকে ছুট্টে পালালো সূর্য আর সোহা।

___

বাইকের ওপর আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে নীল।
শার্টের ওপরের তিনটি বোতাম খোলা হওয়ায় বক্ষের আংশিক অংশ দৃশ্যমান। চোখে ব্ল্যাক সানগ্লাস, হাতে ব্রান্ডেড রিলিক্স ওয়াচ, পরনের শার্টটির কালারও ব্ল্যাক। গোলাপি ওষ্ঠজোড়া দিয়ে চেপে ধরে নিকোটিনের ধোঁয়া ওড়াতে ব্যস্ত সে।সিল্কি চুলগুলো বাতাসে খেলা করছে। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে খুব শীঘ্রই তার অপেক্ষার অবসান ঘটবে। সূর্য, জিসান,ইশান সকলেই তার সঙ্গে আছে। ওরা গাড়ি করে এসেছে। নীল একাই বাইকে।গাড়ির ওপরে বসে হাত দিয়ে ড্রাম বাজানোর মতো ভঙ্গিতে আছে সূর্য। হঠাৎই সে জিসানকে শাহাদাত আঙুল দ্বারা খোঁচা মে’রে বলল,

“এতদিন কেন লুকিয়ে গেছ এসব আমার থেকে ভাই। সকালের ওই ঘটনা না দেখলে আমি তো জানতেই পারতাম না এতসব।”

জিসান বিরক্ত হয়ে বলল,

“এসব কী বলার মতো কোনো কথা সূর্য। লুকিয়ে তো যাইনি শুধু চেপে গেছি। এখনো তো তেমন কিছু হয়ইনি তাহলে কী বলতাম তোকে।”

“ভাই এসব কথা তোমাকে নিজে থেকে বলেছে?”

“আরেহ না আমি হাবভাবে বুঝে নিয়েছি। ছোট থেকেই সোহার প্রতি ভাইয়ের কেয়ারনেস আমাকে খুব ভাবাত। দিনে দিনে সেটা আরও গভীর আর দায়সারা হয়ে উঠছিল। তারপর একদিন ভাইকে খুব করে চেপে ধরি। পুরোপুরি স্বীকার না করলেও খুব দক্ষতার দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছে।”

“আমিও তো আজ সকালে ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য। ভাই সোহার আঙুল…… ”

আর কিছু বলতে দিল না জিসান সূর্যকে। সে ইশারায় ইশানের দিকে দেখতে বলল সূর্যকে। ইশান তখন এদিক ওদিক তাকানোতে ব্যস্ত। জিসান আর সূর্য ইশানের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে। জিসান নিজের জায়গা থেকে উঠে ইশানের কাছে গেল। অতঃপর ইশানের পিঠে একটা জোরে চড় বসিয়ে দিয়ে বলতে লাগল,

“কী হয়েছে তোর?এদিক ওদিক কী দেখছিস?”

ইশান নিজের হাত পিঠ বরাবর চেপে ধরে আহত কন্ঠে বলল,

“আহ ভাইয়া আস্তে দেবে তো ভীষণ লেগেছে।”

জিসানের সাবলীল উত্তর,

“লাগার জন্যই তো দিয়েছি। তা বল এভাবে কী দেখছিলি?”

ইশান একটু ভাব ধরতে ধরতে বলে,

“দেখছি আশেপাশে কাউকে পাই কিনা। তাহলে ভাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমারও হিল্লে টা হয়ে যেত আরকি।”

জিসান ইশানের কান টেনে ধরে বলে,

“একদম সূর্যর মতো হচ্ছিস তাই না। তোর হিল্লে এবার আমি করব।”

জিসানের কথায় সূর্য দাঁত কেলিয়ে,
“দেখতে হবে না ভাইটা কার।”

অবশেষে ইশান বলল,

“ভাইয়া কী করছ কী তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও।আমার মান সম্মান দিয়ে তো একদিন টিনের কৌটা বানিয়ে ফুটবল খেলবে দেখছি। কানটা ছেড়ে দাও প্লিজ এখনই সোহার স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। অতঃপর সুন্দ্রীদের আনাগোনা।”

জিসান আরও কিছু বলতে নিবে তার আগেই নীলের বিরক্তিমাখা কন্ঠ,

“কী শুরু করেছিস তোরা। সমানে ফিসফিস করে চলেছিস। কী বলছিস আমাকেও বল আমিও একটু শুনি।”

জিসান ইশানকে ছেড়ে দিয়ে মেকি হেসে বলে,

“না নাহ না, তেমন কিছুই না৷ ওই আসলে এমনিতেই কথা বলছিলাম আমরা। ”

নীলের উত্তরটি পছন্দ হলো কিনা কে জানে? সে সিগারেটে শেষ টান টি অব্যাহত রেখে বলল,

“সবাই গাড়িতে ঢুকে পড়৷ সোহার ছুটির সময় হয়ে গেছে।”

অগত্যা সকলে গাড়িতে গিয়ে বসে পরল।

___

সোহার চোখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ । এরা এখানে আসা মানে এক ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া। এই পরিস্থিতির মূল কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে নীল। তার ওই কি’লা’র লুকে সোহার স্কুলের প্রত্যেকটি মেয়েই দিশেহারা। নীল যে সোহার কাজিন এটা এই কয়েক বছরে সকলেই জেনে গেছে।তার কারণ সোহার স্কুলের সামনে নীলের প্রায়শই আনাগোনা। ইতোমধ্যে মেয়েদের কুদৃষ্টি নীলের ওপর পড়েও গেছে। সকলে নানারকম কমেন্ট করতে শুরু করে দিয়েছে। কমেন্ট গুলো ঠিক এমন, “এই দেখ দেখ ওই যে সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা আজ আবারও এসেছে, ওই যে সোহার কাজিন, ইশ কী ফিগার আমি তো ফিদা হয়ে যাব, বাবাকে বলে লাইনটা খুব শীঘ্রই ক্লিয়ার করে নিতে হবে, শার্টের বোতামগুলো খোলা ইচ্ছে করছে টুক করে একটা চুমু খেয়ে আসি, আরও ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রকম কমেন্ট’স। সোহা রাগে ফুঁসছে। কেন জানি এই মেয়ে গুলোকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে তার। সবথেকে বেশি রাগ উঠছে তার নীলের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশের পরিবেশটা পর্যবেক্ষণ করছে সোহা। আর মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছে। এরই মধ্যে তার বেস্ট ফ্রেন্ড সাথী তাকে ধাক্কা মে’রে বলল,

“এই কী এতো ভাবছিস। ওই দেখ তোর ওই হ্যান্ডসাম ভাইটা আজ আবার এসেছে। এতবার বলেছি আমার সঙ্গে তার লাইনটা একটু ক্লিয়ার করে দে কিন্তু তুই তো আমার কোনো কথাই শুনিস না। দেখ দেখ আমাকে দেখতে কতটা কিউট তোর ভাইয়ের পাশে একদম ঝাক্কাস লাগবে। বাই দি ওয়ে, তোর ভাই এখানে কেন আসে বলত?এ্যাট এনি চান্স, তোর সঙ্গে আমাকে দেখে প্রেমে পড়ে যায়নি তো? এজন্যই বোধহয় আমাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে ছুটে আসে। হায় আল্লাহ, মে তো মা’র’গা’য়া।”

শেষ উক্তিটি সাথী বেশ লজ্জার সহিত বলল। যেটা দেখে সোহার মনের এতক্ষণের চাপা রাগটা দাবানলের ন্যায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। সোহা সাথীর মুখের ওপর বলতে চাইল অনেক কিছু কিন্তু শেষ পর্যায়ে কিছুই বলতে পারল না। রাগে,দুঃখে, অভিমানে ধপ ধপ করে কয়েক কদম এগিয়ে চলে গেল সোহা। পেছন থেকে সাথী বারকয়েক ডাকল কিন্তু সোহা পুরোটাই ইগনোর করল। এদিকে সোহাকে হনহনিয়ে চলে যেতে দেখে আশ্চর্য হলো নীল,জিসান,ইশান, সূর্য। সকলেই অবাক। এই কয়েক বছরে এমন কখনো হয়নি। তাদের দেখলে বরাবরই সোহা ছুট্টে চলে আসত কিন্তু আজ তার কী হলো? নীল কিছু একটা ভেবে সূর্যকে পাঠালো সোহাকে দাড় করানোর জন্য। সূর্য অনেক চেষ্টার পরেও সোহার জেদের কাছে পরাস্ত হলো। সোহার এক কথা, ‘সে কিছুতেই তাদের সঙ্গে যাবে না তারা যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই যেন চলে যায়।’ সোহার মুখের বানীটি খুব সুন্দর করে সূর্য নীলকে শুনিয়ে দিল। নীলের মাথায় ধপ করে ক্রোধ এসে হানা দিল। সে জিসানকে বলল সূর্য আর ইশানকে নিয়ে বাড়িতে চলে যেতে সে পরে আসছে। জিসান আটকাতে চেয়েও পারল না নীলকে ধরে রাখতে। তবে এটা সে বেশ বুঝতে পারছে আজ সোহার কপালে দুঃখ আছে।

___

সোহা প্রায় রিকশায় উঠে পরবে ঠিক তখনই নীল তার হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরল। হতভম্ব সোহা কিছুটা ভয় পেয়ে গেল আচমকা।ফের কিয়ৎক্ষণ আগের স্মৃতি গুলো মনে পরতেই অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। নীল অন্যায় করেছে, বহুত বড় অন্যায়। নীলের জায়গায় তার অন্য কোনো ভাই হলে এতক্ষণে দু,চারটে বসিয়ে দিত তাদের গায়ে। কিন্তু নীলকে ঘিরে এমন কিছু কল্পনা করাও সোহার জন্য দুঃসাধ্য।

নীলের শক্তির সঙ্গে পেরে উঠছে না সোহা। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নীল থেকে মুক্তি পাবার। নীল রিকশাওয়ালাকে ইশারায় চলে যেতে বলল। সোহা তখনও সমানে জোড়াজুড়ি করে চলেছে। এতক্ষণে নীল মুখ খুলল। সোহার হাত নিজের হাতের বন্ধনে আরও শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বলল,

“আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না সোহা। দ্রুত চল বলছি।”

সোহা পারে তো প্রায় কেঁদেই দেয়। অভিমানের পাল্লা যেন আরও ভারী হচ্ছে খনে খনে। এক পর্যায়ে তার বিদ্রোহী উত্তর,

“আমি কিছুতেই তোমার সঙ্গে যাব না। তুমি ছেড়ে দাও আমায়। চলে যাও আমার কাছ থেকে।”

নীলের রাগের প্রকোপ দিগুণ হচ্ছে। সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

“এটা পাবলিক প্লেস। সিনক্রিয়েট করিস না।”

সোহা এবার নীলের চোখে চোখ রেখে বলল,

“তোমার আদৌ সে জ্ঞান আছে?”

নীল বুঝল এখানে অযথাই কথা বাড়াচ্ছে সে। সোহা কখনোই সেচ্ছায় যাবে না। অতঃপর সে বিনাবাক্যে সোহাকে কোলে তুলে নিল। আশেপাশের সবার দৃষ্টি ওদের দিকে। সোহার স্কুলের প্রত্যেকটি মেয়ে চোখ রসগোল্লার মতো করে চেয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো জন্তু দেখছে। সাথী তো অলরেডি হা করে চেয়ে আছে। মনে হয় তার মুখে এই মুহুর্তে শ’খানেক মশা অনায়াসে ঢুকে যেতে পারবে। এদিকে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে সোহার। সে কোনো দিক তাকানোর সাহস করছে না চুপচাপ নীলের কাঁধে মুখ লুকিয়ে আছে। নীল যে এমন কিছু করে বসবে এটা সোহার ধারণার বাহিরে ছিল। এখন এই পরিস্থিতি এখন তো সে পাড় করে নিল কিন্তু কাল, কাল কী হবে তার? স্কুলে আসলেই তো নিশ্চিত নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। বাইকের ওপর এক প্রকার ছুড়ে মে’রে’ই নীল সোহাকে বসিয়ে দিল। সোহা কাচুমাচু মুখ করে বসে আছে। অগত্যা বাইকে চেপে সাই সাই করে বাইক স্টার্ট দিল নীল।

চলবে,

চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০৩

0

চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৩
Sadia afrin nishi
__________________

রাতে সকলে একসঙ্গে খাবার খেয়ে নিল। নীলের পছন্দের রান্না করেছে তার ফুপি।খিচুড়ি আর গরুর মাংসের ভুনা। এই বর্ষাভেজা পরিবেশে এমন খাবার একদম পারফেক্ট। তবে যার জন্য এতো আয়োজন সেই বেশি খেতে পারল না। নীলের শরীরটা ধীরে ধীরে খারাপ করে নিয়ে আসছে তাই অল্প খেয়েই উঠে গেল। জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ। সোহাও তেমন একটা খেল না। নীলের সামনে থাকতে আজ তার একটু বেশিই অস্বস্তি লাগছে। খাওয়া শেষে যে যার মতো ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সূর্য খাওয়ার সময়ও সোহাকে বেশ জ্বালিয়েছে।

ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে বেজে দশ মিনিট। সোহা ধরফরিয়ে লাফিয়ে উঠে বসে পরল। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করল৷ নাহ, কেউ তো নেই। তাহলে সে কী অনুভব করল? পাশে থাকা গ্লাসের পুরোটা পানি এক নিশ্বাসে খেয়ে নিল সে। অতঃপর চুপটি করে শুয়ে পরল। ঘুমের মধ্যে তার মনে হচ্ছিল কেউ তার কাছে, ভীষণ কাছে এসেছে। সোহা হাসফাস করতে করতেই লাফ দিয়ে ওঠে কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না।

___

মালিহা আহমেদ সকাল সকাল ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নীলকে নিয়ে। রাতে জ্বরের ঔষধ আগে থেকে খায়িয়ে দেওয়ার পরেও নীলের জ্বর আয়ত্তে আসি নি। বরং ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বৃষ্টিতে ভিজলে তার সবসময়ই এমন হয়৷ পুরো একদিন জ্বর থাকে তারপর আস্তে আস্তে কমে আসে। কোনো ঔষধেও কাজ হয় না। নীলের মা এই নিয়ে দশ বার ফোন করে ফেলেছে ছেলের খবর জানতে। মালিহা নীলের দেখাশোনায় কোনো কমতি রাখবে না সেটা সে জানে তবুও মায়ের মন বলে কথা। সন্তানের জন্য ছটফট করবেই।

ডক্টরকে খবর দেওয়া হলো।ডক্টর এসে আরও কিছু মেডিসিন দিয়ে গেলেন। মেডিসিন খেতে হলে আগে কিছু খাবার খেয়ে নিতে হবে কিন্তু নীলকে কিছুতেই খাবার খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না। সকলেই ব্যর্থ হলো।

ঘুম থেকে উঠে এসব দেখে সোহা বেশ হতাশ। এমনটা হওয়ারই ছিল। ছোট থেকেই এগুলো সে দেখে আসছে। সকলে যখন হাল ছেড়ে দিয়ে চলে আসল ঠিক তখনই সোহা চুপিচুপি সে ঘরে প্রবেশ করল।

এক হাত চোখের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নীল। পা থেকে বুক বরাবর কাঁথা দিয়ে ঢাকা। হয়তো ঠান্ডা লাগছে জ্বরের প্রকোপে। ওষ্ঠ জোড়া শুষ্ক বর্ণ ধারণ করেছে। মুখ,হাত ফ্যাকাশে। জ্বর হলে যেমনটা হয় আরকি। সোহা নিরবে দাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে নীলকে। পাশেই টেবিলের ওপর খাবার রাখা। নানারকম ফল,কুকিজ,পায়েস,ভাত,রুটি, তরকারি, এটা ওটা দিয়ে টেবিলটি পরিপূর্ণ। বোঝাই যাচ্ছে নীলকে খাওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে এসব কিছুর আয়োজন। সোহা কীভাবে কী শুরু করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। হঠাৎ শোনা গেল নীলের গম্ভীর কণ্ঠ,

“কিছু বলবি?”

আচমকা কেঁপে উঠল সোহা। নীল এখনো সেভাবেই চোখ বন্ধ করে আছে। বুকে ফুঁ দিতে দিতে বলল সোহা,

“তুমি কী করে বুঝলে আমি এখানে আছি?আমি তো এসে থেকে একটা শব্দও করিনি?”

নীল ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল কিন্তু কিছু বলল না। সোহা ভ্রু কুঁচকে দেখল সেই হাসি। যার অর্থ সে কিছুই বুঝল না।

সোহা বারকয়েক নীলকে খাবার খেয়ে নিতে অনুরোধ করল তবুও নীল শুনল না। ঘাপটি মে’রে পড়ে থাকল। বাধ্য হয়ে সোহা টেবিল থেকে রুটি আর তরকারির বাটিটা নিল। রুটি ছিড়ে তাতে তরকারি মাখিয়ে সেই খাবার তুলে ধরল নীলের মুখের সামনে। অতঃপর বলল,

“মুখ খোলো।”

নীল চোখ খুলল। মুখের সামনে খাবার দেখে চমকালো। সে কখনোই এটা ভাবেনি যে সোহা তাকে নিজে থেকে খাইয়ে দিতে চাইবে। নীল সোহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর খাবারটা খেয়ে নিল। দুটো রুটি আর তরকারি সেই সঙ্গে কিছু ফল খাইয়ে দিল সোহা নীলকে। খাবার শেষ হতেই সোহা উঠতে নিচ্ছিল হাত ধোঁয়ার জন্য কিন্তু দেখা গেল আচমকা নীল তাকে আঁটকে দিয়েছে। সোহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নীলের সেদিকে পরোয়া হলো না। সে সোহার এঁটো হাতটা নিজের দিকে টেনে নিল। সোহা কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। নীল সোহার আঙুল একটা একটা করে নিজের মুখের মধ্যে পুড়ে নিয়ে সেগুলোর স্বাদ নিতে ব্যস্ত। সোহা হতভম্ব। এটা সে কখনোই আশা করেনি। নীলের অধর বারংবার ছুয়ে দিচ্ছে সোহার আঙুল। অজানা শিহরণে বন্ধ হয়ে এলো সোহার চক্ষু। মুক্ত হাতটি দিয়ে চেপে ধরল নিজের কামিজের কিছু অংশ। ওপরের অধর দ্বারা চেপে ধরল নিচের অধর। নীল আড়চোখে দেখল সেই হৃদয়-হরনীকে। ফের মনোযোগ দিল নিজের কার্যে।

নীল থেকে মুক্তি পেতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল সোহা। ঝটপট উঠে পড়ল খাট থেকে। বিনাবাক্যে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার কাছে। দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে হাঁপাতে লাগল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে হঠাৎ মনে পরল সে তো নীলকে মেডিসিন টা খাওয়াতেই ভুলে গেছে। এখন কী হবে? নীলের মুখোমুখি হওয়া এই মুহুর্তে তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

___

ঘর থেকে বেড়িয়ে সোজা সূর্যের রুমে চলে গেল সোহা। সেখানে সূর্য আর জিসান ছিল। সূর্য ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে ফোন টিপছে। আর জিসান তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। সোহা কাচুমাচু মুখ করে দাড়িয়ে পরল জিসানে সামনে। জিসান বুঝতে পারল সোহা কিছু বলতে চায়। সে অল্প কথা বলেই ফোন কেটে দিল। তারপর সোহাকে বলল,

“কী ব্যাপার পিচ্চি কিছু বলবি? মুখটা এমন কাচুমাচু করে আছিস কেন?”

সোহা বিরক্তির সুরে বলল,

“আহহ ভাইয়া বলেছি না আমাকে পিচ্চি বলবে না। আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি।”

জিসান ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

“তাই বুঝি। তো কতবড় হয়েছিস তুই?”

“অনেক অনেক অনেক বড়। আমার বয়স কতো জানো ১৬+। তারমানে আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি।”

জিসান আলতো হাতে সোহার মাথায় একটা চাটি মে’রে বলল,

“তুই যদি বড় হয়ে যেতি তাহলে তো কবেই সব সমস্যা মিটে যেত।”

“কীসের সমস্যার কথা বলছ তুমি ভাইয়া?”

“কিছু নাহ। এখন বলতো তুই কেন এসেছিলি এসেছিস?”

সোহা আমতা আমতা করে বলল,

“ওই আসলে হয়েছে কী তোমার ভাইকে খাবার টা তো আমি খাইয়ে এসেছি কিন্তু ঔষধ টার কথা না একদমই ভুলে গেছি।”

জিসানের সাবলীল উত্তর,

“তো কী হয়েছে আবার যা ঔষধ টা খাইয়ে আয়।”

সোহা ঝটপট করে বলল,

“নাহহ নাহহ না, আমি যেতে পারব না। না মানে আমার স্কুল টাইম হয়ে গেছে। লেট হলে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। তাই বলছি তুমি গিয়ে তাকে খাইয়ে দিয়ে এসো।”

“আমি বললে কী সে খাবে।”

সোহা বিদ্রোহী কন্ঠে বলল,

“কেন খাবে না অবশ্যই খাবে। না খেলে মুখ চেপে ধরে খাইয়ে দিয়ে আসবে।”

“ওকে, চেষ্টা করে দেখি।”

“হুম যাও।”

___

ব্রেকফাস্ট করে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নিল সোহা। আজ একটা ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে তার। জিসানের থেকে জেনে নিয়েছে নীল ঔষধ টা খেয়ে নিয়েছে। প্রথমে খেতে চায়নি যখন জিসান বলেছে তাকে সোহা পাঠিয়েছে তখন আর কোনো দিরুক্তি করে নি।

চলবে,

চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০২

0

চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ২
সাদিয়া আফরিন নিশি
__________________

মালিহা আহমেদের ফোনটা বেজে উঠল। মালিহা আহমেদ কিচেনে ব্যস্ত থাকায় ফোন রিসিভ করতে গেল সোহা। তার বড় মামি অর্থাৎ নীলের মা ফোন করেছে। এই কলটা তো আসারই ছিল। তার ছেলের এমন হুটহাুট পাগলামোতে অলওয়েজ দিশেহারা থাকে সবাই। একদম ছন্নছাড়া, নাছোড়বান্দা,একরোখা টাইপ বজ্জাত ছেলে বলেই আখ্যায়িত করে সোহা নীলকে। ফোন রিসিভ করে সোহা প্রথমেই মিষ্টি করে সালাম দিল। সোহার মামি সালামের উত্তর দিয়ে উদ্বীগ্ন কন্ঠে বললেন,

“আম্মা, নীল কী তোমাদের বাড়িতে গেছে নাকি? এই ঝড়,বৃষ্টির মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল।এত করে বললাম পরিবেশ ঠিক হলে তারপর বের হ বাসা থেকে কিন্তু সে তো কোনো কথাই শুনল না। গাড়িটাও নিল না বাইক নিয়ে ভিজতে ভিজতে চলে গেল।”

সোহা হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলল,

“হ্যাঁ বড় মামনি, তোমার ওই একরোখা বজ্জাত ছেলে আমাদের বাড়িতেই এসেছে। ইতিমধ্যে তোমার ননদ তার আপ্যায়নের জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। তুমি নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। তাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আর তার সঙ্গে সঙ্গে তার গ্যাং-রাও এখানেই আছে। সো সকলকে বলে দিও তাদের নিয়ে টেনশন না করতে।”

নীলের মায়ের মুখে প্রশান্তির হাসি। যেটা চোখে না দেখলেও সোহা ঠিকই অনুভব করতে পারল। সেও মুচকি হাসল। অতঃপর ওপাশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছেদের আওয়াজ শোনা গেল।

____

“যা তো সোহা এই গরম দুধটা নীলকে দিয়ে আয়।”

মালিহা আহমেদ দুধের গ্লাস দিতে দিতে বললেন। সোহার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে ভীত কন্ঠে বলল,

“এসব কী বলছ তুমি আম্মা? তোমার ভাইপো চেয়েছে কফি তুমি দিয়েছ দুধ। তারওপর আবার আমাকে পাঠাতে চাইছ তাকে দুধ খাওয়াতে। দেখা যাচ্ছে তোমার ভাইপো শেষমেশ এক গ্লাস দুধের মধ্যে আমাকে ভিজিয়ে কামড়ে কামড়ে খেয়ে নিল। তখন কিন্তু আমার খুব লাগবে মা।”

শেষ উক্তিটি সোহা শয়তানির ভঙ্গিতে বলল। সোহার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সূর্য বলল,

“ও কুপ্পী সুয়োরানী কিন্তু ঠিকই বলেছে। এরপর দেখবে তোমার মেয়ে আছে কিন্তু তার হাড্ডি নেই নয়তো তোমার মেয়ের হাড্ডি আছে কিন্তু তোমার মেয়ে নেই।এখন যেটা ভালো বোঝ করো।”

সোহা মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মালিহা আহমেদ সেদিকে তোয়াক্কা না করে বিরক্তির সুরে বললেন,

“আহ তোরা থামবি। আমার নীল মোটেই অমন ছেলে নয়। আমি দিয়েছি শুনলে এক লাফে খেয়ে নেবে। সোহা তুই তাড়াতাড়ি যা তো দুধটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। আমার আবার ওদিকে অনেক কাজ আছে।”

মালিহা আহমেদ চলে যেতেই সোহা অসহায় দৃষ্টিতে ভাইদের দিকে তাকালো। জিসান আর ইশান তাকে অভয় দিয়ে বলল,

“যাহ বোন কিচ্ছু হবে না। ভাই কিছুই বলবে না।”

কিন্তু সূর্য তাকে আরও ভয় দেখানোর জন্য বলে,” হ্যাঁ হ্যাঁ যাও যাও পড়ে বুঝবে মজা কাকে বলে।”

সোহা সূর্যকে মুখ ভেংচি কেটে চলে গেল।

____

বেলকনিতে বসে নিকোটিনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত নীল। এ বাড়িতে আসলেই তার মনে আলাদা প্রশান্তি মিলে। কোথাও একটা এটা ভেবে শান্তি পায় যে এ বাড়ির কোনো এক কোণে তার গোলাপরানি আছে। খুব কাছেই আছে। তখন বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। ভীষণ খুশি লাগে মন থেকে। সুমিষ্ট কন্ঠস্বর কানে বাজতেই বুকটা ধক করে ওঠে নীলের। পেছন থেকে কেউ আমতা আমতা কন্ঠে বলছে,

“নীলাদ্রি দা তোমার দ দদ দুধ।”

এই নীলাদ্রি নামে শুধু সোহাই তাকে ডাকে। অন্যকেউ এই নামে ডাকার সাহস পায় না। অন্য কেউ এই নামে ডাকলে সে ভীষণ রেগে যায়। সোহার বলা কথাটি মস্তিষ্কের নিউরনে পৌছতেই ভ্রু কুঁচকে আসে নীলের। সে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। সোহার হাতে দুধের গ্লাস দেখে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“এটা কেন? আমি তো কফি চেয়েছিলাম।”

সোহার রিনরিনে কন্ঠ,

“আম্মা পাঠিয়েছে। বলেছে এটাই তোমার শরীরের জন্য বেশি বেটার।”

নীল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা ভেবে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল সোহার দিকে। সোহার অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ সেই সাথে ভয়ও। সে চুপচাপ দুধের গ্লাসটা টেবিলে রেখে কেটে পড়তে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই কেউ তার এক হাত খপ করে ধরে বসে। থমকে দাড়াল সোহা। এক অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছে তার পুরো শরীর জুড়ে। সে যেন নড়তে ভুলে গেছে। স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। হঠাৎই হাতের স্পর্শ আরও শক্ত হলো। কেউ তাকে এক টানে নিজের সংস্পর্শে নিয়ে গেল। সোহা কাঁপছে অবিরাম। এই কাঁপুনির কারণ তার অজানা। সহাসয় নিজের কাছাকাছি সে যায় না। কিশোরী হওয়ার পর এই বোধহয় প্রথম নীল তাকে টাচ করল।

হাতের বাঁধন আলগা হলো ধীরে ধীরে।সোহার হাত ছেড়ে দিয়ে নীল তার দু কাঁধে নিজের দু হাত রাখল। আলতো স্বরে বলল,

“এভাবে কাঁপছিস কেন?আমি কী তোকে কিছু বলেছি?”

সোহা এখনো চুপ। চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। সব কথা দলা পাকিয়ে কন্ঠনালীতে আটকে আছে। সোহা এবার হাসফাস করছে এখান থেকে মুক্তি নিয়ে জন্য। কিন্তু আমরা যেটা চাই সবসময় কী সেটা হয়? সোহাকে নীল ছেড়ে দিল ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি নয়। সে সোহাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য পাশে ঘুরে দাড়াল। অতঃপর একটা অনাকাঙ্খিত বায়না জুড়ে দিল।বেলকনি থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে সে সোহাকে বলল,

“দুধ টা খেতে পারি তবে এক শর্তে।”

সোহা ততক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। নীলের কথা শুনে চটজলদি বলে ফেলল,

“কী, কী শর্ত?”

নীল খাটের ওপর আরাম করে বসতে বসতে বলল,

“এই দুধটা তোর আমাকে খাইয়ে দিতে হবে নয়তো আমি খাব না।”

নীলের কথা শুনে সোহার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সে ঈশৎ জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,

“কিহহহ, আমি। এটা কী করে সম্ভব? আমি কখনো কাউকে খাইয়ে দেইনি। বরং আমাকেই সবাই খাইয়ে দেয়। তোমার মতো এত বড় একটা ছেলেকে আমি কী করে খাইয়ে দিব? ঢং না করে নিজের টা নিজেই খেয়ে নাও তো বাপু।”

“আচ্ছা বেশ৷ তারমানে তুই দিবি না। তবে ঠিক আছে নিয়ে যা ওই দুধ। তোর আম্মাকে গিয়ে বল আমার কোনো দরকার নেই এই দুধের।”

সোহা পড়ল মহা বিপদে। এই দুধ ফিরিয়ে নিয়ে গেলে তার আম্মা নির্ঘাত তাকেই বেশি কথা শুনিয়ে দেবে। ভাইপো বলতে অজ্ঞান কিনা। সোহা নীলকে মিনতি করে বলল,

“প্লিজ খেয়ে নাও না নীলাদ্রি দা। দেখো এটা ফিরিয়ে নিয়ে গেলে মা আমাকেই বকবে। প্লিজ খেয়ে নাও।”

নীলের এক কথা। সে কিছুতেই নিজ হাতে দুধটা খাবে না। সে গো মে’রে বসে থাকল। শেষমেশ উপায়ন্তর না পেয়ে অসহায় সোহা বাধ্য হলো নীলকে দুধটা খায়িয়ে দিতে। সোহা দুধের গ্লাসটা মুখে ধরতেই নীল খুব দ্রুত খেয়ে নেয়। বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হয়না সোহাকে। খাওয়া শেষে নীল সোহাকে বলল,

“তোর কাজ শেষ। এখন তুই যেতে পারিস। আমি একটু ঘুমবো।”

সোহা কেমন জানি উশখুশ করছে। হয়তো কিছু একটা বলতে চাইছে। নীল সোহার হাবভাব বুঝতে পেরে বলল,

“কী হয়েছে কিছু বলবি?”

সোহা আমতা আমতা করে বলল,

“ওই, আসলে, ওভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কী খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? এখন যদি জ্বর আসে তখন কী হবে?”

“কী আর হবে। তুই বসে বসে সেবা করবি আমার।”

সোহা মুখে ভেংচি কেটে বলল,

“ইশ শখ কতো। বয়েই গেছে আমার আপনার সেবা করতে।”

“তাই বুঝি? বাই দি ওয়ে, তুই কী করে জানলি যে আমি বৃষ্টিতে ভিজে এসেছি? নিশ্চয়ই ফুপি বলেছে?”

“নাহ আম্মা বলেনি। আমি তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। ঠিক সেসময়ই তোমাকে আসতে দেখি। আসতে যখন হতোই তখন গাড়ি নিয়ে আসতে পারতে তো। তাহলে অন্তত এতটা ভিজতে হতো না।”

“তা অবশ্য ঠিক কিন্তু অতো সময় ছিল না আমার হাতে তখন।”

“কেন কেন কী এমন ক্ষতি হতো একটু লেট হলে? তবু শরীর টাতে তো কোনো আঁচ আসত না।”

নীল কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সোহার পানে। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“কী হতো সেটা তুই বুঝবি না।”

নীলের গম্ভীর কণ্ঠ নাড়া দিয়ে গেল সোহার অন্তর। কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল অন্তঃস্থল। সোহা আর কোনো দিরুক্তি করল না। ছোট্ট করে শুধু বলল,

“আমি তাহলে এখন যাই। পড়তে বসতে হবে।”

নীল শেষ বারের মতো বলল,

“শোন আরেকটা কথা…”

সোহা পেছন ঘুরল।

“বড় হচ্ছিস তো নিজেকে সামলাতে শিখ। কোনো ছেলেদের আশেপাশে ঘেঁষবি না। কাউকো তোর গায়ে টাচ করতে দিবি না।বুঝলি।সবসময় নিজেকে আগলে রাখবি।”

সোহার কৌতুহলী প্রশ্ন,

“কই আমি তো কারো কাছে যাই না। তবে এ কথা কেন বলছো?”

“সূর্যের সঙ্গে এত ঢলাঢলি কীসের তোর? সে আবার তোর হাতও ধরল। সবসময় ছেলেদের থেকে এক হাত দুরে থাকবি।”

“তাতে কী হয়েছে। সূর্য ভাই তো আমার ভাই। আমরা সবসময় এমন মজা করি। আর সে আমার ভাই হয়ে আমার হাত ধরতেই পারে। এতে দোষের কী? তুমিও তো একটু আগে আমার হাত ধরেছিলে কই তখনও তো আমি কিছু বলিনি।”

নীলের গাম্ভীর্যপূর্ণ উত্তর,

“সূর্য আর আমি কী এক?”

সোহা তব্ধ মে’রে গেল। সত্যিই তো সূর্য আর নীল কী এক? অবশ্যই এক। তারা দু’জনেই তো সোহার কাজিন। তবে সূর্য যখন হাত ধরে তখন তো সোহার মনে কোনো শিহরণ জাগে না। তবে নীল ধরলেই কেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়? উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সোহা। সোহা যেতেই নীল মনে মনে আওড়ালো,

“কবে বুঝবি তুই গোলাপরানি এ মনের দহন?”

চলবে,

চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০১

0

চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ১
সাদিয়া আফরিন নিশি
__________________

পুরো সিক্ত শরীরে আহমেদ বাড়ির সদর দরজায় এসে দাড়িয়ে আছে নীল। কলিংবেল চাপতেই খনেকের মধ্যে তার ফুপ্পি এসে দরজা খুলে দিল। নীলের শরীর থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। একদম কাঁকভেজা হয়ে আছে সে। নীলকে এমন অবস্থায় দেখে তার ফুপির উদ্বীগ্ন কন্ঠ,

“তোর এমন অবস্থা কেন আব্বা। জলদি ভেতরে আয় নয়তো ঠান্ডা গায়ে বসে জ্বর চলে আসবে।”

নীল কোনো প্রতিত্তোরে করল না। চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেল। তার ফুপি দরজা লাগাতে লাগাতে বলল,

“যাহ ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে নে।”

এটা নীলের ফুপির বাড়ি হলেও এখানে তারজন্য আলাদা রুম বরাদ্দ আছে। কারণ এখানে তার নিত্য যাতায়াত।সে রুমে তার যাবতীয় প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র আছে। নীল গায়ের ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে একটা কালো কালার গেঞ্জি আর একটা এ্যাস কালারের ট্রাউজার পড়ে নিল। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিল।

___

খানিকক্ষণ বাদেই ফের কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। মালিহা আহমেদ দ্রুত কিচেন থেকে বেড়িয়ে দরজা খুলতে গেলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পরল আরও তিনজন যুবক। এরা সবাই তার ভাই-পো। নীল হলো তার বড় ভাইয়ের ছেলে। মেঝ ভাইয়ের দুই ছেলে জিসান আর ইশান। ছোট ভাইয়ের এক ছেলে নাম সূর্য। এদের মধ্যে নীল সবার থেকে বড় আর সূর্য সবার ছোট। জিসান আর ইশান পরেছে মাঝ বরাবর। ছোট তিন ভাই-ই বড় ভাই নীল বলতে অজ্ঞান। নীলের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকাই তাদের নিত্যদিনের কর্ম।

“সানাই এর পো ধরে সকলে হাজির হয়ে গিয়েছ?”

হাসতে হাসতে কথাটি বলল মালিহা আহমেদ।

জিসান আর ইশান নিরবে হাসল। কিন্তু চুপ থাকল না সূর্য। সে বরাবরই ভীষণ দুষ্টু। সে লাফিয়ে এসে মালিহা আহমেদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“হ্যাঁ কুপ্পী চলে এসেছি তো। তোমার হাতের টেস্টি, টেস্টি খাবার কী আর মিস করা যায়।”

সূর্য দুষ্টু প্রকৃতির হওয়ায় তার সবেতেই দুষ্টামি। মালিহা আহমেদকে সকলে ফুপ্পি বললেও সে বলে কুপ্পী। ছোট থেকেই এমন স্বভাব তার।

সূর্যের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মালিহা আহমেদ বললেন,

“তুই কী করে জানলি আমি টেস্টি টেস্টি খাবার রান্না করছি?”

“আরেহ কী বল এসব? ভাই এসেছে আর তুমি টেস্টি খাবার রান্না করবে না এটা আগে কখনো হয়েছে আর না কোনোদিন হবে। ভাইয়ের জন্য তো তোমার সব কিছুই স্পেশাল। শুধু আমরাই পরগাছা।”

শেষ কথাটি রসিকতার ছলে বলল সূর্য। কিন্তু মালিহা আহমেদ স্বজোরে তার কান মলে দিয়ে বললেন,

“পাঁজি ছেলে খুব বেড়েছিস তাই না। দাড়া ভাবিকে ফোন করে এখনই নালিশ ঠুকব।”

“আরেহ আরেহ কানটা ছাড়ো না। লাগছে তো ভীষণ।”

“লাগুক আরও লাগুক। কানটা ছিড়ে হাতে না আসা পর্যন্ত আজ একদমই ছাড়ব না।”

“প্লিজ লক্ষী, সোনা কুপ্পী এমন করে না। প্লিজ ছেড়ে দাও আর কখনো এমন মজা করব না।”

“সত্যি তো?”

“সত্যি, সত্যি তিন সত্যি।”

অতঃপর মালিহা আহমেদ সূর্যের কান ছেড়ে দিলেন। ওদের কান্ড দেখে জিসান, ইশান পেট চেপে ধরে হাসছে। মালিহা আহমেদ ওদের থেকে বয়সে আহামরি বড় নয়। ভাইদের থেকে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় তার বয়স তুলনামূলক কমই। আর উনি এ যুগের সঙ্গে বেশ তাল মিলিয়ে চলতে পারেন। এজন্য ভাই-পো দের সঙ্গে তার বন্ডিং টা একটু বেশিই। মালিহা আহমেদ তড়িঘড়ি করে কিচেনে চলে গেলেন।ওদিকে তার তরকারি পুড়তে বসেছে।

___

“কী ব্যাপার এই ঝড়,বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকলে আমাদের বাড়িতে হাজির। মতলব টা কী তোমাদের? নিশ্চয়ই তোমাদের ওই পাগলা ভাইয়ের পাগলামিতে সাথ দিতে তোমরাও তার পেছন পেছন লেজ নাড়তে নাড়তে চলে এসেছ?”

কথা শেষ করতে করতে সোফায় এসে ধপাস করে বসে পড়ল সোহা। সোহা হলো মালিহা আহমেদের একমাত্র কন্যা। সে এ বছর নিউ টেনে পড়ছে। সূর্যের মতো সেও দুষ্টামিতে কোনো অংশে কম অবদান রাখে না। আর রুপের কথা বলতে গেলে তো এক কথায় অপ্সরী। জিসান,ইশান আর সূর্যের কোনো বোন না থাকায় তারা সবাই সোহা বলতে অজ্ঞান। ছোট থেকেই কোলে পিঠে করে ওরাই মানুষ করেছে সোহাকে। নীলের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে আবার সবক্ষেত্রেই অন্য ধাঁচের। সোহা সকলের সঙ্গে ফ্রী হলেও নীলের সামনে ভেজা বেড়াল। নীলকে দেখলে এমন ভাব ধরে যেন সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতেও জানে না। অপরদিকে নীলের অগোচর রাষ্ট্র উদ্ধার করে ফেলে। সোহার পছন্দের একটি জিনিস আছে এ বাড়িতে। সেটি হলো তার ওয়ান এন্ড ওয়ানলি টিয়া পাখি টুশি। টুশিকে ঘিরেই সোহার সকল সুখ,দুঃখ। সোহার ভালো লাগা,মন্দ লাগা সবকিছুই সে তার টুশির সঙ্গে শেয়ার করে। টুশি এখনো বাচ্চা। সবে আধো আধো বুলিতে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো সোহা উচ্চারণ করতে শিখেছে। এর বাহিরে সে এখনো কোনো শিক্ষাই রপ্ত করতে পারে নি। তবে সোহা সর্বক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাকে কথা শেখানোর জন্য।

সোহা বসতেই জিসান আর ইশান তার সঙ্গে নানারকম স্নেহমূলক কথা বলছে।তারা তেমন একটা সোহার কথা গায়ে মাখেনি। কারণ তারা জানে সোহা মজা করে বলেছে। এমনটা সে প্রায়শই করে থাকে। কিন্তু সূর্য, সে তো আর ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সোহার কথার সে অভিনয়ী সুরে প্রতিত্তোরে করল,

“হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস। আমাদের ওই পাগলাটে ভাইটি এই ঝড়,বৃষ্টির মধ্যে বাইক হাঁকিয়ে কাউকে দেখতে চলে এসেছে। এখন আমাদের আর কী করণীয় বল তার সঙ্গে আসা ছাড়া?আমরা ছাড়া তো আর তার কেউ নেই।”

সোহা কপাল কুঁচকে বলল,

“রাখো তো তোমার এক্টিং। এসব নাটক আমার ভালোই জানা আছে। তা সে কই? নিশ্চয়ই তার ফুপিকে দেখার জন্য তার এই পাগলামি?”

সূর্য রসিকতার ছলে বলল,

“ফুপিকে দেখার জন্য না কাকে দেখার জন্য সেসব তো আর আমরা জানি না তবে এসেছে এটুকুই শুধু জানি। তা সুয়োরানী, এখন বল তোর খবর কী? কূটনৈতিক চর্চা কেমন চলছে? বিয়ের পর দুয়োরাণীকে ঠিক কত রকম ভাবে জ্বালাবি বলে ঠিক করেছিস?”

সূর্য মজা করে সবসময় সোহাকে সুয়োরানী বলে ডাকে। এতে অবশ্য সোহা বেশ ক্ষেপে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সূর্যের কথায় সে সূর্যেকে সোফার কুশন দিয়ে মা’র’তে আরম্ভ করে আর বলে,

“সুয়োরানী তোমার বউ। আমি মোটেই সুয়োরানী নই। আমি একটা ইনোসেন্ট, কিউট,সুইট, নিষ্পাপ ভদ্র মেয়ে। সুয়োরানী হবে তোমার বউ। আর তোমার কপালে বহুত দুঃখ আছে সেই বউ নিয়ে দেখে নিও। এটা আমার অভিশাপ।”

সূর্য মা’র খেতে খেতে বলছে,

“শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।”

সোহা আরও ক্ষেপে গেল।সে কুশন ফেলে দু-হাতে সূর্যের চুল মুঠো করে ধরে জোরে টানতে টানতে ক্ষিপ্র কন্ঠে বলল,

“আমি শকুন। তুমি শকুন। তোমার চৌদ্দ গুষ্টি শকুন।”

চুলের ব্যথায় সূর্য আহহ বলে আর্তনাদ করে সোহার হাত চেপে ধরল। ততক্ষণাৎ পেছন থেকে শোনা গেল কারো রাশভারি কন্ঠস্বর,

“কী হচ্ছে এখানে?”

ভয় পেয়ে গেল সূর্য, সোহা দুজনেই। সূর্য সোহার হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে পরল। সোহাও ভেতরে ভেতরে ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তবুও কোনো রকমে নিজেকে শক্ত করে মাথা নিচু করে চুপচাপ এসে সোফায় বসে পরল। নীল দাড়িয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল সকলকে। তারপর কিচেনের দিকে মুখ করে কিছুটা জোরে সুর টেনে বলল,

“ফুপ্পি আমাকে এক কাপ কফি দিও তো প্লিজ। মাথাটা যন্ত্রণা করে আসছে।”

ওপাশ থেকে শোনা গেল,তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট নে আমি এখনই পাঠাচ্ছি।

নীল আরচোখে আরও একবার ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করে কপাল ডলতে ডলতে রুমে চলে গেল। নীল চলে যেতেই সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। একত্রে হাসির আওয়াজ শোনা গেল পুরো ড্রইংরুম জুড়ে।

চলবে,

পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া পর্ব-১৪(শেষ পর্ব)

0

#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ১৪(শেষ পর্ব)

অনিক মনে মনে বিরবির করে বলতে লাগতো, -“তোদের আমি ভালো থাকতে দিবোনা।” বলেই রাগেমেগে ভার্সিটির বাহিরে যেতে লাগলো। রাগে অনিকের গা থরথর করে কাপছে। সে জোরে ড্রাইভিং করছিলো। হঠাৎ, করেই একটা ট্রাক এসে অনিকের গাড়িকে ধাক্কা দেয়।

———————–

অনিকের জ্ঞান ফিরতেই সে বুঝতে পারলো সে কতটা আঘাত পেয়েছে। সারা শরীর নাড়াতেও পারছে না ও। ও পিটপিট করে চোখ খুলে চারিপাশে চোখ রাখতেই দেখলো আদিল, শুভ্রা, অভ্র, নুসরাত আর অনুভব। সে আদিলকে দেখে রেগে উঠতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না ব‍্যথার জন‍্য। আদিল বিষয়টি বুঝতে পেরে সে একাই শুভ্রাকে নিয়ে বাহিরে চলে গেলো। অনুভব বলল, -“কেমন লাগছে এখন?”

অনিক গম্ভীর কন্ঠে বলল, -“হুম ভালো। তা কে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে?”

অভ্র বলল, “আদিল”

অনিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, -“আদিল কেমনে কি?”

অনুভব বলল, -“দেখ তুই অনেক কিছুই জানিস না তাই এইরকম করে বলতে পারিস না।”

অনিক বলল-“কি জানিনা আমি!সবই জানি।”

অনুভব রাগী কন্ঠে বলল, -“কিছুই জানিস না তুই। আর আজকে তুই শুধু মাত্র আদিলের জন‍্য জীবিত আছিস। আর যাকে তুই অন্ধের মতো বিশ্বাস করিস আজ সে তোকে মারার জন‍্য লোক পাঠিয়েছিলো।”

অনিক বলল, “মানে”

অনুভব বলল, -“তোর ফুফু তোকে লোক দিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। ওই রাজিব নিয়ে আয় তো।” রাজিব একটা লোককে ভিতরে নিয়ে এলো যে ট্রাকটি চালাচ্ছিলো। সে নিজের মুখে শিকার করলো যে, “সে লামিয়া বেগম মানে অনিকের ফুফুর কথা ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট করিয়েছেন। তারপরে অতীতে ঘটে যাওয়া সব কিছু ও অনুভব অনিকের কাছে ক্লিয়ার করে। এমন কি আজকে যদি আদিল অনিককে রেগে ভার্সিটি থেকে বের হতে না দেখতো। তাহলে অনিকে বাঁচানো যেতো না লামিয়া বেগম ওকে মেরেই ফেলতো। এমনকি আদিল রক্তও দিয়েছে অনিককে।”

অনিক সব শুনে নিস্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো। তারপর ভাঙা গলায় বলল, “আদিলকে একটু ডেকে দিবি।”

অনুভব অভ্র আর নুসরাতকে নিয়ে বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর আদিল কেবিনে আসলো। আদিলকে দেখে অনিক উঠতে যাবে তখন আদিল দৌড়ে এসে অনিককে আটকিয়ে বলে, -“পাগল হয়েছিস নাকি। লাগবে তো।” অনিক ছলছল নয়নে আদিলের দিকে তাকিয়ে বলল, -“আমাকে ক্ষমা কর দয়া করে। আমি তাছাড়া যে মরেও শান্তি পাবো না রেএ।”

আদিল বলল, -“ধুরু এগুলো কি বলিস! আর তুই জানিস না বন্ধুত্বের মধ‍্যে নো সরি নো থ‍্যাংকিউ।”

আদিলের কথা শুনে অনিক আদিলকে জরিয়ে ধরলো। অনেকক্ষণ পর আদিল বলল, -“ছাড় বেটা মানুষ কি মনে করবে? আমি কি তোর বউ লাগি নাকি যে এমন করে জরিয়ে ধরে আছিস।”

আদিলের কথা শুনে অনিক হেসে দিলো।
অনিক বলল, -“দোস্ত আমি এখনি এখান থেকে যাবো।”

আদিল বলল, -“কি বলিস কি এই অবস্থায় কিভাবে? না এইরকম অবস্থায় কোনো মতেই যাওয়া যাবে না। অনিকের জেদে কাছে হার মেনে ওরা সবাই মিলে অনিককে ওর বাসায় নিয়ে আসলো। লামিয়া বেগম অনিককে জীবিত দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ওনাকে অবাক হতে দেখে অনিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, -“কি হয়েছে ফুফু,এতো অবাক হলে কেন?আমি জীবিত আছি তাই দেখে তাই না।”

লামিয়া বেগম নেকামির সুরে বলল, -“কি বলছিস এগুলো? আর তোর এমন অবস্থা কিভাবে হলো রে বাবা? বলেই লামিয়া বেগম অনিকের দিকে এগিয়ে আসতে নিলে অনিক হাত উঠিয়ে না করে আর পুলিশকে ডাক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আর আদিল,অভ্র, অনুভব, নুসরাত আর শুভ্রা এসে হাজির হয়। লামিয়া বেগম এদের দেখে কিছুটা ভয় পায় তারপরেও উচু গলায় বললেন, – আদিল আর শুভ্রা এখানে কেন? ওরা কোন সাহসে এই বাসায় এসেছে।

অনিক বলল, -“লামিয়া বেগম দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আপনার কথাগুলো শুনলে গা আমার জ্বলে যাচ্ছে। অফিসার এই মহিলাকে নিয়ে যান চোখের সামনে থেকে।” পুলিশ লামিয়া বেগমকে নিয়ে গেলো। অনিক শুভ্রাকে ডাকলো। শুভ্রা আদিলের দিকে তাকাতেই ও যেতে বলল। অনিক মাথা নিচু করে বলল, -“শুভ্রা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।”

শুভ্রা বলল, -“এতে আপনার কোনো দোষ ছিলো না সব ওই মহিলার দোষ ছিলো। তাই আপনাকে ক্ষমা করার কথা কোথায় থেকে আসছে।”

শুভ্রা কথায় অনিক সামান্য হাসলো তারপর বলল, -“আদিল তুই শুভ্রাকে ভালো রাখিস আর শুভ্রা আদিলকে দেখে রেখো ও অনেক ভালো ছেলে।”

আদিল বলল, -“বাদ দে তো এখন চল সবাই মিলে আবার সব নতুন করে শুরু করি।”

অনিক মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -“কাল আমি বিদেশ চলে যাচ্ছি। সব ব‍্যবস্থা শেষ।”

আদিল বলল, -“এই শরীর নিয়ে তুই কিভাবে কি!”

অনিক বলল, -“পারবো আমি আর আদিল মামা হবার খবরটা কিন্তু আমাকে দিবি।”

অনিকে কথা আদিল হাসলো আর শুভ্রা শরমে লাল নীল হতে লাগলো।

———————–

আজ রাজিব আর লুভা, আদিল আর শুভ্রা, অভ্র আর নুসরাত, অনুভব আর সারার বিয়ে হলো।

ওদের সবার একসঙ্গে বিয়ে করার কথা শুনে অনুভব ও সারাকে বিয়ে করে নেই। আর তাদের পরিবার ও এতে অমত করেন নি।

অনিক সেই দুইমাস আগেই একবারের জন‍্য বিদেশ চলে গিয়েছে। ও সবাইকে এক এক বিয়ের জন‍্য অভিনন্দন জানিয়েছে। ও এখন নিজের গানকে নিজের একাকিত্বের সঙ্গী করে তুলেছে।

ওরা সবাই জোরায় জোরায় ঘুরতে বের হয়েছে।

নুসরাত অভ্রকে বলছে, -“ওই আমি ফুচকা খাবো।”

অভ্র বলল, -“এখন রাত দুটো বাজে এখন কিভাবে? আর এমনি আজকেই বিয়ে কাজকাম করে আমি খুব ক্লান্ত। ঘুম ধরছে আমার চল এখন।”

নুসরাত বলল, -“না আমি যখন বলছি তখন খাবো তো খাবোই।”

অভ্র আর উপায় না পেয়ে ফুচকা আলার বাসায় পৌঁছে গেলো। ফুচকাআলা কেবলি ঘুমিয়ে ছিলেন। দরজায় কড়ানাড়ার শব্দকে সে মনে করেছে চোর মনে হয় খুটখুট করে শব্দ করছে। সে হঠাৎ করেই চোর চোর বলে চিল্লাতে থাকলো। অভ্র বিষয়টি বুঝতে পেরে নুসরাতের হাত ধরে দিলো এক দৌড়। এক দৌড়ে বাসা। দুইজনই হাটুতে হাত রেখে হাপাচ্ছে আর হাসছে। অভ্র নুসরাতকে বলল, -“ভালো লাগছে এখন চোর হয়ে।” নুসরাত বলল, -“হুম অনেক ভালো লাগছে। এখন চলো বাসার ভিতরে যাই। আজকের দিনের কথা আমি কখনো ভুলবো না। শেষমেশ চোর।”

——————

রাজিব আর লুভা ফুটপাত ধরে হেটে চলছে। রাজিব খেয়াল করলো লুভা আর হাটতে পারছে না। হাপিয়ে উঠেছে। আর কিছু বলছেও না। রাজিব কিছু না বলে লুভাকে কোলে নিয়ে হাটতে শুরু করলো। লুভা বলল, -“একি কি করছেন কি নামান বলছি।”
রাজিব বলল, -” চুপচাপ না থাকলে এখন কোল থেকে ফেলে দিবো বলে দিলাম।” রাজিবের কথা শুনে লুভা আর কিছু বলল না।

—————-

সারা অনুভবকে বলছে “আম গাছ থেকে আম পেরে আনতে। অনুভব এখনি না এনে দিলে সে রাস্তায় বসে পরবে আর উঠবেনা বলে হুমকি দিয়েছে।” অনুভব দেখলো সেইদিনের পাগলটা আম গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছে। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো। যেই গাছে উঠতে যাবে তখনি পাগলটার ঘুম ভেঙে গেলো। আর অনুভবের দিকে তাকাতে অনুভব দৌড়ে সারার হাত ধরে দৌড়াতে লাগলো আর পাগলটা ওরে পিছে পিছে “আমার বউকে চুরি করে নিয়ে গেলো” বলে আসতে লাগলো।

———————–

আদিল আর শুভ্রা সেই নদীর পাড়ে বসে আছে। আদিলের কাধে মাথা দিয়ে বসে আসে শুভ্রা। আদিল বলল, -“শুভ্রতা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। যা প্রকাশের মতো না। আর তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লীজ। আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।”

শুভ্রা বলল, -“এই কথা বলবে না আর আমি আছি তো তোমার পাশে।”

কেটে গেছে বছরের পর বছর। দুইজনই হয় তো চেয়েছিলো তাদের কথা রাখতে কিন্তু হয় তো ওরা যেমন ভাবে চেয়েছিলো তেমন ভাবে তাদের ভাগ‍্যে লেখা ছিলো না। তাই তো আজ দুইজনই মৃত্যুর দরজায় পা রেখেছে। শুধু কষ্টে রেখে গিয়েছে দিশাকে। দিশা হলো শুভ্রা আর আদিলের মেয়ে। দিশা হওয়ার সময় শুভ্রা মারা যায়।আর তখন থেকেই আদিল অন‍্য রকম হয়ে যায় কিছু খায় না কারো সঙ্গে কথা বলে না। সারাদিন শুভ্রার ছবি নিয়ে বসে থাকতো। আর বলতো “শুভ্রতা তুমি না বলেছিলে আমার পাশে থাকবে তাহলে এখন কি হলো।”

আদিলের এমন অবস্থা দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পরে। হঠাৎ একদিন নুসরাত আদিলের রুমে গিয়ে দেখে ও অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর শোনা যায় আদিলের ব্রেন ক‍্যান্সার হয়েছে। এই কথা শুনে ওরা সবাই চিন্তায় পরে যায় দিশাকে নিয়ে। দুইমাস পর আদিলও সবাইকে ছেড়ে শুভ্রার কাছে চলে যায়। তখন নুসরাত দিশাকে কোলে নিয়ে বলে ওকে ও মানুষ করবে। ওর কথা শুনে অভ্রও খুশি হয়ে যায় নুসরাতের এমন কথায়।

অভ্র দিশাকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে, -“ওরা হয় তো একসঙ্গে থাকবে বলে দুইজন চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েও যে অপূর্ণতার ছোয়ায় আটকা পরে গেলো। ওদের কথা যেন আমাদের সবসময় মনে থাকে তাই হয় দিশাকে আমাদের কাছে ওদের স্মৃতি সরূপ রেখে গিয়েছে।”

সমাপ্ত

পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া পর্ব-১৩

0

#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ১৩

পরের দিন গুলোতে শুভ্রার আর কিছুই মনে ছিলো না। কিছু মনে করাতে গেলেই তার মাথা ব‍্যথা করতো আর সে অজ্ঞান হয়ে যেতো। আর অতিরিক্ত অজ্ঞান হলে তার কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। ডাক্তার বলেছিলেন একটু জন‍্য শুভ্রা বেঁচে যায় কারণ ওর ক্ষতটা ততটাও গভীর ছিলো না। সামান্য ছুয়ে গিয়েছিলো গুলি। গুলিতে শুভ্রার কিছু হয়েছিলো না। কিন্তু ও অতিরিক্ত আতঙ্কিত হয়ে যখন অজ্ঞান হয়ে পরে তখন নিচের পাথর দিয়ে ওর মাথায় লাগে। যা আদিলরা বুঝতে পারেনি।

————-

আদিল প্রতিদিন রাতে শুভ্রাকে দেখে যেতো সবসময় শুভ্রার আশেপাশে লোক রাখতো দেখে রাখার। আর আবির ছিলো আদিলের লোক। যে সবসময় শুভ্রার খেয়াল রাখতো যখন আদিল কাজে থাকতো। অনিক জেল থেকে ছাড়া পেতেই আদিলের মনে শুভ্রাকে হারানো ভয় জেগে উঠে। সে শুভ্রাকে আবার বিয়ে করে নেয়।

—————–

আদিল একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে। সে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্রার চোখ ছলছল করছে। আদিল শুভ্রাকে একপাশ থেকে আলতো করে জরিয়ে ধরে বলল, -” আরে পাগলি কান্না করো কেন?”

শুভ্রা কাদোকাদো মুখে বলল, -“আপনি আমাকে এতো ভালোবাসেন।”

আদিল মুচকি একটা হাসি দিয়ে শুভ্রার কপালে গভীর একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল, -” ফজরের আজান দিয়েছে চলো দুইজন মিলে নামাজ পরে একটু রেস্ট নেই। সকালে আবার রাজিবের বাবাকে দেখতে যেতে হবে।”

শুভ্রাও মাথা নাড়িয়ে হ‍্যাঁ বোধক উত্তর দিলো।

তারপর দুইজন একসঙ্গে নামাজ পরে ঘুমাতে গেলো। আজ আদিল আর অন‍্যরুমে যাইনি। অন‍্যদিনের মতোও চুপিচুপি আর শুভ্রার কাছে আসেনি সে। শুভ্রা আজ নিজে থেকেই আদিলের বুকে মাথা রেখেছে। আদিলের আনন্দে চোখ ছলছল করছে।

আদিলের চোখে পানি দেখে শুভ্রা বলল, -“একি আপনি কান্না করছেন কেন?”

আদিল মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -“ধুরু কান্না করবো কেন এমনি কিছু না।”

শুভ্রা আর কিছু না বলে আদিলকে জরিয়ে ঘুমিয়ে পরলো।

অন‍্যদিকে সকালের মিষ্টি রোদ লুভা চোখে পরতেই সে পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো ও বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলো আর রাজিব ওর পেটে মুখ গুজে ঘুমিয়ে আছে। লুভা কেমন যেন অসস্থি লাগছে আবার লজ্জাও করছে। ও মৃদু কন্ঠে ডাকতে লাগলো রাজিবকে উঠার জন‍্য।

রাজিব ধরফরিয়ে উঠলো। সামনে লুভাকে বসে থাকতে দেখে ও বলল, -” তুমি সারারাত এরকম করে বসেই ছিলে। ওহ সিট তোমাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম তাই না। আসলে আমি বুঝতে পারিনি।”

লুভা বলল, -“বাদ দেন তো সব এখন ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে খাবার খেতে চলুন। আমি খাবারের ব‍্যবস্থা করছি।”

শুভ্রার আর আদিল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে খেয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো। ওরা হাসপাতালে পৌঁছে দেখলো অভ্র অনুভব রাজিব আর লুভা ওখানে রয়েছে। আদিল গিয়ে বলল, -“কি অবস্থা এখানে।”

অনুভব বলল, -“আঙ্কেল জ্ঞান ফেরার পর রাজিব আর লুভা গিয়েছিলো ওনার কাছে ওনি খুব খুশি হয়েছেন। ডাক্তার বলছেন, দুইজন পর ওনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে।”

আদিল বলল, -“আলহামদুলিল্লাহ্ আর লুভার বাড়িতে কি খবর?”

অভ্র বলল, -“আমি সেখানে গিয়েছিলাম সব ঠিক করে এসেছি। ওনারা বলেছেন আঙ্কেল একদম সুস্থ হয়ে গেলে ওনারা রাজিব আর লুভার ধুমধাম করে বিয়ে দিবেন।”

আদিল বলল, -“বাহ বাহ কি শোনালি ভাই অবশেষে বন্ধুর বিয়ে খেতে পারবো।”

আদিলের কথা শুনে সবাই হাসলো।

আদিল বলল, -“তাহলে ভাবছি আরেকটা বিয়েও দিবো এরসাথে।”

অনুভব বলল, -“কার বিয়ে ভাই?”

আদিল বলল, -“কেন আমাদের নুসরাতের।”

অভ্র উত্তেজিত হয়ে বলল “মানে”

আদিল হেসে বলল, -“আরে ভাই এতো উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই তোর সঙ্গেই দিবো।”

সবাই আরেক দফা হাসলো আর অভ্র লজ্জায় পরে মাথা চুলকিয়ে বলল, -“আমার এখন যেতে হবে একটা কাজ মনে পরে গেছে।” বলেই কাউকে কিছু না বলতে দিয়ে অভ্র চলে গেলো।

আদিল হাসতে হাসতে বলল, -“আমাদের ও যেতে হবে ভার্সিটি। তাহলে এবার আসি।”

রাজিব আদিলকে জরিয়ে ধরে বলল, -“দোস্ত আসলে তুই অনেক ভালো রেএ কিন্তু অনিক তা বুঝলো না।”

আদিল বলল, -“বাদ দে তো ওইসব আর কে বলেছে আমি ভালো? দেখ না আমি তোদের না বলেই বিদেশ গিয়ে কতো আনন্দ করে আসলাম।”

রাজিব বলল, -“যাহ শালা একটু প্রশংসা করলেও তোর গায়ে লাগ। যাহ ভাগ এখান থেকে।” বলে দুইজনই হাসলো।

অনুভব বলল, -“ভাই এবার আমাকে সেট করে দে। আর কতোদিন এমন সিঙ্গেল সিঙ্গেল ঘুরবো। সবগুলো বউ নিয়ে ঘুরবি তখন আমার কি হবে?”

আদিল বলল, -“তুই সিঙ্গেলই মরবি। এখনো পযর্ন্ত একটা মেয়েকেও পটানো তো দূরে কথা পছন্দও করতে পারলি না। তোর দ্বারা কিছু হবে না।”

অনুভব বলল, -“হুম ভালো আমি বাসায় গেলাম। আমার ঘুম ধরছে। থাক তোরা।” বলেই হনহন করে চলে গেলো।

অনুভবের এমন রেগে যাওয়ায় ওরা হাসলো। আদিল বলল, -“তাহলে থাক আমরা যাই।”

রাজিব বলল, -“হুম সাবধানে যাস।”

অনুভব গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার গাড়ির সামনে কেউ চলে আসায় সে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থামালো। সে গাড়ি থেকে নেমে দেখে একটা মেয়ে। অনুভব রাগী কন্ঠে বলল,

-“চোখ কি বাসায় রেখে আসেন নাকি! এইরকম করে মাঝ রাস্তায় হাটার মানে কি? কি হলো কথা বলছেন না কেন? বো…..আর কিছু বলতে পারলো না অনুভব কারণ তার চোখ আটকে গেছে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি তেমন ফর্সা না শ‍্যামলা তবে তার চোখ মায়া ভরা একবার তাকালে আর ফেরানো যায় না। অনুভবের ক্ষেএেও একি অবস্থা। হঠাৎ করেই মেয়েটি অনুভবকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলল, -“অনুভব ভাই বাঁচাও আমাকে। ও আমাকে মেরে ফেলবে।”

মেয়েটির এমন আচমকা কাজে অনুভব থতমত খেয়ে যায়। অনুভব নিজেকে ছাড়িয়ে বলে, -“এই মেয়ে তুমি আমাকে চেনো কিভাবে? আর কে ও যে তোমাকে মারতে চায়।”

মেয়েটি পিছনে ইশারা করতেই অনুভব দেখলো একটা পাগল। সে তাড়াতাড়ি করে মেয়েটির হাত ধরে গাড়িতে উঠে দ্রুত গাড়িটি একটু দূরে নিয়ে গেলো। গাড়ি থামিয়ে বল, -“এবার বলো তুমি এই পাগলের দৌড়ানি কিজন‍্য খেলে আর তুমি আমার নাম জানো কিভাবে?”

মেয়েটি বলল, -“আসলে আমি আপনার বাসার পাশের ফ্লাটেই নতুন এসেছি আমি আপনাকে চিনলেও আপনি আমাকে চেনেন না। সে যাইহোক আমি বাসা থেকে একটু বের হয়েছিলাম হঠাৎ করেই ওই পাগল রহিমা বলে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগে। আর আমি ভয়ে দৌড় দেই।” বলেই মেয়েটি মাথা নিচু করে থাকে।

কিছুক্ষণ নিরব বসে থেকে অনুভব অট্টহাসিতে ফেটে পরে আর মেয়েটি কিছু না বুঝতে পেরে ফেলফেল করে শুধু অনুভবের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুভব অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে, -“আচ্ছা তুমিই কি সেই ভীতু সারা। আর ওই পাগল তোমাকে ওর বউ মনে করছিলো আল্লাহ্ গো” বলেই আবার হাসতে লাগলো।

এইদিকে সারা তো রেগে আগুন অনুভব তার ক্রাশ তাকে ভীতু বলল। নিশ্চিত ওর ছোট ভাই পুরো পাড়া বলে বেরিয়েছে যে ও ভীতু ও খালি একবার ওর ভাইকে কাছে পেয়ে নিক।

অনুভব বলল, -“এখন যাও কোথায় যাবে ওই পাগল সরে গিয়েছে। এরপর থেকে একটু সেফলি চলাফেরা করবে কখন আবার পাগলটা তোমাকে বউ ভেবে তুলে নিয়ে যায় বলা যায় না।” বলেই আবার হাসতে লাগলো।

সারা গাড়ি থেকে নেমে ঠাস করে দরজা গাড়ির লাগিয়ে হনহন করে চলে গেলো।

ভার্সিটিতে আদিল আর শুভ্রাকে একসঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে অনিক তার হাতে থাকা খাতাটা জোরে ছুরে মারে।

আদিল আর শুভ্রা যখন ভার্সিটিতে আসছিলো তখন অনিক তার কেবিন থেকে ওদের দেখতে পায়। সে সঙ্গে সঙ্গে কল করে আর বলে, -“আমি আর সহ‍্য করতে পারছিনা ওদের একসঙ্গে। কিছু একটা বলো কি করবো ওদের?”

ওই পাশ থেকে কথা ভেসে উঠলো, -“কুল মাই বয় কুল এতো উত্তেজিত হতে নেই শান্ত থাকো। আমি ভাবছি কি করা যায়।”

অনিক ওর ফোন ছুড়ে ফেলে দিলো। আর বলল….

( চলবে )

পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া পর্ব-১২

0

#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ১২

আদিল মনে মনে বলল, -“হায় রে ভালোবাসা কাউকে কাদায় কাউকে হাসায়। প্রথম ভালোবাসা হয় তো সত্যিই কাদায়।”

——————

প্রায় দেড় বছর পর আজ বাংলাদেশে ফিরছে আদিল। এই দেড় বছরে অনেক চেষ্টা করেছে সে শুভ্রার কথা ভুলে যেতে। কিন্তু ভুলে যাবো বললেই কি আর ভুলে যাওয়া যায়। দেশের মাটিতে পা রাখতে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো ওর। সে দেখলো ওকে রিসিভ করার জন‍্য অনুভব, রাজিব আর অভ্র দাড়িয়ে আছে। ওদের দেখে মুচকি হাসলো আদিল।

ওরা সবাই এসে আদিলকে জরিয়ে ধরল। অভ্র বলল,-“শয়তান তুই আমাদের না বলে হুট করে বিদেশ কেন চলে গেলি। জানিস আমাদের কতো মন খারাপ হয়েছিল।”

আদিল বলল, -“বাদ দে এসব। চল বাসায় যাই আম্মু অপেক্ষা করছে হয় তো।”

ওরা সবাই বাড়ি পৌঁছতেই আদিলের মা দৌড়ে এসে আদিলকে জরিয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।

আদিল ওর আম্মুকে সামলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখলো নুসরাত গাল ফুলিয়ে ছলছল চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

আদিল ওর কাছে যেতেই নুসরাত কান্না করে দিলো। সে বলল, -“ভাইয়া তুই যে শুভ্রা আর অনিক ভাইয়াকে ভালো রাখতে বিদেশ গেছিলি। কিন্তু অনিক ভাইয়া ভালো থাকলেও শুভ্রা ভালো নেই।”

আদিল বলল, -“মানে কি বলছিস এগুলো? কি হয়েছে শুভ্রতার! বল”

অভ্র বলল, -“আরে ভাই বলিস না এই দেড় বছরে অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে। আমার বোনটা এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ওর সবচেয়ে বড় ভুল হয় তো ছিলো কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসা।”

আদিল বলল, -“কি হয়েছে তোরা আমাকে সব ক্লিয়ার করে বলছিস না কেন? আর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে মানে।” আদিল বলতে বলতে ধপ করে সোফায় বসে পরলো সে মাথার চুল টেনে ধরলো।

কিছুক্ষণ ওই রকম করে বসে থেকে হঠাৎ করে উঠে দাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে অভ্রের সামনে দাড়িয়ে ওর হাত ধরে বলল “কোথায় শুভ্রতা, আমি এখনি যাবো ওর কাছে প্লীজ প্লীজ।”

অভ্র বলল, -“শান্ত হ দোস্ত। একটু রেস্ট নিয়ে নে তারপর না হয় তোকে নিয়ে যাবো।”

আদিল বলল, -“না আমি এখনি যাবো।”

আদিলের জেদের কাছে হার মেনে অভ্র বাধ‍্য হয়ে ওকে শুভ্রার কাছে নিয়ে গেলো।

আদিল দেখলো একটা অন্ধকার রুমে জানালার পাশে বসে আছে একটা মেয়ে। চুলগুলো এলোমেলো, গায়ের পোশাকের অবস্থাও খারাপ, চোখে নিচে কালো দাগ পরে গিয়েছে, কেমন যেন সাদাটে ভাব এসেছে ওর মুখে। শুভ্রার এমন অবস্থা দেখে আদিলের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।সে আর কিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে শুভ্রাকে জরিয়ে ধরলো।

শুভ্রা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। হঠাৎ করেই শুভ্রা আদিলকে ধাক্কা দিয়ে নিজেও ছিটকে অন‍্যদিকে সরে গেলো।

হঠাৎ ধাক্কা দেওয়ায় আদিল পরে গেলো। অভ্র গিয়ে ওকে উঠিয়ে রুম থেকে বাহিরে নিয়ে এলো।

আদিল ছলছল দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকিয়ে বলল “ওর কি হয়েছে,আর অনিক কোথায়?”

অভ্র একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, -“ওদের বিয়ের পর কয়েকমাস সব প্রায় ঠিকঠাকই ছিল। সমস্যা তো হলো যখন অনিকে ফুফু আর ফুফাতো ভাই বোন ওদের সঙ্গে দেখা করতে এলো। অনিকের ফুফু সবসময়ই চেয়েছেন অনিকের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দিতে। তিনি এসেই ওদের সম্পর্কে ফাটল ধরানো চেষ্টা করে। ওনি কিভাবে যেন খবর পেয়ে গিয়েছিলেন অনিকের বন্ধুও শুভ্রাকে পছন্দ করতো। আর ওনার পক্ষে জানাও বেশি টাফ ছিলোনা। কারণ উনি ওনাদের এলাকার এমপি ছিলেন আর ওনার অনেক লোক আছে খোজখবর নেওয়ার। ওনি তোর পিক আর শুভ্রার পিক একসঙ্গে এডিট অনিককে দেখিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন। এমনকি অনিকের বাবা সব বুঝতে পেরেছিলেন বলে ওর ফুফু ওনাকেও খুন করে এবং তা তুই করছিস বলে চালিয়ে দেন।”

আদিল বলল, -“আমি কেমনে কি। আমি তো দেশেই ছিলাম না।”

অভ্র বলল, -“ওইটাই তো ওর মা নেই দেখে ছোট থেকে ও ওর ফুফুর কাছে মানুষ। ওই মহিলা যা বলছে তাই বিশ্বাস করছে। আমরা অনেক চেষ্টা করছি আসল ঘটনা বলার কিন্তু পারিনি। অনিক ওর বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিদিন রাতে বাসায় এসে শুভ্রাকে মারতো আর ফুফুতো বোনের সঙ্গে বিয়ে কথা বলতো। অতিরিক্ত মানসিক চাপের জন‍্য শুভ্রা এমন হয়ে গিয়েছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু লাভ হয়। ডাক্তার বলেছে ও যেটার জন‍্য ডিপ্রশনে গিয়েছে। সেটাই পারে একমাএ ওকে সারিয়ে তুলতে।”

আদিল বলল, -“এখন অনিক কোথায়?”

অভ্র বলল, -“ও ওর বাসায় আছে।”

আদিল বলল, -“ওর ফুফাতো বোন কোথায়?”

অভ্র ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, -“শুভ্রার সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর ওদের বিয়ে হয় বিয়ের ছয়মাস পর অনিকের প্রায় অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে ও অন‍্য ছেলের সঙ্গে চলে যায়। পুরোটাই নিতো কিন্তু পারেনি।”

আদিল উঠে দাড়িয়ে বলল, -“আঙ্কেল আন্টি কোথায়?”

অভ্র বলল, -“আম্মু আব্বু তো রুমে কেন কি হয়েছে?”

আদিল বলল, -“আমি কি যেতে পারি।”

অভ্র বলল, -“হুম কেন না। কিন্তু কি হয়েছে বলবি তো!”

আদিল আর কিছু না বলে রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো। কোনো মতে শুভ্রার আম্মু আব্বুকে রাজি করিয়ে শুভ্রাকে বিয়ে করলো সে। শুভ্রা আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে আদিলের সঙ্গে থাকলেই ঝগড়া করতো। কিন্তু এখন কথা বলে না বললেই চলে।

দিন যায় আর আস্তে আস্তে আদিলের সঙ্গে থাকতে থাকতে শুভ্রা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। খুশেই কাটছিলো ওদের দিন। কিন্তু ওই যে বলে সুখ ক্ষণিকের জন‍্য আসে। তেমনটা আদিল ও শুভ্রার সঙ্গে ও হয়।

অনিক আদিল আর শুভ্রাকে একসঙ্গে ওই সেই নদীর পাড়ে দেখতে পায়। আসলে হয় তো সবার মন খারাপ থেকে ভালো করার জায়গা একই ছিলো।

আদিল প্রায় প্রতিদিন তার শুভ্রতাকে নিয়ে সেই নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতো। হঠাৎ করেই একদিন অনিক ওদের তুলে নিয়ে যায়। ওদের দুইজনকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখে। ওরা পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনে অনিককে দেখতে পায়। শুভ্রা অনিককে দেখে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেয়।

অনিক তার গান আদিলের কপালে ঠেকিয়ে বলল, -“কেন তুই আমার আব্বুকে মারলি? তুই তো জানতিস আমার মা আমার জন্মের সময়েই মারা গিয়েছিলেন আর আমার বাবা। কি অপরাধ করেছিলেন ওনি? তোর শত্রু তো আমি ছিলাম তাহলে কেন তুই ওনাকে কেন কেন বলল?

আদিল বলল, -“তোর ফুফু তোকে…..

আদিলের কথার মাঝখানেই লামিয়া বেগম মানে অনিকের ফুফু এসে বললেন,

-“অনিক তুই এখনো একে বাঁচিয়ে রাখছিস কেন? ও তোর বাবাকে খুন করেছে ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”

অনিক গুলি করে আদিলকে কিন্তু তার আগেই পুলিশ এসে অনিকের হাতে গুলি করায় ওর নিশানা অন‍্যদিকে চলে যায় আর গুলি গিয়ে লাগে লামিয়া বেগমের বুকে।

লামিয়া বেগম বুকে হাত চেপে ধরে শুভ্রার দিকে গান তাক করে বললেন তুই ছিলি আসল ঝামেলা তোকে আমার আগে মারতে হতো বলেই তিনি গুলি করে দিলেন। আদিল অনেক চেষ্টা করলো নিজেকে ছাড়িয়ে শুভ্রাকে বাঁচাতে কিন্তু সে নিজেকে ছাড়ানোর আগেই গুলি শুভ্রার মাথা লাগলো। শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেলো। আদিল “শুভ্রতা” বলে চিল্লিয়ে উঠলো।

অভ্র রাজিব অনুভব দৌড়ে এলো। পুলিশ এসে অনিককে নিয়ে গেলো।

রাজিব এসে আদিলকে খুলে দিতেই আদিল দৌড়ে শুভ্রা কাছে বসে ওকে ডাকতে লাগলো অনুভব বলল, -” ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে চল।”

আদিল শুভ্রাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাহিরে বের হয়ে গাড়িতে বসলো। সবাই মিলে শুভ্রাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ওকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। অন‍্যদিকে আদিল শুভ্রার এমন অবস্থা দেখে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। ও অপারেশন থিয়েটারের সামনেই ঠাস করে বসে পরলো।

কিছুক্ষণ পর আবার উঠে অভ্র রাজিব আর অনুভবের কাছে এসে বলতে লাগলো, -” আমিই শুভ্রতাকে আগলে রাখতে পারিনি তাই না বল।” ওরা আদিলকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ আদিল অজ্ঞান হয়ে গেলো।

দীর্ঘ তিনঘন্টা পর শুভ্রার অপারেশন শেষে ডাক্তার বের হলেন আর যা বললেন তার জন‍্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। ওনি বললেন,

-“শুভ্রার স্মৃতি থেকে দীর্ঘ তিন চার বা এর বেশি সময়ের স্মৃতি মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

আদিলের এই কথা শুনে যেন ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। ও ধপ করে বসে পরল।

পরের দিন গুলোতে শুভ্রার আর কিছুই মনে ছিলো না। কিছু মনে করাতে গেলেই তার মাথা ব‍্যথা করতো আর সে অজ্ঞান হয়ে যেতো। আর অতিরিক্ত অজ্ঞান হলে তার কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। তাই…..

(চলবে)

পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া পর্ব-১১

0

#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ১১

এভাবেই দেখতে দেখতে তিন দিন চলে গেলো। ওদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে হয়ে গেলো। এই কয়েকদিনে অনিক তার কাজে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। প্রায় শুভ্রাকে পটিয়েই ফেলেছে। আর অন‍্যদিকে আদিলের সঙ্গে শুভ্রার সারাদিন ঝগড়া লেগেই ছিলো। সামান্য বিষয় নিয়ে তারা বড়সড় ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছিলো। সবাই ওদের উপর বিরক্ত। সবাই এখানে এসেছে আনন্দ করতে আর এরা সারাক্ষণ ঝগড়ায় করে গিয়েছে।

ওরা নিজেদের বাড়ি ফিরে আবার নিজেদের মতোই ব‍্যস্ত হয়ে পরলো।

তিনমাস চলে গেলো। এই তিনমাসে আদিল অনেকবার চেষ্টা করেছে শুভ্রার সঙ্গে যোগাযোগ করতে কিন্তু পারেনি। মাঝখানে সে জানতে পারে শুভ্রা নাকি অনিকের সঙ্গে রিলেশনে জরিয়েছে। কথাটা শুনে যেনো ওর বুক কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো। ও যে শুভ্রাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো। অনুভব কল করে ওর বড় বোনের বিয়েতে যাওয়ার কথা বললে আদিল না করে। কিন্তু পরে অনুভবে জোর করতে সে শুধু বিয়েতে যাবে বলে। হলুদের অনুষ্ঠানে সে যাবে না।

বিয়ের দিন…

আদিল একটা নেভি ব্লু রঙের পাঞ্জাবি পড়ে উপস্থিত হলো অনুভবের বিয়েতে। ওকে দেখেই অনুভব ওকে জরিয়ে ধরে বলল,

“ভাই কতোজনকে ঘায়েল করতে আসছিস। তোকে ছেড়ে তো কোনো মেয়েই আমাদের দিকে তাকাবে না।”

রাজিব পাশ থেকে বলে উঠলো,- “শালা নিজে মেয়ে পটাইতে আসছে। আমাদের আগে বলবি না। আমরা আরো একটু সাজুগুজু করে আসতাম। এখন তো আর আমাদের কেউ পাত্তায় দিবে না।”

আদিল মুচকি হাসি দিয়ে বলল,-” রাখ তোদের ফাউ কথা।”

অভ্র পিছনে থেকে বলে উঠলো “কি ফাউ কথা বলছিস তোরা আমি ও একটু শুনি।”

অভ্রের কন্ঠ শুনে আদিল পিছু ফিরতেই ওর চোখ আটকে গেলো। শুভ্রাও নেভি ব্লু রঙের একটা শাড়ি পরেছে। হালকা মেকাআপ,হালকা গহনায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে ওকে। আদিল হা হয়ে গিয়েছে পুরো।

অনুভব আদিলকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলল- “হা টা বন্ধ কর শালা। মশা ঢুকে যাবে।”

অনুভবের কথায় আদিল তাড়াতাড়ি করে নিজেকে স্বাভাবিক করলো।

অভ্র আবার বলল,-“কিরে কি কথা।”

আদিল বলল, -“কিছু না।” ওদের কথার মাঝখানেই অনিক এসে হাজির। অনিক এসে বলল,

“কি অবস্থা তোদের। সবগুলো একসঙ্গে কি করছিস?”

অনুভব বলল,-“আমাদের আর অবস্থা। সবারই প্রায় গতি হয়ে গেছে দেখছি। তারমধ‍্যে কিছু কিছু অসহায় পরে পরে খাবলি খাচ্ছে।”

অনিক কপাল কুচকে বলল “মানে”

অনুভব বলল “কিছু না। তুই বুঝবি না। তো আদিল নুসরাতকে তো দেখছিনা ও কোথায়?”

নুসরাত পাশ থেকে হাউ করে উঠতেই অনুভব লাফিয়ে উঠলো। পাশে নুসরাতকে দেখে অনুভবে রেগে বলে “শয়তান মাইয়া এখনই তো আমি ভয়ে খেয়ে টপকে যেতাম। তখন আমার ফিউচার বউয়ের কি হতো? সে তো বিধবা হয়ে যেতো।”

নুসরাত বলল “চিল ব্রো। কিছু হতো না। আমি আছি না নো টেনশন।”

অনুভব বলল “তুই আছিস এটাই বড় টেনশন। ওই অভ্র, আদিল, নুসরাত,শুভ্রা তোরা কি মিলিয়ে মিলিয়ে জামা পরছিস নাকি।”

শুভ্রা এতক্ষণে খেয়াল করলো তার আর আদিলের ড্রেস মিলে গিয়েছে। সে তো অনিককে বলেছিলো মিলিয়ে পরতে কিন্তু অনিক তো সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। আর আদিল কেমনে কি!

অভ্র বলল “না তো আমি তো কারো সঙ্গে মিলিয়ে পড়ি নি।”

অনুভব বলল “বুঝি বুঝি। যাইহোক চল তোরা আপুর সঙ্গে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।” অনুভবের পিছু পিছু ওরা সবাই যেতে লাগলো।

শুভ্রা অনিককে খোচা দিয়ে বলল “এই তুমি আমার কথা মতো পাঞ্জাবি পড়নি কেন?”

অনিক বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলল, -“ধুরু ওই রঙের পাঞ্জাবি পরলে খেতখেত লাগতো আমাকে।”

শুভ্রা অনিকের কথা শুনে মন খারাপ করলো। কারণ এই বিয়ে উপলক্ষে সে অনিককে ওই পাঞ্জাবিটা গিফট করেছিলো। শুভ্রা অনিককে উদ্দেশ্য করে বলল “আচ্ছা বাদ এই পাঞ্জাবি তে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। এখন বলো তো আমাকে কেমন লাগছে।”

অনিক শুভ্রার কথা পাত্তা না দিয়ে শুভ্রাকে এরিয়ে অন‍্যজায়গায় চলে গেলো। এতে শুভ্রার অনেক মন খারাপ হলো। শুভ্রা অনুভবের আপুর সঙ্গে দেখা করে চুপ করে এক নিরিবিলি জায়গায় দাড়িয়ে রইলো। সে দেখলো অনিক একটা মেয়ের সঙ্গে অনেক ফ্রি হয়ে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। অনিকের শুভ্রার দিকে কোনো খেয়ালই নেই।

আদিল অনেকক্ষণ যাবত ওদের খেয়াল করছে। শুভ্রার কাদো কাদো মুখ দেখে শুভ্রার কাছে যেতে নিবে তখনই রাজিব ওর হাত ধরে আটকিয়ে ধরে বলে, -“যাস না অনিক আর শুভ্রার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। আগামী সপ্তাহে ওদের বিয়ে।”

রাজিবের কথা শুনে আদিলের যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। এই প্রথম সে কাউকে ভালোবাসলো। আর তার বিয়ে হবে তারই প্রাণপ্রিয় এক বন্ধুর সঙ্গে। কষ্টগুলো সব দলা পাকিয়ে আসছে যেন ওর। ও মুখে মিথ‍্যা হাসি নিয়ে বলল “ও তাই নাকি। এ তো অনেক ভালো একটা খবর। শালা বিয়ে করছে আর আমাকে বললও না।”

অনুভব বলল, -“ও অনেক বার বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শুভ্রার কথা উঠতেই তুই ওকে থামিয়ে দিয়েছিলি।”

আদিল বলল “ও আচ্ছা।” আদিল অনিকের কাছে গিয়ে ও গলা জরিয়ে ধরে বলল “অভিনন্দন দোস্ত। দোয়া করি তোদের মেরেজ লাইফ অনেক ভালো ও আনন্দে কাটুক। ট্রিট দিস কিন্তু আবার ভুলে যাস না।”

অনিক বলল, -” কিরে ভাই তোর চোখে পানি কেন?”

আদিল মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -“আসলে চোখে যেন কি একটা পরেছে তেমন কিছু না। আচ্ছা তাহলে আমি আসি আমার একটা জরুরি কাজ পরে গিয়েছে।”

অনিক বলল- “আর একটু থেকে যা।”

আদিল বলল, -“না ভাই আর থাকা হবে না।”

অনুভব বলল, -“ওই আদিল থেকে যা বলছি।”

আদিল বলল, -“সোনা ভাই আমার যেতে দে আমাকে। অনেক জরুরি কাজ পরে গিয়েছে।”

অনুভব বলল, -“অন্তত কিছু খেয়ে যা। আপু শুনলে কিন্তু মন খারাপ করবে।”

আদিল পাশের টেবিলে থাকা একটা শরবতের গ্লাস নিয়ে শরবত খেয়ে বলল, -“এখন যাই।” বলেই আর কাউকে কিছু না বলতে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

সে বাহিরে বের হয়ে তার বাবা ইমরান সাহেবকে কল দিলো। দুইবার রিং হতেই ইমরান সাহেব কল রিসিভ করলেন।

আদিল বলল, -“আব্বু তুমি যে আমাকে বিদেশ যাওয়ার কথা বলছিলে তার ব‍্যবস্থা করো। আমি যাবো দুই তিনদিনের মধ্যেই।”

ইমরান সাহেব বললেন, -“আদিল তোমার কি কিছু হয়েছে?এমন শোনাচ্ছে কেন তোমার কথা!”

আদিল বলল, -“না আব্বু কিছু হয়। তুমি তাহলে ব‍্যবস্থা করো। আমি এখন তাহলে রাখি।” বলেই কট করে কল কেটে দিলো।

———————-

আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। বৃষ্টি সুমিষ্ট সুগন্ধ দিয়ে চারিপাশ মো মো করছে। আকাশের ও হয় তো মন খারাপ তাই তো সে তার মনকে হালকা করতে বর্ষণ হিসেবে বয়ে পরতে চাচ্ছে। রাস্তার মানুষজন সবাই নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্য ছুটছে যাতে বর্ষণ তাদের স্পর্শ না করতে পারে। ইতোমধ্যে বর্ষণের ধারা শুরু হয়ে গিয়েছে। আদিল একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার মাটির দিকে তাকিয়ে হাটু গেড়ে বসে পরলো। তার চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে। তার সঙ্গেই কেন এমনটা হতে হলো। দীর্ঘ দুইঘন্টা পর বিষন্নভাবে ঢুলু ঢুলু পায়ে বাড়িতে পৌঁছলো সে। আদিলের মা তার ছেলের এই অবস্থা দেখে আতকে উঠলেন। এ কি অবস্থা তার হাসিখুশি ছেলেটার। যার মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে এমন বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন? আদিলের মা বললেন,

-“বাবা তোর কি হয়েছে, তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

আদিল অনেক কষ্ট নিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, -“আম্মু আমার আবার কি হবে কিছুই হয় নি। আমি তো একদম বিন্দাস আছি। আচ্ছা আম্মু আব্বু আসে নি।”

আদিল মা ছলছল নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, -“তুই আমাকে আমাদের সবাইকে রেখে বিদেশ চলে যাবি।”

আদিল বলল, -“আম্মু আমি তো একবারের জন‍্য যাচ্ছিনা এই ধরো বছর দুয়েক এর মতো থাকবো তারপর তো আবার চলে আসবো। তা আমি কবে যাচ্ছি আব্বু কিছু বলে নি।”

আদিলের মা বললেন, -“কাল সকালে ছাড়া নাকি এইমাসে যাওয়ার আর সুযোগ নেই।” তাই কালকে বলে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

আদিল মুচকি হাসি দিয়ে ওর মাকে জরিয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকলো আর মনে মনে বলল……

( চলবে )