Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 46



ছায়াতরু পর্ব-০১

0

#ছায়াতরু
#সূচনা_পর্ব
–জুনানী চাকমা

হবু স্বামীর সাথে নিজের সৎ বোন রাহাকে এক বিছানায় বাজে অবস্থায় দেখে চমকে গেলেও মনে মনে খুশি হলো স্মরণ । এবার তাহলে বিয়েটা আটকানো যাবে, মানে একদম দৌঁড়োবে। টুপ করেই ছবি তুলে নিলো সে। এরপর চমকানো ভাবটা মুখে রেখে আর চোখের সামনে এমন পাপকাজ দেখে রেগে চেঁচিয়ে বললো,“ এসব কি?ছি!”

হিমেল তখন স্মরণকে দেখে শার্ট পড়তে ব্যস্ত। আর রাহা ওড়না নিজের জামা ঠিক করতে ব্যস্ত। স্মরণ সুযোগে সদ্ব্যবহার করতে ভুললো না। হিমেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে গালে সপাটে একটা চড় মেরে বসলো আর মনে মনে বললো ‘আহা শান্তি। আরও দুটো মারা উচিত।’ যেই ভাবা সেই কাজ, পরপর আরও দুটো চড় মেরে ক্ষান্ত হলো স্মরণ।

এদিকে গালে একটা চড় পড়তেই হিমেল এতটাই হতবম্ভ হয়েছিলো যে পরপর আরও দুটো পড়ে সেই হতবম্ভতা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। ওপাশে দাঁড়ানো রাহা নিজেও হতবম্ভ হলো। হিমেলকে চড় মারতে দেখে স্মরণের দিকে এগিয়ে এলো স্মরণকে মারার জন্য। স্মরণের অতি নিকটে এগিয়ে এসে হাত উঁচিয়ে চড় মারতে প্রস্তুত হতেই স্মরণ খুব সহজেই হাতটা ধরে ফেললো। মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বললো,“ আকাম করবি তুই! আর মার খাব আমি? এটা কি করে হয় রাহা?”

রাহার হাত দিয়ে রাহাকেই চড় মারলো স্মরণ। চড়ের বেগ এতটাই ছিলো যে রাহার বিশুদ্ধ মস্তিষ্ক গাণিতিক সমাধানে নিউটনের প্রয়োজনীয় সূত্রাবলি হিসেব মনে করতে লাগলো। হিমেল নিজের হতবম্ভতা কাটিয়ে শক্ত গলায় ধমকে বললো,“ হাউ ডেয়ার ইউ?”

স্মরণ পেছনে ঘুরে মাথাটা ডান দিকে হেলিয়ে ডান হাত ডান চোখের সামনে এনে তর্জনী আর মধ্যমা ভি আকৃতির করে ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে শান্ত স্বাভাবিক আওয়াজে বললো,“ হাউ ডেয়ার মি?”

হিমেল এতটাই রেগে গেলো যে স্মরণকে মারার জন্য নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলতে লাগলো। স্মরণ ভীষণ বিরক্ত হলো। একে খুব বড়সড় শায়েস্তা করতে হবে মনে মনে ঠিক করে নিলো। হিমেল বেল্টটা হাতে নিয়ে স্মরণকে মারার জন্য উদ্যত হতেই স্মরণ সেটা ধরে ফেললো। হিমেলের মেইন জায়গায় একটা লাথি মারতেই হিমেল সে জায়গায় ধরে কাচুমাচু হয়ে গেলো আর পুরো মুখ লাল হয়ে গেলো। স্মরণ গায়ের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে হিমেলের থেকে কেড়ে নিলো বেল্টটা। হিমেলের গায়ে এক ঘা বসিয়ে দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো হিমেল। পেছন থেকে রাহা স্মরণকে আটকানোর জন্য এগিয়ে এলো, স্মরণ সড়ে গিয়ে রাহাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো হিমেলের কাছে। রাহার গায়েও এক ঘা বসিয়ে দিলো স্মরণ। আর ভাবতে লাগলো এই মেয়ে আর তার মা মিলে তাকে ছোটবেলা থেকে ঠিক কি কি ভাবে হেনস্তা করেছে। আর স্মরণের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পরও কিভাবে স্মরণের হবু স্বামীর সাথে এমন অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। অবশ্য স্মরণের নিজেরও এই বিয়েতে কোনো মত ছিলো না তবে বাবার কঠিন অসুস্থতার কথা চিন্তা করেই রাজি হয়েছিলো। তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ রাহাকে নোটিশ করছিলো স্মরণ ।

হিমেল যেদিন স্মরণের সাথে দেখার করার সিদ্ধান্ত নিলো সেসময় রাহাও কেন যেন স্মরণের সাথে যাওয়ার বায়না ধরে। আর ঠিক সেদিনই স্মরণ টের পায় এদের দুজনের মাঝে গভীর সম্পর্ক চলছে। স্মরণ জানে রাহা তার সমস্ত কিছু কেড়ে নিতেই অভ্যস্ত এবং ভালোবাসে। তবে হিমেলের সাথে এমন বাজে কাজ করবে তাও অবিবাহিত দুজন; এমন কিছু কল্পনার বাইরে ছিলো।

তাই আজ এদের একটা উচিত শিক্ষা দিয়েই তবে বাড়িতে ফিরবে স্মরণ। আজ বাড়িতে আগুন লাগাক এই রাহা। তবুও স্মরণ মোটেও ছেড়ে দেবে না একে। আগুন যদি লাগেই তবে আজই বাড়ি ছাড়বে স্মরণ। পনেরোটা বছর যাবৎ সহ্য করে আসছে, এই মা মেয়ের ঈর্ষা, অত্যাচার। আর কত?

স্মরণ মুখ ফুলিয়ে দাতে দাত চেপে কয়েক বার আঘাত করলো দুজনকে। সেসময় হোটেলের একজন কর্মচারী এসে স্মরণকে আটকালো।

‘‘ ম্যাম একি করছেন আপনি?’’

স্মরণও থেমে গেলো। বাইরে কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছে। রাহা আর হিমেল আর্তনাদ করছে দুজন। ব্যথা পেয়েছে। এটাতো তাদের প্রাপ্যই ছিলো। আরও যখম করা উচিত এদের। সমাজের নোংরা কিট এরা। যারা প্রতিনিয়ত পাপ করে চলেছে আর ভবিষ্যতেও করবে।

স্মরণ হাটুগেড়ে কান্না করতে থাকা রাহার নিকট বসলো। রাহা জলন্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে স্মরণের দিকে। ওপাশে হিমেল অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাহা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রাগান্বিত গলায় স্মরণকে বললো,“ এর হিসেব আমি একদম হাড়ে হাড়ে নেবো স্মরণ।”

স্মরণ মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ালো। এমন হুমকি রাহা ছোট থেকেই তাদের দিয়ে আসছে। অবশ্য রাহার মা মিসেস রাবিনা নিজেও স্মরণকে ভীষণ মারধোর করেছেন নিজের মেয়ের জন্য। যখন স্মরণ কলেজে উঠলো, এরপর থেকেই মিসেস রাবিনার এসব কর্মকাণ্ড কমতে লাগলো। তবে মুখ হতে নিঃসৃত সেই বাজে, বিশ্রি কথাগুলো আর দু একটা চড় এখনও চলমান। স্মরণ ছোট থেকে এতটাই সাফার করেছে যে এখন সে সমুদ্রের তীরে থাকা শক্ত পাথরের ন্যায় হয়ে গেছে। মিসেস রাবিনা কিছুদিন আগেই একটা চড় মেরেছে স্মরণকে। স্মরণ গায়েও মাখে নি। নিজেকে ইস্পাতের কাঠামোয় এমন নিখুঁতভাবে তৈরি করেছে যে এখন এমন জলন্ত খনি সে খুব একটা গায়ে মাখে না। ছোটবেলার সেই অনুদিত তেজটা যেন হঠাৎ করেই স্মরণের মাঝে উদীয়মান।

স্মরণ কণ্ঠে তেজ মিশিয়ে রাহার কথার প্রত্যুত্তর করলো,“ তা না হয় নিয়ে নিস। তবে তোর এই কুকর্ম আমি বাবার কাছে ফাস করে দেবো আজ।”

হিমেলের দিকে তাকালো স্মরণ আর বললো,“ বাবাকে বলবো এমন এক নোংরা কিটের সাথে নাকি আমার বিবাহ ঠিক করেছেন তিনি। যে কিনা হবু স্ত্রীর সৎ বোনের সাথে সবকিছু করে ফেলেছে। সবাই জানুক নবনী এসব আবর্জনা পা দিয়ে পিষে মারে।”

“ মুখ সামলে কথা বল স্মরণ।”

রাহার কথা শুনে স্মরণ হাসলো,“ মুখ সামলেছি বহুবার। তবে শেষবারে আর নয়।”

“ বাবাকে এসব কিছুই দেখাবি না তুই।”

খুব জোড়ে জোড়ে হাসলো স্মরণ। ওদিকে কর্মচারী দুজন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছে এসব। যেন কোনো মুভি চলছে এখানে। স্মরণ হাসি থামিয়ে বললো,“এককথার মানুষ আমি।”

উঠে দাঁড়িয়ে বেল্টটা হিমেলের দিকে ছুড়ে মারলো। এরপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। এদিকে রাহা পাগলপ্রায় হয়ে গেলো। তার মা জানলে তাকে মেরেই ফেলবে। কারণ তার মা আগে থেকেই সাবধান করেছিলো যে এইবার আর নয়। স্মরণের বিয়ের ব্যাপারে কোনো কিছু না করতে। তবে রাহা হিমেলকে দেখে পছন্দ করে ফেলেছিলো। তাইতো এতদূর। চেঁচিয়ে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বললো। উঠে দাঁড়ালো কোনোভাবে। হাতে পায়ে পিঠে সর্বাঙ্গে ব্যথার প্রখরতা বুঝলো। খুড়ে খুড়ে হেঁটে গিয়ে টেবিলের কাছে গেলো। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিলো। আর মায়ের নাম্বারে কল করলো। কয়েক সেকেন্ড বাদে কল রিসিভ হতেই নানা মিথ্যে কথা শোনালো মা–কে স্মরণের নামে। আর তাকে মারার বিষয়টা রসিয়ে কষিয়ে বললো। কলের অপরপ্রান্তে থাকা মিসেস রাবিনা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। বোঝা গেলো আজ বাড়িতে কিছু একটা হবে।

___________________________

শীতের মিষ্টি দুপুর। বাতাসের বেগ সর্বোচ্চ মাত্রায় রয়েছে। যেন ক্ষণবাদেই বৃষ্টি পড়বে। তবে আকাশের উজ্জ্বলতা আর সূর্যের মিষ্টি হাসি যেন অন্য কথা বলছে। তাদের বচন যেন এমন ‘বৃষ্টি নয়, বরং এটা শীতের একছত্র আবহাওয়া মাত্র’। স্মরণ হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো। সকালে রাহাকে কথা বলতে শুনে ফেলেছিলো স্মরণ। তাইতো আজ একদম অ্যাকশন নিতে পারলো সে।

এসব বলেই মেজাজ ফুরফুরে হয়ে হাঁটছিলো সে। সেসময় সামনে থেকে কোনো এক শক্তপোক্ত ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খেলো স্মরণ। স্মরণ থেমে গেলো। স্মরণ তো দেখেই হাঁটছিলো কিন্তু সামনের জন্য চোখ ত্যাড়া করে হাঁটছিলো বলেই অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা। স্মরণ মেজাজ ঠিক রেখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র শক্ত গলায় বললো,“ নেক্সট হতে দেখে হাঁটবেন।”

মুখটা দেখা গেলো না। পিঠ দিয়ে কেমন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো ছেলেটা। স্মরণ তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো। রাস্তার মোড় ঘুরিয়ে বাম দিকে হাঁটা শুরু করলো। সেই ছেলেটি পেছনে তাকিয়ে দেখলো না মেয়েটাকে। তবে মেয়েটার কথা কানে বাজতে লাগলো। তার সামনে অন্য এক ছেলে বললো,“ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।”

ছেলেটা চলে গেলো।
স্মরণ পুরোটা রাস্তা হেঁটে বাসায় এসে পৌঁছালো। একটি তিনতলা বিল্ডিং এর দোতলায় ভাড়া থাকে স্মরণের পরিবার। স্মরণের মা সায়নিকা বেগম ষোলো বছর আগে কার এক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর এক বছরের মাথায় স্মরণের বাবা অনিল মহান রাবিনাকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন। রাবিনা ডিভোর্সি ছিলেন। স্মরণের সমবয়সী এক মেয়েও ছিলো।

তিনি বাড়িতে আসার পর স্মরণের জীবন নরক হয়ে গেলো। ছোট থেকেই মারধোর, লাঞ্চনা-বঞ্চনায় স্মরণের জীবন অতিষ্ট।

স্মরণ কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন মিসেস রাবিনা। অগ্নিচোখে স্মরণের আপাদমস্তক দেখে ঠাটিয়ে চড় মেরে বসলেন স্মরণের গালে। আকস্মাৎ আক্রমণে স্মরণ চমকালো, থমকালো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মিসেস রাবিনা উচ্চৈঃস্বরে রাগী গলায় বললেন,“ আজ তোকে মেরেই ফেলবো আমি।”

#চলবে

শিউলি পাওয়া পর্ব-০৮(শেষ পর্ব)

0

#শিউলি_পাওয়া <শেষ পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
আজ নবমী | পুজোর শেষ দিন | বাঙালির মনে আজ পুজোর আনন্দর সাথে একটা অদ্ভুত দুঃখ মিশে আছে | কালই বিসর্জন , আবার তারপর এক বছরের অপেক্ষা | তাই প্রত্যেকটা বাঙালিই আজকে ঘড়ির কাঁটাকে যেন আটকে রাখতে চায় , সময়টাকে থামিয়ে দিতে চায় , আর নবমীর দিনটাকে ধরে রাখার একটা অদ্ভুত চেষ্টা করে যায় সারাক্ষন | দীপেরও আজকে মনটা একটু খারাপ | এই নবমীর রাতটা কাটলেই তো পুজো শেষ ! আসলে এই কদিন এখানে এতো মজা করেছে , এতো জড়িয়ে গেছে এখানে থাকা মানুষগুলোর সাথে , এই শরৎ-টার সাথে , যে পুজো শেষ হওয়ার কথা মনে এলেই একটা খারাপ লাগা ঘিরে ধরছে ওকে | যাই হোক, সেইসব মন খারাপ নিয়েই ল্যাপটপটা খুলে বসেছিল | সময়কে মুঠো বন্দি না করতে পারুক, ফ্রেম বন্দি তো করেছে | তাই সেইসব পুরোনো ছবিগুলোকেই দেখছিলো ! সেই চতুর্থীর দুপুর , ময়ূরপঙ্খী ঘাটের ফটোগুলো | আর তখনই একটা ফটোটা এসে ওর চোখটা আটকে গেলো | গঙ্গার সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে গিয়ে কখন যে কথাকেও ফ্রেমে নিয়ে এসেছিলো, নিজেও বোঝেনি ! এখন ফটোটা দেখে মনে পড়লো | সেই লাল চুড়িদার, সেই প্রথম দিন | উফ , সত্যি , এই একটা ফটোর জন্য কি ঝগড়াই না শুরু করেছিল কথা ! ভেবেই একটা হাসি চলে এলো দীপের মুখে | ব্যাপারটা যে অনিন্দ খেয়াল করছে দূরে দাঁড়িয়ে , সেটা দীপ বোঝেনি | বুঝলো , যখন হঠাৎ অনিন্দ বলে উঠলো ,
” কি রে ? কি ব্যাপার ? হাসছিস যে ! প্রেমে পরে গেলি না কি ?”
আচমকা এই রকম একটা স্ট্রেট কাট প্রশ্নের জন্য দীপ তৈরী ছিল না , তাই দু সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললো , ” থামবি | আরে , ফটোটা দেখে ময়ূরপঙ্খী ঘাটে প্রথম দিনের ঝগড়ার কথাটা মনে পরে গেলো , তাই হাসছিলাম |”
এবার কিন্তু অনিন্দ একটু সিরিয়াস ভাবেই বললো , ” ওকে , বুঝলাম | তবে একটা জিনিস বলতে পারি | কথার মতন মেয়ে হাজার খুঁজেও পাবি না |”
এটা শুনে দীপ হেসে ফেললো , ” হ্যাঁ , জানি তো | পাবো না | এই রকম পাগল, ঝগড়ুটে টাইপের মেয়েকে পাওয়া সত্যি খুব মুশকিল |”
এরপর অনিন্দ আর কিছু বললো না | চুপ করে গেলো | বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে মুখটা ! দীপ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না | কি হলো আবার হুট্ করে ! ও তো মজা করেই কথাটা বলেছিলো | অনিন্দ রেগে গেলো না কি ! এইসবই ভাবছিলো , তখনই অনিন্দ হঠাৎ বলে উঠলো ,
” আমি মজা করছি না দীপ | সিরিয়াসলি বলছি | কথার মতন মেয়ে দেখা যায় না | নইলে এতো কিছু হওয়ার পরও কেউ এতটা হাসিখুশি থাকতে
পারে ?”
” এতো কিছু হওয়ার পর ? মানে ? কি হয়েছে ওর ?” দীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো এবার |
এর উত্তরটা দেয়ার সময় অনিন্দর একটা দীর্ঘ্যশ্বাস আপনাআপনিই চলে এলো , ” কথার তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার | সেইবার দূর্গা পুজোয় কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলো ওরা | কিন্তু , ফেরার পথে ওদের গাড়িটার একটা একসিডেন্ট হয়ে যায় | গাড়িতে ভূমি , ওর মা বাবাও ছিল | কারোর বিশেষ লাগেনি , শুধু কথারই ! কোমর থেকে প্যারালাইসিস হয়ে গিয়েছিলো পুরো | ওই রকম হাসিখুশি চঞ্চল একটা মেয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল হুইল চেয়ারে | আমরা তো কেউ ভাবতেই পারছিলাম না যে কথা কি করে পুরো ব্যাপারটাকে একসেপ্ট করবে ! এক্সিডেন্টের পর প্রথম দু মাস তো সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ছিল | কারোর সাথে কথা বলতো না | কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিলো | আবার শুরুর থেকে চেষ্টা করতে থাকলো , এক পা এক পা করে হাঁটার | প্রায় দু বছর লেগেছিলো ওর সোজা হয়ে দাঁড়াতে | আর চলতে আরো এক বছর | কত ফিজিওথেরাপি, ওষুধ , ইনজেকশনের পর ! আর সব থেকে বড়ো কথা কি জানিস ! কথা ছোট থেকেই দারুন নাচতো | ওর ঘরে গেলে দেখবি , ক্লাসিক্যাল ডান্সের জন্য কত এওয়ার্ড এখনো সাজানো আছে শো কেসটায় | খুব চাইতো গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বিশ্বভারতী থেকে নাচ নিয়ে পড়বে | কিন্তু ওই এক্সিডেন্টের জন্য সেইসব কিছুই আর হলো না | ডাক্তার বলেই দিয়েছে , ওর পা এ খুব স্ট্রেস দেয়া যাবে না কখনো | তাই আর কোনোদিনও ও নাচতে পারবে না | কিন্তু এতো কিছুর পরও ও কত হাসিখুশি থাকে সব সময় | ওকে দেখে তো কেউ ভাবতেই পারবে না যে লাইফে কি কি ফেস করতে হয়েছে মেয়েটাকে ! ”
এইসব শোনার পর দীপ যেন কিছুক্ষনের জন্য একটু থমকে গেলো | কিছুতেই মেলাতে পারছে না কোনো কিছু ! যার সাথে চার দিন এতো কথা হলো , এতো ঝগড়া , এতো একসঙ্গে ঘোরা , ঠাকুর দেখা , এতো হাসি মজা হলো , তার লাইফটা আসলে এই রকম ! এতটা অন্ধকার , কষ্ট , যন্ত্রনা মিশে আছে ওই হাসি মুখটায় ! ভাবতেই পারছিলো না | তিন বছর একটা মানুষ হাঁটতে পারেনি , একটা হুইল চেয়ারে বসে কাটিয়েছে | কতটা খারাপ লাগা নিয়ে সেইদিন গুলো বাঁচতো কথা ! আর ছোট থেকে যেই স্বপ্ন দেখে এসেছে , নাচ নিয়ে পড়ার স্বপ্ন , সেটা যখন এক সেকেন্ডে ভেঙে গেলো ! তখন ঠিক কি রকম লেগেছিলো ওর | না , দীপ সেটা হয়তো কোনোদিনও জানতে পারবে না | ওই পরিস্থিতে একটা মানুষের কি রকম লাগে , সেটা সে নিজে ফেস না করলে কখনো বুঝতে পারা যায় না | ভেবেই ওর চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো হঠাৎ | নিজের অজান্তেই কথার জন্য ওর চোখে জল জমেছে কখন ! ও বুঝতেই পারেনি | এখন হঠাৎ খুব কথাকে দেখতে ইচ্ছে করছে | মনে হচ্ছে এই চার দিনের চেনাটা যেন কোনো চেনাই ছিল না | আজ নতুন করে চিনলো ওই মেয়েটা | ওর সহ্য শক্তিকে | ওর ওই হাসি মুখটাকে | আসলে এতো কিছু না পাওয়া নিয়েও যে কোনো মানুষ এতো লাইভলি হতে পারে, নিজের কথা দিয়ে অন্যের মুখেও হাসি এনে দিতে পারে , এটা দীপ আজ প্রথম জানলো | তাই আজ কথাকে আবার প্রথম থেকে চিনতে , নতুন করে বুঝতে ইচ্ছে করছে খুব | এইসব ভেবেই কথার বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির | কলিং বাজাতেই দরজার ওপার থেকে সেই হাসি মুখটা বেরিয়ে এলো | আচমকা দীপকে ওদের বাড়িতে দেখে তো সে অবাক ! — ” কি ব্যাপার ? তুমি ? হঠাৎ , এই অধমের বাড়িতে ?”
দীপ গম্ভীর মুখে বললো , ” কেন ? আসতে পারি না ! ”
কি হলো ব্যাপারটা ! মুখটা এই রকম অন্ধকার লাগছে কেন ! ভেবেই কথা বলে উঠলো , ” আরে , আমি ওই ভাবে বলেছি না কি ! আর কি হয়েছে ? তুমি এতো সিরিয়াস কেন ? ”
এবার দীপ একটু অধৈর্য্য হয়ে বললো , ” আচ্ছা , সব কথা কি দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে বলবো ? ভেতরে যেতে দেবে না |”
এটা শুনে কথা হেসে ফেললো | সত্যি , দরজাটা ধরে ও কতক্ষন দাঁড়িয়ে আছে | তাই তাড়াতাড়ি সরে এসে বললো , “প্লিজ প্লিজ , আসুন আসুন | আপনি তো আমার সব থেকে বড়ো অতিথি |”
সেইদিন প্রথম কথার ঘরে গেলো দীপ | অনিন্দর কথাটাকে ওর ঘরে গিয়ে ঠিক মিলিয়ে দেখলো | একটা শো কেশে কত কত মেডেলস , সার্টিফিকেট , এওয়ার্ডস যত্ন করে সাজানো আছে | তখনি আনমনে ও বলে উঠলো , ” এইসব সার্টিফিকেট , মেডেলস গুলো তোমার ? ”
কথা কয়েক মুহূর্তে সময় নিয়ে হেসেই উত্তর দিলো , ” হ্যাঁ, একটা সময়ের আমার | একটু আধটু নাচতাম তখন | এখন আর এইসব কিছুই পারি না |”
এবার দীপের চোখটা কথার সামনেই ভিজে গেলো | সঙ্গে একটা রাগও হলো | চারটে দিন নেহাত কম কিছু না | এতো ঝগড়া, এতো কথা হয়েছে ওদের মধ্যে , কিন্তু এতো বড়ো একটা ঘটনার ব্যাপারে কথা একবারও একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি ওর কাছে ! কেন এতটা দূরের ভাবে ওকে ! ভেবেই বেশ রেগে বলে উঠলো দীপ , ” তোমার এক্সিডেন্টের ব্যাপারে আমাকে কেন কিছু বলোনি ? কাল ও তো আমাদের মধ্যে কত কথা হলো | আমার পুরো লাইফ হিস্ট্রি জেনে নিলে তুমি | আর নিজের জীবনের এতো বড়ো কথাটা শেয়ার করলে না ? ”
তার মানে দীপ সব কিছু জেনে গেছে | ওর থমথমে মুখটা দেখে কথা বুঝতে পারছে এখন ওর কতটা খারাপ লাগছে | সত্যি কখনো ভাবেনি , চার দিনের চেনা একটা মানুষের চোখ ওর কারণে ভিজতে পারে ! তাই দীপের হাতটা শক্ত করে ধরে ওকে পাশের চেয়ারটায় বসালো | তারপর শান্ত গলায় বললো ,
” বলিনি কারণ আমি মনে করি না ওই একসিডেন্ট , ওই তিনটে বছরের ব্যাপারে আমার বলার মতন কিছু আছে ! সত্যি কথা বলবো , আমার এটা নিয়ে এখন আর কোনো কষ্ট হয় না | হ্যাঁ , এক্সিডেন্টের পর দু মাস আমি ডিপ্রেশনে ছিলাম , কারোর সাথে কথা বলতাম না | একেবারে চুপ থাকতাম | কিন্তু তারপর রিয়ালাইজ করলাম , যা হয়েছে আমার লাইফে সেটাকে তো আমি এইভাবে বদলাতে পারবো না | একচুয়ালি আমাদের হাতে তো কিছুই নেই | খারাপ ভালো যা ই হোক , সবটাই আমাদের একসেপ্ট করতে হয় , আর রোজ নিজের মতন করে ভালো থাকার চেষ্টা করতে হয় | এটাই তো লাইফ | জানি , ওই এক্সিডেন্টের জন্য আমার তিনটে বছর নষ্ট হয়েছে , আমার লাইফ থেকে নাচটা চলে গেছে | তার জন্য খারাপ লাগা আছে | কিন্তু সেটা আমি একসেপ্ট করে নিয়েছি | আর যখন মন খারাপ হয় , তখন এটা ভাবি যে ওই একসিডেন্টে তো আমি মারাও যেতে পারতাম | তখন তো সব শেষ হয়ে যেত ! কিন্তু তার বদলে লাইফ তো আমাকে আর একটা চান্স দিয়েছে, নতুন করে বাঁচার চান্স | তাই সেই চান্সটাকে মন খারাপ করে , কষ্ট পেয়ে , কি কি জীবনে হলো না , কি কি পেলাম না , এইসব ভেবে নষ্ট করে কি হবে ! তার থেকে বরং এই হিসাবটা করি , যে কি কি পেয়েছি | কি কি নিয়ে নতুন ভাবে আবার সব কিছু শুরু করা যায় | বুঝলেন | ইশ , অনেক জ্ঞান দিয়ে ফেললাম | বোর হলে না তো ? ”
শেষের এই লাইনটা কথা যেন ইচ্ছে করেই বললো | আর তারপরই ওর মুখে এক চিলতে হাসি | চারিদিকটা আসলে বড্ডো সিরিয়াস হয়ে গেছে | আর দীপের এই রকম থমথমে মুখটা দেখতে একদম ভালো লাগছে না কথার | কিন্তু সেই মুহূর্তে দীপ হাজার চেষ্টা করেও হাসতে পারলো না | অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছিলো ওর | কিসের কষ্ট , ও নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না ! ওই একটা কথা আছে , প্রথম আলাপে কখনো কাউকে বিচার করতে নেই | কথাটার মানে আজ দীপ বুঝলো | যেইদিন এই মেয়েটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল , মনে হয়েছিল এর থেকে বেশি ইমম্যাচিওর মেয়ে ও জীবনে দেখেনি ! আর আজ ঠিক উল্টোটা মনে হচ্ছে | মনে হচ্ছে লাইফটাকে যে কেউ এতটা পজিটিভলি , ম্যাচিওরলি দেখতে পারে , সেটা আজ কথার কথাগুলো না শুনলে বুঝতেই পারতো না | তাই অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো ,
” তুমি খুব আলাদা কথা | সবাই তোমার মতন করে ভাবতে পারে না | সব কিছুকে এই ভাবে একসেপ্ট করতে পারে না |”
কথা এবার দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো , ” কেন পারে না ! চাইলেই পারা যায় | আর একটা কথা বলবো তোমাকে ; তুমিও একসেপ্ট করে নাও | আমি জানি তোমার সাথে যেটা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে | ছোটবেলা থেকে ওই ভাবে একা একা থাকা ! তোমার মা বাবা থাকা সত্ত্বেও তুমি জানো না ফ্যামিলি কি ! আর শুধু টাকা দিয়েই তো আর মা বাবা হয় যায় না | মা বাবা হতে গেলে ভালোবাসতেও জানতে হয় | আসলে তোমার মা বাবা শুধু নিজেদেরটাই ভেবেছে সব সময় | তোমার কথা ওরা কোনোদিনও ভাবেনি | যদি ভাবতো , তাহলে এই ভাবে দূরে সরিয়ে রাখতো না | আর আমি জানি এই কথাগুলো তোমার রোজ মনে হয় | রোজ খুব রাগ হয়ে ওদের ওপর | আর রোজ এই কথাগুলোকে , এই রাগটাকে , এই খারাপ লাগাটাকে তুমি জমিয়ে রাখো, নিজের মধ্যে | কিন্তু ট্রাস্ট মি , এই ভাবে জমিয়ে রাখতে রাখতে তো একদিন তুমি নিজেই শেষ হয়ে যাবে | আর সেইদিনও ওদের কিছু যায় আসবে না | তাই বলছি , যা মনে আছে সেই সব কিছুই বলে ফেলো , আর জমিয়ে না রেখে ! শেষ করে দাও সব কিছু | আর হ্যাঁ, ওদেরও তো জানা দরকার , যে ওরা ঠিক কতটা খারাপ | কতটা ইররেসপন্সিবল দুটো মানুষ | ”
কথাগুলো শেষ করেই কথা চুপ করে গেলো | দীপও আজ নিঃস্তব্ধ | মনে হচ্ছে ওর সামনে যেন কেউ একটা আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখন | এতদিন যেই যন্ত্রনা , যেই কষ্ট , যেই খারাপ লাগা নিয়ে ওর দিনের চব্বিশটা ঘন্টা কেটে যেত , কিন্তু তা ও একটা হাসি হাসি মুখের মুখোশ পরে সারাদিন সবার সামনে ঘুরে বেড়াতো , সেই মুখোশটা হঠাৎ যেন কথা টেনে খুলে দিয়েছে | কি অদ্ভুত , এতো এতো বন্ধু ওর লাইফে , সবাই ওকে কত বছর ধরে চেনে | কিন্তু কেউ আজ অব্দি ওর ভেতরের মানুষটাকে চিনতেই পারেনি ! আর কথা , মাত্র চারদিনের আলাপে , হয়তো ওকে ওর থেকেও বেশি চিনে ফেলেছে | তবে আর না | আর এই ভাবে বাঁচবে না ও | যারা ওর কথা কখনো ভাবে না , তাদের নিয়ে আজকের পর থেকে আর ও নিজেও ভাববে না | কথা ঠিক বলেছে | একসেপ্ট করতে হবে সব কিছু | জমা কথাগুলো জমিয়ে না রেখে বলে ফেলতে হবে আজ | শেষ করে দিতে হবে এই পুরো চ্যাপ্টারটা | এইসব ভাবনার ভিড়েই নবমীর সন্ধ্যে নেমে এলো | চারদিকে মাইকের আওয়াজ , ঢাকের তাল , জমজমাট সন্ধ্যে | কিন্তু দীপের ঘরটা অন্ধকার | তবে আর বেশিক্ষন এই অন্ধকার থাকবে না ওর জীবনে , কারণ আজ সবটা শেষ করে দেবে দীপ |
<১৩>
সেইদিন ল্যাপটবটা খুলে ও আর এক সেকেন্ডও ভাবলো না | কমপোজ মেইল এ গিয়ে সবটা লিখে ফেললো | সেই পাঁচ বছর থেকে জমে থাকা সব কথা |
” ডিয়ার মা এন্ড বাবা ,
কথাগুলো তোমাদের ফোন করেও বলতে পারতাম | কিন্তু বললাম না | আজকাল আর তোমাদের গলা শুনতেও ইচ্ছে করে না আমার , তাই এই মেইলটা করছি | আসলে কথাগুলো অনেক দিন ধরেই জমে ছিল আমার মধ্যে | আর আজ মনে হয়েছে , এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে তোমাদের সবটা বলে দেয়া দরকার | একচুয়ালি আমি আমার লাইফে তোমাদের মতন স্বার্থপর দুটো মানুষ কখনো দেখিনি | আর আই উইশ , যে কখনো যেন দেখতেও না হয় | একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাকে হোস্টেলে রেখে এলে ! খোঁজ নেয়ারও কখনো একবারও প্রয়োজন মনে করলে না, যে সে ঠিক কেমন আছে ! নিজেদের নতুন লাইফ নিয়ে এতোই ব্যস্ত ! সত্যি , তোমাদের মিউজিয়ামে রাখা উচিত , কারণ বিলিভ মি , এই পৃথিবীতে হাতে গুনে হয়তো এই রকম মা বাবা খুঁজে পাওয়া যাবে | মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয় , এর থেকে কোনো অরফ্যানেজে জন্মালে বোধ হয় ভালো হতো | অন্তত নিজেকে শান্তনা তো দিতে পারতাম যে মা বাবা পৃথিবীতে নেই, মারা গেছে !
যাই হোক , একটা কথাই বলার ছিল , মা বাবার সাথে কখনো টাকার সম্পর্ক হয় না | মা বাবা হতে গেলে একটু ভালোবাসতেও জানতে হয় | আর সেটা তো তোমাদের পক্ষে কোনোদিনই পসিবল না ! তাই প্রত্যেক মাসে আমার একাউন্টে টাকাটা প্লিজ আর পাঠিয়ো না | এটা আমার রিকুয়েস্ট | আর খুব ভালো থেকো , যেই রকম এতদিন থেকে এসেছো | এন্ড ফর মি , ইট’স এ গুড বাই ফর এভার , সো আর আমাকে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা কোরো না
কখনো |”
সেইদিন মেইলটা সেন্ড করে দীপের মুখে আপনাআপনিই একটা হাসি চলে এসেছিলো হঠাৎ | মনে হচ্ছিলো যেন অনেক দিনের জমে থাকা একটা পাথর বুক থেকে নেমে গেছে , আর সব কিছু খুব হালকা লাগছে | চারিদিকটা ভীষণ ভালো লাগছে | কথা মনে হয় এই ভালো লাগার কথাটাই বলেছিলো সকালে | আর ঠিকই তো , নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্বটা তো একদম নিজেরই | আর আজ থেকে দীপ এই কাজটাই রোজ করবে | রোজ নিজের মুখে হাসি ফোটানোর একটা রিজন ও ঠিক খুঁজে বার করবে | আর হ্যাঁ , আজকে থেকে কোনো কথা নিজের মনের মধ্যে আর জমিয়ে রাখবে না ও | জমা কথাগুলোই আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে বড়ো একটা পাথরের মতন হয়ে যায় | যেই পাথরটাকে আর ও কোনোদিনও নিজের জীবনে জমতে দেবে না | তাই এবার যাকে যা বলার স্পষ্ট করে , মুখের ওপর বলবে | নিজেকে পুরোপুরিভাবে এক্সপ্রেস করবে |
<১৪>
সেই সন্ধ্যেবেলা দীপ যখন পাড়ার ফাংশনে গিয়ে পৌঁছলো তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা | হ্যাঁ, আজকেই সেই বিখ্যাত অনুষ্ঠান , যেখানে দীপের এন্ট্রি অনেকদিন আগেই অনিন্দর বাবা করে দিয়েছে | আর এমনি সেমনি ভাবে না , বোম্বে থেকে আসা সিঙ্গার হিসেবে ! কথাটা ভেবেই হেসে ফেললো দীপ | আর তখনই খেয়াল করলো দূরে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে , নীল রঙের শাড়িতে, ওরই দিকে তাকিয়ে |
তবে আজ এই মুহূর্তে কথার মুখে একটা অদ্ভুত বিষন্নতা ! যেন জোর করে হাসছে | আসলে আজ নবমীর সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ মনে হচ্ছে পুজো তো শেষ | কাল দশমী , বিসর্জনের দিন | আর আজ রাতটাই হয়তো ওর আর দীপের গল্পেরও শেষ | এরপর প্রবাসী বাঙালির প্রবাসে ফেরার সময় চলে আসবে | তখন ! তখন তো আর এই মিষ্টি মুখের ছেলেটাকে দেখতে পাবে না কখনো ! আর হয়তো কোনোদিনও দীপ আসবে না ওর এই শহরে | হ্যাঁ, ফোন আছে | কিন্তু চারদিনের আলাপে কে ই বা কাকে মনে রেখে ফোন করে ! আর ফিরে গিয়ে দীপের জীবনেও অনেক ব্যস্ততা এসে ঘিরে ধরবে | হসপিটাল , পেশেন্টস , ওখানকার বন্ধু বান্ধব , তখন হয়তো ভুলেও আর কথার কথা মনে পরবে না | আর এটাই তো স্বাভাবিক | এই ক দিনের আলাপে কেনই বা মনে রাখবে কেউ ! ভেবেই মুখটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিলো কথার | কালো মেঘ এসে ভিড় করছিলো ওর চারিদিকে যেন | কিন্তু তখনই হঠাৎ দীপের নামটা মাইকে এনাউন্স হওয়ায় কথার সম্ভিত ফিরলো | মনে হলো , চারিদিকের কালো মেঘ কেটে যেন এক টুকরো রোদ এসেছে ওর সামনে | আর ও নিস্পলকে তাকিয়ে রইলো সেই রোদের দিকে |
সেইদিন পাড়ার ফাংশনে দীপ নিজের পছন্দের গানটাই গেয়েছিল | ” খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি , আমার মনের ভিতরে |” তবে আজকে এই গানের সুর ওর মন খারাপ করে দেয়নি | বরং নতুন করে একটা স্বপ্ন দেখিয়েছি | নতুন খেলাঘর তৈরী করার স্বপ্ন | জানে না , এই স্বপ্নের পরিণতি কি ! এই কয়েকটা মাত্র দিনে কারোর মনে জায়গা করে নেয়া হয়তো আদেও সম্ভব না ! কিন্তু তা ও দীপ নিজের মনের কথা বলবে | তারপর যা হয় দেখা যাবে | আর নিজের মধ্যে কোনো ফিলিংস জমিয়ে রাখবে না ও , এবার এক্সপ্রেশ করার সময় এসেছে | এই ভেবেই সেইদিন ভিড়ের মধ্যে কথার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো | তারপর মনের সব সাহস এক করে কথার কানের কাছে এসে আস্তে করে ওকে ডাকলো | আচমকা দীপকে দেখে কথা একটু অবাক ! ভিড়ের মধ্যে কখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি ! তবে কথার অবাক হওয়ার আরোও বাকি ছিল , কারণ দীপ হঠাৎ নিজের মনের কথার ঝাঁপি খুলে বসলো ওর কাছে | চারিদিকের ভিড়ে , ঢাকের আওয়াজের মাঝে ওর কানের কাছে এসে বললো , ” কথা , একটা কথা বলার ছিল | হয়তো শুনে রাগ করবে | মুখের ওপর না বলে দেবে | কারণ মাত্র এই চার দিনে কাউ কে দেখে আর যাই হোক , ভালোবাসা যায় না | কিন্তু কি ভাবে জানি না ,আমি ভালো বেসে ফেলেছি ,তোমাকে | আর আজই একটা ডিসিশন নিয়েছি আমি | মনে কথা জমিয়ে না রাখার ডিসিশন | তাই কিছু না ভেবে বলে ফেললাম সবটা | ” .. এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে চুপ করে গেলো দীপ | এখন শুধুই অপেক্ষা , কথার উত্তরের | কিন্তু কথার মুখেও এখন আর কোনো কথা নেই ! কি হচ্ছে , ব্যাপারটা বুঝতে ওর একটু সময় লাগছে | ভাবতে পারছে না যার জন্য ভেবে ওর এতো মন খারাপ হচ্ছিলো , যাকে আর কখনো দেখতে পাবে না ভেবে ওর চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসছিলো , সে নিজেই হঠাৎ ওর কাছে এসে ও যা শুনতে চায় সব লাইন এর পর লাইন সাজিয়ে বলে দিচ্ছে | বিশ্বাস হচ্ছে না , যেই স্বপ্নগুলো কিছুক্ষন আগেও অধরা লাগছিলো , সেই সব স্বপ্ন নিয়ে সে এসে হাজির হয়েছে ওর সামনে ! কিন্তু কথাকে ওই ভাবে চুপ থাকতে দেখে দীপের মনটা ভেঙে যাচ্ছিলো | তার মানে উত্তরটা ‘না’ ই | হয়তো খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেছে এইসব শুনে , তাই এইভাবে চুপ করে গেছে | না , আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই ওর , ভেবেই দীপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো ,আর তখনই কথা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে নিলো , আর তারপর ঢাকের আওয়াজ , ভিড় , সব এড়িয়ে ওর কানের কাছে এসে বললো , ” এই কদিনে তোমাকে সহ্য করার অভ্যেস হয়ে গেছে আমার | তাই সারা জীবনের পার্টনারশিপে কোনো প্রব্লেম নেই | তবে হ্যাঁ, ঝগড়া কিন্তু আগের মতনই করবো | আসলে ওটা না করলে ঠিক জমবে না ব্যাপারটা | রাজি তো এই শর্তে ?”
দীপের মুখে এবার চওড়া হাসি | ভাবতে পারেনি এই রকম একটা পজিটিভ আনসার পাবে ! ভাবেনি যে এই ঝগড়ুটে পাগল মেয়েটাকে সারা জীবনের মতন নিজের করে পাবে ! আজ তাই দীপও কথার হাতটাকে শক্ত করে ধরলো | সামনে এখন ধুনুচি নাচ চলছে | ঢাকের তালে ধুনোর ধোঁয়ায় পা মেলাচ্ছে পাড়ার ছেলেরা | আর লোকের ভিড়ে , সবার অজান্তে , দুটো মন একসঙ্গে তাল মেলাচ্ছে | দীপ আর কথার আজ থেকে একটা নতুন গল্পের শুরু হলো | নতুন করে খেলাঘর বাঁধার গল্পের | বিসর্জনের আগেই যেই শিউলি ফুলগুলো হারিয়ে গিয়েছিলো ওদের জীবন থেকে , সেই শিউলি গুলোকে একসাথে জড়ো করে , মুঠো বন্দি করে, এই শরৎ ফিরিয়ে দিয়েছে ওদের কাছে | তাই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখার সময় শুরু হয়েছে |

আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এই রকম হারানো কিছু শিউলি ফুল আছে | প্রত্যেকের জীবনেই ভেঙে যাওয়ার , শেষ হয়ে যাওয়ার গল্প আছে | আর প্রত্যেকেরই হয়তো একটা অপেক্ষা আছে ! হারানো শিউলি ফুল গুলোকে ফেরত পাওয়ার অপেক্ষা | একটা এই রকম শরৎ এর অপেক্ষা |
——— <সমাপ্ত>———–

( এই রকম মন কেমন করা উপন্যাস পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে পারেন আমার নতুন বই ‘ মন কেমনের গল্প ‘ এবার হার্ড কপি হিসেবে। বইটি প্রি বুকিং এর জন্য হোয়াটস অ্যাপ করতে পারেন 8420275853 নম্বরে। বইটির মূল্য মাত্র 150 টাকা। এছাড়া https://shopizen.app.link/cU0E47ExtPb এই লিঙ্কে ক্লিক করে বইটি শপিজেন এর ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি বুক করতে পারেন। বইটি পনেরো দিনের মধ্যে আপনার এড্রেস এ পোস্ট হয়ে যাবে। এছাড়াও 25 ডিসেম্বর থেকে বইটি নিউটাউন বইমেলায় শপিজেন এর স্টলেও পাওয়া যাবে। )

শিউলি পাওয়া পর্ব-০৭

0

#শিউলি_পাওয়া <সপ্তম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১১>
অষ্টমীর সকাল | মানেই মণ্ডপে অঞ্জলি দেয়ার লাইন , মাইকে এনাউন্সমেন্ট ক রাউন্ড অঞ্জলি হয়েছে , আর ক রাউণ্ড অঞ্জলি এখনো বাকি আছে , সব দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা তাড়া , কে আগে ফুল পাবে , কে আগে ফুল ছুঁড়ে মায়ের পায়ের কাছে নিজের মনের আর্জিগুলো পৌঁছে দিতে পারবে ! চারিদিকে যেন একটা হুড়োহুড়ি , ধাক্কাধাক্কি | দীপ এইসবই দেখছিলো মণ্ডপের একটা কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | খুব মন দিয়ে | আসলে এই সব দৃশ্যগুলো ওর কাছে ভীষণ নতুন | বোম্বেতে থাকার সময় কোনো অষ্টমীর সকালেই আর গরজ করে উপোষ করে অঞ্জলি দিতে যায়নি | আর কোনোদিনই বিশেষ একটা উইশ লিস্ট ছিল না ওর মনে | আসলে দীপের কাছে ছোটবেলা থেকেই জীবন মানে হলো এডজাস্টমেন্ট | আর এমন একটা হিসেব, যেখানে চাওয়া পাওয়ার লিস্টগুলো মেলে না বিশেষ | তাই ঠাকুরের পায়ে ফুল ছুঁড়তে যাওয়ার কম্পিটিশনে ও কখনো নামও লেখায়নি নিজের ! তবে আজ এসেছে অনিন্দর মা বাবার জন্য | স্পেশালি অঞ্জলি দেয়ার জন্য ওরা একটা তসরের পাঞ্জাবি গিফ্ট করেছে দীপকে | তাই আজকে ওদের মন রাখতেই এই লাইনে দাঁড়ানো | এইসবই ভাবছিলো মনে মনে, তখনই হঠাৎ একজনের গলার আওয়াজ শুনলো ,
” কি হলো ? কি এতো ভাবছো মন দিয়ে ? তবে একটা কমপ্লিমেন্ট আজ দিতেই হচ্ছে | পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে কিন্তু |” …
কথার মুখে এই কথাটা শুনে দীপের মুখে হাসি .. ” থ্যাংক ইউ .. আই এম অনার্ড … কিন্তু আজকে তোমাকেও একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি | শাড়ি পড়লে বেশ আলাদাই লাগে তোমাকে | লুকিং বিউটিফুল .. “….
যাক , নোটিশ করেছে তাহলে | ভেবেই কথার মনটা খুশি খুশি হয়ে গেলো | এর মধ্যে অঞ্জলি দেয়ার ডাক পড়ে গেছে ওদের | এটাই শেষ ব্যাচ | এবার মিস করলে আবার পরের বছর ডাক আসবে | ভেবেই তাড়াহুড়ো করে কথা আর দীপ ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালো | আজকে ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অঞ্জলির মন্ত্রোচ্চারণ করলো | সেই চতুর্থীর দিন যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখন তো ওরা ভাবতেই পারেনি যে ওদের মধ্যে ঝগড়া ছাড়াও কখনো নর্মাল কথা হতে পারে ! তবে আজ সব হিসাব পাল্টে গেছে | আসলে এটাই তো জীবনের নিয়ম | মানুষ যেটা ভাবে না কখনো , বেশির ভাগ সময় ঠিক সেই সেই জিনিসগুলোই তার জীবনে ঘটে যায় | এই যেমন এখন দীপ কথাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেললো, একেবারে হিসেবের বাইরের ,
” তুমি আজকে সন্ধ্যেবেলা কি করছো ? কোনো প্ল্যান আছে ?”
” আর কিসের প্ল্যান ! দিদি তো অনিন্দদাকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছে | তাই নো প্ল্যান |”
” আমারও সেম কেস | ভূমিকে পেয়ে আমার বন্ধু আর আমাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না | এনিওয়ে , কি আর করা যাবে ! তো আমরা দুজনে আজকে একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে পারি না ? ”
এই প্রস্তাবটা শুনে কথা চোখ বড় বড় করে বললো,
” আমার সাথে ঠাকুর দেখবে ! তুমি ! .. আচ্ছা একজন একদিন আমাকে বলেছিলো যে আমি না কি এতো বকবক করি যে লোকজনের মাথা খারাপ হয়ে যায় | তারপরেও ?”
এই প্রশ্নে দীপ আলতো হেসে বলেছিল,
” এখন অভ্যাস হয়ে গেছে | চার দিন তো হলো |”
” ওহ , আচ্ছা আচ্ছা | বুঝলাম |” ……. কথাটা শেষ করেই কথার মুখে এক চিলতে হাসি | এখন আর দীপের কথায় রাগ হয় না ওর | বরং অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ঘিরে ধরে মনটাকে | তাহলে কি কথারও অভ্যাস হয়ে গেছে ! সত্যিই তো , চারটে দিন কেটে গেলো | দেখতে দেখতেই |
সেদিন অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলা কথা একটু বেশিক্ষণ সময় নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আয়নার সামনে | আশমানি রঙের ওড়নার সাথে ম্যাচিং কানের দুলটাকে ঠিক লাগছে তো ! চোখের কাজলটা বেশি হয়ে যায়নি মনে হয় ! আসলে কাজল ছাড়া ও তো নিজের চোখটাকে ভাবতেই পারে না কখনো | আর চুলটা আজকে খোলাই রাখবে | সবাই বলে ওকে না কি খোলা চুলে বেশি সুন্দরী লাগে | কিন্তু আজ কেন এইসব এতো বেশি করে মনে হচ্ছে ! আজকে কি কথা নিজেকে অন্য একজনের চোখ দিয়ে দেখতে চায় ! তাই এতো ভাবনা চিন্তা এসে ভিড় করছে ! কে জানে , আসলে কিছু প্রশ্নের উত্তর এতো সহজে আর এতো তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় না | আবার কিছু অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যাও অনেক সময় আমাদের মন হাজার খুঁজেও পায় না | কি করছে , কেন করছে সেইসব কারণ গুলো মাঝে মাঝে নিজেরই অজানা হয়ে থাকে | এই যেমন কথা , একদিন আগেও কি ভাবতে পেরেছিলো যে ওই ঝগড়ুটে ছেলেটার মুখ আজকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে কাজল লাগাতে লাগাতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠবে ! একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে থাকবে ওর চারিদিকে ওই প্রবাসী বাঙালির জন্য ! ওর কথা ভাবলেই হঠাৎ মুখে একটা হাসি চলে আসবে, একদম বিনা নোটিশে ! না , সত্যি এতো কিছু ভাবেনি কখনো | এইসবই হচ্ছে একদম হিসাবের বাইরে | উপরি পাওনা |
এইসব ভাবনার ভিড়েই সেইদিন ঠিক সাতটার সময় পাড়ার মণ্ডপের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কথা | দীপ আসলেই একসঙ্গে বেরোবে | অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলার পুজো শুরু হয়েছে এখন | মণ্ডপে বেশ ভালোই ভিড় | অনেক অচেনা লোক ওর আশেপাশে | কিন্তু কথার চোখ এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই একটা চেনা মুখকেই খুঁজছে ! আর তখনই ভিড় ভেঙে সেই ছেলেটা হঠাৎ ওর সামনে |
আজকে কি এই আশমানি রঙের ওড়নায় কথাকে রোজের থেকে একটু বেশিই সুন্দরী লাগছে ! কথাটা মনের মধ্যে এসেই মিলিয়ে গেলো দীপের | কি হচ্ছে আজকাল কে জানে ! মাঝে মাঝেই এই রকম ওলোট পালট চিন্তা মাথায় আসছে এই মেয়েটাকে দেখে | দু দিন আগেও ঠিক এই রকমটা ছিল না | তখন তো কথার আর এক নাম মাথা ব্যাথা ছিল দীপের কাছে | যার সাথে দশ মিনিট শান্তি স্থাপন করে চলা অসম্ভব | যার সাথে কথা কম আর ঝগড়া বেশি হতে পারে , ব্যাস | কিন্তু এখন তো আর এই রকমটা মনে হয় না | এই যেমন আজকে সকালবেলা অঞ্জলি দেয়ার সময় মনে হলো সন্ধ্যেটা এই মেয়েটার সাথে কাটালে কেমন হয় ! তারপর এখন , ঠাকুর দেখতে দেখতে , একসঙ্গে এই ভিড় রাস্তায় পা মেলাতে মেলাতে , আইসক্রিম , ফুচকা আর ভেলপুরীর মাঝে একটা আলাদা ভালো লাগা ঘিরে ধরে আছে ওর মনটাকে | মনেই হচ্ছে না যে সঙ্গে আছে সে মাত্র চার দিনের চেনা , বরং মনে হচ্ছে যেন অনেকদিন হয়ে গেছে ওদের দেখা হয়ে , অনেক সময় কাটিয়েছে ওরা একসঙ্গে , অনেক রাস্তা হেঁটেছে একে অপরের সাথে পা মিলিয়ে ! আচ্ছা , মানুষের মন কি এতটাই পরিবর্তনশীল ! যে কোনো কারণ ছাড়াই , কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই , হঠাৎ করে এক মুহূর্তেই একজন অচেনা কেউ খুব চেনা হয়ে যায় , খুব নিজের হয়ে যায় | যার সাথে জীবনেও দরকার ছাড়া কথা হবে না বলে একটা সময় মনে হয়েছিল , তাকেই আজকে নিজের পুরো জীবনের পাতাগুলো পড়ে শোনাতে ইচ্ছে করে | যেই কথাগুলো কখনো কাউকে শেয়ার করা হয়নি , সেইসব জমা কথাই হঠাৎ করে বলে ফেলতে ইচ্ছে করে ! এইসবই ভাবছিলো মাঠের ধারে বসে বসে | এটা চুঁচুড়ার সেকেন্ড গ্রাউন্ড | আগে পড়ে আরো দুটো মাঠ আছে | আর তার মাঝখানে দিয়ে চলে গেছে রাস্তা | সেই রাস্তার পাশে সার দিয়ে লাগানো অনেক গাছ | পুজোর জন্য এই পুরো মাঠের ধারটাকেই আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে | ছোট ছোট টুনিগুলো যেন তারার মতন জ্বলছে চারিদিকে | আর একটু দূরেই আবার মহসিন কলেজ | সেখানে বেশ বড়ো করে একটা দূর্গা পুজো হয় | সেই পুজো মণ্ডপের মাইকেই বাজানো হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীত , ” খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি , আমার মনের ভিতরে ||” , গানটা দীপের খুব প্রিয় ছোট থেকেই | দিদা মাঝে মাঝে গুনগুন করতো, দাদুর আবদারে আবার কখনো কখনো তানপুরা নিয়ে গানটা শোনাতেও বসে পড়তো | আর এই গানের কথাগুলো দীপের মনের কষ্টটাকে যেন বাড়িয়ে দিতো আরও বেশি করে ! ও নিজেও তো ছোট থেকে একটা ‘খেলাঘর’ই খুঁজেছে নিজের জন্য | এমন একটা ঘর , যেখানে দিনের শেষে ফিরে যেতে পারবে | যেই ঘরের দরজা খুলে অপেক্ষা করবে কিছু নিজের লোক | মা , বাবা কে নিয়ে একটা ছোট্ট ফ্যামিলি | যেখানে কেউ আলাদা না , কেউ দূরের না , সবাই একসাথে , একদম নিজের | এই গানের সুরটা শুনে হঠাৎ এই না পাওয়া গুলো এসে ভিড় করেছিল দীপের মনে , তখনই হঠাৎ কথার আওয়াজে ঘোরটা কাটলো ,” কি হলো দীপ ? চুপ করে যে ?” আর ওর অবচেতন মনটা ভেঙে আবার চেতন মনে ফিরে এলো দীপ | তারপর একটু হেসে বললো ,
” কেন ? দশ মিনিট হয়ে গেছে না কি !”
” আবার শুরু হলো ! না , হয়নি দশ মিনিট | তো ? তাহলে কি চুপ করে যেতে হবে |”
” তো কি বলবো ?”
” আচ্ছা, তোমার ব্যাপারে কিছু বলো | কে কে আছে তোমার বাড়িতে ?”
” কেউ না | আমার বাড়িতে আমি একাই থাকি |”
” মানে ? ” … কথা এই রকম একটা উত্তরের জন্য একেবারেই তৈরী ছিল না | আসলে চারদিনে কখনো আলাদা করে দীপের ব্যাপারে কিছু জানাই হয়নি | তাই একটু অবাকই হলো ! হঠাৎ করে এই প্রশ্নটা করে ঠিক করলো তো ! দীপের থমথমে মুখটা দেখে এটাই মনে হচ্ছিলো ওর | তবে কয়েক সেকেন্ডের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে দীপ নিজেই বলে উঠলো ,
” আমি তখন পাঁচ বছরের ছিলাম | এই রকমই একটা দূর্গা পুজোর আগে বাবা মার্ ডিভোর্সটা হয়ে যায় | তারপর থেকেই হোস্টেল এ !”
কথা এই রকম একটা উত্তর পাবে , এটা ভাবতেও পারেনি ! তাই কোনো রকমে নিজেকে সামলে বলেছিলো, ” ওহ , আই এম রিয়ালি সরি | আমি এই ব্যাপারে সত্যি কিছু জানতাম না |”
দীপ এটা শুনে একটু জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলেছিলো , ” তুমি কেন সরি বলছো ! যাদের বলার তারা তো কখনো বলেনি | কখনো মনেও হয়নি ওদের | মা আর বাবা দুজনেই আবার বিয়ে করে নিয়েছে | বেশ ভালোই আছে এখন ওরা | নতুন লাইফ , নতুন ফ্যামিলির সাথে | ওহ হ্যাঁ, কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে , প্রত্যেক মাসে আমার একাউন্টে ভালোই টাকা ট্রান্সফার করে ওরা | ব্যাস, আর কি ! দ্বায়িত্ব শেষ |”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেছিল সেইদিন দীপ | অনেকদিনের জমা কথা, জমাট কষ্ট | একটা দম বন্ধ করা যন্ত্রণা, যেটা চব্বিশটা ঘন্টা ওর মধ্যে থাকে | যার ভাগ কখনো কাউকে দেয়া যায় না ! এইসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে কথার চোখের দিকে তাকিয়েছিলো দীপ | আর খেয়াল করেছিল এখন কথার চোখটাও ভিজে | নিজের কষ্টের একটা ভাগ যেন ও কথার চোখে দেখতে পাচ্ছিলো সেইদিন | কখনো ভাবেনি , এই চারদিনের আলাপে কাউকে নিজের যন্ত্রণার ভাগও দেয়া যায় ! তাই নিস্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়েছিলো | আর তখনই অনুভব করেছিল একটা স্পর্শ | ওর হাতের ওপর কথার হাতের স্পর্শ | না , সেইদিন আর কোনো কথা বলেনি কথা | কোনো স্বান্তনা দেয়ারও চেষ্টা করেনি দীপকে | শুধু খুব শক্ত করে ওর হাতটা ধরেছিলো | যেন বোঝাতে চেয়েছিলো একটা স্পর্শে , যে ‘তুমি একা নও , সঙ্গে আছি , সঙ্গে থাকবো |’

<চলবে>

শিউলি পাওয়া পর্ব-০৬

0

#শিউলি_পাওয়া <ষষ্ট পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১০>
পুজোর সময় ঘড়ির কাঁটা যেন একটু বেশিই তাড়াতাড়ি এগোয় ! অন্তত প্রত্যেকটা বাঙালির তো তাই মনে হয় | এই যেমন সেইদিন , চোখের পলকেই সপ্তমীর সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে এলো | কিন্তু অনিন্দর আর টিকি খুঁজে পাচ্ছে না দীপ , অনেকক্ষণ ধরেই | ভেবেছিলো সন্ধ্যেবেলা কোথাও একটা বেরোবে , কিন্তু বন্ধু যেহেতু তার গার্ল ফ্রেন্ডকে নিয়ে বেপাত্তা , তাই বেরোনোর প্ল্যান ক্যানসেল করে পুজো মণ্ডপে গিয়েই হাজির হতে হলো দীপকে | কি আর করবে , সপ্তমীর সন্ধ্যে তো আর বাড়ি বসে কাটানো যায় না ! আর সত্যি কথা বলতে কি ,এই মণ্ডপে এসে বেশ ভালোই লাগছে | এতো লোকের ভিড় , ঠাকুর মশাই এর মন্ত্রোচ্চারণ , সন্ধ্যের আরতি , চারিদিকের ধুনোর ধোঁয়া , আর ধূপের গন্ধ , তার মধ্যে ঢাকের আওয়াজ যেন পুরো মণ্ডপটাকেই একেবারে জমজমাট করে রেখেছে | আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো বাচ্চা থেকে বয়স্ক , এই মণ্ডপে এখন যারা যারাই বসে আছে, তাদের প্রত্যেকের মুখে একটা আনন্দ ছড়িয়ে | যাকে বলে পুজোর আনন্দ | এই আনন্দ ভরা মুখগুলো মনে হয় শুধু মাত্র বছরেই এই চারটে দিনই দেখা যায় ! এটা হচ্ছে অনেকটা দূর্গা পুজো স্পেশাল অফারের মতন | ষষ্ঠী , সপ্তমী , অষ্টমী , নবমীর সাথে সাথে সবার হাসি হাসি মুখ ফ্রি ফ্রি ফ্রি ! কথাটা ভেবেই দীপের মুখেও আনমনে একটা হাসি চলে এলো | আর তখনই হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ , ঠাকুর মশাই এর মন্ত্রোচ্চারণ , কাশর ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ ভেদ করে সেই চেনা গলার আওয়াজটা ওর কানে এলো ,
” কি ব্যাপার ? এইভাবে একা একা দাঁড়িয়ে হাসছো যে ? হ্যাঁ , অবশ্য পাগলেরা অনেক কিছুই করে | তোমার কাছে তো এটাই নরমাল | ”
এই কথা মেয়েটা কথা না শুনিয়ে যেন দু সেকেন্ডও থাকতে পারে না ! দিলো হাসিখুশি মুডটার বারোটা বাজিয়ে | এটা ভেবেই দীপ ঘাড় ঘুরিয়ে বললো ,
” আচ্ছা , কথা , তোমার প্রবলেম কি ? এই সপ্তমীর সন্ধ্যেবেলা তো লোকে ঠাকুর দেখে টাইমপাস করে | তাহলে তুমি কেন আমার পা এ পা লাগিয়ে ঝগড়া করে সময় নষ্ট করছো ? ”
এটা শুনে কথার মুখটা একটু যেন অন্ধকার হয়ে গেলো , ” তো কার সাথে ঠাকুর দেখবো শুনি ! দিদি আর অনিন্দদা তো প্রেম করতেই ব্যস্ত | আর ঠাকুর দেখা তো দূরে থাক , কিছুক্ষন বাদেই পাড়ায় অন্তাক্ষরী শুরু হবে | প্রত্যেকবার আমি আর দিদি টিমে নাম দিই , আর ফার্স্ট হয়ে পাঁচশো টাকা প্রাইজ মনি জিতে আসি | কিন্তু এইবার তো সেটাও হবে না | কারণ আমার পার্টনার সকাল থেকেই বেপাত্তা তার হিরোর সাথে | তাই কি আর করবো , ঝগড়া করেই টাইম পাশ করছি | ”
কথার এইসব কথা শুনে দীপ হাজার চেষ্টা করেও নিজের হাসি কন্ট্রোল করতে পারলো না ! সত্যি মেয়েটা যেন মঙ্গল গ্রহ থেকেই আমদানি হয়েছে | এই রকম কথাবার্তা জীবনে কারোর মুখে শোনেনি ! কেউ ঝগড়া করেও টাইম পাশ করে ! এটাও সম্ভব ! … যাই হোক, কোনো মতে নিজের হাসিটাকে কন্ট্রোল করে দীপ কথাকে একটা প্রস্তাব দিয়েই ফেললো এবার , ” বুঝলাম | তো যদি অন্তাক্ষরী তে নাম দেয়ার হয় , তাহলে আমি তোমার পার্টনার হতে পারি | তুমি গিয়ে আমার আর তোমার নামটা দিয়ে আসো |”
যদিও কথা এতো সহজে এই প্রস্তাবটা নিতে পারলো না দীপের | দু সেকেন্ড ভেবে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতন মুখ করে বললো , ” কিন্তু তোমার আর আমার পার্টনারশিপ তো আজ সকালেই শেষ হয়ে গেছে | দিদি আর অনিন্দদার হ্যাপি এন্ডিং এর পর |”
এটা শুনে দীপ ভদ্রতার হাসি হেসে বললো , ” ভালো , তাহলে দিতে হবে না নাম | আমার কি ! দাঁড়িয়ে থাকো একা একা | এই জন্য বলে কারোর ভালো করতে নেই !”
এই রে , এই ছেলে তো সত্যি ক্ষেপে গেছে | আর যতই ছেলেটা পাগল আর ঝগড়ুটে হোক , পাঁচশো টাকা প্রাইজ মনির জন্য এর সাথে আর একবার পার্টনারশীপ তো করাই যায় ! , তাই কথা কিছু কথা সাজিয়ে এবার দীপকে ম্যানেজ করার জন্য বললো , ” আচ্ছা , না না | সরি | রেগে যেও না | আমি নাম দিয়ে আসছি আমাদের | তবে একটা কথা , ভালো ভাবে গাইতে হবে কিন্তু | আমার রেকর্ড ব্রেক হলে চলবে না | এইবারও ফার্স্ট হতেই হবে , যেন তেনো প্রকারেন , বুঝলে |”
সেইদিন এরপর গানের তালে , সুরের ছন্দে কখন যে দুটো ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিলো , ওরা দুজনে বুঝতেও পারেনি ! তবে হ্যাঁ, দীপ কথা কে একটুও ডিসএপয়েন্ট করেনি কিন্তু | এইবারও ওর রেকর্ড ব্রেক হয়নি | গানের অন্তাক্ষরীতে ফার্স্ট হয়ে পাঁচশো টাকার প্রাইজ মনিটা এখন কথারই পকেটে | আর এটা যার জন্য সম্ভব হলো , তাকে তো একটা থ্যাংক ইউ বলতেই হয় এবার | আফটার অল ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে ! তাই কথা বেশ হাসি মুখেই বললো ,
” থ্যাংক ইউ সো মাচ .. তুমি সত্যিই খুব ভালো গেয়েছো | কাকু সেইদিন ঠিক কথাই বলেছিলো , তুমি আসলেই একজন ভালো সিঙ্গার |” ..
দীপ আর যাই হোক, কথার কাছ থেকে ‘থ্যাংক ইউ’ শব্দটা শুনবে এটা কখনোই এক্সপেক্ট করেনি | তাই একটু বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে বলেছিলো , ” বাবা , এই ওয়ার্ড দুটোও জানো তাহলে ! থ্যাংক ইউ !” ..
এটা শুনে কথার মুখ গম্ভীর , ” সব সময় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতেই হবে ? কখনো সোজা ভাবে কথা বলা যায় না ?”
এই রে , আবার রেগে গেছে মেয়েটা | তবে আজ কি জানি কেন , এই মেয়েটার সাথে একদম ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না দীপের | তাই ম্যানেজ করার জন্য বললো , ” আচ্ছা, রিয়ালি সরি | ঐভাবে বলাটা ঠিক হয়নি | আর একটা থ্যাংক ইউ তো তোমারও পাওনা আছে | আজকে তোমার জন্যই এই পাড়ার অন্তাক্ষরীতে নাম দিলাম , আর এতো সুন্দর টাইমটা কাটলো | সত্যি, পাড়ার পুজোর ব্যাপারটাই আলাদা | এখানে এসে আমার এতো ভালো লাগছে | ইনফ্যাক্ট এই পুজোটাই আমার লাইফের বেস্ট পুজো | এর আগে তো কখনোই এইভাবে পুজোটাকে ফিলই করিনি | সারা জীবনই তো একা একাই !” .. না , কথাটা আর শেষ করলো না দীপ | মাঝখানেই থেমে গেলো | কিছু কথা হয়তো এই রকমই হয় , কাউকে বলা যায় না | এইভাবে হঠাৎ করে মাঝখানে থামিয়ে দিতে হয় | তবে কথা ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল , তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললো , ” একা একা মানে ? তুমি চুপ হয়ে গেলে কেন ?” ….
না, চুপ হয়ে যাওয়ার কারণটা দীপের একান্তই নিজের | তার ভাগ কাউকেই দেয়া যাবে না | তাই কথা ঘুরিয়ে বললো , ” কিছু না | এমনি | যাও , এখন বাড়ি যাও | অনেক রাত হলো | কাল তো আবার অষ্টমীর অঞ্জলি আছে সকাল সকাল | দেখা হবে তখন |”
এবার কথাও হেসে উত্তর দিলো , “হ্যাঁ , দেখা হবে , আসি |”
সেইদিন প্রথম একটা ভালো লাগার রেশ নিয়ে কথা বাড়ি ফিরলো | একটা অদ্ভুত ভালো লাগা , যার কারণ ও ঠিক জানে না | তাহলে কি ওই ঝগড়ুটে পাগল ছেলেটা একটু হলেও নিজের জায়গা ওর মনে করে নিয়েছে ! না কি ওর মনে এই জায়গাটা সেই ময়ূরপঙ্খী ঘাটের প্রথম দেখা থেকেই ছিল ! আজ সেটা হঠাৎ বুঝতে পারলো | কে জানে ! সাধে কি বলে মানুষের মন খুব জটিল | তাই তো কিছু প্রশ্নের উত্তর মনের আনাচে কানাচে হাজার খুঁজলেও এতো সহজে পাওয়া যায় না | ভেবেই একটা হাসি চলে এলো কথার | আজকে আলমারি ঘেঁটে পুজোর বেস্ট শাড়িটা বার করেছে ও | কালকে অঞ্জলি দেয়ার সময় এই লাল রঙের তাঁতের শাড়িটাই পরবে | আচ্ছা , দীপ কি সেটা নোটিশ করবে ! কি জানে ! .. এইসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো কথা | আস্তে আস্তে সপ্তমীর রাত শেষের পথে | কালকে একটা নতুন সূর্য উঠবে | অষ্টমীর ভোর উঁকি দেবে বাঙালির দরজায় | আর কাল আসলেই তো আজকে রাতের অপেক্ষাটাও শেষ হবে | দীপের সাথে আর একবার দেখা হওয়ার অপেক্ষা !

<চলবে>

শিউলি পাওয়া পর্ব-০৫

0

#শিউলি__পাওয়া <পঞ্চম পর্ব >
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
আজ সপ্তমী | কথার সকালে ঘুমটা ভাঙলো ঢাকের আওয়াজ শুনে | সত্যি এই চারদিনের সকাল হচ্ছে বছরের বেস্ট চারটে সকাল | চারিদিকে যেন ছড়িয়ে থাকে পুজো পুজো একটা গন্ধ | এই ভেবে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালো | আর হঠাৎ আনমনে ভূমির দিকে চোখ চলে গেলো | সকাল সাতটার মধ্যেই একেবারে রেডি ! ভিজে চুল , গোলাপি তাঁতের শাড়ি , কপালে ছোট্ট লাল টিপ্ ,….
” দিদি , তোকে কিন্তু আজ ব্যাপক লাগছে দেখতে | “….
” হ্যাঁ, হয়েছে | পুজোর কাজ করতে যেতে হবে প্যান্ডেলে | আর তুই বসে আছিস যে এইভাবে ? স্নান করে রেডি হবি কখন ? আর আমার সাথে প্যান্ডেলে যাবি না কি বন্ধুদের সাথে প্ল্যান আছে কোনো ?”
কথা এর উত্তরটা দিতে যাবে তখনই হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠলো | এতো সকালে আবার কে ফোন করলো ! ভেবেই স্ক্রিনে চোখটা রাখলো | দীপের নাম্বারটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে দেখে নিজেও অবাক , এতো সকালে তো ওকে মনে করার কথা না ! …. এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা ধরলো | আর এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো , ——- ” কি ? কি বলছো টা কি ? একসিডেন্ট কিভাবে হলো ? খুব সিরিয়াস ! ইশ ,পুজোর সময় অনিন্দদার এই রকম একটা একসিডেন্ট হলো | ভাবতেই পারছি না ! ”
ব্যাস, আর কিছুই শোনার দরকার ছিল না ভূমির | হঠাৎ যেন শরীরটা খুব হালকা লাগছে | মনে হচ্ছে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না | পাশের দরজাটাকে আঁকড়ে ধরে কোনো ভাবে নিজেকে সামলালো | কি বললো কথা ! অনিন্দর একসিডেন্ট ! কি করে হলো ! কালই তো দেখা হয়েছিল | কাল তো সব ঠিকই ছিল | ওরা পাশাপাশি একই রাস্তা ধরে হাঁটলো , একসাথে ঠাকুর দেখলো , শুধু কথাটাই হলো না | সত্যিই তো , কত কথা বাকি আছে ওদের এখনো | সেই সব কথা কি তাহলে কখনো বলা হবে না | অনিন্দ কি আর কখনো ওর কাছে ফিরে আসবে না ! ওই চেনা মুখটা কি আর কখনো দেখতে পারবে না ভূমি ! ভেবেই আর স্থির থাকতে পারলো না ও | দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো | কিন্তু কোথায় যাবে এখন , কোথায় খুঁজবে অনিন্দকে ? কোন জায়গায় একসিডেন্ট হয়েছে , কিভাবে হয়েছে কিছুই তো জিজ্ঞেস করেনি কথা কে ! তাহলে এখন কি করবে ? হ্যাঁ, অনিন্দর বাড়িতে যাবে ও | অনিন্দর বাড়ি গেলে তো ওর খোঁজ ঠিক পাবে | ইশ , অনিন্দ কতবার ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো , কেন মুখ ঘুরিয়ে নিলো ভূমি ! কেন একবারও জিজ্ঞেস করলো না কেমন আছে অনিন্দ | একদিন যেই ভুলটা অনিন্দ করেছিল , আজ কি সেই ভুলটা ভূমি নিজে করলো ! সময় থাকতে থাকতে কাছের মানুষটার ইম্পর্টেন্সটা বুঝলো না ! ওকে দেখেও দেখলো না | চিনেও চিনলো না | তাই কি আজকে অনিন্দও চলে যাচ্ছে | আর ফিরে না আসার জন্য | আজ, এই মুহূর্তে চারিদিকটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে ভূমির | শুধু মনে হচ্ছে আর যদি কখনো ওই চেনা মুখটাকে দেখতে না পায় ! আর যদি কখনো ওই চেনা গলার আওয়াজটা শুনতে না পারে ! যদি সব শেষ হয়ে যায় এই পুজোতেই | তা ও নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে পা দুটোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও | অনিন্দর বাড়ি ওকে আজ পৌঁছতেই হবে | আজ আর কোথাও দাঁড়াবে না | এইসব ভাবনার ভিড়ে যেতে যেতেই হঠাৎ ওর পা টা থমকে গেলো | সামনের জগন্নাথ মন্দিরে ওটা কে দাঁড়িয়ে নমস্কার করছে ! সেই চেনা মুখ , সেই চেনা মানুষটা | অনিন্দ | তার মানে ও একদম ঠিক আছে | কিছুই হয়নি | ভেবেই ভূমি অনিন্দর কাছে দৌড়ে গেলো , আর সারা জীবনের মতন ওকে আঁকড়ে ধরলো | অনিন্দও এই রকম হঠাৎ মেঘ না চাইতেই জলে অবাক ! কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না | যেই মেয়েটা কাল অব্দি ওর সাথে একটা কথাও বলছিলো না , সে আজ নিজে এসে জড়িয়ে ধরলো এইভাবে , মাঝ রাস্তায় ! কিন্তু ওর এইসব ভাবনার ভিড়েই ভূমি বলে উঠলো
” তুমি ঠিক আছো ? তোমার একসিডেন্ট হয়নি ? ”
” একসিডেন্ট ! কার একসিডেন্ট ! ”
” কার একসিডেন্ট মানে ? তোমার একসিডেন্ট ! দীপ যে কল করে বললো | আমি এতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম |”
ভূমির কথা শুনে অনিন্দ যেন আকাশ থেকে পড়লো , ” কি ! দীপ বলেছে আমার একসিডেন্ট হয়েছে ? আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না | আমি তো ওর সামনে এই এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরোলাম , মণ্ডপে যাবো বলে |”
এইসবের উত্তর পেতে অবশ্য আর এক সেকেন্ড বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি ওদের | কারণ দীপ আর কথা এর মধ্যেই জগন্নাথ মন্দিরের সামনে এসে হাজির | আর দুজনের মুখেই এখন জয়ের হাসি | ঠিক এই সিনটাই ওরা দেখতে চেয়েছিলো এতদিন ধরে | আর আজ ফাইনালি এটা সম্ভব হলো | যদিও এখন ভূমি আর অনিন্দর মুখে একটা বিশাল বড়ো কোয়েশ্চেন মার্ক ! কি হচ্ছে , কেন হচ্ছে , ওরা কিছুই বুঝতে পারছে না | তাই বুঝিয়ে বলার দায়িত্বটা দীপ নিজেই নিলো ,
” দ্যাখ , ফার্স্টলি রিয়ালি সরি | আমি আর কথা প্ল্যান করে এই মিথ্যে কথাটা ভূমিকে বলেছি | আসলে কি করবো , এতদিন ধরে এতো প্ল্যানিং করেও তোদের মধ্যে ডিসটেন্সটা কিছুতেই কমাতে পারছিলাম না ! এতো চার্চ ঘুরে , ঠাকুর দেখেও তোদের মধ্যে একটা লাইন কথা হলো না | তাই আমরা দুজনেও খুব ডিপ্রেসেড হয়ে গিয়েছিলাম | সেই জন্য বাধ্য হয়েই হাজারটা সিনেমায় দেখা এই চেনা সিনটাকে তোদের লাইফে এপ্লাই করলাম | আর , কাউকে হারালেই হয়তো তার ইম্পর্টেন্সটা বোঝা যায় ! যেমন ভূমিকে হারিয়ে তুই নিজের লাইফে ওর জায়গাটা বুঝেছিলিস , ঠিক সেইরকমই আজ তোকে হারানোর কথা ভেবেই ভূমি ওর লাইফে তোর ইম্পর্টেন্সটা বুঝলো | আর তোদের গল্পের একটা হ্যাপি এন্ডিং হলো !”
এটা শুনে কথাও নিজের ঘাড়টা নাইন্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে হেলিয়ে দীপের কথায় সায় দিয়ে বললো , ” প্লিজ দিদি | আর রাগ করে থাকিস না | মনে মনে তো তুইও অনিন্দদাকে ভালোবাসিস | তাহলে এই লোক দেখানো রাগ করে কি হবে ! আর আজ যদি সত্যি অক্সিডেন্টটা হতো , যদি সত্যি সব শেষ হয়ে যেত , তাহলে তুই কি কখনো আর অনিন্দদাকে ফিরে পেতিস ? এই দু বছরেও তো , আমি জানি , তুই এক সেকেন্ডের জন্যও অনিন্দদাকে ভুলতে পারিসনি | শুধু সবার কাছে দেখাতিস যে তুই ভুলে গিয়েছিস | কিন্তু এই ভাবে প্রিটেন্ড করে তো আর পুরো লাইফটা চালাতে পারবি না | তাই সময় থাকতে থাকতে নিজের ফিলিংসগুলোকে একসেপ্ট করে নে | ”
না, এতো কিছু শোনার পর সেদিন ভূমিও আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি | আর নিজের কাছে মিথ্যে বলতে পারেনি | অনিন্দ আজও ওর লাইফের পুরোটা জুড়েই আছে | অনিন্দর থাকা না থাকাতে আজও ওর যায় আসে | আজও অনিন্দকে ও সেই প্রথম দিনের মতনই ভালোবাসে | এই মুহূর্তে ,তাই শক্ত করে অনিন্দর হাতটা ধরে ফেললো ভূমি | আর কখনো এই হাতটাকে ছেড়ে দেবে না ও | আর অনিন্দ তো অবাক ! এখনো যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না ! একটা দূর্গা পুজোয় ও যাকে সারা জীবনের মতন হারিয়ে ফেলেছিলো , একটা সপ্তমীর সকাল যে সেই হারানো মানুষটাকে আবার ওর কাছে ফিরিয়ে আনবে , সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ! এই শরৎ টা যেন এসেছেই ওদের জীবনের হারানো শিউলি ফুলগুলোকে যত্ন করে , মুঠো ভর্তি করে আবার ওদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য | যেখান থেকে সব শেষ হয়েছিল , সেখান থেকেই একটা নতুন শুরুর জন্য | ওদের গল্পটার একটা হ্যাপি এন্ডিং এর জন্য |

<চলবে>

শিউলি পাওয়া পর্ব-০৪

0

#শিউলি_পাওয়া <চতুর্থ পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
ব্যান্ডেল চার্চের উল্টো দিকেই বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আছে | ভূমি আর অনিন্দ সেই রকমই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো | অনেকদিন বাদে অনিন্দর মনে আজ একটা ভালো লাগার রেশ কাজ করছে | তাই একটু হাসি মুখেই কথাটা বলে ফেললো ,
” থ্যাঙ্কস ভূমি | তুমি এতো কিছুর পরেও আমার সাথে রেস্টুরেন্টে এলে |”
কথাটা শুনে ভূমির আবারও এক কথায় উত্তর , ” মানবিকতা | বুঝলে |”
” কি ? মানে ? ” ,.. অনিন্দ যেন আকাশ থেকে পড়লো |
ভূমি এবার একটু হেসেই বললো , ” মানবিকতা মানে হিউম্যানিটি | জানো নিশ্চয়ই | তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আসতাম | কারণ আমি চাই না পুজোর সময় কারোর শরীর খারাপ হোক | আর কিছু ?”
অনিন্দ মুখের ওপর এই রকম একটা কঠিন উত্তরও এক্সপেক্ট করেনি | আর এরপর আর কিছু বলাও যায় না | তাই চুপ করে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে গেলো | কিন্তু সেখানেও ওর জন্য একটা টুইস্ট অপেক্ষা করছিলো | দুজনে একসঙ্গে এখানে এলেও ভূমি গিয়ে বসলো একটা অন্য টেবিলে | ওয়েটারটা তো অবাক ! … ভূমির সামনে গিয়ে বিস্ময় ভরা মুখ নিয়ে বললো ,
” কি ব্যাপার ম্যাডাম ? আপনারা তো একসঙ্গে এলেন | কিন্তু আলাদা টেবিলে বসলেন যে ! ”
এই প্রশ্নটা শুনে ভূমি বেশ রেগে গিয়েই উত্তর দিলো , ” তাতে আপনার কি ? ওই টেবিলে ওনার জন্য একটা ফ্রেঞ্চ টোস্ট , আর আমাকে এক কাপ কফি |”
ভূমির এই রকম রাগী রাগী মুখে উত্তর শুনে ওয়েটারটাও আর কথা বাড়ালো না | আর তারপর যেটা হলো সেটা ইতিহাস | দুই প্রাক্তন , একই রেস্টুরেন্টের দুটো আলাদা টেবিলে বসে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি খেলো | ব্যাস , গল্প শেষ |

আর ওই দিকে দীপ আর কথা এখন ব্যান্ডেল চার্চের ছাদে | তখন প্রেয়ার রুম থেকে ওরা ইচ্ছে করেই কেটে পড়েছিল | ঐভাবে বেপাত্তা না হলে অনিন্দ আর ভূমিকে আলাদা স্পেস দেয়া যেত না ! এবার একান্তে নিশ্চয়ই ওরা ওদের ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করবে | না , কথার প্ল্যানটা খারাপ না | এবার যেন সব ঠিকঠাক মতন ওয়ার্ক করে | এইসবই ভাবছিলো দীপ, আর আনমনে তাকিয়েছিলো দূরে বয়ে চলা শান্ত গঙ্গার দিকে | এখান থেকে পুরো শহরটার ই একটা ভিউ পাওয়া যায় , অদ্ভুত সুন্দর দেখতে লাগে সেটা | ইশ , আগে জানলে ক্যামেরাটা সঙ্গে আনতো | এক সেকেন্ডের জন্য কথাটা মনে হয়েই আবার মিলিয়ে গেলো | না বাবা, আনেনি , ভালোই হয়েছে | সামনে যা একজন দাঁড়িয়ে আছে ! নেচার ফটোগ্রাফার থেকে ওকে ফ্যাশন ফটোগ্রাফার বানিয়ে যেন শান্তি ! অদ্ভুত ঝগড়ুটে মেয়ে | তাই তো যখন থেকে ওরা একা হয়েছে , দীপ চুপ করে আছে | এর সাথে কথা শুরু করারই দরকার নেই , কারণ শেষটা কথা শুনে হয় | তবে বেশিক্ষন এইভাবে চুপচাপ থাকতে পারলো না যদিও , চার্চের ছাদের নিঃস্তব্ধ পরিবেশটা ভেঙে কথা হঠাৎ বলে উঠলো , ” না , আর সম্ভব না | এইভাবে চুপ করে থাকা জাস্ট ইম্পসিবল |”
দীপ এই কথার কোনো অর্থই খুঁজে পেলো না ! অদ্ভুতভাবে কথার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো , ” মানে ? কি হলো আবার ?”
” মানে আমি দশ মিনিটের বেশি কথা না বলে থাকতে পারি না | প্রবলেম আছে আমার | তাই সামনে যে রকমই পাবলিক থাকুক না কেন , আমাকে তার সাথে বকতেই হয় | বাধ্যতামূলক |”
কথাগুলো শুনে দীপ নির্বিকার মুখে বললো , ” কথা , এই ভাবে রোজ রোজ ইনস্টলমেন্টে ইনসাল্ট না করে একদিনেই পুরোটা করে দিতে পারো | বেটার হয় , তাই না |”
” মানে ?”
” মানে আমি কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছি ! ‘এই রকম পাবলিক’ কথাটা তো তুমি আমাকেই ইন্ডিকেট করে বললে , আমি কি বুঝি না কিছু !”
এটা শুনে কথা এবার হেসে ফেললো , ” না মানে তুমি এই গ্রহেরই বাসিন্দা | এই নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই | কিন্তু কি বলো তো , তুমি ঠিক আমার টাইপের না | মানে এই ধরো এতক্ষন কি রকম চুপচাপ থাকতে পারো | তাই |” ..
কথাটা শুনে দীপের পারদ আরোও এক কাঠি চড়লো , ” তো কি বলবো ? আমাদের মধ্যে আলোচনা করার মতন আছে টা কি ?”
এটা শুনে কথার এক লাইনের প্রশ্ন , ” তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে ?”
আচমকা এই প্রশ্নটার কোনোই মানে খুঁজে পেলো না দীপ | এই মেয়েটা যে কি বলে , কেন বলে , দীপের সেসব কিছুই মাথায় ঢোকে না | আর দীপকে ওই রকম চুপ থাকতে দেখে কথাই ওর হয়ে উত্তরটা দিয়ে দিলো , ” চুপ করে আছো , তার মানে নেই | জানতাম আমি |”
” কি ? তুমি জানতে মানে ? হ্যাঁ , আমার গার্লফ্রেন্ড নেই | কিন্তু তুমি এই ব্যাপারে এতো সিওর হলে কি করে ?” .. দীপ এক নিঃশাসে প্রশ্নগুলো করে গেলো | কথা এবার কনফিডেন্সের হাসি হেসে বললো , ” তোমাকে প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম | যেই ছেলে প্রাকৃতিক দৃশ্যের নামে সুন্দরী মেয়েদের ফটো তোলে , তার গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে না | তার ওপরে আবার ঝগড়ুটে |”
এটা শুনে দীপের রাগ মাত্রা ছাড়িয়েছে , একটা যোগ্য জবাব এবার দিতেই হবে ওকে | তাই এক সেকেন্ড ভেবে নিয়েই বললো ,” ফার্স্টলি , তুমি সুন্দরী নও | আর সেকেন্ডলি আমি সেইদিন তোমাদের ফটো তুলছিলাম না | এটা আর কত রকম ভাবে বোঝালে বুঝবে ? এন্ড বাই দ্যা ওয়ে , আমার গার্লফ্রেন্ড না থাকার কারণ তো এতো এক্সপ্লেন করে বললে , তা তোমার ও তো বয়ফ্রেন্ড নেই | এবার আমি বলি কারণটা ?”
এটা শুনে কথা অবাক ! ” তুমি কি করে জানলে আমার বয় ফ্রেন্ড নেই ? বুঝেছি নিশ্চয়ই অনিন্দদা বলেছে |”
এবার দীপ একটু সেই কনফিডেন্সের হাসি হেসে বললো , ” না , কেউ বলেনি | আর বলার দরকারও নেই | প্রথম দেখাতেই বুঝেছি | এই রকম গায়ে পড়ে যে ঝগড়া করে , আর লোকের মাথা অলমোস্ট চিবিয়ে খায় বকবক করে , তার বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে না |”
না | এরপর আর না | এই ছেলেকে সহ্য করার সব লিমিট এখন পেরিয়ে গেছে কথার | ওর পক্ষে আর এক সেকেন্ডও এখানে থাকা সম্ভব না | তাই গলায় বেশ জোর এনে বললো ., ” ভালো | তাতে তোমার কি ? চললাম আমি | অনেক হয়েছে | যদি দিদি আর অনিন্দদার ঝগড়ার ব্যাপারটা না থাকতো , তাহলে তোমার সাথে কখনো একটাও কথা বলতাম না |”
এবার দীপও সৌজন্যের একটা হাসি হেসে বললো , ” সেম উইথ মি .. দরকার না থাকলে আমিও তোমার সাথে একটাও কথা বলতাম না |” ….
এরপর আর কেউই ব্যান্ডেল চার্চের ছাদে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি, কারণ দুজনেই বুঝেছিলো , আর একটুক্ষণ একসঙ্গে থাকলে হয়তো এখানেই ওয়াল্ড ওয়ার থ্রি শুরু হয়ে যাবে |

সেইদিন ওরা যখন ব্যান্ডেল চার্চের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল তখন অনিন্দ আর ভূমিও একসঙ্গে উল্টোদিকের রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল | ব্যাপারটা দেখেই কথার মুখে হাসি | যাক, এতক্ষন ধরে এই ঝগড়ুটে ছেলেটাকে সহ্য করাটা বৃথা যায়নি তাহলে | দীপেরও ব্যাপারটা দেখে মনটা বেশ খুশি খুশিই হয়ে গেলো | নিশ্চয়ই ওদের মধ্যে তাহলে সব ঠিক হয়ে গেছে , তাই তো একসঙ্গে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোলো ! এইসব ভাবনার ভিড়েই ভূমি আচমকা কথার কাছে এসে ওর হাতটা ধরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিস্কাটাতে উঠে গেলো | দীপও এবার আর উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো অনিন্দকে , ” কি রে ? রেস্টুরেন্ট অব্দি পৌঁছে গেলি ? মিটে গেলো সব ঝামেলা ?”
অনিন্দ এবার একটু হেসে একটা সেনটেন্স এ উত্তর দিলো , ” ইট’স কল্ড হিউম্যানিটি .. বুঝলি |”

<৮>
পরের দিনের সূর্য ষষ্ঠীর সকাল নিয়ে বাঙালির দরজায় হাজির | সবার মনে আজ একটা আনন্দ , পুজো শুরু হওয়ার আনন্দ , ঢাকের আওয়াজে চারটে দিন কাটানোর আনন্দ | মার ঘরে আসার আনন্দ | কিন্তু এতো আনন্দের ভিড়েও কথা আর দীপের মুখ ভার | কালকের প্ল্যানটা যে এইভাবে ভেস্তে যাবে , ওরা একেবারে ভাবতে পারেনি ! শেষে কি না মানবিকতা | কোনো মানে হয় | এইসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে কফির কাপে চুমুক দিলো কথা | গঙ্গার ধারের এই কফি শপটায় এখন ও আর দীপ বসে | দুজনের মুখই বেশ গম্ভীর | আজকে তো আর ঝগড়া করার মতনও এনার্জি নেই | যতক্ষণ না অনিন্দ আর ভূমির মধ্যে ঝামেলাটা সল্ভ করছে ততক্ষন যেন কিছুতেই শান্তি আসছে না মনে | দীপ এইসব গভীর ভাবনার মধ্যেই ডুবে ছিল সেদিন , তখনই কথার কথায় চিন্তার রেশটা থেকে বেরিয়ে এলো ,
” আচ্ছা , আজ তো ষষ্ঠী , আজ ঠাকুর দেখতে গেলে কেমন হয় ?”
” কি ? ঠাকুর দেখবো , তা ও আবার তোমার মতন মেয়ের সাথে ! সরি , পারলাম না |” … এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো কথাটা দীপ |
” ওহ , হ্যালো , তোমার সাথে ঠাকুর দেখার কোনো রকম ইচ্ছে আমারও নেই | ঝগড়ুটে পাবলিক একটা | আমি প্ল্যানের কথা বলছি | কেমন হয় যদি আমি আর দিদি ঠাকুর দেখতে যাই , আর রাস্তায় তোমার আর অনিন্দদার সাথে দেখা হয়ে যায় ! তাহলে আবার ওরা একসাথে কিছুটা সময় পাবে |”
কথার এই প্রস্তাবটা মন্দ লাগলো না দীপের | আইডিয়াটা ভালোই |.. কিন্তু একটা চিন্তা মাথায় আসতেই ও বলে উঠলো , ” তবে এবার কিন্তু ওদের আর একা ছাড়া যাবে না | তাহলে প্রেমের বদলে মানবিকতাই হবে | লাভ স্টোরিটা এক ইঞ্চিও এগোবে না |”
এটা শুনে কথাও নাইন্টি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘাড় হেলালো, ” একদমই তাই | আর একা ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না | এবার যা হবে আমাদের সামনেই হবে | নো মোর প্রাইভেসি .. ”
এইসবের পর সেইদিন বাড়ি ফিরেই কথা ড্রেসিং টেবিলের সামনে | ঠাকুর যখন দেখতে যাবে তখন সাজগোজটা তো মাস্ট | ভূমি যদিও তখনও খাটের এক কোণায় এলোমেলো চুলে একটা গল্পের বইকে সঙ্গী করে বসে ছিল | তবে বেশিক্ষন বসে থাকতে পারলো না | কথা হাত থেকে বই টা কেড়ে নিয়ে অর্ডার দিলো একটা , ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে | ঠাকুর দেখতে বেরোব | ষষ্ঠীর দিন কেউ কি বাড়িতে বসে থাকে না কি ?” …. ভূমিও আর বেশি প্রতিবাদ করলো না | মনটা সকাল থেকেই খারাপ | বুকের মধ্যে একটা পাথর যেন চেপে আছে | অনিন্দর সাথে আবার দেখা হওয়াটাকে কিছুতেই একসেপ্ট করতে পারছে না ও | তবে মন খারাপ কে সঙ্গী করে পুজোটা কাটিয়ে দিলে তো আর চলবে না | মন ভালো করার চেষ্টা ওকে করতেই হবে | তাই ঠাকুর দেখতে বেরোনোর আইডিয়াটা খারাপ না | এইসব ভাবতে ভাবতেই রেডি হওয়ার জন্য আলমারিটা খুললো | আর সামনে ঝোলানো নীল শাড়িটার দিকে ওর চোখটা আটকে গেলো | নীল রং অনিন্দর খুব পছন্দ ছিল | তাই একটা সময় মাঝে মাঝেই নিজেকে নীল রঙে সাজিয়ে নিতো ভূমি | তবে আজ না | অনিন্দ নেই , তাই অনিন্দর কোনো রং ও ওর জীবনে আর নেই | এটা ভেবেই পাশে ঝোলানো কালো শাড়িটা তুলে নিয়ে আলমারিটা বন্ধ করে দিলো ভূমি |
সেইদিন সকাল এগারোটার মধ্যে ওরা আখনবাজারে হাজির | এখান থেকেই ঠাকুর দেখা শুরু করা যাক | আর চুঁচুড়া মানেই তো আখনবাজারের পুজো আর তার সাবেকি প্রতিমা | এইসব ভাবনার ভিড়েই চারিদিকে ছড়ানো সোনালী রোদের দিকে মন চলে গেলো ভূমির | আজকের রোদটা একদম শরতের রোদ | এই রোদ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় |
এইসবের মধ্যে ওরা প্যান্ডেলে ঢুকতে যাবে তখনই হঠাৎ ভূমির পা টা থমকে গেলো | দূর থেকে সেই চেনা মুখটা এখন ওর দিকেই এগিয়ে আসছে | সঙ্গে আবার কালকের সেই ছেলেটা | কি যেন নাম বলেছিলো কথা ! হ্যাঁ , দীপ | কিন্তু এরা এখন এখানে কি করছে ? ভূমির পেছনে অনিন্দ কোনো গোয়েন্দা লাগিয়েছে না কি , যে ও যেখানেই যাচ্ছে অনিন্দ এই বন্ধু সমেত এসে হাজির হচ্ছে ওর সামনে ! এইসব ভাবনার ভিড়েই কথা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো |
” আরে তোমরা ? এখানে ? ”
এর উত্তরে দীপ বেশ হাসি মুখেই ওদের দিকে এগিয়ে এসে বললো , ” তোমরাও এখানে ঠাকুর দেখতে এসেছো ? হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স ! খুব ভালো হলো তোমাদের সাথে দেখা হয়ে , নইলে আমি আর অনিন্দ তো একা একা বোর ই হচ্ছিলাম | এবার একসাথে ঠাকুর দেখা যাবে |” ….
দীপের এই অসাধারণ প্রস্তাব শুনে কথার মুখে এক চিলতে হাসি আসলেও ভূমির মুখ রাগে লাল | সব হয়েছে ওই মেয়েটার জন্য | কোথায় ওদের দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেবে , তা না যেচে পরে ডাকছে | আর একটা দুদিনের আসা ছেলের সাথে কথার এতো বন্ধুত্বই বা কিসের যে একসাথে চার্চে ঘুরতে হবে , ঠাকুর দেখতে হবে ! কি অদ্ভুত | কিন্তু যা ই হয়ে যাক , আজ ভূমি কিছুতেই ওদের সঙ্গে ঘুরবে না | এই ভেবে কথাকে সাইডে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব দৃঢ় গলায় বললো ., — ” দ্যাখ , তোর যদি ওদের সাথে ঘুরতে হয় ঘুরতে পারিস | আমি কিছুই বলবো না | কিন্তু আমি ওই অনিন্দর সঙ্গে কোনোভাবেই ঠাকুর দেখতে যেতে পারবো না | আমি বাড়ি চললাম |”
ভূমির এই রিয়্যাকশনের ব্যাপারে কথা আগে থেকেই জানতো , তাই কিছু ডায়লগ ওর রেডি করাই ছিল , এক্সপ্রেশন দিয়ে বলে ফেললো ,
” দেখ দিদি দীপ তোর আর অনিন্দদার ব্রেক আপের ব্যাপারে কিছুই জানে না | তুই যদি এইভাবে হঠাৎ চলে যাস তাহলে আমাকে হাজারটা প্রশ্ন করবে | আর অনিন্দদা তো এটা দেখে খুশিই হবে , যে ওর থাকা না থাকা তে তোর এখনো এতো যায় আসে | ও তোর লাইফে আজও এতটাই ইম্পর্টেন্ট যে তুই ঠাকুর না দেখে একা একা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিস | তুই এটা করিস না , বরং একসাথে ঠাকুর দেখে এটা প্রুভ করে দে যে অনিন্দদা তোর লাইফে আর ম্যাটারই করে না | বুঝলি |” ..কথাটা বলেই কথা ভূমির হাতটাকে শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলো |
না, সেইদিন ভূমি বাড়ি ফিরে যায়নি আর | অনিন্দর থেকেও বেশি ও যেন নিজেই নিজের কাছেই প্রমান করতে চেয়েছিলো যে হারিয়ে যাওয়া ফেলে আসা সময় , আর এই পুরোনো মানুষটা ওর জীবনে আর কোথাও নেই | ওর থাকা না থাকতে ভূমির কিছুই যায় আসে না | তাই নির্বিকার মুখ করে হেঁটে যাচ্ছিলো | চারিদিকে ঢাকের আওয়াজ , মাইকের গান , প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড় , এইসবের মধ্যে ভূমি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইছিলো | তবে অনিন্দর মনে আজ যেন একটা খুশির রেশ | স্কুলে পড়ার সময় ও আর ভূমি সাইকেলে করে সারা চুঁচুড়া ঘুরে ঠাকুর দেখতো | তারপর মাঠের ধারের ফুচকা আইসক্রিম খেয়ে বাড়ি | এটা যেন ওদের একটা রুটিন হয়ে গিয়েছিলো | আজকে কতদিন বাদে আবার ওরা এক সঙ্গে ঠাকুর দেখছে ! যদিও সেদিনের ছবির সাথে আজকের ছবির কোনো মিল নেই , তা ও ! এক সাথে এই চেনা রাস্তাগুলোতে পা তো মেলাতে পারছে | কথা নয় না ই বা হলো ! এইসব ভাবনার ভিড়ে কথা হঠাৎ একটা আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো |
” পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে আইসক্রিম না খেলে ঠিক জমে না | বলো কে কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম খাবে ?”
কথার এই প্রশ্ন শুনে আনমনে অনিন্দ হুট্ করে বলে ফেললো , ” ভূমির জন্য স্ট্রবেরি আইসক্রিম নে , ওর অন্য কোনো ফ্লেভার বেশি ভালো লাগে না !” ,,, এরপর সবাই এক সেকেন্ডের জন্য চুপ | কিন্তু কথা আর দীপের মুখে মুচকি হাসি | এই একটা মুহূর্তের জন্যই তো এতো প্ল্যানিং প্লটিং , একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে আসা ! তবে অনিন্দর কথাটা বলে ফেলে ভয় লাগছে , ভূমির পছন্দের কথাটা এইভাবে সবার সামনে বলে দেয়াটা ঠিক হয়নি | এতে হয়তো ভূমি আরো রেগে গেলো ! আর এইসবের মধ্যে ভূমির মুখটা অন্ধকার | তবে সেটা রাগের জন্য না | অদ্ভুত একটা কষ্টের জন্য ! এখনো মনে রেখেছে অনিন্দ এতো পুরোনো কথা | তাহলে কি অনিন্দ সত্যিই কিছু ভোলেনি ! ওদের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো , ওদের টুকরো টুকরো কথাগুলো ! আর ভূমি নিজেও কি কিছু ভুলতে পেরেছে ! এই কটা বছরে কারণে অকারণে ওর মাঝেই মাঝেই অনিন্দর কথা মনে পড়েছে , কতবার স্বপ্নে ভেসে উঠেছে ওই মুখটা | অনিন্দ ওর মনের মধ্যে আছে বলেই হয়তো এখনো নিজের ফোন থেকে ওর নাম্বারটা ডিলিট করতে পারেনি | পুরোনো মেলবক্স এ রাখা মেলসগুলোকে ডিলিট করতে পারেনি ! আজ হঠাৎ যেন ফেলে আসা সময়গুলো ভূমির চোখের সামনে এসে ভিড় করছে | অনেকদিন বাদে আজ আবার ইচ্ছে করছে অনিন্দর সাথে কথা বলতে | কিন্তু আজ হয়তো আর কোনো কথা বাকিই নেই | কারণ দুজনের মাঝখানে তৈরী হয়েছে একটা কাঁচের দেয়াল | যেই দেয়াল দিয়ে একে অপরকে পরিষ্কার দেখা গেলেও , ধরা ছোঁয়া যায় না | তাই আজও ওরা চুপ করেই কাটিয়ে দিলো দিনটা | চেনা রাস্তায় পাশাপাশি দুটো অচেনা মানুষ হয়ে হেঁটে আর একটা দিন পার করে দিলো |
তবে সন্ধ্যেবেলা পুজো মণ্ডপে কথা আর দীপের মুখ গম্ভীর | আজ ষষ্ঠীর দিনটাও শেষ হয়ে গেলো , তা ও কিছুই হলো না ভূমি অনিন্দর | ঝগড়া শেষ হওয়া তো দূরে থাক , দুটো লাইন অব্দি দুজনে দুজনকে বললো না | এই ভাবে চললে তো বছর পার হয়ে যাবে , কিন্তু গল্প এগোবে না !
” ধুর ধুর | এদের দ্বারা কিছু হবে না | আইসক্রিমের ফ্লেভার বলতে পারে , পাশাপাশি হেঁটে ঠাকুর দেখতে পারে , কিন্তু ঝগড়া মেটাতে পারে না ! ” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো কথা |
কিন্তু দীপ চুপ | যেন গভীর ভাবনায় ডুবে আছে | এটা দেখে কথা আরও অধৈর্য্য হয়ে উঠলো , ” উফ, কিছু তো বলো | কি হবে এবার ? এদের সাইলেন্ট মোড কবে শেষ হবে ? কি করবো এবার ?”
দীপ এবার একটু বিজ্ঞের মতন মুখ করে বললো , ” এইভাবে হবে না | শক ট্রিটমেন্ট চাই | ”
” কি ? শক ট্রিটমেন্ট ! মানে ?”

<চলবে>
( গল্প ভালো লাগলে পেজটাকে লাইক করুন, আর শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে )

শিউলি পাওয়া পর্ব-০৩

0

#শিউলি_পাওয়া <তৃতীয় পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
অনিন্দর মনের অবস্থার কথা দীপ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলো | সেইদিন সন্ধ্যেবেলা ওর ওই থমকে যাওয়া মুখ দেখে দীপেরও খারাপ লাগছিলো | হ্যাঁ , মানছে যে ওর বন্ধু একটা সময় ভুল করেছে | কিন্তু ওই ভূমি মেয়েটা কি শুধু ভুলটাই দেখলো ? ভুলের পরে অনিন্দ যে কতভাবে সেটাকে ঠিক করার চেষ্টা করেছে , এলোমেলো সম্পর্কটাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেছে , দিনের পর দিন একটা ফোন কলের অপেক্ষা করেছে , ভূমির অপেক্ষা করেছে , সেইসব কিছুই ওর নজরে এলো না ! আর একটা ভুল দিয়ে একজন মানুষকে বিচার করা কি ঠিক ! এইসব ভাবনাগুলো বার বার এসে ভিড় করছিলো ওর মনে | এর মধ্যে অনিন্দর বাবা দীপকে জোর করে সন্ধ্যেবেলা পাড়ার ফাংশনের রিহার্সালে নিয়ে গেলো | আর রিহার্সালে পৌঁছেই এনাউন্সও করে দিলো যে দীপ এইবার পুজোর ফাংশনে গান গাইবে | যাই হোক , সেইদিন রিহার্সালে এসে ওর বেশ ভালোই লাগছিলো | পাড়ার পুজোর একটা আলাদা ফ্লেভার আছে ! একদিকে পাড়ার কাকুদের নাটকের ডায়লগ প্র্যাকটিস , আর একদিকে সব কাকিমা জেঠিমাদের শ্যামা সংগীত প্র্যাকটিস , আর এদের মাঝখানে পাড়ার সব কচিকাচাগুলোর মম চিত্তে নীতি নৃত্যেতে নাচ , মানে যাকে বলে একেবারে জমজমাট ব্যাপার | এইসব দেখে দীপের মুখে একটা হাসি আপনাআপনিই চলে এলো , তবে সেই হাসিটা যদিও বিশেষ দীর্ঘ্যস্থায়ী হলো না ! কারণ ওই পাড়ার কাকিমা জেঠিমাদের ভিড়ের মাঝখান থেকে হঠাৎ একটা চেনা গলার আওয়াজ কানে এলো ! সেই সকালের লাল সালোয়ার , কথা | সে বেশ হাসি হাসি মুখেই পাড়ার সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো , ” দীপ শুধু ভালো গানই গান না , উনি দারুণ ফটোগ্রাফারও | প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে ফটো না তুলে থাকতেই পারেন না ! তা উনি যদি আমাদের পাড়ার ফাংশনের ফটোগ্রাফার এর দ্বায়িত্বটাও নেন , কেমন হয় ?” …………. কথাটা শুনে দীপের মুখটা রাগে লাল | খুব ভালো করে বুঝলো যে মেয়েটা ওকে বিধিয়ে বিধিয়ে কথাগুলো বলেছে | কিন্তু এর কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না ও | কারণ এখন ওর এই মেয়েটাকেই দরকার | আসলে এই পাড়ার ফাংশনের রিহার্সালে আসার আর একটা কারণ হলো এই মেয়েটাই | ও জানতো এখানে এলে এই মেয়েটার সাথে দেখা হবেই হবে | অনিন্দ সকালে বলেছিলো না যে এই মেয়েটাই ভূমির বোন | তো এই বোনকে কাজে লাগিয়েই অনিন্দর ভাঙাচোড়া লাভস্টোরিটা কে জোড়া লাগাতে হবে ! এইসব ভেবেই সেইদিন কিছুক্ষণ পর ও নিজে যেচে পরেই কথার সামনে গেলো | তবে কথার যেন ওকে দেখলেই কথা শোনাতে ইচ্ছে করে , তাই দীপ সামনে আসতেই ও আস্তে আস্তে বলে উঠলো , ” দেখুন , আপনার নাম পাড়ার ফটোগ্রাফার হিসেবে রেকমেন্ড করেছি আমি | আমার নাম ডোবাবেন না কিন্তু | ভালো ফটো তুলতে হবে , ঠিক আছে |” ……..
না , ব্যাস , অনেক হয়েছে | এর বেশি সহ্য শক্তি নেই দীপের | এইসব শোনার পর একটা প্রত্যুত্তর না দিলে ওর আজ রাতে শান্তিতে ঘুম হবে না ! তাই একটু হেসে বললো , ” আসলে সব কিছু তো আর ফোটোগ্রাফারের হাতে থাকে না | মানে যার ফটো তোলা হচ্ছে তার ওপরও ডিপেন্ড করে ব্যাপারটা | মানে ধরো একটা কাককে আমি যত রকম এঙ্গেল থেকে যত রকম এফেক্ট ইউজ করেই ফটো তুলি , সেই ফটো তে তো আর তাকে ময়ূর লাগবে না ! ”
কথাটা শুনে কথার মুখ রাগে লাল | কি হলো ব্যাপারটা ! এই ছেলেটা ইন্ডিরেক্টলি ওকে কাক বললো ! ইশ , কি অপমান | তবে হাজার চেষ্টা করেও এর কোনো উত্তর দিতে পারলো না কথা | আর সত্যি বলতে কি এর বেশি কথা বাড়িয়েও কাজ নেই | এই ছেলেকে ওর নিজের দরকার | দিদি বেকার বেকার অনিন্দদার ওপর রাগ দেখাচ্ছে ! এতদিন হয়ে গেছে ঘটনাটার , কিন্তু দিদি নিজেও তো আজ অব্দি অনিন্দদাকে ভুলতে পারেনি ! তাই তো কতগুলো বছর চাকরির নাম করে শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে এলো | আসলে তো ও এই জায়গাটা থেকে , এই স্মৃতিগুলো থেকে পালাতেই চেয়েছিলো | আর এইবার পুজোয় যখন অনিন্দদা দিদিকে মানাতে চায় , ফিরে পেতে চায় , তখন কথারও ওকে হেল্প করা দরকার | তবে এইসব কিছুর জন্য একটা মাধ্যম চাই | এইসব কাজ একা একা হয় না | তাই এই বোম্বে থেকে আসা সিঙ্গার কাম ফোটোগ্রাফেরকেই ওর এখন খুব দরকার | কিছুক্ষণ সময় ধরে এইসব ভেবেই ও দীপকে বললো ,
” আপনার সাথে আমার কিছু দরকারি কথা আছে | একটু সামনের গঙ্গার ধারে চলুন | এখানে অনেক ভিড় | বলা যাবে না |”
দীপ এটা শুনে অবাক ! এ তো মেঘ না চাইতেই জল | এই মেয়েটার সাথে আলাদা কথা বলাটা তো এখন ওরও দরকার |
যাই হোক , এইসব কথার কিছুক্ষনের মধ্যেই দুজনে রিহার্সালের ভিড় পেরিয়ে গঙ্গার ধারের নির্জনতায় হাজির | এরপর কথা-ই কথা বলা শুরু করলো |
” দেখুন , আমি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ন একটা কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকে এনেছি | আপনার হেল্প চাই আমার | করবেন ?”
দীপ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না | এই ডায়লগ তো দীপ রেডি করে এসেছিলো ! কথা কি করে বলে ফেললো ! যাই হোক , একটু চিন্তান্বিত মুখ করেই জিজ্ঞেস করলো , ” কি হেল্প ? অনিন্দ আর ভূমির ঝামেলা সল্ভ করার ব্যাপারে কি ?”
কথাটা শুনে কথার মুখে চওড়া হাসি | যাক , ছেলের মাথায় বুদ্ধি আছে | বুঝেছে তাহলে ! ——– ” হ্যাঁ , রাইট | ঠিক ধরেছেন | অনিন্দদা আর দিদিকে মেলাতে হবে | যেভাবেই হোক | আসলে আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে | কিন্তু একা একা সেই প্ল্যানটা এক্সিকিউট করা সম্ভব না | তাই তোমার হেল্প চাই | ওহ , সরি , আপনাকে তুমি বলে ফেললাম |” …. কথাটা বলেই কথা জীব কামড়ালো |
অনিন্দ ব্যাপারটা দেখেই বলে উঠলো , ” না না , ইট’স ওকে | আমাকে তুমি বলাই যায় | আমি কোনো সিনিয়র সিটিজেন নোই | আর আমিও তোমার সাথে এই ব্যাপারেই কথা বলতে চাইছিলাম | অনিন্দ সিরিয়াসলি নিজের ভুলটা বুঝেছে | ও ভূমিকে খুব ভালোবাসে | তাই তোমার একটু নিজের দিদিকে বোঝানো দরকার , যাতে অনিন্দকে আবার একসেপ্ট করে নেয় |”
কথাটা শুনে কথা বেশ বিরোক্তভাবেই বললো , ” তুমি কি ভেবেছো ? আমি বোঝায়নি ! আর শুধু অনিন্দদাই না , আমার দিদিও তো খুব ভালোবাসে ওকে | শুধু প্রব্লেম হচ্ছে সেটা মানতে চায় না | আসলে সেইবার দিদির কোথাও একটা সেলফ রেসপেক্ট এ লেগেছিলো | অনিন্দদা ঐভাবে মুখের ওপর ফোনে ব্রেক আপ করে দিলো ! দিদি সেটা একসেপ্ট করতে পারেনি | কিন্তু এইভাবে তো সব শেষ হয়ে যেতে পারে না | তাই সোজা আঙুলে ঘি না বেরোলে তো আঙ্গুলটাকে বেঁকাতেই হবে | যাই হোক, তুমি হেল্প করবে কি না বলো ? আর বোঝাতে পারছি না আমি |”
” আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে | করবো হেল্প | কিন্তু প্ল্যানটা কি ?”
দীপের প্রশ্নটা শুনে কথা একটু হেসে বললো, ” তুমি ব্যান্ডেল চার্চ দেখেছো ?”
” কিইই ? ব্যান্ডেল চার্চ ! ” ,. দীপ যেন এবার আকাশ থেকে পড়লো !
” উফ , দেখেছো কি না বলো ? এক কথায় উত্তর প্লিজ |” …
” না , দেখিনি | কেন ? ব্যান্ডেল চার্চ এর সঙ্গে অনিন্দ আর ভূমির কি সম্পর্ক ?”
এটা শুনে কথা বেশ কনফিডেন্সের সঙ্গে একটু হেসে বললো , ” সেটা কাল বুঝবে | তুমি কাল সকাল দশটায় ব্যান্ডেল চার্চ দেখতে অনিন্দদাকে নিয়ে পৌঁছে যেও | ব্যাস তাহলেই হবে | বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও |”
দীপ এইসব শুনে একটা জিনিসই ভাবলো , মেয়েটা কি পাগল ! এই কথাটা ও যখন কথাকে প্রথমবার দেখেছিলো , তখনই মনে হয়েছে | তবে পাগলদের সাথে বেশি তর্ক করে লাভ নেই | তাই দীপও আর কথা বাড়ালো না | আর মেয়েটা যা বলছে সেটা একবার করেই দেখা যাক | কি হয় কাল ব্যান্ডেল চার্চে নয় গিয়েই বুঝতে পারবে !
<৬>
আগেরদিনের কথা মতন দীপ অনিন্দকে সঙ্গে নিয়ে ঠিক সকাল দশটার সময় পৌঁছে গেলো ব্যান্ডেল চার্চে | কিন্তু এ কি ! গেটের সামনে তো কেউ নেই ! কি হলো ব্যাপারটা ? কথা নিজেই তো কাল কি সব প্ল্যানের কথা বললো | আর তারপর কি নিজেই বেপাত্তা হয়ে গেলো ! কিছুই বুঝতে পারছিলো না দীপ | ওর এইসব ভাবনার ভিড়েই অনিন্দ বলে উঠলো , ” কি রে ? ভেতরে চল | গেটের সামনে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? সকাল থেকে তো আমার মাথা খারাপ করে দিলি , ব্যান্ডেল চার্চ দেখবো বলে | এখন দাঁড়িয়ে আছিস কেন ?”
এর উত্তরে কি বলবে দীপ ! যে পুরোটাই প্ল্যান ছিল রে | না , অতো সত্যি বলা যাবে না , তাই একটু মিথ্যে সাজিয়েই বললো ,
” উফ | এমনি | মানে বাইরে থেকে চার্চটা কে দেখছি | খুবই সুন্দর !”
কথাটা শুনে অনিন্দ একটু ভদ্রতার হাসি হেসে বললো , ” বাহ্ , খুব ভালো কথা | চল আর একটু | তাহলে ভেতর থেকেও দেখতে পাবি |”
এই সময়েই হঠাৎ চার্চের গেটের সামনে একটা অটো এসে থামলো | আর সেই অটো থেকে নামা যাত্রীদের দেখে দীপের মুখে একটা চওড়া হাসি | কিন্তু অনিন্দর মুখটা একদম থমকে গেলো ! ভূমি দাঁড়িয়ে ওর সামনে , সঙ্গে ওর বোন কথা | ওরা এখানে কি করে এলো ! তাহলে কি আজকেও দেখা হওয়ার ছিল ওদের | এইসব এলোমেলো ভাবনার মাঝেই কথা অনিন্দ আর দীপের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলো , ” আরে ! তোমরা ! এখানে ? ” … ওর ভাবটা এমন যেন কিছুই জানতো না | দীপের ব্যাপারটা দেখে এক সেকেন্ডের জন্য হাসি চলে এসেছিলো ! বাবা, কি এক্টিং জানে মেয়েটা | যাই হোক , ও আর সময় নষ্ট না করে নিজের ভেতর থেকে শাহরুখ খানটাকে বার করে দ্বিগুন এক্টিং দেখিয়ে বললো , ” আরে কথা ! তুমি | হোয়াট এ সারপ্রাইজ .. ” …
এই পুরো দৃশ্যটা দেখে ভূমির মুখটা যদিও ভীষণ কঠিন হয়ে গেছে এখন | এই ভাবে এখানে অনিন্দর সাথে দেখা হবে জানলে কখনোই আসতো না ! ও বেশ বিরক্তির সাথেই তাই কথার কানের কাছে এসে বললো , ” এইসব হচ্ছে টা কি কথা ? তুই কি এইসব দৃশ্য দেখানোর জন্য আমাকে সকাল সকাল জোড় করে চার্চে নিয়ে এলি ? আর ওই ছেলেটা আবার কে ? ওর সাথে তোর অত হেসে হেসে কথা কিসের !”
কথা এইসব প্রশ্নগুলোর জন্যই তৈরী ছিল | তাই রেডি করা উত্তর গুলো মুখস্ত বলে ফেললো , ” উফ , দিদি , আমি কি করে জানবো যে অনিন্দদা ওর বন্ধু দীপ কে নিয়ে আজকে এই সময়েই চার্চে আসবে ! আমি কি জ্যোতিষী না কি | আর ওই ছেলেটা মানে দীপ , ওর সাথে আমার কালকে রাত্রেই আলাপ হয়েছে | আমাদের পাড়ার ফাংশনের রিহার্সালে | দীপও ডাক্তার , অনিন্দদার সাথে একই হসপিটালে প্র্যাকটিস করে | আর ছেলেটার সাথে প্রথম আলাপেই আমার এতো ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছি , যে তোকে কি বলবো ! এবার চার্চে যখন হঠাৎ এইভাবে দেখা হয়েই গেলো আমাদের , তখন আলাদা আলাদা ঘুরলে কি ভালো দেখাবে বল ? দীপ কি ভাববে !”
এইসব যুক্তি শুনে ভূমির চোখ কপালে , ” মানে টা কি ? এখন কি আমি ওই অনিন্দর সাথে চার্চে যাবো ? তুই ভাবলি কি করে ?”
এই প্রশ্নের উত্তরটাও কথা বেশ হাসি মুখে দিলো , ” দিদি অনিন্দদাকে তো তুই একদম ভুলে গেছিস | ও তো তোর কাছে রাস্তার আর পাঁচটা লোকের মতনই | তাহলে ও থাকলো কি গেলো , তাতে তোর তো কোনো এফেক্ট হওয়ার কথা নয় | আর চার্চে তো রোজ কত লোকই আসে বল | ধরে নে অনিন্দদাও তাদের মধ্যেই একজন | যাই হোক, চল এবার |” … কথাটা শেষ করেই কথা ভূমির হাতটা ধরে টেনে চার্চের ভেতরে এগিয়ে গেলো | আর এতে ভূমির না বলার মতনও কিছু ছিল না | সত্যিই তো তাই | অনিন্দ তো ওর কাছে রাস্তার আর পাঁচটা অজানা অচেনা লোকের মতনই | ওর থাকা না থাকতে ভূমির কিছুই যায় আসে না | তবে এই পুরো ব্যাপারটায় অনিন্দর খুব যায় এসেছিলো , কারণ ভূমিকে যে এইভাবে হঠাৎ সামনে দেখতে পাবে , ও একদম এক্সপেক্ট করেনি | তবে আজও কিছু বলার ছিল না ওর | ভূমিকে সামনে দেখলে এখন এমনিই সব কিছু উল্টো পাল্টা হয়ে যায় , কথা হারিয়ে যায়|
এইসব ভাবতে ভাবতেই ওরা চার্চের প্রেয়ার হলে কখন গিয়ে পৌঁছেছে অনিন্দ খেয়ালই করেনি !
প্রেয়ার হলে ঢুকেই সামনে মাদার মেরির মূর্তি | তাঁর চারিদিকে জ্বালানো অনেক মোমবাতির আলো | বড়ো প্রেয়ার রুমের নিঃস্তব্ধতা , আর সেই মোমবাতির আলোয় অনিন্দর আজ একটা কথাই মনে হচ্ছিলো , জীবনে কি একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া যায় না ! একবার কি পুরোনো হারিয়ে যাওয়া সময়টাকে ফিরে পাওয়া যায় না ! যেই সময়টা আজ শেষ | এইসব ভাবনার মাঝেই ও চোখটা বন্ধ করলো মাদার মেরির সামনে | একটা উইশের জন্য | যেই উইশটার নাম , ‘ভূমি’ |
চোখ খুললো ভূমির গলার আওয়াজে , ” কি হলো ব্যাপারটা ! কথা আর দীপ কোথায় গেলো ? আমাদের সঙ্গেই তো প্রেয়ার রুম অব্দি এলো | এই মাত্র তো এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল | দু মিনিট প্রার্থনা করার জন্য চোখ বন্ধ করলাম, আর তার মধ্যেই বেপাত্তা !” ,…..
ভূমির কথাগুলো শুনে অনিন্দর ঘোরটা কাটলো। প্রেয়ার রুমের আসে পাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো , সত্যিই তো ! কথা আর দীপ দুজনেই নেই | কোথায় গেলো আবার ওরা ! প্রেয়ার হলের সামনের বাগানটায় নেই তো ? ভেবেই ভূমি আর অনিন্দ সামনের বাগানটায় গেলো | কিন্তু না | এখানেও কিছু অচেনা লোকের ভিড় | ওই চেনা মুখ দুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না | কি অদ্ভুত | দু মিনিটে এইভাবে ভ্যানিশ কি করে হয়ে গেলো ওরা , এটা ভেবেই ভূমির অবাক লাগছিলো | আচ্ছা , এটা প্রিপ্ল্যান্ড না তো ! কথাটা ভেবেই ভূমি অনিন্দর দিকে এক পলক তাকালো | কিন্তু চোখটা ফেরাতে পারলো না | এ কি ! ও ওই ভাবে দেয়ালটা ধরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো কেন ? দেখে মনে হচ্ছে যেন টলছে | আচ্ছা , অনিন্দর তো লো প্রেশারের প্রবলেম ছিল একটা সময়ে | তাহলে কি ওর শরীর খারাপ লাগছে ! এইসব ভেবেই ভূমি অনিন্দর দিকে এগিয়ে গেলো | না , আর চুপ করে থাকা যায় না এই সময়ে | তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললো ,
” কি হয়েছে ? তোমার শরীর ঠিক আছে তো ?”
” না মানে , ওই লো প্রেশারের প্রব্লেমটার জন্য | আর সকালে কিছু ব্রেক ফাস্টও করিনি | তাই একটু উইক লাগছিলো | ইট’স ওকে , আই এম ফাইন ..”
ভূমি কথাটা শুনে বড়ো বড়ো চোখ করে বললো , ” এই তুমি ডাক্তার ! চলো | সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে , সেখানে কিছু খেয়ে নেবে | আর এখানে দাঁড়িয়ে কাউকে খুঁজে লাভ নেই | ওরা ইচ্ছে করেই বেপাত্তা হয়েছে | ”
” ইচ্ছে করে ? কিন্তু কেন ?”
অনিন্দর এই প্রশ্নের উত্তরে ভূমি এক কথায়ই দিলো , ” সেই ব্যাখ্যা ওদের কাছ থেকেই চেয়ে নিও | এখন চলো |” … কথাটার মধ্যে কেমন যেন একটা অর্ডার ছিল | তাই অনিন্দও আর সাহস করে কথা বাড়ালো না | চুপচাপ ভূমির সঙ্গে এগিয়ে গেলো |

<চলবে>

শিউলি পাওয়া পর্ব-০২

0

#শিউলি_পাওয়া <দ্বিতীয় পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
দমদমে ওরা যখন এসে পৌঁছলো তখন সকাল দশটা | অনেক দিন বাদে কলকাতায় এলো দীপ | দাদু দিদা মারা যাবার পর প্রায় চার কি পাঁচ বছর আর কলকাতা আসা হয়নি ওর | এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এইসব কথাই মনে হচ্ছিলো | কিন্তু এইসব ভাবনার ভিড়ে হঠাৎ আকাশের দিকে চোখটা চলে গেলো দীপের , নীল রঙের আকাশে সাদা মেঘগুলো ভিড় করে এসেছে | আর আসে পাশে ছড়িয়ে আছে সোনালী রোদ | ঠিক আজকের ভোরের স্বপ্নটার মতন ! একেই মনে হয় বলে শরৎ এর আকাশ ! ভেবেই একটা হাসি চলে এলো মুখে | যাই হোক, সেইদিন ক্যাব বুক করে হুগলী আসতে আসতে প্রায় দু ঘন্টা লেগেছিলো ওদের | এই আসার রাস্তাটাও খুব ভালো লেগেছে দীপের | সব জায়গায় একটা পুজো পুজো ভাব | কত প্যান্ডেল রাস্তার ধার দিয়ে সাজানো | এখনো সব মন্ডপগুলোতে কাজ চলছে | একটা অদ্ভুত ব্যস্ততা চারিদিকে | তার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার ধারে কাশফুলের বন | শরৎ এর আকাশ আর কাশফুলের বন যে একসাথে এতো সুন্দর দেখতে লাগে সেটা দীপ যেন এই প্রথম আবিষ্কার করলো | আর এইসবের মাঝেই একটা ভাবনা বার বার এসে ভিড় করছিলো ওর মনে , গাড়ির কাঁচের ওপারের ছবিটার সাথে আজকের স্বপ্নে দেখা ছবিটার অদ্ভুত মিল ! এই সময়ই হঠাৎ অনিন্দর কথায় সম্বিত ফিরলো ,
” কিরে ? কি এতো ভাবছিস ? এসে গিয়েছি আমরা হুগলী | আর পাঁচ মিনিট বাদেই ময়ূরপঙ্খী ঘাট চলে আসবে বুঝলি | ওখানেই আমার বাড়ি |”
সেইদিন যখন ওরা ময়ূরপঙ্খী ঘাটের জগন্নাথ মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছলো তখন ঘড়িতে সাড়ে বারোটা | জায়গাটা তো বেশ সুন্দর | ওই পারে না কি নৈহাটী ! ঘাটের চারিদিকে বসার জায়গা , ছোট ছোট পার্ক | এইখানেই তার মানে অনিন্দর বাড়ি | যদিও এই জায়গাটার কথা আগে ওর মুখে অনেক শুনেছে | আজকে এখানে এসে সেই সব ডেসক্রিপশনগুলোকেই মিলিয়ে দেখছিলো দীপ | এর মধ্যে অনিন্দ গাড়ি থেকে নেমেই পাঁচ মিনিটের জন্য গেলো পাড়ার ক্লাবে , ওর বাবার সঙ্গে দেখা করতে | এইবার দূর্গা পুজোর কমিটির সেক্রেটারি আসলে ওর বাবা | তাই খুব ব্যস্ত | এয়ারপোর্টের নিতে যেতে পারেনি উনি ছেলেকে |
যাই হোক , দীপ মনে মনে ভাবলো এই ফাঁকা সময়টায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে ময়ূরপঙ্খী ঘাটের কিছু ফটোগ্র্যাফস তুলে নেয়া যাক | জায়গাটাকে একটু ফ্রেমবন্দি করা যাক | সেই ভেবেই গাড়ি থেকে ডিএসএলারটা বার করে গঙ্গার ধারে এগিয়ে গেলো | তারপর শান্ত গঙ্গার বেশ কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দি করতে থাকলো মন দিয়ে , আর তখনি একটা গলার আওয়াজ হঠাৎ কানে এলো , ” কি ব্যাপার ? আপনি ফটো তুলছেন কেন আমাদের ?”
কথাটা শুনে দীপ ক্যামেরা থেকে চোখ সরাতেই দেখলো সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে | চোখ দুটো টানা টানা , মুখটা বেশ মিষ্টি , আর তার মাঝে লম্বা চুল অগোছালো ভাবে বিনুনি বাঁধা | লাল রঙের সালোয়ারে যেন একটু বেশিই সুন্দরী লাগছে ! এই লাল সালোয়ারের আসে পাশে আরোও বেশ কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে , কিন্তু চোখে এই মেয়েটাকেই লাগছে | কয়েক সেকেন্ডের জন্য এইসব অনেক ভাবনাই এসে ভিড় করলো দীপের মনে | যাই হোক , ও কিন্তু বেশ গম্ভীর ভাবেই উত্তর দিলো , — ” আপনাদের ফটো না , আমি এই জায়গাটার ফটো তুলছি | জায়গাটা বেশ সুন্দর তাই |”
কথাটা শুনে মেয়েটা ভ্রু নাচিয়ে বললো , ” ওহ , তাই বুঝি ! আমাকে এতো বোকা পেয়েছেন ?আমি কি বুঝি না কিছু ! হঠাৎ এই ভর দুপুরে কেউ ময়ূরপঙ্খী ঘাটের ফটো তোলে না | আপনি সুন্দরী মেয়ে দেখে ফটো তুলছিলেন | স্বীকার করুন |”
এই রে ! আচ্ছা ঝগড়ুটে তো | এবার দীপ বেশ বিরক্ত হয়েই বললো , ” কি ই বা এমন দেখতে আপনাদের যে আমি ফটো তুলতে যাবো ! আর যদি ফ্রেম এ চলে আসেন অবজেক্ট এর সঙ্গে , তাতে আমার কি দোষ ! আমি গঙ্গার ফটো তুলছিলাম | বুঝেছেন |”
এই কথাটা শুনে মেয়েটা আরো ক্ষেপে গেলো | তবে এবার রিজনটা অন্য , ” কি ই বা এমন দেখতে আমাদের কথাটার মানেটা কি ? আমাদের দেখতে খারাপ ! আপনি বললেই মানতে হবে ?”
এর উত্তরে দীপ ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না ! আর এই সময়েই অনিন্দর গলা | পেছন ফিরে দেখে অনিন্দ হাসি হাসি মুখে ওদের দিকেই এগিয়ে আসতে আসতে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করছে , ” কি রে কথা , কেমন আছিস ? কতদিন পরে দেখলাম তোকে |”
এর উত্তর দিতে গিয়ে মেয়েটারও মুখের সব রাগ হঠাৎ মুছে গিয়ে এক গাল হাসি , ” ভালো আছি অনিন্দদা | তুমি কেমন আছো ?”
এর মানে অনিন্দ চেনে এই মেয়েটাকে ! এই ভাবনার মাঝেই অনিন্দ কথার সাথে দীপের আলাপটা করিয়ে দিলো | যদিও দীপের পরিচয় পাওয়ার পরও কথার মুখে বিশেষ হাসি আসেনি | মুখটা গম্ভীর করেই বলেছিলো , “বুঝলাম |”
দীপেরও অবশ্য তাই | একই এক্সপ্রেশন ! এই ঝগড়ুটে মেয়েটার সাথে আলাপ হয়ে ওরও এমন কিছু ভালো লাগেনি | এইসব প্রাথমিক আলাপচারিতার পর কথা চলে যেতেই অনিন্দর কাছে দীপ ব্রেকিং নিউজটা শুনলো | এই কথাই না কি ভূমির বোন | অনিন্দর সিক্রেট ইনফর্মার | আর এক কথায় হবু শালিকা | এইসব শুনে দীপ ওর ভ্রুটা কয়েক ইঞ্চি তুলে বলেছিলো , ” বুঝলাম |”
<৪>
সেইদিন দীপ অনিন্দর বাড়ি গিয়ে একটা জিনিস বুঝেছিলো , যে এতো দিন ধরে অনিন্দ ওর মা বাবার সম্বন্ধে যা যা বলেছে , সেটা একদম ঠিক | দীপের এখানে এসে মনে হচ্ছে যেন কত দিন ধরেই এই বাড়িতে আসে | মনেই হচ্ছে না যে এটা প্রথমবার | এই এতো কম সময়েই অনিন্দর মা বাবা ওকে এতো নিজের করে নিয়েছে ! গল্প আড্ডায় আজকের দুপুরটা পুরো জমজমাট | আর তার ওপরে অনিন্দর মায়ের হাতের রান্না ! জাস্ট অসাধারণ | আর এই সব কিছু মিলিয়েই দীপের এইবারের চতুর্থীটা পুরো জমে ক্ষীর | কিন্তু এর মধ্যেই খাবার টেবিলে অনিন্দ দীপকে কেসটা খাইয়ে দিলো | বেশ হাসি হাসি মুখে ও মা বাবার কাছে ফাঁস করে দিল যে দীপ খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে , আর গানের গলাটাও ভীষণই সুন্দর | ব্যাস , দেখে কে ! অনিন্দর বাবা তো কথাটা শুনেই লাফিয়ে উঠলো সেইদিন | তার মানে আর একটা শিল্পী পাওয়া গেছে পাড়ার ফাংশনের জন্য | তা ও আবার যে সে শিল্পী না , স্বয়ং বোম্বে থেকে আসা শিল্পী , গিটারিস্ট | দীপের তো আর এরপর না বলার সুযোগই ছিল না | অনিন্দর বাবা তো পারলে দীপের গান গাওয়ার এনাউন্সমেন্টটা চতুর্থীর দুপুরেই করে দেয় ! তাই অগত্যা , চুপ করেই থাকতে হলো | শুধু এক ফাঁকে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে অনিন্দর দিকে তাকালো একবার , ওকে এইভাবে কেস খাওয়ানোর জন্য |
এইসবের মাঝেই চতুর্থীর বিকেল এসে হাজির | অনিন্দ যেই বিকেলটার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলো | আজ ফাইনালি ভূমির সাথে দেখা হবে | কতগুলো দিন বাদে সেই পুরোনো চেনা মুখটাকে দেখবে আজ ও ! এইসব ভাবতে ভাবতেই ভূমিদের বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো | আগে থেকেই কথা ওকে সব জানিয়ে রেখেছিলো | বাড়িতে এই সময় মা বাবা কেউ নেই | ভূমি একাই | তাই এটাই সুযোগ | যদিও অনিন্দর এই আগমনের ব্যাপারে ভূমি কিছুই জানতো না | সে তো নিজের ঘরে আপন মনে বইয়ের আলমারিটা গোছাচ্ছিল | কিন্তু হঠাৎ আনমনে ঘরের দরজার দিকে চোখ যেতেই থমকে গেলো , যেন পুরোনো সময় বিনা নোটিশে ওর কাছে এসে হাজির | যেই সময়টাকে ভূমি আর কখনোই দেখতে চায়নি ! আর কেনই বা দেখতে চাইবে ! এক তরফা অনেক কষ্ট পেয়েছে ও | আর না | তাই বেশ গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল , ” তুমি এখানে ? ”
এর উত্তর দিতে অনিন্দর অবশ্য বেশ কিছুক্ষন সময় লেগেছিলো | আসলে ও যেই মানুষটাকে একদিন ফেলে চলে গিয়েছিলো , তার চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা একটু কঠিন | তা ও কিছু কথা সাজিয়ে বললো , ” হ্যাঁ , আমি | কেমন আছো ভূমি ?”
ভূমি কথাটা শুনে এক কথায়ই উত্তর দিলো , ” ভালো | ভালো আছি |” … আর তারপর আবার বইয়ের আলমারির দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো | অগোছালো বইগুলো যত্ন করে গোছাতে শুরু করলো | অনিন্দর জীবনটাও আজ খুব অগোছালো | এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীবনটাকে একমাত্র ভূমিই পারে গুছিয়ে দিতে ! ভূমির দিকে তাকিয়ে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে তাই বলে উঠলো , ” আই এম সরি ভূমি | আমার সেইবার দূর্গা পুজোয় আসা উচিত ছিল | ঐভাবে সম্পর্কটাকে ভেঙে দেয়াটা ঠিক হয়নি | তখন আসলে কেরিয়ার ছাড়া কিছুই ভাবতে পারতাম না | ব্যাঙ্গালোরে এম.ডি কমপ্লিট করার পর একটা বেটার অপরচুনিটি , একটা ভালো জায়গায় প্র্যাকটিস করতে চান্স পাওয়া , এইসবই ইম্পর্টেন্ট ছিল আমার কাছে | কিন্তু আজ ! ”
কথাটাকে শেষ না করতে দিয়েই ভূমি এবার বলে উঠলো , ” কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হয়েছে যে লাইফে একটা স্ট্রেস বাস্টারও থাকা দরকার | সারাদিনের ক্লান্তি , কাজের টেনশন , স্ট্রেস এইসব কিছু শেয়ার করার জন্য একজন থাকা দরকার | তাই তুমি এখন এই বাড়িতে দাঁড়িয়ে , তাই না অনিন্দ ? ”
এই প্রশ্নের উত্তরে অনিন্দ কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না | তার মানে এই কয়েকটা বছরে ভূমি ওকে এতটাই হিসাবি ভেবে ফেলেছে ! এতটা সেলফিশ মনে করে ওকে ! কথাটা ভেবেই অনিন্দর মনটা ভিজে যাচ্ছিলো , বার বার | তবে সেইদিন অনিন্দ চুপ থাকলেও ভূমি চুপ থাকেনি , আবার বলতে শুরু করেছিল , ” আসলে তোমার দোষ না | এখন বেশিরভাগ মানুষই এই রকম | খুব হিসেবি | তাদের কাছে ফিলিংসটা ও একটা ইনভেসমেন্ট | আর কিছুই না | তুমি কখনো ভালোবাসোইনি অনিন্দ | যদি বাসতে তাহলে ঐভাবে ছেড়ে যেতে না | আর আজকে তোমার আসা , সরি বলা , এইসবই একটা ইনভেসমেন্ট | ওই লাইফের স্ট্রেস বাস্টারটাকে আসলে তুমি খুব মিস করছো | তাই এসেছো এখানে , আমার কাছে | কিন্তু আমি তো তোমাকে খুব ভালো ভাবে চিনি , তাই আমি জানি , তোমার মতন হিসেবি মানুষ কখনো সত্যি করে ফিল করতে পারে না | ভালোবাসতে পারে না | তুমি রিয়্যাল ফিলিংস কি , সেটা জানোই না | ”
ভূমির কথাগুলো শুনে অনিন্দর যেন সব কিছুই শেষ হয়ে যাচ্ছে আজ | ভূমির কথাগুলোর মধ্যে পুরোনো আমি কে খুঁজে পাচ্ছে অনিন্দ | হ্যাঁ, ভূমি যেটা বলেছে একদম ঠিক | অনিন্দ একটা সময় ঠিক এই রকমই হিসেবি ছিল | ফিলিংস , রিলেশনশিপ এইসবটাকেই ও লাভ ক্ষতির হিসেবে ফেলতো | কিন্তু একটা সময়ের পর ওর জীবনের সব হিসেবি উল্টে পাল্টে গেলো | যখন ওর লাইফ থেকে এই চেনা গলার আওয়াজটা , এই পুরোনো ফেলে আসা মুখটা , এই ‘ভূমি’ নামটা শেষ হয়ে গেলো, সেইদিন বুঝলো কাউকে ভালোবাসলে কেমন লাগে | কেউ আসবে না জেনেও দিনের পর দিন তার জন্য অপেক্ষা করতে ঠিক কেমন লাগে ! তবে ও যা বুঝেছে, যেটা ফিল করেছে , সেটাকে কিছুতেই শব্দ দিয়ে সাজিয়ে আজকে ভূমির কাছে বলতে পারলো না | আসলে লাইফে তো কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটার নেই , যে ঠিক সময় ঠিক ডায়লগটা রেডি করে হাতে ধরিয়ে দেবে ! আর মুখস্ত কথাগুলো বলে ফেললেই সিনটা পারফেক্ট হয়ে যাবে | সিনেমা আর রিয়্যাল লাইফে এটাই তো তফাৎ | বাস্তবে এই চরম মুহূর্তগুলোতে শব্দের অভাব হয় , ইমোশনসগুলো একসঙ্গে মনের মধ্যে মিলে মিশে যায় , গলা ধরে আসে কান্নায় , আর কথাগুলো না বলাই থেকে যায় ! তা ও শেষ বারের মতন অনিন্দ দুটো কথা সাজিয়ে ধরা গলায় বললো , ” আর একবার নতুন করে শুরু করা যায় না ? একেবারে প্রথম থেকে ?”
ভূমি অনিন্দর এই প্রশ্নের উত্তরটাও খুব কঠিন ভাবে দিয়েছিলো সেইদিন , ওর চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলেছিলো , ” না অনিন্দ | ভাঙা কাঁচকে যদি তুমি ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগিয়েও দাও , তাহলে দাগটা স্পষ্ট বোঝা যায় | সেটা আর কখনোই আগের মতন হয় না | আমাদের সম্পর্কটাও তাই | যেটা অনেকদিন আগেই ভেঙে গেছে , শেষ হয়ে গেছে | সেটাতে শুরু করার মতন আর কিছুই বাকি নেই |”
এরপর আর অনিন্দর কিছু বলার ছিল না ! সম্পর্কের মূল্য সময় থাকতে না বুঝলে সেটা হয়তো এইভাবেই টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায় | আর এই ভাঙা টুকরো গুলোকে হাজার চাইলেও আর জোড়া লাগানো সম্ভব হয় না | সেইদিন বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে একা বসে এইসবই ভাবছিলো | ঘরের আলোগুলো ইচ্ছে করেই নেভানো ছিল | মাঝে মাঝে অন্ধকারের সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে এখন ওর | কি অদ্ভুত , একদিন হয়তো এইভাবেই একটা দুর্গাপুজোয় ও ভূমির জীবনে কিছু অন্ধকার এনে দিয়েছিলো ! আজকের পুজোয় ভূমি সেটাই আবার ওকে ফিরিয়ে দিলো |

<চলবে>

শিউলি পাওয়া পর্ব-০১

0

#শিউলি_পাওয়া <প্রথম পর্ব>
#ঈপ্সিতা_মিত্র
(১)
শরৎ মানেই শিউলি ফুলের দিন চলে আসা | চারিদিকে আগমনীর সুর আর পুজো পুজো গন্ধ ।
এরকমই একটা শরৎ এ পুজোর আনন্দে যখন সবাই মাতছে, তখনই দীপের জীবন থেকে কিছু শিউলি ফুল হঠাৎ চলে গেল | সালটা ছিল ১৯৯৩। ওর বয়স তখন মাত্র পাঁচ। ওর মা বাবার ডিভোর্স টা হয়েই গেল ! অনেক দিন ধরেই যদিও কেস চলছিল। একটা সম্পর্কের বোঝা , দীপের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলো অলকেশ আর শ্যামলী | দুজনেই সব বাঁধন ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাইছিলো | এমন একটা বাঁচা যেখানে পুরোনোর আর কোনো জায়গা নেই , তাই সেই বছরই দীপকে পাঠিয়ে দেয়া হলো দার্জিলিং এর এস.টি.জোসেফ বোর্ডিং স্কুলে | দূর্গা পুজোটা কাটলো সেইবার কার্শিয়াং এ কাকার বাড়িতে, একা একা | এরপর স্কুলের ছুটিতে কখনো কখনো আসতো কলকাতায়, ওর দাদুর বাড়িতে, তবে পুজো তে আর কখনই আসা হয়নি।
যাই হোক , স্কুল লাইফ শেষ করে দীপ চলে গেল বোম্বেতে ডাক্তারি পড়তে, তারপর শীত গ্রীষ্ম বসন্ত পেড়িয়ে জীবনের ত্রিশটা বছর কেটে গেছে | এখন ও বোম্বের হিরানান্দানি হসপিটাল এর একজন নাম করা গাইনোকোলজিস্ট । জীবনের এই এতগুলো বছর ওকে একা থাকতে শিখিয়ে দিয়েছে। আগে যখন ছোট ছিল তখন একটা আশা ছিল যে অন্যদের মতন ওর বাবা মা ও আসবে একদিন ঠিকই দেখা করতে। কিন্তু সেইসব কিছুই হয়নি কখনো ! একবারের জন্যও মা বাবা আসেনি | তার বদলে এসেছে কিছু সাজানো কথা , অজুহাত |…..” খুব কাজের চাপ, আসতে পারবে না রে এবার |….”দেখা করার সময় নেই একদম |” , এইসব কথাগুলো ছোট থেকে শুনে শুনে এখন তো ওর অভ্যাসই হয়ে গেছে। তাই নিজেই আস্তে আস্তে ফোন করা কমিয়ে দিয়েছে। বাড়তে দিয়েছে দূরত্ব |

আসলে দীপ জানে , ওরা যোগাযোগ রাখতেই চায়নি কখনো | দুজনেই নতুন বিয়ে করেছে। আর এই নতুন সংসারে তারা বেশ খুশি | তাই কেউই পুরনো স্মৃতির বোঝা টানতে চায় না | দীপ আসলে ওদের জীবনে আর কিছুই না ! শুধুই একটা দ্বায়িত্ব । ও এটা বুঝে গেছে যে এই এতো বড়ো পৃথিবীতে ওর নিজের বলতে কেউ নেই | একটা শরৎ ওর জীবন থেকে নিজের সব মানুষগুলোকে কেড়ে নিয়ে ওকে ফেরৎ দিয়েছে শুধুই একাকিত্ব | যেই একাকিত্বকে সঙ্গী করেই হয়তো কাটিয়ে দিতে হবে সারাটা জীবন |

কিন্তু এই বারের শরৎটা একটু আলাদা দীপের জন্য। ওর হিরানান্দ হসপিটাল এ এসে একটা খুব ভালো বন্ধু হয়েছে। ডা: অনিন্দ চক্রবর্তী। বাঙালি বলে প্রথমেই আলাপটা জমে গিয়াছিল। ওরা তো এখন একই ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকে | আগে দীপের বাংলা বলতে একটু অসুবিধা ছিল, কিন্তু এখন অনিন্দর সাথে থাকতে থাকতে বাংলাটা বেশ রপ্ত করে নিয়েছে |

এইবার পুজোতে অনিন্দ যাবে ওর বাড়ি হুগলী | আর অনিন্দ কিছুতেই দীপকে ছাড়া যাবে না | তাই অনিন্দর জোরাজুরিতে না না করে শেষে হ্যাঁ বলতেই হলো ওকে | আর অনিন্দর মুখে এত বার ওর মা বাবার কথা শুনেছে যে একবার দেখা করার ইচ্ছা দীপেরও ছিল ! আর দূর্গা পুজোটাও এই সুযোগে এনজয় করা যাবে। ও তো এই পুজো টা কে কখনো এর আগে ভালো করে ফীল ই করেনি ! তাই একটা আলাদা অপেক্ষা ছিল ওর চতুর্থীর দিনটার জন্য। ওই দিন ই তো ওদের ফ্লাইট।

<২>
অনেক দূর থেকে আসা একটা রাস্তা এসে মিশেছে সবুজ মাঠ আর নীল দিগন্তের ওপারে | আর সেই রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা কাশফুলের বন | সেই কাশফুলগুলোর মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে নীল রঙের আকাশ | পেঁজা তুলোর মতন মেঘগুলো সেই আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক | আর সেই কাশফুল , নীল আকাশের মাঝখানে একটা দুর্গার মুখ | কেউ যেন তুলির টানে এঁকে দিচ্ছে সেই দূর্গা প্রতিমার চোখ | সেই প্রতিমার আসে পাশে ছড়িয়ে আছে কিছু শিউলি ফুল | এই শিউলি ফুলের ভিড়েই হঠাৎ কানে এলো ওর নাম , —–” দীপ , এই দীপ , উঠবি না ঘুম থেকে ! চারটে বেজে গেছে তো | দু ঘন্টা বাদে ফ্লাইট আমাদের !” ……….. চেনা গলার আওয়াজটা কানে আসতেই জেগে গেলো দীপ , সামনে অনিন্দ দাঁড়িয়ে | ওহ , আজই তো চতুর্থী | কিছুক্ষণ বাদে ওদের ফ্লাইট | ভেবেই ঘুমের ঘোরটা কেটে গেলো ওর | তবে স্বপ্নের রেশটা এখনো আছে মনে মনে ! যাই হোক, আর দেরি করা যাবে না | তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে | নইলে সত্যি সত্যিই ফ্লাইটটা মিস করে ফেলবে |

সেইদিন ঠিক টাইমেই এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিল ওরা | তবে ফ্লাইটে বসেও অনিন্দ যেন একটু অন্যমনস্ক | কি একটা ভাবছে অনেকক্ষণ ধরে ! দীপ ব্যাপারটা বুঝেছে যদিও | কার কথা ভাবছে অনিন্দ !

——” ভূমির ব্যাপারে চিন্তা করছিস তো ? বুঝেছি | চিন্তা করিস না এতো | তোকে দেখলে ও আর রেগে থাকতে পারবে না |”
দীপের কথাটা শুনে অনিন্দর একটা দীর্ঘ্য নিঃশ্বাস আপনাআপনিই চলে এলো , ” জানি না কি হবে ! দু বছর আগে দূর্গা পুজোর সময়ই তো ব্রেক আপটা করেছিলাম আমি | তখন বুঝতে পারিনি যে ভূমি আমার লাইফে এতোটা ইম্পর্টেন্ট | ও সত্যি ভালোবাসতো আমাকে | কিন্তু তখন এই সব নিয়ে বিশেষ ভাবিনি | আসলে কেরিয়ার ছাড়া কিছু যেন ভাবতেই পারতাম না আমি তখন | ওই দূর্গা পুজোতে কথা ছিল হুগলী যাবো , দেখা করবো ওর সাথে | ও খুব ওয়েট করেছিল জানিস আমার জন্য সেইবার | কিন্তু আমি যাইনি | হিরানন্দ হসপিটালের অফারটা পেয়েই সব ভুলে সোজা ব্যাঙ্গালোর থেকে বোম্বে চলে এসেছিলাম | ভেবেছিলাম আর লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ রাখা সম্ভব না | তাই একটা ফোন করেই সব শেষ করে দিয়েছিলাম আমি | এইসবের পর প্রথম প্রথম সব ঠিকই ছিল , কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে ওকে মিস করতে শুরু করলাম | যখন দেখলাম সারাদিন পরে আমার কথা শোনার জন্য ওই ফোনটা আর আসছে না , তখন ফিল করলাম যে লাইফে কেরিয়ারটাই সব না | তারপর ভূমিকে অনেকবার ফোন করেছি | কিন্তু ও একবারও ধরেনি | জানিস তো , একটা সময় ছিল যখন ও ফোন করতো , আর আমি ধরার সময় পেতাম না | বা অনেক সময় কত বিরক্তির সঙ্গে কথা বলেছি ওর সাথে | কিন্তু আজ আর ও ফোন ধরে না | এখন আমি বুঝি যে ওই দিনগুলোতে ওর কতটা খারাপ লেগেছিলো | ”

অনিন্দর কথাগুলো শুনে দীপ কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো, ” এই দু বছরে তো তুই হুগলী গিয়েছিলিস কয়েকবার | তো ওর সাথে দেখা হয়নি ?”
” না হয়নি | ও আমাদের ব্রেক আপের পর শান্তিনিকেতন চলে গিয়েছিলো | ওর মাসির বাড়িতে | ওখানেই একটা স্কুলে চাকরি করতো | এই বছর ও চাকরিটা ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে | ওর বোনের সাথে তো কন্ট্যাক্ট আছে আমার | ও ই এইসব খবরগুলো দিয়েছে আমাকে | তাই তো এই পুজোটা আমার জন্য খুব দামি | ওকে ফিরে পাওয়ার হয়তো এটাই শেষ চান্স !” ……

অনিন্দর কথাগুলো শুনে দীপ একটু হাসার চেষ্টা করে বললো, ” ডোন্ট ওরি , সব ঠিক হয়ে যাবে | এন্ড অফ দ্যা ডে হ্যাপি এন্ডিংই ওয়েট করছে তোর জন্য | সো ডোন্ট লুজ হোপ … ”
এইসব কথা বলে অনিন্দকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও আসলে দীপ জানে কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে আসে , যখন সে সব হারিয়ে ফেলা আর সব ফিরে পাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে | অনিন্দও আজ সেইরকমই একটা সরলরেখার ওপর দাঁড়িয়ে | এখন শুধু একটাই অপেক্ষা , জীবন ওকে হারাবে , না কি হারানো সব কিছু ফিরিয়ে দেবে!
< চলবে >

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭৬ এবং শেষ পর্ব

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

অন্তিম পর্ব
[প্রথম অংশ]

আজ তাসনুভার বিয়ে।বেশ আড়ম্বরের সাথে হই হুল্লোড় আর জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে তার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে যাচ্ছে।বিয়ে পড়ানোর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আসরের ওয়াক্তের একটু পরে।

আদির পরিবার বলতে তার মা আর বাবা।তারা দেশে আসার পরেই নামকরা একটা রিসোর্টে বুকিং দিয়েছিলেন।আপাতত তিনজনের অবস্থান সেখানেই।বিয়ে নিয়ে সবার উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি নেই,অথচ আদির অবস্থা সকাল থেকেই নাজেহাল।কিভাবে কি পরবে,প্রথমে কি করবে,সবকিছু কিভাবে সামলাবে এই নিয়ে তার চিন্তার শেষ নাই।তারা তিন বন্ধু পরিকল্পনা করেছিলো আদির বিয়েতে আরহাম আর ওয়াজিদই সব সামলাবে।অথচ ঘটনা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে আদির বিয়েতে তাদের দু’জনের কারো কাছেই অতো সময় নেই যে তারা আদিকে নিয়ে মাথা ঘামাবে।আরহাম নিজের বোনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত।আর ওয়াজিদ ব্যস্ত ঐ বাড়ির সবকিছু নিয়ে।

আদির মেজাজ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে খারাপ হলো।সাথে মেজাজও বিগড়ালো কিছুটা।সবাই তাকে এমন অবহেলা করছে কেন?সব লেমলাইট তাসনুভার দিকে।আর তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে পর্যন্ত না।

রাজিয়া তার ঘরে এসে তার বিরক্তি ধরা মুখটা দেখে বললেন,’কি হলো তোমার?এমন চেহারা বানিয়ে রেখেছো কেন?’

আদি চেহারা ঠিক করলো না।উল্টো আরো বেশি বিরক্ত হয়ে বলল,’আজকে আমার বিয়ে।অথচ একটা মানুষ আমার খোঁজ নিচ্ছে না।আমার রাগ হচ্ছে ভীষণ।’

রাজিয়া বললেন,’আহা! ওরা তো ঐ বাড়িতে ব্যস্ত।তোমাকে সময় দিবে কিভাবে বলো?’

‘একটা ফোনও বুঝি করা যায় না?’

হোটেলের একজন স্টাফ দরজায় একে নক করলো।জানালো কয়েকজন নাকি তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছে।তারা সবাই লবিতে অপেক্ষা করছে।

রাজিয়া কিছু একটা চিন্তা করতে করতে বললেন,’তাসনুভার জন্য যে রিং অর্ডার করেছিলাম,সেটার ডেলিভারি দিতে এলো নাকি?’

আদি বিরক্ত হয়ে বলল,’রিং দিতে কয়েকজন আসবে?দাঁড়াও দেখে আসি।’

অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে আদি লবির দিকে এগিয়ে গেল।লবিতে পা রাখতেই তার চক্ষু চড়াক গাছ।ওয়াজিদ,রিমি,ওয়াসিফ,বিভা,ইজমা,ইফাজ আর শাহাদাত এসেছে।আদি তাদের দেখতেই চমকে উঠল।কতোক্ষণ হা হয়ে থেকে বলল,’তোরা?’

রিমি দাঁত বের করে বলল,’সারপ্রাইজ!!!’

আদি দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়।রিমি উৎসুক গলায় বলল,’আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আমরা বরযাত্রী হবো।তাই সব সেজেগুজে এখানে চলে এলাম।কেমন হয়েছে আমাদের আইডিয়া?’

আদি হতভম্ব চোখে কতোক্ষণ তাদের দিকে তাকায়।শেষে আনন্দিত হয়ে বলল,’দারুন আইডিয়া।ভীষণ মিস করছিলাম তোমাদের।একা একা লাগছিলো অনেক।’

ওয়াজিদ লবিতে থাকা একটা সোফাতে বসে পায়ের উপর পা তুলতে তুলতে বলল,’আমরা সবাই রেডি হয়ে এসেছি।তোর এই অবস্থা কেন?যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।’

আদি তক্ষুনি এক প্রকার লাফাতে লাফাতে ভেতরে চলে গেল।রিমি ওয়াসিফকে কোলে নিয়ে ওয়াজিদের কাছে এসে বলল,’একে ধরুন।আর পারছি না।বাপরে! এতো ভারি কেন?’

ওয়াজিদ চোখ পাকালো,
‘তোমার এধরনের কথা না বললে হয় না?দেখোই তো বাচ্চাটা কতো অসুস্থ থাকে।তুমি আবার ভারি ভারি করছো।চুপ থাকো।নিতে হবে না তোমার কোলে।’

বলেই সে ছোঁ মেরে ওয়াসিফ কে নিজের কোলে নিল।রিমি হাঁফ ছেড়ে বলল,’বাপরে! বাঁচা গেল।’

***

ইজমার দৃষ্টি ইফাজের দিকে যে কিনা করিমুল সাহেব সামনে আসার পরেই কিসমিসের মতো চুপসে গেছে।তারা লবিতে এতোটা সময় বেশ স্বাভাবিক ছিলো।যেই না করিম সাহেব সেখানে পা রেখেছেন,ওমনি ইফাজ নিজেকে লজ্জাবতী গাছের মতো গুটিয়ে নিল।এই ভদ্রলোকের চাহনি তার ভয় লাগে।মনে হয় একা পেলেই তিনি ইফাজকে কাঁচা গিলে ফেলবেন তার মেয়ের মন চুরির অপরাধে।ইফাজের অনুমান লোকটা তাকে ঠিক পছন্দ করে না।কেবল ভদ্রতার খাতিরে মুখের উপর কিছু বলে না এই যা।

ইজমা আজ মেজেন্টা রঙের শাড়ি পরেছে।ইফাজ পরেছে সাদা শার্ট।ইজমা অনেক বলার পরেও সে পাঞ্জাবি পরেনি।তার নাকি অস্বস্তি হয়।কি অদ্ভুত কথা! ঐ বাড়িতে যাওয়ার নাম নিলেই তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়।তার সমস্ত অস্বস্তি কেবল ঐ বাড়িতে যাওয়ার নাম নিলেই শুরু হয়।এক ঘন্টা জোর জবরদস্তির পর ইজমা তাকে মানাতে সক্ষম হয়েছে।

রাজিয়া আর ইফতেখার সাহেব লবিতে আসতেই ওয়াজিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।কিছুটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,’আঙ্কেল-আন্টি! আপনারা রেডি?’

রাজিয়া শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে চোখ না তুলেই বললেন,’হ্যাঁ বাবা।ড্রাইভার কে ফোন দিয়ে বলো পার্কিং থেকে গাড়ি বের করতে।’

আদি আসলো সবার পরে,গায়ে একটা সুন্দর কালো পাঞ্জাবি জড়িয়ে।তার পাঞ্জাবিটা ভীষণ সাদামাটা।তাকে একদম ফর্মাল দেখাচ্ছে।ওয়াজিদ তাকে আগাগোড়া দেখে মুখ কুঁচকে বলল,’তুই যে আজ বিয়ে করতে যাচ্ছিস,এটা তোর জামা দেখলে কেউ বুঝবে না।বেশিই সিম্পল লাগছে তোকে।’

আদি দায়সারা হয়ে জবাব দিলো,’লাগুক।আমার কোনো সমস্যা নেই।আমাকে ঐসব শেরওয়ানিতে মানায় না।আমি পাঞ্জাবিতেই ঠিক আছি।’

ওয়াজিদ আর কথা বাড়ালো না।এগিয়ে যেতে যেতে বলল,’আচ্ছা হয়েছে।এবার আয়।দু’টো বাজে অলরেডি।’
.
.
.
.
“বর এসেছে,বর এসেছে।”

বাড়ির লোকজন সব যার যার কাজে ব্যস্ত ছিলো।এমন সময় নিচ থেকে কারো চঞ্চল কন্ঠের চিৎকার কানে যেতেই সব নড়েচড়ে উঠল।সে কন্ঠটা আগের মতো সুরে আবারো বলল,’বরের গাড়ি চলে এসেছে।সবাই নিচে নামো।’

নবনীতা তখন তাসনুভার ঘরে বসা।তাসনুভাকে পার্লার থেকে এসে একজন সাজিয়ে দিচ্ছিলো।নবনীতার অপলক দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।সে আজ গাঢ় লাল বেনারসি শাড়ি পরেছে।বিয়ের বউ যদি বেনারসিই না পরে,তবে সে আর কিসের বউ?

তাসনুভাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে।এই কথা সে মানতে নারাজ।কেউ তার একটু প্রশংসা করলেই সে লজ্জা পেয়ে বলছে,’ধুর,মিথ্যা কথা।তোমরা সবাই আমাকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলছো।’

নবনীতা পেছন থেকে বলল,’তোমাকে পরীর মতো লাগছে সোনা।আজকের দিনের জন্য তুমিই পরী।’

তাসনুভা লাজুক হাসল।লজ্জা পাওয়া মুখেই বলল,’আর বানিয়ে বানিয়ে কথা বলো না তো।আমি জানি আমায় ভুতের মতো লাগছে।’

আরহাম পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে ঘরের ভেতর এলো।এসেই কিছু বলতে যাচ্ছিলো।কিন্তু তাসনুভার দিকে তাকানোর পর তার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।সে একমনে,এক দৃষ্টিতে কতোক্ষণ তাকে দেখে গেল।কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে!

আরহাম এগিয়ে গেল।এগিয়ে যেতে যেতে অনুভব করল তার পা জোড়া কেমন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।পা না,পুরো শরীরই হঠাৎ কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

সে ভঙ্গুর পায়ে এগিয়ে গেল।হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে ডাকলো,’তাস! তুই বিয়ে করছিস?’

তাসনুভার টলমলে চোখ।আরহাম নিচে বসতেই সে তার একটা হাত লুফে নিয়ে বলল,’এখন আর করতে ইচ্ছে করছে না।আমি সারাজীবন তোমাদের ঘাড়ে বসে খেতে চাই।’

আরহাম কিঞ্চিৎ হাসল।একেবারেই নিষ্প্রাণ হাসি।জমে আসা কন্ঠে ধীরে ধীরে বলল,’খুব ভালো থাকিস তাস।তুই ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকবো।আমার আর আরিশের চোখে তুই সবসময়ই বাচ্চা।’

বলে সে আর অপেক্ষা করলো না।উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়া যে কতো যন্ত্রনার বিষয়,সেটা সে এর আগে কখনো উপলব্ধি করেনি।

নবনীতা ঘরে গিয়েই প্রথম আরশাদকে খুঁজল।সে নেই,থাকার কথাও না।কাল থেকেই সে ছুটোছুটি আর চিৎকার চেঁচামেচিতে ব্যস্ত।

আরহাম খাটের এক কোণায় থম মেরে বসেছিল।নবনীতা গিয়েই তার সামনাসামনি দাঁড়ালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি হলো আপনার?এক্ষুনি তাদের গাড়ি চলে আসবে আর আপনি এখনো এমন চুপ মেরে বসে আছেন।যান,তাড়াতাড়ি নিচে যান।’

আরহাম ক্লান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো,’যাও তো পরী।ভালো লাগছে না আমার।’

নবনীতা অবাক হলো।হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে তার চোখ মুখ দেখতে দেখতে বলল,’আয়হায়! হলো কি?কি সর্বনাশ! ঐ দিকে বোন,আর এদিকে আপনি।এতো টান হলে বিয়ে দিচ্ছেন কেন?’

আরহাম কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।নবনীতা সেসবের পরোয়া না করে বলল,’শুনেন জনাব,এটা সব মেয়ের জীবনেরই করুণ সত্যি।আমাকেও এমন শুভি আর চিত্রকে ছেড়েই এখানে আসতে হয়েছিল।আপনি কি আমাকে চিরকাল মামা মামির সাথে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন?’

আরহাম আড়চোখে তাকে দেখে বলল,’তোমাকে তোমার মামি থেকে বেশি ভালো আমি রেখেছি।যদি সেই কথা স্বীকার না করো,তবে তুমি একটা বেঈমান।’

নবনীতা ঠোঁট উল্টে বলল,’আরে বাবারে! তো মামি কবে আমার গলা চেপে ধরেছিল শুনি?’

আরহামের গায়ে কথাটা ভীষণ বাজে ভাবে লাগলো।মনে হলো পরী তার শরীরে কথা দিয়ে ফোসকা ফেলে দিয়েছে।সে অন্যত্র মুখ ঘুরিয়ে চাপা কন্ঠে বলল,’দুঃখিত! এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করতে হবে বলে দিও।তুমি যদি বলো তোমার পা ধরে বসে থাকতে হবে,তবে বসে থাকবো।তবুও এই খোঁটা আর দিও না।যাই হোক,আবারো দুঃখিত।’

নবনীতা চোখ কপালে তুলে বলল,’সেকি! আপনি এখনো রাগ করছেন?আমি কিন্তু খোঁচা মারতেই বলেছি।মন থেকে বলিনি।’

‘মনে ছিলো বলেই মুখে এসেছে।যাক বাদ দেও।’

নবনীতা অসহায় চোখে আরহামের দিকে তাকায়।তার খারাপ হওয়া মনটা নবনীতার কথায় আরো বেশি খারাপ হয়ে গেছে।তার চোখ মুখে অনুতাপ,নিদারুণ অনুশোচনা।সে মাথা নিচু করে বলল,’সরি পরী।আই ওয়াজ নেভার আ সুইট হাসবেন্ড।আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইউ।’

নবনীতা তার মুখ চেপে ধরল।কড়া গলায় বলল,’হয়েছে?বাজে বকা শেষ হয়েছে?’

নবনীতা সামান্য উঁচু হয়ে আরহামের খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে চুমু খেল।সে তাল সামলাতে পারছিলো না দেখে আরহাম দ্রুত দুই হাতে তাকে আগলে নিল।নবনীতা প্রশান্তিতে চোখ বুজে তার উপরই সমস্ত ভর ছেড়ে দিলো।তার নাকে নাক ঘষে বলল,’আরহাম! আপনি এই আট বছরে আমার জীবনে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।এই আটবছরে কেউ আমাকে আপনার মতো বুঝেনি।কারো কাছে আমি এতো কান্না করিনি,যত কান্না আমি আপনার কাছে করেছি।আপনি আমার জান আরহাম।আমি আপনাকে কতো ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না।’

আরিশ চেঁচাচে চেঁচাতে ঘরে এলো।
‘ভাবি!ও ভাবি! বরযাত্রী,,’

সে কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে এক চিৎকার দিয়ে পেছন ঘুরে গেল।আরহাম থমথমে মুখে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করল,’শালা গর্দভ একটা!’

আরিশ তড়িঘড়ি করে বলল,’ভাবি বরযাত্রী এসে গেছে।আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি নিচে।তুমি নিচে এসো জলদি।এসব আদিখ্যেতা পরেও করা যাবে।’

বলেই সে এক প্রকার পালিয়ে চলে এলো সেখান থেকে।আরহাম মৃদু গর্জন করে বলল,’এ্যাই শালা! তুই শেষে এটা কি বললি?’

নবনীতা তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।আয়নাতে একবার নিজের শাড়ি আর কুচি ঠিক আছে নাকি দেখে নিল।ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে কেবল হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল,’তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।সবাই নিচে আছে।আমরা গেইট ধরব।’

আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’পাগল নাকি?তোমরা ধরো গেইট।এসব ক্রিঞ্জি এক্টিভিটিজে আমি নাই।’

নবনীতা ভেংচি কাটলো।
‘বাপরে! এসেছে গুলশানের পশকিড!’

***

আদি চোখ সরু করে সামনে তাকায়।রিমি তারই মতো চোখ সরু করে বলল,’এভাবে দেখে কোনো লাভ নেই।টাকা ছাড়া নো এনট্রি।’

আদি মুখ বাঁকা করে বলল,’সারা রাস্তা বরযাত্রী বরযাত্রী করে যেই না বান্ধবীকে দেখলে,ওমনি দল পাল্টে নিলে?’

রিমি দাঁত বের করে হাসল।আলতো করে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি কোনো বরযাত্রী টরযাত্রী বুঝি না।যেই পক্ষে টাকা আছে,আমি ঐ পক্ষে।’

নবনীতা বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়েছিল।রিমির কথা শেষ না হতেই সে জোর গলায় বলল,’ওতো কিছু বুঝি না।যেটা চেয়েছি সেটা দিয়ে দেন।’

আদি সন্দিহান চোখে বলল,’ডিমান্ড কতো শুনি?’

নবনীতা নির্বিকার হয়ে বলল,’মাত্র পঞ্চাশ হাজার।কারণ আমরা জানি আপনি বেকার।’

আদি খ্যাক করে উঠল,
‘কি কি?কতো হাজার?’

আরিশ আবারো বললো,
‘পঞ্চাশ হাজার।ফিফটি থাউজ্যান্ড অনলি।’

আদি চোখ গোল গোল করে বলল,’আমাকে বেচলেও তো এতো টাকা আসবে না বাপ।’

শুভ্রা ভাবুক হয়ে বলল,’এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা।আপনার একটা কিডনির দামই এর চেয়ে বেশি।’

আদি পেটে হাত রেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল,’কি সাংঘাতিক! এক গেইটের টাকার জন্য তুমি আমার কিডনি বেচে দিবে শুভ্রা?’

নবনীতা চোখ গরম করে বলল,’এতো কাহিনি বুঝি না।আমি জানি আপনার কাছে পঞ্চাশ হাজার আছে।বেশি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত দিয়ে দিন টাকাটা।’

ওয়াজিদ দুই হাত বগলদাবা করে বলল,’না দিবো না।আমাদের পাত্র নিজেই তো একটা স্বর্ণের খনি।আমরা আবার আলাদা করে টাকা দিবো কেন শুনি?’

ইজমা তার সাথে সুর মিলিয়ে মাথা নেড়ে বলল,’তাই তো।আমাদের পাত্র হাজারে একটা।তাকে বর হিসেবে পাওয়াই তো এই জনমের ভাগ্য।’

রিমি মুখ বাঁকিয়ে বলল,’ওবাবা তাই নাকি?তোমাদের পাত্র তো হাজারে একটা।আর আমাদের পাত্রী লাখে একটা।’

নবনীতা দিরুক্তি করে বলল,’জ্বী না।আমাদের পাত্রী কোটিতে একটা।আপনাদের পাত্র যদি স্বর্ণের খনি হয়,আমাদের পাত্রী তবে হীরার খনি।’

ইজমা মুখ কুঁচকে বলল,’হীরা তো স্রেফ কাঁচের টুকরো।আমাদের ছেলে তো একেবারে নিখাঁদ।’

ব্যাস।ওমনি দুই পক্ষের মাঝে হই হুল্লোড় বেঁধে গেল।ইফাজ চোরা চোখে একবার করিমুল সাহেবকে দেখল।তার শান্ত আর ধাঁরালো দৃষ্টি ইফাজের দিকেই।ইফাজের গলা শুকিয়ে এলো।এতো ভয়ংকর কেন তার চাহনি?ইফাজ কি তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে নাকি?

আদি বলল,’বেশি বাড়াবাড়ি করো না।পাঁচ হাজার দিচ্ছি।নিয়ে নাও।নয়তো এক টাকাও পাবে না।’

ওয়াজিদ তার কথায় সায় দিয়ে বলল,’একদম ঠিক।হয় পাঁচ হাজার রাখো,নয়তো রাস্তা ছাড়ো।এর বেশি এক পয়সাও দিবো না।’

‘কেন রাস্তা ছাড়বে?রাস্তা কি তোর বাপের যে তুই বললেই ছেড়ে দিবে?’

সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরল।পেছনে থাকা যুবককে দেখামাত্র সবার চোয়াল ঝুলে গেল।রিমি খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো,’ইয়েএএএ! ভাইয়া এসেছে।এবার মজা হবে।’
নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি না বলেছেন,আপনি এসবে আসবেন না?’

আরহাম পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে এলো।গম্ভীর গলায় বলল,’আমাকে ছাড়া তো কিছু করতেও পারছো না।তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।’

সে কথা শেষ করেই আদি আর ওয়াজিদের দিকে তাকালো।কটমটে চোখে বলল,’কিরে! ছোট ছোট বাচ্চাদের একা পেয়ে যা খুশি করছিস তোরা?পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেইট পার করে ফেলবি?তাও আমার বাড়ির।এতো সোজা?’

ওয়াজিদ তেঁতেঁ উঠে বলল,’তুই কতো টাকা দিয়ে তোর বিয়ের গেইট পার করেছিস শুনি?এক টাকাও তো খরচ হয়নি তোর।’

তার কথা শুনেই আদি আর আরহাম সমস্বরে চেঁচালো,’শা’লা তুই নিজেও তো গেইটের টাকা না দিয়েই বিয়ে করেছিস।’

তিন বন্ধুর বাক বিতন্ডা বেঁধে গেল।আরহাম চেঁচিয়ে উঠল,’পঞ্চাশ হাজার দে।নয়তো বোন তো দেবোই না,সাথে ঠ্যাং দু’টো ভেঙে দিবো।’

‘আয় ভাঙ।দেখি তোর কতো সাহস।’

অনেক তর্কাতর্কির পর অবশেষে আরহাম গেইট পার করার মূল্য কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হলো।ইফতেখার সাহেব বললেন,’আচ্ছা আচ্ছা যাও।দুই পক্ষের কথাই বিবেচনা করা হয়েছে।পঞ্চাশ হাজারো না,পাঁচ হাজারও না।আমরা পঁচিশ হাজার টাকা দিবো।ঠিক আছে?’

আরহাম কিছুটা ভেবে বলল,’ত্রিশ হাজার দিলে ভালো হয় না আঙ্কেল?একটা রাউন্ড ফিগারে থাকলো সব।’

ইফতেখার সাহেব হেসে ফেললেন।আরহাম নিজেও হাসল।নবনীতা বিস্ময় জড়জনো কন্ঠে বিড়বিড় করল,’আপনি টাকা নিয়ে এমন ছ্যাচড়ামি করেন।আগে তো জানতাম না।’

আরহাম নাক ছিটকে বলল,’তোমরা যা গর্দভ।আমি না এলে দশ হাজারও পেতে না।সব ক’টা বেকুব।’

***

কাজি এসেছে।এখন বিয়ে পড়ানোর পালা।তাসনুভা সামনে আসা মাত্রই আদি চোখ নামিয়ে নিল।তার জীবনে লজ্জার আবির্ভাব হয়েছে তাসনুভার সাথে তার প্রণয়ের পর থেকে।এর আগে লজ্জা বলতে তার কিছুই ছিলো না।যদিও তাসনুভার সাথে তার সম্পর্ককে সে এখনিই প্রণয়ের নাম দিতে পারে না।কারণ তাদের সম্পর্ক আদতে কোনো কপোত-কপোতীর মতো না।তারা দু’জন বিয়ে ঠিক হওয়ার পর দুই বারের মতো দেখা করেছে।দুইবারই দু’জন খাম্বার মতো বসেছিল।না তাসনুভা কিছু বলেছে,না সে কিছু বলেছে।বলবে কি?বলার মতো কিছু তো তাদের মাঝে নেই।তাসনুভা কথা বলতে গেলেই তাকে ভাইয়া ডেকে ফেলে,আর আদি তাকে বাচ্চা ডাকে।এর মাঝে বিয়ে শব্দটার ভার কিভাবে বইবে দু’জন?আদি জানে না,জানতে চায়ও না।শুধু এইটুক জানে,তারা পারবে।খুব সুন্দর করে সবকিছু গুছিয়ে তাসনুভা আর তার সংসার হবে।এই মিষ্টি মেয়েটাকে আদি ভালো রাখবে।যদি কোনোদিন তার মুখের এই স্নিগ্ধ হাসি মিলিয়ে যায়,তবে আদি বুঝে নিবে স্বামী হিসেবে সে পুরোপুরি ব্যর্থ।

তাসনুভা কবুল বলতে গিয়েই ছটফটিয়ে উঠল।চঞ্চল হয়ে বলল,’বড় ভাইয়া কোথায়?ভাইয়াকে ডাকো।’

আরহাম এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল।তাসনুভা তাকে ডাকতেই সে বড় বড় শ্বাস টেনে তার পাশে বসলো।

মা চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে বাবা মারা গেলো।এর কিছুদিন পর তাসনুভা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল।একটা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে আজীবনের জন্য হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে নিল।তারপর আরহাম আনাড়ি হাতে তাকে বড় করলো।সে পরীর মতো যত্ন করে ভাই বোনদের মানুষ করেনি।কারণ সে নিজেই পরীর মতো গোছানো প্রকৃতির মানুষ না।সে নিজেই ভীষণ এলোমেলো গোছের ছেলে।এই এলোমেলোর ভেতর থেকেই সে তার ভাই বোনদের সর্বোচ্চ খেয়াল রেখেছে।সেই ছোট্ট তাসনুভা আজ বড় হয়ে বিয়ের আসরে বসেছে।বড় ভাই হিসেবে এই জিনিসটা তার মনে কিভাবে আঁচড় কাটছে,সেটা আরহাম কোনোদিন মুখে বলতে পারবে না।সে পাশে বসতেই তাসনুভা তার একটা হাত চেপে ধরল।সামনে ফিরে জড়ানো গলায় ডাকলো,’আরিশ ভাইয়া!’

শুভ্রা পাশ ফিরে আরিশের ফ্যাকাসে মুখ আর লাল হয়ে থাকা চোখ জোড়া দেখল।অবাক হয়ে বলল,’আপনি কাঁদছিলেন আরিশ?’

আরিশ সেই কথার জবাব না দিয়ে রোবটের মতো হেঁটে তাসনুভার অন্য পাশে গিয়ে বসল।তাসনুভা দুই হাতে দুই ভাইয়ের হাত চেপে ধরেই কবুল বলল।সে জানে না মায়ের ভালোবাসা কেমন,সে এটাও জানে না বাবার ভালোবাসা কেমন।কিন্তু সে জানে ভাইদের স্নেহ আর যত্ন কতোটা মধুর।তার জীবনে অভিভাবক বলতে সে তারা দুই ভাইকেই বুঝে।যারা ছেলে হওয়া স্বত্তেও তাসনুভাকে রাজকন্যাদের মতোন আদর যত্ন করে বড়ো করেছে।তাসনুভা জানে এই জীবনে এতো স্বচ্ছ আর নির্মল ভালোবাসা সে কোনোদিনও কারো কাছে পাবে না।

_____________________________________________

[দ্বিতীয় অংশ]

“সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।ছোট থেকেই এই প্রবাদ আমরা পড়ে আসছি।বয়স বাড়তেই আমরা নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরা টের পেলাম এই কথা কতোখানি সত্য।সময় কতো দ্রুত চোখের পলকে এগিয়ে যায়,সেই সাথে আমাদের বয়স।পৃথিবীতে কতো কিছু ঘটে যায়।আর তারপর আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করি,এসব কিছুতে আমাদের জীবন থেকে কতোটা সময় কেটে গেছে!

তাসনুভার বিয়ের ছয় মাস হতে যাচ্ছে।বিয়ের পর যেই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল,সেই মেয়েটা এখন একটু একটু করে সংসার করছে।আরিশের গ্র্যাজুয়েশন শেষ।বিয়ের পর সারাদিন ছেলেটা কানের কাছে ভাবি ভাবি করে চেঁচাতো।এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে।চোখে মুখে একটা ভাবগাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে।যদিও আমার মাঝে মাঝে তাকে বলতে ইচ্ছে হয়,’তোকে এভাবে ভালো লাগে না আরিশ।তুই আগেই ভালো ছিলি।’

নওফেল মাঝে মাঝে ছুটিতে শাহাদাতের সাথে আমাদের বাড়িতে আসে।আরহাম কে সে ভীষণ পছন্দ করে।আরহামও আজকাল বেশ সময় নিয়ে তার সাথে আড্ডা দেয়।নওফেল খুব সাবধানতার সাথে নিজের বাড়ি,বিশেষ করে নিজের মায়ের বিষয় গুলো এড়িয়ে যায়।ছেলে ভীষণ ম্যাচিউর।বয়সের তুলনায় তার বুঝজ্ঞান অনেক বেশি।তাসলিমা তার তিন সন্তানের কাছে আর ফিরে আসেনি।তার তিন সন্তানও তাকে চায়নি।অলিখিতভাবে তাদের সম্পর্কেই ইতি অনেক আগেই ঘটে গেছে।

ওয়াসিফ এখন হাঁটতে জানে।তার দাঁত উঠেছে,তাও আবার চারটা।কামড় দিলে যা ব্যাথা লাগে! শুভ্রার প্রথম প্রফ শুরু হবে সামনের মাসে।তাকে ফোন দিলে আজকাল আর পাই না।কোনোরকমে ফোন রিসিভ করেই বলে,’আপাই! আমি পড়ছি।একটু অপেক্ষা করো।পরে ফোন দিচ্ছি।’
পরে আর তার ফোন দিতে মনে থাকে না।

চিত্রা ক্লাস টু তে উঠেছে।সে হয়েছে শুভ্রার উল্টো।তাকে একটু পড়াতে বসাতে গেলেই আমার শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়।তাকে পড়ানো,আর কোনো কিছু নিয়ে যুদ্ধ করা একই বিষয়।সে আমার নাগালের বাইরে।আরহাম একটু ধমকাধমকি করলে যা একটু পড়ে।

আরশাদের কথা আর কি বলবো।সে দিন দিন বাবার প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছে।সে বাবা ছাড়া আর কিছু বুঝে না।কি অদ্ভুত! আমি তাকে বাচ্চা বয়সে বুকে নিয়ে নিয়ে ঘুম পাড়ালাম।সে যখন কাঁদতো,আরহাম তখন বিরক্ত হয়ে কানে বালিশ চাপা দিতো।আর যেই সে একটু বড়ো হলো,ওমনি বাবার ছেলে হয়ে গেল।এটা অন্যায়।ঘোরতোর অন্যায়।তাদের বাবা-ছেলের উপর আমার অভিমান জন্মেছে।

গত মাসে আরো একটা বিয়ের অনুষ্ঠান খেয়েছি।ইজমা আর ইফাজের বিয়ে।ইজমার বাবা অবশেষে রাজি হয়েছে বিয়ের জন্য।গত মাসেই খুব সুন্দর ভাবে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।ইফাজ খুব ভালো ছেলে।ইজমা তার সাথে ভালোই থাকবে।শ্বাশুড়ি বাদে ইজমার শ্বশুরবাড়িতে সবই ভালো।তার শ্বাশুড়িকে কেন যেন আমার ভালোই লাগে না।

ধ্যাত! এসব আমি ডায়রি তে লিখছি কেন?কেউ পড়লে আমাকে কি না কি ভাববে।যাক,এসব কথা বাদ দেই।নিজের কথায় আসি।আমি খুব ভালো আছি।গত দুই মাস আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়েছে।পুরো চাকরিটাই ভার্চুয়াল।যা করার ঘরে বসেই করছি।ফ্রিল্যান্সার আর আমার মধ্যে পার্থক্য হলো আমি একটা নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করি।মাস শেষে সেটা বাড়েও না,কমেও না।চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি কেবল ঐ একটা কোম্পানির হয়েই চাকরি করবো।এখানে বেতনও যথেষ্ট ভালো।মান্থলি এক হাজার ইউএসডি।বাংলাদেশি টাকায় লাখ ছাড়ায়।শ্রমও অবশ্য দিতে হয়।দৈনিক আট নয় ঘন্টা সময় এসবের পেছনেই দিতে হয়।এতো ব্যস্ততায় ব্যবসা আর সামলানো হয় নি।সেটা প্রথাই সামলায়।ব্যবসায় মোটামুটি ভালোই লাভ হয়।প্রথা মাসে একবার বাসায় আসলে হাত ভরে এটা-সেটা নিয়ে আসে।আমার এতো বেশি বেতন দিয়ে আসলে করার মতো কিছু নেই।আরহাম তার সংসারে আমার থেকে কোনোরকম টাকা নেয় না।আমি কেবল জোর করে চিত্রার স্কুল ফি আর টিউশন ফি টা নিজ থেকে দেই।নয়তো আরহাম আমার থেকে কোনো খরচ নেয় না।তার মেল ইগো সে বরাবরই সবকিছুতে ধরে রাখতে চায়।আমি আর কিছু বলি না।গোড়া থেকে একটা মানুষ কে পাল্টে দিতে আমি ইচ্ছুক না।সে যেমন,আমি তাকে তেমন করেই মেনে নিয়েছি।

এই কয়েক মাসে সবচেয়ে চমৎকার যেই বিষয়টা হয়েছে তা হলো আমি কনসিভ করেছি।যদিও বা শুরুতে আমি আর আরহাম কেউই সেটা নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাই নি।তার কারণ আগের বারও দেড় মাসের মাথায় আমার মিস ক্যারেজ হয়েছিল।সেই হিসেবে আমরা ধরেই নিলাম এবারো এমন কিছুই হবে।কিন্তু আমি আরহামের মতো একেবারে শূন্য আশায় ছিলাম না।আমি লোভী বান্দার মতো আল্লাহর কাছে খুব চেয়েছি এবার যেন আগের বারের মতো কিছু না হয়।আমার স্রষ্টা আগেও বহুবার আমার ডাক শুনেছেন।আমার বিশ্বাস ছিলো এইবারও তিনি আমার ডাক শুনবেন।হয়েছেও তাই।আল্লাহ আমায় নিরাশ করে নি।তিন মাসেও যখন মিস ক্যারেজের মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি,তখন গাইনোকোলজিস্ট নাসরিন সুলতানা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন,’আর চিন্তা নেই নবনীতা।আমার মনে হচ্ছে এইবার তোমার বাচ্চাটা সারভাইব করতে পারবে।’
ব্যাস,এইটুকু কথাতেই আমার পুরো জীবন পাল্টে গেল।আমি সেদিন পেটে হাত চেপে কয় ঘন্টা কেঁদেছি আমি নিজেও জানি না।আরহাম বলল,’বাকি ছয়মাস তোমাকে রোজ দু’টো করে ইঞ্জেকশন নিতে হবে।’

আমি বললাম,সমস্যা নেই আমার।

সে বলল,সপ্তাহে সপ্তাহে রক্ত নিতে হবে।

আমি আগের মতো করেই বললাম,সমস্যা নেই।

আরহাম শুরুতে এমন ভাব করলো যেন আমার এই কনসিভ করাতে সে একদমই খুশি না।কিন্তু যখনই ডাক্তার নাসরিন আমাকে জানালেন আমার বাচ্চাটা একদম সুস্থ আছে,আর সে সুস্থ ভাবেই পৃথিবীর আলো দেখবে,তখনই আরহাম পুরোপুরি পাল্টে গেল।সেদিন আমি উপলব্ধি করলাম,আমার চেয়ে একটা সন্তানের আক্ষেপ আরহামেরই বেশি ছিলো।কেবল আমি মূর্ছা যাবো ভেবে সে কোনোদিন নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করে নি।

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিষয় গুলোর একটি হলো প্রেমে পড়া পুরুষ মানুষ।আমার অন্তত তাই মনে হয়।আরহাম ভীষণ খুতখুতে স্বভাবের মানুষ।এই খুতখুত করা মানুষটাকেই এই কয় মাসে আমি কয় হাজার বার বমি করে ভাসিয়েছি,তার কোনো ইয়াত্তা নেই।আরহাম সেই সব বিনা কোনো শব্দে সহ্য করে নিয়েছে।এমনকি একটিবারের জন্যও কপাল কুঁচকায় নি।আরহাম আমার যেই পরিমান সেবা করেছে,আমি স্ত্রী হিসেবে কোনোদিন তার এতোখানি সেবা করেছি নাকি জানি না।রাত নেই,দিন নেই,আমি আমার উদ্ভট আবদারে তার জীবন নাজেহাল করে দিয়েছি।রাত তিনটায় শর্মা খেতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকে শুরু করে গরমের দিনে ভাপা পিঠা খাওয়ার ইচ্ছে পর্যন্ত সব ইচ্ছেই সে আমার পূরণ করেছে।সেদিন সে আতঙ্কিত হয়ে বলল,’তুমি আবার কখনো বলো না যে তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে।সেটা কিন্তু পূরণ করতে পারব না বাপ।’

আমি হাসি।আমার ভারি মিষ্টি লাগে তাকে।বাইরের লোক তাকে রুক্ষভাষী বলেই জানে।কিন্তু আমার তো তাকে বড্ড মিষ্টি লাগে।তার গায়ের ঘ্রাণ ছাড়া আমার ঘুম আসে না।সে আদর না দিলে আমার মন ভালো হয় না।এই যেমন এখন আমার মন ভালো নেই।সে তিনদিন ধরে আমার কাছে নেই।রাঙামাটি গিয়েছে,কিসব প্রজেক্টের কাজে।ফিরবে কাল রাতে।এতোটা সময় তাকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না।সে কাল সন্ধ্যায় আমাকে শেষবার কল দিয়েছিলো।তারপর থেকে সে লাপাত্তা।আর কোনো খরব নেই তার।আমার মন ভালো নেই,একদমই ভালো নেই।

আজ ত্রিশে শ্রাবণ।আমার তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী।অথচ আমার প্রাণপুরুষ আমার সাথে নেই।আজকের তারিখ যে সে বেমালুম ভুলে গেছে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আজকাল কেউই আমাকে ভালোবাসে না।শুধু ব্যস্ততা দেখায়।রিমিকে ফোন দিতেই সে তার কেচ্ছা শুরু করে-ওয়াসিফের জ্বর,ওয়াজিদ ভাইয়ের কাজ,তার পড়াশোনা হ্যান ত্যান কতো কিছু।
তাসনুভা পাসপোর্টের কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত।তারা সম্ভবত সামনের বছরেই আমেরিকা চলে যাচ্ছে।আরিশ ইদানিং ব্যবসার কাজে টুকটাক হাত দিয়েছে।তবে তার ইচ্ছা অন্য কোনো কোম্পানিতে জব করা।এই উদ্ভত ইচ্ছের কারণ কি সে নিজেও জানে না।শুভি দু’টো টিউশন করে।এক টিউশনেই নাকি পনেরো হাজার টাকা পায়।তাও আবার মাত্র এক ঘন্টা পড়িয়ে।শুনেই আমার মাথা ঘুরে গেল।মেডিকেল স্টুডেন্ট রা নাকি এমনই পায় টিউশন ফি।আমি হা হুতাশ করে বললাম ইঞ্চিনিয়ারিং এর প্রস্তুতি না নিয়ে মেডিকেলের প্রস্তুতি নিলেই তো ভালো হতো,এতোদিনে টাকার বালিশে ঘুমাতাম।চিত্রা এখন স্কুলে,আরশাদ নিচে রহিমার সাথে রান্নাঘরে।তার যে রান্নাবান্নার কি শখ! আমি তো বলেছি,’বাবারে! তোকে আমি মাস্টার শেফ বানাবো না।তোর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে না।’
তবুও সে এমন রোজ রোজ কাঠি চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করে।এই ছেলে যে বড়ো হয়ে কি হবে,কে জানে।আমি আর তাকে আদর করব না।সে থাকুক তার বাবার সাথে।আমি আদর করবো আমার ছোট্ট মা কে।সে কখন আসবে আমাদের কাছে?আর অপেক্ষা হচ্ছে না।একদমই অপেক্ষা করতে পারছি না আমি।সে ছাড়া আর কেউ আমাকে ভালোবাসে না।পুরোন হয়ে গেছি বলে কেউ আর পাত্তা দেয় না।”

দরজায় এসে কেউ একজন ধাক্কা দিলো।নবনীতা নূরের দিনলিপি রচনায় ভাটা পড়লো।কলমটা ডায়রির উপর ফেলে সে উঠে দাঁড়ালো।দরজা খুলতেই দেখল দরজার সামনে রিমি।নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’তুই?এই সময়ে?’

রিমি কোনো প্রতিউত্তর করলো না।কেবল তার হাতে থাকা তাজা রক্তিম গোলাপটা নবনীতার সম্মুখে বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা দ্বিধায় পড়ে সেটা হাতে নিল।দেখতে পেল ফুলের সাথে একটা চিরকুটও আছে।বিচলিত হয়ে সে সেটার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।

“প্রিয় নবনী,
আমার জীবনে বান্ধবী বলতে আমি যা বুঝি,সেটা তুই।আমার কোনো ভাই বোন নেই।আমার কাছে তুই ই আমার বোন।তুই চিরকাল এমনই থাকবি নবনী।শুভি,চিত্র আর তাসনুভাকে আদর দেওয়ার পর তোর ঝুলিতে যেইটুকু আদর অবশিষ্ট থাকবে,সেটা তুই আমাকে দিস কেমন?
ইতি,
তোর একমাত্র সই রিমি।”

চিরকুটটা পড়া শেষ করতেই একটা রিনরিনে কন্ঠ তাকে ডাকল,’ভাবি।’

নবনীতা দ্রুত সেদিকে তাকায়।আশ্চর্য হয়ে সামনে এগিয়ে যায়।তাসনুভাও রিমির মতো করেই তার দিকে একটা ফুল সমেত চিরকুট বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা আগের মতোই বিস্মিত হয়ে সেটা হাতে নেয়।চিরকুটে লিখা-

“ভাবি,
তোমার মতো আদর করে কেউ আমায় খাইয়ে দেয় নি।তুমি খুব সুন্দর করে মেখে মেখে ভাত খাওয়াও।তোমার কাছে খেতে বসলে আমি তিন প্লেটও খেয়ে ফেলতে পারি।তুমি আমার ভীষণ প্রিয়।আমি তোমাকে এক আকাশ ভালোবাসি ভাবি।পারলে তোমাকে লাগেজে পুরে আমেরিকা নিয়ে যেতাম।তোমাদের ছাড়া আমি থাকবো কেমন করে?

ইতি
তাসনুভা”

নবনীতার চোখ ভিজে আসে।বুকের ভেতর আচমকাই সমুদ্রের বিশালার স্রোত শব্দ করে আছড়ে পড়ে।এরা এতো সুন্দর করে ভালোবাসা প্রকাশ করছে কেন তার প্রতি?

একটু দূরেই আরিশ।সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ানো।হাতে সেই গোলাপ সমেত চিরকুট।নবনীতার সমস্ত মনোযোগ সেই চিরকুটের দিকে।সেখানে লিখা-

“ভাবি,
ভাইয়ার সাথে বিয়ের পর তুমি খুব কেঁদেছো।তুমি যতোটা কেঁদেছো,আমি আর তাসনুভা ঠিক ততোটাই খুশি হয়েছি।কারণ আমরা একটা মিষ্টি পরীকে চিরকাল আমাদের বাড়িতে আমাদের বাড়ির সদস্য হিসেবে পেতে যাচ্ছিলাম।তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানি না।কিন্তু তুমি আসার পর আমাদের জীবন সত্যিই তারাবাজির আলোর মতো ঝলমল করে উঠেছিল।আমরা তোমায় খুব ভালোবাসি ভাবি।তোমার কানের কাছে প্রতি নিয়ত ‘ভাবি এটা দাও,সেটা দাও’ করে ঘ্যান ঘ্যান করা আমাদের ভীষণ প্রিয়।তুমি চিরকাল এমনই থেকো ভাবি।আমাদের ঘর একটা বাগান।আর তুমি সেখানে থাকা মিষ্টি একটা ফুল।

ইতি,
তোমার ভাই আরিশ[আমি নিজেকে ওসব দেবর টেবর বলে মানি না।আমি তোমার ভাই।]

নবনীতা চোখ মুছে তার দিকে তাকালো।ভাঙা কন্ঠে বলল,’তুই এসব লিখেছিস?’

আরিশ কেবল বিনিময়ে হাসিমুখে উপরনিচ মাথা নাড়ল।

সিঁড়ির একেবারে শেষ মাথা থেকে ডাক এলো,’আপাই!’

নবনীতা দ্রুত সেখানে তাকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’শুভি তুই?’

শুভ্রার পাশে চিত্রাও দাঁড়িয়ে ছিলো।তার পরনে এখনো স্কুল ইউনিফর্ম।নবনীতা অবাক হয়ে নিচে নামতেই শুভ্রা তার দিকে তার হাতে থাকা চিরকুট টা বাড়িয়ে দিলো।পাশ থেকে চিত্রা বলল,’আমার লেখা বাজে।তাই শুভিই সব লিখেছে।’

নবনীতা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল।

“আপাই,
সবাই তোমাকে প্রিয় বলে।আমরা বলিনি।কারণ আমাদের আপাই যে আমাদের কতো প্রিয়,সেটা পুরো দুনিয়া জানে।তোমাকে আমরা ভীষণ ভালোবাসি আপাই।তোমার অবদান,তোমার ত্যাগ,তোমার ঋণ কোনোকিছুই আমরা শোধ করতে পারব না আপাই।তুমি সেদিন আমাদের ফেলে ঐ মেজরের সাথে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারতে।অথচ নিজের সুখের ঊর্ধ্বে তুমি আমাদের ভালো থাকাকে বেছে নিয়েছিলে।মালিবাগের ঐ ছোট্ট ঘরটায় আমরা হয়তো আর্থিক অভাবে ছিলাম,কিন্তু ভালোবাসার অভাবে আমরা কখনোই ছিলাম না।যাদের জীবনে পরী আপাই আছে,তাদের জীবনে ভালোবাসার অভাব হয় কেমন করে?আমরা তোমায় কতোখানি ভালোবাসি সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব হলে বেশ হতো।কিন্তু সত্যি এটাই যে পরী আপাইয়ের জন্য তার শুভি আর চিত্র যেই ভালোবাসা অনুভব করে,সেটা কাগজে কলমে ফুটিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।তবুও একটা কথা বলি আপাই।জীবনের পরিক্রমায় অনেক বছর পরে যদি কখনো তোমার মনে হয়,কেউ তোমায় ভালোবাসে না,তবে মনে রাখবে চিত্র আর শুভি চিরকাল তোমায় ভালোবাসে।আমাদের কাছে আপাই আমাদের আস্ত একটা পৃথিবী।সেই পৃথিবী ভালো না থাকলে চিত্রা আর শুভি কেমন করে ভালো থাকবে?তুমি আমাদের এতো কেন ভালোবাসো আপাই?আমরা কেন কখনো ভালোবাসা দিয়ে তোমার ঋণ শোধ করতে পারি না?

ইতি,
তোমার দু’টো মিষ্টি ফুল,যাদের জন্য তুমি তোমার জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দিয়েছিলে”

নবনীতার হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়ল।তার চোখের পানিতে তার গাল ভাসছে।বাচ্চাগুলো এতো সুন্দর করে তাকে চিঠি লিখেছে?এতো কেন ভালোবাসে তারা তাকে?সে তো খুব সাধারণ।খুব বেশি সাধারণ।সে দ্রুত মেঝে থেকে চিঠিটা তুলে বুকের সাথে চেপে ধরল।এই চিরকুট গুলো কেবলই কাগজের টুকরো না,নবনীতার জন্য এসব এক একটা ভালোবাসার ফোয়ারা।এতো ভালোবাসা সে কেন পাচ্ছে?সে বড্ড সাধারণ।একেবারেই সাধারণ একটা মেয়ে।

দরজা থেকে রাশভারি কন্ঠটা তাকে ডেকে উঠল,’সেনোরিটা! কেমন আছো?’

নবনীতা বোকা বোকা হয়ে সামনে তাকালো।আরহাম এসেছে।কি অদ্ভুত! তার তো কাল রাতে আসার কথা।সে সামনে দেখতেই আরহাম একগাল হেসে দুই হাত প্রসারিত করল।ভারি কন্ঠে বলল,’তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা পরী।তিন থেকে ত্রিশ,ত্রিশ থেকে তিনশো হয়ে গেলেও যেন তুমি এমনই থাকো এই দোয়া করি।’

নবনীতা শব্দ করে কেঁদে ফেলল।তারপরই দিকবিদিক ভুলে সামনের দিকে ছুটে গেল।গিয়েই অতিকায় ঢেউয়ের ন্যায় আছড়ে পড়লো আরহামের শক্তপোক্ত বক্ষে।নাক টানতে টানতে বলল,’আপনি জানতেন আজ আমাদের এনিভার্সারি?’

‘অবশ্যই জানতাম।’

‘কাল রাতে জানান নি কেন?’

‘জানালে আজ তুমি এমন করে চমকাতে?’

‘এই সব প্ল্যান আপনার?’

‘হ্যাঁ।তোমার নাকি ভীষণ অভিযোগ যে কেউ তোমায় ভালোবাসে না।তাই তোমার অভিমান অভিযোগ সব ভেঙে দিয়েছি।’

নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’আপনি আর আমাকে ছাড়া কোথাও যাবেন না।’

‘কেন?তুমি কি কচি খুকি?’

‘হ্যাঁ,খুকি।আপনার কোনো সমস্যা?’

আরহাম মুচকি হেসে বলল,’না আমার কোনো সমস্যা নেই।’

কথা শেষ করেই সে গলা ছেড়ে ডাকলো,’আরিশ!’

আরিশ সঙ্গে সঙ্গে দরজার পাশে ঝুলতে থাকা নাইলনের ফিতা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলো।ওমনি শত শত গোলাপ ঝরঝর করে নবনীতা আর আরহামের উপর এসে পড়লো।আরশাদ ছুটে গেল তাদের দিকে।গিয়েই আরহামের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,’বাবা কোলে নাও।’

আরহাম তাকে হাসিমুখে কোলে তুলে নিল।নবনীতার দিকে দেখিয়ে বলল,’মা কে আই লাভ ইউ বলো তো বাবা।’

আরশাদ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল,’আই লাভ ইউ মা।’

নবনীতা মন ভরে তার দুই গালে চুমু খেল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’আই লাভ ইউ টু বাবা।তুমি তো আমার জান বাচ্চা।’

আরহাম এক হাতে তাকে আগলে নিয়ে বলল,’এই এতো গুলো ফুলের মানে কি জানো?’

নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কি?জানি না তো।’

‘এর মানে হলো এরা সবাই মিলে তোমায় যতখানি ভালোবাসে,আমি একাই তোমায় এর চেয়ে বেশি ভালোবাসি।’

নবনীতার চোখ আবারো ঝাপসা হয়ে এলো।সে আবারো গভীর ভালোবাসায় আরহামের ঘর্মাক্ত শার্ট জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখল।আরহাম বলল,’আমি ফ্রেশ হই আগে।গায়ে কতো ময়লা আমার ছি।’

‘হোক ময়লা।আমার কোনো সমস্যা নেই।’

‘তোমার সমস্যা নেই,কিন্তু আমার মেয়ের সমস্যা আছে।’

‘তারও কোনো সমস্যা নেই।সে তার বাবাকে ভালোবাসে।’

নবনীতা চুপচাপ তার বুকে নিজের মাথা চেপে ধরল।আরহাম আর কিছু বলল না। সে জানে এই পাগল মেয়েটা এখন আধঘন্টা ধরে অকারণে কাঁদবে।আরহাম তাকে থামাতে গেলে সে আরো কাঁদবে।সে এমনই।আরহাম সামনে এলেই তার কান্না বেড়ে যায়।জগতের সামনে সে নিজেকে বড্ড শক্ত চিত্তের অধিকারী বলে প্রমাণ করে।অথচ আরহাম সামনে আসতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে জগতের সবচেয়ে অভিমানী আর স্পর্শকাতর মানবী রূপে।এই মেয়েটা তার প্রাণ ভোমরা।সে জানে নবনীতা ভালোবাসার কাঙাল।দিন শেষে পরীর এই বিত্ত বিভব,ধন সম্পদ কিছুই চাই না।পরীর চাই একটা ছোট্ট ঘর।যেই ঘরটা আদর ভালোবাসায় ভরে থাকবে।পরী কেবল একটু ভালোবাসা চায়।যেই ভালোবাসা সে ছয় বছর ধরে পায় নি।

ব্যাস।পরীর গল্প এইটুকুই।আঠারো বছর বয়সে বাবা মাকে হারানো কিশোরী মেয়েটা ছয় বছরের সংগ্রাম শেষে নিজের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছিল।তারপর মামা বাড়িতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে গিয়ে পার্ট টাইম জব,টিউশন সবকিছুই করেছে সে।তার জীবনে তার দুই বোন ব্যাতীত আর কিছুই ছিলো না।যেই দুই বোনের সুন্দর ভবিষ্যত ছিলো পরীর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন।

তারপর শ্রাবণের এক মিষ্টি বর্ষণে পরীর জীবন পাল্টে গেল।পরী খুঁজে পেল তার প্রিয় পুরুষকে।যে তাকে আগলে নিয়েছে,ভালোবেসে আদর দিয়ে তার সমস্ত যন্ত্রনা মুছে দিয়েছে।রিমির মতো বন্ধু,আরিশ তাসনুভার মতো আদুরে আদুরে দু’টো মানুষ,আরশাদের মতো মিষ্টি একটা বাচ্চা,আর শুভ্রা আর চিত্রার মতো নিষ্পাপ দু’টো বোনকে নিয়ে নবনীতা নূরের জীবন আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছিল।

সমাজের নিদারুণ বাস্তবতায় আর টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে যখনই পৃথিবীর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা নবনীতাদের জেঁকে ধরে,ঠিক তখনই আরহামরা এগিয়ে এসে তাদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।একেবারে নিকৃষ্ট মানুষ দিয়ে পূর্ণ পৃথিবীতে পরীরা কেমন করে যেন তাদের একটা সুন্দর অস্তিত্ব পেয়ে যায়।শত শত নির্ঘুম রাতের শেষে তারা একটা প্রশস্ত নিরাপদ বক্ষ পায়,যেখানে তারা নিজেদের দুঃখ,কষ্ট যন্ত্রনা সব ঝেড়ে ফেলতে পারে।যখনই তাদের কাছে পৃথিবীকে অসহ্য বলে মনে হয়,তখনই আরহামরা এগিয়ে এসে গভীর ভালোবাসায় তাদের জড়িয়ে নেয়।পরীরা সেই ভালোবাসাতেই আটকায়।যেই ভালোবাসা ছিন্ন করে তারা আর কখনোই আসতে পারে না।ভালোবাসার রং কি?সাদা,কালো,লাল?নাকি ভালোবাসা রংহীন?কোনো সুনির্দিষ্ট মানুষের আগমন ছাড়া ভালোবাসা স্রেফ একটা বাংলা শব্দ।যখনই কেউ জীবনে এসে জীবনের ম্লান অধ্যায় গুলো রঙিন করে দেয়,ওমনি ভালোবাসা তার নিজস্ব অর্থ খুঁজে নেয়।

পরী ভালো থাকুক।সেই সাথে ভালো থাকুক তার দু’টো সুন্দর সুন্দর ফুল।সাথে ভালো থাকুক তাকে ঘিরে থাকা প্রতিটা সুন্দর প্রাণ,যাদের ভালোবাসা,আদর,যত্নে নূর আহমেদের তিন মেয়ের জীবন প্রজাপতির ডানার মতো রঙিন হয়ে উঠেছিল।

জগতের সমস্ত পরী ভালো থাকুক।দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই আরহামরা তাদের ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিক।নবনীতা ভালো থাকলেই নবনীতার রচয়িতা ভালো থাকবে।এইবারের মতো এখানেই ইতি।তবে নবনীতাদের গল্প আরো অগণিত বার উঠে আসবে গল্পকারের কলমে।নবনীতারা ভালো থাকুক,খুব বেশি ভালো থাকুক।হেমন্তের ঠান্ডা বাতাসে মানুষ যেমন করে ভালো থাকে,ঠিক ততখানিই ভালো থাকুক।

*******সমাপ্ত*******