Thursday, July 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 47



কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭৫

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭৫)
[অনেক উদ্ভট একটা পর্ব,টাইপিং মিস্টেকও প্রচুর]

বসার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।সকাল হতেই পুরো বাড়ি কেমন ঈদ ঈদ আনন্দে মেতে উঠল।নবনীতা সকালে উঠেই রান্নাঘরে ছুটে গেল।রান্নার হাত তার অতো ভালো না,তবে আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে।এখন বেশ অবলীলায় মুখে তোলা যায়।

আফরোজা বেগমের সাথে তার সম্পর্ক স্থবির।খুব একটা উন্নতি হয় নি,আবার অবনতিও হয়নি।দু’জন দু’জনকে দেখামাত্রই মেকি হাসে।এটাই আপাতত তাদের সম্পর্কের সমীকরণ।তবে সারাহ-র সাথে নবনীতার সম্পর্কের কিছুটা উৎকর্ষ হয়েছে।কোনো এক অজানা কারণে মেয়েটা তাকে সম্মান করে।তাসনুভার সাথে তার কথা কাটাকাটি চলতে থাকে,কিন্তু নবনীতার সাথে সে কখনোই ওমন আচরণ করে না।নবনীতার মনে হলো মেয়েটা আসলে খারাপ না,কেবল গায়ে শহরের বাতাস লাগিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়েছে এই যা।শহরের চাকচিক্যে এসে মানিয়ে নেওয়ার নাম করে আসল সারাহ হারিয়ে গেছে।এই সারাহ নকল,পুরোটাই লোক দেখানো,এলিট শ্রেণির মানুষদের সাথে মেশার প্রয়োজনে নিজের অস্তিত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসা একটা মেকি চরিত্র।

নবনীতা রান্নাঘরে গিয়েই ক্লাচারের সাহায্য চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল,’রোস্ট কি আপনিই করবেন ফুফু?’

আফরোজা বেগম ছোট করে জবাব দিলেন,’হু।’

নবনীতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।যাক বাঁচা গেছে।এসব ভারি রান্নার দায়িত্ব নিতে তার ভয় হয়।বাড়ির মানুষ খেলে অবশ্য সে এতোকিছু ভাবতো না।কিন্তু আজ বাড়িতে মেহমান আসছে।সুতরাং আজ এসব কঠিন রান্নায় হাত না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সে টুকটাক কাজে সাহায্য করে সবার সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করল।হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সে কপাল চাপড়ায়।তারপর আবার ব্যস্ত গিন্নিদের মতো ছুটে যায় নিজের শোয়ার ঘরে।গিয়েই হন্তদন্ত হয়ে ডাকলো,’আরহাম!এ্যাই আরহাম।আপনার না মিটিং আছে সকালে?উঠুন উঠুন।আর কতো ঘুমুবেন?আমি তো ডাক দিতে ভুলেই গিয়েছি।’

আরহাম চোখ ডলতে ডলতে মুখের উপর থেকে চাদর সরালো।বিরক্ত মেজাজে বলল,’বাল আছে।এতো আগে সকাল কেমনে হয়?যাও তুমি।প্লিজ যাও।’
নবনীতা কোমরে হাত রেখে চোখ কটমট করে বলল,’নয়টা বাজে আরহাম।আপনি বলেছিলেন ছয়টায় ডাক দিতে।’

আরহাম ধড়ফড়িয়ে উঠল।নবনীতার দিকে বড় বড় চোখ করে বলল,’কি?কয়টা বাজে?’

‘নয়টা।নাইন ও ক্লক।’

আরহাম সাথে সাথে একটানে চাদর ফেলে তোয়ালে হাতে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো।যেতে যেতে চিৎকার করে উঠল,’তুমি আমায় এতোক্ষণে ডাকছো?আমার মিটিং আটটায় ছিলো।বালের ঘরনী হয়েছো তুমি।একটা কাজ ঠিক মতো পারো না।ধুর ছাতা।’

গোসল করতে করতেও সে মনের আশ মিটিয়ে গালমন্দ করল।বাথরুমের বেসিন থেকে শুরু করে কল,পুশ শাওয়ার,শাওয়ার,টাইলস-কেউ সেই দল থেকে বাদ পড়লো না।নবনীতা চাদর ভাঁজ করতে করতেই খিলখিল করে হেসে ফেলল।চাপা স্বরে বলল,’হয়েছে গালি দেওয়া?এবার দয়া করে গোসল শেষ করে অফিসে যান।’

আরহাম অফিসের জন্য বের হলো এক প্রকার দৌড়ে দৌড়ে।ব্যবসায় ইদানিং সে তার মনোযোগ বাড়িয়েছে।রাজনীতির দিক থেকে ব্যস্ততা সরে এসে সেটা ব্যবসায় গিয়ে যোগ হয়েছে।রোজ রোজ মিটিং,ট্রেইনিং অবজারভেশন,নতুন এম্পয়ি নিয়োগ,টাকা পয়সার হিসেব মেলাতে মেলাতেই তার সময় যায়।সে ব্যস্ত।খুব বেশি ব্যস্ত।যতখানি ব্যস্ত হলে মানুষ নিজের পাঁচ বছরের রাজনৈতিক জীবন বেমালুম ভুলে যায়,সে ঠিক ততখানি ব্যস্ত।

আরহাম বেরিয়ে যেতেই নবনীতা শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে চিত্রার ঘরে গেল।চিত্রা তখন গভীর ঘুমে।চাদরের বাইরে কেবল হাত দু’টো দেখা যাচ্ছে।নবনীতা এসে খাটের এক প্রান্তে বসলো।আলতো করে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে তার মুখের উপর থেকে চাদর টেনে তার গোল গোল গাল দু’টোতে দুইবার করে চুমু খেল।আদুরে স্বরে ডাকলো,’চিত্র! এ্যাই চিত্র।উঠো না পাখি।আজ তো স্কুলেও গেলে না।আর কতো ঘুমুবে?’

চিত্রা টেনে টেনে চোখ মেলার চেষ্টা করল।ঘুমু ঘুমু গলায় বলল,’আপাই! আরেকটু।’

নবনীতা একগাল হাসল।চিত্রাকে ছেড়ে উঠে যেতে নিলেই চিত্র হুড়মুড় করে তাকে জড়িয়ে ধরল।নবনীতার বুকে মুখ লুকাতে লুকাতে বলল,’আপাই! আরেকটু আদর করো।’

নবনীতার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি খেলা করে।সে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলল,’আচ্ছা।করছি আদর।তুমিও আমাকে আদর করো।’

চিত্রা চোখ পাকিয়ে বলল,’আরশু যে তোমাকে এতো আদর করে,তোমার সেটাতে হয় না?’

‘না,হয় না।আমার সবার আদর লাগে।’

চিত্রা লজ্জা পেল কিছুটা।লজ্জায় মুখ নামিয়ে মিনমিন করে বলল,’আরহাম ভাইয়াকে বলো আদর দিতে।’

নবনীতা ফিক করে হেসে ফেলল।চিত্রার গাল টেনে টেনে বলল,’নাহ,আরহাম ভাইয়ার আদর দিয়ে কোনো কাজ হবে না।আমার বাচ্চাদের আদর ভালো লাগে না।বুড়ো মানুষের আদর না।’

‘আরহাম ভাই বুড়ো?’ চিত্র মুখ বাঁকা করে প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ,বুড়োই তো।দেখলে না কালকে?দু’টো ইয়া বড়ো পাকা চুল পাওয়া গেছে তার মাথায়।’

‘তো পাকা চুল পাওয়া গেলেই বুড়ো হয়ে গেল?কতো সুন্দর আরহাম ভাই! একদম নায়কদের মতো।ঢিশুম ঢিশুম।’

নবনীতার হাসি পেল।সে একহাতে মুখ চেপে ধরল।চিত্রাকে রাগানোর জন্য বলল,’না না।তাকে আমার বুড়াই লাগে।আমি কতো সুন্দর অল্প বয়সী মেয়ে।আমার সাথে তাকে কোনোভাবে যায়?’

চিত্রা চোখ পাকায়,’তুমি অল্পবয়সী?’

নবনীতা মাথা নেড়ে বলল,’অবশ্যই।কোনো সন্দেহ?’

চিত্রা জানতে চাইলো,’তোমায় বয়স কতো?’

নবনীতা একটু ভাব ধরে বলল,’আমার বয়স ষোলো থেকে একটু বেশি।’

চিত্রা নাক ছিটকায়।বিক্ষিপ্ত মেজাজে বিড়বিড় করে,’বালের কথা।’

নবনীতার চোখ কপালে উঠল।সে একহাত মুখে চেপে বলল,’কি?কি বললি তুই?’

চিত্রা চাদর টেনে পুনরায় শুয়ে পড়ল।নবনীতা তখনো স্তব্ধ। হুশ ফিরতেই সাথে সাথে আরহামের নম্বরে ডায়াল করলো সে।আরহাম তখন গাড়িতে।ফোন ধরেই ব্যস্ত গলায় বলল,’হাই সেনোরিটা! কি চাই?’

‘আপনার মাথা চাই।’

‘আচ্ছা।বাড়ি ফিরলে নিয়ে নিও।’

নবনীতা বিরক্ত হলো।চটে যাওয়া মেজাজে বলল,’জানেন আজ কি হয়েছে?চিত্র আজ কি বলেছে জানেন?’

‘না তো।কি বলেছে?’

নবনীতা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’সে আমার কথা শুনে বলেছে আমার কথা নাকি বালের কথা।চিন্তা করেন একবার।এই বয়সে সে কিসব বলছে।’

নবনীতা থামলো।আরহাম কিছু বলার আগেই পুনরায় নিজ থেকে বলল,’আরো চেঁচান সারা বাড়ি।আরো এমন গালি দেন দিন রাত।কয়দিন পর আরশুও এসবই বলবে।’

আরহাম লটকানো মুখে বলল,’তো এটা কি খারাপ কিছু নাকি?বাল মানে চুল।তোমার মাথায় চুল নাই?’

‘আপনি চুপ থাকেন।আমাকে গালি শেখানোর প্রয়োজন নাই।’

‘এটা কোনো গালি না।এটা আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।’

নবনীতা হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।আরহাম অন্যপাশ থেকে তাড়াহুড়ো করে বলল,’অফিসে চলে এসেছি।রাখলাম ফোন।টাটা।লাভ ইউ।উম্মাহ।’

ব্রেক কষতে গিয়েই গাড়িটা অন্য একটা গাড়ির সাথে সামান্য ধাক্কা খেল।ওমনি আরহাম ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল,’ধুর বাল! দেখে ড্রাইভ করবে না মোতাহের?’
.
.
.
.
করিমুল সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে সামনে থাকা ছেলেটাকে পরোখ করলেন।তার পরনে কালো রঙের শার্ট।সাথে নেভি ব্লুর জিন্স।চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো।হাতে একটা ঘড়ি ঝুলছে।চেহারায় অদ্ভুত রকমের শান্তভাব বিরাজ করছে।তাকে প্রথম দর্শনেই যে কারো পছন্দ হবে।সে নিরেট ভদ্রলোক।এতে কোনো খাঁদ নেই।

করিমুল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,’তোমার নাম যেন কি বললে?ভুলে গিয়েছি তো।’

সে দ্রুত জবাব দিলো,’জ্বী আমার নাম ইফাজ।পুরো নাম ইফতেখার আহমেদ ইফাজ।’

করিমুল সাহেব আর কিছু বললেন না।কেবল আস্তে করে দুইবার মাথা নাড়লেন।দুই দিন হয়েছে তারা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন।দেশে আসতে হয়েছে এক প্রকার বাধ্য হয়ে।ছেলে মেয়ে দু’টো এমন খেয়ালখুশি মতো কাজ করবে,সেটা তিনি,তার ওয়াইফ,এমনকি আদির মা বাবা পর্যন্ত বুঝে নি।

আদি আর ইজমা দু’জনকে বিয়ে করবে,এটা মোটামুটি ঠিক করা ছিলো।তাদের এনগেজমেন্টও হয়েছিল।এর মাঝে দু’জন দেশেও এলো।মাঝখানে কি হয়েছে কে জানে,দু’জনই তাদের মত পাল্টে নিল।তারা সিদ্ধান্ত নিল তারা একজন অন্যজনকে বিয়ে করবে না।

এই খবর আমেরিকা পর্যন্ত যেতেই করিমুল সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।এসব কেমন ছেলেমানুষী কথাবার্তা?বিয়ে করবে না মানে?বিয়ে কি কোনো ছেলেখেলা?এসব ছেলেমানুষীর বয়স কি আদি আর ইজমার আছে?

সবকিছু ঠিক মতো হজম করার আগেই ইজমা জানালো সে এই দেশের কোনো এক ছেলেকে পছন্দ করে।সে পেশায় একজন চিকিৎসক।ইজমা ঘোষণা দিয়েছে বিয়ে করলে সে ঐ ছেলেকেই করবে।কি আশ্চর্য! এগুলো কেমন ধরনের জেদ করিম সাহেব জানেন না।ঐদিকে আবার আদি ঘোষণা দিয়েছে সে তার বন্ধুর বোনকে বিয়ে করবে।এতোসব ঝামেলার ভেতর দুইজনের পরিবার বাধ্য হয়েছে দেশে ফিরে আসতে।দুই পরিবারই তাদের ছানা পোনাদের উপর ভীষণ রকমের বিরক্ত।

দেশে আসার পরেই করিম সাহেব আর জেসিয়া ইসলাম অস্থির হয়ে উঠলেন ইফাজের সাথে দেখা করার জন্য।আদি যেই মেয়েকে পছন্দ করেছে,ঐ মেয়েটা ভারি মিষ্টি।আদির বাবা মা পরের বিষয়,করিম আর জেসিয়া নিজেরাই প্রথম দেখায় তাকে পছন্দ করে নিয়েছে।এতো আদুরে একটা মেয়ে! জেসিয়া বললেন,’ইশশ! আমার যদি একটা ছেলে থাকতো,তবে এমন একটা বউ আমিও ঘরে তুলতাম।’

মেয়েটা ভারি মিশুক।জেসিয়া আর করিম প্রথম সাক্ষাৎেই তাকে পছন্দ করে নিয়েছে।মেয়েটা পরিপূর্ণ।একটা ত্রুটি অবশ্য আছে।সে নিজ থেকে হাঁটতে পারে না,তবে কেউ ধরে নিলে তারপর আবার অল্প অল্প চলতে পারে। ইদানিং তার অবস্থার ইম্প্রুভমেন্ট হচ্ছে।সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজ থেকে দাঁড়াতে পারছে।রাজিয়া তো তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে।জেসিয়াকে দেখিয়ে বলেছে,’তুমি জানো?তাসনুভার জন্মের পর আমি তিন নম্বরে তাকে কোলে নিয়েছিলাম?’

আদির জীবনসঙ্গী নিয়ে কারো কোনো আপত্তি বা সমস্যা কিছুই নেই।আদি যাকে বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,তাকে অপছন্দ করার মতো কিছুই নেই।কিন্তু ইজমার পছন্দ নিয়ে করিম সাহেব তুষ্ট হতে পারলেন না।ইফাজ কে তিনি চেনেন না।ইফাজের হাতে নিজের মেয়েকে তুলে দিতে তিনি ভরসা পান না।ইজমা তার একমাত্র সন্তান।তাকে নিয়ে তিনি ভীষণ সিরিয়াস।ইফাজকে এখন যথেষ্ট ভদ্রলোক মনে হচ্ছে,কিন্তু আগে গিয়ে সে কি হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।করিম সাহেবের দুশ্চিন্তা সেই জায়গাতেই।

আজ বিকেলে তিনি আর জেসিয়া একটা ক্যাফে তে গিয়েছিলেন ইফাজের সাথে দেখা করতে।ছেলেটা যথেষ্ট ভালো।জেসিয়ার তাকে ভালোই লেগেছে।তার মধ্যে একটা অমায়িক ভাব আছে।যে কোনো মানুষ প্রথম দেখাতে তাকে সুপুরুষ বলে আখ্যা দিবে।

তারা দু’জন আরো নানারকম প্রশ্ন করলেন।জানতে চাইলেন ইফাজের পরিবার সম্পর্কে,তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে।সে সামনে গিয়ে কি করতে চায় সেটাও জিজ্ঞেস করলেন।ইফাজ ভদ্রভাবে সবকিছুর জবাব দিলো।তার মনে হলো ভাইবা বোর্ডে যাওয়ার পরও তার অবস্থা এতো খারাপ হয় না,যতো খারাপ এখন হচ্ছে।ভয়ে,দুশ্চিন্তায় আর অস্থিরতায় তার হাত পা জমে যাচ্ছিল বারবার।

ক্যাফে থেকে বের হওয়ার পরেই সে পকেট থেকে মোবাইল বের করল।ইজমার এগারো টা মিসড কল।পাগল নাকি এই মেয়ে?জানে না ইফাজ এই অবস্থায় ফোন ধরতে পারবে না?সে কল ব্যাক করলো তৎক্ষনাৎ।ইজমা অস্থির হয়ে বলল,’এ্যাই এ্যাই! কি হলো?বাবা কি বলল?মা তোমায় দেখেছে?কথা হয়েছে ঠিক ভাবে?’

ইফাজ ক্লান্ত হয়ে বলল,’হয়েছে বাবা,হয়েছে।আর বেশি কিছু জানি না।’

‘কথা বলে কি মনে হয়েছে?রাজি তো?’

‘এতো কিছু জানি না।ফোন রাখো।’

‘তুমি এমন করে কথা বলছো কেন?বিয়ের আগেই এমন ব্যবহার শুরু করে দিয়েছো?’

ইফাজ হেসে ফেলল হুট করে।হাসতে হাসতেই বলল,’আরে বাবারে! এতো অভিমান নিয়ে থাকো কেমন করে তোমরা?আচ্ছা যাও সরি।’

ইজমা বাচ্চামো করে বলল,’আমাকে একটা চুমু খাও।’

ইফাজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,’কি?চুমু খাবো মানে?মাথার অ্যান্টেনা সব খুলে গেছে নাকি?’

‘হ্যাঁ,খুলে গেছে।তুমি চুমু খেয়ে সব ঠিক করে দাও।’

ইফাজ ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’শুনেন ম্যাডাম।আমি সারাজীবন আহাম্মকের মতো বই পড়ে পড়ে বড় হয়েছে।বই খাতার সাথে আমার সম্পর্ক,বন্ধুবান্ধবদের সাথে আমার সম্পর্কের চেয়েও বেশি গাঢ়।ওসব চুমু টুমু আমি বুঝি না।’

‘অদ্ভুত! চুমু টুমু না বুঝলে বিয়ে করছো কেন আমায়?সারাজীবন তাহলে বই খাতা নিয়েই থাকো যত্তোসব!’

ইফাজ হাসি চেপে রেখে বলল,’নাহ,তোমার থেকে শিখবো বলে আর নিজ থেকে শিখিনি।তুমি একটু চুমু দিয়ে দেখাও তো ফোনে কিভাবে চুমু খায়।’

***

আজিজ ভিলায় আজ অনেক অনেক তারার আসর জমেছে।ঐ তারা রা আকাশে থাকে না,বরং ধরণীতে থেকেই ধরণীকে সুন্দর করে দেয়।মরিচ বাতির হলদেটে রোশনাইয়ে পুরো বাড়ি ডুব দিলো ঝলমলে সৌন্দর্যে।বাড়ির আনাচে কানাচে শুধু কৃত্রিম আলোর ঝলকানি।সেই সাথে তাজা গোলাপ আর বেলির সুবাস।অনুষ্ঠানে সাধারনত গোলাপ,রাজনীগন্ধা আর গাদা ফুল দিয়ে বাড়ি সাজানো হয়।কিন্তু এই বাড়ির কর্তা শাহরিয়ার আরহাম বলেছে বাড়ি যেন অবশ্যই অবশ্যই বেলি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।বেলি তার বোনের প্রিয় ফুল।বাড়িতে যা কিছু হবে,সব তার বোনের পছন্দ মোতাবেকই হবে।

আজ শেখ তাসনুভার গায়ে হলুদ।হাঁটি হাঁটি পা পা করে দুই ভাইয়ের হাত ধরে বড়ো হওয়া তাসনুভা আগামীকাল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে।এই দুইটা দিন তার জীবনে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।বিয়ে নিয়ে তাসনুভার অনেক আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা ছিলো।কিন্তু যেই না তার বিয়ের দিন ধার্য করা হলো,অমনি তার মন খারাপ হয়ে গেল।বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়াকে দেখলেই তার এখন কান্না পায়।কেন পায় সে নিজেও জানে না।

আরহাম সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে একবার তার ঘরে উঁকি দিলো।নবনীতা আর শুভ্রা তখন তাকে টিকলি পরাতে ব্যস্ত।আরহাম ধীর পায়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল।হাঁটতে গিয়ে টের পেল,পদযুগল বারবার মাটির সাথে গেঁথে যাচ্ছে।সে ভারি গলায় ডাকলো,’তাস!’

মেয়েটা সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল।তার চোখ আগে দেখেই ভেজা।ভাইয়াকে দেখামাত্র সে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল।আরহাম দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল।তাসনুভা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,’করব না আমি বিয়ে।তুমি তাদের মানা করে দাও।’

বলেই সে আবারো দুইবার হেঁচকি তুলল।চিত্রা খাটে বসে মোবাইলে গেমস খেলছিলো।তাসনুভার কান্না শুনতেই সে একহাতে মুখ চেপে বলল,’তাস! তুমি কান্না করো আরশুর মতো?লজ্জা লজ্জা।এতো বড়ো হয়ে কেউ কান্না করে?আমার বিয়ে হলে আমি একদমই কাঁনতাম না।’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে বলল,’সেটা কেন করবে তুমি?তুমি তো অকালেই পেকে গেছ।তোমার বিয়েতে তুমি পুরো বাড়ি নেচো,কেমন?’

আরহাম সুর মিলিয়ে বলল,’তোর কাঁনতে হবে না।তোর যা জিহবার জোর,পাত্রপক্ষ এমনিতেই আসর ছেড়ে উঠে পালাবে।বাপরে বাপরে! নূর আহমেদের এন্টিক পিস একটা!’

চিত্র ভেংচি কেটে বলল,’মিথ্যা কথা।আমার বিয়ে কোনো রাজকুমারের সাথেই হবে।’

‘হ্যাঁ হবে।গুলিস্তানের রাজকুমার তোকে বিয়ে করবে চিত্র।’
বলেই আরহাম খ্যাট খ্যাট করে কতোক্ষণ হাসল।

রিমি আর ওয়াজিদ বাড়িতে এলো সন্ধ্যার একটু পর পর।ওয়াজিদের কোলে ওয়াসিফ।চারিদিকের মানুষজনে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।সে একমনে আঙুল খেয়ে যাচ্ছিল।নবনীতা তাকে দেখতেই এক দৌড়ে তার কাছে গেল।তাকে ছো মেরে নিজের কোলে নিয়ে চটপট দু’টো চুমু খেল।উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’মাশাআল্লাহ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে রে রিমি!চোখ দু’টো একদম ভাইয়ার মতো।’

রিমি মুখ ফুলিয়ে বলল,’চোখ?পুরো মানুষটাই হয়েছে বাবার কার্বন কপি।আমার কিচ্ছু পায়নি রে নবনী।খামোখা নয় মাস পেটে ধরলাম।’

নবনীতা চোখ রাঙিয়ে বলল,’কি ব্যাপার ওয়াসিফ?তুমি নাকি তোমার বাবার মতো হয়েছো দেখতে?এটা একদমই উচিত হয়নি।আমরা সবাই একটা ছোট্ট রিমি চেয়েছিলাম।’

আরহাম পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসলো।ওয়াসিফকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে ওয়াজিদের দিকে আড়চোখে তাকালো।বাঁকা হেসে দুষ্টুমি করে বলল,’তাতে কি হয়েছে?এটা ওয়াজিদের মতো হয়েছে।পরের টা রিমির মতো হবে।তাই না রে ওয়াজিদ?’

রিমি দুই হাত তুলে বলল,’থাক ভাইয়া।মাফ চাই।নয় মাসে যা ভোগান্তি ভুগিয়েছে,আমি আর এসবে নাই।আমার একটাতেই চলবে।’

নবনীতা আচমকাই অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’তোর এই নয়মাসের ভোগান্তি আমাকে দিয়ে দে।আমি ভুগতে চাই জানিস।আল্লাহ আমাকে ভোগাচ্ছে না।’

মুহুর্তেই আনন্দমুখর পরিবেশে ভাটা পড়ল।ওয়াজিদ একবার কটমট চোখে রিমির দিকে তাকালো।এর মাথায় ঘিলু বলতে কিচ্ছু নেই।জানে নবনীতা এসব ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ।তাহলে কোন আক্কেলে সে তার সামনে এসব কথা বলল?

সে পরিস্থিতি অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টায় গলা খাকারি দিয়ে বলল,’আরে নবনীতা।বিভাকে দেখো।দেখো কতো বড় হয়ে গেছে বিভা।’

নবনীতা চোখ সরাল।বিভা দাঁড়িয়েছিল ওয়াজিদের পাশে,তার একটা হাত ধরে।তাকে দেখতেই নবনীতার মুখ খুশিতে ছেয়ে গেল।কতো উজ্জ্বল হয়েছে বিভার গায়ের রং।কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে! পল্টনে সেদিন যেই জীর্ণশীর্ণ মেয়েটার সাথে তার দেখা হয়েছিল,সেই মেয়েটা এখন কতো সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েছে।তাকে আর রাস্তার ধাঁরে পড়ে থাকা এতিম মনে হচ্ছে না,তাকে মনে হচ্ছে আদর যত্নের মাঝে বড়ো হওয়া একটা আহ্লাদী বাচ্চা।

নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’বিভু! তোর ভাই কোথায়?’

তৎক্ষনাৎ সদর দরজার সামনে থেকে একটা কিশোর নিরেট স্বরে বলল,’এই যে আপু! এখানে আমি।’

নবনীতা চোখ তুলল।দেখল সদর দরজায় শাহাদাত দাঁড়িয়ে আছে।তার পরনে কালো পাঞ্জাবি।গলায় ঝুলছে ক্যাননের একটা দামি ক্যামেরা।আর ঠোঁটে লেপ্টে আছে অমায়িক হাসি।নবনীতা তাকে দেখতেই হা হয়ে গেল।শাহাদাত বড় বড় কদমে তার সামনে আসতেই সে অবাক হয়ে বলল,’শাহাদাত তুই এতো লম্বা হয়েছিস কবে?’

শাহাদাত বিনিময়ে কেবল একগাল হাসল।নবনীতা তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরা টা দেখে বলল,’এসব আবার কি?’

শাহাদাত আগের মতোই হেসে বলল,’ক্যামেরা।আমি ফটোগ্রাফি করি,শখ আমার।’

সে একটু থামলো।হাসি মুখে বলল,’আমি একা আসিনি।আমার সাথে আরো একজনকে নিয়ে এসেছি।তোমরা কেউ কিছু মনে করবা না তো?’

নবনীতা মাথা নাড়ল।ব্যস্ত হয়ে বলল,’ছি ছি! কিছু মনে করব কেন?ডাকো না তাকে।বাইরে কেন রেখেছো?’

শাহাদাত পেছন ফিরে গলা উঁচু করে ডাকলো,’নওফেল ভাইয়া! ভেতরে আসো।’

নওফেল ছোট ছোট কদমে সামনে এসে দাঁড়ায়।তার মুখটা ভীষণ উদাস,চোখে নিদারুণ আক্ষেপ।তার কোনো ভাই বোন নাই।বাড়িতে সে একদম একা।অথচ এখানে তার তিনটা ভাই বোন আছে।নওফেল অনেক চাইতো তার সিবলিংস হোক।এই বাড়িতে তার দু’টো ভাই,একটা বোন আছে।নওফেলের খুব ইচ্ছে হয় তাদের সাথে মিশতে।

তাকে দেখতেই নবনীতার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল।সে একটা ঢোক গিলে একবার আরহাম,একবার নওফেলকে দেখে।আরহামের মুখোভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে না।তাকে একদমই শান্ত দেখাচ্ছে।নবনীতার বুক ধড়ফড় করে।কখন জানি এই লোক কি করে কে জানে!

আরহাম হাত বাড়িয়ে গম্ভীর গলায় ডাকলো,’নওফেল! এদিকে এসো।’

নওফেল গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো।তার বুক দুরুদুরু করছে।সে কাছে আসতেই আরহাম স্থির চোখে কয়েক পলক তাকে দেখল।তারপর আচমকাই শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।

নবনীতা চমকে উঠে সেদিকে তাকায়।দ্রুত নিজের হাতে চিমটি কাটে।সে সি ঠিক দেখছে?আরহাম নওফেলকে জড়িয়ে ধরেছে?তাকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে আরহাম বলল,’শোনো নওফেল।তুমি এই বাড়িতে যখন খুশি আসতে পারো।তোমার আসা নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই আমার।আমার কথা জানি না,কিন্তু তাস তোমাকে খুব পছন্দ করে।তুমি মন চাইলেই এখানে আসতে পারো,আমাদের সাথে কথা বলতে পারো।তোমার পরিবার,বিশেষ করে তোমার মায়ের প্রসঙ্গ ব্যাতীত অন্য যেকোনো প্রসঙ্গে আমরা তোমার সাথে আড্ডা দিতে রাজি আছি।তুমি মন চাইলেই এই বাড়িতে আসতে পারো নওফেল।’

নওফেল প্রথম দুই মিনিট কোনো কথা বলতে পারল না।শেষে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল,’আর আমি কি তোমাকে ভাইয়া ডাকতে পারি?’

আরহাম স্মিত হাসল।বলল,’হ্যাঁ,অবশ্যই পারো।’

নওফেল জড়ানো কন্ঠে বলল,’তুমি খুব ভালো।আমি বড় হয়ে তোমার মতো রাজনীতিবিদ হতে চাই।’

আরহাম তার কথা শুনেই শব্দ করে হেসে ফেলল।তাচ্ছিল্যেভরা কন্ঠে বলল,’আমি রাজনীতি করি না।ছেড়ে দিয়েছি আরো আগে।আর আমার মতো রাজনীতিবিদ হতেও যেও না।জেলের ভাত খাওয়া ছাড়া আর কিছুই কপালে জুটবে না।’
.
.
.
.
শুভ্রা কানের দুলটা ঠিকঠাক মতো পড়ার চেষ্টা করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।হঠাৎই কোথা থেকে একটা হাত এক টানে তাকে করিডোরের এক কোণায় নিয়ে আসলো।শুভ্রা চমকে গেলো ভীষণ।চোখ তুলে সামনে দেখতেই কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’এসব হচ্ছে টা কি?যেখানে সেখানে এসব কি?’

আরিশ দায়সারাভাবে বলল,’এগুলা প্রেম।লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম।চোরের মতো প্রেম।’

‘আপনাকে কে বলেছে চোর হতে?যান নিচে যান।’

‘উহু এমন করো কেন তুমি?ভাবি ভাইয়ার সাথে এমন করে?’

শুভ্রা কটমট করে বলল,’আমি ভাবি না,আর আপনি ভাইয়া না।’

‘হয়েছে।ঐ একই।’

আরিশ মনোযোগ দিয়ে তার হাতে থাকা দুলটা দেখল।হাত বাড়িয়ে বলল,’দাও।আমি পরিয়ে দেই।’

শুভ্রা আঁতকে উঠে বলল,’পাগল নাকি?সরেন।দূরে যান।’

‘উফফ! তুমি এতো আনরোমান্টিক কেন?’

‘আমি এমনই।’

‘ধুর ছাই।মুডটাই নষ্ট।’

আরিশ বিক্ষিপ্ত মেজাজে মুখ সরিয়ে নিলো।শুভ্রা কতোক্ষণ তার মুখটা দেখল।তারপর বিরক্ত ভঙ্গিতে তার হাতে থাকা দুলটা আরিশের হাতে গুজে দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,’নিন,নিন।তাড়াতাড়ি পরিয়ে দিয়ে।পরিয়ে ধন্য করুন আমায়।’

আরিশের মুখে সঙ্গে সঙ্গে হাসি ফুটলো।সে দাঁত কেলিয়ে বলল,’দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।এজন্যই তো তোমাকে এতো ভালোবাসি।’

***

ইফাজ ভীষণ খচখচ করছিলো।ইজমা তার হাত ধরে টেনে বলল,’আরে চলো না।দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

ইফাজ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আমি না গেলে হয় না?প্লিজ ইজমা।আমার একটু আনকম্ফোর্টেবল লাগে এসব গ্যাদারিং।’

ইজমা বলল,’না হয় না।আসো তুমি আমার সাথে।’

ইফাজ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতর পা রাখলো।বারবার মনে মনে আওড়াচ্ছিল,’নবনীতা যেন সামনে না পড়ে আল্লাহ।প্লিজ।’

তার প্রার্থনা বিফলে গেল।দুই মিনিট যেতে না যেতেই নবনীতার সাথে তার দেখা হয়ে গেল।দু’জন দু’জনকে দেখতেই কেমন থমকে গেল।

নবনীতা অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।ইজমা তাকে আগেই ইফাজের ব্যাপারে জানিয়েছে।দু’জন সামনে বিয়ে করবে।এমন অবস্থায় নবনীতার অস্বস্তি করার মতো কিছুই নেই।ইফাজের সাথে তার চ্যাপ্টার অনেক আগেই ক্লোজড।এখন আর এসব ঘেটে কোনো লাভ নেই।যা হচ্ছে সেটাকে স্বাভাবিক ভাবে হাসি মুখে মানিয়ে নেওয়াই বেটার অপশন।

ইফাজ দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল।ইজমা বলল,’তোমাকে যে ছবি দেখিয়েছিলাম না?এটাই ইফাজ।’

নবনীতা জোরপূর্বক সামান্য হাসল।স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,’আসসালামু আলাইকুম ইফাজ।কেমন আছেন আপনি?’

ইফাজ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,’ভালো আছি।’

নবনীতা সেদিকে আর দেখল না।সে দেখল তাদের থেকে কয়েকহাত দূরে রুদ্রমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে।যার চোখে মুখে চূড়ান্ত রকমের রাগ আর ক্রোধ ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে।সে তার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হনহনিয়ে সিঁড়ির দিকে হেঁটে গেল।নবনীতা ছুটলো তার পিছু পিছু।পেছন ডেকে বলল,’আরহাম,আরহাম।শুনেন আমার কথা।’

সে শুনলো না।গজরাতে গজরাতে বলল,’পারব না শুনতে।তুমি তোমার ইফাজের সাথে কথা বলো।শালা একটা দিন নিজেরা মিলে আনন্দ করতে পারি না।কোথা থেকে তোমার না হওয়া প্রেমিকরা এসে মন মেজাজ সব বিগড়ে দেয়।’

নবনীতা ফিক করে হেসে ফেলল।এক দৌড়ে গিয়ে আরহামকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আরহাম! মন খারাপ করে না।চলুন না।আমাদের না আজকে একসঙ্গে নাচ করার কথা?বাচ্চা গুলো কতো আশায় আছে আমাদের নাচ দেখবে বলে।’

***

নিচ তালায় খুব সুন্দর করে স্টেজ সাজানো হয়েছে।বাইরের মানুষ তেমন কাউকে ডাকা হয় নি।সব ঘরেরই মানুষ।তাসনুভা বসেছে স্টেজের একদম সামনে।পার্লার থেকে একটা মেয়ে এসে তার হাতে মেহেদি পড়াচ্ছে।

রিমি চটপটে স্বরে বলল,’এ্যাই আরিশ! নবনীতা আর আরহাম ভাইয়া কোথায়?দেখতে পাচ্ছি না কেন?’

আরিশ বলো,’আহা অপেক্ষা করো একটু।’

দশ মিনিট বাদেই বসার ঘরের সমস্ত বাতি নিভিয়ে কেবল ইভেন্ট অরগানাইজার দের আনা হলদে আলোর বাতি গুলো জ্বালানো হলো।স্নিগ্ধ সুন্দর কৃত্রিম আলোয় পুরো ঘর ভরে গেল।

এক দুই তিন।সাউন্ড বক্সে মাঝামাঝি ভলিউমে গান ছাড়া হলো।ঠিক তখন স্টেজে প্রবেশ করলো আরহাম।তার একহাতে চিত্রা,অন্য হাতে আরশাদ।আরিশ আর তাসনুভা তাকে দেখতেই তালি বাজালো।আরিশ শিশ বাজিয়ে বলল,’বড় ভাইয়া জিও।’

তাসনুভা বুকে হাত চেপে সামনের দৃশ্য টুকু দেখে।সে আজ আবদার করেছিল ভাইয়া আর ভাবি যেন তার গায়ে হলুদে একসাথে নাচ করে।আরহাম শুরুতে কতোক্ষন খ্যাক খ্যাক করেছে।পরে অবশ্য অনেক জোরাজুরির পর রাজি হয়েছে।তাসনুভা চাপা কন্ঠে বলল,’আরিশ ভাইয়া! সব ভিডিও করো।আমি পরেও এগুলো দেখতে চাই।’

আরহাম টেনে টেনে পাঞ্জাবি ঠিক করল।স্টেজের এক পাশে একটা টুলের সাথে ঠেস দিয়ে বসে গালের নিচে একহাত রাখল।আরশাদ আর চিত্রাকে বসালো তার দুই পাশে।তারপর গানের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের দু’জনের দিকে দেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,

Mujhko keya hua hein?
kiyu main kho gaya hu?
Pagal tha main pehle?
ya aab ho gaya hu?

ঠিক তখনই নবনীতা স্টেজে এলো।হাঁটু গেড়ে আরহামের মুখোমুখি বসে একহাতে তার চুল এলোমেলো করতে করতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,’

Behki hein nigahain aur
bikhre hein bal
tumne banaya hain kya apna ya hal?

আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে একটানে তাকে টেনে তুলল।নবনীতাকে ঘুরিয়ে এনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দু’জন সমস্বরে গাইলো,’

koyi mil gaya
mera dil gaya
keya batau yaroon?
main to hil gaya
koyi mil gaya..
mil hi gaya….

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭৩+৭৪

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭৩)

চিত্রা ওয়ালে ঝুলানো বিশালাকার ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটার দিকে দেখে বলল,’এই লোক আমার বাবা?’

তার প্রশ্নের ধরন শুনে শুভ্রা বিরক্ত হলো।কপাল কুঁচকে বলল,’এই লোক আবার কি?বল বাবা।’

চিত্রা কোমরে হাত রেখে কটমট করে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।তাহলে এখন বলো,এই বাবা কি আমার বাবা?’

শুভ্রা তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে কটমট করে বলল,’তুই আসলেই একটা ত্যাড়া।’

চিত্রা সেই কথায় কান না দিয়ে পুনরায় দেয়ালে থাকা ফটোফ্রেমটা দেখল।সেখানে বাবার পাশে আরেকটা মানুষ আছে।শুভ্রা বলল,’দেখি বলতো,বাবার পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে,সে কে?’

চিত্রা ভেঙচি কেটে বলল,’সে আমার মা।’

‘বাপরে! মা কে তো ঠিকই চিনেছিস।’

‘মামা সারাক্ষণ মায়ের কথা বলে,মায়ের ছবি দেখায়।মা কে না চিনে উপায় আছে?’

আরেক দফা বিরক্তিতে শুভ্রার মুখ ছেয়ে গেল।সে চোখ বাঁকা করে বলল,’এতো পাকনা পাকনা কথা বলিস কেন চিত্র?তোর বয়সের সাথে এসব যায় না।’

চিত্রা সামনের দিকে হেঁটে গেল।ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’না গেলে নাই।’

চিত্রা ধুপধাপ আওয়াজে হেঁটে একটা সোফার কাছে গিয়ে পা তুলে বসলো।শরীর দোলাতে দোলাতে বলল,’জানো শুভি! আমার মনে হয় আমাদের মা বাবা না থাকাতেই ভালো হয়েছে।’

প্রচন্ডরকম বিস্ময়ে শুভ্রার চোয়াল ঝুলে গেল,চোখ গুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো হঠাৎ।সে মুখ হা করে বলল,’কি বললি?কি বললি তুই এটা?’

চিত্রা ভাবলেশহীন হয়ে পুনরায় জবাব দেয়,’বললাম আমাদের মা বাবা না থাকাতে ভালোই হয়েছে।’

‘সেকি!কেন?’ চোখ কপালে তুলল শুভ্রা।

চিত্রা ফোকলা দাঁতে প্রশস্ত হেসে বলল,’মা বাবা থাকলে আপাই আমাকে এতো ভালোবাসতো না।আমার কাছে মা বাবার চেয়েও আপাইকে বেশি ভালো লাগে।’

শুভ্রা অবাক হয়ে বলল,’মা বাবার সাথে তো তোর কোনো স্মৃতিই নাই।মা বাবা কেমন তুই জানিস?’

‘নাহ,জানতে চাইও না।আমার মাও আপাই,বাবাও আপাই।আপাইয়ের মতো ভালো আমাকে মা বাবাও বাসতো না।আপাইয়ের মতো আদরও করতো না আমাকে।আপাই যে সত্যিই একটা পরী সেটা কি তুমি জানো শুভি?’

শুভ্রা দৌড়ে গিয়ে তার পাশে বসলো।চোখ বড় বড় করে বলল,’তোর সত্যিই মা বাবার কথা মনে পড়লে কষ্ট হয় না?’

চিত্রা নির্বিকার হয়ে বলল,’না,হয় না।’

‘কি অদ্ভুত!’

শুভ্রা নিজ থেকেই আবার বলল,’একবারো মনে হয় না যে মামার বাড়িতে না থেকে এই বাড়িতে থাকলে আমাদের সময়টা আরো ভালো কাটতো?’

চিত্রা মুখ বাঁকা করে বলল,’নাহ।আপাইয়ের বুকে ঘুমিয়েই আমার সময় সবচেয়ে বেশি ভালো কেটেছে।পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি ভালো আপাইকেই বাসি।যদি পুরো পৃথিবী ডানদিকে আর আপাই বাম দিকে থাকে,তাহলে আমি বাম দিকেই যাবো শুভি।’

শুভ্রা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনল।সে শেষ করতেই একহাত মুখে চেপে বলল,’তুই আপাইকে এতোখানি ভালোবাসিস?’

চিত্রা গালভর্তি হেসে বলল,’আপাইও আমাকে এতোখানি ভালোবাসে।তোমার থেকেও বেশি আমাকে বাসে।’

শুভ্রা তেঁতে উঠল,’মিথ্যা কথা।সমান সমান বাসে।’

‘কচু।তোমাকে কম,আমাকে বেশি।মনে নাই আপাই আমার ব্যাংকে নিজের টাকা ফেলতো।তোমার ব্যাংকে কখনো আপাই নিজের টাকা ফেলেছে?’

শুভ্রার কষ্ট হলো কেমন যেন।সে মাথা নামিয়ে বলল,’সেটা অবশ্য ঠিক বলেছিস।আপাই তোকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।’

নবনীতা শম্বুক গতিতে হেঁটে এসে ঘরের দরজায় উঁকি দিলো।ধিমি স্বরে ফিসফিস করে বলল,’আপাই আসবো?’

সঙ্গে সঙ্গে দুই বোন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল।চিত্রা দ্রুত মাথা নেড়ে বললো,’এক্ষুণি আসো আপাই।’

নবনীতা এসে তাদের মাঝখানটায় বসলো।সে বসতেই চিত্রা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।হাসিমুখে বলল,’আমার আপাই।’

শুভ্রা উদাস চোখে তাদের দু’জনকে দেখে।মাথায় এখনো চিত্রার সেই কথাটা ঘুরছে,’আপাই আমাকে বেশি ভালোবাসে।’

তাই তো।ভুল কিছু বলে নাই তো।আপাই চিত্রকেই বেশি ভালোবাসে।চিত্র’র কাছে তো আপাই ই তার মা,আবার আপাই ই তার বাবা।আপাই তাকে তেমন করেই বড়ো করেছে।

নবনীতা তার মলিন মুখটা দেখেই এক হাতে তার থুতনি স্পর্শ করল।শুভ্রার মুখটা সামান্য উঁচু করে ধরে বলল,’কিরে?তুই এমন চুপ মে’রে আছিস কেন শুভি?’

শুভ্রা অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিলো।নাক টেনে টেনে বলল,’কিছু না।এমনিই।’

‘এ্যাই শুভি! এদিকে তাকা।আপাইকে বল কি হয়েছে।’

শুভ্রা হঠাৎই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল।বলল,’তুমি চিত্র কে বেশি ভালোবাসো।তুমি তাকে তোমার বাচ্চার মতো আদর করো।’

বলতে বলতেই তার কন্ঠ ভেঙে আসে।নবনীতা হেসে উঠে বলল,’কি রে শুভি?তুই কি এখনো ক্লাস টু তে আছিস?কিসব বোকা বোকা কথা বলছিস।’

শুভ্রা অভিমান করে বলল,’আমি ঠিকই বলছি।’

নবনীতা চিত্রকে ছেড়ে তার কাছে গেল।তাকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,’তুই না আমার লক্ষী সোনা বোন?মন খারাপ করে না শুভি।আপাই তোদের দু’জনকে একদম সমান সমান ভালোবাসি।’

শুভ্রার চোখ ভিজে উঠল।সে পেছন ফিরে শক্ত করে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’চিত্র বার বার বলে তুমি তাকেই বেশি ভালোবাসো।আমাকে না।’

নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে চিত্রার দিকে তাকায়।খানিকটা শাসনের সুরে বলে,’এ্যাই চিত্র!উল্টা পাল্টা কথা বলিস কেন?’

সে খুব যত্নে শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।আরশাদ খাটে দুই হাত ছড়িয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।হঠাৎই তার ঘুম ভেঙে গেল।শুভ্রা দ্রুত তার কাছে ছুটে গেল।তার বুকে আলতো করে মালিশ করতে করতে বলল,’কান্না করে না আরশু।এই যে শুভি খালামণি এদিকে।’

চিত্রা একনজর শুভ্রা আর আরশাদকে দেখে নবনীতার কাছে এগিয়ে গেল।তাকে পুনরায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডাকলো,’আপাই!’

নবনীতা তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে জবাব দেয়,’কি?’

চিত্রা বলল,’আরশাদ আসার পর থেকে তুমি আর আমাকে আদর দাও না আপাই।’

নবনীতা চোখ উল্টে বলল,’সেকি! তোরা দুই বোন এসব কি শুরু করেছিস?’

চিত্রা হঠাৎই কেমন শান্ত হয়ে গেল।আপাইয়ের জীর্ণ আর দুর্বল বক্ষে মাথা রেখে বলল,’আপাই! একটা কথা বলি?’

নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।আদুরে গলায় বলল,’বলো না সোনা।’

‘মিস বলেছে এই পৃথিবীতে সাতশো কোটি মানুষ আছে।আর এই সাতশো কোটি মানুষের মধ্যে আমি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আপাই।আমার বাবার কথা মনেই পড়ে না।কারণ আমার কাছে তুমিই আমার বাবা।আমি স্কুলে সবাইকে বলেছি পরী আপাই ই আমার বাবা,পরী আপাই ই আমার মা।’

নবনীতা অকস্মাৎ নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল।তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।চিত্রা আবার তার বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠে বলল,’আপাই! তুমি আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না।তুমি আমাকে আর বুকে নিয়ে ঘুমাও না।তোমার শরীরের একটা সুন্দর গন্ধ আছে আপাই।আমি ঘুমুতে গেলে ঐ গন্ধ আর পাই না।আরশু নিশ্চয়ই পায়, তাই না?তুমি তাকেই ভালোবাসো।আমাকে বাসো না।আরহাম ভাই আর আমাকে কোলে নেয় না।’

‘তুমি নাকি ভীষণ লজ্জা পাও কোলে নিলে?’

‘তো তাই বলে নিবে না?আরশাদ আসার পরেই তোমরা আর আমাকে আদর দাও না।আরহাম ভাই আর আমাকে চকোলেট চিপস খাওয়ায় না।’

নবনীতা নিশ্চুপ।মেয়েটা এতো গুছিয়ে কথা বলছে কেমন করে?তার বয়স তো মাত্র আট।আট বছরের মেয়ে এতো সুক্ষভাবে অনুভূতি প্রকাশ করছে কেমন করে?চিত্রা নাক টেনে বলল,’আমি যদি জানতাম তুমি বিয়ের পর আমাকে ছেড়ে চলে যাবে,তাহলে কখনো তোমার বিয়েতে বিভার সাথে নাচতাম না।না নেচে শুভির মতো কাঁনতাম।’

সে থামল।একটু পরেই আবারো বলতে শুরু করল,’আপাই!শুভি তো আর আমার সাথে থাকে না।আরেক শহরে চলে গেছে।তুমি আমাকে তোমার সাথে আরহাম ভাইয়াদের বাসায় নিয়ে যাও না আপাই।ভাইয়াদের কতো গুলো রুম।একটা রুমেও বুঝি আমার জায়গা হবে না?আমি দরকার হয় আমার সব খেলনা
মামার বাড়িতে রেখে আসবো।তবুও আমাকে তোমার সাথে রাখো আপাই।আমি দুষ্টুমিও কম করবো।আমি স্কুলেও যাবো,আমি পড়াশোনাও করবো আপাই।তবুও আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে চলো।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না আপাই।তুমিই বলো,মা কে ছাড়া কি বাবুরা থাকতে পারে?ওয়াসিফ কি রিমিপু কে ছাড়া থাকতে পারে বলো?’

আট বছরের ছোট্ট মেয়েটি কোনোরকম ভণিতা ছাড়া নিজের মনের কথা উজাড় করে তার বোনের কাছে প্রকাশ করল।তার দুঃখ,তার যন্ত্রনা,তার আক্ষেপ-সবকিছু।নবনীতা আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।চিত্রাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে ধরা গলায় বলল,’আপাই সরি,সোনা।অনেক অনেক সরি।আপাই তোমাকে আলাদা রাখতে চাই না।কখনো চাই নি।তুমি জানো না,তুমি একা থাকবে ভেবে আমি বিয়েও করতে চাই নি।কিন্তু পরিস্থিতি ওমনই ছিলো।বিশ্বাস করো চিত্র।আপাই কখনো বিয়ে করে আলাদা হতে চাই নি।কিন্তু,,কিন্তু,,’

কান্নার দমকে তার কথা থেমে আসে।সে চিত্রকে জাপ্টে ধরে কতোক্ষণ ফোঁপায়।
‘আপাই তোমাকে ভালোবাসি চিত্র।তুমি আপাইকে এই অপরাধবোধে ফেলো না।তুমি আমার জান।আমিও সাতশো কোটি মানুষের মধ্যে তোমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।তুমি আমার মিষ্টি একটা বাচ্চা।’

চিত্রা হাত বাড়িয়ে তার চোখের পানি মুছে দিলো।ক্ষীণ স্বরে বলল,’আপাই কান্না না করে আগে এটা বলো আমাকে তোমাদের সাথে নিবে নাকি?আমি আরহাম ভাইয়াদের বাসায় থাকতে চাই।’

‘তোমার আপাই কি বলবে?’

দরজার কাছ থেকে ভরাট পুরুষালি কন্ঠের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো।নবনীতা আর চিত্রা দু’জনেই ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়।আরহাম ট্রাউজারের পকেটে হাত গুজে দু’জনের সামনে এসে দাঁড়ালো।তার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ে কাঁধের কাছটা ভিজে যাচ্ছে।

আরহাম চিত্রার পাশ ঘেঁষে বসলো।কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,’আপাই কে কেন বলছো পাখি?তুমি আমার বাসায় থাকতে চাইছো,আর আমি তোমায় রাখবো না?তুমি অবশ্যই অবশ্যই আমার বাসায় থাকবে।এটাই আমার শেষ কথা।’

চিত্রা খুশিতে হাততালি দিয়ে বলল,’সত্যিই?’

আরহাম হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’একদম তিন সত্যি।’

বলেই সে একটানে চিত্রকে কোলে নিলো।চিত্রা লাজুক হেসে তার গলা জড়িয়ে ধরল।পরক্ষণেই আবার তাড়াহুড়ো করে বলল,’লজ্জা পাচ্ছি দেখে নামিয়ে দিও না আবার।’

তার কথা শুনেই আরহাম হো হো করে হেসে উঠল।নবনীতা নিজেও কান্নার মাঝে শব্দ করে হেসে ফেলল।কান্নার শব্দের সাথে তার হাসির শব্দ মিশে কেমন অন্যরকম শোনাল।আরহাম হাসতে হাসতেই বলল,’একেবারে তাসনুভার কপি।দুইটাই অকালপক্ব।’

সে চিত্রকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো।ভ্রু উঁচু করে বলল,’কি চিত্র?লং ড্রাইভে যাবে?আগেই বলে দিচ্ছি,শুধু তুমি আর আমি।আপাই বাদ।’

চিত্রার দুই চোখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল।সে পুনরায় হাততালি দিয়ে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ।তুমি আর আমি।আমরা চিপস চকলেটও কিনবো কিন্তু।’

আরহাম একটু ভেবে বলল,’আচ্ছা কিনবো।কিন্তু এই রাতে কোনো স্টোর খোলা পাবো বলে মনে হচ্ছে না।’

‘আচ্ছা তাহলে শুধু ঘুরবো।এখন চলো না।’

চিত্রার কন্ঠে চঞ্চলতা,একই সাথে এতো এতো বিরক্তি।আরহাম কড়া গলায় বলল,’যাবো।কিন্তু একটা শর্ত আছে।’

চিত্রা চিন্তিত হয়ে বলল,’আবার কি শর্ত?’

আরহাম চোখ সরু করে বলল,’তুমি পুরো রাস্তা আমাকে আরাম ভাই বলে ডাকবে।যদি একবারও আরহাম ভাই বলে ডেকেছো,তবে সেখানেই ফেলে রেখে চলে আসবো।রাজি?’

চিত্রা খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল।আরহামের কাঁধে মাথা রেখে বলল,’আচ্ছা রাজি।’
.
.
.
.
রাতের শেষ ভাগ চলছে।শুভ্রা আরশাদকে ঘুমা পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমে তলিয়ে গেছে।আরহাম আর চিত্র বেরিয়েছে একটু আগে।শ্যালিকা আর দুলাভাইয়ের লং ড্রাইভ,নবনীতা জায়গা পায় নি।পুরো ঘর এখন রাতের নিস্তব্ধতায় ডুব দিয়েছে।

নবনীতা আস্তে করে চেয়ার টানলো।পাশের ঘরেই শুভ্রা আর আরশাদ ঘুমাচ্ছে।কোনোভাবে যদি আরশাদ এই সময়ে জেগে যায়,তবে নবনীতার পক্ষে তাকে ঘুম পাড়ানো প্রায় অসম্ভব।সে একেবারে নিঃশব্দে টেবিলের উপর হাত রাখল।টেবিলটা একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার।আজ সকালেই বোধহয় মোছা হয়েছে।

ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট্ট ডায়রি আর কালো বল পয়েন্ট টা বের করেই নবনীতা এক মিনিট কিছু একটা ভাবলো।তারপরই রোজকার মতো নিয়ম করে লিখতে শুরু করলো,

“বাবা,
আশা করি তুমি ভালো আছো।আমার বিশ্বাস তুমি অবশ্যই ভালো আছো।আজ হঠাৎ অনেক গুলো দিন পর তোমার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে।তুমি আবার ভেবো না অন্যান্য দিন তোমার কথা মনে পড়ে না।এমন কিছু না বাবা।তোমার কথা রোজই আমার মনে পড়ে।

বাবা,আজ আমরা প্রায় আট বছর পর নিজেদের বাড়িতে ফিরে এসেছি।ভাবা যায়?আটটা বছর! আমাদের সেই সুন্দর বাড়ি,যেখানে আমরা খুব যত্ন করে স্বপ্ন বুনতাম।কতো গুলো দিন কেটে গেছে তাই না বাবা?আরহামের মতো আমারো ডেস্ক ক্যালেন্ডার দেখলে ভয় লাগে ভীষণ।সে বত্রিশের ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমি পঁচিশের ঘর থেকে।বয়স হয়ে যাচ্ছে আমাদের।

চিত্র আর শুভিও কতো বড় হয়ে গেছে বাবা।তুমি তো কিছুই দেখলে না।চিত্র’র মতোন মিষ্টি একটা মেয়েকে তুমি কোলেপিঠে বড়ো করতে পারো নি,এই আক্ষেপ আমার চিরকাল থাকবে।তুমি জানো,চিত্র এখন স্কুলে যায়।আমার বড্ড শখ ছিলো চিত্র আর তোমাকে একসাথে দেখার।এই ধরো চিত্র স্কুল ড্রেস পরলো,আর তুমি কোট প্যান্ট।তারপর আমি তোমাদের সুন্দর সুন্দর কিছু ছবি তুলতাম।কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো কোথায়?তুমি নেই,আর তোমার মেয়েরা একেকজন একেক জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেছে।

শুভ্রা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে বাবা।খুব বড়ো ডাক্তার হবে ভবিষ্যতে।ডাক্তার হয়ে আমার চিকিৎসা করবে।এই কথা আমি বলি নি।সেই বলেছে।আমি তাকে কেমন করে বোঝাই জিনগত ব্যাথির কোনো চিকিৎসা নেই?আমারও কোনো চিকিৎসা নেই।যাকগে,এসব কথা ছাড়ো।শুভ্রা যখন এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে ক্লাস করতে যায়,তখন আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে।তোমার মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে বাবা।অথচ তুমি সেই দৃশ্য দেখতে পারছো না।এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?মা কে বলে দিও তার ছোট্ট শুভি ডাক্তারি পড়ছে।ইশশ! মা যদি বেঁচে থাকতো,তবে কতো খুশি হতো।আমি জানি,মা শুভিকে সবসময়ই একটু বেশি ভালোবাসতো।

বাবা,তুমি শুনছো?আমার বিয়ে হয়েছে বাবা।আমার সংসার জীবন নিয়ে যদি আমি লিখতে শুরু করি,তবে কোনোদিন লিখে শেষ করতে পারব না।শুধু এইটুক বলবো,আমি ভালো আছি বাবা।অনেক বেশি ভালো আছি আমি।আমার বর কে তুমি দেখো নি।ভালোই হয়েছে দেখো নি।সে একটু রগচটা স্বভাবের।আমার ধারণা তুমি বেঁচে থাকলে তার সাথে কোনোদিনই আমার বিয়ে হতো না।তুমি এমন লোকের সাথে আমার বিয়ে হতেই দিতে না।আমার বিশ্বাস সে প্রথমদিনই এমন কিছু উদ্ভট কাজ করতো,যেটা দেখে তুমি সসম্মানে তাকে বিদায় করে দিতে।সে এমনই লোক।এবার তোমায় একটা গোপন কথা বলি।সে বাইরে থেকে ভীষণ কাটখোট্টা স্বভাবের হলেও ভেতর থেকে একদম নরম মনের মানুষ।ঐ যে নারিকেল আছে না বাবা?সে পুরো ওমন।তার মনটা খুব ভালো বাবা।বর বলে বাড়িয়ে বলছি না।সে সত্যিই এমন।একটু বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের।সে তথাকথিত গাম্ভীর্যপূর্ণ সুপুরুষ না।সে একেবারেই এলোমেলো আর ছন্নছাড়া একটা মানুষ।আমি গুছিয়ে না নিলে সে সারাজীবন এমন ছন্নছাড়াই থাকবে।আমার কি ধারণা হয়েছে জানো?আমার ধারণা সে তোমাকে মারাত্মক রকমের হিংসে করে।আমি যখনই বলি আমি আমার বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি,তখনই তার মুখটা গ্যাস বেলুনের মতো চুপসে যায়।এবার ভাবো,সে কেমন অবুঝ প্রকৃতির মানুষ।

তাকে আমি খুব ভালোবাসি বাবা।সেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।যতোখানি ভালোবাসলে নিজের বাবা হওয়ার আনন্দকে মাটিচাপা দিয়ে হাসি মুখে সংসার করা যায়,আরহাম আমাকে ঠিক অতোটাই ভালোবাসে।তুমি সবসময় আমাদের জন্য দোয়া করবে বাবা।দোয়া করবে যেন আরহামের ভেতরের এই স্নিগ্ধ সুন্দর মানুষটা যেন আর কখনোই হারিয়ে না যায়।

আরেকটা দোয়া করবে বাবা?জানি আমি লোভ করছি।তবুও বলি।আমি চাই আমিও চিত্র আর শুভির মতো ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তানের মা হই।সে হবে আমার আর আরহামের ছোট্ট সংসারের একটা সুন্দর পূর্ণতা।সে আমাদের একটা মিষ্টি পরী হবে।আমি খুব চাই বাবা,খুব চাই।তুমি দোয়া করো আমার জন্য।আমি রোজ দোয়া করি।আল্লাহ কি কোনোদিনই আমার দোয়া শুনবে না?রিমির মতো কি কোনোদিন আমি মা হতে পারব না?ওয়াজিদ ভাইয়া যেমন করে ওয়াসিফকে মাথায় তুলে ঘুরেন,আমার আরহাম কি কোনোদিন কাউকে এভাবে আদর যত্নে বড় করতে পারবে না?

আর লিখবো না বাবা।তোমার উপর আমার অভিমান জন্মাচ্ছে।তোমার মেয়েরা এতো বড়ো হয়ে গেছে তোমাকে ছাড়া,অথচ তুমি তার কিছুই দেখে যেতে পারো নি।কেন তুমি আমাদের সাথে নেই বাবা?তুমি থাকলে এখন তুমি আর আমি লং ড্রাইভে বের হতাম।চিত্র ঘুরুক তার আরাম ভাইয়ের সাথে।আমি ঘুরবো আমার বাবার সাথে।

পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে বাবা।নূর আহামেদের তিন মেয়ে সেই পৃথিবীর সাথে খুব ভালো মানিয়ে নিয়েছে।তবুও কেন যে মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় বাবা।দুই চোখ ফেটে কান্না আসে।বারবার মনে হয়,’আজ যদি বাবা থাকতো,তবে এই আচরণ কেউ করতে পারতো না আমাদের সাথে।’

আমরা ভালো আছি বাবা।প্রবাহমান স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে আমরাও নিজেদের একটা অস্তিত্ব বানিয়ে নিয়েছি।আমি চাকরি করছি,ব্যবসা সামলাচ্ছি।কিন্তু মাঝে মাঝেই হুটহাট মনে হয় আমার কি যেন নেই।তখনই আমার বুক ফেটে কান্না আসে।যখন ভাবি এই পৃথিবীতে কোনোদিন আর আমাদের দেখা হবে না,তখন আমার পুরো পৃথিবী আধার হয়ে আসে।মনে হয় আমি এক্ষুনি মা’রা যাবো।

কবে তোমার সাথে আমার দেখা হবে বাবা?তোমার দুই মেয়েকে বুকে আগলে বড়ো করার পুরষ্কার স্বরূপ তুমি কবে আমায় বাহবা দিবে?কবে বলবে,’পরী! মাই ড’টার।আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ?’
কবে আসবে সেই দিন?আদৌ কি কোনোদিন আমাদের মূলাকাত হবে বাবা?

যেখানেই থেকো,ভালো থেকো।তোমার পরী ভালোই আছে।শুধু জেনে রেখো,তোমাকে আর মাকে ছাড়া আমাদের জীবনটা আর কোনোদিনই পরিপূর্ণ হবে না।আমরা বরাবরই অসম্পূর্ণ।এই অসম্পূর্ণতার মাঝে থেকেই আমরা সবচেয়ে বেশি ভালো থাকার চেষ্টায় মশগুল।

ইতি
তোমার আদরের মেয়ে নবনীতা”

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭৪)

জীবনের এক জটিল সমীকরণে আটকে পড়ে চূড়ান্ত রকমের দোলাচালে ভুগছিলো ফারাজ রহমান আদি।তার মনে হলো জীবনে এর চেয়ে বিব্রতকর,আর ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সে আর দ্বিতীয়বার কখনো পড়েনি।সে টের পেল,সে একটি মেয়েকে ভালোবাসে,তাও আবার যে কি-না বয়সে তার চেয়ে বারো বছরের ছোট।বারো বছর,মানে এক যুগ।ভাবা যায়?

আদি বরাবরই নিজের অনুভূতি বুঝতে ব্যর্থ।সে কখনোই নিজের দিক থেকে বিষয় গুলো অনুভব করে নি।কিন্তু যেই না সেদিন মেয়েটা তার সম্মুখে একটা জীর্ণ গোলাপ বাড়িয়ে দিলো,ওমনি তার সব এলোমেলো হয়ে গেল।সে তাকে বলেছিল তুমি যাকে ভালোবাসো,তাকে গোলাপ দিয়ে নিজের অনুভূতি জানাও।ওমনি মেয়েটা তাকে গোলাপ দিয়ে দিলো।তাহলে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালে কি দাঁড়ায়?এটাই যে মেয়েটা তাকে ভালোবাসে।গোলাপটা দেখার পর সে কয়েক মিনিট সেভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো।কিছু বলার জন্য নড়তে গিয়ে টের পেল,সে পুরোপুরি জমে গেছে।কি অদ্ভুত ব্যাপার! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এতো এতো মেয়েদের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এখন এই ছোট্ট মেয়েটার সামনে তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না?

তাসনুভা,আদির চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যরকম একটা মেয়ে।মেয়েটা মায়াবী,মেয়েটা চটপটে,মেয়েটা অভিমানী,মেয়েটা চঞ্চল।আদি তাকে বরাবরই স্নেহ করে আসছে।তাসনুভাকে সে তার জন্মের সময় থেকে চেনে।তার ভাবতেই কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত লাগে যে এই মেয়ের জন্মের সময় সে ক্লাস সিক্সে ছিলো।ছিহ ছিহ! কি লজ্জা! বারো বছরের বয়সের ব্যবধান! আদির মন চাইছে মাটি ফাঁক করে ভেতরে চলে যেতে।

তাসনুভা তাকে ফুল দেওয়ার আগ পর্যন্তও পৃথিবীটা বেশ সরল ছিলো।যেই না সে তাকে ফুল দিলো,অমনি পৃথিবীটা জিলাপির মতো পেঁচিয়ে গেল।আদি কাঁপা হাতে ফুলটা হাতে নিতেই মেয়েটা এক প্রকার পালিয়ে তার দৃষ্টির আড়াল হলো।সে তো চলে গেল,কিন্তু যেতে যেতে আদিকে এক অথৈ সমুদ্রে ফেলে গেল।সেখান থেকে উঠে আসার সাধ্যি তার নেই।

আদি সেই রাতে আর ঘুমুতে পারলো না।সে গভীর মনোযোগ দিয়ে সবটা ভাবলো।খুব সুন্দর করে চিন্তা করলো কিভাবে সে তাসনুভা কে বোঝাবে তাসনুভা আসলে যেটাকে ভালোবাসা বলছে,সেটা স্রেফ ইনফ্যাচুয়েশন।এর বেশি কিছুই না।

কিন্তু কথা সাজাতে গিয়েই সে টের পেল,এটা কোনো ইনফেচুয়েশন না।সাব কনশাস মাইন্ডে সে কখন এই মেয়েটিকে পছন্দ করে ফেলেছে সে নিজেও জানে না।

তাসনুভার তার প্রতি অনুভূতি আছে,এটা জানার পর পৃথিবী ছিলো জিলাপির মতো।কিন্তু সেও মনের অজান্তে ঐটুকু মেয়ের প্রতি অনুভূতির জন্ম দিয়েছে,এই কথা বোঝার পর তার পৃথিবী হয়েছে তড়িৎ চুম্বকের সেই কয়েলের মতো,যার প্যাঁচ সংখ্যা কতো,আদি নিজেই জানে না।

আরহাম তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু।আরহামের বোনকে সে বোনের নজরেই দেখে।মাঝখানে এসব কি হলো,কেন হলো সে জানে না।তাসনুভা আরহামের বড়ো আদরের বোন।আদি যদি তাকে তাসনুভার ব্যাপারে কিছু বলে,তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে,এটা নিয়েও আদির কোনো ধারনা নেই।কারণ ভাই বোনের ব্যাপারে আরহাম সবসময়ই ভীষণ সিরিয়াস।

আদির ভয় অন্য জায়গায়।আরহাম স্বভাবতই একটু গরম মেজাজের।অল্পতেই রেগে যায়।সে যদি কখনো শুনে তার বোনের প্রতি আদির একটা ভিন্ন অনুভূতি আছে,তখন সে সেটা কিভাবে দেখবে?সে যদি মনে করে আদি আগে থেকেই তাসনুভা কে পছন্দ করে তার পেছন পেছন ঘুরতো,তাহলে তো সে তাকে খুবই জঘন্য ভাববে।কিন্তু সত্য কথা এটাই যে আদি কখনো তাকে বন্ধুর বোন ব্যতীত অন্য কোনো চোখে দেখেনি।তাসনুভা তাকে ফুল না দিলে সে কোনোদিন তাসনুভার সাথে প্রেম জাতীয় কোনো কিছু কল্পনাই করতো না।

তারা প্রায় দুই দিনের মতো চট্টগ্রাম ছিলো।তারপর আবার ঢাকায়।ঢাকা আসার পরেও সে পুরোটা সময় তার আত্মীয়ের বাড়িতেই ছিল।একটিবারের জন্যও আরহামদের বাড়িতে সে যায়নি।তার অস্বস্তি হতো,এর চেয়েও বেশি যেটা হতো তা হলো ভয়।বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়।ক্লাস ওয়ান থেকে হওয়া বন্ধুত্বের ভেতর কোনো ফাটল আদি কখনোই চায়নি।তার কাছে তার পরিবার আর আরহাম-ওয়াজিদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।সে তাদেরকে পরিবারের মতোই দেখেছে সারাজীবন।কিন্তু হঠাৎই এই তাসনুভার ব্যাপারটাতে আদি এমনভাবে আটকে গেল,যে তার মনে হলো আরহামের সাথে তার সম্পর্কটা পুরোপুরি ভাবে শেষ হয়ে যাবে যদি সে তার অনুভূতিদের প্রশ্রয় দেয়।

তার সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক যখন অদ্ভুত রকমের দোলাচালে ভুগছিলো,তখনই এক বিকেলে ওয়াজিদের নম্বর থেকে তার ফোনে কল এলো।আদি অস্থিরতায় ছটফট করছিলো।ওয়াজিদ ফোন দিতেই সে ফোনটা রিসিভ করে তাড়াহুড়ো করে বলল,’কি হয়েছে রে?সব ঠিক আছে তো?’

ওয়াজিদ হেসে বলল,’রিল্যাক্স ম্যান।সব ঠিকই আছে।’

আদি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল,’আচ্ছা বল কি বলবি?’

‘আরহাম ফোন দিয়েছিলো।বলল আমি যেন তোকে নিয়ে তার বাড়িতে যাই।তুই এক কাজ কর।আমার এখানে চলে আয়।তারপর আমরা দু’জন একসাথে তার বাড়ি যাবো।’

আদিরের বুক মোচড় দিয়ে উঠল।সে একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,’কেন?হঠাৎ তার বাড়িতে ডাকলো কেন?’

‘আমি কি জানি।সেটা গেলেই দেখা যাবে।’

আদি ক্ষীণ স্বরে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’

ফোন কাটার পর আবারো রাজ্যের অস্বস্তি আর দুঃশ্চিন্তা জেঁকে ধরল তাকে।কি কারণে আরহাম তাকে ডাকতে পারে তার জানা নেই।হুট করেই তার মনে হলো সে নিজেকে চোরের মতো ভাবছে,আর আরহামকে ভাবছে পুলিশের মতো।কি আশ্চর্য বিষয়! সে নিজেকে বোঝালো,’শোন আদি! তুই আগে যেমন করে আরহামের সামনে যেতি,অমন করেই যাবি।ভয়ের কি আছে?জাস্ট চিল।’

অথচ এতো স্বান্তনা বাণীতেও কোনো কাজ হলো না।একটু পরেই তার মন খারাপ হয়ে গেল।অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত মনে সে কোনোরামে বাড়ি থেকে বের হলো।আজকের দিনটাই বোধহয় খারাপ।সকাল থেকে শুধু খারাপই হচ্ছে তার সাথে।
.
.
.
.
আরহাম দুই চোখ সরু করে বলল,’সংসার কি?কিভাবে করে?’

তাসনুভা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,’কি?সংসার কি মানে?’

আরহাম তার মাথায় আস্তে করে চাটি মে’রে বলল,’সংসার বুঝিস না?বিয়ের পর যা হয়,তাই সংসার।এবার বল,সংসার কিভাবে করে?’

তাসনুভা মুখ বাঁকা করে বলল,’কিভাবে করে মানে?ভাবি যেভাবে করছে ঐভাবেই করে।সবকিছু মানিয়ে,গুছিয়ে,সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে তারপর সংসার করে।’

আরহাম ব্যঙ্গাত্মক হাসল।তিরষ্কার করে বলল,’ভাবির উদাহরণ টেনে লাভ আছে?তুই তোর ভাবির মতো?কই আগরতলা,আর কই চৌকির তলা।’

তাসনুভার দুই চোখ জ্বলে উঠল।সে তেঁতেঁ উঠে চেঁচালো,’ভাইয়া! অপমান করছো তুমি আমাকে।’

‘হ্যাঁ করছি।কি করবি তুই?’

‘আমি রাগ করব।’

‘কর।পাকনামি না করে একটু রাগ কর,তাও ভালো।’

তাসনুভা বলল,’তুমি ভর দুপুরে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছো কেন?’

আরহাম বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল।হেঁটে এসে তাসনুভার খাটে পা ঝুলিয়ে বসল।দুই পা নাড়াতে নাড়াতে উত্তর দিলো,’কারণ আমি তোর বিয়ে দিবো।বিয়ে দেওয়ার পর তুই সংসার করবি।তাই জানতে চাইলাম তুই সংসারের মানে বুঝিস নাকি?’

তাসনুভা চমকে তার দিকে তাকায়।চোখ বড় বড় করে বলে,’বিয়ে?’

‘হ্যাঁ বিয়ে।তোর কোনো সমস্যা আছে?’

তাসনুভার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো।সে কাঁপা গলায় বলল,’কার সাথে বিয়ে দিবে তুমি আমার?’

আরহাম নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’সেটা আমার চিন্তার বিষয়।তুই জেনে কি করবি?অতো ভাবিস না।বড়োলোকের সাথেই দিব।’

তাসনুভা নাক ছিটকে বলল,’আমি এতো বড়োলোক চাই না।আমি বিয়ে করব না।’

‘কেন বিয়ে করবি না?বয়স হয়েছে,বিয়ে করবি না কেন?’

তাসনুভা ভেঙচি কেটে বলল,’কারণ আমি ল্যাংড়া,তাই।’

আরহাম হঠাৎই কেমন শান্ত হয়ে গেল।সহসা তার মুখের হাসি উবে গেল।তার থম মারা মুখটা দেখেই তাসনুভা চিন্তিত হয়ে বলল,’সেকি! তুমি এমন মন খারাপ করছো কেন?’

আরহাম চোখ তুলে তার দিকে তাকালো।তাসনুভার মনে হলো এতো নরম চোখের ভাষা আর হয় না।সে মিনমিনে স্বরে বলল,’সরি ভাইয়া।মজা করেছি।’

আরহাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’প্লিজ তাস! ঐসব ওয়ার্ড বলিস না।নিতে পারি না আমি।’

তাসনুভা চট করে বলল,’আচ্ছা বলব না।কিন্তু তুমি বলো যে তুমি আমার এখনই বিয়ে দিবে না।করব না আমি বিয়ে।’

আরহাম জেদ ধরে বলল,’একশোবার দিবো।তোর কি?বললাম তো ছেলে বড়োলোক,আরামে থাকবি তুই।সারাদিন খাবি,আর সারারাত ঘুমাবি।এমন জীবন আর পাবি কোথাও?’

‘চাই না আমার এমন জীবন।আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।’

আরহাম মুখ কুঁচকে বলল,’সারাজীবন আমার ঘাড়ে বসে বসে খাবি?’

‘হ্যাঁ খাবো।’

‘চড় খাবি।তোকে এতো বছর পালতে পারব না।অনেক বড় হয়েছিস।এখন বিদায় হ।’

নবনীতা দরজা সামনে এসেই ভেতরে উঁকি দিলো।আরহাম তাকে দেখেই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,’তোমার আবার কি চাই?’

‘আমার কিছু চাই না।আদি ভাইয়া আর ওয়াজিদ ভাইয়া এসেছে।যান গিয়ে কথা বলুন।’

আরহাম উঠে দাঁড়ালো সাথে সাথে।সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই তাসনুভা ব্যস্ত গলায় বলল,’আদি ভাইয়া এসেছে?’

নবনীতা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিলো,’হ্যাঁ,এলো তো দেখলাম।’

‘তার চেহারা কেমন ছিল?’

নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’চেহারা কেমন ছিলো মানে?চেহারা যেমন হওয়ার এমনই ছিলো।কিসব অদ্ভুত কথা বলো তুমি!’

তাসনুভা বিরক্ত হয়ে বলল,’ধুরু! সেটা বলিনি।মানে দেখে কেমন মনে হলো?রাগী?নাকি দুখী?নাকি খুশী?’

নবনীতা একটু ভাবল।তারপর তাসনুভা কে দেখে বলল,’এক কাজ করো।তুমি গিয়ে দেখে আসো।এতো কিছু আমি খেয়াল করি নি।তোমার মন চাইলে দেখে আসতে পারো।’

তাসনুভা মুখ কালো করে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলো।নবনীতা খাটে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল,’আমার কি মনে হয় জানো?’

তাসনুভা তার দিকে না ফিরেই কাঠখোট্টা গলায় বলল,’না জানি না।কি মনে হয় তোমার?’

‘আমার মনে হয় তোমার আদি ভাইয়াও মনে মনে তোমাকে পছন্দ করে।মানে আমার মনে হলো আরকি।’

তাসনুভা সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে তার দিকে তাকালো। হড়বড় করে বলল,’সত্যি?সত্যি তোমার এমন মনে হয়?’

নবনীতা হেসে ফেলল।মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ সত্যি।আমার এমনটাই মনে হয়।’

তাসনুভা চঞ্চল হয়ে বলল,’কেন মনে হয় বলো না?মানে কি দেখে তোমার এমনটা মনে হলো?’

নবনীতা খিলখিল করে হেসে ফেলল।তাসনুভার গালে আলতো করে ঠুকনো মে’রে বলল,’আরে বাবারে! এই মেয়ের কতো আগ্রহ দেখো না।আরহাম ঠিকই বলে।পুরাই অকালপক্ব।নাক টিপলে দুধ পড়ে,আর সে আছে প্রেম ভালোবাসা নিয়ে।’

তাসনুভা মুখ ফুলিয়ে বলল,’মোটেই না।বিশ্বাস না হলে তুমি আমার নাক টিপে দেখতে পারো।সর্দি ছাড়া কিছুই পড়বে না।’
.
.
.
.
আরহামের দৃষ্টি শান্ত।আদির সামনে বসতেই একদম ভণিতা ছাড়া প্রশ্ন করল,’তাস কে তুই পছন্দ করিস?’

আদির ইচ্ছে করল মাটি ফাঁক করে তার ভেতর ঢুকে বসে থাকতে।কি অদ্ভুত প্রশ্ন! কি অস্বস্তিকর প্রশ্ন! সে কি উত্তর দিবে?
আরহাম অধৈর্য হয়ে আবারো বলল,’বল না?করিস পছন্দ?’

আদি মাথা নামিয়ে নিল।কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর গলায় বলল,’করি।’

তার উত্তর এতোটাই ক্ষীণ কন্ঠের ছিলো যে সে নিজেই নিজের উত্তর শুনতে পেল না।আরহাম আবার বলল,’তোর মুখ নাই শালা?আমার বিয়ের সময় তো পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিলি।এখন তোর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না?বল।পছন্দ করিস তুই তাস কে?’

আদি চোখ মুখ খিঁচে ধরল।মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে স্পষ্ট করে বলল,’করি।’

তাসনুভা আর নবনীতা ভীষণ কৌতূহল নিয়ে লিভিং রুমের ভেতরে উঁকি দিলো।তাসনুভার চোখ জোড়া ভীষণ চঞ্চল।আদির উত্তর সে শুনেছে।শোনার পর থেকেই তার বুকে জোয়ারের ঢেউ উঠছে।সবকিছু তীরে এসে আছড়ে পড়ছে বার বার।

আরিশ ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার একটু আগে।লিভিং রুমের সামনে ভাবি আর তাসনুভা কে দেখেই সে এগিয়ে গেল।নবনীতার পেছনে দাঁড়িয়ে দুই পা উঁচু করে ভেতরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করল।ফিসফিস করে বলল,’তোমরা কি করছো এদিকে?’

নবনীতা পেছন না ফিরেই উত্তেজিত স্বরে বলল,’কথা বলিস না আরিশ।শুনতে দে কি বলছে।’

আরিশ মাথা চুলকে বলল,’কিন্তু কি নিয়ে বলছে?’

‘আদি ভাইয়া আর তাসনুভার ব্যাপারে।’

মুহূর্তেই আরিশের দুই চোখে অদ্ভুত দ্যুতি খেলে গেল।সে লাফিয়ে উঠে বলল,’ওরেব্বাস! সেই ইন্টারেস্টিং টপিক! দেখি দেখি,আমাকে একটু জায়গা দাও তো।’

সে ঠেলেঠুলে নিজের জন্য একটা জায়গা বের করে নিল।এই আলোচনা শোনা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।বড় ভাইয়া বিয়ে নিয়ে কেমন চিন্তাধারা পোষণ করে,এটা তার জানা প্রয়োজন।সে নিজেও একই নৌকার মাঝি।

আরহাম পায়ের উপর পা তুলে বসল।একেবারে ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল,’কয়দিন ধরে এসব চলছে?’

আদি চমকে উঠে চোখ তুলে।হতভম্ব কন্ঠে বলে,’কয়দিন মানে?তুই ভুল বুঝছিস।এসব কিছু প্ল্যান করে হয় নি।যতখানি হয়েছে,পুরোটাই সাব কনশাস মাইন্ডে হয়েছে।আমি জেনে বুঝে কিছু করি নি।’

আরহাম মন দিয়ে তার কথা শুনলো।সে থামতেই গম্ভীর হয়ে বলল,’গুড।ভেরি গুড।এবার যা কিছু হয়েছে,সব সাবকনশাস মাইন্ড থেকে ডিলিট করে দে।’

আদি পুনরায় মাথা নামিয়ে নিল।তার আর কিছু বলার নাই।এমনটাই হওয়ার ছিলো।সে আগে থেকেই জানতো।ওয়াজিদ আড়চোখে একবার আরহামের দিকে তাকায়।যে কি-না তার চোখে মুখে একটা মেকি ভাবগাম্ভীর্য ধরে রেখেছে।আদি বেকুবটা সেই নাটক ধরতে না পারলেও ওয়াজিদ খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে।সে নিজেও মাথা নামিয়ে ঠোঁট চেপে হাসল।

তাসনুভার মন ভেঙে গেল।সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’ভাবি।কিছু করো না প্লিজ।ভাইয়া এসব কি বলছে?’

আরিশ নিজেও সুর মেলালো,’হ্যাঁ ভাবি।বলো না কিছু।ভালোবাসা কি কোনো অপরাধ?সে নিজেও তো লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করেছে।আমাদের বেলায় এমন করে কেন?ভালোবাসা যদি কোনো অপরাধ হয়,তাহলে সে নিজেও তো একটা অপরাধী।বয়কট বড় ভাইয়া!’

নবনীতা ফিক করে হেসে ফেলল।হাসির শব্দ যেন লিভিং রুম পর্যন্ত না যায়,সেই চিন্তা করে দ্রুত মুখ চেপে ধরল।চাপা কন্ঠে বলল,’তোমরা দুই ভাই বোন সবকিছুতে ভাবি ভাবি করো কেন?তোমাদের ভাইয়ার সিদ্ধান্ত।আমার এখানে কি করার আছে?’

তাসনুভা কাটকাট গলায় বলল,’কারণ ভাইয়া তোমার কথা পাত্তা দেয়।আমাদেরকে তো ভাইয়া মানুষ বলে গুনেই না।’

আরহাম কতোক্ষণ থম মেরে বসে থাকলো।শেষে থমথমে মুখে বলল,’তুই আর আমার বাড়িতে আসবি না আদি।’

পুরো ঘরটায় একটা বজ্রপাত হলো।নবনীতা নিজেও ভড়কে গেল।হতবাক হয়ে বলল,’এসব কি উল্টা পাল্টা বলছে?’

আরিশের চোয়াল ঝুলে গেল।একহাত মুখে চেপে সে বিড়বিড় করল,’শেষ শেষ।আপন ভাইকে ভায়রা ভাই বানানোর স্বপ্ন তোর স্বপ্নই থেকে যাবে রে আরিশ।’

তাসনুভা মনে হয় কেঁদেই ফেলবে এক্ষুনি।সে নবনীতার একটা হাত চেপে ধরে অভিমানী গলায় বলল,’আমি আর জীবনেও বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলব না।অভিশাপ দিলাম,কালকে সকালেই বড় ভাইয়ার মাথার দুই পাশে দুইটা শিং গজাবে।ভাইয়া সেই শিং দিয়ে সবাইকে ঢু মারবে।’

নবনীকা খিলখিল করে উঠে বলল,’অভিশাপটা কিউট ছিলো অনেক।’

আদি মাথা নামিয়ে রাখা অবস্থাতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তার দৃষ্টি মেঝের দিকে।আরহাম কথা শেষ করতেই সে অল্প করে মাথা নেড়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে আসবো না।’

আরহাম তাকে আগাগোড়া পরোখ করল।একবার চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে দেখল।নবনীতার সাথে চোখাচোখি হতেই সে কুটিল হাসল।নবনীতা কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।সব জায়গায় এমন ফাইজলামি ভালো লাগে না।

আরহাম সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,’বিয়ের আগে পাত্রের ঘন ঘন শ্বশুরবাড়িতে আসা ভালো দেখায় না।এজন্য তুই কম কম আসবি।বুঝতে পেরেছিস?’

আদি তড়িৎ গতিতে মাথা তুলল।তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।আরহামের কথা সে পুরোপুরি শুনেছে,কিন্তু এর ভাবার্থ তার বুঝতে সমস্যা হচ্ছে।বার বার মনে হচ্ছে সে কি ভুল কিছু শুনেছে?

আরহাম উঠে দাঁড়ালো সহসা।এগিয়ে এসে আদিকে একটানে দাঁড় করিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তার পিঠ চাপড়ে ভারি গলায় বলল,’কাম অন ম্যান।তাসনুভার জন্য তোর চেয়ে বেটার আর কে হতে পারে?আমাদের বাসার মানুষদের পর তাসনুভার সবচেয়ে বেশি যত্ন তুই করেছিস।তুই আর তাসনুভা মিলে ঘর করবি,এটা নিজ চোখে দেখা আমার জন্য একটা ব্লেসিংস।’

আদি কিংকর্তব্যবিমুঢ়।কতোক্ষণ সেভাবেই খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো।রাস্তার মোড়ে থাকা খাস্বা গুলো যেভাবে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে,একদম সেভাবে।শেষে যখন হুশ ফিরলো,তখন সে নিজেও আরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’আরহাম! ট্রাস্ট মি।তাসনুভাকে আমি সবসময় স্নেহের চোখেই দেখেছি।আমি কোনোদিন তাকে নিয়ে সেরকম কিছু ভাবি নি।মাই ইনটেনশন ওয়াজ নেভার রং।সে সত্যিই আমার কাছে বাচ্চাদের মতো।মিষ্টি,নিষ্পাপ আর খুব বেশি সরল।’

তাসনুভার চোখ ভরে এলো।সে ঘাড় ঘুরিয়ে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলল,’ভাবিইই! রাজি হয়েছে।’

নবনীতা নিজেও তাকে জড়িয়ে ধরল।কপালে একটা চুমু এঁকে বলল,’জানতাম রাজি হবে।’

আরিশ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।নাহ,এখনো তার আশা টিকে আছে।তার বিশ্বাস বড় ভাইয়া তার প্রেমেও বাগড়া দিবে না।এইটুকু কনসিডার সে নিশ্চয়ই করবে।সে চোখ বাঁকা করে নবনীতাকে দেখল।ভাবি আবার কোনো সমস্যা করবে না তো?

পরমুহূর্তেই তার মনে হলো,’ধ্যাত।ভাবি কেন সমস্যা করবে?আমি কি কোনো খারাপ ছেলে?আমি তো কতো জেন্টেল একটা ছেলে! এমন ছেলে ভাবি তার বোনের জন্য আর দু’টো পাবে?

সে নবনীতাকে ডেকে জানতে চাইলো,’ভাবি! এ্যাই ভাবি।আমাকে তোমার কেমন লাগে?’

নবনীতা তার দিকে ফিরে হাসি মুখে বলল,’আমার দেবর আর ননদ দু’জনকেই আমার ভীষণ আদর লাগে।তুমি তো একটা লক্ষী ছেলে।’

আরিশ লাজুক হাসল।যাক,পাত্রীর অভিভাবক তাকে গ্রীন সিগনাল দিয়েছে।এবার নিজের অভিভাবক গ্রীন সিগনাল দিলেই হলো।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭২

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭২)[প্রথম অংশ]

ওয়াজিদ ওটির সামনে বসেছিল।দুই হাতের আঙুল আড়াআড়ি করে রাখা।মাথাটা নিচের দিকে নুয়ানো।ওটির সামনে থাকা লাল রঙের বাল্বটি তখনো জ্বলছিলো।ওয়াজিদের মনে হলো এই বাল্বটা সাধারণ কোনো বাল্ব না।ওয়াজিদের হাসি কান্না সুখ দুঃখ সবকিছুর সাথে এই বাল্বের সম্পর্ক আছে।সে একটা হাত বুকে রেখে তার হৃদস্পন্দন অনুমান করার চেষ্টা করল।বুক ধড়ফড় করছে ভীষণ।মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এক মণ ভার চাপিয়ে দিয়েছে।সে এলোমেলো ভাবে চারপাশ দেখে।শীলা অনেকক্ষণ যাবত দোয়া পড়ছেন।ওয়াহিদ সাহেব হাঁটাহাঁটি করছেন এই মাথা থেকে ঐ মাথা।তার চোখ মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।ওয়াজিদ পুনরায় মাথা নামিয়ে নিল।চিন্তায় তো সে নিজেই আধম’রা হয়ে যাচ্ছে।

রিমিকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে।তার ডেট ছিলো তিনদিন পরে।কিন্তু হঠাৎই সন্ধ্যার পরে তার শরীর অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল।আধঘন্টাতেও যখন কিছুতেই ব্যাথা কমলো না,তখন সে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।গাইনোকোলজিস্ট রুমানা পারভিন তার চেক আপ করার পরেই ইমার্জেন্সি সিজারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।তারপরই মাত্র আধঘন্টার ব্যবধানে রিমিকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে।সব কিছু এতো দ্রুত হয়েছে যে ওয়াজিদ রিমির মা বাবাকেও বিষয়টা জানানোর সময় পায়নি।এই একটু আগে তাদের জানানো হয়েছে।তারা এখনো সম্ভবত রাস্তায়।

সবার আগে সেখানে পৌঁছুলো আরহাম আর নবনীতা।ওয়াজিদ তাদের ফোন দিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে।খবর পেতেই তারা একপ্রকার ছুটে এখানে এসেছে।তাসনুভার চিঠিটা পড়ার পর আরহাম প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত ব্যক্ত করার সময় পেল না।এর মাঝেই আবার রিমির খবর শুনে সবকিছু ফেলে তারা এখানে এসেছে।নবনীতা আসার পরই ওয়াজিদকে দেখে দৌঁড়ে তার সামনে এলো।ভীষণ অস্থির হয়ে বলল,’কি হয়েছে ভাইয়া?ডাক্তার আর কিছু জানায়নি?’

ওয়াজিদ মাথা তুলে তার মুখটা একনজর দেখেই পুনরায় মাথা নামিয়ে বলল,’নাহ,এখনো কিছু জানায় নি।’

নবনীতার অস্থিরতা আরো বাড়লো।দুই হাত ডলতে ডলতে সে এ’মাথা ঐ’মাথা পায়চারি করল।আরহাম তার কাঁধ চেপে ধরে বলল,’বসো তুমি।এমন অস্থির অস্থির করছো কেন?’

নবনীতা বসলো না।ব্যাকুল হয়ে বলল,’ভয় লাগছে আমার।রিমিকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়।’

‘আচ্ছা তুমি বসো।বসে বসে ভয় পাবে না হয়।’

নবনীতা চোখ কটমট করে তার দিকে তাকালো।হনহন করে সামনে হেঁটে যেতে যেতে বলল,’সব সময় ফাইজলামি ভালো লাগে না।’

সে চুপচাপ একটা সিটে গিয়ে বসল।আরশাদ হেঁটে হেঁটে আরহামের পাশে এসে দাঁড়ালো।নিজের হাতের মুঠোয় ছোট্ট একটা হাত নিজের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো।আরহাম সেটা টের পেতেই দ্রুত নিচে তাকায়।সে তাকাতেই আরশাদ লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল।আরহাম মুচকি হাসল।হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে তার গালে হাত রেখে বলল,’কি বাবা?কিছু খাবে?’

আরশাদ মাথা তুলল না।নত মস্তকেই বাবার কাছে এগিয়ে এসে আস্তে করে তার কাঁধে মাথা রাখলো।আরহাম আলতো হাতে তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,’বাবারে আর কোলে নিতে পারবো না।পুরো রাস্তা তুমি আমাকে জ্বালাতন করেছো।’

আরশাদ তবুও তার গলা জড়িয়ে ধরল।অগত্যা বাধ্য হয়ে আরহাম তাকে কোলে তুলে নেয়।সে কোলে তুলতেই আরশাদ টুপ করে তার গালে একটা চুমু খেল।মিষ্টি গলায় বলল,থাঙ্কু বাবা।তুমাকে আদল।’

আরহাম হাসল।তাকে নিয়ে সামনে হেঁটে যেতে যেতে ভরাট গলায় বলল,’এসব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেই তো আমাকে বশ করেছিস দুষ্টু।’
সে থামে।আরশাদের দুই গালে মন মতো চুমু খেয়ে বলে,’আরশাদ তুমি কি জানো তুমি পৃথিবীর প্রথম ছেলে যাকে আমি এতো যত্ন করে বড় করছি?এর আগে কোনো ছেলেকে আমি এতো আদর করি নেই।পরীর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে তুমি আমার লক্ষী সোনা বাচ্চা।’
.
.
.
.
ওটির লাল বাতি বন্ধ হলো হঠাৎ করে।সেটা দেখেই ওয়াজিদ এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।মন চাইছে এক ছুটে ওটির সামনে যেতে।কিন্তু তার পা চলছে না,শরীর জমে গেছে।হাত পা কেমন মৃ’ত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।রুমানা পারভিন ওটি থেকে বের হয়ে এলেন মিনিট দুয়েক বাদেই।তার কোলে তোয়ালে দিয়ে মুড়ানো ছোট্ট একটি নবজাতক।

ওয়াজিদ যদিও কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছিলো,রুমানার কোলে থাকা সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা ছোট্ট প্রাণটি কে দেখামাত্র পুনরায় ধপ করে বসে বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল।তার হাত কাঁপছে।ঐ টুকু পথ যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।রুমানা নিজেই তার সামনে আসলেন।ওয়াজিদ তার উপস্থিতি টের পেতেই ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করল,’রিমি কেমন আছে?’

রুমানা পারভিন একগাল হেসে জবাব দিলেন,’রিমি ভালো আছে ওয়াজিদ।’

‘আমি দেখা করতে পারবো?’

‘আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।এখনো তো জ্ঞান ফিরে নি,জ্ঞান ফিরতে দাও।এখন আপাতত ছেলেকে আদর করো।’

চমকে মাথা তুলে ওয়াজিদ।বোকা বোকা হয়ে বলে,’ছেলে হয়েছে?’

রুমানা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।দ্রুত হাত বাড়িয়ে নবজাতক শিশুটিকে তার বাবার নিকট এগিয়ে দিলেন।

ওয়াজিদ একটা শুকনো ঢোক গিলল।আতঙ্কিত গলায় বলল,’আমি বাচ্চা কোলে নিতে জানি না।আগে কখনো নেই নি।’

রুমানা শব্দ করে হেসে উঠে বললেন,’সমস্যা নেই।নিতে নিতেই অভ্যাস হবে।’

ওয়াজিদ ফ্যাকাশে মুখে বলল,’যদি ভুলে ফেলে দেই কোল থেকে?’

‘কক্ষনো না।তুমি বাবা।বাবারা কখনো বাচ্চাদের কোল থেকে ফেলে না।নাও ধরো।দুই হাতে ধরো।কিছু হবে না।’

ওয়াজিদ খুব ধীরে উঠে দাঁড়ালো।নিজে কোলে নেওয়ার আগেই রুমানার কোলে থাকা অবস্থায় ছোট্ট মুখটা দেখল।ছোট ছোট হাত দু’টো বুকের উপর ফেলা।সে ঘুমুচ্ছে,খুব আরামে ঘুমুচ্ছে।তাকে তার মায়ের মতো মিষ্টি দেখাচ্ছে।ওয়াজিদের বুক ধুকধুক করছে।কাঁপা হাতে সে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়।

সঙ্গে সঙ্গে বাবা হওয়ার অপার্থিব আনন্দ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।সে এক মনে একদৃষ্টিতে তার কোলে থাকা ছোট্ট শিশুটিকে দেখতেই থাকে।কি সুন্দর! কি সুন্দর! পৃথিবী এতো সুন্দর কেন?এতো আনন্দ ওয়াজিদের ঝুলিতে এসে জমা হচ্ছে কেন?ওয়াজিদ প্রশস্ত হাসল।মাথা নিচু করে আলতো করে সন্তানের গালে চুমু খেল।সে বাবা হয়েছে! কি আশ্চর্য বিষয়! জীবন হঠাৎ এতো পরিপূর্ণ হলো কেমন করে?

দূর থেকে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আরহাম পুরো দৃশ্য টুকু দেখে।সে অনুভব করল দৃশ্যটা ভীষণ সুন্দর।বাবা ছেলের এই মনোরম দৃশ্য তার দেখতে খুব ভালো লাগছে।নিজের সন্তানকে প্রথম কোলে নেওয়া,তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরা,দুই গালে মন ভরে চুমু খাওয়া-জগতের কোন ছেলে এই সুখ চায় না?বাবা হওয়ার যেই অনুভূতি,সেটা কি অন্য কিছু দিয়ে অনুভব করা যায়?সে জোরপূর্বক সামান্য হাসল।তার আশেপাশেই একটা মেয়ে আছে।সেই মেয়েটা যদি কোনোক্রমে বুঝতে পারে যে এই বিষয়টা নিয়ে আরহাম আফসোস করেছে,তবে টানা তিনদিন সে অনুতাপে ভুগতে ভুগতে শেষ হয়ে যাবে।আরহাম চায় না সে অনুতাপে ভুগুক।মেয়েটা এক জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।আরহাম চায় এখন সে ভালো থাকুক।খুব বেশি ভালো থাকুক।আরহামের মিষ্টি আলিঙ্গনে জড়িয়ে সে সর্বদা ফুলের মতো স্নিগ্ধ থাকুক।ব্যাস এইটুকুই চাই তার।

সবাই একে একে বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার পর নবনীতা এলোমেলো পায়ে মিসেস শীলার দিকে এগিয়ে গেল।ওয়াজিদ একটু আগে ওটির ভেতর গিয়েছে।রিমির জ্ঞান ফিরেছে সবে।নবনীতা জড়ানো কন্ঠে খানিকটা অনুনয় করে বলল,’আমাকে একটু দিবেন আন্টি?আমি একটু কোলে নেই?’

শীলা আশ্চর্য হলেন ভীষণ।বিস্মিত কন্ঠে বললেন,’অবশ্যই কোলে নিবে।এতো অনুনয় করছো কেন?’

নবনীতা উদাস মুখে একটুখানি হাসি খুশি ভাব এনে জবাব দিলো,’ঐ তো।এমনিই বলছিলাম।প্লিজ আমাকে একটু দিন আন্টি।’

সে অতি সন্তর্পণে শীলার হাত থেকে বাচ্চাটি কে নিজের কোলে নেয়।তারপর প্রচন্ড আনন্দিত হয়ে তার মুখটা দেখে।রিমির একটা মিষ্টি ছেলে বাবু হয়েছে।কি সুন্দর দেখতে সে! রিমির মতো মিষ্টি,আর ওয়াজিদ ভাইয়ের মতো গম্ভীর।নবনীতার বুকে অনুভূতিরা সব আছড়ে পড়ে।বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্টিনে প্রথম রিমির সাথে তার দেখা।আর আজ এতো গুলো দিন পরে রিমির বাচ্চা সে নিজের কোলে নিচ্ছে।ঐ মিষ্টি মতো দেখতে,বাচ্চামো তে ভরা,অবুধ,চঞ্চল মেয়েটি মা হয়েছে।কি অদ্ভুত! সময় এতো দ্রুত চলে যায় কেন?

নবনীতার বুক ভারি হয়ে আসে।নিজের উপর তার নিজেরই রাগ উঠে।এমন খুশির দিনে মন খারাপ করতে আছে?আজ তো আনন্দের দিন।তবে কেন সে একটু পর পর অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে?

সাদা ইউনিফর্ম পরা নার্সটি তার দিকে এগিয়ে এলো।খানিকটা ব্যস্ত সুরে বলল,’ম্যাম।মিসেস রিমি তার বাচ্চাকে দেখতে চাইছেন।আমার এখন তাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।’

নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ,হ্যাঁ শিওর।এই নিন।’

বাচ্চাটিকে হাতে পাওয়া মাত্র নার্সের পোশাকে থাকা মহিলাটি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন।কেবল পেছনে পড়ে রইল নবনীতা আর তার সাথে অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস।নবনীতা ক্লান্ত হয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।অন্যমনস্ক হয়ে একটা হাত পেটে রাখে।তার কাছেও তো এমন একটা মিষ্টি বাচ্চা ছিলো।কিন্তু সে তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারে নি।এই এতো এতো পূর্ণতায় নবনীতার মনে পড়ে যায় সে আসলে অক্ষম,পুরোপুরি অক্ষম।এমন একটা দিন কখনোই তার আর আরহামের জীবনে আসবে না।নিজের সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে কোলে নেওয়ার যেই স্বর্গীয় তৃপ্তি,সেটা কখনোই আরহাম আর তার জীবনে আসবে না।

সে পিছিয়ে গেল আরো কিছুটা।পেছাতে পেছাতে একেবারে আরহামের কাছাকাছি গিয়ে বলল,’বাসায় চলুন।কাজ আছে আমার।’

গাড়িতে বসার পরেও নবনীতা কেমন থম মেরে রইল।আরহাম সন্দিহান চোখে তাকে আগাগোড়া পরোখ করে বলল,’তোমার হয়েছে টা কি বলো তো?’

‘কিছু না।এমনিই।’

আরহাম ক্লান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস ছাড়ল।নবনীতার দিকে সামান্য ঝুকে কোমল কন্ঠে বলল,’পরী!এ্যাই পরী।’

নবনীতা তার দিকে না ফিরেই বলল,’কি?’

‘আই লাভ ইউ।’

নবনীতা নাক টানতে টানতে জবাব দিলো,’লাভ ইউ টু।এখন গাড়ি টানেন।বাড়ি যেতে হবে আমায়।’

‘না,টানবো না।’

‘কেন?’ নবনীতা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।

আরহাম সিটবেল্ট খুলে তার দিকে আরো খানিকটা ঝুকে তার গালে গাঢ় করে চুমু খেল।নবনীতা হকচকিয়ে গেল ভীষণ।আশ্চর্য হয়ে রাগী রাগী মুখ করে বলল,’হচ্ছে টা কি এসব?আরশাদ আছে না এদিকে?’

‘তো থাকলে?আরশাদ নিজেই তো তোমাকে সারাক্ষণ চুমু খায়।আরশাদের বাবা খেলেই দোষ?’

নবনীতা তার কথার ধরন শুনেই ফিক করে হেসে দিলো।আরহাম তাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি তাকে আরো কয়েক দফা চুমু খেল।শেষে আরশাদের গালে আদর দিয়ে বলল,’এ্যাই বাবা! মা কে একটু আদর করে দাও তো।’

আরশাদ তার কথা শুনেই এক লাফে নবনীতার কোলে উঠে দাঁড়ালো।ছোট্ট দুইটা হাত নবনীতার গালের দুই পাশে রেখে তার দুই গালে শব্দ করে চুমু খেল।নবনীতা থতমত খেয়ে বলল,’কি সর্বনাশ! সে আমার গাল ধরে চুমু খাচ্ছে কেন?’

আরশাদ মুখ ফুলিয়ে বলল,’বাবা তো এভাবেই খায়।’

উত্তর শুনেই নবনীতার চোয়াল ঝুলে গেল।একটু ধাতস্থ হয়ে সে অগ্নিচোখে আরহামের দিকে তাকায়।একহাতে তার কাঁধে পর পর দু’টো চড় মেরে তিতিবিরক্ত কন্ঠে বলে,’দেখুন।বাচ্চাদের সামনে এসব করলে কি হয় দেখুন।’
.
.
.
.
তাসনুভা বসে আছে খাটের এক কোণায়।তার এক পাশে নবনীতা,অন্য পাশে ইজমা।রিমি বসেছে তার থেকে খানিকটা দূরে।শুভ্রা,আরিশ আর চিত্রা সম্ভবত বসার ঘরে।বাকিদের খবর জানা নেই।

এই মুহূর্তে তারা সবাই ওয়াজিদদের বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছে।রিমি কে গত পরশু ডিসচার্জ করা হয়েছে।এখন সে পুরোপুরি সুস্থ।সেই উপলক্ষে শীলা সবাইকে বাড়িতে দাওয়াত করেছেন।তারা সবাই প্রায় সকাল সকাল ওয়াজিদদের বাড়ি পৌঁছে গেছে।কেবল আদি ছাড়া।তার পাসপোর্টে একটা সমস্যা হয়েছে।সে সেটা ঠিক করাতে উত্তরা গিয়েছে।সবকিছু সমাধান করে তারপর সে এদিকে আসবে।

ওয়াজিদ ঘরে ঢুকতেই আরহাম ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো।ঘরের অবস্থা এই মুহূর্তে গুমোট।নবনীতা চিন্তিত মুখে স্বামীর মতিগতি আর পরবর্তী পদক্ষেপ বোঝার চেষ্টা করছে।রিমি ভীতু দৃষ্টিতে আরহামের রগচটা মুখটা কয়েকবার দেখল।তার সমস্ত মুখ রাগে র’ক্তিম হয়ে আছে।তাকে কেমন ক্ষুদার্ত বা’ঘের মতোন দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে তাসনুভার ধর বিহীন মাথাই একমাত্র এই মুহুর্তে তার ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে।

সে চাপা গর্জন করে তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচিয়ে উঠল,’এবার বল,এই বাল পাকনা মেয়ের আমি কি করব?’

তাসনুভা তার ভয়ংকর গর্জন শুনেই আরো বেশি মিইয়ে গেল।কেঁপে উঠে নবনীতার কাঁধ চেপে ধরে বেড়ালের মতো মিনমিনে গলায় বলল,’ভাবি প্লিজ কিছু একটা করো।বাঁচাও আমাকে।’

বলেই সে চোরা চোখে আরহামের দিকে তাকায়।তার সাথে চোখাচোখি হতেই আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’এই বেয়াদব! তুই প্রেমের কি বুঝিস রে?প্রেম কি?ভালোবাসা কি?কিভাবে হয় এসব?থাপ্পড় মে’রে যদি তোর প্রেমের ভূত না ছুটিয়েছি তো আমিও আরহাম না।’

তাসনুভা দ্রুত নিজেকে নবনীতার আড়ালে লুকিয়ে নিলো।কথায় আছে না?যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে সন্ধ্যা হয়।তাসনুভার হয়েছে ঐ দশা।এতো কিছুর পর সে ধরা তো খেয়েছেই,তাও আবার বড় ভাইয়ার কাছে।কি পাপ করলে যে মানুষ এমনভাবে ফেঁসে যায় তাসনুভার জানা নেই।আপাতত কপাল চাপড়ানো আর ভাবির আঁচলে মুখ লুকানো ব্যতীত তার আর অন্য কোনো উপায় নেই।

আরহাম তার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’এ্যাই তাস! এদিকে তাকা।তুই চিঠিতে এসব আলতু ফালতু কথা কেন লিখেছিস?তোর বয়স কতো?তুই ভালোবাসা বুঝিস?’

তার গলায় আওয়াজ শুনেই আরিশ ছুটে এলো।লক ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল,’কি হয়েছে?তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন?’

আরহাম তাকে দেখেই আরো বেশি জোর গলায় বলল,’এ্যাই তাস! আরিশকে দেখ।তোর মতো বাল পাকনামি করে সে?তোর চেয়ে তো বয়সেও বড়।কোনোদিন শুনেছিস এমন প্রেম পিরিত করতে?’

তাসনুভা এতোটা সময় বেড়ালের মতোন মিনমিন করছিল।যেই না আরিশের নাম শুনলো,ওমনি খেঁকিয়ে উঠে বলল,’কি?আরিশ ভাই প্রেম পিরিত করে না?’

আরহাম চোখ রাঙিয়ে বলল,’না,আমার ভাই এসব ফালতু কাজ করে না।কি রে আরিশ?তুই প্রেম করিস?’

আরিশ থতমত খেল।বেকুবের মতো দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,’না ভাইয়া।আমি এসব করি না ছিহ।’

তাসনুভা মুখ হা করে বলল,’কি?ভাইয়ার সামনে সাধু হচ্ছো তুমি?কীর্তি সব ফাঁস করে দেই?’

আরিশ ধমকে উঠল,’এক চড় মারব ফাজিল কোথাকার! আমি এসব প্রেম টেম করি না।আমি ভালো ছেলে।’

শুভ্রা দরজার কাছে এসে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।কৌতুহলী হয়ে বলল,’আপনারা কি নিয়ে কথা বলছেন?’

আরিশ তাকে দেখতেই জায়গা ছেড়ে দিলো।শুভ্রা ভেতরে যেতেই আরহাম আরো এক দফা চেঁচালো,’দেখ! শুভ্রা কে দেখ।আরিশ তাকে স্নেহ করে।এখন কি শুভ্রা তোর মতো পাকনামি করে বলবে যে সে তাকে ভালোবাসে?থাপ্পড় মে’রে তোর দাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত বোয়াদব।তোর ভালোবাসার আমি গুষ্টি মারি।খ্যাতাপুরি তোর ভালোবাসার!’

শুভ্রা বিষম খেল।অসহায় চোখে একবার আরিশ,একবার আরহামের দিকে তাকালো।আরিশ গলার কাছে হাত দিয়ে ছু’রি চালানোর অভিনয় করে ম’রার ভান ধরল।মিনমিনে গলায় বলল,’শেষ শেষ!ভাইয়া তার দুই ভাই বোনের প্রেমের পিন্ডি চড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭২)[দ্বিতীয় অংশ]

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই আরহাম বাইরের দৃশ্য দেখল।বাগানের একটা গাছের মগডালে একটা কাক বসে তখন থেকে ডাকছে।আরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,’আহা! যা না রে শালা।আর কতো ডাকবি?’

নবনীতা ঘরের ভেতর থেকেই শব্দ করে হেসে ফেলল।এগিয়ে এসে বলল,’কাক কে এভাবে বললে সে বুঝবে না।কা কা করে বলুন।তাহলে বুঝবে।’

আরহাম বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।মাথা চুলকে বলে,’এর চেয়ে ফাহাদের গলা আরো ভালো ছিলো।অনেক দিন হলো নিমকহারাম টার সাথে দেখা হয় না।’

নবনীতা তার পাশে থাকা ইজি চেয়ারে বসে বলল,’আর দেখা হওয়ার দরকারও নাই।যেমন আছে সব,সেভাবেই ভালো আছে।’

আরহাম উত্তরে কেবল সামান্য হাসলো।নবনীতা তার হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,’আপনি কি আপনার রাজনৈতিক জীবন খুব বেশি মিস করেন?’

আরহাম মাথা নাড়ল।নিচু স্বরে বলল,’খুব একটা না।তবে আজকাল বাবার কথা খুব মনে পড়ে।ডেস্ক ক্যালেন্ডার দেখলে ভয় লাগে।কতো দ্রুত যায় সময়! তোমার আর আমার বিয়ের দুই বছর হয়ে যাচ্ছে।কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে সবকিছু।’

নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে জানতে চাইলো,’কেমন স্বপ্ন?ভালো স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন?’

আরহাম হাতে থাকা চায়ের কাপ টা গোলাকার টিপয়ের ওপর রাখল।এক হাতে নবনীতার একটা হাত চেপে ধরে গাঢ় স্বরে বলল,’শ্রাবণের সেই বিকেলে তুমি পার্টি অফিসে আসার পর থেকে যা কিছু হয়েছে,পুরোটাই আমার কাছে একটা সুন্দর স্বপ্নের মতো।’

নবনীতা আলতো করে তার কাঁধে মাথা রাখল।জড়ানো স্বরে বলল,’একটা কথা বলি আপনাকে?’

‘হুম বলো।’

‘আমি মা হতে চাই।’

‘তুমি অলরেডি আরশাদের মা।’

‘আমি আরো একবার মা হতে চাই।নয় মাস একটা সন্তানকে নিজের ভেতর ধারণ করার পর যে মা হয়,আমি সেই মা হতে চাই।’

আরহাম বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে ফিরল।মোলায়েম কন্ঠে বলল,’আমি একটা সময় আরশাদ কে নিয়ে অনেক ভালো মন্দ বলেছি।কিন্তু পরে এসে আমি তাকে মেনে নিয়েছি।সত্যি সত্যি আমি তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসি।আরশাদ বাচ্চাটা ভীষণ আদুরে।আমার খুব আদর লাগে তাকে।তোমার অসুস্থতার বিষয়টা জানার পর আমার আর কখনোই ঐসব বাবা হওয়ার ইচ্ছে জাগে নি।আমি তোমাকে,আরশাদকে,আরিশ আর তাসনুভাকে নিয়ে একটা নির্বিঘ্নে সংসার চেয়েছি।আমার এইটুকুই চাই।আর কতো তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ করবে পরী?প্লিজ।স্টপ দিস।’

নবনীতা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না গিলে বলল,’কিন্তু আমি তো এই না পাওয়ার অনুভূতি টা সহ্য করতে পারছি না।কাউকে বললে সে নিশ্চয়ই আমাকে খারাপ ভাববে।কিন্তু সত্য এটাই যে ওয়াসিফকে যখন ওয়াজিদ ভাইয়া আদর করে,মাথায় তুলে পুরো ঘর ঘুরে বেড়ায়,তখন যন্ত্রণায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে আরহাম।আমি পারছি না।কিছুতেই পারছি না।’

আরহামের মায়া হলো ভীষণ।নবনীতা কথা শেষ করার আগেই দুই হাত মুখের উপর চেপে ধরল।রিমির একটা স্বপ্নের মতো সুন্দর সংসার হয়েছে।নবনীতা খুশী।খুব বেশি খুশী।রিমির জীবনটা এতো সুখের হয়েছে,ভাবলেই তার আনন্দ হয়।তার কোনো কষ্ট নেই।সে চায় রিমি আরো বেশি ভালো থাকুক।তার কেবল আক্ষেপ হয়।নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ হয়।আল্লাহ তাকে সব দিয়েছেন।সবকিছুর শেষে কি তাকে মা হওয়ার মতো চমৎকার অনুভূতি টুকু দিবেন না?নবনীতা খুব চায় তার কোল আলো করে একটা ছোট্ট পরী আসুক।এই জীবনে সে অনেক পেয়েছে।পেতে পেতে তার লোভ বেড়েছে।সে এখন লোভী হয়ে আরো একটা জিনিস চায়।সে মা হতে চায়।আর কিচ্ছু না,কিচ্ছু চাই না তার।

আরহাম আচমকাই তার গালে হাত রেখে ব্যস্ত হয়ে বলল,’এ্যাই পরী!চট্টগ্রাম যাবে?’
.
.
.
.
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম,তারপর সেখান থেকে সোজা নাসিরাবাদ।কালো রঙের গাড়িটা মোট সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে এসে পৌঁছুলো।তারা যাত্রা শুরু করেছিল রাত আটটার দিকে।এখন ঘড়িতে সময় রাত একটা চল্লিশ।

গাড়ি থেকে সবার আগে নেমে এলো আদি।নামার পরেই চোখ ঘুরিয়ে সে আশপাশ দেখল।গলার স্বর সামান্য চওড়া করে বলল,’বাপরে! কতো বড়ো বাড়ি!’

আরিশ নামলো তার পেছন পেছন।নেমেই সে ভালো মতো চোখ মেলে সামনে থাকা বিশালাকার বাড়িটা দেখল।বিড়বিড় করে বলল,’আমার হবু শ্বশুরবাড়ি।’

আদি পেছন ফিরে চোখ কপালে তুলে বলল,’কি কি?কি বললে তুমি?’

আরিশ দ্রুত মাথা নাড়ল।দায়সারা হয়ে বলল,’কে?আমি?না তো।কিছু বলি নি তো।’

শুভ্রা ট্রাভেল ব্যাগটা একহাতে নিয় অন্য হাতে আরশাদের হাত ধরে বের হলো।বের হতেই সবার প্রথমে বাড়ির মূল দরজায় তার নজর গেল।সেখানে বড়ো করে একটা তালা ঝুলছে।বাড়ির দরজা টা দেখতেই তার মস্তিষ্কে আবছা কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল।এই বাড়ি,এই বাড়ির চৌকাঠ তার কাছে ভীষণ চেনা।তারা দুই বোন এই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতো।বাবা কেমন ছিলো?শুভ্রার একটু একটু মনে পড়ে তার মুখটা।বাবা বাড়ি এলেই আপাই দৌড়ে যেত তার কাছে।কতোটা প্রাণবন্ত আর দুরন্ত ছিলো সেসময় আপাই! তারপর ছয়টা বছর আপাই নিস্তব্ধতায় কাটিয়েছে।এরপর বিয়ের পর আটমাস আপাই সেই দুরন্তপনা আর চঞ্চলতায় শেষ করেছে।তারপর কি যেন হয়ে গেল আপাইয়ের সাথে।আরহাম ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে আসা,মিস ক্যারেজ,আরহাম ভাইয়ের মামলা মোকদ্দমা,এসব কিছু শেষ হওয়ার পর আপাই আবার তার সেই নিস্তব্ধত রূপে ফিরে গেল।শুভ্রা জানে আপাই ভালো নেই।এটা তার মুখোশ।ছয় বছর ধরে আপাই যে ভালো থাকার মুখোশ পরে রাখতো,এখনো সে সেই মুখোশই পরে আছে।

সবাই একে একে গাড়ি থেকে নামতেই নবনীতা ধীর পায়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।আরহাম গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি লক করতেই আরশাদ শুভ্রার হাত ছেড়ে তার কাছে ছুটে গেল।গিয়েই দুই হাত উপরে তুলে বলল,’কুলে নাও।’

আরহাম অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।পরক্ষণেই আবার একটানে তাকে কোলে নিয়ে বলল,’বাবারে! তোর যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ।প্রথমে আমার কোলেই আসতো না,এখন আর কোল থেকে নামে না।যাও না,মায়ের কোলে যাও।দেখো,মা পাঁচ ঘন্টা ধরে ম’রার মতো ঘুমিয়েছে।মা কোলে নিবে যাও।’

আরশাদ সে কথায় কর্ণপাত করলো না।উল্টো আলতো করে মাথাটা আরহামের কাঁধে রেখে চোখ বুজলো।এই শক্ত পোক্ত লোকটার প্রশস্ত বক্ষে আরশাদ খুব আরাম পায়।মা তো আরশাদকে এতো শক্ত করে চেপে ধরে না।মায়ের কোলে এতো মজা করে থাকা যায় না।আরশাদের তো বাবার কোলই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।

নবনীতা ঝাপসা চোখে বিশালাকার বাড়িটা চোখ ভরে দেখে।এই বাড়িটা তার,এই বাড়িটা শুভ্রার,এই বাড়িটা চিত্রার,এই বাড়িটা তাদের সবার।এই বাড়ির আনাচে কানাচে তার শৈশব আর কৈশোর জড়িয়ে আছে।এই পুরো বাড়িটা তার।

আবেগ অনুভূতির ঝড়ে তোলপাড় হতে হতে নবনী সামনের দিকে পা বাড়ায়।দরজার ঝুলানো তালাটা চাবি ঘুরিয়ে খুলতেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে কপাট দু’টো নিজ থেকেই দুই পাশে সরে গেল।নবনীতা শ্বাস বন্ধ করে দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।তার পা একটু একটু কাঁপছে।চোখ এতো বেশি ঝাপসা যে সে সামনেও দেখতে পারছে না ভালো মতো।নবনীতা ভঙ্গুর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।সে পড়বে না,হোঁচটও খাবে না।এই বাড়ির প্রতিটা বিন্দু তার চেনা।সে চাইলে চোখ বন্ধ করেও এখানে হাঁটতে পারবে।

সে চোখ মেলে চারদিক দেখে।তারা এলোমেলো দৃষ্টিতে অজস্র স্মৃতি পালাক্রমে ধরা পড়ে।তার মনে হলো এই বাড়িটা নিরব না,এখানে অনেক অনেক মানুষ গলা ছেড়ে কথা বলছে।নবনীতা সেই কথার শব্দ,সেই হাসির ঝংকার সবটা শুনতে পারছে।ঐ যে বসার ঘরের টিপয়,বাবা বসে বসে চা খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে।ঐ তো রান্নাঘরের দরজা দেখা যাচ্ছে।মা সেখান থেকে বের হয়ে গলা ছেড়ে ডাকছে,’পরী!এ্যাই পরী! নাস্তা খেতে আসো।কলেজের সময় হচ্ছে।আর কতো ঘুমুবে?’

তার আওয়াজে দোতলার পূর্ব দিকের ঘরে থাকা মেয়েটা ভীষণ বিরক্ত।মা সাতটা বাজতেই এমন শুরু করে কেন?তার কলেজ তো দশটায়।সে তিতিবিরক্ত মেজাজে শখের ঘুম ভেঙে খাট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো।গলা উঁচু করে চেঁচালো,’মা! মাত্র সাতটা বাজে।সব সময় এমন করো কেন?’

অমনি মা মেয়ের ঝগড়া বেঁধে যেত।বাবা হাত তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলতো,’আহা! হয়েছে তো।এসো পরী।বাবা খাইয়ে দিবো তোমাকে।’

ব্যাস।ওমনি তার মন ভালো হয়ে যেত।সব বিরক্তি একপাশে সরিয়ে সে ছুটে যেত বাবার কাছে।গিয়েই বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলল,’আচ্ছা,তাহলে তুমি খাইয়ে দাও।’

নিজের পরিবর্তনে নিজেরই হাসি পায় তার।কতো আহ্লাদী স্বভাবের মেয়ে ছিলো সে।ঐ কি যেন বলে?ওহ হ্যাঁ,বাবার রাজকন্যা।কতো অল্পতেই অভিমান করতো সে! তারপর কি থেকে কি হলো,নবনীতার জীবনের সমস্ত আনন্দ ধূলোয় মিশে গেল।নবনীতা নিজেও নিষ্প্রাণ,ছন্নছাড়া আর দিশাহীন মানবীতে রূপ নিলো।জীবন তাকে ছয় বছর যেই নরকে রেখেছিল,সেই নরকের কথা ভাবলেই নবনীতার বুক ভার হয়ে আসে।

সে এলোমেলো পায়ে সামনে হেঁটে যায়।বাড়ির মানুষের কথার শব্দ,হাসির ঝংকার সবকিছু তার কর্ণকুহরে এসে বারি খায়।সে জানে তারা কেউ নেই,তবুও তাদের অস্তিত্ব,তাদের উপস্থিতি সে টের পায়।এই তো বাবা এখানে,ঐ তো মা দাঁড়িয়ে আছে টেবিল ঘেঁষে।নবনীতা তো সত্যি সত্যি এদের দেখতে পায়।

সে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে গেল।ঘরের দরজা আগে থেকেই খোলা ছিলো।নিশ্চয়ই তারা আসার আগেই আরহাম সবকিছু লোক দিয়ে পরিষ্কার করিয়েছে।

নবনীতা মনোযোগ দিয়ে তার ঘরটা দেখল।অনেক আসবাবপত্রে পরিবর্তন এসেছে।তবে খাট টা আগের মতোই আছে।খাটের পাশের ঐ ইজিচেয়ার টাও অবিকল আগের মতোই আছে।সে ভঙ্গুর পায়ে হেঁটে ইজিচেয়ার পর্যন্ত গেল।আজকের দিনটা তার জীবনের অন্যতম সেরা দিন হওয়ার কথা।অথচ বাড়িতে পা রাখার পর তার মনে হলো এদিকে তার না আসাটাই ভালো ছিলো।এখানে সে যতোক্ষণ থাকবে,ততক্ষণ বাবা মায়ের স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাবে।নবনীতা ক্লান্ত,ভীষণ ভীষণ ক্লান্ত।

হঠাৎ পায়ের কাছে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই নবনীতা নড়ে উঠলো সামান্য।চোখ নামিয়ে দেখল আরহাম দুই হাঁটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসেছে।সে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো।ব্যস্ত হয়ে বলল,’আরে কি করছেন কি?ফ্লোরে বসেছেন কেন?আসুন চেয়ারে বসুন।’

আরহাম জবাব দিলো না।কেবল তার একটা হাত টেনে পুনরায় তাকে ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিলো।ঠান্ডা গলায় বলল,’বসো।বেশি কথা বলো না।’

নবনীতা বসলো।তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আরহামের দিকে নিবদ্ধ।আরহাম আস্তে করে দেয়ালের সাথে পিঠ হেলান দিয়ে বলল,’তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ল।
‘মন খারাপ হয় নি।তবে বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।’

‘ঐ এক ই কথা।মন খারাপই হচ্ছে।’

নবনীতা চোখ বুজে বলল,’বাবা আমায় ভীষণ আদর করতো।’

‘জানি।’

‘বাবার মতো করে আমায় কেউ ভালোবাসে নি।মাও না।’

আরহাম নিশ্চুপ।তার নিরবতা অনুভব করতেই নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তার মুখোভঙ্গি দেখে নিল।সে শান্ত,একেবারে থমকে যাওয়া নদীর মতো শান্ত।নবনীতা পুনরায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ঠিক তার মুখোমুখি হাঁটু মুড়ে বসলো।আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই বলল,’ফ্লোর ঠান্ডা।খাটে গিয়ে বসো।’

নবনীতা সেই কথা শুনল না।উল্টো এক হাত বাড়িয়ে আরহামের গালে আলতো করে স্পর্শ করে জড়ানো কন্ঠে বলল,’আমাকে আপনার মতো করেও কেউ ভালোবাসেনি।আপনি আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র পুরুষ।এর আগে নবনীতা কাউকে ভালোবাসেনি,এরপরেও বাসবে না।’

আরহাম জবাবে কেবল স্মিত হাসল।নবনীতা তার মাথা আরহামের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,’এমন চুপ হয়ে আছেন কেন?কিছু বলুন।’

আরহাম হালকা করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’তুমি যতোই বলো,আমি জানি আমি তোমাকে তোমার বাবার মতো ভালোবাসতে পারিনি।কিন্তু তুমি আমাকে যতখানি ভালোবেসেছো,অতোখানি ভালো কেউ আমাকে বাসেনি।আই অ্যাম লাকি।’

নবনীতা জেদি গলায় বলল,’আমিও লাকি।’

নবনীতা সেই রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা তার বরের সাথে গল্প করল।তার শৈশবের গল্প,তার কৈশোরের গল্প,তার স্কুল জীবনের গল্প,কলেজ জীবনের গল্প-এক কথায় সব।আরহাম হঠাৎই কথার মাঝে বলল,’তোমার কলেজ জীবনে কোনো প্রেমিক টেমিক ছিলো না?’

নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’মানে?’

‘মানে ঐ ইফাজ আর মেজরের মতো আরকি।এক দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছে এমন।’

নবনীতা শব্দ করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই বলল,’জানি না।এতোকিছু কখনো খেয়াল করি নি।’

‘খেয়াল করলে দেখতা সবাই তোমাকে পছন্দ করে,চোখ ঘুরিয়ে শুধু তোমাকেই দেখে।ধুর,ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আমার।কতো পরে আমাদের দেখা হলো।এর আগে সবাই তোমাকে দেখে নিয়েছে।’

নবনীতা আরেক দফা হাসল।আরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লাজুক হয়ে বলল,’জ্বী না জনাব।আপনি যতখানি দেখেছেন,অতোখানি আমায় আর কেউ দেখেনি।’

বলেই সে আরহামের বুকে মুখ লুকালো।আরহাম হঠাৎই লাফিয়ে উঠে বসল।একনজর নবনীতার মিইয়ে যাওয়া মুখটা দেখেই বলল,’আমার একটা কথা মনে পড়েছে পরী।’

নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কি?’

আরহাম গমগমে স্বরে বলল,’শ্বশুরবাড়িতে এখন পর্যন্ত আমাদের বাসর হয় নি।’

নবনীতা বিষম খেল।ফ্যালফ্যাল চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,’কি?কি হয় নি?’

আরহাম জানে উত্তরটা সে ভালো মতোই শুনেছে।এক কথার দুইবার উত্তর দেওয়া তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।সে উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।সামান্য ঝুকে একটানে নবনীতাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল।নবনীতা ছটফটিয়ে উঠে বলল,’আরে আরে।কি করছেন কি?’

আরহাম তাকে খাটে নামাতেই সে এক লাফে খাটের কোণায় গিয়ে বসল।চোখ গরম করে বলল,’আরশাদ এখনো ঘুমায়নি।শুভি একটু পরেই তাকে এখানে নিয়ে আসবে।’

আরহাম একটানে তাকে নিজের কাছে আনলো।তার গলার ভাঁজে মুখ গুজে বলল,’আসুক।আরশাদ আজকে শুভি খালামণির সাথে ঘুমাবে।’

নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’উফফ না।শুভি ওকে রাখতে পারবে না।শুভি নিজেই,,

সে কথা শেষ না করতেই আরহাম তার পেটে দুই আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো।নবনীতা লাফিয়ে উঠে বলল,’এই না না প্লিজ।’

হাসতে হাসতে তার চোখ ভরে উঠল।সে হাসির দমকে কাঁপতে কাঁপতে দুই হাত জোড় করে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।আর কিছু বলব না।আমি রাজি।ছাড়ুন এবার।আল্লাহ রে! মরে যাবো আরহাম হাসতে হাসতে।প্লিজ ছাড়েন।’
.
.
.
.
আদি মাথা তুলে তারা ভর্তি আকাশটা দেখেই বিমুগ্ধ হয়ে বলল,’কি চমৎকার আজকের আকাশ! আসলে এই বাড়িটাই চমৎকার।আই জাস্ট লাভড ইট।’

বলেই সে মাথা নামিয়ে পাশে দেখল।তাসনুভা হুইলচেয়ারে বসে আছে,খুবই বিষন্ন মুখে।আদি কয়েকদিন যাবত লক্ষ্য করছে তার মন খারাপ।কোনো কিছু নিয়ে সে ভীষণ এলোমেলো।অথচ জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যায়।

আদি হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসল।চঞ্চল গলায় বলল,’তোমার কি হয়েছে বলবে?’

তাসনুভা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল।মিনমিনে গলায় বলল,’কিছু না।’

আদি অধৈর্য হয়ে বলল,’প্লিজ বলো না।আমার অনেক জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।তোমার মন খারাপ কেন বলো না।তুমি তো এমন মেয়ে নও।তাহলে সারাক্ষণ এমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো কেন?’

তাসনুভা হালকা করে জবাব দেয়,’জানি না আমি।’

আদি রাগ হলো খানিকটা।অভিমান করে বলল,’আচ্ছা থাক বলতে হবে না।ভালো থাকো তুমি।আমি গেলাম।’

বলেই সে হনহন করে ছাদের দরজার দিকে হাঁটা ধরল।

তাসনুভা হকচকিয়ে গেল খানিকটা।পরমুহূর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিল।আদি যখন একেবারে ছাদ থেকে বেরিয়ে যাবে বলে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে,ঠিক তখনই সে পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল,’আমি একজন কে ভালোবাসি।’

আদির কদম থমকালো।মনে হলো পুরো শরীর মিনিটের জন্য জমে গেছে।সে পেছন ফিরে চূড়ান্ত রকমের বিস্ময় নিয়ে তাসনুভার কাছে এগিয়ে গেল।ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি?তুমি কাউকে ভালোবাসো?’

তাসনুভা স্পষ্ট করে বলল,’হ্যাঁ,বাসি।’

আদি ভ্র উঁচু করে বলল,’তুমি এইটুকু মেয়ে ভালোবাসা বোঝো?’

‘হ্যাঁ।বুঝি।’

‘কচু বোঝো।’ গজরাতে গজরাতে উত্তর দিলো আদি।

তাসনুভা তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,’আমি তাকে ভালোবাসি,অথচ এই কথাটা আমি লজ্জায় তার সামনে বলতে পারছি না।আমার ভালো লাগছে না কিছু।আমি কিভাবে তাকে সব বুঝিয়ে বলবো?আমার তাকে ঐসব কথা বলতে ভীষণ আনইজি লাগে।’

আদি চোখ গোল গোল করে তার কথা শুনল।সে থামতেই একেবারে ঠান্ডা গলায় বলল,’তুমি সত্যিই কাউকে ভালোবাসো?’

তাসনুভা মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ বাসি।কিন্তু কিভাবে তাকে জানাবো,সেটা বুঝতে পারছি না।’

আদি ধপ করে ফ্লোরে গিয়ে বসল।তাসনুভা কাউকে পছন্দ করে,এই কথা হজম করতে তার কষ্ট হচ্ছে।মেয়েটাকে সে যথেষ্ট স্নেহ করে।অথচ তার মুখে এই কথা শুনে তার রাগ হচ্ছে।এইটুকু মেয়ে কাউকে পছন্দ করে মানে?এইটুকু বাচ্চা মেয়ের আবার কিসের পছন্দ?আদির মন চাইছে তাকে একটা জোরেশোরে ধমক দিতে।কিন্তু সে এমন কিছুই করল না।কেবল মাথাটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে গাঢ় গলায় বলল,’তুমি তাহলে এক কাজ করো।তুমি এতো কথা না বলে তাকে ফুল দিয়ে দাও।সে যদি বুদ্ধিমান হয়,তবে ফুল দেখেই সবটা বুঝে যাবে।’

বলেই সে আর অপেক্ষা করল না।দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল।সে টের পেল আচমকাই তার মন খারাপ হয়ে গেছে।কিন্তু কেন হয়েছে সেটাও সে জানে না।কি অদ্ভুত! সি অদ্ভুত!

সে চলে যেতেই তাসনুভা এক গাল হাসল।আকাশ দেখতে দেখতে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।ফুলই দিবো তাকে।’

***

আদি তার জন্য নির্ধারিত ঘরে এসেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ল।এগুলো কেমন ধরনের কথা বার্তা?এইটুকু মেয়ে প্রেম করে?আদি তো তাকে কখনো কারো সাথে অতিরিক্ত কথাও বলতে দেখেনি।এমনকি সে মোবাইলও ঘাটে না তেমন একটা।সারাক্ষণ তো তাদের সাথেই থাকে।তাহলে তার এই ভালোবাসাটা হলো কখন?

তার মন খারাপ হলো ভীষণ।সে নিজেও জানে না তার কেন এতো খারাপ লাগছে।শুধু একটুক জানে তাসনুভা নামের মিষ্টি মেয়েটার উপর তার খুব বেশি রাগ হচ্ছে।রাগে তাকে দু’টো চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছে।কিন্তু এসবের কিছুই সে করতে পারবে না।সে বরাবরই ভীষণ শান্তিপ্রিয় স্বভাবের মানুষ।অকারণে পরিস্থিতি খারাপ করা তার চরিত্রের সাথে যায় না।

আচমকা দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।আদি বিগড়ে যাওয়া মেজাজে বলল,’কে আবার?’

অন্যপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না।একেবারে বিক্ষিপ্ত,চূড়ান্ত রকমের বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে আদি দরজা খুলল।দরজা খুলতেই দেখলো দরজার অন্য পাশে তাসনুভা।আদি তাকে দেখতেই তব্দা খেল।সে আরো বেশি আশ্চর্য হলো যখন দেখল তাসনুভার হাতে একটি লাল গোলাপ।গোলাপটা তেমন তাজা না।দেখে মনে হচ্ছে আর একটু সময় দেরি হলেই গাছ থেকে ঝরে পড়তো।

সে দরজা খুলতেই তাসনুভা নত মস্তকে আন্দাজে তার দিকে ফুলটা বাড়িয়ে দিলো।একেবারে নিচু হয়ে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে কোনোরকমে বলল,’নাও এটা তোমার জন্য।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭১

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭১)

চায়ের কাপটা অনেকক্ষণ ধরে সেভাবেই পড়ে আছে।বিষয়টা চোখে পড়তেই সানাউল হক বললেন,’আরে কি হলো?চা টা নাও না।ঠান্ডা হচ্ছে তো।’

আরহাম একবার কাপটার দিকে দেখে।তারপর হাত কচলে বলল,’না আঙ্কেল।আজ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’

সানাউল আর তাকে জোর করলেন না।নিজের কাপটায় একটা চুমুক বসিয়ে বললেন,’তো এবার খুলে বলো সেদিন কি হয়েছিল?’

সোফার একটা কুশন কোলের উপর রেখে আরহাম ঠান্ডা গলায় বলল,’সেদিন গাড়িতে আমিও ছিলাম।কিন্তু এক্সিডেন্টের সময় গাড়িতে ছয় জন না,সাতজন ছিলো।আমরা কাশিমপুরে যাওয়ার পথে একজন হাবিলদারের দেখা পাই।তার গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে সেও আমাদের গাড়িতে চড়ে বসল।এর মাঝে রাস্তায় একবার গাড়ি থামানো হয়েছিল।গাড়ির নাকি কিসব রিপেয়ারিং করানো লাগতো।তখন সেসব বুঝি নি।তবে যখন আমাদের ড্রাইভার কিছুতেই আর ব্রেক কষতে পারছিলো না,তখন বুঝলাম গাড়িটা ব্রেকফেল হয়ে গেছে।আর ঐ মেকানিক নিশ্চিত শফিকদের পাঠানো লোকই ছিল।আমি গাড়ির সবাইকে বললাম,’আপনারা গাড়ি থেকে ঝাপ দিন।বসে থাকলে নির্ঘাত মারা যাবেন।’
অথচ কেউ সেই সাহস দেখালো না।একমাত্র জিতেন্দ্র নামের একজন সাব ইন্সপেক্টর বলল,’জ্বী স্যার।আমি রাজি আছি ঝাপ দিতে।’
গাড়িটা যখন পথ হারিয়ে একটা বিশালাকার গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার জোগাড়,ঠিক তখনই আমি আর জিতেন্দ্র কোনো কিছু না দেখে গাড়ি থেকে ঝাপ দিলাম।’

‘আর তোমার হাত?হ্যান্ডকাফ পরেই ঝাপ দিয়েছিলে?’

‘নাহ।গাড়ি ব্রেকফেল হওয়ার পর জিতেন্দ্র নিজেই আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়েছিল।আমি যে নির্দোষ এটা অনেকেই জানতো।অমন কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্বের তুলনায় অনুভূতিদেরই বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিল তারা।’

সানাউল হক সামান্য ঝুঁকে গম্ভীর গলায় বললেন,’জিতেন্দ্র বাঁচে নি?’

আরহাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,’নাহ।’

‘জঙ্গলে যেই লাশ পাওয়া গিয়েছিলো,ঐটা তার ছিল?’

‘হুম।আমি পড়ে যাওয়ার পরেই একটা গাছের ডাল চেপে ধরেছিলাম।জিতেন্দ্র ছিটকে একেবারে নিচে গিয়ে পড়ল।আমার ধারণা সেখানেই তার মৃ’ত্যু হয়েছে।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সানাউল হক।চায়ের কাপে আরো একটা চুমুক বসিয়ে বললেন,’তারপর তুমি এতো গুলো দিন প্রভাতির ওখানেই ছিলে?’

‘হুম।প্রভার সাথে থেকেই সব প্ল্যান করেছি।আমি জানতাম প্রভার উপর কেউ নজর রাখবে না।সুতরাং তার বাড়ির মতো সেফ আর কোনো জায়গাই হতে পারে না।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,যতোক্ষণ না সবকিছু সত্যি প্রমাণ হচ্ছে,আমি ওখানেই থাকবো।প্রভাকে আপনার এড্রেসও আমিই দিয়েছিলাম।’

‘সেটা অবশ্য আমি বুঝেছি।মেয়েটা যখন আমার কাছে এসে বলল তুমি বেঁচে আছো,আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না।যাক,জেনে খুব খুশি হলাম,এখন দেখা করে আরো ভালো লাগছে।তোমার ওয়াইফ ভীষণ ভেঙে পড়েছিল এই কয়দিন!’

আরহাম মাথা নামিয়ে অল্প হাসল।গাঢ় গলায় বলল,’পরী এমনই।ভীষণ টেনশন করে সবকিছু নিয়ে।’

‘এখন কেমন আছে নবনীতা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।ভালো আছে আঙ্কেল।’

সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।সানাউল হক কিছু একটা মনে পড়তেই বললেন,’খবর শুনেছো?সেদিন নাকি ডিস্ট্রিক্ট ক্লাবে জালাল আর শফিকের কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল।পরে একজন অন্যজনকে ছু’রি মে’রে খু’ন করেছে।কি বিভৎস দৃশ্য! লা’শ গুলো যদি একবার দেখতে!’

আরহাম তার কথা শুনেই অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে গেল।মুখের হাসি বিলীন হলো সহসা।একটু কেশে নিয়ে তারপর সে ঠান্ডা গলায় বলল,’এসবে আমি আর মাথা ঘামাই না।রাজনীতি আর রাজনীতির সাথে যুক্ত বিষয়াদি এখন আর আমাকে টানে না।’

সানাউল হক ভাবুক হয়ে বললেন,’সত্যি সত্যি রাজনীতি ছেড়ে দিচ্ছো?’

‘হুম।’

‘তুমি তো নির্দোষ প্রমাণ হয়েছো।তুমি চাইলে এখনো ক্ষমতায় থাকতে পারো।’

আরহাম কিছুটা ক্লান্ত হয়ে বলল,’থেকে লাভ কি?এই সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে চলতে গেলে আমাকে ঐসব নোংরামি ডাইজেস্ট করেই চলতে হবে।’

‘এতোদিন তো সেভাবেই ছিলে।’

‘সেভাবে থেকেই টের পেয়েছি এই সিস্টেম টা কতো বাজে।এখানে আমার স্বকীয়তা বলতে কিছু নেই।দলের মেজরিটি যা বলে,তাই হবে।আমার মতামতের ধার কেউ ধারবে না।এই রাজনীতি করা মানে তাদের সমস্ত অন্যায়ে মৌন সম্মতি দিয়ে তাদের পাশে থাকা।যেটা আর আমার পক্ষে সম্ভব না।না আমি এসব ডাইজেস্ট করতে পারছি,আর না আমি এদের বিরোধিতা করার মতো সাহসী হতে পারছি।আই অ্যাম অ্যাফরেইড অব লুজিং মাই পিপল।আমি কোনো শেকড়হীন মানুষ না যে আমি বুক ভরা সাহস নিয়ে পুরো সিস্টেমের বিরোধিতা করব।আই হ্যাভ রুটস।আমার শেকড় আছে,আমার একটা পরিবার আছে।আমি আমার কারণে তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।তারা আমার কাছে খুব মূল্যবান।আমি তাদের নিয়ে খুব বেশি প্রোটেক্টিভ।আমি এদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে পারব না।’

সানাউল হক গম্ভীর হয়ে বললেন,’কিন্তু তুমি যদি সাহস করে সিস্টেমের বিরোধিতা করো,তবে মানুষ তোমায় ভীষণ ভালোবাসা দিবে।’

আরহাম হাসল।একেবারে তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘রিয়েলি?মানুষ ভালোবাসা দিয়ে আমার জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?একটা কথা বলি আঙ্কেল?কিছু মনে করবেন না।আমার মনে হয় বাঙালিদের মতো আবেগী আর ভুলোমনা জাতি পুরো পৃথিবীতে আর দু’টো নেই।আপনি খেয়াল করে দেখেন নিলয়ের মৃ’ত্যুর পর মানুষ প্রথম এক সপ্তাহ কি পরিমান প্রোটেস্ট করল।কি না হলো দেশে!এরপর?এরপর সব এমনভাবে শান্ত হলো যেন নিলয় নামের কেউ এই দুনিয়ায় এক্সিস্টই করতো না।বাঙালি এমনই।এরা মাথায় তুলতেও সময় নেয় না,আবার মাথা থেকে নামিয়ে আছাড় দিতেও সময় নেয় না।আপনি মানুষকে খুশি করার জন্য কখনো কিছু করবেন না।যেটা আপনার ভালো লাগে,যেটা করলে আপনি খুশি থাকবেন সেটাই করবেন।দিনশেষে আপনার খুশি থাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।মানুষকে খুশি করা দিয়ে কিছু যায় না।নিজে খুশি থাকলেই হলো।আমি অন্তত এমনটাই ভাবি।আমি যা করেছি,নিজের আত্মতুষ্টির জন্য করেছি।মানুষের কাছে হিরো হওয়ার জন্য করিনি।আরহাম নিজের চোখেই হিরো হতে বেশি ভালোবাসে।আমার গল্পে আমিই মহানায়ক।’
.
.
.
.
পদত্যাগ পত্রটি হাতে নিয়েই আরহাম বিষন্ন হাসল।চোখ বন্ধ করলেই অসংখ্য দৃশ্য মনসপটে ভেসে উঠে।ফাহাদের সাথে তার রেষারেষি,দু’জনের দ্বন্দ্ব,এই একটা আসনের ক্ষমতা লাভের জন্য কতো কতো ছলনা,কতো কতো ষড়যন্ত্র! আর সবকিছুর পরিশেষে এই পদত্যাগ পত্র।

শাহরিয়ার আরহাম,রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায় বছর পাঁচেকের মতো সক্রিয় থাকার পর আচমকাই সিদ্ধান্ত নিলো সে পদত্যাগ করবে।জনগণ তাকে ভীষণ চায়,দল থেকেও সেরকম ভাবে কোনো চাপ তাকে দেওয়া হয়নি।সবই স্বাভাবিক।তবুও আরহাম সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পদত্যাগ করবে।নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময়ে সে অনুধাবন করেছে এই দেশে রাজনীতি করা আর জীবন নিয়ে জুয়া খেলার ভেতর কোনো ফারাক নেই।আরহাম অতোটা দুঃসাহসী না।জীবন নিয়ে অন্তত সে দুঃসাহস দেখায় না।

সে সাক্ষর করার পর পদত্যাগ পত্রটি যাবে স্পিকারের কাছে।স্পিকার যদি সেটা গ্রহণ করে,তবে সংসদে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে তাকে সংসদ সদস্যের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

আরহাম ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসল।একটি সই,তারপর চিরতরে আরহাম রাজনীতির অঙ্গন থেকে ছিটকে যাবে।আর কখনো ভিআইপি ট্রানজিট ব্যবহার করা হবে না।আর কিছু না হোক,এটা নিয়ে তার ভীষণ দুঃখ হবে।কতো মজা লাগতো যখন সব গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার গাড়িটা সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যেত।এখন তো আবার সেই বিজয় স্মরণির সিগনালে বসে ম’রতে হবে।

নিজের চিন্তায় নিজেরই হাসি পেল তার।নিজেকে ভীষণ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে সে।অথচ ভেতর থেকে তার অসহ্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।সে বাবার পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছিল।সেটা সম্ভব হয়নি।তার পুরো পেশা পাল্টে যাচ্ছে।এই পার্টি অফিস,এই জনগন,এই অল্পবয়স্ক ছেলেদের দল আর তাকে ঘিরে ধরবে না,আর কখনোই আরহাম সমাবেশ করবে না,অনেক গুলো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিবে না।জীবন কতো বিচিত্র!কতো অদ্ভুত! আরহামের গলার কাছে কেমন দলা পাকায় সবকিছু।কাঁপা হাতে কলমটা তুলে নেয় সে।

এই দেশ কি কখনো সুস্থ রাজনীতির মুখ দেখতে পারবে?এই খেটে খাওয়া মানুষরা কি কোনোদিন ইনসাফের দেখা পাবে?রাজনীতির ভয়াল থাবায় যাদের প্রাণ উজাড় হয়েছে,তারা কি আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে?আলোচিত সেই সাগর-রুনি হত্যার এগারো বছর শেষেও কি কোনো বিচার হয়েছে?এই যে পৃথিবী থেকে প্রায় বারোটা বছর চলে যাচ্ছে,অথচ মেঘ কি তার চোখের সামনে তার মা বাবার খু’নীদের বিচারকার্য দেখতে পেরেছে?যেই দেশে একশোবারের মতো রায় ঘোষণার দিন পেছানো হয়,সেই দেশে কি আদৌ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? যেই দেশে তনুরা ধ’র্ষণ হওয়ার পরেও সেটা স্বাভাবিক মৃ’ত্যুর কাতারে ফেলে দেওয়া হয়,সে দেশে কি বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা সম্ভব?তনু,ত্বকী,আবরার ফাহাদ,এমন অগণিত আত্মার আর্তচিৎকার মিশে থাকা রাষ্ট্রে সুদিন ফেরানো সম্ভব কি?বছরের পর বছর পচতে থাকা সিস্টেমে সুবাস ছড়ানো কি বত্রিশ বছরের এই যুবকের পক্ষে সম্ভব?নাকি এই পচে যাওয়া সিস্টেমে থাকলে সে নিজেই একসময় কলুষিত হবে।

আরহাম জানে এই দেশে আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব না।বেশ জানা আছে তার।এই স্বল্প দিনের রাজনৈতিক জীবনে অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছে সে।এই দেশে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে মামলা করাই কঠিন ব্যাপার,বিচার হওয়া তো পরের বিষয়।রাজনীতির যা কিছু আরহাম দেখেছে,যতোটা বুঝেছে,তা থেকে উপলব্ধি করেছে এখানে খুব বেশি ভালো নেতা হওয়ার শর্ত খুব বেশি নির্দয় হওয়া।এসব সস্তা মায়া ভেতরে নিয়ে ভালো নেতা হওয়া যায় না।বিশেষ করে আরহামের মতো পরিবার কেন্দ্রিক লোকজনের তো নেতা হওয়ার যোগ্যতাই নেই।আরহাম চাইলেই ক্ষমতা হাতে রেখে সেটার স্বদব্যবহার করতে পারে না।সে সরকারের হাতের পুতুল মাত্র।এমনভাবে পুতুল হয়ে থাকার চেয়ে এই লুপ হোল থেকে মুক্তি পাওয়াটাই বেশি আনন্দের।

কিন্তু তবুও এতো ভাবনা চিন্তার পরেও সই করার সময় আপনাআপনি তার হাত কেঁপে উঠল।সে ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল।তারপর মনস্থির করে একদম স্বাভাবিক ভাবে কাগজে সই করল।সই করার পরেই সে তোফায়েল কে দেখে মলিন হাসল।আক্ষেপ করে বলল,’তোফায়েল! আমি আর কোনোদিন পার্টি অফিসে বসবো না।এই তোদের কে আমি খুব মিস করব।সপ্তাহে একবার বাড়ি আসবি সময় করে।তোরা বাড়ি এলে আমি মিছেমিছি ভন্ড নেতা সাজবো।নেতা হওয়া আমার খুব বড়ো শখ।’

তোফায়েল একদম শান্ত হয়ে তার কথা শুনল।সে থামার পরেও নিজ থেকে কোনো জবাব দিলো না।তার সমস্ত মনোযোগ ভাইয়ের চোখের দিকে।যেই চোখ একটু পর পর নোনা জলে চিকচিক করছে।ভাই প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার।কিন্তু অবাধ্য অনুভূতিরা কিছুতেই নিষেধ মানছে না।আরহাম দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।এক প্রকার ছুটতে ছুটতে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।এখানে আর এক মুহূর্তও না।

বাড়িতে গিয়েই সে তার ঘরে এসে ধপ করে নবনীতার কোলে মাথা রাখল।নবনীতা মাত্রই আরশাদ কে ঘুম পাড়িয়েছে।আরহাম মাথা রাখতেই সে হকচকিয়ে গেল।অবাক হয়ে বলল,’কি ব্যাপার?আপনি হঠাৎ বাড়ি এসেই সাথে সাথে শুয়ে পড়লেন! হাত মুখ ধুবেন না?’

আরহাম সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো না।কেবল মুখটা আরো বেশি তার শাড়ির কুচির ভাঁজে চেপে ধরে ধরা গলায় বলল,’রেজিগনেশন লেটারে সাইন করে দিয়েছি পরী।’

বলেই কেমন অদ্ভুত ভাবে শ্বাস ফেলল।নবনীতা নরম হাতে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আপনার খুব খারাপ লাগছে তাই না?’

‘উমম,এতো বেশি না।ঐ আরকি।অনেকদিনের স্মৃতি।’

নবনীতা বলল,’শরীর খারাপ করছে নাকি?হাত পা টিপে দিবো?’

আরহাম হাসল।শক্ত করে তার একটা হাত চেপে ধরে বলল,’জ্বী না।তার কোনো প্রয়োজন নেই।তুমি চুপচাপ আমার পাশে বসে থাকো।তাতেই হবে।’

সে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ তার এলোমেলো চুলে হাত ছোঁয়ায়।আরহাম অন্যমনস্ক হয়ে গুনে কতো গুলো দিন,কতো গুলো সময় সে শেষ করেছে রাজনীতির পেছনে।
.
.
.
.
তাসনুভার ইদানিং কেমন অসহ্য অনুভূতি হচ্ছে।সে জানে না কেন এসব হচ্ছে।এসবের প্রতিকার কি সেটাও সে জানে না।শুধু এইটুক জানে যা কিছু হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক না।

আদি তাকে ভীষণ স্নেহ করে।এই জীবনে বাড়ির মানুষের পর তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে আদি।সেই হিসেবে আদির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা কিংবা ভালোবাসা থাকতেই পারে।এতে মন্দ কিছু নেই।কিন্তু তাসনুভা হঠাৎই টের পাচ্ছে,এই ভালো লাগা সম্পূর্ণ আলাদা।যেই ভালোবাসার কথা তাসনুভা বড় ভাইয়ার সামনে মুখেও আনতে পারবে না,আদিকে সে তেমন করেই ভালোবাসে।

এক বিকেলে ইজমা তার কাছে এলো।তার গাল টেনে বলল,’কি ব্যাপার?তুমি এতো মন মরা কেন?’

তাসনুভা মলিন মুখে বলল,’তেমন কিছু না।এভাবেই।’

‘আহা বলো না।কয়েকদিন ধরে দেখছি তুমি কেমন উদাসীন।সবসময় কি যেন ভাবো,মন খারাপ করে থাকো।কি হয়েছে বলো না।’

তাসনুভা একটু দম নিলো।ধিমি গলায় বলল,’আমার খুব বাজে একটা সমস্যা হচ্ছে আপু।আমি খুব লজ্জিত,একই সাথে কনফিউজড।’

ইজমা বোধ হয় বুঝলো কিছুটা।সে কথা শেষ করতেই মোলায়েল গলায় বলল,’আপুকে বলতে পারো কি সমস্যা।যদি কোনো আপত্তি না থাকে তোমার।’

তাসনুভা দুইহাত মুখে চেপে বলল,’বিষয় টা আপত্তির না আপু।বিষয়টা লজ্জার।’

ইজমা কিছুক্ষণ ভাবলো।তারপর আদুরে গলায় বলল,’আচ্ছা যাও।তোমায় মুখে বলতে হবে না।আমি নবনীতার ঘর থেকে একটু ঘুরে আসি।তুমি একটা কাগজে তোমার মনের অবস্থা সব লিখে দাও।যাওয়ার সময় তোমার লিখাটা আমি সাথে করে নিয়ে যাবো।পরে বাসায় গিয়ে পড়ব কেমন?’

এই প্রস্তাব তাসনুভার পছন্দ হলো।সে সাথে সাথেই খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ।এটা দারুণ হবে।প্লিজ তুমি এখন বাইরে যাও।’

বলেই সে ইজমাকে দরজার দিকে ঠেলে দিলো।ইজমা অবাক হয়ে বলল,’আরে আরে দাঁড়াও।যাচ্ছি তো।এমন করে কেউ বের করে দেয়?আদি ঠিকই বলে,তুমি একটা বাচ্চা।’

তাসনুভা চেঁচায়,’আপু প্লিজ যাও তুমি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।আর টমেটোর মতো লাল হতে হবে না।’

তাসনুভা তবুও টমেটোর মতো লাল হলো।ইজমা চলে যেতেই সে দরজা ভিরিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে একটা কাগজ হাতে নিলো।তারপর খাট থেকে একটা বালিশ কোলে নিয়ে তার উপর কাগজটা রেখে লিখতে শুরু করলো।

কি লিখা যায়?কি সম্বোধন দেওয়া যায়?কিভাবে শুরু করতে পারে সে?
তাসনুভা কলম চালায়।প্রথমে কেমন খচখচ করছিল,কিন্তু একবার শুরু করার পর সে আর থামলো না।লিখে গেলো,তো লিখেই গেল।

***

সন্ধ্যায় পায়েসের বাটি হাতে তাসনুভার ঘরের সামনে এসেই আরহাম কপাল কুঁচকায়।দরজা লাগানো কেন?তাসনুভা তো কখনো দরজা বন্ধ করে না।সে এক হাতে দরজায় ধাক্কা দেয়,’তাস! এ্যাই তাস! দরজা খোল।’

দুইবার কোনো সাড়া না পেয়ে বিরক্ত হয়ে দরজার লক ঘোরাতেই আরহাম টের পেল দরজা খোলা,কেবল ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে।সে ভেতরে উঁকি দিলো।দেখল তাসনুভা হুইলচেয়ারেই বসে বসে ঘুমুচ্ছে।

মুখ দিয়ে চ-কারান্ত শব্দ করে আরহাম ঘরে ঢুকল।মেয়েটা এতো উদাসীন কেন?কাউকে ডাকলেই তো হতো।এভাবে হুইলচেয়ারে বসে ঝিমানুর কি দরকার?খাটে আরাম করে শুয়ে গেলেই তো হয়।

সে বিরক্তিতে সামনে এগিয়ে যায়।এগিয়ে যেতেই সবার প্রথমে তার চোখে পড়ে তাসনুভার কোলে একটা বালিশ,বালিশের উপর একটা কাগজ।কাগজের অনেকটা অংশ জুড়ে লিখা,বাকিটা এখনো লিখা হয় নি।এর আগেই সে ঘুমিয়ে গেছে।

আরহাম একটানে কাগজটা নিজের হাতে নেয়।প্রথমে সম্বোধন দেখেই বুঝে এটা একটা চিঠি।কিন্তু প্রাপক বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই তাসনুভা কেন তাকে চিঠি লিখছে সে জানে না।সে আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করল।সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা-

“ইজমা আপু,
তোমাকে কিভাবে সব বলব জানি না।বলার পর তুমি আমাকে কি ভাববা সেটাও জানি না।তবুও বলছি।আদি ভাইয়াকে আমি ভীষণ পছন্দ করি।এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই।তাকে সবাই পছন্দ করে।কিন্তু আমি একটু বেশিই পছন্দ করি।সে যদি তোমার সাথে একদিন দেখা না করে,তবে কি তোমার রাগ হয়?কিন্তু আমার হয়।আমার মন খারাপ হয় ভীষণ।সে একদিন আমার সাথে মিষ্টি করে কথা না বললে আমার কেমন অসহ্য লাগে সব।তার প্রতি আমি যা অনুভব করি,তা মুখে বলতেও আমার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে।কিন্তু সত্য এটাই যে আমি এমনটাই অনুভব করি।

আপু।সেদিন পার্কে যখন সে আমায় বলল ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ তখন অজানা আনন্দে আমার মন ভরে উঠেছিল।জানি সে আমায় স্নেহ করে কথাটা বলেছে।কিন্তু আমার মন তো এখন আর তার আর আমার ব্যাপারটা স্নেহ হিসেবে দেখে না।সে যখন ঐদিন আমায় বলল আমি মোটেও অক্ষম না,বরং আল্লাহ আমাকে ততটুকুই দিয়েছে যতোটুকু আমার প্রয়োজন,,এটা শুনেও আমার চোখ ছলছল করে উঠেছিল।আমাকে কখনো অমন করে কেউ কোনোদিন বোঝায় নাই।কেউ কখনো এমন করে আমাকে ভালোবাসে নি।হুইলচেয়ারে থাকাকে আমি সবসময়ই সমাজের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় হিসেবে দেখেছি।একমাত্র আদি ভাইয়াই এমন একজন যে আমার পরিবারের মানুষের মতো আমাকে একেবারে স্বাভাবিক আর পুর্নাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখে আসছে।তার সেই আদর স্নেহ পুরোটাই আমার হৃদয় জুড়ে আছে।তার মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হয়,’আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’

দয়া করে তুমি এই কথা কাউকে বলো না।প্লিজ আপু।ভীষণ ঝামেলা বেঁধে যাবে যদি এই কথা জানাজানি হয় তবে।বড় ভাইয়ার কানে যদি একবার এই কথা যায়! না না আমি আর ভাবতেই পারছি না।বড় ভাইয়া আমাকে জ্যান্ত ক’ব’র দিবে,নয়তো কে’টে টুকরো টুকরো করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিবে।অথবা রান্নাঘরের ব’টি এনে ডিরেক্ট জ’বা’ই করে দিবে।আমি তাকে চিনি।”

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭০

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭০)[প্রথম অংশ]
[প্রচন্ড ক্লান্তিতে লিখেছি।টাইপিং মিস্টেক হওয়ার চান্স খুব বেশি]

প্রাণপ্রিয় প্রিয়তম,
আকাশের ঠিকানায় এটা আমার একশতো আটাশ তম চিঠি।যেই চিঠি হয়তো কোনোদিনই তার প্রাপকের কাছে পৌঁছুবে না।তবুও আমি লিখি।রোজ রোজ লিখি।কারণ আমার আর মনের কথা ব্যক্ত করার মতো জায়গা নেই।এই কাগজের টুকরোই একমাত্র মাধ্যমে যেখানে আমি প্রাণ খুলে,মন উজাড় করে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি।এখনো আমি স্বপ্ন দেখি আপনি ফিরে আসবেন।কোনো এক অলৌকিক শক্তিবলে আপনি ফিরে আসবেন।আমাদের আমার দেখা হবে,তাও আবার এই ধরণীর বুকেই।আমার বিশ্বাস আপনি বেঁচে আছেন।আমার খুব কাছেই আছেন।যেই বাতাসে আমি শ্বাস নেই,ঐ বাতাসে আপনারও অস্তিত্ব আছে।সেদিন ক্ষণিকের জন্য আমি যেই মানুষটার দেখা পেয়েছিলাম,সেটা আপনিই।আপনি বাদে এমন নিঃসংকোচে কেউ আমায় ছুঁতে পারে না।আমি জানি সেটা আপনি।প্রতিটা মুহূর্ত আমি আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায় বেঁচে আছি।পৃথিবী কেমন করে চলছে,দিন দুনিয়ার খবর কি-এসব কিছুই আমি জানি না।জানতে ইচ্ছেও হয় না।

ব্যবসার দিকেও আজকাল মনে বসে না।ঐতো টুকটাক একটু দেখি।প্রথা আর মামিই সব করে।চিত্রার মিডটার্ম শেষ হলো কিছুদিন আগে।ইদানিং আমি তাকে পড়াতেও বসাই না।সে পড়ল কি না পড়লো,এসবে আমার কোনো খেয়াল নাই।চেষ্টা তো করি স্বাভাবিক হওয়ার।কিন্তু কিছুতেই পারছি না আরহাম।দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।শাস্তি হিসেবে সাময়িক বিচ্ছেদ হলেও তো হতো।এমন অনন্ত কালের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা কেন সহ্য করতে হচ্ছে আমায়?

এই কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছে।ডিস্ট্রিক্ট ক্লাবে শফিক আর রহমানের লা’শ পাওয়া গেছে।পুরো ঘটনা আমি বিস্তারিত জানি না।ওয়াজিদ ভাইয়া ফোন দিয়েছিল।কিন্তু আমি মন দিয়ে শুনিনি।আমি ইদানিং কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারি না।এই অসুখ আমার নতুন যোগ হয়েছে।আমি কিছুতেই ফোকাস করতে পারি না বেশিক্ষণ।ভাসা ভাসা যা কিছু ওয়াজিদ ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি,তা থেকে জানলাম তাদের লাশ নাকি ক্লাবের কমন রুমে পাওয়া গেছে।দু’জনের হাতেই ছু’রি ছিলো।কথা কাটাকাটি হয়ে নাকি একজনই আরেকজনকে মে’রে ফেলেছে।কি ভয়াবহ ব্যাপার! ওয়াজিদ ভাইয়া বলল লাশ গুলোর দিকে নাকি তাকানো যাচ্ছিলো না,এতো জঘন্য ভাবে মেরেছে একজন আরেকজনকে।বিষয়টা দুঃখজনক,কিন্তু আমি শান্তি পেয়েছি।ভীষণ শান্তি পেয়েছি।এদের এমন মৃ’ত্যুই প্রাপ্য।সজীব খন্দকারকে তো এরা এভাবেই মে’রেছিল।এদের সাথে যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে।এদের জন্য আমার একদমই কষ্ট হয় না।

আরহাম! ও আরহাম!
আপনি কি আমায় শুনতে পান?আপনি কি একটু আমার জন্য দোয়া করবেন?মনে আছে গতবার রোজার ঈদে আপনি আমায় দুই হাজার টাকা সালামি দিয়েছিলেন?এবারও রোজা চলে আসছে।আপনি কি এবার আমায় সালামি দিবেন না?আমি কি এই রমজানে আপনাকে আর কাছে পাবো না?ঈদের নামাজের পর আপনি আমার হাতে বানানো পায়েস খাবেন না?এই এত্তো বড় পৃথিবীতে বাকি জীবন আমায় একাই থাকতে হবে?এটাও কি সম্ভব?দয়া করে আমায় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন আরহাম।আমি আর পারছি না।এতো এতো মৃ’ত্যুর মিছিলে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা।আপন মানুষরা কাছে এসে তাদের ভালোবাসায় আমাদের জীবনটা ভরিয়ে দেয়।তারপর যখন আমরা তাদের অস্তিত্ব ছাড়া নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না,তখনই তারা হুট করে গায়েব হয়ে যায়।এমন কেন হয়?সবাই কেন আমায় ছেড়ে চলে যায়?আমি কেন সবাইকে ছেড়ে যেতে পারছি না?এই ভয়াবহ একাকিত্বের মাঝে কিভাবে আমি আমার বাকি জীবন কাটাবো?আরহাম,,আপনি কি আরেকবার আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলবেন?আরেকবার আমায় এই বলে স্বান্তনা দিবেন যে আমাদের খুব দ্রুতই দেখা হবে?আমি আপাতত সেই স্বান্তনাতেই বেঁচে থাকতে চাই।’

নবনীতা বলপয়েন্ট কলমটা বন্ধ করে দুই হাত টেবিলের উপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকায়।আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত লাগছে।এক গ্লাস শরবত খেতে পারলে ভালো হতো।চিত্র একটু পর স্কুল থেকে আসবে।তাসনুভা দুইদিন যাবত অনেকবার ফোন দিচ্ছে ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য।নবনীতা যাচ্ছে না।যেতে ইচ্ছে করে না তার।ঐ বাড়িটা দেখলেই সে কান্নায় ভেঙে যাবে।ঐ বাড়ি তার কাছে আর মানসিক শান্তির জায়গা না।ঐ বাড়িতে পা রাখলেই নবনীতা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবে।বাড়ির আনাচে কানাচে তার সংসার জীবনের স্মৃতি।নবনীতা ঐ স্মৃতিদের এড়িয়ে যাবে কেমন করে?’

সময় গড়ায়।নবনীতা একের পর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসে থাকলো।শরৎ শেষে হেমন্ত এসে যাচ্ছে।অথচ তার প্রিয়তম এখনো আসছে না।সে একটা হাত গালের নিচে রেখে ছোট্ট শিশুদের মতো বিড়বিড় করল,’আকাশে মেঘের ভেলা ভাসতে শুরু করেছে।আপনি কবে আসবেন আরহাম?’
.
.
.
.
রিমি টুলের উপর দাঁড়িয়ে আলমারির উপরে থাকা জুয়েলারি বক্সটা হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।অথচ বক্সটা এতো উঁচুতে,যে সে নাগালই পাচ্ছিল না সেটার।সে দুই পা আরো উঁচু করল।বিরক্ত হয়ে একটা গালি দিলো,’ধুর বাল! ধরতেই তো পারছি না।’

ওয়াজিদ ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখেই চেঁচিয়ে উঠল।দৌড়ে এসে বলল,
‘রিমি! করছো কি তুমি?নামো নামো।এক্ষুনি নামো।’

রিমি ভড়কে গেল ভীষণ।তব্দা খেয়ে বলল,’কেন?কেন?কি হয়েছে?’

ওয়াজিদ সেই কথার জবাব দিলো না।শক্ত করে তার একটা হাত চেপে ধরে ব্যস্ত গলায় বলল,’প্রশ্ন পরে করবে।এখন নামো এখান থেকে।’

রিমি বিচলিত হয়ে ওয়াজিদের হাত ধরে নিচে নেমে এলো।কপাল কুঁচকে বলল,’সমস্যা কি?এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন?’

ওয়াজিদ চোখ রাঙিয়ে বলল,’কি?আমি অদ্ভুত আচরণ করছি?তুমি এই অবস্থায় এমন টুলের উপর উঠেছো কোন সাহসে?’

রিমি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’কেমন অবস্থা?আমার কি হয়েছে?’

ওয়াজিদ মুখ হা করে উপরনিচ তাকে দেখে।তারপর ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে তার পেট বরাবর আলতো করে চাপ দিয়ে বলে,’তোমার কি হয়েছে জানো না?এই যে এটার কথা কি সবসময় ভুলে যাও?’

রিমি হাসল।মাথা চুলকে বলল,’এটা এতো সিরিয়াস কিছু না।আমি সাবধানেই সব কাজ করি।’

ওয়াজিদ থমথমে মুখে কয়েক সেকেন্ড তাকে দেখল।তারপর দুই হাত জোড় করে মাথা নামিয়ে বলল,’থাক হয়েছে।অনেক সাবধান তুমি।সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?দয়া করে আর এইসবে উঠতে যাবে না।আল্লাহ! কতো বড়ো সাহস এই মেয়ের!’

শীলা আনারের রস ভর্তি গ্লাস হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,’কি হয়েছে?কি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে?’

ওয়াজিদ যেন তাকে দেখতেই নতুন করে শক্তি পেল।সে কন্ঠ চওড়া করে বলল,’মা জানো?রিমি আজ একা ঘরে টুলের উপর উঠে জিনিস নামানোর চেষ্টা করিলো।’

মিসেস শীলা চোখ বড় বড় করে বললেন,’কি?এই অবস্থায় সে টুলে উঠেছে?’

‘হ্যাঁ।চিন্তা করো একবার।’

শীলা কপালে হাত রাখলেন।বিস্মিত ভঙ্গিতে বললেন,’আল্লাহ! এতো সাহস তোমার রিমি! যদি পড়ে যেতে?’

রিমি কপাল চাপড়ায়।আশাহত আর ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয়,’এতো ভয় পাওয়ার কি আছে এটাতে?’

‘তো ভয় পাবো না?’

‘না পাবে না।এটা খুব নরমাল।তোমরা এমন আচরণ করো যে আমার মন হয় এই দুনিয়ায় আমিই প্রথম মা হচ্ছি।এর আগে সবার বাচ্চা আকাশ থেকে পড়তো।’

শীলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,’বাকিদের টা জানি না।তবে আমাদের ঘরে তুমিই প্রথম মা হচ্ছো।’

রিমি গোল গোল চোখে বলল,’তো আপনি হন নি মা?’

শীলা মৃদু হেসে তার এক গালে হাত রেখে বললেন,’আমার হিসেব আলাদা।তুমি বাচ্চা মেয়ে।তোমাকে একটু বেশিই যত্ন রাখতে হবে।’

হাতে থাকা আনারের রস পুরোটা রিমিকে খাইয়ে তবেই দম নিলেন শীলা।সে পুরোটা শেষ করতেই তিনি খালি গ্লাস হাতে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।চুলায় যে তরকারি বসানো,এই কথা তার এখন মনে পড়েছে।

তিনি যেতেই ওয়াজিদ রিমির পাশ ঘেঁষে বসলো।রিমি ক্লান্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’আর ভালো লাগে না।বড্ড ভার ভার লাগে শরীর।’
সে তার মাথাটা ওয়াজিদের কাঁধে ফেলল।শ্বাস টেনে বলল,’আপনি জানেন?আমার হাত পা ফুলে যাচ্ছে।বড্ড কুৎসিত হয়ে যাচ্ছি আমি আজকাল!’

ওয়াজিদের কথাটা পছন্দ হয়নি তেমন।সে চোখ গরম করে পাশ ফিরে বলল,’কি?কি হয়েছো তুমি?’

‘কুৎসিত,কুৎসিত।আগলি হয়েছি আমি।পেত্তিনিদের মতো দেখায় আমাকে।’

ওয়াজিদ একটা ভয়ংকর কাজ করল হঠাৎ।রিমি থামতেই সে খানিকটা এগিয়ে এসে তার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল।রিমি নিশ্বাস নেওয়ার পাশাপাশি পলক ফেলাও ভুলে গেল।এক মিনিটের মতো চুমু খেয়ে ওয়াজিদ তাকে ছেড়ে দিলো।আগে যেখানে বসা ছিল,সোজা হয়ে আবার সেখানে গিয়ে বসলো।

রিমির মুখ তখনো হা।তব্দা খেয়ে কতোক্ষণ সে সেভাবেই বসে রইল।শেষে দরজার দিকে দেখে আঁতকে উঠে বলল,’আল্লাহ! দরজা খোলা ছিলো ওয়াজিদ।’

ওয়াজিদ ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল,’তো কি হয়েছে?আরেক বেটার বউকে চুমু খেয়েছি নাকি আমি?নিজেরই তো বউ।সমস্যা কি?’

একেবারে দায়সারা জবাব।রিমির চোখের বিস্ময় কাটে না।সে হতবাক হয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে।অস্ফুটস্বরে বলে,’আপনি ওয়াজিদ?কথায় কথায় মুখ কুঁচকে ফেলা লোকটাই আপনি?’

ওয়াজিদ শব্দ করে হেসে ফেলল।একবার দরজার দিকে দেখে পুনরায় রিমির অধরে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,’জ্বী।আমিই সেই ওয়াজিদ।কোনো সন্দেহ?’

রিমি গোল গোল চোখ করে বলল,’আপনি যে এমন সেটা আমি বিয়ের আগে একদমই বুঝি নাই।’

বলতে বলতেই লজ্জায় সে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিল।ওয়াজিদ তার আরো কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলল,’কেন কেন?আমি কেমন?খুব বেশি রোমান্টিক?খুব বেশি জ্বালাতন করি তোমাকে?’

রিমি মাথা নামিয়ে চোখ মুখ খিঁচে ধরল।মিনমিনে স্বরে বলল,’চুপ করুন।আর শুনতে চাই না।’

‘কেন শুনতে চাও না?বলো না আমি কেমন?অনেক বেশি গা ঘেঁষা?রোজ রোজ তোমায় জ্বালাতন করি?এই দেখো,কতো মাস হলো তোমায় একটুও জ্বালাচ্ছি না।’

রিমির কান ঝা ঝা করে উঠে।মনে হচ্ছে এখনই কান থেকে ধোঁয়া বের হবে।সে মাথাটা আরো বেশি নিচু করে বলল,’চুপ করুন প্লিজ।দরজা খোলা।মা একটু পর পর আসে।এসব শুনলে কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হবে!’

ওয়াজিদ কপাল কুঁচকে বলল,’কেন?বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে কেন?তাদের সময় কি তারা কম করেছে নাকি?’

রিমি হা হয়ে তার দিকে তাকালো।মুহূর্তেই খিলখিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।তার হাসির ঝংকার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো।সে হাসতে হাসতেই কোনোরকমে বলল,’ইসস! কি বাজে কথা।’

ওয়াজিদ বিমুগ্ধ নয়নে তার হাসি দেখল।এই হাসি,এই মেয়ে,এই ঘর,এই সংসার-সবকিছুই তার চমৎকার লাগে।রোজ রোজ সমস্ত ক্লান্তির শেষে এই ঘরটা তাকে শান্তি দেয়।সে সুখী,অনেক বেশি সুখী।রিমি তাকে জগতের সেরা সুখী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।এর বেশি তার আর কিছুই চাই না।

রিমি তার বুকে মাথা রেখে ডাকল,’ওয়াজিদ!শুনছেন?’

ওয়াজিদ তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জবাব দেয়,’হুম।বলো।’

‘আপনি কি চান?আমাদের ছেলে হোক না মেয়ে?’

ওয়াজিদ একটু ভাবল।শেষে গাঢ় গলায় বলল,’যেটাই হোক।আমি চাই যেন ছোট্ট একটা রিমি হোক।আর কিছু চাই না আমার।’
.
.
.
.
‘শুভ্রানী! তোমার সাথে দেখা করতে কে যেন এসেছে।’

শুভ্রা খুব মন দিয়ে পড়ছিল।রিতার কন্ঠ কানে যেতেই সে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো।খুশিতে গদ গদ হয়ে বলল,’কে?আমার আপাই?’

রিতা মাথা নেড়ে বলল,’না না।একটা ছেলে।আগে একবার এসেছিল বোধ হয়।যা গিয়ে দেখা করে এসো।’

শুভ্রা কপাল কুঁচকে নিল।
‘ছেলে এসেছে?’

সে কালো রঙের সুতির ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে হোস্টেলের নিচে নেমে এলো।সে যা ভেবেছিল,তাই।আরিশ এসেছে।পরনে একটা নীল শার্ট।শুভ্রাকে দেখতেই সে স্মিত হাসল।জবাবে শুভ্রাও তাকে একগাল হাসি উপহার দিলো।

শুভ্রা কাছে এসে বলল,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।কেমন আছেন?’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম শুভ্রা।আমি ভালো আছি।তোমার কি অবস্থা?’

শুভ্রা জবাব দিলো,’আমিও ভালো আছি।’

আরিশ একটু খচখচ করছিল শুরুতে।শেষে সমস্ত জড়তা কাটিয়ে সে তার হাতে থাকা প্যাকেটটা ছিঁড়ে সেখান থেকে হাফ পাউন্ডের একটা ছোট্ট কেক বের করে শুভ্রাকে দেখে বলল,’হ্যাপি বার্থডে শুভ্রা।জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমায়।’

সমুদ্রের বিশালাকার ঢেউ তীরে এসে আঁছড়ে পড়লে যেমন অনুভূতি হয়,শুভ্রার ঠিক তেমনই অনুভূত হলো।সে ফ্যালফ্যাল চোখে কতোক্ষণ আরিশের হাতে থাকা কেকটার দিকে তাকিয়ে রইল।আজ তার জন্মদিন?অথচ এই কথা সে দিব্যি ভুলে গিয়েছিল।অন্যান্য বার আপাই তার জন্মদিনে বাসায় কেক বানাতো।অথচ এইবার আপাই ঠিক মতো নিজের নামই মনে রাখতে পারে না,শুভ্রার জন্মদিন মনে রাখবে কেমন করে?অথচ আরিশ তার জন্মদিন মনে রেখেছে।ঢাকা থেকে এই পর্যন্ত এসেছে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে।

তার চোখ ভরে উঠল।সে দ্রুত মাথা নামিয়ে ভেজা চোখ আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে বলল,’অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।আপনি কি করে জানেন আজ আমার জন্মদিন?’

আরিশ নরম গলায় বলল,’ভাবি একবার বলেছিল।তখন মনে রেখেছিলাম।’

‘আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন?’

‘হুম।আজ আমার মিড ছিলো।ঐটা শেষ করে তারপর আসলাম।তাই একটু দেরি হয়ে গেল।’

শুভ্রা আর জবাব দিলো না।কেবল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে যেই মানুষ পরীক্ষার মাঝে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ছুটে এসেছে,তাকে শুভ্রা কি বলবে?কি বলে শুভ্রা তার কৃতজ্ঞতা আদায় করবে?আদৌ কি কৃতজ্ঞতা আদায় করা সম্ভব?

আরিশ ডানদিকে দেখে বলল,’চলো ঐখানে গিয়ে বসি।’

শুভ্রা পুতুলের মতোন তার পিছু পিছু হেঁটে গেল।দু’জন চুপচাপ একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। আরিশ কেক কাটার পর নিজেই শুভ্রাকে খাওয়ালো।খাওয়াতে গিয়েই সে টের পেল মেয়েটা কান্না চেপে রেখেছে।তার দুই চোখ একটু পর পর পানিতে ভরে উঠছে।সে কিছু জানতে চাইল না।শুধু নিচু স্বরে বলল,’আবারো জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুভ্রা।অনেক বড়ো ডাক্তার হও এই দোয়া করি।’

শুভ্রা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরল।কোনোরকমে মাথা নেড়ে বুঝালো সে খুব ভালো ডাক্তার হবে।মিনিট দশেক বাদেই আরিশ উঠে দাঁড়ালো।সামান্য হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে বলল,’আমি তাহলে আসি শুভ্রা।নিজের খেয়াল রেখো।পরে কোনোদিন দেখা হবে আবার।’

মুখে সেই অমায়িক হাসি ধরে রেখেই আরিশ সামনের দিকে এগিয়ে গেল।মেয়েটার আজ জন্মদিন।অথচ কেউ একবার তাকে উইশ করলো না! তার জন্য আরিশের মায়া হয়।শুধু কি মায়া?আরিশ জানে এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে।একেবারে নিরীহ,শান্ত আর ঘরকুনো একটা মেয়ে! ভালো না বাসার মতো কোনো কিছু আদৌ পুষ্পিতা নূরের মাঝে নেই।

‘আরিশ!’

পেছনে থাকা নারী কন্ঠটি অকস্মাৎ উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল।আরিশের কদম থমকে গেল।সে অবাক হয়ে পেছন ফিরল।

সে ঘুরে দাঁড়াতেই শুভ্রা দিকবিদিক ভুলে তার দিকে ছুটে গেল।
গুনে গুনে ছয় সেকেন্ড পর শুভ্রা তীব্র বেগে ছুটে এসে তার প্রশস্ত বুকটায় আছড়ে পড়ল,শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার পিঠ।

আরিশ প্রথম কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।ঘটনাটা মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে বেশ সময় লাগলো তার।কিন্তু যখন শুভ্রার হেঁচকি তোলা কান্নার শব্দ তার কর্ণকুহরে এসে ধাক্কা খেল,তখনই সে সম্বিৎ ফিরে পেল।ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি হয়েছে শুভ্রা?এভাবে কাঁদছো কেন?’

শুভ্রা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।একেবারে তার শরীরের সাথে মিশে যেতে যেতে ধরা গলায় বলল,’জানি না।কিচ্ছু জানি না।আপনি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন।প্লিজ কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন।’

আরিশ সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণ মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।শেষে কোনোরকমে একটা হাত তুলে শুভ্রার পিঠে রাখল,একটু পরে আরেকটা।টের পেল সে হাত রেখতেই মেয়েটা আরো জোরে ফুপিয়ে উঠল।

এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো আরিশের সমস্ত শরীর,সঙ্গে ভেজাল তার বুকের সাথে প্রগাঢ় ভাবে মিশে থাকা মেয়ে টি কে।আরিশ তাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।আনত স্বরে বলল,’কাঁদে না শুভ্রা।জন্মদিনের দিন কাঁদতে নেই।’

শুভ্রা তবুও তার কথা শুনলো না।কান্নার ফাঁকেই একহাতে তার শার্ট খাঁমচে ধরল।বাচ্চাদের মতোন নাক টানতে টানতে ভাঙা গলায় বলল,’আমি কাঁদবো।আপনার সমস্যা কি?আপনি শুধু আমার ধরে রাখুন।আর কিছু চাই না আমার।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭০)[দ্বিতীয় অংশ]

মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়েছে একটু আগে।পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভা ঢাকা পড়েছে রাতের আঁধারে।পাখিরা সব নীড়ে ফিরে যাচ্ছে,ছানারা অপেক্ষায় আছে তাদের মায়ের ঘরে ফেরার।

নবনীতার ট্যাক্সি আজিজ ভিলায় এসে পৌঁছুলো রাত সাড়ে আটটা নাগাদ।গাড়িটা মূল ফটক অব্দি আসতেই নবনীতা ক্লান্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।দুপুর তিনটায় সে গাড়িতে উঠেছে,অথচ এইটুকু রাস্তা আসতে তার এতোক্ষণ সময় লেগেছে।সে গাড়ি থেকে নেমে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,’পেছনের সিটে তোর ব্যাগ আছে শুভি।মনে করে নামিয়ে নিস।’

কথা শেষ করেই সে শান্ত চোখে বাড়ির মূল দরজা দেখে।ঐতো সেদিন কালো রঙের একটা গাড়িতে করে সে প্রথম এই বাড়িতে এসেছিল।এই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কত কত দিন সে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের অপেক্ষা করেছিল! নবনীতা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।সবই এখন স্মৃতি।স্মৃতির জঞ্জালে জড়িয়ে পড়ে সে এখন পরিস্থিতি বাজে করতে চায় না।সে তার অস্বাভাবিক আচরণ থেকে মুক্তি চায়।

নিজের চিন্তায় নিজেরই হাসি পেল তার।জঞ্জাল?নিজের সংসারের স্মৃতি কি কারো কাছে জঞ্জাল মনে হতে পারে?এই যে এতো শখে একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসার,এই সংসার তো নবনীতার বড্ড আদরের! কতো যত্নে সে আর আরহাম মিলে একটা একটা ইট গেঁথে এই সংসারের ভিত তৈরি করেছিল।এই বাড়িরের দেয়ালে দেয়ালে তাদের আনন্দ,দুঃখ,বিরহ,হতাশা মান-অভিমান সব আটকে আছে।সে কাছে গেলেই সেসবের ঘ্রাণ পায়।

নবনীতা চোখ বন্ধ করে শাড়ির দুই পাশ চেপে ধরল।আর না।আর এসব ভাববে না সে।ভাবলেই উল্টা যন্ত্রণা বাড়ে।বড় করে একটা শ্বাস টেনে সে বাড়ির ভেতর পা রাখল।যেমন করে প্রথমবার পা রেখেছিল,সঙ্গে একটা মানুষ ছিলো।তার হাতটা ঐ মানুষের হাতের মুঠোয়ই ছিলো।

নবনীতা চোখ ঘুরিয়ে পুরো বাড়ি দেখে।ঐ যে দূরে ডায়নিং টেবিলটা একটুখানি দেখা যাচ্ছে।একেবারে সামনের চেয়ারে বসে নবনীতা অপেক্ষা করতো তার জন্য।এই যে কি সুন্দর বসার ঘর! এখানের সোফা গুলোতে বসে নবনীতা কতো মুখ ফুলিয়েছে,অভিমান করেছে,রাগ ঝেড়েছে! এই তো ঝকঝকে,তকতকে মেঝে।মাঝে মাঝে হুট করেই দু’জনের উপর পাগলামি ভর করতো।মাঝরাতে কোনো ছাড়াই দু’জন হাতে হাত রেখে নাচতো।কোনো স্টেপ নাই,গান নাই,কেবল এমনিই হাত পায়ের নাড়াচাড়া।নবনীতা হাসল।চোখ মোছার প্রয়োজনবোধ করল না।

সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।বাড়ি ফেরার পর নিচ থেকে ভারি গলায় সেই মানুষটা ডাকতো,’পরী! এ্যাই পরী! এক্ষুনি নিচে নেমে এসো।’
তখন নবনীতা দৌড়ে দৌড়ে এই সিঁড়ির ধাপ পার করতো।এই বাড়িটা তার খুব প্রিয়।বাড়ির আনাচে কানাচে সে শুধু তার বিবাহিত জীবনের স্মৃতি খুঁজে পায়।

অবশেষে সে কাঁপা হাতে লক ঘুরিয়ে তার ঘরের দরজা খুলল।ভেতরটা একদম অন্ধকার,আলো জ্বালানো হয় নি।কেমন গুমোট লাগছে সবকিছু।সুইচ চেপে লাইট জ্বালানো দরকার।কিন্তু নবনীতা বাতি জ্বালালো না।আবছা আলোতেই ঘরের যতোখানি দেখা যায়,ততখানি দেখলো।

একেবারে ধীর পায়ে,শম্বুক গতিতে হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।এটা তার ঘর,তার আর আরহামের সুন্দর গোছানো সংসার।সে আনমনে হাত বাড়িয়ে বেড শীটের কভার ছোঁয়।সেদিন তার জ্বর হলো।আরহাম সারারাত তার শিয়রে বসে তার সেবা করল।ব্যক্তি আরহামকে না হয় নবনীতা প্রায়শই কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে পারে।কিন্তু স্বামী আরহামকে সে কেমন করে বিচার করবে?সে অনুভব করল এই সম্পর্কে ভালোবাসার দৌড়ে আরহাম তাকে অনেক আগেই পেছনে ফেলে দিয়েছে।সে কখনোই অমন করে তাকে ভালোবাসতে পারে নি,যেমন করে আরহাম তাকে ভালোবেসেছে।তার আফসোস হয়,অনুতাপ বাড়ে।আর যদি কখনো সুযোগ হয়,তবে অনেক অনেক ভালোবেসে সে আরহামকে হারিয়ে দিবে।

সে চুপচাপ গিয়ে খাঁটের সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসল।দুই হাঁটু ভাঁজ করে তার মাঝে মুখ গুজল।আবার শরীর ভার ভার লাগছে,মাথা ঘুরছে ভীষণ।আসার সময় অন্তত পাখাটা চালু করে আসা উচিত ছিলো।সে আর উঠল না।সেই অবস্থাতেই কতোক্ষণ টাইলস বেছানো মেঝেতে বসে থাকল।

‘পরী! ফ্লোরে বসেছো কেন?কতো ঠান্ডা ফ্লোর! উঠে এসো এখনি।’

নবনীতা আস্তে করে মাথা তুলল।মৃদু হেসে বলল,’আসবো না।আসলেই আপনি আবার নাই হয়ে যাবেন।’

বলে সে আরো একবার হাসল।সে জানে সে হ্যালুসিনেট করছে।এই ঘটনা রোজ রোজ ঘটছে।সে দেখে আরহাম এসেছে,কিন্তু সে তার কাছে গেলেই আবার নাই হয়ে যায়।এখন এই ভ্রমটাও তার কাছে ভালো লাগছে।এতে ক্ষণিকের জন্য ভালো থাকা যায়,সুখে থাকা যায়।এতে মন্দ কি?

সে খাটের এক কোণায় মাথা রেখে একমনে তাকে দেখল।সামনে দাঁড়ানো পুরুষালি অবয়বটা আবারো অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,’নিজের ব্যাপারে বড্ড উদাসীন তুমি।’

‘কারণ আপনি আমার ব্যাপারে খুব বেশি যত্নশীল।’
একটুও কালক্ষেপন না করে উত্তর দিলো নবনীতা।

অবয়বটা আরো এক ধাপ এগিয়ে আসে।হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে তার চোখে চোখ রাখে।নবনীতা চমকায় খানিকটা।এতো কাছাকাছি তো কখনো সে আসেনি তার।এই মুখ,এই চোখ,এই ধাঁরালো চোখের দৃষ্টি-আগে তো এতো স্পষ্ট ঠেকায় নি তার কাছে।

তার ঠান্ডা হাতে কিছু একটা অনুভব হতেই সে লাফিয়ে উঠল।দেখল তার একটা হাত সামনে থাকা মানুষটার উষ্ণ,খড়খড়ে হাতের ভাঁজে বন্দি।নবনীতা চূড়ান্ত রকমের আশ্চর্য হয়।তব্দা খেয়ে বলে,’আপনি সত্যিই আমায় ধরেছেন?’

আরহামের হাসি পেল ভীষণ।সে অন্যহাতে ভর দিয়ে সামান্য এগিয়ে এসে নবনীতার গালে আর্দ্র চুমু খেয়ে বলল,’না,আমি তোমায় চুমু খেয়েছি সেনোরিটা।’

নবনীতার চোখ ছলছল করে উঠল।বুক ধড়ফড় করে উঠে সহসা।সে অবিশ্বাস্য চোখে সামনে তাকায়।নিশ্চিত হয়,তার সামনে থাকা মানুষটা কোনো ভ্রম না আর সেই মানুষটা তারই স্বামী আরহাম।

নবনীতা আর এক মুহুর্তও দেরি করল না।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়ে আরহামকে জড়িয়ে ধরল সে।আরহামের বুকের সাথে একপ্রকার মিশে যেতে যেতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল,’আমি জানতাম আপনি আসবেন।আমি জানতাম।’

আরহাম তার মাথায় হাত বুলায়,পর পর অসংখ্য বার কপালে চুমু খায়,এলোমেলো চুলগুলো খুব যত্নে তার কানের পেছনে গুঁজে দেয়।চাপা কন্ঠে আদুরে গলায় বলে,’তোমায় ভীষণ মিস করেছি মেয়ে।প্রতিদিন তোমার কথা মনে পড়েছে আমার।’

‘মনে পড়লে এতোদিন সামনে আসেন নি কেন?’

‘কি করে আসতাম?যেই ঝামেলা গুলো শুরু হয়েছিল,সেসবের সমাধান না করে কেমন করে আসতাম?’

নবনীতা নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিয়ে বলল,’সবাই বলেছে আপনি নাকি নেই।’

বলতে গিয়েই তার গলা ভেঙে আসে।আরহাম বলল,’সবাই বলেছে?আর তুমি বলো নি?’

‘না,আমি বলিনি।’

‘বিশ্বাস তো করেছো।’

নবনীতা মাথা তুলল।ভেজা চোখে তাকে দেখে হঠাৎই তার চুল টেনে ধরল।
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’কি বিচ্ছিরি একটা চিঠি দিয়েছেন আপনি আমাকে! ঐটা পড়ার পর আমার কি করা উচিত ছিলো?’

আরহাম নিজের চুল ছাড়িয়ে নিয়ে একগাল হেসে বলল,’সুন্দর ছিলো না চিঠিটা?অনেক সময় খরচা করে লিখেছি।’

‘সুন্দর না,বাল।ঘোড়ার আন্ডা ছিলো ঐ চিঠি।যত্তসব আজগুবি কথা।তুমি যখন চিঠি পাবে,আমি তখন অনেক দূরে।ফালতু চিঠি একটা।’

বলতে বলতেই তার রাগ ধরে গেল।আরহাম হো হো করে হেসে উঠে বলল,’কি সর্বনাশ!তুমি গালি দিচ্ছো?”

‘চিঠিই লিখেছেন এমন গালি খাওয়ার মতো।’

‘আর সেই চিঠি পড়তে পড়তেই নাকি তুমি আধপাগল হয়েছো?’

‘চুপ করেন।বড্ড বেশি বকবক করেন আপনি!’

নবনীতা একেবারে তার বুক বরাবর মাথা রাখল।আরহাম শীতল কন্ঠে বলল,’বড্ড উদাসীন থাকো তুমি আজকাল।শরীরের অবস্থা তো শোচনীয়।’

নবনীতা মুচকি হাসল।বলল,’আপনি তো এসেছেন।এখন যত্ন করে আবার সব ঠিক করে দিন।’

সে তার বন্ধন আরো গাঢ় করে।কান্না থামিয়ে কোনো রকমে বলে,’বিশ্বাস হচ্ছে না আমার আপনি এসেছেন।আমি একটু কাঁদি আপনার বুকে মাথা রেখে?’

একেবারে করুণ সুরে আবেদন।আরহাম জবাব দিলো,’আচ্ছা ঠিক আছে।কাঁদো।’

সে সত্যি সত্যিই কাঁদলো।কতোটা সময় সে নিজেও জানে না।সে একটু শান্ত হতেই আরহাম বলল,’হয়েছে কান্না?’

নবনীতা মাথা তুলে চোখ রাঙিয়ে বলল,’আপনি আদর দিচ্ছেন না কেন আমাকে?অন্য সময় আমি কান্না করলে আপনি আদর করেন।’

আরহাম লটকানো মুখে তাকে দেখে।মাথায় হাত রেখে বলে,’উফফ সরি! ভুলে গিয়েছিলাম ডার্লিং।তোমার তো আবার আদর দিয়ে দুঃখ শুষে নিতে হয়।’

নবনীতা হাসল সামান্য।আরহাম তার সমস্ত মুখে অজস্র চুমু খেল।শেষে আদুরে গলায় বলল,’চলো,এখন নিচে যাই।সবাই আমাদের অপেক্ষা করছে।’

নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরল।জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’না না।কোথাও যাবেন না আপনি।এখানেই থাকুন।’

‘এখানে কি করব?’

‘আদর করবেন আমাকে,ভালোবাসবেন।’

আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’আদর তো করলাম।’

‘আবার করবেন,একশোবার করবেন।’

‘আচ্ছা করব।এখন আগে খেয়ে আসি চলো।’

‘না আমি যাবো না।’

আরহাম ভ্রু উঁচু করে বলল,’তুমি খাবে না?’

‘হুম।খাবো।’

‘তো নিচে না গেলে কি করে খাবে?’

‘এখানেই খাবো।আদর খাবো আমি।’

আরহাম হা হয়ে তার কথা শুনলো।শেষে শব্দ করে হেসে উঠে বলল,’সিরিয়াসলি! তোমার বয়স কতো পরী?কিসব বাচ্চা বাচ্চা কথা বলছো!’

‘বয়স দিয়ে আপনার কি কাজ?জামাইয়ের সাথে আহ্লাদ করার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই।আমি সত্তর বছরের বুড়ি হলেও এমন আহ্লাদ করব।আপনার কোনো সমস্যা?’

‘না,আমার সমস্যা নাই।কিন্তু তোমার যখন সত্তর বছর হবে তখন আমি তোমার আহ্লাদ পূরণ করার অবস্থায় থাকবো বলে মনে হচ্ছে না।দেহটা থাকবে মাটিতে,আর রূহ টা আসমানে।’

নবনীতা মাথা তুলল।চোখ কটমট করে বলল,’বেশি কথা বলেন আপনি।চুপ থাকেন একটু।’

আরহাম চুপ হলো।একটু পরেই আবার দুষ্টুমি করে বলল,’সারা রাত আদর করতে হবে?’

‘হ্যাঁ।রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা।’

‘আচ্ছা,তাহলে দরজা লক করে আসি দাঁড়াও।’

নবনীতা আলতো করে তার বুকে একটা ঘুষি মেরে বলল,’ইসসস ছি! ঐসব কিছু বলিনি।’

‘আমি ঐসবই বুঝেছি।’

‘আপনার মাইন্ড নোংরা।’

‘আরে বাবা! তোমার মাইন্ড কতো ভালো! জামাই এতোদিন পর সামনে এসেছে! কোথায় তুমি তার সেবা যত্ন করবে,তার তোষামদ করবে,তার জন্য রান্নাবান্না করবে,,তা না,তুমি পড়ে আছো নিজের আদর খাওয়া নিয়ে।বেয়াদব কি আর সাধে বলি?’

নবনীতা তার বুকের সাথে মিশে থেকেই মুচকি হাসল।বড় করে একটা শ্বাস টেনে বলল,’আমি বোয়াদবই ভালো।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬৯

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬৯)

তাসনুভা মুচকি হেসে এদিক সেদিক দেখছিলো।আদি কপাল কুঁচকে বলল,’অদ্ভুত তো! তুমি এমন হাসছো কেন?একটু আগেও তো কাঁদছিলে।’

তাসনুভা সাথে সাথেই হাসি থামায় না।বরং আরো কিছুক্ষণ দুই ঠোঁটে সেই হাসি ধরে রেখে জবাব দেয়,’হাসছি কারণ এখন আমার মন ভালো হয়েছে।তোমার কোনো সমস্যা?’

‘নাহ,আমার কোনো সমস্যা না।তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।’

তাসনুভা বিনিময়ে আরো ঝকঝকে একগাল হাসি উপহার দেয়।তার মন আজ ভীষণ ভালো।সে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পেয়েছে।একেবারে অল্প সময়ের জন্য হলেও পেয়েছে।এখন আর তার কোনো দুঃখ নেই।সে আসতে দুঃখরা সব জীবন ছেড়ে পালিয়েছে।

ইজমা বলল,’তোমাকে এমন হাসি খুশি দেখতে খুব ভালো লাগছে।সবসময় এমনই থাকবে।’

তাসনুভা দাঁত কেলিয়ে বলল,’আচ্ছা থাকব নে।’

একটা বল গড়াতে গড়াতে তার পা পর্যন্ত এসে থামলো।তাসনুভা মাথা নামিয়ে সেই বলটা দেখল।একটা বাচ্চা দৌড়ে দৌড়ে তার সামনে এলো।দৌড়ঝাপে তার শ্বাস উঠে গেছে।তাসনুভা হাসিমুখে বলল,’তোমার বল এটা?’

সে ক্লান্ত হয়ে মাথা নাড়ল।কিছু বলার মতো জোর তার আর অবশিষ্ট নেই।তাসনুভা বলল,’অনেক সুন্দর তো বলটা।আমিও তোমার সাথে খেলতে চাই।আমাকে নিবে?’

বাচ্চাটা গভীর চোখে তাকে পরোখ করল।খুটিয়ে খুটিয়ে তার সমস্ত কিছু দেখল।তার মূল মনোযোগ তাসনুভার হুইলচেয়ারের দিকে।সে গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকে পরোখ করে আশাহত ভঙ্গিতে বলল,’তুমি কীভাবে খেলবে?তুমি তো হাঁটতেই পারো না।দৌড়াবে কি করে?’

মুহূর্তেই তাসনুভার দুই ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল।দুই চোখ ভিজে উঠল নোনা জলে।দৃষ্টি ঘোলাটে হলো আচমকা।ঝাপসা চোখে সে দেখল,বাচ্চাটা কথা শেষ করেই তার পায়ের কাছে থাকা বলটা তুলে নিয়েছে।সে উঠে দাঁড়াতেই আদি বলল,’কেন?সে খেলতে পারবে না কেন?অবশ্যই সে খেলতে পারবে।তুমি দেখতে চাও?’

তাসনুভা তার কথার প্রেক্ষিতে কোনো জবাব দিলো না।তার কৌতূহলও জাগছে না মনে।সে জানে এগুলো সব আদির মিথ্যে স্বান্তনা।এসব কথায় ঐ বাচ্চার কথা ভুল হয়ে যাবে না।সে তো ঠিকই বলেছে।তাসনুভা তো হাঁটতেই পারে না,দৌড়াবে কেমন করে?’

আদি তার কাছ থেকে বলটা টেনে নিজের হাতে নিল।সেটাকে দুইবার মাটিতে বাউন্স করিয়ে পুনরায় হাতে তুলে তাসনুভার দিকে দেখে বলল,’চলো বাচ্চা।আমরাও বল দেখল।’

তাসনুভা ক্ষীণ গলায় বলল,’কোনো দরকার নেই।আমি খেলব না।’

‘কেন?কেন খেলবে না তুমি?’ চওড়া গলায় জানতে চাইল সে।

তাসনুভার রাগ হলো।সে মুখ তুলে বিরক্ত হয়ে বলল,’কারণ আমি ল্যাংড়া।ল্যাংড়া রা ফুটবল খেলবে কিভাবে?ফুট থাকলে তবে তো খেলতাম!’

‘চুপ! বড্ড বেশি কথা বলো তুমি! ল্যাংড়ার মানে বোঝো তুমি?যত্তসব আজগুবি কথা!’

বড়সড় ধমকটা খেয়েও তাসনুভা কোনো উত্তর দিলো না।কেবল টলমল চোখে আদির থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।আদির মায়া হলো ভীষণ।সে হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসল।দুই হাতে তাসনুভার কোলের উপর ফেলে রাখা দু’টো হাত মুঠ করে ধরল।মোলায়েম কন্ঠে ডাকল,’বাচ্চা! এ্যাই বাচ্চা!’

তাসনুভা উত্তর দিলো না।মুখ খিঁচে আগে যেভাবে ছিল,সেভাবেই পড়ে রইল।আদি আবার ডাকল,’তাসনুভা! এদিকে তাকাও তাসনুভা।ডাকছি যে কানে যাচ্ছে না?’

সে সাথে সাথে পাশ ফিরল।এই প্রথম আদি তাকে এমন নাম ধরে ডেকেছে।তার অবাক চোখজোড়া এক নজর দেখেই আদি বলল,’পাকিস্তানী বক্তা মুনিবা মাজারী কে চেনো?’

সে দুইদিকে মাথা নাড়ল।আদি বলল,’অবসর সময়ে তার ভিডিও দেখবে।সেও তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়ে,তোমার মতোন হুইলচেয়ারে করেই চলে।তবে কখনো তোমার মতো নিজেকে হেয় করে না।সময় হলে কখনো তার জীবনের গল্প শুনবে।তখন মনে হবে নিজের জীবনই ঢের ভালো।’

তাসনুভা নাক টেনে টেনে কোনোরকমে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে গাল পর্যন্ত নেমে এসেছে।আদি হাত বাড়িয়ে সেটা মুছে দিলো।আশ্চর্য বিষয়! মেয়েটা কাঁদছে,অথচ তার ভেতরে যন্ত্রনা হচ্ছে।সে একটা শ্বাস ছেড়ে গাঢ় স্বরে বলল,’একটা গ্লাস যার অর্ধেক অংশে পানি আছে,সেটা একেকজনের কাছে একেক অর্থ বহন করে।কেউ মনে করে গ্লাসটা অর্ধেক খালি।কেউ আবার মনে করে গ্লাসটা অর্ধেক পূর্ণ।তুমি তার কোনোটাই মনে করবে না।তুমি মনে করবে গ্লাসটা ঠিক অতোটুকুই পূর্ণ যতোটুকু পূর্ণ হলে তুমি তোমার পিপাসা মেটাতে পারো।এর বেশি তোমার প্রয়োজন নেই।’

তাসনুভা ঠোঁট কা’মড়ে ধরে তার কথা শুনল।আদি স্মিত হেসে বলল,’তুমিও অপূর্ণ না তাসনুভা।আল্লাহ তোমাকে অতোখানি পূর্ণতাই দিয়েছে,যতখানি তোমার চলার জন্য যথেষ্ট।তুমি কতো মিষ্টি একটা মেয়ে! আল্লাহ কি সবাইকে তোমার মতো সুন্দর করে বানায়?’

তাসনুভা নাক টানলো।অভিমানী সুরে বলল,’আমায় কেউ ভালোবাসে না।’

আদি অবাক হয়ে বলল,’সে কি! এত্তো বড় মিথ্যা কথা!’

‘মিথ্যা না।সত্যি।স্কুলেও সবাই আমাকে ভয় পেত।’

‘ঐ গুলা সব গাধা।এতো সুন্দর কিউট একটা মানুষ কে কেউ ভয় পায়?’

তাসনুভা ফিক করে হেসে দিলো।ঠোঁট চেপে বলল,’আমি কিউট?’

আদি তার গাল টেনে বলল,’অবশ্যই।অবশ্যই কিউট।এই যে দেখো আমি একটু পর পর তোমার গাল টানি।ইজমার গাল টানি এমন করে?কেন টানি না?কারণ ঐটার গাল শক্ত।কোনো কিউটনেস নাই চেহারার ভেতর।’

তাসনুভা খিলখিল করে হেসে উঠল।ইজমা আদির পা বরাবর ল্যাং মেরে বলল,’নাহ,কিউটনেস তো সব তুই আর তোর বাচ্চা কিনে রেখেছিস।আমরা কিউট হবো কোথা থেকে?’

‘ইয়েস! আই ডু এগ্রি উইথ দিস।কিউট মানেই আমরা,আমরা মানেই কিউট।তুই আর তোর ইফাজ হচ্ছিস নবিতা আর সিজুকা।’

তাসনুভা আরেক দফা হেসে কুটি কুটি হলো।আদি প্রসন্ন হয়ে তার হাসি দেখল।সে থামতেই শান্ত গলায় বলল,’আমি তোমাকে ভালোবাসি বাচ্চা।খুব বড় হও জীবনে।চারপাশের মানুষদের ভালোবাসা তোমায় আজীবন মুড়িয়ে রাখুক,এটাই চাই।’

তাসনুভা লাজুক হাসল।মাথা নামিয়ে নিজের পা জোড়া দেখতে দেখতে বলল,’থ্যাংক ইউ।’

ইজমা নাক ছিটকায়।আই লাভ ইউ এর জবাবে থ্যাংক ইউ কে বলে?সে মনে মনে বিড়বিড় করে,’থ্যাংক ইউ না রে বোকা,আই লাভ ইউ টু বল।’
.
.
.
.
নবনীতা বাজারে গিয়েছিল।গত সপ্তাহে তরকারি কেনা হয় নি,আজ কিনতে হবে।খুব বেশি কিছু কিনলো না সে।যেগুলো একদম না হলেই নয়,কেবল সেগুলোই কিনলো।

ফিরে আসার পথে একটা গাড়ি পুরোপুরি তার পাশ ঘেঁষে গেল।নবনীতা আঁতকে উঠল।তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে রাস্তার এক মাথায় গিয়ে পড়ল।তার হাতে থাকা আলুর প্যাকেট থেকে কয়েকটা আলু গড়িয়ে রাস্তায় পড়েছে।সে বিরক্ত,ভীষণ ভীষণ বিরক্ত।কুঁচকানো মুখে একবার গাড়িটাকে দেখে আলুগুলো পুনরায় প্যাকেটে নিল।সবকিছু গুছিয়ে উঠতে গিয়ে সে টের পেল একা একা উঠা তার পক্ষে সম্ভব না।একহাতে এতোগুলো ব্যাগ নিয়ে সে নিজ থেকে উঠে দাঁড়াতে পারবে না।

তখনই একটি বাইক তার থেকে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।বাইকে থাকা ব্যক্তিটা গা ঝাড়তে ঝাড়তে তার দিকে এগিয়ে এলো।এসেই খপ করে তার এক হাতের কবজি চেপে ধরল।নবনীতা বিষম খেল।এমন অনুমতি না নিয়ে কেউ কাউকে ছোঁয়?

একটানে লোকটা তাকে তুলে দাঁড় করালো।তারপর মাটির দিকে ঝুঁকে তার ব্যাগটা তুলে তার হাতে দিলো।নবনীতা শুরুতে খানিকটা অন্যমনস্ক ছিলো।কিন্তু হঠাৎই তার চোখ পড়ল তার হেলমেটে আবৃত মুখের উপর।মুহুর্তেই ইন্দ্রিয় সমূহ সচেতন হলো তার।ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন থমথমে রূপ ধারণ করে,এমনি থমথমে মুখে সে তার সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখল।

এমন শরীরের গঠন,এমন হেলমেট দিয়ে আড়াল করে রাখা মুখ,এই জোরাল হাতের বন্ধন-এগুলো তো নতুন কিছু না।নবনীতা এসবের সাথে পূর্বপরিচিত।শুধু একজনই তো আছে এই পৃথিবীতে যে তাকে এমন অবলীলায় যখন খুশি তখন ছুঁয়ে দিতে পারে।

সে নিষ্পলক চোখ। সামনে দেখতে দেখতে কাঁপা কন্ঠে বলল,’আপনি কি?’

বলেই সে আর অপেক্ষা করল না।একহাত বাড়িয়ে লোকটার হেলমেট স্পর্শ করতে চাইল।সাথে সাথে এক ঝাড়ায় নবনীতার হাত সরিয়ে দিলো সে।তার সাথে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে দ্রুত বাইকে চেপে বসল সে।আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না।নিজের আবেগের ঠেলায় সে বার বার ধরা খাচ্ছে।প্রথমে তাস,এখন এই পরী।এই মেয়ে গুলো এতো অদ্ভুত কেন?অবয়ব দেখেই তারা তাকে চিনে ফেলছে কেমন করে?নাহ,আর এখানে থেকে আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।তার মূল কাজ এখনো শেষ হয়নি।সেই কাজ করার আগে সে যে বেঁচে আছে,এই কথা এখনই কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না।

সে দ্রুত বাইক স্টার্ট দেয়।নবনীতা চমকে উঠে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।গলার স্বর চওড়া করে বলল,’প্লিজ!যাবেন না।দাঁড়ান আপনি।আমি আপনার মুখ দেখতে চাই।’

সে থামলো না।উল্টো স্পিড বাড়িয়ে উল্কার বেগে বাইকটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।পেছন থেকে নবনীতার আওয়াজ ক্ষীণ হতে হতে একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।সে টের পেল মেয়েটা প্রাণপণ ছুটছে তার বাইকের পেছনে।প্রচন্ড রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়।সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’এবার যদি আরেকটা উস্টা খাস,তো আর সেধে সেধে তোকে তুলতে যাবো না।রাস্তায় পড়ে থাক বেয়াদব।’

সে বাইক থামালো একেবারে ‘সুবাস মিত্র লেন’ এ এসে।খুবই আটসাট একটা গলি।চারপাশের বাড়ি গুলোর দেয়ালের রং খসে খসে পড়ছে।কেমন স্যাত স্যাতে একটা এলাকা।সামনে একটা চাপকল আছে।সেখান থেকে দিনের একটা সময় ওয়াসার পানি পাওয়া যায়।

সে আড়চোখে চারদিক দেখতে দেখতে একেবারে পূর্ব দিকের বাড়িটির দরজা ধাক্কায়।দুইবার কড়াঘাত করতেই প্রভাতি ছুটে এসে দরজা খুলল।তাকে দেখতেই বলল,’এতো দ্রুত চলে এসেছো?’

সে হেলমেট টা খুলে একটা পাশে রাখল।হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে বিছিয়ে রাখা তোষকে বসতে বসতে বলল,’বাইরে গেলেই ধরা পড়ে যাচ্ছি।তাই আপাতত এখানেই ঠিক আছি।’

প্রভাতি একটা লেবু কেটে সেটা গ্লাসের উপর ধরে চাপতে চাপতে বলল,’তো তুমি এমন লুকিয়ে আছো কেন?জালাল আর শফিক কে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে।তুমি এবার সবার সামনে চলে এলেই পারো।’

এই প্রস্তাব তার পছন্দ হলো না।সে মুখ কুঁচকে বলল,’নেভার।জালাল আর শফিকের কেচ্ছা খতম করার আগ পর্যন্ত আমি কারো সামনে আসছি না।’প্রভাতি গ্লাসের ভেতর পানি ঢালতে ঢালতে বলল,’তুমি কি করে তাদের কেচ্ছা খতম করবে?জেলে যাবে তুমি?’

শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সে বাঁকা হেসে বলল,’তোর কি মনে হচ্ছে তারা এতোদিন জেলে থাকবে?তাদের আদৌ কোনো শাস্তি হবে?’

প্রভাতি চোখ বাঁকা করে বলল,’হবে না বলছো?’

‘উমম।নেভার।’

প্রভাতি শরবতে চিনি গুলিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলো।বলল,’এতো কিছু জানি না।কিন্তু নবনীতা আপুকে দেখলে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।তোমার অন্তত তাকে জানানো উচিত ছিলো।’

পুরোটা শরবত একটানে শেষ করে সে ঘন ঘন দুইবার শ্বাস ছাড়ল।ভারি গলায় বলল,’কোনো প্রয়োজন নেই।তার সাথে কথা বললেই আমি বাকিদের নজরে আসবো।আমার ফ্যামিলি মেম্বারদের উপর এমনিতেই চব্বিশ ঘন্টা মানুষের নজর থাকে।’

সে হাঁসফাঁস করতে করতে শার্টের একটা বোতাম খুলল।প্রচন্ড ক্লান্ত গলায় বলল,’স্ট্যান্ড ফ্যান টা চালু কর প্রভা।গরমে ম’রে যাচ্ছি।’

প্রভা দ্রুত সুইচ টিপে ফ্যান চালু করল।এমনভাবে পাখাটা সেট করল যেন শুধু সেই বাতাস পায়।স্ট্যান্ড ফ্যানের ঠান্ডা হাওয়ায় আরামে চোখ বুজতে বুজতে সে বলল,’এসব ঝামেলা মিটলে তোকে একটা সিলিং ফ্যান কিনে দিব।কিসব স্ট্যান্ড ফ্যান ইউজ করিস তুই! গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।’

***

কারাগারের সামনে নেতা কর্মীদের ভীড় জমেছে।অল্প বয়সী ছেলে থেকে শুরু করে মাঝবয়সী লোক,সবাই এসেছে কাশিমপুর কারাগারে,তাদের প্রিয় নেতাদের মুক্তির আনন্দে।

বেলা এগারোটা নাগাদ নত মস্তকে কারাগারের খুপরি আকৃতির লোহার গেইট অতিক্রম করে বেরিয়ে এলো জালালুর রহমান আর শফিক সিকদার।সঙ্গে সঙ্গে দলের নেতা কর্মীরা সব তাদের ঘিরে ধরল,ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নিল তাদের প্রিয় নেতাদের।শফিক আর জালালের জামিন মঞ্জুর হয়েছে।আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেছে।এতো এতো সাক্ষ্য প্রমাণের পরেও তাদের মুক্তি হয়েছে।হবে নাই বা কেন?তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা।তাদের দল ক্ষমতায় বসে আছে।সাক্ষ্য প্রমাণ আর তথাকথিত বিচারব্যবস্থার থোড়াই পরোয়া করে তারা।একটা মানুষকে নি’র্মম ভাবে হত্যা করার পরেও বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে বরণ করা হলো জালাল আর শফিককে।এই দেশে সুবিচার বলতে কোনো শব্দ নেই।ক্ষমতা যার হাতে,রায়ের পাল্লাও তার দিকেই খানিকটা ঝুকে থাকে।তার জন্য সবকিছুতেই বিশেষ ছাড় আছে।

রাতে ডিসট্রিক্ট ক্লাবে জমকালো আয়োজন করা হলো।জালাল,শফিকসহ আরো ডজন খানেক নেতা মদ খেয়ে টাল হলো।নর্তকীদের সাথে নাচ গান,একটার পর একটা মদের বোতল শেষ করতে করতে রাত গভীর হলো।ক্লাব ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করেছে।উচ্ছনে যাওয়া নরপ’শুরা তাদের পুরোনো খেলায় মেতে উঠেছে।মদ খেয়ে তাল হারিয়ে যার তার গায়ে গিয়ে পড়ছে।চারদিকে হাই ভলিউমে চলছে গানের শব্দ।নিস্তব্ধ রাতে সেই শব্দ কানে তালা দেওয়ার মতোন অবস্থার সৃষ্টি করে।

ক্লাবের কর্মচারীরা তখন সারাদিনের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত।আর পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যাওয়া আধবুড়ো লোকজন তখন ব্যস্ত নারী শরীরের ভাঁজে নিজেদের কৈশোর খুঁজে নিতে।

রুম নম্বর টু টুয়েন্টি থ্রি।তিন বারের মতো হুইস্কি গলাঃধকরণ করে জালালুর রহমান তখন ঢুলছিলেন।এলোমেলো কদম,এখুনি পড়ে যাবে যাবে করে পরে আর পড়লো না।তার ঘরের একেবারে মাঝটায় দাঁড়িয়ে আছে একটি নারী কায়া।জালালুর রহমান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজান।লোভাতুর নজরে একনজর দেখেন ঘরে উপস্থিত সেই রমনীর দেহ অবয়ব।শরীরে নিষিদ্ধ বাসনা জেগে উঠে,সেই বাসনা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গাত্রে,শিরা থেকে উপশিরায়,ধমনী থেকে কৈশিক জালিকায়।নিজের পুরোনো নেশায় মত্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে জালাল এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।কামুক বাসনা পূরণের নিমিত্তে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে টেনে ধরলেন মেয়েটা হাত।

সহসা মাথার উপর চাপানো ঘোমটা ফেলে সরাসরি তার দিকে চোখ তুলে তাকালো মেয়েটি।জালালুর রহমান সেই অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বল জ্বল করতে থাকা নেত্রযুগল দেখে থমকে গেলেন।তার চোখে যেই ক্রোধ আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল,সেই আগুনের লেলিহান শিখায় ভ’স্ম হলেন জালালুর রহমান।আচমকাই মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে চড় মারল।এক চড়েই জালালুর রহমান ঢুলতে ঢুলতে মাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়লেন।তার কপাল গিয়ে ঠেকল টাইলস বিছানো শক্ত মেঝেতে।ঘোলা চোখে তিনি একহাতে কপালে ছোঁয়ালেন।নাহ,আজ মদ একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।দুই হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে তিনি কোনোরকমে মাথা তুলে সামনে দেখার চেষ্টা করলেন।

প্রথমে দরজায় লক ঘোরানোর শব্দ হলো।তারপর খটখট শব্দে মূল দরজা খুলে গেল।বুট জুতা পরিহিত পা জোড়া ঠক ঠক শব্দ করে ভেতরে প্রবেশ করল।জালাল কেবল তার পা জোড়াই দেখল।তার চোখ ধীরে ধীরে তার পা ছাড়িয়ে একটু একটু করে উপরে উঠে গেল।হঠাৎই তার হাতে থাকা ধাতব বস্তুটা দেখে তার বুক ধড়াস করে উঠল।ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ধাতব আর সূচালো বস্তুটি চকচক করে উঠল।জালালুর রহমান আঁতকে উঠে খানিকটা সরে গেলেন।ফ্লোরেই হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যেতে চাইলেন।

ছেলেটা নির্বিকার হয়ে সামান্য ঝুকল।একবার জালালের রক্তশূন্য,নীল হয়ে যাওয়া মুখটা,,আর একবার নিজের হাতে থাকা ধারালোর ছু’রিটা গভীর চোখে দেখল।জালাল থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তি জুড়িয়ে বললেন,’এ-এ্যাই তুই কে?’

সে আরো সামান্য ঝুকল।নিয়ন আলোয় ডুবে থাকা নিস্তব্ধ ঘরটার সমস্ত নিরবতা ছাপিয়ে গম্ভীর হাস্কি স্বরে বলল,’আমি তোর যম।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬৮

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬৮)
[বড় পর্ব,পরে রিচেক দিবো]

কোনো আসামি যদি আদালতে কেস চলমান থাকা অবস্থায় মৃ’ত্যৃবরণ করে,তবে তার বিচার প্রক্রিয়ার সেখানেই ইতি টানা হয়।বাংলাদেশের আইন এমনটাই বলে।এই দেশে জীবিত মানুষই ন্যায় বিচার পায় না।সে জায়গায় মৃত ব্যক্তির বিচার করা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না।আরহামের কেসটা তার মৃ’ত্যুর সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু তার আইনজীবী সানাউল হকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে তার কেস রি-ওপেন করা হয়েছে।সানাউল হকের দাবি,আরহাম নির্দোষ।আর একজন নির্দোষ ব্যক্তি কোনো ক্রমেই খু’নের দায় কাঁধে নিয়ে মৃ’ত্যুবরন করতে পারে না।

এই নিয়ে আদালতে আরো একটা শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।খুব সম্ভবত আশ্বিনের আঠারো তারিখ সজীব খন্দকার হ*ত্যার দ্বিতীয় দফায় শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছিল।

ওয়াজিদ বেশ সকালেই আদালতে গিয়ে উপস্থিত হলো।ইদানিং তার শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগে।হাত পা কেমন ভেঙে ভেঙে আসে।রিমির শরীরটাও খুব একটা ভালো না।জ্বর ঠান্ডা এসব লেগেই আছে।আর তার মনের অবস্থা? এই নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই।সে আর আদি রোজ রাতে ছাদে গিয়ে বসে।আকাশ দেখে,তারা দেখে,অথচ তারা কিছুই দেখে না।একটা মানুষ এমন দুম করে হারিয়ে যেতে পারে?এমন হুট করে একটা মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে?তেইশ বছরের বেশি সময়ের বন্ধুত্ব এমন চোখের পলকে হারিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব?ওয়াজিদের বুক ভার ভার লাগে।নবনীতার মতো তারও মনে হয় তার বুকে কেউ এক মণ বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত এই নিষ্প্রাণ প্রাণ গুলোতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

সানাউল হক কেন পুনরায় এই কেস রি-ওপেন করিয়েছে ওয়াজিদ জানে না।সে যতদূর জানে আরিশ কিংবা নবনীতা কেউই এখন মানসিকভাবে অতোটা মজবুত নেই যে তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে।আর এধরনের আপিল কেবল মাত্র আসামির পরিবারের অনুরোধের প্রেক্ষিতেই হয়।তাহলে সানাউল হক কার অনুরোধে এই কেস পুনরায় চালু করার আবেদন করেছেন?

সে আর মাথা ঘামায় না।যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।সেও এর শেষ দেখতে চায়।দেখতে চায় সানাউল হক ঠিক কি উপায়ে আরহামকে নির্দোষ প্রমাণ করে।

নবনীতা এসেছে একটু আগে।আসার পরই কোনোদিকে না দেখে সে সোজা কোর্ট রুমের ভিতরে গিয়ে বসল।তার দুই চোখের নিচে কালি জমেছে।কতোগুলো দিন হয়েছে সে প্রাণভরে শ্বাস নেয় না।এই বাতাসে বিষ মেশানো।নবনীতা শ্বাস নিবে কেমন করে?

আদালতের বিচারকার্য শুরু হলো আরো আধঘন্টা পরে।শুরুতেই সাক্ষ্য প্রমাণের পর্ব।সানাউল হক কিছু প্রত্যক্ষ দর্শীর মতামত,সজীব খন্দকারের ফরেনসিক রিপোর্ট,আরহামের সেখানে যাওয়ার সময়-সবকিছুকে একত্রে দেখিয়ে যেই তথ্য দাঁড় করালেন তা হলো এই যে,রিপোর্ট অনুযায়ী সজীবের মৃত্যু যেই সময়ে হয়েছিল,আরহাম সেই সময় তার বাড়িতে ছিলোই না।সুতরাং,আরহাম তাকে মে’রেছে এটা একেবারেই অসম্ভব।

বাদী পক্ষের আইনজীবীর নাম খালেদ।তিনি সানাউল হকের কথা শেষ হতেই বিদ্রুপ করে বললেন,’আর কোনো তথ্য প্রমাণ না পেয়ে এসব ফরেনসিক রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন?ফরেনসিক রিপোর্ট কখনোই এক্যুরেট টাইম মিয়েজার করতে পারে না।’

তিনি থামলেন।সামনে ফিরে বিচারকের দিকে দৃষ্টি তুলে আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন,’ইউর অ’নার! আমার কাছে এমন একজন সাক্ষী আছে,যার বয়ানে পুরো কেসটা পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।আমার মনে হয় না এরপর আর কারো কোনো প্রশ্ন থাকবে।’
কথা শেষে তিনি তীর্যক চোখে সানাউল হককে দেখতে ভুললেন না।

সানাউল হক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।চুপচাপ গিয়ে তার জন্য নির্ধারিত আসনে বসলেন।বিচারকের অনুমতি পেতেই খালেদ হাতের ইশারায় একটি মেয়েকে আদালতের মূল কক্ষে প্রবেশের জন্য ডাকলো।সে ছোট ছোট কদমে ভেতরে আসতেই পুরো কক্ষের মানুষজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল।নবনীতা এলোমেলো চোখে একবার সেদিকে তাকাতেই তার দিকে চোখ পড়লো।মেয়েটাকে দেখতেই তার মুখ বিস্ময়ে হা হলো।সে অবাক কন্ঠে শুধায়,’প্রভা! তুমি?’

প্রভাতি স্থির চোখে একনজর তাকে দেখল।তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে বড় বড় পায়ে কাঠগড়ার দিকে এগিয়ে গেল।তার হৃদস্পন্দন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।একটা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করল সে।

সে কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াতেই খালেদ দুই ঠোঁটে চওড়া হাসি ঝুলিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।এই মেয়ের সাথে কালকে রাতেই তার কথা হয়েছে।মেয়েটা মাত্র দুই হাজার টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজি হয়েছে,তাও আবার নিজেরই বিরুদ্ধে।সে একবার তার সাক্ষ্য দিয়ে দিলেই খালেদ এই কেসটা জিতে যাবে।আলাউদ্দিন আর জালাল তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিবে যদি সে এই কেস টা জিততে পারে।

তিনি একটা হাত কাঠগড়ায় রেখে জানতে চাইলেন,’তো প্রভাতি,তুমি বলো সজীবের মার্ডার কেস নিয়ে কি জানো তুমি?তুমি কি কিছু দেখেছো?’

প্রভাতি শান্ত চোখে কয়েক পল তাকে দেখল।ভেতরের জ্বলন্ত অগ্নিশিখাকে দমিয়ে রেখে ধিমি স্বরে বলল,’আরহাম ভাইকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি।আমি তাদের অরফানেজ সেন্টারে বড়ো হয়েছি।যেদিন সজীব খন্দকার কে খু’ন করা হয়,সেদিন আরহাম ভাই আমাকে তার বাড়ির এড্রেস পাঠায়।আমাকে বলে আমি যেন সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করি।’

নবনীতা রুদ্ধশ্বাসে তার কথা শুনে।সে থামতেই বিক্ষুব্ধ কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠে,’মিথ্যা কথা।এতো মানুষ থাকতে সে তোমায় কেন ফোন দিবে?’

খালেদ কঠোর চোখে তার দিকে তাকালো।চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’আপনি সবকিছুতে কথা বলেন কেন?প্রভাতি কথা বলছে,তাকে বলতে দিন।’

‘আপনার প্রভাতি ভুলভাল কথা বলছে।’ ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দিলো নবনীতা।

জজের আদেশে শেষপর্যন্ত সে দমে গেল।বিক্ষিপ্ত মেজাজে ধাম করে পুনরায় তার আসনে গিয়ে বসল।প্রভাতি একটু কেশে নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,’আমি যখন সেখানে যাই,তখন আরহাম ভাই আমাকে বলে যে সে সজীবকে খু’ন করবে।আমি যেহেতু তার পূর্ব পরিচিত,তাই এই কাজে সে আমার সাহায্য চায়।সাথে এটাও বলেছে যে আমি যদি তাকে সাহায্য করি,তবে সে আমায় নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিবে।আমার সেসময় টাকার অনেক প্রয়োজন ছিলো,তাই আমিও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।আর তারপর আমরা দু’জন মিলে সেদিন দুপুরে সজীব খন্দকার কে ছু’রি মে’রে খু’ন করেছি।’

সে থামল।ঘন ঘন শ্বাস টেনে নিজের অস্থিরতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করল।ওয়াজিদ এক লাফে নিজের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ক্ষুদ্ধ হয়ে বলল,’হোয়াট ননসেন্স! যা তা বলছো তুমি।’

আদির মাথা ঘুরে গেল।এই মেয়ে কি পাগল নাকি?কিসব উল্টা পাল্টা বকছে।সে দাঁতে দাঁত চেপে খেঁকিয়ে উঠলো,’যতসব পাগল ছাগল!টাকা খেয়ে বানিয়ে বানিয়ে সাক্ষী দিচ্ছে।আমাদের মতো বন্ধু থাকতে আরহাম এই মেয়ের সাহায্য কেন নিবে?সে নিশ্চয়ই তাকে আমাদের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে না?’

খালেদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।সামনে দেখে বিনীত কন্ঠে বললেন,’দেখলেন তো ইউর অনার।কিভাবে এরা আক্রমনাত্মক কথা বলে মেয়েটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে?’

ওয়াজিদ ধপ করে বেঞ্চে গিয়ে বসল।একটানে আদিকেও তার পাশে বসালো।আদি এক ঝাড়ায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গজরাতে গজরাতে বলল,’হাত ছাড় বাল।এমন ভুলভাল কথা বললে আক্রমণ করবো না তো কি করবো?ফালতু মেয়ে একটা!’

প্রভাতি একগাল হাসল।তার কথায় কোনোরকম ভ্রক্ষেপ না করে সামনে দেখতে দেখতে বলল,’কিন্তু এটা আংশিক সত্য।পুরো সত্য আমি এখনো বলিনি।’

খালেদ সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়ল তৎক্ষনাৎ।এই মেয়ের সাথে তার এইটুকু কথা বলারই চুক্তি হয়েছিল।সে আবার অন্য কি সত্য নিয়ে এসেছে?তিনি ললাট কুঞ্চন করে জানতে চাইলেন,’সেটা কি?’

প্রভাতি দম নিল।আর কোনো দিকে না দেখে বিচারকের আসনে থাকা ভদ্রলোকের দিকে চোখ রেখে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলল,’আমি আর আরহাম ভাই একা সবকিছু করিনি।সজীব খন্দকারকে খু’ন করার কাজে আমাদের আরো একজন সাহায্য করেছিল।’

আপনাআপনি চোয়াল ঝুলে গেল খালেদের।তিনি থতমত খেয়ে জানতে চাইলেন,’সে কে?’

‘সজীব খন্দকারের বাড়ির কেয়ার টেকার মনসুর।মনসুরই দরজা খুলে আমাদের ঢুকতে দিয়েছিলো,আর মনসুরই সবার প্রথমে তাকে আঘাত করেছিল।’

মনসুর তখন কোর্ট রুমেই ছিলো।প্রভাতির মুখে এই কথা শুনতেই সে তব্দা খেল।এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল,’এ্যাই মেয়ে! কিসব মিথ্যা বলছো তুমি?আমি তোমাকে কেন সাহায্য করব?আমি তো তোমাকে চিনিই না।’

প্রভা দুই হাতের আঙুলগুলো আড়াআড়ি করে প্রশ্ন করল,’তুমি আমাকে চেনো না?’

মনসুর গলা উঁচু করে চেঁচায়,’না চিনি না।’

প্রভার চোখ সরু হলো।সে গম্ভীর হয়ে বলল,’মিথ্যে বলছ তুমি।তুমিই প্রথম দরজা খুলেছ,আর প্রথম ছু’রির আঘাতটাও তুমিই করেছো।সেই হিসেবে তুমিও আমাদের মতো সমান দোষী।ভালো হয় যদি তুমিও আমার মতো নিজের দোষ স্বীকার করে নাও।’

মনসুর খেই হারালো।কিসব উল্টাপাল্টা বলছে এই মেয়ে!খালেদ নিজেও ভড়কে গেল কিছুটা।কেবল এক চিলতে হাসির দেখা মিলল সানাউল হকের ঠোঁটে।

যখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আর কোনো পথই অবশিষ্ট রইলো না,তখন ভরা কোর্ট রুমে সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে মনসুর চেঁচিয়ে উঠল,’সব মিথ্যা!আমি কাউকে মারি নি।সবার আগে সজীব স্যারকে মা’রছে জালাল স্যার।তারপর শফিক স্যার।আমি শুধু দরজা খুলছি।আর কিছু না।’

পুরো ঘরটায় একটা বজ্রপাত হলো।সেই বজ্রপাতে লণ্ডভণ্ড হলো জালালুর রহমানের সমস্ত পরিকল্পনা।খালেদ ধপ করে তার আসনে গিয়ে বসলেন।শেষ,তিনি হেরে গেছেন।এই মেয়ে মোটেও তার হয়ে সাক্ষ্য দিতে আসেনি।পুরোটাই সানাউল হকের পরিকল্পনার অংশ।তিনি আড়চোখে সানাউল হককে দেখলেন।যার ঠোঁটে এখন রাজ্য জয়ের হাসি।তিনি সফল।একজন নিরপরাধের নামের পাশ থেকে আসামির তকমা সরাতে তিনি সক্ষম।

নবনীতা স্তব্ধ হয়ে প্রভাকে দেখল,তারপর দেখল মনসুর কে।তারপরই নিচের ঠোঁট টা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল।কতো অবলীলায় নিজের করা খুন আরেকজনের নামে চাপিয়ে দিলো! একবার ভাবলো না ঐ ছেলেটা এই কয়দিন কি পরিমান মানসিক পীড়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে! শুধু মানসিক পীড়া?মানুষ যে কতো বাজে বাজে কথা বলল তার নামে,ঐসবের কি হবে?নবনীতা ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ে।ছলছল চোখে প্রভাতির মুখটা দেখে! এতো চমৎকার কেন এই মেয়ে?

মনসুরকে কাঠগড়ায় তুললেই সে কান্নায় ভেঙে পড়লো।দুই হাত জোড় করে নতজানু হয়ে বলল,’আমার কোনো দোষ নেই স্যার।আমি শুধু দরজা খুলছি।তাদের কাজে বাঁধা দিলে আমাকেও মাইরা ফেলতো।আমি শুধু দেখছি,কিন্তু কিছু করি নাই।বিশ্বাস করেন,স্যারের গায়ে একটা আঁচড়ও আমি দেই নাই।’

সানাউল হক তার দিকে এগিয়ে গেলেন।খানিকটা রাগত স্বরে প্রশ্ন করলেন,’তাই যদি হয়,তবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন কেন?আপনি জানেন আপনার একটা মিথ্যা সাক্ষ্যর কারণে একজন মানুষকে কি পরিমান হেনস্তার স্বীকার হতে হয়েছিল?’

‘আমাকে টাকা দিয়েছিল স্যার।আমরা গরীব মানুষ।অতোগুলো টাকা দেখে নিজেকে সামলাতে পারি নাই।’

মনসুর পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ল।ধরা যখন পড়েই গেছে,তখন কান্না ছাড়া আর উপায় কি?আজ তার কোর্টে আসাই উচিত হয় নি।এই ধিঙি মেয়ে যে তাকে ফাঁসানোর জন্যই এখানে এসেছে,সেই খবর কি মনসুরের জানা ছিলো?

****

আদালতের কার্যক্রম সেদিনের মতোন শেষ হলো।সকল সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে শাহরিয়ার আরহামকে আদালত নির্দোষ বলে রায় দিয়েছে।সেই সাথে সজীব খন্দকারকে হত্যার দায়ে জালালুর রহমান,শফিক সিকদার সহ আরো ছয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।আদালত প্রাঙ্গণে থাকা পুলিশ ভ্যানটা রায় ঘোষণার পর পরই ছুটে গেছে তাদের খোঁজে।

পুরো আদালত ফাঁকা হতেই নবনীতা এক দৌড়ে গিয়ে প্রভাতিকে জড়িয়ে ধরল।আনত কন্ঠে বলল,’প্রভা! তোমার সাথে দেখা করার আমার খুব ইচ্ছে ছিলো।’

প্রভাতি স্মিত হাসল।একটা হাত নবনীতার গালে রেখে বলল,’তোমার সাথে দেখা করে খুব ভালো লাগছে।কেমন আছো আছো আপু?’

মেয়েটার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল সহসা।সেখানে এসে ভীড় জমালো রাজ্যের মলিনতা।তার বিষন্ন,বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে প্রভাতি আপনাআপনি জবাব পেল সে ভালো নেই।এতো ঝড় ঝাপটার পর কেউ ভালো থাকতে পারে না।সে কোনোরকমে বলতে চাইল,’প্রভাতি! আরহাম আমাকে,,,’

অথচ মুখের কথা শেষ না করেই সে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল।তার রোগা শরীর এই কয়দিনে আরো বেশি ভর হারিয়েছে।বড্ড রোগা লাগে তাকে আজকাল! মানসিক অবস্থার বিধ্বস্ত ছাপ মুখের উপরও এসে পড়ছে।মা বাবার মৃ’ত্যু সে মুখ বুজে সহ্য করেছে।এই যন্ত্রণা কি যথেষ্ট ছিলো না?এখন স্বামীর মৃ’ত্যুর যন্ত্রনাও তাকে সহ্য করতে হবে?আর কতো যন্ত্রনা সহ্য করে উঠে দাঁড়াতে পারলে প্রমাণ হবে যে সে খুব সাহসী আর ধৈর্যশীল?নবনীতা আর পারছে না।সবকিছু গুছিয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর মতো জোর সে পাচ্ছে না।আজকাল সবকিছুই তার বিরক্ত লাগে।কেমন অনুভূতিশূন্য লাগে সবকিছু।চারদিকে কতো কিছু ঘটে যাচ্ছে।সে কেবল শূন্য চোখে সেসব দেখছে,দেখেই যাচ্ছে।

শুভ্রা কিছুদিন আগে ময়মনসিংহ চলে গেছে।মেডিকেল হোস্টেলের গণরুমই আপাতত তার ঠিকানা।নবনীতা প্রথমদিন গিয়ে তাকে রেখে এসেছিল।তারপর আর সেখানে যাওয়া হয়নি।মেয়েটা কোথায় আছে,কেমন আছে জিজ্ঞেস করা হয়নি।একবার গিয়ে দেখে আসলে মন্দ হতো না।কিন্তু নবনীতার শরীর কিছুতেই সায় দেয় না।বড্ড ক্লান্ত লাগে আজকাল।

প্রভার ফোনে একটা শব্দ হতেই সে দ্রুত সেটা হাতে নেয়।একনজর স্ক্রীন দেখেই দ্রুত পায়ে নবনীতার দিকে এগিয়ে এসে বলল,’আপু ঔষধ খেয়েছো?তোমার না এন্টিবায়োটিক এর কোর্স চলছে?’

নবনীতা চমকালো কিছুটা।আশ্চর্য হয়ে মাথা তুলে বলল,’তুমি কেমন করে জানো আমার যে ঔষধের কোর্স চলছে?’

***

একেবারে নতুন শহর,নতুন মানুষজন।পড়াশোনার ধরনও নতুন।শুভ্রানী সেসবের সাথে একদম মানিয়ে নিতে পারছিল না।শেষমেশ দাঁতে দাঁত চেপে মানিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামল সে।একে তো নতুন শহর,তার উপর আপাইয়ের এই অবস্থা।শুভ্রা রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

তার এখানে ভীষণ একা একা লাগে।আপাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে।মন চায় আপাইকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যেতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।আপাই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।শুভ্রানীর ইদানিং ভয় লাগে।মনে হয় আপাই ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে।তার কাজ-কর্ম,আচার আচরণ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।শুভ্রার তাকে নিয়ে বড্ড ভয় হয়।অবেলার বৃষ্টিতে আপাইয়ের জীবনটা এমন ছন্নছাড়া হয়ে যাক,সে চায় না।আপাইকে সাত বছর আগে সে যেমন বিধ্বস্ত রূপে দেখেছিল,আজ এতোগুলো বছর পর আপাই আবার সেই এলোমেলো রূপে ফিরে গেছে।এই মুর্ছা যাওয়া মানুষটাকে দেখতেই শুভ্রার ভেতরটা ধ্বক করে উঠে।

সেদিন বিকেলে একজন তাকে ডেকে বলল,’পুষ্পিতা নূর! তোমার সাথে দেখা করার জন্য কে যেন এসেছে।’

সে কপাল কুঁচকে বলল,’আমার সাথে দেখা করতে এসেছে?’

পুরো রাস্তা সে ভাবতে ভাবতে গেল কে এমন হতে পারে যে তার সাথে দেখা করতে এসেছে! তার তো পরিচিত কেউ এখানে নেই।অন্যভাবে বলতে গেলে তার জীবনে চেনা জানা মানুষের সংখ্যা একেবারেই সীমিত,হাত দিয়ে গুনে ফেলা যায় এমন।

ওয়েটিং রুমে পা রাখতেই তার কদম থামল।সে থমকে গিয়ে সামনের দিকে তাকায়।নবনীতা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।এক প্রকার ছুটে এসে তাকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বলল,’কেমন আছিস আমার সোনা বাচ্চা?আপাই এই কয়দিন একদমই তোকে সময় দিতে পারি নি।’

শুভ্রা সেসব কিছু শুনল না।কেবল শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ভেঙে বলল,’আমার এদিকে একদম ভালো লাগে না আপাই।আমি তোমার কাছে থাকতে পাই।’

নবনীতা তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে আলতো করে সেখানে দু’টো চুমু খেল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’এসব বলে না শুভি।জীবনে কিছু হওয়ার জন্য তো কষ্ট করতেই হয়।তাই না?’

শুভ্রা মাথা তুলল।আশপাশ দেখে চিন্তিত হয়ে বলল,’তুমি একা এসেছো?সাথে কেউ আসেনি?’

‘এসেছে।আরিশও এসেছে সাথে।’

‘উনাকে আনো নি কেন এখানে?’

‘গার্লস হোস্টেল।আরিশের ভেতরে আসার অনুমতি নেই।’

‘ওহহ।চিত্র কোথায়?আনো নি চিত্রকে?’

‘নাহ।কাল রাত থেকে চিত্রর গলা ব্যাথা।ঠান্ডা লেগেছে বোধ হয়।তাই আর আনিনি।মামির কাছেই রেখে এসেছি।’

শুভ্রা ছোট করে জবাব দিলো,’ওহ।’

হোস্টেলের গেইটের কাছে আসতেই আরিশের সাথে তার দেখা হলো।আরিশ স্মিত হেসে জানতে চাইল,’কেমন আছো শুভ্রা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি?’

‘আছি।আলহামদুলিল্লাহ।’

সেদিন তারা তিনজন মিলে খুব ঘুরাঘুরি করল।হুট করে ময়মনসিংহ আসার এই সিদ্ধান্ত নবনীতার।শুভ্রা নতুন শহরে এসেই একা একা চলতে শিখুক,এটা সে চায় না।সে চায় শুভ্রা আস্তে ধীরে বুঝে শুনে চলুক।তাই এমন কোনো কিছু না ভেবেই সে এই শহরে চলে এসেছে।

সে ভেবে নিয়েছে নিজের ভেতরের অসহ্য যন্ত্রণা সে আর প্রকাশ করবে না।সে বয়সে বড়।তার উপর শুভ্রা আর চিত্রর দায়িত্বভার আছে।নবনীতা আর যাই হোক,সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।স্বামী মরল কি বাঁচলো,নবনীতা বদ্ধ উন্মাদ হলো কি না হলো,এসবে তার উপর চাপানো দায়িত্বভার হালকা হবে না।তাকে পেন্ডুলামের মতো চিরকাল চলতে থাকতে হবে।তার কোনো বিশ্রাম নেই,কোনো বিরাম নেই,কিচ্ছু নেই।শুভ্রার যখন মন খারাপ হবে,তখন সে নবনীতা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে।চিত্র যখন পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবে,তখন সে আপাইকে এসে জড়িয়ে ধরবে।তাসনুভার যখন রাতে হুট করে ঘুম ভেঙে যাবে,তখন সে ভাবির কোলে মাথা রেখে নাক টানতে টানতে পুনরায় ঘুমিয়ে যাবে।আর সাংঘাতিক মানসিক যন্ত্রনায় যখন নবনীতার সমস্ত পৃথিবী আধার হয়ে আসবে,তখন সে একা একটা বন্ধ ঘরের ফ্লোরে শুয়ে চিৎকার করে কাঁদবে।কারণ তার কোনো যাওয়ার জায়গা নেই।এমন কেউ নেই যাকে জড়িয়ে ধরে নবনীতা হাউমাউ করে নিজের মনের অবস্থা বোঝাবে।সে একা,ভীষণ একা।শীতের রাতে স্টেশনের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা অনাথ বাচ্চাটা যেমন একা,সেও ঠিক তেমনই একা।
.
.
.
.
‘এই বাচ্চা! এদিকে তাকাও।’

আদির ডাকে সামনে থাকা মেয়েটার কোনো ভাবোদয় হলো না।সে অসহায় চোখে ইজমার দিকে তাকালো।ইজমা একটু ঝুকে একটা হাত হুইল চেয়ারের হাতলে রেখে ডাকল,’তাসনুভা?শুনতে পাচ্ছো তুমি?’

তাসনুভা এলোমেলো চোখে তার দিকে তাকায়।ইজমার সাথে চোখাচোখি হতেই আরো এক দফা তার চোখ ভিজে উঠল তার।একেবারে ভেঙে আসা কন্ঠে সে বিড়বিড় করল,’বাড়ি চলো।ভালো লাগছে না কিছু।’

আদি মাথায় হাত রাখলো।ইজমা মলিন চোখে তার দিকে তাকালো।ইশারায় বোঝালো কিছুতেই কাজ হবে না।আদি কেবল বিনিময়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আরহামের ঐ দুর্ঘটনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি যে দুইজনের উপর পড়েছে তারা হলো নবনীতা আর তাসনুভা।নবনীতা যদিও ঠোঁট কামড়ে সবটা সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা করে,তবে তাসনুভা এই ব্যাপারে প্রচন্ড আবেগপ্রবণ।সে প্রতিদিন এক নাগাড়ে হাউমাউ করে বড় ভাইয়ার জন্য কান্না করে।এবং এই দুই মাসেও তার আচরণে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আসে নি।তার কান্না শুরু হয় সকালে,সেই কান্না থামে রাতে।তার চকলেট,চিপস কিচ্ছু চাই না।শুধু বড় ভাইয়াকে চাই।আর কিচ্ছু না।সে যখন একদম কোনো কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না,তখন আদি একটা ভয়ংকর কাজ করল।সে তাসলিমার সাথে তাসনুভার দেখা করালো।তার উদ্দেশ্য ছিল মেয়েটার মন ভালো করা,যেহেতু সে তার মা কে পছন্দ করে।

কিন্তু হলো এর উল্টা।তাসলিমা সামনে আসতেই তাসনুভা চটে গেল।চেঁচিয়ে উঠে বলল,’তুমি কেন এসেছো এখানে?আমি তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছি?’

আদি হতভম্ব হয়ে বলল,’তুমিই তো তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাইতে।’

‘আগে চাইতাম।এখন চাই না।লাগবে না আমার মা।আমার বড় ভাইয়াকে লাগবে।মা কে না।’

তাসলিমা অপমানিত হলেন ভীষণ।তবে মেয়েটা তার সেই অপমানের পরোয়া করল না।শুধু জড়ানো কন্ঠে বলল,’আমার ভাইয়া যাকে ভালোবাসে না,আমিও তাকে ভালোবাসি না।আমার কিচ্ছু লাগবে না।শুধু বড় ভাইয়া হলেই হবে।’

আদি এই অবুঝ মেয়েটাকে কেমন করে বোঝাবে যে বড় ভাইয়াকে নিয়ে আনা আদৌ সম্ভব না।তাসনুভাকে বোঝাতে গেলে তার নিজেরই গলা ভেঙে আসে।এই কথা কোনো ভাবেই সে বলতে পারে না যে আরহাম আর নেই।তার পক্ষে বলা সম্ভব হয়ে উঠে না।কন্ঠনালি ছিঁড়ে যায়,বুক ধুকধুক করে।

ইজমা আশাহত হয়ে বলল,’চল আমরা দু’জন সামনের দোকান থেকে চিপস টিপস কিছু কিনে আনি।দেখি তারপর মন একটু ভালো কয় নাকি?’

আদি বিনিময়ে কেবল মাথা নাড়ল।আজ তারা ধানমন্ডির একটা পার্কে এসেছে।তাসনুভার মন ভালো হবে এই আশাতেই তাদের এখানে আসা।অথচ সেই আশা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না।তাসনুভার বড় ভাইয়া ব্যতীত আর কিছুই চাই না।এখন এই পার্কের ভেতর বড় ভাইয়াকে কোথায় পাবে তারা?

সে আর ইজমা তাসনুভাকে একটা গাছের সামনে রেখে দোকানে গেল কিছু কেনার জন্য।তাসনুভা শূন্য চোখে চারপাশ দেখে।বাচ্চারা সব ছুটোছুটি করছে,খেলাধুলা করছে।এই দৃশ্য দেখতেই পুনরায় তার মন খারাপ হলো।সে,বড় ভাইয়া আর মেঝো ভাইয়া ছোট থাকতে এমন দৌড়াদৌড়ি করতো তাদের বাগানে।মুহূর্তেই তার চোখ ভিজে যায়।বড় ভাইয়াকে ছাড়া পৃথিবী এতো মলিন কেন?

হঠাৎই কেউ তার সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসল।তাসনুভা হকচকিয়ে গেল এক প্রকার।চমকে উঠে সে তার দিকে তাকালো।সে তাকাতেই ছেলেটা তার মুঠ করে রাখা হাতটা তাসনুভার সামনে মেলে ধরল।তাসনুভা অবাক হয়ে দেখল তার হাতের মুঠো ভরে আছে শত শত বেলি ফুলে।সে ফ্যালফ্যাল চোখে সামনে তাকায়।দেখে কালো শার্ট গায়ে জড়ানো ছেলেটার মাথায় একটা হেলমেট চাপানো।চোখ দু’টো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।তার বুক ধড়াস করে উঠল।সে জিজ্ঞাসু হয়ে তার দিকে তাকালো।

হাতে থাকা এক মুঠো ফুল অতি সন্তর্পণে তাসনুভার কোলের উপর রাখল সে।বেলি তাসনুভার প্রিয় ফুল।এই কথা কি সে জানে না?তাসনুভা নিশ্বাস বন্ধ করে একবার তার কোল,আর একবার তার সামনে থাকা আগন্তুক কে দেখল।তার দুই চোখ চিকচিক করছে।মনে হচ্ছে ভেতরে সবকিছু ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে।

সে কাঁপা হাতে তার হেলমেট স্পর্শ করল।তৎক্ষনাৎ ছেলেটা এক লাফে উঠে দাঁড়ালো।তাসনুভা ভাঙা গলায় বলল,’তুমি কি সে যাকে আমি চাই?’

ছেলেটা জবাব দিলো না।উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত কদমে তাসনুভার দৃষ্টির আড়াল হতে চাইল।তাসনুভা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল,’বড় ভাইয়া দাঁড়াও! আমাকে ফেলে যেও না প্লিজ।’

সে থামল।কিন্তু পেছন ফিরল না।বড় করে একটা শ্বাস টেনে আরেক কদম সামনে যেতেই তাসনুভা পেছন থেকে চিৎকার করল,’বড় ভাইয়া! দোহাই লাগে ভাইয়া।একটু করুণা করো!’

সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল নিজ থেকে।কোনোরকমে এক পা ঘাসের উপর রেখে ভর দিতেই সে ধপাস করে মাটিতে গিয়ে পড়ল।আপনাআপনি সে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা ঘুরে দাঁড়ালো।তীব্র বেগে ছুটে এসে তাসনুভার দুই হাত আঁকড়ে ধরল।ভীষণ চিন্তিত হয়ে বলল,’এ্যাই তাস! পাগল নাকি তুই?একটা চড় দিবো ধরে।বেয়াদব কোথাকার!’

তাসনুভা গোল গোল চোখে তার কথা শুনল।সে থামতেই তাসনুভা খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল।তার দুই হাতে ভর দিয়ে সেকেন্ডের মাথায় তাকে শক্ত করে জাপ্টে ধরল।কান্না মিশ্রিত সুরে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।চড় দাও।তবুও হারিয়ে যেও না।’

সে কতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল।পরে একটু স্থির হতেই দুই হাতে গভীর মমতায় তাসনুভাকে আগলে নিল।চারপাশ দেখে কিছু সময়ের জন্য হেলমেটটা খুলল।তারপর তাসনুভার কপালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল,’চুপ থাক তাস।এখনই ধরা খাইয়ে দিস না আমায়।আমার এখনো একটা কাজ করা বাকি আছে।প্লিজ ততদিন চুপ থাক।আই বেগ।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬৭

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬৭)

আমার পরী,
চিঠিটা যখন তুমি পড়বে,তখন আমি তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে।যেই দুরত্ব স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব না,ঠিক অতোখানি দূরে।কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে ডুবে ডুবে তোমাকে এই পত্রখানা লিখছি।যখন এই পত্র তোমার সম্মুখে,তখন এর প্রেরক তোমার থেকে হাজার হাজার ক্রোশ দূরে।

শ্রাবণের এক পড়ন্ত বিকেলে আমার পার্টি অফিসে একটি মেয়ের আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের গল্পের সূচনা হয়েছিল।মেয়েটির নাম নবনীতা।কাছের মানুষরা তাকে ভালোবেসে ডাকতো পরী।পরীর একটা আলাদা পৃথিবী ছিলো।সেই পৃথিবীতে দু’টো সুন্দর ফুল ছিলো।একজন অসহায় মামা ছিলো,কথায় কথায় খোঁটা দেওয়ার মতো একটা মামি ছিলো,আর ছিলো এতো এতো দায়িত্বের ভার।সেই পরীর পৃথিবীতে আগমন হয়েছিল একটা বদ লোকের।’বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট’ গল্পের নাম শুনেছো?অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ের সাথে কদাকার রূপী এক জন্তুর ভালোবাসার গল্প।সেই জন্তু বাইরে থেকে কদাকার ছিলো,অথচ পরীর জীবনে আসা সেই মানুষটা ছিল ভেতর থেকে কুৎসিত।পরী তার শুভ্রতা দিয়ে যদিও বা তাকে কিছুটা সংশোধন করতে পেরেছিল,তবে গোড়া থেকে তার পরিবর্তন পরীর দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠে নি।এরপরের ঘটনা তোমার জানা।সেসব এখানে লিখে নিজের অনুতাপ আর যন্ত্রণা বাড়াতে চাই না আমি।

কারাগারে আজ আমার চতুর্থ দিন।রোজ রাতে যখন পুরো কারাগার সুনশান নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে,তখন আমার তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে।তুমি বলতে তোমার কোলে মাথা রেখে দুঃখ ঝেড়ে নিলে নাকি মন ভালো হয়।আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কোলে মাথা রাখতে,কিন্তু সেটা সম্ভব না।আসামিদের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।আমারও হবে না।এই মুহূর্তে তাসনুভার কথা মনে পড়ছে।তার কথা মনে পড়লেই আমি বেলি ফুলের ঘ্রাণ পাই।তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানি না,কিন্তু আমি পাই।মেয়েটা বড্ড অবুধ,কথায় কথায় তার ঠোঁট ভেঙে আসে।মেয়েটাকে তুমি তোমার অসীম ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখো।তোমায় বড্ড ভালোবাসে সে।

মর্ত্যলোকের পিশাচদের মাঝে হেঁটে বেড়ানো মিষ্টি পরী,
জগতের সবার জন্য তোমার ভালোবাসা আছে তাই না?তবে এই অধমের কাছ থেকে এমন পালিয়ে বেড়াও কেনো?তোমার সাথে প্রথম দিকের সাক্ষাৎ গুলো যদিও বা সুখকর ছিলো না,কিন্তু সেদিন কাঁধে বুলেট লাগার পর যেই গভীর মমতায় তুমি আমাকে আগলে নিয়েছিলে,সেদিনের পর তোমাকে উপেক্ষা করা কিংবা তোমার সাথে রুক্ষ আচরণ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো।আমি একটু একটু করে দুর্বল হলাম।পড়বো না পড়বো না করেও একেবারে বাজে ভাবে তোমার প্রেমে পড়লাম।তুমি হয়তো কোনোদিন অনুধাবনও করতে পারবে না আমি তোমায় কি পরিমান ভালোবেসেছি।তুমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে,তখন রাতের পর রাত আমি ফ্লোরে শুয়ে ছটফট করেছি।তোমার একটু যত্ন,একটু স্নেহ,একটু ভালোবাসার অভাবে আমি সদ্য জ*বা*ই*কৃত পশুর মতো তড়পাচ্ছিলাম।আমি দুঃখিত।সেদিন কথার আঘাতে তোমায় চুর্ণ বিচুর্ণ করেছি।তুমি অবশ্যই অবশ্যই আমাকে ক্ষমা করবে।

আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ পজেসিভ।আবার সুর পাল্টে বলতে গেলে বলবো আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ ভীতু।আমার সবসময় তোমাকে নিয়ে ভয় হতো।দোষটা তোমার না,দোষটা আমার নিজের।আমার বারবার মনে হতো আমার মতো লোকের সাথে কোনো মেয়ের নির্বিঘ্নে সংসার করা সম্ভব না।সেই কারণেই তোমাকে এতো চোখে চোখে রাখতাম।তোমার ব্যাপারে আমি চূড়ান্ত রকমের স্বার্থপর।একটা মজার কথা শুনবে?

ওয়াজিদ তোমায় পছন্দ করতো।সেটাও আবার আমি পছন্দ করার আগে থেকে।এই কথা আমি শুরু থেকেই জানতাম।ওয়াজিদ ভাবতো আমি এসব ব্যাপারে বড্ড উদাসীন।কিন্তু সে জানে না পরীর ব্যাপারে আমি সবসময়ই ভীষণ সিরিয়াস।আমি এক সপ্তাহের ভেতরই বুঝে যাই যে সে তোমায় পছন্দ করে।কিন্তু কোনোদিন এই ব্যাপারে সরাসরি তার সাথে কোনো কথা বলিনি।কারণ একটাই।আমার ভয় হতো।ওয়াজিদের জন্য আমি সব করতে পারি।কিন্তু তোমাকে নিয়ে বোঝাপড়া! অসম্ভব! আমি তোমায় ভালোবাসি,আমি তোমার সাথে ঘর করব,এটাই গুরুত্বপূর্ণ কথা।বাদ বাকি কোনো কিছু আমি জানি না।আচ্ছা শোনো,এসব পড়ার পর আবার তুমি ওয়াজিদকে দেখে আনইজি ফিল করো না।সে বড্ড ভালো ছেলে।তোমাকে সে পছন্দ করতো,রিমিকে সে ভালোবাসে।শব্দ দু’টোর মাঝে বিশাল পার্থক্য আছে।তুমি তার সাথে সেভাবেই কথা বলবে যেভাবে আগে বলতে।

তোমার নতুন বিজনেস নিয়ে আমি ভীষণ এক্সাইটেড।চুপি চুপি ভুলভাল এড্রেসে তোমার পেইজ থেকে জিনিসও অর্ডার করেছিলাম।চমৎকার আর্ট সেন্স তোমার! ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছো,অথচ হ্যান্ড ক্রাফ্টস দেখে মনে হচ্ছিল চারুকলার স্টুডেন্ট তুমি।

ঐ দেখো! আজে বাজে কথা লিখে চিঠির সৌন্দর্য নষ্ট করছি।শুরুতে চিঠিটা বড্ড গোছানো ছিল।এখন এলোমেলো হচ্ছে।তার কারণ আমি নিজে সময়ের সাথে সাথে খুব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি পরী।এখন সময় কতো আমার কোনো ধারণা নেই।পাশ থেকে একটা মানুষের হেঁটে যাওয়ার শব্দ পর্যন্ত পাচ্ছি না।এতো নিস্তব্ধ কেন এই কারাগার?

এবার মূল কথায় আসি।সজীব কে আমি মা’রিনি।যেদিন সে খু*ন হয়,সেদিন তার ইমেইল থেকে আমার পারসোনাল ইমেইলে একটা মেসেজ আসে।মেসেজটা এমন যে সে আমায় জরুরি কিছু বলতে চায়,আমি যেন তার সাথে দেখা করি।যেহেতু সে গোপনে আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে,তাই আমি গোপনীয়তা রক্ষা করেই তার সাথে দেখা করতে গেলাম।আমি যখন তার লিভিং রুমে পা দিলাম,তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।গেস হোয়াট?হি ওয়াজ অলরেডি ডেড।তার বুকে একটা ছু’রি ঢোকানো ছিলো,দুই চোখ খোলা,মুখ হা হয়ে আছে,হাত দু’টো দুই পাশে ছড়ানো।তার রক্ত আমার পা পর্যন্ত গড়িয়ে এলো।আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে যখন আমি তার এই বিভৎস অবস্থা দেখি।আমি হাঁটু মুড়ে তার সামনে বসলাম।আমার মায়া হলো।তাই একটানে তার বুক থেকে ছু’রিটা বের করলাম।তখনও বুঝিনি ইটস আ ট্র্যাপ।একজনকে ফাঁসানোর জন্য যে অন্য একজন কে এভাবে নি’র্মম ভাবে মারা যায়,সেটা আমার কল্পনাতীত ছিলো।তুমি কি জানো,যে সজীবকে মে’রেছে তার সজীবের সাথে কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নেই।শুধু আমাকে ফাঁসানোর জন্য সে এই জ’ঘন্য কাজ করেছে।তোমার কি আমার কেসটা আর আট দশটা কেসের মতোই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?একটু খেয়াল করলেই দেখবে আমার কেস-এ ডেট গুলো কেমন পর পর বাসানো হচ্ছে।সাধারণত এই প্রক্রিয়ায় সময় একটু বেশি লাগে।কিন্তু আমার কেসে আপিল হিয়ারিং এবং চূড়ান্ত রায় সবকিছুই অনেক দ্রুত গতিতে শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।কেমন একটা ঘাপলা ঘাপলা লাগছে না সবকিছু?

যাই হোক।তোমায় এসব বলে তোমার মন খারাপ করছি কেন?তুমি ঐসব চিন্তা বাদ দাও।

চোখ মুছো পরী।কাঁদতে কাঁদতে তো বুক ভাসাচ্ছ নিশ্চয়ই।এতো কাঁদতে জানো তুমি! আমি কিন্তু এই নেকু পরীকে বিয়ে করিনি।বড্ড বেশি কান্না করো তুমি ইদানিং! শোনো পরী,আমার মৃ’ত্যু অবধারিত।যেই লুপ হোলে আমি আটকা পড়েছিলাম,সেই লুপ হোল থেকে বেরিয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো আচরণ করা আর নিজেই নিজের বিপর্যয় ডেকে আনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।আমি একটা নির্দিষ্ট দলের সদস্য হয়ে যখন ঐ দলেরই নেতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করি,তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঐ দলে আমার আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।তারা আর আমাকে ক্ষমতায় চায় না।এখন যত দ্রুত সম্ভব যেকোনো উপায়ে আমাকে মে’রে ফেললেই তাদের শান্তি।কারণ আমি এখন তাদের কাছে পথের কাঁটা ব্যতীত আর কিছুই না।আমি জানি আমি খুব দ্রুত মৃ’ত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।এই মুহূর্তে আমার বাঁচার কোনো পথ আর অবশিষ্ট নেই।

আমার সমস্ত সম্পদের নমিনি আমি তোমায় করে যাচ্ছি।তুমি সেগুলো আরিশ আর তাসনুভার মাঝে সঠিক উপায়ে বন্টন করে দিবে।আরিশের যদি অনুমতি থাকে,তবে তাসনুভাকে তার সমান সমান সবকিছু দিবে।তাসনুভার ব্যাপারে আমি বরাবরই পক্ষপাতদুষ্ট।সে আমার জান,আমার লক্ষী সোনা বোন।মেয়ে মানুষ এতো আদুরে হয় কেন?জীবনের খারাপ সময় গুলোতে ঘুরে ফিরে শুধু তাদের কথাই মনে হয়।আমার একবারো মনে হচ্ছে না আমি না থাকলে আরিশ কিভাবে থাকবে।কারণ আমি জানি আরিশ নিজেকে গুছিয়ে নিবে।কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে,আমার তাসনুভা কিভাবে থাকবে আমাকে ছাড়া?তুমি চলে যাওয়ার পর সে সারাক্ষণ আমার সাথে মুখ ফুলিয়ে রাখতো।অথচ রাতে যখন আমি ঘুমাতাম,তখন চুপটি করে আমার ঘরে এসে দাঁড়াতো।চোখ বুজেই আমি তার হুইলচেয়ারের চাকা ঘোরানোর শব্দ পেতাম।তাকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি পরী।তুমি তাকে সেভাবেই ভালোবেসো।

চিত্রা কে আমার ভালোবাসা দিবে।সে যে আমায় আরাম ভাই না বলে আরহাম ভাই বলছে,এতে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।আমি তার কাছে চিরকাল আরাম ভাই ই থাকতে চেয়েছিলাম।আমি কোলে নিলেই দেখি আজকাল সে লজ্জা পায় ভীষণ।চিত্র এতো বড়ো হলো কবে বলো তো?ওহ হ্যাঁ,তাকে মনে করে বলবে আমি মোটেও এমনটা ভাবি না যে সে চিপস আর চকোলেটের লোভে আমায় ভালোবাসে।আমি জানি আমার চিত্র মন থেকেই আমাকে ভালোবাসে।

আমার আধার জীবনে আলো হয়ে আসা পরী,
আমাকে ভালোবেসে তোমার জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তাই না?অবেলায় তোমার জীবনে এসে তোমার জীবনটা জাস্ট নষ্ট করে দিলাম আমি।ভালোই তো ছিলে তুমি আমায় ছাড়া।তবে কেন তোমায় নিজের সাথে জড়িয়ে তোমার সবকিছু এলোমেলো করে দিলাম?তুমি মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিলে,অথচ আমার সাথে বিয়ের পর তুমি নীড়হারা পাখিদের মতো ছন্নছাড়া হয়ে গেলে।আমি তোমার গোছানো জীবনটা নষ্ট করেছি পরী।আমার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে তোমার মতো নিষ্পাপ আর মাসুম স্বত্বার মিলন কোনোভাবেই যায় না।তুমি আমায় ক্ষমা করবে।

এই মুহুর্তেও কি আমি স্বার্থপরের মতো তোমার কাছে একটা জিনিস চাইতে পারি?তুমি প্লিজ অন্য কাউকে নিজের জীবনে আনবে না পরী।আমি চাই না সারাদিনের শত শত ব্যস্ততা শেষে তুমি ক্লান্ত হয়ে যেই বুকে মাথা রাখবে,সেই বুকটা আমি বাদে অন্য কারো হোক।আমি এটা সহ্য করতে পারব না।ভাবছো মৃ’ত মানুষ আবার সহ্য করে কীভাবে?অতো উত্তর আমার কাছে নেই।শুধু জানি সহ্য করতে পারব না।তুমি আমার সব হারানো জীবনের একমাত্র পাওয়া।আমি তোমায় অর্জন করেছি পরী।একটু একটু করে অর্জন করেছি।আমি থাকি বা না থাকি,তুমি চিরকাল আমারই থেকো।

ফজরের আযান দিচ্ছে।লিখতে লিখতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।সবগুলো অক্ষর কেমন দুইবার দুইবার করে দেখছি।তুমি নিশ্চয়ই এই পর্যন্ত এসে হেঁচকি তোলা শুরু করেছো।থাক আর বেশি কিছু লিখবো না।শুধু বলবো,ভালো থেকো।সবাইকে ভালো রেখো।আমি বেঁচে থাকবো তোমার অলস দুপুরে,ক্লান্ত বিকেলে।যখনই তোমার মন খারাপ হবে,ঐ মন খারাপে আমি বেঁচে থাকবো।বিদায়।

ওহ,তুমি তো স্বান্তনা পেতে ভালোবাসো।ঠিক আছে।দিলাম স্বান্তনা-
“আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি পরী।আমাদের আবারো দেখা হবে।যেদিন নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াবে,সেদিন আমাদের আবার দেখা হবে।মেঘের দেশে আমাদের আবার সাক্ষাৎ হবে।

ইতি,
তোমার প্রিয়তম,যাকে ভালোবেসে তোমার গোটা জীবন ছাড়খাড় হয়ে গেছে।

***

একশত পাঁচবারের মতো চিঠিটা পড়ে মেয়েটা শক্ত করে সেটা বুকের সাথে চেপে ধরল।মুহুর্তেই তার ঠোঁট ভাঙা কান্নায় কেবিনের পরিবেশ ভারি হলো।

আজ আশ্বিনের ছয় তারিখ।আরহামের দুর্ঘটনার প্রায় একমাস গড়িয়েছে।সেদিন স্পটে যাওয়ার পর মিসিং বাকি তিনজনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল।দুইজন গাড়ির ভেতরেই চাপা পড়েছিল।আর একজনের লা’শ পাওয়া গিয়েছিল জঙ্গলের ভেতর।বন্য পশুরা তার দুই হাত আগেই খেয়ে নিয়েছে।নবনীতা সেই দৃশ্য দেখেই মুখ ভরে বমি করল।মৃ’ত্যু অনিবার্য,তাই বলে এতো করুণ মৃ’ত্যু!

সেই ঘটনার পর দশদিন সে মৃ’তের মতো ছিল।তার জীবন কোনোদিন এমন পর্যায়ে যাবে,সে কল্পনাও করেনি।আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে নবনীতা সেই কবেই বাড়ির ছাদ থেকে ঝাপ দিতো।জীবন এখন আর তার কাছে রঙিন বলে মনে হয় না।মনে হয় এর চেয়ে ম’রে যাওয়া ভালো।তার দমবন্ধ হয়ে আসে।সে শ্বাস নিতে পারে না।এক মাস হয়ে গেছে ,অথচ নবনীতার জীবনে কিচ্ছুটি পরিবর্তন হয়নি।সেই যে নবনীতার আত্মিক মৃ’ত্যু হয়েছে,আর সে কোনোভাবে জীবনের পথে ফিরে আসতে পারছে না।তার মনে হয় সে একটু পরেই ছটফট করতে করতে ম’রে যাবে।অথচ আশ্চর্যের বিষয় সে ম’রছে না।

আজ সে হাসপাতালে এসেছে র’ক্ত নিতে।রিমি আর ওয়াজিদ জোর করে তাকে নিয়ে এসেছে।তার শরীর বরাবরের মতোই খারাপ।আজ রাতটা তাকে কেবিনেই থাকতে হবে।

সে রক্তিম চোখে কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল।এমন সময় শুভ্রা আরশাদকে কোলে নিয়ে কেবিনে এলো।নিচু গলায় ডাকলো,’আপাই!’

নবনীতা জানালা থেকে চোখ সরাল।খিটখিটে গলায় বলল,’কি সমস্যা?’

‘আরশাদ অনেক কান্না করছে।কিছুতেই আমার কাছে রাখতে পারছি না।’

‘তো এতে আমার কি করার আছে?আরশাদ কান্না করছে,আর আমি কি এদিকে নাচছি?’

শুভ্রা হতাশ চোখে তার দিকে তাকায়।আরহাম ভাইয়ের সেই ঘটনার পর আপাই আর আপাই নেই।সে আর আগের মতো হাসে না,কথা বলে না।শুধু কথায় কথায় খ্যাট খ্যাট করে উঠে।তার মেজাজ চব্বিশ ঘন্টাই খারাপ থাকে।যাকেই সামনে পায়,তার সাথেই এমন খিটখিটে আচরণ করে।আর একটু পর পর হাতে থাকা চিঠিটা পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।এই চিঠিটা তাকে ওয়াজিদ ভাই দিয়েছে।হাতে পাওয়ার পর থেকে এই চিঠিটা ছাড়া সে আর কিছু বুঝে না।এই চিঠি তার প্রাণ ভোমরা।সারাক্ষণ একে নিজের পাশে পাশে রাখে।বাদ বাকি দুনিয়ার আর কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।আচ্ছা,একটা দুর্ঘটনা কি কোনো মানুষের জীবন এমনভাবে পাল্টে দিতে পারে?

‘আপাই তুমি একটু আরশাদকে কোলে নিবে?তুমি কোলে নিলে সে থেমে যাবে মনে হচ্ছে।’

নবনীতা অগ্নিচোখে তার দিকে তাকালো।চেঁচিয়ে উঠে বলল,’যেতে বলেছি না তোকে?যা তুই।আমার মেজাজ খারাপ করিস না।পারব না আমি কাউকে কোলে নিতে।ঠেকা পড়েনি আমার।’

‘এভাবে বলছ কেন?আরশাদ তো একটা বাচ্চা ছেলে।’

‘অতো দরদ হলে তুই রাখ না।আমাকে বলছিস কেন?অসহ্য লাগে এসব আদিখ্যেতা।যা ঘর থেকে বের হ।একা থাকবো আমি।যা তো।’

শুভ্রা ভেজা চোখে ঘর ছাড়ল।উঠতে বসতে বকুনি খেতে কার ভালো লাগে?কাল তার ওরিয়েন্টেশন।আর আপাই এই মুহূর্তেও তার সাথে এমন আচরণ করছে।

সে বেরিয়ে যেতেই নবনীতা আবার অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।তার হাতে ক্যানুলা সেট করা।শরীর অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি দুর্বল মনে হচ্ছে।সে জানে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে সে পাগল হয়ে যাবে।কিন্তু সে নিজেকে এই মানসিক বিপর্যয় থেকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না।প্রতিটা মুহূর্ত তার মনে হয়,তার সবচেয়ে কাছের জিনিসটা হারিয়ে গেছে।সে শূন্য,তার কাছে কিচ্ছু নেই,কিছুই না।

বুকের ব্যাথা আগের চেয়েও প্রকট হলো।নবনীতা একটা হাত বুকে চেপে সামান্য আর্তনাদ করে উঠল।এই যে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে,কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না।স্রষ্টা এভাবে ধুকে ধুকে কেন মা’রছে তাকে?

সে পুনরায় চিঠি টা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।টপটপ করে নোনাজল চিঠির উপর গড়িয়ে পড়ল।

“আমার পরী,
চিঠিটা যখন তুমি পড়বে,তখন আমি তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে।যেই দুরত্ব স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব না,ঠিক অতোখানি দূরে।কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে ডুবে ডুবে তোমাকে এই পত্রখানা লিখছি।যখন এই পত্র তোমার সম্মুখে,তখন এর প্রেরক তোমার থেকে হাজার হাজার ক্রোশ দূরে।”

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬৬

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬৬)
[অনেক বড়ো পর্ব।ধীরে সুস্থে রিচেক দিবো]

নবনীতার অল্প অল্প করে গুছিয়ে উঠা জীবনটা হঠাৎই কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো তান্ডবে একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেল।কি থেকে কি হলো,কোনো কিছুই সে জানে না।তার স্বামীর অনেক দোষ ত্রুটি সম্পর্কে সে অবগত।কিন্তু খু*ন?ভাবলেই সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে নবনীতার।

গতকাল রাতেই আরহামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সজীব খন্দকারকে ছু’রিকাঘাতে হ’ত্যার অভিযোগ উঠে এসেছে তার নামে।নবনীতা যখন এই কথা শুনল তখন সে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।রাজনৈতিক রেষারেষি তে আরহাম মানুষ মা’রবে?এতো জ’ঘন্য তো সে কোনোদিন ছিলো না।এই কাজ অন্তত সে করতে পারে না।

ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ আরহামের নির্লিপ্ত মুখটা দেখে সে প্রশ্ন করেছিল,’আরহাম! আপনি এই কাজ করেছেন?আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।আপনি যদি এমনটা করেন,তবে ফাহাদ আর আপনার মাঝে পার্থক্য রইল কই?’

আরহাম নিরব,কন্ঠ দিয়ে টু শব্দ পর্যন্ত বের করল না।শুধু নির্বিকার হয়ে একবার নবনীতাকে দেখেছিল।তারপরই ম্লান হেসে বলল,’ভালো থেকে পরী।তোমাকে যা কিছু ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিলো,ফিরিয়ে দিয়েছি।এখন তুমি ভালো থাকো।’

সোবহান ততক্ষণে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে।নবনীতার টলমল চোখ সেই হাতকড়ার দিকে।সে ছুটে গেল,জাপ্টে জড়িয়ে ধরল আরহামের শক্তপোক্ত শরীরটা।জড়ানো কন্ঠে বলল,’না না আমি এটা বিশ্বাস করি না।আমার আরহাম এই কাজ করতেই পারে না।’

আরহাম হাসল,প্রশান্তির হাসি।হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় কোনোরকমে একটা হাত তুলে নবনীতার মাথায় রাখলো।চাপা কন্ঠে বলল,’ভালো থাকো পরী।জীবনে অনেক বড় হও।তোমার সাফল্য তোমাকেই ছাড়িয়ে যাক।যদি কোনোদিন সম্ভব হয়,মনে করে আমাকে ভালোবেসো।আমাকে ভালোবাসার মতো মানুষ বরাবরই অনেক কম।’

ব্যাস,তারপরই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোবহানের সাথে বেরিয়ে গেল।নবনীতা কেবল হতবাক চোখে সবকিছু দেখল।আনমনে একটা হাত মাথায় ছোঁয়াল।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে,মনে হচ্ছে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান একটুখানি কমে গেছে।হুশ আসতেই সে দিকবিদিক ভুলে বাইরের দিকে ছুটে যায়।

আরহামকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়েছে।নবনীতা সেই টুকু ছুটে গিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল,’আপনি কিছু করেন নি।তাই না আরহাম?দয়া করে বলুন আপনি কিছু করেন নি।আমি জানি এগুলো মিথ্যা।তবুও আপনি বলুন একবার।প্লিজ।’

আরহাম চোখ তুলে।ম্লান হেসে বলে,’তুমি যা বিশ্বাস করো,ভেবে নিবে তাই সত্যি।আমার বলা দিয়ে কি যায় আসে?ভালো থাকো পরী।’

পুলিশ ভ্যানটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।নবনীতা অনুভূতি শূন্য চোখে একটু একটু করে ভ্যানটার হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখল।যখন সেটা একদমই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল,তখন সে ধপ করে মাটিতে বসে গেল।আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে।বৃষ্টি হবে নাকি আজ?যেমনটা হয়েছিল তার বিয়ের দিন রাতে।আজ তো তার বিবাহ বার্ষিকী।

নবনীতা চোখ মুছল।এতো খুশীর দিনে কাঁদতে আছে নাকি?
.
.
.
.
ওয়াজিদ এক প্রকার ছুটতে ছুটতে আদালত প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলো।তার থেকে একটু দূরেই আদি,একটা পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে এগিয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আদি! আরহাম কে কি আদালতে এনেছে?’

সে অন্যমনস্ক হয়ে সংক্ষেপে জবাব দিলো,’নাহ।’

দুই হাতে মাথা চেপে ওয়াজিদ একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল।তার সমস্ত শরীর অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে,গলার কাছে সবকিছু দলা পাকিয়ে আছে।শ্বাস ফেললেও মনে হচ্ছে চারপাশ ভারি হয়ে যাচ্ছে।

গতকাল বিকেলে ওয়ারীতে নিজের বাড়িতে সজীব খন্দারের ম’রদে’হ উদ্ধার করা হয়েছে।তার কেয়ার টেকার মনসুরের ভাষ্যমতে আরহাম দুপুরের একটু পরেই তার সাথে দেখা করার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিল এবং এসময় তাদের ভেতরে একটা ঝামেলার সূত্রপাত হয়।যার জের ধরে আরহাম এক পর্যায়ে তাকে ছু’রি মে’রে হ’ত্যা করে।তারপরই থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে আরহামের এরেস্ট ওয়ারেন্ট মঞ্জুর করা হয়।এরপর কাল রাতে নারায়ণগঞ্জের কোনো একটা ছিমছাম বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আনা হয়েছে।তার চার্জশিট থানা থেকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।আজ প্রথম ধাপে তার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।

ওয়াজিদের কাছে প্রথম ফোন কলটা এসেছিল রাতের মাঝামাঝি সময়ে। আনুমানিক দুইটার দিকে।খবর পাওয়ার পরে সে কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসেছিল।ইন্দ্রিয় গুলো কেমন অচল হয়ে যাচ্ছিল।তারপর সবার প্রথমে সে থানায় গেল।আরহামের সাথে কেবল দশ সেকেন্ডের জন্য তার দেখা হয়েছিল।ছেলেটার ঐ নির্বাক নির্লিপ্ত রূপ দেখে সে আর কিছু বলার সাহস পায়নি।সেখান থেকে বেরিয়ে সে এডভোকেট সানাউল হকের কাছে গেল।আরহামের কেসটা হ্যান্ডেল করার জন্য অভিজ্ঞ আর বড় মাপের উকিল প্রয়োজন।সানাউল হক ওকালতি তে অনেকদিন পুরোনো।একত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা,নব্বই শতাংশ কেস জেতার রেকর্ড-সবমিলিয়ে আরহামের কেস সামলানোর জন্য ওয়াজিদের তাকেই সবচেয়ে বেশি যোগ্য মনে হয়েছে।

রিমি সেই তখন থেকে একটার পর একটা ফোন দিয়ে যাচ্ছে।ওয়াজিদ শেষে ফোনটা রিসিভ করল।রিসিভ হতেই অন্যপাশ থেকে রিমির উদ্বিগ্ন কন্ঠ ভেসে এলো,’কি হয়েছে ওয়াজিদ?আরহাম ভাইয়া কোথায়?উনাকে আজ ছেড়ে দিবে তো?আপনি কেন আমায় নিলেন না?আমি সেখানে যেতে চাই।প্লিজ আমাকে নিয়ে যান।’

ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে তার কথা শুনলো।সে থামতেই থমথমে গলায় আস্তে করে বলল,’তোমাকে এখানে আনার কিছু নেই রিমি।পরিস্থিতি এমনিতেই খারাপ।তুমি বাসায় থাকো।আমি তোমায় সব জানাবো।দোয়া করো যেন জামিন টা হয়ে যায়।যদিও প্রায় অসম্ভব,তবুও আশা তো করাই যায়।দোয়া করো রিমি।আর কিছুই বলার নেই।’

‘নবনী কি এসেছে?’

‘জানি না,এখনো আমার চোখে পড়েনি।’

রিমি আর কিছু বলল না।একহাতে ফোনটা কানে চেপে কয়েক মিনিট সেভাবেই বসে থাকলো দুই জন।ওয়াজিদ ঘন ঘন কয়েকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’কিছু বলবে রিমি?’

রিমি ইতস্তত করে বলল,’আপনার কি মনে হয়?ভাইয়া এমন কিছু করেছে?’

‘অসম্ভব।’ কিছুটা চেঁচিয়ে উঠল ওয়াজিদ।
‘আমার বন্ধু এই কাজ করতেই পারে না।আমি তাকে চিনি।সে কতোটুকু অন্যায় করতে পারে আমার ধারণা আছে।’

তার কন্ঠের জোর আর নিজ বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসের পরিমান দেখে রিমি নিচু গলায় বলল,’আপনার মতো করে তো সবাই ভাবছে না ওয়াজিদ।এটাই তো সমস্যা।’

‘না ভাবুক।এটা তাদের সমস্যা।আমার না।’

সে ফোন কাটল।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই দেখল আদালতের মূল ফটকের সামনে নবনীতা এসে দাঁড়িয়েছে।তার পরনে একটা সাদামাটা সুতির শাড়ি।আঁচলের দিকটা কিছুটা কুঁচকে আছে।

সে জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।নবনীতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’তুমি ঠিক আছো নবনীতা?বসবে কোথাও?’

নবনীতা হাত তুলে তাকে থামাল।সামনে হেঁটে যেতে যেতে ঠান্ডা গলায় বলল,’না,আমি কোথাও বসবো না।’

***

আরহামকে কোর্টে আনা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।প্রিজন ভ্যান থেকে যখন তাকে নামালো হলো,তখন চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকরা সব তাকে ঘিরে ধরল।চারদিক থেকে আসা ফ্ল্যাশ লাইটের আলো তে তার চোখ বুজে এলো।নিভে আসা চোখেই সে দেখল অদূরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি একটু পর পর ঘুরে ফিরে আরহামের দিকে যাচ্ছে।সে হাসল,তার অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি হচ্ছে।এতো এতো ক্যামেরার সামনেও তার চোখ বার বার মেয়েটির সোজা সরল মুখটার কাছে গিয়ে থামছে।কতোগুলো দিন পর মেয়েটা তার দিকে সহানুভূতির চোখে তাকিয়েছে,কতোগুলো দিন পর তার হৃদয় আরহামের জন্য ব্যথা অনুভব করেছে!আরহাম তো হারে নি।সে জিতেছে।জগতের কাছে হেরে প্রিয়তমার কাছে জিতেছে,প্রভার কাছে জিতেছে,বাবার কাছে জিতেছে,শাহানার কাছেও জিতেছে।

কোর্ট রুমে আসার পর তার সাথে ওয়াজিদের একবার কথা হয়েছে,তাও এক মিনিটের জন্য।আর কথা হয়েছে সানাউল হকের সাথে।তিনি তাকে আশ্বস্ত করেছেন তার জামিন মঞ্জুর করিয়েই ছাড়বেন।তিনি আইনজীবী।এসব বলবেনই।এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই।আরহাম খুশি হচ্ছে না।সে জানে এসব মামলায় এতো সহজে জামিন পাওয়া যায় না।এসবের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছে,তারা অতো কাচা খেলোয়াড় না।আরহাম বুঝে,অনেকে কিছুই বুঝে।

তার ধারনাই সত্যি হয়েছে।আদালতে কয়েকজনের সাক্ষীর ভিত্তিতে আরহাম দোষী প্রমাণিত হয়েছে এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই খু’নের আসামির জামিন অতো সহজে পাওয়া সম্ভব না।তার জামিন হয়নি।আপিল করা,এবং তারপর আপিল পরবর্তী রায় আসা পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল তাকে এই কারা প্রকোষ্ঠের মাঝেই কাটাতে হবে।

সেদিনের মতো কোর্টের কাজকর্মের সেখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।আস্তে আস্তে আদালত ফাঁকা হলো।শুধু নবনীতা আর আরিশ দু’টো পাতানো বেঞ্চিতে মাথা নামিয়ে বসেছিল।

আদি আর ওয়াজিদ সানাউল হকের সাথে কথা বলছিলো।কোর্টের কাজ শেষ হওয়ার পর নিয়ম মোতাবেক আসামীকে পুলিশ সাথে সাথে পুনরায় জেলে নিয়ে যায়।তবে যেহেতু আরহাম সাধারণ মানুষ না,তাই তার বেলায় নিয়মে একটু ছাড় দেওয়ার অনুমতি আছে।

পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো।তার যখন কথা শেষ হবে,তখন সে তাকে নিয়ে যাবে।নবনীতা তখনো বেঞ্চে বসা।আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখল।নিশ্চয়ই কাল রাত থেকে কিছু খায়নি।আজ কি বার?তার না এই সপ্তাহে রক্ত নেওয়ার কথা।নিয়েছে কি?

সে একটা শুকনো ঢোক গিলল।এই ন্যায় অন্যায়ের যুদ্ধে যদি সে হেরে যায়,তবে মেয়েটার কি হবে?বাইরে থেকে সে নিজেকে খুব সাহসী আর মজবুত দেখায়।অথচ আরহাম জানে সে ভালোবাসার কাঙাল।একটু ভালোবাসাতেই গলে যায়।আরহামের যদি কিছু হয়,তবে কি মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে পারবে?পারবে শক্ত হয়ে এই সমাজের সাথে মোকাবিলা করতে?হয়তো পারবে,হয়তো পারবে না।পৃথিবীর নিয়ম বড়ো বিচিত্র।আমাদের অনুপস্থিতিতে যারা দুই মুহূর্তও থাকতে পারবে না বলে আমাদের বিশ্বাস,দেখা যায় আমাদের মৃ’ত্যুর পর তাদের জীবনের কোনো কিছুই থেমে থাকে না।দোষটা তাদের না।দোষটা প্রকৃতির।প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না।কোনো না কোনভাবে সেই সেই শূণ্যস্থান ভরাট হয়।হতেও পারে আরহাম না থাকলে পরী খুব সুন্দর করে সব সামলে নিবে।কিন্তু আরহাম থাকতে চায়।পরীর সাথে সে শান্তিতে সংসার করেছে হাতে গোনা কয়দিন।এইবার সে একটু শান্তিতে মন ভরে সংসার করতে চায়।মেয়েটাকে একটু শান্তিতে রাখতে চায়।পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব এতো ক্ষণিকের জন্য হোক,সে সেটা চায় না।তার এখনো প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া বাকি,পূর্ণিমা দেখা বাকি,তাসনুভার হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা বাকি।কতো কিছুই তো বাকি।গোটা জীবনটাই তো বাকি।

***

একেবারে নিগুঢ় নিস্তব্ধতায় পাঁচ পাঁচটে দিন কেটে গেছে।আরহাম যে কারাগারে খুব বেশি খারাপ আছে এমন না।তার জন্য আলাদা সেল আছে,বিশেষ খাবার দাবারের ব্যবস্থা আছে।শুধু মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতাই নেই।নয়তো সে খুব বেশি যন্ত্রণায় নেই।তবে রোজ রোজ বাড়ির মানুষের সাথে দেখা করার অনুমতি পাওয়া যায় না।এটাই সমস্যা।

তাকে আগামীকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হবে।নিরাপত্তা জনিত কারণ দেখিয়ে তার এই আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে।সে হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আজই তার শেষ দিন।

রাতে ওয়াজিদ এলো তার সাথে দেখা করতে।সে বসেছিল মূলাকাত কক্ষে।কক্ষের দরজায় একজন কারা প্রহরী সটান দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছিলো।সে সেদিকে তাকালো না।ওয়াজিদের পেছন পেছন যে মেয়েটি নতজানু হয়ে মুলাকাত কক্ষে এসেছে,আরহামের সমস্ত মনোযোগ তার দিকে।

নবনীতা কক্ষে এসেই তার খোঁজ করল।দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই নবনীতা চোখ নামিয়ে নিল।ওয়াজিদ এগিয়ে এসে বলল,’কাল সকালেই নাকি কাশিমপুর কারাগারে ট্রান্সফার করা হবে তোকে?’

‘হুম।এমনই তো শুনলাম।’

‘ওহ।’

সে থামল।পেছন ফিরে একবার নবনীতাকে দেখে আবার সামনে ফিরে বলল,’তিন দিন ধরে খুব চাইছিলো তোর সাথে দেখা করতে।আজ অবশেষে ব্যবস্থা করতে পারলাম।কথা বল তুই।আমি আছি।’

সে সরে গিয়ে কারা প্রহরীর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো।বলুক,একটু কথা বলে মন হালকা করুক।মেয়েটা বড্ড ভেঙে পড়েছে এই কয়দিনে।মুখে কিছু না বললেও তার চোখ মুখ সে কথাই বলে।

‘আরহাম’

একেবারে মলিন,বিধ্বস্ত আর ভাঙা কন্ঠ।আরহাম হাত দু’টো টেবিলে রেখে জবাব দিলো,’হু?’

‘আপনি আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।’

‘এমন কিছু না।’

‘তাহলে কেমন কিছু?’ অস্থির হয়ে জানতে চাইল সে।

‘আমি ছাড়া বেঁচে থাকার প্র্যাকটিস করাচ্ছি।’

নবনীতার কন্ঠ ভেঙে এলো।সে ধরা গলায় বলল,’প্লিজ আরহাম।দোহাই লাগে এসব কথা বলবেন না।’

‘কেন?অদ্ভুত তো! তুমি জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো?খু’নের আসামি আমি।যেকোনো সময় আদালত থেকে যে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।দোহাই লাগানোর কিছু নাই।মানসিকভাবে সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে পরী।’

নবনীতা মুখের উপর একটা হাত চেপে অস্পষ্ট স্বরে বলল,’আমি জানি খু’নটা আপনি করেন নি।’

আরহাম নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’তোমার জানা দিয়ে আদালতের কিছু যায় আসে না।আদালতের প্রমাণ চাই।আছে কোনো প্রমাণ?’

নবনীতা আর কথা বাড়ালো না।কেবল কাঁপা হাতে আরহামের একটা হাত নিজের মুঠোয় পুরে জমে যাওয়া কন্ঠে বলল,’আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আরহাম।আমাকে একটু স্বান্তনা দিন,একটু ভালোবাসুন।’

আরহাম ফিচেল হাসল।একটা হাত নবনীতার মাথায় রেখে আদুরে গলায় বলল,’আচ্ছা যাও।তোমাকে স্বান্তনা দিচ্ছি।তোমার বরের কিচ্ছু হবে না পরী।সে ঠিকই কোনো না কোনো ভাবে এইসব জটিলতা পার করে ফেলবে।’

নবনীতা থমথমে মুখে তার দিকে তাকালো।কটমট গলায় জবাব দিলো,’এটা কোনো স্বান্তনা না,এটা সত্যি কথা।এমনটাই হবে আমার বিশ্বাস।’

‘বাপরে! তাহলে তো আর আমার কিছু বলার নেই।’
আরহাম সামান্য ঝুকলো।নবনীতার ঘোলাটে চোখ দু’টো দেখতে দেখতে বলল,’একটা প্রশ্ন করি?’
তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই জিজ্ঞেস করল,’তোমার কি একটি বারের জন্যও মনে হয়নি আমার নামে আনা অভিযোগটা সত্য হলেও হতে পারে?’

হাতের বন্ধন আরো জোরালো হলো নবনীতার।সে চোখ তুলে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো,’নাহ,কখনো না।একটিবারও মনে হয়নি এই কাজ আপনি করেছেন।আপনি রগচটা,তবে এতোটাও নির্বোধ না।’

আরহাম মন দিয়ে তার কথা শুনল।সে থামতেই তীব্র অনুযোগের সুরে বলল,’আমায় খাইয়ে দিবে পরী?’

নবনীতা বড় করে টেনে একটা শ্বাস নিল।জানতে চাইল,’অনুমতি আছে?’

‘অবশ্যই আছে।’

‘তবে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

ভাত,ডিম ভুনা,সবজি আর ডাল।কারাগার হিসেবে খাবারের মেন্যু বেশ ভালো।নবনীতা প্রথম লোকমা হাতে তুলেই আরহামের দিকে দেখে বলল,’নিন হা করুন।’

আরহাম খাওয়ার মাঝেই একগাল হেসে বলল,’এই শেষ।আর কোনোদিন জ্বালাতন করব না তোমাকে।’

স্টিলের প্লেটের উপর থাকা হাতটা হঠাৎই থেমে গেল।নবনীতা চোখ তুলে করুণ সুরে ডাকল,’আরহাম!’

‘দয়া করে এসব কথা বলবেন না।’

‘আচ্ছা বলবো না।তবে কি বলব?’

‘ভালো কথা বলুন।’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।যতখানি ভালোবাসা তুমি কল্পনাও করতে পারো না,ততখানি।’

আচমকা বন্ধ ঘরটায় ফুপিয়ে উঠল নবনীতা।ওয়াজিদ আশ্চর্য হয়ে সেদিকে তাকায়।দেখে একটা পঁচিশ বছর বয়স্কা মেয়ে ভাতের থালা কোলের উপর ফেলে শব্দ করে কাঁদছে।তার সামনে একটা ছেলে বসা।যে শান্ত চোখে তাকে দেখছে।যেন এরকম ক্রন্দনরত রমণী সে এর আগে আর দেখেনি।একটা মানুষের এমন বিষন্ন রূপ এতো গভীর চোখে দেখার কি আছে?

নবনীতা বহুবার নিজেকে সংযত করার প্রতিজ্ঞা করার পরেও শেষটায় ব্যর্থ হলো।বিদায় বেলায় সে এক দৌড়ে গিয়ে আরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তার চোখের পানিতে আরহামের শার্ট ভিজলো।আরহাম অত্যাধিক কোমল হয়ে বলল,’কাঁদে না পরী।মন দিয়ে পড়াশোনা করো।সফল হও দোয়া করি।’

নবনীতা হেঁচকি টানতে টানতে মূলাকাত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই সে ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করবে।

সে চলে যেতেই আরহাম তার পকেটে থাকা চিঠিটা ওয়াজিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’নে এটা ধর।’

ওয়াজিদ চিঠিটা হাতে নিতে নিতে বলল,’এটা কি?’

‘চিঠি।পত্র।লেটার।’

‘সেটা জানি।কার জন্য চিঠি?’

‘পরীর জন্য।’

‘তুই লিখেছিস?’

‘হুম।’

‘তবে দিস নি কেন?’

‘এখন না।যখন সময় হবে তখন তুই তাকে এটা দিবি।’

ওয়াজিদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,’আমি কিভাবে বুঝব সময় হয়েছে নাকি?’

‘বুঝবি।তুই অবশ্যই বুঝবি।এজন্যই তো তোকে দিয়েছি।তবুও একটু পরিষ্কার করি।যখন তোর মনে হবে নবনীতার খুব বেশি আমাকে দরকার,ঠিক তখনই এই চিঠিটা তুই তাকে দিবি।বুঝেছিস?’

জবাবে ওয়াজিদ কেবল মাথা নাড়ল।আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে কারাগারের ভেতরে যেতে যেতে বলল,’ভালো থাকিস ওয়াজিদ।তাস আর আরিশের খেয়াল রাখিস।এরা তোকে খুব ভালোবাসে।’
.
.
.
.
পরদিন সকাল নয়টায় কঠোর নিরাপত্তায় আরহামকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।সে প্রিজন ভ্যানে উঠার দুই মিনিটের মাথায় গাড়িটা হর্ণ বাজিয়ে ধুলো উড়িয়ে কারাগারের মূল ফটক ছাড়িয়ে সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে গেল।

নবনীতা কারাগারের সামনের বিশালাকার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।তার মাথা ঝিমঝিম করছে।এই নিয়ে সে কতোগুলো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তার হিসেব নেই।রোজ রাতে তার মনে হয় সে দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে।এই কয়দিনে আইন আদালত সম্পর্কে সে যতটুকু জেনেছে,সেই অভিজ্ঞতা থেকে তার ধারণা হয়েছে আরহামের রায় খুব একটা ভালো কিছু হবে না।একটা দুশ্চিন্তা তাকে রোজ কুড়ে কুড়ে খায়।সে প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।আর কতো?আর কতো এভাবে ধুকে ধুকে ম’রবে নবনীতা?

ঘন্টাখানো বাদে ওয়াজিদের নম্বরে একটা ফোনকল এলো।রিসিভ করার পর দুই মিনিট ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে হঠাৎ সে ফোনের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল।মুহূর্তেই সেটা সশব্দে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।নবনীতা আশ্চর্য হলো।হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে ছুটে গিয়ে অস্থির হয়ে বলল,’কি হয়েছে ভাইয়া?রিমির কিছু হয়েছে?’

‘ভাইয়া!’

‘ওয়াজিদ ভাইয়া।’

ওয়াজিদের ধ্যান ভাঙল।আঁতকে উঠে সে নবনীতার দিকে তাকালো।নবনীতা উৎকন্ঠা মেশানো কন্ঠে আবারো জানতে চায়,’কি হয়েছে ভাইয়া?বলুন প্লিজ।’

ওয়াজিদ ঢোক গিলল।একহাতে কপালের ঘাম মুছে আচমকাই ছটফটে কন্ঠে বলল,’নবনীতা! আরহামদের গাড়িটা ব্রেকফেল করেছে।তিনজন স্পট ডেড,আর তিনজন এখনো মিসিং।পুরো গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেছে।ভেতরে কেউ আটকা পড়েছে নাকি এখনো বোঝা যাচ্ছে না।’

সে থামল।টেনে টেনে দু’বার শ্বাস নিয়ে আরো কিছু বলতে উদ্যত হলো।কিন্তু তার আগেই তার সামনে দাঁড়ানো নারী কায়াটি সমস্ত ভর হারিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো।ওয়াজিদ হকচকিয়ে গেল ভীষণ।সে নিজেও দ্রুত হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ভীত কন্ঠে বলল,’নবনী! তুমি ঠিক আছো?প্লিজ নবনী।এখনই এতো ভেঙে পড়ো না।শিওর হতে দাও আমাকে।প্লিজ নবনী!’

নবনীতা তার কোনো কথা শুনল না।তার কানে এখনো বেজে যাচ্ছে,’তিনজন স্পট ডেড,তিনজন মিসিং।’
সে ঠোঁট কা’মড়ে দুই হাতে মাটি আঁকড়ে ধরল।তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।তার চোখ যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।সে কোনোরকমে একটা শ্বাস টেনে বলল,’ভাইয়া আমি কি ম’রে যাচ্ছি?আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি,সত্যি সত্যি ম’রে যাচ্ছি।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬৫

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬৫)

লা’শবাহী ফ্রিজিং কার থেকে স্ট্রেচারে করে র’ক্তমাখা নিথর শরীরটা বের করে আনতেই নিপা আক্তার এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।তার সমস্ত শরীর হুট করেই জোর হারিয়ে ফেলল।তার মনে হচ্ছে তিনি একটা মৃ’ত লাশ।যার কথা বলার কিংবা কিছু করা ক্ষমতা নেই।

আবিরের লা’শ রাখা হলো বাড়ির মূল দরজার একটু সামনে।মুখের উপরে থাকা সাদা কাপড়টা তোলার পর যখন তার মুখ দৃশ্যমান হলো,তখন নিপা একহাত মুখে চেপে আর্তনাদ করে উঠলেন।এই ছেলেটা তার সন্তান,তার কলিজার টুকরা।

আবিরের আর নিপার দুরত্ব কয়েক হাতের মতো।নিষ্প্রাণ চোখে নিপা তার সমস্ত শরীর দেখে।কপালের কাছে সেই বিশাল ক্ষত দেখতেই তিনি পুনরায় হাউমাউ করে উঠলেন।বু’লেটটা মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়েছে।কতোটা কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা!

নিপা আক্তার উঠে দাঁড়িয়ে উন্মাদের মতোন ছুটে গেলেন।আবিরের নিষ্প্রাণ বক্ষে মাথা ঠেকাতেই তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
‘আব্বু! তুমি আমার জান।কথা বলো আব্বু।একবার আম্মুর দিকে তাকাও।’

আলাউদ্দিন আহমেদ নিরবে দু’জনকে দেখলেন।তার দুই হাত বগলদাবা করা,চোখ দু’টো আর্দ্র।ক্ষণিক বাদেই একহাতে চোখ মুছলেন তিনি।জালালুর রহমান আর শফিক সিকদারের গাড়ি এই মাত্র তার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে।

জালাল গাড়ি থেকে নেমেই শম্বুক গতিতে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।একবার আবিরের ম’র’দে’হ দেখে পরমুহূর্তেই আবার চোখ সরিয়ে নিলেন।একটা হাত কোনোরকমে আলাউদ্দিন আহমেদের কাঁধে রেখে ইশারায় তাকে স্বান্তনা দিলেন।তবুও কি এতে সন্তান হারানোর কষ্ট লাঘব হয়?আলাউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।এতো কিছুর পরেও ছেলেটার শেষ রক্ষা হয়নি।

সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পরেই শফিক সিকদার আর জালালুর রহমান সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।জালাল বেশ শান্ত,অথচ শফিককে দেখাচ্ছে ভীষণ অস্থির।চোখে মুখে সেই অস্থিরতা ধরে রেখেই তিনি জানতে চাইলেন,’ঘটনা কি বলো তো?আলাউদ্দিনের ছেলে জানার পরেও পুলিশ এমন অবলীলায় ছেলেটা কে মেরে ফেলল কি করে?পুলিশকে তো আলাউদ্দিন আগেই বলেছিল তাকে যেন কিছু না করে।’

জালালুর রহমান ব্যাক সিটে হেলান দিলেন।তাকে কিছুটা ভাবুক মনে হচ্ছে।একহাতে মাথা চুলকে তিনি গম্ভীর মুখ করে বললেন,’সেই উত্তর তো ইয়াসিনই দিতে পারবে।কিন্তু ঘটনা গুলো যেভাবে চক্রাকারে ঘটে যাচ্ছে,আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে প্রভাবশালী কারোরই হাত আছে।যার ক্ষমতা আলাউদ্দিনের থেকেও বেশি।’

শফিক কপাল কুঁচকান।
‘কি মনে হয়?কে হতে পারে সে?’

‘জানি না।তবে একজন কে সন্দেহ হচ্ছে।বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছে।বাকিটা ইয়াসিনই পরিষ্কার করবে।’

‘তোমার কি মনে হয়?ইয়াসিন নিজ থেকে কিছু বলবে?’

জালালুর রহমান কুটিল হাসলেন।একহাত হাঁটুতে ভর দিয়ে সামান্য সামনে ঝুঁকে বললেন,’বলতে বাধ্য।এমন পরিস্থিতি তে তাকে রাখব যে তাকে অবশ্যই বলতে হবে এই সবকিছুর পেছনে মূল হোতা কে।’
.
.
.
.
কমিউনিস্ট পার্টি।বাম রাজনীতি।খুবই পরিচিত কিছু শব্দ।বাম রাজনীতির মূল লক্ষ্য কি?সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা,সম্পদের সুষমবন্টন নিশ্চিত করা,মজদুর আর কৃষকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা,সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।আপাতদৃষ্টিতে শুনতে ভীষণ শ্রুতিমধুর মনে হয়।কিন্তু ভেতরে পরোখ করলে আদতেও বাম রাজনীতি অতোটা স্বচ্ছ,সরল বলে মনে হবে না।

বাম রাজনীতির একটা লক্ষ্য সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় স্রেফ সংসদীয় রীতিনীতি থাকবে,কিন্তু কোনো ধর্মের বালাই থাকবে না।অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়নের এজেন্ডা নিয়েই বাম রাজনীতি কাজ করে।

আরহামের মনে হয় এরা আসলে সাম্য নিয়ে না,বরং নাস্তিকতা প্রমোট করা নিয়েই কাজ করে।এদের যাবতীয় সব সমস্যা এরা টেনে ধর্ম পর্যন্ত নিয়ে যায়।কথা শুনলে মনে হবে,ধর্মই জগতের সব সমস্যার মূল।একমাত্র ধর্মীর অনুশাসন থেকে মুক্তি পেলেই সমাজের তরতর করে উন্নতি হবে।অন্যথায় সমাজ রসাতলে যাবে।

সেদিন পল্টনে একটা মিটিং বসেছিল।সেখানে অন্যান্য দলের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বাররাও ছিলো।কথায় কথায় তাদের একজনের সাথে তর্ক বেঁধে গেল আরহামের।তার নাম সজীব খন্দকার।তর্কের এক পর্যায়ে আরহাম মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে গেল।এসব নাস্তিকদের ভংচং কথা তার অসহ্য লাগে।ঘুরে ফিরে এরা সব দোষ ধর্মকে দিতে পারলেই যেন বাঁচে।এসব সুশীল দের সাথে তার আবার যায় না খুব একটা।

সজীবের সাথে পরে আরেক মিটিংয়েও তার দেখা হয়েছিল।বরাবরের মতো সেদিনও দু’জনের কথা কাটাকাটি হলো।রাগের এক পর্যায়ে আরহাম ফুসঁতে ফুঁসতে বলল,’এই নাস্তিক গুলো কে দেশে রাখাই উচিত না।পুরো দেশটা কে ধ্বংস করছে এরা।যতোসব ফালতু!’

আরহাম রাজনৈতিক ভাবে দূরদর্শী না।সেদিন সে আরো একবার প্রমাণ করলো রাজনীতিতে সে খুব বেশি অজ্ঞ।যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতো,তবে কখনোই সে মিডিয়ার সামনে এমন কথা বলতো না।

সে বিরক্ত হয়ে মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই জালালুর রহমান একপেশে হাসলেন।বেচারা কোনো কিছু বোঝার আগেই ফেঁসে গেল।এই এক কথা তাকে কতদূর নিয়ে যাবে,আরহাম টেরও পাবে না।তিনি আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।আরেকটা ঝামেলা বাঁধানোর সময় এসে গেছে।আরহাম কে নিয়ে তার আর কোনো প্রত্যাশা নেই।যেই আশায় তিনি এতোদিন আরহামকে সাহায্য করছিলেন,সেই আশায় ঐ ছেলে জল ঢেলে দিয়েছে।আজকাল সে জালালের মতামতের তোয়াক্কা করে না।সে চলে নিজের খেয়ালখুশি মতো।নূর আহমেদের সম্পদ দখলদারির যেই মামলা আদালতে করা হয়েছিল,সেটাও সেই করেছে।দেরিতে হলেও জালাল এই খবর জানতে পেরেছে।আবিরকে মা’রার পেছনেও কোনো না কোনো ভাবে আরহামের হাত আছে।এটাও তিনি নিশ্চিত।

নাহ,তাকে আর ভরসা করা যাচ্ছে না।এভাবে চুপ করে বসে থাকলে এক সময় সে জালালের উপর থাবা বসাবে।ক্ষমতায় সে জালালের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছে।তাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই এই মুহুর্তে জালালুর রহমানের মূল লক্ষ্য।তার হাতে ক্ষমতা আর যাই হোক,জালালের জন্য সুখকর কিছু না।জালাল আড়চোখে সজীব খন্দকারের নিরুদ্বেগ মুখখানা দেখেন।ব’লির পাঠা সে পেয়ে গেছে।এবার শুধু সময় মতো জ*বা*ই করার পালা।
.
.
.
.
ক্লাসিকাল ইলেক্ট্রো-ডায়নামিকস বাই গ্রিফিথস।নবনীতা গত মাস থেকে রোজ একটু একটু পড়তে শুরু করেছে বইটা।অর্ধেক সে বুঝতে পারে,বাকি অর্ধেক মাথার উপর দিয়ে যায়।তবুও কিছুটা আয়ত্ত হয়েছে এতোদিনে।

তার ব্যবসার অবস্থা ভালোই।উন্নতি হয়েছে,তবে খুব বেশি না।চাকরির বেতন এক হাজার টাকা বেড়েছে,এটা খুবই খুশীর সংবাদ।আরো একটা খুশীর সংবাদ চিত্রা আজ ক্লাস টেস্টে দশে দশ পেয়েছে।নবনীতার জন্য এটা কোনো চাট্টিখানি কথা না।তার ছোট্ট বোনটা পড়াশোনা করছে,ক্লাসের পরীক্ষায় ফুল নম্বর পাচ্ছে,এটা তার জন্য গর্বের বিষয়।সে আজ ভীষণ খুশি।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে।নবনীতা মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে বইয়ের দিকে ঝুঁকে থেকে শুভ্রাকে ডাকল,’শুভিইই! দরজা টা খোল।দেখ কে এসেছে।নাম জিজ্ঞেস করে তারপর খুলবি।’

সে পুনরায় পড়ায় মন দিলো।দরজার খোলার শব্দ কানে এসেছে মিনিট পাঁচেক আগে।এখন আবার সব নিরব।নবনীতার খটকা লাগল।বইয়ের পাতায় চোখ এটেই সে জানতে চাইল,’কে এসেছে রে শুভি?’

দরজায় কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।নবনীতা না দেখেই ব্যাপারটা টের পেয়েছে।টের পেতেই সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো।দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখতেই চোখ জোড়া আপনা আপনি বড়ো হলো তার।

সহসা হাতে থাকা বইটা সশব্দে বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে।বিস্ময় জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করল,’আপনি?’

আরহাম নিঃশব্দে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালো।নবনীতা একবার তাকে দেখল,একবার তার কোলে থাকা বাচ্চাটাকে দেখল।তার মন চাইছে ছুটে গিয়ে তাকে কোলে নিতে।অথচ সে তার জায়গা থেকে একটু নড়ল পর্যন্ত না।দুই হাতে শাড়ির দুই পাশ খামচে ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো।চোখ ভরে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষ কে।

দুরত্বটা প্রথমে আরহামই কমালো।কয়েক কদম এগিয়ে এসে স্মিত হেসে বলল,’কেমন আছো পরী?’

বহুদিনের বিরহ।সম্পর্ক এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখান থেকে দু’জনকে তাদের কথপোকথন শুরু করতে হয় কুশলাদি বিনিময় করার মাধ্যমে।অথচ একটা সময় তো তারা দু’জন নিজেদের চোখ দেখেই সব বুঝে যেত।

নবনীতা মলিন মুখে সামান্য হাসি ফোটালো।মাথা নামিয়ে বলল,’জ্বী ভালো আছি।’

আরহাম গভীর চোখে তাকে আগাগোড়া পরোখ করল।শেষে তার একেবারে কাছাকাছি এসে বলল,’তোমার ছেলেকে নিয়ে এসেছি সাথে।কোলে নিবে না?’

আরো বেশি মেঝের দিকে মাথা ঝুকালো নবনীতা।একেবারে ক্ষীন গলায় জবাব দিলো,’যদি আপনি দেন,তবে অবশ্যই নিব।’

‘এই নাও,দিলাম।’

সে চোখ তুলে।নিমিষেই ছোঁ মেরে একটানে তাকে নিজের কাছে আনে।গোল গাল ফর্সা মুখটাতে অজস্র চুমু খেয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে,’কেমন আছো বাবা?মায়ের কথা মনে পড়েছে তোমার?’

আরশাদ তাকে কয়েক পল দেখল।তারপরই আবার পেছন ঘুরে আরহামের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে নবনীতার কোল থেকে তার কোলে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,’বাবার কাছে যাবো।’

নবনীতা আশ্চর্য হলো।যতখানি আশ্চর্য হলে মানুষের মুখ হা হয়ে যায়,ঠিক ততখানি আশ্চর্য।সে বোকা বোকা হয়ে বলল,’আপনার কাছে যেতে চাইছে! এতো ভালোবাসে আপনাকে?’

আরহাম মুচকি হাসল।আরশাদকে নিজের কোলে নিয়ে মাথা চুলকে বলল,’,বাসে বোধ হয়।কেন তুমি কি এটা দেখে কষ্ট পাচ্ছো?’

নবনীতা দুই হাত বগলদাবা করল।মুখ ফুলিয়ে অন্য পাশ ফিরে বলল,’জ্বী অবশ্যই কষ্ট পাচ্ছি।তাকে আমি কতো আদর করে,বুকে চেপে ঘুম পাড়িয়েছি।সে এখন বাবা বাবা করছে।আমার কষ্ট হচ্ছে।কেউ আমাকে ভালোবাসে না।’

শেষ বাক্য কি এমন ছিলো আরহাম জানে না,শুনতেই সে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো।তার মুখের হাসি আচমকাই আরো চওড়া হয়েছে।শেষ কথাটা কি পরী তাকে ঠেস দিয়ে বলল?এই ঠেস আরহামের পছন্দ হয়েছে।দুই চোখ সরু করে সে জানতে চায়,’তবে কি তুমি চাও তোমাকে আমরা ভালোবাসি?’

নবনীতা থতমত খেয়ে বলল,’জ্বী না।এমন কিছু চাই না।’

সে গিয়ে খাটে বসল।আরহাম আরশাদকে কোল থেকে নামাতেই সে বসার ঘরের দিকে ছুটে গেল।নবনীতা চোখ নামিয়ে নিজের পা দেখতে দেখতে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’কেন এসেছেন আপনি?কি চাই আবার?’

‘তোমাকে চাই।’ অকপটে জবাব দিলো আরহাম।

নবনীতা মাথা তুলল না।কেবল দুই হাতে চাদরটা মুঠ করে ধরল।সেই প্রথম প্রথম ভালো লাগার যেই অনুভূতি,আজ অনেকগুলো দিন পর তার সেই একই অনুভূতি হচ্ছে।সে ঠোঁট চেপে উত্তর দিলো,’আমাকে চাওয়ার কিছু নাই।’

আরহাম হাসি মুখে এগিয়ে গেল।নবনীতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একবার মুখটা দেখার চেষ্টা করল।নবনীতার মনে হলো লজ্জায়,সংকোচে তার সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে।তার হাঁটুর উপর থাকা হাত দুইটা চেপে ধরেই আরহাম নিচু স্বরে বলল,’শুভ বিবাহ বার্ষিকী পরী।তোমার জন্য বিবাহিত জীবন কেমন ছিলো জানি না,তবে আমার জন্য এই একটা বছর ভীষণ সুন্দর আর দামি ছিলো।তোমাকে ধন্যবাদ এতো এতো সুপুরুষের ভীড়ে আমার মতো অধম কে বেছে নেওয়ার জন্য।এই অধম তার পরীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’

নবনীতা চোখ তুলল।যেই চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে।আরহাম বিচলিত হয়ে বলল,’সেকি! আজ এতো চিন্তা করে এসেছি সব গুছিয়ে বলব,কোনো উল্টাপাল্টা বলব না।সেই তুমি আবার কাঁদছো! আমি কি করলে তুমি কান্না বন্ধ করবে একটু বলবে?’

নবনীতা থামল না।উল্টা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছতে মুছতে বলল,’এতো দিনে আসার কথা মনে হয়েছে!’

‘অদ্ভুত! তুমি সময় চেয়েছিলে।’

‘তো কি হয়েছে?আপনি সেজন্য আসা বন্ধ করে দিবেন?সময় চেয়েছি,মুক্তি চাইনি।’

আরহাম আহাম্মক হয়ে তার কথা শুনলো।সে থামতেই ফিক করে হেসে উঠে বলল,’আন বিলিভেবল।তোমরা মেয়েরা এমন কমপ্লিকেটেড কেনো?মুখে বললেই তো পারো কি চাও।’

‘আমরা কমপ্লিকেটেড না,আপনারা গর্দভ।দোষ আপনাদের,আমাদের না।’

‘আচ্ছা মানলাম।এবার বলো বিবাহ বার্ষিকী তে কি চাও?’

আগের চেয়েও ক্ষীণ স্বরে সে উত্তর দেয়,’কিছুই চাই না আমার।পরে আপনি সেগুলোর খোঁটা দিবেন।’

আরহামের মনে হলো তার সামনে বসে থাকা মেয়েটার বয়স পঁচিশ না,বরং ষোলো কিংবা বড়ো জোড় সতেরো।তার কথায় বাচ্চামো ভাব স্পষ্ট,অভিমানটাও কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মতো।’

সে উঠে গিয়ে তার পাশে বসল।এক হাত থুতনিতে রেখে তার মুখটা উঁচিয়ে ধরে বলল,’চুমু দিতে চাই।সেটার খোঁটা কি কখনো দিয়েছি আজ পর্যন্ত?’

নবনীতা দ্রুত তার হাত সরিয়ে নিল।আরহাম আর দ্বিতীয় বার তার গালে হাত রাখল না।কেবল সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে তার আরক্ত গালে আলতো করে চুমু খেল।এতো বেশি আলতো যে নবনীতার মনে হলো সে কোনো কাঁচা মাটির পুতুল।হালকা জোর খাটালেই গলে যাবে।তার চোখ ভিজে উঠল।আরহাম পর পর অসংখ্য চুমু খেল তার গালে,তার কপালে,তার চোখের পাতায়।তার ভাষায় বলতে গেলে নবনীতার এতোদিনের জমে থাকা দুঃখ গুলো সে অল্প অল্প করে শুষে নিল।

সে একবার টেনে শ্বাস নিল।তারপরই গম্ভীর গলায় জানতে চাইল,’তুমি কি আমায় একটি বার জড়িয়ে ধরবে পরী?বিবাহ বার্ষিকীতে তোমার কাছে এইটুকুই চাই আমার।’

সহজ,সরল আর নিঃসংকোচ আবেদন।নবনীতা চোখ মুখ খিঁচে ধরল।এক,দুই ,তিন,,গুনে গুনে তিন সেকেন্ডের মাথায় সে দুই হাতে শক্ত করে আরহামকে জড়িয়ে ধরল।ঠোঁট ভেঙে বলল,’আমি সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছি আপনার আচরণে।আপনি বলেছেন আমি নাকি পায়ে থাকার জিনিস।আমি এ কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।’

আরহাম জবাব দিলো না।কেবল একটা হাত তার পিঠে রেখে চুপচাপ তার কথা শুনলো।নিজের ভেতর যেই ঝড় উঠেছে,সেই ঝড়ে বিলীন হতে আর বেশিক্ষণ সময় নেই।তাই বলে নিজেদের শেষ মুহূর্ত গুলো খারাপ করবে কেন?এই মুহুর্ত গুলো এমনই থাকুক।পরী যখন এগুলো ভাববে তখন এখনের মতোই তার চোখ পানিতে ভেসে যাবে।

নিজের নতুন ব্যবসা থেকে শুরু করে নতুন চাকরি,পড়াশোনা,এমনকি আদালতের নোটিশ পর্যন্ত সবকিছু নবনীতা একে একে আরহামকে খুলে বলল।বাড়ির কথা বলতে গিয়েই সে খুশিতে খিলখিল করে উঠে বলল,’জানেন আমি এখনো জানি না আমি কিভাবে সবকিছু ফিরে পেলাম।আমি তো,,’

সে কথা শেষ করার আগেই আরহাম তাকে থামিয়ে দিয়ে খানিকটা অস্থির হয়ে বলল,’আচ্ছা পরী! কখনো যদি শুনো আমি কাউকে খু’ন করেছি,তবে তুমি কি করবে পরী?’

নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি?কি করবেন?’

আরহাম শীতল চোখে তার দিকে তাকায়।হাতের বন্ধন অনেক আগেই ছুটে গেছে তার।আচমকা নিচ থেকে পুলিশ গাড়ির সাইরেনের শব্দ ভেসে এলো।শব্দ শুনেই নবনীতা বুঝলো শুধু একটা না,কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির নিচে।সে আঁতকে উঠে বলল,’পুলিশ ভ্যান!’

আরহাম ক্লান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।নবনীতা একহাত মুখে চেপে থমকে যাওয়া কন্ঠে বলল,’বাড়ির নিচে পুলিশ ভ্যান কেন এসেছে আরহাম?কি হয়েছে?’

ততক্ষণে বাড়ির দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুরু হয়েছে।দরজার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর সোবহান রহমান।যার কাছে শাহরিয়ার আরহামের নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে।যার বিরুদ্ধে সজীব খন্দকারকে ছুরি’কাঘাতে কুপিয়ে হ’ত্যার অভিযোগ উঠে এসেছে।

চলবে-