Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 45



জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৩

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩
#তাজরীন_ফাতিহা

আফাজাল হোসেন বিছানায় বসে গতকালের খবরের কাগজ পড়ছেন। প্রতিদিন হোটেলে থাকাকালে পত্রিকা কিনেন, পড়েন আবার রাতে ফিরার সময় বগলদাবা করে বাসায় নিয়ে আসেন। পরদিন সকালে পুরোনো পত্রিকা ঘাটা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। তাঁর মনোযোগ পত্রিকার পাতায়। দেশে খুন-খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে গেছে। এই যেমন পত্রিকার পাতায় বড় বড় করে লিখা, “সুনামগঞ্জের কালীঘাটে গলাকাটা লাশ উদ্ধার” এর পরের পাতায় “আরাই বিঘা জমি নিয়ে কাকরাইলে দাঙ্গা এবং তিনজন নিহত” এইসব এখন নিয়মিত ঘটনা প্রায়। খালি খুন, হত্যা, লড়াই, ঘাত-প্রতিঘাত, ধর্ষণ। দেশটা রীতিমত গোল্লায় চলে গেছে। তিনি শব্দ করে কাগজ ভাঁজ করে রেখে দিলেন। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। জয়নব বেগম হাত মুছতে মুছতে ভিতরে এসে বললেন,

“কিগো আপনে এহনো এইহানে বইয়া রইছেন? বাচ্চাগুলার খোঁজ নেন নাই?”

আফজাল হোসেন রায়হানদের কথা ভুলেই বসে আছেন। সকালে উঠে ফজরের নামাজ, কুরআন পড়ে পত্রিকা পড়ায় এমনভাবে ডুবে গিয়েছিলেন যে বাচ্চাগুলোর কথা মনে ছিল না। জয়নব বেগম আবারও বললেন,

“আল্লাহ্ আপনারে আক্কল কবে দিবো কন তো? আপনেরে রাইতে কইলাম না রায়হান পোলাডায় সহজে কিছু কইতে চায়না, কিছু লাগলে জীবনেও মুখ ফুইটা কইবো না যে এইডা দ্যান?”

“তুমি হুদাই রাগ করছো জয়নব। অনেক রাতে আসছে এখনো ঘুমাচ্ছে বোধহয়।” আফজাল হোসেন হেঁসে বললেন।

“আপনের শুইদ্ধ কতা আপনের কাছেই রাহেন। একবার কইছি না আমার লগে শুইদ্ধ কইবেন না নাকি দেহাইতেছেন আপনে শিক্ষিত আর আমি মূর্খ।” রেগে উত্তেজিত হয়ে বললেন জয়নব বেগম।

আফজাল হোসেনের মুখ চুপসে গেলো। প্রতিদিন জয়নব বেগমের সাথে তাঁর এই কথা বলা নিয়ে একটা রায়েট হয়ে যায়। পড়ালেখায় মেট্রিকের গণ্ডি তিনি পেরিয়েছেন। তাই শুদ্ধ কথা বের হয়ে যায় মুখ থেকে। তবে জয়নবের সাথে তিনি আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলেন কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলে শুদ্ধ কথা বের হয়ে যায়। আফজাল হোসেন মেকি হাসি দিয়ে বললেন,

“ওই কইতরী রাগতাছো ক্যান। এই দেহো অহন ঠিক আছে না।”

জয়নব বেগম আর রাগ করে থাকতে পারলেন না। ‘কইতরী’ ডাকটায় আলাদাই এক মায়া রয়েছে যা তাঁর রাগকে পানি করে দিলো। তিনি এবার বললেন,

“এহন নয়টা বাজে। অহনো ঘুমাইয়া থাকবো না। নির্ঘাত ওই পোলা ঘরের মধ্যে বইয়া রইছে। কাইলকা কতাবার্তায় বুঝছি অনেক আত্মসম্মানবোধ পোলার। ভালা পরিবারের বাচ্ছাগুলা। চাইয়া খুইজ্জা খাওনের মতো না। একটু খোঁজ নিয়া আহেন।”

আফজাল হোসেন স্ত্রীর এহেন বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলেন। আসলেই জয়নব বেগম যা বলেছেন সেটা তিনিও লক্ষ্য করেছেন। ছেলেটা কালকে রাতে তাঁকে বলছিল, “আংকেল একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন। ওদের নিয়ে উঠার মতো জায়গা নেই। কম ভাড়ায় একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিলে মাস শেষে খেয়ে পড়ে যেন থাকতে পারি।” আফজাল হোসেন তখনই তাঁদেরকে সাথে করে নিয়ে এসে তাঁর ভাড়া ঘরটায় থাকতে দেন। তিনি অবশ্য বলেছিলেন কোনো টাকা পয়সা লাগবে না থাকার জন্য। রায়হান তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলেন। ছেলেটার আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ তাঁকে মুগ্ধ করেছে।
______
——
আফজাল হোসেন রায়হানদের ঘরের দরজায় দুইবার টোকা দিলেন। একটু পর দরজাটা খুলে গেলো। তিনি চেয়ে দেখলেন রায়হানের গায়ে হাগু ভর্তি। রায়হান ওনাকে দেখে কাচুমাচু করছে। উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,

“ওমা একি অবস্থা করেছো?”

রায়হান বললো,

“আসলে রাহমিদ এইমাত্র টয়লেট করে দিয়েছে। দরজা নকের শব্দে তাড়াহুড়া করে খুলে দিলাম। দুঃখিত! টয়লেট টা যদি দেখিয়ে দিতেন নিজেকে ও রাহমিদকে পরিষ্কার করিয়ে জামা কাপড় গুলো ধুয়ে দিতাম। ওকে পড়ানোর মতো কোনো কাপড় নেই ওর কাপড়গুলো নোংরা হয়ে গেছে।”

আফজাল হোসেন রায়হানকে টয়লেট দেখিয়ে দিল। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে টয়লেটে ঢুকলো। রাহমিদের জামা খুলে ওর পটি পরিষ্কার করে পিছন ধুয়ে দিলো। রায়হান নিজের জামা খুলে অন্য একটা গেঞ্জি পরলো। তারপর রাহমিদের গায়ে পানি ঢাললো। গায়ে পানি পড়ায় রাহমিদ চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান ওকে দাড় করিয়ে গায়ে পানি ঢালছে কিন্তু বাচ্চাটা স্থির থাকছে না। কেঁদে উঠছে। রায়হান হালকা ধমক দিয়ে বললো,

“পিট্টি দিবো কিন্তু। বোনুর জামা নোংরা করেছো উঠে পিটাবেনে। এখন আবার দুষ্টু করছো। সোজা হয়ে দাঁড়াও পঁচা ছেলে।”

রাহমিদ মোটেও সোজা হলো না, ভাইয়ের ধমক শুনে আরও জোরে কেঁদে উঠে মোচড়ানো শুরু করলো যাতে ভাইয়ের হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। রায়হান তা দেখে তাড়াতাড়ি অল্প একটু সাবান ডলে গোসল শেষ করলো। রাহমিদ রায়হানকে খামচি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। রায়হান দ্রুত ওকে তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসলো। রাহমিদ রায়হানের গলা জড়িয়ে ধরা। রায়হান ওর মাথা গা ভালোভাবে মুছে দিলো। রাহমিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কোলের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠে হেসে দিলো। তা দেখে রায়হান বললো,

“ওরে দুষ্টু, এই বয়সেই পলিটিক্স শিখে গেছিস। বুদ্ধি দেখো দুইদিনের লাড্ডুর। বাবাগো বাবা! গোসল না করার জন্য কত নাটক করলো। এখন আবার খুশির ঠেলায় লম্ফ জম্ফ শুরু করেছে। এখন তোকে বেঁধে পিটাবো। আমাকে খামচিয়ে কি করেছে। জংলি বিল্লি।”

রাহমিদ ভাইয়ের কথা শুনে কোলের মধ্যে হাসি দিয়ে লাফালাফি বাড়িয়ে দিলো। রায়হান ওর গাল চেপে ধরে চুমু খেলো। “ওরে জাদুরে, লাড্ডুরে, গুলুমুলুরে, টোটনরে” বলে ওর পেটের মধ্যে নাক চেপে, গালে গাল ঘষে আদর করতে থাকলো। আদর করতে করতে শোয়ায় দিলো। তারপর ওর গালে গাল লাগিয়ে বললো,

“আমার লাড্ডুগুড্ডু, ভাইয়ু জামা কাপড় ধুয়ে আসি। তুমি বোনুর পাশে শান্ত হয়ে খেলো, ঠিক আছে।”

কথাটা বলে ব্যাগ থেকে কিছু খেলনা ওর হাতে আর পাশে ছড়িয়ে দিলো। সাথে মাথার বালিশ চারপাশে বর্ডার করে দিলো যাতে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে না যায়। রুদ এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। ওকে ঠিক করে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
_____
——
রায়হান টয়লেটের সামনে এসে দেখে কিছু মহিলা দাঁড়ানো। তাঁরা টয়লেটে বাচ্চাদের জামা কাপড় দেখে নানা কথা বলছে। জয়নব বেগম কলে হাত ধুতে এসে দেখেন রায়হান আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মহিলাদের দেখে। সে দ্রুত সেখানে গিয়ে সবাইকে বললো,

“এইহানে জটলা পাকায় রাখছো ক্যান? যাও নিজেগো কামে।”

ভাড়াটিয়া একজন বললো,

“ভাবি টয়লেট করতে আইসা দেখি বাচ্ছাগো জামা কাপড়ে ভরা। এত জামা একদিনে ভিজাইছে কোন বেক্কল কন তো? আমরা টয়লেটে যামু না।”

জয়নব বেগম বুঝলেন রায়হান না বুঝে সব গুলো কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে। এই পরিবেশে নতুন বলে বুঝতে পারেনি। এটা যদি এরা জানে তাহলে তুলকালাম লাগিয়ে দিবে যেহেতু এই ভাড়া বাসাগুলোর টয়লেটের চাহিদা বেশি, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তাই তিনি বললেন,

“আমাগো মেহমানের বাইচ্চার জামা কাপড় এগুলান। তোমরা অন্য টয়লেটে কাম সারো আইজকার লাইগ্যা।”

জয়নব বেগমের কথা শুনে তাঁরা প্রস্থান করে কারণ মালিকের আত্মীয় হইলে তাঁদের এইখানে কিছু বলার নাই। জয়নব বেগম রায়হানকে জামা কাপড় ধুতে বলে চলে গেলো রান্না ঘরে। রায়হানদের নাস্তা দিতে হবে। বেলা অনেক হলো বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে।
_____
রায়হান কাপড় দ্রুত ধুয়ে শুকাতে দিলো। ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো রুদাইফা উঠে গেছে। রাহমিদ রুদাইফার চুল ধরে টানছে আর রুদ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। রাহমিদ বোনের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসলো আর হাত বাড়িয়ে দিলো। রুদ ওকে কোলে নিলো যদিও ভালো করে পারেনি। এই দৃশ্য দেখে রায়হানের চোখ জুড়িয়ে গেলো। রায়হান ভিতরে ঢুকে বললো,

“রুদ সোনা উঠে গেছো। বাবুনকে দাও। চলো হাত মুখ ধুয়ে দেই।”

রুদ রাহমিদকে ভাইয়ের কোলে দিলো। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে রুদকে হাত মুখ ধোয়াতে টয়লেটে নিয়ে গেলো। রুদ টয়লেট করে বের হলে রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়েই রুদকে ব্রাশ করিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দিল। রাহমিদ মোটেও স্থির থাকছে না। দুজনকে সামলাতে রায়হান হিমশিম খেলো আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। একদিনেই এই অবস্থা হলে সামনের দিনগুলো কিভাবে পার করবে? রায়হান বেশ বুঝতে পরলো আগামী দিনগুলো তাঁর জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জের হতে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জের নাম বাচ্চা সংসার নামক যুদ্ধ।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০২

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হানের মুখে একটু আগের কাঠিন্য ভাবটা আর নেই। খুব শান্ত ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে সে। পাশে রুদাইফা একমনে বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে খেলছে। জয়নব বেগমের কোলে রাহমিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চা মানুষ খিদে আর টয়লেট মিটে গেলেই আর ঝামেলা করে না। জয়নব বেগম বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গুলুমুলু আদুরে মুখ! যেন ছুঁয়ে দিলে গলে যাবে। মাশআল্লাহ্ নজর যেন না লাগে। একটু আগে রায়হানের থেকে বাচ্চাটার বয়স জেনেছে। এইতো দশ দিন পর এক বছরে পা দিবে। মেয়েটা পাঁচ বছরের। আফজাল হোসেন রায়হানকে সতেরো বছরে বয়সী ভেবেছিলেন কিন্তু ছেলেটার বয়স উনিশ। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। বাচ্চাগুলো এই বয়সেই এতিম হয়ে গেলো। রায়হান ছেলেটার কাঁধেই এখন তাঁদের গুরু দায়িত্ব। একটা দীর্ঘনিশ্বাস বের হলো জয়নব বেগমের বুক চিরে।
_______
——-
অন্ধকার ঘর। রায়হানের বুকের উপর রাহমিদ ঘুমিয়ে আছে। জয়নব বেগম বাচ্চাটাকে তাঁর সাথে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রায়হান দেয়নি।ভাই বোনদের ছাড়া তাঁর ঘুম আসবে না। এক হাত দিয়ে রাহমিদকে আগলে ধরে পিঠের উপর হাতটা হালকা উঠানামা করছে। রাহমিদের মুখটা তাঁর বুকের সাথে লেগে আছে। ঠোঁটের ভিতর আঙ্গুল ঢুকানো। ঘুমের মধ্যেই একটু পর পর আঙ্গুল চুষছে। তাঁর অপর হাত দিয়ে রুদাইফাকে জড়িয়ে ধরা। রুদাইফা ঘুমাচ্ছে না। ভাইয়ের আঙুল ধরে খেলছে। একবার উঠে বসছে আবার শুয়ে পড়ছে।

“রুদাইফা দুষ্টুমি করে না। ঘুমাও।” রায়হান মৃদু ধমক দিয়ে বললো।

“বাবু ঘুমাই। রুদ ঘুমাই। রুদ দুষ্টু করে না।” রুদ রায়হানের হাতের সাথে মাথা বারি দিয়ে বলে।

“রুদ সোনা খুব দুষ্টু করে। না ঘুমালে ভূতু এসে রুদ সোনাকে খেয়ে ফেলবে।” রায়হান তাকে ঘুম পাড়াতে বললো।

“ভূতু…” রুদাইফা ভয়ার্ত গলায় বললো।

“হুম” রায়হান উত্তর দিলো।

“আমুর কাছি যাবু, আবু কুই?” রুদাইফা কাঁদো কাঁদো গলায় শুধালো।

রায়হান উত্তর দিতে পারলো না আর। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো তাঁর। এখন রুদকে কি উত্তর দিবে সে। কেন সে ভূতের ভয় দেখাতে গেলো? রুদটা তো ভয় পেলেই বাবা মার কোলের মধ্যে ঢুকে থাকতো। সে কিভাবে তা ভুলে গেলো? এখন কিভাবে সামাল দেবে রুদকে। এদিকে রুদ কান্না গলায় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। রায়হান রুদাইফাকে বুকের মধ্যে টেনে আদুরে গলায় বললো,

“আব্বু, আম্মু তো বেড়াতে গিয়েছে সোনা। এইতো কয়েকদিন পরই চলে আসবে। আব্বু, আম্মু রুদ সোনাকে অনেক মিস করছে। শীঘ্রই এসে পড়বে যদি রুদ সোনা কোনো দুষ্টু না করে, ভালো বাচ্চার মতো ঘুমায়, খায়, ভাইয়ুর কথা শুনে।”

“রুদ মিসড আমু, আবু। রুদ কোনো দুষ্টু কব্বে না। ভাইয়ুর কতা শুনবে। রুদ ভালু।” রুদাইফা ভাইয়ের গলা জড়িয়ে বলে।

রায়হান রুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

“রুদ সোনা ভাইয়ুর কানে কানে কবিতা শুনাও তো। রুদ না সুন্দর সুন্দর কবিতা পারে?”

“হাম”

রুদাইফা ভাইয়ের গলা জড়িয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,

“জনি জনি,
ইয়েস পাপা।
ইটিং সুগার,
নো পাপা।
ওপেন ইউর মাউথ
হাঃ..হাঃ.. হাঃ”

রুদাইফা লাস্টের লাইন বলতে গিয়ে জোরে হেঁসে দিলো সাথে রায়হানও। রাহমিদ নড়ে উঠায় সাথে সাথে রুদকে চুপ করতে বললো কিন্তু রুদ হেসেই যাচ্ছে। রায়হান বোনের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আর প্রার্থনা করলো সারাজীবন যেন তাঁর ভাইবোন এভাবেই হাসতে থাকে। ইংশা আল্লাহ্ একটুও কষ্টের আঁচ তাঁদের গায়ে সে পড়তে দিবে না। কিন্তু বাবা মা বিহীন নিঃস্ব রায়হান তা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে আল্লাহ্ তায়ালাই ভালো জানেন।
______
—–
সকাল ছয়টা বাজে। আফজাল হোসেনের বাড়িটা টিনশেডের। স্বল্প ভাড়ায় কয়েকটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এখানে ভাড়া থাকেন। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় এত কম টাকায় ভাড়া থাকা অমাবস্যার চাঁদের মতো। বাড়িটায় টয়লেট দুটো। রান্না ঘর দুটো, একটায় আফজাল হোসেনের ঘরের ও হোটেলের রান্না বান্না হয় আরেকটায় ভাড়াটিয়ারা রাঁধেন। সকালের এই সময়টায় ভিড় লেগে যায় রান্নাঘরে। পুরুষদের তাড়া থাকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য, তাই মহিলারা আগেভাগেই উঠে রান্নার কাজটা সেরে ফেলেন। চুলা চারটা। তাই অতটা ঝামেলা কাউকেই পোহাতে হয়না। এইসব ভাড়া ঘরে তো ঝগড়া মারামারি অহরহ ঘটনা। কিন্তু আফজাল হোসেন নির্ভেজাল মানুষ। ঝুট ঝামেলা তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই ঝামেলা এড়াতে এই টিনশেড বাড়িটায় সাধ্যের মধ্যে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ভাড়াটিয়ারা আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগমকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। আফজাল হোসেনের ভাতের হোটেলের রান্নার কাজেও তাঁরা জয়নব বেগমকে সাহায্য করে বিনা দ্বিধায়। মনেই হয়না টিনশেডের এই বাড়িটায় কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন নিম্নবিত্ত পরিবার থাকে, যেন একই পরিবারের আত্মীয়রা মিলেমিশে বসবাস করছে।

_____
জয়নব বেগম ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাটাকুটি করছেন। পাশে মাছ, মাংস, শাক সবজি ধোঁয়া এবং মশলা বাটাবুটির কাজ করছে ভাড়াটিয়া বিলকিস, রোমানা, পপি আর সহকর্মী আলেয়া। সকাল হলেই জয়নব বেগমের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। স্বামী ভাতের হোটেল চালায়। প্রতিদিন এই ভাতের হোটেলের রান্না সেই করে। আজকে রান্নার মেন্যু থাকবে, “লতি দিয়ে কুঁচো চিংড়ি, লাউ শাক, করল্লা ভাজি, ঢেঁড়স ভাজি, আলু দিয়ে ডিমের ঝোল, ছোট মাছের চচ্চড়ি, রুই মাছের ঝোল, বয়লার মুরগির ভুনা, আলু ভর্তা, পেঁপে ভর্তা, মুগের ঘন ডাল আর পাতলা ডাল।” আফজাল হোসেন দুপুর বারোটায় ভ্যানে করে খাবার গুলো নিয়ে হোটেলে যাবেন। জয়নব বেগম চুলোয় খুন্তি নাড়াচ্ছেন আর রোমানার সাথে কথা বলছেন। রোমানা কড়াইয়ে লাউ শাক ঢেলে দিয়ে জানতে চাইলো,

“কাইলকা অত রাইতে কেডা আইছে আফা?”

“আমগো চিন পরিচিত মানুষ।”

“ওহ আইচ্ছা।”

জয়নব বেগম আবার রান্নায় মনোযোগ দিল সাথে রোমানাও। জয়নব বেগম বেশি কথা বাড়াননি কারণ মানুষ একটা কথাকে নানা ভাবে রসকষ মিশিয়ে সবার কাছে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে যা তাঁর পছন্দ না। তাই অল্প কথায় মিটমাট করলেন।
_____
—–
রাহমিদের কান্নার আওয়াজে রায়হানের ঘুম ছুটে গেলো। রায়হান রাহমিদকে সহ তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। কান্না থামাতে কিছুক্ষণ দোলালো। ভাইয়ের পরশ পেয়ে বাচ্চাটার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করতে লাগলো। রায়হান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার লাড্ডু কি চায়? রাহমিদ সোনা কি চায়?” বাচ্চাটাকে নানা কথা বলে কতক্ষন আদর করলো। বাচ্চাটাও অস্পষ্ট আওয়াজ করে ভাইয়ের আদরের জানান দিলো।

এর মধ্যেই রায়হান অনুভব করলো তাঁর বুক ভিজা। সে তৎক্ষণাৎ রাহমিদের দিকে চাইলো আর বললো,

“ওরে দুষ্টু, ভাইয়ুর গায়ে সুসু করে দিছো?”

রাহমিদ মুখে দুই আঙ্গুল ভরে বলে উঠলো, “য়ু… উ.. পু…উস”

“আমার লাড্ডুগুড্ডু” বলে রায়হান রাহমিদের পেটে নাক দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ওকে নিয়ে চৌকি থেকে উঠলো। রাহমিদকে পরিষ্কার করতে হবে কিন্তু যে কয়টা জামা এনেছিল সব নষ্ট করে ফেলেছে বাচ্চাটা। কালকে থেকে তো পড়ানো লেগেছে। জামা গুলো ধুয়ে দিতে হবে। ধুয়ে শুকাতে তো সময় লাগবে। রাহমিদকে এখন পরাবে কি? জয়নব বেগমের কাছে কাপড় থাকতে পারে। কিন্তু ওনার কাছে চাইতে লজ্জা করছে। রাত থেকে উনাদের ঘাড়ে উঠে বসে আছে। কিছু চাইলে যদি অন্য কিছু মনে করে। রায়হান ভাবলো রুদাইফার কোনো গেঞ্জি রাহমিদকে পরাবে।যেই ভাবা সেই কাজ ব্যাগ খুলে রুদাইফার একটা গোলাপী গেঞ্জি বের করলো তারপর রাহমিদের গা থেকে পূর্বের পোশাক খুলে সেটা পরিয়ে দিলো। পোশাকটা রাহমিদের থেকে অনেক বড়। পায়ের নিচ পর্যন্ত চলে যায়। রাহমিদকে পুরো মেয়ে মেয়ে লাগছে। আদুরে কিউট বাচ্চা। রায়হান ওকে দেখে বললো,

“আমার গুলুমুলু টোটন সোনা। ভাইয়ু তোমায় মেয়ের পোশাক পড়িয়েছি দেখে রাগ করেছো? রাগ করে না। ভাইয়ু তোমায় অনেক গুলো জামা কিনে দিবো, ঠিক আছে লাড্ডুগুড্ডু।”

কথাগুলো বলে রাহমিদের গালে শব্দ করে চুমু খেলো রায়হান। রাহমিদ ফোকলা হেঁসে তাকিয়ে রইলো রায়হানের দিকে।
_______

“ওমা একি অবস্থা করেছো”

চলবে….

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০১

0

জীবন_পেন্ডুলাম

“এই ছেলে এভাবে শুয়ে আছো কেন?”

আফজাল সাহেব ছেলেটার গা ঝাকিয়ে বললেন। বছর ষোলো, সতেরোর একজন ছেলে রাস্তার পাশে শুয়ে আছে কোলে এক বছরের শিশু বা তারও কম হতে পারে। তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে রাখা। পাশে আবার পাঁচ কি ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে ছেলেটার গা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।

একজন কিশোর এত রাতে দুটো বাচ্চা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে তাও আবার রাস্তার পাশে বিদঘুটে একটা ব্যাপার না? আফজাল হোসেন রাত একটা নাগাদ নিজের ভাতের হোটেল বন্ধ করে এই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর হোটেলের বেঁচাবেঁচি ভালোই চলে। প্রায় প্রতিদিনই বাসায় দেরি করে ফেরেন তিনি। যদিও রাস্তাটা জনশূন্য থাকে এই সময়টায় তবুও তিনি ও তাঁর সহকর্মী দিলদার এই রাস্তা দিয়েই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন পথ সংক্ষিপ্ত হয় বিধায়। আজকেও যথাযথ নিয়মে পথ চলছিলেন তাঁরা। হঠাৎ জনমানবহীন রাস্তার পাশে এই দৃশ্য দেখে অনেকটা চমকে যান দুজনেই। দিলদার তো ভয়ে দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।

এত রাতে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পক্ষে কোনোকালেই আগ্রহী নয় দিলদার। মারাত্মক ভীতু সে। শুধুমাত্র আফজাল হোসেনের কারণে এই রাস্তা দিয়ে তাঁকে যেতে হয় রোজ। তাঁর ভাষ্যমতে “রাত বিরাতে রাস্তাঘাট হলো ভূত প্রেতের আড্ডাখানা। এত রাতে এই রাস্তা দিয়ে না গেলেই কি নয়?” আফজাল হোসেন ভীষণ সাহসী মানুষ। তিনি জ্বীন ভূতে বিশ্বাস করলেও বলেন,

“দোয়া দুরুদ পড়ে বের হলে ভূত, জ্বীন কিছুই করতে পারবে না। একটুখানি পথ থাকতে আবার অতখানি হাঁটে কে?”

দিলদার আর তর্কে জড়ায় না। পৃথিবীর সব যুক্তি আফজাল হোসেনের কাছে আছে। অযথা কথা বাড়িয়ে চাকরি খাওয়ার মানে হয় না। কিন্তু আজ এই দৃশ্য দেখে সে ভয়ে কুপোকাত হয়ে গেল। ওর ধারনা ভূত মানুষের সুরত নিয়ে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এখন যদি তাঁরা এখান থেকে যায় আর ভূতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে তাঁদের দুজনের জীবনের এখানেই দফারফা। এই ভূতুড়ে রাস্তায় কে বাঁচাতে আসবে তাঁদের? জীবনে যত দোয়া সে শিখেছে সব পড়ছে কিন্তু কোনোটাই ঠিকমতো মনে করতে পারছে না। ভুলভাল পড়ছে সব।

আফজাল হোসেন প্রথমে চমকালেও একটু সামনে এগিয়ে দেখেন একজন অল্পবয়সী ছেলে শুয়ে আছে। দিলদার আফজাল হোসেনকে সামনে আগাতে বারণ করছেন। কিন্তু তিনি এইসব তোয়াক্কা না করেই সামনে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিলেন। দিলদার একটু দূরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে আর ভুলভাল দোয়া পড়ছে। ওদিকে আফজাল হোসেন ছেলেটার গায়ে আবারও ধাক্কা দিয়ে উপরিউক্ত কথাটি বললেন। ছেলেটা এবার নড়েচড়ে উঠলো। চোখ পিটপিট করে তাকালো আফজাল হোসেনের দিকে। আফজাল হোসেন বললেন,

” এইখানে শুয়ে আছো কেন? তোমার বাড়ি কই?”

ছেলেটা কি বুঝলো কে জানে তড়িঘড়ি করে উঠে কোলের বাচ্চাটাকে দেখলো আর ওর পাশের বাচ্চা মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখলো। আফজাল হোসেন ছেলেটার তাড়াহুড়া দেখলো। বুঝলেন ছেলেটা ভয় পেয়েছে। তারপর বললেন,

” ভয় পেও না। তুমি কে? ওদের নিয়ে এভাবে রাস্তায় ঘুমিয়ে আছো কেন?”

ছেলেটা এবার মুখ খুললো।

” বাড়ি নেই। যাওয়ার জায়গা নেই তাই।”

আফজাল হোসেন ছেলেটার শ্যামলা বদনে রাজ্যের ক্লান্তি ও মলিনতা দেখলেন। যেন কতকাল ধরে অভুক্ত। গলাটা কেমন ফ্যাসফাসে শোনালো। ছেলেটাকে দেখে ভালো পরিবারের মনে হলো। কিন্তু রাস্তায় এভাবে দুটো বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে আবার থাকার জায়গা নেই বললো কেন?

” থাকার জায়গা নেই কেন?” আফজাল হোসেন প্রশ্ন করলেন।

” পৃথিবীতে এতিম অনাথদের জায়গা থাকে না তাই।” ছেলেটার নির্লিপ্ত উত্তর।

আফজাল হোসেন অবাক হলেন। এতটুকু ছেলের এত ভারী কথাবার্তা তাঁর ঠিক হজম হলো না। একটু আগে কি বললো ‘ এতিম ‘। নিজের প্রথম জীবনের টুকরো কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আফজাল হোসেনের বুকটা ধক করে উঠলো। ছেলেটা এতিম। মানতে কষ্ট হচ্ছে। উনি নিজেকে সামলিয়ে বললেন,

” এই বাচ্চা দুটো…”

আফজাল হোসেনের কথা শেষ করতে না দিয়েই ছেলেটা উত্তর দিলো,

” আমার ভাই বোন।”

আফজাল হোসেন বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি মায়া তাঁদের চোখে মুখে! আচ্ছা বাচ্চা দুটো কি জানে তাঁদের মা, বাবা এই পৃথিবীতে নেই। কি বুঝে এতটুকু বাচ্চা? পাঁচ কি ছয় বছরের একজন, আরেকজন কোলের শিশু। ছেলেটারই বা কত বয়স আর। উনি আর ভাবতে পারলেন না। দিলদার এখন আফজাল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে দেখছে। তারও ভীষণ কষ্ট লাগছে। দিলদার এবার বললো,

” তোমার আত্মীয় স্বজন নাই?”

আফজাল হোসেন লক্ষ্য করলেন প্রশ্নটা শুনে ছেলেটার চোখ মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো।কিছুটা ইতস্তত করে মৃদু গলায় বললো,

” নেই।”

আফজাল হোসেনের মনে হলো ছেলেটা কিছু লুকালো। তাই তিনি আর ঘাটলেন না। শুধু বলল,

” তাহলে থাকবে কই? থাকার কোনো জায়গা আছে? এই শহরে কাউকে চিনো?”

” না। আল্লাহর উপর ভরসা করে এসেছি। থাকার জায়গা তিনিই করে দিবেন।”

আফজাল হোসেন বুঝলেন ছেলেটার কেউ নেই এই দুনিয়ায়। এর মাঝেই কোলের বাচ্চাটি নড়েচড়ে উঠলো। ছেলেটা বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য পিঠে হালকা বারি দিতে লাগলো। তাঁর মনে হলো ছেলেটা কোনোভাবেই চাচ্ছে না বাচ্চাটার ঘুম ভাঙ্গুক। কিন্তু বিধিবাম! বাচ্চাটা হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো আর ছেলেটা দিশেহারা হয়ে গেলো। বুকের মাঝে মিশিয়ে বার বার দোলাতে লাগলো। আর বাচ্চাদের ভুলাতে মানুষ সচরাচর যা বলে তাই বলতে লাগলো। তবে সে যে এইসব কাজে আনাড়ি তা বোঝাই যাচ্ছে। আচ্ছা বাচ্চা দুটো কি খেয়েছে? আফজাল হোসেনের মনে হলো খাইনি। তিনি বললেন,

” সারাদিন কিছু খেয়েছ?”

ছেলেটা বাচ্চাটাকে সামলাতে সামলাতে বললো,

” না। দুপুরে থেকে না খাওয়া। শুধু ওকে ফিডার খাইয়েছি কিন্তু অনেকক্ষণ হলো ফিডার শেষ। তাই ওকে আর রুদকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি যাতে ক্ষুধা অনুভব না করে। ক্ষুধা লাগলেই তো কাঁদবে আর খেতে চাইবে তখন ওদের কিভাবে সামলাবো? দুপুর থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছি কিন্তু কতক্ষণ পারবো জানি না।”

এর মধ্যেই বাচ্চার কান্নার শব্দে ছোট্ট মেয়েটিও উঠে পড়লো আর ভাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা মেয়েটার দিকে অসহায় বদনে তাকিয়ে রইলো। যেন বলতে চাইলো, ” কেন উঠলি বোন? খাওয়াবো কি তোদের? কাকে রেখে কাকে সমলাবো? আরেকটু ঘুমোতিস।” আফজাল হোসেন চেয়ে চেয়ে দেখলেন এক ভাইয়ের অসহায় চাহুনি আর ছোট বাচ্চাগুলোর অভুক্ত থাকার করুণ এক আকুতি! চোখটা ভিজে উঠলো কি?
________
———-
ছোট একখানা চৌকি, একটা আধ ভাঙা টেবিল, পুরোনো কাঠের আলমারি, একটা আলনা, রং চটা একটা ট্রাঙ্ক, কোনার দিকে হাঁড়ি পাতিল, গ্লাস আর কিছু প্লেট রাখা। রায়হান কোলে বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে আছে চৌকির উপর। বাচ্চাটার মুখে ফিটার গোঁজা। বাচ্চাটা চুকচুক করে ফিটার খাচ্ছে আর ভাইয়ের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। পাশে বাচ্চা মেয়েটা বসে আছে হাতে বিস্কুট। ক্ষণে ক্ষণে পা দোলাচ্ছে। বিস্কুট নিজে খাচ্ছে আবার ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

” রুদ তুমি খাও। আমাকে দিতে হবে না।” রায়হান বললো।

” নো নো। বিক্কিট মুজা। ভাইয়ু খাউ।” রুদ মাথা দুলিয়ে মজা বুঝালো।

রায়হান বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি মায়া মায়া মুখ। যদি বাবা, মার কাছে যাওয়ার বায়না ধরে তাহলে রায়হান কি বলবে। সেদিন মা, বাবার খাটিয়ার সামনে বসে পুতুল খেলছিল অবুঝ রুদটা। রায়হানের চোখে পানি দেখে বলেছিল, ” কান্দু কেনু?” মা, বাবা যে মারা গেছে সেটাই বুঝতে পারেনি বাচ্চাটা। জাইফ তো এক বছরের শিশু। ও তো বাবা, মার আদর ভালোবাসা বুঝার আগেই এতিম হয়ে গেলো। ভঙ্গুর হৃদয়ে কবর দিয়ে বাসায় এসে দেখলো রুদ পরে আছে ফ্লোরে। চিৎকার দিয়ে কাদঁছে আর মা বাবার কাছে যাওয়ার বায়না করছে। সামনে দাড়িয়ে এক বর্বর নারীমূর্তি! কি অসামান্য ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে ছিল। সে চলে আসায় রুদকে উঠিয়ে আদর করছিল। এসব ভাবতে ভাবতে রায়হানের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো। সে ছাড়া বাচ্চা দুটোর পৃথিবীতে কেউ নেই। তারও নেই। এরাই তাঁর সম্বল। বাচ্চা দুটোর বাবাও সে মাও সে।

” এইখানে কোনো সমস্যা হইতাছে না তো?” একজন মধ্যবয়সী নারী ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বললো। হাতে তাঁর ভাতের গামলা আর তরকারি। রায়হান ওনাকে চিনে। আফজাল হোসেনের স্ত্রী। আফজাল হোসেন এখানে এনেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।

” জি না।” রায়হানের উত্তর।

” তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়া লও। বাচ্চাডারে আমার কাছে দাও।” রায়হানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো নারীটি।

রায়হান ভাইকে কে তাঁর কোলে দিলো। জয়নব বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করলো। প্রশ্ন করলো, ” তোমার নাম তো হুনছি ওগো নাম কি?”

” রুদাইফা জিনাত আর রাহমিদ জাইফ” রায়হানের ছোট উত্তর।

” মাশাআল্লাহ্ সুন্দর নাম।” প্লেট এগিয়ে দিয়ে জয়নব বলে উঠলো। তারপর প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে দিলো। ইতস্তত করে রায়হান রুদকে ছোট ছোট লোকমা তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। রুদাইফা বেশি খেতে পারলো না। একটু আগে বিস্কুট খেয়েছে দেখে রায়হান আর জোর করলো না।

” তুমি আমারে দেইখা অস্বস্তিবোধ কইরো না। আমি তোমার চাচীর লাহান। জয়নব চাচী ডাইকো।” কথাটা শুনে রায়হান ভাতের লোকমা মুখে দিতে গিয়েও দিলো না। জয়নব খেয়াল করলো ছেলেটার চোখমুখ শক্ত হয়ে গিয়েছে। ভুল কিছু বললো কি? বুঝতে পারলেন না তিনি।

চলবে….

ছায়াতরু পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#ছায়াতরু
#পর্ব_০৮ (শেষ পর্ব)

‘ আবার এলো যে সন্ধ্যা,
শুধু দুজনে..
চলোনা ঘুরে আসি, অজানাতে,
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে। ’

গিটার আর ভায়োলিনের সুরের তালে তালে, সন্ধ্যা আকাশের নিচে ছাদের ওপর বসে গলা ছেড়ে গান গাইছে স্মরণদের বন্ধুমহল। গিটার চলনসই হলেও ভায়োলিনটা নকিবের অতিরঞ্জিত উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত মাত্র। সে পারে না তো পিয়ানো সহ নিয়ে আসে।

এদিকে একেকজন গলা ছেড়ে গান গাইছে। হোক কণ্ঠ সুন্দর বা ফাঁটা বাশ। তবুও এতজনের বাহারি সুরের আলিঙ্গনে গানটির আবহ–ই অন্যরকম।

সুর যতই সুমধুর হোক না কেন সেটা বাহারাজের বাঁদুরে কানে কোনো হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজের মতোই লাগছে। যেন সন্ধ্যাবেলার গৃহপালিত কতকগুলো হাস একত্রিত হয়ে নিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য এমন শব্দ তৈরি করছে।

“ এরা গান গাইছে ভালো কথা, কিন্তু এত জোরে কেন? আজই প্রথম এই বাসায় উঠলো। আর আজই এমন?’’

অভ্রর কথা শুনে শায়ন ফোনে গেইম খেলতে খেলতে একটা হাসি দিয়ে বললো,“ যেই ভয়েজটা শুনে মনে হবে কোনো কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে ওটাই আমার ছোট ভাই’’

অভ্র ফিক করে হেসে উঠলো,“ নয়ন যদি জানতে পারে, তোর হাল ঠিক রাখবে না। তুই নয়নকে ভয় পাস এটা আমরাও জানি।’’

শায়ন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,“ কি বলতে চাস তুই?’’

বাহারাজ উঠে দাঁড়ালো। কাভার্ড থেকে একটা শার্ট বের করে গায়ের শার্ট-টা খুলে বের করা শার্টটা পড়লো।রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,“ কোথায় যাবি?’’

“ বাহিরে। দরকার আছে। ’’

রিয়াদও উঠে দাঁড়ালো,“ আমিও যাবো চল। তার আগে দাঁড়া উপরে গিয়ে একটু দেখে আসি।’’

বাহারাজ রিয়াদের দিকে তাকালো। রিয়াদ বোকা বোকা হেসে মত পালটে বললো,“ মজা করছিলাম। তোরা মজাও বুঝিস না।’’

স্মরণ পানি আনার জন্য ছাদ থেকে রুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আর মাত্র ছয় ধাপ সিড়ি বাকি। এমন সময় পা পিচলে গেলো। স্মরণের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আর একটা চিৎকার দিয়ে চোখ বুজে নিলো। মস্তিষ্ক জানানো দিলো ‘ বিদায় স্মরণ ’। তবে শয়তান কি এত তাড়াতাড়ি মরে? বাহারাজও বাইরে যাওয়ার জন্য তখনই বের হলো রুম থেকে। স্মরণকে এভাবে দেখে দাতে দাত চেপে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে ধরলো। এদিকে নিজের ভার কারও ওপর পড়েছে বুঝতে পেরে চোখ খুলে তাকালো স্মরণ।

বাহারাজ এক হাত দিয়ে স্মরণের কোমরে নিজের শক্তপোক্ত হাত দিয়ে ধরলো। আর অন্য এক হাত দিয়ে স্মরণের হাত ধরলো। দুজনের মুখ খুব কাছাকাছি। একজনের নিশ্বাস একজনের ওপর আছড়ে পড়ছে। বাহারাজ স্মরণের দিকে নিবিড় দৃষ্টে তাকালেও চোখে মুখে বিরক্ত ভাবটা বজায় রাখলো। এদিকে স্মরণ বাহারাজকে এতো কাছে দেখে অস্বস্তিবোধ করলো। লজ্জায় গাঁট হয়ে এলো দেহ। মুখ ফুঁটে অস্ফুট স্বরে আওয়াজ বের হলো। চোখ নামিয়ে নিতে গিয়েও নিলো না বাহারাজের হালকা লালচে চোখের দিকে নজর পড়তেই। চোখের মণির লালচে আভায় লেপ্টে থাকা ক্ষুদ্র বিরক্তি আর মুগ্ধতা স্মরণের জন্যই মনে হলো স্মরণের। অনুভুতিরা দাবানলের মতো সমস্ত জায়গায় শিহরণ বইয়ে দিলো। এদিকে বাহারাজের চোখ গিয়ে পড়লো আবার স্মরণের হালকা লাল রঙা ঠোঁটের ওপর। পুরুষ মন পুলকিত হলো। তবে মস্তিষ্ক ভর্ৎসনা করে উঠলো। দমিয়ে দিলো বাহারাজকে। মুহুর্তক্ষণ একদম ভিন্ন। পরিবেশ শান্ত। শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ জড়ালো। তৎক্ষনাৎ আবার স্মরণ নিজেকে বাহারাজের বাহুডোর হতে বেরোনোর হালকা অপচেষ্টা চালালো। বাহারাজ ছাড়বে এমন সময় কেউ বললো,“ এবার তো অন্তত ছেড়ে দে।’’

রিয়াদের কথা শুনে বাহারাজ হুট করেই ছেড়ে দিলো স্মরণকে। ছেড়ে দিতেই স্মরণ ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলো। আর্তনাদ করে উঠলো স্মরণ। রিয়াদ দ্রুত এলো স্মরণকে ধরতে। বাহারাজ তাকিয়ে দেখলো। রিয়াদ স্মরণের হাত ধরতে যাবে এমন সময় স্মরণ থামিয়ে দিলো আর বললো,“ দরকার নেই।’’

থেমে গেলো রিয়াদ। স্মরণ ফ্লোরে এক হাত ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাহারাজের রুমের দরজার দিকে চোখ গেলো। অভ্র, শায়ন মুখ টিপে হাসছে। আর বাহারাজ! সে কেমন নিশ্চল চোখে স্মরণেরই দিকে তাকিয়ে আছে। স্মরণ তাকাতেই দৃষ্টি সড়িয়ে নিলো। স্মরণ ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমের দরজার সামনে গিয়ে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। নোমান সাহেব থাকলে আর্তনাদ করে উঠতেন।

বাহারাজ পাগল বলে নিচে নেমে গেলো। রিয়াদ বাহারাজের যাওয়া দেখলো। তার মন খচখচ করে উঠলো। তবে সেসবে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজেও নেমে গেলো। অভ্র শায়ন দরজায় তালা লাগিয়ে নিজেরাও গেলো পিছু পিছু।

স্মরণ দরজা খুলে আবারও বের হলো। তার মাথা গরম হয়ে আছে এখন। সাহায্য করবি তো আবার আঘাতের কি দরকার ছিলো। আবারও ছাদে উঠে গেলো সে। তুষার জিজ্ঞাসা করলো,“ এতো দেরি হলো যে?’’

“ তোর পানি খেতে মন চায়, তুই গিয়ে নিয়ে আসবি। আমি আর পারবোনা। ’’

স্মরণের এমন রাগ বুঝলো না কেউ। নয়ন জানতে চাইলো,“ মাথা গরম যে?’’

স্মরণ মুখ ফুলিয়ে বললো,“ তোর ভাইয়ের ওই বন্ধুর মতো খারাপ লোক আর পৃথিবীতেই নেই।’’

নয়ন একবার নকিবের দিকে তারপর তুষারের দিকে তাকালো। আবারও স্মরণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,“ কেন আবার কি হয়েছে?’’

“ আচ্ছা আগে এটা বল, আমি চিৎকার করেছি তোরা শুনতে পাস নি?’’

নকিব বললো,“ আমি ভায়োলিন বাজাচ্ছিলাম। শুনবো কিভাবে? সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার বাজানো সুর শুনছিলো।’’

স্মরণ মুখ ঘুরিয়ে বললো,“ তাহলে বাদ দে।’’

নয়ন হেসে বললো,“ আমি ভাবছি তুই এই বাসায় থাকবি কিভাবে? বাহারাজ ভাইয়ের সাথে তোর সাপে নেউলে সম্পর্ক।’’

স্মরণ চোখ মেরে বললো,“ তুই-ই এনেছিস। ঝামেলা হলে আগে তোর ভয়ানক ব্যবস্থা করবো।’’

এবার জিনিয়া বলে উঠলো,“ আরেহ আমাদের স্মরণ কি ঝগড়ুটে নাকি? যে ঝগড়া হবে?’’

নকিব তাচ্ছিল্য করে বললো,“ ওর ঝগড়ার তেজ এতোই যে স্যাটেলাইট পর্যন্ত পৌঁছে স্যাটেলাইটও খারাপ হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।’’

“ তোকে আগে ড্যামেজ করবো। তারপর স্যাটেলাইটের কথা ভাববো।’’ স্মরণ জুস খেতে খেতে কথাটা বললো।

সিমানী বললো,“ নকিব এমনিতেই ড্যামেজ পোলা।’’

নকিব সিমানীর মাথায় গাট্টা মেরে বললো,“ তুই কথা কম বলবি।’’

“ আমি বেশি বলবো।’’

তাদের শুরু হলো। এদিকে ছাদের কার্ণিশ ঘেষে বসায় স্মরণের চোখ গেলো নিচে। বাহারাজরা দাঁড়িয়ে আছে। নোমান সাহেবের সাথে কোনো বিষয়ে হয়তো আলোচনা করছে। হঠাৎ বাহারাজও ছাদের দিকে তাকালো। স্মরণ আর বাহারাজের চোখাচোখি হলো।

~ প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি

→ গল্প শেষ করে দিলাম কারণ আমার সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার জন্য গল্পে মন বসাতে পারছি না। তারওপর ভর্তি এডমিশনের পরীক্ষা। এই জার্নিতে আপাতত কিছুদিন অফলাইন থাকবো। গল্পটা এমনিতেও যেভাবে লিখতে চাইছি সেভাবে ঠিক হচ্ছে না। পরীক্ষা শেষ হলে ফিরবো আবারও স্মরণ বাহারাজকে নিয়ে। মাঝের না থাকার সময়টা হয়তো একটু বেশি হবে। কারণ জানুয়ারির পর থেকেই তো সব পাব্লিকে পরীক্ষা শুরু হবে। তাই অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হবে না সবার সাথে। তবে খুব দ্রুত ফেরার চেষ্টা করবো। আর বাহারি স্বপ্ন আজ কিংবা কাল শেষ পর্ব দেবো। ফিরে এসে দুটো নিয়েই পুরো উদ্যমে লেখা শুরু করবো।এমনিতে যদি লেখতে থাকি মাঝে দশ বারোদিন গ্যাপ রেখে রেখে তাহলে কাহিনী এলোমেলো হয়ে যাবে।ভালো থাকবেন সবাই।আর একটা কথা— স্মরণ বাহারাজের কেমিস্ট্রি জমজমাট হবে💚🫶

– জুনানী চাকমা

ছায়াতরু পর্ব-০৭

0

#ছায়াতরু
#পর্ব_০৭

“ কোথায় গরু? কিভাবে আসছে? আর কিভাবে হিসু করেছে আমাকেও দেখান আঙ্কেল।’’ কথাগুলো নকিব একপ্রকার উৎসুক হয়ে বলতে বলতে উপরে উঠছে। পেছনে তুষার, নয়ন, সিমানী আর জিনিয়াকেও দেখা গেলো।

নকিব নোমান সাহেবের পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাপাতে লাগলো। আর পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো,“ আঙ্কেল কোথায় গরু?’’

শীতলও সে মুহুর্তে বের হলো। নোমান সাহেবের পেছনে নয়নকে দেখে মনে মনে খুশি হলো ভীষণ। এদিকে বাহারাজ এদের এমন সব কথাবার্তায় খুব রেগে গেলো। এমনিতেই কোমরে চিনচিনে ব্যথা অনুভুত হচ্ছে। তার ওপর এখানে এতো গুলো গাধার দল। বাহারাজ আবারও নিজের রুমে ঢুকে দরজা ধরাম করে লাগিয়ে দিলো। সবাই কেঁপে উঠলো। নোমান সাহেব চিন্তিত গলায় শুধালেন,“ আমার দরজা!’’

নয়ন এগিয়ে এসে বললো,“ কি হয়েছিলো আঙ্কেল। বাহারাজ ভাই এতো রেগে গেলো কেন?’’

“ পড়ে গেছিলো এখানে। তাই এতো রাগ।’’ স্মরণের কথা শুনে সবাই তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। নয়ন বলে উঠলো,‘‘ কিইইই?’’

“ হ্যা।’’ স্মরণ আবারও নিজের কাজে মন দিলো। নয়ন এসে জিজ্ঞাসা করলো,“ তোকে কিছু বলে নি?’’

“ আমাকে আর কি বলবে? আমি কিছু করেছি নাকি? উনি কানা মানুষ। দেখে হাঁটতে পারেন না?’’

নয়ন স্মরণের মাথায় বারি মেরে বললো,“ চুপ থাক। এসব কি বলছিস? বাহারাজ ভাই শুনলে না তোর খবর করে দেবে?’’

“ কেন উনি কি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বংশধর নাকি স্পেনের রাজকন্যার বয়ফ্রেন্ড? যে আমার খবর করে দেবে।’’

“ দুটোর একটা না হলেও বাহারাজ ভাইয়ের দাদা ছিলেন সাবেক এমপি।’’

স্মরণ বিরক্তি নিয়ে বললো,“ তো?’’

“ আচ্ছা বাদ দে।’’

সবাই একে একে ভেতরে ঢুকলো। নোমান সাহেবও উঁকি দিলেন। শীতলকে বাসায় যেতে বলে তিনিও চলে গেলেন। এদিকে বাবা চলে যেতেই শীতল নয়নের কাছে এগিয়ে গেলো। নয়ন হেসে বললো,“কেমন আছো? গতকাল এতো মেসেজ দিলাম রিপ্লাই দিলে না যে?’’

শীতল মিষ্টি হেসে সুন্দরভাবে জবাব দিলো,“ ব্যস্ত ছিলাম নয়ন। সরি।’’

নকিব আর তুষার বুকে হাত গুঁজে তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো দুজন। দৃষ্টি তাদের নয়ন আর শীতলের দিকে। নকিব হা হুতাশ করে বলে উঠলো,“ অন্যের ভালোবাসা দেখতেও সুন্দর।’’

“ ঠিক বলেছিস।’’ পাশ থেকে তুষার বললো।

স্মরণ একটা ময়লা কাপড় তাদের দিকে ছুড়ে মেরে বললো,“ অন্যের ভালোবাসা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার জন্য ডাকিনি তোদের।’’

_________________________

সময়টা ভর দুপুর। শীতকাল হয়েও রোদের তেজ কমে নি। শীতকালের সকালের দিকের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই রোদের তেজ থাকে মিষ্টি। গায়ে পড়লেও আরামদায়ক অনুভুত হয়। তবে দুপুরের পরের সময়ের রোদের ঔদ্ধত্য বেড়ে যায় যেন। জানালার পর্দা কাপড় ভেদ করে পশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাওয়া রোদের কিছু আলো এসে পড়ছে ফ্লোরে। যা প্রতিফলিত হয়ে পুরো রুমের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। স্মরণ, জিনিয়া, সিমানী মিলে তিনজন রান্না করলো দুপুরের খাবার। শীতল বাসা থেকে খাবার এনে দিতে চেয়েছিলো তবে এরা কেউ রাজি হয় নি। বরং স্মরণের ফ্ল্যাটে একটা ছোটখাটো পার্টি করতে চেয়েছে। তাই তো এই ভরদুপুরে খেয়েদেয়ে এখন রেস্টে আছে সবাই। সেসময় স্মরণ এসে নয়নদের বললো,“ যা বাজার করে এনে দে। আমি লিস্ট করে দিয়েছি।’’

বলে একটা লিস্ট আর টাকা ধরিয়ে দিলো তাদের হাতে। নকিব হতবম্ভ হয়ে বললো,“ এই ভরদুপুরে কোন বেকুব বাজার করে? সিরিয়াসলি ভাই?’’

স্মরণ শুনলো না তাদের কথা। চলে যেতে যেতে বললো,“ তাড়াতাড়ি যা ভাই।’’

নয়ন উঠে দাঁড়ালো। আর বললো,“ চল।’’

অগত্যা বাধ্য হয়ে তারা বের হয়ে গেলো। সেসময় আবার রিয়াদ,অভ্র আর শায়ন উপরে আসছিলো। শায়ন নিজের ভাইকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে এলো আর জিজ্ঞাসা করলো,“ তুই আবারও এখানে কি করছিস?’’

“ ওইযে বলেছিলাম বান্ধবীটা ভাড়া নিয়েছে ওই রুম। তাই সাহায্য করতে এসেছিলাম।’’

অভ্র রসিকতা করে বললো,“ বড় ভাই সাহায্যের কথা বললে তো না করে দিস। কিন্তু বান্ধবী সাহায্যের কথা বললে একদম হুড়মুড়িয়ে চলে আসিস দেখছি।’’

নয়ন মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে বললো,“ তেমন কিছুই নয় অভ্র ভাই। আচ্ছা তোমরা যাও আমরা একটা কাজে যাচ্ছি।’’

শায়ন থামালো নয়নকে। এক সাইডে নিয়ে গেলো। বাকিরা চলে গেলো যে যার উদ্দেশ্যে। শায়ন নয়নকে বললো,“ কেউ যাতে কিছুই না জানে। বাহারাজ কিন্তু রেগে যাবে। মনে রাখিস বাহারাজের বিষয়ে কেউ যাতে কিছু না জানে।’’

নয়ন মাথা নাড়ালো। আর চলে গেলো। শায়নও বাহারাজের রুমে ঢুকলো। দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ভেতরে বাহারাজের রুমে এসে খাটের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়লো। বাহারাজ তখন কার সাথে যেন কথা বলছিলো। তার মুখায়ব ভীষণ সিরিয়াস। বাহারাজ কথা বলা শেষে সোফায় বসে পড়লো। শায়ন এবার জিজ্ঞাসা করে উঠলো,“ পাশের বাসায় নতুন মেয়ে এসেছে। তোর ফিলিংস কেমন আমাদের কাছে ব্যাখ্যা কর এখন।’’

টিভিতে সেসময় খবর প্রচারিত হচ্ছে ‘ উমুক এলাকায় আরও দুটো নারীর মরদেহ উদ্ধার।’
বাহারাজ শায়নের কথা কানেই নিলো না। বরং কথা ঘুরিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বললো,“ আজকের মরদেহগুলো কি দেখেছিস?’’

শায়ন এবার সিরিয়াস হলো,“ এখানে আসার আগেই দেখে এসেছি।’’

“ সবে কয়েকমাস পার হলো। আর এখনই এমন কিছু আসলে ভাবতে পারি নি আমিও। উকিল মশাইকে মনে পড়ছে খুব।’’

বাহারাজের কথা শুনে মিনিট কয়েক সবাই নিরবতা পালন করলো। সবার মুখে কেমন কষ্টের ছাপ দেখা গেলো। বাহারাজই নিরবতা ভেঙ্গে অভ্রকে বলে উঠলো,“ পরশু বিথীর বিয়ে। আশা করি বুঝতে পারছিস অভ্র, তোর কাজটা ঠিক কি?’’

অভ্র সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললো,“ হু।’’

বাহারাজ রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,“ খোঁজ পেয়েছিস ড্রাইভারের?’’

“ ফরিদপুরে নাকি আছে এখন, সপরিবারে।’’

বাহারাজ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,“ ওই লোককে কাছে পেলে আমি জ্যান্ত পুতে দেবো।’’

রিয়াদ খাটের ওপর শুয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে বললো,“ পাশের রুমের স্মরণ মেয়েটা বেশ রূপবতী।’’

তার কথা শুনে অভ্র আর শায়ন চোখ বড় বড় করে তাকালো রিয়াদের দিকে। রিয়াদ এই কথা বলছে তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। যেই রিয়াদ নিজের প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদের পর আর কোনো মেয়ের দিকেই ফিরে তাকায়নি সেই রিয়াদ কিনা কোনো মেয়ের প্রশংসা করছে? শায়ন উঠে বসে চমকিত আওয়াজে বললো,“ রিয়াদ তুই ঠিক আছিস?’’

রিয়াদ বিরক্ত হলো,“ আমাকে কি তোর অসুস্থ মনে হচ্ছে?’’

অভ্র ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে বললো,“ অসুস্থ মনে না হলেও খুবই অবাক লাগছে।’’

রিয়াদ কথা বাড়ালো না। এদিকে বাহারাজ চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“ মেয়েটা রূপে রূপবতী হলে কি হবে? জ্ঞানে তো গাঁধাবতী।’’

রিয়াদ উঠে বসলো। একে একে সবাই এখন বাহারাজের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বাহারাজের মুখের কথা শুনে সবাই একে অপরের দিকে একবার তাকালো। কেউ কিছু বলার আগেই বাহারাজ বলে উঠলো,“ সৎ মা আর বোনের পিছু ছাড়াতে এই ভয়ানক জায়গায় এসে বাসা ভাড়া নিয়েছে। মেয়েটা কি আদও জানে তার কি পরিমাণ বিপদ হবে?’’

অভ্র’র যেন কিছু একটা মনে পড়লো। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,“ বাহারাজ এটাই সেই মেয়েটা না যার সাথে তোর ধাক্কা লেগেছিলো সেদিন? যেদিন আমরা হোটেলে যাচ্ছিলাম?’’

“ হ্যা আর এই স্মরণই সেই মেয়ে যার সাথে দ্বিতীয়বার ধাক্কা লাগাতে সে আমাকে কানা বলেছে। আর আজ? আজ তো আমায় একদম ফেলেই দিলো। অন্তত বাকি হিসেবগুলো মওকুফ করা হলেও শেষবারের জন্য ক্ষমা নয়।’’

#চলবে
–জুনানী চাকমা

ছায়াতরু পর্ব-০৬

0

#ছায়াতরু
#পর্ব_০৬

স্মরণ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিজের বাসায় যেতেও কেমন অন্যরকম অনুভুতি অনুভুত হচ্ছে। পাশের টং এর দোকান থেকে সেলিম চাচা হাক ছাড়লো,“ কি রে স্মরণ? ওমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’’

স্মরণ ক্লেশিত কণ্ঠে বলল,“ জীবন বড় দুঃখময় গো চাচা।’’

“ তা আর বলতে?’’

স্মরণ সমস্ত কনফিডেন্স নিজের মধ্যে এনে পা বাড়ালো। রুমের সামনে আসতেই অনেক জুতোজোড়া দেখতে পেলো। স্মরণ বুঝলো না কিছু। দরজাটাও খোলা ছিলো। আস্তে ধীরে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো ভেতরে থাকা মানুষজনদের দেখে। এরা তো হিমেলের পরিবার।

সবাই মুখ গম্ভীর করে বসে আলাপ করছিলো কোনো বিষয়ে। স্মরণকে তেমন কেউ খেয়াল না করলেও সবার মধ্যিখানে বসা হিমেল আর রাহা ঠিকই খেয়াল করলো। হিমেল মুখ কালো করে স্মরণের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর রাহা এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেন চোখ দিয়েই স্মরণের মুখ ঝলসে দেবে। স্মরণ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে গেলো।

এদিকে বসার ঘরে অনিল সাহেব হিমেলের বাবা মইন সাহেবকে বলছেন,“ আগামীকালই তাহলে ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে যাক।’’

মইন সাহেবের স্ত্রী হাসিনা বেগম মুখ কালো করে বললেন,“ তা না হলে আর কি করার আছে? পছন্দ করলাম একজনকে আর ছেলের বউ করতে হবে অন্যজনকে। আমার ছেলে যে এতো বড় একটা চরিত্রহীন হয়েছে আগে জানলে মেরে ফেলতাম।’’

হিমেল চোখ ছোটছোট করে মায়ের দিকে তাকালো। এদিকে রাহা সেখানে আর বসে রইলো না। উঠে চলে গেলো নিজের রুমে। তার কখনোই এই খাটাশ হিমেলকে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। আর ভাগ্য তাকে সেদিকেই নিয়ে গেছে। রাহা খুব জোরে দরজাটা বন্ধ করলো। স্মরণও পর্যন্ত কেঁপে উঠলো এমন শব্দে। স্মরণ নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললো,“ ফেল ফেল ভেঙ্গে ফেল সব। দরজা জানালা যা আছে সব ভেঙ্গে ফেল। আমার কিছুই হবে না।’’

স্মরণ ঠিক করেছে আজ রাতটা এখানে কোনোভাবে পার করবে তারপর ওই বাসায় উঠবে। এডভান্স ৫০০টাকাও দিয়ে এসেছে নোমান সাহেবকে। স্মরণ ভাবলো তার ইনকাম আরও বাড়ানো উচিত। নয়তো এই শহরে একা টিকতে খুবই কষ্টকর হয়ে পড়বে। জমানো যে টাকাগুলো আছে সেগুলো দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনবে আজ বিকেলে টিউশনি থেকে আসার সময়।

স্মরণ ব্যাগ গুছিয়ে এক কোণায় রাখলো। দুটো ব্যাগ হয়েছে। এগুল কালকে নিয়ে যেতে হবে ভেবেই ক্লান্ত লাগলো। তার রুমে এটাচ বাথরুম একটা আছে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে বের হতেই রাহার মুখোমুখি হলো। রাহা কটমট চোখে চাইলো। স্মরণ রাহার দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে চাইলে রাহা আটকালো।

“ দাঁড়া স্মরণ।’’

স্মরণ তবুও যেতে নিলে হাত ধরে ফেললো রাহা,“দাঁড়াতে বলেছিলাম!’’

স্মরণ এবার ঘুরে তাকালো,“ অবশ্যই তোর কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।’’

“ তুই কি ভাবছিস আমি হেরে গেছি?’’

স্মরণ রাহার নামটাও নিজের ভাবনাতে আনে না আর এই মেয়ে বলে কি? স্মরণ হেসে জবাবে বলল,‘‘ছোট থেকে সবসময় তুই আমার থেকে একধাপ পিছিয়ে ছিলি, এখনও রয়েছিস। তাই হেরে যাওয়া তো দূর আমার ধারে কাছেও আসতে পারবি না।’’

মুচকি একটা হাসি দিয়ে হাত সড়িয়ে নিলো স্মরণ। তারপর আবারও বসার ঘরে সবার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো বাইরে। এবার সবাই স্মরণকে দেখতে পেলো। স্মরণকে দেখে হাসিনা বেগম হা হুতাশ করা শুরু করলেন,“ আমার ছেলে হিরে ফেলে কাঁচের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। এই যন্ত্রণা রাখি কোথায়?’’

_________________________

বিকেলে স্মরণ বাজারে গেলো। জিনিসপত্র কেনার জন্য। আজকাল বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম স্মরণ ভীষণ চিন্তিত। ফোন করে জিনিয়াকেও আসতে বলেছে বাজারে। জিনিয়া স্মরণের জন্য অপেক্ষা করছিলো। স্মরণ যখন আসলো তখন দুজনে বাজারে ঢুকে পড়লো। স্মরণ হাড়িপাতিল কিনবে আজ। তার কেমন যেন লজ্জা লাগলেও কিছু করার নেই।

“ আজ অনেক বেশি ঠান্ডা রে বইন।’’ শীতে কাঁপতে কাঁপতে কথাটা বললো জিনিয়া। পুনরায় একইভাবেই বললো,“ এই শীতে তুই ফ্লোরে কাপড় বিছিয়ে থাকতে পারবি না একটা খাট কিনে ফেল।’’

“ আমাকে কি তোর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বংশধর মনে হয় রে? যে মন চাইলেই একটা খাট কিনে ফেলবো!’’

ফিক করে হেসে ফেললো জিনিয়া। স্মরণ তখন জিনিসপত্র দেখছে। আর দোকানদারকে দাম জিজ্ঞাসা করছে। স্বভাবতই দোকানদার দাম বেশি চাইছে। আর স্মরণ দিতে রাজি নয়। জিনিয়া জানতো এমনই কিছু হবে। স্মরণকে টেনে অন্যটাই নিয়ে গেলো।

প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দুজনেই নতুন বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। নোমান সাহেবদের দরজায় কড়া নাড়তেই স্মরণদের সমবয়সী একটি মেয়ে দরজা খুলে দিলো। স্মরণরা বুঝলো এই হলো শীতল।

শীতল হেসে বললো,“ স্মরণ আর জিনিয়া?’’

জিনিয়া চমকালেও স্মরণ কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ না করলেও হেসে বললো,“ উপরের রুমের চাবিটা দিতে পারবে?’’

শীতল বললো,“ দাঁড়াও এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’’

শীতল একদৌড়ে ঘরে গিয়ে চাবিটা এনে দিলো। স্মরণকে দিয়ে বললো,“ তুমি কালই আসবে তাই না?’’

“ হ্যা আগামীকালই আসবো।’’

“ চমৎকার। দুজনে মিলে আড্ডা দিতে পারবো।’’

স্মরণ হাসলো। তিনজনে মিলে তিনতলায় উঠতে যাবে সেসময় শায়ন,অভ্র আর রিয়াদ নিচে থেকে উঠে আসলো। তারাও তিনতলার পথযাত্রী। শীতল তাদের দেখে হেসে বললো,“ আজ আপনারা আমাদের বাসায় ডিনার করবেন ভাইয়া। স্মরণ তোমরা চাইলে নৈশভোজ করে যেতে পারো।’’

স্মরণ বললো,“ আজ ব্যস্ত আছি, অন্য একদিন।’’

রিয়াদ স্মরণকে দেখে মুচকি হাসলো। অভ্র আবারও ভাবছে এই মেয়েকে সে কোথায় দেখেছে? শায়ন উপরে উঠে চলে গেছে। বাকিরাও শীতলের কথায় মাথা নাড়িয়ে উপরে চলে গেলো। তারা যেতেই স্মরণরাও উপরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো।
স্মরণ সেসময় জিজ্ঞাসা করলো,“ এরা কি এখানেই থাকে?’’

“ না তবে দিনে দু একবার আসে এই বাসায়। বাহারাজ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে।’’

“ কেন বাহারাজ কি মহিলা নাকি? দিনে দু একবার দেখা করতেই হবে?’’

তার কথায় শীতল জিনিয়া হেসে দিলো। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো। রুমটা ভীষণ অপরিষ্কার। স্মরণ বুঝলো আগামীকাল খুব পরিশ্রম বয়ে যাবে ওপর। জিনিসপত্রগুলো রান্নাঘরে রেখে এলো স্মরণ। এরপর বেরিয়ে গেলো। শীতল বললো,“ কালকেই যেহেতু আসছো তবে চাবিটা নিয়ে যাও।’’

‘‘ ঠিক আছে।’’ বলে স্মরণ চাবিটা নিজের পকেটে রাখলো। সেসময় চোখ গেলো তারই সামনে বরাবর ফ্ল্যাট–টাই। এখানেই তাহলে থাকে বাহারাজ মশাই!
হঠাৎ রিয়াদ বেরিয়ে এলো। স্মরণরা নিচে নামছিলো তখন। শীতলকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে নিলে রিয়াদ নিচে নামতে নামতে বললো,“ রাত হয়ে গেছে। তোমরা কি যেতে পারবে?’’

তার কথা বলার ধরণ এমন যেন সে স্মরণদের বহুদিনের পরিচিত মানুষ। স্মরণ সৌজন্য হেসে বললো,“ ধন্যবাদ তবে তার দরকার নেই।’’

রিয়াদ বিড়বিড় করে বললো,“ তোমার দরকার না থাকলেও আমার আছে মেয়ে।’’ তবে মুখে বললো,“ ভেবে বলছো তো?’’

স্মরণ এর এতো আদিখ্যেতা সহ্য করতে পারছে না। বললো,“ ভেবেই বলছি। আপনি নিজ গন্তব্যে যেতে পারেন।’’

রিয়াদ ‘বাই’ বলে চলে গেলো সামনে। এদিকে রিয়াদ চলে যেতেই জিনিয়া বললো,“ দোস্ত ছেলেটা অনেক হ্যান্ডসাম নারে?’’

“ হ্যান্ডসাম না ছাই।’’

“ তুই যাই–ই বল একে আমার ভালো লেগেছে।’’

দুজনে হাঁটা আরম্ভ করলো। একটা সিএনজিতে উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তবে তাদের সিএনজিটার পেছনেই রিয়াদের গাড়িটা ছিলো। কেউ খেয়াল করে নি। মেয়ে মানুষ একটা চিন্তা তো আছেই। তবে রিয়াদ তাদের আজকেই চিনলো জানলো। বিশেষ করে স্মরণের বিষয়ে এমন চিন্তা ভারী বেমানান মনে হলেও মন ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো।

_________________________

সকালের ধুম ধাম আওয়াজে বাহারাজের ঘুম ভাঙলো। এটা কিসের আওয়াজ তৎক্ষনাৎ ঠাওর করতে পারলো না। তবে প্রচুর বিরক্ত হলো। এই সকালে কে এই শব্দ করছে দেখার জন্য ঘুম ঘুম চোখে এলোমেলো অবস্থায় দরজা খুলে বের হতেই দেখলো সামনে একটা মেয়ে এই শব্দটা করছে।

স্মরণ চাবিটা হারিয়ে ফেলেছে আজ সকালে। সকালে কিভাবে যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সেই জানে। অনিল সাহেব ছাড়তে চাচ্ছিলেন না মেয়েকে তবে স্মরণ খুব দাম্ভীকের সাথে বেরিয়ে এসেছে সেই বাড়ি থেকে। যেই বাসায় তার কোনো দাম নেই সেই বাসায় থেকে কি লাভ?

চাবিটা হারানোর ফলে তালা খোলার মতো আর কোনো উপায় ছিলো না। কারণ এই তালার নাকি চাবি একটাই। তাই তালা ইট দিয়ে ভাঙছিলো স্মরণ। শীতল বললো,“ আরও জোরে দাও।’’

“ এই এখানে এতো শব্দ কিসের?’’

স্মরণ, শীতল দুজনেই ফিরে তাকালো। শীতল বললো,“ বাহারাজ ভাই আসলে তালার চাবিটা হারিয়ে ফেলেছে স্মরণ তাই তালাটা ভাঙতে হচ্ছে।’’

এভাব এলোমেলো অবস্থায় বাহারাজকে দেখে স্মরণ ভাবলো এই ছেলে না জানি কত এলোমেলো হয়। তার বাহারাজকে গুণ্ডার মতো মনে হলো। এদিকে বাহারাজ বিরক্তি নিয়ে বললো,“ আসতে না আসতেই এমন শুরু করেছে? না জানি আরও কত ঝামেলা সহ্য করতে হবে আমায়।’’

বলেই দুজনের সামনে ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। স্মরণ ঠোঁট বেকিয়ে বললো,“ পাগল নাকি?’’

শীতল বললো,“ ভাইয়া অনেক শান্তিপ্রিয় মানুষ তো তাই।’’

এদিকে স্মরণ আরও কয়েকবার বারি মারতেই তালা ভেঙ্গে গেলো। ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। ফোন করে বন্ধুদের তাকে সাহায্য করার জন্য আসতে বললো। শীতল বলল,“ আমি সাহায্য করি?’’

“ ঠিক আছে।’’ বলে দুজনেই কাজে লেগে পড়লো।
স্মরণ সর্বপ্রথম ঘর ঝাড়ু দিলো। শীতলকে সাহায্য করতে বললেও তেমন কোনো কাজ করতে দিলো না। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার পর একটা হুইলের প্যাকেট দিয়ে পুরো ঘরে ছিটিয়ে দিয়ে পানি ছড়িয়ে দিলো। আর ঘরটা পরিষ্কার করতে লাগলো। সেসব পানি দরজার বাইরে ফেলে দিলো। এতে রুমটা অনেকখানি পরিষ্কার হলো। ভালো পানি দিয়েও পরিষ্কার করলো। সমস্ত পানি সিড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়লেও বাহারাজের রুমের সামনেও কিছু পানি গড়িয়ে গেলো।

এদিকে বাহারাজ কোথাও যাওয়ার জন্য দরজা খুলে বাইরে বের হতেই ধপাস করে চিটপটাং হয়ে পড়ে গেলো। বলিষ্ঠ শরীরে বিদ্যুৎ এর মতো শকড খেলো যেন। মুহুর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে গেলো তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যথা সংবরণের ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কি পরিমাণ ব্যথা পেয়েছে।

এদিকে তাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে স্মরণ খুব জোরে হেসে ফেলল। নিজের ব্যথা আর সামনের মেয়েটার হাসিতে যেন মাথায় কোনো দাহ্য পদার্থ ছাড়াই আগুন ধরে গেলো। ধমকে বললো,“ এই মেয়ে হাসছো কেন?’’

স্মরণ নিজের হাসি বহাল রেখেই বললো,“ সামনে এমন হাস্যকর দৃশ্য, আমি স্মরণ না হেসে থাকি কি করে?’’

আরও বেশি রেগে গেলো বাহারাজ। কোনোভাবে কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে নোমান সাহেবকে ডাকতে লাগলো। এমন চেঁচিয়ে ডাকাতে নোমান সাহেব কিছুক্ষণ পর এসে হাজির হলেন। বাহারাজ দাতে দাত চেপে জিজ্ঞাসা করলো,“ এই জায়গাটা পিচলা কেন? কোন গরু এখানে সাবানের পানি ফেলেছে?’’

নোমান সাহেব বিচলিত হয়ে বললেন,“ আমরা গরু পালি না বাবা। তবে বাইরে থেকে হয়তোবা কোনো গরু তিনতলায় এসে এখানে হিসু করে দিয়ে গেছে।’’

#চলবে
– জুনানী চাকমা

ছায়াতরু পর্ব-০৫

0

#ছায়াতরু
#পর্ব_০৫

ভার্সিটিতে সিনিয়রদের আলাদা একটা ডিমান্ড থাকে। এইযে স্মরণের সেই হলের সিটে ওঠার আগেই কোনো এক সিনিয়র নাকি সেখানে উঠে গেছে।

এখন স্মরণ এতটাই রেগে আছে যে ওই সিনিয়রকে পেলে মুহুর্তেই খু*ন করতো। স্মরণ তো সিনক্রিয়েট করার চেষ্টা করেছিলো তবে বন্ধুরা থামিয়েছে তাকে।

আপাতত স্মরণ এখন তীব্র মাথা ব্যথা নিয়ে রেগে বসে আছে শিমুল গাছের নিচে পাতানো কাঠের বেঞ্চে। জিনিয়া খাতা দিয়ে বাতাস করে দিচ্ছে আর সিমানী মাথা টিপে দিচ্ছে। সামনে নকিব, তুষার আর নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তুষার বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে।

“ হলে থাকলেই কি না থাকলেই কি? হল থেকে তো বাসাবাড়িতে থাকা আরও বেটার।’’

নয়নও তাল মিলিয়ে বললো,“ হ্যা তাই–তো। তুই কোনো এক বাসায় উঠে পড় বা হোস্টেলে!’’

স্মরণ চোখ খুলে তাকালো। মুখায়ব শান্ত করে শান্তভাবে বললো,“ এই শহরে কমদামী রুম কোথায় খুঁজে সেসব বল ব্যাটা। শুধু ফটর ফটর করলেই হবে না। আর তোরাই বা কেমন ফ্রেন্ড? সেই বাচ্চাকাল থেকে এক স্কুলে, এক কলেজে এখন আবার একই ভার্সিটিতে একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করছি। ল্যাডাকাল থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক আমাদের। তন্মধ্যে একজন বিপদে পড়েছে, তাকে সাহায্য না করে এখানে বকর বকর করছিস?’’

নকিব নয়নের কাঁধে হাত রেখে স্মরণকে বললো,‘‘তুই এক কাজ কর। আমাদের বিল্ডিং এ রুম খালি আছে। সেখানে উঠে যা।’’

“ ভাড়া বল!’’

“ ১৯০০০ হাজার টাকা।’’

“ যদি তুই মাসে মাসে ভাড়াগুলো দিয়ে দিতে পারিস, তবে আমি আজকেই উঠবো।’’

“ অসম্ভব!’’ তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো নকিব। স্মরণ বিরক্তি নিয়ে বললো,“ তাহলে চুপ থাক।’’

স্মরণের পাশ থেকে সিমানী চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ এখন কি করবি বইন?’’

“ রাস্তায় রাস্তায় থাকবো, তবুও ওই বাড়িতে আর থাকা একদমই সম্ভব না আমার। আমারও একটা সম্মান আছে নাকি? যে বাড়িতে নিজের কোনো সম্মানই নেই, সবসময়ই গালাগাল খেতে হয় ; তো ওই বাড়িতে কোন মুখে থাকবো। ইটস ইম্পসিবল।’’

“ হ্যা, স্মরণ ওই বাড়িতে আর থাকবে না।’’ কথাটা জিনিয়া বলে উঠলো।

সবাই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলো। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে নিরবে। বাতাসের ঘ্রাণে আলাদা একটা ঘ্রাণ অনুভব করলো স্মরণ। হুট করেই তার ভালো লাগা শুরু করলো। বন্ধুদের সবগুলোকে একবার তাকালো। এদের সাথে ছোট থেকেই বন্ধুত্ব খুব ভালো বন্ধুত্ব তার। মা তো নেই, বাবাও স্মরণকে বোঝে না। একমাত্র এই বন্ধুরাই তাকে এতদিন যাবৎ খেয়াল রেখে আসছে।

নিরবতা ভেঙ্গে নয়ন বলে উঠলো,“ আমার একটা বাসা পরিচিত আছে। বাসার মালিকের মেয়ে আমার, আমার আসলে…’’

“ তোর গার্লফ্রেন্ড!’’ নকিব আর তুষার দুজনে সমস্বরে বলে উঠলো। নয়ন মাথা নিচু করে বললো,“ যাই–ই হোক। স্মরণ যদি তুই চাস তাহলে তোকে নিয়ে যাব।’’
তারপর থেমে আবারও বললো,“ ভাড়াও কম।’’

স্মরণ উৎসুক হলো,“ বাসাটা কোথায়?’’

“ বাসাটা একটু দূরে হলেও, নিরিবিলি জায়গায় পড়েছে। বাসার পেছনে জঙ্গল আছে। বাসার পাশে দু-একটা বিল্ডিং, আরেকটু এগিয়ে গেলেই মেইন রোড।’’

“ তাহলে চল।’’ উঠে দাঁড়ালো স্মরণ। জিনিয়া, সিমানীও উঠে দাঁড়ালো। স্মরণ নয়নের কাছে এসে পিঠে একটা চাপড় মেরে বললো,“ স্মরণ নিরিবিলি জায়গায় পছন্দ করে। দরকার হলে মাঝে মাঝে রাতে ওই জঙ্গলে গিয়ে একটা ছোটখাটো পিকনিক অ্যারেঞ্জ করবো।’’

তুষার হেসে বললো,“ আমি গিটার নিয়ে যাবো।’’

নকিব বললো,“ আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে।’’

জিনিয়া নকিবের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,“ তুমি মাইন্ড ঠিক করো নকিব।’’

“ আমার মাইন্ড ঠিকই আছে, এইযে তুই–ই খারাপ করে দিচ্ছিস।’’

সিমানী নিজের নাক গলালো,“ তোরা দুজনই ডার্টি মাইন্ডেড।’’

“ আর তুমি কচি খুঁকি।’’ ব্যাঙ্গ করে বললো নকিব। স্মরণ ধমকালো তিনজনকে,“ এই তোরা কিছুক্ষণের জন্য চুপ থাক। এতো কথা কিভাবে বলিস?’’

“ সৃষ্টিকর্তা মুখ দিছে কথা বলার জন্যই।’’

নকিবের কথায় স্মরণ নকিবের দিকে তাকালো। নকিব তুষারের দিকে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালো। স্মরণ আর কিছু বললো না। নয়নকে বললো,“ চলো বন্ধু। তোমার গার্লফ্রেন্ডের বাসায়। দরকার হলে আমি কালই উঠবো।’’

স্মরণের কথায় সবাই রওনা হলো নয়নের সেই গার্লফ্রেন্ডের বাসায়।
আধঘণ্টা পর এসে পৌঁছালো নির্জন এক এলাকায়। এদিকটা জনবসতি খুব কম। অথচ শহরেই যে এমন এক জায়গা আছে স্মরণের ধারণায় ছিলো না। দুটো সিএনজি এসে থামলো মেইন রোডে। নেমে পড়লো সবাই। যার যার ভাড়া সে সে দিয়ে দিলো।

নয়ন হাঁটা আরম্ভ। বাকিরাও পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলো। একটু হেঁটে গিয়ে একটি তিনতলা ভবন চোখে পড়লো। বাড়ির চারিধার ঘিরে রয়েছে জং ধরা টিন। তিনতলা এই বিল্ডিংটি নয়ন বাদে বাকি পাঁচ বন্ধু খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো৷ বাড়িটির রঙ উঠে গেছে। অনেকবছরের পুরোনো বাড়ি।

স্মরণ নয়নের পাশে এসে দাঁড়ালো,“ সবসময় আসা যাওয়া হয় বুঝি?’’

স্মরণের কথায় সবাই হেসে উঠলো। নকিব হাসতে হাসতে বললো,“ নাহলে কি এতো ভালোভাবে স্মরণে থাকতো নাকি?’’

তখনই চারটা গাড়ি এসে তাদের থেকে কিছুটা দূরে থামলো। গাড়ি থেকে বের হলো পরপর কিছু সাদা কাপড় পরনে লোক। দেখে মনে হচ্ছে কারও বডিগার্ড এরা। মাঝের গাড়ির সামনে এসে একজন গাড়ির দরজা খুলে দিলো। পরপর একদম সিনেমাটিক টাইপে এক মাঝবয়সী লোক নেমে পড়লো। পরনে শুভ্র পাঞ্জাবী-পাজামা। সুপুরষ লাগলেও মুখটা দেখে গুণ্ডা মনে হলো স্মরণের।

তুষার চমকে বলে উঠলো,“ আরেহ এ তো এমপি আব্দুল সরকার!’’

নকিব আর নয়নও মাথা ঝাকালো। তবে মেয়েরা চিনলো না। সাধারণত ছেলেদের এসব বিষয়ে জানা থাকলেও মেয়েরা নাম ছাড়া মানুষগুলোকে খুব একটা চেনে না। তাই স্মরণদেরও একই অবস্থা।

এদিকে সেই এমপি আব্দুল সরকার এগিয়ে এলেন স্মরণদের দিকে। স্মরণরা ভেবেছিলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তবে মানুষগুলো তাদের দিকে এগিয়ে এলো ঠিকই তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। সামনেই একটা জঙ্গল। তার আগে একটা বাড়ি শুধু। এমপি ও তার চ্যালাপ্যালারা সেই জঙ্গলের দিকেই গেলো।

তুষার ব্যঙ্গ করে বলে উঠলো,“ আজকাল এমপি, মন্ত্রীরাও জঙ্গল পরিদর্শনে বের হয়।’’

একটা হাসির রোল পড়ে গেলো সেখানে। তখনই গেইট খুলে এক মাঝবয়সী লোক বের হয়ে এলেন আর ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“কি চাই? ’’

হঠাৎ এরূপ প্রশ্নে স্মরণরা থতমত খেয়ে গেলো। নয়ন একবার বাকিদের দিকে তাকিয়ে সেই মাঝবয়সী লোকটাকে বললো,“ আসলে আঙ্কেল আমরা রুম দেখতে এসেছি। আপনাদের বিল্ডিং এ নাকি রুম খালি আছে।’’

লোকটা এবার খুশি হলেন মনে হলো। হেসে বললেন,“ কয়জন থাকবা?’’

“ আমার এক বান্ধবী থাকবে শুধু। হবে কি?’’

“ হবে মানে দৌঁড়াবে একদম৷ আমাদের তিনতলায় একটা রুম খালি আছে। সেখানে উঠতে পারবে। আমার মেয়েটাও আর নিঃসঙ্গতায় ভুগবে না।’’

নয়ন জিজ্ঞাসা করলো,“ ভাড়া ক…’’

“ দুই রুম, একটা বাথরুম, একটা রান্নাঘর। ভাড়া হচ্ছে ছয় হাজার টাকা।’’

এত কম ভাড়া শুমে চমকালো সবাই। তাদের এই চমকানো ভাব দেখে নোমান সাহেব বললেন,“ এদিকে রুম তেমন ভাড়া হয় না। আমি হুদাই তুলেছি এই বিল্ডিং। তাই ভাড়া কমিয়েছি এখন। তবে তোমরা চাইলে আরও বাড়াবো।’’

প্রায় সবাই একযোগে বলে উঠলো,“ দরকার নেই।’’

স্মরণ তো মহাখুশি। সেসময় বিল্ডিং থেকে চারজন যুবক কথা বলতে বলতে বের হয়ে এলো। সবাই সময় সেদিকে তাকালো। সবাই কপাল কুঁচকে তাকালেও অবাক হলো নয়ন।

বাহারাজরা বাসা থেকে বের হয়ে সামনে একদল ছেলেমেয়ে দেখে তারাও ভ্রু কুঁচকালো। তবে তাদের মধ্যে শায়ন একটু বেশিই ভ্রু কুঁচকালো। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছোট ভাই নয়নকে এখানে দেখে বললো,“ তুই এখানে?’’

নয়নও একইভাবে বললো,“ তুই এখানে?’’

শায়ন বিরক্ত হলো,“ আমি বড় আমার উত্তর আগে দে নয়ন।’’

তাদের এটুকু কথোপকথনেই একপ্রকার বিস্মিত সবাই। নয়ন বললো,“ আমি আমার বান্ধবীর জন্য বাসা খুঁজতে এসেছিলাম।’’

“ আর আমার বাসাতেই রুম নিয়েছে। ওইযে তিনতলার ওই দুইরুমের ফ্ল্যাট–টাই।’’

নোমান সাহেবের কথায় বাহারাজ যেন বিরক্ত হলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,“ আঙ্কেল! দরকার হলে ওই রুমের ভাড়াটাও আমিই দেবো। দ্বিগুণ দেবো। তবুও আপনি বাসায় ভাড়াটিয়া আনবেন না।’’

নয়ন স্মরণের দিকে তাকালো। দেখলো মেয়েটা রেগে গেছে। বাহারাজকে নয়ন চেনে। এই ছেলে খুবই গম্ভীর। এখানে স্মরণ আর তার যদি গণ্ডগোল হয় তাহলে স্মরণের এই বাসায় থাকা আর হবে না। বন্ধুর কথা ভেবেই স্মরণের কিছু বলার আগে নয়নই আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো,“ বাহারাজ ভাই, আসলে স্মরণ বিপদে পড়েছে। আশা করি তুমি কিছুটা হলেও বুঝবে।’’

শায়ন বললো,“ কে স্মরণ?’’

“ আমার বান্ধবী স্মরণ।’’ বলেই নয়ন স্মরণকে দেখিয়ে দিতেই চার বন্ধুর নজর গিয়ে পড়লো স্মরণের দিকে। অভ্রর মনে হলো সে স্মরণকে কোথাও দেখেছে। তবে তাৎক্ষণিক মনে করতে পারলো না।

রিয়াদ বাহারাজের কাঁধে হাত রেখে স্মরণের দিকে তাকিয়ে বললো,“ মেয়েটা হয়তো বিপদে পড়েছে। না করিস না।’’

বাহারাজ একবার স্মরণের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই সামনে হাঁটা ধরলো। স্মরণের সামনে দিয়ে চলে গেলো। দুজনের কেউ বুঝলো না তাদের আগেও দুইবার দেখা হয়েছে। এদিকে নোমান সাহেব খুশি হয়ে বললেন,“ সাবধানে যেও বাবা। আর রাতে আমাদের বাসায় ডিনার করো আজ।’’

এদিকে স্মরণ বুঝতে পারলো এরা এই বিল্ডিং এ ভাড়া থাকে। ভয় পেলো স্মরণ। এতগুলো যুবক এই বিল্ডিং এ থাকে। স্মরণ আর ভাবনার গভীরে গেলো না। এখানে না থাকলে আর রুমও পাবে না তাও আবার এতো কম দামে। এদিকে এই বাসায় এমন যুবক আছে। কি করবে না করবে ভাবতে লাগলো।

বাহারাজ চলে যেতেই শায়ন তার ছোট ভাইকে বললো,“ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবি।’’

সেও চলে গেলো। অভ্র আর রিয়াদ যাওয়ার সময় রিয়াদ স্মরণের দিকে একবার তাকালো। স্মরণও তার দিকে তাকাতেই রিয়াদ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,“ স্বাগতম।’’

বলেই চলে গেলো রিয়াদ আর অভ্র। কথার মানে বুঝলো না স্মরণ। কিসের স্বাগতম জানাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে মনে করতে লাগলো খারাপ কিছুর নয়তো আবার?

এদিকে নয়ন বুঝলো তার ভাইয়ের বন্ধু বাহারাজ এই বাসায় ভাড়া থাকে। আর শায়নও এই বাসায় আসে মাঝে মাঝে। তবে দুই ভাইয়ের কখনোই দেখা হয় নি। নয়ন মাঝে মাঝে শীতলকে বাসায় ছেড়ে দিয়ে যায়। নয়ন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভাগ্যিস দেখা হয় নি।

স্মরণ নয়নের কাছে এসে বললো,“ এই নয়ন আমার কি এখানে ওঠা ঠিক হবে? এখানে এত যুবক থাকে। যদি কি…’’

“ বাজে কথা বলিস না। এখানে শুধু বাহারাজ ভাই থাকে। উনার মতো ভালো মানুষ নেই।’’

নোমান সাহেব তাদের কথার মাঝে বললেন,“ এইযে মেয়ে স্মরণ না মরণ তুমি কালই বাসায় উঠে পড়ো।’’

#চলবে
– জুনানী চাকমা

ছায়াতরু পর্ব-০৪

0

#ছায়াতরু
#পর্ব_৪

“ এভাবে রাস্তায় দৌঁড়াদৌঁড়ি করাটা তোমার মতো বেকারকেই মানাবে, তবে তোমার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কেমন সেটাও মাথায় রেখে তোমার চলাফেরা করা উচিত বাহারাজ।’’

কালো মাইক্রো থেকে এক মহিলা কথাগুলো খুব দাম্ভিকতা নিয়ে বললো। বাহারাজ গাড়ির দিকে তাকালো। বেকারত্ব শব্দটাই বেশি মাথায় ঘুরছে তার। বাহারাজ ব্যাগটা শায়নের দিকে ছুড়ে মেরে গাড়িতে বসে থাকা মহিলার দিকে না তাকিয়ে বললো,“ যে ফ্যামিলিতে থাকি না, সেই ফ্যামিলির স্ট্যাটাস মাথায় রাখবো কেন?’’

মহিলাটি “ হ্যা তাই–ই তো।’’ বলে গাড়ি থেকে নামলো। গায়ে জড়ানো শাড়িটা দেখেও বোঝা যায় উনার আভিজাত্যের অহংকার। জৌলুশপূর্ণ আস্তরণ না থাকলেও জৌলুশে মাখা গাম্ভীর্য যেন নজরকাড়া উদাহরণ। একদম বাহারাজের সামনে বরাবর দাঁড়িয়ে আগের মতোই ঠাট্টার স্বরে বললেন,“ তাই যদি হতো তবে গতকাল রাতে নিশ্চয়ই বন্ধুদের নিয়ে দেওয়ান বাড়িতে পা রাখতে না!’’

তাচ্ছিল্য হাসলেন মহিলাটি। পুনরায় একইভাবে বললেন,“ তাও আবার আমারই অনুপস্থিতিতে।’’

রিয়াদ এগিয়ে এলো সেখানে। সে এতক্ষণ একটু আগের লোকটাকে জেরা করছিলো। লোকটা একজন মহিলার থেকে ব্যাগটা চুড়ি করে নিয়ে যাচ্ছিলো। যেটা বাহারাজরা দেখে ফেলে। তাইতো লোকটার পিছু নিয়েছিলো। মহিলাটাই বলেছিলো ব্যাগে কিছু কাগজপত্র আর টাকা ছিলো। তবে ব্যাগে শুধুমাত্র টাকাগুলোই পাওয়া গেছে। রিয়াদ লোকটাকে মারলো তবে লোকটা কিচ্ছুটি স্বীকার করলো না। রিয়াদ লোকটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে বাহারাজের কাছে আসলো। আর সেসময় বাসনা আমানের কথা শুনে তারও কিছুটা রাগ হলো।

মায়ের এমন ঠাট্টা শুনে বাহারাজ সটান হয়ে দাঁড়ালো। তার ইগোতে লাগলো কথাটা। তার কোনো ইচ্ছে ছিলো না দেওয়ান বাড়িতে পা রাখার। ছোট বোন বীথিকে পাত্র দেখতে এসেছিলো গতকাল। বাবা তো বেঁচে নেই। বড় ভাইও বাড়িতে থাকে না। তবুও অনেক রিকোয়েস্ট করায় বাহারাজও রাজি হয়েছিলো। বীথি বাহারাজের বন্ধুদেরও যেতে বলেছিলো। নয়তো বাহারাজ ওই বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না। এর কারণ অবশ্য তার মা।

বাহারাজের দাদা রাসেল দেওয়ান ছিলেন একজন এমপি মহোদয়। যিনি গত হয়েছেন বছর ছয়েক আগে। রাসেল দেওয়ানের দুই পুত্র। বড় পুত্র রাজিব দেওয়ান আর ছোট পুত্র রাহান দেওয়ান। বাবা এমপি পদ থেকে সড়ে যাওয়ার পর উনার পুত্ররাও রাজনীতি পেশা গ্রহণ করেন নি। বড় পুত্র রাজিব দেওয়ান ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন আর ছোট পুত্র রাহান দেওয়ান বাহারাজের বাবা একজন জার্নালিস্ট ছিলেন। তবে তিনি বছর পনেরো আগে মারা গিয়েছেন কার এক্সিডেন্টে। স্ত্রী বাসনা আমান একজন বিজনেসওম্যান। বাসনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো ছিলো। বাসনা আমানের বাবা বিশাল আমান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। উনার একমাত্র মেয়ে বাসনা আমান। আর তারই প্রেক্ষিতে বাসনা আমান বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। স্বামীর অকালে মৃত্যুর পর ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে নিজেই মানুষ করেছেন। ছেলেকে নিজের ব্যবসায় লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বিদেশে পড়াশোনা করাতে। তবে ছেলে উনার কথা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে এখন আপাতত বেকার রয়েছে। রেগে ছেলেকে বাড়ি থেকেই বের করে দেন বাসনা আমান। এতে অবশ্য কেউই আটকাতে পারে নি উনাকে। উনার শ্বাশুরি দেওয়ান বাড়ির কর্ত্রী মনিকা বেগম মানা করেছিলেন তবে তাও মান্য করেন নি বাসনা। এরপর থেকেই ছেলের সাথে রাস্তাঘাটে দেখা হয়। আর ছেলেকে নানা কথা শোনান।

মায়ের কথা শুনে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না বাহারাজ। বরং রাস্তার অপর পাশে কিছু একটা দেখে হাঁটা ধরলো সেদিকে।

রিয়াদ বাহারাজকে চলে যেতে দেখে ডাক দিলো,“ এই বাহারাজ কোথায় যাচ্ছিস?’’

বাহারাজ উত্তর দিলো না। রিয়াদ একবার বাসনা আমানের দিকে তাকালো। আর বললো,“ আপনার এমন ভাবে বলা উচিত হয় নি আন্টি।’’

বাসনা আমান রিয়াদের দিকে তাকালেন,“ তাই নাকি? তা কিভাবে বলা উচিত ছিলো?’’

সেই উত্তর দিলো না রিয়াদ শুধু বললো,“ বেকার হলেও নিজের খরচ নিজেই চালিয়ে খাচ্ছে।’’

এরপর সেও চলে গেলো বাহারাজের পিছু। এদিকে বাসনা ছেলের যাওয়া দেখলেন। শায়ন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন,“ বাহারাজের খেয়াল রেখো শায়ন। আমি আসি।’’

গাড়িতে উঠে মুহুর্তের মাঝেই গাডি চলে গেলো।
এদিকে স্মরণ কিছুটা সফল হয়েছে ময়লাটা পরিষ্কার করতে। মনে মনে খুশি হলেও যে তাকে ধাক্কা দিয়েছে তার পুরো চৌদ্দ গুষ্ঠিকে গালি দিলো। তার পাশে থাকা ট্রাক ঘেষে যাওয়ার সময় কিছু একটার শব্দ পেলো স্মরণ। শব্দটা ট্রাক থেকেই পেয়েছে। ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলো কিসের শব্দ এটা? তখনই ড্রাইভার এসে চেঁচালো,“ এইহানে দাঁড়াইয়া কি করেন? সড়েন, যান। ’’

স্মরণ সন্দিহান হয়ে বললো,“ ট্রাকের ভেতরে কি মানুষ আছে নাকি?’’

“ আপনে কি পাগল নাকি? ট্রাকের ভিতরে বালু আছে। কেন আপনের ওপর ঢাইলা দিতাম?’’

স্মরণ কপাল কুঁচকে বললো,“ কোন আক্কেলে আমায় পাগল মনে হয় আপনার? আসলে আপনিই পাগল, বেক্কল, বয়রা, কানা; সব।’’

লোকটা ধমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্মরণ চলে গেলো। রাস্তা পার হলো। রাস্তার ওপারে রিকশা দেখা যাচ্ছে। তার পাশ দিয়েই বাহারাজও গেলো। তবে দুজন একে অপরকে চিনলো না। আর না দুজনের মাঝে কোনো চোখাচোখি হলো। একজন ভীষণ চিন্তিত তো অন্যজন রাগত। অথচ একজন জানেই না যে এই সেই যুবক যে বারবার তাকে ধাক্কা দেয়। আর অন্যজন জানে না এই সেই মেয়ে যে তাকে দু– দুবার চেঁচিয়েছে, রাগ দেখিয়েছে।
মুহুর্তেই দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলো।

____________________________

পাব্লিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে স্মরণ। শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে তার। কিছু জায়গায় চিনচিনে ব্যথাও অনুভুত হলো। মাথা ব্যথাটা এতক্ষণ না থাকলেও ভার্সিটিতে আসার পর কেন যেন মাথা ব্যথা শুরু হলো।

“ এই রণ, যাচ্ছিস কোথায়? আমাদের দেখতে পাস নি?’’

বন্ধু তুষারের কথায় থেমে গেলো স্মরণ। কপালে একটা হাত দিয়ে বললো,“ সত্যি বলতে, আসলেই দেখতে পায় নি।’’

তুষার সামনে তাকালো। মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলতে লাগলো,“ কোন রাজকুমারকে দেখেছিস তুই? যে আমাদের দেখতে পাস নি? নাকি তোর কানা হয়ে গেছিস? নাকি তোর চোখে ছানি পড়েছে নাকি তুই পাগল হয়ে গেছিস?’’

“ বাজে বকা বন্ধ কর। এমনিতেই মাথা ব্যথায় মাথাটা একদম ছিড়ে যাচ্ছে। আর তোর এই আজেবাজে কথাবার্তা তার মাত্রা আরও তীব্র থেকে তীব্র করে দিচ্ছে।’’

জিনিয়া, সিমানী এগিয়ে এলো। স্মরণকে ধরলো। নকিব তুষারের মাথায় গাট্টা মারলো। কাঁধে হাত রেখে ব্যঙ্গ করে বললো,“ ওর মাথাব্যথা বোঝো না তুষার?’’

“ আহ হা, চুপ থাক তোরা। এমনিতেই স্মরণের নাকি রাতে জ্বর এসেছিলো। আবার মাত্রই এলো, মাত্রই শুরু করলি।’’ নকিবকে আর জিনিয়াকে বিরক্তি নিয়ে বললো সিমানী। পুরো নাম আসমানী হলেও সবাই সিমানী বলেই ডাকে ওকে।

জিনিয়া বললো,“ চল ওকে ফার্মেসীতে নিয়ে যায়। ঔষধ খেলে কিছুটা হয়তোবা কমবে।’’

স্মরণ মুখ খুললো,“ দরকার নেই। এত উদ্বিগ্ন হবারও প্রয়োজন নেই। আমি সুস্থ আছি। ক্লাসে চল এখন।’’

তুষার ঝুকে বললো,“ আসলেই ঠিক আছিস নাকি ভান ধরছিস?’’

স্মরণ বড়সড় একটা গাট্টা মারলো তুষারের মাথায়। ঠোঁটে বেকিয়ে বললো,“ কি মনে হলো?’’

তুষার মুখ ফুলিয়ে বললো,“ হ্যা হ্যা ঠিকই আছিস।’’

ক্লাস চলাকালীন স্মরণের ফোনে মেসেজের একটা নোটিফিকেশন আসলো। স্মরণ বেঞ্চের নিচে ঝুকে দেখার চেষ্টা করলো কে কি মেসেজ দিয়েছে? দেখলো অচেনা নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজ অপশনে ক্লিক করতেই দেখলো টাইপিং অক্ষরে লেখা,

“ পান খাইতে ডাকে আমারে,
বড় বড় চোখের দিকে তাকাইরে।’’

#চলবে
– জুনানী চাকমা

ছায়াতরু পর্ব-০৩

0

#ছায়াতরু
#পর্ব_৩

রাতে চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো স্মরণের। স্মরণের শরীর খিঁচুনি দিয়ে উঠলো। শরীরের অতি উষ্ণ তাপমাত্রার অনুভুতিটাই বলে দিচ্ছে গায়ে জ্বর উঠেছে। তীব্র মাথা ব্যথায় ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। বিকেলের দিকে বাসায় আসার পরপরই শরীরটা অসাড় হয়ে এসেছিলো বিধায় বাবাকে কথাটা বলে রুমে এসে শুয়ে পড়েছিলো। নয়তো তামাশা দেখাতো স্মরণ।

তবে এই মাঝরাতে এতো কিসের চেঁচামেচি সেটা জ্বরের ঘোরে বুঝতে পারলো না। মাথাটা যদি কেউ টিপে দিতো তবে হয়তো কিছুটা ভালো লাগতো স্মরণের। মা বেঁচে থাকলে হয়তো সেই ভালো লাগার সুযোগটা হতো। তবে মা তো বেঁচে নেই। মায়ের অনুপস্থিতিতে একজন সন্তানের কষ্ট কেমন সেটা শুধুমাত্র সেই সন্তানই বুঝতে পারবে।

স্মরণ দুহাতে মাথাটা ধরে উঠে বসলো। মাথা থেকে গরম ধোঁয়া বের হওয়ার জোগাড়। এদিকে বাইরে চেঁচামেচির আওয়াজ ততোটাই জড়ালো হচ্ছে। শব্দগুলোর প্রখরতা কানে এসে ধরা দিচ্ছে অবলীলায়। স্মরণ এবার কোনোভাবে উঠে দাঁড়ালো তবে মনে হলো এই মুহুর্তেই পড়ে যাবে সে। শরীরের দূর্বলতা জানান দিলো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।

এদিকে বসার ঘরে অনিল সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। আর সেই বিকেল থেকেই রাবিনা বেগম চেঁচামেচি করছেন। তবে রাতে এসে সেটা আরও বেশি হলো কারণ রাহা নাকি আজ মন খারাপের জন্য বাড়িতে আসে নি। অনিল সাহেব রাবিনা বেগমকে শুধু এটুকুই জিজ্ঞাসা করেছিলেন একটু আগে রাহার কি কারও সাথে প্রেম করে কিনা? এটা অবশ্য জিজ্ঞাসা করেছিলেন রাহা কখনও রাবিনা বেগমকে নিজের পছন্দের ব্যাপারে বলেছে নাকি সেটা জানার জন্য। অথচ রাবিনা বেগম রেগে এখন চেঁচামেচি করছেন।

“ তোমার গুণধর মেয়ে এমন মুখ বেচে প্রেম করতে পারে আমার মেয়ে নয়। যা তা কথা আমার মেয়ের নামে একদমই জিজ্ঞাসা করবে না আমায় বলে দিলাম। ’’

এরপরই আবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,“ আবার বিয়ে করবে না বলছে মেয়ে, তার বাপও সায় দিলো সে কথায়? কেন তোমার মেয়ে কোন নাগর জুটিয়েছে যে তার জন্য বিয়ে করতে পারছে না এত ভালো একটা সম্বন্ধ হাত ছাড়া করে দিচ্ছে? বাপের হোটেলে বসে বসে খাবে আর নাগরের সাথে সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে ঘুরে বেড়াবে সেজন্য তাই না?’’

এবার রেগে গেলেন অনিল সাহেব। রুষ্ট স্বরে বললেন,“ আর একটাও বাজে কথা বলবে না রাবিনা। আমার মেয়ে কেমন সেটা আমি জানি। ওর বিয়ে আমি কখনোই হিমেলের সাথে দেবো না। ’’

অনিল সাহেব লজ্জায়, আড়ষ্টতায় বলতেও পারছেন না যে রাহা আর হিমেলের হয়তোবা প্রেমের সম্পর্ক আছে। কিভাবে বলবেন তিনি বললেও তো রাবিনা বিশ্বাস করবেন না।

এদিকে রাবিনা আরও বেশি ক্ষেপে গেলেন। ফুঁসে উঠে চেঁচিয়ে বললেন,“ মেয়েকে যে কি শিক্ষা দিছো সেইটা তো দেখতেই পারছি। মাও হয়তোবা এমনই আছিলো এইজন্য উপরওয়ালা উঠাই নিছে।’’

সায়নিকার ব্যাপারে এমন মন্তব্যে অনিল সাহেব এতটাই রেগে গেলেন যে ধমকে বললেন,“ মুখ সামলে কথা বলো রাবিনা। তুমি আর একটা কথা বললে আমি হাত তুলতে বাধ্য হবো।’’

“ হ্যা তাই–তো, বাপে হাত তুলবো আর মেয়ে মুখে মুখে তর্ক করবো।’’

“ তর্ক করি আর যাই–ই করি, অন্তত আপনার মেয়ের মতো চরিত্রহীনা তো নই।’’ কণ্ঠস্বর নরম তবে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পেলো স্মরণের কণ্ঠে।

ঢুলুঢুলু অবস্থায় দরজার সামনে থেকে কথাটা বললো স্মরণ। চোখদুটো একদম লাল তার। শুধু চোখই নয়। মুখটাও লাল দেখালো। রাগে এমনটা হয়েছে নাকি জ্বরের কারণে সেটা বোঝা না গেলেও এটা বোঝা গেলো রাবিনা বেগমের সমস্ত কথাই শুনেছে স্মরণ। শরীরের দূর্বলতাকে উপেক্ষা করেই উঠে এসেছিলো স্মরণ চেঁচামেচি ঠিক কোন কারণে হচ্ছে সেই মুহুর্ত দেখার জন্য। এসে যে এমন ভয়ানক মধুর বাণী শুনবে সেটা ধারণার বাইরে ছিলো। জ্বরের ঘোরেও শরীরের নিউরনগুলো খুব জ্বলে উঠলো রাবিনাকে কড়া কথা শোনানোর জন্য, যখন রাবিনা বেগম স্মরণের মা–কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করছিলো। স্মরণ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে এই মহিলার জ্ঞান, বুদ্ধি, মানসিকতার কমতি ভারী প্রকট।

মেয়ের বিপক্ষে আজ কথা বলার সাহস পেলেন না অনিল সাহেব। এদিকে স্মরণের মুখে নিজের মেয়ের ব্যাপারে এমন বাজে কথাটা যেন রাবিনা বেগমের কানে আগুন ধরিয়ে দিলো। তেড়ে গেলেন স্মরণের দিকে। এমন কিছুটা আঁচ করতে পেরে অনিল সাহেব থামালেন রাবিনাকে। রাবিনা হুংকার ছুড়লেন স্মরণের দিকে,“ মুখ সামলে কথা বল হারাম–জাদি। কার ব্যাপারে কি বলছিস? তুই আমার মেয়ের নখেরও যোগ্য নোস।’’

স্মরণের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“ ঠিকই বলেছেন। আমি কি আর আপনার মেয়ের মতো ওমন চরিত্রহীনা নাকি।’’

কথাটা বলে রাবিনা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললো,“ বাবা জানিনা বিশ্বাস করবে কিনা? অবশ্য আমার কাছে প্রমাণও আছে তবে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা সেটা তোমার ব্যাপার।’’

মাথা ঘুরে উঠলো স্মরণের। মাথায় এক হাত দিয়ে ধরে কোনোরকম আওড়ালো,“ রাহা আর হিমেলের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক আছে।’’

রাবিনা বেগম আবারও ধমকে বললেন,“ চুপ কর হারাম–জাদি। আর একটা বাজে কথা বললে তোর জিহ্ব কেটে ছিড়ে ফেলবো বলে দিলাম৷ বিয়ে করতে মন চাইছে না তাই এখন এসব অপবিত্র কথা বলছিস তাই না?’’

স্মরণ পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফোন হাতে করে এগিয়ে এলো বাবার দিকে। অনিল সাহেব তখনও রাবিনা বেগমকে আটকে রেখেছেন। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফোনের লক খুলে গ্যালারিতে ঢুকে গ্যালারির প্রথম ছবিটাই তুলে ধরলো অনিল সাহেবের সামনে। রাবিনা বেগমও দেখলেন। আর চমকে গেলেন।

রাহা আর হিমেল নগ্ন অবস্থায় চাদরে মুড়ে চমকে তাকিয়ে আছে। ভাবটা এমন তারাও হয়তোবা ছবিটি তোলার সময় চমকে গিয়েছিলো। অনিল সাহেব একটু দেখেই আর দেখতে পারলেন না। চোখ নামিয়ে নিলেন। তাহলে উনি আজ যেসময় দুজনকে দেখেছিলেন ব্যাপারটা তখনকার। এদিকে রাবিনা বেগমর মেয়ের এমন অবস্থা দেখে চক্ষুস্থির হলো। কথা বলতেও ভুলে গেলেন কিয়ৎক্ষণ।

স্মরণ পাশে থাকা সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। মাথায় হাত দিলো আর অতিকষ্টে বললো,“ বাবা আশা করি বুঝতে পারছো।’’
থামলো স্মরণ এরপর কথার পিঠে রাবিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,“ বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী! আপনার করা আমার মায়ের বিরুদ্ধের মন্তব্যটা কিন্তু আপনার ওপরেই খেলে যাচ্ছে। তবে আমি সেটা বলে আপনাকে অপমান করবো না।’’

রাবিনা বেগমের মুখে কিছুক্ষণের জন্য কুলুপ এঁটে গেলো। স্মরণের কথার উল্টোপিঠে কিছু বলার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। থম মেরে মূর্তির মতো দেয়াল ঠেসে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপর অবশ্য মেয়ের পক্ষ নিতে ভুললেন না,“ আমার মেয়ে এমনটা কখনোই করবে না। এইটা স্মরণ তোরই কোনো পরিকল্পনা আমি জানি। এমন মিথ্যে সংবাদ দিয়ে তুই আমাকে মেয়েকে খারাপ বানাতে চাস আমি জানি। এই ছবি তুইই এডিট করেছিস।’’

আরও নানা কথা বলা শুরু করলেন রাবিনা বেগম। অনিল সাহেব মেয়েকে খেয়াল করলেন। মেয়ের যে শরীর ভালো না বুঝে এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। তবে স্মরণ নিজেই উঠে দাঁড়ালো। বাবার উদ্দেশ্যে দৃঢ়ভাবে শুধুমাত্র এটুকুই বললো,“ বাবা, তুমি সত্য মিথ্যা যাচাই করে উনাকে জানিও দিও। উনাকে আমাকে বিশ্বাস না করুক আশা করি আজকের জন্য তুমি আমায় বিশ্বাস করবে। কারণ আমি তোমারই অস্তিত্ব।’’

স্মরণ আবারও টলতে টলতে চলে গেলো নিজের রুমে। এদিকে রাবিনা বেগম নানা আহাজারি করে চলেছেন। আর আজেবাজে বকে চলেছেন স্মরণকে। অনিল সাহেব নিজেও সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন। এতবছর যাবৎ মেয়েটার দিকে খুব একটা ফিরে তাকাতে পারেন নি তিনি। তবে এখন আক্ষেপে বুক ভেঁসে যাচ্ছে। মেয়েটা আগুনে পুড়তে পুড়তে এখন নিজেই আগুন হয়ে গেছে। মাথা নত করছে না বরং মুখে মুখেই প্রতিবাদ করছে। অসুস্থতা নিয়েও আজ শক্তিশালী হয়ে কথার জবাব দিচ্ছে। মেয়েটা অসুস্থ কিন্তু অনিল সাহেব কিছু করতে পারবেন না। সেবা করতে পারবেন না মেয়ের। কারণ বাবা আর মেয়ের মাঝের দূরত্বটা এখন আকাশ পাতাল ব্যবধানের। এই দূরত্বের অন্ত অনিল সাহেব যেদিন খুঁজে পাবেন সেদিনই মেয়ের সাথে বসে দু–দণ্ড কথা বলবেন বলে ঠিক করলেন অনিল সাহেব। আবার বেশি দেরি না হয়ে যায় এটাও ভাবলেন তিনি। কারণ মেয়ের অভিমানের পাহাড় এতটাই উঁচু হয়েছে যে মেয়ে বাবার বাসায় শুধু থাকে খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত করে না। আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর হলো মেয়ে তার এমন হয়েছে। এসব ভাবলে নিজেরই খারাপ লাগে অনিল সাহেবের।

অনিল সাহেব আর রাবিনা বেগম বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। নিরবতা ভেঙ্গে অনিল সাহেবই প্রথম বললেন,“ তুমি বিশ্বাস করবে না বলেই তোমার থেকে আমি একটা কথা গোপন করেছি আজ। সেটা হলো আমিও নিজ চোখেই রাহা আর হিমেলকে একসাথে দেখেছি।’’

রাবিনা বেগম কিছু বললেন না। চুপই রইলেন। যেন কথা বলার ভাষা আপাতত খুঁজে পাচ্ছেন না। অনিল সাহেবই পুনরায় বললেন,“ একাকী বড় হলেও আমার মেয়ে কখনোই খারাপ কাজ করে নি রাবিনা। যেখানে তোমার উচিত ছিলো ছোট্ট স্মরণকে নিজের মেয়ে মনে করে ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতোই বড় করা সেখানে তুমি তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছো। তাকে মারধোর করেছো। আমি জেনেও একটা টু শব্দ করিনি। কেন করিনি এ নিয়ে আমার আজ আফসোস হচ্ছে। হয়তোবা যদি তখন তোমায় বারণ করতাম মেয়ের পক্ষ নিতাম আজ মেয়েটা এমন কঠিন হতো না। তুমি যদি তাকে ছোট থেকে নিজের মেয়ে মনে করতে তাহলে হয়তোবা মেয়েটা আজ তোমার মুখের ওপর কথা বলতে পারতো না। এটা যে তোমার ভুল সেটাও কখনো বলবো না। কারণ তোমার অবস্থাও বুঝতে পারছি। তবুও এতোটা কঠোর আর নির্মম হওয়া উচিত ছিলো না তোমার। আমার মা মরা মেয়েটাকে কিছুটা স্নেহ দিলে হয়তো আজ তোমায় সম্মান না শুধু মাথার ওপর বসিয়ে রাখতো।’’

রাবিনা বেগম একটা টু শব্দও করলেন না। মুখের তিক্ত কথাগুলো আপাতত মুখেই মূর্ছা গেছে। উনার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের মেয়ের ব্যাপারটা। সবই বানোয়াট আর কাল্পনিক মনে হচ্ছে। অনিল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে নিয়েও আবার থেমে গেলেন। পেছনে ফিরে অবিশ্বাস্যভাবে বসে থাকা রাবিনা বেগমকে শান্তভাবে বললেন,“ আমি হিমেলের পরিবারের সাথে আলাপ করে কিছুদিন বাদেই রাহা আর হিমেলের বিয়ের ব্যবস্থা করবো।’’

___________________________

সকালে স্মরণ সময়মতোই ঘুম থেকে উঠলো। ভার্সিটিতে আজ ক্লাস মিস দেওয়া যাবে না। স্মরণ বান্ধবী জিনিয়াকে দিয়ে হলের একটা সিট পাওয়ার চেষ্টা করবে। জিনিয়া বলেছিলো তাকে, হলে নাকি একটা সিট খালি আছে। স্মরণ সেখানেই উঠবে বলে ভেবে রেখেছে। তবে সেটা সামনের মাসে।

মাথা ব্যাথার প্রভাবতা তখনও প্রখর। তবুও উঠে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো স্মরণ। একদম রেডি হয়ে বের হলো। দরজার বাইরের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো স্মরণ। খুবই শান্ত পরিবেশ মনে হলো। হঠাৎ এই শান্তরূপ স্মরণকে ভাবালো কারণ সকালবেলা তাদের বাসার পরিস্থিতি কখনই শান্ত থাকে না। গতকাল রাতের ডোজটা তবে ঠিক জায়গামতো দেওয়া হয়েছে বলে মনে করলো স্মরণ।

স্মরণ দরজা খুলে বের হলো। কাউকে দেখতে পেলো না। রাহার রুমটা একবার পরখ করলো। রুমের দরজা খোলা। মানে রাহা এখনও বাসায় ফেরেনি। স্মরণ সদর দরজার সামনে গেলো। ব্যাগটা বাম কাঁধে ঝুলিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।

এ বাড়িতে স্মরণ খাবার খায় না। শুধুমাত্রই থাকে। নিজের খরচ চালানোর জন্য বিকেল থেকে চারটা টিউশনি করায় স্মরণ। টিউশনির এ টাকাগুলো দিয়ে তার মাস চলে যায় খুব ভালোভাবেই। কারণ তার আলাদা বাড়তি কোনো চাহিদা নেই। রাহার মতো রংধং এ অভ্যস্ত নয় সে। সাধারণ ভাবে থাকাতে অভ্যস্ত। কলেজে ওঠার পরপরই নিজের ভালো নিজে বুঝে নিতে শিখে গেছে। নিজের হাল নিজেই ধরে নিয়েছে। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হয়েও নিজের ভার, নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই নিয়ে নিয়েছে।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলো স্মরণ। সেসময় তার সামনে দিয়ে এক লোক দৌঁড়ে চলে গেলো। স্মরণ তাকিয়ে রইলো। পর পর দুজন যুবকও দৌঁড়ে গেলো লোকটার পিছু পিছু। স্মরণ খুব একটা বুঝতে পারলো না কি হয়েছে? একটা বাস এসে থামলো সেখানে। স্মরণ বাসে উঠতে যাবে সেসময় আরেকজন যুবক হনহনিয়ে যাচ্ছিলো আর স্মরণের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো। স্মরণ মাটিতে পড়ে গেলো। বাসে থাকা যাত্রীগুলো কেমন হেসে উঠলো স্মরণকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে। এদিকে সুড়সুড় করে আরও যাত্রী বাসে উঠে পড়লো। মুহুর্তের মাঝেই বাসটা চলে গেলো স্মরণের সামনে থেকে। স্মরণ মাটিতে বসেই শুধু তাকিয়ে রইলো বাসের যাওয়া। মাথা এতটাই গরম হলো যে চেঁচিয়ে বললো,“ মানুষ এতটা কানা হয় কিভাবে?’’

কথাটা বলতে বলতে স্মরণ উঠে দাঁড়ালো। জামাকাপড় ঝাড়তে লাগলো। তবে তার ডেনিম জিন্সের পেছনের অংশে ময়লা লেগেছে যা হাত দিয়ে পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। কিছুটা সাইডে গেলো স্মরণ। সাইড ব্যাগ হতে পানির বোতল আর টিস্যু বের করে পরিষ্কার করতে লাগলো।

এদিকে বাহারাজ কিছুটা দূরে এগোলেও পেছন হতে বলা কথাগুলো কিছুটা শুনতে পেয়ে থেমে গেলো। পরিচিত কণ্ঠস্বর। এই স্বর সে আগেও শুনেছে। আর তাকেই যে উদ্দেশ্য করে বলেছে সেটাও সে নিশ্চিত। তবে পেছনে ঘুরে তেমন কাউকে দেখতে পেলো না। কারণ স্মরণের পাশেই একটি ট্রাক ছিলো যার কারণে স্মরণকে আর দেখতে পেলো না বাহারাজ।

“ এই বাহারাজ লোকটার থেকে এই ব্যাগটা পেয়েছি শুধু। কোনো কারসাজি আছে আমি শিওর।’’

শায়নের কথা শুনে তার দিকে তাকালো বাহারাজ। পাশেই একটা কালো মাইক্রো এসে থামলো। তবে বাহারাজ আবারও পেছনে ফিরে তাকালো কে সেই মেয়েটাকে দেখার আশায়। কারণ মেয়েটার ওপর তার ক্ষোভ আছে। সেই ক্ষোভটা যতদিন পর্যন্ত ঝাড়তে না পারবে ততদিন তার পেটের ভাত হজম হবে না।

#চলবে
লেখনী–জুনানী চাকমা

ছায়াতরু পর্ব-০২

0

#ছায়াতরু ‘০২’

স্মরণের চুলে মুঠি করে ধরে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন রাবিনা বেগম। ফ্লোরে এমনভাবে ছুড়ে মারলেন যেন স্মরণ কোনো ফেলনা। স্মরণও দাতে দাত চেপে সহ্য করে নিলো। উল্টো ফ্লোরে ছুড়ে মারার পরই এমনভাবে হাটু ভাঁজ করে বসলো যেন কিছুই হয় নি। দৃষ্টি তার শীতলভাবে পরখ করলো রাবিনা বেগমকে।

দরজা খোলা রাখা ছিলো। রাবিনা বেগম গিয়ে দরজা লাগালেন। পিছে ঘুরে আবারও জলন্ত চোখে স্মরণের দিকে তাকালেন। স্মরণকে এমন শান্ত আর ওভাবে বসে থাকতে দেখে বিস্ফোরিত হলো চোখজোড়া। মাথায় লেগে গেলো আগুন। রাহা ফোন করার পর থেকেই তিনি এতটাই রেগে ছিলেন স্মরণের প্রতি সেটা রাবিনা বেগম নিজেও কল্পনা করতে পারছেন না। গা দিয়ে আর মাথার চামড়া ফেঁটে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ঘরটিতে যেন মুহুর্তের মাঝেই সেই উষ্ণতা দাবনলের মতো ছড়িয়ে পড়লো।

তবে স্মরণের মস্তিষ্ক যথেষ্ট রকমের শীতল। সেই শীতলতায় যেন কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে সক্ষম রাবিনা বেগমের ওপর। তাই স্মরণের দিকে তেড়ে গিয়ে পরপর এলোপাতাড়ি কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন স্মরণের গালে। মারতে মারতে রাবিনা বেগমও হাঁপাচ্ছেন। তবে স্মরণের মূর্তির মতো বসে থাকাতে নিজেও চমকে গেলেন। স্মরণের চুল মুঠি করে টেনে ধরে বললেন,“ কোন সাহসে তুই আমার মেয়েকে চড় মেরেছিস?’’

স্মরণ যেন উত্তর প্রস্তুত রেখেছিলো
তাইতো সঙ্গে সঙ্গেই রাবিনা বেগমের কথার প্রত্যুত্তর করলো,“ আপনি যে সাহসে আমাকে মারছেন।’’

চমকে গেলেন রাবিনা বেগম। কোমড় ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। স্মরণকে তিনি আগে অনেক মারধোর করেছেন। তবে মেয়েটা শুধুই কান্নাকাটি করতো কোনো প্রত্যুত্তর করতো না। তবে আজ এমন কথা বললো এতে রাবিনা বেগমেরই মাথা খারাপ হয়ে গেলো যেন। আবারও একটা চড় মারলেন তিনি। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,“ মুখে মুখে তর্ক করছিস? মুখে মুখে তর্ক করছিস হ্যা? আজ তো আমি তোকে মেরেই ফেলবো?’’

স্মরণ এতোগুলো চড় থাপ্পড় খেয়েও স্বাভাবিক ছিলো। যেন রাবিনা বেগম স্মরণের কোমল গালে নয় কোনো লোহায় চড় মেরেছেন। অবশ্য রাবিনা বেগমের হাতও জ্বলছে এখন স্মরণকে চড় মারতে মারতে। রাবিনা বেগমের শেষোক্ত কথায় স্মরণ বিচলিত হলো না বরং ঠোঁটে বাকা হাসির রেখা টেনে নির্বিকারভাবে বললো,“ কি মারবেন আর আমায়? আমি তো ভেতরে ভেতরে অনেক আগে থেকেই মৃত।’’

চোখ বড় বড় হয়ে গেলো রাবিনা বেগমের। স্মরণের চোখ দেখে তিনি নিজেই ভয় পেলেন। এই মেয়ে তো আগে এমন ছিলো না। চোখে ভয় দেখা যেতো আগে আর এখন চোখজোড়ায় যেন আগুন জ্বলছে নিরবে। আগে কথা বলতে গলা কাঁপতো এই মেয়ের আর এখন কি নির্দ্বিধায় এসব কথা বলে যাচ্ছে। চোখেমুখে ভয় নেই, নেই কান্না কান্না ভাব।

“ মারবেন না আর? তাহলে আমি উঠি।’’

বলেই উঠে দাঁড়ালো স্মরণ। আরও বেশি হতবাক হলেন রাবিনা বেগম। স্মরণ তার সাইড ব্যাগটা খোঁজা শুরু করলো। কোথায় ছিটকে পড়েছে। তার এহেন কাজে রাবিনা বেগমের নির্বাকতা,হতবম্ভতা কাটছে না বরং আরও বাড়ছে।

স্মরণ একটা সময় তার ব্যাগটা খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে গেলো। রাবিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে গলার ঝাঝ কমিয়ে বললো,“ আপনি আপনার আপন মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেন নি।’’

এবার নিজের নির্বাকতা ছাড়িয়ে দাত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,“ তোর বাপ আসুক আজকে। তোর বাবাকে জানাবো তার আগের বউ কি পরিমাণ নোংরা মানসিকতার ছিলেন। তার মেয়েও যে তেমনই হয়েছে।’’

ঘর কাঁপিয়ে হাসলো স্মরণ। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে বললো,“ আমার মা যদি নোংরা মানসিকতার হয় তাহলে ছোট মুখে বড় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনিও চরিত্রহীন ছিলেন তবে। তাই আপনার মেয়েও আপনার মতোই হয়েছে। ’’

তীব্র ঘৃণা নিয়ে স্মরণ কথাটা বললেও রাবিনা বেগম বুঝলেন না। উল্টো কথাটা শোনামাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন রাবিনা বেগম। স্মরণের দিকে তেড়ে গেলেন তবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। থেমে গেলেন তিনি। চোখের তীব্র রাগই যেন স্মরণকে বুঝিয়ে দিলো ‘ তোকে আমি ছাড়বো না ’। দরজা খুলতে চলে গেলেন তিনি। স্মরণ ব্যাগটা হাতে নিয়ে পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রাবিনা বেগমের ছুড়ে মারার কারণে পায়ে কিছুটা আঘাত পেয়েছে স্মরণ।

রাবিনা দরজা খুলতেই বাইরে অনিল সাহেবকে ক্লান্ত অবস্থায় দেখলেন। এদিকে রাবিনা বেগম তখনও রীতিমতো হাপাচ্ছেন। মুখ লাল রয়েছে তখনও। রাস্তা দিলেন অনিল সাহেবকে ঢোকার জন্য। অনিল সাহেবও ভেতরে ঢুকলেন। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন,“ স্মরণ কোথায়?’’

আজ হঠাৎ মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করায় রাবিনা বেগম অবাক হলেন। দরজা লাগিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,“ তোমার গুণধর মেয়ে আমার মেয়েকে তিনটে চড় মেরেছে আজ। ওকে কিছু বলো তুমি। দিন দিন বেশিই করছে সে।’’

অনিল সাহেব টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসে জগ থেকে পানি ঢেলে পান করলেন। আর রাবিনা বেগমের বলা সমস্ত কথাও শুনলেন। পানির গ্লাসটা জায়গা মতো রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“ সত্যিই মেরেছে? আর কি কারণে মেরেছে?’’

তেঁতে উঠলেন রাবিনা।
উচ্চৈঃস্বরে মেজাজ দেখিয়ে বললেন,“ তোমার কি মনে হয়, আমি মিথ্যে বলছি!’’
থামলেন রাবিনা। বলা শুরু করলেন,“ তোমার নবাবজাদী মেয়ে আমার মুখে মুখে কথা বলে। আজ শুধু বারণ করায় পারে তো আমাকেই মারে। এই বয়সে এসে এসব দেখতে হবে কল্পনাতীত ছিলো।’’

অনিল সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। আর জিজ্ঞাসা করলেন,“ স্মরণ কোথায়?’’

রাবিনা চিন্তিত হলেন যদি স্মরণ বলে দেয় রাবিনা তাকে মেরেছে। চুপ রইলেন তাই। কিন্তু অনিল সাহেবই জোরে জোরে স্মরণকে ডাকা শুরু করলেন। স্মরণ সবে বিছানায় গা এলিয়ে দিচ্ছিলো ঘুমানোর জন্য। সেসময় বাবার ডাক পেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। স্মরণকে দেখে অনিল সাহেব অবাক হলেন। দুই গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে কেউ চড় মেরেছে। অনিল সাহেব রাবিনার দিকে তাকালেন। রাবিনা চোখ লুকাচ্ছে।

অনিল সাহেব উঠে মেয়ের নিকটে গেলেন। এক হাত মাথায় রেখে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কি হয়েছে?’’

বাবার আজকের এমন ব্যবহারে ভীষণ রকম চমকে গেলো স্মরণ। চোখ বড় বড় করে বাবাকে উপরনিচ দেখলো। হতবম্ভাবস্থায় বললো,“ আজ সূর্য কোনদিক থেকে উঠেছে বাবা? পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে নাকি মাটি ফেড়ে উঠেছে?’’

স্মরণের এমন কথার মানে বুঝলেন অনিল সাহেব। প্রথম স্ত্রীর সমাধিস্থলে গিয়েছিলেন আজ। সায়নিকা মৃত্যুর আগে বার বার অনিল সাহেবকে নিজের মেয়েকে দেখে রাখার কথা বলেছিলেন। অথচ অনিল সাহেব এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে মেয়ের কথাই ভুলে গিয়েছেন। মেয়ের ভালোর জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন অথচ তিনি নিজেও জানতেন না যে মেয়েকে সেচ্ছায় আগুনে ফেলে দিয়েছেন। আসার সময় যখন দেখলেন স্মরণের হবু বর হিমেল আর রাহা একসাথে একটা হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেসময় তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিলো। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। এতবছর এই মা মেয়ের প্রতি যেন কিছুটা অন্ধভক্তি চলে এসেছিলো উনার যা কয়েক সেকেন্ডেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে।

বাবাকে ভাবুক দেখে স্মরণ সড়ে গেলো। আর মাথা নিচু করে নরম গলায় বললো,“ ক্ষমা করো বাবা, আমি তোমাদের ঠিক করা সেই হিমেলকে বিয়ে করতে পারবো না।’’

তাদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাবিনা যেন আবারও ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো ফুঁসে উঠলেন। চড়া মেজাজে বললেন,“ কেন রে নবাবজাদী? বাবার ঘাড়ে বসেই আজীবন খাবি নাকি?’’

স্মরণ একবার রাবিনা বেগমের দিকে তাকালো। তবে উনার কথার প্রেক্ষিতে কিছুই বললো না। শুধু বাবাকে নম্রভাবে বললো,“ আমি জানি আমার কথায় তোমার রাগ উঠবে। তবে আমি সস্তা নই যে ওমন এক চরিত্রহীন ছেলেকে বিয়ে করবো।’’

অনিল সাহেবের চোখের সামনে আবারও রাহা হিমেলের একসাথে হাঁটার ছবি ভেসে উঠলো। বিরোধিতা না করে রাবিনা বেগমেরও কোনো কথা না শুনে মেয়েকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,“ ঠিক আছে মা, আমিও তোমার কথায় সহমত প্রকাশ করছি।’’

বাবার হঠাৎ এরূপ পরিবর্তন মানতে না পারলেও স্মরণ খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না সেখানে। রেগে থাকা রাবিনা বেগম কিছু বলার আগেই নিজের ঘরে চলে গেলো। ভেতরে এসে বুঝতে পারলো রাবিনা বেগম তার বাবাকে চেঁচামেচি করছেন।

_________________________

নিস্তব্ধ রজনীর মাঝে গাড়ির হর্ণের শব্দ আর গাড়ি চলাচলের শব্দ যেন বেমানান। জোনাকিদের আওয়াজ আর এক তিমিরেও শোনা যায় না। বছর ছয়েক আগে শহরেও জোনাকিদের চলাচল ছিলো তবে এখন জোনাকিরা বিলুপ্তপ্রায়। গ্রামেও তাদের আর দেখা যায় না। জ্বলজ্বল করে ওঠে না তাদের আলো। পৃথিবীর কতকিছুই না পরিবর্তন হয়ে গেছে।

সউচ্চ প্রাচীরের ভেতরের মাঝ বরাবর বিশাল এক শুভ্ররঙা তেতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে নিজ অবস্থানে। বাড়ির গরন আর কারুশিল্প দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়ি যে তৈরি করেছেন আর যে তৈরি করিয়েছেন দুজনই শৌখিন। বাড়ির ভেতরের অসংখ্য সাদা লাইটের সমাহারে বাইরের অবস্থাও ঝকঝকে ঝলমলে। দূর আকাশের চাঁদের আলোর যেন কোনো প্রয়োজনই নেই বাড়ির চারিপাশ আলোকিত করার। অবশ্য এমন আলোর সমীপে কোনো পোকাও আসতে চাইবে না। জানান দিতে চাইবে না নিজের উপস্থিতি। তেতলা ভবনের এই বাড়ির ছাদে কিছুটা আবছা অন্ধাকারাচ্ছন্ন জায়গায় রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। তারই সামনে কয়েক হাত দূরে বেতের সোফায় বসে আছে আরও তিনজন যুবক। বয়স জানা না থাকলেও শরীরের বলিষ্ঠতা আর মুখের স্নিগ্ধ-শুদ্ধতা যেন তাদের সুপুরুষতার আলাদা প্রতীক।

“ সারাদিন কি এতো ভাবিস?’’

সামনে হতে বন্ধু শায়নের এরূপ প্রশ্নে মোটেও উচ্ছুক দেখালো না যুবকটিকে। বরং সে নিগুঢ় চিত্তে ভ্রুদ্বয়ের মাঝে গাঢ় ভাঁজ ফেলে সাদা টাইলসের ফ্লোরে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে আলাদা গাম্ভীর্যতার ধারালো ছাপ। এদিকে শায়নের কথার প্রেক্ষিতে অন্য আরেকজন বলে উঠলো,“ বাই এনি চান্স ও কি সকালের সেই মেয়েটার কথা ভাবছে?’’

উৎসুক দেখালো শায়নকে। জানতে চাইলো,‘‘ কোন মেয়ের কথা বলছিস অভ্র?’’

“ সকালে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো ওর। মেয়েটা কেমন করে যেন গম্ভীর স্বরে বলে ‘নেক্সট হতে দেখে হাঁটবেন’। আমি শিওর মেয়েটার প্রচুর রাগ উঠছিলো তখন।’’

“ চেহারা যতই সুদর্শন হোক না কেন ওর প্রতি সবারই রাগ থাকবে। এমন খিটখিটে পুরুষকে কে বিয়ে করবে?’’

রিয়াদ কথাটা বলতেই ছোটখাটো একটা হাসির রোল পড়ে গেলো সেখানে। এদিকে এরই মাঝে পেছনে হতে একজনের গলার আওয়াজ শোনা গেলো,“ আমার হবু শালা যতই খিটখিটে মেজাজের হোক না কেন লাইন ধরে হাজারও মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তাকে বিয়ে করার জন্য।’’

তার কথায়, তার উপস্থিতি টের পেতেই সবাই একেক করে তাকালো তার দিকে। কেউ চিনলো না।
তবে বুঝতে পারলো এই ছেলেটাই এই বাড়ির বড় মেয়ের জামাই হতে চলেছে।রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে এগিয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে বললো,
“ আমার নাম অন্তর। বীথীর হবু স্বামী। আপনার নামটা যেন কি ভুলে গেছি?’’

যুবকটি এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই সেও হাত মেলালো। হ্যান্ডশেক করতে করতেই গম্ভীর স্বরে নিজের নাম বললো,
“ বাহারাজ। ’’

#চলবে
–জুনানী