Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 44



জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১৩+১৪

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৩
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হান সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাহমিদকে সেলাইন দিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটা এখন শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। সারাটা রাত রায়হান এক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। অন্যদিকে রুদের চিন্তায় অস্থির লাগছিল। চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে। রায়হান ওযু করে এসে হাসপাতালে দেয়া একটা গামছা বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষে অনেক্ষণ আল্লাহর কাছে তার ভাই বোনদের সুস্থ রাখার জন্য দোয়া করলো। দোয়া পড়ে ঘুমন্ত রাহমিদের সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলো। এক দিনেই বাচ্চাটার শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। আর কিছুটা বেলা হলে ডাক্তার এসে বাচ্চাটাকে দেখে গেলো। সেলাইন দেয়া শেষ হয়েছে। দিলদার হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঘুমিয়েছে। রুস্তম ও তার সাগরেদ দের রায়হান কালকেই পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা যথেষ্ট করেছে। রাতে আফজাল হোসেনও এসেছিলেন। দিলদার ফোন করে বলেছে রাহমিদকে ভর্তি করানো হয়েছে। এই অবস্থার কথা শুনে না এসে পারেননি তিনি। উনি রাতে থাকতে চাইলেও রায়হান মানা করে দিয়েছে। হাসপাতালে এতো মানুষের না থাকাই ভালো। যেহেতু উনি হাঁপানির রোগী। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার আগে ডাক্তার তার চেম্বারে যাওয়ার জন্য বলেছেন। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে যায়। ডাক্তার রায়হানকে বসতে বলে। তারপর রাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হেঁসে বলেন,

“অনেক রাগী বাচ্চা মনে হচ্ছে। কালকে সেলাইন দিতে গিয়ে কি কাণ্ডটাই না করলো।”

“জি, ওই আসলে ও পরিচিত কেউ ছাড়া কারো কাছে তেমন যায়না। অপরিচিত কেউ ওকে কোলে নিলে বিরক্ত হয়।”

“বাহ্ বা জেদি বাচ্চা।”। ডাক্তার ঘুমন্ত রাহমিদকে আদর করে বললেন। পরক্ষণেই মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলেন,

“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?”

“জি করুন।”

“আপনার বাবা, মা কেউ আসলো না যে। আপনি ওর ভাই বুঝলাম কিন্তু আপনার মা, বাবাকে তো বাচ্চাটার এই অবস্থায় দেখলাম না? ওনারা নিশ্চয় চাকরি করেন তাও একটা বাচ্চাকে এভাবে হেলায় ফেলে রেখে একদমই ঠিক করেননি তারা। ওনারা এখানে আসলে ওনাদের এই বিষয়ে অবগত করতাম। এছাড়াও বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় বুকের দুধ বেশি বেশি খাওয়ানো লাগবে। মায়ের দুধ বাচ্চাটার জন্য এখন খুবই জরুরি। বাচ্চাটাকে দেখলে মনে হয় বুকের দুধ পায়না। এটা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার বিষয় না। দয়া করে আপনার মা, বাবাকে এসব বিষয়ে সতর্ক হতে বলবেন।”

রায়হান এতক্ষন নির্জীব মূর্তির মতো বসে ছিল। এত ভারী কথার বিপরীতে সে কি বলবে ভেবে পেলো না। সে বহু কষ্টে মুখ খুলে বললো,

“বুকের দুধ কি খাওয়ানো জরুরি? এর পরিবর্তে কি খাওয়ানো যেতে পারে?”

“মায়ের দুধের মতো উপকারী ওষুধ আল্লাহ্ তায়ালা এই দুনিয়ায় আর একটিও পাঠান নি। আল্লাহ্ তায়ালার এক বিচিত্র সৃষ্টি। এতে অনেক পুষ্টি বিদ্যমান আছে। বাচ্চাদের রোগ অসুখে এটি এন্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে বুঝলে ইয়াং ম্যান।”

“আসলে ওর মা, বাবা নেই তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম।” রায়হান মুখ নামিয়ে মিনমিন করে বললো।

ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর রায়হানের কথার মানে বুঝতে পেরে নিজের মধ্যে অনুশোচনা হতে লাগলো। এতক্ষণ এতো ডায়ালগ একটা অনাথ, এতিম ছেলেকে শুনাচ্ছিলেন তিনি। তাও আবার রূঢ় ভাষায়। ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে আসলো। তারপর বললেন,

“সরি ইয়াং ম্যান। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। ওকে যা খাওয়াতে তাই খাইয়ো। বেশি করে পুষ্টি জাতীয় খাবার দিও। খেতে না চাইলে জোর করে হলেও খাওয়াতে হবে নাহলে বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে পড়বে। যদি পারো একটু গাভীর খাঁটি দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করো কেমন। কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ কোরো। যে ওষুধ গুলো লিখে দিয়েছি টাইম টু টাইম খাওয়াবে ঠিক আছে।”

“জি আচ্ছা।”
_____
—-

রায়হান বাসায় প্রবেশ করে দেখলো রুদ রোমানা আন্টির রুমের তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ ফোলাফোলা বাচ্চাটার। জয়নব বেগম পাশে বসে থালা বাসন ধুচ্ছেন। রায়হান দ্রুত রুদের কাছে এগিয়ে গেলো। ওকে দেখে রুদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদে দিয়েছে বাচ্চাটা। জয়নব বেগম উঠতে গেলে দেখলেন রায়হান এসেছে। উনি আর না গিয়ে বসে পড়লেন। ভেবেছিলেন বাচ্চাটা আবার পড়ে গিয়েছে বোধহয়। যাক নিশ্চিত হলেন তিনি। রায়হান রুদকে নানা রকম কথা বলছে। আদর করে বলছে,

“কি হয়েছে আমার রুদ সোনার। ভাইয়ু এসে পড়েছি তো। কাঁদে না রুদ পাখি।”

রুদ কেঁদে কেঁদে ভাড়াটিয়া রোমানার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছে। রায়হানের মনে হলো সে না থাকায় এরা কিছু করেছে নাকি রুদের সাথে। এতটুকু বাচ্চার সাথে কার লাগলো আবার। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়েই নিচে বসে পড়লো। রুদকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে বললো,

“কি হয়েছে? কেউ বকা দিয়েছে তোমায়। কি চায় আমার রুদ সোনা?”

“আমু, আবু চাই। ওই আন্ট তার বাবু আদুর করে। আমার আমু, আবুও আমায় আদুর কুরতো। এখুন আমাকে কেউ আদুর করে না। তুমি কি আমার জন্ন আমু, আবু এনিছো?”

রোমানাদের ঘর দেখিয়ে রুদ বাচ্চা গলায় বলে উঠলো। তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কান্না চোখে উত্তরের আশায়। রায়হানের বুক কেঁপে উঠলো। চোখ দুইটা ভিজে গেলো। রুদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। বাচ্চাটার কথা শুনে জয়নব বেগমের হাত সেই কখন থেমে গেছে। তারও চোখ ভিজে গেছে। কালকে কিভাবে যে বাচ্চাটাকে সামলিয়েছে সে আর আল্লাহ্ জানেন। ভাইয়ের জন্য, বাবা, মায়ের জন্য কেঁদে অস্থির করে তুলেছে তাকে আর আফজাল হোসেনকে। কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? জীবন তাদের কোথায় দাঁড় করায় সেটাই দেখার বিষয়।
_____
—–

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। রায়হান এই কয়েকদিনে নতুন জীবনের সাথে খুব ভালোভাবে না হলেও মোটামুটি ভালোই পরিচিত হয়েছে। জীবন তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। সংগ্রাম করে কিভাবে বাঁচতে হয় সব আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যেন। রায়হান এডমিশন পরীক্ষা দিবে আজ। তার জীবনের একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে সে। ভাত রান্না করতে করতে এসব ভাবছে। এখন আর জয়নব বেগমদের সাথে খায়না রায়হান। শরম লাগে। আর কয়দিন তাদের ঘাড়ে বসে খাবে। বাজারে যায় প্রতিদিন। তার বিনিময়ে চাল, ডাল নেয় রায়হান তাদের থেকে। এখন টুকটাক বাজার করা শিখেছে সে। তবুও হাজার ভুল হয়। দিলদার শিখিয়ে দেয় কখনো, আবার রেগে যায় কখনো। এই কয়দিনে রায়হান অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। আগের রায়হান আর এই রায়হানের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। যে ছেলেকে রাজপুত্রের মতো লাগতো তার চেহারা এখন মলিন। পড়নের পোশাক পুরাতন। পুরোনো হয়ে গেছে কিন্তু কিনার সামর্থ্য নেই। একটা শার্ট আছে। একটু নতুন। ওটা পড়েই আজ পরীক্ষা দিতে যাবে সে। রাহমিদ ঘুমাচ্ছে। সারা রাত জ্বালিয়েছে সে। রায়হান পড়েছে আর ওকে সামলেছে। রাহমিদ এর মধ্যে ওর বইয়ের পাতাও ছিঁড়ে ফেলেছিল একটা। মাগো কি রাগ! এটা ভেবেই রায়হান হেঁসে দিলো। ভাড়াটিয়া একজন বলে উঠলো,

“কি ছেলে, কতক্ষন লাগবে রাঁধতে। চুলা খালি করো আমারও তো রাঁধবো। বেলা গড়ালো বলে। সাতটা বেজে গেছে প্রায়। তোমার আংকেলকে খাইয়ে পাঠাতে হবে তো। তাড়াতাড়ি করো।”

এতক্ষণ যিনি কথা বললেন তিনি ভাড়াটিয়া লাবনী আন্টি। ওনার কথা খুব সাবলীল। রুদকে ভীষণ আদর করেন। ঝামেলার মধ্যে বেশি একটা থাকেন না। রায়হান কোনো কথা না বলে দ্রুত ভাতের মাড় গাললো। তরকারি কালকে রাতের টাই গরম করলো। তরকারি আর কি ওই তো ডাল আর আলু ভর্তা। জয়নব বেগম একটু মুরগির গোশত দিয়েছিলেন সেটা দিয়ে রুদকে ভাত খাইয়েছে। আর যেটুকু বাকি ছিল সেটা রেখে দিয়েছিল। এখন ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিবে। রাহমিদকেও ভাত চটকে পানি দিয়ে নরম করে খাওয়াবে। একটু ডানো দুধ কৌটায় থাকলে সেটা পানি দিয়ে গুলিয়ে খাইয়ে দিবে যদি থাকে আর কি। এসব ভেবে ভেবে দ্রুত কাজ শেষ করলো। হাতও পুড়িয়ে ফেললো কয়েক জায়গায়। আগে জ্বললেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
______
—-

রায়হান পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় রাহমিদ ভীষণ চিল্লালো। কিছুতেই ভাইকে ছাড়া থাকবে না সে। জয়নব বেগমের কোলে বসে ভাইয়ের কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। কঠিন কান্না জুড়ে দিয়েছে সে। রায়হানের এটা দেখে এতো কান্না পেলো। মনে হলো ভাইকে রেখে কিভাবে পরীক্ষা দিবে সে। তার যে কলিজা পুড়ছে। রায়হান কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে আদর করলো। তারপর জয়নব বেগমকে দিতে গেলে রাহমিদ শক্ত করে গলা জড়িয়ে রাখলো। জয়নব বেগম কিছুতেই বাচ্চাটাকে কোলে নিতে পারলেন না। রুদ ছোট ভাইয়ের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে দিলো। তার মনে হলো ভাইও বুঝি মা, বাবার মতো আদর করে চলে যাবে আর ফিরবে না। রায়হানের এখন অসহায় লাগছে। এভাবে ছোট ভাইবোনদের কাঁদিয়ে কিভাবে পরীক্ষায় বসবে সে। ওদিকে পরীক্ষার সময়ও হয়ে যাচ্ছে। আফজাল হোসেন বুঝলেন ওর মনের ভাষা। রায়হানের কাছে গিয়ে দ্রুত রাহমিদ কে কোলে নিলো। রাহমিদ চিৎকার করে উঠলো। আফজাল হোসেনকে খামচি দিয়ে লাল বানিয়ে ফেললো। রায়হান কান্না চোখে চেয়ে দেখলো। আফজাল হোসেন বললেন,

“তুমি আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। ওদেরকে তোমার আন্টি দেখবে। আমরা আছি। চিন্তা না করে ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবা। এদিক ওদিক না তাকিয়ে যা পারো লিখবা। দোয়া দুরুদ পড়ে লিখা শুরু করবা। তাহলে আল্লাহ্ তায়ালাই উপর থেকে ফয়ছালা করে দিবেন। আমার আর তোমার আন্টির দোয়া থাকবে। যাও আল্লাহর নাম নিয়া বের হয়ে যাও। দিলদার তোমার সাথে যাবে। ভয় পাবে না। আল্লাহ্ হাফেজ।”

আফজাল হোসেনের কথা শুনে মনে কিছুটা সাহস পেলো রায়হান। তারপর রুদকে আদর করে বের হয়ে পড়লো। রাহমিদকে আর ধরলো না। বাচ্চাটা ননস্টপ চেঁচিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। রায়হানের বুক ভারী হলো। রাস্তায় হাঁটছে আর ওর কান্না শুনতে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাচ্চাটার কান্না মিলিয়ে গেলো। রায়হান আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

“হে পরওয়ারদিগার, আমার ভাইবোনকে দেখে রাইখেন। আপনি আমার ভাইয়ের কান্না কমিয়ে দেন। আপনি তো সবই পারেন মালিক। হে আল্লাহ আমাকে সাহস দেন, শক্তি দেন এইসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। হে আল্লাহ, আপনার সৃষ্টির কান্না আপনি কমিয়ে দেন পরওয়ারদিগার।”

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৪
#তাজরীন_ফাতিহা

বিকেল চারটা বাজে। বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরলো রায়হান। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের ভিজে শার্ট লেপ্টে রয়েছে শরীরে। বাসায় ঢুকেই চোখে পড়লো দুই ভাইবোনের দিকে। বিছানায় খেলা করছে দুইজন। রাহমিদ খেলছে কম কাদঁছে বেশি। একটু পর পর কেঁদে উঠে আর বোনের কোলের মধ্যে গড়াগড়ি খায়। রুদ ভাইকে আদর করে দেয়। রাহমিদ আবার কান্না থামিয়ে বোনের মুখের দিকে তাকায় মুখে আঙ্গুল ভরে। রুদ ওর তাকানো দেখে গাল টিপে আদর করে দেয়। রাহমিদ গাল ফুলিয়ে তাকায়। বোনের এই গাল টিপা তার পছন্দ হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। সেটা দেখে রুদ গালে আদর করে দেয়। রাহমিদ আবার কি মনে করে যেন কেঁদে ওঠে। রুদ নিজের বাচ্চা বাচ্চা হাত দিয়ে ভাইকে কোলের মধ্যে কোনরকম টেনে নিলো আর বললো,

“বাবুন এতু কাঁদে কেনু? বাবুনকে মিরেছে কে? বাবুনের আপি বাবুনকে আদুর করে তো। কাঁদে না বাবুন, কাঁদে না। ভাইয়ু আসি পড়বে।”

রাহমিদ বোনের কথা শুনে চুপ করে মুখে আঙ্গুল ভরে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে বোনের চুল ধরে টান দিলো। রুদ ব্যথা পেয়ে চিৎকার দিলো। রাহমিদকে সরিয়ে দিয়ে ধমক দিলো,

“আবার চুল টান দিয়েছু কেনু পুঁচা ছিলে। পিট্টি দিবো।”

রাহমিদ বোনের ধমকে আবারও কেঁদে দিলো। এতক্ষণ রায়হান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাইবোনের আদুরে মুহূর্ত দেখছিলো। ভাইয়ের কান্নার শব্দে তার ঘোর কাটলো। সে দ্রুত রুমে ঢুকে ভাইকে কোলে তুলে নিলো। রাহমিদ কান্নার তালে বুঝতে পারলো না কে কোলে নিয়েছে। সে ভেবেছে আবারও জয়নব বেগম কোলে নিয়েছে। সে তাই আরো জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান কোলে নিয়ে আদর করে বলতে লাগলো,

“ভাইয়ু এসে গিয়েছি তো টোটন সোনা। আমার কলিজা কাঁদে কেন? আমার কলিজাকে কে কাঁদিয়েছে? কার এতো বড় সাহস আমার টোটনকে মারে, বকে? ভাইয়ু মেরে দিবো তাকে ঠিক আছে।”

রায়হান ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে কান্না থামিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রুদ রায়হানকে দেখে খাট থেকে নেমে ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান বোনকে আগলে নিলো। জয়নব বেগম ফিটারে দুধ ভরে এনে দেখলেন রায়হান এসে গেছে। তিনি ফিটার টা ঠাণ্ডা করে এনেছেন। রায়হানের হাতে দিয়ে বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ তুমি আইসা পড়ছো। তোমার ভাই তো তুমি যাওনের পর একমিনিটও কাঁন্দন থামায় নাই। কেমনে সামলাইছি আল্লাহ্ জানে। তোমার বইনের কাছে গেলে একটু কাঁন্দন থামায় নইলে কাঁনতেই থাহে। থামাথামি নাই কোনো। যাক চিন্তা মুক্ত হইলাম। তোমার পরীক্ষা কেমন হইছে?”

“জি আলহামদুলিল্লাহ দিয়েছি যতটুকু পেরেছি।”

“আইচ্ছা। পোশাক ছাইড়া লও। ঘাইমা গেছো তো একবারে। আমি ভাত দিতাছি।”

“না আন্টি ভাতের দরকার নেই। আমি রেঁধে নিবো।”

“কেমনে রাঁধবা এই কেলান্ত শরীলে। বেশি কতা না কইয়া গোসল কইরা আহো। ওরে দুধ খাওয়াইতে পারি নাকি দেহি। যাও। বেশিক্ষণ ভেজা শরিলে থাকন ভালা না।”

রায়হান রাহমিদকে কিছুক্ষণ আদর করে টয়লেটে চলে গেলো। রাহমিদ আবার কাঁদতে লাগলো। রায়হান দ্রুত গোসল শেষ করে এসে রাহমিদকে কোলে নিলো। বাচ্চাটা দুধ খায়নি। সে এসে মুখে ফিটার দিলো। ভাইয়ের কোলে শান্ত বাচ্চার মতো পড়ে রইলো রাহমিদ। রায়হান রুদকে কাছে ডেকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে কপালে গালে আদর করলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“বাবুন জ্বালিয়েছে পাখি? ভাইয়ুর উপরে রাগ করেছো বাচ্চা?”

“নো। বাবুন চুলি বিথা দিছে। বাবুন কিছু খাইনি সারাদিন। এট্টু ফিটার খিয়েছে শুধু। তুমি কুই ছিলে ভাইয়ু?”

“ভাইয়ু পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম সোনা। তুমি খেয়েছো কিছু?”

“খিয়েছি। ভাত আর গুস্তো।”

রায়হান বোনকে জড়িয়ে রাখলো। বাচ্চাগুলোর প্রতি এই কয়দিন একেবারেই খেয়াল রাখা হয়নি। রাহমিদ চোখ পিটপিট করে ভাই বোনের কথা শুনছে। ফিটার দুই হাত দিয়ে ধরে চুক চুক শব্দ করে দুধ খাচ্ছে সে। ভাইয়ের কোলে একেবারে শান্ত বাচ্চার মতো পড়ে আছে অথচ সারাদিন ছিল অশান্ত অগ্নিগিরি লাভা।
_____
—-

জয়নব বেগমের মেয়ে আয়েশা ও তার শাশুড়ি এসেছে বেড়াতে। আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগম দম্পত্তির একটি কন্যা। আরও দুইজন ছেলে মেয়ে ছিল। মেয়েটা পাঁচ মাস বয়সে মারা যায় টাইফয়েডে আর ছেলেটা তিন বছর বয়সে পানিতে পড়ে। আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগম প্রচুর ভেঙে পড়েছিলেন। দুইজন সন্তান, কলিজার ধনের অকাল মৃত্যু জয়নব বেগমকে খুবই ব্যথিত করে। প্রথম প্রথম আফজাল হোসেন জয়নব বেগমকে কিছুতেই মানাতে পারতেন না। সেই দিন গুলো তাদের কাছে ছিল অসহনীয় বেদনায় মোড়ানো। সেইসব স্মৃতি কখনোই ভোলার মতো না। এখনো জয়নব বেগমের কাছে দিন গুলো কেমন তাজা। পরে আল্লাহ্ তায়ালার উপর ভরসা করে তিনি নিজেকে সামলেছিলেন। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সেই হাদিস তাকে প্রশান্তি দেয়।

“যে ব্যক্তির দুইটি বা তিনটি সন্তান ছোট বা নিষ্পাপ অবস্থায় মারা যাবে তার জন্য জান্নাত ফরজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ওই সন্তানগুলো জাহান্নামের ঢাল হবে।” (বুখারী)

এই হাদিসটি জয়নব বেগমকে শান্তি ও আশ্বাস দেয়। রায়হানদের দেখে প্রথমেই তার সন্তানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তাদের জন্য জয়নব বেগমের অনেক মায়া কাজ করতো। চোখের সামনে মৃত সন্তানের বয়সী এতিম ছেলেমেয়েদের দেখলে কোনো মানুষই মায়া না দেখিয়ে থাকতে পারবে না। পাষাণ ব্যক্তির মনও গলে যাবে। আর আফজাল হোসেন দম্পত্তি তো দিল খোলা মানুষ। আসলে আমাদের সমাজে ধনীদের তুলনায় গরীব মানুষদের মনে মায়া মহব্বত বেশি। নাহলে তো রায়হানের মতো মানুষদের এই দুনিয়ায় টিকে থাকাটা দুষ্কর হয়ে পড়তো। আয়েশার শাশুড়ি আসাতে আফজাল হোসেন বাজার করে এনেছেন নিজের সাধ্যের মধ্যে। মেয়ের শশুরবাড়ির লোকজনকে ভালো খাওয়াতে না পারলে, মাসে মাসে কিছু না পাঠালে কত কথা শুনতে হয় মেয়েকে। মেয়ের জামাইয়ের আড়তের ব্যবসা আছে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেই কন্যা সম্প্রদান করেছেন আফজাল হোসেন। মেয়েটা খুব বেশি একটা বাবার বাড়ি আসতে পারেনা। আসলে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলে বাবা মায়ের আর অধিকার থাকে না মেয়ের উপর। তখন মেয়ে হয়ে যায় বাবার ঘরের মেহমান। জয়নব বেগম রান্নাবান্না করছে। মুরগি ধুয়ে কাটা বাছা করে কাটতে লেগে গেলেন তিনি। আয়েশা মায়ের হাতে হাতে কিছু এগিয়ে দিচ্ছে। জয়নব বেগম মানা করেছিলেন তাও শুনেনি। এতো রান্না মা একা করবে আর সে বসে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাবে এটা কখনোই সে মানবে না। জয়নব বেগম আর কথা বাড়াননি। আয়েশা পোলাওয়ের চাল ধুয়ে আনলো। আয়েশার শাশুড়ি সেলিনা পারভীন জয়নব বেগমদের ঘরে শুয়ে আছেন। এই বাসায় আসলেই তার বিরক্তি ধরে যায়। ছোট ছোট রুমে কিভাবে এরা থাকে। উনি কখনোই এই বাসায় রাত কাটান না। ছেলেকেও কাটাতে দেন না। এবার এসেছেন ভিন্ন এক কারণে। বেয়াই নাকি অনাথ আশ্রম খুলে বসেছেন। সেটাই দেখতে এসেছেন। নিজেদেরই চলে না আবার তিন তিনটা ছেলে মেয়ের ভরণপোষণ সামলাচ্ছেন তিনি। এমনিতে তো নিজের মেয়ের জামাইকে কিছু দিতে ওনার হাত কাঁপে। তখন নানা বাহানা দেয়া শুরু করে আর এখন নাকি কোথাকার কোন এতিম অনাথদের উঠিয়ে এনেছে। তাদেরকে পালছে। তাও আবার চার মাস ধরে ভাবা যায়। তাদেরকে এসব জানায় পর্যন্ত নি। তার স্বামী হামিদ আলী নাকি কার কাছ থেকে শুনেছেন। এসব ভেবেই সেলিনা পারভীন রাগে দিশেহারা হয়ে পড়েন। এর একটা বিহিত করতে হবে।
_____
—–

রায়হান দুটো টিউশনি করায়। টিউশনি অবশ্য রুস্তম ভাই জোগাড় করে দিয়েছেন। তার চেলা আব্বাসের আত্মীয়ের বাড়িতে একটা আরেকটা বাচ্চুর পাড়ার এক ছোট ভাই। রায়হান টিউশনি করাতে যায় রাহমিদকে নিয়ে। বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগে রাহমিদ ঝুলতে থাকে আর ভাই স্টুডেন্ট পড়াতে থাকে।মাঝে মধ্যে গরম লাগলে চেঁচিয়ে উঠে। স্টুডেন্টের মা প্রথমে মানতে নারাজ। বাচ্চা নিয়ে টিউশনি করায় নাকি কেউ? বাচ্চা চিৎকার করবে, টয়লেট করবে, খেতে চাইবে এতে করে বাচ্চার দিকে মনোযোগ বেশি থাকবে স্টুডেন্ট আর কি পড়াবে? এসব ভেবে দুইজন স্টুডেন্টের অভিভাবকই নাকচ করে দিয়েছেন প্রথমে। কিন্তু রুস্তম ভাইয়ের কাছে রায়হানের করুন কাহিনী শুনে মন তাদের কিছুটা গলেছে। তবুও শর্ত জারি করে দেয়া, তাদের সন্তানের পড়লেখার কোনো ক্ষতি যেন না হয়। বাচ্চা যেন অহেতুক চিল্লাচিল্লি না করে। রায়হান সব শর্ত মেনেছে কিন্তু বাচ্চা কি আর শান্ত থাকার জিনিস। রাহমিদ সাহেব ভাই পড়ানো শুরু করলে ভাইয়ের সাথে সাথে অস্পষ্ট আওয়াজে নানান কথা বলতে থাকে। রাহমিদ এখন মোটামুটি কিছু কথা বলতে পারে। হাঁটতেও পারে কিছুটা। তবে তিনি হাঁটতে রাজি নন। ভাইয়ের কোলে চড়তেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রুদকে জয়নব বেগমের কাছেই রেখে যায় সে। রায়হান রুদকে শান্ত বাচ্চার মতো বাসায় থাকতে বলে। এর বিনিময়ে প্রতিদিন চকলেট নিয়ে আসে বোনের জন্য। বোনটার দেখাশুনা তেমন করতে পারেনা সে। টিউশনি করিয়ে এসে রান্না করা, ভাই বোনের জামাকাপড় ধোয়া এসব করতে করতেই ক্লান্তি ধরা দেয় শরীরে। পরে আর ভাই বোন কারোর প্রতি কোনো যত্নআত্তি করতে পারেনা সে। রুদ প্রথম প্রথম কাঁদতো খুব। বড় ভাই ছোট ভাইকে নিয়ে চলে যায় কেন প্রতিদিন? পরে রায়হান বুঝিয়েছে অনেক। রাহমিদকেও নিতো না কিন্তু ও তো ছোট। একা থাকতে পারবে না। খালি কাঁদবে তাই ওকে নিয়ে যায়। রাহমিদ একটু বড় হোক ওকেও বাসায় রেখে যাবে রায়হান। এরকম নানা কথা বলে রুদকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে। রুদ ভাইয়ের কথা মেনে নিয়েছে এখন। রায়হান আজকেও ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কয়েকদিন ধরে এরকম বিধ্বস্ত হয়েই সে বাড়ি ফেরে। ভার্সিটির রেজাল্ট দিবে পরশু। সেই নিয়ে চিন্তিত রায়হান। আল্লাহর উপর ভরসা করে আছে। নামাজের পর দোয়া তো আছেই। ভালো একটা ভার্সিটিতে যেন চান্স হয়ে যায়। বেশি কিছু চাওয়ার নেই তার। আল্লাহ্ তায়ালা তার ভাই বোনকে নিয়ে চলার একটা গতি করে দিক। এটাই চাওয়া। এসব ভেবেই রায়হান রুমে ঢুকে দেখে রুদ বালিশে মুখ ঢুকিয়ে কান্না করছে। রুদ তো সচরাচর কাঁদে না হঠাৎ আজ এভাবে কাদঁছে কেন? রায়হান রুমে ঢুকে রাহমিদকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালো। তারপর রুদের কাছে গিয়ে ওকে বিছানা থেকে উঠিয়ে কোলে নেয়। আদর করতে করতে জিজ্ঞাসা করে,

“কি হয়েছে রুদ। কাঁদে কেন আমার পাখিটা?”

রুদ ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে। রায়হান মনে করলো সে দেরি করে আশায় বোধহয় বাচ্চাটা কাদঁছে। তাই সে বললো,

“কাঁদে না রুদ। তুমি না ভাইয়ুর স্ট্রং সিস্টার। এইতো ভাইয়ু এসে পড়েছি। আর কাঁদে না সোনা।”

এরকম নানা কথা বলে রুদের কান্না থামালো রায়হান। কান্না কিছুটা কমে এলে রায়হান বললো,

“রুদকে না ভাইয়ু বুঝিয়েছি। ভাইয়ু কাজ করে তো সোনা। কাজ না করলে খাবো কি? তুমি না বলেছো আর কাঁদবে না তাহলে আজকে কাঁদলে কেন? স্ট্রং গার্লরা কখনো কাঁদে না পাখি। আর কাঁদবে বলো?”

“এক আন্টি বুকা দিছে। আমাকে ধাক্কা দিছে। হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছি। আমি কিছু করিনি। এট্টু মুখ ধুতে গেছি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছে। রেগে রেগে অনেক কিছু বলিছে। আমি কান্না করলে নাকি আরও মারবে তাই দৌঁড় দি ঘরে এসে বালিশি মুখ ঢুকিয়ে কানছি। কান্নার আউয়াজ যাতে কম হয়। পরে আবার মারলে। ইখানে বিথা।” রুদ হাঁটু দেখিয়ে বললো।

রায়হান কথা বলতে ভুলে গেলো। জামা উঠিয়ে দেখলো হাঁটু অনেক খানি ছিলে গেছে। রক্ত বার হয়নি। বাচ্চাটা ব্যথায় কান্না করছে। যে রুদ একটু ব্যাথা পেলে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিতো আজ সেই রুদ কারো মারের ভয়ে চুপিচুপি কেঁদেছে যাতে আবার মার না খায়। তার বোনটা কি বড় হয়ে গেলো অনেক। তার ভাই বোনের নসিবে এসবই কি লিখা ছিল? এতিম হয়ে রাজকীয় ঘর ছেড়ে বস্তিতে থাকছে, মানুষের মার, লাথি উষ্ঠা খাচ্ছে এসবই কি তাদের কপালে লিখে রেখেছেন আল্লাহ্। রাহমিদ চিৎকার করে কান্না করছে। রুদ ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে আর সে অদৃষ্টের পরিহাস দেখছে।

চলবে….

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১২

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১২
#তাজরীন_ফাতিহা

আজকের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। চারপাশে কেমন ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এমন পরিবেশে আত্মা জুড়িয়ে যায়। রায়হানের এই রকম আবহাওয়া বরাবরই প্রিয় কিন্তু আজকে রায়হানের এই সুন্দর চারিপাশ বিষাক্ত ঠেকছে। রাহমিদটার জ্বর, ঠাণ্ডা। নাজেহাল অবস্থা প্রায়। বাচ্চাটা থেকে থেকে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠছে, কাশি দিচ্ছে। যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছেনা বাচ্চাটা। রায়হান ওকে কোলে নিয়ে গায়ের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটার কান্না থামছে না। রায়হানের অস্থির লাগছে। কয়েকদিন পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে গিয়ে বাচ্চাগুলোর প্রতি যত্ন নিতে পারেনি সেভাবে। রায়হান এডমিশনের জন্য জান প্রাণ লাগিয়ে পড়ছে। সেদিনের পর বিশ দিন কেটে গেছে। আর কিছুদিন পরই এডমিশন পরীক্ষা। আফজাল হোসেনের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নীলক্ষেত থেকে সস্তা মূল্যে এডমিশনের বই কিনে এনেছে সে। দিলদার ভাই অবশ্য এই নীলক্ষেতের ঠিকানা দিয়েছিল। এখানে নাকি সস্তায় বই পাওয়া যায়। এটা শুনে রায়হান দিলদারকে নিয়ে বই কিনে এনেছে। দিন রাত এক করে পড়ছে সে। তাকে একটা ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেতেই হবে। কিন্তু পড়ালেখায় সময় দিতে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে সময় দিতে পারছে না সে। এটা তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে। মনে হচ্ছে পড়ালেখা করার দরকার নেই আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে পড়ালেখা না করলে এই ভাইবোনদের সে কিভাবে মানুষ করবে। দুনিয়াটা যে সোজা না এটা সে গত কয়েকদিনে বুঝে গিয়েছে। রাহমিদ রায়হানের কোলের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। বাচ্চাটার শরীর গরম অনেক। কিভাবে যে জ্বর আসলো জানা নেই রায়হানের। আর এমনিতেও বাচ্চাদের রোগ শোক লেগেই থাকে। রায়হান জলপট্টি দিলো। রাহমিদ টা জ্বরের ঘোরে খালি কান্না করছে। রায়হান রাহমিদকে কোলের মধ্যে নিয়ে ঝাপটে ধরে জলপট্টি দেয় আর বলে,

“আমার টোটনের কি হয়েছে। আল্লাহ্ আমার টোটনকে ভালো করে দাও। ও রাহমিদ, রাহমিদরে, আমার কলিজা ভাইয়ু তোমায় সময় দেয়নি দেখে জ্বর বাধিয়েছো। ভাইয়ু পঁচা তাই নারে।”

রাহমিদের কান্না কোনোভাবেই থামার নয়। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। রায়হানের অস্থির লাগছে ভীষণ। কি করবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না। কিভাবে জ্বর কমাবে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? কিছু টাকা আছে এতেই হয়ে যাবে বোধহয়। নাহ্ আর বসে থাকা যায় না। এসব ভেবেই দাঁড়িয়ে পড়লো রায়হান। আবহাওয়া যদিও ভালো না তবুও ঘরে বসে থাকলে সমাধান হবে না। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে বের হলো। রুদকে জয়নব বেগমের কাছে দিয়ে যাবে ভাবলো। জয়নব বেগম কলপাড়ে হাঁড়ি পাতিল মাজছিলেন। রায়হান সেখানে গিয়ে বলে উঠলো,

“আন্টি?”

জয়নব বেগম ফিরে চাইলেন। বললেন,

“কি হইছে বাবা? কিছু লাগবো?”

“রাহমিদের অনেক জ্বর। জলপট্টি দিয়েছি কাজ হয়নি ওকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। বাচ্চাটা মারাত্মক কান্না করছে? রুদকে যদি একটু দেখতেন।”

জয়নব বেগম বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। রাহমিদের গালে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

“হায় হায় এত জ্বর? কহন থেইক্কা এমন?”

“সকাল থেকে। এমনিতেও কয়েকদিন ধরে খাবার দাবারে প্রচুর অরুচি ওর। প্রথম এত পাত্তা দেইনি আবার টাকারও ব্যাপার ছিল। চাইলেও ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারিনি কিন্তু আজকে সকাল থেকে এত জ্বর যে কিছুতেই কমে না। তাই ভাবলাম একটু ডাক্তার দেখিয়ে আনি।”

“ঠিক আছে যাও। তয় টেকা আছে তোমার তে?”

“কিছু আছে আন্টি।”

“ওই টেকায় হইবো? খাড়াও এহানে।”

“আন্টি হয়ে যাবে। আর লাগবে না। শুধু শুধু আপনার টাকা দেয়ার প্রয়োজন নেই।”

“তাও লইয়া যাও। যদি লাগে। পড়ে দিয়া দিও তোমার টেকা হইলে।”

কথাটা বলেই জয়নব বেগম দ্রুত ঘরে গেলেন। ঘরে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে এসে রায়হানের হাতে দিলেন। রায়হান নিতে চায়নি কিন্তু তিনি জোর করে দিয়ে দিয়েছেন। রাহমিদ কেঁদে যাচ্ছে একনাগাড়ে। রায়হান আর দেরি না করে দ্রুত ফার্মেসিতে রওনা দিলো।
____
—-

“হাওয়া মে উড়তা রাহে,
মেরা লাল দুপাট্টা মাল মাল
মেরা লাল দুপাট্টা মাল মাল।
ওহো ওহো”

চায়ের দোকানে বসে রুস্তম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গান গাচ্ছে। ভুলভাল গান। তাও আবার বাকের ভাইয়ের বিখ্যাত গান। রুস্তম আবার বাকের ভাইয়ের বিরাট ভক্ত। কাজ কাম সব বাকের ভাইকে কপি করে করে সে। হাতে, গলায় চেইন দিয়ে মুড়ানো। হাতে চায়ের কাপ। তার দুই চেলা বাচ্চু আর আব্বাস ঘাড় টিপে দিচ্ছে। দিলদার মোবাইলে টাকা ভরে হোটেলে যাচ্ছিলো। এর মধ্যেই এই আজাইরাদের দেখা। ফোনে টাকা শেষ হওয়ার আর সময় পায়নি। দিলদারের মনে হলো এই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাবে যদিও পথ বড় হবে তাতে কি এদের থেকে তো মুক্তি পাবে। পুরাই বিরক্তিকর একটা গ্যাং। দিলদার উল্টো পথ ধরতেই দেখলো রুস্তমের আরেক চেলা এইখানেই আসছে। এসেই দিলদারকে বললো,

“কিরে হোটেল তো সামনে তুই এই পথ দিয়ে কই যাস?”

কথায় আছে না “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়” কথাটা একেবারে দিলদারের সাথে খাটে। দিলদার কাচুমাচু করে বললো,

“সবুজ ভাই সামনে একটু কাম আছে তাই যাইতাছি আরকি।”

“কিন্তু তোরে দেখলে তো তা মনে হয়না। কেমন চোরের মতো লাগতেছে।”

শুরু হয়ে গেছে অপমান করা। এসব সহ্য করা যায় না। শেষ পর্যন্ত চোর। দিলদার বললো,

“না ভাই সত্যই কাম আছে।”

“আইচ্ছা যাবি নে। আগে ভাইয়ের লগে দেহা কইরা যা।”

গোদের উপর বিষফোঁড়া। যে ভয়টা দিলদার পাচ্ছিলো সেটাই হলো। সবুজ ওকে টানতে টানতে রুস্তমের সামনে আনলো। রুস্তম চায়ে চুমুক দিয়ে ওর দিকে তাকালো। দিলদার চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বাচ্চু ওকে বললো,

“কিরে চেগাইয়া খাড়ায় আছোস কেন? সালাম দে ভাইরে।”

দিলদার সালাম দিলো। রুস্তম চা খেয়ে বললো,

“কিরে বগা, এহানে কি তোর?”

দিলদারের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আবারও অপমান। সে বললো,

“একটা কাম আছিলো ভাই তাই।”

“কি কাম আবার। যাউকগা হুন। দেখতো আমারে কেমন লাগতেছে।”

রুস্তম পোজ দেয়ার চেষ্টা করলো। দিলদারের বলতে ইচ্ছা করলো, “ভাই বান্দর দেখছেন, বান্দরের থেকেও বিশ্রী।” কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। আব্বাস বলে উঠলো,

“কিরে কস না কেন? ভাইরে হেব্বি লাগতেছে না।”

দিলদার হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু হাসাটা ঠিক ফুটে উঠতে চাইলো না মুখে। বললো,

“হ ভাই হেব্বি।”

এর মধ্যেই কে যেন ডেকে উঠলো,

“দিলদার ভাই?”

দিলদার ও রুস্তমের সব সাঙ্গপাঙ্গ রা ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিলদার দ্রুত সেখানে গিয়ে বললো,

“রায়হান তুমি এইহানে কি করো?”

“ভাই রাহমিদের অনেক জ্বর। ওরে নিয়ে ফার্মেসিতে গিয়েছিলাম। উনি বলছে হাসপাতালে ভর্তি করতে। অবস্থা নাকি ভালো না। আমি তো হাসপাতাল চিনি না এখানকার তাই আপনাকে দেখে ডাক দিছি।”

কথাগুলো বলতে বলতে রায়হান কেঁদে দিলো। ভাইয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে সে। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে গেছে। রায়হান কি করবে দিশা না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন দিলদারের কথা শুনে তাকে ডাক দিয়েছে। রুস্তম এতক্ষন রায়হানের কথা শুনছিল। আব্বাস বলে উঠলো,

“ভাই এই পোলারেই হেদিন দিলু কতা হুনাইতেছিল।”

বাচ্চু বলে উঠলো,

“এ মনে ওয় দিলুর পরিচিত। আহারে পোলাডার চোক্ষে কি মায়া। বাচ্চাটা কানতাছে।”

রুস্তম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেখানে গিয়ে কাহিনী জানলো। তারপর এখনকার একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো।
_____
—-

রায়হান হাসপাতালের বেডে রাহমিদকে নিয়ে বসে আছে। বাচ্চাটার হাতে স্যালাইন লাগানো। সরকারি হাসপাতাল গুলোর এই এক সমস্যা। অনেক ভিড়। অনেক গুলো বেড এক রুমের মধ্যে। ডাক্তার রাহমিদকে দেখে বলেছেন, বাচ্চাটার নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারতো আর একটু দেরি করে ভর্তি করালে। খাবারে অনিয়ম বাচ্চাটার শরীর ভেঙে আরও অসুস্থ করে ফেলেছে। ঘন ঘন গোসল, ভিজা জামাকাপড়ে থাকলে নাকি নিউমোনিয়া অনেক মারাত্মক আকার ধারণ করে। রায়হান মনে করে দেখলো গত কয়েকদিনে রাহমিদকে ঠিক মতো দেখাশোনা করতে পারেনি। হয়তো ভেজা জামাকাপড়ে থেকেই এতটা জ্বর হয়ে গেছে। আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে নিউমোনিয়া হয়নি। এর আগেই রায়হান হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিলো। এটা নিয়ম করে খাওয়াতে বললো। রুস্তম, দিলদার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বাইরে অপেক্ষা করছে। ভিতরে বেশি মানুষ থাকা উচিত না দেখে তারা বাইরে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে গেলো। রায়হান বের হলো তার অল্প কিছুক্ষণ পর। রায়হানকে দেখেই দিলদার বললো,

“গুরুতর কিছু?”

“না ভাই তবে হতে পারতো। কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে। ওকে নিয়মিত খাওয়াতে বলেছে।”

“ছাইড়া দিছে নাকি থাকন লাগবো এইহানে?”

“স্যালাইন দিয়েছে তো তাই কালকে সকালে চলে যেতে বলেছে। আমার রুদের জন্য টেনশন হচ্ছে। ও তো আমাকে ছাড়া কখনো থাকেনি ভাই। ও যদি কান্না করে।”

“টেনশন কইরো না। চাচি দেইখা রাখবো। তুমি রাহমিদ রে দেহো।”

“ভালো লাগছে না কিছুই। আমার ভাই, বোনদের রোগ শোক পিছু ছাড়ে না কেন ভাই?”

রায়হানের কান্না গলা। রুস্তম ও তার চ্যালা প্যালা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে তারা যেয়ে কি করবে। যতই বখাটে গিরি করুক দিন শেষে মানুষের বিপদে বখাটেপনা সাজে না। এটা তারা খুব করে মানে। রায়হান দিলদারের সামনে থেকে গিয়ে রুস্তমদেরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালো। তারাই তো এই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছে নাহলে অতো টাকা দিয়ে কিভাবে সে রাহমিদকে ভর্তি করাতো।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১১

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১১
#তাজরীন_ফাতিহা

আফজাল হোসেন হোটেলে বসে আছেন। হিসেবের খাতা খুলে হিসেব মিলাচ্ছেন। দিলদার কাস্টমারকে খাবার দিচ্ছে। দিলদার ফ্রী হয়ে আফজাল হোসেনের কাছে এসে বললো,

“একটা কতা আছিলো চাচা।”

“বল”

“চাচা, রায়হান কিন্তু বাজার করা এহনো পারে না। কি করবেন কন তো? আইজকা কি করছে হুনবেন?”

আফজাল হোসেন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

“কি করেছে আজকে?”

দিলদার আজকের সকালের ঘটনা অদ্যপন্ত বর্ণনা করলো। আফজাল হোসেন মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। দিলদার জিজ্ঞাসা করলো,

“কি করবেন এহন?”

“ভেবে দেখছি। কাজে যা।”

দিলদার “আইচ্ছা” বলে প্রস্থান করলো। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। এর মধ্যেই রুস্তম বখাটে ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আগমন। দিলদার এদেরকে দেখে অবাক হয়েছে। সেদিনের ঘটনার পর রুস্তম ভাইকে এই হোটেলে দেখা যেতো না। দিলদার ভেবেছে আপদ বিদায় হয়েছে। এখন তো দেখছে সে ভুল ছিল আপদ আবার এসে জুটেছে। বিরক্তিকর একটা নিশ্বাস ফেললো সে। রুস্তমের চেলা বাচ্চু দিলদারকে ডেকে আনলো। দিলদার বিরক্তি চেপে রেখে রুস্তমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুস্তম কোনো কথা না বলে আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে দিলদারকে দেখছে। দিলদার আর থাকতে না পেরে বললো,

“কিছু বলবেন ভাই?”

এতক্ষণ পর রুস্তম মুখ খুললো,

“তুই নাকি বিরাট মস্তান হয়েছিস?”

দিলদার আকাশ থেকে পড়লো মনে হয়। মস্তান আর সে। কোথায় আকাশ আর কোথায় পাতাল। দিলদার বিরক্ত হয়ে বললো,

“এইসব কি বলতাছেন ভাই? আমি মস্তান হুমু কেন?”

“সেটা আমি কেমনে জানমু। কয়দিন আহি নাই দেইখ্যা নিজেরে পাতি গুণ্ডা মস্তান ভাবা শুরু করছিস নাকি?”

“এইসব ফাউ কতা আপনেরে কেডা কইছে? আমি কোনো গুন্ডামি করি নাই? কারতে হুনছেন এই আজগুবি কতা?”

এবার রুস্তমের চেলা আব্বাস কথা বলে উঠলো। বললো,

“ভাই এই সেয়ানার কতা হুনবেন না। আমি নিজের চোক্ষে দেখছি একটা পোলারে ধমকাইয়া ধমকাইয়া কতা কইতে আছিলো। মগা, বলদাও কইছে। পোলাডার কোলে একটা বাইচ্চাও আছিল। পোলাডা এক্কেরে মন খারাপ কইরা খাড়ায় আছিলো ভাই। নিজেরে সিনেমার হিরো ভাবে।”

দিলদার হা হয়ে এতক্ষণ আব্বাসের কথা শুনলো। রুস্তম বললো,

“বহুত বাড়ছিস বুঝলাম। হেদিনের কতায় হেব্বি মেজাজ খারাপ হইছে তোর উপ্রে তাই কয়দিন আহি নাই অমনি উড়া শুরু করছিস। রাস্তায় যারে তারে কতা হুনাস। যাউকগা মাইনষেরে মগা কস তুই কি তাইলে? উম তুই হইলি মগার বড় ডা বগা।”

রুস্তমের সকল চেলা হেঁসে উঠে সহমত জানালো। দিলদার অপমানিত বোধ করলো। সে তো রায়হানকে একটু বকা দিয়েছে আর এরা তাকে না জেনে যা তা বলছে। রায়হানকে ওভাবে বলায় নিজেরও খারাপ লাগছিল। এতিম ছেলেটার সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। আচ্ছা, এতিম ছেলেটার সাথে ওভাবে কথা বলায় আল্লাহ্ নারাজ হয়েছেন? রুস্তমকে আল্লাহ্ তায়ালা তার শাস্তি দিতে পাঠান নি তো আবার?
_____
—–

রায়হান রুদের জামা খুলে সারা শরীর মুছিয়ে দিচ্ছে। রুদ জ্বরের ঘোরে থরথর করে কাঁপছে। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর রায়হান শরীর মুছিয়ে দিয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো। বালতিতে রুদকে কুলিকুচি করালো। পাশে রাহমিদ হামাগুড়ি দিয়ে বসার চেষ্টা করছে। রাহমিদ এখন বসতে পারে। তবে নিজে নিজে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারেনা। কারো সাহায্যে বসতে হয়। সে এখন বসে খেলনা দিয়ে খেলছে তবে ব্যালেন্স করতে না পেরে পিছনের দিকে হেলে পড়ে গেলো। বালিশের উপর পড়েছে। শুয়ে শুয়ে এখন হাত, পা ছড়িয়ে খেলছে। পা উপরে তুলে মুখে আঙ্গুল ভরে নানা ধরনের অস্পষ্ট আওয়াজ করতে লাগলো। মাঝে মাঝে কি জানি বলে চিল্লিয়ে উঠে আর হাসে। রায়হান সেটা দেখে মৃদু হাসলো। রুদকে জামা কাপড় পরিয়ে শুইয়ে দিলো। গায়ে কাঁথা টেনে দিলো। বাচ্চাটা জ্বরের তালে কিছুই ঠিক মতো খেতে পরছে না। সেজন্য আজকে সকালে বার্লি কিনে এনেছে সে। দেখা যাক বার্লি খাওয়াতে পারে কিনা। রায়হান রাহমিদকে আদর করে বালিশ দিয়ে চারপাশে বর্ডার করে দিলো। খেলনা দিলো যাতে সে চলে গেলে না চিল্লায়। রুদের কপালে চুমু দিয়ে রাহমিদকে দেখে রাখতে বলে সে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। রান্না ঘরে এসে দেখে জয়নব বেগম কি যেন রান্না করছে। রায়হানকে দেখে সে দ্রুত বললো,

“কি লাগবো বাবা?”

“কিছু না আন্টি। একটু বার্লি রাঁধবো। রুদ কিছু খেতে পারছে না তাই।”

“দাও আমারে, আমি অক্ষণই রাইন্দা দিতাছি?”

“না না আন্টি দরকার নেই। আমি রাঁধতে পারবো। আপনি শুধু চুলা খালি হলে আমাকে ডেকে দিয়েন।”

“চুলা তো খালিই। আমার রান্না শেষ। তুমি রাঁনতে পারো? আমারে দাও। আমি সুন্দর কইরা পাকাইয়া দেই।”

“সমস্যা নেই। আমি পারবো।”

জয়নব বেগম বুঝলেন রায়হানকে মানানো সহজ না তাই তিনি চুলা খালি করে দিয়ে তরকারি নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরেকবার রায়হানকে জিজ্ঞাসা করলো সে পারবে কিনা? উত্তরে রায়হান সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। রায়হান চুলায় পাতিল বসিয়ে পানি ঢাললো। পানিতে বার্লি ঢেলে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বার্লি ফুটে আসলে নামাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললো। তার মুখ থেকে আর্তনাদ বের হলো। হাতের চামড়া পুড়ে গেছে। সে দ্রুত পানিতে হাত ভিজিয়ে দিলো। এখন একটু জ্বলুনি কম লাগছে। কিছুক্ষন ভিজিয়ে রেখে হাতটা উঠালো। চুলা থেকে পাতিল টা নামিয়ে একটা বাটিতে বার্লি ঢেলে নিলো। বাটি নিয়ে ঘরে এসে দেখলো রাহমিদ বসে বসে বোনের চুল নিয়ে খেলছে। রুদ এক হাত দিয়ে রাহমিদকে জড়িয়ে রেখেছে। রায়হানের হাত টা জ্বলছে আবারও। পানিতে কিছুক্ষণ রাখায় ভালো লাগছিল এখন আবার জ্বলছে। রায়হান রুদকে উঠিয়ে একটু একটু বার্লি খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটার মুখ শুকিয়ে গেছে। দুই দিনের জ্বরে বাচ্চাটা কাবু হয়ে গেছে। রুদকে খাইয়ে দেখে রাহমিদ তাকিয়ে আছে খাবারের দিকে। রায়হান হেঁসে বলে, “খাবে?” বাচ্চাটা কি বুঝলি কে জানে ফিচ করে হেঁসে গড়াগড়ি খেলো। রায়হান আবার রুদকে খাইয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদ আবার মুখে আঙ্গুল ভরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান এবার কোনো কথা না বলে রাহমিদের মুখে এক চামচ ঢুকিয়ে দিলো। রাহমিদ মুখে নিয়ে মুখ নাড়ালো তারপর হঠাৎ করে মুখ বিকৃত করে খাবার ফেলে দিলো। সম্পূর্ণ জামা ভরিয়ে ফেললো। রায়হান হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকলো ওদিকে হাতের জ্বলুনিও বাড়ছে।
_____
—–

আজকে আফজাল হোসেন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছেন। রায়হানের সাথে তার জরুরি আলাপ আছে। জয়নব বেগম রায়হানকে ডেকে আনলো। আফজাল হোসেন আর রায়হান ভাত খেলো। খাওয়া শেষে আফজাল হোসেন রায়হানকে বললো,

“তুমি কি পড়াশোনা করবে না? সেদিনও জিজ্ঞাসা করেছিলাম।”

“কিভাবে পড়াশোনা করবো আংকেল। ওরা ছোট আর ভার্সিটি তে এডমিশনের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে। যা এখন ওদের নিয়ে করা সম্ভব না। টাকারও একটা ব্যাপার আছে।”

“শোনো একটা কথা বলি। পড়াশোনা ছেড়ো না। পড়াশোনা জানা থাকলে একটা না একটা জায়গায় চাকরি অনায়াসে হয়ে যাবে। চাকরি না হলেও মানুষকে পড়িয়ে দু, চার টাকা ইনকাম করতে পারবা কিন্তু পড়াশোনা না করলে কোথাও কাজ পাবে না। অনেক কষ্টের কাজ করে টিকে থাকতে হবে তোমাকে। যা তোমার দ্বারা সম্ভব না। তুমি ছোটবেলা থেকেই রাজকীয়ভাবে বড় হয়েছো এখন কোনো কঠিন কাজ দিলেই তুমি খেই হারিয়ে ফেলবে। তাল রাখতে পারবে না। পদে পদে বিপদে পড়বে তাই বলছিলাম একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও পড়াশোনা ছাড়বে নাকি ধরে রাখবে।”

রায়হান কি বলবে ভেবে পেলো না। এত ছোট ভাইবোনকে রেখে কিভাবে প্রিপারেশন নিবে আর কিভাবেই বা টিকবে। একটা পাবলিক ভার্সিটিতে টিকা তো মুখের কথা না। যদিও রায়হান যথেষ্ট মেধাবী তবুও একটা গাইডলাইন তো থাকতে হবে। আফজাল হোসেন আবারও বলে উঠলেন,

“তোমার ভাই বোনের চিন্তা করো না। ভার্সিটিতে একবার ভর্তি হয়ে গেলে প্রতিদিন নাহয় না গেলে। শুধু পরীক্ষার সময় উপস্থিত থেকে পরীক্ষা দিলে শিক্ষকদের বলে। তারা নিশ্চয় বুঝবে তোমাকে।”

“আসলে আংকেল ঠিক তা না। এখন কিভাবে প্রিপারেশন নিবো। অল্প কয়েকদিন বাকি বোধহয় এডমিশনের। আমার কাছে তো বইও নেই কোনো। তার উপর ওদেরকেও দেখতে হবে। সব মিলিয়ে সাহস হচ্ছে না পড়ার। ”

“তোমার ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট কি?”

রায়হান মুখ নামিয়ে মিন মিন করে বললো,

“জিপিএ ফাইভ।”

আফজাল হোসেন অবাক হয়ে গেলেন। এত ভালো একজন ছাত্রের এভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে এটা তিনি মানতে পারছেন না কিছুতেই। আফজাল হোসেন বললেন,

“এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে তুমি পড়াশোনা ছেড়ে দিবে? আচ্ছা জানতে পারি, তোমার কী হওয়ার ইচ্ছা ছিল?”

রায়হানের মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। কিছু স্মৃতি বোধহয় তার মানসপটে তীব্রভাবে উঁকি দিয়ে তার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিলো। রায়হান মুখ নামিয়ে বললো,

“বাবা, মায়ের শখ ছিল দেশের নামকরা ডাক্তার বানাবেন। কারণ বাবার মা মানে আমার দাদি চিকিৎসার অভাবে মারা যান যা আমার বাবাকে খুব ব্যথিত করেছিল। আর আমারও ইচ্ছা ছিল কিন্তু এখন আর নেই।”

রায়হানের ভাঙা গলা। আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগম পাথরের মতো বসে আছেন। ছেলেটার এত দুঃখ তাদের সহ্য হচ্ছে না। আফজাল হোসেন বললেন,

“এখন তো আর মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে পারবে না মনে হয়। তুমি ভার্সিটিতে চেষ্টা করো। আমি বই খাতা এনে দিবো। তুমি পড়বে?”

“না না আংকেল। আপনি আর আন্টি এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক করছেন। আমি চাই না আমাদের জন্য আর কোনো টাকা খরচ করেন। আমি চাচ্ছি না আপনাদের ঘাড়ে বসে খেতে। প্লিজ আংকেল, জোর করবেন না। পড়াশোনা আমার জন্য না। আমি আমার ভাই বোনকে পড়াবো যেভাবেই হোক। আমার না পড়লেও চলবে।”

“রায়হান জানো, তুমি সব সময় আমার দেয়া কিছুকে দয়া ভাবো। আমার কাছ থেকে ধার হিসেবে নাও এখন পরে নাহয় টাকা হলে পরিশোধ করে দিলে। তোমাকে দেখলে আমার যৌবন কালের কথা মনে পড়ে ভীষণ। আমিও এতিম ছিলাম। তাই বোধহয় তোমার প্রতি টানও একটু বেশি। এতিম খানায় বড় হয়েছি বুঝলে। কোনরকম মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কাজে লেগে যাই নিজের ভবিষ্যতের জন্য। তখন থেকে খেটে খেয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই পর্যন্ত এসেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় পড়াশোনা টা যদি করতে পারতাম তাহলে ভালো একটি পর্যায়ে আজকে থাকতাম। মা, বাবা থাকলে নিশ্চয় পড়াশোনা করাতো। তাই আফসোস লাগে নিজের ভাগ্যের উপর প্রায়ই। যদিও আল্লাহ্ আমাকে যথেষ্ট ভালো রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ। আমি চাই এই আফসোসটা যেন তোমার কখনো না হয়। তারপরও যদি তুমি পড়াশোনা না করতে চাও আমার কিছু বলার নেই। এটা একান্তই তোমার সিদ্ধান্ত। আমি তো তোমার কেউ নই। তোমার উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার অধিকারও আমার নেই।”

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১০

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১০
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হানকে দেখে তাদের ফুসুর ফুসুর বন্ধ হয়ে গেলো। রায়হান চাদর নিয়ে তাদেকে পাশ কাটিয়ে টয়লেটে চলে গেলো। ময়নার মা ভেংচি কাটলো। তারপর আবার কয়েকজন ভাড়াটিয়া মিলে রায়হানদের নিয়ে গবেষণায় নামলো। রায়হান চাদর ধুয়ে বের হয়ে দেখলো তাদের সমালোচনা এখনো শেষ হয়নি। যদিও এসব মহিলাদের সাথে সে তর্কে জড়াতে মোটেও ইচ্ছুক নয় তবুও কিছু কিছু মহিলার এইসব কানাকানি, একে অন্যের পিছনে কথা বলা রায়হানের চরম অপছন্দ। এদের কোনো কাজ নেই খালি মানুষের পিছনে দোষ গাইতে থাকে। রায়হান সেখানে গিয়ে চাদর হাতে নিয়ে বললো,

“আচ্ছা জানতে পারি কি, এইযে মানুষের পিছনে কানাঘুষা করেছেন এতে আপনাদের লাভ কি?”

মহিলাগুলো থতমত খেয়ে গেলো। এমনিতেই মালিকের আত্মীয়। তাদের নিয়েই আবার কথা বলছে। ছেলেটা সব শুনে ফেলেনি তো? ময়নার মা মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললো,

“আরে কি যে কও না। কই কানাঘুষা করলাম। আমরা তো আমাগোর সাংসারিক আলাপ করতেছিলাম।”

“সাংসারিক আলাপ করছিলেন। আচ্ছা ধরে নিলাম আপনারা সাংসারিক আলাপ করছিলেন। আপনাদের এই সাংসারিক আলাপে কি কোনো মানুষ নিয়ে কটূক্তি করা হয়নি? যেমন আমি যতটুকু জানি মহিলারা একত্রে হলে তারা গীবত বা একজনের সমালোচনা না করে থাকতে পারেন না। তো আপনাদের সাংসারিক আলোচনায় নিশ্চয় আপনার শাশুড়ি, ননদ, শশুরবাড়ির লোক বা যেই হোক যাদের সাথে আপনাদের বনে না তাদের নিয়েই বলছিলেন? এম আই রাইট?”

মহিলা গুলো ভোঁতা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ময়নার মা আর কয়েকজন মনে মনে ফুঁসতে লাগলো। এরা মালিকের আত্মীয় না হলে দেখিয়ে দিতো তারা কি? কত বড় স্পর্ধা তাদেরকে জ্ঞান দিতে এসেছে এই দুই দিনের ছেলে। রায়হান তাদের মুখ দেখে বুঝলো তার কথা এদের হজম হয়নি। সে আর কথা না বাড়িয়ে শুধু বললো,

“দয়া করে আল্লাহ্ তায়ালাকে ভয় করুন। মৃত্যুর উপরে কিন্ত আমাদের কারো হাত নেই। এসব করে মারা গেলে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে কি জবাব দিবেন আছে কি কোনো উত্তর? তাছাড়াও গীবত করাকে আল্লাহ্ তায়ালা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য করেছেন। আপনারা নিশ্চয় আপনাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবেন না? যদি খেতে চান বা খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেটা ভিন্ন বিষয়। তাহলে গীবত করুন আর মজা করে চিবিয়ে চিবিয়ে ভাইয়ের গোশত খান। ছোট মুখে অনেক কথা বলে ফেললাম, ক্ষমা করবেন।”

কথাগুলো বলেই রায়হান প্রস্থান করলো। অন্যদিকে মহিলা গুলো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। রায়হানের কথা কি তাদেরকে ছুঁতে পারলো। তাদের মনের মধ্যে কি কোথাও ঝড় বইয়ে দিয়ে গেলো। ভাইয়ের গোশত খেতে হবে শুনেই তো বমি চলে আসছে। কয়েকজন মনে মনে তওবা পড়ে নিলো। এত সুন্দর করে কেউ তাদের কখনো বুঝায় নি। এতটুকু ছেলের কথায় কি মুগ্ধতা রয়েছে তারা তা ভুলেও টের পেলেন না তবে একটা জিনিস ঠিক উপলব্ধি করতে পারলেন, তাদের মনের মধ্যে কিছু তো একটা খেলে গিয়েছে যা তাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার পথে আনলেও আনতে পারে। কিন্তু মনুষ্য জাতি কি এত সহজেই ঠিক হবে? এটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়।
______
—-

রায়হান ঘরে এসে দেখলো রাহমিদ রুদের গায়ের উপরে উঠার চেষ্টা করছে। রুদের মুখে হাত দিয়ে বারি দিয়ে বলছে, “উ.….পু… উ….পু।” রায়হান দ্রুত গিয়ে রাহমিদকে কোলে তুলে নিলো। তারপর রাহমিদের দিকে তাকিয়ে বললো,

“পঁচা ছেলে, দুষ্টু ছেলে আপির ঘুম ভাঙাচ্ছো কেন?”

রাহমিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো গাল ফুলিয়ে। অর্থাৎ খুবই মহৎ কাজ করতে গিয়ে উঠিয়ে অনায় বেজায় রেগে গিয়েছে সে। রায়হানকে রেগে কথা বলতে দেখে হাত দিয়ে মুখে খামচি মেরে বললো,

“ভ…. য়ু…য়ু..”

রায়হান রাহমিদের খামচিতে ব্যথা পেয়ে হালকা চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাহমিদ ভাইয়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে। রায়হান রাহমিদকে ধরে বললো,

“আজকে সম্পূর্ণ হাত কেটে ফেলবো। কথায় কথায় খালি খামচি মারা তাই না?”

রাহমিদ ভাইয়ের কথা না বুঝে ফোকলা হাসলো। তা দেখে রায়হান বলে উঠলো,

“দাড়াও পাজি ছেলে তোমার হাসা ছুটাচ্ছি।”

রায়হান ব্যাগ থেকে নেইল কাটার বের করলো। বাচ্চাটার হাতের নখ অনেক বড় হয়ে গেছে। কথায় কথায় যাকে তাকে খামচি দিচ্ছে। রায়হান, আফজাল হোসেন, জয়নব বেগম, দিলদার, কাউকে ছাড়ছে না। রায়হান রাহমিদকে কোলে শুইয়ে নখ কাটতে লাগলো। রাহমিদ যখন বুঝলো তার মোক্ষম অস্ত্র কেটে ফেলা হচ্ছে তখনই মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিয়েছে। রায়হান ওকে চেপে ধরে নখ কাটতে লাগলো। রাহমিদ এই অনাচার সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। রায়হান দ্রুত কোনরকম নখ কেটে ওকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে লাগলো। রাহমিদ ভাইয়ের গালে কামড় দিয়ে লালা লাগিয়ে দিলো। রায়হান তা দেখে চরম হতাশ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

“নখ কেটেছো তো কি হয়েছে দাঁত আছে না? দাঁত কি আর কাটতে পারবে? এসব ভাবছিস তাই না। ছোট খাটো পাতি গুণ্ডা একটা। বড় হলে পাক্কা সেয়ানা হবে। কাউকে এক চুলও ছাড় দিবে না।”

রাহমিদ কি বুঝলো কে জানে খিলখিল করে হেসে উঠলো। রায়হান ভাইয়ের হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখে “ওরে আমার লাড্ডু রে, টোটন রে, জাদু রে, কলিজা রে” বলে রাহমিদকে ঠেসে চেপে আদর করতে লাগলো। রাহমিদ আরও জোরে হেঁসে উঠলো। এর মধ্যে রুদ ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। উঠেই ভাইকে ডেকে উঠলো। রায়হান দ্রুত রুদের কাছে গেলো। বললো,

“এইতো সোনা, কি লাগবে আমার রুদ পাখির?”

রুদ জরাজীর্ণ মৃদু গলায় বললো,

“আমু, আবুকে লাগবি। আমু, আবু কুথায় ভাইয়ু। আমার জ্বর হয়েছি আমু, আবু এখুনো আসি না কেনু?”

রায়হানের বুক ধক করে উঠলো। পৃথিবীর সব কিছু এনে দেয়ার ক্ষমতা থাকলেও মা, বাবাকে এনে দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। কিভাবে বুঝাবে এই বাচ্চাটাকে। গত চারমাস ধরে কত ছলাকলা করে রুদকে বুঝ দিচ্ছে মা, বাবা আছে। কয়েকদিন পরই চলে আসবে। তার রুদ টা ছিল বাবা ও তার ন্যাওটা। মা যখন বকা দিতো তখন তাদের কাছে দৌড়ে এসে মায়ের নামে বিচার দিতো। একটু পর মায়ের উপর অভিমান কমে গেলে মায়ের কোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। মাও পরম মমতায় আগলে নিতো তার নাড়িছেঁড়া ধনকে। এসব ভেবে রুদের অলক্ষে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রায়হান দ্রুত চোখ মুছে ফেললো। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। সে পরম মমতায় রুদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“আম্মু, আব্বু এসে পড়বে সোনা। তুমি স্ট্রং গার্লের মতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও দেখি। আম্মু, আব্বু তোমাকে অসুস্থ দেখলে আমাকে বকা দিবে তো সোনা। বলবে আমার মেয়েকে দেখে রাখোনি জাইম?”

কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো তার চোখ ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। সে উল্টো দিকে ফিরে চোখ মুছে ফেললো আবার। তাও চোখ ভিজে যাচ্ছে। রাহমিদ ভাইয়ের কোলে বসে হাত, পা ছোড়াছুড়ি করছে। রুদ ভাইয়ের কথা শুনে চুপটি করে ভাইয়ের কোলে মাথা রাখলো। রায়হান আরও নানা কথা বলতে লাগলো রুদকে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একজন বাবা বুঝি তার সন্তানদের আগলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
______
—–

“ওই ঢেঁড়সের কেজি কত?” দিলদার সবজি দেখতে দেখতে বললো।

“১৩০ টেকা?” সবজি ওয়ালা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো।

“কিহ এত দাম কেন?”

“এইডা তো ঢেঁড়সের সিজন না হেইলাইগা দাম বারন্তি।”

“পটল আর করল্লার কেজি কত?”

“পটল ১৪০ টেকা আর করল্লা ১৬০ টেকা কেজি।”

“ওই সব কিছুর এত চড়া দাম কেন?”

“এহন তো এইসবের দাম একটু চড়াই থাকবো। সিজন আইলে ঠিক হইয়া যাইবো।”

দিলদারের মাথা গরম হয়ে গেলো। রায়হান বুঝলো ঝগড়া শুরু করে দিবে দিলদার ভাই। কালকে কিছু না বলাতে ক্ষেপে গিয়েছিল আজকে তাই চুপ করে না থেকে সবজি ওয়ালাকে বললো,

“ভাই পটল ১২০ আর করল্লা ১৪০ করে রাখেন।”

দিলদার রায়হানের কথা শুনে থব্দা মেরে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে ওভাবে তাকাতে দেখে রায়হান মনে করলো আজকে দিলদার ভাই বোধহয় খুশি হয়েছেন। সবজিওয়ালা সহজেই রাজি হয়ে বললো,

“আইচ্ছা ভাই।”

রায়হান দিলদারকে উদ্দেশ্যে করে বললো,

“ভাই সব জায়গায় মাথা গরম করলে হয় না। দেখেছেন কি সুন্দর কম টাকায় দিতে রাজি হয়ে গেলো। সুন্দর ভাষায় কথা বলেও মিটমাট করা যায়।”

দিলদারের রায়হানের কথায় হুঁশ ফিরলো যেন। পরমুহুর্তেই সবজি ওয়ালাকে সবজি দিতে মানা করে রায়হানের হাত ধরে টেনে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলো। বললো,

“পৃথিবীর সব চাইয়া মগা মাইনষের নাম যদি আমারে জিগায় আমি এক বাইক্যে তোমার নাম কমু। আমার লগে থাইকা তুমি এই বাজার করা শিখছো গত দুই দিনে। মানুষ এত বলদা হয় কেমনে? তুমি ওই বেডারে যে দাম কইছো ওই টেকা দিয়া ওই শালায় সবজি কিনেই নাই কিনছে আরও কমে। কাস্টমার গো কাছে বেশি বেশি দাম কয় যাতে ওগোর মেলা লাভ ওয়। তোমার মতো মগা গো ভাইংগাই এরা ব্যবসা করে। তোমারে এতদিন বাজার না করা শিখাইয়া তোমার এই আন্ডা ভাইরে বাজার করা শিখাইলে মেলা লাভ হইতো বুঝলা। হেয়ও প্রতিবাদ করতে পারে আর তুমি মগার লাহান খাড়াইয়া বলদামি করো। আরেকটা কতাও কইবা না আর। তোমারে দিয়া বাজার হইবো না বুইঝা গেছি। চাচারে কইয়া তোমারে অন্য কামের ব্যবস্থা করতে কইতে হইবো।”

রায়হান ভেবেছিল দিলদার ভাই খুশি হবে এখন দেখি হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। আফজাল হোসেন এত ভরসা করে কাজের দায়িত্ব দিয়েছে আর সে এভাবে দায়িত্বজ্ঞান হীনতার পরিচয় দিলো। তার মন খারাপ হয়ে গেলো। এই পৃথিবীর নিয়ম কানুন বড় অদ্ভুত। এসবের সাথে সে কিভাবে মানিয়ে চলবে। কেমন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। পিঠ ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে আছে সামনে রাহমিদ ঝুলছে। তার শরীর কেমন ছেড়ে দিতে চাচ্ছে ক্লান্তিতে। ভাগ্য তার সাথে কি এক আজব খেলায় মেতেছে। হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে।
______
—–

“চাচা রায়হান বাজার করা কিন্তু এহনো পারে না। কি করবেন কন তো? আইজকা কি করছে হুনবেন?”

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৯

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৯
#তাজরীন_ফাতিহা

চারদিকে অন্ধকার কমতে শুরু করেছে। রাহমিদের কান্নার আওয়াজে রায়হানের ঘুম ভেঙে গেলো। তবে উঠতে যেয়ে মনে হলো তার শরীরে কেউ অসংখ্য সূচ বিঁধে দিয়েছে। শরীরে অনেক ব্যথা। রাহমিদের চিৎকারের আওয়াজে তাড়াহুড়া করে উঠতে যেয়ে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো সে। তার মনে হলো হাড্ডি পর্যন্ত ব্যথা করছে। শরীরটা কেমন ঝিমিয়ে আসছে। তারপরও কোনরকম শরীরটা উঠিয়ে রাহমিদকে কোলে নিলো। ওকে দুলিয়ে কান্না কমানোর চেষ্টা করতে লাগলো। হাতে ভিজা অনুভূত হওয়ায় প্যান্ট পাল্টে দিলো। তারপর ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদ ভাইকে বেশি না জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। রায়হান ওকে আবার শুইয়ে দিলো। বিছানা ভিজে গেছে বাচ্চাটার টয়লেটে। সকালে রোদ উঠলে চাদর ধুয়ে দিতে হবে সাথে তোষকটাও শুকোতে দেয়া লাগবে।

রুদের গালে কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর কিছুটা ছেড়েছে। চারপাশ আলোকিত হওয়ার আগে নামাজটা পড়ে নিতে হবে নাহলে ওয়াক্ত চলে যাবে। কোনরকম ব্যথা শরীরটা টেনে নিচে নামলো। নিচে নামতে গিয়ে মনে হলো শরীরটা এখনই ছেড়ে দিবে। খুব কষ্টে আস্তে ধীরে যেয়ে ওযু করে আসলো। নামাজটা পড়ে কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। শরীরটা ভালো না লাগায় শুয়ে পড়লো। বাজারের সময় হলে উঠে যাবে। দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে আবার উঠে বসলো। দরজা খুলে দেখলো আফজাল হোসেন এসেছেন।

“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। ভিতরে আসুন।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। না ঠিক আছে। আসলে রুদাইফাকে দেখতে এসেছি। ওর জ্বর কমেছে?”

“জি কমেছে কিছুটা।”

“তুমি কালকে রাতে নাকি ভাত খাওনি? তোমার আন্টির সাথে রাগ করেছো?”

“না না, এসব কি বলছেন। ওনার উপরে রাগ করার প্রশ্নই উঠে না। আসলে কালকে ক্লান্ত ছিলাম প্রচুর। বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের শরীরটাও ছেড়ে দিয়েছিল তাই ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।” রায়হান দ্রুত বললো।

“তোমার আন্টি তো ভেবেছে তুমি রাগ করে খাওনি। তাই অনেকে কষ্ট পেয়েছে। বাচ্চাটার জন্য খালি কষ্ট পাচ্ছিলো।”

“ঠিক আছে আন্টির সাথে কথা বলবো আমি। আপনি ভিতরে আসুন।”

আফজাল হোসেন ভিতরে প্রবেশ করে দেখলেন সেরেলাকের বাটি পড়ে আছে চৌকির উপরে। বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে আছে। আহা! কি মায়া মায়া মুখ। এদেরকে দেখলেই তার কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। মা, বাবা ছাড়া এদের ভবিষ্যৎ আসলে কেমন হবে? তিনি ভাবতে পারেন না। আল্লাহর কাছে এই মাসুম বাচ্চাগুলোর জন্য দোয়া করেন যেন ওরা সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ পায়। রায়হান চৌকির এক পাশে আফজাল হোসেনকে বসতে দিলো। রায়হান নিজেদের ব্যাগ খুলে কিছু বের করতে লাগলো। আফজাল হোসেন রুদের কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করলো। রাহমিদকে আদর করে দিলো। বাচ্চাটা এখন কি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে অথচ জাগ্রত থাকলে তাকে দেখলেই হাত উঁচিয়ে মার দেখাতো। জোর করে কোলে তুলতে চাইলে খামচি দিতো নাহলে কেঁদে দিতো। মানে তাকে কোনোভাবেই কোলে নেয়া যাবে না। এটা ভেবে উনি একটু জোরেই হেঁসে দিলো। ভীষণ পাজি বাচ্চা। হেসেই ফুলো ফুলো গালে চুমু বসিয়ে দিলো। রুদের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকেও চুমু খেলো। দুটোই মায়া আর কিউটের ডিব্বা। মাশ আল্লাহ্!

“আংকেল আপনার টাকা টা?” রায়হান টাকা বাড়িয়ে বললো।

“কিসের টাকা?”

“কালকে যে ডাক্তার দেখলাম তার ফিস আর ওষুধের টাকা।”

“টাকার প্রয়োজন নেই। রায়হান একটা কথা বলি শোনো, তুমি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ছেলে। তোমার এই স্বভাব আমার খুবই পছন্দ কিন্তু সব সময় আত্মসম্মানবোধ দেখানো উচিত না। তোমার আজকের কাজটায় আমি কষ্ট পেয়েছি। সামান্য কয়টা টাকাও তোমাকে শোধ করতে হবে বুঝি? বাসা ভাড়া দিবে, নিজের ভরণপোষণ নিজে চালাবে, কাজ করে খাবে সব মেনে নিয়েছি এখন তোমার উচিত নয় কি আমাদের সামান্য কথা শোনা? তোমাকে আমরা মোটেও দয়া করছিনা। তোমার এই টাকাটার সামনে প্রয়োজন পড়তে পারে। আমি খুশি হয়ে দিয়েছি আর টাকাটা আমি নিবো না। এতেও তোমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে আমার কিছু করার নেই।”

আফজাল হোসেন কিছুটা কঠোর সুরে কথাগুলো বলে থামলেন। রায়হান কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না কারণ আফজাল হোসেনের কঠিন মুখশ্রী। আফজাল হোসেন রুদ আর রাহমিদকে আদর করে চলে গেলেন।
______
—-

রায়হান আর দিলদার বাজারে এসেছে। দিলদার তিনদিন রায়হানকে সঙ্গ দিবে। রায়হানকে ধরে ধরে বাজার করা শিখাচ্ছে সে। রায়হানের কোলে রাহমিদ। বেবি ক্যারিয়ারে ভাইয়ের বুকে লেপ্টে আছে। ক্ষণে ক্ষণে তার ছোট মাথাটা বের করে বাইরে উঁকি দিচ্ছে। রায়হানের যদিও শরীরটা ভালো লাগছিল না তারউপর রুদ অসুস্থ। ওকে রেখেও আসতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু জয়নব বেগমের আকুতির জন্য ভরসা করে রেখে এসেছে। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে ছিল দেখে তার আর উঠানোর ইচ্ছে হয়নি। এমনিতেও কাজ যেহেতু করছে ফাঁকি দেয়ার ইচ্ছা তার নেই। জয়নব বেগমকে রুদকে কি কি ওষুধ খাওয়াতে হবে বলে এসেছে সে। জয়নব বেগম তাকে আশ্বাস দিয়েছে। চিন্তা করতে নিষেধ করেছে। রায়হান ও দিলদার কথা বলতে বলতে সামনে আগালো। রায়হান সবজি কিনেলো সাথে সবজির নামও জেনে নিলো। মাছ, মাংসের বাজারে ঢুকার আগে নাকে টিস্যু চাপা দিলো। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগবে। দিলদার রায়হানকে মাছ চিনাচ্ছে আর বলছে,

“এডা হইলো পাঙ্গাস মাছ। মেলা সুয়াদ। আর এইডা হইলো লইট্যা মাছ। এইডা রুত মাছ আর এইদিকের এইডা হইলো তেলাপিয়া। বুঝছো?”

“জি বুঝেছি।”

দিলদার দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলো,

“তেলাপিয়া আর রুতের কেজি কত?”

“তেলাপিয়া ৪৫০ আর রুই ৫০০ টেকা কেজি।”

দিলদার ক্ষেপে গিয়ে বললো,

“কাইলকাই তো দাম আছিলো চাইরশো কইরা আইজকা পঞ্চাশ বাড়লো কেমনে?”

“হুনেন নিলে নেন, না নিলে যান গা। আপনেরে কেউ সাদছে?”

“ওই বেডা মুখ সামলাইয়া কতা ক। নিলে নিমু মানে। নেয়ার লাইগাই তো খাড়াইছি। এক দাম তিনশো। প্যাকেট কর।”

“এহ্ মগের মুল্লুক নাকি? ৫০ টেকা কম রাখতে পারি এর এক টেকাও কম না।”

“আইচ্ছা তাইলে আর কি তোর মাছ তুই খা। অন্য জায়গাত্তে কিনুম।”

কথাটা বলেই দিলদার হাটা ধরলো। অন্য জায়গায় দামাদামি করে তিনশোতে আনলো। দিলদার দোকানিকে এক কেজি তেলাপিয়া আর রুই মাছ দিতে বলল। দোকানি একজনকে হাক ছেড়ে ডেকে মাছ গুলো দিতে বললো। দোকানি জিজ্ঞাসা করলো,

“কাইট্টা দিমু?”

দিলদার সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। মাছ কেনা শেষে ওই দোকানের সামনে যেয়ে বললো,

“দেখ তিনশতে কিনছি। তোর মাছ তুইই খা। দেমাগ দেহাস। তোর এই মাছ কেউ কিনতো না শয়তান বেডা।”

রায়হান এতক্ষণ নির্বাক হয়ে সব কিছু দেখছিল। তার এসব দামাদামি দেখে মাথায় চক্কর আসতে লাগলো। এভাবেও দামাদামি করা যায়। দিলদার অন্য সব কিছু কিনে নিলো। রায়হান শিখে নিলো কোনরকম। তার মনে হচ্ছে বাজার করা তার জন্য না। এভাবে পায়ে পা লাগিয়ে সে কোনোদিনও ঝগড়া করতে পারবে না। এভাবে হলে সেতো আফজাল হোসেনের লস করে দিবে। দিলদার রিক্সা নিলো। রিক্সায় করে যাওয়ার সময় দিলদার বললো,

“কিছু মনে না করলে তোমারে একখান কতা কই?”

“জি বলুন।”

“তুমি একটা বলদা। যহোন মাছের বাজারে ঝগড়া করতেছিলাম তহোন একটা কতাও না কইয়া এমন মগার মতো খাড়াইয়া আছিলা কেন? তোমার এই ছুডু ভাইও হাত নাড়াইয়া চিল্লাইয়া প্রতিবাদ করছে ওই বেডার আর তুমি চেগাইয়া খারাই আছিলা। কিছু না কইতা অইন্তত কইতে তো পারতা দাম বেশি চাইতাছেন। তোমার বাজার করা শিখন লাগবো না? এমনে হইলে হইবো।”

রায়হান কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে থাকলো।
_____
—-

রায়হান বাসায় এসে দেখলো রুদ উঠেনি। বাচ্চাটার জ্বর বেড়ে গেলো নাকি? মাথায় হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আবারও উঠছে। সে দ্রুত রুদকে উঠিয়ে মাথায় পানি দিলো। রুদকে কিছু খাওয়ালো তারপর ওষুধ খাইয়ে দিলো। রাহমিদকে শুইয়ে দিয়ে নিজে একটু ফ্যানের নিচে বসলো। এতক্ষণ রাহমিদ বেবি ক্যারিয়ারে তার কোলেই ছিল। বাচ্চাটা ঘেমে গেছে। সে জামা পাল্টে দিলো। কয়েকটা খেলনা দিলো ওকে। বাচ্চাটা খেলতে লাগলো। রায়হান বিছানার চাদর উঠিয়ে ধোঁয়ার জন্য টয়লেটে যাওয়ার পথে একটা কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। ভাড়াটিয়া কয়েকজন মিলে রায়হানদের নিয়ে কথা বলছে।

“এরা বলে মালিকের আত্মীয়। তো আত্মীয় হইলে দুই দিনও হইলো না বাজার করাইতে পাডাইছে কেন? তার উপর আবার বাপ, মায়রেও দেহি না এগো। কাহিনী কি কিছু বুঝতাছো?”

অন্যরাও সাথে তাল দিলো। ঠিকই তো বাপ, মা ছাড়া অত ছোট ছেলে মেয়ে থাকে কেমনে?

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৮

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৮
#তাজরীন_ফাতিহা

মাথার উপরে দিবাকর তীব্রবেগে তার তেজ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সকাল সাড়ে আটটায় এত তীব্র রোদ সচরাচর দেখা যায়না। রাহমিদকে কোলে নিয়ে হাঁটতে রায়হানের কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষন আগে বমি করার কারণে তাঁর হাত,পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। রায়হান ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। রাহমিদ ভাইয়ের কোলে দুষ্টুমি করছে আর মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নানা রকম অস্পষ্ট কথা বলে চলছে। দিলদারের খুব মায়া হলো ছেলেটার জন্য। সে বলে উঠলো,

“একটা রিসকা নেই? দেরি হইয়া গেছে এমনিতেই, জলদি যাওন যাইবো।”

রায়হান না বলতে যেয়েও কেন যেন বলতে পারেনি। তার শরীরটা কেমন ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। সে মৃদু গলায় বললো,

“ভাই বাবুর জন্য পাউডার দুধ কিনতে হবে। তখন মনে ছিল না। সামনে কি দোকান আছে? রিক্সায় গেলে দোকান থেকে দুধ কিনতে পারবো কি?”

“কেন পারবা না। অবিশ্যই পারবা। লও আল্লাহর নাম লইয়া রিসকায় উইড্ডা যাই।”

রায়হান নিভুনিভু কন্ঠে বললো,

“চলুন।”
______

রায়হান আর দিলদার রিক্সায় বসে আছে।রায়হানের শরীর ছেড়ে দিচ্ছিলো দেখে রাহমিদকে কোলে নিতে গিয়েছিল দিলদার। বাচ্চাটা কি বিচ্ছুর বিচ্ছু! তার হাতে কামড়ে দিয়েছে হাত বাড়িয়েছে দেখে। যদিও দাঁত দুই তিনটা উঠেছে মোটে তবুও ইঁদুর দাঁতের কামড়ে জ্বলতেছে একটু। এখন ভাইয়ের কোলে শান্ত হয়ে বসে তার দিকে মুখে হাত ঢুকিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে। কে বলবে এই মায়াবী গুলুমুলু চেহারায় পিছনে একটা বিচ্ছু বাস করে। রুস্তম বখাটে কি কম ছিল এতদিন এখন এই দুই দিনের ল্যাংটার হাতেও মাইর খেতে হচ্ছে। এই দুঃখ কই রাখবে সে। যে যেভাবে পারছে মারছে এমনকি ল্যাদা বাচ্চাও বাদ গেলো না। এই লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না। দিলদার মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে বসে রইলো।
____

দিলদার একটা মুদি দোকানের সামনে রিকশা থামাতে বলল। রায়হানকে বসিয়ে দোকান থেকে সেরেলাক আর নিডো কিনলো। অবশ্য এইসব রায়হানই কিনতে বলেছিল। সে শুধু টাকা নিয়ে দামাদামি করে কিনে আনলো। রিক্সায় বসে জিনিসগুলো রায়হানের হাতে দিলো। রাহমিদ এসব নিয়ে খেলতে থাকলো আর “এ…এ… আ…বা.. ভ..বে..” এইসব অদ্ভুত আওয়াজ করতে লাগলো। দিলদার প্যাকেট দিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো নাহলে বিচ্ছু কখন কামড়ে দেয় বলা যায়না। সে মুখ গোমড়া করে রাহমিদকে ভেংচি দিলো। রাহমিদ এটা দেখে প্যাকেট কামড়ে ফিচ ফিচ করে হেঁসে দিলো। যেন সে খুব মজা পেয়েছে দিলদারের কাণ্ডে। রায়হান রাহমিদের মুখ থেকে প্যাকেট নামিয়ে রাখলো ওর চারপাশে আপাতত ধ্যান নেই। শরীর কেমন নেতিয়ে পড়েছে।
_____
—-
রিক্সা বাড়ির গলির মুখে থামলো। ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকলো তারা। হঠাৎ করে রায়হানের সামনে চোখ যেতেই দুনিয়া স্থির হয়ে গেলো। সামনে রুদকে ধরে জটলা পেকে আছে। রুদ চিৎকার দিয়ে কাদঁছে। জয়নব বেগম রুদকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখতে পারছে না। বাচ্চাটার মুখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। রায়হান আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বাজারের ব্যাগ ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,

“রুদ…”

রায়হান ভিড় ঠেলে দৌড় দিয়ে রুদের কাছে গেলো। রুদ ভাইকে দেখে কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে দিলো। রাহমিদকে জয়নব বেগমের কাছে দিয়ে রুদকে ধরলো দ্রুত। রাহমিদ ভাইয়ের কোল থেকে অন্যের কোলে যাওয়ায় চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠলো। মুহূর্তেই পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেলো। রায়হান রুদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“কি হয়েছে সোনা? কিচ্ছু হয়নি। কাঁদে না।”

রায়হানের কন্ঠস্বর কাঁপছে। সে কথা বলতে পারছে না। ভাড়াটিয়া পপি বেগম বাচ্চাটার নাকে সরিষার তেল, বরফ দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাচ্চাটা কান্না থামাচ্ছেই না। ভাইয়ের কোলে বসে কেঁদেই যাচ্ছে। ওদিকে রাহমিদ জয়নব বেগমের কোলে কেঁদে যাচ্ছে। রায়হান কথা বলতে ভুলে গেলো যেন। রুদের এই অবস্থায় চারপাশের কোনো কিছু তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। এর মধ্যেই আফজাল হোসেন ভ্যান নিয়ে আসলেন। রুদকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। তিনি রায়হানকে তাগাদা দিলেন। রায়হানের হঠাৎ হুঁশ ফিরলো যেন। সে দ্রুত রুদকে কোলে নিয়ে ভ্যানে উঠলো। ভ্যান চলতে থাকলো আর রায়হান ক্রন্দনরত বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণের গিলে রাখা কান্না ছেড়ে দিলো।
_____
—-

রুদকে ড্রেসিং করিয়ে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাচ্চাটার নাক ও ঠোঁট কেটে গেছে ভীষণ বাজে ভাবে। ঠোঁটে কি যেন একটা ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে ডাক্তার আর নিয়মিত এটা মুখে দিতে বলেছে। নাকের জন্য সিরাপ ওষুধ দিয়েছে। সব টাকা আফজাল হোসেনই দিয়েছে। তাড়াহুড়োতে রায়হান টাকা নেয়নি দেখে আফজাল হোসেনকে বাসায় গিয়ে টাকা দিয়ে দিবে বলেছে। আফজাল হোসেন কিছু বলেনি। তাঁর টাকা নেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। কতটুকুই বা খরচ হয়েছে। ফার্মেসি দেখে অযথা কথা বাড়ায়নি সে। রায়হানদের আসতে দেখে জয়নব বেগম দ্রুত ছুটে আসলো। কোলে রাহমিদ কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ। ভাইকে দেখে কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করে উঠলো। জয়নব বেগমকে খামচি দিতে থাকলো। রায়হান রুদকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। উঠানোর দরকার নেই। রায়হান ঘেমে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। সে প্রচুর ক্লান্ত। রাহমিদকে কোলে নিয়ে বসলো বিছানায়। জয়নব বেগম পানি দিলো। সে ঢকঢক করে পানি খেলো যেনো কতবছর ধরে পানি খায়না সে। রায়হান জয়নব বেগমকে বললো,

“এসব কেমন করে হলো আন্টি?”

রায়হানের ভেঙে যাওয়া কণ্ঠ। জয়নব বেগম ইতস্তত করতে লাগলেন। রায়হান কত ভরসা করে তার কাছে বাচ্চাটাকে আমানত রেখে গেলো আর সে একটু দেখে রাখতে পারলো না। সে মাথা নিচু করে বললো,

“তুমি চইলা যাওনের অনেক্ষণ পর রুদ ঘুমের থিকা উঠছে। উইঠা আসে পাশে তোমারে না দেইখা কান্না করতে লাগছিল। তখন আমি বুঝাইয়া শুনাইয়া কল পাড়ে লইয়া যাই মুখ ধোওনের লাইগা। রোমানার ডাকোনে রান্নাঘরে যাই বাচ্ছাটারে দাঁড় করাইয়া। হঠাৎ ওর চিৎকারে দৌড়াইয়া যাইয়া দেহি ওয় পইড়া রইছে কল পাড়ের নিচে সিমেন্টের শক্ত জায়গাডায়। তারপর…”

“তারপরের কাহিনী আর বলা লাগবে না আন্টি। বুঝেছি। আপনি যান। রান্নার সময় চলে যাচ্ছে।”

জয়নব বেগম বুঝলেন ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে ভীষণ। তার উপর রেগে আছে বুঝাই যাচ্ছে। তাই সে বললো,

“বাবা, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আমি…”

“না আন্টি আপনাকে মোটেও ভুল বুঝিনি। এটাই আমাদের নিয়তি মেনে নিয়েছি। আরও কত ঝড় আসবে জীবনে এটা তো কিছুই না।”

রায়হানের ভাঙা গলার নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরে জয়নব বেগম কেঁপে উঠলেন। বাচ্চাটার অবস্থা দেখে তার হু হু করে কান্না আসছে। চোখে আঁচল চেপে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অপরাধবোধ তাঁকে ঝেঁকে ধরেছে। বাচ্চাটাকে রক্ষা করতে পারলেন না। আহারে! কি রক্ত গিয়েছে। ভাবতেই তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে আঁচল ভিজিয়ে দিলো।
_____
—–

রাত দশটা। রুদকে এক গ্লাস নিডো দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে রায়হান। দুধ খাওয়ানোর আগে অবশ্য কিছু হালকা তরল জাতীয় খাবারও খাইয়েছে একটু। অবশ্য তা জয়নব বেগম দিয়ে গেছেন। বাচ্চাটা কিচ্ছু মুখে দেয়নি সারাদিন। ব্যথায় জ্বর এসে গিয়েছে। ঠোঁট ফুলে উঁচু হয়ে গেছে। ওষুধ খাইয়ে দিয়ে রুদকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সে। রাহমিদ পাশে খেলনা দিয়ে খেলছে। রায়হান ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। রাহমিদের চিৎকারে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে উঠে ওকে কোলে নিলো। বাচ্চাটাকে আজকের আনা সেরেলাক বানিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রাহমিদ না খেয়ে দুষ্টুমি করছিল। এমনিতেই আজকের সারাদিনের ধকল তার উপর রাহমিদের নখরামি। শরীরটা ভালো না, রুদের চিন্তা, রাহমিদের দুপুরে না খাওয়া, নিজের পেটে দানাপানি না পড়া। আর সহ্য করতে না পেরে রাহমিদের পিঠে জোরে থাপ্পড় দিলো। বাচ্চাটা কানে তালা লাগানোর উপক্রম করলো যেন। চিল্লিয়ে কেঁদেকেটে নাক মুখ ফুলিয়ে ফেললো। রায়হান ওই অবস্থায় খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা মুখ থেকে সব গলগল করে ফেলে দিলো। জিদে হাত, পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো। রুদের ঘুম ভেঙে যাবে দেখে রায়হান ওকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। পিঠে আদর করে দিতে লাগলো কিন্তু কান্না থামছে না বাচ্চাটার। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে বাইরে বের হলো। বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো আর রাহমিদকে চারপাশ দেখিয়ে কান্না থামাতে চেষ্টা করলো। তার শরীরটা ভেঙে আসছে যেন। কত রাত ঠিক করে ঘুমাতে পারেনা সে। রাহমিদ কান্না থামিয়ে হেঁচকি দিতে থাকলো। রায়হান অনেকক্ষণ পর ঘরে আসলো। কোলে রাহমিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বালিশ দিয়ে বর্ডার করে দিলো চারপাশ। ঘুমের ঘোরে পড়ে যাতে না যায়। রায়হান নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে খিদে পেটেই বালিশে মাথা রেখে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো। তাকে দেখে যে কেউ বলবে, একটা যুদ্ধ করে এসে অনেকদিন পর একটু চোখ বুঝলো যেন। কারণ তার চোখের নিচের কালো দাগ ভাঙা শরীর, ঘামে ভিজা গেঞ্জি, জানান দিচ্ছে অনন্ত কাল ধরে সে ক্লান্ত।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৭

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৭
#তাজরীন_ফাতিহা

সারা রাত রায়হান দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাহমিদ প্রচুর জ্বালিয়েছে। বাচ্চাটা নিজেও ঘুমায়নি তাকেও ঘুমাতে দেয়নি। রায়হানের চোখে ঘুম নামছে। চোখ খুলে রাখতে পারছে না সে কিন্তু এখন ঘুমালে চলবে না। সকাল সকাল বাজার করতে যেতে হবে। তাছাড়াও এখন ঘুমালে ফজর মিস হয়ে যেতে পারে। সে কোনোভাবেই বিনা ওজোরে নামাজ ছাড়তে ইচ্ছুক না। বাবাকে দেখতো যতই অসুস্থ থাকতো, নামাজ কখনোই ছাড়তো না। মা কখনো নামাজে গাফিলতি করলে বাবা কববের আযাব ও হাশরের দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতো। সেই ছোট্ট রায়হান বাবার হাত ধরে মসজিদে যেতো হাতে থাকতো জায়নামাজ। পড়নে থাকতো বাবা ও তাঁর শুভ্র পাঞ্জাবি। তখন তো রাহমিদ, রুদ কেউ ছিল না। বাবা মায়ের সকল আদর, ভালোবাসার ভাগীদার একমাত্র সে ছিল। বাবা, মায়ের কোলে চড়ে দুষ্ট, মিষ্টি খুনসুটির সেইসব স্মৃতি তাঁর মানসপটে উঁকি দিচ্ছে তীব্রভাবে। সেইসব ভাবলেই তাঁর চোখের কোনা ভিজে উঠে। এখন সব কেমন ধোঁয়াশা, স্মৃতি! রায়হান এইসব ভাবতে ভাবতেই ভিজা চোখে ভাইবোনের দিকে তাকালো। সে তো তাও আদর, ভালোবাসা পেয়েছে কিন্তু রুদ, রাহমিদ তো কিচ্ছু পেলো না। রুদটা যাও একটু পেয়েছে রাহমিদ তো মাত্র আট মাস বয়সে দুধের শিশু অবস্থায় বাবা, মাকে হারিয়েছে। এইসব ভেবেই রায়হানের মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। রাহমিদকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলো আরেক হাতে রুদকে আগলে নিলো। এরা ছাড়া তাঁর এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই কথাগুলো ভেবেই চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝরলো।
_______

দূর থেকে ফজরের আযানের আওয়াজে রায়হানের ঘুমে লেগে আসা চোখ খুলে গেলো। স্মৃতিচারণ করতে করতে কখন যে চোখ দুইটা লেগে আসছিল সে জানে না। রায়হান বিছানা থেকে উঠে বসলো। রাহমিদের প্যান্টে হাত দিয়ে দেখলো ভিজা। তৎক্ষণাৎ প্যান্ট পাল্টে ফেললো। কিছু না পরিয়েই ছোট কাথা দিয়ে ওকে ঢেকে দিলো। নিজেও রাহমিদের প্রসাবে ভিজে গেছে। জামাকাপড় নিয়ে টয়লেটে গেলো দ্রুত। একটু বেলা হলেই মানুষ উঠতে শুরু করলে টয়লেটে ভিড় লেগে যাবে তখন গোসল করতে পারবে না। রায়হান দ্রুত টয়লেটে গিয়ে গোসল করে নিজের, রুদের আর রাহমিদের জামা কাপড় ধুয়ে বের হলো। ততক্ষণে আকাশ কিছুটা অন্ধকার মুক্ত হওয়ার পথে। রায়হান বুঝলো ফজরের ওয়াক্ত বেশি নেই। বাচ্চাগুলোর জামাকাপড় ধুতেই অনেক সময় লেগে গেলো। দ্রুত ঘরে যেয়ে নামাজ আদায় করলো। রায়হান জায়নামাজে বসে জিকির, দোয়া খায়ের করে উঠলো। বাইরে বের হয়ে দেখলো চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে। ভোরের মিষ্টি হাওয়া বইছে চারপাশে। তাঁর বাবা বলতো, এই সময় নাকি বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হয়। কি সুন্দর এই সময়টা! রায়হানের বরাবরই ভালো লাগে। বলে উঠলো, সুবহানাল্লাহ্!
______

জয়নব বেগম জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠলেন। সেই সময় আফজাল হোসেন মসজিদ থেকে এসে ঘরে ঢুকলো। জয়নব বেগম বললেন,

“রায়হানের লগে কতা কইছো? কি নাকি কইবা?”

“এত সকালে উঠছে?” আফজাল হোসেন টেবিলে টুপি রাখতে রাখতে বললেন।

“আরে আমি দেখছি ওগো ঘরের দরজা খুলা। যাইয়া দেইখা আসো। আইজকা না বাজার করবো? অহনো ঘুমায় থাকবো না।”

“আইচ্ছা দেখতেছি।”

আফজাল হোসেন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন উদ্দেশ্যে রায়হানদের ঘর। উনি ঘরের সামনে গিয়ে দুটো টোকা দিলেন। দুই মিনিট পর দরজা খুলে গেলো। রায়হানকে দেখে আফজাল হোসেন বললেন,

“ডিস্টার্ব করলাম?”

“জি না। আমি জেগেই ছিলাম। ভিতরে আসুন আংকেল।”

“না আর ভিতরে বসবো না। তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আসলাম।”

“জি বলুন।”

“কালকেই জিজ্ঞাসা করতাম কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি বাজার করতে পারো?”

রায়হান ইতস্তত করলো। আসলে কখনোই সে বাজার করেনি। বাজার করার প্রয়োজনও পড়েনি। বলতে গেলে রাজার হালেই সে থেকেছে এতদিন। এইসব করার লোক ছিল তাঁদের কিন্তু নিয়তি যে এমন হবে সে যদি জানতো তাহলে অবশ্যই বাজার করা ও অন্যান্য কাজ শিখে রাখতো। আফজাল হোসেন বুঝলেন ছেলেটা বাজার করেনি কখনো। তাই তিনি বললেন,

“ঠিক আছে, সমস্যা নাই। আজকে সাথে দিলদারকে নিয়ে যেয়ো। ওই তোমাকে শিখিয়ে দিবে।”

রায়হান ঘাড় কাত করে বললো, “জি আচ্ছা।” আফজাল হোসেন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছিলেন হঠাৎ একটা কথা স্মরণ হওয়ায় থেমে গিয়ে বললেন,

“ভালো কথা। তোমার ভাইকে কি করবে? ওতো তোমার আন্টির কাছে থাকতে চায়না। তোমার বোনকে তো রাখা যাবে কিন্তু তোমার ভাই?”

রায়হানের যে কথাটা মনে হয়নি তা না, মনে হয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। রেখে যেতেই হবে। ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাবে আন্টির কাছে। ও জলদি চলে আসার চেষ্টা করবে। সেটাই আফজাল হোসেনকে বললো। আফজাল হোসেন তাঁর কথায় সম্মতি দিলো। যাওয়ার আগে আরেকটা প্রশ্ন করলেন যা রায়হানকে স্তব্ধ ও নিশ্চল করে দিলো। রায়হান মুখে কথাটা আউরালো,

“তুমি কি আর পড়াশোনা করবে না।”

রায়হান আসলেই জানে না এর উত্তর কি।
______
—-
রায়হান ও দিলদার কাঁচাবাজারে এসেছে। রায়হানের কোলে রাহমিদ। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে আছে। বাচ্চাটাকে রেখে আসতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটা বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই জয়নব বেগমের কাছে থাকবে না সে। রায়হান আর রেখে আসতে পারেনি। এখানে এসেই মাছ, মাংসের উৎকট গন্ধে তাঁর নাড়িভুড়ি উল্টে আসতে চাইলো। কোনরকম রাহমিদকে এক হাত দিয়ে ধরে আরেক হাতের বাজু দিয়ে নাক মুখ ঢাকলো। দিলদারের হাতে বাজারের ব্যাগ। সে রায়হানের কাণ্ড দেখে হেঁসে ফেললো। বললো,

“আল্লাহ্ তুমি দেহি গন্ধ সহ্যই করতে পারতেছ না? প্রতিদিন কেমনে বাজার করবা?”

“আসলে এইসবে অভ্যস্ত না তো তাই। আপনি চিন্তা করবেন না আমি পারবো।”

“এহনো তো মাছ গোস্তের পাশে গেলামই না এহনি এমন হইলে তহন কি হইবো?”

“ভাই এইসব কথা বাদ দেই। দেরি হচ্ছে, বাজার করে ফিরতে হবে।”

কথাটা শুনে দিলদারের হঠাৎ সম্বিত ফিরলো। আসলেই তো হোটেলের রান্নাবান্না শুরু করতে হবে তাড়াতাড়ি। সে দ্রুত পা চালালো। সবজি যা যা প্রয়োজন সব কিনলো আর রায়হানকে সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো। রায়হান মনোযোগ দিয়ে সব শুনলো। তবে বিপত্তি বাজলো এক জায়গায়। মাছের বাজারে ঢুকেই রায়হান হর হর করে বমি করে দিলো। এতক্ষণ সহ্য করা গেলেও এখন কোনোভাবেই নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সে। দিলদার বাজারের ব্যাগ রেখে দ্রুত রায়হানকে ধরলো।রাহমিদকে কোলে নিতে চাইলে সে গেলো না। রায়হান ক্লান্ত হয়ে রাহমিদকে নিয়ে রাস্তায় বসে পড়লো। বাজারে কয়েকজন এগিয়ে আসলো। পানি এগিয়ে দিলো। দিলদার রায়হানের মাথায় পানি ঢেলে দিয়ে কুলি করিয়ে পানি খাওয়ালো। কিছুক্ষন পর রায়হান নিজ থেকেই উঠলো। দিলদার বললো,

“চলো তোমারে বাসায় দিয়া আহি।”

“না তাঁর প্রয়োজন নেই। এখন ঠিক আছি।”

“তুমি অসুস্থ হইয়া পড়ছো এই অবস্থায় বাজারে থাকন লাগবো না। গন্ধে আরও বমি করবা।”

“না ভাই। প্রথম তো তাই সহ্য করতে পারিনি। কয়েকদিন বাজার করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি চলুন। অনেক দেরি হচ্ছে।”

দিলদার আর কিছু বললো না। মাছ, গোশত কিনলো। রায়হান নাকে টিস্যু চেপে তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে থাকলো আর দিলদার যা যা কিনলো সব চিনে রাখলো। কোলে রাহমিদ তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো। ভাইয়ের কোলে নাড়াচড়া করছে সে। বাজার শেষ করে আসার পথে রায়হান রাহমিদকে বহন করার জন্য একটা বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগ কিনলো। দাম সাড়ে চারশো রাখলো। চেয়েছিল সাতশো। রায়হান টাকা দিতে গেলে দিলদার বাঁধা দিলো। দিলদার দামাদামি করে সাড়ে চারশোতে কিনে দিলো। রায়হান অবাক হলো। সে খেয়াল করেছে প্রত্যেকটা বাজার দিলদার ভাই এভাবে দামাদামি করে কিনেছে। এভাবে দামাদামি করা যায়, সে জানতো না। দিলদার হাঁটতে হাঁটতে বললো,

“এই দুনিয়ায় চলতে হইলে এরকম বলদ হইলে হইবো না। যে যা চাইবো তাই দিয়া দিলে দুই দিনে রাস্তার ফকির হইয়া যাইবা। দেখলা না আইজকা কেমনে দামাদামি করলাম। চাচায় যা টেকা দিছিলো সব কিন্তু খরচ হয় নাই। কিছু বাইচ্চা গেছে। এই টেকা দিয়া বাকি দিন আবার বাজার করমু। বুঝছো?”

রায়হান বোকার মতো মাথা নাড়ালো। তাঁর কাছে অল্প কিছু টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়েই ব্যাগটা কিনলো। আজকে দিলদার ভাইয়ের সাথে থেকে সে অনেক কিছু শিখলো। দুনিয়ার নিয়মনীতি বুঝা বড় দায়।
_____

“রুদ……..”

রায়হান বাজার ফেলে জোরে চিৎকার দিলো।

চলবে..

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৬

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৬
#তাজরীন_ফাতিহা

রাত ১০টা। রাহমিদ ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। উঠেই আশেপাশে কাউকে না দেখে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করেছে। রায়হান রুদকে নিয়ে টয়লেটে গিয়েছিল। রাহমিদের কান্নার শব্দে দ্রুত রুমে ছুটে এলো। ওকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে শান্ত করতে লাগলো। রাহমিদ ভাইকে দেখে শান্ত হয়ে ভাইয়ের ঘাড়ে মুখ দিয়ে পড়ে রইলো। ক্ষণে ক্ষণে ফোপাচ্ছে বাচ্চাটা। রায়হান ওকে নিয়েই টয়লেটের সামনে দাঁড়ালো। রায়হান রাহমিদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,

“আমার টোটন সোনা ভয় পেয়েছে। ভয় পায়না বাচ্চা। কি লাগবে আমার লাড্ডুর? ভাইয়ু তো এইখানে।”

রাহমিদ ভাইয়ের কথা শুনে ঘাড় থেকে মাথা উঠিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর রায়হানের মুখে হাত দিয়ে খামচি মারলো যেন এটা দ্বারা বুঝালো তাঁকে একলা রেখে যাওয়ার শাস্তি। রায়হান ভাইয়ের কান্ডে ফিক করে হেসে দিলো। তারপর রাহমিদকে উপরে উঠিয়ে পেটে নাক চেপে সুড়সুড়ি দিতে থাকলো। বাচ্চাটা ফিচফিচ করে হেঁসে উঠলো। রায়হানও ওকে ঠেসে ধরে হাসতে লাগলো। এর মধ্যেই রুদ টয়লেট থেকে বের হলো। রুদকে দেখে রায়হান এগিয়ে গেলো। রায়হান রুদকে নিয়ে ঘরে আসলো। এর মধ্যেই রাহমিদ রায়হানের গায়ে প্রসাব করে দিলো। রায়হান হতাশ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। ঘুমের মধ্যে রাহমিদ কয়েকবার প্রসাব করায় ওর ভিজা জামাকাপড় পরিবর্তন করে দিয়েছে সে। এখন আবার নোংরা করলো নিজেকে সাথে রায়হানকেও। রায়হান হতাশ হয়ে রাহমিদকে বললো,

“এত শাস্তি! একটু আগে না খামচি মারলে এখন আবার সুসু করে দিয়েছো ভাইয়ুর গায়ে। বজ্জাত একটা। এখন পড়াবো কি? লেংটু থাকো তুমি। কিচ্ছু পড়বো না তোমায়। পড়ালেই আবার নোংরা করবে।”

রাহমিদ ভাইয়ের কথা বুঝতে না পারলেও বুঝলো তাঁকে ধমক দিচ্ছে। তাই সে আবারও কেঁদে উঠলো। রায়হান ওকে আবারও শান্ত করার কাজে লেগে পড়লো। ভাগ্যিস নামাজটা পড়ে ফেলেছিল টোটন উঠার আগে নাহলে তো এই রাতের বেলা আবারও গোসল করা লাগতো। কালকে ফজরের আগে উঠে গোসল করে ফেলতে হবে যেহেতু টয়লেটে ভিড় লেগে যায় একটু বেলা হলেই। এখানে থাকতে হলে অনেক পরিশ্রম করে থাকতে হবে। শুয়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে আরাম আয়েশের জীবন ত্যাগ করে এসেছে সে। যদিও এমন পরিবেশের সাথে সে ও তাঁর ভাইবোন অভ্যস্ত না তবুও মানিয়ে তো নিতেই হবে।
_____
—-
জয়নব বেগম রাহমিদের জন্য সুজি রান্না করে নিয়ে এসেছে। রায়হানের কাছ থেকে শুনেছে বাচ্চাটা খিচুড়ি তেমন খায়নি। খাওয়া নিয়ে অনেক জ্বালায় বাচ্চাগুলো। রায়হান ছেলেটার জন্য তাঁর ভারী মায়া হয়। আহারে কি নিয়তি! এই বয়সেই কত দায়িত্ব তাঁর মাথার উপর। জয়নব বেগম আল্লাহর কাছে মন খুলে রায়হানের জন্য দোয়া করেন। জয়নব বেগম রায়হানের হাতে সুজির বাটি তুলে দিলো। বললো,

“ওরে একটু সুজি খাওয়াইয়া দেহো। বেশি কইরা দুধ দিয়া বানাইছি। এইডা নিশ্চয় খাইবো।”

রায়হান বাটি হাতে নিয়ে বললো,

“এত কষ্ট না করলেও হতো আন্টি। এরকম বড়লোকি দেখানো উচিত না আমাদের জন্য। খিচুড়ি খায়নি দেখে আপনি সুজি আনলেন তারপর সুজি যখন খাবে না তখন কি আনবেন? ওদের আমি আমার সাধ্যের মধ্যে যা খাওয়াতে পারবো তাই ওদের খেতে হবে। দরকার হলে পান্তা ভাত ডলে ওকে খাওয়াবো। যেটুটুকু খায় খাবে। তাঁদের বুঝতে হবে ভাই তাঁদেরকে এত হাই প্রোফাইলের জীবন দিতে পারবে না।”

কথাগুলো বলতে বলতে রায়হানের গলা ধরে আসলো কিন্তু জয়নব বেগমের সামনে শক্ত থাকলো। জয়নব বেগম কিছু বলার ভাষা পেলেন না। জয়নব বেগম যদি বলে, তিনি খাওয়াবেন তাহলে তিনি নিশ্চিত রায়হান আর একমিনিটও এখানে থাকবে না। এই ছেলের আত্মমর্যাদা অনেক তা দুইদিনে তিনি ভালোই বুঝেছেন। আর তাছাড়াও তাঁদেরও তো তিনজনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব না। আবেগ দিয়ে ভাবলেই তো হবে না বিবেক দিয়েও ভাবতে হবে। মৌনতা ভেঙে জয়নব বেগম শুধু বললো,

“রুদরে তো আগেই খাওয়াইয়া দিছো, তোমারে খাওন দিমু? রাহমিদরে খাওয়াইয়া তুমি চাইরটা খাইয়া লও।”

” না আন্টি এখন খাবো না। আংকেল আসলে আংকেলের সাথে খাবো। ওনার সাথে কথা আছে আমার। আপনাদের ঘাড়ের উপর আর কয়দিন? কিছুতো একটা করতে হবে। বসে থাকলে তো আর চলবে না।”

“আইচ্ছা তোমার আংকেল আইলে তোমারে ডাইকা দিমুনি। তয় তাঁর ফিরতে মেলা রাইত হইবো তুমি চাইলে কয়টা খাইয়া লইতে পারো এহন, পরে আংকেলের লগে বইসা দুইটা খাইয়ো।”

“না আন্টি দরকার নেই। আমি অপেক্ষা করবো।”

“আইচ্ছা, তোমার মর্জি।”

জয়নব বেগম চলে গেলেন। রায়হান এতক্ষণ তাঁর সাথে কথা বলছিল আর সুজিটা ঠাণ্ডা করছিল। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে রাহমিদকে তাঁর ভাঁজ করা পায়ের উপর শোয়ালো। তারপর বাচ্চাটার বুকের উপর সকালের মতোই তোয়ালে দিলো। রাহমিদ বুঝলো তাঁকে খাওয়ানোর তোড়জোড় চলছে। সে মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিলো রায়হান হাঁটু নাড়িয়ে তাঁকে আদর করতে লাগলো আর চমচ বাড়িয়ে মুখের সামনে ধরলো। বাচ্চাটা সুজি কয়েক চামচ খেলো। সকালের চেয়ে বেশি। তবে খেতে খেতে বহুবার নড়েচড়ে খাবার মুখ দিয়ে ফেলে দিয়েছে। রায়হান কিচ্ছু বললো না। আরও কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে বাটিতে কিন্তু রাহমিদ কিছুতেই খেতে চাইলো না। যাই মুখে দিলো তাই মুখ থেকে ফেলে দিতে লাগলো। রায়হান প্রচণ্ড রেগে ধমক লাগিয়ে বললো,

” একদম মেরে ফেলবো। খাবার নিয়ে খালি ইতরামি। একটু আগে হাসি এখন ছলচাতুরি। ফাজিল কোথাকার। সকালে, দুপুরেও এরকম নখরামি করেছো, এখন আবার করছো। একদম দুইদিন উপোস রেখে দিবো তখন বুঝবে খিদের কি জ্বালা?”

রাহমিদ ভাইয়ের ধমকে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান এবার আদর করলো না। আদর করলেই খেতে চাইবে না, নখরামি শুরু করবে আর সারা রাত খিদে পেটে একটু পরপর কাঁদবে। মাকে দেখেছিল রাহমিদ খাওয়া নিয়ে তামাশা শুরু করলেই জোর করে হলেও খাওয়াতো রাতের বেলা। কারণ বাচ্চাটা রাতের বেলা খিদে পেটে একটু পর পর মাকে জ্বালাতো অথচ মা আবার খাওয়াতে চাইলে এই বিচ্ছু খেতে চাইতো না তাই একবারেই জোর করে হলেও খাইয়ে দিতো। কান্নার ফলে মুখ হা হওয়ায় সেই মুখের মধ্যে সুজি ঢুকিয়ে দিলো। বাচ্চাটা কাঁদতেই থাকলো। রায়হান সম্পূর্ণ খাওয়ানো শেষ করে রাহমিদের হাত,পা ছেড়ে দিলো নাহলে এতক্ষণ হাত,পা ছুঁড়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতো। এমনিতেই অনেকগুলো লাথি, খামচি খাওয়া শেষ। বাচ্চাটার মুখ ধুয়ে দিয়ে কোলে নিলো। রাহমিদ কান্না করতেই থাকলো। রায়হান ওকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক আদর করলো আর গালের সাথে গাল মিলিয়ে বলল,

“ভাইয়ু বকা দিয়েছি টোটন সোনাকে। টোটন সোনা খাবার নিয়ে জ্বালায় দেখেই তো ভাইয়ু বকা দিয়েছি। আমার লাড্ডু খাবার নিয়ে আর দুষ্টুমি করবে? ভাইয়ু নাহলে আবারও বকবো।”

বাচ্চাটা ভাইয়ের কাঁধে ফুপিয়ে যাচ্ছে। রায়হান তাঁকে অনেক্ষন ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে না। রায়হান জানে আজকে আর ঘুমাবেও না। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। এখন সে না ঘুমিয়ে রায়হানকে জ্বালাবে। রায়হান বিছানায় তাকিয়ে দেখে রুদ ঘুমিয়ে পড়েছে। রুদের গায়ে পাতলা একটা কাঁথা টেনে দিলো। মশায় নাহলে বাচ্চাটাকে খেয়ে ফেলবে। রায়হান রাহমিদকে বুকে নিয়ে রুদের পাশে শুলো। ক্লান্তিতে তাঁর চোখ দুটো মুদে আসতে লাগলো।
_____
—-
আফজাল হোসেন অনেক রাত করে দিলদারকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আজকে দিলদার কোনো কথা তেমন বলেনি। রুস্তম ভাইয়ের হাতে চড় খেয়ে তাঁর প্রেস্টিজে লেগেছে। তাঁর সময় আসুক ওই রুস্তম বখাটে জাউরারে সে দেখে নিবে। আফজাল হোসেন ঘরে এসেই ফ্যানের নিচে বসলেন। জয়নব বেগম তাঁকে পানি এনে দিলো আর বললো,

“এত দেরি কইরা ফিরলেন যে। আইজকা কি কাস্টমার বেশি আছিলো?”

“হ্যাঁ গো। তা আইজকা হঠাৎ এই কথা জিগাইলা যে। আমারে মনে পড়ছিল বুঝি?”

“আপনের ফাউ প্যাঁচাল রাহেন। এমন একটা ভাব করলেন যেন কহোনোই আপনেরে জিগাইনা আইজকাই খালি জিগাইছি।”

“না ঠিক তা না। আইজকা কেমন যেন তাড়াহুড়া লাগলো কতায় কইতরী।” আফজাল হোসেন মুচকি হেঁসে বলে উঠলো।

“আপনের যতসব আজগুবি কতা। যান তাত্তারি হাত মুখ ধুইয়া আহেন। রায়হান পোলাডায় আপনের অপেক্ষায় বইয়া আছে। আমি ভাত বাইরা আনি।”

“কি কও, রায়হান এহনো খায় নাই? ওরে না খাওয়াইয়া রাখছো কেন?” তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“আপনের লগে খাইবো কইলো। অনেক জোর করছি খাইবো না। আপনে হাত মুখ ধুইয়া আহেন আমি ওরে ডাইকা লইয়াই।”

আফজাল হোসেন হাত মুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন। জয়নব বেগম রায়হানদের দরজায় এসে টোকা দিলেন কিন্তু খুললো না। আবারও অনেক্ষণ টোকা দিতে থাকলেন।
_____
—-
আফজাল হোসেন আর রায়হান ভাত খাচ্ছে। রায়হানের চোখে ঘুম। রায়হানের কোলে রাহমিদ দুষ্টুমি করছে। জয়নব বেগম বাচ্চাটাকে নিতে চাইলে বাচ্চাটা কান্না করে দিয়েছিল। ভাইয়ের কোল ছাড়া সে কারো কোলে যাবে না। জয়নব বেগমের রায়হানের জন্য খারাপ লাগলো। তখন দরজায় বারি দিয়ে ছেলেটার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছেন। কি আর করার, ছেলেটা না খেয়ে আফজাল হোসেনের জন্য অপেক্ষা করছিল ডাকতে তো হতোই। জয়নব বেগম তাঁদেরকে তরকারি বেড়ে দিলেন। হঠাৎ আফজাল হোসেন জিজ্ঞাসা করলেন,

“তুমি নাকি কিছু বলবে আমাকে, বলে ফেলো?

রায়হান ভাতটুকু গিলে মৃদু গলায় বললো,

“আংকেল আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। খুবই দরকার। ওদেরকে নিয়ে চলতে হলে একটা কাজ করতেই হবে।”

“আমাদের এখানে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?” আফজাল হোসেন জানতে চাইলেন।

“না সমস্যা হবে কেন? আপনাদের ঘাড়ে আর কয়দিন। রুদকে ভর্তি করাবো ভাবছি, রাহমিদকে দেখাশোনা, নিজেদের ভরণপোষণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, বাসা ভাড়া এইসবে তো টাকা লাগবে। তাই চাচ্ছি আগেভাগেই একটা কাজ ধরতে তাহলে মাস শেষে একটু দ্রুত টাকা হাতে আসবে। হাতে অল্প কিছু টাকা আছে। মাস চালানো যাবে না। আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন আংকেল? আপনার কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবো।”

“আরও কয়দিন যাক। তোমরা এখানে থেকে অভ্যস্ত হয়ে নাও তারপর নাহয় ধীরে সুস্থে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে।”

“না আংকেল আপনাদের ঘাড়ে এতদিন খেতে পারবো না। এতদিন বসে খেলে আপনাদেরই একসময় বিতৃষ্ণা লেগে যাবে আর আমার নিজেরই লজ্জা লাগবে আপনাদের এখানে এভাবে বসে বসে খেতে। প্লিজ আংকেল আমার অনুরোধটা রাখুন।”

আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগম ছেলেটার কথায় মুগ্ধ হলেন। রায়হানের আত্মমর্যাদাবোধ তাঁদেরকে আবারও তাঁর প্রতি মুগ্ধ হতে বাধ্য করলো। আফজাল হোসেন বললেন,

” বাবা, তেমন কোনো কাজ তো আমার খোঁজে বর্তমানে নেই।”

কথাটি শুনে রায়হানের মুখ কালো হয়ে গেলো। বহু আশা নিয়ে এসেছিল। আফজাল হোসেন ইতস্তত সুরে বললেন,

“তবে একটা কাজ আছে কিন্তু…”

“কিন্তু কি আংকেল?”

“তোমাকে কথাটা কিভাবে বলি তুমি লেখাপড়া জানা মানুষ?”

“সমস্যা নেই আংকেল, যেই কাজই হোক আমি করবো তাছাড়া কোনো কাজই ছোট না। পড়ালেখা করে তো এটাই শিখেছি। বেতন অল্প হলেও সমস্যা নেই। কিছু না করার থেকে টুকটাক কাজ করা ভালো।”

“আসলে আমার হোটেলের প্রতিদিনের বাজার করার জন্য একটা লোকের দরকার ছিল। আমি প্রতিদিন বাজারে যেতে পারিনা। হাঁপানি উঠে। দিলদারকে দিয়ে বাজার করিয়েছি এতদিন ও তো এমনিতেই হোটেলে কাজ করে, বাজার করে ছেলেটা হাঁপিয়ে যায় তাই তুমি যদি করতে…”

“সমস্যা নেই আংকেল আমি করবো।”

আফজাল হোসেন খুশি হলেন। রায়হান ছেলেটাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। বাজার করার কাজ তিনি ইচ্ছা করেই দিলেন। ছেলেটা কখনোই কোনো কাজ করেনি হঠাৎই যদি বড় কোনো কাজ করতে বলতেন তাহলে ছেলেটা পারতো না। আস্তে আস্তে কাজ শিখুক উনি এমনিতেই একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা রায়হানকে করে দিবেন। ছেলেটার প্রত্যেকটা কথা খুবই গোছানো। খুব সহজেইএকটা কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারবেন আশা করা যায়।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৫

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৫
#তাজরীন_ফাতিহা

“এই দিলু এক প্লেট ভাত দে দ্রুত?”

দিলদার টেবিলে টেবিলে কাস্টমারকে খাবার দিচ্ছিলো। এর মধ্যেই প্রতিদিনের কাস্টমার হাফিজ ভাই এসেই উক্ত কথাটা বললেন। দিলদার প্লেটে ভাত বেড়ে হাফিজ ভাইয়ের টেবিলে দিয়ে গেলো। সাথে দিলো আলু ভর্তা আর মুগের ডাল। এই লোক জীবনেও মাছ,গোশত খায় না। খায় না নাকি পকেটে টাকা নেই কে জানে? তবে দিলদার তাঁর কর্মজীবনে এখন পর্যন্ত তাকে এসব খেতে দেখেনি। খুব বেশি হলে ডিম দিয়ে খায়, এর বেশি কিছু খেতে দেখেনি। দিলদার আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আফজাল হোসেন ক্যাশিয়ারে বসে আছেন আর পেপার পড়ছেন। এর মধ্যেই হোটেলে এলাকার বখাটে রুস্তম হাজির তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। দিলদার চরম বিরক্ত হলো। এই লোক ও তাঁর সঙ্গীরা এসেই তাঁর নামের দফারফা করবে। তাঁকে নিয়ে মজা করবে। এর সাথে যে তাঁর কীসের শত্রুতা আল্লাহ্ মাবুদই ভালো জানেন। একে দেখলেই সে দূরে দূরে থাকে কিন্তু ভাগ্য খারাপ বলে এই বাদাইম্মা গুলোর সাথে প্রতিদিন আল্লাহ্ তাঁকে সাক্ষাত করায়। সে হতাশ, চরম হতাশ। রুস্তম এসেই দিলদারকে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো,

“এই কে কোথায় আছিস, তাড়াতাড়ি কইয়া ফেলা কমিডি ম্যান দিলদার কোথায়?”

দিলদার কোনো সাড়া দিলো না। এর কাজ এসেই ঢংয়ের আলাপ করা। মেজাজ গরম হয় তাঁর। বখাটে রুস্তম ও তাঁর সাগরেদরা একটা টেবিলে বসে সেটার উপর বারি দিতে দিতে গেয়ে উঠলো,

“ভাত বেঁচা দিলদার বানাইলো মোরে বৈরাগী, দিলদারের হোটেলে ভাতও খাইলাম, ডাইলও খাইলাম
ভাত আর ডাইল দিয়া বানাইলাম মিক্স খিচুড়ি
ওরে ভাত আর ডাইল দিয়া বানাইলাম মিক্স খিচুড়ি
ভাত বেঁচা দিলদার বানাইলো মোরে বৈরাগী… ই.. ই।”

রুস্তমের সব চেলাপেলা গান শেষে চিৎকার করে উঠলো। তারই দলের সবুজ চিক্কুর দিয়ে বলে উঠলো,

“ভাই আপনে এক্ষান চীজ, কি মিলাইছেন ভাই। আহা”

আরেক চেলা তাল মিলিয়ে বললো,

“হ ভাই আপনে জিনিস, ভাই জিনিস।”

রুস্তম এতক্ষণ এত প্রশংসায় গদগদ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের সামনের চুল ( যদিও চুল নাই, হালকা একটু মাথার টাকের সাথে ঝুলে আছে সেটাই ) পিছনের দিকে নেয়ার একটা পোজ দিচ্ছিলো। হঠাৎ জিনিস বলায় ক্ষেপে গেলো। এটা আবার কেমন প্রশংসা। জিনিস মানে কি? সে কেন জিনিস হতে যাবে? সে রাগান্বিত কন্ঠে ওই চেলার দিকে তাকিয়ে বললো,

“জিনিস মানে কি? এক চড়ে দাঁত ফালায়া দিমু তোর? আমি কি বেঁচাবেচির কিছু। ফাউল কোনহানের।”

ওই চেলার নাম বাচ্চু। সে থতমত খেয়ে গেলো। সে তো ওই জিনিসের কথা বলেনি। বলেছে ঐযে বুদ্ধিমান গো কয় ঐটা কিন্তু ভাইয়ে দেখি রাইগ্গা গেছে। তাঁর দিকে সবাই কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে সবুজের দিকে তাকালো অসহায় নয়নে। সবুজ বুঝতে পরলো এই বদ একটা বলতে গিয়ে আরেকটা বলে গড়বড় করে ফেলছে। বদের ঘরের বদ ইংরেজি না জানলে কইতে গেছস ক্যান? তাই সে দ্রুত মফিজ ভাইকে ঠাণ্ডা করতে বললো,

“ভাই আপনে জানেন না এই ছাগলে ইংরেজি জানে না? ওয় মূলত কইতে চাইছিল জিনিয়াস। কইয়া ফেলাইছে জিনিস। কইতে পারেনা তো তাই। আপনে রাগ কইরেন না।”

রুস্তম এবার ঠাণ্ডা হলো। পড়ালেখা তাঁর ক্লাস এইট পর্যন্ত।। সে জানে জিনিয়াস মানে কি, আর কিছু বললো না। পোলায় তো প্রশংসাই করছে, তাই রাগ কমে গেলো তাঁর। হঠাৎ দিলদারের কথা মনে পড়ায় জোরে হাক দিয়া ডাকলো,

“আমার দিল আহে না ক্যা্?”

দিলদার ভেবেছিল এই আপদ আজকে রেগেমেগে বিদায় হবে, সে খুশি হয়েছিল প্রচুর কিন্তু ঐযে তাঁর কপাল। তুই বেডা মানুষ তুই ইভটিজিং করবি মাইয়া মাইনষেরে, তা না কইরা এই আপদ তাঁর পিছনে লাগছে ক্যান? উফফ একটা বিহিত করতেই হবে এই ফাউল লোকের। বিরক্ত হয়ে দিলদার সেখানে গিয়ে বললো,

“ভাই আপনের সমস্যাটা কি একটু খুইল্লা কন তো? আপনি কি ঐযে বেডা বেডা আকর্ষণ থাহে হেই রকমের কিছু?”

রুস্তম না বুঝে বললো,

“কি কইলি?”

“কইলাম আপনে কি বেডা বেডা যে করে, ওই যে আছে না ঐরকম কিছু কিনা?

“বেডা বেডা করে মানে?” রুস্তম হতভম্ব গলায় জানতে চাইলো।

“হেইডা তো আমার থেইকা আপনের ভালো জানার কথা।”

রুস্তমের দলের সব লোক বড় বড় চোখ করে দিলদারের দিকে তাকিয়ে আছে। কামাল ফট করে বলে উঠলো,

“তুই কি গে* গো কতা কইলি?”

“গে* মে কইতে পারুম না কিন্তু যেইডাই হউক, ওইডাই কিনা জিগাইছি।” দিলদার সরল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললো।

রুস্তম তড়াক করে উঠে দিলদারকে একটা চড় বসিয়ে দিলো। হোটেলের সবাই এতক্ষন ভয়ে ভয়ে ছিল এই বখাটে কোনো গণ্ডগোল করবে কিনা। আজকে রুস্তমের মন মেজাজ ভালো ছিল বলে ভেবেছিল কিছু করবে না কিন্তু দিলদারের এই কথা শুনে সবারই ভয় লাগা শুরু হয়েছিল আজকে তুলকালাম না হয়ে যায়। ঠিক ভেবেছিল তাঁরা। রুস্তম বখাটে বেজায় ক্ষেপেছে। আফজাল হোসেন একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। এসেই দিলদারকে গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে আর রুস্তমকে রাগে কাপতে দেখে দ্রুত সেখানে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,

“কি হয়েছে এত ভিড় কেন এখানে?”

রুস্তম আফজাল হোসেনকে কিছু না বলে দিলাদারের দিকে তাকিয়ে বললো,

“মজা করি দেইখা আমারে ফাউল মনে অয়। এইসব ফাউল ভাবনা তোর মাথায় আহে কেমনে? তোরে ছোট ভাই ভাইবাই একটু মজা করি আর তুই, ছি।”

দিলদার এমনিতেই ভীতু। আজকে রুস্তম ভাইয়ের এত রাগ দেখে ভীষণ ভয় পেলো। সে এইসব বলতে চায়নি। একবার মাসুদ ভাই বলেছিল, “যখনি রুস্তম তোরে ক্ষেপাইবো তুই সাহস কইরা এই কতা কইয়া দিবি দেখবি আর ক্ষেপাইবো না, শরমে পালাইবো।” প্রতিদিন ক্ষেপানো কার ভালো লাগে, তাইতো আজকে সাহস করে বলেছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি কথাটা অনেক খারাপ কিছু মিন করে।
_____
—-
সন্ধ্যা নেমেছে একটু আগে। রায়হান রাহমিদকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বাচ্চাটা ঘুমে ঢুলছিল। ওকে ঘুম পাড়িয়ে রুদের কাছে গেলো চিরুনি নিয়ে। রুদকে বললো,

“রুদ সোনা ভাইয়ুর কাছে আসো, চুলে তেল দিয়ে বেঁধে দেই। চুলে জট পাকিয়ে ফেলেছো তো?”

রুদ ভাইয়ের কথা শুনে ভাইয়ের কাছে গেলো। রায়হান রুদের মাথায় খুব যত্ন সহকারে তেল দিয়ে আঁচড়ে দিলো। রুদ শান্ত বাচ্চার মতো বসে ছিল। বেণী করার সময় রায়হান বললো,

“রুদ ভাইয়ুকে A,B,C গুলো শুনাও তো একদম Z পর্যন্ত।”

রুদ শুনালো। রায়হান মনোযোগ দিয়ে শুনলো আর বললো,

“গুড। আমার রুদ সোনা দেখি পুরোটা পারে। বলোতো রুদ স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি?”

“সরবন্ন এগারোটি, ব্যঞ্জনবন্ন উঁচল্লিশটি।”

“ব্যঞ্জনবর্ণ চল্লিশটি সোনা। ক্ষ- কে বাদ দেয় দেখে ঊনচল্লিশটি ধরা হয়। ক্ষ- ও কিন্তু একটি ব্যঞ্জনবর্ণ। আগে একে ধরা হতো না বর্তমানে ধরা হয়, বুঝেছো সোনা।”

“বুঝিচি।”

“গুড, ভেরি গুড।”

রায়হানের চুল বাঁধা শেষ। রুদকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে। রায়হানের দ্রুত একটা কাজের প্রয়োজন। ভাইবোনদের একটা সুন্দর ভবিষ্যত তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে। আজকে আফজাল হোসেন বাসায় আসলে তাঁর সাথে কথা বলতে হবে। আগামী দিনের চিন্তায় তাঁর ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। বাচ্চা দুটোর একটা গতি না করা পর্যন্ত এই চিন্তার শেষ হবে না বোধহয়।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৪

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৪
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হান রুদের হাত, মুখ ধুইয়ে ওকে নিয়ে ঘরে আসলো। রাহমিদকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাচ্চাটা হাত,পা ছড়িয়ে খেলতে লাগলো। রায়হান ব্যাগের মধ্যে চিরুনি খুঁজতে গেলো। রুদ রাহমিদের সাথে খেলছে। রাহমিদ বোনকে দেখে হাত বাড়িয়ে ফিচ ফিচ করে হাসলো। রুদ রাহমিদের গালে গাল ঘষলো আর আদর করলো। রাহমিদ বোনকে কাছে পেয়ে বোনের খোলা চুলে হাত ঢুকিয়ে টানতে লাগলো। এতে রুদ ব্যথা পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে রাহমিদের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। রাহমিদের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে ফ্যালফ্যাল করে বোনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে জোরে কেঁদে উঠলো। রায়হান চিরুনি খোঁজা বাদ দিয়ে দ্রুত রাহমিদের কাছে আসলো। রুদ ভয় পেয়ে গেলো। ও তো অতটা জোরে মারেনি। তাহলে বাবুন কাঁদলো কেন? রায়হানকে পেয়ে রাহমিদের কান্না আরও বেড়ে গেলো। রায়হান ভাইকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলো,

“আমার লাড্ডুর কি হয়েছে? এইতো ভাইয়া। কি হয়েছে কাঁদে কেন? আমার টোটন, গোল্লার কি খিদে পেয়েছে? এইতো ভাইয়ু খাবার দিব। কাঁদে না, একদম কাঁদে না। কে কাঁদিয়েছে আমার লাড্ডুকে, কার এত বড় সাহস?”

রাহমিদের কান্না কিছুটা কমে গেলো। ফোঁপাচ্ছে বাচ্চাটা। রায়হান ভাইয়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটতে লাগলো। রুদ কাচুমাচু করছে। কিছুক্ষন হাঁটার পর বাচ্চাটা ভাইয়ের কোলে শান্ত হয়ে পরে রইলো। রায়হান এবার রুদের দিকে তাকালো। দেখলো রুদ বালিশে মাথা দিয়ে ফোঁপাচ্ছে। ফুস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। বুঝতে পারলো রুদই কিছু করেছে। রুদ যদি কখনো কোনো কাণ্ড ঘটাতো তখন এরকম বালিশে মুখ ঢুকিয়ে কাঁদতো। নিশ্চয়ই রাহমিদকে মেরেছে নাহলে বাচ্চাটা কি সুন্দর হাসছিল হঠাৎ করে এত জোরে কেঁদে উঠবে কেন। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে রুদের কাছে গেলো। বোনের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,

“ভাইকে মেরেছো রুদ? ভাই ব্যাথা পেয়েছে না? ভালো বাচ্চারা কাউকে মারে না। আদর করে দাও ভাইকে। ওঠো সোনা।”

রুদ ভাইয়ের শান্ত কথায় কেঁদে উঠে ভাইয়ের কোলে মুখ লুকালো। রায়হান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। রাহমিদ মুখে আঙ্গুল ভরে ভাইয়ের ঘাড় থেকে মুখ তুলে বোনের দিকে তাকালো। রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে গালে গাল ঘষে চুমু দিলো। রাহমিদ বোনের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে ভাইয়ের কাঁধে মুখ লুকালো যেন বলতে চাইলো তোমার আদর লাগবে না। রুদের কান্না কিছুটা কমে এলে রায়হান আবারও তাঁকে ভাইকে আদর করতে বললো। রুদ এবার নাক টেনে বললো,

“বাবুন চুলি বিথা দিছে, তাই মিরেছি কিন্তু বিশি জুরে দি নাই।”

রাহমিদ রুদদের কথা শুনে ভাইয়ের ঘাড় থেকে মুখ উঠিয়ে বোনের দিকে উঁকি মারলো। তারপর ভাইয়ের দিকে ফুলো ফুলো গালে তাকিয়ে রইলো। রায়হান রুদকে উঠালো। উঠিয়ে চোখ মুছে দিলো। আদর করে বলতে লাগলো,

“বাবুন ছোট তো সোনা। ওকে আস্তে মারলেও ব্যথা লাগবে, জোরে মারলেও লাগবে। বাবুনের আপি না তুমি? বড় আপিরা কি ছোট ভাইকে মারে, উল্টো আরও আদরে রাখে। তুমি আদর করে দাও।”

রুদ মুখ কালো করে রাহমিদের দিকে চাইলো তারপর বড় ভাইয়ের দিকে। রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রুদ এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। রায়হান তা দেখে হেঁসে দিয়ে রাহমিদকে ওর কাছে দিতে চাইলো কিন্তু রাহমিদ যেতে নারাজ। ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। ভাবটা এমন একটু আগে মাইর দিয়ে এখন দরদ দেখানো লাগবে না। রায়হান সেটা দেখে ওর গালে গাল লাগিয়ে বললো,

“দুষ্টু বাচ্চা একটা। তুমি আপির চুল টান দিয়েছো পঁচা ছেলে? ভারী দুষ্টুমি করো তুমি। যাও আপির কাছে, আপি আদর করে দিবে।”

রাহমিদ কেঁদে উঠে রায়হানের গলা জড়িয়ে মুখে আঙ্গুল ভরে চুষতে লাগলো। রায়হান বুঝে গেলো বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। রুদের মারায় যতটা না ব্যথা পেয়ে কান্না করেছে, খিদের চোটে এর থেকে বেশি কেঁদেছে। রায়হান রুদের দিকে একবার চাইলো, দেখলো রুদের মুখ শুকিয়ে গেছে সকাল থেকে না খাওয়ার দরুন। রায়হানের হঠাৎ করেই নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করলো। বাবা, মা না থাকলে পৃথিবীটা কি সবার কাছেই এমন মনে হয়?
_____

জয়নব বেগম রায়হানদের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। একটু পর দরজা খুলে গেলো। তিনি দেখলেন, রায়হান রাহমিদকে শান্ত করতে করতে দরজা খুলে দিয়েছে। জয়নব বেগমের হাতে খাবার। রায়হান তাঁকে ঘরে ঢুকতে জায়গা করে দিলো। তিনি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

“বেশি দেরি কইরা ফালাইলাম মনে অয়। অনেক বেলা হইয়া গেছে। আসলে হোটেলের রান্দন চুলায় চাপানো আছিল। রাইন্দা শেষ কইরা তোমগো লাইগ্যা কয়টা রুটি বানাইলাম আর বাবুর লাইগা ল্যাটকা খিচুড়ি। তাঁর লাইগ্যা দেরি হইয়া গেছে। আইচ্ছা বাবু ল্যাটকা খিচুড়ি খাইতে পারে তো? ওর বয়সের বাবুরা খাইতে পারে দেইখ্যা বানাইলাম। কাইলকা রাইত থেইকা তো হুদা দুধ খাওয়া তাই ভাবলাম একটু ভারী খাওন দেই।”

রায়হান বাবুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, “খেতে পারে সমস্যা নেই। এত কষ্ট করে রুটি বানানোর দরকার ছিল না।”

“অত কতা না কইয়া বাবুরে আমার কাছে দাও। আমি ওরে খাওয়াই দেই। তুমি তোমার বইনরে খাওয়াইয়া তাত্তারি খাও। বেলা অনেক হইলো।”

রায়হান রাহমিদকে জয়নব বেগমের দিকে বাড়িয়ে দিলো কিন্তু রাহমিদ ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো মানে অপরিচিত করো কোলে সে যাবে না। জয়নব বেগম তা দেখে বললো,

“ওমা কি হইলো? কাইলকা রাইতেই তো কোলে বইসা ফিটার খাইলো এহন এরোম করতেছে ক্যান? ওরে তো ঠাণ্ডা ভাবছিলাম।”

রায়হান রাহমিদকে আদর করতে করতে বললো,

“আসলে অপরিচিত কারো কাছে ও যায় না। কালকে রাতে চোখে ঘুম ছিল দেখে কার কোলে ছিল বুঝতে পারেনি। আপনি আপনার কাজে যান আন্টি। এমনিতেই আমাদের জন্য যথেষ্ট করেছেন। আমি ওদের খাইয়ে নিজে খেয়ে প্লেট বাটি ধুয়ে দিয়ে আসবো।

“তা হইলে কেমনে হইবো? ওদের খাওয়াইতে সময় লাগবো তো অনেক, তুমি খাইবা কখন তাইলে?”

“সমস্যা নেই আন্টি। আপনি কি সবসময় আমাদের দেখার জন্য থাকবেন? ওদেরকে তো আমারই দেখতে হবে। এখন একদিন সাহায্য করলে পরবর্তীতে আমার খারাপ অভ্যাস হয়ে যাবে। ওদেরকে তখন সামলানো মুসকিল হবে, তাই এখনই এই অভ্যাস করে নি।”

জয়নব বেগম ছেলেটার ম্লান বদনে তাকিয়ে ভাবলেন এই বয়সেই দায়িত্বের বেড়াজাল ছেলেটার চিন্তা ভাবনা কতটা পরিপক্ব করে দিয়েছে। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ছেলেটা তাঁর সিক্ত চোখ দেখে ফেললো নাতো?
_____
—-
রায়হান রুদকে রুটি ছিঁড়ে ছোট ছোট করে দিলো। রুদকে রুটি ছিঁড়ে দিলে ও নিজ হাতে খেতে পারে। রুদ নিজ হাতে খেতে লাগলো আর রায়হান রাহমিদকে ল্যাটকা খিচুড়ি খাওয়ানোর মিশনে নামলো। রাহমিদকে কোলে শুইয়ে বুকের উপর তাওয়াল দিয়ে দিলো যাতে নড়েচড়ে খাবার শরীরে ভরে না ফেলে। চামচে করে রাহমিদের মুখে কয়েকবার দিলো। হঠাৎ করে বাচ্চাটা খাবার মুখ দিয়ে ফেলে দিলো। রায়হান কয়েকবার চেষ্টা করেও ওকে খাওয়াতে পারলো না। শেষে বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললো,

“খুব জালাচ্ছো রাহমিদ, পিটাবনে এখন। পাঁচ চামচও খাওনি, খাও।”

রাহমিদ ভাইয়ের ধমক শুনে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো। রায়হান ওকে বুকের সাথে মিশিয়ে আদর করলো তাও বাচ্চাটার কান্না থামলো না। রায়হানের নিজেরই কান্না এসে গেলো। সে রুদের দিকে তাকিয়ে দেখলো রুদ রুটি খেতে গিয়ে বেশিরভাগ ফেলে দিচ্ছে। তাঁর মা,বাবাকে খুব করে মনে পড়লো। রাহমিদ, রুদ খেতে না চাইলে মা কত কি করতো। ওরা খেতে না চাইলে মা বকা দিলে, বাবা উল্টো মাকে বকা দিতো। চোখের সামনে সেইসব স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো। রায়হানের চোখ ছলছল করে উঠলো। কিভাবে সে দুই ভাইবোনকে মানুষ করবে? এটা তো কেবল শুরু এখনো কত পথ বাকি। এইসব ভাবতে ভাবতে রায়হানের চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কান্নারত ছোট ভাইয়ের মুখে।
_____
—-
আফজাল হোসেন ও তাঁর সহকর্মী দিলদার ভ্যান গাড়িতে করে খাবার নিয়ে হোটেলে চলে গিয়েছে। জয়নব বেগম স্বামীকে বিদায় দিয়ে এসে দেখলেন রায়হান কল পাড়ে থালা বাসন ধোঁয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়াটিয়ারা নিজেদের থালাবাসন পরিষ্কার করছে আর রায়হানের দিকে তাকিয়ে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে। তিনি দ্রুত সেখানে গেলেন। গিয়ে শুনতে পেলেন একজন জিজ্ঞাসা করছে,

“আইচ্ছা তুমি জয়নব বুবুগো কেমন আত্মীয় লাগো? তোমারে সকালেও দেখলাম টয়লেটে কতগুলা বাবুর কাপড় ভিজাইয়া রাখছো, তোমার মা, বাবা কই, হ্যাঁগো তো দেখলাম না?

রায়হান উত্তর দিতে পারলো না। কেমন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকলো, যেন এইরকম ভারী প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। জয়নব বেগম দ্রুত বললেন,

“তোমার এত কৌতূহল ক্যান সব কিছুতে ময়নার মা? ওয় আমগো কেমন আত্মীয় লাগে হেইডা যায়না তোমার কি কাম? নিজের চরকায় তেল দিতে পারো না, খালি এর কি হইছে, ওর কি হইছে, ক্যান এগুলান হইলো এইসব জিগাইয়া তোমার কি কোনো লাভ আছে? এইসব কতা কইয়া ওরে আর বিব্রত করবা না কইলাম। নিজের কাম সাইরা তত্তারি সরো এইহান তে। আমরাও কাম করমু, দাঁড়াইয়া থাকনের সময় নাই।”

ময়নার মা প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করলো। নিজের থালাবাসন ধুয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো। রায়হান থালাবাসন হাতে নির্জীবের মতো দাড়িয়ে রইলো। আজকে একজন জিজ্ঞাসা করছে কালকে আরও কতজন কত কি জিজ্ঞাসা করবে, এটা তো মাত্র শুরু। এইসব ভেবেই নিজের ভাগ্যের উপর হাসলো।

চলবে….