Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 43



জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-৩৩

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৩.১
তাজরীন_ফাতিহা

“তুমি এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে বড় মেয়ে মানুষ?”

রাহমিদ বিজ্ঞের মতো কথাগুলো বলে থামলো। ইফরা মুখ গম্ভীর করে বললো,

“তো বাসা থেকে বের হয়ে যাবো? বড় মেয়ে মানুষ আবার কি?”

রাহমিদ থতমত খেলো। তারপর সেও মুখ গম্ভীর করে বললো,

“তুমি বিরক্ত হচ্ছো কথায়?”

“যদি বলি হ্যাঁ তাহলে কি কথা বলা বন্ধ করবে?”

রাহমিদ মুখ কুঁচকে ইফরার দিকে তাকিয়ে রইলো। রুদ এক গ্লাস পানি নিয়ে ইফরাকে দিলো। ইফরা চুপচাপ বিসমিল্লাহ বলে পানি পান করলো। ওর মুখ এখনো গম্ভীর।

আজকের মতো একটা দিনে তাদের বাসা খালি। মাত্র তিনজন মানুষ তারা। আজকে আরেকজন যোগ হয়েছে। তাদের ভাইয়ুর বউ। রুদ মনে মনে কথাগুলো ভেবে ইফরাকে উদ্দেশ্য করে খুশিমনে বললো,

“ভাবি তোমার এখানে কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে। তুমি আমাকে রুদ বলে ডেকো। রুদ বলে ডাক দিলেই আমি দৌঁড় দিয়ে তোমার কাছে চলে আসবো।”

হাসিমুখে কথাটা বলে ইফরার দিকে তাকালো। ইফরা মুখ অন্ধকার করে বললো,

“অপরিচিত কাউকে আপনি সম্বোধন করতে হয় সেটা জানো না? এভাবে হুট করে বড় কাউকে তুমি বলবে না। দুইজনের কেউই না। এটা ব্যাড ম্যানার্স।”

রুদের হাসিখুশি মুখ নিমিষেই চুপসে গেলো। রাহমিদ বোনের কালো মুখ দেখে বললো,

“আপুনি চলো এখান থেকে। উনি বোধহয় আমাদের উপর বিরক্ত হচ্ছেন।”

রাহমিদের কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পাচ্ছিলো। নিজের অপমান সহ্য করলেও বোনের অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না সে। তাই কিছুটা রাগ প্রকাশ পেলো তার কথায়। বোনকে টেনে হিঁচড়ে রুম থেকে নিয়ে তাদের বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলো।

ইফরা চুপচাপ রোবটের মতো উঠে মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লো। তার মন মেজাজ কোনোটাই ভালো নেই। বেশিরভাগ সময় সে চুপচাপ থাকে কারণ মুখ খুললেই তো রোবোটিক আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বের হয়না। এই গুরুগম্ভীর স্বভাব নিয়ে আগামী দিনগুলো ইফরার কেমন কাটবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউই তা জানে না।
______

রায়হান রুমে ঢুকে রুম অন্ধকার পেলো। বুঝে নিলো মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে বাথরুমে গিয়ে মুখ, হাত, পা ধুয়ে বের হলো। ভাইবোনকে দেখার উদ্দেশ্যে পাশের রুমে গেলো। দেখলো তার ভাইবোন একে অন্যকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। রাহমিদটা ছোট বেলা থেকেই হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমায়। এখনো হাত, পা ছড়িয়ে বোনের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর রুদ ভাইকে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। রায়হানের চোখ জুড়িয়ে গেলো। পরক্ষণেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো। এতদিন সে এই ভাইবোনকে আগলে ঘুমাতো আর আজ থেকে তারা আলাদা থাকবে। তার সাথে ঘুমানোর মানুষ এসে গেছে।

রায়হান অবশ্য ওদের ঘুম পাড়িয়েই ওই রুমে চলে যেতো। বোনকে কমফোর্ট জোন দেয়ার জন্য রুদ বড় হওয়ার পর পরই অন্য রুমে ঘুমাতো সে। রাহমিদ শুধু বোনের সাথে ঘুমায়। যেহেতু বড় ভাই বোনের মাঝখানে ঘুমিয়ে অভ্যাস রাহমিদের তাই শুধুমাত্র ছোট ভাইয়ের জন্য তারা তিনজন একসাথে ঘুমাতো। এখন চাইলেও আর ভাইবোনের সাথে ঘুমাতে পারবে না।

রায়হান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইবোনকে চুমু দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ভাইবোনগুলো আজকে তার সাথে কথা না বলেই ঘুমিয়ে গেলো। ভাইয়ের বউ আসার খুশিতে এতদিনের অভ্যাস ভুলে গেলো। রায়হান চেহারায় অসন্তুষ্টির রেখা ফুটে উঠলো কিছুটা।
_____

রায়হান রুমে এসেই বিছনায় শুয়ে পড়লো আস্তে করে। ইফরা আস্তে করে উঠে বসলো। বললো,

“আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?”

রায়হান তড়াক করে উঠে বসলো। বললো,

“জি না। আমি ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।”

ইফরা হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

“না ঘুমাই নি। জেগেই ছিলাম। শুনুন কিছু কথা খোলাশা করা জরুরি বলে আমি মনে করি।”

ইফরার স্বভাবজাত কাঠখোট্টা কথা। রায়হান কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেলো। তার জানা মতে মেয়েরা বিয়ের রাতে লাজুক থাকে। কথা থাকে ছোট কিন্তু এই মেয়ের কথা দেখি বুলেটের মতো খড়খড়ে। তার নিজেরই তো একটা মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করতে লজ্জা লাগছে। সেখানে মেয়েটা কি অবলীলায় কথাগুলো বলছে। ইফরা রায়হানের চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই রায়হানের হুঁশ ফিরলো। রায়হান কোনমতে বললো,

“জি বলুন।”

ইফরা রোবোটিক গলায় বললো,

“আমার এখানে এডজাস্ট করতে সময় লাগবে। আমার উপরে খবরদারি করা যাবে না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিতে হবে। কোনো কিছুর জন্য জোরজবরদস্তি করা যাবে না। যেহেতু আমার বাবা মা তাদের ঘাড় থেকে নামিয়ে আপনার ঘাড়ে ট্রান্সফার করেছেন সেহেতু আমাকে না পড়ালেও চলবে। আপনার টাকাও বেঁচে যাবে। বুঝেছেন?”

রায়হানের মনে হলো বাজারের কোনো ফর্দ শুনানো হচ্ছে। যেহেতু ইফরার রগচটে স্বভাব সম্পর্কে সারোয়ার হোসেন আগেই কিছুটা অবগত করেছেন তাই রায়হান আর রাগ করলো না। অন্য কেউ হলে ওর কথার বিপরীতে প্রচণ্ড রাগ করতো। বিয়ের রাতেই বরের সাথে বেয়াদবি করার জন্য তার জন্য সালিশ বসানো হতো। তবে রায়হান কিছুই করবে না। এর থেকেও কত কঠিন কঠিন পরিস্থিতি রায়হান মোকাবেলা করেছে সেখানে এতটুকু রোবোটিক খিটখিটে কথা হজম করাই যায়। সে মুচকি হেঁসে কৌতুক গলায় বললো,

“বিছানাটা কি আলাদা করতে হবে সাহেবা?”

ইফরা চোখ মুখ আগের চেয়েও শক্ত করে রায়হানের দিকে তাকালো। তারপর শক্ত গলায় বললো,

“না।”

রায়হান আড়মোড়া ভেঙে বললো,

“যাক বাবা বাঁচলাম। বিছনা আলাদা করতে বললে অবশ্য সমস্যা ছিল না। নাটক সিনেমার মতো আমার সোফা না থাকলেও বিকল্প পন্থা একটা ছিল। ভাইবোনের খাটে গিয়ে আরামছে শুয়ে পড়া যেতো।”

ইফরা আগের মতোই বসে আছে। রায়হান বুঝলো প্রথম দিনেই মজা করা ঠিক হয়নি। চেনা জানা হয়নি এতেই মশকরা করা উচিত হয়নি। তাই তাড়াতাড়ি করে বললো,

“আরে রেগে যাচ্ছেন কেন? নরমাল হয়ে বসুন। আপনি কি সব কোথায় এরকম রেগে থাকেন নাকি?”

ইফরা কোনো কথা বললো না। রায়হান কথা ঘুরাতে আবার বললো,

“আরে আমরা তো পরিচিতই হলাম না। তখন থেকে অহেতুক কথা বলেই যাচ্ছি।”

ইফরা এবার মুখ খুললো,

“আমার পরিচয় দেয়ার মতো কিছুই নেই। আমি একজন মেয়ে। এটা ছাড়া আমার কোনো পরিচয় নেই।”

“এটা কেমন পরিচিতি। এরকম বললে তো আমার কোনো অস্তিত্বই পৃথিবীতে নেই। বাবা, মা থেকেও যদি আপনার কোনো পরিচয় না থাকে তাহলে আমি তো পৃথিবীতে এক্সিস্টই করি না। এবার সুন্দর করে আমার পরিচয় বলি। তারপর আপনি বলেবেন। ঠিক আছে?”

ইফরা কিছুটা নরম হয়ে বসলো। কোনো কথাই বললো না। রায়হান বলতে শুরু করলো,

“আমার নাম রায়হান জাইম। খন্দকার রায়হান জাইম। বাবার নাম মৃত খন্দকার রাতিব ইকবাল। মায়ের নাম মৃত জাইয়ানা আনজুম। আমরা তিনজন ভাইবোন। বোনের নাম খন্দকার রুদাইফা জিনাত আর ভাইয়ের নাম খন্দকার রাহমিদ জাইফ। আমার পরিবার এই দুইজন। আমার সব কিছু এই দুজনকে ঘিরে। সংক্ষেপে আমাদের তিনজনেরই পরিচয় আমরা এতিম। আমি একটা কোচিং সেন্টারে জব করি। এবার আপনার পালা ম্যাডাম।”

“সংক্ষেপে আমারদের তিনজনেরই পরিচয় আমরা এতিম” কথাটা বার বার ইফরার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। হাসিমুখের আড়ালে কথাটায় কি পরিমাণ কষ্ট লুকায়িত ছিল ইফরা একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছে। ইফরার মন কিছুটা নরম হলো। রায়হানের ডাকে এবার কল্পনা থেকে বের হয়ে বললো,

“আমার নাম ইফরা সাবরিয়াহ। আমার কোনো ভাইবোন নেই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানি নিয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছি। আমার অভিবাবক আমার দাদি। এতোটুকুই আমার পরিচয়।”

“আপনার বাবা, মায়ের নাম তো বললেন না?”

ইফরা কথা ঘুরিয়ে বললো,

“আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ুন তাহলে।”

“হ্যাঁ ঘুমাতে হবে। কালকে সকালে আবার উঠতে হবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি একটু আসছি।”

রায়হান ঘড়ি দেখে তাড়াহুড়া করে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ভাইবোনের রুমে গিয়ে ওদের গা থেকে চাদর সরিয়ে দিলো। বাচ্চা দুটো ঘেমে গেছে। রায়হান তাদের শিয়রে বসে কিছুক্ষণ মাথা হাতিয়ে দিলো। তারপর ঘাম মুছে দিলো। ভাই বোন তার প্রচুর ঘামে। এটা বর্ষাকাল তবুও ভ্যাপসা গরম পড়ে এই সময়টায়। কারেন্ট চলে গেলে তো আরও সমস্যা হয়। সারা রাত সে হাত পাখা চালিয়ে বাতাস দেয়। যাতে ভাইবোনের ঘুম কোনোভাবেই না ভাঙে।

সবকিছু ঠিকঠাক করে বেশ রাতে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। পাশে ঘুমে বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে তার নববিবাহিত স্ত্রী। দুইজন দুই দিকে ফিরে শুয়ে আছে। নববিবাহিতের কোনো ছায়াও এদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কতকালের তাদের সংসার। সারাদিনের সংসার শেষে দুইজন বেহুঁশ হয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।

আগামী দিনের সূর্যোদয় কেমন কাটবে এই নব দম্পত্তির?

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৩.২(বর্ধিতাংশ)
তাজরীন ফাতিহা

ফজরের আজান কানে যাওয়ার সাথে সাথেই রায়হানের ঘুম ভেঙে যাওয়া নতুন কিছু নয়। যত রাত করেই ঘুমাক সে ফজরের আজান তার কানে পৌঁছুবেই। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আজান শুনেই আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে গিয়ে কোনো কিছুর সাথে বাধা পেলো। চট করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো তার নববিবাহিত স্ত্রীর গায়ে হাত, পা মেলে দিয়েছে সে। তাড়াহুড়া করে হাত, পা সরিয়ে ফেললো। একজন মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে তার অনুমতি ছাড়া ব্যাপারটা ভেবেই কেমন যেন লাগছে তার। হোক সে স্ত্রী। তবুও তার ভীষণ অকোয়ার্ড লাগছে।

ইফরার ঘুম ভেঙে গেছে কোনো কিছুর ধাক্কায়। রায়হান হাত, পা সরানোর সময় ইফরার ঘুম ছুটে গেছে। তাকে ধাক্কা দিলো কে? দাদু মণি নাকি? চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো রায়হান বসে বসে কি যেন বিড়বিড় করছে। হঠাৎ চোখের সামনে অপরিচিত জায়গা আর পুরুষ মানুষ দেখে খানিকক্ষণের জন্য তব্দা খেয়ে গেলো। এমনিতেই ঘুম থেকে উঠলে সাময়িক সময়ের জন্য মানুষের স্মৃতি ঘোলাটে থাকে। ইফরারও তাই। আচানক চিল্লিয়ে উঠলো সে। রায়হান চিল্লানোতে হতভম্ব হয়ে গেলো। বললো,

“আরে ভাই আপনি চিল্লাচ্ছেন কেন?”

ইফরা উঠে বসে রায়হানকে ভালোভাবে দেখে বললো,

“দুঃখিত। আমি কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম সব। নতুন জায়গা তো মানিয়ে নেয়া হয়নি এখনো।”

রায়হান আর কিছু বললো না। ওযু করার উদ্দেশ্যে বাথরুমে যাওয়ার পথে ইফরার কথা শুনে থেমে গেলো।

“আপনাদের এখানে জ্বীন, ভূত আছে নাকি?”

রায়হান ঘুরে অবাক স্বরে বললো,

“জ্বীন, ভূত আসবে কোথা থেকে?”

“না রাতে ঘুমের ঘোরে শরীর ভার ভার লাগছিল। এরপর একটু আগে কে যেন ধাক্কা দিলো মনে হলো। নাকি স্বপ্ন দেখলাম বুঝতে পারলাম না।”

রায়হানের এখন সত্যি লজ্জা লাগছে। একটা মেয়েকে রাতে জড়িয়ে শুয়ে ছিল। সে বোধহয় ভাইবোন ভেবে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে বদ অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কালকে রাতে অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরেছে। একজন পুরুষ হয়ে যে পরিমাণ লজ্জা সে পাচ্ছে মেয়ে হলে গাল লাল হয়ে যেতো এতক্ষণে। ছেলে মানুষের লজ্জা দেখা যায়না। তাদের লজ্জা হয় সুপ্ত।

ইফরা রায়হানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যেখানে যাচ্ছিলেন যান। আমি কিছুক্ষণ ঘুমাবো।”

“কেন নামাজ পড়বেন না?”

“কিসের নামাজ? তাহাজ্জুদের?”

“না ফজরের।”

“ওমা আজান দিয়ে দিয়েছে। তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? দ্রুত যান। আপনার ওযু শেষে আমি ঢুকবো। আজকে মাথা ভার ভার লাগছে। এতো তাড়াতাড়ি আজান দিয়ে দিলো।”

“আজান ঠিক টাইমেই দিয়েছে। আপনি আর আমি রাত পর্যন্ত গল্প করলাম না এতেই সময় চলে গিয়েছিল।”

“ওহ। হবে হয়তো। আপনি ওযু করে আসুন।আপনার পর আমি যাবো।”

“আচ্ছা।”

কথাটুকু বলেই রায়হান ওযু করতে চলে গেলো। ওযু করে বের হয়ে দেখলো ইফরা নামাজের খিমার বের করছে। রায়হান তাকে পাশ কাটিয়ে ভাইবোনের রুমে চলে গেলো। ইফরা গুরুগম্ভীর চোখে সেইদিকে তাকিয়ে রইলো। এই পৃথিবীতে তাকে প্রায়োরিটি দেয়ার মানুষের খুবই অভাব। ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত কেউই আগ বাড়িয়ে তার খোঁজ নেয়নি। কেউ নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে অন্যের ঘাড়ে দেয়। অন্যজন আবার খুব যত্ন করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এসব আর এখন গায়ে লাগে না তার।

ইফরা কিছু হয়নি এমন ভাব করে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
______
—-

“রাহমিদ, রুদ উঠে পড়ুন কলিজা। ফজরের সময় হয়ে গেছে।”

রায়হান ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো। রুদ এক ডাকে উঠলেও রাহমিদ বিছনায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। রায়হান তা দেখে বললো,

“নামাজের ব্যাপারে গড়িমসি একেবারেই অপছন্দ আমার। দ্রুত উঠে পড়ুন। আল্লাহকে সিজদাহ দিন। আল্লাহ্ আপনার সারাদিন বরকতময় করে দিবেন।”

রাহমিদ ভাইয়ের কঠোর কথার বিপরীতে তাড়াহুড়া করে উঠে বসলো। উঠে চোখ কচলালো। এর মধ্যে রুদ ওযু করে এসেছে। রাহমিদ ঘুম ঘুম চোখে বাথরুমে গেলো। রায়হান অপেক্ষা করলো ভাইয়ের জন্য। সারাদিনের মধ্যে এই ফজরের নামাজটাই দুই ভাই একসাথে পড়তে পারে। অন্যসময় রায়হান থাকে কোচিংয়ে আর রাহমিদ স্কুলে। রুদ নামাজে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। রাহমিদ বের হলে রায়হান ওকে নিয়ে মসজিদে চলে গেলো।
_____

“ভাবি আসবো?”

রুদ নামাজ পড়ে ইফরার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে। ইফরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। রুদের ডাকে ওর দিকে ফিরলো। ঘাড় কাত করে অনুমতি দিলো। রুদ ঢুকে বললো,

“কি করছেন?”

ইফরা ভ্রু কুঁচকে বললো,

“কি করতে দেখছো?”

রুদ থতমত খেলো। ইফরা আবারও জিজ্ঞাসা করায় রুদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

“দাঁড়িয়ে আছেন।”

ইফরা হাত ভাঁজ করে বললো,

“তো জিজ্ঞাসা করলে কেন? এই প্রশ্নটা বিরক্তকর। অন্তত আমার কাছে খুবই বিরক্তকর। যখন একটা মানুষকে দেখো কোনো কাজ করছে বা বসে আছে অথবা দাঁড়িয়ে আছে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে কেন? কি করছেন? এটা কি কোনো প্রশ্ন হলো? দেখছোই তো দাঁড়িয়ে আছি তাহলে এই প্রশ্নের মানে কি? কোনো কাজ নেই আজাইরা কোয়েশ্চেন করা ছাড়া কিছু মানুষের।”

রুদ মুখ নামিয়ে চোখ মুখ আধার করে দাঁড়ালো। তারপর বললো,

“দুঃখিত ভাবি।

“তোমাকে আমি বকেছি?”

রুদ বুঝলো না কি বলবে এই কথার বিপরীতে। চুপ করে মাথা নিচু করেই থাকলো। ইফরা একটু নরম হয়ে বললো,

“মন খারাপ করো না। তুমি কি প্রতিদিনই এতো তাড়াতাড়ি ওঠো?”

“জ্বি ভাবি।”

“গুড। এভাবেই উঠবে। আর কিছু বলবে?”

“না আর কিছু বলবো না। আপনি সকালে কি খাবেন ভাবি?”

“এই মাত্র না বললে কিছু বলবে না। তাহলে শেষে একটা প্রশ্ন করলে কেন?”

ইফরা ভ্রু নাচিয়ে বললো। রুদ আবারও থতমত খেলাম। ইফরা রুদের থতমত ভাব দেখে বললো,

“তুমি রাঁধবে নাকি?”

“ভাইয়ু রাঁধবে আর আমি সাহায্য করবো।”

“আচ্ছা। কখন রাঁধবে?”

“এইতো মসজিদ থেকে এসে।”

“ও ভালোই তো। তোমার ভাই রান্নাবান্না জানে?”

এই প্রশ্নে রুদকে ভীষণ উৎফুল্ল দেখালো। উৎফুল্ল হয়ে বললো,

“জানেন ভাবি, ভাইয়ু না দারুন রাঁধতে পারে। ভীষণ মজার হয় ভাইয়ুর হাতের রান্না। একবার খেলেই ফ্যান হয়ে যাবেন রান্নার।”

ইফরা আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে রাখলো। তারপর বললো,

“ভালো। তোমার ভাইকে শেফ হতে বলতে। বাইরের দেশ গুলোতে শেফের অনেক মূল্য। বাংলাদেশে অবশ্য নেই। বাইরের দেশে থাকলে অনেক টাকা কামাতে পারতো।”

“টাকা দিয়ে কি হবে? টাকা থাকলে শুনেছি সুখ থাকে না। অনেকে টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে পরিবারকে সময় দিতে পারে না। এমন টাকা দিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে, যা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়?”

রায়হানের প্রশ্নে ইফরা ঘুরে তাকালো। দেখলো রায়হান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পাঞ্জাবি, সাদা টুপি আর কালো প্যান্ট পড়ে আছে যা টাখনুর উপরে গুটিয়ে রাখা। রায়হানকে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। রাতে ঠিক করে খেয়াল করা হয়নি। রায়হান মসজিদ থেকে কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করিনি কেউ। রুদ উৎফুল্ল হয়ে ভাইকে সালাম দিলো তারপর হাতের জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখলো। তারপর ভাইকে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়হান টুপি রাখতে রাখতে বললো,

“আপনার কোনো বিষয়ে ইন্টারফেয়ার করবো না তবে আপনাকেও আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে।”

ইফরা রায়হানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোনো কথা বললো না। রায়হান আবারও বললো,

“আমার ভাইবোনকে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা দয়া করে বলবেন না। ওদের আমি এতটুকুন থেকে মানুষ করেছি। ওরা খুব ছোট থাকতে এতিম হয়েছে। মা, বাবার ভালোবাসা কি তা তারা বলতে পারবে না। যখন মা, বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতো ওদেরকে অন্য কথা বলে ভুলিয়ে রেখেছি। রাহমিদ মায়ের বুকের দুধের জন্য কাঁদলে ফিডার দিয়েছি, সুজি খাইয়েছি, খেতে না চাইলে জোর করে মেরে হলেও খাইয়েছি, টয়লেট করলে পরিষ্কার করেছি, রুদ বমি করলে নিজ হাতে পরিষ্কার করেছি, তাদের গোসল করিয়েছি, রুদের যখন মাকে দরকার তখন নিজে মায়ের মতো দায়িত্ব পালন করেছি। সেই আদরের ভাইবোনের সাথে কেউ উচুঁ স্বরে, তাচ্ছিল্য করে কথা বললে আমার বুক জ্বলে। বুকের মধ্যের হৃদপিণ্ডে ব্যথা অনুভূত হয়। দয়া করে ওদের সাথে একটু নমনীয় হবেন। বিশ্বাস করুন একটু আদর দিলে ওরা ভীষণ খুশি হয়।”

কথাগুলো বলেই উল্টো ঘুরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। চোখে পানি জমেছিল কিনা ইফরা তা দেখতে পেলো না। তবে লোকটার গলা ভার ভার লাগছিল। তার কথা কি সব শুনেছে লোকটা? তার কন্ঠ বেশি রূঢ় শুনিয়েছে কি? নাহলে লোকটা এতগুলো কথা বললো কেন? ইফরার এই প্রথম অপরাধবোধ জাগ্রত হলো। মা, বাবার রাগটা অতটুকু ছেলেমেয়ের উপরে না দেখালেই কি নয়? ওরা তো ছোট থেকেই এতিম। ওদের ভালবাসলে আল্লাহ্ তায়ালাও ভালবাসবেন কিন্তু সে তো ওদের সাথে খারাপ কোনো ব্যবহার করেনি। একটু গম্ভীর হয়ে কথা বলেছে দেখে মনে হয়েছে ধমকাচ্ছে।

ইফরা কি করবে বুঝতে পারছে না। তার কথাই এমন মনে হয় কাউকে মারবে বা ধমকাবে। এরপর থেকে একটু নরম হয়ে কথা বলতে হবে। পরক্ষণেই ভাবলো সে কি লোকটার কথা শোনা শুরু করেছে নাকি? অথচ সে-ই একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিল লোকটার জীবন তামা তামা করে ফেলবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই লোকটা বশ করে ফেললো নাকি তাকে?
_____

“রায়হান কাম তো একটা সাইড়া ফালাইছি।”

অনেকদিন পর রুস্তম ভাইয়ের সাথে দেখা। রায়হানকে দেখেই খুশি হয়ে চা খেতে নিয়ে এসেছে। নানারকম গল্প গুজব করেছে। হঠাৎ করেই উপরোক্ত কথাটি বলে বসলো রুস্তম। রায়হান কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি করেছেন ভাই?”

রুস্তম চা খেতে খেতে বললো,

“তোমার বিয়ার পরই বিয়া কইরা হালাইছি। তয় আমি বিয়া করতে চাই নাই। তুমিই কও এই বুড়া বয়সে বিয়া করাডা বেমানান না? আত্মীয় স্বজন জোর কইরা বিয়া দিয়া দিছে। মাইয়াডা অবশ্য ভালা। তোমার ভাবিরে দেখতে একদিন আইসো বাড়িত।”

“না ভাই। উনি আমার জন্য গায়রে মাহরাম নারী। ওনাকে দেখার ইচ্ছা আমার নেই। তবে আমাদেরকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেললেন দেখে কষ্ট পেলাম।”

“ছরি। তুমি তো আবার ইসলাম মাইনা চলো। ভুইলাই গেছিলাম। আল্লাহ্ মাফ করুক। কিছু মনে কইরো না ভাই। বয়স হইছে তো। সব কিছু ভুইলা যাই। আরে হুট কইরা বিয়া দিছে কইলাম না। রাগ কইরো না। বড় কইরা অনুষ্ঠান করলে তোমারে দাওয়াত দিমুনি।”

এরকম আরও কথা চলতে থাকলো তাদের মাঝে। দুইজন অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করলো। রুস্তম ভাই রায়হানকে পেলে আর ছাড়তে চাননা। রায়হানকে যতদিন দেখা হয়নি ততদিনের কাহিনী বলে তারপর থামবে। নামাজের আজান হলে দুজনেই একসাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

সেই বখাটে রুস্তমের সাথে এতিম রায়হানের কি দারুন সখ্যতা! যে এখন রায়হানের সাথে থেকে ইসলামকে লালন করে গভীরভাবে। সুন্দর না দৃশ্যটি।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-৩১+৩২

0

#জীবন_পেন্ডুলাম(আবর্তিত জীবনচক্র)
#পর্ব_৩১
তাজরীন ফাতিহা

মানুষের জীবন এক অদ্ভুত পেন্ডুলামে আবৃত। দিন যায়, মাস আসে। আবার মাস যায় বছর শেষ হয়। এক অদ্ভুত রহস্যময় পেন্ডুলামের নামই জীবন। ঘুরছে তো ঘুরছেই। কতগুলো দিন কেটে গেলো এভাবে করেই।

সেই ছোট্ট রায়হান এখন আর ছোট্ট নেই। উনিশ বছরের অবুঝ রায়হান এখন যথেষ্ট বুঝদার। লিকলিকে গড়নের শ্যামবর্ণের ছেলেটা এখন পরিপূর্ণ যুবক। বেড়েছে দেহের গড়ন, বয়সের পার্থক্য। হয়েছে আরও পরিপক্ব। সাতাশ বছরের সুঠাম দেহি এক পুরুষ যুবা। মুখে ঘন চাপ দাড়ি। মাঝারি আকারের বেশ অনেকটাই দাড়ি। মুখে গম্ভীর আভিজাত্য। বেশ উঁচু তার গড়ন। দূর থেকে তাকালে মনে হয় যেন আভিজাত্যে মোড়ানো এক পুরুষ হেঁটে আসছে।

শিক্ষক হিসেবে রায়হানের বেশ নামডাক। একটি কোচিং সেন্টার খুলেছে বন্ধুদের নিয়ে। পঞ্চম থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ায় সে এবং তার বন্ধুরা মিলে। ইনকাম ভালোই। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় খেয়ে পড়ে ভালোই আছে রায়হান। একটা ছোট্ট দুই রুমের ভাড়া বাসায় দুই ভাইবোনকে নিয়ে থাকে সে।

রুদ, রাহমিদ ভালোই বড় হয়েছে। রাহমিদটা আগের থেকে আরও দুষ্টু হয়েছে। কিছুদিন আগে রায়হান একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল। সেটা নিয়েই বর্তমানে তার মাতব্বরি চলছে।

রুদ বাচ্চাটা আগের থেকে বড় হয়ে গেছে। এবার এইটে পড়ে সে। বেশ বুঝদার বাচ্চাটা। বড় ভাইয়ের রান্নার সময় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এটা সেটা এগিয়ে দেয়া, থালাবাসন ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া, ঘর মোছা, নিজের ও ছোট্ট ভাইয়ের কাপড় ধুইয়ে দেয়া সবই বাচ্চাটা করে। এই বয়সে দারুণভাবে কাজে পটু হয়ে গিয়েছে সে। রান্নার কাটাকুটিও মোটামুটি করতে পারে তবে রায়হান কখনোই বোনকে দিয়ে কিছু কাটায় না। কখন হাত, পা কেটে যায় বলা তো যায়না। বিপদের তো আবার হাত, পা নেই। বিশেষ করে তার ভাইবোনের বিপদের অভাব নেই। সেই চিন্তা করে রায়হান বোনকে বটি বা ধারালো কিছু দিয়ে কাজ করতে দেয়না।
_____

“বলেছিলাম এই মেয়ের বিয়ে দিতে বহুত কসরত করতে হবে শুনো নি তো। এখন দেখো এই মেয়ের কপালে কি পরিমাণ দুঃখ আছে। এক ছেলেকে নাকি কয়েক বছর আগে সামসুল ভাই দেখেছে ওই ছেলে নাকি সাথে সাথে নাকচ করে দিয়েছে। পরে এই বিষয়ে ভেবে জানাবে বলে যে ভেগেছে আর কোনো খবর নেই ছেলেটার। বুঝে গেছে এই মুখতোড়ের সাথে থাকতে পারবে না।”

ইফরা এই এক কথা গত চার বছর ধরে শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন আর মা নামক এই নারীর কথা শুনতে আর তার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়না। তবে রাগে শরীর জ্বলতে থাকে। ইয়াসমিন আহমেদের সাথে কথা বলে রাগটাকে আর প্রশ্রয় দিতে চায়না সে। মেজাজ গরম নিয়েই চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো সে। সারোয়ার হোসেন “চিহ” শব্দ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বললেন,

“এই এক ডায়ালগ দিতে দিতে তুমি বিরক্ত হও না? মেয়েটাকে সবসময় এসব বলে কি লাভ পাও তুমি?”

“এখন আমার কথা তো খারাপ লাগবেই। এই পর্যন্ত মেয়ের কয়টা সম্বন্ধ ভেঙেছো? এই মেয়েকে আদৌ কেউ বিয়ে করবে? তোমার এতো ছুকছুকে স্বভাব কেন বলো তো? মেয়েকে পড়াশোনা তো বিয়ের পরও করানো যেতো। আমরা করাতাম। এখন বয়স বেশি হয়ে গেলো না? পাত্র পাবে আর?”

“উফফ তুমি একটু থামো তো। আল্লাহ্ যখন ভাগ্যে বিয়ে রাখবে তখনই বিয়ে হবে। আমাদের এসব নিয়ে মাথা ফাটালে কোনো লাভ হবে?”

“তোমার এসব কথার জন্য মেয়ে প্রশ্রয় বেশি পেয়েছে। পাত্রের সামনে রোবটের মতো রাগী ভাষায় কথা বলেছে দেখে দুইটা সম্বন্ধ ভেঙে গেছে। মুখ খুললেই যেন বুলেট বের হয়। মেয়ে মানুষ হবে নরম। কথা হবে ছোট ছোট আর এই মেয়ের মুখ না যেন পারমাণবিক বোমা।”

“তুমি একজন শিক্ষিকা হয়ে মেয়ের সম্পর্কে এতো খারাপ ধারণা রাখো এটা কি মানুষ জানে?”

“সেটাই তো দুঃখ। মেয়েকে মানুষ করতে পারলাম না। আর কিছু থাকুক আর না থাকুক মুখটা আছে।”

“সেটা তোমার ব্যর্থতা নয় কি?”

“আমার ব্যর্থতা? কি বলতে চাও?”

“সেটা তুমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছো। মেয়েকে শাসনের নামে দুঃশাসন বেশি করেছো। কথায় কথায় মেয়েকে সব কিছুতে নিচু করেছো। এগুলো মেয়েকে আরও বেপরোয়া বানিয়েছে।”

“আচ্ছা তাই। তা মেয়ে তোমাকে কেন এড়িয়ে চলে?”

“সেটাও আমার ব্যর্থতা। শিক্ষকতা করতে করতে নিজের মেয়েকেই শিক্ষা ও সময় কোনোটাই দিতে পারিনি। মেয়েটা ছোট বেলায় “বাব্বা বাব্বা ” বলে দৌঁড়ে আসতো। ছোট্ট আদুরে হাত ধরার বয়সে তখন স্টুডেন্ট পড়াতে পড়াতে মেয়েকে অবহেলা করেছি। এখন আফসোস হয় বুঝলে। ভীষণ আফসোস। মেয়েটা আমাদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন চাইলেও মেয়ের সাথে সহজ হতে পারবো না। নিজের অপারগতা কুড়ে কুড়ে খায় আমাকে।”

কথাগুলো বলার সময় সারোয়ার হোসেনের চোখ ভিজে উঠেছিল। খুব সন্তপর্নে তা মুছে ফেললেন তিনি। চশমা খুলে গ্লাস পরিষ্কার করলেন। ইয়াসমিন আহমেদ থম মেরে বসে আছেন। তার নিজেরও কেমন যেন লাগছে আজকে।
_____

ইফরা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানি নিয়ে পড়াশুনা করছে। ছোটবেলা থেকেই তার গাছপালার প্রতি ভীষণ দুর্বলতা। বোটানি সাবজেক্টটা নেয়ার পিছনে এই গাছ প্রিয়তা ভূমিকা রেখেছে শতভাগ। এছাড়াও তার গুরুগম্ভীর স্বভাবের সাথে বোটানি সাবজেক্টটা ভালোই মিলে যায়।

আজকে ভার্সিটি থেকে এসেই তার মেজাজ গরম। বাসায় এখন রীতিমত বিরক্ত লাগে তার। মায়ের ঘ্যানঘ্যানিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাসা থেকেই বের হয়ে যেতে ইচ্ছা হয় মাঝেমধ্যে। শুধুমাত্র দাদুমণির কারণে এখানে থাকে সে। নাহলে কবে হোস্টেলে উঠে যেতো। দাদুমণির জন্য তার ভীষণ টান। এই মানুষটা তার রন্ধ্রে মিশে আছে যেন। তার যত্নআত্তি তো সেই এইটুকুন থেকে এখন পর্যন্ত এই মানুষটাই করছে। এই মানুষটার কিচ্ছু হলে ইফরা বোধহয় মরেই যাবে।

“দাদু মণি কি করছো?”

“হাদীস পড়ছি রে ইফরা মনি। তুই আইসা পড়ছিস? আয় ভিতরে আয়?”

ইফরা ভিতরে ঢুকে দাদীর পাশে বসলো। সালমা হোসেন কিছুক্ষণ বিভিন্ন হাদিস আদরের নাতনিকে পড়ে শুনালেন। তারপর ইফরা দাদীকে কয়েকটা হাদিস পড়ে শুনালো। এভাবেই দুই দাদি নাতনির হাদিস বলার প্রতিযোগিতায় বিকেলটা পার হলো।
____
—-

রায়হান বাসায় ঢুকলো চিপস, চকলেট আর বোনের জন্য ফুসকা নিয়ে। ইদানীং রুদ ফুসকা খাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে গিয়ে ফুসকা খাওয়া শিখছে প্লেট ভরে ভরে। রায়হান সেদিন ওকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে বোনের জন্য ফুচকা আনার চেষ্টা করে। তবে প্রতিদিন আনার সাধ্য তার নেই। যা আয় করে সংসারের পিছনে তা ব্যয় হয়ে যায়। বাড়তি খরচ করার সামর্থ্য তার নেই তবুও মাঝে মধ্যে ভাইবোনের আবদার পূরণ করার চেষ্টা করে সে।

আজকে বাসার সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ লাগছে। দরজাটাও খোলা। আবার কি হয়েছে? রায়হানের বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। এই ভাইবোনের চিন্তায় কোনদিন যেন সে স্ট্রোক করে বসে। ঘরে ঢুকেই ওদের আওয়াজ না পেলেই বুকের মধ্যে কামড় দিয়ে উঠে তার। সেই ছোট্ট থেকে এই দুইজনকে একা হাতে মানুষ করেছে সে। তাদের গায়ে একটা ফুলের টোকা পড়লেও তার শরীর, কলিজা পুড়ে যায় যেন। সে জোরে ডেকে উঠলো,

“রুদ, রাহমিদ কোথায় তোমরা? দ্রুত সামনে আসো?”

কোনো সাড়াশব্দ নেই। রায়হান পুরো ঘর খুঁজলো কিন্তু কোনো অস্তিত্ব পেলো না। কোথায় গেছে দুজন এই সন্ধেবেলা। রায়হানের চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ভাই বোনকে খোঁজার উদ্দেশ্যে বাইরে বের হতে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ায় দ্রুত দরজা খুললো। দেখলো রুদ কাচুমাচু ভঙ্গিতে ছোট ভাইকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ গম্ভীর করে কপাল ভাঁজ করে রায়হান জিজ্ঞাসা করলো,

“কোথায় গিয়েছিলে?

রাহমিদ, রুদ দুইজনের একজনও কথা বলছে না। রায়হান ধমকে উঠে বললো,

“কথা বলছো না কেন? আমাকে না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলে দুইজন? পিটিয়ে তোমাদের পিঠের ছাল তুলে ফেলবো একদম। বেশি মাতব্বরি করো তাইনা। বলেছি না কিছু দরকার হলে সোজা আমায় বলবে। কই গিয়েছিলে?”

“রিমা আন্টির কাছে।”

রুদ ভয়ে ভয়ে বললো। রায়হান ভ্রু কুঁচকে বললো,

“রিমা আন্টির কাছে তোমাদের কি কাজ এই সন্ধেবেলা?”

“একটু দরকার ছিল ভাইয়ু।”

“সেটাই জানতে চাচ্ছি। সেদিন তোমাদের নামে যা তা বলে যাওয়ার পরও তার কাছে তোমাদের কি কাজ তাই জানতে চাচ্ছি।”

রুদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকলো। এক পর্যায়ে কেঁদে দিলো। রাহমিদ ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে আছে বড় ভাইয়ের দিকে। বড় ভাইয়ের রাগ উঠলে তারা খুবই ভয় পায়। বড় ভাই তাদের কখনোই মারে নি তবে তার শাসনের সময় দুই ভাইবোনই মাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপতে থাকে। হঠাৎ ছোট বোনের কান্নায় রায়হান তাল হারিয়ে ফেললো যেন। দ্রুত রুদ আর রাহমিদকে ঘরে ঢুকিয়ে রুদের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো সে। নরম গলায় বললো,

“কি হয়েছে কলিজা? ভাইয়ুকে বলবেন না? ভাইয়ুকে বলুন। ভাইয়ু সব ঠিক করে দিবো।”

রুদ তারপরও চুপ। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। রায়হানের অস্থির লাগছে। কোচিং থেকে এসে শার্টটা পর্যন্ত খুলেনি সে। ঘামে জবজবে হয়ে আছে। এসেই বোনের কান্নার হেতু খুঁজে পাচ্ছে না সে। রায়হান রাহমিদকে কাছে টেনে বললো,

“আপুনির কি হয়েছে কলিজা? আপুনি কাঁদে কেন?”

“ভাইয়ু আপুনির না রোগ হয়েছে। রক্তে জামা ভরে গেছে আপুর।”

রায়হানের মনে হলো পুরো দুনিয়া ঘুরছে। রুদকে ধরে পাগলের মতো জিজ্ঞাসা করতে লাগলো,

“কি হয়েছে কলিজা? বল না কি হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? রাহমিদ এসব কি বলছে? রক্ত কোথা থেকে এলো। আল্লাহ্! বল না বোন।”

রুদের ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। যেহেতু এইটে পড়ে সেহেতু সে একটু হলেও বুঝে মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট সময় রক্তক্ষরণ হয়। তার এইবার প্রথম হলো। এই সম্পর্কে একটু জানাশোনা থাকলেও আজকে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। ঘরে সে আর রাহমিদ ছাড়া কেউ নেই। হঠাৎ জামায় রক্ত দেখে জোরে চিৎকার দেয়ায় রাহমিদ ছুটে এসে দেখে বোনের জামায় রক্ত। সেও সাথে সাথে চিৎকার, কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলো। এতটুকু ছেলে বোনকে কত কথা বলে ভরসা দিয়েছে হিসেব নেই। বোনের জামার রক্ত পরিষ্কার করেছে আর বলেছে,

“এসব কিচ্ছু না আপুনি। তুমি কাঁদো কেন? রক্ত ভরালে কি করে? কোথায় পড়ে গিয়েছিলে? কথা বলছো না কেন? তাড়াতাড়ি বলো। চলো ডাক্তারের কাছে যাই।”

এরকম আরও নানা কথা। রুদের যেহেতু একটু হলেও জানা ছিল তাই ছোট ভাইয়ের কাছে খুলে কিছু বলেনি সে। মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে দেখে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে রিমা আন্টির বাসায় গিয়েছে। রিমা আন্টিদের বাসায় গিয়ে দেখে তাদের বাসা তালা মারা। তারা কেউ বাসায় নেই। রুদের দুনিয়া যেন ঘুরে উঠলো। তারপর আস্তে আস্তে নিজেদের বাসায় এসে দেখে দরজা লাগানো। তারপর তো এই কাহিনী।

বড় ভাইয়ের অস্থিরতা দেখে রুদ আর না লুকিয়ে ভাইকে সব জানালো। রায়হানের মনে হলো বুকের উপর থেকে পাথর নেমে গেছে। রায়হান উঠে গিয়ে রুদের প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে আনলো। এগুলো বোনের হাতে দেয়ার সময় বললো,

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এগুলো স্বাভাবিক। এটা বলতে এতো দ্বিধা কেন? এটি প্রত্যেক নারীর জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত এক নেয়ামত। এটা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কিছু নেই। কোনো কিছুর দরকার হলে ভাইয়ুকে বলবে। ভাইয়ু সব সময় তোমার সাথে আছি কলিজা। ভয় পেও না আমার ব্রাভো গার্ল।”

চলবে….

#জীবন_পেন্ডুলাম(ধামাকা: বিবাহ স্পেশাল)
#পর্ব_৩২
তাজরীন ফাতিহা

“আরে রায়হান যে। তোমাকে তো এখন পাওয়াই যায়না। পালিয়ে বেড়াচ্ছো মনে হচ্ছে। তা এতদিন পর আজ কি মনে করে আমার সাথে দেখা করতে এলে।”

ইমাম হুজুর কিছুটা রসিকতার সুরেই কথাগুলো বলে থামলেন। রায়হান থতমত মুখ করে কিছুটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমাম হুজুর বললেন,

“দাঁড়িয়ে কেন? বোসো না।

রায়হান মুখ নামিয়ে বসলো। অনেকদিন ইমাম হুজুরের সাথে তেমন সাক্ষাৎ করা হয়না। মূলত রায়হানই এড়িয়ে চলতো। আজ হঠাৎ করেই দেখা করতে মন চাইলো তাই দেখা করতে চলে এসেছে। এমনিতেই কোচিংয়ে পড়াতে পড়াতে সময় হয়না এদিকটায় আসার।

এখন রায়হান এই এলাকায় থাকে না। এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে আমতলী রোডের পাশে একটি বাড়ির দুই তলায় ছোট্ট দুই রুমের বাসায় সে আর তার ভাইবোনেরা থাকে। ছোটখাটো ছিমছাম সংসার তার। অভাব অনটন থাকলেও ছোট্ট ঘরটায় সুখের কমতি নেই। তবে ইদানীং সুখে কিছুটা ভাটা পড়েছে। রুদটার জন্য রায়হানের ভীষণ চিন্তা হয়। রুদ কেমন মনমরা হয়ে থাকে। তাকে খুলে কিছু বলতে অনেক দ্বিধাবোধ করে।

রায়হানের চিন্তায় চিন্তায় মাথায় ভীষণ ব্যথা হয় ইদানীং। ঠিক করেছে বিয়ে করবে। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তার। অনেক আগেই করতো কিন্তু ভাইবোনের যত্নের ঘাটতি হবে ভেবে আর এগোয় নি সেদিকে। তবে রুদের ভাবমূর্তি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিয়ে করবে। রুদের একটা সঙ্গী তো হবে। এতে তার বোনটা নিশ্চয় আর কোনো দ্বিধাবোধ করবে না কথা বলায়।

ইমাম হুজুর অনেকদিন ধরে বিয়ের বিষয়ে বলছেন। তাই রায়হান ভেবেছে ওনার সাথেই কথা বলে দেখা যাক। ইমাম হুজুর নিশ্চয়ই খারাপ মেয়ের সন্ধান দিবেন না। রায়হান দেখেশুনেই বিয়ে করতে চায়। ভাইবোনের অযত্ন রায়হান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। আবার যে মেয়েটা সবকিছু ছেড়ে তার মতো অনাথের কাছে আসবে তাকেও তার পরিপূর্ণ প্রাপ্যটা দিতে হবে। নাহলে রায়হানের আদর্শের বিঘ্ন ঘটবে। রায়হান তা কোনো মতেই চায়না।

“কি হলো রায়হান চুপ মেরে গেলে কেন? বিয়ে শাদী করেছো? তোমার দেখাই তো পাইনা।”

“জি না আংকেল বিয়ে শাদী করেনি। ওই ব্যাপারেই আপনার সাথে আলাপ করতে এলাম।”

ইমাম হুজুর কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,

“বিয়ের ব্যাপারে আলাপ!

“জি। আপনি অবাক হলেন মনে হয়।”

“তা তো অবশ্যই। তুমি তো বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথাই শুনতে চাও না। বিয়ের কথা উঠলেই পালিয়ে বেড়াতে সেই তুমি বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছো বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো নয় কি?”

ইমাম হুজুর কিছুটা কৌতুক করে বললেন। রায়হানের ভীষণ লজ্জা লাগছে। ছেলে দেখে লজ্জাটা ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। মেয়ে হলে এতক্ষণ ব্লাসিং করতো নির্ঘাত। রায়হান চোয়াল নামিয়ে লাজুক স্বরে বললো,

“এখন ভাবছি ওই বিষয়ে তাই আরকি।”

“আরে বেটা তুমি লজ্জা পাচ্ছো মনে হচ্ছে।”

রায়হানের এই কথাটায় আরও লজ্জা লাগলো। সে মুখ নামিয়েই রাখলো। নিজের বিয়ের কথা নিজে কেউ বলেছে কিনা সে জানে না। তার মতো অনাথদের তো নিজের বিয়ের ঘটকালি নিজেকেই করতে হয়। তাদের হয়ে কেই বা বলবে। তাই শরম করলেও নিজ মুখে এসে কথাটা বলেছে সে। ইমাম হুজুর রায়হান কে লজ্জা পেতে দেখে মুচকি হেঁসে বললো,

“মেয়ে একটা আছে বৎস। তোমাকে তার কথা বহু আগেই বলেছিলাম। তোমার মনে আছে কি বৎস? যার কথা প্রায়ই তোমাকে বলতাম।”

রায়হানের এবার মনে হচ্ছে উঠে কোথাও চলে যেতে। এতো লজ্জা সে কখনোই পায়নি। ছেলে মানুষ হয়েও তার এতো লজ্জা ইমাম হুজুর কি ভাববে? ইমাম হুজুর রায়হানের সাথে আর রসিকতা না করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

“রায়হান তুমি কি সিরিয়াস এই বিষয়ে?”

“জি ভেবেছি এই বিষয়ে কয়েকদিন।”

“তোমার ভাইবোন কি বলে এতে?”

“সরাসরি ওরা কিছুই বলেনি তবে ওদের বিশেষ করে রুদের জীবনে একজন নারীর খুবই প্রয়োজন আমি বুঝতে পারছি।”

“শুধু রুদের প্রয়োজন? তোমার?

“আপাতত ভাইবোনের কথাই বেশি চিন্তা করছি আমি। বিয়ে যেহেতু আমার সাথেই হবে ইংশাআল্লাহ্ কোনো কমতি আমি রাখবো না। আমার সাধ্যমতো আমি সবই দিবো তাকে। তবে মেয়ে যেন নামাজী আর আমার ভাইবোনকে কখনোই অবহেলা না করে এমন হয়। এতটুকু হলেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।

ইমাম হুজুর মুচকি হাসলেন আড়ালে। মেয়ের চাচা হিসেবে ছেলেকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। রায়হান কে ইফরার জন্য অনেক আগেই মনে ধরেছে তার। শুধুমাত্র ইফরা আর রায়হানের অমত ছিল বিধায় এই বিয়ে কত বছর পিছিয়ে গেলো। এবার যেহেতু ছেলে রাজি এই বিয়ে হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। সারোয়ারের সাথে আজই কথা বলতে হবে এই বিষয়ে। কথাগুলো ইমাম হুজুর নিজ মনে ভাবলেন রায়হানের দিকে তাকিয়ে।

দেখা যাক সামনে কি হয়?
_____
—-

“ছেলে একটা কোচিংয়ে পড়ায়। ভীষন ভদ্র আর বিনয়ী সে। তুই একবার ছেলের সাথে কথা বলে দেখতে পারিস। তোর অপছন্দ হবে না।”

ইমাম সামসুল হোসেন কথাগুলো বলে থামলেন। ফোনের ওপাশে সারোয়ার হোসেন চুপটি করে বড় ভাইয়ের কথা শুনছিলেন। এবার মুখ খুললেন। বললেন,

“আপনার উপর আমার বিশ্বাস আছে ভাইজান। আপনি নিশ্চয়ই আমার ইফরার জন্য খারাপ ছেলে আনবেন না। তাছাড়া এই ছেলের কথা বিগত চার বছর ধরে আপনি বলে আসছেন। নিশ্চয়ই ছেলের মাঝে আলাদা কিছু দেখেছেন যা আমার ইফরার জন্য কল্যাণকর। আপনার উপর আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে।”

“বিশ্বাস আছে ঠিক আছে। তবে মেয়ের বাবা হিসেবে ছেলেকে একবার হলেও তোর দেখা উচিত। শুক্রবারে দেখা করতে পারিস। ছেলে জুম্মার নামাজ পড়তে আসে এখানে ছোট্ট ভাইকে নিয়ে। তুই চলে আসিস নামাজ পড়তে। দেখে যাবি ছেলেকে।”

“আচ্ছা ভাইজান। তবে শুক্রবারেই আপনার ঐখানে যাবো।”

“আচ্ছা।”
_____
—-

“রাহমিদ তুমি নাকি নামাজ পড়ায় ফাঁকিবাজি করো?”

ভাইয়ের হাত ধরে জুম্মার নামাজ পড়তে যাচ্ছে রাহমিদ। পথিমধ্যেই ভাইয়ের কথা শুনে কাচুমাচু করা শুরু করলো। একটু আধটু ফাঁকিবাজি করে সে মসজিদে আসায়। এটা আবার ভাইয়ুকে কে বললো? নিশ্চয়ই জিহান বলেছে। ওর খবর আছে। ভাইয়ুকে নালিশ করে কত্তবড় সাহস! রায়হান বললো,

“বদ বুদ্ধি মাথা থেকে বের করে ফেলো। তোমার মাথায় যে বদ বুদ্ধি ঘুরছে আমি জানি না ভেবেছো?”

রাহমিদ চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রায়হান বললো,

“আরেকদিন শুনি, তোমায় কি করবো দেখো। এগুলো কিন্তু খুবই খারাপ কাজ। গুনাহ হবে। এমন আর করবে না। আল্লাহ্ নারাজ হবেন তাহলে।”

রাহমিদ মাথা নুইয়ে অনুতপ্ত স্বরে বললো,

“আর হবে না ভাইয়ু।”

“মনে থাকে যেন।”
_____

জুম্মা পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় ইমাম হুজুর ডেকে উঠলেন। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে সেখানে গেলো। গিয়ে সালাম দিলো। ইমাম হুজুর সালামের উত্তর দিলেন। বললেন,

“বসো। আমার ভাইয়ের সাথে পরিচিত হও।”

রায়হান সারোয়ার হোসেনকে সালাম দিলো। সারোয়ার হোসেন সালাম নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলেন। রায়হান ইমাম হুজুরের ভাই হিসেবেই প্রত্যেকটা কথার উত্তর দিলো। সে তখনও জানে না মেয়ের বাবা সারোয়ার হোসেন। কথাবার্তা বলে ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সারোয়ার হোসেনের ছেলেকে ভীষণ পছন্দ হলো। যেমন সুন্দর, বলিষ্ঠ দেখতে তেমনই সুন্দর আর মার্জিত কথাবার্তা। ছেলেটা এতিম হলেও ইফরার জন্য পারফেক্ট। ইফরার রাগ এই ছেলেটাই কন্ট্রোল করতে পারবে বলে তার ধারণা। আল্লাহ্ তায়ালা কবুল করুন।
_____
—-

তারপরের সময় খুব দ্রুতই গেলো। কিভাবে কি হলো এক আষাঢ়ে রায়হান জাইমের সাথে ইফরা সাবরিয়াহর বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েতে দেনমোহর ছিল মাত্র দশ হাজার টাকা। এর বেশি দেয়ার সামর্থ্য রায়হানের ছিল না। তাই ফাতেমী মোহরে খুব অল্প পরিসরেই অনাড়ম্বরহীন ভাবে রায়হানের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েতে রুদ, রাহমিদ উভয়ই খুশি ছিল। তাদের খুশির সীমানা ছিল না ভাইয়ের বউ অর্থাৎ তাদের ভাবি আসার আনন্দে।

বিয়েতে একমাত্র ইফারার মুখ ছিল কালো। এই বিয়েতে সে সন্তুষ্ট না। মা, বাবার বাধ্য মেয়ের মতো বিয়ে করেছে একমাত্র দাদুমণির জন্য। এই মানুষটা তাকে বুঝিয়ে অনেক কিছু বলেছে। তাই ইফরা বিয়েতে মত দিয়েছে।

কনে বিদায়ের সময় ইফরার চোখে এক ফোঁটা পানিও দেখা যায়নি। শুধু দাদীর রুমে গিয়ে আধাঘণ্টা কেঁদেছে সে। তারপর কিছু হয়নি এমন ভাব করে সোজা বরের আনা সিএনজিতে উঠে বসেছে। সারোয়ার হোসেন গাড়ি সাজিয়ে রেখেছিলেন তবে রায়হান কিছুতেই গাড়িটা নিতে রাজি হয়নি। রায়হানের আত্মসমান প্রবল এই সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে গিয়েছে তাই আর বেশি জোরাজোরি করেননি সারোয়ার হোসেন।

খুব অল্প আয়োজনে বিয়েটা হয়ে গেলো। কি হবে ধৈর্যবান রায়হান জাইম আর রগচটে ইফরা সাবরিয়াহর বিবাহিত জীবনে? আগামী দিন আদৌ সুখকর হবে কি? এটাই দেখার বিষয়।

চলবে….

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৯+৩০

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৯
তাজরীন ফাতিহা

চারদিকে আধো আলো আধো অন্ধকার। ফজর পড়ে ইফরা ছাদে আসে প্রতিদিন। আজকেও এসেছে। এসেই গাছ গুলোর পরিচর্যা করে। ফুল গুলো ছুঁয়ে দেখে। আবার কখনো ছিঁড়ে কানে লাগায়। ফল দেখা দিলে খাওয়ার উপযোগী হলে ছিঁড়ে ধুয়ে ছাদেই খাওয়া শুরু করে। তার কাছে এই ছাদ বাগানটা বেশ প্রিয়। ছোট বেলা থেকে এই ছাদ আর দাদুমনি ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।

বর্তমানে আরও দুইটা সঙ্গী অবশ্য আছে। একটা বই আরেকটা তার পোষা বিড়াল লামজা। আদুরে বিড়াল। ওর সাথে সাথেই থাকে। গা ঘেষে ঘুমায়। ইফরা সবার সাথে খিটখিটে আচরণ করলেও লামজার সাথে সে কখনোই উচুঁ কণ্ঠে কথা বলেনি। বিড়ালটাও বেশ ইফরা ভক্ত।

ইফরার স্বভাব রগচটা। কারো সাথেই সে নরম স্বরে কথা বলতে পারে না। এই জন্য তার বন্ধুবান্ধব বেশিদিন টিকে না। একজন ছেলে কথা বলতে এসেছিল সেদিন। ইফরার কথার ধাঁচে এই মুখো আর হয়নি। ইফরাকে এসেই হাসিমুখে বললো,

“হাই কেমন আছো? আমি তোমার ক্লাসমেট।”

ইফরা মুখ গম্ভীর করে রগচটে গলায় প্রতিউত্তর করেছিল,

“আপনাকে বলেছি পরিচয় দিতে? মেয়ে দেখলেই আগ বাড়িয়ে ফাত্রামি করতে মন চায়। দূর হন। আর শুনুন আমি ভালো নেই। এতক্ষণ ভালোই ছিলাম কিন্তু এখন মুড খারাপ হয়ে গিয়েছে। তাই খারাপ আছি।”

ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। ছেলেটার বলদা নজরে তাকানোতে ইফরা মেজাজ হারানোর আগেই বেঞ্চ থেকে উঠে অন্যদিকে চলে গিয়েছিল। মায়ের কানে এই খবর কিভাবে যেন চলে গিয়েছে। ইফরার মায়ের কাছে খবরটা পৌঁছেছিল এমন,

“ইফরা ছেলেটার সাথে কথা বলছিল।”

আসলে ঘটনা অন্য। এই ঘটনার রেশ ধরেই ইয়াসমিন আহমেদ ইফরাকে কথা শুনিয়েছিলেন সেদিন। এইসব ভেবে ইফরার মন মেজাজ আবারও খারাপ হতে লাগলো। আজকে কলেজে যেতে তার মোটেও ইচ্ছা করছে না। বাসায় থাকলেই তো তার মার চিল্লাচিল্লি, ঘ্যানর ঘ্যানর শোনা লাগবে।

ইফরা আর কিছু না ভেবে তার দাদির রুমে চলে গেলো। এই একটা মানুষের কাছে সে প্রশান্তি পায়। রুমে ঢুকেই দেখলো দাদি কোরআন মজিদ রেহালে রাখছে। অর্থাৎ তার কোরআন পড়া শেষ। ইফরা গিয়ে দাদীর কোলে মুখ গুজলো। দাদী সালমা হোসেন নাতনির মাথায়, সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“কিগো নাতিন মন খারাপ নি?”

ইফরা কোলে মুখ আরও গুঁজে বললো,

“অনেক বেশি মন খারাপ দাদুমণি। তোমার ছেলের বউ সারাক্ষণ ঝগড়া করে আমার সাথে। তুমি বকে দিও তো।”

“ওই বিটির কামই তো খালি আমার নাতনির পিছনে লাগা। বজ্জাত মেয়েছেলে। থাক আমি বইকা দিবো নে। তুমি আবার খবরদার মায়ের লগে গলা উচাইয়া, চোখ রাঙ্গাইয়া কথা কইয়ো না। এডা কিন্তু চরম বেয়াদবি, গুনাহ। আমার লগে তো ঝগড়া, কাইজ্জা লাইগ্যাই থাহে তোমারে নাকি মানুষ বানাইতে পারি নাই। তাইলে কি বনমানুষ বানাইছি তোমারে? ওই হারুনের বিটির যা তা কথা।”

ইফরার হাসি পেলো। দাদুমনি ক্ষেপে গেলে তার মাকে নানার নাম ধরে সম্বোধন করে। “হারুনের বেটি।” ইফরার কাজ শেষ। আজকে দাদুমনির সাথে মায়ের বিরাট একটা ঝগড়া হবে। তার আফসোস হচ্ছে সে কলেজে থাকবে। নাহলে ঝগড়াটা দেখতে পেতো। তার মা, বাবাকে বকা খেতে দেখলে চরম আনন্দ লাগে। এই দুটো মানুষ তার চোখের বিষ। কেন যেন ইফরা তাদের দেখতে পারেনা। হয়তোবা ছোট বেলা থেকে তাকে দূরে দূরে রাখা, বান্ধবীদের বাবা মার সাথে তাদের দারুন সখ্যতা, খুনসুঁটিই এর মূল কারণ।
_____
—–

“রায়হান শোনো?”

এশার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হতে নিলেই ইমাম হুজুর ডেকে উঠলেন রায়হানকে। রায়হান খোশমেজাজে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। ইমাম হুজুর সালামের জবাব দিলো। রায়হানকে বসতে বললো। রায়হান বসলো। নরম গলায় বললো,

“কেমন আছো রায়হান?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন ইমাম আংকেল?”

“ভালোই তবে ইদানিং বুকে ব্যথা হয়। খাওয়াদাওয়ায় অরুচি এসে গিয়েছে।”

রায়হান উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“কেন কি হয়েছে ইমাম আংকেল?”

“জানি নারে বেটা। অনেক চিন্তা ভাবনা মনে উঁকি দেয়। চিন্তায় চিন্তায় বুকে ব্যথা উঠে যায়। সবই আল্লাহর রহমত। তোমার ভাই, বোন কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। রাহমিদকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি একমাস হয়। দোয়া করবেন যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।”

“ও বলেছিল। ওদের দুই ভাইবোনকে কুরআন পড়াই। ভালোই মাথা দুজনের। বাচ্চাটা কায়দা পড়ছে। দ্রুতই ক্যাপচার করে ফেলতে পারে। শীগ্রই কায়দার পর আমপাড়া ধরবে। রুদাইফার থেকে অনেক বুদ্ধিমান হবে আল্লাহর এই ছোট্ট বান্দা। আল্লাহর রহমতে তোমাদের তিন ভাইবোনের ব্রেইন ভালো। আল্লাহ্ তোমাদের কবুল করুক। আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে বেটা।”

রায়হান লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে রাখলো। আসলে প্রশংসা সে ঠিক নিতে পারেনা। প্রশংসা করার মতো তার কিছুই নেই। তবুও ইমাম হুজুরের সাথে দেখা হলেই তাদের তিন ভাইবোনের প্রশংসা শুনতে হয় আর সাথে অনেক দোয়া নিতে হয়। রায়হান মনে মনে ইমাম হুজুরের নেক হায়াত কামনা করলো। হুজুর যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় এই কামনাই মনে মনে করলো সে। ইমাম হুজুর এবার ভীষণ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন,

“রায়হান একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”

রায়হান বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো,

“বলুন আংকেল।”

“তুমি বিয়ে শাদী কবে করবে?”

রায়হান ভীষণ বিব্রত হলো। এই বয়সেই বিয়ের কথা ভাবছে না সে। মাত্র তেইশ শেষ হলো। চব্বিশে পড়েছে কয়দিন হলো। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে তাও আবার তার মতো অনাথকে। কে করবে? এসব ভাবনার মাঝেই ইমাম হুজুর আবারও বললেন,

“দেখো আমি জানি তুমি বিব্রত হচ্ছো। তোমার ভাই বোনকে নিয়ে তুমি অনেক কষ্ট করছো। ওদেরও কিন্তু দেখাশোনার মানুষ দরকার। তুমি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো। ওদেরও কিন্তু তোমাকে প্রয়োজন পড়তে পারে কিন্তু তুমি টিউশনি, ভার্সিটি করিয়ে ওদেরকে ঠিকমতো সময় দিতে পারো না। চাইলে কিন্তু বিয়েটা করে ফেলতে পারো। আল্লাহ্ তোমার সকল চাওয়া সহজ করে দিবেন। ইসলাম কিন্তু তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে বলেছে। দেরিতে বিয়ে করাকে অনুৎসাহিত করেছে। এখন দেখো তুমি কি করবে?”

রায়হান বিব্রত ভঙ্গিতে লাজুক বদনে এখনো মাথা নুইয়ে রেখেছে। এভাবে কেউ তাকে ডিরেক্ট বিয়ের কথা বলবে সেটা সে কল্পনাও করেনি। হ্যাঁ অনেকেই রায়হান কে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলতে বলেছিল এর মধ্যে আফজাল হোসেনও ছিলেন। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে অথৈ সাগরে যখন পড়েছিল তখনই বিয়ের ব্যাপারে তাকে বলেছিল। ইমাম হুজুরের ডাকে রায়হান ভাবনা থেকে বের হয়ে বললো,

“এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছি না আংকেল। বিয়ে করলে আমার বাচ্চা ভাইবোন গুলোকে উনি নিজের মনে নাও করতে পারেন। আমার ভাইবোনকে অবহেলার নজরে কেউ দেখুক আমি তা কখনো চাই না। দেখি আল্লাহ্ কবে তৌফিক দেন। আল্লাহ্ ভাগ্যে রাখলে বিয়ে হবে না রাখলে হবে না এটা আমি বিশ্বাস করি। তবে ভাইবোন আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটিস।”

“সবই বুঝলাম বাবা। কিন্তু জীবনে তুমি কি কখনোই বিয়ে করবে না? একদিন না একদিন তোমাকে সব কিছু ফেইস করতেই হবে তাহলে এখন করলে সমস্যা কি? আর তুমি সব কিছু নেগেটিভ ভাবছো কেন? তোমার ভাই, বোনকে দেখবে না সেটা ভাবছো কেন? আল্লাহ্ চাহে তো দেখতেও পারে। বেশি বেশি দোয়া করো আল্লাহর কাছে আল্লাহ্ তোমাকে নিশ্চয়ই নিরাশ করবেন না। বিয়ে কিন্তু খারাপ না বাবা। ভয় পাচ্ছো কেন তুমি?”

“আসলে আমার ভাইবোন ছাড়া আমার কেউ নেই। ওদেরকে কেউ অবহেলা করলে আমি সহ্য করতে পারবো না তাই বিয়ের চিন্তা করছি না। আর তাছাড়াও আমাকে মেয়ে কে দিবে? আমার মতো এতিম, চালচুলোহীন, বেকার মানুষের হাতে এ যুগে কোন আল্লাহর বান্দা কন্যা দান করবেন বলুন আংকেল।”

“সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। মেয়ে আমার কাছে আছে। আমার খুবই কাছের একজন। আমার ভাস্তি। আমার খুবই আদরের। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। তুমি ঠকবে না আল্লাহর রহমতে তবে মেয়ের রাগটা একটু বেশি। এমনিতে আমাদের মেয়ে খুবই ভালো। বিয়ে হলে আল্লাহ্ তোমার সংসারে বরকত বাড়িয়ে দিবেন। তুমি অহেতুক চিন্তা করো না। তুমি রাজি কিনা আমাকে চিন্তাভাবনা করে জানিও।”

রায়হান এতো লজ্জা পেলো সাথে বিব্রতও হলো। জীবনে প্রথম বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে মেয়ের চাচার কাছ থেকে। তার এতো লজ্জা লাগছে বলার বাইরে। কোনরকম পরে জানাবে বলে রায়হান তাড়াহুড়া করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলো।
_____

বাসায় এসে রায়হান প্রথমে বাথরুমে ঢুকে মুখ, হাত, পা ধুলো। তার কেমন যেন লাগছে। তাকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিবে কোনোদিন কল্পনাও করেনি। তাও আবার এই বয়সে। সে তো ভেবেছে আজীবন চিরকুমার থাকা লাগবে তার। কারণ তার না আছে ইনকাম, না আছে সহায় সম্বল। কিছুই নেই একটা মেয়ের আকৃষ্ট করার মতো। তবুও ইমাম হুজুর কি দেখে রায়হানকে পছন্দ করলেন কে জানে? মাথাটা ঝাকিয়ে অহেতুক চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেললো।

রুমে ঢুকে দেখলো আজকের রুমটা কেমন গুমোট। এরকম তো কখনো হয়না তাহলে আজকে এমন লাগছে কেন তার? রুদ কোথায়? রাহমিদ কই? সে বাইরে থেকে আসলেই আগে তাকে জড়িয়ে ধরে। চুমু খায়। তার ভাইবোন গুলো কই গিয়েছে? রায়হান রুদের নাম ধরে ডাকলো।

সারাশব্দ না পেয়ে রানানঘরে গিয়ে দেখলো রুদ হাঁটুতে মুখ ঢুকিয়ে কেমন ভয়ার্ত ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে। পাশে রাহমিদও বোনকে জড়িয়ে কাদঁছে। রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। তার ভাইবোন কাদঁছে কেন? সে দ্রুত গিয়ে রাহমিদ আর রুদকে জড়িয়ে ধরলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে সোনা? তোমরা কাদঁছো কেন? কে বকেছে তোমাদের?”

রুদ ভাইকে দেখে আরও শব্দ করে কেঁদে দিলো। রাহমিদও বোনের কান্নার তালে কেঁদে উঠলো। রায়হান অনেকবার জিজ্ঞাসা করলো তবুও রুদ কিচ্ছু বললো না। রাহমিদ কান্নার মাঝেই বললো,

“আপুনি আজকে সারাদিন কেঁদেছে ভাইয়ু। কিচ্চু কাইনি সারাদিন।”

রায়হানের মনে কামড় দিয়ে যাচ্ছে। তার রুদ তো এভাবে কাঁদে না। কে কি বলেছে তার বোনকে। অনেকক্ষণ পর রুদের কান্না কিছুটা কমে এলে রায়হান রুদকে জড়িয়ে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। ভাত বেড়ে ভাত খাইয়ে দিলো যত্নসহকারে দুই ভাইবোনকেই। রুদ বেশি খেতে পারলো না। বাচ্চাটাকে কেমন ট্রমাটাইজড লাগছে। কি হয়েছে বলছেও না তাকে। রায়হানের ভালো লাগছে না কিছুই।

রাহমিদকে ঘুম পাড়িয়ে দেখলো রুদ ঘুমায় নি। কেমন যেন কাঁপছে বাচ্চাটা। রায়হান রুদকে জড়িয়ে রাখলো অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে দিতে বললো,

“কি হয়েছে বাচ্চা? আমার কলিজা কথা বলে না কেন? ভাইয়ু কে বলবে না কি হয়েছে?”

রুদ তাও কিছু বলছে না। রুদ তো কখনো এমন করে না। কি হয়েছে বাচ্চাটার। কিভাবে কাঁপছে। ধক করে উঠলো তার বুক। খারাপ কিছু হয়নি তো তার কলিজার সাথে। রুদকে বুক থেকে উঠিয়ে কাঠিন্য গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“এখনই বলবে কে কি বলেছে? নাহলে ভাই কিন্তু ভীষণ রাগ করবো।”

ভাইয়ের ধমকে রুদ অনেকক্ষণ দোনামনা করে আস্তে করে বললো,

“উনি আমাকে বাজেভাবে ছুঁয়েছে ভাইয়ু। আমি ভীষণ ব্যথা পেয়েছি বুকে। তুমিও তো আমায় আদর করো, ছোও কই আমার তো বাজে লাগে না ভাইয়ু। তাহলে ওনার ছোঁয়া আমার এতো বাজে লেগেছে কেন?”

কথাটা বলেই ভাইয়ের গলায় মুখ গুঁজে কান্না করে দিলো রুদ। ভাইয়ের কাছে এই কথাটা বলতে তার এতো সংকোচ হচ্ছিলো। বোন হলে অনায়াসে বলে ফেলা যেতো কিন্তু ভাইয়ের বেলায় অনেক বিব্রত লাগছিল তার। এই প্রথম মায়ের অভাব তাকে অনেক ব্যথিত করেছে। ভাইয়ের দিকে আর না তাকিয়ে সারারাত ভাইয়ের কাঁধেই মুখ গুজে পড়ে রইলো। শেষ রাতে রুদ ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমাতে পারলো না মূর্তির মতো বসে থাকা রায়হান। কত চিন্তা যে তার মাথায় খেলে গেলো তা পরিমাপ করা যাবে না।

চলবে,

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩০
তাজরীন ফাতিহা

“জানোয়ারের বাচ্চা তোদের কারণে ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েগুলোও রেহাই পায়না। এতো নরপিচাশ কেন তোরা?”

কলার ধরে স্কুলের দারোয়ানকে ইচ্ছেমতো শাসাচ্ছে রায়হান। দারোয়ান কলার ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

“কি করছি আমি? কোনো প্রমাণ আছে? অহেতুক গেঞ্জাম করতাছেন ক্যান?

রায়হানের শিরা দপদপ করে জ্বলে উঠলো। এক পর্যায়ে রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে চোয়াল বরাবর ঘুষি মেরে বসলো রায়হান। অনেকেই জড়ো হয়ে গিয়েছে সেখানে। যেহেতু স্কুল সেহেতু মানুষজন অনেক থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কয়েকজন শিক্ষক দৌঁড়ে এসে রায়হানকে ছাড়ালো। আজকে রায়হানের গায়ে যেন শক্তি ভর করেছে। যে রায়হান এতো শান্ত, হাজার কথায় মুখে রা কাটে না সেই রায়হানের এমন ভাবমূর্তি রুদকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। রুদ কল্পনাও করেনি তার ভাইয়ের এতো রাগ। রায়হানকে অনেক কষ্টে চেপে ধরে একজন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে? এরকম অসহায় বাবার বয়সী একজন মানুষের গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?”

রায়হান ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,

“ও অসহায় বাবার বয়সী? ও একটা জানোয়ার। মানুষরূপী এরকম জানোয়ার দিয়ে আমাদের সমাজটা ভরে গেছে। এদেরকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা দরকার। ওকে এখানেই কবর দিয়ে দিবো আমি। কোন সাহসে ও আমার বোনকে ব্যাড টাচ করে? এরকম কত মেয়েকে না জানি প্রতিনিয়ত এই জালিম, নরপিচাশ, কুলাঙ্গারের নোংরা স্পর্শের শিকার হতে হয় আল্লাহ্ মালুম।”

শিক্ষক কয়েকজন হতভম্ব হয়ে গেলো। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলো এসব সত্যি কিনা। দারোয়ান সাথে সাথে নাকচ করে দিলো। শিক্ষক এরপর মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বললো,

“তোমাদের কারো সাথে ও এরকম করেছে?”

অনেকই বলতে পারছে না সংকোচবোধের কারণে। কয়েকজন মেয়ে এগিয়ে এসে দারোয়ানের কুকীর্তির কথা স্বীকার করলো। রায়হান এখনো ফুঁসছে। রুদ একটু দূরে কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। খুব বিব্রত হচ্ছে সে তার মুখের ভঙ্গিমায় তা বোঝা যাচ্ছে। কেমন যেন কাঁপছেও বাচ্চাটা। এতো ছোট বয়সে এরকম বাজে একটা ঘটনার শিকার হবে বুঝতে পারেনি সে।

রায়হানের সব কিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। তার বোনের বিব্রত মুখ তাকে ভিতর থেকে মেরে ফেলছে। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। তার শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো। তার এতটুকুন বোন ভিতরে ভিতরে কি পরিমাণ বিধ্বস্ত রায়হান একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছে। তার কলিজা পুড়ছে। তার ভাইবোনের বিপদের শেষ নেই। এই দুনিয়ায় এতো পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাদের ভাইবোনকে। রায়হান আর ভাবতে পারছে না।

সেদিনই দারোয়ানকে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হলো। পুলিশে দিতে চেয়েছিল কিন্তু দারোয়ান সন্তান, বউ এর দোহাই দিয়ে সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। রায়হানের পা ধরে অনেক্ষণ আহাজারি করায় রায়হান পুলিশে দিতে নিষেধ করে। যাদের সাথে অসভ্যতামী করেছে প্রত্যেকের পায়ে ধরে মাফ চাইয়েছে শিক্ষকরা। দারোয়ান যাওয়ার আগে রায়হান শুধু বললো,

“মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবেন। বয়স তো কম হলো না। কয়দিন পর কবরে যাবেন। আল্লাহর কাছে কি নিয়ে দাঁড়াবেন? এতো কুরুচিপূর্ণ কাজটা করতে আপনার হাত কাঁপলো না। নিজের মেয়ের বয়সী এই বাচ্চাটার সাথে, এই মেয়েগুলোর সাথে সর্বশেষ মায়ের জাতের সাথে এরকম জঘন্য কাজটা করতে বিবেকে বাঁধলো না? মনে রাখবেন, একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। আমরা মানুষ ছেড়ে দিলেও ওই আসমানের মালিক যিনি সব কিছুর পুংখানুপুংখ হিসেব রাখেন তিনি কিন্ত ছাড়বেন না। তার কাছে করায়গণ্ডায় হিসেব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন, আল্লাহ্ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয়না।”

বুকে একরাশ কষ্ট চেপে কথাগুলো বলে মুখ ঘুরিয়ে ছোট্ট বোনকে আদর করেছে কিছুক্ষণ। এই বাচ্চাটা তার কলিজা। তার কলিজা গুলোর গায়ে কেউ আঁচড় দিলে তার সমস্ত দেহে জ্বলুনি শুরু হয়। আজকে এখানে খুনাখুনি হয়ে যেতো। আল্লাহ্ মনে মায়াদয়া না রাখলে এখনই রায়হান প্রলয় ঘটিয়ে ছাড়তো। ভাই হয়ে এরকম মানুষরূপী হায়েনাদের থাবা থেকে বোনটাকে সে রক্ষা করতে পারলো না। এই আফসোস তার চিরকাল থাকবে।
_____

আজকে রুদকে ক্লাস করতে দেয়নি। সাথে করে বাসায় নিয়ে এসেছে। বোনকে গোসল করতে পাঠিয়ে নিজে রান্না বসালো। মন মেজাজ তার মোটেও ভালো না। বোনের চিন্তায় সে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। একবার যেহেতু এরকম ঘটনা ঘটেছে তাহলে সামনে যে হবে না তার নিশ্চয়তা কি? মানুষরূপী হায়েনাদের কি অভাব আছে আমাদের সমাজে? এসব নানারূপ চিন্তা তাকে অস্থির কিরে তুলছে।

কোনরকম ডিম ভুনা আর ডাল রান্না করলো। রাহমিদ স্কুল থেকে আসলে ওকে খাইয়ে দিবে। তার ভাইটা ভালো মন্দ খাবার ছাড়া খেতে পারেনা। তাই প্রতিদিনই ওর জন্য ডিম থাকে। ওর সাধ্যের মধ্যে তরকারি রাখার চেষ্টা করে। প্রতিদিন গোশত খাওয়ানোর সাধ্য তার নেই। বাচ্চাটাকে তাই ডিম গোশতের মসলা দিয়ে কষিয়ে রান্না করে দেয়। সে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিলে বাচ্চাটা আয়েশ করেই খায়।

রায়হান রান্না শেষ করে রুমে এসে দেখলো রুদ ভিজা চুল নিয়ে শুয়ে আছে। বাচ্চাটার শরীর কাঁপছে। জ্বর টর এলো নাকি আবার। রায়হান দ্রুত গিয়ে রুদের কপালে হাত দিলো। বেশ গরম লাগছে। উঠে গামছা আনলো। যত্ন সহকারে ভিজা চুল মুছিয়ে দিলো। রুদ ভাইয়ের কোলে কাঁপা শরীর গুটিয়ে দিলো। ভিজা চুল মুছে হাত পায়ে সরিষার তেল মেখে দিলো। ভাত বেড়ে এনে মাখিয়ে খাইয়ে দিলো।

বাচ্চাটা এখনো ভাইয়ের সাথে লেপ্টে আছে। খাওয়ানো শেষ করে রুদকে নাপা খাওয়ালো। এরপর বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা অল্পের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো। রায়হান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বোনের জন্য তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দিন দিন রুদটা বড় হচ্ছে। আগামী দিন কিভাবে পার করবে সেটা ভেবেই তার মাথা ফেটে যাচ্ছে যেন।
____

রায়হান রাহমিদকে নিয়ে বাসায় আসলো। তার মুখ ভীষণ গম্ভীর। রাহমিদের সারা গায়ে কাদার ছড়াছড়ি। বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে কাদা মাখিয়ে এসেছে। এতটুকু বয়সেই বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছে সেয়ানাটা। এতো বিচ্ছু এই পিচ্চি। রায়হানের ভাবনার বাহিরে। রায়হান বাসায় এসেই গোসলখানায় ঢুকিয়েছে। গায়ে পানি ঢেলে বলছে,

“তোমার বাঁদরামি কবে কমবে? তোমাকে কি মাইরে ঘুরায়?”

“না চিপসে ঘুরায়।”

রাহমিদ পানি গায়ে ঢাললেই লাফিয়ে উঠে দাঁত বের করে কথাটা বললো। রায়হান আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে বললো,

“চিপসে ঘুরায় মানে?”

“মাথায় খালি চিপস ঘুরে। তুমি তো খাওয়াও না। খেলায় জিতলে আমার বন্ধুরা চিপস খাওয়াবে বলেছে। আমিও রাজি হয়েছি চিপসের লুভে। তুমি তো চিপস টা নিতে দিলে না। আমি জিতেছিলাম দৌঁড়ে।”

রাহমিদ উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো। পরক্ষণেই চিপস টা খেতে পারেনি দেখে মুখ কালো করে ফেললো।

রায়হানের এখন জগৎসংসার বিরক্ত লাগে। ভাইবোনের একটা আবদার পূরণ করার সামর্থ্য আল্লাহ্ তাকে দেয়নি। ভাইয়ের ইনোসেন্ট চেহারার আদলে কালো মুখটা তাকে খুবই কষ্ট দিলো। তাড়াতাড়ি সাবান ঢলে গোসল করিয়ে বের করলো রাহমিদকে। সারা শরীর, মাথা ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে ভাত বাড়লো। ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেয়ার সময় রাহমিদ বললো,

“গোশত টা মজা হয়েছে ভাইয়ু। আলু দাও।”

“আলু তো দেইনি আজ। আজকে ঝোল রাখিনি। একটু ডাল নিবো?”

“নাও। মজা মজা।”

রাহমিদ মাথা নাড়িয়ে ভাত চিবুচ্ছে আর বলছে।

রুদ এখনো ঘুমিয়ে আছে। রায়হান আর জাগায় নি বাচ্চাটাকে। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। এতে যদি বিভীষিকাময় অধ্যায়টা ভুলে থাকতে পারে তাহলে ঘুমানোই সই।
_____
—-

প্রায় অনেকদিন পার হয়েছে। রায়হান অনেকদিন ধরে রাহমিদকে মুসলমানি করাতে চেয়েছিল পারেনি। আজকে করাবে। ইমাম হুজুর সুন্নতে খৎনা করাবেন। ইমাম হুজুরের সামনে রায়হান এখন সচরাচর পড়ে না। দেখলেই বিয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। রায়হান বলে দিয়েছে এখন আপাতত বিয়ের ব্যাপারে ভাবছে না। ভাইবোন আরেকটু বড় হোক তারপর দেখা যাবে। ইমাম হুজুর বলেছেন তোমার যেদিন মর্জি হবে বলো। মেয়ে তাহলে আরেকটু বড় হোক। তখনই বিয়ের ব্যাপারে ভাববেন। এ সম্পর্কে মেয়ের বাবা, মাকে জানিয়ে রাখবেন তিনি।
____

রাহমিদকে খৎনা করানোর সময় সে এমন জোরে চিৎকার দিলো। যেই সেই চিৎকার না আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে তোলা চিৎকার। লাফালাফি তো আছেই। চিল্লিয়ে একটা কথাই কেবল আউড়াচ্ছে,

“আমাকে মেরে ফেললো। আমার গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেটে ফেললো।”

রায়হানের এতো হাসি পেলো কিন্তু হাসলো না। বাচ্চাটা অবুঝ। কতকিছুই না তার ভাবনা দোল খায়। খৎনা করানো শেষ হলে রাহমিদকে লুঙ্গি পড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা হাত, পা ছড়িয়ে বিছানায় পড়ে আছে। রুদের ছোট্ট ভাইয়ের জন্য ভারী মায়া লাগলো। মাথায় হাত বুলিয়ে নানা গল্প বললো। রায়হানকে দেখে রাহমিদ জিদে হাত, পা ছড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। রায়হান হেঁসে ফেললো। বললো,

“সব ঠিক হয়ে যাবে। চাপ নিচ্ছেন কেন? আপনি না স্ট্রং পারসন। প্রিন্স টোটন ওরফে রাহমিদ সোনা।”

রাহমিদ জিদে হাত দাপিয়ে বললো,

“আমি সুসু দিবো কিভাবে?”

“যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই দিবেন। ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করার দরকার নেই। আল্লাহ্ ভরসা।”

বেশি দিন লাগলো না রাহমিদের সেরে উঠতে। ভালোভাবেই সুস্থ হয়ে উঠলো বাচ্চাটা।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৭+২৮

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৭
তাজরীন ফাতিহা

ভোরের নির্মল বাতাস রায়হানের বরাবরই পছন্দের। রাহমিদকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। এখন নামাজ থেকে ফিরছে দুই ভাই। ছোট্ট রাহমিদ ভাইয়ের আঙ্গুল ধীরে ঝুলে ঝুলে আসছে। কখনো আবার লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। রায়হান মুচকি হেঁসে ছোট্ট ভাইয়ের কান্ডকারখানা দেখছে।

মাস দুই আগে রাহমিদটা কত বড় একটা মুসিবত থেকে সেরে উঠলো। টানা একমাস বাচ্চাটা বিছানায় পড়া ছিল। রায়হান নিজের পড়াশোনা, নাওয়া খাওয়া ফেলে ছোট্ট ভাইয়ের যত্ন নিতো দিনরাত। রায়হানের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই আল্লাহ্ বাচ্চাটাকে এই গুরতর আঘাত থেকে তাড়াতাড়ি সারিয়ে তুলেছেন। ভাইকে আবারও আগের মতো হাসতে খেলতে দেখে তার পরাণ জুড়ায়। এইতো তার রাহমিদ। টোটন সোনা। আদুরে বিড়ালের মতো কিভাবে লাফাচ্ছে। ভাবতেই রায়হানের চোখ ভিজে উঠে।

বাবা থাকলে সে, ছোট্ট রাহমিদ আর বাবা মিলে বাবার দুই হাত জড়িয়ে দুইজনই নামাজে যেতে পারতো। ভাগ্যের পরিহাসে বাবা নামক বটগাছটা রায়হানদের নেই। ছোট্ট ভাইবোনগুলোর প্রতি তার ভারী মায়া কাজ করে। এই বয়সেই বাবা, মার আদর থেকে বাচ্চাগুলো বঞ্চিত। চোখের পানি সন্তপর্নে মুছে রায়হান রাহমিদকে বললো,

“এভাবে লাফাচ্ছেন কেন কলিজা?”

“মুজা মুজা।”

রাহমিদের উৎফুল্ল কণ্ঠ।

“কিসের মুজা? পায়ের না হাতের?”

রায়হানের রসাত্মক কণ্ঠ। রাহমিদ ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,

“এহ…ইন..না। মুজা মুজা।”

ভাইয়ের রাগ বুঝে রায়হান হেঁসে বললো,

“পড়ে ব্যথা পাবেন তো। তখন মুজা বের হয়ে যাবে।”

“বের অবে না। তুমিও নাফাও।”

“আমি বুড়ো মানুষ। লাফানোর বয়স আমার নেই। তুমিই লাফাও।”

রাহমিদ কোনো কথা না বলে চারপাশ দেখতে দেখতে হাঁটছে। মুখে চকলেট ভরা। ইমাম হুজুর ওকে মসজিদে গেলেই দেয়। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি। বাচ্চাটা খুশিমনে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খাচ্ছে আর হাঁটছে। হঠাৎ ওর হাঁটার মাঝে একজন বোরকা পরিহিত মহিলার সাথে জোরে ধাক্কা খেলো। রায়হান কিছু বলার আগেই রাহমিদ বলে উঠলো,

“ওই চোকে দেকো না। দাক্কা দিলে কিনো? হাতে বিতা পিয়েছি না। উফফ বিতা!”

মহিলাটি এইটুকু বাচ্চার পাকনা পাকনা কথায় মজা পেলো মনে হয়। উত্তরে বললো,

“খুব বেশিই ব্যথা পেয়েছো নাকি বাবু? মলম লাগিয়ে দিবো?”

রাহমিদকে কেউ বাবু বললে রাহমিদ ভীষণ রাগ করে। অভিমানে মুখ ফুলিয়ে টুলিয়ে বসে থাকে। ভাই, বোনের কেউ বললে তার উপর চিল্লানো শুরু করে। আজকেও মুখ ফুলিয়ে পাঞ্জাবি টানতে টানতে বললো,

“কে বাবু? আমি বলো।”

“তুমি বড় নাকি? আসলে তোমাকে ছোট্ট লাগছে। একেবারে পিচ্চি। পন্ডিতের মতো।”

রাহমিদ ঝট করে মহিলাটির হাতে খামচি দিয়ে বসলো। মহিলাটি উফ শব্দ করে তার মোজা পড়া হাতটা চেপে ধরলো।

রায়হান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মহিলাটিকে বললো,

“দুঃখিত আন্টি। আসলে ছোট তো বুঝতে পারেনি। আপনি কিছু মনে করবেন না।”

মহিলাটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান কথা বলেই ভাইকে টেনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। মহিলাটি ওদের যাওয়ার দিকে কেমন চোখে যেন এখনো তাকিয়ে আছে। ওই চোখ জোড়ায় কিছু তো একটা নিশ্চয়ই আছে। নিকাবের আড়ালে ভীষণ অদ্ভুত সেই চোখ!
_____

“দিন দিন বেশি বাড়ছো তুমি?”

রুদ রাহমিদকে ধমকাচ্ছে। বড় ভাইয়ের মুখে আজকের সমস্ত ঘটনা শুনে রুদ রাহমিদকে চোখ রাঙিয়েছে। নেইলকাটার দিয়ে নখ কাটছে আর ভাইকে ধমকাচ্ছে। রাহমিদ কিছুতেই নখ কাটবে না। অথচ রুদ আজকে ছাড়বে না। নখ কেটেই ছাড়বে। রুদ নখ কাটতে গেলেই হাত নাড়াচাড়া করায় নেইলকাটারের কোনা লেগে আঙুলের চামড়া উঠে এসেছে। রাহমিদ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রায়হান রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে আসলো। এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে?”

রাহমিদ বড় ভাইকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,

“ইখানে বিতা দিছে। উফফ বিতা!”

বলেই ফুঁ দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান চট করে আঙ্গুল ধরে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। আঙ্গুল চুষে দিলো। তারপর স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। রুদকে ধমকে বললো,

“রুদ ওকে আঘাত করো কেন? ও ছোট না? বেশি হাত চলে তোমার। আরেকবার এরকম করলে অনেক মারবো তোমায়।”

রুদ বড় ভাইয়ের ধমক শুনে মাথা নিচু করে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে চলে গেলো। দেখতেই পেলো না তার কথায় তার আদুরে বোনটা কি পরিমাণে কষ্ট পেয়ে কাদঁছে। রাহমিদের এক্সিডেন্টের পর রায়হান বোনের প্রতি একটু বেশিই গা ছাড়া ভাব। সেটা খালি চোখে না দেখলেও সূক্ষ্ম চোখে ঠিকই ধরা যায়।
____

“ভাত খেয়ে বেশি বেশি শক্তি বাড়ান আর মানুষকে খামচি দিতে থাকুন। এটা ছাড়া আপনি পারেনই বা কি?”

রায়হান রাহমিদকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে আর বকছে। তবে আদুরে বকা। রুদ পাশে বসে চুপচাপ খাচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। রায়হান রাহমিদকে খাওয়ানো শেষে মুখ ধুইয়ে দিলো। রাহমিদ বললো,

“আজকি উসুদ কাবো না? বলো বলো উসুদ কিতে কসটো।”

“তোমাকে মাইর দিবো। মাইর খেলে ওষুধ খেতে কষ্ট হবে না। সব গুলোই তো লিকুইড দুইটা মাত্র বড় ওষুধ সেটাও পানিতে মিশিয়ে খাওয়াই আর উনার ওষুধ না খাওয়ার হাজারটা বাহানা।”

রাহমিদ মুখ কালো করে রাখলো। রায়হান ওকে ওষুধ খাইয়ে নিজে ভাত খেতে বসলো। রুদ তখনো ভাত খাচ্ছে। আজকে গলা দিয়ে তেমন ভাত নামছে না তার। ভাইয়ের তার প্রতি অবহেলা সে কিছুতেই মানতে পারেনা। মূলত আজকে ভাত খাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। ভাই কষ্ট পাবে দেখে চুপচাপ খেতে বসেছে।এখনো মাথা নিচু করে একটা একটা ভাত মুখে দিচ্ছে।

হঠাৎ করেই সামনে থেকে কে যেন প্লেট নিয়ে গেলো। রুদ মাথা উঁচিয়ে দেখলো রায়হান প্লেটে ভাত মাখাচ্ছে। ভাত মাখিয়ে লোকমা বাড়িয়ে দিলো। রুদের চোখে আবারও পানি টলমল করছে। রায়হান লোকমা বাড়িয়ে বললো,

“বড় হচ্ছো রুদ। নানা প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কখনো কখনো তোমার কাছের প্রিয় মানুষ থেকেও বিরাট ধাক্কা খাবে, ধোঁকা পাবে তবুও তোমায় টিকতে হবে, হাসিমুখে চলতে হবে, খেতে হবে, ঘুমাতে হবে। এককথায় সবই করতে হবে ধাক্কাটা সামলিয়ে। এই বয়সেই এসব শিখলে বড় হলে এসব তোমার কাছে কিছুই মনে হবে না। পৃথিবীতে কাউকে একশো ভাগ ভালবাসতে নেই, বিশ্বাস করতে নেই। কারণ দিনশেষে আমরা কাছের মানুষের কাছেই সব চেয়ে বড় ধাক্কাটা পাই।”

ভাতের লোকমা রুদের মুখে দিয়ে আবারও বলতে লাগলো,

“ভাইয়ের প্রতি অভিমান হয়েছে?”

রুদ মাথা নাড়িয়ে না বললো। রায়হান বললো,

“যখন আমি থাকবো না তখন কিভাবে থাকবে? সামান্য ধমকে এতো কষ্ট পেলে হবে কলিজা?”

রুদ কেঁদে উঠে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান এক হাতে বোনকে জড়িয়ে অনেক আদর করলো। এই ভাইবোনই তো তার জীবন। এদের বকলে তারও তো খারাপ লাগে।
____

দিন যায়। মাস যায়। রাহমিদ, রুদ, রায়হান বড় হচ্ছে। তিনটা অনাথের জীবন কেটে যাচ্ছে সুখ, দুঃখে। তবে দুঃখের পাল্লা বেশি ভারী এদের মতো অনাথদের। মানুষের জীবনই একটা পেন্ডুলামে ঘেরা। এই সুখ, এই দুঃখ। এসব মিলেই জীবন।
______
—-

“ওই দিল তোর খবর কিরে?”

রুস্তম চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে আর দিলদার কে বলছে। দিলদার ভোঁতা মুখে বসে আছে। রুস্তম ভাইয়ের গ্যাং তাকে গুতিয়ে এখানে এনেছে। এলাকায় শুনেছে রুস্তম ও তার গ্যাং নাকি একটু সভ্য হয়েছে। অথচ তার সাথে কি আচরণটা করলো এসব ভেবেই তার মন খারাপ। ভোঁতা মুখেই বললো,

“আছি ভাই কোনরকম।”

“কোনরকম ক্যা? অনেক দিন তগো এলাকায় যাওন পড়ে না। আফজাল চাচা কেমন আছে রে?”

“ভালাই। তয় চাচী বেশি ভালা নাই। রোগ শোকে শরীর ভাইঙ্গা গেছে।”

“আহারে। বেচারারা খুবই ভালো মনের মানুষ তয় এতিম পোলামাইয়া গো এট্টু খোঁজ রাখতে পারতো। তুই তো ওগো খোঁজই পাস নাই। মার্কামারা পোলাপান। আমি তুড়ির মইধ্যে খুঁইজা পাইলাম আর তুই?”

দিলদার আবারও ভোঁতা মুখ করে বসে রইলো। সব সময় তাকে খোঁচা না দিলে রুস্তম ভাইয়ের পেটের ভাত হজম হয়না। রায়হানদের খোঁজ পাওয়া গেছে শুনে তার ভীষণ ভালো লাগলো। খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“ওরা কেমন আছে ভাই?”

“আল্লাহর রহমতে ভালাই তয় মাস তিন আগে ছোট্ট বাচ্চাটার বড় এক্সিডেন্ট হইছিলো। তিন জনই মারাত্মক জখম হইছিল। এহন আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালাই আছে।”

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথা শেষ করলো রুস্তম। দিলদার বললো,

“ওরা কই থাকে ভাই? আমি একটু দেখতাম ওগোরে। অনেক মনে পড়ে বাচ্চা গুলান রে।”

“আইচ্ছা আমার লগে যাইস। পরশু ওগোরে দেখতে যামু। তৈরি হইয়া থাকিস। তুই তো আবার মার্কামারা। কাজের সময় গায়েব। মার্কামারার যত মার্কামারা কাজ কাম।”

খোঁচায় দিলদার আবারও চুপসে গেলো।

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৮
তাজরীন ফাতিহা

শহরের এই জায়গাটা নিরিবিলি। চারপাশে কোলাহল কম। উত্তরে একটা দোতলা সুন্দর বাড়ি। বাড়ির ছাদে বিভিন্ন জাতের ফুল, ফল গাছ রোপণ করা হয়েছে। বাড়ির মালিক শৌখিন দেখলেই বুঝা যায়। তবে বাড়ির বাইরের দিকটা সুন্দর হলেও ভিতরে চলছে তুমুল গণ্ডগোল। বাড়ির একমাত্র মেয়ের সাথে সমানে তর্ক চলছে মা ইয়াসমিন আহমেদের।

“আমার জীবনের ডিসিশন তুমি নিবে? বোরকা পরতে বলো পড়ি। তাই বলে কারো সাথে কথা বলা যাবে না এটা কেমন কথা?”

“তুমি একটা বেয়াদব। সারাজীবন মানুষের সন্তানকে শিক্ষিত করেছি কিন্তু তোমায় শিক্ষিত করতে পারিনি। কথাবার্তার কোনো আদব লেহাজ নেই। ফড়ফড় করে যা মুখে আসে বলা শুরু করো। যার ঘরে যাবে তার জীবনটা কয়লা বানিয়ে রাখবে। তোমার ঔদ্ধত্যপনায় আমি চরম বিরক্ত।”

“তো আমার ঔদ্ধত্যপনা দেখো না। চোখ বন্ধ করে রাখো। যত্তসব।”

বলেই মেয়েটি প্রস্থান করলো।

মেয়েটির নাম ইফরা সাবরিয়াহ। বাবা সারোয়ার হোসাইন ও মা ইয়াসমিন আহমেদের একমাত্র কন্যা। বাবা সরকারি কলেজের প্রফেসর আর মা ইয়াসমিন আহমেদ হাই স্কুলের শিক্ষক। উভয়ই আদর্শে ভরপুর হলেও একমাত্র কন্যা ইফরা সাবরিয়াহ প্রচণ্ড জেদি ও বেপরোয়া। তার জেদ ও বেপরোয়া স্বভাবের একমাত্র কারণ ছোটবেলা থেকে মা, বাবা কর্মজীবী হওয়ায় আদর, ভালোবাসা কম পাওয়া। দাদীর কাছেই বেশিরভাগ সময় লালিত পালিত হওয়া ইফরা সাবরিয়াহ এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরীক্ষার্থী। একমাত্র দাদীর সাথে তার সখ্যতা নজরকাড়া।
_____

“মেয়ে যে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে সে দিকে তোমার খেয়াল আদৌ আছে? একটু শাসন করলে কি তোমার মান খুইয়ে যাবে। ওই মেয়ের মুখ যেভাবে চলে একে বিয়ে দিতে কি পরিমাণ কসরত করতে হয় দেখে নিও।”

ইয়াসমিন আহমেদ কঠিন স্বরে কথাগুলো বলে স্বামী সারোয়ার হোসেনের দিকে তাকালেন। সারওয়ার হোসেন কিছু একটা লিখছিলেন। স্ত্রীর কথায় চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন। বললেন,

“মেয়েকে শাসন ছোট থেকে করেছিলে? এই বয়সে শাসন করে কি কোনো ফায়দা আছে? শাসনের বয়সে শাসন করো নি এখন মেয়ের উপর চিল্লালে হবে। ঠাণ্ডা মাথায় বুঝাও। আমার ইফরা অতটাও বেয়াদব আর বেপরোয়া না। হ্যাঁ এটা ঠিক ছোট থেকে আমাদের আদর, ভালোবাসা মেয়েটা কম পেয়েছে তাই বিগড়েছে। এখন তাকে ভালোবেসেই বুঝাতে হবে। তার জেদ ভাঙতে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ লাগবে। যে তাকে বুঝবে, ভুল করলে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে দিবে এমন কারো কাছেই মেয়েকে দিবো। আমার মেয়ে কি ফেলনা নাকি? বিয়ে দিতে কসরত করতে হবে কেন?”

“আহা তোমার মেয়ের জন্য ঠাণ্ডা মাথার রাজপুত্র এসে হাজির হবে নে। যত্তসব আহ্লাদপনা! যেমন বাপ তেমন মেয়ে। কোনো কিছুতেই কেয়ার করি না টাইপ।”

মুখ ঝামটিয়ে ইয়াসমিন আহমেদ চলে গেলেন। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সারোয়ার হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ের জন্য তারও টেনশন হয়। মেয়েটা দিন দিন এমন বেপরোয়া হচ্ছে কেন আল্লাহ্ জানে। মুখে যতই বলুক মেয়ে তার আদরের। যেই সেই ছেলের কাছে মেয়েকে তিনি বিয়ে কখনোই দিবেন না।

মেয়ের জন্য কয়েকজন পাত্র এসেছিল অবশ্য। একটাও সারোয়ার হোসেনের মন মতো না। সে আর তার স্ত্রী মেয়েকে দ্রুতই বিয়ে দিতে চান কারণ অল্প বয়সে বিয়ে করা সুন্নত। ইসলাম অল্প বয়সে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছে। দরকার হলে বিয়ের পর পড়াশোনা করবে। একমাত্র মেয়েকে একজন সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই তিনি চিন্তামুক্ত হবেন।

হায়াত মউতের কথা তো বলা যায়না। তাদের পরিবার এমনিতেই ধর্মভীরু। তারা দুনিয়ায় না থাকলে মেয়েকটাকে কে দেখে রাখবে এই চিন্তা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে। আল্লাহ্ দ্রুত একজন সুপাত্র মিলিয়ে দিক।
______
—-

সময় খুব দ্রুত চলে যায়। এইতো সেদিন রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে দুধ খাইছেছে, গোসল করিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত, পা দিয়ে রাহমিদ ভাইয়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকতো, একটু বড় হয়ে সারা ঘর মাতিয়ে রাখতো। এখনো রাখে তবে আস্তে আস্তে রাহমিদ ভালোই বড় হয়ে গিয়েছে।

আজকে তার স্কুল জীবনের প্রথম দিন। রায়হান ওকে কেজিতে ভর্তি করিয়ে দিবে। রায়হান বাসায় বসিয়ে লেখাপড়ার খাতেখড়ি রাহমিদকে দিয়ে দেয়ায় আর প্লে, নার্সারিতে পড়াবে না। একেবারে কেজিতে ভর্তি করিয়ে দিবে।

রাহমিদ আজকে খুশি। ভাইয়া তাকে কোথাও নিয়ে যাবে। তাই সকাল সকাল তাকে তৈরি করাচ্ছে। রায়হান রাহমিদকে জামা পড়িয়ে দিচ্ছে আর বলছে,

“উফ এতো লাফালাফি করছো কেন? চুপচাপ দাড়াও।”

“মজা ভাইয়ু মজা।”

“তোমার সবকিছু এতো মজা লাগে কেন?”

রায়হান রাহমিদকে শার্ট পড়াচ্ছে। প্যান্ট ইন করিয়ে দিলো। টাখনুর উপরে প্যান্ট গুটিয়ে দিলো। মাথায় চিরুনি করে দিলো।

রুদ আরও বড় হয়েছে। এবার ক্লাস ফ্লোরে পড়ে। এখন আগের থেকে আরও বুঝদার হয়েছে। অল্প বয়সেই বাচ্চাটা অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। ছোট ভাইকে আগলে আগলে রাখে। শাসন করে, আদর করে, ভাত খাইয়ে দেয়। বেশিরভাগ সময় রায়হানের হাতেই রাহমিদ খাবার খায় তবে বড় ভাইয়ের ভার্সিটি, টিউশনি থাকায় এই দায়িত্ব রুদই পালন করে। রুদ স্কুল থেকে এসেই রাহমিদের দেখাশোনা করতো। এখন থেকে রাহমিদও স্কুলে থাকবে তাই রুদের দায়িত্ব কিছুটা কমবে।

রায়হান ছোট ভাইকে নিয়ে বের হওয়ার আগে রুদকে আদর করলো কিছুক্ষণ। রুদ রাহমিদকে আদর করে বললো,

“ভদ্র বাচ্চার মতো হয়ে থাকবে। দুষ্টুমি একেবারেই করবে না। তুমি বেশি দুষ্টুমি করো। স্কুলে অনেক বাচ্চা থাকবে সবার সাথে মিলেমিশে থাকবে বুঝেছো?”

“বুঝেচি। তুমি যাবে না আপুনি?”

“আমি কোথায় যাবো? আমি তো স্কুল করিই। তুমিও করবে এখন থেকে।”

“থাক তোমাকে লাগবে না। ভাইয়ু থাকবে আমার সাথি।”

রুদ ভাইকে দোয়া পড়ে সারা গা মুছিয়ে দিলো। বাইরে যাওয়ার যে সমস্ত দোয়া আয়ত্ত করেছিল সব পড়ে দুই ভাইকেই ফুঁ দিয়ে দিলো। দুই ভাই বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলো।
______

রায়হান স্কুলে যেতে যেতে রাহমিদকে অনেক উপদেশ দিচ্ছে। রাহমিদ বাচ্চাটা ভাইয়ের কথা বুঝার চেষ্টা করছে। বড় ভাই সাথে থাকলে পৃথিবীর সব কিছু সে জয় করে আসতে পারবে। সে ভাবছে কোথায়ও ঘুরতে যাচ্ছে সে। আসলে যে পড়াশোনা করার জন্য তার জীবনের একটা অধ্যায় শুরু হচ্ছে বাচ্চাটা সেটা বুঝতে পারছে না। ভাইয়ের হাতের আঙুল ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে সে।

স্কুলে ঢুকে রাহমিদ হা হয়ে গেলো। এতো এতো বাচ্চাদের ভিড়ে তাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। এই এতগুলো বাচ্চা কোথা থেকে এসেছে? এটা কিসের জায়গা? এরকম নানা হাবিজাবি চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শেষে না বুঝে ভাইকে জিজ্ঞাসা করলো,

“ইটা কিসের জায়গা ভাইয়ু? এতো বাচ্ছা কেনো ইখানে?”

“এটা পড়াশোনার জায়গা। এখন থেকে তুমিও এখানে পড়বে। তোমার অনেক সাথী আছে এখানে। তুমি তো বাসায় একা থেকে বোরিং হয়ে যেতে। এখন তোমার বয়সী অনেক বাচ্চা আছে এদের সাথে পড়বে, খেলবে, মজা করবে।”

“তুমিও থাকবে? আমার সাথে পড়বে, খেলবে, মজা করবে?”

“উহু। আমি তোমায় প্রতিদিন এখানে দিয়ে যাবো আর নিয়ে আসবো।”

“আমার ভয় করচে ভাইয়ু। তুমিও সাথে থাকো।”

রায়হান ছোট্ট ভাইয়ের ভয় মাখা চেহারা দেখে আর কিছু বললো না। কারণ এখন যদি রায়হান বলে সে থাকবে না তাহলে রাহমিদ এখানেই গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করবে। রাহমিদের যেই রাগ! চিল্লিয়ে কান্না না শুরু করে এই দোয়াই করছে রায়হান।

রাহমিদকে তার নির্ধারিত ক্লাসরুমে বসিয়ে রায়হান পাশে বসলো কিছুক্ষণ। স্যার আসার আগ অবধি রায়হান রাহমিদের সাথে বসে ছিল। গল্প করেছে, ভাইকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে। স্যার এসে পড়লে রায়হান রাহমিদকে আদর করে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে গেলো। রাহমিদ ভাইকে চলে যেতে দেখে ছলছল চোখে ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভাইকে দরজার সামনে দেখে খুশি হয়ে চুপ করে থাকলো। রায়হান ইশারায় পড়ায় মনোযোগ দিতে বললো।

রাহমিদ যেই একটু সামনে তাকিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে অমনি রায়হান ওখান থেকে সরে পড়লো। রায়হানের ভার্সিটিতে যেতে হবে। রাহমিদ তাকে দেখলে পড়ায় মনোযোগ না দিয়ে তার দিকে বার বার তাকাতো তাই সে দ্রুতই সরে এসেছে।

রাহমিদ সামনে থেকে চোখ সরিয়ে দরজায় তাকিয়ে দেখলো ভাই নেই। সারা জায়গায় তাকিয়ে তাকিয়ে ভাইকে খুঁজছে কিন্তু ভাইয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই আশেপাশে। যখন বুঝলো ভাই ফাঁকি দিয়ে তাকে একলা অপরিচিত জায়গায় রেখে চলে গেছে তখন চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো। স্যার ও আশেপাশের স্টুডেন্টরা হকচকিয়ে গেলো। ক্লাসের মধ্যে রাহমিদকে কাঁদতে দেখে স্যার এগিয়ে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে বাবু? কাদঁছো কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

রাহমিদ কোনো কথা না বলে কাঁদতেই থাকলো। অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর রাহমিদ ছোট্ট করে বললো,

“ভাইয়ু কুথায়? আমি ভাইয়ুর কাছে যাবো।”

স্যার বুঝলো বাচ্চাটার পরিস্থিতি। এই বয়সে বাচ্চারা এমন করবে এটাই স্বাভাবিক তবে প্লের বাচ্চাদের এমন করতে দেখেছেন উনি কিন্তু কেজির বাচ্চার এমন কান্না প্রথম দেখেলেন। বাচ্চাটাকেও ছোট লাগছে। মনে হয় মা, বাবা আগে আগে ক্লাসে উঠিয়ে দিয়েছে। যাইহোক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে রায়হানকে ডাকা হলো। রায়হান এসে দেখলো রাহমিদ চিল্লিয়ে কাদঁছে। রায়হান দ্রুত ভাইয়ের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। নানা কথা বলে বাচ্চাটার কান্না থামালো। ভাইকে দেখে রাহমিদ কান্না থামিয়ে ভাইকে জড়িয়ে গলায় মুখ গুঁজে রাখলো। স্যার বাকি ক্লাসটায় রায়হানকে অ্যালাউ করলো ক্লাসে।

ভাইয়ের সাথে রাহমিদ শান্ত বাচ্চার মতো বাকি ক্লাসটুকু করলো। সুন্দর করে বাকি ক্লাসের পড়া বুঝলো।

চলবে….

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৫+২৬

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৫.১ (অতীতের খণ্ডাংশ: গল্পের মোড়)
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হানের বাবা খন্দকার রাতিব ইকবাল একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সব কিছুতে ছিলেন দুর্দান্ত। পড়াশোনা, খেলাধুলা, ইসলামিক জ্ঞানের আদলে গঠিত এই চরিত্রটি গ্রামের সকলের কাছে ছিল আস্থাভাজন এবং সুন্দর মনের একজন। মানুষটি ছিল ছোটবেলা থেকেই শান্ত, বিনম্র। মা রেজোওয়ানা বেগমের আদর্শ ছিল তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান।

রাতিব ইকবালের বয়স যখন তেরো তখন তার জীবনের আদর্শকে তিনি চিরতরে হারিয়ে ফেলেন। মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মনে করলে তিনি ভীষণ পীড়িত হতেন। মা কিভাবে মারা গেলো তা তার মস্তিষ্কে ঐসময় অতো না ঢুকলেও বড় হওয়ার পর ভালোভাবেই ঢুকেছিল। মায়ের উভয় কিডনি বিকল হয়ে গিয়েছিল। তার বাবা খন্দকার ইকরাম উল্যাহ প্রথম প্রথম স্ত্রীর সেবা যত্নের ত্রুটি না করলেও এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। রেজোওয়ানা বেগমের অসুস্থতা ছিল অনেক দিনের। আর স্বভাবতই পুরুষ মানুষ বেশিদিন একা থাকতে পারেনা। তাই হঠাৎ করে স্ত্রীর মৃত্যুতে তার মধ্যে তেমন শোক পরিলক্ষিত হয়নি।

রেজোওয়ানা বেগমের মৃত্যুর একমাসের মাথায় রাতিব ইকবালের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। রাতিব ইকবাল প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। প্রথমত মায়ের মৃত্য, দ্বিতীয়ত বাবার দ্বিতীয় বিয়ে সব মিলিয়ে রাতিব ইকবাল ভিতরে ভিতরে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন।
______

লোকে বলে, “মা মরলে বাপ হয়ে যায় তালই” কথাটা রাতিব ইকবাল খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিল। সৎ মায়ের অত্যাচার সেই কিশোর বয়স থেকেই সহ্য করে বড় হয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে সৎ মায়ের তিন সন্তান হয়েছিল। দুইজন ছেলে আর একজন মেয়ে। রাতিব ইকবাল নামের একজন সন্তান যে ইকরাম উল্যাহর ছিল সেটাই তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার বড় সন্তান রাতিবের প্রতি তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত।

সেই নির্লিপ্ততার অনুতাপে পুড়েই বোধহয় শেষ সময়ে তিনি তার সম্পত্তির অর্ধেক বড় ছেলে রাতিব ইকবালকে লিখে দিয়ে গেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে বিরাট এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল রাতিব ইকবালের সুখের একটুকরো নীড়।
______
——

খন্দকার রাতিব ইকবালের যুবক বয়সের এক টুকরো প্রশান্তি ছিল তার স্ত্রী জাইয়ানা আনজুম। পনেরো বছর পর স্ত্রী জাইয়ানাই তার শুষ্ক জীবনে পরিস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় ফুটেছিল। সৎ মায়ের অত্যাচার, শাসনে মায়ের আদর্শে গড়ে উঠা ছেলেটি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল বেপরোয়া, উশৃঙ্খল। পাড়ায় গুন্ডামি করা তার জন্য হয়ে উঠেছিল ডাল ভাতের ন্যায়। যদিও গুন্ডামি করলেও কখনো খারাপ কাজ তার দ্বারা হয়নি। ছোটবেলার ইসলামের আদর্শ একটু হলেও তার মধ্যে জিইয়ে ছিল।

সন্তানরা বাবা, মায়ের ছত্রছায়া থেকে দূরে সরে গেলে বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। মানুষ খারাপ পথে পা বাড়ায় বয়ঃসন্ধিকালেই বেশি। তেমনি রাতিব ইকবালও বয়ঃসন্ধিকালের মতো এতো সংবেদনশীল সময়ে বাবা, মা কারো ছায়া না পেয়ে বিগড়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই রাতিব ইকবালের সাথে সৎ মায়ের একটা বিরাট দ্বন্দ্ব লাগতো। সৎ ভাই বোন গুলোও ছোট বয়স থেকে বুঝে গিয়েছিল রাতিব ইকবাল তাদের সৎ ভাই। তাই বড় ভাই হিসেবে কোনো সম্মান তারা রাতিব ইকবালকে দিতো না।

ছোট বোনটা রাতিবের প্রতি সামান্য মায়া দেখালেও পরবর্তীতে মায়ের কান ভাঙানিতে বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সব মুছে গিয়েছিল।
______
—–

রায়হানের মা জাইয়ানা আনজুম ছিলেন মামার কাছে মানুষ হওয়া বাবাহীন মেয়ে। তার জন্মের আগে বাবাকে হারিয়ে ফেলায় লোকেরা তাকে অপয়া ভাবতো। দাদার বাড়ি থেকে তার মাকে বের করে দিয়েছিল তার মতো অপয়া, অলক্ষ্মী মেয়ে গর্ভে ধারণ করার জন্য। ছোট বেলা থেকে মামার আদরে ভালোবাসায় বড় হয়েছেন জাইয়ানা আনজুম। মামা সালমান ফারুকী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই মামীও জাইয়ানা আনজুমকে চোখে হারাতো। জাইয়ানা যখন সদ্য যুবতী হয়েছে তখন তার জন্মদাত্রী মাকেও চিরতরে হারিয়ে ফেলে। তখন বাবা, মা হীন জাইয়ানাকে মামা আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

এক সময় রাতিব ইকবালের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। প্রস্তাব মূলত রাতিবের দূরসম্পর্কের এক খালা পাঠিয়েছিল। রাতিবের বাবার সাথে কথা বলেই সে প্রস্তাব পাঠায়। রাতিবের বাবা জাইয়ানাকে দেখে ছিলেন এক আত্মীয়ের বিয়ে বাড়িতে। বিয়ে বাড়ির এক কোনায় বোরকা পরিহিত একটা মেয়েকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তার ভালো লেগে যায়। নম্র, ভদ্র এই মেয়েটিকে বড় ছেলে রাতিবের পুত্রবধূ করার জন্য মন আকুপাকু করছিল। তবে এক সময় বাবা ছেলের মনোমালিন্য বাড়ায় এই চিন্তা ধামচাপা পড়ে গিয়েছিল।
____

বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে ধুমধাম করেই হয়েছিল। তবে রাতিব ইকবাল ছিল পুরো নির্লিপ্ত। জাইয়ানার সাথে বিয়ের প্রথম প্রথম রাতিব ইকবাল বড় অসস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে তার বেয়াড়াপনা জাইয়ানা নিজ উদ্যোগে ঠিক করেছিলেন।

রাতিব ইকবাল ও জাইয়ানা দম্পত্তির কোল আলো করে তাদের প্রথম সন্তান খন্দকার রায়হান জাইমের আগমন ঘটে বিয়ের এক বছরের মাথায়। সুখের পুষ্পবৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে দম্পত্তি যুগলের সংসারে। ছোট্ট রায়হানের আধো আধো বুলি সকলের মন কেড়ে নিয়েছিল। ছোট রায়হান তার ছোট্ট ছোট্ট হাত, পা, চোখ নাড়িয়ে কিসব যে বলতো তা বাবা রাতিব ইকবালের কাছে এক একটি রঙিন বসন্তের ন্যায় ছিল।

রায়হানের বয়স যখন চৌদ্দ বছর তখন তাদের পরিবারে আগমন ঘটে আরেক পতুলের। আকীকা করে পুতুলটির নাম রাখা হয়, খন্দকার রুদাইফা জিনাত। বাবা, মা, ভাইয়ের কাছে যে ছিল আদরের মনি। মায়ের শাসন, বাবা ও ভাইয়ের ভালোবাসায় বড় হতে থাকে ছোট্ট পুতুলটি। বাবা রাতিব ইকবাল অল্প বয়সে বিগড়ে গেলেও বিয়ের পর ইসলামকে মনে প্রাণে লালন করেন। মায়ের আদর্শকে আবারও নিজের মনে কঠোরভাবে লালন করার চেষ্টা করেন।

সন্তানদেরকে ইসলামের দীক্ষায় দীক্ষিত করে ভালোভাবেই। বিশেষ করে রায়হানকে ছোট বেলা থেকেই মসজিদে নিয়ে যেতো নামাজ পড়ার জন্য। বাবা পাগল রায়হানও বাবার হাত ধরে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে মসজিদে যেতো।
_______

সৎ ভাইবোনের রাতিব ইকবালের প্রতি ক্ষোভ ছিল তাদের সবার থেকে বেশি সম্পত্তি পাওয়ায়। সৎ মায়ের প্ররোচনায় নানা ফন্দি আঁটতে থাকে কিভাবে এদেরকে পথের ভিখারী করা যায়। সব সময় তক্কে তক্কে থাকতো কিভাবে তাদেরকে হেনস্তা করা যায়। খন্দকার রাতিব ইকবাল সৎ মা এবং ভাইবোনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেই আলাদা বাড়ি তৈরি করেন। এটা দেখে সৎ মা ও ভাইবোনেরা ভিতরে ভিতরে সাপের মতো ফুঁসতে থাকে।

সমস্যা বাধে জাইয়ানা যখন আবারও গর্ভধারণ করে। সবাই ছি ছি শুরু করে। এই বুড়ো বয়সে আবার বাচ্চা। রায়হান তখন সতেরো বছরের আর রুদ তিন বছরের। চারপাশের মানুষের বিষাক্ত কথার বানে জাইয়ানা আনজুম প্রতিনিয়ত মূর্ছা যেতে থাকেন। সন্তান বড় হয়ে গেলে আবার সন্তান নিলে অনেকেই কটু কথা বলে। তবে এসব কটু কথার প্রচার অবশ্য করেছিল রাতিব ইকবালের সৎ পরিবার।

যেদিন রাহমিদ হলো সেদিন রাতিব ইকবালের পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে গেলো। রায়হান ও রুদ দুজনেই খুব খুশি ছোট্ট আরেকটি পুতুলের আগমণে। রাতিব ইকবাল খুশিতে কেঁদে উঠে ছোট্ট রাহমিদের কানে আযান দিয়েছিল।

খন্দকার রায়হান জাইম এবং খন্দকার রুদাইফা জিনাতের ভাইয়ের নাম রাখা হলো, খন্দকার রাহমিদ জাইফ।

তিন ভাই বোনের মধ্যে রাহমিদ ছিল সব চেয়ে বেশি কিউট। তারা তিন ভাই বোনই ভীষণ সুন্দর ছিল। রায়হান মায়ের মতো চেহারা পেলেও রঙ পেয়েছিল বাবার। রুদ আর রাহমিদ পুরোটাই মা, বাবার মিশ্র চেহারা পেয়েছিল। রায়হান শ্যামলা হলেও চেহারায় ছিল অদ্ভুত সুন্দর মাধুর্যতা। তিনটি জীবন্ত পুতুলের মা, বাবা হয়ে খন্দকার রাতিব ইকবাল আর জাইয়ানা দম্পত্তির খুশির অন্ত ছিল না। তবে সুখ যে ক্ষণস্থায়ী তা তারা টের পায়নি বোধহয়।
_____

রায়হানদের পরিবারে খুশির অন্ত না থাকলেও অন্য এক পরিবারে ছিল সীমাহীন হিংসা ও একটি পরিবারকে চিরতরে মুছে ফেলার পরিকল্পনা।

ভাগ্যের পরিহাস রায়হানদের পরিবারকে পরবর্তীতে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই দেখবার বিষয়।

চলবে…..

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৫.২(অতীত রহস্য উন্মোচন)
তাজরীন ফাতিহা

দুঃখ সুখের এক অপূর্ব প্রাপ্তি রাহমিদ জাইফ। “সন্ধি ছায়া” নামক বাড়িটিতে এক টুকরো নূর নেমে এসেছিল যেন। তিন তিনটি রত্ন নিয়ে রাতিব ইকবালের খুশির সীমানা ছিল না। রাহমিদের জন্মের পর পরই বিরাট আয়োজনে যেদিন আকীকা দেয়া হয় সেদিনই রাহমিদ এক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। বাচ্চাটা কিভাবে যেন খাটের কিনারায় এসে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ বাবা রাতিব ইকবাল চলে আসায় বাচ্চাটাকে বাঁচায়। রাহমিদ জন্মের পর থেকেই জাইয়ানা নানা জটিলতার মুখে পড়েছিল। এর জন্য রাহমিদের ঠিকমতো যত্নআত্তি করতে পারেনি সে। বাবা রাতিব ইকবাল আর ভাই রায়হানই ছোট্ট বাচ্চাটার দেখাশোনা করতো তাদের সাধ্য মতো। জাইয়ানা শুধু দুগ্ধ পান করাতো।
____

“জাইম ভাইয়ের দেখাশোনা করেছো?”

রাতিব ইকবাল খোশমেজাজে জিজ্ঞাসা করলো। আজকে তার মনটা একটু বেশিই ফুরফুরা। কারণ অবশ্য আছে একটা। তাছাড়াও ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে তার মন মেজাজ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। রায়হান বুঝলো বাবা কোনো কারণে ভীষণ খুশি। পাঁচমাসের ভাইয়ের দেখাশোনা রায়হানই বেশি করে। মাও করেন তবে রাহমিদ জন্মের পর বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দেখে দেখাশোনা ঠিকভাবে করতে পারেননি। রায়হান বাবার পাশে বসে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,

“আপনার কনিষ্ঠ রাজপুত্র ওরফে রত্নের সেবা করে আমি কৃতার্থ হয়েছি। দয়া করে আপনিও কৃতার্থ হন বাপজান।”

রায়হানের কথার ঢঙে রাতিব ইকবাল দাঁত বের করা হাসি দিলেন। এই হাসিতে আওয়াজ নেই। মুচকি হাসিও না আবার জোরে হাসিও না। এই হাসিতে দাঁত দেখা যায়। মুচকি হাসি সুন্নত। আমাদের নবীজী (সাঃ) উচ্চস্বরে বা জোরে হাসতে নিষেধ করে দিয়েছেন তাই রাতিব ইকবাল হাসির ব্যাপারে খুবই সচেতন। কোনোভাবেই যেন হাসির আওয়াজ শোনা না যায় সেভাবেই তিনি হাসার চেস্ট করেন।

তাদের কথপোকথনের মাঝেই ছোট্ট রুদ কোথা থেকে যেন উড়ে এসে বাবার কোলে মুখ লুকালো। রাতিব ইকবাল মেয়েকে পেয়ে অনেকক্ষণ মন ভরে আদর করলেন। তার দুই রাজপুত্রের মাঝে একটি মাত্র রাজকন্যা। আদরটা তাই সবার থেকে বেশিই করেন বাবা রাতিব ইকবাল। রুদ বাবার গলা ধরে ঝুলে বললো,

“বাবু দুষ্টু করে। আমাল কোলে উতে না। আচকে মালিচি। বাবু ব্যা ব্যা করি কেদেচে।”

“ভাইকে কেন মেরেছো? তোমাকে মারবো এখন।”

মায়ের কথা শুনে রুদ বাবার কোলে আরও ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলো। রাতিব ইকবাল বললেন,

“কার এতো দুঃসাহস আমার রাজকন্যার গায়ে হাত দিবে। সামনে আসুক দেখি। কি করি দেখবেনে।”

“এসেছি। কি করবেন তাড়াতাড়ি করুন।”

হাত মুছতে মুছতে রাতিব ইকবালের সামনে দাঁড়ালো জাইয়ানা আনজুম। রাতিব ইকবাল মুখ শুকনো করে ফেললেন। রায়হান মুখ ঘুরিয়ে মা, বাবার আড়ালে হেঁসে ফেললো।

“কি হলো। মুখ লটকিয়ে চুপ করে আছেন কেন? যা করার তাড়াতাড়ি করুন। আপনার এই গুনধর কন্যারত্নকে আমিই তো বকলাম। একটু পর মারবোও। আপনার যা দেখানোর তাড়াতাড়ি দেখান।”

জাইয়ানা শীতল কণ্ঠে বলে উঠলো। শাড়ি পরিহিত এই রাগী নারীর প্রেমেই তো পিছলে পড়েছিলেন রাতিব ইকবাল আরও আঠারো বছর আগে। এরকম করে শাসন করেই তো মানুষ বানিয়েছিলেন তাকে এই জেদি, রাগী নারী। রাতিব ইকবাল চুপসানো গলায় বললেন,

“ইয়ে মানে তুমি ছাড়া সবাইকে দেখাবো বলেছি। তোমাকে বলি নি তো। রেগে আছো নাকি?”

“নাটক কম করুন। আমি তো আপনার সামনেই বকলাম আপনার আদরিণী কন্যাকে। আমাকে দেখেই তো আপনি এই কথা বলেছেন। এখন ঢং করছেন কেন?”

কিছুটা রাগী সুরে জাইয়ানা আনজুম বললেন। রাতিব ইকবাল স্ত্রীকে আর চটাতে চাইলেন না। তাই কোমল কণ্ঠে বললেন,

“ও তো ছোট। ওকে মেরে তুমিই তো পরে বেশি কষ্ট পাবে। তাই বকা, মারা বাদ দাও আনা।”

“আনা” ডাকটির মধ্যে মনে হয় মধু আছে। এই এক ডাকেই জাইয়ানা আনজুম গলেছিলেন আঠারো বছর আগে। এমনকি এখনো এই ডাকেই তিনি ঘায়েল হন। জাইয়ানার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক হয়ে আসলো মুহূর্তের মাঝে। তবে ছেলেমেয়েদের সামনে তা দেখাতে নারাজ তিনি। তাড়াহুড়া কণ্ঠে বললো,

“হয়েছে হয়েছে। ঢং রেখে আপনার আদরের কন্যাকে একটু শাসন করুন। দিন দিন বেশি দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজকে রাহমিদকে ধুম ধুম করে মেরে দৌঁড় দিয়েছে। বাচ্চাটা সারাদিন কেঁদেছে। এতক্ষণ ভাইয়ের কোলে ঘাপটি মেরে ছিল এখন আপনার কোলে ঘাপটি মেরেছে। ওকে না মারতে মারতে বেশি আদুরী আপনি আর আপনার বড় রাজপুত্রই বানিয়েছেন।”

রায়হান এতক্ষণ বাবা মায়ের খুনসুটি দেখে মজাই পাচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার দিকে অ্যাটাক আসায় তার হাসিখুশি মুখ চুপসে গেলো। আরও অ্যাটাক আসার আগে আস্তে করে উঠে চলে গেলো সে। রুদও বড় ভাইকে চলে যেতে দেখে দৌঁড়ে ভাইয়ের কাঁধে উঠে চলে গেলো। শুধু রয়ে গেলো বেচারা রাতিব ইকবাল। সব দোষের জন্য কথা তাকেই শুনতে হবে এখন। জাইয়ানা আবার বললো,

“দেখলেন কেমন করে উঠে গেলো। কিছু বলতে নিলেই ওনারা পালিয়ে যান। নবাবের বেটা আর বেটি। যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি। কত বড়…”

জাইয়ানাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিলেন রাতিব ইকবাল। স্ত্রীর কাঁধে হাত জড়িয়ে বললেন,

“মাথা ঠাণ্ডা করো আনা। ওরা ছোট। এতো বকলে হয়। জিনাত নিজেই তো ছোট, অবুঝ। ও কি বুঝে বলতো? ছোট ভাইকে মারলে যে ব্যথা পাবে এটা কি বুঝেছে আমার জিনাত মা। ওসব বাদ দাও। আর তিন মাস পর আমাদের হজ। সব বন্দোবস্ত করে এসেছি আজ। তোমার না হজ করার কত ইচ্ছে। এতদিন পর আল্লাহ্ হজের তৌফিক দিয়েছেন। সবাই মিলে হজে যাবো। তুমি, আমি, জাইম, জিনাত আর আমাদের ছোট্ট জাইফ। আমাদের পরিবারের ছোট হাজী সাহেব হবেন তিনি।”

কথাটা বলেই রাতিব ইকবাল মুচকি হাসলেন। জাইয়ানাও আজকে অনেক খুশি। তার কত দিনের ইচ্ছা হজের। তার স্বামী ও সন্তানের সাথে হজে যাবেন ভেবেই তিনি খুশিতে কেঁদে দিলেন। রাতিব ইকবাল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন। তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। তাদের কতদিনের শখ আল্লাহর ঘর দেখার। এতদিন শখ থাকলেও সাধ্য ছিল না। এখন আল্লাহর রহমতে তার শখ, সাধ্য দুটোই আছে। আলহামদুলিল্লাহ।
_____
—–

সুখ, হাসি, দুঃখ সবকিছুর সমন্বয়ে আড়াই মাস কেটে গেছে। আর কয়দিন পরই হজের জন্য যাত্রা করবেন রাতিব ইকবাল ও তার পরিবার। সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছেন তারা। যেহেতু কয়েকদিনের জন্য বাইরের দেশে যাবেন তারা তাই রাতিব ইকবাল ঠিক করেছেন পরিবার নিয়ে কোথাও ঘুরে আসবেন। অনেকদিন পরিবারকে সময় দেয়া হয় না।

আজকে এসেই জাইয়ানাকে তার এই আশার কথা বললেন। জাইয়ানা খুশি মনে রাজী হয়ে গেলো। ঠিক হলো সন্ধ্যায় বের হবেন তারা। কিন্তু রায়হানের পরীক্ষা থাকায় সে যেতে রাজি হয় নি। রুদও বড় ভাই যাবে না দেখে যাবে না। বাচ্চাটা ভাইয়ের ন্যাওটা। অবশ্য বাবারও ন্যাওটা। তবে আজকে রুদের এমনিতেই যেতে ইচ্ছা করছে না। রাতিব ইকবাল আর জোর করেনি। বাচ্চা মানুষ যেটা ইচ্ছা হবে তাই করবে।

রায়হান, রুদ কেউ যাবে না দেখে রাহমিদকেও রেখে গেলো। আজকে বেশিক্ষণ ঘুরবে না বলে ঠিক করলো। যেদিন তিন সন্তান নিয়েই ঘুরতে পারবে সেদিন বেশি করে ঘোরাফেরা করা যাবে। ঘুমন্ত রাহমিদকে আদর করে রায়হানের তত্ত্বাবধানে রেখে তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে বলে বেরিয়ে গেলো। বিয়ের পর পর এভাবেই ঘুরতে গিয়েছিল একবার। তখন শশুর বেঁচে ছিল। জাইয়ানার কি যে শরম লেগেছিল সেদিন। শশুরের সামনে স্বামীকে নিয়ে একা একা ঘুরতে যাচ্ছেন ভেবেই তিনি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন। আজকেও হঠাৎই লজ্জা লাগছে ছেলেমেয়েদের রেখে বুড়ো বয়সে ঘুরতে এসেছেন ভেবে।

গাড়িতে উঠেই জাইয়ানার পুরোনো স্মৃতি গুলো বেশি উঁকি দিতে লাগলো আজকে। রাতিব ইকবাল গাড়ি চালাচ্ছেন আর স্ত্রীর লজ্জালু মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। ভালোই লাগছে আজকের তার। অনেকদিন পর স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও বের হচ্ছেন তিনি। কাজের প্রেশারে জাইয়ানাকে সময়ই দেয়া হয় না ঠিকমতো। আজকে সময় দিতে পেরে ভালোই লাগছে তার।

আজকে গাড়ির ব্রেকে কেমন সমস্যা করছে। হঠাৎ করেই গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না। রাতিব ইকবাল কোনোভাবেই ব্রেক করতে পারছিলেন না। হঠাৎ বাম সাইড দিয়ে বড় ট্রাক এসে গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। ধাক্কায় গাড়িটা ছিটকে অনেক দূর চলে গেলো। মুহুর্তের মাঝেই সব কিছু কেমন থমকে গেলো।
_____

“সন্ধি ছায়া” বাড়িটায় অনেক মানুষ। যে বাড়িটা পাঁচজনের হাসিতে ঝলমল করতো সেই বাড়িটায় আজকে কান্নার রোল পরে গেছে। দুটো লাশ ঢুকছে বাড়িটায়। বেরিয়েছিল দুটি জীবন। আসলো দুটি লাশ। রায়হান কেমন পাথর হয়ে গেছে। লাশের খাটিয়া তার সামনে অথচ সাদা কাফন সরিয়ে মুখ দুটো দেখার শক্তি তার নেই। তার সমস্ত শক্তি কে যেন শুষে নিয়েছে। পাশে রুদ পুতুল খেলছে। সবার কান্নায় বাচ্চাটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয় কাটাতে পাশের বাসার একজন বাচ্চাটাকে পুতুল দিয়েছে। সেটা নিয়েই খেলছে সে। আট মাসের রাহমিদ রায়হানের কোলে হাত, পা নাড়াচ্ছে। ওকে নিয়েই দৌঁড়ে নিচে নেমেছে রায়হান।

রায়হান রাহমিদকে নিয়েই খাটিয়ার পাশে বসলো। সাদা কাপড়টা সরাতে লাগলো কাঁপা হাতে। তার মা, বাবা আর দুনিয়াতে নেই কথাটা সে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। কাপড় সরাচ্ছে আর মনে মনে প্রার্থনা করছে লাশ দুটো যেন অন্য কারো হয়। কাপড় সরিয়ে রায়হান ছিটকে গেলো।

মুখ একেবারে থেতলে গিয়েছে তার মা, বাবার। মায়ের পরনের সেই বোরকা, বাবার সাদা পাঞ্জাবি। যদিও পাঞ্জাবি আর সাদা নেই। রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। এটা যে তার মা, বাবা তা চিনতে একটুও সময় লাগেনি রায়হানের। কাঁদবে না বলেও হুহু করে কেঁদে উঠলো সে। তার সাথে পল্লা দিয়ে কোলের রাহমিদও চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। বাচ্চাটা কি বুঝেছে তার মা, বাবা এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গিয়েছে চিরজীবনের জন্য? আর কেউ তাকে দুধ খাওয়াবে না, আদর করবে না এটা কি বাচ্চাটা বুঝলো! রুদ পুতুল রেখে ভাইয়ের কাছে দৌঁড়িয়ে আসলো। ভয় মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“কান্দ কেনু?”

বলে রুদও ভাইয়ের সাথে কেঁদে দিলো। রুদকে রায়হানের সৎ ফুপি উপরে নিয়ে চলে গেলো। বাচ্চাটার মা, বাবা যে আর দুনিয়ায় নেই এটা কেউই তাকে বললো না। রায়হানকে কেউ থামাতে পারছে না। আজকে বাবার সৎ পরিবারের সবাই এসেছে। তারাও মেকি কান্না কাঁদছে। রায়হানকে এসে তার সৎ দাদি ধরলো। কেঁদে উঠে রায়হানকে থামতে বললো। দাদীর ভালোবাসা না পাওয়া রায়হান সরল মনে এই ছোঁয়াকে ভালোবাসা ভাবলো। রাতিব ইকবাল কখনোই তার সৎ মা, ভাই, বোনের সম্পর্কে সন্তানের কাছে কোনো খারাপ মন্তব্য করেনি। তাই বোধহয় অবুঝ রায়হান এটাকেই নির্মল ভালোবাসা ভেবেছে।
____

বাবা মায়ের দাফন শেষে রায়হান বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ঢুকার আগেই দেখলো রুদ মেঝেতে পড়ে আছে। মা, বাবার জন্য কাদঁছে বাচ্চাটা। সামনে রায়হানের সৎ ফুপি রণমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে। পিছনে আরও তিনজন নারী দাঁড়ানো। দুইজন রায়হানের সৎ চাচী আর একজন সৎ দাদি। কেউই বাচ্চাটাকে উঠাচ্ছে না। রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। রুদ মা, বাবার জন্য কাদঁছে ভেবে দ্রুত বাসায় ঢুকে বাচ্চাটাকে উঠালো সে। রায়হানকে দেখে তিন নারী মেকি আদর দেখাতে লাগলো। বিধ্বস্ত রায়হান এদের ছলনাকে ভালোবাসা ভেবে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ পেলো না।
______

“এই আপদকে বিষ খাইয়ে মারা লাগবে। সেদিন মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু বড় আপদটা চলে আসায় পারি নি। দুধের সাথে আজকে মিশিয়ে খাওয়াবো। কি বলেন আম্মা।”

রায়হানের ছোট চাচা কথাটা বলে উঠলো। সবাই এক রুমে এসব পরিকল্পনা করছে। রায়হানের বড় চাচা বলে উঠলো,

“ওদের আব্বা, আম্মাকে তো মারতাম না। ওই ছোটটা ছেলে হওয়াতে মেরে ফেলছি গাড়ির ব্রেক নষ্ট করে। রাতিব্বার তো কপাল আম্মা। দুই দুইটা পোলা। আর আমাদের মেয়ে। ওর উপ্রে আমার সেই ছোট বেলা থেকে ভীষণ রাগ। সব ওয় আর ওর আওলাদ একলা পাবে। আব্বায় যে কামডা করছে আম্মা মোটেও ভালো করে নাই। ওয় বাইচ্চাই থাকতো। খালি ওর সম্পত্তিই ওরে আর আর ওর বউরে শেষ করলো। ভাবছিলাম পুরা পরিবাররেই নিশ্চিহ্ন কইরা দিবো কিন্তু ওই তিনডা কই মাছের জান তো যায়ই নাই পরে শুনি। রাগে পুরা শরীর জ্বলতাছিল আমার।”

ওই রুমের উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক হলো। শুধু সৎ মা ছাড়া। রাতিব ইকবাল আর জাইয়ানা আনজুমকে তাদের বড় ভাই মারছে। কথাটায় প্রথমে অবাক হলেও মনে মনে খুশিই হলো। দুটো আপদ বিদায় হয়েছে। একজন শুধু খুশি হতে পারেনি। ওই একজনের চোখে এদের বিশ্রী নোংরা কথা বিষের মতো ঠেকলো।
_____

“জাইম তুমি আইজকাই এই গ্রাম ছাইড়া চইলা যাইবা। তোমার ভাই, বোন কেউই এইহানে নিরাপদ না। সবই তো শুনলা আইজকা। এদের লাহান মানুষরূপী পিচাশদের সাথে তুমি একলা কিছুতেই পারবা না। আমি চাই না এই নরপিশাচদের সম্পত্তির লোভে তোমরা তিইনজন বলি হও। পুলিশের কাছে গেলেও তুমি সাহাইয্য পাইবা না কারণ তোমার বড় শয়তান চাচার পুলিশ গো লগে মেলা খাতির। এরা তোমাগো পক্ষে কোনো কালেই রায় দিতো না। তোমার চাচার লগে আমার মেলা দিন থেইকা উঠাবসা তাই ওর নাড়ী নক্ষত্র সব জানি।”

এতক্ষণ রায়হানের এক দুঃসম্পর্কের চাচা কথাগুলো বলে শেষ করলো। রায়হান পাথরের মতো হয়ে গিয়েছে। এগুলো কি শুনলো। তার বাবা, মায়ের খুনিকে এতোদিন আপন ভেবেছে। এদের এতো রকমের চেহারা দেখে রায়হান পাথুরে মূর্তি হয়ে গিয়েছে। আর কিছু ভাবার অবকাশ সে পেলো না। তার পুরো দুনিয়া ঘুরতে লাগলো। কি শুনলো এসব সে!
জীবন যে তার সাথে খেলা শুরু করেছে এটা রায়হান সেইদিনই বুঝে গিয়েছিলো। রায়হান রাহমিদ ও রুদকে নিয়ে সেদিনই বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। শুধু সম্পত্তির বলি তার ভাইবোনকে সে কোনোদিনও হতে দিবে না। এদের সাথে একলা লড়াই করে কিছুতেই পারবে না সে। এই পৃথিবীতে আইনও টাকায় কেনা গোলাম।

চলবে….

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৬(রাহমিদ😘)
তাজরীন ফাতিহা

“প্রথম প্রথম দুধের অভাবে রাহমিদ প্রচণ্ড কান্না করতো। ওকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যেতো না। কারো কোলেই রাহমিদ যেতে চাইতো না। আমি কোলে নিয়ে থাকতাম। তাও অনেক সময় ওর কান্না কিছুতেই কমাতে পারতাম না। একবার কি হয়েছিল জানেন ভাই?”

রায়হান হাসপাতালের ফ্লোরে বসে উপরের দিকে তাকিয়ে ভাঙা কণ্ঠে রুস্তমকে বলে উঠলো।

রুস্তমও রায়হানের পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে রায়হানের তিক্ত অতীত শুনছে। তার চোখ ভিজা। গালে চোখের পানি শুকিয়ে আছে। রুস্তম বললো,

“কি হয়েছিল?”

রায়হান আগের মতো থেকেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,

“রাহমিদের বয়স তো কম। মাত্র আট মাস বয়স। রাতে মায়ের বুকের দুধ খেতে খেতেই ও ঘুমিয়ে যেতো। মা মারা যাওয়ার পর অনেকদিন ফিডারের দুধ খাইয়ে রেখেছে ওকে। ও আমার সাথেই ঘুমাতো কারণ আর কারো সাথেই বাচ্চাটা থাকতে চাইতো না। ভালোই হয়েছে থাকতে চাইতো না নাহলে ওকেও কখন আব্বু, আম্মুর মতো….”

বলতে বলতে হঠাৎই গলা ধরে আসলো রায়হানের। ওই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবারও বললো,

“তো সেইদিন ঘুমিয়ে আছি। পাশে রাহমিদ ছোট্ট হাত, পা ছড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অনেক কষ্ট হয়েছিল ওকে ঘুম পাড়াতে। যেহেতু দুধের শিশু ওরা মায়ের ওম ছাড়া ঘুমাতে পারে না। তবুও অনেক কাঁদার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল বাচ্চাটা। হঠাৎ মাঝ রাতে আমার বুকের উপরে কারো থাবা অনুভব করি। ঠাস করে চোখ খুলে দেখি রাহমিদ ঘুমের ঘোরেই বুকের দুধ খুঁজছে। যেহেতু আমি ছেলে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই আমার কাছে ও যেটা খুঁজছে সেটা পাবে না। উঠে ফিডার বুকের পাশে লাগিয়ে ওকে খাইয়েছি। আমার এটুটুকুন দুধের ভাইকে আমি ছোট থেকে এই হাতে মানুষ করেছি ভাই। এই হাতে..”

রায়হান হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে রুস্তমকে দেখাতে লাগলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো,

“আমার সেই ছোট্ট দুধের ভাইকেও আল্লাহ্ কেড়ে নিতে এসেছেন ভাই। আপনারা আল্লাহরে বলেন, আমার ভাইরে ছেড়ে দিতে। আমার ভাইরে ফিরাই দিতে। ও আমার কলিজার টুকরা ভাই। আজকে সাত দিন ওই আইসিইউ রুমের মধ্যে কেমনে আছে বাচ্চাটা? আমার সেই ছটফটে কলিজাটা কেমনে নিশ্চুপ, নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে ভাই? সারা ঘর মাতিয়ে রাখা সেই ছোট্ট আদুরে ছানার কোনো রেসপন্স নাই দেখছেন আপনি? আমার কলিজা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। মা, বাবারে নিয়ে আল্লাহ্ আমারে জীবন্ত পাথর বানিয়ে ফেলছে। আল্লাহরে বলেন এখন আমারে জীবন্ত লাশ বানিয়ে এই দুনিয়ায় না রাখতে। আমার কোল খালি করতে, আমার কলিজা কেড়ে নিতে আপনারা আল্লাহরে নিষেধ করেন ভাই।”

বলতে বলতে হুহু করে কেঁদে উঠলো রায়হান। রুস্তমের চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। কি বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। রায়হান আবারও ছটফট করতে করতে বলে উঠলো,

“ওই ছোট্ট শরীরটায় কতগুলো সূচ ফুটে আছে। কতগুলো ইনজেকশনের সূচ আমার ছোট্ট আদুরে কলিজার শরীরে আছে দেখেছেন আপনি ভাই? ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বলতে পরছে না। আমি বা রুদ একটু মারলে সারা ঘর গড়াগড়ি খেতো আমার কলিজাটা। সেই কলিজা এখন কতগুলো সূচ নিয়ে নিস্তেজ, নিশ্চুপ হয়ে সাতদিন পড়ে আছে। আল্লাহ্ এবার সবাইকে ঈদ দিলেও আমাকে দিয়েছে একরাশ দুঃখ, যাতনা, কলিজা ছাই হওয়া কষ্ট। এতো সুন্দর উপহার পেয়ে আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।”

রায়হানের আহাজারি, কান্না হাসপাতালে উপস্থিত সকলের কানে বারি খাচ্ছে। সকলেরই চোখে পানি এসে গিয়েছে ওর আহাজারি শুনে।

আল্লাহ তায়ালা কি এই করুণ আহাজারি শুনতে পেলেন?
_____
—-

আজকে দশ দিন হলো রায়হানের হাসপাতালের জীবনের। জীবনের তিক্ত অনুভূতির সাক্ষী হতে রায়হানের এই হাসপাতাল জীবনের সূচনা হয়েছিল। নামাজের বিছানায় চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চোখের পানি সব শুকিয়ে গেছে মনে হয়।

এই রায়হানকে চেনা যায়না। এই রায়হান হাসে না, কথা বলে না, খায় না। শুধু খুদা মেটাতে একটু খাবার মুখে নেয় এই যা। সেটাও আবার রুস্তম জোর করে খাইয়ে দেয় বলে। রুদের ব্যান্ডেজ খুলা হয়েছে পরশু দিন। এখন ও মোটামুটি ভালোই মুভমেন্ট করতে পারে। পরিপূর্ণ সুস্থতার পথেই রুদ।

রায়হানের মাথায় আর হাতে এখনো ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। ওযু করতে পারেনা তাই তায়াম্মুম করে নামাজের বিছানায় বসে চোখের পানি ফেলে আর আল্লাহর কাছে আহাজারি করে রাহমিদ কে তাঁর বুকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। আবার মাথায় আঘাতের ফলে কিছু ভুলে গেলে রুস্তমের কাছে করুণ আকুতি করে চিল্লায়। কি এক দুর্বিষহ জীবন রায়হানের! যেন একটুকরো বিষাদ।
______

“২৪৮ নম্বর রুমের বাচ্চাটা রেসপন্স করছে। জরুরী বিভাগে যার বাচ্চা ভর্তি দ্রুত চলে আসুন।”

সাদা পোশাক পরিহিত একজন নার্স চিল্লিয়ে কথাগুলো বললো। রুস্তমের বিশ্বাস হচ্ছে না। কত নম্বর রুম বললো। “২৪৮” হ্যাঁ এই রুমেই তো রাহমিদকে শিফট করেছিল গতকাল। জরুরী বিভাগে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য।

যেহেতু এটা সরকারি হাসপাতাল সেহেতু ভালো মানের ডাক্তার এতদিন ছিল না। গত পরশু এসেছে। এসেই বাচ্চাটাকে আরেকবার পরীক্ষা, নিরীক্ষার জন্য তাদের অনুমতি নিয়েই জরুরি বিভাগে ভর্তি করেছেন তারা।

রুস্তম আশেপাশে রায়হানকে খুঁজতে লাগলো। খবরটা শুনে রায়হান আবার দৌঁড় দিয়েছে নাকি সেটাই দেখলো। যখন দেখলো রায়হানের অস্তিত্ব আশেপাশে নেই তখন দৌঁড়িয়ে নামাজ কক্ষে প্রবেশ করলো। যা ভেবেছিল তাই। নামাজের বিছানায় সিজদারত অবস্থায় পড়ে আছে রায়হান। পাশে রুদও ভাইয়ের দেখাদেখি নামাজ পড়ছে।

এদের তিনভাইবোনের ভালোবাসা তাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। মনে হয় তাকে কেন এমন ভাই, বোন আল্লাহ্ দিলো না?

নামাজ শেষের জন্য রুস্তম অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। রায়হান সিজদায় পড়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো প্রতিদিনের মতো। কিছুক্ষণ পর সিজদা থেকে উঠে জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখার সময় রুস্তমের কথা শুনে হাত থেকে জায়নামাজ পড়ে গেলো।

এক দৌঁড়ে জরুরি বিভাগের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রায়হান আর তার পিছে রুস্তম, রুদ।

দরজায় হঠাৎ এত মানুষ দেখে ড. শামসুল আলম অবাক হন কিছুটা। এই বিভাগে রোগীর আত্মীয় ছাড়া হঠাৎ করে কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। এরা কারা? দুইজন নার্স যেয়ে রায়হানদের আটকালো। “কাকে চায়?” “আপনারা কারা” এসব প্রশ্ন করে রায়হানদের বের করে দিতে উদ্যত হলে রায়হান বলে উঠলো,

“আমার কলিজা, আমার রাহমিদ নাকি রেসপন্স করছে? তাহলে আমাকে বের করে দিতে চাচ্ছেন কেন? আমি ওর ভাই।”

নার্স ও ডাক্তার যেহেতু নতুন তাই রায়হানের এই কয়দিনের উদ্বিগ্নতা, আহাজারি কোনো কিছু সম্পর্কেই তারা অবগত নন। একজন পুরোনো নার্স এসে রায়হানের কথা ড. শামসুল আলমকে বললো,

“স্যার পেশেন্টের ভাই ইনি। নাম রায়হান।”

” আই সি। ওর অ্যাগ্ৰিসেভনে্সেই বুঝেছি বাচ্চাটার কেউ হবে হয়তো। তবে এতো দেরি করে আসলেন কেন ইয়াং ম্যান।”

“নামাজে ছিলাম স্যার।”

“আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। আল্লাহ্ তায়ালাকে ডেকেছেন বিধায় বাচ্চাটা রেসপন্স করেছে মনে হয়। আপনি একটু কিছু কথা বলে দেখুন। বাচ্চাটা কিছু বলে কিনা দেখেন।”

বয়সে অনেক বড় হয়েও ছোট একজনকে আপনি করে বলায় বুঝা যায় কত মার্জিত এই লোক। রুস্তমের ডাক্তারের ব্যবহার অনেক ভালো লাগলো।
____

রায়হান রাহমিদের বেডের পাশে বসে আছে। আজকে দশ দিন পর তার কলিজার মুখ দেখতে পাচ্ছে সে। চেহারায় জায়গায় জায়গায় ব্যান্ডেজ, কাটা দাগ তবুও বাচ্চাটার মায়াবী বদন একটুও ম্লান হয়নি যেন। রায়হান চোখের পানি ছেড়ে ডেকে উঠলো,

“আমার রাহমিদ রে। কই চলে গিয়েছিলে ভাইকে ধোঁকা দিয়ে? অনেক মারবো তোমায়। ভাইয়ের সাথে কথা বলবে না? ভাইয়ের প্রতি অভিমান জন্মেছে তোমার। এতদিন কষ্ট পাচ্ছো দেখে ভাইয়ের প্রতি তোমার অনেক রাগ তাইনা কলিজা। আমার টোটন সোনা কথা বল। বলবিনা কথা?”

রায়হান রাহমিদের ব্যান্ডেজ মাখা শরীরে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে যেতে থাকলো তার কয়েকদিনের জমানো অজস্র কথা। রুদও পাশে বসে কেঁদে দিয়েছে। তার ছোট্ট ভাইটা কিভাবে শুয়ে আছে? তার ভালো লাগছে না ভাইকে এভাবে দেখতে। সারা ঘর মাতিয়ে রাখা সেই ছোট্ট রাহমিদকে চাই তার।

রুস্তম পাশে দাঁড়িয়ে এই তিন মায়ার ঢালির জন্য দোয়া করছে। বাচ্চাটা যাতে কথা বলে এটাই চায় সে। রায়হানের কষ্ট আর দেখতে পারছে না সে। কত কত মানুষকে জীবনে কাঁদিয়েছে সে অথচ আজকে চায় হাসুক একজন। তার দোয়ার বদৌলতে হলেও হাসুক রায়হান।

“ভাইয়ু কুব বিতা। ইখানে বিশি বিশি বিতা।”

অস্ফুট স্বরে রাহমিদের আওয়াজ। রায়হান, রুদ, রুস্তম তিন জনই স্তব্ধ। সকলের মুখে বিরাট পাথর নেমে যাওয়ার স্বস্তি।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২৩+২৪

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৩
#তাজরীন_ফাতিহা

দেখতে দেখতে পঁচিশটা রোযা সম্পূর্ণ হবে আজকে। দুপুর তিনটে। কাঠফাঁটা রোদে চারপাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে। রায়হান ফুটপাতে হাঁটছে। হাতে এক পোয়া বেসন আর দুইটা মাঝারি আকারের বেগুন ঝুলছে পলিথিনে। রোদের তেজে রায়হান ঘেমে নেয়ে একাকার। আজকে টিউশনির প্রেশারটা বেশি ছিল। রোযার কয়েকদিন একটু বেশিই পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাকে। যেহেতু মুসলিমদের বছরে দুইটা আনন্দের দিন আসে সেহেতু দুটো ঈদে রায়হান যথাসম্ভব ভাইবোন দুটোকে নিজের সাধ্যের মধ্যে জামাকাপড় দেয়ার চেষ্টা করে। নিজের জন্য কিছু না কিনলেও ভাইবোন দুটোর জন্য সে কিনবেই। টিউশনির টাকায় সারা মাস চালাতে তার হিমশিম খেতে হয়। তাই এই মাসে চেষ্টা করে স্টুডেন্টদের সময় বেশি দিতে। এতে অভিভাবকরা খুশি হয়ে বোনাস দেয়। মানে টিউশনির টাকার সাথে কয়টা টাকা বেশি বোনাস দেয়। যেহেতু তার ভার্সিটি বন্ধ থাকে তাই কোনো সমস্যা হয়না।

রায়হান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মসজিদে পড়ে। মসজিদে ফজরের সালাত আদায় করে বাসায় এসে কুরআন তেলাওয়াত করে বেরিয়ে পড়ে টিউশনের উদ্দেশ্যে। সকাল সাতটায় বের হয়। বাসায় আসে কোনোদিন তিনটায় আবার কোনোদিন চারটায়। টানা কয়েক ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করে বাসায় এসে আবার ভাইবোনদের জন্য কিছু ভাজা পোড়া করে। সাধ্যের মধ্যে শরবত আর কিছু ফলমূল রাখার চেস্টা করে। সব সময় অবশ্য ফল থাকে না। ফলের যে দাম। আগুন একেবারে!

দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে রায়হানদের মতো মানুষদের চলতে হয় হিসেব করে। অন্যান্য মাসে দাম যেমন তেমন কিন্তু রোযার মাসে দাম হয়ে যায় আরও দ্বিগুণ। যা নিম্নবিত্ত, রায়হানের মতো খেটেখাওয়া মানুষদের জন্য খুবই কষ্টকর ও কষ্টসাধ্য। রমাদানে যদিও রায়হানের ঘরে ভুঁড়ি ভুঁড়ি বাজার করা হয়না তবুও ওই একটু ছোলা বুট, মুড়ি এগুলোতেই চলে যায় বেশ কিছু খরচা। প্রতিদিন অবশ্য তাদের ভাজা পোড়া বা বুট মুড়ি থাকে না। কোনো কোনো দিন ভাত, পানি দিয়েও ইফতার সারে তারা তিন ভাইবোন। সেদিন রাহমিদ টা প্রচুর জ্বালায়। পাশের ঘরে ভালোমন্দ খাবার দেখে এসে তারও ছোট্ট মনে খেতে ইচ্ছা করে এসব খাবার।

অবশ্য পাশের ঘরের আপুটা দুই দিন ইফতারি দিয়ে গিয়েছেন। রায়হান কিছু দিতে পারেনি এখনো। তাদের ইফতারি বেশিরভাগই থাকে ভাত নাহলে ছোলা মুড়ি। মাঝে মধ্যে একটু পিঁয়াজু। শুধু ছোলা মুড়ি আর একটু পিঁয়াজু কি কারো বাসায় ইফতারি হিসেবে পাঠানো যায়। তাই আজকে বেসন আর বেগুন কিনেছে। মসুর ডাল ভিজিয়ে রেখে এসেছে। ভাজা পোড়া কয়েকটা বানিয়ে আজকে ওনাদের দিবে। রাহমিদ টাও খুব খুশি হবে আজকে। এসব ভেবে রায়হানের ক্লান্ত দেহে একটুকরো প্রশান্তি বয়ে গেলো। ভাইবোন গুলো খুশি হলেই সে খুশি।
_____

রায়হান ঘরে ঢুকে প্রথমে গোসল করলো। আজকে বেজায় গরম পড়েছে। গোসল করে বের হয়ে দেখলো রাহমিদ বিছানায় বসে পা ছড়িয়ে তার আনা বেসন আর বেগুন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। যেন খুব গভীরভাবে কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করছে সে। রুদ রুমে নেই। ও বিছানায় রাহমিদের পাশে বসে বললো,

“পন্ডিত মশাই কি করছে?”

“দেখচি।”

“কি দেখছো?”

রাহমিদ উৎফুল্ল হয়ে বললো,

“আজ মুজা মুজা লান্না হোবে?”

রায়হান মজা করে বললো,

“না তো। আপনাকে কে বলেছে এই কথা প্রিন্স রাহমিদ ওরফে পন্ডিত সাহেব?”

রাহমিদ মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ফিচ ফিচ করে হেঁসে বললো,

“আমি যানি।”

রায়হান হেঁসে উঠে রাহমিদের পেটে নাক দাবিয়ে আদর করতে লাগলো। রাহমিদ খিলখিল করে হেসে উঠলো। রুদ একটা বাসনে পানি আর বটি নিয়ে এসেছে। দুই ভাইকে হাসতে দেখে নিজেও হেঁসে ফেললো। ওগুলো রেখে বড় ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান পিছনে ফিরে রুদের কপালে গালে আদর করলো। রুদও হেঁসে ভাইয়ের গালে, কপালে, মাথায় চুমু দিলো। এটা দেখে রাহমিদ রুদের দিকে মাথা আর গাল এগিয়ে দিলো। রুদ হেঁসে ওকে বললো,

“না তুমি দুষ্টু। তোমাকে আদর দিবো না। আমার একটাই ভাই। তোমাকে কুড়িয়ে পেয়েছি আমরা। তাই না ভাইয়ু?”

রায়হানও সায় জানিয়ে গম্ভীর মুখে বললো,

“হ্যাঁ আসলেই। এরকম বিচ্ছু আমাদের ভাই হতেই পারে না। খামচি দেয়া যার জন্মগত স্বভাব। আমরা কেউই খামচি দিতে পারিনা। ইনি খামচির উপর পিএইচডি করা মানুষ। খামচির রাজা প্রিন্স রাহমিদ।”

রাহমিদ প্রথমে বোনের কথা পাত্তা না দিলেও ভাইয়ের গম্ভীর মুখে বলা কথা বিশ্বাস করে ফেললো। মুহূর্তেই তার চেহারার রঙ পাল্টে কান্না কান্না ভাব জুড়ে গেলো। সে ভাইয়ের কোল থেকে নামার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। রায়হান ও রুদ থতমত খেলো। ছোট ভাইকে কি বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো দুইজন। রুদ ফিক করে হেসে বললো,

“ভাইয়ু মজা করেছে রাহমিদ। আমিও মজা করেছি। তুমি তো আমার ছোট্ট আদুরে ভাইটুস।”

রায়হান রাহমিদকে আদর করে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

“পৃথিবী এক দিকে আর আমার ভাইবোন একদিকে। ওই একদিকের দুই ভাগ আপনারা দুইজন। আল্লাহ ও রাসূলের পর সব চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম আমার মা, বাবাকে কিন্তু তারা আমার ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে হারিয়ে গেছে দূর অজানায়। এখন তো এই পৃথিবীতে আমার ভালোবাসার আছেই মাত্র দুইজন মানুষ। আমার কলিজা। আমার জীবনে ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা খুবই সীমিত। নেই বললেই চলে। আপনারা আমার কাছে সাত রাজার ধনের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান। বুঝেছেন কলিজা?”

রাহমিদ ভাইয়ের এত ভারী ভারী কথা বুঝতে পারেনি তবে ভালোবাসা ঠিকই বুঝেছে। সে আদুরে বিড়াল ছানার মতো ভাইয়ের কোলে লেপ্টে রইলো। রায়হান রুদ আর ওকে ঝাপটে জড়িয়ে রাখলো। তিন ভাইবোন ভালোবাসার প্রতীক হয়ে একে অপরের সাথে মিশে রইলো। দৃশ্যটা চমৎকার!
____
—-

আজকে ইফতারিতে রায়হান আয়োজন করেছে ট্যাংয়ের শরবত, ছোলা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি আর আলুর চপ। সবই অল্প অল্প করে বানিয়েছে। এতো আয়োজন রায়হান করেনা। আজকে করেছে পাশের ঘরে ইফতারি দিবে বলে। একটা প্লেটে সব সাজিয়ে রুদকে দিলো পাশের ঘরে দিয়ে আসতে। এর মধ্যে রাহমিদ বায়না করলো সে প্লেট নিবে। প্লেট নেয়ার জন্য রীতিমত পা ঝাপটাতে লাগলো। রুদ উপায় না পেয়ে ওকে দিলো। রাহমিদ ছোট দুইটা হাতে প্লেট ধরে হাঁটতে লাগলো। রুদ ভাইয়ের পিছে পিছে যেতে লাগলো। পরে টোরে যায় নাকি এই ভয়ে।

দুই ভাইবোন ইফতারি দিয়ে এসে নিজেরাও বসলো। আজকে রাহমিদের চোখ চকচক করছে। পিঁয়াজু, বেগুনি খাবে। ইতিমধ্যেই দুটো খেয়ে ফেলেছে সে। রাহমিদ প্রতিদিন হাফ হাফ করে রোযা রাখে। এরকম করে ওর চারটা রোযা হয়েছে। এভাবে রোযা রাখতে পেরে সে খুবই খুশি। রুদ মাথায় হিজাব পড়েছে। এই হিজাবটা রায়হান তাকে আরবি পড়তে কিনে দিয়েছিল। বাসায় বেশিরভাগ সময়ই ও এই হিজাবটা পড়ে থাকার চেষ্টা করে।

মাগরিবের আজান দিচ্ছে। রায়হান “বিসমিল্লাহ” বলে খেজুর মুখে দিলো। রুদ আর রাহমিদও ভাইয়ের দেখাদেখি বিসমিল্লাহ বলে খেজুর খেলো। ফলের মধ্যে শুধু খেজুরটাই তাদের ইফতারিতে থাকে। রুদ আর রাহমিদের জন্য আলাদা দুইটা পিঁয়াজু, বেগুনি আর আলুর চপ রেখে একটা করে পিঁয়াজু, বেগুনি ও আলুর চপ মেখে বুট মুড়ি বানালো। এগুলো খেয়ে একেবারে সেহেরিতে ভাত খাবে সে। মাঝখানে আর ক্ষুধা লাগবে না।

রায়হান ইফতারি শেষে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে নামাজে চলে গেলো। রাহমিদও ভাইয়ের সাথে নামাজে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আজকে বেশি খাওয়ায় পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। রাহমিদ বিছানায় ফোলা পেট নিয়ে হাত, পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে।

রুদ নামাজ শেষে ছোট ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে হেঁসে ফেললো। উঠে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা একটু ভালোমন্দ দেখলেই খাওয়ার জন্য কেমন পাগলামি করে। আজকে এক হাতে পিঁয়াজু আরেক হাতে বেগুনি নিয়ে কিভাবে খাচ্ছিলো। ভাবলেই হাসি পায় আবার দুঃখও লাগে। ছোট্ট ভাইটা ভালোমন্দ কত পছন্দ করে অথচ সামর্থ্য নেই তাদের। কষ্ট পেয়ে আর কি হবে। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভাইয়া বলেছে ,

“বিপদে ধৈর্য ধরে যারা তারাই সফল।”

ভাইয়া প্রায়ই কুরআনের একটা আয়াত তিলওয়াত করে বাংলায় অনুবাদ করে বলে,

“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে সস্তি রয়েছে।”
~(সূরা ইনশিরাহ, আয়াত ৫-৬)

মহান রবের প্রতি ভাইয়ের অগাধ বিশ্বাস। তাকে এবং রাহমিদকেও এভাবেই গড়ে তুলছে তাদের বড় ভাই। কোনোভাবেই রবের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা হারানো যাবে না। রুদ এসব ভাবতে ভাবতেই বড় ভাইকে ঘরে ঢুকতে দেখলো। রায়হান রাহমিদকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,

“কি হয়েছে ওর?”

রুদ বললো,

“ভাইয়ু রাহমিদ আজকে বেশি খেয়ে ফেলেছে। এখন লড়তে চড়তে পারছে না।”

রায়হান উদ্বিগ্ন গলায় বললো,

“বলেছি এসব ভাজা পোড়া কম খেতে কিন্তু এই বিচ্ছু একটা কথাও শোনে না।”

রায়হান গ্যাস্ট্রিকের সিরাপ কিনে এনে বাচ্চাটাকে খাইয়ে দিলো। রাহমিদ খেতে না চাইলে জোর করে ধমকিয়ে খাইয়েছে। পরে পেটে গ্যাস হলে অনেক সমস্যা হবে। যা রায়হান মোটেও চায়না। ভাইবোনদের অসুখে সব চেয়ে ব্যথিত সেই হয়। রাহমিদটার এমনিতেই অসুখ বিসুক লেগেই থাকে। কোথা থেকে কি হয় বলা তো যায় না। সে কোনো রিস্ক নিতে রাজি নয়।

চলবে…..

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৪.১
#তাজরীন_ফাতিহা

ঈদের দুই দিন বাকি। রায়হান ঠিক করেছে এবার ভাইবোনকে নিয়ে ওদের পছন্দমতো জামা কিনে দিবে। টিউশনির টাকা সবাই মোটামুটি বোনাস সহই দিয়েছে। হাতে ভালো একটা অ্যামাউন্ট আছে। রাহমিদটা খেলনার জন্য কেমন করে। এবার ওকে ওর পছন্দমতো কয়েকটা খেলনা কিনে দিবে। দেখা যাক কতটুকু সাধ্যে কুলায়। আজকে ইফতারি করে মার্কেটে নিয়ে যাবে দুইজনকে। ভাইবোনকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী জামাকাপড় কিনে দিবে ভেবেই তার মনটা পুলকিত হয়ে যাচ্ছে।

রায়হান আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় যাচ্ছে। যেহেতু ঈদের আর মাত্র দুইদিন বাকি তাই তার স্টুডেন্টদের সবাই এখন ছুটিতে আছে। ওরা অনেক আগে থেকেই ঈদের শপিং করা শুরু করে দিয়েছে। এখনো করছে। যার যেমন সামর্থ্য তেমনই তো খরচ করবে। তার সাধ্য অল্প। আর সে আলহামদুলিল্লাহ অল্পতেই তুষ্ট। রায়হানের যখন বাবা, মা ছিল তখন সেও তো কত শপিং করেছে। সেইসব স্মৃতি মনে করে লাভ নেই। ওগুলো অতীত। অতীত মনে করা মানে দগ্ধ হওয়া। স্মৃতি মনে রাখা ভালো তবে যে স্মৃতি পীড়া দেয় সেই স্মৃতি মনে না রাখাই কল্যাণকর।
_____

“ভাই, এরাম কইরা খুঁইজা আদো কোনো লাভ হইবো বইলা আপনের মনে ওয়?”

রুস্তমের চ্যালা আব্বাস কথাটা হতাশার সুরে বললো। রুস্তম উদাস দৃষ্টিতে অদূরে তাকিয়ে আছে। আজকে কতটা দিন হয়ে গেল রায়হানের খোঁজ করছে সে। যদিও রায়হানের সাথে তার সখ্যতা অতটা গাঢ় ছিল না কিন্তু তিনটা এতিম ছেলেমেয়ের প্রতি তার কেন যেন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। সেই মায়া থেকেই এক সময় ওদের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। কেন যে এতো মায়া তৈরি হলো আল্লাহই জানে? এখন সে চাইলেও ওদেরকে ভুলতে পারেনা। রুস্তম খানিকক্ষণ পর বলে উঠলো,

“জানিস জীবনে নামাজ কালামের ধারে কাছেও যায়নি কিন্তু কয়েকদিন ধরে নামাজ পড়া শুরু করেছি। কারণ কি জানিস?”

রুস্তম তার চ্যালা দের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো। তার চ্যালাপ্যালারা একে অন্যের দিকে তাকালো। তারপর কিছু ভাবলো। কিন্তু ভেবেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলো না। অতঃপর রুস্তমের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। অর্থাৎ এটার উত্তর তাদের জানা নেই। রুস্তম জানতো ওরা কেউই পারবে না তবুও জিজ্ঞাসা করেছে। সে দৃষ্টি রাস্তার পানে রেখে উত্তর দিলো,

“রায়হান একবার কইছিল, ভাই সব সময় চেষ্টা করবেন পাঁচ বার আল্লাহ্ তায়ালাকে হাজিরা দিতে কারণ এই পৃথিবীতে মানুষ আপনের কোনো চাওয়া পূরণ না করলেও মহান রব তার বান্দাদের কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখেন না। বান্দার জন্য সর্বোত্তম জিনিসটিই মহান রব বাছাই করেন। আপনে গো পৃথিবীর সব কাম কাইজ করারই সময় থাকে। শুধু নামাজ পড়ারই সময় থাকে না। মনে রাইখেন, পৃথিবীতে যে কাজগুলা করেন তা অবশ্যই নামাজের থেইকা গুরুত্বপূর্ণ না। নামাজ আমগো উপ্রে আল্লাহ্ তায়ালা ফরজ কইরা দিছে। অর্থাৎ এইডা পড়োনই লাগবো এইখানে কোনো অজুহাতই কামে আইবো না। জানিস এই কতা গুলো তহন এক কান দিয়া ঢুকাইয়া আরেক কান দিয়া বাইর কইরা দিছিলাম। কয়েকদিন আগ পইজন্ত এইসব কতা আমারে নাড়াইতে পারে নাই। এহন জিগা কি এমন হইছে যে আপনে এহন এইগুলান কইতাছেন?”

রুস্তমের সাঙ্গপাঙ্গরা এক মনে তাদের শ্রদ্ধেয় ভাইয়ের কথা শুনছে। রুস্তমের প্রশ্নে তারাও মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। অর্থাৎ তারা জানতে চায়। রুস্তম আবারও বলা শুরু করলো,

” জানিস রায়হানকে একদিন বেলা এগারোটার দিকে মসজিদে ঢুকতে দেহি। তহন আমি চায়ের দোকানে বসে চা খাইতেছিলাম। ওকে এই অসময়ে মসজিদে ঢুকতে দেখে আমি ভীষণ অবাক হইছিলাম। এহন তো কোনো নামাজের ওক্ত না। তাইলে রায়হান এইসময়ে এহানে কি করে? অনেকক্ষণ পর যহন ওয় বের হয় তহন ওরে ডাকি। ওরে জিগাই এই অসময়ে এহানে কি? জানোস ওর উত্তর কি আছিলো?”

রুস্তমের সাঙ্গপাঙ্গরা অতি উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“কি ভাই?”

“ওর উত্তর আছিলো, ভাই একটা বিপদে পড়ছিলাম তাই আল্লাহর কাছে বিপদটার কথা বললাম। মসজিদের ইমাম সাহেব বলছে, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে কিছু চাইলে নাকি আল্লাহ্ তা দেন। চাওয়ার মতো চাইলে আল্লাহ্ কহোনোই ফিরায় না। ওর ওই কথাটা আমাকে ভিতর থেকে এট্টু হইলেও নাড়াইয়া দিছিলো। তারপরও ক্যান জানি নামাজ কালাম পড়তাম না। কিন্তু কিছু চাওয়ার থাকলে কহনো কিছু না চাওয়া আমি আল্লাহর কাছে মনে মনে হইলেও চাইতাম। আল্লাহয় এই গুনাহগারের দোয়া কবুল করছিল কিছু। সব করে নাই হয়তো ঐগুলান আমার লাইগ্যা অকল্যাণকর আছিলো নাইলে আমিই আল্লাহর কাছে চাওয়ার মতো চাইতে পারি নাই। তবুও মহান আল্লাহ আমার মতো পাপী, বেনামাজীর চাওয়া পূরণ করছিল ওইডাই তো অনেক।”

এটুকু বলে রুস্তম একটু শ্বাস নিলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,

“কয়দিন আগে আৎকা মনে হইলো, আইচ্ছা আল্লাহ তায়ালার কাছে যদি নামাজ পইড়া কায়মনোবাইক্যে কিছু চাই তাইলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ফিরাইবো না। এরম কইরা জীবনের পোর্থম নামাজ পড়লাম আর চাইলাম। জানিস ওইদিন নামাজ পইড়া কি যে প্রশান্তি পাইছি। তারপর থেইক্কা আমি নামাজ ছাড়ি না। যদিও সব ওয়াক্ত পড়তে পারি না। তবুও জট্টুক পড়ছি। আলহামদুলিল্লাহ এহন চেষ্টা করি নামাজ পড়ার। আমার বিশ্বাস আছে আল্লাহ্ আমারে ফিরাইবো না। একদিন না একদিন রায়হানের দেখা আমি পামুই পামু ইংশাআল্লাহ।”

এতক্ষণ ধরে রুস্তম ভাইয়ের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ভাইয়ের শেষ কথার সাথে তারাও সমস্বরে “ইংশা আল্লাহ্” বলে উঠলো।
______
—-

রায়হানদের আজকের ইফতারি তে ছিল ভাত আর শুঁটকি ভর্তা। আর রাহমিদের জন্য দুটো ডালের বড়া। রাহমিদটা ভাজা পোড়া না থাকলে ঝামেলা করে। এখন আর কাঁদবে না। ঝামেলাও করবে না। মাগরিব পড়ে এসে দুই ভাইবোনকে নিয়ে ঈদের শপিং করতে বের হলো। রাহমিদ, রুদ দুইজনই আজকে খুশি। ভাইয়ের সাথে এই প্রথম কোথাও দুই ভাইবোন যাচ্ছে। খুশি তো লাগবেই।

রায়হান নিজের সাধ্যের মধ্যে ভাই বোনদের শপিং করে দিলো। রাহমিদকে দুইটা পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছে। পাঞ্জাবি দুইটার দাম সাড়ে আটশো করে রেখেছে। রুদকে দুইটা ফ্রক কিনে দিয়েছে। দুটোর দাম নিয়েছে সাতশো। অনেক দামাদামি করে কম টাকায় চারটা জামা কিনেছে। হাতে টাকা বেশি না থাকায় তার জন্য আর কিছু কিনলো না। ঈদের বাজার। দোকান এখন আগুন হয়ে আছে। অনেক দোকান ঘুরেছে। সাধ্যের মধ্যে একটা পাঞ্জাবিও নেই। কালকে নাহয় আরেকবার এসে ঘুরে যাবে।

রাস্তায় তিন ভাইবোন হাঁটছে। রাহমিদ একবার ভাইয়ের আঙ্গুল ধরে হাঁটছে। খানিকক্ষণ পর আবার বোনের আঙ্গুল ধরে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে রায়হান রাহমিদকে জিজ্ঞাসা করলো,

“আজকে তুমি খুশি কলিজা?”

“অনেক খুচি।”

রাহমিদ খুশি খুশি গলায় বললো। রায়হান বললো,

“তোমাকে এবার খেলনাও কিনে দিবো। বলো তো কি খেলনা চাও?”

“গারি। বুম বুম করে যিটা চলে।”

“আচ্ছা বুম বুম করা গাড়ি কিনে দিবো তোমায়।”

রায়হান এবার রুদকে জিজ্ঞাসা করলো,

“তোমার কি লাগবে রুদ পাখি?

“কিছু না ভাইয়ু। আমি তো জামা কিনেছিই। তুমি একটা জামা কিনো। আমাদের জন্য তো কিনেছোই আর কিছু কিনা লাগবে না।”

“আমি তো আমার জন্য কিনবোই কাল। তোমাকে চুলের ব্যান্ড আর একটা মাথার হিজাব কিনে দিবো।”

“লাগবে না ভাইয়ু। আমার তো আছেই।”

“চুপ। আমি যখন বলেছি তখন কিনে দিবোই।”

ভাইয়ের ধমকে রুদ আর কিছু বলার পেলো না। চুপচাপ ভাইয়ের কেনাকাটা দেখলো। রায়হান রাহমিদকে খেলনা আর রুদকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

রাহমিদ টেম্পুতে চড়ে ভীষণ খুশি। এই প্রথম একটা গাড়িতে করে কোথাও গিয়েছে আবার বাসায় যাচ্ছে। টেম্পু যখন সাই সাই করে চলে তখন তার খুব আরাম লাগে। রুদেরও টেম্পুতে চড়ে ভালো লাগছে। রায়হান ভাইবোনদের খুশি খুশি মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তি খুঁজে পেলো।

কিন্তু নিয়তি বোধহয় আজকের এই খুশি চাইলো না। কোথা থেকে একটা বাস এসে হুট করে টেম্পুটায় ধাক্কা মারলো রায়হান কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। মুহূর্তেই রায়হান ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো। শক্ত গাছের গোঁড়ায় ধাক্কা খেয়ে মাথা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। জ্ঞান হারানোর আগে কানে এলো,

“মেয়ে বাচ্চাটা আঘাত কম পেয়েছে। ছেলে বাচ্চাটাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাও। বাচ্চাটার অবস্থা শোচনীয়। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।”

এরপর চিল্লিয়ে কাউকে বললো,

“বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চলো। কুইক।”

কয়েকজন রায়হানকে ধরাধরি করে উঠালো। রায়হান চক্ষু মুদার আগে অস্পষ্ট সুরে বললো,

“আমার রাহমিদ, রু…..।”

বীভৎস এক ঘটনার সাক্ষী হলো রাতটা।

চলবে…..

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২৪.২(বর্ধিতাংশ)
#তাজরীন_ফাতিহা

সামনে এতো ভিড় দেখে রুস্তম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এগিয়ে গেলো। মূলত তারা এখানে সমিতি থেকে টাকা উঠাতে এসেছিল। প্রত্যেক বছরই আসে। রুস্তম এগিয়ে গিয়ে দেখলো দুটো রক্তাক্ত বাচ্চাকে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। রুস্তমের মন হঠাৎই কামড় দিয়ে উঠলো। আহারে এতো ছোট বাচ্চা দুটো কত রক্তাক্ত হয়েছে। মেয়ে বাচ্চাটার থেকে ছেলে বাচ্চাটা বেশি আহত। আচ্ছা বাচ্চা দুটোর বাবা, মা কই? নিশ্চয়ই ওনারাও এক্সিডেন্ট করেছে।

রুস্তম ভিড় ঠেলে আরও সামনে আগালো। বিরাট গাছের পাশে জটলা দেখে এগিয়ে গেলো। একটা ছেলেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রুস্তমের খুব খারাপ লাগছে হঠাৎ করেই। জীবনে অনেক এক্সিডেন্ট দেখেছে কিন্তু আজকে কেন যেন মনটা বেশি কামড়াচ্ছে। অজানা ভয়ে বুকটা ধুরু ধুরু করছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে রুস্তম দেখলো রক্তাক্ত হয়ে একটা ছেলে পড়ে আছে। বুকটা কামড়ে ধরলো কেন যেন। রুস্তম কি যেন একটা ভাবলো। হঠাৎ করেই দৌঁড়ে গিয়ে ছেলেটার মুখ থেকে রক্ত খানিকটা সরালো। এটা দেখে সবাই চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। রুস্তম দেখলো, তার বহু প্রতীক্ষিত রায়হানকে। রুস্তমের সাঙ্গপাঙ্গরা যারা চেঁচামেচি করছিল ওদেরকে ধমকে ধামকে চুপ করালো। রুস্তম ভাবছে যাকে এতদিন ধরে খুঁজে ফিরেছে, আল্লাহর কাছে যাদেরকে একবার হলেও দেখা করিয়ে দিতে বলেছে তাকে এই বেশে এমন অবস্থায় দেখবে কল্পনাও করেনি। রুস্তম চিল্লিয়ে তার সাঙ্গপাঙ্গদের বললো,

“হাসপাতালে নিতে হইবো। তাড়াতাড়ি গাড়ি লইয়ায়। মাইনষের কাম খালি তামশা দ্যাহা। কতক্ষণ হইছে এক্সিডেন্ট হইছে অথচ খাড়াইয়া খাড়াইয়া তামাশা দ্যাহে।”

রুস্তমের হুকুমে তার চ্যালারা গাড়ি নিয়ে আসলো। তারপর রুস্তম বাচ্চা দুটোকে খুঁজলো। ততক্ষণে বাচ্চা দুটোকে একজন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। কয়েকজনকে হাসপাতালের নাম জিজ্ঞাসা করে রুস্তম রায়হান কে নিয়ে ওই হাসপাতালেই রওনা হলো। গাড়িতে বসে মনে মনে খারাপ কিছু যেন না হয় তার প্রার্থনা করতে লাগলো। মহান রবের কাছে কতো মোনাজাতে রায়হান কে একবার হলেও দেখতে চেয়েছে। আল্লাহ্ তাকে এ কি দেখালো! এর থেকে তো না দেখানোই ভালো ছিল। রুস্তম রায়হানের হাত শক্ত করে ধরে চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ছেড়ে দিলো। অস্ফুট স্বরে বললো,

“আল্লাহ্ খারাপ কিছু কইরো না।”
_____
—-

গত রাতে বাসের ব্রেক হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বড় সরো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় রায়হানদের সাথে। ঈদের বাকি আর মাত্র একদিন। এতো আনন্দ, খুশির মধ্যে এই এতিম বাচ্চাগুলোর খুশি নিমেষেই মুছে গেলো। ওদের আনন্দ ভাগ্য তো মুছে গেছে যেইদিন ওরা অনাথ হয়েছে সেইদিনই। কি এক বিভীষিকাময় রাত ছিল কাল! ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।

কালকে এক্সিডেন্টের পর যখন সবাই জড়ো হয়েছিল তখন এতো ছোট্ট বাচ্চাগুলোর এই মর্মান্তিক অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছে সেখানে উপস্থিত সকল মানুষ। রাহমিদের মায়াবী বদন রক্তে মাখামাখি ছিল। রুদ আঘাত খানিক কম পেলেও ভালো রকমের একটা অ্যাকসিডেন্ট ওদের উপর দিয়ে গিয়েছে।

সব চেয়ে মর্মান্তিক ছিল, অ্যাকসিডেন্টের পর রাহমিদের থেকে কয়েক হাত দূরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়া ছিল তার বুম বুম করা ভাঙাচোরা গাড়ি টা। ছোট্ট হাত দিয়ে ধরা সেই গাড়িটি নিয়ে তার কতো ইচ্ছে দুই সেকেন্ডের মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো

মাঝে মাঝে কিছু পরিস্থিতি শুনলে বা দেখলে মনে হয়, এরকমটা হওয়া কি খুবই জরুরি ছিল?
_____

রায়হানের মাথার ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন,

“রোগীর কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে। তবে রোগীকে উত্তেজনা মূলক কিছু বলবেন না। এই যাত্রায় আল্লাহর রহমতে মাথায় গুরুতর কিছু হয়নি। তবে শরীরে, মাথায় ভালোই আঘাত পেয়েছে। এর জন্য পরে সমস্যা হতে পারে। উনি মাথায় বেশি চাপ নিতে পারবেন না। ভুলে যেতে পারেন আবার অল্পক্ষণের মধ্যেই মনে পড়বে অবশ্য। অর্থাৎ অতি দ্রুত কিছু ক্যাপচার করতে তার সমস্যা হতে পারে। উন্নত চিকিৎসা করালে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা আছে।”

রুস্তম শক্ত হয়ে ডাক্তারের সব কথাই শুনেছে। ডাক্তার রায়হানকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে কিন্তু ভাইবোনের কথা স্মরণ করে যদি নিজেই উত্তেজিত হয় রুস্তম কিভাবে সামাল দিবে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। রুস্তম আর কিছু ভাবতে পারলনা।
_____

“আমার রাহমিদ কি বেঁচে নেই? ওরে একটু দেখবো। আমার কলিজার টুকরাটা কই? কেউ একটু বলেবেন ভাই।”

প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো রায়হান। কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে রায়হানের। তীব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে চোখ খুলে তাকিয়েই রাহমিদ আর রুদের কথা জিজ্ঞেস করেছে। ডাক্তার কাউকেই দেখা করতে দিতে চাইছিল না কিন্তু রোগীর পাশে একজনের থাকা দরকার ভেবে রুস্তমকে থাকতে বলেছেন।

রায়হান জ্ঞান ফিরেই রুস্তমকে দেখে অবাক হয়েছিল। প্রথমে সে কোথায় বুঝে উঠতে পারছিল না। পরে আস্তে আস্তে সব মনে পড়ার পর রুস্তমকে চিনেতে পারে। রুস্তমকে দেখেই ভাইবোনদের কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। রুস্তম কিছু বলতে পারছিল না। তার বুক কাঁপছে। কিভাবে কি বলবে কথাই সাজাতে পারছিল না। অন্যদিকে রায়হান রুস্তমকে এমন দোনামনা করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে উপরোক্ত কথাটি বলে। কথাটুকু বলতে গিয়ে রায়হানের শরীর, মুখ সব কাঁপছিল। রুস্তম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। মৌনতা ভেঙে বললো,

“ওরা আল্লাহর রহমতে ভালাই আছে। তুমি উত্তেজিত হইতাছো কেন? চুপচাপ শুইয়া থাহো।”

“ভাই আমি অজ্ঞান হওয়ার আগে নিজ কানে শুনেছি রুদ আঘাত কম পাইলেও আমার রাহমিদের অবস্থা ভালো না। বাঁচার সম্ভবনা নাকি….”

এতটুকু বলেই রায়হান হুহু করে কেঁদে দিলো। তারপর চিল্লিয়ে বললো,

“আল্লাহ্ আমাকে দুনিয়ায় রাখছে কেন? আর কত হারাবো আমি? প্রথমে বাবা, মা এখন আবার আমার ভাইবোন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভাই। আল্লাহ রে বলেন আমাকেও নিয়ে যেতে। এই পৃথিবীতে আমাকে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে রেখে আল্লাহ আমাকে আর কত বাঁচাবে? আল্লাহর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ভাই। অনেক কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা থেকেই চাই আমার ভাইবোনের কিছু হইলে যেন আমাকেও বাঁচিয়ে না রাখে।”

রায়হানের চোখ থেকে অজস্র পানি পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎই মাথায় হাত দিয়ে গুঙিয়ে উঠলো। রুস্তম তড়িঘড়ি করে রায়হানকে ধরলো। বললো,

“কিছুই হয় নাই। তুমি শান্ত হও। ডাক্তার উত্তেজিত হইতে নিষেধ কইরা দিছে। ওই বাচ্চু খাড়াইয়া আছোস কেন? যা ডাক্তার ডাক।”

বাচ্চু দ্রুত গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনলো। ডাক্তার রুস্তমকে কিছুক্ষণ ধমকালো। রোগীকে উত্তেজিত করতে নিষেধ করেছেন সেখানে রোগী উত্তেজিত হলো কিভাবে? রায়হানকে একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলো। রায়হান কিছুক্ষণ ঘুমাবে।

রায়হান ঘুমিয়ে পড়লে রুস্তম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। রায়হান ঘুমিয়ে থাকলে আর উত্তেজিত হবে না। এখন ওর রেস্টের দরকার।
______
—–

রাহমিদকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। বাচ্চাটার অবস্থা গুরুতর। আজকে দুইদিন ধরে বাচ্চাটা আইসিইউতে ভর্তি। রায়হান আইসিইউর সামনে দাড়িয়ে আছে। গত দুই দিন ওকে দমিয়ে রাখতে পারলেও আজকে আর পারেনি কেউ। ঘুমের ইনজেকশন দেয়ার আগেই ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীর নিয়ে এসেছে ভাইকে দেখতে। আজকে ঘুম ভেঙে গেলে রুস্তমকে বলতে শুনেছে রাহমিদ আইসিইউতে আছে। তাই আর দেরি না করে দ্রুত আইসিইউর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ডাক্তারকে আইসিইউ থেকে বের হতে দেখে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের সামনে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“আমার রাহমিদ কেমন আছে?”

ডাক্তার রায়হানকে দেখে চমকালো। এক রোগী আরেক রোগীর খোঁজ করছে। ডাক্তার মাস্ক নামিয়ে বললো,

“আপনি কে? রোগীর খোঁজ করছেন কেন? আপনার অবস্থাও তো ভালো না।”

“আমি রোগীর ভাই। ওর অভিবাবক আমি। বলুন না ও কেমন আছে?”

“এখনো রেসপন্স করছে না তবে শ্বাস নিচ্ছে। যেহেতু বাচ্চা শরীর। আঘাত তার জন্য মারাত্মক ছিল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। উনি ছাড়া এই এই অবস্থা থেকে কেউই বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারবে না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। আমারা সাধ্য মতো চেষ্টা করছি।”

এতটুকু বলেই ডাক্তার চলে গেলো। রায়হান ওখানেই বসে পড়ে চিৎকার করে উঠলো। জোরে জোরে বলতে লাগলো,

“ও আল্লাহ আমি আর কত হারাবো? আমি যে ক্লান্ত আল্লাহ্। আমার থেকে আর কত কিছু কেড়ে নিবেন মালিক? আপনার কি আমার প্রতি একটুও মায়া হয় না? আমি কি এতটাই নগণ্য আর এতটাই বোঝা আপনার কাছে? আমার থেকে কেন সব কিছু কেড়ে নেয়া হচ্ছে মালিক? আমার অপরাধ কি? আমি কি একটু ভালো থাকা ডিজার্ভ করিনা আল্লাহ্? ওইটুকু বাচ্চা কি অপরাধ করেছে মালিক? দরকার হলে আমাকে নিয়ে যান তবুও আমার এই কলিজার টুকরা গুলোকে ভালো রাখেন।”

দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে উপরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে জোরে জোরে কথাগুলো বলে থামলো। হঠাৎ ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে তাকালো। দেখলো রুদ ব্যান্ডেজ বাঁধা শরীরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর কেঁদে উঠে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। রায়হানও কেঁদে উঠে ঝাপটে জড়িয়ে রাখলো রুদকে।

এ কান্না থামার নয়। পুরো হাসপাতাল জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে শুধু রায়হানদের এই কান্নার সাক্ষী হচ্ছে হাসপাতালের মানুষজন আর অদূরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলা রুস্তম ও তার গ্যাং।

রায়হানের আহাজারীতে সবাই মনে মনে চাইলো,

“আল্লাহ্ ছেলেটার মুখে হাসি ফুটিয়ে দাও। ওর সকল দুঃখ মুছে সুখের হাসি ফোঁটাও মালিক।”

মালিক শুনবে কি এতগুলো মানুষের আর্জি?

চলবে….

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-২১+২২

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২১
#তাজরীন_ফাতিহা

চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। নিশ্চুপ চারিপাশ। পুরো শহরটা ঘুমে আচ্ছন্ন। কোনো আওয়াজ নেই আশেপাশে। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। কানের কাছে রি রি শব্দ হচ্ছে। রায়হান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। রাত সাড়ে তিনটা। ভার্সিটির পড়া পড়েছে এত রাত ধরে। আজকে চোখে ঘুম নেই তার। ইদানীং কেমন বিষণ্ন লাগে। কিছুই ভালো লাগে না। দিনশেষে সবারই মন খুলে কথা বলার, আগলে রাখার মানুষ থাকে কিন্তু তার কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। সব কেমন নিরিবিলি। নিঃসঙ্গ, গুমোট আদলে গড়া তার জীবন। বাইরে অন্ধকারে একদৃষ্টে তাকিয়ে এসবই ভেবে চলছে সে। রায়হান ভাবে। শুধুই ভেবে যায়। কি যে ভাবে মাঝে মাঝে সেটাই বলতে পারবে না সে। জীবনটা কোনো এক অজানায় গিয়ে তো একসময় না একসময় ঠেকবে। সেটা ভালো কিংবা মন্দ।

আচ্ছা, সুখী কিভাবে হওয়া যায়? কি করলে মনে একটু শান্তি পাবে? জীবন হলো এক ঘুটঘুটে অমানিশা। কেউ আনন্দে কাটায়, কেউ সীমাহীন কষ্টে জীবন পাড় করে। দুটোই তো জীবন। পার্থক্য কি শুধু আনন্দ আর কষ্টে? হবে হয়তো। তার কাছে জীবন মানে ভিন্ন। জীবন মানে তার কাছে এক বুক হতাশা, কষ্ট, ভাইবোনদের দেখাশোনা করা, তাদের আবদার পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, মানুষের কথা শোনা, কারো সাথে মিশতে না পারা সব কিছুর সংমিশ্রণ। অনেকে কল্পনায় বাঁচে, ফ্যান্টাসিতে ভোগে এইসবও কি জীবন? এইসবে আনন্দ পাওয়া যায়? আচ্ছা, কল্পনা, ফ্যান্টাসিতে যারা ভোগে তারা কি সুখী? এরকম কোনো মানুষ থাকলে জিজ্ঞাসা করা যেতো আদোতেই তারা সুখী কিনা। রাহমিদের কান্নার আওয়াজে রায়হানের ভাবনা চিন্তার বিচ্যুতি ঘটলো। তাকিয়ে দেখলো রাহমিদ বসে দুই হাত দিয়ে চোখ ডলছে আর কান্না করছে। রায়হান উঠে ওর কাছে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“ঘুম ভাঙ্গলো কিভাবে আপনার? কে আমার টোটন সোনার ঘুম ভাঙিয়েছে? কি লাগবে কলিজা বলেন।”

“সুসু দিবো।”

“আচ্ছা তাই? মহৎ কার্য সমাধানে উঠেছেন তাহলে।”

কথাটা বলেই রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে টয়লেটে গেলো। টয়লেট করিয়ে রুমে এনে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলো কিন্তু রাহমিদ আজকে বোধহয় আর ঘুমাবে না। দুষ্টুমি করছে বাচ্চাটা। শুইয়ে দিলে আবারও বসে পড়ে। জোর করে দুই বার ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিচ্ছুটা ঘুমাচ্ছে না। কি জ্বালা! সারাদিন নির্ঘুম থাকায় ক্লান্তিতে রায়হানের চোখ বুঝে আসছে যেন। রাহমিদকে ঘুম না পাড়িয়ে সে ঘুমাবে কিভাবে? রায়হান শুয়ে থেকেই বললো,

“রাহমিদ ঘুমাও। এতো রাতে দুষ্টুমি করছো কেন?”

“গুম নাই। চুকে গুম নাই।”

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বাচ্চাটা ভাইকে দেখাচ্ছে তার ঘুম নেই। রায়হানের এখন সত্যি ক্লান্ত লাগছে। একটু পর আযান দিয়ে দিবে। একটুও যদি না ঘুমায় তাহলে সারাদিন কোনো কাজই করতে পারবে না। এদিকে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছেও না। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। উফফ বিরক্তিকর! রায়হান চোখ বন্ধ করলো। চোখটা লেগে আসছে সেই সময় রাহমিদ ভাইয়ের বুকের উপরে উঠে বলতে লাগলো,

“ভাইয়ু গুমাও কিনো? আমাকি রিকে গুমাও কিনো?”

রায়হান ঘুম ঘুম কণ্ঠে জবাব দিলো,

“তো কি করবো? তোমাকে নিয়ে নাচবো? তুমি তো ঘুমাচ্ছ না, ভাইয়ু কে ঘুমাতে দাও। তুমিও ঘুমাও।”

“নো নো। গুম পায় না। চুকে গুম নাই। গুম কই পাবু?”

ভাইয়ের বুকের উপরে উঠে ভাইয়ের চোখে, মুখে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো বাচ্চাটা। রায়হানের এখন খারাপ লাগছে। এভাবে কতক্ষণ। সে রাহমিদকে বললো,

“ঘুমাতে বলেছি রাহমিদ। বেশি জ্বালাচ্ছো কিন্তু তুমি। না ঘুমালে ভূত এসে কামড় দিবে নে তোমাকে।”

ভূতের কথা শুনে বাচ্চাটা ভয় পেলো। ভাইয়ের বুকের উপর বসা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। রায়হানের মুদে আসা চক্ষু ফট করে খুলে গেলো। এমন ঝাঁপিয়ে পড়ায় কিছুটা ভয়ও পেয়েছে রায়হান। বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

” কিছু নেই। ঘুমান। বেশি দুষ্টুমি করলে আসবে কিন্তু। ঘুমান প্রিন্স।”

“ভুতু নাই? ভুতু কই? বয় পাই তো। ভুতুকে তুমি চলি যেতি বলো।”

“আরে বাবা বললাম তো কিছু নেই। ঘুমাও। না ঘুমালে আসবে। ঘুমালে কিচ্ছু করবে না।”

বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলো। রায়হানের হাত আস্তে আস্তে অচল হয়ে পড়ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে ওই সময় রাহমিদ আবারও নড়াচড়া করতে লাগলো। বাচ্চাটা উসখুস করছে। বুঝে আসা কণ্ঠে রায়হান জিজ্ঞাসা করলো,

“আজকে কি হলো তোমার? এতো জ্বালাচ্ছো কেন রাহমিদ?”

“কিদা লাগচে।”

রায়হানের চোখ ধপ করে খুলে গেলো। এতো রাতে রাহমিদের খুদা লেগেছে। কখনো তো রাতে খুদা লাগে না বাচ্চাটার। আজকে কি হয়েছে কে জানে। ঘুম ঘুম চোখেই রাহমিদকে নিয়ে উঠে বসলো সে। জিজ্ঞাসা করলো,

“কি খাবে?”

“চিপস কাবো।”

“কি মুসিবত! তোমার জন্য এখন চিপস পাবো কোথায়? অতিরিক্ত করছো তুমি আজকে। সব কিছু দিতে দিতে চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছি নাকি। সারাক্ষণ এটা খাবো, ওটা খাবো। এগুলো খুবই খারাপ রাহমিদ।”

ভাইয়ের বকা শুনে বাচ্চাটা মন খারাপ করলো। রায়হান ওর মন খারাপ করা দেখে উঠে একটা আলু নিয়ে রান্না ঘরে গেলো। রাহমিদকে একটা মোড়ায় বসিয়ে দিলো। আলু গোল গোল করে কেটে লবণ দিয়ে মাখিয়ে নিলো। কড়াইতে অল্প তেল দিয়ে তাতে পিছ করা আলু গুলো ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে আলু গুলো তেলে ভাঁজা করলো। আলু কুড়কুড়ে হয়ে গেলে প্লেটে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে রাহমিদকে খাইয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদকে খাইয়ে দিতে দিতেই ফজরের আযান দিয়ে দিলো। হতাশার একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে হলো রায়হানের মুখ থেকে। আজকে সারাদিন দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। আবার আগামীকাল রাতে ঘুমাতে পারবে। এখন ফজর পড়ে সকাল, দুপুরের রান্নাবান্না করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে তারপর স্টুডেন্ট পড়িয়ে সেই রাত আটটা, নয়টায় ঘরে আসবে। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত!
______
—–

“রায়হান দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল এক্সাম কিন্তু একমাস পর থেকেই। এক্সাম ফি তাড়াতাড়ি জমা দিয়ে দিতে বলেছে ইমরান স্যার। তুই তো এক সপ্তাহ ধরে আসিস না। এতো গ্যাপ যে কেন দিস আল্লাহ্ জানে। আমরা সবাই আগামীকাল জমা দিবো। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতদিন। তুই টাকা নিয়ে আসিস।”

সাইমুন একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো। পাশে জুবায়ের, হাবিব, ইমন বসে বসে কোলড্রিংকস খাচ্ছে। রায়হান পানি খাচ্ছিলো। সাইমুনের কথাগুলো শুনে পানি খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আগামীকাল টাকা জমা দিতে হবে কিন্তু তার হাতে তো এক টাকাও নেই আপাতত। এই মাসটায় একটু বেশিই খরচ হয়ে গেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। পরীক্ষার বেশিদিন নেই। অথচ তার ভালো কোনো প্রিপারেশন নেই। সারাদিন এতো কাজের পর ক্লান্তিতে আর পড়তে বসতে ইচ্ছা করেনা। যতই কষ্ট হোক কয়েকদিন ভালো করে পড়তে হবে দরকার হলে টিউশনি কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হবে। নাহলে ফেল করলে এই সেমিস্টারেই থাকা লাগবে। আল্লাহ্ সাহায্য করো। জুবায়েরের কথায় ঘোর কাটলো রায়হানের।

“তুই শালায় কই মরোস ক তো? ডাকতাছি কতক্ষণ ধইরা আর শালায় দুনিয়ার বাইরে চইলা গেছে মনে হয়। কিছু একটা কইলেই হইলো। কি যে ভাবতে লাগে আল্লাহ্ জানে।”

তার সব বন্ধুদের মধ্যে জুবায়েরের মুখটা খারাপ। যাকে তাকে গালি দিয়ে বসে। রায়হান অনেকদিন মানা করেছে কথায় কথায় মুখ খারাপ না করতে তাও শোনে না। যদিও এখন আগের থেকে সংযত হয়ে কথা বলে তবুও শোধরায়নি পুরোপুরি। রায়হান বোতলের সিপ বন্ধ করে বললো,

“আমি কয়দিন পর টাকা দিবো। তোরা দিয়ে দে। হাতে আপাতত টাকা নেই। টিউশনির টাকা পরের মাসে পাবো। পরের মাসেই টাকা দিবো।”

হাবিব বললো,

“কিন্তু ইমরান স্যার মানবো না তো। হেইদিন ক্লাসে আইসা নানা কতা শুনায় দিছে। জলদি দিতে বলছে না দিলে নাকি পরীক্ষায় বসাইবো না।”

“আমার কাছে তো এখন টাকা নেই কোথা থেকে দিবো। স্যারের সাথে কথা বলতে হবে। যদিও ওনাকে মানানো সহজ হবে না জানি। তবুও বলতে তো হবেই।”

জুবায়ের বললো,

“শালার পিছনে বাশ ভরে দিতে পারলে ভালো লাগতো। রাশেইদ্দা একটা আর এই ইমরাইন্না একটা। পুরা ডিপার্টমেন্টটারে পায়ের নিচে রাহে। ভাব দেহায় যেন রাজা ভিক্টোরিয়া। ওগো ভাবের খেতা পুড়ি। কিছু কওন যায়না তাগোরে। যত্তসব টুট… টুট… টুট।”

“মুখের ভাষা খারাপ করছিস কেন? আর রাজা ভিক্টোরিয়া কে?” রায়হান বলে উঠলো।

“রানীর জায়গায় রাজা কইছি। না বুঝার কি আছে। মাথায় বিখ্যাত বড়লোক্স বেডা লোকের নাম আইতাছিল না। শালারে হেইদিন একটা ম্যাথ বুঝাই দিতে কইলাম। কয় সারাবছর না পইড়া পরীক্ষার আগে আগে নাটক মারাও। তার লাগ্যাইতো পরীক্ষায় বড় বড় ডিম পাও। কত বড় কথা ভাব তুই। কিছু কওয়া যাইবো না তারে। কইলেই ছ্যাত কইরা উঠে। পুরাই…..”

“থাম থাম। আর কিছু বলা লাগবে না। মুখটা কন্ট্রোল কর।”

রায়হান ওকে থামিয়ে দিলো। নাহলে এই টেপ রেকর্ডার চলতেই থাকতো। রাজা ভিক্টোরিয়া এই কথাটা শুনে হাসি পাচ্ছিলো তাদের। তবে হাসে নি কেউই। রেগে আছে এমনিতেই তারা হাসলে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলতো।
_____
—-

“আন্টি এই মাসের টাকাটা যদি একটু তাড়াতাড়ি দিতেন। খুবই দরকার ছিল টাকাটা।”

কথাটা রায়হান আবীরের আম্মুর কাছে খুবই দোনামোনা করে বললো। মাসের আজকে আট তারিখ। পরীক্ষার ফি স্যারকে বলে নয় তারিখ পর্যন্ত নিয়েছে অর্থাৎ কালকেই টাকা দেয়ার লাস্ট ডেট। অথচ হাতে এখনো টাকা আসে নি। তাই আজকে না বলে পারেনি। খুব দরকার না হলে রায়হান টাকা চাইতো না। আবীরের আম্মু বললেন,

“টাকা তো এখনো হাতে পাইনি। তুমি একটু অন্য জায়গা থেকে ম্যানেজ করো। ওর আব্বু এই মাসে হাতে টাকা দেয়নি এখনো।”

রায়হানের বুকটা কষ্টে ফেঁটে গেলো যেন। স্টুডেন্ট পড়ালে টাকা দিতে তারা এত অনিহা দেখায় যেন রায়হানকে তারা শুধু শুধু টাকা দেয়। আজকে আরও দুইজনের কাছে চেয়েছিল সবারই একই অজুহাত। রায়হানের এতো শরম করেছে কথাগুলো বলতে অথচ তারা প্রত্যেকেই নির্লিপ্ত। কালকেই লাস্ট ডেট পরীক্ষার ফি দেয়ার। কত কষ্টে স্যারকে ম্যানেজ করেছে সেই জানে। এসব ভেবেই তার চোখটা ভিজে উঠলো। সন্তপর্নে তা মুছে ফেললো। মনে মনে বলে উঠলো,

“আল্লাহ্ পথ দেখাও। একটা উপায় বাতলে দাও মালিক। আমাকে ধৈর্য দাও রাহমানুর রহিম।।”

চলবে….

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২২
#তাজরীন_ফাতিহা

সন্ধ্যে নামলে পাখিরা নীড়ে ফেরে। কর্মজীবী মানুষ ক্লান্ত পথিকের ন্যায় বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে। কেউ কেউ আরও আগে বা পরে বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়ে। রায়হান মাগরিবের নামাজ পড়ে রাস্তায় একাকী হাঁটছে। তার ভালো লাগছে না কিছুই। সন্ধ্যা পার হয়ে রাতের আধারে ধরণী আচ্ছাদিত হচ্ছে। কিন্তু রায়হানের ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সে এক মনে রাস্তায় হেঁটে চলছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না সে। বাড়িতে যে ছোট দুইজন ভাইবোন আছে যারা তার অপেক্ষায় অপেক্ষারত সেটাও সে ভুলে গেছে খানিকক্ষণের জন্য। পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতায় সে ক্লান্ত, জর্জরিত, আতঙ্কিত। মাথায় পরীক্ষার ফি এর চিন্তা। কিভাবে জোগাড় করবে টাকাগুলো? পরীক্ষায় বসতে পারবে কি? নাকি এই বর্ষেই থাকতে হবে আবার? তার পক্ষে একই বর্ষে দুইবার থাকা সম্ভব না। কি করবে ভেবেই কোনো কুলকিনারা পাচ্ছে না সে। শেষমেষ কোনো উপায় না পেয়ে জগতের সৃষ্টিকর্তা, নিজের সৃষ্টিকর্তা মহান রবের কাছে তার না বলা আর্জি গুলো পেশ করলো আসমানের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক কি তার আর্জি শুনলো? শুনেছে তো অবশ্যই কারণ রবের নিকট সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়ও অগোচর হয় না।
____

রাত সাড়ে নয়টায় রায়হান বাসায় ফিরলো। সচরাচর রায়হান এতো দেরি কখনোই করে না। আজকেই এতটা দেরি করে বাসায় এসেছে। রায়হান নিজেদের বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলো রাহমিদ নিজ হাতে ভাত খাচ্ছে দুই পা ছড়িয়ে। রুদ ভাত মাখিয়ে দিয়েছে আর বাচ্চাটা কোনরকম ভাত খাচ্ছে। যদিও ভাত বেশিরভাগ পড়ে যাচ্ছে তবুও বাচ্চাটা হাল না ছেড়ে নতুন উদ্যমে ভাত খাচ্ছে। রায়হান অনেক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলো। রাহমিদটা বড় হয়ে যাচ্ছে। আগে রায়হান কে না দেখলে কত কান্না করতো এখন আর কাঁদে না। আচ্ছা, তার যদি কিছু হয় বা সে যদি না থাকে এই বাচ্চা দুটো কি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে? ইদানীং এসব বিদঘুটে ভাবনা এতো পরিমাণে আসে মনে হয় শীঘ্রই কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আল্লাহ্ খারাপ কিছু না ঘটাক। এই পৃথিবীতে ভাইবোনদের নিয়ে একটু ভালো থাকতে চাওয়া ছাড়া তার আর কিছু চাওয়ার নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো সে। রায়হান কে দেখে রুদ দৌঁড় দিয়ে আসলো। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

“ভাইয়া সারাদিন কোথায় ছিলে?”

“এইতো কাজে। কেন?”

“ভাইয়া তুমি বাইরে থাকলে আমার চিন্তা হয় অনেক। কোথায় থাকো, কই যাও বলতেও তো পারবো না। বিপদ অপদের তো কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তুমি একটা ছোট্ট কমদামী বাটন ফোন কিনিও।”

“বাটন ফোনের কথা তোমায় কে বলেছে?”

“পাশের ঘরের আপুটা বলছিল আজকে। তুমি না আসায় রাহমিদ তোমাকে অনেক খুঁজেছে, কেঁদেছে। তখন উনি ফোনের কথা বলেন। আমি বলেছি আমাদের কোনো ফোন নাই। ফোনের অনেক দাম। আপুটা বলেছে বাটন কমদামী সেট পাওয়া যায় নাকি। আচ্ছা ভাইয়া সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কি?”

“অন্যের ইউজ করা ফোন কম দামে বিক্রি করলে সেটাকে সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন বলে। কেন বলো তো?”

রায়হানের যদিও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তবুও রুদকে কষ্ট দিতে চাচ্ছে না। সারাদিন সে বাসায় থাকে না। ভাইবোন গুলোরও তো তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। রুদ ভাইয়ের কথা শুনে কিছু ভাবলো। তারপর বললো,

“বাটন ফোনের দাম বেশি নাকি সেকেন্ড হ্যান্ড ফোনের দাম বেশি?”

“সেটা মডেল অনুযায়ী ভেরিফাই করে।”

রুদ অতি উৎসাহী হয়ে বললো,

“ভাইয়া একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কিনবে? ফোনটা নাকি টাচ।”

“কোথায় পাবো? তোমাকে এসব কে বলেছে?”

“ওই আপুই বলেছেন। ওনাদের ফোন নাকি বিক্রি করবে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমরা বাটন ফোন কিনবো নাকি সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন কিনবো? আমি কিছু বলি নাই।”

“ও আচ্ছা ভেবে দেখি। ভাত খেয়েছো?”

“না খাইনি। রাহমিদও সারাদিন খায়নি। ওকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিতে চেয়েছি ও নাকি খাবে না। কেমন লাগে বলো?”

এর মধ্যে রাহমিদ প্লেট রেখে কখন হেঁটে এসেছে ওরা কেউই খেয়াল করেনি। ভাইয়ের গা বেয়ে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে ছলছল নয়নে বললো,

“মালচে। বেশি করি মাইর দিছে পাচায়।”

রাহমিদ পাছা দেখিয়ে দিলো। রায়হান ভাইয়ের ছলছল নয়নে তাকিয়ে কি যেন খুঁজে পেলো। আজকে জড়িয়ে ধরার শক্তি পেলো না। কেমন হাঁসফাঁস লাগছে তার। মাথাটা কেমন ব্যথা করছে। বিষাক্ত লাগছে সব কিছু। আজকে কিছুই ভালো লাগছে না। রাহমিদ কে নামিয়ে মুখ হাত ধুয়ে শুয়ে পড়লো। ভাতও খেলো না। কারণ যতক্ষণ জেগে থাকবে চিন্তায় চিন্তায় সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এর থেকে একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক। জাগতিক সকল চিন্তা, কষ্ট, ক্লেশ থেকে সাময়িকভাবে তো মুক্তি পাওয়া যাবে এই ঢের। রায়হান সারাদিনের ক্লান্তিতে খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লো। রাহমিদ ভাইয়ের বুকের উপরে উঠে শুয়ে থাকলো। বোনের কাছে আজকে যাবে না।

রুদ দুই ভাইয়ের কাণ্ড দেখলো। বড় ভাই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে এতে তার খুব খারাপ লাগছে। ভাইয়ার কি বেশি খারাপ লাগছে আজকে। কিছুই যে বললো না আজকে। অন্যান্য দিন তো এসে তাদের ভাইবোনের সাথে কত গল্প করে কিন্তু আজকে এতো নির্জীব কেন ভাই। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? এসব ভাবতে ভাবতে সব কিছু গুছিয়ে রাখলো। সে আর কিছু খেলো না। ভাইয়া কিছু খায়নি। সে কিভাবে ভাইকে ছাড়া খাবে। বাসনকোসন এক পাশে রেখে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়লো।
______
—–

রায়হান ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে। আজকে আসতে চায়নি কিন্তু কি মনে করে যেন আসলো। স্যারের সাথে আজকে শেষ কথা বলবে। রায়হান জানে ইমরান স্যার কখনোই মানবে না তবুও শেষ একটা চেষ্টা করে দেখবে সে। যথারীতি ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আজকে ইমরান স্যারের বদলে বাদল স্যার এসেছে। রায়হানের বুক ধড়ফড় করে উঠলো। স্যার না আসলে কিভাবে তার সমস্যার কথাটা বলবে। আজকেই তো শেষ তারিখ ছিল পরীক্ষার ফি দেয়ার। টেনশনে রায়হান ঘেমে উঠতে লাগলো। বাদল স্যার ক্লাসের মধ্যেই বললো,

“তোমাদের ইমরান স্যার কয়েকদিন আসবে না। তোমাদের পরীক্ষার ফি যাদের বাকি আছে তারা কালকে বা পরশু আমাকে জমা দিবে। আজকে কিছু সমস্যার জন্য নিতে পারছিনা। পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই। প্রিপারেশন কেমন নিচ্ছো সবাই?”

সকলে সমস্বরে বলে উঠলো,

“ভালো স্যার।”

শুধুমাত্র রায়হান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। চোখ দুটো পানিতে ছলছল করছে। তার মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বের হয়ে গেলো,

“আলহামদুলিল্লাহ।”

মহান রব ঠিকই তার আর্জি কবুল করেছেন। হয়তোবা টাকা পাঠিয়ে দেননি কিন্তু একটা সমাধান ঠিকই পাঠিয়েছেন। আল্লাহর কাছে তার বান্দা কিছু চাইলে মহান রব তা ফিরিয়ে দেননা। একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেন। আবারও সে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। দুই দিনের মধ্যে একটা না একটা টিউশনির টাকা ঠিকই পেয়ে যাবে সে। আল্লাহর উপর ভরসা আছে। মালিক যেহেতু সময় দিয়েছে এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে।
_____
—-

বেশ কিছুদিন পর। রায়হানের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ। ভালোভাবেই পরীক্ষা শেষ করেছে সে। এখন ফলাফল ভালো হলেই চিন্তামুক্ত। কালকে থেকে রোযা শুরু। যদিও রমাদানে তার মতো মানুষের এক্সট্রা কোনো বাজারের চিন্তা থাকে না তবুও একটা পবিত্র মাসের আগমণ তাকে চিন্তিত করে ঠিকই। কিভাবে এই পবিত্র মাসটা কাটাবে, কিভাবে ইবাদত করলে এই পবিত্র মাসে পরিপূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে এসবই তার ভাবনায় কিলবিল করতে থাকে। তাছাড়া রাহমিদ রুদ দুইজনই ভাজা পোড়া খেতে পছন্দ করে। গতবার রাহমিদ এটার জন্য কেমন করলো ভাবলেই তার খারাপ লাগে। এবার চেষ্টা করবে কিছু ভাজা পোড়া রাখতে। যদিও সে জানে না কতটুকু পারবে।

চারপাশে মাইকে সেহেরির জন্য ডাকা হচ্ছে। রায়হানের ঘুম ভেঙে গেলো। ভাত তো রান্না করা হয়নি। সে দ্রুত উঠে ভাত আর ঢেঁড়স ভাজি করলো। সেহেরির অল্প সময় বাকি। ইতোমধ্যে রুদও উঠে গেছে। রুদ সবকটা রোযা রাখতে না পারলেও চেষ্টা করে ভাইয়ের সাথে রাখতে। গতবার রেখেছিল দশটা। এবার দেখা যাক কয়টা রাখতে পারে।

রায়হান এক প্লেটেই তার আর রুদের খাবার বেড়ে নিলো। রুদকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও এক লোকমা মুখে পুড়লো। হঠাৎ করে রাহমিদের কান্নার আওয়াজে মুখে খাবার নিয়েই ওকে কোলে নিলো। বাচ্চাটা ঘুমের ঘোরে কাউকে পাশে না পেয়ে কেঁদে উঠেছে। রায়হান ওকে কোলে নিয়েই দ্রুত ভাত খেতে লাগলো। রাহমিদ ভাইবোনকে খেতে দেখে নিজেও হা করলো। সেটা দেখে রায়হান মুচকি হেঁসে বললো,

“তুমিও সেহেরি করবে?”

রাহমিদ ঘনঘন মাথা নাড়াতে লাগলো অর্থাৎ সেও করবে। রায়হান হেঁসে ওকেও এক লোকমা খাইয়ে দিলো। বাচ্চাটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খেতে লাগলো। রায়হান এটা দেখে বুঝলো রাহমিদের অনেক খুদা লেগেছে। সে আরেক লোকমা বাড়িয়ে দিলো। বাচ্চাটা এবারও খুব আয়েশ করে ভাত মুখে নিয়ে চিবুতে লাগলো। এর মধ্যেই মসজিদের মাইকে বলে উঠলো,

“সম্মানিত এলাকাবাসী সেহেরির আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি। এখনো যারা সেহেরি করেননি তারা অতি দ্রুত সেহেরি করে নিন। সেহেরি খাওয়ার আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি আছে।”

সেহেরির সময় শুনে রায়হান দ্রুত রুদ আর রাহমিদকে খাইয়ে নিজে কোনরকম খেয়ে পানি খেলো। এর মধ্যেই সেহেরির সময় শেষ হয়ে গেছে। ফজরের আজান শুনে মসজিদে যাওয়ার জন্য ওযু করে পাঞ্জাবি গায়ে দিলো। রাহমিদও পাঞ্জাবি নিয়ে দৌঁড়িয়ে বোনের কাছে গেলো। রুদ বাসনকোসন গুছিয়ে রাখছে। ভাইয়া ধুয়ে দিয়েছে তার কাজ শুধু গুছিয়ে রাখা। রাহমিদ এসেই বোনের জামা টানতে টানতে বললো,

“পলিয়ে দাও। মুসজিদে জাবু। তালাতালি পলাও ভাইয়ু চলি যাচ্চে।”

রুদ অবাক হয়ে তাকালো। রাহমিদ যে পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে এতেই আশ্চর্য হয়েছে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে রাহমিদকে পাঞ্জাবি পরিয়ে দিলো। পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে দেয়ার সময়ও বোনকে দিলো না। রাহমিদ পাঞ্জাবি পড়েই ভাইয়ের কাছে দৌঁড়ে গেলো। রায়হান রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল পথিমধ্যে রাহমিদকে পাঞ্জাবি পড়ে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। রাহমিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোকলা হেঁসে বললো,

“মুসজিদে জাবু।”

রায়হান হাঁটুমুড়ে বসে রাহমিদের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দিলো। পাজামা টাখনুর উপরে গোটালো। রাহমিদ পাজামা গোটাতে চায়না। সে আবার নিচু হয়ে পাজামা নামিয়ে দিতে চাইলো। রায়হান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“টাখনুর নিচে ছেলেদের জন্য প্যান্ট পড়া হারাম সোনা। এভাবেই সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ।”

“হালাম কি?”

“হারাম মানে নিষদ্ধ। যেটা করা উচিত নয়।”

“নিচিদ্দ কেনু?”

“কারণ আমাদের ইসালমে এটা নিষেধ। আমাদের নবীজী (সাঃ) এটাকে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

“তোমাদের পুরুষদের কেউ যদি টাখনুর নিচে কাপড় লটকিয়ে রাখে সে জাহান্নামী। অর্থাৎ পোশাকের যে অংশটুকু টাখনুর নিচে থাকবে সে অংশটুকু দোযখের আগুনে জ্বলবে।” (সহীহ বুখারী)

অপর হাদীসে এসেছে,

“যে লোক টাখনুর নিচে কাপড় রাখাকে গর্ববোধ করে বা ঔদ্ধত্য দেখিয়ে কাপড় পড়া থেকে বিরত থাকে না সে জাহান্নামী।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

“সুতরাং এই দুইটা হাদিস থেকে বুঝলাম কোনো অবস্থাতেই টাখনুর নিচে কাপড় পড়া যাবে না। বুঝেছো কলিজা।”

“বুঝেচি।” বলে হেঁসে দিলো।

অতঃপর দুই ভাই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। রাতের আধারে বড় ভাইয়ের আঙ্গুল ধরে ছোট ভাইয়ের মসজিদে যাওয়ার দৃশ্যটি রুদের কাছে দারুন লাগলো।

চলবে….

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১৯+২০

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৯
#তাজরীন_ফাতিহা

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। আজকে শুক্রবার। মুসলিমদের জন্য ভীষণ পবিত্র একটি দিন। কর্মব্যস্ত মানুষের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। রায়হানের জন্য অবশ্য ছুটি না। দুই জনকে টিউশনি পড়াতে হবে। প্রত্যেক শুক্রবার রাহমিদকে সঙ্গে নিয়ে জুমার নামাজে যায় রায়হান। এছাড়াও মাঝে মাঝে রাহমিদকে মসজিদে নেয় সে। ইমাম সাহেব প্রায়ই বলেন রাহমিদকে নিয়ে যেতে এতে করে বাচ্চাদের মসজিদ প্রীতি বাড়বে। তাছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে মসজিদে যাওয়া নবীজী (সাঃ) এর সুন্নত। রায়হান রাহমিদকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। বাচ্চাটা খালি লাফালাফি করছে। স্থির থাকছে না। রায়হান ভালো করে সাবান দিয়ে ডলে গোসল করিয়ে দিচ্ছে। রাহমিদ পানি দিয়ে ভাইকেও গোসল করিয়ে দিলো। রায়হান ধমকে উঠলে আরও বেশি করে পানিতে দাফাদাফি করে। ওকে গোসল করিয়ে দিয়ে দ্রুত নিজে গোসল করে বের হলো। সকালে একটা টিউশনি ছিল। ওটা পড়াতে পড়াতে সময় চলে গেছে। শুক্রবারে মসজিদে আগে আগে যাওয়াও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত। ইসলামকে নিজের জীবনের প্রতিটা পদে মেনে চলার চেষ্টা করে রায়হান। যদিও ঠিকভাবে পারেনা তবুও নিজের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারে সবই মানার চেষ্টা করে। গোসল করে রুমে এসে দেখে রাহমিদ উদোম গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাফালাফি করছে বাচ্চাটা। আজকে ওর জন্য ঈদের মতো আনন্দের দিন। সপ্তাহে কয়েকটা দিন ভাই তাকে বাইরে নিয়ে যায়। তার মজাই লাগে। সারাদিন বাসায় থাকতে কার ভালো লাগে। রায়হান বললো,

“আপনি লেংটু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? লাজ শরম নেই। দাঁড়ান আপনাকে দ্রুতই সুন্নতে খৎনা করিয়ে দিবো তাহলে যদি একটু লাজ লজ্জা আসে শরীরে।”

রাহমিদ ভাইয়ের কথা বুঝে নি। সুন্নতে খৎনা আবার কি? বাচ্চা মানুষ বড়রা কি বলে কিছুই বুঝতে পারেনা সহজে। ফ্যালফ্যাল করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। রায়হান রাহমিদের জন্য দুইটা পাঞ্জাবি কিনেছিল। একটা সাদা আরেকটা নীল রঙের। ওর মধ্যে সাদা পাঞ্জাবিটা বের করে ওকে পড়িয়ে দিলো। প্যান্ট পড়ালো। বাচ্চাটার প্যান্ট টাখনুর উপর গুটিয়ে দিলো। নিজেও একটা অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পড়ে নিলো। রুদকে আসেপাশে দেখছে না অনেকক্ষণ। বাচ্চাটা আবার কোথায় গেলো। সে রাহমিদের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রুদকে ডাক দিলো।

“রুদ, রুদ পাখি কোথায় আপনি?”

রুদ রান্না ঘরে ছিল। প্লেট, বাটি গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। নাহলে পাশের ঘরের আপুটা বকে। ওনাদেরও তো রাঁধতে হয়। রাতের বেলা সব ধুয়ে সিংকে রেখে আসে। কখনো ভাইয়া আবার কখনো সে ওগুলো গুছিয়ে নিয়ে এসে ঘরের এক কোনায় রেখে দেয়। ভাইয়ের ডাক শুনে রান্না ঘর থেকে দৌঁড়ে আসলো। এসে দেখে বড় আর ছোট ভাই রেডি হচ্ছে। সে দৌঁড়ে এসে বড় ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান রাহমিদকে আতর মেখে দিচ্ছিলো। হঠাৎ করে কেউ পা জড়িয়ে ধরায় বুঝলো ওটা রুদ। আতর দেয়া শেষ করে বোনকে আদর করলো কিছুক্ষণ। একা একা থাকবে দেখে মন খারাপ করতে নিষেধ করলো। তারা নামাজ পড়েই চলে আসবে। রুদ ভাইয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর রাহমিদকে আদর করে দিলো। সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলো দুই ভাইকেই। রায়হান এটা দেখে মুচকি হাসলো। রুদ টা বড় হয়ে গেছে। কেমন বড় বোনের মতো তাদেরকে ফুঁ দিয়ে দিলো। এইটুকু বয়সে কি বুঝদার! মাশা আল্লাহ। রায়হান জিজ্ঞাসা করলো,

“এটা কে শিখিয়েছে?”

“ইমাম হুজুর। আয়াতুল কুরসী পড়ে ফুঁ দিতে হয় কিন্তু আমি এখনো পুরোটা পারিনা তাই সূরা ফাতিহা আর ছোট্ট দুইটা সূরা পড়ে ফুঁ দিছি। হুজুর বলেছেন এতে নাকি বিপদ মুক্ত থাকে।”

রায়হান বোনের কথায় খুশি হলো। বোনের মাথায় চুমু দিয়ে রাহমিদের ছোট্ট ছোট্ট হাত ধরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
_____

রাহমিদ ভাইয়ের হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। চারপাশ দেখে সে ভীষণ খুশি। মসজিদে এসে আরও খুশি হয়ে গেলো। কি সুন্দর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে সাদা মেঝে। কত মানুষ এসেছে নামাজে। রাহমিদ মসজিদে ঢুকেই দৌঁড় দিয়ে ইমাম সাহেবের পিছনে চলে গেলো। রায়হান থামাতে চেয়েও পারেনি। এতো গুলো মানুষের সামনে ও বাচ্চাটার পিছনে দৌড়াবেই বা কিভাবে। রাহমিদ নাহয় বাচ্চা তাই চিপা চাপা দিয়ে চলে যেতে পেরেছে সে তো পারবে না। হতাশ হয়ে একটা কাতারে বসে খুতবা শুনতে শুনতে রাহমিদকে নজরে রাখলো। বাচ্চাটা হারিয়ে গেলে বা ওকে না দেখতে পেলে কেঁদে অস্থির হয়ে যাবে। রায়হান দেখলো রাহমিদ ইমাম সাহেবের পাঞ্জাবি টানছে একবার, আরেকবার আরেক মুসল্লির পাঞ্জাবি টানছে। মসজিদের অনেকই বিরক্ত রাহমিদকে ছোটাছুটি করতে দেখে। বাংলাদেশের মসজিদ গুলোতে বাচ্চাদের নিয়ে গেলে মুরুব্বীরা বিরক্ত হন। এখনো হচ্ছেন। রায়হান রাহমিদকে ডাকতে পারছে না জোরে। কারণ খুতবা হচ্ছে। একটু পর নামাজের জন্য কাতার করতে বললো। রায়হান যে সারিতে বসে ছিল সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালো। কোত্থেকে রাহমিদ ছুটে এসে ভাইয়ের পা জড়িয়ে ঝুলে পড়লো। রায়হান ওকে দেখে বললো,

“রাহমিদ দুষ্টুমি করে না। এখন নামাজ পড়ানো হবে। চুপচাপ বসে থাকো নাহয় ভাইয়া যা যা করছি তা করো। বুঝেছো। দুষ্টুমি করলে সবাই বকা দিবে।”

রাহমিদ ঘাড় নাড়িয়ে ভাইয়ের কথায় সম্মতি জানালো। নামাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। রায়হান রাহমিদকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একামত বাঁধলো। রাহমিদ ভাইয়ের দেখাদেখি হাত বাঁধলো। রুকু করতে গিয়ে রাহমিদ একেবারে সিজদায় চলে গেলো। রায়হানের এতো হাসি পেলো। হাসি কন্ট্রোল করে নামাজ পড়তে লাগলো। একটু পর তাশাহুদ পড়তে বসার সময় বাচ্চাটা দাঁড়িয়ে হাত বাঁধলো। যখন দেখলো সবাই বসে আছে সেও বসলো। বেশিক্ষণ বসে থাকতে না পেরে পিছন থেকে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান ওকে নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়লো আবার সিজদা দিলো।

ভাইয়ের কোলে বেশিক্ষণ স্থির থাকতে না পেরে অন্য মুসুল্লিদের পাশে বসলো। অনেকে সরিয়ে দিলো। অনেকে কিছুই বললো না। খানিকক্ষণ পর সে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। নামাজ শেষ করে রায়হান দেখলো রাহমিদ ইমাম সাহেবের জায়নামাজের সামনে শুয়ে আছে। সবাই একে একে বের হয়ে যেতে লাগলো। যাদেরকে রাহমিদ নামাজের সময় ডিস্টার্ব করেছে এর মধ্যে কেউ কেউ রায়হানকে বাচ্চা নিয়ে মসজিদে আসতে নিষেধ করে দিলো। রায়হান কিছু বললো না। বাচ্চাটা কোথাও স্থির থাকতে পারেনা। নামাজ শেষে ইমাম সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বাসায় চলে আসলো। রাহমিদ নামাজ পড়তে আসায় ইমাম সাহেব কতগুলো চকলেট দিয়েছে। বাচ্চাটা খুশি মনে ওগুলো নিয়ে বাসায় এসেছে। যতবারই রাহমিদ মসজিদে যায় ইমাম সাহেব ওকে চকলেট দেন। রাহমিদ মসজিদে যাওয়ার জন্য এতে আরও উৎসাহ পায়।
_______
—–

পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংসের গন্ধে চারপাশ মৌ মৌ করছে। রায়হান বাসায় ঢুকে দেখলো পাশের ঘরের আপুটা অনেক রান্নাবান্না করছে। হয়তোবা কোনো মেহমান দাওয়াত দিয়েছে। মাত্র টিউশন করিয়ে আসলো। ক্লান্ত লাগছে। তার উপর আবার খাবারের গন্ধে তার খালি পেট মুচড়ে উঠছে। নিজের বরাদ্দকৃত রুমে যেয়ে দেখলো রুদ রাহমিদকে ভাত খাওয়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু রাহমিদ খেতে চাচ্ছে না। কিছু একটা চাচ্ছে। রায়হানকে রুমে ঢুকতে দেখে রাহমিদ দৌঁড়ে ভাইয়ের কাছে গেলো। পা জড়িয়ে ধরে বললো,

“গোত্ত কাবো।”

রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। গোশত কই পাবে। নিশ্চয় পাশের ঘর থেকে গোশতের ঘ্রাণ পেয়েছে। নিজেদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় টাইপ অবস্থা সেখানে গোশত কিনবে কোথা থেকে। সে হাঁটু মুড়িয়ে বসে বললো,

“গোশত কোথায় পাবো সোনা। গোশত খেলে অসুখ করবে। পেটে ব্যথা করবে। তুমি কষ্ট পাবে। ওসব খেতে হয়না।”

“চবাই যে কায় মুজা মুজা করে। উসুক করবি কেনু?”

“সবাই খেলেও আমাদের খাওয়া বারণ। আমাদের খেলে অসুখ করবে। যেদিন অসুখ করবে না সেদিন আনবো ঠিক আছে কলিজা।”

“না, না ইখুনি কাবো।”

রাহমিদ জিদে হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। রায়হান অনেক কষ্টে ওকে বোঝালো। কোনোভাবেই মানতে চাচ্ছে না বাচ্চাটা। পটল ভাজি আর ডাল দিয়ে রাহমিদকে ভাত খাইয়ে দিল। খাওয়ানোর সময় বলছিল, এগুলোকে গোশত বলে। এগুলো খেলে ওগুলোও পাবে। রাহমিদ খেয়েছে অল্প। রুদ মন খারাপ করে ভাত খাচ্ছে। রাহমিদ টা কত গোশত খুঁজলো কিন্তু ভাইয়া অপারগ। কিছু করার নেই। বড় ভাইয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রুদ মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো,

“আল্লাহ্ আমার ভাইয়াকে আপনি অনেক টাকা পয়সা দেন নাহলে আমাদের যেন কখনো ভালোমন্দ কিছু খেতে ইচ্ছা না করে এমন বানিয়ে দেন। ছোট ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে দেন। আপনি রাহমিদের মন খারাপ ভ্যানিশ করে দেন মাবুদ।”

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২০
#তাজরীন_ফাতিহা

তিনদিন ধরে রায়হানের ভীষণ জ্বর। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না একেবারেই। তাও কষ্ট করে উঠে নিজের এবং ভাইবোনের জন্য রান্না করেছে কোনরকম। দাঁড়াতে গেলেই থরথর করে কেঁপে উঠে। বাসার বাইরেও যেতে পারছে না। বাইরে গেলে ওষুধ কিনে আনতে পারতো। ঘরের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিই সে। প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ সওদাপাতি ঘরে নেই। কে আনবে? রায়হান তো বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছে না। শুধু ভাত রান্না করে কোনরকম মাড় দিয়ে খায়। জীবনটা যাতে বাঁচে। রুদ ভাইয়ের শিয়রের পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। রাহমিদ দুই দিন ধরে কোনো কিছুই খেতে পারছে না। শুধু মাড় দিয়ে ভাত খায় কিভাবে? ছোট্ট অবুঝ রাহমিদ ভাইয়ের গায়ের উপরে উঠে মুখ ধরে কত যে অভিযোগ জানায়। তার অজস্র অভিযোগ। এই যেমন এখন বলছে,

“ভাইয়ুর উসুক ভালু হোবে কোবে? কেনু উসুক করিছে? ও ভাইয়ু হাতবে না ? মুজা মুজা কাবার কবে কাবো? পুচা কাবার কাই না। তালাতালি সুস্থু হই যাও।”

এরকম নানা অভিযোগ ছোট্ট অবুঝ বাচ্চাটা তিনদিন ধরে করছে। রায়হান জ্বরে অচেতন হয়ে এইসব আদুরে অভিযোগ শোনে। এসব কথা শুনে নিজের বুকটা পুড়লেও কিছু করার নেই। আল্লাহ্ তার শরীর দূর্বল, অচল করে দিয়েছেন। চাইলেও কিছু করতে পারবে না সে। আচ্ছা জ্বর কমছে না কেন? তিনদিন হতে চললো এখনো জ্বর নামার কোনো নামগন্ধ নেই। অবশ্য নাপা খেতে পারলে হয়তোবা একটু কমতো।

রুদ টা যতটুকু পারে তার চেয়েও বেশি করেছে এই তিনদিনে। ভাতের চাল নিজেই ধুয়ে চুলায় বসিয়েছে। শুধু মাড়টাই গালতে পারেনা বাচ্চাটা। তবুও এর মধ্যে একদিন রায়হানকে না জানিয়ে মাড় গালতে গিয়েছিলো পুরো পায়ের উপর মাড় পড়েছে। ইস্ পুরো জায়গাটা পুড়ে গেছে। কি চিৎকার দিয়েছিল বাচ্চাটা! একেবারে গলাফাটা চিৎকার। ভাবলেই রায়হানের বুকটা ফেঁটে যায়। মাথায় অজস্র যন্ত্রণা হয়। এই বয়সের বাচ্চার কি এইসব কাজ আদৌ পারার কথা? অথচ তাদের মতো অনাথদের এই বয়সেই পটু হতে হয় সব কাজে নাহলে বেঁচে থাকবে কিভাবে? নিজেকে তো এই যন্ত্রণার পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখতে হবে। কেউ আগ বাড়িয়ে তাদের দায়িত্ব নিবেও না, তাদেরকে পালবেও না। দিনশেষে তাদের মতো অনাথদের সুখ, দুঃখের সাথী কেউই হবে না।

“জীবনযুদ্ধে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষক আবার নিজেরাই ছাত্র।”
_____
—-

জ্বর আজকে মোটামুটি ছেড়েছে রায়হানের। টানা সাতদিন ভোগান্তি গিয়েছে। উফ এই সাতদিন তার দুর্বিষহ গিয়েছে। রুদ টার পা কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে এখনো খুলেনি। অনেকদিন হয়েছে বাচ্চাটার পা পুড়েছে। প্রথমে পেস্ট দিয়ে অনেক্ষণ রেখে দিয়েছিল। পরে পেস্ট ধোঁয়ার পর দেখে পুরো লাল হয়ে গিয়েছে পা টা। তখন স্যাভলন দিয়ে একটুকরো কাপড় দিয়েই রায়হান পা টা বেঁধে দিয়েছিল। আজকে ব্যান্ডেজ খুলে দেখবে কি অবস্থা? যদি খারাপ অবস্থা হয় ধার দেনা করে হলেও রুদকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।এসবই ভাবছিল এতক্ষণ রায়হান। রুদকে ডাক দিলো।

“রুদ, রুদ..”

ভাই ডাকতে না ডাকতেই ঘরে আসলো রুদ। রাহমিদের হাত, পা ধুইয়ে এনেছে। রুদের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাহমিদের বুকের কাছটা ভেজা। তারমানে এতক্ষণ এই পন্ডিত টয়লেটে ছিল। দুনিয়ার যত অকাজ, কুকাজ এই পন্ডিতের দ্বারাই সম্ভব। সুযোগ পেলেই টয়লেটে গিয়ে পানি হাতাবে। মানা করলেও শোনে না এই বিচ্ছুটা। রুদ ছোট ভাইয়ের হাত ধরে ঘরে ঢোকালো। তারপর দুম করে পিঠে থাপ্পড় মারলো। রাহমিদ শব্দ করে কেঁদে উঠে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। রুদ বলতে লাগলো,

“বেশি বেড়েছো ইদানীং। পঁচা ছেলে। মেরে একদম ভর্তা করে ফেলবো। সারাদিন ডেকেও পাইনা। ওই ঘরে আবার কেন গিয়েছিলে? মার খেতে? সেদিন মার খেয়ে শিক্ষা হয়নি? খেলনার জন্য মার খেয়েছো যে ভুলে গেছো আবার আজকে কোন সাহসে ওই ঘরে গেলে। পিটিয়ে পিঠের ছাল উঠিয়ে দেয়া দরকার তোমার। ভাইয়া অসুস্থ হয়েছে আর উনি ফুর্তি করতে পাশের ঘরে যায়। আরেকবার খালি দেখি কি করি দেখো তোমাকে।”

চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে শাসিয়ে কথাগুলো বলে থামলো রুদ। রায়হানের মনে হলো মা বুঝি সন্তানকে শাসন করছে। রাহমিদ এখনো গড়াগড়ি করে কাদঁছে। বোন মেরে আবার বকাও দিচ্ছে। রায়হান উঠে রাহমিদকে কোলে নিলো। রুদকে বললো,

“রাহমিদ ছোট না, এভাবে বকে না। ভুল করলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিবে। হঠাৎ হঠাৎ হাত উঠাবে না। ও বোঝে কিছু? এভাবে মারা টা ঠিক হয়নি রুদ।”

“ভাইয়া ও ওই ঘরে খাবার খুঁজতে গিয়েছিল। বাটি নিয়ে যেয়ে বলে একটু গোশত খাবো। কেমন লাগে বলো। ওই ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এটা শুনে তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে রুমে আসি। তোমাকে বলতে চাইনি কিন্তু….”

কথাগুলো বলে রুদ হুহু করে কেঁদে দিলো। রায়হানের চোখ দিয়েও পানি বের হয়ে গেছে। তার ভাই গোশত খুঁজতে ওই ঘরে গিয়েছিল। ভাইয়ের কোলে রাহমিদ কেঁদেই যাচ্ছে। রায়হান ওকে নিয়ে অনেক্ষণ হাঁটলো আর কি যেন চিন্তা করতে লাগলো।
______

“ভাই গরুর গোশতের কেজি কত করে?”

“সাতশো পঞ্চাশ। পুরাই তাজা গরুর মাংস। লইয়া যান। কয় কেজি দিমু?”

” না না আমি নিবো না। এমনিতেই জিজ্ঞাসা করলাম। এতো দাম কেন ভাই?”

“দাম তো একটু হইবোই। এক্কেরে ফ্রেশ গরু। যেদিন কমবো হেইদিন কিন্নেন তাইলে। যান অহন। হুদাই ডিস্টার্ব কইরেন না।”

রায়হান কথা না বাড়িয়ে চলে আসলো। শুধু দামটাই জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল। এতো দাম হবে বুঝতে পারেনি। রাহমিদ টা খালি গরুর গোশত খেতে চায়।

“আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় মুরগির গোশত কিনে রান্না করে ওটা রাহমিদকে গরুর গোশত বলে চালিয়ে দিবে। ফার্মের মুরগি একটা কত পরবে কে জানে? অনেকদিন গোশতের বাজারে আসা হয়না তার।”

এসব ভাবতে ভাবতে মুরগির দোকানের সামনে দাড়ালো। দোকানিকে ফার্মের মুরগির দাম জিজ্ঞাসা করলো,

“ফার্মের মুরগি কত করে?”

” একশো পঞ্চাশ আছে, দুইশো আছে, তিনশো আছে আপনে কোনডা নিবেন কন?”

“একশো পঞ্চাশের টা দেন আংকেল।”

“আইচ্ছা। ওই একটা দেড়শোর মুরগি দে তো। কাইট্টা দিমু?”

রায়হান ভাবলো কেটে দিলে টাকা নিবে। বাসায় গিয়ে নিজেই কষ্ট করে কেটে বেছে নিবে। শুধু শুধু টাকা খরচ করার দরকার নেই। বললো,

“লাগবে না। আপনি প্যাকেট করে দিন।”

“আইচ্ছা।”

দোকানদার প্যাকেট করে দিলো। রায়হান গোশত রান্না করতে যা যা লাগে সব অল্প অল্প করে কিনে নিলো। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। মাসটা চালাতে অনেক কষ্ট করতে হবে। যাই হোক ভাইটা খেয়ে খুশি হলেই হলো। এতেই তার খুশি। মনে মনে অনেক কথা ভাবতে ভাবতে বাসার পথে হাঁটা দিলো।
______

মুরগি বাছতে গিয়ে রায়হানের নাজেহাল অবস্থা। মুরগির চামড়া, নাড়িভুড়ি পরিষ্কার করতে কি যে কসরত করতে হয়েছে। রায়হান রাহমিদকে মুরগি দেখায়নি। মুরগি রাহমিদ চিনে। দেখালেই বলতো,

“মুগ্গি ইনেছো কেনু? আমি গুরু কাবো। ইটা কাবো না।”

তারপর শুরু করতো হাত, পা ছোড়াছুড়ি। আলু দিয়ে মুরগির ঝোল করেছে। আলু দিয়েছে যাতে বেশি করে খেতে পারে। যে কয়দিন ইচ্ছা হবে রুদ, রাহমিদ খাবে। প্লেটে ভাত নিয়ে এসে রাহমিদকে বললো,

“কলিজা দেখেন গরুর গোশত। খাবেন না?”

রাহমিদ এতক্ষণ বোনের সাথে খেলছিল। রায়হানই রুদকে বলেছে রাহমিদকে রান্নাঘরে না যেতে দিতে। রুদও ভাইয়ের কথা মতো ওকে খেলাধুলায় ব্যাস্ত রেখেছে। ভাইয়ের কথা শুনে বাচ্চাটা লাফিয়ে উঠলো। “মুজা, মুজা” বলে হাতে তালি দিতে লাগলো। রায়হান হেঁসে ওকে খাইয়ে দিচ্ছে। বাচ্চাটা মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে মজা করে খাচ্ছে। পাশের ঘরে গরুর গোশত রান্না করা দেখে সেদিন খাওয়ার জন্য তার কাছে কি যে বায়না করলো। রায়হানের খুব খারাপ লেগেছিল। আজকে ভাইয়ের হাসি মুখ দেখে ভালোই লাগছে। একটু প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে অবশ্য। তাতে কি? ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটানোই আসল উদ্দেশ্য। রুদকেও খাইয়ে দিলো। রুদের মুখটাও আজকে খুশি খুশি। রুদ মুখ ফুটে যদিও কখনো কিছু চায়না কিন্তু এই বাচ্চাটারও তো ভালো মন্দ খেতে ইচ্ছা করে। ভাইয়ের কষ্টের কথা ভেবে কখনো বলে না ঠিকই কিন্তু ছোট্ট মন তো ঠিকই ভালো কিছু খাওয়ার বাসনা জাগায়।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১৭+১৮

0

#জীবন_পেন্ডুলাম (নতুন অধ্যায়)
#পর্ব_১৭
#তাজরীন_ফাতিহা

(২ বছর পর)

রায়হানের ইদানীং প্রচুর মাথা ব্যথা হয়। স্টুডেন্টদের পড়াতে গেলে ভীষণ অসুস্থ অসুস্থ লাগে। প্রেশার বেড়েছে প্রচুর। ভার্সিটি শেষে টিউশনি করানো একটা যুদ্ধের সমান লাগে তার কাছে। টিউশনি এখন পাঁচটা। সপ্তাহ ভাগ করে দিয়েছে। কাদের কোন কোন দিন পড়াবে। সবাইকেই সপ্তাহে তিনদিন পড়ায়। একদিনে পাঁচজনকে পড়ানো তার দ্বারা পসিবল না। তাছাড়া রাহমিদ বাসায় একা থাকে। যদিও সাবলেট এক দম্পতি থাকে পাশের রুমেই। ওনাদেরকে শুধু একটু দেখে রাখতে বলে। বাচ্চা মানুষ কোনো অঘটন আবার না ঘটিয়ে ফেলে। রাহমিদটা এমনিতেই দুষ্টের শিরোমণি।ভাত রেঁধে রেখে আসে। ভদ্র বাচ্চার মতো থাকতে বলে। খিদে লাগলে ভাত যেন খায়। এসব তার নিত্যদিনের কথা। রুদকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে এক বছর আগেই। দুই বছর আগেই ভর্তি করাতো কিন্তু রাহমিদ ছোট দেখে আর করায় নি। এক বছর রুদই রায়হান বাসায় না থাকলে রাহমিদকে কোনরকম দেখে রাখতো। পাশের ঘরের আপুটাও সময় পেলে রুদ, রাহমিদকে দেখে যেতো। দুই বছর আগে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ে আফজাল হোসেনের ঘর ছেড়ে উঠেছিল এক বস্তিতে। খুব কষ্ট হয়েছিল মানিয়ে নিতে। রাহমিদ, রুদকে একা হাতে মানুষ করতে। সেই দিন গুলোর কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। তবে এখন গা সয়ে গেছে। ঐ বস্তিতে বেশিদিন থাকতে পারেনি। কারণ বস্তির পরিবেশ ছিল জঘন্য। মানুষের মুখের ভাষা শুনলে রায়হানের বমি চলে আসতো। কি বিশ্রী বিশ্রী গালি দিতো ছোট থেকে বড় সবাই। পিচ্চি বাচ্চাদের মুখেও শোনা যেতো ভয়ংকর ভয়ংকর গালি। রায়হানের শুনেই গা ঘিনঘিন করতো। কোনরকম পাঁচ মাস থেকেছিল সেখানে। রুদ, রাহমিদ ইতোমধ্যেই কয়েকটা গালি আয়ত্ত করে ফেলেছিল। একদিন রায়হান রাহমিদকে ভাত খাওয়াতে নিলে বাচ্চাটা কিছুতেই খেতে চাচ্ছিলো না। রাহমিদ টুকিটাকি কথা বলতে পারে তবে অস্পষ্ট। অস্পষ্ট শব্দে বলে উঠেছিল,

“কুতার বাচা, হালামযাদা, ফুইননির পো”

রায়হান প্রথমে বুঝতে পারেনি পরে যখন রাহমিদ প্রত্যেকদিন খাওয়াতে গেলেই এগুলো অনবরত আউড়াতো তখন বুঝেছে গালি দেয় প্রতিদিন তাকে। রায়হানের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল রুদকেও দুই একটা গালি দিতে শুনেছিল। এরপর থেকে রায়হান কোনোভাবেই চায়নি এরকম অশালীন পরিবেশে ভাই, বোন বেড়ে উঠুক। সে এমনিতেই বাসায় থাকে না এসব অশালীন ভাষা এদের সাথে থেকে থেকে খুব ভালো ভাবেই রপ্ত করে ফেলতো। অনেক কষ্টে সাবলেট এই বাসাটা পেয়েছিল। বাসাটায় আগে আরেক দম্পতি থাকতো। তাদের পরিবর্তে এখন অন্য এক দম্পতি উঠেছে। ওনারা মোটামুটি ভালোই। ওনাদেরও সন্তান আছে রাহমিদ থেকে একটু বড়। রাহমিদ ওই বাচ্চাটার সাথে খেলে। রাহমিদটা হাঁটতে শিখেছে। তোতাপাখির মতো কথা বলতে শিখেছে। দুষ্টুও হয়েছে। সাড়ে তিন বছর বয়স বাচ্চাটার। এইতো সেদিন কোলে ঝুলে থাকতো এখন হাঁটতে পারে। দৌঁড়াতে পারে। অভিমান করতে পারে। রায়হানের কলিজা দুইটা।
____

ছোট্ট ছোট্ট দুইটা হাত ভাত বাড়ছে। বাড়ছে কম ফেলে দিচ্ছে বেশি। প্লেটে ঠিক মতো বাড়তে পারছে না। চারপাশে ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পা দুইটা মেলে প্লেটটা উরুর উপরে রেখে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে থাবা দিয়ে ভাত খাচ্ছে। সব গুলো ভাত পড়ে যাচ্ছে। হাতের মধ্যে রাখতে পারছে না বাচ্চাটা। রায়হান এই দৃশ্য দরজা খুলে দেখলো। মাথা ব্যথা করায় আজকে আগে আগেই বাসায় চলে এসেছে। রাহমিদকে ভাতের সাথে যুদ্ধ করতে দেখে দ্রুত সেখানে গেলো। বললো,

“রাহমিদ ভাত ফেলে দিচ্ছো তো। এভাবে খায় কেউ। ভাত বেড়ে রেখে গিয়েছিলাম তো। ওটা খেতে। বাড়তে গিয়েছো কেন?”

“নাই, নাই ভাতু নাই।”

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভাইকে দেখাচ্ছে ভাত বেড়ে রাখা নেই। রায়হান চোখ কপালে তুলে দেখলো সত্যিই ভাত বাড়া নেই। সে কিভাবে ভুলে গেলো। আল্লাহ্! কপাল ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করতে লাগলো রায়হান। তারপর হাত ধুয়ে এসে খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা খাচ্ছে মজা করে। অথচ মজা করে খাওয়ার মতো কোনো আইটেম নেই। ভাত, ডাল চচ্চড়ি। আহারে অনেক খিদা পেয়েছিল বোধহয়। ভাত ছোট ছোট লোকমা তুলে খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো। বাচ্চাটা পানি খেতে গিয়ে জামা ভিজিয়ে ফেলেছে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোকলা হেঁসে ঘর থেকে দৌঁড় দিয়ে বের হয়ে গেলো। যাওয়ার আগে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে চুমু দিতে ভুললো না। পাশের ঘরের ছেলেটার সাথে এখন সে খেলবে। ছেলেটার অনেক খেলনা আছে। রাহমিদের তো কোনো খেলনা নেই। আছে শুধু একটা গাড়ি। রায়হান কিনে দিয়েছিল ওটা। তাই ছেলেটার খেলনাগুলো দেখলে তার অনেক ভালো লাগে। সারাক্ষণ ওখানে থাকতে ইচ্ছা করে। রায়হান হেঁসে সব কিছু গুছিয়ে গোসল করতে গেলো। ভাইবোনের জামা কাপড় ধুয়ে দিলো। আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি আসায় রুদকে স্কুল থেকে আনতে যাবে। রেডি হয়ে রাহমিদকে একবার দেখলো। বাচ্চাটা একমনে খেলছে খেলনা দিয়ে। ওকে আর ডেকে বিরক্ত করলো না। বোনকে আনতে চলে গেলো।
____
—-

“রুদ”

ভিড়ের মধ্যে উচ্চস্বরে রায়হান রুদকে ডাকলো। রুদ ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে দৌঁড় দিয়ে আসলো। ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান হেঁসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“ক্লাস কেমন হলো?”

“ভালো।”

আস্তে করে বললো। রুদের বয়স সাত বছর। এবার ক্লাস টুতে পড়ে। রায়হান ওয়ানে না পড়িয়েই টুতে উঠিয়ে দিয়েছে। যেহেতু গ্যাপ গিয়েছে পড়াশোনায়। ওয়ানের পড়া বাসায় বসেই পড়িয়েছে রায়হান। তাছাড়া বাচ্চাটার মেধা ভালো। মাশা আল্লাহ। বোনকে নিয়ে কিছু বাজার করলো। এখন মোটামুটি ভালোই দরদাম করতে পারে সে। রুদ ছোট ভাইয়ের জন্য চকলেট নিতে বললো কয়েকটা। বাচ্চাটা খালি আপির কাছে চকলেট খোঁজে। সে স্কুল থেকে গেলেই দৌঁড়ে আসে তার কাছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মায়াবী বদনে চেয়ে থাকে। তখন কিছু না দিতে পারলে তার বড্ড খারাপ লাগে। বাচ্চাটা এতো আশা নিয়ে আসে ওকে নিরাশ করতে মোটেও ইচ্ছা করেনা। যদিও ওর সাথে মারামারি বেশি হয়। রাহমিদ ওকে ধুমধাম মেরে দৌঁড় লাগায়। কখনো বা চুল জোরে টান দেয়। রুদের রাগ উঠলে রুদও কয়েকটা লাগিয়ে দেয়। রায়হান ওদেরকে বারণ করে তবুও শোনে না। বিশেষ করে রাহমিদ। রুদ যদি কখনো ওর নামে রায়হানের কাছে বিচার দেয় তখন এমন ইনোসেন্ট মুখ করে তাকায় ইচ্ছা হয় কয়েকটা চটাস চটাস করে চুমু লাগিয়ে দিতে। এসব ভেবে ভেবে সব কিছু কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো দুই ভাই বোন।
_____

“রাহমিদ কান্না করছো কেন?”

রায়হান আর রুদ বাসায় ঢুকে দেখে রাহমিদ ফ্লোরে বসে কাদঁছে। রায়হান ওর কাছে গিয়ে তড়িঘড়ি করে উপরোক্ত কথাটি জিজ্ঞাসা করলো। রাহমিদ ভাইকে দেখে কান্না আরও বাড়িয়ে দেয়। রায়হান আবারও জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে। রাহমিদ কান্না গলায় বলে,

“মালছে”

রায়হান অবাক। কে মেরেছে বাচ্চাটাকে। এর মধ্যেই পাশের ঘরের আপুটা এসে বললো,

“তোমার ভাই, সিয়ামের হাতে খামচি দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। সিয়াম খেলনা দেয়নি দেখে। আচ্ছা বলো তো, খেলনা আমার ছেলের। ওর খেলনা দিয়ে ও খেলবে না তো কি তোমার ভাই খেলবে? কথায় কথায় খালি খামচি, থুতু ছোঁড়া। এগুলো কয়দিন টলারেট করবো বলো? প্রতিদিন এমন করে। আজকে সহ্য সীমার বাইরে চলে যাওয়ায় সিয়ামও ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। সব সময় সহ্য করবে কেন আমার ছেলে। তোমার ভাইকে এসব বুঝিও।”

এই বলে সিয়ামকে নিয়ে উনি চলে যান। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। রাহমিদ অনবরত কাঁদছে। বাচ্চাটার হাতের কনুই ছিলে গেছে। রুদ ভাইকে আদর করে দিলো। চোখে পানি চলে এসেছে ছোট ভাইয়ের জন্য। ইস্ খেলনার জন্য আজকে ভাইটা আঘাত পেয়েছে। এসব ভেবেই রুদ ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। রায়হান কিছু বললো না। স্যাভলন লাগিয়ে দিল। রুদ ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে ভাইকে দিলো। বাচ্চাটা চকলেট দেখেও নিলো না। উল্টো ছুঁড়ে ফেলে দিলো জিদে। খেলনা লাগবে তার। এরকম করে খালি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো। রায়হান নিজের মনের জমানো কষ্ট, ক্ষোভ আকারে বের করে দিলো প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিয়ে। কখনো যে ভাইয়ের গায়ে হাত দেয়নি সেই ভাইয়ের গায়ে এই প্রথম এতো শক্তি দিয়ে মারলো রায়হান। রাহমিদ চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। রুদ বড় ভাইয়ের গম্ভীর মুখ জোড়ায় চেয়ে ভয় পেলো। ছোট ভাইকে কোলের মধ্যে টেনে আদর করতে লাগলো। পিঠ ডলে দিতে লাগলো। রাহমিদ কেঁদেই যাচ্ছে অনবরত। থামার কোনো লক্ষণ নেই। পিঠে অতো জোরে থাপ্পড় মারায় বাচ্চাটা ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। রায়হান চুপচাপ নিষ্প্রাণ হয়ে দাড়িয়ে থাকলো।
_____

“ওই দিলু, আছিস।”

রুস্তমের চেলা বাচ্চুর ডাকে দিলদার আসলো। জিজ্ঞাস করলো,

“কি হইছে ভাই।”

“তোরে রুস্তম ভাই বোলায়। জলদি ল।”

“কি কারণ?”

“অতো কতা কস ক্যা? আইতে কইছে আইবি।”

দিলদার প্রচুর বিরক্ত হলো। হোটেল ফেলে যাবে বখাটের আস্তানায়। এই রুস্তম বখাটের কোনো কাম, কাজ নাই। খালি এরে ওরে জ্বালাবে। এজন্যই রুস্তমকে দিলদার দুই চোখের পাতায় সহ্য করতে পারেনা। আফজাল হোসেনের কাছে অনুমতি নিয়ে বাচ্চুর সাথে গেলো। গিয়ে দেখলো, রুস্তম ও তার চেলারা চাঁদা উঠাচ্ছে দোকানে দোকানে। বাচ্চু রুস্তমকে গিয়ে দিলদারের কথা বলায় রুস্তম চাঁদা উঠানো বাদ দিয়ে চায়ের দোকানে আয়েশ করে বসলো। হাতের ইশারায় দিলদারকে ডাকলো। দোকানদারকে কড়া লিকারের লাল চা দিতে বললো। দিলদার গিয়ে সালাম দিলো। রুস্তম সালামের উত্তর দিয়ে বললো,

“কিরে আজকাল বহুত পালাই পালাই করিস মনে হয়। তোরে কি কাম দিছিলাম তোর মনে আছে? নাকি কামের কতা কইছি দেইখা পলাইয়া পলাইয়া থাহোস।”

দিলদার বুঝলো না কোন কাজের কথা জিজ্ঞাসা করলো রুস্তম ভাই। তাই নিরীহ কণ্ঠে বললো,

“কোন কাম ভাই?”

রুস্তম আকাশ থেকে পড়লো মনে হয়। সে মেজাজ দেখিয়ে বললো,

“এক বছর আগে যে কইলাম রায়হান গো খোঁজ নিতে তুই নিছিলি? পোলাডায় সিফাতরে পড়ানো ছাইড়া দিছে এর লাইগ্যা খোঁজও নিতে পারতাছি না কই আছে। এতিম মানুষ কই আছে কে জানে? আর তুই কস কি কাম। থাবরাইয়া থোবরা মোবরা সব বচকাইয়া দিমু।”

দিলদার খোঁজ নেয়নি এমন না। নিয়েছিল তবে পায়নি। তাই বললো,

“ভাই নিছিলাম তো খোঁজ কিন্তু পাই নাই। অনেক খুঁজছি কিন্তু ওরা কই আছে কইতে পারুম না। এত্তো বড় শহরে কই খুঁজুম। আপনে কাম দিছেন এডা আবার না কইরা পারি।”

দিলদার বিনয় নিয়ে বললো। রুস্তম চোখ মুখ কঠিন করে দিলদারের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

“তুই যেমন মার্কামারা, তোর কাজ কামও তেমন মার্কামারা। এরকম মার্কামারা খোঁজাখুঁজি করলে হইবো না কিছুই। আমার চেলারা তোরে সাহায্য করবো। তুই সময় বাইর কইরা রাহিস।”

চলবে,

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৮
#তাজরীন_ফাতিহা

রাত সাড়ে আটটা বাজে। রায়হান মাত্র বাসায় ফিরেছে। টিউশনি করিয়ে এশার নামাজ মসজিদ থেকে পড়ে এসেছে। দুপুরে রাহমিদকে মারার পর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর বাসায় ফেরেনি। বাচ্চাটাকে মেরে শান্তি পায়নি। সারাদিন বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করছিল। এত্তো জোরে এতো ছোট একটা বাচ্চার গায়ে হাত তুললো সে। এতো রাগ উঠেছিল কেন? কি চেয়েছে এমন। খেলনাই তো। এবার হাতে টাকা আসুক অনেকগুলো খেলনা কিনবে। যেটা পছন্দ হবে সেটাই কিনে দিবে। ঘরে ঢুকে দেখলো রুদ পড়ছে আর রাহমিদ রুদের কোলে বসে বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো বই দেখছে। মাঝে মাঝে দুষ্টুমিও করছে। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাচ্ছে আর নানা কথা বলছে। রুদ বিরক্ত হয়ে বললো,

“রাহমিদ বিরক্ত কোরো না। পড়তে দাও। আপু পড়ছি দেখছো না। তুমি তোমার বই পড়।”

কথাটা বলেই রাহমিদকে কোল থেকে নামিয়ে বাচ্চাদের “একের ভিতর সব” বইটা ওর সামনে মেলে দিলো। কিন্তু রাহমিদ এটায় খুশি হয়নি। সে মুখ ফুলিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়াবী চোখ দুটিতে অশ্রু টলমল করছে। ভাইয়ু, আপু খালি বকে। কেউ ভালোবাসে না। মন খারাপ করে বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে পড়লো। রুদ আর ঘাটলো না। এখন যদি রাহমিদকে আহ্লাদ করে তাহলে বাচ্চাটা পড়তে দিবে না। রুদের পড়া বাকি অনেক। হোমওয়ার্ক করতে হবে। এমনিতেই আজকে সারাদিন রাহমিদকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া মাইর দেয়ায় বাচ্চাটা সারাদিন কেঁদেছে। রুদ কত কিছু করে কান্না থামিয়েছে। এখন আবার ওকে নিয়ে পড়ে থাকলে পড়া কিচ্ছু হবে না। কাল মিসের হাতে বকা খেতে হবে। এইসব ভেবে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। রায়হান হাত, মুখ ধুয়ে এসে ফ্লোরিং বিছানায় বসলো। রুদ ভাইকে দেখে গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান হেঁসে গালে, কপালে চুমু দিলো। বললো,

“পড়া কমপ্লিট?”

“না একটু বাকি। ভাইয়ু একটা ম্যাথ সলভ করতে পারছি না। এট্টু দেখিয়ে দাও।”

“আচ্ছা দিবো। প্রিন্স রাহমিদের রাগ কমেনি?”

“না। জানো ভাইয়ু আজকে ওকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। রাগ করেছে তোমার উপর, জিদ দেখায় খাবারের উপর।”

রায়হানের বুকটা মুচড়ে উঠলো। এত্তো রাগ ভাইয়ের প্রতি। রাহমিদকে শোয়া থেকে কোলে নিলো। রাহমিদ মোচড়ামুচড়ি করতে শুরু করলো। কিছুতেই ভাইয়ের কোলে যাবে না। মাইর দিয়ে আদর দেখানো লাগবে না। সবাই পঁচা। তাকে কেউ ভালোবাসে না। রায়হান তার ছোট্ট ছটফটে শরীরটা ঝাপটে ধরে আদর করলো। রাহমিদ কিল, খামচি দিতে লাগলো। রায়হান অনেক্ষণ ঝাপটে ধরে আদর করে বাচ্চাটার চেহারার দিকে তাকালো। এইতো তার ছোট্ট রাহমিদ। যে জিদে হাত, পা ছুড়তো। খামচি দিতো। পার্থক্য শুধু ওই রাহমিদের শরীরটা আরও ছোট্ট ছিল। এখন একটু বড় হয়েছে। বাচ্চাটার পেটে নাক দাবিয়ে কাতুকুতু দিতে থাকলো। রাহমিদ খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। রায়হান বাচ্চাটার হাসি দেখে নিজেও হাসলো। ছোট্ট শরীরটা আগলে ধরে বললো,

“কলিজা রাগ করেছেন। ভাইয়ু অনেক পঁচা তাইনা? আপনি খাননি কেন সারাদিন?”

“ইখানে বেতা দিসু।”

ভাইকে পিঠ দেখিয়ে বললো। রায়হান পিঠ ডলে দিতে লাগলো। পিঠে অনেকগুলো চুমু খেলো। রাহমিদ শান্ত বাচ্চার মতো ভাইয়ের আদর খেতে লাগলো। রুদ এতক্ষণ বড় আর ছোট ভাইয়ের খুনসুটি দেখছিল। ওর ভীষণ ভালো লাগছে। তিন ভাইবোন বেশ কিছুক্ষণ মজা করলো। রায়হান রুদকে ম্যাথটা বুঝিয়ে দিলো। এরপর রায়হান রাহমিদকে কোল থেকে নামিয়ে রান্না ঘরে যেতে চাইলো কিন্তু রাহমিদ ভাইয়ের কোল থেকে নামবে না। ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। নিরুপায় হয়ে রায়হান ওকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে আসলো। পাতিলে পরিমাণ মতো চাল নিয়ে ধুয়ে বসিয়ে দিলো। রাহমিদকে একটা টুলে বসিয়ে দিয়ে পেঁয়াজ কুঁচি করতে লাগলো। আজকে বাজার থেকে টাটকা টাটকা বেগুন এনেছিল। একটা বেগুন পুড়িয়ে ভর্তা করবে। সাথে থাকবে ডিম ভর্তা আর পাতলা ডাল। কয়েকটা শুকনো মরিচ তেলে ভেজে নিলো। সরিষার তেল বেগুনে মেখে পোড়ালো। আস্ত রসুন মরিচের তেলে ভেজে উঠিয়ে পাশে রাখলো। ডিম সিদ্ধ বসালো। ভাত নামিয়ে মাড় গাললো। এর মধ্যে রাহমিদের হাজারটা প্রশ্ন করা শেষ। এই যেমন,

“ভাতু তিকে পানি পলে কিনো?

বেগুন দেখিয়ে বলে, “ইতা কি?”

বেগুন পোড়ানোর সময় বলেছিল “আমি এত্তু ইতা কাই।”

রায়হান এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছে। পিঁয়াজ হালকা ভেজে ডিম ভর্তা করলো। তারপর বেগুন ভর্তা করে একটা বাটিতে রাখলো। কালকের ডাল গরম করলো। ব্যাস, রান্না শেষ। রাহমিদকে নিয়ে ঘরে চলে আসলো সাথে ভাত, ডিম ভর্তা, বেগুন ভর্তা আর ডাল। রাহমিদ আর রুদকে রায়হান খাইয়ে দিলো। একই প্লেটে সেও খেলো। রুদ রাহমিদকে কাগজ দিয়ে একটা নৌকা বানিয়ে দিয়েছিল। ও সেটা দিয়ে খেলছে আর দু’পা মেলে মজা করে ভাত খাচ্ছে। তরকারি বেশি কিছু না থাক, মিলেমিশে ভালোবেসে খেলে সবই অমৃত। তিন ভাইবোন খেয়ে দেয়ে সব গুছিয়ে রাখলো। রুদ ভাইকে প্লেট ধোঁয়ায় সাহায্য করলো। রাহমিদ পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
______

রাত বাজে সাড়ে বারোটা। রাহমিদ আর রুদকে ঘুম পাড়িয়ে রায়হান পড়তে বসেছে। আগামীকাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করছে। রাত জেগে পড়ার কারণে মাথা ব্যথা বেড়েছে প্রচুর। সারাদিন এতো ধকলের পর পড়ার সময় হয়েই উঠে না। ক্লান্তিতে শরীরটা খালি বিছনা খুঁজতে চায় কিন্তু কিছু করার নেই। পড়তে তো হবে। একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে যেতে হবে কষ্ট করেই। অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে বেশ রাত হলো। ঘুমে চোখ দুটো বুজে আসছে। আর চলছে না শরীর। শরীরের চার্জ সব শেষ। এখন চাইলেও আর জোর করে পড়তে পারবে না। ক্লান্তিতে সব কিছু গুছিয়ে রাখার সময়ও পায়নি। ভাইবোনের পাশে টুপ করে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
______
—–

এক অদ্ভুত কারণে কোনো এলার্ম ছাড়াই ফজরের সময়ে রায়হানের ঘুম সব সময় ভেঙে যায়। রায়হান যত রাত করে ঘুমাক না কেন ফজরের আযান শুনেই তার ঘুম ভাঙে। সে অনেক ওয়াজে শুনেছে, “এলার্ম ছাড়াই যদি কোনো মুমিন ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায় তাহলে বুঝতে হবে ওই ঘুম স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ভাঙিয়ে দিয়েছেন।” রায়হানেরও তাই মনে হয়। নাহলে এতো রাত করে শুলেও তার ঘুম এতো অল্প সময়ের ভিতরে ভাঙে কিভাবে। চোখে কত ঘুম নিয়ে সে ঘুমায় অথচ অল্প কিছুক্ষণ ঘুমালেই ঘুম পূরণ হয়ে যায়। শরীরে ফুল এনার্জি ফিরে পায় সে। ভাবনার মধ্যেই উঠে ওযু করলো রায়হান। মসজিদে যাওয়ার আগে রুদকে উঠিয়ে দিলো। রুদকে অনেক আগে থেকেই নামাজ পড়ার ট্রেনিং দিয়ে ফেলেছে রায়হান। অল্প কয়টা সূরা মুখস্ত পারে বাচ্চাটা। প্রতিদিন মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে রুদ আরবি পড়ে। রায়হান ইমাম সাহেবকে পারিশ্রমিক দিতে চাইলে উনি রাজি হননি। রুদকে এমনিতেই পড়ায়। রায়হান জোর করে কিছু দিতে চাইলে ইমাম সাহেব বলেন,

“আল্লাহর রাস্তায় জ্ঞান বিতরণ করি। এখানে টাকা দিয়ে আমাকে অসম্মানিত কোরো না। তাছাড়া এতিমদের প্রতি আল্লাহ্ সদয় হতে বলেছেন। তোমাদের যত বেশি মায়া, মহব্বত করবো কাল হাশরের মাঠে আল্লাহ্ তায়ালাও আমাকে এর চেয়ে বেশি মায়া, মহব্বত করবেন।”

খুব ভালো একজন মানুষ ইমাম সাহেব। কাঁচাপাকা দাড়ি। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। মানুষটার চেহারায় আল্লাহ্ তায়ালা নূর ঢেলে দিয়েছেন যেন। রায়হান, রুদ কিংবা রাহমিদকে দেখলে অনেক আদর করেন। এসব ভাবতে ভাবতেই রায়হান মসজিদে পৌঁছে গেলো।
_____
—-

“কিরে মামা, আজকে নাকি রাশেদ স্যার প্র্যাক্টিকাল নিবো, জানিস কিছু?”

রায়হান ভার্সিটিতে বন্ধু সাইমুন, হাবিব, ইমন, জুবায়ের এদের সাথে কথা বলছিল। হঠাৎ করেই ইমন উক্ত কথাটা বলে উঠলো। ওরা বন্ধুরা সবাই হতাশ। এই রাশেদ স্যার কাউকে না জানিয়ে প্র্যাক্টিকাল নিতে ওস্তাদ। জুবায়ের বলে উঠলো,

“ধুর ওই বেডার কথা কইস না আর। জীবন ত্যানা ত্যানা বানায় ফেলছে। মেইন কথা হইলো আমগোরে ওনার বকার লাইগা একটা উসিলা দরকার তাই সপ্তাহে সপ্তাহে একটা নাটক মারায়। পুরা নাটকবাজ শালায়। এইসব কতা বাদ দে। নেক্সট মান্থে নাকি পিকনিকে নিবো শুনছিস কিছু?”

হাবিব বললো,

“শুনছি। এবার ডিপার্টমেন্ট থেকে যাওয়া নাকি বাধ্যতামূলক করছে।”

সাইমুন দুই গালে হাত দিয়ে বললো,

“হুম। এডা ভালোই করছে। কি বলিস তোরা। কিরে রায়হান কিছু ক।”

“আমি যেতে পারব নারে। আমার টিউশনি আছে। গার্ডিয়ানরা মানবে না। তাছাড়া বাসায় কাজ আছে আমার। তোরা যা। আমি স্যারের সাথে কথা বলে নিবো।”

“ধুর বাল। তোর সব সময় একটা না একটা সমস্যা লেগেই থাকে। আগের বছরেও যাস নাই। এবার অন্তত চল। কিছু করতে চাইলেই তোর হাজার হাজার বাহানা। এগুলা কি ভাই?”

জুবায়েরের কথার কোনো জবাব না দিয়ে রায়হান চুপ করে থাকলো। তার যে বাবা, মা নেই সেটা তার বন্ধুরা কেউ জানে না। ছোট্ট দুইটা ভাইবোনের যে দায়িত্ব তার কাঁধে সেটাও ওরা জানে না। রায়হানই জানাতে চায়নি। কারণ অনাথদের মানুষ প্রতি পদে পদে হেয় করে। সে চায়না আর হেয় হতে। ওর বন্ধুগুলো যথেষ্ট ভালো। প্রথম যেদিন ভার্সিটিতে এসেছিল র্যাগিং এর শিকার হতে হতেও বেঁচে গিয়েছিল এদের কারণে। ক্লাসে সবাই যখন রায়হানকে দেখে এড়িয়ে চলতো ওর গম্ভীর স্বভাবের কারণে তখন এরাই ওর সাথে জোর করে মিশেছে। টিফিন না খেতে চাইলে জোর করে খাইয়েছে। কখনো জিজ্ঞাসা করেনি “তোর কি তিনটাই শার্ট?” ওর সব বন্ধুরা ওর মতোই নরমাল চলাফেরা করে। আগ বাড়িয়ে কিছুই কখনো জিজ্ঞাসা করেনি তাকে। তাই ওদের এইসব কথায় রায়হান রাগ করেনা। ওরা তো রায়হানের সঙ্গ চায়। তাই এমন করে বলে।

রায়হানের পরিস্থিতি তো আর তারা জানে না। পকেটে আছে দুই হাজার টাকা। এটা দিয়েই আগামী দশদিন চলতে হবে। টানাপোড়নে চলতে হবে দশটা দিন। এর মধ্যে পিকনিকে যাওয়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। এসব ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো সে। তার বন্ধুরা কি আলাপ করছে এসব তার কানে ঢুকছে না। তার চিন্তা কিভাবে মাসটা পার করবে। দায়িত্বের বোঝা বড্ড ভার। মাথায় সারাক্ষণ চিন্তা আর চিন্তা নিয়ে ঘুরতে হয় রায়হানদের মতো ছেলেদের। সুখ, আহ্লাদ করার সময় তাদের নেই।

চলবে…

জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১৫+১৬

0

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৫
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হান রুদকে উঠিয়ে জামা পাল্টে গোসল করালো। রুদের ক্ষতস্থানে স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। রুদকে গোসল করিয়ে রাহমিদকে গোসল করানোর জন্য প্রথমে রাহমিদের গায়ে সরিষার তেল মাখাতে লাগলো। জয়নব বেগম বলেছিলেন সরিষার তেল মাখিয়ে গোসল করালে নাকি বাচ্চাদের ঠাণ্ডা কম লাগে। রায়হানও এখন চেষ্টা করে যেইসব জিনিসে রাহমিদের ঠাণ্ডা লাগে ঐসব এড়িয়ে চলতে। আজকে রায়হানের মনটা বিষণ্ন। বাসায় এসেই রুদের ঘটনা শুনে মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। রায়হান তেল মাখাচ্ছে আর রাহমিদ দুষ্টুমি করছে। হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভাইকে জ্বালাচ্ছে। একটু পর পর হাত তালি দিয়ে ফিচ ফিচ করে হেসে দিচ্ছে। রায়হান ভাইয়ের কাণ্ডে মুচকি হেঁসে বললো,

“কি হয়েছে আপনার কলিজা? এতো খুশি কেন? আপির আজকে মন খারাপ। বেশি হাইসেন না নাহলে মার খেতে পারেন। আপনি বিপদসংকুল পর্যায়ে আছেন। বুঝলেন?”

রায়হান রাহমিদের লেংটু শরীরে নাক চেপে আদর করে বললো। রাহমিদ খিলখিল করে হেসে উঠলো। রায়হানও কিছুটা হাসলো। মনটা ভার এখনো। তেল মাখা শেষ করে রুদের দিকে তাকালো। বাচ্চাটার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে রুদকে আদর করে টয়লেটে গেলো। রাহমিদকে গোসল করানোর জন্য একটা প্লাস্টিকের বোল কিনে এনেছে গত পরশু। সেটায় পানি ভরে রাহমিদকে নামিয়ে দিলো। রাহমিদ পানিতে বসে খিলখিল করে হেসে দিলো। পানির ভিতরে দাপাদাপি করতে লাগলো। ওর লাফালাফিতে পানি ছিটে রায়হানের গা ভিজিয়ে দিলো। রায়হান রাহমিদকে ডলে ডলে গোসল করাতে লাগলো। রাহমিদ বিষয়টা পছন্দ করছে না। রায়হান যখন ওর মুখ ডলতে লাগলো বাচ্চাটা কেঁদে উঠে ভাইকে খামচি দিয়ে চামড়া উঠিয়ে ফেললো। রায়হান ব্যাথাতুর শব্দ করে রাহমিদকে ধমকে উঠলো,

“একদম আছাড় দিয়ে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলবো। সব সময় ইতরামি তাই না। প্রত্যেকদিন গোসল করাতে আসলে তামাশা শুরু করে দেয়। তোর খামচি খাওয়ার জন্য আমাকে টাকা দিস নাকি? মেরে ফেলবো একদম।”

ভাইয়ের ধমকে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। রায়হান ওর কান্না অবস্থায় ডলে ডলে গোসল করাতে লাগলো। রাহমিদ না থেমে কেঁদেই যাচ্ছে। গোসল করিয়ে বের হতেই একজন অপরিচিত নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। রায়হান সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেললো। তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় নারীকণ্ঠ বলে উঠলো,

“তুমিই তাহলে রায়হান। আমি তোমার জয়নব আন্টির মেয়ে আয়েশা। বাবু কাঁদছে কেন?”

“এমনিতেই।” রায়হানের ছোট উত্তর।

“ওকে একটু কোলে নিতে পারি?”

আয়েশার আবদার মাখা গলা। বিয়ের পাঁচ বছরেও সন্তান না হওয়া এক নারীর বেদনা মিশ্রিত কণ্ঠ। রায়হান চেয়েও বলতে পারছে না রাহমিদ কারো কোলে যায়না। নারীটি ভীষণ মমতা নিয়ে বলেছে যে। রায়হান ভাইকে তার কোলে দিলো। রাহমিদ চিৎকার আরও বাড়িয়ে দিলো। আয়েশা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে চেপে চেপে আদর করলো। নানা আদুরে কথা বলতে লাগলো। রাহমিদ প্রথমে কাঁদলেও এখন চুপটি করে আয়েশার ঘাড়ে মাথা দিয়ে আছে মুখে আঙ্গুল ভরে। রায়হান অবাক হলো ভীষণ। রাহমিদ সচরাচর অপরিচিত কারো কোলে যায়না। গেলেই কান্না শুরু করে। আজকে তো পুরোই উল্টো ঘটনা ঘটলো। যেমন ভাবে নারীটির কোলে লেপ্টে রয়েছে দেখে মনে হচ্ছে মা আর ছেলে। রায়হানের বুক ভার হলো। মাও তো এভাবে রাহমিদকে আদর করতো। রাহমিদ কি মা মনে করছে নারীটিকে? আর ভাবতে পারলো না। চোখ দুটো ভিজে গেছে। দ্রুত নিজেকে সংযত করলো। আয়েশা বললো,

“ওকে আমি খাইয়ে দেই? তুমি এই ফাঁকে খেয়ে ফেলো।”

“ও খাবে না। ওকে অনেক জোর করে খাওয়াতে হয়। আমাকে দিন।”

“না না আমি পারবো। দেখছো না কিভাবে কোলে পড়ে আছে। ওর নাম কি?”

“রাহমিদ জাইফ।”

“মাশা আল্লাহ ভীষণ সুন্দর নাম। ওকে পরে দিয়ে আসবো তোমার কাছে। এখন আমার কাছে থাক কিছুক্ষণ। তোমার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

এই বলে আয়েশা রাহমিদকে নিয়ে চলে গেলো। রায়হান মন খারাপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। ভাইকে নিয়ে যাওয়ায় বুক পুড়ছে। তার উপর একটু আগে বকা দিয়েছে। বাচ্চাটা ভীষণ অভিমান করেছে বোধহয়। থাক যেখানে থাকলে ওর ভালো লাগবে সেখানেই থাকুক। রায়হান মন খারাপ করে ঘরে চলে গেলো।
____
—-

“এইডা কেডা?” সেলিনা পারভীন গম্ভীর মেজাজে বললেন।

“আম্মা বলছিলাম না নতুন এক ভাড়াটিয়া আসছে আমাদের বাসায় তাদের বাবু।”

আয়েশা নরম সুরে বললো। এমনিতেই শাশুড়ি অনেক বদমেজাজি। আয়েশার সাথে খিটখিট করতে থাকে সারাদিন। এখন বাবার বাড়ি এসেও যদি খিটখিট করে তখন মা, বাবা কষ্ট পাবে। শাশুড়ি এমনিতেই তার বাবার বাড়ি আসতে চান না। ছেলেকেও আসতে দেন না। এবার যেহেতু নিজ থেকেই এসেছেন সেহেতু ওনাকে রাগিয়ে দেয়ার ইচ্ছা নেই। রাহমিদকে কোলে নিয়ে এসব ভাবছে সে। রাহমিদ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছে। তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো সে। তোয়ালে সরালেই লেংটু সে। সেলিনা পারভীন নাক উঁচিয়ে বললেন,

“তোমার এহন বাইচ্ছা লওয়ার শখ হইছে ক্যা? কার না কার বাচ্চা তারে লইয়া আইছো কেন? নিজে তো একটা বাচ্চা দিতে পারলা না। অহন মাইনষের বাইচ্চা লইয়া ফাল পারতাছো।”

আয়েশা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কোলে রাহমিদ নড়াচড়া করছে আর চিৎকার করছে। নিজে নিজেই কি যেন বলছে বাচ্চাটা। জয়নব বেগম খাবার নিয়ে ঘরে আসলেন। মাকে দেখে আয়েশা স্বাভাবিক মুখ করতে চেষ্টা করলো। সেলিনা পারভীনও হাসিহাসি মুখ করলো। জয়নব বেগম খাবার গুলো নামিয়ে বিছানায় পাটির উপর রাখলেন। রাহমিদকে মেয়ের কোলে দেখে বললেন,

“ওমা, বাইচ্চা ডা তোর কোলে! ওয় তো সবার কোলে যায়না। খালি কান্দে। পুরাই ভাইয়ের ন্যাওটা বাচ্চা ডা।”

রাহমিদকে আদর করে দিয়ে বললো। সেলিনা পারভীন জহুরী চোখে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলেন। বলে উঠলেন,

“এগোই কি আপনেরা পালতাছেন বেয়াই?”

জয়নব বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। সেলিনা পারভীন যে সুবিধার না তা তিনি জানেন। তাই কৌশলে বললেন,

“আসলে পালতাছি না। ওগো ভাই ই কাম করে। আমগো কাছ থেইকা কিচ্ছু নেয়না। পোলাডা অনেক ভালা। আপনে খাইয়া লন তাড়াতাড়ি।”

সেলিনা পারভীন বুঝলেন কথা লুকাচ্ছেন জয়নব বেগম। তিনি কোনো কথা না বলে রাহমিদের দিকে তাকালেন। ওনার রাগে শরীর জ্বলছে। তার ছেলেকে কিচ্ছু দেয়ার বেলায় নেই অথচ কোথাকার কোন এতিম অনাথ নাকি অনায়াসে বসে বসে খাবে। তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে আয়েশাকে বললেন,

“ল্যাদা ডারে দাও। একটু কোলে লই?”

আয়েশা দ্বিরুক্তি না করে সেলিনা পারভীনের কোলে রাহমিদকে দিলো। রাহমিদ এতক্ষণ হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে চারপাশ দেখছিল আর নিজ মনে নানা অস্পষ্ট কথা বলছিলো। এটায় বিঘ্ন ঘটায় বিরক্ত হলো বেশ। পরে যখন দেখলো এক জাদরেল টাইপ মহিলার কোলে তাকে দেয়া হয়েছে তখন কানে তালা লাগানোর জোগাড় করলো। সেলিনা পারভীন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। ভেবেছিলেন পিচ্চিকে একটা শায়েস্তা করবেন কিন্তু এখন তো ভাঙা ক্যাসেট চালু করে দিয়েছে এই বিচ্ছু। সেলিনা পারভীন ওকে নাড়তে লাগলেন। রাহমিদ খামচি দিয়ে ওনাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো। সেলিনা পারভীন রাগে গজগজ করতে লাগলেন। রাহমিদকে ঝাড়া দিয়ে আয়েশাকে দিতে দিতে বললো,

“মা গো মা। বিচ্ছু একটা। আমার শরীর খামচাইয়া ছিইলা ফালাইছে। এরে পালে কেমনে? উফফ মাগো হাতটা জ্বলতাছে।”

আয়েশা রাহমিদকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে লাগলো। কিন্তু রাহমিদ কান্না থামানোর পাবলিক না। সে চিৎকার করে হাত পা নাড়িয়ে গলা ফাটিয়ে কাদঁছে। জয়নব বেগম বললেন,

“ওরে ওর ভাইয়ের কাছে দিয়া আয় কান্না থাইমা যাইবো। ওরে ওর ভাই ছাড়া কেউ থামাইতে পারতো না। দৌঁড় লাগা নইলে তোরে এক্কেরে ছিলাই ফেলবো। আমি বেইয়াইনের লাইগা মলম লইয়া আহি। যা তাত্তারী।”

মায়ের কথা শুনে আয়েশা দ্রুত রাহমিদকে নিয়ে রায়হানদের ঘরের সামনে গেলো। রায়হান ভাইয়ের কান্নার শব্দে রুদকে খাওয়াতে গিয়েও খাওয়াতে পারলো না। আবার কি হলো। পড়ে টোরে গেলো নাকি। আয়েশা দ্রুত ঘরে ঢুকে ওকে রায়হানের কোলে দিলো। দিয়ে বললো,

“ভাই না বলে চলে আসাতে দুঃখিত। ওর কান্নাটা থামাও। আমার খারাপ লাগছে তোমার কাছ থেকে ভালোভাবে নিলাম আর এখন কান্না করিয়ে দিয়ে গেলাম। তুমি রাগ করো না প্লিজ। আসি ভাই।”

আয়েশা যাওয়ার আগে রুদকে আদর করে গেলো। রায়হান ভাইয়ের কান্না থামাতে লাগলো। ভাত মাখা হাতে ওকে দুলিয়ে দুলিয়ে নানা কথা বলতে লাগলো। রাহমিদ মুহূর্তের মধ্যে শান্ত হয়ে গেলো। ভাইয়ের সাথে যে রাগ করেছিল সেটা ভুলে গেছে সে। ভাই ধমক দিয়েছিল সেটাও ভুলে গিয়ে ভাইয়ের কোলে ফোপাতে লাগলো। রায়হান ওকে আদর করে বললো,

“আজকে আমার কলিজা গুলো সারাদিন কেঁদেছে। কে কাঁদায় আমার ভাই বোনকে খালি। সবাইকে মেরে দিবো ভাইয়ু। ঠিক আছে টোটন সোনা।”

ভাইয়ের আদুরে কথা শুনে রাহমিদ ভাইয়ের ঘাড়ে আঙুল ভরে চুক চুক শব্দ করতে লাগলো। রায়হান বুঝলো ওর খুদা পেয়েছে। রায়হান ভাত মাখা হাতে ওকে নিয়ে উঠলো। তারপর হাত ধুয়ে ডানো দুধ পানিতে মিশিয়ে ফিটারে ভরে ভাইয়ের মুখে দিলো। রাহমিদ এখন ভাতও খেতে পারে। অল্প অল্প করে মুখের সামনে দিলে খায়। তবে এখন ভাত খাবে না। কান্না করলে দুধ খাওয়ালে কান্না থামায়। ভাবে বোধহয় মা দুধ দিলো কিনা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রাহমিদকে ফিটার দিয়ে রুদকে ছোট ছোট লোকমা তুলে ভাত খাইয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদ চুক চুক শব্দে ফিটার খেয়ে ভাইয়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লো।
____

আজকে রায়হানের রেজাল্ট দিবে। ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ নফল নামাজও পড়লো। একটা ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে যেন চান্স হয়ে যায়। সকাল থেকে কিছু খেতেও পারছে না। রাহমিদ, রুদকে খাইয়ে দিয়েছে সে। রায়হান উত্তেজনায় ছটফট করছে। ভাইবোনের জামাকাপড় ধুয়ে রশিতে শুকাতে দিলো। ঘরে এসে বসতেই আফজাল হোসেন রুমে ঢুকলেন। ওই অসময়ে আফজাল হোসেনকে দেখে রায়হান অবাক হয়েছে। উনি তো এই সময় হোটেলে থাকেন তাহলে আজ এই সময়। কোনো সমস্যা হয়নি তো আবার। আফজাল হোসেন বললেন,

“রেজাল্ট কিভাবে জানবে? চলো বাজারে যাই। কম্পিউটারের দোকান থেকে রেজাল্ট বার করতে পারবো। ফোনেই নাকি পারা যায় কিন্তু আমাদের তো কারো স্মার্ট ফোন নেই। চল তাড়াতাড়ি।”

রায়হান রেডি হয়ে রাহমিদ ও রুদকে নিয়ে বের হলো। রুদকে আজ জয়নব বেগমের কাছে রাখলো না কারণ ওনাদের আত্মীয় এখনো যায়নি। পরশুর মতো একা রেখে গেলে যদি আবারও কেউ তার বোনকে মারে। কালকে শুক্রবার ছিল দেখে পড়াতে যায়নি কিন্তু আজকে একটু পর পড়াতে যেতে হবে কি করা যায় ভাবছে সে। বোনটা তার খুব শান্ত। তার ভাইবোনকে অপরিচিত কেউ মারবে সে সেটা সহ্য করতে পারবে না। তাই ওকে নিয়েই বের হলো। রেজাল্ট শুনে বোনকে নিয়েই প্রাইভেট পড়ানো যায় কিনা দেখতে হবে। এমনিতেই রাহমিদকেই অভিবাবকরা টলারেট করে না রুদকে করবে কিনা একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই দোকানের সামনে রিক্সা থামলো। আফজাল হোসেন ভাড়া দিলো। দোকানে ঢুকে রোল, রেজিস্ট্রেশন সব দিলো। দোকানদার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললো। অনেক্ষণ পর রেজাল্ট পাওয়া গেলো। রেজাল্ট দেখে রায়হানের হাত পা সব কাঁপতে লাগলো। রায়হানের কোলে রাহমিদ। ভাইকে এভাবে কাঁপতে দেখে ভাইয়ের সারা মুখে হাত বুলিয়ে থাবা দিতে লাগলো। আফজাল হোসেন রায়হানকে কাঁপতে দেখে বললেন,

“কি হয়েছে? ভালো রেজাল্ট আসেনি। থাক চিন্তা করো না। পরবর্তীতে ভালো করবে। পরেরবার আবার চেষ্টা করো। এভাবে কাপছো কেন? কাঁপাকাঁপি থামাও।”

রায়হান রাহমিদকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। রুদ ভাইকে কাঁদতে দেখে ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। আফজাল হোসেন ও পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। রায়হান অনেক কষ্টে বললো,

“আংকেল চান্স হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। গুচ্ছতে ১১২০ নাম্বার পজিশন পেয়েছি।”

কথাটা বলে আবারও কান্না করে দিলো সে।আফজাল হোসেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ওনার মনে হলো বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেলো। আফজাল হোসেন খুশি হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। বলে উঠলো,

“আরে বোকা ছেলে কাদঁছো কেন? আল্লাহ্ তোমার সহায় ছিলেন। এতো ভালো রেজাল্ট করেও কাদঁছো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করো।”

রায়হান মনে মনে অসংখ্যবার আলহামদুলিল্লাহ পড়ে ফেলেছে। মুখেও আবার বললো,

“আলহামদুলিল্লাহ।”

“চলো মিষ্টি কিনবো। এত দারুণ খবরে কেউ কাঁদে নাকি বোকা ছেলে। শুধু কাদলেই হবে। চলো মিষ্টি কিনি। তোমার আন্টি অপেক্ষা করছে।”

রুদ ভাইয়ের পা জড়িয়ে আছে। বাচ্চাটা ভাইকে কান্না করতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। রায়হান রুদকে একটু উপরে তুলে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে কপালে চুমু খেলো। রুদ আর রাহমিদকে জড়িয়ে ধরে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো সে। আফজাল হোসেন নিজেও ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। নিজের চোখটা আলগোছে মুছে ফেললেন তিনি। তারপর হেসে উঠে ভাইবোনের আদুরে মুহূর্ত দেখতে লাগলেন। দোকানদারও এতক্ষণ রায়হানের খুশির মুহূর্ত দেখছিলেন। উনিও ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন।

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৬
#তাজরীন_ফাতিহা

“একি, তুমি দেখি গুষ্ঠি সুদ্ধ হাজির হয়েছো?”

সিফাতের আম্মু চিৎকার করে বলে উঠলেন। রায়হান যে দুইজনকে পড়ায় তার মধ্যে উনি সিফাতের অভিভাবক। প্রচুর কড়া সিফাতের আম্মু। রায়হান পড়াতে গেলে চোখে চোখে রাখে পড়ানোয় কোনো ফাঁকি দিচ্ছে কিনা। রাহমিদ যখন হাত, পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে নানা রকম শব্দ করে উনি প্রচণ্ড বিরক্ত হন। রায়হান বুঝতে পেরে রাহমিদের মুখ চেপে ধরে রাখে। বাচ্চারা কি আর এতো কিছু বোঝে। মুখ ধরে রাখলে রাহমিদ আরও চেঁচিয়ে উঠে। হাত, পা জোরে জোরে নাড়ায়। মাথা দোলায়। এসব দেখে একদিন তিনি বলেছেন,

“বাচ্চা নিয়া পড়ানো যায়। তুমি তো বাচ্চার দিকেই নজর দিয়ে রাখো। সিফাতকে কি পড়াও আর। মাসে মাসে তো ঠিকই টাকা নিবে কিন্তু পড়ানোর বেলায় ঠনঠনা ঠন।”

কথাটায় রায়হান এত দুঃখ পেয়েছিল। মনে হচ্ছিলো তার শরীরের মধ্যে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে রায়হান রাহমিদকে প্যাসিফায়ার বা চুষনি পড়িয়ে রাখে। যাতে কোনোভাবেই চিল্লাতে বা কথা বলতে না পারে। প্যাসিফায়ারের দাম নিয়েছিল একশো টাকা। এই বয়সের বাচ্চাদের কথা বলানোর জন্য সবাই কত আয়োজন করে আর রায়হান কথা বন্ধের জন্য টাকা দিয়ে প্যাসিফায়ার কিনে কথা বন্ধ করে। সবই ভাগ্য। আজকে মনটা একটু ভালো রেজাল্টের খবর শুনে। আফজাল হোসেন আজকে পড়াতে নিষেধ করছিলেন কিন্তু রায়হান শোনে নি। গ্যাপ দিলে গার্ডিয়ানরা বিরক্ত হন। এমনিতেই বাচ্চা নিয়ে পড়ানোতে তাদের বড্ড অনিহা। তার উপর গ্যাপ দিলে ওকে টিউশনিতেই আর রাখবে না। তাছাড়া তার আনন্দের মুহূর্তে তাদের কি আসে যায়? রুদকে বাড়িতে একা রেখে আসতে ভরসা পাচ্ছিলো না দেখে তার সাথে নিয়ে এসেছে। আফজাল হোসেন অবশ্য রুদকে নিয়ে যেতে চেয়েছে, রায়হান রাজি হয়নি। সিফাতদের বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে রায়হান। কোলে বেবি ক্যারিয়ারে রাহমিদ পা দোলাচ্ছে। রুদ ভাইয়ের আঙ্গুল ধরে ভীতু নজরে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান ভয় পাচ্ছে সিফাতের আম্মু মুখের উপর দরজা না বন্ধ করে দেয়। সিফাতের আম্মু গজগজ করতে করতে বললেন,

“কি হলো চুপ করে আছো কেন? বোবা হয়ে গেলে নাকি। তুমি কি বিয়ে খেতে গুষ্ঠি সুদ্ধ হাজির হয়েছো। তুমি আসলেই পড়াতে আসো নাকি তামাশা করতে কোনটা?

“আসলে আন্টি বাসায় কেউ নেই তো। ছোট মানুষ একা কিভাবে থাকবে তাই সাথে করে এনেছি। ও কোনো ডিস্টার্ব করবে না। একেবারে শান্ত বাচ্চা।”

“শোনো তোমার এইসব ইমোশনাল কথা অন্য কাউকে শুনাবে। তোমার ভাইকে অ্যালাউ করেছি দেখে ভেবে বসো না যাকে তাকে অ্যালাউ করবো। এভাবে আদৌ পড়াশোনা হয়? রুস্তমের কারণে এখনো তোমাকে অ্যালাউ করছি নাহলে তোমাকে কবে টিউশনি ছাড়া করতাম। যত্তসব!”

“আন্টি চিন্তা করবেন না। ইংশা আল্লাহ্ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। সিফাতের পড়ানোয় আমার ভাইবোন কোনো ডিস্টার্ব করবে না। এটা আমার ওয়াদা।”

সিফাতের আম্মু একটু নমনীয় হলেন। তারপর মুখ বেজার করে বাসায় ঢোকার অনুমতি দিলেন। রায়হান মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলো। সিফাতের আম্মুর একেকটা কথা তার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হয়েছে। অথচ একটা কথার জবাবও রায়হান দিতে পারেনি। মুখ বুঝে সহ্য করেছে কারণ ঐযে জবাব দেয়া মানা নইলে তো টিউশনি থাকবে না। টিউশনি না থাকলে টাকা থাকবে না। টাকা না থাকলে সে দুনিয়ায় টিকতে পারবে না। বুক চিড়ে লম্বা দীর্ঘনিশ্বাস বের হলো। এটা কষ্টের, হতাশার নাকি কথা চেপে রাখার তা জানা নেই।
_______

রায়হান সিফাতকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে। রাহমিদ আর রুদকে অন্য রুমে রাখতে বলেছেন সিফাতের আম্মু। তাই রায়হান অন্য রুমে রেখে এসেছে ওদের। সিফাতের আম্মু আছে সেখানে। বাচ্চা দেখেবেন তিনি। রাহমিদ বিছানায় বসে বোনের সাথে খেলছে। সামনে একটা বাচ্চাদের বই রাখা। রাহমিদ বইটা বোনের সাথে উবু হয়ে বসে দেখছে আর একটু পর পর বইয়ের উপর থাবা বসাচ্ছে। চিৎকার করছে। নানা রকম কথা বলছে। রুদ বইটা সরিয়ে রাখছে রাহমিদ যদি বই ছিঁড়ে ফেলে ওই রাগী আন্টি অনেক বকবে। রায়হান তাকে শান্ত বাচ্চার মতো ভাইকে দেখে রাখতে বলেছে। সে ভাইকে চোখে চোখে রাখছে। রাহমিদ বই সরানোতে বেজার হলো। বোনের কোলে শুয়ে গড়াগড়ি করতে লাগলো। রুদ বইটা আবারও রাখলো সামনে। রাহমিদ বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো আবারও বই দেখতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর বিকট আওয়াজে সিফাতের আম্মু চিৎকার দিয়ে উঠলো। রায়হান হকচকিয়ে গেলো। কি হলো? ওরা কিছু করেছে কি? দৌঁড় লাগিয়ে ওই রুমে গেলো। গিয়ে দেখলো রাহমিদ আর রুদ ফ্লোরে বসা। রাহমিদ, রুদ দুইজনই ভীতু নয়নে সিফাতের আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে। রাহমিদ এতক্ষণ পর ভাইকে দেখে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান দ্রুত ওকে তুললো। হাতে ভেজা অনুভূত হওয়ায় হাত দিয়ে দেখলো রাহমিদ হিসু করে দিয়েছে। সিফাতের আম্মু রায়হানকে দেখে খিটখিটে মেজাজে বললো,

“তোমার ভাইকে কি আমার চাদর নষ্ট করার জন্য আনছো? আমার চাদর যে নোংরা করলো ধুবে কে? গত পরশু নতুন চাদর বিছালাম আর আজকেই নষ্ট করে ফেলছে চাদর টা। কত দামী আর সাধের চাদর জানো? এই পিচ্চিরে খাটে বসানোই ভুল হয়েছে। ওদের নিচে বসাতাম বেশি আদর করতে গিয়ে আমার চাদরটা নষ্ট হলো। উফফ অসহ্য।”

একেকটা কথা যেন বুলেটের থেকেও জোরে গায়ে এসে বিঁধলো। এর থেকেও দামী চাদরে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল তাদের। রাহমিদ কখনো নোংরা করলে মা নিজ হাতে ধুয়ে দিতো নাহয় কাজের আন্টিদের দিয়ে ধোঁয়াতো। ওসব এখন অতীত। ওগুলো ভাবাও পাপ। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাদঁছে। রায়হান থামাচ্ছে না। রুদ ফ্লোর থেকে উঠে এসে ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। ও ভীষণ ভয় পেয়েছে। কিভাবে রাহমিদকে আর তাকে নিচে নামালো। হাতে ব্যথা পেয়েছে সে। রাহমিদও প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। সিফাতের আম্মু আবার বললেন,

“উফ! এই তোমার ভাইয়ের কান্না থামাও তো। অসহ্য লাগছে। মাথাটা ধরে গেছে পুরো। একে তো চাদর নষ্ট করেছে এখন আবার ভ্যা ভ্যা করছে। ওদের নিয়ে কালকে থেকে আর পড়াতে আসবে না নইলে তোমাকে টিউশনিতে রাখতে পারবো না। বুঝেছো?”

“এভাবে বলবেন না আন্টি। ওদের আমি ছাড়া কেউ নেই। এরকম ভুল আর করবে না কখনো। কোনোদিন তো করেনি আজকে ভুলে হয়ে গেছে। পরেরবার আমি খেয়াল রাখবো যাতে এরকম না হয়। মন থেকে ক্ষমা চাচ্ছি আপনাদের চাদর নষ্ট করার জন্য। আমি চাদরটা ধুয়ে দিবো। বাথরুমটা দেখিয়ে দিলে ভালো হতো।”

সিফাতের আম্মু একটু গললেন বোধহয়। একটু বেশিই করে ফেলেছেন। বাচ্চা মানুষ এসব তো স্বাভাবিক ব্যাপার। তাও তার রাগ উঠে গেছে চাদর নষ্ট করায়। যেহেতু চাদর ধুয়ে দিতে চাচ্ছে দিক। কথা না বাড়িয়ে সিফাতকে পড়ানো শেষ করে চাদর ধুতে বললেন। রায়হান রাহমিদের ভেজা প্যান্ট পাল্টে দিলো। ওকে বেবি ক্যারিয়ারে ঝুলিয়ে নিলো। রুদকে পাশে বসিয়ে সিফাতকে পড়ানো শেষ করলো। তারপর রাহমিদকে রেখে চাদর ধুতে গেলো। এতো ভারী চাদর। ধুতে হিমশিম খাচ্ছে রায়হান। শরীর যেন চলছে না তার। তাও অনেক কষ্টে ধুয়ে দিলো। ধুয়ে রাহমিদ, রুদকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। রায়হানের এক হাতে রাহমিদের ভেজা প্যান্ট আর কোলে বেবি ক্যারিয়ারে রাহমিদ ঝুলছে। ফোঁপাচ্ছে বাচ্চাটা। এখনো কান্না থামেনি। চিৎকার করাটা থেমেছে। আরেক হাত রুদ ধরে আছে। তিন ভাই বোন হাঁটতে লাগলো বাসার উদ্দেশ্যে। আজকে আরেকটা টিউশনি নেই। লাবিবরা ঘুরতে গেছে। ফিরবে পরশু। ভালোই হয়েছে। প্রেশার একটু কমেছে। হাঁটতে হাঁটতে রুদ বললো,

“ভাইয়ু, বাবুন ব্যথা পেয়েছে। আন্টি অনেক জোরে ধাক্কা দি বাবুনকে ফ্লোলে ফিলেছে।”

রায়হান শুধু শুনে গেলো। কি বলবে সে? একজন ব্যর্থ ভাইয়ের আর কি বলার আছে? আজকে খুশির খবর শুধু ভার্সিটিতে চান্স পাওয়াটাই। বাকি সব তো দুঃখের কাব্যগাঁথা। ওসব মনে করতে নেই রায়হানের মতো ছেলেদের নাহলে দুঃখ বাড়ে। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। বিকেলের এই সময়টা দারুন এক বাতাস প্রবাহিত হয়। সেই বাতাসের শীতল পরশে রায়হানের দুঃখ গুলোর বিলুপ্তি ঘটুক।
_____
—–

“বেয়াই, পোলাডার ব্যবসা খারাপ যাইতাছে কয়দিন ধইরা। আপনে কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন তো নাকি। মাইয়া বিয়া দিছেন হুদাহুদা। কিছু তো দিলেন না পোলাডারে। অহন এই সময়েও যদি কিছু না দেন তাইলে কেমনে হইবো।”

সেলিনা পারভীন মুখে এক খিলি পান ভরে আয়েশ করে বলতে লাগলো। আফজাল হোসেন চুপচাপ শুনছেন। মেয়ের বিয়েতে কিছু দেননি কথাটা একেবারে ভুল। নিজের সাধ্যের মধ্যে একটা খাট আর ফ্রীজ দিয়েছিলেন তিনি। তাও কিছুটা ধারদেনা করা লেগেছে। ওই টাকা পরিশোধ করতে অনেকদিন লেগেছে তার। এছাড়াও প্রতি বছরে দুই ঈদে মেয়ের শশুরবাড়ির জন্য সওদা পাতি পাঠাতে হয়। মেয়ের বাবা হয়েছেন এসব তো মিটাতে হবেই। তার স্বল্প আয়ে এতো কিছু করা সম্ভব না। মাঝেমধ্যে না দিতে পারলে এই নিয়ে সেলিনা পারভীনের কথার শেষ নেই। পোলাডারে কিছু দেন নাই? পোলাডা কিছু চায়ও নি। এতো ভালা পোলা কই পাইবেন। এতো ছাড় কিন্তু ভালা না বেয়াই। মাইয়া বাড়িতেই তো পাঠাইতাছেন। কিছু দিলে খাইবো পিনবো তো আপনের মাইয়াই। আমরা তো দুই দিনের মেহমান। এরকম হাবিজাবি আরও কথা বলেন ফোন দিয়ে। আজকেও কানের কাছে এসব বলে চলছেন। বাসায় তাড়াতাড়ি আসাও বিপদ যেন। উনি তো সচরাচর এই বাসায় আসে না। আসলেও এতদিন কখনোই থাকে না। সকালে আসলে বিকেলে চলে যান। ওনার রুচিতে নাকি কুলোয় না এই বাসা। তাহলে এবার এতদিন থাকার কারণ কি? রুচিতে কি এবার বেশি কুলাচ্ছে নাকি? কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে কে জানে? আফজাল হোসেন শুধু বললেন,

“হাতে তো এখন তেমন টাকা পয়সা নেই। টাকা পয়সা হলে পাঠিয়ে দিবো। এখন কিছুটা টানাপোড়নে চলতে হচ্ছে। দেখি কি ব্যবস্থা করা যায়।”

সেলিনা পারভীন আফজাল হোসেনের কথা শুনে মনে মনে ফুঁসতে লাগলেন। হাতে টাকা নেই অথচ দিব্যি তিনটা অনাথ ঠিকই পালতে পারে। ঢং। এবার টাকা না নিয়ে যাবেন না তিনি। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“টেকা না থাকলে মিষ্টি কেমনে কিনলেন আবার হুনছি তিনডা এতিমরে নাকি পালেন। ঐসময় বুঝি টেকা লাগে না?”

আফজাল হোসেন বিস্মিত হলেন। উনি রায়হানদের পালেন মানে? ছেলেটা নিজে টিউশনি করে খরচ চালায়। উনি কখন রায়হানদের পেলেছেন? হ্যাঁ রায়হানদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন তিনি। তাই বলে তো ওদের খরচ আর তিনি বহন করেননি। রায়হান কাজ করে পরিশ্রম করে নিজেদের খরচ নিজেরাই চালায়। তাছাড়া তিনটা বাচ্চা পালা তো মুখের কথা না। উনি এসব কথা কিভাবে জেনেছেন। আফজাল হোসেন নরম গলায় বলেলন,

“ওদেরকে আমি মোটেও পালছি না বেয়াইন। এসব আজগুবি কথা কোথা থেকে শুনেছেন? রায়হান নিজে ইনকাম করে, কাজ করে খায় আমি তাকে একটু সাহায্য করেছি এই যা। এর বেশি কিছু করার সাধ্য আমার নেই। আপনি যে ডিমান্ড করছেন অতো দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। একটা বলে দিলেই তো হবে না বেয়াইন।”

সেলিনা পারভীন ভিতরে ক্রোধে ফেঁটে পড়লেন। ক্রোধের বশে বলে বসলেন,

“আপনেরা যদি নাই পালেন তাইলে ওগো এইহানে রাখছেন কেন? ওরা অন্য কোথাও থাহে না কেন? নিজেই কামাই করলে অবশ্যই অন্য জায়গায় থাকতো। আপনে আমারে ভক্কর চক্কর বুঝাইলেই আমি মাইনা লমু। আমার পোলারে কিছু দেয়ার বেলায় আপনের যত তামাশা কিন্তু তলে তলে তিনডা অনাথরে ঠিকই পালতে পারেন। আবার পরীক্ষায় পাশ করছে দেইখা মিষ্টিও কিন্নাও আনতে পারেন অথচ আমরা কিছু চাইলেই শুরু হইয়া যায় আপনের হাতে টেকা নাই। আপনেরা চলতে পারেন না। আর কত মিত্তা কতা কইবেন? জালিয়াতি আর কতকাল করবেন কন?”

ওযু করে আফজাল হোসেনের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কথাগুলো শুনে রায়হান পাথরের মতো জমে গেলো। তাদের জন্য আফজাল হোসেনকে কথা শুনতে হচ্ছে। বিষয়টা তাকে খুবই ব্যথিত করলো। আজকে সারা দিন দুঃখ পেতে পেতেই কাটলো। আল্লাহ্ আনন্দ দিয়েছে দুঃখ না পেলে চলে। বাসায় ফিরেই ওযু করতে চলে এসেছে সে। আসরের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে দেখে তাড়াহুড়া করে ওযু করে বের হয়ে কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রায়হান। আর দাঁড়িয়ে না থেকে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো সে। মোনাজাতে কাঁদলো কিছুক্ষণ। সারাদিন পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি তার। ভাইবোনদের সকালে একটু খাইয়েছিল তারপর থেকে ওরাও না খাওয়া। ওদের খাওয়াতে হবে। ডানো দুধ গুলিয়ে ফিডারে ভরে রাহমিদকে দিলো। রাহমিদ কান্না থামিয়ে ফিডার ধরে চুক চুক শব্দে দ্রুত দুধ খেতে লাগলো। আহারে কত খিদা লেগেছিল বাচ্চাটার! রায়হান ভাত আর আলু সেদ্ধ বসালো তাড়াতাড়ি। বোনটা খিদার জ্বালায় কাতরাচ্ছে।

চলবে….

#জীবন_পেন্ডুলাম
#বোনাস_পার্ট
#তাজরীন_ফাতিহা

ভাত রান্না করতে গেলে রায়হান সবসময় ভাত বেশি হওয়ায় নাহলে চাল চাল থাকতেই উঠিয়ে ফেলে। এখন পর্যন্ত সে সঠিকভাবে ভাত রান্না করতে পারেনি। একটা না একটা ভুল থাকবেই। আজকে ভাত বেশি নরম করে ফেলেছে। নরম ভাত রাহমিদকে খাওয়ানো গেলেও সে আর রুদ খেতে পারেনা। রুদকে চটকিয়ে খাইয়ে দেয়া যাবে কিন্তু রায়হান খেতে পারেনা একেবারেই। খেতে তো হবেই কিছু করার নেই। তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললো। গরম গরম আলু চটকাতে গিয়ে পোড়া হাতে জ্বলুনি অনুভব করলো। দ্রুত হাত পানিতে ভেজালো। উফফ কি অসহ্য যন্ত্রণা! ছেলে মানুষ হয়ে এই কাজগুলো করতে তার অনেক কসরত করতে হয়। ঠিকভাবে রাঁধতে পারেনা সে। তবে আস্তে আস্তে শিখছে। ভবিষ্যতে আরও পাকাপোক্ত হবে। মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাসবসত কাজ করতে করতে একদিন অভিজ্ঞ হয়ে যাবে। যেই কাজে যত বেশি অভিজ্ঞ হবে সেই কাজ পরবর্তীতে সব চেয়ে ভালো পারবে। ভাত, আলু ভর্তা নিয়ে ঘরে আসলো। রুদ খিদে পেটেই ঘুমিয়ে গেছে। রাহমিদও বোনের পাশে হাত পা ছড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। দুটো মায়া মায়া চেহারার আদুরে বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। ফুটন্ত পুষ্পের মতো ভাইবোন গুলো এখন নেতিয়ে পড়েছে। যেন দুটো নেতানো পুষ্প কড়ি। তাদের তিন ভাইবোনের পরিচয় এখন অনাথ। সবাই এখন তাদের অনাথ, এতিম বলে সম্বোধন করে। আহা কি নিদারুণ নিয়তি!
___

রায়হান রুদকে উঠিয়ে মুখ ধুইয়ে আনলো। বাচ্চাটা ঘুম থেকে উঠতে চাচ্ছিলো না। রায়হান এক প্রকার জোর করেই উঠিয়েছে। খিদে পেটে অনেক্ষণ ছিল। বেশিক্ষণ থাকলে গ্যাস্ট্রিক দেখা দিবে। পরে অসুস্থ হয়ে গেলে ডাক্তার দেখাবে কিভাবে? হাতে টাকা একেবারেই নেই। মাস শেষ হতে বাকি আরও কয়েকদিন। এখন প্রায় মাগরিবের ওয়াক্ত। আযান দিয়ে দিবে এখনই। রায়হান রুদকে খাইয়ে দিচ্ছে। বাচ্চাটা ঘুম ঘুম চোখে খাচ্ছে। বেশি খেতে পারলো না। রায়হান মুখ ধুইয়ে দিলো। বোনের প্লেটেই খেতে বসে গেলো সে। এর মধ্যেই রাহমিদ উঠে গেছে। চিৎকার দিয়ে কাদঁছে। ঘুম ভাঙলে সাধারণত বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে। রায়হান ভাত মাখা হাতে ওকে কোলে নিলো। প্যান্ট ভিজা। ওটা পাল্টিয়ে দিলো। ওকে কোলে নিয়ে চেপে চেপে আদর করলো। রাহমিদ আঙ্গুল ভরে চুষছে। রায়হান বুঝলো বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। ওকে কোলে বসিয়ে সাদা ভাত চটকিয়ে অল্প মুখে দিলো। রাহমিদ ভাইয়ের কোলে বসে ভাত মুখে নিলো। একটু একটু চিবুচ্ছে সে। তারপর মুখ থেকে বের করে ফেলে দিয়ে কেঁদে উঠলো।রায়হান বুঝলো খাবারটা পছন্দ হচ্ছে না রাহমিদের। উঠে ডানো দুধ নিয়ে এসে একটা বাটিতে ভাতের সাথে দুধের গুড়া নরম করে মাখালো। মাখিয়ে মুখের সামনে ধরলো আর আদুরে স্বরে বললো,

“কলিজা এটা খান। খাবার নষ্ট করবেন না। আল্লাহ্ গুনাহ দিবে। হা করুন দেখি কলিজা।”

রাহমিদ ভাইয়ের কথায় হা করলো। এখন খেতে লাগলো মজা করে। পা দুলিয়ে দুলিয়ে দুধ ভাত খাচ্ছে। রায়হান ওর গাল টিপে আদর করলো। খাওয়ানো শেষ করে নিজে দ্রুত খেয়ে নামাজ পড়লো। আফজাল হোসেন বা জয়নব বেগম এর মধ্যে একবারও আসেননি। রায়হান ওনাদের আশাও করেনি। তাদের জন্য তাকে কত কথা শুনতে হলো। নিজের মেয়ের আবার শাশুড়ি। চাইলেও কিছু বলতে পারবেন না। রায়হান দীর্ঘক্ষণ কিছু ভাবলো। টাকা হাতে আসলেই ভাবনাটা বাস্তবায়ন করতে হবে।
_____
—-

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। ঐদিনের পরের দিন সেলিনা পারভীন সব কিছু গুছিয়ে চলে গিয়েছেন। আয়েশাকে রেখে গিয়েছেন বাপের বাড়ি। তার এক কথা, হয় তার ছেলেকে কিছু দিতে হবে নাহলে রায়হানদের এখানে রাখা যাবে না। এতিম, অনাথ রাস্তার মানুষদের জন্য করতে পারবে অথচ তার ছেলের বেলায় যত দোনামনা। তিনি কিছুতেই তা মেনে নিবেন না। সব ভন্ডামি বের করে ছাড়বেন। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে সারা বাড়ি এক করে ফেলেছিলেন এসব কথা বলে। সব ভাড়াটিয়া চেয়ে চেয়ে দেখছিল। আফজাল হোসেন মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার জীবনে সে এতো অপমানিত হয়নি তাও আবার ভাড়াটিয়াদের সামনে। ভাড়াটিয়ারা কানাকানি করছিল। এরা নাকি মালিকের আত্মীয় লাগে তাহলে এসবের মানে কি? এতদিন ধরে তাদেরকে মিথ্যা বলে এসেছেন আফজাল হোসেনের মতো মানুষ। ময়নার মা তো বলেই বসেছেন, “ওই পোলায় আবার আমাগো জ্ঞান দেয়। নিজেই অনাথ আবার ভাব দেহাইতো যেন কোন দেশের রাজপুত্তুর সে।” ওনার সাথে অনেকেই তাল দিয়েছে তখন। রায়হান এক কোণে ভাইবোনদের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কথা গুলো তীরের মতো বিঁধছিলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কি করার ছিল তার। ঐদিনই বাসা থেকে চলে যেতো যদি হাতে টাকা থাকতো। কিন্তু টাকা ছিল না দেখে চলে যেতে পারেনি। তাদের জন্য আফজাল হোসেনের মেয়ে শশুরবাড়ি যেতে পারছে না কথাটা ভেবেই এতদিন রায়হান অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো। আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগম সেদিনের পর থেকে রায়হানদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। নিজের মেয়ের থেকে নিশ্চয়ই পরের ছেলে মেয়ে আপন নয়। রায়হান বুঝেছিল এরকম কিছুই হবে। তাই রায়হান ওনাদের কোনো দোষ দেননা। ঠিকই তো দুনিয়ায় অনাথের আবার কিসের কষ্ট, কিসের থাকা খাওয়া। ওরা পৃথিবীতে আসেই তো যুদ্ধ করার জন্য। এখন সব কিছু কেমন গা সয়া হয়ে গেছে। ভাড়াটিয়ারাও কেমন যেন দুচোখে দেখে। আগে মালিকের আত্মীয় বলে তোষামোদ করে চলতো এখন দেখলেই কেমন বিরক্ত হয়। রায়হান দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।

এসব ভেবেই সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। একটা কম ভাড়ার মধ্যে বাসা দেখেছে। ভাইবোনকে নিয়ে উঠবে। কারো আর দুচোখের বিষ হতে হবে না। ভার্সিটিতে ভর্তির সময়ও হয়ে এসেছে। বাসা পাল্টানোতে অনেক খরচ হয়ে যাবে। টিউশনি আরেকটা জোগাড় হয়েছে। আল্লাহর রহমতে সব যেন ভালোই ভালোই হয়ে যায়। রুদকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। তাহলে বাসায় আর রুদকে একা রেখে যাওয়ার ভয় থাকবে না। রাহমিদ, রুদের জামা আলনা থেকে নামিয়ে ব্যাগে ভরলো। এখনই সব গোজগাজ করে রাখছে। কালকে সকালেই আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। রুদ, রাহমিদের খেলনা, জুতা, দুধের কৌটা, প্লাস্টিকের বোল, প্লেট, বাটি গুছিয়ে নিলো একটা ব্যাগে। বেশি কিছু নেই। ব্যাস সব কিছু গোছানো শেষ। অপেক্ষা কালকের সকালের।
_____
—-

” আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন? এই মাসের ভাড়াটা।”

রায়হান হাসিমুখে আফজাল হোসেনের দিকে টাকা বাড়িয়ে বললো। ফজর পড়ে আফজাল হোসেন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছিলেন। তন্মধ্যে রায়হানের কণ্ঠ শুনে অবাক হয়েছেন। সেদিনের পর থেকে ছেলেটার সাথে তেমন একটা কথা বলেননি। মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় আছেন। ভাড়াটিয়াদের সামনে অপমানিত হওয়ার পর উনি ঘর থেকে বেশি একটা বেড়োতেন না। জয়নব বেগমও প্রতিদিন কাঁদেন মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য। জামাইটা নিতে আসলো না এটা ভেবেই তিনি শঙ্কিত ছিলেন। কতবার মেয়ের শশুরবাড়িতে কল দিয়েছেন। শরমের মাথা খেয়ে বুঝাতে চেয়েছেন কিন্তু সেলিনা পারভীন মানতে নারাজ। এক কথা হয় টাকা দিতে হবে নাহয় রায়হানদের পালা যাবে না। আফজাল হোসেন তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারেননি রায়হানদের সে পালছে না। এসব ভেবেই তার প্রেশার বেড়ে গেছে গত কয়েকদিন। আজকে রায়হানকে টাকা হাতে দেখে ছেলেটার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আহারে কতটা শুকিয়ে গেছে। চেহারা গাম্ভীর্যপূর্ণ রুক্ষ রোদে পোড়া। মুখে মলিন হাসি। কি ছিল কি হয়েছে ভেবেই তার খারাপ লাগছে। রায়হান আফজাল হোসেনকে নিজের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও ডেকে উঠলো। আফজাল হোসেনের ধ্যান ভাঙলো। বলেলন,

“কিসের টাকা?”

“এ মাসের ভাড়ার। একটু পরে চলে যাবো তো তাই আপনার আর আন্টির সাথে দেখা করতে আসলাম।”

রায়হান ম্লান হেঁসে বললো। আফজাল হোসেন কথাটা বুঝতে পারেননি। তাই জিজ্ঞাসা করলেন,

“কোথায় যাবে?”

“একটা বাসা দেখেছি আংকেল। ওখানেই উঠবো আজ। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি ক্ষমা করবেন। নিজের অজান্তেই আমাদের দ্বারা কষ্ট পেয়ে থাকলে মাফ করে দিবেন আংকেল। আন্টিকে একটু ডাকুন।”

আফজাল হোসেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রায়হানরা চলে যাবে। তারা জানেনও না। জয়নব বেগম রান্না ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। পথিমধ্যে রায়হান আর আফজাল হোসেনকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। রায়হান এগিয়ে গিয়ে তাকে সালাম দিলো। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলো। জয়নব বেগম দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো। ফের জিজ্ঞাসা করলো না রায়হান কেমন আছে। রায়হান আর না ঘেঁটে বললো,

“আন্টি এতদিন আপনাদের কষ্ট দেয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আমরা আজকে চলে যাচ্ছি। আয়েশা আপুকে শশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েন। আশা করি আর কোনো সমস্যা হবে না।”

জয়নব বেগম ভীষণ অবাক হয়ে তাকালেন। রায়হান কোথায় চলে যাওয়ার কথা বললো? জিজ্ঞাসা করলেন,

“কই যাইবা?”

“নতুন বাসায় আন্টি। দোয়া করবেন। আপনাদেরকে কষ্ট দেয়ার কারণে বদদোয়া করবেন না প্লিজ। আপনাদের জন্য সব সময় মন থেকে দোয়া থাকবে। আপনারা না থাকলে আমাদের আজকে রাস্তায় থাকতে হতো। আল্লাহ্ আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিক। আপনাদের পেরেশানি দূর করে দিক। আসি আল্লাহ্ হাফেজ।”

কথাটা বলেই রায়হান প্রস্থান করলো। ঘরে গিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে বের হলো। কোলে বেবি ক্যারিয়ারে রাহমিদ ঝুলছে। একটা রিক্সা ডেকে মাল পত্র উঠালো। রুদকে নিয়ে আফজাল হোসেনদের কাছে গেলো। তারপর রুদকে বিদায় নিতে বললো। রুদ বিদায় নিলো। বললো,

“আসি আন্টি, আসি আনকেল। আল্লাহ্ হাফিজ।”

আফজাল হোসেন, জয়নব বেগম রুদ আর রাহমিদকে আদর করে দিলেন। তাদের চোখে পানি। বাচ্চাগুলো চলে যাচ্ছে দেখে এত কষ্ট হচ্ছে। এরকম না হলেও পারতো। নিয়তি তাদের কোথায় দাড় করিয়েছে। রায়হান বিদায় নিয়ে রুদকে নিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লো। গন্তব্য এখন নতুন জীবনের, নতুন পথের। রায়হানরা চলে যেতেই জয়নব বেগম হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। বাচ্চাগুলোর সাথে যে তাদের কত ইমোশন জড়িয়ে আছে। দীর্ঘ পাঁচ মাস একসাথে ছিল। লাস্ট কয়েকটা দিন ঠিক করে কথাও বলেননি তারা। ওরা যে এভাবে চলে যাবে বুঝতে পারেননি। এসব ভেবে আফজাল হোসেনকে জড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছেন জয়নব বেগম। আফজাল হোসেনেরও বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। স্ত্রীকে কি বলে সান্ত্বনা দিবেন বুঝতে পারলেন না।

চলবে…