1. নিয়তের উপর আমল নির্ভর করে
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আমলের মূল্যায়ন নির্ভর করে নিয়তের উপর। প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।”
(সহীহ বুখারি: ১)
2. পাঁচটি জিনিসকে মূল্যায়ন করো
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“পাঁচটি জিনিসকে মূল্যায়ন করো: বার্ধক্যের আগে যৌবন, অসুস্থতার আগে সুস্থতা, দারিদ্র্যের আগে সম্পদ, ব্যস্ততার আগে অবসর এবং মৃত্যুর আগে জীবন।”
(তিরমিজি: ২৩৪০)
3. ভাল ব্যবহার করা শ্রেষ্ঠ আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার আচরণ সবচেয়ে ভালো।”
(সহীহ বুখারি: ৩৩১৮)
4. ভাইয়ের জন্য যা চাই, তা নিজের জন্যও চাই
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যও নিজের জন্য যা চায় তা চায়।”
(সহীহ বুখারি: ১৩)
এগুলো সহজে মনে রাখা ও জীবনে প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবার-পরিজনের জন্য উত্তম।” — (তিরমিজি, হাদিস: ৩৮৯৫)
হযরত ওমর (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণ
হযরত ওমর (রাঃ) ইসলামের প্রথম দিকে একনিষ্ঠভাবে মুসলিমদের বিরোধিতা করতেন। তিনি ইসলামকে খুবই ঘৃণা করতেন এবং তার বিরুদ্ধে নানান কূট কৌশল অবলম্বন করতেন। কিন্তু একদিন, তার মনের মধ্যে পরিবর্তন আসলো।
হযরত ওমর (রাঃ) একদিন এক সাহাবীর কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু শোনা এবং তিনি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ইসলামিক বিশ্বাসের প্রতি সন্দেহ দূর করার জন্য মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে উপস্থিত হন।
অতঃপর, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওমর, তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো, তবে আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ দেখাবে।” হযরত ওমর (রাঃ) তখন বললেন, “হ্যাঁ, আমি আল্লাহর রাসুলের পথ গ্রহণ করবো।”
ইসলাম গ্রহণের পর, হযরত ওমর (রাঃ) ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক হয়ে ওঠেন। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে দেন এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শিক্ষা:
আল্লাহর পথ কখনোই বন্ধ থাকে না; যেকোনো ব্যক্তি সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে।
একজন মানুষের হৃদয়ে পরিবর্তন আনা আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপার।
ইসলাম গ্রহণে কোনো দেরি নেই, এবং পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত।
বাসর ঘরে শিউলিকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে এল। ফুলসজ্জিত বিছানার মাঝখানে বসে আছে আরেকটি ফুল। আমার অনেক সাধনার ফুল, ঘুম হারাম করা ফুল।
শিউলির পরনে লাল বেনারসি। মাথায় জরির ওড়না। ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা। আমি ধীরপায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে তাকে ডাকলাম।
‘শিউলি।’
সে ডাকে ঘোমটার আড়ালে থাকা রমণী কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। কিয়ৎক্ষণ বিমূঢ় হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। ইতিউতি করে একসময় বিছানার একপাশে বসলাম। শিউলি মাথানিচু করে বসে আছে। ঘোমটার একপ্রান্ত মৃদু বাতাসে উড়ছে। কম্পিত হাতে আমি তার ঘোমটা সরিয়ে দিলাম। চোখের সামনে শিউলির চাঁদ মুখটা ভেসে উঠল।
তাকে বিয়ের সাজে দেখে আমার হৃদস্পন্দন দ্রুততর হলো। গলা শুকিয়ে এলো। আমি নিঃশব্দে ঢোক গিললাম। শিউলির শরীর থেকে মিষ্টি মধুর গন্ধ ভেসে আসছে। মাতাল করা গন্ধ। মেয়েটা আমার এতো কাছে! সামান্য একটু হাত বাড়ালে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়। বুকের মধ্যিখানে লুকিয়ে ফেলা যায়। এসব ভাবতে সমস্ত দেহে শিহরণ বয়ে গেল।
শিউলি ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে। গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। আমি ক্রমশ ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। শিউলিতে ডুবে যাচ্ছি। তাকে অনুনয়ের সুরে বললাম,
‘আমার দিকে তাকাও প্লিজ।’
শিউলি আমার ডাকে সাড়া দিল। কাজলকালো আঁখিপল্লব মেলে আমার পানে তাকাল। তার চোখে আমি নিজের ধ্বংস দেখতে পেলাম। মনের গহীনে প্রশ্ন জাগল। এই চোখের মায়া কি কখনো কাটিয়ে উঠতে পারব? না!
শিউলির মেহেদি রাঙা হাত মুঠোবন্দি করে নিলাম। ডান হাতের তালুতে আমার নামটা জ্বলজ্বল করছে। সে লেখায় আঙুল দিয়ে ছুঁইয়ে দিলাম। শিউলি কেঁপে উঠল। হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। আমি ছাড়লাম না। প্রগাঢ় স্বরে বললাম,
‘তোমাকে আমি ভালোবাসি শিউলি। ভালোবাসি, ভালোবাসি , ভালোবাসি। তুমি বিয়েতে রাজি নাহলে মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় ছিল না আমার।’
‘আমার ছিল বুঝি?’
শিউলি অবশেষে মুখ খুলল। তার কম্পিত মিহি সুর কানে বাজতে অবাক হয়ে গেলাম। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
‘মানে?’
‘আপনার জন্যই তো এই মনে অন্য কাউকে জায়গা দেইনি। কতগুলো দিন হলো আমি আপনার অপেক্ষায়। আমার কাছ অবধি পৌঁছাতে আপনার এতো সময় লাগল কেন?’
শিউলির অভিমানি কন্ঠস্বর। দুচোখ ভরা অভিযোগ। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তার পানে চেয়ে রইলাম। অবশেষে সব খোলাসা হলো। রোজ নিয়ম করে সিঁড়িতে শিউলির দেখা পাওয়া, আমাকে দেখে তার লজ্জামিশ্রিত অস্বস্তি হওয়া – সব পরিষ্কার হলো। শিউলিও যে আমার মতো অপেক্ষায় থাকত। কখন আমাদের দেখা হবে। সাক্ষাৎ হবে!
আমার বুকের ভেতর সুখপাখিরা দাপাদাপি শুরু করল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছে। শিউলি আমায় পছন্দ করে? আমায় ভালোবাসে? এ যে আমার জন্য কতবড় পাওয়া! শিউলির হাতদুটো বুকের কাছে নিয়ে বললাম,
‘তুমি আমায় ভালোবাসো শিউলি?’
সে ফের লজ্জায় মাথা নিচু করল। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল,
‘বাসি তো।’
‘কী?’
‘ভালোবাসি আপনাকে।’
আমাকে আর কে পায়। খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
‘শিউলি আমায় ভালোবাসে। আমার শিউলি আমায় ভালোবাসে।’
আমার সে চিৎকারে শিউলি চমকে উঠল। হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল,
‘এসব কি করছেন? বাইরে থেকে যদি শোনা যায়, সবাই কী ভাববে?’
শিউলি আমায় টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। আমি ফিক করে হেসে দিলাম। ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। সেই সাথে আমাদের গল্প এগিয়ে চলল। আমাদের জমানো কত কত কথা! কত কত অনুভূতি। নিঃস্তব্ধ রাত্রিতে আমরা একে অপরের কাছে নিজেদের মেলে ধরলাম। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসার গল্প চলতে থাকল।
একফাঁকে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। টেবিল থেকে একটা ডায়েরি এনে শিউলির হাতে দিলাম। ধূসর বর্ণের ডায়েরি। যার প্রথম পাতায় বড় করে লেখা ‘শিউলি তোমার জন্য’।
মোটাসোটা এই ডায়েরি জুড়ে শুধু শিউলির গল্প। শিউলির গল্প আর শিউলির গল্প। আমাদের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে ছোট্ট ছোট্ট সব মুহূর্ত। আমি লিখে রেখেছি। শিউলি তার কয়েক পাতা পড়ে বেশ অবাক হলো। একসময় ঝাপসা চোখে বলল,
‘এতো অনুভূতি নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলেন কীভাবে? আপনার কষ্ট হয়নি?’
‘হয়েছে তো। এখানটাতে।’
আমি চোখের ইশারায় বুকের বা পাশটা নির্দেশ করলাম। শিউলি সেখানটাতে হাত রাখল। আমি ওকে দুহাতে আগলে নিলাম। বুকের মাঝে, নিজের খুব কাছে। সময় বয়ে চলল। আমি শিউলির মাঝে ভালোবাসাময় এক অপার্থিব সুখের সন্ধান পেলাম।
ক্রমশ রাত বাড়ছে। শিউলি ফোঁটা একটা ভোর দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। আমি উৎসুক হয়ে সেই ভোরের অপেক্ষায় রইলাম। জনম জনমের অপেক্ষা!
‘আন্টি আমাদের সাথে একটু আসুন। গতকাল থেকে শিউলির জ্বর। হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। কিছুতেই কমছে না। ও সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।’
শিউলি নামটা শুনতেই আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। মা চিন্তিত গলায় বললেন,
‘সে কি! আমাকে আগে থেকে বলো নি কেন?’
‘ভেবেছি সামান্য জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এত বেড়ে যাবে বুঝতে পারিনি। এখন এই রাতেরবেলা আমরা মেয়ে মানুষ নিয়ে যেতে পারব না। এজন্য আপনাকে জানাতে এলাম।’
মা আমায় উদ্দেশ করে বললেন,
‘আমি নিচে যাচ্ছি, মাসুদ। তুই তোর বাবাকে বলে তাড়াতাড়ি আয়। গাড়িটা বের করতে হবে। আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে যাই।’
মা তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলেন। আমি বাবাকে ডেকে তুললাম। তাকে বলে মানিব্যাগটা নিয়ে বের হলাম। নিজেকে কেমন বোধশূন্য লাগছে। শিউলির সবটুকু ব্যথা, যন্ত্রণা যেন আমায় গ্রাস করেছে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে।
ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে শিউলিকে দেখে ভেতরটা ভেঙ্গে এলো। এতটা অসুস্থ মেয়েটা? চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। কথা বলতে পারছে না। দাঁতে দাঁত আটকে আসছে। মা শিউলির মাথায় কয়েক মিনিট পানি ঢাললেন। ভেজা চুলগুলো মুছে দিলেন। তারপর শিউলিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। সাথে মা আর শিউলির মেসের একজন মেয়ে গেল।
(৪)
শিউলির জ্ঞান ফেরার পর আমি তাকে দেখতে গেলাম। আমাকে দেখে সে লজ্জা পেল। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া খানিক প্রসারিত করে হাসার চেষ্টা করল।
‘এখন কেমন লাগছে?’
আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। শিউলি ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল,
‘একটু ভালো লাগছে।’
দুদিনের জ্বরে ওর কাহিল অবস্থা। চোখমুখ শুকিয়ে পান্ডুর মতো হয়ে গেছে। দূর্বল শরীর। রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ডাক্তার বলেছে, খুব নাকি খাবারের অনিয়ম করে।
শিউলির অবস্থা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। এক ধরনের অপরাধবোধ হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে, আমার কাছে থাকলে শিউলি ভালো থাকত। আমি ওর যত্ন নিতে পারতাম। দেখাশোনা করতে পারতাম। আদর আর ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখতাম।
মা ওয়াশরুম থেকে এখনো ফেরেননি। শিউলির হাতে ক্যানোলা লাগানো। ধীরগতিতে স্যালাইন চলছে। প্রেসক্রিপশনের কাগজটা নাড়াচাড়া করছিলাম। শিউলি গায়ে কাঁথা টেনে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। ওকে শুধালাম,
‘শীত করছে এখনো? জ্বর আছে?’
শিউলির উত্তরের অপেক্ষা না করে খানিক ঝুঁকে ওর কপালে হাত রাখলাম। ও অবাক হয়ে তাকাল। চেহারায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ল। আমিও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে হাতটা সরিয়ে নিলাম। খানিক পিছিয়ে এসে বললাম,
‘জ্বর নেই।’
শিউলি কিছু বলল না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ফের জিজ্ঞেস করলাম,
‘খাবারের এত অনিয়ম করা হয় কেন?
সে তার যথোপযুক্ত উত্তর খুঁজে পেল না হয়ত। লাজুক হাসল। বলল,
‘আর করব না।’
আমি মনে মনে বললাম, আর করতে দিব না। এই খাবার অনিয়ম করার শাস্তিস্বরূপ খুব শীঘ্রই তোমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।
লিমা এতক্ষণ ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল। সে আসতে আমি ফোনটা কানে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম।
(৫)
দুদিন পর শিউলিকে রিলিজ করা হলো। মায়ের মুখে শুনলাম, ওর বড়ভাই মেসে দিয়ে গেছে। বাড়ি যায় নি। পরের সপ্তাহ থেকে নাকি টার্ম পরীক্ষা। তাছাড়া এই দূর্বল শরীরে দীর্ঘপথের জার্নি করা ঠিক হবে না বিধায় যায় নি।
শিউলিকে দেখেছি দুদিন আগে। অসুস্থতার পরেরদিন খবর পেয়ে তার ভাই এসেছে। আমার দায়িত্ব শেষ। ইচ্ছে থাকলেও আর কিছু করার ছিল না। শিউলিকে দেখার সুযোগ ছিল না। মা অবশ্য দেখতে গেছেন। কয়েকবার রান্না করা খাবার দিয়ে এসেছেন। খোঁজ খবর নিয়েছেন। শিউলিকে দেখার কোনো অধিকার শুধু আমার নেই।
রাতেরবেলা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিলাম। শিউলির সাথে কথা বলতে মন চাইছে। এখন কেমন আছে, কী করছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। অথচ সামনে কোনো পথ খোলা নেই। অনেক ভেবেচিন্তে আজকে কল করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাত্রি এগোরটার কাছাকাছি। ব্যালকনিতে বসে কল করলাম। একবার রিং হতে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে শিউলির দূর্বল গলার সালাম ভেসে এলো। ওর কন্ঠ শুনে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। কিছু সময়ের জন্য কথা হারিয়ে ফেললাম। শিউলি নিজে থেকে প্রশ্ন করল,
‘কে বলছেন?’
‘আমি মাসুদ! চিনতে পেরেছ?’
কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর উত্তর এলো,
‘জি। চিনতে পেরেছি।’
‘মা কল দিয়ে তোমার ব্যাপারে জানতে বললেন। তাই কল করা। কেমন আছ এখন?’
‘জ্বর নেই। ঠিক আছি এখন।’
‘রাতে খেয়েছ?’
‘হুঁ। আপনি?’
‘খেয়েছি। তুমি কি ঘুমাবে এখন? ফোন রেখে দিব?’
‘খানিক আগে ঘুম থেকে উঠেছি। এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না। আপনি বলুন।’
মনটা পুলকে ভরে গেল। শিউলিকে আমার কতকিছু বলার আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলব! অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলাম। ক্রমশ রাত বাড়তে লাগল। এপাশে আমাদের কথোপকথন এগিয়ে চলল।
শিউলিকে আমি চাই। তাকে দেখার অধিকার চাই। ছোঁয়ার অধিকার চাই। নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখার অধিকার চাই। তার থেকে এই দূরত্ব আর সইতে পারছি না।
অনেক ভেবেচিন্তে পরেররাতে তাকে মেসেজ করলাম,
“শিউলি! আমার শিউলি! তোমাকে আমি ভালবাসি। আমার এই ভালোবাসা ভালোবাসা রোগের বয়স একদিন নয়, দুদিন নয়। দেড় বছর! যতদিন যাচ্ছে আমি ততই তোমাতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। আমার দিন যায় না। রাত কাটে না। সারাক্ষণ তোমায় মনে পড়ে। তোমাকে বুঝাতে পারছি না হয়তো। আমার তোমাকে লাগবে। লাগবেই লাগবে।”
মেসেজটা পাঠিয়ে আমি মায়ের রুমে গেলাম। মা মশারি টানাচ্ছিলেন। তাকে ডেকে বাইরে নিয়ে এলাম। বললাম,
‘মা, সেদিন বিয়ের কথা বলছিলে না? আমার একটা মেয়েকে ভীষণ পছন্দ। ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।’
মা বিস্মিত গলায় বললেন,
‘বলিস কি! মেয়েটা কে?’
‘শিউলি।’
‘শিউলি?’
‘হুঁ, শিউলি। যতদ্রুত সম্ভব আমি ওকে বিয়ে করতে চাই! তুমি প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করো।’
আমার অনুরোধ মা রাখলেন। খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন। শিউলির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেন। দেখা করে বিয়ের দিন তারিখ পর্যন্ত ঠিক করলেন।
শিউলিকে নিয়ে ভয় ছিল। রাজি হবে না বোধ হয়। না! আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে শিউলি রাজি হয়ে গেল। তারপর শুক্রবারের এক সন্ধ্যায় শিউলির সাথে আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। শিউলি চিরদিনের জন্য আমার হয়ে গেল।
(১)
শিউলি প্রতিদিন সকাল সাতটায় বের হয়। সে যখন তড়িঘড়ি করে ভার্সিটির বাস ধরার জন্য রওনা করে আমি তখন জগিং শেষ করে ঘরে ফিরি। আমাদের প্রায় দিন সিঁড়ির ধাপে দেখা হয়। দুই তলা বা তিনতলার সিঁড়িতে! আমাকে দেখে শিউলি কখনো কখনো বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একপলক দেখে চোখ নামিয়ে নেয়। দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। তাকে পাশ কাটানোর সময়টা আমি খুব ধীরপায়ে হাঁটি। তখন আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে। গলার কাছটায় শুকনো শুকনো লাগে। কেমন যেন ভয় হয়। বার বার মনে হয় এই বুঝি শিউলির কাছে ধরা পড়ে যাব। সে বুঝে ফেলবে যে তাকে একপলক দেখার জন্য রোজ আমি এই সময় জগিং শেষ করে ঘরে ফিরি।
প্রতিবার শিউলির কাছাকাছি আসতে আমি ফুলের গন্ধ পাই। স্নিগ্ধ, আবেশিত, শরতের শিউলির মতোই তার পারফিউমের গন্ধ। আমার ঘোর লাগে। মনে হয় এই পারফিউমশুদ্ধ মানুষটাকে বুকের মাঝে পিষে ফেলি।
দুই ধাপ উঠে আমি পেছন ঘুরে তাকাই। স্বপ্নাবিষ্টের মতো তার পানে চেয়ে থাকি অপলক। সে সিঁড়ির বাঁকে আড়াল হলে আমি ছুটে নিজের রুমে চলে আসি। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দ্বিতীয়বার তাকে দেখি। গলি দিয়ে সে তাড়াহুড়ো করে হেঁটে যায়। আমি বিড়বিড় করে বলি, আরেকটু আস্তে পা ফেলো প্লিজ! আরো কয়েকটা সেকেন্ড তোমায় বেশি দেখি।
শিউলি শুনতে পায় না। অবলীলায় হেঁটে যায়! ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে তার চুল উড়ে। ওড়নার আঁচল উড়ে। আমি দূর থেকে মুগ্ধ নয়নে তার পানে চেয়ে থাকি। চোখের তৃষ্ণা মেটাই।
শিউলি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে। আমাদের মিরপুরের বাসায় সে ভাড়া থাকে। একা নয়; তার সাথে আরো ছয়জন মেয়ে আছে। তারা আমাদের চারতলার ফ্ল্যাটের উত্তর দিকের ইউনিটে থাকে। আর আমরা থাকি পাঁচ তলায়। এত কাছাকাছি তবুও যেন বহুদূর!
শিউলিকে আমি ভালোবাসি। একটু নয়, অনেক বেশি। এতটা বেশি যে তার জন্য আমি নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দিতে পারি। এই যে দেড় বছর হলো শিউলিকে আমি এমন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে চলেছি। গোপনে গোপনে ভালোবেসে চলেছি শিউলি তার কিছুই জানে না। কয়েকবার তাকে বলতে গিয়ে সাহস করে উঠতে পারিনি। ভয় হয়। পাছে যদি রাজি না হয়? দুনিয়ার সব নিয়ম মানতে পারব। শুধু শিউলির প্রত্যাখ্যান মানতে পারব না। কিছুতেই না!
মা ইদানীং বিয়ের কথা বলছেন। এইতো গতকাল নাস্তার টেবিলে মা বললেন,
‘বিয়ে-টিয়ে নিয়ে কী ভাবলি, মাসুদ? বয়স তো আর কম হলো না। তোর বাবা মেয়ে দেখার কথা বলেছে।’
আমার তখন মাথাভর্তি শুধু শিউলি আর শিউলি। মায়ের কথায় ঘোর কাটে। সত্যি তো! তিন বছর আগে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়েছি। বাবার ব্যবসা দেখছি। এখন তো বিয়ে করা উচিৎ। কিন্তু মাকে শিউলির কথা বলব কী করে? তাছাড়া শিউলির পড়াশুনা এখনো শেষ হয়নি। সে কি এখন রাজি হবে বিয়ে করতে? নিশ্চয়ই হবে না!
মনে নানাবিধ চিন্তা ভর করে। তবে বিয়ের কথা শুনে বুকের ভেতরের পুরোনো তৃষ্ণা জেগে উঠে। আশা, আকাঙ্খা তরতাজা হয়। শিউলিকে কাছে চাওয়ার, আপন করে পাওয়ার তৃষ্ণা। যে মানুষটাকে এতগুলো দিন হলো বুকের মাঝে লালন করে চলেছি, তাকে চিরদিনের জন্য আমার করে পাওয়ার জন্য মন ছটফট করে উঠে।
(২)
শিউলিকে আমি প্রথম দেখি এক শুক্রবারের সকালে। তখন বেলা নয়টা বাজে বোধ হয়। থেমে থেমে বাসার ডোরবেল বাজছে। মা রান্না ঘরে। বাবা মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরেছেন ভেবে আমি দরজা খুলতে যাই। কিন্তু দরজা খুলে ভারি অবাক হই। ওপাশে অপরিচিত এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ জড়সড় হয়ে। চেহারা মায়াবী, লাজুক লতার মতো। যেন ছুঁয়ে দিলে এক্ষুণি নিজেকে গুটিয়ে নেবে। আমার দুচোখে মুগ্ধতা ভর করে।
মেয়েটা আমাকে প্রত্যাশা করেনি হয়তো। আমার চোখে চোখ পড়তে বেশ ঘাবড়ে যায়। কোনরকমে সালাম দেয়। বলে,
‘আন্টি আছেন?’
মেয়েটার কিন্নর কন্ঠ। সমুদ্রের জলরাশির মতো তার ধারা। চোখমুখে আলাদা এক ধরনের সারল্যতা। ভয়ার্ত, নিষ্পাপ চাহনি। যেন ধমক দিলে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। দেখে আমার ভালো লাগে। পুলকিত হই। তাকে নিয়ে মনে কৌতূহল জাগে। আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করি,
‘কে আপনি?’
‘আমি শিউলি। চারতলার ফ্ল্যাটে থাকি। আন্টি আছেন? সকাল থেকে আমাদের ফ্ল্যাটে পানি নেই। একটু দেখতে বলবেন?’
‘বলছি।’
‘আচ্ছা। আমি তাহলে যাই?’
‘যাবেন কেন? ভেতরে এসে বসুন না!’
শিউলি অসম্মতি জানায়। মাথা নেড়ে ধুপধাপ পা ফেলে নিচে নামে। আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। সহজে ঘোর কাটে না। মা হঠাৎ রান্নাঘর থেকে প্রশ্ন করেন,
‘কে এসেছে?’
আমি দরজা বন্ধ করে মায়ের কাছে যাই। চারতলার ফ্ল্যাটে পানি নেই কেন সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। খুব দ্রুত পানি সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু শিউলি নামের মেয়েটা আমার মনের ভেতরে যে সমস্যার সৃষ্টি করে রেখে যায়, সেটার সমাধান হয় না। বরং সময়ের সাথে সাথে সেটা শিকড় গেড়ে যায়। শুরু হয় ভালো লাগা আর ভালোবাসার নতুন অধ্যায়।
(৩)
আজ রবিবার। শিউলির ভার্সিটি খোলা। কিন্তু সকাল থেকে অপেক্ষা করে তার দেখা পাইনি। সে আজ ক্লাসে যায়নি। কিন্তু কেন? কোনো বিপদ আপদ হয়েছে কি? মনটা আনচান করছে।
শিউলির নাম্বার আমার কাছে আছে। ‘ভোরের শিউলি’ লিখে সেভ করে রেখেছি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে আমি নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কল করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কখনো সাহস হয়ে উঠে না। কল করে কী বলব? কী পরিচয় দিব? শিউলি নিশ্চয়ই বখাটে ভাববে আমাকে।
সারাটা দিন শিউলির চিন্তায় গেল। এক সেকেন্ডের জন্য তাকে মন থেকে দূর করতে পারলাম না। বেশ কয়েকবার চার তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করলাম। গেটের কাছে বার কয়েক গেলাম। কিন্তু শিউলির দেখা মিলল না।
রাত তখন গভীর। বারোটা-একটা বাজবে বোধ হয়। হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। আমার ঘুম পাতলা। শব্দ কানে যেতে এক লাফে উঠে পড়লাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমাকে দেখে বললেন,
‘এত রাতে কে এলো?’
আমাদের বাসার সিকিউরিটি ব্যবস্থা ভালো। নিচ তলায় সার্বক্ষণিক একজন পাহারাদার থাকে। তাই অপরিচিত কেউ ভেতরে প্রবেশের কোনো সম্ভাবনা নেই। মা নির্ভয়ে দরজা খুললেন। দেখি, ওপাশে দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত চোখমুখ। তাদের একপলক দেখে বুঝলাম, চার তলার ফ্ল্যাটের। মেসের মেয়েরা। মা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে লিমা? তোমরা এতরাতে?’
লিমা নামের মেয়েটা ঝটপট উত্তর দিল,
‘আন্টি আমাদের সাথে একটু আসুন। গতকাল থেকে শিউলির জ্বর। হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। কিছুতেই কমছে না। ও সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।’
শিউলি নামটা শুনতেই আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৪০(অন্তিম পর্বের প্রথম অংশ)
তাজরীন ফাতিহা
শীতের আমেজ চারপাশে ভালোই বিরাজ করছে। প্রকৃতিতে কেমন শীত শীত গন্ধ লেগে আছে। যখন যে ঋতু শুরু হয় তখন সে ঋতুর ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রে বারি খায় যেন। গ্রীষ্মকালে ঘেমে জবজবে অবস্থা, বর্ষাকালে বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ, শরৎকালে কাশফুল ও মেঘের পেঁজা তুলোর মতো উড়াউড়ি, হেমন্তে ধান উঠানোর ধুম, শীতকালে হাড় কাঁপানো শীত। সর্বশেষে বসন্তে পাখপাখালির কলরব, নতুন পাতা গজানোর আমেজ। প্রত্যেকটি ঋতুই যেন আল্লাহ প্রদত্ত এক অপূর্ব সমাহারের সৃষ্টি। সুবহানাল্লাহ!
ইফরা আজকে ফজর পড়ে আর ঘুমায়নি। ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা খেয়ে সাধারণত একটু ঘুমায় সে। তবে আজকে ঘুমাচ্ছে না। ভার্সিটির শেষ বর্ষে এবার সে। পড়াশোনা রায়হান শেষ করতে বলেছে। ইফরা রাজি ছিল না পড়াশোনা করায় কিন্তু রায়হান বলেছে শুধু পরীক্ষা দিতে। তবুও যেন পড়ালেখাটা শেষ করে। ইফরা আর না করেনি। দেখতে দেখতে তার দাম্পত্য জীবনের প্রায় তিন বছর। আল্লাহ তাকে খুব উত্তম এক নিয়ামত দিয়েছেন। যে নিয়ামতের নাম রায়হান জাইম।
গতকাল রাতে হঠাৎ করেই রায়হান ইফরাকে বলছিল,
“এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে ঋণী কার কাছে জানো?”
ইফরা সরল মনে উত্তর দিয়েছিল,
“আপনার মা, বাবার কাছে।”
রায়হান মুচকি হেঁসে বলেছিল,
“উহু, মা বাবার ঋণ তো কখনোই শোধ করা যাবে না। তাদের নিজ সন্তান আমি। আমার চামড়া কেটেও তাদের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। ওনাদের অস্তিত্ব আমি। কিন্তু আমার আপন না এমন দুইজন মানুষের কাছে আমি চিরঋণী। তুমি তাদের দেখতে চাও?”
ইফরার খুব আগ্রহ জাগলো। সে বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেলো। রায়হান সকাল সকাল রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল তখন। রুদ, রাহমিদকেও রেডি হয়ে থাকার জন্য বলে এসেছিল।
রাতের কথা ভাবতে ভাবতে ইফরা রেডি হয়ে গেলো। রুদও এরমধ্যে তৈরি হয়ে ভাবির কাছে চলে এসেছে। ইফরা রুদকে দেখে বললো,
“রাহমিদ রেডি হয়েছে?”
“জ্বী ভাবি।”
“ভাইয়ু কোথায় ভাবি?”
“তোমার ভাইয়ু কোথায় যেন গেলো। বলেছে তৈরি হয়ে থাকতে। আমাদের এসে নিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা।”
______
—-
“আপনারে না কইলাম ওষুধটা লইয়া ঘরে আসতে। একটা কতাও হুনেন না কেন?”
“আরে কইতরী চেইতা যাইয়ো না তো। তোমার এমনিতেই হাঁপানির সমস্যা। বুড়া হইতেছি তো দুইজনই। এহন আর আগের মতো বল পাইনা শরীরে। আস্তে আস্তে রত বল সব চইলা যাইতেছে।”
জয়নব বেগম নিজেদের ছিড়া কাঁথাটা সেলাই করতে করতে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। আগামী দিন কিভাবে জানে মাবুদ ছাড়া কেউ জানে না। আফজাল হোসেনের শরীরে রোগ বাসা বেঁধে আছে। কবিরাজি চিকিৎসা করিয়ে ওষুধ খেয়েছে। এমনিতে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। মেলা দাম ওষুধের। এখন হোটেলে কেনা বেচাও অতো হয়না। কত নতুন নতুন হোটেল হয়েছে। আফজাল হোসেনের সেই পুরোনো ভাতের হোটেলের কদরও কমেছে।
আফজাল হোসেনের দিকে তাকালে জয়নব বেগমের ভারী মায়া হয়। বেচারা জীবনে বহুত ভালো কাজ করেছে কিন্তু কারো কাছে কোনো মূল্য পায়নি। সারাজীবন বিনে পয়সায় মানুষের সেবাই করে গেছে কিন্তু নিজের সেবার দরকার হলে কাউকে পাননি। যাক আল্লাহ যেমনই রেখেছেন তাদের কোনো অভিযোগ নেই ওই মহান রবের প্রতি। কথাগুলো মনে মনে বলে জয়নব বেগম কাঁথা সেলাইয়ে মনোনিবেশ করলেন।
আফজাল হোসেন স্ত্রীকে চুপ মেরে যেতে দেখে বিছনায় শুয়ে পড়লেন। গলায় মাফলার পেঁচিয়ে খাটের এক কোণে শুয়ে রইলেন। ইদানীং শরীরটা বেশিই খারাপ লাগছে। জয়নব বেগমকে ভয়ে বলেন না। তাহলে চিৎকার চেঁচামেচি করে হাঁপানি উঠিয়ে ফেলবে। তাদের দুই বুড়া বুড়িরই হাঁপানির সমস্যা। কোনদিন যেন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে চলে যেতে হয়। জয়নব বেগমের জন্য তার ভীষণ চিন্তা হয়। সে না থাকলে তার স্ত্রীর কি হবে? এসব চিন্তা ইদানীং মাথায় জোঁকের মতো জেঁকে বসে থাকে।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ আসছে। এইমাত্র বিছানায় পিঠ ঠেকালেন এখনই আবার কার আসতে হলো? আফজাল হোসেন জোরে বলে উঠলেন,
“কে?”
“চাচা আমি দিলদার। দরজাডা একটু খুলেন?”
“তোর এইসময় কি কাজ?”
বলেই আফজাল হোসেন কেশে উঠলেন। দিলদার কোনো কথা না বলে আবারও দরজা ধাক্কালো। জয়নব বেগম বললেন,
আফজাল হোসেন কাশতে কাশতে উঠে দরজা খুললেন। খুলেই বলতে নিলেন,
“তোর আসার আর সময় ছিল না?”
বাকি কথা শেষ করতে পারলেন না দরজার সামনে অপরিচিত কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হলেন। এরা কারা?
রায়হান মুচকি হেঁসে বলে উঠলো,
“আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন?”
আফজাল হোসেন এখনো ঠাহর করতে পারছেন না কিছু। রায়হান আফজাল হোসেনকে তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বলে উঠলো,
“আংকেল চিনতে পারেন নি? আমি রায়হান।”
আফজাল হোসেন অস্ফুট স্বরে বললেন,
“রায়হান!”
“আংকেল আপনার শরীর এমন ভেঙে গিয়েছে কেন? খাওয়াদাওয়া করেন না?”
আফজাল হোসেনের হুঁশ ফিরলো যেন। চেহারায় কেমন অবিশ্বাস ভাব। রুস্তম পিছন থেকে বলে উঠলো,
“চাচা কি অহনো চিনবার পারেন নাই?”
“না পেরেছি। তবে সেই রায়হানের সাথে চেহারার ভীষণ তফাৎ। ভিতরে আসো বাবা।”
রায়হান হেঁসে বললো,
“রুদ, রাহমিদকে মনে আছে আংকেল?”
আফজাল হোসেন হেঁসে বললেন,
“মনে থাকবে না কেন? খুব মনে আছে। তোমার ছোট ভাইয়ের খামচির কথা কি ভুলা যায়। সব ভুললেও সেটা ভুলা সম্ভব না। ওরা কত ছোট ছিল। ওদের দেখলে এখন আর চিনবো না।”
ভাইয়ের পাশ থেকে বারো বছর বয়সী রাহমিদ বলে উঠলো,
“তাহলে চিনানোর জন্য কি আবার খামচি দিতে হবে?”
রুস্তম আর দিলদার হেঁসে উঠলো। আফজাল হোসেন বারো বছরের রাহমিদের দিকে মায়াভরা নজরে তাকালেন। সেই ছোট্ট রাহমিদ কি এইটা? গুলুমুলু গালের এই বালকটাই কি সেই এক বছর বয়সী গুলুমুলু বাচ্চাটা? কতকিছু ভেবে চলেছেন তিনি। রায়হান বললো,
“আংকেল কি ভাবছেন? সেই এক বছর বয়সী বাচ্চাটাই কিন্তু ইনি।”
আফজাল হোসেনের চোখ ছলছল করলো যেন। আগের রায়হান, রুদ, রাহমিদের সাথে বিস্তর ফারাক বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের। উনি স্বাভাবিক হয়ে রায়হানদের ঘরে ঢোকালো। জয়নব বেগম সেলাইরত অবস্থায় দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। স্বামীকে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখে ভাবছিলেন, “কে এলো এই অসময়ে?” অপরিচিত কতগুলো মুখকে ঘরে ঢুকতে দেখে মাথায় শাড়ির আঁচল ভালোভাবে টেনে দিলেন। ছিঁড়ে কাঁথাটা লুকিয়ে রাখলেন ভালো কাঁথার ভাঁজে। আফজাল হোসেন বললেন,
“চিনতে পারো কিনা দেহো তো?”
জয়নব বেগম কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি কিভাবে চিনতে পারবে এদের? এদের কি চিনার কথা তার? এসব ভাবছেন তিনি। রায়হান মুখ খুললো,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
“আন্টি” ডাকটা এর আগেও শুনেছেন তিনি। কিন্তু ওই মুখ আর এই মুখের মধ্যে বিস্তর ফারাক। চেহারা, পোশাকে আভিজাত্যে ভরপুর। রায়হান জয়নব বেগম আর আফজাল হোসেনকে পাশাপাশি বসিয়ে নিজে নিচে বসলো। দুইজনের প্রৌঢ় হাতের ভাঁজে হাত গলিয়ে দুইজনের দিকে তাকালো। অনেক মায়াময় দৃষ্টি ফেলে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
“যখন আমাদের জন্য দুনিয়ার স্বার্থপর মানুষগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ঠিক তখনই মহান রবের অনুগ্রহে দুইজন ফেরেশতারূপী মানুষের আগমন ঘটে আমাদের জীবনে। স্বার্থপর এই দুনিয়ায় আপন মানুষেরাই যখন দু মুঠো অন্ন দিতে কার্পণ্য করেছে তখন তারা একজন নয় দুজন নয় তিন তিনটি মুখের অন্নের ব্যবস্থা করেছিলেন। এইযে আমি রায়হান আজকে এখানে পৌঁছেছি তার পিছনে এই দুইজন মনুষের অনেক অবদান।”
কথাটুকু বলে রায়হানের গলা আটকে গেলো। আগের কিছু স্মৃতি তীব্রভাবে বারি খাচ্ছে মাথায়। থেমে থেমে আবারও বলতে লাগলো,
“যখন আমি তিনটি মুখের খাবারের যোগানই দিতে পারছিলাম না ঠিক তখন আফজাল হোসেন নামক এই মানুষটা আমাকে পড়াশোনা ছাড়তে বাধা দিলো। পড়াশোনা জানা থাকলে একটা না একটা কিছু করে এই পৃথিবীতে টিকতে পারবো অন্যথায় সারাজীবন পস্তাতে হবে এরকম নানা উপদেশ এই মানুষটা দিয়েছিল। আমার এখনো মনে আছে যেদিন ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাই সেদিন রাহমিদকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারছিলাম না। আমার এক বছর বয়সী দুধের ভাই আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। ও আমাকে ছাড়তেই চাচ্ছিলো না। এদিকে আমার পরীক্ষার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তখন এই মানুষটা রাহমিদকে কোলে নিয়ে ওর খামচি খেয়ে হাত থেকে রক্ত বের হলেও পর্বতের মতো অটল ছিল শুধুমাত্র আমি পরীক্ষা যেন ভালোভাবে দিয়ে আসতে পারি সেজন্য।”
রায়হানের চোখ থেকে পানি টপ টপ করে ঝরছে। মাথা নিচু করে আবারও ভাঙা গলায় বলতে লাগলো,
“যেদিন ভর্তিপরীক্ষার রেজাল্ট দিলো সেদিন এই মানুষটার চোখে আমি সত্যিকারের খুশি দেখতে পেয়েছিলাম। আমার কাঁপা শরীর ধরে এই মানুষটা আমাকে ভরসা দিয়েছিল।”
রায়হান কিছুক্ষণ থেমে জয়নব বেগমের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
“এই মানুষটা সম্পর্কে কি বলবো? যখন টিউশনি করাতাম রুদকে তার কাছে রেখে যেতাম। এই মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে রুদকে আগলে রাখতো। ঘরে খাওয়ার কিছু না থাকলে নিজে খাবার দিয়ে আসতো। প্রতিবেশীদের খোঁচা মারা কথার জবাব দিতো। কখনো এই দুই চোখে বিরক্তি দেখিনি। তখন ভাবতাম আল্লাহর দুনিয়ায় এখনো এতো ভালো মানুষ আছে? যাদের আমাদের থেকে পাওয়ার কিছু ছিল না, বিনিময় ছিল না তবুও দিল খুলে এই দুটো মানুষ আমাদের জন্য করেছেন। আপনাদের দুজনের চোখে এতো অবিশ্বাস কেন আন্টি, আংকেল? কেন আপনাদের চোখ দুটো বলছে আপনাদের ভুলে গেছি? আপনাদের কি কখনো ভুলতে পারি আমি?”
কথাগুলো বলে রায়হান আরও ভেঙে পড়লো। ষোড়শী রুদ, বারো বছরের রাহমিদও কাদঁছে। তাদের অতীত মোটেও সুখকর ছিল না। ভাইয়ের মুখে কথাগুলো শুনে স্থির থাকতে পারেনি তারা। ইফরা, দিলদার, রুস্তম ওদেরও চোখে পানি জমেছে।
আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগমের চোখ থেকেও পানি পড়ছে। রায়হান ওনাদের হাত ধরে আবারও বলে উঠলো,
“আপনাদের এই এগারো বছরে অসংখ্যবার মনে পড়েছে কিন্তু আপনাদের সামনে আসতে পারিনি অপরাধবোধে। আপনার মেয়ে আমাদের জন্য শশুরবাড়ি যেতে পারছিল না কথাটি আমাকে আজও ভীষণ পীড়া দেয়। এগারো বছরে কোনো নামাজ নেই যে আপনাদের জন্য দোয়া ছিল না। এই অধমের মাথায় কি একটু হাত বুলিয়ে দিবেন আংকেল, আন্টি?”
রায়হান মাথা বাড়িয়ে বললো। আফজাল হোসেন এবং জয়নব বেগম ইতস্তত করতে করতে হাত বুলিয়ে দিলেন। রুদ, রাহমিদও ভাইয়ের দেখাদেখি মাথা বাড়িয়ে দিলো। তারা ওদের মাথায়ও হাত বুলালেন। রায়হান আফজাল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“একটা আবদার করবো, রাখবেন?”
“বলো।”
“আমাদের সাথে যাবেন। আপনার এই ছেলের কাছে থাকতে আপনাদের সমস্যা আছে?”
“তা হয়না বাবা। তোমাদের দেখেছি এতেই শান্তি। নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে কোথাও যাবো না। এখানেই শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলতে চাই। তুমি আমায় এই অনুরোধ করো না বাবা।”
আফজাল হোসেন আকুল কণ্ঠে বললেন। রায়হান আর কিছু বলতে পারলো না। রায়হান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক আছে। আপনার ইচ্ছে। তবে আপনাদের সাথে প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে নাহয় মাসে মাসে দেখা করার অনুমতি দিতে হবে।”
“আচ্ছা দিলাম।”
রায়হান খুশি হলো। বললো,
“আপনার মেয়ে কেমন আছে আংকেল?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই বাবা। ওর শাশুড়ি তো প্যারালাইজড হয়ে আছে গত পাঁচ বছর হয়। এখন নাকি খালি কাঁদে। তোমাদের কথা অনেকবার বলেছিল। তোমাদের কাছে নাকি মাফ চাইবে। আল্লাহ এতিমদের সাথে খারাপ ব্যবহারের শাস্তি তাকে এই দুনিয়াতেই দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের ক্ষমা করো বাবা। কিছু করার ছিল না তখন। তোমরা মনে অনেক কষ্ট নিয়ে এই বাসা ছেড়েছিলে ভাবলে এখনো আমার খারাপ লাগে।”
আফজাল হোসেন হাত জোর করে মাফ চাইলেন। রায়হান তৎক্ষণাৎ হাত ধরে নিলো। বললো,
“আপনার কোনো দোষ নেই আংকেল। সবই আমাদের ভাগ্যে ছিল। আমি ওসব মনে রাখিনি। আপনাদের বৌমাকে দেখছেন?”
“কোথায়?”
জয়নব বেগম তাড়াহুড়ো করে বললেন। রায়হান ইফরাকে দেখিয়ে দিলো। জয়নব বেগম দেখলেন বোরকা পরিহিত নিকাবে মুখ ঢাকা একজন অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কাছে ডাকলেন। ইফরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। রায়হানের পাশে বসলো। জয়নব বেগম ইফরাকে উঠিয়ে তার পাশে বসালেন। বললেন,
“মাশাআল্লাহ। আল্লাহ তোমাগো সংসারে বরকত দিক। তুমি কি সন্তান সম্ভবা?”
ইফরা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। জয়নব বেগম মাথায় হাত দিয়ে অনেক দোয়া করে দিলেন। বললেন,
“এই অধম মানুষ গুলারে সময় কইরা দেইখা যাইয়ো। এই বুড়ির কাছে কয়দিন থাইকা যাও তোমরা।”
রায়হান বললো,
“আমার বন্ধ নেই আন্টি। আপনাদের দুজনকে কয়েকদিন আমাদের সাথে থাকতে হবে। তাই আজকে এসেছি আপনাদের নিতে। এটা মানা করবেন না। তাহলে ভীষণ কষ্ট পাবো।”
সবাই খুশি হয়ে গেলো। দিলদার রায়হান যে জিনিসপত্র এনেছে সব মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। কয়েকপদের ফলমূল, বিস্কুট, কয়েকদিনের বাজার সব কিছু করে এনেছে রায়হান। সবকিছু নামিয়ে দিলদার চলে যেতে নিলে রায়হান থামলো তাকে। বাইরে নিয়ে এসে কোলাকোলি করলো। রসিকতার স্বরে বললো,
“দিলদার ভাই, আমি কিন্তু এখন বাজার সদাই ভালোই করতে পারি।”
দিলদার লজ্জা পেলো। রুস্তম পিছন থেকে এসে দিলদারের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
“কিরে দিল। আমারে ভুইলা গেছস নাকি।”
দিলদার মুখ গোমড়া করে বললো,
“ভাই আমি বিবাহিত। বউয়ের সামনে প্রেস্টিজ নষ্ট কইরেন না। যেখানে সেখানে টুকা দিয়েন না। পাশের ঘরে বউ আছে।”
দিনগুলো যেন পলকের মধ্যে হারিয়ে যায়। সপ্তাহ, মাস, বছর শেষে আরেকটি বছরের আগমন ঘটে। আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগম আজ সকালেই চলে গেছেন রায়হানদের বাসা থেকে। একমাস তাদের ভীষণ যত্ন নিয়েছে রায়হান। ইফরা, রুদ, রাহমিদের সাথেও তাদের ভালো রকমের একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গেছে। রুদ, রাহমিদের ভীষণ মন খারাপ। ইফরারও খারাপ লাগছে। মানুষের জীবন এক প্রবাহিত চক্র। কেউ থামাতে পারবে না এই জীবনচক্রকে।
রায়হান দুইদিনের জন্য কোথাও যেন যাবে। ইফরা তাই কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিচ্ছে। তার নিজের শরীরটাও ভীষণ দুর্বল ইদানীং। রাতে ঘুমোতে পারেনা। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। পড়াশোনাও করতে পারেনা ঠিক করে অথচ দুই দিন পর এগ্রোনোমি অ্যান্ড হর্টিকালচারের উপর পরীক্ষা। বাবু পেটে আসার পর পড়াশোনায় একেবারই মনোযোগ দিতে পারছে না সে।
রায়হান অবশ্য প্রতিদিন সবাইকে পড়িয়ে নিজের বউকে পড়ানোর মিশনে নামে। রাত হলেই পেটে তেল ম্যাসাজ করে দিয়ে বউকে পড়াতে বসায়। ইফরাকে পড়ানো যেন একটা যুদ্ধের সমান। বেচারা সারাদিন খেটে এসে বউ আর ভাইবোনের আবদার রাখতে গিয়ে আরও কুপোকাত হয়ে যায়।
কলিংবেলের শব্দে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো ইফরা। রাহমিদ দরজা খুলেই ভাইয়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে এখন। ইফরা তার খানিক উঁচু পেট নিয়ে আস্তে করে হেঁটে রুমের দরজার সামনে আসলো। যা ভেবেছিল তাই। রাহমিদ বড় ভাইয়ের গলা ধরে ঝুলছে। রুদও ভাইকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ব্যাগ নিয়ে সোফায় রাখলো।
রায়হান রাহমিদকে জড়িয়ে দরজা বন্ধ করলো। দুই ভাইবোনের মাথায়, কপালে চুমু খেলো। ইফরার দৃশ্যটি দারুন লাগলো। কিছুক্ষণ ভাইবোনের সাথে কথা বলে ব্যাগ নিয়ে রুমে আসলো। ইফরাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে বললো,
“কিগো, আমার আওলাদ দেখি দাঁড়িয়ে আছে।”
ইফরা আস্তে আস্তে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
“আপনার আওলাদ সারাক্ষণ জ্বালায়। আপনার মতো হয়েছে।”
রায়হান ইফরাকে পিছন থেকে জড়িয়ে বললো,
“আমি কি করলাম। কিছু না করেও সবসময় আমাকে দোষী বানাতে ভালো লাগে বিবি সাহেবা?”
“হেই বাচ্চা, মাকে বেশি জ্বালাবে না কিন্তু। বাবা দুইদিন থাকবো না। ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে দুই দিন। ঠিক আছে।”
তারপর বউকে ছেড়ে হাত মুখ ধুতে গেলো। ইফরার খুব সুখ সুখ অনুভূত হয় হয় ইদানীং। তার যে এতো সুন্দর একটা সংসার হবে সেটা জানতোই না কখনো। আল্লাহ তায়ালা উত্তম পরিকল্পনাকারী। মহান রবের প্রতি সীমাহীন শুকরিয়া এতো সুন্দর একটা পরিবার উপহার দেয়ার জন্য।
_____
বাসায় ডাইনিং টেবিল থাকলেও রায়হানরা খাওয়াদাওয়া সবসময় নিচে বসে করে। কারণ নিচে বসে খাওয়া সুন্নত। আধুনিক সময়ে টেবলের বেশ কদর থাকলেও রায়হানের বাসায় টেবিল একটি অবহেলিত বস্তু। পাটিতে গোল হয়ে বসে আছে ইফরা, রুদ, রাহমিদ। সামনে বোলে ভাত আর তরকারি রাখা। রায়হানের জায়গা ফাঁকা। এখনো মুখ ধুয়ে আসেনি সে। রাতের খাবারের জন্য তারা গোল হয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে টুকটাক আলাপ করছে।
রায়হান হাত, মুখ মুছে বসলো তার বরাদ্দকৃত জায়গায়। এখন তার কাজ হলো তিনজনকে খাইয়ে দেয়া। তিন বাচ্চাকে পালতে পালতে তার জীবন শেষ। ইফরা প্রেগনেন্ট হওয়ার পর রান্না মূলত রুদ আর ইফরা মিলেই করে। এতে ইফরার স্বস্তি হয়। আজকে খাবারের মেন্যুতে আছে লইট্যা শুটকি ভুনা, চুই ঝাল দিয়ে হাঁসের গোশত ভুনা, পাতলা ডাল আর গরম গরম সাদা ভাত। শীতকালে এসব দিয়ে ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা। যদিও শীত খানিকটা কমেছে। বসন্ত দরজায় উঁকি দিচ্ছে তবুও শীতের আমেজ কিন্তু এখনো রয়ে গেছে।
রায়হান বোলে ভাত মাখিয়ে প্রথমে রাহমিদকে খাওয়ালো। রুদ আর ইফরা অধির আগ্রহে বসে আছে। রাহমিদের পর রুদকে খাইয়ে শেষে ইফরাকে খাওয়ালো। টুকটাক কথা বলে খাবারের সমাপ্তি ঘটালো তারা।
______
—-
নিজ জন্মস্থান ছেড়ে থাকাটা কলিজায় সূচ নিয়ে হাঁটার মতো। তাও যদি জন্মস্থানে নিজের মা, বাবার খুন হয় এবং কবর থাকে তাহলে তো সেটা আরও কষ্টকর। প্রায় এগারো বছর, ঠিক এগারো বছর পর নিজের শহরে পা রেখেছে রায়হান। এই শহরে অসংখ্য সুখময় স্মৃতি যেমন জড়িয়ে আছে তেমনই বিদঘুটে ভয়ংকর স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। যা তাকে প্রতি রাতে ঘুমোতে দেয়না।
তারপর দু হাত মেলে তাকে ডাকছিল। তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নটি দেখে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল সে। সেদিনই ঠিক করেছিল নিজ শহরে, নিজ জন্মস্থানে একবার হলেও যাবে। কেমন আছে তার বাবা, মায়ের স্মৃতি জড়ানো সেই বাড়িটি? ভাবলেই বুকটা হুহু করে ওঠে।
রুস্তমের ডাকে ভাবনা থেকে বের হলো রায়হান। তারপর দুজন রায়হানের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। এখানের সবকিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর বেড়েছে। এগারো বছরে এতো পরিবর্তন রায়হানকে অবাক করছে।
“সন্ধ্যা ছায়া” বাড়িটার বিশাল গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে রায়হান আর রুস্তম। রায়হান মন ভরে বাড়িটাকে দেখে নিলো। তারপর কি মনে করে মা, বাবার কবরের নিকট গেলো। দেখলো কবরের উপর ঘাস জমে কবর একেবারে সোজা হয়ে গেছে। রায়হান হাঁটু গেড়ে শরীর ছেড়ে বসে পড়লো। কবর দুটি খুব যত্ন নিয়ে ছুঁয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম আব্বু ও আম্মু। ভালো আছেন আপনারা?”
কবর দুটি থেকে কোনো প্রতিত্তর আসলো না। রুস্তমের এতো কান্না পেলো দৃশ্যটি দেখে। সে চোখের পানি আড়াল করতে চাইলো। রায়হান এবার ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
“জানেন আব্বু, আম্মু আমি আপনার আদরের রত্নের কোনো অবহেলা করিনি। ওদেরকে কষ্ট ছুঁতে দেইনি। ওরা না আপনাদের প্রচুর মিস করতো। আমিও করতাম কিন্তু আপনাদের এনে দেয়ার সাধ্য কি আমার আছে বলুন? যে সম্পত্তির জন্য আপনারা আমাদের ছেড়ে আজ এতো দূরে ঐ সম্পত্তির একটা কানা কড়িও আমি এবং আমার ভাইবোন ভোগ করিনি। যেদিন জানলাম আপনাদের হত্যা পূর্বপরিকল্পিত সেদিনই আমি মরে গিয়েছিলাম। যেদিন আপনাদের লাশ বহন করতে হলো সেদিন আরও মরে গিয়েছিলাম। একটা সন্তানের জন্য পিতামাতা উভয়ের লাশ বহন করা কি পরিমাণে কষ্টের তা কি আপনারা জানেন?”
রায়হানের চোখ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। রুস্তম রায়হানের কাঁধে হাত রাখলো। রায়হান আবারও বললো,
“আপনাদের জাইম অনেক বড় হয়েছে আব্বু, আম্মু। আপনারা তো তা দেখতে পারলেন না।”
রায়হান আর বলতে পারলো না। বাধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ পিছন থেকে একজন বলে উঠলো,
“কে? কে ওখানে?”
রায়হান চোখে পানি নিয়েই ঘুরে তাকালো। তার চোখ দুটি ভীষণ লাল। এগারো বছর আগে যে মানুষটির জন্য রায়হান এবং তার ভাইবোন বেঁচে গিয়েছিল আর তার বাবা, মায়ের খুনিদের চিনেছিল সেই বেলায়েত চাচা তার সামনে দাঁড়িয়ে। চাচার শরীর আগের থেকে ভেঙে গিয়েছে। চুল দাড়িতে পাক ধরেছে। বেলায়েত চাচা রায়হানকে চিনলো না। রায়হান চোখের পানি মুছে তার নিকট গেলো। গিয়ে সালাম দিয়ে বললো,
“চাচা আমি জাইম। খন্দকার রাতিব ইকবালের বড় ছেলে খন্দকার রায়হান জাইম।”
বেলায়েত ইসলাম হতভম্ব হয়ে গেলেন। মুখে কোনো রা নেই। যেন পাথর বনে গেছেন। অস্ফুট স্বরে বললেন,
“জাইম!!”
পরক্ষণেই আবার হুঁশ ফিরলে বলতে লাগলো,
“তুমি সত্যই জাইম?”
“জি বেলায়েত চাচা।”
বেলায়েত ইসলামের এবার সত্যিই মনে হলো এটা জাইম। কারণ জাইমই একমাত্র তারে নাম ধরে চাচা ডাকতো। তিনি চোখের পানি ছেড়ে রায়হানকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
“এতদিন কই আছিলা বাপ? তোমগো অনেক খুঁজছি। পাই নাই। তোমগো বাড়িডা কতদিন ধইরা খালি পইড়া আছে। আমি সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িডা পরিষ্কার করায় রাখি। জানি তোমরা আইলে বাড়িঘর অপরিষ্কার না দেহো। কই আছিলা এতদিন? কত বড় হইয়া গেছো!”
“ছিলাম চাচা। আল্লাহ রেখেছেন। বাড়ি খালি পড়ে আছে কেন? ঐ লোভী কুলাঙ্গারের দল থাকে না আমাদের বাড়িতে?”
“না। দুই বছর আগ পইযন্ত আছিলো। তারপর তোমার মেঝ চাচা অ্যাক্সিডেন্টে মইরা গেলো। পোলার শোকে তোমার মেঝ চাচীরে অপয়া কইয়া বুড়িডা বাইর কইরা দিলো। হেরপর তোমার বড় চাচার অবস্থা আরও করুণ। পায়ে ফোড়া হয়ে পুঁজ জমে গেছিলো। হেই পুঁজ থেইকা সারা শরীরে বিষাক্ত পুঁজের দেখা দিছে। ডান হাত তো কাইটা ফেলাইতে হইছে। এতো পরিমাণে হইছিলো হাতে তাই। হাটা, চলা করতে পারতো না। হাগা, মুতা সব বিছানাতেই করতো। এসব দেইখা তোমার বড় চাচী তার মাইয়াগো নিয়া বাপের বাড়ি চইলা গেছে। এসব শুইনা তোমার ফুপির জামাই তারে মারধর কইরা বাপের বাড়ি পাঠায় দিছে ডিভোর্স দিয়া। নিজ সন্তানগো এমন করুণ পরিণতি শুইনা বুড়িডা গেছে মইরা। এহন তোমার ফুপি খালি তোমাগো মা, বাবার কবরের সামনে আইসা কান্দে, মাফ চায়।”
রায়হান স্তব্ধ হয়ে এতক্ষণ কথা শুনছিল। এতো কিছু ঘটে গেছে! বেলায়েত চাচা আবারও বললেন,
“বুঝলা এসবই হইলো হেগো পাপের ফল। পাপ বাপরেও ছাড়ে না একটা কতা আছে না? আল্লাহ হেগো দুনিয়াতেই বুঝাই দিছে দুইটা নিষ্পাপ মানুষরে বিনা অপরাধে মারার শাস্তি কতডা ভয়ানক হইতে পারে। আমি খুব খুশি হইছি শয়তান গুলার শাস্তি হইছে দেইখা। আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যারা তিনডা পোলাপানরে এতিম করছে তাগো বিচার যেন নিজ চোক্ষে দেইখা যাইতে পারি। আল্লাহ কবুল করছেন আমার দোয়া। তোমাগো বাড়ি তো এহন খালি। হুনো, বাড়িতে চইলা আসো। আর কোনো ঝামেলা নাই।”
“না চাচা, আমি ওখানে শিক্ষকতা করি। আমার সব কিছু ফেলে আসা সম্ভব না। তবে আমি মাসে মাসে আসার চেষ্টা করবো।”
“ও আইচ্ছা। তোমার ভাইবোনরে আনো নাই?”
“না। ওদের নিয়ে আসবো এখন থেকে। ভেবেছিলাম বাড়িতে ঢুকতে পারি কিনা? তাই ওদের আনি নি।”
“তুমি আইজকা থাকবা?”
“এসেছিলাম তো বাড়ি বুঝে নিতে কিন্তু মহান রব তো আগেই আমার বাড়ি সুরক্ষিত রেখে দিয়েছেন তাই থাকবো না। ওদের নিয়ে এসে একেবারে থাকবো।”
“আইচ্ছা। তয় মুখে কিছু দিয়া যাইতে হইবো কিন্তু।”
_______
—-
“সন্ধ্যা ছায়া” নামক বাড়িটা কেমন ঝলমল করছে। ঠিক এগারো বছর আগে যেমন পাঁচজনের হাসিখুশিতে বাড়িটি হেঁসে উঠতো ঠিক তেমনই আজকেও বাড়িটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেন। রাহমিদ তো ঘরের ভিতর এই প্রথম সিঁড়ি দেখেছে। এটা নাকি ডুপ্লেক্স বাড়ি। উপরে কতগুলো রুম। আবার নিচেও রুম। তার কাছে এগুলো নতুন। তার কেমন শান্তি শান্তি লাগছে বাড়িটাতে। ভাইয়ু বলেছে এটা নাকি তার নিজের বাড়ি। এখানে যা খুশি তাই করা যাবে।
রুদের মনে হচ্ছে, এই বাড়িটি তার খুবই পরিচিত। এই বাড়িতে সে আগেও থেকেছে। কেমন ঝাপসা ঝাপসা কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে যেন। সে বাড়িটির সব কিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।
ইফরা জার্নি করাতে উপরের ঘরে শুয়ে ছিল। তারপর রাহমিদ, রুদের উৎফুল্লতায় নিচে নেমে এসেছে। উপরে একা একা বোরিং লাগছিল তার। এখন রুদের সাথে গল্প করছে।
রায়হান কোথা থেকে এসে যেন বললো,
“চলো সবাই। আমার মা, বাবার কবর জিয়ারত করে আসি। ইফরা আর রুদ দূরে দাঁড়িয়ে দোয়া করবে আর আমি ও রাহমিদ কবরে ফুল গাছ লাগিয়ে দোয়া করবো।”
রায়হান অনেকগুলো ফুল গাছের চারা এনেছে। সবাই মিলে কবর জিয়ারত করলো। রাহমিদ, রুদ তো কেঁদেই দিলো। তাদের মা, বাবার কবর এই দুটো। রাহমিদ কবর ছুঁয়ে অনেকক্ষণ কবরের উপর শুয়ে ছিল। বাচ্চা মানুষ। রায়হান জোর করেও উঠাতে পারেনি। যেহেতু মহিলাদের কবর জিয়ারত উচিত না তাই রুদ আর ইফরা দূরে দাড়িয়েই দোয়া পড়েছে। যতক্ষণ তারা কবরের কাছে ছিল ততক্ষণ ইফরা, রুদ, রাহমিদ, রায়হান সবারই মন খারাপ ছিল। বাসায় এসেও মন আর ঠিক হয়নি। মা, বাবা তো সবার কাছেই ইমোশন।
_____
—
“সন্ধ্যা ছায়ায়” আজ গরীব, এতিম, মিসকিনদের চাঁদের হাট। রায়হান মা, বাবার জন্য দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত করে তাদেরকে খাওয়ানোর নিয়ত করেছিল। বিরাট ডেকচিতে পোলাও, কোরমা, খাসির রেজালা, গরু ভুনা হচ্ছে।
রাহমিদ এতিম বাচ্চাগুলোর সাথে খেলছে। সে আর রায়হান সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মা, বাবার কবরের পাশে কুরআন পড়ে দোয়া করেছে। এখন সে একবার বাবুর্চিদের রান্না দেখে আবার বাচ্চাগুলোর সাথে খেলাধুলো করে। খুব আনন্দিত আজকে সে।
ইফরা আর রুদ কুরআন পড়া শেষ করে নিচে নামলো। পুরুষ লোকের আনাগোনা দেখে আবারও উপরে চলে গেলো। রায়হান বাবুর্চিদের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে।
আজকে আরও অনেকে জড়ো হয়েছে “সন্ধ্যা ছায়া” বাড়িটায়। আফজাল হোসেন, জয়নব বেগম, তাদের মেয়ে আয়শা ও তার পুত্র এবং স্বামী, দিলদার, রুস্তম, তাদের বউ সবাই এসেছে। মূলত রায়হানই কাল রাতে তাদের এনেছে
রুস্তম, দিলদার, রায়হান, আফজাল হোসেন আর তার মেয়ের জামাই সবাই টুকটাক আলাপ করতে করতে কাজ করছে।
__
বাড়ির সামনে খোলা উঠোনে পাটি, চাদর বিছিয়ে পুরুষ সবাইকে নিয়ে খাওয়া শেষ করলো রায়হান।
মহিলারা সবাই বাড়ির মধ্যে। রায়হান তার চাচা আর ফুপুকে খাবার দিয়ে এসেছে। সে আর যাই হোক জালিম তো আর না। শুনেছে তারা খুব দুঃখে দিন পার করছে। এছাড়াও তার ফুপি সেদিন তার পায়ে ধরে মাফ চাচ্ছিলো। সে তৎক্ষণাৎ তাকে উঠিয়ে দিয়েছিল। সে তাদের ক্ষমা করলেও মহান রবের কাছে তারা আজীবন অপরাধীই থেকে যাবে। তাই নিজের হাতেই খাবার দিয়ে এসেছে।
খুব আনন্দে, আয়োজনে দিনটি শেষ হলো সবার।
_____
—–
রায়হান বিরাট এক পেন্ডুলাম ঘড়ি নিয়ে এসেছে আজ। ঘড়িটায় ঘণ্টার কাটা পড়লেই ঢং ঢং করে বাজতে শুরু করে। ঘড়িটার আওয়াজ বাহির পর্যন্ত যায়। তাই নিজেদের হলরুমে ঘড়িটা লাগিয়ে দিয়েছে রায়হান। যাতে তারা চলে গেলেও বাসাটা ফাঁকা ফাঁকা মনে না হয়।
রায়হান আজকে রাতে সবাইকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে বসবে বলে পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু ইফরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ইফরার সারা শরীর ফুলে গেছে। প্রেগন্যান্সির সময়ে এরকম হয়। রায়হান প্রতিদিন সকালে ও রাতে ইফরার হাত, পায়ে তেল ম্যাসাজ করে দেয়।
রাত বাজে এখন একটা। রাহমিদ আর রুদকে উঠিয়ে নিচে নামলো রায়হান। ইফরার শরীর অসুস্থ থাকায় আর সিঁড়ি ভেঙে তাকে নিচে আনেনি রায়হান। দশটা বাজলেই ইফরা ঘুমে কুপোকাত হয়ে পড়ে।
রাতের আধারে “সন্ধ্যা ছায়া” নামক বাড়ি থেকে বের হলো তিনজন। বাড়ির বিশাল উঠোনের মাঝখানে চাদর বিছিয়ে বসে পড়লো রায়হান, রুদ আর রাহমিদ। রায়হান মাঝখানে। রাহমিদ ও রুদ তার দুই পাশে। রাতে হালকা শীত পড়ে দেখে চাদর নিয়ে এসেছে রায়হান। এখন সেই চাদরের নিচে রায়হান তার দুই ভাইবোনকে জড়িয়ে গল্প করছে। হঠাৎ রুদ জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“ভাইয়ু জানো, আল্লাহ রাসূলের পর আমরা সবচেয়ে বেশি কাকে ভালবাসি?
রায়হান বললো,
“কাকে?”
দুইজন একসাথে বলে উঠলো,
“তোমাকে।”
রায়হান জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”
রুদ ভাইয়ের ঘাড়ে মাথা দিয়ে বলতে লাগলো,
“এর কোনো ব্যাখ্যা নেই ভাইয়ু। আমার কিংবা রাহমিদ উভয়ের কাছে তুমি অনেক স্পেশাল। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া তোমার মতো ভাই আমাদের উপহার দেয়ার জন্য। মানুষ নাকি বাবা, মায়ের ঋণ শোধ করতে পারেনা কখনো। কিন্তু আমরা বাবা, মায়ের পাশাপাশি তোমার ঋণও কখনো পরিশোধ করতে পারবো না। তোমাকে আমরা কারণ ছাড়াই ভীষণ ভালবাসি ভাইয়ু।”
দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকালো রায়হান। মহান রবের কাছে সকল কিছুর জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রায়হানের মনে হলো আসমান থেকে আল্লাহ বলছেন,
“সব কিছুর হিসেব ঠিকঠাক মতো হয়েছে তো? অতএব তোমরা (জ্বীন ও মানবজাতি) তোমাদের রবের কোন নিয়ামত ও অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?”
দূর থেকে পেন্ডুলামের আওয়াজ ভেসে আসছে। রায়হান দু’চোখ মুদে ফেললো। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে আসলো,
শীতের আমেজ চারপাশে বিরাজ করছে। আকাশে হালকা রোদ উঁকি মারছে। মেঘের কারণে সূর্য ছেয়ে আছে। মেঘ আর রোদের দারুন লুকোচুরি খেলা চলছে। রায়হান জ্যাকেট গায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মনটা তার বিষন্নতায় ঘেরা। আজকে তিনদিন হলো ইফরার কোনো খোঁজ নেই। বিষন্ন মনে রায়হান আকাশের দিকে তাকিয়ে রবের উদ্দেশ্যে নানা কথা বলে চলছে। প্রতিদিন যেই কথাটা রবকে উদ্দেশ্য করে সবচেয়ে বেশি বলে তা হলো,
“আল্লাহ আমাকে স্বস্তি দাও।”
এর মধ্যেই বাসার দরজা কে যেন পিটিয়ে উঠলো। রায়হানের ধ্যান ভঙ্গ হলো যেন। মন খারাপি নিয়েই দরজা খোলার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো। রাহমিদ এর মধ্যেই দরজা খুলে দিয়েছে।
এই তিনদিন বাড়ির সবচেয়ে আশ্চর্যকর বিষয় ছিল সবাই চিন্তিত থাকলেও রাহমিদ ছিল রিল্যাক্স। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, স্কুলে গিয়েছে আবার খেলাধুলাও করেছে। রুদ প্রায়ই সন্দেহের নজরে তার দিকে তাকিয়েছে। বোনকে তাকাতে দেখলেই খানিক দুঃখী দুঃখী ভাব আনার চেষ্টা করেছে। ইফরার দাদি তো বলেই বসেছেন,
“এই ছোট্টডার মইধ্যে চরম ঘাপলা আছে। ওয় আমার সোনার নাতিনডারে আবার ভাগাইয়া দেয় নাই তো? ওর নজরও কেমন যেন। ছোডো হইলে কি হইবো? নজর তেমন সুবিধার লাগে না। কেমন নষ্ট নষ্ট।”
রাহমিদ তো এই কথা শুনে রেগে বোম হয়ে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিল,
“আমার নজর নষ্ট মানে? আমি আপনার কোথায় নজর দিয়েছি যে এরকম কথা বললেন। হ্যাঁ, আপনার সোনার নাতিনকে আমিই ভাগিয়েছি। বেশ করেছি। আরও ভাগাবো। আসার পর থেকে খালি খুঁচিয়েই যাচ্ছে। যেন আমি তার কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি। হুহ!”
রাহমিদের কথা শুনে দাদি থতমত খেয়ে গিয়েছিল। দাদি নষ্ট নজর বলতে খারাপ কিছু মিন করেননি। ইফরা চলে যাওয়ায় রাহমিদকে রিল্যাক্স হয়ে ঘুরতে ফিরতে দেখে বলেছেন ওকে রাগাতে। এই বিচ্ছুর সাথে তার ঝগড়া করতে ভালোই লাগে। একটু বিনোদন পাওয়া যায়। তাই বাচ্চাটাকে খোঁচায় সে। এতে ইফরার কথা সাময়িক ভুলতে পারে।
______
রায়হান ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো রাহমিদের ফিসফিস কণ্ঠে। দরজা খুলে মাথা হালকা বের করে কার সাথে যেন নিচু কণ্ঠে কথা বলছে। রায়হান এগিয়ে গিয়ে রাহমিদকে সরিয়ে দেখলো বোরকা পরিহিত তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। রাহমিদ কাঁচুমাচু করছে। রায়হান স্বাভাবিক হয়ে জানতে চাইলো,
“কাকে চাচ্ছেন?”
বোরকা পরিহিত একজন বলে উঠলেন,
“আপনার বউকে দিতে আসলাম।”
রায়হান চমকে উঠলো যেন। বিদ্যুত খেলে গেলো যেন তার পুরো শরীরে। কথাটার মানে বুঝে উঠতে সময় লাগলো তার। তাই আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললেন?”
বোরকা পরিহিত নারীটি আবারও বলে উঠলেন,
“কিছু বলছি না। দেখে নিন।”
বলেই পিছন থেকে বোরকা পরিহিত একজনকে টেনে রায়হানের দিকে ঠেলে দিলো। রায়হান এখনো বুঝে উঠতে পারছে না কিছু। রাহমিদ পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,
“আরে ভাইয়ু ওনাদের বসতে দাও। ভাবির আত্মীয় হবেন মনে হয়।”
ভাবি কথাটা রায়হানের কানে ঝিঁঝিঁ করে বাজছে। রাহমিদ ভাইকে ধাক্কা দিলো। ছোট ভাইয়ের ধাক্কায় রায়হান ভাবনা থেকে বেরিয়ে ওনাদের ভিতরে বসতে বললো। তিনজনই ভিতরে ঢুকে গেলো। কারো দিকে না তাকিয়ে রায়হান নিজের রুমে চলে গেলো। রাহমিদ ভাইকে চলে যেতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ইফরাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“এতোদিন কোথায় ছিলে ভাবি? ভাইয়ু ভীষণ রেগে আছে তোমার উপর।”
ইফরা নড়েচড়ে উঠলো। ঢোক গিলে বলে উঠলো,
“বেশি রেগে আছে নাকি?”
“ভীষণ ভীষণ রেগে আছে। ভাইয়ু এই কয়দিন তোমার বিরহে কাতর হয়ে গিয়েছে। আমাদের সাথেও আগের মতো কথা বলেনি। যদি কোনভাবে জানে আমি আছি তোমার চলে যাওয়ার পিছনে আমাকে সুদ্ধ বাসা থেকে বের করে দিবে। এখন বিরাট ভয়ে আছি।”
কথাটি শেষ হতেই কেউ তার কান টেনে ধরলো। বলে উঠলো,
“আমি বুঝছিলাম এইডা বহুত সেয়ানা। মাগো কিছু কইলেই ছ্যাত কইরা উঠতো। তোর চোরা নজর দেইখাই আন্দাজ করছিলাম কিছুতো একটা গড়বড় করছস। মাগো মা পিচ্চির বুদ্ধি কত?”
“শুধু আমার দোষ ধরছেন কেন? আপনার নাতিন আমার মতো পিচ্চির কথা শুনেছে কেন? আমাকে হেনস্থা করতে সারাক্ষণ খালি ওত পেতে থাকেন নাকি?”
দাদির হাত থেকে ছাড়া পেয়েই রাহমিদ ভোঁ দৌড় দিয়ে অন্যপাশে চলে গেলো। রুদ এতক্ষণ বাথরুমে ছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সবার এমন চিৎকার চেঁচামেচি দেখে বুঝে উঠতে পারলো না কিছুই। ইফরা এতক্ষণে নিকাব উঠানোর স্কোপ পেলো। নিকাব উঠিয়ে খাটের পাশে রাখলো। এখন তারা সবাই রাহমিদ, রুদের রুমে অবস্থান করছে। দাদি ছিল রায়হানের রুমে নামাজে। সেখান থেকেই আওয়াজ পেয়ে নামাজ শেষ করে দ্রুত উঠে এসেছে।
যেহেতু রুম মাত্র দুইটা তাই ইফরার মা, বাবা যেদিন এসেছিলেন সেদিনই চলে গিয়েছেন। দাদি ইচ্ছে করেই থেকে গিয়েছেন। তার কথা হলো, নাতনিকে না পাওয়া পর্যন্ত সে এক পাও নড়বে না।
রুদ ভাবিকে দেখে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ইফরাও রুদকে জড়িয়ে ধরলো। দাদি এটা দেখে বলে উঠলেন,
“আমি যে সামনা খাড়াই আছি তুই তো আমারে পাত্তাই দেস না। ও দেবর, ননদ পাইয়া এই বুড়িরে ভুইলা গেছস?”
ইফরা উঠে এসে বললো,
“তোমারে ভুলতে পারি? তুমি ছাড়া আমার আছে কেডা বুড়ি?”
“হইছে হইছে আর ঢং করোন লাগতো না। বোরকা, হিজাব খুল।”
“রুমে গিয়ে খুলবো। দাদি এরা আমার বান্ধবী ফিহা আর ফিহার খালা। ফিহার বাসায় এই তিনদিন ছিলাম।”
এতক্ষণ যে রুমে তারা ছাড়াও আরও দুইজন আছে তা ভুলেই গিয়েছিল সবাই। দাদি দুজনের হাত ধরে বললো,
“তোমগো অনেক অনেক শুকরিয়া। আমার অবুঝ নাতিনডারে ফিরাইয়া দেওনের লাইগ্যা।”
ফিহা হাসিমুখে বললো,
“আরে না দাদি। আমরা কিছুই করিনি। সবই উপরে যে বসে আছেন তার ইশারা। আমরা তো স্রেফ উছিলা মাত্র। আপনার নাতিনকে আপনাদের হেফাজতে রেখে গেলাম। দেখে রাখবেন। আমরা এখন উঠবো।”
ইফরা বললো,
“এখনই উঠবি কেন? কিছু মুখে দিয়ে যা।”
ফিহা দাঁড়িয়ে বললো,
“নারে সময় হবে না। অন্য একদিন আসবো। এখন আসি।”
“এরকম খালি মুখে যাবি? আমার খারাপ লাগছে।”
ইফরার দাদিও বলে উঠলেন,
“কিছু খেয়ে যাও।”
ফিহা বললো,
“না দাদি। সময় নেই। আসি। আল্লাহ হাফেজ।”
অনেক জোরাজোরি করেও ফিহাকে রাখা গেলো না। সবাইকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো তারা। দাদি এবার ইফরার দিকে ফিরে বললো,
রুদ রাহমিদের কালো মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে দিলো।
_______
——
অনেকক্ষণ ধরেই ইফরা তাদের রুমে দাঁড়িয়ে আছে। রায়হান বারান্দায় দাঁড়ানো। সে কিছুতেই রায়হানের সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না। হঠাৎ করে রায়হানকে ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ পর সামান্য কেশে উঠলো সে। রায়হান তারপরও আসলো না। এবার আগের থেকে জোরে কাশি দিলো ইফরা। রায়হান বারান্দা থেকে রুমে আসলো। এসেই কোনোদিকে না তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
ইফরা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার উপর কি খুব বেশিই রেগে আছে? ইফরা আস্তে আস্তে রায়হানের পায়ের কাছে বসলো। রায়হান উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। ইফরা চট করে রায়হানের পা ধরলো। রায়হান হুড়মুড় করে উঠে বসলো। ইফরা তাও পা ছাড়লো না। মুখ নিচু করে পা আঁকড়ে ধরেই থাকলো। রায়হান ঝট করে বলে উঠলো,
“আশ্চর্য পা ধরেছেন কেন? পা ছাড়ুন।”
রায়হান ইফরার থেকে তার পা ছাড়িয়ে আনলো। বললো,
“এখানে এসেছেন কেন? আমি তো খারাপ। এই খারাপ মানুষটার সাথে থাকতে সমস্যা হবে না? নাকি দুঃখ পেতে এসেছেন?”
ইফরা একটা চমকপ্রদ কাজ করে ফেললো। লজ্জার মাথা খেয়ে সোজা রায়হানকে জড়িয়ে ধরলো। মুখে তার কোনো কথা নেই। রায়হান এতোটাই চমকালো যে কথা বলতেই ভুলে গেলো। যে ইফরা একদিন বলেছিল তার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ না করতে সেই ইফরাই কিনা তাকে জড়িয়ে ধরেছে? ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না তার। ইফরা অনেকক্ষণ পর আস্তে করে বলে উঠলো,
“মাফ করে দিয়েন। আপনাকে না জানিয়ে চলে যাওয়ায় অন্যায় করেছি। ক্ষমা চাচ্ছি।”
রায়হানের মন গললো যেন। সেও ইফরাকে বুকে টেনে বললো,
“দোষটা তো আপনার না। দোষী হলাম আমি। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি নিজের অজান্তেই। এই অধমকে কি ক্ষমা করা যায়?”
ইফরা রায়হানের বুকে মিশে গিয়ে বললো,
“যায়। ক্ষমা না করলে শয়তান খুশি হবে। আমি কিছুতেই শয়তানকে খুশি হতে দেবো না। আমাদের মধ্যে এখন থেকে আর কোনো দুরত্ব থাকবে না। স্বামী, স্ত্রীর মাঝে যত দুরত্ব বাড়বে শয়তান তত তাদের ছাড়াছাড়ি করাতে পারবে। আমি আপনার মতো মহৎ মানুষকে কিছুতেই হারাতে চাইনা।”
ইফরা রায়হানকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো। রায়হান বুঝে উঠতে পারছে না যে ইফরা সবকিছুতে শয়তানকে কেন টানছে? যাইহোক ইফরা আর তার মাঝে দুরত্ব মিটে গেলে তো ভালোই। আলহামদুলিল্লাহ। রায়হান ইফরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলো,
“আপনি আমার তাহাজ্জুদের সঙ্গী হবেন? হবেন আমার ইহকাল পরকালের সুখ দুঃখের সাথী? হবেন কি আমার চক্ষুশীতলকারিণী?”
ইফরা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললো,
“হবো। সাথে রুদ, রাহমিদের যোগ্য ভাবিও হবো। আপনি কিন্তু আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না। আমি বাদে অন্য নারীর দিকে ভুলেও তাকাবেন না। আপনি আমার মানে একান্তই আমার। আমার একান্ত বলার ছোটবেলা থেকে কেউ ছিল না। আপনি কি আমার একান্ত বলা মানুষটা হবেন?”
রায়হানকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ফোঁপাতে লাগলো ইফরা। রায়হান ইফরার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
“হবো। আমি রায়হান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমার বউয়ের নামে নিজেকে লিখে দিলাম। যাতে বিচারের দিনে আমার বউ আমার চরিত্রের উত্তম সার্টিফিকেট দিতে পারে। এবার ঠিক আছে?”
ইফরা কান্নার মাঝেই মুচকি হেঁসে বললো,
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
চলবে…..
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৯
তাজরীন ফাতিহা
চারদিক সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। ইফরা রান্নাঘরে পোলাও, রোস্ট, গরুর গোশত কষা, ফিরনী রান্না করছে। তার সাথে হেলপিং হ্যান্ড হিসেবে আছে রায়হান, রাহমিদ আর রুদ। রাহমিদ পাতিলে করে পানি এনে দিচ্ছে। বেচারা বয়সে ছোট হওয়ায় পানি আনতে হিমশিম খাচ্ছে। রুদ থালাবাসন এগিয়ে দিচ্ছে, ধুয়ে দিচ্ছে, কোনো কিছু লাগলে এগিয়ে দিচ্ছে। রায়হান রোস্ট আর গরুর গোশত রান্না করেছে। ইফরা শুধু পোলাও আর ফিরনী রাঁধবে।
রায়হানরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে গত মাসে। আগের বাসাটা তাদের থাকার জন্য যথেষ্ট ছোট ছিল। মেহমান আসলে তাদেরকে থাকতে দেয়া যেতো না। এছাড়াও রাহমিদ বড় হচ্ছে। দেবর ভাবির মধ্যে যেন দুরত্ব থাকে সেজন্য রায়হান বাসাটা চেঞ্জ করেছে। এখন চার রুমের একটা বাসা নিয়েছে।
রায়হানের জন্য আরেকটি সুখবর ছিল দুইমাস আগে একটা সরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কলেজ আর কোচিংয়ে বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পড়িয়ে তবেই বেচারা বাসায় ঢুকতে পারে। এই দুই জায়গা থেকে মোটামুটি একটা ভালো অ্যামাউন্ট পায় রায়হান। আলহামদুলিল্লাহ ভালোই দিনকাল চলছে তার। এখন আর অভাব, অনটন তাকে ছুঁতে পারেনা। একটু ভালোমন্দ খাওয়ার জন্য রায়হান ও তার ভাইবোনের আহাজারি, লুকায়িত কান্না এখন সবকিছু ধোঁয়াশা।
আজকে ইফরার খালামণি তাদের বাসায় আসবে। এই খালা রায়হানের সাথে তার বিয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল। রায়হানের মতো এরকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার এরকম নানা কথা বলে ইফরাকে রাজি করিয়েছিল সে। উনি মাদ্রাসার একজন শিক্ষিকা। কথাবার্তায় ভীষণ স্মার্ট তিনি। বয়স হলেও কথাবার্তা এখনো বাচ্চাদের মতো।
ইফরা গতকাল রায়হানকে বলেছে যেহেতু খালামণি আসছে সেহেতু কয়েকজন এতিমদের দাওয়াত দিয়েন। রায়হান মাথা নেড়ে সায় জানিয়েছে। তারা প্রত্যেক মাসের শেষেই এরকম গরীব, এতিম, অনাথদের ডেকে এনে ভালোমন্দ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। এতিমদের প্রতি সদয় হলে আল্লাহ তায়ালা ভীষণ খুশি হন। আল্লাহ যেহেতু তৌফিক দিয়েছেন তাই সাধ্য মতো তাদের জন্য করার চেষ্টা করে। এতে হাতে টান পড়লেও রায়হান কখনো তাদেরকে খাওয়ানোতে পিছপা হয়না।
রাহমিদ, রুদ প্লেট বের করে ধুয়ে সাজাতে গেছে। এখন রান্নাঘরে শুধু রায়হান আর ইফরা। রায়হানের অবশ্য রান্না শেষ। শুধু ইফরার রান্না বাকি। ইফরা পাতিলে ঘি দিয়ে পিঁয়াজ কুচি, এলাচ, তেজপাতা, লবঙ্গ, কিছুক্ষণ ভেজে পোলাওয়ের চাল দিয়ে কিছুক্ষণ চালটাকে ভেজে আদা বাটা আর রসুন বাটা দিয়ে আবার কিছক্ষণ ভাজলো। এরপর পানি আর লবণ দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখে দিলো। ইফরা হাত ধোয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো রায়হান মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। ইফরা হাত ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করলো,
“জাইম সাহেবের মুখ কালো কেন?”
“এই অবস্থায় তোমাকে রাঁধতে নিষেধ করেছিলাম। রাতে মাথা ব্যথা হলে আবার বইলো?”
ইফরা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে জবাব দিলো,
“ওমা ব্যথা হলে বলবো না। আপনার ব্যথা হলে আপনি বলেন না বুঝি?”
রায়হানের বলার ভঙ্গিমা দেখে ইফরার হেঁসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। ইফরা এখন আর গম্ভীর হয়ে থাকে না। রাগও কমে এসেছে। তবে রগচটে ভাবটা এখনো আছে। ইফরা বললো,
“আপনি গোসল করে রেডি হয়ে নিন, যান।”
“না তোমার রান্না শেষ হলে যাবো।”
ইফরা পোলাও নাড়া দিতে দিতে বললো,
“আমার রান্না শেষ হলে তো আমিই গোসলে ঢুকবো। তখন কি সিরিয়াল ধরবো নাকি?”
“সিরিয়াল ধরবো কেন? একসাথে গোসল করবো। স্বামী, স্ত্রী একসাথে গোসল করা সুন্নত।”
ইফরা খুন্তি উঠিয়ে বললো,
“যাবেন নাকি বারি খাবেন?”
“যাচ্ছি তো। ওটা দেখানোর মানে কি? কিছু হলেই রাগ দেখায় খালি। আমি ভয় পাই নাকি?”
“তাই, ভয় পান না?”
রায়হান থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললো,
“মোটেও না। স্ত্রীর কাছে ভয় পাওয়ার কি আছে? ভয় পায় তো কাপুরুষরা, আমি তো বীরপুরুষ।”
রায়হান গেঞ্জির কলার ধরে একটু ভাব নিয়ে বলতে চাইলো। যেইনা চুলে হাত দিয়ে আরেকটু স্টাইল নিতে যাবে অমনি ইফরা বলে উঠলো,
“তা কিছু সুন্নতের নাম বলুন? আপনার তো সুন্নত সম্পর্কে অনেক ধারণা।”
ইফরা পোলাও নামিয়ে ফিরনী নাড়তে নাড়তে কথাটি বলে উঠলো। রায়হান মুখ কাচুমাচু করে বললো,
“বলতেই হবে।”
“ইয়েস।”
“আচ্ছা বলছি। খাবার আগে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত, বসে পানি পান করা সুন্নত, পানির পাত্রে নিশ্বাস না ফেলা সুন্নত, মেসওয়াক করা সুন্নত, চেনা অচেনা সবাইকে সালাম দেয়া সুন্নত, শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য সবাইকে ভালোবাসা সুন্নত, স্বামী স্ত্রী এক পাত্রে পানি পান করা সুন্নত, চার বিয়ে করা সুন্নত।”
শেষ কথাটা রায়হান ইচ্ছে করেই বলেছে ইফরার রিয়েকশন দেখতে। ইফরা খুন্তি নাড়ানো থামিয়ে চোখমুখ শক্ত করে রায়হানের দিকে তাকালো। রায়হান তা দেখে বললো,
“আরে রাগ করছো কেন?”
“হাজার হাজার সুন্নত থাকতে আপনার চার বিয়ের সুন্নত টানতে হবে কেন? কত সুন্নতের গাফিলতি করেন তার বেলায় কিছু না। যেই চার বিয়ের কথা ওঠে অমনি চোখমুখ চিকচিক করে, জিব্বা লকলক করে তাই না?”
“বোম ফাটে মানে? আপনাকে কথা বলতে নিষেধ করেছি? উল্টো পাল্টা কথা বলে আমাকে রাগিয়ে দেন কেন?”
“উল্টো পাল্টা কি বললাম আবার? থাক রাগ করো না। আমি বরং গোসলে যাই।”
রায়হান বুঝেছে বেশিক্ষণ থাকলে তার কপালে দুঃখ আছে। তাই আগেভাগেই কেটে পড়তে চাইছে। ইফরা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কেন আমার সাথে গোসল করবেন না?”
“না। আমার দেরি হবে তাহলে। যোহরের আযান দিচ্ছে। আমি যাচ্ছি।”
কথাটি বলেই রায়হান একরকম দৌঁড়ে পালালো। বেশিক্ষণ থাকলে তার সাথে যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারতো। জীবন বাঁচানো ফরজ।
______
রুদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে । মাত্রই গোসল করে বের হলো সে। এরমধ্যেই রাহমিদ বাথরুম থেকে চিল্লিয়ে ডেকে উঠলো,
“আপুনি.. ই… ই।”
“কি হয়েছে? চেঁচাচ্ছো কেন?”
“আরে গামছা দিয়ে যাও।”
“চড়িয়ে তোমায় লাল করে ফেলবো। বড় হচ্ছো নাকি ছোট হচ্ছো দিন দিন? এখনো তোয়ালে নিয়ে ঢুকো না কেন?”
“উফ দাও না আপুনি।”
রুদ তোয়ালে নিয়ে রাহমিদকে দিলো। রুদ ফ্যান ছেড়ে চুল শুকাতে লাগলো। রাহমিদ তোয়ালে পড়ে বের হয়েছে কাঁপতে কাঁপতে। ভালোই শীত পড়েছে ইদানীং। রুদ সোয়েটার জড়িয়ে চুল মেলে বসেছে দ্রুত চুল শুকানোর জন্য। রাহমিদ ফ্যান ছাড়া দেখেই চিল্লিয়ে উঠলো,
“এটা কেমন ভাষা তোমার? কুত্তা মরা কি? এসব কোথা থেকে শিখেছো তুমি?”
রাহমিদ মুখ কালো করে ফেললো। বললো,
“ওই আমার বন্ধুরাই তো মাঝে মাঝে বলে।
“তোমার বন্ধুরা বলবে দেখে তুমিও বলবে? এসব ওয়ার্ড আর যেন ইউজ করতে না দেখি।”
“আচ্ছা রে বাবা। এবার ফ্যান বন্ধ করো।”
“দাড়াও চুলটা একটি শুকাতে দাও।”
“ধুরু। অন্যরুমে যে যাবো তাও পারছি না। ভাবির সামনে প্রেস্টিজ পাঞ্চার হয়ে যাবে নাহলে।”
রুদ মুখ ঘুরিয়ে হাসলো। ভাইটা তার বড় হয়ে যাচ্ছে। সেই ছোট্ট গুলুমুলু বাচ্চা থেকে এখন দশ বছরের বালক। আগের মতোই গুলুমুলু আছে। কথাগুলোও কিউট কিউট। রুদের আদরের ভাই। বড় ভাইয়ের কলিজা।
রুদ উঠে রাহমিদের জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসলো। গেঞ্জি পড়িয়ে দিলো। রাহমিদ প্যান্ট পড়লো। টাখনুর উপরে প্যান্ট গোটালো। রুদ জ্যাকেট পড়িয়ে দিলো। মাথা ভালোভাবে মুছে তোয়ালে মেলে দিলো। বাথরুমে ঢুকে ছোট ভাইয়ের জামাকাপড় ধুয়ে বারান্দায় শুকাতে দিলো। তারপর ছোট ভাইয়ের চুল আঁচড়ে দিলো সাথে নিজেও চুল আঁচড়ালো।
খুব দ্রুতই হিজাব পড়ে পরিপাটি হয়ে গেলো রুদ। রাহমিদের গায়ে আতর মেখে দিয়ে ওকেও পরিপাটি করে দিলো। একটু পর রায়হান জায়নামাজ হাতে রাহমিদকে ডাকতে লাগলো। রাহমিদ বললো,
“আসছি ভাইয়ু। আপুনি যাই।”
রায়হান ইতোমধ্যেই রুমে ঢুকে দেখে তার ভাই রেডি। সে রুদের কাছে গিয়ে বললো,
“কলিজা আমাদের দুজনকে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিন।”
রুদ দোয়া পড়ে দুই ভাইকে ফুঁ দিয়ে সারা শরীর মুছে দিলো। দুই ভাই বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রায়হান রাহমিদকে দাঁড়াতে বলে রান্নাঘরে ইফরার কাছে গেলো। মাথা ঝুঁকিয়ে ইফরাকে বললো,
“বিবি সাহেবা নামাজে যাচ্ছি। দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে শয়তান হটিয়ে দিন তো।”
ইফরা রান্না শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে রাখছিল। রায়হানের কথায় তার দিকে ফিরে ফুঁ দিয়ে দিলো। পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দিয়ে চুল ঠিক করে দিলো। বললো,
“সোজা মসজিদে যাবেন। আশেপাশে তাকাবেন না। চক্ষু এদিক ওদিক করলে খবর আছে। আমার জন্য সুন্দর একজোড়া চক্ষু আর বরকত নিয়ে আসবেন। অপেক্ষায় থাকবো।”
রায়হান ইফরার কপালে, গালে চুমু দিয়ে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করলো। ইফরা আহাম্মক বনে গেলো। পরক্ষণেই লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো তার।
______
—-
“জানিস ইফরা, রায়হান আর রাহমিদকে কিন্তু আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। তোর বিয়েরও বহু আগে থেকে।”
ইফরার ব্যস্ত হাত চট করে থেমে গেলো। ইফরার খালা কিছু হয়নি এমন ভঙ্গিমায় খাচ্ছে। ইফরা বললো,
“কি বললে খালামণি?”
ইসমাত মাহমুদা মুখের খাবার টুকু গিলে বললেন,
“বললাম, রায়হানকে অনেক ছোট থাকতে আমি দেখেছি। তখন ওর ছোট ভাই আরও পিচ্চি ছিল। এমনকি ওর ছোট ভাইয়ের খামচিও আমি খেয়েছি।”
ইফরা আগ্রহ নিয়ে বললো,
“কিভাবে, কোথায় দেখা হলো?”
“তোদের বাসা থেকে যাচ্ছিলাম আরেকটি জায়গায় একটা কাজে। অতটা খেয়াল নেই কোথায় যাচ্ছিলাম ঠিক। পথিমধ্যে রায়হানকে দেখলাম ছোট ভাইকে শিখাতে শিখাতে যাচ্ছে। বাচ্চাটা লাফাতে লাফাতে ভাইয়ের হাত ধরে যাচ্ছে। হাতে ছিল জায়নামাজ। ব্যাস, আমার এতো চমৎকার লাগলো দৃশ্যটা। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চাটার ধাক্কা লাগলো। অমনি কি বললো জানিস?”
“এতো মাশা আল্লাহ বাচ্চাটা। কি যে কিউট কথাবার্তা! চাচ্ছিলাম গাল টিপে দিতে। সামান্য ধাক্কা লাগায় যেভাবে রেগে গেলো অপরিচিত একজন গাল টিপে দিলে ওখানে কামড়ে টামরে একাকার করে দিতো আমাকে। কি যেন একটা বলেছিলাম অমনি হাতে খামচে দিলো! তোর জামাই তখন আমার কাছে মাফ টাফ চাইলো আরকি। জানিস অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ওদের দিকে। আল্লাহর কাছে ছেলেটাকে তোর জন্য খুব করে চেয়েছিলাম সেদিন। আল্লাহ কবুল করেছেন। চাওয়ার মতো চাইলে আল্লাহ ফিরান না কখনোই।”
ইফরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো খালার কথা শুনে চলেছে এতক্ষণ। সে মনে মনে বহুবার আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। ইসমাত মাহমুদা আবার বললেন,
“তুই খাবি কখন? আমি একাই তো খাচ্ছি। তুইও বসে পড়।”
“উহু আমি তোমাদের জামাইয়ের সাথে খাবো। উনি আমাদের খাইয়ে না দিলে আমাদের কারো পেটের ভাত হজম হয়না। আমি তো নিজ হাতে খেতেই ভুলে গেছি।”
ইসমাত মাহমুদার কথাটি শুনে ভীষণ ভালো লাগলো। যাক আল্লাহ মেয়েটাকে একটা সুন্দর সংসার দিয়েছেন। ছোট থেকে মেয়েটা ভীষণ একলা। এখন তার সুখের সময়। খুশি আড়াল করে মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন,
রাহমিদকে বাসায় আনা হয়েছে গতকাল রাতে। আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ সে। রুদ ছোট ভাইকে কাছ ছাড়া করছে না। রায়হান তো রাহমিদকে পেয়েই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে। তার আর কোনোদিকে মনোযোগ নেই। ভাইয়ের রুগ্ন শরীরে চোখ বুলায় একবার আবার একটুপর কিছু খাবে কিনা, কোনো সমস্যা আছে কিনা ইত্যাদি বলে চলে একমনে। তিনদিন কোচিংয়ে যায়নি সে। এখন রাহমিদকে খুব যত্নসহকারে সুপ খাইয়ে দিচ্ছে রায়হান। নিজের হাতেই বানিয়েছে সুপ। রাহমিদ খেতে না চাইলে বলে উঠলো,
“খাওয়া নিয়ে ঝামেলা কোরো না। তুমি এখনো ছোট নেই যে ধরে, বেঁধে, মেরে খাওয়াতে হবে। চুপচাপ সুপ টুকু শেষ করো।”
ভাইয়ের ঠান্ডা ধমকে রাহমিদ জোর করে খেয়েছে। খেয়েছে বললে ভুল হবে। গিলেছে কেবল। ইফরা সেদিনের পর থেকে আগের থেকে আরও নিশ্চুপ হয়ে গেছে। রায়হান ইফরার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ সময় ছোট ভাইবোনের রুমে থাকে সে। রান্নাবান্নাটাও রায়হানই করে। ইফরা নিশ্চুপ হয়ে তা চেয়ে চেয়ে দেখে।
_____
রাত বাজে তিনটা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো আওয়াজ নেই চারিপাশে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষ। ইফরার চোখে ঘুম নেই। বিছানায় একা শুয়ে আছে সে। এপাশ ওপাশ করছে। একপর্যায়ে উঠে বসলো। নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু ভেবে চললো খানিকক্ষণ। তারপর বিছনা থেকে আস্তে আস্তে উঠে পাশের রুমে গেলো। দেখলো রায়হান চেয়ারে বসে ভাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে।
আজকে মোটামুটি ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদার। রায়হান খানিকটা কাঁপছে। ইফরা রুম থেকে কাঁথা এনে রায়হানের শরীরে জড়িয়ে দিলো। রায়হান , কাঁথার ওম পেয়ে একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো।
ইফরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই নিষ্পাপ দায়িত্বশীল মুখটা দেখলো অনেকক্ষণ। রায়হান আবার নড়ে উঠতেই দ্রুত রুমে চলে গেলো। রায়হানের ঘুম হটাৎ করেই ছুটে গেছে। মনে হচ্ছিলো অনেক্ষণ তার দিকে কেউ তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখলো না। ভাইবোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। একটুও লক্ষ করলো না তার গায়ে কেউ খুব যত্ন করে কাঁথা দিয়ে গিয়েছে। সে তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এইমুহুর্তে। তাই কারো যত্নে মোড়ানো ভালোবাসাটুকু দেখার সময় হলো না তার।
এদিকে ইফরা কাঁথা মুড়ি দিয়ে মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। উঠে ওযু করে তাহজ্জুদ নামাজ পড়লো। মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে কত কিছু যে বললো। সেটা মহান রব আর ইফরা ছাড়া কেউ কোনোদিন জানবে না। ফরজ সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো তাহাজ্জুদ। এই নামাজে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হয় আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে থাকেন। ইফরা সাবরিয়াহ নামের বান্দাটি তার রবের কাছে কি এমন চেয়েছে কেঁদে কেঁদে? আমরা সাধারণ মানুষেরা তা কিভাবে জানবো। এটা তো তার আর তার রবের সিক্রেট লেনাদেনা।
______
—–
রাহমিদ পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেলো। ইফরা বাসা থেকে চলে গিয়েছে কাউকে না বলে। রুদ প্রথমে ভেবেছিল ভাবি হয়তবা দরকারি কোনো কাজে গিয়েছে। কিন্তু প্রায় অনেকক্ষণ বাসায় না আসলে তার চিন্তা বাড়ে। ভাইকে কল দিয়ে দ্রুত জানায় কথাটা। রায়হান কোচিং ক্লাসে ছিল তখন। প্রথমে বিশেষ পাত্তা দেয়নি। কোথায় আর যাবে? গেলেও ওই বাবার বাড়ি। তাই সারোয়ার হোসেনকে কল দিলো সে। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর বললো,
” বাবা, ইফরা কি আপনাদের ওখানে গিয়েছে?
তিনি জানালেন,
“না তো বাবা। ইফরা আমাদের এখানে কেন আসবে? ও তো তোমাদের বিয়ের পর থেকেই এই বাড়িতে পা রাখেনি। মেয়েটার অনেক জেদ। সেই যে বলে গেলো কখনোই পা দিবে না, আর কখনোই এই বাড়িতে পা দেয়নি সে।”
রায়হানের বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। রায়হান বললো,
“ও আচ্ছা। ঠিক আছে। রাখছি বাবা।”
“কি হয়েছে বললে না তো? হঠাৎ ফোন দিয়ে এটা জিজ্ঞেস করলে কেন যে ইফরা এখানে এসেছে কিনা?”
রায়হান কি বলবে ভেবে পেলো না। ওনাদেরকে কিভাবে বলবে তার মেয়ে যে বাসায় নেই। রায়হান আর কিছু ভাবতে পারলো না। বললো,
“আসলে ও বলেছিল আপনাদের ওখানে যাবে। আমি তো কোচিংয়ে চলে এসেছি তাই রাগ করে আবার চলে গেলো কিনা তাই জানতে ফোন দিয়েছি। রাখি এখন তাহলে। আসসালামু আলাইকুম।”
ফোন দ্রুত কেটে কোচিং থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসলো। এসে নিজেদের রুমে ঢুকলো সর্বপ্রথম। রুদ ভাইয়ের পিছনে গেলো। রায়হান আলমারি খুলে দেখলো ইফরার জামাকাপড় কিছু নেই। রায়হানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো যেন। চারপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলো না। বিছানার মাঝ বরাবর একটা সাদা কাগজের মতো দেখলো। রায়হান দ্রুত গিয়ে ওটা খুলে দেখলো ওটা চিঠি। ইফরাই লিখেছে। সে দ্রুত পড়তে শুরু করলো,
রায়হান সাহেব,
এই চিঠিটা যখন আপনার হাতে পৌঁছুবে তখন আমি অনেকটা দূরে। ভাববেন না আবার আত্মহত্যা করেছি। উহু, আত্মহত্যার মতো মহাপাপ আমার দ্বারা হবে না। আল্লাহ নারাজ হবেন যে। কিছু কথা অনেকদিন ধরেই আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু বলা হয়ে ওঠে নি। সামনাসামনিই বলতাম কিন্তু আপনার সাথে আমার যথেষ্ট দুরত্ব তৈরি হয়েছে এই কয়দিন। তাই চিঠিতেই লিখলাম। জানেন, ছোট বেলা থেকে আমি ইফরা সাবরিয়াহ অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছি। আর দশটা ছেলেমেয়েদের মতো আমি বাবা, মায়ের ভালোবাসা উপভোগ করতে পারিনি।
কে বলেছে, বাবা মা না থাকলেই কেবল এতিম হয়? উহু, বাবা মা থাকলেও এতিম হওয়া যায়। আপনার তো বাবা, মা ছিল না তাই তাদের আদর, ভালোবাসা পান নি। কিন্তু আমি যে বাবা, মা থাকতেও তাদের আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, আহ্লাদ কিচ্ছু পাইনি। সেই ছোট্ট আমিটার খোঁজ কয়জন রেখেছে বলতে পারবেন? কেউ না।
দিনশেষে কারো কাছে আবদার করতে পারিনি, মন খুলে দশটা কথা বলতে পারিনি, কারো কাছে প্রায়োরিটি পাইনি। পেয়েছি কি জানেন, সবার একবুক লাঞ্ছনা, পাশ কাটিয়ে যাওয়া, অপবাদ আরও কত কি! জানেন, আমার মা বলতো আমার মতো মুখতোড়ের সাথে কেউ থাকতে পারবে না। যার সংসারে যাবো সেই সংসার নাকি ধ্বংস করে ফেলবো। কথাগুলোতে প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট পেতাম। তাদের কথার বানে দগ্ধ হয়ে এই আমিটা মরে গিয়েছিলাম বহু আগে।
বলুন তো, আপনার দুঃখ বেশি না আমার দুঃখ বেশি? আপনি বাবা, মা ছাড়া এতিম আর আমি বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিয়ে এতিম। হা হা।
জানেন, এইজীবনে আমি জীবিত অবস্থায় দুইবার মরে গিয়েছি। একবার বাবামায়ের অবহেলা, কথার বানে। আরেকবার আপনার অবহেলায়, কথার বানে। জি ঠিক শুনেছেন। আপনার কথার বানে। হাসপাতালে সবার সামনে চেঁচিয়ে যখন বললেন, রাহমিদ মরে গেলে আমার কি? আমি ইচ্ছে করেই আপনাকে জানাই নি ওর অসুস্থতার কথা। আল্টিমেটলি পুরো দোষটা আমাকে দিয়েছিলেন। অথচ আমি কখনোই চাইনি রুদ, রাহমিদের কিছু হোক। ওরা আমারও দুর্বলতা হয়ে গিয়েছিল। এই বাচ্চা দুটোর দিকে চাইলে আমার ভীষণ মায়া লাগতো। বিশ্বাস করুন ওদের কিছু হোক সেটা আমি কোনোভাবেই চাইনি।
জানেন, আপনার এই কথাকে আমি ভুলে যেতাম যদি না আপনি আমাকে বিগত কয়েকটা দিন না অবহেলা করতেন। আপনি আমাকে এমন ভাবে এড়িয়ে চলেছেন যেন আমি এক্সিস্টই করিনা। আমাকে দিয়ে রান্না করাননি। যদি আমি কোনোভাবে তরকারিতে কিছু মিশিয়ে দেই সেই ভয়ে বোধহয়। আমাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলেছেন, যেন আমি পরিষ্কার পানিতে ভেসে আসা একটুকরো খড়কুটো।
অনেক কথা বলে ফেললাম। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবেন না। জানি আমাকে খুঁজবেন না। আমি এমন কেউ না যে আমাকে খুঁজতে হবে। আপনার জীবনে যে কয়টা দিন ছিলাম, আপনাদের সবাইকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছি। পারলে মাফ করে দিয়েন। রুদ, রাহমিদকে দেখে রাখবেন। ওদের দেখাশোনার জন্য আপনি নামক মহৎ মানুষটি আছে। বিশ্বাস করুন আমার জন্য সেই ছোট্ট থেকে এরকম একটা বস্তুও ছিল না।
আমার চারপাশে আমার বাবা, মা, স্বামী, দেবর, ননদ সব আছে কিন্তু সত্যি বলতে আমার আসলে কেউ নেই। আমি একা। ভীষণ একলা। জীবনের ২২টি বছর যেহেতু একাই ছিলাম বাকি জীবন টুকুও একাই পাড়ি দিতে পারবো। ভালো থাকবেন। আপনার জন্য অফুরন্ত দোয়া।
ইতি
আপনার ঘাড় থেকে নামানো এক বোঝা।
চিঠি টুকু পড়ে রায়হান ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। তার চোখ ছলছল করছে। বুকটা কেমন ফেটে যাচ্ছে যেন। তার দায়িত্বে থেকেও মেয়েটা কতটা অবহেলার শিকার হয়েছে। সে নিজেই করেছে। কিভাবে পারলো। ভাইকে ভেঙে পড়তে দেখে রুদ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। রায়হান বোনকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। তার খুব খারাপ লাগছে।
ইফরাকে বিয়ে করার পিছনে তার জীবনের করুন কাহিনী অনেকাংশে দায়ী। ইফরার বাবা যখন তার হাত ধরে বলেছিল,
“বাবা, মেয়েটাকে দেখে রেখো। ও ছোট থেকে ভীষণ একা। আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। তোমার দায়িত্বে দিচ্ছি। মেয়েটাকে ভালো রেখো। ও ভীষণ রাগী, গম্ভীর। ওর কথায় রেগে যেও না বাবা। মেয়েটা আমার ছোট থেকে আমাদের ভালোবাসার অভাবে এমন হয়ে গিয়েছে। তুমি একটু সামলে নিও। তোমার ধৈর্যের সুনাম শুনেই আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি বাবা। দেখে রেখো।”
রায়হান সেদিন সারোয়ার হোসেনকে কথা দিয়েছিল সে দেখে রাখবে। কোনো দায়িত্বের হেরফের হবে না। অথচ আজ সে কি করলো? তার মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না।
কি হবে রায়হান জাইম আর ইফরা সাবরিয়াহর পরবর্তী জীবনে? সুখ কি ধরা দিবে তাদের জীবনে নাকি অধরাই থেকে যাবে?
চলবে…..
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৭
তাজরীন ফাতিহা
“দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করো না। সেখানে একা একা দরজা জন্মাবে না। ওপাশে যেতে চাইলে দরজা বানাতে চেষ্টা করো।”
~কোকো শ্যানেল
“পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধা হলো ধৈর্য এবং সময়।”
~লিও টলস্টয়
সময় নিয়ে এই দুটি উক্তি রায়হানের ভীষণ পছন্দের। সে যখন বিদেশী নভেল বা বিখ্যাত উক্তি পড়ে তখন বিখ্যাত লাইন বা উক্তিগুলো আন্ডারলাইন করে রাখে। অবশ্যই শিক্ষণীয় নভেল বা উক্তির প্রতি তার ঝোঁক প্রবল। সে নিজেকে ধৈর্যবান আর সময়নিষ্ঠবান ভাবতো এতদিন তবে আজ মনে হচ্ছে সে ভুল।
ধৈর্যশীল আর সময়নিষ্ঠবান হওয়ার জন্য জীবনে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকে ফলো করার চেষ্টা করেছে সে। তার মধ্যে নবীজী (সাঃ) সবার উপরে। এখন মনে হচ্ছে তার আদর্শকে সে ঠিকমতো ধারণ করতে পারেনি। নাহলে তার বউ হারিয়ে যায়।
রায়হান এখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে চুপচাপ বসে আছে। কত জায়গায় খুঁজেছে কিন্তু কোথাও পায়নি ইফরাকে। যেন মানুষটা হারিয়ে গেছে চোখের পলকে। রায়হানের এখন পাগল পাগল লাগে। দুইদিন ধরে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারাক্ষণ খুঁজে বেড়িয়েছে সে। তবে ইফরা তো ভালো ইফরার কোনো চিহ্নই কোথাও পায়নি সে।
ইফরার বাবাকে প্রথমে ইনফর্ম না করতে চাইলেও পরে রায়হান জানিয়ে দেয়। ইফরার বাবার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ে যেন। তার মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেলো সবাইকে কাঁদিয়ে। ইফরার মা ইয়াসমিন আহমেদ থেকে থেকে কান্না করছেন। ওনারা এখন রায়হানের বাসায়। ইফরার দাদি চোখ, মুখ শক্ত করে রেখেছেন। ইয়াসমিন আহমেদকে কান্না করতে দেখে বলে উঠলেন,
“তোমার ন্যাকা কান্না থামাও তো। জীবনে মাইয়াডার সাথে দুইডা ভালা কথা কইছো? এহন মরা কান্না জুইড়া দিছো কেন? আমার নাতিনের জীবনডা তামা তামা বানাই দিছো তোমরা সবাই। ভালাই করছে ভাগছে। তোমাগো লগে থাকলে আমার নাতিনডা মইরা যাইতো।”
উনি রাগ রাগ কণ্ঠে কথাগুলো বলে থামলেন। শাশুড়ির ধমকে ইয়াসমিন আহমেদ কান্না চাপা দিতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কান্নার আওয়াজ শোনা যেতেই লাগলো। সালমা হোসেন বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে রায়হানের রুমে চলে গেলেন। তারা এতক্ষণ রাহমিদ আর রুদের ঘরে বসে ছিলেন।
সালমা হোসেন রায়হানকে চুপচাপ মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে তার পাশে গিয়ে বসলো। রায়হান চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ইফরার দাদিকে। সালমা হোসেন দেখলেন রায়হানের চোখের নিচে কালি, চোখ ডেবে গেছে। তার মায়া লাগলো। পরক্ষণেই নাতনির চলে যাওয়ার কথা মনে পড়লে চোখ, মুখ শক্ত করে ফেললো। বললো,
“ওই চ্যাংরা, তোর বউ পালাইলো কেন? তোরে না হাত ধইরা কইছিলাম নাতিনডারে দেইখা রাখিস। এই তোর দেইখা রাখা?”
রায়হান কোনো জবাব দিলো না। দাদি আবারও কথা বলে উঠলেন। বললেন,
“কিরে থোতা বন্ধ কেন? এহন আর মুখ চলে না বুঝি? দেইখা রাখতে না পারলে বিয়া করছিলি কেন? তোরে কঠিন বাটনা বাটমু আমার নাতিনরে খুঁইজা না পাইলে।”
রুদ, রাহমিদ ভাইয়ের পাশে বসে আছে। রুদের চোখে মুখে উদ্বেগ, মন খারাপ থাকলেও রাহমিদের চোখেমুখে তার ছিটেফোঁটাও নেই। সে আরামছে বসে বসে পা দোলাচ্ছে। ইফরার দাদি বিষয়টা খেয়াল করে বললেন,
“ওই ছোট্ট চ্যাংরা, তুই অভদ্রের মতো ঠ্যাং লড়াস কেন? দেহিস না সামনে মুরুব্বী বসা। দেইখা তো মনে হয়না ভাবি হারানোর দুঃখে কোনো কষ্ট পাইছিস। মনের সুখে ঠ্যাং লড়াইয়া যাইতাছিস কহন থেকে।”
এতক্ষণ রাহমিদ ভাইকে ধমক খেতে দেখেও কিছু বলেনি। কিন্তু এখন তাকে সরাসরি ধমক দিয়ে কথা বলাতে তার ইগো হার্ট হয়েছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলে উঠলো,
“ঠ্যাং তো আমার। আমার ঠ্যাং আমি লাড়ামু তাতে আপনার কি? ভাইয়ুকে কথা শুনাচ্ছেন শুনান। সে আপনার নাত জামাই কথা শুনাতেই পারেন। কিন্তু আমি আপনার কোন নাতিনের জামাই যে ধমক মেরে কথা বলছেন। আমি কি আপনার কোনো নাতিনকে ভাগিয়েছি?”
ইফরার দাদি চোখ বড় বড় করে বললেন,
“তোগো কাছে আমি আমার আর কোনো নাতিন থাকলেও দিতাম না। নাক টিপলে দুধ বেড়োয় সেদিনের চ্যাংরা আসছে তেলেছমতি দেখাতে।”
“নাক টিপে দুধ বের করে দেখান। এক্ষুণি দেখাবেন।”
রাহমিদ আয়েশ করে বসে নাক বাড়িয়ে দিলো। সালমা হোসেন বিব্রত ভঙ্গিতে রাহমিদের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলেন।
রুদ ছোট ভাইয়ের কথা শুনে ওর পিঠে মারলো। ইফরার দাদি বড় বড় চোখ করে রাহমিদের দিকে এখনো তাকিয়ে আছেন। বেচারি বোধহয় বুঝে গেছে, বড়টার সাথে পারলেও ছোটটার সাথে পারবেন না তিনি। ভীষণ বজ্জাত আর বুদ্ধিমান ছোট টা। রায়হান ছোট ভাইকে ধমকে উঠলো,
“রাহমিদ, এটা কেমন বেয়াদবি? সে তোমার গুরুজন। এভাবে কথা বলছো কেন? এটা কেমন বিহেভ তোমার?”
“থাক থাক। আর ঢং করা লাগবো না। আমার নাতিনরে ভাগাইয়া এহন সাধু সাজোন লাগতো না। সব কটা জাহেল। আমার নাতিনডা আছিলো কেমনে এই সংসারে?”
রায়হান এতক্ষণ পর মুখ খুলে বললো,
“দাদি আমাকে একটু ঘুমোতে দিবেন। আজকে দুইদিন ধরে আমি দু চোখের পাতা এক করতে পারছিনা। এখন প্রচুর ঘুম আসছে। বিশ্বাস করুন আমার জীবনে আমি একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি মা, বাবা ইন্তেকালের পর। কোনোদিন পারবো কিনা জানি না। তবে এখন আমার প্রচুর ঘুম আসছে। আমি কি একটু ঘুমোতে পারি? কথা দিচ্ছি ঘুম থেকে উঠে আপনার নাতনিকে আবার খুঁজবো।”
সালমা হোসেনের এই কথাটা শুনে কি হলো জানা নেই। তবে তার চোখের কোন ভিজে গেছে। তার সামনে বসা ছেলেটার অনেক দুঃখ। তার নাতনিও ছেলেটাকে সুখে রাখেনি সেটা তিনি জানেন। ইফরা যে রাগী। রাগ নিয়েই কথা বলতো সারাক্ষণ। নিশ্চয়ই এই ছেলেটার সাথেও রাগী, রূঢ় আচরণ করতো। তিনি আর কোনো কথা না বলে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে।
ইফরার দাদিকে চলে যেতে দেখে রায়হান চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিমিষের মধ্যে সে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
________
—–
“তুই কি আর ফিরে যাবি না?”
ইফরার বান্ধবী ফিহা কথাটি বলে থামলো। ইফরা মুখ গম্ভীর করে বললো,
“সেটা সময় বলে দিবে। ফিরে গেলে তো দেখতেই পাবি। কেন আমি থাকায় তোর সমস্যা হচ্ছে নাকি?”
ফিহা বালিশে হেলান দিয়ে বললো,
“সমস্যা আমার না আমার পরিবারের। তারা তো ভাবছে তুই কয়েকদিন থেকে চলে যাবি। কিন্তু তুই তো একেবারেই চলে এসেছিস বললি। মা তো বলেই বসেছে, তোর বান্ধবী না বিবাহিত? তাহলে জামাই রেখে তোর কাছে কি? আবার জামাই ছেড়ে চলে এসেছে নাকি? বলা তো যায়না, যে রাগী ও। চলেও আসতে পারে।”
ইফরার কথাটি শুনে খুব খারাপ লাগলো। বিষন্নতায় মন ছেয়ে গেলো। ফিহা ব্যাপারটা লক্ষ করে বললো,
“শোন, জীবনটা নাটক সিনেমা না? তুই বললি আর সব কিছু হয়ে গেলো। আমরা একটা সমাজে বাস করি। এখানে কিছু নিয়ম কানুন আছে। এসব মেনেই আমাদের এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। রাগারাগি প্রত্যেকটা সংসারেই হয়। আমাদের উচিত রাগারাগি হলে মাথা ঠান্ডা করে তার মীমাংসা করা। কারণ রাগ হলো শয়তানের অস্ত্র। জানিস শয়তান সবচেয়ে খুশি হয় কখন?”
ইফরা কথা বললো না। চুপটি করে ফিহার কথা শুনতে লাগলো। ফিহা আবার বলতে লাগলো,
“শয়তান সবচেয়ে খুশি হয় স্বামী স্ত্রীর তালাক হলে। তাই স্বামী স্ত্রীর বেশিক্ষণ রাগারাগি করে থাকা উচিত না। এতে করে শয়তান তার অস্ত্র ব্যবহার করে স্বামী স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি করিয়ে ফেলে। স্বামী স্ত্রীর তালাক হয়ে গেলে সে তার অনুসারীদের নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে। শয়তানের যে অনুসারী স্বামী, স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে সারাদিনের কুকর্মের ফলাফল দেয়ার সময় ঐ অনুসারীর মাথায় সেরা মুকুট পড়িয়ে দেয় স্বয়ং শয়তান। অর্থাৎ সেরা অপকর্মের মুকুট পায় যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তালাক করাতে পারে সে। ভাবতে পারছিস কি ভয়ংকর কথা?
ফিহা একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো,
“তোর স্বামী যদি তোকে ভুল বুঝে তুই পারবি তাকে সঠিকটা বুঝাতে। এতদিন আমার কাছে ছিলিস তুই। কিন্তু সে যদি ভাবে আল্লাহ না করুক তুই কোনো পরপুরুষের সাথে ছিলিস। পারবি তার মনে সত্য উদ্রেক করতে। শয়তান তো এটাই চায়।”
ইফরার মনে ভয় ঢুকে গেলো। সে ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করবে। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত সে। সামনে কি করবে সব তার আগেই ভাবা শেষ। দেখা যাক তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে। শয়তানকে সে কিছুতেই জয়ী হতে দিবে না। এটাই তার নিজের সাথে নিজের অঙ্গীকার।
রাহমিদের স্বভাব হলো কেউ তাকে পাত্তা না দিলে সেও তাকে পাত্তা দেয় না। ইগনোর করে। ইফরার সাথে রাহমিদের সম্পর্কটা অনেকটা সাপে নেউলে টাইপ। ইফরা মুখ গম্ভীর করে তাদের কিছু বললে রাহমিদ ফোঁস করে ওঠে। যদিও ইফরা তাদের সাথে উচ্চস্বরে কখনো কথা বলে না তবুও মুখ গম্ভীর করে কথা বললেই রাহমিদ মনে করে ইফরা বিরক্ত হচ্ছে তাদের উপর। তখনই বাঝে বিপত্তি। রাহমিদকে কিছু বলতে নিলে রাহমিদ ছেড়ে দেয়না। রুদ চুপ থাকলেও সে প্রতিউত্তর করে।
আজকের বিকেলটা অনেকটা গুমোট। ইফরা রুদকে গম্ভীর স্বরে কি যেন একটা বলেছে অমনি রাহমিদ প্রতিউত্তর করেছে। তার মতে, যে তাদেরকে দেখতে পারেনা সেও তাকে দেখতে পারে না। রুদ বহুবার ছোট ভাইকে থামাতে চাচ্ছে কিন্তু রাহমিদ থামতে নারাজ। এক চুল ছাড়ও দেয়া হবে না। রুদ আবারও থামাতে এলে রাহমিদ ঝটকা মেরে সরিয়ে বললো,
“বেশি সাধু সাজতে গেলে এরকম করেই সারাজীবন মানুষের কথা শুনতে হবে। মুখ বুঝে খালি শুনে গেলেই হয় না আপুনি। মাঝে মধ্যে প্রতিউত্তরও করতে হয়। সে প্রত্যেকটা কথা এমন ভাবে বলে যেন সে প্রিসেন্স ডায়না আর আমরা হলাম কোনো এক ক্ষেতের পঁচা মুলা। মুখটাকে এমন বানিয়ে রাখে যেন পেঁচা উনি। মনে হয় পেঁচার কষা হয়েছে তাই মুখটাকে এমন করে রেখেছে।”
রুদের এ পর্যায়ে হাসি পেলো। তবে ভাবির সামনে হাসলো না। ইফরা চোখ মুখ কঠিন করে তাকিয়ে আছে। তাকে পেঁচা বললো। সে মুখ পেঁচার মতো করে রাখে। ইফরা এবার বললো,
“এই কি বললে? কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? কথাবার্তার কোনো আদব লেহাজ নেই। দুই দিনের পুঁচকি যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছো। কথার লাগাম টানো।”
“আপনি টানুন। আসছে আদব লেহাজের গোডাউন। আপনার জ্ঞান আপনার মাথার ভিতর ঢুকিয়ে রাখুন। পুঁচকি কাকে বলছেন? আমি যথেষ্ট বড়। অন্তত আপনার ত্যাছড়া কথার প্রতিউত্তর করার মতো বড় নিশ্চয়ই হয়েছি।”
কথাটুকু বলে রাহমিদ প্রস্থান করলো। এর থেকে বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। শত হলেও উনি ভাইয়ুর বউ। যা বলেছে এটাই বেশি হয়ে গেছে। ভাইয়ু জানলে কষ্ট পাবে। কারণ তার আদর্শে প্রশ্ন উঠবে। অবশ্য ভাবির একটা গুণ তার খুবই পছন্দনীয়। তাদের মাঝে শত রেষারেষি হলেও ভাইয়ুকে কখনোই বলে না। তাদের অবর্তমানে ভাইয়ুর কান ভাঙায় না, কথা লাগায় না। ঝগড়া তার সাথে হলে তার সাথেই গম্ভীর স্বরে ঝগড়া করে ঝগড়ার পরিসমাপ্তি ঘটায়। এইতো একটু পরই তাদেরকে নাস্তা খেতে ডাকবে গম্ভীর স্বরে।
_______
আজকের সন্ধ্যার নাস্তার মেন্যু হলো, ঝাল ঝাল চানাচুর মুড়ি মাখা আর লাল চা। বাসায় আজকে দুধ নেই নাহলে দুধ চা-ই বানানো হতো। রায়হান বাসায় চলে এসেছে মাগরিব পড়ে। এখন পাটিতে বসে আছে তিনজন। রায়হান, রাহমিদ আর রুদ। মুড়িতে মরিচের পরিমাণ দেখেই রাহমিদ আর রুদ বুঝলো ভাবির রাগ এখনো কমেনি। রায়হান হাত গুটিয়ে বসে আছে। ইফরা আসার অপেক্ষা করছে। কিন্তু ইফরার দেখা নেই। মুড়ি মাখা দিয়ে চলে গেছে। রায়হান বললো,
“রুদ, রাহমিদ পড়াশোনার কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়ু।”
দুইজন একসাথে বলে উঠলো।
“আলহামদুলিল্লাহ হলেই ভালো। যাক আজকে বাসার পরিবেশ এমন নিস্তেজ কেন? কোনো কিছু হয়েছে?”
রুদ এবং রাহমিদ এদিক ওদিক তাকালো। কিছু বললো না। এর মধ্যেই ইফরা মুখ গম্ভীর করে এসে বসলো। রায়হান বললো,
“আপনার মন মেজাজ কি কোনো কারণে খারাপ?”
ইফরা রোবটের মতো উত্তর দিলো,
“না।”
রায়হান বললো,
“চলুন খাওয়া শুরু করা যাক।”
এরপর সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলো। রাহমিদ মরিচ বেছে বেছে মুড়ি খাচ্ছে। এতেই ভীষণ ঝাল লেগে গেলো তার। সে ছোট দেখে ঝাল খেতে পারেনা তেমন। রায়হান ভাইকে পানি খাওয়ালো। তারপর চা খেতে বললো। রাহমিদ খেলো। একটু ঝাল কমেছে। ইফরা চোখ ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন বলতে চাচ্ছে, “কি কেমন দিলাম?” রাহমিদও ত্যাছড়া চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো পরের চাল আমার। সকলের অগোচরে দুইজনের চক্ষু যুদ্ধ হয় গেলো কেউ তা টেরও পেলো না। আজকের “নাস্তা সন্ধ্যাটা” তেমন জমলো না।
_____
—-
আজকের আবহাওয়া যেহেতু ঠান্ডা ঠান্ডা সেহেতু ইফরা ভেবেছিল আজকে খিচুড়ি রাঁধবে। কিন্তু আজকে মন মেজাজ ভালো না থাকায় রাঁধতে ইচ্ছে করছে না। রায়হান কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। ঘরে রাহমিদ আর রুদ আছে।
আজকে দুই জনের একজনও স্কুলে যায়নি। বৃষ্টি পড়েছে দেখে নানা অজুহাত দেখিয়ে বাসায় থেকে গেছে। ইফরা বাইরে তাকিয়ে আছে। অনেক কিছু ভেবে চলছে সে। আসলেই কি সে একজন টক্সিক মানুষ? তাকে কেউই পছন্দ করেনা। সেই ছোট্টবেলা থেকে এখন পর্যন্ত সবাই অবহেলার চোখে, দোষীর চোখে দেখে চলছে। আসলে সে মানুষটাই বোধহয় খারাপ। কারো সাথে কথা বলতে পারেনা, আগ বাড়িয়ে মিশতে পারে না, কথার কোনো সৌন্দর্য নেই। এতো এতো ত্রুটিপূর্ণ একজন মানুষ সে। কারো চোখেই আজ পর্যন্ত ভালো হতে পারে নি।
কত চেষ্টা করে একটু স্বাভাবিকভাবে ননদের সাথে কথা বলতে। কিন্তু সেই গম্ভীর, রোবটিক ভাব এসেই যায় তার। কি করবে বুঝতে পারছে না সে। রায়হান মানুষটা যথেষ্ট ভালো একজন মানুষ। তার খ্যাটখ্যাটে কথার বিপরীতে কখনোই উচ্চবাচ্য করেনি। সে কথা শোনালে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে তবুও ঝগড়া করেনি। এই মানুষটার সাথে সে কিভাবে ঝগড়া করবে?
কালকে রাতে ভীষণ মাথা ব্যথা উঠেছিল। সারারাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। মাথা টিপে দিয়েছে। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিল। সে বলেছে একটু টক জাতীয় কিছু খেলে ভালো লাগতো। মানুষটা কোথা থেকে যেন লেবু কেটে মরিচ, লবণ দিয়ে মাখিয়ে এনেছে।
লেবু একটা ছিল বোধহয় নাকি কিনে এনেছে সে সঠিক জানে না। তবে দরজার আওয়াজ পেয়েছে। হয়তবা বাইরে গিয়েছিল। রাত বেশি হয়নি অবশ্য তখন। বসে বসে যখন সে লেবু খাচ্ছিলো তখন মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছে। এতে নাকি মাথা ব্যথা কমে যাবে। এই প্রথম মানুষটা তাকে খুব যত্নের সাথে ছুঁয়েছে। ভীষণ ভালো লাগছিল তার। বাবা, মা অন্তত ভালো একজন মানুষের কাছে তাকে দিয়েছে এতে সে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে তাদের কাছে।
তার বিয়ের বয়স পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসে মানুষটার সাথে যথেষ্ট দুরত্ব রেখে চলেছে সে। প্রথম প্রথম রান্নাঘরে ঢুকতও না সে। একদিন এতো ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছিল তার এতো খারাপ লাগলো সেদিন। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে গোসল করেই রান্না ঘরে ঢুকে রান্না করতে দেখে সেই প্রথম তার উপলব্ধি হলো এই মানুষটার কাজে একটু সাহায্য করতে হবে। রান্না শেষে ভাই, বোনকে খাইয়ে দিতেও যে মানুষটা ক্লান্তিবোধ করে না ওই মানুষটার সাথে এতোটা পাষাণ ব্যবহার করতে তার বিবেকে বাধা দিয়েছিল প্রচণ্ড।
তারপর আর কি। সেদিনের পর থেকে রান্নাটা সেই করে। সাথে রুদ সাহায্য করতে থাকতো। তবে রুদকে সাথে থাকতে নিষেধ করেছে সে। রান্নাবান্নায় তার পাশে কেউ থাকলে রান্নাটা ঠিক করে করতে পারেনা। তাই এখন একাই রান্নাটা করে। রুদের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো ইফরা।
“ভাবি আসবো?”
“আসো জিনাত।”
“আপনার মন কি বেশি খারাপ? ভাইয়ু ভাত খেয়ে আপনাকে ওষুধ খেতে বলেছিল মাথা ব্যথার।”
“না মন খারাপ না। তুমি যাও। রান্নার বেলা গড়ালো বলে। শরীরটা কেমন করছিল দেখে এখনো রান্না করতে যায়নি। তুমি কিছু বলতে এসেছিলে কি?”
“আমি আপনাকে হেল্প করি একটু। রান্না নাহয় আপনিই করবেন আমি পিঁয়াজ, রসুন কুচি করে দিবো।”
“ভালো কথা মনে করেছো আজকে রসুনের ভর্তা করবো। তোমরা রসুন খাও?”
“খাই তবে রসুনের ভর্তা আমরা কেউ কখনো খাইনি। আপনি বানাতে চাইলে বানাতে পারেন ভাবি। আপনি বানাবেন আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখে শিখবো।”
“আচ্ছা। পাশে থেকো।”
ইফরার শরীরটা আজকে খারাপ দেখে রুদকে সাথে থাকতে সায় জানালো।
_____
ছোটবেলা থেকেই ইফরা মা, বাবার আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দাদি তাকে আদর ভালবাসা দিতো। রান্না করলে আদরের নাতনিকে সাথে নিয়েই রান্না করতো। ছোট্ট ইফরা দাদির পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না দেখতে দেখতে রান্নাটা ভালোভাবেই আয়ত্ত করে ফেলেছিল। প্রায় সব রান্নাই সে মোটামুটি ভালোই পারে। রান্না শিখে ভালোই হয়েছে এখন কাজে লাগছে তার।
আজকে রান্না করেছে গরম গরম খিচুড়ি। সাথে মুরগি ভুনা, ডিম ভাজি আর রসুনের ভর্তা। রাহমিদের খিচুড়ি অনেক পছন্দের। ভাবির সাথে তার ঝগড়া হলেও খাবারের সময় রাহমিদ রাগ করে থাকতে পারেনা। এই যেমন এখন গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে কখন এটা পেটে চালান করবে তাই ভাবছে।
ইফরা যোহরের নামাজ পড়ে খিমার পড়েই ওদেরকে খাবার বেড়ে দিতে চলে আসলো। রায়হান বাসায় আসে এই সময়টায়। এসে খেয়েদেয়ে আবার চলে যায় কোচিংয়ে। আজকে ফিরতে কিছুটা দেরি হলো তার। এসেই খিচুড়ি আর মুরগির ঘ্রাণে পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। বহু বছর আগে এরকম ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরার পর পাশের ঘরে রান্না করা খিচুড়ি, গোশতের ঘ্রাণে পেট মোচড় দিয়ে উঠেছিল তার। সেই দৃশ্য স্মৃতির পাতায় উঁকি দিয়ে উঠলো।
রায়হান হাত, মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলো। ইফরা সবার প্লেটে খিচুড়ি, গোশত, ডিম ভাজি আর রসুনের ভর্তা দিলো। সাথে নিজেও নিলো। রাহমিদ খাবার পেয়েই বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করেছে। তার আয়েশ করে খাওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে সে। বাকিরাও তৃপ্তি করে খেতে লাগলো। রুদ তো বলেই বসলো,
“দারুন হয়েছে রসুনের ভর্তাটা। খিচুড়ির সাথে মজাই লাগছে। ভাইয়ু এই ভর্তা আগে খাওয়াও নি কেন?”
রায়হান খেতে খেতে জবাব দিলো,
“আমি পারতাম নাকি? আমিও এই প্রথম খেলাম। মজা লাগছে।”
একমাত্র রাহমিদ কোনো কথা না বলে খাচ্ছে। শত হলেও ভাবির সাথে তার রেষারেষির সম্পর্ক। এখানে প্রশংসা করা তার ধাঁচে নেই। তবে মুখে তৃপ্তি ফুটিয়ে খেয়ে চলছে সে।
ইফরার ওদেরকে এভাবে তৃপ্তি করে খেতে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। রায়হান খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো,
“আপনার না মাথা ব্যথা? এতো রান্না করতে গেলেন কেন এই অবস্থায়?”
“এখন আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি। মাথা ব্যথা নেই।”
মানুষটার এতটুকু যত্ন তার ভীষণ প্রিয়। শত ব্যস্ততার মাঝেও ভাই, বোন, বউ করো চিন্তা তার মাথা থেকে যায়না। “বউ” কথাটা ভেবেই ইফরা একটু লজ্জা পেলো। একদিন রায়হানকে বলেছিল,
“আমাকে বউয়ের মতো দেখবেন না আর কোনো যত্নও করবেন না। এসব আমার বিরক্ত লাগে। রায়হান ফট করে বলেছিল,
“বউয়ের মতো না দেখলে কিসের মতো দেখবো? আপনাকে দেনমোহর দিয়ে কবুল পড়ে বিয়ে করেছি কি বউয়ের মতো না দেখে বোনের মতো দেখার জন্য? কি রকম কথা বলছেন?
ইফরা সেদিন তব্ধা খেয়ে গিয়েছিল। রায়হানকে সহজ সরল ভেবেছিল সেদিন তার ধারনা ভেঙে যায়। কিভাবে তার মুখের উপর বউয়ের ভাষণ দিয়ে গেলো। লজ্জায় ইফরার মুখ নিচু হয়ে গিয়েছিল। তবে তার স্বভাবের সাথে লজ্জা যায়না দেখে চেহারায় ফুটিয়ে তুলেনি যে সে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। খাবার খেতে খেতে পুরোনো কথা মনে পড়ায় ইফরার হঠাৎই বিব্রত লাগলো।
চলবে…
#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩৫
তাজরীন ফাতিহা
আজ সকাল থেকে রাহমিদের শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। আজকে স্কুলে যেতে পারেনি। রুদ বহুবার ডেকেছে “যাবে না” বলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। রুদ আর ঘাটায় নি। ওর স্কুলের সময় চলে যায় দেখে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেছে রায়হানের সাথে। রায়হান রাহমিদের কথা জিজ্ঞাসা করলে রুদ বলেছে “ও স্কুলে যাবে না।”
রায়হান চিন্তিত হয়েছিল কথাটায়। পরক্ষণে রুদের স্কুলের আর তার কোচিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে বেরিয়ে পড়েছে দুইজন।
বাসায় এখন ইফরা আর রাহমিদ। ইফরা রাহমিদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলে না। বলেই না একেবারে। শুধু ঝগড়া টা হয় দুইজনের ফাটাফাটি ভাবে। সে রাহমিদ বাসায় থাকলে পুরো শরীর ঢেকে রাখে। শুধু মুখমন্ডল খোলা রাখে। কারণ রাহমিদ শত হলেও তার দেবর। আর দেবর মৃত্যু সমতুল্য। রাহমিদ ছোট দেখে ইফরা এখন কথাবার্তা বলছে। বড় হয়ে গেলে আর দেখাও দিবে না।
ইফরা ঘর গুছিয়ে রান্নার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় রাহমিদের রুম থেকে হালকা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়। সে উঁকি দিয়ে দেখে রাহমিদ কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর কাঁপছে। বিষয়টায় ইফরার খটকা লাগে। সে খিমার দিয়ে মুখ ঢেকে রুমে ঢুকে কাঁথা সরিয়ে রাহমিদের কপালে হাত দিলো। হাতে ভীষণ গরম অনুভূত হওয়ায় হাত দ্রুত সরিয়ে ফেললো।
রাহমিদ অবচেতনে বির বির করে, “মা মা” ডেকে চলেছে। ইফরার এতো খারাপ লাগছিল ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আহারে বাচ্চাগুলো কতো ছোট বয়সে মাতৃহারা হয়েছে। মাকে না দেখেলেও, মায়ের আদর স্নেহ না পেলেও অবচেতনে ঠিকই মাকে খুঁজে বেড়ায় বাচ্চাগুলো। ইফরা আর দেরি না করে মাথায় জলপট্টি দিলো। রাহমিদ এখন বলছে,
“ভাইয়ু আমার ভীষণ শীত করে, তুমি ঝাপটে জড়িয়ে ধরো।”
ইফরা বুঝলো বাচ্চাটার ভালোই শীত লাগছে। রায়হানকে কি একটা ফোন করবে সে? না থাক কোচিং করাচ্ছে সব ছেড়ে চলে আসতে পারে। রাহমিদের অসুস্থতা নিয়ে ইনফর্ম করলে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবে। ইফরা উঠে থার্মোমিটার নিয়ে রাহমিদের মুখে দিলো। রাহমিদ এ পর্যায়ে চোখ খুললো। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে তার। চোখ খুলেই ভাবিকে তার সামনে বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক এবং বিব্রত হলো। মুখ খুলে কিছু বলতে গেলেই ইফরা নিষেধ করে বললো,
“কথা বলো না। মুখে থার্মোমিটার আছে।”
কথাটি শুনে রাহমিদ কথা না বলে চুপটি মেরে থাকলো। ইফরা এক মিনিট পর থার্মোমিটার উঠিয়ে দেখে জ্বর একশো তিন ডিগ্রি। সে উঠে বালতিতে করে পানি নিয়ে আসলো। বালিশের উপরে পলিথিন দিয়ে রাহমিদকে ধরে শোয়ালো। রাহমিদ প্রথমে ইতস্তত করলেও ইফরার চোখ গরমে শুয়ে পড়লো। ইফরা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পানি দিতে থাকলো। পানি দেয়া শেষ হলে মাথা মুছিয়ে দিলো। বালতি বাথরুমে রেখে রান্নাঘরে চলে গেলো। একটু পর জাউ ভাত রান্না করে নিয়ে আসলো। পোলাওয়ের চাল দিয়ে রান্না করা হয়েছে এই জাউ ভাত।
ইফরা রাহমিদকে উঠিয়ে অল্প অল্প করে খাইয়ে দিলো। খাওয়ানো শেষ করে মুখ মোছালো। রাহমিদ অবাক নজরে ইফরার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন ইফরাকে ঝগড়া করা অবস্থায় আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় দেখেছে। আজ একজন মায়ের রূপে দেখলো। যে গভীর মমতা নিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সেবা করছে। এ সেবায় না আছে অতিরঞ্জিত ভাব আর না আছে তাড়াহুড়া। চোখ মুখ আগের মতোই গম্ভীর কিন্তু সেবাযত্ন যেন এক অপূর্ব মায়ার থালি। রাহমিদের হঠাৎ করে ইফরাকে মা মনে হলো। যে তার বাচ্চার জ্বর হয়েছে দেখে চিন্তায় অস্থির হয়ে মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। তার চোখ ছলছল করে উঠলো কি?
_________
—–
রাহমিদের জ্বর এসেছে শুনে রায়হানের অস্থির অস্থির লাগছে। বাসায় এসে মাত্র হাত, মুখ ধুয়ে বের হয়েছে। এরমধ্যে ইফরা জানালো সকাল থেকে রাহমিদের ভীষণ জ্বর শরীরে। তাকে ওষুধ আনার জন্য তাড়া দিতে থাকলো। রায়হান এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ভাইয়ের রুমে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো রুদ ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রায়হান দৌঁড়ের ভঙ্গিতে রুমে ঢুকে ভাইয়ের কপালে, চোয়ালে হাত ছোঁয়ালো। দেখলো জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কলিজা কি হয়েছে আপনার? এতো জ্বর বাঁধালেন কি করে?”
রাহমিদ পিটপিট করে চোখ খুলে ভাইকে দেখেই বলে উঠলো,
“ভাইয়ু এসেছো? আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।”
রায়হান ভাইয়ের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বললো,
“কেমন লাগছে বাচ্চা? ভাইয়ুকে বলেন। কোথায় কষ্ট হচ্ছে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো?”
রাহমিদ মাথা ছেড়ে দিয়ে থেমে থেমে বললো,
“ভাইয়ু আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। ভাবির সাথে অনেক ঝগড়া করেছি, তোমাদের অনেক জ্বালিয়েছি। তোমরা আমাকে মাফ করে দিও। ভাবিকে বইলো তার এই পুঁচকিকে মাফ করে দিতে। জানো ভাইয়ু ভাবি না অনেক ভালো। আমরা ভাবিকে যেমন দেখি উনি আসলে তেমন না। ওনার খুব সুন্দর একটা মন আছে।”
এতটুকু বলে রাহমিদ আর কিছু বলতে পারলো না। শরীর একেবারে ছেড়ে দিলো। রায়হান অস্থির ভঙ্গিতে ওকে ডাকতে থাকলো। চিল্লিয়ে বললো,
“ও কলিজা, টোটন রে। কি হলো কথা বলিস না কেন?”
ইফরা দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললো। রায়হান ভাইকে তাড়াতাড়ি কোলে নিয়ে হাসপাতলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। রুদও ভাইয়ের পিছু পিছু মাথায় হিজাব পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ইফরা আর বোরকা পড়ার সময় পেলো না। এর আগেই রায়হান ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ইফরা দ্রুত গিয়ে ওযু করলো। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসলো। দীর্ঘ আঠারো বছর কান্না না করা শক্ত খোলসের ইফরা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।
শুধু বিয়ের পর দাদিকে জড়িয়ে ধরে আধা ঘণ্টা কান্না করা ছাড়া দীর্ঘ আঠারোটি বছর ইফরা চোখের পানি ফেলেনি। এমনকি মহান রবের নিকটও কেঁদেকেটে কিছু চায় নি। ভীষণ অভিমান জমেছিল রবের প্রতি। তাই মুখ ফুটে নিজের জন্য কিছুই চাইনি। তবে আজকে ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলের জন্য তার বুক ফেটে যাচ্ছে একেবারে। এই অল্প কয়েকদিনেই বাচ্চাগুলোর প্রতি তার ভীষণ মায়া তৈরি হয়েছে। এতদিন তা টের না পেলেও আজকে রাহমিদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় খুব করে তা টের পাচ্ছে।
সিজদায় গিয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বললো,
“আল্লাহ ওইটুকু বাচ্চার সাথে খারাপ কিছু করো না। ও এখনো নিষ্পাপ। মা, বাবাকে বাচ্চাটা একেবারে ছোট্ট থাকতে হারিয়েছে। ওকে এতো অল্প সময়ে এতো বড় পরীক্ষা দিও না। ওর কিছু হলে ওর ভাই নামক মানুষটা মরে যাবে মাবুদ।”
ইফরা কান্নার দমকে কথা বলতে পারলো না।
______
রায়হানের শরীর থেকে ঘাম টপটপ করে পড়ছে। হাসপাতালের দেয়াল ঘেষে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত পাথর। রুদ পাশে বসে কেঁদে চলেছে। রায়হানের কোনো সাড়া শব্দ নেই। যেন ছুঁয়ে দিলেই ঠাস করে পড়ে যাবে এমন দেখাচ্ছে তাকে। অনন্তকাল ধরে ক্লান্ত সে। ফোন বাঁচছে পকেটে। কিন্তু ধরছে না সে। অনেকক্ষণ বাজার পর রায়হান আস্তে করে ফোন বের করলো। না দেখেই রিসিভ করলো। ওপাশে ইফরা অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনারা কোন হাসপাতালে আছেন। আমাকে অ্যাড্রেস বলুন দ্রুত।”
রায়হান রোবটের মতো অ্যাড্রেস বলে রেখে দিলো ফোন। খানিকক্ষণের মধ্যে কালো বোরকা পরিহিত ইফরাকে ছুটে আসতে দেখা গেলো। এসেই রায়হানের পাশে ধপ করে বসে পড়লো। আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
“ডাক্তার কি বলেছে?”
রায়হান মূর্তির মতো বসেই থাকলো। না নড়াচড়া করলো আর না কিছু বললো। ইফরা ওকে ধাক্কা দিলে রোবটের মতো মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইলো। ইফরাও তাকিয়ে আছে। ইফরা অনেক কিছু বলেই গেলো কিন্তু রায়হান কিছুই বললো না। ইফরার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। ইফরা বুঝলো রায়হান ভিতরে ভিতরে ভীষণ ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার রুম থেকে বের হলে রায়হান দ্রুত উঠে ডাক্তারের সামনে দাঁড়ালো। কেমন উন্মাদের মতো বলতে লাগলো,
“এই যে স্যার, আমার এইটুকু বাচ্চা ভালো আছে তো।”
রায়হান হাত অল্প প্রসারিত করে দেখালো। ডাক্তার কিছুটা হকচকিয়ে উঠেছিল আচমকা রায়হানের আগমনে। তারপর মুখ গম্ভীর করে বললো,
“ওর তো অনেকদিন ধরেই অ্যানিমিয়া। আপনারা কোথায় ছিলেন? এতটুকু বাচ্চার রক্তের হিমোগ্লোবিন এতোটা কমে গেলো কি করে? এছাড়াও ওর মাইগ্রেইন এর প্রবলেমস আছে। স্নায়ুবিকভাবে ভীষণ দুর্বল বাচ্চাটা। বাচ্চাটার এতো মারাত্মক রোগ হওয়ার কারণ কি? আপনারা কি করেন? বাচ্চার বাবা কি আপনি?”
রায়হান উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই ওর বাবা।”
ইফরা বুঝলো রায়হানের সেন্স হারিয়ে গেছে। কি বলছে, কি করছে সেটাও বলতে পারছে না। ডাক্তার সন্দেহ নিয়ে বললো,
“কিন্তু আপনাকে দেখে তো অতো বয়সী মনে হচ্ছে না। এইটুকু বয়সেই এতবড় বাচ্চার বাবা? যাইহোক যেটাই হন, রক্তের ব্যবস্থা ইমিডিয়েটলি করুন। বেশি অপেক্ষা করা যাবে না।”
ডাক্তার এরপর নার্সকে বললো,
“ওনাদেরকে ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করে দ্রুত জানান।”
নার্স “ইয়েস স্যার” বলে চলে গেলো। রায়হান শরীর ছেড়ে দিয়ে আবারও বসে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে হচ্ছে তার। ইফরার ভীষণ মায়া লাগলো। মাথায় হাত দিয়ে টিপে দিতে নিলেই রায়হান হাত ঝাড়া দিয়ে উঠলো। রাগ কণ্ঠে বললো,
“দূরে সরুন। আমার ভাইয়ের সকাল থেকে জ্বর আর আপনি কিনা বসে বসে তামাশা দেখেছেন? বাচ্চাটা যে অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিল আমাকে একটা ফোন দিয়ে জানাতে পারলেন না? আপনি ইচ্ছে করে ইনফর্ম করেন নি তাই না? ও তো আপনার শত্রু তাই ইচ্ছে করেই জানান নি। ও মরে গেলে আপনার কি? আপনি তো বেঁচে যান।”
এরকম নানা কথা বলতে থাকলো। যার সবকিছু ইফরাকে দোষী করে। রায়হানের যে হুঁশ নেই তা বোঝাই যাচ্ছে। ইফরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ও রাহমিদকে মেরে ফেলতে চায়। নার্স এসে রায়হানকে রক্তের গ্রুপ বললে রায়হান রক্তের জোগাড়ে বেরিয়ে পড়লো। এদিকে যে একজনের মন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেলো সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না।
_______
“আলহামদুলিল্লাহ বাচ্চাটা সুস্থ আছে। আর টেনশনের কিছু নেই। আল্লাহ আপনাদেরকে সাহায্য করেছেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান।”
কথাটি শুনে শুষ্ক পাতায় একফোঁটা পানির ন্যায় রায়হানের বুক তৃষ্ণিত হলো যেন।