Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 431



আজল পর্ব-০৫

0

#আজল
#পর্ব-পাঁচ

১২.

প্রিয়তার আজকাল কেন জানি সবকিছু অসহ্য লাগে। মনের মধ্যে বিচিত্র ধরনের অস্থিরতা। এমন অবস্থা যে মেয়েটা কেও মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে। ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে এই অসহ্য লাগাটা যেন বেড়ে গেছে। ভাবি, সাঁচিকে ওর খুব হিংসে হচ্ছিল। কি সুন্দর পড়ালেখা প্রায় শেষ করে বিয়ের পিড়িতে বসলো! অনার্স শেষ করে দুবছর চাকরি ও করেছে। তারপর আবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আর ভাইয়ের সাথে বয়সের ডিফারেন্স টাও বেশি না, দু তিন বছর হবে হয়তো? দুজন পাশাপাশি দাড়ালে কি সুন্দর মানিয়ে যায়! দুজনেরই কথা, বার্তা, আচার আচরনে এক ধরনের স্থীরতা আছে। ভবিষ্যতে যে ওরা সুখি হবে তা যে কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে। আর তার অবস্থা হচ্ছে একেবারে বিপরীত। জীবনের মানে বোঝার আগেই জীবনটাকে বোঝা মনে হচ্ছে! এই বাইশ বছর বয়সেই সে দুই বছর বয়সের এক বাচ্চার মা। তার উপর সুখি হওয়ার অভিনয় করতে করতে ও টায়ার্ড হয়ে গেছে। তানভীরের সাথে ওর কোন কিছুতেই মিল হয় না। ও ডানে গেলে তানভীর যায় বামে! হবেই বা কিভাবে? বারো বছর, পুরো এক যুগ পার্থক্য দুজনার!? এই ব্যবধানটাও মেনে নেওয়া যেতো যদি তানভীর ওকে বোঝার চেষ্টা করতো, ওর প্রতি সহানুভূতিশীল হতো!

ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো প্রিয়তা। মনে কত রঙিন স্বপ্ন ছিলো। ভার্সিটি তে পড়বে, চাকরি করবে, ঘুড়ে বেড়াবে। কোনো কিছুই পূরন হলো না!বয়সে বারো বছরের বড় একজনার সাথে ধরে বেঁধে বাবা আঠারো তেই বিয়েটা দিয়ে দিলো। ভাইয়া বাবাকে মানা করেছিল অনেক, কিন্তু বাবা কোন বাড়নই শোনেনি। বাবার কথা অনুযায়ী বিয়ের পরে পড়াশোনা, ঘুড়ে বেড়ানো, চাকরি যা মন চায় কোরো। প্রিয়তা তো ভেবেছিলো জীবনে মনে হয় আর পড়া হবে না! তাও ওর ভাগ্য ভালো যে, তানভীর ওকে পড়ালেখার ব্যাপারে বাধা দেয়নি। তানভীর নিজে মাস্টার্স পাশ তাই বউ অন্তত অনার্স পাশ হবে এটা ভেবেই হয়তো মানা করেনি। আর তাছারা তানভীরের অন্য ভাবীরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় প্রিয়তা জোর বাঁচা বেঁচে গেছে! ও এই কারনেই পড়ালেখার সুযোগ টা পেয়েছে হয়তো!

কিন্তু এর জন্য কম কষ্ট ও সহ্য করেনি প্রিয়তা! ইন্টার শেষ হওয়ার আগেই বাচ্চা পেটে চলে আসলো। সেই অবস্থায় পড়ালেখাটা করাটা যে কি কষ্টকর তা একজন প্রেগনেন্ট মেয়ে ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না। তানভীর কে ও রিকোয়েস্ট করেছিলো, বাচ্চাটা পরীক্ষার পরে নিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সে নিজের ইচ্ছার বাইরে এক পাও নড়ে না। ওর ইচ্ছা হয়েছে বাচ্চা নেবার তাই তখনই নেবে। প্রিয়তা ভেবে পায়না তানভীর একজন শিক্ষিত লোক হয়ে কিভাবে প্রতি পদে পদে ওকে অপদস্থ করতে চায়! এই যে এখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পরে প্রিয়তা! সরকারি তে চান্স পাওয়া সত্বেও বাড়ির কাছাকাছি একটা বেসরকারি তে পড়তে হচ্ছে প্রিয়তার, বলাই বাহুল্য সেটাও তানভীরের ইচ্ছাতেই। তাছাড়া আরো কত শত ইচ্ছা যে প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে চাপিয়ে রাখতে হয় তা কে বুঝবে? ভার্সিটিতে ওর বান্ধবী গুলো যখন আড্ডা দেয়, শপিং এ যায়, রেস্টুরেন্টে খেতে যায় ওর তখন মেয়ের জন্য পরিমরি করে ঘরের দিকে ছুটতে হয়। সবাই যখন দূরের ট্রিপ প্লান করে তখন ও ঘর পাহারা দেওয়ার প্লান করে। কারন তানভীর বিজনেস ট্রীপে। এসব কিছু যখন মনে পড়ে খুব কান্না পায় প্রিয়তার। ও ছটফট করে খাচায় বন্দী পাখির মতো। ওর ও ইচ্ছে করে একটু আকাশে ডানা মেলে উড়তে। কিন্তু কিভাবে উড়বে? ওর তো ডানাটাই কেটে নেওয়া হয়েছে??

অথচ তানভীর ঠিকই ঘুরে বেরাচ্ছে নিজের মতো। বিজনেসে ট্রিপের নাম দিয়ে দেশ বিদেশের কত জায়গায় ঘুরে আসলো তানভীর। আসার পর দামী কিছু গিফট প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কর্তব্য সারে। আজকাল এই বন্দীত্ব মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তার। প্রায়ই মন বিদ্রোহ করে উঠতে চাচ্ছে। মনে হয় ভাইকে জানাক যে, ও ভীষন কষ্টে আছে। এই জীবন মেনে নিতে পারছে না আর। ও জানে ফুয়াদকে বললে ও হয়তো এক সেকেন্ড ও থাকতে দেবে না প্রিয়তাকে এই নরকে। শুধু বাবার ভয়ে চুপচাপ আছে প্রিয়তা। আবার ভাইয়ের ও নতুন বিয়ে! ওর জীবনের নতুন পথ চলার কেবল শুরু! এখন ওকে কোন টেনশন দিতে চায় না প্রিয়তা। কিন্তু কতদিন চুপ থাকবে?? কতদিন এরকম নিজের মনকে মেরে পথ চলবে প্রিয়তা? কতোদিন তানভীরের এই অন্যায় আচরণ মেনে নিতে হবে? কতোদিন?

১৩.

” আর ইউ ইন আ রিলেশনশিপ? আর ইউ ইন লাভ উইথ সামওয়ান? অর আর ইউ আ গে?”

অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে ফুয়াদ। ওর চোখের উপর হাত। ফ্রেশ হতেও ইচ্ছা করছে না। কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে শরীর টা। আর মনটাও ভার হয়ে আছে কদিন থেকে। আসলে শুয়ে শুয়ে সাঁচির কথা ভাবছিলো। সেদিনের পর থেকে ও সাঁচির সাথে কথা বলছে না খুব একটা। খুব বিরক্ত লেগেছিলো সাঁচির কাজ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে এত করে বুঝানোর পরও সে যদি এরকম করে তাহলে বিরক্ত লাগবে না? ফুয়াদ তো সময় চেয়েছিলো আর সাঁচিও রাজি হয়েছিল। তবে? তবে কেন এমন করলো? ওর সাঁচির দিকে তাকালেও খারাপ লাগে। মেয়েটা তারপর থেকে মন খারাপ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর সামনে আসে না পারতপক্ষে। ইদানিং আবার প্রিয়তার রুমে থাকতে শুরু করেছে। মানা করতে যেয়েও করেনা ফুয়াদ। কেন করবে? সাঁচি কেন ওকে সরি বললো না? থাক তবে ওর মতো?

এসব আকাশ পাতাল ই ভাবছিলো তখনই সাঁচির গলা শুনলো। হাত সরিয়ে দেখলো সাঁচি দাড়িয়ে আছে সামনে, চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
“সরি! কিছু বলছিলে নাকি?”
” আর ইউ আ গে? ”
চোখ বড় বড় করে তাকালো ফুয়াদ। চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি –
“কি বললে?”
” ও আচ্ছা! ইংলিশ বোঝেন না? আচ্ছা ঠিক আছে, বাংলায় বলছি। আপনি কি গে মানে সমকামী ??”

ওর কথা শুনে ফুয়াদ বিছানায় উঠে বসলো। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো। ওর হাসি দেখে কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকল সাঁচি- “বেহায়া লোক! হাসি হচ্ছে! আমি কি এমন হাসির কথা বলেছি!”

বিরবির করলো সাঁচি। ফুয়াদের হাসতে হাসতে কাশি উঠে গেল। সাঁচি সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলো ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ হাসি আটকে পানি খেলো একটু, তারপর গ্লাস টা আবার সাঁচির দিকে ফেরত দিলো। সাঁচি গ্লাস হাতে নিতে নিতে বললো-
” খুব তো হাসলেন? তা এখন বলেন তো? আপনি যদি গে না হয়ে থাকেন তবে চুমুতে এতো কিসের এ্যালার্জি!? একটা চুমুই তো খেয়েছি! তাতেই এতো রাগ? মেয়েদের মতো কান্না কাটি করছেন।
মনে হচ্ছে আপনার ইজ্জত লুটে নিয়েছি। ”
“কি বলছো এসব? তোমার কি ধারনা আছে তুমি কি বলছো?”
“খুব জানি!আপনার আচরন দেখে এর চাইতে ভালো কিছু মনে আসছে না,বুঝলেন? ”
” ওহ সাঁচি! তুমি আসলেই একজন মজার মানুষ, বুঝলে? এতো মজা করে কথা বলো ক্যান? আচ্ছা! একটা চুমুই তো! ঠিকই বলেছো! গতদিন তো তুমি করেছিলে? আজ আমি করি? আমার কাছ থেকে চাও তো নাকি? আর চুমু খেলেই বোঝা যাবে যে আমি ঐ টা না। তাইতো?”
হাসতে হাসতেই কথাটা বললো ফুয়াদ।
” হ্যা, চাই। আপনার কাছে চাইলেই মনে হচ্ছে করবেন? হুহ! চরিত্রবান স্বামী বলে আমাকে চুৃুমু দেবে! এতো এলার্জি মেয়েতে তো বিয়ে করেছেন কেন?”
” এটা একটা ভালো প্রশ্ন করেছো! আমিও ভাবি কেন বিয়ে করলাম? তবে উত্তর কিন্তু আছে আমার কাছে। শুনবে?”
সাঁচি ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফুয়াদের দিকে।
“আজকাল বয়স হচ্ছে বুঝলে? বন্ধু বান্ধব সব বিয়ে করে ফেলছে। আমি কিভাবে সিংগেল থাকি বলোতো? কথা বলার ও তো লোক চাই, তাই না?”
“স্বার্থপর কোথাকার? শুধু নিজের চিন্তা করেছেন। যাকে বিয়ে করেছেন তার চিন্তা কে করবে শুনি?”
“আমিই করবো! কে করবে আবার?”
“এই আপনার চিন্তা করার নমুনা? আপনি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। কেন রাখছেন তার কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না! এসবের মানে কি?”
“সাঁচি, সেদিনই তো কথা হলো তোমার সাথে? কিভাবে আগাবো জীবনে দু’জনে বসেই তো ঠিক করলাম। তবে এতো তাড়াতাড়ি অস্থির হচ্ছো কেন বলো তো? এরমধ্যেই তুমি আবার… ”
ক্লান্ত গলায় বলে ফুয়াদ। মেয়েটা সত্যি বড্ড অবুঝের মতো করছে।
“ঠিক তো হয়েছিলো কিন্তু আপনি তো হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন। তাই আমাকেই স্টেপ নিতে হচ্ছে। ”
“আচ্ছা, কি প্রমান করতে হবে? আমি গে না বা আমার কোন প্রবলেম নাই এটাই তো? আসো আজকে তোমাকে একটা চুমু দেই। আ লং ওয়েটেড কিস, তবে একটা শর্ত আছে কিন্তু!?”

সাঁচি তাকিয়ে থাকলো ফুয়াদের দিকে। বুঝার চেস্টা করছে, ফুয়াদ কি ওর সাথে ফান করছে নাকি? ও কি সত্যি সত্যি কিসি দেবে সাঁচিকে?

“ওমা! ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন!? এসো, কাছে এসো! আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই আসছি। ছেলেদের ই তো কাছে আসতে হয় তাই না?”

সাঁচির সামনে এসে দাড়ালো ফুয়াদ। সাঁচি এখনো ভ্রু কুঁচকে আছে? ওর ঠিকঠাক বিশ্বাস হচ্ছে না যে ফুয়াদ এমনটা করবে। ফুয়াদ সাঁচির দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায় –
“শর্তটা শুনবে না?”
“কিকককি শর্ত?”
নার্ভাস সাঁচি।
“চুমুর পরে তোমায় বলতে হবে যে আমি গে নাকি পুরুষ মানুষ!!?”

ফুয়াদের চোখে দুষ্টমি খেলা করছে। সাঁচি এবার একটু ঘামতে শুরু করেছে। ফুয়াদ সত্যি সত্যি ওকে কিস করবে!! শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে সাঁচির। গরম লাগছে ওর। সাঁচি যখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছিল তখনই ফুয়াদ ওর আরো একটু কাছে এলো, একহাত দিয়ে কোমর পেচিয়ে ধরল আর এক হাত চুলের মধ্যে দিয়ে মুখটা উচু করে ধরলো। কিছুক্ষণ সাঁচির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে নিলো ঠোঁট টা। তারপর একবার আলতো করে ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট ছুইয়ে পরে পুরো ঠোঁট ই মুখে নিয়ে নিলো। সাঁচি আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো, নিজের অজান্তেই ওর হাত দুটো চলে গেল ফুয়াদের বুকে।

কিছুক্ষণ বাদে সাঁচিকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে এসে দাড়ালো ফুয়াদ। সাঁচি তখনো বিভোর হয়ে আছে নেশায়। চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে আগের মতই। ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে, নাকের ডগা ঘামে চিকচিক করছে। অসম্ভব মায়াবী লাগছে সাঁচিকে। ফুয়াদের যে কি হলো তখন? বুকের মাঝে উথাল পাথাল আবেগের ঢেউ আছরে পড়ল যেন! সব কিছু ভুলে ও নেশারুর মতে এগিয়ে গেল সাঁচির দিকে। সজোরে সাঁচিকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমো খেতে শুরু করলো।

ঠিক কতক্ষণ পরে জানে না সাঁচি, মনেহলো ওর গাল দুটো ভিজে যাচ্ছে। সাঁচি বুঝলো না কার চোখের পানি? ওর নিজের নাকি ফুয়াদের? কিন্তু ফুয়াদ কেন কাঁদবে? ও তো নিজ ইচ্ছায় চুমু দিচ্ছে ওকে! তখনই মনে পড়লো যে, সেদিন ও কাঁদছিলো ফুয়াদ যখন সাঁচি ওকে চুমু দিয়েছিলো। কেন কাঁদে ফুয়াদ? একটা চুমুতে কান্নার কি?? ও কি তবে অন্য কাউকে ভালোবাসে? তাহলে ওকে কেন বিয়ে করলো?? ওর মতো ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ বিয়ে করে একটা মেয়েকে ঠকাবে এমনটাও মানতে পারে না সাঁচি! তাহলে কি হতে পারে!!??

” আমি খুব কস্টে আছি, ফুয়াদ! আমাকে তুমি মুক্ত করো, প্লিজ! আর পারছি না। নিয়ে যাও আমায়,প্লিজ!”
কে যেন ফুয়াদের কানে কানে ফিসফিস করে। আচমকা ছিটকে সরে যায় ফুয়াদ। কি করলো ও? এতো অল্পতেই সাঁচির কথার ফাঁদে পা দিলো? এতো অল্পতেই হেড়ে গেলো নিজের রিপুর কাছে? নিজের কাছে করা নিজের ওয়াদাও তো রাখতে পারলো না? মেয়েরা এমন হয় কেন? মায়া আর আবেগ দিয়ে যে কাউকে বেধে ফেলে অল্প সময়েই। এই কয়েকদিনের পরিচিত মেয়েটাও কিভাবে ওকে মায়ায় জড়িয়ে ফেলছে? ওর প্রতি ঠিকঠাক রাগও দেখাতে পারে না আর দূরেও ঠেলতে পারছে না? কি এক অদ্ভুত দোলাচল! ফুয়াদ সাঁচির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও তখনও চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে। ওর চোখের পানিতে সাঁচির মুখ ভিজে আছে। সাঁচির থেকে মুখ ফিরিয়ে ফুয়াদ চট করে বাথরুমে ঢুকে গেল। ওর কান্না ভেজা মুখ সাঁচিকে দেখাতে চায় না। পুরুষ মানুষের আবেগ দেখাতে নেই, পুরুষ মানুষের কান্না করা পাপ!

এই প্রথম ভালোবাসার ছোয়ায় সাঁচি ভেসে যাচ্ছিলো। ভালোলাগায় ডুবে বুদ হয়ে থাকা সাঁচির চোখ খুলতে ইচ্ছা হচ্ছিল না একটুও। একটু লজ্জা ও লাগছিলো ফুয়াদের সামনাসামনি হতে। তবুও অনেক কস্টে জোর করে চোখ খুলে দেখলে ফুয়াদ নেই। রুমে চোখ বুলালো, নাঃ! নেই! কোথায় গেল? হঠাৎ বাথরুমে পানি পড়ার আওয়াজ। বুঝলো ফুয়াদ বাথরুমে ঢুকেছে। যাক ভালোই হলো ও সামনে নেই। লজ্জা পেয়েছে হয়তো? ফুয়াদের চোখের পানিতে ভিজে যাওয়া গাল দুটো মুছে নিলো সাঁচি। একটুখানি ভালোবাসা তবুও কতো ভালো লাগছে? প্রিয় মানুষের ছোয়া বুঝি এমনই! একটুতেই মন ভরে যায়! শেষের দিকে এসে ঠোঁটে একটা কামড় দিয়েছে ফুয়াদ। জ্বলছে খুব এখন। হাত দিয়ে দেখলো রক্ত বেরোচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে টিস্যু দিয়ে ঠোঁট টা মুছে একটু লিপজেল লাগিয়ে নিলো। সাঁচি ভাবছে ফুয়াদের কি এমন কষ্ট যার কারনে ও কাঁদে! ওর জানতেই হবে? একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ যখন কাঁদে তখন বুঝতে হবে ব্যাপারটা গুরুতর। নিশ্চয়ই বুকের ক্ষতটার গভীরতা অনেক!!??

ফুয়াদের মা কতো আশা করে ছেলের দ্বায়িত্ব তার হাতে দিয়েছে, এখন ফুয়াদ যদি এরকম পাগলামি করতে থাকে তাহলে তো বিপদ? ওই বা আর কতোদিন ধৈর্য্য ধরে বসে থাকবে? এরকম চলতে থাকলে ওরও তো বিরক্তি চলে আসবে ফুয়াদের প্রতি। আর ছেলেটাই বা এমন কেন করছে? ছেলেটার মনে কি চলছে তা মুখে না বললে বুঝবে কি ভাবে সাঁচি? কথাও তো বলতে চায় না? অর্ধেক কথা বলে আর অর্ধেক মনের মধ্যে রেখে দেয়! এমন অবস্থায় সল্যুশান আসবে কোত্থেকে?

চিন্তিত অবস্থায় রান্না ঘরের দিকে গেল সাঁচি।

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৪

0

#আজল
#পর্ব-চার

১০.

রাতে রুমে ঢুকতেই ফুয়াদ বললো-
“সাঁচি, দুকাপ কফি বানিয়ে আনো তো। আজ তোমার সাথে একসাথে বসে কফি খাবো আর গল্প করবো।”
সাঁচি তো মহা খুশি। ফুয়াদ নিজের মুখে বলেছে আজ গল্প করার কথা। সে কিছুক্ষণের মধ্যে দু কাপ কফি বানিয়ে আনলো। রুমে এসে বসতেই ফুয়াদ বললো-
“এখানে না, আসো বারান্দায় যাই। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নাও। ঠান্ডা বাতাস আছে।”
“হুম নিচ্ছি। ”
সাঁচি আলমিরা খুলে একটা পাতলা শাল বের করে গায়ে জড়ালো। তারপর বারান্দায় গেলো। ফুয়াদ বসার চেয়ার গুলো সাইড করে পাটি পেতেছে। সাঁচি আরো একবার চমকিত হলো। সে মনে মনে ভাবছিলো পাটি পেতে বসার কথা আর ফুয়াদ যেন সেটা শুনতে পেয়েছে! ইশ! ইচ্ছে গুলো কি সুন্দর পুরোন হয়ে যাচ্ছে? ফুয়াদের প্রতি মনটা কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলো।

বারান্দায় মুখোমুখি বসা দুজন, দুজনের দু হাতে দুটো কফির মগ। কিছুক্ষণ দুজনই নিরব থেকে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ফুয়াদ খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। আর সাঁচি মাঝে মাঝে আড়চোখে ফুয়াদকে দেখছে আর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফুয়াদই নিরবতা ভাঙল-
” তোমার পড়ালেখার কি খবর বলোতো?”
” মাস্টার্স এর প্রথম সেমিস্টার শেষ। দ্বিতীয় সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে ১৫ তারিখ থেকে।”
” ভালোই হলো! বাবা মা চলে গেলে তোমার আবার একা একা লাগতো। আমিতো কাজের চাপে তোমাকে সময় দিতে পারবো না অতো। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে ক্লাস, পড়ালেখা নিয়ে বিজি থাকবা, লোনলি লাগবে না।”
” জ্বী।”
” তোমার ক্লাস কয়দিন সপ্তাহে? ”
“সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস।”
” ঠিক আছ। তোমার যেদিন যেদিন ক্লাস থাকবে সেদিন আমাকে আগে থেকে জানিয়ে দেবে। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবে।”
সাঁচি ঘাড় নাড়ালো। ওর আজকে চুপ থেকে ফুয়াদের কথা শুনতে ভালো লাগছে খুব। ওর গলার ভয়েজটা একদম অন্যরকম। কথা বললে মনেহয় কবিতা আবৃতি করছে।
” কি হলো? কিছু বলো? আজ তো আমিই বকবক করছি। ”
” হুম, বলুন না! আমার ভালো লাগছে আপনার কথা শুনতে। আচ্ছা, আপনি কি আবৃতি করতেন? এতো সুন্দর করে কথা বলেন কিভাবে?”
সাঁচির কথায় শব্দ করে হাসলো ফুয়াদ-
“হুম, করতাম এক সময়। তুমিও তো খুব সুন্দর করে কথা বলো। একেবারে চিকন রিনরিনে গলা, কানে বাজতে থাকে।”
” আপনার মতো না। আপনার টা শুনলে মনে হয় খেয়ে ফেলি এক্কেবারে। ”
বলেই জিভ কাটলো সাঁচি। এই রে! কি বলে ফেললো! দুর! এই লোকের সামনে সবসময় এমন বেসামাল হয়ে যায় কেন ও!! এমন ছেচড়ামো পনার কোনো মানে হয়!! লোকটা নিশ্চয়ই ওকে বেহায়া ভাববে?? কিন্তু কি করবে ও? কিছুতেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। ফুয়াদ যেন ওকে চুম্বকের মতো টেনেই যাচ্ছে। লজ্জায় সাঁচির গাল দুটো লাল হয়ে গেল।

ওদিকে সাঁচির কথা শুনে ফুয়াদের কাশি উঠে গেল। এই জন্যই ভয় লাগে ফুয়াদের। মেয়েটা শুরু থেকেই ওর প্রতি দূর্বল। ইদানীং সেই দূর্বলতা বেড়েছে বুঝতে পারে ফুয়াদ। ভয় লাগে নিজেই না কখন হার মেনে যায় মেয়েটার কাছে। তারপর মান অভিমান অশান্তি। কোন কিছু না যেনে বুঝে জীবন শুরু করাটা বোকামি মনেহয় ফুয়াদের । তাইতো মেয়েটার সাথে লুকোচুরি খেলছে প্রতিনিয়ত। এক অসস্তিকর নিরবতা নেমে এসেছে দু’জনার মাঝে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না কেউই। তাই তো দুজনেই চুপ করে আছে। একসময় সাঁচিই কথা বললো-
” আসলে, আমি কিন্তু ওরকম না। আপনার সামনে আসলে কি যে হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। সরি! আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি নি! হঠাৎ করেই মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেছে! ”
“ইটস ওকে, সাঁচি! এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে! তুমিতো তোমার হাজবেন্ড কেই বলেছো! কোনো পর পুরুষ কে তো বলোনি? আসলে আমিই মনেহয় হাজবেন্ড টাইপ বিহেব করছি না, তাই না!?”
ফুয়াদের কথা শুনে সাঁচি আরো লজ্জিত হয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
“আচ্ছা, প্রেম করেছো কখনো?”
“নাহ”
“প্রস্তাব পেয়েছো নিশ্চয়ই। ”
“হুম। অনেক,বাট বাবার নিষেধ ছিলো। আমি ফ্যামিলির বড় কিনা, ওসব প্রেম ভালোবাসা আমার জন্য না! তো আমি ভেবেছিলাম যার সাথে বিয়ে হবে সে তো আমার নিজের হবে! অধিকার থাকবে তার উপর আমার। নিজের সমস্ত আবেগ ভালোবাসা তাকেই দেখাবো। এই জন্যই হয়তো আপনার সাথে এমন কথা বলে ফেলি যা বলা উচিত না। আপনি হয়তো আমাকে বেহায়া ভাবেন। তবুও বলছি, আপনাকে দেখলে আমার মনে ভয়ঙ্কর সব ইচ্ছা জাগে। বিয়ের জন্য পাত্র হিসেবে যেদিন আপনার ছবি দেখেছিলাম সেদিন ই আপনাকে পচ্ছন্দ করে ফেলেছিলাম। তারপর যতদিন গেছে আপনার প্রতি আকর্ষন তত বেড়েছে। একদিকে আপনার নির্লিপ্ততা, অন্যদিকে আপনার কেয়ারিং বিহেভিয়ার, মনেহয় দুটো কারনেই আপনার প্রতি আমায় বেশি আকর্ষিত করেছে। হয়তো ভালোবাসতে শুরু করেছি আপনাকে। আমি আসলে বুঝতে পারছি না। আগে তো কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরিনি তাই বুঝতে পারছি না।”
একনাগারে বলে দম ফেললো সাঁচি। নিজের মনের সব কথা ফুয়াদকে বলতে পেরে নিজেকে হালকা লাগছে অনেক। যেন এক মন পাথর এর ভার নেমেছে বুক থেকে।

আর এদিকে সাঁচির কথা শুনে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ফুয়াদ। এই মেয়ে যে এরকম অসম্ভব কথাবার্তা এভাবে অবলীলায় বলে ফেলবে তা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ওর! কি করবে ও এখন??? ওর কথা শুনে ফুয়াদের শরীর গরম হয়ে গেছে, কান দিয়ে ধুয়া বের হচ্ছে। ও সাঁচির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দু বার বড় বড় নিশ্বাস টানল। তারপর মাথাটা ঠান্ডা করে সাঁচির দিকে ফিরলো। ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। সাঁচি অবিশ্বাস্য চাহুনী নিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ফুয়াদ বলতে শুরু করলো-
” সাঁচি, এখন কিছু কথা বলবো। খুব মন দিয়ে শুনবে, কেমন?”
সাঁচি মাথা নাড়লো।
” সাঁচি, আমাদের এ্যারেন্জ ম্যারেজ হয়েছে, তাই না? আমরা কেউ কাউকে আগে থেকে চিনতাম না, একে অপরকে জানতাম না। এরকম পরিস্থিতিতে দুটো অপশন হাতে থাকে। কি কি বলোতো??”
” কি?”
” এক. দুজনে দুজনকে না জেনেই শারীরিকভাবে ভাবে সম্পর্কটাকে শুরু করতে পারি। পরে দুজনার একে অপরকে জানাজানির ব্যাপার। এক্ষেত্রে পরে দুজনের মনের মিল না হলেও শুধু শারীরিক ভাবে একে অপরকে কাছে পাওয়ার জন্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাটা কঠিন হয়ে যাবে!
দুই. দুজনাই একটু কস্ট করে দুজনকে সময় দিলে, একে অপরকে চিনলে ভালো হবে না, বলো??? একে অপরের চাওয়া, পাওয়া,ইচ্ছা, অনিচ্ছা এগুলো জেনে নিয়ে মিউচুয়াল আন্ডার্স্ট্যান্ডিং এ জীবন শুরু করলে আমার মনে হয় জীবনটা অনেক আনন্দের হবে।
আমি চাই তুমি আমাকে সম্পূর্ণ জানো, বোঝো, চেনো তারপর আমরা আমাদের জীবনে আগাবো। আমার অনেককিছু জানানোর আছে তোমাকে, সাঁচি! তুমি কি শুনবে না সেগুলো!? আমি আমার জীবনে একজন স্ত্রী নয় একজন বন্ধু কে চাই সাঁচি! আমার একজন বন্ধুর খুব দরকার জীবনে।”

ফুয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলো সাঁচি। সেই চোখটা কি চাইছে? আকুতি নাকি নির্ভরতা? আলো আধারির মাঝে কিছু বুঝতে পারলো না সাঁচি। শুধু বুঝলো ওর হাতে ধরা ফুয়াদের হাত দুটি মৃদু কাঁপছে। সেটা কি আবেগে নাকি ভয়ে বুঝলো না সাঁচি।
“তবে আমি এই ডিশিসন তোমার উপর ছেড়ে দিলাম সাঁচি। তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবে ই আগাবো। জীবনে আমি বহুবার কম্প্রোমাইজ করেছি, আরো একবার না হয় করবো! বলো তুমি কি চাও?”
“ঠিক আছে! আপনার যেভাবে ঠিক মনেহয় সেভাবেই আগাবো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, সাঁচি। সম্পর্কের শুরুটা তবে বন্ধুত্ব দিয়েই হোক? ক্যান উই বি ফ্রেন্ডন্স?”
ফুয়াদের চোখে উত্তরের আশা। সাঁচি মাথা নেড়ে হ্যা বলে। বলে দ্বীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সাঁচি। কোনে পুরুষ যদি নিজেকে এভাবে অসহায়ের মতো নিবেদন করে তবে ও মেয়ে হয়ে কি করবে? সে তো আর এটা বলতে পারে না যে, না এটা আমি মানবো না। মেয়ে হয়ে জন্মেছে যখন সবকিছু সহ্য তো করতেই হবে। আর তাছাড়া, সারাজীবনের ভালোর জন্য এটুকু তো করতেই হবে তার! মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া- এটাই তো মেয়েদের জীবন। তবে, খুব আপন কারো জন্য মেনে নেওয়াতে মনে হয় কস্ট নেই! তাতে যদি তার ভালো হয় তাহলে তো কথাই নেই! ডিশিসনটা নিয়ে সাঁচির নিজের কাছেই ভালো লাগলো।
আর ফুয়াদ এতই খুশী হলো যে সে নিজের হাতে ধরে রাখা সাঁচির হাত দুটিতে দুটো চুমো এঁকে দিলো।

১১.

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে সাঁচি। ফুয়াদের বাবা মা আজ টাঙ্গাইল চলে যাবে। তাই আজ সাঁচি সকালেই ঘুম থেকে উঠেছে। সকালের নাস্তাটা আজ নিজের হাতেই তৈরী করেছে। সেই সাথে শশুর শাশুরির যাতে বাড়ি যেয়ে রান্না না করতে হয় তাই হরেক পদের তরকারি রান্না করে দিচ্ছে সাঁচি। রান্নাটা ভালোই পারে সাঁচি। বাড়ির বড় মেয়ে বলে কথা। এই কদিন ওর শাশুড়ি মা একদম রান্নাঘরে যেতে দিতো না। বলতো-
“আমি বাড়ি গেলে কোরো। তখন তো তোমাকেই করতে হবে।এখন বরং তুমি আমাদের চা বানিয়ে খাওয়াও।”
আজ সাঁচিকে এতো রান্না করতে দেখে বকা দিলেও মনে মনে যে খুশি হয়েছেন সাঁচির শাশুরি তা ওনার চেহারা দেখে বুঝতে পারলো সাঁচি। ওর ও বেশ ভালো লাগছে শাশুড়ির জন্য কিছু করতে পেরে।

ভালো লাগার কারনও আছে যে! সেদিনের পর থেকে ওর আর ফুয়াদের সম্পর্কটা খুব সহজ হয়ে গেছে। এই কয়েকটা দিন বেশ সাবলীল ভাবে ফুয়াদ ওর সাথে গল্পগুজব করেছে, ওকে সময় দিয়েছে। ওকে সাথে নিয়ে এজায়গা ওজায়গা বেড়াতেও গেছে। ওর ভার্সিটিতেও গেছে ভর্তি সংক্রান্ত খোজখবর নিতে। বাহিরে থাকা কালীন ওর পচ্ছন্দের খাবার কিনে দিয়েছে। মোটকথা
সময়গুলো বেশ ভালো কেটেছে সাঁচির। গতকাল থেকে ফুয়াদের অফিস শুরু হয়েছে। ও খুব ব্যস্ত হয়ে গেছে। সাঁচির একটু খারাপ লাগলেও ও মেনে নিয়েছে। সাঁচি ওর শশুর শাশুড়ি কে নাস্তা দিচ্ছিলো আর ওর শাশুড়ি মা ওকে সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়ে জানাচ্ছিলো। তখনই ফুয়াদ সাঁচিকে ডাকছে-
“সাঁচি,এই সাঁচি! একটু এদিকে আসবে?”
সাঁচি দৌড় দিলো বেড রুমের দিকে। ওর মনেই নাই ফুয়াদের আজ অফিস আছে। রুমে যেয়ে দেখে ফুয়াদ নেই। তবে ওকে ডাকলো কোথা থেকে? ভাবতে ভাবতে ফুয়াদ বাথরুমের দরজা সামান্য খুলে বললো-
“সাঁচি, আমার টাওয়েল টা বারান্দা থেকে এনে দাওনা প্লিজ। তাড়াহুড়ো তে আনতে ভুলে গেছি।”
“দিচ্ছি। একটু ওয়েট করুন! ”
ফুয়াদকে টাওয়েল দিয়ে সাঁচি চট করে বিছানাটা গুছিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ পরে ফুয়াদ বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। আড়চোখে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে সাঁচি মনে মনে হতাশ হলো। সেই গেঞ্জি আর প্যান্ট পড়েই বেরিয়েছে। এই ছেলেটা এমন কেন! ভুলেও একবারের জন্য কাপড় ছাড়া বেড়োয় না। এতো সচেতন হওয়ার কি দরকার! একটু ভুলভাল হলে কি হয়? সাঁচির কি ইচ্ছে হয় না ওকে একবার খালি গা দেখার! আচ্ছা! ওর বুকে কি ঘন লোম আছে? মা বলতো, যেসব পুরুষের বুকে লোম হয় তারা ভীষন মায়াময় হয়। তাদের বুক ভর্তি মায়া। তারা কাউকে কষ্ট দেয় না। ওর এখনো ফুয়াদের বুকটাই দেখা হলো না! সাঁচি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
‘বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে লোকটা ওকে একেবারে বোন বানিয়ে দিলো!!??’
হুহ! মনেমনে বিরবির করে গালি দেয় ফুয়াদকে
” লাজুক বানর কোথাকার? ”
“সাঁচি, বাবা-মা রেডি হয়েছে? গাড়ি চলে আসবে এখনি। যাও তো তাড়া দাও বাবা মা কে। আমারও বেরুতে হবে আজকে মিটিং আছে একটা!”

সাঁচি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ও জানে ওকে বের করে দিয়ে এখন কাপড় পরবে ফুয়াদ। প্রতিদিনই সে এরকম কোন না কোন কজ দেখিয়ে সাঁচিকে রুম থেকে বের করে কাপড় পাল্টায়। সাঁচি বাবা মায়ের সবকিছু গোছগাছ করে দিয়ে ওনাদের চা খেতে দিয়ে ফুয়াদকে ডাকতে এলো। রুমে ঢুকো থমকালো সাঁচি। ফুয়াদ ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছে। ফুয়াদ আজকে সাদা শার্টের উপর লাইট ব্লু কালারের ব্লেজার পরেছে সাথে জিন্সের প্যান্ট। চুলগুলোতে জেল দিয়েছে মনে হয়! একদম পলিশ হয়ে আছে, একটুও দুলছে না। সেভ করা গালে নীলচে আভা। আফটার শেভ দিয়েছে! নাকি পারফিউম! নাকি দুটোই? পুরো রুম জুড়ে পুরুষালি স্মেল। এতো সুন্দর লাগার কি দরকার ফুয়াদের!?

সাঁচি মাতাল হয়ে গেল। ও মোহগ্রস্থের মতো আস্তে আস্তে ফুয়াদের দিকে এগিয়ে গেল। আয়নায় সাঁচিকে দেখে ফুয়াদ ঘুরে দাড়ালো। চোখ নাচিয়ে সাঁচি কে ইশারা করলে কি হয়েছে।
সাঁচি বললো-
“চুল গুলে এমন হয়ে আছে কেন?”
“কেমন? ঠিকই তো আছে দেখলাম? জেল দিলাম।কাজের সময় চুলগুলো ওড়াউড়ি করে, খুব কাজে ডিস্টার্ব হয়।”
” ও মা মুখে কি লেগে আছে? দেখি?”

বলেই গালে হাত দিলো, তারপর সেই হাত দিয়ে একটু ঠোঁট টা ছুয়ে দিলো। ফুয়াদের পাতলা ঠোঁট দুটো সাঁচিকে ডাকছে যেন!! ফুয়াদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাঁচি আচমকা ওকে কিস করে বসলো। প্রথমে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট ছেয়ালো তারপর গভীরভাবে ঠোঁটের দখল নিলো।দু হাতে আলতো করে জরিয়ে ধরলো ফুয়াদের পিঠ জোড়া। ফুয়াদ ঠায় দাড়িয়ে রইল কাঠ হয়ে। না সে চুমুতে পার্টিসিপেট করলো না সাঁচিকে বাধা দিলো! কিছুক্ষণ পরে সাঁচি যখন ওকে ছেড়ে দিলো, ও দেখলো ফুয়াদ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আশ্চর্য! চুমুতে ছেলেমানুষ কাঁদে নাকি? কখনো এরকমটা শোনেনি সাঁচি। পুরুষ সব সময় আগ্রাসী হয় মেয়েদের ব্যাপারে। আর এখানে দেখছে উল্টোটা! আবেগে মেয়েরা কাঁদে এটা জানে সাঁচি কিন্তু ছেলেরা? সাঁচি খুব অবাক হয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ফুয়াদ বললো-
” ফার্স্ট কিসটা এরকম না হলেও পারতো সাঁচি?”
ফুয়াদের কথাতে ঘোর কাটলো সাঁচির। এ কি করলো ও??!! এতে ছলাকলা করে কেন কিস করলো ও!? নিজেকে কেন যে বারবার ফেলনা বানাচ্ছে ফুয়াদের কাছে?? কেন এই আকর্ষন বের হতে পারছে না সাঁচি? কেন ফুয়াদকে দেখলে মাথা কাজ করে না? নিজেকে খুব হীন আর ছোট মনে হলো নিজের কাছেই। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে গেলো সাঁচির। ফুয়াদের চোখে চোখ রাখার যোগ্যতাও যেন হারিয়ে ফেললো। নিজেকে ফুয়াদের চোখ থেকে বাঁচাতেই যেন দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ওর মাথায় শুধু ঘুরতে থাকলো-
“আ থাউসেন্ড অব এক্সকিউজ বিহাইন্ড আ সাকসেসফুল কিস”

কিন্তু এতো এক্সকিউজ দিয়ে যে চুমুটা দিলো, চুম্বনটা কি সার্থক ছিলো!!? ফুয়াদতো অংশই নিলো না? ঠায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। একা একা কি শখ পূরন হয়? আর তাছাড়া এতো ছলচাতুরি করে করা এই এক তরফা চুম্বনের সার্থকতা বা কি?

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৩

0

#আজল
#পর্ব-তিন

৭.

দুই দিন বাবার বাড়িতে থেকে আজ শশুড়বাড়ি ফিরলো সাঁচি। এই দুদিনের একদিন ফুয়াদ শশুড়বাড়িতে বাজার করার রীতি পূরন করলো আর একদিন ওরা দাওয়াত খেয়েই পার করলো। সাঁচির বাবার বাসা ওয়ারিতে। সাঁচির জন্ম বেড়ে ওঠা সবই এই ওয়ারিতে। এখানেই ওর বাবা চাচারা স্থায়ীভাবে থাকে বহুকাল। যদিও সবারই আলাদা আলাদা সংসার, তবুও যে কোন উপলক্ষে বাবা চাচারা সবাই একসাথে হয়ে যায়। উপলক্ষের দিনগুলোতে একসাথে খাওয়া দাওয়া, আড্ডা সব একসাথে। ওরা কাজিনরা মিলেই বিশাল এক গ্যাং। ওদের সাথে থাকলে সময় যেন ফুর ফুরিয়ে পাড় হয়ে যায়। সাঁচি আর ফুয়াদের দুটো দিনও কিভাবে যে পার হলো ওরা টেরই পেলো না। সবসময় লোকজনের ভীর থাকার কারনে ফুয়াদ আর সাঁচি নিজেদের জন্য কোন সময়ই বের করতে পারলো না। দুজনে চাইলেও একাকি সময় কাটানো পারলো না। হয় ওর কাজিনরা সব চলে আসতো আড্ডা দিতে। আর নয়তো ওদের দাওয়াত থাকতো কারো না কারো বাসায়। আর ফুয়াদ ও কেন কে জানে খুশি মনে আড্ডা দিতো। নতুন জামাই বলে মনেই হতো না ওকে। ওর ভাই বোনদের সাথে ফুয়াদ এমনভাবে মিশে গেছে যে, কেউ বিশ্বাসই করবে না ও এ বাড়ির নতুন জামাই। সারাদিন আড্ডা বাজি, তারপর খাওয়া দাওয়া, হৈ-হুল্লোড়ের করে রাতে দুজনেই এতো টায়ার্ড থাকতো যে নিজেদের মধ্যে আর কথা বলার সুযোগ হতো না। তাই আজ শশুড়বাড়ি ফিরে একটু সস্তির নিশ্বাস ফেললো সাঁচি। মনে হচ্ছে এবার একটু আরাম করে শ্বাস ফেলে গল্প করা যাবে ফুয়াদের সাথে। নিজেদের চেনাজানার সুযোগ পাওয়া যাবে এইবারে।

সাঁচিকে বাসায় নামিয়ে দিয়েই ফুয়াদ অফিসে চলে গেছে। যদিও আরো দুদিন ছুটি আছে ফুয়াদের, বিয়ে উপলক্ষে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়েছিলো। কিন্তু অফিসে হঠাৎ করে কি যেন জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই যেতে হয়েছে।

ফুয়াদের ফ্লাটটা দক্ষিনমুখী আর চারিদিকে খোলামেলা হওয়ায় কারনে আলো বাতাসের কমতি নেই কোনো। বেশ ভালো লাগছে সাঁচির। গতদিন নতুন ছিলো তাই অত ভালোভাবে খেয়াল করেনি। আজ বেশ ফুরফুরে মনে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো আর গল্প করছিলো প্রিয়তার সাথে। প্রিয়তা ওদের সবার বিষয়ে জানাচ্ছিলো সাঁচিকে। ফুয়াদদের স্হায়ী ঠিকানা টাঙ্গাইল। পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ফুয়াদ ঢাকায় এসেছিলো। তারপর পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করে ফুয়াদ নিজের টাকায় ঢাকায় শ্যামলীর আদাবরে ফ্লাট কিনেছে। বাবা মা মাঝে মাঝে ওর কাছে এসে থাকে তবে বেশিরভাগ সময় টাঙ্গাইলেই থাকে। ঢাকায় থাকলে নাকি দম বন্ধ লাগে উনাদের। আর প্রিয়তার বিয়েও হয়েছে ঢাকায়, মোহাম্মদপূর শশুড়বাড়ি ওর। দু ভাইবোন কাছাকাছি থাকার জন্যই নাকি ফুয়াদ এখানে ফ্লাট কিনেছে। এসব গল্পই করছিলো প্রিয়তা।

সাঁচি আসার পর থেকে প্রিয়তার মেয়ে প্রিতি ওর সাথে আঠার মতো লেগে আছে। দু বছর বয়স ওর, আধো আধো বোলে ওকে সাঁচি বলে ডাকছে, শুনতে খুব ভালো লাগছে সাঁচির। ও প্রিতিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করলো, ক্ষুনশুটি করলো খানিকক্ষণ।
“থাতি..এই.. .থাতি, তুমি আমার সাথে থেলবে?”
“হ্যা গো থেলবো তো! ”
“তলো খেলি, আমাল অনেকগুলো ডল আতে তলো ওদের নিয়ে তেলি।”
“ওলেএএএ,সোনা বাচ্চাটা…”
প্রিতিকে গাল ভরে চুমু দিলো সাঁচি। একেবারে একটা ডল। খালি আদর করতে ইচ্ছা করে শুধু!
প্রিয়তা কিছুক্ষণ ওদের দুজনার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর হঠাৎই সাঁচিকে বললো-
” ভাবি, ভাইয়ার সাথে কতদূর এগোলো গো?”
” কি বলো এগুলো! কি এগুনোর কথা বলছো?” গাল আরক্ত হলো সাচির।
” এই, বলোনা! ভাবি,কিছুদূর আগালো কি? আমাকে তো বিয়ের পর তারেক খুব জ্বালাতো, জানো!? তখন অল্প বয়স আমার! এসবের কিছুই বুঝি না! তার উপর বিয়েটা একরকম জোর করে দেওয়া। আমার তো ভীষন ভয় হতো ওকে। আগে থেকে তো চিনি না, কেমন মানুষ, কি, কিছুই জানিনা। প্রথম দিকে খুব জোরাজোরি করলেও পরে বুঝতে পেরেছিল যে আমি ওকে ভয় পাই। তাই পরে আর ফোর্স করে নাই। উল্টো আমার ভয় ভাঙানোর চেস্টা করতো। শেষে একদিন নিজেই ধরা দিয়েছিলাম ওর জালে। সে হিসেবে আমার ভাই তো অনেক ভালো। ও মেয়েদের অনেক সম্মান করে। ওকে যতদুর জানি, জোর ও কখনো করবে না। বরং ভালোবাসার জন্য ওয়েট করবে!”
” হুম, তোমার ভাই একটু বেশীই ভালো। এত বেশী সম্মান করে যে কাছেই আসে না। শুধু দূরে দূরে পালিয়ে বেড়ায়।” বিরবির করে সাঁচি।
“কি গো কি বলছো বিরবির করে।”
” আরে না! কিছু না। চলো যাই দেখি মার রান্নার কাজে কোন হেল্প লাগবে কি না?”

৮.

দুপুরে একসাথে খেতে বসার আগে ফুয়াদকে ফোন দিয়েছিল সাঁচি যে, খেতে আসবে কিনা? ফুয়াদ জানালো সে একবারে রাতে আসবে। কাজে শেষ না করে আসতে পারবে না। অগত্যা ওরা খেতে বসলো ফুয়াদকে ছাড়াই। খাওয়ার টেবিলে প্রিয়তা বললো যে, ও আজ চলে যাবে। রাতে তারেক নাকি নিতে আসবে। শুনে মন খারাপ হলো সাঁচির। প্রিয়তা না থাকলে বাড়িটা একেবারে খালি খালি লাগবে। এর মধ্যে ওর শশুর জিজ্ঞেস করলো-
“বউমা, কোথাও বেড়াতে যাবে নাকি তোমরা?”
“জানিনা বাবা, আপনার ছেলে বলতে পারবে। আমার সাথে অবশ্য কোনো কথা হয়নি যাওয়ার ব্যাপারে।”
“ওহহ, আচ্ছা। আমি তাহলে কথা বলবো ফুয়াদের সাথে।”

খাওয়া দাওয়ার পর সব গুছিয়ে নিতে শাশুড়ী কে হেল্প করলো সাঁচি। তারপর দুপুর এ একটু ভাত ঘুম দেওয়ার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সাঁচি। মোবাইলে নিজের বিয়ের ছবিগুলো দেখছিলো আর মনে মনে হাসছিল। সবাই বলছে, ওদের জুটিটা নাকি একেবারে ‘মেড ফর ইচ আদার’ টাইপ। সত্যি কি তাই? ছবির ফুয়াদের সাথে কথা বলছিল সাচি-
” এই, লাজুক পাখি! বউয়ের সাথে এতো কেন লজ্জা তোমার? এতো পালিয়ে বেড়াও কেন বলোতো? বউয়ের সাথে একটু কথা বললে, একটু হাতটা ধরলে কি হবে? গল্প করতে করতে আমার মুখে একটু আঙুল ছুয়ে দিলো কি ক্ষতি তোমার? দুষ্ট লাজুক বানর কোথাকার!! আজকে তোমায় ছাড়ছি না কিন্তু? আজ তোমার কথা বলতেই হবে আমার সাথে! এ কি কথা! বিয়ে হয়েছে চারদিন হয়ে গেলো তবুও বউয়ের সাথে বসে দুদন্ড কথা বলার সময় নেই? ”
লাজুক হাসল সাঁচি। ফুয়াদের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমে তলিয়ে গেল।

সাঁচির যখন ঘুম ভাংলো তখন পুরো রুম অন্ধকার। জানালার পর্দাগুলো টেনে দেওয়ার কারনে সাঁচি বুঝতে পারছিলো না রাতের শুরু নাকি শেষ! শেষে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখলো সন্ধা সাতটা বাজে প্রায়। এতোক্ষন ঘুমিয়েছে! কেউ ডাকেনি কেন ওকে! প্রিয়তা কি চলে গেল নাকি! হুর মুর করে উঠতে যেয়ে বাধা পেল, শাড়ির আঁচলে টান পরলো। বাধ্য হয়ে আবার শুয়ে পরলো সাঁচি। মোবাইলটা ওদিকে ধরতেই দেখতে পেল ফুয়াদ গালে হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। আর ওর কাঁধের নিচে সাচির শাড়ির আঁচল।

ওমা! এই লোক কখন এলো! এসেছে তো এসেছে ওকে ডাকেওনি! নিজের কাপড়টাও চেঞ্জ করেনি! ওভাবেই শুয়ে গেছে ওর পাশে। মোবাইলের আলোটা ফুয়াদের মুখ থেকে একটু দুরে রেখে সাঁচি অপলক তাকিয়ে রইলো ফুয়াদের দিকে। মোবাইলের নীলচে আলোয় ফুয়াদকে অপরুপ লাগছে। আচ্ছা! ছেলে মানুমানুষ কেন এতো সুন্দর হবে? একটু কম সুন্দর হলে কি হতো? ঠোঁট দুটো কেমন ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে দেখো! সাঁচির প্রচন্ড ইচ্ছে হলো টুপ করে ফুয়াদের ঠোঁটে নিজের ঠোটটা একটু ছুইয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করলো সাঁচি। সে বরং আবার ফুয়াদকে দেখায় মন দিলো।

গত তিনদিন ধরেই সাঁচি এই কাজ করছে। ফুয়াদ ঘুমিয়ে গেলে ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। এই অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই লোকটাকে অসম্ভব ভালো লেগে গেছে। কি যে আছে ওর মধ্যে যা সাঁচিকে চুম্বকের মতো টানছে!? আচ্ছা! এই লোকটাকে ওর এতো ভালো লাগছে কেন? লোকটা ওকে ইগনোর করছে সেজন্যই কি? নাকি ওর জেন্টেলম্যান স্বভাবের কারনে? নাকি ও দেখতে সুন্দর বলে! নাকি ওর স্বামী বলে? ও শুনেছে বিয়ে হয়ে গেলেই নাকি বাঙালি নারীর স্বামীর প্রতি আলাদা টান হয়? আগে বিশ্বাস হতো না কথাটা। কিন্তু এখন নিজের ক্ষেত্রে এসে সত্যি মনে হচ্ছে কথাটা।

আচ্ছা!ফুয়াদ যদি ওকে জোর করে কাছে টানতো তাহলে কি এতো ভালো লাগতো ওর! কি জানি!? সব জায়গায় দেখা যায় বিয়ের পর ছেলেরা বউয়ের পিছন পিছন ঘুরে, ওর ক্ষেত্রে উল্টোটা। সাঁচি বেশ বুঝতে পারে, ফুয়াদ ওকে খুব সন্তর্পনে এভোয়েড করছে। ও যে সাঁচিকে এভোয়েড করছে এটা ওকে বুঝতে দিতে চাইছে না। আচ্ছা পাগল লোক তো! ওর যদি কোন প্রবলেম থাকে তাহলে সাঁচিকে মুখে বললেই তো হয়! এতো কি ভয়? ফুয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে যাচ্ছে সাঁচির। প্রচন্ড আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বসে থাকতে!? মনেহচ্ছে ফুয়াদ একটু আদর করুক ওকে। এতো জোরে জাপটে ধরুক ওকে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় ওর! ভাবতেই বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো সাঁচির। গা হাত পা শিরশির করে উঠলো, কান, মুখ গরম হয়ে গেলো। ইশ! ইচ্ছে গুলো এতো বেহায়া ক্যান!!??? দিবে নাকি ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে। অচেনা অনুভূতি কাবু করে ফেলছে সাঁচিকে। এই আলো আঁধারের মাঝে মোহগ্রস্থের মতো ফুয়াদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সাঁচি। ফুয়াদের নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে এখন। এই সময় দড়জায় নক হলো-
” ভাবি, এই ভাবি, তোমরা কি উঠবে! আমি চলে যাবো তো!”
হঠাৎ ডাকে সাঁচি ব্যালান্স রাখতে না পেরে ফুয়াদের গায়ের উপর পরলো, সাঁচির ঠোঁট ফুয়াদের ঠোঁটে বাড়ি খেলো। ভয় আর লজ্জায় সাঁচি চোখ বন্ধ করে ফেললো।

আর ওদিকে ফুয়াদ এমন আতর্কিত আক্রমনে লাফ দিয়ে বিছানায় বসে পরলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে, অন্ধকারে কিছু বুঝতে পরছিলো না। সাঁচিকে এতো কাছাকাছি অনুভব করে একটু বোকা বনে গেছে ও। তারাতারি উঠে ঘরের বাতি দিলো। সাঁচিও ততক্ষণে শাড়ির আচল জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ফুয়াদ হয়তো বুঝেনি কি হয়েছে। ওকে আর বুঝতে দিতে চায় না সাঁচি। ফুয়াদ ঘুরে দেখলো সাঁচি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ও এগিয়ে এলো-
” কি হয়েছে সাঁচি! ভয় পেয়েছো নাকি?”
“ননন না নাতো। আসলে প্রিয়তা আপু ডাকছে অনেকক্ষণ যাবত। ঘুমের মধ্যে উঠতে গিয়ে আপনার গায়ের উপর পড়ে গেছি। আপনি যে পাশে শুয়েছেন তাতো জানতাম না??”
“সরি, আসলে অফিস থেকে এসে এতো টায়ার্ড লাগছিল যে ওভাবেই শুয়ে গেছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।”
” ইটস ওকে। এখন দরজাটা খুলুন। আপু অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে আপনাকে।”
ফুয়াদ আর কিছু না বলে দরজা খুলে বাইরে গেলো।

৯.

রাতে খাওয়ার টেবিলে সাঁচির শাশুরি জানালো দুদিন বাদে তারাও টাঙ্গাইল চলে যাবে। বিয়ে উপলক্ষে গত একমাস ধরে ঢাকায় থেকে তারাও অস্থির হয়ে গেছে। তাই কিছুদিন খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে চান। ফুয়াদের বাবা ফুয়াদকে জিজ্ঞেস বললো, সাঁচিকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে। ফুয়াদ জানালো ওর হাতে এই মুহুর্তে বড়সড় একটা প্রজেক্টের দ্বায়িত্ব আছে। এটা শেষ না হলে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। উনি আর কিছু বললেন না। খাওয়া শেষে সাঁচির শাশুড়ি ওকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের রুমে।
” সাঁচি মা, তোমায় কিছু বলতে চাই?”
“জ্বী মা, বলুন না।”
” আমরা চলে গেলে তুমিতো একা হয়ে যাবে। ফুয়াদ ও ওর কাজে ব্যাস্ত থাকবে। খারাপ লাগবে হয়তো তোমার।”
” না মা সমস্যা নেই। আমারও নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে।”
” তাহলে তো ভালোই।” বলে মহিলা সাঁচির হাত দুটো নিজের হাতে মধ্যে নিলো
” মা, আমার ফুয়াদ বড্ড চাপা। ওর মনের ভেতর কি চলছে ও কাউকে বুঝতে দেবে না। ভিতরে ভিতর কস্ট পাবে, নিজে শেষ হবে তবুও কাউকে জ্বালাবে না। তাই আমি তোমাকে অনুরোধ করছি মা ওর দিকে খেয়াল রাখবে। ও হয়তো কখনোই কোন কিছুর জন্য তোমায় কিছু বলবে না, তোমার উপর কখনো অধিকার ফলাবে না। ও এরকমই। নিজের চাওয়া পাওয়াগুলো নিজের মাঝেই রাখে আর কস্ট পায়। তুমি প্লিজ ওকে একটু বুঝে চলিয়ো মা। নিজের অধিকার আদায়ে তোমাকেই হয়তো এগিয়ে যেতে হবে? তাই বলে এটাকে নিজের অবমাননা ভেবে ভুল করো না! পৃথিবীতে সব মানুষ তো সমান হয় না, তাই না? আমার বাচ্চাটা এরকম বলেই তো তোমার মতো হীরা খুজে এনেছি। ওর ভালো মন্দের দ্বায়িত্ব আজ থেকে তোমার, মা। ”
মায়ের টলোমলো চোখে আকুতি ফুটে উঠছে।
” মা, এভাবে বলছেন ক্যানো! এটাতো আমার দ্বায়িত্ব। আমি নিশ্চয় ওনার খেয়াল রাখবো।”
” আমি নিশ্চিত হলাম মা। আমার আর কোনো চিন্তা রইলো না। তবে তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি একা নও। যখনই তোমার প্রয়োজন হবে আমাকে ডাকলেই তুমি আমাকে তোমার পাশে পাবে।”
” থ্যাংকু মা।”
ফুয়াদের মা সাঁচিকে জরিয়ে ধরে কপালে চুমু দিলেন-
” যাও, শুয়ে পরো। অনেক রাত হয়েছে। ”
“জ্বী, মা।”

মনে মনে খুশি হলো সাঁচি। যাক বাবা লোকটা সম্পর্কে কিছু তো জানা গেল! এখন ওর সাথে ডিল করা যাবে! এই ছুপা রুস্তম কে এখন জনসম্মুখে আনার কিছু একট উপায় করা যাবে। কিন্তু কি উপায় টা কি হবে? ভাবতে ভাবতে আরক্ত হয় সাঁচি। এমন লাগে কেন? এ কেমন অনুভুতি? ফুয়াদকে নিয়ে ভাবলেই এমনটা হচ্ছে। এটা কি শুধুই শারীরিক আকর্ষন? বিয়ের পরে সবাই কি এই অনুভুতির মধ্যে দিয়ে যায়? সাঁচির মনে প্রশ্নগুলো ঘুর পাক খায়। হঠাৎ মনে পড়ে যায় তখনকার অনাকাঙ্ক্ষিত কিস এর কথা। ইশ! তখন কিস টা হলো কিন্তু কিছুই টের পেল না ফুয়াদ! সাঁচি নিজেও তো ফিলিংসটা পেলো না পুরোপুরি! প্রথম স্পর্শের অনুভুতি উপলব্ধির তীব্র আকাঙ্খায় সাঁচির গায়ে শিহরন উঠলো। কেঁপে উঠে দু হাতে মুখ ঢাকলো সাঁচি!!!

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০২

0

#আজল
#পর্ব-দুই

৪.

রিসিপশানের অনুষ্ঠানটা সাঁচির জন্য যেন একটা বিশাল সারপ্রাইজ। তার পিওর জেন্টেলম্যান হাজবেন্ডের যে এত বন্ধু বান্ধব আছে এবং সে যে এত পপুলার একজন মানুষ তা সাঁচির জানাই হতো না যদি এই অনুস্ঠানটা না হতো! সাঁচি আর ফুয়াদকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুয়াদের বন্ধুরা। ফুয়াদ সবার সাথে একে একে সাঁচির পরিচয় করিয়ে দিতে শুরুই করেছে কিন্তু সাজিদ নামে ওর এক ফ্রেন্ড ফুয়াদকে থামিয়ে দিলো-
” দোস্ত, আজকে এইসব পরিচয় ফরিচয় করানো বাদ দে তো! আমরা এতোগুলা মানুষ, ভাবির মনে থাকবে না সবার নাম। শেষে দেখা যাবে অন্য সবার নাম মনে করতে করতে তোরেই ভুলে গেছে।”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। পাশ থেকে আর একজন বললো-
“হ দোস্ত, আপাতত এইসব বাদ। পরে একদিন আমরা আলাদা ভাবে ভাবির সাথে পরিচয় হবো নে। এর জন্য অবশ্য তোর আর একদিন পকেট ফাঁকা করতে হবে। কিন্তু কি আর করা। বউয়ের জন্য এইটুকু তো করতেই পারিস, তাই না? এখন তোরে চান্স দিলাম, তুই আগে ভাবির সাথে ভালোমতো পরিচিত হ। ”
এরমধ্যেই পাশ থেকে আরেকজন ফোরন কাটে-
“হা দোস্ত, আপাতত এই কয়েক দিন তোর পরিচয়ের পালা। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তোর পরিচয় দিতে থাক!”
আবার সবার একসাথে হাসি।
” তা ভাবি, দোস্ত আমার ঠিকমতো যন্ত টত্ন নিয়েছে তো আপনার! কোনো সিমটম তো দেখি না। শালা কি বাসর রাতেও ভদ্রতা দেখাইছে নাকি!!?? ”
পাশ থেকে প্রথমজন বললো। ফুয়াদ বন্ধুদের মৃদু ধমক দিলো এবার-
“আহঃ, কি হচ্ছে এসব? এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে? ”
“দোস্ত তুই কি লজ্জা পাইলি নাকি?”

আবার সমস্বরে হাসি। ওদের কথা শুনে সাঁচির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কান দিয়ে মনে হচ্ছে ধোয়া বের হচ্ছে। এই ছেলেগুলো এতো ফাজিল কেন? খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা বলছে! সাঁচি ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও শুধু মিটিমিটি হাসছে। কিছু না বলে মুখ নিচু করলো বসে রইলো সাঁচি। তখনই পাশ থেকে দুই আপু বের হয়ে এলো, ফুয়াদের বান্ধবী মনে হয়। ওরা সাঁচিকে বাঁচিয়ে নিলো। একজন বললো-
” এই শয়তানের দল, তোদের শুরু হয়ে গেছে তাই না! কোনো জ্বালাচ্ছিস মেয়েটাকে? ভাগ এখান থেকে!”
“ঐ যে চলে এসেছে নারী নেত্রী। এখন এই বিয়ে বাড়িতে বর বউ এর অনুষ্ঠানের মঞ্চকেও আন্দোলনের মঞ্চ বানিয়ে দেবে!? ”
কেউ একজন বললো।
“রুমন, শয়তান! কি বললি তুই! তুই বাসায় চল আজ তোর খবর আছে?”
“তুই আর কি খবর করবি? তোর খবর করা মানে তো খাওয়া বন্ধ! তবে আজ আর কোনো খবর করতে পারবি না। কারন আজ তো এখান থেকেই খেয়ে যাবো। তাই আজকের জন্য তোকে ভয় পাচ্ছি না।”
দুজনের ঝগরা শুনে সবাই আবার হেসে দিলো। সাঁচি বুঝলো ওরা দুজন স্বামী স্ত্রী। পাশের আপুটা বললো-
” আহ! তোরা কি শুরু করলি। চল ওদের সাথে কয়েকটা ছবি তুলো ওদের ছেড়ে দেই। দেখছিস না সবাই দাড়িয়ে আছে। আমাদের জন্য কেউ আসতে পারছে না ওদের কাছে।”
সবাই ছবি তুলে চলে গেল। সাথে ফুয়াদও গেল।
“ভাবি, আপনার স্বামীকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে গেলাম! যাওয়ার আগে আবার দিয়ে যাবো, কেমন?”
বন্ধুদের বিদায়ের আগে আপু দুটো ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। আপুদের একজনের নাম মীম আর একজনের নাম আলিফ। মীম আপু সাঁচিকে বললে-
” সাঁচি, ইউ নো! ইউ আর এ ভেরি লাকি গার্ল। বিকজ ইউ গট ফুয়াদ। ফুয়াদ ইজ আ জেম। হি ইজ আ রিয়েল হিরো।”
“ইয়েস সাঁচি! মীম ইজ রাইট। ফুয়াদ ইজ দা অননি ওয়ান পারসন। আই হ্যাভ নেভার সিন হিম টু ফ্লার্ট এনি গার্ল। সো কিপ হিম হ্যাপি। এন্ড গুড উইশ ফর ইয়োর ম্যারিড লাইফ।”

ওরা যাওয়ার পরে কিছুক্ষণ একা একাই বসে ছিল সাঁচি। ফটোগ্রাফাররা বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে ওর ছবি তুলছিলো। কিছুক্ষণ পরে ফুয়াদও এলো। দুজনের কিছু যুগল ছবি তুললো স্মৃতি রাখার জন্য। ফ্যামিলি ছবিও তোলা হলো অনেক। বিয়ের অনুষ্ঠান মানে অনেক অনেক স্মৃতি আর ছবিগুলো যেন সেইসব স্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা!

৫.

রাতে নিজেদের বাড়িতে নিজের রুমে আয়নার সামনে বসে ফ্রেশ হচ্ছিল সাঁচি। আসলে আয়নার সামনে বসে চুলের জট ছাড়াচ্ছিলো আর ফুয়াদের কথা ভাবছিলো। লোকটা বেশ পপুলার। তার অফিস কলিগরাও ফুয়াদ বলতে পাগল। ভালোই লাগছে সাঁচির। বিখ্যাত মানুষের সঙ্গী হতে কে না চায়! জীবনসঙ্গী হিসেবে এরকম একজন মানুষকে পেয়ে সত্যি জীবনটা পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে সাঁচির । একটু যেন গর্বও হচ্ছিল। ভার্সিটি তে সাঁচিও বেশ পরিচিত মুখ। বহু প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছে কিন্তু বাবার আদেশ ছিল, জীবনেও যেন কোনো কারনে বাবার মাথা হেট না হয়! ফ্যামিলির বড় মেয়ে, তাকে দেখেই বাকিরা শিখবে। তাই এমন কাজ যেন তার দ্বারা না হয় যেটাতে তাদের সম্মান হানি হয়। সাঁচি এসব কথা মাথায় রেখেই বড় হয়েছে। তাই কখনো প্রেম ভালোবাসার চিন্তা তার মাথায় আসেনি। আজ মনে হচ্ছে তার এই ত্যাগের কারনেই হয়তো ফুয়াদের মতো লাইফ পার্টনার পেলো! এই যে ফুয়াদ বাসায় এসে তার বাবা মায়ের সাথে তাদের ছেলের মতো, ভাই বোনের সাথে তাদের বড় ভাইয়ের মতো গল্প করছে এটাও কি কম পাওয়া!? মনে মনে এসব ভাবছিলো সাঁচি আর মুখে একটা খুশির আভা ছড়িয়ে পরছিলো।

তখনই রুমে ঢুকলো ফুয়াদ। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালো-
” কি ব্যাপার! এতো খুশি ক্যান? কি হয়েছে?”
” কিচ্ছু না। এমনিই!”
বলে আয়না থেকে মুখ ঘুরলো সাঁচি। ওকে সরাসরি দেখে ফুয়াদ হেসে দিলো-
” এ অবস্তা কেন? সারা মুখে তেল?”
” আর বলবেন না! পার্লারে চুল বেধে চুলের বারোটা বেজেছে। তাই আজকে ইচ্ছা মতো তেল দিয়েছি চুলে। এখন শাওয়ার নিয়ে নেবো। ”
” ওওও, আচ্ছা। তাহলে ঠিক আছে।”
” আপনি কি শাওয়ার নেবেন? নিলে নিয়ে নিতে পারেন। আমি ঢুকলে একটু দেরি হবে তো তাই বলছিলাম আরকি! আপনি করলে আগে করে নেন। গিজার অন করা আছে।”
“হুম, গোসল তো করাই দরকার? এতোক্ষণ অনুষ্ঠানের মধ্যে ওভাবে থেকে গা হাত পা কেমন যেন নোংরা নোংরা লাগছে! ঠিক আছে,আমি তাহলে করে ফেলি গোসলটা। এই সাঁচি, তুমি কি আমায় একটু চা বানিয়ে দিতে পারবে আদা দিয়ে। গোসলের পর চা খেলে খুব আরাম লাগবে। মাথা ধরাটা কমবে।”
ফুয়াদের ‘এই সাচি’ ডাকে সাচির শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। কি সুন্দর করে ডাকলো লোকটা! লোকটার ভারি কন্ঠে ওর নামটা শুনতে একেবারে ইউনিক লাগলো। সাঁচি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-
” আপনি গোসল করে আসুন। আমি চা বানিয়ে আনছি।”
” থ্যাংকু।”
সাঁচি দৌড়ে গেল চা বানাতে। আসলে ফুয়াদের কাছ থেকে সরে যেতে চাইলো। ওর এতো ভালোলাগার ব্যাপারটা যদি ফুয়াদ বুঝে ফেলে?
তাই ছুতো পেয়ে বেড়িয়ে এলো। লোকটা কাছে থাকলে এতো ভালো লাগে কেন? একটু কথা বললেই নিজেকে ধন্য মনে হয়। কেন এমনটা লাগে সাঁচির? এই অনুভুতিটা একেবারেই নতুন সাঁচির কাছে। তাই বুঝে উঠতে পারছে না এটাকে কি বলবে?

ভাবতে ভাবতে চা বানাচ্ছিলো সাঁচি। একটু বেশি করেই বানালো চা। শেষে দুমগে চা ঢেলে ঢাকা দিয়ে ট্রেতে করে নিয়ে ঘরে গেল। ভাবলো নিজের শাওয়ার শেষে ফুয়াদের সাথে বসে একসাথে চা খাবে আর গল্প করবে। ফুয়াদ শাওয়ার নিয়ে বের হতেই ও একবারে থমকে গেল। ফুয়াদ একটা হাফ হাতা গেন্জি আর ট্রাউজার পরেছে। চুলগুলো ভেজা ভেজা, সেগুলো টাওয়েল দিয়ে মুছতে মুছতেই হেঁটে আসছিলো রুমে। সাঁচি হা করে তাকিয়ে দেখছে ফুয়াদকে। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের নীলাভ গাল, মোটামুটি লম্বাটে মুখের মাঝে টিকোলো নাক আর পাতলা ঠোঁটের ফুয়াদ যেন চুম্বকের মতো টানছে সাঁচিকে। আজ পর্যন্ত কখনো কোনে ছেলেকে এতো মন দিয়ে, এতো কাছ থেকে দেখেনি সাঁচি আর! তাই আজ ও বেহায়ার মতো নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকবার সাঁচিকে ডাকলো ফুয়াদ। ও শুনলো না, শুনবে কিভাবে? ও তো নিজের মধ্যে নেই! বাধ্য হয়ে
হাতের তুড়ি মেরে সাঁচির ধ্যান ভাঙালো ফুয়াদ- “কি হলো! গোসলে যাবে না?”
” এ্যা, হ্যা হ্যা ওহ, যাবো তো!?”
তোতলাচ্ছে সাঁচি। ভীষন লজ্জা ও পেলো। না জানি ফুয়াদ কি অবস্থায় দেখেছে ওকে? কতক্ষণ ধরে ডাকছিলো ওকে কে জানে! আর এত বেহায়াই বা হলো কবে ও! ছি ছি! কি ভাবলো ফুয়াদ! অসস্তি কর অবস্থা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কাপড় চোপড় নিয়ে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলো সাঁচি।

৬.

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল আচরাচ্ছিলো ফুয়াদ। চুল আচরানো শেষে সাঁচির রুমটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। একটা মাঝারি সাইজের খাট, সাথে ম্যাচিং আলমিরা। খাটের পাশে পড়ার টেবিল, যেখানে হরেক রকম বই সাজানো আছে। পড়ার বই ছাড়াও নানা ধরনের গল্পের বই, ভ্রমন কাহিনী আর আত্মজীবনী কোনে কিছুই বাদ যায়নি লিষ্ট থেকে! বইয়ের কালেকশন দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা জীবনে বৈচিত্র্য পচ্ছন্দ করে। আবার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে কিছু ছবি, কয়েকটা ওয়ালম্যাট আর সাঁচির বিভিন্ন বয়সের ছবি। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা ছোট থেকেই বেশ কিউট দেখতে। উজ্জল ফর্সা গায়ের রং, পাতলা ঠোঁট আর বোঁচা নাক। অনেকটা চাকমা মেয়েদের মতো। তবে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে ওর চোখ দুটো। একেবার গভীর দৃষ্টি যাকে বলে। দেয়ালের ওয়ালম্যাট গুলোতে শোভা পাচ্ছ গ্রামের দৃশ্য, আনারী হাতের কাজ, দেখে মনে হচ্ছে সাঁচির নিজের হাতে তৈরী। বাহ! মেয়েটা গুনি আছে তো!? মনে মনে তারিফ করলো ফুয়াদ। টেবিলের ট্রেতে দুটো মগ দেখে মনে মনে একটু হাসলো ফুয়াদ। মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর সাথে একসাথে চা খাওয়ার কথা ভেবেছে!? কিন্তু আজ মনেহয় সাঁচির সাথে চা খাওয়া ঠিক হবে না! কিছুক্ষণ আগে ওর চোখে নিজের জন্য নেশা হতে দেখেছে ফুয়াদ। তখন থেকেই অসস্তি হচ্ছে ফুয়াদের। রিলেশনটা এতো দ্রুত মেনে নেওয়া ওর জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এতোদিন স্বাধীনভাবে নিজের একাকী জীবনটা কাটিয়েছে। এখন কিছুটা সময় দরকার ওর। সব কিছু মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে। দুটে অপরিচিত মানুষ শুধু শরীরের টানে কাছে আসবে এটা ভাবতেও অস্বস্তি ফিল করছে ফুয়াদ। কিন্তু ও জানে, এখন এই মুহুর্তে সাঁচিকে কিছু বললো ও ভুল বুঝতে পারে। ওর সময় চাওয়াটার অন্য কোন মিনিং করতে পারে। ফুয়াদ চায় না সম্পর্ক টা শুরু হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যাক। তাই সাঁচিকে একটু এ্যাভোয়েড করতে চাচ্ছে ফুয়াদ। ও চায় না ওর কারনে মেয়েটা কষ্ট পাক। মেয়েটা খুবই ভালো। একেবারে ক্লিন ইমেজের সহজ সরল মেয়ে। এই টাইপের মেয়েরা খুব অল্পতেই বেশি আঘাত পায়। সহজ ব্যাপারকে জটিল করে তোলে। এখন যে কোন কথাই ওর মনে যেয়ে লাগবে। ওর মনে হবে ওকে অপমান করা হচ্ছে? এই কষ্টটা ওকে দিতে চায় না ফুয়াদ। তারচেয়ে বরং নিজেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেয়েটাকে সুখী করার চেস্টা করবে।

চা খেতে খেতে এসবই ভাবছিলো ফুয়াদ। কি মনে হতেই একবার বেডের দিকে চোখ গেলো। ওর বাড়ির তুলনায় এই বেডটা বেশ ছোট। একসাথে শুলে সাঁচির গায়ের সাথে গা না লেগে যায়! ধুর! লেগে গেলেই বা কি!? বিয়ে করা বউই তো ওর!? ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে পড়লো ফুয়াদ। সাঁচি নিশ্চয়ই আজকে ওর থেকে কিছু এসপেক্ট করবে। কিছু না হোক অন্তত হাতটা ধরবে, চোখে চোখ রেখে কথা বলবে এটা তো আশা করবেই মেয়েটা! ফুয়াদ ও তো চায় সাঁচির সাথে স্বাভাবিক থাকতে! তবে কেন জানেনা ওর কাছে গেলে মাথাটা ঝিমঝিম করে! কেন বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে!!??? এক অব্যক্ত কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে জমা হয়! নাহ ভালো লাগে না কিছু??? মাথা নাড়ে ফুয়াদ। তারচেয়ে বরং ঘুমিয়ে যাক। সাঁচি নিশ্চয়ই ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গল্প করতে চাইবে না!! এই ভালো! চোখের সামনে থেকেও পালিয়ে বেড়ানো!!!????

সাঁচি শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে দেখলো ফুয়াদ ঘুমিয়ে গেছে। আশ্চর্য তো! লোকটা আজকেও কেন ঘুমিয়ে গেল!! কাল না হয় টায়ার্ড ছিলো কিন্তু আজ? আজ কি হয়েছে? আচ্ছা! ও কি অনেক লেট করেছে নাকি শাওয়ার নিতে! ঘড়ির দিকে তাকালো। আধাঘন্টা মতো লেগেছে। লেট ই বলতে হবে। তবুও তো ওয়েট করতে পারতো ওর জন্য! নতুন বউয়ের সাথে আজকে অন্তত কিছুটা সময় গল্প করতে পারতো??? নাকি ওয়েট করতে করতে ঘুমিয়ে গেছ? হয়তোবা ? মন খারাপ করে সাঁচি চুল ঝেড়ে টাওয়েল টা বারান্দায় মেলে দিলো। তারপর আবার রুমে এসে ফুয়াদের দিকে তাকালো একবার। দেখে মনে হচ্ছে গভীরে ঘুমে আছে। চায়েট ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওখানে একটা মগ খালি পড়ে আছে। তারমানে, নিজের চা টুকু খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে? খুব কষ্ট লাগলো সাঁচির। এমনটা কেন করলো ফুয়াদ? কতো আশা নিয়ে দুমগ ভরে চা বানালো যে অনেক সময় নিয়ে চা খেতে গল্প করবে! আর উনি নিজের চা টা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! প্রচন্ড অভিমান হলো সাঁচির। কেন এমন করলো ফুয়াদ? কাল এর জবাব চাইবে ফুয়াদের কাছে।

ঘরের বাতিটা বন্ধ করে নিজের চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় পাতানো চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিলো সাঁচি। বারান্দা টা বেশ সুন্দর সাঁচির। সামনে কিছু লতানো ফুলের গাছ গ্রিলের কিছু অংশ জুড়ে আছে। নিচে কিছু পাতা বাহার। সাথে আছে হরেক রকম ফুলের গাছ। সাঁচির রুমটা এই বাসার সবচেয়ে সুন্দর রুম। এই বাড়িটা যখন তৈরী হচ্ছিল সাঁচি তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। সাঁচি ওর বাবার কাছে বায়না করেছিলো, ওকে দক্ষিণ দিকে একটা সুন্দর বড় বারান্দা সহ রুম দিতে। প্রথম সন্তান হওয়ার সুবাদে বাবা ওকে ভালোবাসতেন খুব! তাই মেয়ের আবদার মেনেই সাঁচির জন্য এই রুমটা তৈরী করেন। এই রুমের বড় আকর্ষন হলো এই বারান্দা। তার উপর সাঁচি গাছ টাছ লাগিয়ে বারান্দা কে এক অন্যরকম সৌন্দর্য দিয়েছে। জোছনা রাতে চাঁদের আলো যখন এই বারান্দায় লুটোপুটি খায় কি যে অপরুপ লাগে দেখতে? কতো জোছনা রাত যে ওরা তিন ভাইবোন কাটিয়েছে এখানে! সে সব কথা মনে করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাঁচি। ওর কত স্বপ্ন ছিলো ওর হাজবেন্ড কে নিয়ে এই বারান্দায় বসে জোছনা বিলাস করবে ও। আর ভাগ্যক্রমে আজ জোছনা রাতও ছিলো! কিন্তু ওর আন রোমান্টিক বরটা ঘুমাচ্ছে আজকে।

পূর্নিমা রাতে চাঁদের আলো এসে বেশ মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ওর খুব ইচ্ছা করছে যেয়ে ফুয়াদকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে আসে। তারপর বারান্দায় বসে ফুয়াদের সাথে নিজের জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা সব শেয়ার করে। সেই সাথে ফুয়াদের টাও শুনে। কিন্তু তা কি করা সম্ভব ?? ব্যাটাকে ঘুম থেকে ডাকলে যদি রেগে যায়? মন খারাপ করে একা একাই নিঃশব্দে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সাঁচি। ভাগ্য খারাপ, তার সঙ্গী আজ পাশে নেই। আজকের আকাশের চাঁদই সঙ্গী তার এই জোছনা বিলাসের!!!

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০১

0

#আজল
#সূচনা পর্ব

১.

একেবারে পিওর এ্যারেন্জ ম্যারেজ যেটাকে বলে, সাঁচি আর ফুয়াদের বিয়েটা ঠিক সে রকমটাই হয়েছে । কনে দেখা থেকে শুরু করে এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ, বিয়ে সবকিছুই সমস্ত আঁচার আনুষ্ঠানিকতা মেনে বেশ জাঁকজমক ভাবে হয়েছে। ছবি তোলা, নাচ-গান, খুনসুটি, জামাইয়ের গেট ধরা, জুতো চুরি এমনকি জামাইয়ের কাছ থেকে বাসর ঘরে ঢোকার টাকা আদায় করা, কোনো আনুষ্ঠানিকতাই বাদ যায়নি এই বিয়েতে। শশুর বাড়ির সব আচার অনুষ্ঠান পালন শেষে কনে সাঁচি এখন বসে আছে বাঁসর ঘরে। প্রিয়তা, ওর একমাত্র ননদ, তার ভাইয়ের রুমে ফুলে সাজানো বিছানায় বসিয়ে গেছে সাঁচিকে।

বসে থেকেই নিজের ঘোমটা টা একটু তুলে পুরো ঘরটাতে চোখ বুলালো সাঁচি। মাঝারি সাইজের রুমটার একপাশে আলমিরা আর বুক সেলফ রাখা, সেই সাথে পাশে একটা আরামদায়ক সোফা। বোঝাই যাচ্ছে বুক সেলফ থেকে বই নিয়ে পড়ার জন্যই সোফাটা রাখা হয়েছে। বেডের পাশে বেশ ইউনিক ডিজাইনের একটা ড্রেসিং টেবিল। সবগুলো ফার্নিচারের নকশা একই রকম ডিজাইনের। লোকটার রুচি আছে বলতে হবে।
সেই সাথে মনটাও ভীষন রকম ভালো। সেটা টের পেয়েছে অনুষ্ঠানের মধ্যেই। না না, তারও মাসখানেক আগে! যখন ফুয়াদের সাথে সাঁচির এনগেজমেন্ট হলো!

মনে মনে হাসলো সাঁচি। অনুষ্ঠানের মধ্যে মাঝে মাঝে আঁড়চোখে দেখেছে লোকটাকে। লম্বা চওড়া বডিতে মায়াকারা মুখ। বেশ ভালোই লেগেছে সাঁচির। অবশ্য লোকটাকে এই প্রথম দেখছে না সে! এর আগে বেশ কয়েকবারই দেখা হয়েছে। প্রথমবার দেখা হয়েছিলো ওদের বাড়িতে, ফুয়াদ ফ্যামিলির সাথে ওকে দেখতে গেছিলো। ওর সাথে টুকটাক কথা বলেছিলো লোকটা। সেদিন ই ভালো লেগে গেছিলো সাঁচির লোকটাকে। তারপর এনগেজমেন্ট, বিয়ের শপিং নানা জায়গায় দেখা হয়েছে দুজনার। যতদিন গেছে স্বল্প ভাষি এই লোকটার প্রতি সাঁচির ভালোলাগা বেড়েই গেছে। অনুষ্ঠানেও খেয়াল করেছে সাঁচি, সবার সাথেই লোকটা বেশ হাসিমুখে সৌজন্যতা দেখিয়েছে। আবার সাঁচির কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা তাও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছে। সাঁচির বেশ ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। ওর বাড়ির সকলেও খুব খুশি লোকটার উপর। এতো অমায়িক ব্যবহার লোকটার! উফ এতো ‘লোকটা লোকটা’ করছি কেন? ওর নামতো ফুয়াদ-‘ মনে মনে বলে নিজের মাথায় একটা চাঁটি মারলো সাঁচি। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হলো। সাঁচি মাথার ঘোমটা টা ঠিক করে টেঁনে নিয়ে ভালো ভাবে বসলো। কিছুক্ষণ পর দড়জা লক করার শব্দে একটু কেঁপে উঠলো সাঁচি। নার্ভাস ফিল করছে। লোকটা কি আজকেই সব অধিকার নিয়ে নেবে? উল্টাপাল্টা কিছু করবে না তো আবার? যদিও তাকে দেখে মোটেও সেরকম মনে হয়নি। তবুও পুরুষ মানুষ বলে কথা। এদের কি বিশ্বাস! তখনই ফুয়াদ কথা বললো-
” শুনুন, আপনার জন্য খাবার এনেছি। ঐ যে টেবিলে রাখা আছে। আপনি ড্রেস চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন। তারপর আমরা কথা বলবো। ততক্ষণে আমিও ফ্রেস হয়ে নিচ্ছি। ”

সাঁচি অবাক হয়ে ঘোমটা তুলে ফুয়াদের দিকে তাকালো। ভাবলো, ফুয়াদ কি সহজ ভাবে ওর সাথে কথা বললো। লোকটা ওর দিকে কত খেয়াল রাখছে। অথচ ও লোকটাকে নিয়ে আজেবাজে কত কিই না ভাবছিলো? ছি!

ভাবনা থেকে বর্তমানে ফিরলো সাঁচি। আজই লোকটা ওর সাথে প্রথম এতো কথা বললো। এঙ্গেজমেন্টের পর টুকটাক কথা বলেছে, যা প্রয়োজনের বাইরে না। না কখনো ওর সাথে আলাদা করে কথা বলেছে আর না কখনো ফ্লাটিং করার চেস্টা করেছে। একেবারে পিওর জেন্টেলম্যান যাকে বলে ফুয়াদ হচ্ছে সেই ব্যাক্তি। সাঁচির খুব ভালো লাগলো। ফুয়াদের প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। ফুয়াদ নিজের কাপড় নিয়ে অন্য রুমে যাচ্ছিলো। সাঁচি বললো-
“কোথায় যাচ্ছেন? একটু দাড়ান তো?”

খাট থেকে নেমে এলো সাঁচি। ফুয়াদ একটু অবাক নয়নে সাঁচির দিকে তাকিয়ে আছে। সাঁচি ফুয়াদের সামনে এসে একবার ওর চোখের দিকে তাকালো। নিচু হয়ে ফুয়াদের পা ছুয়ে সালাম করলো। সাঁচির কান্ডে ফুয়াদ ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন একটা মেয়ে বিনা দ্বিধায় পুরোনো একটা রেওয়াজ সম্পন্ন করলো এটা ওর একটু অবিশ্বাস্য লাগছে। সাঁচিকে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না ফুয়াদ। সাঁচিই বললো-

“মন থেকেই করলাম। আপনার আন্তরিক ব্যবহারে আপনার প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ তৈরী হয়েছে এটা তার বহিঃপ্রকাশ মাএ। থ্যাংকু।”
ফুয়াদ খুব সুন্দর করে হাসলো একটু। সে আলমিরা খুলে কিছু একটা হাতে নিয়ে ফেরত আসলো। সাঁচি তাকিয়ে দেখলো ফুয়াদের হাতে সুন্দর একটা বক্স। ফুয়াদ বক্সটা সাঁচির হাতে দিতে দিতে বললো-

“দ্যাখেন তো পচ্ছন্দ হয় কিনা। জিনিসটা পরে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি যেহেতু আমাকে সালাম করে আপনার কর্তব্য করে ফেললেন, এবার তাই আমিও আমার কর্তব্য করে ফেললাম। জিনিসটা যদি আপনার পছন্দ হয় তবে পরে ফেলবেন। আমার ভালো লাগবে। আর হা, আপনি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অজু করে নেবেন প্লিজ। আমি আধাঘন্টা পরে আসছি। দুজনে একসাথে নামাজ পরবো, কেমন?”
সাঁচি মাথা নাড়লো।

২.

নামাজ পরে উঠে দুজনেই বিছানায় বসলো। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে, যেন বুঝতে পারছে না কিভাবে কথা শুরু করবে। হঠাৎই সাঁচির গলার দিকে নজর গেলো ফুয়াদের। ওর দেয়া পেনডেন্ট টা সাঁচির গলায় ঝুলছে।
” ধন্যবাদ।”
” কি জন্যে?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সাঁচি।
” ওটা পরেছেন বলে!”
গলার দিকে ইশারা করলো ফুয়াদ।
“ওহ! আসলে জিনিস টা খুব সুন্দর। না পরে থাকতে পারলাম না। থ্যাংকস এতো সুন্দর জিনিস উপহার দেওয়ার জন্য।”
” আচ্ছা, আপনার সাথে তো সেভাবে কখনো কথা বলা হয়নি। আজ না হয় আমরা একবারে শুরু থেকে শুরু করি। কি বলেন?”
“হুম, বলুন না! আচ্ছা আমি আগে বলি? আমি সাঁচি রাওনাফ। মাস্টার্স করছি আই ইউ আই থেকে। আমরা দু বোন আর এক ভাই।”
হেসে দিলো ফুয়াদ। সাঁচি একটু লজ্জা পেল।
” আমি ফুয়াদ, মুহতাসিম ফুয়াদ। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে এখন একটা আইটি ফার্মে আছি। আমার একটি আদরের বোন আছে যার বিয়ে হয়ে গেছে তারেক ভাইয়ের সাথে আর আছে বাবা মা। আর আমার খুব আদরের ভাগনি প্রিতি আপনি তো জানেনই। খুব ভালোবাসি ওকে।”
এবার সাঁচিও হেসে দিলো-
” বেশ তো পরিচয় পালা তো শেষ। এবার?”
সাঁচির কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে ফুয়াদ।
” এবার তো অনেক কিছু! আমি আপনার কাছে যাব, একটু আদর টাদর মানে কিসিমিসি করবো। তারপর—”
” এই থামেন থামেন।”
লজ্জায় মুখ ঢাকলো সাঁচি। ফুয়াদ মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে।
” কি সব বলছেন আপনি!?”
” ওমা, আমি কি বললাম!? আপনিই না বললেন এবার কি?”
” ভারি দুষ্ট তো আপনি? আমি মোটেও ওরকম বলতে চাইনি!”
“হুম, বুঝলাম। একটু দুষ্টুমি করলাম আপনার সাথে। ”
“বাব্বাহ, আপনি আবার দুষ্টুমি ও করতে পারেন?”
“হুম, একটু একটু সবই পারি। আচ্ছা, আপনি খেয়েছেন? খাবারের থালা তো ওভাবেই ঢাকা দেয়া এখনো।”
“না খাইনি। ইচ্ছে হচ্ছে না।”
“কেন? আমি খেয়াল করে দেখেছি আপনি অনুষ্ঠানে ঠিক মতো খাননি। এখন না খেলে রাতে ঠিক মতো ঘুম হবে না। প্লিজ, অল্প হলেও খেয়ে নিন।”
ফুয়াদ উঠে যেয়ে খাবারের প্লেটটা এনে সাঁচির হাতে দিলো। সাঁচি কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো। আসলেও খিদে পেয়েছে ওর।
“আপনিও একটু খান আমার সাথে?”
কথাটা বলেই সাঁচি তাকালো ফুয়াদের দিকে। কিছু একটা ভেবে ফুয়াদ বললো-
“আচ্ছা, আপনি শুরু করুন, আমিও নিচ্ছি। ”
সাঁচি খাওয়া শুরু করলো। ফুয়াদ উঠে গিয়ে পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে আসলো। বসলো না সাঁচির সামনে। জানে ও বসে থাকলে খেতে পারবে না মেয়েটা। তাই এটা ওটা করে সময় পার করলো। কিছুক্ষণ পরে সাঁচি ডাকলো-
“শুনছেন? আমার খাওয়া শেষ। এবার আপনি খান।”
ফুয়াদ তাকিয়ে দেখলো প্লেটের প্রায় অর্ধেকের বেশি খাবার পরে আছে। কিছু আর বললো না ফুয়াদ। থাক যতটুকু খেয়েছে খাক। নতুন জায়গা, কমফোর্ট হতে একটু সময় লাগবে হয়তো। ফুয়াদ নিজে একটু খেয়ে রেখে দিলো প্লেটটা।
তারপর সাঁচির দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে ফুয়াদ বললো-
” আমার সাথে বেড শেয়ারে আপত্তি নেই তো?”
মাথা নেড়ে না করলো সাঁচি।
” তবে আপনি ওদিকটায় শুয়ে পরুন। আমি এপাশে শুচ্ছি। দুতিন দিনের পরিশ্রমে শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। আপনিও নিশ্চয়ই ক্লান্ত? ”
“হুম।”
“বাঁতি বন্ধ করলে প্রবলেম হবে? ভয় পাবেন নাতো?”
ফুয়াদ জিজ্ঞেস করলো সাঁচিকে। সাঁচি মাথা নেড়ে না বলে।সাঁচির সম্মতি পেয়ে বাতিটা বন্ধ করে বেডের আরেক পাশে যেয়ে শুয়ে পরলো ফুয়াদ। সাঁচিও শুয়ে পরলো।কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ডাকলো ফুয়াদকে-
” শুনুন, আপনাকে একটা কথা বলি?”
“হুম, বলুন না!”
“আমাকে তুমি করে বলবেন, প্লিজ। আপনার মুখে ‘ আপনি’ শুনতে কেমন যেন লাগে?”
” আচ্ছা,ডাকবো। শুরুতে একটু প্রবলেম হবে বাট পরে ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঘুমাই তাহলে, হ্যা! কালকে আবার রিসিপশান। অনেক কাজ। তুমি আবার কিছু মনে করলে নাতো সাঁচি!?”
ফুয়াদের তুমি সম্বোধনে খুব খুশি হলো সাঁচি।
“কি মনে করবো বলুন তো?”
” না মানে, আজ বাসর রাত। আর আমি এমনি শুয়ে পরলাম। তুমি হয়তো অন্য কিছু ভেবেছিলে।”
ফুয়াদের কথা শুনে লজ্জা পেলো সাঁচি-
“দেখুন বাকি সবকিছুর জন্য সারাজীবন পরে আছে। আপনিও আছেন আমিও আছি। এত চিন্তার কিছু নেই।”
” থ্যাংকস। আমি আসলেই অনেক টায়ার্ড। ঘুমাই তাহলে।”
” হুম”
বলে চোখ বন্ধ করলো সাঁচি। ক্লান্ত থাকার কারনে ও নিজেও ঘুমিয়ে গেলো তারাতারি।

৩.

সকালে যখন ঘুম ভাংলো সাঁচির, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকাল আটটা বেজে গেছে। নিজেই জিভ কামরালো। এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমালো? পাশে তাকিয়ে দেখলো ফুয়াদ নাই। তার মানে ফুয়াদ আগেই উঠেছে? তবে ওকে ডাক দিলো না কেন? লোকটার তো উচিত ছিলো ওকে ডেকে দেওয়া! সবাই এখন ওকে খারাপ ভাববে না!? নতুন বউ কি কখনো এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায়? মনে মনে ঠোঁট ফুলালো সাঁচি। তখনই দরজায় নক হলো-
” ভাবি? ঘুম ভেঙেছে? আসবো ভিতরে?”

তারাহুরো করে উঠে নিজের গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিয়ে দড়জা খুললো সাঁচি। ওকে দেখে প্রিয়তা মিস্টি একটা হাসি দিলো। সাঁচিও হাসলো-
” সরি, আমার না ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। বুঝতেই পারিনি যে এতো বেলা হয়ে গেছে?”
” আরে ভাবি এতো সরি বলছো কেন? কয়েকদিনের ধকল, এরকম তো হবেই। সো এতো সরি বলতে হবে না। বাট এখন একটু তারাতারি ফ্রেশ হয়ে আসবে কি? আমরা সবাই নাস্তার টেবিলে ওয়েট করছি।”
” আচ্ছা আপু, তুমি আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি চট করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
“ঠিক আছে। আমি যাই, তুমি এসো তবে।”

গেট চাপিয়ে চলে গেল প্রিয়তা। তারাহুরো করে গোসল দিয়ে কোনো রকমে শাড়ী টা পরে ডাইনিং এ আসলো সাঁচি। ওর শাশুড়ি মা ওকে দেখে এগিয়ে এলেন। ও শাশুড়ি কে সালাম করলো। তারপর শশুরকেও সালাম করলো। ফুয়াদের চাচা, চাচি ছিলো, ওদেরও সালাম করলো সাঁচি। সবাই টেবিলেই বসে ছিল। ফুয়াদ, প্রিয়তার বর, প্রিয়তার পিচ্চি মেয়ে প্রিতি সবাই। সাঁচি খেয়াল করলো ফুয়াদ কোনার দিকের চেয়ারে মাথা নামিয়ে বসে আছে। সামনে নাস্তার প্লেট। প্রিয়তা ফুয়াদের পাশের চেয়ারটাতে সাঁচিকে বসতো বললো। ফুয়াদ মিস্টি হেসে চেয়ার টেনে দিতেই সাঁচি বসে পরলো। নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই সাঁচির শশুর বললো-
” সাঁচি মা, আমাদের কে কি তুই একটু চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবি?”
” জী বাবা। এখনি বানাচ্ছি।”

খুশি হলো সাঁচি। ইশ এরা সবাই কত ভালো! ওর দেরি করে ঘুম থেকে ওঠাতে কেউ কিছু বললো না। উল্টো এখন চা খেতে চাচ্ছে ওর হাতের। যেন ও এ বাড়ির ই মেয়ে। খুশিতে কান্না পেয়ে গেল সাঁচির। সবাই এতো ভালো কেন?

ফুয়াদ চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। সাঁচি চা বানিয়ে সবাইকে দিয়ে শেষে ওর আর ফুয়াদের জন্য দু কাপ চা নিয়ে রুমে গেল। দেখলো ফুয়াদ রেডি হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ ফুয়াদের রেডি হওয়া দেখলো। লোকটা বেশ সুন্দর দেখতে। ফর্সা, টল, হ্যান্ডসাম, মাথাভর্তি চুল, মায়াবী চোখ। দেখে আপনাতেই নেশা লেগে যায়। আজ আবার পড়েছে গাড় সবুজ রঙের শার্ট সাথে অফ হোয়াইট গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। সাঁচির চোখ সরতে চাইছে না। তবুও অনেক কষ্টে চোখ সরিয়ে টেবিলে চা রেখে সাঁচি বললো-
” কোথাও যাচ্ছেন নাকি? আমিতো ভাবলাম আপনার সাথে চা খাব একসাথে? ”
” হ্যা একটু বেরুবো। সন্ধ্যায় রিশেপশন এর প্রোগ্রাম না! রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে। একা মানুষ তো, আমারই সবদিকে নজর রাখতে হয়। সমস্যা নেই তোমার সাথে বসেই চা টা খাবো। আর একটা কথা!”
“জ্বী, বলুন?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সাঁচির।
“সকালে তুমি এতো আরাম করে ঘুমাচ্ছিলে যে ডাকতে যেয়েও ডাককে পারিনি। তাই দয়া করে আমায় গাল টাল দিয়ো না। আমার কোনো দোষ নেই।”
মনে মনে ভীষন খুশি হলো সাঁচি। লোকটা এতো কেয়ারিং কেন?
“ধন্যবাদ আপনাকে।”
বলে ফুয়াদের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো সাঁচি। ফুয়াদের চায়ে চুমুক দেয়া পর্যন্ত ওয়েট করে তাকিয়ে থাকলো ওর মুখের এক্সপ্রেশন দেখার জন্য।
” চা টা ভালো হয়েছে। শুধু ভালো না অনেক ভালো হয়েছে।”
” সত্যি!!” আনন্দে উচ্ছসিত হলো সাঁচি।
” হুম। তুমিতো ভালোই চা বানাও।”
” ধন্যবাদ। আচ্ছা, একটা কথা বলি?”
” হুম, বলো না?”
” বিয়ে বাড়ি কিন্তু সেরকম ভীড় নেই। আত্বীয় স্বজন কেউ আসেনি?”
“ওহ, এই কথা। আরে সবাই তো ঢাকায় সেটেল্ড তাই কেউ আর থাকেনি। তাছাড়া এই কদিন সবাই ছিলো তো, ওরাও টায়ার্ড। আজ অনুষ্ঠানে আসবে সবাই। আমি যাচ্ছি তাহলে! তুমি বরং একটু রেস্ট নাও। দুপুরে খেয়ে আবার প্রিয়র সাথে পার্লারে যেতে হবে। ঠিক আছে?”

মাথা নাড়লো সাঁচি। ফুয়াদ যাওয়ার পর সাঁচি ওর শাশুড়ির কাছে গেল। সেখানে সবাই মিলে বসে গল্পের আসর বসিয়েছে। সাঁচিও সেই আসরে যোগ দিলো। সবার সাথে গল্প করে সময়টা ভালোই কেটে গেল সাঁচির। শেষে ওর শাশুড়ি মা ওকে নতুন একজোড়া গহনা দিলো আজ রিসিপশনের অনুষ্ঠানে পড়বার জন্য।

শাশুড়ির রুম থেকে বেড়িয়ে এলো সাঁচি। ননদ প্রিয়তাও বেড়িয়ে এলো ওর সাথে। ওকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখাচ্ছিলো আর ফাঁকে ফাঁকে নানান গল্প করছিলো –
” ভাবি, তুমি খুব লাকি, বুঝলে? আমার ভাইটা খুব ভালো। ও কখনো বাবা মায়ের আবাধ্য হয়নি, জানো? নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা কখনো আমাদের উপর চাপায়নি। এই যে, মা তোমায় পচ্ছন্দ করলো আর ও রাজি হয়ে গেল বিনা বাক্যে। আমারই মাঝে মাঝে অবাক লাগে। কোনো ছেলে কখনো এমন হয় এই যুগে!? বলো? তবে ওর মধ্যে কিছু একটা চেন্জ হয়েছে যা সবাই বুঝতে পারে না। ও আগে খুব হাসি তামাসা করতো,খুব প্রান চঞ্চল ছিলো জানো? কিন্তু এখন সেই তুলনায় গম্ভীর ই বলা চলে। এছাড়া ও অসাধারণ একজন মানুষ, একজন অসাধারণ ভাই, একজন অসাধারণ ছেলে, মামা হিসেবে তো ওর কোনো তুলনাই নেই। আশাকরি স্বামী হিসেবেও নিশ্চয়ই অসাধারণ ই হবে? তুমি প্লিজ ওকে মেনে চলো। ওর ব্যপারে কখনো ভুল বুঝো না ভাবি। ভাইকে বোঝার চেস্টা করো। ও একটু চাপা স্বভাবের তো? মনের কথা বলতে চায় না সহজে। তাই বলছি, ওর বন্ধু হওয়ার চেস্টা করো। তাহলে দেখবে সম্পর্কে সবকিছু ইজি হয়ে যাবে!”
প্রিয়তা সাঁচির হাত ধরলো।
“এভাবে বলছো কেন, আপু? উনি তো আমার স্বামীও হয়, তাই না! আমি অবশ্যই চেস্টা করবো, আপু। সবরকম চেষ্টা করবো ওনার সাথে ফ্রেন্ডলি হয়ে মেশার। তুমি চিন্তা করো না।”

মুখে প্রিয়তাকে বললেও সাঁচি মনে মনে খুব ভয় পেলো। ভাবলো সত্যিই এতো ভালো ভাগ্য ওর! ফুয়াদ, ওর পরিবার, সবাই এতো ভালো! সব ভালো এতো সহজে পেয়ে গেল ও! সত্যি সুখি হবে তো সাঁচি!!?? ফুয়াদের আবার কোনো অতীত নেই তো!!? বাড়ির বড় আদরের মেয়ে সাঁচি। বড় কোমলতায় মানুষ। প্যাঁচঘোচ বোঝে না। সহজ পথে চলে অভ্যাস। সোজা কথা বলতে পচ্ছন্দ করে। তাই এর বাইরে কোনো কিছু তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না! ফুয়াদ যদি তার মতো না হয়? তাহলে কিভাবে এডজাস্ট করবে সাঁচি? যদি কোনোরকম প্যাঁচানো ব্যাপার থাকে ফুয়াদের? যদি না মেনে নেওয়ার মতো অতীত থাকে তাহলে কি করবে ও? আর ভাবতে পারে না সাঁচি! আসলে আর ভাবতেই চায় না ও। সত্যি সত্যি যদি সেরকম কিছু থেকে থাকে তাহলে মরেই যাবে সাঁচি? সহ্য করতে পারবে না একেবারেই !?

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব(প্রথমাংশ)
#ফিজা_সিদ্দিকী

“শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত কোন ছবি বা পোর্ট্রেট দেখেছ?”

ঘাড় ঘুরিয়ে আরাধ্য তাকালো শ্রেষ্ঠার দিকে। ভাবখানা এমন যেন হুট করে সুস্বাদু বিরিয়ানি মুখে দিয়ে তাতে এলাচ খুঁজে পেয়েছে। চরম বিরক্তি নিয়ে আবারও সামনে তাকাতেই শুনতে পায় শ্রেষ্ঠার কণ্ঠস্বর।

“ছবির বিপরীত পাশ হয় ঘোলাটে। এই পিঠ দেখতে পছন্দ করে না কেউ। সে যত বড়ই শিল্পীর আঁকা ছবি হোক না কেন।”

পিনপতন নীরবতার মাঝে গতিবেগে চলতে থাকা গাড়ি আর বাতাসের সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে শা শা শব্দ। শ্রেষ্ঠা পিঠ এলিয়ে বসে আছে সামনের সিটে। আরাধ্যর দৃষ্টি ঘোলা। অনেক কিছুই বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। অসহ্য ব্যথায় আঁকড়ে ধরছে বুকের বাম পাশটা। এই বুঝি মারা যাবে সে!

“আরাধ্য”

নীরবতার মাঝে শ্রেষ্ঠার থমথমে কণ্ঠ শুনে আতঙ্কে গা শিউরে উঠলো আরাধ্যর। যেন কোনো এক অশরীরী আত্মা ডাক দিল তাকে। আরাধ্য ফিরে তাকালো না একবারও। ভয় নয় বরং বিরক্তি আর একরাশ ক্ষোভ উন্মাতাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে তার মনের আঙিনায়। ঠিক সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠা উপলব্ধি করলো তার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ রকমের কষ্ট। আরাধ্যর ফিরিয়ে নেওয়া মুখ, আক্রোশে ফেটে পড়া দৃষ্টি, গনগনে এক ব্যথার সূচনা করেছে তার সমস্ত শরীর জুড়ে। বলার জন্য অনেক কিছু গুছিয়ে রাখলেও শব্দগুলো একে একে ধসে পড়লো বালুর স্তূপের ন্যায়। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে উপলব্ধি করল তার বানানো ঘরের কোনো ভিত ছিল না। তাসের ঘরের মতো আলগোছে ঘর বেঁধেছিল সে তাইতো আজ সামান্য আঘাতেই ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

“আজও শ্রেয়ার পরিচয় লুকিয়ে রাখবে? আমাদের মধ্যে লুকানোর মতো আর কিছু কি আদৌ আছে?”

২৭.
বেশ কয়েকমাস থেকেই বেশ ঘন ঘন বাড়ি আসছে স্নিগ্ধা। অন্তত প্রতি মাসে একবার হলেও কয়েকটা দিন বাড়িতে থাকছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে মাসের এই দিনগুলোতেই সবচেয়ে বেশি চুপচাপ থাকে শ্রেষ্ঠা। প্রথম প্রথম বিষয়গুলো শিমুল নিহারের কাছে স্বাভাবিক লাগলেও, সময়ের সাথে সাথে আভাস পাচ্ছিলেন জটিলতার। শ্রেষ্ঠা আর আগের মতো চঞ্চল নেই। তার সবকিছুতেই কেমন কেনো অনীহা। সহজ সরল প্রাণখোলা মেয়েটা ক্রমে গুটিয়ে নিচ্ছিলো নিজেকে। নিজের চারদিকে শক্ত কোকুনের ন্যায় অভেদ্য এক আবরণের মাঝে ঘিরে ফেলছিলো নিজেকে।

সেদিন চৈত্রের দুপুর। খা খা রোদ্দুরের তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। অনেকদিন পর স্কুলে গেছে শ্রেষ্ঠা। আজকাল স্কুল, টিউশনে তার আনাগোনা নগণ্য। বকাবকি করেও বিশেষ লাভ হয়না। মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে সব শোনে। এরপর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। একটা রা কাটে না মুখে। আদিল সাহেব ছোটো মেয়েটার চিন্তায় নিজেকে জর্জরিত করে ফেলছেন দিন দিন। বয়ঃসন্ধিকালে হটাৎ বদলে যাওয়া মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয় শিমুলেরও। মাঝে মাঝেই স্বামীর আড়ালে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন তিনি। আজ প্রায় পনেরো দিন পরে নিজে থেকে স্কুলে যাচ্ছে শ্রেষ্ঠা। প্রথম প্রথম এই গরমে বাইরে বের হতে বারণ করতে গিয়েও থেমে গেলেন শিমুল। কী যেনো মনে করে শ্রেষ্ঠার মতামতের গুরুত্ব দিলেন।

বিকাল পার হতেই দৌড়াতে দৌড়াতে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ী ফিরলো শ্রেষ্ঠা। গায়ের জামা ঘামে চুপচুপে। বাড়িতে ঢুকতেই মুখোমুখী হলেন শিমুলের। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো শ্রেষ্ঠা। অতঃপর রুমে ঢুকেই খিল টানলো দরজায়। শ্রেষ্ঠার চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া জল আর মুখের ঘামের মধ্যে পার্থক্য করতে পেরেছিলেন শিমুল। হুট করেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো তার। পুরো দুই ঘণ্টা ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হতেই শিমুলকে বেডে বসে থাকতে দেখে টালবাহানা শুরু করলো শ্রেষ্ঠা। কিন্তু শিমুল নাছোড়বান্দার মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে।

“তুমি কি কিছু বলবে মা?”

“তোর কাহিনী কী বল?”

“কাহিনী? কিসের কাহিনী? কিসব বলছো তুমি?”

“শ্রেষ্ঠা, তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস তোকে পেটে ধরেছি আমি। ঠিক কোন সময়, কোন কারণে তোর মাঝে কেমন পরিবর্তন ঘটতে পারে সেসবই আমার জানা। তাই অহেতুক কথা না বাড়িয়ে সত্যিটা বল। কেউ তোকে কিছু বলেছে? ”

“এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে অনেক বেশি ভেবে ফেলছ মা। পাড়ার রাস্তায় ঢোকার মুখে একটা কুকুর ছিলো। তাকে দেখে আমি দৌড় দিয়েছি। দৌড়াতে দেখে আরো তাড়া করেছে আমাকে। এজন্য এভাবে দৌড়ে এলাম।”

কথাটুকু কেনো যেনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। কিন্তু অবিশ্বাসের মতো কোনরূপ কারণ না পেয়ে এবার যেনো সস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শিমুল। তবুও বেশ খানিকটা সময় গজগজ করে নিজের মতো বেরিয়ে গেলেন। মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফিকে হাসলো শ্রেষ্ঠা। অতঃপর রুমের দরজা লক করে বসে পড়লো টেবিলে। খাতা থেকে একটা কাগজ বের করে লিখতে শুরু করলো,

“প্রিয় আপা,

অনেককিছু বলার আছে তোমাকে। অথচ সামনাসামনি কোনো কথাই বলতে পারি না। কেমন যেনো জড়তা কাজ করে আমার মধ্যে। তোমার সামনে যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি হয়তো ভাবো আমি তোমাকে দেখতে চাইনা বা ঘৃনা করি বলেই সামনে আসিনা। কিন্তু বিষয়টা এমন নাহ। তোমার অজানায় ঘটে গেছে অনেক কিছু। যার সবকিছুই একটা দুঃস্বপ্নের মতো। আমার ছোটো জীবনটা এমন কেনো হয়ে গেলো আপা? আমি তো জগতের এই কালো দিক সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। রঙিন জীবনটা নর্দমার পচা কাদায় মাখামাখি হয়ে কী বিশ্রী দুর্গন্ধ! আমার দমবন্ধ হয়ে আসে আপা। তুমি ছাড়া আর কারো কাছে আমি সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারি না। তাই আজও সবকিছু উজাড় করে তোমাকেই বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

সার্থক ভাইয়া আমাদের এখানে আসেন আপা। মাঝে মাঝেই ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম আমাদের স্কুলের সামনে। সেদিন তোমার ওখান থেকে পালিয়ে আসার মধ্যে একটা কারণ ছিলেন ওই মানুষটা। তার স্পর্শ ছিলো গা ঘিনঘিন করার মতো। তার চোখ ছিলো শরীরের বিভিন্ন বাঁকে। তার কথা ছিলো অশ্লীল। নিজের অজান্তে উঠিয়ে নেওয়া একটা অ্যাডাল্ট স্টোরি বুকের জন্য সে আমাকে কিসব দিয়েছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তার কারণে আমি স্কুলে যাইনা ঠিক মতো। টিউশনিতেও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।

প্রথম বেশ কিছুদিন শুধু দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। সেই কারণে আমিও সেভাবে পাত্তা দিইনি। কোনক্রমে গা ঢাকা দিয়ে চলে আসতাম। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন ফাঁকা রাস্তা দেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিশ্বাস করো আপা, সে যখন আমার হাত ধরেছিল, মনে হচ্ছিল আমার হাত ঝলসে যাচ্ছে। এরপর একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েই উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন তিনি। আমি ভাবলাম হয়তো তুমি আমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য কিছু পাঠিয়েছ। বাড়ি এসে প্যাকেটটা খুলতেই যা যা দেখলাম, তাতে আমার শরীর গুলিয়ে উঠলো। সাথে সাথেই মুখ ভর্তি করে বমি করে ফেলেছিলাম। সেখানে ছিলো একটা ম্যাগাজিন। যার মধ্যে ছেলেদের নগ্ন, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ছবি। আর দুটো গল্পের বই। যে গল্পগুলো ছিলো ছবিগুলোর চেয়েও অশ্লীল। এরপর থেকে বেশ কয়েকদিন আমি আর বের হইনি বাড়ি থেকে। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো। সুস্থ হয়ে আবারও স্কুলে যাওয়ার পথে, পাড়ার গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতো সে। অনেকবার তাকে বারন করেছি এমন না করতে। তোমাকে বলে দেওয়ার হুমকি দেখালেও কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু আজ! আজ তো সে সব সীমা অতিক্রম করে ফেলছিল আপা। সরাসরি আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। তোমার সাথে তার সম্পর্ক আছে, এ কথা বলার পর তার রূপ বদলে যায় একেবারেই। তোমাকে রক্ষিতা বলতেই তার দুইবার ভাবতে হয়না। আমি একদলা থুতু তার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি আপা।

আপা, ছোটো থেকেই তোমরা সবাই বলতে আমি নাকি অনেক সুন্দর। এই সৌন্দর্য্য এভাবে কাল হয়ে ধরা দেবে কেনো বলোনি? কেনো বোঝাওনি রঙিন দুনিয়ার উল্টোপিঠ এতখানি কর্দমাক্ত? নিকৃষ্ট অমানুষে ভরা।”

২৮.
বিগত দুই মাসে বাড়ি যাওয়া হয়ে উঠেনি স্নিগ্ধার। আজকাল একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। তাই বাড়ী থেকে চিঠি এসেছে শুনে সেটা আনার জন্য আঁকুপাঁকু করতে শুরু করলো। শ্রেষ্ঠা ফোনে বারবার করে বলেছে চিঠিটা যেনো সে একাই পড়ে। কিন্তু নিয়ে আসার কথা কিছু বলেনি। তাছাড়া এই গরমের মধ্যে বাইরে বের হওয়ার কোনো ইচ্ছে না থাকায় সার্থককেই আনতে বললো চিঠিটা।

#চলবে?

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব(দ্বিতীয়াংশ)
#ফিজা_সিদ্দিকী

২৯.
গত দুইমাসে শতাধিক কল, টেক্সট, চিঠি পাঠিয়েছে শ্রেষ্ঠা। অথচ তার একটাও জবাব আসেনি ওদিক থেকে। ফোন সুইচড অফ। মাঝে মাঝে একটা করে বেনামী চিঠি আসে তাদের ঠিকানায়। যার মূল বিষয়বস্তু দেখে বোঝা যায় চিঠিটা স্নিগ্ধার লেখা। কিন্তু কোথাও কোনো ঠিকানা কিংবা নাম লেখা থাকে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো চিঠিগুলো যেনো সে নিজের ইচ্ছেতে লেখে না। সেখানে শুধু লেখা থাকে বাবা, মা, আর স্নিগ্ধার কথা। শ্রেষ্ঠার কথা এই দুইমাসে আসা কোনো চিঠিতেই উল্লেখ্য নয়। এমনকি এরই মাঝে নিজের ঠিকানাও পরিবর্তন করে ফেলেছে সে। সবকিছু ধরা, ছোঁয়া, নাগালের বাইরে। আদিল সাহেব দিন দিন কেমন যেনো ঝিমিয়ে পড়ছেন এসবের চিন্তায়। শ্রেষ্ঠাও কেনো যেনো আর নিতে পারছে না এগুলো। যদিও বিগত একমাসে সার্থককে আর দেখা যায়না এই গ্রামে। তাও কেনো যেনো সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে সে।

এইচ এসসিতে ভালো রেজাল্ট হওয়ায় খুব সহজেই ভালো সরকারী কলেজে চান্স পেয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। সমস্যা শুধু একটাই কলেজ থেকে বাড়ীর দূরত্ব। ঠিক এই সময়েই সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেন আদিল সাহেব। গ্রামের জমিসহ বাড়িটাও বিক্রি করে সপরিবারে উঠে আসেন কলকাতা শহরে। শ্রেষ্ঠা কলকাতার আশুতোষ মুখার্জী কলেজে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে যতীন দাস পার্ক শিশু উদ্যানের কাছাকাছি খানিকটা ভেতরের দিকে একটা পুরোনো বাড়ি ভাড়া নেন তিনি। নোনা ধরা স্যাঁতস্যাতে বাড়ির আনাচে কানাচে অন্ধকার থাকলেও শহরে ফেরার পর মনের কোনো একটা কোনে আলো জ্বলে তার। বড়ো মেয়ে স্নিগ্ধার খোঁজ পাওয়ার আলো। একই শহরে যখন আছে, তবে একদিন না একদিন ঠিকই মিলিয়ে দেবে নিয়তি তাদের। এমনই নানান জল্পনা কল্পনা নিয়েই কেটে গেলো আরও দুটো মাস।

৩০.
ঘুটঘুটে অন্ধকার রুম। অথচ বাইরে দিনের আলো। সময়টা ঠিক পড়ন্ত বিকেল কিংবা সন্ধ্যার মিলনকাল। নিস্তব্ধ অন্ধকার হয়ে ভেসে আসছে গোঙানির শব্দ। করুন সুরে কেউ যেনো কিছু বলছে। সময়ের সাথে সাথে সেই সুর মিলিয়ে গেল। অতঃপর ঝনঝন শব্দ করে খসে পড়লো টেবিলের উপরের স্টিলের গ্লাস। চাপা আর্তনাদের সাথে হু হু করে চাপা কান্নার শব্দ শব্দহীন রুমের ছন্দপতন ঘটিয়েছে। আচমকা দরজা খুলে কারোর প্রবেশের ফলে একছটা আলো এসে পরলো স্নিগ্ধার শরীরের অর্ধাংশে। আবছায়া পরিবেশে দৃশ্যমান তার আঁখিকোটরের কালিমা, গলার পাশের কালচে দাগ। চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

“তোর মতো থার্ড ক্লাস মেয়ের পাল্লায় পড়ে জীবনটা শেষ হয়ে গেলো আমার। আমাকে কী চাকর পেয়েছিস তোর? এসব বাচ্চার দোহাই দিয়ে মহারানীর মতো শুয়ে বসে থাকবি আর তোর সেবা করবো আমি? সার্থক আহসান রুদ্র তোর মতো মেয়েদের বিছানায় নিয়ে মজা লুটতে পছন্দ করে শুধু।”

গলা শুকিয়ে কাঠ স্নিগ্ধার। আচমকা পানি পিপাসার চোটে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় গুঙিয়ে ওঠে। অতঃপর ঘুমের ঘোরে তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে পড়ে গিয়ে শব্দের উৎপত্তি। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে আজকাল স্নিগ্ধার। কিন্তু অজানা কোনো এক কারণে গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয়না। চেনা জগৎটা হুট করেই অচেনা হয়ে গেলে মানুষের বোধহয় এমনটাই হয়। এইযে চেনা মানুষগুলোর হুট করে বদলে যাওয়া। যেনো এই নতুন সত্তার সাথে কোনোকালেই মিল ছিল না তার। কোথায় গেলো সেই আগের ভালোবাসা, মিষ্টি কথন। রক্ষকই যখন ভক্ষক হয় পড়ে তখন পুরো দুনিয়াটা অসহ্য লাগে। কতোদিন হয়ে গেলো বাবা মায়ের সাথে কথা হয়না। শ্রেষ্ঠা কেমন আছে কে জানে? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে সার্থক হিসেবে মেনে নিতে বড্ডো কষ্ট হয় তার। এমন দানব রূপ কী তার আগেও ছিলো? অবশ্যই ছিলো হয়তো, তবে লুকায়িত।

“তোমার খেলার সঙ্গী হিসেবে আমিই কেনো? চাইলে তো মেয়ের অভাব হতো না তোমার। যে কেউ স্বেচ্ছায় বিছানায় আসতে রাজি হতো। তবে আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের জীবন এভাবে তছনছ কেনো করলে? আমি তো কখনও কোনো ক্ষতি করিনি তোমার।”

গর্জে ওঠে সার্থক। স্নিগ্ধার কোনো কথাই আজকাল সহ্য হয়না তার। দিনের পর দিন বাচ্চাটাকে পেটে রেখে তার জন্য একের পর এক সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিগত কয়েকমাসে শ্রেষ্ঠারও কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছে তারা। কিন্তু কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। এখন তুরুফের তাস হিসেবে একমাত্র স্নিগ্ধা। তাইতো এখনও পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছে তাকে। নাহলে কবেই এসব কেচ্ছা কাহিনী খতম করে দিতো। শ্রেষ্ঠার রূপ, যৌবন দেখার পর থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে সার্থকের। যে কোনো মূল্যেই তার চাই শ্রেষ্ঠাকে। এই রূপ সে অন্য কাউকে ভোগ করতে দেবে না। প্রয়োজনে বিয়ে করে প্রত্যহ সেই রূপ সৌন্দর্য্যের ভাগীদার হবে সে। তবুও এই মাথা ধরে যাওয়ার মতো সৌন্দর্য্য হাতছাড়া করবে না।

দিনের পর দিন শ্রেষ্ঠাকে খুঁজে না পাওয়ার হতাশা থেকে ধীরে ধীরে সার্থক হয়ে ওঠে অন্য মানুষ। ঠিক মানুষ নয়, বরং হয়ে ওঠে পশু। আর তার পুরোটা দিনের রাগ, ঝঞ্ঝা সবটা উগড়ে দেয় স্নিগ্ধার উপর। সার্থকের পাশবিক অত্যাচারের কারণ প্রথম প্রথম বুঝতে পারতো না স্নিগ্ধা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারে, সার্থক সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ না। মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলা তার কাছে একপ্রকার নেশার মতো। ইতিমধ্যে স্নিগ্ধা জানতে পারে সে অন্তঃসত্ত্বা। অবিবাহিতা একটা মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ব্যাপারটা সমাজের কাছে নিকৃষ্ট এক ঘটনা। কয়েক মাস আগেই আগের বাড়ী ছেড়ে দিয়ে নতুন বাড়ী নিয়েছে তারা। এমনকি বাড়ির কারোর সাথেও কোনরূপ যোগাযোগ করতে দিতো না সার্থক। শ্রেষ্ঠার আসা একটা চিঠি, তারপর থেকেই সার্থকের এই পরিবর্তন। কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ কিংবা রাগারাগির এক পর্যায়ে গায়ে হাত তুলতেও বাদ রাখতো না। অনেক চেয়েও বাড়িতে কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি স্নিগ্ধা। ভালোবাসায় অন্ধ স্নিগ্ধা এই সময় সবচেয়ে বেশি করে উপলব্ধি করে নিজের করা ভুলগুলো।

সংরক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েটা হুট করে মুক্ত বাতাসের স্বাদ পেয়ে কিভাবে যেনো ভুলে গেলো সব শৃঙ্খল। ভুলে গেলো বাবা মায়ের আদর্শ, তাদের সম্মানের কথা। বয়ঃসন্ধিকালের প্রেমের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে কখন যেনো ভাসিয়ে দিলো নিজেকে। যখন বুঝতে পারলো, তখন অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে। না পারছে বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে আর না পারছে সার্থককে এসব ব্যাপারে বলতে। ইতিমধ্যেই সার্থকের যে আমূল পরবর্তন ঘটেছে তা মেনে নিতেই কষ্ট হচ্ছে তার। উপরন্তু বাচ্চার কথা শুনে কিভাবে রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারেনি। বিধায় স্নিগ্ধার অনেকগুলো দিন কেটে গেল নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে। অতঃপর কোনো এক গভীর রাতের একান্ত সময়ে সার্থক জানতে পারে স্নিগ্ধার গর্ভধারণের কথা। এরপর থেকেই তার সাবলীল জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বাচ্চা নষ্ট করতে না চাওয়ায় প্রচুর মারধর করতে শুরু করে সার্থক। যার প্রতিটা চিহ্ন আজও বয়ে বেড়ায় শরীরের প্রতিটা অঙ্গ। শরীরে লেপ্টে থাকা কালশিটে দাগগুলোকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নিয়ে দেখে স্নিগ্ধা। আর ভাবে, ভালোবাসার নাজানি আর কতো রূপ হয়!

জোরপূর্বক স্নিগ্ধার গাল চেপে ধরে সার্থক। অতঃপর হিশহিশিয়ে বলে ওঠে,

“ধীরে ধীরে প্রেম থেকে শুরু করে অধিকার পাওয়া। অতঃপর বিছানা সঙ্গী। এই ব্যাপারটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। যা স্বেচ্ছায় পাওয়া সঙ্গিনীর মধ্যে কোথায়? আবার সেটা যদি হয় তোর মতো হাবাগোবা, রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে। তাহলে তো ব্যাপারটা আরও জমজমাট।”

স্নিগ্ধার চোখ বেয়ে জল জড়িয়ে পড়ে। খানিকটা ব্যথা শরীরের। তবে বেশিরভাগটাই মানসিক। দুই হাতে ধস্তাধস্তি করছে সে নিজেকে সার্থকের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। অতঃপর ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠতেই তাকে ছেড়ে দিয়ে সার্থক হনহন করে বেরিয়ে যায় রুমের বাইরে। স্নিগ্ধা ওখানেই বসে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল যেনো ফুরিয়ে গেছে। আজকাল কান্না করলে হু হু করে জ্বলে ওঠে চোখের কোল। কান্নাগুলোও ছন্দহীন লাগে।

#চলবে!

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)
#ফিজা_সিদ্দিকী

৩১.
পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভাঙচুরের শব্দ ভেসে আসছে। সেই সাথে কারো করুণ আর্তনাদ। ক্ষণে ক্ষণে বুকটা কেঁপে উঠছে শ্রেষ্ঠার। অজানা কারণেই চোখ ভিজে আসছে তার। মেয়েটার করুন অবস্থা যেনো সে এখানে বসেই টের পাচ্ছে। ইতিমধ্যে ছাত্রীর মা এসে বসেন তার মুখোমুখী। চোখ মুখে তার বেদনার ছাপ। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন,

“মেয়েটা কেনো যে এখনও এখানে পড়ে আছে বুঝিনা। কয়েক মাস আগেই পাশের ফ্ল্যাটে এসেছে একজোড়া দম্পতি। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই চলতো। মেয়েটা বেশ ভালো, মিশুকে স্বভাবের। কিন্তু ইদানিং বোধহয় কোনো সমস্যা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটা এমন করে। মেয়েটাকেও আর বাইরে বের হতে দেখা যায়না।”

“আপনারা কেউ কিছু বলেন না কেনো? প্রতিবেশী হিসেবে তো আপনাদের কিছু করা উচিৎ।”

“শহরের মানুষ কেউ কারোর না। তুমি তো গ্রামে থাকতে, তাই এসব বোঝো না। শহরের মানুষ কারোর সাতেও নেই পাঁচেও নেই।”

“কিন্তু তাই বলে একটা মেয়েকে একা পেয়ে এভাবে অত্যাচার করছে, আর আপনারা মুখ বুঁজে সহ্য করবেন?”

“একবার দরজা খোলা ছিলো দেখে উঁকি দিয়েছিলাম, মেয়েটা কেমন আছে জানার জন্য। বিশ্বাস করো মেয়েটাকে দেখে চোখে পানি এসে গেছিলো। রুগ্ন শরীরে যেনো কিচ্ছু নেই। চোখে মুখে কালশিটে দাগ। আমাকে যেতে দেখে ছেলেটা কড়া চোখে তাকিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর আর কিভাবে যাই বলো?”

পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি নিয়েছে শ্রেষ্ঠা। কলেজের পাশের এলাকায় থাকা বেশ ব্যয়বহুল। আদিল সাহেব অনেক কষ্টে ছোটো খাটো একটা দোকানে কাজ পেয়েছেন। তার আর শ্রেষ্ঠার আয় করা টিউশনির টাকা দিয়ে মোটামুটি কোনো রকম চলে যায় তিনটে মানুষের সংসার। নীলাকে পড়ানোর অফার পেয়েছিল এক বান্ধবীর কাছ থেকে। তার দূর সম্পর্কের কেউ হয় বোধহয়। যদিও জায়গাটা বালিগঞ্জের দিকে। তার বাড়ি থেকে বেশ অনেকটাই দূরে। কিন্তু মাইনে ভালো অঙ্কের। তাই কষ্ট হলেও এই টিউশনিটা হাতছাড়া করেনি সে।

ছাত্রীর পরীক্ষা। তাই পড়াতে পড়াতে খানিকটা রাত হয়ে যায় শ্রেষ্ঠার। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে সিড়ি দিয়ে নামছিলো সে। আচমকা সিঁড়ির কোণে কাউকে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠে সে। এই ফ্ল্যাটের সিড়ির দিকে তেমন একটা আলো আসেনা। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা চলে। এমতাবস্থায় কাওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে মতো অবস্থা শ্রেষ্ঠার। তার উপর মেয়েটার খোলা চুল পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। কেমন যেনো কান্না আর গোঙানির মিশ্র শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। ভয়ে ভয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতেই মুখ তুলে তাকায় বসে থাকা মেয়েটা। থেমে যায় শ্রেষ্ঠার হৃদস্পন্দন। হাত পা কাঁপতে শুরু করে। আচমকা হাত থেকে ফসকে পড়ে যায় ফোনটা। আবারও আঁধারের মাঝে নিস্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। শ্রেষ্ঠা প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেছে। বরফের ন্যায় জমে গেছে যেনো তার সারা শরীর। নাড়াতে পারছে না একটুও। মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে না কোনো শব্দ। বহু কষ্টে একটাই শব্দ উচ্চারিত হলো শুধু।

“আ আআআপু!”

অন্ধকারে সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছিলো না স্নিগ্ধা। অতঃপর পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনেই দুই হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। এতক্ষণে যেনো হুঁশ ফেরে শ্রেষ্ঠার। ঠোঁট কেটে ঠোঁটের কোণায় রক্ত জমে। চোখে, মুখে ক্লান্তির ছাপ। কপালের একদিকে বহু আগের কেটে যাওয়া একটা দাগ। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালশিটে দাগ আবার কোথাও তাজা রক্ত। মুহুর্তের জন্য চেনা মুখ অচেনা ঠেকলো। আঁতকে উঠেছিলো শ্রেষ্ঠা।

৩২.

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে স্নিগ্ধার বাড়ি ফেরার। সেদিন রাতে বাড়ীতে ঢোকার সময় শ্রেষ্ঠার সাথে স্নিগ্ধাকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন শিমুল নাহার। আদিল সাহেব থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকেন দূরে। মনে মনে ভাবতে থাকেন, এই কী তার সেই আদরের কন্যা? পাড়ার সেরা মেধাবী সেই মেয়েটা তার? যার রেজাল্টের দিকে মুখিয়ে থাকতো পুরো গ্রাম। গোটা একটা গ্রামের কাছে উদাহরন হিসেবে থাকা তার সেই ছোট্ট মেয়েটা কবে এতো বড়ো হয়ে গেলো? একদিকে ক্ষত, বিধ্বস্ত, রক্তশূন্য চেহারা। শরীরে নির্মম আঘাতের ছাপ। অপরদিকে তার বেড়ে ওঠা উঁচু পেট। এক পা এগোনোরও সাহস পাননি তিনি। উল্টো পথে ফিরে যান নিজের রুমে। শিমুল নাহারও কাঁদতে কাঁদতেই আহাজারী শুরু করে দেন। জীবনের সবচেয়ে বড়ো সর্বনাশ আর সমাজের দোহাই দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন। গেটের সামনে অশ্রুসিক্ত, অসহায় অবস্থায় বসে পড়ে স্নিগ্ধা। দুই হাতে মুখ ঢেকে বলে ওঠে,

“এজন্য আমি এতোদিন কোনো সাহস দেখাইনি শ্রেষ্ঠা। আমার করা ভুল যে কোনো ছোটো ভুল না। আমি জানতাম এই সমাজ, আমার পরিবার, কেউই কখনও মেনে নেবে না আমাকে। আমি তো বলেছিলাম ফিরবো না এখানে। সকাল হলে সার্থক ঠিকই নিজের ভুল বুঝতে পারতো। ভালো ব্যবহার না করলেও গেট ঠিকই খুলে দিতো আমার জন্য। এখন যে আমার আর যাওয়ার কোনো জায়গা রইলো না শ্রেষ্ঠা। ওখানে থাকলে দুই বেলা খাওয়া পরা আর আমার বাচ্চার দায়িত্ব তো অন্তত নিতো সার্থক। এখন আমি কী করবো শ্রেষ্ঠা? আমার যে যাওয়ার আর কোনো জায়গা রইলো না।”

শ্রেষ্ঠা অসহায় চোখে তাকায় স্নিগ্ধার দিকে। মানুষটাকে এভাবে দেখে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিলো তার বড়ো বোন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। বাবা মা আর তাদের দুই বোনের সুখের একটা জীবন হবে। অভাবের সংসারে বাবার করা প্রতিটা ত্যাগের প্রতিদানে একটা সময়ের সুখ লুটিয়ে দেবে তার কদমে। কিন্তু এ কী হলো? সময় এমন কেনো? আমাদের করা প্রতিটা জল্পনা কল্পনা কিভাবে যেনো তছনছ করে বয়ে যায় অন্য স্রোতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা বললো,

“তুমি এখানেই থাকবে আপু। মা বাবার সাথে আমি কথা বলবো। প্লীজ এভাবে আর কান্না কোরো না। তোমার ড্রেসিং এর প্রয়োজন আছে। অন্তত যে আসছে তার কথা ভেবে নিজেকে সামলাও।”

৩৩.

নয় মাসের উঁচু পেট নিয়ে কিচেনে নিজের আর শ্রেষ্ঠার জন্য রান্না করছে স্নিগ্ধা। যেদিন থেকে স্নিগ্ধা এই বাড়িতে এসেছে বাবা মা রুম থেকে বের হওয়া কম করে দিয়েছেন। এমনকি নানা বিষয়ে শ্রেষ্ঠার সাথে বিবাদও লেগেছে তাদের। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শিমুল নাহার সিদ্ধান্ত নেন এই বাড়িতে তিনি থাকবেন না। ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু সব বিক্রি করে চলে আসার ফলে সেই পথও বন্ধ হয়ে গেছে।

“একটা পরপুরুষের সাথে ফুর্তি করার সময় ওর মনে ছিলো না? এখন আমাদের ঘাড়ে এসে কেনো পড়েছে? যেতে বল ওই ছেলের কাছে। ওই মেয়ের মুখও আমি দেখতে চাই না। আমার বড়ো মেয়ে মরে গেছে আমার জন্য।”

শিমুল নাহারের কথার প্রেক্ষিতে গর্জে ওঠে শ্রেষ্ঠা। জীবনে প্রথমবারের মতো মায়ের কথার উপর উঁচু কণ্ঠে বলে ওঠে,

“বাবা তো একা এই সংসার সামলায় না। এই সংসারের প্রতি আমারও কিছু অবদান আছে। মাসের শেষে পুরো টাকাটাই আমি তোমার হাতে তুলে দিই সংসারের জন্য। তাহলে এই বাড়ীতে আমার কথায় একজন সদস্য নাহয় খাওয়া দাওয়া করলো। এতে এতো আপত্তি কেনো তোমার মা?”

মুখের উপর কথা বলায় শ্রেষ্ঠাকে বেয়াদব আখ্যান দিয়ে স্বামীর কাছে বিচার চান শিমুল। আদিল সাহেব সবকিছু দেখে যাচ্ছিলেন শুধু গম্ভীর মুখে। আজকাল তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় এইতো দুটো দিনের অতিথি আর তিনি এই দুনিয়ায়। প্রাণপাখিটা উড়াল দিলেই বাঁচেন যেনো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে শ্রেষ্ঠাকে বলেন,

“আমার ইনকামের টাকায় আমাদের দুজনের বেশ চলে যাবে। বাকিটা তোমরা দেখে নিও।”

ছোটো শ্রেষ্ঠার বুকের উপর একরাশ হতাশা, ভার, দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আলাদা হলো সংসার। স্নিগ্ধা অনেক চেষ্টা করেও আর এর সমাধান করতে পারেনি। অতঃপর সবাই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে সময়ের উপর। রান্নাঘর একটাই। অথচ রান্না হয় দুইভাগে। শিমুল নাহার রান্না করেন তাদের জন্য। আর শ্রেষ্ঠা করে স্নিগ্ধা আর তার জন্য। তবে মাঝে মাঝে শ্রেষ্ঠার ফেরার আগে কিচেন ফাঁকা ফেলে স্নিগ্ধা নিজেই সেরে রাখে রান্নাটা। এতগুলো দিনে একবারের জন্যও শ্রেষ্ঠা জানতে চায়নি স্নিগ্ধার সাথে ঘটে যাওয়া অতীতের কথা। বরং সে যতটা সম্ভব চেয়েছে স্নিগ্ধাকে সেসব কিছু ভুলিয়ে দিতে। যদিও মানুষ ভোলা গেলেও স্মৃতি কখনও ভোলা যায়না। হোক সেটা সুখের বা দুঃখের। তবে পুরোনো স্মৃতিতে মরিচার প্রলেপ পড়ে নতুন সুখময় স্মৃতিদের আগমনে। দুই বোনের ছোটো সংসার খুব একটা মন্দ কাটে না। সারাদিনের ক্লাস, টিউশন শেষে বাড়ি ফেরা। আবার রাত জেগে পড়াশোনা করার সময় স্নিগ্ধার তার প্রতি খেয়াল রাখা, আগত সন্তানকে নিয়ে দুজনের খুনসুটিময় মুহূর্ত, এসব নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে সময়। তবে অভিমানের মস্ত এক পাহাড় জমেছে শ্রেষ্ঠার মনে বাবা মায়ের প্রতি। যেটা টপকে তারা আর কখনো এক হতে পারবে কিনা জানা নেই।

দুপুর থেকেই শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে স্নিগ্ধার। বিকালে রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে যাওয়ার সময় চেয়ার ধরে বসে পড়ে সে। হাত লেগে নীচে পড়ে যায় কয়েকটা থালা বাসন। শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শিমুল নাহার আর আদিল সাহেব। রাগ হোক বা অভিমান, মেয়েকে এমন অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে স্থির থাকতে পারেন না তারা কেউই। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে পড়েন হসপিটালের উদ্দেশ্যে। শ্রেষ্ঠা তখন মাত্র কলেজ শেষ করে টিউশনিতে যাচ্ছে। রাস্তায় থাকা অবস্হায় বাবার কল পেয়ে উল্টো পথে দৌড় দেয় সেও।

৩৪.

গর্ভাবস্থায় পেটে আঘাত পাওয়ায় বাচ্চা সঠিক অবস্থানে নেই। তাই সিজারের জন্য রেডি করা হচ্ছে পেশেন্টকে। আদিল সাহেব হসপিটালের সমস্ত ফর্মালিটি পূরণ করতে ব্যস্ত। চোখ ভিজে আসছে তার। শিমুল নাহার থম মেরে বসে আছেন কেবিনের বাইরে। শ্রেষ্ঠা কাউকে তোয়াক্কা না করে হন্তদন্ত পায়ে ঢুকে পড়ে কেবিনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে স্নিগ্ধাকে। একজন নার্স বেশি কথা বলতে বারণ করে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে। নার্স বের হয়ে যেতেই স্নিগ্ধা বড়ো এক নিঃশ্বাস টেনে নেয় নিজের মধ্যে। অতঃপর বলতে শুরু করে,

“বাবা মায়ের মতো তুই কখনো আমাকে ছেড়ে যাসনি। বরং ছায়ার মতো পাশে থেকেছিস প্রতিটা মুহূর্তে। এমনকি আমার অতীত, এতদিন ঠিক কী হয়েছে আমার সাথে এসব কিছুই জানতে চাসনি কোনোদিন। কিন্তু আমার কেনো জানি না মনে হচ্ছে আজ না বললে আর কখনো বলা হবে না এসব। আমার হাতে সময় বোধহয় বড্ডো কম। তাই আমাকে কয়েকটা কথা বলতে দে প্লিজ।”

“আপু, এভাবে ভেঙে পড়িস না। এখন এতো কথা বলিস না। আমি শুনবো। সব শুনবো। কিন্তু আগে তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।”

“এসব ভূমিকা করার সময় এখন নেই শ্রেষ্ঠা। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। সার্থক শুধুমাত্র তোকে পাওয়ার জন্য এতোদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল আমাকে। যেদিন তোকে প্রথমবারের মতো দেখেছিল, তোর রূপের প্রতি জন্মেছিল তার লালসা। যে কোনো মূল্যে তোকে পেতে চেয়েছে। এমনকি তোর পাঠানো চিঠিও আমাকে পড়তে দেয়নি। তার বদলে দেখিয়েছিল অন্য চিঠি। যেখানে লেখা ছিল তুই পছন্দ করিস সার্থককে। আমি তোদের মাঝখান থেকে যেনো সরে যাই। ছোটো বোনের সুখ যেনো না হাতিয়ে নিই, এমন সব কথা। আমিও অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলাম সেসব। এই কারণেই ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরী হয় আমাদের মাঝে। ঘৃনা করতে শুরু করি তোকে। সার্থক প্রটিনিয়ত আমাকে বোঝাতে চাইতো যে ও আমাকে ভালোবাসে শুধু। আর তুই চেষ্টা করছিস আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ার। এসব মেনে নিতে পারিনি। তাই সবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে নতুন বাড়িতে উঠি সার্থকের সাথে। পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে করবো, এমন প্ল্যান ছিলো আমাদের। কিন্তু হুট করেই কিভাবে যেনো কনসিভ করে গেলাম। ব্যপারটা জানার পর থেকেই সার্থক বদলাতে শুরু করলো। বারবার প্রেশার দিলো বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। কিন্তু একটা নিস্পাপ শিশুকে মেরে ফেলার মতো ক্ষমতা কখনোই হয়ে ওঠেনি আমার। তাই চুপচাপ মুখ বুঁজে সহ্য করে যাই তার ব্যবহার। অথচ আমি একবারের জন্য টেরও পাইনি সার্থক এতো নোংরা একটা লোক। যে শুধু ভালোবাসে নতুন নতুন নারী শরীর, নারীকে না।”

শ্রেষ্ঠার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ইতিমধ্যে। আর কোনো কথা বলতে পারলো না সে। তাকে শিফট করা হলো ওটিতে। শুরু হলো অপারেশন।

দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা পর ওটির লাইট অফ হলো। ছোট্ট একটা শিশুকে তোয়ালে পেঁচিয়ে নিয়ে এলো একজন নার্স। শ্রেষ্ঠা প্রথম কোলে নিলো তাকে। এরপর একে একে আদিল সাহেব আর শিমুল নিহার। স্নিগ্ধাও মোটামুটি সুস্থ বলা চলে। তাকে শিফট করা হয়েছে কেবিনে।

৩৫.

সদ্যোজাত এক সপ্তাহের দুধের শিশুকে রেখেই চিরতরে চোখ বুঁজলো স্নিগ্ধা। আত্মহত্যা করলো সে নিকশ কালো গভীর এক রাতে। সাথে লিখে রেখে গেলো ছোটো একটা চিরকুট।

“আমি সত্যিই আর পেরে উঠছি না। সকলের অবজ্ঞা, ঘৃনা সহ্য করার পর যখনই বাচ্চাটাকে দেখি মনে পড়ে যায় ওই বেইমান লোকটার কথা। ও যে পুরো বাবার আদল পেয়েছে! আমাকে ক্ষমা করিস সবাই।”

বাড়িতে শোকের ছাড়া। অথচ শ্রেষ্ঠা কোথাও নেই। তাকে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে বের হাওয়ার আগে বলে গেলে তার ফেরার আগে যেনো দাফন কার্য সম্পন্ন না করে।

৩৬.
অচেনা নম্বর থেকে পাওয়া কল দেখে বেশ বিরক্ত হয় সার্থক। এমনিতেই স্নিগ্ধা যাওয়ার পর থেকেই মেজাজ আরও বেশি খিটখিটে থাকে তার। অতঃপর বিরস মুখে ফোন কানে তুলতেই তার চোখে মুখে খেলে যায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে লালসার বিশ্রী হাসি। অতঃপর ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

নির্জন রাস্তা। গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যহীন পথে। গাড়ির মধ্যে বসে আছে একজন সুন্দরী রমণী আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। যার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে রমণীর শরীরের বিভিন্ন বাঁকে। শ্রেষ্ঠা হাসছে। প্রাণ খুলে হাসছে। ঠোঁটের কোণ হতে হাসি যেনো সরছেই না। আচমকা বেশ শুনশান, জঙ্গলে আবৃত একটা জায়গা দেখে সার্থককে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে শ্রেষ্ঠা। সার্থক মনে মনে হাসে, পৈশাচিক হাসি হাসে। শারীরিক ক্ষুদা নিবারণের মতো পর্যাপ্ত এক জায়গা বেছে নিয়েছে শ্রেষ্ঠা। একথা ভেবেই যেনো ক্ষুধার্ত কুকুরের ন্যায় লালা ঝরতে থাকে তার জীভ হতে। শ্রেষ্ঠা হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের খানিকটা ভেতরের দিকে। সার্থকও এগিয়ে যায় তার পিছু পিছু। একটু ভেতরের দিকে গিয়ে অচমকা পিছনে ঘুরে সার্থককে জড়িয়ে ধরে শ্রেষ্ঠা। সার্থক হকচকিয়ে যায় মুহূর্তেই। অতঃপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার কাজে। এদিকে কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে নিমগ্ন সার্থকের ঘাড়ের ডানপাশে খুব সূক্ষ্মভাবে মেডিসিন ভর্তি একটা ইনজেকশন পুশ করে দেয় শ্রেষ্ঠা। সামান্য ব্যথা পেলেও সেদিকে তেমন একটা গুরত্ব দেয় না সার্থক। কাজ শেষ করে পিছিয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় জঙ্গলের আরও গভীরে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই মাথা ঝিমঝিম করে সার্থকের। অবশ হয়ে আসে শরীর। পা টেনে টেনে চলতে হচ্ছে যেনো তাকে। শরীরটা পাথরের মতো ভারী লাগছে। একসময় হাঁটতে গিয়ে ধপাস করে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সজ্ঞানে থাকা সত্বেও শরীরের একটাও অঙ্গ নাড়াতে পারছে না সে।

শ্রেষ্ঠা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে সার্থকের সামনে। চোখে মুখে তার পৈশাচিক আনন্দ। খিল খিল করে হেসে পকেট থেকে বের করে ধারালো এক ছুরি। গাছের ফাঁক দিয়ে পড়া সূর্যের আলোকরশ্মি সেই ধারালো ছুরির উপর হতে প্রতিফলিত হয়ে তার তীক্ষ্ণতার প্রমান দিচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার ধার। আঁতকে ওঠে সার্থক। গো গো শব্দ ছাড়া তার মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে না আর কোনো শব্দ। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে শ্রেষ্ঠা তাকিয়ে থাকে সেই ধারালো ছুরির দিকে। অতঃপর জোরে আঁচড় টানে সার্থকের বুক বরাবর। ঘাড় থেকে শুরু করে তলপেট অবধি জামা ভেদ করে চামড়া ছিঁড়ে যায়। বেরিয়ে আসে রক্তের স্রোত। খানিকটা রক্ত ছিটকে পড়ে শ্রেষ্ঠার পরনের জ্যাকেটেও। এরপর বিরতিহীন ভাবে এমনভাবেই ছুরি দিয়ে আঘাত করে যায় শ্রেষ্ঠা। ব্যথায় কাতরানোর মতো অবস্থাও রাখেনি সার্থকের। তার চোখে মুখে ছিটকে আসে কয়েক ফোঁটা রক্তের ছটা। হাঁপিয়ে না ওঠা পর্যন্ত এমনই বিরতিহীন ভাবে ছুরি চালায় সে। অতঃপর উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে,

” আপুর শরীরের প্রতিটা ক্ষত সময় নিয়ে দেখেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যেদিন ওই বাড়ি থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় নিয়ে আসি তাকে, সেদিনই ঠিক করেছিলাম তার পাওয়া প্রতিটা আঘাতের সুদ সমেত জবাব দিতে হবে আপনাকে। তবে সেটা এতো তাড়াতাড়ি হবে সেটা ভাবিনি। আপনার আয়ু আরও কয়েকটা দিন ছিলো। কিন্তু যেই মুহুর্তে পাহাড়সম কষ্ট, হাহাকার নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে আমার আপু। সেই মুহূর্ত থেকে এই দুনিয়ায় তোর মতো শয়তানের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। তোর দেওয়া আঘাত গুলো ঠিক এভাবেই মুখ বুঁজে সহ্য করতো আমার আপু। আজ তুই বুঝবি তার কষ্ট। তোর সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় যে পেটে লাথি দিয়েছিস, তোর সেই পেট আমি ঝাঁঝরা করে দেবো। শুধু তোর মুখটা বাদ রাখবো? কেনো জানিস? নাহলে তোর এই নৃশংস মৃত্যুর খবর তো কেউ পাবে না। কেউ দেখবে না একজন প্রতারকের শাস্তি কতো ভয়ানক হতে পারে।”

চুরির গা চুঁইয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। ছুরিটা পাশে রেখে খালি সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে তাতে বাতাস ভরে নেয় শ্রেষ্ঠা। এরপর সেই বাতাস ভর্তি সিরিঞ্জ পুশ করে দেয় সার্থকের দুই বাহুর শিরায়। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,

“আপুর লাশটা ফেলে রেখে এসেছি। তোর লাশ ফেলে তবেই সেই খাটিয়া উঠবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। তাই ইচ্ছে থাকলেও পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে এর চেয়ে বেশি শাস্তি দিতে পারছি না তোর মতো শয়তানকে। ইওর গুড লাক।”

শ্রেষ্ঠা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। পিছনে পড়ে থাকে ফুলে ফেঁপে ওঠা শিরার যন্ত্রনা আর হাইহিলের জুতো দিয়ে পিষে ফেলা গোপনাঙ্গের যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া চেহারার মানুষটা।

গাড়ি থেকে পানির বোতল বের করে শরীর, হাত মুখ আর ছুরিতে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে ফেলে শ্রেষ্ঠা। অতঃপর ছুরি আর সিরিঞ্জটা আবারো ঢুকিয়ে নেয় জ্যাকেটের পকেটে। এরপর পা বাড়ায় নির্জন সেই রাস্তার শেষ প্রান্তে। এখান থেকে মিনিট দশেক পথ হেঁটে গেলেই একটা নদী আর চারপাশে জনসমাগম এলাকা। নদীর কাছে এসে চুরি সহ জ্যাকেটটা ছুঁড়ে মারে নদীর ঢেউয়ের মাঝে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকায় না। একটা গাড়ি ধরে সোজা ফিরে আসে বাড়িতে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হওয়ার পর সম্পন্ন হয় স্নিগ্ধার দাফন কার্য। সেইদিন সেই মুহূর্ত থেকে সে হয়ে ওঠে ছোটো শ্রেয়ার মানি। মা ডাকটা কখনও ডাকতে শেখায়নি তাকে। কেনো যেনো তার মনে হয় জন্মদাত্রী মায়ের জন্যই তৈরী এই ডাক শোনার কোনো অধিকার তার নেই। এই ডাক শুধু স্নিগ্ধারই প্রাপ্য ছিলো, তার নয়।

৩৭.
বন্ধ করা চোখ আচমকা খুলে ফেলে শ্রেষ্ঠা। নমনীয় দৃষ্টিতে তাকায় আরাধ্যর দিকে। অতঃপর ডান হাত এগিয়ে নিয়ে যায় আরাধ্যর দিকে। তার গালে হাত ছুঁইয়ে ভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে,

“শ্রেয়া তোমাদেরই বংশের সন্তান। তোমাদের রক্ত বয়ে চলছে তার মাঝে। আমাকে যতো খুশি ঘৃনা করো, কিন্তু তাকে কখনো অবহেলা কোরো না প্লিজ।”

“কী পরিচয় শ্রেয়ার? সত্যিটা বলো।”

“চাইলেও সব কথা বলতে পারবো না তোমাকে। পারবো না দেবতার আসনে বসিয়ে রাখা কোনো মানুষকে ধপ করে মাটিতে বসিয়ে দিতে। শুধু আমার শেষ চাওয়াটা রেখো, আমার শ্রেয়ার খেয়াল রেখো। আমাদের স্বপ্ন ছিল একসাথে ঘর বাঁধার। কিন্তু সে ঘর চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর এর মতো জরাজীর্ণ, দমবন্ধকর হবে, তা কী কারো জানা ছিল? ভালোবাসি তোমাকে। হাসতে হাসতে বিদায় নিলাম তোমাদের থেকে। বিদায় নিলাম এই জগৎ সংসার থেকে। অনেক তো চেষ্টা করলাম বাঁচার। লড়াই করতে করতে এখন ক্লান্ত। জগতের কারোর পরোয়া না করলেও এই দুটো চোখে যে ঘৃণা আমি দেখেছি নিজের জন্য, তা এক জীবন বিষের চেয়েও বেশি বিষাক্ত করার জন্য যথার্থ। এর চেয়ে ভালো থেকো প্রিয়।”

কথাটুকু শেষ করে আরও কাছাকাছি এগিয়ে আসে শ্রেষ্ঠা আরাধ্যর। দুই চোখ বন্ধ করে অধর ছোঁয়ায় ললাটে। গাঢ় মোহময় এক চুম্বনে তাকে আবিষ্ট করে বাম হাত বাড়িয়ে খুব সন্তর্পনে খুলে দেয় গাড়ির গেট। অতঃপর সজোরে ধাক্কা দেয় আরাধ্যকে। গাড়ির খোলা গেট দিয়ে আরাধ্য ছিটকে পড়ে ডানপাশের পাথরের অমসৃণ দেওয়ালে। খানিকটা আঘাতও পায় মাথায় । সেই অবস্হায় অবিশ্বাস্য চেহারা নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে এলোমেলোভাবে এগিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। গতিশীল গাড়িটার মধ্যে শ্রেষ্ঠা আরাধ্যর ফোন থেকে কল করে নির্ঝরকে। এরপর তাদের লোকেশন বলার সাথে সাথেই গাড়িটা গড়িয়ে পড়ে খাদে। আর কিছু বলার মতো অবস্থায় থাকে না শ্রেষ্ঠা। আরাধ্য নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মতো অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে খাদে পড়তে থাকা গাড়িটার দিকে। অতঃপর একদফা চিৎকার করে শ্রেষ্ঠার নাম নিয়ে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে সেখানে।

৩৮.

আজ শ্রেয়ার আঠারোতম জন্মদিন। আরোহী খাঁন আর আরাধ্য দুজনে মিলে সস্নেহে বড়ো করে তুলেছেন শ্রেয়াকে। কখনও কোনো কিছুর অভাববোধ হতে দেননি। তবে সারা জীবন একটাই আফসোস রয়ে গেলো শ্রেয়ার। সে কখনো বাবা মা দুইজনকে একসাথে পায়নি। যখন মা ছিলো তখন কষ্ট পেতো বাবার জন্য আর যখন বাবা আছে তখন মা নেই। আরাধ্য আর শ্রেয়া দুজনে বসে আছে সেই জায়গায়, যেখানে শেষ বারের মতো গাড়িসহ শ্রেষ্ঠা পড়ে গিয়েছিল খাদে। কয়েক মাস ধরে অনেক খোঁজা খুঁজি করেও পুলিশ কোনো বডি পায়নি শ্রেষ্ঠার। তাই তারা ধরে নেয় গভীর জঙ্গলে থাকা কোনো হিংস্র পশু তার শরীরটাকে অক্ষত রাখেনি। শ্রেয়া বুঝতে শেখার পর থেকে কখনো নিজের জন্মদিন পালন করে না। বরং এই দিনটা সে আর আরাধ্য আসে এই জায়গায়। এখানে আসলেই যেনো তারা খুঁজে পায় শ্রেষ্ঠাকে। মনের মাঝে জমানো কত শত অভিযোগ ব্যক্ত করে দুজনে। এই জায়গায় বছরের আরও একটা দিন আসে আরাধ্য। সেটা শ্রেষ্ঠার মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। এই দিন আরাধ্য কাঁদে। প্রচুর কাঁদে। হাহাকার করে প্রিয়তমার শোকে। লুকানো সমস্ত দুঃখ বিলীন করে এই নির্জন বিশালাকায় বিস্তৃত পাহাড়ের কাছে।

#সমাপ্ত।

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১২

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১২
#ফিজা_সিদ্দিকী

“লং ড্রাইভে বেরিয়েছ নাকি রেসিং কম্পিটিশন? স্পিড এতো বেশি রাখার কোনো মানে হয়?”

শ্রেষ্ঠার কপট রাগী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয় আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার রাগ বাড়ে। বিগত ত্রিশ মিনিট ধরে তারা চুপচাপ বসে আছে পাশাপাশি। না আরাধ্য আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে আর না তাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে।

“আরাধ্য, গাড়ি থামাও।”

থমথমে কণ্ঠ শ্রেষ্ঠার। আরাধ্য এবার যেনো খানিকটা শব্দ করেই হেসে উঠলো। এই অসময়ে তার এহেন হাসি দেখে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো শ্রেষ্ঠা। আজকে যেনো একদম অন্যরকম লাগছে তাকে। একেবারে উন্মাদ, পাগলপ্রায়, ছন্নছাড়া যার হাবভাব। কোনো কারণ ছাড়াই হুট করে খানিকটা ভয় লাগছে শ্রেষ্ঠার। পর পর ঘটে যাওয়া সব ঘটনা কেমন যেনো গোলমেলে ঠেকছে। অকারনেই শুকনো ঢোক গিলে আরাধ্যর কাঁধে হাত রাখতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আরাধ্য। আরাধ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে সে। গাঢ় লাল ফোলা ফোলা চোখ। অথচ শীতল, শুনশান তার হাবভাব। এতক্ষণের দমিয়ে রাখা ভয়টা এতক্ষণে মাথা চাগাড় দিয়ে উঠলো। চকিতে হাত সরিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কিছু বলে ওঠার আগেই ভেসে আসে অপর পাশের মানুষটার গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

“জীবনের মতো গাড়িও আজ নিয়ন্ত্রণহীন। পথ ভুলে গেছে থামার।”

“মানে?”

কৌতুহলে উদ্ভূত শ্রেষ্ঠার বিচলিত চেহারা দেখে খিলখিল করে পাগলের মতো হেসে উঠলো আরাধ্য। অতঃপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

“ভয় পাচ্ছো নাকি?”

“ভয় পাবো কেনো? ভয় পাওয়ার কিছু তো দেখছি না। তবে তোমাকে বেশ অস্বাভাবিক লাগছে।”

“স্বাভাবিক আর থাকতে দিলে কই?”

“দেখো আরাধ্য, আমি বেশ কিছুদিন ধরে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছিলাম। তোমার কাছে সময় চেয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে সামলানোর। আর আজ বোধহয় সেই সময় ফুরিয়েছে। আমি আমাদের থেমে যাওয়া সম্পর্কটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই।”

“আসলেই বোধহয় সময় ফুরিয়েছে। তবে সেটা আমাদের জীবনের।”

“কিসব আবোল তাবোল বলছো তুমি আরাধ্য? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“সজ্ঞানে আছি। চলো মৃত্যুর আগে কিছু সত্যি জেনে নেওয়া যাক। সেই সাথে জানিয়ে দেওয়া যাক অজানা কিছু ঘটনা কিংবা কাহিনী যাই। এই যে গাড়িতে তুমি বসে আছো আমার পাশাপশি সিটে, এই গাড়ির ব্রেক ফেইল। আর যে রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি চারিদিকে তাকিয়ে দেখো একদিকে উঁচু পাহাড়ের পাথর আর একদিকে খাদ।”

আরাধ্যর কথা শুনে আঁতকে উঠে বাইরে তাকালো শ্রেষ্ঠা। এতক্ষন নিজের চিন্তায় বিভোর থাকার ফলে এসব কিছুই খেয়াল করেনি সে। আরাধ্যর প্রতিটা কথা হুবহু সঠিক। গতিশীল গাড়ি কোনোভাবে যদি ডানপাশের পাথরে ধাক্কা লাগে, তবে ছিটকে সোজা গিয়ে পড়বে খাদে। আবার বামপাশে গেলেও সোজা পড়বে অগভীর সেই খাদে। আতঙ্কে প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। ক্রমাগত সিক্ত জীভ দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছে নিজের রুক্ষ, শুষ্ক ঠোঁট।

“কেনো এমন করলে আরাধ্য? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। ভালোবাসার দাবি নিয়ে তুমি এসেছিলে। আমি তো প্রাথমিকভাবে প্রশ্রয়ও দিইনি।”

শ্রেষ্ঠার কান্নাসিক্ত করুন কণ্ঠে শুনে ব্যঙ্গাত্মক হাসে আরাধ্য। অতঃপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,

“মেয়েদের প্রতি বিতৃষ্ণার সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিলো ভাইয়ার ব্রেকআপ। মেয়েটার জন্য কতো রকম পাগলামী করতে দেখেছি তাকে। ছোটো বয়সে ভাইয়াকে দেখেছি বেধড়ক মার খেতে বাবার হাতে। এতো বড়ো ছেলে হয়েও হাউমাউ করে কান্না করতে করতে রাত পার করা দেখেছি। একটা মানুষকে কতখানি ভালোবাসলে মানুষ এমন হতে পারে আমার জানা ছিলো না সেই বয়সে। তবে শুধু ঘৃনা করতাম মেয়েটাকে। কারন তার কারণেই ভাইয়াকে এতো কষ্ট পেতে হতো। অথচ যে মেয়ের জন্য ভাইয়ার এতো লড়াই। যে মেয়েকে অল্প বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছে বলে ঘর বন্দী হয়ে এতো মার খেয়ে হয়েছে তাকে। সেই মেয়ে নির্দ্বিধায় বেছে নিলো সুখের সংসার। ভাইয়ার ভালোবাসা, ত্যাগ সবকিছুকে পাগলামির নাম দিয়ে বাড়ীর পছন্দে বড়োলোকের এক ছেলেকে বিয়ে করে নিলো।”

এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাধ্য। এতক্ষনে শ্রেষ্ঠা বুঝে গেছে সার্থকের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছুটা হলেও জেনেছে আরাধ্য। আর এসবের পিছনে থাকা মানুষটাকেও চিনে ফেলেছে। তবে সে কতটুকু আর কিভাবে জেনেছে সেটা জানে না। এতটুকু না জানা পর্যন্ত পরবর্তী ঠিক কী করা উচিৎ সিদ্বান্ত নিতে পারছে না সে। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই নোংরা পূরুষের জীবনকথা শুনতে হচ্ছে তাকে।

“শক্ত সামর্থ্য ভাইয়া হয়ে পরলো জীর্ণ। নানান রকম মানসিক চাপে বিধ্বস্ত। যেনো কোনোভাবে উঠে দাড়ানোর শক্তি পাচ্ছেন না। এখান থেকেই মেয়েদের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। একপ্রকার অসহ্য লাগতো। স্কুল, কলেজেও মেয়েদের সবসময় এড়িয়েই চলা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো। তবুও জীবন চলছিলো বেশ ভালই। কিন্তু হুট করে পূর্ণিমার রাত শেষ হয়ে হুট করে আমাদের জীবনে নেমে এলো ঘোর অমাবস্যা। কালো অন্ধকারে ঘনঘটা জীবন পাড়ি দিলাম, যখন বাবা মারা গেলেন হার্ট এ্যাটাক করে। ভেঙ্গে পড়া ওই মানুষটাকে সেই মুহুর্তে শক্ত সামর্থ্য হতে দেখেছিলাম। একা হাতে বড়ো ছেলে নয় বরং বাবার ভূমিকা পালন করতে দেখলাম। একদিকে বাবাকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন পরিবার। অন্যদিকে ভাইয়ার পরবর্তন। বাবার বিজনেস দেখাশোনার সাথে সাথে নিজের পড়াশোনাও কন্টিনিউ করে ভাইয়া। এক কথায় বাবার পরে মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই হুট করে একদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়না। এরপর এরপর…”

আরাধ্যর গলা ধরে আসে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা জল। সেই জল মোছার কোনো চেষ্টা করলো না সে। আজ চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া জল মোছার তাগিদ নেই তার মাঝে।আজকের পর থেকে তো সমাজের মুখোমুখী হতে হবে না আর তাকে। তবে কিসের ভয়ে আর কান্নাগুলো আঁটকে রাখবে? আজ নাহয় তারা গড়িয়ে পড়ুক অবাধে।

২৬.

রুমের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে নির্ঝর। সকাল সকাল আরাধ্যর মেসেজ পেয়ে ছুটে আসে এই বাড়িতে। অথচ বাড়ির কোথাও তার দেখা নেই। অগত্যা মেসেজ অনুযায়ী রুমে গিয়ে আলমারি থেকে কাঙ্খিত জিনিসটা বের করে সে। কালো রঙের ডায়রির সাথে একটা চিঠি।

প্রিয় নির্ঝর,

বন্ধুর চেয়েও বেশি ভাই তুই আমার। বাবা মায়ের আর একটা ছেলে। কখনও ভাবিনি আজকের দিনটা আসবে আমার জীবনে। সময়ের অভাবে চেয়েও সবটা বলা হয়নি তোকে। তাই এই শেষবেলায় জানাতে হচ্ছে। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছি আজ। যে মানুষটাকে পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছিলাম আমরা, সে আমাদের খুব কাছেই ছিল। হ্যা, শ্রেষ্ঠা খুন করেছে ভাইয়াকে। অনেকবার ভেবেছি ওকে মেরে ফেলবো। কিন্তু ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো বলতে পারিস? প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যু যন্ত্রণা সমান হবে। এর চেয়ে ভালো দুজনের একসাথে মরে যাওয়া। মাকে দেখে রাখিস। ভালো থাকিস।

চিঠিটা পড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো নির্ঝর। শ্রেষ্ঠার জীবনের ওপিঠের কালো অধ্যায়টা কিভাবে জানলো আরাধ্য? রহস্যময়ী প্রতিটা খুনের মাস্টারমাইন্ডকে হন্যে হয়ে খুঁজতে গিয়েই এই রহস্যের জাল ভেদ করেছিলো সে। কিন্তু এসবের আসল কারণ আজও অজানা তার কাছে। তবে প্রতিটা মার্ডার কেসের ফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, শ্রেষ্ঠার খুন করা প্রতিটা মানুষই ছিলো এক একজন দাগী আসামি। এই রেকর্ডে আজ পর্যন্ত কোনো ভালো মানুষ ধরা পড়েনি। একদিক থেকে শ্রেষ্ঠা আইনের কাজে সাহায্য করেছে। আবার অপরদিক থেকে দেখতে গেলে সে নিজে আইন হাতে তুলে নিয়েছে। তবে অন্যায়কে বিনাশ করার জন্য নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়াকে সে অন্যায় মনে করে না। শ্রেষ্ঠার এই গোপন সত্যিটা জানার পর থেকেই নির্ঝর আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছিলো তার দিকে। শ্রেষ্ঠার মতো সুন্দরী, ঠিক সুন্দরী নাহ আগুন সুন্দরী মেয়ের বুদ্ধিমত্তা আর উপস্থিত বুদ্ধি প্রশংসনীয়। সেই সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর প্রবনতা। নিজের জীবনের বাজি রেখে অন্যায়ের ধ্বংস কে বা করতে পারে? এই চেষ্টাই বা কতোজন করে? সবাই তো আজকাল নিজের সুখটাই আগে দেখে।

রাতের আড়ালে লুকিয়ে রাখা নিজের আরও এক সত্তার দুর্ধর্ষ কাহিনী, এসব কিছুই অনেক বেশি আকর্ষণ করেছিলো সার্থককে। মেয়েটাকে জানতে গিয়ে, তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে, তাকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে, কখন যে ভালোবেসে ফেললো তার হদিস ছিলো না নির্ঝরের। তবে যতোদিনে নিজের অনুভূতিপ্রবন হৃদয়ের উপচে পড়া ভালোবাসার কথা জানানোর সময় হয়েছিলো, ততদিনে শ্রেষ্ঠা আরাধ্যর হয়ে গেলো। গড়ে উঠলো তাদের মধ্যে ভালোবাসা নামক মিষ্টি এক সম্পর্ক। প্রথমদিকে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নেবার ক্ষমতা সার্থকের আছে। ছোটো থেকেই বেশ সংগ্রাম করে বড়ো হওয়ায় জীবনের চাওয়া পাওয়া জিনিসটা বেশ কম তার। আবার যা পায়না তা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও ভুল পথে ছুটে যাওয়ার প্রবণতাও কম। কারন অভাবের সংসারে অপ্রাপ্তি আর না পাওয়ার হাহাকার ছিলো কানায় কানায়। কখনও সেই অপ্রাপ্তি খাবারের তো কখনো বাসস্থানের।

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১১

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১১
#ফিজা_সিদ্দিকী

সম্পর্কের টানাপোড়নে দুটো মানুষ এমনভাবে আঁটকা পড়েছে, যা ছিন্ন করার সাধ্য কারোর নেই। অথচ তারা চেয়েছিল একটু ভালো থাকতে। একসাথে একে অপরের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে জীবনের বাকি সময়টায় পাড়ি দিতে। অথচ ভাগ্যের লিখন কি তা জানার সাধ্য কারোর নেই।

সুখ আসে যাওয়ার তরে। আর দুঃখ আসে জরা জীর্ণ, বেদনার সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। আমরা যতোই আঁকড়ে ধরতে চাই না কেনো সুখ তবুও ক্ষণস্থায়ী। আর দুঃখ দীর্ঘকায়। অথচ তবুও ওই ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্যই আমাদের বেঁচে থাকা। এতো কষ্ট, ক্লেশ সহ্য করা।

সময়ের স্রোতে বাড়তে থাকা অসহনীয় দ্বিধা দ্বন্দ আর দূরত্বের অদৃশ্য দেয়াল টপকে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে সেদিন শ্রেষ্ঠার কাছে গিয়েছিলো আরাধ্য। তীব্র ভালোবাসার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিলো ক্ষণিকের রাগ অভিমানের অস্তিত্ব। সমস্ত দ্বিধা, সংকোচ দূরে ঠেলে আবারও সেই দরজার চৌকাঠে উপস্থিত হয়েছিলো আরাধ্য, যেখান থেকে অপমান হয়ে ফিরে গিয়েছিলো সে। এ জীবনে তার অপরাধ কী সে জানে না। শুধু এটুকু জানে শ্রেষ্ঠাবিহীন একটা জীবন বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কারণে যদি তাকে বেহায়া হতে হয়, সে প্রস্তুত। কিন্তু তার সমস্ত মনোবল, ভালোবাসা এক লহমায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় শ্রেষ্ঠার বুক শেলফ থেকে পাওয়া সেই ডায়রির প্রথম পাতা উল্টাতেই। সার্থকের একটা ফটোতে খুব সুন্দর করে মার্কার দিয়ে ক্রস করা। ব্যাস এটুকু দেখেই দুনিয়া থমকে যায় তার। এলোমেলো হয়ে যায় এতদিনের ভালোবাসা, বিশ্বাসে গড়ে তোলা সম্পর্কের নিবিড় স্তম্ভ। শরীরের চামড়া ভেদ করে কেউ যেনো ছুরি চালাচ্ছে অনবরত তার বুকে। সারা শরীর অসহনীয় ব্যথায় বশ হয়ে যাচ্ছে। এতোখানি বিস্ময় বোধহয় এতো বছরের জীবনে কখনো হয়ে ওঠা হয়নি তার। দূরত্ব ঘুঁচাতে গিয়ে আরও খানিকটা দূরত্বের জোগাড় হলো দুজনের মাঝে।

২৪.

বিগত কয়েকদিনের অফিসের কাজে ফুরসৎ পাওয়ার মতো সময় হয়ে ওঠেনি আরাধ্যর। সেদিন বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে শ্রেষ্ঠার ডায়রিটা নিয়ে এসেছিলো সাথে। অথচ সেই ঘটনার সপ্তাহ পেরিয়েছে। এরপর সারাদিন অফিসের মিটিং, ক্লায়েন্ট অ্যাটেন্ড আর বিদেশি কিছু প্রজেক্টের কাজ এমনভাবে ফেঁসে গিয়েছিলো যে ডায়রির কথা বেমালুম ভুলে গেলো। সকাল সকাল বেরিয়ে আবার রাত করে বাড়ি ফেরা। ফোনটাও হাতে নেওয়ার মতো সময় হতো না সেভাবে। এতো এতো ব্যস্ততার অবসান ঘটিয়ে আজ থেকে ফ্রী সে। আপাতত একটা সপ্তাহ সে একেবারেই ফ্রী। মাঝে বেশ কয়েকবার শ্রেষ্ঠা কল দিলেও ঠিক মতো কথা হয়নি দুজনের। ফলস্বরূপ সেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে অনেকখানি। নিজের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে অদৃশ্য এক বদ্ধপরিকর দেওয়াল দ্বারা।

বিকাল থেকেই আকাশে গুমোট ভাব। কেমন যেনো নীরবতায় আচ্ছন্ন চারপাশ। ঠিক যেমন ঝড় ওঠার পূর্বের নীরবতা। বাতাসে কেমন যেনো হাহাকারের রেশ। আরাধ্য উশখুশ করছে। অস্থির পায়ে পায়চারী করছে রুমের মধ্যে। ডায়রিটা খোলার সাহস পাচ্ছে না সে। মন বলছে অপ্রিয়র থেকেও অতি অপ্রিয় জিনিস আছে সেখানে। ঠোঁট গোল করে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো বার কয়েক। অতঃপর বেডের পাশের টেবিলে অবহেলায় পড়ে থাকা কফির কাপে চুমুক দেওয়ার বদলে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেললো পুরোটা। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো অস্থিরতার তীব্রতায় ধোঁয়া ওঠা কফির উষ্ণতার হদিস পেলো না সে। কেমন যেনো দমবন্ধ লাগছে। অতঃপর ব্যালকনির দরজা খুলে খোলা বাতাস টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো। খানিকটা শান্ত লাগলো এবার বোধহয়। তবে অস্থিরতা কমার নাম নেই।

সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা নেমেছে প্রকৃতিতে। হালকা শীতের দিনেও আকাশে গুমোট ভাবের জন্য কেমন ঊষ্ণ ঊষ্ণ ভাব। আরাধ্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সময় চারটে বেজে পনেরো। অথচ আকাশ অন্ধকার। আকাশের বুকেও কী তবে মেঘ জমেছে? অন্ধকার নেমেছে তার জীবনেও? ঠিক যেমন আরাধ্যর হচ্ছে!

বড়ো বড়ো কয়েকটা দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করলো আরাধ্য। অতঃপর ধীরে ধীরে খুলে ফেললো ‘প্রতিশোধ’ নামক ডায়রিটা। সার্থকের ছবির নিচে বড়ো বড়ো করে লেখা তার মৃত্যুর ডেট। সার্থকের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো তার মৃত্যুর পাঁচদিন পর। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে ধৈর্য্যশীল, শান্ত স্বভাবের আরাধ্যও অশান্ত হয়ে পড়ে। শরীর হিম হয়ে আসে। এতোখানি নৃশংসভাবে কেউ কাওকে আঘাত করতে পারে, প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের মৃতদেহ দেহ দেখার আগে জানাই ছিলো না তার। পুরো মুখে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। বেশ ধারালো কোনো ছুরি দ্বারা বেশ নকশা করে আঁকা কোনো কারুকাজ যেনো। বুকের মাঝে আড়াআড়ি ভাবে গভীর ক্ষত বেশ কিছু। মাংসপেশী পচে গিয়ে তার রূপ ধারণ করেছিলো বিভিৎস। শরীরের বিভিন্ন অংশ পচে গিয়ে চামড়ার সাথে শিরা ফেটে যাওয়ার মতো দৃশ্য দেখে শরীর শিউরে উঠছিলো। পুলিশ নিজেও হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিলো লাশের দিকে কয়েকক্ষণ। লাশ চেনার কোনো উপায় নেই। লাশের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দেখে তাকে শনাক্ত করার জন্য ডাক পড়েছিলো আরাধ্যর। কাঁপা কাঁপা পায়ে রুমে ঢোকার আগে আরাধ্য বার বার করে চাইছিলো এটা যেনো তার বড়ো ভাই না হয়। সার্থককে ভীষণ ভালোবাসে আরাধ্য। বাবা চলে যাওয়ার পর এই মানুষটাই বটগাছের মতো ছায়া দিয়েছিলো মা আর তাকে। অথচ এই মানুষটাকে এভাবে এই অবস্থায় দেখে নিজের মধ্যে ছিলো সে না। সকলের সামনেই হাঁটু মুড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। মনের ভেতর জ্বলতে থাকা ক্রোধের আগুনে তুষ দেওয়ার কাজ করেছিলো ফরেন্সিক রিপোর্ট। প্রাথমিকভাবে এটাকে এক্সিডেন্ট বলে মেনে নেওয়া হলেও ক্ষতগুলো অস্বাভাবিক ছিলো। ফলস্বরূপ লাশ পাঠানো হয় পোস্টমর্টেম করার জন্য।

সার্থকের মৃত্যু প্রী প্ল্যানড খুন। ব্যপারটা আগে থেকেই জানতো আরাধ্য। তবে এই ডায়রি আর তার মালিকানায় থাকা মানুষটাই যে সেই খুনি, সেটা কল্পনাতীত ছিলো তার কাছে। ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে যেনো। এতো যন্ত্রণা! তার যে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে! এতোগুলো বছর যে মানুষটাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলো সে, তার এতো কাছে ছিলো তার অবস্থান! শুধু কাছে নয়, বরং তার অন্তর জুড়ে ছিল সে। সেই মানুষটাকে ঘিরে সাজিয়েছিল অজানা ভবিষ্যতের অসংখ্য চিত্র। থম মেরে বসে রইলো আরাধ্য। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কতো শত মানুষের চেহারা। রহস্যময় খুনের সব ঘটনা। যা নিয়ে এতোদিন মাথা ঘামায়নি, আজ সবকিছুই তার চোখের সামনে পরিষ্কার। চাইলেও ঘৃনা করতে পারছে না সে শ্রেষ্ঠাকে। তবে মনের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এক বিতৃষ্ণার তিক্ত সুর ভেতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কেউ যেনো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তার শরীরে। দাউ দাউ করে জ্বলছে তার পুরো শরীর। হতভম্ভ, হতবুদ্ধি হয়ে সেই যে ব্যালকনিতে বসেছিলো আরাধ্য, ওভাবেই কখন যে রাত পেরিয়ে গেলো ইয়াত্তা নেই। ভোরের আজান কানে ভেসে আসতেই ঘোর কাটে তার। চোখ দুটো জ্বলছে ভীষণ। টুপ করে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। তাচ্ছিল্যকর হাসি দিয়ে সেই জলটুকু মুছে ফেলতেই ঘটলো আরও কয়েক ফোঁটা জলের আনাগোনা। তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা শাওয়ার নিয়ে নামাজে দাড়ালো সে। আজ অনেকগুলো দিন পর নামাজ আদায় করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আরাধ্যর। মনের মাঝে ঘটতে থাকা তোলপাড় বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার চেয়েও উন্মাদ। সারারাত ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টিও হয়েছে খানিক। অথচ এসবের কিছুই টের পায়নি সে।

২৫.

হাইওয়ের রাস্তা ধরে শো শো শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ধূসর রঙের গাড়ি। ভেতরে পিনপতন নীরবতা। শ্রেষ্ঠা আড়চোখে তাকাচ্ছে আরাধ্যর দিকে। তার চোখমুখ লাল। নির্ঘুম, ক্লান্ত চেহারায় কী যেনো একটা খেলা করছে। হুট করে সকালে শ্রেষ্ঠাকে মেসেজ দিয়ে একসাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার আবদার জানায় আরাধ্য। সেই সাথে ক্রমে বাড়তে থাকা তাদের মাঝের দূরত্বের একটা মীমাংসা প্রয়োজন। শ্রেষ্ঠা এতগুলো দিন মিলিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে অনেকখানি। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরাধ্যকে আর এড়িয়ে চলবে না সে। তাদের সম্পর্কটা এবার স্বাভাবিক করা উচিৎ। আর যাইহোক সার্থকের ভুলের শাস্তি তো আরাধ্যকে দেওয়া যায়না। আর আরাধ্য সার্থকের ভাই হলেও দুজনের চরিত্রের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। এক কথায় দুজনকে দুই প্রান্তের মানুষ বলে মনে হয়, এতোখানি ফারাক। সব মিলিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে একসাথে নতুন করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আদৌ কি নতুন করে কিছু গুছিয়ে উঠতে পারবে তারা? নাকি এই শুনশান নীরবতা বড়ো কোনো ঝড়ের সংকেত!

#চলবে?

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১০

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১০
#ফিজা_সিদ্দিকী

সার্থক আহসান রুদ্র। নামটুকু দেখেই আতঙ্কে, উত্তেজনায় শরীরের আদ্যোপান্ত জুড়ে অদ্ভুত এক আলোড়নের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। অদ্ভুতভাবে ঘামতে থাকে আরাধ্যর শরীর। শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে শিহরণ। তিক্ত অথচ বিস্ময়কর অনুভূতিরা রক্তের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেহ প্রান্তে। নির্বাক, হতবুদ্ধি আরাধ্য নিজেকে ক্ষণিক সময়ের জন্য সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। তার মন বলছে বিষের চেয়েও বিষাক্ত কিছুর সাক্ষী হতে চলেছে সে। অস্বস্তিতে দরদর করে ঘামছে শরীর।

“আরাধ্য!”

শ্রেষ্ঠার কণ্ঠ শুনে আচমকা কেঁপে ওঠে আরাধ্য। ধ্যান জ্ঞান ভুলে শুন্য দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মাথায় উপর ফ্যান ঘুরছে আপন গতিতে। তবুও ঘামে জুবুথুবু অবস্থায় আরাধ্যকে দেখে ভ্রু কুঁচকে সন্ধিহান চোখে তাকায় সে। আচমকা ভোল পাল্টে যাওয়ার মতো কোনো কারণ না খুঁজে পেয়ে সে এগিয়ে যায় আরাধ্যর কাছে।

বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকা অন্তর্মুখী যুদ্ধের একটা মীমাংসা প্রয়োজন। মূলত এ কারণেই আজ আরাধ্যর এই বাড়ীতে আসা। শ্রেষ্ঠার মুখোমুখী হওয়া। সেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় শ্রেষ্ঠাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এক মুহুর্তের জন্যও সস্তি পায়নি আরাধ্য। ফলস্বরূপ বাড়ী পৌঁছেই কল করে শ্রেষ্ঠাকে। অথচ দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। যেনো ওপাশের মানুষটা ইচ্ছে করেই তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে না। অথচ দুজনের মাঝে এহেন আচরণের যৌক্তিক কোনো ঘটনাই ঘটেনি। চিন্তায় পুরোটা রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। সকাল হওয়ার সাথে সাথেই শ্রেষ্ঠার ফ্ল্যাটের সামনে এসে সমানে কলিং বেল বাজালেও গেট খুললো না কেউই। সারারাত নির্ঘুম থাকার ফলে আরাধ্যর চোখ দুটো লাল টকটকে। ফুলেছেও কিছুটা। সেই সাথে জ্বলছে ভীষণ। উস্কখুস্ক চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। কেনো যেনো ছন্নছাড়া, সর্বহারা এক দুর্বিষহ জীবন সত্তার প্রলেপ পুরোটা জুড়ে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও কেউ দরজা খুললো না। তবে সেই মুহুর্তে টুং শব্দে বেজে উঠলো আরাধ্যর ফোনের মেসেজ টোন। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মাত্র কয়েকটা বাক্য।

“স্রোতে ভেসে গিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বোধহয় ঠিক হয়না সবসময়। জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভেবে চিন্তে। আমি আমার ভাবনার সময় চাই। ততোদিন কোনোরূপ যোগাযোগ কিংবা হস্তক্ষেপ চাইছি না। ব্যবহার প্রেক্ষিতে এটা বোধহয় বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিলো।”

হতবাক দৃষ্টিতে আরাধ্য তাকায় বন্ধ দরকার দিকে। কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছে তার। হুট করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই মস্তিকে প্রবেশ করছে না যেনো। কী ঘটছে, কেনো ঘটছে কোনো সমীকরণই মেলাতে পারছে না সে। পুরোটা মেসেজের শেষ লাইনটাই শুধু বারংবার আঘাত হানছে মস্তিষ্কে। সেই সাথে মনের মাঝে চলছে তীব্র আলোড়ন। চলে যেতে গিয়েও সেদিন একবার শুধু পিছু ফিরে তাকিয়েছিল সেই বন্ধ দরজার দিকে। এরপর আর ফেরেনি এই মুখে। যতোই কষ্ট হোক না কেনো একটা বারের জন্যও ফেরেনি সে। তবে মাঝে মাঝেই ফোনে ডায়াল করতে গিয়েও কেটে দিয়েছে শ্রেষ্ঠার নম্বর। কেনো যেনো মন সায় দেয়নি তার। সেদিনের প্রতিটা কথার মাঝে সূক্ষ্মভাবে অপমানের তীর ছুঁড়ে দিয়েছিলো যেনো শ্রেষ্ঠা।

একটা মানুষের এতখানি ভালোবাসার বিপরীতেও এতটা অগ্রাহ্য করার মতো ব্যবহার কী আসলেই সহনীয়? সেও তো মানুষ। রাগ, অভিমান, জেদ, ইগো, আত্মসম্মানবোধ, সবই আছে তার মাঝে। কষ্ট তো তারও হয়। ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। আবার সেটা সামনের মানুষটার সামনে প্রকাশ করাটাও কোনো অন্যায় কাজ নয়। কিন্তু যদি সেই ভালোবাসার দাবি নিয়ে সে বিরক্ত করতো, তবে হয়তো সেটা অন্যায় হতো। অন্যায় হতো অপর পক্ষের মানুষটার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সামনে বারংবার ভালোবাসা জাহির করা। কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো এমন নয়! এমনকি শ্রেষ্ঠা নিজেই স্বীকার করেছে তার ভালোবাসা। স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে তাদের নামহীন সম্পর্কের। তবে কিসের এত অবহেলা? নাকি শুধু রূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ্য মানুষ মনে করে তাকে এহেন অপমানাত্বক কথা শোনাতে পারছে?

দুটো সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। আরাধ্য নিজের মতো জীবনযাপনের চেষ্টায় ভীষণভাবে ব্যস্ত। এহেন সময় হুট করেই কল আসে শ্রেষ্ঠার। গুরুতর মিটিং চলাকালীন সময়ে আসা ফোনটা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয় আরাধ্য। ত্রিশ মিনিট সময়ের মাঝে মোট দুইবার কল করেছে শ্রেষ্ঠা। মিটিং রুম থেকে বের হয়ে বাকি কাগজপত্র রেডি করতে করতে দুই ঘণ্টা পেরিয়েছে। এর মাঝে আর কোনো কল না আসায় শ্রেষ্ঠার ব্যপারটা একেবারেই ভুলতে বসেছিলো সে। ফাইল রেডি করে জরুরি এক কল করার প্রেক্ষিতে ফোন উঠিয়ে হাতে নিতেই আরাধ্যর আচমকা মনে পড়ে শ্রেষ্ঠার কথা। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে বেজে পঁচিশ। তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করে আরাধ্য। বিনয়ী ভঙ্গিমায় হ্যালো বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে আসে তাচ্ছিল্যকর এক কণ্ঠস্বর।

“ডেটে ছিলে বুঝি? খুব বেশি ডিস্টার্ব করিনি তো? উম করেছি মনে হয়। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।”

“এগুলো কেমন ধরনের কথা শ্রেষ্ঠা? আগে তো এভাবে কথা বলতে না আমার সাথে? তোমার কথা বলার ভঙ্গি কেমন বিশ্রী রকম লাগছে। কী হয়েছে তোমার?”

ফোনের ওপারে সশব্দে হাঁসে শ্রেষ্ঠা। একেবারে অট্টহাসি যাকে বলে। অতঃপর হাসতে হাসতেই নিজেকে কোনরকম কন্ট্রোল করে বলে,

“আই সি। আই সি মিষ্টার আরাধ্য খান। আমাকে তো এখন বিশ্রী লাগবেই। এটা একেবারেই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিছুদিন পর রেডিকিউলাস বলবেন। এরপর…”

আর কথা বলতে পারলো না শ্রেষ্ঠা। হো হো করে হেঁসে উঠলো সে। আরাধ্যর কেনো যেনো মনে হচ্ছে শ্রেষ্ঠা আদৌ হাসছে না। করোর হাসি এতো করুন হয় বুঝি? কারোর হাসির শব্দে বুকে চিনচিন ব্যথা হয় বুঝি? কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে জীবনের সমস্ত তিক্ততা সে ব্যক্ত করছে এই হাসির মাধ্যমে। শব্দটা হাসির হলেও আদতে সে কাঁদছে। মুখে হাসি থাকলেও তার চোখে জল টলটলে। তবে কী আসলেই কাঁদছে শ্রেষ্ঠা। কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছে সে? কে দিলো তাকে এই কষ্ট? সে নিজে নয় তো? কিন্তু কষ্ট দেওয়ার মতো কোনো কাজ কি আদৌ সে করেছে?

“শ্রেষ্ঠা”

কথার ভঙ্গিমা শান্ত। শীতল তার কণ্ঠস্বর। এটুকু একটা কথায় কী যেনো ছিলো। থেমে গেলো শ্রেষ্ঠার হাসি। কিছু সময় নীরবতা। এরপর হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। সেই কান্নার শব্দ যে মুখ চেপে ধরে নিবারণ করার চেষ্টা করছে কিংবা গিলে ফেলতে চাইছে তা বুঝতে এক মুহুর্তও দেরি হলো না আরাধ্যর। তাই আর সময় অপচয় না করে কথা বলতে বলতেই সে বেরিয়ে পড়লো শ্রেষ্ঠার বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো সময়। চারটে বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। শ্রেয়ার স্কুল ছুটির সময় হয়েছে। অতঃপর কাউকে একটা মেসেজ করে বলে দিলো শ্রেয়াকে স্কুল থেকে ড্রপ করার জন্য। সেইসাথে আজকের পুরো বিকেলটা যেনো তাকে নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়ায় সে, এমন নির্দেশনা ও দিলো।

“তোমরা সবাই এক আরাধ্য। আমি কেনো চিনতে পারলাম না। কেনো বলো? কেনো এলে আমার জীবনে তুমি? এভাবে বাঁচতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি সাধারন চিন্তা করতে পারছি না কিছু। সবসময় যেনো কোনো আতঙ্কের মধ্যে বাঁচছি। এ জীবনে আমার নিস্তার কী তবে নেই আর? আই অ্যাম ফেডেড আপ।”

“দরজা খোলো।”

এতোখানি আবেগী কথার বিপরীতে এহেন উত্তর আশা করেনি শ্রেষ্ঠা। সেই সাথে হুট করে এমন কথা শুনে খানিকটা সময়ের জন্য হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলো সে। অতঃপর মস্তিক সাড়া দিতেই বুঝতে দেরি হয় না যে আরাধ্য দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। বিনা বাক্য ব্যয়ে হলরুম পার হয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। মুখোমুখী হয় দুজনে। দুজনের কানেই চেপে ধরা মুঠোফোন। দরজার দুই পাশের মানুষটাই বিধ্বস্ত। কেমন যেনো ছন্নছাড়া। এই কয়েকদিনেই শ্রেষ্ঠার উজ্জ্বল চেহারার খেই হারিয়ে গেছে যেনো। কেমন বিবর্ণ, ফ্যাকাশে লাগছে তাকে। কী ভীষণ রকমের হাড় হিম করা থমথমে।

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০৯

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৯
#ফিজা_সিদ্দিকী

২১.
আরাধ্য আজ দেশে ফিরেছে। এই খবর যেনো হাসনাহেনা ফুলের তীব্র সুগন্ধের ন্যায় অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো ফ্ল্যাট জুড়ে। পুরো ফ্ল্যাটে একটা হৈ হৈ রব। তবে এতো আয়োজনের মাঝেও নিশ্চুপ শ্রেষ্ঠা। খুশি প্রকাশ করবে নাকি দুঃখ! আর খুশি হলেও তার কোনোরূপ কারণ খুঁজে পাচ্ছে না শ্রেষ্ঠা। কিংবা হয়তো খোঁজার চেষ্টা করছে না। সে তো আর বাড়ির মালিক নয়! তবুও তার আগমনী বার্তায় যেনো উৎসব নেমেছে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে। শ্রেষ্ঠা বাদে ফ্ল্যাটের সকলে নেমেছে নানা আয়োজনে। সকলের পুরোদস্তুর প্রচেষ্টায় সন্ধ্যার আগে আগেই সেজে উঠলো বাড়ি। লাইটিং থেকে শুরু করে ফুল, কিছুই বাদ রাখেনি যেনো। তাদের ফ্ল্যাটের নীচতলায় একটা বিশাল হলরুম আছে। বাড়ী বানানোর সময় মালিকপক্ষ এই জায়গাটা বিয়ে কিংবা পার্টির স্পট হিসেবে ভাড়া দেওয়ার জন্য আলাদা ভাবে তৈরি করেছিলেন। আজ সেখানেই চলছে নানান আয়োজন।

সূর্য ডুবি ডুবি অবস্থা। দূর থেকে ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছে চাঁদের আলোর ছটা। দিনের আলো নিভে নেমেছে সাঁঝবেলা। শ্রেষ্ঠা সবেমাত্র মেয়েকে টিফিন করিয়ে কিচেনে টুকিটাকি যাবতীয় কাজ সারছে। ইতিমধ্যে বেজে ওঠে কলিংবেল। একবার, দুইবার থেকে বারবার এভাবে বেজেই চলেছে। শ্রেষ্ঠার অবস্থা বেগতিক। হাত পা কাঁপছে ঠক ঠক করে। যেনো এখানে দাঁড়িয়েই সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দরজার ওপাশের মানুষটাকে। পড়ে ফেলতে পারছে তার মনের অভিব্যাক্তি। এইতো কয়েকমাস আগেই দেখা হলো তার সাথে। কাটানো হলো কতখানি সুন্দর সময়। কুড়িয়ে নেওয়া হলো সুমধুর কিছু স্মৃতি। তবুও আজ কেনো তার এতো নার্ভাস লাগছে? কেনো মনে হচ্ছে লোকটার সামনে এসে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। তবে কী এই মানুষটা তার দুর্বলতা? যার সাথে কঠিন থাকা যায়না। যাকে চেষ্টা করেও কোনো কঠিন কথা শোনানো যায়না। প্রতিটা শক্তপোক্ত মানুষেরই কোনো না কোনো দুর্বলতা থাকে। যেখানে চলে না তার রাজত্ব। বরং সে হয় সেই রাজ্যের প্রজা। রাজত্ব চলে অন্য কারোর। তবে কী তার এই দুর্বলতার রাজ্যের রাজা আরাধ্য!

ড্রয়িংরুমের সোফায় মুখোমুখি বসা দুই প্রাণী। অথচ কারোর মুখে কথা নেই। শ্রেষ্ঠা আড়চোখে বার কয়েক তাকিয়েছে সেদিকে। কিন্তু ভস্ম করার মতো একজোড়া মোহনীয় দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির রাখতে পারেনি। তৎক্ষণাৎ সরিয়েছে চোখ। স্কুলের ভাইভা থেকে শুরু করে কলেজের এক্সটার্নালের মুখোমুখি, সব জায়গায় বসেছে সে। তবে আজকের মতো অনুভূতি কখনোই হয়নি। কখনও মনে হয়নি যে এই পরীক্ষায় সে ফেল করবে। কিন্তু আজ! আরাধ্যকে কেনো যেনো রুঢ় এক ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন পরীক্ষক লাগছে তার কাছে। যে খুঁটিতে খুঁটিতে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে। খুঁজছে কোনো এক কারণ তাকে এই পরীক্ষায় ফেল করানোর জন্য। যেনো পুরোদস্তুর উঠে পড়ে লেগেছে তাকে এই যাত্রায় হারিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায়। কিন্তু শ্রেষ্ঠাকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে আরাধ্য বলে ওঠে,

“তাকাও আমার দিকে।”

থমথমে তার কণ্ঠস্বর। আচমকা কেঁপে উঠলো শ্রেষ্ঠা। খামচে ধরলো জামার একাংশ। দৃষ্টি আরো গাঢ়ভাবে নিবদ্ধ করলো মেঝের দিকে।

“এদিকে তাকাতে বলেছি আমি।”

“না মানে শ্রেয়া একা রুমে..”

“শ্রেয়া ঠিক আছে। নিজের গিফট আর চকলেট নিয়ে ব্যাস্ত। ওকে ডিস্টার্ব না করে সোজাসুজি তাকাও আমার দিকে। কিসের ভয় এতো?”

“ভ ভভয় কই? ভয় কেনো পাবো? আমি কী অন্যায় কিছু করেছি নাকি?”

“করোনি?”

“নাহ”

শ্রেষ্ঠার নির্লিপ্ত জবাব।

“শ্রেয়া কে?”

“শ্রেয়া আমার মেয়ে। ও শুধুই আমার মেয়ে। যেটুকু বলার ছিলো তোমাকে চিঠিতে জানিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু জানার নেই। আর কোনো সত্যি নেই।”

শ্রেষ্ঠার কণ্ঠে দৃঢ়তা। এবার খানিকটা নরম হলো আরাধ্য। কোমল কণ্ঠে বললো,

“পারবে তো বেড়ে ওঠা শ্রেষ্ঠার সকল জবাব দিতে? পারবে তো আজীবন তাকে মিথ্যা বোঝাতে? পারবে তো সত্যিটা তার থেকে আড়াল রাখতে? আর যেদিন সত্যিটা তার চোখের সামনে আসবে, সেদিন পারবে তো তাকে সামলাতে? পারবে তো নিতে সেই দায়ভার, যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তার থেকে আড়াল করার জন্য দোষারোপ করবে সে! পারবে তো তার ঘৃনা ভরা দৃষ্টি সহ্য করতে?”

চকিতে চোখ তুলে তাকায় শ্রেষ্ঠা। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে, ” শ্রেয়া আমার মেয়ে। এর বাইরে আর তো কোনো পরিচয় নেই ওর।”

“বিয়ে না করেই তার মানি কিভাবে তার মা হয়ে গেলো? এই প্রশ্ন করাটা কী খুব অস্বাভাবিক? সমাজ তো আর তোমার মতো চুপ করে থাকবে না। নানা ভাবে উত্যক্ত করবে তার মন মস্তিষ্ককে।”

“আরাধ্য, আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাইনা। ফিরে আসার আগে নিজের অনুভূতির কথাটা আপনাকে জানিয়েছিলাম। সেই সাথে মনে হয়েছিল আমার জীবনে ঘটে যাওয়া নোংরা এক লোকের ছোঁয়া, সেই বিষয়টাও আপনার জানা উচিৎ। এছাড়া আপনার জানার আয়ত্তের মধ্যে থাকা সম্ভাব্য সব কথাই আমার মনে হয় আপনি জানেন। এরপরের সিদ্ধান্ত আপনার। আমি অপেক্ষা করেছি। তবে আজ এই আচরণ প্রত্যক্ষভাবে বয়ান দিচ্ছে আপনার উত্তরের। আর কিছু বলার না থাকলে আসুন।”

“তাড়িয়ে দিচ্ছ?”

“নাহ। যে নিজে থেকে চলে যেতে চায়, তাকে তাড়িয়ে দেওয়া নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। আমি শুধু আপনাকে রাস্তাটা দেখিয়ে দিলাম।”

“বাড়ীতে এক্সট্রা ম্যাট্রিক্স আছে তো? নাকি থেকে যেতে গেলে ম্যাট্রিক্স আমাকেই কিনে আনতে হবে?”

“মানে?”

“বাই এনি চান্স তুমি আমাকে তোমার রুমে, তোমার বেডে, পাশাপাশি, কাছাকাছি ঘুমানোর জন্য বলছো না তো?”

ভ্রু কুঁচকে আরাধ্যর মতিগতি বোঝার চেষ্টায় রত শ্রেষ্ঠাকে দেখে আচমকা শব্দ করে হেসে দেয় আরাধ্য। আরাধ্যর ঠাট্টা বুঝতে পেরে বেশ খানিকটা লজ্জা পায় শ্রেষ্ঠা।

“অচেনা দেশে একই ফ্ল্যাটে থেকেও যে ছেলেটা সুযোগ নেয়নি, তোমার কি মনে হয় সে এই পরিচিত জায়গায় সুযোগ নিতে চাইবে?”

নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জা পেলো শ্রেষ্ঠা।আসলেই তো, তার যদি সুযোগ নেওয়ার হতো তবে তেমন অনেক সুযোগ সে পেয়েছে। তবুও কখনও বাজে ভাবে স্পর্শ তো দূর ইচ্ছাকৃত ছুঁয়ে দেয়নি তাকে। বরং বেশ কয়েকবার সে নিজেই উত্যক্ত করেছে আরাধ্যকে। কী ভীষণ পরিমাণ কন্ট্রোল নিজের উপর থাকলে একটা মানুষ সেই মুহূর্তেও নিজেকে সামলে নেয়। প্রশ্ন এড়াতে লাজুক কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা বলে,

“হুট করে এতো আয়োজনের কারণ?”

“সেটা তো সময় হলেই জানতে পারবে। এখন রুমে গিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমি নীচে অপেক্ষা করছি।”

২২.

প্রবানহমান সময়ের ধারায় কিছু থেমে থাকে না। সময়ের সাথে পাল্টায় পরিস্থিতি। কখনও কখনও পরিস্থিতি হয়ে ওঠে জটিল তো কখনও সরল। আরাধ্য আর শ্রেষ্ঠার জীবনের সবচেয়ে জটিল মুহুর্তটা বোধহয় শুরু হয়ে গেছে। সেদিন রাতে সকলের সামনে হাতে হাত রেখে স্বীকৃতি পাওয়া মেয়েটা আজ ছন্নছাড়া। অনেকখানি লক্ষ্যভ্রষ্ট। জীবনের কূল কিনারা খুঁজতে গিয়ে উথাল পাথাল অবস্থা।

আয়োজনটা মূলত একটা গেট টুগেদার হিসেবে থাকলেও, সেদিন সকলের সামনে শ্রেষ্ঠাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আরাধ্য। সেই সাথে এটাও বুঝিয়ে দেয়, তার অতীত নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই আরাধ্যর। তার সবটুকু চিন্তা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। শ্রেষ্ঠার বাবা মা তাদের এই সিদ্ধান্তে খুশি হলেও অসন্তোষ রিয়ে গেলো আরাধ্যর মায়ের। যদিও এর আগে ছেলের সাথে এই বিষয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে তার। কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা। এই মেয়েকে ছাড়া সে বিয়ে করবে না। এমনকি দেশেও ফিরবে না আর। অগত্যা বাধ্য হয়ে এই সম্পর্কটা মেনে নিতে হয়েছে তাকে। নয়তো অন্যের সন্তানের বোঝা নিজের ছেলের ঘাড়ে কিছুতেই চাপাতে দিতেন না তিনি।

যেখানে শুরু থাকে সেখানে অন্তও থাকে। তাইতো সখের পুরুষকে পেয়ে অতীতকে ভুলতে বসা শ্রেষ্ঠার সামনে হুট করে খুলে যায় অতীতের আরও একটা পাতা।

সেদিন শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে প্রথমবারের মতো নিজের বাড়িতে গিয়েছিলো আরাধ্য। প্রাথমিকভাবে নাকচ করলেও আরাধ্যর জোরাজোরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তার সঙ্গ দেয় শ্রেষ্ঠা। বাড়ীর ড্রয়িংরুমের এক সাইডে টাঙানো বড়োসড়ো একটা ফটোফ্রেম। সাধারণের চেয়ে বেশ বড়ো হওয়ায় কৌতূহলবশত সেটা দেখার আগ্রহ নিজের মাঝে চেপে রাখতে না পেরে সেদিকে এগিয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকাতেই নিঃশ্বাস আঁটকে আসে তার। শরীর কাঁপতে থাকে মৃগী রুগীদের মতো। নিঃশ্বাসের গতি আচমকা মাত্রা ছাড়িয়েছে। এক পা দুই পা করে পিছাতে পিছাতে টেবিলের কোনা লেগে পড়ে যায় সে। শব্দ পেয়ে রুম থেকে ছুটে আসে আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার অস্বাভাবিক আচরন আর গোঙানো দেখে ভয়ে প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। আচমকা শ্রেষ্ঠার এহেন আচরনের কিছুই বুঝতে না পেরে তার মাথা টেনে নেয় বুকে। দুইহাতে জড়িয়ে নানাভাবে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে তাকে। সেই প্রচেষ্টা সফলও হয়। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে শ্রেষ্ঠা। কিন্তু তার দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই বড়ো করে বাঁধানো ফ্রেমের দিকে।

২৩.
“প্রতিশোধ” এটা কোনো ডায়রির নাম হতে পারে? শ্রেষ্ঠার বুকশেলফের একদম শেষের দিকে খানিকটা আড়ালে থাকা এই ডায়রির নাম দেখে অনেকখানি অবাক হয় আরাধ্য। প্রতিশোধ! কিসের প্রতিশোধ? আর এই নামে কোনো ডায়রি হয় নাকি? কার প্রতি শ্রেষ্ঠার এতোখানি রাগ? এতোখানি উন্মত্ততা? আরাধ্য ডায়রিটা হাতে নিয়ে জমে থাকা ধুলোগুলো পরিষ্কার করে। অতঃপর প্রথম পাতা ওল্টাতেই যা দেখে তাতে তার চোখ আঁখিকোটর হতে বের হয়ে আসার উপক্রম।

#চলবে!