Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 430



আজল পর্ব-১৪

0

#আজল
#পর্ব-চৌদ্দ

২৮.

সেই যে শুরু হলো আমাদের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক চলেছিলো প্রায় দেড় বছর। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তোমার জীবনের শ্রেস্ঠ সময় কোনটা? আমি চোখ বুজে বলবো,ঐ দেড়টা বছর আমার জীবনের শ্রেস্ঠ সময়। এমন না যে দেড় বছর সুখেই কেটেছে একদম, সুখ দুঃখ মিলে ভালো কেটেছে। সপ্তাহের চারদিন ওদের পড়াতাম, এই চারদিন পড়ানো শেষ করে দুজনে একসাথে হাটঁতে হাটঁতে রেহনুমার নানির বাড়ি পর্যন্ত যেতাম। বাড়ির আগের গলি পর্যন্ত ওর সাথে যেতাম, তারপর আমি ফিরে আসতাম।আমরা একটু ঘুর পথে যেতাম যেন বেশি সময় ধরে হাঁটা যায়। বাকী দিনগুলোতে বের হওয়া সম্ভব ছিলো না। প্রতি শুক্রবার করে রেহনুমার বাবা আসতেন ওকে দেখতে। মাঝে মাঝে ওকে সাথে করে নিয়েও যেতো বাড়িতে। বাবার ওখানে থাকলে রেহনুমা আমার সাথে কথাই বলতো না পাছে ওর বাবা কিছু বুঝে যান। ওখান থেকে আসার পর মাঝে মাঝে খুব কান্না করতো, মন খারাপ করে থাকতো। আমি জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে চাইতো না। বলতো-” আপনি প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, আমার কষ্ট হয়। আপনি শুধু একটা কাজ করবেন,আমি যতক্ষণ আপনার সাথে থাকবো ততোক্ষণ আমায় হাঁসাবেন। এই সময় টুকু আমি দুনিয়ার কোনো কিছুই মনে রাখতে চাই না। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে কষ্ট দেবেন না দয়া করে।”
আমার আর কিছু জানা হতো না। পাছে আমি কিছু বললে ও কষ্ট পায় এই ভয়ে আমার আর কিছু বলা হয়ে ওঠে না। তবে যেদিন ওর মন খারাপ থাকতো ও আমার কাছে কবিতা শুনতে চাইতো। আমি বুঝে যেতাম ওর মন খারাপ।

সত্যি কথা বলতে কি, পড়ালেখায় আমার অবনতি হয়েছিল। ফার্স্ট ইয়ারে আমি গড়পরতা রেজাল্ট করলাম। সেকেন্ড ইয়ারে তার চেয়ে একটু ভালো। উন্নতি হয়েছিল কিন্তু সে রকম না যে রকমটা আমার করা উচিত। অন্যদিক দিয়ে আবার বেশ নাম করে ফেললাম। ভার্সিটির অনুষ্ঠান হলে আমার ডাক পড়ে। আমি আবৃতি করি, হাল্কা গান টান গাই। রেহনুমা আমার পড়ালেখার ব্যপারে খুব উৎসাহ দিতো,কিন্তু ওর মন খারাপ,ওর অশান্তি গুলো আমাকে না বললেও খুব ইফেক্ট করতো। আমার মনে হতো আমি ওকে যে আশা দিয়ে সম্পর্ক করেছিলাম সেটা পূরন করতে পারিনি।
বাবা মনেহয় কিছু খবর পেয়েছিলেন। কারন এই দেড় বছরে ঈদের ছুটি ছাড়া বাড়ি যাইনি। আমার পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো, বাড়িতে না যাওয়া সব কিছু মিলে বাবা দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিলেন৷ তবে আমাকে কিছু বললেন না। পরের ঈদে যখন বাড়ি গেলাম তখন সে শুরুর দিনেই আমাকে ডেকে পাঠালেন। পড়ালেখার খোজ খবর নিলেন। রেজাল্ট জানলেন। আশ্চর্য ব্যাপার বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। শুধু ঠান্ডা মাথায় এটাই বললেন –
“পরবর্তী সেমিস্টারের রেজাল্ট যদি ভালো না হয় তাহলে আমাকে কিছু বলবেন না, প্রিয়তার বিয়ে দিয়ে দেবেন।”
উনি এতো ঠান্ডা গলায় কথাটা বললেন যে, আমি বুঝে গেলাম বাবা সত্যি সত্যি তাই করবেন। কারন আমরা সবাই জানতাম, বাবা খুব জেদি আর একগুয়ে মানুষ। সে কোনোকিছু ঠিক করে ফেলে সেটা করেই ছাড়ে। কিন্তু তবুও কেন যেন আমি ভয় পেলাম না। আমার মনের কোনে হয়তো একটু বিশ্বাস ছিলো যে, বাবা প্রিয়তার সাথে এরকমটা করবেন না। হাজার হোক, নিজের মেয়ে বলে কথা! মাত্র ক্লাস নাইন পড়ুয়া প্রিয়তা আমাদের সবারই বড় আদরের ছিলো।

বছর খানেক এভাবেই ভালো মন্দ টানাপোড়েনে কেঁটে গেলো। মিলিও আমাদের ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পেরেছিলো হয়তো। একদিন ও আমাকে ডেকে নিয়ে গেছিলো আলাদা করে-
“ফুয়াদ, ভাই যেটা করছিস সেটা মোটেও ভালো হচ্ছে না? ”
“কেন? আমি কি করেছি?”
“কি করেছিস সেটা তো তুই ভালোই জানিস? আমার কাছে শুনতে চাচ্ছিস ক্যানো? তবে যেটা করছিস সেটা অন্যায় হচ্ছে। ও বাচ্চা মানুষ, ভীষন কষ্ট পাবে রে? এমনিতে তো আর কম কষ্টে নেই?”
আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলাম মিলি আমায় থামিয়ে দিলো-
“একদিন ঠিকই বুঝবি আমি কি বলছি? কেন বলছি?”
সেদিন মিলির কথা শুনে সত্যিই আমার রাগ হয়েছিল। আমি কি এমন করেছি যে সবাই এতো নেগেটিভ কথা বলছে। একটা দুঃখী মেয়ের হাত ধরেছি তাই এতোসব। মনেহলো,পৃথিবীটাই অনেক নিষ্ঠুর, অসহায় কে আরো অসহায় বানিয়ে দেয়। সবকিছু মিলে আমি বেসামাল ছিলাম। পড়তে বসতাম ঠিকই কিন্তু পড়া হতো না। ক্লাসে থাকতাম কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকতো না। আমার সেই সেমিস্টারের রেজাল্ট ও এ্যাজ ইউজুয়াল হলো।

এদিকে রেহনুমার এইচ এস সি পরীক্ষা এগিয়ে আসছিলো। আমার পড়ানো কমে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে যেতাম মডেল টেস্ট নেওয়ার জন্য। রেহনুমা কেও কেমন যেন দেখতাম সবসময় অন্যমনস্ক আর মন খারাপ থাকে। জিজ্ঞেস করলে বরাবরের মতই কিছু বলে না। আমিও জোর করি না আর। রেহনুমার পরীক্ষার পর পর আমার পঞ্চম সেমিস্টারের ফাইনাল এক্সাম। এবার আমি খুব চেষ্টা করছিলাম যেন পরীক্ষা গুলো ভালো হয়। এর মধ্যে আর রেহনুমার সাথে দেখা হয়নি, ফোনে কথা হতো। ও মাঝে একদিন জিজ্ঞেস করলো পরীক্ষা কবে শেষ হবে? আমি যে ডেট বললাম ও শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছু একটা বলতে যেয়েও যেন বলতে পারে না। আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম, একেবারে আমার শেষ পরীক্ষার দিনে দেখা করবো।

পরীক্ষা শেষে পরদিন দেখা করি রেহনুমার সাথে। পরিচিত কফি শপে যেয়ে বসি। অনেকদিন পরে দেখা, প্রায় দু মাসের বেশি। খেয়াল করলাম ও অনেক শুকিয়ে গেছে, চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে। উষ্কখুষ্ক চেহারা, দেখে মনে হচ্ছে কোনো রকমে চুলটা বেধে চলে এসেছে। আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ওর হাত ধরলাম-
“রেহনুমা কি হইছে?এই অবস্থা কেন?”
ও ছলছল চোখে আমার দিকে তাকায়, চোখ ভরা জল, ঠোট দুটো চেপে ধরে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ওর কান্না যেন আমার বুকে যেয়ে লাগলো। রেহনুমা অনেক শক্ত মেয়ে, ও তো সহজে কাঁদে না?আমি অস্থির হয়ে ওর হাত ধরি-
“এই রেনু, পাগলী, কি হইছে? কাঁদো ক্যান?”
এবার রেহনুমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। আমি ওকে একটু স্থির হতে সময় দেই, কিছুক্ষণ পর ওর দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দেই। ও কান্না নিয়ন্ত্রণ করে পানি খায়। দু হাত দিয়ে মুখটা মুছে, তারপর বলে
“বাবা আমাকে নিতে আসছে অনেকদিন, আপনার সাথে দেখা করবো বলে যাই নাই।”
“ও। তো এতে কান্নার কি আছে? যাও ঘুরে আসো? তারপর তো তুমিও ভার্সিটিতে ভর্তি হবা!”
” এই বার গেলে বাবা আর আসতে দিবে না। আর পড়াবেও না আমাকে। বাবার বউয়ের বাচ্চা হবে, তাই তার আগেই আমাকে বিদায় করতে চায়।”
“মানে? বিদায় করতে চায় মানে?”
আমি বোকার মতো প্রশ্ন করি।
“বাবা, আমার বিয়ে ঠিক করছে। ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে। এইবার আমাকে নিয়ে যায়ে বিয়ে দিবে। ”
“কি বলো,রেনু? কবে বিয়ে ঠিক করসে? তুমি আমাকে জানাও নাই ক্যান?”
“কি লাভ জানায়ে? আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?”
“কেন করবো না? কিন্তু আমাকে একটু সময় দিবা না? আমি তো বলছি যে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো। পড়ালেখা শেষ হোক?”
“আর ততোদিন আমি কার কাছে থাকবো? কে আমাকে আশ্রয় দিবে? আর তাছাড়া আপনার পরিবার মানবে? আমার বাবাকে তো আমি বলতেই পারবো না। এমনিতেও সৎমা সারাক্ষণ মাকে নিয়ে কথা শোনায়। এখন যদি আমি এই বিয়ে না করি তাহলে তো তার আরো সুযোগ হবে বাবাকে উল্টো বুঝ দেয়ার।”
“আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলি? ”
“নাহ, দরকার নাই। যদি আপনার ফ্যামিলি নিয়ে আসতে পারেন তাইলে আসেন। না হলে দরকার নাই।”
“তুমি একটু চেষ্টা করো না? আমি পাশ করা পর্যন্ত সময় দাও আমাকে। আর তা না হলে চলো বিয়ে করি এখনি। তোমাকে চলাইতে পারবো, টিউশনি করে।”
আমি ওর হাত ধরি, অনুনয় করি।
“তারপর একসময় যেয়ে মনে হবে আপনি ভুল করছেন। পরিবারের সাপোর্ট পাবেন না,আমি তো এমনিতেই একা, আপনারও যদি কেউ না থাকে তাহলে চলতে পারবেন? আমি জানি পারবেন না। আর যে ব্যাথ্যা আমি সহ্য করছি তা আপনাকে কিভাবে পেতে দেই?”
আমি কি বলবো বুঝে পাই না। এতটুকু মেয়ে ও যা বুঝে আমি কেন তা বুঝি না, আগেও কেন বুঝলাম না। এইজন্যই কি মিলি বলেছিলো ঐ কথা। আমি নিরুপায় হয়ে বসে থাকি।
“জানেন, আমি জানতাম এমনই কিছু হবে? এই জন্যই আমি কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই নাই। অথচ আপনি আমায় বাধ্য করেছিলেন। যাক, বেপার না। এই দিনগুলো তো সুখে কেটেছে? এই স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে পারবো আমি।”
“রেনু, প্লিজ এভাবে বইলো না। আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো। প্লিজ,বোঝার চেষ্টা করো, ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকলে সব পারা যায়। আমরাও পারবো দেখো?”
“শোনেন, ঠান্ডা মাথায় ব্রেকাপ বুঝেন? আমি আপনার সাথে সেটাই করতেছি। আমি জামি, আপনি আগেও আমার পরিস্থিতি বুঝেন নাই, এখনও বুঝবেন না। তাই আমিই আপনার সাথে ব্রেকাপ করলাম। আপনি সারাজীবন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিবেন যে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে গেছি, বুঝলেন? তাহলে আর আপনি কষ্ট পাবেন না।”
আমার কান্না আসে, কিন্তু কাঁদতে পারিনা। জানি,রেহনুমা রেগেই কথাগুলো বলছে। আসলেই তো আমি তো কিছু ভাবি নাই, ওকে স্বপ্ন দেখাইছি শুধু। স্বার্থপরের মতো জোর করে ওকে ভালোবাসতে বাধ্য করছি। আমার চোখ লাল হয়, আমি হাতের মুঠো চেপে ধরি। অথচ রেহনুমা কি সুন্দর নিজের কান্না গিলে নিয়েছে। কত অবলীলায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
“আচ্ছা, আমি যাই। আমাকে এগিয়ে দেবেন না? আজ শেষবারের মতো এই দায়িত্বটা পালন করুন। এরপর আপনি মুক্ত। ”
রেহনুমা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি জানি ও কান্না লুকাতে চাইছে। আমি আর ও পাশাপাশি হাটছি। একটু পথ বাকী থাকতে আমি রেহনুমার হাত চেপে ধরি-
“রেনু চলোনা আমরা বিয়ে করি। বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যা কিছুদিন কষ্ট হবে তারপর দেখবা সব ঠিক।”
” জানেন তো আমি প্রেম,ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না। যেটা আজ আছে কাল নাই তার কি বিশ্বাস! আর বাবাকে কিভাবে কষ্ট দেই বলেন তো? যে বাবা আমার আট বছর বয়স থেকে আমাকে পেলেপুষে বড় করেছেন তাকে কিভাবে কষ্ট দিবো? দরকার হলে নিজের জীবনটা দিয়ে দেবো বাবাকে তবুও মায়ের মতো কষ্ট তাকে দিতে পারবো না।”
আমার আর কিছু বলার থাকলো না। কি বলবো? ও তো ঠিকই বলেছে? আমিই ভুল। ও হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটে-
“একটা কবিতা শুনবেন? এতোদিন তো আপনি আমাকে শুনিয়েছেন, আজ আমি শোনাই, আমার নিজের লেখা। আমি মাথা নাড়ি, ও বলে-


আমার একটা জনম আমি দিতে চেয়েছি তোরে
তুই হেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিস মোরে।
দিতে চেয়েছি
একটি সোনালী সকাল
আমার ভেজা চুলের আলতো ছোয়ায় তোর ঘুম ভাঙা।
দিতে চেয়েছি
রোদ্দুর জ্বলা দুপুর
একই ছাতার নিচে তোর কাঁধের সাথে আমার কাঁধের ঠোকাঠুকি।
দিতে চেয়েছি
একটি গোধুলী বিকেলে
এক কাপ ধোয়া ওঠা গরম চায়ের পেয়ালা।
দিতে চেয়েছি
বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা
তোর আমার ভিজে যাওয়া শরীরের তাপের আদান প্রদানের ব্যগ্রতা।
আমার একটা জনম আমি দিতে চেয়েছি তোরে
তুই হেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিস মোরে।

ও বলছিলো আর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিলো পানি। ও চলে গেলে আমি আমার ভেজা চোখ নিয়ে অপলক ওর যাওয়ার পথে চেয়ে থাকি। প্রিয়জন চলে গেলে কেমন লাগে আমি তখনো বুঝতে পারছিলাম না। দুদিন পর আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম….. কি যে এক অদ্ভুত শুন্যতা, ও তো আমার অভ্যাস ছিলো, দিনে তিনবার ফোন…খাইছো নাকি…ঘুমাইছো নাকি…পরীক্ষা কেমন দিলা…পড়তে বসছো নাকি…কেন বসো নাই…এইরকম হাজারো অভ্যাস কে মিস করতে শুরু করলাম। ওকে ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাই…নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে আমার…আমি ওর কলেজের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকি অকারনে ঘন্টার পর ঘন্টা। বাড়িতেও যেতে ইচ্ছা করে না।আমি শুধু ভাবি ও কিভাবে এতো সহজে নিজেকে মানিয়ে নিলো এই পরিস্থিতিতে।

তিনদিন পর একদিন হঠাৎ মায়ের ফোন-
” বাপ, বাড়িতে আসবি না? প্রিয়র তো বিয়ে ঠিক করলো তোর বাবা।?”

একদিকে রেহনুমার সাথে আমার সম্পর্ক আর একদিকে আমার একমাত্র ছোটোবোনের বিয়ে। মাথা আমার নষ্ট হওয়ার অবস্থা। সেই পাগল পাগল অবস্থায় আমি পরদিন সব দুঃখ ভুলে বাড়ির দিকে ছুটি। প্রিয়তাকে কিছুতেই বিয়ে দিতে দিবো না। এতো অল্পবয়সে কিছুতেই ওর জীবন নষ্ট হতে দেবো না। বাড়িতে পৌঁছে সবকিছু স্বাভাবিক ই মনে হলো। মাকে জিজ্ঞেস করতেই মা বললো, প্রিয়র বিয়ের কথা পাকাপাকি করেছে বাবা। পরদিন আংটি পড়ানো হবে। এক দেড় বছর পর বিয়ে।
আমি বাবার সাথে কথা বলতে গেলাম। মা আমাকে অনেক আটকানোর চেষ্টা করলেন আমি শুনলাম না। বাবাকে যেয়ে বিয়ের কথা বলতেই বাবা আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকালো, তারপর বিছানা থেকে উঠে এসে সজোরে চড় মেড়ে বসলেন। আমি হতচকিত হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম, এতো বড় ছেলের গায়ে বাবা হাত তুললেন? আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বাবা আরো একবার হাত তুললেন, মা বাঁধা দিলো। বাবা হিসহিসিয়ে বললো-
” তুই কি ভাবছিস,আমি জানি না কিছু? যার নিজের পড়া লেখার কোনো ভবিষ্যৎ নাই সে বোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে কোন অধিকারে? এখন ওকেও তোর মতো বানাতে চাচ্ছিস? আমার মেয়ে আমি যা খুশি করবো, তোর তাতে কি? তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি, সে কথা রেখেছিস?”
মা কিছুই না বুঝে শুধু একবার বাবার দিকে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি ঐ দিনই ঢাকায় ফেরত আসি। একা একা হোস্টেলের রুমে গুমরে মরছিলাম। ঐ মুহুর্তে আমার মতো একা কেউ ছিলো কি না আমার জানা নাই। আমার জন্য, শুধু আমার জন্য দুই দুইটা মেয়ের জীবন নষ্ট হলো, এটা আমার মাথার মধ্যে ক্রমাগত ঘুরতে থাকে।

আমি টোটালি চেঞ্জ হয়ে গেলাম। এই বন্ধের মধ্যে একা একা হোস্টেলে আমি পড়া শুরু করলাম। আমার এতোদিনের যতো গ্যাপ হয়েছিলো সব সব একসাথে নিয়ে হামলে পরলাম। মাঝে মাঝে না পেরে ফোন দিয়ে দিতাম রেহনুমাকে। নাম্বারটা বন্ধই পেতাম। সব ভুলতে পড়ালেখাই হলো আমার সঙ্গি। তার ফলাফল আমার সার্টিফিকেটের ওজন, যে ওজনের ওপর আজকের সাকসেসফুল আমি দাড়িয়ে। বাড়ি থেকে ফোন এলে আর ধরতাম না। মাঝে মাঝে চাচারা আসতেন আমাকে দেখার জন্য, আমি দুচার কথা বলে ওদেরকে বিদায় দিতাম। বাবার টাকা আর নেইনি, নিজেই টিউশনি করে নিজের খরচ জোগার করতাম। পাশ করার আগ পর্যন্ত আমি আর বাড়ি যাইনি।
বন্ধের পর যখন ক্লাস চালু হলো, মিলি কেমন যেন আমার সাথে কথা বলে না। আমারও লজ্জা লাগতো। ওর কথা ঠিক আর আমি ভুল প্রমান হলাম এই গ্লানিতে আমি ওর থেকে লুকিয়ে বেড়াতাম। একদিন মিলির সাথে মুখোমুখি পড়ে গেলাম-
“মিলি,রেহমুনা কেমন আছে?”
মিলি কেমন একটা বাঁকা হাসি দিলো-
” তুই ওকে ভালো থাকার মতো রেখেছিস? ভালোই করলি রে? তোরা ছেলেরা কেবল স্বপ্ন দেখাতে জানিস??”
আমার আর সাহস হয়নি কিছু বলার। ঠিকই তো বলেছে মিলি। আমি যা তাই তো বলেছে। আমার জন্য দু দুটো মেয়ে অল্প বয়সে কঠিন শাস্তি পেয়ে গেলো। আমি তো জানি রেহনুমা, প্রিয় এরা কেউ ভালো নেই। এই অপরাধবোধ আমাকে আজও তাড়া করে বেড়ায়। আমি সস্তি পাই না, বিশ্বাস করো সাঁচি….আমি ভীষন কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি…আমার….
“দু জন নয় তিনজন…তিনজনের জীবন নষ্ট করেছেন….”
সাঁচি থামিয়ে দেয় ফুয়াদ কে।
“আমিও আছি তে আপনার তালিকায়…”
ফুয়াদ অবাক চোখে তাকায়..সাঁচিও তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে…ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে… সাঁচি উঠে দাড়ায়…”
আজ বুঝলাম, ভালোর ভিতরেও মন্দ থাকে…উপরে ভালো দেখা গেলেই ভিতরটা পঁচা হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নাই। ”
“তুমি আমাকে ভুল…বুঝছো…সাঁচি…” হাতের ইশারায় ফুয়াদকে থামিয়ে দেয়-
“দেখুন সকাল হয়ে গেছে এখন না ঘুমালে আমার শরীর খারাপ করবে”
ফুয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাঁচি ঘরে ঢুকে যায়…ফুয়াদ দাঁড়িয়ে থাকে ওখানেই…….হতাশ হয়ে…

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১৩

0

#আজল
#পর্ব-তেরো

২৭.

“তারপর?” বেশ অনেকক্ষণ পরে সাঁচি কথা বলে।
ফুয়াদ চোখের জল মুছে নিজেকে সামলে নিলো। মুখটা শুকিয়ে গেছে, ঠান্ডা কফিতেই চুমুক দিলো একটু।
“আমি সেদিন দুটো ক্লাস এ্যাটেন্ড করেই বেরিয়ে আসি। একেতো মনটা ছটফট করছিলো, তার উপর একটু নার্ভাস লাগছিলো। এতদিন একরকম ঘোরের মাঝে ছিলাম, কিন্তু সেদিন লজ্জা লাগছিলো খুব। একদিনের পরিচয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা করা, ব্যাপারটা তখন নিজেরই হজম হচ্ছিল না। যাইহোক, রেহনুমার ক্লাস ছিলো আড়াইটা পর্যন্ত। আমি তার আগেই ওর কলেজের সামনে পৌছে গেলাম। ওকে ম্যাসেজ করে দিলাম যে, আমি ওর কলেজের সামনে দারিয়ে আছি। পৌনে একঘন্টা দারিয়ে থাকার পর ও আসলো। আমি ঠিক অপজিটের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও হেলেদুলে হেঁটে আসছিলো। আমি দূর থেকে দেখে হাত নাড়লাম। ওকে গতবারের তুলনায় আরো শীর্ন দেখাচ্ছিলো। স্বাস্থ্য আরেকটু কমেছে। ও আমার সামনে এসে সালাম দিলো। দুজনাই কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ আমিই বললাম, কোথাও বসার কথা। রেহনুমা বললো সামনে একটা ভালো ফাস্টফুডের দোকান আছে। আমরা হেঁটে সামনে গেলাম। রেস্টুরেন্টে বসে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কিছু খাবে কিনা? ও মাথা নাড়লো। আমি তবুও জোর করে দুটো বার্গার আর কফি অর্ডার করলাম। জানি সারাদিন না খেয়ে ক্লাস করছে, আর তাছারা আমারও খাওয়া হয়নি সারাদিন। কিছুসময় পর ও নিরবতা ভঙ্গ করলো-
” কেন ডেকেছেন, ভাইয়া? আপনি যদি আপুর কথা না বলতেন তাহলে কিন্তু আমি কখনোই দেখা করতে আসতাম না!”
“কেন? তুমি কি ওকে ভয় পাও?”
“ভাইয়া, এই মুহুর্তে আমি সবাইকে ভয় পাই। যার বাবা মা থেকেও থাকে না তাকে সবাই ঢোল এর মতো বাজাতে চায়। আর সেখানে আমি আপুদের বাড়ির আশ্রিতা। নেহাত মিলি আপুর বাবা মানে আমার মামা ভালো মানুষ তাই থাকছি। আপুও ভালো,ঐ বাড়িতে একমাত্র আপুই খাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে আমি খেয়েছি কিনা? কিন্তু ঐ যে বললাম, আমি বাবা মা থেকেও এতিম, তাই ভয়ে ভয়ে থাকি। আমাকে এতো সহজে কি সবাই ভালোবাসবে? ”
“যদি বলি বাসবে? কেউ যদি তোমাকে ভালোবাসতে চায়, তোমার কেয়ার করতে চায়, তোমাকে জীবনের সব সুখ দিতে চায়, তাহলে কি তুমি তাকে সুযোগ দেবে?”
“নাহ! কখনোই না। আপনি যে ভালোবাসার কথা বলছেন সে সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না।” মাথা নাড়লো রেহনুমা।
“কারন আমি জানি ওগুলো সবই টাইম পাস হবে। কে আমার মতো চালচুলোহীন কে বাড়ির বউ বানাবে? আর তাছারা আমি স্বইচ্ছায় কারো কাঁধে বোঝা হতে চাই না। আবার ফ্যামিলির কারো কথার অমান্য করতেও চাই না। এমনিতেও মায়ের কাজের জন্য কম কথা তো শুনিনি জীবনে? ফ্যামিলির বিপক্ষে যাওয়ার মতো সাহস আমার নাই।”
“কে তোমাকে বলেছে বিপক্ষে যেতে? তুমি তোমার মতই থাকো না। রেহনুমা, তোমাকে কিছু বলতে চাই? বলতে চাই এই কারনে যে, না বলতে পারলে আমি মারা যাবো মনে হয়।”
“এমন কিছু বলবেন না যেটা অসম্ভব। আমি স্বপ্ন দেখে কষ্ট পেতে চাই না।”
“প্লিজ,একটু শোনো মন দিয়ে।আমি…আমি আসলে জানি না আমার কি হয়েছে…যেদিন থেকে তোমাকে দেখেছি…কি যে হয়েছে…আমি পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছি। না ঠিক মতো পড়ালেখা করতে পারছি, না খাওয়া, না ঘুম!কিচ্ছু ঠিক নেই। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে যাওয়ার বাট পাড়ছিনা। জীবনে এই প্রথম এরকম ফিলিংস এর সাথে পরিচয় হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না কি করলে ভালো লাগবে। এই যে তোমার সাথে দেখা করলাম মনের মধ্যে অনেক শান্তি লাগছে। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, তোমার সাথে আজ দেখা হবে এই খুশিতে এতদিন পর গত রাতেরই প্রথম আমি একটু পড়তে পেরেছি। মাঝখানে সব পরীক্ষায় লাড্ডু পেয়েছি, জানো?”
রেহনুমা আমার কথা শুনে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, সেই মুহুর্তে মনে হচ্ছিল ও আসলেই একটা বাচ্চা। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে ও আবার গম্ভীর হয়ে গেল।
“শোনেন, এই যে যেগুলা বললেন, মানে জানেন?”
আমি বোকার মতো মাথা নাড়ি।
“আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন, বুঝলেন? বাট লাভ নাই, এই প্রেম ভালোবাসার কোনো মুল্য নাই, বুঝলেন। আমার বাবা মাও প্রেম করে বিয়ে করছিলো, তার হাল তো দেখছেনই।”
নিজের দিকে ইশারা করলো রেহনুমা। আমার একটু রাগ হলো-
“সব সম্পর্ক যে একই রকম হবে তার কি গ্যারান্টি, বলোতো? ”
“ঘুরে ফিরে ঐ একই হবে। আচ্ছা আপনি এই যে এতো কথা আমাকে বুঝাচ্ছেন, আপনি কি আপনার বাসায় আমার কথা বলতে পারবেন?”
“পড়ালেখা শেষ করে বলবো?”
“মানে পাঁচ বছর পরে?”
“হ্যা”
“ততোদিন প্রেম করলে তো আমরা ভাইবোন হয়ে যাবো? নিজেদের মধ্যে কথাবলার কিছুই খুজে পাবো না। আমার ভাই আপনার বোন হওয়ার শখ নাই। আপনি আপনার রাস্তা মাপেন। আমার পিছে আইসেন না। ”
“রেহনুমা, কি বলো এইগুলা? প্লিজ, ফাজলামো কইরো না?”
আমি অসহায় হয়ে বলি।
“আপনি ফাজলামো করতেছেন। জেনেশুনে আমার জীবনটা তেজপাতা বানাতে চাচ্ছেন। আমাকে অবলা পেয়ে আপনিও সুযোগ নিবেন নাকি?”
রেগে উঠে গেল রেহনুমা।
“আমার পিছে যেন আবার না আসেন?” বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেল। আমি বুঝে গেলাম এই মেয়ে সহজ না। সহজে হার মানবে না। এত অলপ বয়সে এতো কঠোরতা কিভাবে পেলো?আর কি অবলীলায় বলে দিলো যে, আমি ওর প্রেমে পড়েছি? আমারও যেন জেদ চেপে গেলো। ওকে রাজি করানোর জেদ। আমি ভুলে গেছিলাম, বাবা ঠিক এই কথাগুলো বলেই আমাকে সাবধান করেছিলো। বাবা আমার কাছ থেকে কথা আদায় করেছিলো সে কথাও আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। মাথার মধ্যে তখন শুধুই ওকে রাজি করানোর নানা রকম বুদ্ধি ঘুরছিলো।

পরদিন আবার গেলাম ওর কলেজের সামনে। ও আর আমাকে দেখে এগিয়ে আসে না। আমি পিছন পিছন গেলেও আমাকে না দেখার ভান করলো। একটা কথাও বললো না আমার সাথে। আমিও হার মানার ছেলে না….প্রতিদিন যেতে লাগলাম ওর কলেজে। কোনো কোনো দিন এমন হতো যে দু’ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি ওর দেখা নাই। হয়তো নিজেকে ভীরের মধ্যে লুকিয়ে চলে যেত, এমন ও হতো কোনো কোনো দিন ও আসেনি। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে ওকে ফোন দিতাম। ও ফোন ধরতো না। এভাবে প্রায় একমাস কেটে গেলো। একদিন হঠাৎ রেহনুমার ম্যাসেজ আসলো-“আপনার না পরীক্ষা সামনে? আপনি এইভাবে আমার পিছনে সময় নষ্ট করছেন কেন? মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিন। আর আসবেন না, কেমন? পরীক্ষা শেষে কথা বলবো।”
ম্যাসেজ দেখে আমি তো মহা খুশি। যাক বাবা, তাওতো কিছু রেসপন্স পাওয়া গেল। কিন্তু আমার পরীক্ষা সেটা ও জানলো কিভাবে? তখন মনে পড়লো হয়তো মিলির কাছে শুনেছে। যাইহোক, ওর ম্যাসেজে আশ্বস্ত হয়ে এবার আমি পড়ালেখা শুরু করলাম। কিন্তু এতোদিনের গ্যাপ কি এই কদিনের পড়াশোনায় পূরন করা সম্ভব? ফলাফল, কোনোরকমে পরীক্ষা গুলো দিলাম। টেনেটুনে পাশ হবে হয়তো! পরীক্ষার পরদিনই আমি ছুটলাম রেহনুমার সাথে দেখা করতে। ওকে আগেই ম্যাসেজ করেছিলাম। কলেজ থেকে বের হয়েই ও আমার দিকে এগিয়ে এলো,বললো-
“চলুন, একটু দূরে কোথাও বসি। এখানে বসলে পরিচিত কেউ দেখে ফেলতে পারে।”
“ভার্সিটি এলাকায় যাবা?”
“নাহ,ওখানে আপনার ফ্রেন্ডরা আছে না?অন্য কোথাও।”
“সব জায়গায় ওরা থাকে নাকি? চলো কার্জন যাই।”
কিছুক্ষণ ভেবে রেহনুমা মাথা নাড়লো –
“নাহ, যাবো না। চলেন এই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলি। কেউ দেখলে দেখুক”
কিছুক্ষণ হাঁটার পর রেহনুমা বললো-
“আচ্ছা আপনি এইরকম পাগলামি কেন করতেছেন? কোনো ভবিষ্যৎ আছে এর?”
“কেন থাকবে না? তুমি চাইলেই ভবিষ্যৎ হবে।”
“দেখেন,আপনি বাচ্চা না আমি? কেন শুধু শুধু জেদ করতেছেন? আমি কোনোদিনও এই সম্পর্কে যাবো না।”
“প্লিজ তুমি আমাকে একবার সুযোগ দাও,তোমার জন্য কিছু করার। আমি শুধু তোমাকে একটু খুশি দিতে চাই, সুখী দেখতে চাই।”
“আমি তো সুখী হতে চাচ্ছি না? কেন আপনি জোর করতেছেন? আপনি আর আসবেন না প্লিজ! আমার কষ্ট হয়!”
কান্না করতে লাগলো রেহনুমা। আমার প্রচন্ড কষ্ট হলো। আরে, আমি তো কেবল ওকে একটু সুখ দিতে চাই, আমি তো ওর কান্নার কারন হতে চাই না। আমিতো তো ভেবেছিলাম, ও আজকে পজিটিভ কিছু বলবে? কিন্তু আমি কি করবো? ওকে না দেখলেও যে আমার ভালোলাগে না। আমি ওর দু গালে হাত দিয়ে চোখ মুছে দিতেই ও ছিটকে দূরে সরে গেল-
“কি করছেন টা কি? এই দুঃসাহস আপনাকে কে দিলো?”
“সরি,তুমি কাঁদছিলো তাই…”
“প্লিজ কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ…”
নিজেই হাত দিয়ে নিজের কান্না ভেজা মুখটা মুছলো।
“আচ্ছা, তুমি তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট, তাই না?”
“হ্যা,তো?”
“আচ্ছা, আমি তবে তোমাকে টিউশন দেই। তোমার যে যে সাবজেক্টের সমস্যা থাকবে আমি দেখিয়ে দেবো। আসলে তোমাকে একবারে না দেখতে পারলে আমি থাকতে পারবো না, তখন অযথাই তোমাকে বিরক্ত করবো। তুমি নিশ্চয়ই তা চাও না?”
আমি না পারতে অন্য পথ ধরলাম ওর কাছাকাছি থাকার জন্য।
“তো কোথায় পড়াবেন? এই রাস্তায়…..”
“এই ধরো আশেপাশে কোথাও বসে দেখিয়ে দেবো…”
আমি মাথা চুলকাই।
“আপনার মাথা! উনি রাস্তায় বসে আমায় টিউশন দেবেন? আচ্ছা, আমি দেখি আমাদের ক্লাসের কেউ পড়বে কিনা? যদি পড়ে তাহলে কয়েকজন একসাথে ব্যাচ করে পড়বো। আপনারও ইনকাম হবে, আবার আমাকে আপনার দেখার শখও মিটবে?”
ওর কথা শুনে আমি তো মনে মনে রীতিমতো নাচতে শুরু করেছি। ও যে এতো সহজে রাজি হবে আমি ভাবিনি।
“শুনুন,আমি কিন্তু ফ্রি পরবো।আমি তো আপনাকে স্টুডেন্ট জোগার করে দিবো,তাই আমি ফ্রি পড়বো। আর খবরদার মিলি আপু যেন ভুলেও এসব না জানে??”
“কোনোদিনও না।”
আমি খুশি হয়ে বলি।
“আপনি বরং এইফাকে কিছুদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। কোনো ব্যবস্থা হলে আমি জানাবো আপনাকে।”
আমার তো বাড়িতে যাওয়ার এক ফোটাও ইচ্ছা ছিল না। এবার মনে হচ্ছে যেতেই হবে। আমি মাথা নেড়ে চলে এলাম। যাক, যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেটাতেই আমি খুশি। ও যদি পড়ে আমার কাছে তাওতো প্রতিদিন ওকে দেখতে পাবো?

আমি বাড়িতে গেলাম ঠিকই কিন্তু মন পড়ে রইলো ঢাকায়। আমার এই উদাসীন ভাব মায়ের নজর এড়ালো না। মা আমাকে ধরলেন এক বিকেলে-
“কি রে বাবু, তোর কি হয়েছে বল তো? সারাদিন এতো ছটফট করিস কেন?”
“কিছু না মা। এমনিতেই, অনেকদিন পর বাড়ি আসলাম তো তাই।”
“কিছু না হইলেই ভালো, বাপ। মন দিয়ে পড়ালেখা কর। রেজাল্ট খারাপ হইলে কিন্তু তোর বাবা খুব রাগ করবে?”
আমি মনে মনে মাকে বলি, মা তোমার ছেলে তো পড়তেই ভুলে গেছে। আব্বা জানলে কি করবে জানি না তবে যাই করুক আমার মনেহয় আর গায়ে লাগবে না!!
সপ্তাহ খানেক পর রেহনুমা ফোন করলো, চারজন পাওয়া গেছে। ওরা পড়বে, সাথে রেহনুমা। চারজনের কোনো একজনের বাসায় পড়াতে হবে। খবর শুনেই আমার খুশি দেখে কে? খুশির চোটে মাকে ফটাফট কয়েকটা চুমো দিয়ে দিলাম। মাতো অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। বাবার নজর বাঁচিয়ে এক রকম পালিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। পাছে বাবা আবার পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করে?

আমার টিচারের জীবন শুরু হলো। রেহনুমাসহ পাঁচ জন পড়তো ওরা। আমার বেশ মজা লাগছিলো পড়াতে। ওদেরকে বুঝানোর পরে ফাঁকে ফাঁকে যখন টাস্ক করতে দিতাম সেই সময় টুকু আমি রেহনুমা কে দেখতাম। ও তাকালে মাঝে মাঝে আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে যেত। ও লজ্জিত হয়ে চোখ সরিয়ে নিতো আর আমি হাসতাম মিটিমিটি। আমাদের এই লুকোচুরি খেলাতে দিন ভালোই কাটছিলো। আমার নতুন সেমিস্টারের ক্লাসও শুরু হয়েছিল এর মধ্যে। টেনেটুনে পাশ করেছিলাম। নিজের ক্লাস, রেহনুমাদের পড়ানো সবমিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছিলো। এবার আমি একটু স্থির হয়ে নিজেও পড়তে শুরু করলাম। সবকিছুই ঠিক চলছিলো, কিন্তু মাঝে আমি জ্বরে পড়লাম। ভীষণ রকম জ্বর আমাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিলো। তিনদিন কোনো জ্ঞান ছিলো না আমার। কাউকে খবরও দিতে পারিনি। আমার রুমমেটগুলা যথেষ্ট ভালো ছিলো, আমার অসুস্থতায় ওরা অনেক সেবা করেছে আমায়। তিনদিন পরে আমার জ্বর ছাড়লো। বিকেলে আমার এক রুমমেট বললো, ফুয়াদ তোর অনেক ফোন আসছিলো ভাই। তুই কি স্টুডেন্ট পড়াস নাকি, কই কখনো তো বলিস নাই। তোর ছাত্রীরা তো ফোন দিয়ে মাথা নষ্ট করে দিতেছিল তাই বাধ্য হয়ে ফোন বন্ধ করে রাখছিলাম। দয়া করে ফোন টা চালু কর ভাই।

আমি তড়িঘড়ি করে ফোনটা ওপেন করতেই অসংখ্য ম্যাসেজ, একটার পর একটা টুংটাং আওয়াজে আসতেই থাকল। সব একই নাম্বার থেকে, আর আমি বিস্ময়ের সাথে দেখলাম প্রায় সব রেহনুমার ম্যাসেজ। আমি একটা ম্যাসেজ ওপেন করে কেবলই পড়তে শুরু করেছি তখনই রেহনুমার কল-
“হ্যালো”
“এই, কি হইছে আপনার? তিনদিন কোনো খবর নাই, ফোনটাও বন্ধ। আপনি এক্খন আসেন আমি আপনাকে দেখবো।”
“আস্তে রেহনুমা, আস্তে। দম নেও একটু। আরে,জ্বর হইছিলো আমার। এই কেবল একটু আগে জ্বরটা ছাড়লো। ফোনটা বন্ধ হয়েছিলো। কেবল খুললাম।”
“আমি কিছু জানিনা,আপনি এখন আসবেন, আমি আপনাকে দেখবো। নাইলে শান্তি পাবো না।”
“আরে শরীর টা দূর্বল তো, এখন বের হওয়া ঠিক হবে না। আর তাছারা তুমিই বা কি বলবা বাসায়, একটু পরে তো সন্ধ্যা লাগবে।”
“আমি কিছু জানিনা, আমি কিছু একটা বলে বের হবো,আপনি আসেন। আমার কলেজর সামনেই আসেন। আপনার তো কাছে হবে ঐইটা।”
রেহনুমার আচরনে আমি চরম অবাক হলাম। আমি যার পাগল সে আমাকে নিয়ে পাগলামি করতেছে? আমাকে নিয়ে ওর এই রকম পাগলামি করার কারন কি? ও তো এইরকম কখনো করে না? আমি অনেক কষ্টে দূর্বল শরীরে বের হলাম। সেদিনই প্রথম রেহনুমা দেখলাম আমার আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে রিকশা থেকে নামতে দেখে ও নিজেই দৌড়ে আসলো। আমাকে ধরলো দু’হাতে। রিকশা একটু দূরে যেতেই ও আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। আমি বুঝতেই পারলাম না কি হলো তার আগেই ছেড়ে দিলো। লজ্জিত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম বোবা হয়ে। কি বলবো, যার পিছু আট নয় মাস ধরে পড়ে আছি সে আজ নিজের থেকে আমার কাছে ধরা দিচ্ছে? আমি অবিশ্বাস্য ভাবে জিজ্ঞেস করলাম-
” কি হইছে রেহনুমা, তুমি ঠিক আছো তো?”
রেহনুমা এবার চোখ তুলে তাকালো, ওর দুচোখ ভরা জল, সে আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে কপালে হাত রাখলো তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো-
“নাহ,আমি একদম ঠিক নাই…এই যে তিনদিন আপনার কোনো খবর নাই…জ্বরে পরে আছেন..আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারতেছিলাম না…আমি কিভাবে ঠিক থাকি বলেন তো…আজকে ছয়-সাত মাস যাকে প্রতিদিন দেখি তাকে না দেখলে কি ঠিক থাকা যায়?”
“ওহ! তা এখন তো দেখলা। এখন তো ঠিক থাকবা। আমি যাই তাহলে?”
আমি চলে আসতে নেই, রেহনুমা পেছন থেকে আমার হাত ধরে। আমি বলি-
“কি?”
“ভালোবাসি তো!”
“কাকে?”
রেহনুমা রেগে যায়-
“ঐ রিকশাওয়ালাকে যে আপনাকে নিয়ে আসছে। হইছে?”
আমি হাসি-
“তাহলে এই খানে দাড়ায় আছো ক্যান। যাও বেটাকে খুজো যায়ে।”
রেহনুমা আরে রাগে, আমার দেখতে ভালো লাগে। ও আমার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়-
“আমি গেলাম তাহলে?”
আমি ওর হাত ছাড়ি না, আরো শক্ত করে ধরে বলি-
“পারলে ছাড়াই যাও দেখি?”
রেহনুমা বৃথা চেষ্টা করে হাত ছাড়ানোর, আমি দেখি আর হাসি আর মনে মনে বলি-
” অবশেষে আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম!!!”

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১২

0

#আজল
#পর্ব-বারো

২৬.

দুজনার হাতে দু মগ কফি নিয়ে আবার বারান্দায় বসেছে ফুয়াদ আর সাঁচি। কফি টা ফুয়াদ বানিয়েছে। কফি না থাকলে নাকি কথা বলে মজা পাওয়া যায় না! এটা ফুয়াদের কথা, সাঁচির অবশ্য একটা হলেই হয়, চা কিংবা কফি? কোনোটাতেই কোনো এ্যালার্জি নেই। হঠাৎই ফুয়াদ বললো-“আচ্ছা, তোমার জীবনে কোনো গোপন ব্যাপার নেই?”
“সে রকম বলার মতো কিছু নেই। আমার মতো এতো খ্যাতমার্কা মেয়েদের কেই বা পচ্ছন্দ করবে? আর কেউ করলে পাত্তাই বা দিচ্ছে কে?”
“হুম, বুঝলাম।”
“প্লিজ অন্য কথা না বলে আপনার বাকী কথাটা শেষ করুন।”
ফুয়াদ একটু হাসলো মনে হয়। বারান্দা অন্ধকার হওয়ার কারনে সাঁচি ঠিক বুঝতে পারলো না। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক সেই সাথে মশারাও সমান তালে গান শুনাচ্ছে। ওষুধ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। ঠান্ডা বাতাসে মাঝে মাঝে গা টা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাঁচি পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসে গায়ের চাদরটা ভালো মতো জড়িয়ে নিলো।
“আমি হলে এসে উঠলাম। ক্লাস শুরু হলো যথারীতি। কিছু বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে ফেললাম অল্প দিনের মধ্যেই। আমার দিনগুলো বেশ মজায় কাটতে লাগলো। একে তো স্বাধীন জীবন তার উপর নিজের আশেপাশে বন্ধু বান্ধব এর খুব ভালো একটা গ্রুপ পেয়ে জীবনটা যেন একেবারে অন্য রকম মজাদার হয়ে গেল। তবে যাই করি না কেন পড়ালেখার সাথে কোনো আপোশ করি নাই। যেদিন সারাদিন ব্যস্ত থাকতাম সেদিন রাতে পড়ে কাভার দিয়ে দিতাম। যার ফলস্বরূপ বরাবরের মতো ক্লাস টেষ্ট আর মিডটার্মে ভালো ফল।
আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, মিডটার্মের রেজাল্ট এর পর পরই ছিলো বৈশাখ। আমি অবশ্য এসব দিবস টিবস এ্যভোয়েড করতাম। সেবারও করেছিলাম। সারাদিন বের হইনি। সন্ধ্যায় ঢাকা ভার্সিটিতে একটা কনসার্ট ছিলো, বন্ধুরা জোর করে ধরে নিয়ে গেল। এসব কনসার্ট এ আমি জীবনেও যাই নাই। এতো কোলাহল আমার ভালো লাগে না।

যাইহোক, বেশ নামকরা শিল্পীরা এসেছিলেন সেই কনসার্ট এ। আমি কিছুক্ষণ গান শুনলাম, তারপর বিরক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, চা খাবো ভাবছিলাম। বেশ একটু হেঁটে নিরিবিলি দেখে একটা চায়ের দোকানের সামনে বসলাম। চায়ের কথা বলতেই খেয়াল করলাম সামনে আমার এক ক্লাসমেট নাম মিলি মুখচোখ কালো করে বসে আছে। আমাকে দেখা মাত্রই ও বললো
” ফুয়াদ, তুই কি এখন এখানেই থাকবি নাকি কিছুক্ষণ ?”
“হ্যা রে, ওখানে অসহ্য লাগছে, এতো আওয়াজ, কান একেবারে গেল।”
“তাহলে প্লিজ আমার একটু উপকার করনা, ভাই?”
“হ্যা, বলনা। কি হইছে, তোরে এই রকম বিরক্ত লাগতেছে ক্যান?”
“আর বলিস না! এই যে আমার ফুপাতো বোন,রেহনুমা। পিচ্চিরে নিয়া আসছিলাম কনসার্টে কিন্তু ও এখন থাকবে না বলতেছে। কেবলই তো আসলাম এখনই যাইতে চাইতেছি না। তুই যদি না যাস তাইলে ওর সাথে একটু বস না ঘন্টাখানেক। ঐদিকে তনিমা, ফয়সাল ওরা সব আমার জন্য বসে আছে। আমি ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চলে আসবো।”
আমি মিলির বোনটার দিকে তাকালাম, ফর্সা গোলগাল মুখ, হেংলা স্বাস্থ্য নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। মেয়েটার চেহারার বিশেষত্ব হলো ওর চোখ, ওর টানা টানা গভীর চোখ দুটো যেন বিষাদের সাগর। অদ্ভুত দুঃখি ভাব নিয়ে সে আমার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। জাস্ট একবারই, কিন্তু কেন জানিনা আমার ভেতরটা নড়ে উঠলো। আমার ঐ মুহুর্তে মনে হলো, এরকম দুঃখী চেহারা, বিষাদময় মুখ আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। এই ঘোরের মধ্যেই আমি মিলিকে কখন হ্যা বললাম, মিলি কখন চলে গেলো আর মেয়েটাই বা কখন আমার সামনে এসে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে আমি কিছুই টের পাইনি। বেশ অনেকক্ষণ বাদে আমার ঘোর ভাঙলো –
“এই যে শুনছেন, হ্যালো, কি হয়েছে আপনার! তখন থেকে দেখছি একইভাবে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন? কি হয়েছে? আপনি কি অসুস্থ ফিল করছেন?”
আমার সম্বিৎ ফিরলো-
“ওহ!সরি।আমি… আসলে..একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম…আচ্ছা, আপনি কি চা খাবেন?”
“আমাকে তুমি বলুন প্লিজ। অনেক ছোট হবো আপনার থেকে।”
চা ওয়ালা মামাকে দু কাপ রং চায়ের কথা বলে বসলাম মেয়েটার পাশে-
“তো তোমার নাম রেহনুমা? কোথায় পড়ো তুমি?”
“জ্বী আমি এবার এস এস সি দিলাম। রেজাল্ট এর অপেক্ষায় আছি।”
“ওহ! তুমিতে তাহলে পিচ্চি বাচ্চা একটা।”
আমার মুখ দিয়ে আপনাতেই বেড়িয়ে গেলো। আমার বলার ভঙ্গিতে ও হেসে দিলো, কিন্তু আমার মনে হলো ওর সে হাসি যেন চোখ ছুলো না।
“তো, এই বাচ্চা মেয়েটা বড়দের অনুষ্ঠানে কেন এসেছে, হুমম?”
“ভাইয়া, আমি তো একদম আসতে চাইনি। এমনিতেও আমার এসব হই হল্লা ভালো লাগে না। আজ আপু আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে। ”
“ওহ। কিন্তু তোমার কেন এসব ভালো লাগে না? তোমাদের বয়সি ছেলেমেয়েরা তো এসব বেশ এনজয় করে।”
” আপনি এমন ভাবে বলছেন যেন আপনি একটা বুড়ো দাদা?? কত বড় হবেন আপনি আমার থেকে?? বড়জোর তিন বা চার বছর, তাই এমন দাদু দাদু ভাব??”
ওর কথা শুনে আমি হাসতে শুরু করলাম, কি মজা করে কথা বলে পিচ্চি? আমার হাসি যেন থামতেই চাচ্ছে না! অল্পতেই যেন ভীষন মজা পাচ্ছি। নিজেই অবাক হয়ে গেলাম! আজিব, এতো হাসছি কেন আমি? এতো কিসের খুশি আমার বোধগম্য হলো না?

সেদিন মিলি পাক্কা তিনঘন্টা পর এসেছিলো। আর আমি, এই তিন ঘন্টা যেন তিন মিনিটের মতো কেটে গেলো এই পিচ্চির সাথে গল্প করতে করতে। রেহনুমা অতো কথা বলতে চাইছিলো না, আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওর হিস্ট্রি জানার চেষ্টা করছিলাম। শুরুতে আমি ওকে যতটা জলি মাইন্ড মনে করেছিলাম ও মোটেও তেমনটা নয়।
এই তিনঘন্টায় আমি মনেহয় জীবনের সব কথাই বলে ফেলেছিলাম, আর ও নিরব শ্রোতা হয়ে শুনেছিলো কেবল। মাঝে মাঝে আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উওর দিচ্ছিলো শুধু। শেষে মিলি আসাতে রেহনুমা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।

“তোমার কি বোর লাগছে শুনতে,সাঁচি?” ফুয়াদের আচমকা প্রশ্নে ঘোর কাটলো সাঁচির। ও তো সেই পুরনো দিনে চলে গেছিলো, যে গল্পে ফুয়াদ ওর নায়ক আর নিজেকে ওর রেহনুমা মনে হচ্ছিল, এমনই বুদ হয়ে শুনছিলো ফুয়াদের কাহিনী।
“নাহ! বোর লাগবে কেন? বেশ ভালোই তো লাগছিলো? বলুন আপনি…”
ফুয়াদ একটু অসস্তি বোধ করলো। নিজের স্ত্রীর কাছেই প্রাক্তনের গল্প করতে মোটেও ভালো লাগছে না ওর।
“তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? চাইলে কালকেও বলতে পারি? অথবা শর্টে বলে শেষ করে দিতে পারি?”
“নাহ, প্লিজ। বলুন না, আজ যতটুকু পারা যায় বলুন। আর প্লিজ ডিটেইলস বলুন। কোনো কিছুই বাদ দেবেন না। আমার শুনতে ভালো লাগছে….” সত্যি কথাটাই বললো সাঁচি।
আবার বলতে শুরু করলো ফুয়াদ-
” সেদিনের পর থেকে আমি কিছুতেই রেহনুমা কে
ভুলতে পারছিলাম না। বিশেষ করে ওর বিষাদময় চোখ দুটো আমাকে ঘুমাতে দিতো না। কি অদ্ভুত ব্যাপার, আমার মধ্যে আবার কবিতারা ফিরে আসলো। আমি আবার দিনরাত শুধু বিভিন্ন কবিতার বই পড়তে শুরু করলাম, নেশারুর মতো। রেহনুমার চোখদুটো মনে করে দু একটা কবিতাও লিখে ফেললাম। কেমন যেন মন বসছিলো না পড়ালেখায়। নিজের অজান্তেই
পড়ালেখার থেকে বেশ অনেকটা দুরে সরে যাচ্ছিলাম। ক্লাসেও মন বসে না, চোখের সামনে শুধু দুটো উদাস বিষাদময় চোখ ভেসে বেড়ায়। কয়েকদিন মিলিকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছি কিন্তু লজ্জায় আর কিছু জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। পাছে ও কিছু বুঝে ফেলে? সবকিছু মিলে আমি অকুল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। ফলাফল স্বরুপ আমি ক্লাস টেস্ট গুলোতে জিরো পেতে শুরু করলাম। আমি চেষ্টা করতাম পড়ার বাট পারতাম না। রেহনুমা কে আরেকবার দেখার ইচ্ছা আমার ভেতরকার আমিকে পাল্টে দিচ্ছিলো। না পারতে আমি একদিন মিলিকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, রেহনুমার কথা। ও কেমন একটা নাক সিটকানো ভাব নিয়ে জবাব দিলো, রেহনুৃমার মা মানে ওর ফুফু নাকি কার হাত ধরে পালিয়ে গেছে অনেক আগেই, যখন রেহনুমার বয়স আট। এতদিন ও বাবার সাথে থাকতো। কনসার্টের দিন ওর বাবার বিয়ে ছিলো….মানে দ্বিতীয় বিয়ে আরকি…তাই ওর নানি… ওকে অনুরোধ করেন রেহনুমাকে নিয়ে আসতে। রেহনুমা যাতে বাবার বিয়ের ব্যাপারটা টের না পায়। ওর বাবা নিজে বিয়ে করবেন বলে রেহনুমার পরীক্ষা হওয়ার পর পরই ওকে ওর নানুর কাছে রেখে যায়। ওর বাবা রেহনুমার নানুকে অনুরোধ করেছিলেন তার বিয়েতে থাকতে। কিন্তু রেহনুমা বাসায় থাকলে সেটা সম্ভব হতো না, তাই ওকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

সেদিন আমি হলে ফিরে বাথরুমে ঢুকে অনেক কেঁদেছিলাম, জানো? এতটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে জীবনে কতকিছুই না দেখে ফেলেছে! ওর চোখের এত উদাসিনতা আর বিষাদের স্তুপ এর কারন টা আমি বুঝে গেছিলাম। বাবা মায়ের ভালোবাসাহীন ওর জীবনটা চিন্তা করেই আমার ভেতরটা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই আমার কান্না বন্ধ করতে পারছিলাম না। আমার এতোদিন মনে হতো আমিই হয়তো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী দুঃখী যার জীবনে কোনো স্বাধীনতা নেই, যে জীবনে কোনো ইচ্ছা পূরন করতে পারেনি। অথচ দেখ, রেহনুমা তার জীবনে এখন পর্যন্ত যা সয়েছে আমি তার ছিটেফোঁটাও দেখিনি।
নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত করে আমি বাথরুম থেকে বের হলাম। বিছানায় বসলাম, যদিও মনে প্রচন্ড অস্থিরতা, আমার শুধু মনে হচ্ছিল…আমি রেহনুমার কাছে ছুটে যাই, ওর হাত দুটে ধরে বলি-
” তুমি আর কষ্ট পেয়ো না রেনু, তোমায় আর কষ্ট পেতে দেবো না আমি…আজ থেকে তোমার সমস্ত দুঃখ আমার আর আমার সব সুখগুলো কেবল…কেবলমাত্র তোমারই।”
আবার আমি আমার চিন্তাগুলো গা ঝাড়া দিয়ে দুরে ঠেলতে চাই, ভাবি… এসব কি ভাবছি আমি!একটা মেয়ে যার সাথে আমার কেবল একবারই দেখা হয়েছে, জীবনের মাত্র তিনঘণ্টা যার সাথে কাটিয়েছি….তারজন্য আমার এতো চিন্তা? কিন্তু চিন্তা আমার পিছু ছারে না। না চাইতেও ঘুরে ফিরে রেহনুমা আমার মনের কোনে উকি দিয়ে যাচ্ছিলো। বুঝে গেলাম মনটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছিলো আমারই অজান্তে।

এরপরের দু’তিন মাস আমার দিনগুলো কিভাবে গেছে আমি নিজেও জানিনা। বাড়িতে মাকেও ফোন করতাম না। মা বরং আমাকে ফোন করতেন, জিজ্ঞেস করতেন সব ঠিক আছে কিনা। আমি মাকে বলতে চেয়েও বলতে পারতাম না, পাছে মা বাবাকে যদি বলে দেয়। আমার ক্লাসে মন বসে না, খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করি না, বন্ধুরা বুঝে যায় আমার কিছু একটা হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি এড়িয়ে যেতাম। সেমিস্টার ফাইনাল এগিয়ে আসছিলো অথচ আমি আমার হুশে নেই। বুঝতে পারছিলাম এখনই যদি কিছু না করি তাহলে নির্ঘাত পরীক্ষায় ফেল করবো। একদিন না পারতে আমি মিলিকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম রেহনুমার কথা।ও কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে জানতে চাইলাম আর ওর যদি কোন ফোন নাম্বার থাকে সেটাও চাইলাম। মিলি ভীষন অবাক হয়ে চেয়েছিলো আমার দিকে। আমি ও ভীষন অসস্তি ভাব নিয়ে মাথাটা নামিয়ে নিয়েছিলাম। মিলি কি বুঝলো কে জানে, ও একটা কাগজে রেহনুমার মোবাইল নাম্বারটা লিখে দিলো আর জানালো ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ এ ভর্তি হয়েছিল। ও এখন ওর নানুর কাছেই থাকে। বাবার বিয়ের খবর জেনে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি আর। তবে বাবার কাছে আর ফেরতও যায়নি।

আমি আর দেরি করিনি, ঐদিন বিকেল বেলাই রেহনুমা কে ফোন করেছিলাম। ও আমাকে প্রথমে চিনতেই পারেনি, তারপর ওকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দিতেই ও চিনলো আমাকে। বাট কেমন নিরাসক্ত কন্ঠস্বর। আমি ওর সাথে দেখা করতে চাইলাম। ও কিছুতেই রাজি হয় না। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর, মিলিকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে ওকে দেখা করতে রাজি করিয়েছিলাম। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম, মিলির কথা বলতেই রাজি হলো কেন? মনেহয় মিলিকে ভয় পায়। ঠিক হলো পরদিন ওর কলেজ শেষ হওয়ার পর আমরা দেখা করবো। বুয়েট থেকে প্রায় হাটা দুরত্ব। আমি তো দারুন খুশি।ওর সাথে দেখা হবে এই আনন্দে আমি অনেক দিন পর সেদিন রাতে পড়তে পেরেছিলাম।”

বলতে বলতে ফুয়াদের গলা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।পুরনো ব্যাথাগুলো আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে, ফুয়াদের চোখ দিয়ে অবিরাম পানি পড়ছিলো। আর এদিকে সাঁচিও কেঁদে যাচ্ছিলো নিঃশব্দে। একদিকে নিজেকে রেহনুমা মনে করে ওর কষ্ট ফিল করে কান্না পাচ্ছিলো অন্যদিকে যেটা ওকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিছিলো সেটা হলো, ফুয়াদের এই সমস্ত আবেদ অনুভুতির কিছুই আর ওর জন্য অবশিষ্ট নেই। ফুয়াদের সমস্ত আনকোরা অনুভূতিগুলো অন্য কারো কাছে আগেই বিলিন হয়ে গেছে এটা ভাবতেই সাঁচির দুচোখ বেয়ে পানির ঢল নামলো। ওর তাহলে সারাজীবন ফুয়াদের সেকেন্ড চয়েজ হয়ে থাকতে হবে? কোনো একদিন ফুয়াদ বাধ্য হয়ে মেনে নেবে ওকে, এটা ভেবে কান্নার বেগ দ্বিগুন হলো সাঁচির। দু’টো মানুষ অন্ধকারে বসে কাঁদছে…দুজনেই তাদের প্রিয়জনের কথা ভেবেই কাঁদছে… কিন্তু কেউ কারো কান্না দেখতে পারছে না….জানতে পারছে না….অথচ…..কাঁদছে……

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১১

0

#আজল
#পর্ব-এগারো

২৫.

দুদিন হলো শ্রীমঙ্গল এসেছে ফুয়াদ আর সাঁচি। সাঁচিকে ও কথা দিয়েছিল যে চা বাগান ঘোরাবে। সেই কথা রাখতেই সাঁচিকে নিয়ে শ্রীমঙ্গল এসেছে। ফুয়াদের এক বন্ধুর বাবা চা বাগানের মালিক। ফুয়াদ ঐ আংকেলকে বলে চা বাগানে তিনদিন থাকার জন্য অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। সাঁচি অবশ্য এতে খুশি কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সেই দিনের পর থেকে সাঁচি কেমন যেন হয়ে গেছে। সব সময় চুপচাপ থাকে, মুখে যেন একটা গাম্ভীর্যের মুখোশ এটে নিয়েছে…হাসে না একদমই। ফুয়াদের সাথে আগের মতো কথাও বলে না। শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটা বলে.. তাও মনেহয় যেন জোর করে বলছে। ফুয়াদ দু এক বার ওকে সরি বলতে চেয়েছে… কিন্তু কি কারনে যেন বলতে যেয়েও বলতে পারেনি। আর তাছাড়া ফুয়াদ কিছু বলতে গেলে সাঁচি আর আগের মতো আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে না… বরং ওর কথা না শুনেই হেটে চলে যায়। সাঁচির এই চেন্জটা ফুয়াদের ভালো লাগছে না…আবার নিজে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। খুবই অসস্তিকর অবস্থা… দুজন মানুষ একসাথে খাচ্ছে, ঘুরছে, পাশাপাশি ঘুমাচ্ছে কিন্তু কেউ কারো সাথে প্রয়োজনের বাইরে কোনো কথা বলছে না…ব্যাপারটা মোটেও সুখকর না! ফুয়াদ মাঝে মাঝেই দুর থেকে সাঁচির দিকে তাকিয়ে থাকে…বোঝার চেষ্টা করে ওর মনে কি চলছে? কিন্তু সাঁচি যেন আজকাল অচেনা বইয়ের পাতা। ওর মুখে কেমন এক ধরনের কঠোরতা চলে এসেছে, কি অদ্ভুত নির্লিপ্ততা ওর চোখে মুখে…ফুয়াদ বোঝে, সেদিনের কথাগুলো সাঁচির আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে…ও আর এতো সহজে ফুয়াদের সাথে সহজ হবে না হয়তে???

এই দুদিনে ওরা আশপাশের বেশ কয়েকটা জায়গা ঘুরে ফেলেছে। চিড়িয়াখানা, মাধবপুর লেক আর আজ গেছিলো লাউয়াছড়া উদ্যানে। ওখান থেকে তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে হলো আজ বৃষ্টির কারনে। বৃষ্টিতে ভিজতেই সাঁচির হাঁচি আর কাশি শুরু হলো। সাঁচি অবশ্য কিছু বলছিলো না, ফুয়াদ ই জোর করে সাঁচিকে নিয়ে ফিরে আসলো বাধ্য হয়ে। যেভাবে ও হাঁচি দিচ্ছিলো ফুয়াদ ভয় পেয়ে গেলো। সাঁচি অবশ্য ওকে অভয় দিচ্ছিলো, কিছু হবে না বলে. . . ফুয়াদ শুনলো না। ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে এক রেস্টুরেন্টে লান্চও করে নিয়েছে ওরা। ফুয়াদ খেয়াল করেছিলো সাঁচি কিছু না খেয়ে কেবল খাবার নাড়ছিলো। ও হাবিজাবি কিছু খাবার প্যাক করে নিলো সাঁচির জন্য।
ওদের এই চা বাগান থেকে সব গুলো ঘোরার স্পটই দুরে হয়ে যাচ্ছে। একদিনে একজায়গায় গেলে আর অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তবে বাগানের মধ্যেই বেশ ভালো লাগে…বিশাল বড় বাগান, মাঝখানে এই বাংলো…বাংলোটার চারদিকেই বারান্দা…. যে কোন দিকে বসেই বাগান দেখা যায়… বেশ ইউনিক ডিজাইনে তৈরি। ঘোরার সময় বাদে বাকি সময় প্রায় পুরোটাই সাঁচি বাগানে কাটায়। দিনের বেলা হলে ঘুরে ঘুরে মালিদের কাজ দেখে, গল্প করে আর রাত হলে মগ ভর্তি চা নিয়ে বাংলোর বারান্দায় বসে থাকে অনেক রাত অবধি। ফুয়াদ না ডাকলে সে ঘরে ঢোকে না, ঠায় ওভাবেই বসে থাকে বারান্দা অন্ধকার করে। গতকাল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছিলো ফুয়াদের…দেখে খাটে পাশের জায়গাটা ফাঁকা। খুজতে খুজতে বারান্দায় এসে দেখে সাঁচি চুপচাপ বসে আছে বারান্দায়। আশ্চর্য মেয়েটা! এতো রাতে ভয় করে না ওর? আর তাছারা একা একা কথা না বলে এতোক্ষণ একটা মানুষ কিভাবে থাকে? ফুয়াদ ভাবে। এই সাঁচিকে ফুয়াদের ভীষণ অচেনা লাগে।

আজ ফিরতে ফিরতে সন্ধা লেগে গেল প্রায়। বাংলোয় ফিরে এসে কাপড় চেন্জ করেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেল ফুয়াদ। খুব টায়ার্ড লাগছিল ওর। সাঁচি একবার ওর দিকে তাকিয়ে নিজের জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। আজকাল আর শাড়ি পড়ে না সাঁচি। কি হবে শাড়ি পড়ে? কে দেখবে ওকে? দরকার নেই কোন শাড়ি পড়ার-নিজের মনেই কথা বলে সাঁচি। গোসল করে সুন্দর ফুলেল কাজের এ্যাশ কালারের একটা থ্রিপিছ পড়ে বাথরুম থেকে বের হলো সাঁচি। ওদেরকে দেখা মাত্রই বাগানের কেয়ারটেকার টা পট ভর্তি করে চা বানিয়ে দিয়ে গেছে…সেই সাথে বলে গেছে আজ রাতে খিচুড়ি আর সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস কসানো খাওয়াবে। সাঁচি এক মগ ভর্তি করে চা নিয়ে বারান্দার বসলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে….বাগানের শ্রমিকগুলো সব সারিবদ্ধভাবে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এই বারান্দায় বসে দৃশ্যটা দেখতে বেশ ভালো লাগে সাঁচির। গত দু’দিন ধরে এই সময়টার এই দৃশ্য দেখছে। চমৎকার আবহাওয়া…. সূর্য ডুবে গেছে…চারিদিকে লালচে একটা আভা ছড়িয়ে আছে। এই সময়টা খুব উপভোগ করে সাঁচি, কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজেকে ভুলে থাকা যায়। আজকাল নিজের মনকে বেশ প্রবোধ দিয়ে ফেলেছে… ফুয়াদের সাথে আর কথা বলতে যায় না নিজ থেকে…কি দরকার! অযাচিতভাবে কাউকে বিরক্ত করার!! এর চেয়ে এই ভালো..নিজেকে নিয়ে ভালো থাকা। এই যে শর্ত জিতে বেড়াতে আসলো…ফুয়াদ ওর অজানা অধ্যায় জানাবে বলেছিল..অথচ কিছুই বলছে না এখন? এই যে সাঁচি রাগ দেখিয়ে ওর সাথে কথা বলছে না তবুও ওকে একবার সরি বলারও প্রয়োজন মনে করছে না? সাঁচি ভেবে রেখেছে এবার ঢাকায় ফেরত যেয়ে ফুয়াদকে বলবে, লাষ্ট সেমিস্টার টা ও বাবার বাসায় থেকে করবে। ফুয়াদকে ওর হালে ছেড়ে দেবে। ও নিজে থেকে অনেক চেষ্টা করেছে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার জন্য… এখন ফুয়াদের পালা। ফুয়াদ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে আর ওর কিছুই করার নেই। নিজেকে আর ছোট করতে পারবে না সাঁচি!!

ফুয়াদের ঘুম ভাংলো রাত তখন সাড়ে আটটা বাজে। বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো ফুয়াদের। দড়জা খুলে দিতেই কেয়ারটেকার রাতের খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে চলে । ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গেলো ফুয়াদ, জানে সাঁচি ওখানেই আছে….বাতি জ্বালিয়ে সাঁচির পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলো, এক নজর সাঁচির দিকে তাকিয়ে দেখলো, এ্যাশ কালারের উপর মাল্টিকালারের সুতোর কাজের জামায় সাঁচিকে বেশ অন্যরকম লাগছে, যদিও চেহারায় মলিনতা স্পষ্ট। ফুয়াদ মুখ ফিরিয়ে বললো –
“আমাকে একমগ চা দেবে, সাঁচি?”
চমকে ফুয়াদের দিকে ফিরলো সাঁচি। মনেহচ্ছে কতযুগ পর ফুয়াদের মুখে নিজের নাম শুনলো। কারন কি? আজ গলায় একটু আন্তরিকতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে মনেহয়? সাঁচি কিছু না বলে উঠে গেল। মগ ভর্তি চা নিয়ে ফেরত আসলো। মগটা ফুয়াদের হাতে দিয়ে ফেরত আসছিলো সাঁচি, তখনই ফুয়াদ বললো-
“বসো না, তোমার সাথে গল্প করি একটু! ”
সাঁচি বসলো ওর চেয়ার টাতে।
“আমার ধাঁধার উত্তর টা কি ছিলো যেন?”
“অতীত। আপনি আপনার বুকের ভেতর কোনো একটা অতীত লুকিয়ে রেখেছেন সেটাই তো?”
“হুম। তো তোমার সাথে সেই অতীত টা শেয়ার করার কথা ছিলো, তাই না? আজ ভাবছি কথাগুলো বলবো? তুমি কি শুনবে?”
সাঁচি কিছু না বলে অবাক হয়ে তাকালো ফুয়াদের দিকে। “বাহ!ভালো,উন্নতি হয়েছে ফুয়াদ সাহেবের? আজ নিজে থেকেই কথা বলছে? “মনেমনে আউরালো সাঁচি। ফুয়াদ সাঁচির উত্তরের অপেক্ষা না করে চায়ে চুমুক দিয়ে নিজেই শুরু করলো-

” আমি না ছেলেবেলা থেকেই ভদ্র, আলাভোলা টাইপ ছেলে ছিলাম। বাবাকে ছোট থেকেই প্রচন্ড রাগী হিসেবেই পেয়েছি। মা ছিলো আমার বন্ধু, মাও বাবাকে প্রচন্ড ভয় পেতেন। কি কারনে এত ভয় পেতেন তখনো বুঝিনি, কারন ভয় পেলেও মা বাবাকে ভালোও বাসতেন প্রচুর। বাবা এমনিতে তো কিছু বলতেন না কিন্তু তার কথার বাইরে যাওয়ার কারো কোনো উপায় ছিলো না । একান্নবর্তী বিশাল পরিবারে বাবার কথাই ছিলো শেষ কথা। ছোট থেকে সব ঠিকই চলছিলো, আমার আট বছর বয়সে প্রিয়তা আসলো আমাদের মা ছেলের দুনিয়ায়। বাবা প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসা নিয়ে। তাই আমরা তিনজন মিলে বেশ সুন্দর একটা দুনিয়া সাজিয়ে নিলাম। আমি যাই করতাম মা আমাকে প্রচন্ড উৎসাহ দিতেন। আমার আবৃতি ভালো লাগতো, সাহিত্য পড়তে ভালো লাগতো, মা আমাকে সঙ্গ দিতেন। আমি মাঝেমাঝে স্কুলে অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃতি করতাম। বাবার কাছে সব খবরই যেত। কখনো কিছু বলেনি এব্যাপারে। হয়তো আমার রেজাল্ট ভালো হচ্ছিল বলে। এভাবেই আমার দিন কাটছিলো। প্রথম ধাক্কা খেলাম ক্লাস এইট থেকে নাইনে যখন উঠলাম। আমার ইচ্ছা ছিল আর্টস বা কমার্সে পড়বো যাতে পরবর্তী কালে বাংলা বা ইংরেজি নিয়ে পড়তে পাড়ি। কেন জানিনা কবিতা বা গল্প লিখতে, পড়তে প্রচন্ড মজা লাগতো। বাবা সেই প্রথম আমার উপর রাগলেন। এতো ভালো ছাত্র আমি, সেই আমি কিনা এইসব হাবিজাবি পড়বো। মারলো বেধড়ক। লাইনে চলে আসলাম মার খেয়ে। বাবার মারের ভয়েই কিনা জানিনা আমি আর টাঙ্গাইল থাকাকালীন কোনোদিনো ওসব গল্প, কবিতার ধারে কাছেও যাইনি। মা মাঝে মাঝে আমাকে কবিতা আবৃতি করতে বলতেন আমি মানা করে দিতাম, প্রচন্ড অভিমান হতো মায়ের উপর, সে কেনো বাবাকে বোঝালো না! মা বুঝতে পেরেছিলেন, আমি রাগ করে হয়তো আর কবিতা আবৃতি করবো না কোনো দিন। যাই হোক, সায়েন্সে পড়ে এইচ এস সি পাশ করে ফেললাম বেশ ভালো মতোই। তারপর চান্স হয়ে গেলো বুয়েটে। আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। এই কারনে না যে আমি বুয়েটে চান্স পেয়েছি! আনন্দ টা এই কারনে বেশি ছিল যে, এই প্রথম বাড়ির বাইরে আমি একটা স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাবো। কারন, বাড়িতে কোনোদিনও নিজের ইচ্ছা মতো কিছু করতে পারতাম না। মোটকথা মুক্তির আনন্দে আমি পাগল ছিলাম প্রায়। আমার ঢাকায় আসার আগেরদিন বাবা ডাকলেন আমাকে-
“ফুয়াদ, কাল তো ঢাকা যাচ্ছিস, তাই না?”
“জ্বী, বাবা।”
“এই প্রথম আমার চোখের আড়ালে যাচ্ছিস, আমার খুব চিন্তা হবে রে তোর জন্য।”
“বাবা, চিন্তার কি আছে? টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার দূরত্ব আর কতটুকুই বা!”
“তবুও তো…চাইলেই আর দেখতে পাবো না…. যাইহোক তোকে যে কারনে ডেকেছিলাম…”
“জ্বী,বাবা বলেন না?”
“আমাদের থেকে দূরে থাকবি, একা একা থাকবি, দেখার কেউ নাই, শাসন করার কেউ নাই।”
ফুয়াদ নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকে কোনো কথা না বলে।
” হঠাৎ করে এরকম স্বাধীনতা পেলে বেশিরভাগেরই হজম হয় না। বখে যায়, নস্ট হয়ে যায়, প্রেম ভালোবাসা করে। বুঝলি?”
ফুয়াদ মাথা নাড়ে। বাবার কথাতে লজ্জায় ওর মাথা টা আরেকটু হেলে যায়।
“তোমার কাছে আজ কিছু চাইবো, দেবে?”
ফুয়াদ অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। বাবা ওকে তুমি করে বলছে? তারমানে বাবা সিরিয়াস কিছু চাইবে?
“আমাকে তোমার কথা দিতে হবে, এই পড়ালেখার সময়টাতে তুমি কোনো ধরনের কোনো সম্পর্কে জড়াবে না! তুমি এতদিন যে রকম ভালো রেজাল্ট করেছো সেটা ধরে রাখবে। এমন কিছু করবে না যাতে তোমার বাবা কস্ট পাবে! আর জানো তো বাবা কস্ট পেলে মা ভীষণ কষ্ট পাবে?”
ফুয়াদ ভয় পেল। ততদিনে ফুয়াদ জেনে গেছে, ওরা কিছু দোষ করলে বাবা ওদের কিছু না বললেও মাকে খুব বকে।ফুয়াদ তাই সবসময় চেষ্টা করে ওর দ্বারা ওর মা যেন কষ্ট না পায়। ও ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ে।
“মুখে বলো।”
বাবা হুঙ্কার ছাড়ে।
“জ্বী, বাবা। কথা দিলাম।”
ফুয়াদ মৃদু সুরে জবাব দেয়।
এইটুকু বলে ফুয়াদ থামে। চায়ে চুমুক দেয়, চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবে। ওপাশে সাঁচি উশখুশ করে। জানতে চায় তারপর কি হলো, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। দুজনাই বেশ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আছে। সাঁচি ভাবে, এতোক্ষণ হয়ে গেল, তাও চুপ! কি এতো ভাবছে? জিজ্ঞেস করবে ভাবলো….মুখ খুলতে যাবে তখনই ফুয়াদ বলে-
“এক হিসেবে তুমি অনেক লাকি,জানো তো?”
“কেন?”
থাকতে না পেরে সাঁচি বলে উঠলো।
“এই যে আমার মনের একান্ত কথাগুলো, এই যে গোপন অতীত, যা এতোদিন কেবল আমার ছিলো তা এখন তোমারও হতে যাচ্ছে। যেগুলো বলছি তা আমি ছাড়া কেউ জানতো না, আজ তুমি জানছো, আরো জানবে হয়তো ভবিষ্যতে। ”
“আপনি ভাববেন না! কথাগুলো আপনি যেভাবে স্বযতনে রেখেছেন আমার কাছেও সেভাবেই থাকবে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে দামী অতীত স্মৃতি যা আপনি আমার সাথে শেয়ার করছেন। ”
“থ্যাংকস। আর একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম?”
“বলুন!”
“যেগুলো বলবো সেসব কোনো মেয়েরই ভালো লাগবে না। তোমারও কষ্ট হবে। তাই আগে থেকেই সরি বলছি তোমাকে। যদি এগুলো না বলে তোমার সাথে সম্পর্ক টা কন্টিনিউ করতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। কিন্তু তা করতে পারছি না। এতে তোমাকে ঠকানো হবে। সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে না?”
“হুম, ভালো তো লাগবেই না। কষ্ট হলেও আমি শুনবো। আপনি বলুন।”
“আমাকে বোঝার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ”
“ঠিক আছে। এবার বলুন তারপর কি হলো?”
“আচ্ছা আমরা ডিনারটা সেরে নিয়ে আবার বসি? আমার না খিদে পেয়ে গেছে। আসলে, এতোক্ষণ যেটুকু বললাম সেটুকু কেবল পটভূমি, আসল গল্প এরপর শুরু হবে। তাই একটু এ্যনার্জি নিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম। ”
সাঁচি কিছু না বলে উঠে এলো। সাথে সাথে এলো ফুয়াদ ও। দু’জনে নিঃশব্দে খেয়ে উঠলো। সাঁচির খুব অস্থির লাগছে, বাকিটুকু জানার জন্য ওর তর সইছে না। কি হয়েছে এরপর? ফুয়াদ নিশ্চয়ই কারো প্রেমে পড়েছিল? নিশ্চয়ই ভালোবেসেছিল কাউকে? বোঝাই যাচ্ছে, তাকেই এখনো মনের মধ্যে বসিয়ে রেখেছে! তাহলে,ওকে বিয়ে করলো কেন? ব্রেকাপ হয়ে গেছিলো? ছ্যাকা খেয়েছে নিশ্চয়ই? নাকি ওর শশুর কিছু করেছিলো? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে। উফ কখন শুনবো বাকিটুকু????

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১০

0

#আজল
#পর্ব-দশ

২৩.

“তুমি হয়তো ভাবছো এসব কথা তোমাকে কেন বলছি? তাই না?”
তানভীর মাথা নাড়ল।
“কারন তো অবশ্যই আছে। এই পৃথিবীতে কোন কিছুই কারন ছাড়া ঘটে না, জানো তো? তো যা বলছিলাম…. আমি আসলে ফ্যামিলির দ্বায়িত্ব পালন করতে করতে বুঝতেই পারিনি যে আমার আসল ফ্যামিলি যারা আমার…. শুধুমাত্র আমার দ্বায়িত্ব তাদেরকেই অবহেলা করেছি সারাজীবন ভর। অবশ্য না বোঝার যথেষ্ট কারনও ছিল…. তোমার শাশুড়ি মা আমাকে কোনোদিনও কোনো ব্যাপারেই কোনো অভিযোগ দেননি কখনো। ছেলেমেয়েরাও কখনো বলেনি যে, বাবা তোমার এই কাজটা পচ্ছন্দ হচ্ছে না…বা বাবা আমি এই কাজটা করতে চাই। অথবা এমন হয়েছে হয়তো যে, ওরা বলতে চেয়েছে…. ওদের মা ওদের বলতে দেয়নি….কিংবা প্রচন্ড অভিমান ওদের বাঁধা দিয়েছে?? আর ওরা যদি কিছু বলতোও আমার মনে হয়না সেই সময় আমি ওদের কথা কখনো আমলে নিতাম। কারন ততদিনে আমি আমার সংসারে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছি। কারো কোনো কথা কখনো শুনিনি আর তখনো শুনতাম বলে মনে হয় না। ফুয়াদ সারাজীবন আমি যেভাবে বলেছি সেভাবেই ওর জীবন চালিয়েছে…. পড়ালেখা করেছে, চাকরি করছে… এর পাশাপাশি হয়তো আরো কিছু করে। আর মেয়েটা প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্বেও তাকে আমি সবার অমতে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। মেয়ের বিয়ের সময়ই প্রথম তোমার শাশুড়ি মা আমার মতের বিরুদ্ধে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন, সাথে ফুয়াদ তো ছিলোই। আমি কারো মতের তোয়াক্কা না করেই প্রিয়র দ্বায়িত্ব তোমায় দিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম তুমি আমার মেয়েকে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। এখন আমি তোমায় জিজ্ঞেস করছি- তুমি কি আমার বিশ্বাসের মান রাখতে পেরেছো?”

তানভীরের দিকে প্রশ্ন ছুরে দিয়ে থামলেন আজমল সাহেব। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন তানভীর কে। তানভীর সেই দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করলো।
“আসলে বাবা, আমি বুঝতে পারছি না কি হয়েছে? প্রিয় কি কিছু বলেছে? আমি তো নিজের দ্বায়িত্ব ঠিক ভাবেই পালন…. ”
শেষ করতে পারলো না তানভীর, তার আগেই ওকে থামিয়ে দিলো আজমল সাহেব।
” তোমার কি ধারনা? প্রিয়তা এসব বলতে পারে আমাকে? নিজের স্ত্রীকে এই চেনো তুমি? আমি ভেবেছিলাম তোমার সৎসাহস আছে! সেই গাটস আছে যা তুমি সত্য বলায় ব্যবহার করো। কিন্তু আমি ভুল। আসলে কি বলোতো…. টাকা থাকলেই মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করে… ভাবে যে, সে যা খুশি তাই করতে পাড়ে। কিন্তু আসলে কি তাই…. ”
শশুরের কথা বলার টোনে তানভীর এবার ঘামতে শুরু করলো। লোকটা এতো স্ট্রং ভয়েজে কথা বলছে যে, তানভীরের মনে হচ্ছে ওর ভিতর টাও দেখে নিচ্ছে আজমল সাহেব, মগজের চিন্তাগুলোও পরে ফেলছে সব!!! তানভীরের সব কথা গুলিয়ে গেলো।
” আমি তোমার লাস্ট কয়েকটা বিজনেস ট্রিপের খবর নিয়েছি….দুর্ভাগ্যজনক হলো সেরকম ভালো বলার মতো কিছু পাইনি। তুমি যদি ভেবে থাকো যে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি তাই ঝাড়া হাত পা হয়ে কারো কোনো খবর রাখবো না তাহলে ভুল ভাবছো!!..মেয়েকে যেমন নিজের ইচ্ছায় তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি তেমনি সেরকম মনে হলে তাকে ফিরিয়ে নিতে দ্বিধা করবো না….”
তানভীরের মুখটা এই মুহূর্তে প্রচন্ড হাস্যকর দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে রক্তশুন্য মুখ… মুখোশ উন্মোচন হলে যেমনটা হয় আর কি….
” তুমি এতদিন প্রিয়র সাথে কি করেছো, স্বামী বা বাবার দায়িত্ব পালন করেছো কি না এসব কথা আর তুলছি না। এখন তুমি কি করবে সেটাই আমি দেখবো। আমি তোমাকে ছয়মাস টাইম দিলাম… এই ছয়মাসে তুমি আমার মেয়ের মনে তোমার জন্য জায়গা তৈরী করবে… উহু ভয় দেখিয়ে না.. ভালবাসা দিয়ে…৷ যেন তোমার কথা মনে হলেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে…সে হাসিটা অবশ্যই যেন সুখের হাসি, ভালোবাসা, বিশ্বাস আর নির্ভরতার হাসি হয়।”
তানভীর এর মুখে কোনো কথাই ফুটছে না… এতো বড় বিজনেসম্যান…. আজ এই লোকটাকে ভয় পাচ্ছে একটু একটু। বাবা মারা গেছে সেই কবে? ভাইয়েরা সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। আর মা বরাবরাই ওকে একটু বেশি আদর করতো তাই শাসন সেভাবে পায়নি তানভীর। আর এখন তার শশুর মশাই তাকে রীতিমতো ভদ্র ভাষায় শাসন করে যাচ্ছে! রাগ ওঠার কথা তানভীরের কিন্তু তার বদলে ওর ভয় লাগছে একটু একটু। শশুরের কনফিডেন্স লেবেল ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। সত্যি সত্যি কি লোকটা ওর বিজনেস ট্রিপ এর খবর জানে? লোকটা আবার মাকে কিছু জানিয়ে দেবে নাতে? যত যাই হোক মা আবার প্রিয়কে খুব ভালোবাসে। প্রিয়র সাথে ও এরকম করে শুনলে খুব কষ্ট পাবে মা!

” এবং তোমার আমার মধ্যকার এই কথাবার্তা যেন সে ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। মনে কর তোমাকে নতুন করে জীবন গড়ার সুযোগ দিচ্ছি। সেই সুযোগটা তুমি কিভাবে কাজে লাগাবে নাকি কাজে লাগাবে না সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। মাত্র ছয় মাস…. এই ছয়মাসে নিজের বউ বাচ্চাকে কিভাবে নিজের করে নেবে সেটাই চিন্তা করো…. তা না হলে… একদিন আফসোস করতে হবে।”
উঠে দাড়ালেন আজমল সাহেব। এসে তানভীরের কাছে দাড়ালেন…কাঁধে হাত রেখে বললেন
” ইয়াংম্যান! আমার কথাগুলো নেগেটিভলি না নিয়ে পজিটিভলি নাও…আশাকরি ভালো হবে… তা না হলে একদিন আমার মতো পস্তাতে হবে, বুঝলে?”
বলেই সেখানে আর দাড়ালেন না আজমল সাহেব। দ্রুত বের হয়ে এলেন রেস্টুরেন্ট থেকে। সাহস নিয়ে পুরো অনুমানের ভিত্তিতে ঢিল ছুড়েছিলেন তানভীরের দিকে। ঢিলটা জায়গা মতো লেগে গেছে বলে মনেমনে একটু হাসলেন আজমল সাহেব। তার ষাট বছর জীবনের মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা এবার আসল কাজে লাগলো, মনেহয়!!! তানভীর যে রকম ছেলে তাতে আজকের ডোসটাই পারফেক্ট, আর কিছু করার দরকার হবে বলে মনে হয় না? মেয়ের জীবনে যদি সুখটা ফেরত আসে তাহলে আর কি চাই জীবনে??? সারাজীবন বাচ্চাদের জন্য ওদের মনের মতো কিছু করতে পারেননি, এখন তার এইটুকু প্রচেস্টা যদি ওদের জীবনে ভালো কিছু সুখের মুহুর্ত এনে দেয় তাহলে উনি মরেও শান্তি পাবেন। এটা ভাবতেই মনটা ফুরফুরা হয়ে গেল আজমল সাহেবের। তিনি খুশি মনে গাড়িতে না উঠে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলেন।

২৪.


মনের মধ্যে যতনে রেখেছি এক কুঠুরি আজল
সেই আজলে লুকিয়ে আছে দুঃখ আমার সকল।★
আজ তিনদিন ধরে সচির মাথায় ঘুরছে লাইন দুটো। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে সব সময় এই দুটো লাইন নিয়েই ভেবে যাচ্ছে। তিনদিন সময় দিয়েছিল ফুয়াদ। এরমধ্যে উওর বলতে না পারলে ফুয়াদের গোপন কথা জানা তো হবেই না সেই সাথে বেড়ানোর সুযোগটাও হাত থেকে যাবো-এটা ভাবতেই মাথার চুলগুলো সব টেনে ছিড়তে ইচ্ছা করছে সাঁচির। তিনদিনের আজ শেষ দিন। কি করা যায়…কি করা যায়… ভাবতে ভাবতেই ছোট বোনের কথা মনে পড়লো। ওকে একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়….ওর সামনে ভার্সিটি এ্যাডমিশন এক্সাম… পড়ালেখার মধ্যে আছে….ওর আবার রহস্য ভেদের আগ্রহ অনেক…একবার ট্রাই করে দেখা যাক… ট্রাই করতে দোষ কোথায়? সাঁচি ফোন দিলো ছোট বোন প্রাচিকে-
“হ্যালো!প্রাচী, কোথায় রে তুই?”
“আপ্পি, কেমন আছিস? এতদিন পর বোনকে মনে পড়লো?? বাসাতেও তো আসিস না অনেকদিন? তুই কি রে? বর পেয়ে আমাদের এইভাবে ভুলে গেলি?”
“আস্তে… মেরি মা আস্তে…তোর সব অভিযোগ পরে শুনবো… আগে তুই আমাকে একটু হেল্প কর। একটা প্রবলেমে ফেসে গেছি..”
“হুম, তাইতো বলি… আপ্পি.. আজ কেন ফোন করেছে…”
“এই রাখলাম…যা তোর হেল্প লাগবে না… দুষ্টু মেয়ে…”
“ওহ, আপ্পি! একটু দুষ্টুমিও করতে দেবে না নাকি…আচ্ছা বলো কি বলবে?”
“তোকে একটা ধাঁধা বলবো তুই আমাকে এর উত্তর টা বলবি…. একঘন্টা সময়….”
“এতোক্ষণ লাগবে না… বলোতো তুমি কি ধাঁধা। ”
“উম্মাহ! আমার বোনটা… তোকে এত্তগুলা ভালোবাসা… আচ্ছা লিখে নে…..”
প্রাচিকে বলতে পেড়ে খুব নিশ্চিত হলো সাঁচি। ও জানে প্রাচি ঠিক বের করে ফেলবে উত্তর। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে হাত দুটো ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। উফ! এই দুটে দিন খামোখাই নিজে টেনশন নিয়েছে… আগেই যে কেন প্রাচির কথা মনে আসেনি? যাক বাবা…. তাও ভালো…. সময় থাকতেই মনে এসেছে!!! ফুয়াদ বাবু!এখন কি করবে তুমি…. হানিমুনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নাও…মনে মনে বলতে বলতে একা একাই হাসছে সাঁচি।

অফিসে আজ কাজের চাপ একটু কম ছিলো। ফুয়াদ ভাবলো আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে। অনেকদিন কারো সাথে দেখা হয়না। সেই যে বিয়েতে দেখা হলো তারপর আর কারোরই কোনো খবর নাই। দেখি ওদের কে ফোন দিয়ে… কি অবস্থা সবার…ভাবতে ভাবতে ফোনটা হাতে নিতে না নিতেই ফোন বেজে উঠলো….সাঁচির ফোন!! ও তো কখনো এই সময় ফোন দেয় না…. তাহলে কি ও জবাবটা পেয়ে গেছে?
“হ্যালো”
“কোথায় আপনি?বাসায় কখন আসবেন?”
“এই তো অফিসে… কেন? কি দরকার? ”
“আরে!আমরা বেড়াতে যাবো না….কোথায় যাবো…কখন যাবো… এগুলো ঠিক করতে হবে না?তাড়াতাড়ি চলে আসেন না আজ!!!”
“আচ্ছা! ঠিক আছে আসছি। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কাটলো ফুয়াদ। বিয়ে করলে আসলেই জীবনটা আবদ্ধ হয়ে যায়… শুধু মেয়েদের না ছেলেদেরও….ভাবলো ফুয়াদ।

বাসায় ঢুকতেই রান্নার সুঘ্রাণ পেলো ফুয়াদ। নিশ্চয়ই আজ পোলাও হচ্ছে… ড্রইংরুমে দেখলো প্রিয়, বাবা, মা বসে আছে…প্রিতি আর সাঁচি দুজনে খেলছে…
“ভাই, এসেছিস?”
“তুই হঠাৎ এলি যে?”
প্রিতিকে কোলে নিয়ে আদর দিলো ফুয়াদ। প্রিতিও মামাকে পাল্টা আদর দিলো।
“আর বলিস না…ভাবি জোর করলো খুব…তোরা নাকি হানিমুনে যাচ্ছিস? সে উপলক্ষে ভাবি আজ রান্না করেছে নিজ হাতে…সবাই মিলে একসাথে খাব…”
শুনে কাশি উঠে গেল ফুয়াদের। এই মেয়ে তো আচ্ছা ত্যাদর… বেহায়া মেয়ে…উনি হানিমুনে যাবেন তাই ঢোল পিটিয়ে সবাই কে জানাচ্ছে…. আজব???
সাঁচি গ্লাসে পানি এনে দিলো….হাত বাড়িয়ে পানি নিলো…
“ভাই যা তো তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে… আমি আবার খেয়েই বেড়িয়ে যাবো.. এক্সাম চলছে তো আমার…” প্রিয়তা বললো।
ফুয়াদ মাথা নেড়ে উঠে এলো নিজ রুমে….আনমনে রুমে ঢুকতেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সাঁচি….চমকে উঠে ফুয়াদ বললো-
“কে?”
“আপনার বউ গো? আর কে হবে?”
সাঁচির হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করলো ফুয়াদ-
“কি হচ্ছে এসব? গেট খোলা তো…বাবা মা দেখতে পাবে তো?”
” দড়জা বন্ধ, আপনার টেনশনের কোনো কারন নেই?”
পিঠে মুখ রেখে বললো সাঁচি।
“তোমার আজকাল সাহস বেড়েছে দেখছি! ছাড়ো তো দেখি…কেন ধরেছো আমাকে….”
পিছন থেকে একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিলো সাঁচি
” আমি শ্রীমঙ্গল যেতে চাই…চা বাগানের বাংলোয় বসে গভীর রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনবো… তারপর সমুদ্র দেখবো….কক্সবাজারে…”
ফিসফিসিয়ে বললো সাঁচি।
“উহ! সাঁচি, ছাড়ো আমাকে….”
জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো ফুয়াদ। চিরকুটে চোখ বুলিয়ে দেখলো সেখানে ওর জানতে চাওয়া ধাঁধার উওরটা গোটাগোটা অক্ষরে লেখা।
“শর্ত অনুযায়ী তুমি যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাব। বাট প্লিজ যখন তখন এভাবে জড়িয়ে ধরবে না…আমি চাই না কোনোভাবেই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে…. বাট তুমি…তুমি বারবার সেই সুযোগটাই নিচ্ছো।”
সাঁচির খুব… খুব লজ্জা লাগলো ফুয়াদের কথা শুনে…ও তারাতাড়ি ফুয়াদ কে ছেড়ে দিলো…চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো একটা কথাও না বলে…আসলেই তো…ও মনেহয় একটু বেশিই করে ফেলেছে…সবসময় কি জোর চলে…এই প্রথম ফুয়াদ কে রেগে যেতে দেখলো ও…
“প্লিজ,ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট…সবসময় ভালো লাগে না…বিয়ে করেছি বলেই কি সবসময় এমন করতে হবে? যত্তোসব…”
ফুয়াদের হঠাৎই রাগ উঠে গেল..কেন ও নিজেও যানে না?
ফুয়াদের শেষের কতাগুলো শুনে অপমানে লাল হয়ে গেল সাঁচি…কষ্ট পেল খুব…কান্না চলে আসলো…এই প্রথম ফুয়াদের রুদ্র রুপ দেখলো…চোখদুটো জলে ভরে গেলো আপনাতেই…টুপটুপ করে চোখ থেকে পানি পড়ছে….দু দিন না হয় জোর করে কিসি দিয়েছি আর আজ খুশির চোটে একটু না হয় জড়িয়ে ধরেছি সব ভুলে… তাই বলে এভাবে কথা শোনাবে…কান্নার বেগ বাড়ছে সাঁচির। ও চায়না ফুয়াদ ওর কান্না দেখে ওকে আরো কয়েকটা কথা শোনাক…তাই ও দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
ফুয়াদের হঠাৎ হুঁশ হলো-হায় হায় কি করলো এটা! সাঁচির সাথে এতো রুডলি কথা বললো….কি করলো এটা…মেয়েটা মনেহয় কাঁদছে?কেন জানেনা আজ প্রচন্ড রাগ উঠে গেল….নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সাঁচির কাছে নিজের বন্ধ ডায়েরির পাতাগুলো মেলে দিতে হবে বলেই কি এতো রাগ!!!
এখন নিজের উপরই রাগ লাগছে ফুয়াদের। সে হাতে থাকা চিরকুট টা দুমড়ে মুচড়ে সজোরে ছুরে ফেললো ঘরের কোনে….

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৯

0

#আজল
#পর্ব-নয়

২১.

“ডু ইউ হ্যাভ এনি পাস্ট ফর হুইচ ইউ আর নট কমফোর্টেবল উইথ মি? ইফ ইউ হ্যাভ, ইউ ক্যান শেয়ার উইথ মি?”
ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলো ফুয়াদ। ফুয়াদ সাংসারির টানাপোড়েন খুব ভয় পায়। সারাজীবন এই অশান্তি কে দূরে রাখার জন্যই তো সবার সব কথা মুখ বুজে মেনে গেছে। এখন কি এই প্রশ্ন, প্রশ্নের সব উত্তর তারপর জীবনটা হ জ ব র ল বানাবে? কি বলবে? ভেবে পেলো না ফুয়াদ। প্রশ্নের উত্তর হ্যা হলে আরো একগাদা প্রশ্ন আর না হলে মিথ্যে বলা হবে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো দু’জনাই। ফুয়াদ ই নিরবতা ভাঙলো-
” তোমার প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যা হয় তবে কি হবে আর না হলেই বা কি? ”
ফুয়াদ উৎসুক দৃষ্টিতে সাঁচির দিকে তাকালো।
সাঁচি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে ও আসলে কি বলতে চাইছে? ফুয়াদ ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো-
“ধরো, তোমার যদি কোনো ভালোবাসার মানুষ থাকতো তারপরেও কি আমার সাথে বিয়ে টা এতো সহজে মেনে নিতে? ”
“আমার কেউ থাকলে কি আমি আপনাকে বিয়ে করতাম নাকি?”
“তোমার বাবা মেনে নিতো? সে তো তোমাকে আগেই বলেছে যে এসব প্রেম ভালোবাসা চলবে না।”
“মেনে নিতো কি না সেটা পরের কথা…আমি আগে চেষ্টা করে দেখতাম। কিন্তু আপনি এখন এ প্রশ্ন কেন করছেন? আমি তো আমার প্রশ্নের উওর চেয়েছি! প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন করতে বলিনি!!!??”
“আমিও তো তোমার কাছে বলে কয়ে সময় চেয়েছিলাম সাঁচি… কিন্তু তুমি বারংবার আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছো। মাত্র তো চারমাস তাতেই এত অস্থির হয়ে গেলে? আচ্ছা তোমার কি চাই বলোতো?? ভালোবাসা নাকি শারীরিক সুখ?? তুমি যা চাবে আজ তোমাকে তাই দেবো!!”
ফুয়াদের কথায় রাগে, অপমানে লাল হয়ে গেল সাঁচি। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলো না কোনো।
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন? বউ হই আপনার…..কোনো খারাপ মেয়ে না??? তাছাড়া আমরা দুজন এ্যাডাল্ট মানুষ সইচ্ছায় একে অপরর সাথে এই বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।সম্পুর্ণ হক আছে আমার আপনার উপর….. আপনার ভালো…মন্দ সবকিছু জানার – এই কথাটা ভুলে যান মনে হয়?? আর সময় চেয়েছেন…. ঠিক আছে…..কিন্তু কত সময়? সেটাতো বলেননি?? আমি কি অনন্ত কাল আপনার জন্য অপেক্ষা করবো???কেন করবো?? কিসের আশায় করবো?? বিয়ের চারমাস পার হয়ে গেছে আমরা একই জায়গায় স্টাক হয়ে আছি। নিজেরা যদি চেষ্টা না করি সম্পর্ক টা কি আগে বাড়বে বলে আপনার মনেহয়??!!”
একদমে কথাগুলো বলে থামে সাঁচি। ফুয়াদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এই প্রথম সাঁচিকে রেগে যেতে দেখলো। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে সাঁচির, চোখদুটো যেন ঠিকরে বের হয়ে আসবে! শান্ত শিষ্ট মেয়েটার রাগও আছে দেখছি- মনে মনে বলে ফুয়াদ। ওকে একটু ভরকে দেওয়া যাক- মনে মনে ভাবলো ফুয়াদ।
“আমাকে ভালোবাসো?”
আচমকা এরকম প্রশ্ন শুনে নার্ভাস হয়ে গেল সাঁচি। নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো-
“আপনি কি আমার সাথে ফান করার চেষ্টা করছেন? যদি করেন তাহলে এটা খুব বাজে ফান। তারপরেও উত্তর টা আপনাকে দিচ্ছি, হ্যা!ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে! তাই জানতে চাইছি, কি ব্যাপার? কেন আপনি কষ্ট পাচ্ছেন? আর আমাকেই বা কেন কষ্ট দিচ্ছেন? আপনি হয়তো বুঝবেন ব্যাপারটা যে, আপনি যাকে ভালোবাসবেন…… চাইবেন সে সুখে থাকুক সবসময়….কাছে থাকুক সবসময়। তার আনন্দ বেদনা সবকিছুই নিজের করে নিতে মন চাইবে।”
“না মানে আসলে আমি ওভাবে বলতে চাইনি কথাগুলো। আসলে মা বাবা আমাকে জোর না করলে বিয়েটা হয়তো করা হতো না। আমি…..মানে….মানে…. কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না..কি করবো…. আসলে চেষ্টা করছি মেনে নেওয়ার.. কিন্তু… আসলে… প্লিজ তুমি কিছু মনে করো না।”
সাঁচির কথা শুনে এলোমেলো হয়ে গেল ফুয়াদ।
ফুয়াদের নমনীয় কন্ঠ শুনে একটু নরম হলো সাঁচি। কন্ঠ টা মোলায়েম করার চেষ্টা করলো একটু-
“দেখুন আমি আপনাকে এটাই বলছি যে, আপনার যদি কোনো প্রবলেম থেকে থাকে আমার সাথে শেয়ার করুন। দু’জন মিলে সেটার সলুশান বের করার চেষ্টা করবো। আপনি তো আমাকে ফ্রেন্ড বলেছেন। তো ফ্রেন্ড এর সাথে কি প্রবলেম শেয়ার করা যায় না???”
“ওতো সব মেয়েরাই শুরু তে এরকমটা বলে…. তারপর ঝামেলা দেখলে পালিয়ে যায়।”
“দেখুন আমাকে সব মেয়ের কাতারে ফেলবেন না, প্লিজ!!! আর সত্যি কথা বলতে কি… সম্পর্কটা এভাবে ঝুলিয়ে রাখতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না। যে কোনো জিনিসের একটা লিমিটেশন থাকে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তাই না?”
ফুয়াদ আবার চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। ঠিকইতো বলছে মেয়েটা! সাঁচি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো, ফুয়াদের হাতের উপর হাত রাখলো, ভরসা দিতে চাইলো যেন-
“প্লিজ, কিছু বলার থাকলে বলুন!”
ফুয়াদ কিছু বলতে যেয়েও যেন বলতে পারলো না। সাঁচি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। সাঁচি চুপচাপ দেখছে ফুয়াদকে….চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো ফুয়াদের মুখে কষ্টের ছাপ। ও ফুয়াদের হাতের উপর নিজের হাতের চাপ বাড়ালো-
“প্লিজ আমাকে বলুন তো কি হয়েছে… না বললে বুঝবো কি করে….”
“এখন একটা ধাঁধা বলবো তোমায়, যদি ঠিক ঠিক উওর দিতে পারো তবে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো তুমি যেখানে চাইবে সেখানে, আর সেই সাথে আমার সুখদুঃখের ভাগিদার হওয়ার সুযোগ পাবে। রাজি আছো?”
উত্তেজনায় শরীর টানটান হয়ে গেল সাঁচির। সত্যি সত্যি ফুয়াদ এই প্রস্তাব দিয়েছে?… এটাতো কোনো ভাবেই হেলায় হারানো চলবে না?!
“ঠিক আছে, ডান। সাথে আমারও একটা শর্ত আছে, সেটাও আপনাকে মানতে হবে এখন…..”
“তোমার আবার কি শর্ত? তোমার শর্ত কোথা থেকে আসলো? এখানে তোমার কোনো শর্তের কথা বলা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না!!”
“কেন? আমার শর্তের কথা শুনে আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
“না, ভয় পাবো কেন? বলো…”
“মানতে হবে কিন্তু?..”
আচমকা সাঁচি দুষ্টু হাসি দিতে শুরু করেছে । ফুয়াদকে এবার একটু নাচাতে হবে….ব্যাটা বহুত কষ্ট দিচ্ছে ওকে???
“আহ, বলনা।”
অস্থির হলো ফুয়াদ।
“ধাঁধা বলার আগে আমায় একটা কিসি দিতে হবে নিজে থেকে, খুব গভীরভাবে…… একেবারে মন থেকে। তারপর আপনি যা বলবেন তাই হবে!…. আপনার সব কথা মেনে নেবো।”
” এটা আবার কি ধরনের শর্ত? না না এমন তো কথা ছিলো না!!!”
ফুয়াদের কন্ঠে অসস্তি টের পাওয়া যাচ্ছে।
ফুয়াদের আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো সাঁচি, চোখে চোখ রাখলো, ফিসফিসিয়ে বললো-
“এই যে দেখুন আপনার কত কাছে এসেছি….. আজ এতো সুন্দর ওয়েদার…তার উপর আপনি এতো দারুণ করে আবৃতি করছিলেন…… এতো ভালো লাগছিলো আপনাকে দেখতে…মনে হলো চকাম করে খেয়ে নেই আপনার ঠোট দুটো….” বলতে বলতে ফুয়াদের ঠোঁটটা হাত দিয়ে আলতো করে ছুয়ে দিলো সাঁচি-
” আজ নিজে থেকে দিন না……সেদিনের মতো…. জানেন আপনার জ্বরের ঘোরে আপনাকে কতবার কিসি দিয়েছি….. কিন্তু..আপনিতো কিছু বুঝতেই পারেন নি…..প্লিজ….”
কাতর গলায় বলে যাচ্ছে সাঁচি আর ফুয়াদের সেসব শুনতে শুনতে চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে -“বলে কি মেয়ে ওকে নাকি জ্বরের সময় চুমু দিয়েছে? মিথ্যুক কোথাকার!!…শুধু কপালে একটু আদর দিয়েই কি সুন্দর করে মিথ্যা বলছে?”
“প্লিজ আজ ফিরিয়ে দেবেন না সেই যে দু তিন মাস আগে একটা দিয়েছেন….. আমার বুঝি ইচ্ছে করে না!!!! জানেন তো মেয়েরা নিজে মুখে কখনো এসব বলে না অথচ আমি কিনা শুধু বলা না করেও দেখিয়েছি….. আমার মতো মেয়ে….ভাবা যায়….শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে…???”
আধো আধো চাঁদের আলোয় সাঁচির মিনতি ভরা মুখ… ফুয়াদ ভিতরে ভিতরে ভাঙছিলো… কাঁপন উঠে যাচ্ছে শরীরের মধ্যে…কোন সাধু পুরুষেরও সাধ্য নেই এই মিনতি পায়ে ঠেলার..আর ফুয়াদ তো মানুষই…..ফুয়াদ সম্মোহিতের মতো সাঁচিকে কাছে টেনে নিলো….. বসে থাকা অবস্থায়ই শক্ত করে একহাত দিয়ে সাঁচির কোমরটা পেচিয়ে ধরে একেবারে কাছে টেনে আনলো….সাঁচি কেঁপে উঠলো একটু …..ফুয়াদ সাঁচির পেছনের চুলের ভেতরে হাত দিয়ে চুল মুঠো করে ধরে সাঁচির মুখটা উচু করে ধরলো….ফুয়াদকে একবার দেখে সাঁচি চোখ বন্ধ করে ফেললো…উত্তেজনায় মুখটা লাল হয়ে আছে সাঁচির… ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁকা হয়ে আছে….হালকা হালকা কাঁপছে ঠোঁট দু’টো…ফুয়াদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সাঁচির দিকে। সাঁচিকে এতটাই মোহনীয় লাগছে যে ফুয়াদের মতো নিয়ন্ত্রিত মানুষের ও ঘোর লেগে যাচ্ছে। ফুয়াদ থাকতে না পেড়ে সাঁচির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো। প্রথমে ছোয়ালো তারপর এমনভাবে সাঁচির ঠোঁট গ্রাস করলো যেমনটা একটা জোক মানুষের শরীরে চেপে বসে। সাঁচি অন্ধের মতো হাতরে ফুয়াদের পিঠের দখল নিলো দুহাতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফুয়াদের চুলগুলো সাঁচির হাতের মুঠোয় চলে আসলো। একহাতে পিঠ আকরে ধরে আর এক হাতে মাথার চুল আকরে ও যেন ফুয়াদের শরীরের মধ্যে সেধিয়ে যেতে চাইছে! আলো আধারির মধ্যে দুজন মানব মানবী বিভোর হয়ে ডুবে আছে একে অপরের মাঝে…..

২২.

এই মুহুর্তে তানভীর আর আজমল সাহেব মুখোমুখি বসে আছে। রেস্টুরেন্টের কোনার দিককার টেবিল, এখান থেকে রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। দু’জনার সামনেই দু’টো চায়ের কাপ রাখা। আজমল সাহেবের দৃষ্টি বাহিরের রাস্তার দিকে, মাঝে মাঝে সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। শশুরের কান্ড দেখে তানভীরের খুবই বিরক্ত লাগছে। পনেরো মিনিট ধরে এখানে বসে আছে ওরা। শশুর মশাই নিজে কথা বলতে চেয়ে পনেরো মিনিট ধরে শুধু শুধু বসে আছে! অথচ অফিসের অনেক ইম্পর্টেন্ট কাজ ফেলে রেখে ও এসেছে। আবার ঘড়ি দেখলো তানভীর। নাহ আর সম্ভব না, আজকে ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং আছে সাড়ে এগারো টা নাগাদ। উশখুশ করতে করতে বলেই ফেললো-
“বাবা, কিছু বলতে চেয়েছিলেন মনেহয়?”
“হু, চাচ্ছি তে? তোমার কি কোন জরুরি কাজ আছে নাকি?”
“জ্বী বাবা, সারে এগারো টা নাগাদ একটা মিটিং আছে।”
“তাহলে ওটা ক্যানসেল করে দাও। ”
“জ্বী!!!!”
অবাক চোখে তাকালো তানভীর।
“বললাম মিটিংটা ক্যানসেল করে দাও। তোমার সাথে যে কথাগুলো বলবো সেটা এই মিটিং থেকেও অনেক জরুরি। ”
তানভীর কিছুক্ষণ শশুরের দিকে তাকিয়ে থাকলো, বুঝলো লোকটা বেশ সিরিয়াস। কিন্তু কি এমন বলবে!…. যাই বলুক…দেখা যাবে। ও ওর পিএ কে ফোন করে বলে দিলো আজকের মিটিংটা ক্যানসেল করার জন্য। তানভীর ফোন রাখতেই আজমল সাহেব এবার ওর দিকে ঘুড়ে বসলো।পূর্ণ দৃষ্টিতো ওর দিকে তাকালো। শীতল গলায় ওকে জিজ্ঞেস করলো-
“আমার মেয়ের সাথে তোমার যখন বিয়ে হয় ওর বয়স কত ছিলো?”
প্রন্শটা শুনে হকচকিয়ে গেল তানভীর –
” জ্বী, আঠারো.. ”
“আর তোমার?” কন্ঠ আগের চাইতেও শীতল।
” ত্রিশ “মাথা নামিয়ে উত্তর দিলো তানভীর।
” কখনো ভেবেছো ওর সাথে তোমার বয়সের ব্যবধান কত? নাকি ভাববার অবকাশ পাওনি?”
তানভীর বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইলো শশুরের দিকে। এতদিন পরে এসব কথার কি মানে….. ওর বোধগম্য হলো না। এনারা তো সব জেনে বুঝেই বিয়ে দিয়েছিলো তখন!!! তানভীর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আজমল সাহেব আবার বলতে শুরু করলো-
“তোমার শাশুড়ির সাথে আমার যখন বিয়ে হয় তখন ওর বয়স পচিশ আর আমার বত্রিশ। যুগ হিসেবে দু’জনারই বয়স বেশি ছিল। আমি বাপ হারা বড় ছেলে, সংসারের পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে ছিল। সংসারের ঘানি টানতে টানতে কখন বয়স পার হয়ে যাচ্ছিলো টের পাইনি। ভাইবোনেরা বেশ বড় হয়েছে সবাই। তখন মায়ের হুশ হলো যে ছেলেকে বিয়ে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি পাত্রী খোজা শুরু করলেন। কিন্তু পাত্রী আর পাওয়া যায় না, আসলে পাওয়া যায়না বললে ভুল হবে… কেউ মেয়ে দিতে চাচ্ছিলো না। কারন আমার তিন বোনের এক বোনেরও তখন বিয়ে হয়নি। ভাইও আছে দুটো ছোট। কে জেনেশুনে এরকম ঝামেলার ঘরে মেয়ে দিতে চায় বলো!!!

তো ঐ সময় তোমার শাশুড়ি মায়ের খোঁজ পাই। তারও বিয়ে হচ্ছিল না। মোটামুটি শিক্ষিত ফ্যামিলি। ছোট বোনটা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিলো… বদনাম হয়েছিল প্রচুর… তাই আর ওর বিয়ে হচ্ছিল না। যাইহোক, তোমার শাশুড়ি মায়ের সাথে বিয়ে হলো। বাচ্চারা আসলো পৃথিবীতে। এর মধ্যে আমার তিন বোনের বিয়ে দিলাম। ভাই দুটো পড়ালেখা করে বেশ ভালোভাবেই দাড়িয়ে গেল। ওরাও বিয়ে শাদী করে সংসারী হলো। আমি কখনো কারো দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখি নাই। আর আমার সাথে এই দায়িত্ব পালনের পূর্ন অংশীদার ছিলেন তোমার শাশুড়ি মা। তার মুখ থেকে আমি জীবনে কোনেদিনই আমার বিরুদ্ধে কোনে অভিযোগ শুনি নাই। ছেলেমেয়ে দু’টোকেও সে মানুষ করেছে। ভাই বোনের আর মায়ের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে আমি আসলে ওদের দেখারই সুযোগ পাই নি। ওদের মা ওদের সব কিছুর খোঁজখবর আমাকে জানাতো। কোনো ডিসিশন নেয়ার হলে আমিই নিতাম। কিন্তু কখনো বাবার মতো বাবা হয়ে কিংবা বন্ধু হয়ে ওদের সাথে মেশা হয়নি। তাই ওরা হয়তো বা আমাকে ভয় পেত।”
একনাগারে বলে থামলেন আজমল সাহেব। এতোক্ষনে একটু নড়েচড়ে বসলো তানভীর। তার শশুর নিজের জীবন বৃত্তান্ত ওকে শোনাচ্ছে……. কিন্তু কেন????

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৮

0

#আজল
#পর্ব-আট

১৯.

সকালে অফিসে আসার পর পরই শশুরের ফোন পেলো তানভীর। খুবই অবাক হলো। প্রিয়তার বাবা কালেভদ্রে ওকে ফোন করে। ওর মনেও পরে না শেষ কবে ফোন দিয়েছিলেন উনি। শাশুড়ি মা আর ফুয়াদ ভাই মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। আর এতো কাছাকাছি ডিস্টেন্সে থাকে ওরা! কারনে অকারনে দেখাও হয়! তাই আর সেভাবে ফোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর তাছাড়া প্রিয়তা আর প্রিতি তো এতদিন ওখানেই ছিলো, দু’তিন দিন হয় মাত্র বাসায় এসেছে। তানভীর ও তো প্রায়ই যেতো বাবার অসুস্থতা উপলক্ষে। তবে আজ আবার কেন ফোন দিচ্ছে? তানভীর চিন্তিত হয়ে ফোন রিসিভ করলো-
“জ্বী বাবা! আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম সালাম। ”
“বাবা, ভালো আছেন তো? ”
“হ্যা, ভালোই আছি। তোমরা কেমন?”
“জ্বী বাবা, ভালো। হঠাৎ ফোন দিলেন যে বাবা! কোন কি দরকার? জরুরি কিছু?”
“কেন বাবা, দরকার ছাড়া কি ফোন দিতে পাড়ি না?”
“না না বাবা, তা বলছি না? কখনো ফোন টোন দেননা তো, তাই বলছিলাম আর কি!”
তানভীরের কন্ঠে স্পষ্ট দ্বিধা।
“বাবা তানভীর, দরকার একটু ছিলো বইকি!।”
“কি বাবা, বলুন। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? সবাই ভালো আছে তো? মার শরীর? ”
” সবাই ভালো আছে। আসলে না সেরকম কোনো সমস্যা না….আবার বলতে গেলে সমস্যা। আমি…..আসলে…. তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
“আচ্ছা, তবে আমি বিকেলে বাসায় আসছি? ”
“না..না… বাসায় না…. আমি তোমার সাথে বাইরে কোথাও দেখা করতে চাই। আসলে….. তোমার সাথে একটু পারসোনালি কথা বলতে চাচ্ছি। ”
ফোনের ওপাশে তানভীর কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে ছিলো। ও আসলে বুঝতে পারছিলো না কি হচ্ছে! ওর শশুরের ওর সাথে কি পারসোনার কথা থাকতে পারে এটা ওর মাথায় আসছিলো না।
“আচ্ছা, বাবা! আমি তবে গাড়ি পাঠাচ্ছি। আপনি তৈরী হয়ে নিন। আমার অফিসের কাছে ভালো একটা রেস্টুরেন্ট আছে, বেশ নিরিবিলি। আমরা ওটাতেই বসি তবে??”
“ঠিক, আছে। রাখছি তবে?”
তানভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন রাখলো। কি কথা বলবে বাবা? ফুয়াদ ভাইয়ার কি কোন সমস্যা? না, না…..তা হবে কেন? সে রকম হলে তে ভাইয়াই বলতো? তবে? তবে কি হতে পারে? আচ্ছা! প্রিয়তা কি কিছু বলেছে নাকি? কিন্তু কি বলবে? ওর সাথে ইদানিং কালে সম্পর্ক টা একটু ঠান্ডা যাচ্ছে। অবশ্য ওকে কোনো কালেই সহ্য হতো না তানভীরের। হবেই বা কিভাবে? এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, কোনো কথাই বোঝে না তানভীরের। বিয়ের পরে পরে তো শুধু কান্নাকাটি করতো! অসহ্য লাগতো তানভীরের। বিয়ে হয়েছে, কোথায় খুশি থাকবে? তা না শুধু ভেউ ভেউ কান্না। ওর কাছ ঘেসা যেতো না। ওকে কাছে যেতে দেখলেই কান্না জুড়ে দিতো মেয়ে।পাক্কা পাঁচ মাস পরে ওর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তানভীরের। তারপরও কত ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান! কি করতে যে এই মেয়েকে পচ্ছন্দ করেছিলো বুঝে পায় না তানভীর! চেহারাটাই যা সুন্দর, বোধবুদ্ধি একদম বাচ্চাদের মতো। একটা কাজই ভালো পারে তা হলো পড়ালেখা। সে সব কথা মনে হতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে গেলো তানভীরের।

২০.

“একটা কবিতা শুনবে, সাঁচি?”
রুমে ঢুকতেই ফুয়াদের এরকম অদ্ভুত প্রস্তাবে যেন আকাশ থেকে পড়লো সাঁচি। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই লোক আর কবিতা! ভ্রু কুচকে বুঝতে চাইলো ফুয়াদের কথার মানে।পাগল হয়ে গেছে নাকি লোকটা? ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে নিশ্চয়ই মাথা নষ্ট হয়ে গেছে! এখন ওকে পটিয়ে পটিয়ে নিশ্চয়ই বেড়াতে যাওয়া ক্যানসেল করাতে চাইবে!
“কি হলো তোমার? তুমি খুব অদ্ভুত সাঁচি? সবসময় দেখি কিছু একটা বললেই তুমি ভাবনার জগতে চলে যাও। আজব ব্যাপার! কি ভাবো এতো সবসময়?”
“না…না…. কি ভাববো? কি যেন বলছিলেন?”
“বলছিলাম যে চলো আজ বারান্দায় মাদুর পেতে বসি। তোমাকে কবিতা আবৃতি করে শোনাবো। আজ বহু…বহুদিন পর কেন জানিনা আমার ইচ্ছে হচ্ছে, আবৃত্তি করার ইচ্ছে। ”
লোকটার মাথা সত্যি সত্যি গেছে নাকি? এ বলে তাকে কবিতা শোনাবে?? যে লোক ওর সাথে বসে ঠিকমতো দুটো কথাই বলে না,সে শোনাবে আবৃত্তি!!! তাও আবার বারান্দায় মাদুর পেতে বসে…..উহ! আল্লাহ! এতো রোমান্টিক প্রস্তাব? সহ্য হবে তো সাঁচির….!!!
সাঁচি নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো ফুয়াদের দিকে-
“দেখি, হাতে একটা চিমটি কাটেন তো? সত্যি সত্যি আপনি ফুয়াদই তো নাকি?”
ফুয়াদ ও দুষ্টুমি করে একটু জোরেই চিমটি কাটলো সাঁচির হাতে-
“উফ…..আল্লাহ.. মরে গেলাম গো….আপনি কি মানুষ? এতো জোরে কেউ চিমটি কাটে?উহ….হাত জ্বলে গেলো তো???”
“আমার কি দোষ! তুমিই তো বললে চিমটি কাটতে?”
ঠোঁট উল্টালো ফুয়াদ।
“আমি বললাম বলেই কি এতো জোরে চিমটি কাটতে হবে?”
“আচ্ছা বাবা, সরি। হয়েছে? এখন এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে মুড নষ্ট করবে নাকি দু মগ কফি বানিয়ে আনবে? আমি বারান্দায় মাদুর বিছাচ্ছি।”
সাঁচি আবারও ঝাটকা খেলে যেন। এই লোক তো আজ সারপ্রাইজ এর উপর সারপ্রাইজ দিয়েই যাচ্ছে। এতো সারপ্রাইজ আবার বদ হজম না হয়ে যায়!?

★★★
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ
সেই সব স্পর্শ, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধকার খুপরীর থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
বুকের মধ্যে।
★★★

ফুয়াদ আবৃত্তি করছিলো, মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে, আবার মাঝে মাঝে ওর চোখ দুটো আপনাতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। আবেগে মাঝে মাঝে ফুয়াদের গলাটা কাঁপছিলো…. সাঁচি এক অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ওর গলার ভয়েজ একদম চেন্জ হয়ে গেছে। কি সুন্দর ভরাট গলায় কাটা কাটা উচ্চারনে কথাগুলো বলছে। বলার সময় ওর ঠোঁট দুটো বাড়ি খাচ্ছে একে অপরের সাথে, চুলগুলো হাওয়ায় দুলছে একটু একটু, চাঁদের হালকা আলোয় ফুয়াদের মুখটা দেখতে কি যে অসাধারণ লাগছে…. কি এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য ফুটে আছে ফুয়াদের চোখে মুখে….সাঁচি নেশারুর মতো তাকিয়ে রইলো…. চোখের পলকও ফেললো না একবারও। ফুয়াদের আবৃত্তি শেষ হওয়ার পর….অনেক…বেশ অনেকটা সময় পর…. ওরা দুজনেই চুপচাপ বসে আছে….. ফুয়াদ চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে….. সাঁচি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেও কখন যে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো…জানে না…. কি এক অদ্ভুত অনুভুতি ওকে গ্রাস করে রাখলো…..আপনাতেই ওর চোখ দুটো থেকে জল গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা। চোখ দু’টো বন্ধ রেখেই সাঁচি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-
“আবৃতি করতেন, আপনি?”
ফুয়াদ তখনো বুদ হয়ে আছে সেই পুরনো স্মৃতিতে। এই কবিতা ওকে কত কিছু মনে করিয়ে দেয়….কত…স্মৃতি…. আবেগ….ভালোবাসা….. এসব তো কখনো ধুসর হওয়ার নয়!? ভার্সিটিতে ওর এই আবৃতি, ওকে কতো মেয়ের ক্র্যাশ বানিয়েছে ও নিজেও জানে না। এটা ছিলো ওর নেশার মতো….মানুষের মদ,গাজা, বিড়ি, সিগারেট এর নেশা হয়…. ওর ছিলো কবিতার নেশা। আজ কতগুলো বছর পর আবার সেই নেশাটা মাথাচারা দিলো….কেন দিলো জানে না…..শুধু খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ও একটু কবিতা আবৃতি করবে আর কেউ একজন শুনুক! ওকে বাহবা দিক একটু! হাতে স্পর্শ পেতেই চোখ খুললো ফুয়াদ, সাঁচি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সাঁচির হাতটা ফুয়াদের হাতের উপর আলতো করে রাখা। ফুয়াদ সাঁচির হাতের দিকে তাকাতেই সাঁচি হাতটা সরিয়ে নিলো। হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফুয়াদ সাঁচির মখের দিকে তাকালো। ফুয়াদের মনে হলো সাঁচির চোখদুটো ভেজা ভেজা। কাঁদছিলো নাকি মেয়েটা!
“আপনাকে ডাকছিলাম অনেকক্ষণ ধরে।”
“ওহ, সরি। আসলে অনেকদিন পর আবৃতি করলাম তো…. একদম নস্টালজিক হয়ে গেছিলাম। ”
“ওহ! আপনি আবৃতি করতেন আগে?”
“হুম! আমার ছোট থেকেই খুব শখ ছিলো, গুনটাও ছিলো হয়তো! ভার্সিটিতে একসময় প্রচুর আবৃতি করেছি।”
“খুব সুন্দর আবৃতি করেন। তা বাদ দিলেন কেন? মাঝে মাঝে করলেও পারেন।”
“কি যে বলোনা? এইসব চাকরি বাকরি করে কি আর সাহিত্য চর্চা হয়? আর তাছাড়া আবৃতি ছেড়েছি আমি অনেক আগে। আট নয় বছর তো হবেই।”
“এতোদিন??? এতোদিন পরেও তো ভোলেননি কিছুই! আমি অবশ্য এসব কবিতা টবিতা অতো বুঝি সুঝি না। তবে আপনার গলায় শুনতে বেশ লেগেছে! মনে হচ্ছিল আরো শুনি, শুনেই যাই! একেবারে বুদ হয়ে গেছিলাম!”
নিজের প্রশংসা শুনে একটু যেন লজ্জা পেলো ফুয়াদ। সে চুপ করে বসে রইলো।
“কার কবিতা?”
“পূর্নেন্দু পত্রী। আমার খুব পছন্দের একজন।”
“আমারও ভালো লাগলো খুব। মাঝে মাঝে আমাকে এরকম দু একটা আবৃতি করে শোনাবেন প্লিজ।”
সাঁচি আকুতি জানালো। তারপর দুজনেই আবারও চুপচাপ বসে আছে। যেন কি বলবে বুঝতে পারছে না। সাঁচি উসখুস করছে একটু। ফুয়াদের সাথে ও সিরিয়াসলি আজ কথা বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু ও তো আজকের পরিবেশটাই বদলে ফেললো। এই পরিস্থিতিতে কথা বলে এত সুন্দর পরিবেশ টা নষ্ট করা কি ঠিক হবে?? বুঝে উঠতে পারছে না সাঁচি। বেশ কিছুক্ষণ দোটানার মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো। এই সুন্দর আধো চাঁদের আলোর মধ্যে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকাও তো অনেক বড় পাওয়া?
“তুমি কি কিছু বলবে? এরকম উসখুস করছো কেন?”
হঠাৎ ফুয়াদের কথায় চমকে ওঠে সাঁচি। বলবে না বলবে না করেও বলে ফেললো সাঁচি-
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম। প্লিজ ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন!!”
ফুয়াদ মনে মনে ভয় পেল-
“এই সেরেছে! যে কথার ভয়ে এত কিছু করলো, তারপরও মনেহয় সেটা থেকে রেহাই পাওয়া গেল না???!!”
কি প্রশ্ন করবে সাঁচি? কি জানতে চাইবে ও? অধীর আগ্রহে সাঁচির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ফুয়াদ……….।

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৭

0

#আজল
#পর্ব-সাত

১৭.

সকালের নামাজ টা পড়ে সাঁচি ভাবলো একটু ঘুমিয়ে নেবে। রাতে ফুয়াদ কে জলপট্টি দিতে দিতে আর ওর আবোল তাবোল প্রলাপ শুনতে শুনতে ঘুমের বারোটা বেজেছে। তাই ফজরের আযান টা শোনা মাত্রই চট করে নামাজ পড়ে নিয়ে ঘুমাতে আসলো। বিছানার অর্ধেকের বেশিটা জুড়ে ফুয়াদ শুয়ে আছে বাঁকা হয়ে। সাঁচি ফুয়াদের কপালে হাত দিলো, নাহ! জ্বর একটু কমেছে! ও ডাকলো ফুয়াদকে-
” এই, একটু সোজা হয়ে শোন না! আমি শোবো তো? একটু জায়গা দিন তো?”
ফুয়াদ সরলো না শুধু একটি নড়ে উঠলো-
“একটু পানি দেবে, সাঁচি?”
“হুম, দিচ্ছি। ”
উঠে বসে পানিতে চুৃুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করলো ফুয়াদ। মুখ একদম তেতো হয়ে আছে, পানির স্বাদও তিতকুটে লাগছে। দু চুমুক পানি খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিলো সাঁচিকে-
” রাতে কি বেশি জ্বালিয়েছি তোমাকে? ঘুমাতে দেইনি না?!”
” তা একটু জ্বালিয়েছেন বৈকি। তবে ব্যাপার না! অসুস্থ মানুষ, এরকম একটু তো হতেই পারে! আচ্ছা রাতে তো সেরকম কিছু খাননি। এখন ঘুম যেহেতু ভেঙেছে কিছু খেয়ে ওষুধ টা খেয়ে নেবেন?”
” খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে কিন্তু! ওষুধ না খেলে জ্বর ভালো হবে??”
“আচ্ছা, তবে একটু খিচুড়ি খাবো, সবজি খিচুড়ি। মা কে বলো মা রান্না করে দেবে। মা খুব মজা করে সবজি খিচুড়ি রান্না করে।”
একটু মন খারাপ করলো সাঁচি। ওকেও তো কিছু রান্নার কথা বলতে পারতো?লোকটা ওকে কিছু মনেই করে না! অন্তত বন্ধুত্বের দাবিতেও তো বলতে পারতো? মন খারাপ ভাব নিয়েই বললো-
“আচ্ছা, তবে মাকে বলে আসি।”
সাহেরা বেগম রান্না ঘরেই ছিল। কাজের মেয়েটাকে নাস্তা বানানোর ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলো। সাঁচি ডাকলো পেছন থেকে-
” মা, উনি আপনার হাতের সবজি খিচুড়ি খেতে চাচ্ছে।”
” জ্বর কমেছে ফুয়াদের? ”
“জ্বী, মা কমেছে। ”
“আচ্ছা, আমি চট করে খিচুড়ি রান্না করছি। তুমি ফুয়াদের কাছে যাও। দেখো কিছু লাগবে কিনা?”
সাঁচি মাথা নাড়লো। রুমে এসে দেখে ফুয়াদ বিছানায় উঠে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।
“কি হয়েছে? মাথা ব্যাথা নাকি?”
“হুম। একটু বাথরুমে যাবে বলে নামতে চাইলাম। কিন্তু মাথা প্রচন্ড রকম ঘুরছে। ব্যাথাও প্রচুর, মাথা তুলতে পারছি না। প্লিজ একটু হেল্প করো না!!?”
সাঁচি মনে মনে ভীষন খুশি হলো। আব আয়ে উট পাহাড় কে নিচে!?এতদিন তো নিজের কাছে ঘেষতে পর্যন্ত দিতো না! চেষ্টা করেও পারেনি সাঁচি। এখন এতো কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পাবে ভাবতেই মনের মধ্যে হাজারো অনুভুতিরা সব ঘুম থেকে যেগে উঠছে যেন। ইস! একবার যদি ওর খালি বুকটা দেখতে পেতাম? ওর সে বুকে মাথা রাখতে পারতাম! ওর জ্বরের কারনে যদি সুযোগ টা পেয়ে যায়! মনের মধ্যকার ইচ্ছে গুলো সব ঝাপি খুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! নিজের মনের এরকম দশা দেখে কম অবাক না সাঁচি! একজন অসুস্থ লোকের অসুখের চিন্তা না করে কি সব চিন্তা করছে?? আসলেই ফুয়াদের অবহেলা ওর মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। নিজেকে শাসন করলো সাঁচি-
“কি হচ্ছে! সাঁচি, ছি! কি ভাবনা এগুলো! কোথায় লোকটার চিন্তা করবি তা না করে নিজের মনোবাসনা পূরণ করার চিন্তা করছিস??! লুচ্চি কোথাকার!”
পরক্ষনেই আবার বলছে-
” কেন,কি দোষ তাতে! ও আমার স্বামী! হক আছে ওর ওপর আমার। ও যদি সে অধিকার না দেয় তাহলে আমি কি চুপচাপ বসে থাকবো?? কখনোই না!”
ভাবনায় বুদ সাঁচি কে ফুয়াদ ডেকেই চলেছে –
” সাঁচি, এই সাঁচি! কি রে ভাই! এতে ডাকছি তুমিতো শুনছোই না? কই হাড়ায়ে গেলা?”
সম্বিত ফিরলে সাঁচির-
” এই, আমি আপনার কোন জনমের ভাই লাগি! হ্যা?”
“আচ্ছা! বোন লাগো তাইলে? ডাকছি কখন থেকে? কি ভাবো এতো? আর কতক্ষণ বাথরুম আটকায়ে থাকবো? এখানেই করে দেই তাইলে?”
“এই না! ছি ছি! সরি, আমি আসলে… আমার খেয়ালই ছিলো না…. চলুন….”
ফুয়াদকে কাঁধের সাপোর্ট দিলো সাঁচি। দু হাতে আগলে ধরলো ফুয়াদকে। লম্বা ফুয়াদের কাঁধ বরাবর আসলে সাঁচি। মাথাটা বুকে রাখতে ইচ্ছা হলো খুব। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলো।ফুয়াদ বাথরুমে যেয়ে দাড়ালো –
“এখন যাও তুমি!আমার হলে তোমাকে ডাকবো।”
সাঁচি ঘাড় নেরে বেড়িয়ে এলো।

ফুয়াদকে খিচুড়ি আর ওষুদ খাইয়ে নিজে খেতে খেতে বেলা নয়টা বেজে গেল। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে সাঁচির। শাশুড়ি কে বলে ঘুমাতে চলে এলো। শাশুড়ি মা যে কয় দিন থাকে সংসার নিয়ে সাঁচি ভাবে না। মা ঠিক সামলে নেয়। রুমে ঢুকে দেখলো ফুয়াদ ততক্ষণে ঘুমে কাঁদা। সাঁচিও পাশে শুয়ে পড়লো। ওদের মাঝে একটা বালিশ দেয়া থাকে সবসময়। যেটা ফুয়াদ আজ পর্যন্ত কখনো ডিঙায় নি। সাঁচি মাঝে মাজে ইচ্ছা করে সরিয়ে নিতো। কিন্তু ফুয়াদ ভুলেও আসতো না এদিকে। সাঁচি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতো এই ছেলে মনেহয় ঘুমায় না। ঘুমের ভান করে জেগে বসে থাকে সারারাত। আজ সাঁচি নিজে পাশ বালিশ টা জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়লো, মনে মনে বললো, “ওকে তো জরিয়ে ধরতে পারছি না! তুইই সই!”

সাঁচির গায়ের মনে হচ্ছে আগুন লেগে গেছে, এতো গরম লাগছে কেন? গরম নিঃশ্বাস এসে লাগছে গায়ে। হাতটা সরাতে গেলে বুঝলো ফুয়াদ শুয়ে আছে খুব কাছে। ওরই নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে সাঁচির শরীরে এসে। হাতটা বাড়িয়ে ফুয়াদের কপালে রাখলো। দেখলো জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে ওর। দ্রুত হাত সরিয়ে উঠে বসলো। ঘরের দড়জা জানালা সব বন্ধ হওয়ার কারনে বেলা বোঝা যাচ্ছে না। আধো আলোতে ঘড়ির দিকে তাকালো। পাঁচটা বাজে। তারমানে বিকাল হয়ে গেছে? ইয়া আল্লাহ! এতোক্ষন ঘুমিয়েছে? উঠে তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালালো সাঁচি। ফুয়াদের কপালে পট্টি দিয়ে মা কে ডেকে নিয়ে আসলো। মা বললেন, একটু গা স্পঞ্জ করে দিতে। কথাটা শোনা মাত্রই সাঁচির মুখে খুশির এক অপার্থিব হাসি ফুটে উঠল। সাঁচির হঠাৎ করে মনে হলো আজকের দিনটা ওর জন্য খুব লাকি। ওর মনের সুপ্ত ইচ্ছে গুলো সব পূরন হয়ে যাচ্ছে। ফুয়াদের জ্বর হওয়াটা ওর জন্য শাপেবর হয়েছে যেন। ও তারাতারি একটা টাওয়েল ভিজিয়ে আনলো। কিন্তু ফুয়াদের গেন্জি খুলবে কিভাবে? ওর মতো বিশালদেহী পুরুষ কে কি সাঁচির পক্ষে তোলা সম্ভব? সাঁচি ফুয়াদের পাশে বসে ওকে ডাকলো-
“এই যে শুনছেন? আপনার গা টা একটু মুছিয়ে দেবো। একটু উঠবেন? গেন্জিটা একটু খুলুন না।”
“না না আমার লজ্জা লাগে তোমার কাছে। গেঞ্জি খুলবো না আর গা ও মোছাতে হবে না।”
ঘুমের ঘোরে বিরবির করলো ফুয়াদ। সাঁচি ঝারি দিলো একটা –
” এতো কিসের লজ্জা আপনার? পুরুষ মানুষ না আপনি? এত লজ্জা থাকতে নেই পুরুষের, বুঝলেন? তারাতারি খুলুন বলছি!”
ধমক খেয়ে ফুয়াদ জ্বরের ঘোরে উঠে বসার চেষ্টা করলো। সাঁচি ওকে ধরলো, তারপর আলতো করে গেঞ্জি খুলে নিলো। মনেমনে যতই ফটপট করুক সাঁচি, ওর ও ভীষন লজ্জা লাগছিলো, হাত কাঁপছিলো। গেন্জি খুলতেই ফুয়াদের উজ্জ্বল ফর্সা লোমশ বুকটা সাঁচির চোখের সামনে চলে এলো। সাঁচি হা হয়ে তাকিয়ে আছে, নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন? ইস! কি সুন্দর প্রশস্ত লোমশ বুক ফুয়াদের! মার কথাই ঠিক তাহলে? এই জন্যই তবে ফুয়াদ এত্তো ভালো? ওর মনটা এতো নরম? এতো মায়া মমতা ওর মধ্যে? ইস! ফুয়াদ কবে ওকে আপন করবে? কবে ওর বুকে মাথা রাখতে পারবে সাঁচি? কবে ফুয়াদ ওর দুটো হাত দিয়ে আগলে নেবে সাঁচিকে? কবে মাথায় ফুয়াদের ভালোবাসার স্পর্শ পাবে? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় সাঁচির মাথায়।
“ওহ, ঠান্ডা লাগছে তো! আবার কি হলো, সাঁচি?”
“নাহ, কিছুনা। এই মুছিয়ে দিচ্ছি। তারপর কাপড় পরিয়ে দেবো।”
কাঁপা কাঁপা হাতে ফুয়াদের গা মুছিয়ে ওকে নতুন একটা গেঞ্জি পরিয়ে দিলো সাঁচি। ওকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাথা দিলো। উঠে আসার সময় কি মনে করে ঘুমন্ত ফুয়াদের কপালে নিজের ঠোঁট ছুইয়ে দিলো-
” এবার আপনি সুস্থ হয়ে গেলে নিজের অধিকার চাইবো আপনার কাছে। নিজে থেকে তো দেবেন না, আমি চাইলেও কি ফিরিয়ে দেবেন? ভালোবাসার মানুষটা এক কাছে অথচ তাকে ছুতে পারছি না! এই কষ্ট কি আপনি বোঝেন না?”
ফিসফিস করলো সাঁচি।

১৮.

দিন তিনেক পরে জ্বর ছারলো ফুয়াদের। সকালেই ঘুম ভেঙে দেখলো ওর পাশেই সাঁচি গুটি সুটি মেরে শুয়ে আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো বিছানার মাঝখানে ও শুয়ে। হেসে দিলো ফুয়াদ। মেয়েটা বাধ্য হয়ে এভাবে শুয়ে আছে। একটু পাশ ফিরলেই নিচে চিটপটাং হবে। কিছুক্ষণ সাঁচির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি সুন্দর গোলগাল মুখ,চোখের নিচটা একটু বসা বসা। হয়তো এই কদিনের ক্লান্তির কারনে। পুরো সেন্সে না থাকলেও ফুয়াদ বুঝেছে সাঁচি এই কদিন অনেক খেটেছে ওর জন্য। মাঝে মাঝে কপালে ওর ভালোবাসার স্পর্শও বুঝতে পেরেছে। ভালোই লেগেছে সে স্পর্শ। বহুদিন পরে কারো স্পর্শ পেলো এই কপালটা। খুব ইচ্ছে হয়েছে ওকে বলে, তুমি আমার কপালে কিছুক্ষণ তোমার ঠান্ডা হাতটা রাখো। এই রকম মায়া মায়া চেহারা নিয়ে বসে থাকে আমার পাশে আরো কিছুক্ষণ। এই রকম ভালোবাসাপূর্ন স্পর্শ দিয়ে বারবার হাজারবার আমার কপালটা ছুয়ে দাও।
কিন্তু বলতে পারেনি! ফুয়াদ তো ছোটবেলা থেকেই এমন! নিজের মনের ইচ্ছা সহজে বলতে ভয় লাগে। পাছে সেটা যদি অন্য কারো কাছে বাড়তি মনেহয়! কোনো একজন খুব আপন ভেবে নিজের ইচ্ছা গুলো জানিয়েছিলো তো ফুয়াদকে। সে কি সেই ইচ্ছার মান রেখেছে? তাহলে অন্যের কাছ থেকে কিভাবে আশা করে? কারো উপর কোনো প্রেশার ক্রিয়েট করতে চায় না ফুয়াদ। এই বেশ ভালো আছে। নিজের কষ্টের জগত নিয়ে। তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ হটাৎ মনে হয়, ঠকাচ্ছে নাতো মেয়েটাকে? ও তো নিজে ইচ্ছায় মেয়েটাকে নিজের জীবনে এনেছে, তবে এই অবহেলা কি ওকে দেয়া ঠিক হচ্ছে? সাঁচি যদি ওর পাওনা টা কখনো চেয়ে বসে? ওর সাথে কি কথা বলা উচিত ? জানানো উচিত সবটা? কিন্তু জানালে যদি ভুল বোঝে? যদি হীতে বিপরীত হয়! যদি এটাই বলে আমায় ঠকালেন কেন বিয়ে করে? বড্ড ভয় লাগে ফুয়াদের। আজকাল কি তবে সাঁচিকে হারানোর ভয় জাগছে মনে? কিন্তু কেন? ও কি তবে সাঁচির প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে মনে মনে?
“কখন উঠলেন? এভাবে বসে আছেন যে? বাথরুমে যাবেন নাকি? জ্বর আসছে আবার?” উদ্দিগ্ন কন্ঠে বললো সাঁচি।
” নারে বাবা, জ্বর ছেড়ে গেছে। তাই আপনাতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাথরুম যাবে অবশ্য! তবে তোমার উঠতে হবে না। তুমি বরং আর একটু ঘুমাও।”
“আরে না, চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“আহ! বললামতো লাগবে না। আমি পারবো একা একা যেতে।”
ফুয়াদের মৃদু ধমকে সাঁচি থমকে গেলো। মনে মনে ভ্যাংচালো ওকে-
“এহ, একটু সুস্থ হতেই দেখ কেমন করছে? আমাকে চিনতেই পারছে না যেন! বদের লাঠি কোথাকার?”
ফুয়াদ একা একাই আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে গেল। সাঁচি আর শুয়ে না থেকে উঠে পরলো। ভাবলো, বদটার শরীর যখন ভাল হয়েছে, তখন আজকের নাস্তা টা না হয় নিজের হাতে বানাবে। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া যাবে বেশ অনেকদিন পর।

আরো বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে। জ্বর ভালো হওয়ার পর ফুয়াদ অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। অনেকদিন গ্যাপ হয়ে যাওয়ার কারনে প্রচুর কাজ জমে গেছে। সাঁচিও প্রচন্ড ব্যাস্ত। ওর সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। বেচারি দম ফেলার টাইম পাচ্ছে না। রাতে বাবা মা সাঁচি আর ফুয়াদ খেতে বসেছে একসাথে। তখন মা কথা তুললো-
” তোদের বিয়ের চারমাস পার হয়ে গেলো সাঁচিকে নিয়ে তো কোথাও ঘুরতে গেলি না ফুয়াদ?”
” মা, দেখছোই তো সময় পাচ্ছি না একটুও। তাছারা সাঁচিও তো বিজি।”
সাঁচি একবার ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে খেতে লাগলো।
” সাঁচি মা, তোমার পরীক্ষা কবে নাগাদ শেষ হবে?”
” মা, আমার আর দুটো আছে। তারপর কিছু দিনের ব্রেক পাবো।”
” তাহলে তো হলোই। ফুয়াদ তুই সাঁচিকে নিয়ে এর মধ্যে কোথাও থেকে ঘুরে আয়। ততদিন আমরা না হয় এখানে থাকবো। তোরা আসলে আবার টাঙ্গাইল চলে যাবো। এবার অনেকদিন থাকা হলো। আর তোর বাবার শরীর ও এখন ভালো আছে।”
“হ্যারে, ফুয়াদ ঘুরে আয়। এখন না ঘুরলে আর কবে যাবি? পরে গেলে দেখবি আর ভালো লাগবে না।”
বললেন ফুয়াদের বাবা।
” আমি তো ভাবলাম সবাই মিলে একসাথে বেড়াতে যাবো। একসাথে কোথাও যাওয়া হয়নি অনেকদিন।”
ফুয়াদ বললো।
“কোনো দরকার নেই। এবার তোমরা ঘুরে নিজেরা নিজেরা ঘুরে আসো। বিয়ের পর প্রথম বেড়ানো টা নিজেরা নিজেরা গেলেই ভালো। এতে দুজনার মধ্যে বোঝাপড়ার সময় পাওয়া যায়। এটা খুব দরকার জীবনটা একসাথে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য। আর এই সময়টাও অনেক স্পেশাল। এই অনুভব গুলো পরে আর আসে না জীবনে। তাই এখন তোমরাই যাও। পরেরবার না হয় আমরা সবাই যাবো?”
বললেন আজমল সাহেব। ফুয়াদ কিছুটা অবাক হলো। বাবা কখনো এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলে না। আজ কি সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো বাবার দিকে। অসুখের পর বাবা কি একটু পাল্টে গেছে নাকি?

সাঁচির পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুদিন হলো। সেদিন বেড়াতে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে সাঁচির মনের মধ্যে খুশির বান ডেকেছে। চব্বিশ ঘন্টা একসাথে থাকলে নিশ্চয়ই ফুয়াদ ওকে এভাবে এড়াতে পারবে না? কি করবে তখন তুমি,বাছাধন! কোথায় পালাবে? হয় আত্মসমর্পণ করবে আর না হয় নিজের অপারগতার কথা স্বীকার করবে! দুটোর মধ্যে থেকে যে কোন একটা বেছে নিতেই হবে তোমায়।
খুশিতে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলো সাঁচি।

সেদিন রাতে ফুয়াদ যখন বাসায় ফিরলো সাঁচি তখন ভীষন সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর সামনে দাড়ালো। ফুয়াদ একটু ভয় খেয়ে গেল-
“কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
” আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
” ঠিক আছে বলো। কি বলবে?”
“এখন না। রাতে বলবো। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ততোক্ষণে। ”
চিন্তিত ভঙ্গিতে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফুয়াদ। কি বলবে সাঁচি ওকে? সিরিয়াস কিছু কি???

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৭

0

#আজল
#পর্ব-সাত

১৭.

সকালের নামাজ টা পড়ে সাঁচি ভাবলো একটু ঘুমিয়ে নেবে। রাতে ফুয়াদ কে জলপট্টি দিতে দিতে আর ওর আবোল তাবোল প্রলাপ শুনতে শুনতে ঘুমের বারোটা বেজেছে। তাই ফজরের আযান টা শোনা মাত্রই চট করে নামাজ পড়ে নিয়ে ঘুমাতে আসলো। বিছানার অর্ধেকের বেশিটা জুড়ে ফুয়াদ শুয়ে আছে বাঁকা হয়ে। সাঁচি ফুয়াদের কপালে হাত দিলো, নাহ! জ্বর একটু কমেছে! ও ডাকলো ফুয়াদকে-
” এই, একটু সোজা হয়ে শোন না! আমি শোবো তো? একটু জায়গা দিন তো?”
ফুয়াদ সরলো না শুধু একটি নড়ে উঠলো-
“একটু পানি দেবে, সাঁচি?”
“হুম, দিচ্ছি। ”
উঠে বসে পানিতে চুৃুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করলো ফুয়াদ। মুখ একদম তেতো হয়ে আছে, পানির স্বাদও তিতকুটে লাগছে। দু চুমুক পানি খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিলো সাঁচিকে-
” রাতে কি বেশি জ্বালিয়েছি তোমাকে? ঘুমাতে দেইনি না?!”
” তা একটু জ্বালিয়েছেন বৈকি। তবে ব্যাপার না! অসুস্থ মানুষ, এরকম একটু তো হতেই পারে! আচ্ছা রাতে তো সেরকম কিছু খাননি। এখন ঘুম যেহেতু ভেঙেছে কিছু খেয়ে ওষুধ টা খেয়ে নেবেন?”
” খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে কিন্তু! ওষুধ না খেলে জ্বর ভালো হবে??”
“আচ্ছা, তবে একটু খিচুড়ি খাবো, সবজি খিচুড়ি। মা কে বলো মা রান্না করে দেবে। মা খুব মজা করে সবজি খিচুড়ি রান্না করে।”
একটু মন খারাপ করলো সাঁচি। ওকেও তো কিছু রান্নার কথা বলতে পারতো?লোকটা ওকে কিছু মনেই করে না! অন্তত বন্ধুত্বের দাবিতেও তো বলতে পারতো? মন খারাপ ভাব নিয়েই বললো-
“আচ্ছা, তবে মাকে বলে আসি।”
সাহেরা বেগম রান্না ঘরেই ছিল। কাজের মেয়েটাকে নাস্তা বানানোর ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিলো। সাঁচি ডাকলো পেছন থেকে-
” মা, উনি আপনার হাতের সবজি খিচুড়ি খেতে চাচ্ছে।”
” জ্বর কমেছে ফুয়াদের? ”
“জ্বী, মা কমেছে। ”
“আচ্ছা, আমি চট করে খিচুড়ি রান্না করছি। তুমি ফুয়াদের কাছে যাও। দেখো কিছু লাগবে কিনা?”
সাঁচি মাথা নাড়লো। রুমে এসে দেখে ফুয়াদ বিছানায় উঠে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।
“কি হয়েছে? মাথা ব্যাথা নাকি?”
“হুম। একটু বাথরুমে যাবে বলে নামতে চাইলাম। কিন্তু মাথা প্রচন্ড রকম ঘুরছে। ব্যাথাও প্রচুর, মাথা তুলতে পারছি না। প্লিজ একটু হেল্প করো না!!?”
সাঁচি মনে মনে ভীষন খুশি হলো। আব আয়ে উট পাহাড় কে নিচে!?এতদিন তো নিজের কাছে ঘেষতে পর্যন্ত দিতো না! চেষ্টা করেও পারেনি সাঁচি। এখন এতো কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পাবে ভাবতেই মনের মধ্যে হাজারো অনুভুতিরা সব ঘুম থেকে যেগে উঠছে যেন। ইস! একবার যদি ওর খালি বুকটা দেখতে পেতাম? ওর সে বুকে মাথা রাখতে পারতাম! ওর জ্বরের কারনে যদি সুযোগ টা পেয়ে যায়! মনের মধ্যকার ইচ্ছে গুলো সব ঝাপি খুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন! নিজের মনের এরকম দশা দেখে কম অবাক না সাঁচি! একজন অসুস্থ লোকের অসুখের চিন্তা না করে কি সব চিন্তা করছে?? আসলেই ফুয়াদের অবহেলা ওর মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। নিজেকে শাসন করলো সাঁচি-
“কি হচ্ছে! সাঁচি, ছি! কি ভাবনা এগুলো! কোথায় লোকটার চিন্তা করবি তা না করে নিজের মনোবাসনা পূরণ করার চিন্তা করছিস??! লুচ্চি কোথাকার!”
পরক্ষনেই আবার বলছে-
” কেন,কি দোষ তাতে! ও আমার স্বামী! হক আছে ওর ওপর আমার। ও যদি সে অধিকার না দেয় তাহলে আমি কি চুপচাপ বসে থাকবো?? কখনোই না!”
ভাবনায় বুদ সাঁচি কে ফুয়াদ ডেকেই চলেছে –
” সাঁচি, এই সাঁচি! কি রে ভাই! এতে ডাকছি তুমিতো শুনছোই না? কই হাড়ায়ে গেলা?”
সম্বিত ফিরলে সাঁচির-
” এই, আমি আপনার কোন জনমের ভাই লাগি! হ্যা?”
“আচ্ছা! বোন লাগো তাইলে? ডাকছি কখন থেকে? কি ভাবো এতো? আর কতক্ষণ বাথরুম আটকায়ে থাকবো? এখানেই করে দেই তাইলে?”
“এই না! ছি ছি! সরি, আমি আসলে… আমার খেয়ালই ছিলো না…. চলুন….”
ফুয়াদকে কাঁধের সাপোর্ট দিলো সাঁচি। দু হাতে আগলে ধরলো ফুয়াদকে। লম্বা ফুয়াদের কাঁধ বরাবর আসলে সাঁচি। মাথাটা বুকে রাখতে ইচ্ছা হলো খুব। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলো।ফুয়াদ বাথরুমে যেয়ে দাড়ালো –
“এখন যাও তুমি!আমার হলে তোমাকে ডাকবো।”
সাঁচি ঘাড় নেরে বেড়িয়ে এলো।

ফুয়াদকে খিচুড়ি আর ওষুদ খাইয়ে নিজে খেতে খেতে বেলা নয়টা বেজে গেল। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে সাঁচির। শাশুড়ি কে বলে ঘুমাতে চলে এলো। শাশুড়ি মা যে কয় দিন থাকে সংসার নিয়ে সাঁচি ভাবে না। মা ঠিক সামলে নেয়। রুমে ঢুকে দেখলো ফুয়াদ ততক্ষণে ঘুমে কাঁদা। সাঁচিও পাশে শুয়ে পড়লো। ওদের মাঝে একটা বালিশ দেয়া থাকে সবসময়। যেটা ফুয়াদ আজ পর্যন্ত কখনো ডিঙায় নি। সাঁচি মাঝে মাজে ইচ্ছা করে সরিয়ে নিতো। কিন্তু ফুয়াদ ভুলেও আসতো না এদিকে। সাঁচি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতো এই ছেলে মনেহয় ঘুমায় না। ঘুমের ভান করে জেগে বসে থাকে সারারাত। আজ সাঁচি নিজে পাশ বালিশ টা জরিয়ে ধরে শুয়ে পড়লো, মনে মনে বললো, “ওকে তো জরিয়ে ধরতে পারছি না! তুইই সই!”

সাঁচির গায়ের মনে হচ্ছে আগুন লেগে গেছে, এতো গরম লাগছে কেন? গরম নিঃশ্বাস এসে লাগছে গায়ে। হাতটা সরাতে গেলে বুঝলো ফুয়াদ শুয়ে আছে খুব কাছে। ওরই নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে সাঁচির শরীরে এসে। হাতটা বাড়িয়ে ফুয়াদের কপালে রাখলো। দেখলো জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে ওর। দ্রুত হাত সরিয়ে উঠে বসলো। ঘরের দড়জা জানালা সব বন্ধ হওয়ার কারনে বেলা বোঝা যাচ্ছে না। আধো আলোতে ঘড়ির দিকে তাকালো। পাঁচটা বাজে। তারমানে বিকাল হয়ে গেছে? ইয়া আল্লাহ! এতোক্ষন ঘুমিয়েছে? উঠে তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালালো সাঁচি। ফুয়াদের কপালে পট্টি দিয়ে মা কে ডেকে নিয়ে আসলো। মা বললেন, একটু গা স্পঞ্জ করে দিতে। কথাটা শোনা মাত্রই সাঁচির মুখে খুশির এক অপার্থিব হাসি ফুটে উঠল। সাঁচির হঠাৎ করে মনে হলো আজকের দিনটা ওর জন্য খুব লাকি। ওর মনের সুপ্ত ইচ্ছে গুলো সব পূরন হয়ে যাচ্ছে। ফুয়াদের জ্বর হওয়াটা ওর জন্য শাপেবর হয়েছে যেন। ও তারাতারি একটা টাওয়েল ভিজিয়ে আনলো। কিন্তু ফুয়াদের গেন্জি খুলবে কিভাবে? ওর মতো বিশালদেহী পুরুষ কে কি সাঁচির পক্ষে তোলা সম্ভব? সাঁচি ফুয়াদের পাশে বসে ওকে ডাকলো-
“এই যে শুনছেন? আপনার গা টা একটু মুছিয়ে দেবো। একটু উঠবেন? গেন্জিটা একটু খুলুন না।”
“না না আমার লজ্জা লাগে তোমার কাছে। গেঞ্জি খুলবো না আর গা ও মোছাতে হবে না।”
ঘুমের ঘোরে বিরবির করলো ফুয়াদ। সাঁচি ঝারি দিলো একটা –
” এতো কিসের লজ্জা আপনার? পুরুষ মানুষ না আপনি? এত লজ্জা থাকতে নেই পুরুষের, বুঝলেন? তারাতারি খুলুন বলছি!”
ধমক খেয়ে ফুয়াদ জ্বরের ঘোরে উঠে বসার চেষ্টা করলো। সাঁচি ওকে ধরলো, তারপর আলতো করে গেঞ্জি খুলে নিলো। মনেমনে যতই ফটপট করুক সাঁচি, ওর ও ভীষন লজ্জা লাগছিলো, হাত কাঁপছিলো। গেন্জি খুলতেই ফুয়াদের উজ্জ্বল ফর্সা লোমশ বুকটা সাঁচির চোখের সামনে চলে এলো। সাঁচি হা হয়ে তাকিয়ে আছে, নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন? ইস! কি সুন্দর প্রশস্ত লোমশ বুক ফুয়াদের! মার কথাই ঠিক তাহলে? এই জন্যই তবে ফুয়াদ এত্তো ভালো? ওর মনটা এতো নরম? এতো মায়া মমতা ওর মধ্যে? ইস! ফুয়াদ কবে ওকে আপন করবে? কবে ওর বুকে মাথা রাখতে পারবে সাঁচি? কবে ফুয়াদ ওর দুটো হাত দিয়ে আগলে নেবে সাঁচিকে? কবে মাথায় ফুয়াদের ভালোবাসার স্পর্শ পাবে? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় সাঁচির মাথায়।
“ওহ, ঠান্ডা লাগছে তো! আবার কি হলো, সাঁচি?”
“নাহ, কিছুনা। এই মুছিয়ে দিচ্ছি। তারপর কাপড় পরিয়ে দেবো।”
কাঁপা কাঁপা হাতে ফুয়াদের গা মুছিয়ে ওকে নতুন একটা গেঞ্জি পরিয়ে দিলো সাঁচি। ওকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাথা দিলো। উঠে আসার সময় কি মনে করে ঘুমন্ত ফুয়াদের কপালে নিজের ঠোঁট ছুইয়ে দিলো-
” এবার আপনি সুস্থ হয়ে গেলে নিজের অধিকার চাইবো আপনার কাছে। নিজে থেকে তো দেবেন না, আমি চাইলেও কি ফিরিয়ে দেবেন? ভালোবাসার মানুষটা এক কাছে অথচ তাকে ছুতে পারছি না! এই কষ্ট কি আপনি বোঝেন না?”
ফিসফিস করলো সাঁচি।

১৮.

দিন তিনেক পরে জ্বর ছারলো ফুয়াদের। সকালেই ঘুম ভেঙে দেখলো ওর পাশেই সাঁচি গুটি সুটি মেরে শুয়ে আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো বিছানার মাঝখানে ও শুয়ে। হেসে দিলো ফুয়াদ। মেয়েটা বাধ্য হয়ে এভাবে শুয়ে আছে। একটু পাশ ফিরলেই নিচে চিটপটাং হবে। কিছুক্ষণ সাঁচির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কি সুন্দর গোলগাল মুখ,চোখের নিচটা একটু বসা বসা। হয়তো এই কদিনের ক্লান্তির কারনে। পুরো সেন্সে না থাকলেও ফুয়াদ বুঝেছে সাঁচি এই কদিন অনেক খেটেছে ওর জন্য। মাঝে মাঝে কপালে ওর ভালোবাসার স্পর্শও বুঝতে পেরেছে। ভালোই লেগেছে সে স্পর্শ। বহুদিন পরে কারো স্পর্শ পেলো এই কপালটা। খুব ইচ্ছে হয়েছে ওকে বলে, তুমি আমার কপালে কিছুক্ষণ তোমার ঠান্ডা হাতটা রাখো। এই রকম মায়া মায়া চেহারা নিয়ে বসে থাকে আমার পাশে আরো কিছুক্ষণ। এই রকম ভালোবাসাপূর্ন স্পর্শ দিয়ে বারবার হাজারবার আমার কপালটা ছুয়ে দাও।
কিন্তু বলতে পারেনি! ফুয়াদ তো ছোটবেলা থেকেই এমন! নিজের মনের ইচ্ছা সহজে বলতে ভয় লাগে। পাছে সেটা যদি অন্য কারো কাছে বাড়তি মনেহয়! কোনো একজন খুব আপন ভেবে নিজের ইচ্ছা গুলো জানিয়েছিলো তো ফুয়াদকে। সে কি সেই ইচ্ছার মান রেখেছে? তাহলে অন্যের কাছ থেকে কিভাবে আশা করে? কারো উপর কোনো প্রেশার ক্রিয়েট করতে চায় না ফুয়াদ। এই বেশ ভালো আছে। নিজের কষ্টের জগত নিয়ে। তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ হটাৎ মনে হয়, ঠকাচ্ছে নাতো মেয়েটাকে? ও তো নিজে ইচ্ছায় মেয়েটাকে নিজের জীবনে এনেছে, তবে এই অবহেলা কি ওকে দেয়া ঠিক হচ্ছে? সাঁচি যদি ওর পাওনা টা কখনো চেয়ে বসে? ওর সাথে কি কথা বলা উচিত ? জানানো উচিত সবটা? কিন্তু জানালে যদি ভুল বোঝে? যদি হীতে বিপরীত হয়! যদি এটাই বলে আমায় ঠকালেন কেন বিয়ে করে? বড্ড ভয় লাগে ফুয়াদের। আজকাল কি তবে সাঁচিকে হারানোর ভয় জাগছে মনে? কিন্তু কেন? ও কি তবে সাঁচির প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে মনে মনে?
“কখন উঠলেন? এভাবে বসে আছেন যে? বাথরুমে যাবেন নাকি? জ্বর আসছে আবার?” উদ্দিগ্ন কন্ঠে বললো সাঁচি।
” নারে বাবা, জ্বর ছেড়ে গেছে। তাই আপনাতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাথরুম যাবে অবশ্য! তবে তোমার উঠতে হবে না। তুমি বরং আর একটু ঘুমাও।”
“আরে না, চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“আহ! বললামতো লাগবে না। আমি পারবো একা একা যেতে।”
ফুয়াদের মৃদু ধমকে সাঁচি থমকে গেলো। মনে মনে ভ্যাংচালো ওকে-
“এহ, একটু সুস্থ হতেই দেখ কেমন করছে? আমাকে চিনতেই পারছে না যেন! বদের লাঠি কোথাকার?”
ফুয়াদ একা একাই আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে গেল। সাঁচি আর শুয়ে না থেকে উঠে পরলো। ভাবলো, বদটার শরীর যখন ভাল হয়েছে, তখন আজকের নাস্তা টা না হয় নিজের হাতে বানাবে। সবাই মিলে একসাথে খাওয়া যাবে বেশ অনেকদিন পর।

আরো বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেছে। জ্বর ভালো হওয়ার পর ফুয়াদ অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। অনেকদিন গ্যাপ হয়ে যাওয়ার কারনে প্রচুর কাজ জমে গেছে। সাঁচিও প্রচন্ড ব্যাস্ত। ওর সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। বেচারি দম ফেলার টাইম পাচ্ছে না। রাতে বাবা মা সাঁচি আর ফুয়াদ খেতে বসেছে একসাথে। তখন মা কথা তুললো-
” তোদের বিয়ের চারমাস পার হয়ে গেলো সাঁচিকে নিয়ে তো কোথাও ঘুরতে গেলি না ফুয়াদ?”
” মা, দেখছোই তো সময় পাচ্ছি না একটুও। তাছারা সাঁচিও তো বিজি।”
সাঁচি একবার ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে খেতে লাগলো।
” সাঁচি মা, তোমার পরীক্ষা কবে নাগাদ শেষ হবে?”
” মা, আমার আর দুটো আছে। তারপর কিছু দিনের ব্রেক পাবো।”
” তাহলে তো হলোই। ফুয়াদ তুই সাঁচিকে নিয়ে এর মধ্যে কোথাও থেকে ঘুরে আয়। ততদিন আমরা না হয় এখানে থাকবো। তোরা আসলে আবার টাঙ্গাইল চলে যাবো। এবার অনেকদিন থাকা হলো। আর তোর বাবার শরীর ও এখন ভালো আছে।”
“হ্যারে, ফুয়াদ ঘুরে আয়। এখন না ঘুরলে আর কবে যাবি? পরে গেলে দেখবি আর ভালো লাগবে না।”
বললেন ফুয়াদের বাবা।
” আমি তো ভাবলাম সবাই মিলে একসাথে বেড়াতে যাবো। একসাথে কোথাও যাওয়া হয়নি অনেকদিন।”
ফুয়াদ বললো।
“কোনো দরকার নেই। এবার তোমরা ঘুরে নিজেরা নিজেরা ঘুরে আসো। বিয়ের পর প্রথম বেড়ানো টা নিজেরা নিজেরা গেলেই ভালো। এতে দুজনার মধ্যে বোঝাপড়ার সময় পাওয়া যায়। এটা খুব দরকার জীবনটা একসাথে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য। আর এই সময়টাও অনেক স্পেশাল। এই অনুভব গুলো পরে আর আসে না জীবনে। তাই এখন তোমরাই যাও। পরেরবার না হয় আমরা সবাই যাবো?”
বললেন আজমল সাহেব। ফুয়াদ কিছুটা অবাক হলো। বাবা কখনো এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলে না। আজ কি সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো বাবার দিকে। অসুখের পর বাবা কি একটু পাল্টে গেছে নাকি?

সাঁচির পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুদিন হলো। সেদিন বেড়াতে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে সাঁচির মনের মধ্যে খুশির বান ডেকেছে। চব্বিশ ঘন্টা একসাথে থাকলে নিশ্চয়ই ফুয়াদ ওকে এভাবে এড়াতে পারবে না? কি করবে তখন তুমি,বাছাধন! কোথায় পালাবে? হয় আত্মসমর্পণ করবে আর না হয় নিজের অপারগতার কথা স্বীকার করবে! দুটোর মধ্যে থেকে যে কোন একটা বেছে নিতেই হবে তোমায়।
খুশিতে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলো সাঁচি।

সেদিন রাতে ফুয়াদ যখন বাসায় ফিরলো সাঁচি তখন ভীষন সিরিয়াস ভঙ্গিতে ওর সামনে দাড়ালো। ফুয়াদ একটু ভয় খেয়ে গেল-
“কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
” আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
” ঠিক আছে বলো। কি বলবে?”
“এখন না। রাতে বলবো। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ততোক্ষণে। ”
চিন্তিত ভঙ্গিতে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফুয়াদ। কি বলবে সাঁচি ওকে? সিরিয়াস কিছু কি???

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-০৬

0

#আজল
#পর্ব-ছয়

১৪.

জীবনে নেয়া সব ডিশিসান এর সুফল বা কুফল যাই বলি না কেন তা সব সময় তাতক্ষণিক বোঝা যায় না। দুই বছর, পাঁচ বছর কিংবা অনেক সময় জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে মনে হয় যে, জীবনটাকে আরেক টু ভালোভাবে সাজানো যেত বা অমুক ডিশিসন নেওয়াতে এতো কঠোর না হলেও পারতাম বা ডিসিশন টা এভাবে না নিয়ে ওভাবে নিলেও পারতাম। আসলে বিপদ নিজের দোরগোড়ায় না আসলে মানুষ কিছু টের পায় না। এটা আজমল সাহেব মানে ফুয়াদের বাবা আজকে হারে হারে টের পাচ্ছেন। অসুস্থ হয়ে ঢাকায় ছেলের বাসায় এসেছিলেন। বেশি কিছু না, ভাইরাস জ্বর হয়েছিল, তাতেই কাত হয়ে গেছেন। বয়সের দোষ বলেও একটা কথা আছে। এই বয়সের দোষেই ভাইরাস জ্বরেই তিনি কাতর হয়ে গেছেন। তার ছেলেমেয়ে দুটো মাশাল্লাহ বাবা অন্তপ্রান। যথেষ্ট ডাক্তার, হাসপাতালে দৌড়া দৌড়ি করেছে এই কয়দিন। দু তিনদিন হয় বাসায় এসেছেন। বৌমা সাঁচি আর জামাই তানভীর ও তার জন্য কম করেনি বা করছে না! কিন্তু তবুও আজকে তার নিজেকে প্রচন্ড রকম অসুখী একজন মানুষ মনেহচ্ছে। মনেহচ্ছে বাবা হিসেবে সন্তানদের জন্য সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।

বিকেলের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে নিজের রুমে যাওয়ার সময়ই শুনতে পেলেন প্রিয়তার গলা। খুব নিচু স্বরে মায়ের সাথে কথা বলছে আর কান্না করছে। যদিও আড়ালে থেকে অন্যের কথা শোনা গর্হিত কাজ। তবুও উনি নিজেকে এর থেকে দমন করতে পারলেন না। একটু এগিয়ে গেলেন প্রিয়তার রুমের সামনে। দরজা সামান্য আলগা করে দেখলেন মেয়ে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। মাও কাঁদছে, কিন্তু সে তার শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে পরম আদরে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

” মা, আমার কস্ট হয় অনেক। নিজের ইচ্ছা মতো কিছুই করতে পারলাম না জীবনে। কেমন বন্দী হয়ে থাকতে হয় মা তানভীরের ওখানে। নিজের কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা নাই মা! এই ভাবে কি বাঁচা যায় মা? কত বয়স আমার? আমার ক্লাস মেটরা সব কি সুন্দর ঘুরে বেড়ায়, হাসে, খেলে, খায় দায়। আর আমার মা! মেয়ের চিন্তা করতে হয়, সংসারে কি রান্না হবে সেই চিন্তা করতে হয়! শাশুড়ীর চিন্তা করতে হয়। অথচ মা, তানভীর কে দেখ! ওর কিন্তু কোন চিন্তা নেই! নিজের মতো স্বাধীন আছে? এমনকি নিজের মাকে নিয়েও চিন্তা করে না? সব আমার উপর ছেড়ে দিয়ে রাখছে। আমার ভালো লাগছে না মা? বাবা কেন তখন তারাহুরা করে আমার বিয়েটা দিলো মা!!?? একদম ভালো লাগে না মা!”
“শোনা মা, এমন করে বলিস না, মা! বাবা শুনলে কষ্ট পাবে।ধৈর্য্য ধর মা, আল্লাহ সব ঠিক করবে।”

আজমল সাহেবের আর ইচ্ছা হলো না শোনার।
কি শুনবেন! তার একমাত্র মেয়েটা এতো কষ্টে আছে আর সে বাপ হয়ে কিছুই টের পেলো না! কেমন বাপ সে! আর কিছু ভাবতে পারছেন না! টলতে টলতে তিনি নিজের রুমে ফিরলেন।আস্তে করে শুয়ে পরলেন খাটে এসে। বাবা মায়ের বড় সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা অকালে মারা যাওয়ার পর ভাইবোনের বড় ভাই হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে করতে তার আর আলাদা করে স্বামী আর বাবার দায়িত্ব পালন করা হয়ে ওঠেনি মনেহয়! আজ তার মনে হচ্ছে, ওদের সাথে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনাই করেননি কখনো! ওরা কি করতে চায়? ওদের কি ইচ্ছা? এগুলো কখনোই জানা হয়ে ওঠেনি তার! ওরা হয়তো বলতে চেয়েছে অনেকবার! উনিই হয়তো ভ্রুক্ষেপ করেননি কখনো! মেয়েটা যে সুখে নেই তা তো আজ বোঝা গেল। আচ্ছা ছেলেটা সুখে আছে কি? কি জানি? অনেকদিন ধরে ছেলেকে খেয়াল করে দেখেছেন। কেমন যেন মনমরা থাকে সবসময়! সবকিছুই করে ছেলেটা, হাসে, খায়, কথাও বলে কিন্তু মনে হয় যেন মন থেকে করছে না? তাতে যেন প্রানের ছোয়া নেই কোনো? পড়ালেখা শেষ করে এতো তারাতারি জীবনে উন্নতি করে ফেললো, গর্ব হতো তার! ইদানীং ছেলের কাছাকাছি থাকার কারনে টের পান কিছু যেন নেই ছেলের মধ্যে। আগে অতটা না ভাবলেও, আজ মনে হচ্ছে ছেলের ও বুঝি তার বিরুদ্ধে কোনো কমপ্লেন আছে?

আর সাহেরা?? সারাজীবন তার সাথে সংসার করলো! কই কখনো তো বলেনি সে অসুখী তার সাথে?? নাকি বলেছে? আর সে শুনতে পায়নি? একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন সাহেরাকে। কিন্ত পরক্ষণেই মনে হলো, যদি সেও বলে আমি তোমার সাথে সুখী ছিলাম না কখনো?? না না করবো না জিজ্ঞাসা! সাহেরার কাছ থেকে এরকম কঠিন কথা শোনার মতো সাহস নেই তার! হজম হবে না! ভয় হতে লাগলো আজমল সাহেবের। নিজের সবচেয়ে কাছের যারা, তাদেরকে যখন দূরের মানুষ মনে হয় তখন সেটা মনের কোথায় যেন লাগে! আজকের আগে এরকমটা কখনো মনে হয়নি। কিংবা কে জানে! মনে এই ভাবনাটা আসার প্রয়োজন হয়নি হয়তো?

১৫.

আজ অফিস থেকে একটু তারাতারি বাসায় ফিরেছে ফুয়াদ। শরীর টা আজ সাথ দিচ্ছিলো না। বাবার অসুস্থতায় দৌড়াদৌড়ি তার উপর অফিসে কাজের প্রেশার সব মিলিয়ে শরীরের উপর দিয়ে যেন স্টীম রোলার চলেছে এই কদিন। ভীষন রকম ক্লান্তি আর অবসাদ আজ যেন জেকে বসেছে শরীরে। বাধ্য হয়ে ছুটি নিয়ে চলে আসতে হলো। মা কিছুটা উদ্দিগ্ন হলো ছেলেকে দেখে –
“কি রে বাবা, শরীর খারাপ নাকি? আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? বউ মা তো এইমাত্র ক্লাসে গেল!”
“হুম মা! আজ খুব খারাপ লাগছিলো। তাই চলে এলাম। দুপুর আজ খাইনি মা, আমাকে কিছু খেতে দাও তো!”
“আচ্ছা তবে ভাতই খেয়ে নে না। পাঁচটা বাজে, এখন নাস্তা খেলে আবার তোর গ্যাস হয়ে যাবে। সেই সকালে খেয়েছিল কিনা!”
“ঠিক আছে মা, তাই দাও। একটু আলু ভর্তা করে দিয়ো তো মা শুকনো মরিচ দিয়ে। খুব খেতে করছে।”
” আচ্ছা দিচ্ছি। তুই গোসল করে আয় ততক্ষণে আমি সব রেডি করে ফেলি। ”

ফুয়াদ গেল ফ্রেশ হতে। দেখলো বিছানার এক কোনে ওর পরার জন্য কাপড় আর টাওয়েলটা ভাজ করে রাখা। তা দেখে ফুয়াদ হাসলো একটু। মেয়েটা নিজের কর্তব্য করতে কখনো ভোলে না। আজকে ক্লাসে যাবে তাই আগেই ওর কাপড় রেডি করে রেখে গেছে। মনে মনে গুনগুন করতে করতে ওয়াশ রুমে ঢুকলো।

বিয়ের তিনমাস পার হয়ে গেছে। এখনো সাঁচির সাথে সম্পর্ক টা আগের মতই আছে। সেদিনের পর থেকে উল্টো আরো অকওয়ার্ড লাগে ফুয়াদের। কিভাবে নিজের থেকে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। ভয় ও লাগে পাছে না আবার টাল সামলাতে না পেরে বেশি কিছু না করে ফেলে। যদিও করলে সেটা অন্যায় হবে না বরং সাঁচির সাথে ন্যায় করা হবে। কিন্তু মনকে কে বোঝাবে? মনের ব্যাপার সব তর্কের উর্ধে। নিজে ফুয়াদ জীবনে অনেকবারই মনের সাথে কম্প্রোমাইজ করেছে, তাতে ও যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার থেকে অনেক অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিলো একজনকে স্বপ্ন দেখিয়ে, কথা দিয়ে তারপর সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে আর কথা রাখতে না পেরে। তার সেই আকুতি এখনো ওর কানে বেজে যায় সর্বক্ষন। সেই অপরাধ বোধের বোঝা থেকে যেন মুক্তি নেই ওর! সে যে কি এক অসহ্য যন্ত্রণা, ফুয়াদ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। এ এক এমনই গোপন ব্যাথা যার খবর কেউ যানে না, কাউকে বলতে পারে না। বন্ধু দেরও না, ওরা অবশ্য আবছা ভাবে জানে, কিন্তু পুরোটা কেউ জানে না। পাছে কেউ তাকেই ভুল বোঝে এই ভয়ে কাউকে কিছু বলা হয়ে ওঠে না!

মাঝে মাঝে মনে হয় সাঁচির সাথে শেয়ার করে ঘটনাটা। খুব ইচ্ছে করে নিজের গোপন ব্যাথ্যার একটু ভার সাঁচির কাধেও চাপিয়ে দিতে। কিন্তু
পরক্ষনেই আবার ভয় লেগে যায়, সাঁচি যদি ওকে ভুল বুঝে দূরে সরে যায় নিজ থেকে! যদি বলে! ফুয়াদ ভরসা করার মতো ছেলে না! সাঁচিকে নিয়ে কি এক দ্বিধা ফুয়াদের মনে। ও মেয়েটাকে ভালোবাসতে চায় কিন্তু পারে না। কি এক বাঁধা যেটা কোন ভাবোই ডিঙাতে পারছে না ফুয়াদ। মেয়েটা ওর কারনে কষ্ট পাচ্ছে এই ভাবনাটাও ওকে কষ্ট দিচ্ছে। নিজের ভেতরকার গিল্টি ফিলিং কুরে কুরে খায় ফুয়াদকে। কেন মেয়েগুলোর কষ্টের কারন ফুয়াদ? এসব চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করে সবসময়। তাই চাইলেও জীবনটা স্বাভাবিকভাবে গুছিয়ে নিতে পারছে না ফুয়াদ। সবকিছু থেকে পালিয়ে বেড়াতে তাই আরো বেশি ব্যস্ত হয়ে যায় কাজে।

মাঝে সাঁচি বেশ জ্বালাতন করতো। হঠাৎ হঠাৎ জড়িয়ে ধরতো, চুমুও দিতো মাঝে মাঝে। আরো বেশি কিছু চাইতো, কিন্তু মেয়ে হয়ে আর কতই বা আগাবে! শিক্ষিত মেয়ে, নিজেকে সামলে নিতো। ফুয়াদের সারা না পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ও এখন পড়ালেখা নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকে। ফুয়াদ কে জিজ্ঞেস করেছিলো একবার, কিছু বলার থাকলে যেন ফুয়াদ শেয়ার করে ওর সাথে। ফুয়াদ নিশ্চুপ থেকেই তার উওর দিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে সাঁচি আর কিছু বলে না ওকে। নিজের মতো থাকে।

কতক্ষণ ধরে ভিজছিলো কে জানে! মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরলো ফুয়াদের।
” বাবা, আর কতক্ষণ ভিজবি? তোকে ডাকছি সেই কখন থেকে?”
” মা, এই বের হচ্ছি। তুমি যাও আমি আসছি।”
কিছুক্ষণ পর কাপড় পরে বের হলো ফুয়াদ। বেশ ঠান্ডা লাগছে এখন। খেতে বসেও কেমন যেন অরুচি লাগছিলো। মা গরম ভাতের মধ্যে ঘি ছড়িয়ে দিলো সাথে আলুভর্তা। তাই দিয়ে ভাত মাখালো ফুয়াদ-
“বাবা কোথায় মা? প্রিয় আর প্রিতি? খেয়েছে ওরা?”
” তোর বাবা ঘুমাচ্ছে। প্রিয় আর প্রিতিও ঘুমাচ্ছে। তোর চোখ এরকম লাল হয়ে আছে কেন, বাবা?”
“কি জানি,মা? গা ব্যাথা করছে খুব।”
“জ্বর বাধালি নাকি?”
মা গায়ে হাত দিলেন।
” গা টা গরম মনে হচ্ছে। একটু আদা চা করে দেই নাকি? বউমা কে আসতে বলবো?”
“আরে না মা। আমি ঠিক আছি, সাঁচি কে কিছু বলো না! এমনিতেই এক সপ্তাহ ক্লাস করতে পারেনি বাবার অসুস্থতার সময়।”
ফুয়াদ কোনো রকমে একটু খেয়ে উঠে গেলো- “আমি একটু শুলাম,মা। কোনো দরকার থাকলে ডেকে দিয়ো।”
আর দাড়ালো না ফুয়াদ। ঘরে এসে চাদর জড়িয়ে শুয়ে গেল। ঠান্ডায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল কিছু টের পেলো না।

১৬.

সাঁচি যখন ভার্সিটি থেকে ফিরলো রাত সারে আটটা বাজে। আজ একটা ক্লাস হয়নি বলে আগে চলে আসতে পারলো। ফুয়াদ অবশ্য চলে আসে এতো ক্ষনে। যেদিন ফুয়াদের আসতে আরো রাত হয়, সারে নয়টা দশটা বাজে সেদিন ও সাঁচিকে নিয়েই ফেরে। নিজেই ওর ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ওর ক্লাস শেষ হওয়া অবধি। সাঁচির ক্লাস রুটিন মুখস্থ আছে ফুয়াদের। তাই আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করে না। সাঁচি বেড় হয়েই ফুয়াদকে দেখতে পায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ব্যাপারটা বেশ এনজয় করে সাঁচি। ফুয়াদের কর্তব্য পরায়নতা দেখে খুব অবাকও লাগে মাঝে মাঝে। কখনো কোনো কর্তব্য পালনে ভুল হয় না ওর। শুধু মনের ব্যাপারটা যেন বোঝে না!

আজ যখন ফোন দেয়নি তার মানে ফুয়াদ বাসায়। বাসায় ঢুকে বাবা মা প্রিয়তা আর প্রিতির সাথে কথা বলে নিজের রুমে ঢুকলো সাঁচি । বাতি জ্বালাতেই দেখলো ফুয়াদ গুটি শুটি মেরে চাদর গায়ে জরিয়ে শুয়ে আছে। এসি ও বন্ধ। কি ব্যাপার! এভাবে শুয়ে আছে কেন ও? ভ্রু কুচকে তাকালো সাঁচি। ডাকলো দু একবার কিন্তু সারা দিলো না ফুয়াদ। সাঁচি এগিয়ে গিয়ে ফুয়াদের গা থেকে চাদরটা সরালো। মুখটা লাল হয়ে আছে ফুয়াদের। ঠোঁট টা শুকিয়ে আছে। ফুয়াদের ঠোঁটে নজর যেতেই একটা ঢোক গিললো সাচি। পরক্ষনেই নিজেকে মনে মনে গালি দিলো একটা। কেন যে ফুয়াদের সামনে এলে এরকম বেসামাল হয়ে যায় সাঁচি? নিজের ভাবনাগুলো কিছুতেই নিজের থাকে না। মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে ফুয়াদের কপালে হাত রাখলো সাঁচি ।
” আল্লাহ! জ্বরে তো গা পুরে যাচ্ছে! এই লোক তাও এতো শান্ত হয়ে শুয়ে আছে কীভাবে? ”
সাঁচি তাড়াতাড়ি আলমিরা থেকে একটা ব্লাংকেট বের করে ফুয়াদের গায়ে জড়িয়ে দিলো। শাশুড়ি মাকে ডাকলো। বাবা আর প্রিয়তাও এলো। প্রিয়তাই বললো-
” ভাইয়ের তো অসুখ হয় না বললেই চলে। হঠাৎ করে এরকম জ্বর হলো কেন? ডাক্তার ডাকলে ভালো হবে। না হলে ভাই অনেক কস্ট পাবে। ওতো জ্বর সহ্য করতে পারে না।”
সাঁচির ও তাই মনে হলো। ডাক্তার কে খবর দিলো। ডাক্তার তিনদিনের ওষুধ আর কিছু টেস্ট দিয়ে বললেন, তিনদিনে জ্বর না কমলে যেন টেস্টগুলো করায়।
রাতে ফুয়াদের কপালে পট্টি দিতে দিতে ঘুমিয়ে গেছিলো সাঁচি। ফুয়াদের কথা শুনে জেগে গেল। জ্বরের ঘোরে বিরবির করছে-
“রেনু, আমি বুঝিনি তুমি এতো কষ্ট পাবে? না বুঝেই ভুল করে ফেলেছি। প্লিজ মাফ করে দাও আমায়। প্লিজ! কথা বলো রেনু?”
“এই, এই কি বলছেন?”
সাঁচি হালকা ধাক্কা দেয় ফুয়াদকে।
“ও আমাকে কখনো মাফ করবে না। কখনো না!”
ভ্রু কুচকে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে সাঁচি। “কি বলছে? কে মাফ করবে না ওকে?সাঁচি আবার ডাকলো-
“এই কি বলছেন? কে মাফ করবে না?”
” ও, খুব কষ্টে আছে। আমি ওকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারিনি। ও আমায় ক্ষমা করবে না। কখনে না…”
সাঁচি আবারও আস্তে ধাক্কা দিলো ফুয়াদকে। ফুয়াদ চোখ মেলে তাকালো একটু। পুরো ঘোলাটে চোখ নিয়ে তাকলো ফুয়াদ।
” কি বলছেন? কে মাফ করবে না?”
একটু চুপ করে থেকে আবার চোখ বন্দ করলো ফুয়াদ। সাঁচির দু হাত আগলে ধরলো, ঘোলাটে চোখে তাকালো আবার-
” সত্যি জানলে তুমিও আমাকে ভুল বুঝবে?ছেড়ে চলে যাবে, সাঁচি?”
সাঁচি বুজলো ফুয়াদ কোন মেয়ের বিষয় নিয়ে কষ্টে আছে। যে বিষয় টা হয়তো কেউ জানে না। হয়তো ভয় পায় ফুয়াদ! লোকটা জানে না এই এতদিনে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে সাঁচি ওকে!!?? জীবনের প্রথম ভালোবাসা ফুয়াদ ওর, তার উপর সাঁচির স্বামী ও। ফুয়াদ কি বুঝবে? সাঁচির ঠিক কতটা জুরে ফুয়াদ আছে? কত শত বার জিজ্ঞেস করেছে ফুয়াদকে, কোন অতীত থাকলে যেন ওর সাথে শেয়ার করে। কিন্তু ফুয়াদ তো ওকে বিশ্বাস ই করতে পারছে না!? কিভাবে ওর বিশ্বাস অর্জন করবে সাঁচি? ভেবে পায় না! মাঝে মাঝে ওর খুব ইচ্ছে করে ফুয়াদকে বলতে, ” লাজুক বানর, একটা বার আমাকে বিশ্বাস করেই দেখো? বিয়ে করা বউ তোমার, আমাকে বিশ্বাস করে ঠকবে না কখনো!!!! ”

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin