Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 429



মুক্তির স্বাদ পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#মুক্তির_স্বাদ
লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

“আজ তুমি মা’রা গিয়ে আমায় যেন মুক্তি দিলে মা! মনে পড়ে মা, সতেরো বছরী কিশোরী মেয়েটা তোমার কাছে এসেছিলো উড়ন্ত দু’টো ডানা নিয়ে, তুমি নিমিষেই কেঁড়ে নিলে তার সমস্ত চঞ্চলতা। ভালোবাসার বদলে বিষিয়ে দিয়েছো তার ছোট্ট মস্তিষ্ক’কে। হাহ্! তুমি চলে গেলে, আজ তবেই আমার ভাগ্য বদলের দিন এসেছে মা, তোমায় ছাড়াই আমি ভীষণ ভালো থাকবো। ভীষণ!”

সবাই যখন শোক পালনে ব্যস্ত সেখানে শ্বাশুড়ি”র মৃত্যু দেহের সামনে বসে একমাত্র পুএবধূ “শিখা” তাকে নিয়ে আক্ষেপ করে বসলেন। এসময়ে পুএবধূ’র এহেন কথা বড়োই অদ্ভুত শোনালো। লোকজন চমকে উঠলো, অবাক হয়ে দেখছেন মেয়েটাকে। তান্মধ্যে শিখার ছোট বোন শখা দৌড়ে আসলো বোনের কাছে। দু’হাতে শিখার মুখ চেপে ধরে সাবধানী কণ্ঠে শুধালো,

“চুপ কর আপা, তুই পা’গ’ল হয়ে গেছিস আপা? মানুষটা আর বেঁচে নেই। দুলাভাই যদি শুনতে পায় একথা, তোকে আর আ’স্ত রাখবে না আপা।”

সেদিকে কোনো হেলদোল নেই নারীটির। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে পুরনো বিষাদময় স্মৃতি।

অতীতের স্মৃতিচারণ ঃ

গরীব বাবার ১৭ বছরী রূপবতী কিশোরী মেয়েটার বিয়ে হয়েছে আজ ৩৫ বছরের এক লোকের সাথে। লোকটার একটু বয়স বেশি হলেও সমাজে তাদের নাম-ডাক বেশ। শহরে পাকা দালান,গুটিকয়েক বড় বড় দোকান, ছেলের নিজেস্ব বিজনেস ও রয়েছে।
সেখানে শিখার বাবা একজন রিক্সা চালক। মা ছিলেন পরিচালিকা। বছর দু’য়েক আগে রোড এ’ক্সি’ডে’ন্টে পা হারিয়ে এখন মা’টা প’ঙ্গু। শিখা ও শখা দুই বোন শুধু। আয়-রোজগারের জন্য বাবার দু’টো হাতই ভরসা। দুই মেয়ে, ঘরে অসুস্থ বউ, বাবা অভাবের তাড়নায় দিশেহারা!

এরিমধ্যে শিখার শ্বশুর তার বড় মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব রাখে। বড় মেয়েটার বয়স অল্প হলেও রুপে গুণে অনন্যা!
বাবা বড় ঘরের ছেলে পেয়ে পাএের বয়স দেখেনি আর। তার উপর দেনাপাওনার কোনো পার্ট নেই। এমন ঝুট-ঝামেলাহীন প্রস্তাব আর আসবে না বৈকি, বাবা এতো বাছ-বিচার না করে বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলো বড়ঘরে। বড় মেয়েটা তার বড়ই আদরের! অভাবের তাড়নায় মেয়েদের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারেনি সে।
মেয়ে বিয়ে দিয়ে বাবা স্বঃস্তি পায়, বড় ঘরটায় এবার তার আদরের মেয়েটা সুখেই থাকবে।
.
.

উড়ন্ত দু’টো ডানা নিয়ে কিশোরী মেয়েটা পা-রাখলো শ্বশুরের পাকা ঘরে। শিখা মেয়েটার বয়স কম। সে বুঝতো না সংসার কি, সংসারের দায়িত্ব বা কি? শুধু বুঝতে শিখলো, এটা তার স্বামীর ঘর।
ফুলসজ্জিত ঘরটায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে শিখা। অপেক্ষা করছে তার স্বামীর জন্য। কিছু সময় বাদে ঘরে প্রবেশ করলো “আযান”।
নববধূর হাতটি মুঠোয় আগলে নিয়ে বললো, আমার মাকে ভালোবেসো শিখা, কখনো কষ্ট দিও না যেন। মনে করো, উনি তোমার মায়ের মতন।”

এটাই ছিলো তার স্বামীর প্রথম কথা। চঞ্চল শিখা পরক্ষণে বোকার মতো প্রশ্ন করলো, “শুধু কি আমি একাই তাকে ভালোবাসবো? উনি আমায় ভালোবাসবে না?”

আযান মুচকি হেসে কিশোরী বউকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে শুধালো, “বাসবে…! তুমি একটু মানিয়ে নিও নিজেকে।”

তাদের প্রথম রাতেই স্বামী তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে, মা’কে ভালোবাসতে হবে, উনি শিখারই আরেকটা মা। এই সত্যটুকু মেনে নিয়েছে মেয়েটা।

বিয়ের পরেরদিন সকালে নিজের রুমে বসে পা দোলাচ্ছে শিখা। এমন সময় রুমে তার শ্বাশুড়ি আসলো। শিখা শ্বাশুড়িকে দেখে এগিয়ে গেলো তার কাছে। উচ্ছাসিত কণ্ঠে শুধালো, “মা। তুমি আমার আরেকটা মা তাই না? উনি বলেছে, তোমাকে ভালোবাসতে। আচ্ছা আমি তোমাকে ভালোবাসলে, তুমি আমায় ভালোবাসবে মা?”

শ্বাশুড়ি তার এমন মায়া মাখা আবদার খানি মুহুর্তেই গুঁড়িয়ে দিয়ে গমগমে গলায় বললেন, “বাড়ি বউ হয়ে এসেছো তবুও কোনো কান্ড জ্ঞান নেই তোমার? মা কিছু শিখায় নাই তোমাকে? সকাল যে হয়েছে, এখনো স্বামীর সোহাগী বউ হয়ে রুমে ঘাপটি মে’রে আছো। রান্নাটা কে করবে শুনি?”

শ্বাশুড়ি মা শক্ত হাতে তার নরম হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রান্না ঘরে। শিখা চমকে উঠলো, ফর্সা মুখ-খানায় আঁধার নেমে আসলো তার। যাবার সময় একটুখানি আশা নিয়ে, ছলছল চোখে স্বামীর পানে একবার তাকালো সে। ভাবছে লোকটা তার হয়ে কিছু বলবে মাকে। কিন্তু, লোকটা সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিলেন। মা’কে কিছু বলার সাহস হয়ে উঠেনি তার।

স্বামীর ঘরে প্রথম সকালেই কাঁদল সে। শিখা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ছোট ছোট হাতে সব একাই রান্না করে নিলো। পরক্ষণেই খুব সহজে মে’নে নিলো এই বাক্য, “বাড়ির একমাত্র বউ সে, রান্না ঘরের দায়িত্বও তার।”

সব খাবার টেবিলে গুছিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো শিখা। এবার একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। কিয়াৎক্ষণ বাদে আসতেই দেখতে পেলো, বাড়ির সবাই তাকে রেখেই খেতে বসেছে। এমনকি তার স্বামীও। অভিমানে বুক ফুলে উঠলো তার, নিঃশব্দে ওখান থেকে চলে যেতে নিলো। তান্মধ্যে, শ্বশুর মশাই স্নেহময়ী কণ্ঠে ডাক দিয়ে বললো,

“বউ মা,কই যাচ্ছো? খেতে এসো, আজ একসাথে খাই।”

দাঁড়িয়ে গেলো শিখা। বড়দের অবাধ্য হতে বাবা-মা কখনোই শেখায়নি তাকে। সকল অভিমান চা’পা রেখে হাসিমুখে গিয়ে বসলো শ্বাশুড়ির কাছ ঘেঁসে। কিন্তু, শিখার শ্বাশুড়ি রেহেনা বেগম চার মেয়ে-একমাএ ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত, তাদের পাতে এটা সেটা দিচ্ছে। ছোট্ট মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে। শিখারও একবার বলতে ইচ্ছে করছে, “আমাকেও খাইয়ে দেও মা।”

পরক্ষণে, ভয়ে নিজের ইচ্ছে মনের মাঝে চাপা রাখলো মেয়েটা। চারপাশে তাকিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে অচেনা মানুষগুলোকে। তারা দিব্যি খাচ্ছে, পাশে যে নতুন বউটা খালি প্লেটে বসে আছে তা কেউ দেখছে না।
এই পরিবেশের সাথে অচেনা সে, পরে ভাবলো বড়োলোক বাড়ীর মানুষ গুলো বোধহয় এমনই হয়!
কারো ভরসা না করে নিজের প্লেটে নিজেই ভাত নিলো শিখা। মাংসের বাটিটা ধরার আগেই শ্বাশুড়ি সেটা নিয়ে নিলো। নিজের ও ছেলের প্লেটে ভর্তি করে সবটুকু মাংস রাখলো। তারা মা-ছেলে খাচ্ছে, শিখার জন্য এক টুকরোও মাংস অবশিষ্ট রাখলো না। শ্বাশুড়ি একবার জিজ্ঞেস অবধি করলো না, “তুমি মাংস খাও?”
এদের আচরণে শিখার ছোট্ট মনটা পি’ড়া দিচ্ছে, চোখ দু’টো টলমল করছে।
আসলে কিন্তু এমনটা নয় যে, শিখা মাংস ভীষণ পছন্দ করে। শাক অথবা একটা তরকারি দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস তার আছে।
তবুও প্রথম দিনে এই এবাড়িতে তার মূল্য কতটুকু? কিশোরী কন্যা, খুব সহজেই অনুমান করে ফেললো। প্রথম সকালে এটাই প্রথম শ্বাশুড়ি ও স্বামীর প্রতি তার অভিযোগ হয়ে রইলো, খুব গোপনে অভিমান পুষে নিলো তার বক্ষে।
.
.
ধরণীর বুকে বিকেল নেমেছে। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে শিখার বাবা “মনিরুল” এসেছে মেয়েটাকে একটুখানি দেখার জন্য। তার শক্ত হাতে রয়েছে একটা মিষ্টির ব্যাগ। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই, বাড়িটা নিরব মনে হলো। বড় মেয়েটার মুখটা দেখার জন্য বাবার তড় সইছে না যেন। উচ্চ স্বরে ডাকলো,” শিখা আম্মা? কই তুই মা? দেখ তোর আব্বা তোরে দেখবার লাইগা আইছে ।”

ততক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে আসলো শিখার শ্বাশুড়ি। আধ পুরোনো ধূসর পোশাকে মনিরুল’কে দেখে মুখখানা অন্ধকার হয়ে গেছে তার। বিরক্ত কণ্ঠে শুধালো, “কি হচ্ছেটা কি এই বাড়িতে? এমন চেচাচ্ছেন কেন?”

থমথম খেয়ে যায় বাবা। উনি ভুলেই গেছে, মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বাবাদের উচ্চ স্বরে কথা বলতে নেই। উনি তবুও মুখে হাসি টেনে বললেন, “দুঃখিত আপা! আসলে, মেয়েটাকে কতক্ষণ দেখি না। তা আপনি, কেমন আছেন আপা?”

রেহনা বেগম ভেংচি কাটলো, এদের সাথে কথা বলতেও রুচিতে বাঁধে তার। বড়সড় পা ফেলে চলে যেতে নিলো গেলো শিখার ঘরটার দিকে। মনিরুলের হাতে ব্যাগ দেখে দাঁড়িয়ে গেলে, এগিয়ে তাকে একবার আগাগোড়া পরখ করে বললেন, ভালোই আছি। তা ব্যাগে করে কি এনেছেন।”

মনিরুল নিজের হাতের ব্যাগটা এগিয়ে দিলো উনার হাতে। রেহেনা বেগম তড়িঘড়ি করে ব্যাগটায় উঁকি দিখলো, দুই কেজির সচতা মিষ্টি। চোখ মুখ কুঁচকে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে বললেন, “এসব কম দামী মিষ্টি আমাদের খাওয়া হয় না। যাওয়ার সময় সাথে করে নিয়ে যাবেন এগুলো।”

লজ্জায় অপমানে গা- গুলিয়ে আসছে তার। শখা মেয়েটা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বাবা’কে বললেন, “আব্বা চলো আমরা চলে যাই।”

তবুও বাবা নড়লো না, পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো মেয়েটাকে এক নজর দেখার জন্য।

শিখা মেয়েটা সারাদিন পর বিছনা পেয়ে ক্লান্তিতে চোখ লেগে গিয়েছে তার। সে আরামসে ঘুমাচ্ছে। আযান বাসায় নেই। সকালে খেয়ে যে নিজের কাজে বেড়িয়েছি আর খোঁজ নেই তার।
রেহনা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে ঠকঠক আওয়াজ করে বললেন, “বউমা? তোমার বাবা-বোন এসেছে।”

বাবা এসেছে,শুনে ঘুম ছুটে যায় তার। আনন্দে লাফিয়ে উঠলো শিখা। পরক্ষণে পিছন থেকে শ্বাশুড়ি বলে উঠলো, “কিছু খাইয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করো এদের। গোষ্ঠী সুদ্ধ সব হাজির।”

মুখটা চু’প’সে যায় মেয়েটার। শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন, ” আমার বাবা আজই প্রথম আসছে মা। তাও আপনার সহ্য হলো না।”

শিখা শ্বাশুড়ির উওরের অপেক্ষা করলো না। ছুটে গেলো বাবা-বোনের কাছে।মেয়ের পড়নে দামী শাড়ী, গহনা দেখে পরাণ জুড়ালো বাবা’র। মেয়ে তার সুখেই আছে স্বামীর সংসারে। কত সুন্দর লাগছে তার মেয়েটাকে। দু’হাতে মেয়ে’কে বুকে আগলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস আম্মা?”

শিখা সব চেপে একগাল হেসে বললেন, “ভীষণ ভালো আছি আব্বা।”

স্বঃস্তি শ্বাস ছাড়লো বাবা। শিখা খেয়াল করলো, বাবা-বোনের মুখ শুকনো। নিশ্চয়ই তারা কিছু খায়নি। শিখা টেবিলে খাবার দিলো। কিন্তু খেলো না বাবা।এক গাল হেসে বললেন, ” আমরা খেয়ে আসছি মা।”

বাবা আর দাঁড়ালো না। ছোট্ট মেয়েটার হাত চেপে বেরিয়ে গেলো। শিখা বাবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

“বাবা তুমি তোমার মেয়েকে বড় ঘর দেখে বিয়ে দিলে। কিন্তু, এ ঘরে যে তোমার মেয়ের সম্মান নেই,তোমার কোনো দাম নেই। এই বড়ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বাবা। এর চেয়ে আমি তোমার ভা’ঙা কুটিরেই সুখে ছিলাম। এই ঘর কি আমায় আদৌও সুখি করতে পারবে বাবা?”
.
.
বিয়ের পনেরো দিন যেতে না যেতেই সব কাজের দায়িত্ব চাপলো তার উপর। বয়স কম, এতো বড় সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মেয়েটা। শ্বশুর বাড়ি পা রাখতেই যেন বড় হয়ে গেলো সে। সবার আগে হারিয়ে ফেলছে তার চঞ্চল তা! এখন অবুঝ কন্যা বুঝতে শিখেছে কতকিছু! এতো বড় ঘরও তাকে সুখী করতে পারলো না। সুখের এতো দাম! স্বামী নামক লোকটা দিয়েও তার ভাগ্যে সুখ দেয়নি বিধাতা। মানুষটা যে পুরোপুরিই মা ভক্ত। কোনটা অন্যায়, কোনটা সঠিক, এ যেন চোখেই পড়ে না তার। তবে রাত হলেই শরীর ছোঁয়ার নাম করে, মেয়েটাকে একটু হলেও ছুঁয়ে দেয় আযান। ইতিহাস সাক্ষী, স্ত্রীর প্রতি দায়িত্বহীন পুরুষ দিয়ে কোনো মেয়ে আজ অবধি সংসারে সুখী হয়নি।

তবুও মেয়েটা হন্যে হয়ে একটু খানি সুখ খুঁজছে, খুঁজে যাচ্ছে তাদের ভালোবাসা। মস্তিষ্কের মাঝে গেঁথে নিলো, “শ্বাশুড়ির মন জয় করতে পারলেই তার স্বামী তাকেও ভালোবাসবে।”

এই বাক্যটা মেনে নিয়ে, যথারীতি চেষ্টা করছে সবকিছু সামলাতে। রাত দিন এক করে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে এই সংসারকে। তবুও কেন জানি এই সংসারে অবহেলিত মেয়েটাই শিখা। এ বাড়িতে তাকে কেউ বউ করে আনেনি যেন, এনেছে কাজের মেয়ে। যার কোনো ক্লান্তি নেই, নেই কোন অবসর।

চলবে……

আজল পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0

#আজল
#অন্তিম পর্ব

৪১.

পরেরদিন ওরা গেছিলো সেন্টমার্টিন। দু’দিন সেখানে কাটিয়ে রাতে হোটেলে ফিরলো ওরা। হাসি আনন্দে কেটে যাওয়া দু’টো দিন, সবারই মনেহয় মনে থাকবে এই দুই দিনের স্মৃতি! বিশেষ করে সাঁচি কোনদিনও ভুলবে না। শেষ দিনে সবাই মিলে সমুদ্রে নেমেছিলো ওরা। সেফ জায়গা দেখেই নেমেছিলো। সাঁচির আবার একটু পানি ভীতি আছে। ও সহজে নামতে চায় না পানিতে। সবার পীরাপীরিতে পানিতে নেমেছিলো। গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা, ছবি তোলা, এসব করতে গিয়ে কখন যে সমুদ্রের একটু গভীরে চলে গেছে টের পায়নি সাঁচি। হঠাৎ এক বড় ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সাঁচিকে বেশ অনেকখানি দূরে। সবাই আনন্দে এতোই মশগুল ছিলো যে কিছুই টের পাচ্ছিলো না। সাঁচির গগনবিহারী চিৎকার শুনে সবার হুশ আসলো। সবার মধ্যেই কান্নার রোল পড়ে গেলো। সাঁচি ভেসে যতদুর গেছে সেটা সাঁতার জানা কারো জন্য ব্যাপার না। কিন্তু ও যেহেতু সাতার জানে না তাই ভয়েই ও তলিয়ে যাচ্ছিলো। ফুয়াদ আর তানভীর দুজনেই ছুট লাগালো।তানভীরের আগেই ফুয়াদ পৌঁছে গেলো। অনেককষ্টে সাঁচিকে টেনে তুললো পানি থেকে। কোলে করে তুলে নিয়ে আসলো পানি থেকে। ভয়েই জ্ঞান হারিয়েছে সাঁচি। ফুয়াদ ওকে হোটেলে নিয়ে এলো। অনেক কষ্টে খুঁজে একজন ডাক্তার পাওয়া গেলো। ডাক্তার যখন আস্বস্ত করলো তেমন সিরিয়াস কিছু না তখন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস নিলো। সাঁচির এই অবস্থায় কেউই আর আনন্দ করতে পারলো না। তল্পিতল্পা গুটিয়ে দ্রুত কক্সবাজার ফিরে এলো। এই ঘটনার পর থেকেই সাঁচি আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। সবাই বেড়াতে গেলেও ও যায় না। বেচারীর ভয় এখনো কাটেনি। ঘোরের মধ্যে আছে এখনো। বাধ্য হয়ে ফুয়াদকেও থাকতে হয় ওর সাথে।

আরো একদিন পর সকালে নাস্তা সেরে চা খেতে খেতে প্রিয়তা আর সাঁচি গল্প করছিলো।
“ভাবি, তুমি কি ঠিক আছো?”
“হুম,ঠিক আছি তো? কেন?”
“না মানে, এতো চুপচাপ থাকো? কোনো কি সমস্যা হয়েছে? তোমার এই অবস্থা দেখে ভাইয়া বেচারা তো আরো চুপসে গেছে। সেদিন যদি তুমি ভাইয়াকে একবার দেখতে? তোমার অবস্থা দেখে পুরো পাগল হয়ে গেছিলো। ও নিজে কিন্তু সাঁতার জানে না অথচ কিভাবে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে তোমাকে বাঁচালো? ভাবি, ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালোবাসে গো। ওকে আর কষ্ট দিয়ো না!”
“কক ক কি কষ্ট দিচ্ছি? কি বলো এসব?”
তোতলায় সাঁচি।
“শোনো ভাবি, তোমাদের ব্যাপারটা কিন্তু সবাই বুঝতে পারছে গো? ”
“সত্যি?
অস্ফুটে চিৎকার দিলো সাঁচি। প্রিয়তা মাথা নাড়ে।
“মিথ্যে বললাম। শোনো, আমি জানি না কেউ বুঝেছে কিনা তবে আমি আর তানভীর বুঝতে পেরেছি। তানভীর ই অনুমান করেছিলো। অবশ্য কেউ খুব খেয়াল না করলে বুঝবে না। সো টেনশন করো না, আমি কাউকে বলবো না।তবে শর্ত হলো,দুজনাই তাড়াতাড়ি প্যাচআপ করে নাও। এবং সেটা এই ট্রিপেই হওয়া চাই, বুঝলে?”
সাঁচি আর কিছু বলতে পারে না। লজ্জায় গাল লাল করে বসে থাকে। ওর আর ফুয়াদের ব্যাপারটা প্রিয়তা বুঝে এগেছে এটা ভাবতেই ওর লজ্জা লাগছে।

হঠাৎ প্রিয়তা প্লান করলো বার্মিজ মার্কেটে যাওয়ার। সবার জন্য কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। বসে থাকতে কারোরই ভালো লাগছিলো না, তাই সবাই রাজি হয়ে গেলো। এবার প্রিয়তা জোর করে সাঁচিকে সাথে নিলো। সাঁচি যথারীতি একটা নরমাল সুতি শাড়ী পড়লো আর ফুয়াদ আজ একটা ডার্ক চকলেট কালার শার্ট পরেছে অফ হোয়াইট গ্যাভারডিনের সাথে। হঠাৎ সাঁচির চোখ ফুয়াদের উপর পড়তেই যেন চোখ ধাঁদিয়ে গেলো সাঁচির। এতো সুন্দর লাগছে ফুয়াদকে,ওর উজ্জ্বল শ্যামবর্নে শার্টটা একেবারে ফুঁটে রয়েছে যেন। অনেকক্ষণ ধরে মনেহয় সাঁচি তাকিয়ে ছিলো ফুয়াদের দিকে, তাই ওর ডাক শুনতে পাচ্ছিলো না। বাধ্য হয়ে ফুয়াদ সাঁচির কাছে এসে তুরি বাজালো-
“এই যে ম্যাডাম, মুখটা বন্ধ করো তো, মশা ঢুকবে?”
সাঁচি থতমত খায়, ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় দ্রুত মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে। ওর পাশে বসে ফুয়াদ শীষ বাজাতে থাকে। আজ যেন একটু বেশিই খুশি ফুয়াদ। আজ কি কোনো বিশেষ দিন নাকি?

কেনাকাটা সারতে সারতে বিকেল হলো ওদের। হোটেলে ফিরেই বাবা মায়েরা সবাই ঠিক করলো আজ রাতেই সবাই ঢাকায় ফিরে যাবে। শুনে সাঁচির একটু মন খারাপ হলো। ও তো ঘুরতেই পারলো ঠিকমতো! ভেবেছিলো আরো কিছুদিন থাকবে। তখনই ফুয়াদের বাবা বললেন যে, ফুয়াদ আর সাঁচি আরো কয়েকদিন থাকবে এখানে। সাঁচি যেহেতু অসুস্থ ছিলো এতোদিন প্লাস ওর সাথে ঘটে যাওয়া ইন্সিডেন্ট এর কারণে দুজনে ভালোমতো এনজয় করতে পারেনি তাই এই ব্যবস্থা। সাঁচি ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখলো ফুয়াদ নির্বিকার ভঙ্গিতে মোবাইল গুতোচ্ছে। ভাব দেখেতো মনেহচ্ছে কিছু শুনতে পাচ্ছে না! ঢং, যতসব! সাঁচি মনে মনে ভেংচি কাটে।
সন্ধার পর থেকে সাঁচি শাশুড়ী মায়ের লাগেজ গুছাতে হেল্প করছিলো। ওটা শেষ হতেই মা ডাকলো, তারপর প্রিয়তা।
“ভাবি তোমাকে একটা গোপন কথা বলার আছে!”
“কি বলো?”
“আজ রাতে ভাইয়ার জন্মদিন গো। তুমি মনেহয় জানোনা? আর ভাইয়াও তোমাকে বলতে নিষেধ করেছিলো। ”
“সত্যি? ”
অবাক হয়ে চেচিয়ে উঠলো সাঁচি। এইজন্যই এতো নির্বিকার বসে ছিলো ফুয়াদ। প্রিয় যেন সাঁচির মনের কথা পড়তে পারলো। তাই বলে দিলো-
“ভাইয়া কিছু জানে না গো। বাবাকে দিয়ে বলানো আমার প্লান।”
বলে উঠে গিয়ে খাটের উপর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো। সাঁচির হাতে দিয়ে বললো-
” আজ রাতটা যেন ভাইয়ার জীবনের বেস্ট রাত হয়, ভাবি। আর এবারের জন্মদিনটাও যেন ওর জীবনের বেস্ট জন্মদিন হয়? আমরা যখন নিচে নেমে যাবো, ভাইয়াকে সাথে নিয়ে যাবো, এরমধ্যে তুমি তৈরী হয়ে নিও। আজ আর কোনো দ্বিধা আসতে দিয়ো না মনে। আমার এটা অনুরোধ তোমার কাছে। এই বেলায় যদি প্যাচআপ না করো তবে কিন্তু ভাইয়া ভীষণ কষ্ট পাবে।”
সাঁচি যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। নড়তে চড়তে ভুলে গেছে। ইস! কি লজ্জা! ছোট বোনের কাছে!
“লজ্জার কিছু নেই ভাবি! এরকম তো হতেই পারে, তাইনা? আমি তো তোমার বোনই, আমার কাছে লজ্জা পেয়োনা?”
সাঁচি প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে। আজ আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না।
“ভাবি আজ কিন্তু আমার কথা শুনিও। তোমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চলেছে। বুঝেছো?”
সাঁচি মাথা নাড়ে। কি করবে কিছুই ভাবতে পারছে না। মনে মনে নিজেই নিজেকে বলছে-
“নিজের মগজ আজ নাই বা খাটালাম? আজ প্রিয়র কথাটাই না হয় মেনে নেই? অন্তত ফুয়াদ যে ওর জীবন বাঁচিয়েছে সেই হিসেবেও তো ও মনেহয় একটা চান্স ডিজার্ভ করে! ”

৪২.

প্রিয়তার দেয়া শাড়ীটা পড়তে যেয়েও পড়লো না সাঁচি। বরং ফুয়াদের দেয়া সোনালী কাজের শাড়ীটা বের করলো লাগেজ থেকে। খুব যত্ন নিয়ে শাড়ীটা পড়ে নিজেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজালো আজকে। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে সাজটা কমপ্লিট করলো। তারপর যখন প্রিয়তার রুম থেকে ওদের রুমে ঢুকে বাতি জ্বালালো চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো সাঁচির। পুরো রুমটা সাজানো গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। পাপড়ি গুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব দেখে হাত পা ঘামতে লাগলো সাঁচির। প্রিয় এই কারনেই তবে বলেছিলো যেন ওরা গেলে রুমে আসে সাঁচি। এখনো ধাতস্ত হয়নি সাঁচি, এরই মধ্যে রুমের দড়জায় নক। সাঁচি দড়জা খুলে সরে দাঁড়ালো। ফুয়াদও রুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে গেলো। বোকার মতো মুখ করে বললো-
“একি,এগুলো কে করেছে? সাঁচি আমি কিন্তু এসবের কিছুই জানি না। প্লিজ, তুমি আবার আমাকে ভুল বুঝো না?”
“জানি, আপনি করেননি! প্রিয়র কাজ এসব।”
“যাক, বাবা তুমি যে আমাকে ভুল বেঝোনি এতেই আমি খুশি।”
বলেই সাঁচির দিকে তাকালো। এবং অবাক হয়ে খেয়াল করলো, সাঁচি অনেকটাই বউদের মতো ওর দেয়া সোনালী শাড়ীটা পড়েছে, চুল ছেড়ে দেয়া গাড় সাজের সাঁচিকে নববধূর মতো সুন্দর লাগছে। ফুয়াদ হা করে সাঁচিকে দেখছে। মানে কি? সাঁচি ওর উপহার দেয়া বিশেষ শাড়ীটা কেন পড়েছে? ও কি তবে মেনে নিয়েছে আমাকে? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে ফুয়াদ। উত্তর তো সাঁচি দিতে পারবে।
সাঁচি মনেহয় অনেকক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছিলো। শেষে গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে হলো-
“এই কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
“আর তোমার এই সাজ? এটাও কি প্রিয়….”
সাঁচি মাথা নাড়ে-
” চা খাবে? ”
কথা ঘুরায় সাঁচি।
“কোথায় চা?”
এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে ফুয়াদ।
“বারান্দায় আছে। প্রিয় বলে গেছে।”
লাজুক স্বরে সাঁচি বলে।
“বোন আমার খুব কাজের দেখা যাচ্ছে? ”
মুচকি হাঁসে ফুয়াদ।
দুজনে বারান্দায় এসে বসে। আজও জোছনা কিন্তু আকাশ মনেহয় মেঘলা। চাঁদটাকে পরিপূর্ণ দেখা যাচ্ছে না। সেই আলো আধারির মাঝে সাঁচি যেন অপ্সরী। ফুয়াদ বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে আজ। ঐ অবস্থায় চায়ে চুমুক দেয়। একবারের জন্যও পলক ফেলে না ফুয়াদ। হঠাৎ বলে-
” আজ একটা কবিতা শোনাতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। শোনাবো? ”
সাঁচি মাথা নাড়ে।
ফুয়াদ সাঁচির মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আবৃতি করতে থাকে-

★কি করছো?
– ছবি আকঁছি।
– ওটা তো একটা বিন্দু।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই বৃত্ত হবে। কেন্দ্র হবে তুমি। আর আমি হবো বৃত্তাবর্ত।
– কিন্তু আমি যে বৃত্তে আবদ্ধ হতে চাই না। আমি চাই অসীমের অধিকার।
– একটু অপেক্ষা করো। . . . এবার দেখো।
ওটা কি? ওটা তো মেঘ।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই আকাশ হবে। তুমি হবে নি:সীম দিগন্ত। আর আমি হবো দিগন্তরেখা।
– কিন্তু সে তো অন্ধকার হলেই মিলিয়ে যাবে। আমি চিরন্তন হতে চাই।
– আচ্ছা, এবার দেখো।
– একি! এ তো জল।
– তুমি ছুঁয়ে দিলেই সাগর হবে। তিনভাগ জলের তুমি হবে জলকন্যা। আর আমি হবো জলাধার।
– আমার যে খন্ডিতে বিশ্বাস নেই। আমার দাবী সমগ্রের।
– একটু অপেক্ষা করো। এবার চোখ খোল।
– ওটা কি আঁকলে? ওটা তো একটা হৃদয়।
– হ্যাঁ, এটা হৃদয়। যেখানে তুমি আছো অসীম মমতায়, চিরন্তন ভালোবাসায়। এবার বলো আর কি চাই তোমার?
– সারাজীবন শুধু ওখানেই থাকতে চাই।★

“আমিও! আমিও তোমার হৃদয়ে থাকতে চাই সারাজীবন। ”
আনমনেই বলে ফেলে সাঁচি। বলেই জিব কাটলো সাঁচি। কি বলে ফেললো? কবিতা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে যেন মনের কথাটাই বলে ফেলেছে?
আর এদিকে সে কথা শুনে ফুয়াদ হাসছে মিটিমিটি। সাঁচি কথা ঘোড়াতে জিজ্ঞেস করে-
“কয়টা বাজে?”
“এই তো, বারোটা বাজলো প্রায়।”
“উইশ ইউ এ ভেরি হ্যাপি বার্থডে। হ্যাপি বার্থডে, ডিয়ার হাবি।”
নার্ভাস হয়ে ফুয়াদকে উইশ করে দেয় সাঁচি।
“থ্যাংকু। বাট শুধু উইশে কাজ হবে না, গিফট কোথায় আমার? একটা কেকও তো আনোনি?”
“এই যা, ভুল হয়ে গেছে? এখন কি করবো? তুমি বলো কি চাই তোমার? কাল কিনে দেবো!”
“উহু, নগদ চাই, বাকির কোনো কারবার নাই।”
“বেশ তো বলোনা, কি চাই?”
“তোমাকে! তোমাকে! তোমাকে! দেবে না? আজকে চিরদিনের মতো আমার হওয়ার জন্য তোমাকে চাইছি সাঁচি! হবে কি আমার?”
লজ্জায় লাল,নীল,বেগুনি হতে হতে অনেকক্ষণ পড়ে সাঁচি মৃদু স্বরে বলে-
“তো নাও। আমিও যে চাইছি আজ তোমার হতে!”
ফুয়াদ ততক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘাবরে যেয়ে সাঁচিও দাঁড়িয়ে যায়। ফুয়াদ এগিয়ে আসে সাঁচিও পিছিয়ে যায় আনমনেই। এবার ফুয়াদ একপা এগিয়েই সাঁচিকে হাত দিয়ে ধরে টান দেয়, বুকের উপর আনে-
“এবার?”
“কি?”
“চোখ বন্ধ করো?”
“কেন?”
“বোকা মেয়ে! আদর করবো তোমায়! লজ্জা পাবে না? তাই আগেই চোখ বন্ধ করতে বললাম।”
সাঁচি সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলে। ফুয়াদ আজকে রয়ে সয়ে নয়,একেবারে জবরদখল করতে চাইছে যেন! সাঁচির ঠোঁট দু’টো নিমিষেই দখল করে নিলো। দখল দারিত্বে মরিয়া ফুয়াদ আজ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। সাঁচি ব্যাথায় আহ! আওয়াজ করতেই তার হুশ হলো। সে তখন ঠোঁট ছেড়ে অন্য কিছু দখলে বেশি মনোযোগী।
“আহ! কি করছো? ব্যাথা পাচ্ছিতো। একটু আস্তে? ডাকাত একটা!”
সাঁচির কাতর স্বর শোনা যায়।
” এতদিন তো ভদ্রলোক ফুয়াদকে দেখেছো, এবার একটু দস্যু ফুয়াদকেও দেখো!”
বলতে বলতে কোলে তুলে নেয় সাঁচিকে। রুমে এসে আলতো করে ফুলেল বিছানায় নামিয়ে দেয় সাঁচিকে। সাঁচি লজ্জায় মুখ ঢেঁকে শুয়ে থাকে। ফুয়াদ সাঁচির হাত দু’টো টেনে নেয়, দু’হাতে তার হাত দুটো ঢুকিয়ে নেয়, ফিসফিস করে ডাকে সাঁচিকে-
“তাকাও আমার দিকে?”
সাঁচি আধো আধো লাজুক চোখে ফুয়াদের দিকে তাকায়। ফুয়াদ সেই চোখে চোখ রেখে বলে-
“বউ, ভালোবাসি তোমাকে, অনেক অনেক ভালোবাসি। ”
“আমিও তোমাকে…..”
“কি?”
“ভালোবাসি…”
ফিসফিসিয়ে সাঁচিও উত্তর দেয়।

এরপর ওরা যখন একে অপরের মাঝে ডুব দিচ্ছিলো,আকাশেও যখন মেঘ সরে গিয়ে চাঁদটা দৃশ্যমান হচ্ছিল! তখন ওদের জীবনেও মান অভিমান, ভয় ভীতির মেঘ সরে গিয়ে ভালোবাসার আলো ছড়িয়ে পড়ছিলো।

পরিশিষ্টঃ মাস ছয়েক পর একদিন সাঁচি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে-” এই আমি যাবো না প্লিজ। তোমায় একা রেখে।”
“বউ,কেন জেদ করছো? মালয়েশিয়া কি অনেক দূর? আমি সুযোগ পেলেই চলে যাব আর সেমিস্টারের ব্রেকে তুমিও চলে আসতে পারবে। কেন এমন করছো বলোতো? মাত্র তো এক বছর! এতদিনের স্বপ্ন এভাবে নষ্ট হতে দেবে?”
সাঁচি মন খারাপ করে বসে থাকে। কি করতে যে এ্যাপ্লাই করেছিলো? এখন মাথার চুল ছিরতে ইচ্ছা হচ্ছে। আসলে সাঁচি মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স এ ফুল ফ্রি স্কলারশিপ পেয়েছে। এক বছর থাকতে হবে তাই এখন যেতে চাচ্ছে না। আজই ওর ফ্লাইট। ফুয়াদ ওর পাশে এসে বসলো-
“আচ্ছা, বলোতো! বাচ্চারা যখন আমায় বলবে যে, মাম্মাকে তুমি পড়তে দাওনি কেন? তখন কি জবাব দেবো বলোতো?”
“বাচ্চা? কোথা থেকে আসবে?”
“কোথা থেকে আবার? তোমার পেট থেকে, গাধী? মানে ভবিষ্যতে ওরা যখন এই পৃথিবীতে আসবে তখন ওরা যদি বলে, তুমি তো তখন আমাকেই দোষী বানাবে,তাই না?”
“ও, তাহলে এইজন্য পাঠাতে চাচ্ছো?”
ঠোঁট ফুলায় সাঁচি।
“এই একদম ঠোট ফুলাবে না! খেয়ে নেবো একদম বলে দিলাম? এই পাগলি, এটাতো তোমার স্বপ্ন ছিলো, একটা বিদেশি ডিগ্রি। মানুষ সুযোগ পায়না, আর তুমি সুযোগ পেয়েছো,কাজে লাগাবে না? আর আমি তো কথা দিয়েছিলাম, তোমার সব শখ আহলাদ পূরন করবো। কথা রাখতে হবে না?আচ্ছা যাও, এবার পড়া শেষ করে আসলে আমরা বেবির জন্য ট্রাই করবো, ঠিক আছে?”
শেষের কথাটা কানে কানে ফিসফিস করে ফুয়াদ।
লজ্জা পায় সাঁচি। ফুয়াদের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে-
“সত্যি তো?”
“হুম, সত্যি! এবার জটপট তৈরি হও তো,তা না হলে কিন্তু ফ্লাইট মিস হবে।”

প্লেনটা যখন বাংলাদেশের সীমানা ছাড়ছিলো তখন সাঁচি আকাশের মেঘেদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো, অপেক্ষা শব্দটা এতোটাও খারাপ না। কোনো ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করাতেও সুখ আছে,সেটা কেবল পাওয়ার পরই বোঝা যায়। সাঁচি সেই মুহূর্তে প্রিয় পুরুষ টিকে পাশে নিয়ে একটি সুন্দর পৃথিবী কল্পনা করছিলো। যে পৃথিবীতে ওর কোলে ফুটফুটে এক রাজকুমারী অথবা রাজকুমার খেলা করছিলো। সাঁচি, ফুয়াদ আর ওদের বাবুরা! একটু বেশিই সুন্দর ওর স্বপ্নটা! দোয়া রইলো এই সুন্দর জুটির জন্য!!! নতুন এক সাঁচি অথবা নতুন এক ফুয়াদ এই পৃথিবীতে আসুক,আরো একটি নতুন গল্পের জন্ম হোক এটাই কামনা!!!!!

সমাপ্ত।
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-২২

0

#আজল
#পর্ব-বাইশ

৩৯.

ফুয়াদের বাবা আর মা সমুদ্রের ধারে একটা রিলাক্সিঙ বেঞ্চে বসে নিজের ছেলে মেয়ে দু’টো কে দেখছিলেন। তখনই ফুয়াদের মা বলে উঠলো-
“প্রিয়কে আজকাল একটু বেশিই হাসিখুশি লাগে,দেখছো। চেহারা যেন ফুটে ফুটে বের হয়।”
শুনে একটু মুচকি হাসে আজমল সাহেব।
“প্রিয় কিছু বলছে?”
“কি বলবে?”
“এই যে, এতো খুশি কেন?”
“হুম, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম। বললো, তোমার জামাই ভালো হয়ে গেছে। আমাকে এখন অনেক কেয়ার করে। দোয়া কইরো আম্মা।”
খুশিতে চোখ মুছে ফুয়াদের মা।
“ছেলেরে নিয়া চিন্তা হয় গো? কেমন জানি মনে হয়, দু’জনের মধ্যে কিছু হইছে?দেখলে কেমন জানি ছাড়া ছাড়া লাগে?”
“আরে, এতো চিন্তা কইরো নাতো। ফুয়াদ ঠান্ডা মাথার ছেলে ওকে নিয়ে আমার চিন্তা নাই।”
“আগে তো খালি ছেলেকে মারতা কথায় কথায়। এখন ছেলে ভালো?”
“শাসন টা করছিলাম বইলাই তো এখন ভরসা করতে পারি। ওদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থাকেও তবুও আমার বিশ্বাস দুইজনে মিলে ঠিক করে নিবে।”
“হুম, সেইটাই যেন হয় গো?”
“সেই রকমই হবে। তুমি এতো চিন্তা কইরো না। আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বলো না?”
“তোমার কি আমাকে নিয়ে কোন অভিযোগ আছে? তুমি কি সুখি আমার সাথে?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফুয়াদের মা। কি বলে মানুষটা। যখন বিয়ে হচ্ছিল না, একের পর এক বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিলো তখন এই লোকটা বিয়ে করেছিলো তাকে। হ্যা সংসারে উনার কথাই শেষ কথা ছিলো কিন্তু অবজ্ঞা তো করেনি কখনো। তাই কখনো লোকটাকেও অবজ্ঞা করার কথা মনেই আসেনি। লোকটার যে স্বভাব টাই এমন। সুখে দুখে,কষ্টে আনন্দে ত্রিশ বছর একসাথে কাটিয়ে দিলেন। সময় কিভাবে গেলো টেরই পেলেন না। তিনি লজ্জিত হয়ে জবাব দিলেন-
“আলহামদুলিল্লাহ, তোমার সাথে অনেক সুখের একটা জীবন পার করছি। আর তাছাড়া ছেলেমেয়ে সুখে আছে এর বেশী আর কি চাই?”
আজমল সাহেব বউয়ের দিকে তাকিয়ে বেশ তৃপ্তির একটা হাসি দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দূরে সাগরের পানে চেয়ে রইলো।

৪০.

রাতে হোটেলে ফিরে সবাই রাত বারোটায় প্রিয়র ম্যারেজ এনিভারসারির কেক কাটার জন্য তৈরী হচ্ছিল। ফুয়াদ ওর লাগেজ থেকে নিজের পোশাক বের করছিলো আর আড়চোখে সাঁচিকে দেখছিলো। সাঁচি কোনো কথা বলছে না ওর সাথে। মেয়েটার মনে কি চলছে?এখনো কেন এরকম অসহযোগিতা মুলক আচরন করছে? ফুয়াদ কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছে-
“সাঁচি, তুমি কি আমার দেওয়া শাড়ী গুলো এনেছিলে?”
সাঁচি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো ফুয়াদের দিকে-
“হ্যা,এনেছি তো?”
“তাহলে প্লিজ আজকে তুমি অফ হোয়াইট জামদানী শাড়ীটা পড়বে? প্লিজ! এটা তোমার পচ্ছন্দের রং, আমি জানি। ”
সাঁচি কিছু না বলে শাড়িটা নিয়ে বাথরুমে যেতে চাচ্ছিলো।
“কোথায় যাও?”
“ওয়াশরুমে। শাড়ি পরবো?”
“এখানে পড়ো। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
ফুয়াদ দরজা চাপিয়ে চলে যায়। সাঁচি শাড়িটা পড়ে নেয়, আয়নায় নিজেকে দেখে। বেশ সুন্দর লাগছে। সাঁচি চুলগুলো সাট করে আঁচরে পিঠে ছড়িয়ে দিলো। চোখে একটু হালকা কাজল দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতেই যাবে তখনই ফুয়াদ দরজায় নক করলো। সাঁচি দড়জাটা খুলে দাঁড়ায় একপাশে। ফুয়াদ ওকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। ইস কি সুন্দর লাগছে সাঁচিকে? একেবারে সাদা পরি যেন! মনে হয় যেন নজর টিকা লাগিয়ে দিই! ভাবতে ভাবতে সাঁচির চোখের কোনা থেকে একটু কাজল নিয়ে ঘারে লাগিয়ে দিলো। সাঁচি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ মৃদু হেসে বললো-
“এতো সুন্দর লাগছ যে ভয় হচ্ছে পাছে কেউ নজর না লাগায়? তাই নজর টিকা দিয়ে দিলাম।”
সাঁচি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। প্রশংসা কার না ভালো লাগে?
“কিন্তু বউ, চুল খোলা রেখেছো কেন? রাতের বেলা চুল খোলা রাখতে নেই। বেনী অথবা হাত খোঁপা করে নাও একটা।”
বলে ফুয়াদ নিজের কাপড় পাল্টাতে চলে যায়। ফিরে এসে আরেক প্রস্থ অবাক হয়। ইস মেয়েটা এমন করে পাগল বানাতে চাচ্ছে কেন ওকে? সেই যে বিয়ের পর পর সাঁচি এরকম করে সেজে থাকতো আর ফুয়াদ না দেখার ভান করতো। আজ যেন সেইসব দিন ফিরে আসছে। কিন্তু এখন তো ইগনোর করা যাচ্ছে না! এতো বড় গলার ব্লাউজ কে পড়তে বলেছে ওকে? মেয়েটা নিশ্চয়ই ওকে পরীক্ষা করছে? সেই সব সময়ের শোধ তুলছে নিশ্চয়ই! সাঁচি হাত খোপা করে শেষ মুহুর্তে এসে একটু হাল্কা করে লিপস্টিক দিচ্ছিলো। ফুয়াদ সেটা হাত থেকে কেড়ে নিলো। সাঁচি দু হাত ঝেরে প্রশ্ন করলো-
“কি হলো?”
“এটা দেওয়া লাগবে না। একটু লিপজেল দিয়ে নাও তাতেই হবে। আর ব্লাউজের গলা এতো বড় কেন? সবাইতো তোমার ঐ খোলা পিঠের দিতে তাকিয়ে থাকবে এখন। এসব সৌন্দর্য দেখার অধিকার তো শুধু আমার হওয়া উচিত, অন্য কেউ কেন দেখবে?”
বলেই শাড়ির আঁচল টা তুলে পিঠ ঢেকে দিলো। চট করে কপালে একটা চুমু দিয়ে দিলো।
“চলো। সবাই নিচে চলে গেছে, আমরাই লেট।”
” হুম ঢং হচ্ছে এখন? ফরহেড কিস, আঁচল দিয়ে পিঠ ঢেকে দেয়া, খুব ঢং হচ্ছে এখন। এতোদিন তো ফিরেও চাইতো না। তোমার জিনিস অন্য কেউ কেন দেখবে?”
মনে মনে বলছে আর ভেংচি কাটছে ফুয়াদকে।
” খুব এসেছে আমার পত্নী ব্রতা পতি!”
বিরবির করে সাঁচি।
“কি হলো, এসো? আবার আঁচল সরিয়েছো? এবার সরলে কিন্তু ভালো হবে না? আর এর পর ব্লাউজ বানাবে গলা একেবারে ছোট দেবে বুঝলে?”
সাঁচি কোনে জবাব দেয় না ফুয়াদকে। নিচে এসে দেখে ওদের জন্যই ওয়েট করছে সবাই। একটু লজ্জা পেলো সাঁচি। সবাই কি না কি ভাবছে? ছি!
ওদের দেখা মাত্রই প্রিয়তা বলে উঠলো-
“দিস ইজ নট ডান, ভাবি। তুমি আবার লেট। কেক কাঁটতে পারছি না। এসো তাড়াতাড়ি। ”
হাত ধরে নিয়ে গেলো ওকে।

কেক কাঁটার পর্ব শেষ করে হালকা খাওয়া দাওয়া করে সবাই উপরে চলে গেলো। সাঁচি অবাক হয়ে দেখছে ওর বাবা মা যেন এবার বেড়াতে এসে নতুন জোড়া হয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে ছাড়া নড়ছেই না। মনেহচ্ছে ওনাদের নতুন বিয়ে আর হানিমুন পিরিয়ড চলছে। বেচারা ওর ভাইবোন দুটো প্রাচী আর রঞ্জু বাবা মায়ের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। দেখে সাঁচির হাসি পেলো। ও প্রাচী আর রন্জুকে ডাক দিতে যাচ্ছিলো তখনই কেউ ওর মুখ চাপা দিলো পিছন দিক থেকে। ফিসফিস করলো-
“আমি ফুয়াদ। কোনো আওয়াজ করো না। আমার সাথে এসো তো। ফুয়াদ সাঁচির হাত টেনে একপাশে সরিয়ে আনলো ওকে।
“চলো বিচে হাঁটতে যাবো!”
“এতো রাতে? ”
“হুম।”
“কিন্তু আমার ঘুম পাচ্ছে যে?”
ফুয়াদ কিছু না বলে ওকে টেনে নিয়ে গেলো। হোটেলের সাথে লাগোয়া বিচটুকু হোটেলের নিজস্ব… কাউকে দেখা গেলো না। সাগরের ঢেউয়ের আওয়াজ আর তার সাথে বহমান ঠান্ডা বাতাস, শরীরে কাঁপন ধরে যাচ্ছে। সাঁচি শিউরে শিউরে উঠছে। হঠাৎ পেছন থেকে ফুয়াদ ওকে জড়িয়ে ধরলো, পিঠে ফাঁকা জায়গাটাতে নাক ঘষছে, ছোট ছোট চুমু দিচ্ছে। সাঁচি সরে যেতে চাইলো,ফুয়াদ শক্ত করে দু’হাতে পেচিয়ে ধরলো সাঁচিকে-
“মানা করেছিলাম না আঁচল যেন না সরে? তবুও কথা শোনোনি, এখন সাজা দিচ্ছি। চুপচাপ নাও, বেশি নড়াচড়া করলে বেশি সাজা পাবে।”
“প্লিজ ছাড়ুন। এমন করলে আমি কিন্তু ভীষন রাগ করবো?”
সাঁচি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে।
“ইচ্ছে করছে না বউ! একদম ইচ্ছে করছে না ছাড়তে। তুমি দিন দিন এতো সুন্দর হচ্ছো কেন বলোতো? আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ। ”
বলতে বলতে ফুয়াদ ফটাফট আরো কয়েকটা চুমু দিয়ে আঁচল দিয়ে সাঁচিকে ঢেকে দিয়ে চুপচাপ দাড়ায় ওর সাথে-
“রাগ করলে? কিছু বলো?”
“কি বলবো? আমার আজকাল কথা বলতে ভালো লাগে না। বরং আপনি বলুন আমি শুনি।”
“শুনবে? সত্যি শুনবে তো?”
“হুম, বলুন।”
“আমাকে কি মাফ করা যায় না, সাঁচি? আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি, তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, তোমার মন ভেঙেছি! কিন্তু আমি তো মানুষ সাঁচি! ফেরেশতা না যে কোনো ভুল হবে না আমার। হয়ে গেছে ভুল, আর তারজন্য আমি সরিও তো বলেছি? এই যে গত একটা মাস আমি তোমার মন জয় করার জন্য যা কিছু করেছি তার কিছুই কি তোমার মন ছুয়ে যায় নি? মন থেকে আমাকে একটুও কি ভাবোনি? মানলাম আমি তোমাকে নয় মাস কষ্ট দিয়েছি, তার বদলে তুমিও কি আমাকে নয় মাসই কষ্ট দেবে, সাঁচি? আমাকে আর একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না?”
সাঁচি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না সাঁচি। ফুয়াদ আবার বললো-
“ছোটর থেকেই আমি মানুষটা এমন৷ আমি ভালোবাসা, রাগ কিংবা ঘৃনা কোনোকিছুরই ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারি না। সেটা কি আমার দোষ বলো? পৃথিবীতে সব মানুষ কি এক রকম হয়? আমি না হয় এতোদিন তোমায় ভালোবাসিনি কিন্তু এখন তো বাসি? তুমি কি একটুও বোঝো না? সাঁচি বলো না? প্লিজ কিছু বলো না?”
ফুয়াদ সাঁচির দুহাত জড়িয়ে ধরে। সাঁচি ফুয়াদের চোখের দিকে তাকালো। ওর চোখে পানি চিকচিক করছে। যে কোন সময় সেই পানি গাল বেয়ে পড়বে। সাঁচির খারাপ লাগলো একটু। প্রিয় মানুষের চোখে পানি! এটা কোনো ভাবেই সহ্য হচ্ছে না সাঁচির। পুরুষ মানুষ কাঁদলে ভালো লাগে না মোটেও।
“প্লিজ কাঁদবেন না! এটা আমার মোটেও ভালো লাগবে না যে কেউ আমার জন্য কাঁদছে। ”
ফুয়াদ চোখের পানিটুকু হাত দিয়ে মুছে নিলো।
“এসো না ঐ খানে বসি। একটু মন দিয়ে আমার কথা শুনো। ”
“চলুন, বসি।”
সাঁচির খারাপ লাগছিলো ফুয়াদের জন্য তাই সে না করলো না। ফুয়াদ কথা বলছে-
“তোমাকে একটা উদাহরন দেই। যদিও আমাদের মনের ক্ষেত্রে এমনটা ভাবা ঠিক না তবুও তুমি বুঝবে আমি কি বলতে চাইছি।”
“বলুন, শুনছি।”
“ধরো একটা গ্লাস পানিতে পরিপূর্ণ, এখন কি ঐ গ্লাসে নতুন করে আর পানি ঢালা যাবে?”
ফুয়াদ প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সাঁচির দিকে।
“এটা আবার কেমন কথা হলো? যেটা আগে থেকেই পানিতে পূর্ণ সেটাতে কিভাবে পানি ঢালা যাবে?”
“তাহলে কি করতে হবে?”
“গ্লাসে পানি ঢালতে হলে অবশ্যই আগে গ্লাস টা খালি করতে হবে। তারপর নতুন করে গ্লাসটাতে…. ”
“রাইট! নতুন করে পানি পূর্ণ করতে হবে, তাইতো? এখন তোমার যদি তেষ্টা না পায় তাহলে কি করবে? মানে ধরো, তোমার সামনে একটা পানি পূর্ণ গ্লাস রাখা আছে, কিন্তু তোমার তেষ্টা নেই,তাহলে…”
“সিম্পল, তেষ্টা না পেলে পানি খাবো না, পানি না খেলে গ্লাস ফাঁকা হবে না আর গ্লাস ফাঁকা না হলে নতুন করে গ্লাসে পানিও ঢালতে পারবে না। তাই তো ব্যাপারটা?”
সাঁচি মাথা নাড়ে।
“আমি তোমাকে ঠিক এই কথাটাই বোঝাতে চাইছি। এখন আমার মনটাকে তুমি ঐ পানিপূর্ণ গ্লাসের সাথে তুলনা করো, যেটা কারো ভালোবাসা কিংবা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে পূর্ন ছিলো। ওখানে আমি কিভাবে তোমাকে জায়গা দিতাম বলোতো?”
সাঁচি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে, বুঝতে পারছে ফুয়াদ কি বলতে চায়।
“তোমাকে পুরো ব্যাপারটা যখন বলতে পারলাম, বিশ্বাস করো খুব হালকা লাগছিলো নিজেকে। তোমার উপর নির্ভরতা বাড়ছিলো। তোমার জন্য তৃষ্ণা বাড়ছিলো। যখন বিদেশে ছিলাম তখন রেহনুমা আস্তে আস্তে ধুসর হতে শুরু করেছিলো। তখন কেবল তোমাকেই মনে পড়তো কারনে অকারনে। আমি ঠিক করেছিলাম যে,এবার দেশে ফিরে তোমার সাথে দুরত্বটা শেষ করবো। কিন্তু দেশে ফিরে তোমাকে কেমন যেন নিস্পৃহ পেলাম।আমার এই একটা স্বভাব, আমি কাউকে জোর করতে পারি না। তোমার সাথেও পারলাম না। হয়তো তখনও একটা কিন্তু রয়ে গেছিলো মনে, যার কারনে তোমায় জোর করিনি। যেটা পরবর্তীতে তুমি দূর করে দিয়েছো। রেহনুমার সাথে দেখা হওয়াটা জরুরী ছিলো বোধহয়। ও আমার সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে দিয়েছিলো। আমার যে আজল বা অতীত আমাকে পিছু টানছিলো, শেষ পর্যন্ত সেটাকে আমি ত্যাগ করতে পারলাম। সেও তো তোমারই কারনে! এখন আমার মনটা পুরোপুরি খালি আছ, ঠিক সেই গ্লাসটার মতো। এখন আমি আবার নতুন করে তৃষ্ণার্ত। তুমি কি আমার এই মনটাকে নতুন করে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করতে চাও,সাঁচি? আমাকেও কি নতুন করে ভালোবাসার সুযোগ দেবে আরেকবার?”
আবেগপূর্ণ চোখে কথাগুলো বলে সাঁচির দিকে তাকিয়ে আছে ফুয়াদ। শেষের কথাগুলো বলার সময় গলাটা ভীষন রকম কাঁপছিলো ফুয়াদের। সাঁচি কি বলবে ভেবে পায়না। মেনে নেবে সে? নাকি সেও ফুয়াদের মতো সময় গড়াতে দেবে? এইরকম মূহুর্ত কতো কল্পনা করেছে সাঁচি বিয়ের পর? ঠিক সে রকম একটা মূহুর্ত, বাস্তব! বিশ্বাস হয় না যেন? অন্যসময় হলে মনে হয় সেও ভেসে যেত ফুয়াদের সাথে। কিন্তু এখন? মানুষের মন যে কতটা বিচিত্র তা কি কেউ জানে? আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়ে গেলে খুব সমস্যা! এ দেয়াল টপকানো যায় না সহজে? সে যেন চাইলেও আগের সাঁচি হতে পারছে না? কি করবে? নিজের অপারগতায় নিজের ই কান্না পায় সাঁচির! তেষ্টা পায় না কেন ওর? কেঁদে ভেসে যায় সাঁচি। ফুয়াদ ভেবে নেয় ‘নিরবতা সম্মতির লক্ষন’। সে সাঁচিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।মাথায়, চুলে, পিঠে হাত বুলিয়ে নির্ভরতা জাগাতে চায়।আর সাঁচি অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত পাখির ছানাটা, ভেসে জেতে জেতে, ডুবে যেতে যেতে খরকুটোর আশ্রয় নিতে চায়! ফুয়াদের বাহুডোরে তার পুরুষালি বলিষ্ঠ বুকে আশ্রয় নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে উত্তর দেয় ,
“আমাকে একটু সময় দাও? আমার আত্মসম্মান এর দেয়ালটা ভাঙতে একটু সময় দাও, প্লিজ। আমি চাইছি তোমাকে ভালোবাসতে, তোমার ভালোবাসা গ্রহন করতে কিন্তু পারছি না। আমি কি করবো বলোতো?”
ফুয়াদের হাত থেমে যায়, সাঁচিকে একটু সামনে এনে ওর মুখের দিকে তাকায়, মুখ নিচু করে আছে মেয়েটা, কান্না চাপার চেষ্টায় ঠোঁটদুটো কাঁপছে তিরতির করে। ফুয়াদ আবারও গভীর মমতায় ওকে বুকে টেনে নিলো। মেয়েটার মাথাটা জোর করে ওর বুকে চেপে ধরলো –
“পাগলী, কোনে চাপ নেই, তুমি সময় নাও। শুধু এই খালি বুকে মাথা রেখে এটাকে পূর্ণ করে আমাকে শান্তি দাও। বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি একা থাকতে থাকতে। আপাতত এতটুকুই চাই তোমার কাছে। এতটুকু তো দিতে পারবে নাকি?”
সাঁচি মাথা নাড়ে। দু’হাতে আকরে ধরে ফুয়াদকে। ওর চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে ফুয়াদের বুক। যেন এই জলই ঝর্নাধারা হয়ে শীতল পরশ দিচ্ছে ফুয়াদকে…..

চলবে—–
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-২১

0

#আজল
#পর্ব-একুশ

৩৭.

বাপের বাড়িতে প্রায় মাসখানেক কাটিয়ে আজ নিজে বাসায় এসেছে সাঁচি। আসার ইচ্ছে ছিলো না যদিও কিন্তু ফুয়াদকে কথা দিয়ে ফেলেছে তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো। ফুয়াদের কাছে এতো তাড়াতাড়ি মাথা নোয়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না সাঁচির। যতই ভালোবাসুক ও ফুয়াদকে, তবুও সেটা নিজের আত্মসম্মান এর উর্ধে নয়। যতোটুকু আত্মসম্মান চুর্নবিচুর্ন হয়েছে তা আগে জোড়া লাগতে হবে তবেই আবার সবকিছু ভাবা যাবে। সাঁচি আজকাল এসব নিয়ে খুব ভাবে। কোনো সমাধান খুঁজে পায় না। এরমধ্যেই নিজে নিজে উদ্দোগি হয়ে দেশের বাইরে কয়েকটা ভার্সিটিতে এপ্লাই করেছে। যদি হয়ে যায় তবে চলে যাবে। কাউকে কিছু জানায়নি অবশ্য! জানালে কে কি ভাববে সেটা নিয়েও ভয় হয়। এমনিতেই বাবা মা গতদিন ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছে, ফুয়াদের সাথে ওর কোন প্রবলেম চলছে কিনা। ও কোনোরকমে বুঝ দিয়ে সরে এসেছে। এরপর এরকম কিছু শুনলে তারা নিশ্চয়ই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না? আফটার অল ওদের এরেন্জ ম্যারেজ। তাই সাঁচি ভয়ে ভয়ে থাকে, কেউ যেন কিছু না বোঝে!

সাঁচিকে আসতে দেখে ওর শাশুড়ী মা ভীষণ খুশি হলো।
“আসছো মা? আমি খুব খুশি হইছি। তোমাকে ছাড়া বাড়িটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগতেছিলো। এখন তুমি চলে আসছো এবার দেখো চাঁদের হাট লাগতেছে। ”
“জ্বী মা।”
“আচ্ছা, যাও। আগে ফ্রেশ হও তারপর কথা বলবোনে।”
সাঁচি মাথা নাড়িয়ে চলে আসে। শাশুড়ী কে আজ একটু বেশিই উৎফুল্ল মনে হলো। সত্যি হয়তো ও আসাতে খুশি হয়েছে! রুমে ঢুকতেই সাঁচির মনটা একটু উদাস হলো। কতোদিন পর এই রুমটাকে দেখলো? কতশত স্মৃতি এই রুমে জমা আছে। বিয়ের শুরুতে এটা একটা স্বপ্নপূরী ছিলো ওর কাছে আর এখন? এখন ঠিক কি বোঝে না সাঁচি! প্রথম অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে সবকিছু জীর্ন আর মলিন হয়ে যায় মনে হয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে লাগেজের চেন খুললো সাঁচি।

এক এক করে নিজের কাপড়গুলো আলমিরা তে তুলছিলো সাঁচি। সে সময় নজরে এলো প্যাকেটগুলো। একবার ভাবলো দেখবে না। ফুয়াদের জিনিস ওর হাতানো উচিত নয়। পরক্ষনেই সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলো। সবগুলো প্যাকেট নিয়ে বিছানায় এসে বসলো। প্রত্যেকটা প্যাকেটে একটা করে শাড়ী। সাঁচি খুব কৌতুহল নিয়ে সোনালী রঙের শাড়িটা খুলতেই ভেতর থেকে চিরকুটটা বের হলো। তাতে লিখা-
“আমাদের সবথেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি
মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই
সে কথা আজও আমি বলিনি।”
যেদিন আমি কথাটা বলবো সেদিন যেন পরনে এই শাড়ীটি থাকে।
মুখে এক ধরনের খুশির হাসি ফুটে উঠলো সাঁচির। সে দ্বিগুন কৌতুহল নিয়ে দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুললো। সেটাতে একটা অফ হোয়াইট জামদানী শাড়ি। ভাজ খুলতেই চিরকুট বের হলো-
“হাত বাড়িয়ে ছুই না তোকে মন বাড়িয়ে ছুই।
কোনো একদিন তোমার মন ছোয়ার অপেক্ষায়। ”
চিরকুট গুলে আবার যথাস্হানে রেখে দিলো সাঁচি। বাকি প্যাকেট দুটোও খুলে দেখলে, একটাতে সবুজ আর একটাতে নীল রঙের শাড়ী। প্রত্যেকটা রংই সাঁচির প্রিয়। ঐ দুটোর চিরকুট আর খুললো না। ভাবলো যেদিন পড়বে সেদিন খুলে দেখবে। যদিও মন কন্ট্রোল করতে ভীষণ কষ্ট হলো ওর। সাঁচির ঠোঁটের কোনে একটা মন ভালো করা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। ফুয়াদ ওর জন্য এই শাড়ীগুলো কিনেছে সেটা ভেবেই ওর মন ভালো হয়ে গেলো। ও মনের আনন্দে গুনগুন করে বাকী কাপড়গুলো আলমিরাতে তুলতে লাগলো।

ফুয়াদ ও আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসলো। সাঁচি তখনও আলমিরায় ওর কাপড়গুলো গুছাচ্ছিলো। রুমে ঢুকেই ফুয়াদ পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলো-
“কখন আসলে? ”
“এই তো কিছুক্ষণ। আপনি আজ এতো তাড়াতাড়ি? ”
” চলে আসলাম। বউ, কাপড় তুলো না বরং নতুন করে কাপড় গুছিয়ে নাও তো?”
“কেন?”
“আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি আজ রাতে। সবাই মিলে?”
“মানে?”
“তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে আগে বলিনি। তোমার ফ্যামিলি, আমার ফ্যামিলি, তানভীরের ফ্যামিলি সবাই যাচ্ছি। একটা বড় গাড়ি নিয়ে, বুঝলে?”
“কই, মা বাবা তো আমাকে কিছু বললো না?”
“আমি মানা করেছিলাম তো, তাই।”
সাঁচির কাঁধে থুতনি রেখে কথা বলছে ফুয়াদ। কথাগুলো বলার সময় ফুয়াদের নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছিলো সাঁচির গলায়,ঘারে। সে নিঃশ্বাসের স্পর্শে সাঁচি শিউরে উঠলো। ফুয়াদকে সরিয়ে দিতে চাইলো-
“ও এইজন্যই আমাকে বাসায় আনার এতো পায়তারা? ”
“হুম। কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো তো?”
“দেখি, সরেন! কাজ করছি তো?”
সাঁচি ফুয়াদকে সরাতে চায়। ফুয়াদ সরলো না-
” এইবার আমরা হানিমুনটা সেরে ফেলবো, কি বলো? গতবার তো কেবল ঘুরে ফিরে চলে চলে এসেছি?”
ফুয়াদ কি বলতে চাইছে তা বুঝতে পেরেই মুখ, চোখ গরম হয়ে গেলো সাঁচির। ফুয়াদকে সুযোগ দেয়ার কথা বলেছে সাঁচি কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি? নাহ৷ সম্ভব না। আরো সময় চাই ওর। নয় মাসের অপমান এতো দ্রত ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। যে ব্যাপারটা ফুয়াদ বাসর রাতেই বলতে পারতো সেটা বলতে নয়টা মাস লাগিয়েছে, এতোগুলো দিন ওকে কষ্ট দিয়েছে এই ব্যাপারগুলো হজম করতে পারে না সাঁচি। মনের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে ওর। আবার ও এও জানে কোন ধরনের হার্ড ডিসিশন নেয়া ওর পক্ষে সম্ভব না। আরো একটা ছোট বোন আর ভাই আছে ওর। আর তাছাড়া বাবা মা ব্যাপারগুলো বুঝবে কিনা কে জানে? জামাইতো তাদের কাছে ভালো মানুষই। এই কয়েকটা দিন ফুয়াদ ওর যথেষ্ট যত্ন করেছে। ওর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওর সাথেই ছিলো সবসময়। তারপর গত কিছুদিন সাঁচির মন জয়ের, মান ভাঙানোর জন্য কম কিছু করেনি ফুয়াদ। তবুও সবকিছু যেন সাঁচির কাছে মেকি মেকি লাগে। মনেহয় জোর করে করছে সবকিছু, মন থেকে না। যে মানুষ টা এতগুলো বছর তার প্রাক্তনকে মনে রেখে জীবনে সামনে আগাতে পারেনি সে কিভাবে এতো সহজে সবকিছু মেনে নিচ্ছে! সাঁচির মনের খটকা যেন যায় না। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ফুয়াদকে।
“বউ, কি ভাবো?”
ফুয়াদের ডাকে সম্বিত ফেরে সাঁচির।
“কিছুনা। আপনি কি সরবেন? সবকিছু গোছাতে হবে তো নাকি?”
সাঁচির রুক্ষস্বরে ফুয়াদ একটু দূরে সরে যায়।
“তোমার কি কোন কারনে মন খারাপ? ”
“নাহ। প্লিজ, বিরক্ত করবেন না তো!”
“আচ্ছা বাবা আর বিরক্ত করবো না।”
বলে যেতে চেয়েও ঘুরে আবার আসে সাঁচির কাছে।
“তোমার জন্য শাড়ী কিনেছিলাম। দেখেছো? পচ্ছন্দ হয়েছে তোমার?”
সাঁচি কোনো জবাব দিলো না। একমনে কাপড় গোছাতে লাগলো। ফুয়াদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওখান থেকে সরে এলো। ফুয়াদ জানে, সাঁচির মনের ঘরে ঢুকতে আরো অনেক সময় লাগবে এখন। যে দরজা কেবলই বন্ধ হয়েছে সে দরজা সহসাই খুলবে না। তবুও ও হাল ছাড়বে না, চেষ্টা করে যাবে।

রাত দশটা নাগাদ গাড়িতে ওঠার জন্য নিচে নামলো সাঁচি। ওর পড়নে একটা সাদামাটা কালো রঙের সুতির শাড়ী। শাওয়ার নেওয়ার কারনে চুলগুলো ভেজা তখনো, মুখে স্নিগ্ধতা খেলে যাচ্ছে। ফুয়াদ কিছুক্ষণ সাঁচির দিকে তাকিয়ে ছিলো হা হয়ে। নরমাল কালো শাড়ীতে উইথআউট মেকআপ কাউকে এতো সুন্দর লাগে? পাশে দাড়ানো তানভীর ফুয়াদকে গুতো দেয় –
“ভাইয়া,দেখার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপাতত মুখ বন্ধ করে গাড়িতে উঠুন।”
ফুয়াদ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। মাথা চুলকে অন্য দিকে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে।

আর ওদিকে সাঁচি ওর বাবা,মা,বোন প্রাচি আর ভাই রন্জুকে দেখে অবাক। ও যখন আজ বাসা থেকে আসলো তখনও এরা কিছুই জানালো না ওকে। আর এখন দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। ওকে চোখেই দেখছে না? সাঁচির খুব রাগ হলো ওদের উপর। নিজের বাবা মা হয়ে এমন করলো? ওকে আগে থেকে জানালে কি হতো? ফুয়াদ বলতে মানা করেছিলো? তাই আর বলেনি। মেয়ের চেয়ে এখন জামাই আপন হয়েছে ওনাদের কাছে। অভিমানে ও কারো সাথে কোন কথা বললো না। সাঁচি সামনের দিকে একটা সিটে বসতেই ফুয়াদ ওকে টেনে পিছনে নিয়ে গেলো। সেখানে প্রিয়তা আর ওর বড় তানভীরও বসে আছে। ফুয়াদ সাঁচিকে ফিসফিস করে বলে-
“আমরা নতুন জোড়া, একটু রোমান্স টোমান্স করবো, সামনে বসলে সবাই দেখতে পাবে। পেছনে বসাই ভালো, কি বলো?”
বলে চোখ মেরে ছিলো সাঁচিকে। বিরক্ত লাগলেও সাঁচি আর কিছু বলেনি। ফুয়াদ পাশে বসতে বসতে আবার কানের কাছে ফিসফিস করে-
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে, সাঁচি। এই মুহুর্তে তোমাকে একেবারে আদরে আদরে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে যে? কি করবো বলো তো?”
ফুয়াদের কথা শুনে সাঁচির শরীর জুড়ে কম্পনের ঝড় বয়ে গেলো। কিন্তু সে তা ফুয়াদকে বুঝতে না দিয়ে সিটে বসে কানে হেডফোন গুঁজে ছিলো। আর ফুয়াদ পাশের সিটে বসে ওকে সমানে গুতিয়ে যাচ্ছিলো।

রাত গভীর হলে বাসের বাতিগুলো যখন বন্ধ হয়ে গেলো ফুয়াদের জালানি আরো বাড়লো। সে কিছুক্ষণ পর পর চুপচাপ হঠাৎ হঠাৎ টুপ করে একটা করে চুমু দিয়ে যাচ্ছিলো সাঁচির গালে। জানে বাবা মায়ের সামনে কিছু বলতে পারবো না সাঁচি তাই সুযোগ নিচ্ছে ফুয়াদ।

কিছুক্ষণ ফুয়াদ আরো একটু সাহসী হলো। সে সাচির শাড়ীর ফাঁক গলে পেটে হাত দিলো। সাঁচি সে হাত সরিয়ে দিতেই ফুয়াদ আবার দেয়। এবার সে সাঁচির হাত দুটো তার এক হাত দিয়ে ধরে রাখে যাতে সাঁচি বাঁধা দিতে না পারে। ফুয়াদের অন্য হাতটি ঘুরে বেড়াচ্ছে সাচির পেটময়। ফুয়াদের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে সাঁচি। হাত ছাড়াতে মোচরা মুচরি করছে। শেষে রাগী দৃষ্টিতে ফুয়াদের দিকে তাকাতেই ফুয়াদ চট করে সাঁচির ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে দেয়। বেশ লম্বা একটা চুমু। আলো আধারির মাঝে ফুয়াদ যখন সাঁচির মুখ থেকে ওর মুখ সরালো দেখলো সাঁচি কাঁদছে।
“সরি! আর করবো না।”
মন খারাপ করে ফুয়াদ সাঁচিকে ছেড়ে দেয়। একটু দূরে যেয়ে বসে। ওর কারনে সাঁচি কাঁদলো? কিন্তু ও তো কষ্ট দিতে চায়না সাঁচিকে? সাঁচিকে মানানোর জন্যই তো এতো কিছু? মনটা বড্ড ছটফট করে ফুয়াদের। সারারাস্তা আর বিরক্ত করেনি সাঁচিকে। শুধু প্রয়োজনীয় কথাটা বলেছে।

৩৮.

সকালে নয়টা নাগাদ কক্সবাজার পৌছোলো সাঁচিরা। সকালের নাস্তা করে সবাই যার যার রুমে চলে গেল। ঠিক হলো একেবারে বিকেলে বের হবে সবাই মিলে। এই ফাঁকে সবাই একটা লম্বা ঘুম দেবে। সাঁচি রুমে ঢুকে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়েই শুয়ে পড়লো। ওর এমনিতে গাড়িতে জার্নির অভ্যাস নেই। তাই শরীর টা একটু বেশিই খারাপ লাগছে। ও বেডে শোয়া মাত্রই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ফুয়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো সাঁচি গভীর ঘুমে। ও সাঁচির কপালে একটা চুমু দিয়ে সাঁচির পাশে শুয়ে পড়লো। ফুয়াদ জানে সাঁচির মনে এখনও অনেক প্রশ্ন ভীর করেছে। হঠাৎ করে ফুয়াদের ওর প্রতি ভালোবাসা হয়তো সাঁচির মনে প্রশ্ন তৈরী করছে। কিন্তু ফুয়াদ কি করবে? ও কি জানতো ও সাঁচিকে ভালোবেসে ফেলবে? রেহনুমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়ে সাঁচি একদিনে যেন ফুয়াদের মনের আরো কাছে চলে আসলো একেবারে! আর এই কয়েকদিন সাঁচির মান অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে ফুয়াদ যেন আরো বেশি করে ওর দিকে ঝুকে গেছে ! সাঁচিকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা বেড়েছে দ্বিগুন হয়ে। মাঝে মাঝে মনের কোনে রেহনুমা কে খুঁজে বেড়ায় ফুয়াদ। আজকাল সেখানে সাঁচি ছাড়া আর কারো প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় না ও। ভারী অদ্ভুত ব্যাপার! ও কি তবে রেহনুমা কে পুরো পুরি ভুলে গেলো? ফুয়াদ কি তবে সাঁচিকে ভালোবেসে ফেললো? নিজেকে নিয়ে এভাবে ভাবতে ভয় হয় ফুয়াদের। রেহনুমা কে ধরে রাখতে পারেনি এইটা যেন ওর বিশ্বাসের ভিতটা নষ্ট করে দিয়েছিলো। এরপরে তো ভালোবাসা ব্যাপারটা ওর কাছে ভিতিকর মনে হতো। কিন্তু এখন সাঁচি যেন ওকে নতুন করে ভালোবাসতে বাধ্য করছে। ফুয়াদের ভালো লাগে সাঁচির হাত ধরে রিকশা করে ঘুরতে। ওর ফুচকা খাওয়া দেখতে। কিংবা ওকে একটু জরিয়ে ধরলে বা চুমু দিলে সাঁচির শরীরে যে কাঁপন ওঠে, ফুয়াদের কাছে ঐ মুহুর্তটা ভীষণ ভালো লাগে। এই যে এতো এতো অনুভুতি সেটা এই পাগলি কবে বুঝবে? ও কিভাবে মেয়েটাকে বুঝাবে যে, যাকে মন থেকে ভালোবাসা যায় না তাকে কাছে টানা অর্থহীন। এতো এতো ভাবনা মনটা অসার করে দিচ্ছে ফুয়াদের। সব চিন্তা দূরে ঠেলে ঘুমানোর চেষ্টা করে ফুয়াদ।

বিকেলের দিকে খাওয়া দাওয়া করে সবাই মিলে বিচে গেলো। বিকেল চারটার সময় বেশ করা রোদ। মুরুব্বিরা কেউ থাকতে চাইলো না। পরে ঠিক হলো ইনানী বিচে যাবে। রাতে ওখানেই কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে ফিরবে। এবার দুটো মাইক্রো নিলো ওরা, একটাতে সব মুরুব্বিরা আর একটাতে সব জোড়া, বাচ্চা কাচ্চা। এবারের রাইডটা সাঁচি বেশ এনজয় করলো। ঘুম থেকে উঠে মনে হয় শরীরটা ঝরঝরে হয়েছে। তাই চেহারায় হাসি ফিরে এসেছে বুঝি! ফুয়াদ দেখলো, সাঁচি বাচ্চাদের সাথে অল্পসল্প দুস্টুমি করে বেশ হাসাহাসিও করলো। ওর ঔ হাসিটুকু দেখেই ফুয়াদের মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। যাক বাবা, পাগলী হেসেছে তো, সেই ঢের। কাল রাত থেকে যে রকম মুড অফ করে বসেছিলো? ফুয়াদ তো ভয় পেয়ে গেছিলো যে, সাঁচি মনে হয় আর ওর সাথে বেড়াতে রাজিই হবে না?

গাড়ি থেকে নেমেই আগে ফটোসেশান হলো প্রিয়র জোরাজোরিতে। আজ রাতে প্রিয়র ম্যারেজ ডে সেলিব্রশন হবে। সে ভীষণ রকম আনন্দিত। সাঁচি খেয়াল করলো প্রিয় যেন আজ বেশিই খুশি! তানভীর এর বিহেভিয়ার ও যেন স্বামীর চেয়ে প্রেমিক প্রেমিক বেশি মনে হচ্ছে! সাঁচি খুশি হয়, সুখি মানুষ দেখতে কার না ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে, এরকম খুশি ও নিজেও হতে পারতো। এরকম সুন্দর মুহুর্ত ওরও আসতে পারতো জীবনে। কিন্তু ওর কপালে হয়তো সুখ নেই তাই এসব মুহুর্ত মিস হয়ে গেলো ওর জীবন থেকে। ভেবে আনমনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাঁচি।

এসবের মাঝে দূর থেকে একজন সাঁচিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো, সে হচ্ছে ফুয়াদ। সে মন ভরে সাঁচিকে দেখছিলো। হঠাৎ সাঁচির হাত ধরে টান দিলো ফুয়াদ-
“চলো আমরা ও দিকটায় যাই। হেঁটে আসি একটু।”
ফুয়াদ আলতো করে সাঁচির হাত ধরে হাটঁতে লাগলো-
“আমার সাথে থাকতে তোমার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে, সাঁচি? আমি কি ফোর্স করছি তোমায়?”
সাঁচি কিছু না বলে চুপ থাকলো। ফুয়াদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। ফুয়াদও আর ঘাটালো না।

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-২০

0

#আজল
#পর্ব-বিশ

৩৬.

গত দু সপ্তাহ ধরে ফুয়াদের ভালোবাসার অত্যাচার চলছে সাঁচির উপর। বেশ মধুর সে অত্যাচার। কোনো কোনো দিন ফুয়াদ লুকিয়ে রাতে সাঁচিদের ছাদে চলে আসে, আবার কোনো কোনো দিন রাতে ডিনার করার জন্য কোনো রেষ্টুরেন্টে নিয়ে যাবে সাঁচিকে অথবা কোনো কোনো দিন বিকেল থেকে সন্ধা অবধি দু’জনে মিলে শুধু রিকশা ভ্রমন যেদিকে দু’চোখ যায়। রিকশা ভ্রমনের দিনগুলো বেশি মজা লেগেছে সাঁচির কাছে। সন্ধার পরে রাতের ঢাকা দেখতে বেশ মজা লাগছে সাঁচির। পাশে ফুয়াদ বসে ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে। হালকা বাতাসে সাঁচির চুলগুলো দোলে। আর ফুয়াদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা উপভোগ করে। সাঁচি খুব টের পায় ফুয়াদের এই মুগ্ধ দৃষ্টি। ও মনে মনে বেশ একটা রোমাঞ্চ ফিল করে। বিয়ের আগে প্রেম তো করেনি জীবনে। এখন যেন দূধের স্বাদ ঘোলে মিটছে সাঁচির। ফুয়াদের সাথে বেশ একটা মিষ্টি প্রেম প্রেম ভাব জমে উঠেছে। মাঝেমধ্যে সাঁচি ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরে। ফুয়াদ তখন রিকশা থামিয়ে ফুচকা কিনে দেয় সাঁচি কে। সাঁচি রসিয়ে রসিয়ে ফুচকা খায় আর ফুয়াদ অবাক হয়ে দেখে। ওর নিজেরও খেতে ইচ্ছে করে। সাঁচির খাওয়া দেখে নিজেও একদিন ট্রাই করেছিলো কিন্তু টক আর ঝালের ঠেলায় ফুয়াদের ফুচকা খাওয়ার শখ মিটে গেছে। এই মেয়ে খায় কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক ফুয়াদ। মাঝে মাঝে নব্য প্রেমিকের মতো সাঁচির মুখে আগুল ছুয়ে দেয় ফুয়াদ। সাঁচি কপট রাগ দেখায় যদিও। কিন্তু ফুয়াদ জানে সাঁচি মনে মনে ভীষন খুশি হয়। ঐ মুহূর্তে ওর চেহারা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। কি অদ্ভুত ঐশ্বরিক এক ধরনের উজ্জলতা দেখা যায় ওর মুখে। এরকম সৌন্দর্য দেখে ফুয়াদের মাথা পাগল পাগল লাগে। তার তখন খুব ইচ্ছে করে সাঁচিকে আদরে আদরে মেরে ফেলতে। কিন্তু সাঁচি কি মনে করবে এই ভয়ে আর কিছু করা হয় না। এমনিতেই মেয়েটা ওকে সুযোগ দিয়েছে এই ঢের। অতো লোভ করতে যেয়ে হেলায় হারাতে চায় না এই সুযোগ। তাই ভদ্র বাবুটি সেজে বসে থাকে ফুয়াদ।।

আজও ফুয়াদ এসেছে সাঁচিদের বাড়ির ছাদে। আজ অবশ্য অন্য কারো হেল্প নিতে হয়নি, সাঁচিকেই বলেছিলো। সাঁচি আজ নিজেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে ছাদে। পাটি বিছিয়ে ফ্লাক্স ভর্তি চা বানিয়ে এনেছে। একটা কয়েলও জালিয়ে দিয়েছে। মশার অত্যাচারে বসা যায় না তাই। ফুয়াদ ছাদে এসে এসব দেখে বেশ খুশি হলো। ভাবলো, আজ সাঁচিকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলবে। মেয়ের মন ভালো আছে, রাজি হলেও হয়ে যেতে পারে। দেখা যাক সাঁচি কি বলে? একা একা বসে বসে গুনগুন করছিলো ফুয়াদ-
“শোনো গো দখিনা হাওয়া, প্রেম করেছি আমি
লেগেছে চোখেতে নেশা, দিক ভুলেছি আমি
শোনো গো দখিনা হাওয়া, প্রেম করেছি আমি।
মনেতে লুকানো ছিলো সুপ্ত যে পিয়াশা
জাগিল মধু লগনে বাড়ালো কি আশা
উতলা করেছো মোড়ে, আমারি ভালোবাসা
অনুরাগে প্রেম শরীরে ডুব দিয়েছি আমি
শোনো গো মধুরও হাওয়া প্রেম করেছি আমি।”

সাঁচি বেশ অনেকক্ষণ হলো ছাদে এসেছে। উঠতে গিয়ে ফুয়াদের গান শুনেছে, তখন খুব আস্তে আস্তে ছাদে উঠে এক কোনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মগ্ন হয়ে ওর গান শুনছিলো। আজ একেবারে ভরা পূর্নিমা। চারিদিকে ফকফকা চাঁদের আলো, মাঝে মাঝে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাস সাথে ফুয়াদের এই রোমান্টিক গান একেবারে অন্যরকম মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সাঁচি যেন মাতাল হয়ে যাচ্ছিলো। ফুয়াদ এতো সুন্দর গান করে কিভাবে? সাঁচি চোখ বুজে তন্ময় হয়ে গান শুনছিলো। ফুয়াদের গান থেমে যেতেই সাঁচি চোখ মেললো। সামনে ফুয়াদকে দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। লোকটা এমন কেন? অলওয়েজ ভয় পাইয়ে দেয়? সাঁচির অবস্থা দেখে ফুয়াদ ফিকফিক করে হাসছে-
“কি ভয় পেয়েছো?”
“আপনি এতো বদ কেন? সবসময় ভয় পাইয়ে দেন? ”
“তুমিই বা এতো বদি কেন? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গান শুনছো? ”
“বদি টা আবার কে?”
“কেন তুমি? আমি বদ, তুমি আমার বউ কি হবে? বদ এর স্ত্রী লিঙ্গ বদি।”
“ছিহ, কি পচা আপনি! যা মুখে আসে তাই বলে দেন!”
“এহ আসছে আমার পচা বলনে ওয়ালি। আগে বলো গান কেমন লাগলো?”
“বলবো না!”
সাঁচি হেটে যেয়ে পাটির বিছানায় বসতে চাইলো-
“এই দাড়াও দাড়াও, তুমি ঐ শাড়িটা পড়েছো না?”
“কোনটা?”
“যেটা আমি ঐ যে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে আনলাম, ঐইটা না?”
“ইশ, কিছু ভোলে না দেখি! এতো ভালো ব্রেন নিয়ে কি করেন আপনি? ”
“দেখছো ধরে ফেলছি?”
“এ আর এমন কি! জীবনে প্রথম বউয়ের জন্য একখানা শাড়ি কিনেছেন সেটা কি এতো সহজে ভোলা যাবে? ঠিকই ধরেছেন, এটা সেই শাড়ী।”
“দেখি একটু দেখতে দাও তো? তোমায় কেমন লাগছে দেখি?”
ফুয়াদ সাঁচিকে হাত ধরে সামনে দাড় করিয়ে দেয়। তারপরে মন ভরে দেখে সাঁচিকে। আলো আধারির খেলায় সাঁচিকে মায়াবী মায়াবী লাগছে।
“একেবারে অন্যরকম সুন্দর লাগছে তোমাকে। মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একেবারে। একটু আদর করে দেই?”
“কিহ? এসব কি কথা?”
“না মানে কিছু না। এমনি মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।”
“কিছু না হলেই ভালো।”
“এসো বসি। আজকে কি বানিয়েছো? চা না কফি?”
কথা ঘুরায় ফুয়াদ।
“কফি! আপনি পচ্ছন্দ করেন কিনা?”
“বাহ, বেশ জমবে আজ! ”
সাঁচি দু মগ ভরে কফি ঢালে। একটা ফুয়াদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। নিজের টাতে নিঃশব্দে চুমুক দেয়।
“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম অনেকদিন ধরে। করবো?”
“করেন? এতো অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”
“না মানে আবার রাগ হয়ো না কিন্তু! ”
“হবো না। বলেন কি বলবেন?”
“তুমি রেহনুমার খোঁজ কিভাবে পেলা একটু বলবা আমাকে? আমি কিন্তু অনেক চেষ্টা করসি পারি নাই।”
“উহু, আপনার চেষ্টায় ঘাটতি ছিলো তাই পান নাই। আমি মন থেকে চেষ্টা করেছি তাই পেয়ে গেছি। এর জন্য অবশ্য আমাকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে অনেকদিন। ”
“কেমন?”
“প্রথমে আপনার বন্ধুদের মাধ্যমে মিলি আপুকে খুঁজে বের করসি। ”
ফুয়াদ অবাক হয়-
“আমার বন্ধুদের তুমি পেলে কোথায়? ওদের সাথে তো তোমার দু’বার মাত্র দেখা হয়েছে? ”
“আপনার মোবাইল থেকে চুরি করে নাম্বার নিয়েছি। এ আর এমন কঠিন কি?”
“ও মা! তারপর?”
“তারপর তার মাধ্যমে রেহনুমা কে। রেহনুমা অবশ্য প্রথমে দেখা করতে রাজি ছিলো না। অনেক অনুনয় করে রাজি করাই। একদিন যেয়ে কথা বললাম, আপনার কথা জানাইলাম ওকে আর ওর হাজবেন্ড কে। জানেন লোকটা না খুব ভালো। এতো হেল্পফুল হাজবেন্ড আমি আগে দেখিনাই। অন্য কেউ হলো স্ত্রীর প্রাক্তন কথাটা শুনলেই দৌড়ানি দিতো। কিন্তু উনি মন দিয়ে সব কথা শুনলেন তারপর নিজে থেকেই রেহনুমা কে বললেন দেখা করতে। উনার কথাতেই রেহনুমা রাজি হয়েছে আপনার সাথে দেখা করতে। একজন স্বামীর তার স্ত্রীর উপর কতটুকু বিশ্বাস থাকলে স্ত্রী কে প্রাক্তনের সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়? আমার জাস্ট আন বিলিভেবল লাগছিলো বেপারটা। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম লোকটার দিকে। লোকটার উপর আমার শ্রদ্ধা জাগলো। লোকটা সত্যি ভালোবাসে রেহনুমা কে। সেটা ইন্টারে পড়ার সময়কার আনারি প্রেম না একেবারে পরিপক্ব ভালোবাসা যাকে বলে! এটা সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া প্রেম নয় বরং বয়সের সাথে সাথে দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাওয়া ভালোবাসা এটা। আমার কি মনে হয়েছে জানেন?”
“কি?”
“হি ইজ দা পারফেক্ট ম্যান ফর রেহনুমা। নো ওয়ান ক্যান লাভ রেহনুমা এজ লাইক হিম।
ঐ যে বলে না আল্লাহ জোড়া মিলিয়ে দেয়? ব্যাপারটা সেই রকম। রেহনুমার জন্য আল্লাহ আনিস ভাইকে পাঠাইছে। সেই পারবে ঠিকঠাক মতো রেহনুমাকে সুখী করতে। পারবে কি পেরেছে অলরেলি।”
“তাহলে তো তোমার আমার জোড়াও আল্লাহ বানিয়েছে। আমরাও নিশ্চয়ই একে অপরের পরিপূরক হবো? এই যে তুমি আমার জন্য এতো কষ্ট করে রেহনুমাকে খুঁজে আনসো এইটা কেন করসো? তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই না করসো! আমাকে কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্যই না করছো? তাহলে সেই হিসেবে আমরাও মেড ফর ইচ আদার জোড়া!”
“ইশ! শখ কতো? মেড ফর ইচ আদার হবে?”
“সাঁচি একটা কথা বলি। রাখবে?”
” বলুন?”
“বাসায় ফিরে চলো। আর কতোদিন এভাবে চলবে? মা বড্ড আশা করে থাকেন তোমার!”
“এখন শুধু মায়ের জন্য যাবো? আমি কি মায়ের সাথে সংসার করবো নাকি?”
“না না, সেটা বলছি না। সংসার তো আমার সাথেই করবে। আমিও যে তোমায় ভীষণ ভাবে মিস করছি। রুমটা ফাঁকা লাগে গো! তুমি এসে আমার ঘরটা পূর্ণ করে দাও প্লিজ। একা একা আর ভালো লাগে না। চলো না প্লিজ, প্লিজ! তুমি তোমার সুবিধা মতো থাকবে। আমি মোটেও তোমাকে ডিসটার্ব করবো না। ”
ফুয়াদের বলার স্টাইল দেখে হেসে দেয় সাঁচি। অঅঅ! কি কিউট ভাবে বলছে ফুয়াদ?
“আচ্ছা, যাবো।”
“আচ্ছা, চলো তাইলে যাই।”
ফুয়াদ উঠে দাড়ালো।
“মানে, কি বলেন এইগুলা? এখন কেন যাবো? সকালে বাবা মাকে বলে নিয়ে যাবেন। যেই না হ্যা বলেছি অমনি প্রেমিক রুপ হাওয়া হয়ে গেলো? সব হচ্ছে অভিনয়!”
“আচ্ছা, সরি। কালকে নিয়ে যাবো তোমাকে। কিন্তু এটা বললা কেন? প্রেমিক রুপ হাওয়া?”
“তা নয়তো কি? বলেছি আর দৌড় শুরু? এই আপনার পটানো?”
আবার বসে যায় ফুয়াদ। অস্থির লাগছে ওর।
“কি হয়েছে? এমন করছেন ক্যানো?”
“না মানে, তুমি সামনে বসে আছো, আর কিছু করতে পারতেছি না, তাই আর কি?”
“কিহ! কি করতে পারতেসেন না?”
“আদর সোহাগ আর কি?”
“এহ, ঢং দেখে আর বাঁচিনা। এতোদিন তার সাথে একরুমে থাকলাম, এক বিছানায় ঘুমাইলাম তার ফিলিংস জাগলো না আর এখন সে আমাকে রং তামাশার কথা শুনায়?”
“আরে বুঝোনা, তখন তো অন্য ধ্যানে থাকতাম। তাই তোমাকে খেয়াল করি নাই। এখন তো তুমি আমার ধ্যান জ্ঞান তাই আর কি নিজেকে কন্ট্রোল করতে কষ্ট হয়। তাছাড়া এতো সুন্দর মনোরম পরিবেশ, সামনে সুন্দরী বউ! নিজেকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করি বলোতো?”
“বুঝছি! মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার। আমি যাই, আপনিও বাড়ি যান। ঘুমান গিয়া। আর হ্যা, আমি বাসায় যাবো ঠিকই কিন্তু আমার সাথে এইসব করতে পারবেন না বলে দিলাম?”
“কোন সব?”
“এহ,ন্যাকা! যা বলেছি ঠিকই বুঝেছেন? যদি জোর করেন তবে খুবই খারাপ হবে। ”
“কেন? তুমি চাও না আমায়? এতোদিন তো খুব পিছনে পরে থাকতে? ”
” থাকতাম কারন তখন চাইতাম। এখন যখন আপনি আমার কাছে আসেন আমার পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। আপনি আমার সাথে যে দূর্ব্যবহার গুলো করেছেন সেগুলো মনে পড়ে যায়। জড়িয়ে ধরার অপরাধে আপনি আমায় যা নয় তাই বলেছেন। চাইলেই তো সেগুলো ভুলতে পারছি না। কানে বাজে সারাক্ষণ। আপনার কানে যেমন বাজতো রেহনুমার গলা। মনেহয় আমি খারাপ মেয়ে। তা নাহলে কি আপনার সাথে জোর-জবরদস্তি করতাম!”
ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে সাঁচি। দু হাতে মুখ ঢাকে।
ফুয়াদ এগিয়ে এসে সাঁচির হাত ধরে, চোখের পানি মুছে দেয়-
“সরি, সাঁচি। আমি সত্যিই সরি! আমার যে ঐ সময়গুলোতে কি হতো, না চাইতেও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলতাম। আমার নিজের কাছেও প্রচন্ড খারাপ লাগতো। কিভাবে যে কি করতাম কিছুই বুঝতে পারতাম না!”
“এতোটাই যখন খারাপ লাগতো তবে কোনোদিন সরি বলেননি কেন?”
” অনেক বলতে চাইতাম কিন্তু পারতাম না। মুখে এসে আটকে যেত। আমার নিজের দুঃখটাই নিজের কাছে বড় ছিলে যে! প্লিজ এজন্য নিজেকে আর কষ্ট দিয়ো না। এমনিতেই নিজেকে আমার বড্ড ছোট মনেহয়। এরপর তুমি যদি এমন করো তবে আমি কোথায় লুকাবো বলো?”
“তার আমি কি জানি? দুঃখ দেওয়ার সময় মনে ছিলোনা সেকথা? ”
ঝাঝালো কন্ঠে বলে সাঁচি। ফুয়াদ সাঁচি কে কাছে টেনে নেয়। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে-
“আমি আর কি করবো বলোতো? কি করলে তোমার মনের রাগ কমবে? অভিমান গুলো বুকের দেয়াল থেকে খসে পড়বে। বলে দাও, যা বলবে তাই করবো। তবুও এতো কষ্ট পেয়ো না। আজকাল আমার ও ভালো লাগে না আর। বড্ড ক্লান্ত লাগে। ভুলের বোঝা আর বইতে পারছি না। এবার একটু সুখ চাই জীবনে। তোমার রাগ কমানোর জন্য দরকার হলে মারো কাটো, যা খুশি করো আমায়, তবুও স্বাভাবিক হও।”
“কিছুই আর করার নেই। এখন একমাত্র সময়ই হলো বড় অসুধ। আমাকে সময় দিন। সব ভুলে যাওয়ার জন্য। আমি নিজেও জানি কবে মনের এই বেহাল দশা থেকে মুক্তি পাবো? আমারও কষ্ট হয় খুব। তবুও কিছু করার নেই।”
ফুয়াদ সাঁচির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চুলগুলে
সাট করে দিয়ে চুমু দেয় আলতো করে-
“যত সময় লাগে নাও কিন্তু আমার চোখের আড়ালে থেকে নয়। আমার চোখের সামনে থাকো সবসময়। তাহলে হয়তো ব্যপারটা তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে। আমিও চেষ্টা করবো না হয়। দুজনে একসাথে চেষ্টা করলে নিশ্চিয়ই হবে?”
“হুম। ঠিক আছে।”

এর পরের সময়টুকু দুজনই চুপচাপ বসে থাকে। আসলেও মন বড় অদ্ভুত জিনিস। গতকালই যেটা খুব করে চাইতো আজ সেটা হাতের কাছে পেয়েও গ্রহন করতে পারছে না! কেন এমন হয়? এর কি কোন উত্তর আছে? অন্য কারো কাছে থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু এই মুহুর্তে এই দু’জনার কাছে এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। এরা কেবল মন হাতরে প্রশ্নের উত্তর খুজে চলেছে!

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১৯

0

#আজল
#পর্ব-উনিশ

৩৫.

সাঁচি কিছুতেই আসতে রাজি হলো না ফুয়াদের সাথে। তার এক কথা সে যাবে না। ফুয়াদ যদি বেশি জোরাজোরি করে তাহলে তাদের ব্যাপারটা বাবা মাকে জানিয়ে দেবে, এই বলে হুমকি দিলো ফুয়াদকে। শেষমেষ ফুয়াদ বাধ্য হয়ে সাঁচিকে বাবার বাড়িতে রেখেই চলে আসলো। ওকে দেখেই ফুয়াদের মা প্রশ্ন করলেন-
“বউ কই, আসেনাই?”
“আসতে চাইলো না মা। শরীর এখনো দূর্বল, তাই আমিও আর জোর করি নাই। থাক না হয় কয়দিন?”
“ওওও, আচ্ছা। ভালো করেছিস। ওর যেটা ভালো লাগে করুক।”
“হ্যা, মা সেটাই।”
“বাবু, শোন?”
“বলো, মা। কি বলবে?”
“তোদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো?”
“কেন, হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছো যে মা?”
“এমনি মনে হলো? সাঁচির মনটন কেমন খারাপ থাকে মনেহলো!”
“না, মা টেনশন করার মতো কিছু হয়নি। সব ঠিকই আছে। ”
ফুয়াদ মাকে আশ্বস্ত করে। নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে ফুয়াদ। ভাবতে থাকে কিভাবে সাঁচিকে মানাবে! মেয়েটা সুযোগ তাকে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কেমন যেন কঠোরতাও এসেছে ওর ব্যবহার আর আচরনে। আগের সাঁচি হলে হয়তো পটিয়ে ফেলা যেতো এক নিমিষেই। কিন্তু এখনকার সাঁচিকে ফুয়াদের অচেনা লাগে, ভয় হয় একটু। মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত মানাতে পারলে হয়! ফুয়াদ জানে যারা একটু সরলরৈখিক হয় মানে যারা ভালোমানুষ আরকি! তারা রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়। সহজে তাদের রাগ পরে না। তাই সাঁচিকে নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছে ফুয়াদ। মাঝে মাঝে নিজেরই নিজেকে কষে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করে। কেন সময়ের আগে সব বুঝ আসলো না। কেন সে নিজেই রেহনুমা কে খুঁজে বের করলো না?

নাহ, এইখানে একটু ভুল আছে। ফুয়াদ চেষ্টা করেছিলো রেহনুমার খোঁজ করার কিন্তু মিলি ওকে রেহনুমার কোনো খবরই দেয়নি।ওর ই বা কি করার ছিলো! চেষ্টা তো করছিলো কিন্তু ব্যাটে বলে হয়নি। কিংবা এমনও হতে পারে যে, ফুয়াদ হয়তো মন থেকে চায়নি যে রেহনুমার সাথে ওর দেখা হোক? মানুষিক দূর্বলতা ছিলো হয়তো! সত্যের মুখোমুখি হওয়ার মনমানসিকতা সবসময় থাকে না। তখনও হয়তো ছিলো না কিংবা এখন যে হয়েছে তাই বা কে বলবে? হঠাৎ করে রেহনুমাকে কাছে দেখে হয়তো আড়স্ঠতা কমে গেছে? হঠাৎ ফুয়াদের মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে যায়। আচ্ছা! সাঁচি কিভাবে ওর খোঁজ পেলো? জিজ্ঞেস করতে হবে ওকে? বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ফুয়াদের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো, ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

দিন দু’য়েক পরে রাতে খাবারের পর রুমেই হাটাহাটি করছিলো সাঁচি। ছোট বোন প্রাচী এলো রুমে-
“আপু, চা খাবি?”
“এতো রাতে? তোর পড়া নেই?”
সাঁচি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“এতো রাত? মাত্র রাত দশটা! পড়া আছে রাতে করে নেবো। খাবে?”
কিছু একটা ভেবে সাঁচি বললো-
“ঠিক আছে, বানা।”
কিছুক্ষণ পরে দু’মগে চা নিয়ে ফিরলো প্রাচী। মগে চা দেখে সাঁচির ফুয়াদের কথা মনে পড়ে গেলো। ফুয়াদ মগে করে চা বা কফি খেতে খুব পচ্ছন্দ করে। সাঁচির মনটা খারাপ হয়ে গেলো কেন জানি! ফুয়াদের কথা মনে পরলে মনটা ভীষন ভার হয়ে যায়। সাঁচি মাইন্ড ডাইভার্ট করার চেষ্টা করে।
“এতো চা এনেছিস কেন? আমি এতো চা খাবো না ”
“আপু, চলো ছাদে যাই। হাটতে হাঁটতে চা খাবো, এইজন্যই মগে চা এনেছি। ”
“নাহ, ইচ্ছে হচ্ছে না…”
“ওহ চলো তো.. তোমার শরীর টা ফ্রেশ লাগবে দেখো।”
প্রাচী টানতে টানতে সাঁচি কে ছাদে নিয়ে এলো। সুন্দর ঝিরিঝিরি হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে…ছাদের একপাশের ছোট বাগানের গাছগুলো হালকা দোল খাচ্ছে, দেখেই সাঁচির মন ভালো হয়ে গেলো। প্রাচী সাঁচির হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলো।
“তুই কোথায় যাচ্ছিস? একা একা ভয় লাগবে আমার!”
“আছি এখানেই। ওপাশ থেকে একটু হেঁটে আসি। তুমি গাছ দেখো।”
সাঁচি আর কিছু না বলে গোলাপ গাছে ফুটে থাকা ফুলগুলো দেখতে লাগলো। আগে এই গাছগুলোর যত্ন সাঁচিই নিতো। এখন তো এবাড়িতেই থাকা হয়না, তার যত্ন কিভাবে নেবে? আর ও বাড়িতেও গাছ আছে কিন্তু কেন যেন সাঁচির সেসব যত্নের ইচ্ছে হয় নাই। ফুয়াদের সাথে বিয়ের পরে কি ও চেঞ্জ হয়ে গেছে? আগে তো এমন ছিলো না? কেমন কাঠখোট্টা টাইপ হয়ে গেছে? নিজের শখ আহলাদ, ইচ্ছে পূরন সব ভুলে গেলো নাকি? সব কিছু কেমন যেন ফুয়াদ কেন্দ্রীক হয়ে গেছে! ফুয়াদ না থাকলে কিছু ভালো করতে লাগে না, খেতে ভালো লাগে না! এ কেমন অসুখ? মেয়েদের জীবনটাই বুঝি এমন! প্রথমে বাবা মায়ের ছায়াতলে থাকা পরে স্বামীর, শশুরবাড়ীর ছায়াতলে থাকা। নিজের বলে কিছু থাকে না নাকি?
সাঁচি মনে মনে ভাবলো এখন থেকে আগে নিজেকে নিয়ে ভাববে। নিজের ছোট ছোট শখ আহলাদ গুলে পূরন করবে। কাউকে এতোটাও ভালোবাসা উচিত না যে সে হাত ছেড়ে দিলে, পথ চলার শক্তিটুকুও হাড়িয়ে যায়। এই ভাবনাটুকু সাঁচিকে অনেকখানি নির্ভরতা দিলো। মনের ভার কমাতে গুনগুন করে গান ধরলো-
“প্রিয়তম
কি লিখি তোমায়?
কি লিখি তোমায়?
তুমি ছাড়া আর কোনো কিছু ভালো লাগেনা আমার
কি লিখি তোমায়?
কি লিখি তোমায়?”

ওপাশ থেকে একটু গুনগুন শুনতেই সাঁচি থেমে গেলো। কে যেন গান গাইছে-
“আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম;
শুধু শ্রাবন সন্ধাটুকু তোমার কাছেই চেয়ে নিলাম;”
সাঁচি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ওপাশের ছাদে। একটু ভয় ভয় লাগছে। এই সময় ছাদে কে থাকবে? সাঁচি প্রাচীকে দুইবার ডাকলো-
“প্রাচী, এই প্রাচী! আছিস?”
গানটা থেকে গেলো। সাঁচি আর একটু এগিয়ে গেলো, একটা ছেলের আয়বর ছাদের রেলিং ঘেঁষে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। চাঁদের আবছা আলোয় তাকে রহস্যময় লাগছে। সে এবার নতুন গান ধরলো-
“আবার হবে তো দেখা
এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো
কি চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজো হয়তো
এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।”
“এই কে আপনি! এতো রাতে ছাদে কি করেন?”
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে সাঁচি।
“তুমি কি করো? এতো রাতে মেয়েদের একা ছাদে আসতে নেই জানোনা? ”
সাঁচি আরো ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করলো-
“এই প্রাচী, প্রাচী কোথায় তুই?”
কোনো সারা না পেয়ে সাঁচি দৌড়ে চলে আসতে নেয়। পেছন থেকে বাধা পায়-
“আআআআ, মাগো, ভুত….বাঁচাও? ”
চোখ বন্ধ করে চিৎকার করেই যাচ্ছে সাঁচি। কেউ একজন ওর কানের কাছে ফিসফিস করলো-
“শশশশশশ,চুপ করো আমি, ফুয়াদ! এখন কি আমাকে শশুরের হাতে পিটুনি খাওয়াতে চাও নাকি?”
সাঁচি চিৎকার থামিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
“আপনি এতো রাতে? কি করেন? এখনই জানটা বের হয়ে যাচ্ছিলো?”
“ইশ! ভীতুর ডিম একটা! আমার বউটা একেবারে ভীতু! ”
“আমি মোটেও ভীতু না। আগে বলেন আপনি কি করছেন এখানে এতোরাতে?”
“তোমার সাথে প্রেম করতে আসছি।”
বলে দাঁত বের করে হাসলো ফুয়াদ।
“এহ, প্রেম করতে আসছে? ঢং! আপনার সাথে কে প্রেম করবে? গম্ভীর রসকষহীন মানুষ একটা! উনি নাকি আমার সাথে প্রেম করবে?”
সাঁচি চলে আসতে নেয়। ফুয়াদ ওকে পেছন থেকে জাপটে ধরে।টানতে টানতে নিয়ে আসে ছাদের কোনায়। সাঁচি কে সামনে দাড় করিয়ে দিয়ে নিজে পেছনে দাঁড়িয়ে সাঁচির কাঁধে থুতনি রাখে-
” আজ আকাশে চাঁদ আছে, পুরোটা না হলেও অর্ধেকের বেশি আছে। ঠান্ডা বাসাত আছে তোমার আমার হাতে চায়ের মগ আছে, প্রেম করার জন্য আর কি লাগবে বলো তো?”
ফুয়াদের নিঃশ্বাস যেয়ে বাড়ি খাচ্ছে সাঁচির গলায়। সাঁচি তাতে কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করলো।
“ওহ, এটা তবে আপনার প্লান? প্রাচীকে দিয়ে আমাকে ছাদে আনানো?”
“হুম, আমার বউটার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছি একটু। কি গান যেন গাইছিলে? আবার গাও না, বেশ ভালো লাগছিলো?”
“আমার বয়েই গেছে আপনাকে গান শোনাতে!”
“শোনাও না! আমাকে মিস করেই তো গানটা গাইছিলে, তাই না?”
“মোটেই না! আমি এমনিতেই গাইছিলাম ”
“গাওনা?”
“উহু, আটটার সংবাদ একবারই হয়?”
সাঁচির কথা শুনে গলা ফাটিয়ে হাসলো ফুয়াদ-
“আচ্ছা, একদিনে একবারই হয়। তবে কালকে শুনাবে তো? আজ বরং গল্প করি!”
“আমি যাই, ঘুম পাচ্ছে খুব।”
সাঁচি চলে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।
“তুমি কিন্তু আমার সুযোগ দিয়েছো একবার। এখন যদি আমার সাথে কথা না বলো তবে আমি সে সুযোগটা পাবো কিভাবে? ”
ফুয়াদের কথা শুনে সাঁচি থেমে গেলো। লোকটা আসলেও একটা বিটকেল লোক। সবসময় ব্লাকমেইল করে কাজ আদায় করে। সামনে এগিয়ে যেতেই দেখলো ফুয়াদ পাটি বিছাচ্ছে, তারপর দুটো বালিশ আনলো কোত্থেকে বা। সবশেষে সাঁচিকে ডাকলো-
“এসো আজ সারারাত জেগে গল্প করবো না না শুনবো। আজ তুমি বলবো আমি শুনবো।”
সাঁচি বাধ্য হয়ে এসে পাটিতে বসলো। ফুয়াদ পাশে শুয়ে ছিলো। সাঁচিকে টানলো-
“শোও না। আকাশের তাড়া দেখতে দেখতে গল্প করার মজাই আলাদা। দেখো, কি মজা লাগছে?”
“আপনার বুঝি আগে এই এক্সপেরিমেন্ট হয়ে গেছে, আপনার রেনুর সাথে?”
ফট করে বলে ফেলে সাঁচি। বলেই বুঝলো ভুল বলে ফেলেছে, ফুয়াদের হাসোজ্জল মুখটা নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেছে।
“সরি, বলতে চাইনি, মুখ থেকে বেড়িয়ে গেছে।”
“ইটস ওকে, আমি কিছু মনে করিনি। আমার ভালো লাগতো আগে ছাঁদে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে। তাই ভাবলাম তোমার সাথে আজ এই প্রিয় একটা কাজ শেয়ার করি।”
সাঁচি ফুয়াদের পাশে শুয়ে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বেশ অদ্ভুত লাগলো। মনেহলো আকাশটা এক্কেবারে কাছে চলে এসেছে। এতো বিশাল আকাশের মাঝে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল ভীষণ। দুজনেই বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো। একসময় সাঁচি বললো-
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই?”
“বলো?”
“আপনি কি বাবার উপর এখনো রাগ করে আছেন? কথা টথা খুব কম বলেন দেখি?”
“উমমম, রাগ হয়তো নেই অভিমান থাকতে পারে চাপা। বাবা আসলে কখনো আমাদের সাথে বন্ধু সুলভ ছিলেন না। আমরা বাবাকে ভয় পেতাম, মনের কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না। তাই বাবার সাথে কখনো সেরকম সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আর তাছাড়া বাবা আমার ভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় গায়ে হাত তুলেছিলেন। সেটা নিয়ে আমার প্রচন্ড রাগ ছিলো। আর যাই হোক এটা করা তার উচিত হয়নি। বুঝিয়ে বলতে পারতো, কিন্তু তা না করে সোজা গায়ে হাত। আবার প্রিয়তার বিয়েটা ওভাবে না দিলেও পারতো বাবা! তুমি জানো,ও কতো ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলো? এই যে সংসারের এতো ঝামেলা সামাল দিয়ে ও পড়ালেখা করে যাচ্ছে, এটা কি এতো সহজ মনেহয় তোমার কাছে? একটা সরকারি ভার্সিটিতেও তো চান্স পেয়ে গেছিলো। অথচ তানভীর এর জন্য পড়তে পারলো না। এতো অল্প বয়সে এতো দায়িত্ব ও আসলে ডিজার্ভ করে না। এসব মনে হলে বাবার উপর রাগ হয় প্রচুর।”
“যত যাই হোক ওনারা আমাদের বাবা মা। আপনি প্লিজ বাবার সাথে কথা বলবেন ঠিক মতো। এখন বয়স হয়ে গেছে, তার নিশ্চয়ই খারাপ লাগে?”
“আমিও বুঝি বাট মন থেকে সারা পাই না। তবুও তো এখন বাবার সাথে অনেক কথাই বলি। কি জানো, বাবা মায়ের যখন বয়স হয়ে যায় তখন আর তাদের উপর রাগ করা যায় না। আমি তাই চাইলেও বাবার সাথে রাগ দেখাতে পারছি না। এখন আর মন থেকেই আসে না ব্যাপারটা।”
“এই তো বুঝতে পেরেছেন। সবাই তো ভুল করেই শেখে তাই না। বাবাও নিশ্চয়ই এখন বোঝে তার কোন কাজগুলো ভুল ছিলো? আমার তো বাবাকে দেখলে কেমন অনুতপ্ত মনে হয়?”
“কি জানি হতে পারে? এবার তোমার কথা বলো তো? আমি খালি নিজের কথা বলি।”
“আমার আর কি কথা? সেরকম স্পেশাল কোনো কথা তো নেই?”
“তোমার কোনো ক্রাশ নেই যাকে খুব পচ্ছন্দ করতে?”
“হুম, আছে তো? আমার সালমান কে ভালো লাগে। না, ওর ছবির জন্য না! ওর অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের জন্য। সে যে কারো বিপদে যেভাবে পাশে দাঁড়ায় সেটা আমার খুব ভালো লাগে।”
“বলিউডি নায়ক? হুম, আসলেও লোকটা ইউনিক। আর পড়ালেখা? ”
“আমার খুব ইচ্ছা আছে এখানকার পড়া শেষ করে একটা বিদেশি ডিগ্রি নেবো। তারপর কোনো ভার্সিটিতে টিচার হয়ে যাবো।”
“অন্য কোনো প্রফেশন ভালো লাগে না? শেষ পর্যন্ত টিচার?”
“আমার পড়াতে ভালো লাগে। আর রেজাল্ট ভালো আছে, সো নিজ ভার্সিটিতে যদি চান্স পেয়ে যাই তবে খারাপ কি? ওটাতে একটা আলাদা মজা আছে। অথবা নিজে একটা ছোটখাটো বিজনেস করলাম! ”
“বাব্বাহ, এতো চিন্তা করে ফেলেছো? আমি তো কোনোদিন ও ভবিষ্যৎ ভাবি না। সামনে যা আসে সেটাই করে ফেলি।”
“সেটাও খারাপ না। এতো প্লান প্রোগ্রাম করে আসলে কোনো লাভ হয় না। কপালে যেটা থাকে সেটাই হয়।”

এভাবেই এটাসেটা গল্প করে দু’জনে রাত পার করে দিলো। পাঁচটার দিকে ফুয়াদ উঠে বাসায় চলে গেলো আর সাঁচি চোরের মতো পা টিপে টিপে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার চেহারায় প্রচ্ছন্ন হাসি ছিলো একটা। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো সাঁচি। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠা হাসিই বলে দিচ্ছিলো আজ সে গভীর প্রশান্তির এক ঘুম দিয়েছে । বহুদিন পর এরকম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে।

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১৮

0

#আজল
#পর্ব-আঠারো

৩৪.

গাড়িতে বসেই সাঁচিকে ফোন দিলো ফুয়াদ। ফোন দিয়েই যাচ্ছে দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু সাঁচি ফোন ধরছে না। কিছুক্ষণ পরে আবার যখন ডায়াল করলো তখন সাঁচির ফোন বন্ধ পেলো। কি ব্যাপার! ফোন বন্ধ হলো কেন? আর ও ফোন ধরলো না কেন? এমন তো কখনো হয়না? চিন্তিত হলো ফুয়াদ। মাকে ফোন দিলো-
“হ্যালো মা! সাঁচিকে একটু দাও তো। ওকে ফোনে পাচ্ছি না।”
“বউমা তো নাই রে বাবু। কি যেন কাজ আছে বলে বের হইছে সেই সকালে। এখনো তো আসলো না?”
“ওওও! আচ্ছা আমি দেখছি কই আছে ও।”
চিন্তিত হয়ে ফোন কাটলো ফুয়াদ। কোথায় গেলো সাঁচি। রাগ করে একেবারে চলে গেলো নাতো?? ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো ফুয়াদের। ইশ! মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর না! সাঁচি! আর তোমায় কষ্ট পেতে দেবো না। প্লিজ শেষ বারের মতো ক্ষমা করো আমায়। শেষ একটা সুযোগ দিয়ো আমাকে আমার ভুলটা শুধরে নেওয়ার। শেষ একবার….আর বলবোনা… কখনো না… বিরবির করতে করতে আবার ডায়াল করে সাঁচির নাম্বারে। নাহ,বন্ধই আছে। টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ফুয়াদের। মেয়েটার কিছু হলো নাতে? শশুরবাড়িতে একবার ফোন দেবে কি? যদি ওখানে যায়? আর যদি না যায় তাহলে? তাহলে ওরা জিজ্ঞেস করলে কি জবাব দেবে? দেবে কি দেবে না এই দ্বন্দ্বে বেশ অনেকটা সময় কেঁটে গেলো। তারপর সাহস করে ফোনটা দিয়েই দিলো।
“হ্যা, মা। সাঁচি কি ওখানে আছে? অনেকক্ষণ থেকে ট্রাই করছি ওর ফোনে কিন্তু বন্ধ পাচ্ছি। ”
” হ্যা, বাবা। এই ঘন্টাখানেক আগেই এসেছে। ওর গায়ে প্রচন্ড জ্বর। আমি ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছি।”
“ওহ! আচ্ছা মা আমি তাহলে আসছি ওখানে। সাথে ডাক্তার নিয়ে আসছি।”
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো ফুয়াদের।
জামাইয়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে আস্বস্ত হলেন সাঁচির মা। মেয়েকে ঐ রকম জ্বর গায়ে বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে মনে মনে ভয় পেয়েছিলো সাঁচির মা। তিনি ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই জামাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে সাঁচির। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব ঠিকই আছে। তিনি নিশ্চিত মনে রান্নাঘরে গেলেন রান্না করতে। মেয়ে জামাই আসবে, ভালোমন্দ কিছু সামনে না দিলে হবে?

ফুয়াদ ওর এক ডাক্তার বন্ধু কে সাথে নিয়ে আসলো। রুমের দরজা খুলে যখন ফুয়াদ ভেতরে ঢুকলো সাঁচি তখন জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডাক্তার বন্ধু টি কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে মাথায় পানি দিতে আর কপালে জ্বলপট্টি দিতে বললো। জ্বর একটু কমলে যেন গোসল করে আর কোনো ভাবেই জ্বর যেন মাথায় উঠে না যায়। সাঁচির এমন বেহাল দশা দেখে ফুয়াদ যেন পাগল হয়ে গেলো। ও নিজেই বালতিতে পানি নিয়ে মাথায় ঢালতে লাগলো। চুলগুলো যত্বের সাথে মুছিয়ে দিলো তারপর কপালে পট্টি দিতে থাকলে। তাপ একটু কমতেই সাঁচির জ্ঞান ফিরলো। বিরবির করে কি যেন বলেই যাচ্ছে সাঁচি। ফুয়াদ ওর ঠোঁটের কাছে কান লাগালো কথাগুলো শোনার জন্য।
” ওকে আমি কখনো মাফ করবো না। এতো কষ্ট দিয়েছে আমাকে! এই সাঁচিকে! কিভাবে পারলো? আমি কি ওর সাথে কোনো অন্যায় করেছি কখনো? নিজের ভালোবাসাটাও তো প্রকাশ করতে পারিনি কখনো? নিজে ভালো নাই বা বাসলো আমায় ভালোবাসতে দিতো? আমার কি দোষ? ওর কপালে যদি ওর ভালোবাসা না থাকে তাতে আমার দোষটা কোথায়? বিনা কারনে আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছো তুমি? তোমায় মাফ করবো না কখনো? দেখো তুমি?”
সাঁচির কথা শুনে কেঁদে দিলো ফুয়াদ। আসলেই তো, মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সত্যি সত্যি কি মেয়েটা কখনো মাফ করবে না ওকে?ওর জীবনে ফিরবে না? না…না… এরকম কখনোই হবে না…আমি হতে দেবো না! তোমায় আমি মানিয়েই ছাড়বো সাঁচি! তুমি যেমন কষ্ট পেয়েছো দরকার হলে আমায় ও ওরকম সাজা দিয়ো তবুও আমায় ছেড়ে যেতে দেবো না আর।
বলতে বলতে পরম মমতায় সাঁচির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো ফুয়াদ। অনেকক্ষণ ধরে ফুয়াদকে খেতে ডাকছিলো সাঁচির মা।
“তুমি খেয়ে নাও বাবা, সেই কখন এসেছো? আমি ওর কাছে বসছি।”
“মা, ও তো খায় নাই কিছু। ওকে একটু খাইয়ে দেই আগে। তারপর আমি খাবো।”
মা কিছু বলতে যেয়েও বলেন না। খুশিই হলেন বরং। জামাই মনেহয় মেয়েকে একটু বেশিই ভালোবাসে।
“আচ্ছা, আমি তবে প্লেটে করে খাবার এনে দিচ্ছি। ”
মাথা নাড়লো ফুয়াদ। কিছুক্ষণ পরেই একটা প্লেটে কিছু ভাত আর তরকারি নিয়ে ফিরলো সাঁচির মা। ফুয়াদ ডাকলো সাঁচিকে-
“এই সাঁচি, ওঠো বাবু, একটু খেয়ে নাও!”
“আমি খাবো না আম্মু! বিরক্ত কোরো না তো যাও?”
“আমি আম্মু না, ফুয়াদ। তোমার ফুয়াদ। ”
“আপনি!আপনি কখন এসেছেন? কেন এসেছেন এখানে? আরো কিছু বলতে চান? আরো কোনো অতীত আছে আপনার?”
উঠে বসার চেষ্টা করে সাঁচি। ওকে ধরে বসিয়ে দেয় বালিশে ঠেস দিয়ে। নিজে বসে ওর সামনে।
“এমন বলে না,সোনা। আর কিছুই বলবো না তোমায়। এখন তুমি বলবে আর আমি শুনবো।” ভাতের গ্রাস বাড়িয়ে দেয় সাঁচির দিকে। সাঁচি মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“খাবো না। দয়া দেখাতে এসেছেন? প্লিজ চলে যান, আপনার দয়া আমার চাই না! প্লিজ যান আপনি!”
“ছি, বাবু! আমার কি সে ক্ষমতা আছে? আমি তো বরং বরাবরই তোমার দয়া নিয়েই এসেছি। আজও প্লিজ আমায় দয়া করো একটু, খেয়ে নাও না। ওষুধ খেতে হবে তো?”
” খাবো না বললাম তো?”
“আচ্ছা, আমার যখন জ্বর হয়েছিল, তুমি কি দয়া করে আমার সেবা করেছিলে?”
” উহু, আমি তে ভালোবেসে করেছিলাম?”
“আমিও ভালোবেসেই করছি। প্লিজ খাও, তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাবো না!”
“তবুও খাবো না। আপনি না খেলে আমার কি?”
“আচ্ছা ঠিক আছে যাও, আমি খাবো না কিন্তু তোমায় খেতে হবে।”
বলেই জোর করে সাঁচির মুখে একগ্রাস ভাত তুলে দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে রাখলো। যাতে ভাত ফেলে দিতে না পারে। সাঁচি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ভাত গিলো নিলো। আবার দিলো, আবার গিললো। দুই লোকমা খেয়েই পানি খেলো সাঁচি, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই বমি করে ফুয়াদের গা ভাসিয়ে দিলো। ফুয়াদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সাঁচি। এখন সাচির নিজেরই লজ্জা লাগছে। এরকম টা তো করতে চায়নি ও! ফুয়াদ হাসলো একটু
“লজ্জা পাওয়ার কোনো দরকার নেই। জানি, তুৃমি ইচ্ছা করে করোনি। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি, তোমার ড্রেস চেন্জ করে দেবে। আমি ততক্ষণে গোসল দিয়ে আসি।”
সাঁচি সেভাবেই বসে থাকলো। মাকে ডেকে দিয়ে ফুয়াদ ফ্রেশ হতে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে আবার সাঁচিকে অল্প একটু খাইয়ে দিয়ে সেই প্লেটের বাকিটুকু নিজে খেয়ে নিলো ফুয়াদ। তারপর সাঁচিকে ওষুধ খাইয়ে দিলো। খুব যত্নের সাথে সাঁচিকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা টেনে দিলো, তারপর মাথায় মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
“ঘুমাও। আমি পাশেই আছি।”
সাঁচি ঘোলা চোখে চেয়ে সব দেখছে।
“যতই করেন, তবুও আপনাকে মাফ করবো না, কিছুতেই না? অনেক কষ্ট দিয়েছেন আমায়।”
“আচ্ছা, করোনা মাফ। এখন ঘুমাও তো! তোমার জ্বর ভালো হোক তখন আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো, ওকে?”
বলেই কপালে একটা চুমু দিলো।
সাঁচি চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর ফুয়াদ তা দেখে মুচকি হাসে।

দুইদিন পর সকালের দিকেই সাঁচিকে দেখতে ফুয়াদের বাবা, মা, প্রিয়তা, প্রিতি, তানভীর সবাই এসেছে। সকালের দিকে সাঁচির জ্বর কমেছে একটু। যদিও গত দু’দিন সারারাত জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকেছে প্রচুর, ইচ্ছা মতো কেঁদেছে, ফুয়াদ ওকে সান্তনা দিতে আসলে ফুয়াদকে মেরেওছে। শেষে না পারতে ফুয়াদ ওকে জোর করে জাপটে ধরে শুয়ে ছিলো। শারীরিক দূর্বলতায় ফুয়াদের সাথে পেরে উঠতে না পেরে শেষে হার মেনে ওভাবেই ঘুমিয়েছে। সকালে সবাইকে একসাথে দেখে খুব খুশি হলো সাঁচি। ওর শাশুড়ীর মা কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। কেঁদে দিলো সাঁচি। এরা সবাই তাকে ভালোবাসে, শুধু যার ভালোবাসার জন্য সে অপেক্ষা করেছে সেই আসেনি। এখন যখন এসেছে, তখন মনে হচ্ছে বাধ্য হয়ে এসেছে। ফুয়াদের কি কখনো ইচ্ছা ছিলো ওকে ভালোবাসার? রেহনুমা যদি সুখে না থাকতো তাহলে কি ফুয়াদ এতো সহজে ফিরতো ওর কাছে? নাকি নিজের গিল্টি ফিলিংস দূর করার জন্য রেহনুমা কে আবার জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো? হিসেব যেন ফুরায় না সাঁচির। ফুয়াদ কি কখনো বুঝবে এই সাঁচিকে? অবহেলার স্বাদ কেমন হয় সেটা কি বুঝে ফুয়াদ? কতবার সুযোগ দিতে চেয়েছে ফুয়াদকে? এখন তো বিশ্বাস টাই নড়বড়ে হয়ে গেছে! মনেহয়, সবকিছু মিথ্যা মায়াজাল। সত্য কোথায় আছে? সাঁচি শাশুড়ীর কোলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে যায়।
“কি রে মা! কি হয়েছে? এতো কাঁদছিস কেন? শরীর তো ভালো হয়ে যাবে? এইজন্য এতো কাঁদতে হয়?”
সাঁচি চুপ করে থাকে।
“আমার ছেলেটা বুঝি তোকে বেশিই জ্বালায়? শুধু দূরে দূরে থাকে? তাই কাঁদছিস?”
বিছানায় উঠে বসে মুখ মোছে সাঁচি-
” না মা এমনিই। আপনারা এসেছেন, খুশি লাগছে খুব।”
তখনি প্রিয়তা মেয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলো-
“ওহ ভাবি, কি গো তুমি! ভাইয়া এলো, কোথায় ভাইয়ার সাথে সময় কাটাবে তা না জ্বর বাধিয়ে বসলে। কি করে হলো বলোতো?”
প্রিতিকে কোলে বসালো সাঁচি। প্রিয়তার কথা শুনে হাসলো একটু কিছু বললো না।
” ভাবি, সামনে আমার ম্যারেজ ডে, জানো তো?”
মাথা নারে সাঁচি। ভাবছি এবার একটু অন্যভাবে সেলিবেট করবো। তোমায় কিন্তু সাথে থাকতে হবে?”
“অবশ্যই থাকবো। কি করতে চাও বলো?”
প্রিয়তা কিছু বলতে মুখ খুলতেই ফুয়াদ রুমে ঢুকে-
” এই প্রিয়, তোকে তানভীর ডাকছে, যা তো শুনে আয় দেখ কি বলে।”
প্রিয় মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। শাশুড়ী মাও উঠে পরে। ফুয়াদ কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপে-
“বাহ, এই তো জ্বর কমে গেছে। এখন চটপট গোসল সেরে নাও তো। আমরা আজ বাসায় যাবো।”
“আমি যাবে না।”
ফুয়াদ এসে সাচির পাশে বসে, গালে হাত দিয়ে বলে-
” শরীর বেশি খারাপ লাগলে আমরা এখানেই বরং দুদিন থাকি, পরে যাবো।”
“আমি কখনোই যাবো না আর।”
“যেতেই হবে। কেন যাবে না?”
“জোর করবেন আমাকে? কেন জোর করবেন? কোন অধিকারের বলে?”
“তোমাকে ভালোবাসার অধিকারে।”
ফুয়াদের কথা শুনে কিছুক্ষণ হাসলো সাঁচি –
“এতো অভিনয় কি করে করেন বলুন তো! টায়ার্ড লাগে না? আর মানুষ কে বুঝি মানুষ মনে হয় না? আজকে ইচ্ছে হলো ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিলেন আবার কালকে লাথি মারলেন! একই সাথে এতো ক্যারেক্টার কিভাবে প্লে করেন?”
ফুয়াদ অসহায় দৃষ্টিতে সাঁচির দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা অতি দুঃখে পাগল হয়ে গেছে মনেহয়! ফুয়াদ এগিয়ে এলো-
“আমার ভুল হয়ে গেছে সাঁচি। আমায় ক্ষমা করে দাও। এরকম ভাবে বলো না প্লিজ!”
“হুহ,ক্ষমা! আমি যদি আপনার সাথে এরকম করতাম আপনি ক্ষমা করতেন আমায়? খুব এসেছে ক্ষমা চাইতে?”
মুখ ঘুরিয়ে নেয় সাঁচি। ফুয়াদকে তার আজকাল অসহ্য লাগে।
“আমার একটু কাজ আছে, তুমি গোসল সেরে খেয়ে নিয়ো দুপুরে কেমন। আমি সন্ধা নাগাদ চলে আসবো।”
ফুয়াদ যেন সাঁচির কথা শুনতেই পায়নি। ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো। যেন পালাতে পারলে বাঁচে!

সন্ধায় বাড়ি ফিরে ফুয়াদ শুনলো সাঁচি খায়নি দুপুরে। শুনে মৃদু হাসলো, যেন ও জানতো এরকম কিছুই হবে। সাঁচি ঘুমিয়ে ছিলো, ফুয়াদ ফ্রেশ হয়ে সাঁচিকে ডাকলো,ঘুম ঘুম চোখে সাঁচি তাকালো, ফুয়াদ খালি গায়ে ওর দিকে ঝুকে আছে। সাঁচি ধরমর করে উঠে বসলো-
“একি! আপনি খালি গায়ে কেন?”
“কেন ভালো লাগছে না?”
দুষ্ট হাসি দেয় ফুয়াদ।
” মোটেই না, ছি। কাপড় পরুন তাড়াতাড়ি। ”
“আগে তো খুব চাইতে আমায় শার্টলেস দেখতে?”
” এখন চাই না।”
গম্ভীর গলায় উত্তর দেয় সাঁচি। ফুয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে একটা গেন্জি পরে নেয়। রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে সাঁচির পাশে বসে-
“খাওনি কেন দুপুরে? ”
“ইচ্ছে হয়নি।”
ভাতের গ্রাস বাড়িয়ে ধরলো ফুয়াদ। সাঁচি মানা না করে খেয়ে নিলো। বেশি অবশ্য খেলো না। ফুয়াদ আর জোর করে না। প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ করেই দুকাপ কফি নিয়ে ফেরত আসে। মগ দুটো বারান্দায় রেখে এসে সাঁচিকে ডাকে-
” এসো বারান্দায় বসি। তোমার সাথে কথা আছে? ”
সাঁচি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নামে। মাথাটা ঘুরছে, বসে পরে আবার।
” আমি ধরি?”
” না, আমি পাড়বো।”
বারান্দায় এসে সাঁচির হাতে একটা মগ দেয়। সাঁচি কফিতে চুমুক না দিয়ে ধরে থাকে-
“বলুন,কি বলবেন?”
“আচ্ছা বলোতো, বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত আমি কি কখনো তোমার সাথে কোনোরকম অশোভন আচরণ করেছি?”
“নাহ।”
“তোমার সাথে প্রতারনা করেছি?”
এবার সাঁচি কনফিউজড হয়ে যায়। কি বলবে? পাষ্ট গোপন রাখাও তো এক হিসেবে প্রতারনা। সাঁচি চুপ থাকে। ফুয়াদ শ্বাস ছাড়ে লম্বা-
“দেখো,আমি যদি চাইতাম তাহলে তোমার সাথে সব করতে পারতাম, সব। তুমি কি বাঁধা দিতে? দিতে না! কিন্তু আমি তা করিনি? কেন করিনি? কারন আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কের একটা সুন্দর সুচনা হোক। সময় লাগে লাগুক কিন্তু তুমি আমি যখন একসাথে পথ চলতে শুরু করবো তখন সেই পথচলা যেন অনুকরণীয় না হয়ে অনুসরণীয় হয়! কোনো ধরনের অবিশ্বাস, কপটতা, চতুরতা যেন আমাদের মধ্যে না আসে! তাই আমি তোমার কাছে কিছুই লুকাই নাই। আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। নিজের স্বামীর প্রাক্তনের গল্প শুনতে কার ভালো লাগবে? তবুও তুমি শুনেছো, ধৈর্য্য সহকারে শুনেছো। এজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। ”
একটু থেমে দম নেয় ফুয়াদ।
” তুমি কিন্তু বারবার আমার কাছে জানতে চেয়েছো…. তারপরেই আমি বলছি। তার আগে তোমাকে অনেকদিন এভোয়েড করেছি, কষ্ট দিয়েছি। এই কারনে যে,আমার মনে হতো এসব কথা জানলে তুমি ব্যাপারগুলো কিভাবে নেবে? তুমিও যদি ভুল বুঝে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাও? অনেক সাহস জুটিয়ে তোমায় কথাগুলো বলেছিলাম এই ভরসায় যে তুমি অন্তত বুঝবে? বুঝেওছো! এবং বুঝে তুমি যে কাজটা করেছো সেটার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। আসলেই রেহনুমার সাথে আমার দেখা হওয়াটা জরুরি ছিলো। ওর ক্ষমা না পেলে জীবনটা কেমন অভিশপ্ত লাগছিলো। বাচ্চা বয়সে আমি আবেগে ভেসে যেয়ে ওর জীবনে যে ঝড় তুলেছিলাম সেটার জন্য অনুশোচনা হতো সবসময়। তুমি আমাকে সেই ভার থেকে মুক্তি দিলে। ”
“আর যদি রেহনুমা ক্ষমা না করতো তবে কি করতেন? এভাবেই কি ফিরে আসতেন আমার কাছে?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ফুয়াদ, যেন কথা গুলো সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের মনে-
“তোমাকে আমি আগেও বলেছি, আমার যদি সেরকম কোনো ইচ্ছা থাকতো তবে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না মোটেও। হ্যা, রেহনুমা যদি ভালো না থাকতো তাহলে হয়তো তোমার কাছে ফিরতে আরো একটু দেরি হতো আমার তবে আমি তোমার কাছেই ফিরতাম এটা শিওর। তার আগে আমি হয়তো রেহনুমার ভালো থাকার জন্য কিছু ব্যাবস্থা করতাম। সেটা করতে যেয়ে হয়তো আমার কিছু সময় নষ্ট হতো ওর পিছনে!”
“হুহ, সময়! বিয়ের নয় দশ মাস পার হয়ে গেছে আর এখন আপনার বোধোদয় হয়েছে? হাসালেন আমায়!”
হঠাৎ সাঁচির হাত দুটো আকরে ধরলো ফুয়াদ-
” আমি তোমার কাছে একটা সেকেন্ড চান্স চাই, সাঁচি! প্লিজ! না করবে না? তুমি আমার জন্য যে কষ্টগুলো সহ্য করেছো সেগুলোকে সুখে রুপান্তর করে তোমায় সুধ সমেত ফেরত দিতে চাই। প্লিজ! প্লিজ!প্লিজ! আমায় ফিরিয়ে দিয়ো না? তুমি যেভাবে থাকতে চাও সেভাবেই থাকে শুধু তোমার ইচ্ছা গুলো পূরন করার অধিকার টুকু আমায় দাও। আমি তোমায় জোর করবো না কোনোদিনও। যেমন তুমি আমায় সময় দিয়েছো তেমনই আমি তোমায় দিলাম অফুরন্ত সময়। যেদিন তুমি নিজে আমায় মাফ করে গ্রহন করবে সেদিন আমি তোমায় নিজের করবো। তার আগে নয়।”
ফুয়াদের এরকম অনুনয় দেখে সাঁচি কাঁদে, কতদিন না জানি এরকম কিছুর অপেক্ষা করেছে সাঁচি। অথচ আজ যখন এরকমটা হচ্ছে তখন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। প্রচন্ড কান্না মনটাকো ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। এটা কি সব কিছু ফিরে পাওয়ার কান্না নাকি প্রিয় পুরুষ নতজানু হচ্ছে তার কাছে সেই কান্না, বোঝে না সাঁচি। তারও যে আজ হেরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে? নিজেকে সমর্পনের ইচ্ছে হচ্ছে? কিন্তু না, এতো তো সহজ নয় সবকিছু? এখনো যে প্রিয় তিনটি ম্যাজিক ওয়ার্ড শোনা হলো না? তাহলে কিভাবে সমর্পিত হতে পারে সে? আরো কিছুদিন তবে নেয়া যাক ভালোবাসার পরীক্ষা। সাঁচি মাথা নেড়ে অস্পষ্ট ভাবে বলে-
“যাও, দিলাম তোমায় সুযোগ, আমায় মানিয়ে দেখাও দেখি???!!!

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১৭

0

#আজল
#পর্ব-সতেরো

৩২.

গত পাঁচটা মাসে জীবনের মোড়টা পাল্টে গেছে অদ্ভুত ভাবে। যে জীবনটাকে আগে বোঝা মনে হতো, বাঁচার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছিলো, সেটাই হঠাৎ করে এতোটা সুখকর, রোমাঞ্চকর আর প্রিয় হয়ে উঠবে তা জানা ছিলো না প্রিয়তার! আজকাল অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে থাকে। এই মনের ভালোলাগার চক্করেই কিনা কে জানে তার পড়ালেখার গতিও যেন বেড়ে গেছে। রেজাল্ট ও ভালো হচ্ছে খুব। হবে নাই বা কেন? ওর পরীক্ষার দিনগুলোতে প্রিতিকে যে তানভীর ই সামলায় এখন। যে জীবনটাকে একসময় বাবার দেয়া অভিশাপ মনে হতো সেটাকেই আজ আশির্বাদ মনে হচ্ছে। আজকাল ফড়িঙের মতো উরে বেড়ায় প্রিয়তা। মনেহয়, ইশ! জীবন টা এতো সুন্দর কেন?

তানভীরও আজকাল নিজের মধ্যকার পরিবর্তন টা বেশ টের পায়। প্রিয়তার সাথে অভিনয় করতে করতে কখন যে ওকে নিজের মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছে নিজেই জানে না তানভীর। আজকাল
অফিস থেকে বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে, মেয়েটার জন্য অদ্ভুত টান অনুভব করে আবার বউটার জন্যও বেশ একটা অন্যরকম অনুভুতি জন্মেছে মনে। ওর এখন নিজেকেই কেমন অচেনা মনে হয়। মনেহয় ও আর আগের তানভীর নেই, নতুন জন্ম হয়েছে তার। সেদিন যদি প্রিয়তার বাবা ওসব না বলতো তাহলে এই সুন্দর ব্যাপারগুলো জানা হতো না তানভীরের। হ্যা, ইচ্ছা করলে কথাগুলো ও নেগেটিভ ভাবেও নিতে পারতো! নেগেটিভ ভাবে নিলে কেউ কিছু করতে পারতো বলে মনে হয় না। যদি ও প্রিয়কে ডিভোর্স ও দিতো তবুও। কিন্তু কেন জানেনা সে ব্যাপারটাকে একটা এক্সাম হিসেবে নিয়ে নিলো। মনে হলো সারাজীবন তো একভাবে জীবন কাটালাম এবার একটু শশুর বাবার কথা শুনে দেখি।
তানভীর সারাজীবন নিজের মর্জি মতোই চলেছে। বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে। যথেষ্ট আমোদ ফুর্তি করেই জীবন কাটিয়েছে। পড়ালেখা, ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়ানো, মেয়ে বান্ধবী কোন কিছুর কমতি হয়নি জীবনে। তারপর হঠাৎ করে একদিন বাবা মারা গেল, বড় ভাইয়েরা সবাই যার যার বিজনেস, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো তখন ওর হয়ে গেল বিপদ! বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র গার্মেন্টস এর বিজনেসটা দিন দিন লসে যাচ্ছিলো। মায়ের অনুরোধে ও সেটার হাল ধরলো। তারপর সেই বিজনেস এক্সপান্ড করে নিজে আরো নতুন দুটো বিজনেস শুরু করে দাঁড় করিয়েও ফেললো। বয়স হয়ে যাচ্ছিলো তখন প্রিয়র সাথে প্রস্তাব আনে বড় ভাবি। দেখে ভালোই লাগে, মনে হয় ঘরে মাকে দেখে রাখবে, এইরকম মেয়ে হলেই ভালো। ওর তো বাইরের জগৎ আছেই। সে ভাবেই এতদিন চলেছে। সেদিন প্রিয়র বাবা যেন ওর চোখ খুলে দিলো। ও নিজেও মনেহয় হাঁপিয়ে গেছিলো ঔ জীবনে। এখন ঠিক রাস্তায় ফিরে এসে জীবনটা বেশ মজায় কাটছে। মনে হচ্ছে একেবারে কলেজ লাইফের প্রেম। প্রিয় বেশ রোমান্টিক মেয়ে। একেবারে অন্যরকম, কোনোরকম বাড়াবাড়ি নেই ওর মধ্যে, নেই কোন বাহুল্যতা। এতোদিন অবহেলা করেছে সেই জন্য বরং বারংবার আফসোস হয় তানভীরের। চারটা বছর নষ্ট করেছে মনেহয়। তবুও ভালো সবকিছু শেষ হওয়ার আগেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে! মনে মনে শশুর কে ধন্যবাদ জানায় তানভীর। গাড়িতে বসে ভাবতে ভাবতেই ফোন আসে প্রিয়র।
“এই কোথায় তুমি? আজ এখনো এলে না যে?”
“এই তো গাড়িতে আছি। চলে এসেছি প্রায়। কেন গো, আমাকে মিস করছিলে বুঝি?”
“তোমার মেয়ে খুজছে তোমাকে?”
“আর তুমি?”
“ঠিক আছে, রাখলাম এসো তাড়াতাড়ি। ”
লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলো প্রিয়। আর ওদিকে তানভীর হাসছে মিটিমিটি।

“এই শোনোনা, ভাইয়া আসবে কাল। বাবা মা যেতে বলছিলো। যাবো?”
“হ্যা, অবশ্যই যাবে!এবার বাবা মাও তো এলেন অনেকদিন পর তো যাবে না? আমিও যাবো।”
“সত্যি? খুব মজা হবে।”
” এই ভাইয়া ভাবীর মধ্যে সব ঠিক আছে তো? নতুন বউ ফেলে এতদিন কেউ এভাবে বাহিরে থাকে?”
“সেই কতদিন আগে দেখা! তখন তো সব ঠিকই মনে হচ্ছিল। ”
“আচ্ছা শোনোনা, সামনে তো আমাদের ম্যারেজ ডে, এবার ভাবছিলাম সবাই মিলে দশদিনের একটা ট্যুর দিবো। কেমন হবে বলোতো?”
“খুব ভালো হবে? বিয়ের পর তো কোথাও যাওয়া হয়নি সেরকম। ভাইয়া ভাবীর ও এই চান্সে সেকেন্ড হানিমুন হয়ে যাবে।”
প্রিয় বলে।
“আচ্ছা, ভাইয়া আসুক। কয়েকদিন যাক, তারপর ভাইয়ার সাথে কথা বলে সব ফাইনাল করবো। এখন এসোতো কাছে?”
“কেন? কি করবে?”
“না আসলে কিভাবে বলবো?”
প্রিয় তানভীরের কাছে যেতেই তানভীর ওকে জরিয়ে ধরলো দু হাত দিয়ে-
“এখন বউটাকে আদর করবো তো।”
তানভীর ফিসফিস করে বললো।
“ছি! কি বলো? লজ্জা সরম নাই কিছু?”
“অনেক আছে? এই যে বাতি বন্ধ করলাম, আসো।”
তানভীর প্রিয়কে কাছে টানে আর প্রিয় ভীষন ভালোবাসায় তানভীরের বুকে মুখ লুকায়।

৩৩.

ফুয়াদের ফ্লাইট ল্যান্ড করলো সকাল দশটায়। সব প্রসেসিং শেষ করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে বারোটা বেজে গেলো। ফুয়াদ ভেবেছিলো আজও সাঁচি ওকে নিতে আসবে। বের হয়ে দেখলো বাবা আর তানভীর এসেছে। বাবাকে সালাম করে লাগেজ গুলো গাড়িতে তুলে বসলো ফুয়াদ। পাশে বাবা বসেছে, তানভীর সামনে।
“ইস! কতদিন পর মনে হলো প্রান খুলে শ্বাস নিচ্ছি। ”
“হুম, নিজের দেশের থেকে শান্তি আর কোথাও নাই, ভাইয়া। আপনার কাজ কেমন কাটলো?”
“ভালো।”
কথা বার্তা বলতে বলতেই বাসায় চলে আসলো ওরা। বাড়িতে ঢুকে মাকে সালাম করে প্রিতিকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর দিলো। অথচ তার চোখ খুজে বেরাচ্ছে কাউকে।
“কাকে খুঁজছো, ভাইয়া? ”
দুষ্টুমি করলো প্রিয়তা।
“ভাবি কে?”
“হু। কোথায় ও?”
“আজ তো ভাবি তোমার সব ফেবরিট আইটেম রান্না করেছে। গোসলে ঢুকেছিল। হয়েও গেছে মনেহয় এতোক্ষণে। তুমি যাও না ফ্রেশ হয়ে নাও। দুপুরে খাব একসাথে। ”
“হুম।”
নিজের রুমে ঢুকলো ফুয়াদ। সাঁচি আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল আওরাচ্ছিলো। ফুয়াদকে দেখে থেমে গেল-
“ওহ!চলে এসেছেন? আমি ভাবলাম আরো লেট হবে মনে হয়?”
ফুয়াদ সাঁচিকে দেখছিলো অপলক। সাঁচি শুকিয়ে গেছে অনেক। চোখের নিচে কালি, চেহারা যেন উজ্জ্বলতা হারিয়েছে। আগের সেই হাসিখুশি সাঁচি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে!
“তোমার কি অসুখ করেছে? কই ফোনে তো কিছু বললে না?”
“নাতো! অসুখ করবে কেন? এই তো একদম ফিট আছি। ”
“তবে এতো শুকিয়ে গেছো কেন? চোখের নিচে কালি?”
“আরে লাষ্ট সেমিস্টার ছিলো তো! পড়ালেখার অনেক চাপ ছিলো।”
“সত্যি বলছো?”
“জ্বী, জনাব। এবার আপনি দয়া করে ফ্রেশ হয়ে নিন। খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমাবেন তো নাকি? তা না হলে শরীর আবার খারাপ লাগবে।”
একটু শুকনো হাসি দিলো সাঁচি।
“আপনার কাপড় সব জায়গা মতো রাখা আছে। আপনি গোসল করুন আমি ততক্ষণে খাবার রেডি করি।”
ফুয়াদ সাঁচির দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ। সাঁচির অসস্তি হচ্ছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে সামনে থেকে সরে এলো।

খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে ফুয়াদ। কেমন একটা অসস্তি ফিল হচ্ছে? সাঁচিকে কেমন অচেনা অচেনা লাগছে! মেয়েটার মনে কি কিছু চলছে? কিছুক্ষণ পর সাঁচি আসলো। বিছানার এক কোনো শুয়ে পরলো। ফুয়াদ সাঁচির গায়ে হাতটা রাখতেই সাঁচি ধরমর করে উঠে বসলো-
“আপনি ঘুমাননি এখনো?”
“নাহ, ঘুম আসছে না! কি হয়েছে এভাবে চমকে উঠলে যে? তোমারিতো বর।”
“আমি ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে গেছেন?”
“ও, তাই তুমি এতে লেট করে আসলে? কি হয়েছে সাঁচি? কোনো সমস্যা?”
“নাহ,কি হবে? ঘুমিয়ে পরুন প্লিজ।”
সাঁচি উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পরলো। ফুয়াদও কিছুটা মন খারাপ ভাব নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘুম আসছে না। এতোদিন পর সাঁচি ওকে দেখলো অথচ ওর মধ্যে কোনো খুশি বা আনন্দ নেই। একটু ঠিক মতো কথাও বললো না! ওর কি সাঁচিকে কাছে টানা উচিত? খুব ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটাকে একটু আদর করতে। এতোগুলা দিন ওর থেকে দূরে, ভীষণ মিস করেছে ফুয়াদ সাঁচিকে। অনেকটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে মাঝের বালিশটা সরিয়ে নিজের দূরত্ব কমাতে পারলো না ফুয়াদ।

ঠিক তার দুদিন পর সাঁচি ফুয়াদকে বললো-
” আজ কি আপনি বিজি আছেন?”
“কেন বলতো?” অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল ফুয়াদ।
” বিকেলে একটু সময় দিতে হব।”
ফুয়াদ হাতে ঘড়ি পরতে পরতে থেমে গেলো-
“কাকে? তোমাকে?”
“নাহ! কেউ একজন আপনার সাথে দেখা করতে চায়। আজ বিকেলে, রেড চিলিস এ চলে আসবেন।”
“কে? কে দেখা করবে?”
” আগে আসুন তো? তারপর দেখবেন?”
ফুয়াদ ঘার হেলিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর সাঁচি শাশুড়ী মাকে জরুরি কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। আজ সারাদিন ঘুরবে ও একা একা। আজ যে সাঁচির মনটা ভীষন খারাপ! সাহস করে কত্তো বড় একটা কাজ করে ফেললো সাঁচি। ফুয়াদের জন্য খুব জরুরী ছিলো কাজটা। রিকশায় উঠে ভীষন কান্না পেলো সাঁচির। চোখ যেন আজ কোনো বাঁধা মানছে না….ঝর্নাধারার মতো জল গড়িয়ে পরছে চোখ থেকে। বিয়ের পর থেকে নিজেকে কতটা ছোট করেছে ফুয়াদের কাছে! তাই বুঝি আজও ফুয়াদ ওকে ওর প্রাপ্য সন্মানটুকু দিলো না। এই যে বিদেশ থেকে ঘুরে এলো, কত কিছু নিয়ে এলো ওর জন্য। ওতো এসব চায়নি ফুয়াদের কাছে। এর চাইতে যদি একবার বলতো, তোমায় অনেক মিস করেছি সাঁচি, কিছু ভালো লাগতো না, শুধু তোমায় মনে পড়তো। তাহলেই খুশি হয়ে যেত সাঁচি। কিন্তু বললো না, কিছুই বললো না। ফুয়াদ কি বোঝে না! সম্পর্কে মনের কথা প্রকাশ করাটা কতটা জরুরী? সবকিছু বুঝে নিতে হবে বললে কি দায় মিটে যায়? যায় না? তাই সাঁচি আজ চলে যাচ্ছে! যেদিন ফুয়াদ ওকে ওর প্রাপ্য সন্মান দিয়ে ওকে নিয়ে আসবে, সেদিনই ও ফেরত আসবে! তার আগে নয়। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদেই যাচ্ছে সাঁচি। কাঁদুক মেয়েটা। কেঁদে নিজেকে হালকা করুক। হয়তো এই কান্নাই ওর জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনবে?!

রিসিপশনে জিজ্ঞেস করতেই কোনার দিকের একটা টেবিল দেখিয়ে দিলো ফুয়াদকে। ফুয়াদ দূর থেকে দেখলো ওখানে একটা মেয়ে বসে আছে। গোলগাল,ফর্সা সুন্দর মতো মুখশ্রী। চেনা চেনা লাগছিলো, বাট মেমোরি ঠিকঠাক ক্যাঁচ করতে পারছিলো না। কাছে যেতেই মুখ আয়বরটা স্পষ্ট হলো। ফুয়াদ যেন জায়গার ফ্রিজ হয়ে গেলো। রেহনুমা! কিভাবে সম্ভব! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না! রেহনুমা এখানে কেন আসবে? কিভাবে? তাহলে কি সাঁচি ওর সাথেই মিট করার কথা বলছিলো? সাঁচি কিভাবে ওকে খুজে পেলো? ফুয়াদের হাঁটার গতি স্লো হয়ে গেছে। রেহনুমা মনেহয় ততক্ষণে ওকে দেখতে পেয়েছে! ওর দিকে হাতের ইশারা করলো। ফুয়াদ ধীরে ধীরে ওর কাছে যেয়ে সামনাসামনি চেয়ার টেনে বসলো। রেহনুমা হাসলো একটু ওকে দেখে-
“তুমি তো দেখছি আগের মতোই সুন্দর আর হ্যান্ডসাম আছো? ওহ, সরি! তোমাকে তুমি বলে ফেললাম। ”
” ইটস ওকে। তুমি!তুমি কেমন আছো রেহনুমা? আর এখানে কিভাবে?”
“কেন তোমার বউ বলেনি বুঝি? আজ তো আমার সাথে তোমার এই মিটিং ওই ঠিক করেছে?”
“বলেছিল, বাট তোমার সাথে এটা বলেনি?”
“বেশ ভালোই। তা কেমন আছো? এতো সাকসেসফুল হয়ে কেমন লাগছে?”
“তোমার খবর বলো। তুমি কি ভালো আছো? তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা? রেহনুমা, তোমায় আমি অনেক খুঁজেছিলাম।”
“কেন খুঁজেছিলে? ”
হাসলো রেহনুমা।
“সরি বলার জন্য। আমার সেদিন মাথা একদম ঠিক ছিলো না। তুমি ছিলে না, জীবনে তখন এতোকিছু হচ্ছিল যে আমি আমার মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। তারপর যখন আমার হুশ আসে আমি বুঝতে পারি, কতোবড় ভুল করে ফেলেছি আমি। তোমার মোবাইলে যে কত হাজার বার ফোন করেছি আমি নিজেই জানি না। বাট তোমার ফোন বন্ধ পেয়েছি। ”
একদমে কথাগুলো বলে থামে ফুয়াদ। রেহনুমার ঠোঁটে মুচকি হাসি।
“আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি, ফুয়াদ। সেদিন ই ক্ষমা করে দিয়েছি যেদিন আমি আনিসকে পেয়েছি।”
“আনিস?”
“আমার হাজবেন্ড”
“তোমার হাজবেন্ড? ওনার নাম না….”
“আমার সেকেন্ড হাজবেন্ড। তোমায় সব বলবো বলেই তো এলাম এখানে! সেদিন যখন তোমার কাছে ফোন দিলাম,আমি পুরোপুরি বিদ্ধস্ত ছিলাম। বাবা বিয়ে দিলেন, আমি তোমাকে ভুলে সব ভুলে মেনে নিয়ে সংসার করতে চাইলাম। কিন্তু ঐ যে বলে না, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়- কথাটা যেন আমার জন্যই তৈরি। আমার স্বামীটা আমাকে ভীষন ব্রুটালি মারতো মাঝে মাঝে জানো? মদ খাওয়ার অভ্যাস ছিলো, মেয়ে মানুষের নেশা ছিলো মোটামুটি সব ধরনের খারাপ অভ্যাস তার মধ্যে ছিলো। তো সে যেদিন যেদিন মদ খেতো আমায় মারতো ভীষন আর আর….ফিজিক্যাল টর্চার তো ছিলোই। তখন আমার শুধু মনে হতো, এরচেয়ে তো তোমাকে বিয়ে করলেই ভালো হতো। গাছ তলায় সংসার করতাম, তবুও এই জীবন থেকে ভালো হতো! একবার ভাবলাম, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে অভিশাপ দিয়েছো তাই আমার এই হাল। শুধু মনে হতো তোমার কাছে ফেরত যাই। একবছরে এতোটাই অসহ্য হয়ে গেছিলাম যে পালিয়ে যেতে মন চাইতো। আমার একটা ভাই হলো, বাবা আগে যাও বা খোঁজ নিতো তারপর যেন আকাশের চাঁদ, এতোটাই দূরে সরে গেলো। না পারতে তোমায় ফোন দিলাম, শেষ আশ্রয় মনে করে। আমার বিশ্বাস ছিলো, তুমি আমায় ফিরিয়ে দেবে না। তুমি যখন সেসব কথা বলছিলে তখন মনে হলো, দুনিয়ায় বেঁচে থেকে আর কি হবে? কেউ তো আমাকে চায় না? আমি না থাকলে কারো কিছু আসে যাবে না। জীবনের মায়া না করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। মরতে চেয়েছিলাম গাড়ির নিচে পরে। সেই সব দিন! উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আনিস আমায় বাঁচায়, আশ্রয় দেয়? ও হয়তো আমাকে দেখে কিছু বুঝতে পেরেছিলো, অনেকক্ষণ নাকি আমায় ফলো করেছিলো। ও এতিম কিনা…তাই হয়তো আমায় বুঝেছিলো। মোটামোটি ধরনের একটা চাকরি করতো আনিস। আগে পিছে কেউ নাই। আমাকে ওর বাসায় নিয়ে গেলো। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আমাকে অনেক যত্ন করে সুস্থ করেছিলো। তারপর একদিন আমি আমার জীবনের সব কথা তাকে বললাম। সব শুনে সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। সাথে এটাও বললো, সব বিয়ের সম্পর্কে ভালোবাসা থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই। আমাদের টা না হয় এভাবেই শুরু হোক, মায়া থাক, শ্রদ্ধা থাক, একসাথে থাকলে ভালোবাসা আপনাতেই হবে।
ওর কথাগুলো ভীষন ভালো লেগেছিলো আমার। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আগের স্বামীকে ডিভোর্স দিলাম,তারপর শুরু করলাম নতুন জীবন। আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমি অনেক সুখী। অনেক পরে আমি বুঝেছিলাম, তুমি আমার জীবনে পারফেক্ট মানুষ ছিলে না… আমি তোমায় ত্যাগ করে কোনো ভুল ডিসিশান নেইনি। আমার জীবনের এঞ্জেল আনিস ছিলো তাই ও যে কোন ভাবেই হোক আমার জীবনে এসেছে… একটু দেরিতে এসেছে এই যা। তবে আমি আফসোস করি না…এখন এতো সুখে আছি… আমার সব আফসোস দূর হয়ে গেছে।”
ফুয়াদ চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে…নিজেকে কেমন যেন ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
” কি হলো, এতো চুপ যে? কিছু বলো? তুমি কি জানো ফুয়াদ, তুমি অনেক লাকি?”
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় ফুয়াদ।
” কি? বুঝলে নাতো? এই যে তোমার জীবনের নারী চরিত্র গুলে সবাই তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে, জানো? তোমার বউ, সাঁচি তোমাকে কি পরিমান ভালো যে বাসে তুৃমি ধারনাও করতে পারবে না? এক সময় যে রকম টা আমি তোমায় বাসতাম। তা না হলে কেউ কি স্বামীর প্রাক্তনকে খুজে বে করে এতো কষ্ট করো। তারপর তাকে স্বামীর সাথে মিট করায়? তুমি হলে করতে? বউয়ের প্রাক্তনের সাথে এরকম করতে পারতে? জানি, পারতে না! তাই বলছি, মেয়েটাকে ভুলেও কষ্ট দিয়ো না ফুয়াদ। তাহলে সত্যি সত্যি তোমার পাপ লাগবে কিন্তু? ”
আজ যেনো ফুয়াদের শুনে যাওয়ার দিন! কিছুই বলতে পারে না ফুয়াদ। এইজন্যই বুঝি সাঁচি এতো চুপচাপ ছিলো এই কয়দিন! রেহনুমার কষ্টের ভার থেকে ওকে মুক্তি দিতে চাইছিলো। ইশ! কত না জানি কত কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা? আচমকা সাচির জন্য বুকের ভিতর একরাশ ভালোবাসা ফোয়ারার মতো ছুটলো যেন।রেহনুমার ডাকে ঘোর ভাঙলো –
” আমাকে একটু উঠতে হেল্প করবে?”
ফুয়াদ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে উঠে দাঁড়িয়ে রেহনুমার হাতটা ধরলো। রেহনুমা লজ্জিত ভঙ্গিতে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। তখন ফুয়াদ টের পেলো রেহনুমা প্রেগনেন্ট।
” শেষের দিকে তো তাই একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। ”
রেহনুমা লজ্জা পায়। ফুয়াদ খেয়াল করলো একটা মাতৃত্ব সুলভ সৌন্দর্য রেহনুমার চোখেমুখে খেলা করছে।
“তোমায় পৌছে দেবো? যেতে কষ্ট হবে তো?”
” আনিস এসেছে তো, কোনো কষ্ট হবে না। ও আমাকে একমুহূর্ত একা ছাড়ে না জানো? আমি দোয়া করবো সাঁচিও যেন খুব শিগগিরই তোমাকেও এই সুসংবাদ দেয়। বাবা মা হওয়ার ব্যাপারটা একদম অন্যরকম ফিলিংস।”
ফুয়াদ এবার লজ্জা পেলো একটু। এতোকিছু তো কখনও ও ভাবেই নি! সাঁচি নিশ্চয়ই ভেবেছে? সব মেয়েদেরই তো মা হওয়ার একটা স্বপ্ন থাকে!
রেহনুমাকে এগিয়ে দিয়ে ফুয়াদ গাড়ি নিয়ে যখন বাসার দিকে ছুটছিলো তখন ওর শুধু তীব্রভাবে একবার সাঁচিকে কাছে পেতে ইচ্ছা হচ্ছিল……

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১৬

0

#আজল
#পর্ব-ষোলো

৩১.

ড্রইং রুমের সোফায় বসতে বসতেই খবরটা শুনলো ফুয়াদ। মনটা খারাপ হলো ভীষন, মুখের উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে গেলো। কোথায় ও ভাবলো ঘরে ঢুকেই সাঁচিকে দেখবে মনভরে, তা আর হলো না! সাঁচির মা বিষয়টা খেয়াল করে মুখ টিপে হাসলো একটু-
“বাবা, তুমি ফ্রেশ হয়ে চা নাস্তা খাও, সাঁচি ততক্ষনে চলে আসবে।”
“জ্বী মা।”
সাঁচির পড়ার টেবিলে ওর জন্য আনা জিনিসগুলো সযতনে রাখলো। তারপর ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হতে যেয়ে মনে হলো যে ও নিজের কোনো কাপড় আনেনি। কি পড়বে এখন? হঠাৎ টেবিলে নজর গেলো। একটা বই থেকে অনেকখানি কাগজ বেরিয়ে আছে। কোতুহলী হয়ে কাগজটা টানতেই চোখে পড়লো লেখাগুলো-
“জানি, আপনি পরার মতো কোনো কাপড় আনেননি সাথে। সমস্যা নেই, আমার আলমিরা খুললেই পেয়ে যাবেন আপনার কাপড়। হাতের কাছেই আছে,বেশি কষ্ট করতে হবে না।”
ফুয়াদের মুখে হাসি ফুটলো। মেয়েটা উপরে উপরে যতই কঠোর ভাব দেখাক না কেন ভিতরে ভিতরে ভালোই বাসে ওকে। তা না হলে এতো খেয়াল রাখতো না ওর। আর ওর এই কঠোরতার জন্যও তো সে নিজেও দায়ী। ফুয়াদের ও ইচ্ছে করে আবার নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে, কারো মায়ায় নিজেকে বেঁধে ফেলতে? কিন্তু বড্ড ভয়ও হয় মনের মাঝে, ও তো কারো প্রত্যাশা পূরন করতে পারে না? এবারও যদি কোনো ভুল হয়ে যায়? এমনিতেই একটা ঘা এখনো মন থেকে মুছে যায়নি। সবসময় তারই কন্ঠস্বর যেন কানের কাছে বাজে। সেটাই যেন সবসময় তাড়া করে ফিরে ফুয়াদকে। ও ভেবেছিলো সাঁচিকে বলে মন থেকে বোঝা নামাবে। নিজের করনীয় সম্পর্কে জানতে চাইবে কিন্তু সাঁচি তো ফুয়াদকে ওর কথাটা শেষ করার সুযোগটাই দিলো না? ফুয়াদ মনেমনে ভাবে আজ যে করেই হোক বাকি কথাগুলো সাঁচিকে বলতেই হবে! সাঁচি শুনতে না চাইলেও জোর করে বলবে আজ।

ভার্সিটি থেকে আসতে আসতে লেইট ই হয়ে গেল সাঁচির। আজ একটা এ্যাসাইমেন্ট করে জমা দিতে গিয়েই লেট হলো। অথচ ক্লাসের পুরোটা সময় বাসায়ই মন পরে ছিলো। ফুয়াদকে দেখে না কত দিন? আজ দেখবে সেই খুশিতে ভেতর ভেতর ছটফট করছিলো। বাসায় আসতেই দেখলো পিচ্চি ভাই বোন দুটো আর ফুয়াদ গোল হয়ে বসে গল্প করছে। ফুয়াদ কিছু একটা বলছে আর সবাই হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে। সাঁচি মনে মনে রাগ হলো-
” আমি নাই আর ওনার গল্প দেখো? আমার সাথে তো জীবনেও এতো হাসির কথা বলে না। মুখটা এমন করে রাখে যেন মনে হয় তিতা করলা খাইছে, হুহ!”
সাঁচি ফুয়াদকে না দেখার ভান করে ভিতর রুমে চলে যাচ্ছিলো। মা ডাকলো ওকে-
“কি রে সাঁচি! জামাই এসে কখন থেকে বসে আছে? আজই তোর আসতে দেরি হলো?”
“কাজ থাকলে কি করবো মা? ভার্সিটিতে তো আর খেলতে যাই না?”
ওর কথা শুনে ফুয়াদ মুখ টিপে হাসলো একটু। সেটা খেয়াল করে সাঁচির আরো রাগ হলো।
“আচ্ছা যাক বাদ দে। আমরা সবাই বসে আছি তোর জন্য। তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় একসাথে খাবো।”
“তোমরা বসো মা। আমি চট করে মুখ ধুয়ে আসছি।”
রুমে ঢুকতেই দেখলো টেবিলের উপর রাখা জিনিস গুলো। লাল টকটকে গোলাপ, টকলেট বক্স আর খুব সুন্দর একটা শাড়ি। খুব খুশি হলো সাঁচি, কেন জানেনা চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। প্রিয়জনের থেকে উপহার পেলে যে সুখ সুখ অনুভব হয় তাই মনে হয় চোখের জল হয়ে গড়িয়ে যায়! জিনিসগুলো সস্থানে রেখে সাঁচি চোখটা মুছে নিয়ে বাথরুমে যায়।
খাওয়াদাওয়া সেরে সাঁচি রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। তারপর পড়তে বসলো, আসলে ওর মনটা অস্থির হয়ে আছে। খাবার টেবিলে ফুয়াদের সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা যখন বলছিলো ফুয়াদ একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। পরে বুঝতে পেরেছে যে বাবা মা সামনে আছে বলেই সাঁচি এভাবে কথা বলছে। ও নিজেও তারপর সাঁচির সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে সাঁচি তারাতাড়ি নিজের রুমে চলে এলো। ও দিকে ফুয়াদ এখনো গল্প করছে শালা শালিদের সাথে। সাঁচির ও আসলে খুব ইচ্ছা করছে ফুয়াদের সাথে কথা বলতে! পরক্ষণেই আবার মনটাকে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছে,তুই কেন কথা বলবি, ও নিজে থেকে না বললে? অভিমান ও হলো,ফুয়াদ একবারও বললো না ওকে বসতে। হুহ! বয়েই গেছে ওর সাথে গল্প করতে? সাঁচি মন অন্যদিকে ঘুরাতে পড়তে বসলো। কিছুক্ষণ পর ফুয়াদ রুমে ঢুকলো। টেবিলে তাকিয়ে দেখলো ওর দেওয়া গিফটগুলো ওভাবেই টেবিলে পড়ে আছে। ভ্রু কুচকে তাকালো ফুয়াদ, সাঁচি কি ওগুলো খুলে দেখেনি?
“সাঁচি, তোমার জন্য কিছু এনেছিলাম। তুমি দেখোনি কি এনেছি? ”
“কোনগুলো? ওহ এগুলো? না তো? কেন দেখবো? আপনি কার জন্য না কার জন্য এনেছেন, আমি জানি? বিনা অনুমতিতে কারো জিনিস আমি ধরি না।”
মিথ্যে বলে সাচি।
“প্লিজ,এখন দেখো না? আমায় বলতো তোমার পচ্ছন্দ হয় কিনা?”
বলতে বলতে খাটে যেয়ে বসলো ফুয়াদ। সাঁচি প্যাকেট থেকে চকলেট আর শাড়িটা বের করলো-
“হুম, সুন্দর আছে।”
বলেই আবার জিনিসগুলো রেখে পড়তে লাগলো।
“তোমার পড়াটা কি খুব জরুরী? ”
“কেন বলুন তো?”
“একটু কথা বলতাম তোমার সাথে?”
“আপনার কথা কি খুব জরুরী? জরুরী না হলে থাক? পরে শুনবো? ”
ফুয়াদ উঠে এলো, সাঁচির সামনে দাঁড়ালো। কি মনে করে ওর হাত দুটো নিজের দুহাতের মধ্যে নিলো। এই প্রথম সইচ্ছায় সাঁচির হাত ধরলো ফুয়াদ। সাঁচি একটু অবাক হয়ে তাকালো।
“আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করে কথা বলছো না আমার সাথে। প্লিজ! তুমি এমন করো না আমার সাথে! আমি আমার কথাগুলো শেষ করতে চাই, আর আজ তোমার সেগুলো শুনতেই হবে। আমার তো আর কেউ নেই যাকে আমি এগুলো বলতে পারি। এই বোঝা আমি আর নিতে পারছি না সাঁচি, প্লিজ?”
ফুয়াদের চোখে অসহায় এক অনুনয় ঝরে পরলো। সাঁচি হার মানলো সেই নজরের সামনে-
“ঠিক আছে বলুন, কি বলবেন?”
“এসো না খাটে বসি।”
সাঁচি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় এগিয়ে গেলো, এক কোনো বসলো। ফুয়াদ বললো-
“আমি যদি চাইতাম তাহলে এসব কিছু না বলেই তোমার সাথে জীবন শুরু করতে পারতাম। কিন্তু কেন শুরু করিনি জানো?”
সাঁচি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
“কারন আমি তোমার সাথে কোনো ছলচাতুরী করতে চাইনি। আর তাছাড়া যে অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে তার ছোয়া একদিন না একদিন আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে ইফেক্ট ফেলতো। এটাতো শুধু একটা শারীরিক সম্পর্ক না, তাই না? প্রথম প্রথম হয়তো শরীরের একটা নেশা থাকতো, তাই বুঝতে পারতে না। তারপর সেই নেশা কেটে গেলে সেটা একটা মৃত সম্পর্কে পরিনত হতো, যেটা আমি কখনো, কোনোদিনও চাইনি। তাই তোমার সাথে সম্পর্ক আগানোর ক্ষেত্রে আমি সত্য প্রকাশ করতে চেয়েছি। তুমি বলো? আমি কি ভুল ভেবেছি? ”
সাঁচি কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
“আর আমি চাইনি আর একটা মেয়ে আমার কারনে কষ্ট পাক? ”
“এখনো তো কষ্ট পাচ্ছি। পাচ্ছি না?”
“মা যখন আমাকে তোমার ছবি দেখিয়েছিলো আমি হ্যা কেন বলেছিলাম জানো?”
মাথা নারে সাঁচি।
“তোমায় দেখে কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিলো,তুমি ই পারবে আমায় এই মনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে। মানুষ কিন্তু সবার থেকে সব কিছু আশা করে না? বুজলে?”
“আচ্ছা, যাইহোক, সেদিন তোমাকে বাকি কথাটুুকু বলতে যেয়েও বলতে পারিনি। যতবার বলতে গেছি তুমি বাঁধা দিয়েছে? আজ সেটুকু বলতে চাই জানি তোমার কষ্ট হবে শুনতে,তবুও তোমায় শুনতে হবে? তারপর তুমি আমায় বলবে আমার করনীয় কি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁচি বলে-
“বলুন, কি বলবেন?”
“ঐ ঘটনার এক বছর পরে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। তখন আমার ফাইনাল সেমিস্টার চলছে। সামনে এক্সাম, ভীষন রকম ব্যস্ত সময় কাটছে আমার। আমি ঔ সময়টা মোবাইল ব্যবহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। কারন বাড়িথেকে মা প্রায় সময় ফোন দিয়ে কান্না কাটি করে বাড়ি যাওয়ার কথা বলতো। প্রায় সময়ই মোবাইল আমি হোস্টেলেই রেখে যেতাম। তো একদিন আমি হোস্টেল ফিরে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখি একান্নটা মিসকল, একটা আননোন নাম্বার থেকে। এতগুলো মিসকল দেখে আমি তারাহুরো করে সেই নাম্বারে ফোন দিলাম, ধরলো না। এরপর আমি ভাবলাম যার প্রয়োজন সে নিশ্চয়ই আবার ফোন দেবে? আমি ফোন রেখে আমার কাজে বিজি হয়ে গেলাম। ঠিক সন্ধ্যার সময় ঐ নাম্বার থেকে আবার ফোন। এবার আমি সময় নষ্ট না করে ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে রেহনুমার গলা পেলাম-
” ফুয়াদ, কই আপনি? সারাদিন কত্তো ফোন দিলাম ধরলেন না একবারও? আমাকে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?”
“রেহনুমা? ”
আমি অবাক হয়ে বললাম।
“হ্যা,রেহনুমা। আপনার রেহনুমা। আমি খুব কষ্টে আছি ফুয়াদ। প্লিজ আমাকে নিয়ে যান এখান থেকে? প্লিজ? আপনাকে ভুলতে পারিনা, খুব কষ্টে একটা বছর পার করেছি! কেমন দম বন্ধ লাগে, মনে হয় মারা যাবো?”
আমার কেন জানিনা সেদিন খুব রাগ উঠেছিলো ওর উপর, জানো? রাগটা কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারিনি। রাগের মাথায় ওকে কত কি যে বললাম। বললাম-
” এখন কেন আমায় ফোন দিয়েছো? যখন আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলছিলাম তখন তো অনেক কথা বলছিলা? এখন থাকতে পারো না ক্যান? আমাকে এখন কেন এইসব বলতেছ?”
“এই ভাবে বলোনা প্লিজ। কষ্ট হয় গো। আমাকে নিয়ে যাও গো? আমি আর পারি না?সহ্য হয় না!”
“কেন সহ্য হয় না? সহ্য করো এখন? খবরদার আমাকে ফোন দিবানা? সামনে আমার পরীক্ষা, ফেল করার শখ নাই আমার, বুঝলা?”
আমি খট করে ফোনটা কেটে দিলাম। প্রচন্ড রাগে গা কাঁপছিলো আমার। মাথা ঠান্ডা করার জন্য গোসল দিলাম, তারপর এসে না খেয়েই ঘুম দিলাম। ঘুম যখন ভাংলো তখন রাত এগারো টা বাজে। উঠে বসে মনে পরলো রেহনুমার কথা। হায়!হায়! ওকে আমি কি সব বলেছি? এতো নিষ্ঠুর ভাবে ওকে আমি অপমান করলাম কিভাবে? মেয়েটা আমার কাছে সাহায্য চাইছিলো তাকে আমি অপমান করলাম?? ভাবতেই নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছিলো। আমি তখনই রেহনুমার নাম্বারে ফোন দিলাম, নাম্বার বন্ধ। সারারাত ধরে ফোন দিলাম, বন্ধ ই পেলাম ফোন। পরদিন আমি মিলিকে ধরলাম। মিলি আমার সাথে কথা বলা বাদ দিয়েছে বহুদিন আগেই, যখন রেহনুমার বিয়ে হয়েছে। ঐ দিন ওকে অনেক অনুরোধ করার পরও আমাকে রেহনুমার কোন ইনফরমেশন ই দিলো না। শুধু বললো-
” সামনে পরীক্ষা, পড়ায় মন দে? যে চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করিস না। আর তাছাড়া বারবার রেহনুমার ফিলিংস নিয়ে খেলার সুযোগ আমি তোকে দেবো না।”
“তারপর?”
নির্লিপ্ত ভাবে প্রশ্ন করে সাঁচি।
“বিশ্বাস করো? আমিও চাই তোমাকে ভালোবাসতে, কাছে টানতে কিন্তু পারি না।
আমি যখনই তোমার কাছে যাই আমার কানে রেহনুমার কন্ঠ বাজে। আমি…আমি…আমার শ্বাস আটকে আসে….কষ্ট হয়…ভীষন কষ্ট হয়। বলোতো আমি কি করবো?”
দু হাতে মুখ ঢেকে কাদে ফুয়াদ।
“আচ্ছা এখন যদি ওকে সামনে পান তাহলে কি করবেন? আসলে আপনি এখন কি করতে চান?”
“আসলে… আমি শুধু একটু জানতে চাই যে রেহনুমা কেমন আছে? ও যদি ভালো থাকে…তাহলে আমি শান্তি পাবো। আমি আসলে একবার ওর কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। ওকে আমি স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম কিন্তু তার মর্যাদা রাখতে পারিনি। সেই অপরাধ থেকে যদি ও আমাকে মুক্তি দেয় আমি ঠিকঠাক মতো জীবন শুরু করতে পারবো।”
ফুয়াদ মুখ মোছে। সাঁচি আবার বলে-
“আর যদি এমন হয় যে, ও সুখে নেই, তখন আপনি কি করবেন? ওকে আবার গ্রহন করবেন আপনার লাইফে?”
সাঁচির এরকম প্রশ্নে ভ্যবাচ্যকা খায় ফুয়াদ। আসলেই তো!এরকম তো ভাবেনি সে-
“আমি আসলে সে রকম কিছু ভাবিনি?”
সত্যি কথাই বললো ফুয়াদ।
“আর তাছাড়া ওকে গ্রহন করার কথা আসছে কেন? সে রকম হলে তোমায় বিয়ে করতাম নাকি? তুমি মনেহয় সব ব্যাপার গুলিয়ে ফেলছো? আমার তোমাকে সবকিছু বলার উদ্দেশ্য কিন্তু এটা না যে,আমি রেহনুমা কে জীবনে ফেরত চাই!”
“আপনারা যে কোন কারনে কি করেন? নিজেরাই নিজেদের বোঝেন না? যদি বুঝতেন তাহলে জীবনে এতো জটিলতা হতো না? আর কোনটা আপনার উদ্দেশ্য আর কোনটা না সেটাই তো বুঝতে পারলাম না এতোদিনে?”
সাঁচির কথা শুনে ফুয়াদ বিছানা থেকে নেমে পানি খায়। কিছুটা ধাতস্থ হয়, প্রসঙ্গ পাল্টে বলে-
” তোমাকে আর একটা কথা জানানোর ছিলো?”
“বলুন?”
” সিঙ্গাপুর আর মালোয়েশিয়ান দুটো প্রজেক্ট এর কাজ হ্যান্ডেল করার জন্য অফিস থেকে আমার নাম সিলেক্ট করেছে। মাস দুয়েকের জন্য যেতে হবে। ওয়াইফ কেউ নিয়ে যাওয়া যাবে। তুমি চলো আমার সাথে?”
“আমি যেয়ে কি করবো? আপনি কাজে বিজি থাকবেন আমি কি করবো? আর তাছাড়া আমার লাস্ট সেমিস্টার চলছে। আপনি বরং ঘুরে আসুন, ততদিনে আমার পড়া শেষ হয়ে যাবে।”
” তাহলে আমি আসলে তুমি বাসায় যাবে বলো? তখন তো কোনো অযুহাত দিতে পারবে না আর? আমার উপর রাগ করবে থাকবে না বলো?”
“সে দু মাস পরের ব্যাপার, তখন দেখা যাবে। এখন এসব নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। প্লিজ, আপনি ঘুমিয়ে পরুন। ”
“তুমি ঘুমাবে না?”
“নাহ, আমি একটু পড়বো। তারপর শোবো।”
আসলে ফুয়াদের চোখের সামনে থেকে সরতে চাচ্ছিলো সাঁচি। ফুয়াদ কি সুন্দর ওকে বলে ভারমুক্ত হয়ে গেলো। অথচ ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে কি করবে তাই জানে না। চোখে জ্বালা ধরে সাঁচির। বারান্দায় এসে বসে। কান্না করে আর ভাবে কি করবে ও? ফুয়াদ কি কখনো পুরোপুরি ওর হবে? ফুয়াদের অপরাধবোধ কি কখনো ওর পিছু ছারবে? এ কেমন জীবন পেলো ও? এই এতোদিনে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে ফুয়াদকে তা এই দেড়মাসে হারে হারে টের পেয়েছে সাচি। কিন্তু এতোকিছু জানার পর নিজে থেকে আর ফুয়াদের কাছে যেতে ইচ্ছা জাগে না ওর। আবার ওর আকর্ষনও এড়াতে পারে না। মাঝে মাঝে মনটা তীব্রভাবে কাছে চায় ফুয়াদ কে। নিজের মনের চাওয়া পাওয়াকে বুঝতে পারে না সাঁচি। মনের এই দ্বন্দ্ব ওকে যেন শতটুকরো করে দিচ্ছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে সারারাত এভাবেই কেঁটে যায় সাঁচির।

দিন দশেক পর ফুয়াদ যেদিন সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলো, সাঁচি এসেছিলো ওকে সি অফ করতে। ফুয়াদ যাওয়ার আগে ওর কপালে একটা চুমো দিয়ে যখন বললো-
“ভালো থেকো। নিজের যত্ন করবে। আমার বিরহে আবার অসুস্থ হয়ে যেয়ো না যেন!”
তখন সাঁচি ওর কপালের চুমোর জায়গায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো আর ভাবছিলো-
” এটা কি হলো?”

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

আজল পর্ব-১৫

0

#আজল
#পর্ব-পনেরো

২৯.

প্রিয়তা আজকাল অবিশ্বাস এর ঘোরে ডুবে থাকে। হবে নাই বা কেন? তানভীর এর কাজগুলো আজকাল বড্ড গোলমেলে ঠেকছে প্রিয়তার কাছে। প্রায় প্রতিদিনই হাতে ফুল নিয়ে ঘরে ঢোকে। তাও আবার প্রিয়তার পচ্ছন্দের ফুল। একদিন হঠাৎ তানভীর বিকেলের দিকেই বাসায় ফিরলো। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাদা ফুলের স্টিক হাতে। প্রিয়তাকে দিয়ে বললো-
“আজ হঠাৎ রাস্তায় চোখে পড়লো তাই নিয়ে এলাম। আর ফুল কেনার সময় আমার মনে হলো তোমার কি ফুল পচ্ছন্দ, আমি তাই জানিনা। এজন্য সবগুলোই ক’টা ক’টা করে এনেছি। তুমি রাগ করলে নাতো?”
প্রিয়তা অবাক হলে চেয়ে রইলো তানভীর এর দিকে। একেতো আজ তানভীর তারাতাড়ি বাড়িতে এসেছে, হাতে আবার ফুল নিয়ে, তার উপর ওকে বলছে -রাগ করোনিতো?! হজম হচ্ছে না প্রিয়তার। ভয় লাগলো, আজ আবার কিছু উল্টাপাল্টা করবে না তো তানভীর? তানভীর রেগে গেলে খুবই ভিন্ন পন্থায় শাস্তি দেয়। খুব খুব আদর দেয় সারারাত ধরে। প্রিয়তাকেও বাধ্য হয়ে আদর গ্রহন করতে হয়। ঘড়ি ধরে ছয়ঘন্টা একটানা। এক সেকেন্ড ছাড় দেয় না। প্রিয়তার কান্না পায় সে রাতে। কেমন নির্লিপ্ত ধরনের সে ভালোবাসা অথচ সেটাই গ্রহন করতে হবে সারারাত। এর চাইতে কঠিন শাস্তি মনে হয় দুনিয়াতে আর একটাও নেই- প্রিয়তা ভাবে। আজ কি সেই দিন? ভয়ে কুকরে যায় প্রিয়তা। সে একটা শুকনো হাসি দেয় তানভীর এর দিকে তাকিয়ে। তানভীর প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে কোল থেকে প্রিতিকে নেয়। প্রিতি অবশ্য যেতে চাচ্ছিলো না। মেয়েও বাবার এই আদর ভালোবাসা আগে পায়নি, সেও এসবে অভ্যস্ত না। তবে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে অত্যন্ত খুশি হয়ে বাবার সাথে খেলতে লাগলো। প্রিয় তখনে দাঁড়িয়ে আছে এভাবেই।
“কি ব্যাপার এখনো এভাবেই দাঁড়িয়ে আছো? কি হলো তোমার? বিকেলে কি কিছু নাস্তা টাস্তা পাবো আজ?”
প্রিয়তার ঘোর ভাঙে-
“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি নাস্তা বানিয়ে আসছি ততোক্ষণে। ”
হাত বাড়িয়ে প্রিতিকে নিতে চাচ্ছিলো।
“আরে আরে কি করছো? ওকে কেন নিচ্ছো? তুমি কাজ করবে তো ওকে নিচ্ছো কেন? ও থাক আমার কাছেই। আমরা বাবা মেয়ে আজ খেলবো। তাই না মা?”
তানভীর বলে।
প্রিয়তা আরো একবার অবাক হয়েছিলো সেদিন। তারপর নাস্তা বানিয়ে যখন তানভীর কে খেতে ডাকলো, তানভীর ওকেও বসতে বললো-
“তুমিও বসো না? আজ দুজনে একসাথে খাই?” হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয় ওকে।
“আচ্ছা বলোতো তোমার ফেভারিট ফুল কোনটা?”
“কি হয়েছে আপনার? আমি কি কোনো দোষ করেছি? এমন করছেন কেন?”
কেঁদে দেয় প্রিয়। তানভীর ব্যস্ত হয়-
“আরে আরে কাঁদছো ক্যানো? আমি তো কেবল তোমার প্রিয় ফুল কোনটা সেটাই জানতে চাইলাম। ”
নিজের হাতে চোখ মুছে দেয় প্রিয়র।
“আসলে আমি ভাবলাম, বিয়ের চার বছর পার হয়ে গেল অথচ আমরা দুজন দুজনার সম্পর্কে কিছুই জানি না…ব্যাপার টা কেমন না? ভাবলাম সেটা আজ থেকেই শুরু করি? আমি তোমার সম্পর্কে জানবো, তুমি আমার সম্পর্কে জানবে তারপর দুজন দুজনার মনের মতো চলার চেষ্টা করবো। যদিও শুরুটা আমাদের ভালো ছিলো না, তাই বলে শেষ টা যে খারাপ হবে এমন তো নয়? আমরা সেটাকে ভালো করার চেষ্টা করতে পারি তো, তাই না?”
প্রিয় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকে। হঠাৎ কানের কাছে সুরসুরি মতোন লাগে-
“আরে বাবা, আজ তোমাকে রাতে কোনো শাস্তি দেবো না যাও। টেনশন করোনা। এখন ফটাফট আমাকে বলোতো, তোমার প্রিয় ফুল কোনটা?”
প্রিয়তা লজ্জায় আরক্ত হয়-
“বেলী আর কাঠালিচাপা। ”
তানভীর লজ্জায় রাঙা প্রিয়র মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। মেকি অভিনয় করতে করতে সে হঠাৎ খেয়াল করছিলো, প্রিয় মেয়েটার লজ্জা রাঙা মুখটা দেখতে আসলেই সুন্দর লাগছে। ভীষন নিস্পাপ আর পবিত্র একটা ভাব আছে। মেকআপ করা মেয়েদের ফেস দেখতে দেখতে তার নিজের বউয়ের দিকেই ঠিক মতো তাকানো হয়নি কখনো। তানভীরের মনের মধ্যে বেশ একটা খুশির ভাব ছড়িয়ে পরলো। সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে প্রিয়তার সাথে গল্প করতে লাগলো।

সেই যে শুরু,আজ দু মাস ধরে এই চলছে তানভীরের। সেইদিন থেকে তানভীর তাকে একের পর এক সারপ্রাইজ দিয়েই যাচ্ছে। কোনোদিন হয় ওর প্রিয় ফুল দেয় অথবা কোনোদিন ওর পচ্ছন্দের কোনো একটা খাবার কিনে নিয়ে আসছে, কোনোদিন চকলেট নিয়ে আসছে অথবা কোনোদিন একটা শাড়ি বা জামা। এরমধ্যে সে একবারও প্রিয়র সাথে ইন্টিমেট হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। এ যেন এক নতুন তানভীর কে দেখছে সে। আজকাল প্রিয়রও বেশ ভালো লাগে তানভীরের এই নতুন বিহেভিয়ার। ও এনজয় করছে তানভীরের এই নতুন রুপ। ওর নিজেকে এখন বেশ প্রেমিকা প্রেমিকা মনে হয়। মনেহয় জীবনে প্রথম প্রেম করছে তানভীরের সাথে। সব মিলে ওর চেহারার খুশির একটা জেল্লা ফুটে উঠছে। ভাবতে ভাবতে তানভীরের ফোন আসে-
“আমার বউটা কি করছে? ”
“কিছু না।” খুশিতে নেচে ওঠে প্রিয়। ইদানিং তানভীর ওকে বউ বলে ডাকে মাঝে মাঝে। ভীষন ভালো লাগে প্রিয়র। বুকের মধ্যে কেমন একটা ভালোলাগা ছেয়ে যায়। নতুন প্রমিকার মতোই বুকে কাঁপন ধরে।
“বউটার আজ ক্লাস নেই?”
“নাহ।”
“তাহলে কি বউটা আমার সাথে আজ ডিনারে যাবে? সাধারণ একটা সুতি শাড়ি থাকবে পড়নে, চোখে মোটা করে কাজল টানা আর হালকা লিপস্টিক ব্যস আর কিছু না।আর হ্যা চুলটা খোপা করবে বাট সেই খোপায় ফুলের মালাটা আমিই গুজে দেবো। যাবে কি বউটা?”
“হুম। আমি রেডি হচ্ছি তাহলে?”
অদ্ভুত আনন্দে প্রিয়তার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।
“আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। রাত আটটায় ফোর সিজন এ… ঠিক আছে?”
খুশিতে আত্মহারা প্রিয় আলমিরা খুলে একের পর এক শাড়ি বের করে বিছানায় ফেলতে থাকে। আশ্চর্য! ওর একটাও ভালো সুতি শাড়ি নেই? সব ভারি ভারি শাড়ি, এগুলো তো পড়া যাবে না? খুজতে খুজতে শেষ পর্যন্ত একটা অফহোয়াইট সোনালী পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পেয়ে গেলো। বাহ! এটা পড়লে বেশ লাগবে। বিয়ের পর প্রথম এই রকম ডেটে যাচ্ছে প্রিয়তা, বারংবার নিজেকে আয়নায় দেখে যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে। বাহ!ভালোই তো লাগছে আজ! নিজেরই তো চোখ সরছে না, তানভীর কি করবে আজ? ভাবতেই বুকের ভেতর হাজারো জোনাক পোকা দৌড়োদৌড়ি শুরু করলো। মেয়েটাকে আজ সাথে নেবে না ঠিক করল। কাজের মেয়ে আছে আর মেয়ের দাদী ও আছে, আজ মেয়েকে ওদের জিম্মায় রেখে যাবে।

প্রিয়তা যখন গাড়ি থেকে নামছিলো তানভীর পাশ থেকে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা লজ্জা পেলো আনকোরা কিশোরী মেয়ের মতো। গাল দুটো লাল হলো লজ্জায়। তানভীর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রিয়র দিকে। ওরা দুজন যখন রেস্টুরেন্ট এর দড়জা দিয়ে ঢুকছিলো অনেকের মুগ্ধ দৃষ্টি টের পাচ্ছিলো প্রিয়। সেটা বুঝেই প্রিয়র মাথা ঝুকে গেল আরেকটু। এতো এ্যাটেনশন পেয়ে সে অভ্যস্ত না। তানভীর ওকে কোনার দিকে একটা টেবিলো নিয়ে গেলো। ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে তানভীর বসলো পাশেই আরেকটা চেয়ার টেনে।
“আজ তোমার কাছ থেকে দূরে বসতে ইচ্ছা করছে না, তাই পাশেই বসলাম।”
তানভীর মুগ্ধ গলায় বললো। প্রিয় একটু লজ্জারাঙা হাসি দিলো।
“বউ তোমাকে আজ ভীষন সুন্দর লাগছে। সাধারনের মধ্যে ও অসাধারণ লাগছে। তবে একটা জিনিস মিসিং আছে?”
“কি?”
প্রিয় অবাক চোখে তাকায়।
প্যাকেট থেকে দুটো বেলি ফুলের মালা বের করে প্রিয়র খোপায় পরিয়ে দিলো তানভীর-
“এবার একেবারে পারফেক্ট লাগছে। এই আমার দিকে তাকাও তো একটু?”
প্রিয় মুখ তুলো তাকাতেই তানভীর পটাপট ওর কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
প্রিয় বাধা দিলো ওকে-” এই, কি হচ্ছে? সবাই দেখছে তো?”
“দেখুক, আমি তো অন্য কারো না আমার বউ এর ছবি তুলেছি।”
“এই তুমি আমার মেয়েটাকে আনলে না কেন? একাই আসলে যে? ওহ! বুঝেছি আমার সাথে একা একা সময় কাটাতে চাচ্ছিলে তাই না?”
প্রিয় কে তানভীর আজকে লজ্জা দিয়েই মারবে মনেহয়? কি সব কথা বলছে? তানভীর মিটিমিটি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ইশ! মানুষটা যে কি না? এক্কেবারে খারাপ একটা মানুষ!
“আপনি খুব খারাপ! খুব!”
প্রিয়র কথা শুনে তানভীর হো হে করে হাসছিলো আর প্রিয় মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখছিলো অপলক!!!

৩০.

“আচ্ছা, বিয়েটা আপনি কি ভেবে করেছিলেন, বলুন তো?”
সাঁচির হঠাৎ করা প্রশ্নে নড়েচড়ে বসে ফুয়াদ। কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাঁচি বলে-
“থাক বাদ দিন তো! আমার আর আপনার কোনো কথাই শুনতে ইচ্ছা করে না।”
“প্লিজ সাঁচি!আমার কথাগুলো শেষ করার একটা সুযোগ অন্তত আমাকে দাও। তুমি তো আমার কোনো কথাই শুনছো না। সেদিনের কথাগুলোও তো অসমাপ্ত রয়ে গেল?”
“আপনি শুনেছিলেন? বিয়ের পরের পাঁচটা মাস আমিও তো কত কথা বলতে চেয়েছি আপনি শুনেছিলেন? আপনার কথা শোনার জন্য বসে থেকেছি, আপনি বলছিলেন কিছু? তাহলে আজ আমি কেন শুনবে?”
ফুয়াদ মাথা নিচু করে বসে থাকে। কি বলবে ও? সাঁচির প্রতিটা কথাই তো সত্যি! মনে সাহস জমিয়ে কথাগুলো বলতে বড্ড দেরি করে ফেললো মনে হয়? আরো একটা ভুল! এই ভুলের বোঝা বইবার শক্তি মনে থাকলে হয়?
“যাই হোক, বাবা মা চলে গেলে এবার আমি বাসায় যাবে। অনেকদিন যাওয়া হয় না আর তাছাড়া এই লাস্ট সেমিস্টার টা ওখান থেকেই করবো ভাবছিলাম। এখানে থেকেই বা কি করবো? বরং আপনার খারাপ লাগলে আপনি ওখানে চলে আসবেন মাঝে মাঝে।”
ফুয়াদ দীর্ঘশ্শ্বাস ছাড়ে। সিলেট থেকে আসার পর থেকেই এমন করছে সাঁচি। ওর সাথে আর কথা বলে না। ওর চোখের সেই মুগ্ধতা ও যেন আর নাই। কেমন কঠোর বিহেভ করে? নিজের মনের বোঝা হালকা করতে চেয়েছিলো ফুয়াদ। কিন্তু পারলো না! উল্টো বোঝা বেড়ে গেলো আরো। এর চাইতে সব লুকিয়ে মৃত মন নিয়ে সংসার করলেই ভালো হতো। অন্তত এই মেয়েটা সুখে থাকতো। কেউ না কেউ তো সুখী হতো ওর কারনে!

ফুয়াদের বাবা মা চলে যাওয়ার পরদিনই সাঁচি ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসলো। ফুয়াদই অবশ্য ওকে রেখে গেছে। সাঁচি বলেছিলো-
“আপনিই আমাকে রেখে আসবেন। মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখেও যাবেন। আমি চাই না আব্বু আম্মু এত সহজে কিছু বুঝে যাক। অন্তত আমার পড়ালেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত।”
ফুয়াদ মেনে নিয়েছে সেকথা। আর তাছাড়া ও তো চায় সাঁচিকে নিয়ে সংসার করতে, তাই তো সব সত্যি সাঁচির কাছে বলেছে। মিথ্যা দিয়ে জীবন শুরু করলে সেটাও তো আরেকটা ভুলই হতো। রেহনুমা তার অতীত আর সাঁচি বর্তমান। অতীত কে ঢেকে রেখে বর্তমান নিয়ে চলা যায় না বরং অতীত কে সাথে নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের পথে পা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ। সাঁচি নিশ্চয়ই একদিন সে কথা বুঝবে!

আজকাল বাড়িতে ফিরতে ভীষন ক্লান্তি লাগে ফুয়াদের। ফাঁকা বাড়ি যেন হা করে গিলতে চায় ফুয়াদকে। বিয়ের আগে তো এই বাড়িতেই থাকতো, তখন তো এরকমটা লাগেনি ফুয়াদের? তবে, তবে এখন কেন এমনটা মনে হয়? বিয়ের পরে পরে সাঁচি ওর জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতো, জানে ফুয়াদ। তাই ও অফিস থেকে ফিরলেই ওর আশেপাশেই ঘুরঘুর করতো সাঁচি। চা নাস্তা, এটা ওটা দেবার বাহানায়। মাঝে মাঝে ওকে নিজে থেকেই তো জড়িয়ে ধরতো, চুমুটুমুও দিতো। তখন বিরক্ত লাগলেও আজকাল যেন সেটাই মিস করছে ফুয়াদ। কতবার ফোন দিতে যেয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়েও আবার রেখে দিয়েছে ফুয়াদ। ফোন দিয়ে কি বলবে সেটাই খুঁজে পায়না ফুয়াদ! ক্লান্ত, বিষন্ন ফুয়াদ গোসল না করেই, না খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকে আর মনে মনে বির বির করে-
“তুমি তো বলেছিলে তুমি অন্যরকম। তোমায় বিশ্বাস করতে বলেছিলে। বলেছিলে আমায় ছেড়ে যাবে না কখনোই। তবে কি হলো, সাঁচি? কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলে নাতো? তুমিও তবে আমাকেই দোষী বানালে??”

ওদিকে সাঁচিরও যে দম বন্ধ হয়ে আসে বাবার বাড়িতে। মনের মধ্যে অসহ্য বেদনা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। বাসায় থাকলে তবুও তো ফুয়াদকে এক নজর দেখা যায়? মাঝে মাঝে জোর করে ছুয়েও দেয়া যেত। আর এখন? এখন তো সেই চোখের দেখাটাও দেখা যাচ্ছে না!! ছোয়া তো দূরে থাকুক। এই যে ও এসেছে একমাস হয়ে গেল ফুয়াদ তো একদিন ও এলো না ওকে দেখতে? নিজ ইচ্ছায় একটা বার ফোনও তো দেয় না? নিজেকে কেমন যেন পরিত্যক্ত আসবাবের মতো মনে হয় সাঁচির। গভীর রাতে বুকে হাহাকার হয়, ফাঁকা ফাঁকা লাগে বুকটা। পানির তেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায় সাঁচির। পানি খেয়ে এসে, হাটুতে মুখ গুজে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে সাঁচি। সারারাত না ঘুমিয়ে ছটফট করে সাঁচি। ভোরের দিকে ক্লান্তিতে চোখ ভেঙে ঘুম আসে। এভাবেই প্রতিটা রাত কেঁদে আর প্রতিটা দিন ব্যস্ততার ভান করে কেটে যায় সাঁচির।

অফিসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিলো ফুয়াদ। দুপুরের এই সময়টা খাওয়ার পরে কাজে একটু ঢিলেমি হয়, বেশ একটু ঝিমঝিম ভাব আসে। খাওয়ার পড়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ঝিমোচ্ছিলো ফুয়াদ। তখনই ফোন টা বেজে উঠলো। স্কৃিনে নামটা দেখে হাসি ফুটলো ঠোঁটে, সাঁচি ফোন করেছে।
“হ্যালো!কি ব্যাপার এতোদিনে একবারও এলেন না যে? আমি আপনাকে কি বলেছিলাম মনে নাই? কিছুদিন পরে পরে এসে বাসায় দেখা দিয়ে যেতে? তা আপনি তো একবারও এলেন না! আজব মানুষ তো আপনি! আপনি জানেন বাবা আপনার কথা বলে বলে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে আমার? সামনে পরীক্ষা আমার অথচ আপনার জন্য ঠিকমতো পড়ালেখা করতে পারছি না! আপনি কি কোনোদিনও নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাববেন না?”
একদমে কথাগুলো বলে সাঁচি। ফুয়াদ নিস্তব্ধ থেকে কথা গুলো শুনে যায়। সাঁচি আবার বলে-
“আজ অফিস থেকে সোজা এখানে চলে আসবেন। ঠিক আছে?”
ফুয়াদ ঘার নাড়ে। সাঁচি বলে-
” কি? কথা নেই কেন? আপনি ঘাড় নাড়লে আমি কি দেখতে পাবো? মুখে বলুন।”
ফুয়াদ চমকে ওঠে। সাঁচি কিভাবে বুঝলো ফুয়াদ ঘার নাড়ছে? মেয়েটা কি সবজান্তা নাকি? না দেখে কিভাবে বলে দিলো? ফুয়াদের খুব ভালো লাগে সাঁচির বকাটা। কতোদিন পর তাও তো একটু কথা শুনলো, হোকনা সেটা বকাই। ও হেসে উওর দিলো-
“ঠিক আছে? আসবো।”
সাঁচি আর কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দিলো। ফুয়াদের হঠাৎ করে মনটা ভালো হয়ে গেল। ঠোঁটের কোনো একটা হাসি লেগে রইলো সবসময়ই। ও নিজেই অবাক। সাঁচির একটা ফোন কলে ও এতো খুশি! মেয়েটা কি ওকে জাদু করলো নাকি? গুনগুন করতে করতে কাজে মন দিলো ফুয়াদ।

বিকেলে অফিস থেকে একটি তাড়াতাড়িই বের হলো ফুয়াদ। এতোদিন পর শশুরবাড়ি যাবে? ভালোমন্দ কিছু কিনতে তো হবে? আর তাছাড়া ধানমন্ডি থেকে ওয়ারি বেশ ঝামেলার পথ।যেতেও সময় লাগবে অনেক। ফুয়াদ সাঁচির জন্য ফুল, চকলেট আর কি মনে করে একটা শাড়ি কিনে ফেললো গাড় বেগুনি রং এর সাথে বাড়ির জন্য প্রচুর ফল মিষ্টি সহ হাতের কাছে যা পেল,পচ্ছন্দ হলো সব নিয়ে নিলো। ফুয়াদ যখন সাঁচিদের বাড়ি পৌছোলো তখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুইছুই। ফুয়াদের কেমন বুকটা টিবটিব করছে। আচ্ছা! সাঁচি কি আজকে ওর জন্য ওয়েট করছে? নাকি ক্লাসে গেছে? ইস! আসার আগে ফোন করলেই পারতো? ক্লাসে গেলে ওকে নিয়েই আসতে পারতো? গাড়ি থেকে জিনিসগুলো নামিয়ে দারোয়ান এর হাতে উপরে পাঠিয়ে দিলো। শুধু সাঁচির জিনিসগুলো নিজের হাতে নিলো। লিফ্টে উঠে নিজেকে একটু পরিপাটি করে নিলো। কাপড়চোপড় ঠিকঠাক করে চুলটা হাত দিয়ে ব্যাকব্রাশ করলো। তারপর লিফটের আবছা আয়নায় নিজেকে দেখে হেসে দিলো। কি সব পাগলামি করছে ও? ও কি সাচির প্রেমে পড়ে গেলো? ভাবনাটা মনে আসতেই কেমন অদ্ভুত লাগলো ফুয়াদের! সাঁচিদের দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে ফুয়াদ যখন কলিংবেল দিচ্ছিলো তখন ওর বুকের ভেতর যেন ড্রাম বাজ্জাচ্ছিলো কেউ!!!!!

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin