Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 428



প্রেম প্রেয়সী পর্ব-০৩

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_০৩
#আয়েশা_আক্তার

ভার্সিটিতে গিয়ে এশা চুপচাপ ক্লাসের এক কর্ণারে বসে আছে। হঠাৎ তার কাঁধে কোমল স্পর্শ পেয়ে সে ঘুরে তাকায়। চেয়ে দেখে এক হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এশা তাকাতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করে,

-আমি কি এখানে বসতে পারি?

এশা কৃত্রিম হেসে জবাব দিলো, – অবশ্যই।

মেয়েটি বসতে বসতে বললো, -আচ্ছা তোমার কি মন খারাপ? আর আমি কি তোমায় তুই করে বলতে পারি?

মেয়েটি এমন প্রশ্ন করবে সেটা এশা আশা করেনি। তাই হতভম্ব হয়ে শুধু চেয়ে রইলো। আর মনে মনে ভাবতে থাকলো, এটা নিশ্চিত বাঁচাল টাইপ মেয়ে। যারা বেশি কথা বলে তাদের বাঁচাল বলা হয়। তবে বেশি কথা বললেও এরা সরল প্রকৃতির হয়। এদের মনে কোনো প্যাঁচ থাকে না। এরা যেমন খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারে। তেমনই এদের মনে যা থাকে অকপটেই সেগুলো বলে ফেলতে পারে।

এশার এমন তাকিয়ে থাকা দেখে মেয়েটি এশার সামনে দিয়ে বার কয়েক নিজের হাত এপাশ ওপাশ করলো। এতে এশার ধ্যান ভাঙলো। এশা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,

-না, আমার মন খারাপ নয়।

-তাহলে এমন হুতুমপেঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন?

এশার অনুমতি দেওয়ার আগেই মেয়েটি তুই করে বলতে শুরু করেছে। এতে অবশ্য এশার আপত্তি নেই। কারণ একই ডিপার্টমেন্টের একই ক্লাসে যেহেতু পড়ে সেক্ষেত্রে তারা বন্ধু। আর বন্ধুকে বন্ধু তুই করে বলতেই পারে। এশার জবাব দেওয়ার আগেই আবারো মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,

-তুই কি নতুন এডমিট হয়েছিস ভার্সিটিতে? না মানে এই ক’মাস দেখিনি তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।

এশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলো,

-নতুন এডমিট হইনি তবে আমি ভালো করে একমাসও ক্লাস করিনি।

-ওমা কেন? এতো ফাঁকিবাজ হলে চলে?

-ফাঁকিবাজ না রে ভার্সিটিতে কাউকে চিনি না। নতুন পরিবেশ তাই ভালো লাগে না আসতে।

-কি যে বলিস! আমার তো নতুন নতুন পরিবেশে যেতে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। তো নাম কি তোর?

-এশা ইসলাম তোমার?

-তাবাসসুম তানহা, আর তুই আমায় তুমি করে বলবি না। তুই করে বলবি বুঝেছিস?

-ওকে।

-হ্যাঁ, একটা পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করবো?

-হ্যাঁ, করতেই পারিস।

তানহা কিছু বলে উঠার আগেই ক্লাসে স্যার চলে আসলো। তাই সে আর কিছু বলতে পারলো না। প্রথম ক্লাস যখন প্রায় শেষ সময় ঠিক তার পাঁচ মিনিট আগে একটা নোটিশ এলো। স্যার সবাইকে মনোযোগের সহিত শোনার আদেশ দেওয়ায় সবাই বেশ মনযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনার চেষ্টা করলো। নোটিশে জানালো, ভার্সিটির কর্তৃপক্ষ সবাইকে কোনো এক গানের কমপিটিশনে যেতে হবে। তাই আজ প্রথম ক্লাস শেষ হওয়ার পরই ভার্সিটি ছুটি। এবং আগামী দু’দিন ভার্সিটি বন্ধ থাকবে। এ নোটিশ পেয়ে অনেকেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। এমনকি তানহা নিজেও। কিন্তু এশার এতে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

-যাক দু’দিন বাঁচলাম।

-বাঁচলি মানে? ভার্সিটি বন্ধ তাই?

-হ্যাঁ, অবশ্যই। আমার ভার্সিটিতে একদমই আসতে ইচ্ছে করে না।

-তুই না বললি তোর কোনো বন্ধু নেই, কাউকে চিনিস না তাই ভালো লাগে না? তাহলে এখন তো আমি আর তুই বন্ধু। এখন সমস্যা কোথায় ভার্সিটি আসতে।

-সমস্যা, নেই আসবো তো দু’দিন পর।

-দু’দিন পর নয় কালই আসবি। তোর বাসার ঠিকানা দে আমি নিজে গিয়ে তোকে পিক করে নিয়ে আসবো।

-কাল এসে কি করবি? কাল তো ভার্সিটি বন্ধ।

-তো কি হয়েছে? গানের কম্পিটিশনে যাবো। বাসায় যদি বলিস ভার্সিটি বন্ধ তাহলে বের হতে দিবে?

-বাসায় বলবোই বা কেন? আর কেনই বা ভার্সিটি আসার নাম করে কমপিটিশনের ওখানে যাবো?

-উফ, আমি যাবো তাই তুই ও যাবি,ওকে?

-তুই কেন যাবি? আর আমি কোথাও যাবো না।

-উফ, আল্লাহ মেয়েটা এতো কথা কেমনে বলে! তুই যাবি আমার সাথে কাল। আর আমি যাবো আমার ক্রাশের গান শুনতে বুঝেছিস?

-তোর ক্রাশ?

– হ্যাঁ, ফাইনাল ইয়ারে পরে সাদাফ আহমেদ। কি সুন্দর যে গান করে আমি তো একবার গান শুনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছি।

-তারমানে তুই প্রেমে পড়েছিস?

-সেটা তো কবেই দোস্ত। কিন্তু কেউ জানে না আজই তোকে বললাম কাউকে বলিস না।

তানহা ফিসফিসিয়ে বললো কথা গুলো। এশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে গেলো। তানহাও নিজের বাসার দিকে পা বাড়ালো।
_____________________

সাদাফ আজ ভার্সিটিতে এসেই গান কমপিটিশনে যোগ দেওয়ার জন্য দূরের অন্য একটা ভার্সিটিতে চলে গেছে। কিন্তু তার আজ ভয় হচ্ছে। যেভাবে নৌকায় দেখা অপরিচিত মেয়েটা তার চোখে আর মনে জায়গা করে নিয়েছে। সবসময় শুধু তাকেই ভাবতে ইচ্ছে করে। বন্ধু’রা বারবার জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? এতোক্ষণ না বললেও এবার বলে ফেললো,

-আমি বোধহয় শেষ!

-শেষ মানে?

সাদাফ ঠোক গিলে জবাব দেয়,

-একটা সুন্দরী মেয়ে আমার মনে বসত তৈরি করে ফেলেছে রে তাই শেষ।

-বলিস কি? কে সে? (সবাই চিৎকার করে বললো একসাথে)

-কে সে জানি না তবে আমার মনে হয় এটাই সেই প্রেয় প্রেয়সী যার জন্য এতো বছর অপেক্ষা করে ছিলাম।

-প্রেমে পড়ে গেলি, মনের ঘরে জায়গা দিয়ে ফেললি আর জানিসই না মেয়েটা কে? এটা আবার কেমন কথা?

লাবণ্য জিজ্ঞেস করলো। আর বাকি সবাই জিজ্ঞেসু দৃষ্টি নিয়ে সাদাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। সাদাফ মেয়েটির সাথে কোথায় দেখা হয়েছে সেই ঘটনা বন্ধুদের খুলে বললো। সবাই হুহু করে হেসে ফেললো। অমিত হাসতে হাসতে বললো,

– সবচেয়ে বড় কথা হলো শেষে তুই ও প্রেমে মজনু হলি!

সাদাফ কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই স্টেজের মাইকে লাবণ্য এবং সাদাফের নাম এনাউন্সমেন্ট করা হলো। হ্যাঁ, আজ লাবণ্য এবং সাদাফ ডুয়েট গান গাইবে। গানের সুত্রেই সাদাফ -লাবণ্যর বন্ধুত্ব হয়েছে। তারা দু’জন বাকি বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে স্টেজে উঠে গেলো। সবাইকে সালাম জানিয়ে লাবণ্য গাইতে শুরু করলো,

তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো
তোমার ইচ্ছে গুলো
ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

এটুকু গেয়ে লাবণ্য থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পর সাদাফ গাইতে শুরু করলো,

তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো
তোমার ইচ্ছে গুলো
ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো।
আমার ভালোলাগা ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

সাদাফ থামতেই লাবণ্য আবার শুরু করলো,

তুমি হাতটা শুধু ধরো
আমি হবো না আর কারো।
তুমি হাতটা শুধু ধরো
আমি হবো না আর কারো।
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়োসড়ো।

তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো।

লাবণ্য স্টেজে সাদাফের পাশে গান গাইছে ঠিকই। কিন্তু তার মনে চোখে বার বার মেহেদী চলে আসছে। ঠিক তেমন সাদাফের মনেও বারবার অপরিচিত আসমানী পরীটা এসে হানা দিচ্ছে। সাদাফও তার অপরিচিতাকে মনে করেই গাইছে,

তোমার আবেগ মাখা খামখেয়ালী
হাঁটছে আমার পিছু।
আমার আসা যাওয়ার পথের বাঁকে
পায়নি অন্য কিছু।

সাদাফ থামার সাথে সাথে লাবণ্য সুর তুললো,

তোমার আবেগ মাখা খামখেয়ালী
হাঁটছে আমার পিছু।
আমার আসা যাওয়ার পথের বাঁকে
পায়নি অন্য কিছু।

এভাবে দুজন একসাথে পুরো গানটা গেয়ে শেষ করলো। ওরা থামতেই চারপাশ হাত তালিতে মুখরিত হলো। তারা যেন আগাম জানিয়ে দিচ্ছে এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী সাদাফ এবং লাবণ্য। যদিও তিনদিন পার্টিসিপেট করার পর। সর্বোচ্চ বাছায় করে বিজয়ী নির্বাচন করা হবে।

চলবে…

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-০২

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_০২
#আয়েশা_আক্তার

সাদাফ আহমেদ বেশ শৌখিন একজন মানব। তার পোষাক, চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুই বেশ গোছানো এবং মার্জিত। তার গায়ের শ্যাম রঙের সাথে মানিয় সবসময় সে পোষাক নির্বাচন করে। সেও ঢাকা শহরেরই বাসিন্দা। তবে তার বাবা সাহাবউদ্দীনের জন্ম রূপপুর গ্রামে। এর মানে হলো সাদাফের দাদাবাড়ী রূপপুর গ্রামে। পড়াশোনার ফাঁকে প্রায়ই যাওয়া হয় সেখানে তাঁর। গ্রামে সে বেশ এনজয় করে। সেখানে গিয়ে সে সাঁতার, নৌকা চালানো সবই শিখেছে। রূপপুর বেড়াতে গিয়ে প্রায়ই শখের বশে নৌকা চালিয়ে মানুষজন পারাপার করে সাদাফ। আর আজও সে ঢাকা আসার পূর্বে নিজে নৌকা চালিয়ে নদী পার হয়েছে। সেই সাথে কিছু মানুষকেও পার করেছে। ঢাকায় ফিরতেই বন্ধু’রা তার বাসায় এসে হাজির হয়েছে। অমিত, লাবন্য, প্রিতম, হৃদয় হচ্ছে সাদাফের ভার্সিটি লাইফের বন্ধু। সেই প্রথম বর্ষ থেকে এখনো তারা একসাথে আছে। কিন্তু কে জানে এবছর পর তারা কে কোথায় চলে যাবে! হ্যাঁ, সাদাফ ও তার বন্ধু’রা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। সাদাফ গ্রামে থাকায় অনেক দিন তাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়ে উঠেনি। তাই আজ সাদাফের ফেরার খবর শুনেই সঙ্গে সঙ্গে চলে এসেছে। কিন্তু সাদাফের আজ কোনো কিছুতেই মন নেই। তার চোখে বারবার শুধু একটা মায়াবী মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে। হ্যাঁ আজ সকালে নৌকা চালিয়ে গ্রামের নদী পার হওয়ার সময় নৌকায় দেখা একটা মেয়েকে দেখে চোখ আঁটকে গিয়েছিল সাদাফের। সোজাসুজি মেয়েটির দিকে না তাকালেও বেহায়া চোখ বারবার চলে যাচ্ছিলো তার দিকে। সুন্দর একটা মায়াবী মুখ, টিকালো নাক, বিনুনি করা চুল, হালকা আকাশি রঙের কাপড়ে সাদা এমব্রয়ডারি কাজ করা একটা সাধারণ থ্রি পিছ জড়ানো গায়ে, ব্যাস এটুকুই। এতো সাধারণ লুকেও মেয়েটিকে কেমন অসাধারণ লাগছিলো।

-কি রে আমাদেরকে সামনে বসিয়ে কই হারিয়ে গেলি?

সাদাফের ভাবনার মধ্যেই লাবন্য কথাটা বলে উঠে। সাদাফ ধ্যান ভেঙে সামনে তাকাতেই দেখে লাবন্য আকাশি রঙের একটা লং টপস পড়েছে। আকাশি রঙটা দেখে আবারও সাদাফের চোখের সামনে সকালে দেখা মেয়েটির প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। এবার সাদাফ মাথা নেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। আর ভাবে, “নাহ, আর বাঁচা গেলো না। এবার বোধহয় প্রেম প্রয়সী চলেই এলো!” যারজন্য সাদাফ এতোদিন অপেক্ষায় ছিলো।

-কি রে হা করে কি ভাবছিস? সেই কখন থেকে বসে আছি আমরা। তুই কোনো কথাই বলছিস না! (লাবন্য)

লাবন্যের কথা শুনে সাদাফ ফেকাসে চেহারা নিয়ে জবাব দিলো,

-আজ অনেক ক্লান্ত লাগছে। আজ আমার আর বের হওয়া হবে না। তোরা রাগ করিস না প্লিজ। কাল ভার্সিটি গিয়ে দেখা হবে। আর কম্পিটিশন নিয়ে সব রকম আলোচনাও কালই হবে।

-আচ্ছা, তাহলে আজ আমরা যাই। তুই বরং রেস্ট নে।

কথা শেষ করে সাদাফের বন্ধুরা সব চলে গেলো। সবাই কিছু না বুঝলেও লাবন্যর মনে হতে লাগলো, সাদাফের কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে সাদাফ তো এমন করে না কখনো? কি জানি আমি হয়তো বেশি ভাবছি। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বাসায় পৌঁছালো লাবণ্য। বাসায় গিয়ে দেখে মেহেদী এসেছে। নিমিষেই লাবন্যর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। মেহেদী লাবন্যর হবু হাসবেন্ড। দুই পরিবার মিলে তাদের বিয়ের পাকা কথা বলে রেখেছে। প্রথমে দু’জন দু’জনের উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করলেও ধীরে ধীরে দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। আর তারজন্যই এখন দু’জন নির্ভয়ে একজন আরেকজনের সাথে হাটতে হাটতে কথা বলতে বলতে পথ পাড়ি দিতে পারে। মেহেদীকে দেখেই লাবণ্য ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কখন এলে?

-এইতো কিছুক্ষণ।

-হঠাৎ না বলেই চলে এলে? বললেই তো আমি বাসা থেকে বের হতাম না তাহলে।

– ভেবেছিলাম বউকে চমকে দিবো এসে। কিন্তু হায় ভাগ্য! বউকে ছাড়াই এক ঘন্টা পার হয়ে গেলো!

কাঁদো কাঁদো মুখ করে কথাগুলো বললো মেহেদী। লাবণ্য এটা দেখে হেসে ফেললো। রিনরিনে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললো,

-এখন তাহলে কি করতে হবে আপনার জন্য?

-বেশি কিছু না ঘরে গিয়ে বিছানার ডান পাশে দেখবেন একটা ব্যাগ আছে। সেটাতে যা আছে তা পড়ে চটপট তৈরি হয়ে আসুন বাইরে বের হবো একটু। শাশুড়ী আম্মুকে বলেছি আগেই। আপনার আর বলতে হবে না।

-ওকে দু মিনিটে আসছি। তুমি টিভি অন করে দেখতে থাকো।

-আপনার দু’মিনিট মানে কতক্ষণ বলবো?

-না বলতে হবে না। যা বলেছি সেটা করো।

বলতে বলতে লাবণ্য ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরে এসে দেখে, বিছানার ডানপাশে একটা শপিং ব্যাগ রাখা। ব্যাগে কি আছে দেখতে গিয়ে লাবণ্য অবাক হলো বেশ! ভেতরে একটা পার্পল কালার শাড়ি, পার্পল কালার এক মুঠো কাচের চুড়ি, পার্পল রঙের পাথর দেওয়া একজোড়া ঝুমকো। লাবণ্য এসব দেখে ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। সে এগুলো বিছানায় রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আশপাশ দেখে নিলো কেউ আছে কি না। কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে ড্রয়িং রুমে বসা মেহেদীর দিকে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মা মিসেস স্বপ্না বেগমকে দেখা যাচ্ছে কি না। দেখতে না পেরে। মেহেদীর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বললো,

“এতোগুলা গিফট দিয়ে খুশি করার জন্য এটা আপনার।”

বলেই দৌড়ে রুমে চলে আসলো লাবণ্য। ঘটনার আকস্মিকতায় কি হলো সেটা বুঝতে পারলো না মেহেদী। গালে হাত দিয়ে লাবণ্যর ঘরের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পেরে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে অস্ফুট উচ্চারণ করলো,

-পাগলী!

কিছুক্ষণের মধ্যেই লাবণ্য তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে স্বপ্না বেগমও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মেয়ের দিকে তাকাতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো

-মাশাল্লাহ, নজর না লাগুক।

লাবণ্য মায়ের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, -দেখতো মা কেমন লাগছে?

-একদম রাজকুমারীদের মতো লাগছে তোকে।

-উফ, মা! তুমি সবসময় বানিয়ে বলো।

এবার স্বপ্না মেহেদীর সামনে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,- বলো তো কেমন লাগছে আমাকে?

মেহেদী শাশুড়ীর সামনে কিছু বলতে পারলো না। শুধু স্বপ্না বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মা, আমরা বের হচ্ছি।

লাবণ্য মেহেদীর এমন আচরণে অবাক হলো। সে কি জিজ্ঞেস করলো আর মেহেদী তার জবাব না দিয়ে এটা কি বললো! আশ্চর্য! এতে লাবণ্যর খানিক মন খারাপ হলো। সে গাড়িতে গিয়ে মন খারাপ করে বসে রইলো। মেহেদী গাড়িতে উঠে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিলো। তারপর লাবণ্যর নরম গালে টুপ করে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে ড্রাইভিং করতে শুরু করলো। লাবণ্য একবারো মেহেদীর দিকে তাকায়নি। মেহেদী বুঝতে পারে তার মন খারাপ হয়েছে। তাই হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে লাবণ্যর দিকে চেয়ে রইলো। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় লাবণ্য মেহেদীর দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায়। মেহেদী কাব্যিক সুরে বলতে শুরু করে,

“আমি কবি হলে না হয়
কাব্যের সুরে করতাম তোমার রূপের বর্ণনা।
তুমি কি জানো? তোমায় স্বর্গের পরীর চেয়েও
সুন্দর লাগছে প্রিয়তমা।”

লাবণ্যর মন ভালো হয়ে গেলো। তার ঠোঁটে লজ্জা রাঙা হাসিরা এসে ভিড় জমালো।

চলবে…

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-০১

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#সূচনা_পর্ব
#আয়েশা_আক্তার

রূপপুর গ্রামে এশার মামা বাড়ি। ছোট সময় মায়ের সাথে এ গ্রামে অনেকবার এলেও বড় হয়ে অনেক পরে এসেছে এখানে এশা। রূপপুর গ্রামটা এশার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এশার মতে এই গ্রামের সাথে নামের বেশ মিল আছে। পুরো গ্রামটা কি অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো! এশার এই ক’দিন সারাদিনই বাতাসে ধানগাছের দোল খাওয়া, পাখিরা কিচিরমিচির, কৃষকদের ধান কাটা, জেলেদের মাছ ধরা এসব দেখেই কেটেছে। এমন ছবির মতো সুন্দর গ্রামের রূপে মুগ্ধ এশা।তার ইচ্ছে করছে বাবাকে বলে, বাকিটা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিতে। তবে ইচ্ছে হলেই কি সবকিছু করা যায়? তার যে ভার্সিটির প্যারাময় ক্লাসগুলো করার সময় হয়ে গেছে। হ্যাঁ, এশা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সবেই এডমিট হয়েছে। এক সপ্তাহও ক্লাস করেনি। ভার্সিটিতে তার কোনো বন্ধু নেই তাই তার ভার্সিটি যেতে ইচ্ছে করে না। তারজন্যই এতো বছর পর মামা বাড়িতে পালিয়ে এসেছে সে। কিন্তু এসেও শান্তি নেই। ভার্সিটি থেকে কল করে করে নাকি মিস্টার ইয়াশ খানকে পাগল করে ফেলেছে প্রফেসর’রা। খেয়ে তো আর কাজ নেই প্রফেসরদের। মিস্টার ইয়াশ খানই হয়তো বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছে। ইয়াশ খান এতো হিটলার কেন? এশা মোটেও এমন হিটলার টাইপ বাবা ডিজার্ভ করে না। মোটেও না। এশার এসব ভাবনায় পানি ঢেলে পাশে রাখা মুঠোফোনটা ব্রাইভেট করে উঠলো। এশা এক গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে মিস্টার ইয়াশ খান ওরফে এশার বাবারই কল। কল রিসিভ করে এশা সালাম দেয়,

– আসসালামু আলাইকুম বাবা।

-ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কি ব্যাপার তুমি আসছো না কেন? তোমার প্রফেসর গুলো তো এবার আমায় কিডন্যাপ করবে তোমায় না পেয়ে।

-হুহ, করুক তোমায় কিডন্যাপ তাহলে আমার উপর থেকে জল্লাদ বাপের অত্যাচার একটু কম হয়।

-কি বিরবির করছো? আসবে নাকি আমি এসে তোমায় নিয়ে আসবো?

-তোমায় আসতে হবে না। আমি রেডি হয়ে বসে আছি। মামা বাজার থেকে এলেই বের হবো।

-সত্যি আসবে তো আজ? নাকি আজ-ও মিথ্যা বলছো?

-হ্যাঁ, বাবা সত্যিই। তোমার মেয়ে কখনো মিথ্যা বলতে পারর?

-মোটেই না শুধু ভার্সিটির ক্লাসের ভয়ে অজুহাত দেখিয়ে মামাবাড়ি লুকিয়ে থাকে আমার মেয়ে হা, হা, হা।

-বাবা, মামী ডাকছে আমি বের হয়ে তোমায় কল করবো।
-ওকে সাবধানে এসো।

নাদিরা বেগম রুমে এসে দাঁড়াতেই এশা বাবার সাথে কথা শেষ করে কল কাটে। নাদিরা বেগম হেসে এশার মাথায় হাত রেখে বলে,
-বাবার বড় মেয়েকে না দেখে পাগল হয়ে গিয়েছে বাবা তাইতো বারবার কল দিয়ে যেতে তাড়া দিচ্ছে।

-না, মামী। ভার্সিটির ক্লাস আছে। এই ক’দিনে অনেক গুলো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। আমি তো কাউকে তেমন চিনিও না। তাই আমার জন্য নোটস কালেক্ট করাও কষ্টকর হবে। এরজন্যই বাবা এতো তাড়া দিচ্ছে।

-হ্যাঁ, আবার এসো রুমু-ঝুমু তোমাকে অনেক মিস করবে। বারবার বলছে, মা আপাকে বলো আর কিছুদিন থেকে যেতে।

-আমিও ওদেরকে খুব মিস করবো মামী। ওরা কই?

-ঘরে মন খারাপ করে বসে আছে। খেতে ডাকলাম আসলো না। তোমার ও তো খাওয়া হয়নি,চলো খেয়ে নিবে।

-হ্যাঁ, চলো আর আমি ওদের ডেকে আনছি তুমি গিয়ে খাবার বাড়ো।

নাদিরা বেগম রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন সবার জন্য খাবার বাড়তে। আর এশা চলে গেলো তার দুই মামাতো বোন রুমু-ঝুমুর ঘরে। রুমু-ঝুমু দু’জনেই জানালা দিয়ে বাইরেের দিকে তাকিয়ে আছে মন খারাপ করে। দু’জনেই সুতি সেলোয়ার-কামিজ পড়া আর চুলে বিনুনি করা। ওরা দু’জন এক বছরের ছোট বড় হলেও ওদের দেখতে একদম জমজ বোনের মতো। দূর থেকে তাদেরকে কেউ আলাদা করতে পারে না। যারা চিনে না তারা কাছ থেকেও আলাদা করতে পারে না। তবে বাবা-মা ভাই আর এশা ওদেরকে দেখলেই চিনে ফেলে যে কে রুমু আর কে ঝুমু। এশা দুজনের পিঠে গিয়ে হাত রাখলো তারপর দু’জনের মাথা সরিয়ে জানালা দিয়ে উকি দিতে দিতে বললো,

-দেখি তো কোন রাজপুত্র দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। যাকে আমার দুই মামাতো বোন এতোক্ষণ ধরে দেখছে।

এশার কথা শুনে রুমু-ঝুমু হেসে উঠলো। তাদের হাসিতে লম্বা বিনুনি করা চুল গুলো খানিক নেচে উঠলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ থাকলো না। দু’জনেই এশা’কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। এশারও দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। তবে সে তা কাউকে না দেখতে দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে রুমু-ঝুমু’ কে বলে উঠে,

-তোদের কি আজ বিয়ে? এভাবে কাঁদছিস কেন?

-তোমাকে খুব মিস করবো আপা।(রুমু চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে উঠে।)

-আমিও খুব মিস করবো আপা।(ঝুমু)

-আমিও তোদেরকে মিস করবো। স্কুল ছুটি হলে মামাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসবি কেমন?

-বাবা নিয়ে যাবে?

-অবশ্যই নিয়ে যাবে আমি বলে যাবো।

ওদের কথার মাঝখানে নাদিরা বেগম আবার এসে ডাক লাগালো,

– এশা এবারকি তুমিও এদের সাথে কান্নার আসর জমালে? খাবে না নাকি? তোমার মামাতো এখনই এসে পরবে।

-এইতো মামী আসছি আমরা।

ওদের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই হাকিম মিয়াও (এশার মামা) বাজার থেকে চলে আসলো। তারপর হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো। এই সুযোগে এশা, রুমু, ঝুমু তিনজন আরো একবার একে অপরকে জড়িয়ে থাকলো খানিক্ষণ। একটু পড়েই যে এশা চলে যাবে গ্রাম ছেড়ে।
_____________________

হাকিম মিয়ার পেছনে পেছনে হাঁটছে এশা। তার এই প্রথম এত্তো মন খারাপ লাগছে। এর আগে কখনো এমনটা হয়নি। সে হুমায়ুন আহমেদের বইয়ে পড়েছিলো মেয়েদের কারণে অকারণে মন খারাপ হয়। এই কথা সে বিশ্বাসই করেনি এতোদিন। তবে বুঝি কথাটা এখন তার ক্ষেত্রেও সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেলল!

এসব হাবিজাবি কথা ভাবতে ভাবতেই এশা মামার সাথে নদীর ধারে এসে পৌঁছালো।মামা তীরে থাকা একটা নৌকা দেখিয়ে তাড়া দিয়ে বললো,

-তাড়াতাড়ি উঠে বোস। নৌকা প্রায় ভরে গেছে। এরপর আবার কোনো নৌকা ঘাটে আসবে কিনা সেটাও সন্দেহ।

এশা বিনা প্রতিত্তোরে নৌকায় ওঠার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।কিন্তু যেই নৌকায় পা রাখলো ওমনি পা’টা স্লিপ করে গেলো। একটু হলে নদীতেই পরে যাচ্ছিলো এশা। সে ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু একটা বলিষ্ঠ হাত এশাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর তারজন্যই এশা এযাত্রায় বেঁচে গেলো। এশা চোখ খুলে দেখে এক শ্যাম বর্ণের সুদর্শন পুরুষ এশাকে শক্ত করে ধরে আছে। এশা স্বাভাবিক হওয়ার পর ছেলেটি এশাকে ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। এক বয়স্ক মহিলা শ্যামবর্ণা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-কি বাজান তোমার শখের নৌকা ছাড়বা কহন?

-এইতো চাচি এখনই ছাড়বো।

এশা ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। হাকিম মিয়া এশাকে বললেন,

-একটু সাবধানে চলবি তো মা? পোলাড না থাকলে আইজ কি অবস্থা হইতো? আমি তোর বাপ-মা’কে কি জবাব দিতাম?

মামা’র কথার মাঝখানেই। শ্যাম পুরুষ মামাকে ডেকে বলে উঠে,

-চাচা, ভেতরে এসে বসেন। নৌকা ছেড়ে দিলে এবার আপনারা দু’জনেই পরে যাবেন।

হাকিম মিয়া এবং এশা দু’জনেই ভেতরে গিয়ে বসলো। এশা না চাইতেও বারবার তার চোখ শ্যামবর্ণা ছেলেটির দিকেই চলে যাচ্ছে। ছেলেটি এতোক্ষণে নৌকা চালাতে শুরু করেছে। এশা বসে বসে ভাবছে,

” এতোদিন ভাবতাম নৌকার মাঝি হবে মধ্য বয়স্ক মামা-চাচা টাইপ কিন্তু এই পোলা দেখি কেমন বয়ফ্রেন্ড টাইপ।”

বয়ফ্রেন্ড কথাটা মাথায় আসতেই এশা চমকে উঠলো। সে এই প্রথম বয়ফ্রেন্ড শব্দটা উচ্চারণ করেছে। তবে এশার বয়ফ্রেন্ড – গার্লফ্রেন্ড শব্দ দুটো পছন্দ করে না। তার মতে এখনকার তথাকথিত বয়ফ্রেন্ড -গার্লফ্রেন্ড থেকে নব্বই দশকের প্রেমিক প্রেমিকা বেশ ভাল্লাগে। এশা মাঝে মাঝে কল্পনা করে,
এশা নব্বই দশকের এক তরুণী। সে সুন্দর করে শাড়ি পড়ে, চোখে গাঢ়ো কাজল, রুমু-ঝুমু’র মতো মাথা ভরতি তেল দিয়ে চুলে বিনুনি করে ভার্সিটি যাবে। তার একটা ব্যাক্তিগত পুরুষ হবে। যে প্রতিদিন না হোক সপ্তাহে একদিন বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবে এশার জন্য। সে খুব ফর্সা হতে হবে এমন না। হোকনা একজন শ্যাম পুরুষ। আবারও “শ্যাম পুরুষ” শব্দ দুটো ভেবে নিয়ে এশা চমকে উঠলো। তার সামনে নৌকা চালানো ছেলেটাও তো শ্যাম বর্ণের। তবে কি….

এতোটুকু ভেবে নিয়ে এশা নিজের মাথায় নিজেই হালকা চাপর দিলো। একি ভাবছে সে? এই ছেলেকে তো এশা চিনেও না। এশা লক্ষ্য করলো,

তখন কথা বলা বয়স্ক মহিলার পাশে বসা মেয়েটি গিয়ে নৌকা চালানো ছেলেটাকে বললো,

-ভাইয়া তুমি তো অনেক ভালো গান পারো। আজ একটা গাইবে না?

শ্যামবর্ণা ছেলেটি মেয়েটির কথা শুনে হেসে উঠলো। কি সুন্দর ঝলমলে হাসি! হাসির সাথে সাথে ছেলেটার কালো ঘন চুল গুলোও খানিকটা নেচে উঠলো। ছেলেটি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-ভাইয়া কি বোনের আবদার ফেলতে পারে? কখনোই না। তোমার ভাইয়া অবশ্যই গাইবে। তুমি বসো।

ছেলেটি এবার ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সুর তুললো,

কবির লেখা যত কবিতা
শিল্পীর আঁকা যত ছবি
তোমার তুমির কাছে
হার মেনে যায় যেন সবই।
সাঁঝের বেলা রাঙ্গানো ধুলি
বর্ষাকালের ভরা নদী
তোমার রূপের কাছে
হার মেনে যায় যেন সবই।
তুমি সাগর নীলিমা নও
তুমি মেঘের বরষা নও
তুমি সাগর নীলিমা নও
মেঘের বরষা নও
তুমি শুধু আমারই গয়না
আয়না.. তুমি হৃদয়ের আয়না।

এটুকু গেয়েই থেমে গেলো ছেলেটি। এশা কেমন নেশালো দৃষ্টি নিয়ে সারাক্ষণ ছেলেটার দিকে চেয়ে আছে। ছেলেটিও তার দিকে বারকয়েক আড়চোখে তাকালো কি-না সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এশা। এশা ভাবছে,

“যদি ছেলেটি না তাকিয়ে থাকে। তবে তাকালো না কেন? অবশ্যই তার তাকানো উচিত ছিলো এশার দিকে। শুধু তাকানো কি বলছি একদম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা উচিত ছিল। এশা কি সুন্দর নয়?যথেষ্ট সুন্দরী। মামী বলে এশা একবার সুন্দর করে শাড়ি পড়ে বাইরে বের হলে রাস্তায় ছেলের লাইন লেগে যাবে। মামী তো আর এমনি এমনি বলে না।”

-কিরে কি বিরবির করছিস? নৌকা থেমে গেছে নামবি না?

মামার ডাকে থতমত খেয়ে গেলো এশা। তারপর কোন কথা না বলে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ায় সে। মামা বাস কাউন্টারে এসে গাড়িতে তুলে দেয় এশাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে,

-কি যেতে পারবি তো?

– হ্যাঁ, মামা তুমি চিন্তা করো না।

– পৌছে আমায় কল দিস কেমন? চিন্তায় থাকবো তোর জন্য।

-চিন্তা কিসের আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি মামা।

-তুই যখন আমার মতো হবি তখন বুঝবি ছেলেমেয়ে যতবড়ই হোক বাবা-মা এর চিন্তা হবেই।

-উফ, মামা তুমি আর বাবা একদম একই রকম কথা বলো।

কিছুক্ষণ কথা বলে এশা মামার থেকে বিদায় নিলো। বাসও ছেড়ে দিলো। হাকিম মিয়া দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ বাসটি দেখা যায়।

চলবে….

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

1

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৮ (অন্তিম পর্ব)

সময় এগোচ্ছে সেই সাথে মৃ*ত মানুষটাকে তার নিজস্ব ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে মৃ*ত বাড়িতে। চারপাশে মানুষের ভিড়।ভিড়ের মাঝে সাদা কাপড়ে মোড়ানো মৃ*ত মায়ের চারপাশ ঘিরে কাঁদছে ছেলে-মেয়েরা। সে কি আ’হা’জা’রি! প্রিয় হারানোর শো’ক! মা যেমনই হোক তাদেরই তো মা। মা হিসেবে রেহেনা বেগম কখনো সন্তানের কোনো ইচ্ছের খামতি রাখেনি। আজ তাদের সন্তানদের একেবারে এতিম করে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো সেই মানুষটি।
জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় হয়ে আসছে,নি*থ*র হওয়ার লা*শে*র জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। কেউ কেউ অধৈর্য হয়ে তা*ড়া দিচ্ছে, সবাই সবার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত কিনা!
একেক করে সবাই শেষ দেখা দেখো বিদায় জানালো রেহেনা বেগম’কে। দূরের ওই মাটির ঘর খানিতে একা একা পড়ে রইলো রেহেনা বেগম, কেউ আর তার কাছে দাঁড়ালো না দু’দন্ড।
জীবিত থাকতেই যত বাহাদুরি আমাদের, নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে সব আয়োজন শেষ।

মা’কে ক’ব’রে রেখে এসে একেবারেই ভে’ঙে পড়লো আযান। মায়ের রুমে এসে খালি বিছানাটার উপর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা। তারই পাশে চার বোন হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মেঝেতে।
আজ থেকে এই রুমটায় আর কেউ থাকবে না, সবকিছুই পড়ে রইলো শুধু হারিয়ে গেলো মা। সে কথা ভাবতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আযান। মা’কে একটু বেশিই ভালোবাসতো ছেলেটা।
বাবা’কে কাঁদতে দেখে ছোট্ট আলো গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো বাবার নিকটে। রুম থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে, বাবার কাঁধে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে শুধালো,

“বাবা! কেঁদো না বাবা! কষ্ট হচ্ছে খুউব! আমার মা একবার বলেছিলো, মানুষ ম’র’ণ’শী’ল! এরা তো আর চিরকাল বেঁচে থাকবে না,তাই না বাবা? মা হারিয়ে গিয়েছে তো কি হয়েছে বাবা! আজ থেকে আমি তোমাদের আরেকটা মা। কেঁদো না বাবা!”

তার ছোট্ট মেয়েটা হুট করেই যেন বড় হয়ে গেলো। কি সুন্দর করে বিজ্ঞদের মতো কথা বলছে। আলোর ফুপিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। পরক্ষণে আযান ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বার কয়েক ডাকলো,

“মা! মা! মা! তুমি আমার ছোট মা।”

এমন করে এতো স্নেহ মাখা কণ্ঠে হয়তো আর কখনো মেয়ে’কে ডাকেনি আযান। টুপ করে মেয়েটার কপালে চুমু খেলো সে। বাবা’র এতো আদর পেয়ে ফোকলা দাঁত বের করে খিলখিল করে হেসে উঠলো অবুঝ আলো। ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবা’র চোখের কার্ণিশের লোনা-জলটুকু মুছে দিলো। আযান মলিন হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ধীরপায়ে এগিয়ে আসলো শিখার মুখোমুখি, হঠাৎ করেই স্ত্রী’র একটি হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ভেজা কণ্ঠে শুধালো,

“আমার মা’কে তুমি ক্ষমা করে দিও শিখা। জানি আমার মা, আমি তোমার সাথে খুব অন্যায় করেছি। মায়ের দোষত্রুটি গুলো দেখেও আমি নিরব ছিলাম, মা’কে কিচ্ছুটি বলতে পারিনি, যদি মা কষ্ট পায়! কিন্তু তবুও পারলে আমার মৃ*ত মাটাকে ক্ষমা করো শিখা।”

শিখা গম্ভীর নির্বাক চিএে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল! দৃষ্টি তার ফ্লোরের দিকে নিবন্ধিত। এই মানুষটাকে ক্ষমা করতেও মন সায় দিচ্ছে না তার। কি করে ভুলে যাবে কিশোরী মনে শ্বাশুড়ির দেওয়া এতো আঘাত।
আযান আবারও ডাকলো,

“শিখা?”

শিখা চোখ তুলে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড মৌনতা পালন করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

“তাকে হয়তো আমি ক্ষমা করে দিলাম তবে আমার রু’হু তাকে ক্ষমা করতে নারাজ।
যদি কখনো অতীত ভুলে তার দেওয়া আঘাত ভুলতে পারি, তবে সেদিনই আর কোনো অভিযোগ থাকবে না। ”

আযান মিনিট খানিক সময় নিয়ে শিখার হাত ছেড়ে দিলো। এহেন কথায় এখান কি বলা উচিৎ জানা নেই তার। তবে পণ করলো মনের সাথে, ধীরে ধীরে নিজেকে পাল্টে ফেলবে আযান। স্ত্রীকে ভালো না বাসলেও অবহেলা করবে না। অতঃপর মেয়েকে সাথে করেই চোখ মুছতে মুছতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো উঠোনে।
.
.
মা নেই আজ সপ্তাহ দু-এক হলো। সবাই ধীরে ধীরে শোক ভুলে আবারও নিজ জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আত্মীয় স্বজনেরা চলে গিয়েছে আগেই, মেয়েরাও চলে গেলো নিজ নিজ সংসারে। বড় ঘরটা এখন ফাঁকা, নিরিবিলি নিস্তব্ধ। বাড়ির একমাত্র ছেলে আযান দু’দিন ধরে অসুস্থ,তাকে আজ সন্ধ্যায় হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে শিখা। ডায়রিয়া জনিত সমস্যা সাথে জ্বর, জ্বরে দিশেহারা ছেলেটা। ডক্টর দেখে ঔষধ, স্যালাই দিয়েছে সাথে বারবার শরীর মুছে দিতে বলছে।
অসুস্থ স্বামীর পাশে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে শিখা। অন্য বেডে আলো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, আযান এখনো শরীরের উওাপে ছটফট করছে।
রাত তিনটায় আবারো “ডক্টর সুমা” আসলো চেক-আপ করতে। উনি শিখার পূর্ব পরিচিত। শিখাকে রাতের শেষ প্রহরের স্বামীর মাথায় জ’ল’প’ট্টি দিতে দেখে উনি কিঞ্চিৎ হেসে শুধালো,

“আপনি এখনো জেগে আছেন?”

শিখা মৃদু কণ্ঠে বললো, “কি যে বলেন, উনি অসুস্থ তাকে রেখে ঘুমোই কি করে।”

“বাহ! স্বামীকে খুব ভালোবাসেন বুঝি।”

“তা জানি না। তবে, বিয়ের পর একটা মেয়ের সবটা জুড়েই থাকে তার স্বামী।”

শিখার উওর শুনে সুমা একটু রসিকতা করেই বললো,

“বাহ! বাহ! সুখী কাপল! আপনি ভীষণ ভাগ্যবতী নারী! আপনার হাসবেন্ডও বোধহয় আপনাকে খুব ভালোবাসে।”

“হাহা! ভালোবাসা অতি দামী শব্দ ! এটা সবার জন্য নয়। নারীর সবটা জুড়ে তার স্বামী থাকলেও একজন স্ত্রী তার স্বামীর কখনো প্রিয়জন হতে পারে না ম্যাডাম। স্বামীর প্রিয়জন তো তার মা-বোন আর আপন জনেরা!
স্ত্রী সে-তো পরের মেয়ে, সে তো শুধুমাত্র শ্বশুর বাড়ির চাকরানী আর সকলের প্রয়োজন মেটানোর মেশিন।”

কথা শেষ করে ঠোঁট এলিয়ে নিঃশব্দে হাসলো শিখা। সবটা শুনে ডক্টর সুমা ততক্ষণাৎ আমতা আমতা করে বললো,

“স্যরি ম্যাম! আপনাকে পার্সোনাল ভাবে অ্যাটাক করে ফেললাম। এটা একদম অনুচিত কাজ। আমি আবারও সরি,কিছু মনে করবেন না।

শিখা মুচকি হেসে বললো, “আরে ব্যাপার না ম্যাডাম। এভরিথিং ইট’স ওকে! ”

ডক্টর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মনযোগী হলো। আযান চোখ বন্ধ করে থাকলেও শিখার কথা কান এড়ালো না তার। খুব গোপনে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পুরুষটি। তারই বা কি দোষ! ছোট বেলা থেকে মা তাকে এভাবেই গড়ে তুলেছে তাকে। মা যতটুকু শিখায় সন্তানতো তাই’ই শিখে।
__________________

পাঁচ বছর পর…….

সবকিছুই আগের নিয়মে চলছে, সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এরিমধ্যে শিখার একটা ছেলে হয়েছে। আযানও এখন একজন দায়িত্বশীল পিতা হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে নিজেকে কিছুটা হলেও পাল্টে নিয়েছে সে।
আজ ফজরের নামাজ পড়ে কবর স্থানে আসলো শিখা। শ্বশুরের করব যিয়ারত করে, শ্বাশুড়ির কবরের নিকট দাঁড়িয়ে মিহি কণ্ঠে শুধালো,

“কেমন আছো মা? আমি চাই ওপাড়ে তুমি খুব ভালো থাকো। তুমি নেই আজ পাঁচ বছর হয়ে গেলো। লোকে বলে মৃ’ত মানুষের নামে কোনো অভিযোগ করতে নেই, বা মনে আনতে নেই। কিন্তু, তোমার প্রতি যে আমার এক আকাশ অভিযোগ জমা! সেগুলো কোথাও প্রকাশ না পেয়ে মনের ভিতরই গুমরে গুমরে ম’র’ছে! আজ কিছুটা প্রকাশ করে মনের সেই ভার হালকা করে নিচ্ছি মা। আর সেই অপরাধের জন্য আমায় ক্ষমা করো।

জানো মা?
তুমি বিনা-দোষে সতেরো বছরী এক কিশোরীর মন ভে’ঙে দিয়েছো। তার সব স্বপ্ন তুমি গুড়িয়ে দিয়েছিলে অবেলায়। সংসার জীবন বানিয়ে দিয়েছো তিক্তময়! জীবিত থাকা কালীন সংসারে এতটুকু শান্তি দেওনি আমায়। সবসময় গরীবের মেয়ে বলেই অবহেলা অ’ব’জ্ঞা করেছো। অথচ এই আমাকেই দেখে শুনেই তোমার ছেলের বউ করে ছিলে। তোমার সব প্রয়োজনে তবুও এই অকর্মা আমাকেই লাগতো। তাও তুমি বিন্দুমাএ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করোনি কখনো।
তুমি এতোটা নিষ্ঠুরতম মা ছিলে যে, গর্ভকালীন সময়টাও একটা মেয়েকে ছাড় দেওনি।
আমার গর্ভকালীন সময়টায় তুমি দিয়েছো আমায় বড় এক পাপের সাজা। তুমি তোমার মনের সকল রাগ উগড়ে নিয়েছিলে আর তোমার ছেলে ছিলো নির্বাক। যা মনে করলে এখনো আমার রুহু কেঁপে উঠে। হয়তো, সেই কালো অতীতের কথা আমি ইহজন্মে ভুলতে পারবো না।
জানো মা?
আমি সব সময় তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকতাম। কারণ, তোমার ভালোবাসা পেলেই বুঝি তোমার ছেলের ভালোবাসা পাবো, এটাই মাথায় ঘুরতো শুধু। কিন্তু, হায়! তোমার ভালোবাসা পাওয়া আমার কাছে শিয়ালের আঙুর-ফল হয়েই রয়ে গেলো! তুমি খুব ভাগ্য করে ছেলে পেয়েছিলে মা, অল্প বয়সী মেয়েও তার মনে জায়গা করতে পারেনি পাছে তোমার ভালোবাসা যদি কম পড়ে! তাইতো, আমিও তাকে “আমার স্বামী” না বলে তোমার ছেলে বলেই সম্মোধন করলাম। আমি মনে করি, সে একটা মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ! যে কারো স্বামী হওয়ার যগ্যতা রাখে না,এরা শুধুমাত্র মাতৃভক্ত ছেলে হয়েই থাকে।
চিন্তা করো না, মা। তোমার অনুপস্থিতে সে আমাদের ভালোবেসে তোমায় ভুলে যায়নি, বরং এখনো তোমার কথা মনে করে খুউব কাঁদে। প্রতি কথায় তোমায় মিস করে! তুমি খুশী তো মা?

এবার আমি কেমন আছি, শুনবে না মা? শুনো তবে।
আমি ভালো আছি মা, তুমিহীন আমি ভীষণ ভালো আছি। আমি এ-ও জানি, এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি সমাজের সব থেকে ঘৃণ্যিত পুরবধূ হবো! তবুও বলবো, তোমার মৃ’ত্যু’র পর থেকে আমি ভীষণ ভালো আছি। তোমার মৃত্যুর কয়দিন পরই আমি জবটা ছেড়ে দিয়েছি।
জানো, মা? তোমার মৃত্যুর বছর খানিক পরই আমার একটা ছেলে হয়েছে। সব থেকে অবাক বিষয় কি জানো, আমার ছেলেটা দেখতে অনেকটা তোমার মতো হয়েছে। অনেক প্রার্থনার ফল আমার এই ছেলে। আমি প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার নিকট এই ছেলের জন্য মাথা ঠুকেছি। কারণ কি জানো মা?
আমিও ছেলে মানুষ করবো, তাকে অন্ধভক্ত না বানিয়ে ঠিককে ঠিক, ভুলেকে ভুল বলা শিখাবো। তাকে শুধু ভালো সন্তান নয়, কি করে ভালো স্বামী ও ভালো বন্ধু হতে হয় তাও শিখাবো।
যাতে আমার মৃ’ত্যু’র পর, কারো কাছে আমার নামে কোনো অভিযোগ না থাকে। আমি আমার সন্তানদের আদর্শ মানুষ বানাবো। আমার জন্য আর্শীবাদ করো মা, আমি যেন আমার উদেশ্যে সফল হতে পারি।
সবশেষে এটাই বলবো মা, তুমি খুব ভালো থেকো।
আমার কথা ভেবো না মা, তুমিহীনা আমিও ভালো থাকবো!
এখন আর দ’ম বন্ধ হয়ে শ্বাসকষ্ট হয় না আমার, এখন চাইলেই যখন তখন প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায়, মুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়ে বেড়ানো যায়,তিনবেলা বঞ্চনা আর খেতে হয়না আমাকে।তুমিহীণা কা’রা’গা’রে’র এক ক’য়ে’দি পেয়েছি #মুক্তির_স্বাদ!”

(সমাপ্ত)

[বার্তা-১ঃ শ্বশুর বাড়িতে একটা মেয়ের সব থেকে বড় আশ্রয় হচ্ছে তার স্বামী। একজন স্বামীর আচার-আচরণের উপর ভিওি করেই পরিবারের বাকি সদস্য তাকে সম্মান করে। তাই বিবাহিত সব পুরুষদের উচিত, নিজ স্ত্রীকে তার যথার্থ সম্মান দেও।

বার্তা -২ঃ আপনার সন্তানকে ভালো সন্তান বানানোর পাশাপাশি একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন।
যাতে আপনি মা*রা গেলেও আপনার নামে কেউ অভিযোগ তুলতে না পারে।
মনে রাখবেন, পারিবারিক শিক্ষাই হচ্ছে একটা ছোট্ট শিশুর শিক্ষার প্রথম ধাপ।

বার্তা-৩ঃ প্রিয় অভিভাবক!
আপনার কন্যাকে বিয়ে দিবার সময় পয়সাওয়ালা ছেলে না খুঁজে, আগে মানুষ খুঁজুন। বড় ঘর দেখার আগে, আগে দেখুন ঘরের পরিবেশ কেমন, মানুষ গুলো কেমন।
ভুলকে ভুল, অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎ সাহস যার আছে তার হাতেই আপনার প্রিয় কন্যাকে তুলে দিন। ]

(শুভ সমাপ্তি!!)

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০৭

0

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৭

ফ্লোরে বসে গলা ফা*টি*য়ে চিৎ*কা*র করে কাঁদছে আলো। মেয়েটার মুখটা জ্ব*লে যাচ্ছে। হা*মা*গু*ড়ি দিয়ে মায়ের পায়ের কাছে এসে ছোট ছোট হাত দিয়ে,জড়িয়ে ধরলল মা’কে। নিজের ভাষায় হয়তো অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলছে সে। বিরক্ত হলো শিখা,এদের জন্য ম’র’তে গিয়েও শান্তি নেই। রাগের চো’টে মেয়েটার ছোট্ট শরীরে বসিয়ে দিলো কয়েক গা। মা’র খেয়ে কান্নার গতি বাড়লো বাচ্চাটার,যা দেখে অস্থির হয়ে পড়লো মায়ের কোমল মন। সে দুনিয়া ছাড়লে এই বাচ্চাটার কি হবে, কে দেখবে তার মেয়েটাকে? মেয়ের কথা ভাবতেই মোচড় দিয়ে উঠলো মায়ের কলিজা। ততক্ষণাৎ বিষের বোতলটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মা’ও কেঁদে বুক ভাসালো।

ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে মাএই বাসায় ফিরলো আসহাব। এই সময়টায় বাড়িটা কেমন যেন নিরব হয়ে আছে, কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিরবতার মাঝে থেমে থেমে আলোর মিহি কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আসহাব ব্যাগ গুলো বসার ঘরে রেখে ডাকলো শিখাকে। কিন্তু, সাড়া দিচ্ছে না শিখা। উনি ব্যাস্ত হয়ে নাতনির কান্না অনুসরণ করে শিখাদের রুমে উঁকি দিলো। দরজা এখন খোলাই আছে। দরজার পাশ ঘেঁষে আলো হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে, মেয়েটার মুখ ফুলে গিয়েছে এখন। তারই পাশে নিরবে বসে আছে শিখা, মেয়েটার চোখ দিয়ে অনবরত ঝড়ে লোনা জল। মা-মেয়ের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে আসলো উনি। নাতনিকে কোলে তুলে নিয়ে, ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,

“তোমাদের এই অবস্থা কেনো মা? আলোর কি হয়েছে, তোমার কি হয়েছে বউমা, আজ ঈদের দিনটায় ও তুমি কাঁদছো কেন মা?”

চোখ তুলে শ্বশুরের দিকে এক পলক তাকালো শিখা। খানিকটা দম নিয়ে ভা’ঙা ভা’ঙা কণ্ঠে বললো,

“আপনি তো আগে থেকেই জানতেন বাবা,আপনার ছেলে কেমন, আপনার স্ত্রী কেমন মানুষ। সব জেনে-শুনেও আপনি কেনো আমাকেই ছেলের বউ করে এই ঘরে আনলেন বাবা? কেনো আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন আপনারা, কি ক্ষতি করছিলাম আমি আপনাদের?”

মেয়েটার কথা শুনে সাথে সাথে মাথা নিচু করে নিলো আসহাব, উনার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে। শিখা এখনো উওরের আশায় তাকিয়ে রইলো শ্বশুরের মুখো পানে। যা দেখে অপরাধীর ন্যায় আসহাব বললে উঠলেন,

“আমাকে ক্ষমা করে দেও মা! অজান্তেই বড় ভুল করে ফেলছি আমি, জানি ক্ষমা চাওয়ার ও মুখ নেই আমার। ভাবছি বিয়ের পর ছেলেটা পাল্টে যাবে,কিন্তু ছেলেকে আমি সঠিক মানুষ করতে পারিনি মা। আমি একজন ব্যর্থ বাবা, ব্যর্থ স্বামীও বটে।”

শিখা ঠোঁট এলিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসলো কিঞ্চিৎ। তার চঞ্চল জীবনটাই ন’র’ক বানিয়ে দিয়েছে এরা। ক্ষমা! সব ভুলের কি ক্ষমা হয়!
পরক্ষণে জড়োসড়ো শিখার হাত ধরে নিচে নিয়ে আসলো আসহাব।
যদিও এরা মা-ছেলে দু’জনই তার হাতের নাগালে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। তবুও এর একটা বিহিত করতেই হবে আজ। নাহ্! এভাবে আর চলে না! হয়তো এরা মা-ছেলে ভালো হবে নয়তো নিজ দায়িত্ব মেয়েটাকে এই অশান্ত নগর থেকে মুক্ত করে দিবে উনি।
.
.
ঘড়ির কাঁটায় সময় বারোটা ছুঁই ছুঁই! বাড়ির সবাই বসার ঘরে থমথম মুখে বসে আছেন। কারো মুখে কোনো আওয়াজ নেই। তারমধ্যে উচ্চ স্বরে একের পর এক ক্রোধিত কণ্ঠে ছেলেকে কথা শুনাচ্ছে বাবা। খানিকক্ষণ আগেই বাবা সবাইকে এক জায়গায় ডেকেছেন।
সোফায় গম্ভীর মুখ করে বসে আছে আযান। বুড়ো বয়সে মাএই সবার সামনে বাবা তার গালে থাপ্পড় এঁটে দিয়েছে। বোন-জামাইদের সামনে লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে তার। স্বামীর ভয়ে রেহেনা বেগমও চুপচাপ বসে আছেন আজ।কেননা, এভাবে কখনো রাগতে দেখেনি আসহাব লোকটাকে। তবে মনে মনে ফুঁসছে উনি। তান্মধ্যে আসহাব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় বললেন,

” ছোট্ট বেলায় মা মা’রা গেছে আমার, বাবার হাতেই মানুষ হয়েছি আমরা। বড় সংসারে আমিই বড় ছিলাম। বয়স অল্প ছিলো তবুও আব্বা সংসারের হা’ল ধরাতে তোমাকে ছেলের বউ করে আনে। তখন থেকেই এই সংসার তোমার ইচ্ছেতেই চলতো রেহেনা। বয়স অল্প ছিলো, আমি বাহিরের কাজকর্ম সেরে এসে সংসার নিয়ে ঘাঁটতাম না, ইনকাম যা হতো তোমার হাতেই তুলে দিতাম। এরিমধ্যে আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্ম হলো, আমিও যুবক থেকে পুরুষে পরিণত হলাম। মেয়েরা বড় হতে লাগলো, দায়িত্ব বাড়লো।
এভাবে চলতে চলতে কখন যে সংসারের রাজাত্ব সব তুমি নিয়েছো বুঝতেই পারিনি। এরপর যখন বুঝলাম তখন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে। আসলে, আমি তোমারে আমার রাজ্যের রানী করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, তুমি ঠিকই রানী হলে তবে স্বামীকে বানিয়ে নিলে গোলাম। এরপর থেকে তোমার কথায় চলতে হতো আমায়। মাঝেমধ্যে সহ্য করতে না পেরে কিচ্ছুটি বললে সংসারে তুমি সে কি অশান্তি করতে। আমার যে চার মেয়ে ছিলো, এদের বিয়ে দিবার চিন্তা ছিলো মাথায়। এদের জন্য মুখ বুজে হজম করেছি সব। কিন্তু তুমি আমায় দুর্বল ভেবেই, পায়ে পি’ষে এসেছো। আসলে ছোট থেকে আমি শান্তি প্রিয় পুরুষ। সংসারে ঝুট-ঝামেলা কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। এরপর মেয়েদের বিয়ে দিলাম, ছেলের জন্য বউ করে আনলাম। বয়স বাড়ছে তোমার, ভাবছি তুমি কিছু হলেও পাল্টে যাবে। কিন্তু, কিন্তু তুমি এই মেয়েটাও একটু শান্তি দিচ্ছো না রেহেনা। এদের স্বামী-স্ত্রীর পার্সোনাল লাইফেও তুমি ঢুকে পড়ো,মিনিমাম লজ্জাও তোমার নেই।
আজ টাকা-পয়সা পেয়ে তোমার দেমাগে মাটিতে পা পড়ছে না। ভুলে যেওনা, তুমিও কিন্তু ছিলে একজন হতদরিদ্র মাঝির মেয়ে। এসব অতীত ভুলতে নেই বুঝলে? তুমি যেমন এই বাড়ির বউ ঠিক তেমনই শিখাও এই বাড়ির বউ। আজ তুমি বউমার গায়ে হাত তুললে? কাজটা একদম ঠিক করলে না রেহেনা। এখনো সময় আছে নিজেকে শুধরে নেও। নয়তো তোমাদের মা-ছেলেকে আমি নিজ দায়িত্বে জেলের ভাত খাওয়াবো, বলে দিলাম। আমার নিরবতাকে তোমরা দুর্বল ভেবো না, বুঝলে?”

লম্বা কথা শেষ করে শ্বাস ছাড়লো আসহাব। রেহেনা বেগম মেয়েদের জামাইদের সামনে অপমানিত হয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো। আসহাব পুনরায় মেয়েদের কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“এই যে মেয়েরা? তোমাদের বিয়ে দিয়েছি এখন স্বামীর সংসারই তোমাদের নিজের সংসার। মাঝে মাঝে বাপের বাড়িতে আসবে, দু’চার দিন হাসি-আনন্দ করে থেকে চলে যাবে। তোমারা কেন অন্যের সংসারে মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অশান্তি করছো? এ-সব বাদ দিয়ে নিজের সংসারে মনযোগী হও। আর কখনো এমনটা যেন আমি না দেখি, খবরদার!”

মেয়েরা আর কিছু বলার সাহস পেলো না। আসহাব ছেলের কাঁধ চেপে থমথম মুখে আবারও বললেন,

“একজন ভালো সন্তান হওয়ার পাশাপাশি একজন ভালো স্বামীও হতে হয়, বুঝলে আযান। একজন তোমার জন্মদাএী অন্যজন তোমার অর্ধাঙ্গিনী।
এরা দু’জনই তোমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তুমি একজনের জন্য অন্যজন অবহেলা করলে এর জন্য রবের নিকট তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তুমি আজ বউ মার গায়ে হাত তুললে? ছি! আযান। এমনটা তোমার থেকে আমি কখনো আশা করিনি। আমাকে দেখছো, তোমার মায়ের গায়ে কখন হাত তুলতে, বা তার সাথে জ’ঘ’ন্য ব্যবহার করতে?”

কিচ্ছুটি জবাব দিলো না আযান। আজ যেন কিচ্ছুটি কানে যাচ্ছে না তার। আসহাব আবারো সবার হয়ে, শিখার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। শিখা নির্বাক। পরমুহূর্ত আসহাব আলোকে নিয়ে ডক্টর দেখানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
শিখা এলোমেলো দৃষ্টিতে চাইলো একবার নিজের মেরুদন্ডহীন স্বামীর দিকে। একই পুরুষ কতটা না কেয়ারিং সন্তান সে। আর স্বামী হিসেবে কতই না জঘন্য পুরুষ!
ঐ যে অতিরিক্ত মা ঘেঁষে!
অতিরিক্ত মা ঘেঁষা সব ছেলেই যে সবসময় ভালো স্বামী হয় এমনটা কিন্তু নয়। এরা ভালো সন্তান হতে পারলেও স্বামী হিসেবে ঠুনকো।
এই সমস্ত ছেলে তার মাকে জীবনে যেভাবে সম্মান ও প্রায়োরিটি দেয়, সেই ছেলেটাই যদি তার সন্তানের মাকে তার অর্ধেক সম্মান ও প্রায়োরিটি দিতো তাহলে আমাদের সমাজের অর্ধেক পারিবারিক কলহ মিটে যেতো।
.
.
মানিয়ে নিতে নিতে কে’টে গিয়েছে আরো কয়েকটি বছর। কিশোরী মেয়ে থেকে নারীতে পরিণত হয়েছে শিখা। এই সংসারে এখনো শুনতে হয় তাকে কত গঞ্জনা। বছর কয়েক একটু স্বঃস্তি মিললেও তাকে আগলে রাখা বাবা রুপি শ্বশুরটা হারয়িছে অবেলায়। ওইতো সেবার চৈত্রে ম’র’লো ডে*ঙ্গু জ্বরে। একটি বছর হয়ে গিয়েছে বাবা নেই।
সময় এগোচ্ছে, বুঝতে শিখেছে, মস্তিষ্ক উন্নত হয়েছে এক ঘরোকন্নার। তার ছোট্ট মেয়েটাও এখন কথা শিখেছে, হাঁটতে শিখেছে।
তারই অবুঝ মায়ের বয়স বাড়ায় বুঝতে শিখেছে, নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে এবার। শান্তিতে এবার একটু দম নিতে হবে,এই কোলাহল আর কত?
ভাগ্য ক্রমে হসপিটালের রোগীদের দেখাশোনার জন্য একটা জবও মিলে গেলো।
দায়িত্বহীন সেই পুরুষটা আর পাল্টালো না,তবে শিখাকে আর গাল-মন্দ করে না, গায়ে হাত তুলে না বহুকাল। এই সংসারের গুরু এখনো মা’ই রয়ে গেলো। কিছু মানুষ আজন্মকাল একই থাকে,তারা কখনো নিজের স্বভাব পাল্টাতে পারে না।

তবে শিখা জব পেয়েছে শুনে রেহেনা বেগমও এবার খুশী, বাড়তি ইনকামের একটা সুযোগ হলো।
শিখাও নিজের কাজে জয়েন হলো, এটাই তার জীবনের প্রথম আশার আলো। সংসার নামক বন্দি খাঁচা থেকে মুক্ত হয়ে কয়েক ঘন্টা আরামসে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ মিললো যেন।
তবুও এখানেও তাকে ছাড় দেয়নি রেহেনা বেগম, বাড়ির সব কাজ করে তবেই ছুটি মিলতো মেয়েটা। মাঝে মাঝে নাইট ডিউটি করেও রেস্ট পেতো না সে, বাড়ির বউ রোবট কিনা! এদের তো কাজই, সবাইকে বিনা স্বার্থে রাত-দিন সেবা দেওয়া। তবুও খুশি শিখা। নিজের ইনকামে সবার অগোচরে বাবা-মাকে কিছু পয়সা দেওয়া যেতো, নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করা যেতো, ধারে ধারে হাত পাতার ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্তি মিললো।

এভাবেই যাচ্ছিলো দিন কিন্তু হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লো রেহেনা বেগম। আযান দিশেহারা হয়ে যায়, বড় বড় ডক্টর দেখায় মাকে। কিন্তু, মায়ের উন্নতি নেই।
ধীরে ধীরে সুঠাম গড়নের দেহটা অচল হয়ে আসলো, বাকশক্তি হারলো মা। শরীরে দেখা দিলো নানাবিধ রোগ,একসময় নিস্তেজ হয়ে বিছানাতেই গড়াগড়ি খেতে হলো সেই তেজীওয়ালা মহিলাকে। সে আর কথা বলে না, শরীরের অশান্তিতে দিনরাত ছটফটিয়েই কে’টে যায় দিন।
তার করুণ সময়ে এখন আর মেয়েদের ও দেখা যায় না আশপাশে, ঘরের সেই অকর্মা মেয়েটাকেই প্রয়োজন হচ্ছে তার।
শেষ সময়টায় শ্বাশুড়ির দেখাশোনা করছে শিখা। কিন্তু এখন আর ভালোবেসে নয় যতটুকু করছে দায়িত্ব থেকে।
রেহেনা বেগম নিজেকে দেখে বুঝলো, তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে, ততক্ষণে নিভে যাওয়া বিবেক জাগ্রত হলো। নিজের করা অন্যায় গুলো ক্ষণে ক্ষণে মস্তিষ্কে কি’ল’বি’ল করছে। খুব করে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে আজ, তবে সেই ক্ষমতা যে হারিয়ে ফেলছে বেলা শেষে।
শিখাকে দেখলেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে নিরব জল, কিন্তু এই ভাষাহীন নিরব যন্ত্রণা কেউ আর দেখছে না, কেউ বুঝছেও না আর না চেষ্টা করছে। অনুশোচনায় দ’গ্ধ হতে হতে আজ দুপরে হা*র্ট অ্যা’টা’ক করে দুনিয়ায় ছাড়লো রেহেনা বেগম।
__________

মা…. ও মা!

মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে শ্বাশুড়ির মুখপানে তাকিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলো শিখা। মূর্ছা মাখা কিছু স্মৃতি চারণে ঝাপসা হয়ে আসছে তার চোখ। হঠাৎ করেই আলো মা’কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ডাকলো। মেয়ের স্পর্শে ধ্যান ভাঙলো মায়ের, মেয়েকে কোলের উপরে বসিয়ে একবার আশপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো শিখা। লোকজন আড়চোখে দেখছে তাকে, তা দেখে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলো মনিরুল ও তার স্ত্রী। বাবা মেয়ের মাথায় স্নেহেতুময় হাত বুলিয়ে মিহি কণ্ঠে শুধালো,

“আম্মা? এখানে এমনে বইসা আছো কেন?আলো নানুকে নিয়ে তুই ভিতরে যা আম্মা।”

ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে পুনরায় বাবা বললো,

“শখা? তোর আপাকে ধরে ভিতরে নিয়া যা।”

তান্মধ্যেই ভারী কয়েক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলো শিখা। কোনো বনিতা ছাড়াই এক হাতে আলোকে জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে পা চালালো। এমন সময় আরো একটা পিচ্চি ছেলে তার অন্য হাত ধরে আধোঁ আধোঁ কণ্ঠে শুধালো,

“কালামনি আমিও তোমাল সাথে দাবো (যাবো)।”

শিখা কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে কোলো তুলে নিলো বোনের ছেলেকে। এটাই হচ্ছে শখার দুষ্ট একটা ছেলে “শাওন”। বছর চারেক আগে গার্মেন্টস কর্মী রওনকের সাথে বিয়ে হয় শিখার।
বাবা এবার আর ছোট মেয়ের জন্য উঁচু ঘর কিংবা টাকা-পয়সা খুঁজেনি। প্রথম ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে খুঁজেছে একটা সঠিক মানুষ।
রওনকের ঘরে বিলাসিতা না থাকলেও সীমাহীন ভালোবাসা রয়েছে। স্বামীর ওই ছোট্ট কুটিরে দিব্যি সুখে আছে শখা।

চলবে..

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০৬

0

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৬

আরো ঘন্টা খানিক সময় অতিবাহিত হলো, কিন্তু শিখার কোনো উন্নতি নেই। আযান বউয়ের ঠান্ডা হাত-পায়ে গরম তেল মালিশ করছে, ক্ষণে ক্ষণে নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু সাড়া দেয়না শিখা। আরো ঘাবড়ে গেলো আযান। এবার কিছুটা মায়ের বিপক্ষে গিয়েই হসপিটালে নিয়ে গেলো নিস্তেজ শিখাকে। সাথে গেলো রেহেনা বেগম ছেলেকে তদারকি করার জন্য, না জানি ছেলেটা বউয়ের পিছনে অহেতুক টাকা খরচ করে! সেই চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে মায়ের।

ততক্ষণাৎ ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের ডক্টর মেয়েটাকে পরিক্ষা করে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“লা’শ’টা নিয়ে আসছেন আপনারা? কম সময়ের মধ্যেতো এতো শোচনীয় অবস্থা হয়নি রোগীর। এতো দেরি করলেন কেনো?”

আযান আমতা আমতা করছে, শুকনো ঢোক গিলে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলো, “ডক্টর বেঁচে আমার স্ত্রী?”

“সৃষ্টিকর্তা করুণায় এখনো শ্বাস চলছে, তবে হার্টবিট খুব স্লো। বাচ্চাটা বেঁচে আছে কিনা বলা যাচ্ছে না, উনাকে এক্ষুণি অপারেশন দরকার। প্রচুর ব্লাডিং হয়ে গিয়েছে রোগীর, ইমারজেন্সি রক্ত জোগাড় করুণ।কুইক।”

সিজার লাগবে শুনে বেঁ’কে বসলেন রেহেনা বেগম। পাশ থেকে উনি ডক্টরকে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

“এতো দ্রুত সিজার করার দরকার নেই ডক্টর, কত টাকার ব্যাপার। আপনারা বরং নরমালে ডেলিভারির চেষ্টা করুণ।”

ডক্টর উনাকে দমক দিয়ে বললেন,

“আপনি কি মানুষ? দেখেতো মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের লোক, কিন্তু অসুস্থ মস্তিষ্ক! মেয়েটার জীবন-মরণ সংশয় রয়েছে আর আপনি এখনো টাকার চিন্তা করছেন। এই টাইমটাও দ্রুত মনে হচ্ছে আপনার কাছে?”

পাবলিক প্লেসে ডক্টরের দমক খেয়ে চুপসে গেলো রেহেনা বেগম। মনে মনে ডক্টরকে প্রাণ ভরে গালি দিচ্ছেন উনি। শ্লা’র ডাকাত এরা! কিচ্ছুটি হলেই সিজার করো, সব রোগী থেকে টাকা খাওয়ার ধান্দা! এগুলো ভালোই জানা আছে তার।
এরিমধ্যে আযানের অনুমতি নিয়ে ডক্টর ও নার্স মিলে শিখাকে নিয়ে গেলো ইমারজেন্সি অপারেশন থিয়েটারে। আযানও ব্যস্ত হয়ে পড়লো রক্তের সন্ধানে। ছেলেকে ব্যস্ত হতে দেখে মা আশ্বাস দিয়ে শুধালো,

” এতো তাড়াহুড়ো করার কিচ্ছু নেই আযান, রিলাক্স! তুই একা কেন এতো চাপ নিচ্ছিস, বউমার বাপকে কল দিয়ে এখানে আসতে বল। জানিয়ে দে, তাদের মেয়ে অসুস্থ অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার।”

আযান মা’কে কিচ্ছুটি জবাব না দিয়ে ততক্ষণাৎ ওখান থেকে চলে গেলো। বাহিরে গিয়ে শ্বশুরকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো, শিখা অসুস্থ।
বাবা-মা এতো রাতে মেয়ের এমন খবর পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো, ততক্ষণাৎ সবাই বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
.
.
কোলাহল পূর্ণ একটি দুপুর। হসপিটালের বারান্দায় বসে রোগীর আপনজনেরা কেউ নতুন অতিথির আগমনে হাসছে,কেউবা হারানোর শোকে কাঁদছে। হসপিটালের সাদা বেডে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শিখা, হাতে হরদমে স্যালাইন চলছে তার। দু’দিন হলো এখনো চোখ খুলেনি মেয়েটা। মেয়ের মাথার পাশে ব্যকুল হয়ে আশপাশ করছে, শিখার মা-বোন। মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে মায়ের মন, মেয়েকে রেখে এক মিনিটের জন্য কোথাও নড়ছে না অসুস্থ মা।
অবশ্য হসপিটালে উনারা দু’জন ছাড়া এখন কেউ নেই। অসুস্থ মেয়েটা’কে রেখেই বাবা’কে বের হতে হয়েছে নিজের কাজে।মেয়েটার পিছনে দু’টো পয়সা ব্যয় করতে হলেও বাবা’কে দিনরাত খাটতে হবেই, বাবার জন্য যে একদন্ড বিশ্রাম নিষিদ্ধ!
আর রইলো স্বামী, শ্বাশুড়ি!
একদিন শিখার সাথে ছিলো আযান, সে-ও আজ নিজের অফিসে গিয়েছে। ব্যস্ত মানুষ কিনা! রেহেনা বেগম ওদিন রাতে যে বাড়িতে গিয়েছে, এরপর আর তাকে হসপিটালের চার সীমানায়ও দেখা যায়নি।

মাথার উপর শোঁ-শোঁ করে ঘুরছে বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি। খটাখট আওয়াজে আস্তে আস্তে মস্তিষ্ক সচল হতে লাগলো শিখার।একটু সময় নিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলে, নিজেকে আবিষ্কার করলো হসপিটালের বেডে। পুনরায় আবারো চোখ বন্ধ করে নিলো শিখা। নিজেকে ধাতস্ত করতেই মনে পড়লো, সেদিন রাতের ভ’য়া’ব’হ ঘটনাটি।
রান্না ঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই মাথা ঘুরছিলো তার, ততক্ষণাৎ নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলো ফ্লোরে। এরপর, এরপর শুরু হলো প্রবাল র’ক্ত’পা’ত! দমবন্ধ হয়ে নিস্তেজ হয়ে আসছিলো তার ছোট্ট দেহখানি, তবুও টের পেয়েছে তার সাথে পেটের বাচ্চাটাও ছটফট করছে। তবুও মুখ থেকে কোনো আওয়াজ করতে পারেনি শিখা। ক্রমশ নিস্তেজ হতে হতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে কখন জানি, এরপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই তার।
নিজের অনাগত জানটার কথা মাথায় আসতেই, পেটে হাত রাখে শিখা। কিন্তু, অদ্ভুত! পেটটা খালিখালি লাগছে। তবে কি বাচ্চাটা হারিয়ে গেছে, না! না! শিখা হঠাৎ করেই মৃদু আওয়াজে চিৎকার করে উঠে,

“আমার বাচ্চা, আমার বাচ্চা! ”

মা এগিয়ে আসে, আলতো হাতে মেয়ে’কে জড়িয়ে ধরলো। তার মেয়ে কথা বলছে, আনন্দে মায়ের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা জল। উনি ভেজা চোখে কোমল কণ্ঠে শুধালো,

“মা তুই কথা বলছিস? এখন কেমন লাগছে তোর?”

শিখা একবার আশপাশ তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, “মা আমার বাচ্চাটা?”

শিখার মা মৃদু হাসলো। তান্মধ্যে শখা বোনের গাল ছুঁয়ে বললো,

“তোর বাচ্চা বেঁচে আছে আপা। তুই এতো হাইপার হোসনা, অসুস্থ তুই।”

স্বঃস্তির শ্বাস ছাড়লো শিখা। বাচ্চাটা ছুঁয়ে দেখার জন্য আকুপাকু করছে তার অবচেতন মন। হ্যাঁ সৃষ্টিকর্তা বিশেষ কৃপায় দু’জনই ম’র’তে ম’র’তে বেঁচে গিয়েছে তারা। সেদিন রাত তিনটায় মেয়ে হয়েছে তার। তবে বাচ্চাটা ভীষণ অসুস্থ ছিলো, ডক্টর পেট থেকে বের করেই আইসিইউতে ভর্তি করিয়েছে তাকে।

ঘন্টাখানিক পর মেয়ে নিয়ে শিখার কেবিনে ঢুকলো নার্স। সাথেসাথে মেয়ে’কে কোলে তুলে নিলো শিখা। দু’হাতে জড়িয়ে মা প্রথমেই কপালে গভীর ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো মেয়েটার। ছোট্ট বাচ্চাটার স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারাটা দেখে পরাণ জুড়িয়ে গেলো তার। শুকনো ওষ্ঠে এক চিলতে মিষ্টি হাসি হেসে বলে উঠলো,

“মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! আমার ছোট মা!”

ততক্ষণাৎ মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে আবারো বললো,

“আমার দুঃখবিলাস জীবনে তুই আমার এক চিলতে সোনালী আলো। তুই আমার একখন্ড সুখ!”

বাচ্চাটা কি বুঝলো কিছু? মায়ের পরশ পেয়ে, গোলগোল আঁখিদুটি ঘুরিয়ে কিঞ্চিৎ ঠোঁট এলিয়ে দিলো মেয়েটা। এদের মা-মেয়ের ভালোবাসার সাক্ষ্যী হয়ে রইলো, বাকিরা। উনারাও নিঃশব্দের হাসি হাসলো সবাই। কিয়াৎ ক্ষণ সময় নিয়ে শিখা মেয়ের নাম রাখলো, “আলো”।
.
.
সাতদিন হসপিটালে থেকে আলোকে নিয়ে আজ শ্বশুর বাড়িতে আসলো শিখা। তার সাথে রয়েছে মা-বোন। এই সাতদিনের মধ্যে একটিবারের জন্যও পুরবধূ বা নাতনিকে দেখতে যায়নি রেহেনা বেগম। আজ শিখা এসেও তার খোঁজ নেয়নি, বোনের সাহায্যে নিজের ঘরে গেলো মেয়ে’কে নিয়ে।
তার শরীর এখনোও অনেক দুর্বল, হাঁটতে পারছে না একা।
রেহেনা বেগম চা’পা রাগে ফুঁসছে, একে তো বউয়ের পিছনে হাজার হাজার টাকা নষ্ট করেছে তার ছেলে। তান্মধ্যে, দেখলে তো মেয়েটার তেজ কত! নাতনিকে নিয়ে আসছে বাড়িতে, কই দাদির কোলে তুলে দিবে, তা না একদম রুমে গিয়ে ঘাপটি মে’রে’ছে! এদের দে’মা’ক দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে তার, এর একটা বিহিত নিয়েই ছাড়বে সে।

এই বাড়িতে একদিন গত হতেই পরদিন রেহেনা বেগম শিখার মা’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“আপা! বউমা তো এখন খুব অসুস্থ, আপনি বরং মাসখানেক মেয়েটাকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে রাখুন। দেখছেনই তো আমাদের বাড়িতে দেখা-শোনার জন্য কেউ নেই, আমি নিজেই অসুস্থ। আবার অন্য দিকে আপনাদের বাড়িতেও তো ভাই একা, বেচারা একার সবকিছু সামলাতেও না জানি কত কষ্ট হচ্ছে।”

শিখার সহজ-সরল মা আর না করলো না। কৌশলে রেহেনা বেগম শিখাকে পাঠিয়ে দিলো বাপের বাড়ি। অসুস্থ বউটাকে গাড়িভাড়াও করে দিলো না। আযান দিতে চাইলেও চোখ রাঙিয়ে গড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছে রেহেনা বেগম। উনি নিজেই ট্রেনের সীট বুকিং করে দিলো।
শিখার শ্বশুর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ির দুরত্ব অনেকটাই, সাধারণত ট্রেনে করে যেতে হয়। রিজার্ভ গাড়ি না পেয়ে বাধ্য হয়ে, অসুস্থ শিখাকে বসতে হলো ট্রেনে। অপারেশনের আটদিনের মাথায় ওভার ব্রিজ ক্রশ করে ট্রেন জার্নির ধকল নিতে পারেনি মেয়েটার শরীর। সেলাইয়ের জায়গা গুলোতে টান লেগে, গড়িয়ে পড়ছে জল। অসহ্য যন্ত্রণায় সেই সাথে কেঁপে উঠছে শিখার রুহু।
বাড়িতে গিয়েও আবারো ডক্টরের কাছে নিতে হয়েছে তাকে। আর এটাই হচ্ছে রেহেনা বেগমের সূক্ষ্ণ ভাবে দেওয়া পরোক্ষ শাস্তি।
____________________

আজ ঈদের দিন। শিখার শ্বশুর বাড়িতে ঘরভর্তি মেহমান, হৈচৈ-আনন্দে কোলাহল পরিপূর্ণ একটি পরিবেশ। একই সাথে বাড়ির চার মেয়ে তাদের স্বামী সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। অনেকদিন পর একসাথে চার মেয়েকে পেয়ে খুশিতে বাক বাঁকুক রেহেনা বেগম। মেয়েদের নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নানি-জান। আশার ছেলেটা এখন আধোঁ আধোঁ বুলি শিখেছে, মধুর সুরে “নানি আপু” বলে ডাকছে রেহেনা বেগমকে। ডাক শুনে,প্রাণ জুড়ে যায় তার। বোনদের সবার মধ্যে তার বাচ্চাটাই ছোট।
আশা ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে, চারবোন মিলে খোশগল্প করছে। এতোগুলা মানুষের রান্না তবুও শিখা একা একাই রান্না ঘরে কাজ করছে। কেউ তাকে হাতে-হাত এতটুকু সাহায্য করছে না। উল্টো,
ননদরা একেক-জনের একেক-রকমের পছন্দের খাবার, একটার পর একটা অর্ডার করছে শিখাকে।

রেহেনা বেগম সোফায় বসে মেয়ের নাতনিদের এটা-সেটা গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে আর রুপকথার গল্প শুনাচ্ছে। বাচ্চা গুলো খিলখিল করে হাসছে।
এরিমধ্যে হঠাৎ করেই ফ্লোরে বসে আলো মেয়েটা কাঁদছে।সেদিকে হুঁশ নেই দাদির। মায়ের মতো এই মেয়েটাও পরিবারের অবহেলিত প্রাণী। হবেই না কেনো, বাবা নিজেই তাদের মা-মেয়ের প্রতি দায়িত্বহীন।
সংসার জীবনে একজন নারীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার স্বামীর “মেন্টাল সাপোর্ট”। আর এজন্য থাকতে হবে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান।
শ্বশুর বাড়িতে একজন নারীর গুরুত্ব ঠিক কতটুকু হবে, তা নির্ভর করে তার স্বামীর ভালোবাসা ও সম্মানের উপর।
যে পুরুষ সংসার জীবনে নিজের স্ত্রী, সন্তানকে গুরুত্ব দেয় না, পরিবারের বাকি সদস্যও তাদের বিন্দুমাত্র মূল্যয়ন করে না। এই স্ত্রী সন্তানেরা পরিবারের সবার কাছেই অবহেলিত হয় দিনের পর দিন। যেমনটা হয়ে আসছে, শিখা।

মেয়ের কান্না শুনে রান্না ঘর থেকে দৌড়ে আসছে শিখা। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে আতঙ্কে উঠলো, মা। মেয়েটা তার দাদির চুনের কৌটা থেকে চুন খাচ্ছে। যার ফলে এখন মুখ জ্বলে যাচ্ছে।
আলোর এখন আটমাস চলছ। হামাগুড়ি দিয়ে একজায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে সে। অবুঝ মেয়েটা কখন জানি দাদির পানের ডালা থেকে চুন নিয়ে খেলছে আর সেটাই খাচ্ছে। ভাগ্যিস চোখে যায়নি।
শিখা মেয়েকে সাথে সাথে কোলে তুলি নিলো, বিয়ের পর এই প্রথম উচ্চ স্বরে বললো,

“মা?”

পাশ থেকে রেহেনা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

“কি হয়েছে? এতো জোরে ডাকলে কেন?”

“তোমরা সবাই এখানে বসা অথচ আমার বাচ্চা মেয়েটা ঠান্ডা ফ্লোরে বসে চুন খেয়ে যা-তা অবস্থা করে কাঁদছে। এগুলো কি তোমার চোখে পড়ে না মা? তুমি তো দিব্যি মেয়ের নাতি-নাতনীদের কোলে-পিঠে নিয়ে কত খাতির-যত্ন করছো। তবে আমার মেয়েটার প্রতি কেন এতো সবার অবহেলা। আলোও তো তোমার ছেলেরই মেয়ে মা। ওকে তো কখনো দেখি না, আদর করে একটু কাছে ডাকো বা যত্ন করে খাইয়ে দেও। মাঝেমধ্যে আমি কোলে দিলেও তোমার কোমড় ব্যথা করে, কত অসুখ হয়! এখন গেলো কই সেসব, কি করে পারো এগুলো?”

একদম কথাগুলো বলে শ্বাস ছাড়তেই তেড়ে আসলো রেহেনা বেগম। শিখার গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়ে উনি ক্রোধিত কণ্ঠে শুধালো,

“ফকিন্নির ঘরে ফকিন্নি! আমি কি করবো না করবো তাও এখন তোকে বলে-কয়ে করতে হবে? আমার মেয়েরা আসছে বলে, তোর ভাগে কম পড়েছে না! তুই আমার মেয়ে, নাতি-নাতনীদের হিংসা করছিস?”

শিখা অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে বললো,

“আমি কখন তাদের হিংসা করলাম মা? সে যাইহোক তাই বলে, তুমি আমার গায়ে হাত তুলবেন? শেষমেষ মা’র…..”

শিখাকে থামিয়ে দিয়ে রেহেনা বেগম পুনরায় বলে উঠলো,

“তো কি তোমায় মাথায় তুলে নাচবো।
বহুকষ্টে গড়া এই সংসার আমার, আমার সংসারে এসে তুমি দু’দিনের মেয়ে মাতব্বরি করছো। কান খুলে শুনে রাখো, এসব মাতব্বরি এখানে মোটেও চলবে না। আমার যখন যা ইচ্ছে করবো, আমার মেয়েরা যখন খুশী আসবে যাবে। তুমি বলার কে?”

এরিমধ্যে চার ননদ এক হলো এখানে। মায়ের সাথে সুর মিলিয়ে কথা শুনাচ্ছে শিখাকে। তাদের পাশে দাঁড়ায়ি মুখ টিপে হাসছে নন্দন মশাইয়েরা।
এতগুলো মানুষের সামনে লজ্জায়,কষ্টে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার। উনাদের সামনে টিকতে না পেরে, মেয়ে’কে নিয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো শিখা।
.
.
কিয়াৎ ক্ষণ পরে বাহির থেকে বাড়িতে আসলো আযান। আসতে না আতেই মা বোনদের বিচার। কথা না বাড়িয়ে রুমে আসতেই, বউয়ের বিচার। এই প্রথম শ্বাশুড়ির নামে অভিযোগ তুললো শিখা। কিন্তু বিনিময়ে স্বামীর হাতে খেতে হলো আরো একটু শক্ত চড়। আযান সবার ক্রোধ উগড়ে নিলো শিখার উপর, চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

“তোমারা কি আমায় একটু শান্তি দিবে না? কেনো এতো অশান্তি করো শিখা? আরে বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবে না, তো জন্ম দিয়েছো কেনো?”

আযান আর একমুহূর্তে সেখানে দাঁড়ালো না, একরাশ রাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে। ছেলেটারও একটু শান্তি নেই। সারাজীবন সবার দায়িত্ব নিতে নিতে কখনো নিজেকে একটু সময় দেওয়া ভাগ্যে জুটেনি।
সংসারের বড় ছেলে কিনা! ছোট বোনদের লেখাপড়া শেষ করিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এরপর নিজে বিয়ে করেও পড়লো আরেক অশান্তিতে। সারাদিন খেঁটে বাড়িতে আসলেই, শুরু হয় মায়ের এক কথা, বউ বাচ্চার আরেক কথা। মানুষ কেন যে বিয়ে করে?
লম্বা শ্বাস ছেড়ে, বড় মাঠের ঘাসে বসে পড়লো আযান। কিয়াৎ ক্ষণ পরে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ঠোঁটে চেপে লম্বা টান দিলো।
.
.
আযান যেতেই রুমের দরজা আঁটকে দিলো শিখা। সবার এরূপ আচরণে বিতৃষ্ণা এসেছে গিয়েছে জীবনের প্রতি। আদরের মেয়েটাকে ফ্লোরে রেখে, রাগের দুঃখে হাতে নিলো বি’ষে’র বোতল। না আর এই অশান্তি সহ্য করবে না সে,সবাইকে মুক্তি দিয়ে নিজেও মুক্তি নিবে এইবার, এই ন’র’ক থেকে।

চলেবে…..

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০৫

0

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৫

দিন গিয়ে কয়েক মাসে পরিণত হয়েছে, শিখার বাচ্চা হওয়ার সময়টা ঘনিয়ে আসছে। অপরিপক্ক বয়সে গর্ভধারণ করার ফলে শরীরের নানা রোগে ভুগছে মেয়েটা, ভরা পেট নিয়ে চলাফেরা করাই দায় হয়ে আসছে আজকাল। চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসছে তার, হাত-পা ফুলে গিয়েছে।
সেদিন হসপিটাল থেকে ডক্টর দেখিয়ে আসার পর ডক্টর শিখাকে সম্পূর্ণ বেট রেস্ট দিয়েছিলো। কিন্তু, হায়! সেই বেট রেস্ট কি তার কপালে ছিলো? একদমই না! অসুস্থ শরীরটা নিয়েও করতে হয়েছে সংসারের হা’ড়’ভা’ঙা খাটুনি। কেউ কখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি, মেয়েটার জীবন মরণের সময়টায়ও তার অর্ধাঙ্গিন সেই দায়িত্বহীন পুরুষ হয়েই রয়ে গেলো। তবুও শিখা ছিলো নির্বাক! তার যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, যাওয়ার মতো নিদিষ্ট কোনো আশ্রয় নেই। শত কষ্টের পরও ছোট্ট সোনামণির আগমনের প্রহর গুনছে একজন নবীন মা। শত ব্যথার মাঝে এইটুকু তার প্রশান্তি!

মেঘলা আছন্ন একটি দিন। সকাল থেকে মৃদু হাওয়া, টিপ-টিপ বৃষ্টি। ভালো লাগার মতো একটি সন্ধ্যা। বিছনার এক কোণে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে আযান, তারই পাশে সুয়ে আশপাশ করছে শিখা। মাএই নামাজ পড়ে একটু বিছনায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো সে, কিন্তু শরীরে এতটুকু শান্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। অদ্ভুত এক অশান্তিতে আনচান করছে মন! সুয়ে, বসে কোথাও কিঞ্চিৎ স্বঃস্তি নেই যেন। বাচ্চাটা পেটে কি’ক মার”ছে, পেট ধরে ব্যথা ককিয়ে উঠে মেয়েটা।

শিখার এতো নড়াচড়ার কারণে ঘুমে ব্যঘাত ঘটছে আযানের। পরমুহূর্তে মেজাজ বিগড়ে গেলো তার হঠাৎ কিঞ্চিৎ দমকে আযান বলে উঠলো,

“কি হয়েছে তোমার শিখা, পাশে বসে এতো নড়াচড়া করছো কেন? দেখলেতো মাএই একটু দু-চোখ এক করলাম, এরিমধ্যে তোমার অশান্তি শুরু হয়ে গেলো। সমস্যা কি তোমার, এতটুকু শান্তি দিচ্ছো না কেন আমায়?”

শিখা আযানের ডান হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে অসহায় কণ্ঠে শুধালো,

“দেখুন না!বাবু এখানে বারবার কি’ক মারছে, আমার একদম কলিজায় লাগছে! দশ-টা মাস সহ্য করে আসছি আমি এরকম হাজারটা অসহ্য য’ন্ত্র’ণা, আর আপনি এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলেন। পাশে অসুস্থ বউ থাকলে এতটুকু’তো অশান্তি হবেই। সবসময় এরকম দমকিয়েই আসলেন আপনি, কখনো বুঝতে চেষ্টা করেননি আমাকে। একদিন শত অভিযোগ নিয়ে নিখোঁজ হবো, সেদিন ঠিকই খুঁজবেন।”

আযান নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো,

“হয়েছে ঢঙ করো না, আমি টায়ার্ড শিখা। আজকে প্রচুর খাটুনি গিয়েছে শরীরে, আমাকে ঘুমাতে দেও বিরক্ত করো না।”

অন্য পাশে মুখ করে পুনরায় সুয়ে পড়লো আযান। অসুস্থ বউটার এসব কথা নিছক ঢঙ লাগছে তার কাছে। হতাশ হলো শিখা! তপ্ত এক শ্বাস ছেড়ে বললো,

“লোকে বলে, পুরুষ মানুষ নারীর ছোঁয়া পাইলে এমনিতেই বদলে যায়।
সেখানে আমি মেয়ে আপনার নামে আমার আস্তো জীবনটা উৎসর্গ কইরা দিলাম, তাও আপনার একটুখানি ভালোবাসা আমার ভাগ্যে জুটলো না। আপনি বড্ড পাষাণ,পা’ষা’ণ পুরুষ!”

কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো জবাব দিলো না আযান! শিখা জবাবের অপেক্ষাও করলো না। স্বামীর ঘুমের ডিসটার্ব হচ্ছে ভেবে, ভরা পেটটা নিয়ে পা টিপে টিপে পাশের রুমে চলে গেলো শিখা।
রুমে পা রাখতে না রাখতেই নিচ থেকে ভেসে আসলো রেহেনা বেগমের বাজখাঁই কণ্ঠ,

“বউমা! সন্ধ্যা হলো সেই কখন, আমার চা টা কি পাবো না নাকি? তুমি জানো না সন্ধ্যায় চা না হলে আমার চলে না। এখনো রুমে ঘাপটি মে’রে বসে, কি করছো তুমি? রাতের রান্নাটাও এখনে করোনি, আজকাল কাজের ফাঁকি দেওয়াটা কি তোমার স্বভাব হয়ে গিয়েছে? জমিদারী ভাব ছেড়ে, দ্রুত নিচে এসো।”

শিখা আর বসতে পারলো না, অচল শরীরটা টানতে টানতে রান্না ঘরে যেতেই হলো। দাঁড়াতে পাড়ছে না, নড়তেও পারছে না মেয়েটা। খুব করে কান্না আসছে তার, অসহায় লাগছে নিজেকে। অথচ শ্বাশুড়ি তার আয়েশ করে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে।
পরমুহূর্তে পেটে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে বললো শিখা,

“মা, আমার শরীরটা আজকাল ভীষণ অসুস্থ লাগছে। এই কয়দিন সবকিছু একটু মানিয়ে নেও মা, আর চলছে না দেহটা।”

রেহেনা বেগম টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে কপাল কুঁচকালো। শিখাকে আগাগোড়া একবার পরখ করে মুখ বাঁকিয়ে বললো,

“আজ কালের মেয়েদের যত আগলা শরীর হয়েছে বাপু! আমাদের বুঝি বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি,হয়েছে নিশ্চয়ই!”

“এভাবে বলো না মা, কেউ ইচ্ছে করে অসুস্থ হয় না। ”

“রাখো তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছা। জানো, সে-কালে আমরা বাচ্চা ডেলিভারি করেও সংসারের সব কাজ একা করেছি, কতগুলো বাচ্চা-কাচ্চা সামলিয়েছি।
কই আমরা তো এতো কাজ-চোর ছিলাম না। যাও গিয়ে রান্নাটা সেরে ফেলো, এই সময়ে কাজ-কর্ম শরীরের জন্য ভালো।”

রেহেনা বেগম পুনরায় আবারো সিরিয়াল দেখায় মনোযোগ দিলো৷ শিখা অবাক চোখে দেখলো কেবল শ্বাশুড়িকে। লোকে বলে, শ্বাশুড়ি কখনো মা হয়না। আসলেই তাই, হারে হারে প্রমাণ পাচ্ছে মেয়েটা। সে-বার যখন তার অসুস্থ ননদ আসছিলো, এই মায়েরই কত না সতর্ক আর নীতিবাক্য শুনেছে শিখা। তার মেয়েকে দিয়ে একটা কাজ করানো যাবে না,এতে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লাগাতারে এই অকর্মা, কাজ চোর মেয়েটাই সেবা যত্নের কোনো কমতি রাখেনি। এমনকি মায়ের দায়িত্বের কাজ গুলোও করতে হয়েছে তাকে। আজ যখন শিখা ভীষণ অসুস্থ, নিজেকে সাহায্য করার মতো একটা কাকপক্ষী ও মিলছে না এ বাড়িতে। বাপের বাড়ি থেকে বাবা পোয়াতি মেয়ে’কে নিতে আসছে কয়েকবার , সে বাড়িতেও যেতে দেয়নি তারা। কড়া গলায় নিষেধ করে দিয়েছে রেহেনা বেগম, পুনরায় যেন নিতে না আসে তার বউকে।
সব ছিলো নিজেদের স্বার্থে, সবার প্রয়োজন মিটানোর মেশিনটা চলে গেলে তাদের আবার কাজ করতে হতো না!
এসব ভাবতেই মেয়েটার চোখে ভীড় করছে কান্নারা, অনবরত গড়িয়ে পড়ছে কিছু বুক ফা’টা বো’বা কান্না!
শিখাকে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেহেনা বেগম তেঁতো কণ্ঠে পুনরায় শুধালো,

“এভাবে বেয়াক্কালের মতো দাঁড়িয়ে কি দেখছো বউমা? আমাকে কি নতুন দেখছো, নাকি আমার চেহারা বেড়েছে? যাও রান্না করো, রাত অনেক হয়েছে। আর হ্যা, শোনো? আমার জন্য একটু শিং মাছের ঝোল করিও।”

শিখা নড়েচড়ে উঠলো। নিজের ভাবনায় থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে আঁচলে চোখ মুছে মৃদু হেসে শুধালো,

“তোমরা আমার কাছে নিত্য নতুন মা। তোমাদের যত দেখি ততই আগ্রহ পাই। ভাগ্য করে তোমাদের বাড়িতে এসেছি, নয়তো কতকিছু থেকে বঞ্চিত হতাম, কত কিছু জানা হতো না।”

পরমুহূর্তেই আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে জায়গা ত্যাগ করলো শিখা। রেহেনা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো, মেয়েটার যাওয়ার পানে। কি বলে গেলো মেয়েটা? সব তার মাথার উপর দিয়েই গেলো। অকারণেই মুখ বাঁকালো উনি, সময় নষ্ট না করে আবারো ধ্যান দিলো টিভির দিকে।
.
.
রাত প্রায় নয়টার দিকে ঘুম ভাঙে আযানের। আড়মোড় ভেঙে উঠে বসলো, অকারণেই আশেপাশে তাকিয়ে শিখাকে একবার খুঁজলো বোধহয়। মেয়েটা রুমে নেই।কই গেলো? পাশেই তো ছিলো এতক্ষণ। পরমুহূর্তে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো আযান।
শরীরটা মেজমেজ করছে। এখন এক কাপ গরমগরম কফি চায় তার শরীর। মায়ের রুমে একবার যেতে যেতে চাইলো আশেপাশে, এখানেও দেখছে না শিখাকে। এবার একটু উঁচু কণ্ঠেই আযান বলে উঠলো,

“শিখা, কোথায় তুমি? আমার জন্য একটা কফি নিয়ে এসো।”

এভাবে বারকয়েক ডেকেও সাড়াশব্দ নেই মেয়েটার। বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে গেলো তার, মেয়েটাকে সময় মতো পাওয়া যায় না কখনো। কেয়ারলেস মেয়ে একটা! বড়সড় পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে উঁকি দিলো আযান। মুহুর্তেই শরীর শিউরে উঠলো তার শরীর, ফ্লোরে র’ক্তে’র স্রোত বইছে।
এরিমধ্যে জুবুথুবু অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শিখা।
আযান দৌড়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। শিখার গা ছুঁয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,

“এই মেয়ে? এই কি হয়েছে তোমার? এমনটা কখন হলো, উঠো শিখা। এতো র’ক্ত কিসের!”

কোনো হুঁশ নেই মেয়েটার,শরীরটা একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চালালো আযান। কিন্তু, এবারো ব্যর্থ সে।
ভয় পেলো আযান, বেঁচে আছো তো মেয়েটা! পরমুহূর্তে উচ্চ স্বরে মা’কে ডাকলো। শিখাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডে সুয়ে দিলো। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো রেহেনা বেগম। উনি শিখাকে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

“কি হয়েছে রে? ”

আযান বসা থেকে দাঁড়িয়ে চিন্তিতো কণ্ঠে বললো,

“বলতে পারছি না মা। রান্না ঘরে রক্তে মাখো-মাখো অবস্থায় ফ্লোরে পেলাম। অবস্থা খুব শোচনীয়! ওকে এক্ষুণি হসপিটালে নিতে হবে মা।”

রেহেনা বেগম ছেলেকে দমক দিয়ে চুপ থাকতে বললো। কিছু হলেই হসপিটাল, ডক্টর! এতোকিছুর কি দরকার? এতটুকুতো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। দেখো গিয়ে না জানি, ভাং ধরে এমন করছে। শুধু শুধু টাকা খরচ।

চলবে……

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০৪

0

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৪

মেয়ের ভাঙা কণ্ঠ শুনে কেঁপে উঠে মায়ের কোমল হৃদয়খানি। মুহুর্তেই উনার সমস্ত উচ্ছাসেরা মুখ থেকে বিলীন হয়ে কালো মেঘ ঘিরে ধরেছে। পরমুহূর্তেই আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলেন তিনি। উনি আগেই ঠাহর করছিলো, তার মেয়েটা ও বাড়িতে ভালো নেই। এর আগে মেয়েটাও কখনো প্রকাশ করেনি সেকথা। কখনো জিজ্ঞেস করলে এক গাল হেসে বলতো, “আমি ভালো আছি মা। চিন্তা করো না আমার জন্য।”

সেই মেয়েটা আজ নিজ মুখেই, স্বামীর ঘর ছাড়তে চাইছে। কতোটা না কষ্ট সহ্য করছে তার বাচ্চা মেয়েটা! কি করবে মা? মেয়েকে নিয়ে আসবে নিজের কাছে?
সে-কি সম্ভব! নিরুপায় তারা। ঘরে অবিবাহিত আরো একটা মেয়ে তার, তারমধ্যে নিজে অসুস্থ। এরিমধ্যে তার বিবাহিত অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা এনে, কি করে সব সামলাবে? তার স্বামীর কি সেই সমার্থ আছে? এই অভিশপ্ত গরীব জীবনে সৃষ্টিকর্তা কেন যে এতো অশান্তি দেন! মেয়েটার জন্য মন পু’ড়’ছে তার। মন চাইলেও বুকের মাঝে সে ইচ্ছে চেপে মুখে বললো,

“আমি তোরে আইনা কোথায় রাখুম মা? তোর বাপের আয়-রোজগারে কথা তো তুই জানোস। নুন আনতে পান্তা ফুরায়! ঘরে তোর ছোট্ট বোইনডা আবিয়াওা। তুই একটু মানাইয়া নে মা। উনারা যা বলে, একটু সহ্য কর। আম্মা! তুই দেহিস, একদিন তুই ঠিকই সুখী হইবি। তোর মায়ে তোরে প্রাণ ভইরা দোয়া কইরা দিলো। তুই একটু মানাইয়া নে মা! পাগলামি করিস না।”

মায়ের কথা শুনে হঠাৎ করে হাসলো শিখা। সে কি হাসি! চোখে জল, মুখে খিলখিল করা হাসি! মনে-মনে বার কয়েক আওড়ালো,

” যেকোনো সমস্যার একটাই কি সমাধান? মানিয়ে নেও নয়তো মেনে নেও! মেয়েদের জীবন কি এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ?”

উওর মিলাতে পারছে না শিখার ছোট্ট মস্তিষ্কে। পুনরায় মস্তিষ্কে জাগ্রত হলো, সুখ নাম শব্দটি!
তবে, সুখী কি হবে সে! মা যে বললো, তা কি আদৌও সম্ভব? ব্যাঙ্গ করে আবারো হাসলো শিখা।
নিজের হাসি থামিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো,

” সংসারে সুখী হওয়ার জন্য দরকার একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী। সেই সঙ্গী কি আমাকে দিয়েছো তোমরা মা?”

মেয়ের প্রশ্নের জবাব নেই মায়ের! আঁচলে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন মা। শিখা মায়ের জবাবের অপেক্ষা না করে ফের বললো,

“আমি মানিয়ে নিবো নিজেকে মা। আর কখনো তোমাদের কিচ্ছুটি বলবো না, বাড়িতেও আসতে চাইবো না। এইতো মানিয়ে নিতে নিতেই একদিন হঠাৎ করেই দেখবে, তোমার মেয়ের জীবন প্রদীপ ফুরিয়ে গেছে।”

“এমন কথা বলিস না মা। আমি যে নিরুপায়!”

এরিমধ্য মনিরুল আসলো, স্ত্রীকে মুঠোফোন হাতে নিয়ে কান্না করতে দেখে, হকচকিয়ে গেলেন তিনি। ততক্ষণাৎ তড়িৎ কণ্ঠে শুধালো,

“কি হইছে তোমার? এভাবে কানতেছো কেন? কোনো সমস্যা, কে কল করছিলো?”

বাবার কণ্ঠ শুনে চট করে লাইন কেটে দিলো শিখা। মা নির্বাক হয়ে কাঁদছে। কিয়াৎ ক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো উনি। খুব সূক্ষ্ণ ভাবে স্বামীর থেকে বিষয়টি এড়িয়ে গেলো। কেননা, বাবা মেয়ের এরূপ কথা শুনলে ভেঙে পড়বে। অনুশোচনার ভুক্তভোগী হয়ে, গুমরে যাবে ভেতরে! বড় কন্যাকে যে খুব শখ করে বিয়ে দিয়েছে, বড় বাড়িতে। এই মানুষটাকে কি কাঁদানো ঠিক হবে? একদমই না! তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে ভারি হলো মায়ের বুক।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে তবুও না খেয়ে নিজের রুমে চোখ দু’টো বন্ধ করে সুয়ে আছে শিখা। তারই একপাশে সুয়ে আযান, মাএই পেটপুরে খেয়ে সুখের ঢেঁকুর তুলছে লোকটা। তার পাশে যে অসুস্থ বউটা না খেয়ে আছে, তাতে কোনো হেলদোল নেই তার।
শিখা আজ কেন পাঁচদিনও যদি নিজ ইচ্ছেয় না খেয়ে থাকে, এতে অবশ্য এ বাড়িতে কারো কিছু যায় আসে না। চঞ্চল সেই মেয়েটা নিজেকে রোবটের মতো চালাচ্ছে আজকাল।
মায়ের কথা মতো, মনের অভিমান গুলো খুউব গোপনে মনিকোঠায় ঠায় লুকিয়ে সব অন্যায় মেনে নিলো মেয়েটা। এইতো কিছুক্ষণ আগেই রান্না সহ যাবতীয় কাজ সেরে রুমে এসেছে শিখা। অসুস্থ শরীরে এতো খাটুনির ফলে শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছে, পেটে ক্ষুধাও লাগছে। তবুও এই খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না তার। চারপাশে খাবারের গন্ধ মৌ-মৌ করছে, বাড়িতে সবাই ঘটা করে খেয়েছে খানিকক্ষণ হলো। অথচ কেউ একবার তার খোঁজ নেয়নি। যেখানে স্বয়ং স্বামীই দ্বায়িত্বহীন সেখানে অন্য সদস্যের থেকে আশা রাখাও বিলাসিতা বৈকি!
একবার খেতে গিয়েও ফিরে এসেছে সে, এই খাবার আজ গলা দিয়ে নামবে না তার।

আজ যদি তার বাবা’রও ষোল কণা পূর্ণ থাকতো, হয়তো এই বাড়িতে সবার চোখের মনি হতো শিখা। চাপা কষ্টে চোখের কার্ণিশ বেয়ে অজান্তেই গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণারা। হুঁশ ফিরলো মেয়েটার, তড়িঘড়ি করে হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো সেই জল। একবুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাইলো পাশে সুয়ে থাকা স্বামীর মুখোপানে। লোকটা এখন আরামসে ঘুমাচ্ছে। ভাগ্য করে একটা পুরুষ জুটেছে তার কপালে। হেয়ালি করে হাসলো শিখা, ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ নিয়ে বলে উঠলো,

“সন্তান হিসেবে তুমি জাতির আদর্শ, এমন সন্তান প্রতিটি মায়ের হোক।
স্বামী হিসেবে তুমি রি’ক্ত’শূ’ন্য, এমন স্বামী কোনো মেয়ের না হোক।”

আযান কি শুনলো সে কথা? বুঝা গেলো না। এরিমধ্যে শ্বশুর মশাই “আসহাব” ডাকলো শিখাকে,

“বউমা! এদিকে একবার এসো তো মা।”

বাড়িতে আসলে একমাত্র এই ব্যক্তিই তার একটুআধটু খোঁজ-খবর নেয়। শিখা একমুহূর্ত দেরি করলো না , নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।
.
.
গর্ভকালীন সময়টা খুব ভালো ভাবেই কেটেছে আশার। তাকে দিনরাত সেবা দিয়ে গেছেন শিখা। ননদের জামা-কাপড় ধুয়ে দেওয়া সহ বাচ্চার জন্য কাঁথা অবধি সেলাই করতে হয়েছে তার।
আজ নরমালেই ছেলে বাবুর মা হয়েছে আশা। বাড়িতে নতুন মেহমানের আগমনে আনন্দের শেষ নেই কারো। ননদরা সবাই এসেছে, বাড়িতে ঘরভর্তি মেহমান। রেহেনা বেগম আনন্দে আত্মহারা! পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলিয়েছে সে। অসুস্থ মেয়েকে ভালো মন্দ খাওয়াতে ব্যস্ত মা।
কিন্তু অভাগা শিখা মেয়েটার এক মিনিটের জন্য নিস্তার নেই।
বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা ননদ আসার ফলে সেই থেকে শুরু হলো তার দিন-রাত বাড়তি শরীর খাটুনি।
তারমধ্যে মেয়েটা নিজেও অসুস্থ। তবুও কেউ তার প্রতি একটু বিনয়ী হয়নি। তাকে সাহায্য করতে কখনো এগিয়ে আসেনি রেহেনা বেগম। উল্টো কোথাও কোনো কাজের ভুল করলে কথা শুনিয়েছেন।

মাএই ননদের গর্ভকালীন সময়ের র’ক্ত’মা’খা কাপড় গুলো ধুয়ে পুকুর পাড়ে ধাপ করে বসে পড়েলো মেয়েটা। তার মাথা ঘুরছে, আঁ’ট শি’ট গন্ধে গা ঘুলিয়ে আসছে। মুহূর্তেই হরহর করে বমি করে দিলো শিখা। শরীরে এতটুকু শক্তি নেই আজ, কোমড়টায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে।
তাকে সাহায্য করার কেউ নেই, কোনোমতে দুর্বল দেহটা সচল করে টলতে টলতে রুমে গেলো শিখা।
এবার একবার ডক্টরের কাছে যাওয়া উচিৎ, এর আগে একবার কেউ সে কথা মনেও করেনি। আযান অফিসে এখন। কি করবে শিখা?
নিজের শরীরের সাথে না পেরে কল দিলো স্বামীর কাছে। ভয়ে ভয়ে বললো,

“শুনুন? আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে, মাথাটা বড্ড ঘুরছে। বলছিলাম কি, আমাকে একটু ডক্টরের কাছে নিয়ে চলুন। এতো যন্ত্রণা আর সহ্য করতে করতে পারছি না। ”

আযান বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে উঠলো,

“এই অসময়ে এজন্যই ফোন দিয়েছো তুমি? আমি অফিসে কাজ করতে আসি, ঘুরতে আসি না শিখা।”

“আমি কখন বললাম, আপনি ঘুরতে যান। আসলে, আজকে একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। আপনি একবার ছুটি নিয়ে আসুন না, প্লিজ!”

“আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং রয়েছে এখন, একদম সময় নেই হাতে। তোমার সমস্যা তুমি বুঝে নেও শিখা। আমিতো আর তোমাকে এতো দ্রুত বাচ্চা নিতে বলিনি। আমাকে জ্বালাবে না একদম, কাজ করতে দেও।”

“আচ্ছা, বাচ্চাটা কি আমার একার, আপনার কোনো দায়িত্ব নেই? আপনি এতো পাষাণ কেনো আযান! আমাকে একটু ভালোবাসলে আপনার কি খুব ক্ষতি হয়? কেন আমার প্রতি আপনার এতো অনাচার?”

কয়েক সেকেন্ড পেরোল ওপাশে নিশ্চুপ, নিঃশব্দ। শিখা অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,” কি হলো কথা বলছেন যে? হ্যালো!”

তবুও সাড়া নেই। শিখা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, লাইন কেটে গিয়েছে ইতোমধ্যে। আবারও কল করলো মেয়েটা। কিন্তু ফোনটা এবার বন্ধ বলছে। এই সময়টাতেও লোকটা ফোন বন্ধ করে রাখলো? হায়রে পুরুষ!
স্বামীর এমন আচরণে বিষিয়ে উঠলো কিশোরী মেয়েটার মন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, দায়িত্বহীন পুরুষটাকে আর কখনো কিছু বলবে না সে। জেদ চাপলো তার অষ্টাদশী মনে, একাই ডক্টরের কাছে যাবে সে।
কিন্তু, টাকা? পরমুহূর্তে শ্বশুরের রুমে গেলো শিখা। বউমা’কে দেখে সৌজন্য মূলক কিঞ্চিৎ হাসলো আসহাব। পরক্ষণে, মেয়েটার মলিন মুখ পর্যবেক্ষণ করে কোমল কণ্ঠে বললেন,

“কিছু বলবে বউমা? তোমার মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেন, কি হয়েছে তোমার?”

লজ্জায় জড়সড় হয়ে দাঁড়ালো শিখা। এসব সিক্রেট কথা কি শ্বশুরকে বলা যায়? বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আজ শ্বশুর কাছে টাকার জন্য হাত পাততেও কেমন জানি লাগছে তার। তবুও নিজেকে ধাতস্ত করে মিহি কণ্ঠে শুধালো,

“বাবা আমাকে কিছু টাকা দিবেন? আমি আজকে একটু ডক্টরের কাছে যাবো, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।”

“সে নায় দিলাম। কিন্তু, তুমি একা যেতে পারবে মা? এক কাজ করো, আযানকে ফোন করে আসতে বলো।”

শ্বশুরের কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো শিখা। খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

“আপনার ছেলের কি আর আমার জন্য সময় আছে বাবা। ব্যস্ত মানুষ কিনা! আপনি যদি টাকাটা দিতেন, তাহলে আমি একাই খুব করে যেতে পারবো।”

কথা বাড়ালো না আসহাব। তার ছেলে যে একটা মেরুদণ্ডহীন, সে ভালো করেই জানে বাবা। ভাবছে হয়তো বউ পেলে বদলে যাবে ছেলেটা। কিন্তু, আযান আর বদলালো না। মা’কে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছে, এখন তাকেও পরোয়া করে না রেহেনা বেগম। এই পারিবারিক নিত্য অশান্তির জন্য নিজেই বাড়ি ছেড়ে শহরে থাকছে সে। সেখানে, শহরের দোকান গুলো দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসলে দুই-চারটা দিন থেকে চলে যায়। সংসারের অশান্তি পোহাতে পোহাতে চরম বিরক্ত মানুষটা। তাইতো, এই সংসার নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই আজকাল। পারিবারিক কোলাহল থেকে নিজেকে আড়াল করেছে দিনদিন, দূরে থেকে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে। এইতো শান্তি!

পরমুহূর্তে, আসহাব আশপাশ তাকিয়ে মানিব্যাগ থেকে হাজার দশেক টাকা শিখার হাতে গুঁজে দিলো। শিখা এতগুলো টাকা দেখে অবাক হয়ে বললো,

“এতো টাকা? এতটা লাগবে না বাবা। আপনি বরং আমাকে দু’হাজারের মতো দিন। তাতেই দিব্যি হয়ে যাবে আমার।”

“সবটা নিজের কাছে রেখে দেও বউমা। যতটুকু লাগে প্রয়োজন খরচ করো, বাকি কিছু থাকলে ভালো-মন্দ যা খেতে ইচ্ছে করে নিজে কিনে খেও। আমিতো আর সবসময় বাড়িতে থাকছি না।”

তবুও নিতে চায়নি শিখা, এক প্রকার জোর করেই হাতে গুঁজে দিলো আসহাব।
শিখা কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। ডক্টরের চেম্বারে এসে পড়ে গেলো বিপাকে। ডক্টর যখন জানলো, শিখা প্রেগনেন্ট। উনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,

“তুমি নিজেই তো বাচ্চা, বয়স কতো তোমার?তোমার সাথে কেউ আসেনি, একা এসেছো তুমি?”

সতেরো বছরী কিশোরী মেয়েটা নিজ মুখে, নিজের গ’র্ভ’ধা’র’ণে’র কথা বলতে লজ্জায় ম’রে যাচ্ছে। এমন লজ্জা ইহজন্মে পায়নি শিখা। তবুও ভে’ঙে পড়া যাবে না। বয়স যাই হোক, সে একজন হবু মা! মায়েদের এতটুকুতে ভেঙে পড়তে নেই। মা হওয়া কি আর এতোটা সহজ?
নড়েচড়ে বসলো শিখা। গুটিকয়েক লম্বা শ্বাস ছেড়ে, শক্ত কণ্ঠে ডক্টর’কে বললো,

“নাম শিখা,বয়স সতেরো চলছে। ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য হাসবেন্ড বা অন্যরা সাথে আসতে পারেনি, বাধ্য হয়ে একাই এসেছি। আপনার যা জানার প্রয়োজন হয়, আমাকেই জিজ্ঞেস করুণ।”

চলবে…….

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০৩

0

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতে ঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ৩

বিয়ের মাস পেরোতে না পেরোতেই বাচ্চার জন্য রেহেনা বেগম পাগল করে দিচ্ছিলো শিখাকে। কথায় কথায় একটা বাচ্চার আবদার করতো, রেহেনা বেগম। শিখা ভাবলো, বাচ্চা আসলে বোধহয় পাল্টে যাবে উনি। নাত/নাতনির পেলে ভালোবাসবে শিখাকে। আর উনি ভালোবাসলেই স্বামীর ভালোবাসা পাবে মেয়েটা।
বিয়ের তিনমাস পেরোতেই আজ যখন শুনলো শিখা প্রেগনেন্ট, মুহুর্তেই সবার চোখের রঙ বদলে গেলো। শিখার বড় ননদ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

” বিয়ে হলো মাএ কয়েকটা দিন হলো, এরমধ্যে তুমি প্রেগনেন্ট হলে কি করে ভাবি? এই বাচ্চা আমার ভাইয়ের তো, নাকি অন্যের পাপ আমার ভাইয়ের বলে চালিয়ে দিলে?”

বড় মেয়ের যুক্তি শুনে চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো রেহেনা বেগম। এরিমধ্যে উনি মেয়ের সাথে সায় দিয়ে শিখার দিয়ে আঙুল উঁচু করে বললো,

” হ্যাঁ তাইতো। সত্যি করে বলো বউমা, এই বাচ্চা কোথায় পেলে তুমি?”

এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে অশান্ত হয়ে পড়লো মেয়েটা হৃদয়। অবাক হয়ে দেখছে সবাইকে। আচ্ছা এরাও কি মানুষ? শেষমেষ নিজের চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিলো সবাই। শিখা মাথা চেপে বসে পড়লো, শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে কান্নার কণ্ঠে শুধালো,

” মা, আল্লাহর দোহাই লাগে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন কইরো না! তুমি না খুউব করে বলতে, একটা বাচ্চা নেও বউ মা, আমার নাত/নাতনীর প্রয়োজন। তাহলে আজ কেন, এমন বিব্রতকর প্রশ্ন করছো মা?”

কেউ শুনছে না অষ্টদশী মেয়েটার কাকুতি-মিনতি করা আহাজারি। চার ননদ, শ্বাশুড়ি মিলে চিরুনী তল্লাশী করা শুরু করে দিলো। একেকজন একেকরকম মন্তব্য করছে। মেয়েটা দিশেহারা হয়ে শেষ ভরসা নিয়ে স্বামীর কাছে ছুটলো। ভাবলো বাবা হওয়ার আনন্দে শিখাকে সাপোর্ট করবে তার স্বামী। শিখার হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে উনি। কিন্তু, আযান মেয়েটাকে আরো এক ধাপ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে বললো,

“এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলো শিখা। এতো দ্রুত আমার বাচ্চা চাই না।”

শিখা অবাক হয়ে বললো,

“কি বলছেন আপনি? এটাই আমাদের প্রথম সন্তান। না, না এটা আমি পারবো না। এটা অন্যায়, এটা পাপ!”

“আমি ঠিকই বলছি শিখা। আজই আমার সাথে হসপিটালে যাবে তুমি।”

শিখার বয়স অল্প হলেও মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না সে। অদ্ভুত এক মায়ার কারণে নিজের সাথে বেড়ে উঠা অস্তিত্বকে বিলীন করতে নারাজ মেয়েটা। মা হয়ে কি করে খু’ন করবে নিজের অনাগত সন্তানকে? বাচ্চাকে এভাবে খু’ন করে সারাজীবন অপরাধী হয়ে বাঁচতে চায় না সে। নিরুপায় হয়ে,স্বামীর হাতে পায়ে ধরে কাঁদছে মেয়েটা। বুক ভরা আহাজারি নিয়ে বললেন,

“আমার সাথে এমন অন্যায় কাজ করবেন না আপনারা। প্লিজ! এই অসহায় মেয়েটার উপর একটু দয়া করুণ। ”

অসহায় এক মা, অনাগত সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। কিন্তু আযান নিজের কথায় অটল।
শিখা দিশেহারা হয়ে যায়। না এই অসভ্য সমাজে থাকবে না শিখা! বাচ্চা সহ এক সাথে ম’রে যেয়ে মুক্তি দিবে সবাইকে। সবার প্রতি অভিযোগ, একরাশ কষ্ট নিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস লাগলো মেয়েটা।
কিন্তু, বেঁচে গেলো সে। কিছু করার আগেই দেখে ফেললো আযান। তাকে সেইবার বাঁচিয়ে নিলো তার স্বামী। কিন্তু, বাচ্চা রাখার অপরাধে স্বামীও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো যেন। অসুস্থ মেয়েটাকে কেউ একচুল শান্তি দিচ্ছে না।
_____________

কেটে গিয়েছে আরো দু’টো মাস। শিখার এখন তিন মাস চলছে।
আজ শিখার শ্বশুর বাড়িতে বিশাল আয়োজন চলছে। আজ শহর থেকে আযানের বাবা ও ছোট বোন “আশা” আসছে বাড়িতে। আযানই বোনের শ্বশুর বাড়ি যাবে আশাকে আনতে। তার ছোট্ট বোনটাও আট মাসের প্রেগনেন্ট,এখন থেকে এখানেই থাকবে। স্বামী ও ছোট মেয়ে আসার খবর পেয়ে মা তাদের সকল পছন্দের খাবারের আয়োজন করছে। কিন্তু নিস্তার নেই এই অল্প বয়সী অসুস্থ মেয়েটার।
শিখা রান্না করছে, রেহেনা বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তদারকি করছে।এরিমধ্য আযান রুম থেকে হুং’কা’র ছাড়লো,

“শিখা, আমার শার্ট-প্যান্ট আয়রন করতে বলেছিলাম না তোমাকে? এখনো করোনি কেন? কেনো করো’নি? এখন পড়বোটা কি আমি?”

আযানের কথা কানে আসতেই মাথায় হাত রেখে ফাঁকা ঢোক গিলে শিখা। রান্না ঘরে কাজের চাপে একদম সে কথা ভুলে গিয়েছিলো মেয়েটা।
ছেলের কথা শুনতে পেয়ে পাশ থেকে রেহেনা বেগম দাঁত কটমট করে শিখাকে বললেন,

“বউমা! আমার সংসারে কিন্তু এসব হেয়ালি চলবে না, আমার ছেলেটার একদম খেয়াল রাখো না তুমি। পরবর্তীতে এগুলো কিন্তু সহ্য করবো না আমি। যাও রুমে গিয়ে দেখো, বাবুর কি প্রয়োজন।”

“আমার একদম মনে ছিলো না মা। আপনি একটু তরকারিটা দেখুন, যাচ্ছি আমি।”

“মনে ছিলো না ছাই! সব কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা।”

শ্বাশুড়ির কথা শুনে আর কথা বাড়ালো না শিখা।
চঞ্চল পায়ে রুমে চলে গেলো। ভেজা হাতটা শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে অপরাধীর ন্যায় শুধালো,

“সরি, সরি!কাজের চাপে আপনার শার্টের কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলাম আমি। আপনি একটু অপেক্ষা করুণ, আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি।”

মেয়েটার এসব হেয়ালি দেখে মুহূর্তেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো আযানে। বিছানায় রাখা শার্টটা শিখার গায়ে ছুঁড়ে মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

“কি এমন কাজ করো তুমি সারাদিন?তোমার মন আজকাল থাকে কোথায়, হ্যা? সময় মতো, একটা কাজ ঠিক মতো করো তুমি? এখন আর করার প্রয়োজন নেই এগুলো, এটা দিয়ে তুমি এখন পূজা করো।”

স্বামীর আচরণে ভারি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শিখা। মাথার উপর থেকে শার্ট সরিয়ে হেয়ালি করে বললো,

“আসলেই, আমি করিটা কি সারাদিন? আপনার সংসারে আমাকে তো আপনি রাণীর মতোই রেখেছে। এইতো অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটাও, ভোর থেকে রাত দশটা অবধি গরুর গোয়াল পরিষ্কার অবধি শুরু করে, পানি গ্লাস একেক-জনকে ঢেলে খাওয়াতে হয়। এটা কোনো কাজ হলো? মেয়ে মানুষ বাড়িতে তো শুধু সুয়ে বসেই খায়। কাজ তো করেন আপনি, আপনার মতো পুরুষেরা।”

এখানে আর দাঁড়ালো না শিখা, তড়িঘড়ি করে রুম ত্যাগ করলো। মেয়েটার কথা আযানের গায়ে খুব লেগেছে। মুহূর্তেই মাথায় র,ক্ত চাপলো তার, রাগের চো’টে নিজের হাত দিয়ে দেয়ালে বার কয়েক ঘুসি মা’র’লো। মুখে বার কয়েক উচ্চারণ করলো,

“বেয়াদব মেয়ে! বেয়াদব!”

শিখা কাছে থাকলে বোধহয় এই আঘাত গুলো আজ তার গায়েই পড়তো। ভাগ্যিস ছিলো না।!
.
.
শিখাকে দেখে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ফ্যানের নিচে আরামসে বসলো রেহেনা বেগমে। যে গরম লাগছে না। বড্ড জল তৃষ্ণা পেয়েছে তার। সোফায় শরীর এলিয়ে হাঁক ছেড়ে বললেন,

“বউমা! আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে এসেতো। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।”

পর মুহুর্তেই ছেলেকে ডাকলেন, “আযান এদিকে আয় তো বাবা। কখন বের হবি? ”

আযান রুম থেকে বের হতে হতে কমল কণ্ঠে বললেন, “এই তো মা, এক্ষুনি যাচ্ছি।”

রেহেনা বেগম রুম থেকে কয়েকটা চকচকে হাজার টাকার নোট ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

“এটা রাখ। আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ভালো দেখে পাঁচ কেজি মিষ্টি আর ব্যাগ ভর্তি ফল নিয়ে যাস। আরো কিছু প্রয়োজন হলে নিয়ে যাস, ও বাড়িতে আশার যেন কোনো অসম্মান না হয়।”

“পাঁচ কেজি মিষ্টির কি প্রয়োজন মা? সচতা দেখে দুই কেজি মিষ্টি নিলেইতো হয়ে যায়।”

শ্বাশুড়ি মায়ের কথা শুনে পিছন থেকে শিখা তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো। শিখার কথা শুনে রেহেনা বেগম এক গাল হেসে বললেন,

“কি যে বলো বউমা? আযান বড় ভাই যাচ্ছে বোনের শ্বশুর বাড়িতে, ওর একটা সম্মান আছে না।”

“হ্যা মা।তোমার মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পাঁচ কেজি মিষ্টি, ব্যাগ ভর্তি ফল নিতে হয়। না নিলে তোমাদের সম্মান থাকে না। আর ছেলের শ্বশুর বাড়িতে সচতা দেখে দুই কেজি মিষ্টিই, যথেষ্ট!আচ্ছা, তখন তোমার ছেলের সম্মান যায় না?”

অপমানে মূর্চ্ছা যাচ্ছেন রেহেনা খানম। মেয়েটার মুখে বুলি ফুটেছে বেশ। আযান ক্রো’ধি’ত চোখে একবার চাইলো শিখার পানে, শক্ত একটা চড় বসিয়ে বলে উঠলেন,

“তোকে বলছিলাম না, মায়ের মুখে মুখে তর্ক করবি না? তবুও কেন কথা বলছিস? আমার বোনদের কি দিবো না দিবো তাও তোকে জিজ্ঞেস করে দিতে হবে? টাকা কি তুই কামাই করিস নাকি তোর বাপ দিয়ে যায়। দু’দিন হলো না এ বাড়িতে আসছিস, তারমধ্যে সংসার নিয়ে মাতব্বরি করছিস তুই? এসব এখানে চলবে না। নেক্সট টাইম এমন করলে না, বাসা থেকে একদম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।”

পাশে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে রেহেনা বেগম। থামানোর নাম নেই, বরং খুশীই হয়েছে সে। এটাই না হলো, তার ছেলে। একেবারে কাজের মতো একটা কাজ করছে।
শিখা গালে হাত দিয়ে, অবাক চোখে দেখছে নিজের অপদার্থ স্বামীকে।
শেষমেশ তার অসুস্থ অবস্থায়ও গায়ে হাত তুললো লোকটা? এতো অধঃপতন হয়েছে আজকাল! সবসময় তার ভুল গুলোই চোখে পড়ে তার? মায়ের প্রতি এতো সম্মান , তবে বউয়ের প্রতি কেনো এতো অবিচার?
তার গায়ে হাত তুললেও খ্যান্ত নেই, তার বাবা’কেও টানছে। আচ্ছা, তার বাবা গরীব, তাই বলে কি তার সম্মান নেই? ফুঁসে উঠলো শিখা। আযানের হাতটা ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিয়ে আঙুল উঁচু করে শুধালো,

“মেরুদণ্ডহীন পুরুষ! আমার বাবা’কে নিয়ে আর একটা কথা বললে আপনাকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। আপনার সাহস কি করে হয়, আমার গায়ে হাত তোলার?”

আযান গা-ঝাড়া দিয়ে মৃদু হেসে বললো, “তোর গায়ে আবার হাত তুলবো। কি করবি তুই, শুনি?”

” অন্যাকে অন্যায়, ভুলকে ভুল বলার সাহস কি আপনার আছে? আপনার মতো মেরুদণ্ডহীন পুরুষ দিয়ে আর কিইবা আশা করা যায়। নিজের স্ত্রীকে যারা সম্মান করতে জানে না, তাদের বিয়ে করা উচিৎ নয়। আপনার উচিৎ ছিলো, মায়ের আঁচলের তালায় বসে থাকা।”

শ্বাশুড়ির পাশে শরবতের গ্লাসটা রেখে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো শিখা। তা দেখে রেহেনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,

“দুইটার রিকশাওয়ালার মেয়ে হয়ে দেমাক কত! এই মেয়ে খুব বাড় বেড়েছে বাবু।”

রুমের দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে শিখা। এ কোথায় বিয়ে দিলো বাবা? এই বাড়িতে এসে বড্ড হাঁপিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। হাসতে ভুলে গিয়েছে সেই কবেই।
আজ ভীষণ ক্লান্ত! এতো বড় ঘর, টাকা পয়সার কি খুউব বেশি দরকার ছিলো তার? বাবার আনা ডাল-ভাতেই তো দিব্যি দিন চলতো তার।

পরমুহূর্তেই দলা পাকিয়ে আসা কান্না গুলো গিলে বিড়বিড় করে বলে উঠলো মেয়েটা,

“বাবা! কেন বুঝলো না তুমি? গরীব ঘরের মেয়েদের এতো উঁচু ঘরে বিয়ে দিতে নেই। উঁচু ঘর, টাকাপয়সা ওয়ালা লোক গুলো গরীব ঘরের মেয়েকে সবসময় অবহেলা আর অসম্মানই করে। তুমি চাইলে নিচু ঘরেও আমি আজ প্রাণ ভরে শ্বাস ছেড়ে বাঁচতে পারতাম। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে বাবা। এখান থেকে আমাকে নিয়ে নেও।”

বাবার কথা মনে পড়তেই, শিখা তড়িঘড়ি করে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলো বাবার নাম্বারে। রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছে না বাবা। একবার, দুইবার, তিনবারের বার ফোনটা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ভেসে আসলো মায়ের হাস্যজ্জল কণ্ঠ, “কেমন আছিস আম্মা?”

মায়ের কোমল কণ্ঠ শুনে, আহ্লাদী কান্না গুলো আবারো দলা পাকিয়ে আসছে তার। লম্বা শ্বাস টেনে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে শুধালো,

” উনি আমার গায়ে আজ হাত তুলেছে মা। এ বাড়িতে সবাই কথায় কথায় আমাকে গাল-মন্দ করে। আমাকে তোমার এখান থেকে নিয়ে যাও মা, নিয়ে নেও আমাকে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। ”

চলবে….

মুক্তির স্বাদ পর্ব-০২

0

#মুক্তির_স্বাদ

লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী

#পর্বঃ২

সেদিন অপমানের পরও আজ সকালে বাবা আবারও এসেছে এই বাড়িতে, নিজের ভা’ঙা কুটিরে মেয়েসহ জামাইকে নিতে। আসলে মেয়ের বাবারা নির্লজ্জ, বেহায়া! বাবাদের মোটেও লজ্জা নেই। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে হাজারো অপমান-লাঞ্ছনা দিলেও বাবারা গায়ে মাখে না। শুধু মাএ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, বাবারা মুচকি হেসে উড়িয়ে দেয় সমস্ত বঞ্চনা।মনিরুলও তার ব্যতিক্রম নয়।

বিয়ের পর এই প্রথম স্বামীর সাথে বাপের বাড়ি যাবে শিখা। আনন্দের শেষ নেই তার মনে। বাড়ি গিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিবে সে, মায়ের হাতে শাক দিয়ে পেট ভরে ভাত খাবে। শ্বশুর বাড়িতে এই কয়দিনেই হাঁপিয়ে গিয়েছে কিশোরী কন্যা। নিজ বাড়ির নাম শুনেই ভিতর থেকে ভুলে গিয়েছে সব মন খারাপি। চঞ্চল কন্যা নিজেকে আজ ইচ্ছে মতো রাঙিয়েছে, বাহারি সাজসজ্জায়। আযান তাদের রুমে বসেই ফোন ঘাটছিলো। শিখা তার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে শুধালো, “আমাকে কেমন লাগছে বলুন তো?”

আযান পূর্ণ দৃষ্টি রাখে কিশোরী বউয়ের পানে। তার চোখ ঝ’ল’সে যাচ্ছে যেন! এতোদিনে এক সাথে থেকেও সেভাবে দেখা হয়নি মেয়েটাকে। মেয়েটাকে বলাই চলে, আগুন সুন্দরী! আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তাকে।
নীল রঙা শাড়ী পড়েছে শিখা, সাথে সিম্পল সোনার গহনা ফর্সা শরীরে চিকচিক করছে। ফাঁকা ঢোক গিলে আযান। পরক্ষণে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে শিখার খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে মৃদু স্বরে শুধালো,

“শিখার থেকে তো আজ আগুন বের হচ্ছে। শিখার অনলে পু’ড়ে যাচ্ছে ই হতভাগা! একদম আগুন সুন্দরী লাগছে তোমায়!”

এই প্রথম স্বামীর থেকে নিজের প্রসংশা পেয়ে লজ্জা পেলো মেয়েটা। লাজুক হেসে বললো,

“আমি আগুনের শিখা হবো, আপনি আগলে নিন। এতো অবহেলা না করে, একটু ভালোবাসা দিন।”

আযান জবাব দিলো না। এমনটা নয় যে মেয়েটাকে তার অপছন্দ।পছন্দও, তবুও কোথাও যেন জড়তার রয়েছে! এই জড়তার জন্য নিজের ভিতরের কথা প্রকাশ করা হয় না। তান্মধ্যে, বাসায় পা রাখলেই মা বউয়ের নামে ছেলের মস্তিষ্কে বি’ষ ঢুকিয়ে দেয়। এজন্য আযান নিজের দুর্বলতা শক্ত খোলসে মুড়িয়ে রাখে। বাচ্চা মেয়ে আশকারা পেয়ে মাথায় উঠে যাবে। তাছাড়া মায়ের ভাষ্যমতে,

“বউ হচ্ছে শাসনের জিনিস! এদের বেশী আহ্লাদ করতে নেই। তাহলেই হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।”

মায়ের থেকে এই শিক্ষাই বড় হয়েছে ছেলেটা। যুবতী বউয়ের ছোঁয়া পেয়ে আজ অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হলেও থেমে যায় আযান। নিজের ইচ্ছে গুলো গুটিয়ে নিলো ততক্ষণাৎ। শিখাকে ছেড়ে দূর গিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে নিচে এসো।”

কথা শেষে করে, বড়-বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। মায়ের রুমে নক করে নরম কণ্ঠে শুধালো,

“মা আসবো?”

রেহেনা বেগম খাটে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে পান চিবোচ্ছে। ছেলের কণ্ঠ শুনে এক গাল হেসে বললো, “আয় বাবা।”

“মা বলছিলাম কি, কিছু টাকার প্রয়োজন।” ইনিয়ে-বিনিয়ে মাথা নিচু করে বললো আযান।

হাজার হাজার টাকা নিজে ইনকাম করলেও মাতুব্বরি সব মায়ের। মাস শেষে বেতন পেয়ে মায়ের হাতেই তুলে দেয় সে। এমনকি হাত-খরচটাও মাঝে মাঝে মায়ের থেকে চেয়ে নিতে হয়। এই সংসার চলেই মায়ের কথায়।
ছেলের টাকা লাগবে শুনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয় রেহেনা বেগম। হেয়ালি পায়ে আলমারি থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট ছেলেকে ধরিয়ে দিলো। আযান টাকাটা নেড়েচেড়ে দেখে অনেকটা সাহস নিয়ে কিয়াৎ ক্ষণ পরে বললো,

“মা মাএ এক হাজার টাকা। ওই বাড়িতে তো প্রথমবারই যাচ্ছি আমি। এই বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম! তাছাড়া আমার তো এক্সটা একটা হাত খরচও রয়েছে।”

তেঁতে উঠলেন মা। ছেলের দিকে তাকিয়ে মুখ কিড়মিড় করে বললো,

“দুই দিননেই বউ মগজ ধুয়ে ফেলছে তোর আযান। আমার মুখে মুখে খুব তর্ক করা শিখেছিস? শ্বশুর বাড়ির জন্য দেখছি, দরদ উতলে পড়ছে আজকাল!”

আযান মিনমিন করে বললো, কি যে বলছো মা। আসলে….”

তাকে থামিয়ে দিয়ে মা বললো, “হয়েছে চুপ কর। এক হাজার টাকাই খুউব হয়ে যাবে তোর। যেই না তোর শ্বশুর বাড়ি! ভাঙা টিনের চালে, দু’কেজি সচতার মিষ্টি নিয়ে গেলেই লে’টা চুকে গেলো। খবরদার! এর চেয়ে বেশি কিছু নিসনে।”

দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো শিখা। মূলত আযানকেই হাসি-হাসি মুখে ডাকতে আসছিলো সে। এসেই শ্বাশুড়ির এমন আচারণে তার এই উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। অপমানে গা হিশহিশ উঠলো মেয়েটার। অথচ স্বামী তার নির্বাক! লোকটা এমন কেন? ন্যায়-অন্যায় কি তার চোখে পড়ে না? তার বাবা গরীব তাই বলে কি কথায় কথায় এভাবে অপমান করবে? শিখা এগিয়ে গেলো রুমে। তান্মধ্যে
আযান বিনাবাক্যে মাথা নত করে বেরিয়ে যেতে উদ্যতো হলো।
এমন সময় পিছন থেকে শিখা শ্বাশুড়ি’কে উদ্দেশ্য করে মৃদু কণ্ঠে বললেন,

“আপনার ছেলে আমাদের বাড়ি খালি হাতে গেলেও তার কোনো অমর্যাদা হবে না মা। আমার বাবা হতেই পারে রিক্সা চালক কিংবা গরীব। তবুও সে নতুন অতিথিদের কি করে খাতির-যত্ন করতে হয় সে বিষয় সচেতন।”

শিখার এহেন কথায় গা জ্বলে যাচ্ছে রেহনা বেগমের। মুখে ঝামটি মে’রে বললেন,

“এ্যা,নুন আনতে পান্তা ফুরায় তার মেয়ে দেমাক কত! আযান দেখছিস, তোর বউ আমার মুখে মুখে তর্ক করছে।”

মায়ের ন্যাকা কথা শুনে আযান শিখার দিকে তাকিয়ে মৃদু চোখ রাঙিয়ে বললো,

“আমাদের মা-ছেলের মাঝে তোমাকে কথা বলতে কে বললো শিখা? নেক্সট টাইম এমনটা যেন না হয়, মাথায় রেখো।”

শিখা স্বামীর আচরণে অবাক হয়ে যায়। আচ্ছা এখানে তার দোষটা কোথায়? সে কি ভুল কিছু বলেছে? কই লোকটা প্রতিবাদ করবে , উল্টো তাকে ধমকাচ্ছে।
পরক্ষণেও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো মেয়েটা। বাবা নিচে বসা,আবার যদি বাবাকে অপমান করে তারা।
তান্মধ্যে, নিচ থেকে বাবা হাঁ’ক ছেড়ে বললেন,

“শিখা আম্মা,হলো তোদের? তাড়াতাড়ি কর মা।আমার ওদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

শিখা বিনাবাক্যে নিচে আসলো তার পিছনে পিছনে আযান। রেহনা বেগম পিছন থেকে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” আজকের দিনটা থেকেই আগামীকাল বউকে নিয়ে চলে আসিস বাড়িতে। তোর সংসারের এতো কাজ-কাম আমি করতে পারবো না বাপ। এমনিতেই হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে।”

আযান বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লো।
.
.
কতদিন পরে মেয়ে-মেয়ের জামাইকে পেয়ে আনন্দের শেষ নেই শিখার মা-বাবার। এই প্রথমবার জামাই এসেছে বাড়িতে তার, আদর যত্নের কোনো কমতি নেই। বাবা ধারের টাকায় ব্যাগ ভর্তি বাজার করছে, মা খোয়ারের সব চেয়ে বড় মুরগীটা নিয়েছে রান্নার জন্য। শখা হরেক রকম নকশি পিঠা বানাচ্ছে।
কিন্তু জামাইটা একদিনের বেশি থাকলোই না। আফসোসে ম’রে যাচ্ছে শিখার মা। মন মতন কিছু করতেই পারলো না।
যথারীতি মায়ের কথা মোতাবেক পরদিন সকালে আযান শিখা’কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও শিখা আর কয়টা দিন থাকার বায়না ধরেছিলো। কিন্তু, কিন্তু আড়ালে স্বামীর র’ক্তি’ম চোখের কাছে চুপসে গেলো তার ইচ্ছে।

শিখার মনটা আজ ভীষণ খারাপ! কতদিন পর বাবার বাড়িতে এসেও ক’টা দিন থাকা হলো না তার। আপন-জনকে ছেড়ে আসার কষ্টে দু-চোখে অশ্রুকণা ভীড় করছে মেয়েটার। সেদিকে কিচ্ছুটি যায় আসে না কারো। অতিরিক্ত মা ঘেঁষা পুরুষের বউ সে, স্ত্রীর প্রতি লোকটা সবসময়ই উদাস!
আযান বাড়িতে পা রাখতেই রেহেনা বেগম জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন “শ্বশুর বাড়ি কোন বেলায় কি কি খাইয়েছে তাকে, তার ছেলের কোথাও কোনো অসম্মান হলো কিনা। আরো কত কি।”
তান্মধ্যে, শিখা শ্বাশুড়ির সামনে কয়েকটা বক্স ভর্তি খাবার রেখে বললেন, “এগুলো আমার মা তোমার জন্য পাঠিয়েছে মা।”

কথা শেষ করে শিখা কাজে লেগে পড়লো। তার আর বিশ্রাম নেই। একটা দিন ছিলো না, রান্না ঘরে হাঁড়ি পাতিল জমা হয়ে গিয়েছে, ঘরগুলো অপরিষ্কার। দুপুর হয়ে গিয়েছে প্রায়, এক্ষুনি আবার রান্না করতে হবে।

শিখা যেতেই রেহনা বেগম দ্রুত বক্স গুলো খুলে দেখতে লাগলেন। পোলাও, আস্তো মুরগীর রোস্ট, গরুর মাংস সহ আরো কয়েক রকমের বড় বড় মাছ রয়েছে বক্সে। যা দেখে জিভে জল চলে আসছে তার। ততক্ষণাৎ পেট ভরে খেয়ে ঢেঁকুর তুলে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলললো,

“খাবারের কি বিশ্রী স্বাদ! এগুলো না নিয়ে আসলেও তো হতো।”

শিখা কান এড়ালো না এ কথা। শ্বাশুড়ির কথা শুনে রান্না ঘরের বসে বিড়বিড় করে বললেন, “তোমাকে কলিজা ভুনা করে খাওয়ালেও তুমি বলবে লবনে কম হইছে।”

কেউ শুনলো না তার নিরব বাক্য। এরিমধ্যে আযান মুখ ফসকে বোকার মতো বলে উঠলো, “তাহলে তুমি এতো গুলো খেলে কেন মা? কম খেলেও তো হতো, আবার না জানি পেটে সমস্যা হয় তোমার।”

খেঁপে গেলেন রেহনা বেগম। ছেলের দিকে তাকিয়ে ন্যাকা কণ্ঠে বললো,

“এখন আমি এতো বেশি খাই যে তোর চোখে পড়ে গেছে আযান? তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে বলে, তুই আমাকে খাবারের খোঁটা দিচ্ছিস? বউ, নতুন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি পেয়ে মা এখন পর হয়ে গেলো তোর? আল্লাহ গো! এই দিন দেখার জন্যই কি বেঁচে আছি আমি।”

আযান এতক্ষণে ঠাহর করতে পারলেন, সরল মনে কি বলে ফেলছেন তিনি। ভাবতেই জিভে কামড় দিলো ছেলেটা। এখন মা কি তাকে আস্ত রাখবে? পেঁচাল করে মাথা খেয়ে দিবে আজ। তার থেকে এখান থেকে কে’টে পরাই শ্রেয়। ততক্ষণাৎ আযান অফিসের নাম করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।

চলবে……