Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 432



চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০৮

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৮
#ফিজা_সিদ্দিকী

পরেরদিন ভোর হওয়ার আগেই কাওকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ফেরে শ্রেষ্ঠা। দমবন্ধ গিয়ে আসছিলো তার ওই বাড়িতে। অবচেতন মন বারবার টের পাচ্ছিলো কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে। সার্থক ভালো ছেলে নয়। স্নিগ্ধা ঠকছে। খুব বাজে রকমভাবে ঠকছে। এই একটা বিষয় তাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। স্নিগ্ধার পাশে শুয়েই পুরোটা রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। অসহনীয় রাতের প্রহরে বারবার মন চেয়েছে স্নিগ্ধাকে ডেকে সবকিছু সত্যি বলে দিতে। কিন্তু এতোকিছু বলার মতো সাহস তার ছিলো না। আর না পারছিলো সবকিছু মেনে নিতে। সার্থকের করা স্পর্শগুলো কাঁটার মতো ফুটছিলো তার সারা শরীরে। তাইতো ভোর হওয়ার আগেই কাউকে কিছু না জানিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলো বাড়ী থেকে।

ঘুম থেকে উঠে পুরো বাড়ির কোথাও শ্রেষ্ঠাকে খুঁজে না পেয়ে ক্রমে অস্থির হয়ে পড়েছিলো স্নিগ্ধা। হটাৎ বালিশের তলায় রাখা ছোটো একটা চিরকুট পায় সে।

“হয়তো তোমার কাছে আমার আর কখনও আসা হবে না। আর বাহানা খুঁজবো না ছুটে আসার। তোমার ঐ শরুরে জীবনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না কেউ। তুমি আর আগের মতো নেই আপু। একটুও আগের মতো নেই। তোমার শরীরে সেই আগের মতো স্নিগ্ধ মা মা গন্ধ পাই না। বরং সেখানে…. থাক সেসব কথা।

আর আসবো না আমি। খুঁজবো না তোমায় এখানে সেখানে। আর ভালোবাসবো না। অকারণে বিরক্ত করবো না। তুমি কিভাবে এমন হলে আপু? আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। সেই সহজ সরল মেয়েটা, যাকে এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। যার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, সেই মানুষটার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। শহরের হাওয়া বদলে দিয়েছে তাকে। বদলেছে তার শরীরকে। সেই সাথে শরীরি চাহিদাকে। এতটুকু বোঝার মতো বড়ো আমি হয়েছি। ওই বিছানায় আমার ঘুম আসবে না। যেখানে তুমি মেতেছ অন্য খেলায়, সেই বিছানা আমাকে কামড়ে ধরছে যেনো। ঘিনঘিন করছে শরীর। চাইলেও আটকাতে পারছি না, তোমার প্রতি আসন্ন ঘৃণাটুকু। তুমি কিভাবে পারলে? মা বাবার কথা ভাবলে না একটুও? আমি আর কখনও তোমার কাছে যাবো না আপু। কখনও না। সবশেষে বলবো, তুমি মানুষ চিনতে শেখোনি আপু।”

চিঠিটা পড়ার পর পুরোটা দিন থম মেরে বসে ছিল স্নিগ্ধা। ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে ভুগছিলো। শ্রেয়া তার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোটো। সার্থকের সাথে গড়ে ওঠা সম্পর্কের কথা এভাবে শ্রেয়ার সামনে খোলাসা হবে সে কখনো ভাবেনি। বরং এমন একটা সম্পর্ক সে নিজেও কখনো চায়নি। সে তো একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক চেয়েছিলো। তবুও কিভাবে যেনো সেই সম্পর্ক ক্রমে হয়ে উঠলো শারীরিক সম্পর্ক। সার্থকের ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো স্নিগ্ধা। তাইতো তাকে হারানোর ভয়ে হুট করেই নিজেকে সঁপে দেয় তার কাছে। কারন ছেলেরা নাকি মনের চেয়ে শরীর চেনে বেশি। সে তো এই অচেনা শহরে একটা চেনা মানুষ চেয়েছিলো। তাকে বোঝার মতো, ভালোবাসার মতো মানুষ। কিন্তু শ্রেয়া যে ভুল বুঝলো তাকে! শ্রেয়া কী সত্যিই আর কখনো আসবে না তার কাছে?

পুরোটা দিনে রুমবন্দী স্নিগ্ধাকে পঞ্চাশোর্ধ বার কল করেছে সার্থক। প্রতিবার একই ঘটনা ঘটছে। রিং হয়ে কল কেটে যাচ্ছে নিজের মতো করে। বারবার বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে ফোন। স্নিগ্ধা শুনেও কিছু শুনছে না যেনো। এই মুহূর্তে কারোর সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তার। একা থাকতে চায়, সম্পূর্ন একা। কিন্তু এই কথাটুকু বলার মতো শক্তিও যেনো অবশিষ্ট নেই তার মাঝে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সশব্দে বেজে ওঠা কলিং বেলের শব্দে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় গেট খোলার উদ্দেশ্যে। গেট খুলে সার্থককে দেখেও যেনো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মাঝে। উল্টো ঘুরে আগের মতোই ফিরে আসে রুমে। সার্থক নির্বাক। ফ্যালফ্যাল চাহনিতে চেয়ে থাকে শুধু তার দিকে। এতগুলো মাসে স্নিগ্ধাকে এতটা উদাসীন, এতো বেশি আনমনা আর কখনো দেখেনি সে।

১৯.
প্রায় দুই বছর পর ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে স্নিগ্ধা। তাকে ঘিরে বাড়িতে তুমুল আয়োজন। শিমুল নিহার ব্যস্ত নানান বাহারী আয়োজনের হুল্লোড়ে। আজ কতোগুলো দিন পরে কলিজার টুকরো মেয়েকে দুই চোখ ভরে দেখছেন তিনি। আবেগে চোখ দুটো ভরে আসছে তার বারে বারে। শাড়ির আঁচল টেনে চোখের কোনের জলটুকু সন্তর্পনে মুছে ফেলেন তিনি। কিন্তু আবারও কিছুক্ষনের মাঝে ভরে আসে তার চোখ। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন দূরে সোফায় বসে থাকা মেয়েটার দিকে। খুঁটিতে খুঁটিতে দেখতে থাকেন তার সবকিছু। আগের চেয়ে গায়ের রং বেশ উজ্জ্বল হয়েছে। দেখতে শুনতেও ভালো হয়েছে। শরীরে খানিক মেদ জমেছে। বাঙালি মেয়েদের শরীরে হালকা মেদ বেশ মানায়। সে কারণে স্নিগ্ধাকে দেখে একেবারে পরিণত নারী মনে হচ্ছে তার। শহরের ছোঁয়া পেলে বোধহয় মানুষ ঠিক এভাবেই বদলে যায়। সুন্দর হয় চেহারা। অজান্তেই নিজের মেয়ের প্রতি নজর দিয়ে ফেলছেন তিনি, ভেবেই জিভ কাটেন শিমূল নিহার।

খাওয়া- দাওয়া, আলাপ- আলোচনা কোনোটাতেই দেখা গেলো না শ্রেষ্ঠাকে। অসুস্থতার বাহানা দেখিয়ে পুরোটা দিন শুয়ে থাকলো রুমে। অথচ এইতো কয়েকমাস আগেও এই মানুষটাকে সে কতো ভালোবাসতো। ঠিক যেমন আলপিন ছুটে যায় চুম্বকের টানে! মানে না কোনো বাধা বিঘ্ন। সেভাবেই ছুটে যেতো সে। অথচ আজ সে সবকিছুই ম্লান। অনুভূতিরা নির্জীব।

সেদিন হুট করে বাড়ি ফেরায় অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। তবুও সত্যিটা প্রকাশ করেনি সে। কিন্তু একলা রুমে কেঁদেছে প্রত্যহ। দহনে দহনে শেষ হয়েছে প্রতিটা মুহূর্তে। পুরো দুনিয়া ওলোট পালোট হয়ে গেছে তার। যন্ত্রণায় বুঁদ হয়ে কেটেছে প্রতিটা প্রহর। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে সে। বারবার মন চেয়েছে ছুটে যেতে মানুষটার কাছে। দ্বিধা, সংশয় ধুয়ে মুছে একাকার করে তার সাথে খোলাখোলি কথা বলতে। কিন্তু হয়নি। পেরে ওঠেনি মস্তিষ্ক আর মনের সাথে লড়াই করতে করতে। এক সময় হাঁপিয়ে যাওয়ার মতো হাল ছেড়ে দিয়েছে।

রাত তখন আটটা। শ্রেষ্ঠার রুমের দরজায় নক করে স্নিগ্ধা। শ্রেষ্ঠা জানে কে এসেছে এই মুহূর্তে।

“দরজা খোলা আছে।” -শ্রেষ্ঠা বলে।

স্নিগ্ধা নিঃশব্দে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাকায় রুমের এদিক ওদিক। কেমন যেনো এক অস্বস্তি লাগছে তার। অস্বস্তির কাঁটা খচখচ করে বিঁধছে যেনো তার বুকে। ক্ষণে ক্ষণে জিভ দিয়ে রুক্ষ ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত করছে নিজেকে। অবশেষে অবসন্ন কণ্ঠে বললো,

“কেমন আছিস?”

“ভালো।”

“পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“ভালোই।”

“এক্সাম কবে তোর?”

“এইতো কয়েকমাস পরেই।”

এরপর বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না স্নিগ্ধা। অনেক কিছু বলতে চেয়েও যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কই আগে তো এমন হতো না? আগে তো এতো ভাবতে হতো না তাকে। তবে আজ কেনো এতো দ্বিধা তাদের মাঝে? দ্বিধা দ্বন্দরা মিলেমিশে এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে তাদের মাঝে। যাকে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের কারোর পক্ষেই। আচমকা স্নিগ্ধা উঠে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো তার অস্বস্তি হচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে এই রুমে। বন্ধ করা দরজার পাল্লা হাট করে খুলে বের হতে গিয়ে শোনা গেলো একটা নিভু নিভু কণ্ঠ,

“সে আরও অনেককে এভাবে ঠকিয়েছে। ঠিক যেভাবে তোমাকে ঠকাচ্ছে। সব চকচকে জিনিস হীরে হয়না।”

২০.

“মানি, তুমি কাঁদছো?”
শ্রেয়ার ডাকে চমকে ওঠে শ্রেষ্ঠা। বিকাল গড়িয়ে কখন যে রাত নেমেছে ধরণীতে তার ইয়াত্তা নেই। কাপের কফিটা এতক্ষণে ঠাণ্ডা জল। চোখের কার্নিশ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে জলের ধারা। নিঃশব্দ কান্না। অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, বরং যেনো অতীতের মাঝে বাঁচছিলো সে এতক্ষন। কতোগুলো বছর কেটে গেলো। তবুও সেই দিনগুলো আজও গেঁথে আছে বুকে। প্রত্যহ নিয়ম করে পীড়া দেয় তাকে। র’ক্ত ঝরায় বুকের মাঝখানে। এ যেনো এমন এক ঘা, যা ভরতেই চায়না। বরং স্মৃতির পাতায় দগদগে ঘা হয়ে জ্বলজ্বল করে।

শ্রেয়াকে বুকে টেনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শ্রেষ্ঠা। এই একটাই শেষ আশ্রয়স্থল তার। যাকে ঘিরে দুনিয়া তার। শ্রেয়ার মাঝে খুঁজে পায় সে স্নিগ্ধাকে। বোনের উজাড় করা ভালোবাসার এক শতাংশ সে শ্রেয়াকে দিতে পারে কিনা জানা নেই। তবে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালো রাখার চেষ্টা করে তাকে।

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০৭

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৭
#ফিজা_সিদ্দিকী

(❌ কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত❌)

“তুমি বলেছিলে এই প্ল্যানে সামিল ছিলো দুইজনে। তবে আর একজন কে?”

“এক আমি। আর এক আমার মন। এই দুইয়ের ষড়যন্ত্রে ঘটেছে এসব।”

সার্থক স্বাভাবিক। যেনো খুব সাধারণ কোনো কথা বলেছে সে। কিন্তু তার কথা শুনে আচমকা আসমান থেকে ঠাস করে জমিনে আছড়ে পড়লো যেনো স্নিগ্ধা। বিস্ময়ে হাসা উচিৎ নাকি তৎক্ষণাৎ তার কলার চেপে ধরে রাগ দেখানো উচিৎ বোধগম্য হচ্ছেনা তার। অতঃপর মৌন থাকার সিদ্ধান্ত নিলো সে। যেনো আসলেই কিছু হয়নি।

১৮.

ছুটি পেলেই শ্রেষ্ঠা চলে আসে বোনের কাছে। বোনকে সে বোধহয় মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। মায়ের শূন্যতার চেয়ে বেশি ছারখার হয় একমাত্র বড়ো বোনের শূন্যতায়। এইযে কতোগুলো দিন দেখা পায়না তার। জড়িয়ে ধরে আয়েশ করে ঘুমানো হয়না। এতে ভীষণ মন খারাপ হয় তার। কিন্তু নিয়তির কাছে বরাবরের মতো হার মানতে হয় আমাদের। নিষ্ঠুর নিয়তির জন্য নিজের পড়াশোনা ছেড়ে একবারের জন্য থেকে যেতে পারেনা স্নিগ্ধার কাছে। তবে দুই এক মাস পর পরই ছুটি পাওয়া মাত্র ব্যাগ পত্র গুছিয়ে হাজির হয় বোনের ফ্ল্যাটে। স্নিগ্ধাও মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নেয় তাকে। আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় আদরের ছোটো বোনকে। যে কয়টা দিন শ্রেষ্ঠা থাকে জীবনটা ভীষণ প্রানবন্ত লাগে তার। পড়াশোনার উপযোগী কথাবার্তা থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা বয়সের বিভিন্ন অসম সমীকরণ, সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয় তাদের মাঝে।

শ্রেষ্ঠা সবেমাত্র ডগমগে পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে মরীচিকা স্বরূপ যৌবনের রাস্তায়। চারিপাশে মুখোশধারী মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ফলে তাকে সেই পথে পাড়ি দেওয়ার মতো উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে স্নিগ্ধা।

তপ্ত দুপুরে উত্যক্ত রোদ্দুর। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে স্নিগ্ধা। রুমের মধ্যে অবস্থিত ছোটো বুকশেলফ ভর্তি বইগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে শ্রেষ্ঠা। মূলত সেখান থেকে একটা উপন্যাস পড়ার ইচ্ছে হচ্ছে তার। দেখতে দেখতে একটা ইংরেজি নামের উপর চোখ আঁটকে যায় তার। যেখানে লেখা,” ফিফটি শেডস অফ গ্রে”। নাম সম্পর্কে কৌতূহল হয় তার। সেই সাথে উপন্যাসের ভেতরের কাহিনী সম্পর্কে আগ্রহ বোধও। শেলফ থেকে বইটা বের করে কভারপেজ দেখে খানিকটা ইতস্ততবোধ হয় তার। এক তরুণীকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে মূলত কিস করার চেষ্টা করছে এক তরুণ। কভার পিক দেখে ধারণা করা যায় এটা একটা রোমান্টিক উপন্যাস। আর ইংলিশ রাইটারদের লেখা একটু খোলামেলা হয়। শ্রেষ্ঠা আগেও পড়েছে ইংলিশ উপন্যাস। তবে সেটা ছিলো থ্রিলারধর্মী। কভারের পিক দেখে পড়বে কি পড়বে না খানিকটা দোটানায় ভুগছিলো সে। অতঃপর মনে পড়ে জর্জ ইলিওট নামক এক রাইটারের লেখা একটা বাক্য, ” ডোন্ট জাজ এ বুক বাই ইটস কভার।”

এরিকা লিওনার্ড জেমস্ নামক একজন বিখ্যাত লেডি রাইটারের লেখা বই “ফিফটি শেডস অফ গ্রে” বইটা নিয়ে বিছানায় আয়েশ করে বসলো শ্রেষ্ঠা। বইটা খুলে মাত্র পড়তে শুরু করবে এমন সময় হটাৎ করে কলিং বেল বেজে ওঠার শব্দে খানিক বিরক্ত হলো সে। বইটা একপাশে রেখে একবার তাকালো ওয়াশরুমের বন্ধ দরকার দিকে। ভেতর থেকে পানির শব্দ ভেসে আসছে। তার মানে স্নিগ্ধার বের হতে সময় লাগবে। তাই বিরক্তিকর ভাবটা মন থেকে সরিয়ে সে নিজেই চলে গেলো গেট খোলার উদ্দেশ্যে।

দরজার সামনে দাঁড়ানো বলিষ্ঠদেহী একজন পুরুষ আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে শ্রেষ্ঠাকে। শুধু জড়িয়ে ধরেই খান্ত নয় সে। বরং অনবরত একের পর এক চুমু খেয়ে যাচ্ছে তার গলায়, ঘাড়ে। তার দুইহাত নির্লিপ্তভাবে ছুটে চলেছে শ্রেষ্ঠার দেহের বিভিন্ন বাঁকে। আকস্মিক এহেন আক্রমনে বিস্ময়ে কিংকর্তবযবিমূঢ় সে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেও বলিষ্ঠদেহী একজন পুরুষের সাথে ধস্তাধস্তি করে পেরে উঠছে না সে। অতঃপর পায়ের সাহায্যে পুরুষটির স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করতেই দ্রুত তাকে ছেড়ে দেয় সে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেকে নিয়ে। যদিও খুব বেশি জোরে হিট করেনি সে। শুধুমাত্র নিজের আত্মরক্ষার জন্য তার থেকে ছাড়া পেতে যেটুকু ব্যথা দেওয়ার প্রয়োজন সেটুকুই দিয়েছে।

খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে দুটো মানুষ। একজনের চোখে মুখে স্পষ্ট অনুতাপ আর অপরজনের রাগী দৃষ্টি। এতক্ষণে যেনো একে অপরকে খেয়াল করেছে তারা। ছেলেটাকে শ্রেষ্ঠা চেনে। স্নিগ্ধার বন্ধুমহলের একজন সে। নাম সার্থক। সার্থকও শ্রেষ্ঠাকে চিনেছে বেশ ভালো করেই। স্নিগ্ধা তার পরিবারের সকলের ছবি বেশ কয়েকবার দেখিয়েছিল তাকে। সেখানেই দেখেছিল সে শ্রেষ্ঠাকে। তবে দুজনের প্রথম পরিচিতি এভাবে হবে তা কল্পনাতীত ছিলো। আড়ষ্টতা ভেঙ্গে প্রথমে কথা বললো সার্থক।

“আই অ্যাম সরি। এক্সট্রিমলি সরি। বিশ্বাস করো, আমি ভ্রুনাক্ষরেও টের পাইনি যে দরজার এপাশের মানুষটা স্নিগ্ধা না হয়ে অন্য কেউ। অভ্যাসবশত এভাবে..”

তার কণ্ঠে অপরাধবোধ। সেইসাথে খানিক দ্বিধা।

“অভ্যাসবশত মানে? সত্যি করে বলুন আপনাদের মাঝে সম্পর্ক কী?”

সার্থক আশপাশে তাকাচ্ছে বারবার। শ্রেষ্ঠার উচ্চকণ্ঠের শব্দ বাইরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই দরজা লাগিয়ে সার্থককে ভেতরে আসতে ইশারা করলো সে। এই বাড়ির একটাই রুম। একটা কিচেন, একটা ওয়াশরুম। একপাশে বাইরের দিকের খানিকটা অংশ জুড়ে ফাঁকা ঝুলন্ত ব্যালকনির মতো। অগত্যা সার্থক বেডরুমে এসে বসলো। তার পাশেই বেডে উপুড় করে রাখা রয়েছে ফিফটি শেডস অফ গ্রে বইটা।

“বইটা তুমি পড়ছিলে?”

বইটা হাতে নিয়ে ওলোট পালোট করে দেখতে দেখতে সার্থক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো শ্রেষ্ঠার দিকে। সার্থকের স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে বেশ অবাক হলো শ্রেষ্ঠা। কিছুক্ষন আগে পর্যন্ত এই কণ্ঠে ছিলো রাজ্যের অপরাধবোধ। কেমন যেনো লজ্জায় গুটিয়ে যাওয়ার এক মনোভাব। কিন্তু আচমকাই যেনো রং বদলে গেলো তার। কণ্ঠ স্বাভাবিক। যেখানে নেই কোনো অপরাধবোধের ঠাঁই।

“হুম। কিন্তু আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম।”

“উমম, তা করেছিলে বৈ।”

সার্থকের নির্লিপ্ততা দেখে অবাক না হয়ে পারেনা শ্রেষ্ঠা। অতঃপর রাগী কণ্ঠে বলে,

“কিন্তু কোনো জবাবদিহিতার প্রবণতা দেখছি না আপনার মাঝে।”

শ্রেষ্ঠার কণ্ঠ গম্ভীর। কাট কাট তার জবাব। এসবের মাঝেও হাসলো সার্থক। ঠোঁট চেপে হেসে বললো,

“কিছুক্ষন আগেও বাচ্চাসুলভ স্বভাবের ভাবা মানুষটাকে দেখে আমার অপরাধবোধ হচ্ছিলো। খুব অনৈতিক একটা কাজ করে ফেলেছি ভেবেই গিল্টি ফিল হচ্ছিলো। বাট আই ওয়াজ টোটালি রং। অ্যাডাল্ট স্টোরি পড়া মানুষটা কখনো বাচ্চাসুলভ হতে পারে না। আর একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর সাথে এটুকু মজা তো করাই যায়। তাইনা?”

কথাটা শেষ করেই শ্রেষ্ঠাকে চোখ টিপ দিলো সার্থক। রাগে উত্তেজনায় প্রায় হিশহিশিয়ে উঠলো শ্রেষ্ঠা।

“বিশ্বাস করুন, আপনার চেয়ে খারাপ মানুষের সাথে আমার এতো বছরের জীবনে কখনো পরিচিতি ঘটেনি। আর না কখনও ঘটবে।”

কথাটাতে যেনো বেশ মজা পেলো সার্থক। হাসতে হাসতেই বললো,

“ইউ আর ড্যাম অ্যাট্রাক্টিভ। তোমার বোনের চেয়েও দারুন বডি। আর…”

“ছিঃ! লজ্জা করছে না আপনার। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, রাগের চেয়ে বেশি বিস্মিত হচ্ছি আমি ক্ষণে ক্ষণে। আমার আপু ছোটো থেকে প্রতিটা পরীক্ষায় প্রথম হয়ে এসেছে। অথচ জীবনের এতো বড়ো একটা পরীক্ষায় তার এভাবে ফেল করে যাওয়া অবিশ্বাস্য লাগছে আমার।মানলাম আপুর সাথে আপনার বিশেষ কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তাই বলে আমাকে যাচ্ছেতাই বলার কোনো অধিকার রাখেন না আপনি। আমি স্নিগ্ধা আপু নই। আর না আপুর মতো এতো সহজ সরল। তাই সাবধান। নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে।”

“উমম, লঙ্কায় যতো ঝাল হবে মিষ্টির সুইটনেস ততো তীব্রভাবে বোঝা যাবে।”

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সেদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় দুজনে। শাওয়ার থেকে বের হয়ে সার্থককে দেখে আচমকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় স্নিগ্ধা। সার্থকের আজ এখানে থাকা স্বাভাবিক। যেটা অস্বাভাবিক সেটা হলো শ্রেষ্ঠার হুট করে চলে আসা। কাল রাতেই কোনো রকম আগাম বার্তা না দিয়েই দুইদিনের ছুটি নিয়ে তার কাছে চলে আসে শ্রেষ্ঠা। রাত তখন প্রায় আটটা। এতরাতে একা শ্রেষ্ঠাকে আসতে দেখে বেশ বিচলিত হয়ে পড়ে সে। এই কারণে ব্যাপারটা সম্পর্কে সার্থককে অবগত করার কোনো সুযোগ পায়নি। আর সকাল থেকে সার্থকের ফোন বন্ধ। তাই কোনোরকম ভাবেই যোগাযোগ না হওয়ায় শ্রেষ্ঠার আসার খবরটা দেওয়া হয়নি তাকে। এদিকে রোজকার মতোই ক্লাস শেষে স্নিগ্ধার ফ্ল্যাটে এসে উপস্থিত হয় সার্থক। ফলে গেট খুলতে যাওয়া মানুষটা স্নিগ্ধা না হয়ে অন্যকেউ হবে, এই বিষয়টাও মাথায় আসেনি তার।

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৬

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৬
#ফিজা_সিদ্দিকী

চিঠিখানা হাতে স্নিগ্ধা ঠিক কতোখানি সময় অবসন্নগ্রস্থ হয়ে বসে ছিলো তার ইয়াত্তা নেই। তবে শরীর কাঁপছিলো তার। নব্য ছন্দের তালে সুর মিলিয়ে প্রজাপতির মতো ডানা মেলেছে সুবিন্যস্ত আকাশে। আবার কখনও কখনও জোনাক পোকার মতো আলো ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় শহরের অলিগলি। এ যেনো এক নব্য সুখময় অনুভূতি।

১৬.

পরের অপেক্ষাটা অবশ্য ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। দিন পেরিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ পেরিয়ে মাসের অর্ধেক চলে যায়। স্নিগ্ধা ততদিনে পুরোপুরিভাবে ডুবে গেছে সেই অচেনা মানবে। ডুবেছে তার প্রেমে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কঠিন কাব্যিক বাণীতে। প্রায় ছন্নছাড়া অবস্থা তার। সবার উপরে থাকা মেয়েটা দিনে দিনে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে ক্রমে। নিজেকে যেনো গুটিয়ে নিচ্ছে সবকিছু থেকে। সারাটা সময় অপেক্ষায় থাকে কারোর। অদেখা, অজানা সেই মানুষটার নতুন কোনো বার্তার অপেক্ষায় কাটে তার দিন। এক এক মিনিট কাটে প্রহর সমান সময় নিয়ে। স্নিগ্ধা আদৌ জানেনা সেই মানুষটার কাছ থেকে আর কোনো চিঠি আসবে কিনা! জানেনা তাদের কোনোদিন দেখা হবে কিনা! শুধু জানে এই মানুষটাকে ছাড়া সে নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। এইযে আজকাল কী এক শূন্যতায় যেনো মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যায় তার। মনে হয় বুকটা যেনো ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা। আচ্ছা এই শূন্যতা কিভাবে তৈরি হলো? সে তো মানুষটাকে কখনো দেখেনি। কখনও ছিলোও না তার জীবনে। যে কখনও ছিলো না, তার হারানোতে এতোখানি শূন্যস্থান তৈরি হয় কিভাবে? হাজারো প্রশ্নের শেষে উত্তর ওই একটাই। দীর্ঘশ্বাস।

লাইব্রেরীর একেবারে কর্নারের টেবিলে বসে আছে স্নিগ্ধা। লাইব্রেরী প্রায় ফাঁকা। কারন এই সময় ক্লাস চলছে। অথচ ক্লাসের সবচেয়ে পড়াকু, মনোযোগী মেয়েটা টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে কী যেনো ভাবছে। এমন সময় হুট করে সেখানে উপস্থিত হলো সার্থক। পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে আনমনে সেদিকে তাকায় স্নিগ্ধা। অতঃপর আবারো আগের মতো টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো জানালার বাইরে। অদূরে কোথাও একটা। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলো সার্থক,

“স্নিগ্ধা”

“হুম”

“আপসেট?”

“নাহ”

“টপার মেয়েটাকে আজকাল আর ক্লাস করতেই দেখা যায়না। আর তুই বলছিস কিছু হয়নি!”

“একা থাকতে চাই। প্লীজ।”

“এভাবে একা থাকলে কী তাকে খুঁজে পাবি? হতেও তো পারে সে তোর খুব কাছেই রয়েছে বেনামী ছায়া হয়ে।”

বিস্ফোরিত নয়নে চোখ তুলে তাকালো স্নিগ্ধা। এতক্ষণের নির্জীবতা কেটে গিয়ে তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে চরম বিস্ময়। সার্থক কিভাবে জানলো এইসব ঘটনা? সে তো কাউকেই শেয়ার করেনি এ ব্যাপারে। মনের ভুলেও কাওকে কিচ্ছু বলেনি সে। তবে কী সার্থক তাকে চেনে? এগুলো কী প্রী প্ল্যানড?

আচমকাই সার্থকের কলার চেপে ধরে স্নিগ্ধা। সার্থক চেয়ারে বসা অবস্থায় ছিল। স্নিগ্ধার কলার ধরতে সমস্যা হওয়ায় সার্থকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে সে। স্নিগ্ধা সার্থকের কাঁধ সমান। তাই এই অবস্থায় সবচেয়ে পারফেক্টভাবে ধরতে পেরেছে সে।

“মশকরা করিস আমার সাথে?”

“নাহ তো।”

“সত্যি করে বল, কারা কারা মিলে এই প্ল্যান বানিয়েছিস?”

“আমি আর একজন। মোট দুইজন মিলে।”

“লজ্জা করছেনা তোর? এভাবে অকপটে নিজের ভুলগুলো নিয়ে গর্ব করে বলতে!”

“লজ্জা করার মতো কোনো কারণ দেখছি না।”

“কারন দেখছিস না? আসলেই দেখতে পাচ্ছিস না? এটা কোনো মজা করার মতো বিষয়? আমার ইমোশন তোর কাছে মজা করার জিনিস। এতোদিন ভাবতাম আর কেউ না বুঝুক অন্তত তুই আমাকে খানিকটা হলেও বুঝিস। অন্যরা যখন আমার সাদাসিদে চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করার সুযোগ খোঁজে তুই অন্তত আমার পাশে থাকিস। কিন্তু আসলে মনে মনে এই চলছিল তোর? এভাবে, এভাবে আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলি তুই? বল কী চাইছিলি তুই? সবার সামনে আমার ইমোশন নিয়ে মজা লুটবি? আমাকে হেনস্থা করবি? বাহ সার্থক! বাহ! আমি তো এতদিন চিনতেই পারিনি তোকে।”

দীর্ঘসময় ধরে উচ্চশব্দে কথা বলে হাঁপাচ্ছে স্নিগ্ধা। থর থর করে কাঁপছে সারা শরীর। ফ্যানের তলায় থেকেও রাগের ফলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার পুরো মুখে। খানিকটা সময়ের জন্য থামলো সে। অতঃপর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো নিজেকে। লুকাতে চাইলো অনাকাঙ্খিতভাবে আগত অশ্রুকণাদের। আঁটকে দিতে চাইলো তাদের আঁখিপল্লব দিয়ে। কিন্তু তারা মানলো না সেসব বাঁধন। বাঁধহারা নদীর কূল কিনারা ছাপিয়ে আছড়ে পড়লো ঝর ঝর করে। সার্থক নির্বাক। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে।

ম্রিয়মাণ কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা বললো, “মানুষ ঠিকই বলে। পিছন থেকে আঘাত করা মানুষগুলো কখনও দূরের হয়না। বরং তারা কাছে পিঠে থেকেই সুযোগের সন্ধান করে। বাইরের মানুষ আঘাত করলে তো সরাসরি চোখে চোখ রেখে সামনে থেকেই করে।”

শ্রেষ্ঠার বুক কাঁপছে। কান্নায় ভেঙে আসছে ঠোঁট। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে সে। পাশের চেয়ার থেকে ব্যাগ উঠিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নেয় সে। অতঃপর পা বাড়ায় বের হওয়ার জন্য। আচমকা একজোড়া হাত বজ্রের বেজে এসে পেঁচিয়ে ধরে তার কোমর। অতঃপর টান দিয়ে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। স্নিগ্ধা জোর করে উঠে যেতে গেলে তাদের মাঝের দূরত্ব ঘুঁচে যায় আরও খানিকটা।

একে অপরের মুখোমুখী বসে আছে সার্থক আর স্নিগ্ধা। সার্থক এই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্নিগ্ধা অনেকটা সময় ছুটাছুটি করেও লাভ হয়নি। অগত্যা হার মেনে নিয়ে ঠাঁয় বসে আছে সেখানে। দুজনের কারোর মুখে রা টুকু নেই। যেটুকু শোনা যাচ্ছে তা হলো নিস্তব্দ পিনপতন নিরবতাযুক্ত লাইব্রেরির রুমে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ।

“তোমার নামে লিখেছি কতশত চিঠি। ওহে প্রিয়সী, দিও না গো এভাবে ফাঁকি।”

“সার্থক, এসব কী ধরনের ব্যবহার। মানছি তোরা এতদিন মজা করেছিস। কিন্তু আর নাহ।”

“কে বললো মজা করেছি? আমি বলেছি? এটাকে প্রেম করা বলে রে গাধী।”

“প্রেম?”

“হুম প্রেম। সেই প্রথমদিন থেকেই তোকে ভালো লেগে গিয়েছিলো। কিন্তু বাকিদের মতো আপডেটেড নাহ তুই। তাইতো এতটা সময় লেগে গেলো তোকে বোঝাতে।”

“দেখ, এসব মজা একদম ভালো লাগছে না।”

“হুস। বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রমাণ লাগবে? ওয়েট।”

অতঃপর একজোড়া রুক্ষ অধরে সম্পৃক্ত হলো একজোড়া নরম ভেজা অধর। দীর্ঘ এক চুমু শেষে দাঁত বের করে হাসলো সার্থক। সবকিছু স্নিগ্ধার মাথার উপর দিয়ে গেলো। এতক্ষন ঘটে যাওয়া একের পর এক কাহিনীগুলো মেলানোর পূর্ন চেষ্টা করে। অতঃপর বিষয়টা বোধগম্য হতেই বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় সে সার্থকের দিকে। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে সার্থক। এটুকুই যেনো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। তেড়ে গিয়ে তার বুকে ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি বসালো স্নিগ্ধা। একসময় নিজেই ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলো সে। স্নিগ্ধাকে বুকের সাথে চেপে ধরে সার্থক বিড়বিড় করে বললো,

“ভালোবাসি আমার বোকাফুলকে।”

লাজুক হাসে স্নিগ্ধা। অতঃপর কোমল কণ্ঠে বলে,
“আমিও ভালোবাসি সীমাহীন।”

১৭.

পড়ন্ত বিকেল। লেকের পাশে একটা বেঞ্চে বসে আছে দুজনে। সার্থকের কাঁধে স্নিগ্ধার মাথা। তার দুই হাত সার্থকের হাতের মাঝে বাঁধা। নানা বিষয়ে টুকিটাকি গল্প করতে করতে সময়টা উপভোগ করছে তারা। আচমকা সার্থকের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে মুখোমুখি বসে স্নিগ্ধা। কৌতূহল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

“তুমি আমাকে চিঠি দিতে আগে বলোনি কেনো?”

“লুকিয়ে থাকতে মন চেয়েছিলো তাই।”

“এতোদিন এভাবে লুকিয়ে ছিলে কেনো?”

স্নিগ্ধার বোকা বোকা প্রশ্নে হাসে সার্থক। বলে,

“আমি যদি সরাসরি তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতাম রাজি হতে?”

স্নিগ্ধার সোজাসাপ্টা উত্তর,” নাহ”

“এজন্যই। ঠিক এই কারণেই সরাসরি বলিনি তোমাকে। এইযে প্রথম প্রথম চিঠি লিখতাম। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার ব্যাগে রেখে দিতাম। তুমি প্রথম কয়েকদিন ফেলে দিতে, মনে আছে?”

“হুম”

“কিন্তু কিছুদিন পর থেকে তোমার আগ্রহ বাড়লো। ফেলার নাম করে চারপাশে তাকিয়ে ঝট করে ঢুকিয়ে দিতে ব্যাগের মধ্যে। এরপর প্রথম প্রথম হয়তো ততটা গুরুত্ব দিয়ে পড়তে না। এরপর আস্তে আস্তে তোমার আগ্রহ বাড়লো। রোজ অপেক্ষা করলে সেই কাঙ্খিত সময়ের। সেই চিঠির। এরপর কিছুদিন আমি আর চিঠি দিলাম না। তোমার মন খারাপ হলো। কৌতূহল হলো। নিরাশ হলে। আগের চেয়ে বেশী উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করলে চিঠির জন্য। এরপর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই চিঠি দিতে দেরি করলাম। এতে তোমার কৌতূহল আরও বাড়লো। সেই বাড়তে থাকা কৌতূহল অপেক্ষার সাথে মিলেমিশে ধীরে ধীরে রূপ নিলো নতুন এক অনুভূতির। যার নাম প্রেম।”

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৫

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৫
#ফিজা_সিদ্দিকী

শ্রেষ্ঠার উন্মুক্ত কোমরের উপর প্রবাহমান উত্তাল ঢেউ এর ন্যায় বিচরণ করছে আরাধ্যর হাত। প্রতিটা ঢেউ লোমহর্ষক, উত্তেজক। উত্তাল ঢেউগুলো টালমাটাল হয়ে আছড়ে পড়ছে যেন। শরীরের আদ্যোপান্ত জুড়ে বিচরণ করছে শিরশিরানি এক উন্মাদনা। কেউ যেনো বশ করে ফেলেছে শরীর। শুধুই কী শরীর? নাহ বরং দেহ, মন দুইই বশীভূত। প্রেমময় ছোঁয়া ছাড়া দেহ বশ্যতা স্বীকার করেনা এতো সহজে। লালসার খেলায় মোহ থাকেনা। না থাকে ভালোবাসা। যেটা থাকে তা হলো সর্বস্ব বিচরণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা।

“আরাধ্য!”

শ্রেষ্ঠার কণ্ঠে ক্লেশ। গলা কাঁপছে খানিক। অনুভূতির শিওরে অবস্থান করা অবস্থায় তার এহেন কণ্ঠে কেঁপে উঠলো আরাধ্যও। চোখে মুখে স্পষ্ট হলো অপরাধবোধ। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘটাতে যাওয়া অঘটনের জন্য দোষারোপ করতে লাগলো নিজেকে। নিখুঁদভাবে উপলব্ধি হলো নিজের ভুল। অস্বস্তির কাঁটার মতো খচখচ করে বাঁধতে লাগলো পরিস্থিতি। শ্রেষ্ঠা কী তাকে ভুল বুঝলো? শরীরী খেলায় মেতে ওঠা এক পুরুষ ভাবলো আবারও? এবার কী তবে আগের চেয়েও দূরে ঠেলে দেবে তাকে? মনের যাতনা বাড়তে লাগলো ক্রমশ। ইতিমধ্যে শ্রেষ্ঠার কোমর হতে তার হাত নেমে এসেছে। নিজেকে খানিক চরিত্রহীন বলেও আখ্যায়িত করার চেষ্টা করলো সে।

আরাধ্যকে অবাক করে দিয়ে তার দুই গালে হাত রাখলো শ্রেষ্ঠা। অতঃপর ম্লান হেসে বললো,

“শারীরিক ক্ষুধা আর ভালোবাসার স্পর্শের মাঝে পার্থক্য বোঝার বয়সটা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।”

এই একটা কথা। একটা কথাই এতক্ষণের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে একেকার করে দিলো যেনো। নিগুঢ় উত্তেজনায় আচমকা জড়িয়ে ধরলো শ্রেষ্ঠাকে। কোমর ধরে উঁচু করে মিশিয়ে নিলো তাকে বুকের সাথে। যেনো নরম এক টুকরো পেঁজা তুলো! অতঃপর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিশহিশিয়ে বললো,

“তবে কী বাকি রাতটা কেউ আমাকে ভালোবাসার সুযোগ দিচ্ছে! এমনিতেই তো তাকে এই রূপে দেখে আমি অর্ধেক শেষ। বাকিটা শেষ করার দায়িত্ব কী সে নেবে?”

লজ্জায় রাঙ্গা শ্রেষ্ঠা মাথা গুঁজে দিলো আরাধ্যর বুকে। এমনটা নয় যে সে চাইছে আরাধ্যকে নিজের কাছাকাছি। এতোটা কাছাকাছি যেখানে একে অপরের নিঃশ্বাসের সাথে সাথে সাথে শরীরের গন্ধও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক। কিন্তু এভাবে আরাধ্যকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তার নেই। প্রেম জিনিসটা তার জীবনে বহু কাঙ্ক্ষিত এক তপস্যার ফল। এই জীবনে কখনও প্রেমে পড়বে না বলেও সে পুরোদস্তুর আছড়ে পড়েছে আরাধ্যর প্রতি। আজ যদি আরাধ্য তার খুব কাছে আসে, আটকানোর সাধ্য নেই তার। তবে সে খুব করে চায় এতো তাড়াহুড়ো না করুক আরাধ্য। যখন মনটা স্বেচ্ছায় দিয়েছে, তবে শরীরটা পাওয়া তো খুব কঠিন নয়! অতঃপর আরাধ্যর কানের কাছে মুখ। ইয়ে গিয়ে ফিসফিস করে শ্রেষ্ঠা বললো,

“অপরাধবোধ থেকে যদি কারোর প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি জেগে উঠতে পারে। তবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। যতখানি গভীর ভরা পূর্ণিমায় উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ, ততখানি গভীর আমার ভালোবাসা।”

১৫.

ব্যালকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠা ভাবছে আরাধ্যর কথা। আসার পর থেকে আরাধ্যর সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই তার। সে ইচ্ছে করেই কোন যোগাযোগ রাখেনি আরাধ্যর সাথে। দুজনের একসাথে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতিচারণে অদ্ভুত এক উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে তার আদ্যোপান্ত জুড়ে। শীতল হয় দেহ, মন। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে, এমন তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভালোবাসা ভালো থাকে অনুভবে। ভালো রাখে মনোহর স্মৃতিতে। অসময়ের স্মৃতিচারনে চোখ ভিজে ওঠার মতো টুকরো টুকরো স্মৃতি কুড়িয়েছে সে।

আজ তিনদিন হলো দেশে ফিরেছে শ্রেষ্ঠা। এয়ারপোর্টে ঢোকার আগের মুহূর্তেই তাকে আচমকা পিছু ডাকে আরাধ্য। অতঃপর বজ্রবেগে আছড়ে পড়ে তার বুকে। আবদ্ধ করে ফেলে বাহুবন্ধনের ঘেরাজালে। শ্রেষ্ঠা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। একেবারে নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। যেনো কোনো অনুভূতিই ছুঁয়ে দিতে পারছে না তাকে। এভাবে কতোটা সময় পার হয়েছে জানা নেই। তবে বাহুবন্ধনী আলগা হতেই ঘোর কাটে শ্রেষ্ঠার। করুন কণ্ঠে বলে ওঠে,

“আমাকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন? এতোটা শক্ত করে ধরবেন যেনো মিশে যেতে পারি একে অপরের সাথে। আপনার ঘামের গন্ধটুকুও যেনো লেপ্টে থাকে আমার শরীরে আজীবনের জন্য।”

আরাধ্য তাই করলো। দুই বাহু দ্বারা শক্ত করে চেপে ধরে রাখলো তাকে। দুজনের চোখের কোল ঘেঁষে বইছে অঝোর ধারা। শ্রেষ্ঠার বুক ভেঙে কান্না আসছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে এটাই তাদের শেষ দেখা। আর কখনো তারা একে অপরের এতটা কাছাকাছি আসতে পারবে না। পাশাপশি থাকলেও দুজনের মাঝে থাকবে যোজন যোজন দূরত্ব। যাওয়ার আগে শ্রেষ্ঠা একটা সাদা আনকোরা খাম ধরিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“প্লেন টেক অফ করার পরে চিঠিটা পড়বেন। এরপর কোনো রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। ভালোবাসলেই কাছে পেতে হবে এমনটা কোথাও লেখা নেই। স্মৃতির পাতায় জীবন্ত থাকুক প্রেমময় কিছুটা সময়।”

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে শ্রেষ্ঠা ডুব দিল অতীতের নৃশংসতা ঘেরা এক অধ্যায়ে। এই অধ্যায় চাপা থাকার কথা ছিলো আজনম। যেখান রয়েছে দুঃখ ও দহনের যন্ত্রণা। নশ্বর পৃথিবীর কদাকার এক মূর্তির কাহিনী দাফন যেখানে। অন্ধকার ঘন জগৎ এর কুৎসিত এক রচনা। জরাজীর্ণ কিছু চরিত্রের বসবাসে এক দানবের ক্ষোভ নিঃসৃত ক্ষুদা।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, কলেজের পাশেই ভাড়া বাড়িতে থাকে স্নিগ্ধা। সাদামাটা ছিমছাম স্বভাবের স্নিগ্ধার সবচেয়ে স্ট্রং পয়েন্ট তার পড়াশোনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে আলাদা ভাড়া বাড়ি নিয়ে একা থাকার পথটা সহজ ছিল না তার জন্য। তবে মেধাবী হওয়ায় বেশ কিছু টিউশনির অফার আসে তার কাছে। সে সময়ে সবেমাত্র কলেজের শুরু। সেইসাথে নতুন জায়গা, নতুন দুনিয়া। চারিদিকের সবকিছু রঙচঙে। চোখের উপর যেনো রঙিন কোনো আস্তরণ। শ্রেষ্ঠার তখন সবেমাত্র দশম শ্রেণীর। তবে বয়সের তুলনায় একটু বেশিই পরিপক্ক সে। দুনিয়ার জটিলতা, কুটিলতা খুব সহজে ধরে নেওয়ার ক্ষমতা যেনো ঈশ্বরপ্রাপ্ত। অথচ তার চেয়ে চার বছরের বড়ো হয়েও স্নিগ্ধা এসব ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞাত। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা বাকি মেয়েদের সাথে তার যায়না একদমই। তার বেশিরভাগ সময়টা কাটে পড়াশোনা নিয়েই। কখনও নিজের পড়াশোনা তো কখনো টিউশনির বাচ্চাদের। মাত্র দুটো টিউশনি নিয়েই নিজের খরচ ওঠানোর মতো টাকা জোগাড় হয়ে যেতো তার। তাই অতিরিক্ত টিউশনির বদলে সেই সময়টায় নিজের পড়াশোনার কাজে লাগিয়ে বরাবরের মতো সবার থেকে এগিয়েই থাকতো সে।

সময়ের গতিবিধির তাড়নায় নতুন শহর হয়ে উঠলো পুরোনো। জমে উঠলো একজোট হয়ে বন্ধুবান্ধবের আড্ডা। তাদের গ্রুপের সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় সদস্য ছিলো স্নিগ্ধা। চুপচাপ, গম্ভীর, লাজুক। এই নিয়ে অনেকে অনেক সময় নানান ঠাট্টাও করতো তাকে নিয়ে। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে একজন সবসময় আগলে রাখতো তাকে। তার ছোটো ছোটো প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা সার্থক নামের ছেলেটা ছিলো তাদেরই গ্রুপের সদস্য। যাকে যে কোনো সময়, যে কোনো বিপদে আগে খুঁজে পেতো স্নিগ্ধা। সকলের ঠাট্টা তামাশা উপচে ছিলো যার ভরসার হাত।

রোজকার মতো আজও কলেজ থেকে ফিরে বইগুলো ওলোট পালোট করে চেক করলো স্নিগ্ধা। নির্দিষ্ট এক বইয়ের মাঝে থাকা ছোটো চিরকুট খানা দেখে আপনা আপনি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠলো তার। বিগত দুই সপ্তাহ ধরে এমনটা প্রায়ই হচ্ছে। চিরকুটে খুব বেশি কিছু লেখা থাকে না। শুধু গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থাকে কয়েকটা শব্দ। এটুকুতেই কম্পন শুরু হয় তার বুকে। থেমে থেমে আসে হৃদস্পন্দন। ওলোট পালোট হয়ে যায় অনুভূতির পসরা। তবে আজকের চিরকুটটার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছে সে। গুনে গুনে চারটে দিন পরে চিরকুট দিয়েছে সে। আচ্ছা, মাঝের এই দিনগুলোতে সে কেনো চিরকুট দিলো না? সে কী অসুস্থ ছিলো? নাকি তাকে লেখা চিরকুটগুলো ছিলো কেবলই তার অবসর সময়ের নশ্বর এক কাজ? কী ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে ছিলো সে, তা কী জানে সে? সে কী আদৌ জানে, কতোখানি অস্থিরতায় নিমগ্ন ছিলো তার দিনগুলো?

“অপেক্ষার প্রহর যদি প্রেমের তৃষ্ণা জাগায়, তবে এই অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হোক। কেউ একজন তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো চেয়ে থাকুক এই পথের পানে।”

স্নিগ্ধার বুক কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। অনুভূতিগুলো একসাথে জটলা পাকিয়ে বিবশ করে ফেলছে তার দেহ, মন। এই এতটুকু একখানি চিরকুট তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অন্য এক জগতে। যে জগতে নেই কোনো ছলনা। নেই কোনো মিথ্যা রাখঢাক। যা আছে তা হলো আবেগ ও মোহমায়ায় নিমজ্জিত কিছু রং বেরংয়ের চিরকুট, তাতে লেখা প্রেমময় শব্দ। চারপাশের অন্ধকার ছাপিয়ে উড়ে বেড়ানো এক ঝাঁক জোনাক পোকা। আর রং বেরং এর ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো কিছু প্রজাপতির দল।

#চলবে?

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০৪

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৪

“পুরনো কলিগ” কথাটা শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল আরাধ্য। কিছুক্ষণ আগে উদয় হওয়া ভালো লাগার উত্তাল ঢেউ মিলিয়ে গেল ভাটা রূপে। তোলপাড় করতে থাকা অনুভূতির রেশ পরিণত হলো চোরাবালিতে। অনুভূতি শুন্য চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকালো সে শ্রেষ্ঠার দিকে। অতঃপর হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রাগ হচ্ছে আরাধ্যর। ভীষণ পরিমাণের রাগ। এতগুলো দিন পরে হুট করেই এতখানি রাগ হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। শুধু এটুকু জানে এই মুহূর্তে সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়ার মত রাগ হচ্ছে তার। বিষাক্ত লাগছে সবকিছু।

১৪.

অতিরিক্ত রাগের বসে কাল শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও হোটেল থেকে লাগেজগুলো নেওয়া হয়নি। রাগে জেদে একপ্রকার অন্ধের মতো ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরেছে সে। ভয়ে তটস্থ হওয়া শ্রেষ্ঠার কাঁচুমাচু করা মুখটাও তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। এতগুলো মাস, এতুগুলো দিন তো কোনো অপেক্ষা করেনি সে। বরং তার নাগালের বাইরে কিছু চেয়ে ফেলেছিলো, একথা ভেবেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু আজ এতটা কাছাকাছি থেকেও না থাকার বেদনা অসহনীয়। রাগে অন্ধের মতো লাগছে নিজেকে। বাড়ি ফিরে শ্রেষ্ঠাও আর কোনো কথা বলেনি। নিজের মতোই একেবারে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলো। বাকি রাত টুকু আরাধ্যর টি শার্ট আর ট্রাউজার পরে কাটাতে হয় তাকে। যদিও এ ব্যাপারে কিছুই আরাধ্য জানতো না। বাড়িতে ঢুকেই তার পাশের রুমটা খুলে দিয়ে পায়ে গট গট শব্দ তুলে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় আরাধ্য। রুমের মধ্যে আরাধ্যর বেশ কয়েক জোড়া কাপড় রাখা দেখে, সেখান থেকেই একটা উঠিয়ে পরে নেয় শ্রেষ্ঠা। এরপর থেকে আর আরাধ্যর মুখোমুখি হওয়া হয়নি তার।

রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে খিদের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিলো শ্রেষ্ঠার। অগত্যা রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই চোখ পড়ে টেবিলে ঢাকা দেওয়া খাবারের দিকে। হালকা হেসে খাবারটা শেষ করে শান্তির ঘুম দেয় সে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা রেডি করে আরাধ্য। বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার আছে। নিজে নাস্তা করে বাকিটুকু চাপা দিয়ে আরাধ্য বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে। তখন ঘুমে বুঁদ শ্রেষ্ঠা। জেদ থেকে হোক বা ভালোবাসা, শ্রেষ্ঠাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি আরাধ্যর। তাই রোজকার মতোই বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।

“আমার জন্য একটা শাড়ী কিনে পাঠাতে পারবেন, প্লিজ!”

গোটা এক বছর পর চিরচেনা সেই নম্বর থেকে আসা মেসেজটা দেখে রাগের মাত্রা খানিকটা থিতিয়ে যায়। কিন্তু এতো সহজে গলে যাওয়ার ছেলে আরাধ্য নয়। তাই শ্রেষ্ঠার মেসেজের কোনোরূপ রিপ্লাই না করেই সাথে সাথে টেক্সট পাঠালো ইরাকে।

“একটা কালো রঙের কাতান শাড়ি মার্কেট থেকে কিনে আমার ফ্ল্যাটে দিতে এসো একটু। সাথে মেয়েলি যা যা লাগে সব।”

এমন অসময়ে আরাধ্যর মেসেজ পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে ওঠে ইরা। খুশিতে বেডে শুয়ে গড়াগড়ি করে এরপর টেক্সটা ওপেন করতেই এতক্ষণের হাসিখুশি মুখটা চুপসে যায় বেলুনের মতো। চোখের কোণে জমা হয় জলরাশি। নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে রিপ্লাই করে,

“তোমার ফ্ল্যাটে মেয়ে?”

“হ্যা। ইন্ডিয়া থেকে একজন কলিগ এসেছে। পরিচিত আমার। আর সেই সাথে আমাদের কোম্পানির কাজেই এসেছে। তাই কিছুদিন থাকবে। ”

কথাটুকু শুনে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শ্রেষ্ঠা। বুকের উপর থেকে বড়ো একটা পাথর যেনো নেমে গেলো। অতঃপর উৎফুল্লচিত্তে সাথে সাথে বের হয়ে গেলো মার্কেটের উদ্দেশ্যে। সুন্দর একটা শাড়ি, সেই সাথে ম্যাচিং ব্লাউস আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এসে নক করলো আরাধ্যর ফ্ল্যাটের দরজায়। ইরাকে দেখে প্রথমে খানিকটা বিচলিত হলেও অপরিচিত দেশে আরাধ্যর পরিচিত একজনকে পেয়ে পরবর্তীতে অনেক খুশি হলো শ্রেষ্ঠা। কথায় কথায় তার আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার বাহানায় দুজনের বের হলো মার্কেটে। মার্কেট ঘুরে বেশ কিছু জিনিস কিনে বিকালের মধ্যেই বাড়িতে ফিরে এলো দুজনে। কিন্তু ফেরার পথে তেমন একটা কথা হলোনা ইরার সাথে। মেয়েটাকে একেবারে অন্যরকম লাগছিলো। মন খারাপ নাকি কিছু ঘটেছে বুঝে উঠতে পারলো না শ্রেষ্ঠা। যেহেতু সেভাবে পরিচয় নেই, তাই আর জিজ্ঞাসা করার সাহসও পেলো না সে। অতঃপর ইরাকে বিদায় নিয়ে ঢুকে পড়লো ফ্ল্যাটে। কিন্তু ইরা তার বিদায়ের অপেক্ষা না করেই উল্টোপথে হেঁটে চলে গেলো নিজের ফ্ল্যাটে। বিষয়টাতে খারাপ লাগলেও পাত্তা দিলো না শ্রেষ্ঠা। অতঃপর লেগে পড়লো নিজের কাজে।

সময়টা সন্ধ্যার। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে আরাধ্য। সিগনালে আঁটকে পড়েছে গাড়ি। রাস্তার পাশে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো সুন্দরী একজন মহিলা ফুল বিক্রি করছেন। হরেক রকম ফুলের বুকে থেকে শুরু করে নানা রঙের গোলাপ ও জানা অজানা বিভিন্ন ফুলের সমাহার সেখানে। হুট করেই কেনো যেনো ভীষণ লোভ হলো আরাধ্যর। গাড়ি সাইড করে নিজেও কিনে ফেললো কয়েকটা ফুল। যেটা সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সেটা হলো কালো রঙের গোলাপ। একপিস কালো গোলাপের সাথে কিছু টিউলিপ ফুলও নিলো সে। অতঃপর আবারো রওনা দিলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় যেতে যেতে ভাবতে লাগলো ফুলগুলো কী করবে সে! অনেক ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিলো ফ্লাওয়ার ভাসের আর্টিফিশিয়াল ফুলগুলো সরিয়ে টাটকা ফুলগুলো রেখে দিলে বেশ সুন্দর স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ তৈরি হবে।

বেশ অনেকটা সময় ধরে কলিংবেল বাজানোর পরও কেউ দরজা খুলছে না। ইতিমধ্যে মনের মাঝে ভয়েরা উঁকি দিতে শুরু করেছে। চিন্তা হচ্ছে শ্রেষ্ঠার জন্য। অচেনা দেশে এসে কোথাও হারিয়ে গেলো না তো! নাকি খারাপ কিছু! না না আর ভাবতে পারছে না সে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভয়ের চোটে রীতিমত ঘামছে সে। হটাৎ দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে তার খেয়াল হলো দরজা খোলা। ভয়ের মাত্রা এবার বাড়লো বৈ কমলো না। দ্রুত দরজা খুলে ভেতরটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছাদিত অবস্থায় পেয়ে বুকটা ছ্যাত করে উঠলো তার। অযাচিত চিন্তাগুলো তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই ক্রমাগত আঘাত করছে তাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

রুমের দরজা হালকা খোলা। ভেতর থেকে হালকা আলো ভেসে আসছে। তারাহুরো করে দরজা খুলতেই প্রথমেই চোখে পড়ে শ্রেষ্ঠাকে। উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে যেনো। আরাধ্য দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে ধরে তাকে। আচমকা এহেন আক্রমনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আরাধ্যর বুকে মাথা রাখে শ্রেষ্ঠা। তীব্রগতিতে ওঠানামা করা বুকের অবস্থা বুঝতে পেরে মাথা তুলে কিছু বলতে গেলে বামহাত দিয়ে তার মাথা আবারও বুকের সাথে চেপে ধরে আরাধ্য।
“একটু থাকো প্লিজ!”
শ্রেষ্ঠাও বাধ্য মেয়ের মতো চুপটি করে গুনতে থেকে তার হৃদস্পন্দন। প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেনো আরাধ্য!

নিজের অবস্থান সম্পর্কে খেয়াল হতেই শ্রেষ্ঠাকে ছেড়ে দূরে সরে যায় আরাধ্য। মাথা নীচু করে আমতা আমতা করে বলে,

“সরি। আসলে দরজা খোলা আর এভাবে রুম অন্ধকার দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম অনেক। উত্তেজনায় কী থেকে কী করে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। আই অ্যাম সরি।”

একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকালে আরাধ্য বুঝতে পারতো শ্রেষ্ঠার ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি। কিন্তু এমন কিছুই হলোনা। বরং নত শিরে সে বের হয়ে যেতে গেলো রুম থেকে। আচমকা মুখের সামনে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চমকে সামনে তাকায় আরাধ্য। দরজা বন্ধ করে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেষ্ঠা। এতক্ষণে প্রথমবারের মতো তাকে খেয়াল করলো আরাধ্য। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষন আগে গোসল করেছে। চুলগুলো হালকা ভেজা। পরনে কালো শাড়ি, সাথে সাদা শরীরে লেপ্টে থাকা কালো ব্লাউজ। কী অসম্ভব রকম আকর্ষণীয় লাগছে তাকে, সে কী জানে? জানলে কী এভাবে তার সামনে আসতো? নাকি জেনে শুনেই এসেছে সে? ইচ্ছে করেই তাকে আকর্ষণ অনুভব করাতে চাইছে কি? শ্রেষ্ঠার চোখে চোখ পড়তেই আরও একবার হারিয়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। পাশ কাটিয়ে বের হতে যেতে গেলে আচমকা সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে শ্রেষ্ঠা। বুকে মাথা রেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে,

“কেনো ভালোবাসেন আমাকে?”

“জানা নেই।”

“অকারনে কিছু হয়না। অবশ্যই তার পিছনে কিছু কারন থাকে।”

“হয়তো আছে। তবে আমার জানা নেই। কারন সেই কারণগুলো কখনও খোঁজার চেষ্টা করিনি।”

“কেনো চেষ্টা করেননি?”

“প্রয়োজন মনে করিনি।”

“আমি এক বাচ্চার মা। এরপরও কারো অনুভূতি থাকতে পারে আমার প্রতি?”

“মা হওয়া খারাপ কিছু নাহ। ”

“আপনি চাইলে অনেক সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করতে পারতেন। যারা আমার মতো সেকেন্ড হ্যান্ড হতো না।”

“সেকেন্ড হ্যান্ড! ওয়াও! নিজেকে নিয়ে এতো দারুণ ব্যাখ্যা করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? আপনি কী জানেন আপনি মেন্টালি সিক? সাইকোলজিস্ট দেখান। আপনার মানসিক সমস্যা আছে।”

“জানি। ডক্টর দেখিয়েছিল। ডক্টর কী বললো জানেন?”

“নাহ”

“কেউ একজন আমার অভাবে দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমিও পুড়ছি যন্ত্রণায়। দুটো মন দূরে, বহুদূরে, তবুও জ্বলছে তারা দুজনেই। এই রোগের ওষুধ শুধুই সে, যে এই রোগের কারন। তার শুন্য বুকে মাথা রাখলেই নাকি যন্ত্রণা কমে যাবে। হাহাকার গুলো নাম লেখাবে প্রাপ্তির খাতায়। নব্য অনুভূতিরা খেলা করবে মনের আঙিনায়। আমাকে সুস্থ হতে গেলে তার মাঝে আমার আমিকে জাগিয়ে রাখতে হবে।”

“তো আমাকে ছাড়ুন। একবার তার কাছে যান।”

“আমার সে, আমার খুব কাছেই আছে। তাইতো এতো সুস্থ। জানেন, হুট করেই পেয়ে গেছি তাকে। একেবারে অনাকাঙ্খিতভাবে। এই দেশ আমার জন্য এতখানি চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে জানলে আগেই পাড়ি জমাতাম।”

ঠোঁট কামড়ে হাসলো আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার ইঙ্গিত বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে সে। কিন্তু সরাসরি তার মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত নিস্তার নেই।

“যদি এতদিনে তার জীবনে নতুন করে কেউ এসে যায়? যন্ত্রণার একটা বছরে যদি সে নতুন এক আশ্রয় খুঁজে নেয় প্রশান্তির জন্য?”

হুট করেই অমাবস্যা নেমে এলো শ্রেষ্ঠার চোখে মুখে। হাতের বাঁধন আলগা হলোও সামান্য। অতঃপর কণ্ঠে খাদে ফেলে বললো,

“এলেও আসতে পারে। আসাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসের জন্য একটা বছর অপেক্ষা! ব্যাপারটা আসলেই বোকামি। হয়তো সে এতো বোকা নয়। শুধু সে কেনো, দুনিয়ার কেউই এমন বোকা নাহ। তবে সে নতুন আশ্রয় খুঁজে নিলে বরং আমি বেশি খুশি হবো। পুরানো জিনিস, ইউজড জিনিস, এগুলোর জন্য কেউ এতো মায়া দেখায় না। মায়া যতো সবতো নতুন জিনিসের।….”

শ্রেষ্ঠা পরবর্তীতে কিছু বলার আগেই দুইহাত দিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো আরাধ্য। হিশহিশিয়ে বললো,

“এই মুহূর্তে আমার ঠোঁট দিয়ে আপনার ঠোঁট বন্ধ করাতে না চাইলে ওই ঠোঁট নিজে থেকেই বন্ধ করুন। নইলে তারা একে অপরের স্পর্শ পেতে কিন্তু বেশ উদগ্রীব।”

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৩

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৩

“হেই বেবস! এতো মনমরা কেনো আজকের দিনে? চলো ক্লাবে যাই।”

“ইরা, তোমাকে কতোবার বলেছি এসব নামে ডাকবে না আমাকে। আমার একটা নাম আছে। একান্তই নাম নিতে ইচ্ছে না করলে বাকিদের মতো এরাদ বলবে।”

“কাম অন, এক বছর হয়ে গেলো আমাদের ফ্রেন্ডশীপের। অথচ তুমি সেই আগের মতোই টিপিক্যাল বিহেভ করো। হুয়াই?”

“ইরা, আমার ভালো লাগছে না। আজকের দিনে একা থাকতে চাই।”

“হুয়াট রাবিশ! এসব টিপিক্যাল বাঙালি নাম আমার ভালো লাগে না তুমি জানো। অ্যারাস নাম আমার।”

“ভুলে যেওনা তুমি নিজেও একজন বাঙালি। বাবা মায়ের ভালোবাসার দেওয়া নাম ইরা। বাঙালির রক্ত তোমার শরীরে। এসব ক্লাব, পার্টি করে উড়নচণ্ডীর মতো ঘুরে বেড়ানো, এসব বাঙালি কালচার নয়। আর আমি তোমাকে ইরা নামেই ডাকবো। পছন্দ না হলে দরজাটা ওদিকে আছে।”

চুপসে গেলো ইরা। ছেলেটাকে মনে মনে ভালোবাসে সে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারেনি আজও। সবসময় রুড বিহেভ করা মানুষটার উপরেই কিভাবে যেনো সে ঝুঁকে পড়লো নিজের অজান্তেই। অথচ মানুষটা একবারের জন্যও তার সাথে মিষ্টিমুখে কথা পর্যন্ত বলেনি। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিতে খুঁটিতে দেখে ইরা। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী সে। সাদা মসৃণ ত্বকের কোথাও সামান্যতম দাগ নেই। যাকে এক দেখায় পছন্দ হয়ে যাবে যে কোনো ছেলের। অথচ এই একটা মানুষের সামনে তার সমস্ত রূপ সৌন্দর্য্য ফিকে লাগে। কারন সে তো ঘুরেও তাকায়না তার দিকে।

কানাডার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আরাধ্য। আজকের এই দিনটা ভীষণ পোড়াচ্ছে তাকে। বাকি দিনগুলো যে স্বাভাবিকভাবে কাটে এমনটা নয়। কিন্তু আজকে দিনটা একটু বেশিই বিষন্ন লাগছে। বিষাক্ত লাগছে সবকিছু। ভালবাসার সাথে অভিমানগুলোও আজও জীবন্ত। বরং দিনে দিনে সময়ের কালক্ষেপে আরও বেড়েছে। শ্রেষ্ঠাকে সে ভুলতে পারেনি আজও। তার আত্মার সাথে যেনো মিশে গেছে সে। সেদিন রাতের এতো কাছাকাছি আসা, শ্রেষ্ঠাকে এতো কাছ থেকে দেখা, তার প্রথম চুম্বন, প্রথম বারের মতো ছুঁয়ে দেওয়া, সবকিছুই কী ভীষণ রকম জীবন্ত। একটা বছর কেটে গেছে। ব্যস্ততায় পুরোটা দিন বুঁদ থাকে আরাধ্য। তবুও মস্তিষ্কে একটা মানুষ থেকেই গেছে। যাকে দেখার অনুমতি না থাকলেও ভালোবাসায় কোনো বাধা নিষেধ নেই।

সেদিনের ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় দেশ ছেড়ে আবারও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলো আরাধ্য। যে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য বাধ্য হয়ে নিজের দেশে ফিরতে হয়েছিলো তাকে, আজ তারই বিরহে দেশ ছাড়লো সে। জীবন কী ভীষণ রকম অদ্ভুত।

১৩.
ইন্ডিয়া থেকে বেশ কিছু মানুষ আজ কানাডায় এসেছে। মূলত অফিসিয়াল কিছু চুক্তিপত্রের কাজেই পাঠানো হয়েছে তাদের। তাদের হোটেল বুক করা থেকে শুরু করে মিটিং ম্যানেজ সবকিছুর দায়িত্ত্ব পড়েছে মিষ্টার হেনরির উপর। ইন্ডিয়ান কোম্পানি শুনেই আরাধ্যর চোখের সামনে ভেসে উঠলো শ্রেষ্ঠার মুখবয়ব। কিন্তু আদৌ কী তা সম্ভব? শ্রেষ্ঠার দেখা কী সে এজনমে পাবে? হয়তো নাহ। আবার হয়তো পেলেও পেতে পারে। শুনেছে দুনিয়াটা গোল। তাই কোনো এক ক্ষণে আবার দেখা হলেও হতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো আরাধ্য। ইতিমধ্যে কেবিনের দরজায় নক করছে কেউ।

“স্যার মিটিংরুমে আপনাকে ডাকছেন। ”

“আমাকে কেনো? আজকে তো ইন্ডিয়ান ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং ছিলো। মিস্টার হেনরি আসেননি?”

“না না স্যার। আসলে আপনি নিজেও তো ইন্ডিয়ান। তাই স্যার আপনাকেও মিটিংয়ে জয়েন করার জন্য বললেন। ”

বিরক্ত হয় আরাধ্য। নিজেকে কেমন যেনো শো পিস লাগে। তাকে যেখানে ডাকবে যেতে হবে নাকি? চোখে মুখে হাজারও বিরক্তি নিয়েই মিটিং রুমে প্রবেশ করলো সে। মুখে লম্বা একটা হাসির রেখা টেনে সামনে তাকাতেই বড়ো রকমের ধাক্কা খেলো। চমকের তীব্রতা এতটা বেশি ছিলো যে কয়েক কদম পিছিয়েও গেলো সে। শ্বাস প্রশ্বাস ওঠানামা করছে তীব্র গতিতে। আচমকা আরাধ্যর এমন পরিবর্তনে মিটিং রুমের সবার দৃষ্টি তার দিকেই। এভাবে সকলের তাকানো দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়লো সে। অতঃপর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। পুরো একটা বছর পর আবারও দেখছে সে শ্রেষ্ঠাকে। একই দিনে আবারো তাদের দেখা। বুকের ভিতর তীব্র জ্বালাপোড়া টের পাচ্ছে। ভেতরে কেউ যেনো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে।

সাদা ঠাই গ্লাসের এপার ওপার স্পষ্ট। ছয়তলার উপর থেকে নিচের দিকে তাকালে মানুষগুলোকে অনেক ছোটো ছোটো দেখাচ্ছে। যেনো ইঁদুর ছানার মতো বিচরণ করছে কোলাহল মুক্ত, সুষ্ঠ পরিমার্জিত রাস্তায়। আরাধ্যর ডানহাতে কফির কাপ। বামহাত পকেটের মধ্যে বন্দী। গভীর কিছু চিন্তায় মগ্ন হয়ে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে। দৃষ্টি নীচে রাস্তার দিকে নিমগ্ন হলেও মস্তিষ্কে চলছে অন্যকিছু। আচমকা পিছন থেকে একজোড়া হাতের জাপ্টে ধরার আভাসে হকচকিয়ে যায় আরাধ্য। বিদেশে এগুলো স্বাভাবিক হলেও অফিসের সবাই জানে আরাধ্যর এসব একদমই অপছন্দের। তাই তার সাথে ভুলেও কেউ এমন ধরনের কিছু করার সাহস পায়না। বিরক্তির সাথে সাথে রাগটাও দপদপ করে বাড়তে লাগলো তার। মেয়েটার দুইহাত তার বুকের উপর রাখা। আচমকা কফির কাপটা পাশের টেবিলে রেখে হাত ধরে টান দিয়ে সামনের ঠাই গ্লাসের সাথে চেপে ধরে তাকে। হকচকিয়ে যায় মেয়েটা। সাথে উচ্চারিত হয় ব্যাথাতুর কিছু শব্দ। আরাধ্যর ডান হাত তার গলায় বেড় দিয়ে ধরা। যেনো আর একটু হলেই গলা চেপে ধরবে।

শ্রেষ্ঠা! শ্রেষ্ঠা তাকে এভাবে ছুঁয়েছে! ভাবতেই উত্তেজনায় সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে আরাধ্যর। হাতটা আপনাআপনি গলা থেকে সরে যায়। চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিতে গিয়েও সরিয়ে নেয় হাত। শুধু এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে শ্রেষ্ঠার দিকে। আগের উজ্জ্বলতা আর নেই। চোখের নীচে জমা হয়েছে অনেক নির্ঘুম রাতের নিদর্শন। চেহারায় মলিনত্বের ছাপ। আরাধ্যকে নিশ্চুপ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা প্রশ্ন করে,

“মে আই?”

সম্মতি ফিরলো আরাধ্যর। শ্রেষ্ঠা হয়তো চেয়ারে বসার জন্য অনুমতি নিচ্ছে। একথা ভেবে মাথা নাড়ায় আরাধ্য। কিন্তু পরক্ষনেই আরাধ্যকে অবাক করে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে শ্রেষ্ঠা। হকচকিয়ে যায় আরাধ্য। এমন কিছু হতে পারে সে কল্পনায়ও ভাবেনি। তবে কল্পনাতীত কিছু পাওয়াতে যে এতো সুখ, তা আজ বেশ অনুভব করছে। এতদিনের জমা হওয়া অভিমানের পাহাড় ধুয়ে মুছে যাচ্ছে কারো চোখের জলে।

“শ্রেষ্ঠা, কী হয়েছে? এমন পাগলামী করছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?”

“উহু। এতোদিন খারাপ ছিলো। আজ তো ভালো হওয়ার পালা।”

“তুমি অসুস্থ ছিলে এতোদিন?”

“হুম। মানসিক অসুস্থতায় চুবিয়ে রেখে এসেছিলো কেউ। কেউ একজন ইচ্ছে করে অনুতাপের আগুনে ঝলসে যাওয়ার জন্য রেখে এসেছিলো।”

“ঝলসে গেছো?”

“শুধু ঝলসে যাইনি, অনুতাপের তীব্রতা তাকে আমার মনে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছে।”

“মানে?”

“কিছুনা”

“শ্রেষ্ঠা বলো!”

“নাহ”

আরাধ্য শ্রেষ্ঠার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করলো। বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে মুছিয়ে দিলো গালে লেপ্টে থাকা অস্রুকনা। অতঃপর তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় কোমল অথচ অসহায় গলায় বলে উঠলো,

“একটা বছর। সময়টা অনেক বেশি। তাও নিজেকে সামলে নিয়েছি। তোমাদের থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। সেদিনের পর থেকে আর কখনো মুখোমুখি হইনি তোমার। অথচ আমার ভেতরটা কতখানি পুড়েছে, তার সাক্ষী আমার নির্ঘুম রাত। একলা রাতের আকাশ। অনেক তো হলো অপেক্ষা। এবার কী অবসান হতে পারেনা সবকিছুর? এতো কাছে পেয়েও তোমাকে না পেলে এই আক্ষেপ যে আমাকে বাঁচতে দেবে না। একবার অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি। পরেরবার কিন্তু পারবো না। মরেই যাবো আমি।”

কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আরাধ্যর থেকে দূরে সরে যায় শ্রেষ্ঠা। অতঃপর চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

“অচেনা শহরে পুরোনো কলিগ থাকতে কষ্ট করে হোটেলে উঠতে যাবো কেনো? কাজ শেষ করে জলদি বাড়িতে চলো। যাওয়ার সময় হোটেল থেকে লাগেজগুলো পিক আপ করে নেবো।”

“মানে?”

“এখানে এতো মানে মানে করার কী আছে? কয়েকদিনের জন্য এসেছি কানাডা ঘুরে দেখাবে। তোমার বাড়িতে রেখে আদর আপ্যায়ন করবে ব্যাস। এটুকু অতিথী সেবা তো করাই যায়। আফটার অল পুরোনো কলিগ বলে কথা।”

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০২

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২

আরাধ্যর কোমর জড়িয়ে উষ্ণতা পাওয়ার আশায় আরও খানিকটা তার দিকে সরে এলো শ্রেষ্ঠা। একই বিছানায় পাশাপাশি দুটো দেহ। ঠিক পাশাপাশি নয় বরং ঘেঁষাঘেঁসি। একে অপরের শরীরের উষ্ণতা মাপার জন্য যথেষ্ট যে দূরত্ব, এতটাই দূরত্ব তাদের মাঝে। শরীর সারা দেয় মনের আগে। অথচ আরাধ্যর মন তো সেই কবেই সাড়া দিয়ে ফেলেছে! শ্রেষ্ঠার ঊষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার বুকে। শিরশিরানি ধরে যাচ্ছে পুরো শরীরে। দুইচোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সে। অতঃপর নিজেকে নিয়ন্ত্রনে এনে সরে যায় বেডের কিনারার দিকে।
রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে ক্ষীণ আলো দেখা দিয়েছে আকাশে। অথচ আরাধ্যর চোখে ঘুম নেই। এক হাত গালে ঠেকিয়ে ব্যাস্ত সে প্রেয়সীকে দেখতে। ভেজা চুলগুলো শুকিয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ছে শ্রেষ্ঠার চোখে মুছে। ঘুমের মাঝেই নড়ে চড়ে ওঠে সে। আলতো হাতে শ্রেষ্ঠার চোখ মুখে পড়া ছয় চুলগুলো সরিয়ে দেয় আরাধ্য। এতোটা কাছ থেকে এই প্রথম দেখছে সে শ্রেষ্ঠাকে। মসৃণ ত্বক, গোলাপী ঠোঁট সবকিছুই যেনো বিশেষভাবে টানছে তাকে। অন্য এক ঘোরের মধ্যে চলে যায় আরাধ্য। বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে স্লাইড করতে থাকে আরাধ্যর কোমল মসৃণ ত্বকে। ড্রিম লাইটের আলোতে তাকে কী ভীষণ রকম রূপসী লাগছে! সে কী আসলেই নজরকাড়া সুন্দরী নাকি শুধু তার এমন লাগে? দেখলেই ঘোর লেগে যায় যেনো! বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না সেদিকে। শ্রেষ্ঠার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নিজের অজান্তে আরাধ্য ঠোঁট ছোঁয়ালো তার কপালে। গাঢ় এক চুম্বন এঁকে দিলো সেখানে। একে একে বেশ কয়েকটা চুমু খেলো তার চুলের ভাঁজেও। অতঃপর আগের মতোই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্তিতে ঘুম নেমে এলো তার চোখে।
রাতের ঘটনা ভাবতে ভাবতেই আরাধ্যর মনে পড়লো শ্রেষ্ঠার শরীরে লেগে থাকা রক্ত আর তার কাটা হাতের কথা। হাতের কব্জির কাছে বেশ অনেকখানি কেটে গিয়েছে। সচরাচর এমন জায়গায় কাটার কথা তো নয়। দেখে মনে হচ্ছিল যেনো আচমকা পিছন থেকে আক্রমন করেছে কেউ। কিন্তু কে করবে এমন? আর কেনোই বা করবে? আবার তার ধরনা ভুলও হতে পারে। হয়তো একটু বেশি বেশিই ভাবছে সে শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে। কিন্তু আজকের পর থেকে যে তাকে নিয়ে ভাবার অনুমতি রইলো না আর! হুট করেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে যেনো তার বসবাস!

১১.
সময়ের স্রোতে একটা বছর পেরিয়েছে। সেদিন এক কাপড়েই ফ্ল্যাট ছেড়েছিলো শ্রেষ্ঠা। দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজেকে করেছিলো রুম বন্দী। অফিস থেকে আসা লাগাতার কলগুলো শেষ পর্যন্ত যখন আর অগ্রাহ্য করা গেলো না, রুম থেকে বের হলো সে। একটা রোবটের মতোই বাড়ি থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ি, এভাবেই চলছিল জীবন। শিমূলের মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু আদিল সাহেব বরাবরই শান্ত মেজাজের মানুষ। হুটহাট কিছু করে বসা ব্যাপারটা তার ধাঁচে নেই। তাই তিনি স্ত্রীকে বোঝান, যেনো শ্রেষ্ঠাকে সময় দেওয়া হয়। সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে সে নাহ। কিন্তু মায়ের মন মানতে নারাজ। হুট করে মেয়েটার মূর্ছা যাওয়া চেহারা তার বুকে গিয়ে বিঁধছে। শ্রেয়া বেশ অনেকটা সময় মায়ের সান্নিধ্য পায়নি। নানা নানুর কাছেই থাকতো। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো শ্রেষ্ঠা। আবারও আগের মতো পুরোদমে জীবন শুরু করতে গিয়ে বুঝতে পারলো অনেককিছুই ফেলে এসেছে আগের ফ্ল্যাটে। একবার ওখানে যাওয়া দরকার। আবার বাড়ি থেকে অফিস করতে অনেক সমস্যাও হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো নতুন কোনো ফ্ল্যাটে উঠবে।
আরাধ্যর মুখোমুখি হওয়ার কোনরকম ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও গেটের চাবি ঘোরানোর সময় একবার সেদিকে তাকালো শ্রেষ্ঠা নিজের অজান্তেই। আরাধ্যর ফ্ল্যাটেও তালা দেওয়া। কিছুটা অবাক হলেও সেদিকে পাত্তা দিলো না সে। স্বভাবত এই সময়টা তার বাড়িতেই থাকার কথা। তবুও এসবে মাথা ঘামালো না সে।

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চললেও বিপত্তি ঘটলো এর কিছুক্ষণ পরে। কাজের মেয়েটা কোথা থেকে যেনো হুড়মুড় করে ঢুকলো ফ্ল্যাটে। হাসি হাসি মুখে তাকালো তার দিকে। অতঃপর ব্যাস্ত হাতে সাথে সাথে সাহায্য করতে শুরু করলো তাকে। আচমকা তাকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হলো শ্রেষ্ঠা। তবুও মুখে প্রকাশ করলো না। কারন তার বিশ্বাস মেয়েটা নিজেই সব বলা শুরু করবে গড়গড় করে কিছুক্ষনের মাঝে। ভীষণ সরল আর সাদাসিধে মনের কিনা! হলোও তাই। কিছুক্ষনের মাঝেই শুরু হয়ে গেলো তার একঝাঁক কথার পসরা।

“আপা, মেলা দিন পর দেখলুম আপনারে। কত্তোডি খারাপ হই গেছেন। খাওয়া দাওয়া করেন না নাহি?”

“আরে কী বলো! এই তো পনেরো দিন আগে গেলাম এখান থেকে। কিছুদিন পর দেখছো তো, তাই এমন মনে হচ্ছে। তুমি কেমন আছো বলো।”

“আর ভালা আপা। আমনেরা এলেন, ভাবলুম নতুন ভাড়াটিয়া আইছে কাম পামু। টাকাও পামু বেশি। ওমা আপনারাও দেহি চলি গেলেন, সেই সাথে সাহেবও চলি গেলো। দুইটা কাম গেলো। আর কেমনে ভালা থাহি বলেন!”

“সাহেব কে?”

“আরে ওই যে আমনের পাশের ফেলাটে যে থাকতো। হেব্বি করে দেখতে।”

“আরাধ্য!”

“হ্যা হ্যা। ওই সাহেব তো দেশের বাইরে চলি গেছে। যাওয়ার সময় আমার হাতে বকশিশ দিয়া গেছে কিন্তু! সাহেব মেলা ভালা মানুষ আছিলো।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো শ্রেষ্ঠা। মেয়েটার মতো সেও তো ভালো ভেবেছিলো আরাধ্যকে। ভরসা করেছিলো। কিন্তু দিনশেষে তার ধারণা ভেঙেছে। কে জানে মেয়েটার ধারণা কখনও ভাঙবে কিনা!

“ও ভালা কথা আপা, আপনার শরীর কেমন আছিলো? হেইদিন রাইত্তে যেই জ্বরডা আছিলো! হের পরের দিনই তো আমনেরা চইলা গেলেন। জিগায়াম পারুম না।”

বেশ অনেকটা অবাক হলো শ্রেষ্ঠা। তার জ্বরের কথা মেয়েটা জানলো কিভাবে? তার তো জানার কথা নাহ! সেদিন রাতে তো আরাধ্য ছাড়া আর কেউ ছিল না তার কাছে! হিমোফোবিয়া আছে তার । সেদিন রাতে রক্তে মাখামাখি হাত দেখেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসে গেছিলো। আর সেভাবেই অজ্ঞান হওয়া। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে শ্রেষ্ঠা জিজ্ঞাসা করলো,

“সেদিন রাতে আমার শরীর কাঁপতে জ্বর এসেছিল, তুমি জানলে কিভাবে?”

“আরে, কী বলেন আপা! আমনেরে ওয়াশরুমে নিয়া পুরো শরীর মুছায় দিছিলাম তো আমি। কাপড়ে রক্ত লাগি ছিলো। হেইটাও তো আমি খুলে দিয়ে অন্য কাপড় পরাই দিছিলাম।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় শ্রেষ্ঠা। হাতে থাকা স্টিলের গ্লাসটা পড়ে গিয়ে ঝন ঝন শব্দের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। তার শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,

“তু তুমি করেছিলে ওগুলো?”

“হ আপা। সাহেব আমাকে ফোন দিয়া ঘুম থেইকা ডেকে আনাইছিলো। এমনে সাহেব আমারে টাকা বেশি দেয়, তাই তার কথা ফেলতি পারি নাই। হের উপর আবার হেই কামের লেইগা হাজার টাকা বকশিস দিছিলো গো আপা। সাহেব মেলা ভালা মানুষ।”

সেই ফ্ল্যাট আর ছাড়েনি শ্রেষ্ঠা। ভুল করে হলেও যদি কোনোদিন আরাধ্য তাকে খোঁজে, এই আশায়। তাকে খুঁজতে গিয়ে যদি এখানে না পায়! তবে তো আর কোনোদিনও দেখা হবে না তাদের! মনের মাঝের অনুশোচনা আর আরাধ্যর ফিরে আসার মনোবাসনা নিয়েই কেটে গেছে একটা বছর। আজও রোজ নিয়ম করে আরাধ্যর ফ্ল্যাটের দিকে তাকায় শ্রেষ্ঠা। হুট করেই যদি কোনোদিন দরজা খোলা পায়! এই আশায়।

১২.
বিগত এক বছরে সেই মিস্ট্রিম্যানের খুনের ব্যাপারটা প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে। এখন আর তেমনভাবে কোনো খুনের খোঁজ পাওয়া যায়না। তার করা প্রতিটা খুনের মাঝে ছিলো একই রকম মিল। একইভাবে মার্ডার। কিন্তু হুট করেই যেনো কোথাও উধাও হয়ে গেছে সে। ডিপার্টমেন্ট থেকে কেসটা ক্লোজ করে দিলেও নির্ঝর প্রতিদিন স্টাডি করে এটা নিয়ে। প্রতিটা জিনিস খুঁটিতে খুঁটিতে দেখে। যদি কোনো ক্লু পেয়ে যায়, সেই আশায়। নিজের চাকরির সাথে আরো একটা কাজ সে বেশ ভালো করে করে। সেটা হলো শ্রেষ্ঠার উপর নজর রাখা। তাকে ফলো করা। তার আগেই তার বিপদ বুঝে ফেলে সেটা সরিয়ে ফেলা। তার অগোচরেই তার প্রেমে হাবুডুবু এক প্রেমিক পুরুষ। আজকাল নির্ঝরের আর দূরত্ব সহ্য হয়না। মাঝে মাঝে মন চায় তাকে সবটা জানিয়ে দিতে। কিন্তু মনের কোথাও যেনো ভয়েরা জটলা পাকিয়ে আছে। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেই সরাসরি জানিয়ে দেবে তাকে। বাবা মাকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে শ্রেষ্ঠাদের বাড়িতে।

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-০১

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১

কড়া পারফিউমের স্মেল নাকে আসতেই ঘুম ভেঙে যায় শ্রেষ্ঠার। আলতো করে চোখ খুলতেই চোখের সামনে আবিষ্কার করে আরাধ্যকে। বেডে হেলান দিয়ে খানিকটা তার দিকে ঝুঁকে শুয়ে আছে সে। দুইজনের শরীর একে অপরের সাথে লেপ্টে না থাকলেও দূরত্বের সীমা ছাড়িয়ে প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থা। বিষয়টা বোধগম্য হতেই আঁতকে ওঠে শ্রেষ্ঠা। দুচোখের পাতায় তন্দ্রাচ্ছন্নতা কেটে গিয়ে ততক্ষনে বিস্ময় ভাব ঠাঁই পেয়েছে। আচমকা বেখেয়ালিতে নিজের শরীরের দিকে নজর যেতেই আরেকদফা আঁতকে ওঠে সে। শরীরে অন্য এক পোশাক আর একই বেডে আরাধ্যর অবস্থান দেখে কল্পনায় ভেসে ওঠে বিশ্রী কিছু দৃশ্য। লোমহর্ষক, কল্পনাতীত কিছু মুহূর্ত। ঘটনক্রমে ছিটকে দূরে সরে যেতে গিয়ে আচমকা বেড থেকে নিচে পড়ে যায় শ্রেষ্ঠা।

কিছু পড়ার শব্দ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আরাধ্য। ভোরের দিকে হুট করেই চোখ লেগে গিয়েছিল তার। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে শ্রেষ্ঠাকে নীচে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে দ্রুতকদমে এগিয়ে যায় সেদিকে। ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলে,

“পড়ে গিয়ে এভাবে বসে আছো কেনো? শরীর কী খুব বেশি খারাপ লাগছে? শরীরে ব্যথা করছে?”

অবিশ্বাস্য অথচ ফ্যালফ্যাল চাহনী শ্রেষ্ঠার। ব্যথা! কিসের ব্যথার কথা বলছে আরাধ্য? তবে কী তার ধারনাই সঠিক! গভীর রাতে কী তাদের মধ্যে ব্যাথা পাওয়ার মতো সম্পর্ক হয়েছে? ভাবনার মাঝেই গলা ধরে আসে শ্রেষ্ঠার। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে তো বিশ্বাস করেছিলো আরাধ্যকে! কান্নারা দলা পাকিয়ে জমাট বাঁধে বুকের কাছে। শ্রেষ্ঠার ব্যাথাতুর দৃষ্টি দেখে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আরাধ্য। চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়ে হাত দিয়ে ব্যথা পাওয়া স্থান শনাক্ত করতে গেলে, পায়ে ব্যথা নিয়েই পিছিয়ে যায় শ্রেষ্ঠা। ঠিক যেভাবে আগুনের সংস্পর্শে আসা অঙ্গ দ্রুতবেগে পিছিয়ে নেয় মানুষ! সেভাবেই পিছিয়ে গেলো শ্রেষ্ঠা। দুরুদুরু বুকে কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো কয়েকটা শব্দ,

“বিশ্বাসঘাতক! এ জীবনে এই মুখ আর দেখতে চাইনা।”

আহত দৃষ্টিতে তাকালো আরাধ্য। এই কয়েকটা শব্দ যেনো শব্দ নয়, একেকটা ক্ষেপণাস্ত্র ছিলো তার কাছে। কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করলো তার ঠোঁট কাঁপছে। অনেককিছু বলতে চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না। গভীর এক দীর্ঘশ্বাসের সাথে ঠোঁট দিয়ে জীভ ভিজিয়ে আরাধ্য বললো,

“তুমি ভুল ভাবছো শ্রেষ্ঠা। আমাদের মাঝে……”

” বেরিয়ে যান। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যান আমার রুম থেকে। আমার সহ্য হচ্ছেনা আপনাকে। আমার ত্রিসীমানায়ও যদি আর কখনো আপনাকে দেখি, তবে….!”

কথার মাঝেই থেমে গেলো শ্রেষ্ঠা। তবে তার প্রতিটা কথা ছিলো ভয়ংকর। কণ্ঠে কী যেনো একটা ছিলো। তবুও বেশ খানিকটা সময় ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলো আরাধ্য। শ্রেষ্ঠা মনের ভুলে একবারের জন্যও তাকালো না তার দিকে। তবুও বেহায়া মন বারবার চাইছে সে তাকাক একটু। একবার তাকাক তার চোখের দিকে। চোখ তো মিথ্যা বলেনা। সে কী পারবে না, তার চোখের ভাষা বুঝে নিতে? পারবে না মিথ্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে সত্যিটা জানতে?

আরাধ্য বেরিয়ে যেতেই হাঁটু মুড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্রেষ্ঠা। একহাতে বিছানার চাদর টেনে ছুঁড়ে মারে দূরে। দুইহাতে মুখ ঢেকে পাগলের মতো কান্না করতে থাকে সে। মনে মনে ভাবে, বিশ্বাসঘাতকদের দেখতে হুবহু মানুষের মতো কেনো হয়? কেনো বিশ্বাসঘাতকদের জন্য আলাদা কোনো চেহারা বানাননি সৃষ্টিকর্তা? কেনো করলো আরাধ্য তার সাথে এমন? সে তো একজন ভালো বন্ধু হিসেবে চিনতো আরাধ্যকে। আচ্ছা, শুধুই কী বন্ধু? হয়তো নাহ। হয়তো তার ভালোও লাগতো আরাধ্যকে। খানিকটা পছন্দ করতো কি? অথচ আজ এক লহমায় সেই ভালোলাগার স্থানে জমা হলো একরাশ বিতৃষ্ণা।

ক্লান্ত, বিধ্বস্ত পায়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢোকে আরাধ্য। রুমে যেতেই চোখ পড়ে বেডের মধ্যিখানে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা শ্রেয়ার দিকে। বেডের কাছে গিয়ে ঘুমন্ত শ্রেয়াকে বুকে টেনে নেয় সে। হয়তো এরপর আর কখনো দেখা হবেনা তাদের। তবে অল্পদিনেই অতিরিক্ত মায়া জন্মে গেছে তার এই মেয়েটার প্রতি। অজানা এক টান অনুভব করেছে সেই প্রথমদিন থেকে। চোখ জ্বলছে তার। ঠোঁট নামিয়ে চুমু খেলো ঘুমন্ত শ্রেয়ার কপালে। দুইহাত মুঠোয় ভরে চুমু খেলো সেখানেও। শ্রেষ্ঠার ঘুম ভেংগে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে সেও গলা জড়িয়ে ধরলো আরাধ্যর।

“গুড মর্নিং আঙ্কেল।”

“গুড মর্নিং মামনি। মানি তোমাকে খুঁজছে তো! যাও মানির কাছে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

শ্রেয়া বাধ্য মেয়ের মতো বেরিয়ে গেলো আরাধ্যর ফ্ল্যাট থেকে। পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট। দরজা খোলা থাকায় সহজেই ঢুকে গেলো সে। শ্রেষ্ঠাকে মেঝেতে বসে কাঁদতে দেখে ছোটো ছোট দুইহাতে চোখ মুছিয়ে দেয় শ্রেয়া। অতঃপর কোলে বসে কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,

“তোমার খারাপ লাগছে মানি? অনেক বেশি অসুস্থ লাগছে? ডক্টর ডাকবো?”

মেয়ের চিন্তিত মুখ দেখে ফিকে হাসে শ্রেষ্ঠা। কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে চুমু খায় সারামুখে। বলে,

“তুমি ডাক্তার চেনো? তাহলে ডাকবে কিভাবে?”

“আমি তো চিনি না। কিন্তু ভালো আঙ্কেল চেনে। ভালো আঙ্কেলকে বললে ঠিক ডেকে দেবেন।”

“শ্রেয়া, ওনাকে আমরা চিনিনা। আমাদের পরিচিত নন উনি। এভাবে কয়কেদিনের পরিচয়ে কাউকে বন্ধু মনে করতে নেই। বন্ধু আর বিশ্বাসঘাতক সবার চেহারা একই রকম হয়। ফার্দার যেনো আর ওনার সাথে কথা বলতে না দেখি আমি।”

মায়ের কড়া কণ্ঠের বাক্যে শ্রেয়া কী বুঝলো কে জানে? শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। যার অর্থ সে কথা বলবে না।

আরাধ্য নিশ্চুপে শুয়ে আছে দীর্ঘক্ষণ ধরে। এভাবে কতক্ষন কেটে গেছে জানা নেই তার। রাতের ঘটনাগুলো একে একে পালাক্রমে ঘুরে চলেছে তার মস্তিষ্কে। কোথা থেকে কী হয়ে গেলো কিছুই মাথায় আসছে না। অভিমান পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তরতর করে। রাতের ঘটনাগুলো তাকে যতোখানি শীতলতা দিয়েছে, সকালটা হয়েছে ততখানি তিক্ততার। সে কোনোভাবেই বোঝাতে পারবে না শ্রেষ্ঠাকে। ভালোবাসার কথাটা মুখে বলার আগেই এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে যাবে কল্পনায় ভাবেনি।

শ্রেয়ার ডাকে ছুটে গিয়ে অন্ধকার ওয়াশরুমের ফ্লোরে আবিষ্কার করে শ্রেষ্ঠাকে। থরথর করে কাঁপছে সে। কান্নার সাথে গোঙানিগুলো মিলেমিশে অন্যরকম এক ভয়ানক শব্দের সৃষ্টি করেছে যেনো! আরাধ্য এগিয়ে গেলো। খানিকটা আড়ষ্ঠতা নিয়েই হাত ধরলো শ্রেষ্ঠার। শরীর অত্যধিক গরম। অতঃপর কপালে, গলায় হাত দিতেই চমকে গেলো। জ্বরে সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আলতো হাতে শ্রেষ্ঠাকে ডাক দেয় আরাধ্য। বেহুশের মতো গুঙ্গিয়ে যাচ্ছে শুধু সে। বাধ্য হয়ে তাকে কোলে তুলে বেডে নিয়ে আসে আরাধ্য। বেশিক্ষণ ওয়াশরুমের ঠাণ্ডা ফ্লোরে থাকলে শরীর আরও বেশি খারাপ করবে, এজন্য বেডে শুইয়ে দেয়। শ্রেষ্ঠার এমন অবস্থা দেখে শ্রেয়া আরো জোরে জোরে কান্না করে দেয়।

“শ্রেয়া, তোমার মানি এমনিতেই অসুস্থ। মেডিসিন নিয়ে ঘুমাতে হবে তাকে। এভাবে কান্না করলে তার অসুবিধা হবে তো!”

“কিন্তু আমার তো কান্না পাচ্ছে খুব।”

“আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো, আমার রুমে গিয়ে বসো। ঘুম পেলে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়বে কেমন?”

হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে যায় শ্রেয়া। পুরোটা রাত শ্রেষ্ঠার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দেয় আরাধ্য। মাঝে মাঝে মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কমানোর চেষ্টা করে। অথচ রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরের মাত্রাও বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। ঘুমন্ত শ্রেষ্ঠাকে মেডিসিন খাইয়ে ভোররাত পর্যন্ত জলপট্টি দেয় আরাধ্য। ভোরের দিকে জ্বরের মাত্রা খানিকটা কমেছে। শরীর ঠাণ্ডা হয়েছে দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।

আচমকা আরাধ্যর কোমর জড়িয়ে ধরে আলতো করে তার দিকে সরে আসে শ্রেষ্ঠা। অতিরিক্ত গরম শরীর হটাৎ করে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় উষ্ণতার খোঁজে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। আরাধ্য ছুটানোর চেষ্টা করে কয়েকবার। কিন্তু লাভ হয়না। অতঃপর ঘুমন্ত শ্রেষ্ঠার দিকে চোখ পড়তেই আরাধ্য মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে সেদিকে। যেনো কতো জনমের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে আজ সে। চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলো ফু দিয়ে সরিয়ে দেয় আরাধ্য। নড়েচড়ে ওঠে শ্রেষ্ঠা।

#চলবে!

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৭ এবং প্রথম পরিচ্ছেদ(সমাপ্ত)

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৭(প্রণয়াবেগ উৎসর্গ)
#প্রথম_পরিচ্ছেদ(সমাপ্ত)

“সূচনার রেশ পরিসংহারে হারিয়ে যায়।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় আকাশপানে তাকিয়ে দুইতলা বাড়ীর ছাদের কার্নিশে বসে পা দোলাচ্ছে আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি তাকালো তার দিকে। অতঃপর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেশ বসায় রেখে বললো,
“মুগ্ধতা খুঁজে পেয়েছি তোমার মাঝে। প্রতি মূহুর্তে প্রতিটা ক্ষণে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছি অনিমেষ।”

শ্রেষ্ঠা স্থির। যেনো কাঠের পুতুলকে জোর করে বসিয়ে রাখা। অথচ দৃষ্টি শূন্য, এলোমেলো। তবুও কণ্ঠের মাঝে রয়েছে অসম্ভব আত্মবিশ্বাস।
“সময়ের ফেরে মুগ্ধতার বাণী ছেয়ে যায় তিক্ততায়।”
“তবে প্রেম!””
“হৃদয়ে লুকায়িত প্রেমের কুঠুরি হতে নির্গত হয় দীর্ঘশ্বাস। ঝলসে যায় সাজানো গুছানো সংসার।”
“এতো তিক্ততা আর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ানো যায়না। আমাদের সবারই জীবনে হয়তো এক অধ্যায় থাকে, যা হয় একান্ত ব্যাক্তিগত। পুরো দুনিয়া থেকে লুকিয়ে যাকে আমরা পুষে রাখি বুকের মাঝে আজীবন। কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হয়! যদি বাঁচতেই হয় তবে ভালো থাকা কেনো হবে না?”

অনেকটা সময় কাটলো নিরবতায়। হয়তো কারো আবেগী মনের উন্মত্ততা লুকানোর চেষ্টা নয়তো অতীতের ঝলসে যাওয়া পাতাগুলো জীবন্ত হওয়ার ব্যাথায় বার কয়েক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত কিছুই শোনা গেলো না। শাোঁ শাোঁ শব্দে প্রবাহমান বাতাসের সাথে শ্রেষ্ঠা নিঃশ্বাসের গতিবেগ বাড়লো। ঠোঁট দুটো গোল করে বিষাক্ত কিছু বাতাস ঝেড়ে ফেলে দিলো ভেতর থেকে। আরাধ্য দেখলো। সবটাই বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। একেবারে যাকে বলে খুঁটিতে খুঁটিতে দেখা। শ্বেতাভ চামড়ার মাঝে ভেসে ওঠা লালচে তিল, লালাভ ঠোঁটের দাঁত দ্বারা আঁকড়ে ধরা, কখনও বা জিহ্বা দ্বারা শুষ্ক ঠোঁটের আদ্রতা প্রদান, সবটাই যেনো মুখস্ত করে ফেললো। সেই সাথে আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়লো শ্রেষ্ঠার প্রতি। টকটকে রক্তবর্ণ ঠোঁটের গা ঘেসে বেড়ে ওঠা লালচে তিল। আফিমের চেয়েও অধিক মাদকতার সুরে হাতছানি দিচ্ছে যেনো! এই আগুন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে না করেছিলো সে! সেদিন কেনো এত রূপ, মাধুর্য্য তার চোখে আঁটকালো না? এই চোখ ধাঁধানো রুপ সুন্দরী মেয়েটাকে সে নিজে রিজেক্ট করেছিলো, ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আজ। সেদিন এমনটা না করলে হয়তো আজ দুজনের জীবন ভিন্ন হতো। আরোহী খাঁন যেভাবে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, হয়তো এতদিনে তাদের জায়গা হতো এক ছাদের নীচে। একই কুঠুরির একে অন্যের পোশাকের ন্যায় কাটতো কোনো এক রাত। বিনিদ্র মধুরতায় ছেয়ে যেতো কোনো এক রাত।

শ্রেষ্ঠা মুখ তুলে তাকায়। আরাধ্যর বিমোহিত দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত হতেই চোখ সরিয়ে ফেলে দুজনে। অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি থেকে বের হতে তাৎক্ষণিক আরাধ্যর জিজ্ঞাস্য,

“কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে তোমার আনাগোনা কেনো? জানামতে তোমাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ে তুমি। ”

“সবকিছুই যে আপনার জানার মাপকাঠির মধ্যে পড়বে, এমনটা নাও হতে পারে। আমার ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে কারো নাক গলানো একেবারেই অপছন্দের।”

কণ্ঠের মাঝে রাগের আভাস। মুহুর্তেই মূর্ছা পড়া মেয়েটা যেনো দৈবশক্তি পেয়েছে। তেজ এসে ভর করেছে তার মাঝে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আরাধ্য। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো শ্রেষ্ঠার যাওয়ার পানে। আচমকা জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলো,

“মনের ভুলে কিংবা মন খারাপের কবলে, ধরা দিও এ ভুবনে। সাঁঝের বেলা, ছোটাছুটি করে নাইবা পেলে দেখা, ছুটে এসো এই নিবাসে সব বেলা।”

৯.

আজ অনেকগুলো দিন পর শ্রেয়া দেখা পেল আরাধ্যর। ভূবন ভোলানো হাসি মুখে দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার উপক্রম। আরাধ্য খুব সাবধানে দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে। এতে যেনো তার হাসির পরিমাণ আরও বাড়লো। চওড়া হলো ঠোঁটের দুইপাশের বহর। খিলখিল শব্দে মুখরিত চারিপাশ। আরাধ্যও মেতে উঠলো তার শিশুসুলভ আচরণে। মেয়েটা যেনো আস্ত এক ভালোবাসার ডিব্বা। যেখানে শুধু ভালোবাসা জমা রাখতে ইচ্ছে করে। ঠিক যেভাবে প্রতিদিন ভাঙতি টাকাগুলো জমানো হয় ভান্ডারে, সেভাবেই খুচরো ভালোবাসাগুলো উজাড় করে রেখে দিতে মন চায় তার কাছে। এতো এতো বেশি আদুরে, যেনো ছোট্টো এক বিড়ালছানা। শ্রেয়ার ফ্যামিলির সাথে কোনোদিন দেখা হয়নি আরাধ্যর। তবে তাদের সম্পর্কে বেশ খানিকটা ধারণা জন্মেছে তার। দৃষ্টিপটে অপরূপা এক মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বারেবারে তার মস্তিষ্কে। শ্রেষ্ঠার মা একজন সিঙ্গেল মাদার। বাবাকে সে কখনো দেখেনি। এমনকী আদৌ তার মায়ের বিয়ে হয়েছে কিনা সে বিষয়েও নিশ্চিত নাহ আরাধ্য। তবে জানার পন্থা থাকলেও কখনও সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করেনি সে। কী প্রয়োজন একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশের! সে তো শ্রেয়াকে ভালোবাসে। এইতো মাঝে মাঝেই তায়েফ দেখা হয় স্কুলে, বেশ অনেকটা সময় কাটে অগোছালো ছন্নছাড়া গল্পগুজবে। এইতো বেশ। সম্ভবত শ্রেয়ার মায়েরও তাদের কথোপকথনে কোনো আপত্তি নেই। নইলে এতদিনে হয়তো শ্রেয়া খানিকটা দূরে সরে যেত তার থেকে। কিন্তু এমনটা যখন ঘটেনি তখন ধরে নেওয়াই যায়, শ্রেয়ার মতো তার মাও অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী এক মহিলা। এই মানুষটার কথা ভাবলেই শ্রদ্ধা আর সম্মানে ভরে ওঠে আরাধ্যর বুক। আজকাল এমন মানুষ আসলেই বিরল। বরং নিজেদের সুখের কথা ভেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেওয়া মানুষের সংখ্যাই অধিক। অথচ এই যুগের মানুষ হয়েও নিজের চেয়ে বেশি সন্তানের কথা ভেবেছেন তিনি। সমাজের চক্ষুশূল হয়েও সন্তানকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। হয়তো রাস্তার কিছু কুকুররুপী মানুষদের টিটকারীও শুনতে হয় প্রতি মূহুর্তে।

১০.

লাশের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তেই থাকছে। প্রতিটা খুনই হচ্ছে অবিকল একই ভাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ধরা পড়েছে প্রতিটা লাশের শরীরে উপস্থিত চেতনানাশক ঔষধি। হাতের শিরার মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণের বায়ু একইসঙ্গে প্রবেশ করানোর ফলে মৃত্যু ঘটছে সকলের। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ এ মৃত ব্যাক্তির ফিঙ্গাপ্রিন্ট ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। প্রতিটা লাশের পাশেই পড়ে আছে একটা করে খালি সিরিঞ্চ। যেটা মৃত ব্যাক্তি নিজেই নিজের শরীরে প্রবেশ করাচ্ছে।

এতো এতো সমীকরণ মেলাতে গিয়ে আরও বেশি জটিল হয়ে পড়ছে কেসটা। নির্ঝর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কেবিনে। এই একটা কেস পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে নাড়িয়ে রেখে দিয়েছে। উপরমহল থেকে চাপ, তা না হলে কখনোই এই বিষয়ে মাথা ঘামাতো না সে। কারন ইনভেস্টিগেশনে দেখা গেছে খুন হওয়া প্রতিটা মানুষের অতীতই কালো। অনেকে ড্রাগ পাচারকারি কিংবা নারী পাচারকারি চক্রেও জড়িত। অনেকে কয়েকবছর হাজতবাস কাটিয়েও গেছে। বেশিরভাগ মানুষের ফাইল খুঁজে পাওয়া গেছে আসামীদের রেকর্ডের লিষ্টে। অনেকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে হাজতবাস করেনি আবার অনেকে হাজতবাস থেকে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হওয়ার নয়। তাই জেল থেকে বের হয়ে তারা আবারো যুক্ত হয়েছে সেই সব কাজের সাথে।

মাঝরাত। হুট করেই ঘুম ভেংগে যায় শ্রেয়ার। পাশ ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে হাতড়ায় বেশ অনেকটা সময়। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পায়না শ্রেষ্ঠার। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে শ্রেয়া। ঘুমের রেশ ছাড়াতে দুই চোখ হাত দিয়ে কচলে পাশে তাকায়। শ্রেষ্ঠা নেই। ভীতু চোখে আশপাশের সব জায়গায় তাকিয়েও শ্রেষ্ঠাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে কান্না পায় শ্রেয়ার। কিন্তু মায়ের শেখানো কথায় কান্না চেয়ে রেখে বেড থেকে নেমে পড়ে সে। একে একে রান্নাঘর থেকে শুরু করে সবজায়গায় দেখে ফেলে সে। অবশেষে বাথরুমের দরজা খুলে শ্রেষ্ঠাকে দেখতে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তার বুকে। কিন্তু কয়েকটা বাড়াতেই থমকে যায় সে। শ্রেষ্ঠা কাঁদছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ভয় পেয়ে ছুটে দরজা খুলে বাইরে চলে যায় শ্রেয়া। আচমকা তার মনে পড়ে আরাধ্যর কথা। তাদের পাশের রুমটাই আরাধ্যর। ভয় থেকে বাঁচতে মাঝরাতে জোরে জোরে ধাক্কা দেয় আরাধ্যর রুমের দরজা।

বেশ অনেকটা সময় ধরে কেমন এক খট খট হচ্ছে দরজায়। ঘুমের মাঝেই হুট করে সজাগ হয় আরাধ্যর মস্তিষ্ক। ঘুম ছুটে গিয়ে কৌতূহল চেপে বসে মনে। ভারী এক লাঠি ডান হাতে উঠিয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে দরজার কাছে। খুব সাবধানে লক খুলে দরজা টানতেই শ্রেয়ার কান্নারত নিস্পাপ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ছ্যাত করে ওঠে তার বুক। হাতের লাঠিটা ফেলে দৌড়ে দরজার বাইরে থেকে তুলে আনে শ্রেয়াকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে শ্রেয়া। হয়তো কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছে অনেকটা, এমনটা ভেবে তাকে শান্ত করার চেষ্টায় লেগে পড়ে আরাধ্য।

গুনগুনিয়ে করা শ্রেষ্ঠার কান্না দেখে প্রাথমিকভাবে আরাধ্য নিজেও ভড়কায়। বেশ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকটা সময় কান্না করার পর যেনো আর বেগ পাচ্ছেনা। গলা ভেঙে গেছে। শ্রেষ্ঠাকে এ অবস্থায় দেখে বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে আরাধ্যর। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে বুকে টেনে নেয় শ্রেষ্ঠাকে। একজোড়া ভরসার হাত পেয়ে শ্রেষ্ঠাও অবচেতন মনে আঁকড়ে ধরে তাকে আস্টেপৃষ্টে। আরাধ্য একহাত শ্রেষ্ঠার মাথায় রেখে আদুরে কণ্ঠে বলে ওঠে,

“কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!”

#সমাপ্ত।

চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর পর্ব-০৬

0

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৬(মানুষ থেকে পশু হওয়ার জার্নির শুরুটা কোথায়!)

প্রতিদিনের নিউজপেপারে একই হেডলাইন দেখতে দেখতে বিরক্ত শ্রেষ্ঠা। শুধু রহস্যময় খুনের বিবরণ। অথচ যারা খুন হচ্ছে তারা কেউই কখনও ভালো মানুষ ছিলো না। এক্ষেত্রে পুলিশের উচিৎ তাকে বাহবা দেওয়া। যে আসামীগুলোকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিংবা উচ্চস্তরের পা চাঁটা লোকের সহযোগিতার ফলে বারবার জামিন দিয়ে দিতে হচ্ছে, তাদেরকে নির্মূলে শেষ করছে এই লোক। অথচ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল সমাজের ওই কীট গুলোকে মেরে ফেলা মানুষটাকে ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে পুরো শহর। মন্ত্রী মিনিস্টার থেকে শুরু করে পুলিশ ফোর্স কেউ দুই দন্ড বসে থাকতে পারছে না। মানুষটাকে যেখানে দেখা যাবে সাথে সাথে গুলি করার অর্ডার আছে উপর মহল থেকে।

নির্ঝর একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। অথচ একথা আরাধ্য ছাড়া কেউ জানে না। ছোট থেকে পুলিশে জয়েন হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও পরিবারের চাপে তাকে বিজনেস নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। তবে পুলিশ ফোর্স জয়েন হওয়ার সমস্ত ক্রেডিট নির্দ্বিধায় আরাধ্যকে দেওয়াই যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রভাবশালী বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় বেশ উচ্চপদস্থ কিছু পরিবারে ছিল তার আনাগোনা। সঠিক সময় সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে নির্ঝরকে পুলিশের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য ট্রেনিং এ পাঠিয়েছে সে। এই পুরোটা সময়টা বিদেশে থেকেও একান্তভাবে পাশে থেকেছে নির্ঝরের।

শ্রেষ্ঠাকে অফিস থেকে সোজা বাড়িতে ড্রপ করে দিতে চায় আরাধ্য। কিন্তু সে কিছুতেই ছুটি নিতে রাজি নয়। জয়েনিংয়ের অল্প কয়েকদিনের মাঝেই এভাবে ছুটি নেওয়া ব্যাপারটা ভীষণ দৃষ্টিকটু। সেই সাথে ম্যানেজার আরমানের সাথে ঘটে যাওয়া ধস্তাধস্তির কথা ততক্ষণে লোকমুখে রটে গেছে অনেকখানি। আর বরাবরের মতোই সব দোষ এসে পড়ে নারী জাতির উপর। এটাই আমাদের সমাজ। সমাজের গুটিকয়েক লোক টেনে হিঁচড়ে বিচার বসাবে মেয়েটার। কোনরূপ ভূমিকা পালন না করেও সমস্ত দোষারোপ জোর করে থুপে দেয়া হয় তার মুখে।

“দেখতে সুন্দর বলে নিশ্চয়ই সিডিউস করার চেষ্টা করেছে আরমানকে। নয়তো এভাবে মেয়ে দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ছেলে নাকি ও! বোঝোই তো উচ্চপদে রয়েছে কিনা!”

“আমরা তো এক জনম কাটিয়ে দিলাম এই অফিসে। আর এই মেয়ে আসতে না আসতেই নিজের রূপ দেখাতে শুরু করে দিয়েছে। লজ্জা শরম কোথায় বেচে এসেছে কে জানে!”

“কোথায় আর বেচবে! দেখো গিয়ে এমন কতো নিস্পাপ ছেলেকে ফাঁসিয়েছে। আরে ভাই, নিজে থেকে সম্মতি না দিলে কারোর সাহস আছে নাকি চোখ তুলে তাকানোর!”

“আমি তো প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম মেয়েটার চরিত্রের সমস্যা আছে। রূপ আছে কিনা? রূপসী মেয়েগুলো সব এক এক টা জোস মাল হয়। রাত হলেই এদের পাব আর নাইট ক্লাবে দেখা যায় ভিড় করতে। বড়লোক ছেলেদের গলায় ঝুলে পড়ে। ওই তো কটা টাকা মাইনে পায়। ওই দিয়ে এসব রূপ ধরে রাখা যায় নাকি! মাসে মাসে পার্লারের বিল দিতে গেলে এমন কয়েকটা বড়লোকের ছেলেকে হাতে না রাখলে আবার হয় না।”

কেবিনে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে বসে আছে শ্রেষ্ঠা। হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে একজন কর্মচারী। জরুরী কিছু ফাইল নিয়ে বের হওয়ার সময় ভুলবশত দরজা পুরোপুরি না আটকেই চলে যায়। ফলস্বরূপ খানিকটা দূরের ডেস্কে আলোচনায় মেতে থাকা ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক গোছের লোকেদের প্রতিটা কথায় কানে আসে তার। নিজের সম্পর্কে এত এত খারাপ মন্তব্য শুনে ধক করে ওঠে শ্রেষ্ঠার বুক। হৃদস্পন্দনে ক্রমাগত উত্থান পতনের সাথে উঁকি দেয় অতীতের কিছু কাহিনী। জীবনের বীভৎসতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত সে। সমাজের মাঝে ভদ্ররূপে বসবাস করা নিচু মানসিকতার মানুষগুলোর পায়ের তলায় থাকা ভাবনা গুলোতে সে রীতিমতো হতাশ। এখন আর ইচ্ছে করে না তাদের সাথে লড়াই করার। সব ক্ষমতা যেন হারিয়ে গেছে। অথচ একটা সময় পুরো দুনিয়ার সাথে চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে সে। ছোট শ্রেয়াকে নিয়ে পালিয়ে যায়নি কোথাও। বরং সমাজের মাঝে থেকে কানাঘুঁসো করা প্রতিটা কথাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।

৮.

বিগত দুইদিন ধরে আরাধ্যর দেখা নেই। বরং তার পরিবর্তে আবির্ভাব ঘটেছে নির্ঝরের। শ্রেষ্ঠা বেশ কয়েকবার কৌশলে আরাধ্যর কথা জিজ্ঞাসা করলেও ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায় নির্ঝর। রাগ হয় শ্রেষ্ঠার। সেদিনের পর থেকে আরাধ্য নিজে থেকেই আড়ালে থেকেছে। তাই ইচ্ছাকৃত হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত, শ্রেষ্ঠাও আর কোনোরূপ যোগাযোগ করেনি।
হুট করেই শ্রেষ্ঠার মনে পড়ে আরাধ্যর শেষ কথাগুলো,

“খাঁন ইন্ডাস্ট্রির এমডি যে ছেলেটা আছেনা! আরে কী যেনো নাম! আজকাল তো শ্রেষ্ঠাকে দেখি তার সাথে চিপকে চিপকে থাকতে। নিশ্চয়ই একে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। এই সব মেয়েরা আবার প্রয়োজনে শরীর দেখিয়ে হলেও ছেলেদের কাবু করতে পারে। নাহলে কোম্পানির এমডি হয়ে ওই ছেলেটা কি আর এমনি এমনি পড়ে থাকে নাকি! দেখো গিয়ে ভেতরে কী কী সব চলে।”

অফিসের কর্মরত একজন ভদ্রমহিলার কথাগুলো একের পর এক নির্বিঘ্নে সহ্য করে গেলো আরাধ্য। একটা টু শব্দটুকুও করেনি। মহিলাটির ঠিক পিছনে বুকে হাত গুঁজে অপেক্ষামান সে। তার কথা শেষ হওয়া মাত্র পাল্টা প্রশ্ন করে আরাধ্য,

“আপনি এখানে কী করছেন বলুন তো! আপনাকে তো আমার বাড়িতে হওয়ার কথা। কারন আমার মাও আমাকে এতটা চেনেনা, যতটা আপনি চেনেন। আঃ! কী সৌভাগ্য আমার।”

পুরুষালী কণ্ঠের রুঢ় বাক্যে থতমত খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। মানুষটাকে ভালো ভাবে খেয়াল করে একদফা হাসে আরাধ্য। অতঃপর সেই চেয়ার টেনে বসে পড়ে নিজেই। এরপর নরম কণ্ঠে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলে ওঠে,

“আপনার বয়স দেখে বোঝা যায় এই বয়সী একটা মেয়ে কিংবা ছেলে থাকার কথা। অথচ আজও আপনি পাড়ার পি এন পি সি করা কাকিমাদের বৈশিষ্ট্যটাই ছাড়তে পারলেন না। আচ্ছা, এইযে দামী একটা শাড়ী, বেশ পরিপাটি হয়ে সাজগোজ করা, গলায় কানে স্বর্ণের একটা হালকা মডার্ন সেট পরলেই তাকে ভদ্রমানুষ বলা যায়! তবে তো একটা গোরিলাকে এভাবে সাজিয়ে দিলে ঠিক আপনার মতোই লাগবে। তাইনা! একেবারে ডিটো কার্বন কপি। কারন, না তার আছে কোনো বিবেক-বুদ্ধি, মান-অপমান বোধ, সহবদ-ভদ্রতা, আর না আছে আপনাদের। হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে এমন চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে রুচিতে বাঁধলো না একটুও! অন্যকে নীচে নামাতে নামাতে কখন যে নিজেকে একেবারে নিম্নস্তরে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন, দেখেছেন একবারও? আজ বরং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবেন। মানুষ থেকে পশু হওয়ার জার্নির শুরুটা কোথায়!”

অল্পবয়সী এক ছেলের কাছ থেকে এতখানি অপমান ঠিক হজম হচ্ছেনা কারোরই। প্রত্যেকে নিজেদের ডেস্কে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেস্টা করলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিশোধপরায়ন সাপের মতো ফুঁসছে।

নির্ঝরের ডাকে ধ্যানভঙ্গ হয় শ্রেষ্ঠার। অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসে বাস্তব জগতে। অফিসের নির্দিষ্ট কিছু মানুষ তাকে দেখলেই বাঁকা চোখে তাকায়। তার বেশভূষা থেকে শুরু করে কাজ প্রতিটা ক্ষেত্রেই খুঁত ধরতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়না।

প্রজেক্টের একটা কাজের জন্য নির্ঝরের সাথে সাইট ভিজিটিংয়ে এসেছে শ্রেষ্ঠা। চারিদিকে দাপটে বেড়ানো হাওয়ার তুমুল ঝাপটায় মাটিতে বসে পড়ে শ্রেষ্ঠা। সাথে রয়েছে একজন আর্কিটেকচার। কাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে সে তাকে। মাঝে মাঝে তুখোড় হাওয়ার দাপট এলেমেলো করে দিচ্ছে তার খোঁপায় বেঁধে রাখা চুল। নির্ঝর মুগ্ধ দৃষ্টিতে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে শ্রেষ্ঠার দিকে। যেনো চোখ ফেরালেই বিশেষ কিছু হারিয়ে ফেলবে।

বিগত পনেরো মিনিট ধরে গাড়িতে পাশাপাশি সিটে বসে আছে নির্ঝর আর শ্রেষ্ঠা। দুজনের মাঝে বিদ্যমান ঘোর নিস্তব্ধতাকে বিদায় জানিয়ে শ্রেষ্ঠা বলে,

“আপনাকে কিছু কথা বলবো। আরাধ্য স্যারকে বলে দিতে পারবেন?”

“অবশ্যই কেনো নয়!”

“বলবেন, আমার সাথে কাজ করতে যদি তার সমস্যা হয়, তবে এই প্রজেক্টের দায়িত্ত্ব অন্য কাউকে দেওয়া হবে। আমি আমার সমস্ত ডকুমেন্ট বুঝিয়ে দেবো তাকে। সমস্যা নিয়ে অযথা সহ্য করতে হবে না তাকে। আমি আজই এই প্রজেক্ট হস্তান্তর করে দেবো।”

#চলবে!