Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 284



তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-২৫+২৬

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৫.
বিশাল ড্রয়িংরুমে আভিজাত্যের ছোঁয়া। বিলাসবহুল সকল চিত্রকর্ম দ্বারা আবদ্ধ দেয়াল। বাড়িটার প্রতিটা আসবাবপত্র যেন অত্যন্ত সৌখিন হাতে গঢ়ে তোলা হয়েছে। বলা চলে বাড়ির কর্ত্রী ও অত্যন্ত সৌখিন। তার সৌখিনতার উদাহরণ ছিমছাম পরিপাটি সবকিছু। অন্তি না চাইতেও মুগ্ধ হয়।
বসার ঘরটায় লাল নীল রঙের মৃদু আলো জ্বলছে। এই মৃদু আলোতে দেয়ালে টাঙানো চিত্রকর্মগুলো যেন আরো জীবিত হয়ে উঠেছে। লাল নীল রঙের ছোঁয়ায় তুলে ধরা নারীদেহটার চোখ দুটো যেন জ্বল জ্বল করছে। অন্তি অবাক হয়। বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রয়। কি ভয়ংকর সুন্দর শিল্পীর ভাবনা! কি সুন্দর তার হাতের সৃষ্টি!

অন্তির এই ভালোলাগার হ্রেস খানিকের মাঝেই বিলিন হলো। আরাব নামের লোকটাকে প্রথম দেখাতেই তার অতিব মাত্রায় অভদ্র বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তার বাবা মা কিনা এই লোককে মাথায় তুলে নাচিয়ে চলছে। এ মানা যায়? অন্তির মনক্ষুণ্ণ হয়। তার বাবা সবসময় তার জন্য বেস্ট জিনিস এনে দিয়েছে তবে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে তার বাবা কেন ভুল কাউকে পছন্দ করলো? সবটাই কি কেবল বাহ্যিকতা? ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকা আরাবের ভেতরের রূপটা যদি সে তাদের দেখাতে পারতো!
অন্তির বুক ভারি হয়ে আসে। হুট করেই বুকের ভেতর শূন্যতা আঁকড়ে ধরে। কাউকে না জানিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে ছাদে। আজ আকাশে ঝলমলে চাঁদ উঠেছে। শীতের আমেজে পরিপূর্ণ প্রকৃতি। প্রকৃতির এমন সুন্দর রূপ তাকে মায়ায় জড়াতে পারলো না। প্রেমে ক্লান্ত হৃদয় তখন অগাধ জলে বাঁচার জন্য ছটফট করছে। প্রেমিক পুরুষটির কন্ঠস্বর শোনার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে হৃদয়। অন্তি তার ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিলো। দিহানের প্রতি জমা ক্ষণিক অভিমান ভুলে সাদা রঙের ঝলমলে পার্স থেকে ফোন বের করে দ্রুত হাতে কল করে দিহানের নম্বরে। ছলছল চোখে বিরবির অরে আকুতি জানায়,

‘প্লিজ পিক দা ফোন দিহান। আমার দম বন্ধ লাগছে। একটু কথা বলেন আমার সাথে। শুধু একটু কথা বলেন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ….’

অন্তির আকুতি ভরা চাপা কান্না হয়তো তার প্রেমিক পুরুষটি শুনলো না। নিষ্ঠুর প্রেমিকের মতো ফিরিয়ে দিলো তাকে। ফোনের ওপাশ থেকে রিনরিনে মেয়েলি গলায় প্রতিবারের ন্যায় জানালো সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রেমিকরা বুঝি এমন নিষ্ঠুর হয়? নিদারুণ কষ্ট অভিমানে চোখ ভরে ওঠে অন্তির। মনে আক্ষেপ জমে খুব। লাল হয়ে ওঠে নাক চোখ। সংযোগ বন্ধ জেনেও উম্মাদের মতো পরপর কল করতে থাকে দিহানের নম্বরে। যেন এভাবেই বিচ্ছিন্ন সংযোগ জোড়া লাগাতে চলছে সে। একসময় ক্লান্ত হয়ে হুঁ হাঁ করে কেঁদে ওঠে। তার কান্নার শব্দে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। উড়তে থাকা ঝিঁ ঝিঁ রাও নিরবতা বয়ে আনে। হয়তো তারাও তার দুঃখকে মন থেকে উপলব্ধি করতে পারছে। এসবের পাশাপাশি আরো একটি প্রাণ তার এই হৃদয়বিদারক কান্নার সাক্ষী হয়েছিলো। যা অন্তি বুঝতেও পারেনি।

‘কার জন্য এত আকুতি? জানতে পারি?’

ছাদ থেকে নামতে নিতেই হঠাৎ এমন প্রশ্নে থমকে দাঁড়ায় অন্তি। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালে অন্ধকার চিঁড়ে বেরিয়ে আসে আরাব। গায়ে হাফ হাতার কালো রঙের একটা টি শার্ট। পরণের প্যান্টটাও হাফ। শীতের রাতে এমন অদ্ভূত পোশাক পরার মানে কি? অন্তি তা জানতে চাচ্ছে না আপাতত। তার প্রশ্ন লোকটা এখানে কি করছে? মনের প্রশ্ন চেপে রাখার স্বভাব না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই সে প্রশ্ন করলো,

‘আপনি এখানে?’

‘আমার বাড়িতে আমার থাকাটাই স্বাভাবিক। নয় কি?’

‘তেমন না। আন্টি বললো আপনি অসুস্থ। রুমে ঘুমাচ্ছেন। তাই আর কি।’

‘বাহ! আসতে না আসতেই খোঁজ নিয়ে ফেলেছেন! ভেরি গুড। আই লাইক ইট! কিন্তু এই কান্নাকাটিটা কার জন্য রূপন্তি?’

আরাব কিছুটা সামনে এগিয়ে আসতেই অন্তি পিছিয়ে যায়। আরাবের শান্ত দৃষ্টি হঠাৎ করেই তার নার্ভাসনেস বাড়িয়ে দেয়। মন তাকে হুঁশিয়ারি জানায়। মস্তিষ্ক তাকে ছুটে পালাতে বলে। খারাপ কিছু না ঘটে!
ভয় মানুষকে কাবু করে নেয়। এ প্রবাদে পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাসী অন্তি। সেই বিশ্বাস থেকেই সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। কড়া কিন্তু শান্ত গলায় জবাব দেয়,

‘সেটা আপনার না জানলেও চলবে।’

‘চলবে না। আমি সেই অধিকার দেইনি আপনাকে যেই অধিকারে আপনি অন্যকারো জন্য কাঁদবেন।’

অন্তি মুচকি হাসে। বলে,

‘আপনি অধিকার দেওয়ার কে?’

‘আপনার হবু বর।’

‘বিয়ে তো করছি না আপনায়।’

আরাব হাসে। অন্তির মনে হয় লোকটা পাগল। মানসিক ভাবে অসুস্থ। নয়তো এমন ভাবে কেউ হাসে? অন্তি উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না। তার এই পাগল ধরণের মানুষটার সাথে কথা বলতে একদমই ভালো লাগছে না। লোহার দরজা ঠেলে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নামতে নিলে পেছন থেকে আরাব বলে,

‘পালাচ্ছেন? ওকে যান। আপনাকে পালাতে দিলাম। কিন্তু এটাই শেষ। দ্বিতীয়বার আমার সামনে আসার আগে অন্যপুরুষের নাম মাথা থেকে মুছে ফেলে আসবেন। আপনার মুখে অন্যপুরুষের নাম পছন্দ হয়নি আমার। আর শুনুন, কাঁদবেন না। আপনার কান্না খুবই ভয়ংকর। আমাকেও দুঃখি করে তোলে।’

অন্তি পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। তার ভিষণ কান্না পাচ্ছে। সবাই তাকে খেলনা মনে করছে। যার যেমন ইচ্ছা তেমন আচরণ করছে তার সাথে। সে আর নিতে পারছে না। বসার ঘরে সকলে মিলে গল্প করছিলো। ভেতরে তাদের আপ্পায়নের ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্তি ছাদ থেকে নেমে সরাসরি সাহেদের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। আশপাশে নজর না দিয়ে জোর গলায় বলে ওঠে,

‘বাসায় চলো বাবা।’

অন্তি সাধারণত বুঝদার সামাজিক ধরণের মেয়ে। চটপটে হলেও অবস্থান বুঝে আচরণ করে। নাহার রাগি চোখে মেয়ের দিকে তাকালেও সাহেদ শান্ত ভাবে জিজ্ঞাস করে,

‘কি হয়েছে মা? কোনো সমস্যা?’

অন্তির গলা কাঁপছে। চোখে পানি জমেছে। ভেজা গলায় সে বলে ওঠে,

‘আমি বাসায় যেতে চাচ্ছি বাবা।’

সাহেদ আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করেন না মেয়েকে। অত্যন্ত নম্র ভাষায় ক্ষমা চান আজিম সাহেবের কাছে। মিসেস আজিম কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েছেন যেটা তার চুপসানো মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। সাহেদের কাছে ফাস্ট প্রেয়রিটি তার পরিবার। পরিবারের পর সকল সম্পর্ক। সে তার মেয়েকে জানে। তার মেয়েটা অকারণেই এমন বাচ্চামো করে না। এর পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাড়িতে ফেরার যাত্রাটা ছিলো অত্যন্ত নিরব। সাহেদ বা নাহার কেউ কোনোরূপ কথা বলেনি। এমনকি বাড়িতে ফিরেও সাহেদ অন্তিকে কিছু বলেনি। কেবল শান্ত গলায় বলেছিল,

‘নিজের ঘরে যাও। ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও। সকালে কথা হবে।’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে ফিরে গেলো। ধরজা বন্ধ করে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর হুট করেই কেঁদে উঠলো। গভীর রাত পর্যন্ত তার কান্নার পাট চললো। আজ রাতে তাকে খাওয়ার জন্য ডাকা হয়নি। হয়তো কেউ তাকে বিরক্ত করতে চায়নি বলেই।

খোলা আকাশের নিচে ছোট্ট একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছে অন্তি। মাথার উপর ঝকঝকে ফর্সা আকাশ। ঝলমল করছে রোদ। নরম সবুজ ঘাস বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। অন্তি নগ্ন পায়ে নরম ঘাসে পা রেখে বসে আছে। জায়গাটা তার খুব চেনা। এখানে প্রায়ই দিহানের সাথে আসা হয়। কিছুটা দূরেই তিনতলা পুরোনো‌কলেজ ভবন। অন্তি যেখানে বসে আছে আছে এটা কলেজ মাঠ। যেখানে সে প্রথম দিহানকে দেখেছিলো। তার স্বপ্নের পুরুষ! অন্তির ঠোঁট ছুঁয়ে যায় মিষ্টি হাসি। অন্তির চোখ যায় কিছুটা দূরে। হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে তার পুরুষটি এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে তার পানে। হাতে হলুদ রঙের এক গুচ্ছ গোলাপ। অন্তির চোখ ঝলসে ওঠে। আনন্দে পানি জমে চোখে। প্রথমবারের মতো তার জন্য ফুল এনেছে দিহান। অন্তির মন চায় এক ছুটে গিয়ে দিহানকে আঁকড়ে ধরতে। লক্ষ কটিবার বলতে,

‘ভালোবাসি আপনাকে।’

কিন্তু সে ঠাঁয় বসে রয়। দিহান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুচকি হেসে গোলাপ গুচ্ছ বাড়িয়ে ধরে। স্নিগ্ধ কন্ঠে বলে,

‘তোমার জন্য এনেছি।’

জমে থাকা অভিমান ঝড়ে গেল নিমিষেই। বসা থেকে উঠে মানুষটিকে আঁকড়ে ধরতে গেলেই সে পিছিয়ে যায়। অন্তি ছলছল হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয়। কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে,

‘দূরে যেতে চাচ্ছেন?’

দিহানের হাসি হাসি মুখটা হঠাৎ ই ভিষণ গম্ভীর হয়ে পড়ে। আকাশে জ্বলতে থাকা সূর্যটা হঠাৎ করেই অতল গভীরে হারিয়ে যায়। অন্ধকারে বুদ হয়ে আসে চারপাশ। মেঘ গর্জে ওঠে। মুশলধারে বৃষ্টি নামবে তার ই জানান দিচ্ছে যেন প্রকৃতি। অন্তি হঠাৎ করেই ভিষণ ভয় পায়। ভয় থেকে মুক্তি পেতে আশ্রয়ের জন্য দিহানের কাছে যেতে নিলে দিহান আবারো পিছিয়ে যায়। অন্তি থমকে দাঁড়ায়। কান্না ভেজা গলায় বলে ওঠে,

‘এমন করছেন কেন দিহান? আমি ভয় পাচ্ছি। আপনার কাছে একটু আশ্রয় দেন।’

দিহানকে ভিষণ শান্ত দেখালো। শীতল দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কেমন প্রাণহীন সে চাহনি। তেমনি প্রাণহীন গলায় জবাব দেয় দিহান।

‘আশ্রয় নেই রূপ। ফিরে যাও। আমার নিকট পা বাড়ালেই তুমি হারিয়ে যাবে। অতল‌ গভীরে ডুবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমার দেওয়া এই এক গুচ্ছ গোলাপ আমাদের বিচ্ছেদের রং। আমাদের বিচ্ছেদটাই কেবল ঝলমলে ঠিক এই এক গুচ্ছ গোলাপের মতো।’

অন্তি চিৎকার করে প্রতিবাদ করে ওঠে।

‘আমি এই বিচ্ছেদ মানি না। আমি এমন রং চাই না। আমি রংহীন আপনাকেই চাই। আমি অন্ধকারকেই আপন করে চাই। প্লিজ আপনি দূরে যাবেন না।’

দিহান শুনলো না। একরাশ কালো ধোঁয়ার মাঝে হারিয়ে গেলো। তাকে ফেলে রেখে চলে গেলো সে। সে যেতেই আকাশ থেকে মেঘ কেটে গেলো। ঝলমল করে উঠলো রোদ। ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠলো পরিবেশ। অন্তি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কিছুটা দূরেই পরে আছে দিহানের আনা এক গুচ্ছ ফুল। অন্তি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,

‘আমার রং চাই না দিহান। আমার আপনাকে চাই। শুধু আপনাকে।’

তীব্র ঝাঁকিতে অন্তি চোখ মেলে তাকায়। তার পাশে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে নাহার। তাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখতেই সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো,

‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? উঠে পর। সব কিছু ঠিক আছে। তোর বাবা অপেক্ষা করছেন। জলদি উঠে ফ্রেশ হয়ে নে।’

_____________

বেশ কিছুদিন পর নুহাশের নম্বর থেকে কল পেয়ে ভিষণ অবাক হয়েছে তন্নি। সে তো ভেবেছিল লোকটা বোধহয় তাকে ভুলে গেছে। এ জন্য তার কিছুটা মন খারাপ ও হয়েছিলো বটে। এমন দাজরেল লোকের জন্য মন খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই, তবুও তার মন খারপ হয়েছিলো। কেনো তার উত্তর অজানা। তন্নি কল রিসিভ করতে দেরি করে না। কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নুহাশের ক্লান্ত গলা শোনা যায়।

‘বারান্দায় আসো।’

তন্নি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নুহাল এর আগে কখনো দিডনের বেলায় তার বারান্দার নিচে আসেনি। এটাই প্রথম। দিনের ঝলমলে আলোতে এই প্রথম তন্নি বারান্দা থেকে নুহাশের স্পষ্ট মুখ দেখতে পায়। কেমন মুর্ষে পরা অবস্থা মানুষটার। তন্নি তাকিয়ে থাকে নুহাশের ক্লান্ত চোখ জোড়ার দিকে। আজ যেন ভয় লাগছে না তার লোকটাকে দেখতে। বরং মায়া হচ্ছে। তন্নি কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে,

‘ঠিক আছেন?’

‘হুম।’

‘আপনাকে ক্লান্ত লাগছে।’

‘আচ্ছা।’

তন্নি বলার মতো কিছু খুঁজে পায়না। নুহাশের নিরবতা তার কেন যেন পছন্দ হচ্ছে না। মন বলছে লোকটা তাকে বকুক। ধমক দিক। রাগি চোখে তাকাক তার দিকে। তবুও এমন নিরব না থাকুক। তন্নির আকুতি হয়তো শুনলো সে। নরম গলায় ডাকল,

‘তন্নি!’

‘হুম।’

নুহাশ খানিক থেমে বলে,

‘আমাদের আর কথা না হোক। ভালো থেকো। আমি চাই চাই তুমি ভালো থাকো। পারবে‌ না ভালো থাকতে?’

অনাকাঙ্ক্ষিত এমন প্রশ্নে থমকে যায় তন্নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ক্লান্ত চিত্তের মানুষটার পানে দৃষ্টি থমকে থাকে। পালাতে পালাতে আজ যখন সে ধরা দিতে চাইলো তখনই কিনা লোকটা সবকিছুর ইতি টানতে চাইছে! মন কেঁদে উঠলেও কঠোর মুখে শক্ত ভাবে সে জবাব দিলো,

‘তাই হোক। আর কথা না হোক।’

চলবে……

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৬.
খবরের কাগজ পরতে পরতে চায়ে চুমুক বসাতেই নাক মুখ কুঁচকে ফেলল সাহেদ। অত্যন্ত তিক্ত স্বাদ যুক্ত এই চা তার স্ত্রী নিজ হাতে তার জন্য বানিয়েছে। সাহেদ বুঝতে পারেনা নাহার ভালোবেসে তার জন্য চা বানালেই কেন সেটা তিক্ত হয়! ভালোবাসা মিষ্টি হতে হয় কিন্তু তার স্ত্রীর ভালোবাসা তিক্ত। এতটাই তিক্ত যা মুখে তোলা ভার হয়ে যায়। হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে নাহারকে ডাকেন তিনি। নাহার তখন রান্নাঘরে পারুকে আজকের কাজ বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। স্বামীর ডাক পেতেই শাড়ির আঁচল কোমর থেকে ছাড়িয়ে বসার রুমে পা বাড়ান। যেতে যেতে পারুকে হুঁশিয়ারি ভাবে বলেন,

‘আগ বাড়িয়ে কিছু করবি না। বাকিটা আমি এসে বুঝিয়ে দেব।’

পারু অসন্তোষ চিত্তে মাথা নাড়ায়। নাহারের এমন হুঁশিয়ারি বার্তা তার পছন্দ না। নাহার যেতেই মুখ বাঁকিয়ে বলে,

‘মায়ের প্যাটেত্তে পড়তেই কাজ শুরু করছি। এহন ও কাজ সেখন লাগবে নাকি!’

বিদ্ধস্ত মেজাজ নিয়ে সবজি ঝুড়িতে গোছাতে লাগলো। সাথে সমানভাবে বেজে চলছে তার একান্ত রেডিও। যা বর্তমানে নাহারের বিরুদ্ধে বাজছে।

শীতের সকালের রোদটা ভিষণ মিষ্টি। অন্তিদের লিভিংরুমের বড় জানালাটা থেকে সরাসরি রোদ এসে সোফায় পড়ে। হাল্কা ঠান্ডা সকালে এমন রোদে বসে চা খেতে ভারী আনন্দ। সাহেদ সেই রোদ গায়ে মাখতেই এখানে বসেছে। নাহার আসতেই সে ভিষণ আফসোসের সুরে বললেন,

‘চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে নাহার। বেশি চিনি দিয়ে আর এক কাপ চা হবে?’

‘চা থেকে যে ধোঁয়া উঠছে?’

‘ওটুকু গরম কিছুনা। আর এক কাপ চা করে দাও না! সাথে মেয়েকেও ডেকে দাও।’

ততক্ষণে অন্তিও ফ্রেস হয়ে চলে এসেছে। বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাকে বলে,

‘আমাকে এক মগ কফি।’

টেবিল থেকে চায়ের কাপ তুলে নাহার মেকি হেসে বলে,

‘আর কিছু লাগবেনা তোমাদের? আমিতো সকাল সকাল এ বাড়িতে হোটেল খুলে বসেছি! আর কি কি লাগবে বলো, এনে দেই!’

সাহেদ চুপ করে থাকেন। গত রাগ থেকেই নাহারের মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এখন জবাব দেওয়া মানেই অথৈ সাগরে ঝাঁপ দেওয়া। নাহার থমথমে মুখ নিয়ে রুম ছাড়তেই সাহেদ আয়েশ করে বসেন। খবরের কাগজটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,

‘দেখো তো রাশি চিহ্ন আছে নাকি এটায়। আমি আমার রাশিটা চেক করতে চাই।’

অন্তি বাবার উপহাস বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেসে ফেলে। বাবা মেয়ের হাসির পর্ব শেষ হতে সাহেদ কিছুটা সিরিয়াস ভাবে নড়েচড়ে বসেন। গতরাতের ব্যাপারটা নিয়ে মেয়ের সাথে সরাসরি আলোচনায় বসার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিভাবে কথা শুরু করবেন খুঁজে না পেলে মেয়ের দিকে ফিরে অগোছালো ভাবেই বলেন,

‘গতরাতের ব্যাপারে কিছু বলো? তোমার সমস্যাটা আমাদের জানাতে হবে তো মা। না বললে বুঝে নেওয়ার মতো ক্ষমতা পৃথিবীর কারোর নেই। আমাদের বললে তবেই আমরা বুঝবো।’

অন্তি চুপ হয়ে যায়। হাতের পেপারটা সুন্দর করে ভাঁজ করে টেবিলের নিচের তাকে রাখে। সেখানে এমন ভাঁজ করা আরো অনেক পেপার জমে আছে। গত মাসের পেপারগুলো এখনো এখান থেকে সরানো হয়নি। পেপার সরানোর কাজটা প্রতিমাসে পারু নিজ দায়িত্বে করে থাকে। সামনের মুদিদোকানে বিক্রি করে অতিক্ষুদ্র সংখ্যক টাকা পায় সে। তাতেই মহাখুশি মেয়েটা। এ মাসে হয়তো ভুলে গেছে!

‘কি ভাবছ?’

অন্তি সোজা হয়ে বসে। এবার সে কিছুতেই পূর্বের ন্যায় ভুল করবে না। কিছুটা সংকোচ নিয়েই সে বলে ওঠে,

‘বিয়েটা এখন না হলেই কি নয় বাবা? আমাকে কিছুদিন সময় দাও প্লিজ। আমি এখনি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না।’

অন্তি এটুকু বলে থামে। টলমলে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। নাহার কখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে তা দুজনের কেউই টের পায়নি। গতরাতে মেয়ের আচরণে রেগে ছিলেন তিনি। এখন অন্তির মুখে এমন কথায় চেপে থাকা রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দিক দিশা হারিয়ে ছুটে এসে মেয়েকে টেনে তুলে জোর হাতে থাপ্পর দেন। চিৎকার করে বলে ওঠেন,

‘বেশি বুঝতে শিখে গেছিস? এই বয়সেই এত বুঝতে শিখে গেছিস? সব ঐ বখাটেটার জন্য তাই না? আমি কিছু জানিনা ভেবেছিস? কাল কোথায় গিয়েছিলি সেটা আমি জানিনা ভেবেছিস। তোকে ভালো হতে সুযোগ দিয়েছি আমি। নিজের ভুল বোঝার সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু তুই? যে পথে ছিলি সে পথেই চলছিস।’

রাগে শ্বাস তুলতে পারছে না নাহার। গতকাল তন্নিদের বাড়িতে মেয়েকে না পেয়ে সে বাড়ি ফিরে এসেছে। সে গিয়েছিল এ ব্যাপারে তন্নিও জানেনা। তখন থেকেই মেয়ের উপর সন্দেহ ছিল তার। মেয়েটা এখন লুকিয়ে ঐ বখাটের সাথে দেখা করে। সাহস কত!

হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যাবে সাহেদ বুঝতে পারেনি। আচানক ঘটনায় থমকে গেছিলো সে। সম্বিত ফিরে পেতেই কড়া গলায় স্ত্রীকে বলেন,

‘নাহার তুমি এখান থেকে যাও। মেয়ের সাথে আমি কথা বলছি।’

‘কি বলবে তুমি? জানোয়ার ধরেছি পেটে। আমাদের কথা বুঝবে না ও। ও ওর বোধ হারিয়ে ফেলেছে।’

সাহেদ চিৎকার করে ধমক দেন এবার।

‘সেটা বোঝার জন্য এখনো আমি বেঁচে আছি। তোমাকে বিচার করতে হবে না। ভেতরে যাও। দ্বিতীয়বার না বলতে হয়!’

স্বামীর কথার উপর কথা বলার সাহস পেল না নাহার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরো একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে রুম ছাড়লেন। অন্তি থম ধরে বসে আছে। চোখে পানি নেই তার। এসব কিছু যেন তাকে ছুঁতে পারেনি। পাথরের মতো হয়ে গেছে তার মন। আজ মায়ের কথার জবাব দিতেও তার ইচ্ছা হয়নি। সাহেদ চেয়েও আর কিছু বলতে পারলো না। নরম গরায় মেয়েকে রুমে যেতে বলে সে নিজেও নিজ রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। অন্তি মুচকি হেসে বললো,

‘গতকাল আমি দিহানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম বাবা।’

সাহেদ দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে মেয়ের দিকে তাকান। অন্তি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে ওঠে,

‘কিন্তু সে আসলো না বাবা। আমি অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পরও সে আসলো না। কাল থেকে তাকে কল করছি, কিন্তু সে ফোন ধরছে না। ব্যাপারটা ভিষণ মজার তাই না? তোমরা সকলে একসাথে আমাকে ত্যাগ করার চিন্তা করছো! তোমরা চাচ্ছো আমায় বিয়ে দিয়ে দূরে সরাতে; দিহান ও হয়তো তাই চায়!’

অন্তির চোখ ছলছল করে ওঠে। সাহেদ মেয়ের মানষিক অবস্থা বুঝতে পেরে আহত হয়। তার চঞ্চল মেয়েটা কোথায়? কেমন করে কি হয়ে গেলো? বুক ধরে আসে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে ভেতরটা। কোমল গলায় বলে,

‘রুমে যাও। বিশ্রাম নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সব ঠিক হয়ে যাবে, এই কথাটা অন্তির কাছে কৌতুক ঠেকলো। আদেও কিছু ঠিক হওয়ার আছে?

______________

দিহানের জ্ঞান ফিরেছে। রেহানা সকাল সকাল চলে এসেছেন। তাকে না জানাতে চাইলেও ছেলের মায়ের কাছ থেকে এত বড় কথা লুকিয়ে যাওয়া অন্যায় হবে ভেবে পরে রেজওয়ান নিজেই জানান তাকে। ছেলের অবস্থা দেখে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। বর্তমানে দিহানের পাশের বেডে সেলাইন হাতে সুইয়ে রাখা হয়ে তাকে। রেজওয়ান মির্জার কপালে ভাঁজ সূক্ষ্ম হয়েছে। তাকে দেখে অত্যন্ত চিন্তিত মনে হচ্ছে। নাহারের পায়ের কাছে বসে মিণু নাহারের পায়ে তেল মালিশ করছে। সাথে বিলাপ করে গুণগুণ করে কাঁদছে।

‘স্যার ছোট সাহেব ডাকেন আপনাকে।’

মাহবুবের কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে কেবিনে প্রবেশ করেন রেজওয়ান মির্জা। দিহান পিঠে বালিশ ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। পাশে নুহাশ গ্লাসে করে বেদানার রস খাওয়াচ্ছে তাকে। এক হাতে সেলাইন অন্যহাতে চোট থাকায় নিজ হাতে খাবার তুলে খেতে অক্ষম সে। দিহানের এমন করুণ অবস্থা দেখে নুহাশ না চাইতেই চোখ থেকে দু ফোটা পানি ঝরিয়ে ফেলেছে। তা দেখে দিহান সময় ব্যায় না করেই ধমকে উঠে বলেছে,

‘মাইয়্যাদের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করলে লাথি মাইরে কেবিনের বাইরে ফেলবো। তোর ঐ ফ্যাচকাদুনি গার্লফ্রেন্ডের স্বভাব পাইছো? কান্না থামা ডাফার।’

দিহানের ধমকে চোখের পানি থামলেও মুখে আঁধার নেমে আসে তার। গার্লফ্রেন্ডের কথা বলতেই তার তন্নির কথা মনে পড়ে। আজ সকালেই তো সে ইতি টেনে এলো সবকিছুর। গার্লফ্রেন্ড আর হলো কোথায়? তাদের সম্পরৃকের একটা নাম দেওয়ার আগেই সমাপ্তি ঘটেছে। মেয়েটার চাহনি কতটা নিথর হয়ে পড়েছিল ভাবতেই কষ্ট হয় তার। মুখে অন্যকথা বললেও তার চোখ নুহাশকে এভাবে যেতে না করছিলো। বোকা মেয়েটা বোধহয় এতদিনে তার অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলো!

‘এভাবে মুর্তির মতো বসে আছো কেন? একটা কাজ অন্তত মন দিয়ে কর। কোনো কাজেই দেখছি তোমার মন নেই।’

রাশভারী গলার ধমকে নুহাশ নড়েচড়ে উঠে। রেজওয়ান মির্জাকে দেখা মাত্র চেড়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে তিনি কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন,

‘স্কুলের হেডমাস্টার না আমি। বসো। নিঝের কাজে মন দাও।’

নুহাশ দাঁত চেপে স্বল্প হাসার চেষ্টা করে। দিহানের দিকে তাকালে দেখা যায় সে কিছু দেখেনি এমন ভাবে বসে আছে। কতবড় মিরজাফর হলে বন্ধুর সাথে এমন আচরণ করতে পারে? এই যে নিজে না খেয়ে বসে বসে খাওয়ায় দিচ্ছে এর জন্য সামান্যতম সিমপ্যাথি তো সে ডিজার্ভ করে! নুহাশ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুচকি হেসে বলে,

‘আঙ্কেল ওর পেট ফুল। এখন আর খাবেনা বলেছে। আপনারা কথা বলেন। ঘন্টাখানেক পর আবার কিছু খাওয়ায় দিবোনি।’

কথাটা বলে গ্লাসের বাকিটুকু জুস নিজে খেয়ে ফেলে দিহানকে চোখ টিপি দেয়। বিছানায় শুয়ে থেকে তার সাথে পাঙ্গা নিতে এলে এভাবেই না খাইয়ে সাস্থি দিবে সে। হাত পায়ের যে অবস্থা তাতে দিহান কেবল মুখের কথা দ্বারাই তাকে মারতে পারবে হাত পা চালানোর ক্ষমতা নেই। নুহাশ বুক ফুলিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। দিহান সূক্ষ্ম চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কি হলো? সে খাবেনা তা কখন বললো?

_______________

‘তোমার কারো উপর সন্দেহ আছে যারা এমন করতে পারে?’

‘না।’

‘যারা তোমাকে মেরেছে তাদের কাউকে চেনো?’

‘না।’

রেজওয়ান অধৈর্য হয়ে ওঠেন। ওকালতি জবটাকে তার এতদিন নিতান্ত আন্ডাররেটেড জব বলে মনে হতো। কিন্তু ছেলের থেকে তার দুর্ঘটনার কথা শুনতে যেয়ে তার মনে হচ্ছে ওকালতি আসলে উচ্চসম্মান যোগ্য একটা পেশা। এই পেশাধারী সকল পুরুষকে অস্কার প্রদান করা উচিত।
রেজওয়ান মির্জা ছেলের উপর চরম হতাশ হয়ে বলেন,

‘তোমার নিজের জীবনের চিন্তা না থাকতে পারে কিন্তু তোমার মায়ের চিন্তাটা একটু করো। তোমার মা কতটা নরম মনের সেটা তুমি জানো।’

দিহান সোজা গলায় উল্টো প্রশ্ন করে,

‘মাকে এখানে আনার মতো খাটো বুদ্ধিটা কে দিয়েছে আপনায়?’

রেজওয়ান মির্জার মুখ চুপসে যায়। এ বুদ্ধিটা তাকে কেউ দেয়নি। কিন্তু ছেলের অপমান জনক চাহনির শিকার হওয়ার ভয়ে তিনি চেপে গেলেন। তাকে বাঁচাতে মাহবুব প্রসঙ্গটাকে বদলাতে নিজ কদম এগিয়ে বললেন,

‘দিহান সাহেব আপনার উচিত কিছুটা সময় বাড়িতে কাটানো। সারাদিন বাড়ির বাহিরে থাকলে ম্যাডাম এমনিতেও আপনার চিন্তায় বুদ হয়ে থাকে।’

চতুর বুদ্ধিধারী দিহান মাহবুব সাহেবের কথাটাকে কাজে লাগিয়েই নিজ কার্য হাসিলের পথ বের করে নিলো। সময় এবং সুযোগ এর যথাযথ ব্যাবহারের দক্ষতাধারী দিহান বাঁকা হেসে রেজওয়ান মির্জার চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে,

‘বাবা হয়ে ছেলেকে ঘরে আটকাতে পারছেন না? ব্যাপারটা হাস্যকর। আমাকে ঘরে আটকানোর ব্যবস্থা করুণ। সুযোগ কিন্তু বারবার আসবে না। লিমিটেড অফার।’

চলবে……….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-২৩+২৪

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৩.
ব্যস্ত ঢাকার সড়কে আধঘন্টা যাবত আটকে রয়েছে রেজওয়ান মির্জার আলিশান গাড়িটা। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা অবস্থায় তার কপাল থেকে টুপটাপ করে ঘাম ঝড়ছে। এসি অন থাকা সত্ত্বেও তার শরীরের তাপ যেন প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে। পাশেই তার ম্যানেজার লোকটা আশপাশে বিরক্ত ভঙ্গিতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আরো পনেরো বিশ মিনিটে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। চিন্তিত মুখে সে মির্জা সাহেবের দিকে তাকায়। ছোট করে বলে,

‘স্যার আরো কিছু সময় দরকার হবে। এই মুহূর্তে অন্য রুট নেওয়াও সম্ভব না। আমরা মাঝ রাস্তায় আটকে আছি।’

কপালের পাতলা চামরা কুঁচকে আসে রেজওয়ান মির্জার। পাশ থেকে পানির বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে গিলে নেয় খানিক। অসম্ভব চিন্তায় হাত পায়ে কাঁপন ধরেছে তার। পুরুষকে কাঁদতে নেই তবুও কেন যেন তার চোখ বারবার ভিজে আসতে চাইছে। তৎক্ষণাৎ ফোনে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় অপরিচিত কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,

‘আপনারা আসতে এত সময় কেন নিচ্ছেন? রোগীর কন্ডিশন ভালো না। তিন ব্যাগ ব্লাড ইতিমধ্যে প্রোভাইড করা হয়েছে। আরো দু একব্যাগ লাগতে পারে। আমরা রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিতে পারছি না। এটা কোনো মার্ডার কেস হতে পারে। শরীরে অসংখ্য ছুড়ির আঘাত রয়েছে। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করা দরকার। বুঝতে পারছেন?’

রেজওয়ান মির্জার শ্বাস আটকে আসতে চায়। কন্ঠনালি শুকিয়ে আসে। গলা থেকে শব্দ গুলো যেন বের হতে চায়না। বহু কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে ওঠে,

‘সকল ব্যাবস্থা করুণ। আমরা আসছি। অপারেশন শুরু করুণ। অপেক্ষা করবেন না। আপনাদের সো কলড ফর্মালিটির জন্য আমার ছেলের কিছু হলে এর ফল মোটেই ভালো হবে না।’

‘কিন্তু…’

‘যেটা বলেছি সেটাই করুণ।’

কল কেটে বড় করে শ্বাস ফেলে রেজওয়ান মির্জা। লাল হয়ে আসা চোখ নিয়ে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘অন্যকোনো ব্যাবস্তা করো মাহবুব। দু সেকেন্ড অপেক্ষা চাই না।’

মাহবুব নামের লোকটা দ্রুত মাথা নাড়ায়। কিভাবে কি ব্যাবস্থা করবে তা তার জানা নেই। তবে তাকে কিছু একটা করতে হবে। গাড়ি থেকে কোনোভাবে নেমে যায় সে। রাস্তার জ্যাম দীর্ঘ। তেমনি দীর্ঘ জ্যাম বর্তমানে তার মাথায়। দিক দিগন্ত শূন্য হয়ে পড়েছে তার। কপালে ভাঁজ ফেলে দ্রুত কোনো সুরহার কথা ভাবতে থাকে।

________________

ঘড়ির কাঁটা দুপুর একটার কাছে। সূর্যের তেজ বেড়েছে। সাথে ভাপসা গরমের উপস্থিত ও। অন্তি বর্তমানে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। সবুজ গাছপালায় ঘেরা এক ছোট্ট পার্ক। এখানে খুব একটা মানুষজন নেই। পার্কের খোলা মাঠে ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। অল্প কিছু স্কুল পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের দেখা যাচ্ছে এক কোণে। জোড়ায় জোড়ায় তারা। নিঃসন্দেহে স্কুল পালিয়ে ঘুরতে এসেছে। অন্তি আগ্রহভরা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ওখানে থাকা প্রতিটা মেয়ের হাতেই একটা করে গোলাপ। তাদের প্রেমিকের তরফ থেকে পাওয়া গোলাপ। মুখে লাজুক হাসি। কি সুন্দর চোখে চোখে কথা হয় তাদের। যত্ন করে চুল গুঁজে দেওয়া হচ্ছে কানের পেছনে। অন্তির হঠাৎ করেই ভিষণ মন খারাপ হয়। ছলছল হয় চোখ। কিশোরী মনে কিছু প্রেমময় স্মৃতির অভাবে হাহাকার করে ওঠে। ব্যস্ত হাতে পুনরায় প্রেমিক পুরুষটির ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠানো হয়।

‘আমার একটা গোলাপ চাই। আপনার নামের গোলাপ।’

উত্তর আসবেনা জেনেই দ্বিতীয় ম্যাসেজ পাঠায়।

‘আপনি ভিষণ পাষাণ প্রেমিক। আমার কি এই মুহূর্তে রাগ করে বিচ্ছেদ ঘটানো উচিত?’

অন্তি নিজেও জানে তার দ্বারা বিচ্ছেদ কখনোই সম্ভব নয়। যাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই তার দম বন্ধ লাগে তাকে পেয়েও ছেড়ে দেওয়া যায়? কখনোই না। দিহান যেতে চাইলেও অন্তি যেতে দিবে না। সেখানে ছেড়ে দেওয়ার কথা নিতান্তই বোকামি। অন্তি ফোন রেখে চুপটি করে বসে থাকে। পেটে ক্ষুদা অনুভব হয়। দিহানের সাথে দেখা করার উত্তজনায় সকালে খাওয়া হয়নি। আর এখন মন খারাপের ভারে খাওয়া হচ্ছে না। তার আনা বাটির খাবারটাও নিশ্চই ঠান্ডা হয়ে এসেছে? হোক ঠান্ডা। এই ঠান্ডা খাবারই খেতে হবে লোকটাকে। দেরী করার শাস্তি এটা।
পার্কের এক সাইডে কিছু ছোট দোকান বসেছে। ঝালমুড়ি, ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। খালি পেটে এসব তেলযুক্ত খাবার ভয়ংকর পতিক্রিয়া করবে যেনেও অন্তি সেদিকে পা বাড়ায়। আজ সে নিষিদ্ধ ভয়ংকর কাজ গুলোই করবে। হলে হোক কিছু ক্ষতি!

অন্তির মন খারাপের কথাগুলো কিভাবেই যেন তন্নি যেনে যায়। তার একা লাগা সময়গুলোতেই হুট করে কল করে বসে মেয়েটা। অন্যসময় তন্নির অযথা আলাপ বিরক্ত ঠেকলেও তখন কোনো বিরক্ত কাজ করে না। অন্তি খুব মনোযোগী স্রোতার মতো তন্নির প্রতিটা শব্দ মন দিয়ে শোনে। আজ ও হলো তাই। ফুচকা খেয়ে বিল মিটিয়ে পূর্বের জায়গায় এসে বসতেই কল আসে তন্নির। ঠোঁট চিড়ে হাসি ফুটে ওঠে অন্তির। কল রিসিভ করতেই তন্নি হামলে পড়ে।

‘কোথায় তুই? আমার বাড়ি কখোন আসছোস? বাই এনি চান্স পালায় যাসনিতো দোস্ত? কি ভয়ংকর কথা! আমাকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?’

‘না।’

‘মিরজাফোর! যাই হোক বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস? দিহান ভাইয়ের মতো মানুষ আসলেই এমন চমৎকার কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে?’

অন্তি হাসে। জবাব দেয়না। তার নিরবতা অনেক কিছুই প্রকাশ করে। ফোনের ওপাশ থেকে তন্নি বলে ওঠে,

‘কোথায় তুই? আন্টি কল করেছিলো। হয়তো সন্দেহ করেছে তোকে। আমি হঠাৎ করেই ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমাকে বলে যাবি তো যেখানেই যাস!’

‘স্যরি। মাথায় ছিলো না।’

‘হুম। এখন ঘটনা কি? কথা এমন ভার কেন? ঝগড়া হয়েছে?’

অন্তির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে উঠে জানায়,

‘সে আসেনি। আমি অপেক্ষা করছি। এমন পাষাণ লোককে কেন আমি এত ভালোবাসি? আমার একদম তাকে ভালোবাসা উচিত না।’

তন্নি অবাক হয়। সাথে চিন্তিতও। বলে,

‘তুই এখন কোথায় পাখি?’

‘গুলশান। এক্সাক্ট লোকেশন জানিনা।’

‘পাগল তুই? ওদিকে কেন গেছিস? ভাইয়া জানে?’

‘ম্যাসেজ করেছি।’

‘আযব! কল করিসনি কেন? ম্যাসেজতো সে না ও দেখতে পারে। কল কাট। ভাইয়াকে কল কর কুইক। এমন বোকামি কেন করিস পাখি? দ্রুত আপডেট জানা। ওয়েট করছি আমি।’

দিহানকে কল করার কথা অন্তির মাথায় একবারের জন্যও আসেনি। নিজের এমন ছোট একটা ব্যাপারে এতবড় বোকামির জন্য আফসোস হয়। এই তন্নিটা কল না করলে হয়তো তার মাথায় এই অতি সাধারণ কথাটা কখনোই আসতো না। নিশ্চই মানুষটা ব্যাস্ততার জন্য ম্যাসেজ খেয়াল করেনি। অন্তি নিজ মাথায় চাপড় কাটে। কেঁদে কেটে লাল করে ফেলা মুখটা হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু এটা খানিকের জন্য। দিহানের নম্বর অফ। মুখ শুকিয়ে আসে অন্তির। সাথে এভাবে হুট করে এতদূর একা চলে আসার জন্য ও আফসোস হচ্ছে। দীর্ঘ এক ঘন্টা বাস জার্নি করে এখানে আসা মোটেই তার জন্য সহজ ছিলো না। তার উপর সবটা অপরিচিত। নিজের উপর রাগ হওয়ার সাথে দিহানের উপর ও চাপা অভিমান জমে। সে জানে না আজ অন্তি তাকে কল দিতে পারে? তবুও কেন ফোন বন্ধ রাখবে?
দিহানের জন্য কেনা এক পাউন্ডের ছোট কেকটা অন্তি মাঠে খেলা বাচ্চাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। তার রান্না করা খাবারের প্রথম স্বাদটাও বাচ্চারাই পায়। কিন্তু এতে তাদের রিয়্যাকশন মোটেই ভালো ছিলো না। রান্নাটা কি একটু বেশিই খারাপ হয়েছে?
দিহান আসবেনা যেনেও অন্তি তিনটা পর্যন্ত ওখানে বসে থাকে। একা একা রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে বেড়ায়। নিজের জন্য একটা গোলাপ কিনে কানে গুঁজে নেয়। সবশেষে বাড়ি ফেরার পথে পুনরায় দিহানের নম্বরে একটা টেক্সট পাঠায়।

‘আজ দিনটা সুন্দর। ঝলমলে। ঠিক আপনার মতো। এতো সুন্দর একটা দিনে পৃথিবীতে আগমনের জন্য আপনাকে সুভেচ্ছা প্রিয়।’

পরপর দিহানের জন্য কেনা কেকটার একটা ছবি পাঠায়। সাথে বাচ্চাগুলোর ও।

‘আপনাকে ছাড়াই আপনার জন্মদিন উদযাপন করে ফেলেছি। রাগ করবেন না। রাগ করলেও আমি রাগ ভাঙাবোনা একদম। আপনি জানেন কতো অপেক্ষা করেছি?’

অন্তির হাত থামে। বাসের জানালা থেকে বাহিরে উদাস দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রয়। মন তার হাহাকার করে বলে ওঠে,

‘আমি ভিষণ দুঃখি প্রিয়। আপনায় পাশে না পাওয়ার কষ্ট আমার গ্রাস করে নিচ্ছে। আমার বড্ড দুঃখ! বুঝলেন?’

চলবে…….

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৪.
মাহবুব নামের লোকটা মাঝ বয়সী। গোলগাল চেহারার স্বাস্থ্যবান লোক। রেজওয়ান মির্জার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন প্রায় বছর পাঁচেক। লোকটার মাঝে কাজ করার আলাদা রকম এনার্জি রয়েছে। সেই কখন থেকে লোকটা এখানে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। তবুও তার ক্লান্তি নেই। এত ছোটাছুটির মাঝেও খানিক পরপর এসে রেজওয়ান মির্জাকে শান্তনা দেওয়ার মতো করে বলে যাচ্ছেন,

‘স্যার চিন্তা নেই। ছোট সাহেব এখন ঠিকঠাক। জ্ঞানটা ফিরলেই সব সমস্যা সমাধান।’

রেজওয়ান মির্জা মাথা নাড়ায়। নড়েচড়ে বসে ক্লান্ত প্রশ্ন করে,

‘বাড়িতে জানিয়েছ?’

‘জ্বি না স্যার। আপনি বললে জানাবো।’

‘দরকার নেই মাহবুব। তোমার ম্যাডাম জানতে পারলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এখনি কিছু জানিওনা।’

‘আচ্ছা স্যার।’

‘ঐ বাঁদরের দলগুলো জানে?’

মাহবুব সামান্য দ্বিধায় পড়ে যায়। মিনমিনে গলায় বলে,

‘এটা কোন দল স্যার?’

রেজওয়ান মির্জা চোখ মুখ শক্ত করে তাকান। রাগতে যেয়েও রাগেন না। শক্ত জবাব দেন,

‘তোমার ছোট সাহেবের যে নামছাড়া একটা দল আছে, সেই দলের কথা বলছি। ওদের খবর দাও। এদের জন্যই আমার ছেলেটার আজ এই দশা।’

দিহানের দলের কোনো এক সদস্যকেই তার পছন্দ নয়। বিশেষ করে নুহাশ। তার মতে নুহাশের ভোলাভালা সুন্দর মুখটার পেছনে ভয়ংকর এক রূপ আছে। যা কেউ দেখতে পায়না। কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারে। ঐ ছেলেটাই তো তার ছেলেটার মাথা খেয়েছে। আস্ত এক অভদ্র ছেলে!

_______________

অন্তি যখন বাসায় ফিরলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। দিহানের আড্ডা দেওয়ার প্রতিটা জায়গায় সে গিয়েছিল। কোথাও সে দিহানকে পায়নি। চায়ের দোকানের ছেলেটাকে জিঙ্গাস করলে সে জানিয়েছে দিহান আজ সকাল থেকে এদিকে আসেনি। অন্তি বিষন্ন মন নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাড়িতে ঢোকার পথে দাড়োয়ান তাকে দেখতেই ভীতু গলায় প্রশ্ন করেন,

‘কোথায় ছিলেন আপামনি?’

অন্তি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। সরল জবাব দেয়,

‘বান্ধবীর বাসায় ছিলাম। কেন?’

‘চাচি তো সেই ক্ষ্যাপছে। আপনেরে খোঁজতে সে আপনের বান্ধবীর বাড়িতে গেছিলো। আপনে ছিলেন না সেইখানে।’

অন্তির আঁতকে উঠে। গলা শুকিয়ে আসে। মা হঠাৎ খোঁজ নিতে বের হলো কেন? দুরুদুরু বুকে সহসা প্রশ্ন করে।

‘খুব সিরিয়াস কিছু হয়েছে সুরুজ ভাই? বাবা বাড়িতে?’

‘চাচা একটু আগেই আসছে। দেইখা তো সিরিয়াস মনে হইলো। আপনি ঘরে জান। দেখেন কি অবস্থা।’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে আলতো হাসে। কিন্তু মাথায় তার হাজার খানেক চিন্তা। তন্নিও তখন কলে বললো সন্দেহের কথাটা। মা কি সত্যি কিছু সন্দেহ করেছে?

ড্রয়িংরুমের সোফায় পা তুলে বসে সাহেদ চা খাচ্ছে। চোখ তার এক হাতে ধরে রাখা পেপারে। টিভিতে একটা শো চলছে। গানের শো। টিভিতে গানের শো চালিয়ে পেপার পড়ার মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। এটা কোনো ট্যালেন্টকেও রিপ্রেজেন্ট করেনা। তবুও সাহেদ প্রায়শই এই কাজটা করে। এতে ঘরের কারো কোনো মাথা ব্যাথা না থাকলেও একজনের আছে। সে হচ্ছে পারু। এই সময়টুকু সে তার সিরিয়াল দেখায় পার করতে পারতো। কিন্তু সাহেদের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না। তখনি অন্তি দরজা ঠেলে ঘরে‌ প্রবেশ করে। অন্তিকে দেখতেই পারু প্রায় চিৎকার করে ওঠে,

‘আপনের আসার সময় হইলো এহন আপা?’

অন্তি ভনিতা ছাড়া জবাব দেয়,

‘কোনো ধরাবাঁধা সময় ছিল আমার আসার?’

‘না তা না..’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কি তা তো আমার তে আপনের মা ভালো বলতে পারবে। হের কাছে যান।’

অন্তি পারুর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সাহেদের পাশে গিয়ে বসে। অবাক গলায় বলে,

‘বাবা আজ এসময়ে বাসায় যে?’

সাহেদ পেপার ভাঁজ করতে করতে সোজা হয়ে বসে। চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মেয়ের দিকে ঘুরে সপ্রতিভ হাসে।

‘তোমাদের একজায়গায় নিয়ে বের হবো আজ। এজন্যই তাড়াতাড়ি বাসায় আসলাম। ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও।’

অন্তি কৌতুহল প্রশ্ন করে,

‘কোথায়?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’

_____________

নুহাশ সাথে আরো পাঁচজন ছেলে নিয়ে হাসপাতালে যায়। দিহানের খবর শোনার পর থেকেই তার হাত পা অস্বভাবিক হারে কাঁপছে। শরীর থেকে গাম গড়াচ্ছে অনর্গল। চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে।
রেজওয়ান মির্জা কেবিনের সামনে চেয়ার পেতে বসে রয়েছেন। ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। এখনো জ্ঞান ফেরেনি দিহানের। বারোবার ছুড়ির আঘাত করা হয়েছে তার শরীরে। মাথা ফেটেছে। পায়ে খুব ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করায় ফ্র্যাকচার হয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে দিহানের পুরো শরীরকে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ দ্বারা আবদ্ধ করা হয়েছে। রেজওয়ান খানিক বাদে বাদে দরজার কাঁচের অংশ দিয়ে ভেতরে নজর বুলাচ্ছেন। যতই ছেলের সাথে তার দন্দ, মত বিরোধীতা হোক, দিনশেষে তার একটা অংশ এই ছেলেটা। কঠোর ব্যক্তিত্ব নিয়ে তার সাথে লড়াই করা ছেলেকাকে এভাবে দেখতে তার বুকটা ভিষণ জ্বলছে। কাঁদতে না চাইলেই অবাধ্য জল চোখে হামলা করছে। বাব হয়ে ছেলের এ অবস্থা কিভাবে সহ্য করবেন সে?
নুহাশকে দেখতেই রেজওয়ান মির্জার গম্ভীর মুখটায় আরো গম্ভীরতা নেমে আসে। ভিষণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজার হামনে থেকে অল্প সরে দাঁড়ান। ধারালো গলায় বলেন,

‘দেখো কি অবস্থা তোমাদের বন্ধুর। এরপর ও তোমরা নিজেদের পথ পরিবর্তন না করলে আমার সত্যিই কিছু বলার থাকবে না। তবে আমার জায়গায় তোমরাও একদিন দাঁড়াবে। বাবা হয়ে দেখো, একজন বাবার দায়িত্ব, চিন্তা ঠিক কতটা। সেদিন তোমাদের এই নিষ্ঠুর আচরণের কথাও চিন্তা করবে। আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখবে, আমি ঠিক‌ কতটা শান্তিতে আছি।’

কাঁচের দরজার এপাশে নুহাশ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। চোখ থেকে তার টপটপ পানি পড়ছে। বিপদের কথা অনুমান
করেই সে সেদিন দিহানকে একা কোথাও যেতে মানা করেছিলো। কিছুদিন বাদে নির্বাচন। সবাই এখন ক্ষাপা ষাঁড়ের মতো এর ওর উপর হামলা করবে। কিন্তু ছেলেটা শুনলো কই? তাকে না জানিয়ে চলে গেলো।

‘কাদের কাজ জানো কিছু?’

রেজওয়ান মির্জার প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়ায় নুহাশ। মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘বলতে পারছি না। পার্টি ছাড়া দিহানের ব্যক্তিগত শত্রু সংখ্যা ও কোনো অংশে কম নেই কোথাও। নিজ দলে যেখানে শত্রু রয়েছে সেখানে অন্য দলে শত্রুর সংখ্যা হিসাব করা বোকামি।’

রেজওয়ান মির্জা তাচ্ছিল্য করে হাসে। কিছুটা অপমান করে বলে ওঠে,

‘শত্রু না চিনে রাজনীতিতে নামো কোন মুখে? রাজনীতিতে শুধু শত্রু কেন? শত্রুর চার বংশের খোঁজ রাখতে হয় হাতে! অবশ্য তোমাদের মতো পাতি মাস্তান এসব রাজনীতির কি বুজবে। তোমরা পার্টির কথায় ওঠো আর বসো। তাকেই রাজনীতি ভেবে বসে আছ। ডাফারের দল সব!’

নুহাশ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। কোনো জবাব দেয় না। নজর তার ফ্লোরে। রেজওয়ান মির্জা আরো কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মাহবুব ছুটে আসে। আর্জেন্ট কাজে তাকে বের হতে হবে। তিনি যাওয়ার পূর্বে কাঠকাঠ গলায় নুহাশকে হুকুম করে যান,

‘গাধার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে খুঁজে বের করো কে এমন কাজ করলো। মাথাটাকে একটু কাজে লাগাও।’

নুহাশ মাথা নাড়ায়। এ কাজটা সে নিজেই করবে। খুঁজে বের করে সেই কু* কে সে নিজ হাতে শাস্তি দিবে। কত বড় কলিজা নিয়ে দিহানের দিকে হাত বাড়াইছে সে সেটা দেখে ছাড়বে।

গাড়ি ছুটছে শা করে। মাহবুব সেই কখন থেকে হাঁসফাঁস করছে কিছু বলার জন্য। রেজওয়ান তির দিকে না ফিরেই বললেন,

‘কিছু বলার থাকলে ঝটপট বলে ফেলবে। চিন্তা ভাবনা করে সময় অপচয় করবে না। সময়ের মূল্য অনেক জানো তো?’

‘জ্বি স্যার জানি।’

‘তাহলে বলো।’

মাহবুব কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,

‘নুহাশ ছেলেটাকে আপনার এত অপছন্দ কেন? না মানে এমনি..’

‘তুমি ব্যাপারটা ভুল ধরেছ মাহবুব। আমি কাউকে অপছন্দ করি না। তাছাড়া কারো অপছন্দের কারণ হওয়ার মতো নূন্যতম জোগ্যতাও ঐ গাধার মধ্যে নেই।’

‘তাহলে আপনি তাকে সর্বদা গাধা কেন বলেন?’

‘কারণ ও আসলেই গাধা। বুঝেছ!’

‘জ্বি স্যার।’

‘কি বুঝেছ?’

‘ইয়ে মানে…’

‘আমার দেখা দ্বিতীয় গাধাটা তুমি মাহবুব।’

‘জ্বি স্যার।’

__________

দারোয়ানের থেকে শোনা পরিস্থিতির সাথে বাসার পরিস্থিতির কোনো মিল পাচ্ছেনা অন্তি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে যখন পরিস্থিতির এসব মিল অমিল খুঁজে ব্যস্ত তখনি হন্ত দন্ত হয়ে নাহার রুমে ঢোকে। পড়নে তার ইন্ডিয়া থেকে আনা ভারী কাতান। কানে সোনার বড়ো ঝুমকা। গলায় মোটা চেইন। অন্তি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে অবাক গলায় শুধায়,

‘তুমি এমন অদ্ভূত সেজেছো কেন মা?’

নাহার ভ্রু বাঁকিয়ে তকায়। গলার স্বর গম্ভীর করে বলে,

‘অদ্ভূত কেন? শাড়ি গহনা পড়ার মাঝে অদ্ভূতের কি আছে?’

‘শাড়ি গহনার মাঝে অদ্ভুত কিছু না থাকলেও তোমার মাঝে আছে। এমন সাজে অদ্ভুত লাগছে। গহনা বদলাও। এত ভারী গহনা শাড়ি পড়ে কোথায় যাবে?’

নাহার এ কথার কোনো জবাব দেয়না। বরং হালকা মেরুণ রঙের একটা জামদানী শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘আজ তুই ও শাড়ি পড়ছিস। এটা সুন্দর তাই না? তোকে মানাবে। ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে আয়। আমি সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছি।’

অন্তি হতবাক দৃষ্টিতে শাড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো মায়ের দিক। এমনিতেও তার মন মেজাজ বেজায় খারাপ। তার উপর নাহারের এসব কান্ডে সে অতিষ্ঠ প্রায়।

‘আমার ভালো লাগছে না মা। আমি ভালো দেখে একটা কামিজ সেট পড়ে নিচ্ছি। জোড় করো না। শাড়ি পড়ার মুড নেই।’

নাহার এ কথায় গুরুত্ব দিলো বলে মনে হলো না। শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে তাড়া দিলেন,

‘ঝটপট ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে আয়। সময় কম। তোর বাব তৈরি হয়ে বসে আছেন।’

অন্তি আর রা করে না। চুপচাপ মায়ের কথা মতো ব্লাউজ পেটিকোট হতে ওয়াশরুমে চলে যায়। আজকাল এ বাড়িতে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দের কদর খুব কমই করা হয়। তার মা তো রোজ শুক্রবার তার কি খেতে মন চাচ্ছে ত শুনে রান্না বসাতেন। আজকাল সেটাও পরিবর্তন করা হয়েছে। এ পরিবারে তার কদর সবদিক থেকেই ফুরিয়ে আসছে দিনদিন।

অন্তিকে না বললেও অন্তি বেশ বুঝেছে কাদের বাড়িতে তারা এসেছে। এটা আরাবদের বাড়ি অন্তি তা চোখ বন্ধ রেখেই বলতে পারে। তার মায়ের মাখো মাখো ভাব আর বাবার বড়ো হাসিতেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। বিশাল আলিশান বাড়ি আরাবদের। ছোটখাটো কোনো রাজপ্রাসাদ বলা চলে। নিঃসন্দেহে ডক্তার আজিম রুচিসম্পন্ন মানুষ।
বাড়ির একপাশে ফল বাগান করা হয়েছে অল্প জায়গা নিয়ে। তাতে রয়েছে তিন চার ধরণের ফল গাছ। ড্রাগন, কমলা, দেশি মাল্টা সহ আরো কি একটা ফল গাছ। অন্তি চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে সামনে এগিয়ে চলছে। নাহার অন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘সৌখিন ভীষণ তাই না? আমার ও কতো সখ ছিলো বাগান করার। তোর বাপের জন্য হলো কই।’

সাহেদ চাপা ধমক দেন।

‘নাহার আস্তে। লোক জানাতে এসেছ নাকি? যত অপবাদ বাড়ি ফিরলে দিবে। এক ঘন্টা সময় দিবো তোমায় অপবাদ দেওয়ার জন্য। এখানে কোনো কথা চাই না।’

অন্তি মুচকি হাসে। নাহার মুখ বাঁকায়। কিছু বললেই অপবাদ হয়ে যায়।

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-২১+২২

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২১.
স্নিগ্ধ বাতাস, কালো চাদরে জড়ানো আকাশ আর পাশে প্রিয় পুরুষ! অন্তি চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করে। এই যে দিহান তার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে আছে, সে ব্যথা পাচ্ছে, তবু ও নড়চড় নেই। ঐ শক্ত হাতের ছোঁয়ার মাঝেই ভালোবাসা খুঁজতে ব্যস্ত সে।
দিহান দূরত্ব ঘুচিয়ে আরো কিছুটা নিকটে টেনে নেয় অন্তিকে। অন্তির নাকে পুরুষালী গন্ধ ধাক্কা খায়। তড়িৎ চোখ মেলে চায় সে। চাঁদের অল্প আলোতে দিহানের মুখটা খুব ভালোভাবে দেখতে পায়। লোকটার চাহনি শক্ত। মুখে দারুন কঠিনতা এটে রয়েছে। এমন প্রেমময় পরিবেশেও কি লোকটা একটু পাগল প্রেমিকের মতো আচরণ করতে পারে না? সবসময় শক্ত খোলসে আটকে রাখে নিজেকে। অন্তি ভিষণ ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,

‘একটু হাসবেন?’

ছোট্ট একটা আবদার, কিন্তু কত ব্যাকুলতায় ভরা! চোখ ভরা কৌতুহল মেয়েটার। প্রেমিক পুরুষটিকে শক্ত খোলস থেকে বের করতে কত অস্হিরতা তার! কিন্তু তাকে ভিষণ দুঃখি করে দিয়ে তার পুরুষটি কাঠকাঠ গলায় বলে ওঠে,

‘ছেলেটা কে ছিলো? এ মহল্লায় তো আগে কখনো দেখিনি!’

হতাশ চিত্তে বড় শ্বাস ফেলে অন্তি। দিহানের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়ায় মেয়েটা। মনে উথলে ওঠা প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়ে থমথমে দৃষ্টি ফেলে সামনে। রাগে পুড়ে ওঠা কাঠকাঠ গলায় শুধায়,

‘কি দরকার? হবে কেউ একজন। আপনার কেন জ্বলে?’

দিহান দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,

‘অন্যকারো জ্বলার কথা বুঝি?’

অন্তি কম কিসে? ঘুম থেকে জাগিয়ে ছাদে এনেছে এসব ছাইপাশ কথা শোনার জন্য! অসভ্য লোক। ক্লাস টু এর বাচ্চারাও এর থেকে ভালো বুঝে, হোয়াট ইজ প্রেম! কিন্তু এই লোক বুঝলো না। অন্তি ঝাঁঝালো জবাব দিলো,

‘অন্যকারো জ্বলার হাজার কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আপনার জ্বলার কারণ কি?’

অন্তির হঠাৎ এমন ফুঁসে ওঠা ব্যাপারটা দিহানকে অবাক করে। এইতো মেয়েটা দিব্যি আদুরে গলায় কথা বলছিল। এখন কি হলো? দিহান নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। বড়ো করে শ্বাস ফেলে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। গলার গম্ভীরতা ঢেকে নরম গলায় অন্তিকে ডাকে।

‘মেয়ে কাছে আসো।’

অন্তি চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। এক চুল ও নড়ে না জায়গা থেকে। দিহান আচমকা হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়। দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয় পুরোপুরি ভাবে। হঠাৎ টান সামলাতে দিহানের বুকের কাছে শার্টের অংশ আঁকড়ে ধরে অন্তি। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসে তার। ধুমধাম শব্দে লাফাতে থাকে খাঁচায় আটকে থাকা হৃদযন্ত্রটা। চোখ আটকায় দিহানের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সিল্কি চুলগুলোতে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে দি সুন্দর দুলছে। অন্তির মন চায় হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু তার হাত দিহানের শার্টের অংশটুকু ছাড়তে নারাজ। অন্তি হাল ছাড়লো। দৃষ্টি নামিয়ে চোখ বারবার থামতেই দিহানের শান্ত দৃষ্টিতে জমে গেলো দৃষ্টি। অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে নড়ে উঠতেই বাঁধন শক্ত হলো। অন্তি কিছু বলতে নিলেই তার পূর্বে দিহান তার মুখ খুললো। কিছু বলতে নিলে তার পূর্বেই অন্তি নাক মুখ কুঁচকে নেয়। বিরক্ত গলায় বলে,

‘সিগারেট খেয়েছেন? কড়া স্মেল পাচ্ছি।’

‘ওটা আমি সবসময় খাই। সেটা তুমি‌ জানো।’

‘অভ্যাস বদলানো যায়না? এখন থেকে….’

অন্তির মুখ চেপে ধরে দিহান। কথা শেষ করতে পারেনা সে। দানবিয় হাতের আড়ালে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় মেয়েটার। দিহান কড়া শাসনের গলায় বলে,

‘ভুলেও এটা বলবে না যে, তুমি আর সিগারেটের মধ্য থেকে একটা বেছে নিতে হবে আমায়। জানে মেরে ফেলবো। দুটোই চাই আমার। কথা মাথায় ঢুকেছে?’

অন্তি দ্রুত উপর নিচ মাথা নাড়ায়। দিহান ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। বাঁধন মুক্ত হতেই বড়ো করে শ্বাস ফেলে অন্তি। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে অশ্রুকণা। রাগে লাল হয়ে ওঠে মুখ। এই লোককে আদেও প্রেমিক বলা চলে? পাষাণ লোক। একটু হলেই দমবন্ধ হয়ে মরতে যাচ্ছিলো!
দিহান সেদিকে কেয়ার করলো কম। গমগমে গলায় পুনরায় বলে উঠলো,

‘উত্তর দাও রূপ। তোমার প্রেমিক মোটেই ভালো মানুষ নয়। এবার উত্তর না পেলে ভয়ংকর কোনো শাস্তি পেতে চলছো। আমি মোটেই তোমার উপর জুলুম করতে চাইছি না। কে ছিলো ছেলেটা? আমি জানি ওর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জাস্ট ছেলেটা কে সেটা জানতে চাইছি। তোমায় সন্দেহ করছি এ ধরনের চিন্তা যেন ভুলেও মাথায় না আসে।’

অন্তি দুঃসাহসীকতার কাজ করলো। দিহানের হুসিয়ারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে জেদ ধরে চুপ করে রইলো। সে ও দেখতে চায় এই লোক ঠিক কতটা কঠিন হতে পারে তার সাথে। অন্তির চাল ঠিক বুঝলো দিহান। এই মেয়ের নাকের ডগায় জেদ। এতটুকু পুঁচকি মেয়ে এত জেদ পায় কোথায়? দিহান বাঁকা হেসে এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অন্তির কোমর। অন্যহাতে অন্তির খোঁপা করা চুল খুলে দিয়ে হাত বুলায় চুলের গভীরে। অন্তি দিহানের প্রতিটা কাজ দক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। যতক্ষনে সে বুঝতে পেরেছে সরে যাওয়ার পূর্বেই আটকা পড়ে যায় দিহানের শক্ত বাঁধনে।

এরপর?

এরপর অন্তি জীবনে প্রথমবারের মতো দীর্ঘ এক চুম্বনে আবদ্ধ হয়। দমবন্ধকর দীর্ঘ এ চুম্বনে ভালো অনুভূতির তুলনায় খারাপ লাগার পরিমাণটা একটু বেশিই ছিলো। দিহান তার নিষ্ঠুরতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে চুমুকেই বেছে নিয়েছিল।
প্রথম দিকে অন্তি দূরে সরবার জন্য ছটফট করলেও পরে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। লম্বা চুম্বন শেষে দিহান অন্তির কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্তির গাল গড়িয়ে পড়া চোখের পানিটুকু পরম যত্নে মুছে নেয়। ছোট করে একটা‌ চুমু খায় লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায়। কোমল গলায় শুধায়,

‘এটা শাস্তি ছিল। আমার অবাধ্য হওয়ার চেষ্টা করবে না। তুমি আমার বাধ্য থাকলে দ্বিতীয় সবকিছু ভালোবাসা দিয়ে হবে। প্রমিস!’

অন্তি জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে দিহানের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। দুর্বল শরীর টেনে নিজ ভরে দাঁড়াতে চায়। দিহান আঁটকে দেয় তাকে। ফিসফিস করে বলে,

‘এভাবেই থাকো। আমি আর অল্পকিছুক্ষণ আছি।’

অন্তি বাধ্য মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে রয়। দিহান তা দেখে ঠোঁট টেনে হাসে। বুক ভরে আসে। বিধাতার নিকট বারবার শুকরিয়া জানায়। এই মেয়েটা ছাড়া তার জীবন একদম চলবে না। দিহান মুখ নিচু করে অন্তির কানে ছোট করে বলে,

‘ধন্যবাদ রূপ।’

অন্তি ঘাড় উঁচু করে দিহানের পানে চায়। কথা না বললেও চোখের ইশারায় কারণ জানতে চাইলে দিহান বলে,

‘কিছুনা। এখন সোজা রুমে চলে যাও। আমি তোমাকে যেতে দেখে ফিরে যাব।’

____________

অন্তির ঘুম ভাঙে বেলা করে। মাথার উপর যান্ত্রিক ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরছে। অন্তির সমপরিমাণ বয়স ফ্যানটার। এজন্য শব্দ করলেও অন্তি ফ্যানটা বদলাতে দেয়না। একটা মায়া কাজ করে। হামি ছেড়ে উঠে বসে অন্তি। ঘড়িতে চোখ পড়তেই আতকে ওঠে। বারোটা বিশ বাজে। বালিসের তলা থেকে ফোন বের করতে সেখানে তন্নির বিশটা কল উঠে রয়েছে। কল ব্যাক করতে নিয়েও ফোন পূর্বের জায়গায় রেখে থম মেরে বসে রইল। গতরাতের ঘটনা মনে পড়তেই গাল গরম হয়ে ওঠে। কি ভয়ংকর কান্ড! লজ্জা লজ্জা! অন্তি দ্রুত পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। ঠোঁট লাল হয়ে ফুলে আছে। অতিরিক্ত ঘুমের ফলে ফোলা ভাবটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। এই মুখ নিয়ে মানুষের সামনে কিভাবে যাবে সে? এ চিন্তা ছোট্ট মাথায় হানা দিতেই দিহানের উপর আক্ষেপে ফেটে পড়ে মেয়েটা।

সবার নজর থেকে বাঁচতে অন্তি সর্বক্ষণ রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। দুপুরের খাবারটাও সে নিজ রুমে বসেই খেলো। নাহার জিঙ্গাস করলে উত্তর হিসেবে সে জানিয়েছে শরীর খারাপ করছে। নাহার গায়ে কপালে হাত দিয়ে চেক করতে গেলেই অযথা রাগ দেখিয়ে রুমের দরজা লাগিয়েছে। কি একটা বিশ্রি অবস্থা। এই অবস্থার জন্য অন্তি দিহানকে দোষারোপ করে চলছে। বিকেলে স্যার পড়াতে আসলেও অন্তি দরজা খুললো না। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে স্যারকে ফেরত পাঠিয়েছে। মেয়ের ব্যাবহারে নাহার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে স্যারকে বলেছেন,

‘মেয়েটা সকাল থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে। সারাদিন বাহিরে আসেনি। দুপুরের খাবারটাও নিজের ঘরে বসে খেলো। শরীরটা বোধহয় ভালো নেই। আপনি কিছু মনে করবেন না।’

ভদ্রলোক রাগ করেছে কিনা তা বোঝা গেলো না। কিন্তু গম্ভীর ভাবে বললেন,

‘ও ব্যাপারনা। এমন হয়। অল্প বয়সের তো!’

স্যার চলে যেতেই নাহার ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো হামলে পড়েছেন মেয়ের ওপর। দরজা বন্ধ থাকায় তার সবকথা অন্তির কান অব্দি না পৌঁছালেও এটুকু বুঝেছে আজ বাবা ফিরল বিচার বসবে। বড় করে তপ্ত শ্বাস ফেলে মোবাইল হাতে নেয় সে। দিহানের নম্বরে চট করে একটা ম্যাসেজ পাঠায়।

‘এই যে প্রেমিক!
আপনার শাস্তির দরুন বাড়িতেও শাস্তি পেতে চলছি। এটা তো ফেয়ার নয় তাই না? তাই জরিমানা হিসেবে আপনার
জন্যও শাস্তি ধার্য করা হয়েছে। আপনি রাজি কিনা‌ বলুন?’

প্রায় সাথে সাথেই জবাব আসলো।

‘শাস্তি হিসেবে যদি রূপবতী কন্যার নরম ঠোঁটের তপ্ত ছোঁয়া পাওয়া যায়, তবে আমি দিহান বারবার শাস্তির জন্য তাহার নিকট মাথা নোয়াবো।’

ম্যাসেজ পড়া মাত্র অন্তির কাঁশি উঠে যায়। কি সাংঘাতিক মাত্রায় অসভ্য লোক। গম্ভীরতার আড়ালে লোকটার এই অসভ্য রূপটা ঢেকে ছিল এতদিন। আস্তে আস্তে খোলস মোচন হচ্ছে যেন!

চলবে……….

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২২.
চোখের পলকের মাঝেই যেন সময় কেটে যেতে লাগলো। বাড়তে লাগলো ভালোবাসায় ঘেরা পাগলামি গুলো। অন্তি মাঝে মাঝেই দিহানের ভিন্ন রূপ দেখে হতবাক হয়, মনে হয় লোকটাকে চিনতে তার এখনো বহু বাকি। তাদের কথা হয় খুব কম। দেখা হয় হুটহাট। তবুও অনুভূতি যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুরহুর করে বেড়ে চলছে।
রাস্তায় লোকটা তাকে খুব করে এড়িয়ে চলে। অপরিচিতর মতো আচরণ করলেও সেই আচরণ অন্তিকে আঘাত করতে পারেনা কখনো। রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারেও কি সূক্ষ্ম নজরদারি! দূর থেকেও যত্ন নেওয়া যায় এই কথাটার প্রমাণ অন্তি দিহানের থেকেই পেয়েছে। একটা মানুষ এতটা পর্ফেক্ট কিভাবে হতে পারে?

এখন নভেম্বর মাস বিদায় নেওয়ার পথে। ঠান্ডা পড়েছে খুব। অন্যবছরের তুলনায় এবার শীতের প্রকোপ কিছুটা বেশি। বর্ষপঞ্জিকার হিসেবে আজ নভেম্বরের ২৯ তারিখ। এখন ভোর ছয়টা। বাহিরে কুয়াশারা কুন্ডলী পাকিয়ে পাক খাচ্ছে চারদিকে। কাছের জিনিস ও কেমন ধোঁয়াশা মনে হয়। এই শীতের সকালে যেখানে বাড়ির সকলে লেপের ওমে শান্তির ঘুম দিচ্ছে, অন্তি সেখানে পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘরে হাজির। উদ্দেশ্য হালকা কিছু রান্না। আজ তার প্রিয় পুরুষটির জন্মদিন বলে কথা।

রান্নাঘরের ছোট্ট জানালাটা‌ খুলে দেওয়া। হুরমুর করে শীতল বাতাস প্রবেশ করছে চিকন লোহার বেদ পেরিয়ে। জানালার পাশেই এ বাড়ির সবথেকে পুরোনো সজনে গাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যার বিস্তার ডালপালা থেকে হলদে রঙের পাতা গুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। জানালা গলিয়ে আসা বাতাসে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও অন্তির ভালো লাগছে। ভালোলাগার সময় গুলোতে বোধহয় বিষ ও মধুর মনে হয়!

ইউটিউব থেকে সিলেক্ট করা রেসিপিটা প্লে করে সামনে রেখে রান্নায় মনোযোগ দিলো অন্তি। রেসিপিটা হোমমেড নুডুলসের। রান্নার সবথেকে প্রয়োজনিয় উপাদান হচ্ছে ময়দা। কিন্তু সমস্যা হলো প্রয়োজন ব্যাতীত সখের বসেও কখনো রান্নাঘরে পা ফেলা হয়নি তার। রান্নার উপকরণ কোনটা কোথায় আছে তা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা নেই তার। একটা ডিম ভাজতে কতটুকু লবণ লাগে তার হিসাব না জানা অন্তি এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাবতেই সে অবাক। বলতেই হবে তার সাহস আছে! অনেক খুঁজে তাকের উপরে সে তার কাঙ্খিত জিনিস দেখতে পেল। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। পাশাপাশি দুটো বোয়ামে রাখা সাদা বস্তু দেখে চেনার উপায় নেই কোনটা ময়দা কোনটা আটা। কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে বিচক্ষণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও কোনো সুরহা না হলে রান্নাঘরের পাশের ছোট কক্ষে হামলা চালায়।
এ বাড়িতে সবার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ রয়েছে। এ কক্ষটি কাজের মেয়ে পারুর জন্য বরাদ্দ। দরজায় ধুমধাম আঘাতে পারু বিরক্ত হয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার সামনে অন্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বিরক্তির মাত্রা আরো এক কাঠি উপরে উঠে যায়। বড়োলোক বাড়ির ন্যাকা ধরনের মেয়ে মানুষ তার পছন্দ না। এরা নিজের জামাটাও ধুয়ে গায়ে জড়াতে পারে না। শুধু পারে উঠতে বসতে হুকুম জারি করতে।

‘সকাল সকাল আপনের কি লাগবে আবার? শীতের দিন সাতটার আগে আমি উঠবার পারতাম না, আগেই জানাইছি।’

‘উঠতে হবে না। দু সেকেন্ডের জন্য রান্নাঘরে আয়। ময়দার বোয়াম কোনটা বললেই তোর ছুটি।’

পারু না বোঝার মতো করে বলে,

‘কি কন?’

অন্তি বিরক্ত জবাব দেয়,

‘ময়দা লাগবে আমার। বোয়ামটা দিয়ে যা।’

পারুল এবার কন্ঠে কৌতুহল ধরে বললো,

‘ময়দা কি করতেন? রূপচর্চা?’

অন্তি চোখ‌ কটমট করে চাইতেই পারু থেমে যায়। তার মুখ সর্বদা তার আগে দৌড়ায়। মুখ বন্ধ হলেও পারুর কৌতুহল দমে না। আজ এ ব্যাপারে তদন্ত করে দিহানকে গরম গরম নিউজ দিবে সে। দুশো টাকা বাড়ায়ে চাইবে। ঘুম রেখে তদন্ত করার জন্য দুশো টাকাতো বাড়তি লাগবেই! না দিলে সে ও কাজে না করে দিবে। তদন্তর কাজ অত সহজ নাকি?

_____________

গতকাল রাত থেকে দিহানের কোনো খোঁজ নেই। হঠাৎ করেই যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে মানুষটা। মোবাইল ফোনও বন্ধ বলছে। রেহানা সারারাত ছেলের চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পুরোটা রাত কেটেছে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে। ভয়ে মুখ ফুটে ছেলের বাড়িতে না ফেরার কথা স্বামীকেও জানাতে পারেনি। আবার নতুন কোনো অশান্তির ভয়ে মুখ বন্ধ রাখলেও সকাল দশটা পেরুলে ভয়ে বুকটা ধক করে ওঠে। স্বামীকে না জানিয়ে ভুল করলো কি? রেহানার বুক শুকিয়ে আসে। মনের ভেতর কেমন কু ডাকছে। কোনো বিপদ হলো না তো? এই তো সকালে গতকাল সকালে নাস্তা শেষে কত হাসিখুশি ভাবে ঘর থেকে বের হলো তার ছেলেটা।
এদিকে নুহাশকে কল করলেও যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। নুহাশকেও সমপরিমাণ চিন্তিত মনে হয়েছে। রেহানা দিক শুন্য হয়ে বড়ো ছেলেকে কল করলেন। রেহানকে এসময় কল করলে কখনোই ফোনে পাওয়া যায়না। থানার নম্বরে কল করলে তাকে পাওয়া যেতে পারে। অফিস আওয়ারে পার্সোনাল ফোন ইউজ করেনা সে। রেহানার কাছে রেহানের থানার নম্ব নেই। ফোনে পাবেনা জেনেও পরপর দুবার কল করলো। ফলাফল পরিবর্তন হলো না। রেহানা দুশ্চিন্তায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঘরের কাজের মহিলা মিনু দৌড়ে আসেন।

‘আপা কাইন্দেন না। ভাইজানরে জানাই?’

রেহানা ফোন এগিয়ে দেয়। মুখে আঁচল চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। মুখে বলে,

‘দিহানের বাপকে কল কর। বাসায় আসতে বল তাকে।’

মিনু বেগম সম্মতি জানায়। তৎক্ষণাৎ মুঠোফোন হাতে কল করে রেজওয়ান মির্জাকে। কিন্তু সময় কিংবা ভাগ্য কোনোটাই তাদের সাথে ছিলো না। রেজওয়ান মির্জার ম্যানেজার কল রিসিভ করে জানান তিনি বর্তমানে জরুরি কোনো মিটিং এ রয়েছেন। ঘন্টা খানেক সময় বাদেই তিনি ফ্রি হবেন। মিনুর মুখ শুকিয়ে আসে। ফোন কাটার পর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রেহানার কান্না‌ দেখে তার ও কান্না পাচ্ছে।

‘তোর ভাইজান কি বললো মিনু?’

মিনু জবাব দেয়না। তার শুকনো মুখ দেখেই রেহানা বুঝতে পারে এখানেও কাজ হয়নি। চোখের পানি বাঁধ ভাঙে। মিনু ব্যর্থ শান্তনা দিতে চেষ্টা করে।

‘দিহান বাবা ছোট না আপা। চিন্তা করবেন না। পোলা মানুষ, আছে হয়তো বাইরে কোতাও। বাড়িতে আসলে এবার আপনে একটু কঠিন হবেন। আপনে কঠিন না হলে পোলা সোজা হইবে না।’

_____________

অন্তি আজ ভয়ংকার এক কান্ড ঘটিয়েছে। তন্নিদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে সে সরাসরি মিরপুর থেকে গুলশানে চলে এসেছে। হাতে তার ছোট একটা বাগ। তার মধ্যে রয়েছে তার হাতে রান্না করা নুডুলস। এই সামান্য নুডুলস নিজ হাতে প্রিয় পুরুষটিকে খাইয়ে দিতেই তার মিরপুর থেকে গুলশান অবদি আসা। মিরপুরের আনাচে কানাচে সর্বত্রে দিহানের পরিচিত লোকের সমগম। কোনো‌ এক অঙ্গত কারণে দিহান সবার থেকে অন্তিকে আড়াল করে রাখতে চায়। এর কোনো সঠিক কারণ অন্তির জানা নেই। তবে একটা চাপা কৌতুহল বোধ তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়ায়। প্রেমের এতদিন হয়েগেলেও দিহানের সাথে অফিসিয়ালি তার কখনো মিট করা হয়নি। হাত হাত রেখে হাঁটা হয়নি। পাশাপাশি বসে গল্প করা হয়নি। যা হয়েছে সব ভীষণ গোপনে।‌ নিভৃতে!
এজন্য পরিচিত জায়গা থেকে‌ দূরে আসা। উদ্দেশ্য কেবল প্রিয় মানুষটার সাথে কিছু মুহূর্ত কাটানো। অন্যসব প্রেমিক যুগলদের মতো কফি খেতে খেতে গল্প করা। সুযোগ পেলেই আলতো হাতে হাত ছুঁয়ে দেওয়া! এছাড়া আর কি? এইতো তার চাওয়া! অন্তি নিজ মনে হাসে। সে বড্ড লোভী হয়ে পড়েছে। ভীষণ রকম নির্লজ্জতা তকে ঘিরে ধরেছে। এইযে সে এসব ভাবছে তা কি তার প্রেমিক পুরুষটা জানে? জানলে কি সে অবাক হবে? বিস্ময় ঘেরা গলায় বলবে,

‘তুমি তো ভীষণ ভয়ংকর রূপ! দিনে দুপুরে আমাকে লুট করার ছক কষছো! মায়া হয়না তোমার?’

অন্তি হাসে। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে। এগারোটার বেশি বাজে। তার হাতে এখনো পুরো সাত ঘণ্টা সময় রয়েছে। আসার পূর্বে দিহানকে টেক্সট করে এসেছে। সাহেব নিশ্চই কিছুক্ষণের মাঝেই হাজির হবেন। দেরী করার অভ্যাস নেই তার!
বুক ভরে শ্বাস নেয় অন্তি। এটাই তার‌ প্রথম একা এতটা পথ পারি দেওয়া। এটাই প্রথম বাড়িতে মিথ্যা বলে বের হওয়া। তার কি অনুশোচনা হওয়া উচিত? পরিবারকে ধোঁকা দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণে অন্তির মন শক্ত ভাবে জবাব দেয়,

‘অবশ্যই উচিত‌ নয়। আমি তাদের কখনোই ধোঁকা দিতে চাইনি। তারা আমাকে বাধ্য করেছে এ পথকে বেছে নিতে।’

নিজ মনের শক্ত জবাবে কিছুটা অপরাধ বোধ ম্লান হলেও বুকের কোথাও একটা ভার অনুভব হয়। সাথে কিছুটা অস্বস্তি বোধ। আশপাশে এত এত মানুষের ভীড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা আশঙ্কিত হয়। অহরহ গাড়ির হর্ণের শব্দে মাথা ভারী হয়ে আসতে চায়। অদ্ভূত এক ধরণের অনুভূতি তকে কাবু করে আনে। ঝকঝকে দিনটাকেও তার কাছে কেমন অন্ধকারে ঘেরা এক মন খারাপের দিন বলে মনে হচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়! সামান্য পথ পাড়ি দিতে এতটা আতঙ্ক তাকে কাবু করার কথা নয়! তবে কেন? অন্তি বারবার ফোনের স্ক্রিনে নজর বুলিয়ে বিরবির করে,

‘দিহান দ্রুত আসুন। আমি ভয় পাচ্ছি!’

অন্তি বেছে সুন্দর গোছানো নিরব পরিবেশের একটা কফিশপে ঢুকেছে। ঢোকার পথে সুন্দর করে শপের নামটা দিহানকে টেক্সট করে দিয়েছে। বাহিরের ধুলাময় পরিবেশের তুলনায় এখানে নিরবে বসে থাকাটাই তার কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। অন্তি এক কাপ কফি অর্ডার করে জানালা থেকে বাহিরে নজর দেয়। এই রেস্টুরেন্টটা তৃতীয় তলায় অবস্থিত। তৃতীয় তলার উপর থেকে রাস্তার ভিউটা বেশ ভালো লাগছে। অন্তি আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ক্লান্তহীন চোখ দুটো শতশত মানুষের ভীড়ে পরিচিত পুরুষটিকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়। ছুটতে থাকা গাড়িগুলোতেও দৃষ্টি আটকে পড়ছে। এই বুঝি সে এলো! ধোঁয়া ওঠা কফি ঠান্ডা হয়ে আসে। অন্তির চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে আসে। তবুও পরিচিত মুখটার দেখা মেলে না। অন্তি ক্লান্ত ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শপের এক সাইডে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বুকসেল্ফ দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। চোখ আটকায় হুমায়ূনের ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসের উপর। কেন যেন তার এই মুহূর্তে এই উপন্যাসটাই খুব করে টানছে। হয়তো এই উপন্যাসের এই নামটার বদৌলতেই!

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ❤️)

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৯+২০

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৯.
রাত ঘন হয়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ঝিম ধরা ডাক যেন রাতের পরিবেশকে আরো গম্ভীর করে তুলেছে। এখন মধ্যরাত। চারপাশ ভিষণ নিরব। হাইওয়ে তাদের বাসা থেকে বেশ খানিক দূরে। এজন্য মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ির হর্ন ব্যাতীত কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এই মধ্যরাতে অন্তি ছাদে চুল খুলে দিয়ে বসে আছে। ঘনকালো চুলগুলো রাতের আঁধারের সাথে মিশে আছে। রাতে মেয়েদের একা ছাদে উঠতে নেই, চুল খোলা রাখতে নেই, জিনে আঁচর করে। এসব তার মায়ের মুখে শোনা কথা। তার নানার বাড়ির দিকে এসব কথার প্রচলন খুব বেশি। শহরের দিকে এসব ব্যাপারে খুব একটা শোনা যায় না। এমন না যে সে এসবে বিশ্বাস করে না। তবে চার ধারণা গ্রামের সতেজ পরিবেশ রেখে জিন ভূত কখনোই শহরের ধুলামাখা এ পরিবেশে আসবে না। ভূত হলেও মাথায় ঘিলু তো আছে তাই না! তবুও কেন জানি মনের কোথাও একটা ভয় লাগছে। যদি হঠাৎ করেই ভয়ংকর চেহারার কেউ একজন এসে তার পাশে বসে? কেমন হবে ব্যাপারটা? অন্তি নাক চোখ কুঁচকে নিলো। নিজেই উত্তর দিলো,

‘ভিষণ জঘন্য ব্যাপার।’

খুলে দেওয়া চুলগুলো তৎক্ষণাৎ হাত খোপা করে কাঠের তৈরি চুলে পড়ার কাঠি গুঁজে দিলো তাতে। গায়ে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দিয়ে ভালোভাবে মাথা ঢেকে নিয়ে একইভাবে বসে রইল। ভয় কিছুটা লঘু হলো বোধহয়!

সময়ের কাটা যখন তিনটার ঘরে থামলো অন্তি ব্যস্ত হাতে কাঙ্খিত মানবটিকে কল করলো। এটাই সময় তার সাথে কথা বলার। দু বার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। অন্তি শক্ত হাতে ফোন কানে চেপে ধরে। নিদারুণ উত্তেজনায় তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হতে চায় না। কতশত কথা বলার আছে তার তবুও শব্দগুলো গলার কাছে এসে আটকে থাকে। শক্ত হয়ে আসা মনটা নিমিষেই ভেঙে পড়ে। কান্নায় লেপ্টে যায় চোখ। ওপাশের মানবটা তখনও নিশ্চুপ। অন্তির কষ্ট হয় খুব। লোকটা তাকে কাঁদতে শুনেও কিভাবে চুপ করে আছে? তার ভেতর সত্তা তৎক্ষণাৎ তাকে কল কেটে দিতে উৎসাহ দেয়। এমন পাষাণ পুরুষকে ভালোবেসে নিজেকে বলি দেওয়ার থেকে আরাবের মতো সুপুরুষকে বিয়ে করে সংসার করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু অন্তির হাত অবাধ্যতা করে। শক্ত হয়ে ফোন কানে আঁকড়ে ধরে থাকে। ওপাশের মানবটির নিস্তব্ধতা তার মনের কষ্টকে যেন বাড়িয়ে তুলছে দ্বিগুণ হারে। কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। অন্তির কান্না থেমে এসেছে। দুর্বল হয়ে আসা ডহৃদয় কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জোগাড় করতেই অপাশের মানবটি কথা বলে উঠলো,

‘নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আসবে?’

গম্ভীরতায় ঘেরা স্নিগ্ধ কথাটুকু কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ মাত্র চমকে উঠলো অন্তি। প্রিয় পুরুষটির থেকে এমন লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে তার উথাল মন নিমিষেই শান্ত হয়ে এলো। কি হবে? কি হতে পারে? সেসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে অন্তি প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলো,

‘আসছি।’

কল কেটে গেল। দিহান বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেট রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। জ্বলতে থাকা লাল আগুন নিভিয়ে গেলো নিমিষে। দু মিনিটের মাথায় অন্তি নেমে এলো। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোতে সে মেয়েটার ভেঙে যাওয়া মুখখানা দেখলো। বুকের বা পাশটা খানিক জ্বলে উঠলো। কেমন মলিন হয়ে এসেছে আদুরে মুখটা। চঞ্চল চোখদুটো কেমন ডেবে গেছে। দিহানের মুখ শক্ত হয়ে আসে। সাহেদ নওয়াজ খানকে সে অবশ্যই এর সুন্দর সাজানো জবাব দিবে।
দুদিন বাদে মানুষটাকে চোখের সামনে দেখতেই কান্নার ভেঙে পড়ে অন্তি। আশপাশে না তাকিয়ে এক ছুটে এসে বিশাল দেহী শক্ত বুকে আছড়ে পড়ে। দুহাতে শক্ত করে পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে। দিহান শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁধা দেয়না তবে আঁকড়েও নেয় না। পাঁচ মিনিটের মাথায় অন্তি শান্ত হয়ে আসে। তবে মাথা তোলে না বুক থেকে। নড়াচড়া না করে ওভাবেই বুকের সাথে লেগে থাকে। দিহান হাত ঘড়িতে সময় দেখে। তিনটা বেজে বত্রিশ মিনিট। তার শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট শরীরটাকে সরাতে চাইলে তা সরতে চায়না। দিহান দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করে না। কেবল ভারী শব্দে বলে ওঠে,

‘এভাবে আমাকে পাবে না তুমি রূপ। আমাকে পেতে হলে তোমাকে আমাকে জয় করতে হবে। আমাকে জয় করা তোমার জন্য মোটেই সহজ হবে না। আমার গোটা তোমাকে চাই। তোমার প্রতিটা অংশে আমি আমাকে চাই। তোমার জীবনে আমার আগমনটা অন্য সবার মতো হবেনা রূপ। আমি ধ্বংসের আগুন। যে কোনো সময় প্রলয় ঘটাতে পারি। তুমি কি নিশ্চিত আমায় সবভাবে গ্রহণ করতে পারবে তুমি?’

অন্তি মাথা উঁচু করে দিহানের চোখে তাকায়। এত ভারী শব্দ বোঝার ক্ষমতা তার নেই, তবে এই পুরুষটার প্রতি তার ভরসা আছে। এজন্যই তো সে এতো ভালোবাসে। বারবার অবহেলা পাওয়ার পরও ভালোবাসে। অন্তি নাক টেনে জবাব দেয়,

‘আমি অলরেডি আপনাকে গ্রহণ করেছি। আপনার নাক উঁচু স্বভাবের কথা জেনেও গ্রহণ করেছি। আর কি চাই?’

না চাইতেও দিহান হেসে ফেলে। মুচকি হেসে বলে,

‘এবার ঠিক আছে। এতক্ষণ তোমাকে অপরিচিত লাগছিলো। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই তোমায় চিনি আমি। আমার হরিণ চোখি রূপরাণী!’

প্রিয় মানুষদের ডাকা প্রতিটা নাম সুন্দর। সবথেকে সুন্দর দিহানের ডাকা এই রূপ নামটি। যা সবার থেকে তাকে আলাদা করে রাখে। তাকে এ নামে কেউ ডাকে না। নিঃসন্দেহে লোকটার সাইকোলজি সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে।

‘এভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকবে? তোমার এখন বাসায় যাওয়া উচিত। আর নয়তো আমাকে সাথে নিয়েই চলো!’

অন্তি সাথে সাথে দিহানকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। সে বেমালুম ভুলে বসেছিলো যে সে দিহানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ লজ্জা না পেলেও এখন ভিষণ লজ্জা লাগছে। দিহান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসে। বাকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘তুমি ভয়ংকর মেয়ে রূপ। নিজ থেকে কাছে এসে নিজেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাও। আমার বুঝি লজ্জা নেই?’

অন্তি মুখ বাঁকিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকটা তাকে লজ্জা দিতে দিতে মেরেই ফেলবে। সুযোগ সন্ধানী লোক কিনা! সুযোগ পেতেই জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে। অসভ্য লোক।

_____________

অন্তিদের বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে ওর নাম পারু। ঘরের কারো সাথেই তার তেমন সখ্যতাপূর্ন সম্পর্ক নেই। বিশেষ করে নাহারের সাথে। প্রতিদিন টুকটাক ঠুকোঠুকি লাগবেই। এতসব জেনেও সাহেদ ওকে কাজের জন্য রেখে দিয়েছে। তার মতে মেয়েটা একটু অকাজের হলেও মন ভালো। মানুষ হিসেবে সৎ। কিন্তু তার সেই আস্থাকে ভেঙে দিয়ে পারু দিহানের গুপ্তচর হয়ে কাজ করছে। ঘরে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার সবটাই তো তার জানা। সেই কথা কাউকে বলায় যদি মোটা অংকের টাকা মেলে তাতে দোষের কি?

‘বইলেন না ভাইজান! আফারে চাচি যেমনে কয়দা থাপ্পর মারছে আফায় মাতা ঘুরাই পইরা গেলো। আফায় শক্ত মানুষ। আফার জায়গায় আমি থাকলে প্রত্তম থাপ্পরেই ফিট খাইতাম।’

‘পুরোনো কথা বাদ। নতুন করে কি হইছে সেইটা বল।’

‘নতুন কইরা আর কি হইবো। আফার বাইরে যাওন বন্দ হইছে। এইডা অবশ্য ভালোই হইছে। মাইয়া মানুষের বাইরে না যাওন ভালো।’

দিহান বিরক্ত হয়ে বলে,

‘ভালো খারাপ আমি বুঝবানি। ফোন রাখ। দরকার ছাড়া কল দিবিনা। নয়তো থাপ্পরের আগায় মাথায় তোকে ফিট খাওয়াবো।’

পারু কিছু না বললেও মুখ বাঁকায়। শুধু কয়টা টাকা পায় বলে কিছু বলেনা নয়তো মানুষ হুমকি ঝুমকিকে পারু ভয় পায়না। হুহ। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই যে সে দারুণ খবর জানালো তাতে কোনো শুকরিয়া নেই মানুষদের।
তখনি নাহার ডাকলো তাকে।

‘পরাটা করতে হবে জলদি ময়দা মেখে নে তো পারু। আমি ভাজি বসায় দিচ্ছি।’
.
.
তন্নির দিন খুব খারাপ কাটছে। অন্তিকে‌ ছাড়া একা একা তার দিন কখনোই ভালো কাটে না। এই যে আজ সে একা একা ব্যাচে গেলো, কোনো ম্যাথ তার মগজ অবদি পৌঁছায়নি। সবকিছু মাথার দু ইঞ্চি উপর থেকে চলে গেছে। ব্যাপারটা নিঃশন্দেহে ভয়ানক। অন্তির বিয়ে শাদি হয়ে গেলে তার কি হবে? আর যাই হোক একজন গ্রাজুয়েট মা হতে গেলেও তাকে অন্তত পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। কিন্তু এভাবে চললে তার কিভাবে হবে?

এসব ভাবতে ভাবতেই কল করলো অন্তিকে। অন্তি তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। তন্নির কল দেখে ফোনটা ওভাবেই ফেলে রাখলো। কিন্তু তন্নি থেমে যাওয়ার মেয়ে নয়। সে আবারো কল লাগালো। অন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন তোলে।

‘দোস্ত কলেজে আসতেছিস তো? পেটের মধ্যে গ্রুম গ্রুম করছে। তুই না আসলে হচ্ছে না।’

‘কি হচ্ছে না? ওয়াশরুমে যা। পেটের ময়লা ফেলে দে। আর গ্রুম গ্রুম করবে না।’

‘এটা ওয়াশরুমে ফেলা চলবে না দোস্ত। পেটে কথা জমে আছে। চাইলেও ওয়াশরুমে ফেলতে পারছি না। কলেজে চলে আয়।’

‘হুম। এখন কল রাখ।’

সকাল সকাল ফুরফুরে মেজাজে জল ঢেলে খুব গদগদ ভাবে কল কাটলো তন্নি। অন্তি আস্তধীরে বিছানা ছেড়ে নামলো। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো। তার রাগি কুমরাটা ফাইনালি তার কাছে ধরা দিলো! এই খুশিতে তন্নিকে একটা ট্রিট দেওয়া যেতেই পারে।

অন্তিকে হাসিখুশি ভাবে নাস্তার টেবিলে বসতে দেখে নাহার খানিক অবাক হলো। মেয়ে তো তার দেবদাসী হওয়ার পথে ছিলো। হঠাৎ এ পরিবর্তন কিসে? কিন্তু মেয়ের মুখে হাসি দেখে সে এসব ভাবনা দূরে ঠেলে দিলেন।

‘পরাটা দেই? নাকি নুডুলস করে দিবো?’

‘যেটা আছে সেটাই দাও।’

চলবে…..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২০.
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। কেউ বাদররের মতো লাফঝাপ করে কেউবা মেধা দিয়ে। কিন্তু অন্তির সাথে ঘটা আশ্চর্য জনক ঘটনাটা ভিন্ন। অন্যসকল দিনের মতো আজও কলেজ ছুটি হলে তন্নির সাথে গল্প করতে করতে কলেজ গেটের পাশে দাঁড়ানো হয়। অসম্ভব ব্যস্ত রাস্তার ধারে কুঁচকানো কপাল নিয়ে অতিব বিরক্ত মাখা মুখে তন্নির কথার হুঁ হা জবাব দিচ্ছিলো সে। বিরক্তিটা মূলতো কাঙ্খিত কোনো রিকশা খুঁজে না পাওয়ায়। এ শহরে রিকশার সংখ্যা অসংখ্য হলেও তার প্রয়োজনে তাদের দেখা মেলা ভার হয়ে পড়ে। এই যে ত্রিসীমানায় রিকশার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যসব সময় ‘আপা যাবেন কোই?’ প্রশ্ন শুনতে শুনতে হাঁটার মুডের ধফারফা হয়ে যায়। বাসা থেকে হেঁটে না যাওয়ার কড়া নিষেধ রয়েছে। এটা তার জন্য তার মায়ের তৈরি নতুন নিয়ম। আজ সকালেই বাবার মাধ্যমে তার সামনে পেশ করা হয়েছে। অন্তিও দ্বিমত করেনি। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে সে মাথা খাটানো বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।
অন্তি বিরক্তে কুঁচকে আসা ভ্রুজোড়া আরো কিছুটা সংকুচিত করে বলে ওঠে,

‘আজ কি রিকশা ওয়ালাদের সরকারি ছুটি? আশ্চর্য!’

তার কথায় তন্নিও সমান ভাবে হতাশা প্রকাশ করে। পরক্ষণে কিছু মনে পড়েছে ভাব নিয়ে বলে,

‘দোস্ত? দিহান ভাইকে কল লাগা। দু মিনিটে রিকশা হাজির হয়ে যাবে। পাক্কা!’

তন্নির আইডিয়া অন্তির পছন্দ হলো না। থমথমে জবাব দিলো,

‘সামান্য রিকশার জন্য তাকে কেন লাগবে? আই ক্যান হ্যান্ডেল ইট!’

তন্নি বিপরীতে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই ফরমাল গেটআপে একজন সুদর্শন পুরুষ এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। অপরিচিত কাউকে এভাবে সামনে দাঁড়াতে দেখে তন্নির কন্ঠনালি ওখানের বন্ধ হয়ে যায়। অন্তি তখনো ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তন্নির হাতের চিমটিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ব্যাপারটায় সেও খানিক ঘাবড়ে যায়। এভাবে অচেনা কেউ সামনে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অস্বভাবিক। অন্তি মুহূর্তের মধ্যে বুঝে নেয় লোকটা নিঃসন্দেহে তন্নির কোনো সিক্রেট প্রেমিক। রূপবতী মেয়েদের অনেক প্রেমিক থাকে, হোক সেটা গোপনে কিংবা প্রকাশে। লোকটার চোখ ঘুরিয়ে বারবার তন্নির দিকে তাকানোর ব্যাপারটায় আপাতত তার সেটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভদ্র সমাজে দাঁড়িয়ে লোকটার এমন অভদ্রের মতো আচরণ অন্তির পছন্দ হলো না। কাউকে পছন্দ হলেই বুঝি কথা বার্তা ছাড়া এভাবে মুখের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়? কথায় ভদ্রতা ধরে রাখতে চেয়েও অন্তি ব্যার্থ হলো। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,

‘আপনাকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র মনে হলেও আপনার কাজে তা চরম অভদ্রের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তো এখানে কি চাই?’

এতক্ষণে লোকটা পুরোপুরি ভাবে অন্তির দিএ তাকায়। মোটা গ্লাসের চশমা গলিয়ে কিছুটা কৌতুহলি দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে,

‘আপনাদের মধ্যে রূপন্তি কে?’

পরপর তন্নির দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,

‘বাবার বর্ণনা মতে অত্যন্ত চমৎকার দেখতে বলতে তাকে মনে হলেও কথার ধরণটা আপনাকে ইঙ্গিত করছে। আ’ম কনফিউজড!’

লোকটার কথার সারমর্ম বুঝতে না পারলেও তাকে কেন খোঁজ করছে ব্যাপারটায় ভিষণ কৌতুহল বোধ করলো। সে কিছু বলার আগেই তন্নি উঠলো,

‘কনফিউজড হওয়ার কি আছে? আমরা দুজনেই রূপন্তি। এবার ঝটপট বলে ফেলুন কি চাই?’

তন্নির জবাবে লোকটা মুচকি হেসে জবাব দিলো,

‘তাহলে তো বেশ হয়। ওয়াইফ হিসেবে আমার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে।’

তন্নি‌চুপ হয়ে যায়। দেখতে সভ্য মনে হলেও লোকটা চরম অসভ্য। অন্তির হঠাৎ টনক নড়ে। সে সন্দিহান গলায় বলে,

‘আপনি আরাব?’

‘এতক্ষণে চিনতে পারলেন! যাক চিনতে পেরেছেন তাতেই খুশি আমি।’

‘কিন্তু এখানে কেন এসেছেন?’

‘আপনাকে দেখতে। অবশ্য অনেক দিন ধরেই আসার‌ প্লান করছিলাম, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। আজ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় ভাবলাম আপনাকে ছোটখাটো একটা চমক দেই!’

আরাব লোকটাকে অন্তি মোবাইলের মাঝে দেখে যেমনটা ভেবেছিলো লোকটা পুরোটাই তার ভিন্ন। যথেষ্ট সুন্দর হলেও লোকটা ভিষণ রকম ফ্লার্টি। কথার ধরণেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। ছবিতে চোখে চশমা ছিলো না। কিন্তু বাস্তবে মোটা গ্লাসের চশমা চোখে থাকায় চিনতে পারেনি। এরকম একটা ছেলে কিভাবে তার বাবা তার জন্য পছন্দ করতে পারে? আর মা! তার মা কি জানে আরাব এমন ধরণের মানুষ? না জেনেই এই লোকটার প্রশংসায় মত্ত হয়ে পড়েছে সবাই। অন্যদিকে কোনো কিছু না জেনেই দিহানকে খারাপ চরিত্রের লোক বলে আক্ষায়িত করলো! অন্তার বুক আবারো ভারী হয়ে আসে। বিয়ের ব্যাপারটা এখনো দিহানকে বলা হয়নি। সে ভেবেছিল তাকে ভয় দিতে তর বাব মা অমন বলেছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের কথা সত্যি ছিলো, মাঝখান থেকে তাদের উপর বিশ্বাস করে সে নিজেই বোকা সাজলো।

‘কি ভাবছেন এতো? চলুন কোথাও বসি?’

অন্তি সরাসরি না করে দেয়।

‘আজ হচ্ছে না। দুঃখিত। আমার একটু কাজ রয়েছে।’

‘কি কাজ?’

অন্তি কিছুটা বিরক্ত গলায় জবাব দেয়,

‘এটা পার্সোনাল। আল্লাহ হাফেজ।’

তন্নির হাত শক্ত করে ধরে সামনে হাঁটা দিতেই চোখ পড়ে রাস্তার ওপারে। দিহান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইকটা নুহাশের। তবে আশপাশে নুহাশকে দেখা যাচ্ছে না। লোকটা সরু চোখে তাকিয়ে আছে।

‘দোস্ত! কথা বলবি না? তোর দিকেই তাকাই আছে।’

‘উহু। আমার থেকেও তার ওতবড় বুকে ভয় বেশি। রাস্তার মাঝে তার সাথে কথা বলা আমার মানা। ঢং সব।’

আরাব বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উল্টো পথে পা বাড়ায়। তাকে এভাবে ইগনোর করাটা তার সম্মানে আঘাত করেছে। কোনো মেয়ের থেকে সে এমন জবাব পায়নি। ব্যাপারটা ভিষণ অপমানজনক। এতটুকু মেয়ের কথার তেজ দেখে সে কিছুটা অবাক। যদিও তার কাছে চুপচাপ শান্ত সুন্দরী মেয়েটাকে ভালো লেগেছে খুব।

_______________

তন্নি খুব মনোযোগ দিয়ে অন্তিদের বাসার কাঠামো আকাচ্ছে। এটাকে ম্যাপ বললেই চলে। আঁকাআঁকি ব্যাপারটায় সে কখনোই ভালো না। মানুষ আঁকালে সেটাকে গরু বলেই বেশি মনে হয় দরণের দক্ষতা তার। এমন দক্ষতা নিয়ে বাড়ির ম্যাপ আঁকা বেশ চ্যালেন্জিং তার জন্য। এই চ্যালেন্জটাই গ্রহণ করেছে সে।‌ সেচ্ছায় নয়, নুহাশ নামক লোকটার গম্ভীর চাহনিতে। আজকাল তার মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। লোকটার এমন নির্যাতনের জন্য তার নামে কেস ঠুকে দিলে কেমন হয়? পুলিশের ডান্ডির দু তিনটা আঘাতে ঠিক সোজা হয়ে যাবে। বজ্জাত লোক।
তন্নির ফোনে কল আসে। নম্বর দেখতেই তন্নি বিরবির করে বলে,

‘শয়তানের নাম নিতেই সে হাজির।’

ফোন রিসিভ না করেই ছোট ছোট পায়ে বারান্দায় যেয়ে দাড়ায়। এখন অল্প রাত। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুব। নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে তার বারন্দার নিচে। তন্নির তার আঁকা ম্যাপট ফোল্ড করে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে রুমে ঢুকে যায়। কেউ তকে দেখে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

রাত বেজে বারোটা। অন্তি দিহানের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোজ নিয়ম করে এই সময়ে কল দেয় দিহান। কখনো বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্তি তখন চুরি করে দেখা করতে যায় তার নাক উঁচু প্রেমিকের সাথে।‌ অন্তির ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। ঘুম চোখে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদেশ আসে,

‘ছাদে আসো।’

অন্তি বুঝতে না পেরে অস্পষ্ট গলায় বলে,

‘হু?’

‘তোমার বাসার ছাদে আসো। অপেক্ষা করছি। দেরী হলে রুমে চলে আসবো। সো ফাস্ট।’

অন্তির কপাল কুঁচকে আসে। বুঝতে দু মিনিট সময় লাগে। ফোন কেটে গেছে ততক্ষনে। যতক্ষণে বুঝতে পারে তার বুক ধক করে ওঠে। এই লোক ছাদে কিভাবে আসলো? নাকি ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখেছে? ফোনের ডায়াল লিস্টে দিহানের নাম্বার দেখতেই শিওর হয় সে। কোনো রকম গায়ে ওড়না জড়িয়ে পা টিপে ঘর থেকে বের হয়। ছাদ পুরোপুরি অন্ধকার। লাইটটা দুদিন হলো কেটে গেছে। লোহার গেট ঠেলে ছাদে পা‌ রাখতেই তার‌ ভেতর হাল্কা ভয় লাগা কাজ করে। যদি দিহান এখানে না থাকে? এর বেশি ভাবার অবকাশ পেলো‌না সে। শক্ত একটা হাত তার নরম হাতকে আঁকড়ে ধরে তার দিকে টেনে নিলো। হাতের কঠিন বন্ধন অনুভব হতেই অন্তির বুক শান্ত হয়ে আসে। এই হতের অধিকারীকে তার চেনা। খুব বেশিই চেনা।

চলবে…….

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৭+১৮

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৭.
আবেগ, এই জিনিসটা মানুষের মধ্য থেকে বিবেগকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনে। সাময়িকী ভাবে জ্ঞান বুদ্ধিকে শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। অন্তি নিজেও জানে না তার এই ছোট একটা স্বীকারোক্তি তার জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে চলছে। তার বোকা মন খানিকের জন্য ভেবে নিয়েছিল পরিবারকে তার পছন্দের কথা জানালে তারা হয়তো সবসময়ের মতো করে তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলবে,

‘এতে এত কান্নার কি আছে? আমার মেয়ে যা চাইছে সেটাই হবে।’

কিন্তু এটা কেবল তার ভ্রান্ত ধারণা হয়েই থাকলো। বাস্তবটাতো ছিল ভিন্ন কিছু! তার কথা শেষ না হতেই গালে দানবীয় আঘাতে ছিটকে পড়লো অন্তি। নিমিষে কি হলো কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারলো না সে। মাথার ভেতরটা কেমন ঝিম ধরে গেছে। এত তীব্র আঘাত এর পূর্বে কখনো সে কারো থেকে পায়নি। জল ভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই তার বুকের ভেতরা কেঁপে ওঠে। নাহার অত্যন্ত শীতল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত জোরে মেয়েকে আঘাত করেও তার ভেতর নূন্যতম ব্যাকুলতা দেখা গেলো না। কিন্তু অন্তির ঠিক মনে পড়ছে বেশ কিছুদিন পূর্বে অন্তি নিজ থেকে ডিম ভাজতে গিয়ে সামান্য তেল ছিটে পড়েছিল হাতে। ঠিক কতটাইনা ব্যাকূল হয়েছিলো সেদিন নাহার! চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিলো। তার ফুলের মতো মেয়েটার হাতের ছোট্ট একটা অংশ জুড়ে লাল হয়ে ছিলো, এ সামান্য জিনিসটা তাকে কতই ঞা পিড়া দিয়েছিল! তবে আজ? অন্তি মাথা ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকায়। তার বুকটা আরো ভারী হয়ে আসে। সাহেদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্তি দিশেহারা হয়ে পড়েছে যেন। কি এমন ভুল করেছে সে? এমন অদ্ভূত আচরণ কেন করছে সবাই? কেউ কিছুই বলছে না। এই নিরবতা বড্ড যন্ত্রণা দেয় তাকে। সহ্য না করতে পেরে কেঁদে উঠে বলে,

‘কি ভুল করেছি আমি? কেন এমন করছো তোমরা?’

তার এ কথার জবাব কেউ না দিলেও তার বড় চাচা গম্ভীর স্বরে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আমাদের পরিবারের এ সমাজে একটা মর্যাদা আছে সাহেদ। আমাদের পরিবারের ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত এবং সভ্য। আমরা আমাদের পরিবারের সাথে তেমনি কোনো‌ ভদ্র সভ্য পরিবারের আত্মীয়তা করবো। তোমার মেয়েকে বোঝাও। এখনো সময় আছে। সময় থাকতেই ভুল শুধরে নাও।’

সাহেদ বড় ভাইয়ের কথায় লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। জবাবা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। তার এত অহংকার যে মেয়েকে নিয়ে সেই মেয়ের কারণেই কিনা আজ তাকে এভাবে মাথা নামিয়ে রাখতে হাচ্ছে। বুকটা অসহ্য জ্বলছে তার। অতি আদরে কি সত্যিই মেয়েটাকে বিগড়ে ফেলেছে সে?

শাহিন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে।‌ ফ্লোরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা অন্তিকে একবার পরখ করে বলে ওঠে,

‘তোমাকে আমি এ পরিবারের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সবথেকে বুদ্ধিমতী একজন ভাবতাম। ভাবতাম যে যেমনটা হোক না কেন তুমি হবে একজন পারফেক্ট মানুষ। যার প্রতিটা কাজে থাকবে সকলকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। তোমার ভেতর সেই প্রতিভা আমি দেখেছি। কিন্তু এভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে কিভাবে? ছেলেটা তোমায় ঠিক কতদিন ধরে বিরক্ত করছে? পরিবারকে জানাওনি কেন?’

অন্তি সরল দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকায়। তার চোখের পানি এখনো গাল গড়িয়ে পড়ছে। চোখদ্বয় ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। তার ক্রন্দনরত মুখ দেখে শাহিনের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। এই আদুরে মেয়েটার সাথে এত কঠিণতা সত্যিই বেমানান। মেয়েটাকে ভালোবেসে বোঝাতে হবে। তার রক্ত কখনো ভুল পথ বেছে নিবে না! ভাইকে নিরবে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলবে।
এতক্ষণ নাহার চুপ থাকলেও বড় ভাসুরের প্রশ্নে মেয়েকে উত্তর না দিতে দেখে রেগে গেলেন খুব। রূঢ় গলায় বলে উঠলেন,

‘তোমাকে এতদিন এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে? বড়রা প্রশ্ন করলে জবাব দিতে হয় এই সামান্য ম্যানারসটাও দেখছি ভুলে বসেছ?’

নাহার যখন খুব রেগে যায় তখন কেবল তুমি করে কথা বলে। অন্তি মায়ের কথাতেই বুঝে নিয়েছে তার রাগের পরিমাণ। কিন্তু সে নিরুপায়। বড় চাচার প্রশ্ন সে ইচ্ছা করে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল কারণ সে চেয়েও দিহানকে পরিবারের কাছে খারাপ করতে পারবে না। যে মানুষটাকে সে এত ভালোবাসে পরিবারের কাছে সে মানুষটাকে কিভাবে সে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে খারাপ করে তুলবে? সে যদি সত্যিটা বলে তবে সেটাও তার পরিবারের কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। এসব ভেবেই সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ হয়তো ভাগ্য বা নিয়তি কোনোটাই তার সাথে নেই। অন্তি ঢোক গিলল। সরাসরি কারো চোখে চাইতে পারলো না। মাথা নিচু রেখেই বিরবির করে বললো,

‘সে কখনোই আমায় বিরক্ত করেনি।’

নাহার মেয়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণে ক্ষুদ্ধ হয়ে বললেন,

‘অনেক বড় হয়ে গেছ দেখছি! আমিতো এতদিন লক্ষ্যই করিনি আমি নিজ হাতে পালছি যে মেয়েকে সে এত বড়ো হয়ে গেছে! মিথ্যা বলতে শিখে গেছ? রাস্তার একটা গুন্ডাকে বাঁচাতে চাইছো? এত অধঃপতন! তুমি না বললেও রাস্তার ছেলেরা কেমন হয় আমরা জানি। তোমার রুচি নিচে নামলেও আমাদেরটা নামেনি। ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেও।’

এতক্ষণ চুপ থাকলেও অন্তি এবার মাথা উঁচু করে মায়ের চোখে তাকালো। ভয়হীন ভাবে প্রতিবাদ করে উঠলো,

‘তোমাদের রুচি নিচে না নামলেও তোমাদের মানসিকতা নিচে নেমে গেছে মা। না জেনেশুনে তুমি কিভাবে কাউকে বারবার রাস্তার ছেলে বলতে পারো? কতটুকু জানো তুমি তার ব্যাপারে?’

সাহেদ অবিশ্বাস্য চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। নাহার ক্ষিপ্ত হয়ে দ্বিতীয় বারের মতো থাপ্পর লাগালেন অন্তির নরম গালে। একই গালে পরপর দুবার এহেন আঘাতে গাল অবশ হয়ে পরেছে অন্তির। হঠাৎ করেই চারপাশ কেমন করে দুলে উঠলো। চোখের সামনের সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। একসময় ওভাবেই লুটিয়ে পড়লো। নাহার শক্ত হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। শাহিন মেঝ ভাইয়ের বউয়ের এমন ক্ষিপ্ত স্বভাবে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। তার সামনে তার পরিবারের মেয়েদের গায়ে হাত তোলা চুড়ান্ত রকমের বিয়াদপি। যেখানে মা নিজেই সভ্যতা জানেনা সেখানে মেয়ে কিভাবে শিখবে? শাহিন কঠিন গলায় ভাইকে বললেন,

‘রূপন্তি তোমাদের মেয়ে হতে পারে কিন্তু মনে রেখো ও এই খান বংশের একটা অংশ। তোমরা শাসন করবে তা মেনে নিব কিন্তু গায়ে হাত তোলার মতো সাহস করো কিভাবে? আমি এখানে গুরুজন থাকতে তোমার স্ত্রী কিভাবে মেয়েকে আঘাত করে? আগে নিজের স্ত্রীকে সভ্যতা শিখাও।’

শাহিন ব্যাস্ত পায়ে উপরে চলে যান। বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হয়। তেমন কিছুই হয়নি, দুর্বলতার জন্য সেন্স হারিয়েছে। সামান্য কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে যান তিনি। নাহার মেয়ের রুমের দরজায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা হিসেবে কি সে অনেক খারাপ? কতটা খারাপ মা হলে আঘাত করে মেয়েকে এভাবে শয্যায় ফেলে দেওয়া যায়! বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ওঠেন তিনি। সাহেদ স্ত্রীকে রুমে নিয়ে যান। মেয়েকে আঘাত করা নিয়ে কোনো কথা বলেননা তিনি। ইতিমধ্যে নাহার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। পুনরায় তাকে এ ব্যাপারে বলে আর কষ্ট দিতে চাননি তিনি। কেবল স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন,

‘তোমাকে আরো ধৈর্যশীল হতে হবে নাহার। অনেক কিছুর মোকাবেলা করতে হবে কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না। ধরে নাও এটা একজন মা হিসেবে তোমার চ্যালেঞ্জ।’

______________

জীবনের অতিব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে বিয়ে। যেখানে বাছাই করে নেওয়া হয় একজন জীবন সঙ্গীকে। দোকানে পছন্দ হওয়া ড্রেসটার মতো করে জীবন সঙ্গী বাছাই করা চলে না। এজন্যই বোধহয় এ সমাজের বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সেরা জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে চায়। হোক জোর করে কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে। তবে উদ্দেশ্য একই; সন্তানের সুখ! তবে সন্তানের চাহিদা কেন তারা বুঝতে চায় না? কেন বোঝে না যে ভালোবাসা ছাড়া সংসার হয় না?

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায়না অন্তি। চারদিক থেকে কেবল শুন্যতায় ঘেরা এক অদ্ভুত জবাব আসে। যার অর্থ তার জানা নেই। আচারের বোয়াম হাতে ডায়নিং এ যেতেই সাহেদ মেয়ের জন্য চেয়ার টেনে দেয়। বড় করে হেসে বলে,

‘আজকের রান্নাটা ফাস্টক্লাস হয়েছে। জলদি বসেপরো। টেস্ট করে দেখো। মাংসটা কিন্তু আজ আমি রেঁধেছি। সাহেদ নওয়াজ খানের হাতের ছোঁয়া পেতেই রান্নার স্বাদ দশগুণ বেড়ে গেছে বুঝলে। হেহে!’

তাকে হাসাতে বাবার এই সামান্য প্রচেষ্টা অন্তির বিফলে যেতে দিতে ইচ্ছা হলো না। কষ্ট চেপে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে সে ও হেসে উঠলো। ইশশ! যদি সে গতকাল ওমন বোকামি না করতো আজ দিনটা তবে ভিন্ন হতো। এইযে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে তার কেমন জড়তা অনুভব হচ্ছে! একই টেবিলে খেতে বসতেও কতটা জড়তা! তখন হয়তো এমনটা হতো না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে ঐ মানুষটাকি জানে তাকে নিয়ে অন্তি নামক মেয়েটার জীবনে কেমন ঝড় চলছে? জানলে সে কি করবে? রাজকুমার রূপে তাকে উদ্ধার করতে আসবে? নাকি না জানার মতো করে মুখ ঘুরিয়ে নিবে?

চলবে……..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৮.
পানি ছাড়া মাছের মতো ছটফট করতে করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর তারপর বিকেল এলো। ঘড়িতে চারটা বাজে। ঠিক পাঁচটায় অন্তির ব্যাচ। এই সময়টার অপেক্ষাতেই চাতক পাখির ন্যায় সময়ের কাটা গুনেছে সে। এই অপেক্ষার অল্প সময়টুকু তার কাছে কয়েকশত বছরের সমান ঠেকেছে। অপেক্ষার প্রহর সত্যিই ভিষণ বড় হয়। সময়ের কাটা যেন একই জায়গায় চক্রাকারে ঘুরছে। অপেক্ষার প্রহর কাটলো দীর্ঘ সময় নিয়ে। অন্যদিনের মতো আজ আর সাজগোজ করা হলোনা। চোখে লাগানো হলোনা কাজল আর না ঠোঁটে লাল রঙ। সাদামাটা ভাবেই পোশাক পাল্টে নিলো। চুল বাঁধার সময় আয়নায় নিজেকে লক্ষ্য করতে চমকে গেলো। সে যেন নিজের এক অন্যরূপ দেখতে পাচ্ছে। একদিনেই কেমন বদলে গেছে সে। চোখ গুলো গর্তে চলে গেছে। লাবন্যময়ী চেহারা ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। মাত্র একটা দিনের তফাৎ এ কতকিছু ঘটে গেল! কি অদ্ভুত নিয়ম জীবনের।
অন্তি রুম ছেড়ে বেরহতেই দেখলো নাহার ডায়নিং এ বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। সাহেদ রোজ নিয়ম করে গুটাকয়েক কাঁচা বাদাম খায়। তার হাঁটুতে ব্যাথার রোগ রয়েছে। ডাক্তার তাকে ক্যালসিয়াম জনিত সকল প্রকার খাবার খেতে বলেছেন। এ জন্যই সে এই বাদাম খান।
অন্তিকে দেখা মাত্রই নাহার চোখ কুঁচকে ফেললেন। এমন সময় কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা তা না জানার মতো করে প্রশ্ন করলেন,

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

এমন প্রশ্নে অন্তিও খানিক অবাক হলো। সে তো রোজ এ সময়ে ব্যাচে যায়। এটাতো নতুন কিছু না। তবুও ছোট করে সে জবাব দিলো,

‘ব্যাচে।’

নাহার ভিষণ স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো,

‘ব্যাচে যেতে হবেনা আর। তোর বাবা বাসায় টিচার ঠিক করেছেন। কাল থেকে পড়াতে আসবে।’

অন্তির পা থেমে যায়। চোখে মুখে বিস্ময় খেলে যায়। অবাক গলায় বলে,

‘বাবা টিচার ঠিক করেছে? আমাকে তো জানালো না?’

নাহার বাদাম গুলো একটা কাঁচের বোয়ামে রাখতে রাখতে বেশ সাবলীল ভাবেই বললেন,

‘এখানে জানানোর কি আছে? সে যেটা ঠিক মনে করেছে সেটাই করেছে। মেয়ের ব্যাপারে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এখানে তো অস্বভাবিক কিছুই দেখছি না।’

অন্তি টু শব্দ ছাড়া রুমে ফিরে এলো। মায়ের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত। এইযে সে অতি স্বাভাবিক আচরণ করছে এটাও অস্বভাবিক। কিন্তু বাবা? সে তো অন্তিকে বোঝে। তাহলে সে কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে? অন্তির চিৎকার করে কাঁদতে মনে চাচ্ছে। নিজের পরিবারের প্রতিটা মানুষকে তার বড্ড অচেনা বলে মনে হচ্ছে। দম বন্ধ লাগছে। কাঁধের ব্যাগ খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে। টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাগে দুঃখে চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে মেয়েটার। বা হাতে চোখের পানি মুছে কাঙ্খিত মানবটার নম্বরে ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ‌ জানালো, এ মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…
মানুষটার নম্বর রাত ছাড়া দিনের যেকোনো প্রহরে বন্ধ পাওয়া যায়। দুশ্চিন্তায় অন্তির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দুশ্চিন্তা‌ গুলো যেন‌ গলায় কাঁটা আকারে আটকে আছে। এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু এ ব্যাপারে তন্নি বা দিহান কেউ‌ কিছু জানে না। অন্তি তন্নিকে ইচ্ছা করেই কল করলো‌ না। মেয়েটা বড্ড ভীতু ধরণের। এমন কিছু জানলে কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে ফেলবে হয়তো। তখন সমবেদনা পাওয়ায় চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে সমবেদনা জানাতে হবে। তাই ঐ চ্যাপ্টার সে আগেই অফ করে দিয়েছে।

_____________

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। সারাদিন বাইক কিংবা জিপে করে ছুটতে থাকা ছেলে গুলোকে আজ রাস্তার প্রাঙ্গনে দেখা গেলো না। না দেখা গেলো চায়ের দোকানে আড্ডা। দীর্ঘদিনের নিয়ম ভেঙে আজ দিহান মির্জা আজ নিজেকে গৃহবন্দি করেছে। ঠিক বন্দি বলা চলে না, তার নিজ মর্জিতেই আজ সে ঘরে রয়েছে। তার এই হঠাৎ পরিবর্তন সবথেকে যে ব্যক্তিকে আশ্চর্য করেছে সেটা হচ্ছে তার মা। রেহানা এ পর্যন্ত তিন থেকে চারবার ছেলের ঘর থেকে ঘুরে গেছে। দু একবার বুকে কপালে হাত রেখে চেক করে গেছেন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়লো কিনা। চিন্তায় তার প্রেশার ফল করেছে। ছেলেটাকে নিয়ে এমনিতেই তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই, তার উপর হঠাৎ এমন পরিবর্তন তাকে আরো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। দিক শূন্য হয়ে সে নুহাশকে কল করে। ছেলের কাছের বন্ধু বলতে নুহাশকেই চেনেন তিনি। তার ব্যাকুলতায় নুহাশ তাকে আশ্বস্ত করলো কিছুক্ষণের মাঝেই সে আসছে। ঠিক তাই হলো। দশ মিনিটের মাথায় আগমন ঘটলো নুহাশের। রেহানা ড্রয়িংয়ে বসে ছিলেন। কাজের মহিলা দরজা খুলে দেয়। নুহাশকে দেখতেই রেহানা তাকে হাসিমুখে ভেতরে ডাকেন। মিষ্টি হেসে বলেন,

‘তোমাকে তো দেখাই যায়না বাবা। মাঝে মধ্যে তো আসতে পারো?’

নুহাশ বোকা হাসে। সে কেন আসে না তা যদি আন্টি জানতো!

দিহানকে আজকাল কেমন অন্যধরণের মানুষ বলে মনে হচ্ছে নুহাশ। যেই ছেলে সারাদিন শুয়ে বসে থেকে আড্ডা আর রাজনীতি নামক ঝামেলায় জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে সে আজকাল নিজেকে আড্ডা, মারামারি থেকে দূরে দূরে রাখছে। এই তো আজ সকাল সকাল কল এসেছে পার্টি অফিস থেকে। অন্যান্য সময় কল আসা মাত্র সে প্রস্থান করে কিন্তু আজ সুস্থ সবল মানুষটা অসুস্থতার দোহাই দিয়ে থেকে গেল। দিহান মির্জাকে অবিশ্বাস করার কথা কেউ ভুলেও ভাববে না। এমন শক্ত সমর্থ এক কথার পাথুরে মানুষটাকি মিথ্যা বলতে পারে? নিজ চোখে না দেখলে হয়তো নুহাশ ও কখনো বিশ্বাস করতে পারতো না। নুহাশকে অন্যমনষ্ক দেখে দিহান ওর দিকে কুশান ছুঁড়ে মারে।

‘তোকে আমার নীতিবান বাপ দেখেনি আসতে?’

নুহাশ অসহায়ের মতো মুখ করে জবাব দেয়,

‘দেখলে তোর রুম অবদি আসার ক্ষমতা আমার থাকতো না ভাই। দরজা থেকেই জুতো হাতে পালাতে হতো। বুঝিনা ভাই আমি কি করলাম? আমার উপর এত জুলুম কেন?’

এর উত্তর দিহান খুব ভালো করেই জানে। তার পিতা মহাশয় ভাবেন তার ছোট বেপরোয়া ছেলেটা বিগরে যাওয়ার একমাত্র কারণ এই নুহাশ। এমন বাউন্ডুল ছেলের সাথে মিশেই তার সোনার ছেলে তামায় পরিণত হয়েছে। দিহান পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দেয়। নুহাশের কথাকে পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

‘রূপের সাথে যে ছোট খাটো করে মেয়েটা ওর নাম যেন কি?’

নুহাশ না বোঝার মতো করে বললো,

‘কার কথা বলিস ভাই? মাইয়া মানুষের খোঁজ খবর কি আমি রাখি?’

দিহান ফিচেল হাসে। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘বেশ! আমি লোক পাঠিয়ে নাহয় খোঁজ নিব। ভাইয়ার জন্য মা মেয়ে দেখতে বলছে। ভাইয়া খুব চুজি জানিস তো! ভাবলাম ভাবী হিসেবে ঐ মেয়েটাকে বেশ মানাবে! মেয়েটা একদম ভাইয়ার টাইপ।’

নুহাশের মুখ কালো হয়ে এলো। এই মির্জা বংশটাই খারাপ। বাপ ছেলে কেউ তাকে সহ্য করতে পারে না। এদের কোন জমিতে আগুন দিয়েছিল সে? মন চায় গুল্লি মেরে উড়াই দিতে সব। কিন্তু মনের এসব আক্ষেপ সে প্রকাশ করলো না। মিনমিনে গলায় বললো,

‘কি জানতে চাস বললেই তো হয় ভাই। শত্রুর মতো আচরণ করোস কেন?’

দিহান সোজা হয়ে বসে। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

‘ওর থেকে রূপদের বাসার নকশাটা ম্যানেজ করবি।’

কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় যেমন রিয়্যাকশন হওয়ার কথা তার থেকেও ভয়ানক রিয়্যাকশন দেখা দিলো নুহাশের মাঝে। যেন সে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে পাতালের গভীরে হারিয়ে গেছে।

‘কি বলিস? ডাকাতি করবি ভাই?’

দিহান বাঁকা হাসে। ল্যাপটপ অন করে কোলে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা করতে লাগে। মাঝ পথে কথা থামানোতে নুহাশ মহা বিরক্ত হয়। দিহানের এই স্বভাবগুলো তার কাছে বড্ড অসহ্য ঠেকে। ব্যাটা যা বলবি সরাসরি বলবি। ধর তক্তা মার পেরেক টাইপের। তা না করে এত ভনিতা কেন?

‘বা*ল মেজাজ খারাপ হয় কিন্তু। ক্লিয়ার করনা ভাই।’

নুহাশ ভাবেনি দিহান এত দ্রুত মুখ খুলবে। অবশ্য আজকাল দিহানের সকল কার্যক্রম তার ভাবনার বিপরীতে হয়। এক্ষেত্রে ও তেমন হলো। দিহান ভিষণ দাম্ভিকতার সহিত জানালো।

‘না হওয়া শ্বশুর সাহেব আমার প্রেম হওয়ার আগেই বিরহের ব্যাবস্থা করতেছে। ভাবতে পারিস? এমন বোকামি কেউ করে? বাঘের সামনে থেকে খাবার টেনে নিতে চাইছে! অথচ এটাই জানেনা যে, তার মেয়েকে তুলে আনতে আমার দু মিনিট সময়ের দরকার হবে না। বোকা শ্বশুর!’

নুহাশের অক্ষিকোটর থেকে চক্ষুদ্বয় বেরিয়ে আসার উপক্রম। তার কানদ্বয় সত্যি শুনছে? নাকি সবটা ভ্রম? ব্যাটা প্রেমে পড়েছে তা সে বহুআগেই বুঝেছে কিন্তু মুখ ফুটে এভাবে শ্বশুর বলার মতো প্রেমে পড়েছে এটা তার জানা ছিলো না। মানে ব্যাপারটা এতোটা গভীরে কখন এবং কিভাবে গেলো? সে কেনো জানলো না?
দিহান নুহাশের এহেন রিয়্যাকশনে কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘ঠিক যতটুকু বলেছি ততটুকুই ভাব, কম বেশি ভাবতে যাবি না। নয়তো তোর পথে কাঁটা হতে দুবার ভাববো না।’

নুহাশ দমে গেলো। চিন্তা ভাবনাকে ওখানেই ছুঁড়ে ফেললো। মেকি হেসে বললো,

‘তোর শ্বশুর, তোর শ্বশুরের মেয়ে, সবই তোর। অযথা আমি ভাবাভাবি কেন করবো? নো ওয়ে। আন্টি মাংস রান্না করছে। সেটাই ভাবছিলাম। আজ না খেয়ে যাচ্ছি না। তোর নীতিবান বাপটা মাঝখান থেকে না আসলেই হচ্ছে!’

চলবে………

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৫+১৬

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫.
চেনা পরিচিত মুখ গুলোকে হঠাৎ করে বদলে যেতে দেখলে বা ভিন্ন ধর্মী আচরণ করতে দেখলে যেকোনো ব্যক্তির মস্তিষ্ক স্বাভাবিকের তুলনায় বিপরীত প্রতিক্রিয়া করবে। উক্ত পরিবর্তনের রহস্য উন্মোচনে ব্যাকুল হবে। অন্তির ব্যাপারটাও তেমন। প্লেটে বাহারি খাবার থাকা সত্ত্বেও সে তা গালে তুলতে পারছে না। তার নজর দূরে খাবারের তদারকি করা দিহানের দিকে। লোকটা হঠাৎ করেই কেমন দায়িত্ববান পুরুষের ন্যায় আচরণ করছে। ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক ঠেকছে তার কাছে। কুকুরের লেজ হুট করে সোজা হয়ে যাওয়ার মতো কোনো প্রবাদ সে শোনেনি। তার মানে এটা দাড়ায় যে ব্যাপারটা অসম্ভব! তাহলে দিহান মির্জার মতো মানুষের লেজ কিভাবে সোজা হতে পারে?

‘দোস্ত লেগ পিস দিলো না কেন আমাদের? দেখ তুলির প্লেটে! বেছে বেছে বড় লেগ পিছটা দিছে। কেন রে? আমরা বুঝি টাকা দেইনি?’

অন্তি তার কথা শুনলো বলে মনে হলো না। বরং সে তন্নির হাত ঝাঁকিয়ে বললো,

‘দোস্ত তোর মনে হয়না কিছু একটা গোলমেলে হচ্ছে। মানে আই ফিল সামথিং ফিসি হিয়ার!’

তন্নি উৎসাহিত হয়ে বললো,

‘দ্যাটস ইট গার্ল! আমিও এটাই বলছিলাম। দেখলি তো কেমন অবিচার চলছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠেনের মতো জায়গায় যদি লেগ পিছ নিয়ে এমন রাজনীতি চলে তবে দেশের অন্য সব প্রান্তে কি চলছে ক্যান ইউ এভার ইমেজিন! আমি হাইলি ডিজাপয়েন্টেড!’

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তন্নি। অন্তি কটমট করে চাইলো। এখানে এত বড়ো কিছু ঘটে যাচ্ছে আর এই মেয়ে পরে আছে লেগপিছ নিয়ে!

‘ওমনে তাকাস কেন?’

অন্তি চাপা শ্বাস ফেলে উদাস ভঙ্গিতে বলল,

‘দিহান মির্জাকে লক্ষ্য করেছিস? কেমন ঘাপলা লাগছে লোকটার ভেতর। ধমকা ধমকি বাদ দিয়ে আজ এত দায়িত্ববান পুরুষের রোল কেন প্লে করছে? মনে মনে নিশ্চই চুড়ান্ত কোনো ষড়যন্ত্র কষছে। এই লোকের শিরায় শিরায় খারাপি লুকিয়ে আছে!’

অন্তির এই ওভার থিংকিং ব্যাপারটা তন্নির ঠিক পছন্দ হলো না। সে বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো,

‘তোর জন্য কি মানুষ ভালো পথে চলতে পারবে না? আযব দুনিয়া! তুই না চাইতি সে ভালো হয়ে যাক, একদম মাম্মাস বয় টাইপের! তোর সেই দোয়ার প্রভাবে এমন চেঞ্জ। আরো কিছুদিন দোয়া কন্টিনিও কর ইনশাআল্লাহ সফলতা নিশ্চিত।’

অন্তির মস্তিষ্ক তন্নির যুক্তিকে পুরোপুরি ভাবে মেনে নিতে পারলো না। মাথায় চিন্তার ঘড়িটা টিক টিক করে বাজতেই লাগলো। মন বরংবার হুঁশিয়ারি বার্তা প্রেরণ করছে। কি চলছে লোকটার মাথায়?

___________

সাহেদ আজ অফিস আওয়ারেই বাড়িতে ফিরলো। নাহার তখন খিটখিটে মেজাজে কাজের মেয়েটার উপর ডিটার্জেন্ট ছাড়া ধুয়ে দিচ্ছে। এমনটা প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। সাহেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘আহ নাহার! এত রাগ করো কেন? কি হয়েছে?’

‘কি হয়নি তাই বলো? রোজ রোজ এক জিনিস আমার ভালো লাগে না। ওকে কোনোদিন আমি একবারে কোনো কথা শুনাতে পারলাম না।’

সাহেদ স্ত্রীর রাগ সম্পর্কে জানেন। একটুতেই রেগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিপি হাই কীনা! সে এগিয়ে এসে নাহারকে টেনে সোফায় বসালেন। তাকে শান্ত করতে বললেন,

‘বিশ্রাম নেও। এভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমাকে বলো কি করেছে ও?’

স্বামীর এই ছোট মত্নে শান্ত হয়ে আসে নাহার। শরীর বয়স্ক হতে চললেও মন এখনো ষোড়শী কিশোরীর মতোই আদর যত্নের খোঁজ করে। স্বামী নামক ব্যক্তিটির যত্নে তৃপ্ত হয়ে আসে হৃদয়। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,

‘ওকে আমি দোকান থেকে এক কেজি ডাল আনতে বলেছি। সে ধেই ধেই করে এক কেজি চাল নিয়ে চলে এসেছে। ফেরত পাঠিয়ে বারবার করে বলেছি মুশুর ডাল আনতে, আর ও আনছে ছোলার ডাল। এমন উল্টাপাল্টা কাজ করলে আমি ওকে দিয়ে কি করবো?’

সাহেদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখলো। মেয়েটার বয়স অন্তির মতোই হবে। বাংলা সিনেমার ভক্ত খুব। সারাদিন মুখে তার বিভিন্ন সিনেমার গান আর কাহিনী ঘোরে। সে ক্ষেত্রে এসব টুকটাক বিষয় ভুলে যাওয়াটা অস্বভাবিক নয়। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে আলাদা রকম ক্ষমতা থাকে। এই মেয়েটার মাঝে আছে কাজের বিষয়গুলো ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। সাহেদ গম্ভীর স্বরে মেয়েটাকে বলে,

‘তুমিকি এখানে থাকতে চাও নাকি চলে যেতে চাও?’

মেয়েটা মাথা নিচু করেই জবাব দিলো,

‘থাকতে চাই সাহেব।’

সাহেদ ফের বললো,

‘তাহলে আমার মিসেসকে আর এভাবে জ্বালাতন করবে না কেমন? তোমাকে আমি একটা ডায়েরি আর কলম দিবো। কিছু বলার সাথে সাথে চট করে নোট করে ফেলবে। তাহলে আর ভুল হবেনা।’

‘জ্বি আচ্ছা সাহেব।’

‘লিখতে পারো তো? পড়াশোনা করেছো?’

‘জ্বি পারি সাহেব। ফাইপ পর্যন্ত লেকাপড়া জানি সাহেব।’

‘এখন যাও কাজে লেগে পড়ো।’

কাজের মেয়ে যেতেই সাহেদ স্ত্রীর দিকে ফেরেন। চিন্তিত স্বরে বলেন,

‘তোমায় এভাবে হাইপার হতে না করেছি না? এমনটা যেন আর কখনো না দেখি নাহার। তুমি এখন কিশোরী নেই। বুঝতে হবে তোমাকে।’

নাহার এক বাক্যে স্বামীর কথা মেনে নেয়। সাহেদ গলার টাই ঢিল করতে করতে বলে,

‘মেয়ে কোথায়?’

‘কোথায় আর কলেজে।’

সাহেদকে হঠাৎ চিন্তিত দেখায়। যেন হঠাৎ করেই কোনো একটা ব্যাপার তাকে খুব ভাবাচ্ছে। নাহার বতা লক্ষ্য করে কোমল গলায় ভলে,

‘কিছু হয়েছে?’

সাহেদ মাথা নাড়ায়।

‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ নাহার?’

নাহার চমকে তাকায় স্বামীর দিকে। অবাক গলায় বলে,

‘মেয়েটা এখনো ছোট। বিয়ের জন্য অনেক সময় বাকি আছে। এখন ওসব নিয়ে ভাবাভাবির দরকার কি?’

সাহেদ মাথা দুলিয়ে সার জানায়। বলে,

‘আমিও তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আজিমকে তো চেনো? আমার বন্ধু ডাক্তার আজিম। ওর ছেলেটা এবার মেডিকেল শেষ করে জব এ ঢুকলো। আজিমের হস্পিটালেই জয়েন হয়েছে শুনলাম।’

‘হ্যা তো?’

‘আজিম চাচ্ছে ছেলেকে বিয়ে করাতে। আরাবের মতো হীরের টুকরো ছেলেকে আমি মেয়ের জন্য বেষ্ট বলে মনে করি। মেয়েটাকে চেনা পরিচিতের মধ্যে দিতে পারলে বুকের উপরের ভার কিছুটা নামতো আরকি।’

নাহারকে চিন্তিত দেখালো। সাহেদের উপর তার ভরসা আছে। সাহেদ যখন বলেছে নিশ্চই ছেলেটা তাদের মেয়ের জন্য উপযুক্ত। তাছাড়া তার মেয়েটা যা দস্যি! ওমন মেয়েকে কোন ভালো ছেলে বিয়ে করবে? তাছাড়া মেয়েকে বিয়েতো দিতেই হবে। আজ হোক বা কাল! আহার স্বামীর কাঁধে হাত রাখলো। সাহেদ তাকাতেই বললো,

‘তুমি আজিম ভাইয়ের সাথে কথা বলো। আমি মেয়েকে দেখছি!’

___________

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রক্তিম হয়ে উঠছে আকাশ। আজ পুরোটাদিন সূর্য তার প্রখরতা বিছিয়ে বেড়িয়েছে। অন্যদিনের মতো মেঘের দল এসে তাকে রুখে দেয়নি। অন্তি আর তন্নি কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আজ যেন রিকশা এ ধরণীর বুক থেকে ভ্যানিস হয়ে গেছে। কোথাও কোনো রিকশার খোঁজ নেই। ব্যাপারটায় অন্তি বিরক্ত হলেও তন্নি আকাশ সম উৎসাহ নিয়ে বললো,

‘দোস্ত ডোন্ট ইউ থিংক আমাদের একটা রিকশাওয়ালা বফ দরকার? চাইলেই যখন তখন রিকশা চড়ে ঘুরে বেড়াবো। আহ্! ভাবতেই সেই ফিল আসতেছে।’

আন্তি অতিষ্ঠ চিত্তে দাঁতে দাঁত চেপে খেকিয়ে ওঠে।

‘মুখা বন্ধ রাখ তন্নি। আর একবার মুখ খুলেছিস তো তোর জীবনের দা এন্ড ঘটাতে দু বার ভাববো না।’

তন্নি না চাইতেও দুঃখ প্রকাশ করে ফেললো,

‘তুই আর তুই নেইরে পাখি। দিহান ভাইয়ার মতো ডেন্জারাস হয়ে গেছোস। ভালোবাসার কি দারুণ ক্ষমতা!’

সত্যিই কি তাই? অবশ্য অন্তির ও আজকাল মনে হয় সে দিহানের মতো খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে। একটুতেই কি রাগ তার! অন্তি নিজের এসব উদ্ভট আচরণের জন্য দিহানকেই দায়ী মনে করে। তার সকল খারাপ অভ্যাসের কারণ এই লোক।

ভাবনা থেকে সে বের হলো তন্নির কথায়,

‘দোস্ত! তোদের বিয়ে হলে তো দেখছি ঘোর বিপত্তি ঘটে যাবে! দুইয়ে দুইয়ে চার, মানে তোদের বাচ্চারা…… আমারতো ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’

তন্নির এসব নাটকে অভ্যস্ত অন্তি জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রিকশার ভরসায় থাকলে রাত ফুরিয়ে দিন হয়ে যাবে তাও রিকশা পাবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া তন্নির ভাবনা কেবল তার বাচ্চাদের কাছে পৌঁছেছে, আরো কিছুক্ষণ পর হয়তো নাতি নাতনির কাছেও পৌঁছে যাবে। বলা যায় না!

তন্নিও অন্তির পিছু পিছু চলতে শুরু করেছে। কিন্তু তার মুখ বন্ধ নেই। মাঝে মাঝে তার মুখ আউট অফ কন্ট্রোলে চলে যায়। ছুটতেই থাকে। হাজারবার ব্রেক কষলেও লাভ হয়না। আজ ও তেমন হয়েছে। সে চেয়েও তার মুখের শাটার টানতে পারছে না।

.

.

মোরে আজ ও দিহানের দেখা মিললো। জিপের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে। মৃদু বাতাসের তালে ঘন চুলগুলো দোল খাচ্ছে। সাদা বলিষ্ঠ হাতে চকচকে কালো বেল্টের ঘড়িটা বড্ড মানিয়েছে। অন্তি আড় চোখে সবটা দেখলো। মন চাইলো লোকটা যেন একবার তার দৃষ্টি তুলে তাকায়। তার ভারী দৃষ্টিতে খানখান করে দিক কিশোরী হৃদয়। কিন্তু পুরুষটা যে বড্ড অবাধ্য। অন্তির মনের ব্যাকুলতাকে দূরে ছুড়ে ফেলে অন্তির দিকে একবার ও চাইলো না চোখ তুলে। জিপের দরজা খুলে চড়ে বসলো তাতে। দাম্ভীকতার সাথে প্রস্থান করলো জায়গা। পরপর তাকে অনুসরণ করে সাই সাই করে বাইক নিয়ে ছুটলো সবাই। মিনিটের মাঝে ফাঁকা হলে গেলো জায়গা।

দিহানের এমন ইগনোর করার ব্যাপারটা অন্তির পাহাড় সমান উঁচু ব্যক্তিত্বে আঘাত হানলো। নিজ মনকে দু চারটা কটু বাক্য শুনিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে। দু পা এগোতেই পাশ ঘেঁষে একটা রিকশা এসে থামলো।

‘আপা ওঠেন।’

অন্তি রিকশাওয়ালার দিকে একবার তাকিয়ে পেছন ঘুরলো। রাস্তায় গাড়ি আর অপরিচিত লোকজন ব্যাতীত পরিচিত প্রিয় মুখের মানুষটাকে সে কোথাও দেখতে পেল না। তবুও অন্তির মন বলছে দিডহান আশপাশেই কোথাও আছে। নিরবে গোপনে তাকে দেখছে। এই রিকশাটাও তার ঠিক করে দেওয়া। তন্নিও হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এজন্য অন্তির আগেই সে রিকশায় চেপে বসেছে। অন্তি বিনা বাক্যে বিষন্ন মন নিয়ে উঠে বসলো। দিহান নামক মানুষটার প্রতি তার অভিমান গাঢ় হলো। মানুষটা এমন কেন করছে? না তাকে কাছে টানছে আর না দূরে যেতে দিচ্ছে। শূন্যের মাঝামাঝি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে তাকে। সে কি বোঝেনা এতে অন্তির কষ্ট হয়? নাকি তাকে কষ্ট দিতেই এত আয়োজন?

পুরোটা রাস্তা নিরবতায় কেটে গেলো। তন্নির গলার কাছে এতশত কথা এসে আটকে রইলো। অন্তির মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই নিজের মুখকে বন্ধ করে রেখেছে সে। অন্তিদের বাসার সামনের রাস্তায় এসে রিকশা থামলো। এবার কোনো রকম ভয় ছাড়াই একা একা নেমে দাঁড়ালো সে রিকশা থেকে। যদিও শাড়ি অনেকটা এলোমেলো হয়েছে। কুচিতে পা লেগে কুঁচি খুলে এসেছে অনেকটা। কোনোরকম তা আঁকড়ে ধরে বাকিটা রাস্তা হেঁটে বাসায় ঢুকলো। অন্তি গেট দিয়ে ঢুকতেই তন্নি ছোট করে শ্বাস ফেলল। সামনে ফিরে বললো,

‘মামা চলেন।’

তার মনটাও কেমন বিষিয়ে এসেছে। সে কি একবার দিহান ভাইয়ার সাথে অন্তির ব্যাপারে কথা বলবে? কিন্তু তার জন্য যে পর্যাপ্ত সাহস দরকার!

চলবে……..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৬.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অদ্ভূত মায়াজড়ানো মাদকতায় পূর্ণ সে গন্ধ। প্রকৃতি ভিষণ শীতল হয়ে পড়েছে। গায়ে পাতলা চাদর টানতেই ঘুমে চোখ দুটো বুঝে আসতে চায়। যেন কত বছরের নির্ঘুমতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে চোখ দুটো! বছর পর রকৃতির পরশ পেয়ে সকল ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। অন্তির রুমের জানালায় টাঙানো সাদা ধবধবে পর্দাগুলো চঞ্চল ছুটছে। বাতাসের তাড়নায় তারা স্থির থাকতে ব্যর্থ। রাতে জানালা বন্ধ করা হয়নি। বৃষ্টির ছিটে জানালার পর্দার অনেকাংশই ভিজে গেছে। পর্দার উড়ে চলার ফাঁকে ফাঁকে বাহিরের স্বল্প সতেজ দৃশ্য চোখে আটকায় অন্তির। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। সাথে আসছে চাল, ডাল একত্রে করে রান্না নরম খিচুড়ির ঘ্রাণ। অন্তি আলগোছে উঠে বসে। নাসারন্ধ্রে খিচুড়ির ঘ্রাণ প্রবেশ করা মাত্রই তার নিজেকে ভিষণ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। পেটের ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছে। অগোছালো চুলগুলো হাত খোপা করে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় সে। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং যেতেই দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই তার বাবা বসে আছেন। আজ অফ ডে না হওয়াতেও সে বাসায়। এমনটা খুব কমই দেখা যায়। প্লেটে খাবার নিয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। খিচুড়ির পাশেই বড়ো বাটিতে রাখা মুরগির ঝাল মাংস। বেগুন ভাজি ও করা হয়েছে। এসব অন্তির পছন্দের খাবার। বৃষ্টির দিনে নরম খিচুড়ি খাওয়া অন্যরকম একটা আনন্দ। নাহার এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলদি খেতে বোস। খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

সাহেদ মেয়েকে দেখে মুচকি হাসে। বলে,

‘আচার আছে মা? নিয়ে আসো তো।’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে আচার আনতে রান্নাঘরে চলে যায়। পরিবারের প্রতিটা মানুষ কত স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন সব আগের মতো সাজানো গোছানো রয়েছে। ছোট্ট একটা সুখি পরিবার। যেখানে সব কিছুতে রয়েছে ভালোবাসার ছোঁয়া। কিন্তু আদেও কি তাই? এই সবটাই কি সত্যি নাকি কেবল অভিনয়? অন্তি গতকালের কথা মনে করে,

গতকাল সন্ধ্যায় সাহেদের সাথে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। সম্পর্কে তিনি সাহেদের ভিষণ কাছের একজন বন্ধু। অন্তি অবশ্য তার নাম কয়েকবার শুনেছে। ডা: আজিম খন্দকর। বেশ ভালোমানের ডাক্তার তিনি। ভদ্রলোক বেশ রসিক ধরণের। অন্তির তার সাথে কথা বলে তেমনটাই মনে হয়েছে। কথায় কথায় জানতে পেরেছে ভদ্রলোকের একটা মাত্র ছেলে রয়েছে। সে ও একজন ডাক্তার। ভদ্রলোকের ছেলের গল্প শুনে অন্তির এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আরাব নামের লোকটা অত্যন্ত রকমের সুপুরুষ। যার এত এত ভালো গুণ সে সুপুরুষ ব্যাতীত কি হতে পারে যানা নেই অন্তির। কথার এক পর্যায়ে ভদ্রলোক কৌশলে তার গুনধর ছেলের ছবিখানাও দেখিয়েছে অন্তিকে। বেশ সুদর্শন বলা চলে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত এসে থামলেই চলত কিন্তু ব্যাপারটা তখনই খারাপের দিকে গেলো যখন ভদ্রলোক কথার ছলে অন্তির সামনে সাহেদকে বললো,

‘তোর মেয়ে ছোট তাতে কি? তোর মেয়েকে কি আমি বা তোর ভাবী অন্যসব শশুর শাশুড়ির মতো রান্নাঘরে আটকে রাখবো নাকি? আমার বউমা হবে আমার সন্তানের মতো। এখানে যেভাবে আছে আমার কাছেও সেভাবেই থাকবে।’

বন্ধুর কথায় ভরসা পায় সাহেদ। উজ্জ্বল হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘তাহলেতো সমস্যার আর কিছু দেখছি না।’

অন্তি শক্ত হয়ে বসে তাদের আলোচনা শোনে। তার কান অব্দি বাদবাকি কথা পৌছাতে পারলো না। বুকের ভেতরটা কেমন জমে এসেছে। কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে যেন। এমন বিপদের কথা তো সে কখনো ভাবেনি। তার বয়স সবে সতেরো। এত দ্রুত… কেন? অন্তির চোখ ভরে আসে। মাথায় হাজার চিন্তা দলা পাকাতে থাকে। কোনো কথা ছাড়া দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। রুমে যেতে নিলে আজিম সাহেব বাঁধা দিয়ে বলে ওঠেন,

‘মামনি বসো। আরো কিছুক্ষণ গল্প করি তোমার সাথে।’

অন্তির পা আবস হয়ে আসছে। সে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দিহানকে ছাড়া অন্যকাউকে তার চাই না। সে ব্যক্তি যতই সুপুরুষ হোক না কেন অন্তির কেবল দিহানকে চাই।
আজিম সাহেবর কথায় খুব কষ্টে ঠোঁট টেনে স্বল্প হেসে সে বলে,

‘আমার শরীর খারাপ করছে আঙ্কেল। অন্য এক সময় কথা হবে।’

দ্রুত প্রস্থান করতে নিলে অন্তির মনে হয় তার পায়ে যেন পাথর বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সে কিছুতেই পা টেনে রুম অবদি যেতে পারছে না।
সাহেদকে চিন্তিত দেখালো। মেয়ের এভাবে চলে যাওয়াটা তার কাছে ভালো লাগলো না। চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে দেখা গেলো সেও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অন্তি স্বভাবত চটপটে ধরণের। কথা বলার মানুষ পেলে তার মুখ ননস্টপ চলতে থাকে। এতক্ষণ পর্যন্ত সব তো ঠিক ছিল। বিয়ের কথা উঠতেই মেয়েটা…… !!
সাহেদের যতটুকু বোঝার সে বুঝে ফেললেন। এ বয়সের মেয়েরা বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা নষ্ট করতে চায় না। বিয়ে বলতেই তারা চার দেয়ালে বন্দি জীবন মনে করে। মেয়েকে বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবে ভেবে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।
আজিম সাহেব বিদায় নেন তার খানিক বাদেই। রাতে খাবার টেবিলে অন্তি না আসায় সাহেদ স্ত্রীকে বলেন,

‘মেয়েকে ডাকছো না কেন?’

নাহার প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলে,

‘তোমার মেয়েকে তুমি কেন ডাকছো না? দুবার ডেকেছি দরজা খোলেনি।’

স্ত্রীর এমন গা ছাড়া ভাব সাহেদের কখনোই পছন্দ হয় না। মেয়েটা না খেয়ে থাকবে নাকি রাতে? নিজেই উঠে এসে অন্তির রুমের দরজায় কড়া নাড়ে।

‘দরজা খোলো রূপন্তি।’

ভেতর থেকে জবাব আসে,

‘আমি খাব না। ক্ষুধা নেই।’

সাহেদের হঠাৎ করেই হাসি পায় খুব। পুরোনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে। তার যখন বিয়ে হলো নাহার তখন বেশ ছোট। তাকে একটু আধটু বকলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। সব রাগ খাবারের উপর দিয়ে চলে যেত। মেয়েটাও হয়েছে তেমন। একদম মায়ের কপি।
কিন্তু এখন হাসলে চলবে না। মেয়ের ছোট্ট মনে নিশ্চই বাবার প্রতি অভিমান জন্মেছে। এই অভিমানকে ক্ষোভে রূপ নিতে দেওয়া যাবে না। তার পূর্বেই মেয়েকে বোঝাতে হবে তাকে। এই বয়সটা খারাপ। এ বয়সেই ছেলে মেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে বাবা হয়ে মেয়ের বিন্দু ক্ষতি চান না।

ঘড়িতে দশটা বাজে। অন্তি বসার ঘরে এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই সোফায় বসে তার বাবা মা এবং বড় চাচা। বড় চাচার হঠাৎ এই রাতে এখানে আসার কারণটা অন্তির অজানা। সাহেদ মুশত মেয়েকে বোঝানোর জন্য এত রাতে বড় ভাইকে কল করে ডেকেছেন। বংশের মাথা তিনি। বাচ্চা থেকে বড় সকলেই বেশ মেনে চলেন তাকে। নিরবতা ভেঙে অন্তির বড় চাচা শাহিন রাশভারী গলায় বলেন,

‘এখানে এসে বোসো। আসামির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোনো অন্যায় করেছ তুমি?’

অন্তি দুদিকে মাথা নাড়ায়। সাহেদ মুচকি হাসে। সে উপযুক্ত লোককেই এনেছেন মেয়েকে বোঝাতে। অন্তি চুপটি করে সামনের সোফায় বসে।তার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ইতিমধ্যে তার সচেতন‌ মস্তিষ্ক বড় চাচার আসার কারণ উদঘাটন করে ফেলেছে।

‘সোজা কথায় আসি। আরাব ছেলেটার ছবি দেখেছো?’

চাচার কথায় মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তার ধারণাই ঠিক। ঝেঁপে আসা কান্না চেপে রেখে অন্তি মাথা নাড়ায়। সে দেখেছে। শাহিন সাহেব পুনরায় বলেন,

‘ছেলেকে দেখে তোমার অপছন্দ হয়েছে?’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে না জানায়। শাহিনের সাথে সাহেদ ও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। এ পর্যায়ে সাহেদ কথা বলেন,

‘বাবা তোমার খারাপ চায়না মা। আরাব ছেলেটা ভিষণ ভালো। আমি খোঁজ নিয়েছি। তাছাড়া এখন বিয়ে হলেই আমরা তোমায় দিয়ে দিব না ওদের কাছে। তোমার যাখন মনে হবে তুমি ওবাড়িতে যেতে প্রস্তুত তখন আমরা ব্যাবস্থা নিব।’

অন্তি বাবা চাচাকে সম্মান করে এবং ভয় ও পায়। কিন্তু তাই বলে নিজের মতের বিরুদ্ধে সে কারো কথাই চুপ করে মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে নয়। এবারো তাই হলো। সে বাবার মুখের উপর বললো,

‘আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না বাবা। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।’

‘কেন মা? খুলে বলো। না বললে বাবা বুঝবে কিভাবে?’

অন্তি এখানেই ভুলটা করে বসে। বাবার কাছে বায়না করলেই সব পাওয়া যায় সে চিন্তা থেকেই জীবনে প্রথম বারের মতো চুড়ান্ত বোকামিটা করে বসে সে। কিন্তু মেয়েটা যানেই না বাবার কাছে পুতুল চেয়ে আবদার করা আর জীবন সঙ্গী আবদার করা দুটোর মধ্যে মাইল মাইল পার্থক্য রয়েছে!
আবেগে আপ্লুত অন্তি কেঁদে কেঁদে ততক্ষনে হেঁচকি তুলে ফেলেছে।‌ মেয়ের এমন কান্না দেখে নাহার এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চেষ্টা করে। সাহেদ অস্হির হয়ে ওঠে। তার ছটফটে চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করে এমন ভেঙে পড়লো কেন? শাহিনকেও চিন্তিত দেখালো। তার বংশের তারা এই মেয়েটা। নিজের মেয়ের থেকেও বোদহয় এজন্য ভাইয়ের মেয়েটার প্রতি এত স্নেহ তার।

নাহার মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে দেয়।

‘কাঁদে না পাগল মেয়ে। তুমি চা চাইবে সেটাই হবে। বাবাকে বলো তুমি কি চাও।’

মায়ের পরম স্নেহে অশান্ত মন শান্ত হয়ে আসে। ভাবনা চিন্তা ছাড়াই মেয়েটা তার মনের অত্যন্ত গোপন তথ্য তাদের নিকট পেশ করে।

‘আমি দিহান মির্জাকে পছন্দ করি। আমি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমার দিহান মির্জাকে চাই বাবা।”

চলবে…….

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১৩+১৪

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৩.
শাড়িতে নারী! কথাটা আসলেই সত্যি। নারীর সৌন্দর্য শাড়িতেই প্রকাশ পায়। অন্তি চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে আয়নায় নিজেকে দেখছে। কলাপাতা রঙের শাড়িটা তার শ্যাম শরীরে বড্ড মানিয়েছে। তন্নি তা দেখে দাঁত বের করে হাসে। চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলে ওঠে। এগিয়ে এসে পেছন থেকে অন্তিকে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

‘সুন্দর লাগছে তোকে পাখি। আজ তোর গুন্ডা সাহেব তোকে দেখলে নির্ঘাত ফিট খাবে। এ ব্যাপারে একশত পার্সেন্ট না হলেও নব্বই পার্সেন্ট সিওরিটি দিতে পারি আমি। তাকে হসপিটালাইজড্ করার জন্য অগ্রিম একটা অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রাখা দরকার! কি বলিস?’

অন্তি মুখ বাঁকায়। ঐ অসভ্য লোক এসব সৌন্দর্যের কদর করতে জানে না। কেবল পারে চোখ মুখ কুঁচকে ধমক দিতে।
আয়না থেকে চোখ সরিয়ে তন্নির দিকে তাকাতেই তার চোখ কুঁচকে আসে। অবাক গলায় বলে,

‘একি তোর ও না সেম কালারের শাড়ি পড়ার কথা?’

তন্নির মুখটা ছোট হয়ে আসে। তার পরনে হালকা নীল রঙের একটা জামদানী। এটাই সেদিন পার্সেল এসেছিলো। সে তো অন্তির সাথে মিল রেখে কলাপাতা রঙের মায়ের শাড়িটা পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু ঐ খারাপ লোকটা সকাল সকাল টেক্সট করে বললেন,

‘আমার দেওয়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বের হবে। ইটস্ আ অর্ডার।’

তন্নির সাহস নেই দ্বিমত করার। আবার কেমন শাস্তি দিবেন তা তো বলা যায় না!

তন্নিকে চুপ থাকতে দেখে অন্তি মুচকি হেসে বললো,

‘তোকে কিন্তু দারুণ লাগছে তনু। একদম পরীর মতো।।’

তন্নি ও উত্তরে লাজুক হাসলো। অন্তির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

‘তোকে কিছু বলার আছে। মানে আবার রাগ করবি কিনা!?’

অন্তি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘তুই কি আমাকে প্রপোজ করতে চাচ্ছিস? ডোন্ট ডু দ্যাট। আই অলরেডি হ্যাভ সামওয়ান!’

_____________

কলেজ প্রাঙ্গনে আজ রমনীদের মেলা বসেছে। খিলখিল হাসির ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে পরিবেশ। রাস্তায় চলার পথে সকলে আগ্রহভরা দৃষ্টিতে উঁকি দিচ্ছে কলেজ গেটের ভেতরে। অন্তিদের রিকশা এসে থামে কলেজ গেটে। সমস্যা বাঁধে রিকশা থেকে নামতে যেয়ে। শাড়ি পড়ার অভ্যাস নেই দুজনের কারোর। কষ্ট করে একজনের সাহায্যে অন্যজন উঠতে পারলেও নামার সময় এটা চ্যালেন্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তির চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েছে। হাত দিয়ে পেটের কাছের শাড়ি চেপে ধরে রেখেছে। এত কষ্ট করে পড়া শাড়ি যদি মাঝরাস্তায় পায়ের নিচে পড়ে খুলে যায় লজ্জার সাথে কষ্টের পরিমানটাও সমানুপাতিক ভাবে বাড়বে। শাড়ি খুলে যাওয়ার চিন্তায় ইতিমধ্যে অন্থির চোখে মুখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠেছে। অসহায় দৃষ্টিতে তন্নির দিকে তাকাতে তার দৃষ্টি আরো ঘোলাটে হলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠ ধরে তন্নি বললো,

‘আমরা কি আজ এভাবেই পিকনিক শেষ করব পাখি? এই মুহূর্তে একটা বফের খুব প্রয়োজন বোধ করছি। পৃথিবীতে এতশত অফারের মাঝে বফ সংক্রান্ত কোনো অফার নেই? আমি দুই মিনিটের অফারটা নিতে চাই।’

অন্তি কিছু বলতে নিবে তার আগেই কোথা থেকে হাওয়ার গতিতে এগিয়ে নুহাশ। পড়নে তার নীল রঙের পাঞ্জাবি। রিকশার কাছে এসে এক গাল হেসে উঠলো।

‘আরে ভাবী যে! কতদিন বাদে দেখা।’

নুহাশ অন্তির সাথে কথা বললেও তার চোখ ব্যস্ত অন্তির পাশে জুবথুব হয়ে বসে থাকা রমনীর দিকে। তাকে দেখতেই মেয়েটা কেমন গুটিয়ে গেছে।

অন্তি গাল ফুলিয়ে বললো,

‘ভাবী ঠেকেছেন যখন একটু হেল্প করুন। রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াতে…..’

অন্তি কথা শেষ করার আগেই নুহাশ এসে তন্নির দিকে হাত বাড়ালো। ছোট করে হেসে বললো,

‘নেমে আসুন বেয়াইন। আপনার সেবায় এই বান্দা হাজির।’

তন্নির দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। ফেঁসে গেছে সে। এই মুহূর্তে এই লোকটার হাত না ধরেও উপায় নেই। তন্নি নেমে গেল। অন্তি সেদিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নুহাশ মুচকি হেসে বললো,

‘বন্ধুর পার্মিশন ছাড়া তো তার বউয়ের হাত ধরতে পারিনা! বন্ধুর থেকে পার্মিশন পেলেই তোমায় নামাবো।’

অন্তির মেজাজ চটে গেলো। রুক্ষ কন্ঠে শুধালো,

‘একদম আমায় ঐ অসভ্য লোকের বউ বলবেন না। তার সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। ইহজনমে সম্ভব ও নয়। আপনার বন্ধু অতিব মাত্রায় অসভ্য একজন মানুষ। আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন, রূপন্তি নওয়াজ খান এখন আর আবেগে বশীভূত হয়ে তার মতো অসভ্য মানুষকে পছন্দ করার মতো ভুল করবে না।’

অন্তি এতগুলো কথা বলে শ্বাস ফেলল। বহুদিন পর মনের সব তিক্ততা বের করতে পেরে খুব হালকা লাগছে নিজেকে। সে পারলে এই লোকটার অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে নাই করে দিত। কিন্তু পারছে না বলেই তো চুপ করে আছে।

‘অসভ্য ব্যক্তিত্বের মানুষের জন্য কেঁদে কেটে সাগর মহাসাগর বানানোর পেছনের থিওরিটা জানতে চাই আমি।’

অন্তি চকিত দৃষ্টিতে সামনে থাকায়। দিহান বুকে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার কালো রঙের পাঞ্জাবি। লোকটা সবসময় কালো পড়ে নয়তো সাদা। এছাড়া কি পৃথিবীতে কোনো রং নেই? বুকপকেটে ঝুলে আছে কালো রঙের রোদচশমা। চোখ দুটো কুঁচকে আছে সামান্য। যেন সে সত্যিই উত্তরটা জানতে আগ্রহী। অন্তি চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আশপাশে তাকালো। এভাবে হাঁটে হাঁড়ি ভাঙার কি দরকার ছিল? শুধুই কি অন্তি তাকে অসভ্য বলে? এর পেছনে যথাযথ কারণ রয়েছে।

অন্তিকে চুপ দেখে দিহান বাঁকা হাসে। এগিয়ে এসে রিকশা ওয়ালার হাতে দুশো টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়। অন্তির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ঠোট কামড়ে হাসে। বলে,

‘আপনাকে প্রতি দশ মিনিটের জন্য একশত করে টাকা দেওয়া হবে। আপনার কাজ সামনের চায়ের দোকানে বসে মনের সুখে চা খাওয়া। চাইলে সাথে অন্যকিছু ও খেতে পারেন।’

লোকটার চোখ চকচক করে ওঠে। বিনা বাক্যে সে রাজি হয়ে যায়। দশ মিনিটে রিকশা চালিয়ে একশত টাকা ইনকাম করা অসম্ভব সেখানে বসে বসে চা নাস্তা খেতে খেতে ইনকিম হলে আপত্তি কিসে?
দিহান ঠিক কি করতে চাচ্ছে বোধগম্য হলোনা অন্তির। সে কেবল ড্যাবড্যাব করে দেখতে লাগলো। তবে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠেছে। এই অসভ্য লোক তার অসভ্য মস্তিষ্ক নিয়ে নিশ্চই কোনো ঝটলা পাকাতে চলেছে। চোখ ঘুরিয়ে তন্নির দিকে তাকালে দেখা গেলো সে মাথা নিচু করে মুর্তির মতো নুহাশের থেকে স্বল্প দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তি রাগে দাঁত চিবিয়ে তন্নিকে ডাকলো। সে বিপদের মাঝে আটকে আছে আর এই মেয়ে দেখো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

‘হাত ধর। সং সেজে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

অন্তির ধমকে তন্নি ঠোঁট উল্টায়। পা আগাতে গেলেই টান অনুভব করে। নুহাশ তার শাড়ির আঁচল হাতে পেঁচিয়ে রেখেছে। তন্নি চেয়েও পাড়লো না সামনে আগাতে। অন্তির দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই অন্তি চোখ রাঙালো। তন্নি পড়লো বিপাকে। সে কিভাবে অন্তিকে বলবে যে সে নিজেও ফেঁসে আছে!

দিহান একটা ছেলেকে ডাকলো হাতের ইশারায়। কথা বার্তায় জানা গেলো ছেলেটার নাম রাকিব। পেশায় সে দিহানের ভক্ত! অন্তি এটা চট করেই বুঝে ফেলেছে। কারণ ছেলেটা দিহানের কথার আগায় মাথায় ‘জ্বি ভাই’ ‘আচ্ছা ভাই’ এভাবে রিপ্লাই করে যাচ্ছে। অন্তি মুখ বাঁকিয়ে বিরবির করলো,

‘ভাই না ছাই!’

অন্তিকে শেষ বারের মতো চমকে দিয়ে দিহান ছেলেটাকে বললো,

‘চোখে চোখে রাখবি এই যে অতি সুদ্ধ একজন নারী বসে আছে রিকশায়, তাকে যেন কেউ ওখান থেকে নামতে হেল্প না করে। মাইন্ড ইট!’

ছেলেটা অতি উৎসাহে জবাব দিলো,

‘জ্বি ভাই! নো চিন্তা। আমি আছি।’

এটা কি হলো? অন্তি চকিত হয়ে তাকিয়ে রইল। দিহান অন্তির দিকে তাকানোর নূন্যতম প্রয়োজন বোধ করলো না। সে দিব্যি হেলে দুলে উক্ত স্থান থেকে প্রস্থান করলো। ইতিমধ্যে নুহাশ তন্নির আঁচল ছেড়ে হাত আঁকড়ে ধরেছে। তাতে তন্নির প্রাণ যাই যাই অবস্থা। ভূমিকম্পের ন্যায় তার সর্বশরীর কাঁপছে। এত অত্যাচার কেন তার প্রতি? হাতের বাঁধন ছাড়াতে পারবেনা যেনেও সে ব্যর্থ চেষ্টা করেছে দুবার। এতে করে নুহাশ গলার স্বর খাদে নামিয়ে চরম দুটো ধমক দিয়েছে। তন্নি পুনরায় সে কাজ করার সাহস করেনি। নুহাশ এতে মজা পায়। নিরবে হাসে। বোকা মেয়েটা কেবল তাকে ভয় পেয়েই গেলো। একবারো এসব কাজের পেছনের মোটাভ বোঝার চেষ্টা করলো না! করলে হয়তো সেই শুরুতেই নুহাশ নামক ধোঁয়াশা তার নিকট স্বচ্ছ পানির ন্যায় হতো। কিন্তু তার রমনী যে বোকা! বড্ড বোকা! এই অতি সামান্য সমীকরণ মেলানোর মতো পর্যাপ্ত বুদ্ধি‌ তার‌ নেই।

________________

আকাশে রোদ উঠেছে খুব। তীর্যক রোদে শরীর থেকে জল গড়াচ্ছে। অন্তি অতিষ্ঠ ভঙ্গতে কপাল, নাক মুছলো। রাগে তার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। একটা মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হতে পারে? বিরক্ত দৃষ্টিতে গেটের সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকা দিহানকে দেখে সে। লোকটা কেমন নির্লপ্ত ভঙ্গিতে ফোন টিপছে। এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ এমন ঠান্ডা মস্তিষ্কে কিভাবে বসে থাকতে পারে?
অন্তি আশপাশে নজর বুলায়। আশপাশে তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তন্নি সেই কখন নুহিশের সাথে ভেতরে চলে গেছে। কতবর বেঈমানি করলো মেয়েটা তার সাথে ভাবা যায়? রাকিব নামের ছেলেটা ঘুরে ঘুরে নজরদারি করছে। যেন কোথা থেকে কেউ এসে ছো মেরে অন্তিকে নিয়ে যাবে। এসব কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে অন্তি নিজ থেকেই নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চেষ্টা ছাড়া এ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ সফল হতে পারেনি। কবি বলেছেন, একবার না পারিলে দেখো শতবার। সে নাহয় একবার চেষ্টা করে দেখলো!
শাড়ির কুচি শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে লাফ দিতে নিলেই দিহান‌ এসে তার সামনে দাঁড়ায়। চাপা কন্ঠে বলে,

‘এনার্জি কেন নষ্ট করছো? সুন্দর ভাবে আমাকে বললেই হয়!’

অন্তি ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। দাঁত চেপে বলে,

‘আই ডোন্ট নিড ইয়োর হেল্প।’

‘বেশ! তবে বসে থাকো।’

অন্তি শক্ত জবাব দেয়,

‘আমি একাই নামতে পাড়বো!’

‘আমি সেটা হতে দিব না!’

‘কেন করছেন এমন?’

দিহান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,

‘ইচ্ছা হলো!’

অন্তি শান্ত চোখে তাকায়। দু সেকেন্ডের মাঝে হাত বাড়িয়ে দিহানের কাঁধ ছোঁয়। দিহান চমকে ওঠে। বুকের ভিতর ছলৎ করে ওঠে। অন্তি শক্ত ভাবে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরেছে। দিহান আশা করেনি অন্তি এভাবে মেনে যাবে। দিহানকে নির্লপ্ত দেখে অন্তি বলে,

‘কি হলো? নামিয়ে দিন?’

দিহান নিজেকে ধাতস্থ করে। সে ভুলে বসেছিলো যে এটা অন্তি! যাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। কেবল তার নিকট পরাজয় স্বীকার করাই কাম্য!
অন্তির ঠোঁট কোণে হাসি খেলে যায়। ব্যাটা রাগি কুমরা আসছে তাকে হেনস্থ করতে! এত সহজ নাকি? এই রূপন্তি নওয়াজ খানকে হেনস্থা করার জন্য দিহান মির্জাকে দ্বিতীয় বার জন্ম নিতে হবে। এ জীবনে সেটা অ স ম্ভ ব!

চলবে……..

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৪.
সময়ের কাটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটছে। ঢাকা শহরের বুকে দুপুর নেমেছে। ঘড়িতে সময় দুপুর একটা। অন্তি মাঠের এক কোনে জুবথুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বা হাতে ধরে রাখা তার শাড়ির কুচি। অন্যহাতে মাবাইল সহ পার্স। খোলা চুলগুলো অবাধ্যের ন্যায় উড়ে উড়ে চোখ মুখে পড়ছে। দু হাত ব্লক থাকায় বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে চুল সরানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে সে জায়গা ছেড়ে নড়তেও পারছে না। উঁচু হিলের তলায় শাড়ির কুচি বেঁধে শাড়ি কিছুটা এলোমেলো হয়েছে। এজন্যই মূলত সে এখানে তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে গেলে যদি খুলে যায়? এক শাড়ি পরার জন্য এতসব ইতিহাস তৈরি হবে জানলে সে এই ভুল কিছুতেই করতো না। সবাই কেমন হেলেদুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর সে?
ওদিকে তন্নির কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটা ওয়াশরুমের নাম করে সেই গেলো এখনো এলো না। অন্তি যখন আকাশ কুসুম ভাবতে ব্যস্ত তখন সেখানে আগমন ঘটলো দিহান মির্জার। তাকে খুব চিন্তাগ্রস্থ দেখালো। অন্তি চোখ পিটপিট করে চাইলো। এই লোকের মতলব কি? দিহান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল,

‘কোনো সমস্যা?’

অন্তি না বোঝার ভঙ্গিতে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। ছোট করে বললো,

‘কোনো সমস্যা না।’

দিহান আশপাশে তাকিয়ে পুনরায় বললো,

‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

অন্তি জবাবে মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর যাই হোক সে তো এখন বলতে পারবে না তার শাড়ি খুলে যাওয়ার ব্যাপারটা। লজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!

প্রশ্নের সাথে সাথে উত্তর না পেলে মেজাজ তিতো হয়ে আসে দিহানের। সেখানে এই মেয়েটা প্রতিটা জবাবের আগে মৌনতা পালন করে। দু একটা থাপ্পর লাগালে এতদিনে ঠিক ঠাক হয়ে যেত। কিন্তু সেটা পারছে না আপাতত। তেমন করলে এই মেয়ে তার জিনা হারাম করে দিবে।
দিহান দু আঙুল দিয়ে কপাল ঘঁষে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

‘যা পড়তে পারো না তা পরো কেন? দ্বিতীয়দিন যেন তোমায় শাড়িতে না দেখি!’

অন্তি ঠোঁট উল্টে তাকালো। শাড়ির কুচি শক্ত করে ধরে রাখলো। লোকটা বুঝলো কিভাবে? অন্তি আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে দিহানের পানে চাইলো। পরপর পাতলা ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে বলতে নিলো,

‘আপনি বুঝলে কি…..’

তার কথাকে অসম্পূর্ণ রেখে দিহান উল্টো পথে পা বাড়ালো। যেতে যেতে শাসিয়ে বললো,

‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। কাউকে পাঠাচ্ছি।’

অন্তি কথা শোনে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে দিহান দুকদম এগিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে অন্তির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,

‘চুমু খেতে চাইতে লজ্জা লাগে না, আর সামান্য শাড়ি খুলে গেছে বলতে এতো লজ্জা? ইমপ্রেসিভ পারফরমেন্স! আ’ম ইমপ্রেসড্!’

কথা শেষ করে ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো দিহান। তবে অন্তি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। লোকটা কি বলে গেলো? পরক্ষণে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে ওঠে। ইশশ! আবেগের বশে কোনো একদিন চুমু খাওয়ার কথা নাহয় সে বলেছিলো, সেটা এতদিন মনে রাখার কি দরকার ছিলো? লোকটা নিশ্চই তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য সেসব কথা নোট মার্ক করে রেখেছে! অন্তি চিন্তিত ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ালো। এই মানুষটা তো চরম অসভ্যের সাথে নির্লজ্জ ও বের হলো। এতসব খারাপ গুণ কেন তার মাঝেই থাকতে হলো? অন্তি কিভাবে ওভারকাম করবে এসব গুণ?

প্রায় দশ মিনিটের মাথায় একটা আপু এলো। কোলে তার চার কি পাঁচ বছরের একটা মেয়ে। অন্তিকে দেখতেই হেসে বললো,

‘তুমিই রূপন্তি বুঝি?’

অন্তি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল। আপুটা অন্তিকে বললো,

‘একটু কষ্ট করে ক্লাসরুমে চলো। এভাবে মাঠে বসে তো শাড়ি ঠিক করা যাবে না। হাঁটতে পারবে?’

অন্তি ছোট করে জবাব দিলো,

‘পারবো।’

‘গুড। আসো তাহলে।’

শাড়া ঠিক করতে করতে আপুটার সাথে অনেক কথা হলো অন্তির। তাদের কথার মেইন টপিক ছিল দিহান। আপুর ভাষ্যমতে দিহান এক কালে তার ও ক্রাশবয় ছিলো। দিহানকে পরপর চারবার প্রেম প্রস্তাব দেওয়ার পর দিহান তার গাল বরাবর ঠাঁটিয়ে এক থাপ্পর মেরেছিল। যদিও এর যথেষ্ট কারণ ছিলো। অতিরিক্ত আবেগের বশে সে হাত পা কেটে বসেছিলো। অনুভূতি স্লোগান ছিল, প্রাণ যায় যাক আমার তুমি হলেই চলবে। কিন্তু তার অনুভুতির দু আনা দাম দিহান দেয়নি। যাই হোক সেই থাপ্পর খেয়েই মূলত তার মাথা থেকে দিহানের ভূত নেমেছিল। তবে তার এই বারাবারি রকম পাগলামির দরুন তার পড়াশোনাটা সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারে জানাজানি হওয়ার ফলে তার বাবা তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেন। এখন সে এক বাচ্চার মা।

এমন হৃদয় ভাঙার গল্প শুনে অন্তির দয়ার মনটা কেঁদে ওঠে। বুক ভার হয়ে আসে প্রেমে ব্যর্থ হৃদয়টার প্রতি। আক্রোশ নিয়ে বলে,

‘পাষাণ মানব একটা!’

অন্তির কথায় হাসে মেয়েটা। কোমরে কুচি গুজে দিতে দিতে বলে,

‘এক দিক থেকে কিন্তু এতে তোমার লাভ হয়েছে।’

অন্তি চোখ পিটপিট করে জানতে চায়,

‘কিভাবে?’

‘দিহান পাষাণ না হলে সে এতোদিনে অন্যকারো হয়ে যেত। ও পাষাণ বলেই ওকে তুমি পাচ্ছ। লাভ হলো না তোমার?’

অন্তির মস্তিষ্ক চট করে ব্যাপারটা ধরতে পারতেই উচ্ছাসিত গলায় বললো,

‘একদম তাই!’

আপুটা শব্দ করে হেসে ফেলে। অন্তি লজ্জ পায়। সে সত্যিই লোকটার প্রেমে পড়ে নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে।

অন্তি শাড়ি ঠিক করে বের হতেই দেখলো দিহান ক্লাসরুমের সামনে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে। পেছন থেকে সেই আপু এসে জোরে বলে ওঠে,

‘প্রেম বিদ্বেষী দিহান দেখছি এখন প্রেমে মাখো মাখো হয়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দেওয়া হচ্ছিলো বুঝি?’

দিহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অন্তিকে এক পলক দেখে নিয়ে আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘অযথা কথা খরচ না করে তোর কাজে যা। এখানে তোর আর কোনো কাজ নেই।’

‘যাচ্ছি যাচ্ছি।’

আপুটা চলে যায়। অন্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছে। এই যে দিহান তার দিকে তাকিয়ে আছে, এতে সে মাথা সোজা করতে পারছে না। যেন চোখে চোখ মিললেই তার মৃ ত্যু ঘটবে। দিহান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রেখে শান্ত গলায় বলে,

‘এখন সব ঠিক আছে?’

অন্তি মাথা উপর নিক করে। দু দন্ড সময় পর দিহান পুনরায় বলে,

‘সোজা খাবারের ওখানে চলে যাও। আমি আশপাশেই থাকবো।’

দিহান ব্যস্ত পায়ে চলে যায়। দিহানের বলা কথাগুলো অন্তির ছোট মনে ঝড় তোলে। এলোমেলো করে দেয় অনুভূতিদের। কি ছিলো কথাগুলোতে? এত মাদকতা কেন? তার হৃদয় উষ্ণতায় ভরে ওঠে। এই যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মানুষটার ছোট ছোট যত্ন পাচ্ছে সে, তার লোভ বেড়ে যাচ্ছে। কড়া শাসনে আটকে রাখা হৃদয়টা অস্হির হয়ে ছটফট করছে। ভালোবাসা চাই তাদের। মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা প্রেমটা যেন নতুন রূপে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। মানুষটার এতটুকু যত্ন পেতে সে মরতেও রাজি।

_____________

‘সোজা হয়ে দাঁড়াও! এভাবে কাচুমাচু করছো কেন? তুমি কি আসামি?’

নুহাশের ধমকে তন্নির চোখে জল আসে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু চেয়েও কিছুতেই সে মাথা সোজা করে সরাসরি তাকাতে পারছে না। এদিকে নুহাশ ক্যামেরা হাতে অনর্গল নির্দেশনা দিয়ে চলছে। এভাবে না এভাবে দাঁড়াও, মাথা উঁচু করে তাকাও, অল্প হাসো, আকাশেল দিকে তাকাও ব্লা ব্লা ব্লা। ছবি তোলার প্রতি বিশেষ আগ্রহ আছে তন্নির ও। কিন্তু ক্যামেরা ম্যানটা নুহাশ না হলেই চলতো। এমন দানবীয় মানুষের সামনে সে কিভাবে পোজ নিবে?
তন্নির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে নুহাশ তপ্ত শ্বাস ফেলে। ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসে। কপালে পড়ে থাকা চুলগুচ্ছো যত্ন নিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তন্নি তখনো চোখ নামিয়ে রাখে। নুহাশ ধমক দিতে যেয়েও হেসে ফেলে। চঞ্চল কন্ঠে শুধায়,

‘তুমি বড্ড বোকা সুন্দরী! এত বোকা হলে চলে?’

এবার তন্নি তাকায়। সরাসরি নুহাশের চোখে চোখ রাখে। সে অন্তির মতো চটপটে নয়,শান্ত স্বভাবের, এটা সবাই বলে কিন্তু বোকা? এটা কখনো কেউ বলেনি। বোকা শব্দটা তন্নির কাছে নিতান্তই অপমান সূচক শব্দ বলে মনে হলো। তার আত্মমর্যদা সম্পন্নো মস্তিষ্ক তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। তন্নি প্রথম বারের মতো নুহাশের কথার বিরোধীতা করে প্রতিবাদী কণ্ঠে জানালো,

‘আমি বোকা না। আপনি ভুল বুঝছেন!’

নুহাশের হাসি সেকেন্ডের জন্য থামে। কপাল বরাবর সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। পরক্ষণে হাসি চওড়া হয়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কৌতুক করে বলে,

‘বোকা বলায় সুন্দরী বিড়াল বাঘ বনে গেলো যে! ইন্টারেস্টিং!’

তন্নি মাথা নিচু রেখেই দু পা পেছনে সরে দাঁড়ায়। চোখ তুলে সম্মুখে তাকানোর দ্বিতীয় চেষ্টা করে না। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলে,

‘যাচ্ছি।’

আর দাঁড়ায় না মেয়েটা। নুহাশ মুচকি হাসে। ভীতু বাঘিনীকে তার ভালো লেগেছে খুব। এই নতুন রূপটা আনএক্সপেক্টেড ছিলো। নারীর আর কতো রূপ আছে?

চলবে………..

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১১+১২

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১১.
কলেজ শেষে আজ দু বান্ধবী ফুচকা খাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে। এখানের ফুচকাটা দারুন। বিশেষ করে তিন ধরনের আলাদা স্বাদের টকের জন্যই এই মামার ফুচকার এত কদর। প্রতি প্লেট পঞ্চাশ টাকা। আজ বিলটা অন্তির পক্ষ থেকে। লম্বা সিরিয়াল পরেছে। কম করে হলেও বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অন্তি ভীর ঠেলে দু প্লেট ফুচকার অর্ডার দিলো। অদ্ভূত ভাবে দোকানদার তাকে দেখতেই এক গাল হেসে বললো,

‘একটু দাঁড়ান আপা, এহনি দিতাছি।’

অন্তি একটু অবাক হলো। সচরাচর অর্ডার দিলে লোকটা ভিষণ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,

‘দেরী হইবে আপা। লাইনে দাঁড়ান।’

সেখানে আজ এত মধু মিশিয়ে কথা বলছে? নিশ্চই ব্যাটা ভালো মুডে আছে। অন্তি আর পাত্তা দিলো না। ব্যস্ত হলো খোশগল্পে। কিন্তু তাদেরকে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে এক মিনিটের মাথায় দু প্লেট ফুচকা হাতে হাজির হলো লোকটা। অন্তির সাথে সাথে তন্নির চোখেও রাজ্যের বিষ্ময়। বিস্ময় কে আরো একধাপ এগিয়ে দিতেই লোকটা বিনয়ী স্বরে বললো,

‘আপা চেয়ার দেই? রোদ্দুরে খারাই আছেন, ছায়ায় আইসা বহেন?’

তন্নির মুখ এক ইঞ্চি পরিমান ফাঁকা হয়ে আ হয়ে আছে। অন্তি ফিসফিস করে বললো,

‘দোস্ত কোনোভাবে কি আমরা সেলিব্রিটি হয়ে গেছি?’

‘নো ওয়ে! আমরা তো টিকটক করি না!’

দুজনের মাঝের কৌতুহল এখানেই চাপা পড়লো। কিন্তু তাদের দমে যাওয়া কৌতুহল পুনরায় আবির্ভাব হলো বিল পে করার সময়। একশত টাকার নোট এগিয়ে দিতেই লোকটা চমকে বলে ওঠেন,

‘আপা টাকা লাগবে না। আপনেরা যান। আবার আসবেন। যখন মন চাইবে চইলা আসবেন।’

এ পর্যায়ে অন্তি আর তার মুখ বন্ধ রাখতে পারলো না।

‘বিল কেন লাগবে না মামা?’

লোকটার মুখের হাসিভাবটা ভোতা হয়ে এলো। কিছুটা আমতা করে বললো,

‘আপনাগো আমি মনে মনে সৎ বোন ভাবি তাই লাগবে না আপা। আপনারা এখন যান আপা। বাইরে রোদ্দুর খুব।’

লোকটা তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অন্তির ব্যাপারটা মোটেও সুবিধার লাগলো না। চেনেনা জানেনা কেউ তাকে মনে মনে বোন ভাবলেই কে হলো নাকি? অন্তি টাকাটা লোকটার পাশে রেখে বললো,

‘পরেরবার বিশ্বাসযোগ্য কোনো অযুহাত দিবেন। তখন ভেবে দেখবো।’

অন্তি আর তন্নি চলে গেল। তারা যেতেই লোকটা কাউকে কল করলো। খুব অস্বস্তি নিয়ে মিনমিন করে বললো,

‘ভাই ভাবী আসছিলো। আমি টাকা নিতে চাই নাই। জোর কইরা দিয়া গেল। যাওয়ার সময় বলছে, পরেরবার বিশ্বাসযোগ্য অযুহাত দিতে।’

দিহান সবটা শুনে ছোট করে বললো,

‘আচ্ছা।’

কল কেটে বিরবির করে বললো,

‘গোবরে তবে পদ্ম ফুটেছে! মাথায় বুদ্ধি তবে অল্প স্বল্প আছে! নট ব্যাড।’

দিহানের ঠোঁটে হাসি খেলে গেলো। তা দেখে নুহাশ কাতর স্বরে বললো,

‘দোস্ত যা খুশি কর কিন্তু ব্যাপারটা প্লিজ আমার জন্য জটিল করিস না। তোর প্রেমের উপর আমারটা ডিপেন্ড করছে। দোহাই লাগে তোর!’

____________

অন্তিদের বাড়িতে আজ তার মায়ের দুঃসম্পর্কের এক বোন এসেছে। সাথে এসেছে তার মেয়ে। নাহার তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভালো মন্দ রান্না হয়েছে। অন্তি সেই দুপুর থেকে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সেই দূর আত্মীয়ের মেয়েটা তার রুমে আস্তানা গেঁথে বসে আছে। এতেই চরম বিরক্ত সে। শুধু বসে থাকলেও হতো কিন্তু এই মেয়ে রিতিমত তার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘আচ্ছা আপু তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

মেয়েটার কথায় দারুন বিরক্ত হয়ে অন্তি বললো,

‘থাকলেও বা কি?’

‘তেমন কিছু না। আমার বয়ফ্রেন্ড ছাত্রলিগের সাথে জড়িত। তোমার কোনো সাহায্য লাগলে আমি ওকে বললেই হয়ে যাবে তাই আর কি।’

অন্তির মুখ আ হয়ে গেছে। অবাক হয়ে বললো,

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো যেন?’

এ কথায় মেয়েটা কিছুটা বিরক্ত হলো। বললো,

‘এই নিয়ে তিনবার বলছি, ক্লাস স্যাভেন।’

অন্তি ভেবে পায়না এটুকু একটা মেয়ের ও বয়ফ্রেন্ড আছে! পরক্ষণে মনে হয় এতদিনে তার প্রেমটাও হয়ে যেত যদি দিহান মানুষ হিসেবে আর পাঁচটা স্বাভাবিক পুরুষের মতো হতো। কিন্তু লোকটাতো একটা পাষাণ। হৃদয়হীন মানুষ।

‘বলোনা তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘না।’

‘আমি খুঁজে দিব একটা?’

এ পর্যায়ে অন্তি মেয়েটাকে ধমক দিলো। মেয়েটা তৎক্ষণাৎ সুর সুর রুম থেকে বের হয়ে গেল। সে যাওয়া মাত্র অন্তি বড় করে শ্বাস ফেলল। এমন বিচ্যু মেয়ে কিভাবে সামলায় আন্টি আল্লাহ জানেন।

বাহিরে মুষোল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাঁচের জানালায় ফোটা ফোটা বৃষ্টিকণা জমে আছে। বেশ কিছুদিন ধরেই রাতের দিকে এমন বর্ষণ হয়। অন্তির চোখে ঘুম নেই। রুম অন্ধকার করে বসে আছে। মনের মধ্যে অদ্ভুত অশান্তি হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে। দিহানকে ছাড়া তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আজকাল। মানুষটা কেমন মনের সাথে রক্তেও মিশে গেছে। বিছানা হাতড়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দিহানের নম্বর ডায়াল করলো। এটা তার নতুন নম্বর। দিহান রিসিভ করলো একটু সময় নিয়ে। রিসিভ করেই তার চিরচেনা গম্ভীর স্বরে শুধালো,

‘কি চাই?’

অন্তি কিছু বললো না। চুপ করে ওপাশের মানুষটাকে অনুভব করতে চাইলো। দিহান তখন ল্যাপটপে কিছু একটা করতে ব্যস্ত। কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে থাই দেওয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এক হাতে সিগারেট ঠোঁটের মাঝে চেপে তাতে আগুন লাগালো। তখনো ওপাশের মানুষটা নিরব। দিহান তপ্ত শ্বাস ফেলল। ধীর গলায় শুধালো,

‘কতদিন এভাবে লুকোচুরি করবে? কাল মিট করো।’

ঐভাবে ধরা পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি অন্তি। সোজা হয়ে বসে শক্ত করে ফোন কানে চেপে রাখলো। মিনমিন করে বললো,

‘কিভাবে বুঝলেন?’

দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে।

‘দিহান মির্জাকে কল করে চুপ করে থাকার মতো সাহস একটা পিচ্চি মেয়ে ছাড়া কেউই করে না।’

অন্তি নাক ফুলায়। গলার স্বর চড়াও করে বলে,

‘আমি পিচ্চি না। যথেষ্ট বড়।’

কথাটা বলে খানিক থেমে আবার বলে,

‘আপনিকি একজন্যই আমায় ইগনোর করছেন?’

কথাটা বলার সময় তার গলা কাঁপে অল্প। দিহান ছোট করে উত্তর দেয়,

‘না।’

‘তাহলে? প্রেমিকা আছে আপনার?’

চঞ্চল স্বর বলে উঠে অন্তি। দিহান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

‘প্রেমিকা নেই তবে বউ আছে। তুমি জানতে না?’

অন্তি জবাব দিলো না। খট করে কেটে দিলো কল। দিহান থতমত খেয়ে গেল। আবার কি হলো? খানিক সময় মোবাইলে দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এসব পিচ্চি পাচ্চা মেয়ের সাথে কি আদেও প্রেম করা যায়? জাস্ট ইমপসিবল! এই প্রেম তাকে দিয়ে হবে না।

অন্তি কল কেটে রাগে ফুঁসছে। লোকটা আবারো তাকে মিথ্যা বলছে। পাষাণ লোক! আর কখনো সে কল করবে না অসভ্য লোকটাকে। অন্তির মাঝে মধ্যে মনে হয় এই মানুষটা পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর একজন মানুষ। রস-কষ হীন তেতো একটা মানব। যার প্রতিটা কথায় মুক্তর বদলে নিমের ফল ঝরে। কখনো তো তার ইচ্ছা হয় লোকটার কান টেনে ধরে বলতে,

‘আজ থেকে ফ্রিতে টিউশন দিবো আপনায়। তিন বেলা নিয়ম করে সুন্দর করে কথা বলতে শিখবেন। নয়তো নর্দমার মাঝে কান ধরিয়ে দাড় করিয়ে রাখবো।’

মানে একটা মানুষ কতটা অসহ্য হলে এমন কাঠ কাঠ কথা বলতে পারে! অন্তি হাতের ফোন বেডে ছুঁড়ে মারলো। বিরবির করে বললো,

‘তোর আর তোর বউয়ের একটা একটা করে চুল ছিঁড়বো আমি। যাস্ট ওয়েট। অসভ্য লোক!’
___________

দিনটা শুক্রবার। আকাশে আজ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। বৃষ্টি শেষে এমন ঝলমলে দিন যেন সকল ক্লান্তি দূর করতে যথেষ্ট। কি সুন্দর রূপ প্রকৃতির! চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। নাহিদ নামের ছেলেটা দারুন গান গায়। ভার্সিটিতে থাকা কালিন এভাবে গোল হয়ে বসে কতো গান গেয়েছে! আজ সে দিনগুলোর কথা ভিষণ মনে পড়ে। জীবন কিভাবে কোন দিকে মোড় নিলো খুঁজে পায়না নুহাশ। দিহান ছিলো ডিপার্টমেন্টের টপ স্টুডেন্ট। ওর ব্রাইট ফিউচার নিয়ে সকলেই আশাবাদী ছিলো। কিন্তু শেষে এসে কি হলো? টেনেটুনে পাশ করা নুহাশ আর সে একই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন। যেখানে তাদের মহৎ কোনো কাজের জন্য পোষ্টারে, খবরের কাগজে তাদের নাম ওঠার কথা,‌সেখানে তাদের নাম হয়েছে গুন্ডা! এমনটা না হলেও তো পারত!
নুহাশের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসে। পাশ থেকে সুমন হাত দিয়ে তাকে ঠেলা দেয়। মজা করে বলে,

‘কি মামা! মোন কই গেছে? আমাদের বলো, খুঁইজা আইনা দেই।’’

নুহাশ শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘তিন রাস্তার মোড় থেকে বা হাতে নাক বরাবর চলে গেলে নীল রঙের তিনতলা একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ির মালিকের ছোট মেয়ের কাছেই আছে। যা নিয়া আয়।’

সুমন দাঁত বের করে হাসে। চোখ টিপে বলে,

‘শুধু মোন আনলেই হবে? নাকি মাইয়াও লাগবে!’

নুহাশের মেজাজ খারপ হয়। দাঁত খিচে দিহানের দিকে তাকায়। দিহান অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোয়াচ্ছে। নুহাশ পুনরায় সুমনের দিকে তাকিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সাবধানি কন্ঠে বলে,

‘এসব বাজে ইঙ্গিত দ্বিতীয়বার আমায় দিবি না। ভুলেও না।’

চলবে…………

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.
পাঁচতলা ভবনের গেটের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক মাঝ বয়সী লোক। পড়নে সাদা রঙের ফতুয়া সাথে ঢোলা প্যান্ট। হাতে চামড়ার ব্যাগ। মাথার অর্ধেকাংশেই চুলের অস্তিত্ব নেই। অনেকক্ষণ ধরেই গেটের সামনে চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করে চলছেন ভদ্রলোক। গেটের ভেতরে যাবেন কি যাবেন না তা নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন তিনি। গেটের দাড়োয়ান হাসি হাসি মুখ করে বললেন,

‘আর কতক্ষণ দাঁড়াই থাকবেন মজনু ভাই? স্যারে সেই কখন আপনারে ডাকছেন। বেশি দেরি করলে আবার চাকরি নট! জানেন-ই তো!’

মজনু বিরক্ত চোখে তাকায়। ধমক দিয়ে বলে,

‘কথা কম বলতে পারেন না? চাকরি নট হলে হোক। আপনার স্যারের হাতে মান সম্মান খুয়ানোর থেকে চাকরি নট হওয়া ভালো।’

দারোয়ান লোকটার চোয়াল ঝুলে পড়লো যেন। গলার স্বরে বিস্ময় ঢেলে বললো,

‘কি বলেন ভাই! আপনের চাকরি‌ নট হওয়ার ভয় নাই? আপনের তো ভাই মেলা বড়ো কলিজা!’

মজনু মিয়া কথা বললো না। তবে তার কলিজা বড়ো বটে! নয়তো এই অসভ্য বাপ ছেলের চক্করে নিজের জীবন জরায় কখনো? চিন্তায় চিন্তায় তার বিপি লো হয়ে পড়েছে। এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।

মজনু মিয়া পায়চারি বন্ধ করে শান্ত ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন পরপর উল্টো পায়ে চলতে শুরু করলেন। রেজওয়ান মির্জার কোনো কল সে আর রিসিভ করবে না, আর না করবে দিহান মির্জার কল। এই বাপ ছেলে দুটোই অতিব মাত্রায় অসভ্য। এই অসভ্য পরিবারের অসুস্থ চাকরি সে আর করবে না।

মজনু মিয়ার ফোন বাজছে। ফতুয়ার পকেটে রাখা ফোনটা কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। মজনু জানেন কে কল করেছে। রিসিভ করলেই কথার দু চারটা মার পরবে তার উপর সেটাও তার জানা। মজনু মিয়া দাঁড়ালেন, পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনটার লাল বাটন চেপে ধরে অফ করে দিলেন সংযোগ। এতেও তার হৃদতুষ্ঠি হলো না। সিমটা খুলে পাশের নর্দমায় ফেলে দিলেন। অতিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁত চেপে বিরবির করলেন,

‘মির্জা গুষ্ঠির ষষ্ঠী…!’

____________

কলেজে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর পিকনিকে কলেজ থেকে বাহিরে নিয়ে গেলেও এবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ক্যাম্পাসেই পিকনিক আয়োজন করা হবে। মেয়েরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাড়ি পড়বে সকলে। শাড়ি পড়ার এ ব্যাপারটায় সবথেকে বেশি আগ্রহী অন্তি। ইচ্ছা থাকলেও তার কখনো শাড়ি পড়া হয়ে ওঠেনি। এই শাড়ি পড়া নিয়ে তার মায়ের ঢের আপত্তি রয়েছে। তার মায়ের অকারণে আপত্তি থাকা ব্যাপারগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। শাড়ি পড়ার কথা শুনলেই চোখ নাক কুঁচকে বলবেন,

‘ওসব পড়তে হবে না। ভালো একটা জামা পড়েনে।’

স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে সবাই শাড়ি পড়েছিল। সে নিজেও খুব শখ করে মায়ের কাছে শাড়ি পড়ার আবদার নিয়ে হাজির হতেই নাহার কাটকাট গলায় বললেন,

‘ছোট মেয়ে মানুষের শাড়ি পড়ে কি কাজ? ভালো কোনো জামা পড়ে যাও। বড়ো হওয়ার দরকার নেই এত।’

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় উজ্জ্বল মুখটা। গলা খাদে নামিয়ে মায়ের কথায় বিস্ময় নিয়ে অন্তি বলেছিল,

‘শাড়ি পড়লেই মেয়েরা বড়ো হয়ে যায় বুঝি?’

নাহার তাখন মেয়ের কথার জবাব না দিয়ে কেবল বলেছিলেন,

‘আজ শপিং এ যাবো। সুন্দর দেখে একটা কুর্তি কিনে নিও।’

অন্তির আর সেবার শাড়ি পড়া হলো না। অনুষ্ঠানে সবাই লাল রঙের শাড়ি পড়লেও সে পড়েছিল গাঢ় নীল রঙের লং কুর্তি। কি বেমানান ই না লাগছিলো! মনে হচ্ছিলো ঝাঁক ঝাঁক পাখির মধ্যে সে একমার কাক! কি অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। পুরোটা সময় অন্তির হাঁসফাঁস করেই কাটলো। কিছুটা লজ্জাও পেয়েছিলো সে। এত বড় বড় কথা বলে শেষে কিনা সে নিজেই ড্রেসকোড ফলো করেনি!

অনুষ্ঠানের মাঝ পথেই সে বাসায় চলে এসেছিলো। টানা দুদিন সে মায়ের সাথে কথা বলেনি।

সেসব পুরোনো দিনের কথা ভেবেই অন্তি শাড়ি পড়ার কথাটা সাবধানে লুকিয়ে গেলো। এবার সে কোনোভাবেই এটা মিস করতে চায় না। নাহার জানতে পারলে কখোনোই তাকে শাড়ি পড়তে দিবে না।

তন্নিকে সাথে নিয়ে কোচিং শেষে শপিংয়ে চলেছে অন্তি। যাওয়ার পথে দিহানের সাথে দেখা হয়েছে। লোকটার গম্ভীর চোখজোড়ার বন্ধী হয়েছে সাথেই। অন্তি খুব সাবলীল ভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। যেন দিহান নামক মানুষটার কোনো অস্তিত্ব নেই এ জগতে। অন্তির এহেন কান্ডে দিহানের সাথে সাথে বাদবাকি সকলেই অবাক। তারা যা দেখলো তা কি সত্যি!

দিহানের দুই ভ্রুর মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। এই মেয়ের মতিগতি সে বুঝতে পারে না। এই কেঁদে কেটে বন্যা বইয়ে দেয় তো এই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। মেয়ে মানুষ এতো ঘোলাটে কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিহান। তার এত শক্ত ব্যক্তিত্বকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে মেয়ে রাখে সে মেয়ে নিশ্চই সাধারণ কেউ নয়। বিশেষ কেউ একজন! আর এই বিশেষতাই দিহানকে খুব করে টানে। মস্তিষ্ক চায় একবার মনকে প্রশ্রয় দিতে। কিন্তু প্রশ্রয় দিলেই যে তার ধ্বংস নিশ্চিত!

দিহানের ভাবনার সুতো ছেড়ে নুহাশের কথায়।

‘মেয়েগুলো উল্টোপথে কোথায় যাচ্ছে? হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখা দরকার। এত টো টো করে ঘোরার কি আছে বুঝিনা!’

দিহানের ভাবনার কাঠি আরো একবার নড়ে উঠলো। এতো হেলেদুলে কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? চোখের চাহনি দৃঢ় হলো। জিপের উপর থেকে সটান নেমে দাঁড়িয়ে নুহাশকে বললো,

‘বাইকের চাবি দে।’

নুহাশ তৎক্ষণাৎ মানা করে দিলো।

‘মামা বাড়ির আবদার নাকি? তোর গাড়ি নিয়ে যেখানে খুশি যা। বাইক দিতাম না।’

দিহান অবশ্য নুহাশের কথায় কান দিলো না। ছো মেরে চাবি নিয়ে নিলো। বাইক স্টার্ট দিতেই নুহাশ লাফ দিয়ে পেছনে উঠে বসলো। দিহান ধমকে বললো,

‘নেমে দাঁড়া! তোর সাথে রাইড করার ইচ্ছা‌ নেই আমার।’

‘আমারো নেই। বাধ্য হয়ে উঠেছি।’

দিহান আর কথা বাড়ালো না। এখন ফালতু আলাপ করার মুড নেই তার। কিন্তু তাদের এ যাত্রা বৃথা হলো। অন্তি এবং তন্নির টিকিটাও তারা কোথাও খুঁজে পেল না। মুহূর্তের মাঝে কোথায় গায়েব হলো মেয়ে দুটো? দিহানের মেজাজ খারাপ হয়। সাদা মুখটা রাগে লাল হয়ে আসে। নুহাশ মুখ দিয়ে চ শব্দ করে নেমে যায়। আজ সে তন্নিকে হারে হারে বোঝাবে টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর শাস্তি ঠিক কেমন হতে পারে!

অন্তি ঘুরে ঘুরে কাবার্ড খুলে সদ্য কিনে আনা কলাপাতা রঙের শাড়িটা দেখছে। তার কাবার্ড ভরা জামাকাপড়ের মাঝে শাড়িটা জাগা পেয়েছে সবার উপরে। এটাই তার একমাত্র শাড়ি। সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ পেটিকোট ও কিনে এনেছে সে। কিন্তু তার এই রঙের চুড়ি নেই। বাজারে কোথাও খুঁজে পায়নি ম্যাচিং চুড়ি। এজন্য অল্প স্বল্প মন খারাপ। কিন্তু ওটা আপাতত কোনো ব্যাপার না। অন্তি উৎফুল্ল মনে হেলেদুলে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমে তার মায়ের সাথে খোশ গল্পে মগ্ন মিলাকে দেখে মুখ বাঁকায়। মিলাকে রাগাতে নাহারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘বড় কাকি কি তোমার আদরের মেয়েকে ঘর ছাড়া করেছে মা? আজকাল এ বাসায় যে ঘাটি গেড়ে বসেছে!’

আশ্চর্য জনক ভাবে মিলা এ কথার কোনো জবাব দেয় না। উল্টো নাহার রেগে কিছু বলতে গেলে বলে,

‘ওর কথায় কান দিওনা তো মেজ মা। তারপর বলো, কোথায় যেন ছিলাম আমরা? ও হ্যাঁ শোনো…’

অন্তি চোখ কপালে তুলে তাকায়। এই ন্যাকা এতো ভালো হলো কবে থেকে? নাকি এটাও নতুন ন্যাকামির ট্রেইলার!

_____________

গভীর রাত। ব্যস্ত রাস্তা এখন পুরোপুরি নিরব হয়ে উঠেছে। দূর থেকে কুকুরের ডাকের শব্দ ভেসে আসছে। এই গভীর রাতেও রাস্তার দিকে মুখ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে লাগাতর কান ধরে উঠবস করছে তন্নি। চোখ ছলছল করছে মেয়েটার। যখন তখন টুপ করে জল গড়িয়ে পড়বে। কান্না চেপে রেখে ছোট ছোট করে উচ্চারণ করছে,

‘সাতান্ন, আটান্ন, ঊনষাট…….’

বারান্দা বরাবর রাস্তায় বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুহাশ। রাস্তার ধারের হলদে রঙের আলোতে তার মুখ জ্বলজ্বল করছে। চঞ্চল লোখজোড়া নিবদ্ধ সম্মুখে দোতলায় শাস্তিপ্রাপ্ত মেয়েটার দিকে। মেয়েটা সেই কখন থেকে মাথা নিচু করে আছে। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এই ভুলের জন্য কি শাস্তিটা আর একটু বাড়ানো উচিত? ননুহাশের আবার দয়ার হৃদয়। প্রেয়সীর এতো কষ্ট সে ঠিক সহ্য করতে পারবে না। নুহাশ ফোন হাতে কল করলো। রিং বাজলো দোতালার বারান্দায়।‌ সময় কল রিসিভ করলো মেয়েটা।

‘কাছে এগিয়ে আসো। সোজা হয়ে দাঁড়াবে। একদম সোজা আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিন্দু নড়চড় চাই না!’

‘আচ্ছা।’

মেয়েটা সত্যি এগিয়ে আসে। রোবটের মতো করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এই অল্প আলোতেও সে লক্ষ্য করে মেয়েটার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কেঁদেছে খুব‌। নাকের ডগা ও ডালিমের মতো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। নুহাশ আবিষ্কার করলো মেয়েটাকে কাঁদলে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। মেয়েটার এই ডালিম রাঙা রূপটাই তার বেশি পছন্দ হয়েছে। নুহাশ খুব আফসোস করে বলে,

‘দুঃখিত সুন্দরী। তোমাকে যে এখন থেকে একটু বেশিই কাঁদতে হবে!’

তন্নি বুঝতে পারে না তার কথার অর্থ। চোখ ঝাপটায় কেবল। প্রশ্ন করার সাহস হয়ে ওঠে না। নুহাশ হাত ঘড়ির দিকে চোখ বূলায় একবার। রাত দুইটা বেজে পাঁচ মিনিট। ফের দৃষ্টি ফেলে তন্নির দিকে। মেয়েটার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।

‘ঘুম পায়?’

তন্নি তৎক্ষণাৎ দু পাশে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। নুহাশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। মেয়েটা তাকে বাঘের থেকেও বেশি ভয় পায়। এটা নুহাশের ভালো লাগে। মেয়েটার ভয় পেয়ে আড় চোখে তাকানোটা দারুন।

‘রুমে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।’

নুহাশের কথাটা বলতে দেরী হলেও তন্নির বারান্দা থেকে গায়েব হতে দেরী হলো না। রুমে ঢুকেই চট করে দরজা আটকে দিলো। যেন সে এতক্ষন ধরে এই অপেক্ষাতেই ছিল। নুহাশ হেসে ফেলে। বুকের মাঝে শান্তি অনুভব হয়। এই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য সে বরবাদ হতেও দুবার ভাববে না।

বারান্দার বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নুহাশ। বলে,

‘এখন না হয় একটু ভিলেন হলাম! ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিব পড়ে। তখন তোমার যা শাস্তি মন চায় দিও! আমি নুহাশ হাসতে হাসতে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকবো।’

চলবে……….

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-১০

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১০.
রূপালি সুতায় সাজানো আকাশটা আজ কেমন বিষন্ন হয়ে আছে। কোথাও তার জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল দ্যুতি নেই। চাঁদ মামা অবসর নিয়েছে আজ, সাথে তার পাশে জ্বলতে থাকা তারারাও। আকাশ পানে চাইলে শূন্য, অন্ধকার ব্যাতিত কিছুই নজরে আসে না।
অন্তি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে ছোট চুমুক বসিয়ে অদূর আকাশ পানে চায়। উদাস চিত্তে একাধারে চেয়ে রয়। নিজেকে পাগল মনে হয়। চোখ ছলছল হয়। কর্ণিশ বেয়ে নিরবে ঝড়ে যায় নোনতা পানির স্রোত। তার চাওয়ার মাঝে কি কমতি ছিলো? এমনটা কেন হলো? দিহান মানুষটাকে সে ভালোবাসে। সত্যিই ভালোবাসে। কেন মানুষটা বুঝলো না?

সন্ধ্যা থেকে তন্নির ফোনে নুহাশের কল আসছে। তন্নি ভুলেও তা রিসিভ করছে না। যা হওয়ার পরে হবে, কিন্তু সে কিছুতেই কল রিসিভ করবে না বলে শপথ করেছে। ফোন সামনে রেখে পা গুছিয়ে বসছ আছে সে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ থাকলেও বুক ভরা সাহস নিয়ে এরূপ কাজ করছে সে। তখনি টুং করে নটিফিকেশন আসলো। ম্যাসেজ এসেছে।

‘দরজা খুলো বেবি!’

ম্যাসেজটা দেখে তন্নির চোখ কপালে। দরজা খুলো মানে? এই লোক কোথায়?
তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। তন্নির মা তার রুমে এখন সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। বড় আপু রুমের দরজা বন্ধ করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম আলাপে ব্যস্ত। এখন বোমা হামলা করলেও সে দরজা খুলবে না। বাদ বাকি রইল কাজের মেয়েটা। সে ও মায়ের রুমে সিরিয়ালের ভিলেনদের গুষ্টির ষষ্ঠী করতে বসে পড়েছেন।
আবারো রিং হলো কলিং বেল। ওপাশ থেকে তন্নির মায়ের গলা এলো,

‘কে এলো দেখ তো।’

ফাঁকা ঢোক গিলে রুম থেকে বের হলো। ইতিমধ্যে আরো দুবার বেল বেজেছে। তন্নির এখন কান্না পাচ্ছে। কলটা রিসিভ করলেই হতো। এখন আর কল দিচ্ছে না খারাপ লোকটা। এক বুক সাহস নিয়ে দরজা খুলতেই দেখা গেল বাহিরে ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে। তন্নি কপাল কুঁচকাতেই এক গাল হেসে বললো,

‘আপনার পার্সেল ছিল ম্যাম।’

তন্নি অবাক হয়ে বললো,

‘না তো!’

‘জ্বি ছিলো ম্যাম।’

‘আরে আজিব তো! আমি কিছু অর্ডারই করলাম না পার্সেল আসবে কোথা থেকে?’

আবারো ম্যাসেজ এলো।

‘পার্সেলটা নিয়ে নাও বেবি।’

তন্নি থামলো। এভাবে বেবি বেবি ডেকে লোকটা কি প্রমাণ করতে চায়? অদ্ভূত!
কথা না বাড়িয়ে তন্নি পার্সেল নিয়ে ধুম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ধুম শব্দে ডেলিভারির ছেলেটা কিছুটা লাফিয়ে উঠলো। এভাবে দরজা বন্ধ করার কি আছে? পরক্ষণে মেয়েটার মানসিক সমস্যা আছে ভেবে সে প্রস্থান নিলো।

তন্নি পার্সেলটা খুললো না। কাবার্ডের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলো। ফোন থেকে সিম খুলে রাখলো। এখন থেকে সে খুব সাবধানে তার পা ফেলবে। ভুলেও ঐ ভয়ংকর লোকের সামনে সে যাবে না।

_____________

রেজওয়ান মির্জা আজ বাড়িতে। রেহান ও ছুটিতে ফিরেছে। তার পোস্টিং রাজশাহীতে। রেহেনা আজ নিজ হাতে সকালের সকল নাস্তা তৈরি করেছেন। কতদিন বাদে পরিবারের সবাই একত্রে খেতে বসবে!

রেহানের নামটা রেহেনার সাথে মিলিয়েই রাখা হয়েছিলো। রেজওয়ান মির্জা যখন রেহেনাকে বিয়ে করে আনলো তখন রেহেনার বয়স মাত্র ১৭। বিয়েরদিন তার দাদিমা তার কানে কানে বলেথিল, ‘বুবু তোমাগো নামের প্রত্তোম অক্কোর মিল্লা গেছে। দেখবা জামাই তোমারে মেলা ভালোবাসবে। চোখ্খে হারাইবে।’
কথাটা অবশ্য ভুল বলেনি। রেজওয়ান মির্জা তাকে ভালোবাসাথ চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। যখন রেহান হলো তখন তাদের নামের ‘র’ শব্দ দিয়েই নাম রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু পৃথক হলো দিহানের বেলায়। এজন্যই বোধহয় ছেলেটা সবার থেকে ভিন্ন ধাঁচের হয়েছে।
.
.
সকালের নাস্তায় আজ অনেক পদ করা হয়েছে। সবার আগে ডায়নিং এ এসে উপস্থিত হলো রেহান। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,

‘দিহান কোথায় মা? আমি এসেছি ও জানে না?’

রেহেনার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। প্লেটে লুচি তুলে দিতে দিতে বললো,

‘খুব রাত করে ফিরেছে কাল। কথা হয়নি আমার সাথে। এখনো জানে না হয়তো।’

‘আমি যেয়ে ডাকবো?’

‘দরকার নেই। নিজে থেকেই আসবেনে। তুই বোস।’

রেহান আশপাশে তাকিয়ে ফের বলে,

‘বাবা কোথায়?’

‘বাসায় আছে। এখনি চলে আসবে।’

তখনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো দিহান। মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। চোখ মুখ ফুলে আছে। ভোর রাত থৈকে সকাল অবদি বৃষ্টি হয়েছে। ওয়াক আউটে যাওয়া হয়নি তাই। পরণের সাদা ফুল হাতার টিশার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে নেমে এলো সে। রেহানের পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,

‘হঠাৎ আসলে যে? কোনো অঘটন ঘটিয়েছি বলে তো মনে করতে পারছি না!’

রেহান মুচকি হাসলো। ভাইয়ের প্লেটে নিজ হাতে লুচি তুলে দিতে দিতে বললো,

‘অনেকদিন অঘটন ঘটাচ্ছনা তো, তাই দেখতে এলাম বেঁচে আছো কি না।’

‘তোমার নীতিবান বাবার কাছে শুনলেই পারতে! তার তো আবার চর রয়েছে আমার খোঁজ খবর রাখার জন্য। ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট জানায়!’

তখন ডায়নিং এ উপস্থিত হলেন রেজওয়ান মির্জা। দিহানের কথায় মুখ কুঁচকে বললেন,

‘এতকিছু তুমি জানো কিভাবে? তুমিও আমার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছ নাকি?’

দিহান খুব আয়েশে লুচির টুকরা গালে তুলে নেয়। রেহানা ছেলের প্লেটে কষা মাংস বেড়ে দেয়। রেহান আর রেজওয়ান দুজন উত্তরের আশায় দিহানের দিকে তাকিয়ে। দিহান এক পলক সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। রেহান সন্দিহান চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। তার পুলিশ মন কেবল এই মানুষটাকেই বুঝতে পারে না।
দিহান খাওয়া থামিয়ে সরাসরি তার বাবার চোখে তাকালো। মুচকি হেসে বললো,

‘দুঃখিত! কিন্তু প্রতি মাসে পকেট থেকে বিশ ত্রিশ হাজার টাকা খসিয়ে গুপ্তচর রাখার মতো অর্থ আর ঘিলু কোনোটাই নেই আমার। আপনার চর মজনু মিয়ার পকেটে পাঁচশ টাকা গুঁজে দিলেই সব তথ্য আপনাআপনি বেরিয়ে আসে।’

এ কথায় রেজওয়ান মির্জার হুস উড়ে গেলেও রেহান ফিক করে হেঁসে ফেলল। রেহানাও মুখ টিপে হাসছে। স্বামীর ভয়ে জোরে হাসতে পারলো না। রেজওয়ান গম্ভীর মুখ করে বললো,

‘তুমি আমার চরকে ঘুষ দিয়ে আমারই তথ্য নাও? এটা কেমন নীতি?’

‘আমি কেবল আপনার অপচয়কৃত টাকাকে কাজে লাগিয়েছি। সন্তান হিসেবে আপনার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না?’

রেজওয়ান মির্জা আর কোনো কথা বললেন না। কতবড় বজ্জাত ছেলে তিনি জন্ম দিয়েছেন ভাবতেই তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। এমন স্বৈরাচারী ছেলে দিয়ে সে কিভাবে কি করবে? তবে আজই মজনুকে পেছনে লাথি মেরে সে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবে। পাঁচশত টাকার জন্য বেঈমানি! আর সে যে মাস শেষে হাজার খানেক টাকা দিচ্ছে!

____________

রাতভর বর্ষনের জন্য পিচডালা রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে পানি জমেছে। আকাশে রোদ নেই। ঝিমিয়ে পড়া বিকেলের ন্যায় শান্ত হয়ে আছে প্রকৃতি। তবে রাস্তায় মানুষের আনাগোনা আগের মতোই রয়েছে। অন্তি বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুটা সামনে অপেক্ষা করছে তন্নির জন্য। ওদের বাড়ির এ পথটায় তিনদিকে তিনটা রাস্তা চলে গেছে। যার সোজা পথ ধরে যেতে হয় কলেজে, বা পাশের রাস্তা দিয়ে তন্নিদের বাসা। অন্তি বর্তমানে এই তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত নজরে আশপাশে তাকাচ্ছে। যদি মানুষটাকে এক নজর দেখতে পায়! এত দিনের ভালোবাসা এভাবে চট করে কি ভুলে যাওয়া যায়? কাউকে ভালোবাসা যতটা সহজ, ভুলে যাওয়া ঠিক ততটাই কঠিন। যা অন্তি হারে হারে টের পাচ্ছে।

‘মেয়ে? দাঁড়িয়ে কেন?’

অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠে চমকে ওঠে কিশোরী বুকটা। মলিন মুখটা আরো মলিন হয়ে আসে। ফুলে ওঠা চোখ গুলোতে পানি জমতে শুরু করে। ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা। পেছনে তাকায় না। এতক্ষণ যে মানুষটাকে দেখার জন্য অস্থির হয়েছিলো মন এখন তার সন্নিকটে গুটিয়ে আসতে চাইছে যেন।

‘কথা বলো না কেন অভদ্র!’

দিহানের ধমকে কেঁপে ওঠে কিশোরী শরীর। অভিমান দৃঢ় হয়। লোকটা কখনোই তার সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। এতটাই কি অপছন্দের সে! অন্তি মুখ ফুটে বলতে চায়, ‘ আমি আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবো না। আপনি আর আমাকে ধমকাবেন না।’

কিন্তু বলা হয়না। কন্ঠনালিতে যেন জং ধরেছে। কথা বের হয়েও হচ্ছে না।

দিহানের রাগ হয়। এতটুকুন মেয়ের এত জেদ কিসের? সে নিজে এসে কথা বলছে আর এই মেয়ে কিনা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে! এই মেয়ের জন্য যে সে দীর্ঘ বিশ মিনিট যাবত অপেক্ষা করছে তা কি ডাফারটা জানে? দিহান ধৈর্য্য হারায়। বড় করে শ্বাস ফেলে। রাগ দমন করে ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

‘লাস্টবার বলছি রূপ; পেছনে ঘুরো? কথা আছে। এটাই লাস্ট কিন্তু।’

অন্তির চোখ থেকে টুপটাপ করে পানি গড়ায়। দোটানায় পড়ে মন। কি বলতে চায় দিহান? জানার জন্য অস্থির হয় চিত্ত। কিন্তু পরক্ষণেই মস্তিষ্ক তাকে জানায়, দিহান কখনোই তার সাথে প্রেমের আলাপ করতে কথা বলে না। হয়তো ধমকায় নয়তো তার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য বলে। আজ ও হয়তো একারণেই এসেছে! রাগ হয় ওর। চোখ মুছে পিছু না ফিরেই কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে,

‘কিছু বলার দরকার নেই ভাইয়া। এতদিন আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আর কখনোই সেটা করবো না। আমাকে আর কিছু বলার দরকার নেই। আপনি আসতে পারেন।’

দিহান শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে খানিক সময়। কথা বলার সময় অন্তির গলা কাঁপছিল। দিহান খুব বুঝেছে মেয়েটা কাঁদছে। চোখ বন্ধ করে ছোট করে শ্বাস ফেলে বললো,

‘বেশ!…’

এরপর সবটা নিরব। সময় গড়ায় মিনিট খানেক। অন্তি হাঁসফাঁস করে ওঠে। মানুষটাকি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? অল্প করে ঘাড় বাঁকায়। নাহ কেউ নেই। দিহান নেই ওখানে। চলে গেছে। তার এতগুলো কথার পিঠে লোকটা ছোট একটা জবাব দিয়েই চলে গেলো! পাষাণ লোক। হু হু করে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। তখনি তন্নি চলে আসে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে অন্তিকে কাঁদতে দেখে অস্হির হয়ে ওঠে। ব্যস্ত হাতে আঁকড়ে ধরে অন্তিকে। নরম গলায় শুধায়,

‘এভাবে কাঁদছিস কেন পাখি? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?….’

দূর থেকে দিহান সবটা দেখে। পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেট ধরায়। শূন্য চোখে চেয়ে থাকে সামনে। পাশ থেকে নুহাশ মেজাজ খারাপ নিয়ে বলে,

‘কি বা*ল শুরু করছিস? ভালোভাবে একটু ভালোবাসা দিয়ে কথা বলে তো বোঝাতে পারতি?’

দিহান জবাব দেয়,

‘আমার মুখে ভালোবাসা নেই। মুখ দিয়ে ভালোবাসতে পারবো না।’

নুহাশের মন চাচ্ছে ঠাটায়ে দুইটা থাপ্পড় মারতে। কিন্তু তেমন হলে তার কানটাই আগে ফাটবে তাই সেই কাজ থেকে বিরত থাকলো। কিন্তু কোনোদিন সুযোগ হলে এই অপরচুনিটি সে কিছুতেই মিস করবে না।

চলবে……..

তাহার উম্মাদনায় মত্ত পর্ব-৮+৯

0

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৮.
কাক ডাকা ভোর। বাহিরে কেবল আলো ফুটতে শুরু করেছে। সূর্যি মামার দেখা পেতে ঢের বাকি। গ্রামের দিকে সকাল নামে খুব আয়োজন করে। চারপাশ কোকিলের ডাকে মুখরিত হয়। লাল ঝুঁটি মোরগেরাও নামে প্রভাতের বার্তা ছড়াতে। গলা ছেড়ে ডাক ছাড়ে। এই একটা ডাকই যথেষ্ট সকাল হওয়ার খবর জানতে। অন্তি এবার গ্রামে এসে এই ব্যাপারটা খুব বেশিই উপভোগ করেছে। আজ ও সে বারান্দায় বসে সকাল হওয়া দেখেছে। কালো আকাশ ফুঁড়ে সাদা ঝলমলে আকাশকে বেড়িয়ে আসতে দেখেছে সে। কি দারুন সে দৃশ্য!
এই মুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই অন্তির মনে হলো তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের প্রকোপ এতটাই বেশি যে তার এই বারান্দাতেই হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তে মন চাইছে।
রাতে দিহানের জন্য অপেক্ষার শেষে তার দু’চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছিল। শত তপস্যা করেও তা ফিরিয়ে আনতে পারেনি অন্তি। বরং পুরোরাত বারান্দায় বসে দারোয়ান রহমত চাচার বদলে সে বাড়ি পাহারা দিয়েছে। এই তো ভোর হওয়ার ঘন্টা আগের কথা। রহমত চাচা চেয়ারে বসে দিব্যি ঘুমোচ্ছিলো। অন্তি দিব্যি তার ভুষ ভুষ করে নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেয়েছে। সেই সুযোগ নিয়েই বাড়ির ভেতরে কেউ প্রবেশ করে। কুঠুরি ঘরের লাল টিমটিমে আলোতে অন্তি স্পষ্ট একটা ছায়া মানব দেখতে পেয়েছিল। অন্তি ফোনের ফ্লাস ফেলতেই তা বড় আম গাছটার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। এরপর ঘন্টাখানেকেও আর কিছু টের পায়নি সে। হয়তো কোনো এক ফাঁকে কেটে পড়েছে।

অন্তি সে ব্যাপারে একদম ভাবছে না। তার ভাবনা জুড়ে বিচরণ করছে দিহান। দিহান মির্জা। লোকটা মোনের সাথে সাথে মস্তিষ্কেও দারুন ভাবে আটকে আছে। দখলদারিতে ইংরেজদের হার মানাবে লোকটা। ইংরেজরাতো সম্পত্তি, ক্ষমতা দখলে নিতো কিন্তু এই ভয়ংকর মানব সরাসরি মোন ও মস্তিষ্কে দখলদারি চালায়।

রাতে দিহানের কল আসায় অন্তি আশ্চর্য বনে যায়। মানে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। দিহান মির্জা তার ইগো রাগকে সাইডে ফেলে কল করেছে! এটা নিশ্চই যেন তেন ব্যাপার না। অন্তির অবাকের পর্ব শেষ হতে না হতেই কল কেটে গেল। অন্তি দু মিনিট বসে রইলো। এই কল আসে এই কল আসে করে পাক্কা এক ঘন্টায় ও কল আসলো না। অন্তি তখন বিছানায় গোল হয়ে বসে চাতক পাখির ন্যায় ফোনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু পাষান মানবটা দ্বিতীয় বার কল দিলো না। অন্তি রাগে দুঃখে কেঁদে ফেলে। এমন হবে জানলে সে কল রিসিভ করতে একদমই দেরি করতো না। পরপর ফোন উঠিয়ে কল দেয় কাঙ্খিত মানবটিকে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ফোন সুইচড অফ। এরপর থেকেই থম মেরে বারান্দায় বসে সে। তার মতে দিহান হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে নিষ্ঠুর একজন পুরুষ। যার হৃৎপিণ্ডে চার প্রকোষ্ঠের বদলে রয়ছে একটি মাত্র প্রকোষ্ঠ। এজন্য তার মনে ভালোবাসা কম। দিহানের হৃৎপিণ্ডের সার্জারি করা দরকার। এই রোগ নিরাময় অতি শিঘ্রই হওয়া দরকার।

______________

সকালে দিহান যখন জানতে পেরেছে তার দলের ছেলেকে মারা হয়েছে; শুনতেই সে তৎক্ষণাৎ পরশকে কল করে। মাথায় তার রক্ত উঠে গেছে যেন। কপালের পাশের রগ ফুলে উঠেছে। ফর্সা কপালে দৃশ্যমান নীল রগ একটু বেশিই ভয়ংকর ঠেকছে যেন।
পরশের সাথে ঝামেলাটা দিহানের ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত ঝামেলা বাহিরে এলে সেটা সে একদম সহ্য করবে না।

‘দিহান মির্জা? শহরের বাঘ হঠাৎ আমায় কল করলো কি মনে করে?’

পরশের সূক্ষ্ম খোঁচা আঁচ করতে পেরেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো দিহানের। দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করে শুধালো,

‘আমার সাথের ঝামেলা পার্সোনালি হ্যান্ডেল করার জন্য বলেছিলাম! আমার ছেলেদের আঘাত করে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছিস?’

‘এটাই যে বাঘ রূপে থাকা দিহান আসলে একটা হুলো বিলাই। আসল বাঘ তো এখানে!’

দিহান চুপ করে শুনলো। তার সাদা মুখ খানা রাগের কারণে লাল হয়ে এসেছে। নাকের পাটাতন ফুলে উঠছে। শক্ত চোয়ালটা আরো কঠিন হয়ে এলো। রাগ দমিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

‘এতোই যখন ক্ষমতা তাহলে পেছন থেকে চাবুক কেন ছুঁড়ছিস? সামনাসামনি আয়। আসল নকলের ফারাকটা না হয় তখন বুঝিয়ে দিব।’

জবাবে পরশ হাসলো। দিহানের সাথে সকল দেনা পাওনা পরিশোধের সময় এসেছে।
.
.
অন্তিরা আজ ঢাকায় ফিরবে। তাদের পার্সোনাল গাড়িতে করেই ফিরবে। বারোটার দিকে নাহার মেয়েকে টেনে তুললেন। অন্তি তখনো ঘুমে ঢুলছে। মেয়ের উপর যথেষ্ট বিরক্ত নাহার। বিছানায় এলোমেলো হয়ে বসে থাকা অন্তিকে একবার দেখে নিয়ে বললেন,

‘ঝটপট ফ্রেশ হয়ে সব গুছিয়ে নে। নয়তো এভাবেই ফেলে রেখে চলে যাব।’

‘কোথায় যাবে?’

‘তোর বাপের বাড়ি।’

মায়ের কথায় অন্তি বড় করে হামি দিলো। চোখ ঢলতে ঢলতে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

‘আমার বাপের বাড়ি তুমি কেন যাবে? তোমার বাপের বাড়িতে তুমি থাকো। আমি আমার বাপের বাড়িতে যাচ্ছি।’

সকাল থেকে নাহারের মন মেজাজ বেজায় খারাপ। এতদিন বাদে বাবার বাড়িতে এসে আবার দুদিনের মাথায় ফিরে যাচ্ছে। আবার কত বছর পর আসা হবে জানা নেই। এতদিন পর বাপের ভিটায় পা রেখে যতটা শান্তি লেগেছিল এখন বিদায়ের সময় ততটাই বিতৃষ্ণা লাগছে। তাছাড়া বাবা মায়ের বয়স হয়েছে কখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যান বলা যায় না। এসব ভাবতেই তার চোখে জল জমে। তার উপর মেয়ের এমন কথায় যেন গায়ে আগুন লেগে গেল। মুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠলেন মেয়ের উপর।

‘খোটা দিচ্ছিস? তোর বাপের বাড়িতে কি আমি তোদের হাত পা ধরে ঝুলে থাকি? নাকি ওখানে না গেলে মরে যাবো আমি? যাবো না তোর বাপের বাড়ি। দেখি কিভাবে থাকিস। যত বড় মুখ না তত বড় কথা!…’

অন্তির ঘুম মায়ের চিৎকারের সাথে সাথেই এ পাড়া থেকে পালিয়েছে। অন্তিও দ্রুত বেড থেকে‌ নেমে ওয়াশরুমে ছুটেছে। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে দারুন ভাবে ফেঁসে গেছে সে। মায়ের স্বভাব তার খুব জানা আছে। দেখা গেলো সত্যিই ঢাকায় ফিরলো না। তখন কি হবে? অন্তির মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো। মন চাইলো নিজের চুলের মুঠি ধরে টানতে আর সবার কাছে বলতে ,’আমি হলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাধা।’

অন্তির ভাবনাকে ভুল করে নাহার গোছগাছ করে নিচে নামলেন। গাড়িতে ওঠার আগে আধ ঘন্টার মতো বিদায়ের কান্নার পর্ব চললো। অন্তি খুব মনোযোগ দিয়ে সবটা দেখলো। তার মামা পর্যন্ত বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তার ও কি দিহানের বাড়িতে যাওয়ার সময় কান্না পাবে? বাবা মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলবে! তৎক্ষণাৎ অন্তির ভেতর সত্তা বলে উঠলো,’আর ইউ কিডিং মি! কান্না? দিহানের কাছে যাওয়ার কথা‌ শুনলেতো তুমি ধেই ধেই করে নাচ শুরু করবে। কান্নার সময় পাবে কই?’
অন্তি সম্মতি দিতে পারলো না। এতটাও নির্দয় সে না হুহ!

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গ্রামের ইটের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি পিচঢালা রাস্তায় উঠেছে। নাহার গাড়িতে ওঠার দশ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা তার অন্যতম স্বভাব। গাড়ি চলতে শুরু করলে সে কিছুতেই ঘুম ধরে রাখতে পারে না। অন্তির এই অভ্যাস নেই। গাড়িতে থাকা কালিন পুরোটা সময় সে জেগে জেগে আশপাশ দেখতে থাকে। ঐ যে ছুটতে থাকা গাছে সারি, দালান এগুলো ভিষণ ভালো লাগে তার।
এত কিছুর মাঝে অন্তি দিহানের কথা একদম ভোলেনি। লোকটা যে গত রাতে ওমন কান্ড করলো তার জন্য অন্তি কিছুটা ক্ষেপে আছে। সেই রাগ থেকেই অন্তি দিহানকে ম্যাসেজ করলো।

‘আপনি কি জানেন আপনি ভিষণ রকম একটা অসহ্য ক্যারেক্টর?’

ম্যাসেজটা সেন্ড করে দুদন্ড সময় নিলো। পরপর আবারো টাইপ করলো,

‘আমি নেহাৎ ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছি নয়তো আপনার মতো পাথুরে মানবকে ইঁদুর ছুঁচো ও পাত্তা দিত না।’

‘অসহ্য লোক!’

অন্তি ভেবে নিয়েছিল এসব ম্যাসেজ দেখার মতো সময় বা সূযোগ কোনোটাই দিহানের হবে না‌। ব্যস্ত মানুষ কিনা!
কিন্তু দিহান দেখলো। রিপ্লাই ও করলো তৎক্ষণাৎ।

‘দ্যাটস্ মিন ইঁদুর ছুঁচোর মাথায় ও তোমার থেকে বেশি ঘিলু আছে!’

লোকটা তার বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে! এটা ভিষণ অপমান জনক কথা হলেও অন্তি রাগ করলো না। দিহান রিপ্লাই করেছে এতেই খুশি সে। লাজুক হেসে রিপ্লাই দিলো,

‘এত্তগুলা ভালোবাসা ভিলেন সাহেবকে। আর কাল রাতের ভুলের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হলো।’

দিহানের চোখ কুঁচকে এলো। কাল রাতে সে কি করেছে যার জন্য ক্ষমা করবে মেয়েটা তাকে? ব্রেইনে কিঞ্চিত চাপ প্রয়োগ করলেও কিছু মনে করতে পারলো না। বেশি ঘাটলো না সে। কি জানি কোন ব্যাপারে নিজে রাগ করে আবার নিজেই ক্ষমা করেছে পাগলটা!

চলবে………

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

৯.
কলেজে যাওয়ার পথেই আজ‌ ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ করে নামা বৃষ্টিতে হঠাৎ করেই কেমন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে আকাশ। যেন কালো চাদরের আবরণে ঢেকে দেওয়া হয়েছে আকাশকে। অন্তি ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। তন্নিটা এখনো আসেনি। ফোন বের করে কল দিতেই রিসিভ করলো।

‘কোথায় তুই?’

তন্নি মন খারাপ করে জানালো,

‘বাড়িতে। আজ আর বের হতে পারব না। মা বলে দিয়েছে এই বৃষ্টিতে কোথাও না যেতে।’

অন্তি ছোট করে শ্বাস ফেলল।‌ তন্নি মায়ের বাধ্য মেয়ে। মায়ের কথার বাহিরে একটা বর্ণ বলতে পারে না। সেখানে বাহিরে বের হওয়া তো দূরের কথা। তন্নির মন খারাপ বুঝে অন্তি হেসে উড়িয়ে দিলো।

‘কোনো ব্যাপার না। আজ যদি ভিলেন সাহেবের সাথে আমার প্রেমটা হয়ে যেত তাহলে ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে চুটিয়ে প্রেম করা যেত! কিন্তু আফসোস!’

অন্তির মুখে দিহানের কথা শুনতেই তন্নির নুহাশের কথা স্মরণ হলো। মুহূর্তেই তার চোখে মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। অন্তিকে বললো,

‘দোস্ত তুই শিউর তুই দিহান ভাইয়াকে হ্যান্ডেল করতে পারবি?’

অন্তি কপাল কুঁচকালো।

‘পারবো না কেন? আলবাত পারবো।’

তন্নি কিছু বললো না। তার চিন্তা এখন আকাশ ছুঁয়েছে। এই যে নুহাশ নামক গুন্ডা মানবটা অকারণেই তাকে আসামির ন্যায় ট্রিট করছে এটার কি সমাধান করবে সে? অন্তি দিহানকে নাহয় ভালোবাসা দিয়ে সামলাবে কিন্তু সে কিভাবে ঐ দানবীয় মানুষটার থাবা থেকে নিজেকে বাঁচাবে?

বৃষ্টি থামার নাম নেই। আশপাশে আজ কোনো রিকশা বা ট্যাক্সিও নেই। অন্তি কলেজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এমন হাঁটু জল ভেঙে কলেজে যাওয়ার কোনো মানে নেই। দিহান নিশ্চই এই বৃষ্টির মধ্যে মোড়ে বসে থাকবে না। সো যাওয়া ক্যান্সেল। এর থেকে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে বাড়িতে ফেরা ঢেড় ভালো। এতসব ভেবেই অন্তি পা বাড়িয়েছে সবে ছাউনি থেকে বের হবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার আগেই একটা শক্ত হাত তাকে এক টানে পূর্বের জায়গায় এনে দাঁড় করালো। গমগমে কন্ঠে বললো,

‘স্টে স্টিল!’

অন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। আধভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিহানকে দেখতেই তার চোখ জ্বলে উঠলো। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার দরুন গায়ের কালো রঙের শার্টটা শরীরের সাথে এটে আছে। মাথার চুলগুলো ও লেপ্টে পড়েছে। অন্তি গভীর চোখে তাকালো। তার চোখ জোড়া যে তাদের লজ্জা হারিয়েছে! দিহান অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

‘চোখ সরাও। এভাবে তাকাবে না।’

এবার অন্তি লজ্জা পেলো। চোখ সরিয়ে নিল। মুখে এসে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে কানের পেছনে গুজে নিলো। দ্বিতীয়বার দিহানের দিকে তাকানোর মতো সাহস হলো না তার। আর না পারলো মুখ ফুটে কিছু বলতে। তবে তার ভাবনারা খান্ত হলো না। দিহানকে নিয়ে মনের কোণে এতশত প্রশ্ন জমতে শুরু করেছে। অন্যদিনের থেকে লোকটাকে কিছুটা ব্যতিক্রম লাগছে যেন।

দিহান আড় চোখে একবার অন্তিকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে নিরবে হাসলো যেমন।

বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। হঠাৎ আগমনের বৃষ্টির এমন দীর্ঘ সময় স্থায়িত্ব কাম্য ছিলো না কারো। ঠান্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে শীতল বাতাস বইছে। অন্তি তার হাত দ্বারা দু বাহু শক্ত করে চেপে রেখেছে। দিহান সেদিকে একবার দেখেই পকেট থেকে সেলফোন বের করে কাউকে কর করলো।

‘পাঁচ মিনিটের মাঝে গাড়ি নিয়ে মসজিদের অপজিটে ছাউনির ওখানে চলে আয়। ফাস্ট!’

দিহানকে ফোনে কথা বলতে দেখলেও কথা শুনতে পায়নি অন্তি। তার মুখটা এতটুকুন হয়ে আছে। এত কাছে থেকেও লজ্জার জন্য সে মানুষটার সাথে কথা বলতে পারছে না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? এই লজ্জা নামক ইমোশন টা যথাসম্ভব দূর করতে হবে। এই ইমোশন তার চাই না।

কেটে গেল দু মিনিট। অন্তি হাঁসফাঁস করছে কথা বলার জন্য। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলার একটা কিছু খুঁজে চলছে। কিন্তু সে কোনো টপিক পাচ্ছে না। অবশেষে টপিক বাদে হুদাই আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিলো।

‘শুনছেন?’

দিহান শুনলো না। ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তি জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে আবারো বললো,

‘এই যে শুনছেন?’

দিহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে ভ্রু নাচিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলো। অন্তি খুব আগ্রহ নিয়ে বললো,

‘আপনি কখনোই আমার নাম জানতে চাননি। এর কি কারণ?’

দিহান পূর্বের ন্যায় ফোনে তাকিয়ে অকপটে উত্তর দিলো,

‘ বিকজ আ’ম নট ইনট্রেস্টেড!’

অন্তির হাসি হাসি মুখটাতে আবারো আঁধার নেমে এলো। চোখ গুলোতে কোনো বার্তা ছাড়া আগমন নেওয়া বৃষ্টির মতো করেই জলে ভরে উঠলো। লোকটা অকপটে তাকে অপমান করে। আবার কেয়ার ও দেখায়। পাইছে টা কি? তার কি কোনো মর্জাদা নেই? এতই ফেলনা নাকি! তিক্ত অনুভূতিতে ধরে এলো মন। পাশেই কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটার জন্য তৈরি হলো পাহাড় সমান অভিমান। অন্তির চোখ মুখ কঠোর হলো। তৎক্ষণাৎ তার ফোনে ছাকা দিহানের নম্বরটা ব্লক লিস্টে যুক্ত করলো। একদিন মানুটাকেও এভাবে তার মনের ব্লক লিস্টে আবদ্ধ করে নিবে। তারপর গালা দিয়ে মনের দরজায় সিল করে দিবে।

বৃষ্টি পুরোপুরি ভাবে না থামলেও তান্ডব কমে এসেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সাথে মৃদু বাতাস। অন্তির আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা হলো না। ওভাবেই নেমে পড়লো ছাউনি থেকে। দিহানের কপালে ভাঁজ দৃঢ় হলো। কঠোর গলায় বললো,

‘মেয়ে ভেতরে দাঁড়াও। ভুলেও ভিজে যাওয়ার মতো সাহস করবে না। পা ভেঙে রেখে দিব।’

অন্তি কথাগুলো শুনলো। কিন্তু কোনো অনুভূতি আজ আর তাকে ছুঁতে পারলো না। না সামান্য ভয় তাকে কাবু করতে পারলো। তার মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দিহানকে উপেক্ষা করে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। বৃষ্টির জলের সাথে চোখের জল মিশে একাকার হলো। দিহান অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা তাকে উপেক্ষা করলো! কই আগে তো করেনি! তবে আজ কেন? চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেমন। হাতের মুঠো শক্ত হয়। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে অন্তি চলে যাচ্ছে। ঐ তো একটু বাদেই চোখের আড়াল হলো বলে!

____________

বিকেল হতেই এক দারুণ ঘটনা ঘটে। সকালের ঘটনার জন্য দিহান তখনো প্রচন্ড ডিস্টার্বড্। মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। নুহাশ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে দিহানের কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘দোস্ত তোর জন্মের সময় হয়তো মৌয়ালরা মধুর চাক কাঁটা থেকে বিরতি নিছিলো। এজন্য আন্টি তোর মুখে মধু দিতে পারে নায়। তাই আমি ভাবছি প্রতিদিন তোকে একটা করে মিষ্টি খাওয়াবো।’

দিহান বিরক্ত চোখে তাকালো। সিগারেট ধরাতে নিলে নুহাশ তা ছো মেরে নিয়ে নেয়।

‘আগে মিষ্টি! তারপর সিগারেট।’

নুহাশের জোর জবরদস্তির শিকার হয়ে দিহান হাল ছেড়ে দিলো। তাদের মহল্লার বেষ্ট মিষ্টির দোকান হচ্ছে জমজম মিষ্টা মহল। দোকানের মালিক একজন মহিলা। পঞ্চাশ প্রায় বয়সে এসেও চটপটে ভাবে কাজ করে। মিষ্টির স্বাদ ও মুখে লেগে থাকার মতো। তারা দোকানে ঢুকতেই মহিলা চওড়া হাসলো।

‘কত্তদিন পর দেকলাম তোমাদের। কেমন আছো বাবারা?’

শুদ্ধ আর চলিতর মিশ্র ভাষাটা নুহাশের দারুণ লাগে। সেও চওড়া হেসে বলে,

‘এই তো ভালো চাচি। গরম গরম গলাপজাম হবে?’

‘দিতাছি বসো।’

খাওয়া শেষে বিলের সময় ঘটনাটা ঘটলো। দিহান বিল দিতে গেলে মহিলাটা বললো,

‘তা বাবা বউমা কেমন আছে?’

দিহান মুচকি হাসে। বলে,

‘এখনোতো বিয়ে করলাম না চাচি।’

মহিলা হাসে।

‘যাই বলো তোমার ফেন্সি কিন্তু দেখতে মাশআল্লাহ। আমার দোকানের মিষ্টির থেইকেও মিষ্টি।’

দিহান ভ্রু বাঁকায়।

‘ফেন্সি?’

মহিলা অবাক হয়ে বলে,

‘আরে ফেন্সি! হবু বউ! ওইটা ইংরেজি কতা।’

দিহান মুচকি হাসে। দোকানি কার কথা বলছে বুঝতে বাকি নেই তার। এই মহল্লায় এমন সাহস কেবল একজনেরই আছে। সেই একজনটা হচ্ছে তার শ্যামকন্যা।

দোকানি আবারো বলে,

‘বউমা জিলাপি নিয়া গেছিলো। বলছে তুমি দাম দিবা। তোমাকে বলে নাই?’

দোকানির কথায় দিহানের চোখ ছোট হয়ে আসে। মেয়েটা আজকাল তার নাম করে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি ও নিয়ে যাচ্ছে! ইমপ্রেসিভ!
দিহান ঠোঁট কামড়ে হাসে। বিয়ে না করা বউ তার বেশ ভালো লেগেছে। তার বউয়ের উপর তার তো কিছু দায়িত্ব আছে! এখন থেকে দায়িত্ব গুলো খুব সুন্দর ভাবে পালন করবে সে। কোনো কৃপনতা চলবে না। দিহান মির্জা তার দায়িত্ব পালনে কখনো কৃপনতা করে না।

‘চাচি আপনার বউমা আবার এলে তার যা দরকার হয় দিবেন। টাকা আমি দিয়ে দিব। কেমন?’

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)