৭.
বর্ষাকালের আগাম বর্তা দিতে আকাশ ঘনিয়ে মেঘ করেছে। এখন জৈষ্ঠের প্রায় শেষ। কিছুদিন বাদেই আষাঢ়ের পদার্পন ঘটবে। তারই বার্তা জানাচ্ছে প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই মেঘ গর্জন তুলছে। যখন তখন ঝুপ করে বৃষ্টি নামতে পারে। মেঘের গর্জনে দোতালার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরীর বুক বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাও সে রুমে ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তার ভয়ার্ত দৃষ্টি রাস্তায় বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির দিকে। পুরুষটি তার দিকে তাকাচ্ছে কম। ফোনে অনবরত কিছু করে চলছে। মেয়েটার অবস্থা কাঁদো কাঁদো। আজ তার সিভি জমা দেওয়ার কথা ছিলো। কোনো জবের জন্য নি। এলাকার গুন্ডার কাছে নিজের পরিচয় তুলে ধরার জন্য। কিন্তু সে সেটা করেনি। সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। ভেবেছিলো এই অতি সূক্ষ্ম ব্যাপারটা কারো মনে থাকবে না। কিন্তু হলো তার ভিন্ন। লোকটা ঠিক মনে রেখেছে। গুন্ডাদের মেধা এতো ভালো হয় তার ধারণা ছিলো না। লোকটা কোথা থেকে তার নম্বর খুঁজে বের করে বিকেল হতেই কল ঠুকেছে। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসায় সে প্রথমে না ধরলেও বারবার কল আসায় ধরেছে। পরিচিত কেউ হতে পারে! সুন্দর করে সালাম দিয়ে কে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর আসে,
‘সিভি কোথায়?’
তন্নির আর বুঝতে বাকি থাকেনা এটা কে হতে পারে। তার প্রাণ পাখি গলায় এসে আটকে আছে। লোকটা নাম্বার খুঁজে পেল কোথায়? এসব ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় ধমকটা আসে।
‘স্টুপিড! চুপ করে আছো কেন? বারান্দায় আসো। এখন মাত্র। আমি না বলা অবদি এক পা ও নরবে না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। নয়তো তোমার বাসায় আসতে একদম কৃপনতা করবো না।’
তখন থেকেই এভাবে দাঁড়িয়ে সে। এদিকে মশা তার পা কামড়ে ঝাঝড়া করে ফেলছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই এই মশার উৎপাত শুরু হয়। তন্নি কাঁদো চোখে বাহিরে তাকালো। নাহ লোকটা আজ আর যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার ছোট্ট জীবনটা বোধহয় এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মশার কামড়েই শেষ হয়ে যাবে!
তন্নি মেয়েটা সুন্দরী। একদম ভয়ংকার সুন্দর যাকে বলে। টকটকে গায়ের রঙ আর গোলগাল মুখ। তবে নাকটা চাকমাদের মতো বোঁচা। এই বোঁচা নাকটাই বেশি সুন্দর।
অন্তি আর তন্নি একত্রে কোথাও বের হলে আশপাশের মানুষ ঘুরেফিরে তন্নিকেই দেখে। অন্তির দিকে তাকাতে যেন তারা ভুলে বসে।
তবে তন্নি মেয়েটা অন্তির থেকে অনেকটা ভিন্ন। তাদের স্বভাব একে অপরের বিপরীত। “সুন্দরী মেয়েরা বোকাসোকা হয়” এই প্রবাদটাকে প্রমাণ করতেই যেন তন্নির এই ধরণীতে আগমন। একটুতেই কেঁদে ফেলার মতো মহৎ গুণের অধিকারী সে।
এখন সেই মহৎ গুণেরই সূক্ষ্ম বহিঃপ্রকাশ করছে সে। খানিক বাদেই নাক টানছে। চোখ থেকে উপচে পড়ছে পানি। নুহাশ তার তীক্ষ্ণ চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করে কল করলো তন্নিকে। তন্নির পাশেই ফোন ছিল। নাক টেনে একবার দাঁড়িয়ে থাকা নুহাশকে দেখে কল রিসিভ করলো। প্রেয়সীর চোখের পানিতে তখন প্রেমিক পুরুষের মন গলে শীতল হয়ে এসেছে। নুহাশ নরম গলায় বললো,
‘কাঁদছো কেন? আমিকি তোমায় বকেছি? মেরেছি?’
তন্নি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। তা দেখে ছোট করে হাসলো নুহাশ। শুধালো,
‘তবে?’
‘এখানে অনেক মশা। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।’
এ কথার জবাব কিভাবে দিবে নুহাশ বুঝতে পারলো না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
‘এজন্য কাঁদছিলে?’
‘হুম।’
নুহাশ কেমন প্রতিক্রিয়া দিবে তা ভেবে পেলো না। মানে সত্যি? মশা কামড়ালে মানুষ কাঁদে? তাও আবার এতো বড়ো একটা মেয়ে! দুদিন পর বাচ্চার মা হবে এমন মেয়ে এখনো বাচ্চাদের মতো হুদা জায়গায় কাঁদে! নুহাশ হাসি আটকে রাখতে পারল না। হু হাঁ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এসেছে। হাসি থামিয়ে বললো,
‘রুমে যাও। কয়েল জ্বালিয়ে দাও। আর মশা কামড়াবে না। তোমার সব ভুল মাফ করা হলো।’
_______________
অন্তির নানা বাড়িতে বড়োসড় একটা বাগান আছে। বাগান ভর্তি ফলের গাছ। তার মধ্যে রয়েছে হাইব্রিড জাতের পেয়ারা। যেগুলো বছরের বারো মাস গাছে থাকে। ছোট একটা গাছে থোকা থোকা পেয়ারা ঝুলে আছে। দেখতেই কেমন সুন্দর লাগে। গাছটা লম্বায় তুলনামূলক ছোট হলেও অন্তির উচ্চতার থেকে বেশ বড়। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারেনা সে। তাই মই বেয়ে গাছে ওঠার অভিযান শুরু করেছে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে বাগানের পরিচালক মতলব মিয়ার ছেলে মতিন। রোগা পাতলা ছেলেটা একদিনেই অন্তিকে তার গুরু মেনে নিয়েছে। অন্তির প্রত্যেকটা কথা হরফে হরফে পালন করেই একজন ভক্ত শিষ্যর পরিচয় দিচ্ছে সে।
বহু প্রচেষ্ঠার পর বড় দেখে তিনটা পেয়ারা পাড়তে সক্ষম হয়েছে অন্তি। এই অল্পতেই তুষ্ট সে। মই বেয়ে নিচে নেমে বাগানে গোল করে সাজানো চেয়ার টেবিলে বসে পড়লো। মতিনকে বললো,
‘রান্নাঘরের ফ্রিজে দেখবে কাসুন্দি আছে। নিয়ে আসো। সাথে একটা বাটিও আনিও। ও আর, ফল কাটার ছুরি।’
‘আইচ্চা আপা।’
মতিন ছুট লাগালো। অন্তি হাসলো। তার এই ছেলেটাকে দারুন লেগেছে। মাকে বলে একে সাথে করে নিয়ে যাবে। ঢাকার একটা স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দিবে। ছেলেটার মেধা ভালো। একবার কিছু বললে চট করে ধরে ফেলার ক্ষমতা আছে।
.
.
দিহান আজ ও কিছু কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছে। আড্ডাস্থানে আজ ও তার দেখা নেই। তবে অন্যদিনের মতো সবাই আড্ডায় মত্ত নেই আজ। সবাই কেমন থমকে আছে। চোখে মুখে ক্রোধ স্পষ্ট। নুহাশ খানিক বাদে বাদেই পানির বোতরে চুমুক দিচ্ছে। এটা তার রাগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম। সে যখন খুব রেগে থাকে তখন খুব বেশি পানি খায়।
মূলত এই মহল্লায় দুটো দল রয়েছে। একটা দিহানের অপরটা পরশের।
একই বনে যদি দুটো বাঘ থাকে তবে রাজা হওয়ার লড়াই তাদের আমৃত্যু তাড়া করবে। এখানেও ঘটনা তেমন। দিহানের সাথে পরশের দন্দের কথা পুরো মহল্লা যানে। এর মাঝে এক ঝামেলা ঘটেছে। দিহানের এক ছেলেকে পরশের ছেলেরা বেধরম পিটিয়েছে। ছেলেটা এখন হাসপাতালে ভর্তি। মাথা ফেটেছে। বারোটা সেলাই লেগেছে। ডান হাত ভেঙেছে। পা নাড়ানোর মতো অবস্থা নেই। একথা জানতেই নুহাশ ফুঁসে উঠেছে। দিহান এখনো কিছু জানে না। জানলে বড় একটা ঝামেলা হবে যা নুহাশ চাচ্ছে না। কিন্তু না জানালেও যে সমস্যা। এখনি কোনো ব্যাবস্থা না নিলে পরবর্তীতে ওরা যে এভাবে আবারো হামলা চালাবেনা তার কি নিশ্চয়তা?
___________
রাত প্রায় বারোটা। অন্তির দুচোখের পাতায় ঘুম নেই। এত রাতেও সে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে। খোলা বারান্দায় বাহির থেকে আসা বাতাস গায়ে মাখছে দারুন।
নানু বারবার করে না করেছে রাতে বাহিরে বসতে। এটা তাদের শহর না। এখানে রাতে অনেক কিছু ঘটে যা শহরের ঝকঝকে কৃত্রিম আলোয় ঘটে না। তখন ভয় পেলেও এখন কেন যেন ভয় লাগছে না। তার মন খারাপ করেছে। দিহানকে বহুবার কল করেছে সে। কিন্তু প্রত্যেকবার ফোন বন্ধ বলছে। লোকটা কি নম্বর বদলে ফেলেছে? ভাবতেই অসর হয়ে আসে মন। বাহিরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতোই শুন্য হয়ে আসে মস্তিষ্ক। তার ভেতর সত্তা তাকে জানায়,
‘এই লোক পাথরের থেকেও কঠিন অন্তি। এই কঠিনতা ভেদ করা সম্ভব নয়।’
অন্তি সম্মতি জানায়। লোকটা সত্যিই পাথুরে হৃদয়ের। অন্তি মনে মনে আজ থেকে দিহান নামক মানুষটির সাথে হৃদয়ের সকল লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করে দিলো নিমিষেই। এই মানুষটাকে আর ভালোবেসে দুঃখ বাড়াতে চায় না সে। এমনিতেই দুঃখকি কম পাচ্ছে সে? নতুন করে আর দুঃখর দরকার নেই। বারান্দার দরজা আটকে রুমে এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আজ কিছুতেই সে দিহানকে নিয়ে ভাববে না। তার জন্য সুন্দর একটা ঘুম দরকার। তখনি তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে কল এলো। পাশে পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিণে জ্বলজ্বল করছে কলদাতার সেভ করা নাম ‘মাই ভিলেন’।
৬.
অন্তি আর তন্নি পৃথক দুটো মানুষ হলেও তাদের যেন এক প্রাণ। একে অপরকে ছাড়া চলে না। একে অপরের নাড়ি নক্ষত্র সব জানা তাদের। সেই হিসেবে তন্নি খুব ভালো করেই অন্তির মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে। মেয়েটার পগলাটে কান্ড সবার কাছে মজার মনে হলেও সে জানে ঠিক কতটা ডেস্পারেট হয়ে মেয়েটা এসব কান্ড ঘটিয়েছে। রিকশা কলেজ মোড়ে পৌঁছাতেই সে রিকশা থেকে নেমে পড়ে। আশপাশ মানুষ জনে ভর্তি। এই সময়টা এখানে প্রচুর মানুষ থাকে।
দিহানদের আড্ডাস্থানে আজ দিহান নেই। বাদবাকি সবাই গাড়িতে হেলান দিয়ে,বসে আড্ডা দিচ্ছে। তন্নির সাহস হচ্ছে না সামনে এগিয়ে যাওয়ার। একটা মেয়ে এত্তগুলো ছেলের মাঝে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ব্যাপারটা দেখতেও কেমন দৃষ্টি কটু লাগে। অন্তির ব্যাপার আলাদা। সে এসবে তোয়াক্কা করে না। পাছে লোকে কিছু বলে কবিতাটা খুব ভালো ভাবেই আয়ত্ত করেছে সে। এজন্যই এসব লোকভয় তার মাঝে নেই।
নুহাশ খুব ক্ষিপ্ত মেজাজে বসে আছে। আজকাল সব কেমন অসহ্য ঠেকছে তার কাছে। এতকিছু সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রীতিমতো। এদিকে দিহান গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং এ অ্যাটেন্ড করেছে। আজকাল প্রেশার বেড়েছে খুব।
‘শুনছেন?’
রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠে কপালের কুঁচকানো চামড়া আরো কুঁচকে এলো। পাশ ফিরে তাকাতেই একজোড়া ভয়ার্ত চোখ নজরে এলো। মাথায় বড়ো করে কাপড় টেনে দেওয়া। জুবথুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা কি ভয় পাচ্ছে? নুহাশের কুঁচকে থাকা কপাল সোজি হয়ে আসে। চট করে মেয়েটাকে আরো একবার স্ক্যান করে নেয়। পড়নে সাদা কালো মিশ্রণে লং কামিজ। সাদা রঙের ওড়না দিয়ে সুন্দর করে মাথা ঢেকে রাখা। গায়ের রঙ ফর্সা। এক কথায় সুন্দরী বলা চলে। নুহাশ চেতনা থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
‘কি চাই?’
এমন প্রশ্নে তন্নি আরো কিছুটা ঘাবড়ে গেল। শক্ত করে চেপে ধরলো ওড়নার এক পাশ। এই লোকটাও কি দিহান ভাইয়ার মতোই হিংস্র? ভয়ে বুক কাঁপে মেয়েটার।
‘তোমাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে!’
নুহাশ বলে। মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরপর সোজা চেয়ে বলে ওঠে,
‘আমি কি তোমাকে চিনি? কোথাও দেখেছি?’
তন্নি ঘাড় ডানে বামে নাড়ায়। সে জানে না। নুহাশ ধমক দেয়।
‘কথা বলতে পারো না? মুখ নেই?’
তন্নির অবস্থা কাঁদো কাঁদো। প্রাণের বান্ধবীর লাইন ঠিক করতে যেয়ে তার জীবনের লাইনটাই যে বেঁকে যাচ্ছে!
তন্নি বুক ভরে শ্বাস নেয়। চোখ বন্ধ করে বলতে শুরু করে,
‘আপনি আমাকে চেনেন কিনা এ ব্যাপারটা আমার জানার কোনো প্রশ্নই আসে না। এটা তো আপনিই ভালো জানবেন! তবে আমি আপনাকে চিনি। দু একবার দিহান ভাইয়ার সাথে দেখেছি।
আমি এখানে এসেছি দিহান ভাইয়ার নম্বরটা নেওয়ার জন্য। আপনার মিষ্টি ভাবী আমাকে পাঠিয়েছে।’
কথা শেষে তন্নি পিটপিট করে তাকালো। নুহাশের মুখভাব বদলেছে। তার চোখে মুখে এখন দারুণ কৌতুহল খেলা করছে। নুহাশের এখন মনে পড়লো মেয়েটাকে সে অন্তির সাথেই দেখেছিল। মানে ভাবীর বান্ধবী। ভাবতেই বাঁকা হাসে। তবে কিছু বলে না। এক পলক ভিতু চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে ফোন বের করে দিহানের নম্বর এগিয়ে দেয়।
তন্নি পারলে সেই কখন ছুট মারে। কিন্তু এভাবে ছুট লাগানোটা তো ভালো দেখায় না। তাই সে আস্তে ধীরেই নুহাশদের সামনে থেকে সরতে চাইলো। তখনি পেছন থেকে নুহাশ বলে উঠলো,
‘মেয়ে তোমার নাম,ঠিকানা থেকে শুরু করে যাবতীয় ইনফরমেশন মিলিয়ে একটা সিভি দিয়ে যাবে। এবং সেটা কালকের মধ্যে।’
তন্নির পা থেমে গেছে। ভয়ে প্রাণ যাই যাই করছে। এই লোক সিভি দিয়ে কি করবে? বাসায় যেয়ে নালিশ বসাবে? তেমন হলে তার আর বেঁচে থাকা হবেনা। মনে মনে বিরবির করে বললো, অন্তি তোর প্রেম সার্থক হবেই। কারণ তোর জন্য আমি জীবন স্যাকরিফাইস করতে চলছি।
তন্নির ভাবনার কাঠি ঘুরিয়ে নুহাশ তার জন্য রিকশা ঠিক করে দিলো। তন্নি ড্যাবড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে। এই গুন্ডাদের মধ্যে মানবতাও আছে! ইন্টারেস্টিং!
‘আমাকে পরে দেখার অনেক সুযোগ পাবে। এখন চটজলদি বাসায় যাও। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কুইক!’
তন্নি মনে মনে মুখ বাঁকালো। তার ওতো দেখার সখ নেই। অন্তির মতো ভুল সে ইহজনমে করবে না। অন্তি নিজের ভালো না বুঝলেও সে বোঝে। প্রেমে অন্ধ হওয়ার মতো মেয়ে সে না। রিকশায় চেপে বসতেই নুহাশ রিকশাওয়ালাকে কঠোর ভাবে বললো,
‘চাচা যেখানে যেতে চাইবে সেখানেই পৌঁছে দিয়ে আসবেন। এবং পৌঁছানোর পর আমাকে জানাবেন। নাম্বার আছে না?’
রিকশাওয়ালা ভদ্রলোক মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো।
‘হ বাবা আছে।’
তন্নি অবাকের উপর অবাক। সে অন্তির ফ্রেন্ড বলেই কি এত খাতির যত্ন করছে! হতেই পারে। ফিউচার ভাবীর বান্ধবী বলে কথা!
___________
আজ আকাশে রূপালি আলোয় রাঙা চন্দ্র উঠেছে। আশপাশে তার হাজারো তারার মেলা। যেন একখন্ড কালো চাদরে রূপালি সুতোয় কারুকার্য করা হয়েছে। সেই চাদর থেকে রূপালি দ্যুতি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। এই অতি সুন্দর পরিবেশ প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে এক পুরুষ ছাদের রেলিংয়ে ভর দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পুরুষটির এমন নির্মম কান্ডে চাঁদের বোধহয় অভিমান হলো। তার রূপে মুগ্ধ না হওয়া পুরুষটার প্রতি একরাশ মন খারাপ নিয়েই বিশাল এক মেঘের পেছনে নিজেকে আড়াল করে নিলো। মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে পুরুষটির ভাবাবেগ বোঝার চেষ্টা করলো। এই পুরুষের মাঝে কি রূপের মোহতা নেই? এত নিষ্ঠুর কেন এই মানব?
দিহানের সিগারেটে শেষ হতেই সে সিগারেটের প্যাকেট থেকে চতুর্থ নম্বর সিগারেট বের করতে নিলে দেখা গেলো সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। চোখ মুখ কুঁচকে চ শব্দ করলো। সারাদিনের ব্যাস্ততার মাঝে আজ একটাও সিগারেট খাওয়া হয়নি। এই কেবল একটা জিনিস যা দিহানকে সাময়িক শান্তি দিতে পারে। চোখ তুলে আকাশ পানে চাইতেই বিরক্তে মুখ কুঁচকে আসে। চাঁদ তার পছন্দ না। অন্ধকারে ঘেরা কালো আকাশটাই তার প্রিয়। চাঁদের এই রূপালি সুন্দর রূপ সবাইকে মুগ্ধ করলেও তাকে মুগ্ধ করতে পারে না। তার মতে চাঁদের কোনো নিজস্ব ক্ষমতা নেই। এই যে সুন্দর রূপালি দ্যুতি; এটাও সূর্যের থেকে ধার করা। এমন ধারকরা রূপের প্রশংসা সে করবে না। কখনোই না।
দিহানের পাশে রাখা ফোনটা জ্বলে উঠলো। নুহাশ কল করেছে। দিহান কল রিসিভ করে লাউডে দিয়ে ফোন পাশে রাখলো। নুহাশ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘কখন ফিরছিস?’
‘ঘন্টাখানেক হবে।’
‘একবার জানাতে হয় এই নূন্যতম ভদ্রতাও দেখছি তোর মধ্যে নাই।’
দিহান তার ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘হু আর ইউ?’
নুহাশ খুব বাজে একটা গালি দিতে গিয়েও মুখ সামলে নিলো। পরক্ষণে কিছু মনে পরতেই বললো,
‘যাই হোক। আমি এখন ফোন রাখি। নয়তো কেউ একজন কল করে আবার আপনাকে পাবে না।’
‘কে সে?’
‘কেন বলবো? হু আর ইউ?’
বলেই খট করে কল কেটে দিলো নুহাশ। ব্যাটা বজ্জাত! তাকে কিনা বলে ‘হু আর ইউ?’ আমি তোর জম। বলেই ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো।
এদিকে নুহাশ কল কাটার প্রায় সাথে সাথেই আননোন এক নম্বর থেকে কল আসলো। দিহান কপাল কুঁচকে এগারো ডিজিটের নম্বরটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। কোনোভাবেই সে এই নম্বর চিনতে পারছে না। তাছাড়া তার এই নম্বর বাহিরের কারো জানার কথা না। যারা জানে তাদের নম্বর মূলত ফোনে সেভ করা রয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই কল কেটে গেল। দিডহান ফোন রেখে দিতে উদ্যত হতেই আবারো কল আসলো। এবার কল আসার প্রায় সাথে সাথেই কল রিসিভ করলো দিহান। কানে চেপে রুক্ষ কন্ঠে বললো,
‘কে বলছেন?’
ফোনের ওপাশ থেকে অন্তি চুপ করে রইলো। কেন যেন তার খুব ভয় করছে। লোকটা রেগে গেলে তাকে দেখার সৌভাগ্য টুকুও দুর্ভাগ্যে পরিনত হবে। তাই অন্তি এক চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে দিহানকে কল করবে ঠিক কিন্তু কথা বলবে না। লোকটা জানতেও পারবে না তায কথা! হোয়াট এ বুদ্ধি!
‘চুপ করে থাকলে দেশের যে প্রান্তে আছো সেখানে গিয়ে থাপ্পড় মেরে আসবো। অভদ্র মেয়ে! স্পিক আপ!’
‘নম্বর কোথায় পেয়েছো? সোজা উত্তর দিবে। নয়তো মেরে ফেলবো একদম!’
অন্তি গাল ফুলালো। লোকটা একদম সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। অভিমান নিয়ে বললো,
‘আপনি শুধু আমাকে মারতে চান কেন? আমি মরে গেলে কে আপনায় ভালোবাসবে?’
দিহান দমলো। তার হিংস্র চোখ শান্ত হয়ে এলো। কুঁচকে থাকা কপাল সোজা হলো। পাথরের মতো হৃদয়টা কিছুটা কোমল হলো বোধহয়। চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে সে অন্যসবার মতো ধমকাতে পারে না। খুব একটা কঠোর হতে পারে না। ঐ কোমল মুখখানা দেখলেই তার হিংস্রতা ক্ষীণ হয়ে আসে। মেয়েটার চঞ্চলতা অকারণেই তার ভালো লাগে। মেয়েটা যেন মরুর বুকে সবুজ সতেজ এক চারাগাছ।
‘এই যে শুনছেন?’
অন্তি ডাকে। দিহান ছোট করে জবাব দেয়,
‘হুম।’
অন্তির ঠোঁটে হাসি ফোটে। জ্বলজ্বল করে উঠে মুখ। ইশশ! লোকটা তার কথা শুনছে! অন্তি খাটে গোল হয়ে বসলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
‘ফোন কাটবেন না ঠিক আছে?’
দিহান উত্তর দিলো না। চুপ করে অন্তির কথা শুনলো। নিরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে অন্তি বলতে শুরু করল,
‘আচ্ছা আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি বলছি আপনি শুনেন। এত অগোছালো কেন আপনি? চুলগুলো কত বড় হয়ে এসেছে একটু ছোট করে নেন না কেন? দেবদাসের মতো লাগে! আমি তো মরে যাই নি! আপনিকি আপনার চুলগুলো একটু কেটে ছোট করবেন? অনেক ছোট না। একদম অল্প।’
‘কথা শেষ?’
অন্তির মুখ কালো হয়ে এলো। খানিক চুপ থেকে নরম গলায় বললো,
‘আপনি কি আমার উপর বিরক্ত?’
‘বুঝতে এত সময় লাগলো!’
কথাটার তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারলো না অন্তি। কান্নায় তার মুখ ভেঙে আসছে। চোখ থেকে টুপটাপ করে জল গড়াচ্ছে। কষ্ট সাথে অপমান অনুভব হচ্ছে তার। এই নিষ্ঠুর মানুষটাকে সে আর ভালোবাসবে না। যে ভালোবাসা বোঝে না তাকে ভালোবাসা বোকামি। অন্তি কান্না চেপে রেখে ছোট করে বললো,
‘সরি! আর বিরক্ত করবো না।’
দিহান তার স্বভাবসুলভ চোখ ছোট করলো। আর বিরক্ত করবে না বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছে মেয়েটা?
অন্তি বুকে একরাশ কষ্ট নিয়ে বললো,
‘রাখছি। আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবেন।’
কিন্তু তার কল রাখা হলো না। দিহানের দমক তার হাত থামিয়ে দিয়েছে।
‘একদম কল কাটবে না। থাপড়ে দাঁত ফেলে দিব!’
ব্যাস। অন্তির সাধ্য হলো না দিহানের কথার বিপক্ষে যেয়ে কল কাটতে। কানে ফোন চেপে রেখেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা। দিহান ফোনের ওপাশ থেকেই কান্নার সে শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। বেশ কিছু সময় কাটার পরও যখন অন্তির কান্না থামে না তখন দিহান প্রথম বারের মতো নরম গলায় কথা বলে।
‘মেয়ে কান্না থামাও। কথা বলো।’
দিহানের নরম কন্ঠে অন্তির কান্নার গতি যেন বেড়ে গেল। সে আর বিরক্ত করবেনা শুনতেই লোকটা এত ভালো ব্যাবহার করছে! এত অপছন্দ করে লোকটা তাকে?
‘কান্না থামাতে বলেছি। কান্না না থামালে আই সয়ার আমি সত্যিই তোমাকে মেরে ফেলব।’
অন্তি এবার সত্যিই কান্না থামালো। তবে পুরোপুরি ভাবে থামাতো পারলো না। হেঁচকি উঠেগেছে তার। দিহান বুঝতে পেরে তপ্ত শ্বাস ফেলল। বললো,
‘আমার সম্পর্কে আইডিয়া আছে তোমার? আমি কিন্তু মোটেই ভালো মানুষ না। আমাকে ভালোবাসা মানেই নিজ হাতে বিষ পান করা। তুমি আমাকে যতটা ভয়ংকর ভাবো তার থেকেও অনেক বেশি ভয়ংকর আমি। বুঝতে পারছো তুমি?’
অন্তি নাক টেনে জবাব দিলো,
‘যতই ভয়ংকর হন না কেন আমি আপনাকেই ভালোবাসব?’
দিহান প্রায় সাথে সাথেই বললো,
‘একটু আগেই না বললে আর বিরক্ত করবে না? এখন পাল্টি খাচ্ছ কেন?’
‘বিরক্ত না করার কথা বলেছি। ভালোবাসবোনা তা কখন বললাম?’
দিহান আর কথা বাড়ালো না। কেবল শীতল গলায় বললো,
‘ঘুমিয়ে পড়ো।’
কল কেটে গেল। এতক্ষণ মরা কান্না করা অন্তি মুহূর্তেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। লোকটা কতক্ষন তার সাথে কথা বললো! নিশ্চই সে সো কল্ড হোঁচট খেয়েছে। কিছুদিন পর প্রেম ও করবে। নো ডাউট!
অন্তি চটজলদি তন্নিকে কল করলো। এই খুশির খবরটা মেয়েটাকে না জানালে আজ আর ঘুম হবে না তার।
৫.
ব্যাচের আজ প্রথম দিন কিন্তু অন্তি ব্যাচ করলো না। কিভাবে করবে? আজ যে তার পড়ায় মন বসবে না। আজ তার খুশির দিন। দিহানের দেওয়া ধমকের কথা সে অনেক আগেই ভুলে বসেছে। মন ছটফট করছে। ইশশ! মানুষটা তবে তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে! নুহাশ তো তার একদম কাছের মানুষ। সে নিশ্চই মিথ্যা বলবে না! অন্তির গাল গরম হয়ে আসছে। শরীরের তাপ ও বেড়েছে। তার কি জ্বর আসছে? প্রেমের জ্বর!
ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই অন্তির চোখ পড়লো রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানের সামনে কতেক পথশিশু দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দৃষ্টি দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা গরম জিলাপির দিকে। কি মিষ্টি গন্ধ! চারদিক যেন মৌ মৌ করছে ঘ্রাণে। সেদিকেই অপলক দৃষ্টি তাদের। তাদের না আছে কিছু কিনে খাওয়ার ক্ষমতা আর না আছে চেয়ে খাওয়ার সাহস। কেবল ব্যাথাতুর চোখে ট্রেতে সাজিয়ে রাখা জিলাপির দিকে তাকিয়ে থেকেই মনের ভেতরের ছোট্ট খায়েশ পূরণ করছে যেন। অন্তির মায়া হলো। এই ছোট ছোট প্রাণ গুলোর জন্য তার বুক ভার হয়ে আসে। নিজেকে শুধায়,আজ এই সুন্দর দিনে সুন্দর একটা কাজ করা যেতেই পারে!
এই রাস্তায় বড় কোনো গাড়ির চলাচল নেই। রিকশি,ভ্যান,ট্যক্সি আর মানুষের ব্যক্তীগত গাড়ি চলাচল করে। অন্তি আশপাশ দেখে রাস্তা পার হয়ে ওপাড়ে এলো। বাচ্চাগুলোর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। মুচকি হেসে বললো,
‘জিলাপি খাবে?’
কথাটা শোনা মাত্রই কতক চোখ ঝলমলে দৃষ্টিতে তাকালো। মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানালো। তারা খাবে। অন্তি মুচকি হাসলো। দোকানিকে একজন মাঝ বয়সী মহিলা। পরনের রঙচটা শাড়ি। একমনে দাড়িয়ে তেলে জিলাপির প্যাচ দিচ্ছে।
‘একশ টাকার জিলাপি দেন তো।’
দোকানি ছোট চোখে তাকালো। আগা মাথা দেখে নিয়ে বললো,
‘জিলাপি কেজিতে বিক্রি হয়। টাকায় না।’
অন্তি বোকা হাসলো। সে কি জানে নাকি!
‘আচ্ছা এক কেজি দেন।’
দোকানি প্যাকেট এগিয়ে দিতেই অন্তি তার পার্স বের করতে করতে বললো,
‘কত হলো?’
‘ এক হাজার।’
অন্তির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এক হাজার!
‘এত?’
‘জিলাপির কেজি এক হাজার এই কতা সবাই জানে। দাম কমছে কিছু। মাঝে ১২০০ তে বিক্রি করছি।’
অন্তি অবাক হয়ে বললো,
‘কি বলেন চাচি? পোস্ট অফিসের পাশের দোকানটাতেও তো ২০০/২৫০ করে বিক্রি করছে!’
দোকানি মহা বিরক্ত হলো।
‘ঐগুলিনের সাথে এগুলিন মিলালে তো চলবেনা আফা। এগুলা জাফরান দিয়ে বানানো।’
অন্তি দোকানি মহিলার দিকে তাকালো। রোগা শোকা দেহে ছোট্ট একটা মুখ। চোখ মুখে লেপ্টে আছে দারুন বিরক্তি। এমন মুড নিয়ে নিশ্চই কেউ মিথ্যা বলবে না! তাছাড়া জাফরান জিলাপির দাম বেশি এটা সে জানে। মিষ্টি পছন্দ না বলে এসব চেনেনা সে।
অন্তির পার্সের এক কোণে পাঁচশ টাকার একটা নোট পড়ে আছে। এ ছাড়া আর একটা কানাকড়িও নেই তার কাছে। তার খুব অসহায় ফিল হচ্ছে। করুন চোখে দোকানির দিকে তাকালো। মহিলা যেন দেখতে পেয়েও দেখল না। থমথমে গলায় বললো,
‘তাড়াতাড়ি করেন আফা। হাতে সময় কম।’
অন্তি আশপাশে অসহায় দৃষ্টি ফেলল। বাচ্চা গুলো ততক্ষনে জিলাপির প্যাকেট থেকে জিলাপি খেতে শুরু করেছে। ওদের খাওয়া দেখে মন জুড়ালেও মাথা জুড়ালো না। চিন্তায় অস্থির সে। এতগুলো টাকা কই পাবে সে?
বিধাতা অন্তির ভাগ্য বোধহয় সোনা দ্বারা বাঁধিয়েছে। এজন্যইতো আশার আলো হিসেবে দেখা মিলল দিহান মির্জার। দিহানরা তখন এদিকেই কোনো এক কাজে আসছিলো। দিহান তার জিপ আনেনি। হেঁটেই আসছে এদিকে। দিহানকে দেখতেই অন্তির মাথায় চিন্তা যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। যে মানুষটা তাকে এক দন্ড প্রশ্রয় দেয়না তাকে দেখতেই এত ভরসা পাওয়ার কারণ অন্তির জানা নেই। তবে তার বুকের উপর থেকে যেন পাথর নেমে গেল। তবে দিহান মির্জা তো সাধারণ লোক না! তার কাছ থেকে সাধারণ ভাবে সাহায্য পাওয়া যাবে না তা অন্তি বেশ জানে। সমস্যা কি? মানুষটাকে সব ভাবে মোকাবেলা করার ক্ষমতা নিয়েই তো অন্তি জন্মেছে!
অন্তি দোকানিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ইশশ! চাচি টাকা যে বাসায় ফেলে এসেছি! চিন্তা করবেন না। ঐ যে দিহিন মির্জা! চিনেন নিশ্চই? আমি ওর ফিয়ন্সে। ওকে বললেই টাকা দিয়ে দিবে।’
অন্তি উইদআউট ফেয়ার মিথ্যা কথাগুলো বলে শ্বাস নিলো। বাপের জনমেও সে এতগুলো মিথ্যা বলেনি। দোকানি কেমন করে যেন তাকালো। বিশ্বাস করলো না নাকি? অন্তি ছোট করে ঢোক গিলল। দোকানি অবাক হয়ে বললো,
‘ফেন্সি কি?’
অন্তি ভুল শুধরে দিলো,
‘ফেন্সি নি চাচি ফিয়ন্সে। হবু বউ! বুঝেছেন?’
কথাটা বলে লাজুক হাসলো অন্তি। এটা তার অভিনয় ছিল না। নিজেকে দিহানের বউ ভাবতেই তার লজ্জা লাগে। লজ্জায় ডুব দিতে মন চায়। শ্যাম মুখখানা লাল আভায় রাঙিয়ে ওঠে।
.
.
বিশ্বাস জিনিসটা কঠিন। বরফের থেকেও কঠিন বস্তু। সহজে লাভ করা যায় না। অন্তি প্রাণপনে চাইছে দোকানি তাকে বিশ্বাস করুক। একবার বিশ্বাস করলেই চলবে। অন্তি দোকানিকে বিশ্বাস করানোর জন্য তার শেষ অস্ত্র ব্যাবহার করলো। এটাই তার শেষ চাল। এতে কাজ না হলে আজ হয়তো তাকে দোকানের থালাবাসন মেজে টাকা শোধ করতে হবে।
দিহান তাকে উপেক্ষা করবে এটা অন্তি জানে। মানুষটা কখনো একটু ভালো করে তাকায় অব্দি না। তার কাছে অপশন হিসেবে আছে কেবল এবং কেবল মাত্র নুহাশ। দিহানরা তার থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়েছে। বয়স্ক এক লোকের সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে। মুখভঙ্গি খুব গম্ভীর। এটা নতুন কিছু না। অন্তির মতে দিহান এমন গম্ভীর কঠোর রূপ নিয়েই জন্মেছিল।
অন্তি হাত উঁচিয়ে নুহাশকে ইশারা করলো। একবার, দুবার, তিনবারের সময় নুহাশ তাকে দেখলো। নুহাশ তাকাতেই অন্তি হেসে হাত নাড়িয়ে হায় জানালো। উত্তরে নুহাশ ও হেসে হাত নাড়ালো। ব্যাস! অন্তির প্লান কাজে দিলো। এবার নিশ্চয়ই দোকানি তাকে সন্দেহ করবে না! অন্তি বাঁকা চোখে তাকালো।
দোকানি এক গাল হেসে বললো,
‘মাশআল্লাহ! বাবার লগে তোমারে ভালোই মানাবো।’
অন্তি লাজুক হাসলো। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বললো,
‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন চাচি।’
______________
সকাল সকাল মায়ের সাথে নানুর বাড়িতে হানা দিয়েছে অন্তি। এখানে আসার নূন্যতম ইচ্ছা না থাকলেও মায়ের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়েই এসেছে। অন্তির গ্রাম পছন্দ না। গ্রামের এই নিস্তব্ধতা তার ভালো লাগে না। তার মতো ছটফটে প্রাণ কি গ্রামের এই নিরব পরিবেশে চুপটি করে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে নাকি?
এই গ্রামের বাতাস সুন্দর। সতেজ। শহরের বাতাস বিষাক্ত। ধোয়া আর ধুলা মিশানো অস্বাস্থ্যকর বাতাস। গ্রামে এলে কেবল সতেজ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। তবে মনকে ধরে রাখা যায় না। মন বারবার উঁচু উঁচু দালানে ঘেরা শহরের এক মস্তো বড়ো গুন্ডার কাছে ছুট লাগায়। মন এত বেহায়া হলে অন্তির কি করার আছে?
অন্তির মায়ের দাদা জমিদার ছিলেন। বিশাল জমিদারি ছিলো তার। সে আমলের তৈরি বারোটা কক্ষবিশিষ্ঠ দোতালা বাড়িটা আজ ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তির নানা বাড়ির মানুষের মধ্যে জমিদারির ভাবটা আজ ও রয়ে গেছে। তাদের পোশাক আসাক, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতেই তার ছাপ পাওয়া যায়। অন্তির মা জমিদার ওয়াহেদুজ্জামানের একমাত্র মেয়ে। তিন ছেলের পর এক মেয়ে বলে খুব আদরেই বড়ো করেছেন মেয়েকে।
অন্তির বাবার পরিবার ছিলো হতদরিদ্র। অভাবে দিন কাটতো। অন্তির দাদু ছিলো পোস্ট অফিসের পিয়ন। অন্তি ওর বাবার কাছে শুনেছিলো তার দাদু সকল জমি বন্ধক রেখে ছেলেদের পড়াশোনা করিয়েছেন। এভাবেই তাদের উন্নতি। কিন্তু অন্তির মায়ের ব্যাপারটা ভিন্ন। তাকে অভাব ছুঁতে পারেনি। সোনার চামচ মুখে জন্ম তার। অভাব কাকে বলে তা সে জানে না। এই যে প্রতি মাসে তার নানু মেয়ের বাড়িতে মাসিক বাজার পাঠান। চাল,ডাল থেকে শুরু করে ক্ষেতের সবজি সহ নিজস্ব ঘেরের মাছ। এত এত বাজারের অর্ধেকটাই প্রিয় কাজের খালাকে দিয়ে দেওয়া হয়। অন্তির বাবার শশুরের এমন কান্ড পছন্দ না। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না।
বাড়িতে নানা নানু, আর মেজ মামা মামী ছাড়া কেউ নেই। বড়ো মামা মামী থাকেন অস্ট্রেলিয়া। বছর পাঁচেক হবে ওখানে পাড়ি জমিয়েছে। ছোট মামা মামী কুষ্টিয়া থাকেন। মামার বদলি ওখানে। বাদ রইলো মেজ মামা আর মামী। তারা এখানে থেকেই বাবা মার সেবা যত্ন করছে সাথে ব্যাবসা আছে মামার। ছেলে মেয়ে নেই। স্বামী, শশুর,শাশুড়ি নিয়েই মামীর জীবন চলছে।
অন্তির মেজ মামীকে ভিষণ পছন্দ। কেমন যত্ন নিয়ে মাথায় তেল মালিশ করে দেয়। কত রকম করে চুল বেঁধে দেয়! অন্তি মাঝে মধ্যে আহ্লাদ করে বল,
‘ইশশ! তুমি যে কেন আমার মা হলেনা!’
মেজ মামী তখন হাসে। শব্দ করে হাসে। বলে,
‘আমিতো তোমারই মা অন্তি!’
দেখতে দেখতেই কেমন বেলা পেরিয়ে গেল। আজ যেন সময় ফুরাতে চাইছে না। এক এক মিনিট যেন এক এক ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে। অস্থিরতায় কাবু অন্তি কল লাগালো তন্নিকে। মেয়েটা আজ কল ধরছে না কেন?
অন্তি ব্যাচে না গেলে সেদিন তন্নির জন্য ও বন্ধের দিন। আজ অন্তি নেই তাই সেও মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের সাথে তার অদ্ভুত টান আছে। ঘুম থেকে জেগে উঠলে তার আরো ঘুম পায়। ঘুমের হ্রেস কাটে ফোনের জগৎ কাঁপানো শব্দে। ঘুম ঘুম গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তেঁতে ওঠে অন্তি।
‘মরার মতো ঘুমাস? এদিকে আমার প্রাণ যাই যাই করছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে কেমনে ঘুমাচ্ছিস? মানে কেমনে পারিস!’
অন্তির কথায় চোখ মুখ কুঁচকে তন্নি বললো,
‘তুই কেমন পরিস্থিতিতে আছিস এত মাইল দূরে থেকে আমি কেমনে জানবো?’
‘ওসব জানা জানি বাদ। শোন! এখন বেড থেকে নেমে মুখ ধুয়ে একটা রিকশা নিয়ে সোজা কলেজ মোড় যাবি। ওখানে রাগি কুমরাটাকে পেলে তার নাম্বার নিয়ে আসবি। যেমনে হোক নম্বর চাই। বুঝতে পারছিস কেমন দমবন্ধ অবস্থায় আছি আমি!’
অন্তির কথায় ঘুম সুর সুর করে পালিয়েছে। এক লাফে উঠে বসেছে তন্নি। চোখে মুখে রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে বললো,
‘এমন করছিস যেন তুই গেলে উনি তোকে খেয়ে ফেলবে! আশ্চর্য!’
‘ছিঃ। নাউজুবিল্লাহ! এসব খাওয়া খাওয়ির কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না দোস্ত। তাও আবার কিনা জিজুর সাথে! ছিঃ!’
‘উফফ! নাট অফ কর। যাচ্ছিস তো?’
তন্নি এবার কিছুটা সিরিয়াস হলো। গলার স্বর নরমাল করে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,
‘দোস্ত! আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মানে উনার কাছে নাম্বার চাওয়া মানে বুঝতে পারছিস? আমি আমার কথা ভাবছি না। আমি জাস্ট তোকে নিয়ে চিন্তিত। এতদিনের ব্যাপারগুলো মেনে নিলেও এটা কেমন ভাবে দেখবে ভাইয়া আমি ভাবতে পারছি না। আরো একবার ভেবে দেখ!’
তন্নির কথা যুক্তিযুক্ত। অন্তির নিজের ও মনে হচ্ছে সে তার লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তার কি এবার থামার সময় এসে পড়েছে? তার মন আর মস্তিষ্ক একে অপরের বিরুদ্ধে চলতে চাচ্ছে। মন চাচ্ছে আরো বেহায়া হতে। সকল সিমা লংঘন করে দিহান নামক পাথরকে আকরে ধরতে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে থেমে যেতে। এ পথ তার জন্য নয়। পাথরে কখনো ফুল ফোটে না। আদেও কি তাই! দিহান নামক মানুষটা ছাড়া তার যে চলবে না। তার যে অন্তর পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে!
৪.
সাইকোলজি হিসেবে কোনো মানুষের মনে ঢুকতে হলে সর্বপ্রথম তার চিন্তা চেতনায় প্রবেশ করা দরকার। মানুষটা তোমায় নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই বুঝতে হবে মনে ঢোকার কাজটা সহজ হয়ে এসেছে। অন্তি এই কথাটার উপর ভিষণভাবে ফোকাস করছে। তার এসব রিস্কি কাজের কারণ দিহানের মনে কৌতুহল জমানো। কিন্তু আদেও কি মানুষটার মনে কৌতুহল জেগেছে? এটলিস্ট তার আচরণে তো তা বোঝা যায় না। অন্তি বিষন্ন মনে জানালার বাহিরে তাকালো। বিকেল নেমেছে। সূর্য ডুবতে বেশ বাকি। এই মুহূর্তে দিহানের সাথে দেখা হলে খারাপ হতো না।
এর মাঝে তার ডাক এলো। তার বাবা ডাকছে। বসার রুমে যেতেই সাহেদ মেয়েকে দেখে মুচকি হাসলো। কাছে ডেকে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
‘পড়াশোনা কেমন চলছে মা?’
‘ভালো বাবা।’
‘কোচিং এ যাচ্ছ না কেন? তোমার স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। তোমাকে যেতে বলেছেন।’
‘আমি ওখানে পড়ব না বাবা।’
‘কেন মা? কেউ কিছু বলেছে?’
অন্তি সাহেদের হাত জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
‘তোমায় তুলির কথা বলেছিলাম না? ঐ মেয়েটাও ওখানে পড়ে। স্যার ওর প্রতি এক্সট্রা কেয়ার নেয়। নিক! তাতে আপত্তি নেই। কথা হচ্ছে আমি কিছু প্রশ্ন করলে স্যার শুনেও এড়িয়ে যায়। বুঝিয়ে দেয় না।’
‘এটা তো খুব খারাপ কথা!’
‘হুম।’
‘কিন্তু সামনেতো তোমার পরীক্ষা। একটা টিচার বাসায় রেখে দেই?’
অন্তি চট করে উঠে বসলো। মিষ্টি হেসে বললো,
‘তার দরকার নেই। কলেজ মোড় এ একটা ব্যাচ আছে। হাকিম স্যারের ব্যাচ। ওখানে খুব ভালো পড়ায়। তন্নি ও ওখানে পড়ে। ওখানে ভর্তি হই?’
সাহেদ হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলেন,
‘তোমার যেখানে সুবিধা হয় তুমি সেখানেই পড়বে। আমি কখনো না করেছি?’
অন্তি দু পাশে মাথা নাড়ল। যার অর্থ কখনো না।
রুমে ফিরেই অন্তি মহা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তার দারুণ খুশি লাগছে। এই যে কাল থেকে নতুন ব্যাচে যাবে! ওখানে গেলেই দিহানের সাথে দেখা হবে। দিহান তো দিন রাত ওখানে বসেই আড্ডা দেয়। মাঝে মাঝে গায়েব হয়। কেন হয় জানা নেই। আপাতত ওসব ভেবে সময় নষ্ট করতে চাইল না সে। এই মুহূর্তে তন্নিকে কল করে এই সুখবরটা জানানো দরকার।
‘হ্যা বল।’
‘সুখবর আছে। কাল থেকে হাকিম স্যারের ব্যাচে যাচ্ছি।’
তন্নি ঠোঁট উল্টে বললো,
‘এতে সুখবরের কি হলো?’
অন্তি হাসলো। তার হাসি চোখ উপচে পড়ছে। হাসি আবার চোখ উপচে পড়ে নাকি? অন্তির পড়ছে। তার হাসির সাথে চোখ দুটোও হেসে উঠছে। এটাই চোখ উপচে পড়া হাসি।
‘আলবত সুখবর। ওখানে গেলেই দিহান মির্জা আমার চোখে বন্দি হবে। এটা অবশ্যই সুখবর।’
তন্নি হাসলো। এই মেয়েটা যে কি ভয়ংকর প্রেমে পড়েছে তা এক বাচ্চা শিশুও বুঝতে পারবে।
‘তুই যে এসব কান্ড করছিস আঙ্কেল জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?’
‘ধুর! কিভাবে জানবে?’
‘বাই এনি চান্স! যদি দিহান ভাইয়া বলে দেয়?’
অন্তির হাসি হাসি মুখ চুপসে এলো। ঐ রাগি কুমরোটা এমন কাজ করতেই পারে। অসম্ভব কিছু না। অন্তি গলার স্বর কঠিন করে বললো,
‘এমন করলে দিহান মির্জার মাথার চুল আমি একটা একটা করে ছিড়ব। সবার সাথে গুন্ডামি মাস্তানি করুক, সেটা আমি দেখতে যাচ্ছি না। আমার সাথে লাগতে আসলে আমি তাকে বুঝিয়ে দিব কত চালে কত ভাত হয়।’
____________
আজ অন্তি কলেজ যায়নি। ইচ্ছা করেই যায়নি। মাঝে মাঝে নিয়মের হেরফের করতে হয়। এই যে যেমন সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিকে ওঠে। এটা পুরো পৃথিবীর মানুষ জানে। এই নিয়ম চলছে পৃথিবী তৈরির পর থেকেই। তাই এ ব্যাপারে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। সূর্য উঠছে তার মতো উঠুক! কিন্তু হঠাৎ করেই যদি এই নিয়মের ব্রেক কষে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে তাহলে পুরো পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। সবার কৌতূহল বাড়বে। হাজার হাজার প্রতিবেদন তৈরি হবে। অন্তির মতে আজ যদি সে কলেজ নি যায় তাহলে দিহান অবাক হবে। তার আশপাশে উঁকি ঝুঁকি দেওয়া মেয়েটা হঠাৎ আজ গায়েব ব্যাপারটা তাকে ভাবাবে। না চাইতেও দিহান বাধ্য হবে অন্তিকে নিয়ে ভাবতে। বিজ্ঞদের মতো এসব ভেবেই আজ কলেজ পথে পা রাখেনি অন্তি। বিকেলে তাকে দেখে কেমন চমকাবে দিহান তা ভেবেই মিটিমিটি হাসছে সে।
‘খাওয়া রেখে পাগলের মতো ওমন হাসছিস কেন?’
নাহারের ধমকে হুস ফিরল অন্তির। সে বোকা চোখে মায়ের দিকে তাকাল। নাহার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। আজকাল মেয়ের হাবভাব তার কেমন যেন লাগে। অন্তি কিছু হয়নি এমন ভাবে গালে ভাত তুলল। নাহার একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর মামা কল করেছিল। মা নাকি অসুস্থ। একবার যেয়ে দেখে আসব।’
‘যাও।’
‘আমার সাথে তুই ও যাচ্ছিস।’
‘আমি কখন বললাম আমি যাব!’
‘তোকে কেন বলতে হবে? আমি বলেছি তাই যাচ্ছিস।’
অন্তির চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। সে এখন গ্রামে গেলে দিহানকে কিভাবে দেখবে?
‘কতদিন থাকবে?’
‘এই ধর দু একদিন। তোর বাবা বাসায় একা থাকবেন। তাই তাড়াতাড়ি চলে আসবো। তোর ও তো পড়াশোনা আছে।’
‘হুম।’
.
.
অন্তি আজ সুন্দর করে সেজেছে। আসমানী রঙের একটা কামিজ পড়েছে। সেলোয়ার আর ওড়না সাদা রঙের। কপালে কালো ছোট্ট টিপ পড়েছে। ঠোঁটেও হালকা লিপস্টিক দিয়েছে। চোখেও টেনেছে চিকন কাজলের প্রলেপ। সাজ শেষে আয়নায় ঘুরে বার কয়েক নিজেকে দেখলো। নিজেকে শুধালো,
এই সাজ কেবল দিহান মির্জার জন্য। লোকটা সকালে ওকে না দেখতে পেয়ে নিশ্চই অবাক হয়েছে। হয়তো একটু আধটু মিস ও করেছে। অন্তি যখন এই পরিপূর্ণ রূপে তা্য সামনে দাঁড়াবে তখন সে সকালের সামান্য বেদনা ভুলে যাবে। অন্তি তো মহৎ হৃদয়ের এক মহৎ প্রেমিকা। সে কি প্রেমিক পুরুষটাকে কষ্ট দিতে পারে? একদম না!
ব্যাচ শুরু হবে পাঁচটা থেকে। অন্তি ঠিক এক ঘন্টা আগে অর্থাৎ চারটায় ঘর থেকে বের হলো। হেলেদুলে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখা হলো মিলার সাথে। মিলা মাঝে মধ্যেই তাদের বাসায় আসে। তার মায়ের সাথে ভিষণ ভাব কিনা! ওকে দেখতেই মিলা বলে উঠলো,
‘কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’
অন্তি মুখ বাঁকালো। বললো,
‘হুম। ব্যাচে যাচ্ছি।’
‘সেকি! এত সেজেগুজে ব্যাচে যাচ্ছিস? আমি ভাবলাম বিয়ের দাওয়াতে যাচ্ছিস!’
অন্তি মহা বিরক্ত হয়ে মিলার দিকে তাকালো। ততক্ষণে নাহার ছোট ছোট চোখ করে মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন। বললেন,
‘ও তো ঠিকই বলেছে। এত সেজেছিস কেন?’
অন্তি বিরক্ত হয়ে বললো,
‘উফ মা এত কোথায় দেখছ? আর একটু সেজেছি তাতেই বা কি?’
পাশ থেকে মিলা বলে উঠলো,
‘বাড়ির মেয়ে কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে কি করছে তা তো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। চাচি তুমি একদিন ওর ব্যাচে যেয়ে খোঁজ খবর নিও তো। দিনকাল যা পড়েছে!’
এ পর্যায়ে অন্তির মন চাইলো মিলার চুল টেনে ধরে দুই গালে দুটো করে চারটা থাপ্পর লাগাই দিতে। কতবড় বজ্জাত মহিলা। নিজে সারাদেশ চড়িয়ে বেরায় সে বেলায়? এই তো দুদিন আগেই এক ছেলের সাথে রিকশা করে পুরো ঢাকা শহর ঘুরে এসেছৈ সেটা বুঝি সে জানে না? কিন্তু অন্তি এসব কথা গিলে ফেলল। এখন ঝামেলা করতে গেলেই দেরী হয়ে যাবে।
অন্তি আজ রিকশা নিলো। এখান থেকে হেঁটে যেতে পনেরো মিনিটের মত লাগবে। কিন্তু আজ হাঁটতে মন চাইছে না।
রিকশা ছুটতেই বিকেলের নরম রোদ এসে চোখে মুখে লেপ্টে পড়তে লাগলো। মৃদু বাতাসে খোলা চুল নিজের মতো করে উড়তে লাগলো। অন্তি বাঁধা দিলো না। উড়তে দিলো তাদের নিজের মতো করে।
দিহানদের বিকেলের আড্ডা জমে উঠেছে। তাদের মধ্যে শাহিন নামের একজন খুব শীঘ্রই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে। সেই খুশিতে মিষ্টি মুখ করা হচ্ছে। পাঁচ কেজি মিষ্টি আনা হয়েছে। তাদের খাওয়া শেষ হলে বাকি মিষ্টি সকল দোকানদারদের একটা করে দেওয়া হচ্ছে। নুহাশ রসিকতা করে বললো,
‘সারাদিন ভাই ভাই করিস আর সেই ভাইয়ের আগেই কিনা বিয়ের পিঁড়িতে বসতেছো। তুমি তো মামা আগাই গেলা! আমরাই পিছিয়ে আছি।’
শাহিন নামের ছেলেটা লজ্জা পেলো। তবে কিছু বললো না।
ঠিক সেই সময়ে অন্তির রিকশা এসে থামলো। নুহাশ সেদিকে তাকাতেই মুখ হাঁ হয়ে গেলো। এ কাকে দেখছে সে? আড় চোখে একবার দিহানের দিকে তাকালো। সে আপাতত সিগারেটে আগুন ধরাতে ব্যস্ত।
অন্তির আজ দিহানের সামনে দাড়াতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। লজ্জায় তার চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে একই জায়গায় সে দু মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো। নিজেকে ধাতস্থ করে সরাসরি দিহানের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বললো,
‘কেমন লাগছে আমায়? আপনার চোখে লাগার মতো?’
দিহানের সিগারেটে টান দেওয়া হলো না। হাত থেকে সেই কখন তা খসে পড়েছে তার ঠিক নেই। তার চোখ আটকে আছে কাজল টানা একজোড়া চোখের মাঝে। শুধুই কি তাই? ঐ কাঁপতে থাকা গোলাপী ঠোঁট জোড়া ও তার চোখকে বেহায়া করলো।
অন্তি তার কথা রিপিট করলো,
‘কেমন লাগছে আমায়?’
দিহান চোখ সরালো। ভারী গলার ঝংকার তুলে নুহাশকে বললো,
‘এই মেয়ে এখানে কেন?’
অন্তির মুখে আঁধার নামলো। চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো জল। এত অপমান? আজ অন্তত নুহাশ চায়নি দিহান এমন কঠোর আচরণ করুক। এমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটাকে বারবার প্রতাক্ষাণ কিভাবে করে দিহান? মায়া হলো তার ভিষণ।
অন্তি আর ওখানে দাঁড়ালো না। আর না কিছু বললো। মাথা নিচু করে বের হয়ে এলো। ব্যাচ আর একটু সামনেই। এখন অন্যদের ক্লাস হচ্ছে। অন্তি চাইলেও ব্যাচের ভেতর ঢুকতে পারবে না। লজ্জায় তার মাটিতে মিশে যেতে মন চাচ্ছে। কোথায় লুকাবে সে নিজেকে? চোখের জল ইতিমধ্যে গাল গড়িয়েছে। মানুষটা এমন পাথর কেন?
অন্তির পেছষ পেছন নুহাশ ও বেড়িয়ে এলো। এই প্রথম মেয়েটার চোখে পানি দেখেছে সে। তার খারাপ লাগছে। অন্তি ব্যাচের সামনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুহাশ পেছন থেকে ডাক দিল,
‘এই যে মিষ্টি ভাবী!’
নুহাশ হাসি মুখে এগিয়ে এলো। অন্তি মাথা নিচু করে নিলো। এখন তার আরো কান্না পাচ্ছে। নিশ্চই লোকটা তার মজা নিতে ভাবী বলে ডাকছে! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নুহাশ মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘দিহানের কথায় কষ্ট পেও না পিচ্চি। ও তো একটু অমনি। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘোরে। কিন্তু তুমি যদি কান্না থামাও আমি তোমায় একটা সিক্রেট বলতে পারি।’
অন্তি জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকালো। সিক্রেট জানার আগ্রহ চেপে রাখতে পারলো না। চটপট করে ওড়নার কোণে চোখ মুখ মুছে নিলো। তা দেখে নুহাশ হাসলো।
‘গুড গার্ল।’
‘সিক্রেট বলুন।’
নুহাশ তার হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আগে একটা মিষ্টি খাও। এত সুন্দর কথা মিষ্টি মুখ না করে বলা যাবে না।’
অন্তি না চাইতেও একটা মিষ্টি তুলে নিলো। নুহাশ তখন ফিসফিস করে বললো,
‘আমার মনে হয় দিহান মির্জা পা স্লিপ করেছে আমার মিষ্টি ভাবীর উপর!’
৩.
রূপন্তি যতই ছটফটে মাছ হোক দিহাকে দেখলেই তার বুক মুচড়ে ওঠে। এই বুঝি লোকটা তার দানবীয় হাতের থাপ্পর লাগিয়ে দিল। এই বুঝি হুংকার ছাড়লো। এমন চিন্তায় তার ভেতরের আত্মা শুকিয়ে আসে। সামনে অনেক সাহস দেখালেও ভেতরে কাচুমাচু হয়ে থাকে। এখনো তেমনটা হচ্ছে। এই যে লোকটা তার দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে কেমন করে তাকিয়ে আছে। রূপন্তির বুক কাঁপছে।
‘কে কার ভাবী এখনো বুজতে পারলাম না!’
নুহাশ হেসে রূপন্তির পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কন্ঠে রসিকতা ধরে রেখে বলল,
‘সেকি নিজের বউকে নিজেই চিনতে পারছিস না?’
ব্যাপারটা একটু বেশি গভীর হয়ে গেল না? রূপন্তি ফাঁকা ঢোক গিলল। লোকটা রেগে না যায়। কিন্তু দিহান রাগলো না। মুচকি হাসলো। শুধালো,
‘আমাকে কি খুব বেশি পছন্দ?’
এ যেন না চাইতেই মরুর বুকে টুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো শোনালো অন্তির(রূপন্তি) কাছে। সে তার বড় বড় চোখ দু তিন বার ঝাপটালো। দিহান তখনো উত্তরের জন্য তার দিকে তাকিয়ে। অন্তির মনে লাড্ডু ফুটলো। শ্যাম গালে লালা আভা ছড়ালো। মাথা উপর নিচ করে বললো,
‘ভিষণ!’
কথাটা বলেই সে দিহানের দিকে তাকালো। দিহানের রিয়্যাকশন দেখতে হবে না?
দিহানের মুখে আগের মতোই মুচকি হাসি। অন্তি চোখ বুজে নিল। খুন করে দিবে নাকি লোকটা? এভাবে কেন হাসে?
‘বেশ। নুহাশ ওর কাছে একটা খাতা আর কলম দে।’
অন্তির কপালে ভাঁজ পড়লো। ভালোবাসার সাথে খাতা কলমের কি সম্পর্ক? আশ্চর্য!
নুহাশ যেন এর জন্য প্রস্তুত ছিল। বলা মাত্রই ছোট একটা ডায়েরি আর কলম এগিয়ে দিল। চোখে মুখে তার লেপ্টে আছে হাসি। অন্তি সন্দিহান নজরে আড় চোখে দেখলো দিহানকে। সে আপাতত কালো রঙের বাইকটার উপর উঠে বসেছে। অন্তির ধৈর্য্যর বাঁধ ভাঙলো। সে চটপটে ভাবে বললো,
‘আপনার কি ভালোবাসার লিখিত ডকুমেন্ট চাই? সেটা আগে বললেই হতো। আমি বাসা থেকে সুন্দর করে লিখে নিয়ে আসবো কেমন? এখন চলি।’
এটুকু বলে বোকা হেসে অন্তি ছুট লাগালো। দিহানের চাহনি অন্তির একদম সুবিধার মনে হচ্ছে না। প্রেমে অন্ধ হলেও লোকটার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তো তার ধারণা আছে। এই ভয়ংকর লোক এমন মিষ্টি করে হাসছে মানে তার মাথার ভেতরের চিন্তা চেতনা কোনো ভয়ংকর ফন্দি আটছে। আপাতত এখান থেকে কেটে পরতে পারলেই বাঁচে সে। অন্তির মাঝে মধ্যে আফসোস হয়। দিহান কেন গোবেচারা টাইপের হলো না? হলেকি খুব ক্ষতি হতো? অন্তি তো তার খুব যত্ন নিত। রাজার আসনে বসিয়ে রাখত। দিনভর সেবা করত। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। দিহান একদম গোবেচারা ধরণের না। লোকটা নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘোরে। এত রাগ আসে কোথা থেকে? অন্তিয মন চায় দিহানের রাগের গোডাউনে আগুন জ্বেলে দিতে। জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক ঐ রাগ।
পেছন থেকে দিহান রেগে ডাক দিলো,
‘এই মেয়ে দাড়াও। এখনি থাম। পা ভেঙে রেখে দিব কিন্তু।’
কিন্তু ততক্ষণে অন্তি চলে গেছে সীমানার বাহিরে। দিহান প্রচন্ড রেগে গেছে। এতটুকু একটা মেয়ের সাহস দেখে রীতিমত সে অবাক। এত সাহস পায় কোথায় মেয়েটা?
এদিকে আশপাশের সবগুলো হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। নুহাশ পেট চেপে নিচে বসে পড়েছে। তার কাছে অন্তিকে চরম লেগেছে। এই মহল্লায় যে এমন একটা সাহসী মেয়ে আছে তার জানা ছিল না। তাহলে সে নিজ দায়িত্বে মেয়েটাকে খুঁজে তার বন্ধুর দায়িত্ব চাপিয়ে দিত।
_______________
অন্তিদের কলেজটা বেশ বড়। অনার্স পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা রয়েছে। ছেলে মেয়ে উভয়েই আছে কলেজে। সেই হিসেবে ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা ও অনেক। অন্তি এবার একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। বানিজ্য বিভাগে। অন্তির ক্লাসরুম তৃতীয় তলায়। ওজের ক্লাস সংলগ্ন জানালাটা থেকে কলেজ মোড়টা স্পষ্ট দেখা যায়। কোনো গাছপালা না থাকার দরুন সব একদম ফকফকা। জানালার পাশের বেঞ্চটা অন্তির জন্য বরাদ্দ। কলেজে এলে এই সিটটা তার। অন্যকেউ বসলে হামলা চালিয়ে হলেও আদায় করে ছাড়ে। আজ ও এক বিপত্তি ঘটেছে। দিহানের প্রশ্ন উত্তর পর্বের জন্য অন্তির পৌঁছাতে সামান্য দেরী হয়েছে। ফলস্বর জানালার পাশের বেঞ্চটা অন্যকারো দখলে চলে গেছে। তন্নি পেছনের দিকের একটা সিটে বসে আছে। সে ভেবেই নিয়েছিল আজ অন্তি আসবে না। কিন্তু অন্তিকে দেখে তার খুশি হওয়ার বদলে মুখ খানা আরো চুপসে এলো। জানালার পাশে আজ তুলি বসেছে। মেয়েটার সাথে তার বা অন্তির কারো সাথেই বোনাবুনতি পরে না। ওর বাবা এ কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। যে কারণে তার ভাব আকাশ সমান। পান থেকে চুন খসলেই খ্যাপা ষাঁড়ের মত গর্জে ওঠে। স্যারের মেয়ে হওয়ায় কেউ অযথা ঝামেলা করতে চায়না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে সর্বদা। কিন্তু আজ কি হবে? অন্তি তো দমে যাওয়ার মেয়ে না! তার তো ঐ সিট না হলে চলবেই না! তার গুন্ডা প্রেমিককে না দেখলে যে তার ছটফটানি বেড়ে যায়!
তন্নি ফাঁকা ঢোক গিলল। বেঞ্চ থেকে বেরিয়ে অন্তির কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে শুধালো,
‘দোস্ত আজ পেছনে বসি আমরা? আমার খুব পেছনে বসতে মন চাইছে। বসি?’
তন্নির কথা যেন শুনতে পায়নি এমন ভাব করে এগিয়ে গেল অন্তি। তুলির সামনে যেয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘তুমি কিছু মনে না করলে এই সিটটা আমি পেতে পারি?’
‘না।’
এমন জবাব আসবে সেটা অন্তি আগে থেকেই জানত। জানালা গলিয়ে বাহিরে চোখ যেতেই দেখলো দিহান তার ছেলেপেলের সাথে কিছু নিয়ে খুব গভীর আলোচনা করছে। চোখের সানগ্লাসটা স্থান পেয়েছে বুকে। যা শার্টের সাথে ঝুলে আছে। চোখ মুখে সিরিয়াস ভাব। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিসব বলছে। পাশেই সিরিয়াস মুখ করে নুহাশ মনোযোগ সহকারে সবটি শুনছে। খানিক বাদে মাথা নাড়িয়ে সায় জানাচ্ছে। অন্তি চোখ ঘুরিয়ে তুলির দিকে তাকালো। মেয়েটা গল্পের একটা বই মেলে বসে আছে। অন্তির রাগ হচ্ছে ভিষণ। কিন্তু রাগলে তো চলবে না। সে নরম গলায় বললো,
‘প্লিজ তুলি! ফ্রেন্ড হিসেবে এতটুকু সাহায্য কর প্লিজ। সামনের সিটটা ফাঁকা রয়েছে। তুমিতো রোজ ওখানেই বসো!’
‘তো? আজ আমি এখানে বসবো।’
কতবড় শয়তান মেয়ে ভাবা যায়? অন্তির বুঝতে বাকি নেই তুলি কাজটা শয়তানি করেই করেছে। ওর মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এদিকে তার হিরো আজ কিলার লুকে হাজির। কোথায় সে একটু মন ভরে দেখবে! কিন্তু এই বজ্জাত মাইয়া…
তন্নি পেছন থেকে অন্তির জামা ধরে টানল। করুণ সুরে বলল,
‘বাদ দে না দোস্ত! আজ একদিনই তো।’
ইতিমধ্যে ক্লাসে স্যার চলে এসেছে। অন্তি বাধ্য হয়ে পেছনে তন্নির পাশে ধপ করে বসে পড়লো। তার রাগের থেকে দুঃখ হচ্ছে বেশি। ক্লাসে মন বসলো না। পুরো ক্লাস উদাসীনতায় কাটলো। মাঝখানে দু তিনবার স্যারের ধমক খেতে হয়েছে। অন্তি বুঝে না, ঘুরেফিরে স্যার ওকেই কেন প্রশ্ন করে? ক্লাসে কি মানুষের অভাব আছে? আশ্চর্য!
______________
ভর দুপুরে গরম গরম চা খাওয়ার ব্যাপারটা আজাইরা মনে হয় নুহাশের কাছে। এই গরমে মানুষের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় সবাই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়ার জন্য ছটফট করছে সেখানে দিহান এই এক ঘন্টায় চার কাপ চা খেয়েছে। দোকানদার ছেলেটা অল্প বয়স্ক। এই বিশ কি বাইশ বছরের হবে হয়তো। নাম তামিম। দিহানের ডাইহার্ট ফ্যান। দোকানে আসলে ভাই ভাই করে পাগল বানাই ফেলায়। এই ব্যাপারটাও নুহাশের অসহ্য লাগে। মানুষ এত গায়ে পড়া টাইপ কেন হবে?
ইতিমধ্যে দিহানের চতুর্থ নম্বর কাপটাও ফাঁকা হয়ে পড়েছে। তারেক এগিয়ে এলো। এক গাল হেসে বললো,
‘ভাই আর এক কাপ দেই?’
দিহান কিছু বলার পূর্বেই নুহাশ চোখ নাক কুঁচকে ধমকে উঠলো।
‘এই গরমের মধ্যে আলগা ভালোবাসা দেখাইয়া কি মারতে চাইতাছোস?’
তামিমের মুখটা চুপসে এলো। ছোট করে বললো,
‘না ভাই।’
‘তাইলে আর এক কাপ দেই মানে কি?’
তামিম তার জায়গা থেকে কিছুটা পিছিয়ে গেল। মুখ কাচুমাচু করে বললো,
‘সরি ভাই।’
দিহান চুপচাপ সব দেখলো। হাত উঁচু করে বললো,
‘একটা সিগারেট দে তো।’
‘কোন ব্রান্ডের ভাই?’
কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো তামিম। আড় চোখে নুহাশের দিকে তাকালো। যে আপাতত চরম বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারিম বোকা হাসলো। বলল,
‘খালি ভুইলা যাই ভাই। দাড়ান এখনি দিতাছি।’
সিগারেট ধরাতে ধরাতেই দিহান দোকান থেকে বাহিরে বের হলো। সিগারেটে এক টান দিতে না দিতেই কেউ একজন তা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলল। এই ঘটনায় সবথেকে বেশি যে চমকালো সে হচ্ছে তামিম। তার চোখের সামনে এমন ঘটনা এখন পর্মন্ত ঘটেনি। সে বড় চোখ করে অন্তির দিকে তাকালো। এই মাইয়ার এত সাহস? ভাইয়ের সিগারেট টান মারে! কিছু বলার জন্য উদ্যোগ নিতেই নুহাশ তার হাত টেনে পাশে বসাই দিলো। এতক্ষণে নুহাশের মুখে হাসি ফুটেছে। তামিম অবাক হয়ে গেল। ভাইয়ের সাথে একটা মেয়ে বিয়াদপি করতিছে আর এই মানুষটা এইখানে বসে হাসতিছে! কতবড় বেইমান! তার ক্ষমতা থাকলে দিহানকে সে চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রাখত যাতে কেউ টোকা পর্যন্ত দিতে না পারে। কিন্তু তারতো ক্ষমতা নেই। তাই বিরস মুখে সামনে তাকালো।
এমন কথার পিঠে কি জবাব দিবে খুঁজে পেল না সে। নিজেই তাজ্জব হয়ে গেল এমন কান্ডে। একটা পুঁচকে মেয়ের কথায় কিনা তার জবান বন্ধ হয়ে গেল?
‘বলি আপনি কি চোখে পট্টি বেঁধে রেখেছেন? এইযে আপনার সামনে কিউট একটা মেয়ে ছোটাছুটি করে বেড়ায় আপনার নজরে পড়ে না?’
অন্তির এই কথার জবাবে দিহান বাঁকা হাসলো। কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
‘আমার চোখ কেবল আগুনে আটকায়। বাচ্চা, কিউট এসব আমার টাইপের না!’
অন্তি নাক কুঁচকালো। কিছুটা পেছনে সরে বললো,
‘আপনি কি খারাপ! ছিঃ ‘
‘এই ছোট ব্যাপারটা বুঝতে এত সময় লাগলো!’
অন্তি বুঝলো লোকটা তাকে বোকা বানিয়ে দূরে সরাতে চাইছে। এত সহজ নাকি? এই পাথরে ফুল ফুটিয়ে তবেই সে খান্ত হবে।
‘কিন্তু আমার এই খারাপ আপনি টাকেই ভালো লাগে। একদম ডেইরি মিল্কের মত। মন চায়…..’
অন্তি কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই দিহান ধমকে উঠলো,
‘যাবে এখান থেকে? নাকি থাপ্পর লাগাবো?’
অন্তির মুখটা চুপসে এলো। কথাটা এত জোরে বলার কি আছে?
সবাই মুখ টিপে হাসছে। বিশেষ করে তামিম। সে বেজায় আনন্দ পেয়েছে। অন্তির অপমান বোধ হলো। সে দু পা এগিয়ে দিহানের বরাবর দাঁড়ালো। জোর গলায় বললো,
‘আমাকে একদম এভাবে ধমকাবেন না। ভবিষ্যতে সংসারটা আমার সাথেই করতে হবে কথাটা মাথায় রাখবেন। খারাপ লোক একটা। আপনি ধমকালেও আমি আপনাকেই ভালোবাসব। একশো বার বাসব।’
কথা শেষ করেই ছুট লাগালো সে। আজ সে কষ্ট পেয়েছে। দিহান কেনো সবার সামনে এত জোরে ধমক দিবে? তার বুঝি খারাপ লাগে না?
এদিকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিহান। পেছন ফিরে নুহাশকে বললো,
২.
রূপন্তির জীবনে দীহানের আগমনটা অনেকটা ভাদ্র মাসের এক পশলা বৃষ্টির মতো। অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত তবে প্রতিক্ষিত। নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়ে উড়তে থাকা কিশোরী মনটা হঠাৎ করেই যেন এক পুরুষে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। চঞ্চল কিশোরী মনে প্রথম প্রেমের দোলা লাগে। প্রথম প্রেম হয় আবেগে মাখা। একরাশ মুগ্ধতায় ঘেরা। প্রেমিক পুরুষের সব কিছুই বাড়াবাড়ি রকমের ভালো লাগে। চোখে মুখে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। একটুতেই মন ভেঙে আসে। আষাঢ়ের বর্ষনের মতোই এক ছুটে জল জমে চোখে। আবার অল্পতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে মুখ। প্রেমের এ অনুভূতি গুলো ভয়ংকর। সব সময় কেমন তাড়া করে বেড়ায়। রূপন্তির বেলাতেও তেমনটাই ঘটেছে। তার কিশোরী মন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মাস ছয়েক আগে এক গম্ভীর কঠিন পুরুষ হরণ করেছে। এতদিন দূরে দূরে থাকলেও পাক্কা চার মাস পর তার মুখোমুখি হয়। আবেগের কাছে প্রেমিক পুরুষটির রাগ কঠোরতা যেন ফিকে হয়ে পড়েছিল। এজন্যই তো এক বুক সাহস নিয়ে অমন কান্ড ঘটিয়ে এলো। এরপর থেকে দিহানের সামনে যাওয়াটা নিত্যদিনের ঘটনা। কখনো অগচরে একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িনো কখনো বা চুরি করে তার সাথে সেলফি নেওয়া। এসব নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রূপন্তির মতে প্রেমে পড়ে তার মাঝে কিছু আধ্যাতিক শক্তি এসে পড়েছে। সেই শক্তি হলো সাহস। তার বুকে অসীম সাহস এর যোগান হয়েছে। নয়তো ওমন দানবের মতো মানুষের সাথে পেরে ওঠা কি যেমন তেমন কথা নাকি?
_____________
রূপন্তি নওয়াজ খান। সাহেদ নওয়াজ খানের একমাত্র মেয়ে। রূপন্তির আরো দুজন চাচা রয়েছে। সাহিন নওয়াজ খান এবং সাফিন নওয়াজ খান। একই বাড়িতে থাকলেও সবার পরিবার আলাদা ভাবে থাকে। ওদের বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট। যার নিচ তলায় থাকে চোট চাচা। ছোট চাচার ছোট একটা ছেলে আহান। বয়স সাত। বড় চাচা থাকেন তৃতীয় তলায়। তার দুই ছেলে মেয়ে মিলি আর মিলন। মিলন লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে বাপ চাচার ব্যাবসায় হাত দিয়েছে। আর মিলি রূপন্তির থেকে গুনে গুনে দু বছরের বড়ো। ইন্টার শেষ করে কলেজেই ইতিহাসে অনার্স করছে। রূপন্তির সাথে সবার বোনাবুনতি পরলেও মিলির সাথে তার কোনো সখ্যতা নেই। দুজনে দুজনের ছায়াও সহ্য করতে পারেনা টাইপ। এইযে আজ দুপুরে দেরিতে আসা নিয়ে যে ঝামেলা টুকু হল সেটাও মিলির জন্য। ও না বললে মা কি জানতে পারত?
বিকেল নেমেছে। রূপন্তির ঘুম ভাঙে পাঁচটা নাগাদ। দুপুরে নাহার অনেকবার এসে মেয়েকে ডেকে গেছে। সাড়াশব্দ না পেয়ে ফিরে গেছেন। কলেজ ড্রেস বদলে ডায়নিং এ যেতেই দেখলো টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা। রূপন্তি মুচকি হাসলো। তার মা টা একটু রাগ করতেও জানে না। রাগ করলে যত্ন নিতে হয় বুঝি?
.
.
দিহান মির্জা এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি রেজওয়ান মির্জার ছোট ছেলে। এলাকায় তার নাম ডাক অনেক। বড়ো ব্যাবসার সূত্রে উপর মহলের সাথে সখ্যতা রয়েছে বেশ। বড় ভাই রেহান মির্জা পেশায় একজন পুলিশ সুপার। হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি বড় ছেলে পুলিশ আর ছোট ছেলে আসামি!
এই মারামারি,ঝামেলার জন্য কতবার দিহানকে পুলিশ কাস্টাডিতে যেতে হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। তবে এক ঘন্টার বেশি কেউ তাকে আটকে রাখতে পারেনি। এ নিয়ে বাপ ভাইয়ের সাথে বেশ দন্দ রয়েছে দিহানের। বাহিরের মানুষ তো আর ঘরের কথা জানে না।
আজকাল ব্যাবসার কাজ একা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রেজওয়ান মির্জাকে। বয়স হয়েছে। আর কত? দুটো ছেলে থাকতেও তার জেন কষ্টের শেষ নেই। সোফায় বসে গা এলিয়ে দিতেই তার চোখ বুজে আসতে চায়। গলা উঁচিয়ে স্ত্রী রেহেনাকে ডাকেন।
স্বামীর কথায় রেহেনা কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই বাপ ছেলে কাউকেই সে বুঝত পারে না। কেউই তার কথা শোনে না। মাঝে মধ্যে তার দম বন্ধ লাগে। মন চায় সব ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে। এসব অশান্তি তার আর সহ্য হয়না।
রেহানা ভাবলো সে বলবে দিহান ঘুমাচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটা এখানেই চেপে যাবে। কিন্তু তার পরিকল্পনাকে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে দিহান এসে রেজওয়ানের সামনে বসলো। পায়ে পা তুলে দিয়ে শান্ত ও সুন্দর ভাবে বললো,
‘আপনি আমায় দেখতে চাচ্ছিলেন? দেখে নিন মন ভরে। আপনার মনের তৃষ্ণা না মেটা অবদি আমি এখান থেকে নড়ব না প্রমিস।’
রেহেনা অসহায় চোখে একবার স্বামী আর একবার ছেলের দিকে চাইল। মাঝে মধ্যে তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। এই বাপ ছেলের কারণে সত্যিই না সে পাগল হয়ে যায়।
দিহানের আগমনে রেজোয়ানের ভাবান্তর হলো না। সে পূর্বের ন্যায় চোখ বন্ধ করে রইলেন। দিহান তা দেখে বাঁকা হেসে বলল,
‘গত দু বছর ধরেই চেষ্টা করছো। লাভ তো কিছুই হলো না। একবার জোর খাটিয়ে আমার সাথে অফিসে চলো। দু একদিন গেলেই মন টিকে যাবে।’
‘আচ্ছা।’
‘যাচ্ছ তবে?’
‘ভেবে দেখব।’
এ পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিলেন রেজওয়ান। এত বড় ছেলেকে তো আর পিটিয়ে পিটিয়ে অফিসে নেওয়া যায় না। অবশ্য যদি সম্ভব হতো তিনি সেটাই করতেন। ছেলেটা যে তার মস্ত বড় বিয়াদপ। কোথায় তার এক ধমকে ছেলে চুপসে যাবে কিন্তু ঘটে তার উল্টোটা। কথা বলার সময় তার মাথা ভার হয়ে আসে। এই বুঝি ছেলেটা রেগে গেল। রেগে গেলেই বিপর্যায় নেমে আসবে। বুক কেমন দুরুদুরু করে। এগুলো মেনে নেওয়া যায়?
__________
রূপন্তির ঘুম ভাঙে কাক ডাকা ভোরে। এ সময় বাড়ির সকলে ঘুম থাকে। তার এই অভ্যাস হয়েছে দিহানের জন্য। দিহান রোজ ভোরে ওয়াক আউট করতে বের হয়। রূপন্তি ছাদে দাঁড়িয়ে দু মিনিটের জন্য দিহানকে দেখতে পায়। এই দু মিনিটের জন্য আধঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠে এক মগ কফি হাতে ছাদে চলে যায়। দিহানকে দেখার পিপাসা তার কিছুতেই কাটতে চায় না। মাঝে মধ্যে তার মন চায় দিহানকে ছোট কোনো কাঁচের বোতলে বন্দি করতে। তারপর সে সারাক্ষণ দিহানকে দেখবে। অমসৃণ খোঁচা খোঁচা দাড়ি যুক্ত গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিবে। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে আসে মুখ। চট জলদি দু হাতে ঢেকে ফেলে মুখ। এই মানুষটা তার কবে হবে?
দিহান আজ হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট আর ঢোলাঢালা টিশার্ট পরেই ওয়াক আউটে বের হয়েছে। এই সময়টা সে একা থাকে। দিনের এই সময়টা খোলা পরিবেশে একা দৌড়াতে ভালো লাগে তার। কেমন ফ্রেশ ফ্রেশ একটা ভাব আছে। অযৌক্তিক কোনো ঝামেলা নেই।
ছাদ থেকে রূপন্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখছে। একটা চুল ও যেন মিস না হয় তেমন ভাবে। এই যে সকাল সকাল দিহানের ঘুম থেকে উঠে আসা ফোলা ফোলা চোখ এটা তার ভিষণ পছন্দের। সারাদিন স্মোক করার পর সকাল বেলায় ঠোঁট দুঠোকে তার কাছে কিছুটা জীবন্ত মনে হয়। অযান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
‘ওরে আমার ডার্ক চকলেট। মন চায় টুপ করে খেয়ে নেই।’
কথাটা বলে নিজেই লজ্জায় মিইয়ে যায়। কিন্তু হাঁটু অবদি বের করা প্যান্ট দেখতেই মেজাজ চটে গেলো। লোকটা কি তার লোমশ সাদা পা দুটো মানুষকে দেখিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে? এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? এত সাহস কোথায় পায় সে?
এক প্রকার খারাপ মেজাজ নিয়েই রুমে ফিরলো রূপন্তি। এই লোকটার ফোন নম্বর থাকলে এতক্ষণে একগাদা কথা শুনিয়ে দিত সে। এসব লুতুপুতু স্বভাব তার একদম পছন্দ না। পা দুটো সুন্দর তাই বলে সবাইকে দেখাতে হবে? কোন ধরনের ম্যানারস্ এটা? অসহ্য!
.
.
কলেজে যাওয়ার পথে আজ দিহান বাদে বাকি সবাইকে দেখলো রূপন্তি। দিহানের গাড়িটির ও নেই আশপাশে। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সেদিকে পা বাড়ায় সে। এই লোক কোথায় গেল আজ?
‘দিহান মির্জা কোথায়?’
রূপন্তিকে এই গ্যাংয়ের প্রায় সকলেই চেনে। যেই মেয়ে দিহানের আশপাশে ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি করে তাকে না চিনলে হয়?
নুহাশ এগিয়ে এসে বলে,
‘দিহানকে দিয়ে কি কাজ?’
রূপন্তি ঠোঁট টিপে হাসে। শুধায়,
‘সব কাজ তো তাকে দিয়েই। ওসব সিক্রেট। বলা যাবে না। কেবল বলুন দিহান মির্জা কোথায়?’
‘তা তো বলা যাবে না। দিহানের নিষেধ আছে।’
রূপন্তির চোখ ছোট হয়ে আসে। এদের কথা বিশ্বাস করা কি ঠিক? এর মাঝে পাশ থেকে অপর একটা ছেলে বলে ওঠে,
‘এই মেয়ে! কি নাম তোমার?’
‘নাম দিয়ে কাম কি? ভাবী বলে ডাকবেন। যার আমার নাম জানা দরকার তাকে আমি ঠিক জানিয়ে দিব। আপনারা ভাবী বলে ডাকলেই চলবে।’
কথার মাঝেই পেছন থেকে রুক্ষ কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
‘কে কার ভাবী?’
কি ভয়ানক কন্ঠ! মুহূর্তেই গায়ে হিম ধরিয়ে দিয়েছে যেন। রূপন্তি এলোমেলো চোখে পেছনে তাকালো। দিহান এসেছে। আজ তার শরীরে এটে আছে নীল রঙের একটা শার্ট। বরাবরের মতো উপরের দুটো বাটন খোলা। শার্টের হাতা ফোল্ড করে কনুই পর্যন্ত তুলে রাখা। পেশিবহুল লোমশ ডান হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। সাদা হাতে কালো ঘড়িটা কেমন ফুটে উঠেছে। রূপন্তি ছোট করে ঢোক গিলল। তার চোখ জোড়া যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটা তো তার চরিত্র খারাপ করে দিবে! ঐইযে তার খোলা শার্টের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে লোমশ বুক। রূপন্তির নজর ওখানে যেয়েই আটকাচ্ছে। এতে দোষ কার? অবশ্যই দিহানের। তাছাড়া এই লোকটা সবসময় ওর বুকে আগুন লাগিয়ে দেয়। এইযে কেমন নেশাতুর চোখে তাকিয়ে আছে। এতেই রূপন্তির মনে আগুন জ্বলে উঠলো। কিন্তু হায়! এই আগুন নেভানোর যে কেউ নেই। রূপন্তির মাথায় চট করে একটা গানের লাইন মনে পড়লো।
১.
‘আপনার মনে হয়না, আপনার টুপ করে আমার প্রেমে পড়ে যাওয়া উচিত?’
দিহান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়। তার সামনে এক চঞ্চল কিশোরী মেয়ে দাড়িয়ে। পড়নে তার কলেজ ইউনিফর্ম। চুলগুলো বেণী করে দু কাঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ছে। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার স্বভাবের সাথে চোখ দুটোও ভিষণ চঞ্চল। দিহান চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। তার হাতে থাকা আধ খাওয়া সিগারেটটা কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখ চেয়ে থমথমে গলায় বললো,
‘কতবার না করেছি আমার সামনে আসতে? সোজা কথা কানে যায় না?’
দিহানের এই স্বল্প পরিসরের ধমক কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না কিশোরীর মনে। বরং সে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিহানের পাশে এসে দাঁড়ায়। তার মতো করেই গাড়িতে হেলান দিয়ে জবাব দেয়,
‘আপনি বললেই কেন দূরে থাকব? কাছে আসতে কি পারমিশন নিয়েছি? নেইনি তো! এখানে সব আমার মর্জিতে চলবে। যখন তখন কাছে আসবো। ইচ্ছে হলে টুপ করে চুমু খাব আপনার কি তাতে?’
দিহানের আশপাশে থাকা ছেলে পেলেরা ঠোঁট টিপে হাসছে। তাদের বসের জন্য তাদেরৎএই মেয়েকে বেশ পছন্দ হয়েছে। বসটা কেবল রাজি হলেই ভাবী কনফর্ম। কিন্তু তাদের এই আশা পন্ড করে রেষান্তিত কন্ঠে ধমকে উঠলো দিহান।
‘এই থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিব। চেনো আমাকে?’
রূপন্তি কিছুটা কেঁপে উঠে। এই লোক ভয়ংকর। ভয়ংকর তার রাগ। কেমন লাল হয়ে গেছে চোখ দুটো। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু এভাবে ভয় পেলে তার প্রেমটা কিভাবে হবে? সে কথা বলার জন্য হা করে কিন্তু দিহানের রাগি রাগি মুখ আর কুঁচকে থাকা কপালের দিকে চোখ পড়তেই হা টা গিলে ফেলে। জোর করে মুখে হাসি টেনে ছোট করে বলে,
‘আজ তবে আসি। অন্যদিন কথা হবে।’
দিহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উল্টো পথে পা বাড়ালো রূপন্তি। তার মনটি হুট করেই খারাপ হয়ে গেছে। লোকটা শুধু ধমকায়। এত ধমকানোর কি আছে? একটু সুন্দর করে হাসলে কি হয়? লোকটা শুধু তাকে দূরে সরাতে চায়। কছাটা ভাবতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। এভাবে মন খারাপ করে চলে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া। এভাবে শুরুতেই হার মেনে নিলে কিভাবে চলবে? তৎক্ষণাৎ সে পেছন ফিরে চাইল। দিহান চোখে রোদ চশমা পড়ে এক আঙ্গুল চাবি ঘোরাচ্ছে। পাশের ছেলেটাকে কিছু একটা বলে সে তার কালো রঙের গাড়ির দরজা খুললো। রূপন্তি জোর গলায় ডেকে উঠলো,
‘এই ভিলেন!’
দিহান চট করে সামনে তাকালো। কিছুটা দূরে হাসি হাসি মুখ করে রূপন্তি দাঁড়িয়ে। দিহান তার দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে তাকালো। কেবল না মেয়েটা মন খারাপ করে চলে গেল? তার দেওয়া ডোজের রিয়াকশন এত দ্রুত শেষ! দিহানকে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে রূপন্তি বা চোখ টিপে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ল। দিহান হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে। যেখানে মানুষ জন তার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলার সাহস পায় না সেখানে নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে কিস ছুঁড়ছে। সিরিয়াসলি?
দিহানের এমন গোবেচারা মুখ দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে রূপন্তি। মনের মাঝে এখন শান্তি লাগছে। এইতো সে পেরেছে। এই কঠিন মানুষটাকে পেতে হলে তাকে মানুষটার চিন্তা চেতনায় ঢুকতে হবে। তারপর নাহয় মনে ঢুকে দরজায় খিল লাগাবে!
‘এই এক ঘন্টা কোথায় ছিলি? মিলা তো সেই কখন বাসায় আসছে।’
রূপন্তি ঠোঁট জিভে ভেজাল। আপাতত তার মাথায় কোনো মিথ্যা আসছে না। এটা তার একটা সমস্যা। মন খুব বেশি ভালো থাকলে সে মিথ্যা বলতে পারে না। তার মিথ্যার ফ্যাক্টোরিতে তখন তালা পড়ে। অনেক কষ্টে স্বল্প হেসে বললো,
‘ফুচকা। মানে ফূচকা খাচ্ছিলাম আমি আর তন্নি। তাই দেরী হলো।’
নাহারের মেয়ের কথা একদম বিশ্বাস হলো না। সন্দিহান চোখে চেয়ে বললো,
‘তুইনা ফুচকা অপছন্দ করিস?’
রূপন্তি মাথা নাড়িয়ে না জানলো। স্বল্প হেসে বললো,
‘আমারতো ফুচকা ভিষণ পছন্দ। একদম দুই প্লেট খেয়েছি।’
নাহার আর মেয়েকে ঘাটল না। মেয়েটা তার বাঁদর হয়েছে। এত বড়ো ধিঙ্গি মেয়ে এখনো টৈটৈ করে চড়ে বেড়ায়। যত দোষ সব মেয়ের বাপের। বাপের আল্লাদেই তো এমন হয়েছে। রূপন্তি তার রূমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ না করেই শুয়ে পড়ে। তার মনের আকাশে পেজা তুলোর মতো প্রেমের ভেলা ভাসছে। বুকটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। বারবার শক্ত চোয়ালের কঠিন মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই মানুষটাকে সে প্রথম দেখেছিল কলেজ মাঠে। কোনো একটা ব্যাপারে প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল দুই দলের মধ্যে। সবাই যখন মারামারি করতে ব্যস্ত এই মানুষটা তখন গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত। কালো রঙের পাতলা শার্ট পড়নে ছিল তার। বুকের কাছের তিনটা বোতাম খোলা। পুরোই ব্যাড বয় টাইপ। কিন্তু তবুও কি ভিষণ আকর্ষণীয় লাগছিল। রূপন্তির নজর আটকে যায়। খানিক বাদে বাদে সিল্কি কালো চুল গুলো হাতে দিয়ে পেছনে ঠেলে দেওয়ার দৃশ্যটা যেন তার কাছে এক মুগ্ধকর চিত্রকর্ম মনে হচ্ছিলো। সেদিন না চাইতেও সে মুখ থুবরে এই ভয়ংকর মানুষটার প্রেমে পড়েছিল। এক কথায় ভয়ংকর প্রেম। তার এই ভয়ংকর প্রেমের কথা জানতে পেরে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু তন্নি আতংকিত হয়ে পড়লো। চোখে মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে বললো,
‘তোর এই প্রেমের এখানেই বিচ্ছেদ ঘটা। দোহাই তোর এই প্রেমকে ভুলেও প্রশ্রয় দিস না।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা? তার মনে ততদিনে পাকাপোক্ত ভাবে এই মানুষটা প্রেমিক হিসেবে সেট হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম সে লুকিয়ে মানুষটাকে দেখতো। আড়াল থেকে মানুষটার এলোমেলো চুল, খাড়া নাক, বাদামী চোখ আর ঐ কালচে পোড়া ঠোঁট গুলোকে নিরবে পর্যবেক্ষণ করতো। রূপন্তির মতে দিহান কোনো শিল্পীর তৈরি নিখুঁত শিল্পকর্ম। যা দেখলে কেবল দেখতে মন চায়। পিপাসা বাড়িয়ে দেয়। দিহান যখন স্বল্প ঠোঁট টেনে হাঁসতো প্রিয়ন্তি তখন বুকে হাত চেপে দেয়ালে মিশে যেত। কি ভয়ংকর সে হাসি! একদম তীরের মতো বুকে এসে লাগে। কিশোরী হৃদয়ে ঝড় উঠিয়ে দেয়।
এমন বেশ চলছিল। কিন্তু মাসখানেক আগে হুট করেই তিন দিনের জন্য মানুষটা গায়েব হয়ে যায়। সাথে গায়েব হয় তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কলেজ মোড়ের যে জায়গাটায় ওদের আড্ডা বসে যায়গাটা ফাঁকা পড়ে রয়। সাথে ফাঁকা হয়ে পড়ে অষ্টদশী এক কিশোরীর মন। বিষন্নতায় ছেয়ে ওঠে সব। দিনে দুপুরে যখন সময় পেয়েছে ছুটে এসেছে একপলক দেখার জন্য মানুষটাকে। কিন্তু দেখি পায়নি। এমন বেদনার মাঝেই কেটে গেল তিনটি দিন। বিরহ বেদনায় তখন কিশোরী মন নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে। যাকে না দেখে এক বেলা কাটে না তাকে না দেখে তিনটা দিন পার করা কি যেমন তেমন কথা? এই তিনদিনে রূপন্তি বদলে গেলো। চোখের নিচে কালি পড়ে গেল। প্রেম শুরু হওয়ার আগেই হৃদয় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে তার। ঠিক সেদিন কলেজে যাওয়ার পথে আবারো পরিচিত মোড়ে পরিচিত মুখ দেখে থমকে যায় সে। আবেগে চোখে পানি চলে আসে। সাথে কিছুটা রাগ ও হয়। হুট করে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার মানে কি? এই রাগ আর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরেই মুখোমুখি হয় দিহানের। সে তখন খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু করছে। রূপন্তি সামনে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা তার নজরে আসেনি। এই ছোট্ট ঘটনায় রূপন্তির মেজাজ মুহূর্তেই খারাপ হয়ে যায়। সে ভয়ংকর এক কাজ করে বসে। চট করে দিহানের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে সবাই রিয়্যাকশন দিতে ভুলে যায়। কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। এর মাঝে একটা ছেলে জিভ কামড়ে অন্যজনকে বলে,
‘এই মাইয়া আজ শেষ। সাহস দেখছিস? ভাই আজকে ওর হাতটাই না ভাইঙ্গা রাখে।’
অপরজন ও সহমত জানায়। নুহাশ দিহানের পাশেই ছিল। সে কেবল পানি মুখে দিয়েছিল। কিন্তু এমন কান্ডে পানি আর গলা দিয়ে নামলো না। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে।
রূপন্তি ওসবের ধার ধারলো না। সে সরাসরি দিহানের চোখে তাকালো। শান্ত ভাবে প্রশ্ন করলো,
‘এই তিনদিন কোথায় ছিলেন?’
দিহান তখনো তার বিষ্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একটা মেয়ে এসে তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো আবার তাকেই প্রশ্ন করছে এই তিনদিন কোথায় ছিল সে? এটা কি আদেও স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার? এই বিষ্ময় ভাবের জন্যই অযান্তে সে ছোট করে উত্তর দিলো,
‘একটু কাজ ছিল।’
এ পর্যায়ে নুহাশ যেন আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো। সে কি ঠিক শুনলো? দিহান উত্তর দিলো? কোই সে যখন কছু জিজ্ঞাস করলে তো এমন ভাবে তাকায় যেন এখনই টুপ করে গিলে ফেলবে। কখনো দশবার বলেও একটা উত্তর পাওয়া যায় না। তবে এখন? এখন সে কাকে দেখছে?
‘বেশ। তবে এখন থেকে কোথাও যাওয়ার হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। চিন্তা হয়না বুঝি?’
এতক্ষণে দিহান তার বিষ্ময় কাটিয়ে বের হয়। একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চটপটে ভাবে কথা বলছে দেখতেই বেশ অবাক সে। সাথে কিছুটা বিরক্ত ও। রূপন্তির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে গম্ভীর গলায় শুধালো,
‘এখানে কি চাই?’
রূপন্তির সাবলীল জবাব,
‘আপনাকে চাই।’
এমন কথায় সবার হুশ উড়ে গেল। নুহাশ শুকনো ঢোক গিললো। মনে মনে রূপন্তির জন্য প্রার্থনা করলো। প্রেম করার জন্য দেশে কি মানুষের অভাব পড়ছে বোন? কথাটা বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। মুখের মাঝেই আটকে রইল। এ পর্যায়ে দিহান চোখ তুলে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে দাঁত চেপে বলল ,
‘এক থাপ্পর দিব। ফাজলামি করো?’
রূপন্তি একটু ভয় পেল। যতই হোক এই লোকতো আর পাঁচটা মানুষের মত স্বভাবিক না। তিনি অসাধারণ। তার এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য এ মুহূর্তে তার গালে দুই একটা থাপ্পর পড়তেও পারে। বলা যায় না। রূপন্তি কিছুটা ভিতু হয়। মনে মনে আল্লাহর নাম জপে। কিন্তু তবুও মুখে হাসি টেনে বললো,
‘তা কেন? প্রেমে পড়লে মানুষ থাপ্পর খায় শুনেছেন কখনো? আপনি চাইলে চুমু খেতে পারেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি সেটা ভালো দেখায়? ওটা নাহয় আরো কিছুদিন পরে হবে!
এখন আসছি। কলেজ টাইম হয়ে গেছে।’
কথা গুলো বলে এক প্রকার ছুটে পালায় সে। এসব কথা বলে দিহানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানে নিজেকে বলির জন্য নিজেই সঁপে দেওয়া। সে কি অত পাগল নাকি? প্রেম করার আগেই থাপ্পর খেলে প্রেম প্রেম মুডটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সে প্রচন্ড সচেতন।
#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৯
,
একের পর এক প্রমাণ এসে পৌঁছেছে মিডিয়ার হাতে। মন্ত্রী আশফাক মির্জার বিরুদ্ধে। দেশ থেকে লাখ লাখ টাকা বাইরের দেশে পাচার সহ অবৈধ অস্ত্র দেশে আনা ড্রাগস এর ব্যাবসাসহ নারী পাচারের মতো যঘন্য কাজের সাথে ওনি জড়িত। মোট কথা মন্ত্রী পদের বেশ ভালো সুযোগই নিয়েছেন ওনি। ওনার সাথে যারা যারা ছিলো সবাই ধরা পড়েছে। তবে ওনার বোন মালবিকা মির্জা পালিয়েছে। এখনো তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পুলিশ টানতে টানতে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। জনতা রাগে ক্ষোভে ওনার বাড়ি ভাঙ্গচুর করেছে। পুলিশ তাকে জিপে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। সমুদ্র সেই গাড়ির দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।
“স্যার আপনার কি মনে হয় ওনি ওনার প্রাপ্য শাস্তি পাবে? যদি টাকা খাইয়ে আবার বেরিয়ে আসে তাহলে?
ইমরান এর কথাশুনে সমুদ্র বাঁকা হাসলো। বুকে গুঁজে রাখা হাতটা ইমরানের কাঁধে রেখে বলল।
” তুমি একটু বেশিই ভাবো সব বিষয়ে ইমরান। সব কাজ তো শেষ হলো এবার তোমার একটা বিয়ে দেওয়ার পালা।
সমুদ্রের কথাশুনে ইমরান লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল।
“এখনো সব কাজ শেষ হয়নি স্যার আরো একটা কাজ বাকি আছে।
ইমরান এর কথাশুনে সমুদ্র কিছু বলল নাহ। ইমরান এর থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল।
” যাওয়া যাক?
ইমরান সমুদ্রের কথামতো গাড়িতে উঠে বসল। তাদের গন্তব্য শহরের বাইরে। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে।
,,,,,,,,,,,,
অন্ধকার একটা রুম। বাইরে থেকে একটু আলোও ভিতরে আসার কোনো ব্যাবস্হা নেই। ঘরের মধ্যে অবস্থান করলে বাইরে দিন নাকি রাত সেটা জানাও যেনো অসাধ্য। হঠাৎ শব্দ করে রুমের দরজাটা খুলে গেলো। ফাঁক পেয়েই যেনো বাইরের তেজী সূর্যের আলোটা লাফ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। ধূলোমাখা শাড়িতে উষ্কখুষ্ক চুলে হাঁটুতে মাথা গুঁজে কেউ রুমের মধ্যে বসে আছে। রুমের মধ্যে আলো এসেছে এটার আভাস পেয়েই মাথা তুলে সেদিকে তাকালো। চোখের সামনে চার জোড়া পা এসে থামলো। মালবিকা মাথা তুলে সামনে আসা ব্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে কর্শক কন্ঠে বলল।
“মৃত্যু কেনো দিচ্ছো না আমায়?
” দেখেছেন স্যার এতো কিছুর পরেও এই মহিলার তেজ এখনো কমেনি। কেমন আপনার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছে। মনে চাইছে এখনি একটা রড দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে দিই।
ইমরানের কথা শুনতেই মালবিকা ইমরানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। যেনো ইমরানকে উষ্কে দিতে চাইছে। সমুদ্র এক ধ্যানে মালবিকার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পর বলল।
“মৃত্যু? এটা তো আমার হাতে নেই। এটা একমাত্র একজনের হাতেই আছে। আর আপনার যখন সময় হবে ঠিক তখন মৃত্যু আপনার সম্মুখে এসে দাঁড়াবে। তবে হ্যাঁ আপনাকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া আমার হাতে না থাকলেও শাস্তি তো দিতেই পারি। আর আপনার শাস্তি হলো এটা। এই অন্ধকার ঘর। এখানে বসে প্রতিটা মিনিট, সেকেন্ড, ঘন্টা আপনি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবেন। বুঝতে পারবেন মৃত্যু না হয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণা টা কত কঠিন। এটাই আপনার শাস্তি।
কথাগুলো বলে সমুদ্র বেরিয়ে আসলো। সমুদ্রের পিছন পিছনে ইমরান ও বেরিয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে রুমটা আগের ন্যায় অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। তবে সেই অন্ধকার থেকে মালবিকার আহাজারি শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে সমুদ্রের কাছে মৃত্যু ভিক্ষা চাইছে। কিন্তু সমুদ্র তার কান অবধি কথাটা পৌঁছাতেই ভিতরে কেমন একটা পৈচাশিক শান্তি অনুভব করছে। গাড়িতে গিয়ে বসতেই ইমরান সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল।
” স্যার এবার কোথায় যাবো?
“রৌদ্রের কাছে।
,,,,,,,,,,,
কাঁচা বাঁশের কাবাড়ি এখনো কেমন নতুনই আছে। নতুন থাকবেই বা না কেনো কদিনই বা হলো। এই তো সেদিনকার কথা রৌদ্রকে ছোটো দুটি হাতে সমুদ্র নিজের কোলে তুলে নিয়েছিলো। ছোটো নরম দেহটা বড় ভাইয়ের উষ্ণতায় কেমন চুপ করে টুকুর টুকুর চোখে তাকিয়ে ছিলো সমুদ্রের দিকে। গাড়ি থেকে নেমে অযু করে সোজা রৌদ্রের কাছে চলে এসেছে সমুদ্র। কবরের পাশে বসে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে নরম কন্ঠে বলল।
” তোর বাবাকে মনে আছে? হয়ত আছে। বাবাকে তো খুব অল্প সময়ই পেয়েছিস। আর জয় তো বাবাকে দেখেইনি। এই দুই হাতে তোদের দুটোকে মানুষ করেছি। বকেছি শাসন করেছি আবার ভালোও বেসেছি। দুটোর একটাও কখনো আমার কথার অবাধ্য হোসনি যখন যা বলেছি তাই শুনেছিস। তাহলে আজকে এতো অবাধ্যতা কেনো? এতো করে ডাকার পরেও কেনো আমার কথা শুনছিস নাহ। তুই কবে কবে এতো অবাধ্য হলিরে রৌদ্র? কথা ছিলো আমরা তিন ভাই মাকে সব সময় খুশি রাখবো। বাবা তো মাকে একা ফেলে চলে গেলো। কিন্তু তুইও যে এভাবে মাঝ পথে হাত ছেড়ে বাবার মতো চলে যাবি ভাবিনি। হ্যাঁরে সব দায়িত্বই কি আমার একার? তোর কোনো দায়িত্ব নেই? সেই ছোটোবেলা থেকে একা হাতে সবটা সামলে আসছি। আর কত? আমারও তো বয়স হচ্ছে এতো কষ্ট আমি আর নিতে পারছি নাহ। তোর উচিত নয় কিছু দায়িত্ব নেওয়া? এভাবে বড় ভাইয়ের কাঁধে সবটা দায়িত্ব দিয়ে কি আরামেই না ঘুমিয়ে আছিস। যেনো কোনো চিন্তা নেই।
দায়িত্বশীল শক্ত সার্মথ্য অফিসার টাও আজকে যেনো অবুঝ বাচ্চা হয়ে গেছে। জানে রৌদ্র ফিরবে নাহ তবুও পাগলের মতো রৌদ্রকে ডেকে যাচ্ছে। এই শক্ত মানুষ টাও যে এভাবে কাঁদতে পারে তা সকলের অজানায় বটে। শরীলটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎই সমুদ্রের কাঁধে কেউ হাত রাখলো। সমুদ্র তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে পিছন ফিরে তাকালো। শশী দাঁড়িয়ে আছে। চোখে টলমল করছে পানি। শশী কে দেখেই সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে রাগী সুরে বলল।
“তোমাকে এখানে আসতে কে বলেছে? আর এই অবস্থায় সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমেছো কেনো?
” আর একটু কান্না করুন নাহ। তাহলে নিজেকে হালকা লাগবে। নয়ত গুমরে গুমরে ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাবেন।
“আজকাল বড় বেশি কথা বলতে শিখে গেছো এতো কথা শিখেছো কোথায়?
কথাটা বলেই সমুদ্র শশীকে কোলে তুলে নিলো। শশীও দুই হাতে সমুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে সমুদ্রের শক্ত গালে নরম ঠোঁটের চুমু দিয়ে মুচকি হেসে তাকালো। সমুদ্র সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল
” দিন দিন এতো ভারি হয়ে যাচ্ছো একটু কম কম করে খেতে পারো নাহ?
সমুদ্রের কথায় শশী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“হ্যা নিজেই রাতদিন ঠুসে ঠুসে খাইয়ে মোটা বানিয়ে এখন খোঁটা দিচ্ছেন। আর আপনি কী আমায় একা কোলে নিয়েছেন নাকি। আমাদের দুজন কে একসাথে কোলে উঠাছেন তাই এমন হচ্ছে।
সমুদ্র কিছু বলল নাহ চুপচাপ সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।
,,,,,,,,,,,,,,
পুরো রুম জুড়ে রঙ তুলি আর কগজ দিয়ে ভর্তি। মেঝেতে রঙ বেরঙের বতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। কোথাও কোথাও কাগজে পেন্সিল দিয়ে কিছুর অর্ধেক এঁকে সেটা ফেলে দেওয়া হয়েছে। টুকরো টুকরো করে বেশ কাগজ জমা হয়েছে মেঝেতে। যে কেউ এক দেখায় চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে এই রুমের মালিক আঁকতে বেশ ভালোবাসে। জোনাকি রুমের সামনে এসে হতাশ চোখে নিচে তাকালো তারপর কমরে হাত রেখে রুমে ঢুকতে ঢুকতে সামনে ক্যানভাসে কিছু আঁকতে থাকা সাত বছরের একটা ছোট্ট মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল।
” তোকে পেটে নিয়ে তোর মা যেসব কান্ড করেছিলো। আমিতো ভেবেছিলাম তুই বড় হয়ে হয়ত কোনো পুলিশ বা আর্মি হবি। কিন্তু তুইতো দেখি পুরো উল্টো।
কথাটা শুনেই জোনাকির বেষম লাগল। পরক্ষণেই মনে পড়লো কালকে রাতেই সমুদ্র বাড়ি এসেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর সামনে থাকা অফিসার সমুদ্রের একমাত্র কন্যা অথই যা বলল তাতে জোনাকির কান গরম হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে অথইকে বলল
” এই সব বলতে হয় নাহ সোনা। আর এসব তোকে কে বলেছে?
“কে আবার ছোটো চাচ্চু বলেছে।
অথই মুখ থেকে কথাটা শুনতেই জোনাকি মুখ বাঁকিয়ে ফেলল। বিরবির করে বলল।
” নিজেতো গোল্লায় যাচ্ছেই সাথে এটা কেও নিয়ে যাচ্ছে।
“মনে হয় আমার নামে কেউ সুনাম করছে। আসলে কেউ মনে মনে আমার নামে সুনাম করলেও তা আমার কানে ঠিকি চলে আসে।
পিছন থেকে জয় কথাটা বলতেই জোনাকি পিছন ফিরে তাকালো। জয়কে দেখেই অথই দৌড়ে গিয়ে জয়ের কাঁধে ঝুলে পড়লো। জয়ও অথইকে নিজের কাঁধে নিয়ে বলল।
” আম্মা আপনি এসব মূর্খদের সাথে কথা বলেন কেনো? আপনার খালামনি কি আর্ট সম্পর্কে কিছু বুঝে নাকি। আমি বলছি আপনি একদিন অনেক বড় আর্টিস হবেন। আর ওই ঘরে আপনার মায়ের যেই ছবিটা আছে ঠিক তার মতোই আপনিও একদিন আঁকতে পারবেন।
নিজের সম্পর্কে এমন কথাশুনে জোনাকি রেগে জয় এর দিকে তাকালো। তেড়ে গিয়ে আঙুল উঠিয়ে বলল।
“নিজে কি হ্যাঁ কুমড়ো পটাস একটা খেয়ে খেয়ে নিজেকে হাতির মতো বানিয়েছে।
” এই হ্যালো মিস আস্তে একটু থামুন। এই যে ম্যাসেল দেখেছেন? এইটা দিয়ে একটা মারলেও না আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাবে নাহ। নিজে কি মুটকি একটা।
” তুই, ধ্যাত আমি থাকবোই নাহ। এই বাসায় আসায় আমার ভুল আমি আজকেই চলে যাবো। সমুদ্র ভাইয়া কে বলবো আমাকে দিয়ে আসতে।
রাগে রাগে কথাটা বলেই জোনাকি বেরিয়ে গেলো। জয় অথইকে কাঁধ থেকে নামিয়ে সামনে দাঁড় করালো। জোনাকির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে অথই এর দিকে তাকালো।
“খালামনি রাগ করলো কেনো চাচ্চু?
” আরে বাদ দেন আপনার খালামনি তো মাসের এিশ দিনের একএিশদিনই রেগে থাকে।
“আচ্ছা চাচ্চু ওই ঘরে যে আম্মুর বড় একটা ছবি ওটা বড় চাচ্চু এঁকেছিলো তাই নাহ?
” হুম আম্মা.
“আমিও একদিন ঠিক বড় চাচ্চুর মতো আঁকা শিখবো। এখন তুমি যাও তো আমাকে আমার কাজ করতে দাও আমার কত কাজ বাকি এখনো। কথাটা বলেই অথই পুনরায় নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। জয় সেদিকে তাকিয়ে হেঁসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
,,,,,,,,
” কবে আসা হবে শুনি।
“কেনো কেউ কি আমায় মিস করবে বুঝি।
” হু মিস করতে বয়েই গেছে।
ছাঁদে রেলিং এর উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো জোনাকি। তখনি জয় এসে জোনাকির পাশে দাঁড়ালো। জয়কে দেখে জোনাকি কথাটা বলে চুপ হয়ে গেলো। কেউ কোনো কথা বলল নাহ। খানিকক্ষণ নিরবতার পর জয় আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল।
“কেউ যদি আমার জন্য অপেক্ষা করে তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আর অপেক্ষা যদি না করে তাহলে ফিরে এসে কি লাভ।
” কত দিনের এটা?
“আমার জানা মতে হয়ত বছর খানিক লাগবে।
” এতোগুলো দিন না দেখে থাকতে পারবে বুঝি মানুষ।
জোনাকির কথাশুনে এবার জয় হেসে ফেলল। পাশে এক পা টেনে জোনাকির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল,
“ম্যাডাম আপনার বোনের বর বলেছে কোনো চাকরি না পেলে তার শালিকার জন্য এই অধম অযোগ্য তাই জন্যই তো এতো অপেক্ষা। তবে আমার জানামতে অপেক্ষায় ফল মিষ্টি হয়।
“অপেক্ষা করবো ফিরে আসার। ফিরে না আসলে একদম মেরে ফেলবো।
” এই কুঁমড়ো পটাস তো সেই কবেই এলিডির প্রেমে মড়ে ভূত হয়ে গাছে গাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
জয়ের কথা শুনতেই জোনাকি হেসে ফেলল। জয়ও মুচকি হেসে তার প্রেয়সীর হাসি মুখের দিকে চেয়ে থাকলো।
,,,,,,,,,,,,
“কেবল তো কালকেই আসলেন এতো শীঘ্রই চলে যাবেন কেনো?
” কেনো আদর কম হয়েছে বুঝি? আর তাছাড়া আমি এখনো এক সপ্তাহ থাকবো চিন্তা নেই এই এক সপ্তাহের একদিনও বাদ দেবো নাহ আদর করতে।
সমুদ্রের কথাশুনে শশী সমুদ্রের বাহুতে মাড়লো। এখন রাতের মধ্যে অংশ চলছে। ভালোবাসাবাসির শেষে সমুদ্রের খালি বুকে শুয়ে ছিলো শশী। তখনি কথাটা বলল সমুদ্র।
“এবার যাওয়ার সময় জয়ও যাবে ওর ট্রেনিং শুরু হবে।
সমুদ্রের বুক থেকে মাথা তুলে সমুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে শশী বলল, আমার কি মনে হচ্ছে বলুন তো অথই তো তবুও আপনাকে আব্বু ডেকেছে। কিন্তু এইবার যেটা আসছে সে আর আপনাকে আব্বু ডাকবে নাহ। সোজা দাদু ডাকবে৷ দিন দিন তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন।
” কিহ এতোবড় কথা। তোমার কি মনে হয় আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি? এই যে একটু আগে তোমাকে এতো আদর করলাম তোমার কি মনে হয়েছে যে আমি আর আগের মতো আদর করতে পারি নাহ।
“ছিঃ কি সব কথা বলেন।
” তো? গভীর রাত এক কাঁথার মধ্যে দুজন স্বামী স্ত্রী একজনের শরীর অন্যজনের সাথে লেপ্টে আছে। ভিতরে ভালোবাসার উন্মাদনা। এই রকম মুহুর্তে এই সব ছিঃ মার্কা কথা বলবো নাতো নীতি কথা বলবো? তাহলে সরি বস আমি সাধু সন্নাসী নয়।
“এই আপনি আর ভালো হলেন নাহ।
” আমি যদি ভালো হয়ে যায় না তাহলে আর বছর বছর মা ডাক শুনতে পাবে নাহ।
“ধূর আপনার সাথে কথা বলায় বেকার ছাড়ুন আমায় ঘুমাবো।
” তো কথা বলতে বলেছে কে। এখন কি কথা বলার সময়? এখনতো অন্য কিছু করার সময়। আর কিসের ঘুম এতোদিন পর বউয়ের কাছে আসলাম রাতে নাক ডেকে ঘুমানোর জন্য নাকি।
“আচ্ছা আপনার কাজের ওখানে জানে তাদের রাগী গম্ভীর স্যার কত বেফাঁস আর বেহুদা কথা বার্তা বলে।
” ওদের স্যার ওদের সাথে যেভাবে কথা বলার প্রয়োজন সেভাবেই বলে। আর রাতের অন্ধকারে বউয়ের সাথে যেভাবে কথা বলা দরকার সে ভাবেই বলছে। এই কথা না বলে চুপ থাকো আমাকে আমার কাজ করতে দাও৷ আর পারলে একটু আমার সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে সাহায্য ও করো।
কথাটা বলেই সমুদ্র ওর সবচেয়ে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনি কে ভালোবাসতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো। এই রাত যে ভালোবাসার রাত। এক সময় রাত ফুরিয়ে যাবে দিনের আলো ফুঁটবে কিন্তু সমুদ্রের তার অর্ধাঙ্গিনি কে ভালোবেসে ফুরাতে পারবে নাহ।
#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৮
,
সাদা কাফনের কাপড়ে সুন্দর করে মুড়িয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে রৌদ্রকে। একে একে সবাই আসছে দেখে আহাজারি করছে। শাহানারা কান্না করতে করতে যেনো চোখের পানি ফুরিয়ে গেছে। জয় এখনো হসপিটালের বেডে। শশী মোটামুটি সুস্থ। তবে এখনো শরীর দুর্বল। শাহানারা কে সমুদ্রের কথা এখনো জানানো হয়নি। এক ছেলের শোকেই কেমন পাথর হয়ে গেছে। আরেক ছেলের মৃত্যুর কথা সয্য করতে পারবে নাহ। সকাল দশটা নাগাদ জানাযা। পুলিশ ড্রাইভার দুজনকে এ্যারেষ্ট করেছে। এখনো তদন্ত চলছে। এটা শুধুই এক্সিডেন্ট নাকি অন্যকোনো চক্রান্ত। শশী শাশুড়ী কে শান্তনা দিচ্ছে। এখনো ও বা ইমরান কেউই মুখ খুলেনি। আগে রৌদ্রের কাজটা শেষ হোক তারপর না হয় ব্যাবস্হা নেওয়া যাবে। দুটোদিন শরীরের উপর এতো ধকল গিয়েছে যে এখন সামান্য কোনো কিছুতেও ভয় লাগছে। বাড়িতে মানুষের সমাগম। শশী কখন থেকে ইমরান কে খুঁজতেছে কিন্তু কোথাও ইমরানকে পায়নি৷ তখন অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো হয়ত ইমরান কেউ ওরা রৌদ্রের মতো চিরতরে শেষ করে দিয়েছে। বেলা বাড়ছে জামশেদ সবাইকে তাড়া দিলো। এভাবে এতো সময় মুর্দা রাখা ঠিক নয় তার আত্মার কষ্ট হয়। চারজন খাটের চার পায়া যখনি ধরতে যাবে তখনি সাদা রঙের বড় গাড়িটা গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। সকলে সেদিকে তাকাতেই গাড়ির দরজা খুলে একে একে আর্মি ইউনিফর্ম পড়া কয়েকজন বেড়িয়ে আসলো। ইমরান ও গাড়ি থেকে নেমে পুনরায় ভিতরে হাত বাড়িয়ে দিলো। একটা টাওজার আর গেঞ্জি পড়া সমুদ্র গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো। দুজন দুদিক থেকে ধরে আছে। মাথা থেকে পা অবধি ক্ষত বিক্ষত শরীর। মুখের এক অংশ আধ পোড়া। সমুদ্র কে দেখে সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কাল থেকে আজ এখন অবধি যে মানুষ টা সকলের কাছে মৃত ছিলো। হঠাৎ তাকে জীবিত অবস্থায় দেখলে যে কারোরই অবাক হওয়ার কথা। ইমরান আর অন্য একজনের কাঁধে ভর দিয়ে সমুদ্র রৌদ্রের খাটিয়ার কাছে আসলো। সাবধানে হাঁটু মুড়ে বসে রৌদ্রের স্নিগ্ধ মুখটার দিকে তাকালো। নিষ্পাপ পবিত্র টলটলে চেহারাটা। যেনো এখনি চোখ মেলে তাকাবে। সমুদ্র এক ধ্যানে কিছুক্ষণ রৌদ্রের বন্ধ চোখের দিকে চেয়ে থাকলো। কিন্তু কই রৌদ্রতো একটাবারের জন্যও চোখ মেলে তাকালো নাহ। সমুদ্র ইমরান এর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ইশারায় রৌদ্রকে নিয়ে যেতে বলল। সকলে রৌদ্রের খাটিয়ে কাঁধে নিয়ে সামনের দিকে এগোলে হঠাৎ শাহানারা চোখ মেলে তাকালো। কান্না করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছিলো। কেউ আর জ্ঞান ফিরাই নাই। জ্ঞান ফিরে রৌদ্রকে নিয়ে যেতে দেখেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সমুদ্র কে দেখে দৌড়ে গিয়ে সমুদ্রের বুকে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করতে লাগলো। সমুদ্রের কষ্ট হলেও সেটা প্রকাশ করলো নাহ। মায়ের মাথায় হাত রেখে বলল।
“কেঁদো না মা।
শাহানারা কান্না করতে করতে আবারও জ্ঞান হারিয়েছে। এবার সকলে মিলে ওনাকে ধরে রুমে নিয়ে গেলো। সমুদ্র কে রুমে নিয়ে যেতে চাইলে হাত উঁচিয়ে বাঁধা দিলো। ওখানেই বসে রৌদ্রের নিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। রৌদ্রকে ওদের বাড়ির পিছনের দিকটাই কবর দেওয়া হবে। ইমরান আশে পাশে তাকিয়ে শশীকে খোঁজার চেষ্টা করলো। শশীই এখন সমুদ্র কে সামলাতে পারবে কিন্তু পেলো নাহ। হয়ত আছে কোথাও। সমুদ্র ইমরান কে বলতেই ইমরান সমুদ্র কে ধরে ওর রুমে দিয়ে আসলো।
,,,,,,,,,,,,,
শরীরটা ভালো লাগছে না বিধায় রুমে এসে বসে ছিলো শশী। বিছানার উপর হাঁটু মুড়ে বসে দুহাত ভাজ করে হাঁটুর উপর রেখে সেখানে মাথা দিয়ে বসে ছিলো। রৌদ্রের সাথে দেখা হওয়া কথা বলা সবটা মনের মধ্যে কেমন উতলে উঠছে। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে। কান্না করার ফলে মাথাটাও ভীষণ বেথ্যা করছে। কখনো এভাবে কাছের কাউকে হারানো বেথ্যা পায়নি এই জন্য কষ্টটা বেশিই হচ্ছে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে শশী মাথা তুলে সেদিকে তাকালো। দেখলো ইমরানসহ আরো একজন সমুদ্র কে ধরে রুমে আনছে। শশী সমুদ্রকে দেখে তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামলো। নেমে এক পাশে দাঁড়িয়ে টলমল চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। ইমরান সমুদ্রকে সাবধানে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এক পলক শশীর দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে সাবধানে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলো। সমুদ্র খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আসে। চোখ দুট লাল হয়ে আছে হয়ত কান্না না করার দুরুন এমনটা হয়েছে। বাঁ হাতে মাথাটা চেপে ধরে পাশে শশীর দিকে তাকালো। দেখলো শশী চোখ ভর্তি পানি নিয়ে সমুদ্রের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র হাতের ইশারায় শশীকে নিজের কাছে ডাকলো। শশীও নিঃশব্দে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে আসলো। আস্তে করে পাশে বসতেই সমুদ্র শশীর মাথাটা নিজের বুকে রাখলো। ব্যাস এতোটাই বুঝি দরকার ছিলো। সমুদ্রের বুকের কাছের গেঞ্জি দুহাতে চেপে ধরে জোরে জোরে কান্না করতে করতে শশী বলে উঠল।
“আমি পারিনি সমুদ্র । আপনার দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমি রৌদ্র ভাইয়া কে বাঁচাতে পারিনি৷ জয়কেও দেখে রাখতে পারলাম নাহ। হসপিটালের বেডে শুয়ে না জানি ছেলেটা কত কষ্ট পাচ্ছে। আমাকে মাফ করে দিন সমুদ্র আমি কিচ্ছু দেখে রাখতে পারিনি।
ক্রমশ শশীর কান্না বেড়েই চলেছে। সমুদ্র শশীর মাথাটা বুকে চেপে ধরে শক্ত চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ শশীকে থামালো নাহ আর না নিজে কোনো শব্দ মুখ দিয়ে বের করলো। শুধু চুপ করে এক ধ্যানে বাইরে দিকে তাকিয়ে আছে।
,,,,,,,,,,,,,,,,
” আজকের বিশেষ খবর। গতরাতে হাইওয়ে তে মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোই এক্সিডেন্ট এ মন্ত্রী আশফাক মির্জার একমাত্র ছেলে জোসেফ মির্জা নিহত। তার ডেটবডি সকালে পুলিশ ব্রিজের নিচে নদী থেকে উদ্ধার করেছে। জানা গেছে অতিরিক্ত মাদক সেবন করে গাড়ি চালানোর ফলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নদীতে পড়ে যায়। এবং তিনি ওখানেই মারা যায়। তদন্ত চলছে বাকি খবর পেতে আমাদের সাথেই থাকুন। ফিরে আসছি ছোট্ট একটা বিরতির পর।
মুঠোফোনে খবরটা শুনতেই বাঁকা হেসে সামনের দিকে তাকালো সমুদ্র। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন৷ দিন চলে গেছে বাড়িতে আসা আত্মীয় বন্ধু বান্ধবরাও চলে গেছে। কিন্তু শোকের রেশটা এখনো যেনো গিয়েও যাচ্ছে নাহ। সমুদ্র মুটামুটি সুস্থ পায়ের আঘাতটা এখনো তেমন সাড়েনি হাঁটতে গেলে খুঁড়িয়ে হাটতে হয়। মুখের এক অংশের ঘা অর্ধেক শুকিয়ে গেলেও দাগটা বেশ ভালোই বোঝা যায়। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। এই সেই রাস্তা যেখানে রৌদ্র মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো। জয় কাঁটা মুরগির মতো ছটফট করছিলো। শশী একটু সাহায্যের আশায় অসহায় হয়ে দিক বেদিক ছুটছিলো। এই কথাগুলো মনে হতেই নিজের উপর রাগ হয় কেনো সে তার পরিবারের বিপদের সময় পাশে থাকতে পারলো নাহ৷ তার দায়িত্বের কাছে সে হেরে গেলো। কীভাবে থাকতো তখন সে তার পরিবারের কাছে। তখন যে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিলো শত শত লাখ পরিবার। সে যদি তার পরিবারের কথা ভেবে তার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসতো তাহলে শত শত মানুষের প্রাণ যেতো। তার কাজই তো এটা নিজের জীবনকে বিপদে ফেলে দেশকে রক্ষা করা। দেশের মানুষ কে রক্ষা করা। সমুদ্রের এসব ভাবনার মাঝেই পাশ থেকে ইমরান বলে উঠল।
“এরপর?
” এরপর কি হবে সেটা সময়ের উপরই ছেড়ে দাও ইমরান। সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
সমুদ্রের কথাশুনে ইমরান সমুদ্রের দিকে তাকালো। যদিও খবরে বলছে জোসেফ এর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে৷ তবে সোতো জানে আসল ঘটনাটা কি। ইমরান সমুদ্রের সামনে গিয়ে বলল।
“আই লাভ ইউ স্যার। আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?
ইমরান এর কথাশুনে সমুদ্র ইমরান এর দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুঁটিয়ে ইশারায় ইমরান কে নিজের কাছে ডাকলো। ইমরানও হেসে সমুদ্র কে জড়িয়ে ধরে সড়ে এসে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল।
” রৌদ্র নেই তাতে কি হয়েছে আমিতো আছি। কথা দিচ্ছি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবো নাহ। ছোট ভাই হয়ে সর্বদা আপনার পাশে থাকবো। এই ইমরান এর জান আপনার জন্য সব সময় হাজির।
কলিং বেল এর আওয়াজ পেয়ে শশী ভারী পেট নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। বাড়িতে দরজা খোলার মতো সে ছাড়া আপাতত কেউ নেই। জয় রুমে ঘুমাচ্ছে। শাহানারাকেও ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। কাজের খালাও ছাঁদে গিয়েছে কাপড় শুকাতে দিতে। শশী উঠে দরজা খুলে দিতেই অবাক হয়ে সামনে তাকালো। সাদা ফর্সা বাদামী চোখ লাল চুলের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিসন্দেহে যে কেউ প্রথম দেখায় বুঝে ফেলবে মেয়েটা বিদেশী৷ কিন্তু এই বাড়িতে বেদেশী কেউ কেনো আসবে? লিজা বড় বড় চোখ করে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সামনে দাঁড়ানো ছোটখাটো গড়নের চিকন ফুলে উঠা পেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাই শশী। রৌদ্রের সেই ছোট্ট শশী। লিজা শশীকে দেখে মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল।
” হাই আমি লিজা৷ তুমি নিশ্চয়ই শশী? আমি তোমাকে প্রথম দেখাতেই চিনে ফেলেছি।
কোনো বিদেশী মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনে শশী যেনো পুরো অবাক। ওর জানামতে ও এতো জনপ্রিয় কেউ নয় যে সদূর বিদেশ থেকে কেউ ওর সাথে হাত মেলাতে আসবে।অবাক হয়ে ও হাত বাড়িয়ে দিলো। হাত মিলিয়ে অবাক কন্ঠে বলল।
“আপনি আমাকে চিনেন? কিন্তু কীভাবে?
শশীর প্রশ্ন শুনে লিজা হাসলো। লিজা মেয়েটাই যে এমন সব সময় হাসিটা যেনো মুখে লেগে থাকে। পুনরায় মিস্টি হেসে বলল।
” আমি লিজা রৌদ্রের বন্ধু। আসলে বেশ কয়েকদিন হলো রৌদ্রের কোনো খবর নেই। কত টেক্সট মেল করলাম তবুও কোনো খবর নেই। ও বোধহয় এটাও জানে নাহ যে ও কত বড় একটা পুরুষ্কার পেয়েছে। ওর আঁকা ছবি সবার মন কেঁড়েছে। আমাদের সবাইকে পিছনে ফেলে ও সামনে এগিয়ে গিয়েছে। কোথায় সে? ওকে একটু ডেকে দাও তো এমন মার দেবো নাহ। বাড়িতে এসে আমাদের সবাইকে ভুলে গিয়েছে।
এবার শশীর কাছে সবটা পরিষ্কার হলো। তবে রৌদ্রের কথা শুনতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। লিজাকে নিয়ে ভিতরে আসলো। লিজাও নিজের সাথে আনা বড় একটা কিছু র্যাপিং পেপারে মোড়ানো। জিনিসটাকে টেনে ভিতরে আসলো। শশী সোফায় বসতে বললে লিজা বসে আশে পাশে তাকালো। কিছুই মাথার মধ্যে ঢুকছে নাহ। শশী লিজাকে সবটা বলতেই লিজা যেনো পাথর হয়ে গেলো। এতোটা দূর থেকে যেই বন্ধুর জন্য ছুটে আসলো তার এমন করুন পরিনতি শুনলে কেই বা ঠিক থাকতে পারে। কোনোমতে কান্না আটকে কাঁপা কন্ঠে শশীকে জিগাস করলো লিজা।
” তুমি থাকো পাগলটার সাথে আমার অনেক কথা জমে আছে আমি একাই যেতে পারবো। তোমাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে নাহ। এখানে বসে থাকো আমি কথা শেষ করেই আসছি।
কথাটা বলেই লিজা রৌদ্রের কবরের দিকে চলে গেলো। শশী অবাক চাহনিতে সেদিকে চেয়ে থাকলো। কই রৌদ্র ভাইয়া তো কখনো বলেনি লিজা নামের তার কোনো বন্ধু আছে।
,,,,,,,,,,,,,,
“তুমি অনেক সার্থপর রৌদ্র। সবাইকে শুধু দিয়েই গেলে। কখনো কিছু নিয়ে গেলে নাহ। জানো আমি আজকে তোমার শশীকে দেখেছি। তুমি ঠিকি বলেছিলে তোমার শশী ছবির থেকেও সুন্দর। ওই রঙ তুলি তার সৌন্দর্য কে ক্যানভাসে মেলে ধরতে অক্ষম। তুমি শুধু আড়ালে ভালোবেসে গেলে। বিনিময়ে ভালোবাসা পেলে না বরং দু হাত ভরে কষ্ট টাকে আপন করে নিলে। তুমি চেয়েছিলে তোমার সত্যিটা কেউ কখনো না জানুক। কথা দিচ্ছি কেউ কখনো জানতে পারবে নাহ। এক পাগল প্রেমিক ছিলো যে কিনা কাউকে উজার করে ভালোবেসে গিয়েছিলো। কখনো অপরপক্ষ থেকে ভালোবাসা আশা করেনি। তুমি ঠিকি বলেছিলে কিছু কিছু সত্যি ভীষণ অপ্রিয় হয়। সেই সত্যিটা কখনো সামনে না আসায় সবাই জন্য মঙ্গল। তাই হবে! আসবে না সামনে। আমার সাথে সাথে এই অপ্রিয় সত্যিটা অনেক দূরে চলে যাবে। কখনো তোমার শশীর সামনে আসবে নাহ। তোমার শশী জানতেও পারবে নাহ কেউ তাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো। ওপাড়ে ভালো থেকো। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবো পরের জনমে যেনো শশী শুধুমাত্র তোমার হয়েই পৃথিবীতে আসে। এতো সবের মাঝে আমি একটা কথা ভুল বলেছি। তোমার শশী তোমার সাথেই চলে গিয়েছে। এখন যাকে দেখেছি সে রৌদ্রের শশী নয় বরং সে সমুদ্রের শশী। ওপাড়ে ভালো থেকো বন্ধু।
কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করে নিলো লিজা। ফর্সা গাল বেঁয়ে পানির ফোঁটা থুঁতনি থেকে টপ করে মাটিতে পড়লো। বেশ খানিকক্ষণ রৌদ্রের কবরের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো।
#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৬
,
কালো রঙের গাড়িটা বেশ বড়সড় একটা বাড়ির সামনে এসে থামলো। জোসেফ রৌদ্রকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে বাড়িটার ভিতরে প্রবেশ করলো। গাড়ি থেমে গেছে ভেবে জয় ও ডিকি থেকে বের হলো। হাঁটু মোড়া দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে। হাঁটু আর প্যান্ট ভালো মতো ঝেড়ে নিলো। সাদা ইউনিফর্ম টাই ধূলো লেগে গেছে। ভালো মতো ঝেড়েঝুড়ে সামনের দিকে তাকালো। কাঁধের স্কুল ব্যাগটা কাঁধ থেকে একটু ঢিলা করে আশেপাশে তাকালো।
“এই যা মেজো ভাইয়া কোন দিকে গেলো ওই লোকটার সাথে এখন কীভাবে বুঝবো?
চারপাশে বেশ ভালোমতো তাকালো জয়৷ এদিকটায় মানুষজন বেশ কম। সামনে বড় একটা বাড়ি হয়ত বাড়িটার ভিতরে গিয়েছে। তবে গেটের সামনে দুজন দারোয়ান দাঁড়ানো। জয় সেদিকে গিয়ে দারোয়ান এর সামনে দাঁড়িয়ে বেশ সোজা ভাবে বলল।
” আমার মেজো ভাইয়াকে দেখেছেন?
জয়ের কথায় দারোয়ান ওতোটা গুরুত্ব দিলো নাহ। ভাবলো ছোটো মানুষ হয়ত হারিয়ে গেছে। এই জন্য তিনি বেশ নরম গলায় বলল।
“নাহ আমরা তোমার মেজো ভাইয়াকে দেখেনি। তুমি এখানে কেনো বাবু যাও বাড়ি যাও।
” বাড়ি যাবো কেনো? আমি আমার মেজো ভাইয়া কে নিয়েই বাড়ি যাবো। আর আমি জানি মেজো ভাইয়া এই বাড়িতেই গিয়েছে আপনারা বলছেন নাহ।
“এতো বেশ অবাধ্য বাচ্চা। ভালো কথা বললাম তবুও শুনলো নাহ।
কথাটা অপর দারোয়ান বলে জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল।
” এই যাওতো এতো বেশি কথা বলো কেনো। আর এখানে তোমার ভাই নেই যাও।
জয়ের বেশ রাগ হলো। তবে কিছু বলল নাহ। বাধ্য ছেলের মতো গেটের সামনে থেকে চলে গেলো। কিন্তু ওর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। কোনো দুষ্ট বুদ্ধি।
,,,,,,,,,,,,
“এখন কি হবে। আমি এতো করে বললাম ইমরান ভাইয়া আপনি আমার দিকে ধ্যান নাহ দিয়ে ওই গাড়িটাকে ফলো করেন। শুনলেন নাহ আমার কথা এখন তো গাড়িটিকে হারিয়ে ফেললাম। কোন দিকে গেলো সেটাও জানি নাহ।
” আমরা গাড়িটা পরেও খুঁজতে পারবো৷ কিন্তু আপনি তো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ম্যাম। এখন আমাদের হসপিটাল এ যাওয়া প্রয়োজন।
“এটা কি ধরনের কথা বলছেন ইমরান ভাইয়া। ওই গাড়িতে জয় রয়েছে। এতোক্ষণে ওর কিছু হয়ে গেলো কিনা সেটাও জানি নাহ। রৌদ্র ভাইয়ার ফোনটাও বন্ধ আসছে। সমুদ্র যাওয়ার আগে আমাকে ওদের দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমি কীভাবে ওদের কথা ভুলে নিজের কথা ভাবি। আমি ঠিক আছি আপনি প্লিজ কারো কাছে জিগাস করে দেখেন কেউ ওই গাড়িটা দেখেছে কি নাহ।
শশীর কথা শুনে হতাশ শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো ইমরান। ম্যামও ঠিক তার স্যারের মতোই জেদী। মেইন রোডে গাড়িটাকে নজরে রেখেছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়িটা ডান দিকে মোড় নিয়ে একটা গলির মধ্যে চলে গেলো। সামনে আরো অন্য গাড়ি ছিলো বিধায় ওদের গাড়িটা বেশ পিছনে পড়ে গিয়েছে। তবে যখন ওরা গলির মধ্যে গেলো। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পরে সামনে দুটো রাস্তা যা দুদিকে চলে গেছে। কালো গাড়িটা ঠিক কোন দিকে গেছে এটা ওদের অজানা। ইমরান গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকালো বড় বড় বিল্ডিং ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সামনে থেকে যদি আরো একটা গাড়ি আসে তাহলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। গলির মধ্যে দিয়ে এতোটাই জায়গা। ইমরান পুনরায় গাড়িতে এসে বসে শশীর দিকে তাকালো। শশী পেটের বেথ্যায় একদিকে কাঁত হয়ে হেলান দিয়ে আছে। ইমরান একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলল।
” ম্যাম এই পাশের রাস্তাটা বন্ধ কাজ চলছে।
“তাহলে আমাদের এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া উচিত। আপনি গাড়ি স্টার্ট দেন ইমরান ভাইয়া।
,,,,,,,,,,,,
বাইরে থেকে বাড়ির মতো মনে হলেও আসলে এটা বাড়ি নয় কোনো গুদাম ঘর। ভিতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছোটো ছোটো কাঠের বাক্স সাজানো। আর তার সামনে বস্তা সাজানো। জোসেফ রৌদ্র কে নিয়ে ভিতরে আসতেই রৌদ্র অবাক হয়ে আশেপাশে দেখলো। কৌতূহল নিয়ে জোসেফ কে জিগাস করলো।
” এটা কোন জায়গা? তুই নাহ বললি তোর বাসায় যাবি তাহলে এটা?
রৌদ্রের কথায় জোসেফ বাঁকা হাসি দিয়ে রৌদ্রের কাঁধে নিজের হাত রেখে বলল।
“আর এতো তাড়া কিসের আগে ভিতরে চল তারপর আপনাআপনি সবটায় জেনে যাবি।
জোসেফ এর কথাটা রৌদ্রের তেমন পছন্দ হলো নাহ। কাঁধ থেকে জোসেফ এর হাত সরায়ে বলল।
” আজকে নয় অন্য কোনোদিন আসবো। এখন আমাকে যেতে হবে। জয় বাসায় গেছে কিনা তাও জানি নাহ। তুই আমার ফোনটা দে আমি বাড়িতে যাবো।
“আরে যাবে যাবে এতো তাড়া কীসের। প্রথমবার আসলে কোনো আ্যাপায়ন ছাড়াই যেতে দেবো। তা আবার হয় নাকি। জানো নাহ অতিথি সম্মানিয় ব্যাক্তি।
পিছন থেকে আসা মেয়েলি স্বরে জোসেফ রৌদ্র দুজনেই সেদিকে তাকালো। মালবিকাকে দেখে জোসেফ বাঁকা হাসি দিলেও রৌদ্র অবাক চোখে মালবিকার দিকে চেয়ে আছে। এই মহিলা কে ও চেনে। মায়ের কাছ থেকে জেনেছে চাচ্চুর সাথে এই মহিলার সম্পর্ক ছিলো। তবে সেটা অর্ধেক পুরো সত্যিটা সমুদ্রের থেকে শোনা৷ যেটা ওর মায়েরও অজানা। মালবিকা কে দেখে রৌদ্র রাগী চোখে তাকিয়ে বলল।
” আপনি এখানে? আর জোসেফ এই মহিলা এখানে কি করছে। একে আমার সামনে থেকে সরে যেতে বল নয়ত আমার হাতে কোনো খুন হয়ে যাবে।
কথায় বলে নরম মনের মানুষের রাগ ভয়ংকর হয়৷ তবে তারা সেটা প্রকাশ করে নাহ। সব সময় যারা চুপ থাকে রাগলে তারা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। রৌদ্র ও ঠিক সেই রকম। রৌদ্রের এমন কথাশুনে মালবিকা হেসে সামনে রাখা চেয়ারে বসল। অতঃপর বাঁকা হেসে বলল।
“এতো রাগ? কিন্তু আমার জানা মতে তো তুমি রাগ করতেই পারো নাহ। তবে তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। আসলে তুমি না ঠিক অভিক এর মতো হয়েছো। প্রচন্ড বোকা। সল্প কথায় যে কাউকে বিশ্বাস করে ফেলো। সে কে তার পরিচয় কি এসবের কোনো খোঁজ না নিয়েই বন্ধুত্ব করে ফেলো। তবে তোমার বড় ভাই সম্পূর্ণ আলাদা এই জন্যই তো ওকে শেষ করতে আমার এতো পরিকল্পনা করতে হলো।
মালবিকার কথাশুনে রৌদ্র রেগে তেড়ে এসে মালবিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলল।
” কি করেছেন আমার ভাইয়ার সাথে?
“তেমন কিছুই করেনি শুধু আস্তে করে আমার রাস্তা থেকে সরানোর ব্যাবস্হা করেছি। এতোক্ষণে হয়ত সরেও গেছে। ঠিক তোমার বাবা কাকা কে যেভাবে আমার রাস্তা থেকে সরিয়ে ছিলাম তেমন ভাবে।
রাগে রৌদ্রের মুখ লাল হয়ে গেছে। পুরো শরীর কাঁপছে। তবে মালবিকার কথাশুনে রৌদ্র অবাক হলো। ওর বাবা আর চাচ্চুর মৃত্যুর পিছনে এর হাত ছিলো? কই ওতো জানে নাহ। তাই রৌদ্র বুঝতে না পেরে বলল।
” মানে?
“আচ্ছা তাহলে আমাদের রৌদ্র বাবু দেখি কিছুই জানে নাহ। সমুদ্র দেখি তোমাকে কিছুই জানাইনি। ওকে ব্যাপার নাহ। আমি তোমাকে সবটা জানাচ্ছি। কি বলোতো কারো শেষ ইচ্ছে টা পূরণ করা আরেকজনের কর্তব্য। তোমার বাবা ছিলো একজন সৎ আর্মি অফিসার ঠিক সমুদ্রের মতো। তো সৎ হবে ভালো কথা ঘুরে ফিরে আমাদের পিছনে লাগতে আসার কি দরকার ছিলো? এর জন্য তো পুলিশ ছিলোই। কিন্তু নাহ ওনার তো সব বিষয়ে নাক গলানোর স্বভাব। আমার বিজনেস এর দিকে ঝোঁক টা বেশি ছিলো। সাথে ছিলো টাকার প্রতি লোভ। টাকার জন্য সবকিছু করতে রাজী ছিলাম৷ চতুর বৃদ্ধির জন্য ভাইয়ের বেশ কাছের ছিলাম। আমার ভাই তখন সদ্য মন্ত্রী পদ পেয়েছে। কি বলোত সৎ পথে না বেশি টাকা ইনকাম করা যায় নাহ৷ এতো মানুষের দেশের সেবা করে লাভ কী? তাই জন্য আমরা অন্য ব্যাবসাও শুরু করলাম। কিন্তু সেটা তোমার বাবার পছন্দ হলো নাহ। মেয়েদের এভাবে পাচার হওয়া দেশে অবৈধ অস্ত্র আসা এসব কোন সৎ অফিসার এর পছন্দ হয় বলো? যাই হোক তোমার কাকু তখন সদ্য ট্রেনিং শেষে জয়েন করেছে। সমুদ্র ও বেশ বড় তুমিতো তখন নিতান্তই ছোট ছিলে। তোমার বাবার জন্য আমাদের বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। সেই জন্য আমি এক প্লানিং করলাম। কি বলোত? তোমার বোকা কাকু কে প্রেমের ফাঁদে ফেলার।
এই টুকু বলেই মালবিকা বাঁকা হাসি দিলো। রৌদ্র পারে নাহ সামনে থাকা মালবিকা কে নিজে হাতে খুন করতে। কোনো সন্তানই এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের বাবা কাকার এমন নির্মম মৃত্যুর বর্ণনা শুনতে পারে নাহ। মালবিকা আয়েস করে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল।
“তবে তোমার বাবাকে মারতে আমাদের বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি সে নিজেই কোনো এক মিশনে গিয়ে মারা গিয়েছে। তবে হ্যাঁ তোমার কাকা কে আমি নিজ দায়িত্বে মেরেছি।
কথাটা বলেই মালবিকা হাসি দিলো। রৌদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলো।
” তখন হয়ত জয় সম্ভবত তোমার মায়ের পেটে ছিলো। তুমিও বেশ বড়ই। সমুদ্র তো বুদ্ধিমান হয়ে গিছিলো। কি বলোত তোমার পরিবারের লোকেরা বেশ সহজ সরল এই জন্য তাদেরকে বোকা বানানো ভীষণ সহজ। এতো নিরীহ দের মারতে আমার ভীষণ খারাপ লেখেছিলো। কিন্তু কি আর করার বলো। নিজে বাঁচতে হলে তো পথের কাঁটাকে সরাতেই হতো। অভিক আমার প্রেমে মজে ছিলো। বোকা ছেলেটা বুঝতেও পারলো নাহ সে কতবড় চক্রান্তের শিকার হচ্ছে । তবে আমার পুরো খেলাটা ভেজতে দিলো ওই সমুদ্র। আমাকে অন্য লোকের সাথে হোটেলে দেখে ফেলে। যুবক বয়স তো সব কিছুতে কৌতুহল নিতান্তই বেশি। এইজন্য আমাকে রীতিমতো ফলো করা শুরু করলো। অভিক তো ব্যাস্ত তার এসবের জন্য সময় কোথায়। কিন্তু সমুদ্র সে আমার পিছু ছাড়লো নাহ। আমার অজান্তেই সবকিছু তদন্ত করলো। আর সবটা সুন্দর মতো অভিককে বলেও দিলো। কিন্তু অভিক সেতো প্রমে অন্ধ ছিলো। ভাইয়ের ছেলের কথা কেনো বিশ্বাস করবে৷ তার উপর ছোট মানুষ হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে ভেবে পাত্তা দিলো নাহ। আমিও সেটার সুযোগ নিলাম। কিন্তু সমুদ্র? ওতো নাছোড়বান্দা সবটা অভিককে বিশ্বাস করায়ে তারপর দম নিলো। এতোবড় ধোঁকা অভিক মেনে নিতে পারেনি। আমার কাছে এসে হাত ধরে বলে। মালা আমরা চলো কোথাও পালিয়ে যায় এসবে কিছুই লাগবে নাহ। দুজনে ঠিক কোথাও না কোথাও নিজেদের ব্যাবস্হা করে নিতে পারবো। হায়! গাধা একটা। এতো ভালোবাসা যে এদের কোথায় থাকে। ওফ!
কথাগুলো বলে অভিক এর উপর হাসলো মালবিকা।
“কিন্তু আমিতো রাজি ছিলাম নাহ৷ সরাসরি ওকে না করে দিই। তবে বেচারা প্রেমে বেথ্যা পেয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আমাকে হুমকি দিলো যদি না শুধরে যায় তাহলে আমাকে শাস্তি দিবে। ব্যাস এটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়ালো। ওই রাতেই পরিকল্পনা মতো ওকে বিষ দিয়ে শেষ করে দিলো আমার দলের লোকেরা। কি বলোত টাকার কাছে সবাই গোলাম। ওর সঙ্গীদের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু খুব দুঃখ লাগলো বেচারা মরেও শান্তি পেলো নাহ। ওর ঘাড়ে দায় চাপলো ড্রাগস আর অবৈধ অস্ত্র পাচার এর। এটা অবশ্য চাপেনি আমিই চাপিয়েছি। ক্যাপ্টেন অভিক ইকবাল লোভে পড়ে নিজের সততা কে টাকার কাছে বিক্রি করে খারাপ কাজের সাথে যুক্ত ছিলো। নিজের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে রাতের অন্ধকারে বিষ পান করে নিজের জীবন ত্যাগ করেছে। সুন্দর নিউজ টা শুনলেও মনটা ভরে যায়। আজও সেই গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে বেচারা। মরে গিয়ে শান্তি পেলো নাহ।
মিছে মিছে দুঃখ পাওয়ার অভিনয় করলো মালবিকা। রৌদ্র রেগে তেড়ে এসে আচমকা মালবিকার গলা টিপে ধরল। যেনো আজকেই এই মহিলাকে শেষ করে দিবে।
“আমার নিষ্পাপ পবিত্র চাচ্চুর চরিত্রের উপর এমন নোংরা দাগ লাগাতে তোর একবারও ভয় লাগলো নাহ? আরে সেতো তোকে ভালোবেসে ছিলো আর তুই তার সুযোগ নিলি। তোর মতো মহিলার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
রৌদ্রের উপর যেনো অসুরের শক্তি ভর করেছে। দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম মালবিকার। জোসেফসহ আরো কয়েকজন মিলে রৌদ্রকে টেনে সরিয়ে আনলো। ছাড়া পেতেই কাশতে লাগলো। গলা ডলে পাশ থেকে পানি খেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল মালবিকা। রৌদ্র নিজেকে ছাড়ায়ে জোসেফ এর কলার ধরে রেগে বলল।
” আর তুই কি বলতো তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই। রাগ তো আমার নিজের উপর হচ্ছে। যে তোর মতো কাউকে আমি বিশ্বাস করেছি। বন্ধুত্বের যোগ্য তুই নোস।
কথাটা বলেই জোসেফ এর নাক বরাবর ঘুষি মারলো। জোসেফ ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। নিজের নাকে হাত দিয়ে দেখলো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বাঁ হাতে সেটা মুছে। উঠে দাঁড়িয়ে রেগে রৌদ্রের দিকে তেড়ে যেতে গেলে পিছন থেকে মালবিকা থামিয়ে দিয়ে বলল।
“না! কোনো মারামারি নয়। তুই বরং তোর বন্ধু কে আমাদের নতুন আসা জিনিসগুলো টেস্ট করা। একটাও বাদ রাখবি নাহ। কি বলতো আমরা আমাদের বাড়িতে আসা মেহমানদের একটু অন্যভাবে ট্রিট করি।
কথাটা বলে মালবিকা বাঁকা হাসলো। জোসেফ এর মালবিকার ইশারা বুঝতে পেরে বাঁকা হেসে রৌদ্রকে টেনে ভিতরের একটা রুমে নিয়ে গেলো। রৌকে নিয়ে যেতেই ওখানে শশী আর ইমরান এসে উপস্থিত হলো। শশী সামনে মালবিকা কে দেখেই চমকে গেলো। গেটের সামনে কালো গাড়িটা দেখে ভিতরে এসেছে। তবে এখানে এসে মালবিকাকে দেখবে এটা আশা করেনি। মালবিকা শশী কে দেখে অবাক হওয়ার অভিনয় করে বলল।
” আরে এসো এসো আজকে তো দেখি আমার বাড়িতে চাঁদের হাট লেগে লেগো। মানে আশা না করতেই সবকিছু হাতের নাগাড়ে চলে আসছে। আর আসতে তো হবেই সময়টা যে এখন মালবিকার।
মালবিকার কথাশুনে শশী কোনো উত্তর দিলো নাহ৷ হাতটা পেটে রেখে বহু কষ্টে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলল।
“জয় কোথায়?
কথাটা শুনতেই এবার মালবিকা সত্যিই অবাক হলো৷ কেননা প্লান মোতাবেক ওরা রৌদ্র কে এনেছে জয়কে আনেনি৷ তাহলে এরা জয়ের কথা কেনো জিগাস করছে? পরক্ষণেই মালবিকা কিছু একটা ভেবে বাঁকা হেসে শশীর দিকে এগিয়ে গেলো। শশীর ফুলের উঠা পেটের উপর হাত রেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল।
” আরে আমি জানি নাহ জয় কোথায়। কি বলোত জানলেও বলতাম নাহ।
কথাটা বলেই বাঁকা হাসলো মালবিকা। পরক্ষণেই দুঃখি মুখ করে শশীর দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলল।
“আহারে বাচ্চাটার জন্য বড়ই দুঃখ হচ্ছে। বেচারা বাবার মুখটাও দেখতে পাবে নাহ।
মালবিকার কথাশুনে শশী আতংকিত চোখে মালবিকার দিকে তাকালো। তবে শশী কিছু বলার আগেই ইমরান সামনে এগিয়ে এসে বলল।
” একদম ম্যাম কে ভুলভাল কিছু বলবেন নাহ। ভালোই ভালোই বলে দিন জয় কোথায়। আমরা পুলিশকে ইনফর্ম করে দিয়েছি৷ পুলিশ এসে সব কটাকে জেলে পুড়ে দিবে।
ইমরানের কথায় মালবিকার কিছু এলো গেলো নাহ৷ আরাম করে আবার চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল।
“হ্যাঁ আসুক পুলিশ আমিও অপেক্ষা করছি। তবে আমাকে একটা কথা বলো। পুলিশ আসলে তোমরা কি বলবে? আমি জয়কে কিডন্যাপ করেছি? কিন্তু প্রমাণ কোথায়? আর তোমরাও এখানে নিজে ইচ্ছে এসেছো কেউ জোর করে তোমাদেরকে আনেনি৷ আর মুক্তি পনের জন্য তোমাদের কল ও করেনি আমি৷ তাহলে এবার আমাকে বোঝাও পুলিশ আমাকে কেনো ধরবে?
মালবিকার কথায় এবার ইমরান দমে গেলো। তবুও সেটা প্রকাশ না করে পুনরায় কিছু বলতে যেতেই ঘাড়ে কিঞ্চিৎ বেথ্যা অনুভব হলো। সাথে সাথে সেখানে হাত দিতেই পিছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। শশী ভয়ে ইমরান এর কাছে গেলো তবে ও নিচে বসতে পারলো নাহ পেটে চাপ অনুভব হলো। মালবিকা মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ শব্দ করে বলল।
” মাঝখান থেকে এই বেচারাকে বলি হতে হলো। এসব নিরীহ মানুষ কে মারতে আমার একদম ভালো লাগে নাহ। যাওতো ওকে বাইরে কোথাও সযন্তে ফেলে আসো।
“কি করেছো ইমরান ভাইয়ার সাথে সত্যি বলো।
শশীর কথা শুনে মালবিকা শশীকে শাম্ত করার ভঙ্গীতে বলল।
” আরে কুল কুল ওকে প্রাণে মারেনি শুধু বেশি লাফানোর জন্য শাস্তি দিয়েছি।
দুজন লোক এসে ইমরান কে টেনে নিয়ে গেলো। শশী সেদিকে তাকিয়ে আবার কিছু বলতে যেতেই একজন লোক জয়কে টানতে টানতে ভিতরে এনে মালবিকাকে বলল।
“ম্যাম এই পিচ্চি টা বাইরে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিলো এটাকে কি করবো?
কথাটা শুনতেই শশী পিছন ফিরে জয়কে দেখলো৷ মালবিকা জয়কে দেখে খুব খুশি হলো। ইশারায় লোকটিকে বলল জয়কে ছেড়ে দিতে৷ জয় ছাড়া পেতেই শশীকে জড়িয়ে ধরলো। শশীও জয়কে আগলে নিলো। মালবিকা কিছু বলল নাহ। তখন ওখানে জোসেফ আসলো। ও শশী আর জয়কে খেয়াল করেনি। মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল।
” কাজ শেষ।
মালবিকা বাঁকা হেসে ইশারায় পিছনে তাকিয়ে বলল।
“সবে তো শুরু।
জোসেফ ও পিছনের দিকে তাকালো। অতঃপর শশীকে এখানে দেখে বলল।
” আরেহ বাহ সমুদ্রের পুরো পরিবার যে এখানে। তাহলে আমাদের কষ্ট কম হয়ে গেলো। না চাইতেই সবকিছু হাতের মুটোয় হাজির৷
কথাটা বলে বিচ্ছিরি একটা হাসি দিলো। শশী ভয়ে জয়কে জড়িয়ে ধরে আছে৷ ভিতরে ভয় পেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলো নাহ। শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো পুলিশের আসার। ওরা এখানে আসার আগে পুলিশকে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে তবে আসতে এতো দেরি কেনো হচ্ছে । জোসেফ শয়তানি হাসি দিয়ে মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল।
“ওহ ফুপি আমার মাথায় একটা দারুন আইডিয়া এসেছে৷
” বলে ফেল।
“বাইরে সমুদ্রের প্রাণের স্ত্রী আর ভিতরে মাতাল ভাই। এদের দুজনকে দিয়ে একটা ভিডিও বানালে কেমন হয়? কালকের রসালো হেড লাইন। মৃত অফিসার সমুদ্রের স্ত্রীর সাথে তারই ছোট ভাই এর অন্তরঙ্গ গোপন ভিডিও ফাঁস। আহা ভাবলেও শান্তি লাগছে।
কথাটা বলেই জোসেফ আর মালবিকা হেসে উঠল।
” আরে নাহ এটা তো এখন ওসমানের ওকে দিয়ে আমাদের কি কাজ।
“বাহ স্বামীর থেকে তার ভাইয়ের জন্য চিন্তা দেখি বেশি।
” এই আপনি আমার মেজো ভাইয়ার বন্ধু নাহ? আমার ভাইয়া কোথায়?
জয়ের কথাশুনে জোসেফ হাসলো তবে কিছু বলল নাহ। শশী কিছুই বুঝতে পারছে নাহ৷ এই লোককে সে চেনে তবে এই লোকটি যে ওই মহিলার আত্মীয় তা জানতো নাহ। মনে মনে ভয় পেলেও নিজেকে শক্ত রাখলো এখানে ভয় পেলে হবে নাহ৷ শক্ত হাতে এদের কে প্রতিহতো করা লাগবে। জোসেফ ইশারা করতেই ভিতর থেকে রৌদ্রকে আনলো। রৌদ্র পুরোপুরি মাতাল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পযন্ত পারছে নাহ৷ ঝাপ্সা চোখে সামনে তাকিয়ে আবছা আবছা শশী আর জয়কে দেখলো বোধহয়। তবে দেখেও কিছু করতে বা বলতে পারার মতো শক্তি ওর নেই৷ শশী রৌদ্র কে এভাবে দেখে আতংকে চিৎকার করে নাম ধরে ডাকলো। তবে রৌদ্রের কোনো সাড়া নেই। মালবিকা জোসেফ এর দিকে তাকিয়ে বলল।
কথাটা শুনতেই শশী চমকে উঠল। দৌড়ে রৌদ্রের কাছে যেতে গেলেও পারলো নাহ। পেটের মধ্যে বেথ্যা করে উঠল। পেট ধরে মাঝ পথেই দাঁড়িয়ে পড়ল। জয় গিয়ে জোসেফ এর হাতে কাঁমড় দিলে জোসেফ ধাক্কা দিয়ে জয়কে পাশে ফেলে দিলো। সবাই রৌদ্র কে নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। মালবিকা শশীর দিকে তাকিয়ে বলল।
” যাও গিয়ে পারলে নিজের দেবরকে বাঁচিয়ে নাও। কেউ তোমাকে বাঁধা দিবে নাহ। আমি কথা দিচ্ছি। আর আমি এখন বসে বসে আরাম করে তোমাদের পরিবার টাকে ধ্বংস হতে দেখবো। তোমার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করেছে।
শশী বুঝলো মালবিকাকে কিছু বলে লাভ নেই৷ এই মহিলার মায়া দয়া কম। শশী কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চলে গেলো। জয় ওদের পিছু পিছু আগেই চলে গেছে। হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছে তবুও বাইরে গিয়ে সিএনজি পেয়ে গেলো। ওতে জয়কে নিয়ে উঠে বসলো। সোজা মেইন রোডে গিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই দেখলো রৌদ্র মাঝ রাস্তায় টলছে। শশী যেতে গিয়েও পারছে নাহ৷ চলন্ত গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে। তার উপর পেটে অসয্য যন্ত্রণা। জয় শশীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো কাঁধের ব্যাগটা শশীর হাতে দিয়ে বলল।
“তুমি বসো আমি ভাইয়া কে আনছি।
শশী জয়ের হাত ধরে ফেললো কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে নিষেধ করলো যেনো না যায়৷ তপ্ত দুপুরে রাস্তায় মানুষ কম শুধু গাড়ি চলছে৷ আর যারা আছে তারা ফিরেও দেখছে নাহ। শহরে এমনি হয় কেউ যেছে এসে বিপদে পড়তে চাই নাহ। জয় শশীর কথা শুনলো নাহ৷ হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকে দৌড়ে গেলো। শশী বেথ্যা সয্য করতে না পেরে ফুটপাতে বসে পড়েছে৷ বারবার নিষেধ করছে তবে জয় শুনলে তো। রৌদ্র টলছে কোনো হুশ জ্ঞান নেই। জয় কোনো দিকে না দেখে দৌড়ে যেতে গেলেই ডান দিক থেকে মালবাহি ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা দিলো। ছিটকে ইটের ফুটপাতে পড়ে গেলো। সাদা ইউনিফর্ম লাল রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেলো। উপুড় হয়ে পড়েই গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে লাগলো। শশী জয়ের অবস্থা দেখে চিৎকার করে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে ওর কাছে গেলো। মাথা তুলে কোলের উপর নিতেই নেতিয়ে পড়ল। শশী চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে তবে কেউ শোনেনি। ওদিকে রৌদ্রকেও মালবিকার কথামতো অন্য একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিলো। রৌদ্র গাড়ির ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলো। শশী রৌদ্রের এমন অবস্থা দেখে চিৎকার করে কান্না করছে৷ পরপর দুটো এক্সিডেন্ট হওয়ায় গাড়িগুলো থেমে গেছে। গাড়ি থেকে মানুষ জন নেমে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে হাত দিতে ভয় পাচ্ছে। শশী পাগলের মতো কান্না করছে। মাঝ রাস্তায় এমন জটলা দেখে ট্রাফিক পুলিশ ও ওখানে আসলো। বাইক থামিয়ে নেমে এসে ঘটনা দেখে দ্রুত একটা গাড়ি দেখে ওদের তিনজনকে গাড়িতে তুলল।
,,,,,,,,,,,,,,
জঙ্গল থেকে পুড়ে যাওয়া বডিসহ আরো কয়েকটা ডেডবডি উদ্ধার করেছে। শুকনো পাতার নিচে পুড়ে যাওয়া একটা বডি অবহেলায় পড়ে আছে। শরীরের একাংশ পুড়ে গেছে। ক্ষতে মাছিগুলো ভন ভন করে উড়ছে। ওসমানকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে সেন্যারা পুনরায় জঙ্গলে এসেছে। তাদের সৈনিকদের বডি উদ্ধার করতে। একে একে বেস কয়টা বডি উদ্ধার করা হয়েছে। সমুদ্রের বডিটা একপাশে শুকনো পাতার নিচে পড়ে আছে। পুরো শরীরের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে। মাছি ভন ভন করছে। সব শেষে সমুদ্রের কাছে আসলো। সকলের চোখে পানি টলমল করছে। সমুদ্রের সাথে তাড়া অনেক মিশনে সফল হয়েছে। তাদের স্যার তারা একজন দায়িত্ববান অফিসার কে হারিয়ে ফেলল। সকলে এক সারিতে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলো সমুদ্রের বডিকে। অতঃপর হেডস্যারের আদেশে সমুদ্রের বডিকে তুলতে গেলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সমুদ্রের পুড়ে যাওয়া হাতটা ধরলো। এই সেই মানুষ যে সব সময় সকল পরিস্থিতিতে সাহস যুগিয়েছে। সম সময় দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। এই লোকটি এমন একজন যাকে দেখলে সম্মানে মাথা এমনিই নুইয়ে যাই। আজ সেই মানুষ টা হারিয়ে গেলো সারা জীবনের মতো। কেউ আর কখনো বলবে নাহ সব সময় নিজের লক্ষের দিকে এগিয়ে যাবে। আশেপাশে যা কিছুই হয়ে যাক নাহ কেনো। সৈনিক টি টলমল চোখে সমুদ্রের পোড়া মুখের দিকে তাকালো অতঃপর দুজনে মিলে সমুদ্র কে তুলতে গেলে চমকে পুনরায় সমুদ্রের মুখের দিকে তাকালো।
#চলবে?
#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪৭
,
শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পড়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সমুদ্র। চারপাশে পাখির সুমধুর ডাক। প্রকৃতি কত সুন্দর। শুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। নিজেকে কেমন হালকা পাখির ন্যায় লাগছে। এতো শান্তি কখনো অনুভব হয়নি। সামনে থেকে সাদা আলোর বলক থেকে তীক্ষ্ণ আলোর রশ্মি আসছে। সমুদ্র মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেদিক পানে এগিয়ে গেলো। গোল বলের মতো জিনিসটা থেকে সাদা আলো ভেসে আসছে। সমুদ্র মহিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওইতো ওর বাবা আর কাকু দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পড়ে আছে। কত সুন্দর লাগছে কতটা পবিত্র আর স্নিগ্ধ। হাত বাড়িয়ে সমুদ্র কে নিজের দিকে ডাকলো। যেনো ছোট্ট সমুদ্র কে কাছে ডাকছে আদর করার জন্য। সমুদ্র ও ছোট বাচ্চার মতো বাবার দিকে এগিয়ে গেলো। যেনো ওখানেই সব সুখ লুকিয়ে আছে। যেনো ছোট্ট সমুদ্র এখনি বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাবার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরার জন্য সেদিকে হাত বাড়াতেই হঠাৎ অনুভব হলো বাম হাতের একটা আঙুল কেউ শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। সমুদ্র বাবার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা থেমে গেলো। মাথা নিচু করে নিজের আঙুল ধরে রাখা মানুষ টার দিকে তাকালো। ছোট্ট একটা প্রাণ ওরই মতো শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি পড়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র তাকাতেই মিষ্টি করে হাসলো। সমুদ্র অবাক হয়ে সেই হাসির দিকে চেয়ে আছে। কত নির্মল আর পবিত্র সেই হাসি। দেখলেও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সমুদ্র অবাক চাহনিতে সেদিকে চেয়ে থাকলো। সামনে থেকে পুনরায় সমুদ্রের নাম ধরে কেউ ডাকলো। সমুদ্রের ধ্যান ভেঙে গেলো। সামনে থাকা বাবার দিকে চেয়ে সেদিকে হাত বাড়াতেই বাম হাতের আঙুল ধরে রাখা ছোট্ট প্রাণটা মিষ্টি কন্ঠে ডেকে উঠল।
“বাবা!
আহ, কি শান্তি এই ডাকটায়। কতটা মধুর এই ডাক। এতো সুখ কেনো এই ছোট্ট শব্দ টায়। সমুদ্র অবাক হয়ে প্রাণটার দিকে চাইলো। সেই ছোট্ট প্রাণটা মিষ্টি হেসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে পুনরায় ডাকলো।
” বাবা!
এবার বুঝি প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। হাঁটু মুড়ে বসল সম্মুখে থাকা ছোট্ট প্রাণটা তার ছোটো দুটো হাত দিয়ে সমুদ্রের পুরো মুখে হাত বুলালো। কী নরম সেই ছোট্ট হাত দু খানা। যেনো আঁকড়ে ধরলেই মিলিয়ে যাবে। অতঃপর কপালের মাঝ বরাবর আস্তে করে চুমু দিয়ে মিষ্টি হাসলো। সমুদ্র অবাক চাহনিতে চেয়ে সেই হাসির সাক্ষী হলো। সমুদ্র চোখটা বন্ধ করে নিলো। এই মুহুর্তটাতো অনুভব করতে হবে৷ কত শান্তি, ভিতরটা একদম শান্ত হয়ে গেছে। আস্তে করে চোখ খুলতেই সামনে সেই ছোট্ট প্রাণটা কে আর দেখতে পেলো নাহ। ভিতরটা অশান্ত হয়ে উঠল। ওর বাবা কাকাও নেই। সেই সাদা আলোটা মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। ঝলমল করতে থাকা চারপাশটা কেমন কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেলো। আর সেই ছোট্ট প্রাণটা কালো অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলে উঠল বাবা! কিন্তু সমুদ্র? ও যেনো পাথর হয়ে গেছে হাত পাও নড়াতে পারছে নাহ৷ কি হলো হঠাৎ। হাত বাড়িয়ে কাছে টানতে পারছে নাহ সেই প্রানটাকে। শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎই সেই কালো অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসলো এক নারী। খোলা চুলের সাদা শাড়ি পড়হিত এক নারী। কী করুন তার মুখখানি৷ কতটা ব্যাথিত সে। সমুদ্রের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। নারীটি সামনে এসে সেই ছোট্ট প্রাণটির ছোট হাতটি ধরলো। সমুদ্রের মনে হচ্ছে এই নারীটিকে সে চেনে। খুব কাছ থেকে চেনে, তার সবটা ওর জানা। হ্যাঁ সে আমার অর্ধাঙ্গীনি। আমার জীবনের অর্ধেক অংশ। কিন্তু তার এমন কঠিন রুপ কেনো? সমুদ্র হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে। নারীটি সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। কঠিন কন্ঠে কয়টা বাক্য আওড়ালো বোধহয়। সমুদ্র মন দিয়ে তা শুনছে।
“আপনি কথা রাখলেন নাহ। কখনো ক্ষমা করবো নাহ আপনাকে।
ব্যাস কথাটা বলেই দুজনে কালো অন্ধকারের দিকে পা বাড়ালো। ছোট্ট প্রাণটা নারীটির সাথে কালো অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে পুনরায় মিস্টি করে হাসলো। সমুদ্র চিৎকার করে ডাকতে চাইলো কিন্তু কোনো আওয়াজই বের হলো নাহ। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে উঠল তাদের।
পুরো শরীলে ব্যান্ডেজ এ মোড়ানো নিথর দেহটা হসপিটালের বেডে পড়ে আছে। মুখের অক্সিজেন মাস্কটার কাজও বোধহয় শেষ। আর কোনো আশা নেই। ডাক্তার নিরাশ হয়ে যখনি মাস্ক টা খুলতে যাবে তখনি বেশ জোরে গুঙ্গিয়ে উঠল সমুদ্র।
,,,,,,,,,,,,,
সৈন্যরা যখন সমুদ্রের ডেডবডিটা তুলতে যাচ্ছিলো তখনি একজন চমকে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল।
” স্যার ওনার তো শ্বাস চলছে।
এ যেনো মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে। ব্যাস ওপাশ থেকে কেউ দরজাটা খুলে দিলেই ইহকালের জীবন এর সমাপ্তি। সৈনিক এর কথাশুনে মেজর তাপস চমকে সেদিকে তাকালো।
“কি বলছো কী?
” আমি সত্যি বলছি স্যার। সমুদ্র স্যার এর শ্বাস চলছে তবে খুবি ক্ষীণ।
“ওকে জলদি উঠাও। আর যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে বের করো। মিডিয়ার সামনে পড়া যাবে নাহ পড়লে ওখানে আরো বেশি দেরি হবে।
” তাহলে আমরা মিডিয়াকে কী জবাব দেবো স্যার?
সৈনিক এর কথাশুনে। মেজর নিজের মুখটা কঠিন করে বলল।
“এটাই যে সাহসী অফিসার সমুদ্র এই মিশনে শহীদ হয়েছে।
,,,,,,,,,,,,,
শশীকে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এই শরীরে এতো দৌড় ঝাঁপ সয্য হয়নি। স্যালাইন চলছে তবে শশীর কোনো ঙ্গান নেই। গ্রাম থেকে সকলেই চলে এসেছে। ইমরান কে পুলিশ উদ্ধার করেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে অপারেশন থিয়েটার এর সামনে সমানে পায়চারী করছে। শাহানারার অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। তিন ছেলের এমন অবস্থার কথা শুনলে কোনো মা ই সুস্থ থাকতে পারেন নাহ। ওনাকে ভর্তি করা হয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ পর ডাক্তার বেরিয়ে আসলো। ডাক্তারকে দেখতেই সবাই সেদিকে এগিয়ে গেলো। ডাক্তার সবাইকে আসতে দেখে ওনিও তাদের দিকে গেলো। জামশেদ দ্রুত ডাক্তারকে জিগাস করলো।
” জয় আর রৌদ্রের কী অবস্থা ডাক্তার?
“দেখুন কথাটা খারাপ লাগলেও আপনাদের শুনতে হবে। সত্য সব সময়ই শুনতে খারাপ লাগে। ছোটো ছেলেটা মানে জয়। ওর আঘাতটা বেশ গভীর। মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছে সেরে উঠতে সময় লাগবে। তবে আপাতত বিপদ মুক্ত সামনে কি হবে সেটা বলতে পারছি নাহ।
” আর রৌদ্র?
জামশেদ কথাটা বলতেই ডাক্তার বিষন্ন স্বরে বলল।
“আম সরি ওনাকে আমরা বাঁচাতে পারলাম নাহ। আসলে ওনার শরীরে এতো পরিমাণ ড্রাস দেওয়া হয়েছিলো যে ওনার শরীর এটা নিতে পারেনি। আর তাছাড়া ওনি আগে কখনো এসব সেবন করেনি। এই জন্য প্রভাবটা বেশি পড়েছে। তার উপর এই এক্সিডেন্ট, আমাদের হাতে কিছুই ছিলো নাহ। ওনি হসপিটালে আসার আগেই মারা গিয়েছে। মানে স্পট ডেট।
এই একটা কথাটায় ওখানে থাকা প্রতিটা মানুষের কথা বন্ধ করে দিলো। সবাই নির্বাক হয়ে বসে পড়লো। শাহানারাকে কীভাবে সামলাবে ওরা। তার থেকেও বড় সমুদ্রের কথাটা কীভাবে জানাবে। দুই ছেলের এমন করুন পরিনতি কোনো মায়ের পক্ষেই সয্য করা সম্ভব নয়। কোনো মা বাবাই চাই নাহ তারা বেঁচে থাকতে তাদের চোখের সামনে তাদের সন্তানের মৃত্যু হোক। জামশেদ মাস্টার খুব কঠিন মনের মানুষ তবুও এখন কেমন ভেঙে পড়েছে। তবে তাকে শক্ত থাকতে হবে। সামলাতে হবে তার মেয়েকে। ইমরান নিচে মাথায় হাত রেখে বসে পড়েছে। সে থাকতেও কিছুই করতে পারলো নাহ। যে স্যার তার এতোবার জীবন বাঁচিয়েছে তার পরিবারের জন্য ও কিছুই করতে পারলো নাহ। এই অপারগতা ভিতরটায় যেনো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। নার্স এসে জানালো শশীর ঙ্গান ফিরেছে। পারভিন দৌড়ে শশীর কাছে গেলো। দরজা খুলে কেবিনে যেতেই দেখলো শশী বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে শশী সেদিকে তাকালো। মাকে দেখে শুকনো হেসে ইশারায় কাছে ডাকলো। মেয়ের এমন শান্ত ভাবটাই পারভীন এর ভিতরে ভিতরে ভয় পেয়ে গেলো। শশীতো জানে সমুদ্রের কথা তারপরেও এমন কীভাবে আছে। পারভীন কাছে গিয়ে শশীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতেই শশী মুখ খুলে ক্লান্ত স্বরে বলল।
“চিন্তা করো না মা। ওনি এসে সবটা ঠিক করে দেবে। ওনি যে আমায় কথা দিয়েছে। কথা রাখতে ওনাকে যে ফিরতেই হবে। এটা আমার বিশ্বাস।
মেয়ের এমন ভাবনায় মুখে কাঁপড়ের আঁচল চেপে কেঁদে উঠল পারভীন তার ছোট্ট মেয়েটা আর কত সয্য করবে।
,,,,,,,,,,,,,,
জয় কে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছে জয় বিপদ মুক্ত। কেবিনের দরজা ছোট হাতে ঢেলে ভিতরে প্রবেশ করলো জোনাকী। মাথায়, পায়ে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। জোনাকি আস্তে আস্তে জয়ের বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জয়ের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ওখানে থাকা ছোট্ট টেবিলটাই হাতের মধ্যে থাকা লজেন্স গুলো রাখল। লজেন্স রেখে জয়ের মাথার কাছে গিয়ে বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
” নাও এই সবগুলো তোমার। আমি আর তোমার থেকে নেবো নাহ। তোমাকে কাঁমড়েও দেবো নাহ। তুমি যতখুশি খেতে পারো আর কুঁমড়ো পটাস নামে ডাকবো নাহ। শুধু তুমি ঠিক হয়ে যাও। তোমাকে এমন দেখে আমার একটুও ভালো লাগছে নাহ। কেমন জানো অনেক বেশি কান্না পাচ্ছে। তুমি এক টা বার ঠিক হয়ে যাও তারপর আর আমি আন্টির কাছে তোমার নামে বিচার দেবো নাহ। আমরা ভালো বন্ধু হয়ে যাবো। আর আড়ি করবো নাহ।