-“এসবের কিছুই আমি জানতে চাইনি। মুখটা বন্ধ রাখো। সব কথায় ঝড়ের গতিতে উত্তর দিতে হয়না। মাঝেমধ্যে চুপ থাকতে হয়। ধৈর্য তো নাই মনে হয় আর না আছে শালিনতা। কথায়,কথায় উত্তর দেওয়া লাগে।”
সেরিনকে ধমক দিয়ে বলে আরজিন। সেরিন নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এতো ধমকা ধমকি তার পছন্দ না। কিন্তু শুভ্র তাকে ধমকের উপরেই রাখছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে পাটওয়ারী ভিলার গেট দিয়ে গাড়ী প্রবেশ করে। সেরিন গাড়ী থেকে নেমে নিশাতের হাত ধরে ভেতরে চলে যায়। বিশাল লিভিং রুমের সোফায় বসে আছে এমপি আরফান চৌধুরী শুভ। সাথে বসে আছেন কিরণ পাটওয়ারী এবং সিহান পাটওয়ারী।সেরিন আর নিশাতকে দেখে কিরণ পাটওয়ারী বলেন,
-বড়দের সালাম দাও মামনিরা।
সেরিন, নিশাত দু’জনে সালাম দেয়। তখন সেরিনের আম্মু সাইয়ারা আসে। তাঁদের দু’জনকে দেখে বলে,
-মিশাত, নিশাত যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
সেরিন, নিশাত উপরে চলে যেতে পেছন দিয়ে শুভ্র আসে। তাকে আর মাহিকে দেখে একজন সার্ভেন্ট ঠান্ডা পানীয় দেয়। সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়ে শুভ্র। আরফিন চৌধুরী তখন বলেন,
-আর্থ তো আসলো না।
তখন শুভ্র বলে,
-হয়ত কোন কাজে চাচ্চুর সাথে আটকে গেছে।
-হয়ত!
মিশাত,নিশাত, শুভ্র,মাহি তারা ফ্রেশ হয়ে আসতে সবাই খেতে বসে পড়ে।
সাইয়ারা এবং কিরণ পাটওয়ারীর ওয়াইফ তুষি তারা খাবার সার্ভে হেল্প করছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে বড়রা সবাই গল্প গুজবে মেতে উঠে। শুভ্র মাহির রুমে সোফায় বসে,বসে ফোনে ইমফরটেন্ট কথা বলছে। সেরিন নিশাতকে বিদায় দিয়ে ভেতরে আসে। নিজের রুমে গিয়ে ফোন হাতে আর্থকে কল দেয়। কয়েকবার রিং হতে আর্থ কল রিসিভ করে। এপাশ থেকে সেরিন বলে,
বিকেলের দিকে চৌধুরী পরিবারের সবাই চলে যায়। সন্ধ্যায় সিরাত পাটওয়ারী শসী আসে সেরিনের রুমে। কিরণ পাটওয়ারীর একমাত্র মেয়ে। সে এবার ইন্টার সেকন্ড ইয়ারে পড়ে। তবে তাঁদের দু’জনের কলেজ সম্পূর্ণ আলাদা। সেরিনকে ডেকে টেনেটুনে ঘুম থেকে উঠায় শসী। শসীকে দেখে সেরিন স্থির হয়ে বসে বলে,
-কখন আসলি?
-একঘন্টা আগে।
-কী দরকার ছিলো আমায় এই কলজে এডমিশন নেওয়ার। দূর তোর সাথে থাকতাম।
-এখানেই ঠিক আছে তোর।
-কেন জিজুর সাথে প্রেমের ডিস্টার্ব হয়ে যেতো নাকী?
-কে জানে বেডা কার পেছনে দৌড়াচ্ছে। সারাদিন তো এই কাজ,ওই কাজ ওর ছোট চাচ্চুর সাথে দৌড়ায়।
-জিজুর নাম কী?
-থাকুক! পরে একদিন বলবো।
সেরিন মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। শসী ফোন হাতে তার প্রেমিক পুরুষের একটা পিক বের করে। একনজরে তাতে তাকায়। ঠোঁটের কোণের হাসিটা কিছুটা প্রশস্থ হয়।
******
সন্ধ্যায় আফরান চৌধুরী আর্থ এবং আয়মান চৌধুরী বাড়ী ফিরে। আগামী কালকে আর্থর বাবা আরাফ চৌধুরী এবং তার আম্মু মিরা ঢাকায় চলে যাবে। তারা কয়েকদিনের জন্য বাড়ী এসেছিলো। আর্থ এখানেই থাকে এবং থাকবে। সে তার আম্মুর থেকে বেশী তার বড় আম্মুর জন্য পাগ’ল।
আজকে চৌধুরী পরিবারের সবাই একসাথে শুধু আর্থর বোন আর আয়মান চৌধুরীর মেয়ে ছাড়া। তারা ঢাকায় আছে। সন্ধ্যায় আর্থ আসতে আরজিনের আম্মু জান্নাতুল ফেরদৌস কোল্ড ড্রিং আর হালকা খাবার দেয়। পাশে আয়মান চৌধুরী সেসবে তার হেলদোল নেই। তার আর্থ ঠিকঠাক খেতে পারলেই হলো। বাড়ীতে সবাই আর্থকে একটু বেশী আদর যত্ন করে। তখন আয়মান চৌধুরী বলেন,
-আর্থকে এতো আদর করো কেন তোমারা?
তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
-ও আমাদের পরিবারের ছোট ছেলে। আর ছোটরা আদর একটুু বেশিই পায়।আমার ছেলেটা সারাদিন কাজে দৌড়াদৌড়ি করে। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে এটা চেয়ে আনন্দ আর কিছু আছে?
আয়মান চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর্থ হেঁসে দেয়। আরজিন তখন নিচে আসে। আর্থকে দেখে বলে,
-ব্রো সারাদিন বাইরে দৌড়াদৌড়ি করলে হবে? নিজের দিকেও তো তাকাতে হবে। এসব রাজনীতি না করে ভালো কোন জব ধরো নাহয় কোম্পানি সামলাও। রাজনীতির পেছনে বাবা ছুটে, ছোট চাচ্চু ছুটে তুমি নাহয় মেঝো চাচ্চুর সাথে অফিসে জয়েন করো। দেখো আমি কলজে সামলানোর পাশাপাশি অফিসের কাজ ও করি।
তখন আরফিন চৌধুরী বলেন,
-আয়মান ঢাকায় চলে যাবে। সুলতানাকেও বলবো চলে যেতে। তারা অফিস সামলাবে। আর্থ আমার সাথে রাজনীতি করবে। আমার পর আর্থ হবে ঢাল।আমার পরিবারে রাজনীতি ওই জিইয়ে রাখবে।
আরজিন আর কিছু বলেনা। কফির মগ নিয়ে রুমে চলে আসে। তখন তার নাম্বারে একটা মেসেজ আসে। তাতে লেখা,
“শুভ্র স্যার! আমার ফিউচার বাবুর পাপা, বাবুর আম্মুকে তো উত্তরটা দিলে না। আসলে তুমি রাজী তো? দেখো আমি কিন্তু ওয়েট করে বসে আছি।”
মেসেজ দেখে মেজাজ গরম হয়ে যায় শুভ্রর। আবার সেরিন মেসেজ পাঠিয়েছে। মেয়েটাকে বকা দিয়েও কাজ হয়নি। এতো বাবুর আম্মু হওয়ার শখ তো বিয়ে করে নেক। এতে শুভ্রকে টানার কী আছে?
“বাবুর আম্মু আপনি কী জানেন শুভ্র বিবাহিত? এমনকি তার একটা বাচ্চাও আছে। তার বাবুর আম্মু আরেকজন আপনি না। আর আশাও করবেন না কখনো। আমার বাবু আছে,বাবুর আম্মুও আছে সো এসব ফাল’তু কাজ বাদ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করেন।”
মেসেজটা লিখে শুভ্র ব্লক করে দেয়। এসব শুভ্রর বিরক্ত লাগে। নারী সংক্রান্ত কোন বিষয়ে সে নেই। তার কলেজ সুন্দর ভাবে পরিচালনা করতে পারলেই হলো। বরাবরের মতো শুভ্রদের কলেজ উপজেলায় ফাস্ট হতো রেজাল্টের দিক দিয়ে। এই কলেজের প্রিন্সিপাল শুভ্রর দাদু ছিলেন। তার ইচ্ছে ছিলো তারপরে শুভ্র কলেজটা পরিচালনা করবে। কলেজটা তার পরিশ্রম, স্বপ্নের ফল। দাদুর কথা রাখতে শুভ্র এই পেশাটাই বেছে নেয়। লন্ডন থেকে এসে কয়েকমাস দেশের আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হয়। শুভ্র ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে।
কিছুক্ষণ পর ফেসবুক স্ক্রোলিং করতে একটা ভিডিও সামনে আসে। ভিডিওটা মূলত অন্ধকার রুমে গাওয়া গানের। মেয়েলী ভয়েসটা শুভ্রকে টানলো। বর্তমানের ট্রেন্ড চলছে এটার। পুরো গানটা শুনে শুভ্র। গানটা ছিলো,
“যদি বারে,বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়।
তবে প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশেরাতে প্রেমি ডেকে যায়।
তবে ইশারা কোথায় আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা।
যদি চায়ের কাপেতে জমে নিরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!”
শুভ্রর ভয়েসটা ভালো লাগে। আইডিটা স্টক করতে ভুলেনি। মোটামুটি ভালোই ফলোয়ার্স আছে। বেশীর ভাগ গানের ছোট,ছোট রিল ভিডিও। শুভ্র কয়েকটা গান শোনে। আইডিটা চিনে রাখে। মাঝেমধ্যে আসবে গান শোনে মন ভালো করবে। আইডির মালিকের কোন পিকচার আইডিতে নেই।
রাতে ডিনার করে সেরিন আর সিরাত গিটার হাতে বেলকনিতে বসে। চন্দ্রপ্রভায় গিটারের সুর তুলছে সিরাত। সেরিন গান গাইছে। সেরিন বরাবরের মতো গান গাইতে পছন্দ আর সে ভালো গায়। গান নাচ এই দু’টো গুণে একটু বেশী গুণান্বিত সেরিন। সিরাত গান পারে তবে খুব একটা গায় না। সে নাচে সেরিনকেও ছাড়িয়ে।
***
পরেরদিন সকালে প্রাইভেটের জন্য বেড়িয়ে পড়ে সেরিন সিরাত। দুজন দু’দিকে যাবে। সেরিন তার ব্যাচমেটদের সাথে প্রাইভেট শেষ করে পিটিতে যায়। মনে,মনে হাজারখানেক গা’লি শুভ্রকে দেয়। এখন কড়া রোদে না বসালেই হলো। আজকে শুভ্র পিটিতে এসেছে তবে কোন ভাষন দেয়নি। বিষয়টা অষ্টম আশ্চর্য। এমন কোন দিন যায়নি সে ভাষণ দেয়নি। আজকে শুভ্র ভাষণ দেয়নি বিষয়টা কেউ হজম করতে পারছে না। নিশাত সেরিনকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-ইয়ে কেয়া হুয়া বান্দুফি? তোর এক বকায় বেডা সোজা! আমার মনে হয় এই শুভ্র স্যারকে একমাত্র তুই সোজা করতে পারবি।
-আরে ভাই আগামী কালকে দেখবো ঠিকই ভাষন দিচ্ছে।
-আর দিবেনা মনে হয়। কবে দেখা যাবে পিটিই বাদ দিয়ে দিলো।
-দিলে তো ভালোই। বা’লের পিটি করতে বিরক্ত লাগে।
শুভ্র পিটি শেষ হতে নিজের রুমে চলে যায়। আজকে সে ফাস্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাসটা নিবে বলে ঠিক করে। ভাবনা অনুযায়ী ফাস্ট ইয়ারের সাইন্সের রুমে চলে যায়। শুভ্রকে দেখে অনেকেই বিরক্তবোধ করে। বিশেষ করে সেরিন,নিশাত। বেশীরভাগ মেয়েরা খুশি। তাদের ক্রাশ,হ্যান্ডসাম শুভ্র স্যার। যার কাছে এটেনশন পাওয়া যায় না।
সেরিন ভাবছে শুভ্র, না জানি কত ভাষন দেয়। শুভ্র ক্লাসে প্রবেশ করাতে ক্লাস ঠান্ডা। একটা শব্দও হচ্ছে না।
তখন শুভ্র ক্লাসে চোখ ভোলায়। ঠিক সেরিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। চোখ দিয়ে ইশারা করতে সেরিন দাঁড়ায়। শুভ্র তখন বলে,
-পৃথিবীতে একজন মানুষ যার ব্রেইন সবচেয়ে বেশী চিন্তা করেছে বা খরচ করা হয়েছে। এমনকি তার মাথাটা সংরক্ষণ করা হয়েছে মিউজিয়ামে। কে সেই ব্যক্তি?
তখন সেরিন বলে,
-আইনস্টাইন।
– কত পার্সেন্ট খরচ করা হয়েছে?
– ১০০% এর ২.৫% মাত্র।
-গুড।
তখন শুভ্র বলতে শুরু করে,
– প্রতিষ্ঠিত হতে হলে পড়াশোনার বিকল্প নেই। একটা কথা মনে রাখবে “এডুকেশন ইজ দ্যা কে টু সাকসেস।”
অধ্যবসায় নিজেকে অভ্যস্ত করতে হবে। ভালো একটা রেজাল্ট নিয়ে ভালো ভার্সিটি এডমিশন নিবা। কেউবার স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে পড়াশোনার জন্য যাবা। সবচেয়ে বড় কথা মনে জোর,তেজ রাখতে হবে। এবং ছাত্রদের অবশ্যই সাপোর্ট প্রয়োজন।
তখন একটা ছেলের ফোনের সাইলেন্ট করা কলের শব্দ হয়। কথার মাঝে, শুভ্রর কানে আওয়াজ আসতে সে জিজ্ঞেস করে,
-শব্দটা কোথা থেকে এসেছে? কেউ বলতে পারবে?
তখন সেরিন বলে,
-এই ছেলেগুলোর থেকে।
-ক্লাসে ফোন নিয়ে এসেছে কে?
শুভ্র ছেলেদের সামনে যায়। তখন একটা দাঁড়িয়ে বলে,
-স্যার ওটা সেরিনের ব্যাগ থেকে শব্দ হয়েছে। আর দোষ দিচ্ছে আমাদের।
তখন শুভ্র ধমক দিয়ে বলে,
-লজ্জা করেনা? আমি বলেছি ক্যাম্পাসে ফোন এলাউ না। আমি ধরতে পারলে খবর করে ছেড়ে দেবো বলে দিলাম।
তখন আরেকটা ছেলে দাঁড়িয়ে বলে,
-স্যার সেরিন কলেজে ফোন এনেছে।
তখন সেরিন দাঁড়িয়ে বলে,
-নিজেদের দোষ আমার গাড়ে দিচ্ছিস কেন? লজ্জা করেনা? মেয়েদেরকে তো র্যাগ ভালো করিস। আমি বিচার দেইনা দেখে। যখন তোর হাত পা ভে’ঙে দেবো তখন বুঝবি এই সেরিন কী জিনিস।
তখন ছেলেটা বলে,
-তুই কী হাত পা ভাঙবি? বিচার দিয়েছিস না আমাদের নামে বাড়ী যাবি না? রাস্তায় ফেলে তোকে…. ”
ঠাস করে দু’টো চ’ড় পরে যায় ছেলেটার গালে। শুভ্র কলার ধরে টেবিল থেকে বের করে এনে ছেলেটার গাড় বরাবর একটা লা’থি মারে।
চিৎকার করে বলে,
-আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কলেজে না চলবে র্যাগিং না চলবে গুন্ডামি, না চলবে রাজনীতি, না চলবে নেতাগিরি। এই কলেজে কোন রাজনীতি চলবে না। তোর নাম কী?
-“ ডিয়ার হ্যান্ডসাম শুভ্র স্যার, আমি তোমার বাবুর আম্মু হতে চাই। আচ্ছা বাবুর আম্মু হওয়ার আবদার করেছি এখন কী আমার পা’প হবে জান? কিন্তু কী করবো বলো? তুমি তো এখনো আমায় বিয়েই করোনি। তোমার প্রস্তাবের আশায় থাকতে গেলে আমায় বুড়ো হয়ে যেতে হবে। সেজন্য নিজেই চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলাম।
এখন তোমায় আমার জামাই ওরফে বাচ্চার বাবা রুপে দেখতে চাই। একমাত্র ফিউচার বউয়ের আবদার রাখো জান।”
ইতি
তোমার ফিউচার বাবুর আম্মু
চিঠিটা পড়ে মূহুর্তে চোয়াল শক্ত করে নেয় আরজিন চৌধুরী শুভ্র।
কার এতো বড় স্পর্ধা তাকে এই ধরনের চিঠি লেখার! চিঠিটা এসেছে ফাস্ট ইয়ার থেকে। একমূহর্ত না দাঁড়িয়ে ফাস্ট ইয়ারের দিকে ছুটে আরজিন চৌধুরী শুভ্র।
তখন ফাস্ট ইয়ারে ফিজিক্স ক্লাস হচ্ছে। প্রিন্সিপাল স্যারকে এভাবে আসতে দেখে ক্লাসে থাকা টিচার কিছুটা আন্দাজ করে। হয়ত কোন ভুল হয়েছে। আরজিন শুভ্র রেগেছে মানে এখন পুরো ক্লাসে একপ্রকার ঝড় যাবে। এক ধমকে সব নিরব।
আরজিন শুভ্র ক্লাসে প্রবেশ করতে সবাই দাঁড়িয়ে সন্মান জানায়। আরজিন ক্লাসে চোখ ভোলায়। কণ্ঠস্বর কিছুটা স্বাভাবিক রেখে বলে,
-“কেউ একজন আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলে আমার কাছে। সেই মহামান্য ব্যক্তি নিজ থেকে দাঁড়িয়ে মুখটা দর্শন দাও আমায়।”
সবাই এদিকওদিক তাকাচ্ছে। তখন সবার মাঝ থেকে সেরিন দাঁড়ায়। আরজিন তাকে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সেরিনের টেবিল বরাবর এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-“তাহলে তুমি আমায় আবেদন পত্র পাঠিয়েছো?”
‘হ্যাঁ’ বোধকে মাথা নাড়ায় সেরিন। কিন্তু বুঝতে পারছে না আবেদনপত্র পেয়ে কেউ এভাবে ছুটে আসে? সাধারণ ব্যপার। সেরিনের ছুটি লাগবে সেজন্য আবেদন পত্র লিখেছে। এই প্রিন্সিপালের রুলসের শেষ নেই কলেজে। এতো,এতো রুলস মনে হয় না অন্য কোন কলেজে আছে। শুধু তার ভাইয়ার জন্য এই কলেজে এডমিশন নিয়েছে নাহয় এতো রুলস, ধমকাধমকি হ্যানত্যান এসবে সেরিন কোন কালে ছিলো না আর না থাকতে চেয়েছে।
তখন শুভ্র বলে,
-“দপ্তরি এসে যখন বলবে তখন তুমি আমার রুমে যাবে।”
শুভ্র প্রস্থান করতে সেরিন বসে পড়ে। মনের মধ্যে ভয় জোকে বসেছে। সাধারণ একটা আবেদনপত্রর জন্য এতো কাহিনী? একবারে ভালো হয়েছে আরো দাও রুলস। ভাবনা চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ক্লাসে মনোযোগ আনার চেষ্টা করে সেরিন।
পরপর দু’টো ক্লাস শেষ হতে একজন দপ্তরি আসে। সেরিন ও অনুমতি নিয়ে দপ্তরির পেছনে,পেছনে যায়। আরজিনের রুমের সামনে আসতে দপ্তরি চলে যায়। সেরিন দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
-মে আই কাম ইন স্যার?
শুভ্র হাতের পেপার থেকে নজর সরিয়ে অনুমতি দেয় ভেতরে আসার। সেরিন তখন বলে,
– “কোন প্রয়োজন স্যার?”
-“আবেদন পত্রের জায়গায় প্রেমপত্র লিখতে শিখে গেছো দেখছি। বাংলা ম্যামকে বলবো আবেদন পত্র কোনটা আর প্রেমপত্র কোনটা সেটার পার্থক্য বুঝাতে?”
-“প্রেমপত্র?”
-“আমায় জিজ্ঞেস করছো?”
-হ্যাঁ আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি।”
-“কী জেনো নাম তোমার?”
-“সেরিন পাটওয়ারী মিশাত।”
-“মাহির বোন?”
-“হ্যাঁ,হ্যাঁ।”
-“বেয়াদব মেয়ে পারিবারিক শিক্ষার বড্ড অভাব তোমার। আমি তোমার কে হই ভুলে গেছো? কত বড় দুঃসাহস তুমি দেখিয়েছো যা তোমার কল্পনার বাইরে।আমার ডায়েরিতে একবার যে স্টুডেন্ট এর নাম উঠে তার অবস্থা এক্সাম অব্দি রফাদফা করে দেই।”
ধমক দিয়ে বলে আরজিন চৌধুরী শুভ্র। সেরিন কিছুটা কেঁপে উঠে।
-“আরে ভাই এমন ভ্যাঁ, ভ্যাঁ না করে ক্লিয়ার করে বল কী করেছি আমি। সেই কখন থেকে দুঃসাহস, ব্রেইন নাই যা তা বলেই যাচ্ছিস। তোর আছেনি ব্রেইন? দু’দিন পর পর নতুন,নতুন রুলস বের করে ভাষন দেস। কোন কলেজে পিটি করায়? একমাত্র তোর বলদমার্কা আইডিয়া আর বলদ মার্কা কলেজেই এসব সম্ভব। তাও হতো কিন্তু কড়া রোদে মাঠের বসিয়ে রেখে যে ভাষণ গুলো ডেইলি দেছ ওগুলোর জন্যও হাজারটা অভিশাপ তোকে দান করি। তাও দেখ কাজে লাগে না। আস্ত মডুলাস। বাপের ক্ষমতা দেখে প্রিন্সিপাল হয়েছিস নাহলে তোর মতো পাগলকে প্রিন্সিপাল কেন কলেজ গেটের সামনে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসার অনুমতি কেউ দিতো না।”
মনে, মনে যত ক্ষোভ আছে শুভ্রর প্রতি সব তুলে নিয়েছে সেরিন। এসব কথা একবার মুখ ফসকে বাইরে বের হলে এই কলেজে জায়গা তো হবে না। আজিমপুরের কবরস্থানেও না।
তখন শুভ্র ধমকে বলে,
-“যাও ক্লাসে যাও। শিক্ষাদীক্ষা ভালোভাবে গ্রহণ করে আমার কলেজে পা রাখবে। একসপ্তাহ তোমার কলজের আশে-পাশে আসা নিষেধ। ভাগ্য ভালো টিসি দিয়ে বের করে দেইনি।”
সেরিন আর কথা বাড়ায়নি। রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা দ্বিতীয় ভবনের থার্ড ফ্লোরে যায়। লাস্ট ক্লাসটা কোনরকম করে। ছুটি হতে তার বেস্টফ্রেন্ড নিশাতের সাথে বেড়িয়ে আসে। ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে বসে দু’জন। একটু পর সেরিনের ভাই, নিশাতের বয়ফ্রেন্ড সাফিন পাটওয়ারী মাহি আসবে। তাঁদের দু’জনকে পিক করে নিয়ে যেতে। সেরিন কিছুটা মন মরা হয়ে বসে আছে।
মাহি গাড়ী নিয়ে কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আবার শুভ্র আসে। মাহিকে দেখে সেও গাড়ীতে উঠে বসে। আজকে মাহিদের বাসায় যাবে। তাঁর বাবা মা, জেঠু,জেঠিমা বাকী সদস্যরাও আজকে গিয়েছে। তাঁদের ইনভাইট ছিলো। মাহি গাড়ী স্টার্ট দিয়ে শুভ্রদের বাড়ীর গেটের সামনে এনে থামায়। সেরিনের জন্য অপেক্ষা করছে সে।
শুভ্র ফোন স্ক্রোল করে।
তাঁদের বাড়ী আর কলেজ রাস্তার এপাশ আর ওপাশ। কলেজের চত্বর শেষে তাঁদের বাড়ীর চত্বর শুরু।
নিরবতা বজায় রেখে মাহি বলে,
-“দিনকাল কেমন যাচ্ছে শুভ্র?”
-“যেমন যাওয়ার।খুব প্রেশারে নিজেও আছি প্লাস স্টুডেন্টদের ও দিচ্ছি। কলেজটা তো বরবাদ হয়ে যাচ্ছিলো। এখনো প্রচুর স্টুডেন্ট আমায় গা’লি দেয় আমার এসব আউলা ঝাউলা রুলসের জন্য।”
-“আসলেই আউলা ঝাউলা মার্কা রুলস তোর।”
তখন সেরিন পানির বোতল নিয়ে গাড়ীতে বসে। নিশাত ও তার পাশের সীটে বসে। আরজিন যে গাড়ীতে বসে আছে সেসব তাদের খেয়াল নেই। সেরিনের মেজাজ বিগড়ে আছে। নিশান আরজিনের কথা তোলার সাহস পাচ্ছে না। তবুও বলে,
-“সেরিন আরজিন চৌধুরী শুভ্র স্যার আজকে তোকে কেনো ডেকেছে?”
-“শা’লা তার নিজের আছেনি ব্রেইন? আবার আসে আমায় বলতে। কথা ক্লিয়ার ভাবে না বলে আমার পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বা’লের একটা কলেজ। ভাগ্যিস তার বাপ এমপি, তাদের কলেজ নাহলে একে কলেজের প্রিন্সিপাল কেন পাগ’ল মনে করেও কেউ কলেজ গেটে ভিক্ষা করার জন্য বসতে দিতো না। দেখনা দুইদিন পর পর কড়া রোদে বসিয়ে রেখে চুলের ভাষণ দেয়। মানুষ অসুস্থ থাকতে পারে,পারিপার্শ্বিক প্রব্লেম থাকতে পারে। কল দিয়ে বললে ছুটি দেওয়া যায় না? আবেদন পত্র লাগবে তাও তার কাছে আবেদন! কত ঢং দেখলাম। শুধু সাফিনের জন্য নাহলে এসব কলেজে সেরিন পদধূলি ও দেয়না।”
-“দেখবি সাফিন আবার ওই মাথামোটা স্যারের কাছে সব লাগিয়েও দিয়েছে। সাফিন কোন কথা বাইরে গেলে খবর আছে। সেরিন ঠিকই বলেছে। ওই প্রিন্সিপালের মাথায় সমস্যা আছে।”
-“সমস্যা মানে পুরাই সমস্যা। ওনার নাম আরজিন না আস্ত একটা জিন।”
তখন আরজিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-“হ্যাঁ,হ্যাঁ আমি জিন। আর তুমি হলে পেত্নী।”
আরজিনের কন্ঠ শোনে সেরিন বলে,
-“ভাই সত্যি মনে হয় প্রিন্সিবা’ল একটা জিন। দেখ তার নামে বদনাম করছি তো তার জিন তার হয়ে কথা বলছে। আল্লাহ একে কবিরাজ দেখানো উচিত। নাহলে বাকী দুই বছরে আমাদের লা’*শ বানিয়ে দিবে।”
-“মাহি গাড়ীটা থামা তো।”
শুভ্রর কথায় মাহিম ব্রেক কষে। সেরিন আর নিশাত দু’জন দু’জনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। তখন নিশাত বলে,
-“আয় গাড়ী থেকে নেমে যাই। আসলেই জ্বী’ন আছে।”
তখন সেরিন বলে,
-“না,না জ্বী’নকে আমি ভয় পাবো নাকী? দোয়া দরুদ পড়লে জিন চলে যাবে।”
-“ওটা হাওয়ায় ভাসা জিন না আরজিন। আরজিন চৌধুরী শুভ্র।একবারে স্ব শরীরে উপস্থিত এখানে। কথা বলার সময় তো হুঁশ থাকে না দুজনের। আমার কলেজ,আমার নামে এতো,এতো বদনাম। একসপ্তাহ না দুইমাস কলেজের চত্বরের আসেপাশে দেখলে ঠ্যাং ভে’ঙে দেবো।”
-“এখন তো আপনি আমার ভাইয়ার গেস্ট। প্রিন্সিপাল না। আপনার কলেজে বসে আপনার নামে কিছু বললে তখন নাহয় একশন নিতেন। এখন তো আমরা কলেজের বাইরে প্রিন্সিপালকে নিয়ে কথা বলছি। চাইলে আপনিও আমাদের সাথে যোগ দিয়ে তার নামে কিছু বলতে পারেন।”
-“আমার বয়ে গেছে নিজের নামে নিজে বলতে।”
-“তাহলে চুপচাপ শুনুন আর আমাদের বলতে দিন।”
-“নিজের নামে বদনাম নিজে বসে,বসে শোনবো?”
-“সেটা আপনার ইচ্ছা।”
তখন সাফিন বলে,
-“আসল ঘটনাটা কেউ আমায় খুলে বলবি? কী নিয়ে এতো বকা-ঝকা?”
-“আসল ঘটনাটা আমি জানলে তো বলবো ভাইয়া। শুভ্র স্যার আমায় কী জন্য বকা-ঝকা করেছে জানি না। আমি ছুটির জন্য আবেদনপত্র লিখেছি আর উনি কীসব প্রেমপত্রের কথা বলছে।”
-“ছিঃ বন্ধু ছিঃ! আমার বোনের আবেদনপত্রকে তুই প্রেমপত্র বানিয়ে দিলি?”
-“মাহি ওটা আবেদনপত্র হলে আমি আবেদনপত্রই বলতাম। তোর বোনের জামাই দরকার সেজন্য আমায় প্রেমপত্র দিয়ে ডিস্টার্ব করছে।”
-“বয়ে গেছে আমার আধবুড়ো লোককে ডিস্টার্ব করতে। আমার ও বাপ ভাই,পার্সোনাল লোক আছে। সেরিন কাউকে প্রেমপত্র দেয়না। উল্টো ছেলেরা তাকে দেয়।”
-“এসবের কিছুই আমি জানতে চাইনি। মুখটা বন্ধ রাখো। সব কথায় ঝড়ের গতিতে উত্তর দিতে হয়না। মাঝেমধ্যে চুপ থাকতে হয়। ধৈর্য তো নাই মনে হয় আর না আছে শালিনতা। কথায়,কথায় উত্তর দেওয়া লাগে।”
সেরিনকে ধমক দিয়ে বলে আরজিন। সেরিন নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এতো ধমকা ধমকি তার পছন্দ না। কিন্তু শুভ্র তাকে ধমকের উপরেই রাখছে।
দেখতে দেখতে প্রায় ২ বছর কেটে গেছে। সৌরভ আর মিথিলার সাংসারিক জীবন বেশ ভালো কাটছে। আহতাব আর অহনার ছেলে হয়েছে। সবেমাত্র ২ বছরে পা দিয়েছে আহান। বয়সের তুলনায় তার বুদ্ধি বেশ প্রখর।
আজ মেঘ আর মেহতাবের ম্যারেজ এনিভার্সারি। মেঘ ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মেঘের এই অবস্থায় মেহতাব কাজ ফেলে এসে সারাক্ষণ মেঘের আশে পাশে থাকে। বলা যায় না মেঘের কখন কিসের প্রয়োজন পরে? এখন সে শুধু স্বামী নয় বাবা হতে চললো বলে। এই নিয়ে সবাই মজা করলেও মেহতাব গাঁয়ে মাখে না।
কেউ কিছু বললেই এক কথা, ❝বউ আমার আমি আগলে রাখবো না তো কে রাখবে?❞
আপাদত মেঘ সোফায় বসে আছে। পেট সামলে চলতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়। আর মেহতাব তো আছেই পান থেকে চুন খসলেই সঙ্গে সঙ্গে হাজির। এই যে মেঘ সোফায় বসে আছে নিজের জ্বালায় আর মেহতাব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যদি কোনো আর্জি থাকে সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করতে প্রস্তুত। বাকি সদস্যরা তা দেখতে হাজির। হুল্লোড় পার্টির সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে মজা দেখছে। হঠাৎ সেখানে আহান গুটি গুটি পায়ে হাজির। সব বাচ্চারা এই বয়সে আদো আদো গলায় কথা বললেও আহান একদম আলাদা তার কথায় কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি নেই। এই বয়সেই নির্ভুল এবং স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারে সে। মেহতাব আহান কে কোলে নিয়ে বলে উঠলো,
মেহতাব : তুমি কি চাও ভাই না বোন?
আহানের সোজা সাপ্টা উত্তর,
আহান : বউ।
সবাই আহানের কথা মজা নিয়ে উড়িয়ে দিলো।
সন্ধ্যায় ঘরোয়াভাবে মেঘ, মেহতাবের ম্যারেজ এনিভার্সারির আয়োজন করা হয়েছে। মেঘ অসুস্থ বলে ঘরোয়া ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। আপাদত মেঘ নিজের রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লাল রঙ্গের সাদা পাড়ের শাড়ি পরেছে সে। নুয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করতে পারছে না। হঠাৎ মেহতাব এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসে মেঘের কুচি ঠিক করতে লাগলো। মেহতাবের আচমকা আশায় মেঘ হতবিহ্বল হলেও মেহতাব কে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মেহতাব কুচি ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে মেঘের কপালে গাঢ় চুম্বন করলো। মেঘকে ঘুরিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
মেহতাব : এই যে মিহির মাম্মাম, মিহির আসার অপেক্ষায় তাঁর পিতৃহৃদয় ভীষণ ব্যাকুল, বলে দিও ওকে।
মেঘ মুচকি হাসলো মিহি কে? সে বুঝে গেছে। সে যা ভেবেছে তা নয় সে একটু বেশি ভেবে ফেলেছে। যেই লোকটা তাকে এতো ভালোবাসে সেই লোকটা তার বিশ্বাস কোনোদিনও ভাঙবেনা। লোকটা একান্ত মেঘের, শুধুই মেঘের। এই কথা ভাবতেই দেহে অদ্ভুত এক অনুভুতির জানান দিচ্ছে! মেঘ মধুর, সিগ্ধময়ী হাসি ঝুলিয়ে মনে মনে একটা শব্দই বিড়বিড় করতে থাকলো,
❝আপনি মেঘের, একান্তই মেঘের❞
সন্ধ্যায় সবাই মোটামুটি ভালোই মজা করেছে। সৌরভ আর মিথিলাও এসেছে। বড়রা নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। মেয়েরা সবাই উপরের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।ছেলেরা সবাই ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। অনেকদিন পর দেখা আড্ডা দিচ্ছে সবাই। সৌরভ সোফায় শুয়ে পা দুলাতে দুলাতে মজা করে ঠাট্টার ছলে বলে উঠলো,
সৌরভ : দোস্ত যাই কও। আমার জন্যই কিন্তু তুই পিতা হইতে পারতাছোস।
মেহতাব ফোন টেবিলে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বলে উঠলো,
মেহতাব : বাবা হবো আমি অথচ বাবা হওয়ার সব ক্রেডিট তোর।
সিয়াম আফসোসের সুরে বললো,
সিয়াম : ভাই তোরা তো বিয়া করছোস পিতাও হবি আমাগো তিন জনের ভাগ্য কবে খুলবো।
রৌফ : জীবনে কিছুই করতে পারলাম না।
সামির : আমিও কারো বেবি হওয়ার কারণ হতে চাই।
মেহতাব সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বললো,
মেহতাব : বাবা হওয়া অতো সহজ না। ইটস এ লং প্রসেস।
সিয়াম দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলে উঠলো,
সিয়াম : নাউজুবিল্লাহ। বেশরম কথাবার্তা লজ্জা বলতে কিচ্ছু নাই।
মেহতাব বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
মেহতাব : লজ্জা থাকলে বাবা হতে পারতাম না আর তুই মামা হওয়া থেকে বঞ্চিত হতি।
রৌফ : আমার পাক পবিত্র মন তোগোর লগে মিশা নষ্ট হইবার পথে, দূরে যা।
সামির : এমন ভাব করতাছোস যেনো ভাজা মাছ উল্টাইয়া খাইতে পারোছ না।
রৌফ: খাওয়া শুধু তোর কাজ পেটুক একটা।
সামির : গু খায় সব মাছে দোষ পড়ে পাঙ্গাস মাছের।
সৌরভ হেসে বলে উঠলো,
সৌরভ : তুই পাঙ্গাস মাছ নাকি? পাঙ্গাস মাছ টারে তোর লগে তুলনা কইরা অপমান করিস না।
এই বলে সামিরকে কেন্দ্র করে সবাই হাসিহাসি করলো। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে সবাই যার যার রুমে বিশ্রাম করতে চলে গেলো।
মেহতাব ঘরে প্রবেশ করে মেঘকে দেখতে না পেয়ে মেঘকে খুঁজতে লাগলো সবজায়গায়। অনেক খোঁজা খুঁজির পর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মেঘকে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রিয়তমা পড়নে ওই একই শাড়ি। চুলগুলো শীতল বাতাসে উড়ছে। দৃষ্টি তাঁর আকাশপানে আকাশে তাঁরার মেলা। তাঁরা ভরা আকাশ মেঘের বরাবরই প্রিয়। মেহতাব পাশে এসে মেঘের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মেঘ মেহতাবকে দেখে স্মিত হাসলো। মেহতাবের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলে উঠলো,
মেঘ : আমি যদি আপনার জীবনে এইভাবে না আসতাম আপনি কি আমায় ভালোবাসতেন?
মেঘের কথা কর্নপাত হতেই মেহতাব অবাকের সহিত বললো,
মেহতাব : হঠাৎ এই প্রশ্ন?
মেঘ : ভালোবাসতেন?
মেহতাব আকাশপানে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পরক্ষনেই বলে উঠলো,
মেহতাব : জানি না তবে #তুমি_এসেছিলে_বলে জীবন আজ সুন্দর। এই এতো সুন্দর তাঁরা ভরা আকাশ তোমায় ছাড়া ভালো লাগত না। আমার জীবনের সৌন্দর্য টাই তো তুমি। তুমি যেভাবেই আমার জীবনে আসতে আমি সেভাবেই তোমায় ভালবাসতাম। ❝ভালোবাসা এমনি হয় তুমি যেভাবেই আসো না কেনো তোমার প্রেমে পড়তে বাধ্য আমি❞
মেঘ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। প্রতিটি কথা মেঘকে বাধ্য করে মেহতাবের প্রেমে পড়তে। মেহতাবের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত মেঘের হৃদয়ে গেঁথে গেছে। ঠিকই তো ভালোবাসা এমনই হয় যাকে ভালোবাসার সে যেভাবেই আসুক শুধু ভালোবাসায় পবিত্রতা, ভরসা, বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। আর কি চাই?
মেঘ মেহতাবের মলিন, সিগ্ধকর মুখের পানে তাকলো। মেহতাব একই ভাবে গভীর, ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এগিয়ে গিয়ে মেহতাবকে শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরলো। যেনো এই বাঁধন আজীবনের। মেহতাবের বুকে মাথা রাখলো এই একটিমাত্র জায়গাই তাঁর একমাত্র ভরসার স্থল। মেহতাব কপালে গাঢ় চুম্বন করে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,
সবাই বাড়িতে ফিরেছে বেশ বেলা করে। কেনাকাটা করে রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেয়ে একেবারে বাসায় ফিরেছে। গাড়ি পার্ক করে সবাই একসাথে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়ির সাজগোজ কমপ্লিট। অরিন বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে সবাইকে তাড়া দিলেন রেডি হতে। কিছুক্ষণ পর গেস্ট রা এসে পড়বে। মিথিলার গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার দিকে পালন করা হবে। তাই কেউ আর দিরুক্তি না করে নিজেদের রুমে চলে গেল রেডি হতে।
সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। মেঘ কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে। কানে বড় ঝুমকো পড়েছে, হালকা মেকআপ। এতেই তাকে ভারী মিষ্টি লাগছে! মেঘ বেরোতে যাবে চোখ দরজায় ঠেস হয়ে দাড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে গেলো। পড়নে হলুদ রঙের শার্ট। বেশ ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।মেঘ দেখেও না দেখার ভান করে যেতেই। মেহতাব গলা খাঁকারি দিলো। মেঘ তবুও ফিরে তাকালো না। এবার মেহতাব ছুটে এসে পিছন থেকে মেঘের হাত ধরলো। মেঘের চুলে হাত দিয়ে সন্তর্পনে কিছু একটা করলো। মেঘ হাত রাখতেই বুঝে গেলো গোলাপের গাজরা। মেঘ খুশি হলো তবুও প্রকাশ করলো না। মেহতাব কানের কাছে মুখ এনে ঘোর লাগা কন্ঠে শুধালো,
মেহতাব : এতো সুন্দর না হলেও পারতে।
মেঘ মুচকি হাসলো। মেহতাব এর দিকে কড়া নজরে তাকালো। ভাবুক কন্ঠে বলে উঠলো,
মেঘ : আপনি পাঞ্জাবি কেনো পড়েননি?
মেহতাব বেশ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ভঙ্গিতে বললো,
মেহতাব : যতদিন বউ আমায় নিজের হাতে পাঞ্জাবি পড়িয়ে দিচ্ছে না, ততদিন পড়বো না বলে ব্রত করেছি।
মেঘ মেহতাবের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেহতাব ইতস্তত করে বলে উঠলো,
মেহতাব : সমস্যা নেই বউ। পাঞ্জাবি আমি নিজেই পড়তে পারবো কিন্তু তুমি চাইলে আমি তোমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে পারি। আমার দিক দিয়ে কোনো আপত্তি নেই।
মেঘ কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। লোকটা ইদানিং উদ্ভট কথাবার্তা বলে। মেঘকে লজ্জায় ফেলতে ওস্তাদ লোকটি। মেঘ বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলো। গালে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করলো। গাল দুটো আবার গরম হয়ে গেছে। মেহতাব মুচকি হেসে পিছন থেকে বলে উঠলো,
মেহতাব : যেখানেই যাও দেখা তো আবার আমার সাথে হবেই। ❝মেয়ে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।❞
শেষ কথাটা মেহতাব বেশ জোড়ে বললো। আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো সবাই তার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী অদ্ভুত সেই চাহনি! হুল্লোড় পার্টির গ্যাং নিচেই ছিলো তারা চাইলেও হাসি থামাতে পারলো না। মিটিমিটি হাসতে লাগলো। কেউ ঠোঁট কামড়ে, কেউ মুখ চেপে তো কেউ বা প্রকাশ্যে হেসে উঠলো। মেহতাব কে এই প্রথম তারা এভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখেছে। সবার বেশ ভালো লেগেছে!
গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করা হয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টা আগে। এতক্ষন গান বাজনা চালালেও। এখন পরিবেশ টা বেশ শান্ত। মিথিলাকে হলুদ মাখিয়ে সবাই ভূত করে দিয়েছে। মিথিলা চেঞ্জ করে রুমের ভিতর সৌরভের সাথে কথা বলছে। সব মেহমানরা বাসায় চলে গেছে। কাছের কয়েকজন গেস্ট উপরের খালি রুমে গুলোতে শুয়েছে। সবাই ভীষণ ক্লান্ত থাকায় নিজেদের মতো যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে। এখন শুধু মেহতাব আর মেঘ জেগে রয়েছে। মেঘ টুকিটাকি কাজ করে নিচ্ছে। মেহতাব সোফায় বসে তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেগুনি রঙের শাড়ি পরে আঁচল কোমরে গুঁজে সে এক ধ্যাঁনে কাজ করছে। মেহতাব চুপি চুপি মেঘকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মেঘের কাধে থুতনি রেখে নেশালো কন্ঠে বলে উঠলো,
মেহতাব : চলো না উপরের রুমে একটু আলাদা টাইম স্পেন্ড করি।
মেঘ মেহতাব বের হাত সরিয়ে বলে উঠলো,
মেঘ : ছাড়ুন অনেক কাজ।
মেহতাব : স্টাফরা করে নিবে।
মেঘ : স্টাফদের জন্য এতো কাজ ফেলে রাখা মোটেও উচিত নয়।
মেহতাব : হুশ যাবে কি যাবে না?
মেঘ : যাবো না।
মেহতাব : এখন যদি আমার সঙ্গে না যাও তুলে নিয়ে যাবো। ওয়ার্নিং দিচ্ছি।
মেঘ : আপনার যা ইচ্ছে করুন। আমি যেতে পারব না।
মেঘের কথায় মেহতাব কান না দিয়ে মেঘকে কলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে দিল। মেঘ ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না সুঠাম দেহীর লোকটার সঙ্গে। মেহতাব যেই ড্রয়িংরুম পেরোবে। মার্জা বেগম হাজির হলেন পিছু পিছু হুল্লোড় পার্টির সদস্যরা ও। মারজা বেগম হেসে বলে উঠলেন,
মারজা বেগম : পুতির মুখ কবে দেখাইবা?
মারজা বেগমের কথায় লজ্জা পেয়ে মেহতাব মেঘকে ওখানেই দাড় করিয়ে রেখে কেটে পড়লো। সবাই সমস্বরে হেসে বলে উঠলো,
“দাদী তুসি গ্রেট হো”
মারজা বেগম মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে চলে গেলেন নিজের রুমে। সবাই সোফাতে বসে পড়লো। শাম্মী বলে উঠলো,
শাম্মী : ভাইয়ার মুখটা দেখার মতো ছিলো।
সিমরান : একদম।
সিয়াম মেঘের দিকে তাকিয়ে নেকা কান্না কেঁদে বলে উঠলো,
সিয়াম : মেঘ আমার নিষ্পাপ দোস্ত টাকে দেখে রেখো।
রৌফ সিয়ামের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলে উঠলো,
রৌফ : যারে হাতে ধইরা বড় করছি সে আজ অন্য মেয়ের জামাই।
মেহসান : ওভারএকটিং বন্ধ করো ফর গড সেইক।
সামির অভার লোডেড হয়ে বলে উঠলো,
সামির : অতো আমার কোলে ১ নাম্বার কতো করছে। আজও আমার সেই ভেজা পেন্ট স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি এখনো শুকোয় নি।
সৌম বলে উঠলো,
সৌম : চাপা মারার লিমিট কার্ড এখনও দেয়নি নাকি তোমাদের।
শাম্মী পা দুটো সোফায় উঠিয়ে বলে উঠলো,
শাম্মী : আজাইরা কথা। ভাইয়া যখন ছোট তুমি কি তখন দামড়া ছিলা।
সবাই হেসে উঠলো। সবাই সবার মতো কথা বলে যাচ্ছে। কেউ কারো পিছু লাগতে ছাড়েনি। মেঘ সোফায় বসে ওদের খুনসুটি গুলো দেখছিল। সবাই একসাথে থাকলে কতো হাসি-খুশি থাকে! বাড়িটাও প্রাণ ফিরে পায় যেনো।
সবাই কথা বলে রুমে ঘুমাতে চলে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় এখন ৩ টা বাজতে ২০ মিনিট দেখাচ্ছে। মেঘ তপ্ত শ্বাস ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনি গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো। মেঘ কৌতূহল বশত সদর দরজা খুলতেই মেহতাব কে জিপে বসে থাকতে দেখতে পেলো। পড়নে ব্ল্যাক জ্যাকেট আর ব্ল্যাক পেন্ট। মেঘ অবাকের সহিত প্রশ্ন ছুড়ে বলে উঠলো,
মেঘ : এখানে কী করছেন?
মেহতাব : পেত্নীদের থেকে বউ পটানোর কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করছি।
মেঘ : ফালতু কথা বলবেন না। বলুন কি করছেন?
মেহতাব : বউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। বউ বড্ড আনরোমান্টিক তাই একটু লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে চাই যাতে বাইরের প্রকৃতিতে ভিতরের ফিলিংসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
মেঘ : ঠিকাছে আপনি বউয়ের জন্য অপেক্ষা করুন আমি ঘুমাতে গেলাম।
মেঘ এই বলে যেতেই মেহতাব জোড়ে জোড়ে হর্ন বাজানো শুরু করলো। মেঘ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। মেহতাব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এখনও বসে আছে। নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
মেহতাব : জান আসো প্লিজ। নাহলে আমি হর্ন বাজিয়ে সকলের ঘুমের ৩ টা বাজিয়ে দিবো। তিনটা বাজতে এখনো ১৫ মিনিট আছে, যাও রেডি হয়ে এসো।
মেঘ : ব্ল্যাকমেল করছেন।
মেহতাব কোমল সুরে বললো,
মেহতাব : এই প্রথম কোন কিছুর জন্য অনুরোধ করছি। আশা করবো এই প্রেমিক পুরুষকে নিরাশ করবে না।
মেহতাবের এই অনুরোধ কে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাধ্য মেঘের নেই। মেঘ কিছু না বলে চলে গেলো। মেঘ রেডি হতে গেছে এটা মেহতাব জানে। এই বুদ্ধি কাজে লেগেছে, বুদ্ধিটা অবশ্য সৌরভের ক্রেডিট তাকেই দেওয়া যায়।
৫ মিনিট বাকি ৩ টা বাজতে, মেহতাব একই ভাবে বসে আছে। মেঘের আসার অপেক্ষা শুধু। আজ পূর্ণিমার রাত চাঁদের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে। নিস্তব্ধ পরিবেশ এতো রাতে কারো জেগে থাকার কথাও নয়। ফেব্রুয়ারি মাসে শীত খুব বেশি না পড়লেও আজ শীত অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি। হঠাৎ মেঘের আবির্ভাব ঘটলো । মেহতাব কাভার্ডে একটা কালো শাড়ী কিনে লুকিয়ে রেখেছিল। মেঘ সেটাই পড়েছে। কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহার করে নি। তবুও বড্ড মায়াবী লাগছে! মেহতাব চাইলেও চোখ সরাতে পারছে না। মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো মেহতাব। মেঘ মুচকি হেসে উঠে পড়লো। মেহতাব চাঁদের আলো মিশ্রিত হাসি দিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
মেহতাব : ❝ভালোবাসি❞
মেঘ এক দৃষ্টিতে মেহতাবের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহতাবের গভীর দৃষ্টি দেখে মেঘের হৃদ স্পন্দন যেনো শতগুন বেড়ে গেলো।
মেহতাব জিপ চালাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আড়ালে মেঘের দিকে দুই একবার তাকাচ্ছে। মেঘ এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। শীতল শিরশিরে বাতাস তার মধ্যে এই নির্জনতা বেশ ভালো লাগছে! মেহতাব হঠাৎ জিপ কোথাও একটা দাড় করালো। নিজে নেমে মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। মেঘও নেমে পড়লো। পূর্ণিমার রাত হওয়ায় চারিদিক আলোকিত। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা কোনো দীঘি। মেহতাব এগিয়ে যেতে লাগলো মেঘও তাকে অনুসরণ করে এক স্থানে বসলো। মেহতাব ফিসফিসিয়ে বললো,
নতুন বছরের দিনগুলো প্রতিদিনের মতো ব্যাস্ততায় কেটেছে মেঘের। গভীর রাত প্রায় ৪ টা ছুঁই ছুঁই। মেঘ গভীর ঘুমে মগ্ন। জানালার পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঠাঁই পেয়েছে। হঠাৎ ঘাড়ে কারো গরম নিশ্বাস টের পাচ্ছে মেঘ। কারো বাহুডোরে আবদ্ধ সে। তড়িঘড়ি করে উঠে হনহনিয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ধরাম করে নিচে পড়ে গেল মেঘ। মেঘের পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে লোকটি ঘুম মগ্ন অবস্থায় পিটপিট করে তাকালো। মেহতাবকে দেখে মেঘ চিৎকার করতে যাবে। মেহতাব এসে মুখ চেপে ধরলো।
— করছো কী? শাট আপ। এটা আমি মেহতাব কোনো ভূত নই।
মেঘ মুখ থেকে মেহতাবের হাত সরিয়ে কোমরে হাত দিয়ে উঠে দাড়াতে গিয়ে আবার ধপাশ করে পড়ে গেলো। মেহতাব মেঘকে হাত ধরে উঠিয়ে দিলো। মেঘ মেহতাবকে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করলো। পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে ঘরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। মেহতাবের দিকে দৃষ্টি যেতেই মেহতাবের গভীর দৃষ্টি আর মুখে শয়তানি হাসি দেখে বুঝতে বাকি রইল না সে অপ্রস্তুতকর পরিস্থিতিতে আছে। এপাশ ওপাশ না তাকিয়ে বিনাবাক্যে নিচে পড়া থাকা ওড়না নিয়ে দৌড় দিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে গিয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। মেহতাব স্মিত হেসে আবার শুয়ে পড়লো । একে তো জার্নি করে এসেছে আবার বউ তাকে ভুলে গেছে। মনে করাতে হবে একটু রোমান্টিকভাবে। এই ভেবে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে পড়লো।
মেঘ ফ্রেশ হয়ে এসেছে। মেহতাব কে বসে থাকতে দেখে বলে উঠলো ,
— আপনি হঠাৎ না বলে হুট করে চলে এলেন?
— কেনো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, খুশি হও নি?
— না তেমন কিছু না, তাহলে রান্না করে রাখতাম।
আপনি কি খাবেন?
— এনিথিং ভালোবেসে যা বানিয়ে দিবে।
মেঘের বেশ সন্দেহ হচ্ছে মেহতাবের মধুর বাণী শুনে । এটা মেহতাব নাকি কোনো ভূত প্রেত । যাই হোক রোমান্টিক বটে!আপাদত এইসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে গাঁয়ে শাল জড়িয়ে নিচে কিচেনের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
কিচেনে রান্না করছে মেঘ। সামির ঘরের দরজা খোলা দেখে কিছু না ভেবে ঢুকে পড়লো। এমনিতেও আজকে সৌরভের সম্মন্ধ নিয়ে আসবে মিথিলার জন্য। তাই বাকিরা সৌরভের বাড়িতেই বর পক্ষ হিসেবে আসবে। এই বাড়িতেই মেয়ে দেখবে। একে তো সৌরভ তাদের সম্পর্ক গোপনে রেখেছে কিন্তু যাই হোক বিয়েতে খাবারের দিকের দায়িত্ত্ব সে নেবে সে বলে দিয়েছে। তাই সে কনের বাড়িতেই থাকবে। মুচকি হেসে মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে বলে উঠলো ,
— খাবার মানে সামির। সামির মানে খাবার। খাদ্যসৃঙ্খল ভঙ্গ করা কার সাদ্ধি আমি খাবার খেয়ে তা রক্ষা করবে। দুনিয়া বিলুপ্ত হয়ে যাক, খাবার তুই আমার থাক।
এইসব ভাবতে ভাবতে কিচেনে তাকিয়ে থমকে যায় সে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কে? সাদা চাদর টা শুধু চোখে পড়েছে। কিন্তু রাতে তো ডাইনি, পেত্নীরা সুন্দর ছেলেদের ধরে ব্রেকফাস্ট সাড়ে ।
— আমি তো একদম দেখতে নাদুস-নুদুস দুই বেলার জন্য পারফেক্ট।
নিজের কথার মানে নিজে বুঝতে পেরে, ওখানেই অজ্ঞান হয়ে ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো সামির।
সকাল হয়ে গেছে। সবাই বাড়িতে বেশ হাসিখুশি মেহতাব ফিরে এসেছে তাই। অরিন বেগম আর বাকিরাও সকল ব্যাস্ততা ছেড়ে এক হয়েছে। শুধু অহনা আসতে পারেনি আহ্তাব অহনার কাছে গিয়েছে তার সাথে কয়েকদিন থাকার জন্য। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই একসাথে বসে নাস্তা করছে। মিনহাজ সাহেবের জরুরি কল আসায় বসা থেকে উঠে চলে গেলেন। সামির চুপচাপ নড়াচড়া বিহীন বসে আছে । টেবিলে এতো খাবার সাজানো সামিরের তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই বেশ লক্ষ্য করেছে মিটিমিটি হাসছে।
— খাচ্ছ না কেন বাবা?
অরিন বেগমের স্নেহময়ী গলা শুনে সামির কথা না বাড়িয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে খাওয়া শুরু করলো। মেহসান তা দেখে বলে উঠলো,
— ভাইয়া তো সেই পেত্নীর সাথে আলাপ- সালাপ কেমন হলো? কবে খাবে তোমায়? কোনো ডট ফিক্সড করেছে?
মেহসানের কথা শুনে সবাই মুখ টিপে মিটিমিটি হাসলো। মেহসানের দিকে অরিন বেগম রাগী দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করলেন। মেহসান আর কিছু বললো না। সবাই ব্রেকফাস্ট শেষে সোফায় বসে পড়লো। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। মেঘ গিয়ে দরজা খুলতেই মিথিলা , সিমরান , শাম্মী আর সিমু বেগম প্রবেশ করলেন সঙ্গে মেহতাবের মামী ইতি বেগম আর সৌমও এসেছে। ইতি বেগম আর শিমু বেগম মেঘকে জড়িয়ে ধরলেন। অরিন বেগম এগিয়ে এসে শিমু বেগম আর ইতি বেগম কে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। সিমরান,শাম্মী,মিথিলা মেঘের দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো একসাথে। সৌম হাই টেনে বলে উঠলো,
— সরো তোমরা। ভাবীকে আমার সাথে কথা বলার সুযোগ দেও। তিনজন এতো ফ্যাট রাখো কোথায়?
সৌমের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভিতরে প্রবেশ করে সবাই সোফায় বসে পড়লো। সবাই বসে বসে আলাপ আলোচনা করছে। মেহতাবের মুখোমুখি মেঘ বসেছে। মেঘের পাশে মিথিলারা আর মেহতাববের পাশে সামির প্লেট থেকে মিষ্টি খাচ্ছে। মেহতাব গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে মেঘের বেশ লজ্জা লাগছে। সিমরান আর বাকিরাও বেশ লক্ষ্য করেছে। হঠাৎ মেঘের ফোনে টুং করে আওয়াজ হলো। মেঘ ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মেহতাব এর মেসেজ দেখতে পেলো। সবার চোখের আড়ালে মেসেজ টা পড়ে নিল।
— উপরে এসো আ’ম ওয়েটিং।
মেঘ সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মেহতাব সিড়ি দিয়ে উপরে যাচ্ছে। মেঘের ভীষণ রাগ হলো। একেই তো বাড়িতে এতো মানুষ। তাদের চোখের আড়ালে কিভাবে যাবে? মেঘ হঠাৎ দাড়িয়ে বলে উঠলো,
— মা আমার ফোন টা ঘরে রেখে এসেছি। অহনা আপুকে জানিয়ে দিয়ে আসি বিকেলে এই জায়গায় চলে আসতে।
অরিন বেগম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে আবার গল্প করতে লাগলেন। মেঘ তড়িঘড়ি করে উপরে চলে গেলো। সিমরান, শাম্মী, মিথিলা, মেহসান আর সৌম এতক্ষন বেশ মনোযোগ দিয়ে মেঘকে পর্যবেক্ষণ করেছে। মেঘ এক নিশ্বাসে কথা গুলো বললো যেনো অনেক তাড়া। বেশ অদ্ভুত! অন্যদিকে সামির খেয়েই চলেছে যেনো কতো দিন না খেয়ে ছিলো। সামির কে পাত্তা না দিয়ে তারা মেঘের উপর গোয়েন্দা গিরি করতে উপরে চলে গেলো।
মেঘ ঘরে প্রবেশ করতেই মেহতাবকে দেখতে পেলো না। না কোথাও নেই? ভিতরে ঢুকতেই কেউ পিছন থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজা আটকানোর শব্দ পেতেই মেঘ পিছনে ফিরে তাকালো। মেহতাব কে দেখে বলে উঠলো,
— কেনো ডেকেছেন?
— কেনো ডাকা বারণ?
— না আজকে মিথিলাকে দেখতে আসবে। কাজ তো কম নয় বলুন?
— হুম বেশী সময় নিবো না ,জাস্ট ফাইভ মিনিট।
এই বলে মেহতাব পিছন থেকে কিছু একটা বের করলো। মেঘ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
— কি এটা?
— তোমার গিফট’স।
— আমার?
— না আমার আরো বউ আছে তাদের জন্য এনেছি।
মেহতাবের কথা শুনে মেঘ প্যাকেটটা বিছানায় রেখে দিলো। মুখটা শুঁকনো করে বলে উঠলো,
— তাহলে আমায় কেনো দিচ্ছেন?আমি গেলাম।
এই বলে মেঘ দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে সবাই এক জনের উপর অন্যজন পড়ে গেলো।
মেহতাব ওদের উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,
— তোরা?
সবাই একসাথে কিঞ্চিৎ হেসে বলে উঠলো,
— আমরা আমরাই তো।
পিছন থেকে সামির বলে উঠলো,
— আমি কী তাইলে গাঙের জল থেইকা ভাইসা আইছি।
সামিরের কথা শুনে মেহতাব আফসোসের সুরে বলে উঠলো,
— যে আসুক না আসুক। আমার প্রজন্ম আসার কোনো চান্স নেই।
মেঘ মেহতাবের কথার মানে বুঝতে পারলো না। সবাই আহাম্মকের মতো অদ্ভুত ভঙ্গিতে মেহতাববের মুখের পানে চেয়ে রইলো।
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব:২৯
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
বিকাল সাড়ে ৪ টা। সবার ভীষণ ব্যস্ততা। সৌরভ এসেছে স্বপরিবার নিয়ে মিথিলার হাত চাইতে। রান্নার দিকটা বড়রা সামলে নিয়েছে। সিমরান, শাম্মী, মেহসান আর সৌম আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। ড্রয়িং রুমে সৌরভ লজ্জায় রাঙ্গা মুখখানা নিয়ে বসে আছে। মুখে নাজুক নাজুক ভাব। রৌফ, সিয়াম, সামির পিঞ্চ মারতে ছাড়েনি। মেহতাব আর আহতাব ওদের পাশে বসেই হাসছে। সৌরভের মা সুহা বেগম আর বাবা আনোয়ার সাহেব বসে আছেন পাশের সোফাতে। তারা এই সম্বন্ধে বেশ খুশি। আনোয়ার সাহেব আর মিনহাজ সাহেব পুরনো বন্ধু। এই বন্ধুত্ব গভীর সম্পর্কে রূপান্তর হবে তা ভেবে তারা খুব খুশি। মিনহাজ চৌধুরী তাদের সাথে আলাপ আলোচনায় মেতে উঠেছেন। বহু ব্যস্ততার মাঝে এতদিন পর দেখা। অরিন বেগম, ইতি বেগম আর শিমু বেগম ট্রেতে খাবার এগিয়ে দিলেন। সুহা বেগম শুধালেন,
— এতো আয়োজনের কী দরকার।
অরিন বেগম হেসে বলে উঠলেন,
— এইটুকু আয়োজনকে এতো বড় করে দেখবেন না আপা।
মিনহাজ চৌধুরী মেহতাবকে মিথিলাকে ডেকে আনতে ইশারা করলেন। মেহতাব সোফা থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলো।
মিথিলার সাজগোজ শেষ আপাদত প্রশংসার পর্যায় চলছে। দরজায় করাঘাতের শব্দ পেতেই শাম্মী দরজা খুলে দিল। মেহতাব তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
— অল কমপ্লিট?
শাম্মী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
— ঠিকাছে। মিথিলাকে নিয়ে আয়।
অহনা, শাম্মী, সিমরান মিথিলাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেঘ পা বাড়াতেই পিছন থেকে নিজের হাতে টান অনুভব করলো। সবাই মিটিমিটি হেসে দরজা ভিড়িয়ে চলে গেলো। মেঘ পিছনে ফিরে মেহতাবকে বলে উঠলো,
— ছাড়ুন যেতে হবে। সবাই কী ভাবছে?
— ভাবার কী আছে? আমরা তো প্রেমিক প্রেমিকা নই? আমরা হাসবেন্ড ,ওয়াইফ এন্ড ইট’স লিগাল।
এই বলে মেহতাব মেঘের ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। মেঘ ঈষৎ কেঁপে উঠলো। মেহতাব মেঘকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করলো। মেঘ লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। লজ্জা ভীষণ ভাবে কাবু করলো তাকে। মুখ থেকে কথা বেরনোর জো নেই। মেহতাব স্মিত হেসে বলে উঠলো,
— এইটুকু ছোঁয়াতে এই অবস্থা! আর সবাই মিহির আসার হরতাল শুরু করে দিয়েছে। আমার উপর ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
‘মিহি’ নামটা কর্নপাত হতেই মেঘের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো। মেহতাব কে সরিয়ে বলে উঠলো,
— মিহি কে?
মেহতাব হাত পিছনে নিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠলো,
— ফিউচারে বুঝে যাবে।
এই বলে মেহতাব মেঘের অনেক কাছে চলে এলো। মুখটা মেঘের কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
— সন্ধ্যায় সারপ্রাইজ আছে। ওয়েট ফর’মি।
এই বলে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে মেহতাব রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেঘ স্থির দৃষ্টিতে মেহতাব বের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে মুচকি হাসলো। রিনরিনিয়ে বলে উঠলো,
— মেহতাব কাছে আসলে দেহ শিউড়ে কেনো ওঠে?
নিজের কথার মানে নিজেই বুঝতে পেরে ম্লান হাসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরখ করে নিলো। মুচকি হেসে শুধাল,
— ভালোবাসলে হয়ত এমনি হয়। যাকে মন থেকে চাই তার ছোঁয়াতে ভালোলাগা বিচরন করে, দেহ শিউড়ে ওঠে!
মাগরিবের আজান দিয়েছে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আকাশে কালো মেঘেরা ভির জমিয়েছে যেকোনো সময় বৃষ্টি হয়ে ধরণীতে নামবে। মেঘ মেহতাবের বলা শেষ কথাটা অর্থাৎ সারপ্রাইজের কথা ভাবছে। কিসের সারপ্রাইজের কথা বলেছে মেহতাব? মেঘ জানালা ধরে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি বাইরে দূর আকাশে। মেহতাব বের আসার অপেক্ষা শুধু। এতো ধৈর্য্য সম্পন্ন মেয়েটার হৃদয়ও আজ ব্যাকুল হয়ে আছে। সময় যেনো আজ ফুরাতে চায় না।
বাড়িতে বেশ জমজমাট পরিবেশ। মিথিলা আর সৌরভের বিয়ের পাকাপাকিভাবে কথা হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার বিয়ে আর বৃহঃস্পতিবার গাঁয়ে হলুদ হবে সেই মোতাবেক বিয়েটা এগোবে।
বাড়ির ছেলেরা নামাজ পড়তে গেছে। আর বাড়ির মেয়েরা সবাই নামাজ শেষ করে দ্বিতীয় তোলার বৈঠকখানায় বসে আছে। অরিন বেগম , ইতি বেগম আর শিমু বেগম তাদের পুরনো দিনগুলোর কথা বলছেন। অহনা,মেঘ, মিথিলা,শাম্মী, সিমরান এতক্ষন কথাগুলো শুনছিল। মেঘকে ভাবুক দেখাচ্ছে! মিথিলা,সিমরান,শাম্মী মেঘের উপর কড়া নজরদারি চালু রেখেছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে আসলো। মেঘ তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলতে দৌঁড় লাগালো। সিড়ি দিয়ে নামার সময় মেঘের নূপুরের রিনঝিন আওয়াজ শোনা গেলো মাত্র। মেঘ যেনো বিদ্যুতের গতিতে ছুট লাগালো। এতো তাড়া! বেশ অদ্ভুত লাগলো সবার। পরক্ষনেই সবার মুখের অদল হাসিতে রূপান্তর হলো। সবাই মিটিমিটি হাসছে। মেহতাবকে চোখে হারাচ্ছে মেঘ। সবাই এই নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে লাগলো। অরিন বেগম বুকে প্রশান্তি অনুভব করলেন। বুকের উপর থেকে ভারী কিছু সরে গেলো যেনো! মেহতাব আর মেঘ স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতো জীবন কাটাচ্ছে। ভাবতেই আলাদা প্রশান্তি!
মেঘ তড়িঘড়ি করে সদর দরজা খুলে দিল। এক এক করে সবাই প্রবেশ করলো। মিনহাজ সাহেব মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। আহতাব মুখে হাসি ঝুলিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো। সবাই ঢুকেছে এখন শুধু মেহতাব আর তার বন্ধুরা দাড়িয়ে আছে। রৌফ মুচকি হেসে বলে উঠলো,
— মেহতাবের জন্য অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো অবশেষে।
সৌরভ হেসে বলে উঠলো,
— আমার জন্য মিথিলা নামক নারী কবে এইভাবে মনমরা হইয়া দরজার আড়ালে দাড়াইয়া থাকবো? ভাবতেই বুকটা ধুক করে কেঁপে ওঠে।
সিয়াম মুখ টা বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
— বেশরম কথাবার্তা। নাউজুবিল্লাহ।
ওরা এইসব কথাবার্তা বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করলো।মেহতাব মেঘের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। সেও বুঝতে পেরেছে তার প্রেয়সী তার জন্যই অপেক্ষা করেছে। সবাই নিচে নেমে ড্রইংরুমে এসে বসে পড়লো। আজ বাড়িটা মানুষের সরাগমে বেশ মো!মো! করছে। বড়রা সবাই উপরের বৈঠকখানায় চলে গেলো। বাচ্চারা এতদিন পর এক হয়েছে একান্ত সময় কাটাক সবাই মিলে। মেহতাবের দাদীর ভিডিও কল এসেছে। উনি আসতে পারেন নি কিন্তু সৌরভ আর মিথিলার কথা শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছেন।
আপাদত বাড়ির বাকি ছেলে মেয়েরা সবাই এক জায়গায় বসেছে। বাইরে বৃষ্টির দাপাদাপির শব্দ ঘরেও শোনা যাচ্ছে। একাধারে বৃষ্টির শব্দ বেশ মনোমুগ্ধকর! শীতল শিরশিরে বাতাস বহমান, ঘরেও তার ঠাই বোঝাই যাচ্ছে। এই শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস সবাইকে অদ্ভুত এক অনুভুতির জানান দিচ্ছে। কেউ দুলছে , কেউ খাচ্ছে কেউ বা চোখের ইশারায় কথা বলে যাচ্ছে। বেশ রোমান্টিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অহনার বিশ্রামের সময় হওয়ায় আহতাব তাকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেছে। মেহতাব চোখের ইশারায় বাকিদের কিছু বলতেই তারাও ঝটপট কেটে পড়লো। এখন শুধু তিনটি জিনিস বিদ্যমান। মেহতাব,মেঘ আর নিস্তব্ধতা। সবাই চলে যাওয়াতে মেঘ হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। মেঘের অবস্থা দেখে মেহতাব ঠোঁট কামড়ে হাসছে। মেঘ হাসির কারণটা ধরতে পারছেনা। তবে অসস্তির থেকে লজ্জাটা বেশি লাগছে। লজ্জায় মুখখানায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহতাবের বেশ অদ্ভুত একটা ইচ্ছা জেগেছে! ভীষণভাবে ইচ্ছে করছে মেঘের লাল টুকটুকে গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে। আপাদত ইচ্ছে টাকে পোষণ করে গভীর ভাবে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— ভালোবাসো আমায়?
হঠাৎ ভালোবাসা শব্দটা কর্ণ অবধি পৌঁছাতেই মস্তিষ্কের শাখা-প্রশাখা নাড়া দিয়ে উঠলো মেঘের। আমরা আমতা করলো কিছুক্ষণ। মেহতাব ওই একই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেনো আকুল আর্জির জানান দিয়েছে। মেঘের একটা শব্দে যেনো দুনিয়া তোলপাড় করতেও থামবে না। মেঘ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
— হঠাৎ এই প্রশ্ন?
মেহতাবের সোজা উত্তর,
— না কি হ্যাঁ?
মেঘ মেহতাবের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে পারছেনা। তার বুকের ভিতর তোলপাড় চলছে। অদ্ভুত এক অনুভুতির সাগরে ডুবে যাচ্ছে! মেহতাবের দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে যা তাকে কিছু বলতে চায়। মেহতাব কী ভালোবাসে তাকে? মেহতাব অধৈর্য হলো না সে একই ভাবে তাকিয়ে আছে। সে অপেক্ষা করছে মেঘের উত্তরের আশায়। মেঘ অস্পষ্ট স্বরে ওষ্ঠ প্রসারিত করে বলে উঠলো,
— হুমম।
হুমম বলে আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকল আলো চলে গেলো। মেঘ উঠে দাড়াতে যাবে হঠাৎ নিজেকে হাওয়ায় ভাসমান অনুভব করলো। মেহতাব তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। হঠাৎ এই কাজে মেঘ ভয়ে মেহতাব বের শার্ট খামচে ধরেছে। বাইরে থেকে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেই আলোতেই মাঝে মাঝে মেহতাবের মুখ দেখতে পাচ্ছে সে। মেহতাব যেনো চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে মেঘের একটা উত্তরে মুখে তার তৃপ্তির হাসি। মেঘের ঘোর কাটিয়ে মেঘকে দার করিয়ে দিলো দরজার সামনে। মেঘ মেহতাবের মুখে তাকাতেই সে ইশারায় দরজা খুলতে বললো। মেঘ দরজা খুলতেই হতবাক। মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় ঘরের অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। ফুল দিয়ে সাজানো ঘর তার প্রিয় ফুল সাদা গোলাপ। কখন করলো এইসব মেহতাব? অবাকের চরম পর্যায় অবস্থান করে সে ঘরে ঢুকে পড়লো। হঠাৎ ঘরে এক এক করে সবাই একটি করে মোমবাতি হাতে প্রবেশ করলো। মোমবাতির আলোয় সবার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। সব পরিচিত মুখ। হঠাৎ মেহতাব এগিয়ে এসে মেঘের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। একটি হীরের আংটির বক্স খুলে এগিয়ে দিলো। বক্স থেকে নীল আভা বের হচ্ছে হীরে টা জ্বলজ্বল করছে। মেহতাব মুচকি হেসে বলে উঠলো,
— আমি জানতাম তুমি আমায় ভালোবাসো। কিন্তু তোমার মুখ থেকে স্বীকার করাতে চাইছিলাম।
— আপনি জানতেন?
— হুমম।
— আমিও জানতাম আপনি আমায় ভালোবাসেন।
— সত্যি?
— হুমম। যাকে ভালোবাসি তার মনের কথা বুঝবোনা।
মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসলো। মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে শূধাল,
— জানতে বলোনি কেনো?
— আপনি নিজে এসে বলবেন সেই অপেক্ষায় ছিলাম।
— হুমম ভালোবাসি ভীষণ যা তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা। যেই কাছে আসার গল্প বিয়ে নামক প্রবিত্র বন্ধন দিয়ে শুরু সেই সম্পর্কে ভালোবাসা নামক অনুভুতি দিয়ে আরেক ধাপ এগোনো যায় না। ভালোবাসি তোমায়, বাসবো, বেসে যাবো। ডোন্ট ইউ ওয়ান্ট টু বি মাই লাভ? মাই জান।
মেঘ স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। মেহতাব আংটিটা মেঘের হাতে পড়িয়ে দিলো। মেঘ এগিয়ে এসে মেহতাবকে জড়িয়ে ধরলো। মেহতাব আরো শক্তপোক্তভাবে মেঘকে জড়িয়ে ধরলো।
সবাই সমস্বরে হেসে বলে উঠলো,
“আলহামদুলিল্লাহ”
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ৩০
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
বাড়িতে বিয়ে অথচ কারো কোনো হেলদোল নেই। গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করা হবে আজ। সবাই সোফায় বসে আছে দৃষ্টি মেঘের দিকে। মেঘকে কাজে সাহায্য করতে গেলে মেঘের কাজ আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাই কেউ আর আগ বাড়িয়ে যায় নি। তবুও একা হাতে সব দিক সামলে নিচ্ছে মেঘ। অরিন বেগম এসে মেঘকে তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,
অরিন বেগম : রেডি হয়ে নে শপিংয়ে যেতে হবে?
মেঘ : মা ,আপনি একটু অপেক্ষা করুন অল্প কিছু কাজ বাকি আছে।
অরিন বেগম মেঘকে সরিয়ে বলে উঠলো,
অরিন বেগম : এতো ব্যস্ত থাকিস শরীরের যত্ন নিস না কেনো?তুই যা এইদিকের সবকিছু আমি সামলে নিবো।
মেঘ : কিন্তু মা আপনি যাবেন না?
অরিন : না, মেহতাবকে বলে দিয়েছি ও গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে। আর মিথিলা,সিমরান,শাম্মী ওরা তো আছেই। ওরা হেল্প করে দিবে। একটু ঠাণ্ডা বাতাস খেয়ে আয় ভালো লাগবে। মায়ের কথা ফেলবি না যেনো।
মেঘ : কিন্তু মা?
অরিন বেগম : কোনো কিন্তু নয় তুই যাবি ব্যাস। তোর পছন্দ সবার পছন্দ হবে আমার বিশ্বাস। আমার লক্ষ্মী মেয়ে যাও রেডি হয়ে নেও।
মেঘ ম্লান হেসে উপরের রেডি হতে চলে গেলো। সবার গুরুদায়িত্ব এখন তার উপর। এই পরিবার এখন তার সব। মেহতাবের মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছে, স্নেহময়ী মায়ের মতো শাশুড়ি পেয়েছে, বাবা, বোন,ভাই সব কিছু পূরণ হয়ে গেছে। আর কীসের অভাব?
.
.
মেহতাব গাড়ির বোনাটের উপর বসে আছে। ধূসর রঙের শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স চোখে সানগ্লাস। দৃষ্টি তার সদর দরজায়, মেঘকে একদণ্ড শান্তিতে দেখার সুযোগ নেই। এতো ব্যস্ততা! যার জন্য সব কাজ ফেলে রেখে এসেছে তারই কোনো পাত্তা নেই। ভালোবাসা শব্দটা বলার পর থেকে যেনো আরো। সদর দরজা থেকে হুড়মুড় করে হুল্লোড় পার্টির সবাই দৌঁড়ে আসছে যেনো কম্পিটিশন চলছে। মেহতাবের মেজাজ যেনো আরো তুঙ্গে চড়ে গেলো। সিয়াম এসে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাকিরাও তাকে ফলো করে মেহতাবকে ঘিরে ধরলো। সবার দৃষ্টি মেহতাব এর দিকে যেনো কিছু বলতে চায়। মেহতাব সবার দিকে চোখ বুলিয়ে সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে বলে উঠলো,
মেহতাব : তোদের সবার কী চাই?
সৌমের সোজা সাপ্টা উত্তর,
সৌম : ট্রিট।
মেহতাব : কিসের জন্য?
মেহসান : ভাবী আম্মা আর তোমার মিলনের।
মেহতাব স্মিত হাসলো তবে নাকোচ করলো না। প্রতিউত্তর বলে উঠলো,
মেহতাব : নো প্রব্লেম যা খেতে চাস খাবি। তবে এই গাড়িতে এক জন ও উঠবি না। আন্ডারস্ট্যান্ড?
শাম্মী : উই বেটার আন্ডারস্টুড।
মেহতাব শাম্মীর ঝুঁটি টেনে দিলো। সিমরান বলে উঠলো,
সিমরান : ভাইয়া তুমি কত রোমান্টিক! আমার বিয়ে বিয়ে ফিলিংস আসছে।
মিথিলা : বিয়ের ফিলিংস টাই আলাদা যদি সঠিক মানুষের সাথে হয়। তাই না ভাইয়া?
মেহতাব মুচকি হেসে তিন বোনকে জড়িয়ে ধরলো। সামির বলে উঠলো,
মেহতাব : ওহ, মনে হয় সুইংমিং পুলের ঘটনা ভুলে গেছিস? মনে করাতে হবে নাকি?
রৌফ : না দোস্ত ওর মগজ অত খারাপ না। প্রত্যেকদিন দুধ আর বাদাম খায়। খাওয়া ছাড়া তো কিছুই মনে থাকে না।
সবাই রৌফের কথায় সামিরকে নিয়ে হাসাহাসি করলো। সৌম সবাইকে থামিয়ে বলে উঠলো,
সৌম : এবারের সংগ্রাম,,
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,
“মেহতাবকে ফতুর করার সংগ্রাম”
.
.
সবাই ভদ্র বাচ্চাদের মতো গাড়িতে বসে আছে। মেহতাব একইভাবে সামনের গাড়ির সামনে স্থির দৃষ্টিতে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মেঘের আগমন ঘটলো। হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস পড়েছে। বেশ ভালো লাগে এই রঙে মেঘকে, ঝিলমিল করছে রোদের আলোতে যেন। আবেদনময়ী লাগছে তাকে!
মেহতাব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমার দিকে। সবাই গাড়ির কাঁচ নামিয়ে “ওহহহহ” বলে চলছে, সিটি বাজাচ্ছে। মেহতাবের ধ্যান ভাঙ্গেনি তাতে। মেঘ সামনে এসে তুরি মারতেই মেহতাব দৃষ্টি সরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো। মেঘের বেশ অভিমান হয়েছে তার পছন্দের কালারের থ্রিপিস পড়েছে। অথচ একটা প্রশংসাও করলো না। মেঘ গাড়িতে উঠে বসলো। মেহতাব গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। মেহতাব মিরর গ্লাস দিয়ে মেঘের মুখের অদল দেখে মনে মনে হাসলো। মেঘ কিছু একটা লক্ষ করে বলে উঠলো,
মেঘ : হাসছেন কেন?
মেহতাব থতমত খেয়ে গেল। গাড়ি সাইডে থামিয়ে বলে উঠলো,
মেহতাব : তুমি দেখলে কিভাবে?
মেঘের সোজা সাপ্টা উত্তর,
মেঘ : সিম্পল চোখ দিয়ে।
মেহতাব : হাউ ইজ ইট পসিবল?
মেঘ স্মিত হাসলো মেহতাব তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মেঘ নিজের মুখ মেহতাবের কাছে এনে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
মেঘ : মনের চোখ দিয়ে।
মেঘের কথায় যেনো মেহতাবের অদ্ভুত এক ভালো লাগা বিচরন করলো। ঘোর লেগে গেল যেনো! তাকে কাটিয়া তোলা আপত্তিকর। মেহতাব মেঘকে এক টানে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো। আর মেঘকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিলো। মেঘ ও সায় দিলো তাতে। পবিত্র স্পর্শ তাতে আপত্তিকর কিছু নেই। পরিস্থিতি গভীর থেকে গভীরে যাচ্ছে। দুজনেই আরো বেসামাল হয়ে পরছে। মেঘ মেহতাব কে ঠেলে সরিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিলো। মেহতাবের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল। তবে সে বুঝতে পেরেছে মেঘের অনুমতি না নেওয়ায় সে রেগে গেছে হয়তো। তাই সে বলে উঠলো,
মেহতাব : রাগ করেছো? সরি আমার অনুমতি নেওয়া উচিত ছিলো। আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।
সত্যি মেঘের ভীষণ রাগ হচ্ছে সে লজ্জায় নুয়ে পড়লো বলে উঠলো,
মেঘ : সরি বলতে বলেছি নাকি। এটা পাবলিক প্লেস আপনার এইটুকু মাথায় রাখা উচিত ছিলো। বাসায় থাকার সময় পিড়িত কোথায় থাকে?
মেহতাব হতবাক হয়ে গেলো। সে হাসবে না কাঁদবে সেটা বুঝতে তার বেশ কাঠখড় পোহাতে হলো। মেঘ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে পুরো! মেহতাব মুচকি হেসে বলে উঠলো,
মেহতাব : ভালোবাসি তোমায় তাই সুযোগ হাতছাড়া করতে পারি নি। এক কথায় কান্ট্রোল করতে পারিনি নিজেকে। তুমি জীবনে এসেছিলে বলে বুঝতে পেরেছি ভালোবাসা কী? আর ভালোবাসা যখন তখন পেতে পারে বলে কয়ে আসে নাকি?
শেষ কথাটা বলে মেহতাব গাড়ি আবার স্টার্ট করলো। মেঘ আর কিছু বললো না তবে তার মেহতাব বের কথাগুলো ভালো লেগেছে। গাড়ির কাঁচের গ্লাস দিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেহতাবের আড়ালে আনমনে মুচকি হাসলো। মেহতাবের চোখের আড়াল হলো না। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্মিত হেসে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দিলো। মেঘ তা দেখে খুশি হলো তবে ফিরে তাকালো না। গালে হাত রাখতেই অনুভব করলো গাল দুটো আগুনের মতো গরম হয়ে আছে।
গাড়ি শপিং মলের সামনে এসে দাড় করালো। সাইডে পার্ক করে দুজনেই নেমে পরলো। পুরো গাড়িতে তাদের আর কথা হয় নি। ছেলেরা দূরে এসে এক স্থানে দাড়ালো, সৌরভও এসেছে। বিয়ের দরুন তার মেহতাববের বাড়িতে আনাগোনা সম্ভব হচ্ছে না। সুযোগ পেয়েছে তাই মিথিলাকে দেখতে এসে পড়েছে। মেহসান তাদের দিকে এগিয়ে এসে মাথা চুলকে বলে উঠলো,
মেহসান : ভাইয়া ভাবীর সাথে তুই কী করেছিস?
মেহসানের কথার মানে কেউ বুঝতে পারলো না। সবাই মেঘের দিকে নজর দিলো। মেঘ একবারও মেহতাবের দিকে তাকাচ্ছে না। গাল দুটো এখনো রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। মেহতাব আনমনে হেসে বলে উঠলো,
মেহতাব : তোর ভাবী মিথিলার জেরক্সকপি একদম।
কেউ তার মানে বুঝতে পাড়লো না। সবাই ইতস্ত হেসে উড়িয়ে দিলো।
মেঘ শপিং মলে ঢুকতে যাবে তখনি তার কয়েকটা লোকের উপর চোখ পড়লো। মেঘ হাতের ইশারায় মিথিলাদের লোকগুলো দেখালো,
মেঘ : ওই লোকগুলো না যারা প্রথম দিন মেয়েদের আজেবাজে নোংড়া কথা বলছিলো।
৫ টা ছেলে মেঘকে দেখে মুখ লুকিয়ে ফেললো। একটা ছেলে বলে উঠলো,
“আপা আপনার ভুল হইতাছে। আমরা খারাপ ছিলাম এহন আমরা গুড বয়। কোনো মেয়েদের দিকে ভুলেও তাকাই না। নাউজুবিল্লাহ, ভাই দেখলে জানে মাইরা ফেলবো”
আরেকটা ছেলে ওর মুখ ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“আপা চানাচুর নিবেন? এখন আমরা হালাল উপায়ে ব্যাবসা করি। নো গালি, নো মারামারি, ওনলি হালাল পন্থা”
মেঘের বেশ ভালো লাগলো। সবাই একসাথে এসে পা ধরে ক্ষমা চাইতে নিলে। মেঘ ওদের সরিয়ে বলে উঠলো,
মেহতাব একমনে গাড়ি ড্রাইভ করছে । সৌরভ , রৌফ , সিয়াম বুঝতে পারছে না হঠাৎ মেহতাব কাউকে না বলে লন্ডনের উদ্দেশ্যে কেনো রওনা হয়েছে । অজানা ভয় তাদের গ্রাস করেছে । অন্যদিকে সামির বুঝতে পারছে মেহতাবের এহেন আচরণের কারণ কিন্তু ভয়ে সে চুপ হয়ে আছে । মেহতাব গাড়ির মিরোর গ্লাস দিয়ে সকলের ভয়ার্ত মুখ দেখে স্মিত হাসলো । নিরবতা ভেঙে শুধালো ,
“কে করেছে এই কাজ”?
কেউ কিছু বুঝতে পারলো না সামির ছাড়া । মেহতাব আবার শুধালো ,
“আমাদের ড্রিংকসে আ্যলকোহল আসলো কিভাবে? আই নিড এন্সার হারি আপ”
সৌরভ বলে উঠলো ,
“দোস্ত আমার ভালোবাসার কসম আমি কিছুই জানি না এই বিষয়ে”
রৌফ বলে উঠলো ,
“দোস্ত আমার পাঁচ বংশের কসম আমি কিছুই জানি না এই বিষয়ে আমার কোনো হাত নাই”
সিয়াম বলে উঠলো ,
“আমার বাবার তৈরি এতিমখানার কসম আমিও জানি না । মনে হয় রৌফ করছে জলজ্যান্ত প্রমান ওর দুটো হাত”
সবাই সিরিয়াস ভাবে সিয়ামের দিকে তাকালো । সিয়াম ইতস্তত হেসে চুপ হয়ে গেলো । সবার কথা শেষে সামিরকে কিছু বলতে না দেখে সবাই সামিরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ।সামির ইতস্তত করে মুখ ফুটে বলে উঠলো ,
“যাহা বলিব সত্য বলিব সত্য ছাড়া কিছু বলবো না । দোস্ত মাফ কইরা দে । এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে আশা করি নাই । আসলে আমি কালকে এলকোহল মিশ্রিত ড্রিঙ্কস এর মধ্যে টিনার কথা মতো নেশার ট্যাবলেট মেশানোর বদলে টিনার ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দিয়েছি । আই ছোয়্যার তোদের মধ্যে কিছু হয় নাই । আমরা যখন নিচে এসেছিলাম স্টাফকে নিয়ে তখন অলরেডি তোরা ঘুমাচ্ছিলি । আর টিনা মেঘের শাড়ি চেঞ্জ করে দিয়েছে কমফোর্টেবল এর জন্য । তোরা সাক্ষী আমি যদি মিথ্যে বলে থাকি আমার জীবনেও বিয়ে হবে না”
সামিরের কথা শেষ হতেই মেহতাব তপ্ত শ্বাস ফেলে গাড়িতে জোড়ে ব্রেক কষলো । সবাই পড়তে পড়তে বেচেঁ গেলো । মেহতাব বলে উঠলো ,
“আমাদের মধ্যে কিছু হয়ছে কী হয় নি এই নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই । মেঘ আমায় ভুল বুঝুক আই কান্ট একসেপ্ট দিস । বাই চান্স ও যদি ভুল বুঝে তোকে আমি বিক্রি করে দিবো সামির গড প্রমিস । গাড়ি থেকে নাম তোরা”
সবাই ভদ্র বাচ্চাদের মতো নেমে পড়লো । মেহতাব বলে উঠলো ,
“শুরু কর”
সবাই জানে মেহতাব তাদেরকে দিয়ে কী করাতে চাইছে । সৌরভ আশেপাশে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো ,
“দোস্ত এইটা তো পার্ক মান সম্মান সমুদ্রে মিশা যাইবো । অন্য কোনো শাস্তি… আর এমনিতেও সামিরের সব দোষ আমরা কিছু করছি নাকি”?
মেহতাব শয়তানি হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে যাবে । সবাই কান ধরে উঠবস করতে শুরু করলো । মেহতাব ছোট একটা হাঁসি দিয়ে কাউন্ট করতে শুরু করলো । শাস্তি শেষে সবাই কোমরে হাত দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো । রৌফ বলে উঠলো ,
“আমি মেঘের কাছে বিচার দিমু”
“মনে হয় ডোস টা কম পড়েছে । আরেকবার হয়ে যাক কি বলিস”? (মেহতাব)
রৌফ সবার দিকে আঙুল তাক করে বলে উঠলো ,
“এই কে কইলি মেঘের কাছে বিচার দিবি । হেরে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওই কূলে পাঠাইয়া দিমু”
মেহতাব স্মিত হেসে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো ।
.
.
মেঘ রুমের বারান্দার দোলনার উপরে মুখ গোমড়া করে বসে আছে । এক তার কালকে রাতের কোনো ঘটনাই মনে নেই , দুই মেহতাব তাকে না বলে কয়ে সামান্য একটা বিদায় না জানিয়ে আচমকা চলে গেছে । টেবিলে লেম্পের পাশে রেখে গেছে ১ হাজার টাকার ৮ টা নোট আর একটা ক্রেডিট কার্ড । সঙ্গে চিরকুট স্পষ্ট লেখা ।
“আমি লান্ডান ফিরে যাচ্ছি একটা আর্জেন্ট কাজ এসে পড়েছে । গিয়েই মিটিং এর ব্যাবস্থা করতে হবে । আর তোমার যদি কোনো জিনিসের দরকার পড়ে কন্টাক্ট মি ওকে । আমায় বলতে প্রবলেম হলে সমস্যা নেই আমি আম্মুকে বলে দিবো । টেক কেয়ার”
ব্যাস এই কথা ভাবতে ভাবতে মেঘ এক ধ্যাঁনে দোলনায় বসে আছে । তার মনে বিষণ্ণতার মেঘ ছেয়ে গেছে । সকালে নাস্তার টেবিলেও যায় নি । কারো পায়ের শব্দ পেতেই মেঘ সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো । অহনা , শাম্মী , সিমরান আর মিথিলা এসেছে । অহনার হাতে খাবারের প্লেট । মেঘকে মনমরা দেখে অহনা বলে উঠলো ,
“কী হয়েছে তোর? নাস্তা করতে আসলি না কেনো ? মেহতাব আর সৌরভদেরও দেখতে পেলাম না”
মেঘ ওই চিরকুট কার্ড আর টাকা অহনার দিকে এগিয়ে দিলো । অহনা চিরকুট টা হাতে নিলো তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো । বলে উঠলো ,
“কী এগুলো”?
“ভাবী চিরকুটে কিছু লেখা আছে”
অহনা চিরকুট আওয়াজ করে পড়লো । মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ,
“কী এমন আর্জেন্ট কাজ পড়েছে ? যে ও আমাদের কাউকে বিশেষ করে তোকে কিছু না বলে লন্ডনে চলে গেলো”
মেঘের মেহতাবের কথা আবার মনে পড়তেই চোখ ছলছল করে উঠলো ,
“শেষ কথা তো দূর দু চোখ ভরে দেখতেও পেলো না । বলতে পারলো না তার ভালোবাসার কথা গোপনেই রয়ে গেলো”
.
.
সকাল গড়িয়ে বিকেল । সবাই ব্যাগ প্যাক করে নিয়েছে । আজই রওনা দিবে । মিথিলা , শাম্মী , সিমরান আর সৌম এখান থেকে বাসায় যেতে চেয়েছিল । অহনা , মেঘের জোরাজোরিতে একদিন থেকে যাবে তারা । সৌম , মেহসান ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করছে মেহতাব বা সৌরভদের আপডেট স্ট্যাটাস দেখার জন্য । টিনা এখান থেকে এয়ারপোর্টে গিয়ে লন্ডনে যাবে কোম্পানিতে জয়েন করতে আর মেহতাবকে বলে তার ভালো কাজের ক্রেডিট নিয়েই ছাড়বে সামিরকে একা ভোগ করতে দিবে না কিছুতেই না । সবাই টিনাকে আর কয়দিন থাকতে বলেছে সে শোনেনি । আহতাব সব ব্যাগ, সুইটকেস গাড়িতে তুলে সবাইকে ডাকতে এসেছে । সবাইকে এভাবে মনমরা দেখে শুধালো ,
“বধূ , শালীকা আর আমার ভাই-বোনেরা তোমরা এতো মন খারাপ কেনো করছো । মেহতাবরা আবার আসলে আমার তরফ থেকে ককটেল পার্টির অ্যারেঞ্জ করবো । সবাই খুশি তো” ?
সবার মুখে আহতাবের কথা শুনে একটু হাসি ফিরলো । অহনা মেঘকে সামলে নিয়েছে । আহতাবের কথা মতো সবাই গাড়িতে উঠে পড়লো ।
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ২৬
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
বাড়িতে পিনপতন নিরবতা । সবাই যার যার রুমে ঘুমাচ্ছে । সবাই জার্নি করে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে । মেঘ ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে । এমনিতেও রুমে গেলে তার মন খারাপ থাকবে ঘুম আসবে না । টিভি দেখলে একটুর জন্য হলেও মানুষটিকে ভুলতে পারবে । হঠাৎ কেউ তার পাশে এসে বসলে মেঘ চমকিয়ে উঠলো । পাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলো অরিন বেগম । অরিন বেগম তার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলেন ,
“মন খারাপ মা তোর”?
“না , মা তেমন কিছুই নয়”
অরিন বেগম স্মিত হাসলেন আর বলে উঠলেন ,
“মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া এতো সহজ নয়”
মেঘ জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো । তখনি মিনহাজ সাহেব রুমে থেকে এসে মেঘকে বসে থাকতে দেখে পাশে এসে বসলেন । বলে উঠলেন ,
“মা , তুমি এখনও জেগে আছ কেনো ? শরীর খারাপ করবে ঘুমোতে যাও । আর কালকে তোমাকে আর অহনাকে আমি স্কুলের শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব । তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না”
মেঘ ভাবতে পারেনি এতো সহজে পরিবারের সকলে ব্যাপারটা মেনে নিবে । সে মুচকি হেসে বলে উঠলো ,
“ধন্যবাদ বাবা”
“ধন্যবাদের কী আছে মা । তুমি নিজে থেকে কিছু করতে চাইছ সেটা তো ভালো কথা , শুনে অনেক ভালো লাগলো । মেহতাব আমায় বলে দিয়েছে বারবার করে যাতে তোমাদের আমি চাকরী করার অনুমতি দিয়ে দিই । আমিও না করি নি । কিন্তু ও কাউকে না বলে চলে যাবে । সেটা আমি আশা করি নি আমি বিয়ের আগে ওকে কথা দিয়েছিলাম ওর কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করবো না”
“আপনি কেনো অপমানিত বোধ করছেন বাবা । উনি আমার খেয়াল ঠিকঠাকমতো রাখছেন । আর উনি তো জরুরি কাজের জন্য গিয়েছেন বাবা । আর আমাদের মধ্যে সম্পর্ক নরমাল । আমাদের বিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তাই বলে উনি কখনো কোনো খারাপ কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেননি বা এমন কোনো বিহেভ করেননি যাতে আমি কষ্ট পাই”
“তাহলেই ভালো আমার ও চাই তোমরা ভালো থাকো মা”
মিনহাজ চৌধুরী আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই সবাই একসাথে ড্রয়িং রুমে এসে বসে পড়লো । অহনা রান্না ঘরে চলে গেলো সবার জন্য হালকা কিছু খাবার তৈরি করতে । মেঘ ও সাহায্য করতে রান্না ঘরে চলে গেল । সবাই গল্প করতে করতে কিছু কথা বলে নিলো । মেঘ আর অহনা সবাইকে চা আর হালকা কিছু খেতে দিলো । তারাও পাশে বসে পড়লো । মিনহাজ সাহেব অল্প হেসে বলে উঠলো ,
“মেহতাব হঠাৎ চলে যাওয়াতে তোমাদের মুখ গম্ভীর করে রেখেছো নাকি”?
সবাই মনমরা হয়ে আছে সবার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মিনহাজ চৌধুরী আবার বলে উঠলেন ,
“চলো একটা রোমান্টিক মুভি দেখি । তোমাদের বয়সে বউ কে নিয়ে কতো ঘুরেছি সিনেমা দেখেছি। আর তোমরা তো আমার নখের গুনও পাও নিই । সবাই মায়ের মতো রসকষহীন হয়েছো”
সবাই মুচকি হেসে উঠলেন । মেহসান বলে উঠলো ,
“আম্মু এতো আনরোমান্টিক ছিলো নাকি”
অরিন বেগমের দৃষ্টির কাছে মেহসান ঝলসে গেলো । অরিন বেগম কেশে নিচু কণ্ঠে বলে উঠলেন ,
অরিন : তোমার কি লজ্জা সরম বলতে কিছু নেই । বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে ।
আস্তে বললেও কারো কান এড়ায় নি অরিন বেগমের কথা । সবাই দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে হাসি থামানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সবাই এভাবে অনেক কথা বিনিময় করে রুমে চলে গেলো ।
শাম্মী , সিমরান , মিথিলা আর অহনা মেঘের কাছে শুতে চেয়েছিল । মেঘ একান্ত সময় কাটাটে চায় বলে তারা কেউ আর বিরক্ত করেনি ।
মেঘ রুমে ঢুকে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে পড়লো । অনেকদিন পর ফোন অন করলো । মেহতাব হয়তো কল দিতে পারে এই ভেবে । ফোন অন করে সে বিছানার পাশে রাখলো ।যাতে কল দিলে শুনতে পায় সে । ক্লান্ত হওয়ায় দু চোখের পাতা বন্ধ করতেই নিজের অজান্তে সে ঘুমিয়ে পড়লো ।
.
.
মেহতাব কোম্পানিতে এসে পড়েছে । প্রাইভেট প্লেনে এসেছে তাই সময় লাগেনি বেশি । হাতে ফোন নিয়ে মেঘের কথা ভাবছে সে । ফোন করবে কি করবে না । এই ভেবে ফোন করলো । একটা নয় ২০ টার ও বেশি । তার এখন বেশ অভিমান হয়েছে আর রাগ ও । রাগ ঝাড়তে সে তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হ্যারিকে ডেকে পাঠায় । হ্যারি রুমে প্রবেশ করে । ছেলেটার বয়স বেশি না ১৬ কি ১৭ হবে । গাঁয়ের রঙ মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা । হ্যারিকে বলে উঠলো ,
“সৌরভ, সামির ,সিয়াম আর রৌফ কে ডেকে পাঠাও । হারি আপ”
মেহতাবের কথামতো হ্যারি চলে যায় ওদের কেবিনে ওদের ডাকতে । কেবিন রুমে ঢুকেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে বলে ওঠে ,
“এই অনেক গুলো ঝামেলা তোমাদের বস ডাকছে”
সবাই এক জনের উপর অন্যজন ঘুমাচ্ছিলো । কারো কথা কর্ণকুহুর অব্দি পৌঁছাতেই পিটপিট করে তাকালো । হ্যারিকে দেখে ভূত দেখার মতো ভয় পেলো । শুধাল ,
“দোস্ত এই গিরগিটি এখানে কী করছে?”
হ্যারি বাংলা খুব ভালো অনুবাদ করতে পারে আর বলতেও পারে । তাই তার বুঝতে অসুবিধা হয় নি । শয়তানি হাসি হেসে বলে উঠলো ,
“তোমরা চার জন আমার আগামী ১০০ জন্মের শত্রু । তোমাদের যতবার পুনর্জন্ম হবে আমার তত বার হবে । বস আমাকে অনুরোধ করেছে তাই থেকে গেলাম নয়তো তোমাদের মতো গাধা, গরু, মোরগ, ছাগলের সাথে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই এই হ্যারির”
হ্যারিকে আপাদত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রৌফ বলে উঠলো,
“কী হয়েছে মেহতাব ডাকতাছে কেন”?
“চল দেইখা আসি”(সৌরভ)
যেইভাবা সেই কাজ কেউ কোনো কথা না বাড়িয়ে কাঁচা ঘুম থেকে উঠে মেহতাবের অফিস রুমে চলে গেল সবাই । হ্যারি দুর থেকে মিটিমিটি হাসছে । তাদের আজ খবর আছে হ্যারি ভালো করেই বুঝতে পারছে । সবাই নিজেদের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে সিয়াম শুধাল ,
“কিছু বলবি দোস্ত”?
মেহতাব বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে পাশের কাঁচের জানালার দিকে এগিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলো । এতক্ষন অন্ধকার থাকলেও পর্দা সরানোর কারণে মেহতাবের কেবিনে আবছা আবছা আলোর প্রবেশ ঘটেছে । সে যে সাংঘাতিক রেগে আছে তা একটু হলেও সবাই আঁচ করতে পেরেছে । মেহতাব হ্যারিকে ইশারায় কিছু বললো । হ্যারি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে কোথায় একটা চলে গেলো । সবার অবস্থা বেশ খারাপ । তারা অনবরত শুঁকনো ঢোক গিলছে । সামিরের জন্য তাদের কতো ঝড় পোহাতে হবে । হঠাৎ রুমে কারো প্রবেশ ঘটলো । দুইজন পালোয়ান বেশবহুল আধুনিক কোট আর প্যান্ট পরিধান করা । হঠাৎ দুইজন মিলে তাদের চার জনকে তুলে নিলো । যেনো তারা তাদের দুইজনের কাছে পুঁটি মাছ । ঠান্ডা কিছু অনুভব করতেই পিটপিট করে তাকালো তারা । নিজেদের সুইমিং পুলে দেখে চমকে গেলো । তাও আবার হাফ প্যান্ট পরে গার্ডরা সব প্যান্ট শার্ট খুলে নিয়েছে । এমনিতেই শীতের মৌসুম তার উপর শিরশিরে বাতাস বহমান । বাংলাদেশের চাইতেও ১০ গুন বেশি ঠান্ডা এখানে । মুহূর্তেই থরথর করে কাঁপতে লাগলো তারা । সবাই সামিরের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালো । সামির জানে সে এখন গনপিটুনি খাবে । মুহূর্তেই সৌরভ , সামির , রৌফ তাকে পানিতে চুবাতে শুরু করলো ।
সবাই M.C (মেহতাব চৌধুরী) কোম্পানির নিচের ক্যাফে বসে আছে । সবার অবস্থা বেহাল । সামির তো ৪ টা জ্যাকেট সঙ্গে চাদর জড়িয়ে গরম গরম কফি নিয়ে বসে আছে । সৌরভ , রৌফ , সিয়ামের ও একই অবস্থা । হঠাৎ কারো আগমন ঘটে । অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লাইট অন করতে ভুলে গেছে সবাই । আবছা আবছা আলোয় অবয়ব টা দেখতে পেলো তারা । এ আর কেউ না টিনা । টিনা এসে তাদের সাথে বসে পড়লো । সামিরের কফি টা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে বলে উঠলো ,
“কেমন আছো তোমরা ? আমি আজ থেকে এই M.C কোম্পানিতে জব করবো । আর আমার ভালো কাজের ক্রেডিট নিয়ে আমার প্রমোশন হয়ে যাবে । আই এম এ লাকি গার্ল যার প্রথম দিনেই প্রমোশন হবে । উহ হু”
সবাই বেশ বুঝতে পারছে টিনা কোন কাজের কথা বলছে । সবাই কষ্টের মধ্যে থেকেও মুখে হাসি ফুটলো টিনার কথা শুনে । সামির বলতে যাবে সবাই ওর মুখ চেপে ধরেছে । রৌফ হেসে বলে উঠলো ,
“হ্যাঁ তোমার প্রমোশন নেওয়া উচিত । সামিরকে প্রমোশন দিতে চাইছিলো মেহতাব । সামির তোমার নামে সব ক্রেডিট দিয়ে দিয়েছে । যাও মেহতাব তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে”
“তাহলে যাই কী বলো তোমরা?”
টিনাকে এতো উৎফুল্ল দেখে সবাই মিটিমিটি হাসলো । নিজেদের স্বাভাবিক করে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান করলো । টিনা নিজের সুইটকেস নিয়ে হাসতে হাসতে উপরে চলে গেলো । সবাই টিনার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ভেবে একটু নড়েচড়ে বসলো । সবাই টিনাকে দেখার জন্য সুইমিং পুলে চলে গেলো । কিছুক্ষণ পর টিনাকে গার্ডরা এনে পুলে ফেলে দিলো । যেই জামা কাপড় পড়ে ছিলো সেই জামা কাপড় পড়ে আছে সে। সৌরভ আর বাকিরা উল্লাসে এগিয়ে গেলো পুলের দিকে । টিনা বলে উঠলো ,
“হোয়াট ইজ দিস”?
রৌফ কাঁপা কাঁপা বসে যাওয়া গলায় বললো ,
“দিস ইস ঠান্ডা শাস্তি ”
“আর তোমার প্রমোশন” (সৌরভ)
.
.
ভোর হয়েছে পাখিদের আনাগোনা । ঘরের মধ্যে জানালা ভেদ করে সূর্যের আলো মেঘের মুখের উপর পড়তেই । সে পিটপিট করে চোখ মেলল । নিঃশব্দে বিরক্তি প্রকাশ করলো । ঘুম থেকে উঠে অ্যালার্ম বন্ধ করে নামাজ আদায় করার জন্য ওজু করতে চলে গেলো । ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ আদায় করে নিচে চলে গেলো নাস্তার ব্যবস্থা করতে । অহনা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলো মেঘকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখে বলে উঠলো ,
“তোর ঘুম ভেঙেছে । আয় নাস্তা করে নিবি”
মেঘ অহনাকে সাহায্য করতে নিলে । অহনা জোর করে বোনকে চেয়ারে বসিয়ে দেয় । আর পরোটার কিছু অংশ মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে ওঠে ,
“মেহতাবের সাথে কথা হয়েছে”?
অহনার কথা কান অব্দি পৌঁছাতে দেরী । টেবিল ছেড়ে উঠতে দেরী হয়নি মেঘের । সিঁড়ি দিয়ে হন্তদন্ত করে উঠে রুমে প্রবেশ করলো । ফোন বিছানায় পরে থাকতে দেখেই হাতে নেয় সে । হাতে নিয়ে সে থমকে যায় । এক দুই টা না ৫২ টা কল । মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় শুইয়ে পড়ে ।
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ২৭
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
মেঘ বিছানায় শুয়ে আছে মুখে বিষণ্ণতার ছাপ । একটা কল ও শুনতে পেলো না । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়লো । আপাদত এইসব ভাবলে চলবে না । চাকরির প্রথম দিন পরিপাটি হয়ে যেতে হবে । সুইটকেস খুলে জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখতে লাগলো । হঠাৎ চোখ গেলো একটা প্যাকেট এর উপর । যার উপর স্পষ্ট তার নাম লেখা । সে অবাক ভঙ্গিতে প্যাকেট টা খুলতে লাগলো । একটা হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস সুন্দর কাঁচ করা । বেশ সুন্দর তার উপর একটা সিল করে লাগানো মিসেস এম.ছি । মেঘ অজান্তেই মুচকি হাসলো । থ্রিপিস নিয়ে আয়নার সামনে ধরলো । শূধালও,
মেঘ : বেশ সুন্দর লাগছে । ওনার চয়েজ বেশ ভালো বলতে হবে ।
হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ পেতেই পিছনে ফিরে তাকাতেই অহনাকে দেখতে পেলো । অহনা উদ্বিগ্ন হয়ে মেঘের কাছে এসে বিছানায় বসে পড়লো । মেঘের কপালে ভাঁজ পড়লো । মেঘ অহনার পাশে বসে বলে উঠলো ,
মেঘ : কি হয়েছে আপু?
অহনা মনমরা হয়ে বলে উঠলো ,
অহনা : আমি বেবি কনসিভ করেছি ।
অহনার কথা টা শুনে মেঘ কি করবে দিশা হারিয়ে ফেললো । কিন্তু অহনা কে এমন বিধ্বস্ত দেখে বলে উঠলো ,
মেঘ : এটা তো খুশির খবর মুখটা এমন করে রাখার কী হলো ? আমাদের ঘরে একটা পুচকো সোনা আসবে । আলতো আলতো হাতে আমায় ছুঁয়ে দিবে । আমায় খালামণি বলে ডাকবে । কত মজা হবে !
অহনা : আমার চাকরির কী হবে ?
এবার মেঘ কী বলবে বুঝে পায় না । সত্যিই তো অহনা চাকরি সামলাবে না বাচ্চা ঘর সামলাবে । কিছু একটা ভেবে মেঘ বলে ওঠে ,
মেঘ : তুই চিন্তা করিস না তেমন কিছুই হবে না । আমরা দুই জা মিলে দেখবো । কেমন ?
অহনার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মেঘ আবার বলে ওঠে ,
মেহতাব চেয়ারে হেলান দিয়ে সবেমাত্র দু চোখের পাতা এক করেছিলো । কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়ে । সবাই এসে সামনের রকিং চেয়ারে এসে বসে পড়ে । মেহতাব ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা পরোক করে বলে ওঠে ,
“তোদের একটা কাজ দিবো করতে পারবি ? সামির বাদে”
সামিরের উৎফুল্ল মন টা নিমিষেই কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“দোস্ত আমার পাপের ঘরা খালি হইবো কখন?”
“যখন তুই কোনো কথা এমনকি মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করবি না তখন । আর কাজ টা হলো”
মেহতাব বলার আগ মুহূর্তে সৌরভ বলে ওঠে ,
“কী করতে হইবো দোস্ত দেখ আমরা এক পায়ে খাড়া”(সৌরভ)
সবাই চেয়ার থেকে উঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে । হ্যারি (এসিস্ট্যান্ট) মেহতাবের পাশে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে ।
“আজ থেকে তোদের কোনো টাফ কাজ করতে হবে না । আমি ম্যানেজ করতে পারবো । তোরা শুধু মেঘের ফিলিংস কী আমার জন্য সেটা জানিয়ে দিবি ব্যাস । যদি মেঘের আমার প্রতি কোনো ফিলিংস থাকে তাহলে তোদের মাফ করার বিষয় টা আমি দেখবো, না থাকলে তোদের সুইমিং পুলের কথা মনে আছে আশা করি । জানি এই কথাটা আনপ্রফেশনাল বাট মানুষ ভালোবাসলে সব কিছু করতে পারে”
সবাই এতক্ষন মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল কিন্তু শেষের কথাটার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না । সিয়াম সামিরকে চিমটি মারলো যে তারা সপ্ন দেখছে নাকি । সামির ব্যাথায় মুখ দিয়ে শব্দ করবে মেহতাবের দেওয়া শর্তের কাছে হার মানতে হলো ।
সবাই যার যার কাজে চলে গেলো । মেহতাব ফোন হাতে নিয়ে মেঘকে আবার ফোন করবে কিনা এইভেবে ফোন করেই দিলো ।
____________
মেঘ রেডি হয়ে নিয়েছে । হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় ফোনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলো মেহতাবের নামটা জ্বলজ্বল করছে । কোনো কিছু না ভেবে ঠাস করে ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো । রিসিভ করার সাথে সাথে মেহতাব বলে উঠলো ,
মেহতাব : আর ইউ ওকে ?
মেঘ : হুমম ।
মেহতাব : ফোন ধরো নি কেনো ?
মেঘ : আব…আসলে শুনতে পাই নি ।
মেহতাব : ওকে ঠিকাছে আজকেই কী জয়ন করবে ?
মেঘ : হুমম একটু পর বের হবো ।
মেহতাব : বাবা রাজি হয়েছে ?
মেঘ : হুমম , আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর মতো ভাষা নেই আমার ।
মেহতাব : ভালোবাসলেই হবে ।
শেষের কথাটা বলে মেহতাব ফোন কেটে দিলো । মেহতাব আস্তে বলায় মেঘ শুনতেও পায়নি । তখনি মিনহাজ চৌধুরী নিচ থেকে মেঘ আর অহনাকে ডাক দিলেন । মেঘ ব্যাগ নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো ।
___________
বেশ অনেকদিন কেটে গেছে মেহতাবদের যাওয়ার পর । সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত । মিথিলারা পড়াশোনা নিয়ে বিজি , সৌরভ বাকি সবাই তাদের চাকরি , মেহতাব আর আহতাব এর অফিস । মেঘও দুই দিক ভালো করে সামলে নিয়েছে । অহনার ডেলিভারির ডেটও প্রায় সন্নিকটে তাই সে চাকরি থেকে কয়দিন স্থগিত নিয়েছে । আর মৌমিতা বেগমের কাছেই থাকবে এই কয়দিন । সব ঠিক আছে শুধু মেঘ আর মেহতাবের কথা বলার সময় কমে গেছে । মেহতাব সময়ের অভাবে খুব বেশি কথা বলতে পারে না । মেহতাব অনেক ব্যস্ত থাকায় মেঘও বেশি ফোন করে না । শুধু খবর নেওয়া হয় এই আর কী ।
___________
মেঘ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহসানের জন্য মেহসানের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে তাই একসাথে যাবে তারা । পিছনে কেউ মেঘের নাম নিতে সে পিছনে ঘুরে তাকায় । একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে।
“আপনি কী এখানে জব করেন?”
“জ্বি আপনাকে চিনতে পারলাম না”
“আমি নতুন জয়েন হয়েছি আমি আরাব”
“ওহ আমি মেঘ , মেহনুর মেঘ”
মেহসান তার বন্ধুদের নিয়ে গেট পেরোতেই মেঘের সাথে কাউকে কথা বলতে দেখে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে । কলার উচিয়ে বলে ওঠে ,
“এই যে মিস্টার অচেনা , ইনি মিসেস মেহতাব চৌধুরী দূরে থাকবেন এনার থেকে । নাহলে মেহসান নামক ঝড়ের কবলে পড়তে হবে”
মেঘ কোনমতে মেহসানের মুখ চেপে ধরে । ওকে ওখান থেকে নিয়ে চলে এসেছে নাহলে আজ মেহসান লোকটাকে কথা দিয়ে আধমরা করে ফেলতো । মেহসান মুখ গোমড়া করে রেখেছে । মেঘ মুচকি হেসে বলে ওঠে ,
“কী খাবে তুমি?”
যেই মেহসান খাবারের কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় । সে আজ এই কথা শুনে ও মুখ ফিরিয়ে রেখেছে । মেঘ একটা আইস্ক্রিমের স্টল থেকে দুইটা আইসক্রিম নিয়ে মেহসানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠে ,
“হয়েছে । মেহসান নামক লক্ষ্মী ছেলের মুখ এমন গম্ভীর থাকলে বেমানান লাগে । ভাবী আর কোনো অচেনা লোকের সাথে কথা বলবে না প্রমিজ”
এবার মেহসান ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ,
“পাক্কা প্রমিজ”
“হুম , এবার চলো”
_____________
বাড়িতে মেঘ আর মেহসান ছাড়া কেউ নেই । মিনহাজ চৌধুরী আর আহতাব কাজ সূত্রে বাইরে গেছেন । অরিন বেগম আর মেহসানের দাদী গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন । মেঘের উপর সব দায়িত্ত্ব ভার সে সামলে ও নিয়েছে । মেঘ খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে । মেহসান কে খেতে ডাকতেই মেহসান ফোন হাতে নিয়ে টেবিলে বসে পরে । সে ভিডিও কলে হুল্লোড় পার্টির সাথেই কথা বলছে । মেঘের দিকে ক্যামেরা ঘোরাতেই সৌরভ তার ল্যাপটপ মেহতাবের সামনে রাখে মেহতাব কিছু ফাইল দেখছিল ল্যাপটপে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই তার বধূরুপি মেঘকে দেখে থমকে যায় । মেঘ বাটিতে তরকারি বেড়ে রাখছিল । শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে একদম পাক্কা গৃহিণী লাগছে তাকে । সবার দৃষ্টি মেহতাবের দিকে । মেহতাব বেশ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে । ছোট ছোট চুলগুলো মেঘের চোখের সামনে এসে তাকে জ্বালাতন করছে মেহতাবের ইচ্ছে তো করছে ল্যাপটপের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ঠিক করে দিতে ।
অন্যদিকে মেঘ মেহসানকে ফোন ধরে থাকতে দেখে বলে উঠে ,
“অনেক কাজ করেছেন , এসে পড়ুন”
মেহতাব ভাবে মেঘ তাকে ফিরে আসতে বলছে । পরক্ষণেই মেহসান ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেয় । মেহতাব ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফাইল টেবিলের উপর রেখে দেয় । চোখের নিচে হাত দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে । সামির বলে ওঠে ,
“দোস্ত আর কতো দিন । ভালো একটা দিন দেখে মেঘকে প্রপোজ করে দে কেচ্চা খতম ।
“কেচ্চা কী?(রৌফ)
“তোর বাচ্চার নাম মূর্খ ।
মেহতাব স্মিত হেসে বলে ওঠে,
“নোট ব্যাড ।
সৌরভ খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে ওঠে ,
“আমাগো আর ঠান্ডা শাস্তির কবলে পড়তে হইবো না । আজকে
আমি মিষ্টি বিলীন করিবো সবার পানে । ঠান্ডা শাস্তির কসম এবারের সংগ্রাম ,
সবাই একসাথে বলে ওঠে ,
“মেঘ আর মেহতাবের ভালোবাসার সংগ্রাম”
সৌরভ আবার বলে ওঠে ,
“এবারের সংগ্রাম”
“মিহির আসার সংগ্রাম”
মেহতাব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে ওঠে ,
“মিহি কে?”
“তোর মাইয়া দোস্ত ২০৫০ সাল এসে পড়েছে , অর্থাৎ তোর প্রজন্ম আসার পার্ফেক্ট টাইমিং” (সিয়াম)
সকাল গড়িয়ে দুপুর । সবাই নিচের কেফ এ বসে গল্প করছে । মেহতাব আর মেঘ রুমে আছে । তাই তারা আর বিরক্ত করেনি । তাদের কেউ প্রাইভেসি দেওয়া উচিত । আহতাব আর অহনার নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক নরমাল থাকলেও তারা ঝগড়ার অ্যাক্টিং করছে । সৌরভ তার বাকি বন্ধুদের টিম আর মিথিলার টিম আলাদা বসে আছে । সৌম আর মেহসান শান্তি বজায় রাখার কাজে নিযুক্ত । টিনার শরীর ব্যাথা করছে । সে ওয়াশরুমে ঘুমাচ্ছিল সে এটাকে তার ঘুমের ওষুধ না খাওয়ার জন্য ঘুমের মধ্যে হাটাকে দায়ী করছে । কাউকে বলেও নি মজা করবে ভেবে । নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ । দুই দল তাদের চোখের ইশারায় তর্ক বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছে । সৌম আর মেহসান ক্ষণে ক্ষণে শুঁকনো ঢোক গিলছে আর পানি খাচ্ছে । আহতাব আর অহনা বেশ মজা পাচ্ছে । এই ছমছমে পরিবেশ সম্পর্কে অবগত নয় টিনা । টিনা এক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাদের মুখ পানে । বলে উঠলো ,
টিনা : কী হয়েছে ?
সকলের অগ্নি নিক্ষেপণ দেখে আগ বাড়িয়ে আর কিছু বললো না টিনা । নিরব দর্শকের মতো দেখতে লাগলো । জল কতটুকু গড়িয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে ।
.
.
মেহতাবদের রুমে মেঘ কোনো এক উপন্যাসের বই পরছে । মেহতাব মেঘের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আছে আর ল্যাপটপে কাজ করছে । মেঘকে সে দাড়ি বাইট দিয়েছে । তা সম্পর্কে সে অবগত ছিলো না । মেঘের নরম গালগুলো ফুলে গেছে । হয়তো তাই সে আজ নিচে যায় নি আর মেহতাব এর সাথে কথাও বলে নি বইয়ে মশগুল হয়ে আছে । মেহতাব কে আড় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ বলে উঠলো ,
মেঘ : কিছু বলবেন ?
মেহতাব ইতস্তত করে বলে উঠলো ,
মেহতাব : ব্যাথা করছে মেডিসিন এনে দিবো ?
মেঘ : না ঠিক আছি ।
মেহতাব : ওকে ।
এই বলে সে রুম থেকে চলে গেলো । মেঘ একটা তপ্ত শ্বাস ফেললো । গালে হাত দিতেই ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো । সামান্য ব্যাথা কিন্তু ভীষণ জ্বলছে । সে বই রেখে বারান্দায় খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো । লোকটার প্রতি অনুভুতিটা ভালোবাসায় পরিপূর্নরূপ ধারণ করেছে তা বুঝতে পারছে মেঘ । অপলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় লোকটার মুখের পানে । তার মুখে বিষন্নতার ছাপ এই ব্যাথার জন্য নয় বরং তার মন মধ্যিখানে মানুষটিকে নিজের করে না পাবার ব্যাথা যা সর্বক্ষণ ধাওয়া করে । উথালপাথাল করে দেয় তাকে । সে চায় নিজে মেহতাবের ভালোবাসার শিকড়ে জড়ানোর আগে মেহতাব যেন তাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নেয় । একটিবার যেনো মেঘকে নিজের অনুভুতি সম্পর্কে অবগত করিয়ে দেয় । বেশি কিছু নয় একটু ভরসা , আস্থা আর কিঞ্চিৎ ভালোবাসাই যথেষ্ট ।
পিছনে কিছুর শব্দে ভাবনার ছেদ ঘটে মেঘের । পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় মেহতাব এসেছে হাতে অনেকগুলো প্যাকেটে ফল , চকলেট আর কিছু একটা নিয়ে । জিনিসটা নিয়ে এগিয়ে আসতেই মেঘ জিজ্ঞেস করে ,
মেঘ : কী এটা ?
মেহতাব উত্তর দেয় না বরং মেঘের অনেকটা কাছে চলে আসে সে । মেহতাবের হৃদস্পন্দনের আওয়াজ শুনতে পারছে সে । মেহতাব বিনাবাক্য খরচ করে একটু ক্রিম বের করে মেঘের গালে লাগিয়ে দেয় । মেঘের দৃষ্টি মেহতাবের মুখের পানে । আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে সে নির্ঘাত কিছু একটা করে বসবে । ক্রিমটা লাগানো শেষ হতেই সে কোনো রিয়েক্ট না করে সেখান থেকে নিচে চলে গেলো । মেঘকে লজ্জা পেতে দেখে মেহতাব আনমনে হাসলো । পিছনে চুলে হাত দিয়ে বলে উঠলো ,
মেহতাব : লাজুকতা মেয়েদের শোভা পায় । বউ আমার বড্ড লাজুক একটু বেশি । ( মুচকি হেসে )
সিয়াম : হুমম গভীর প্রশ্ন । একটা এপস খুলবো ভাবছি ভালোবাসা ডট কম । দামে সস্তা ভালোবাসার বস্তা ।
মেহতাব কিছু বললো না ওদের কথায় হাসতে বাধ্য সবাই এই ভেবে বারান্দার সোফায় বসে পড়লো । রৌফ বলে উঠলো ,
রৌফ : দোস্ত আজকে একটা পার্টি আছে । মেয়েদের থেকে ছেলেরা যেন এগিয়ে থাকে । বি রেডি ।
সামির : পার্টিতে কী ভালো খাবার পাওয়া যাইবো ?
সৌরভ : তুই বরং বেগুনের সাথে বিয়ে করিস । কুমড়োর সঙ্গে গাঁয়ে হলুদ । ফুলকপির সঙ্গে ফুলসজ্জা । অধপেটুক একটা ।
সামির : তাহলে খাবো কাকে ?
সৌরভ : এটা তো ভেবে দেখিনি গুড কোয়েশ্চেন ।
সৌরভ আর সামিরের কথায় হাসিতে ফেটে পরলো সবাই মেহতাব ও তাদের সাথে যোগ দিলো ।
.
.
অহনার রুমে বসে আছে সবাই । টিনা সবার হাতে কিছু একটা ধরিয়ে দিলো । সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে টিনা বলে উঠলো ,
টিনা : সিস এটাতে শাড়ি আছে হোয়াইট কালার সবার জন্য । সন্ধ্যায় পার্টি আছে । ছেলেদের থোতা মুখ ভোতা করে দিয়েই ছাড়ব ।
শাম্মী : উফফ এই প্রথম আমার মন জয় করে নিয়েছো টিন আপু এক বালতি চুমু ।
এই বলে শাম্মী টিনাকে চুমু দিয়ে রুম থেকে চলে গেলো । টিনা অবাক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে বলে উঠলো ,
টিনা : আমাকে কী অপমান করলো না প্রশংসা ।
সিমরান : যাই হোক । সবাই আমাদের রুমে চলে আসো । ওখানে রেডি হয়ে নিবো । অহনা আর মেঘ ভাবীতো আছেই ।
মেঘ : আমি পার্টিতে থাকতে পারবো না ।
মিথিলা : কেনো ভাবী ? এমন করো না প্লিজ ।
অহনা : মেঘ আসবে আমার লাস্ট কথা নাহলে আমিও আসবোনা ।
মেঘ : আপু এমন করিস না আমার শরীর ভালো লাগছে না ।
অহনা : না কোনো কথা নয় । আপুর কথা রাখবি তুই নাহলে ভাববো তুই আমায় ভালবাসিস না ।
মেঘ : ব্ল্যাকমেল করছিস ভালো খুব ভালো । ( রাগ দেখিয়ে )
টিনা : হোয়াইটমেল এটা মেঘু ভাবী ।
টিনার কথায় সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো ।
টিনা : যাক ভাবীর মুখে হাসি ফুটলো । ( মুচকি হেসে )
.
.
সন্ধ্যা আকাশ । শীত হওয়ায় পার্টির আয়োজন সন্ধ্যার দিকে করা হয়েছে । মেহতাব একটা ব্ল্যাক শার্ট তার সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট পড়েছে । চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে নিয়েছে । মেঘ এখনও রুমে আসে নি । তাই মেহতাব রেডি হয়ে নিচে মেঘকে খুঁজতে চলে গেছে । পথের মাঝখানে কাঁটার মতো সৌরভ আর তার দল দাড়িয়ে আছে ।
মেহতাব কিছুই বললো না তার চোখ এড়ানো এতো সহজ নয় । সৌরভের ভয়ার্ত কন্ঠে বলা কথায় হেসে দিলো ।
মেহতাব : জ্বালা নয় শালা হবে ।
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ২৩
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
সন্ধ্যার পার্টি সবাই যার যার মতো ইনজয় করছে । মেহতাব নিজের ফোনে কোনো জরুরি কল এটেন্ড করছে । সৌরভ একটা জুস নিয়ে তাকিয়ে আছে । রৌফ , সামির , সিয়াম তিনজনের নজর মেহতাবের দিকে । সৌম আর মেহসান প্রকৃতি কি অবস্থায় আছে আঁচ করার চেষ্টা করছে । বেশ কিছুক্ষণ পর মেহতাব কথা বলা শেষ করে ওদের সাথে একটা টেবিলে বসে পড়লো । মেহতাবকে আসতে দেখে সিয়াম বলে উঠলো ,
সিয়াম : দোস্ত মেঘ কই ?
মেহতাব : জানিনা তুই যেখানে আমিও সেখানে ।
সিয়াম সৌম আর মেহসান এর দিকে ইশারা করলো । তারা কথা না বাড়িয়ে মেয়েদেরকে খুঁজতে চলে গেলো । সবাইকে গোমড়া দেখে সবার মন ভালো করার জন্য রৌফ চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে উঠলো ,
রৌফ : বিলকিসের মা ওঠ ।
সবাই নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো রৌফ কাকে কথাটা বলেছে সেটা বোঝার জন্য । রৌফ কিঞ্চিৎ হেসে সামিরের কোমর জড়িয়ে ধরে বললো ,
রৌফ : রূপবতী হওয়া উচিত তোমার মতো । তোমার বিড়ালের মতো চোখ , কুকুরের মতো দাঁত, হাতির মতো নাক, বাদুড়ের মতো কান আমায় তোমার দিকে আকৃষ্ট করে প্রিয় । ওরে বিলকিসের মা চুল গুলা পাইকা গেছে হাওয়াতে ।
সিমরান : এখানে শুয়ে আছিস কেনো ? দেখ কেউ আসছে নাকি । একদম ঢুকতে দিবি না ।
শাম্মী : জো হুকুম হুজুর ।
এই বলে শাম্মী দরজায় ঠেস হয়ে দাড়িয়ে রইলো । তখনি সৌম আর মেহসান ঢুকতে গেলেই শাম্মীর পায়ের সাথে উষ্ঠা খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো । মেহসান বুকে ফুক দিয়ে বলে উঠলো ,
মেহসান : আপু কী করছো ? আমরা তো উভয় পক্ষ ।
শাম্মী তাচ্ছিললের সুরে বলে উঠলো ,
শাম্মী : ওরে আমার সিঙ্গারার আলু । তোদের ভালো করেই জানা আছে ।
মেহসান : সরো ভাবীকে দেখতে চাই ।
শাম্মী : উহুম একদম চালাকি না । নাহলে ছাদে শুকো দিয়ে শুঁটকি বানিয়ে দিবো ।
সৌম : দেখতে ভেটকি মাছের মতো আমাদের আবার শুঁটকি বানাবে আসামী একটা । (মজা করে)
শাম্মী আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলো ,
শাম্মী : যা যা মাফ করে দিলাম ।
সৌম আর মেহসান কথা বাড়ালো না । ওরা চলে গেলে শাম্মী পিছনে মেঘ কে দেখেই মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো ।
সিমরান : মশা ডুকে যাবে ।
সিমরানের কথায় হুশ ফিরল শাম্মীর।
শাম্মী : হায়! হায়! কারো নজর না লাগে ।
.
.
সবাই নিচে বসে বোর হচ্ছে । সৌরভ মুখে তালা দিয়ে রেখেছে । মেহতাব ফোনে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছে আর আহতাবের সাথে ডিসকাস করছে । সিয়াম , রৌফ চুপচাপ বসে আছে । সৌম আর মেহসান ফোনে মগ্ন । সামির পরিস্থিতি ঠিক করতে বলে উঠলো ,
সবাই সামিরের ভঙ্গি দেখে হেসে নিজেদের কাজে মন দিলো । তৎক্ষণাৎ মেঘ আর বাকিদের নিচে নামতে দেখে সবার দৃষ্টি সিড়ির দিকে গেলো । মেহতাবের নজর কেড়ে নিলো সাদা শাড়ি পরিধানরত রমণী । চোখে গাঢ় কাজল , ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক , মাথায় লাল গোলাপ । যাকে বলা যায় কোনো কিছুর খামতি নেই । মেহতাব কে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে উপস্থিত সবাই হেসে দিলো । সৌরভ মুখ খুলে বলে উঠলো ,
সৌরভ : দোস্ত এটা মেঘ তোরই বধূ এমন ভাবে দেখছিস যেনো প্রথমবার দেখলি ।
সৌরভকে চিমটি মেরে থামতে বললো আহতাব । আহতাব মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
আহতাবের কথায় সবাই হেসে দিলো । হাসলো না মেহতাব । মেঘ লজ্জা পেলো প্রকাশ করলো না । মেয়েরা এসে সবাই এক টেবিলে গোল করে বসলো । মিউজিক চালানো হলো । মুহূর্তেই রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি হলো । সবাই ডিনার পার্টির জন্য ভালো ভালো খাবার অর্ডার দিয়েছে । খাবার এসে পড়েছে সঙ্গে পার্টি আরো রসালো করার জন্য টিনা আর সামির এক পাশে এসে পড়লো । টিনা বলে উঠলো,
টিনা : একটা প্লান আছে । আমি আর তুমি এখানে সবচেয়ে অকাজের চরিত্র । তো আমাদের কে আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে হবে । তাহলে কোম্পানিতে মেহতাব আমাদের দুজনকে প্রমোশন করিয়ে দিতে পারে ।
সামির : টিনা এমন কিছু করিস না বইন যাতে মেহতাব প্রমোশন তো ধুর চাঙায় তুইলা রাখে ।
টিনা : নো টেনশন ওদের বিয়ে আরো রসালো করবো জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ ।
সামির : আমি জানতাম না তুমি বাবুচি গিরি করতে পারো ।
টিনা মুচকি হেসে টেবিলে এসে বসে পড়লো । সামির কে ইশারা করতেই ও উপরে চলে গেলো । সবাই যার যার মতো খাচ্ছে । সৌরভ পা দিয়ে মিথিলার পায়ে গুতো দিচ্ছে । মিথিলার অগ্নি দৃষ্টি দেখেও থামে নি সে । মিথিলা কেশে বলে উঠলো ,
মিথিলা : সিমরান , শাম্মী আমার পায়ে কিছু একটা পড়েছে দেখ না প্লিজ ।
সৌরভ এই কথা শুনে পা নিজের জায়গায় গুটিয়ে নিলো ।
মেহতাবের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে ওঠে ,
সৌরভ : দোস্ত আমারে কিছু মেয়েদেরকে পটানোর টিপস দে । লাভ গুরু তোরে ময়মসিংহগামী ট্রেনে হানিমুনের টিকেট কাইটা দিবো । ফ্রীতে ট্রেভেল আর হানিমুন হইয়া যাইবো । এক ঢিলে দুই পাখি আর কী ।
মেহতাব বিষম খেয়ে উঠলো সৌরভের কথা শুনে । সৌরভ হা করে তাকিয়ে রইল সে ভুল কিছু বলেছে নাকি ? মেঘ মেহতাব কে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো ।
মেঘ : এই নিন ।
মেহতাব পানি এক ঢোকে শেষ করলো । মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,
মেহতাব : থ্যান্ক ইউ মেঘ ।
সবাই যার যার খাওয়া শেষ করে ফেললো । সামির সবাইকে ড্রিংক সার্ভ করে দিলো । মেঘ ড্রিংক করবে না । সামির বলে উঠলো ,
সামির : ডোন্ট ওয়ারী ভাবী এটা আ্যলকোহল না ফ্রুট জুস।
সামির মেঘকে জোর করে ধরিয়ে দিলো । সামির কে মেহতাব বলে উঠলো ,
মেহতাব : তোরা আজেবাজে কিছু করবি না । আমি ওয়ার্নিং দিচ্ছি ।
সবাই ডিনার করে একসাথে বসে আছে । সবার হাতে ড্রিঙ্কস মেহতাবের বাদে । টিনা ফিসফিস করে সামিরের কানে কিছু বলে দিলো । সামির কথামত মেঘ আর মেহতাবের ড্রিঙ্কস এ ট্যাবলেট জাতীয় কিছু একটা মিশিয়ে দিলো । সামির ড্রিঙ্কস নিয়ে মেহতাব কে জোর করে ধরিয়ে দিলো । মেঘ নিতে না চাইলে সামির টলমল চোখে তাকাতেই নিতে বাধ্য হলো মেঘ । সবাই ভালো লেভেলের ড্রিঙ্কস করে নিয়েছে । কেউ দুলছে তো কেউ উল্টোপাল্টা কথা বলছে । টিনার বুঝতে বাকি নেই সামির সবাইকে আ্যলকোহল দিয়েছে ফ্রুট জুসের বদলে । অকর্মন একটা এই ভেবে সে সবাইকে যার যার রুমে দিয়ে আসার চেষ্টা করছে । সবাইকে নিয়ে সামির আর টিনা চলে গেলো মেঘ আর মেহতাবকে বাদে তাদের জন্য আজ বাসর ঘর সাজাবে এই প্লান ওদের । ওদের কাছাকাছি আনলে ওদের ঝামেলাও ঘুচে যাবে আর টিনাকেও ক্ষমা করে দিবে । যতই হোক সে মেহতাবের খারাপ অন্তত চাইনি । সে ভালো থাকুক এটাই তার প্রত্যাশা । এই ভেবে তপ্ত শ্বাস ফেলে সামির আর টিনা সবাইকে রুমে দিয়ে আসার জন্য নিয়ে গেলো ।
মেহতাব আর মেঘ দুজন পাশাপাশি বসে আছে । টেবিলে হেলান দিয়ে দুজন দুজনকে দেখছে মেঘ মেহতাবের দিকে আর মেহতাব মেঘের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । মেঘ বলে ওঠে ,
মেঘ : আপনি এতো সুদর্শন কেনো ? আপনার মতো এতো সুদর্শন পুরুষ পৃথিবীতে একজনকেও দেখিনি ।
মেহতাব মুচকি হেসে মেঘের কপালের উপর পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দেয় । বলে ওঠে ,
মেহতাব : তোমার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দর আর আমি তো তোমারই অর্ধেকঅঙ্গ । তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী । প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ট সুদর্শন পুরুষটি হচ্ছে তার স্বামী ।
মেঘ : আপনি এতো রোমান্টিক কথা বলছেন । আজ কি হলো সাহেব ?
মেহতাব : জানিনা আমি যখনই তোমাকে দেখি আমি ভুবন ভুলে যাই কেবল তোমাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা অনুভব করি । আমি যখনই তোমাকে আমার পাশে একাকী পাই তখন আমি তোমাকে ভালোবাসার সুযোগ হারাতে পারি না ।
মেঘ মুচকি হাসে নিজের মুখটাকে মেহতাবের আরো কাছে এনে ভালোবাসার স্পর্শ দেয় কপালে । মেহতাব মেঘের আরো কাছে চলে আসে । টিনা আর সামির নিচে এসে ওদের এতো কাছাকাছি দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে ।
টিনা : সামির আমি যা দেখেছি তুমিও কী তাই দেখেছো ?
সামির : আমি এমনি আধপাগল আমার দেখায় কিছু যায় আসে না ।
টিনা : কথায় যুক্তি আছে ।
সামির রাগী দৃষ্টিতে তাকায় টিনার পানে । টিনা ইতস্তত করে বলে ওঠে ,
টিনা : সরি ভুল হয়েছে । এখন কী করবো এই দুই চাতক পাখিকে নিয়ে ।
টিনা আর সামির উপরে চলে যায় । কোনো স্টাফের সাহায্য নিতে মেঘকে নিতে পারলেও মেহতাব কে তুলতে পারবে না তারা । আর রুমও তো সাজাতে হবে ।
মেঘ মেহতাব কে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয় । বুকে কয়েকটা কিল ঘুষি দিয়ে বলে উঠে ,
মেঘ : আপনি বড্ড খারাপ আমায় ভালোবাসেন না , অনুভব করেন না ।
মেহতাব মেঘের হাত তার বাম বুকে চেপে ধরে । মেঘ অনুভব করতে পারছে মেহতাবের হার্টবিট বিদ্যুতের বেগে চলছে । মেহতাব মেঘের চোখে চোখ রেখে বলে উঠে ,
মেহতাব : কিছু জিনিস শুধু দুর থেকে অনুভব করা যায় ধরা ছোঁয়া যায় না । এই হৃদয়ে তোমার জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করতে তোমার কি ধরা ছোঁয়ার প্রোয়জন ?
মেঘ ওষ্ঠাধর প্রসারিত করে মুচকি হেসে নেশালো কণ্ঠে বলে ওঠে ,
মেঘ : না আপনার কিঞ্চিৎ ভালোবাসাই যথেষ্ট এই মেঘকে অনুভব করিয়ে দিতে । এই সাহেব মেঘের একান্ত মেঘের ।
মেহতাব স্মিত হেসে বলে ওঠে ,
মেহতাব : তোমার ঠোঁটের হাসি যথেষ্ট আমায় অনুভব করিয়ে দিতে যে তুমি আমার । ভীষণ ভালোলাগে যখন তুমি আমার চোখে চোখ রেখে তাকাও তোমার চোখের এক চাহনি আমায় বিশ্বাস করিয়ে দেয় তুমি আমার শুধু আমার । তোমার মুখের চাহনি আমার মনের ছবিতে আকা হয়ে গেছে চাইলেও তা ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব নয় । তোমার ঠোঁটের হাসি আমার বুকে গেথে গেছে চাইলেও তা মুছে ফেলা সম্ভব নয় । আসলে তুমি টাই এই মেহতাবের সব । এই সাহেব তোমায় বড্ড চায় অনেক চায় ভীষণভাবে চায় অর্ধাঙ্গিনী ।
মেহতাবের প্রকাশ্য কথাগুলো আজ বেশ ভালো লাগছে শুনতে মেঘের কাছে । মেঘ মেহতাবের চোখে দৃষ্টি রেখে বলে ওঠে ,
মেঘ : ভালোবাসেন আমায় ?
মেহতাব উত্তর দেয় না কোলে তুলে নেয় তার প্রিয়তমাকে ।
সকাল হয়ে গেছে । বাইরে কুয়াশার কারণে জানালায় পানির সূক্ষ কণা জমে আছে । মেঘ বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে । মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে । মেঘ শোয়া থেকে উঠে পরে । আসে পাশে তাকায় মেহতাব কে খুঁজতে মেহতাব ঘরের কোথাও নেই । মেঘ হাই তুলে নিজের গায়ে মেহতাবের শার্ট দেখে থমকে যায় । কালকের ঘটনা কিছুই মনে পরছে না তার । তারাতারি বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে । ফ্রেশ হয়ে বের হতেই তার চোখ যায় বিছানার পাশে টেবিল ল্যাম্প এর দিকে । তার পাশে চিরকুট জাতীয় কিছু রাখা । মেঘ চিরকুট খুলতেই থমকে যায় ।
সবাই একসাথে গোল টেবিলে বসে আছে । সিয়াম , রৌফ , সামির মুখ কালো করে বসে আছে । তাদের হজম করতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েগুলো তাদের ইজ্জতে আলপিন ফুটিয়েছে তাও আবার অধুনিক পদ্ধতিতে । সৌরভের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সে বিন্দাসভাবে বসে কফি খাচ্ছে । মেঘ , মেহতাব , আহতাব আর অহনা চেয়ারে বসে আছে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে । মেহসানের ধ্যান ফোনে সে ফোনে গেমস খেলছে । মিথিলা , শাম্মী , সৌম আর সিমরান দাড়িয়ে সামিরদের দিকে তাকিয়ে আছে । নিরবতা ভেঙে শাম্মী বলে উঠলো ,
শাম্মী : হজম করতে কষ্ট হচ্ছে নাকি ? হজমের গুলি এনে দিই ? ( মজা করে )
সিয়াম : কচু গাছ এনে দে ফাঁস দিয়া মইরা যাই ।
রৌফ : দোস্ত আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আমি কি আমার আব্বা – আম্মার ছেলে না ? যদি হই তাইলে আমার আব্বার মতো গোঁফ কই ? ( বেদনার সুরে )
সামির : দোস্ত আগের জন্মে ছিলাম আমি বাদশা আমির এই জন্মে আমি গরীবের সামির ।
সামির : দোস্ত তুই ও । এই রাজাকারনীদের দলে যোগ দিলি ।
শাম্মী : ভাইয়া মুখ সামলাও । নইলে বিয়া করার আগেই বিধবা হয়ে যাবে তোমার স্ত্রী ।
সামির : ভাই আর বোন একরকম । পুরাই টাস্কি মার্কা ।
মেহতাব : তোরা থামবি শুধু আজেবাজে কথা ।
সৌরভ : চল দোস্ত উপরে গিয়া ঠান্ডা বাতাস খেয়ে ঝাক্কাস হয়ে আসি । প্লান তো করতে হবে নাকি চল । ( নিচু কণ্ঠে )
হুল্লোড় পার্টির সবাই সৌরভকে ফলো করে উপরে চলে গেলো । আহতাব আর অহনা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে আর মেঘ আর মেহতাব নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলো ।
.
.
মেঘ আর মেহতাব রুমে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো । খুব সুন্দর করে রুমের ডেকোরেশন করা হয়েছে । বারান্দায় সুন্দর করে ডিনারের ব্যাবস্থা করা । তারা বিছানায় দুটো প্যাকেটও দেখতে পেলো । একটা প্যাকেটের উপর মেঘের নাম আরেকটা প্যাকেটের উপর মেহতাবের নাম । প্যাকেট খুলতে তারা আরেকদফা অবাক হলো মেঘের প্যাকেট এ খুব সুন্দর একটা রেড আর ব্ল্যাক কম্বিনেশনের শাড়ি আর মেহতাবের প্যাকেটে ব্ল্যাক ব্লেজার , প্যান্ট আর রেড শার্ট । তাদের বুঝতে বাকি নেই এইসব চক্রান্ত কাদের । মেহতাব বলে উঠলো ,
মেহতাব : ওরা এতো পরিশ্রম করে যেহুতু এইসব করেছে । আমাদের ওদের পরিশ্রমের মান রাখা উচিত নয় কি ?
মেহতাব : আমি রেডি হচ্ছি তোমার শাড়ী চেঞ্জ করা হয়ে গেলে ডোরে নক করো ।
মেঘ : হুম ঠিকাছে ।
এই বলে মেহতাব ওয়াশরুমে ডুকে পড়লো আর মেঘ রুমে শাড়ি চেঞ্জ করতে লাগলো । শাড়ি চেঞ্জ করে মেঘ মেকআপ করতে বসে পড়লো । সে বেশি গর্জিয়াস মেকআপ করতে পছন্দ করে না । সে চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় করে লাল রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে। তাতেই যেনো তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে । মেঘ রেডি হয়ে ওয়াশরুমে নক করে দিলো । কিছুক্ষণ পর মেহতাব ওয়াশরুম থেকে বের হলো । বের হতেই মেঘের দিকে চোখ পড়লো সে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করলো মেঘকে । তাকে এতো অল্প সাজে কোনো পরীর থেকে কম লাগছে না চোখ ফেরানো দায় । মেহতাবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ মেহতাবের দিকে একটা তুরি মারলো । মেহতাবের হুশ ফিরতেই সে ভীষণ লজ্জা পেলো । ব্লেজার পড়তে পড়তে মেহতাব বলে উঠলো ,
মেঘের কথায় মেহতাব ছোট একটা হাসি দিলো । আর তারা দুজনেই একসাথে বারান্দায় প্রবেশ করলো । খুব সুন্দর করে গোল টেবিলটি সাজানো হয়েছে । টেবিলের চারপাশে বেলুন ভর্তি । মেহতাব একটা চেয়ার টেনে মেঘকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো । টেবিলে অনেক রকমের খাবার সুন্দর করে সাজানো হয়েছে । তারা হালকা খাবার নিয়ে দুজনেই কিছু কথা বলে খেতে লাগলো ।
অন্যদিকে সৌরভ,সিয়াম,সামির, রৌফ,মেহসান,সৌম আর মিথিলারা ঝোঁপঝারে দাড়িয়ে দূরবীন দিয়ে মেহতাব আর মেঘকে দেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । সৌরভ বলে উঠলো ,
সৌরভ : বাহ! মেঘ আর মেহতাব কে অনেক সুন্দর লাগছে ।
মিথিলা : হুম সত্যিই অনেক সুন্দর!
মেহসান : তারা খাচ্ছে পোলাও বিরিয়ানি কোরমা আমরা খাচ্ছি মশার কামোড় ওহ মা !
সিয়াম : চুপ থাক । তোর কবিতার চেয়ে নর্দমার ময়লা গুলা বেশি সুন্দর ।
রৌফ : খাঁটি কথা শুনতেও ভালো লাগে ।
মেহসান : হুমম । তাহলে বিয়ের পর ওই নর্দমায় বাসর ঘর সাজিয়ে দিবো ওকে ? ( মজা করে )
সৌম : সহমত আমি । ( মুচকি হেসে )
এই কথা শুনে রৌফ আর সিয়াম মেহসান আর সৌমের মাথায় চাটি মারলো ।
সিমরান : সবারটাই ঠিক আছে । শুধু মিথিলা আপুর হবু বরের পোড়া কপাল ।
শাম্মী : হুমম ঠিক আপু ।
সৌরভ মিথিলার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন তুলে বললো ,
সৌরভ : কেনো বোনেরা আমার ?
সিমরান : কেনো আবার । মিথিলা আপু যেইরকমের আনরোমান্টিক তা আমরা সবাই জানি । নয় কি ?
সৌরভ : হুম ঠিক । বেচারা জামাইটার কথা ভাবলে আমার বুকটার ভিতরে ধুকপুক ধুকপুক করে ।
মিথিলা : ভাইয়া আপনাকে এতো ভাবতে হবে না । আমার জামাই তো রোমান্টিকের বাজার সে আমায় শিখিয়ে দিবে ।
সৌরভ : তাই নাকি । ( লজ্জা পেয়ে )
শাম্মী : তুমি কেনো লজ্জা পাচ্ছ । মিথিলা আপুতো তার হবু জামাইয়ের কথা বলেছে তোমার না । ঠিক বললাম কিনা ?
সবাই শাম্মীর কথায় একমত পোষণ করলো । সামির পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বলে উঠলো ,
সামির : থাম সবাই । এই জায়গা থেইকা ওগো কথা ভালো কইরা শুনা যাইতাসে না উপরে গিয়া কান পাইতা শুনতে হবে চল ।
সামির এর কথায় কেউ আর কথা বাড়ালো না । সবাই সামিরের পিছু পিছু উপরে চলে গেলো । রুমের সামনে আসতে তারা রীতিমতো অবাক সেখানে আগে থেকেই অহনা আর আহতাব কান পেতে দাড়িয়ে আছে । তা দেখে কেউ আর হাসি থামাতে পারলো না সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে ফেললো । হাসির শব্দ শুনে আহতাব আর অহনা চমকে উঠলো।
আহতাব : উফফ তোরা তো আমাদের ভয় পাইয়ে দিলি ।
সিয়াম : আজকের তাজা খবর নতুন দম্পতির ঘরে কান পেতে কথা শুনছে আরেক নতুন দম্পতি । এরকম আরো নিউজ পেতে চোখ রাখুন অসময় টিভিতে ।
সিয়ামের কথায় সবাই আরেকদফা হেসে নিলো ।
সিমরান : চলো আমরাও শুনি ।
সিমরানের কথামতো সবাই সিরিয়ালভাবে কথা শুনতে আহতাব আর অহনার পিছনে দাড়িয়ে পড়লো । আশেপাশের সবাই তাদের কান্ড দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগলো । তাদের ওইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই । তারা সবাই কথা শুনতে ব্যাস্ত ।
অন্যদিকে হালকা খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেঘ আর মেহতাব দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । মেহতাব মেঘের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো তার ঠান্ডা লাগছে । তাই সে তার ব্লেজার খুলে মেঘকে পরিয়ে দিলো আর বললো ,
মেহতাব : এখন ঠান্ডা লাগছে ?
মেঘ : উহুম ।
কিছুক্ষণ পর মেহতাব মেঘের দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো । মেঘ অবাক দৃষ্টিতে মেহতাব এর দিকে তাকিয়ে প্যাকেট টি হাতে নিল । প্যাকেট খুলতেই সে হতভম্ব হয়ে গেলো ।
মেঘ : এটা তো অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার স্কুলের শিক্ষিকা পদে নিয়োগ হওয়ার ।
মেহতাব : হুম । অহনা আপু আর তোমার দুজনের জন্যেই ।
মেঘ : আপনি কি করে জানলেন আমাদের দুজনের সপ্ন শিক্ষিকা হওয়ার ?
মেহতাব : এটা কোনো কঠিন কাজ ছিলো না । আর এমনিতেও আমি লন্ডনে ব্যাক করবো তুমি যাতে তোমার হাজব্যান্ডকে বেশি মিস না করো সেই প্রস্তুতি । তাই ভাবলাম তোমায় একটু ব্যাস্ত করে যাই । কেনো তুমি খুশি নোও ?
মেহতাবের কথায় মেঘ এই নিয়ে আরেকদফা লজ্জা পায় । দরজায় কিছু শব্দ শুনে মেহতাব আর মেঘ দোলনা থেকে উঠে পড়ে । মেহতাব দরজা খুলতেই আহতাব অহনা সহ সবাই একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে । সবাইকে এভাবে একসাথে দেখে মেঘ আর মেহতাব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । আহতাব মুচকি হেসে ইতস্তত করে বলে উঠে ,
আহতাব : আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ , তুমি থাকো আমি যাই বউ । ( ইতস্তত করে )
বলতে দেরি কিন্তু আহতাবের দৌড় দিতে দেরী না । আহতাবের কান্ড দেখে সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো ।
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ২০
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
সবাই মেহতাবের রুমে চুপচাপ বসে আছে । সৌরভ , রৌফ , সামির , সিয়াম সোফায় বসে নিজেদের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে । সৌম আর মেহসান বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে । শাম্মী , সিমরান , মিথিলা বেতের টুলে বসে আছে । অহনা মেঘের পাশে বসে আছে । নিরব পরিবেশ সবাইকে এভাবে দেখে মেহতাব বলে উঠলো ,
মেহতাব : তোরা সবাই একসাথে দরজায় কান পেতে ছিলি কেনো ? আর ভাবী শেষমেষ তুমি আর ভাইয়াও ওদের দলে যোগ দিলে । I can’t believe it .
অহনা : মেহতাব কী বলোতো আমি আসতে চাইনি তোমার ভাইয়া দেখতে মানে শুনতে চাইছিলো তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক নরমাল কিনা । এ ছাড়া আমরা নির্দোষ ।
সৌরভ কথা শেষে মেহতাবের দিকে তাকাতেই মেহতাবের দৃষ্টি দেখেই চুপসে গেলো । রৌফ বলে উঠলো ,
রৌফ : আসল কথা আমরা বেশি কিছু শুনি নাই দোস্ত । আজকে সবার কানের নেটওয়ার্ক এ প্রবলেম ছিলো । এই রিসোর্টে খুব দূর্বল নেট দেয় শুনতেই পাই নাই । দরজাগুলো ভালো মানের এই রিসর্টের মালিকের নামে কেস করা উচিত ।
সিমরান : নাম মেহতাব চৌধুরী ৬ ফুট উচ্চতা গাঁয়ের রঙ ফর্সা , জিম করা বডি , সিল্ক চুল । এই তার বর্ণনার সার্টিফিকেট যান খুঁজুন আর কেস ঠুকে দিন ।
সিয়াম : ভাইয়ের প্রশংসার বেলায় কোনো ত্রুটিই থাকে না । আই অ্যাম তো বিস্মিত ।
সিয়ামের কথা শুনে সবাই মুচকি একটা হাসি দিলো ।
পরক্ষণে রৌফের মনে পড়ে যায় এই রিসোর্ট তো মেহতাবদের নিজেরই । মার কাছে মাসির বাড়ির গল্প আরকি ।
সামির : আমার মনে হয় ফার্নিচার গুলা কাকলী ফার্নিচার । দামে কম মানে ভালো । তাই না দোস্ত ? ( মজা করে )
সৌরভ : এই সামিরের মাথায় কেউ শিলা পাথর ঘোষ তো তবুও যদি ধার হয়ে একটু বুদ্ধি হয় ।
শাম্মী : তবুও বুদ্ধি হবার নয় । মরিচা পড়ে গেছে কী করার বলো ?। ( মুচকি হেসে )
সিয়াম : চুপ থাক তোরা । আসল কথা আমরা নিতান্তই ভদ্র ছেলে দোস্ত । মেয়েগুলার সাথে মিশে আমরা নষ্ট হয়ে গেছি । আগে আমরা ছিলাম ভালো এখন আমাদের কী হলো ? ( সুর দিয়ে )
মিথিলা : ভাইয়া আমাদের নামে কী আজেবাজে কথা বলছো । এইসব তোমাদের দোষ ।
শাম্মী : ঠিক আমাদের নামে আজেবাজে কথা বলে ভাইয়ার কান ভাঙাচ্ছো ।
সিমরান : এই সব প্লান তো তোমাদের ছিলো আমাদের নয় । আমাদের মিস ইউজ করেছো ।
মেয়েরা আর কিছু বলতে যাবে মেহতাব তাদের থামিয়ে বলে উঠলো ,
মেহতাব : ফর গড সেইক তোরা থাম সবাই ।
অহনা : চলো সবাই আজ থেকে আমরা মেয়েরা আলাদা ছেলেরা আলাদা দেখা যাক আমাদের হেল্প ছাড়া ওদের ক্ষমতা কতো ।
সৌরভ : ভাবী তুমি ওদের দলে যোগ দিলে শেষমেষ ।
অহনা : তোমাদের দলে আহতাব আছে । ওই দলে আমি নেই ।
এই বলে অহনা সহ বাকি মেয়েরা চলে গেলো । সৌম আর মেহসান হাই তুলতে তুলতে যেতে লাগলো । এই দেখে সৌরভ সহ বাকি সবাই ওদের মাথায় একটা একটা চাটি মেরে চলে গেলো । তা দেখে মেহসান বলে উঠলো ,
মেহসান : আমরা কী করেছি আমরা তো আম্পায়্যার ।
রৌফ পিছনে ফিরে মুচকি হেসে বলে উঠলো ,
রৌফ : এখানে কী কোনো খেলা চলছে যে তোরা আম্পায়্যার ।
সৌরভ , সামির আর সিয়াম রৌফের এমন কথা বার্তায় হেসে দিলো ।
মেহসান মাথা চুলকিয়ে যেতে লাগলো । সৌম বলে উঠলো ,
সৌম : So unfair . ( মুচকি হেসে )
মেহসান : হুমম । আমি আজ থেকে সন্ন্যাসী হয়ে যাবো । কোনো দলে থাকবো না যেখানে যাই সবাই শুধু ফ্রি ভেবে যা ইচ্ছা তাই করে ।
.
.
মিথিলা , শাম্মী আর সিমরান রুমে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো । বেড এ টিনা শুয়ে আছে । টিনার কথা তো তারা ভুলেই গেছিল। যে কিনা হেল্প করবে বলে প্রমিজ করেছে সে আরামসে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে । শাম্মী বলে উঠলো ,
শাম্মী : বাহ্ এতো সুন্দর দৃশ্য দেখার পর আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না।
সিমরান : হুম মজা দেখাই চল ।
মিথিলা : তোরা আজেবাজে কিছু করবি না ।
মিথিলার কথায় তারা কোনরকম গুরত্বরোপ করলো না । টিনাকে বিছানা থেকে হাত আর পা ধরে তুলে ওয়াশরুমে শুইয়ে দিলো । টিনার কোনো হুশ নেই সে আরামছে ঘুমাচ্ছে । মিথিলা আর কিছু বললো না । সবাই হাসাহাসি করে শুয়ে পড়লো ।
.
.
সৌরভদের রুমে সবাই রেগে বেশ আগুন হয়ে আছে । মেহসান সন্ন্যাসীদের মতো পোশাক পরিধান করে ধ্যাঁন করার ভঙ্গিতে বসে আছে । সৌম বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় চিপস খাচ্ছে । সামির সৌমের থেকে প্যাকেট কেড়ে নিয়ে নিজে খেতে শুরু করেছে । সৌরভ , সিয়াম , রৌফ সিরিয়াস ভঙ্গিতে সোফায় বসে আছে । তাদের উপর সব দোষ চাপিয়ে দিলো । সিয়াম বলে উঠলো ,
সিয়াম : দোস্ত এটা কি ছিলো, যত দোষ নন্দ ঘোষ।
রৌফ : ওই যে কয় না , গু খায় সব মাছে দোষ পড়ে পাঙ্গাস মাছের ।
সৌরভ : তুই কি ইন্ডিরেক্টলি আমাদের পাঙ্গাস মাছ বললি । তুই জানিস না আমার পাঙ্গাস মাছে এলার্জি ।
এই কথা শুনে মেহসান ধ্যানরত অবস্থায় ঠোঁট কামড়ে নিজের হাসি থামাতে লাগলো । সামির বিষম খেয়ে উঠলো । সৌম পানি দিতে গিয়ে সব পানি সামিরের গাঁয়ে ঢেলে দিলো । সৌম ইতোস্ত করে বলে উঠলো ,
সৌম : পানির অপর নাম জীবন । আমি তোমাকে আরেকটা জীবন দিয়েছি তাও আবার ঢেলে । ( মুচকি হেসে )
সামির রাগে গজগজ করে বললো ,
সামির : সৌম তোরে আজ বানামু আমি মমো । ( রাগ দেখিয়ে )
সৌম : ভালো লাগেনা সব সময় এতো খাই খাই করো কেনো ।
সামির : তোকে পরে দেখছি ।
এই বলে সামির ওয়াশরুমে ডুকে পড়লো । সৌম পরান যায় জ্বলিয়া গান ছেড়ে গলা ছেড়ে জোড়ে চিৎকার করে গাইতে লাগলো ,
সৌম : ঠান্ডায় যায় পুড়িয়া রে……….. । ঠান্ডায় যায় পুড়িয়া রে……….. ।
সৌমের গান শুনে মেহসান নিজেকে আর সামলাতে পারলো না সন্ন্যাসীবেশ ছেড়ে সে মুখ দিয়ে বিট বাজাতে বাজাতে গিটার চালানোর ভঙ্গিতে নাচতে থাকে । ওদের এলোাপাথাড়িভাবে নাচ দেখে রৌফ বলে উঠে ,
রৌফ : দাদীর কাছে শুনছিলাম বুড়া বয়সে পাটের ব্যাবসা আর এখন দেখি কিশোর বয়সে মুড়ির ব্যাবসা করতে হইবো ওগো। ( অবাক ভঙ্গিতে )
সৌরভ : আমি বাকরুদ্ধ স্বাধীনতা অর্জনের পরেও । ( মুচকি হেসে )
আহতাব আর অহনার মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই তারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে । তারা বুদ্ধি করে ওদের মধ্যে ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে । বাকিটা আর তাদের কিছুই করতে হবে না । মেয়ে আর ছেলে দুই দল করে নিবে । তারা শুধু দেখবে ।
.
.
( মেহতাবদের রুমে )
মেঘ শাড়ি চেঞ্জ করে একটি বেগুনি রঙের শাড়ি পড়ে এসেছে । আর মেহতাবও একটা ব্রাউন টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়েছে । মেঘকে দেখে মেহতাব বলে উঠলো ,
মেহতাব : সব ঠিকঠাক আছে শুয়ে পড়ো ।
মেঘ মেহতাবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ,
মেঘ : আপনি ঘুমাবেন না ?
মেহতাব : আসলে আমি কালকে ফিরে যাবো না সো আগে থেকে বলে দিবো আমার এসিস্ট্যান্টকে যাতে ও কালকের দিন টা একটু ম্যানেজ করে রাখে । অনেক পেন্ডিং কাজ পড়ে আছে । I have no other option .
মেহতাবের কথা শুনে মেঘ ভীষণ খুশি হলো । কিন্তু অনুভুতি গোপনেই থেকে গেলো প্রকাশ করলো না বা তার প্রকাশ করার ক্ষমতাটুকু হয়তো নেই । মেঘের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মেহতাব ভ্রু কুচকে বলে উঠলো ,
মেহতাব : তোমার হাজব্যান্ড তার ওয়াইফ এর জন্য থেকে যাচ্ছে । ওয়াইফের তো খুশি হয়ে হাজব্যান্ড কে জড়িয়ে ধরা উচিত নয় কি ? ( মলিন হেসে )
শীতের মৌসুম ভোরের রৌদ্রজ্জল মিষ্টি সকাল । সূর্যের দেখা মেলেনি কাঁচের জনালাগুলো বড় বড় পর্দা দ্বারা আবৃত । মেঘ আর মেহতাব বিছানায় শুয়ে আছে । মেঘ ছোট বাচ্চাদের মতো মেহতাববের উষ্ণ দেহতে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে রয়েছে । কখন সে এই বুকে ঠাই নিয়েছে কারোই জানা নেই কনকনে শীত তাদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে । হুল্লোড় পার্টি থাকলে শীত কে পা ধরে সালাম করতো । গালে কিছুর খোঁচা খেতেই ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো সে । বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন গুলো আরো শক্তপোক্ত হলো । মেহতবাকে নিজের সন্নিকটে দেখে চমকে উঠলো । অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও ব্যাথায় মেঘ চেঁচিয়ে উঠলো । মেহতাব পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঘুম মগ্ন অবস্থায় শোয়া থেকে উঠে পড়লো । চুল গুলো কপালে এলোমেলো ভাবে পরে আছে তবুও তাকে সুদর্শন পুরুষ বলা যায় । মেহতাবের নজর গেলো খাটের পাশে পড়ে থাকা সুন্দরী রমণীর দিকে । মেঘ গালে হাত ডলতে ডলতে নিচে বসে আছে । মেহতাব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । বলে উঠলো ,
মেহতাব : নিচে বসে আছো কেনো ?
মেঘ কিছু বললো না কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো । মেহতাব উত্তরের আশা না করে শোয়া থেকে উঠে চুল গুলো ঠিক করতে করতে সৌরভদের ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো ।
.
.
রিসর্টের টপ ফ্লোর অর্থাৎ ছাঁদে ছোট ছোট গোল টেবিলে মেহতাব আর তার বন্ধুরা বসে আছে ।
সৌরভ সামির কে গুঁতিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে বললো । সামিরের সেই দিকে মনোযোগ নেই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা টেবিলের উপর সুন্দর করে সজ্জিত খাবার খাচ্ছে সে । সিয়াম ব্যায়াম করছে । রৌফ ছাঁদে দৌড়াচ্ছে । মেহতাব ফোনে নিউজ দেখছে আর কফি খাচ্ছে । সবাই নিজেদের কাজে ব্যাস্ত শুধু সৌরভ নিজে ছাড়া । সৌরভ বলে উঠলো ,
সৌরভ : পেটুক সামির খাবার গুলোকে আধমরা করা বন্ধ কর । আর সকিনার স্বামী মর্নিং দৌড় বন্ধ কর । এতিমখানার এটিএম ব্যায়াম করা থামা বলছি । সবাই এদিকে আয় ।
সৌরভের কথায় সকলের মুখ চুপসে গেলো । মেহতাব ধোঁয়া ওঠা কফির মগটা সাইডে রেখে দিয়ে বললো ,
মেহতাব : প্লিজ নতুন কোনো ঝামেলা ক্রিয়েট করিস না । অনেক কাজ বাকি । I’m so busy .
রৌফ বলে উঠলো ,
রৌফ : দোস্ত এই পৃথিবীতে সৌরভ আজ পর্যন্ত যত ঝামেলার আবিষ্কার করছে ওই আবিষ্কারের সম্পদ দিয়া আজ ওয় উগান্ডার প্রেসিডেন্ট হইয়া যাইতো । সুং সাং সৌরভাং ।
সৌরভ আফসোসের সুরে বললো ,
সৌরভ : ইসস আমি ওই সকল আবিষ্কার উগান্ডার জন্য না করে তোর জন্য করেছি মেহতাব । ভাব আমি কতোটা উদার মনের অধিকারী । ( চুল ঝারা দিয়ে )
সিয়াম : উগান্ডার প্রেসিডেন্টের তো পাবনার পাগলা গারদে থাকা উচিত । নয় কি ? মায়ের কোলে সন্তান আর বনের পশু বনে শোভা পায় ।
সৌরভ : থাম সমুদ্রের মাঝখানের আম ।
সিয়াম : হোয়াট এভার ।
সৌরভ : তো আসলে দোস্ত আমরা কিছু প্রশ্ন করবো তুই উত্তর দিবি তাইলে আমরা কোনো কথা কি কোন শব্দ ছাড়া লন্ডন এ ব্যাক করবো ।
মেহতাব : এমনিতেও তোদের জন্য অনেক দেরী করেছি । বেশি উল্টোপাল্টা কাজ করলে আই প্রমিজ আজই রওনা দেবো ।
মেহতাবের কোনো ভাবাবেগ না দেখে সৌরভ আর বাকিরা চারটা চেয়ার টেনে নিয়ে মেহতাবের সামনে বসে পড়লো । তাতেও মেহতাব গুরত্বরোপ করলো না সে ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছে । সৌরভ ফোন টা কেড়ে নিলো । আর বলে উঠলো ,
সৌরভ : দোস্ত আমার নানার তার দাদার তার শ্বশুরের শালির কসম শেষ সুযোগ চাই ।
সবাই চাই চাই বলে সম্মতি জানালো । মেহতাবের অন্য কোনো উপায় না থাকায় বলে উঠলো ,
মেহতাব : দিস ইজ দা লাস্ট চান্স ওকে ?
সৌরভ : হুমমম ওকে । তো আমাদের প্রথম প্রশ্ন করবে লাল বাতি টিমের পক্ষ থেকে সিয়াম ।
সিয়াম একটু নিজেকে ঠিকঠাক করে নিলো। একটা শিট হাতে নিয়ে বলে উঠলো ,
সিয়াম : এটা আমার অপশনে ছিলো না । দিস ইজ বাজে চিটিং ।
মেহতাব : যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর । চিটিং এর কি দেখলি ?
সৌরভ : দোস্ত সিয়াম বরাবর বাংলায় একটু কাঁচা লাল বাতি ক্ষমা পার্থী । এবার চুল কালো টিমের পক্ষ থেকে রৌফ নাই যার গোঁফ ।
রৌফ : করমু আমি বিয়া তোমাগো দাওয়াত দিয়া । তো আমার প্রশ্ন ,
ভালোবাসা বলতে কি বোঝেন আপনি ?
মেহতাব : ভালোবাসা ? এরকম টাইপ প্রশ্ন করলে আমি কিন্তু চলে যাবো প্লিজ অন্য কিছু আস্ক কর ।
সৌরভ : ওকে আর একজন বাকি তো আধপেটুক টিম থেকে সামির যার দিবাসপ্ন হলো সে বাদশা আমির ।
সামির : আমি সামির । বয়স ২৫ । একদম খাঁটি সিঙ্গেল । আমার জীবনে তিনটি সখ খাওয়া , খাওয়া আর খাওয়া ।
সৌরভ : আয় আয় সূর্য মামা বুদ্ধি দিয়ে যা সামিরের মাথায় একটু বুদ্ধি দিয়ে যা । মাথারে হরলিক্স খাওয়া যদি একটু বুদ্ধি হয় । টেকো মাথায় চুল গজাইতে পারলে মস্তিষ্কহীন মাথায় বুদ্ধির বীজ লাগানো কোনো ব্যাপার না ।
সামির : হে প্রভু , পেট টা আমার একটু খেতে ভালোবাসে ওকে কি করে অনাহারে রাখি আমি এতোটা নির্দয় নই ।
মেহতাব আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে নিচে চলে যায় । আর কিছুক্ষণ ওদের সাথে থাকলে মেহতাবেরও পাবনার পাগলা গারদে নিজেকে এডমিট করতে টিকিট কাটতে হতে পারে ।
নিজেকে ধাতস্থ করে মেহতাব রুমে প্রবেশ করতেই মেঘকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু লাগাতে দেখে থমকে যায় ।
মেহতাব : কী করছো গালে ব্যাথা পেলে কিভাবে ?
মেঘ কোনো উত্তর দেয় না । কিছুক্ষণ পর রিনরিনিয়ে বলে উঠে ,
মেঘ : আপনি দিয়েছেন ?
মেহতাব অবাক হয়ে যায় সে আবার কখন দিলো । নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,
মেহতাব : রেলি ? আমি তোমাকে হাউ ইজ ইট পসিবেল ?
মেঘ : কিভাবে আবার আপনার খোঁচা খোঁচা দাড়ি দিয়ে ঘষা দিয়েছেন ।
সৌরভরা মেহতাবকে তার ফোন দিতে এসেই এই কথা শুনে থমকে যায় ।
সৌরভ : এটা আমি কি শুনলাম মেহতাব তো অনেক অ্যাডভান্স লাভ বাইট এর জায়গায় দাড়ি বাইত দিয়ে দিলো । আমি সামিরের মতো দিবাসপ্ন দেখছি না তো ? দোস্ত একটা চিমটি দে তো ।
এটা বলতে দেরী তিনটে হাতের সজোরে চিমটি কাটতে দেরী হয়নি । সৌরভ ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো ,
সিয়াম : কী বেসুরে গলা ।
রৌফ : হুম উগান্ডার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট কিনা ।
সামির : উগান্ডায় কী ভালো খাবার পাওয়া যায় ?
সৌরভের আওয়াজ শুনে মেহতাব আর মেঘ দরজার দিকে দৃষ্টি পড়ে । মেহতাব আফসোসের সুরে বলে ওঠে ,
মেহতাব : নিজের বউয়ের সাথে ঠিকঠাক মতো কথা বলার সুযোগ নেই আবার রোমান্স । আমার মনে হয় উগান্ডার টিকেট কিনে ওখানেই হানিমুনের ব্যাবস্থা করতে হবে ।
মেঘ : আপনি তো খুব গুনী মানুষ। আমি তো আমার চোখ সরাতেই পারছিনা এই অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্য থেকে ।
মেহতাব : থাঙ্কস ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট । বাট আরো খুশী হতাম যদি তুমি এই ডিজাইন কে না বলে আমাকে বলতে । ( মেঘের দিকে চোখ মেরে )
মেঘ মেহতাবের এই কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলতে যাবে । তখনি মেহসান সেখানে উপস্থিত হলো । আর মেঘ আর মেহতাব কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
মেহসান : কি করছো তোমরা ? ( মুচকি হেসে )
মেহসান কে দেখে দুজনে চমকে উঠলো । আর মেহতাব মেঘের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো আর মেহসানের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো ,
মেহতাব : আমরা কিছু করি বা না করি তুই নিশ্চয়ই কিছু একটার ব্যাঘাত ঘটিয়েছিস । ( রাগ দেখিয়ে )
মেহতাব এই কথা বলে নিজের সানগ্লাস টা খুলে হাতে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো । এবার মেহসান সহ সেখানে উপস্থিত সবাই মেঘের দিকে প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকালো । মেঘ পরিস্থিতি সামাল দিতে একটি মুচকি হাসি দিলো । আর মেহসানকে বলে উঠলো ,
মেঘ : তো মেহসান আমার ছোটো দেওর চলো তোমায় রুমে দিয়ে আসি । ( মেহসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে )
মেহসান : আমি মোটেও ছোট নই ভাবী । আমার শুধু একটু অভিজ্ঞতা কম এই আর কি । ( লজ্জামাখা হাসি দিয়ে )
মেঘ : তাই বুঝি । ( মুচকি হেসে )
তখনি হুল্লোড় পার্টি সেখানে উপস্থিত হলো আর সিমরান মেঘের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ,
সিমরান : তোমায় দিয়ে আসতে হবে না মেঘ ভাবী । মেহসান আর সৌরভ ভাইয়াদের রুম তো একই । তারা একসাথে যাবে । তুমি বরং মেহতাব ভাইয়ার কাছে যাও । ভাইয়া তো আবার চলে গেলো । ( মুচকি হেসে )
মেঘ : ঠিকাছে তাহলে আমি আসছি । তোমরা সবাইও রুমে চলে যাও দেরি করো না ।
শাম্মী : ওকে ভাবী আমরা তাড়াতাড়ি চলে যাবো । তুমি ফ্রিলি যাও বাই ।
শাম্মীর কথা শুনে মেঘ সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেলো । তখনি হুল্লোড় পার্টির সবাই মেহসানের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আর বলে উঠলো ,
সৌরভ : তুই সুধরাবি না ? কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হওয়ার সখ । ঘর শত্রু বিবিশন ।
মেহসান : চিন্তা করো না শুধরিয়ে যাবো একদিন । শুধরাতে তো আর টাকা লাগে না । আর সেটা ঘর শত্রু মেহসান হবে ।( জামার কলার উচিয়ে ভাব নিয়ে )
কেউ আর মেহসানের কথার প্রতিউত্তরে কিছু বললো না । সবাই জানে গরুকে যতই বলুক অন্যের খেতে না যেতে সে তো যাবেই । বোধবুদ্ধি কম কিনা । সবাই এই ভেবে মন কে শান্ত করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেদের রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ।
.
.
( মেহতাবদের রুমে )
মেহতাব রুমে ঢুকেই দেখলো বড় পর্দা দিয়ে বড় বড় জানাল গুলো ঢাকা তাই সে সেগুলো সরিয়ে দিলো যাতে রুমে আলো আসে । তখনি মেঘ রুমে ডুকলো । সে মেহতাবের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । এক চিলতে রোদ পড়েছে মেহতাবের মুখে তাতে তাকে একদম স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে । অল্প তেই তাকে বেশ সুন্দর লাগে । তখনি মেঘের দৃষ্টি রুমের দিকে গেলো । দুইজনের রুম অথচ ১০ জনের থাকার মতো জায়গা আছে । মেহতাবদের বাড়ির রুম অবশ্য অনেক বড় ছিলো । সে এইসব আর না ভেবে এবার মেহতাবের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আর মেহতাব কে উদ্দেশ্যও করে বলে উঠলো ,
মেঘ : আপনি কি রাগ করেছেন কোনো কারণে ?
মেহতাব : কেনো আমায় দেখে কী তোমার মনে হচ্ছে আমি রাগ করেছি ? ( ভ্রু কুচকে )
মেঘ মনে মনে বিড়বিড় করে বললো ” তখন তো রাগে বরফের মতো ফুলে গিয়েছিল । যাই হোক উনি রাগলেও ওনাকে সুন্দর লাগে ” ( মুচকি হেসে )
মেহতাব : কিছু যদি বলার থাকে জোরে বলো ? ( মেঘের দিকে তাকিয়ে )
মেহতাবের কথায় মেঘের হুশ ফিরল । সে একটা ছোট হাসি দিয়ে বলে উঠলো ,
মেঘ : না তেমন কিছু না । ( প্রকাশ্য হাসি দিয়ে )
আর মনে মনে আবার বললো , ” আপনাকে নিয়ে কিসব ভাবছি ইচ্ছে তো করছে নিজের মাথায় চাটি দিতে ”
মেহতাব : ওকে তাহলে তোমার মনে মনে কথা বলা শেষ হলে তুমি শাওয়ার সেরে নেও । আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে ।
এই বলে মেহতাব রুম থেকে চলে যাওয়ার সময় আবার কিছু একটা মনে পড়ায় ফিরে এলো । আর মেঘকে বলে উঠলো ” ওয়াশরুম লক করে নিও ”
এই বলে সে আর সময় নষ্ট না করে রুম থেকে চলে গেলো । মেঘ মেহতাবের কথা শুনে একটা স্নিগ্ধকর মিষ্টি হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ।
.
.
অন্যদিকে সৌরভ , রৌফ , সিয়াম আর সামির তাদের রুমে কে ওয়াশরুমে আগে যাবে সেটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে । সৌরভ ওয়াশরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে । আর সবাই তাকে সরানোর চেষ্টা করছে । তা দেখে সৌরভ বলে উঠলো ,
সৌরভ : ও শুধু আমার ওর গায়ে হাত লাগানোর চেষ্টা টুকু যদি তোগো মধ্যে কেউ করে ভালো হইবো না । ( রাগ দেখিয়ে )
একদিকে সৌরভ আর বাকিরা ঝগড়া করছে আর মেহসান আর সৌম সোফায় বসে মজা দেখছে আর বাজী ধরছে । সৌম মেহসান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
সৌম : তোর কি মনে হয় কে জিতবে ?
মেহসান একটা হাই তুলে বলে উঠলো , “সৌরভ ভাইয়ার উপরে ২০ টাকা , রৌফ ভাইয়ার উপরে ৫০ টাকা , সিয়াম ভাইয়ার উপরে ১৫ টাকা আর সামির ভাইয়ার উপরে ২ টাকা ।
এই কথা সৌরভদের কানে যেতে দেরি কিন্তু তাদের অগ্নিদৃষ্টি মেহসানের উপর পড়তে দেরি নেই । মেহসানকে তারা ৪ জন যেনো চোখ দিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে । মেহসান একটা ঢোক গিললো আর রুম থেকে যেতে যেতে সুর দিয়ে বলে উঠলো ,
মেহসান : টয়লেট তুমি বলে দেও তুমি কার ৪ জন মানুষ একটি টয়লেটের দাবিদার । ( সুর দিয়ে )
এই কথা বলে মেহসান যাওয়ার সময় সবাই পা থেকে জুতা খুলে ছুঁড়ে মারলো মেহসানের দিকে । মেহসান জুতোগুলো এড়িয়ে রুমে থেকে দৌড়ে বাইরে চলে গেলো । মেহসান যাওয়ার সময় সবার প্রতিজোড়া জুতো থেকে একটি জুতো নিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে রুম থেকে চলে গেলো । এবার সৌমিক বলে উঠলো ,
সৌম : তোমরা থামবে না নাকি ? বাচ্চাদের মতো করছো । ওয়াশরুম টার উপর কি অত্যাচার টাই না চালাচ্ছো তোমরা । আমি বরং চলে যাই আমার দ্বারা আর দেখা সম্ভবপর নয় । আমি প্রস্থান করিলাম তোমাদিগ গণকে পানি শুভেচ্ছা ।(গ্লাস থেকে পানি ছিটিয়ে)
এই বলে সৌম চলে গেলো । সবাই সেইদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সেই সুযোগে রৌফ ওয়াশরুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিলো । আর বাকিরা রাগ করলেও আর দাড়ানোর ক্ষমতা না থাকায় নিচে পাবলিক ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য একসাথে দৌড় দিলো ।
.
.
( মেহতাবদের রুমে )
মেঘ শাওয়ার শেষ করে শাড়ি গায়ে প্যাঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে । ওয়াশরুমে শাড়ি ঠিক ভাবে পড়তে পারেনি । তাই সে কিছু না ভেবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করতে থাকলো । হঠাৎ সেই সময় মেহতাব রুমে প্রবেশ করলো আর মেঘকে শাড়ি ঠিক করতে দেখে পিছনে ঘুরে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে মেঘ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
মেহতাব : I’m sorry . I didn’t notice you . ( আমি দুঃখিত । আমি তোমাকে খেয়াল করি নি )
মেহতাবের কণ্ঠস্বর পেয়ে মেঘ নিজের শাড়ি গায়ে দিয়ে যেই ওয়াশরুমে প্রবেশ করবে তখনি শাড়ির সাথে পা প্যাচিয়ে ঠাস করে পরে গেলো । মেহতাব শব্দ পেয়েই পিছনে ফিরে তাকালো আর দেখলো মেঘ নিচে পরে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে রেখেছে । সে মেঘকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো আর বলে উঠলো ,
মেহতাব : দরজা লক করো নি কেনো ?
মেঘ : আমি বুঝতে পারি নি আপনি এসে পরবেন । আমি দুঃখিত ।
শাম্মীর এমন কথা বার্তায় সিমরান আর মিথিলা হেসে দেয় । আর মিথিলা বলে উঠে ,
মিথিলা : আমার হবু দুলাভাইকে বলবো যাতে তোর কোমর সহ হাঁটুতেও মলম লাগিয়ে দেয় বুদ্ধিতো সব হাঁটুর তোলায় এসে পড়েছে । খালি উল্টোপাল্টা কথা গাধা একটা ।
শাম্মী মিথিলার কথার প্রতিউত্তরে রাগ নিয়ে বলে উঠলো ,
শাম্মী : গাঁধী হতে পারি তবে গাধা নই ।
মিথিলা : তোকে নিয়ে পারা যাবে না । ঠিকিই বলেছিস কিন্তু তোর সাথে তুলনা করা মানে গাধার স্ত্রীকে অপমান করা ।
সিমরান : গাঁধী মানে গাধার স্ত্রী বেশ বলেছিস আপু ।
শাম্মী : চুপ থাক সিমরান । ( রাগ দেখিয়ে )
এই সব বলে তারা ক্রিম আনতে রুমে চলে যায় । অন্যদিকে সিয়াম , সৌরভ আর সামির তাদের কাজ সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সবাই তাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসতে থাকে । এতে তাদের বেশ অদ্ভুত লাগে । তারা তাদের পায়ের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে তাদের পায়ে জুতো নেই । তাদের খেয়ালই ছিল না । সবার এমন হাসি মজা দেখে সৌরভ মডেলদের মতো ক্যাট ওয়াক করে হেঁটে সামনে যেতে থাকে । তা দেখে সিয়াম বলে উঠে ,
সিয়াম : তুই আবার নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চাস নাকি ? ( ভ্রু কুচকে )
সৌরভ : নিউ ট্রেন্ড হয়ে যাবে । মানুষ যা দেখে তাকেই ট্রেন্ড মনে করে । সম্মান রাখতে চাইলে অনুসরণ কর ।
তখনি কিছু মেয়ে সামির এর দিকে এগিয়ে আসে আর একটা মেয়ে সামির কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে , ” ভাইয়া ওয়াশরুম যাতে নংরা না হয় তাই জুতো পড়েন নি নাকি ? ( হেসে দিয়ে )
সামির : নাহ বোন । আজ শহিদ দিবস পালন হচ্ছিল টয়লেট এ তাই আর কি সম্মান প্রদর্শন করছিলাম খালি পায়ে ডুকে । তোমরা চাইলে যেতেই পারো আমরা কিছু মনে করব না ।
সামির এর কথায় মেয়েগুলো নিজেদের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে । তারা এই উত্তরের জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলো না । তাদের কে মুরগি বানিয়ে দিলো ।
ততোক্ষনে সামির আর সিয়াম দুজনেই সৌরভ কে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে ।
.
.
মিথিলা , শাম্মী আর সিমরান একজন স্টাফকে দিয়ে কোমড়ের মলম টা পাঠিয়ে দেয় । তা দেখে শাম্মী বলে ওঠে ,
শাম্মী : আপু আমরা দিলে কি হতো ?
সিমরান : কী আর হতো ? ভাইয়া আমাদের বলতো ভাবীকে দিয়ে দিতে ।
শাম্মী : ওহ তাহলে চল গিয়ে বাকি সিন টুকু দেখে আসি ।( মুচকি হেসে )
শাম্মীর কথা শুনে মিথিলা ওদের দুজনকে বলে ওঠে ,
মিথিলা : নো এরকম হবে না । চল নিচে যাই ।
এই বলে শাম্মী আর সিমরানকে টেনে নিচে নিয়ে যায় মিথিলা । এতে অবশ্য তারা রাগ করেছিলো। কিন্তু মেহতাবদের একান্ত টাইম স্পেন্ড করা উচিত এইভেবে তারাও চলে আসে ।
অন্য দিকে মেহতাব ক্রিম টা হাতে নিয়ে মেঘের কোমরে লাগাতেই মেঘের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো মেঘের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে । মেহতাবের প্রতিটি স্পর্শে মেঘ কেঁপে কেঁপে উঠছে । তা দেখে মেঘ কে উদ্দেশ্য করে মেহতাব বলে উঠলো ,
তখনি মেহসান রুমের ভিতর প্রবেশ করলো । মেহসান পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলো সে আবার ভুল টাইমে এন্ট্রি করেছে ।
মেহতাব : ওকে ভালো করে লাগিয়ে দিয়েছি । আর তোমার জন্য এখানে খাবার নিয়ে আসছি ?
মেঘ : না আমি যেতে পারবো আপনি শাওয়ার নিয়ে নিন ।
মেহতাব : Are you sure ?
মেঘ : হুম ।
মেঘের কথা শেষে মেহতাব একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে মেহসান কে বললো ,
মেহতাব : মিথিলাদের বলে দিবি মেঘকে নিয়ে নিচে যেতে । আর সৌরভ দের আমার রুমে পাঠিয়ে দিস ।
মেহসান মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো । মেহতাব আর সময় নষ্ট না করে ওয়াশরুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিলো । তখনি রুমে হুল্লোড় পার্টির সবাই প্রবেশ করে। একসাথে ডুকতে গিয়ে সৌরভ পরে যেতে নিলেই মিথিলা সৌরভের কোমড় ধরে ফেলে । সেখানে মুহূর্তেই রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায় । সৌরভ মিথিলার দিকে তাকিয়ে আছে আর মিথিলা সৌরভের দিকে তা দেখে সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে । তাদের নিরবতা ভেঙে সিয়াম বলে উঠে ,
সিয়াম : এমন ভাবে তাকিয়ে আছে দুজনে যেন এখানে রোমান্টিক শুটিং চলছে । কিন্তু ডিরেক্টর ভুলে নায়ককে নায়কার চরিত্রে দিয়ে দিয়েছে আর নায়কাকে নায়কের চরিত্রে । স্ক্রিপ্ট লেখার সময় বানান বেশ ভুল হয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে । ( মুখ টিপে হেসে )
সিমরান : ডান চোখ টা লাফাচ্ছে আজ কিছু তো হবে । ( মুচকি হেসে )
সবার এমন কথাবার্তায় সৌরভ আর মিথিলা ভরকে যায় । নিজেদের ধাতস্ত করে সৌরভ সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ,
সৌরভ : জনগন পরিবেশকে এভাবে দূষণ কেনো করিতেছো তোমাদের ময়লা কথাবার্তা দ্বারা । এখানে ময়লা কথা বলা নিষিদ্ধ ।
রৌফ : দোস্ত ময়লা আবার কথাবার্তা হয় নাকি ? ( হেসে )
রৌফের কথায় সবাই একটু হাসাহাসি করে । সবার নজর হঠাৎ মেঘের দিকে যায় । মেঘ তাদের কথাবার্তায় হাসছে । তা দেখে সবাই একটু লজ্জা পায় । তখনি শাম্মী বলে উঠে ,
শাম্মী : ভাবী মলম লাগিয়েছো ? এখন কেমন লাগছে ?
মেঘ : হুম ভালো । কোমড়ের ব্যাথা একটুও নেই ।
তা শুনে বাকিরা একসাথে জিজ্ঞেস করে উঠলো , ” কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে মেঘ ভাবী ”
শাম্মী হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালো ।
মেঘ : ঘাবড়ানোর কারণ নেই তেমন কিছু হয়নি । তোমাদের কথাবার্তা সব ব্যাথা ভুলিয়ে দিয়েছে । ( হেসে )
এতে সবাই আরেকদফা লজ্জা পেলো । তারা সবাই কিছুক্ষণ এইসব নিয়ে কথা বলে নিচে চলে গেলো । সৌরভ আর তার বাকি বন্ধুরা মেহতাবের আসার জন্য সোফাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ।
মেহতাব তখনি একটা কালো রঙের শার্ট আর প্যান্ট পরে বের হলো ওয়াশরুম থেকে । সৌরভদের দেখতে পেয়ে বললো , ” কাল ফিরে যাচ্ছি আমরা ”
হঠাৎ ফিরে যাবার কথা শুনে সবাই একসাথে বিষম খেয়ে উঠলো । সৌরভ বলে উঠলো , ” কালকেই যেতে হবে ”
তারা সবাই মেহতাব আর মেঘকে সেটেল করার মিশন সম্পূর্ন করেই যাবে । তাই তারা যাওয়ার জন্য বেশ আগ্রহ দেখায় না । আর মেহতাব চলে গেলে সেটাতো সম্ভবই নয় । তাই রৌফ চোখের ইশারায় সবাইকে তার কথায় হ্যাঁ মিলাতে বলে দেয়। সবার তার ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হয় না । মেহতাব তাদের ফিসফিস করতে দেখে বলে ওঠে ,
রৌফ : কি করি দোস্ত কালকেই যাইতে হইবো তাহলে ভাবীর সারপ্রাইজ ডিনার এর কি হইবো ।
এই বলে রৌফ সিয়ামকে ধরে কান্না করতে থাকে । রৌফের কথা শুনে মেহতাব সহ উপস্থিত সকলে বেশ অবাক হয় । রৌফ সৌরভ আর বাকিদের দিকে চোখ মারে সবাই তার প্লান বুঝতে পারে ।
মেহতাব : কাদের সারপ্রাইজ ডিনার ? ( অবাক ভঙ্গিতে )
সামির : কার আবার তোর আর মেঘের । মেঘ তোকে সারপ্রাইজ দিবে তাই আমাদের বলতে নিষেধ করেছে তাই বলিনি ?
মেহতাব এই কথা শুনে বেশ অবাক হয়। কিন্তু নিজেকে ধাতস্থ করে বলে , ” মেঘ ? কখনই না । It’s impossible . I don’t believe ”
সৌরভ আর সামির তা দেখে নিজেরা মেহতাব আর মেঘ সাজে আর তাদের অভিনয় করতে শুরু করে । সৌরভ সামির কে বলে উঠে ,
সৌরভ : মেঘ তোমার সেই এক চিলতে হাসি আমাকে তোমার দিকে আকৃষ্ট করে । ( চোখের অনেকগুলো পলক ফেলে )
সামির : কিন্তু আমরা তো নিজেদের ফিলিংস বুঝতেই পারি না । আমাদের প্রজন্ম আসবে কি করে ! ( মেয়েদের নেকা কণ্ঠে )
মেহতাব তাদের এইসব কথা শুনে বেশ বিরক্ত হয় । বিরক্ত সহিত সোফা থেকে একটা বালিশ ছুঁড়ে মারে তাদের দিকে ।
সিয়াম বালিশ টাকে আদর করে সামির এর কোলে দিয়ে বলে , ” এই নিন আপনাদের প্রজন্ম যা ২০৮০ সালে জন্মেছে । ফিলিংস বুঝতে দেরি হয়ে গেলো কিনা । ”
সিয়ামের এমন কথা বার্তায় উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে দিলো । মেহতাব রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো ,
মেহতাব : ওভার একটিং বন্ধ কর । আমি গেলাম বাই । ( রাগ দেখিয়ে )
এই বলে মেহতাব রুম থেকে চলে গেলো । আর সিয়াম বালিশটা নিয়ে পিছনে আসতে আসতে বললো ,
সিয়াম : আপনার প্রজন্ম নিয়ে যান ।
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ১৮
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
মেহতাব : ওভার একটিং বন্ধ কর । আমি গেলাম বাই । (রাগ দেখিয়ে)
এই বলে মেহতাব রুম থেকে চলে গেলো । আর সিয়াম বালিশটা নিয়ে পিছনে আসতে আসতে বললো ,
সিয়াম : আপনার প্রজন্ম নিয়ে যান ।
সকলে লাঞ্চ করার জন্য এসে পড়েছে । সবাই মেহতাব আর সৌরভদের আসার জন্য খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে । মেহতাবরা নিচে নামতেই তারা সকলে নিজেদের জায়গায় বসে পড়লেন । মেহতাব সহ সকলে উপস্থিত হওয়ায় অরিন বেগম বলে উঠলেন ,
অরিন বেগম : আমি আর তোমাদের দাদী চলে যাবো আজকে । তোমরা বরং আর দুটো দিন ঘুরে তারপর এসো ।
আহতাব : কিন্তু কেনো ?
অরিন বেগম : তেমন কেনো কারণ নেই । তোমার দাদীর শরীর টা ভালো নেই । তোমাদের চিন্তা করতে হবে না আমরা যেতে পারবো ।
মেহতাব : আমি তোমাদের গিয়ে দিয়ে আসবো ।
মারজা বেগম : তার কোনো প্রয়োজন নেই দাদু ভাই আমরা চলে যাবো আর ড্রাইভার তো আছেই ।
মেহতাব : কিন্তু ?
অরিন বেগম : কোনো কিন্তু নয় । সবাই খাওয়া শুরু করো ।
অরিন বেগমের কথায় কেউ আর দিরুক্তি করে না । সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে অরিন বেগমদের এগিয়ে দিয়ে আসে ।
অরিন বেগমরা গাড়িতে করে সেখান থেকে চলে যান ।
সবাই আবার রিসোর্টে ফিরে আসে । রিসোর্টে ফিরতেই আহতাব আর অহনা সেখান থেকে অন্যদিকে ঘুরতে চলে যায় । বাকিরা সবাই বাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করে । কিছুক্ষণ পর মেহতাব আর মেঘকে রেখে সবাই সেখান থেকে চলে আসে । আর মেহসান বলে ওঠে , ” আমরা পালাচ্ছি কেনো ? ”
সৌমিক : কেনো আবার তাদের প্রাইভেসি দিতে ?
শাম্মী : ঠিকাছে কিন্তু মিথিলা আপু আর সৌরভ ভাইয়া কোথায় ?
শাম্মীর কথায় সবাই চারদিকে তাকায় কিন্তু মিথিলা আর সৌরভকে তারা দেখতে পায় না । এতে সবার বেশ ঘটকা লাগে ।
রৌফ : গেলো কই ওরা ?
সিয়াম : চল সবাই খুঁজে দেখি ?
সামির : খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই আশেপাশেই হবে হয়তো ।
সামির এর কথায় সবাই সামির কে চেপে ধরে । সিমরান বলে উঠে ,
সিমরান : কিছু তো লুকাচ্ছ সত্যি সত্যি বলো সামির ভাইয়া । তুমি জানো আমি জানি ।
সিয়াম : না বললে তোর বিয়া হইবো না ?
তৌফ : এই প্রথম সিয়াম ঠিক কথা কইছে ।
সামির : ওই যে আসতাছে ।
সামির কথায় সবাই সামনে তাকায় সৌরভ আর মিথিলা এসে পড়েছে তা দেখে কেউ আর প্রশ্ন তুলে না ।
সামির : উফ ঠিক টাইম মতো আইছোস নাইলে ওরা বিয়ার আগেই বিধবা বানাইয়া দিতো । ( নেকা কান্না করে )
রৌফ : তোর আর ডং করতে হইবো না ।
সৌরভ : চল সবাই ।
সিমরান : কিন্তু কোথায়?
সিয়াম : ডিনার পার্টির জন্য ।
শাম্মী : তোমরা আবার আমাদের বাদ দিয়ে কিছু করেছো । তাই না ?
সৌরভ : বেশি কিছু না তোগো আমি বুঝাইতাছি ।
.
.
মেহতাব আর মেঘ পিছনে ফিরে দেখে কেউ নেই । তাদের বুঝতে বাকি থাকেনা তারা সবাই কেনো চলে গেছে । মেহতাব মেঘকে নিয়ে সামনের একটা নির্জন স্থানে বসে পড়ে । মেহতাব নিরবতা ভেঙে বলে ওঠে ,
মেহতাব : মেঘ আমি কালকে লন্ডন ব্যাক করছি ।
মেহতাব হঠাৎ এমন কথা বলায় মেঘ বেশ হকচকিয়ে যায় । নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে ,
মেঘ : কালকেই ফিরতে হবে ?
মেহতাব : হুম আর্জেন্ট । অনেকদিন হয়ে গেছে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর দায়িত্বে যাদের নিয়োজিত করেছি । তাদের উপর আর প্রেসার ক্রিয়েট করতে চাই না । সো কি করবো বলো ? প্রবলেম নেই তোমার জন্য একটা গিফট রেখে যাবো । যাতে আমার অনুপস্থিতি তোমায় কিছু টা ভুলিয়ে দেয়। আফটার অল আমি তোমার হাজব্যান্ড আমায় তো মনে পড়বেই । ( মেঘের চোখে চোখ রেখে )
মেঘ মেহতাবের থেকে চোখ সরিয়ে নেয় । তার কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলে না সে । সে যে তাকে মিস করবে সেটা কিছুটা হলেও সে নিজেও অনুভব করতে পারছে । নিজের অধিকার খাটিয়ে বলার মতো অনুভুতি এখনও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি ।
.
.
সৌরভরা মিলে সবাই প্লান এটে ফেলে । প্লান মোতাবেক মেয়েরা একদল আর ছেলেরা অন্য দলে ভাগ হয়ে যায়। সৌরভরা মেহতাবের কাছে আর মেয়েরা মেঘের কাছে এসে হাজির হয় । আর মেহসানকে আহতাব আর অহনার কাছে ডিনার পার্টির জন্য জায়গা বুক করতে পাঠিয়ে দেয় আহতাবদের আগেই বলে রেখেছে সৌরভ।
শাম্মী মেঘকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে ওঠে,
শাম্মী : ভাবী চলো আমরা ওই দিক টা ঘুরে আসি ।
মেঘ : কিন্তু ?
সিমরান : কোনো কিন্তু নয় । আমরা ননদ আর ভাবী একটু আলাদা টাইম স্পেন্ড করবো চলো ।
মেঘ আর আপত্তি জানায় না । মেয়েরা মিলে অন্যদিকে চলে যায় । আর সৌরভরা মেহতাবকে নিয়ে তার বিপরীত দিকে চলে যায় ।
সৌরভ : দোস্ত আজকে রাতে মেঘ আর তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে । আসলে তখন বললাম না মেঘ সারপ্রাইজ দিবো ঐটা আসলে সত্যি ছিলো না । কিন্তু দোস্ত তোদের আমরা ভালো চাই সো প্লিজ আমাদের গিফট টা নাকোজ করিস না ।
সিয়াম : হুম সৌরভের সাথে আমরা সকলে সহমত ।
সিয়ামের কথায় সবাই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয় ।
মেহতাব আন্দাজ তো করেছিলো তাই তাদের একটু শায়েস্তা করার জন্য মেহতাব একটু ভেবে বলে ওঠে ,
মেহতাব : I have one condition . যদি তোরা আমার শর্তে রাজি হতে পারিস এন্ড আমার শর্ত পূরণ করিস তাহলে ভেবে দেখবো যে আমি তোদের গিফট একসেপ্ট করবো কিনা ।
সবাই একটু ভেবে রাজি হয়ে যায় । মেহতাব আবার বলে ওঠে ,
মেহতাব : এখান থেকে তোদের মধ্যে একজন কোনো মেয়েকে ইম্প্রেস করতে পারলেই হবে সিম্পল ।
মেহতাবের কথায় সবাই আর না করতে পারে না তারা জানে মেহতাব তাদের ঘায়েল করার চেষ্টা করছে । সৌরভ বলে ওঠে ,
” মেহতাব বুনো শিয়াল হলে আমরাও বাঘা কুমির ”
মেহতাব : প্লিজ কুমির গুলোকে তোদের সাথে তুলনা করে অপমান করিস না আই রিকুয়েস্ট । ( কিঞ্চিৎ হেসে )
সবাই ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে হাত পা এদিক ওদিক সরিয়ে ব্যায়াম করতে থাকে । একটা দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে সামনে থাকা টপস আর জিন্স পরা অনেকগুলো মেয়ের সামনে দাঁড়ায় । রৌফ চুল স্পাইক করতে করতে কবিতার ছন্দে বলে ওঠে ,
রৌফ : আমার বাবার ছিলো বড় বড় গোফ নাম আমার রৌফ ।
রৌফের কথা শুনে একটা মেয়ে বলে উঠে , ” আপনার গোঁফ কেনো নেই তাহলে ”
সৌরভ রৌফ কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠে ,
সৌরভ : বাবা-মা করত আমায় নিয়ে গৌরব নাম আমার সৌরভ ।
সৌরভের কথা শুনে আরেকটা মেয়ে বলে উঠে , ” কেনো সৌরভ ভাইয়া করত বললেন কেনো এখন কেউ আর গৌরব করে না ” ( হেসে দিয়ে )
রৌফ , সিয়াম , সামির ভাইয়া নাম শুনে হেসে বলে ” ভাইয়া টিকিটের মেয়াদ শেষ সাইট প্লিজ ”
সামির সৌরভ আর রৌফের সামনে এসে বলে ,
সামির : আমি ছিলাম আগের জন্মের আমির নাম আমার সামির ।
সিয়াম , সৌরভ আর রৌফ ঠাট্টার স্বরে হেসে বলে উঠে , ” গরীবের আমির ”
এবার শেষ পালা সিয়ামের সিয়াম বলে ওঠে ,
সিয়াম : ওগোরে এতিমখানায় দিয়াম নাম আমার সিয়াম ।
আরেকটা মেয়ে হেসে বলে ওঠে ” ধন্যবাদ আমাদের তিনজন লোক দরকার ছিলো এতিমখানা পরিষ্কার করার জন্য । আর এখানে তিনজনের সাথে একজনকে ফ্রি দিচ্ছে ”
মেয়েগুলো তাদের ইজ্জতের তান্দুরি বানিয়ে দিয়েছে । তা আর তাদের বুঝতে বাকি নেই । সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে হাসা হাসি করছে । সিয়াম বলে উঠলো , ” আমি বাংলাতে একটু কাঁচা তাই বানানে বেশ ভুল হয় ” ( জোরপূর্বক হাসি দিয়ে )
মেহতাব : তোদের তো কোনো কাজ নেই যে ছুটি নিয়ে প্রবলেম । সো ফিরে গিয়ে কি করবি আর কয়েকদিন থেকে যা আমি আর তোরা একসাথে লন্ডন এ ব্যাক করবো । ( সৌরভ এবং মেহতাব লন্ডনে বিজনেস হোল্ডারস আর তার বাকী সব বন্ধুরা ওই কোম্পানি তে উচ্চ পদে জব করে )
সামির : সৌরভ যাচ্ছে না তার মিঠু পাখির টানে । প্রমান করা লাগবে না নিশ্চই সৌরভ ডার্লিং ।
এই কথা বলে সামির হেসে দেয় । সামিরের হাসি দেখে সবাই না জেনেই মজা করে হেসে দেয় । কিন্তু সৌরভ আর সামির তা দেখে ভড়কে যায় তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে আরো জোরে হেসে উড়িয়ে দেয় ।
অরিন বেগম বলে ওঠে ,
অরিন বেগম : হয়েছে অনেক হাসি ঠাট্টা । সবাই গিয়ে বেগ গুছাও কালকে ভোর ভোর বের হতে হবে ।
অরিন বেগমের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় আর মেহসান বলে উঠে ,
মেহসান : কেনো মা আমরা কি কোথাও যাচ্ছি ? ( কৌতূহলী হয়ে )
ওই সময় তার দাদী সেখানে উপস্থিত হয় আর বলে উঠে ,
মারজা বেগম : আসলে দাদুভাই আমরা সবাই তোমার দাদুবাড়ি যাচ্ছি । মেহতাব দাদুভাই আর তার বন্ধুরা তো চইলাই যাইব আর মিথিলা , শাম্মি , সিমরান আর সৌম ওগো পরিবারও চইলা গেছে ওরাও তো যাইবো গা । আবার কবে আসে না আসে তাই সবাই একলগে তোমার দাদুর পৈতিক ভিটায় যামু ঘুরতে । কি বলো দাদুভাই আর দিদুমনিরা ?
মারজা বেগমের কথা শুনে সবাই খুব খুশি হয় আর সম্মতি জানায় । তারপর সবাই নিজেদের রুমে গুছ- গাছ করতে চলে যায় । শুধু টিনা থেকে যায় সে মারজা বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে ,
টিনা : আমিও কি যাবো নানুমনি ?
টিনার কথায় মারজা বেগম বলে উঠে ,
মারজা বেগম : তোরে কি আলাদা কইরা নিমন্ত্রণ পাঠানো লাগবো ?
টিনা : থ্যাংক ইউ নানুমনি ইউ আর বেস্ট ।
( এই বলে মারজা বেগমকে জড়িয়ে ধরে )
মারজা বেগম : হইছে আর ঢঙ করোন লাগতো না গিয়া বেগ গুছাও আর তোমার ভাবী গো কিছু লাগে নাকি দেহো যাও ।
এই বলে মারজা বেগম চলে যায়। আর টিনা সয়তানি হাসি দিয়ে বলে উঠে ,
টিনা : এখন দেখবো না শুধু দেখাবো যে এই টিনা কি কি করতে পারে । ( এই বলে সে নিজের রুম এ চলে যায় )
সবাই নিজেদের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে প্লান করছে ওখানে গিয়ে কি কি করবে । সবাই গোল বৈঠক করে বসেছে । সবাই উপস্থিত শুধু বড় রা ছাড়া ।
সৌরভ : শোনো ভাইয়েরা আর বোনেরা আমরা যাইতাছি মজা আনন্দ করতে তাই কিছু রুলস ফলো করতে হইবো : যেমন বলা যায় কেউ তার পারসোনাল ইসু সেখানে আনতে পারবা না। বিজনেস বা ফোন নিয়ে পরে থাকা এইসব চলবো না । ওখানে আমরা প্রকৃতি ইনজয় করবো। সো কেউ ফোন নিয়া যাইতে পারবা না। যদি জরুরী কল দেওয়ার থাকে তাইলে অরিন আন্টির কাছ থেকে ফোন নিয়া দিবা । সবাই একমত । ( এই বলে সৌরভ উপরে এক হাত জাগায় )
সবাই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে । তারপর সবাই সৌরভের কথায় সহমত পোষন করে ।
রৌফ বলে উঠে ,
রৌফ : ভাই আবার এইটা কইস না যে হাগতে পারমু না বা বজ্র পদার্থ বাড়িতে রেখে আসুন। ( মজা করে )
রৌফের কথা শুনে সিয়াম হেসে বলে উঠে , “এখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা নিষেধ । তোর মুখ থেইকা যেই কথা বাইরাইতাছে তা বজ্র পদার্থের থেইকা কম না ”
সিয়ামের কথা শুনে সৌমিক সাবধান করে বলে ,
সৌম : মেঘ আর অহনা ভাবী আইতাছে তাদের সামনে অন্তত নিজেদের মান সম্মান রাখো ।
সৌমের কথা শুনে মেহতাব আর আহতাব সামনে তাকায়।
মেঘ আর অহনা সবার জন্য চা আর কফি নিয়ে এসেছে । সবাইকে দেওয়া শেষ করে তারা মিথিলার পাশে বসে পরে । মিথিলা তা দেখে বলে ওঠে ,
মিথিলা : আরে ভাবীরা এতো লজ্জার কি আছে নিজেদের হাসব্যেন্ড দের কাছে বসতে অনুমতি লাগে নাকি ।
মিথিলার কথায় অহনা আর মেঘ কিছুটা ভড়কে যায়। মেঘ মনে মনে বলে ” আমি আবার কখন লজ্জা পেলাম ”
শাম্মি : তাই নাকি ।
এই বলে শাম্মি তাদের দুজন কে নিয়ে মেহতাবের পাশে মেঘকে আর আহতাবের পাশে অহনাকে বসিয়ে দেয় আর মেঘকে পাশে বসাতে গিয়ে মজা করে কোলেই বসিয়ে দেয় । তা দেখে ঠাট্টা করে তৌফ বলে উঠে ,
তৌফের কথায় কেউ হাসি থামাতে না পেরে হেসে দেয় । অহনা , আহতাব আর মেহতাবও হেসে দেয়।এবার মেঘ ভীষণ লজ্জা পায় আর মেহতাবের কোল থেকে নেমে পাশে বসে পরে । মেঘকে লজ্জার হাত থেকে বাচাতে মেহতাব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে ,
মেহতাব : এতে লজ্জার কি আছে আমরা দুজন বিবাহিত ।
মেহতাবের কথা শুনে সবাই মুখ দিয়ে শিস বাজতে শুরু করে আর কেউ তো হাত তালি দেওয়া শুরু করে।
এতে মেঘ আগের থেকে তিনগুন বেশি লজ্জা পেয়ে যায় । মেঘ মেহতাবের দিকে তাকায় তার রিয়েকশন দেখতে মেহতাব কিছু হয় নি এমন ভাব নিয়ে ফোন এ বিজি হয়ে আছে। মেঘ আর কিছু বলে না। সবাই অনেক প্লান করে। তারপর যে যার রুম এ চলে যায়। মেঘ রুমে ঢুকতেই অনেক গুলো পেকেট দেখতে পায়। এগুলো কিসের পেকেট সে বুঝতে পারে না। তাই সে একটি পেকেট হাতে নিয়ে দেখার চেষ্টা করে এগুলো কি। তখনি সে দেখতে পায় এতে স্পষ্ট ভাবে তার নাম লেখা আছে । সে কৌতূহলবশত পেকেট টি খুলে দেখে । সেখানে একটি লাল রঙের শাড়ি। এমন করে মেঘ প্রতিটি পেকেট খুলে দেখে । প্রতিটি পেকেটে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ১০ টি শাড়ি । সে বুঝতে পারে এগুলো মেহতাবের কাজ । সেই হয়ত তার জন্য কিনেছে । তাই সে মেহতাবকে খুজতে যাবার জন্য বেরতে যাবে তখনি কারো বুকের সাথে তার পিঠ ধাক্কা খায় । সে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় মেহতাব দাড়িয়ে আছে । সে মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে ,
মেঘ : এগুলো কি ?
মেহতাব : তোমার চোখে প্রবলেম হলো নাকি দেখতে পারছো না ? ( ভ্রু কুচকে )
মেঘ : আপনি ভনিতা না করে আগে বলুন এগুলো এখানে কি করছে ? ( রাগ দেখিয়ে )
মেহতাব : আমি কি করে জানবো আমিও তো রীতিমতো অবাক। (অবাক হওয়ার ভান করে)
মেঘ : আপনাকে এতোগুলো শাড়ি কে কিনতে বলেছে । আমার এখনো কতোগুলো শাড়ি পরে রয়েছে । ওগুলো পরতে পরতে বছর পেরিয়ে যাবে।
মেহতাব : তো কি হয়েছে তাই বলে আমি নিজের ওয়াইফ কি কিছু দিতে পারব না । এরকম কথা কোন ইতিহাস এ লেখা আছে মাই ডেয়ার ওয়াইফ। ( মুচকি হেসে )
মেঘ : দিয়েছেন ঠিকাছে তাই বলে এতোগুলো শাড়ি ।
মেহতাব : আসলে আমি জানতাম না তোমার কোন রঙ ফেভারিট । সো বুঝতেই পারছো তাই দুই একটা বেশি এনেছি । যদি পছন্দ না হয় বলো তোমায় নিয়ে আবার শপিং মলে গিয়ে নিউ কালেকশন দেখিয়ে আনি । (সুন্দর হাসি দিয়ে)
মেঘ : হয়েছে আর লাগবে না । আপনি বসুন আমি কফি আনছি আর বাবা-মা এর ঘরে চা দিতে হবে ।
মেহতাব : ঠিকাছে । কিন্তু ছাদে এসো আমার কফি নিয়ে আর তোমার জন্যও এক কাপ এনো দুজনে একটু বসে আড্ডা দেওয়া যাবে । কোনো সমস্যা নেই তো ? ( মেঘের দিকে চোখ মেরে )
মেঘ : ঠিকাছে নিয়ে আসবো ।
এই বলে মেঘ নিচে চলে যায় । মেহতাব ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম এ চলে যায় । ফ্রেশ হয়ে এসে সে ছাদে চলে যায় । তাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো বিল্ডিং বা দালান নেই । তাদের বাড়ির আসে পাশে বিভিন্ন ফল, ফুলের গাছ আছে ফাকা মাঠ । আর কিছু দুরে অনেক সুন্দর একটি পার্ক আছে । তাদের বাড়ির ছাদ দেখে দূরদূরান্ত দেখা যায় । মেহতাব ছাদে গিয়ে ছাদের দোলনার উপর বসে পরে । কিছুক্ষণ পর কেউ তার চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে দেয় । সে ভাবে হয়ত মেঘ এসেছে তাই সে হাত টা চোখ থেকে সরিয়ে জড়িয়ে ধরতে যাবে । তখনি খেয়াল করে এটা মেঘ নয় বরং টিনা । টিনাকে দেখে মেহতাব বলে উঠে ,
মেহতাব : What are you doing here ? ( তুমি এখানে কি করছো )
টিনা : চিল এখানে আমি এমনি এসেছি । আসলে আগের দিনের জন্য আমি সরি বলতে এসেছি । প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দেও । আমি ভীষণ অনুতপ্ত ।
মেহতাব : Ok but this is your last chance . এরকম বিহেভ আরেকবার করলে তুমি তোমার লাস্ট চান্সও হারিয়ে ফেলবে। Now go from here .
টিনা : থাঙ্কস আমায় ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য বাই।
এই বলে টিনা সেখান থেকে চলে যায় । যাবার পথে মেঘের সাথে দেখা হয় । টিনা মেঘকে দেখে একটি হাসি দেখিয়ে চলে যায় । মেঘ তার দিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে ছাদে চলে যায় । আজ ছাদ আলোয় পরিপূর্ণ আজ পূর্ণিমা । ছাদে উঠেই মেঘ মেহতাব কে স্পষ্ট দেখতে পায় সে কফির মগ নিয়ে একটা মগ মেহতাব এর দিকে এগিয়ে দিলো ।মেহতাব মগ টা নিয়ে মেঘকে ইশারায় বসতে বললো । তাই মেঘও দাড়িয়ে না থেকে মেহতাবের পাশে বসে পরলো । মেহতাব কফির মগ এ একটা চুমুক দিয়ে বলে উঠলো ,
মেহতাব : মেঘ তোমার তো পড়াশোনা শেষ তো কি হতে চাও বা সপ্ন কি ?
মেহতাবের কথায় মেঘ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠলো ,
মেঘ : এখনো কি আমি আমার সপ্ন পুরণ করতে পারব মানে চান্স আছে । ( এই কথাটা বলার সময় মেঘের চোখ খুশীতে জল জল করে উঠলো )
মেঘের কথায় মেহতাব চাঁদের আলো মিশ্রিত একটি হাসি দিয়ে বললো , “কেনো পারবে না অবশ্যই পারবে”।
মেহতাবের কথায় মেঘ যেনো চাঁদ হাতে পেয়ে গেলো । খুশিতে গদগদ হয়ে মেহতাব কে জড়িয়ে ধরলো আর বলে উঠলো , ” আই লাভ ইউ মেহতাব ”
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ১৪
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
মেঘের কথায় মেহতাব চাঁদের আলো মিশ্রিত একটি হাসি দিয়ে বললো , “কেনো পারবে না অবশ্যই পারবে”।
মেহতাবের কথায় মেঘ যেনো চাঁদ হাতে পেয়ে গেলো । খুশিতে গদগদ হয়ে মেহতাব কে জড়িয়ে ধরলো আর বললো , ” আই লাভ ইউ মেহতাব ”
এই কথা বলার পর মেঘ নিজেই থতমত খেয়ে গেলো । ইতস্ত বোধ করে বললো ,
মেঘ : আসলে মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে । মা আমায় ডেকেছিলেন ডিনার সার্ভ করার জন্য আমি নিচে যাই আপনিও নিচে খেতে আসুন ।
এই বলে মেঘ মেহতাবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে এলো । তারাহুড়া করতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হচোট খেয়ে পরতে পরতে বেচে গেলো । সৌরভ , সিয়াম , রৌফ আর সামির নিজেদের রুমে বসে কথা বলছিলো । মেঘকে এভাবে নামতে দেখে তৌফ বলে উঠলো,
রৌফ : মেঘের আবার কি হইলো?
সিয়াম : দেখার বিষয় নয় কি ?
সৌরভ : দেরি কিসের ?
এই বলে তিনজন ছাদের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলো। তা দেখে সামির উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো ,
সামির : আমার জন্য কেউ দ্বারা বুনো হাতির বংশধোর দেখবি তোগো একটারো বিয়া হইব না হইলেও আমি তোগো ডিভোর্স এর কেস লরমু ।
এই বলে সামিরও ছাদের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলো।
ছাদে বসে মেঘকে এভাবে ঘাবড়াতে দেখে মেহতাব একটা মুচকি হাসি দিয়ে কফিতে একটা চুমুক দিলো । কফিতে চিনি দেওয়া নেই তবুও কফি টা মিষ্টি লাগছে । তা দেখে নিজের অজানতেই হেসে দিলো । সৌরভ মেহতাবের হাসি মুখ দেখে বলে উঠলো ,
সৌরভ : চাঁদও তোকে দেখে হেসে দেবে । তো আমার দোস্তোর হাসির কারন টা কি জানতে পারি?
সৌরভকে দেখে মেহতাব বললো ,
মেহতাব : তোদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি না ।
এই বলে মেহতাব সৌরভের হাতে কফির মগ টা দিয়ে নিচে চলে এলো । তা দেখে সিয়াম মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বললো ” হাসিয়া গেলাম ফাসিয়া যামু এখন পাশ কাটিয়া ” । ( হেসে ) সৌরভ কফির মগে এক চুমু দিয়ে বলে উঠলো ,
সৌরভ : এতো তিতা কফি । মেহতাব এই কফিতে চুমুক দেওয়ার পর হাসির কারন টা কি ছিলো ? ( অবাক হয়ে )
রৌফ : তুই বাম হাত ডুকানো কবে ছাড়বি ?
সৌরভ : যেদিন তুই টয়লেট করার পর সাবান বা হেন্ডওয়াশ দিয়া হাত ধুবি । ( মজা করে )
সিয়াম : ছি রৌফ ওয়াক। তাই তো কই তোর সাথে ঘুমানোর সময় তোর হাতের থেইকা বজ্র পদার্থের গন্ধ আসে কই থেইকা ।
রৌফ : আরো শুকবি নে । ( এই বলে হাত টা সিয়ামের দিকে এগিয়ে দিলো )
সিয়াম তা দেখে দৌড় দিলো আর রৌফ তাকে ধাওয়া করতে শুরু করলো । তা দেখে সামির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোলনায় বসে পরলো সৌরভের হাত থেকে কফি মগ টা নিয়ে বলে উঠলো ,
সামির : যার হাতে গন্ধ তার মুখ বন্ধ ।
এই বলে কফি মগে একটা চুমুক দিলো আর থু ফেলে বলে উঠলো ,
সামির : এই ব্ল্যাক কফির জাতও ব্ল্যাক আমার এতো সুন্দর সাদা মনটা কাদা করে দিলো । এতে তো কোনো মিষ্টাত্তর চিহ্নও নেই । আমায় ছেকা দেওয়া দ্বারা বেডা দেখবি এই কফিরও বিয়া হইব না ।
সামির এর পাগল পাগল কথা শুনে সৌরভ একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললো ,
সৌরভ : দোস্ত তুই ঠিক আছিস ?
সামির : পা থেকে গলা ঠিক আছে মাথাটা গরম ফিল হইতাছে । ( দোলনায় হেলান দিয়ে )
ভোর বেলায় সবাই রেডি হয়ে ড্রইং রুমে উপস্থিত হয়েছে ঘুরতে যাবে বলে । কেউ দুলছে তো কেউ সোফায় ঘুমাচ্ছে । তখনি অরিন বেগম আর মেহতাবের দাদী মারজা বেগম সেখানে উপস্থিত হোন । অরিন বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে ,
অরিন বেগম : তোরা সবাই এখানে বসে দুলছিস কেনো ?
সিমরান : এই ঠান্ডা ওয়েদার ঘুমনোর জন্য বেস্ট । I’m so sleepy .( মুখ দিয়ে হাই টেনে )
শাম্মি : ভাইয়া তোমরা কি এতো কথা বলছো । গাড়িতে উঠো ।
এই বলে শাম্মি গাড়িতে উঠে পরে । আস্তে আস্তে সবাই গাড়িতে উঠে পরে । অরিন বেগম , মারজা বেগম , অহনা আর আহতাব এক গাড়িতে উঠে পরে । আর বাকী ছোটো সদস্যরা এক গাড়িতে এখন শুধু মেঘ , টিনা আর মেহতাব বাকী তাই তারা কি করবে । তখনি সৌরভ বলে উঠে ,
সৌরভ : এখানে কাপল এলাও না । তুই আর মেঘ বরং তোর জিপ এ করে আয় ।
মেহতাব : Ok . আমি আর মেঘ তাহলে জিপ এ করে আসছি ।
এই বলে মেঘ আর মেহতাব জিপে উঠে পরে। তখনি টিনা বলে উঠে ” আমিও বরং মেহতাবদের সাথে যাই “।
এই বলে জিপে উঠতে যাবে। তখনি সিমরান টিনার হাত ধরে বলে উঠে ,
সিমরান : এখানে সিঙ্গেল দের এলাও নেই তুমি বরং আমাদের গাড়িতে ওঠো ওখানে সিঙ্গেল এলাও আছে ।
সিমরানের কাজে মেহতাব সহ সবাই বেশ খুশী হয় । টিনা রাগ করে সৌরভদের গাড়িতে উঠে পরে । মেহতাব সিমরান কে উদ্দেশ্য করে বলে ,
মেহতাব : থ্যাংক ইউ মাই সিস ।
সিমরান : নোট মেনশন । ( ভাব নিয়ে )
তারপর সবাই গাড়িতে উঠে পরে । সবার গাড়ি আগে চলে যায় । মেহতাব জিপ আস্তে করে চালাতে থাকে । তা দেখে মেঘ বলে উঠে ,
মেঘ : গাড়ি এতো আস্তে চালালে আমাদের পৌছাতে দুই দিন লেগে যাবে ।
মেঘের কথার কোনো জবাব না দিয়ে মেঘ নিজের ব্লাক জ্যাকেট টা খুলে মেঘের হাতে দিয়ে বললো ,
মেহতাব : এটা পরে নেও গাড়ি জোরে চালালে ঠান্ডা লাগবে ।
মেঘ মেহতাবকে জ্যাকেট টা ফেরত দিয়ে বললো ,
মেঘ : আমার ঠান্ডা লাগবে না আপনি পরে নিন । আমার ঠান্ডা সয্য করার ক্ষমতা আছে ।
মেহতাব : As you wish .
এই বলে মেহতাব গাড়ি স্টার্ট দিলো আর স্পিড বাড়িয়ে দিলো । এর কারনে মেঘ এর খুব ঠান্ডা লাগা শুরু করলো । মেঘ মেহতাবের থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে নিজে পরে নিলো আর বললো ,
মেঘ : আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম।
মেঘের কান্ড দেখে মেহতাব মুচকি একটি হাসি দিলো ।
চলবে……..
#তুমি_এসেছিলে_বলে
পর্ব : ১৫
#নাদিয়া_আক্তার_সিয়া
মেহতাব : As you wish .
এই বলে মেহতাব গাড়ি স্টার্ট দিলো আর স্পিড বাড়িয়ে দিলো । এর কারনে মেঘ এর খুব ঠান্ডা লাগা শুরু করলো । মেঘ মেহতাবের থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে নিজে পরে নিলো আর বললো ,
মেঘ : আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম।
মেঘের কান্ড দেখে মেহতাব মুচকি একটি হাসি দিলো আর জিপ চালানো তে মনোযোগ দিলো। বেশ অনেকটা পথ চলার পর মেহতাব লুকিং মিরোরে মেঘের দিকে তাকালো । সে জিপের জানলার পাশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । মেহতাব গাড়িটা ব্রেক করে এক সাইডে পার্ক করলো । আর মেঘের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো । সে ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে । একজোড়া চোখ যে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই । মেহতাব মেঘের মুখে পরে থাকা চুল গুলো পরম যত্নে সরিয়ে দিলো । তারপর মেঘের মাথা তার ঘাড়ে রেখে তার বাম হাত মেঘের কোমরে রেখে গাড়ি চালানো শুরু করলো ।
.
.
সৌরভদের গাড়িতে সবাই বেশ মজা করছিলো শুধু টিনা বাদে । তা গাড়ির সবাই লক্ষ্য করছিলো । তারা টিনাকে সয্য করতে না পারলেও তাদের মেহতাব আর মেঘের ভালোর জন্য টিনাকে বোঝানো উচিত । সবাই তাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে এই নিয়ে আলোচনা করছিলো । সব শেষে মিথিলা কোনো কিছু না ভেবে টিনার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো ,
মিথিলা : টিনা আমি জানি তুমি মেহতাব ভাইয়াকে ভীষণ ভালোবাসো । এটা ঠিক তোমার সাথে আমাদের অতো মেলা-মেশা নেই । কিন্তু তার মানে এই নয় তোমাকে আমরা অপছন্দ করি । দেখো মেহতাব ভাইয়া আর মেঘ ভাবী নতুন বিয়ে করেছে। তাদের মধ্যে অশান্তি হোক তা কেউ আমরা চাই না । তুমি মেহতাব ভাইয়া কে সত্বি ভালোবাসো সেটা আমরা কেউ অবিশ্বাস করি না ।তুমি যদি মেহতাব ভাইয়াকে সত্তিকারের এক বিন্দু ভালোবেসে থাকো তাহলে তুমি তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা ক্রিয়েট করবে না । আমি তোমাকে হুমকি দিচ্ছি না এটা আমার অনুরোধ । প্রকৃত ভালোবাসা এটাই যেই ভালবাসায় তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে না পেলেও তার খুশিতে খুশী থাকবে । তার দুঃখে কষ্ট পাবে । তুমি হয়তো আরো ভালো কিছু ডিসার্ব করো । তুমিও একদিন তোমার মনের মতো মানুষ পাবে যে সবসময় তোমাকে ভালোবাসবে , তোমার পাশে থাকবে , তোমার অনুভুতি বোঝার চেষ্টা করবে , তোমার সুখ-দুঃখের সাথি হবে , নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাকে আগলে রাখবে । আমি চাই তুমি তাঁকে খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাও। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি ।
মিথিলার এতোগুলো কথা শোনার পর সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । সৌরভ সামির কে একটা চিমটি কেটে বলে উঠলো ,
সৌরভ : আমি সপ্ন দেখছি না তো ।
সামির : আউউউউ। ভাই তুই আমারে মারবি নাকি । আমি এহনও কারো হাসির কারন হইতে পারি নাই । অন্তত কারো দুঃখের কারন হতে চাই। ( আফসোসের সুরে )
সিয়াম : ভাই আমি এইডা বুঝতাছি না । মিথিলারে কোনো রোম্যান্টিক শাকচুন্নি ধরলো নাকি ।
সৌরভ : মুখ শামলা সিয়াম নাইলে এতিমখানায় দিয়াম ।
সিয়াম : দোস্ত তোর বাজে কবিতার থেকে ঐ জায়গা হাজার গুন ভালো ।
মেহসান : ভাইয়েরা বোনেরা মিথু আপু কোনো রোমান্টিক রোগে আক্রান্ত হইছে ।
সিমরান : হুম তাই হবে হয়ত ।
শাম্মি : যাই হোক মিথিলা আপু আর রোম্যান্টিক অসম্ভব ।
সৌম : দেখ ওরে আমরা ছোটোবেলা থেকে দেখতাছি এই প্রথম ও কোনো ভাষণ দিলো তাও আবার ভালোবাসা নিয়া । সবাই হাত তালি দেও ।
এই বলে সবাই মিথিলার উদ্দেশ্যে হাত তালি দিলো টিনাও মিথিলা কে জড়িয়ে ধরলো । টিনা যেমনি হোক সে মেহতাবকে মন থেকে ভালোবেসেছে । সে এটা মানতে পারে নি মেহতাবকে সে নিজের করে পাবে না । সে কিছুক্ষণ আগেও মেঘ এর ক্ষতি চাইতো । কিন্তু মেঘ যদি মেহতাবের জীবনে নাও থাকতো তবুও মেহতাব তাঁকে ভালোবাসতো না । ভালোবাসা জোর করে আদায় করা যায় না ভালোবাসা অর্জন করতে হয় এটা টিনা বুঝে গেছে । সে আর মেহতাব আর মেঘের মাঝে কাটা হয়ে থাকবে না বরং তাদের এক করতে হেল্প করবে । এই ভেবে সে একটা প্রশান্তির হাসি দিলো আর বললো ” থ্যাংক ইউ মিথিলা আমি আমার বেস্ট দিবো মেহতাব আর মেঘকে এক করতে । আই প্রমিস ” । এই কথা শুনে সবাই টিনার উদ্দেশ্যে হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো , ” তো হুল্লোড় গ্যাং এর নিউ মেম্বার টিনা খান ”
এই বলে সবাই হইচই আনন্দ ফুর্তি করতে করতে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ।
.
.
মারজা বেগমরা গন্তব্যস্থলে পৌছে সবার জন্য অপেক্ষা করছিলো । আস্তে আস্তে সৌরভ আর মেহতাবদের গাড়ি এসে উপস্থিত হলো । তখনি মেঘ এর ঘুম ভেঙে গেলো । সে নিজের মাথা কারো ঘাড়ে আর কোমরে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই একঝোটকায় উঠে পরলো । সে কিছু না বলেই গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করতেই মেহতাবের হাত ঘড়ির সাথে তার শাড়ির আচল আটকে গেলো । সেটা দেখে মেঘ পিছনে মেহতাবের দিকে না তাকিয়েই ছারানোর চেষ্টা করতে লাগলো । তা দেখে মেহতাব মেঘকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
মেহতাব : এতো লজ্জার কি আছে ? আমিতো শুধু তোমার কোমর টাচ করেছি তাও আবার শাড়ির উপর দিয়ে ।
এই কথা পিছন থেকে সৌরভদের গ্যাং রা শুনতে পেলো । তারা তড়িঘড়ি করে গাড়ির পিছন থেকে কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো । মেহতাব তাদের দেখতে পেয়ে বললো ,
মেহতাব : এখানে কোনো রোম্যান্টিক সিনের সুটিং হচ্ছে না । তোরা সামনে আয় ।
এই কথা শুনে সবাই না শোনার ভান করে মারজা বেগমের কাছে চলে গেলো । সৌরভ বলে উঠলো ,
সৌরভ : কি চোখ রে বাবা!
সিয়াম : ঠিক পুরো এনাকোন্ডার চোখ ।
শাম্মি : আমি শুনেছি সাপের নাকি চোখ থাকে না।
সিয়াম : আরে গাধা আমরা এনাকোন্ডার কথা বলছি সাপের না । ( ভাব নিয়ে )
শাম্মি : এনাকোন্ডাও সাপ । আর হ্যাঁ আমি গাধী হতে পারি কিন্তু গাধা না ।
এই কথা শুনে সৌরভ ঠাট্টা করে বলে উঠলো ,
সৌরভ : চলুন গাধীরানি কৃপা হবে আমার ।
শাম্মি : ঠিকাছে ভাইয়া আপনাকে ধন্য করে দিই ।
এই বলে সবাই একজোট হয়ে এক স্থানে জোড়ো হলো । মেহতাব আর মেঘ ও উপস্থিত হলো । মারজা বেগম সকল কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
মারজা বেগম : এই হইলো তোমাগো দাদুর পৈতিক ভিটা ।
রৌফ : কি কোন দাদীজান এইডা দেখতাছি রিসর্ট ।
মারজা বেগম : হো । এই জায়গায় এহন রিসর্ট বানাইছে । তোমার দাদু এই জায়গা মেহতাব এর বাবা মানে আমার পোলার নামে কইরা দিছিলো ওয় এইডা আহতাব , মেহতাব আর মেহসানের নামে কইরা দিছে । আমার দাদু ভাইরা এইডা এতিম,অনাথ পোলাপান গো দিয়া দিছে । এই রিসর্ট থেইকা যেই টাকা আয় হয় । সব ওই বাচ্চাগুলারে দেওয়া হয় যাতে ওগো ভবিষ্যত সুন্দর হয় । আরেকটা কথা এই রিসর্টের ডিজাইন মেহতাব দাদুভাই করছে ।
সবাই এই কথা শুনে ভীষণ অবাক হয় তবে খুব খুশীও হয় । সিমরান বলে উঠে ,
সবাই সিমরানের কথা শুনে মেহতাবের উদ্দেশ্যে হাত তালি দেয় । তা দেখে মেহতাব বলে উঠে ,
মেহতাব : ওকে হয়েছে অনেক কমপ্লিমেন্ট । Now let’s go .
মেহতাবের কথায় সবাই সম্মতি জানায় । আর ভিতরে ডুকে পড়ে । বিশাল বড় মেনশন এর মতো ডিজাইন । সবাই হা হয়ে দেখতে থাকে । টিনা সৌরভদের বলে উঠে ,
টিনা : So Wonderful . আমি তো আবার মেহতাবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি ।
টিনার কথা শুনে সবাই রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টিনার দিকে । তা দেখে টিনা মুচকি হেসে বলে উঠে ,
টিনা : আমি তো সাতার কাটতেই পারি না । হাবুডুবু খাবার প্রশ্নই ওঠে না ?
টিনার কথায় সবাই হেসে দেয় । অন্যদিকে মেঘ তো পুরো মুগ্ধ হয়ে গেছে । মেঘ মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে ,
মেঘ : আপনি তো খুব গুনী মানুষ। আমি তো আমার চোখ সরাতেই পারছিনা এই অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্য থেকে ।
মেহতাব : থাঙ্কস ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট । বাট আরো খুশী হতাম যদি তুমি এই ডিজাইন কে না বলে আমাকে বলতে । ( মেঘের দিকে চোখ মেরে )