Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 279



বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০৫

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৫.
আরিন্তা শরবত নিয়ে মিশকাতের রুমে এসে দেখল মিশকাত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ফোনে ভিডিয়ো দেখছে। পরনের জামা-কাপড়ও এখনো পালটায়নি। আরিন্তা দরজার সামনে থেকে ডাকল,
“মিশু ভাই, তোমার শরবত এনেছি।”
মিশকাত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ফোন বন্ধ করে হাতের তালুতে মাথা ভর দিয়ে বলল,
“ভেতরে আসতে জানিস না? না কি কোলে তুলে ভেতরে আনতে হবে?”

আরিন্তা ভেতরে গিয়ে মিশকাতকে শরবতের গ্লাস দিলো। মিশকাত শোয়া থেকে উঠে আরাম করে বসে গ্লাসে চুমুক দিয়ে গভীর আফসোসের সুরে বলল,
“আহ্! রোজ বাইরে থেকে ফিরে যদি এমন সুন্দরী বউয়ের হাতের ভালোবাসায় টলমলে শরবত পেতাম!”
আরিন্তা বলল,
“ঢং বন্ধ করো। তখন ওভাবে ইশারা করেছিলে কেন?”
“কেন আবার? আমার চাওয়া পূরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলাম না? ভুলে গেলি?”
“ভুলিনি। কী চাও তুমি?”
মিশকাত ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ঝুলিয়ে বলল,
“উলটা-পালটা কিছু চাইব?”
আরিন্তা চোখ পাকিয়ে বলল,
“ভালোয়-ভালোয় বলবে, না চলে যাব?”
“বলছি, এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন?”
“আমি তোমার বিয়ে করা বউ না যে, তোমার ঘরে এসে লাগাতার বসে থাকলেও কারো চোখে লাগবে না।”
“একদিন তো হবি।”
“তখন আর এখন আলাদা সময়। তুমি দ্রুত বলো কী চাও।”
মিশকাত বলে উঠল,
“বউ সাজে দেখতে চাই।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করে শুধাল,
“মানে? কে বউ সাজবে?”
“আমার ভবিষ্যত বউ।”
আরিন্তা চোখ বড়ো করে বলল,
“ফাজলামি করো? আমি কীভাবে বউ সাজব?”
“কেন? এমনিতে তো সুবর্ণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কম অকাজ করিস না। একটু বুদ্ধি খাটালে কাজের কাজও করতে পারবি।”
“বউ সাজতে শাড়ি, গয়না কোথায় পাব?”
“মায়ের বিয়ের শাড়ি, গয়না আছে তো। আপাতত না হয় শাশুড়িরটা দিয়েই টেম্পোরারি বউ সাজ। পরে বরের দেওয়া শাড়ি, গয়নায় পার্মানেন্ট বউ সাজবি।”
আরিন্তা চিন্তিত মুখে বলল,
“এমন ঝামেলায় না ফেললেও পারো। হুট করে আমি গিয়ে খালার বিয়ের শাড়ি, গয়না কীভাবে চাইব? আমি বউ সাজব শুনলে খালা না জানি মনে-মনে কী ভাববে!”
“কিছুই ভাববে না। সুবর্ণার হেল্প নে। এমনিতে তো ছবি-টবি তোলার জন্য-ও কত সময় সাজগোজ করিস।”
আরিন্তা ঠোঁট উলটে নাকি সুরে বলল,
“এটা পালটে দাও না প্লিজ। আমার ওসব চাইতে লজ্জা লাগে।”
“তার মানে তুই আমাকে কথা দিয়ে কথা রাখবি না?”
“তা নয়। আমি তো চাওয়া পালটে দিতে বলেছি।”
“চাওয়া কীভাবে পালটাব পোনি? এটা তো আমার বহুদিনের ইচ্ছা, তোকে বউ সাজে দেখব। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি, তখন তুই আমাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছিস?”

আরিন্তা গাল ফুলিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মিশকাত তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে বহুদিনের চাওয়া পূরণের কোমল আবেদন। আরিন্তা মিনমিনে গলায় বলল,
“সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভালোই জানো। খালা আর সুবর্ণা যদি আমাকে লজ্জা দেয়, তাহলে তোমার খবর আছে।”

মিশকাত শুধু হাসিমুখে ঘাড় কাত করল। যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে সে প্রস্তুত। আরিন্তা গাল ফুলিয়ে মিশকাতের রুম থেকে বেরিয়ে এল।

আরিন্তা যখন সুবর্ণাকে বলল, ‘চল, আমরা সাজি।’ সুবর্ণার মুখে গাঢ় অনীহা ফুটে উঠল। আজ তার সাজগোজ করতে একদমই ইচ্ছা করছে না। সে বলল,
“এখন সাজতে ইচ্ছা করছে না আপু। চলো আমরা অন্যকিছু করি।”
“কেন ইচ্ছা করছে না? এমনিতে তো নিজের যখন ইচ্ছা করে, তখন আমাকে চেপে ধরে সাজিয়ে ছাড়িস। এখন আমার ইচ্ছা করছে, সেই বেলায় তোর ইচ্ছা চলে গেছে?”
সুবর্ণা ঘ্যানঘ্যান করে বলল,
“আমার একদম ভালো লাগছে না আপু।”
“আমার ভালো লাগছে। আয়, তুই না সাজলে আমাকে সাজিয়ে দে।”
“তুমি একা সেজে কী করবে?”
“ছবি তুলব।”
“আচ্ছা চলো তোমাকে সাজাই।”

সুবর্ণা তার সাজগোজের সমস্ত সরঞ্জাম বের করল। আরিন্তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“শাড়ি পরব।”
সুবর্ণা শুধাল,
“আমার তো মাত্র দুইটা শাড়ি। কোনটা পরবে?”
“তোরটা পরব না। খালার শাড়ি পরব।”
“তাহলে তুমি গিয়ে মায়ের থেকে চেয়ে নিয়ে এসো।”

আরিন্তা ড্রয়িংরুমের কাছে গিয়ে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। আয়েশা খাতুন এখনো সিরিয়াল দেখছেন। একটু আগে ভালোভাবেই বসে ছিলেন, এখন টান হয়ে সোফায় শুয়ে পড়েছেন। আরিন্তা শাড়ি চাইলে তিনি ‘না’ করবেন না। কিন্তু বিয়ের শাড়ি চাইবে কীভাবে? আরিন্তার ইচ্ছা করল গিয়ে মিশকাতকে বলতে, ‘এত যখন শখ তখন যাও, তোমার মায়ের কাছ থেকে শাড়ি, গয়না চেয়ে এনে দাও।’

কিছুক্ষণ ঠোঁট উলটে মনে-মনে এটা-সেটা ভেবে আরিন্তা ধীর পায়ে আয়েশা খাতুনের কাছে এগিয়ে গেল। তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“খালা?”
আয়েশা টিভির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আরিন্তার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবি?”
“তোমার একটা শাড়ি বের করে দিবে? আমি সাজব।”
“এখন?”
“হ্যাঁ, আমি আর সুবর্ণা ছবি তুলব।”
“এই রাতে পরবি শাড়ি?”
“হুম।”
“তোদের যে কখন কী শখ জাগে! আচ্ছা চল, দিচ্ছি।”

আয়েশা খাতুন সোফা ছেড়ে উঠলেন। আরিন্তা তার পেছন-পেছন রুমে চলল। আলমারি খুলে আয়েশা খাতুন প্রশ্ন করলেন,
“কোনটা পরবি?”

অনেকগুলো ভাঁজ করা শাড়ির মাঝে আরিন্তা চোখ বুলিয়ে চলল। হ্যাঁ, একটা লাল বেনারসি দেখা যাচ্ছে। এটাই বোধ হয় খালার বিয়ের শাড়ি। আয়েশা একটা নীল রংয়ের শাড়ি বের করলেন। বললেন,
“এটায় তোকে মানাবে।”
আরিন্তা শাড়িটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর লাল শাড়িটা দেখিয়ে শুধাল,
“এটা কি তোমার বিয়ের শাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“দেখাও না একটু।”
আয়েশা তার বিয়ের শাড়িটা বের করলেন। লাল টুকটুকে জামদানির ওপর সোনালি সুতার কাজ। শাড়িটা আরিন্তা হাতে নিয়ে বলল,
“সুন্দর তো! এটা কার পছন্দ ছিল?”
“তোর খালুর‌।”
“তোমার বিয়ের ছবি দেখেছিলাম, তোমাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছিল বউয়ের সাজে।”
আয়েশা হেসে বললেন,
“তোর মা সাজিয়েছিল।”
আরিন্তা লজ্জা ভেঙে বলে ফেলল,
“খালা, এটা আমি পরি?”
আয়েশা খাতুন অবাক হলেন। হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করলেন,
“বিয়ের শাড়ি পরবি?”
“হ্যাঁ, দেখব আমাকে কেমন লাগে। পরি?”
“আচ্ছা, তোর ভালো লাগলে পর। ওড়না নিবি?”
“দাও।”
আয়েশা শাড়ির সাথে ওড়না-ও বের করে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন,
“আর কিছু লাগবে, না আটকে দিবো?”
আরিন্তা একটু মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“তোমার গয়নাগুলো দিবে?”

আয়েশা খাতুন সূক্ষ্ম চোখে আরিন্তার দিকে তাকালেন। মুচকি হেসে বললেন,
“তোর হঠাৎ বউ সাজার শখ জাগল কেন রে? বর খুঁজব?”
“ধুর! না। এমনি তোমার বিয়ের সাজ সুন্দর হয়েছিল দেখে আমারো সাজতে ইচ্ছা করছে।”
“তোরা পারিসও!”

আয়েশা তার বিয়ের গয়নাগুলো-ও বের করে দিলেন। শমসের খাঁন যখন জুয়াড়ির তালিকায় নাম লেখিয়েছিলেন, তখন আয়েশা বুদ্ধি করে তার সমস্ত গয়না মেরিনার কাছে আমানত রেখে এসেছিলেন। শমসের খাঁন অনেকদিন সেই গয়না চেয়েছিলেন, আলমারিতে খোঁজ-ও করেছিলেন। না পেয়ে শুধু নিজের দেওয়া গয়নাটুকু চেয়েছিলেন। আয়েশা খাতুনের গয়নাগুলো কিছু তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া আর কিছু শমসের খাঁনের থেকে। শমসের খাঁন যখন নিজের দেওয়া গয়না চেয়ে বসেছিলেন, আয়েশা খাতুন তখন বলেছিলেন তার বড়ো বোনের কাছ থেকে চেয়ে আনতে। শমসের খাঁনের সেই সাহস ছিল না যে, নিজে গিয়ে বড়ো শ্যালিকার কাছ থেকে গয়না চেয়ে আনবে। তিনি আয়েশা খাতুনের কাছেই বারবার চেয়েছিলেন। মাঝে-মাঝে ধমকাধমকি-ও করেছিলেন। কিন্তু আয়েশা কিছুতেই তার হাতে গয়না তুলে দিতে রাজি হননি। নিজের বিয়ের স্মৃতি কোন মেয়ে হারাতে দিতে চায়? আয়েশা খাতুন-ও চাননি। ভাগ্যিস তখন বুদ্ধি করে বড়ো বোনের কাছে রেখে এসেছিলেন। নইলে তার কোনো গয়নাই এত বছর অবধি টিকে থাকত না।

শাড়ি, গয়না নিয়ে আরিন্তা নাচতে-নাচতে রুমে আসার সময় মিশকাত ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছিল। আরিন্তার হাতে শাড়ি, গয়না দেখে সে হাসিমুখে কনিষ্ঠাঙ্গুলি দেখিয়ে শব্দহীন মুখ নাড়িয়ে বলল,
“ওয়েল ডান।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে, মুখ বাঁকিয়ে সুবর্ণার রুমে ফিরে এল। তার হাতে নিজের মায়ের বিয়ের শাড়ি, গয়না দেখে সুবর্ণা চোখ দুটো ছানাবড়া করে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“একি! তুমি মায়ের বিয়ের শাড়ি, গয়না এনেছ কী করতে?”
আরিন্তা প্রশস্ত হেসে দুলতে-দুলতে বলল,
“তোর মায়ের মতো বউ সাজব।”
“মা দিয়ে দিলো?”
“দিবে না কেন? খালা কি আবার বউ সাজবে?”
“তুমি হঠাৎ বউ সাজবে কেন?”
“খালার শাড়িটা দেখে পরতে ইচ্ছা করল। খালার বিয়ের ছবিতে তাকে কী সুন্দর লাগে না?”
সুবর্ণা ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল। আরিন্তা হেসে বলল,
“আমি-ও দেখব আমাকে কেমন লাগে?”
সুবর্ণা মুচকি হেসে বলল,
“তোমার নিশ্চয়ই বিয়ের সাধ জেগেছে। এবার যে বিয়ের প্রস্তাব এল, তাতে না করলে কেন? রাজি হলেই তো সত্যিকারের বউ সাজতে পারতে।”
আরিন্তা বিরক্ত মুখে বলল,
“তোর এত শখ থাকলে তুই বল, আমি তোর সত্যিকারের বউ সাজার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
“আমি তো আর বউ সাজতে চাইছি না। তুমি চাইছ, শখ তো তোমারই আছে।”
“আমার শখ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। নে, আমাকে হেল্প কর।”

আরিন্তা সুবর্ণার সাহায্যে আস্তে-ধীরে শাড়ি পরতে লাগল। আয়েশা খাতুনের ব্লাউজ আরিন্তার গায়ে অনেকটা ঢোলা। সুবর্ণা সেফটিপিন দিয়ে ব্লাউজটা যতটুকু পেরেছে চাপিয়ে দিয়েছে। সুবর্ণা খুব যত্ন করে গুছিয়ে শাড়ির কুঁচি-ও দিয়ে দিয়েছে। আরিন্তার পরনে শাড়িটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে নতুন বউকেই সাজানো হচ্ছে। শাড়িটা তার জন্যই আনা। সুবর্ণা প্রশ্ন করল,
“তুমি নিজে সাজবে, না আমি সাজিয়ে দিবো?”
“তুই চুল বেঁধে দে, আমি সাজছি।”
“আচ্ছা।”

তারা দুজন সাজগোজের সরঞ্জাম নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসেছে। আরিন্তা ছোটো আয়নাটা বিছানায় ফেলে একটু উপুড় হয়ে বসে নিজে-নিজে মেকআপ শুরু করেছে। সুবর্ণা তার পেছনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। দক্ষ হাতে চুল বাঁধতে তার বেশি সময় লাগেনি। চুল বাঁধা শেষ করে সে আরিন্তার সামনে গিয়ে বসল। আরিন্তা তখন মুখে ফাউন্ডেশন মাখছে। সুবর্ণা বলল,
“আপু, হালকা মেকআপ করো। ভারী মেকআপের চেয়ে হালকা মেকআপে তোমায় বেশি সুন্দর লাগে।”
“হালকা মেকআপ-ই করব। তোর তো চুল বাঁধা শেষ, এই নে, তুই-ই চোখ সাজিয়ে দে। আমার করতে দেরী হবে।”
সুবর্ণা এগিয়ে বসল। মেকআপ বক্স টেনে নিয়ে আরিন্তার চোখ সাজাতে লাগল।

এসব সাজ-গোজের ব্যাপারে সুবর্ণা অল্প বয়স থেকেই বেশ দক্ষ। ছোটো থেকেই সে খুব সাজতে পছন্দ করত। সেই থেকেই নিজে-নিজে সাজার চেষ্টা করত। মন খারাপেও সে সাজতে বসে। তার ধারণা সাজতে বসলে সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তখন তার সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকে সাজটা সুন্দর করে তোলার দিকে। গ্রামের মেয়েদের বিয়েতে মানুষজন তাকেই ডেকে নেয় বউ সাজানোর জন্য। আশেপাশের বাচ্চাদের-ও সে যখন ইচ্ছা ডেকে এনে সাজাতে বসে। বাচ্চারাও তার কাছে সাজতে পছন্দ করে। কখনো কারো সাজার দরকার পড়লে বা ইচ্ছা জাগলেই ছুটে আসে সুবর্ণার কাছে। সুবর্ণা এই কাজটা মন থেকেই খুব উপভোগ করে। এভাবেই সাজগোজে তার দক্ষতা অর্জন। সুবর্ণার মনের গোপন ইচ্ছা ছোটোখাটো একটা পার্লার দিবে। যদিও এই ইচ্ছার কথা সে ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি জানে না। তার চিন্তা হয় বাবাকে নিয়ে। শমসের খাঁন নিশ্চয়ই এই কাজটা পছন্দ করবেন না। শুনলেই রেগে যাবেন। সুবর্ণা সবে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। পার্লার দেওয়ার মতো পুঁজি তার নেই। এই ইচ্ছা পূরণ করতে হলে কারোর আর্থিক সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। এসব কথা চিন্তা করেই তার গোপন ইচ্ছাটা অপ্রকাশিতই রয়ে গেছে। সে নিজেও জানে না কোনোদিন তার এই ইচ্ছাটা পূরণ হবে কি না। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়েদের কাছে নিজেদের ছোটোখাটো ইচ্ছা পূরণ-ও এলাহি ব্যাপার।

আরিন্তাকে বউ সাজে দারুণ লাগছে। মনেই হচ্ছে না সে এমনি-এমনি বউ সেজেছে। যেন বধূবেশে নতুন বউ বরের আগমনের অপেক্ষায় আছে। সুবর্ণা হাসিমুখে বলল,
“আপু, তোমাকে যে কী দারুণ লাগছে! একদম সত্যিকারের নতুন বউ।”
আরিন্তা ঘুরেঘুরে নিজেকে আয়নায় দেখছিল। সুবর্ণার কথায় সে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
“খালার মতো সুন্দর লাগছে?”
‌‌ “অবশ্যই। আজ যদি সত্যি-সত্যি তোমার বিয়ে হত, তাহলে তোমার বর বিয়ের চিন্তা ভুলে তোমার দিকেই হা করে তাকিয়ে থাকত।”
”বেশি-বেশি বলছিস।”
“বেশি-বেশি না, সত্যি বলছি। বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস করবে, চলো। দেখি মা তোমাকে দেখে কী মন্তব্য করে।”

সুবর্ণা টেনেহিঁচড়ে আরিন্তাকে নিয়ে চলল মায়ের সামনে। আরিন্তা বলল,
“আরে, টানিস না, পড়ে যাব। যাচ্ছি তো আমি।”

আয়েশা খাতুন আরিন্তাকে দেখেই খুশি হয়ে গেলেন। আরিন্তার মাঝে যেন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন। সেই দিনটিকে স্মরণ করলেন, বহুবছর আগে যেদিন তিনি বউ সেজে শমসের খাঁনের জীবনে এসেছিলেন। সুবর্ণা বলল,
“মা, তুমিই বলো, আপুকে তোমার মতো সুন্দর লাগছে না?”
আয়েশা খাতুন হেসে বললেন,
“আমার চেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর লাগছে। একদম সুন্দরী নতুন বউ। ছবি তুলে রাখ, আপাকে দেখাবি পরে। আপা দেখবে না তার মেয়েকে বউ সাজে কেমন পরীর মতো লাগে?”
আরিন্তা খুব খুশি হলো। মায়ের পছন্দ হয়েছে মানে ছেলেরও পছন্দ হতে বাধ্য। সুবর্ণার হাতে আয়েশা খাতুনের ফোন ছিল। সে ক্যামেরা অন করে ঠোঁট উলটে বলল,
“মায়ের ফোনের তো ক্যামেরা কোয়ালিটি ভালো না আপু। এত কষ্ট করে সেজে পচা ছবি তুলে লাভ কী?”
আরিন্তা বলল,
“মিশু ভাইয়ের ফোনটা চেয়ে আন, যা।”
“ভাইয়া ওর ফোন দিবে আমাকে? তাহলেই হয়েছে! চলো, তুমি নিজেই চাও।”

সুবর্ণা আরিন্তাকে নিয়ে গেল মিশকাতের ঘরে। মিশকাতকে ঘরে না দেখে দুজনে ভেতরে ঢুকে বুঝল মিশকাত ওয়াশরুমে আছে। তার ফোনটা বিছানায় পড়ে ছিল। সুবর্ণা গিয়ে ফোন হাতে তুলে বলল,
“এই তো ফোন। পাসওয়ার্ড জানলে ভালো হত। না বলেই নিয়ে পালাতাম।”
এই ফোনের পাসওয়ার্ড আরিন্তার অজানা নয়। প্রেমের সূচনা থেকেই এই ফোন জুড়ে রয়েছে সে নিজেই। তবু আরিন্তা বলল,
“দাঁড়া, মিশু ভাই আসুক।”
“আমি চেষ্টা করে দেখি খুলতে পারি কি না। পাসওয়ার্ড কী হতে পারে?”

সুবর্ণা আন্দাজে একটার পর একটা ভুল পাসওয়ার্ড প্রয়োগ করে চলল। কিন্তু কিছুতেই লক খুলতে পারল না। তবু সে হাল ছাড়ল না। একবার ব্যর্থ হয়ে নতুন উদ্যমে আবার চেষ্টা করেই চলল। আরিন্তা চুপচাপ দাঁড়িয়ে সুবর্ণার আপ্রাণ চেষ্টা দেখছে। বেচারির চেষ্টা যে কোনোভাবেই সফল হবে না তা সে ভালোভাবেই জানে। এরমধ্যে মিশকাত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। সুবর্ণা নিজের প্রচেষ্টায় এতটাই মগ্ন ছিল যে, ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ-ও তার কানে পৌঁছায়নি। আরিন্তা-ও প্রথমে ঠিক খেয়াল করেনি। মিশকাত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সুবর্ণার হাতে তার ফোন দেখে তেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ করছিল। পরক্ষণেই লাল টুকটুকে বউটার ওপর দৃষ্টি পড়তেই সে থমকে দাঁড়াল। এক চুল-ও নড়ল না, না টু শব্দটি করল। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল বধূরূপী আরিন্তার দিকে। এ যেন তার মায়েরই প্রতিচ্ছবি। ঊনত্রিশ বছর আগে তার মা এভাবেই বউ সেজে এসেছিল এ বাড়িতে। আজ ঊনত্রিশ বছর পর মনে হচ্ছে মায়েরই আরেক প্রতিচ্ছবি এ বাড়িতে বউ সেজে এসেছে। আরিন্তার দৃষ্টি মিশকাতের দৃষ্টিতে আটকাল দুই মিনিটের মাথায়। মিশকাতের অমন মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টি আরিন্তার অনেক বেশি প্রিয়। কিন্তু আজ যেন অনুভূতিটা অন্যসব দিনের চেয়ে একদম আলাদা। মিশকাতের চাহনিতে এত বেশি লজ্জা তো আরিন্তা এর আগে কখনো পায়নি। আজ মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ মিশকাতের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেই তার হাত-পা অবশ হয়ে যাবে। তার সামনে দীর্ঘ সময় থাকলে জ্ঞান-ও হারিয়ে ফেলতে হারাবে। আরিন্তা নিজেকে এই কঠিন লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতেই মৃদু কন্ঠে ডেকে উঠল,
“মিশু ভাই।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০৪

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৪.
মিশকাত বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ইদের ছুটি উপলক্ষে বন্ধুরা যারা দূরে থাকে, তারাও গ্রামে এসেছে। মিশকাতকে ফোন করে ডেকেছে ক্যারম খেলার জন্য। সুবর্ণা আরিন্তাকে খোঁচাচ্ছে,
“আপু, ভাইয়াকে বলো আসার সময় চটপটি নিয়ে আসতে।”
আরিন্তা দুপাশে মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি পারব না, তুই বল।”
“আমি বললে জীবনেও কানে নিবে না, জানোই তো কেমন শয়তান।”
“তোর শ’য়তান ভাই যেন আমার কথা শুনতে বসে আছে?”
“শুনবে, শুনবে। তুমি তো আর প্রতিদিন এটা-ওটা আনতে বলো না। আমি বলি বলেই পাত্তা দেয় না। তুমি আজ আমাদের মেহমান। মেহমানের কথা ফেলবে না।”
“হু, তোর ভাই মেহমানের চুল ছিঁড়তে পারে, আর কথা ফেলতে পারবে না। এত ভালো মানুষি জানে কবে থেকে?”
সুবর্ণা ঠোঁট উলটে নাকি সুরে বলল,
“যাও না আপু, প্লিজ।”
“তারপর আমাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিলে?”
“তোমাকে তাড়িয়ে দিলে মা আছে না? যাও।”
“তাহলে তুইও আয় আমার সাথে।”
“আমি গেলে বুঝে যাবে আমিই তোমাকে পাঠিয়েছি। জানো না, ওর পেটে-পেটে শ’য়তানি?”
“হুঁ, শ’য়তানের কাছে আমার মতো ভালো মানুষই পাঠাবি,” বিড়বিড় করে কথাটা বলে মিশকাতের ঘরে চলল আরিন্তা।

ঘরের দরজা হা করে খোলা-ই ছিল। আরিন্তা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল মিশকাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে পারফিউম মাখছে। তাকে ডাকতে গিয়েও আরিন্তা চুপ মে’রে গেল। মিশকাতের পারফিউম মাখার দৃশ্যটা দেখতে তার ভালো লাগছে। মিশকাতের সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের ওপর। এই সুযোগটা আরিন্তা ছাড়ল না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। মিশকাত আজ কালচে সবুজ শার্ট পরেছে। পরনে দারুণ মানিয়েছে। ফরসা হওয়ার সুবাদে ছেলেটাকে যেকোনো রংয়ের শার্টেই মানায়। শার্ট, প্যান্ট, কেডস পরে লম্বা, চওড়া একটা সুদর্শন পুরুষ আয়নায় দাঁড়িয়েছে নিজেকে আরও গুছিয়ে নিতে। অথচ আরিন্তার চোখে এটুকুতেই তাকে রাজপুত্র লাগছে। যদিও রাজপুত্রদের পোশাক আলাদা থাকে। তবু মিশকাতের সৌন্দর্যের উপমায় আরিন্তা রাজপুত্র-ই মানানসই মনে করে। আধুনিক রাজপুত্র। মিশকাত যখন এমনভাবে নিজেকে খুব গুছিয়ে আরিন্তার সামনে পড়ে, আরিন্তা তখন বিভোর হয়ে মিশকাতকে দেখে। মিশকাত তার এহেন কাণ্ডে হাসলেও, সে দৃষ্টি ফেরায় না। দেখতে-দেখতে ভাবে,
“এই অতীব সুন্দর পুরুষটা তার ব্যক্তিগত মানুষ। এই সুদর্শনকে এমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখার অধিকার সে ব্যতীত পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো রমণীর নেই।”

মিশকাত আয়নার মাঝেই আরিন্তাকে খেয়াল করেছে। কিন্তু আরিন্তার মনোযোগ না ভেঙে সে নিজের মতো চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। অনেকটা সময় কে’টে গেলেও যখন আরিন্তা কোনোরকম রা না করে চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল, তখন মিশকাত আয়নার দিকে ঘুরেই বলে উঠল,
“কাকে চাই?”

আরিন্তা বুঝল মিশকাত তাকে দেখে ফেলেছে। সে স্বাভাবিকভাবেই কয়েক পা এগিয়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
“এ ঘরের অস্থায়ী মালিককে।”
মিশকাত ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে শুধাল,
“কে বলল আমি অস্থায়ী মালিক?”
“স্থায়ী মালকিন।”
“আমি তো এ ঘরে নিজেকে ছাড়া আর কোনো মালকিন দেখি না।”
“সে আসার আগ পর্যন্তই তোমার মালিকানা থাকবে জনাব অস্থায়ী মালিক। সে আসার পর থেকে শেষ পর্যন্ত সে-ই স্থায়ী মালকিন।”
“তা স্থায়ী মালকিন নিজের মালিকানা কবে ফলাতে আসবে?”
“আমি কী জানি!”

হাতের ঘড়িটা ঠিক করে মিশকাত চট করে ঘুরে দাঁড়াল। এগিয়ে এসে আরিন্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল,
“জানতে হবে না। চল বিয়ে করে নিই।”
আরিন্তা চোখ পাকিয়ে বলল,
“সাহস কত!”
“এ ঘরের মালিকানা হস্তান্তর করতে এটুকু সাহসের দরকার আছে।”
“আমার মালিকানা আমি সময়মতো বুঝে নেব। তোমাকে দিতে হবে না। আগে বলো, এমন সেজেগুজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
মিশকাত শার্টের হাতা ভালোভাবে ফোল্ড করতে-করতে বলল,
“বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। বললামই তো।”
“ক্যারম খেলার জন্য যাচ্ছ না?”
“হ্যাঁ।”
আরিন্তা হুট করে মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরল। বলল,
“এমন সাহেব সেজে তুমি যাচ্ছ ক্যারম খেলতে? আমাকে বোকা বানানো অত সোজা না মিস্টার পোল্ট্রি। তাড়াতাড়ি সত্যি কথা বলো।”
মিশকাত কপাল কুঁচকে তাকাল। কথায়-কথায় আরিন্তার এই আস্তিন চেপে ধরার স্বভাবটা মিশকাতের ভালো লাগে। রাগ বা বিরক্ত হলেই সে এভাবে আস্তিন চেপে ধরে। মিশকাতের কাছে এটা আরিন্তার ব্যক্তিগত অধিকার।

আরিন্তা আস্তিন চেপে ধরে জেরা করলে মিশকাত মুচকি হেসে বলল,
“রিমা সুন্দরীর সাথে আজ ফার্স্ট ডেট। আমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে না?”
আরিন্তার মুখোভাব নিমেষেই পালটে গেল। আস্তিন ছেড়ে দুহাত তুলে মিশকাতের সদ্য আঁচড়ানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“সুন্দরী? হ্যান্ডসাম? ও বাঁদর আর তুমি ভোঁদড়।”
“হিংসুটে মেয়ে, কী করলি এটা? আমি কষ্ট করে কত সুন্দর করে চুল আঁচড়েছিলাম।”
আরিন্তা আবারো শুধাল,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
“শুনে কী করবি?”
আরিন্তা বিরক্তির সুরে বলল,
“তুমি সোজাসাপ্টা উত্তর দিতে পারো না?”
“না।”
“মিশু ভাই-”
“ভয় লাগছে, রিমার সাথে সত্যি-সত্যি ডেটে যাচ্ছি কি না ভেবে?”
আরিন্তা মুখ ফুলিয়ে শক্ত মুখোভাব করে বলল,
“না।”
“না কেন?”
“আমি কি জানি না তুমি মিথ্যা কথা বলছো?”
“জানলে আবার গাল দুটো এমন ফোলে কেন?”
“তুমি বারবার ওর নাম নাও কেন?”
“নাম নেওয়া-ও বারণ?”
“অবশ্যই বারণ। তোমার মুখে থাকবে শুধু আমার নাম, আরিন্তা। বুঝেছ?”
মিশকাত এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে-করতে বলল,
“না বুঝে উপায় আছে?”

আরিন্তা আবারো হাত তুলে মিশকাতের হাতের ফাঁক দিয়ে চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিলো। কড়া গলায় বলল,
“খবরদার, যদি এমন সেজেগুজে কোনো মেয়ের সামনে গিয়েছ-”
আরিন্তার কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে মিশকাত তার হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের দুই কানে চেপে ধরে বলল,
“আমার ঘাড়ে একটার বেশি মাথা নেই মহারানি, তা-ও আপনার দখলে। গর্দান নিলে আপনার ভাগেরটাই আপনি নেবেন। এবার ভালোয়-ভালোয় আমার চুল ঠিক করে দিন। দুইবার এলোমেলো করেছেন। এবার নিজ দায়িত্বে গুছিয়ে দিন।”
কথাটা বলতে-বলতেই মিশকাত কান থেকে আরিন্তার হাত দুটো নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে। সেই সুযোগে আরিন্তা খপ করে মিশকাতের চুলগুলো মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
“আগে বলো ফেরার সময় যা আনতে বলব, আনবে।”
“কী চাই?”
আরিন্তা চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“চটপটি নিয়ে আসবে।”
মিশকাত সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল,
“সুবর্ণা পাঠিয়েছে?”
“না, আমার খেতে ইচ্ছা করছে।”
“আমার জানা আছে তোদের কু’টনামি।”
“বলছি তো আমার জন্য আনবে।”
“ঠিক আছে, তাহলে আমি এক প্লেট নিয়ে আসব তোর জন্য।”
আরিন্তা বলে উঠল,
“এই না, এক প্লেট আনবে কেন? খালা আর সুবর্ণাকে রেখে আমি একা খেতে পারি?”
“মা এসব খায় না।”
“সুবর্ণা তো খায়।”
“খেলে নিজের টাকায় এনে খাক।”
“এমন করো কেন? ও তোমার ছোটো বোন না?”‌
“তোকে ওর হয়ে কথা বলতে কে ডেকেছে? সর সামনে থেকে।”

আরিন্তা মিশকাতের কপালে পড়া চুলগুলো ডান হাতে ঠেলে পেছনের দিকে সরিয়ে দিতে-দিতে নরম গলায় বলল,
“শোনো না, ফেরার সময় আমার আর সুবর্ণার জন্য চটপটি নিয়ে এসো প্লিজ।”
মিশকাত বলল,
“ঢং কমিয়ে কর। আগে বল বিনিময়ে আমি কী পাব।”
“আমার সাধ্যের মধ্যে তুমি যা চাইবে।”‌
মিশকাত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“সত্যি তো? যা চাইব দিবি?”
আরিন্তা আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“এই, তুমি মনে-মনে কী মতলব আঁটছো? আমি কিন্তু আগেই বলে দিয়েছি, যা চাইবে তা আমার সাধ্যের মধ্যে থাকতে হবে। উলটা-পালটা কিছু চাওয়া নিষেধ।”
মিশকাত কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
“উলটা-পালটা চাওয়া কী পোনি?”
আরিন্তা চোখ পাকিয়ে তাকালে মিশকাত হেসে ফেলল। এগিয়ে গিয়ে চিরুনিটা নিয়ে আসতে-আসতে বলল,
“ওকে, ডান। আমি ফেরার সময় তোদের দুজনের জন্যই চটপটি নিয়ে আসব। আমার চাওয়া পূরণের জন্য প্রস্তুত থাকিস।”

কথাটা বলেই মিশকাত চিরুনিটা আরিন্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। আরিন্তা মুচকি হেসে মিশকাতের চুলে চিরুনি চালাতে-চালাতে বলল,
“খালা দেখলে একদম চুল কামিয়ে ন্যাড়া করে দিবে মিস্টার পোল্ট্রি।”
“উঁহু, বিয়ে করিয়ে বউ এনে দিবে।”
আরিন্তা হাত থামিয়ে বলল,
“কী এনে দিবে?”
মিশকাত হেসে বলল,
“পোনি বউ।”
“শয়তান কোথাকার।”

ঠোঁট টিপে হেসে আরিন্তা মিশকাতের চুলগুলো যত্ন সহকারে গুছিয়ে দিলো। ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে মিশকাত দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
“আসছি।”
আরিন্তা ঠোঁট উলটে বলল,
“বললে না কোথায় যাচ্ছ?”
মিশকাত থেমে গেল। পুনরায় পিছিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছি। মা এখন শুনলে চেঁচামেচি করবে, তাই বলিনি। কাউকে বোলো না, ঠিক আছে?”
আরিন্তা মাথা হেলিয়ে বলল,
“আচ্ছা। তাড়াতাড়ি ফিরবে।”
মিশকাত হাসিমুখে আরিন্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার লক্ষ্মী পোনি। চিন্তা কোরো না, জীবনে কোনো মেয়ের সাথে ডেটে গেলে সে তুমিই হবে। আমার ঘাড়ে তো মাথা একটাই।”


মিশকাত চটপটি নিয়ে এসেছে। চটপটি পেয়ে সুবর্ণা সঙ্গে-সঙ্গে চেয়ারে পা তুলে খেতে বসে পড়েছে। মিশকাত সুবর্ণার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
“রাক্ষসী, এসব গেলার জন্যই আরিকে ঠেলে পাঠিয়েছিলি, তাই না?”
সুবর্ণা বলল,
“আমি বললে আনতে?”
“আনলে তোর শুকরিয়া আছে? ফাজিল।”
“সরো, এখন শান্তিতে খেতে দাও।”
“সরবো কোথায়? আমি কষ্ট করে চটপটি এনে ঘেমে গেছি, এখন কৃতজ্ঞ মানুষের মতো আমাকে ঠান্ডা শরবত বানিয়ে খাওয়া।”
সুবর্ণা বলল,
“তুমি চটপটি এনেছ, না পাথরের বস্তা বয়ে এনেছ যে ঘেমে গেছ? আর অজুহাত খুঁজে পাও না?”
মিশকাত শ্লেষের সুরে বলল,
“এজন্যই তোর মতো অকৃতজ্ঞকে কিছু এনে দিতে হয় না। এই আরি, চটপটি আনার জন্য তুই তখন হাতে-পায়ে ধরেছিলি না? এখন যা, আমাকে শরবত বানিয়ে খাওয়া।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে তাকাল। হাতে-পায়ে কবে ধরল সে? সুবর্ণা বলেও ফেলল,
“হাতে-পায়ে ধরেছে মানে?”
মিশকাত ধমকের সুরে বলল,
“তোর দরকার। তোর গেলার কাজ গিল, রা’ক্ষসী। এই আরি, তুই উঠছিস না কেন?”
আরিন্তা বলল,
“আমার চটপটি ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
“ঠান্ডা হলে গরম করে খাবি। এই সুবর্ণা রা’ক্ষসীর সাথে তুইও অকৃতজ্ঞ হয়েছিস? তখন তো খুব অনুরোধ করেছিলি। এখন যখন এনে দিয়েছি, হাতে পেতেই চেহারা পালটে ফেলেছিস?”
আরিন্তা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু মিশকাত চোখের ইশারায় তাকে দ্রুত উঠতে বলল। আরিন্তা ভ্রুকুটি করল। মিশকাত পুনরায় ইশারা করলে আরিন্তা উঠতে-উঠতে বলল,
“দিচ্ছি।”

আরিন্তা রান্নাঘরে গেল শরবত বানাতে। মিশকাত হাত বাড়িয়ে সুবর্ণাকে বলল,
“আমি একটু খেয়ে দেখি, দে।”
সুবর্ণা চটজলদি হাত দিয়ে বাটি ঢাকা দিয়ে বলল,
“দেখে এনেছ না? আর কী দেখবে?”
“আমি আনলাম আর আমাকেই দিবি না?”
“আমাদের জন্য এনেছ, আমরা খেয়ে অবশিষ্ট থাকলে তুমি খাবে।”
“শয়তানের হাড্ডি, তোর চটপটি গেলানো বের করছি। দে আমার টাকা ফেরত দে তাড়াতাড়ি।”
“কিসের টাকা?”
“আমার টাকায় চটপটি এনেছি সেই টাকা।”
“আমি তোমাকে আনতে বলেছি? আরি আপু বলেছে, তার কাছে চাও।”
“বেয়াদব, গিলছিস তো তুই। হাত সরা।”

মিশকাত সুবর্ণার হাত টেনে সরিয়ে চটপটি খেতে গেলেই সুবর্ণা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“মা…ভাইয়াকে কিছু বলো। দেখো, আমার সাথে কেমন শ’য়তানি করছে।”

আয়েশা সোফায় হেলান দিয়ে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন। মেয়ের চিৎকারে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। চোখ গরম করে রাগত স্বরে বললেন,
“মিশকাত, ওর কাছ থেকে সর তুই। আমাকে যেন উঠতে না হয়। কানের কাছে আর চিৎকার, চেঁচামেচি করলে খবর আছে।”

মিশকাত সুবর্ণার হাত ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর আরিন্তার বাটি থেকে এক চামচ চটপটি তুলে মুখে দিতেই সুবর্ণা আবার চেঁচিয়ে উঠল,
“আপু, তোমার চটপটি খেয়ে ফেলল।”
আরিন্তা রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলো,
“আমারটা যে খাবে তার আজ রাতেই পেটব্যথা হবে।”
ততক্ষণে মিশকাত তিন-চার চামচ খেয়ে ফেলেছে। আরিন্তার কথা শুনে সে বলল,
“যার অভিশাপ তার ওপর-ই ফলবে।”

মিশকাত নিজের রুমে চলে যাওয়া ধরতেই সুবর্ণা বলল,
“শরবত খেয়ে যাও না কেন এখন?”
মিশকাত যেতে-যেতে বলল,
“এক গ্লাস শরবতের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে আমার সমস্ত চুলে পাক ধরে যাবে। বানানো হলে দিয়ে যেতে বলিস।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০৩

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
আরিন্তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। প্রস্তাব এসেছে সেদিন অটোতে সাক্ষাত হওয়া সেই বৃদ্ধ দম্পতির মাধ্যমে। পাত্র তাদেরই আত্মীয়। নতুন শিক্ষকতা করছে, তা-ও সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। আরিন্তা তখন বাড়িতে ছিল। তাদের দেখে সে সালাম জানালেও, মনে-মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। মেরিনাকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে দেখে আরিন্তা কটমট করে বলল,
“মা, এত খাবার বুড়া-বুড়িকে না খাইয়ে আমাকে খাওয়াও, কাজে আসবে।”
মেরিনা বললেন,
“তোকে খেতে না বলে কে? ঘরে কি খাবারের অভাব?”
“অভাব নেই বলেই তো ট্রে ভর্তি খাবার অচেনা মানুষকে খাওয়াতে নিচ্ছ।”
মেরিনা রাগত স্বরে বললেন,
“এসব কোন ধরনের কথা? ঘরে মেহমান এলে আপ্যায়ন করব না? মেহমান কি সবসময় চেনা মানুষ-ই হয়? তুই তোর আব্বাকে একটা ফোন কর তো।”
“মা, তুমি কি আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাও? আব্বার কানে এসব কথা তুললেই সে বিয়ের পেছনে লাগবে।”
“বিয়ে দেওয়া, না দেওয়া পরের ব্যাপার। ঘরে মেয়ে থাকলে বিয়ের সম্বন্ধ আসবেই। কথাবার্তা না বলে কি মানুষজনকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়? এতে মানুষ খারাপ ভাবে। ওনারা তোর আব্বার সাথে কথা বলতে চাইছেন, বলুক। তারপর দেখা যাবে।”

আরিন্তা বিরক্ত মুখে বলল,
“তারপর আর কী দেখা যাবে? আমার আব্বা ছুটবে পাত্রের খোঁজ-খবর নিতে। ওসব আমার জানা আছে। তুমিই আব্বাকে ফোন করো। আমি ভাইয়াকে ফোন করছি।”
“আচ্ছা যা, আমিই করছি। তুই এই ট্রেটা দিয়ে আয়।”
আরিন্তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবারের ট্রে নিয়ে গেল বৃদ্ধ দম্পতির কাছে। টেবিলে ট্রে রেখে সৌজন্যতা দেখিয়ে বলল,
“খান আপনারা। মা আসছে।”
আরিন্তা চলে আসার উদ্যোগ করতেই বৃদ্ধ বলে উঠল,
“বহো বইন, তোমার লগে কতা কই কয়ডা।”
আরিন্তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। তবু সে বসল না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
“জি বলুন।”
“তোমার নামডা কী জানি?”
“আরিন্তা।”
“আরিতা?”
“না, আরিন্তা।”
“কঠিন নাম-”
আরিন্তা বলে উঠল,
“কঠিন না। আপনার উচ্চারণ করতে সমস্যা হচ্ছে।”
“হ, হ। বুড়া মানুষ তো। তা তোমার বয়স কত হইল?”
“মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই দাদু।”
“ক্যান?”
“এটা নিয়ম।”
“এইডা আবার ক্যামন নিয়ম? বিয়ার সময় তো বয়স জানার দরকার আছে।”

আরিন্তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। আশেপাশে আর কেউ নেই। সে কন্ঠস্বর নিচু করে বলল,
“এবার ছাব্বিশে পা দিয়েছি দাদু। কাউকে বলবেন না যেন।”
বৃদ্ধ দম্পতির চোখ বড়ো হয়ে গেল। বৃদ্ধা অবাক হয়ে বললেন,
“তোমারে দেইখা তো বুঝা যায় না তোমার এত বয়স। মাইয়ারা আবার হাতে-পায়ে তাড়াতাড়ি বড়ো হইয়া যায়। ঘরের কাজকাম জানো কেমন গো?”
আরিন্তা বলল,
“কাজ? আমি তো কোনো কাজকর্ম জানি না দাদি। কখনো করিও না। আমার কাজ শুধু সারাদিন খাওয়া আর ঘুম।”
বৃদ্ধা অসন্তুষ্টির সাথে বললেন,
“মাইয়া মাইনষের ঘরের কাজকাম জানার দরকার আছে। বিয়ার পর নিজের সংসার সামাল দিতে হইব না? এহন থিকা তোমার মার কাছে কাজকাম শিখো।”
“কেন গো দাদি? আমার শ্বশুরবাড়িতে কাজ করার জন্য আর কোনো মানুষ থাকবে না? না কি কাজ করার মানুষ নেই বলে আমাকে নিবে?”
“এমন কইরা কতা কও ক্যা গো বইন? মাইয়া মানুষ বিয়ার পর নিজের সংসার নিজে সামলাইব, এইডাই তো নিয়ম।”
“এই নিয়মটা কে বানাল দাদি?”
“কে জানে? এইয়াই দেইখা আইছি ছোডোকাল থিকা।”
“দাদি, আমরা বর্তমান যুগের মেয়ে। আগেকার উদ্ভট নিয়ম-কানুন আঁকড়ে ধরে রাখার সময় এখন নেই আমাদের।”
বৃদ্ধা পান খাওয়া লাল দাঁতে জিব কে’টে বললেন,
“এইসব কতা আর মাইনষের সামনে কইয়ো না। মাইনষে খারাপ ভাবব।”
আরিন্তা হেসে বলল,
“সত্য কথা মানুষ খারাপ-ই ভাবে দাদি। এটাই নিয়ম। আপনারা খান, আমি আসছি।”

আরিন্তা উঠে ওপরে চলে গেল। রুমে গিয়ে পেলবকে ফোন করে এদিকের কাণ্ডের কথা বলল। পেলব শুনে রেগেমেগে একাকার। সে জানাল দশ মিনিটের মধ্যে সে বাড়ি আসছে।

বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে কথা বলার পর পুলক তালুকদার পাত্র দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন সময় করে তিনি পেলবকে নিয়ে যাবেন পাত্র দেখতে আর খোঁজ-খবর নিতে। কিন্তু পেলব নারাজ। সে এত তাড়াতাড়ি ছোটো বোনকে বিয়ে দিবে না। বড়ো বোন আশাকেও তার বাবা এমন হুট করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। ফলস্বরূপ তার বোনটার বর পছন্দ হয়নি। জীবনের কথা ভেবে সংসারজীবনে নিজেকে মানিয়ে নিলেও, এখনো পর্যন্ত সে তার বরকে মন থেকে পছন্দ করতে পারেনি। পেলব চায় না আরিন্তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটুক। তাছাড়া আরিন্তা এ বাড়ির ছোটো মেয়ে। তার পরে বাড়িতে আর কোনো মেয়ে নেই। সে চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। পেলবের ইচ্ছা আরিন্তা অনার্স শেষ করার পর তার বিয়ে নিয়ে ভাববে। এই নিয়ে বাবা-ছেলের মাঝে বেঁধে গেল তর্ক। পুলক তালুকদার কিছুতেই ছেলেকে রাজি করাতে পারেননি। আরিন্তা মনে-মনে ভাইকে হাজারটা ধন্যবাদ জানিয়ে বসে আছে।‌ কারণ বিয়ের কথা শোনার পর থেকে তার বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা চলেছে।

ওদিকে গত চারদিন ধরে মিশকাতের দেখা নেই। না ফোন ধরছে, না এ বাড়িতে আসছে, না কলেজের রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে। বিয়ের কথা উঠেছে হতে আরিন্তা শ’খানেক ফোন করেছে মিশকাতকে। প্রতিবার রিং হয়ে কেটে গেছে। অথচ তার কোনো পাত্তা-ই নেই। ভাইয়ের অসম্মতিতে বাবা বিয়ের কথা ভোলার পর সে নিশ্চিন্ত হলেও, মিশকাতের প্রতি জমা হয়েছে অভিমান। সেই অভিমান কিছুটা রাগেও পরিণত হয়েছে।

আজ কলেজ ফেরার পথে হঠাৎ করেই আরিন্তার কী হলো কে জানে? ফিরছিল বাড়িতে, কিন্তু পথে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল খালার বাড়িতে। হঠাৎ ভাগনির আগমনে আয়েশা খাতুন খুশি হলেন। ছোটো মেয়ে সুবর্ণাকে ডেকে বললেন আরিন্তাকে তার একটা নতুন জামা বের করে দিতে। আরিন্তা বলল,
“খালা, আমি থাকব না। বাড়ি চলে যাব।”
আয়েশা খাতুন বললেন,
“যাবি কেন? এবার কতদিন পর এসেছিস! আজকে রাতটা থাকবি।”
“না, আমি এমনিতেই এসেছি তোমাদের দেখতে। বাড়িতে বলিওনি এখানে আসব।”
“তাতে কী হয়েছে? আমি ফোন করে বলছি তোর মায়ের কাছে। তুই যা, জামা পালটে, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। আমি ভাত বাড়ছি।”

আরিন্তা আর জোর দিয়ে ‘না’ বলেনি। খালাকে সে যে অজুহাতই দেখাক না কেন, তার মন জানে সে এ বাড়িতে কেন এসেছে। বাড়িতে ঢুকে মিশকাতের কোনো সাড়াশব্দ পায়নি। বাড়ি আছে কি না তা-ও জানে না। এখনই চলে গেলে দেখা হবে কী করে? সুবর্ণার থেকে জামাকাপড় নিয়ে আরিন্তা কলেজ ড্রেস বদলে নতুন জামা পরল। সুবর্ণা তার তিন বছরের ছোটো হলেও, স্বাস্থ্যের দিকে দুজন একই রকম। তাই আরিন্তা মাঝে-মাঝে এ বাড়িতে এলে সুবর্ণার জামাকাপড়-ই পরে থাকে। খেতে বসেও আরিন্তার খাওয়ার রুচি চলে গেল। ঠিকমতো খেতে পারল না। কথায়-কথায় সুবর্ণাকে জিজ্ঞেস করল,
“মিশু ভাই কোথায় রে? কয়েকদিন ধরে আমাদের বাড়িও যাচ্ছে না।”
সুবর্ণা বলল,
“বাড়িতেই তো আছে, ঘুমাচ্ছে মনে হয়। কদিন ধরে তোমার আব্বার সাথে গোরুর হাটে দৌড়াদৌড়ি করছে কুরবানির গোরু কেনার জন্য। পছন্দমতো গোরু না কি পাচ্ছেই না। সেজন্যই মনে হয় তোমাদের বাড়ি যায়নি।”
আরিন্তা জানে এ কথা সত্য হলেও, পুরোপুরি সত্য নয়। মনের জেদ-ই আসল কারণ। আরিন্তা মুখে কেবল উচ্চারণ করল,
“ওহ্!”

আরিন্তার খালার বাড়িটা একতলা। তিনটা শোবার ঘর আর ডাইনিং, ড্রয়িংরুম। ছোটোখাটো একটা কিচেনও আছে। তবে দিনবেলায় তাদের রান্নাবান্না হয় বাইরের আলাদা রান্নাঘরে, জ্বালানি পু’ড়িয়ে। মিশকাতের বাবা শমসের খাঁন এককালে এই গ্রামের পয়সাওয়ালা ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। তখন মিশকাত ছিল খুব ছোটো। আয়েশা খাতুনের সঙ্গে তার বিয়েটা হয়েছিল পুলক তালুকদারের সাহায্যে। পুলক তালুকদার নিজের একমাত্র শ্যালিকাকে দেখেশুনে ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পার্শবর্তী গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে শমসের খাঁনের সাথে তার একটু-আধটু পরিচিতি ছিল। আয়েশা খাতুন যখন বোনের শ্বশুরবাড়ি আসা-যাওয়া করতেন, তখনই তিনি শমসের খাঁনের ফুপুর চোখে পড়েন। তারপর শমসের খাঁনের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে পুলক তালুকদারের কাছেই। পুলক তালুকদার দেখেশুনে নিজ দায়িত্বে শমসের খাঁনের হাতে আয়েশা খাতুনকে তুলে দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে তাদের সংসারটা যথেষ্ট বিলাসবহুল ছিল। বলা চলে শমসের খাঁন তখন দুহাতে টাকা রোজগার করতেন। কথায় আছে যার টাকা বেশি, তার বন্ধুর অভাব হয় না। শমসের খাঁনের বেলায়ও কথাটা শতভাগ সত্যি ছিল। তার বন্ধু নামক কাল সাপের অভাব ছিল না।‌ সেসব বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই কবে, কখন তিনি জুয়ার আসরের মধ্যমনি হয়ে ওঠেন, কেউ টেরও পায়নি। সেখান থেকেই শুরু হয় তার অধঃপতন। দুহাতে টাকা রোজগার করে দিনের পর দিন তা ঢালতে থাকেন জুয়ার আসরে। ফলস্বরূপ সংসারে শুরু হতে থাকে টানাপোড়েন। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপই থাকে না। আয়েশা খাতুন জানতে পেরে নিজের সংসারের চিন্তায় ছুটে গিয়েছিলেন পুলক তালুকদারের কাছে। পুলক তালুকদার অনেকদিন, অনেকভাবে শমসের খাঁনকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বরং শমসের খাঁন জুয়ার আসরে টাকা ঢেলে-ঢেলে নিজের সমস্তটা হারিয়ে পথের ফকির বনে যান। আয়েশা খাতুনের সঙ্গেও তখন সম্পর্ক ভাঙার পথে। আয়েশা খাতুন সংসারের এমন টানাপোড়েন মানিয়ে নিতে গিয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। দিনের পর দিন চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছিলেন। কিন্তু শমসের খাঁন সব হারালেও আয়েশা খাতুনকে ছাড়তে নারাজ ছিলেন। মিশকাত আর সুবর্ণা তখন ছোটো। মিশকাত যেটুকু বুঝতে শিখেছিল, সুবর্ণা তা-ও বুঝত না। দুটো সন্তান সাথে নিয়ে বা তাদের ছেড়ে সংসার থেকে বিদায় নেওয়া আয়েশা খাতুনের জন্য-ও সহজ ছিল না। তাই অতিষ্ট হয়েও তিনি সহ্য করে নিয়েছিলেন। পুলক তালুকদার আর মেরিনা অনেকদিন তাকে বলেছিলেন সে যদি ওই সংসারে আর মানিয়ে নিতে না পারে, তাহলে যেন ফিরে আসে। কিন্তু আয়েশা খাতুন দাঁত কামড়ে সমস্ত বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে অভাবের সংসারে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই করেছিলেন। তিনি সফলও হয়েছিলেন। তার সেই সফলতা শমসের খাঁনের মনে অনুতাপ এনে দিলেও, তিনি নিজের পুরোনো কোনোকিছুই আর ফেরত আনতে পারেননি। ব্যর্থ হাতে পুলক তালুকদারের সাহায্যে নতুন করে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলেন। আজ তাদের সংসারে সুখ আছে। সবসময় বিলাসিতায় ভাসতে না পারলেও, তারা অভাবে পড়ে নেই। শমসের খাঁনের জীবনের সেই কাল সাপ রূপধারী বন্ধুরা এখন তাকে চেনেও না। প্রয়োজন ফুরালে কে কার খবর রাখে? স্বার্থের বন্ধুত্ব কি আর অভাবে বজায় থাকে? শমসের খাঁনের জীবন পুরোপুরি পরিবর্তন হয়েছে নিজের ভুলের জন্য। আজ আর তার দুহাত ভর্তি টাকা নেই। আছে একটা সংসার চালানোর আর দুটো সন্তানকে মানুষ করার মতো সীমিত সাধ্য। শমসের খাঁন এটুকুর জন্যই পুলক তালুকদারের কাছে কৃতজ্ঞ। সেই অভাবের দিনগুলোতে শ্যালিকার সংসার আর ভাগনে-ভাগনির জীবনের কথা ভেবে পুলক তালুকদার তার পাশে না দাঁড়ালে, অভাবের স্রোতেই হয়তো ভেসে যেত তার স্ত্রী, সন্তান, সংসার। পুলক তালুকদার আগাগোড়া-ই অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী মানুষ। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কোনো ভুল কাজ পছন্দ করেন না। নিজের কর্ম, সংসার দুটোই সামলান খুব যত্ন সহকারে। আর্থিক সচ্ছলতার দিকে তার কোনোকালেই কমতি ছিল না। তিনি নিজে যেমন সুখী জীবন পছন্দ করেন, তেমনি নিজের কাছের মানুষদেরও সুখী দেখতে পছন্দ করেন। পৃথিবীতে বোধ হয় খুব কম মানুষই আছে, যে নিজের সুখের পাশাপাশি অন্যের সুখ দেখতেও পছন্দ করে।


আরিন্তাকে পেলে সুবর্ণার মাথায় যত ভূ’ত চাপে। সুবর্ণার বাবা যখন বাড়ি থাকে না, তখন দুজন মিলে বাড়ি মাথায় তোলে। আরিন্তার খাওয়া শেষে সুবর্ণা তাকে নিয়ে বসল টিভি দেখতে। ভলিউম বাড়িয়ে হিন্দি গান ছেড়ে দুজন সোফায় পা তুলে বসেছে। গানের সাথে-সাথে দুজন গলা মিলাচ্ছে, আবার মাঝে-মাঝে নাচের তাল-ও উঠছে। বসে-বসেই তারা নাচছে, গাইছে। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় নিজের ঘর থেকে মিশকাত চেঁচিয়ে উঠল,
“সুবর্ণার বাচ্চা, টিভি বন্ধ কর বলছি। আমি এলে কিন্তু আছড়ে মা’রব।”

সুবর্ণা দাঁতে জিব কে’টে দ্রুত রিমোট হাতে নিল ভলিউম কমানোর জন্য। আরিন্তা ঝট করে তার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিলো। একদম ফুল ভলিউম। সুবর্ণা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“আল্লাহ্! আপু, কী করছো? ভাইয়া চলে আসবে, সাউন্ড কমাও তাড়াতাড়ি।”
আরিন্তা হেসে বলল,
“চুপ করে বোস।”
“ভাইয়া এসে পরে আমাকেই মা’রবে।”
“কিছু হবে না। মাঝে-মাঝে একটু সাহস নিয়ে ভাইদের বিরক্ত করতে হয়। চুপ থাক তুই।”
সুবর্ণা মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমি কিছু জানি না। সব তোমার দোষ।”
“আচ্ছা, আমারই দোষ। দেখব নে তোর ভাই কী করে আমাকে।”
এরমধ্যেই মিশকাত সুবর্ণার ওপর চেঁচাতে-চেঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ড্রয়িংরুমে পা রেখেই সে কিছু সময়ের জন্য দুটো অতি প্রিয় চোখে থমকে গেল। পরক্ষণেই তেড়ে এসে সুবর্ণার পিঠে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। সুবর্ণা অসহায়ের মতো চেঁচিয়ে উঠল,
“আমি কী করেছি? দেখছো না রিমোট আপুর হাতে?”
মিশকাত আবার এক পলক আরিন্তার দিকে তাকাল। তবু ত্যাড়া কন্ঠে বলে উঠল,
“আমি ঘর থেকে ডাক দিয়েছি, তুই শুনিসনি? তারপর আবার সাউন্ড বাড়ে কীভাবে? অতিরিক্ত সাহস হয়ে গেছে? চা’পড়ে গাল লাল করে ফেলব, বেয়াদব।”
নিরপরাধ সুবর্ণা রেগেমেগে সোফা থেকে উঠে পড়ল। ধুপধাপ করে পা ফেলে ঘরে চলে যেতে-যেতে রাগত স্বরে বলল,
“সবসময় হাত চলে বেশি। অযথা মা’রতে থাকে। বড়ো হয়েছে বলে বেশি বাড়াবাড়ি করে। আজকে যদি আব্বা এর বিচার না করছে-”

আরিন্তা সুবর্ণার চলে যাওয়া পথে তাকিয়ে ছিল। মিশকাত তার হাত থেকে রিমোট ছোঁ মে’রে নিয়ে সোফায় আছড়ে ফেলে দিলো। আরিন্তা মৃদু চমকে চোখ তুলে তাকাতেই শক্ত গলায় বলল,
“কী সমস্যা?”
আরিন্তা প্রত্যুত্তর করল না। নীরব চোখে তাকিয়েই রইল। মিশকাত পরবর্তী প্রশ্ন করল,
“কেন এসেছিস?”
এবারে আরিন্তা ধীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“দেখতে এসেছি নিখোঁজ ব্যক্তি ম’রেছে, না বেঁচে আছে।”
“মরলে সুবিধা হত, না? রাস্তাঘাটে মানুষ রূপ দেখে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসত, আর বিনা বাঁধায় নাচতে-নাচতে বিয়ে করে অন্যের সঙ্গে সংসার পাতা যেত। খুব তো শখ।”
“হুম, অনেক শখ। আজই গিয়ে বলব ওই লোকদের ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে।”

মিশকাত শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা যেভাবে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, কড়া ভাবটা বজায় রাখা মুশকিল। মিশকাত পা দিয়ে মেঝেতে আঘাত করল। তারপর ধুপ করে সোফায় বসে পড়ল। আরিন্তা একটু সরে বসতে গিয়ে খেয়াল করল মিশকাতের ডান হাতের কবজি ফুলে লাল হয়ে আছে। হাতের দিকে নজর পড়তেই সে হাত বাড়িয়ে মিশকাতের হাতের কবজি ছুঁলো। জানতে চাইল,
“কী হয়েছে?”
মিশকাত মৃদু স্বরে উত্তর দিলো,
“গতকাল গোরুর হাটে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।”
“সাবধান হতে পারলে না?”
“আমি কি হাত পেতে গোরুকে বলেছিলাম ব্যথা দিতে?”
সুযোগ বুঝে আরিন্তাও সঙ্গে-সঙ্গে বলে বসল,
“তাহলে আমি কি যেচে ওই খারাপ লোকটাকে বলেছিলাম আমাকে ছুঁয়ে দিতে?”
মিশকাতের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। আরিন্তা তার কবজিতে আঙুল বুলিয়ে দিতে-দিতে নরম গলায় বলল,
“জেনে-বুঝে এমন পা’গলামি কেন করো মিশু ভাই? তোমার থেকে কেউ আমাকে কেড়ে তো নিচ্ছে না।”

মিশকাত কিছু মুহূর্ত একইভাবে চুপ মে’রে বসে রইল। তারপর ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরিন্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোকে অন্য কোনো পুরুষ অনিচ্ছাকৃত ছুঁলেও আমার সহ্য হয় না। তুই বুঝিস না? ইচ্ছা করে তার হাত কে’টে ফেলে দিই।”
আরিন্তা মৃদু হেসে বলল,
“এখন যে আমি তোমাকে ছুঁয়েছি, সে বেলায় কী ইচ্ছা করছে?”
“আজীবন ছুঁয়ে থাক।”
“ইশ্! নিজের বেলায় ষোলো আনা?”
“হুঁ, আমার ষোলো আনা অধিকার আছে।”
“কিসের অধিকার দাবি করছো?”
“ভালোবাসার অধিকার। যা দ্বিতীয় কোনো পুরুষের নেই।”
“গত চারদিন সেই অধিকার কোথায় ছিল? খুব তো গাল ফুলিয়ে থাকা হয়েছে। আমি কতবার করে ফোন করেছি, তা-ও গায়ে লাগেনি। আগামী চারদিন আমিও দেখব কেউ আমাকে ফোন করে কি না। ফোন ছোঁব-ও না।”
“ঠিক আছে, দেখা যাবে কে আমার ফোন ইগনোর করে। তুলে এনে বিয়ে করে নেব একদম।”
“সাহস কত! আমার বাপ আর ভাই তোমায় আস্ত রাখবে না।”
মিশকাত তোয়াক্কা না করে বলল,
“কী করবে তোর বাপ-ভাই? মে’রে ফেলবে? অকালে বিধবা তো তাদের মেয়ে-ই হবে।”
আরিন্তা মিশকাতের বাহুতে চিমটি কে’টে বলল,
“চুপ, ফালতু কথা কম বলবে। আমার বেলাতেই জ্ঞান-বুদ্ধি চাঙ্গে উঠে যায়? পোল্ট্রি কোথাকার।”

মিশকাত চোখ পাকিয়ে তাকাল। আরিন্তা ভয় না পেয়ে উলটা মুখ বাঁকাতেই সে খপ করে আরিন্তার চুলের মুঠি চেপে ধরল। আরিন্তা ব্যথাতুর শব্দ করলেও ছাড়ল না। রাগত মুখে বলল,
“পোল্ট্রি, পোল্ট্রি করতে নিষেধ করেছি না বারবার?”
“তুমি পোল্ট্রি না তো কী? সাদা চামড়াওয়ালা, মোটাসোটা শরীরের পোল্ট্রির মতো দেখতে।”
কথাটা বলেই আরিন্তা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
“খালা…দেখে যাও তোমার ছেলে আমাকে আর সুবর্ণাকে মে’রে ফেলছে। খালা… তাড়াতাড়ি এসো। তোমার জল্লাদ ছেলেকে বারণ করো।”

আয়েশা খাতুন হাতের কাজ ফেলে রেখে তেড়ে এলেন। সুবর্ণা রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। মিশকাত আরিন্তার চুল ছেড়ে দিলো। আয়েশা বিরক্ত মুখে বললেন,
“মিশকাত, তোকে না বলছিলাম ওদের খ্যাপাবি না?”
মিশকাত বলল,
“মা, তোমার ভাগনিকে বলতে পারো না আমাকে পোল্ট্রি না বলতে? ওর বেয়াদবি চোখে পড়ে না তোমার?”
“তুই খ্যাপাস বলেই তো ও ওগুলো বলে। সাধে বলে?”
“হ্যাঁ, এভাবেই নিজের ছেলের বিপক্ষে দাঁড়াবে। তোমার মেয়েগুলো দুধে ধোয়া তুলসী পাতা।”
সুবর্ণা এগিয়ে এসে অভিযোগ তুলল,
“মা, তোমার ছেলে একটু আগেও আমাকে মে’রেছে।”
মিশকাত কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“অ্যাহ্! এসেছে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে। সর সামনে থেকে, বেয়াদবের দল।”
আয়েশা শাসনের সুরে বললেন,
“তোকে যেন আর ওদের পেছনে লাগতে না দেখি।”
মিশকাত কথাটা গায়েই মাখেনি। নিজের মতো চলে যেতে-যেতে বলল,
“আগে বেয়াদবগুলোকে আদব শেখাও মা।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০২

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
মেরিনা ভাত বেড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিশকাত, আরিন্তাকে দেখেই তাড়া দিলেন,
“আয়, তাড়াতাড়ি খেতে বোস। আমার কাজ আছে। আরি, পেলব কি ভাত খাবে?”
আরিন্তা বলল,
“তা তোমার ছেলেকেই জিজ্ঞেস করো। দেখলে না, এসেই বলল কেউ যাতে না ডাকে?”
“থাক তাহলে। ঘুম থেকে উঠলে খাবে নে।”
তারা খেতে বসলে মেরিনা বললেন,
“মিশু, যা লাগবে নিয়ে খাস। আমি বাইরে গেলাম। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। হাঁস, মুরগি ঘরে ঢুকাতে হবে।”
মিশকাত বলল,
“আচ্ছা খালা।”

মেরিনা চলে গেলেন ঘরের বাইরে। তার বাইরে পা দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মিশকাত খপ করে বাঁ হাতে আরিন্তার ঘাড় চেপে ধরল। বলল,
“কী যেন বলছিলি? আমাকে বিয়ে করতে বয়ে গেছে?”
আরিন্তা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
“মিশু ভাই, শান্তিতে খেতে দাও বলছি। হাত সরাও, নইলে পরে তোমার খবর আছে।”
মিশকাত হাতের মুঠি আরও শক্ত করে বলল,
“পরে কী খবর আছে? এখন বল, শুনি।”
আরিন্তা ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করায় শান্ত চোখে চেয়ে বলল,
“ব্যথা পাচ্ছি।”
মিশকাত সঙ্গে-সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল। খাওয়ার মাঝে হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে নিয়ে আরিন্তার প্লেটে তুলে দিতে-দিতে বলল,
“সদর যাবি, বললি না কেন?”
আরিন্তা গম্ভীর গলায় বলল,
“কীভাবে বলতাম?”
“খালার ফোন দিয়ে কল করতে শিখিয়ে দিতে হবে নতুন করে?”
“মায়ের ফোনে মিসকল করারও টাকা ছিল না।”
একটু থেমে অভিযোগের সুরে বলল,
“নিজে দিয়েছিলে? আজকে যে এখানে আসবে, তা-ও তো খবর দিলে না।”
“সকালে তোরা বের হওয়ার পর কল করেছিলাম। তখনই তো খালা বলল তোরা সদর যাচ্ছিস। বিকালে আসবি শুনে তাড়াতাড়ি এসেছি। তা-ও তোদের খবর নেই।”
“তাড়াতাড়িই আসতাম। রাস্তায় একটু ঝামেলা হয়েছিল, ওইজন্য দেরী হয়ে গিয়েছিল।”
“কী ঝামেলা হয়েছিল?”
“ওই বাসের এক যাত্রীর সাথে।”
“কার?”
“এতকিছু জেনে কী করবে? চুপচাপ খাও তো।”

মিশকাত ভ্রুকুটি করল। আরিন্তা কথার মাঝে হঠাৎ করে যেভাবে খাওয়ায় অতি মনোযোগী হয়ে পড়েছে, তাতে তার সন্দেহ হচ্ছে ঝামেলাটা আরিন্তা বা পেলবের সাথেই হয়েছে। এর মাঝেই হঠাৎ দোতলা থেকে পেলব নেমে এল বেশ তাড়াহুড়া করেই। মিশকাতকে দেখে শুধাল,
“কখন এসেছিস?”
মিশকাত বলল,
“তোরা ফেরার অনেক আগেই। দাদির ঘরে ছিলাম। তুই ভাত খাবি?”
“না, তোরা খা।”
তারপর পেলব সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আরিন্তার কাছে এগিয়ে গিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“আরি শোন।”
আরিন্তা উৎসুক হয়ে মুখ তুলে তাকাল। পেলব তার কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“বাসের ঝামেলার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিস না কিন্তু। আব্বা শুনলে রাগারাগী করবে। ঠিক আছে?”
আরিন্তা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। পেলব আর দাঁড়াল না। যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার ওপরে চলে যেতে-যেতে বলল,
“মিশু, খাওয়া শেষ হলে ওপরে আসিস।”

পেলব চলে গেলে মিশকাত সন্দিহান কন্ঠে আরিন্তাকে বলল,
“এদিকে তাকা।”
আরিন্তা তাকাল। মিশকাত জেরার সুরে বলল,
“সত্যি করে বল তো বাসে কার সাথে, কী ঝামেলা হয়েছিল।”
আরিন্তা সাবধানি সুরে বলল,
“ওহ্! আস্তে কথা বলো। মা শুনবে।”
“তাহলে বল আমাকে।”

আরিন্তা ধীরে-ধীরে বাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিস্তারিত বলল। ওসব শুনে মিশকাতের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। খাওয়া থামিয়ে সে শক্তপোক্ত মুখে আরিন্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরিন্তা বলল,
“তুমি আমাকে রাগ দেখাও কেন?”
মিশকাত রাগত স্বরে বলল,
“তোকে কোন সাহসে ছুঁয়েছে ওই হা’রামজা’দা?”
“খেতে বসে গালাগালি করতে হয় না। শান্তি করে খাও আগে।”
প্লেটে খাবারের শেষ অংশটুকু পড়ে ছিল। মিশকাত সামনে থেকে প্লেটটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার শান্তি তোর সহ্য হয়? দিস তুই আমাকে একটা দিন শান্তিতে থাকতে?”
মিশকাতের কন্ঠে এমন ভয়াবহ রাগের আভাস পেয়ে আরিন্তা অবাক হয়ে বলল,
“তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? আজব! আমি কি ইচ্ছা করে ওই লোকের কাছে গেছি?”
“চাপড়াব তোকে বেআক্কেল মেয়ে। উঠেছিলি কেন তুই ওই বাসের ভিড় দেখেও? আরেকটু অপেক্ষা করে অটোতে ওঠা যেত না?”
“দাদিই তো তাড়া দিচ্ছিল। আমি কী করতাম?”
“কিছু করার না থাকলে নাচতি।”
“তুমি চুপ করবে?”
“করলাম চুপ। আর একটা কথাও বলবি না আমার সামনে, অতি চালাক পোলাপাইন।”
কথাটা বলতে-বলতেই হাত ধুয়ে ফেলেছে মিশকাত। তাকে উঠতে দেখে আরিন্তা বলল,
“অযথা রাগ দেখাচ্ছ। খাওয়া রেখে উঠছো কেন? মিশু ভাই, খাওয়া শেষ করো।”
মিশকাত শুনেও শুনল না। আরিন্তা পিছু ডাকলেও আর একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না। হনহনিয়ে হেঁটে ওপরে পেলবের কাছে চলে গেল। আরিন্তা থম মে’রে বসে রইল। তার খাওয়া শেষ। অথচ শেষ মুহূর্তে মিশকাতের এমন আচরণ তাকে থামিয়ে দিলো। এখন তার উঠতেও ইচ্ছা করছে না। গাল ফুলিয়ে সে আপন মনে বিড়বিড় করে বলল,
“পাগল-ছাগল জুটেছে কপালে।”

মিশকাত মেরিনার ছোটো বোনের ছেলে। পাশাপাশি এলাকায় তাদের দুই বোনের বাস। সেই সুবাদে একে অপরের ছেলে-মেয়েদের খালার বাড়ি আসা-যাওয়া হয় ঘন-ঘন। দুই বোনেরই একমাত্র ছেলে মিশকাত আর পেলব। পেলবের ছোটো-বড়ো দুই বোন থাকলেও, মিশকাতের শুধু ছোটো এক বোন। দুই বোনেরই একে অপরের ছেলে-মেয়ের প্রতি মাতৃসম টান। বলতে গেলে দুই বোনের পরিবারের মাঝেই নজরকাড়া সম্পর্ক। মিশকাত আর পেলব প্রায় সমবয়সী। তাদের পড়াশোনা, খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা-ও একইসঙ্গে। পারিবারিক সম্পর্কের বাইরেও তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশি। পেলবের চেয়ে মিশকাতের-ই তাদের বাড়ি আসা-যাওয়া হয় বেশি। তার বড়ো কারণ হলো আরিন্তা। আরিন্তার প্রতি মিশকাতের অন্যরকম টান সেই উঠতি বয়স থেকেই। তখন থেকেই সে আরিন্তাকে বোন মানতে পারে না। আরিন্তা বয়সে তার চেয়ে চার বছরের ছোটো। এই তো এখন সে মাস্টার্স করছে, আর আরিন্তা সবে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। রঙিন জগতের রং-চং বোঝার পর থেকেই আরিন্তা নিজের প্রতি মিশকাতের অনুভূতি বুঝতে পেরেছিল। বয়স কম হলেও সে ছিল ইঁচরেপাকা মেয়ে। আকর্ষণীয় চেহারার জন্য গ্রামের আর পাঁচটা ছেলের নজর সবসময়ই তার ওপরে ছিল। সেই অল্প বয়স থেকে প্রেম নিবেদন-ও সে কম পায়নি। কিন্তু কখনো কেউ মিশকাতকে ডিঙিয়ে তার মন অবধি পৌঁছাতে পারেনি। মিশকাত কখনোই তার সামনে নিজের অনুভূতি লুকায়নি। তার ভয় ছিল সে নিজের অনুভূতি লুকালেই আরিন্তা অন্য ছেলেদের পাল্লায় পড়ে যেতে পারে। আরিন্তা সবসময় দেখে এসেছে তার জন্য মিশকাতের যত পা’গলামি। আবেগী বয়সে মিশকাত-ই হয়ে উঠেছিল তার স্বপ্নের রাজকুমার। কিন্তু বাবা আর ভাইয়ের ভয়ে সে মিশকাতের রোজকার কৌশলে প্রেম নিবেদনে সায় দিতে পারত না। সারাক্ষণ তার মন ছটফট করত, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারত না। মিশকাতের-ও বিশেষ তাড়া ছিল না। সে নিজেও চেয়েছিল তার ছোট্ট অনুভূতিটা বড়ো হোক, ঠিকঠাকমতো জগতটাকে চিনতে শিখুক। আরিন্তার এখনো মনে পড়ে, সেই সময়গুলোতে মিশকাত সবসময় তাকে বলত,
“তুমি দ্রুত বড়ো হও আমার পোনি। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। বড়ো হয়ে একবার আমায় অনুভূতি মিশিয়ে ডেকো। আমি বুঝে নেব আমাদের একে অপরের জীবনে জড়ানোর সময় হয়েছে।”

আরিন্তা তখন মুখ ফুটে বলতে পারত না মিশকাত তার ভেতরের ঠিক কতটা জায়গা দখল করে বসে আছে। মিশকাতের কথামতোই সে-ও সেই সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল। আজও তার সেই যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিতে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিনটি হচ্ছে আঠারো বছরপূর্তি জন্মদিনটি। আরিন্তার বাবা ঘটা করে জন্মদিন পালন করা পছন্দ করেন না। তাই আরিন্তার মা সবসময় ছেলে-মেয়েদের জন্মদিনে নিজেই তাদের পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ান। সেবারেও তা-ই করেছিলেন। বোনের ছেলে-মেয়েকেও ডেকে এনেছিলেন। মিশকাত সেদিন আরিন্তার জন্য কিছু খাবার-দাবারের সাথে আঠারোটা গোলাপফুল দিয়েছিল। আরিন্তাকে থমকে দিয়ে এক ফাঁকে তার হাতে আঠারোটা চিরকুট-ও গুঁজে দিয়েছিল, যার প্রত্যেকটায় লেখা ছিল,
“পোল্ট্রির জীবনে স্বাগত পোনি। বড়ো হয়ে গেলে তো। এবারে অনুভূতির উত্তর দেওয়ার সময় হয়েছে। অপেক্ষার অবসান ঘটাবে না?”

সেই চিরকুট পেয়ে আরিন্তার মন নেচে ওঠার পরপরই ঝুপ করে শান্ত হয়ে গিয়েছিল। বুঝেই উঠতে পারছিল না কীভাবে সে উত্তর দিবে। টানা তিন দিন সে মিশকাতের থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছিল। চতুর্থদিন আর পারেনি। মিশকাত সেদিন তার পায়ে শিকল বেঁধে দিয়েছিল। আরিন্তা অসহায় মুখে বলেছিল,
“মিশু ভাই, আমার লজ্জা লাগে। তুমি বুঝো না কেন?”
মিশকাত হাসতে-হাসতে বলেছিল,
“ইশ্! তুই আবার লজ্জাবতী হলি কবে রে? জানতাম না তো। না কি আমার সাথে প্রেম শুরুর কথা ভেবে নতুন লজ্জা আবিষ্কার হয়েছে?”
“হুহ্! তোমার সাথে প্রেম করার জন্য হা করে আছি আমি।”
“তুই কি আমাকে রিজেক্ট করতে চাইছিস? তাহলে সোজাসাপ্টা বলে দে। তুই না করে দিলে আমি রিমাকে অ্যাকসেপ্ট করে নেব।”
ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর নাম উঠতেই আরিন্তা হকচকিয়ে গিয়ে চোখ বড়ো করে জিজ্ঞেস করেছিল,
“রিমা তোমাকে প্রপোজ করেছে কবে?”
“তোকে বলব কেন?”
“ও তোমাকে পছন্দ করে কবে থেকে?”
“তা আরেকজনের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোর কী দরকার?”
‌ “অবশ্যই দরকার। ও সেই প্রথম থেকে জানে আমি তোমাকে পছন্দ করি। ও জেনেশুনে এমন কাজ করবে কেন?”
মিশকাত সঙ্গে-সঙ্গে বলেছিল,
“তুই আমাকে পছন্দ করিস, তার প্রমাণ কী? রিমা তো আমাকে সরাসরি বলেছে, মিশকাত ভাই, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুই কী বলেছিস?”
“তারপর তুমি কী বলেছিলে?”
“আমি বলেছি তোর উত্তর জানার পর আমি ওকে উত্তর দিতে পারব।”
“তার মানে তুমি ওকে-ও সিরিয়ালে রেখেছ?”
“একজনের বিরহ কা’টাতে আরেকজনকে সিরিয়ালে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। তুই বুঝবি না, কারণ তুই অতি বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী। অতি বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীদের নিজের বেলায় সব বুদ্ধি উড়ে যায়।”
আরিন্তা রেগেমেগে বলেছিল,
“তুমি এতদিন ধরে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য মেয়েকেও সিরিয়ালে রাখলে কীভাবে? সব কি তাহলে মিথ্যা ছিল?”
“মিথ্যা হবে কেন? অবশ্যই একশো ভাগ সত্য।”
“তাহলে তুমি আমার সাথে এমন করলে কেন?”
“কী করলাম?”
“অপরাধ করেছ, প্র’তারণা করেছ।”
মিশকাত আকাশ থেকে পড়ার ভান করে অবাক কন্ঠে বলেছিল,
“প্রতারণা হলো কীভাবে? তুই আমাকে এত বড়ো অপবাদ দিস কেন? আমার তো একতরফা ভালোবাসা। এখানে তোর অপবাদ দেওয়ার মানে হয় না।”
“একতরফা? নাটক করো? তুমি বুঝতে না আমিও তোমাকে ভালোবাসি? এতদিন তো নিজেকে খুব প্রেমিক পুরুষ দাবি করতে। রিমার প্রেম নিবেদন পেয়ে অবুঝ শিশু হয়ে গেছো?”
আরিন্তার চোখে পানি এসে পড়েছিল। মিশকাত হাসি-হাসি মুখ করে বলেছিল,
“আবার বল তো। তুই আমাকে ভালোবাসিস?”
“নতুন জানো?”
“সত্যি?”
ভেজা চোখে শক্ত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠেছিল আরিন্তা,
“মিশু ভাই।”
মিশকাত নিচু স্বরে বলেছিল,
“তাহলে অবশেষে স্বীকার করলি তুই আমাকে ভালোবাসিস?”
আরিন্তা থতমত খেয়েছিল। মিশকাতের মিটমিটে হাসিটা লক্ষ্য করতেই নিজের বোকামির জন্য সে লজ্জিত হয়েছিল। মিশকাত বলেছিল,
“আমি কি এটা উত্তর ভেবে নেব? না কি রিমাকে -”
“খুন করে ফেলব মিথ্যাবাদী পোল্ট্রি।”

রিমার নাম তুলতেই আরিন্তা আচমকা মিশকাতের আস্তিন মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে ফট করে কথাটা বলে ফেলছিল। ‌মিশকাত তখনই নিজের বন্দী হাতটা টান মে’রেছিল। আচমকা আরিন্তা হোঁচট খেয়ে মিশকাতের মুখোমুখি গিয়ে পড়েছিল। মিশকাত ঝুঁকে পড়ে মুচকি হেসে বলেছিল,
“মন পো’ড়ে না কি পোনি?”

আরিন্তার কেমন বুকের মধ্যে ধুপধাপ শব্দ বেড়ে গিয়েছিল। মিশকাতের আস্তিন ছেড়ে দিয়ে সে সঙ্গে-সঙ্গে দূরে সরে দাঁড়িয়েছিল। তারপর থেকে টানা এক মিনিট সে অন্যদিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। লজ্জায় মিশকাতের চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মিশকাত গলা ঝেড়ে বলেছিল,
“তবে কি আজ আমার কপাল থেকে সিঙ্গেল ট্যাগটা মুছল? এরপর থেকে নিজেকে মিঙ্গেল দাবি করতে পারি? প্রেমিকার কী মতামত?”
আরিন্তার ঠোঁটের কোণে মিটমিটে হাসি ধরা দিয়েছিল। রয়েসয়ে সে উত্তর দিয়েছিল,
“জেনেশুনে এত ঢং কিসের? কেউ না কি আমার মন বোঝে? এত বুঝলে তাকে আবার ভেঙে বুঝাতে হবে কেন?”
মিশকাত চট করে আরিন্তার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
“বুঝাতে হবে না। একবার বল তো, ভালোবাসি।”
আরিন্তা পড়েছিল মহা ঝামেলায়। কিছুক্ষণ দোনামোনা করে সে ঘ্যানঘ্যান করে বলেছিল,
“মিশু ভাই, আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।”
মিশকাত হো-হো করে হাসতে-হাসতে আরিন্তার মাথায় দুই আঙুলে টোকা মে’রে বলেছিল,
“এখন থেকে সব ভালো লাগবে। প্রেমে পড়লে চোখে সরষে ফুল লাগে। তখন পচা ডোবাকে-ও বিলাসবহুল সুইমিংপুল মনে হয়।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০১

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১.
লোকাল বাসের যা-তা ভিড়ের মধ্যে শরীরে অপরিচিত পুরুষের অযাচিত স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল আরিন্তা। মাথা ঘুরিয়ে সে তাকাল তার ডানপাশে একটু পেছনে দাঁড়ানো পেলবের দিকে। পেলবের সাথে চোখাচোখি হতেই আরিন্তা চোখের ইশারায় স্পর্শকারী মাঝবয়সী লোকটাকে দেখাল। তার চোখ-মুখের অভিব্যক্তি আর ইশারা দেখেই পেলব বুঝতে পারল এখানে বিপদ আছে। আরিন্তার বাহু ধরে টেনে এনে কোনোমতে পেলব জায়গা পালটাপালটি করে দাঁড়াল। তাতেও লাভ হলো না। লোকটা পেছনে থাকায় আবারো সুযোগ বুঝে একই কাজ করল। এবারে আরিন্তার গা ঘিনঘিন করে উঠল। লোকটা হাত সরানোর আগেই খপ করে হাতটা মুঠোয় চেপে ধরল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত মুচড়ে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে উঠল,
“হারামজাদা, তোর ঘরে মেয়ে নেই?”

সঙ্গে-সঙ্গে পেলব ঘুরে দাঁড়াল। লোকটা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করায় আরিন্তা হাতের মুঠি আরও শক্ত করল। পেলব তাড়াতাড়ি আরিন্তার হাত সরিয়ে নিয়ে দুহাতে লোকটার শার্টের কলার চেপে ধরল। রাগে-ক্ষোভে লোকটাকে সিটের সাথে ঠেসে ধরে ধমকে উঠল,
“শালা বুইড়া খচ্চর, বাপের বয়সী হয়েও মেয়েদের দেখলে হাত নিশপিশ করে? তোর হাত যদি আজ আস্ত রেখেছি।”

বলেই পেলব লোকটার দুই হাত পেছনদিকে এনে মুচড়ে ধরল। লোকটা মুখে ব্যথাতুর শব্দ করে ছাড় পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। বাস ভর্তি মানুষের উৎসুক দৃষ্টি তখন তাদের দিকেই। সবার মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। কেউ-কেউ লোকটাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে, কেউ বলছে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিতে। দু-একজন লোক গলা তুলে ড্রাইভারকে বাস থামাতে বলছে। পেলব বেশ খেপে উঠেছে। তার রাগের পরিমাণ দেখে আরিন্তার-ই এখন ভয় ধরে গেছে। এটা নিয়ে এখন নিশ্চিত ঝামেলা বাঁধবে। কিন্তু ব’জ্জাত লোকটাকে তার নিজেরই জুতাপে’টা করতে ইচ্ছা করছে। বদমেজাজি পেলবের রেগে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাসের মধ্যে কুরুক্ষেত্র দেখে ড্রাইভার স্টিয়ারিং থামাতে বাধ্য হলো। ততক্ষণে পেলবের সাথে আরও দুজন ছেলে লোকটাকে চেপে ধরে বাস থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানোর পাঁয়তারা করছে। তাদের সাথে বাসের অধিকাংশ জনতা-ই রাস্তায় নেমে পড়েছে। পেলবের হাত থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে না পেরে লোকটা যত কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গা’লিগালাজ করতে শুরু করেছে। লোকটার মুখের ভাষা শুনে পেলবের মাথা ঝট করে দ্বিগুণ গরম হয়ে গেল। মুষ্টাঘা’ত পড়তেও বেশি সময় লাগল না। শক্তপোক্ত হাতের চার-পাঁচটা মুষ্টাঘা’ত খাওয়ার পর আর লোকটা মুখ খোলার সাহস পেল না। কারণ আশপাশের কয়েকটা ছেলেও তখন খুব উৎসুক হয়ে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গণধোলাই দেওয়ার উৎস দেখে তাদের হাত নিশপিশ করছে। যেকোনো সময় তারাও পেলবের সাথে যোগ দিতে পারে। পেলবের একার হাতের জোরেই লোকটার প্রাণ ওষ্ঠাগত, এতগুলো জোয়ান ছেলের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। নিজের প্রাণের মায়ায় লোকটা মাথা নিচু করে চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। আশেপাশের মানুষের মাঝে গুঞ্জন লেগেই আছে। তারা খুব তেজ নিয়ে উৎসাহিত করছে যাতে লোকটাকে গণধোলাই দেওয়া হয়। আরিন্তা চাপা স্বরে পেলবকে বলল,
“আমাদের বাড়ি পৌঁছাতে দেরী হবে। ঝামেলা বাড়তে দিয়ো না।”
পেলব লোকটাকে ধমকে উঠল,
“মাফ চা। পা ধরে মাফ চাইবি, আর প্রতিজ্ঞা করবি জীবনে আর মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাবি না। বোস, মাফ চা।”
আরিন্তা বলল,
“পা ধরা লাগবে না।”

লোকটা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকায় পেলব আবারো ধমকে উঠল,
“মাফ চা।”
লোকটা মাথা আরও একটু নিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
“মাফ কইরা দ্যান মা।”
আরিন্তা বলল,
“আজকের কথা মনে থাকলে জীবনে আর কোনোদিন নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলবেন না। আপনাদের মতো লোকেদের জন্যই কোত্থাও মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। মনের মধ্যে বাজে মতলব নিয়ে ঘোরাঘুরি করলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন। তবে যদি আপনার পাপ ঘোচে।”

লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে পেলব আরিন্তাকে নিয়ে বাসের ভিড়ের কাছ থেকে সরে এল। আরিন্তা শুধাল,
“কী করবে? বাসে যাবে না?”
“না। মাঝপথ থেকে আবার বাস পাব কোথায়?”
“অটো নিবে?”
“হুম।”
পরপরই পেলব ধমকের সুরে বলল,
“তোর তাড়ার কারণে এই লোকাল বাসে উঠতে হয়েছে। শিক্ষা হয়েছে এখন?”
আরিন্তা চুপসানো মুখে বলল,
“আমি কী করতাম? দাদিই তো বারবার বাবাকে দিয়ে ফোন করাল।”
“এত তাড়া থাকলে আমাদের পাঠিয়েছিল কেন? নিজেরা যেতে পারল না?”
“দাদির ছড়ি ভেঙে গেছে। আমরা আনতে না গেলে দাদি হাঁটাচলা করত কীভাবে?”
“কেন? যে ঢাকা থেকে সদর পর্যন্ত ছড়ি আনতে পেরেছে, সে সদর থেকে আমাদের বাড়ি আসতে পারল না? হাত-পা ভেঙে যেত তার?”
“এখন তো নিয়েই এসেছ, শুধু-শুধু আর রাগারাগী কোরো না তো। দেখো গাড়ি পাও কি না।”

লোকাল বাসটা মাত্রই তাদের পাশ কা’টিয়ে চলে গেল। এই রাস্তায় আর বাস পাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারা একটা অটো পেল। তা-ও অটোতে দুজন বৃদ্ধ দম্পতি ছিল। খালি অটো পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে থাকলে আরও সময় নষ্ট হবে ভেবে এই অটোতেই উঠে পড়ল।

গতকাল হঠাৎ পেলবের বৃদ্ধা দাদির ছড়িটা ভেঙে গেছে। ছড়ি ছাড়া সে হাঁটাচলা করতে পারে না। তাই নতুন ছড়ি কেনার দরকার ছিল। পেলবের ফুপাতো ভাই রাগীব ঢাকায় চাকরি করে। গতকালই সে ইদের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে। নানির ছড়ির কথা শুনে সে আসার সময় নতুন ছড়ি কিনে নিয়ে এসেছে। রাগীবদের বাড়ি জেলা সদর, আর পেলবদের বাড়ি যেতে সদর থেকে দুই ঘন্টার পথ। তাই বাড়ি ফিরে সঙ্গে-সঙ্গে রাগীবের দূরে কোথাও বেরোতে ইচ্ছা করেনি। তার মা তাকে পাঠানোর জন্য অনেক জোরাজুরি করলেও, সে কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে রাজি হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে পেলব আর আরিন্তাকেই তাদের মা ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা গিয়েছিল সেই সকালে। দুপুরে ফুপুর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে ছড়ি নিয়ে বিকালেই ফিরে এসেছে। তারমধ্যে রাস্তায় আবার এমন বিপত্তি।

এদিকে অটোতে উঠে হতে বৃদ্ধ দম্পতি যেন তাদের দুজনের ইন্টারভিউ নিতে বসেছে। তারা কোথায় গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, নাম কী, বাড়ি কোথায়, কোন ক্লাসে পড়ে, দুজনের সম্পর্ক কী। পেলব মুখটাকে গম্ভীর করে বাইরের দিকে মুখ করে বসে আছে। আরিন্তার হয়েছে বিপদ। বৃদ্ধ দম্পতির প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে কোনো বড়ো কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলেও তাকে এত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত না। চটপটে মেয়ে আরিন্তার মাঝে বিরক্তি আসার পর আর সে এসব মেনে নিল না। খুকখুক করে একটু কেশে বলল,
“কিছু মনে করবেন না দাদি। আমার গলার সমস্যার কারণে ডাক্তার বলেছে কথা কম বলতে।”
বৃদ্ধা চোখ বড়ো করে বললেন,
“কী কও বইন! এই বয়সে গলায় সমস্যা? কী হইছে? বড়ো রোগ?”
“না, না। ওই একটু ঠান্ডার কারণে গলায় সমস্যা। আমি কিন্তু আর কথা বলছি না।”
“আইচ্ছা, আইচ্ছা। ভাই, তুমি কথা-টথা কও না ক্যান?”
পেলবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়তেই পেলব ফিরে তাকাল। এক পলক তাকিয়েই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সোজাসাপ্টা বলে দিলো,
“আমি বেশি কথা বলা পছন্দ করি না।”

কথাটা বৃদ্ধ দম্পতির একদমই ভালো লাগল না। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা এমনই ঠোঁটকা’টা। বয়স্ক মানুষের মুখে-মুখে কথা বলতে বাঁধে না।
তবে পেলবের আচরণটা উপকারে এল। বৃদ্ধ দম্পতি এরপর আর তাদের বেশি বিরক্ত করেনি। কিন্তু নিজেদের মধ্যে তাদের বকবক থামেনি। সারাটা পথ তাদের মুখ চলেছে, আর পেলব-আরিন্তা মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বসে রয়েছে। তাদের আগেই বৃদ্ধ দম্পতি অটো থেকে নেমে পড়ল। যাওয়ার আগে আরও একবার জিজ্ঞেস করেছে তারা ঠিক কোন বাড়ির ছেলে-মেয়ে। অটো আবার ছাড়তেই আরিন্তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমরা যে আমাকে বাচাল বলো, আমার তো মনে হচ্ছে আমি ওনাদের চেয়ে দশগুণ কম কথা বলি।”
পেলব শ্লেষের সুরে বলল,
“হুম, ওনাদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর তো আমি দিয়েছি।”
“প্রশ্ন করলে উত্তর দিবো না? আশ্চর্য!”
“আমি দিয়েছি?”
“তুমি দাওনি বলেই তো আমাকে দিতে হয়েছে।”
“হুম…তালুকদার বাড়ির অতি ভদ্র মেয়েটা।”


গোসল সেরে ভেজা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দিয়ে হেলেদুলে রুম থেকে বেরিয়ে এল আরিন্তা। খাবার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডাকল,
“মা…ক্ষুধা লাগছে।”

মেরিনা ছাদ থেকে শুকনা কাপড় নামিয়ে এনেছেন মাত্রই। মেয়ের ডাক শুনে বললেন,
“এমন করে চেঁচাচ্ছিস, মনে হচ্ছে সারাদিন ধরে পেটে দানাপানি পড়েনি। তোর ফুপুর বাড়ি থেকে না খাইয়ে পাঠিয়েছে?”
আরিন্তা বলল,
“ফুপুর বাড়ি থেকে পেট ভরেই খাইয়ে পাঠিয়েছে। বাড়িতে এসে ক্ষুধা পেলে আমি কী করব?”
“কাপড় ভাঁজ করে রেখে নিই আগে, দাঁড়া।”
“আজকে কী রান্না করেছো?”
“হাঁস রান্না করেছি। মিশকাতকে খেতে ডাক।”
মেরিনা ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে আরিন্তা প্রশ্ন করল,
“মিশু ভাইকে কই পাও?”
“তোর দাদির ঘরে গিয়ে দেখ।”

আরিন্তা কপাল কুঁচকে কিছু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ছুট লাগাল দাদির ঘরের দিকে। দাদির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনল ভেতরে দাদি-নাতির আলাপ চলছে। দরজার কাছ থেকে ধীর পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে-ঢুকতে বলল,
“কী গো দাদি? ছড়ি পাইয়া আমারে ভুইলা আরেকজনের সাথে রসের আলাপ করতে বইছো?”
আশির্ধ্বো খায়রুন নেসা আরিন্তাকে দেখে ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন,
“ও লো রঙ্গিলা, তোরে আবার ভোলতে পারে কেডা? এইহানে আয়।”

আরিন্তা গিয়ে ধপাস করে বিছানায় উঠে বসল। খায়রুন নেসার ওপাশে বসা মিশকাতের দিকে এক পলক তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ছেলেটার স্থির দৃষ্টি তার মুখে আটকে। আরিন্তা খায়রুন নেসার গা ঘেঁষে বসে কপট চাপা স্বরে বলল,
“হ্যাঁ গো বুড়ি, এই পোল্ট্রিটার রোজ-রোজ তোমার কাছে কী কাজ? গোপনে প্রেম-ট্রেম করো না কি? আব্বারে কাজি ডাকতে কমু নি?”
খায়রুন নেসা হো-হো করে হেসে উঠে বললেন,
“তা ক গিয়া, পোলা কি খারাপ নি? এক্কেরে রাজপুত্তুর পাইছি।”
“তুমি একা রাজি হইলে তো হইব না বুড়ি। তোমার পাত্র রাজি আছে তো?”

এই বলে আরিন্তা দ্বিতীয়বার মিশকাতের দিকে চোখ তুলে তাকাল। মিশকাত এখনো সেই একইভাবে মূর্তির মতো তার দিকেই চেয়ে আছে। আরিন্তা ঠোঁট টিপে হেসে এক ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কবুল?”
মিশকাতের উত্তর আসতে এক মুহুর্ত দেরী হলো না। আরিন্তার চোখে চোখ রেখেই চট করে শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“কবুল।”
চটজলদি চোখ সরিয়ে নিয়ে আরিন্তা খায়রুন নেসাকে বলল,
“তোমার পাত্র তো এক পায়ে রাজি গো বুড়ি। শুভ কাজ কবে সারতে চাও?”
মিশকাতের উত্তর এল,
“যেদিন বউ সাজবে।”

আরিন্তা সরু চোখে তাকাল। খায়রুন নেসা ফিক করে হেসে উঠে বললেন,
“দেখছো নি পোলা কত চালু? ও লো রঙ্গিলা, আমার ভাইজান কই?”
“তোমার ভাইজান বাড়ি আইসাই সোজা রুমে ঢুইকা দরজা আটকায় দিছে। কড়া কইরা কইছে কেউ যাতে না ডাকে। সে গোসল কইরা ঘুমাইব। তোমার নাতি ফোন করলে কইয়ো তোমার ছড়ি পছন্দ হইছে কি না।”
“আমার আবার একটা পছন্দ! হাঁটতে পারলেই হইল।‌ হ্যাঁ রে, রাগেবে কবে আইব আমারে দ্যাখতে?”
“তিন-চারদিন পর তো এমনেই ইদ। তহনই আইব মনে হয়।”

মেরিনার ডাক পড়ল,
“আরি, ভাত বেড়েছি, খেতে আয়।”
আরিন্তা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বলল,
“দাদি, খায়া আসি আগে। মিশু ভাই, চলো। মা খেতে যেতে বলছে।”
মিশকাত বলল,
“আমি খেয়ে এসেছি।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কেউ না খেলে আমি একাই খেতে পারব।”
আরিন্তা হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। দরজা পর্যন্ত যেতেই মিশকাত দ্রুত উঠে পড়ল। খায়রুন নেসাকে বলল,
“খেয়ে আসছি দাদি।”

বড়ো-বড়ো পা ফেলে মিশকাত আরিন্তার কাছাকাছি এসেই গলা ঝাড়া দিলো। আরিন্তা ফিরে না তাকালেও পায়ের গতি মন্থর করল। মিশকাত হাঁটতে-হাঁটতে নিচু স্বরে বলল,
“ওই পোনি, তোর বাপরে বল কাজি ডেকে আনতে। বিয়ে করব।”
“ক্যান? খায়রুন বুড়ির জন্য তর সইতাছে না?”
“উঁহু, বুড়ির নাতনির জন্য। বুড়ির নাতনিটা সুন্দর না?”
আরিন্তা চোখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বুড়ির সুন্দরী নাতনির এমন পোল্ট্রি বিয়ে করতে বয়ে গেছে।”
মিশকাত প্রত্যুত্তরে কড়া কিছু বলতে চাইল। কিন্তু খাবার টেবিলের কাছে চলে আসায় চুপ মে’রে যেতে হলো।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৪১|
#শার্লিন_হাসান
(অন্তিম পার্ট)

আজকে সেরিনের কনসার্ট। বিকেলের দিকেই রওনা হয় সে তার টিমের সাথে। এবারের কনসার্টে শুভ্র থাকবে না। তবে সেরিন তাকে ভীষণ মিস করছে। একটু রাগ জমেছে। শুভ্র চাইলে আসতে পারতো। কিন্তু আসেনি।
সন্ধ্যা আটটায় কনসার্ট শুরু হয়। সেরিন ও মনোযোগ সহকারে গান গায়। সুন্দর একটা সময় কাটে সেরিনের। এই যে তার একটু,একটু পরিচিত বাড়ছে সেটা তাকে কী-যে আনন্দ দেয়।
কনসার্ট শেষে তাদের বরাদ্দকৃত রুমে চলে আসে সেরিন। রাত তখন বারোটা প্রায়। শুভ্রর কল আসতে সেরিন ধরে। শুভ্র তাকে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন কাটলো আজকের কনসার্ট?”

“জানি না।”

“এই তোমার কী হয়েছে বলো তো?”

“কিছু না।”

“বউফুল রাগ করে না।”

“এই আহ্লাদ করতে আসবেন না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। কয়টা চুমু দিলে রাগ ভে’ঙে যাবে?’

” জানি না।”

“আচ্ছা আগামী কালকেই কুমিল্লায় চলে আসবা। তখন গুনে,গুনে দশটা চুমো দিবো।”

“লাগবে না বা’ল!”

“আবার গা’লি দিচ্ছো?”

“কই আর!”

“দেখো তোমার একটু ভদ্র হওয়া উচিত।”

“ঠিক আছে। যেদিন ভ্দ্র হবো সেদিন কল দিবো।”

“আগামী কালকে কুমিল্লায় আসবা।”

“ঠিক আছে।”

“গুড নাইট।”

“যা ঘুমা।”

সেরিন কল কেটে দেয়। ফোন রেখে সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন ঢাকায় তার আন্টির বাসায় আসতে,আসতে এগারোটার মতো বেজে যায়। ফ্রেশ হয়ে বসতে শুভ্র কল দেয়। সেরিনকে জিজ্ঞেস করে,
“কী করছো?’

” ভদ্র হচ্ছি।”

“লাগবে না ভদ্র হওয়া।”

“লাগবে।”

“তোমায় নিয়ে পারা যায় না।”

“ঠিক আছে। যেদিব পারা যাবে সেদিন কল দিলেই হবে।”

“এই তুমি আবারো রাগ করছো?”

“এই আপনি আমায় আর কল দিবেন না।”

“ঠিক আছে।”

শুভ্র কল কেটে দেয়। সে তার অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়। তখন আবার সেরিনের ফোনে কল আসে নিশাতের। মেয়েটার বিয়ে ঠিক। তার ভাইয়ের বন্ধুর সাথে। সেরিন কংগ্রাচুলেশনস জানায়। তবে মাহীর জন্য একটু আধটু খারাপ লাগছে তার। তবে সমস্যা নেই তার ভাইয়ের সাথে মেহেরের আকদ হবে সামনে। সেরিন একটা লম্বা ঘুম দেয়।

বিকেলের দিকে সে তার ভিডিও গুলো এডিট করতে বসে। ঘন্টাখানেকের মতো সময় যায় সব ঠিকঠাক করতে। একটা ভিডু আপ দিয়ে সে তার আন্টির কাছে যায়। তার আন্টি তখন কিচেনে রান্না করছে। সেরিন বুঝলো শুভ্র আসবে। কিন্তু তাকে বলবে না তারা কেউ। সেরিন চুপিসারে রুমে এসে বেলকনিতে চলে যায়।

সন্ধ্যার দিকে শুভ্র ঢাকায় আসে। হাতের জিনিসপত্র গুলো লিভিং রুমে রেখে,আয়াশ,সিদরাতের সাথে কথা বলে। সেরিনের আন্টি শুভ্রর জন্য হালকা নাস্তার আয়োহন করেন। শুভ্র সেসবের কিছুই মুখে নেয়নি। শুধু কফির মগটা নিয়ে সেরিনের রুমে প্রবেশ করে। সেরিন তখন খাটের উপর পা ছিটিয়ে ফোন স্ক্রোল করছিলো। আচমকা শুভ্রকে দেখে ফেনটা সাইডে রাখে। সেরিনের দিকে তাকিয়ে শুভ্র কফিতে চুমুক দেয়। দরজাটা হালকা ভিজিয়ে সেরিনের সামনেই গিয়ে বসে। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে সেরিনের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
“দেখো কত কষ্ট করে, ক্লান্তি নিয়ে এতোটা পথ জার্নি করে এসেছি। বলতে হবে তোমার রাগের পাওয়ার আছে বেশ ভালো। যে আমায় কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে।”

“আমি কী বলেছি আসার জন্য?”

“তুমি না বললেও তোমার রাগ আর অভিমানরা আমায় বলে গেছে।”

সেরিন উঠে দাঁড়ায়। খাট থেকে নিচে নেমে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।”

শুভ্র কফিটা শেষ করে ফ্রেশ হতে চলে যায়। সেরিন দরজাটা লাগিয়ে, খাটের উপর বসে পড়ে। শুভ্র আসতে সেরিন শুভ্রর কলার চেপে ধরে বলে,
“এরপর আমায় কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার কথা বললে, খু-ন করবো কিন্তু!”

” আচ্ছা করিও খু-ন। যখন আমি থাকবো না তখন বুঝবে।”

সেরিন কলার ছেড়ে বলে, “আজে বাজে কথা বলছেন কেনো? আমি তো ওটা থ্রেট দেওয়ার জন্য বলেছি। আমি এমন কিছু করবো নাকী? দেখুন আপনি আমার দশটা না বিশটা না একটা মাত্র জামাই। আমি এমন কিছু করবো না।”

“পাগ’ল ওটা তো আমি জানি।”

“এই শুভ্র স্যার! আপনি আগের থেকে একটু মিষ্টি হয়েছেন।”

“আর কিছু বলার আছে?”

“না!”

“ঠিক আছে।”

“দশটা চুমু পাওনা আছি কিন্তু।”

সেরিনের কথায় শুভ্র হেঁসে দেয়। সেরিনের হাত ধরে নিচে দাঁড়ায়। সেরিন তখন প্রশ্ন করে, “এটা কী হলো?”

“চলো সিদরাত,আয়াশের সাথে গল্প করবো।”

“ওরা এখন পড়বে। আপনি আগে আমায় চুমু দেন।”

“আরে চুমু পাগলী মেয়ে।”

কথাটা বলে শুভ্র গুণে,গুণে দশটা চুমু দেয় সেরিনকে। সেরিন নিজের হাত ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়, দরকারী জিনিপত্র নিয়ে। নাহলে আবার শুভ্রর গুলো নিয়ে টানাটানি করতে হয় কুমিল্লায় গেলে। অথচ তার ব্লুটুথ,চার্জার, ঢাকায় থাকে।
ব্যাগ টা গুছিয়ে সেরিন শুভ্রর কোলে বসে,গলা জড়িয়ে ধরে। শুভ্রর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে, “জামাই ভালোবাসি।”

“ফাজিল হয়ে গেছো।”

“কোন লেভেলের আনরোমান্টিক আপনি?”

“এই আমি একটু আগেও দশটা চুমু দিয়েছি।”

“কেউ ভালোবাসি বললে, প্রতিত্তোরে ” আমিও ভালোবাসি” বলতে হয়। করলার জুশের মতো, “ঘুমাও,গুড নাইট,ফাজিল হয়ে গেছো, ফাজিল। এসব বলে না রে ভাই।”

“ঠিক আছে ধন্যবাদ বলে দেওয়ার জন্য।”

“এবার বলুন ” ভালোবাসি”!”

“সময় হয়নি।”

“এটা বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?”

“সেরিন আগের থেকে বেশী ফাজিল হয়ে গেছে।”

“না আজকে আপনার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শুনেই ছাড়বো।”

“সময় হলে বলবো।”

“আমার ধৈর্য নাই।”

“তাহলে ঘুমাও।”

“এ্যাই!”

শুভ্র সেরিনকে পাত্তা দেয়নি। সেরিন বসে,বসে আফসোস করছে। তার আর এই জন্মে শুভ্রর মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দ শোনা হবে না। পরক্ষণে নিজেকে স্বান্তনা দিলো এই ভেবে যে, “জামাই টা আমার। ভালোবাসলেও আমার। না বাসলেও আমার। শুভ্র মানে আমার। যাই হোক ভালো তো ঠিকই বাসে। মুখে স্বীকার না করুক!”

বেশী কিছু বলেনা। আবার ধমক, বকা দিলে সমস্যা। সেরিন হার্ট হবে,কান্না কাটি করবে। তখন শুভ্র তাকে ছিঁদকাঁদুনি উপাধি দিবে।

*********

দেখতে,দেখতে কেটে যায় তিন তিনটা বছর। এই তিন বছরে অনেক কিছু চেন্জ হলেও সেরিন,শুভ্রর রাগে-অভিমান,খুনসুটি আগের মতো থাকলেও ভালোবাসা তার থেকে বহুগুণ বেড়েছে। তবে আজো শুভ্রর মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শোনা হলো না। সেরিন ট্রিপল হয়েছে। আটমাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। শুভ্র একটু বেশী কেয়ার করে। সবাই বেশ খেয়াল রাখে সেরিনের। শশীর ছেলে বেবি হয়েছে ছয়মাস হবে। মেহেরের সাথে মাহির বিয়ে হয়েছে বছরখানেক হলো। নিশাতের বিয়ের তিনবছর চলছে। তবে তাঁদের বন্ধুত্ব এখনো আছে। সেরিন জানে না নিশাত তার বিরুদ্ধে গিয়েছিলো বা কিছু করতে চেয়েছিলো। বলা যায়, শুভ্রই জানায়নি তাকে। মূলত নিশাতের রিকুয়েষ্ট ছিলো। শুভ্রর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সেই সাথে বলেছে সেরিনকে এসব যাতে না বলে। তাঁদের বন্ধুত্ব সে ন”ষ্ট করতে চায় না। শুভ্র ও বলেনি। সেরিনকে সে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না।

সেরিনের গানের ক্যারিয়ার এগিয়ে। ছয়মাস হলো সে অবসরে। এই সময়টায় সেরিনের রিলেক্সে থাকা দরকার।
সময়টা সন্ধ্যা। জান্নাতুল ফেরদৌসে, মিরা ইসলাম, সুলতানা খানমের সাথে লিভিং রুমে বসে আছে সেরিন। এখন বাড়ীতে সবাই থাকে। সেরিনকে সবাই সময় দেয়। তখন শুভ্র আদিনকে (শশীর ছেলে) নিয়ে লিভিং রুমে আসে। ছেলেটা মাশাল্লাহ এক টুকরো চাঁদ। সবার ভীষণ আদরের। শুভ্র তো জেনো তাকে চোখে হারায়। আদিনকে নিয়ে সোফায় বসে শুভ্র। সেরিন তার শাশুড়ী দের সাথে কথা বলছে। মেয়েটার দিকে তাকালে শুভ্রর খারাপ লাগে। চঞ্চল মেয়েটাও এখন অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। হাঁটতে চলতে অনেকটা কষ্ট হয়। শুভ্রর বেশ চিন্তা। তার বাবু আর বাবুর আম্মু যাতে সুস্থ থাকে। সুস্থ ভাবে সব সম্পন্ন হয়।

সবাই রাতের ডিনার করলেও, জান্নাতুল ফেরদৌস সেরিনকে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দেয়। সবাই ডিনার করে রুমে গেলেও, শুভ্র,সেরিন, জান্নাতুল ফেরদৌস এখনো লিভিং রুমে। সেরিনের খাওয়া শেষের অপেক্ষায় আছে শুভ্র। এই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হবে তাই কোলে নিয়ে রুমে যাবে। এরকমটাই করে যখন থেকে সেরিনের চলতে কষ্ট হয়। মেডিসিন খেয়ে সেরিন উঠে দাঁড়ায়। শুভ্র তাকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি পাড়ি দেয়। রুমে এনে খাটের উপর বসায় খুবই যত্ন সহকারে। সেরিনের কপালে চুমু খেয়ে বলে, “বাবুর আম্মু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।”

সেরিন হাসে শুভ্রর কথায়। শুভ্রর বুকে মাথা দিয়ে রাত পার হয়ে সেরিনের। সকালে উঠে নামাজ আদায় করে নেয় সেরিন। সকাল,সকাল শুভ্র সেরিনের ব্রেকফাস্ট রুমে নিয়ে এসেছে। যদিও সেরিন তেমন খেতে পারে না। তবে শুভ্র তার খাবারের দিকেও বেশ এলার্ট। সকালের নাস্তাটা নিজ হাতে খাইয়ে দেয় সেরিনকে।

দেখতে,দেখতে সেরিনের ডেলিভারির দিন চলেই আসে। সকাল বেলায়ই তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। শুভ্রর চিন্তায় ভালো লাগছে না। চৌধুরী পরিবারের মোটামুটি সবাই হসপিটালে। যেহেতু এমপির পরিবার এসেছে আলাদা একটা প্রায়োরিটি, এবং সন্মান দেওয়া হয়। অপারেশন থিয়েটারের সামনে সবাই অপেক্ষা করছে। শুভ্র চিন্তিত মুখে বসে আছে। সে তো সেরিনকে আজোও মুখ ফুটে “ভালোবাসি” বললো না। অথচ মেয়েটার কত আশা ছিলো শোনার। শুভ্রকে এই চিন্তাটাই কুঁড়ে, কুঁড়ে খাচ্ছে। যদি বলতে না পারে সেরিনকে। সে তো প্রকাশ না করলেও ভীষণ ভালোবাসে মেয়েটাকে। শুভ্রর চিন্তার মাঝে একজন নার্স তার বাবুকে নিয়ে আসে। শুভ্র সবার আগে সেরিনের কথা জিজ্ঞেস করে। নার্স হাসি মুখেই বলেছে, “সুস্থ আছে।” শুভ্র তার মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খায়। তার বউফুলের আরেকটা মেয়েফুল হয়েছে। শুভ্রর দু’টো ফুল। একটা প্রথমে মেয়ে ফুল ছিলো কারণ সেটা বাচ্চা,বাচ্চা ছিলো। তারপর হলো বউফুল। এখন এই ফুলের থেকে আরেকটা মেয়ে ফুল।

শুভ্রর মেয়েকে নিয়ে বাকীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেরিনকে রুমে আনা হলে শুভ্র তার কাছে যায়। সেরিনের হাতে,কপালে চুমু খেয়ে বলে, “বউফুল ভালোবাসি।”

“আমিও ভালোবাসি।”

“আমায় এতো সুন্দর একটা মেয়েফুল দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমায়।”

সেরিন হাসে। শুভ্র ঝুকতে শুভ্রর কপালে,ঠোঁটে চুমু খায় সেরিন। শুভ্র ও পুনরায় সেরিনের ঠোঁটে চুমু খায়। তখন আবার কোথা থেকে আর্থ আসে শুভ্রর মেয়েকে কোলে নিয়ে। শুভ্রকে জ্বালানোর জন্য বলে,
“বিশ্বাস করো ভাইয়া। আমি ঠোঁট কাটা ছিলাম তবে তোমার মতো ওতো রোমান্টিক না। দেখো কোন লেভেলের রোমান্টিক হলে মানুষ হসপিটাল রোগী হয়ে থাকা বউয়ের থেকে চুমু নিতে এবং দিতেও ভুলে না।”

“এই তুই চুপ থাকবি? আমি কত চিন্তায় ছিলাম তুই জানিস? আমার বউয়ের কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে?”

শুভ্রর কথায় আর্থ হাসে। সেরিন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে হাসে। এই যে মানুষটার চোখে,মুখে তাকে হারানোর ভয় দেখলে এতেই জেনো সেরিনের সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেলো। শুভ্র মেয়েকে কোলে নিয়ে সেরিনকে দেখায়। সেরিন মেয়ের গাল টেনে দিয়ে বলে, “মাশাল্লাহ আমার মেয়েফুল।”

“আমার মেয়ের নাম কী রাখবো?”

“আপনি বলুন?”

” সেহেরিশ চৌধুরী পুষ্প’কুমারী।”

” পুষ্পকুমারী এই নামের অর্থটাও মেয়েফুল।”

“আমার মেয়ে ফুল তো।”

এক সপ্তাহ পর পুষ্পকুমারীর জন্য অনুষ্ঠান করা হয়। পাটওয়ারী বাড়ীর সদস্য থেকে শুরু করে চৌধুরী পরিবার। সবাই মিলে একটা সুন্দর সন্ধ্যা কাটানোর ব্যবস্থা কর হয়। শুভ্রর মেয়েকে বাকীরা সেরিনের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা ‘সেহেরিশ’ বলে ডাকলেও শুভ্র,সেরিন দুজন তাকে ‘পুষ্প কুমারী’ বলে ডাকে।

পুষ্প কুমারীর জন্য এতিমখানার বাচ্চাদের টানা দুইদিন খাবার দেওয়া হয়। এছাড়া দোয়া মিলাদ সবই পড়াবো শেষ এই একসপ্তাহে। আজকে শুধু ফ্যামিলি মিলে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান। শুভ্র মেয়ের জন্য ডায়মন্ডের লকেট কিনে এনেছে গিফ্ট হিসাবে। সেরিন গোল্ডের চুড়ী এনেছে।

সন্ধ্যায় সদ্য আট দিনে পা রাখা ‘সেহেরিশ চৌধুরী পুষ্পকুমারী’ কে আনা হয়। তারা বাবা-মা, মেয়ে ম্যাচিং পড়েছে। সেহেরিশ অনেকটা তার বাবার মতো চেহারা পেয়েছে। এই নিয়ে সেরিন হিংসায় জ্বলে। দশমাস সে গর্ভে রাখলো আর চেহারা পেলো বাবার। দিস নট ফেয়ার! সবাই মিলে কেক কাটে তাদের লিটল প্রিন্সেসকে নিয়ে।

পাটওয়ারী বাড়ী,চৌধুরী পরিবারে প্রত্যেকটা সদস্য তাদের চৌধুরী ভিলার লিটল প্রিন্সেসকে গিফ্ট দিয়েছে। আট দিনের বাচ্চাকে বেশীরভাগ গোল্ডের গিফ্ট দিয়েছে। শুধু তার দুই নানা, তিন দাদা, বাবা এই তিনজন ডায়মন্ড দিয়েছে। অধরা,আদ্রিতা তারা সেরিনের মেয়ে নিয়ে ঝগড়া করে। কে বেশী কোলে নিবে, কে আগে কোলে নিবে। সেরিন তাদের ঝগড়া খুনসুটি গুলো দেখে আর হাসে।

রাতের ডিনার করে সবাই গল্পের আসর জমায়। সেরিনকে রুমে নিয়ে দিয়ে আসা হয়। এখনো সে পুরোপুরি সুস্থ না। শুভ্র আর থাকেনি। তার বউ,কন্যাকে নিয়ে রুমে চলে আসে। সেরিন বাবুকে ঘুম পাড়ায়। শুভ্র বসে,বসে দেখছে তা। কে বলবে চারবছর আগে এই মেয়েটাও একটা বাচ্চার মতোই ছিলো। হাতে পায়ে বড় হলেও ব্যবহারে বাচ্চামী ছিলো। আজ সেই আরেকটা বাচ্চার মা। শুভ্রর মনে পড়ে বাবুর পাপা আর বাবুর আম্মুর কাহিনী। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে তার। বাবু ঘুমাতে শুভ্র সেরিনকে তার কাছে টেনে নেয়। কপালে চুমু খেয়ে বলে, “বউ ফুলের বাবুর আম্মু হওয়ার ইচ্চেটা পূরণ হলো। থ্যাংকস দাও আমাকে।”

“বাবুর পাপা!”

“হ্যাঁ! চারবছর আগের ডাক। এখনো বুকের বা পাশে লাগে। কী সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলো।”

“আসলেই সুন্দর ছিলো। কী ফাজিল ছিলাম আমি।”

“ফাজিল না হলে বুঝি আমি বউ ফুল আর মেয়ে ফুলকে পেতাম?”

“আরেকবার বলুন বাবুর আম্মু ভালোবাসি।”

“বাবুর আম্মু ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।”

“জানেন একটা কথা?”

“কী?”

” আপনার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা আজন্ম কাল শোনলেও আমার কানের তৃষ্ণা মিটবে না। এই শব্দটা শুনতে আমার কী পরিমান ভালো লাগে বলে বুঝাতে পারবো না।”

“তাই?”

“হ্যাঁ ভীষণ!”

“বউফুল ভালোবাসি।”

“ভালোবাসি আমার ব্যক্তিগত জ্বীনকে।”

“হয়নি!”

“উঁহু!”

“বলো?”

“আগে চুমু দেন?”

“হায়রে চুমু পাগ’ল মেয়ে। কয়দিন পর আমার মেয়ে ও তোমার থেকে শোনে,দেখে শিখবে। কথায়,কথায় বলবে ” পাপা আগে আদর দাও।”

“দিন তো!”

শুভ্র সেরিনের মুখশ্রী তে অসংখ্যা চুমোয় ভড়িয়ে দেয়। পুনরায় বলে,
“আমার একমাত্র বউফুল, আমার মেয়েফুলের মাম্মাম আমার বাবুর আম্মু, তোমাকে আমি ভালোবাসি,ভালোবাসি এবং ভীষণ ভালোবাসি।”

“মেয়েফুলের বাবা,আমার বাবু পাপাকে আমিও ভীষণ ভালোবাসি। আমার প্রথম এবং একমাত্র প্রেমিক পুরুষ এবং ভালোবাসার মানুষ।”

#সমাপ্ত

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৪০

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৪০|
#শার্লিন_হাসান

এরই মাঝে কেটে যায় প্রায় পনেরো দিন। সেরিন ঢাকায় ব্যাক করলেও বেশীদিন থাকেনি। শুভ্রকে বলে আবার কুমিল্লায় চলে এসেছে। সময় রাত এগারোটা প্রায়। সবাই ডিনার করে রুনে চলে গেলেও সেরিন যায়নি। সে জগে পানি নিয়ে উপরে যাবে। লিভিং রুমে কেউ নেই। সবাই উপরে। সেরিন টেবিলের উপররে ফিল্টারের থেকে জগে পানি নিচ্ছিলো। তার ডান সাইডে একটা কাঠের আলমারী টাইপের রাখা। তবে সেটায় কাঁচের আয়না ভেতরে কিছু প্রাইজ টাইপের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা। দেওয়ালের ওপার থেকে সেরিন কারোর কান্নার আওয়াজ পায়। কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে শক্ত করে নেয় সে। এই বিষয়টা নিয়ে অবশয় শশীর সাথে মেলা আলোচনা হয়েছে। ভূত টুত কিছুই না। সেরিন আলমারীর সাইডে যায়। ফোনের ফ্লাশ অন করতে দেখেআলমারীর পেছনে হালকা ফাঁক দিয়ে একটা দরজার কাঠ বোঝা যাচ্ছে। সেরিনের আর বুঝতে বাকী রইলো না বিষয়টা। সে সিদ্ধান্ত নেয় এটা সরিয়ে দরজার ওপারে যাবে। এর পেছনের মানুষটাই হয়ত অনেক কিছু বলতে পারবে। বাট কে এই মানুষটা? আর কেনোই বা দেওয়ালের ওপারে বন্দী? সেরিন জগ রেখে আলমারীটা টান দেয়। ওতোটাও ভারী না তবে সরানো যায়ই। একটু কষ্ট হবে। শক্ত করে আলমারীতে স্পর্শ করতে কারোর ছোঁয়া কাঁধে পেতে শিওরে উঠে সেরিন। গাড় ঘুরাতে দেখে জান্নাতুল ফেরদৌস। সেরিনের দিকে তাকিয়ে সে কী ডেভিল হাসি। সেরিন আমতা আমতা করে বলে, “আরে মা আপনি এখানে?”

“তুমি আলমারীতে কী করছো?”

“এমনিতে পানি নিতে এসেছি। আলমারীটা দেখছিলাম কাঠের তো আবার পোকায় ধরেছে কী না।”

“গুড!”

“আমি তাহলে আসি মা?”

কথাটা বলে সেরিন জগ আর ফোন হাতে এক কদম ফেলতে জান্নাতুল ফেরদৌস খপ করে সেরিনের হাত ধরে নেয়। সেরিন পুনরায় পা স্থির করে তাকায়। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“আমি জানি তুমি অনেক কিছু বুঝে গেছো। তো চলো তোমায় আরো কিছু বুঝাই এবং বলি।”

থেমে পুনরায় বলেন,
“আসলে দেওয়ালের ওপারে একজন মানুষ বন্দী আছে। যাকে আমি আটকে রেখেছি। অবশ্য তুমি বলতে পারো আমি কেনো আটকে রাখলাম।আমার মতলব টা আসলে কী! দেওয়ালের ওপারের মানুষটা একজন মহিলা। এই মহিলাটা আমার বোন।”

সেরিন জেনো শকড। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস তাকে হাতে দরে সোফায় বসায়। সেরিনের পাশে বসে বলে,
” জানো তো মা আমি ভীষণ খারাপ একজন মা। শুভ্রকে আমি ভালোবাসি কিন্তু ও আমার থেকে দূরে থাকে। কিঞ্চিৎ রাগ আমার উপর। মূলত তার মায়ের মৃ’ত্যুর পর আমি তার বাবার জীবনে না আসলেও পারতাম। জানো তো! আমি চাইলে সন্তান নিতে পারতাম। নেইনি, কারণ আমি চেয়েছি শুভ্রর বাবার ভালোবাসাতে কারোর ভাগ না বসে। সৎ ভাই বোন আসলে যতই ভালো সম্পর্ক থাকুক কিঞ্চিৎ হলেও ঈর্ষা থাকে। আমার বোন ও তোমার শ্বশুর কে পছন্দ করতো। জানো তো তোমার শাশুড়ী আসলে রোড এক্সিডেন্টে নাম দুর্ঘটনায় মা’রা গেলেও তাকে মা’রা হয়েছে। আমার বোন মে’রেছে। এতো দিনআমি অনেকটা পর,পর বা ভিলেন টাইপের আচরণ করে নিজেকে রহস্যময়ী করতে চেয়েছি। যাতে আমার বোনের উপর সন্দেহ না পড়ে। ওর পরিকল্পনা ছিলো চৌধুরী বাড়ীতে ঢুকে সবাইকে নিজের কথায় চালানোর। কিন্তু চৌধুরীরা সোসাইটিতে অনেক সন্মানীয় লোকজন। ওদের সম্মানহানি বা পরিবার তছনছ হয়ে যাক আমি চাইনি। সেজন্য ওকে সরিয়ে আমিই বিয়েটা করেছি। ওকে ঠিক কী শাস্তি দিলে ওর পাপের শাস্তিটা পূর্ণ হবে আমার জানা নেই। তটিনী আমার ভালো ফ্রেন্ড ছিলো। শুধু তটিনী না আশরাফ মালিথার ওয়াইফ ও আমার ভালো ফ্রেন্ড ছিলো। তুমি জানো বেস্টফ্রেন্ড এর মর্ম। তুমি তো এই যুগের মেয়ে।”

“ওনাকে ছেড়ে দিন তাহলে?”

“হুম দিবো ছেড়ে। সময় হয়ত হয়েছে। আশা করি ও আর এই পরিবারে ঢুকতে চাইবে না।”

“ওনার নাম কী?”

” জাহানারা।”

“ওনাকে কবে ছেড়ে দিবেন?”

“তুমি বলো?”

“আগামী কালকে?”

“আচ্ছা।”

সেরিন জান্নাতুল ফেরদৌসকে আগলে ধরেন। জান্নাতুল ফেরদৌসে সেরিনের কপালে চুমু খেয়ে বলেন, “তোমার কাছে এই পরিবার নিয়ে বা শুভ্র নিয়ে প্রথমে যা বলেছি তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

“ইট’স ওকে মা।”

“শুভ্রকে বলিও আমায় যাতে মা বলে ডাকে। আর বলিও কঠোর ভাবটা কমাতে।”

“বলবো।”

“আচ্ছা যাও শুভ্র অপেক্ষা করছে।”

“ঠিক আছে মা।”

কথাটা বলে সেরিন উঠে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কয়েক কদম ফেলতে শুভ্রকে দেখে। সেরিনের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। জান্নাতুল ফেরদৌস সেরিনের পেছন দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুভ্রকে দেখে। দু’জনেই ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সেরিন আমতা আমতা করে বলে, “নিচে আসার কী হলো? আমি তো যাচ্ছিলামই।”

সেরিনের কথায় শুভ্র জান্নাতুল ফেরদৌসের থেকে দৃষ্টি সরায়। সেরিনের কথায় পাত্তা না দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের কোণে তার ওানি চিকচিক করছে। জান্নাতুল ফেরদৌস শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেরিন পরিস্থিতি বুঝে শুভ্র সামনে এসে শুধায়, “প্লিজ মাকে ভুল বুঝবেন না। মা পরিবারের খারাপ চায় না। আপনি মাকে আমার মতো করে মা ডাকুন না?”

শুভ্র কথা গুলো শ্রবণ করে বলে, “মা!”

জান্নাতুল ফেরদৌসের মনটা জুড়িয়ে যায়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। শুভ্রকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায় জান্নাতুল ফেরদৌস। সেরিন তাঁদের দেখে খুশি হয়ে যায়। তখন আবার আর্থ,শশী কিছু নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে,করতে নিচে আসে। ওঁদের তিনজনকে দেখে শশী বলে,
“আরে তোমরা এখনো ঘুমাওনি?”

“এই বনু তোমরা কোথায় যাচ্ছো?”

সেরিনের কথায় শশী বলে,
“ওই যে দেওয়ালের ওপাশের রহস্য উদঘাটন করতে।”

“ওইটা জেনে গেছি।”

সেরিনের কথায় শশী চোখ মুখ ঢলা দিয়ে সামনে আসে। সেরিনকে বলে, “এবার আমায় বল বনু?”

সেরিন তখন জান্নাতুল ফেরদৌসের বলা কথাগুলো বলে। এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় আগামী কালকে জাহানরাকে বের করে দিবে। শুভ্র সেরিনের সাথে উপরে যায়। শশী,আর্থ তারা একটু বাইরে যাবে। এই আর্থর শশীকে নিয়ে রাতের আকাশের শশী দেখতে যাবে তারা।

শুভ্র সহ সেরিন রুমে আসতে, শুভ্র সোফায় বসে পড়ে। সেরিন দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে সোজা শুভ্রর কোলে বসে,শুভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে, “এবার প্লিজ নরম মনের হয়ে যাও মাই ডিয়ার হ্যান্ডাসাম শুভ্র স্যার ওরফে বাবুর পাপা।”

“বাবুর আম্মু যখন বলেছে হওয়া যায়ই।”

“আচ্ছা চলো আমরা বাবুর পাপা এবং বাবুর মাম্মাম হওয়ার মতো রোমান্টিক কাজটা করি।”

“এই তোমার মাথায় কী এই বাবুর আম্মু হওয়া ছাড়া কোন কথা নেই?”

“এই শুনুন তো! আপনি আমার স্বামী। মানে একটা হালাল সম্পর্কে আছি আমরা। আর স্ত্রী হয়ে আমি আমার অধিকার টা আদায় করে নিচ্ছি। আপনি বলুন আপনার উপর আমার হক নেই?”

“সে তো আছে।”

“তাহলে এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেনো?”

“আচ্ছা আর তাড়াবো না। এখন আসো আদর করি।”
কথাটা বলে সেরিনের কোমড় জড়িয়ে ধরে শুভ্র। প্রিয় পুরুষের ছোঁয়া নিজের সর্বাঙ্গে মাখছে সেরিন।

*******

আর্থ শশী গাড়ী এক সাইডে থামিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। শশী ভাবছে সেদিনের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। পরের দিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরে তখন জানতে পারে আর্থ সবার কী পরিমান বকা শুনেছিলো। সেই সাথে দুইদিন পর তাঁদের খাট চেঞ্জ করা সে আরেক ঘটনা। শুভ্র এখনো আর্থকে চেতায় খাট ভা’ঙা নিয়ে। কিন্তু কে জানতো খাটটা এভাবে ভে’ঙে যাবে? আর্থ শশীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“শোনো আমার ব্যক্তিগত চাঁদ আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।”

“তাহলে শুনুন আমার ব্যক্তিগত সূর্য। আপনাকে প্রথমে সেরিন আমি সেজে ইমপ্রেস করেছে।”

“এই তুমি কী বলছো?”

“ঠিকই বলেছি। ওই যে কলেজে গেলেন চিনতে পারিনি কারণ জানিনা তো আপনি প্রেম করছেন আমার সাথে। মানে সেরিনের সাথে।”

“আসতাগফিরুল্লাহ আমি বড় ভাবীর সাথে প্রেম করেছি?”

“আরে ওটা তো আমিই ছিলাম। আমি আর সেরিন কী? দু’টি দেহ একটা আত্মা। আমরা টুইনের মতো।”

“সে নাহয় বুঝলাম।”

“এবার বলুন আ-মৃ’ত্যু অব্দি আমায় ভালোবাসবেন?”

“বাসবো,বাসবো,বাসবো।”

“ভালোবাসি।”

“আমিও ভালোবাসি।”

“এবং আমরা ভালেবাসি।”

শশীর কথায় আর্থ হাসে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে তারা দু’জন বাড়ী ফিরে আসে।

*********

পরের দিন ওই রুমটায় যায় সবাই। সবাই বলতে মূলত শুভ্র,সেরিন,জান্নাতুল ফেরদৌস। জাহানারার অবস্থা অনেকটা কংকালের মতো। জান্নাতুল ফেরদৌসকে দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“বোন আমায় মুক্তি দে। আমি অনুতপ্ত। শুভ্র আমায় ক্ষমা করো। আমায় বের করো। কতো গুলো বছর হলো দুনিয়ার আলো দেখিনি।”

তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“আজকে তোর মুক্তির দিন। আশা করি বাকীটা জীবন সুন্দর ভাবে কাটাবি।”

“কাটাবো।”

তখন শুভ্র জাহানারার হাতের বাঁধন খুলে দেয়। সেরিন,জান্নাতুল ফেরদৌস তাকে ধরে বাইরে আনে
শুভ্র গাড়ী আনতে তাকে গাড়ীতে বসিয়ে রওনা হয় জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়ীতে। তারা দুই বোন ছিলো। কোন ভাই নেই। বাবা-মা অনেক আগে মা’রা যায়। বাড়ীতে পুরান হলেও দেখা শোনা করার মতো মানুষ আছে। প্রথমে জাহানারাকে ডক্টর দেখানো হয়। মেডিসিন, জামাকাপড় কিনে তাকে বাড়ীতে পাঠানো হয়। জাহানারার টেক কেয়ার করার জন্য দু’জনকে রাখেন জান্নাতুল ফেরদৌসে।

সেরিনকে নিয়ে শুভ্র চলে আসে। এরই মাঝে সেরিনের একটা কনসার্টের ডেট ফাইনাল হয়। সেইফ ফুড কার্নিভাল,বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার, আগারগাঁও ঢাকা। ( লোকেশন কালেক্টেড)
আগামী কালকের মধ্যে সেরিন ঢাকা চলে যাবে। শুভ্র তাকে নিয়ে একটু শপিং মলের দিকে যায়। দু’জন মিলে কিছু কেনাকাটা করে। দুপুরের লান্স টা তারা বাইরেই করে নেয়। বাড়ীতে ফিরতে,ফিরতে প্রায় তিনটা বেজে যায়।

শুভ্র সেরিনকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার চেষ্টা করে। এই তো তাঁদের সবার দিন গুলো ভালোই কাটছে। স্বাভাবিক আর দশটা মানুষের জীবনের মতোই।

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৩৯

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৯|
#শার্লিন_হাসান

আজকে আর্থ,শশীর বিয়ের রিসিপশন অনুষ্ঠান। চৌধুরী বাড়ীতে ব্যস্ততা। আর্থ শশীকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। তাঁদের ভা’ঙা খাটের দিকে একবার চোখ ভোলায়। বুঝতে পারছে না এটা ভাঙতে গেলো কেন? মনে হয় অনেকদিন হয়ে গেছে তাই। শুভ্রর কথা মতো খাটটা চেঞ্জ করা উচিত ছিলো। ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে আর্থ। দু’জনে ফ্রেয় হয়ে নিচে যেতে দেখে, বাকী কাজ কর্ম ঠিকই হচ্ছে শুধু চৌধুরী পরিবারের সবাই ঘুমোচ্ছে। দু’জনে নাস্তা করে রুমে চলে যায়।

সকাল দশটার দিকে সবাই নাস্তা করতে বসে। নাস্তা শেষ হতে শশী,সেরিন,আদ্রিতা,অধরা তারা রেডি হতে চলে যায়। আয়মান চৌধুরী, শুভ্র তারা বাকী সব দেখছে। তাঁদের ইনভাইট দেওয়া গেস্ট রা আজকে আসবে। বাড়ীর ভেতরের বিশাল লিভিং রুমেই সব ঠিক করা হয়।

সেরিন আজকে শাড়ী পড়েছে। শশী গাউন পরিধান করেছে সাথে মেক-আপ। মেয়েটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গেস্ট আসা শুরু করে। আর্থ,শশী স্টেজে বসে। শুভ্র সবার সাথে কথা বলছে। তার কিছু গেস্ট আছে। আবার তার বাবার কিছু গেস্ট আছে। সব মিলিয়ে শুভ্র একটু ব্যস্ত । বাকীরা সবাই নিচে আসলেও সেরিন এখন অব্দি আসেনি। ফ্যামিলি ফটো তুলবে অথচ সেরিন মিস্টেক। সবাই এক প্রকার তাড়া দেয় সেরিন কেনো আসেনি। শুভ্র মূহুর্তে মেজাজ হারায়। সেই তো গতকাল বড় মুখ করে বললো রেডি হতে বেশী সময় লাগবে না। শুভ্র একটু সাইডে এসে উপরে চলে যায়। রুমে প্রবেশ করতে দেখে সেরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে কিছু কুড়াচ্ছে। শুভ্র ভেতরে প্রবেশ করে রাগ দেখিয়ে, চেঁচিয়ে ধমকে বলে,
“টাইম মেইনটেইন করা শিখোনি তুমি? এই তুমি এতো লেজি কেনো? তুমি এই বাড়ীর বড় বউ একটু দায়িত্ব জ্ঞান থাকা উচিত তোমার।”

ধমক শুনে সেরিন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শুভ্রর ধমকটা তার পছন্দ হয়নি। মুখ দিয়ে কিছু বলার আগে চোখে জেনো পানি টলমল করছে তার। তখন শুভ্র পুনরায় ধমকে বলে,
“আবারো দাঁড়িয়ে আছো? আমার কথা তোমার কানে যায়নি মেয়ে?”

“আসছি। আপনি আগে যান?”

“কেনো? তুমি আবার লেট করতে? আমার সাথে আসবা তুমি।”

“পেছন দিয়ে আসছি।”

“এই তুমি কী লুকাচ্ছো?”

কথাটা বলে শুভ্র সেরিনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এক হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে আরেক হাত পেছনে সেরিনের হাত নিজের মুঠোয় নেয়। সেরিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্র সেরিনের হাত সামনে আনতে দেখে হাতে কাঁচের বোতলের টুকরো। শুভ্র তখন জিজ্ঞেস করে,
“এটা কিসের বোতল?”

“ওই পারফিউমের বোতল।”

“তো এটা নিয়ে এতো লুকোচুরির কী আছে? এটা ভে’ঙে গেছে ফেলে দাও। হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না।”

“আপনার পছন্দের এটা।”

“তো?”

“যদি বকা দেন?”

“সেরিন এই পারফিউম শপিংমলে হাজারটা আছে। তুমি এই সামান্য বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছো?”

“আপনার যেই ধমক ভয় না পেয়ে উপায় আছে?”

সেরিনের কথা শুভ্র মাথা চুলকে বলে,
“আসলেই বেশী ধমক দেই?”

“তা নয়ত কী!”

“আচ্ছা আর দিবো না। এবার আসো।”

সেরিন মাথা নাড়িয়ে কাচের টুকরো গুলো ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে শুভ্রর সামনে দাঁড়ায়। শুভ্রর দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“আমায় কেমন লাগছে?”

“পরীর মতো।”

“তাহলে আসুন আমার জ্বীন। আপনাকে একটা চুমু খাই।”

“পরে। এখন লেট হয়ে যাবে।”

“আপনি এতো আনরোমান্টিক কেনো?”

“আমি এমনই।”

“আমার আর বাবুর আম্মু হওয়া লাগবে না।”

“ওটা সময় হলে দেখা যাবে।”

সেরিন শুভ্রর বরাবর দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে শুভ্রর গলা জড়িয়ে ধরে। চুপচাপ শুভ্রর অধরে নিজের অধর ছোঁয়ায়। কপালে চুমু দিয়ে বলে,
“এটা হলো বউয়ের দেওয়া নজর টিকা। দেখবেন দেখতে বিবাহিত,বিবাহিতদের মতো লাগবে তখন কেউ নজর দিবে না।”

“কেউ জানবে না এই কপালে কেউ চুমু দিয়েছে।”

“আচ্ছা চুলন।”

শুভ্র সেরিন বেড়িয়ে আসতে অধরার সাথে দেখা। তাকেও পাঠানো হয়েছে শুভ,সেরিনকে ডেকে নেওয়ার জন্য। তারা তিনজন এক সাথে যায় নিচে। সেরিনের সাথে শুভ্র সবার পরিচয় করিয়ে দেয়। সবাই মিলে সুন্দর একটা সময় কাটায়। শশী,আর্থ তারা সবাই পাটওয়ারী বাড়ীতে যাবে। সেরিনের কেনো জেনো যেতে ইচ্ছে করছে না। শুভ্র যাবে না মূলত সেইজন্য। মুখ ফুটে বলতে পারছে না। নাহলে সবাই ভাববে জামাই পাগ’ল মেয়ে। সেরিনের বিরক্ত লাগছে। এই বিরক্তি নিয়েই গাড়ীতে উঠে সে। মাহী ড্রাইভ করছে পাশে সেরিন বসা। মনে,মনে সবাইকে বকা দিচ্ছে সেরিন।

“আমার আর বাবুর আম্মু হওয়া লাগবে না। যে যেভাবে পারছে আমায় জামাইয়ের থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এক ঢাকা শহর আরেক পাটওয়ারী বাড়ী। এই শুভ্র টা ও না। বউয়ের জন্য একটু ও টান নেই। আমার মতো রোমান্টিক মেয়ের জামাই হওয়া চাই আরো চারগুণ রোমান্টিক। তা না! কী এক করলার জুশ।”

সেরিনের ভাবনার মাঝেই পাটওয়ারী বাড়ীতে এসে গাড়ী থামে।
সন্ধ্যাটা আড্ডা মাস্তিতে কেটে যায়। তবে সেরিন শুভ্রকে ভীষণ মিস করছে।
পাটওয়ারী বাড়ীতে পুনরায় শশীর রুম সাজানো হয়। সেরিন আসেনি সাজাতে। সে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিয়েছে। কেউ আর জাগায়নি তাকে।

আর্থ ও তার শালিকাদের সাথে ঝগড়াঝাটি, আড্ডা মাস্তি দিয়ে সময় কাটিয়ে দেয়।

*********

এরই মাঝে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। বিয়ের আমেজ শেষ হয়ে ব্যস্ততার আমেজ শুরু। সেরিনের ও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। যদিও শশীও এখন আছে চৌধুরী বাড়ীতে। দুই বোনের একটা ভালো সময় কাটে। সন্ধ্যায় শুভ্রর রুলস অনুযায়ী খাটের উপর পড়তে বসে সেরিন। তখন কোথা থেকে শুভ্র আসে। চুপচাপ সেরিনের পায়ের উপর মাথায় রাখে শুভ্র। সেরিন একনজর শুভ্রর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শুভ্র সেরিনের সামনে আসা চুলে হাত ভোলায়। পুনরায় শুধায়,
“কয়েকদিন পর তুমি ঢাকায় ব্যাক করবা।”

“আম্মুউউউ!”

“আস্তে!চেঁচাচ্ছে কেনো?”

“আমি ঢাকায় যাবো না।”

“এই তুমি আমার কথা শোনবা নাকী মা-ইর দিবো?”

“আমি গেলে অন্য মেয়েরা কলেজে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। স্যার,স্যার বলে হোমওয়ার্ক দেখাবে?”

“এই তুমি খোটা দিচ্ছো?”

“তা নয়ত কী? দেখুন আপনি ওদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। আপনার কত সুন্দর একটা বউ আছে।”

“আসলে কী জানো সেরিন? আমি তোমায় বিয়ে করার পর থেকে একটু নরম হয়ে গেছি। আগের মতো তেমন রাগ দেখাই না কারোর সাথে। এই মানুষ সুযোগ ও পেয়েছে তাই এমন।”

“এখনি ঠিক আছেন। ওতো রাগী হতে হবে না। শুধু মেয়েদের এভয়েড করবেন।”

“ধুর পা’গল। তোমার আমাকে কী মনে হয়? তুমি থাকতে আমি কেনো অন্য মেয়ের দিকে তাকাবো?”

“মনে থাকে যেনো।”

“থাকবে।”

**********

শশীর বেলকনি শুভ্রদের বেলনির সোজা পূর্ব সাইডে। রাতের ডিনার করে ফ্রেশ হয়ে সবে রুমে এসেছে শশী। আর্থ এখনো আসেনি তার চাচ্চুর কাছে কী দরকারে গিয়েছে। শশী বেলকনিতে আসতে ভয় পেয়ে যায়। বাইরে অন্ধকার। অথচ সন্ধ্যা থেকেই আলো জ্বলেছে। তারউপর কেউ একজন হাল্কা মৃদু আলোতে পূর্ব সাইডে যাচ্ছে। যেটা দেখে ভয়ে রীতিমতো শশী জ্ঞান হারানোর উপক্রম। তড়িঘড়ি বেলকনির দরজা লাগিয়ে দিয়ে রুমে আসে। তার পেছন দিয়ে আর্থ নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে, “শশী!” বলে ডাক দিতে বেচারি সেখানে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। আর্থ শশীকে ধরে বলে,
” হায় তুমি মা হতে চলেছো? কিন্তু আমি তো এখনো কিছুই করিনি।”

আর্থর কথাটা কানে বাজলেও চোখ মেলে তাকতে পারেনি শশী। বার কয়েক ডাক দিয়ে শশীকে খাটের উপর শুইয়ে বাইরে যায় আর্থ। সবাইকে ডেকে ডুকে তার রুমে নিয়ে আসে। সবাই বেশ চিন্তিত। আয়মান চৌধুরী ডক্টরকে কল দিতে বিশ মিনিটের মধ্যে ডক্টর হাজির। শশীর প্রেসার চেক করে। আর্থ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে শুভ্র তাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। তাতে জেনো আর্থর গা জ্বলে যাচ্ছে। শুভ্রকে আলতো করে কি’ল মেরে বলে,
“বিশ্বাস কর ভাই আমি কিছু করিনি। কিন্তু ও যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়?”

“না করলে বুঝি খাট ভেঙেছে? আর এটাতো খুশির খবর আমিও বাবা হবো। আইমিন তোর বাবুর বড় বাবা।”

“রাখ তোর বাবা। খাট ভাঙলেই যে বাসর করা হয়ে যায় বিষয়টা এমন না। খাটটা আগে থেকে ভাঙা ছিলো। দু’জন বসায় আরো তাড়াতাড়ি ভে’ঙে গেছে। আর আর আমি ওকে কিছুই করিনি যে ওর বাবু হবে।”

“তাহলে বাবুটা অন্যের তুই সেটা বলতে চাচ্ছিস?”

“আরে ভাই বাসরই করলাম না বাবু আসবে কোথা থেকে?”

“শ্লা তাহলে তোর খাট আমি এসে ভেঙে দিয়ে গেছি?”

“আরে ভাই ওটা তোর বদ দোয়া লেগেছে।”

ওদের কথার মাঝে ডক্টর বলে,
“কেন কিছু নিয়ে ভয় পেয়েছে। চিন্তার কারণ নেই জ্ঞান ফিরে যাবে।”

তখন আর্থ জোরেই বলে, “আল্লাহ বাচাইছে।”

আর্থর কথায় সবার দৃষ্টি আর্থর দিকে। বেচারা মুখ ফসকে কথাটা বলে আশে পাশে তাকাতে হুশ আসে। তখন আমতা,আমতা করে বলে, “আসলে আমি ভেবেছিলাম শুভ্র ভাই যেভাবে ভাবীকে ধমক দিয়ে অজ্ঞান করেছে নাকী আমার ধমকে শশী অজ্ঞান হয়ে গেছে। নাহলে তো আবার সবাই আমায় বকা দিতো।”

তখন সুলতানা খানম বলেন,
“তার মানে তুমি ওকে ধমক দিয়েছো আর ও ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে?”

তখন আরফিন চৌধুরী ধমকে বলেন,
“কী ছেলে তোমরা? এতো ধমকা ধমকি কিসের? এই তোমরা তো মেয়ে দুটোকে দুই দিনে হার্ট অ্যাটাকের রোগী বানিয়ে দিবে। এগুলো কোন ধরনের ধমকাধমকি যে মানুষ অজ্ঞান করে দাও।”

“আরে বাবা ওটা শুভ্র ভাই দেয়। আমি কোন ধমক দেইনি।…..

“শুধু বলেছিলো শশী কাছে আসো।”

আর্থর কথার মাঝে পোড়ন কেটে কথাটা বলে শুভ্র রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ওদের দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে বাকীরাও কিছু বলেনা। যে যেভাবে পেরেছে কেটে পরেছে। আর্থ মনে,মনে শুভ্রকে বকা দিচ্ছে। সব চেৈ বেশী বকা দিচ্ছে শশীকে। কী এমন দেখেছে যে অজ্ঞান হয়েছে? আর এই অজ্ঞান হওয়াকে ঘিরে কত গল্প রটে গেলো।

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৩৭+৩৮

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৭|
#শার্লিন_হাসান

সন্ধ্যায় শুভ্র পাটওয়ারী বাড়ীতে যায়। শশীকে দিয়ে সেরিনের রুমে জিনিসগুলো পাঠিয়ে দেয়। সেরিন তাকে দেখেও না দেখার ভান করেছে তাও সবার সামনে। শুভ্র সেসবে কিছু বলেনি। শুধু জানিয়েছে আগামী কালকে সকালে চৌধুরী বাড়ীর বউ চৌধুরী বাড়ীতে চলে যাবে। সেরিন শুনেছে কথাটা তবে কিছুই বলেনি সে। শুভ্র বাকীদের সাথে গল্প করে। একবারে রাতের ডিনার করেই সে রুমে যায়। সেরিন কিচেনে কফি বানাচ্ছে।
শুভ্র রুমে এসে খাটে আধশোয়া হয়ে ফোন স্ক্রোল করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেরিন আসে কফির মগ হাতে। শুভ্রর কফির মগটা চুপচাপ তাকে দিয়ে দেয়। মগ হাতে সেরিনের দিকে তাকায় শুভ্র। কন্ঠ স্বর খাদে নামিয়ে বলে,
“মুখটা ওমন করে রেখেছ কেনো?”

“এমনিতে!”

“কিছু এনেছিলাম আমি। তুমি সেগুলো দেখোনি।”

“ইচ্ছে করছে না।”

“দেখো সেরিন মানুষ মাত্রই ভুল। কেউই ভুলের উর্ধ্বে না।”

“শুনেছি।”

“আচ্ছা স্যরি।”

“ইট’স ওকে!”

“এরপর তোমার মুখটা ওমন গোমড়া দেখলে খবর আছে।”

সেরিন মাথা নাড়ায়। শুভ্র তখন শুধায়,
“যাও গিফ্ট গুলো খুলে দেখো।”

সেরিন গিফ্ট গুলো খাটের উপর আনে। শুভ্রর সামনেই খুলে দেখে। আর কিছু বলেনি সেরিন। শুভ্র সহ কেক কাটে তারা। ব্রেসলেট টা শুভ্র সেরিনের হাতে পড়িয়ে দেয়। বাকীগুলো রেখে দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে সেরিন। শুভ্রর বুকে মাথা লুকিয়ে নেয়। শুভ্র সেরিনের কপালে চুমু একে বলে,
“দেখো রাগ টা একটু কমাও!”

“সবই বুঝলাম। এতো কিছু করলেন তো একবার “ভালোবাসী বউ” বলে দিলেই তো হতো। ওটায় আমি গলে যাই।”

“ওতো গলার দরকার নেই।”

“ঠিক আছে।”

*********

পরের দিন দুপুরের শেষ বিকেলের দিকেই চৌধুরী পরিবারের সবাই কুমিল্লায় যায়। সেরিন শুভ্রর সাথে সেদিন সকালেই চলে আসে চৌধুরী বাড়ীতে। পরিবারের বড়রা মাইক্রো দিয়ে। সেরিন,শুভ্র,আর্থ,আদ্রিতা,অধরা, তারা এক গাড়ীতে করে যাচ্ছে। পুরো বিকেল আর সন্ধ্যায় তারা শপিং করেই কাটিয়ে দেয়। দশটার দিকে রেস্টুরেন্টে ঢুকে ডিনার করে আবার দাউদকান্দির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। সেরিন মেঘনা ব্রিজের উপর আসতে বাইরের দিকে মুখ নিয়ে ঠান্ডা হিমশীতল বাতাস উপভোগ করে। এই নদীর ঠান্ডা বাতাসটা সেরিনের অনেক পছন্দের।

বাড়ীতে এসে যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে। পরের দিন সকালে বাড়ী ডেকোরেশনের কাজ শুরু হয়ে যায়। সেরিন,আদ্রিতা,অধরা তারা সবাই ঢালা সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সুলতানা খানম সহ তারা ঢালা রেডি করে নেয়। সন্ধ্যারর দিকে পাটওয়ারী বাড়ীতে যাবে ঢালা দিতে। সময়টা ব্যস্ততার মাঝেই কাটছে সবার। বিকেলে পাটওয়ারী বাড়ী থেকে ঢালা আসবে। জোর দমে রান্নাবান্না চলছে। এছাড়া চৌধুরী বাড়ীর অন্যান্য পরিবার ও আসা যাওয়া হচ্ছে এমপির বাড়ীতে। যেহেতু রাস্তা থেকে পুরো বাড়ীটাই ডেকোরেশন করা হয়েছে।

শুভ্র কলেজে এসেছে। লাস্ট পিরিয়ডের সময় ল্যাব ক্লাস ছিলো ফাস্ট ইয়ারের। কয়েকদিন পর ইয়ার চেন্জ ফাইনাল এক্সাম। তখন আবার নিশাত বিনা অনুমতিতে শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র ল্যাপটপে ব্যস্ত থাকায় নজর রাখেনি সেদিকে। নিশাত শুভ্রর সামনের চেয়ার টেনে বসতে শুভ্র সেদিকে দৃষ্টি স্থির করে। মেজাজ দেখিয়ে বলে,
“অনুমতি দিয়েছি আমি? আমার রুমে এসেছো অনুমতি ছাড়া আবার বসেছো। প্রব্লেম কী তোমার?”

“আরে শুভ্র স্যার! আমার বান্ধবী আপনার বউ না হলে আমিই হতাম। সে যাই হোক শালির অধিকার নিয়ে এসেছি। এমনিতে বউ হলেও খারাপ হয়না।”

কথাটা শেষ হতে নিশাত চেয়ার ছেড়ে দাড়াতে শুভ্র ও পুনরায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠাস করে দু’টো চ’ড় বসিয়ে দেয় নিশাতের গালে। রেগে বলে,
“এরপর আমার রুমের আশেপাশে আসলে তোর পা আমি ভে’ঙে দেবো।”

নিশাত গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মূহুর্তে তার মাথা ঘুরছে, পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে। শুভ্রর দিকে একনজর তাকিয়ে কোনরকম বেড়িয়ে আসে সে। সামনের সবই ঘুরছে তার সামনে। মনে,মনে স্থির করে নিয়েছে আর আসবে বা শুভ্রর আসেপাশে। এই চড় জীবনে যে একবার না খেয়েছে তাহলে তার সাত কপালের ভাগ্য। আজীবন মনে রাখার মতো চ’ড়।
“না এর বউ সেরিনই ঠিক আছে। আমি শালি হিসাবেই ঠিক আছি। দেখতে যতটা সুন্দর ব্যবহার আর মা-ইর তার চেয়ে জঘন্য। সেরিন এটা তোর জন্যই ফিক্সড করা বইন। আর ভুলেও তাকাবো না।”

নিশাত কোনরকম গাড়ীতে উঠে নিজের বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়।
নিশাত যেতে শুভ্র বেড়িয়ে আসে রুম থেকে। তার কাজ আছে সেজন্য বাড়ী চলে এসেছে।
এসে রুমে প্রবেশ করে হাত ঘড়িটা খোলে সোফায় বসে পড়ে। সেরিন সবে শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছে। শুভ্রকে দেখে সোজা নিচে আসে। কোল্ড ড্রিং নিয়ে পুনরায় রুমে যায়। শুভ্র চোখ বন্ধ করে আছে। সেরিন তার সামনে কোল্ড ড্রিং ধরে বলে,
“এটা খেয়ে নিন।”

সেরিনের থেকে কোল্ড ড্রিং নিয়ে শুভ্র মাথা নাড়ায়। সেরিন আজকে শাড়ী পড়েছে। দেখতে অনেকটা বউ,বউ লাগছে। শুভ্র ড্রিং টা শেষ করে শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। সেরিন রেডি হয়ে শুভ্রর জন্য ওয়েট করে। শুভ্র এসে রেডি হতে সেরিন বলে,

“আপনি আমায় জন্য একটা শাড়ী ও আনলেন না। আর্থ ভাইয়ার বিয়ে আপনি তো পারলে আমায় শপিং করিয়ে দিতে পারতেন।”

“সময় নেই। পরে করে দেবো।”

“এই আপনার কিসের এতো ব্যস্ততা? বউয়ের থেকে কী ব্যস্ততা বেশী?”

“দুটোই ইমফরটেন্ট। দেখো কাজ না করলে তোমার শখ পূরণ করবো কীভাবে?”

“ঠিক আছে। আমিও যখন কোন জব পাবো,ইনকাম করবো তখন আমি আপনার মতো কিপ্টামি করবো না। আমি আমার বরের জন্য শপিং করবো আমার টাকা দিয়ে।”

“এই তুমি খোঁটা দিচ্ছো? আচ্ছা আমি কুমিল্লায় গেলে আনবো শাড়ী। বাট আমার এসবে আইডিয়া নেই।”

“আপনার পছন্দে একটা আনলেই হবে। সেখুন আপনি আমায় পছন্দ করেছেন তাহলে পছন্দ খারাপ হবে না আশা করি।”

সেরিনের কথায় শুভ্র হাসে। সেরিন নিজেও হেঁসে দেয়। সেরিন উঠে আয়নার সামনে গিয়ে বলে,
“আজকে আমি শাড়ী পড়েছি। আপনি দেখেছেন?”

“হ্যাঁ দেখলাম তো।”

“বলুন তো কেমন লাগছে?”

“শুভ্রর মেয়েফুল!”

“না! শুভ্রর বউ ফুল সেরিন।”

“আচ্ছা শুভ্রর বউফুল সেরিন।”

*******

বিকেলের দিকে সাফা,রাফা,মেহের,সিদরাত, মাহী সহ তারা আসে। সেরিনের খালামনি ঢাকা থেকে এসেছে। সিদরাতকে দেখে সেরিন, শুভ্র বেশ খুশি হয়। হাল্কা নাস্তা করে ঢালা গুলো দিয়ে তারা বেড়িয়ে পড়ে। সবাই ব্রিক রেড কালারের শাড়ী পড়েছে। সবাইকেই সুন্দর লাগছে। ঢালা দেওয়ার সময় রাস্তায় পিকচার ভিডিও নিয়ে নেয় তারা। সবাই মিলে সুন্দর একটা মূহুর্তে পার করে।

সেরিন ব্লাস পিংক কালারের শাড়ী পড়েছে। অধরা,আদ্রিতা তারা পার্পল কালারের শাড়ী পড়েছে। সন্ধ্যায় নাস্তা করে গাড়ী রেডি হতে তারা তিনজন রওনা হয়। তাঁদের গাড়ীতে কিছু ঢালা বাকী গুলো পেছনের গাড়ীতে করে আসছে। পাটওয়ারী বাড়ীর গেট থেকে শুরু করে গার্ডেনের রাস্তা, পুরো বাড়ী লাইটিং করা হয়েছে। যেহেতু তারা সন্ধ্যা পেড়িয়ে গিয়েছে ভিউটা সুন্দর এসেছে। একে,একে সব গুলো ঢালা ভেতরে নেওয়া হয়। রাস্তার সাইডেই তাঁদের গাড়ী দাঁড় করানো। সেরিন,আদ্রিতা,অধরা তারা ভেতরে যায়। সাফা,রাফা,মেহের আফসোস করছে এবার আর সেরিন সহ মেহেন্দী পড়া হবে না। কত মজা হতো! এখন তো সেরিন তার ননদিনীদের সাথেই মেহেন্দী পড়বে। অনেকটা সময় তারা শশী,সাফা,রাফা,মেহেরের সাথে কথাবার্তা,আড্ডা দেয়। শুভ্র সেরিনকে কল দিয়ে জ্বালাচ্ছে। আজকে কী পাটওয়ারী বাড়ীতেই তারা থেকে যাবে নাকী? সেরিন বলেছে ডিনার করে তারা রওনা হবে। শুভ্র আর কিছু বলেনি। প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে তারা ডিনার করে কফি নেয়। বিদায় জানিয়ে তড়িঘড়ি রওনা হয়ে নেয়। যদিও ওতো দূরে না। ত্রিশ মিনিট সময় এনাফ। যেহেতু ড্রাইভার নিয়ে এসেছে ওতো প্যারা নেই তাঁদের।

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৮|
#শার্লিন_হাসান

(বিয়ে স্পেশাল ২💞)

দেখতে,দেখতে আর্থর হলুদের দিন চলেই আসে। খুবই ঝাঁক ঝমক ভাবেই হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। দিনটি মঙ্গলবার। আজকে আর্থর বিয়ে। শশী অফিশিয়াল ভাবে তার ওয়াইফ হবে। চৌধুরী বাড়ীতে ভীষণ ব্যস্ততা। সেরিন ও নিজের জামাকাপড় দেখছে কী পরবো বিয়েতে। শুভ্র তার জন্য শাড়ী আনেনি এই নিয়ে একটা অভিমান জমেছে সেরিনের। ভাইয়ের বিয়ের ব্যস্ততার ভীড়ে ভুলেই গিয়েছে সে। যদিও এরপর অনেকবার কুমিল্লায় আসা যাওয়া হয়েছে। মনে করে আর কিছুই চুজ করে আনেনি সেরিনের জন্য।

অধরা,আদ্রিতা তারা এগারেটা বাজে সাজতে বসেছে। সেরিন তখনো সাজতে যায়নি। সে নিচে সবার সাথে কথা বলছে। তখন মিরা ইসলাম সেরিনকে তাড়া দেখিয়ে বলেন,
“আদ্রিতা অধরার সাথেই সাজতে বসে যেতে। আবার যদি লেট হয়ে যায়?”

“মেঝো আম্মু আমার ওতো লেট হয়না।”

সেরিনের কথায় শুভ্র তার দিকে তাকায়। মুখ বাকিয়ে বলে,
“আসলেই লেট হয়না। যাওয়ার সময় আধ সাজে দৌড় মারে উনি। তখন গাড়ীতে বসে আফসোস করে। আম্মু ঠিকই বলেছে যাও তোমাদের তো আবার সময় লাগে বেশী।”

শুভ্রর কথায় আয়মান চৌধুরী সুর মিলিয়ে সুলতানা খানমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“তুমিও তো সেরিনের দলের লোক। লেট হয়না,হয়না বলে চারঘন্টা লেট করাও। তারপর দেখা যায় আধ সাজে গাড়ীতে দৌড়।”

সেরিন,সুলতানা খানম তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেরিনের শুভ্রর দিকে চোখ পড়তে শুভ্র যাওয়ার জন্য ইশারা করে। কিন্তু সেরিন তো অভিমান করে আছে। শুভ্রকে বুঝাতে অক্ষম সে। তাই চুপচাপ উপরে চলে যায়।
জান্নাতুল ফেরদৌস আবার অনেক আগেই সাজতে বসে গেছেন। উনি একটু সাজ গোছের পাগল। শুভ্রর মা তেহজিব ও সাজতো তবে সাধারণের মাঝে। এই সাধারণ সাজেই তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগতো। যার সৌন্দর্যতা আজো ভুলতে পারেনি আরফিন চৌধুরী শুভ। ওতো প্রসাধনী ব্যবহার না করলেও নব্বই দশকের নায়িকা হিসাবে তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগতো। জান্নাতুল ফেরদৌস কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহার করলেও তেহজিব তটিনীর আশেপাশে ও এখন অব্দি যাননি।

শাওয়ার নিয়ে হেয়ার ড্রয়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়েছে সেরিন। তখন আবার শুভ্রর আগমন ঘটে। সে শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে। সেরিন লেহেঙ্গাটা বের করে একনজর দেখে। অফ হোয়াইট কালারের ভেতর হাল্কা পিংক কালার লেহেঙ্গা। সাথে মেচিং গোলাপ ফুল যেগুলো শুভ্র এনে দিয়েছিলো। সেরিন লেহেঙ্গাটা পরিধান করে সাজতে বসে। প্রথমে চুলগুলো বেঁধে নেয়। কোমড় অব্দি গড়ানো চুলগুলো ছেড়ে তাতে গোলাপ গুঁজে দিয়েছে। সিথিতে মেচিং করা একটা টিকলি। ইয়ারে সেম টিকলির ইয়ার রিং। তেমন একটা সাজেনি সে। আজকে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হওয়া কমপ্লিট হয়ে গেছে সেরিনের। শুভ্র আজকে অফ হোয়াইটের মাঝে হাল্কা পিংক কালারের পাঞ্জাবি পরিধান করেছে। শুভ্রকে শুভ্র লাগছে বেশ। মনে হয় শুভ্র ফুলের মাঝে হাল্কা পিংক কালার।

সেরিন জোর করে শুভ্রকে দাঁড় করিয়ে মিররে পিক তুলে নেয়। শুভ্রকে বলে দিয়েছে আগে নিচে গিয়ে পিক তুলবে তারপর যা করার করবে।

আর্থ আজকে বর সেজেছে তার প্রিয়তমার জন্য। আজকের দিনটা তার জন্য অনেক আনন্দের। চৌধুরী বাড়ীর প্রিন্সেস রাও অফ হোয়াইট কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে। শুধু বউরা শাড়ী পড়েছে। শুভ্র,সেরিন থেকে শুরু করে প্রত্যেক কাপল পিক তুলেছে। তাঁদের বাড়ীর রাস্তাতেই তাঁদের অর্ধেক ফটোশুট করা শেষ হয়ে গেছে।

দেড়টার দিকে পাটওয়ারী বাড়ীতে আসে তারা সবাই। চৌধুরী পরিবারের সবাইকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। মেহের সেরিনকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। মেয়ে পক্ষ বানিয়ে দেয়। সেই সাথে গেটে টাকা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হয়। মূলত মজার ছলেই। জানে আর্থ ফিক্সড করা এমাউন্টই দিবে। তাঁদের মজা-খুনশুটির পর আর্থকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে স্টেজে নেওয়া হয়। সেরিন ভেতরে গিয়ে প্রথমে শশীর সাথে দেখা করে। মেয়েটাকে অফ হোয়াইট কালারের গাউনে সাজানো হচ্ছে। খাওয়া দাওয়া, ফটোশুট কিছুটা শেষ হতে আর্থকে ভেতরে নেওয়া হয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করা হয় বিয়ে পড়ানোর জন্য। ফ্লোরের উপর বিছানা করে তাতে ফুল দিয়ে পর্দা করা। তার দুই পাশে দু’জনকে বসানো হয়। শশী কান্না করছে দেখে কিরণ পাটওয়ারী টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আমার কলিজা কান্না করতে হবে না। এই তো আমরা আমরাই।”

তখন আর্থ ভরা মজলিসে মুখ ফসকে বলে,
“ওটা আপনার কলিজা না। আমার কলিজা।”

আর্থর কথায় বাকীরা হাসলেও শশী বেশ লজ্জা পায়।
কাজী এবং হুজুর সহ বিয়ে পড়ানো শেষ করে। বর-বউকে একসাথে স্টেজে নেওয়া হয়। তারা আয়না দেয় দু’জনের হাতে। তখন সেরিন আর্থকে বলে,
“ভাইয়া কী দেখো আয়নায়?”

তখন আর্থ শুধায়, ” উপরওয়ালা আকাশের সত্যিকারের শশীটা আমায় দিয়ে দিলো? এক টুকরো চাঁদ।”

তখন সাফা বলে,
“বনু তুমি কী দেখো?”

“সবচেয়ে ভালো মনের মানুষটা।”

এই তো তাঁদের খুনশুটি দুই পরিবারে আরেকটু সুন্দর সময় কাটানো। আর্শিয়া, অক্ষর এসেছে বিয়েতে। আর্শিয়া শুভ্রকে একদমই আশা করেনি। তারউপর শুনেছে অক্ষর ও নাকী সেরিনকে পছন্দ করতো। যদিও আফসোস নেই এসবে। তবে ব্যপার কেমন জেনো! আর্শি শুভ্রকে পছন্দ করলেও শুভ্র বিয়েটা সেরিনকে করেছে। আবার অক্ষর সেরিনকে পছন্দ করলেও বিয়েটা করেছে আর্শিকে। শুভ্র ও আর্শির সাথে হাসিমুখে কথাবার্তা বলে।

সন্ধ্যার দিকে রওনা হয় তারা। প্লান করেছে ফ্রেশ হয়ে তারা কুমিল্লায় যাবে রাতের শহরে। মেঘনা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করবে। চৌধুরী বাড়ীতে আসে, সাফা,রাফা, মেহের। মাহী ব্যস্ত কুমিল্লায় যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই সে আসবে।

ফ্রেশ হয়ে সবাই চা-কফি খেয়ে নেয়। শশী চেন্জ করে থ্রি-পিস পড়ে নেয়। লিভিং রুমে সবাই বসে কথা বলছে। আদ্রিতা,অধরা,সেরিন,সাফা,রাফা,মেহের তারা আর্থর রুম সাজায়। রাতের ডিনার করেই তারা বের হবে। আর্থ,শশী ছাড়া।

ডিনার করতে,করতে সারেএ গারোটা পেড়িয়ে যায়। বাকীরা তাড়াতাড়ি ডিনার করে আর্থর রুমের দরজা দখল করে নেয়। শশীকে আগেই নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। আর্থ আসতে তার শালিকা মহল এবল বোনদের দাবি শুনে। বেশী কথা বাড়ায়নি টাকাগুলো সেরিনের হাতে দিয়ে দেয়। তখন শুভ্র বলে,
“এতে তাড়া কিসের ভাই?”

“অনেক কিছুর।”

ওদের কথা শুনে বাকীরা হাসে। আর্থ ভেতরে প্রবেশ করে দরজাটা লক করে ভেতরে যায়। শশী বসে আছে এক কোণে। আর্থর টায়ার্ড লাগছে বিধায় ধপাস করে খাটের উপর শুয়ে পড়তে সেটা ভে’ঙে যায়। বাকজটায় আর্থ শশী কেউই প্রস্তত ছিলো না। শশী দেরী না করে আর্থর কানে ধরে একটা টান দিয়ে বলে,
“এই তোমায় কে বলেছে এভাবে ধপাস করে শুয়ে পড়তে? আর কী খাট রাখো?”

“আরে খাট তো ভেঙেছি কিন্তু কাজের কাজ তো কিছুই করতে পারলাম না।”

“কী বললে তুমি?”

“ওই আর কী বলেছি।”

আমতা আমতা করে বলে আর্থ। শশী রাগ দেখিয়ে বলে,
“এখন মুখ দেখাবো কীভাবে? ছিঃ! বড়রা কী ভাববে?”

“এহহ্! এতো লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমরা তো জানি আমরা এখনো কিছু করিনি বাকীরা বুঝলে বুঝুক আমরা বাসর করেছি। আর ওতো লজ্জা পাওয়ার কী আছ? বাসর না করলে বুঝি আমরা দুনিয়ায় আসতাম?”

“এই তোমার মুখে কিছু আটকায় না।”

“এই তুমি বেশী লজ্জা পাচ্ছো তাই আরকী।”

“মুখটা বন্ধ রাখবে তুমি?”

“আরে এটা শুভ্র ভাইয়ার বদ দোয়া। ওকে জ্বালানো এবং পচানোর কারণে বলেছিলো আমি নাকী খাট ভাঙবো। খাট ঠিকই ভাঙলো অথচ কোন কিছুই করলাম না।”

“আবারে একই কথা বলছো?”

“তো কী করবো? এখন তুমি বলো? ”

“খাট এটা সরাও। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

“খাট এক পাশ নাহয় ভেঙেছে আরেকপাশ তো ঠিক আছে। তুমি আমার উপর ঘুমাবে।”

“যদি ঘুমের মধ্যে কোলবালিশ ভেবে লা’থি মেরে পেলে দিই?”

“সমস্যা নেই তবে দেখেশুনে লা” থি মেরো। আমার এখনো বাসর করা হয়নি। বাবা ডাক শোনা কিন্তু বাকী আছে।”

” ঠোঁট কাটা বেডা একটা।”

“আসে আদর করি!”

আর্থ শশীকে ডায়মন্ড গিফ্ট করে। যদিও বা তারা টায়ার্ড। তাই আর্থ শশীর ঠোঁটে দু’টো চুমু খেয়ে শুয়ে পড়ে তাকে বুকে জড়িয়ে।

**********

বারেটার দিকে রওনা হয় সবাই মেঘনা ব্রিজের কাছে যাওয়ার জন্য। মাহী ও আসে তাঁদের সাথে। শহরের রাস্তায় গাড়ীর যনযাট একটুও কমেনি। ব্রিজের উপর একের পর এক গাড়ী আসছে যাচ্ছে। গাড়ী দু’টো নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিং করে তারা ব্রিজের উপর যায়। একেকজন একেক প্রান্তে। সেরিন শুভ্র একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। সেরিন একটু চুপচাপ। শুভ্র আজকে খেয়াল করেছে। তেমন আনন্দ করতে পারেনি মেয়েটা। যদিও বা শুভ্র কিছুই বলেনি।

ঘণ্টা খানিকের মতো সময় কাটিয়ে আবারো দাউদকান্দির উদ্দশ্যে রওনা হয় সবাই। বাড়ীতে আসতে,আসতে ঘড়ির কাটা দুইটা পেড়িয়ে গেছে। শুভ্র,সেরিন কোন রকম ফ্রেশ হয়। আজকে টায়ার্ড থাকলেও শুভ্র সেরিনকে জিজ্ঞেস করে,
“আজকে তোমার মন খারাপ কেনো?”

সেরিন কিছু না বলে শুভ্রর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে। পা উঁচু করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“আই নিড ইউ!”

“আর ইউ ম্যাড? আমি প্রচুর টায়ার্ড।”

“আই নিড ইউ।”

কথাটা বলে সেরিন শুভ্রর অধর জোড়া দখল করে নেয়। পুনরায় শুধায়,
“আই নিড ইউ। তোমার ছোঁয়া পুনরায় সর্বাঙ্গে মাখার আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো।”

শুভ্র আর কথা বাড়ায়নি। তার প্রিয় মানুষ তাকে চাচ্ছে, ভীষণ করে চাচ্ছে আর না করেনি। দু’জনেই ভালোবাসার সাগরে তলিয়ে গেলো।

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৩৫+৩৬

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৫|
#শার্লিন_হাসান

পাশ থেকে আকাশ বলে। সেরিন তখন শুধায়,
“মিথ্যে বলবি না একদম।”

“তুমি চুপ থাকো।”

শুভ্র ধমকে বলে সেরিনকে। সেরিনের কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তাকে এভাবে কেনো অবিশ্বাস করছে?
“প্রথম দোষের পর সব ভালোই কী সন্দেহ জনক হয়?”
শুভ্র জুম্মানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“একদম আমার সাথে মিথ্যে বলার চেষ্টা ও করবি না। এখানে একটা কথাও যদি মিথ্যে হয় তো তোর হাত ভে’ঙে আমি হসপিটালে বসিয়ে রাখবো।”

আকাশ,জুম্মান কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। সেরিন চুপচাপ। ওদের সবাইকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্র আকাশের কলার চেপে ধরে জুম্মানের দিকে তাকায়। রাগী কন্ঠে বলে,
“ওইখান থেকে এক পা ও নড়বি না।”

কথাটা শেষ হতে আকাশকে নন স্টপ থাপড়াতে থাকে। সেরিন কিছটা ভয় পেয়ে যায় শুভ্র মা-র দেখে। কম করে বিশটার বেশী থাপ্পড় দিয়েছে আকাশকে। ছেলেটা কালা হয়ে গেছে বোধহয়। শেষে একটা ধাক্কা দিতে করিডোরের গ্রিলের সাথে বা’রি খায় ছেলেটা। নিজের কান,মাথা চেপে ধরে ব্যথায়। অনেকটা ভীড় জমেছে করিডোরে। তবে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। অনেকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে। শুভ্র পুনরায় জুম্মানের কলার চেপে ধরে। চিৎকার করে বলে,
“তোর সাহস বড্ড বেড়ে গেছে জুম্মান। তোকে এর আগে কতবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে? আমি বলেছি কোন মেয়েকে র‍্যাগিং করা যাবে না। আমার কথার দাম রইলো কোথায়? কত বড় কলিজা তোর মেয়ের ওরনা ধরে টান দিয়েছিস। আজকে তোর সেই বড় কলিজা আমি টেনে এনে ছোট করবো।”

তখন জুম্মান কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
“আর করবো না স্যার। ওকে স্যরি বলে দিচ্ছি।”

“ও যা বলেছে তা সত্যি তো?”

“হ্যাঁ!”

ভয়ের চোটে জুম্মান সবটা স্বীকার করে নেয়। সেরিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। কেউ কিছু দেখলো না। শুভ্র জুম্মানকে একটা লা’থি মারে। জুম্মান নিচে পড়তে শুভ্র পুনরায় টেনে তুলে। থাপ্পড় দুতে,দিতে নিচের দিকে বেয় জুম্মানকে। সবাই তাকিয়ে আছে। শুভ্রর পেছন দিয়ে বাকীরাও আসছে। দোতালা থেকে থাপ্পড় দিতে,দিতে নিচে নিয়ে যায়। সামনের মাঠে এনে চু’ল গুলো টেনে ধরে বলে,
” চুল এতো বড় কেন? মেয়ে সাজতে মন চায়? দপ্তরি…”

বলার সাথে,সাথে একজন হাজির। শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার রুম থেকে কে’চিটা নিয়ে আসো তো!”

ওইদিকে আকাশ ছেলেটার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। জুম্মান দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাথায় তার শরীর ও অসাড় হয়ে আছে। শুভ্র এখনো তার কলার চেপে ধরে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কে’চি আনতে শুভ্র জুম্মানের বড়, বড় চুলগুলো কেটে দেয়। বাকীরা শুধু দেখছে। অনেক দিন পরেই শুভ্র কাউকে ধরেছে। আর ধরলেও ধরার মতো ধরে। কেউ,কেউ সেরিনের দিকে তাকাচ্ছে কেউ আকাশ,জুম্মানকে দেখছে। তখন শুভ্র চেঁচিয়ে বলে,
“আজকের ঘটনার সবার ব্রেইনে গেঁথে রাখবি। এরপর আমার কানে কোন মেয়েকে টিজ করার কথা আসলে এর থেকেও ভয়ংকর পরিনতি হবে।”

কথাটা বলে জুম্মানকে ছেড়ে দেয়। বাকীরা আস্তে,আস্তে চলে যায়। নাহলে আবার তাঁদের উপর কখন ঝড় আসে বলা যায় না। সব বিশ্বাস করা গেলেও শুভ্রর মুডকে বিশ্বাস করা বড্ড দায়। ভীড় কমতে যে যার মতো চলে যায়। সেরিন ও ল্যাব ক্লাসের দিকে যায়। শুভ্র কিছুটা সামনে সেরিন পেছন দিয়ে। দ্বিতীয় ভবনে প্রবেশ করতে শুভ্র সেরিকে তার রুমে আসার জন্য বলে। সেরিন চুপচাপ রুমে যায়। শুভ্র নিজের চেয়ারে বসে। সামনে সেরিন দাঁড়িয়ে আছে। রুমে এসি চলছে তাও সেরিন বরাবর ঘামাচ্ছে। এই বুঝি শুভ্র তাকে ধমক দিলো। কিন্তু শুভ্র সেসবের কিছুই করেনি। বরং নরম স্ব-রে বলে,
“ওরা আর কিছু বলেছে তোমায়?”

“না।”

“সত্যি করে বলো?”

“না কিছু বলেনি।”

“এর আগে বোতল টা জুম্মান ছুঁড়ে-ছিলো তাইনা?”

সেরিন হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়ায়। শুভ্র কিছু বলেনা। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শুভ্র বলে,
“ভালো হয়ে যাও সেরিন। তোমায় হয়ত তেমন মা-রতে পারবো না তবে আমি ভালো অবহেলা করতে জানি। তুমি আমার মানে একান্ত আমার।”

“ওই ভিডিওটা কেউ ইচ্ছে করে করেছে। ওই তাতান হুট করে এসেই আমার কানের পিঠ থেকে ফুল নিয়ে পুনরায় পড়িয়ে দিয়েছিলো। এই নিয়ে তাকে আমি বকা-ঝকা গালাগালি করেছিলাম। আপনার বিশ্বাস না হলে সিদরাত আর আয়াশকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি নহায় মিথ্যে বলছি ওরা তো ছোট ওরা মিথ্যে বলবে না।”

“ওদের জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। যাও আজকে আর ক্লাস করতে হবে না। বাড়ী চলে যাও।”

“আচ্ছা পাটওয়ারী বাড়ীতে যাবো। মাহী আসবে নিতে! আপনার সাথে হয়ত আর দেখা হবে না। আল্লাহ হাফেজ।”

সেরিন কথাটা বলে চলে আসে। শুভ্র সেরিনের যাওয়ার দিকে তাকায়। কিছু বলেনা। মেয়েটা অভিমান করেছে তার কথায় বুঝা যায়। শুভ্রর নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। সেদিন রাতে হয়ত ওইরকম বিহেভ করা উচিত হয়নি তার। যাই হোক সে জানে সেরিন রাগ, অভিমান করলেও তার কাছেই আসবে।

গেটের সামনে এসে মাহীকে মেসেজ দেয় সেরিন। পাঁচ মিনিটের মাথায় মাহী গাড়ী নিয়ে আসে। সেরিন গাড়ীতে বসতে পুনরায় গাড়ী স্টার্ট দেয়। সেরিন বেশ আনমনা ব্যপারটা মাহী খেয়াল করে।
পাওয়ারী বাড়ীতে আসতে সেরিনকে পেয়ে সবাই খুশি। সেরিন শাওয়ার নিয়ে লান্স করে নেয়। সবার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে চলে যায় সে।

সন্ধ্যায় আর্থর সাথে কথা বলছে শশী। একপর্যায়ে আর্থ বলে উঠে,
“ভাইয়ার সাথে কী সেরিনের কোন জামেলা হয়েছে? তুমি কিছু জানো?”

“আরে না! সেরিন বোর ওই বাড়ীতে আমাদের মিস করে তাই চলে এসেছে।”

“তোমার বোন জামাই পাগ’ল। জামাই হলে কিছু লাগেনা। তুনি বলছো সে জামাই ছেড়ে আসতে পারে?”

“সেটা একান্ত তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যপার। তোমাকে ওতো মাথা ঘামাতে বলিনি। অন্য কথা বলো।”

“ঠিক আছে!”

“কী ঠিক আছে?”

“কিছু না।”

“অন্য কথা বলো?”

“ওকে।”

“কী ওকে,ওকে করছো?”

“তো কী বলবো?”

“অন্য কথা বলো।”

“আচ্ছা।”

“বলো না?”

“কী বলবো?”

“আমার মাথা বলবি মাথা। কিছু বলতে হবে না। কল রাখ!”

কথাটা বলে শশী কল কেটে দেয়। আর্থ ফোন হাতে নিয়েই হাসে। তার ভাইকে জ্বালানো যায় ভেবে শুভ্রর রুমে যায় আর্থ। শুভ্র সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। আর্থ ধপাস করে খাটে বসতে সেটা একপাশে ভে’ঙে যায়। আর্থ নিজেও বোকা বনে যায়। শুভ্র আর্থর দিকে তাকিয়ে বলে,
“দিলি তো খাটটা ভে’ঙে।”

“তোমরা বাস করে খাট ভাঙতে পারোনি তাই আমি বসেই ভেঙে দিলাম।”

“চুপ থাকবি তুই?”

“আরে ভাই ভাগ্য ভালো তোমাদের ফুলসজ্জার রাতে এটা ভাঙেনি। আজকে ভেঙেছে তাও ভাবী বাড়ীতে নেই।”

“এটা আগে থেকেই কেমন জেনো করছিলো। চেন্জ করতে মনে থাকে না।”

“আচ্ছা সার্ভেন্ট দের বলছি এটা সরিয়ে অন্য রুমেরটা এখানে নিয়ে আসতে।”

“যা! সাথে নিজেও কাজ করবি। খাটটা তুই ভেঙেছিস।”..

আর্থ উঠে বাইরে যায়। তাঁদের পড়ে থাকা রুম গুলো তে যায়। যেগুলোতে কেউই থাকেনা। ফার্নিচার ওইভাবেই পড়ে আছে। কয়েকজন সার্ভেন্টকে দিয়ে শুভ্রর রুমের খাটটা বাইরে বের করে। অন্য রুমের আরেকটা খাট শুভ্রর রুমে ঢুকায়। আদ্রিতা রুমে প্রবেশ করেই জিজ্ঞেস করে,
” খাট ভাঙলো কে?”

তখন আর্থ বলে,
“কে আবার? ভাইয়া আর…..”

শুভ্র চোখ গরম করে তাকাতে আর্থ কথার স্বর চেন্জ করে বলে,
“আমি, আমি ভেঙেছি।”

“তুমি এটা ভাঙলে কীভাবে?”

“ওই খাটটা এখানে এনে দে। তারপর দেখাচ্ছি ভেঙেছি কীভাবে।”

“আরে রেগে যাচ্ছো কেন?”

“তোরা ভাই বোন দু’টো ই রা’জাকার। একজন নিজের পুরোনো জিনিস ভাঙচুরা জিনিস রুমে রাখাে আর ভেঙে গেলে দোষ পড়ে আমার। ভাই আমি দুইদিন পর বিয়ে করবো। শেষ বারের মতো হলুদ মাখবো বিয়ের পর নিজের জীবনকে ভাজার জন্য। একটু সাহস,শক্তি দরকার। এই শুভ্র আমায় কাজ করিয়ে আমার রুপ,গুন সব শেষ করে দিচ্ছে।”

“তাহলে বিয়েটা আরো ছয়মাস পড়ে কর?”

শুভ্র জবাব দেয়। তখন আর্থ বলে,
“না,না! এখনি সঠিক সময় বিয়ের।”

“দেখবি তোর খাটটাই ভেঙেছি৷ এমন দিনে ভাঙবে যে লজ্জায় মুখ ও দেখাতে পারবি না।”

“এই তুমি বুঝাতে চাচ্ছো আমার ফুলসজ্জার দিন খাট ভাঙবে?”

“গুড! বুঝে গিয়েছিস।”

“আমি কিছু করবো নাকী যে খাট ভাঙবে? ওই খাট চেঞ্জ করে নতুন খাট যেদিন আনবো সেদিনই যা করার করবো।”

“আহারে! খাটের জন্য ভাই আমার ফুলসজ্জা করতে পারবে না। বিষয়টা খুবই সিরিয়াস! আচ্ছা যা তোর বিয়েতে আমি নতুন খাট গিফ্ট করবো।”

“না তুমি হানিমুনের টিকেট দিবা। মালদ্বীপ যাবো!”

“টাকা নাই।”

“বিয়ের গিফ্ট এটা।”

“না খাট দিবো। মালদ্বীপ গিয়েও সেই খাটের উপরেই হানিমুন করবি। তারচেয়ে নতুন খাট দিবো বাড়ীতেই হানিমুন করতে পারবি। তোরই লাভ ভেবে দেখ!”

“আজকাল শুভ্র স্যারের মুখে লাঘাম কমে যাচ্ছে।”

“তুই কী মেয়ে মানুষ নাকী যে তোর সাথে লাঘাম টেনে কথা বলতে হবে?”

“না তাও!”

“মজা করছিলাম।”

দু’জনে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে, সবার সাথে ডিনার করে নেয়। শুভ্র রুমে আসতে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সেরিনের সাথেও কথা হয়নি। কিন্তু কোন মুখে কল দিবে সে? গতকাল ভীষণ বা’জে বিহেভ করেছে শুভ্র অনুভব করছে। রাগের মাথায় যা-তা বললেও তার ভীষণ খারাপ লেগেছে। ভিডিওটা দেখেই তো সব উলোটপালোট করতে মন চেয়েছে। সেই হিসাবে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে সেরিনের সাথে যথেষ্ট ভালো বিহেভ করেছে। তবুও মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। তার সতেজ,সুন্দর মেয়েফুলটার মনে কষ্ট লেগেছে। ভাবতে শুভ্রর খারাপ লাগছে ভীষণ। সাত পাঁচ না ভেবে কল দেয় সেরিনকে। কয়েকবার রিং হতে রিসিভ হয়। সেরিন সালাম দিতে শুভ্র সালামের জবাব দেয়। দু’জনের মাঝে পূর্ণ নিরবতা বিরাজমান। কেউই কথা বলছে না। শুভ্র তখন বলে,
“মেয়ে ফুল শুনেছো? আমি ‘স্যরি’!”

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৬|
#শার্লিন_হাসান

“মেয়ে ফুল শুনেছো? আমি ‘স্যরি’!”

সেরিন কোন কথা বলেনা। শুভ্র পুনরায় শুধায়,
“স্যরি পাখি। ক্ষমা করো আমায়।”

“ইট’স ওকে!”

“না ইট’স ওকে তে হবে না। এই ইট’স ওকে তে আমি অভিমান দেখতে পাচ্ছি।”

“তাহলে?”

“মন থেকে বলো।”

“আচ্ছা।”

“কী আচ্ছা?”

“কিছু না।”

“বলো না?”
তখন সেরিন শুধায়,
“কী বলবো?”

“বলো ক্ষমা করলাম।”

“ইট’স ওকে!”

“প্রব্লেম কী তোমার?”

“আপনার প্রব্লেম কী সেটা আগে বলুন তো? বললাম না ইট’স ওকে! ওতো লুতুফুতু আমার পছন্দ না। আমার ঘুম আসছে প্লিজ কল দিয়ে ডিস্টার্ব করবেন না।”

“এই তোমায় আমি এতো সুন্দর ভাবে স্যরি বলেছি।”

“একটা কথা মনে রাখবেন আঘাত দেওয়ার পর ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করা যায়। তবে আঘাতের ক্ষতটা সহজে ভোলা যায় না। আমি আদুরে মেয়ে! কেউ আমায় চোখ রাঙিয়ে কথা বলেনি। অল্পতে আমি হার্ট হই! সেখানে আচ্ছা বাদ দেই।”

কথাটা বলে সেরিন কল কেটে ফোন সুইচড অফ করে নেয়। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। কখনো তার বাবা তাকে চোখ রাঙায়নি। তার কথার উপর দিয়ে কেউ কিছু বলেনি। এই না যে সেরিন অধঃপতনে গেছে। সে যথেষ্ট ভালো মন্দ বুঝে। শুভ্র যাচাই বাচাই না করেই তাকে ভীষণ হার্ট করেছে। অন্ধকার রুমে উঠে বসে সেরিন। তার মনটা ভীষণ খারাপ। হুট হাট যেটাকে মুড সুয়িং ও বলা যায়। মূহুর্তে নিজেকে পাগ’ল মনে হচ্ছে। উঠে বেলকনিতে যায় সেরিন। রাত প্রায় বারোটার উর্ধ্বে। আকাশে উজ্জ্বল শশী আলো ছড়াচ্ছে। সেরিন সেদিকে তাকিয়ে জোরে কয়েকটা শ্বাস নেয়। কিছুক্ষণ দোলনায় বসে দোল খেয়ে রুমে আসে। কেনো জানি কিছু লেখার ইচ্ছে হলো! ডায়েরিটা বের করে তাতে লিখে,
❝বাবুর পাপা বাবুর আম্মুকে ভীষণ হার্ট করেছে। বাবুর আম্মু ভীষণ অভিমান করেছে। বাবুর পাপা এতো পঁচা কেনো? সে জানে না বাবুর আম্মু একটা ধমক দিলেই চোখে অশ্রু ঝড়ে। নিতে পারেনা বাবুর আম্মু। সে ভীষণ সফট হার্টের। বাবুর পাপার মতো নির্দয় নিষ্ঠুর না। বাবুর পাপা বাবুর আম্মুকে বুঝে না।❞

নিচে তারিখ আর সময়টা লিখে রাখে সেরিন। টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে সেরিন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে উঠে। সূরা আর-রাহমান তেলাওয়াত শুনে সেরিন। আজকে রাতে তার ঘুম হবে না ভালো করেই বুঝে গেছে।

ওইদিকে শুভ্র বেলকনিতে বসে তার আর সেরিনের পিকচার দেখছে। শুভ্র পারছে না এখনি গিয়ে সেরিনের মন টা ভালো করে দেয়। মনে,মনে শপথ নিয়েছে আর যাই হোক সেরিনের সাথে বাজে বিহেভ করবে না। আর না তাকে ধমকাধমকি করবে। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় বুঝে শুনে তারপর যা বলার বলবে। তাও নরম স্বরে। মেয়েটা বেশ সফট হার্টের। অল্পতে কষ্ট পায়।

এভাবেই তাঁদের দু’জনের রাতটা কোন রকমের কাটে। শুভ্র তাহাজ্জুদ পড়ে, ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। সকাল,সকাল হাঁটতে বের হয় সে। তাঁদের কলেজের পেছনের বিশাল মাঠের শেষ প্রান্তের দীঘিতে। পাশে একটা হোস্টেল আছে সেটাও যারা অনাথ বা বাড়ী দূরে তাঁদের থাকার জন্য। শুধু ছেলেদের জন্য এই ব্যবস্থা। শুভ্র দীঘির পাড়ে গিয়ে হিমশীতল বাতাস উপভোগ করে। হাটাহাটি শেষে সে বাড়ীতে এসে কফি খায়। আগামী কালকে তারা বিয়ের শপিংয়ে যাবে। সুলতানা খানম শুভ্রকে বলছে সেরিনকে চৌধুরী বাড়ীতে নিয়ে আসতে। সে তো এখন বর পক্ষ যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে। শুভ্র কিছু বলেনা। চুপ চাপ সবার কথা শোনে! বাকীরাও একই কথা বলছে সেরিনকে নিয়ে আসতে। তবে একটা ব্যপার সুন্দর তাঁদের মধ্যে কী হয়েছে সেটা কেউই জিজ্ঞেস করেনি। ব্যপারটা তাঁদের পার্সোনাল।

শুভ্র রেডি হয়ে কলেজে আসে। আজকে তার মেজাজ ভালো না সাথে মুড অফ। কলেজে প্রবেশ করে প্রথমে পিটিতে যায় শুভ্র। স্টুডেন্টদের বসিয়ে সে সামনের এক্সাম নিয়ে কিছু কথা বলে। তবে বেশীরভাগ স্টুডেন্টের চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। শুভ্র পিটি শেষে
ফাস্ট ইয়ারের ক্যামিস্ট্রি টিচারকে তার রুমে আসার জন্য বলে।

তার কিছুক্ষণের মধ্যে টিচার শুভ্রর রুমে উপস্থিত হয়। শুভ্র কিছুটা মেজাজ দেখিয়ে বলে,
“কয়েকমাস আগে! সেরিন নামের মেয়েটির মাথায় কেউ বোতল ছুঁড়েছিলো। আমি যতটুকু জানি আপনার ক্লাস চলা কালীন। এবং মেয়েটাকে আমার কাছেও পাঠানো হয় বলা হয়েছে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। রাইট?”

স্যার কিছুটা ইতস্ত বোধ করে বলে,
“আসলে শুভ্র স্যার….

” আমি শুধু ‘হ্যাঁ আর ‘না’ উত্তর জানতে চেয়েছি। কোন আসলে,শুভ্র বা স্যার টাইপের কোন কথা না।”

“হ্যাঁ! ওইদিন জুম্মান তাকে বোতল ছুঁড়ে মারে।”

“তাহলে মিথ্যেটা কেনো বলা হয়েছে?”

“আসলে স্যার!”

“এখন আমার কী করা উচিত বলুন তো? ওই জুম্মানকে টিসি দেওয়া বাকী আপনাকে কলেজ থেকে বিদায় করা? আমার দেওয়া রুলস আপনি ব্রেক করেছেন স্যার। আপনার তখন দায়িত্ব টা কী ছিলো বলুন তো? জুম্মানকে কয়েকটা থা’প্পড় দেওয়া। তা তো করেননি আমায় উল্টো মিথ্যে বলেছেন।”

“স্যরি স্যার!”

“লাস্ট ওয়ার্নিং। আজকের মিটিংয়ে আবারো বলে দেবো সবাইকে। এরপর আমার রুলসের ব্রেক হলে এর পদক্ষেপ আমি গ্রহন করতে বাধ্য। এখন আসতে পারেন।”

স্যার বেড়িয়ে যেতে শুভ্র এসির পয়েন্ট বাড়িয়ে দেয়। দপ্তরিকে বলে কফি আনায় শুভ্র। তার মিটিং শেষে কুমিল্লায় যেতে হবে।

পাটওয়ারী বাড়ীতে শশীর বিয়ের প্রিপারেশন চলছে। সেরিন বিল্ডিংয়ের প্রতিটি রুম সাজাচ্ছে। মাহী সহ ক্লিন ও করছে। শশীকে কোন কালে কোন কাজ করতে হয়না। কাজ দেখলে তার ঘুম পায়,মাথা ব্যথা করে। এক কথায় শশী কাজ চো”র। সেরিনকেই বেশীরভাগ সময় অতিথি বা ফ্যামিলি ইভেন্টে রুম সাজাতে হয়। নতুন চাদর,সোফার কভার ইত্যাদি দিয়ে। মাহী সহ বেচারী চুপচাপ কাজ করছে। এক পর্যায়ে সেরিন বলে,
“তুমি বিয়ে কবে করবা? তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নেও। আমি তোমার বিয়েতে নাচবো।”

“করবো,করবো আর ছয়মাস পড়েই।”

“নিশাতের এক্সামের পরই করো।”

“কিসের নিশাত?”

“কেনো তোমার গফ!”

“না আনাদের ব্রেক আপ হয়ে গেছে।”

“বাহ আমি জানি না তাহলে।”

“তুই তো বিজি! আর আমাদের তেমন কথাও হয়না।”

“তাহলে অন্য মেয়ে খুঁজবো? ”

“এমনিতে খালামনির দুই মেয়ে আছে আবার মেহের আছে। তোর যাকে ভাবী হিসাবে পছন্দ হয় তাকেই আমি বিয়ে করবো।”

“সাফা,রাফা,মেহের। কী জানি! তিনজন সুন্দরীর কাকে তোমার মনে ধরে কে জানে?”

“ধরেছিলো একজনকে। টিকলো না তো।”

“বাদ দাও! মেয়েটা বুঝেনি তোমায়। কী হারিয়েছে পরে বুঝবে।”

“ওর থেকে দূরে থাকবি সেরিন। ও ভীষণ বা’জে। তোর ক্ষতি করতে চায়।”

“মাথা খারাপ তোমায় ভাইয়া? ও তোমায় এক্স আইমিন প্রাক্তন তোমার রাগের থেকে হয়ত এসব বলছো। বাট ট্রাস্ট মি ও ভীষণ ভালো একজন ফ্রেন্ড। মানুষ হিসাবে বলবো না বাট বন্ধু হিসাবে সী ইজ….

” বাঁশ যখন খাবি তখন আমার কথার মানে বুঝবি সেরিন।”

“বাদ দাও তোমার রাগের থেকে এটা বলছো। ওকে আমি চিনি। ও খুব ভালো একটা মেয়ে।”

“ওকে। থাক তোর ভালো ফ্রেন্ড নিয়ে।”

কথাটা বলে মাহী চলে আসে। সেরিন মাহীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসে। নিশাতকে কল দেয় তখন। কল রিসিভ হতে হেঁসে বলে,
“কীরে তুই আমার ভাইকে কী বলেছিস হ্যাঁ? ও আমার মুখে তোর নাম সহ্য করতে পারছে না। আমি তো জানি তুই ভীষণ ভালো একটা মেয়ে।”

“হ্যাঁ! মেয়ে হিসাবে ভালো হতে পারি বাট তোর ভাইয়ের প্রাক্তন হিসাবে না।”

“মজা নিচ্ছিস?”

“আরে ইয়ার তোর ভাইটা এক নাম্বারের ত্যাড়া। দেখ তুই কত সুইট একটা মেয়ে তোর ভাই ও হওয়া চাই সুইট তা না এটা দেখি করলা পাতা।”

“তুই ও না!”

“বাদ দে। কী করছিস?”

“কাজ করি রে।”

“এমা শুভ্র স্যারদের এতো সার্ভেন্ট থাকতে তুই কেনো কাজ করছিস? দেখ তোকে কী ওরা কাজের বুয়া পেয়েছে? কী আজব মানুষরে বাবা!”

“আরে ইয়ার আমি পাটওয়ারী বাড়ীতে। আর শশীর বিয়ে তো তাই আরকী রুম গুছিয়ে নিচ্ছি। পরে চাপ পড়বে বেশী।”

“ওহ আগে বলবি তো?”

“বলার সুযোগ দিয়েছিস তুই?”

“আচ্ছা কাজ কর। সময় হলে কল দিস। কথা বলবোনি।”

“ওকে বায়!”

***********

শুভ্র মিটিংয়ে বসেছে। তার কথাবার্তা সব শেষ হতে বলে,
“ক্লাস চলা কালীন কোন ঘটনা আইমিন স্টুডেন্টদের মাঝে ঝগড়া মা’রামারি টাইপের কিছু হলে অবশ্য বিচার করবেন। আর আমার প্রতিষ্ঠানের কোন মেয়েকে যাতে অসন্মান করা না হয়। আর নির্দোষ হলেও যাতে সঠিক বিচার টা সে পায়। আমি জানি আমার প্রতিষ্ঠানের ভালো ছেলের সংখ্যা স্বল্প হলেও আমার সামনে আসলে সবই ভালো। যদি ক্লাসের বিষয়টা ক্লাসে মিটমাট না করতে পারেন সোজা আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। অবশ্যই এই দায়িত্বটা ভালো ভাবে পালন করবেন। আর বিচার টাও সুষ্ঠু ভাবে। এটা ভাববেন না কেউ যে বিচার হেরফের করবেন। আমার লোক লাগাবো আছে ঠিক আছে? পরে স্টুডেন্টদের সাথে আপনাদের চাকরী নিয়েও টানাটানি হবে।”

শুভ্রর কথায় সবাই “ওকে স্যার” বলে। তাঁদের মিটিংয়ের পার্ট শেষ হতে শুভ্র বেড়িয়ে পরে কুমিল্লার উদ্দেশ্য। আজকে সে গাড়ী নিয়েই বের হয়েছে। লোকাল বাসে যাওয়ার মুড নেই।

কুমিল্লায় এসে প্রথমে সে এক তোড়া ফুল নেয়। শপিং মলে গিয়ে একটা ব্রেসলেট নেয় গোল্ডের। সেই সাথে চকলেট,টেডিবিয়ার। তার মধ্যে একটা টেডিবিয়ার লাভ শেপের মাঝে “Sorry Bow”।

সব কিছু গাড়ীতে রেখে লাস্ট একটা কেক নেয়। সেটার উপরে লেখা ” স্যরি মেয়েফুল”।

তাড়াহুড়োয় যা মাথায় এসেছে তাই নিয়েছে। দুই ঘন্টার মাঝে শপিং শেষ করে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা দেয় শুভ্র।

#চলবে