Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 278



বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-২১+২২

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২১.
মিশকাতের ফোন থেকে তার রুমমেট কল করেছে সুবর্ণাকে। ছেলেটার সাথে আগেও মিশকাত সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। নাম সৈকত। বয়সে মিশকাতের দুই-এক বছরের ছোটো। মিশকাতের আগেই সে আমেরিকা গিয়েছিল। মিশকাতকে রুমমেট হিসাবে পাওয়ার পর থেকে ছেলেটা মিশকাতকে বড়ো ভাইয়ের মতো মেনে চলে। গতকাল থেকে মিশকাতকে বারবার করে ফোন করেও না পেয়ে সুবর্ণা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। সৈকতের ফোন পেয়ে যেন রুহে পানি ফিরল সুবর্ণার। সৈকত তার খবরাখবর জিজ্ঞেস করল। সুবর্ণা জানতে চাইল,
“ভাইয়া কোথায় সৈকত ভাইয়া? গতকাল থেকে ফোন ধরছে না।”
সৈকত বলল,
“ভাইয়ের কথা বলতেই ফোন করলাম তোমায়। তোমাদের বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী হয়েছে? সিরিয়াস কিছু?”
“আমার খালাতো বোনের সাথে ভাইয়ার সম্পর্ক ছিল। গত পরশু আপুর বিয়ে হয়ে গেছে।”

সৈকত একটু অবাক হলো। এক মেয়ের সাথে মিশকাতের গভীর প্রেমের খবর তার অজানা নয়। রুমমেট হওয়ার সুবাদে মিশকাতকে সবসময় সে ফোনে কথা বলতে বা ম্যাসেজ করতে দেখেছে। মিশকাত তার কাছে অস্বীকার-ও করেনি। কয়েকদিন সে ভিডিয়ো কলে কথাও বলেছিল আরিন্তার সাথে। মিশকাত কথা বলার সময় তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সে বুঝত মিশকাত-আরিন্তার একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটা খাঁটি। সুবর্ণার মুখে হঠাৎ এমন সংবাদ শুনে সৈকত যারপরনাই অবাক হলো। বলল,
“কী বলো! আরিন্তা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে? এটা কীভাবে সম্ভব?”
“আপনি চেনেন আপুকে?”
“হুম, ভাইয়া পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আপু হঠাৎ ভাইয়াকে রেখে বিয়ে করে নিল কেন?”
“আপুর দোষ নেই। তাকে জোর করে রাজি করানো হয়েছে। ওসব অনেক কাহিনি। আমি আপনাকে পরে বলব। আপনি আগে ভাইয়ার খবর বলুন। ভাইয়া কী করছে? বাসায় ফিরেছে?”
“আমরা হসপিটালে আছি।”
সুবর্ণা আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“হসপিটালে কেন? ভাইয়া কিছু করেছে না কি?”
“সে কিছু করেনি। গতকাল রাতে হঠাৎ প্রেশার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমি একা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছি।”
“এখন কেমন আছে?”
“এখন একটু ভালো আছে। কিন্তু ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে মানসিকভাবে অনেক বিপর্যস্ত।”

সুবর্ণা চিন্তিত মুখে বলল,
“ভাইয়া অনেক বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছে। আপাতত কদিন হয়তো একটু বেশি মানসিক চাপে থাকবে। একটু দেখে রাখবেন ভাইয়া। আমরা অনেক ভয়ে আছি তাকে নিয়ে।”
“ভয়ের কিছু নেই। ভাইয়া সুস্থ হলেই দেখবে আবার তোমাদের সাথে কথা বলবে। আমি খেয়াল রাখব, চিন্তা কোরো না। আর চাচা-চাচিকে এসব জানিয়ো না। তারা আরও চিন্তায় পড়ে যাবে।”
“ঠিক আছে। আপনি একটু বুঝাবেন ভাইয়াকে। মা চিন্তায় খেতে পারছে না ঠিকমতো।”
“সমস্যা নেই, আমি আছি তো। ভাইয়াকে একটু সময় দাও তোমরা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা কি বিয়েতে গিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, না গিয়ে উপায় আছে?”
“এখন কোথায় আছো?”
“আমি ওইদিনই বাড়ি চলে এসেছিলাম। বাবা-মা আজ এসেছে।”

বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানের পর আরিন্তা বাবার বাড়িতে এসেছে আজ দুদিন হলো। নিয়াজ আর থাকতে পারবে না। ইতোমধ্যে হসপিটাল থেকে তার ডাক পড়ে গেছে। আগামীকাল সকালেই সে চলে যাবে। পুলক তালুকদার বলেছেন আরিন্তা যেন আর কটা দিন থেকে যায়। নিয়াজ নিতে আসতে না পারলে পেলব নিজে তাকে নিয়ে যাবে। নিয়াজ বলেছে আরিন্তা থাকতে চাইলে থাকবে, তার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আরিন্তা এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি। শুনেও চুপ ছিল। পেলবের সাথে বাইরে গিয়েছিল নিয়াজ। ফিরে দেখল আরিন্তা মেঝেতে বসে ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগ গোছানোর ধরণ দেখে সে ভ্রুকুটি করল। শাড়ি, চুড়ি, হ্যান্ডব্যাগ, টুকটাক অনেক জিনিসপত্র ছোটো একটা ব্যাগে ঠেসে-ঠেসে ঢুকাচ্ছে আরিন্তা। তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে নিয়াজ এগিয়ে গিয়ে বলল,
“কী করছো?”
আরিন্তা উত্তর দিলো,
“মিশু ভাইয়ের থেকে পাওয়া উপহার এগুলো। এখানে ফেলে রেখে গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমার কাছে রেখে দিবো।”
“এগুলো নিয়ে যাবে?”
“কেন? আপনার আপত্তি আছে?”
“তা বলিনি।”

আরিন্তা হাতের ব্যাগটা সরিয়ে রেখে লাগেজ খুলে বসল। আলমারি থেকে একে-একে জামাকাপড় নামাতে দেখে নিয়াজ বলল,
“এসব তো যাওয়ার আগেই গোছাতে পারবে। এত তাড়াতাড়ি গোছাতে লাগলে কেন?”
“তাড়াতাড়ি কোথায়? কাল সকালে রওয়ানা দিবেন না?”
“কাল আমি যাচ্ছি, তুমি তো যাচ্ছ না।”
“কেন?”
“তোমাকে না‌ বাবা আরও কদিন থেকে যেতে বলল?”
আরিন্তা নির্লিপ্তভাবে উলটা বলে বসল,
“আমি কি একবারও বলেছি আমি থাকতে চাই?”
নিয়াজ অবাক হয়ে শুধাল,
“তাহলে? তুমি কি আমার সাথে চলে যেতে চাইছ?”
“অবাক হওয়ার কী আছে? বিয়ের পর কি মেয়েরা বাবার বাড়িতে পড়ে থাকে?”
“না, তবে প্রথম-প্রথম তো সবারই বাবার বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করে।”
“সবার মতো বিয়ে কি আমার হয়েছে?”

নিয়াজ চুপ হয়ে গেল। আরিন্তা পুনরায় বলল,
“রোজ-রোজ কা’টা ঘায়ে নুনের ছিটা পেতে রেখে যেতে চাইছেন আমাকে?”

নিয়াজ এতক্ষণে বুঝল আরিন্তা কেন চলে যেতে চাইছে। এখানে থেকে সে রোজ তার বাবা-ভাইয়ের মুখোমুখি হতে চায় না। তার সাথে যা হয়ে গেছে, এরপর এখানে থাকলে হয়তো তার মনে আরও খারাপ প্রভাব পড়বে। এসব চিন্তা করে নিয়াজ বলল,
“ঠিক আছে। তোমার বাবাকে তবে বলে দিচ্ছি আমি তোমাকে সাথে নিয়েই যাব।”
আরিন্তা বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমি শুধু মাকে বলেছি। আপনাকে মিথ্যা অজুহাত দেখাতে হবে না। বাবাকে আমিই বলতে পারব।”
“কী বলবে?”
“সত্য কথাই বলব। আমার এখানে থাকার ইচ্ছা নেই।”
“এভাবে বললে তারা কষ্ট পাবে।”
“আমার কষ্টের দায় কে নিয়েছে যে, আমি কারো কষ্টের দায় নেব?”
“তবু তারা তোমার আপনজন?”
“আমিও তাদের আপনজন ছিলাম। কই? আমার কথা তো কেউ ভাবেনি।”
“কিন্তু-”
“আপনাকে একটা অনুরোধ করি? দয়া করে আপনি তাদের হয়ে আমার কাছে সুপারিশ করবেন না। আমি শুধু একজনের ভালোবাসা হারাইনি। তিনজনের ভালোবাসা হারিয়েছি। ভালোবাসা বলতে আমি আজীবন সেই তিনজনকেই বুঝেছি। অথচ আজ তারা কেউ আর আগের মতো নেই। একজনকে আমি নিজে ঠকিয়েছি, বাকি দুজন আমাকেই ঠকিয়ে দিয়েছে। এই ঠকানোর, ঠকে যাওয়ার যে কী ব্যথা, আপনি তা বুঝবেন না। আমার পরিস্থিতি শুধু আমিই জানি।”

আরিন্তার চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমেছে। তা গড়িয়ে পড়ার আগেই সে মুছে ফেলল। নিয়াজ ব্যথিত চোখে চেয়ে থেকে বলল,
“সরি। তোমার যা ভালো মনে হয় করো।”

মেরিনা দুটো বাটিতে চটপটি নিয়ে এসেছে আরিন্তা আর নিয়াজের জন্য। আরিন্তাকে লাগেজ গোছাতে দেখে তিনি নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অনেক করে বলেছিলেন কটা দিন থেকে যেতে। কিন্তু মেয়েটা নারাজ। কিছুতেই থাকবে না সে। চটপটি দেখে আরিন্তা শুধাল,
“চটপটি কখন বানালে?”
“আমি বানাইনি। তুই খেতে পছন্দ করিস তাই পেলব নিয়ে এসেছে।”
আরিন্তা চটপটির বাটি হাতে তুলে-ও রেখে দিলো। শান্ত স্বরে বলল,
“মা, আমার পছন্দ, অপছন্দের কথা আর কাউকে ভাবতে বারণ করে দিয়ো প্লিজ। আমার পছন্দের এত মূল্যায়ন আমি নিতে পারছি না।”

মেয়ে জামাইয়ের সামনে মেরিনা একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। আরিন্তাকে পালটা কিছু বলতেও পারলেন না। যাওয়ার আগে শুধু নিয়াজকে বলে গেলেন,
“ঠান্ডা না হতে খেয়ে নাও বাবা। আরিকেও খেতে বোলো।”

এ বাড়িতে এসে হতেই নিয়াজ খেয়াল করেছে পেলব সবসময় আরিন্তার সাথে ভাব জমাতে চায়। কথা বলার জন্য আশেপাশে ঘুরঘুর করে, নানান অজুহাত খোঁজে। কিন্তু আরিন্তা কথা বলা তো দূর, ভাইয়ের ছায়া-ও মাড়াতে চায় না। পেলব যখনই বাইরে যায় পূর্বের স্বভাব বশত বোনের জন্য এটা-ওটা খাবার নিয়ে আসে। পূর্বে খাবারের ওপর হামলে পড়া আরিন্তা এখন ভাইয়ের আনা সেসব খাবার ছুঁয়েও দেখে না।

নিয়াজ একটা বাটি পুনরায় আরিন্তার হাতে দিয়ে বলল,
“খাবারের সাথে রাগ কোরো না। কাল তো চলেই যাবে। আজ ফিরিয়ে দিয়ো না, খেয়ে নাও। পেলব তো তোমার জন্যই এনেছে।”
আরিন্তা নিজেরটাসহ অপর বাটিটাও নিয়াজের দুই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“দুটোই আপনার। খেয়ে নিন। আপনার আদরের শালাবাবু এনেছে বলে কথা!”
“আমি বাইরের খাবার এতটা খাই না।”
“এ বাড়িতে এলে খাবেন। আসার সময় ডাক্তারিটা হসপিটালে তুলে রেখে আসবেন। তাহলেই দেখবেন নির্দ্বিধায় বাইরের খাবার খেতে পারবেন।”
“ডাক্তারি তুলে রাখে কীভাবে?”
“সেটা আপনার ব্যাপার।”
“পরামর্শ তো তুমি দিলে।”
“পরামর্শ কাজে লাগাতে হয় নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে। সবই যদি পরামর্শদাতা বলে দেয়, তবে আপনার মগজের কী কাজ?”
“ও…আচ্ছা।”

পরিবারের কোনো কথাই আরিন্তাকে আটকাতে পারেনি। নিয়াজের সাথেই সে শশুরবাড়ি ফিরে এসেছে। নিয়াজ বাড়ি ফিরেই হসপিটালে ছুটেছে। আতাউর রহমান আজ শান্তিতে আরিন্তার সাথে গল্প করার সুযোগ পেয়েছেন। সন্ধ্যায় আরিন্তাকে ড্রয়িংরুমে ডেকে গল্প করতে বসেছেন। আরিন্তা নিজের হাতে চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। দুজন চা খেতে-খেতে গল্প করছে। সামনে টিভিতে খবর চলছে, সেদিকে কারোর মনোযোগ নেই। আতাউর রহমান তার যুবক বয়সের গল্প করছেন। আরিন্তা বেশ আগ্রহ নিয়ে তার গল্প শুনছে। আতাউর রহমানের বন্ধুসুলভ মানসিকতা আরিন্তার ভালো লাগছে। বাবাসম শ্বশুর-ও যে বন্ধুর মতো পুত্রবধূর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারে, আতাউর রহমানকে না দেখলে আরিন্তার বিশ্বাস হত না। তিনি যখন নিজের যুবক বয়সের কাহিনি বলছেন, আরিন্তার তখন মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে বয়সের তফাত নেই। মনের দিক থেকে দুজন সমবয়সী। তাই তো লোকটা নির্দ্বিধায় এত কথা বলতে পারছেন। আতাউর রহমান কথায়-কথায় নিয়াজের মায়ের কথাও বলল। আরিন্তা আঁচ করতে পারছে লোকটা স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। আতাউর রহমান আরিন্তাকে বললেন তার সাথে রুমে আসতে। আরিন্তার পাওনা কিছু জিনিস না কি তার হেফাজতে আছে। আরিন্তা বুঝতে পারল না এখানে তার পাওনা কী আছে। আতাউর রহমানের সাথে সে তার রুমে গেল। আতাউর রহমানের ঘরে দুটো আলমারি। একটা পুরোনো, আরেকটা নতুনের মতো। আরিন্তার হাতে চাবি গুঁজে দিয়ে তিনি তাকে পুরোনো আলমারিটা খুলতে বললেন। আরিন্তা ইতস্তত বোধ করে বলল,
“আপনিই খুলুন না।”
“সমস্যা নেই, খোলো। ভেতরে যা আছে সব তোমার। এই আলমারির মালিকানা-ও এখন তোমার।”

আরিন্তা আলমারি খুলল। আলমারি ভর্তি নানান রকমের শাড়ি। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুঝল শাড়িগুলোর মালিকানা নিয়াজের মায়ের। মহিলা এত শাড়ি দিয়ে কী করেছে? আতাউর রহমান আরিন্তার চোখের প্রশ্ন বুঝে হাসলেন। নিজেই বললেন,
“নিয়াজের মায়ের নতুন শাড়ি কেনার খুব শখ ছিল। জুয়েলারি থেকে শাড়ি বেশি পছন্দ ছিল। হাতে টাকা পেলেই সে আগে নতুন ডিজাইনের শাড়ি খুঁজে কিনে রাখত। আমিও তাই সবসময় শাড়ি উপহার দিতাম। আমার থেকে উপহার হিসাবে শাড়ি পেলেই সে সন্তুষ্ট থাকত। এমন করে-করে আলমারি ভর্তি হয়ে গেছে। কিছু শাড়ি সে তার আপনজনদের উপহার-ও দিয়েছে। আমি যখন জিজ্ঞেস করতাম এত শাড়ি কে পরে শেষ করবে। সে বলত তার ছেলের বউ পরবে।”
“এত শাড়ি সব পরেছিল সে?”
“হুম। এই মহিলার ধৈর্য সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। এই আলমারিতে এমন কোনো শাড়ি নেই যেটা সে না পরে রেখে দিয়েছে। নতুন শাড়ি কিনেই সে একবার হলেও তা পরেছে। অনেক সময় তো অবসর পেলে বাড়িতেও শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াত। শাড়িতে তাকে সুন্দর-ও লাগত। খুব গুছিয়ে শাড়ি পরতে জানত সে।”

আরিন্তা চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে শাড়ি দেখছে। প্রতিটি শাড়ির ডিজাইন নজর কাড়া। নিয়াজের মায়ের পছন্দ প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য বলতে হয়। আতাউর রহমান জানতে চাইলেন,
“পছন্দ হয়েছে তোমার?”
“অনেক সুন্দর সব কালেকশন। অপছন্দের কারণ নেই।”
“ঠিক আছে। তাহলে আজই খলিলকে দিয়ে এগুলো তোমাদের রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
“এত শাড়ি দিয়ে আমি কী করব?”
“তুমি কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার। আমার দায়িত্ব তোমাকে তোমার মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়া, দিলাম।”
“এগুলো সরালে তো এই আলমারিটা ফাঁকা পড়ে থাকবে।”
“তা ঠিক বলেছ। পুরোনো হলেও এটা একটা স্মৃতি। কিন্তু পুরোনো আলমারি তো তোমাদের কাজে আসবে না।”
“কাজে লাগালেই কাজে আসবে। পুরোনো হলেও আলমারিটার রং নষ্ট হওয়া ছাড়া ফেলে দেওয়ার মতো তেমন বেশি ক্ষতি হয়নি। ইচ্ছা করলে এটাকে নতুন করে রং করে এনে ব্যবহার করা যাবে।”
আতাউর রহমান শুধালেন,
“তুমি এটা ব্যবহার করতে চাও?”
“শাড়িগুলো সরিয়ে নিয়ে আলমারিটা ফেলে দিলে শাড়িগুলোর অভিমান হবে। এত বছর এই পুরোনো আলমারিটাই তো এগুলো যত্নে রেখেছে। আমি শাড়ি নিলে আলমারিসহ-ই নেব।”

আতাউর রহমান খুব সন্তুষ্ট হলেন। তিনি ভেবেই রেখেছিলেন আরিন্তাকে শাড়ি হস্তান্তর করে অকেজো আলমারিটা সরিয়ে ফেলবেন। এ যুগের ছেলে-মেয়েরা কী আর এত পুরোনো আসবাবপত্র ব্যবহার করতে চাইবে? আরিন্তার কথা শুনে তার ভীষণ খুশি লাগছে। শত হলেও এটা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রিয় স্মৃতি। তিনি বললেন,
“তোমার চিন্তা-ভাবনা দেখে আমার যে কী শান্তি লাগছে মা। নিয়াজ সত্যিই সঠিক মানুষ পছন্দ করে এনেছে। খলিলকে আমি আজই বলছি আলমারি সারাতে নিয়ে যেতে।”

আরিন্তা আজ রান্না করেছে। কাজের মেয়েটাই সবসময় রান্না করে। কিন্তু তার হাতের রান্না আরিন্তার ভালো লাগেনি। তার মনে হয়েছে এর চেয়ে তার রান্নার স্বাদ কিছুটা হলেও ভালো। সারাদিন বসে থেকেও তার বিরক্তি ধরে যায়। এর চেয়ে রান্না করলে অনেকটা সময় কে’টে যাবে। কাজের মেয়েটা রান্নার সবকিছু গুছিয়ে দিয়েছে। তাই রান্না করতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। নিয়াজের দুপুরের খাবার বাইরেই খেতে হয়। আরিন্তার রান্নার খবর তার অজানা। রাতের খাবার খেতে বসে খাবারের পদ দেখে সে একটু অবাক হলো। কাজের মেয়েটা সাধারণত এত পদ রান্না করে না। তাড়াহুড়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রান্না শেষ করে টুকটাক কাজ করেই বিদায় হয় সে। আজকের খাবার দেখতেও অন্যরকম লাগছে। আরিন্তা চুপচাপ খাবার পরিবেশন করছিল। আতাউর রহমান দুপুরেই আরিন্তার হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করেছেন। বাড়িতে বসে সবসময় এভাবে তৃপ্তি করে খাওয়া হয় না তাদের। আরিন্তার রান্নার হাত মোটামুটি ভালো। চেষ্টা করলে আরও ভালো হবে নিশ্চিত। নিয়াজ খাওয়া শুরু করে বুঝল আজকের খাবারের স্বাদ আলাদা। সে আরিন্তাকে শুধাল,
“আজ কি তুমি রান্না করেছ?”
আরিন্তা মাথা ঝাঁকাল। নিয়াজ বলল,
“এজন্যই আজ অন্যরকম লাগছে।”

আতাউর রহমান ছেলেকে প্রশ্ন করলেন,
“কেমন লাগছে?”
“ভালো।”
“আমাদের বাড়িতে তাহলে এখন থেকে আবার তৃপ্তি করে খাওয়ার দিন ফিরল। কী বলিস?”

নিয়াজ উত্তর না দিয়ে কেবল মৃদু হাসল। সে জানে না আরিন্তা আদৌ এই সংসারটাকে নিজের করে নিবে কি না। আতাউর রহমান পুনরায় বললেন,
“আজ আমার সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগছে, জানিস? তোর মা চলে যাওয়ার পর থেকে এই সংসারে বিরাট একটা শূন্যতা অনুভব করেছি। আজ মনে হচ্ছে সেই শূন্যতা অনেকখানি ঘুচে গেছে। মানতেই হবে কপাল করে বউমা পেয়েছি।”

নিয়াজ এবারেও হাসল। আরিন্তা আসার পর থেকে তার কাছেও বাড়ির পরিবেশটা অন্যরকম লাগছে। কিন্তু বাবার মতো সে প্রকাশ করতে পারছে না। সম্পর্কটা ঠিক থাকলে সবকিছু হয়তো আরও অন্যরকম হতে পারত। আরিন্তা চামচে একটু মাংস তুলে বলল,
“বাবা, আরেকটু মাংস নিন।”
আতাউর রহমান বললেন,
“আমার আর লাগবে না মা। নিয়াজকে দাও। বাইরের খাবার খেতে-খেতে ওর রুচি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার আগে ওর খাবারের দিকে নজর রেখো তুমি।”

চামচে তোলা মাংসটুকু আরিন্তা নিয়াজের প্লেটে দিলো। জিজ্ঞেস করল,
“আর কিছু লাগবে?”
নিয়াজ বলল,
“আমি নিয়ে নেব। তুমি খাও।”

মিশকাতের দেওয়া ফোনটা পেলব মেরিনার কাছে রেখে দিয়েছিল। ফেরার সময় মেরিনার কাছ থেকে আরিন্তা সেটা নিয়ে এসেছে। যদিও পেলব বারণ করেছিল দিতে। কিন্তু মেরিনা শোনেননি। আরিন্তা নিশ্চিত ছিল ফোনের সবকিছু পেলব মুছে দিয়েছে। ফোন চালু করার পর দেখল সত্যিই সবকিছু মুছে ফেলা হয়েছে। সমস্ত ছবি, চ্যাটিং ডিলিট করে মিশকাতকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে। ফোনটা এখন একদম নতুনের মতো। আরিন্তা নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার যে গুগল ব্যাকআপ আছে সে খবর হয়তো পেলব জানত না। হতে পারে খেয়ালও ছিল না। আরিন্তা ছবিগুলো ব্যাকআপ করেছে। নিয়াজ এখনও জানে না সে ফোন নিয়ে এসেছে। রাতের খাবারের পর নিয়াজ রুমে ফিরেই ল্যাপটপ নিয়ে বারান্দায় চলে গেছে। হয়তো সে আরিন্তাকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। আরিন্তা চুপচাপ শুয়ে গ্যালারি ঘেঁটে পুরোনো ছবিগুলো দেখছিল। গ্যালারি জুড়ে মিশকাতের যত স্মৃতি। একেকটা ছবি আরিন্তাকে একেক মুহূর্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। স্মৃতিচারণা করতে-করতে তার বুকের ভেতর টনটন করে ব্যথা ধরে যায়। চোখ দুটো বিনা বাঁধায় অশ্রু বিসর্জন দেয়। এক মুহুর্তের জন্য মিশকাতের মুখটা তার মন থেকে মোছে না। মস্তিষ্ক এক মুহুর্তের জন্য ওই নামটা ভোলে না। স্মৃতিরা এক মুহুর্তের জন্য শান্ত থাকে না। নিঃশব্দে কাঁদতে-কাঁদতে আরিন্তা ভুলে যায় নিজের অবস্থান। অজান্তেই তার নীরব কান্না ফুঁপিয়ে ওঠে। আরিন্তার গুনগুন কান্নার আওয়াজ নিয়াজের কানে পৌঁছায় খানিক বাদে। তার ল্যাপটপে চালানো আঙুল থেমে যায়। স্থির হয়ে ঠাঁয় বসে স্ত্রীর কান্নার আওয়াজ শোনে সে। তবু জায়গা থেকে নড়ে না। কান্নারত স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করার মতো সম্পর্ক তার নেই। তার অধিকার আছে, তার চেয়ে বেশি আছে বাঁধা। আরিন্তার সামনে আছে সুউচ্চ অদৃশ্য দেয়াল। দেয়াল টপকে আরিন্তাকে ছোঁয়ার মানসিকতা নিয়াজের নেই। দুজনের মাঝের দেয়ালটা না ভাঙা অবধি তার সমস্ত ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষারা চাপা পড়েই থাকবে। নিয়াজ অপেক্ষায় আছে কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তে আরিন্তার চোখে তার জন্য বিশেষ অনুভূতি দেখার। কিন্তু সে জানে না ঠিক কবে, কখন তার সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত আসবে; কিংবা আদৌ আসবে কি না।

আরিন্তার কান্নার শব্দ কমে এলে নিয়াজ রুমে এল। আরিন্তার দিকে তাকাতেই তার চোখ পড়ল আরিন্তার হাতের ফোনটার ওপর। তার দেওয়া ফোনটা টেবিলের ওপর দেখা যাচ্ছে। আরিন্তা তাকে বলেছিল মিশকাতের দেওয়া ফোনটা পেলবের কাছে আটকা আছে। এবার যে আরিন্তা সেটা নিয়ে এসেছে তা তার জানা ছিল না। নিয়াজ প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না। ওই ফোনে এমন কী দেখে আরিন্তা এভাবে কাঁদতে পারে, তা বুঝার মতো জ্ঞান তার আছে। তাকে দেখে আরিন্তা ফোন রেখে চোখ মুছে ফেলল। তারপর ওপাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে রইল। নিয়াজ ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে উঠল,
“আরিন্তা, জানি তুমি তোমার কষ্টের জ্বালায় কাঁদো। কিন্তু কাঁদলে তো আর কোনোকিছু ঠিক হবে না। বাস্তবতা বুঝতে হবে।”
“কোন বাস্তবতা বুঝতে বলছেন আপনি আমায়? মিশু ভাইকে ভুলে আপনাকে ভালোবাসতে হবে?”
“আমি বললেই কি তুমি তা করবে?”
“না।”
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তাহলে অন্তত নিজেকে এত কষ্ট দিয়ো না। শক্ত হও। পরিস্থিতির কাছে সমস্ত আবেগ হারিয়ে ফেলো না। সবকিছু আগের মতো না হলেও নিজেকে ভালোবাসতে ভুলো না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২২.
বিয়ের পর থেকে আরিন্তার সাথে সুবর্ণা বা খালা-খালুর যোগাযোগ হয়নি। ফোন করার সাহস সয়নি তার। ফোন করলেই না জানি তারা কী খবর দিয়ে বসে। তাদের কাছে নিজেকে দোষী-ও মনে হয় তার। মা ফোন করলেই তাদের খবরাখবর জানতে চায় সে। কিন্তু সন্তুষ্ট হওয়ার মতো তেমন কোনো খবর সে মায়ের কাছে পায় না। মেরিনা ফোন করলে তারা না কি এ ব্যাপারে কোনো কথাই বলে না। মেরিনা ফোন করে সুবর্ণাকে অনেকবার বাড়ি আসতে বললেও সে আসতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে মেরিনা নিজেই গিয়ে তাদের দেখে এসেছে। আয়েশা মুখে কিছু না বললেও ছেলের চিন্তায় দিন-রাত এক করে ফেলেছে, তা বোনের শুকনা মুখ দেখেই মেরিনার বুঝা হয়ে গেছে। কিন্তু সে কথা তিনি আরিন্তাকে জানাননি। বিয়ের আগে দুদিন পরপর খালার বাড়ি ছুটে যাওয়া আরিন্তার পক্ষে বেশিদিন মন শক্ত করে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আজ সকাল থেকেই তার মনটা বড্ড উতলা হয়ে আছে। বারবার খালার কথা মনে পড়ছে। সুবর্ণার পার্লারের খবর শুনতে ইচ্ছা করছে। অনেকদিন মেয়েটা উচ্ছাসিত মুখে বলছে না,
‘আপু জানো? আজ আমার এত জন কাস্টমার হয়েছে। সারাদিন ভীষণ চাপে ছিলাম, কিন্তু এখন আনন্দ হচ্ছে। কী খেতে চাও বলো। এই খুশিতে তোমাকে ট্রিট দেওয়া বাঞ্ছনীয়।’

সারাদিন ফোন করব-করব করেও মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে আরিন্তার ফোন করা হলো না। অবশেষে সন্ধ্যায় সে সুবর্ণার নাম্বারে কল করল। প্রথমবারেই সুবর্ণা রিসিভ করল। তাকে কোনোরকম অস্বস্তিতে না ফেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই খোঁজখবর নিল। আরিন্তা জানতে চাওয়ার আগেই নিজের পার্লারের খবর জানাল। আরিন্তা খালা-খালুর কথা জানতে চাইলে সুবর্ণা জানাল তারা ভালো আছে। সুবর্ণা আরিন্তার শশুরবাড়ি নিয়ে নানান প্রশ্ন করছে। তার এমন স্বাভাবিক আচরণ আরিন্তার কাছে খুবই অস্বাভাবিক লাগছে। সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মেয়েটা নিজের আসল অনুভূতি লুকাচ্ছে। স্বাভাবিক আলাপের আড়ালে অনেক অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে রেখেছে। সে এমন কোনো কথা ভুলেও মুখে আনতে চাইছে না যাতে আরিন্তা অস্বস্তিতে পড়বে। অনেকটা সময় আলাপের পরও সুবর্ণা নিজে থেকে মিশকাতের নাম না তোলায়, আরিন্তা নিজেই কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে শুধাল,
“মিশু ভাই কেমন আছে সুবর্ণা?”
“ভালো।”
“কাজ কেমন চলছে?”
“আগের মতোই।”
“আমার কথা কিছু বলে?”

সুবর্ণা খানিক সময় নিয়ে উত্তর দিলো,
“না।”
“সত্যি?”
“আপু, একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না। বিয়েটা যেভাবেই হোক, তোমার এখন স্বামী আছে। তাকে তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। কারণ তার কোনো দোষ নেই। তোমার মনে যা-ই চলুক। ওই সংসারকে তোমায় নিজের করে নিতে হবে। জানো তো? মেয়েদের সংসার হলে তারা কোনোভাবেই সংসারের ওপরে অন্য কোনো ভাবনা রাখতে পারে না। নিজের অজান্তেই সবকিছু্ সংসারের পরে চলে যায়। হয়তো তুমি আমাকে নির্দয় ভাববে। তবু আমার পরামর্শ থাকবে, সময় যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দাও। নিজের মনকে মুক্তি দাও। এখন তুমি কী চাও সেটা অবশ্য তোমার ব্যাপার।”

আরিন্তার চোখ ভরে উঠল টলমলে জলে। ধরা গলায় বলল,
“মিশু ভাই কি আমাকে ক্ষমা করবে না সুবর্ণা?”
“করবে না কেন? তোমার তো ভুল ছিল না।”
“ক্ষমা করলে তো আমার খবর নিত।”
“খবর নেওয়া কি উচিত? তুমি আমার ভাইকে চেনো না? তোমার বিবাহিত জীবনে ধ্বস নামানোর মতো কোনো কাজই সে করবে না।”
“বিবাহিত জীবন? মিশু ভাই সত্যিই চাইছে আমি অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিই?”
“এক্ষেত্রে তার চাওয়া, না চাওয়ায় কিছু আসে যায় না। যে ইতোমধ্যে তোমার স্বামী হয়ে গেছে, তাকে তুমি অস্বীকার করবে কীভাবে? জীবনে বিয়ে কতবার হয়, বলো? তাকে ছেড়ে দিলেও কি তুমি বা ভাইয়া আগের শান্তিটা খুঁজে পাবে? পাবে না। বরং তোমাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।”
“শান্তি আমি এই জীবনে আর পাব না রে। সেই আশা চিরতরে ম’রে গেছে। পৃথিবীতে অহরহ মেয়েদের ভালোবাসা বদলে যাচ্ছে ভালোবাসার মানুষকে ধরে রাখতে না পেরে। তারা বাধ্য হচ্ছে জীবনের সাথে জুড়ে যাওয়া পরবর্তী মানুষটিকে ভালোবাসতে। কিন্তু আমি পারব না সুবর্ণা। বিশ্বাস কর, মিশু ভাইয়ের জায়গা আমি এই জীবনে কাউকে দিতে পারব না।”
“আপু, সময় সবকিছু বদলে দেয়। দেখবে, আজ থেকে এক বছর পরে গিয়ে এই পরবর্তী মানুষটাই তোমার একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে উঠবে। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথা।”
“আমি পারব না। কোনোভাবেই পারব না। আমার মনে সেই জায়গাটাই নেই রে। মিশু ভাইকে দেওয়া সমস্ত কথা আমি কী করে ভাঙব?”

আরিন্তা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। সুবর্ণা ভেজা চোখে বলল,
“আপু, তোমার মনে যা চলে আমাকে বলতে পারো সবসময়। আমি তোমাকে আটকাব না। কিন্তু তুমি তোমার জীবনকে এক জায়গায় আটকে রাখতে পারবে না। আমি বলছি না তোমায় আমার ভাইকে ভুলে যেতে। সেই অধিকার আমার নেই। কিন্তু তার কথা জানতে চেয়ো না। তুমি যেমন তোমার মতো থাকছো, তাকেও তার মতো থাকতে দাও। তোমার মনের কথা বলার মানুষ আছে, কিন্তু আমার ভাইটার নেই। তোমার মতো ইচ্ছা করলেই সে আমাদের ফোন করে কেঁদে-কেঁদে মনের ব্যথা প্রকাশ করতে পারে না। তোমার বিয়ের এক মাস হতে চলল। আজ পর্যন্ত ভাইয়া আমাদের নিজের মনের কথা বলেনি। আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস-ও করি না। কী দরকার কা’টা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার? সময় যেভাবে চলছে চলুক না। একটা সময় ঠিকই সবকিছু বদলে যাবে।”
“এসব এত সহজ নয়।”
“জানি, তবু তোমায় সহজ থাকতে হবে। আমি তোমাকে ভালো দেখতে চাই আপু। প্লিজ নিজেকে সুযোগ দাও। তুমি ভালো থাকলে আমার ভাই-ও ভালো থাকবে।”
“আমাকে মিথ্যা বুঝানোর চেষ্টা করিস না সুবর্ণা। আমি জানি তোর ভাই ভালো নেই। মিশু ভাই ভালো থাকতে পারবে না, সে আমি যেমনই থাকি।”
সুবর্ণা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করে বলল,
“ভিডিয়ো কল দিই। তোমার শশুরবাড়ি দেখাও একটু।”
“কাল দিনের বেলায় দেখিস। এখন রাখছি, কাল ফোন করব নে আবার।”
“মায়ের সাথে কথা বলবে না?”
“কাল বলব।”
“আচ্ছা, রাখো তাহলে।”
আরিন্তা ফোন কে’টে দিলো। একা ঘরে নীরবে অনেকটা সময় কাঁদার পর টের পেল মাথাটা ভার হয়ে আসছে। চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। তাই সে ঘরের লাইট বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইল।

নিয়াজ বাড়ি ফিরে নিজের ঘরের লাইট বন্ধ দেখে কপাল কুঁচকাল। সাধারণত এই সময়ে আরিন্তাকে হয় বাবার ঘরে পাওয়া যায়, নয়তো বই পড়তে বা ফোন দেখতে দেখা যায়। বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে এসেছে সে। আরিন্তাকে ওখানে দেখেনি। এখন ঘরে ফিরে চারদিকে অন্ধকার দেখে তার মন কেমন একটা করে উঠল। দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে দেখল আরিন্তা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। অন্ধকার ঘর হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠেছে টের পেয়ে সে মুখ তুলে তাকাল। নিয়াজকে দেখে বলল,
“আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলেন যে?”
নিয়াজ বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“ঠিক সময়েই এসেছি। তোমার হয়তো সময় খেয়াল নেই।”
“ওহ্।”
শব্দটা উচ্চারণ করেই আরিন্তা উঠে বসল। এতক্ষণ পর শোয়া থেকে উঠে বসতেই মাথাটার মধ্যে টনটন করে উঠল। আরিন্তা চোখ-কপাল কুঁচকে মাথা ঝাড়া দিলো। নিয়াজ মনোযোগ দিয়ে আরিন্তার মুখের অবস্থা লক্ষ্য করে শুধাল,
“তোমার কি মাথা ব্যথা করছে?”
“তেমন কিছু না।”
“তোমাকে ঠিক লাগছে না। শরীর বেশি খারাপ লাগলে শুয়ে থাকো।”
“সমস্যা নেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, টেবিলে খাবার দিচ্ছি আমি।”

আরিন্তা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ানো মাত্রই নিয়াজ তার বাহু ধরে পুনরায় বিছানায় বসিয়ে দিলো। আরিন্তা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই নিয়াছ হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আরিন্তা, তুমি না চাইলেও এখানে তোমার খেয়াল রাখার দায়িত্ব শুধু আমারই। আমি এতটাও নির্দয় নই যে, একজন অসুস্থ মানুষ খাবার বেড়ে না দিলে আমি নিজে নিয়ে খেতে পারব না। তুমি আসার আগে আমি নিজেই খাবার নিয়ে খেয়েছি।”
“আমার সমস্যা হবে না।”
“আমার সমস্যা হবে। চুপচাপ শুয়ে থাকো।”
“বাবাকে খাবার দিতে হবে।”
“আমি দিতে পারব। মেডিসিন খেয়েছ?”
আরিন্তা না-বোধক মাথা নাড়ল। নিয়াজ হতাশ গলায় বলল,
“তুমি নিজের ব্যাপারে অনেক উদাসীন।”

নিয়াজ ড্রয়ার খুলে ঔষধের বক্স বের করল। গ্লাস ভর্তি পানি আর ঔষধ আরিন্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“কান্নাকাটি করে মাথাব্যথা ডেকে এনেছ?”
আরিন্তা পানি মুখে নেওয়ার আগে উত্তর দিলো,
“সুবর্ণাকে ফোন করেছিলাম।”
নিয়াজ আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বোধ হয় সহসা কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তারপর ধীর গলায় বলল,
“এক মাস হতে চলল। আর কতদিন এভাবে সময়ে-অসময়ে চোখের পানি ফেলবে? তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগে না।”
“স্বাভাবিক, ভালো লাগার মতো আচরণ আমি আপনার সাথে করি না। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, মনের ওপর জোর খাটিয়ে আমাকে আপনার সহ্য করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি যখন ইচ্ছা আমাকে ছুড়ে ফেলতে পারেন।”
“আমি তোমাকে ছুড়ে ফেলার জন্য স্ত্রীর সম্মান দিয়ে নিজের ঘরে তুলিনি।”
“আপনি সম্মান দিয়ে ঘরে তুলেছেন, কিন্তু আমি কখনোই সেই সম্মানের মর্যাদা দিই না।”
“আজ দাও না, কাল তো দিতেও পারো। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? জীবন তো একভাবে চলে না। সময় আর পরিস্থিতির সাথে বদলাতে থাকে।”

আরিন্তা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
“দয়া করে আমার ওপর কোনো প্রত্যাশা রাখবেন না। আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি মিশু ভাইয়ের জায়গা আমি দ্বিতীয় কাউকে দিতে পারব না। তা ভবিষ্যত কেন, এক জন্মেও না।”
“আমিও তোমাকে প্রথম থেকেই বলেছি তোমাকে জয় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব।”

আরিন্তা কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। নিয়াজ শুধাল,
“রাগ করলে?”
“না। বাবাকে খাবার দিতে দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
“আমি যাচ্ছি। তোমার শরীর খারাপ, শুয়ে থাকো।”
“আমার শরীরের অবস্থা আমি আপনার থেকে ভালো জানি। দয়া করে আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করবেন না। হঠাৎ-হঠাৎ আমার আচরণে কষ্ট পেতে পারেন। আমি আপনার সাথে খারাপ আচরণ করতে চাই না।”

আরিন্তার শরীর খারাপ বলেই যে আজ খাবার দিতে দেরী হয়েছে বুঝতে পারলেন আতাউর রহমান। মেয়েটা মুখে কিছুই বলে না। অথচ চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। খেতে বসে তিনি জিজ্ঞেস করার পরও বলেছে শরীর ঠিক আছে। নিয়াজ বলার পরেই তিনি জানতে পেরেছেন। আতাউর রহমান নিয়াজকে বললেন সে যেন আগামীকাল আরিন্তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন। নিয়াজ সঙ্গে-সঙ্গেই রাজি হলো। কিন্তু আরিন্তা বলল সে হাসপাতালে যেতে চায় না। বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না তার। আতাউর রহমান তাকে বুঝিয়ে বললেন স্বাস্থ্য পরীক্ষা কতটা জরুরী। আতাউর রহমান ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে আজকাল খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। প্রায় এক মাস হতে চলল তাদের বিয়ের। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক দম্পতির মতো মনে হচ্ছে না। তারা কথাও বলে মেপে-মেপে। প্রয়োজনের বাইরে কোনো বিষয়ে কথা বলাই যেন তাদের জন্য বাক্য অপচয় বা সময়ের অপব্যবহার। অপরিচিত মানুষের মতো নিজ-নিজ ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে কথা বলে তারা। প্রথমদিকে সহজভাবে নিলেও, আজকাল এই বিষয়গুলো আতাউর রহমানের চোখে লাগছে। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ। নারী-পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা পরিস্থিতি দেখেই আঁচ করতে পারেন। তবে তিনি এটাই মিলাতে পারছেন না এদের সম্পর্কে সমস্যাটা কোথায়। এমনিতে তো দুজনকেই একে অপরকে যথেষ্ট সম্মান দিতে দেখা যায়। কোনোরকম কথা কা’টাকা’টি-ও শোনা যায় না। দুজন সবদিক থেকে ঠিকঠাক থাকার পরেও তাদের সম্পর্ক কেন জটিল?

আজ আবধি আরিন্তাকে সাথে নিয়ে নিয়াজের বাড়ির বাইরে বেরোনো হয়নি। একেবারেই যে সময় পায়নি এমনটা নয়। সে সময় করে কয়েকবারই বেরোতে চেয়েছিল। আরিন্তা রাজি হয়নি। শপিং করতে যেতে-ও রাজি করা যায়নি তাকে। এমনকি এ কদিনে তার বাবা-মা হাজারবার বাড়ি যেতে অনুরোধ করেও তাকে রাজি করাতে পারেনি। নিয়াজকে তারা প্রতিদিন ফোন করে অনেক করে বলে আরিন্তাকে নিয়ে গিয়ে যেন কদিন থেকে আসে। নিয়াজ বলেছিল-ও। আরিন্তার এক কথা, ওই বাড়িতে একটা দিন পার করাও তার জন্য যন্ত্রণার। অথচ নিয়াজ জানে মেয়েটার মন মায়ের জন্য ছটফট করে। মেরিনার কান্নাকাটির কারণে একবার নিয়াজ আরিন্তাকে ভালোভাবে বুঝাতেও চেয়েছিল। আরিন্তা উলটা তাকে বলে বসেছিল,
“আপনার কাছে শশুরবাড়ি মধুর হাড়ি মনে হলে আপনি যান। ওই বাড়িতে মেয়ের আদর না থাকলেও, জামাই আদরে কমতি পড়বে না। নিশ্চিন্তে গিয়ে বেড়িয়ে আসুন। একমাত্র আদরের জামাইকে এক মাসে একবার দেখতে না পেয়ে হয়তো সবার মন খারাপ লাগছে।”

এরপর আর নিয়াজ তাকে বুঝাতে যায়নি। কিন্তু এবারে আরিন্তার বাড়ির বাইরে পা না রেখে উপায় নেই। নিয়াজের খালাতো ভাইয়ের বিয়ে এক বছর আগে হলেও, তখন ব্যক্তিগত কারণে রিসেপশন করতে পারেনি। তাই এখন তারা বিরাট আয়োজনে রিসেপশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিয়াজের খালা নিজে ফোন করে আরিন্তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে সময়মতো তাদের বাড়ি চলে যেতে। খালুও একবার ফোন করে বলেছে। নিয়াজের খালার বাড়ি ময়মনসিংহ। আতাউর রহমান জার্নি করে এতদূরে যেতে চাইছেন না। তাই তিনি সবাইকে বলে দিয়েছেন নিয়াজ-আরিন্তা যাবে। শেষমেশ আতাউর রহমান-ও তাকে যাওয়ার কথা বলে বসার পর আর আরিন্তা নিজের অনিচ্ছা প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি। এবার অবশ্য নিয়াজকে কিছুই বলতে হয়নি। ফাঁদে পড়ে আরিন্তা নিজেই ব্যাগপত্র গোছাতে লেগে পড়েছে। তার চোখে-মুখে তীব্র অনিচ্ছা লক্ষ্য করে নিয়াজ বলল,
“এবার কিন্তু আমি তোমাকে কোথাও যেতে বলিনি।”
“সেজন্যই তো এবার যেতে হচ্ছে।”
“ওখানকার সবাই খুব মিশুক। তোমার খারাপ লাগবে না, দেখো। গিয়ে দেখবে সবাই কত আনন্দ করছে।”
“আনন্দে আমার রুচি নেই।”
“রুচি আছে, তুমি তা চাপা দিয়ে রাখছো।”
“যার জীবন থেকে আনন্দের উৎস-ই মুছে গেছে, সে আর কোন আনন্দ চাপা দিয়ে রাখবে?”
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলল,
“এভাবে নিজেকে হারাতে দিয়ো না আরিন্তা।”
“নিজেকে ধরে রাখার কোনো কারণ নেই আমার।”
“আমি সেই কারণ হতে চাই।”
“আমার কাছে সেই জায়গা নেই।”
“নিজের জায়গা আমি তৈরি করে নেব। তোমাকে দিতে হবে না।”

আরিন্তা আর কথা বাড়ায় না। ব্যাগের গোছানো কাপড় নতুন করে গোছানো ধরে ব্যস্ত হতে চায়। বুঝতে পেরে নিয়াজ আর কথা টানে না।

নিয়াজ এক চালাকি করে বসেছে। সে আরিন্তাকে বলেছে তার গাড়িতে কী এক সমস্যা হয়েছে, তাই এতদূর নেওয়া যাবে না। পথে গাড়ি খারাপ হলে পড়ে সমস্যায় পড়তে হবে। তাই তারা ভাড়া গাড়িতে যাচ্ছে। আসলে কথাটা সত্য নয়। নিয়াজের গাড়ি একদম ঠিক আছে। সে চাচ্ছে না এত পথ ড্রাইভ করে সময় নষ্ট করতে। তার চেয়ে ভাড়া গাড়িতে গেলে অনেকটা সময় আরিন্তার কাছাকাছি থাকা যাবে। মেয়েটা সঙ্গ-ও পাবে। এমনিতেই বাড়িতে একা পড়ে থাকে। নিয়াজ চায় না আরিন্তা বাইরে বেরিয়েও একাকী সময় কা’টাক। আতাউর রহমানের খেয়াল রাখার লোককে নিয়াজ বারবার বলে দিয়েছে বাবার খেয়াল রাখতে। আরিন্তা-ও কাজের মেয়েটাকে ভালোভাবে রান্নাবান্না করার কথা বলেছে। তাদের দুশ্চিন্তা দেখে আতাউর রহমান হেসে বললেন,
“দুই-তিনদিনে আমার বিশাল সমস্যা হবে না। এত চিন্তার কিছু নেই। নিশ্চিন্তে আনন্দ করে এসো তোমরা।”

আরিন্তা একা রাস্তা পেরোতে জানে না। দুদিক থেকে একের পর এক গাড়ি আসা-যাওয়ার মধ্যে রাস্তা পেরোতে তার ভীষণ ভয় লাগে। মনে হয় এক্ষুনি তাকে পিষে ফেলবে। প্রথমেই নিয়াজের সন্দেহ হয়েছিল আরিন্তা রাস্তা পার হতে পারে কি না। আরিন্তার ভীতু মুখ দেখে বলল,
“আমি পার করে নেব। ভয় পেয়ো না।”
নিয়াজ আরিন্তার হাত ধরতে গেলে আরিন্তা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আপনার সাথে-সাথে যেতে পারব।”
আরিন্তাকে পাশে নিয়ে নিয়াজ দুহাত দুদিকে তুলে রাস্তা পেরোতে লাগল। কিন্তু আরিন্তা ভয়ে নিয়াজের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে ব্যর্থ হলো। রাস্তার মাঝামাঝি এসে আরিন্তা এগোতে না পারায় নিয়াজ দূর্ঘটনার ভয় পেল। আরিন্তার এক হাত মুঠোয় চেপে ধরে সে আরেক হাত তুলে দ্রুত আরিন্তাকে টেনে ওপারে নিয়ে গেল। ওপারে গিয়ে আরিন্তা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিয়াজের মুঠো থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
“এজন্য আমার রাস্তায় নামতে ভয় লাগে।”

গতকালই নিয়াজ পরিচিত এক প্রাইভেট কার ঠিক করে রেখেছিল। ড্রাইভারকে নিয়াজ বলেছিল গাড়ি নিয়ে তার বাড়ির সামনে থাকতে। কিন্তু লোকটা কী এক কাজে আটকে পড়ে গাড়ি নিয়ে তার বাড়ি অবধি যেতে পারেনি। নিয়াজকে ফোন করে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়ে বলেছে বেশি দেরী মনে হলে কষ্ট করে একটু পথ এগিয়ে গিয়ে গাড়ি ধরতে। নয়তো অপেক্ষা করতে। দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার চেয়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ি ধরা ভালো মনে করে নিয়াজ পথ চলছিল। কিন্তু রাস্তা পেরোতে গিয়ে আরিন্তার অবস্থা দেখার পর হঠাৎ মনে হলো নিজের গাড়িটা নিয়ে না বেরিয়ে সে সত্যিই ভুল করে ফেলেছে। নিজের চালাকিতে এখন তার নিজেরই কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করছে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তির পর্ব-১৯+২০

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তির
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৯.
জমকালো আয়োজনে ধুমধাম করে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন পুলক তালুকদার। সুনাম করার বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখেননি। গোটা এলাকা জুড়ে লোকমুখে তার প্রশংসা,
‘তালুকদার মেয়ে বিয়ে দিয়েছে দেখার মতো আয়োজন করে। পাঁচ এলাকায় এমন আয়োজন কেউ করতে পারেনি। টাকা থাকলেই হয় না, আত্মা থাকতে হয়। তালুকদারের আত্মা আছে। কপাল করে জামাইও পেয়েছে লাখে একটা। যেমনি চেহারা, তেমনি টাকা। পারিবারিক অবস্থান তো দেখলেই বুঝা যায়। কোনোদিকে কমতি নেই। মেয়ে বাবার বাড়ি রাজকন্যার মতো ছিল, শশুরবাড়ি গিয়েও রাজরানি হয়ে থাকবে।’

আরিন্তার বিদায়ের পর মেরিনা ড্রয়িংরুমে নেতিয়ে পড়ে আহাজারি করে কেঁদে চলেছেন। চোখ মুছতে-মুছতে আয়েশা বোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। চুপচাপ বসে চোখের পানি ফেলছেন পুলক তালুকদার-ও। পেলব ঘরের দরজা আটকেছে বোনকে বিদায় দিয়েই। বাড়িসুদ্ধ লোকজনকে চোখের পানি দেখাতে চায় না সে।
সুবর্ণা ব্যাগ হাতে দোতলা থেকে নেমে এল। তা দেখে দুই-একজন জিজ্ঞেস করল সে ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। সুবর্ণা কারোর সাথে কথা বলল না। কান্নারত মেরিনার কাছে গিয়ে বসতেই আয়েশা তার ব্যাগের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
সুবর্ণা মেরিনার এক হাত ধরে বলল,
“খালা, আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। কান্নাকাটি করে শরীর খারাপ কোরো না তুমি। আপুর সাথে ঠিকমতো কথা বোলো।”
আয়েশা বলে উঠলেন,
“তুই এখনই বাড়ি যাচ্ছিস মানে কী?”
সুবর্ণা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না মা। তোমাদের যখন ইচ্ছা যেয়ো, আমাকে এখন যেতে হবে।”

মেরিনা সুবর্ণার হাত আঁকড়ে ধরে বললেন,
“তুই এখনই যাচ্ছিস কেনো? রাগ করেছিস?”
“আমি ছোটো মানুষ, কার ওপর রাগ করব? আমার কাজ আছে, থাকতে পারব না।”
“আমি জানি তুই রাগ করেছিস। যাস না মা। তোরা-ও চলে গেলে আমি কী করব?”
“আমাকে আর এখানে থাকতে বোলো না খালা। আমার দম বন্ধ লাগছে। আমি বাড়ি ফিরে শান্তিতে থাকতে চাই।”

সুবর্ণার গলা ধরে এসেছে। মেরিনা কাঁদতে-কাঁদতে বললেন,
“আমার মিশুকে বলিস আমাকে মাফ করে দিতে মা। আমার মিশুর খারাপ আমি কোনোদিন চাই না। আমার বাবার মনে কষ্ট দিতে চাইনি আমি। এতদূরে একা-একা আমার বাবা না জানি কত কষ্ট পাবে! ও সুবর্ণা, ওকে বলিস আমার ওপর রাগ না করতে।”

পুলক তালুকদার আয়েশাকে ইশারা করে বললেন,
“তোমার বোনকে রুমে নিয়ে যাও। সবার সামনে আবোল-তাবোল বলতে বারণ করো।”
আয়েশা বললেন,
“আপা, ওঠো। কান্নাকাটি বন্ধ করো। রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো, চলো।”
সুবর্ণা বলল,
“খালা, তুমি এমন কোরো না। আমরা সবাই তো জানি তুমি কেমন। ভাইয়া তোমার ওপর রাগ করবে না। যাও, রুমে যাও।”
তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা, আমি গেলাম। তুমি খালার কাছে থাকো।”
“সাবধানে যাস। রাতে একা ঘরে ঘুমাস না। কাউকে ডেকে নিস।”
“আচ্ছা।”

সুবর্ণা পুলক তালুকদারকে বলে চলে গেল। পুলক তালুকদার কিছুই বললেন না। কাছে থাকা আত্মীয়দের দুই-একজন যাদের কানে তাদের কথাবার্তা গেছে, তারা কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই হয়তো প্রশ্ন করে বসবে। সুবর্ণা চলে যেতেই মেরিনাকে ধরে আয়েশা রুমে নিয়ে গেল।


নিয়াজের ঘরে বাসর সাজানো হয়েছে। ঘরভর্তি দারুণ সব ফুলের মৌ-মৌ গন্ধ। অথচ এত মিষ্টি গন্ধ আরিন্তাকে অনুভব করতে পারছে না। মন ছুঁতে পারছে না ঘরের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। মালিকানা পাওয়া ঘরটাকে আপন লাগছে না। বাসরঘরে বসে থেকেও মন কারো আগমনের অপেক্ষায় ধুকপুক করছে না। নতুন জীবন নিয়ে সাজাচ্ছে না কোনোরকম নতুন স্বপ্ন। মস্তিষ্ক জুড়ে চক্রাকারে ঘুরছে শুধু একটি নাম, মিশকাত খাঁন; যাকে দেওয়া কথা ভেঙে আরিন্তা আজ অন্যকারো সহধর্মিণী। যার অজান্তে আরিন্তা বাসরঘরে বসে আছে অন্য কোনো পুরুষের জন্য। অথচ বিষাক্ত অনুভূতিটা এখনও অবধি সে একাই বয়ে বেড়াচ্ছে। মন খুব করে চাইছে এই অসহ্য যন্ত্রণা ওই মানুষটাকে ছুঁতে না পারুক। কিন্তু মন এটাও জানে, আজ বা কাল এই নরক যন্ত্রণা মিশকাতকেও গ্রাস করবে। তার চেয়েও ভয়ানকভাবে ভেঙে দিবে ওই মানুষটাকে। পাগলপ্রায় ভালোবাসার পরিণতিতে কী অপেক্ষা করছে, জানা নেই আরিন্তার। তবে এটুকু জানে, মিশু ভাইয়ের জীবন সে এমনভাবে এলোমেলো করে দিয়েছে, যা গুছিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারোর নেই। আরিন্তা খুব চেষ্টা করেছিল বিয়েটা আটকানোর। সবসময় সমর্থন করা ভাইয়ের সাথে রীতিমতো ঝগড়া করেছিল। ভাইয়ের ভেতরের পাষাণ রূপটা সে বাগে আনতে পারেনি। না পেরে শেষমেশ বাবার পায়ে অবধি পড়েছিল। কাঁদতে-কাঁদতে কত আকুতি-মিনতি করেছিল! অথচ বাবা গাম্ভীর্যের সঙ্গে এড়িয়ে গিয়েছিল। বারবার ব্যর্থ হয়ে শেষে বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানোর মতো ভয়ানক সিদ্ধান্ত-ও সে নিয়েছিল। গন্তব্য অজানা জেনেও চেষ্টা করেছিল নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার। কিন্তু ভাইয়ের কড়া নজরদারির কাছে ধরা পড়ে আরও বিপদ বেড়ে গিয়েছিল। পেলব সেদিন খুব বেশি রেগে গিয়েছিল। আরিন্তার সঙ্গে চেঁচামেচি তো করেছিলই, রাগের মাথায় হুমকিও দিয়েছিল। মিশকাত যেদিনই দেশে ফিরুক, তাকে সে এলাকায় পা রাখতে দিবে না। মিশকাতসহ তার পুরো পরিবারের সাথে আজীবনের জন্য সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবে। এমনকি তাদের এলাকাছাড়া করতেও সে দুবার ভাববে না। নিজেদের সম্মান বাঁচাতে সেদিন পেলবের পাষণ্ড রূপ বেরিয়ে এসেছিল। আরিন্তার সমস্ত পথ বন্ধ ছিল, কেবল আত্মত্যাগ ছাড়া। কিন্তু সে পথে পা বাড়ানোর সাহস সে ভুল করেও করেনি। কেবলমাত্র একজন মানুষকে আরও একবার চোখের দেখা দেখার জন্য, হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরের এক সপ্তাহ আরিন্তা যেন ঘোরের মধ্যে কা’টিয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তার মনের মৃ’ত্যু। ডক্টর নিয়াজ বিয়ের আগে হবু বউয়ের সঙ্গে ফোনালাপ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরিন্তা পারেনি কথা বলতে। মনের ভয় থেকে পেলব নিজেই কথা বলতে দেয়নি। আরিন্তা লাজুক, ফোনে কথা বলতে চাইছে না, এটা-ওটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে।

কাজিনমহলের দাবি মিটিয়ে কোনোমতে তাদের হাত থেকে ছাড় পেয়ে নিয়াজ আরিন্তার কাছে আসতে পেরেছে। মেয়েটাকে একা বসে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাতে খারাপ লাগছিল তার। আজ তাদের নতুন জীবনের শুরু। কত কথা আছে একে-অপরের। পরস্পরকে ভালোভাবে জানতে হলে একটা দীর্ঘ আলাপের প্রয়োজন আছে তো। নিয়াজ জানে এই বিশেষ দিনটিতে মেয়েদের মনে অনেক কথা জমে থাকে। জীবনসঙ্গিনী তাদের মনকে প্রাধান্য না দিলে তারা সেসব কথা প্রকাশ করতে পারে না। এটা তাদের মনোকষ্টের-ও কারণ হতে পারে। নিজের মনের কথা নিজের মানুষের সঙ্গে শেয়ার করার সুযোগটা কোন মেয়ে না চায়? নতুন জীবনের শুরুতেই নিয়াজ কোনো ভুল করতে চায় না। তার নিজের মনেই তো কতশত কথা জমে আছে আরিন্তার জন্য। গত এক সপ্তাহে সেসব জমানো কথারা তাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। মনখুলে কথাদের মুক্তি না দেওয়া অবধি যেন পেটের ভেতরের মোচড়া-মুচড়ি থামবেই না। গোটা দুনিয়ার কাছে চাপা স্বভাবের এক শক্ত মনের পুরুষ নিয়াজ। একমাত্র আরিন্তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার বহুদিনের। নিয়াজের আগমন টের পেয়েও আরিন্তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। নিয়াজ বলল,
“নতুন জায়গায় একা বসে থাকতে খারাপ লাগছিল তোমার?”
আরিন্তা প্রশ্ন শুনল, কিন্তু উত্তর দিলো না। নিয়াজ পুনরায় বলল,
“আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না। কালকের মধ্যে বাসা ফাঁকা হয়ে যাবে। তারপর দেখবে নতুন পরিবেশ দুদিনেই পুরোনো মনে হচ্ছে। তুমি কি বাবা-মাকে মিস করছো? আসার পর কথা বলেছ তাদের সাথে?

আরিন্তা এবারেও নিরুত্তর। একইভাবে ঠাঁয় বসে আছে। নিয়াজ স্পষ্ট দৃষ্টিতে আরিন্তার দিকে তাকাল। মেয়েটা কথা বলা তো দূর, নড়াচড়াও করছে না। লজ্জা পাচ্ছে, না ভয়? নিয়াজ এগিয়ে গিয়ে আরিন্তার সামনে বসল। আরিন্তার পরনের শাড়ির আঁচল টেনে মাথার তালু অবধি ঘোমটা দেওয়া। মাথা নিচু করে বসেছে সে। নিয়াজ নিজের মাথা নিচু করে উঁকি মে’রে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কি লজ্জায় কথা বলছো না?”
আরিন্তা সঙ্গে-সঙ্গে মুখ তুলে উত্তর দিলো,
“না, আমার লজ্জা কম। সবার জন্য আসে না।”

নিয়াজ যেন ছোটোখাটো এক ধাক্কা খেল। বিয়ের প্রথম রাতে প্রথম কথাতেই বউ নিজের মুখে বলছে তার লজ্জা কম। এমন অদ্ভুত কাণ্ড বোধ হয় আরিন্তাই প্রথম করল। তার ওপর নিয়াজের সাথে এটাই তার প্রথম কথা। সারাদিনে নিয়াজ অনেকবার তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে প্রতিবারই নীরব ছিল। নিয়াজ ভেবেছিল অতিরিক্ত লজ্জায় কথা বলছে না। তাহলে এটা কী বলল আরিন্তা! ধাক্কাটা সামলে নিয়ে নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে? সারাদিন যে কথা বললে না আমার সাথে? বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও তো লজ্জায় কথা বললে না। এখন হঠাৎ করে লজ্জা কমে গেল কীভাবে?”
“আপনি বুঝবেন না।”
“আমি বুঝব না? তুমি আমার সিনিয়র, না আমি তোমার সিনিয়র?”

আরিন্তা এবারেও উত্তর না দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। নিয়াজ আবারও মাথা নিচু করে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“কান্নাকাটি করে চোখ দুটোর কী অবস্থা করেছ! তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছি।”
“হ্যাঁ, কিডন্যাপই বলা চলে।”
নিয়াজ হাসল। পরক্ষণেই নরম সুরে বলল,
“তুমি জানো তুমি কত সুন্দর?”
আরিন্তা উত্তর দিলো,
“সত্যি কথা না জানার কিছু নেই।”

নিয়াজ ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরাতে পারছে না। তার নতুন বউ যে এমন বাচ্চামি কথাবার্তা বলছে, এটা অদ্ভুত হলেও তার মজা লাগছে। সে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“জানতে না কি? কতবার শুনেছ তুমি এই প্রশংসা?”
“অসংখ্যবার।”
“ও বাবা! এত প্রশংসা কারা করেছে?”
“যার কাছে আমি চাঁদের মতো।”

নিয়াজ ভ্রুকুটি করল। সে ভাবেইনি আরিন্তা এমন নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারে। সে ভেবেছিল বিয়ের পর বউয়ের লজ্জা ভাঙতেই তাকে যথেষ্ট ভুগতে হবে। কিন্তু হলো তার উলটোটা। তবে আরিন্তার মনখোলা স্বভাবটা নিয়াজের ভীষণ ভালো লাগছে। সে হাসিমুখে মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে আরিন্তার নত মুখে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা সত্যিই চাঁদের মতো সুন্দর। অন্যদের থেকে প্রশংসা শোনা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

“তোমার না লজ্জা কম? তাহলে মাথা নিচু করে থাকো কেন? চাঁদের মতো মুখটা মনভরে দেখতে না দিলে প্রথম চোখাচোখি সার্থক হবে কীভাবে? দেখি, তাকাও তো আমার দিকে।”
কথাটা বলে নিয়াজ আরিন্তার থুতনি ছুঁতে হাত বাড়াতেই আরিন্তা পেছনে হেলে পড়ল। ফলস্বরূপ খাটের হেডবোর্ডের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে তার মাথা ধরে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে সে মাথার পেছনে হাত চেপে ধরল। কিন্তু মুখ দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ বের করল না। নিয়াজ চমকে উঠে দুহাতে আরিন্তার মাথা ধরে বলল,
“ব্যথা পেয়েছ? দেখি।”
আরিন্তা আবারও মাথা সরিয়ে নিল। অসন্তুষ্ট চোখে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি তো দেখি কিছুই জানেন না। আশ্চর্য!”
নিয়াজ শুধাল,
“কী জানি না?”
“আমাকে ছোঁয়ার অনুমতি চেয়েছেন আপনি?”
নিয়াজ আরেক ধাক্কা খেয়ে পূর্বের জায়গায় বসে পড়ল। চমকিত হয়ে বলল,
“তুমি তো আমার অভিজ্ঞ গুরুজন। আমি যা না জানি তা শিখিয়ে দাও।”
“অভিজ্ঞ না, বুঝদার। এত বড়ো মানুষ, ভুলভাল কথা বলছেন কেন?”
“আমার তো মনে হচ্ছে তুমি আমার চেয়ে শত বছর বড়ো মানুষ।”
“আপনার মন বড্ড কাঁচা। কোনোকিছুই বুঝতে পারে না।”
হাতের তালুতে মাথা ঘষছে আরিন্তা। নিয়াজ ভাবুক সুরে বলল,
“তুমি এত পাকা কথা বলো, বুঝে উঠতে এখন আমার নিজেকেই গাধা মনে হচ্ছে। আচ্ছা থাক, মাথা অনেক ব্যথা করছে? দেখতে দাও আমাকে।”

আরিন্তা এবারেও বাঁধা দিয়ে বলল,
“দেখতে হবে না। কিছু হয়নি।”
“ব্যথা করছে, আবার বলছো কিছু হয়নি?”
“এটুকু ব্যথায় কিছু হয় না। সয়ে নিয়েছি।”
“ডক্টর আমি, না তুমি?”
“পুরুষরা বাইরে ডক্টর, ঘরে না। ঘরে নারীরাই আসল ডক্টর।”
নিয়াজ শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“সালাম তোমাকে আমার ঘরের ডক্টরনি।”

আরিন্তাকে নিজে থেকে কোনো কথাই বলতে না দেখে নিয়াজ প্রশ্ন করল,
“তোমার কি খুব খারাপ লাগছে এখানে?”
আরিন্তা সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ।”
নিয়াজ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বাড়ি থেকে হসপিটাল, হসপিটাল থেকে বাড়ি ছুটে চলি। বাবাকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারি না। জানি বাবার একা থাকতে খারাপ লাগে, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। এখন তুমি এসেছ। বাবা হয়তো তোমাকে পাশে পেয়ে একাকিত্ব ভুলে যাবে। এটা ভেবে আমার শান্তি লাগছে। কিন্তু এটা ভেবেও খারাপ লাগছে যে, বাবার একাকিত্ব হয়তো তোমাকে পেয়ে বসবে। কী করব বলো? মা নেই। আমি ছাড়া কোনো ভাই-বোন নেই। আমরা একাকিত্বেই অভ্যস্ত। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, আমার জন্য একটু কষ্ট করে মানিয়ে নিয়ো প্লিজ। আমার প্রতি তোমার অভিযোগ থাকলেও আমাকে জানিয়ে দিবে। আমি কিছু মনে করব না। এই পরিবারটার তোমাকে খুব প্রয়োজন আরিন্তা। নিজের করে নিয়ো একে।”

আরিন্তা চুপচাপ নিয়াজের কথা শুনল। কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। তার মনের অবস্থা তো নিয়াজ জানে না। নতুন বউয়ের কাছে মনের কথা বলাটা তার জন্য স্বাভাবিক। নিয়াজ বলল,
“আমার কথা শুনতে কি তোমার খারাপ লাগছে? কিছু বলছো না যে?”
আরিন্তা বলল,
“আমি জানি না আমার কী বলা উচিত।”
“মনে যা আসে বলো, তোমার কথাও তো আমার শুনতে হবে।”
“আমার মনে তো কোনো কথা নেই।”
“নতুন জীবনের শুরুতে তোমার মনে কোনো কথাই নেই? এতদিনেও তোমার মনে কোনো কথা জমা হয়নি?”
“না।”

নিয়াজ অবাক হলো। আরিন্তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। একটু আগেও তো মনে হচ্ছিল মেয়েটা প্রচুর কথা বলতে পারে। এখন বলছে তার মনে কোনো কথাই নেই। সে কি বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও নিজের নতুন জীবন, নতুন মানুষ নিয়ে ভাবেনি? এটা কীভাবে সম্ভব? পুরুষ হয়েও তো নিয়াজ গোটা এক সপ্তাহ এসব ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনি। বিষয়টাকে বেশি না ঘেঁটে নিয়াজ প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“আজ আমাদের সম্পর্কের সূচনা। স্মরণে রাখার মতো দিন। আমার কাছে তোমার কী চাওয়ার আছে আরিন্তা?”
“কিছু না।”
“লজ্জা কোরো না। মন যা চায় বলো। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার প্রথম চাওয়া পূরণ করার।”
আরিন্তা একটু চুপ থেকে বলল,
“যা চাইব তা-ই দিবেন?”
“দিবো, বলো কী চাও।”
“যদি আপনার ফোনটা চাই?”
নিয়াজ ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমার ফোন? তোমাকে তো আমি নতুন ফোন কিনে দিবো। আমারটা পুরোনো হয়ে গেছে।”
“কিছু সময়ের জন্য চাই।”
“ও, বাড়িতে কথা বলবে? তোমার ফোন আনোনি?”
“আনতে দেয়নি।”
“আচ্ছা, সমস্যা নেই। ওটার আর দরকার নেই। আমি কালকের মধ্যেই ফোন এনে দিবো।”

নিয়াজ নিজের ফোনটা বের করে আরিন্তাকে দিয়ে সামনে থেকে উঠে গেল। আরিন্তা ফোন অন করতেই লকস্ক্রিনে নিয়াজের পেশাগত বেশের একটা ছবি চোখে পড়ল। আরিন্তা শুধাল,
“পাসওয়ার্ড?”
“তোমার নাম।”
আরিন্তা আবাক হয়ে তাকাল। এরমধ্যেই লোকটা পাসওয়ার্ডে তার নাম বসিয়ে দিয়েছে? নিজের নাম দিয়ে ফোন আনলক করে আরিন্তা আরেক দফা অবাক হলো। হোমস্ক্রিনে এরমধ্যে তাদের বিয়ের ছবিও দিয়ে রেখেছে। লোকটা তো বেশ অ্যাক্টিভ। আরিন্তা প্রথমে একটা ম্যাসেজ করল। ঠিক এক মিনিটের মাথায় তার কল এল।‌ শব্দ শুনে নিয়াজ বলল,
“তুমি ফোন করতে।”

আরিন্তা ফোন কানে ধরে চুপ করে আছে। ওপাশ থেকে মিশকাতের উৎকণ্ঠা চলছে,
“আরি? হ্যালো, কথা বলছিস না কেন? এই পোনি? শুনতে পাচ্ছিস না?”
আরিন্তা ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“শুনছি।”
“এতদিন পর তবে মনে পড়ল অসহায় প্রেমিককে?”
“কেমন আছো মিশু ভাই?”
“জানিস না তুই কেমন রেখেছিস?”
“তবু তো দিন কে’টেছে।”
“আমার সময় তো এক জায়গাতেই থমকে ছিল।”
“না, সময়ও বদলেছে। ভালো থাকতে শিখে ফেলো।”
“আমার ভালো থাকা যার ওপর নির্ভর করছে সে ভালো থাকলেই চলবে।”
পরক্ষণেই বলল,
“এই, এটা কার নাম্বার? কার ফোন দিয়ে কথা বলছিস?”
আরিন্তা বলল,
“এতদিন পর কথা বলছি। আমি কেমন আছি তা না জিজ্ঞেস করে তুমি কী নিয়ে পড়ছো?”

কথাটা বলতে গিয়ে আরিন্তার গলাটা মৃদু কেঁপে উঠল। মিশকাত হেসে বলল,
“কত ভালো ছিলেন তা গলা শুনেই বুঝা যাচ্ছে। ফোন ঠিক করা হয়নি এখনও?”
“না।”
“তাহলে এটা কার নাম্বার?”
“পরিচিত মানুষেরই। তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“প্রেমিকার বিরহে কি আর কাজ থামিয়ে রাখার উপায় আছে? কাজ কাজের মতো চলছে প্রতিদিন।”
“কাজের সাথে কোনোকিছু গুলিয়ে ফেলবে না। মন দিয়ে কাজ করবে সবসময়। কাজের মধ্যে থাকলে সবকিছু ভুলে থাকা যায়।”
“এসব ভুলভাল কথা কে বলল তোকে? আমি তো এক মুহুর্তের জন্যও ভুললাম না। ভোলার প্রসঙ্গই বা আসছে কেন?”
“জীবনে সব প্রসঙ্গেরই দরকার আছে। কোনো প্রসঙ্গই অপ্রয়োজনীয় নয়। বলা তো যায় না, কখন কোনটা এসে ভাগ্যে জুটে যায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা ভালো।”
মিশকাত সন্দিহান কন্ঠে ডাকল,
“আরি?”
মিশকাতকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে আরিন্তা বলে উঠল,
“মিশু ভাই, একটা প্রশ্ন করব, সত্যি উত্তর দিবে?”
“মিথ্যা উত্তর কবে দিয়েছি?”
“তুমি বিশ্বাস করো আমি শুধুমাত্র তোমাকে মন থেকে চেয়েছি?”
মিশকাতের কপালে ভাঁজ পড়ল। মেয়েটার মনে কী চলছে বুঝতে পারছে না সে। তবে মন যে ঠিক নেই তা টের পাচ্ছে। সে শান্ত স্বরে শুধাল,
“কী হয়েছে আমার পোনির? এ কদিনে মন তো আমারও এলোমেলো হয়ে ছিল। তাই বলে এভাবে কথা বলতে হবে?”
“আমি তোমার মুখে উত্তরটা শুনতে চাইছি।”
“উত্তর তুই জানিস না?”
“জানি, তবু শুনব।”
“অবিশ্বাসের কী আছে? আমরা দুজনই জানি আমরা একে অপরকে কতটা চাই, কতটা ভালোবাসি। আমাকে মন থেকে না চাইলে তুই অযথা আমার জন্য অপেক্ষা করে আছিস কেন? তোর রোজকার অপেক্ষা, মনের আকাঙ্ক্ষা এসবই তো তোর প্রশ্নের উত্তর।”

আরিন্তার চোখ ভর্তি জল চলে এল। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি মিশু ভাই, ভীষণ ভালোবাসি। প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকেই আমি চেয়েছি।’
কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য বাঁধায় আরিন্তার গলায় সমস্ত কথা আটকে গেল। কন্ঠনালিতে দলা পাকানো কান্না চেপে সে বলল,
“আমার ভালোবাসা যদি এক মুহুর্তের জন্যও তোমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে থাকে, তবে পারলে আমায় মাফ করে দিয়ো মিশু ভাই। আমি তোমার কাছে অপরাধী হয়ে রইলাম, সরি। আমার জন্য হলেও নিজেকে ভালো রেখো। কোনো একদিন শেষ দেখার বেলাতেও আমি তোমায় সুস্থ দেখতে চাই।”

হতবাক মিশকাতের প্রত্যুত্তর শোনার অপেক্ষাটুকু-ও আরিন্তা করল না। সঙ্গে-সঙ্গে ফোন কে’টে নাম্বারটা ব্লক করে দিলো। ওদিকে নিয়াজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল। কিন্তু ল্যাপটপ রেখে সে তখন থেকে হতভম্ব হয়ে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসর ঘরে বসে তার সদ্য বিয়ে করা বউ তারই ফোন নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলছে। এ যেন তার জন্য আজকের সবচেয়ে বড়ো চমক। নিয়াজ কী রিয়্যাকশন দিবে বুঝে উঠতে পারল না। আরিন্তা চোখ ভর্তি ছলছল জল নিয়ে নিয়াজের দিকে তাকাল। নিয়াজের প্রশ্নভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সে ফোনটা ফেরত দিয়ে ধরা গলায় বলল,
“সরি, সম্ভব হলে আপনিও আমায় মাফ করবেন। আমি সবার কাছে অপরাধী।”

কথাটা বলেই আরিন্তা হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতক্ষণে চেপে রাখা কান্নারা বাঁধ ভেঙে অঝোরে গড়িয়ে পড়ল। নিয়াজ বিস্ময়ের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে ফোনের নাম্বারটা চেক করল। কোন দেশের নাম্বার তা ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও, আরিন্তার ‘মিশু ভাই’ নামক মানুষটাকে চিনতে তার ভুল হলো না। আরিন্তার খালু যখন হসপিটালে ভর্তি ছিল, তখন অনেকবার ছেলেটার সাথে তার দেখা হয়েছিল, কথা-ও হয়েছিল। আমেরিকা চলে যাওয়ার আগেও ছেলেটা তাকে ফোন করে বাবার ব্যাপারে কথা বলেছিল। তখনই তার দেশ ছাড়ার কথা শুনেছিল নিয়াজ। ফোন থেকে চোখ তুলে কান্নারত আরিন্তার দিকে তাকিয়ে নিয়াজ বিভ্রান্ত মুখে শুধাল,
“এটা কি তোমার ওই খালাতো ভাইটা, হসপিটালে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
আরিন্তা মুখ তুলল না, উত্তর-ও দিলো না। নিয়াজ মাথায় এক ঝাঁক বিশৃঙ্খল চিন্তা নিয়ে কিছুক্ষণ নিরব রইল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
“কান্না থামাও আরিন্তা। এটা কান্নার সময় নয়। আমার সঙ্গে কথা বলো।”
আরিন্তা ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে নাকচ করল। নিয়াজ বলল,
“এইমাত্র তুমি যে সাহসটা দেখালে, এরপরও তোমার মনে হয় না আমার সঙ্গে তোমার খোলাখুলি আলোচনা করা উচিত?”
আরিন্তা উত্তর দিলো,
“আমি জানি না।”
“তোমাকে জানতে হবে। আমরা কেউই বাচ্চা নয় যে এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় ভেবে নেব। আজ আমাদের দুজনের একটা নতুন পথ শুরু হয়েছে। একসঙ্গে চলতে গেলে আমাদের একে অপরকে জানতে হবে। তুমি আমাকে না জানতে চাইলেও, আমি তোমাকে জানতে চাই। কারণ গোটা জীবন আমি তোমার সঙ্গে কা’টাব। তোমার মনে কী চলছে তা আমাকে জানতে হবে। আমি চাই না আমার স্ত্রী মনে গোপন ব্যথা রেখে আমার হোক। তাছাড়া তুমি যেহেতু নিজ থেকেই আমার সামনে এমন একটা বিষয় তুলে আনলে, সেহেতু আমার মনে হয় না তোমার কোনোকিছু গোপন রাখার ইচ্ছা আছে।”
আরিন্তা হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
“আমি পারছি না। আমাকে একটু একা ছেড়ে দিবেন, প্লিজ?”
“তোমার যতটা সময় প্রয়োজন আমি দিবো। তবু আমি তোমার মনের কথা জানতে চাই। আমাকে নিয়ে হোক বা তোমার মিশু ভাইকে নিয়ে হোক, তোমার মনে কী চলছে আমাকে জানতে হবে। এটা আমাদের জীবনের ব্যাপার। তোমাকে আমার যথেষ্ট বুদ্ধিমতী বলেই মনে হয়। একটু বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ।”

আরিন্তা কিছু সময় পর মুখ তুলল। তার সারা মুখ অশ্রুসিক্ত। লাল টকটকে দুচোখ ভর্তি যন্ত্রণা। নিয়াজ তার বিষণ্ণ মুখটার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। আরিন্তা তাকাল না। কোলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে ভাঙা গলায় বলল,
“বুঝতে পারছি আপনার কথা। কিন্তু আমি মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন। দয়া করে আমাকে একটু সময় দিন। আমার সত্যিই কোনোকিছু গোপন রাখার ইচ্ছা নেই। আমি নিজেই আপনাকে সব বলব।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২০.
মিশকাতের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা আরিন্তা নিয়াজকে বলেছে। বাদ দেয়নি বাবা-ভাইয়ের করা অন্যায়ের কথা-ও। কথার মাঝে সে বারবার থেমেছে, কখনও কেঁদেছে; তবু নিয়াজ বিরক্ত হয়নি। আরিন্তাকে সময় দিয়ে ধৈর্য ধরে সবটা শুনেছে। অথচ তার ভেতরে মিশ্র অনুভূতির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তোমার সাথে এটা সত্যিই ঠিক হয়নি। আমি এসব আগে থেকে জানতে পারলে হয়তো ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না।”
আরিন্তা ব্যথিত মুখে বলল,
“আপনি জানতে পারলেও গড়াত। আপনি বিয়ে ভেঙে দিলে অন্য কোনো বড়োলোক পাত্র খুঁজে আমার বিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু আপনার মতো বুদ্ধিমান একজন মানুষ যে বিয়ের আগে অন্তত হবু বউয়ের সঙ্গে একবার কথা বলে নিবে না, এটা আমি ভাবিনি।”
“তখন তো পেলব বলেছিল তুমি কথা বলতে চাও না। আর আমি ওর মুখে তোমার এত গল্প শুনেছি যে, আমার মনেই হয়নি তোমার অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে। তোমার অস্বস্তির কথা ভেবেই আমি আগে কথা বলার গুরুত্ব দেখাইনি। বড়োদের সামনে লজ্জা-ও লাগছিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর তো আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তখন-ও পেলব একই কথা বলেছিল।”
“কারণ তারা জানত কথা বলতে দিলেই বিয়েটা ভেঙে যাবে।”
“কিছু মনে কোরো না। আমি তাদের অনেক ভালো মনের মানুষ ভেবেছিলাম।”
“মনে করার কিছু নেই। সবার কাছে সবসময় তারা ভালো মনের-ই মানুষ। এবারে একটু রূপ বদলাতে হয়েছে অহংকারে আঘাত লাগায়। চিন্তা নেই, ওই রূপ আপনাকে কখনও দেখতে হবে না। আপনি তাদের বড়ো সাধের জামাই বলে কথা।”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার সাথে এটা একদম ঠিক করেনি।”
“আপনার সাথেও ঠিক করেনি।”

নিয়াজ স্থির দৃষ্টিতে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে শুধাল,
“তুমি আমায় গ্রহণ করবে না, তাই না আরিন্তা?”
“আমার ভালোবাসার পাত্রটা আমি এক পুরুষকে দিয়ে দিয়েছি। আমার হাতে অবশিষ্ট কিছু নেই বিশ্বাস করুন।”
“তোমাকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন।”

আরিন্তা এ কথার জবাব দিলো না। নিয়াজের চোখের গভীরে, কন্ঠের কম্পনে কী যেন এক ব্যথা স্পষ্ট। সে বুঝতে পারছে, কিন্তু নিয়াজের অপ্রকাশিত ব্যথার কারণ জানার আগ্রহ তার নেই। নিয়াজ বলল,
“জানো আরিন্তা? গত এক সপ্তাহে আমি তোমার জন্য এত কথা জমিয়ে ফেলেছি যে, এখন আমার কথার ঝুলিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। তোমার বর্তমান অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। তাই ওসব কথা গিলে নিলাম। পরে কখনও সুযোগ হলে বলব। জানি আমাদের সম্পর্কটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার মনে হয়তো আমার জায়গাও হবে না। কিন্তু আমার কাছে তুমি আর এই সম্পর্ক, দুটোই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

কথাটা শুনেই আরিন্তার মুখটা কালো হয়ে গেল। নিয়াজ বলল,
“তোমার ভয় নেই। আমি কখনোই তোমাকে কোনোকিছুতে জোর করব না। তোমার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই। আপাতত আমাকে তুমি ভালো বন্ধু মনে করতে পারো। বন্ধু হিসেবে আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
“তারপর?”
“তারপরের প্রশ্নটা থাক না। সম্পর্কটা যখন তৈরি হয়ে গেছে, এখন তো আমাদের কিছু করার নেই। আমি তোমাকে মেনে নিতে বলছি না। কিন্তু কষ্ট হলেও এখন তোমার এই সংসারে থাকতে হবে। এছাড়া উপায় নেই। আমাকে তুমি না মানলেও বন্ধু হিসেবে আমার একটা অনুরোধ তুমি রেখো। আমার বাবাকে একটু আপন করে নিয়ো। ওই মানুষটা তোমার মুখে বাবা ডাকটা শোনার জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। তাকে ডাকার কেউ নেই।”

আরিন্তা-ও জানে এখন এই সংসারে পড়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। চারদিকের সব পথ বন্ধ। এতক্ষণে তার বুঝতে বাকি নেই নিয়াজ কেমন মানসিকতার ছেলে। চাইলে এই মুহূর্তে নিয়াজের থেকে সে এক কথায় মুক্তি চাইতে পারে। কিন্তু মুক্তি নিয়ে তার যাওয়ার জায়গা নেই। কার কাছে যাবে সে? যার কাছে যাওয়ার আছে, সে-ই যে শত-সহস্র মাইল দূরে। মুক্তি মেললে-ও তার কাছে ছুটে যাওয়া সম্ভব না। বাবার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাটা তার ম’রে গেছে। তার ওপর নিয়াজের সাথে সম্পর্ক নিয়ে টানাহেঁচড়া তারা কেউই মেনে নিবে না।


তখন থেকে সুবর্ণার ফোন বেজে চলেছে। কিন্তু সে ফোন ধরার সাহস পাচ্ছে না। কারণ স্ক্রিনে ভাসছে ইংরেজি অক্ষরের ‘ভাইয়া’ শব্দটা। এই প্রথম ভাইয়ের ফোন ধরতে ভয় লাগছে তার। প্রথমবারে সুবর্ণা ফোন রিসিভ করতে ব্যর্থ হলো। দ্বিতীয়বারে ফোন কে’টে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রিসিভ করল ঠিকই, কিন্তু সবসময়ের মতো সঙ্গে-সঙ্গে কথা বলতে পারল না। মিশকাত বলল,
“হ্যালো সুবর্ণা, শুনতে পাচ্ছিস?”
সুবর্ণা গলা ঝেড়ে বলল,
“হ্যাঁ ভাইয়া। কী খবর তোমার?”
“তোদের কী খবর তা আগে বল। কোথায় আছিস?”
“বাড়িতেই।”
“বাবা-মা কোথায়?”
“বাড়িতে নেই।”
“পেলবদের বাড়ি?”
“হুঁ।”
“তুই একা বাড়িতে?”
“একা না, মিলিকে ডেকে এনেছি। ও ঘুমাচ্ছে।”
“তুই ওই বাড়িতে যাসনি?”
“গিয়েছিলাম, আবার চলে এসেছি বিকালে।”
“কেন? বৌ-ভাতের আগেই বিয়ে খাওয়া শেষ তোর?”

সুবর্ণা চমকে উঠল। মিনমিনে গলায় বলল,
“তুমি জানো?”
“জানতাম না। ফেসবুকে ঢুকিনি সারাদিন। একটু আগে সাইফুলের পোস্ট চোখে পড়ল। ওই বাড়িতে ফোন করলাম, কেউ রিসিভ করেনি। বাবা-মাও না। যাইহোক, কেমন কা’টল তোর বোনের বিয়ে?”
ভাইয়ের এত স্বাভাবিক কথাবার্তা সুবর্ণার কাছে ভালো লাগল না। সে ধরা গলায় বলল,
“সরি ভাইয়া। সবকিছু জানার পরেও তোমাকে কিছু জানানোর সুযোগ পাইনি আমি।”
“আরে তোকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। কৈফিয়ত ছাড়াই আমার সব বুঝা হয়ে গেছে। শুধু একটু দেরী হয়েছে বুঝতে। তোর বোনকে আমার তরফ থেকে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানিয়ে দিস। বিয়ের উপহার পেয়ে যাবে সময়মতো, সমস্যা নেই। দাওয়াত পাইনি তো কী হয়েছে? বড়ো ভাইয়ের একটা দায়িত্ব আছে না?”
সুবর্ণা কাঁদতে-কাঁদতে উত্তর দিলো,
“আপুকে তুমি ভুল বুঝো না ভাইয়া। সে শুধুমাত্র তোমার জন্য একা-এটা অনেক লড়াই করেছে, কিন্তু সবার সাথে পেরে ওঠেনি। উলটো মানসিক টর্চার চলেছে তার ওপর। তাকে সামনে থেকে দেখলে বুঝতে, প্রাণটা ফেলে রেখে সে শশুরবাড়ি গিয়েছে। এই সম্পর্কটা কতদিন টিকে, তা নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে আমার।”
“সুবর্ণা, তোর আপুকে যদি এই পৃথিবীতে সবথেকে ভালোভাবে যে চিনে থাকে, সে আমি। আমার পর দ্বিতীয় কেউ তাকে অমনভাবে চিনতে পারবে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমার কাছে কাউকে দোষী হতে হবে না। তোর ভাইয়ের ভাগ্য তো এমনই, দেখছিস না?”
“তুমি কষ্ট পেয়ো না ভাইয়া, প্লিজ।”
“চিন্তা করিস না। আমি ভালো থাকব। আমাকে তো ভালো থাকতে হবে। নইলে এতগুলো মানুষকে কী করে ভালো রাখব আমি?”
“আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ো না। আমি বাচ্চা নই।”
“আমি ম’রব না রে বোন। যতদিন মাথার ওপর দায়িত্ব আছে, ততদিন আমার নিঃশ্বাস চলবে। তোর বোনকেও বলিস ভালোভাবে বেঁচে থাকতে। তাকে জানিয়ে দিস, সমস্ত সম্পর্ক হারিয়ে গেলেও, তার সাথে আমার শেষ দেখাটা বাকি আছে। সেই দিনটির জন্য তাকে বাঁচতে হবে।”

সুবর্ণা কাঁদছে। মিশকাত সেই কান্নার শব্দ শুনতে পারল না। ফোন কে’টে দিলো। ফোন রাখতে গিয়েও চোখ থমকাল ফোনের ওয়ালপেপারে ভাসতে থাকা সেই ছবিটা, যেখানে নববধূ সাজা আরিন্তার চোখে তার চোখ আটকা পড়ে ছিল। মিশকাত কয়েক মুহূর্ত ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ওয়ালপেপারের ছবিটা পালটে চুপচাপ ফোনটা রেখে দিলো। সময়ে-অসময়ে অন্য কারো অপরূপা বধূকে মগ্ন হয়ে দেখার অধিকার সে কী করে কেড়ে নিবে?

সকাল থেকে বেশ কয়েকবার পেলব নিয়াজকে ফোন করেছে। আরিন্তার সাথে কথা বলতে চাইছে সে। নিয়াজ আরিন্তার কাছে ফোন দিতে চাইলেও প্রতিবারই আরিন্তা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কাটকাট বলে দিয়েছে নিজ হাতে তার সাজানো জীবন নষ্ট করে দিয়েছে, এমন মানুষের সাথে বাকি জীবনেও তার সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার সাধ নেই। নিয়াজ তাকে বুঝাতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তার কথায় অনড়। তবে আরিন্তা মায়ের ফোন উপেক্ষা করেনি। মেরিনা যখন ফোন করেছে, তখন সে ভালোভাবেই কথা বলেছে। বাবার সাথেও কথা হয়েছে, তবে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি আরিন্তা। একদিন বাদেই তার বউভাত। আপনজনরা সবাই তার শশুরবাড়ি আসবে। এটা নিয়েও তার বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই। নিয়াজের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই আজ চলে গেছে। বউভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না তারা। হয়তো আগামীকাল অতিথি হয়ে এসে পেটভোজ সেরে চলে যাবে। এদিকে সমস্ত আয়োজন নিয়ে নিয়াজ ভীষণ ব্যস্ত। একা সবদিক সামলে উঠতে পারবে না বলে সে ছেলেপুলে ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। আরিন্তা এখানে নতুন হলেও, নিয়াজের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যে তাদের খুব বেশি সুসম্পর্ক নেই, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি তার। বিশেষ করে তার বাবার দিকের আত্মীয়রা আপন হয়েও কেমন পর। ছেলের বিয়েতে সবাই এসেছে কেবল অতিথি হয়ে। কারো কোনো দায়ভার নেই। তবে নিয়াজের মায়ের দিকের আত্মীয়দের মধ্যে তার খালা-খালু আর খালাতো, মামাতো ভাই-বোন এসেছে। তবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। ভাইদের সংখ্যা নিতান্তই কম হওয়ায় নিয়াজকে সাহায্য করার মতো লোকের অভাব পড়েছে।

নতুন সংসারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও আরিন্তাকে প্রথম দিনেই কাজের মহিলাটি বিপাকে ফেলে দিয়েছে। বাড়ির কোথায় কী আছে, নিয়াজের আত্মীয়-স্বজনরা কে কেমন, নিয়াজ আর তার বাবার কখন কী প্রয়োজন সমস্ত কথা সে গড়গড় করে বলে চলেছে। আরিন্তা তাকে বারণ করতে না পেরে চুপচাপ সব কথা গিলছে। মহিলারই বা কী দোষ? সে তো ভাবছে নতুন বউয়ের এই সংসার সম্পর্কে সবকিছু জেনে নেওয়া দরকার। শাশুড়ি নেই, সংসারটা তো তাকেই নিজ হাতে গুছিয়ে নিতে হবে। মানবতার খাতিরে আরিন্তা কাজে হাত লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু নিয়াজের খালা তাকে হাত লাগাতে দেয়নি। দুদিন বাদে তারা চলে গেলে মেয়েটাকেই সারাবছর এই সংসার একা হাতে সামলাতে হবে। অন্তত প্রথম দুয়েকটা দিন সবকিছু দেখেশুনে নিজেকে প্রস্তুত করুক। সারাদিন নিয়াজ ব্যস্ত থাকলেও সময় পেলেই আরিন্তার খবর নিতে ভোলেনি। শুধু নিয়াজ নয়, তার বাবাও কিছুক্ষণ পরপর পুত্রবধূর খোঁজ করেছে। নিয়াজের বাবার আচরণ, কথাবার্তা আরিন্তাকে আকৃষ্ট করেছে। লোকটা পছন্দ করার মতো একজন মানুষ। তার প্রতিটি কথা খুবই সুন্দর। কথার মাঝে আরিন্তাকে যখন বারবার ‘মা’ বলে ডাকছিল, তখন তার অজান্তেই বেশ ভালো লাগছিল। লোকটার ডাকে কেমন অদ্ভুত মায়া মিশে আছে। নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হলেও এই মানুষটার সাথে কথা বলার পর আরিন্তা ভাবছে, এটুকু সময়ের মধ্যেও কারোর কথার মায়ায় পড়া যায়? কী অদ্ভুত মন!

বিয়ের দ্বিতীয় রাতেও স্ত্রীকে বিছানার মাঝে কোলবালিশের দেয়াল গড়তে দেখে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিয়াজ। ইচ্ছা করলেই সে আরিন্তার সামনে অনেক জ্ঞানমূলক যুক্তির ঝুলি খুলে বসতে পারে। কিন্তু সে আরিন্তার বর্তমান মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে। সে জানে মানসিক অশান্তি একটা মানুষের জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। নিয়াজ বরাবরই যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে। না ভেবে সে কোনো ভুল কাজ করে না। সে চাইলেই পারে আরিন্তার ওপর জোর খাটাতে। আইনত অধিকার আছে তার। কিন্তু সে কাপুরুষ নয়। জীবনে কোনোদিন সে এমন কোনো কাজ করেনি যাতে মানুষ তাকে কাপুরুষ ভাবে। নিজের স্ত্রীর সামনে কাপুরুষ সাজার তো প্রশ্নই আসে না। আরিন্তা তার পছন্দের মানুষ, ভীষণ শখের নারী। সম্পর্কটার শুরু এমন বাজে অভিজ্ঞতা দিয়ে হলেও, সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার। আরিন্তাকে নিজের করে ধরে রাখার। তবে সেটা জোর খাটিয়ে নয়। সে চায় না মনে অন্য কাউকে রেখে আরিন্তা নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তার হোক। এমন কোনো দিন এলে যেন আরিন্তা সজ্ঞানে মন থেকে তার কাছে ধরা দেয়।

আরিন্তা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নিয়াজ আপনমনে অনেকটা সময় ভাবার পর ড্রয়ার খুলে দুটো বাক্স এনে আরিন্তার সামনে রেখে বলল,
“এগুলো তোমার জন্য।”
আরিন্তা বাক্সগুলোর দিকে তাকাল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটা গয়নার বাক্স, আরেকটা ফোনের। আরিন্তা বলল,
“ধন্যবাদ, কিন্তু আমার এসব চাই না।”
নিয়াজ বলল,
“জানি তুমি চাও না। তবু এগুলো তোমায় নিতে হবে।”
নিয়াজ গয়নার বাক্সটা খুলল। একটা হার, দুটো বালা, দুটো আংটি আর এক জোড়া মাঝারি আকারের কানের দুল। কানের দুল দুটো তকতকে নতুন মনে হলেও বাকিগুলো একটু পুরোনো মনে হচ্ছে। নিয়াজ বলল,
“এই হার, বালা আর আংটি আমার মায়ের। এগুলো এতদিন তোমার জন্য রাখা ছিল। এসব তোমার পাওনা। দয়া করে না করবে না। বাবা আমাকে বারবার করে মনে করিয়ে দিয়েছে এগুলো তোমাকে দেওয়ার জন্য। তুমি ফিরিয়ে দিলে সে কষ্ট পাবে। আর এই কানের দুল দুটো আমি তোমার জন্য গড়িয়ে রেখেছিলাম। গতকাল দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আমাদের ভেতরকার সম্পর্ক যেমনই হোক ‌ আমি চাই না তা অন্য কেউ জানুক। বাড়ি ফিরলে নিশ্চয়ই সবাই জানতে চাইবে তুমি আমার থেকে কী উপহার পেয়েছ। আমি নিজেও অস্বস্তিতে পড়তে চাই না, তোমাকেও অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না।”
“সম্পর্কই যেখানে ঠিক নেই, সেখানে এতকিছু ভেবে কী হবে? অন্য কারো কথাকে আমি আসলে তোয়াক্কা করি না আর। তোয়াক্কা করার দিন চলে গেছে আমার।”
“তবু আমার কথাগুলো একবার ভেবে দেখো। আমি তোমাকে অযথা কথা বলছি না।”

আরিন্তা কিছু সময় চুপ থেকে শুধাল,
“আর ফোন দিচ্ছেন যে? আপনার ভয় লাগছে না সব জেনেবুঝে আমার হাতে ফোন দিতে?”
“একজনের জন্য তো আমি তোমাকে সারা দুনিয়ার মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি না। আপনজনদের সাথে যোগাযোগ করার অধিকার আছে তোমার।”
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি ভুল করছেন?”

নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“জানি না। হয়তো ভুল-ই করছি। যে থাকার সে এমনি থাকবে। চলে যাওয়ার হলে সে মানুষকে তো আর বেঁধে রাখা যায় না। তুমি আমার কাছে বন্দিনী নও। তবে এটা ভেবো না যে আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো। ছেড়ে দেওয়ার মতো অত বড়ো ভুল অন্তত আমি করতে পারব না, দুঃখিত। আমি তোমায় মুক্ত রেখেই অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধার চেষ্টা করব। সফল হলে তুমি সেচ্ছায় থেকে যাবে।”
“আর ব্যর্থ হলে?”
“তোমার প্রতি আমার অভিযোগ থাকবে না। ব্যর্থতা আমি নিজের করে নেব। তোমার কাছে শুধু অনুরোধ থাকবে ভুল পথে না হাঁটার। তোমার প্রতি অনেক অন্যায় হয়েছে। তাই বলে তুমিও সেই পথে পা বাড়িয়ো না। এরপর যা করবে, নিজের জ্ঞান থেকে ভেবে কোরো।”
“আপনি জানেন আপনার এসব কথা শুনলে লোকে আপনাকে অতি বোকা ভাববে?”
“তুমি কী ভাবছো?”
“বুদ্ধিমান।”
নিয়াজ হেসে বলল,
“দ্যাটস্ মাই প্লেজার।”

বউভাতের বিরাট আয়োজন হয়েছে নিয়াজের বাড়িতে। আপনজন থেকে বাইরের অতিথিই তার বেশি। আছে হসপিটালের সহকর্মীরা। বাড়িভর্তি লোকজনের মধ্যে একমাত্র আরিন্তা চুপচাপ এক জায়গায় বসে আছে। আজ তার কাজই সেজেগুজে বসে সবার সাথে ফটোশুটে অংশ নেওয়া। বাবার বাড়ির মানুষ এলেও আরিন্তা স্বাভাবিক কুশল বিনিময় ছাড়া কারো সাথেই তেমন কথা বাড়ায়নি। পেলব তার কাছে এসে বসলেও সে ভাইয়ের সাথে এক বাক্যও ব্যয় করেনি। মেরিনাও এসেছে। সে এসে হতেই মেয়ের কাছে-কাছে থাকছে। বুঝার চেষ্টা করছে মেয়ের মনে কী চলছে। পেলব অনেকবারই বোনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই আরিন্তা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। খাওয়ার সময়ও আরিন্তার পাতে এটা-ওটা তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। আরিন্তা তখন নিচু গলায় মেরিনাকে বলেছে,
“মা, আমার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত যত্নের আর প্রয়োজন নেই তোমাদের। এতদিন যা যত্ন নিয়েছ, তাতেই আমি তোমাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। এখন আর আমি এত যত্ন নিতে পারছি না, মাফ করো।”

মেরিনা ইশারায় পেলবকে বারণ করল আরিন্তার কাছে আসতে। পাশে বসা নিয়াজ অনেক চেষ্টা করল আরিন্তাকে খাওয়ানোর জন্য। আরিন্তা তেমন কিছু খেতে পারেনি। আরিন্তা খেয়াল করেছে তার খালা-খালু, সুবর্ণা কেউই আসেনি এখানে। এই নিয়ে সে কোনো প্রশ্ন-ও করেনি। মেরিনা নিজেই একবার যেচে বলেছিল,
“তোর খালা-খালু আগেই আসবে না বলে দিয়েছে। সুবর্ণাকে অনেক সাধলাম, এল-ই না। তুই আসার পর আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল, আর আসেইনি মেয়েটা। আজ তুই বাড়ি গিয়ে ওকে আসতে বলিস। তুই বললে ও না এসে পারবে না।”
আরিন্তা উত্তর দিয়েছিল,
“ক্ষত খোঁচানোর কী দরকার মা? আমার ভাইয়ের প্রতি আমার যেমন তীব্র ঘৃণা আসছে, ওর ভাইয়ের জন্য ওর তেমন তীব্র কষ্ট হচ্ছে। কারোর জন্য আর ভেবো না মা। সবাইকে যার যার মতো থাকতে দাও। ভালো থাকুক, খারাপ থাকুক, সবাই নিজের মতোই থাকুক। অন্তত কাউকে বারবার বাজেভাবে আঘাত দিতে তোমাদের নরকে ডেকো না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-১৭+১৮

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৭.
ছেলের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলতে গিয়ে আয়েশা খাতুনের মনে কেমন খটকা লাগল। ছেলে মুখে ভালো আছি, সুস্থ আছি বললেও মায়ের মন টের পেল ছেলে ভালো নেই। কিছু একটা সমস্যা আছে। সুস্থ থাকলে, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে এই অসময়ে ছেলের মুখটা অমন ছন্নছাড়া দেখাবে কেন? অন্যসময় তো বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় সে বেশ হাসিখুশি মনে কথা বলে। আয়েশা খাতুন চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলেন,
“তোর শরীর কি সত্যিই ঠিক আছে বাবা? মুখটা অমন লাগছে কেন?”
মিশকাত বলল,
“বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি আজ, সেজন্যই হয়তো। আমি ঠিক আছি মা, চিন্তা কোরো না।”

আয়েশা খাতুনের তবু মনে হলো ছেলে তার মন খারাপ হবে ভেবে স্বীকার করছে না। মিশকাত কিছু সময় চুপ থেকে প্রশ্ন করল,
“খালার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে কবে মা?”
“গতকাল সকালেও তো ফোন করেছিল।”
“আরির সাথে কথা হয়?”
“ও তো বাড়িতেই চলে আসে, ফোনে আর কী কথা বলব? ফোনে কথা হয় সুবর্ণার সাথে।”
“ওই বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে না কি?”

আয়েশা খাতুন কপাল কুঁচকে বললেন,
“কিসের সমস্যা?”
“মনে তো হচ্ছে কোনো সমস্যা হয়েছে।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“কেউই তো ফোন রিসিভ করছে না।”
“কেউ না?”
“না।”
“সবাইকে ফোন করেছিলি?”
“পেলবের সাথে গতকাল কথা হয়েছিল। ও বলল আরির ফোনে সমস্যা হয়েছে। আজ খালাকে ফোন করলাম, রিসিভ করল না। তারপর পেলব আর খালুকেও ফোন করেছিলাম। সবার ফোনেই রিং হয়, কিন্তু কেউ রিসিভ করে না।”

আয়েশা খাতুন অবাক হয়ে বললেন,
“কী বলিস? হঠাৎ করে এমন করবে কেন? এখন আবার ফোন করে দেখ তো।”
“তোমার সাথে কথা বলার আগেও ফোন করেছিলাম। সবাইকেই ফোন করছি, কারোরই রিসিভ করার নাম নেই। খালার ফোন তো এখন বন্ধই বলছে।”
আয়েশা খাতুনের কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো। চিন্তিত মুখে সুবর্ণাকে ডেকে বলল,
“হ্যাঁ-রে, আরি আজ তোর পার্লারে যায়নি?”
ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে আরিন্তা রোজ সুবর্ণার পার্লারে যায়। কিছু সময় সুবর্ণার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বা তাকে সাহায্য করে চলে যায়। মায়ের প্রশ্ন শুনে সুবর্ণা উত্তর দিলো,
“না তো। আজ মনে হয় আপু ভার্সিটি যায়নি। গেলে তো পার্লারে যেত।”

আয়েশা খাতুন মিশকাতকে বললেন,
“আরি না কি আজ ভার্সিটিতে-ও যায়নি। সত্যি-সত্যি কোনো সমস্যা হলো না কি আবার?”
“তুমি একটু পেলব আর খালুকে ফোন করে দেখো তো। তোমার ফোন যদি রিসিভ করে।”
“তোর ফোন রিসিভ করবে না কেন তাহলে? আজব ব্যাপার!”
“দেখো তুমি ফোন করে। এখনই ফোন করতে বলো সুবর্ণাকে।”

আয়েশা খাতুন আবার সুবর্ণাকে ডেকে বললেন,
“সুবর্ণা, তোর খালুকে একটা ফোন কর তো।”
মায়ের কথায় সুবর্ণা ফোন করল। প্রথমে পুলক তালুকদার, তারপর পেলব, দুজনকেই ফোন করল। কিন্তু কেউই রিসিভ করল না। পরপর কয়েকবার ফোন করার পরও তাদের পাওয়া গেল না। সুবর্ণা বলল,
“কেউই তো ধরছে না মা।”
আয়েশা খাতুন বললেন,
“কী হলো তাদের?”
মিশকাত বলল,
“মা, একটু খোঁজ নিয়ে দেখো ওই বাড়িতে। তুমি না যেতে পারলে সুবর্ণাকে পাঠাও।”
“আচ্ছা দেখছি।”
“আমাকে জানিয়ো। চিন্তা লাগছে।”
“চিন্তা করিস না। জানাব।”
“রাখছি তাহলে।”
“আচ্ছা রাখ। আমি দেখি সুবর্ণাকে পাঠিয়ে।”

সেদিন আর সুবর্ণা যেতে পারল না। তার পার্লারে জরুরি কাস্টমার ছিল, তাই। গেল তার পরদিন। সকালে পার্লার খুলল না। নাশতা করে একাই চলে গেল খালার বাড়ি।

তখন সকাল দশটা। পুলক তালুকদার খেয়ে-দেয়ে বাইরে চলে গেছেন। পেলব এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। আরিন্তা নিজের রুমে। বাড়িতে ঢুকে দেখা হলো শুধু খালার সাথে। তিনি থালা-বাসন ধুচ্ছিলেন। সুবর্ণাকে দেখে তিনি তেমন অবাক হননি। ওই বাড়ি থেকে কারোর আগমন আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন। কারণ হুট করে তাদের অদ্ভুত আচরণের কারণ খুঁজতে কেউ আসবেই। কিন্তু অন্যান্য সময়ের মতো আজ আর মেরিনা তেমন খুশিও হতে পারলেন না। সুবর্ণা যখন বিভিন্ন প্রশ্ন করবে, তখন তিনি কী উত্তর দিবেন তা-ই ভেবে পাচ্ছেন না। ভাবতে-ভাবতেই সুবর্ণা প্রশ্ন করে বসল,
“খালা, তোমরা কেউ ফোন রিসিভ করছো না কেন আমাদের? ভাইয়া আর আমি সবাইকে এত ফোন করলাম, কেউ যে রিসিভ করলে না?”
মেরিনা বলল,
“আমার ফোন পেলবের কাছে।”
“কেন?”
“ওর দরকার দেখে নিয়েছে।”
“তাহলে ভাইয়া আর খালু ফোন ধরছে না কেন?”
“হয়তো ব্যস্ত ছিল।”
“কী বলো? এত ব্যস্ততাই কি থাকে যে আমার আর ভাইয়ার শখানেক ফোনের একটা ধরার সময় নেই? এমন তো জীবনেও হয়নি।”
“জানি না। জিজ্ঞেস করিস তাদেরকেই।”
“আপু ঘুম থেকে উঠেছে?”

মেরিনা মনে-মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ে তার ঘুম ভুলে গেছে, খাওয়া ভুলে গেছে, তা তিনি মুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছেন। তবু তার কিছু করার নেই। মেরিনা বললেন,
“উঠেছে হয়তো। খেতে আসেনি এখনও। তুই গিয়ে ডেকে আন তো।”
“আচ্ছা।”
সুবর্ণা হাঁটা ধরে আবার থামল। বলল,
“খালা, আপু কি দুদিন ধরে ভার্সিটি যাচ্ছে না?”
“গতকাল যায়নি। আজ বন্ধ মনে হয়।”
“আজ কিসের বন্ধ?”
“জানি না। তুই আরিকে ডাক, তারপর দুজন নাশতা কর।”
“আমি খেয়ে এসেছি।”
মেরিনা হঠাৎ বলে উঠলেন,
“তোর ফোনটা একটু দিয়ে যা তো। তোর খালুকে ফোন করতে হবে।”

সুবর্ণা খালুর নাম্বারে ডায়াল করে ফোনটা খালাকে দিয়ে চলে গেল আরিন্তার কাছে। আরিন্তার ঘরের দরজা বন্ধ। দুই-তিনবারের ডাকে আরিন্তার সাড়া না পেয়ে সুবর্ণা এলোপাথাড়ি দরজা ধাক্কানো শুরু করল। আরিন্তা দরজা খোলার পর সুবর্ণা হঠাৎ তাকে দেখে অবাক হলো। খালা বলল আপু ভালো আছে, অথচ তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ অসুস্থ। চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। মুখটা শুকনা লাগছে। চুলগুলো অগোছালো। সর্বোপরি সে নিজেই অগোছালো। সুবর্ণাকে দেখেও আরিন্তা প্রথমে চুপচাপ বিছানায় চলে গেল। সুবর্ণা কাছে গিয়ে চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আপু, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি অসুস্থ?”
আরিন্তা ডানে-বায়ে মাথা নেড়ে ভাঙা গলায় বলল,
“আমি অনেক ভালো আছি।”
“তাহলে কী হয়েছে তোমার?”
আরিন্তা পালটা প্রশ্ন করল,
“তুই কখন এলি?”
“একটু আগে। গতকাল থেকে তোমরা কেউ রিসিভ করছো না। তাই মা চিন্তায় পড়ে গেছে। আমাকে পাঠিয়েছে খবর নিতে। কী হয়েছে গো আপু? খালা বলছে সে জানে না খালু আর পেলব ভাইয়া ফোন ধরছে না কেন। আমি নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে। নইলে আমি গতকাল থেকে ফোন করছি, ভাইয়া ফোন করছে তারও আগে থেকে, কারোর ফোনই রিসিভ করবে না কেন?”

আরিন্তা হঠাৎ কী ভেবে এক লাফে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ছুটে এসে সুবর্ণার হাত চেপে ধরে বলল,
“তোর ফোনটা দে তাড়াতাড়ি।”
আরিন্তার এমন অদ্ভুত আচরণে সুবর্ণা অবাক হয়ে বলল,
“কেন?”
“দরকার খুব। দে।”
“আমার ফোন তো খালার কাছে।”
“মা রেখে দিয়েছে?”
“খালুর সঙ্গে কথা বলবে, তাই চেয়ে রেখেছে।”
আরিন্তা রাগে বিছানায় মুষ্ঠাঘাত করল। সুবর্ণা বোকা চোখে আরিন্তাকে পরখ করে বলল,
“আপু, তুমি এমন করছো কেন? কী হয়েছে বলবে আমাকে? তোমাদের কাজকীর্তি কিছু মাথায় ঢুকছে না আমার।”
“আগে আমাকে ফোন এনে দে। কাউকে বুঝতে দিবি না, যা।”

কথাটা বলেই আরিন্তা উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো। সুবর্ণা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আরিন্তাকে সে দুবার ডাকল। কিন্তু আরিন্তা সাড়া দিলো না। সুবর্ণার মনে পড়ল খালা তাকে বলেছে আরিন্তাকে খেতে ডাকতে। সেটাই সে ভুলে গেছে। সুবর্ণা বলল,
“আপু, খালা তোমাকে খেতে ডাকছে। খাবে না?”
আরিন্তা মিনমিনে গলায় বলল,
“গিয়ে বল আমার ক্ষুধা নেই। আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই কারো।”
“ধুর…কিছু বুঝতে পারছি না।”
বিড়বিড় করে কথাটা বলে সুবর্ণা আবার নিচে চলে গেল। মেরিনা তাকে জিজ্ঞেস করল,
“আরিকে খেতে ডাকিসনি?”
“আপু বলেছে তার ক্ষুধা নেই।”
মেরিনা চিন্তিত মুখে বলল,
“ক্ষুধা তো আছেই। না খেয়ে কতদিন থাকতে পারবে ও-ই জানে।”
“আপুর কী হয়েছে খালা? মুখ দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ, কথাবার্তাও অন্যরকম লাগছে। কোনো সমস্যা হয়েছে?”

ডাইনিংয়ে বসে পেলব নাশতা করছিল। মায়ের উত্তরের আগেই সে সুবর্ণাকে ডাকল,
“সুবর্ণা, এদিকে শোন।”
সুবর্ণা এগিয়ে এসে পেলবের মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল,
“বলো।”
“তুই কি এখান থেকে পার্লারে যাবি?”
“হ্যাঁ।”
“কখন?”‌
“এখনই।”
“আজ যাওয়ার দরকার নেই। থাক আজ।”
“না ভাইয়া। পার্লারে কাস্টমার এসে ফেরত যাবে।”
“একদিনে কিছু হবে না। থাক, কাজ আছে।”
“কী কাজ?”
“আরিন্তাকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।”

আচমকা সুবর্ণা আরও এক ধাক্কা খেল। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে? কই? আমরা কেউ শুনলাম না তো কিছু।”
“এখন তো শুনেছিস।”
“মা-ও তো জানে না।”
“শুধু খালা না, কেউই জানে না এখনও। তারা আসুক, তারপর সবাইকে জানাব। আমিই মাকে বারণ করেছি আগে থেকে সবাইকে জানাতে।”

সুবর্ণা খালার মুখের দিকে তাকাল। সে চুপচাপ নিজের কাজ করছে। কেন জানি সুবর্ণার মনে হলো কিছু একটা গণ্ডগোল আছে এখানে। কোনোকিছু ঠিক নেই। সবার মনে কিছু একটা চলছে। কিন্তু সেটা কী, তা-ই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সুবর্ণা সেই বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, তুমি আর খালু গতকাল থেকে আমাদের ফোন রিসিভ করছিলে না কেন?”
পেলব একটু থমকাল। সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। বলল,
“আজকের ব্যাপারটা মিটে যাক, আমি ফোন করব নে খালাকে।”
“মাকে ফোন করার সাথে আজকের ব্যাপার মিটে যাওয়ার কী সম্পর্ক? আমি কিছু বুঝতে পারছি না তোমাদের কথা। তোমাদের কী হয়েছে আমাকে একটু বলবে প্লিজ। আরি আপুকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে না কি?”
“সমস্যা একটা হয়েছে। কিন্তু এখন ওসব নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। বাড়ি ফেরার আগে জানতে পারবি, সমস্যা নেই। এখন এসব বাদ দে। আপাতত মা আর আরিকেও কিছু জিজ্ঞেস করিস না। আর আরি ফোন চাইলে ভুলেও দিবি না। পাত্রপক্ষ আসুক, ওসব ঝামেলা মিটে গেলে আমি নিজেই তোকে বলব। ঠিক আছে?”
সুবর্ণা বিশৃঙ্খল মস্তিষ্কে সহসা মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা।”

পুলক তালুকদার ব্যাগ ভর্তি বাজার এনেছেন। কাজের মেয়েকে নিয়ে সেসব গোছাতে ব্যস্ত মেরিনা। সুবর্ণা বিশৃঙ্খল মস্তিষ্কে থম মে’রে বসে আছে। আরিন্তার কাছেও যাচ্ছে না। কী করবে কিছু মাথায় আসছে না তার। পেলব বাজারে গিয়েছিল। ফিরে এসে সুবর্ণার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরিকে দিয়ে আয়।”
“কী এটা?”
“শাড়ি।”
“তুমি কিনেছ?”
“হ্যাঁ, আজ এটা পরিয়ে দিস।”
সুবর্ণা মাথা নেড়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই পেলব ডাকল,
“শোন।”
সুবর্ণা পেছন ফিরে তাকালে বলল,
“ফোনটা রেখে যা। আরির হাতে ফোন দিস না।”

সুবর্ণা মনে-মনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা পেলবের হাতে দিয়ে দিলো। সে এখন নিশ্চিত আরিন্তা কিছু একটা অঘটন ঘটিয়েছে, যে কারণে সবাই তার সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। হুট করে পাত্রপক্ষ আসার কারণও এটাই হবে। সে গিয়ে শাড়ির ব্যাগটা আরিন্তাকে দিয়ে বলল,
“নাও, এটা তোমার জন্য এনেছে ভাইয়া।”
আরিন্তা ব্যাগ ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
“শাড়ি দিয়ে কী করব আমি?”
“আজ এটা পরে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে বলেছে।”
সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তা শাড়িসহ ব্যাগটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো। রাগে গজগজ করতে-করতে বলল,
“তোর ভাইয়াকেই বলিস এটা পরে সামনে যেতে। ওদের কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই আমার।”
সুবর্ণা চমকে উঠল। মেঝে থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল,
“এমন করছো কেন আপু? কী সমস্যা তোমার?”
“আমার কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা তোর খালা-খালু আর ভাইয়ের।”
“কী করেছে তারা?”
“আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করিস না তো সুবর্ণা। ভালো লাগছে না আমার। তোর ফোন এনেছিস?”
সুবর্ণা চুপসানো মুখে বলল,
“ফোন ভাইয়ার কাছে।”
“ও, তোর ফোনও আটকেছে শয়তানটা?”
সুবর্ণা চুপ রইল। আরিন্তা বলল,
“এটা নিয়ে যারটা তাকে ফেরত দে। আর আমাকে একটু একা থাকতে দে।”

সুবর্ণা গিয়ে শাড়ির ব্যাগ পেলবকে ফেরত দিলে পেলব মেরিনাকে বলল,
“তোমার মেয়ে যেন মেহমান আসার পর কোনো পাগলামি না করে মা। ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ো তা।”
মেরিনা উত্তর দিলো,
“নিজেরা তো বুঝাতে পারছিস না। আমাকে ঠেলছিস কেন? আমার সব কথা শুনে বসে আছে ও? শুনলে তো নাওয়া-খাওয়া ছাড়ত না।”
“জোর করে কিছু খাইয়ে দাও গিয়ে। এখন তুমি ছাড়া আর কে বুঝাবে ওকে? সাপের পাঁচ পা দেখেছে। বাপ-ভাইয়ের কথা এখন আর মাথায় ঢোকে না।”

পাত্রপক্ষ এসে পৌঁছাল বিকাল সাড়ে চারটায়। ডক্টর নিয়াজ, তার বাবা, খালা, খালু আর ফুপা এসেছেন। নিজেদের গাড়ি নিয়েই এসেছেন তারা। সঙ্গে এনেছেন দুহাত ভর্তি খাবার-দাবার। পেলব এবং তার বাবা-চাচা মিলে মেহমানদের অতি খাতির যত্ন করতে লেগে পড়েছে। মেরিনা ব্যস্ত মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা নিয়ে। সুবর্ণা খালাকে হাতে-হাতে সাহায্য করছে। মেহমান এসেছে শুনেই সুবর্ণার মন উচাটন হয়ে উঠেছে পাত্র দেখার জন্য। পেলবের হাতে খাবার এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ বুঝে তার পাত্র দেখাও হয়ে গেল। কিন্তু পাত্র দেখতে গিয়ে ডক্টর নিয়াজকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে সে খালার কাছে ছুটে গেল। চোখ বড়ো করে বলল,
“খালা, এই ছেলেকে তো চেনা-চেনা লাগছে। উনি না বাবার চিকিৎসা করেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“সত্যি? ওনারা এখানে কীভাবে?”
“আরিন্তাকে পছন্দ করেছে ছেলে নিজেই।”
“আপু যখন হসপিটালে গিয়েছিল, তখন?”
“হুম।”
“কী আশ্চর্য! এতকিছু হয়ে গেল, কিছুই জানতে পারলাম না।”

পেলব সুবর্ণাকে বলল আরিন্তাকে রেডি করতে। কিছুক্ষণ পর তাকে সামনে আনা হবে। সুবর্ণা সঙ্গে-সঙ্গে চলে গেল। পেলব মেরিনাকে বলল,
“মা, তুমিও যাও।”
“আমার হাতে কাজ আছে, দেখছিস না?”
“এটুকু হালিমাকে করতে দাও। সুবর্ণার কথা যদি না শোনে? তুমি গিয়ে দেখো।”

আরিন্তা সত্যিই সুবর্ণার কথা শোনেনি। সুবর্ণা তাকে রেডি হওয়ার কথা বলাতে যাওয়ায় সে উলটা সুবর্ণার উপরেই চটে গেছে। মেয়েটার সঙ্গে ধমকা-ধমকি করেছে। মেরিনা গিয়ে এই অবস্থা দেখে মেয়ের কাছে গিয়ে বসলেন। বুঝিয়ে বললেন,
“এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলা করিস না আরি। ওনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। আমাদের মান-সম্মানের কথা ভাব একটু।”
আরিন্তা বলল,
“তোমরা একবারও আমার কথা ভেবেছ? নিজেদের মান-সম্মানের অনেক ভয় তোমাদের। মান-সম্মান নষ্ট করার মতো কাজ কি আমি সত্যিই করেছি?”
মেরিনা থমথমে মুখে বললেন,
“যা করেছিস তা-ই তোর বাপ-ভাইয়ের কাছে মান-সম্মানের ব্যাপার।”
“মান-সম্মান না, বলো অহংকারের ব্যাপার। আমাকে বড়োলোক পরিবারে বিয়ে দিয়ে এলাকাবাসীকে নিজেদের উঁচু জায়গাটা দেখাতে হবে না? মিশকাত খাঁনের তো আর ডক্টর নিয়াজের মতো গাড়ি, বাড়ি নেই। মাসে-মাসে পকেট ভর্তি ইনকাম নেই। তার কাছে মেয়ে দিলে কি আর এলাকাবাসীর কাছে অহংকার করতে পারবে?”

সুবর্ণা হা করে আরিন্তার কথা শুনল। আরিন্তার কথা শেষ হতেই সন্দিহান মুখে বলল,
“ভাইয়ার কথা বলছো কেন? ভাইয়ার সাথে এর কী সম্পর্ক? খালা, ভাইয়া কী করেছে?”
মেরিনা বললেন,
“ওসব পরে শুনিস। এখন ওকে রেডি কর।”
আরিন্তা জেদ ধরে বলল,
“আমাকে জোর করো না মা।”
“ওনারা তোর অপেক্ষায় বসে আছে। দয়া করে মানুষের সামনে এমন করিস না। সামনে যাবি, ওনারা কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দিবি। দেখলেই তো আর সঙ্গে-সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় না। বিয়ে কি এত সোজা? পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার আছে, কথাবার্তা মেলার ব্যাপার আছে। আমার কথাটা শোন মা। এতদূর থেকে মানুষ এসে বাড়িতে ঝামেলা দেখলে অনেক খারাপ ভাববে। ওঠ।”

অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুজিয়ে মেয়েকে রেডি করতে লেগে পড়েছেন মেরিনা নিজেই। আরিন্তা শাড়ি পরবে না। মেরিনা জোর করলেন না। নিজের পছন্দের একটা থ্রি-পিস পরালেন। আরিন্তা সাজগোজ করতে নারাজ। তাতেও মেরিনা জোর করলেন না। কোনোরকমে চুল বেঁধে মুখে একটু ক্রিম মেখেই ছেড়ে দিলেন। পুরোটা সময় সুবর্ণা চিন্তিত মুখে বসে ছিল। তার মাথায় নানান প্রশ্নের জটলা। আরিন্তার অঘটনের সঙ্গে যে তার ভাইয়েরও কোনো যোগসূত্র আছে, তা সে বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু ঘটনাটা কী, তা না জানা অবধি সে শান্তি পাচ্ছে না। আরিন্তার ম্লান, কালো মুখের দিকে তাকিয়ে মেরিনার বুকের ভেতরটা হুঁ-হুঁ করে কাঁদছে। প্রতিদিন যে মেয়েটার জন্য তিনি কিছু না কিছু খাবার প্রস্তুত রাখতেন, কিছুক্ষণ পরপর মেয়ের খাওয়ার অভ্যাস বলে। তার সেই মেয়েটা দুদিন ধরে পেটপুরে খাচ্ছে না। একা ঘরে দিন-রাত কেঁদে-কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে। মেরিনার খুব ইচ্ছা করছে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে বুকে আগলে নিতে। কিন্তু তার যে দাঁড়ানোর জায়গাটাই নেই।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৮.
আরিন্তা ভেবেই নিয়েছিল তাকে অনেক প্রশ্ন করা হবে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা তার নেই। ডক্টর নিয়াজের পরিবারের মানুষ যথেষ্ট ভালো মানসিকতার। তারা জানেন একজন শিক্ষিত, বুঝদার মেয়েকে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার দরকার পড়ে না। সাধারণভাবেই তারা আরিন্তাকে দু-একটা প্রশ্ন করলেন। মেয়ে সম্পর্কে তারা পরিবারের থেকে আগেই জেনেছেন। তাই বেশকিছু জানার আর প্রয়োজন বোধ করলেন না। তার চেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম দেখাতেই আরিন্তাকে সবার পছন্দ হয়েছে। বুঝতে পেরেছেন খনিকের পরিচয়ে আরিন্তার মিষ্টি মুখটা কেন তাদের ছেলের মনে ধরেছে। নিয়াজের বাবা আতাউর রহমান জানালেন ছেলে-মেয়ে চাইলে আলাদা করে কথা বলতে পারে। বিয়ের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে তাদের একে-অপরের নিজস্ব কথা থাকতেই পারে। সঙ্গে-সঙ্গে পেলব বলে দিলো,
“আমার বোনের ব্যাপারে তো অনেক কথাই হয়েছে ভাইয়ার সাথে। ভাইয়া কেমন মানুষ তা-ও শুনেছে ও। ওর আর বলার কিছু নেই। এখন ভাইয়ার কিছু জানার থাকলে তা ভিন্ন ব্যাপার।”

নিয়াজ একটু অস্বস্তি বোধ করল। আরিন্তার কিছু জানার নেই, সে আর নতুন করে কী জানবে? যেটুকু জেনেছে, সেটুকুই যথেষ্ট। বিয়ের পর দুজন দুজনকে এমনিতেই জেনে যাবে। তাই সে-ও জানাল তার কিছু জানার নেই। এই পর্যন্ত আরিন্তা বুকে পাথর চেপে চুপচাপ মাথা নত করে বসে ছিল। কিন্তু এরপর যখন নিয়াজের বাবা সরাসরি বলল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। সবার সম্মতি থাকলে তিনি হবু পুত্রবধূকে আংটি পরিয়ে দিতে চান। ঠিক তখনই আরিন্তার ধ্যান ভাঙল। মুখ তুলে তাকাল পাশে দাঁড়ানো ভাইয়ের দিকে। দৃষ্টিতে তীব্র নারাজ। কিন্তু মেহমানদের সামনে মুখে কিছু বলতে পারল না। পেলব চোখের ইশারায় চুপ থাকার নির্দেশ দিলো। আরিন্তার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করল। পেলব আরিন্তার হাত এগিয়ে ধরল। আতাউর রহমান অতি আনন্দের সাথে আরিন্তার আঙুলে আংটি পরালেন। টেরই পেলেন না একটা আংটি মেয়েটাকে কীভাবে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। আংটি পরানোর পর সবাই হাসিমুখে মিষ্টি খেয়ে মিষ্টি মুখ করছে। বিয়ের পাকা কথা বলতে হবে তাদের। মেরিনা মেয়েকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পেছন-পেছন গেল সুবর্ণা। মা-বাবার রুমে গিয়েই আরিন্তা ধপ করে মেঝেতে বসে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে ফেলল। সুবর্ণা দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো, যাতে কান্নার শব্দ বাইরে না যায়। মেরিনা গিয়ে মেয়েকে তোলার চেষ্টা করলেন। আরিন্তা মায়ের হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে বলল,
“তুমি বলেছিলে না দেখলেই বিয়ে হয়ে যায় না? এখন এটা কী হলো মা?”
মেরিনা অন্ধকার মুখে বললেন,
“আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে তোর বাপ-ভাই?”
“নাটক শুরু করেছে ওরা আমার সাথে? নিজেদের মতো যা ইচ্ছা, তা-ই করছে। আমি কি রোবট, ওরা যা বলবে তা-ই মেনে নেব?”

সুবর্ণা বলল,
“ঠিকই তো। খালু আর ভাইয়া আপুর মতামত না নিয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।”
আরিন্তা বলল,
“মতামতের গুরুত্ব দিলে কি বিয়ে দিতে চাইত? জানেই তো আমি বিয়ে করব না। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিবে, এটাই তো তাদের আসল উদ্দেশ্য।”
মেরিনা বললেন,
“এতকিছুর পরেও তোর মতামত চাইবে, এটা ভাবিস কীভাবে তুই? তোর কারণেই তোর বিরুদ্ধে গিয়েছে তারা।”
আরিন্তা ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“হ্যাঁ, আমি তো পাপ করেছি, মহাপাপ। সেই পাপে আমার পরিবার অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এখন বিশুদ্ধ হবার জন্য মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে। কী সাধু পরিবার!”
সুবর্ণা অসহায় মুখে বলল,
“আমাকে কি এবার বলবে ভাইয়ার সাথে কী হয়েছে? আমার মাথা ঘুরছে সারাদিন ধরে।”

নিয়াজের পরিবার চেয়েছিল আজই ঘরোয়াভাবে আকদ সম্পন্ন করে রাখতে। অনুষ্ঠান হবে পরের সপ্তাহে। কিন্তু পুলক তালুকদার এতটাও তাড়াহুড়া করতে চাননি। অনুষ্ঠানের মাত্র এক সপ্তাহ আগে হুট করে আকদ করানোর চেয়ে, এক সপ্তাহ পর একসঙ্গে সবটা করাই ভালো। আলোচনা সাপেক্ষে এক সপ্তাহ পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। পুলক তালুকদার চেয়েছিলেন মেহমান আজকের রাতটা থেকে যাক। কিন্তু নিয়াজ রাজি হলো না। সবারই কর্মব্যস্ততা আছে। তাই তারা সন্ধ্যার পরপরই বিদায় নিল।

মেহমান বিদায় নেওয়ার পরই আরিন্তা মা-বাবার ঘর থেকে বেরুল। তারপরই শুরু হলো তার চেঁচামেচি। পেলব তাকে বুঝাতে এলে প্রচণ্ড রাগে সে আঙুল থেকে আংটি খুলে ফেলে দিলো। পেলবের রাগ নিয়ন্ত্রণহারা হলো তখনই। আরিন্তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে সে রাগত স্বরে বলল,
“অনেক সহ্য করছি তোর আজাইরা রাগ। সময় থাকতে থাম বলছি।”
আরিন্তা মুখের ওপর বলল,
“না থামলে কী করবে তুমি? আমার মুখ ছুটাচ্ছ কেন তোমরা? নিজেদের আজাইরা কাজ থামাতে পারো না আগে?”
“অধঃপতন থেকে বাঁচাতে চাইছি, তা ভালো লাগছে না তোর?”
“আমি অধঃপতনে গেলে তোমাদের কী ক্ষতি? তোমাদের কোনো ক্ষতি তো করছি না। আমার জীবন নিয়ে আমার চেয়ে বেশি তোমাদের মাথাব্যথা?”
“নিজের ভালো নিজে বুঝিস না, আবার মুখের ওপর তর্ক করছিস তুই?”
“আমার ভালো আমি খুব ভালোভাবেই বুঝি। তোমাদের অন্তত আমার ভালো বুঝতে হবে না। ভালো করার নামে তোমরা আমাকে নরকে ছুড়ে ফেলতে চাইছো, বুঝতে পারছো না তা? তোমরা আমাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিবে, আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংসার করব কীভাবে? আমার আর মিশু ভাইয়ের জীবন তো তোমরা কুরবানি করছই, সঙ্গে আরেকজন লোকের জীবনও নষ্ট করার চেষ্টা করছো।”
“তার জীবন নষ্ট হতে যাবে কেন? ওই লোক নিজে তোকে পছন্দ করেছে। নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করছে।”
“করছে, কারণ লোকটা আমার মনের খবর জানে না। তোমরা জানতে দাওনি। ওই লোকটার সঙ্গেও তোমরা প্রতারণা করছো। তোমাদের কি মনে হয় লোকটা সব জানার পর তোমাদের মাফ করে দিবে? জেনেবুঝে এত বড়ো ভুল কোরো না ভাইয়া। আমি এই বিয়ে করতে পারব না, ম’রে গেলেও না। মিশু ভাইকে আমি কথা দিয়েছি।”
“আর আমরা যে ওই লোকগুলোকে কথা দিয়েছি, সেই বেলায়? বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে, কানে শুনতে পাচ্ছিস না? মান-সম্মান যেটুকু আছে, তা-ও ধুলায় মিশাবি?”
“ও… মিশকাত খাঁন তোমাদের মান-সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিবে, আর ডক্টর নিয়াজ মান-সম্মান আরও বাড়িয়ে দিবে, না? তোমাদের মানসিকতা বুঝতে পারলে তোমাদের মুখে থুথু ফেলবে ওই লোক, মিলিয়ে নিয়ো।”

পেলব রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে বলল,
“মুখ সামলা আরি, এখনও ভালোভাবে বলছি।”
“তোমরা আগে তোমাদের মানসিকতা সামলাও। সময় থাকতে এসব বন্ধ করো। আমি বারবার বলছি আমি বিয়ে করব না। তারপরও যদি জোর করো, তাহলে নিজেদের মান-সম্মানের মায়া-ও ত্যাগ করো।”

মেরিনা ধমকে উঠে বললেন,
“আরি, মুখ বন্ধ কর। তোর বাবা শুনলে মে’রে ফেলবে।”
আরিন্তা ভেজা কন্ঠে বলল,
“এমনিতেই মে’রে ফেলার ব্যবস্থা করছে মা। ভয় পেয়ে আর কী হবে?”

পেলব মেঝে থেকে আংটি কুড়িয়ে মায়ের হাতে দিয়ে বলল,
“এসব পাগলামি বন্ধ করতে বলো। এসব করে যদি ও ভেবে থাকে মিশুর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে, তাহলে সেটা দুঃস্বপ্ন। পরে বিয়ে করলেও ওকে অন্য ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। তার চেয়ে ডক্টর নিয়াজ হাজার গুণ ভালো।”

আরিন্তা কান্নাভেজা গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
“আমি বিয়ে করব না। শুনেও কেন শুনছো না তোমরা? যে হাতে বড়ো করেছো, সেই হাতেই আমায় ম’রার আগে মে’রে ফেলো না।”
পেলবের কানে সব কথাই পৌঁছাল, তবু সে ফিরে তাকাল না। আরিন্তা মেঝেতে বসে অসহায়ের মতো কাঁদছে আর আহাজারি করছে। মেরিনা মেয়েকে মেঝে থেকে তুলে সোফায় বসালেন। আরিন্তা মায়ের বুকে পড়ে হেঁচকি তুলে বারবার আওড়াল,
“মা, আমায় বাঁচাও মা। এভাবে মে’রে ফেলো না। আমি ভালো থাকতে পারব না। বাবাকে একটু বুঝাও মা, তোমার পায়ে পড়ি।”

সুবর্ণা এখনও কোনোকিছুই স্পষ্টভাবে শুনতে পারেনি। কিন্তু এতক্ষণে তার আর বুঝতে বাকি নেই, আরিন্তার এই পাগলামি তার ভাইয়ের জন্য। তাদের মাঝে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সুবর্ণা আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সে ভাবছে এখন তার কী করা উচিত। আরিন্তা আর তার ভাইয়ের সম্পর্কের কথা জানা তো দূর, কখনো আঁচ-ও করতে পারেনি তারা। কিন্তু আরিন্তার পাগলামি দেখে সে টের পাচ্ছে তাদের সম্পর্কটা ঠুনকো নয়। এ কারণেই আরিন্তার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে তার ভাই এত চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তার ভাই এখনও এসব ব্যাপার জানে না। জানার পর কি সে-ও আরিন্তার মতোই পাগলামি করবে? তার কি এখন ভাইকে এই খবরটা জানানো উচিত? কিন্তু ফোনটা তো এখনও পেলবের কাছে। সুবর্ণা ঠিক করল সে এখনই বাড়ি ফিরে যাবে। যা করার বাড়ি ফিরেই করতে হবে। এখানে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার ভাইয়ের সাথে কথা বলা দরকার। আগে জানতে হবে আরিন্তা তার ভাইকে যতটা ভালোবাসে বলছে, তার ভাইও আরিন্তাকে ততটাই ভালোবাসে কি না। এসব সত্যি হলে যে আরিন্তার সাথে-সাথে তার ভাইয়ের জীবনেও নিশ্চিত অন্ধকার নেমে আসবে।

সুবর্ণা গেল পেলবের কাছে তার ফোন চাইতে। কিন্তু পেলব তাকে ফোন তো ফেরত দিলোই না, বরং জানাল আগামীকাল তার বাবা-মাও আসবে। পুলক তালুকদার তাদের ফোন করে আগামীকাল জরুরী ভিত্তিতে ডেকেছেন। সুবর্ণাকেও আগামীকাল পর্যন্ত এখানে থাকতে বলা হয়েছে। হতাশ হয়ে সুবর্ণাকে ফেরত আসতে হয়েছে। আগামীকাল পর্যন্ত তাকে এখানে বসে আরিন্তার আহাজারি দেখার সাথে-সাথে নিজেকেও দুশ্চিন্তায় ভুগতে হবে ভেবেই তার মাথা ঘুরছে। তার ওপর আগামীকাল বাবা-মাকে ডেকে এসব কথা তুললে না জানি কী ঝামেলা বাঁধে। এসবের চাপে পড়ে দুই পরিবারের মাঝের সম্পর্ক নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু না হলেই হয়। আরিন্তার আহাজারি দেখে তার ভীষণ খারাপ লাগছে। আজীবন সে তার খালুকে তার দেখা সবচেয়ে মহৎ মানুষ ভেবে এসেছে, অনেক সম্মান করেছে। ওই মানুষটার জন্যই তো তারা এখনও ভালো আছে। এই প্রথমবারের মতো ওই মহৎ মানুষটাকেই তার ভীষণ স্বার্থপর, ভীষণ নির্দয় মনে হচ্ছে। সঙ্গে পেলবকেও। ওই ছেলেটাকেও তো সে আজীবন নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবেসে এসেছে। অথচ একেকটা মানুষের ভেতরের সত্তা কী বিচিত্র!

শমসের খাঁন আর আয়েশা খাতুন অবিশ্বাস্য ঘটনা শুনে অতি বিস্ময়ে সঠিক কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। দুজনেই ভাবছেন এতসব কখন হয়ে গেল। তাদের সঙ্গে কথা বলছেন পুলক তালুকদার। পেলব আর মেরিনা পাশে থাকলেও তারা কিছু বলছে না। পুলক তালুকদার নিজেই মিশকাত-আরিন্তার সম্পর্কের ব্যাপারে বললেন। সাথে আরিন্তার বিয়ে ঠিক হওয়ার কথাও বললেন। ঠান্ডা মাথায় সোজাসাপ্ট জানিয়ে দিলেন ছেলে-মেয়ে ভুল করেছে, কিন্তু তিনি সেই ভুল মেনে নিবেন না। শমসের খাঁন আর আয়েশা খাতুনকেও জিজ্ঞেস করলেন তাদের কী মতামত। ছেলের পক্ষ হয়ে তাদের কথা বলার জায়গা নেই এখানে। পুলক তালুকদারের কাছে তারা সবসময় ঋণী হয়ে থাকেন। কম উপকার করেননি তিনি তাদের। আজ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে বিবেকে বাঁধল। আয়েশা খাতুন মেরিনার মুখের অবস্থা দেখেই আঁচ করতে পারছেন ছেলের সাথে আরিন্তার হঠাৎ বিচ্ছেদ সহজ নয়। দুলাভাইয়ের সিদ্ধান্তে তার বোন যে অসন্তুষ্ট, তা-ও বুঝতে পারছেন। মনে-মনে আয়েশা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের জন্য এখন তার চিন্তা লাগছে। এখন বুঝতে পারছেন কেন তার ছেলেকে ঠিক মনে হচ্ছে না। কেন তার ছেলে এত চিন্তিত। আরিন্তার জন্য দুশ্চিন্তা করেই তার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শমসের খাঁন ছেলের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকে সমর্থন করতে পারছেন না। পুলক তালুকদারের সূক্ষ্ম যুক্তির কাছে তার চিন্তা-ভাবনা হার মানতে বাধ্য হলো। তার চেয়ে বড়ো কথা পুলক তালুকদারের সিদ্ধান্তের ওপর বিপরীত কথা বলার সাহস তাদের নেই। তবু আয়েশা শুধু এটুকু বললেন,
“সবই বুঝলাম দুলাভাই। আমার ছেলের হয়ে আমি কথা বলছি না। আপনি মেয়ের যাতে ভালো মনে করেন, করবেন। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে আরির ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? পরে যদি সংসার জীবনে অশান্তি হয়?”

পুলক তালুকদার বললেন,
“বিয়ের পর আস্তে-আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। অশান্তি কিসের? তোমার ছেলেকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দূরে রেখো, দুজনের মধ্যে কথাবার্তা না হলে আস্তে-আস্তে মানিয়ে নিতে পারবে। যোগাযোগ থাকলেই অশান্তি হবে।”
আয়েশা চুপ করে রইলেন। পুলক তালুকদার পুনরায় বললেন,
“আরিকে আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে দিচ্ছি না। তাই ও আমাকে আর পেলবকে বারবার ফোন করছে। তোমাদের কাছে আমার কথা হচ্ছে, এই মুহূর্তে আরির বিয়ের খবর তোমরা ওকে জানাবে না।”
আয়েশা বললেন,
“কিন্তু মিশু তো বারবার ফোন করে জানতে চাইছে এখানে কী সমস্যা হয়েছে। গতকাল সুবর্ণাকে এখানে পাঠিয়েছিলাম-ও ওর কথায়। এখন তাহলে ও ফোন করে জানতে চাইলে আমি কী বলব আপনিই বলুন।”
“বলবে আমার ব্যবসায় বড়ো লস হয়ে গেছে, তাই মেজাজ খারাপ বলে কারো সাথে কথাবার্তা বলছি না।”
“কিন্তু পেলব? পেলব-ও তো যোগাযোগ করছে না।”
পেলব বলল,
“সমস্যা নেই। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব নে। কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্যবসার কথাই বলে দিবো। তোমরাও ওটাই বোলো।”
মেরিনা থমথমে মুখে বললেন,
“এখন না হয় সবাই মিলে মিথ্যা কথা বলে ছেলেটাকে চুপ রাখবে। কিন্তু পরে যখন ও জানতে পারবে, তখন? ওর কথা কি কেউই ভাবছো না? ছেলেটা সবাইকে ছেড়ে এতদূরে পড়ে আছে। শেষমেষ সবার থেকে আঘাত পেয়ে ওর না জানি কী অবস্থা হয়।”

ছেলের আশঙ্কায় বোনের সাথে আয়েশার বুকের ভেতরটাও কামড় দিয়ে উঠল। কিন্তু এখন যে দুশ্চিন্তা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই করার নেই।

এ বাড়িতে এসেও আয়েশা খাতুন আরিন্তার সঙ্গে দেখা করলেন না। মেয়েটার ব্যথিত মুখটা দেখতে ইচ্ছা করেনি তার। ওই মুখ দেখে তিনি বুকের ব্যথা আরও বাড়াতে চান না। আজকের দিনটা তাদের থাকার জন্য বলেছিলেন পুলক তালুকদার। কিন্তু তারা থাকেননি। কথাবার্তা শেষ করেই বাড়ি ফিরে এসেছেন। ফেরার সময় সুবর্ণাকেও বারবার করে সতর্ক করে দিয়েছে পুলক, যাতে সে আবেগের বশে ভাইকে কিছু না জানিয়ে বসে। বাড়ি ফিরে আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা সবাই নীরব হয়ে আছেন। শমসের খাঁন কিছুক্ষণ পরপর ছেলের ওপর চেঁচামেচি করছেন। জ্ঞানী ছেলে জেনেবুঝে এমন ভুল কেন করল, এটাই তার বক্তব্য। আয়েশা খাতুন ভয়ে ছিলেন কখন ছেলের ফোন আসে, সেই ক্ষণের। দুপুরের দিকে সুবর্ণা ফোন নিয়ে এসে চুপসানো মুখে বলল,
“ভাইয়া ফোন করেছে।”

আয়েশা খাতুন ফোন হাতে নিয়ে কিছু মুহূর্ত চুপ রইলেন। কথা বলার আগেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। নিজের ছেলেকে দূরে বসিয়ে এত বড়ো মিথ্যা কথা বলতে মন সায় দিচ্ছে না তার। তবে ফোন ধরে কথা শুরু করার পর একটু শান্ত হলেন। মিশকাত জানাল পেলব তাকে ফোন করেছিল। পুলক তালুকদারের ব্যবসায় বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে, এটাই জানিয়েছে সে। কারোর মনের অবস্থা ভালো না বুঝতে পেরে মিশকাত আর বেশি প্রশ্ন করেনি। তবে মনে থাকা একটা কথা সে মাকে বলল। মেরিনার ফোন দিয়ে পেলবের এত কী কাজ? এমন করলে মেরিনার সঙ্গে সবাই কথা বলবে কীভাবে? ছেলের এক কথার মাঝেই আয়েশা বুঝলেন, তার ছেলের উস-খুসের আসল কারণ আরিন্তার সাথে কথা বলতে না পারা। মনের কষ্টটা চেপে রেখে আয়েশা এটা-ওটা বলে ছেলেকে ভুলভাল বুঝানোর চেষ্টা চালালেন। সত্য না জানা মিশকাতের কাছে মায়ের সব কথাই স্বাভাবিক মনে হলো। অথচ ফোনের এপাশে বসে প্রতিটা মিথ্যা কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে আয়েশা খাতুনের বুক কেঁপে উঠল। সুবর্ণা পাশে বসে ছলছল চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার যে মা কোনোদিন তাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেনি, সে আজ ছেলের সাথে একের পর এক মিথ্যা বলে চলেছে। সুবর্ণা জানে তার মা নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার যত দুশ্চিন্তা হচ্ছে মিশকাতের জন্য। তার ভাইটা তাদের ক্ষমা করবে তো?

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-১৬

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৬.
গতরাতে দুশ্চিন্তায় ছটফট করে অনেক দেরী করে ঘুমিয়েছিল আরিন্তা। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠতেও দেরী হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে চেঁচামেচি কানে আসতেই সে ফ্রেশ হওয়ার কথা ভুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। সিঁড়ির ধারে এসে বুঝল তার বাবা চেঁচামেচি করছে। আরিন্তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হলো। গলাটাও সঙ্গে-সঙ্গে শুকিয়ে কাঠ হলো। তিন-চার সিঁড়ি নেমে দাঁড়াতেই স্পষ্ট শুনতে পেল পুলক তালুকদারের গালাগাল। উচ্চ স্বরে তিনি মিশকাতের নাম ধরে গালাগাল করছেন। আরিন্তার আর বুঝতে বাকি রইল না পেলব সব জানিয়ে দিয়েছে বাবাকে। আর এক সিঁড়ি সামনে পা ফেলার শক্তি এল না আরিন্তার শরীরে। বাবার এই রুদ্রমূর্তি রূপের ফলাফল কী হতে পারে ভেবেই তার হাত-পা অসাড় হয়ে এল। এরমধ্যে কী যেন ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল। নিশ্চয়ই পেলব তালুকদার নিজের রাগ দমাতে ভাঙচুর শুরু করেছেন। আরিন্তা নিচে নামল না। উলটা ঘুরে নিজের রুমে ফিরে গেল। দরজা আটকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থম মে’রে বসে রইল।

গোটা সকাল পুলক তালুকদার চেঁচামেচি করেছেন। সকালের নাস্তা খেতে বসে পেলব মিশকাত-আরিন্তার কথা জানানোর পরপরই এক কথা দুই কথায় পুলক তালুকদার রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। খাবারটা আর কারোরই ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। এদিকে মেরিনা হতবাক হয়ে আছেন। এমন অবিশ্বাস্য সত্যি জানার পর থেকে তার মাথা ঘুরছে। পুলক তালুকদার বাইরে চলে যাওয়ার পর পেলবের সাথে তিনি মেয়ের কাছে এসেছেন। পেলবকে দেখেই আরিন্তা বলে উঠল,
“ভাইয়া, তুমি এটা কেন করলে?”
পেলব উত্তর দিলো,
“করাটা ঠিক মনে হয়েছে, তাই করেছি।”
“বাবাকে এভাবে খেপিয়ে তোলা তোমার ঠিক মনে হয়েছে?”
“বাবাকে আমি খেপানোর কেউ না। আজ শুনে বাবা যেমন আচরণ করছে, কাল শুনলেও একই আচরণ করত, স্বাভাবিক।”
“কিন্তু তুমি আজই কেন শোনাতে গেলে? কী ভেবে করলে তুমি এটা? চুপচাপ থেকে তুমি মনে-মনে ছক কষেছ এভাবে বাবার কাছে সব ফাঁস করার? তোমার কি কোনো ক্ষতি হয়েছে?”

মেরিনা বললেন,
“ক্ষতি কারোরই হয়নি। কিন্তু তুই এসব করার আগে একবারও তোর বাবার কথা ভাবিসনি? মিশু যতই ভালো ছেলে হোক, তোর বাবা ওকে কোনোদিন মেয়ে জামাই মানবে?”
আরিন্তা বলল,
“না মানার কী আছে? আমি তো আজেবাজে কোনো ছেলেকে পছন্দ করিনি।”
পেলব বলল,
“বাবা কী বলেছে জানিস তুই? বলেছে মিশু আজীবন যেই থালায় খেয়েছে, বিশ্বাসঘাতকের মতো সেই থালা-ই ফুটা করেছে।”
“বিশ্বাসঘাতকতার কী আছে এতে?”
“কী আছে মানে? সারাজীবন ওদের পরিবার চলেছে বাবার সাপোর্টে। নইলে কবে ভেসে যেত। মিশুর ইনকামে যে এখন একটু দিন ফিরেছে, বাবা সাহায্য না করলে পারত এসব করতে?”

আরিন্তার রাগ উঠল। শক্ত মুখে বলল,
“আপন মানুষকে সাহায্য করেছে, এতে ক্ষতি কী? এই ব্যাপারটাকে এত নিচভাবে নিচ্ছ কেন তোমরা? সাহায্য করেও তোমরা ওই পরিবারকে এমন নিচ মনে করেছ সবসময়? তাহলে লাভ কী এসব করে?”
পেলব মেরিনাকে বলল,
“মা, তোমার মেয়েকে বুঝাও। সহজে না বুঝলে কিন্তু এর ফল পরে খুব খারাপ হয়ে যাবে। তখন বাবার কাছে কেঁদেও লাভ নেই। আমি ওকে বুঝিয়ে মাথা খারাপ করতে পারব না। গেলাম।”

থমথমে মুখে পেলব চলে গেল। মেরিনা মেয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন,
“কী করলি তুই আরি? এখন আমি কোনদিকে যাব? আমার কাছে তুই, মিশু সবাই একরকম ছিলি।”
আরিন্তা মমতাময়ী মায়ের সামনে যেন বরফের মতো শীতল হয়ে গেল। নরম কন্ঠে বলল,
“মা, ভাইয়ার মুখে তো সবই শুনেছ বোধ হয়। মিশু ভাই আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করত। আমি ওনাকে ফেরাতে পারিনি।”
“আগে কেন জানালি না আমাকে?”
“আগে জানালে কী হত মা? এখন জেনেই তোমরা কেউ মানতে পারছো না। আগে জানলে মানতে?”
“আত্মীয়-স্বজনের ভেতর সম্পর্ক হলে এমনই হয়।”
“আচ্ছা, মিশু ভাই কি অযোগ্য ছেলে, তুমিই বলো? বাবা আর ভাইয়া কেন এমন করছে?”
“তাদের নারাজ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার বোনের সংসার টিকে আছে তোর বাবার কারণে। ওরা তোর বাবার কাছে অনেক ঋণী। তাছাড়া ওরা তোর বাবার মতো অবস্থাশীল না।”
“মিশু ভাই কত কষ্ট করছে, তা কি তোমরা জানো না? আস্তেধীরেই তো পরিবর্তন আসবে।”
“এসব তুই যতটা সহজ ভাবছিস, বড়োরা এভাবে ভাববে না। তুই তোর বাবার একমাত্র মেয়ে, ভাইয়ের একমাত্র বোন। স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে তোকে অনেক ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে। তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবলে মিশুর সঙ্গে তোর বিয়ে সম্ভব না।”
“পকেট ভর্তি টাকা থাকলেই কি সেই পরিবার ভালো হয় মা? তোমরা তো আমাকে সুখী করতে চাও। কিন্তু আমি আসলে কিসে সুখে থাকব, তা কি একবারও ভাবছো? এতগুলো বছর একজনকে কথা দিয়ে এখন আমি তার সাথে বেইমানি করে সুখী হতে পারব?”

আরিন্তার চোখ ভর্তি জল চলে এল। সে মায়ের কাছে বিনীত অনুরোধ করল,
“মা, তোমার কাছে অনুরোধ করছি তুমি অন্তত বাবাকে বুঝাও। বাবাকে না পারো, ভাইয়াকে বুঝাও। ভাইয়া বুঝলেই বাবা বুঝবে।”
“তোর ভাইকে তুই বুঝাতে পেরেছিস? আমি কী বুঝাব বল তো?”
“আমি জানতাম না ভাইয়া-ও আমার বিপরীতে কথা বলবে। ওকে ভরসা করে আমি সত্যি কথা বলেছিলাম। ভেবেছিলাম মিশু ভাইয়ের কথা শুনলে ও অসন্তুষ্ট হবে না।”
“মিশুর সাথে তোর ভাইয়ের যতই ভালো সম্পর্ক থাকুক, তোর বেলায় ও এসব মানবে না। আত্মীয়-স্বজনের ভেতর কোনো সম্পর্কই মানবে না ও। তোর জন্য না আবার মিশুর সাথে আমাদের সবার সম্পর্কই খারাপ হয়ে যায়। তার চেয়েও বড়ো ভয় তোদের জন্য আমার বোনের পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় কি না, তা-ই দেখার বাকি। তোর বাপ-ভাই যা খেপেছে মিশুর ওপর!”

আরিন্তা ধরা গলায় বলল,
“মিশু ভাই আমাকে নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় থাকে, তা তোমাদের বুঝাতে পারব না। উনি এসব শুনলে কী করবে আমি নিজেও জানি না। এই পরিস্থিতির ভয়েই উনি ছিলেন। আমি সবসময় ওনাকে বলেছি আমি সামলে নেব। কথা দিয়েছি উনি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। উনি আমার কথার ভরসায় আছেন। আমি কথা রাখতে না পারলে উনি কী পাগলামি করবেন ঠিক নেই। মা, তোমার হাতে ধরি, কিছু একটা করো।”
মেরিনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“আমি পড়েছি ঠেকায়। মিশু আমার বোনের ছেলে। সম্পর্ক খারাপ হলে আমার ক্ষতি, তোর বাবার না। তোর মনে হয় উনি আমার কথা শুনবে? আমি এখন তোর হয়ে কথা বলতে গেলে উলটা আমাকেই কথা শুনিয়ে দিবে।”
“তাহলে এখন আমি কী করব? তোমার-আমার দুজনের ফোনই তো ভাইয়ার কাছে। মিশু ভাইয়ের সাথে কথাও বলতে পারছি না।”
“তুই নিজেই তোর বাবার সাথে কথা বল।”
আরিন্তা চমকে উঠে বলল,
“কী বলছো? বাবা তো আমাকে কিছু জিজ্ঞেসই করেনি এই বিষয়ে। সে আমাকে কিছু না বলতে আমি কীভাবে বলব?”
“আমার মনে হয় না তোর বাবা তোকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। কারণ সব কথাই পেলবের মুখে জানা হয়ে গেছে তার। তোর সাথে কথা তুললেই কথা বাড়বে, তা উনি ভালোভাবেই জানেন। সেজন্যই তোর সাথে এ বিষয়ে কথা বলছেন না।”

আরিন্তা বলল,
“মা, ভাইয়ার কাছ থেকে তোমার ফোনটা একটু এনে দিবে? এটুকু উপকার করো দয়া করে। এই মুহূর্তে মিশু ভাইয়ের সাথে আমার কথা বলতেই হবে। নইলে বাবা-ভাইয়াকে বুঝানো সম্ভব না।”
“পেলব এখন ফোন ছাড়বে না। ও নিজেই এখন তোর বিয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি দেখাচ্ছে।”
আরিন্তা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ভাইয়া এমন করবে আমি ভাবতেও পারিনি মা। এই অবধি সবসময় আমি সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছি ওকে। ও ভালোভাবেই জানে আমি বিয়ে করতে চাই না।”
“জানি না মা, আমি কিছু জানি না। কী করবি, না করবি তোরাই জানিস। চারদিক থেকে সবাই আমাকে ঘিরে ধরবি, আমি শুধু শুনব। কারোর হয়ে কথা বলার অবস্থা আমার নেই। যার যা ভালো মনে হয় কর। আমাকে টানাহেঁচড়া করিস না।”

আহাজারি করতে-করতে মেরিনা উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আরিন্তা ভেজা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরটা ক্ষণে-ক্ষণে মুচড়ে উঠছে তার। কেমন এক পীড়াদায়ক অনুভূতি হচ্ছে। অতিরিক্ত ভালোবাসা হয়তো এভাবেই মানুষকে যন্ত্রণার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। যারা হাবুডুবু খেতে-খেতে একসময় তীর ছুঁতে পারে, তারা বেঁচে যায়। আর যারা বহু কষ্টেও তীর খুঁজে না পেয়ে অতল সাগরে ডুবে যেতে বাধ্য হয়, তাদের ভালোবাসা এমনিতেই ম’রে যায়। আরিন্তা জানে না তাদের কপালে কী আছে। শুধু জানে এতদিন সে মনে যে জোর ধরে রেখেছিল, সেই জোর দিয়ে এই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা সে শেষ পর্যন্ত করবে। কিন্তু ফলাফল তার অজানা।

সারাদিনে আরিন্তা নাওয়া-খাওয়া কিচ্ছু করেনি। পুলক তালুকদার মেরিনাকে বলে গেছেন আরিন্তাকে ভার্সিটিতে যেতে না দিতে। তাই ভার্সিটি-ও যাওয়া হয়নি। ভার্সিটি গেলেও মিশকাতের সাথে যোগাযোগ করার একটা উপায় পাওয়া যেত। বদ্ধ ঘরে আরিন্তা ছটফট করে দিন কা’টিয়েছে। মেরিনা অনেক করে বলেও কথা শুনাতে পারেননি। পেলব-ও কয়েকবার ডাকাডাকি করেছিল, কিন্তু আরিন্তা তার সাথে কথাই বলেনি। রাতে পুলক তালুকদার বাড়ি ফিরে মেয়ের খবর শুনে নিজেই ডাকতে গেলেন। আরিন্তা বাবাকে কিছু বলতে পারল না। কারণ পুলক তালুকদার মেয়েকে খাবার টেবিলে ডাকার বাইরে অন্য কোনো কথা বলেননি। সারাদিনে পেটে কিছু না পড়ায় আরিন্তার প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। সবসময় খাই-খাই করা মেয়েটা কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে? খাওয়া-দাওয়া না করলে তার শরীর দুর্বল লাগে। তবু দুশ্চিন্তায় খাওয়ার ইচ্ছা জাগছে না আজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বাবার ডাকে বদ্ধ ঘর ছেড়ে খাবার টেবিলে এসে চুপচাপ বসেছে। পুলক তালুকদার নিজেই মেয়ের পাতে মাছ তুলে দিয়েছেন। কিন্তু আরিন্তার এখন কাঁ’টা বেছে মাছ খেতে একদমই ইচ্ছা করছে না। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে সে টেবিল ছাড়তে পারলে বাঁচে। বাবার সামনে এই প্রথম তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। নিচু স্বরে বলল,
“মাছ খাব না।”
মেরিনা শুধালেন,
“কেন?”
“খেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে কী দিয়ে খাবি?”
পুলক তালুকদার স্ত্রীকে বললেন,
“একটা ডিম ভেজে দাও।”
আরিন্তা বলল,
“লাগবে না। সবজি দিয়ে খেতে পারব।”

পুলক তালুকদার তবু স্ত্রীকে ডিম ভেজে আনতে বললেন। স্বামী, সন্তানদের শান্ত, গম্ভীর মুখে একবার চোখ বুলিয়ে মেরিনা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আরিন্তা মাছ রেখে পাতে সবজি নিয়ে মাথা নিচু করে খাওয়া আরম্ভ করে দিয়েছে। বাবা, ভাই কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। গাম্ভীর্যতা দেখে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে দুজনের মনের মধ্যে এখন কী চলছে। হঠাৎ পেলব বলে উঠল,
“ডক্টর নিয়াজের সাথে কথা হয়েছে।”
সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তার খাওয়া থেমে গেল। পুলক তালুকদার পেলবকে শুধালেন,
“কী বলল?”
“বলল আলাদা করে আর মেয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। সে তো দেখেছেই। আর আমি যে ছবি পাঠিয়েছি তা ওনার বাবাকে দেখিয়েছেন। ওনার বাবা না কি বলেছেন এলে একেবারে পাকা কথা বলে ফেলবেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে।”

আরিন্তা চুপ করে শুনলেও এই পর্যায়ে পেলবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমি বিয়ে করব না।”
পেলব উত্তর না দিয়ে বোনের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পুলক তালুকদার পেলবকে বললেন,
“ওর বাবার ফোন নাম্বারটা দিস আমাকে। তুই আসার দিনের কথা কিছু বলেছিস?”
পেলব বলল,
“আমি বলেছি কাল বা পরশুর কথা। তুমিও কথা বলে দেখো। তারপর না হয় তাদের সুবিধামতো আসবে একদিন।”

আরিন্তা ভীষণ বিরক্ত হলো। যত রাগ এসে পড়ল পেলবের ওপর। এবারেও সে পেলবের দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগত স্বরে বলল,
“আমি কী বলছি শুনতে পারছো না? আমি বিয়ে করব না। কাকে বিয়ে দিবে তোমরা?”
পেলব রাগ দেখাল না। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“বাবাকে বল।”
আরিন্তা বাবার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। পুলক তালুকদার মেয়েকে বললেন,
“সারাজীবন কোনো কাজে বাঁধা দিইনি। এবার অন্তত চুপ থাকো। যা হচ্ছে তোমার ভালোর জন্যই হচ্ছে।”
আরিন্তা ঢোক গিলে থমথমে মুখে বলল,
“আমার অমতে বিয়ে দেওয়া কেমন ভালো বাবা?”
“তুমি ভালো থাকার জন্য ভুল পথ ধরে হেঁটেছ। বাবা হিসাবে আমি সেই ভুল শুধরে দিবো। সময় এলেই বুঝতে পারবে কোনটা তোমার জন্য ঠিক।”
আরিন্তা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাল। বলল,
“আমি বিয়ে করতে পারব না। শুধু-শুধু এসব ঝামেলা কোরো না।”
“ঝামেলা কে করবে? তুমি, না তোমার মিশু ভাই?”

আরিন্তার ডান চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মেরিনা একটা বাটিতে ডিম ভাজা এনে আরিন্তার সামনে রাখল। পুলক তালুকদার পুনরায় মেয়েকে বললেন,
“এত বড়ো হয়েছ, আজ পর্যন্ত আমি তোমার গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, ধমক দিয়ে কথাও বলিনি। একমাত্র মেয়ে হিসাবে সবসময় আহ্লাদ পেয়েছ। সেই সুযোগে যা ভুল করার করেছ। তা নিয়েও আমি তোমার সাথে অযথা ধমকা-ধমকি করতে চাই না এখন আর। কারণ এখন আর ঘটে যাওয়া ঘটনা পরিবর্তন হবে না। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে বাগড়া দেওয়ার মতো দ্বিতীয় ভুলটা কোরো না। যা হচ্ছে হতে দাও। নইলে আমার যে রূপ তুমি দেখোনি, সেই রূপ দেখাতে বাধ্য হব। আহ্লাদের দিন ভুলে যাও, নিজের ভুল শুধরাও। তোমার ইচ্ছায় আর কিছু হবে না। জল্পনা-কল্পনা বাদ দিয়ে এবার নিজের ভালো বুঝতে শেখো।”

আরিন্তা চোখের পানিতে রাগ সামলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“তোমরা যা-ই করো, আমি বিয়ে করতে পারব না।”
পুলক তালুকদার বললেন,
“খাওয়া শেষ করো।”
মেরিনা-ও বললেন,
“বোস, সারাদিন না খেয়ে ছিলি।”
আরিন্তা কারো কথা কানে তুলল না। হনহনিয়ে হেঁটে সোজা ওপরে চলে গেল। মেরিনা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন। পুলক তালুকদার কিছু সময় থম মে’রে বসে থাকার পর স্ত্রীকে বললেন,
“মেয়েকে বুঝাও। ত্যাড়ামি করে কোনো লাভ নেই। যে আশায় বসে আছে, তা পূরণ হবার নয়। সময় থাকতে বুঝা ভালো। নইলে জোরজবরদস্তি ছাড়া কিছু করার নেই। আর আপাতত আয়েশাদের কারোর সাথে যোগাযোগ করার দরকার নেই। তোমার ভাগনের সাথে ভুলেও কথা বলবে না এখন। বলার হলে সব মিটে যাওয়ার পর বলবে। আপাতত নিজের মেয়ের ভালোর দিকে তাকাও।”

মেরিনা প্রত্যুত্তর করার মতো কথা পেলেন না। কী-ই বা বলবেন? তার যে কারোর পক্ষে কথা বলার সুযোগ নেই। মেয়ের পক্ষ নিলে স্বামী নারাজ হবে। নানান কথা শুনতে হবে তাকে। এই মুহূর্তে মেয়ে সমর্থন পেলে আরও সাহস পেয়ে যাবে। তখন তাকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে। আবার মেয়েকে কটু কথাও বলতে পারছেন না তিনি। মিশকাতকে তিনি আজীবন নিজের ছেলের মতো ভালোবেসেছেন। স্বামী এমন নারাজ না হলে তিনি মেয়েকে সমর্থন করতেন। মনে-মনে তিনি বিশ্বাস করেন মিশকাতের মতো ছেলে অবশ্যই তার মেয়ের যোগ্য। কিন্তু এ কথা যে তিনি ছাড়া কেউ বুঝেও বুঝতে চাইছে না।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-১৪+১৫

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৪.
দেশে আসা এক পরিচিতজনের কাছে মিশকাত সবার জন্য কিছু উপহারের সাথে দুটো স্মার্টফোন পাঠিয়েছে। একটা সুবর্ণা, আরেকটা আরিন্তার জন্য। কিন্তু ফোন পাঠানোর কথা আগে থেকে কেউই জানত না। আরিন্তাকে এখনও তার বাবা ফোন কিনে দিচ্ছে না বলে মিশকাত তার জন্য ফোন পাঠানোর কথা ভাবে। তারপর আবার মাথায় আসে আরিন্তার জন্য একা পাঠালে সুবর্ণার মন খারাপ হতে পারে, বা নানাজন নানা কথা বলতে পারে। তাই দুজনের জন্যই পাঠিয়ে দিয়েছে। অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে দুজন যেমন অবাক, তেমনি খুশি। কিন্তু পুলক তালুকদার খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একে তো তিনিই এখনও মেয়েকে ব্যক্তিগত ফোন কিনে দেননি, তার ওপর মিশকাত অতিরিক্ত টাকা খরচ করে এসব পাঠিয়েছে। মেরিনা তাকে বুঝালেন, মেয়ের এখন নিজস্ব মোবাইল ফোন দরকার। এমনিতেও যে সে মোবাইল ফোন ছাড়া থাকে, তেমনটা নয়। মেরিনার ফোন সবসময়ই নিজের মতো ব্যবহার করে। মিশকাত-ও বুঝিয়ে বলল এটুকু উপহারে তার বিশেষ আর্থিক ক্ষতি হয়নি। বর্তমানে তার আয়-রোজগার সন্তোষজনক।

মিশকাত রাগে ফুঁসছে। আরিন্তা চুপ মে’রে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজকাল আরিন্তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব বেশি আসছে। এতদিন পুলক তালুকদার চুপ থাকলেও, এবার তার একটা ছেলেকে ভালো লেগেছে। তাই তিনি বিয়ের ব্যাপারে এগোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এবারেও আরিন্তা আর পেলব বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না আরিন্তা বিয়ে করবে, না পেলব বোনের বিয়ে দিবে। এই নিয়ে এবারেও বাবার সাথে পেলবের তর্ক হয়েছে। কথাটা মিশকাতকে জানাতেই ধুম করে সে রেগে গিয়েছে। তার সমস্ত রাগ এসে পড়েছে ঘটকের ওপর। ঘটক কেন এত বেশি মাথা ঘামাচ্ছে, এটাই তার ক্ষোভের কারণ। আরিন্তা বলল,
“আচ্ছা, এখন এই রাগ দেখানোর দরকারটা কী? এসব তো নতুন না। বিয়েও করে ফেলছি না আমি। তাহলে?”
মিশকাত কোনো প্রত্যুত্তর করল না। আরিন্তা পুনরায় বলল,
“মিশু ভাই, ঠিক এই কারণেই আমি তোমাকে এসব কথা জানাতে চাই না।”
মিশকাত বড়ো একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরও ওই ঘটক পিছু ছাড়ে না কেন, তুই-ই বল?”
“তাদের তো কাজই এটা।”
“হ্যাঁ, আর তাদের এই কাজের চক্করে আমাকে প্রতিদিন দুশ্চিন্তায় ভুগতে হয়।”
“তোমাকে কে বলেছে দুশ্চিন্তা করতে? আমি বলেছি?”
“সুন্দরী বউ ফেলে রেখে হাজার মাইল দূরে পড়ে থাকলে দুশ্চিন্তা ছাড়া উপায় কী?”
“তোমার বউ কি চাইলেই অন্য কেউ নিয়ে যেতে পারবে? এত সোজা?”
“দিয়ে দিতে কতক্ষণ?”
“কে দিবে?”
“তোর বাপ।”
“দিতে চাইলেই আমি চলে যাব?”
মিশকাত হতাশ কন্ঠে বলল,
“ভালো লাগে না রে আরি। একটা বছর দূরে থেকে কতটা চিন্তা নিয়ে একেকটা দিন পার করতে হয়েছে, তা আমিই বুঝি।”
“আমি বুঝি না তোমায়? তোমায় রোজ-রোজ চিন্তা করতে নিষেধ করলেও তো শোনো না।”
“করতে তো চাই না। কিন্তু চিন্তা যে আমায় ছাড় দেয় না। উপার্জন বাড়ার পর পরিবারের চিন্তা যা একটু কমেছে। কিন্তু তোর চিন্তা তো উপার্জন দিয়ে আটকে রাখার উপায় নেই। মাঝে-মাঝে আমার কী মনে হয় জানিস? তোর চিন্তায়-চিন্তায় আমি একদিন পা’গল হয়ে যাব।”
আরিন্তা হাসতে-হাসতে বলল,
“চিন্তা কোরো না। ততদিনে তোমার চক্করে পড়ে আমিও পা’গল বনে যাব। তারপর দুজন মিলে একসঙ্গে পাগলাগারদে সংসার পেতে নতুন ইতিহাস গড়ব। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হবে না?”
“হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি রকমের ইন্টারেস্টিং।”

আরিন্তা শুধাল,
“কী করছেন মিস্টার পোল্ট্রি?”
“জোড়া চাঁদ দেখছি।”
আরিন্তা বোকার মতো প্রশ্ন করল,
“চাঁদ আবার জোড়া হয় কীভাবে? চাঁদ তো একটাই।”
“আমার আকাশে তো সবসময় জোড়া চাঁদ-ই দেখা যায়। একটা অমাবস্যা এলে হারিয়ে গিয়ে অন্ধকার দিয়ে যায়। আরেকটা সবসময় একইভাবে জ্বলতে থাকে। অমাবস্যা-ও তাকে হারিয়ে নিয়ে যেতে পারে না।”
আরিন্তা এবার বুঝল মিশকাতের জোড়া চাঁদের রহস্য। সে ঠোঁট টিপে হেসে আবার প্রশ্ন করল,
“বলো কী! তোমার চোখে আবার সমস্যা হয়নি তো? আচ্ছা, শুধু চাঁদ-ই জোড়া দেখো, না অন্য কোনো কিছু-ও?”
মিশকাত বলল,
“দেখি তো, প্রেমিকা-ও জোড়া দেখি।”
“কীহ্! এসব চলছে তাহলে? সাদা চামড়ার মেয়েদের দেখে-দেখে চোখে সমস্যা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, এজন্যই তো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। এত রমণীদের ভিড়ে কেবল একজনকে পাই না। তাকে তাই চাঁদের পাশে খুঁজে বেড়াই।”
“দেখতে পাও?”
“পাই তো, স্পষ্ট দেখতে পাই। কিন্তু ছুঁতে পারি না।”
আরিন্তা চুপ হয়ে গেল। মিশকাত ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“দিনকে দিন আমার চাঁদাসক্তি যা ভয়ানক বেড়ে যাচ্ছে, আজকাল মনে হয় কোনো একদিন না আমার চাঁদাসক্তি বিরহবিধুর পরিণাম পায়।”

আরিন্তা হঠাৎ বলে উঠল,
“রাখছি।”
“কেন?”
“এমনি, ভালো লাগছে না। ঘুমিয়ে পড়ো।”
“রাগ করেছিস?”
আরিন্তা গাল ফুলিয়ে বলল,
“না।”
“তাহলে গাল ফুলিয়ে রেখেছিস কেন?”
“কই? অডিয়ো কলে-ও আজকাল মানুষের মুখ দেখা যায়?”
“আমি তো দেখতে পাই।”
“কারণ তোমার চোখে সমস্যা। ডক্টর দেখাও।”
“এই সমস্যা দুনিয়ার কোনো ডক্টরই সারাতে পারবে না। পারলে দেখাতাম।”
“আচ্ছা, দেখিয়ো না। যাও ঘুমাও।”
“এত রাগিয়ে ফেললাম?”
“না।”
“আচ্ছা, আর রাগ করার মতো কথা বলব না।”
“তা তুমি প্রতিদিনই বলো।”
“এরপর বললে শাস্তি মাথা পেতে নেব।”
“শাস্তি-ই নিতে পারবে, তবু তুমি এ কথা মনে রাখতে পারবে না।”
“থাকবে কী করে? আমার মনে তো শুধু তোমার বিচরণ আরিপাখি। তাই আর কোনো কথা মনে জায়গা পায় না।”
“চাপাবাজি কম করো তো মিশু ভাই।”
“আমার আকাশসম ভালোবাসাকে তুমি চাপাবাজি বলতে পারলে আরি?”
“পেরেছি বলেই তো শুনতে পারলে।

একটা কথা মনে পড়তেই মিশকাত প্রসঙ্গ পালটে বলে উঠল,
“ভালো কথা, সুবর্ণার পার্লারের কী খবর?”
“ভালো। আজকাল সুবর্ণা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পার্লার নিয়ে। শুধু আমিই অকর্মা হয়ে পড়ে আছি।”
“অকর্মা কীভাবে? সারাক্ষণ খাওয়া-ও একটা কাজ। আপাতত তুই ওটাই কর মন দিয়ে। আমি ফেরার পর না হয় চব্বিশ ঘন্টার পার্মানেন্ট কাজ দিয়ে দিবো।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে বলল,
“তুমি আবার আমায় খ্যাপানোর চেষ্টা করছো? এবার কিন্তু আমি সত্যি-সত্যি ফোন কে’টে দিবো।”
মিশকাত হেসে উঠে বলল,
“আচ্ছা, আচ্ছা, আর খ্যাপাচ্ছি না।”

শমসের খাঁনের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন তিনি স্ক্র্যাচ ছাড়াই ধীরে-ধীরে হাঁটতে পারেন। তবে তার চিকিৎসা চলমান। মাঝে-মাঝে গিয়ে চেকআপ করাতে হয়। আরিন্তা দুই-তিনবার সাথে গিয়েছিল। অথচ এটাও যে তার জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে, এমন ধারণাই তার ছিল না। শমসের খাঁনের ডক্টরের সাথে পুলক তালুকদারের ভাব জমেছে। ডক্টর অল্প বয়সী যুবক। নাম নিয়াজ মাহমুদ। আরিন্তার দুই-তিনবারের সাক্ষাতেই যে সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসবে, এটা পুলক তালুকদারের কাছেও অবিশ্বাস্য ছিল। ডক্টর নিয়াজের প্রতি বরাবরই পুলক তালুকদারের দারুণ প্রশংসা ছিল। মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব যেন তার কাছে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দের ছিল। একে তো ডক্টর নিয়াজ দেখতে-শুনতে লাখে একটা ছেলে। আচরণ খুবই সুন্দর। মনের দিক থেকে ভেজালমুক্ত ছেলে বলা চলে। তার ওপর পরিবারে-ও কোনোরকম ঝামেলা নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে তার মা কেউই বেঁচে নেই। নিজস্ব বাড়ি আছে। সাজানো বাড়িতে সবই আছে। শুধু নিজের মানুষের বড়ো অভাব। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে তার বাস। বাবার দেখাশোনার জন্য বাড়িতে দুজন কাজের লোক-ও আছে। তবু নিয়াজ যতটুকু সময় বাড়িতে থাকে, তার ভীষণ একাকী বোধ হয়। বাবার সঙ্গে গল্প করে আর কতটুকু সময় কা’টানো যায়? তার ওপর বাবা অসুস্থ মানুষ, বেশিরভাগ সময়ই তার বিশ্রামে কা’টে। অনেকদিন ধরেই নিয়াজ বিয়ে করার জন্য মেয়ে খুঁজছিল। কাউকে তেমন মনে ধরেনি। হুট করে আরিন্তাকে ভালো লেগে যাওয়ায় আর দেরী করতে চায়নি। পুলক তালুকদারের কাছে নিজেই প্রস্তাব রেখেছে। প্রথমবারেই যে পুলক তালুকদার সন্তুষ্ট হবেন, এতটা-ও সে ভাবেনি। তবে আশা রেখেছে এবার তার একটা মানুষ হবে।

পেলব তালুকদার বাড়িতে ডক্টর নিয়াজের প্রস্তাবের কথাটা তুলতেই মেরিনা রাজি হয়ে গেছেন। আত্মীয়-স্বজন যে শুনেছে, সে-ই এক কথায় সহমত জানিয়ে দিয়েছে। এমনকি শমসের খাঁন আর আয়েশা খাতুন-ও। ডক্টর নিয়াজকে পেলবের পছন্দসই মনে হয়। বোনের জন্য যোগ্য পাত্র। মনে-মনে সে রাজি থাকলেও মুখে এখনও তেমন কিছু বলেনি। কারণ আরিন্তার মনের কথা জানা আগে জরুরী। এখন সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত কি না, তা জানা দরকার। তবে পেলবের বিশ্বাস সবার সন্তোষজনক এই প্রস্তাবে এবার আরিন্তা রাজি হবে। মনে-মনে সে এটাও ঠিক করে রেখেছে, ডক্টর নিয়াজের কথা শোনার পরও যদি আরিন্তা অনার্স শেষ করেই বিয়ে করার জেদ ধরে, তবে সে আপাতত বিয়ে পরিয়ে রাখার পরামর্শ দিবে। অনার্স শেষ হলেই না হয় শশুরবাড়ি পাঠানো হবে তাকে। পুলক তালুকদার আগের ঝামেলার কথা চিন্তা করে এবার বিয়ের ব্যাপারে আরিন্তার সাথে কথা বলার দায়িত্ব পেলবের ওপরেই দিয়েছেন। মেরিনা-ও তাই আগে-আগে আরিন্তার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে যায়নি। তাই বলে যে আরিন্তা কিছুই জানে না, তেমনটা নয়। বাড়ির সবার ফিসফিস আলোচনা, আনন্দিত মুখ সবই তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কান সজাগ রেখে আসল খবর সে ঠিকই জেনে গেছে। জানার পর থেকে সে ঘর থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছে। মিশকাতকে আগেভাগেই এ ব্যাপারটা জানাতে চায় না সে। জানালেই যে মিশকাতের পা’গলামি শুরু হবে। তাই বিষয়টা নিজের ভেতর চেপে রেখে সে গোটা দিন ধরে দুশ্চিন্তায় ভুগছে, আর মনে-মনে ডক্টর নিয়াজের চৌদ্দ গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করছে। নিজেকে-ও বকছে, কেন সে নাচতে-নাচতে খালুর সঙ্গে হসপিটাল গেল। একা-একা সে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। অনেক কথা গুছিয়ে রেখেছে। কোন কথার কোন উত্তর দিবে তা আগে থেকেই ভেবে রেখেছে। একটা ভয়ানক সিদ্ধান্ত-ও নিয়ে ফেলেছে। বিয়ের ক্ষেত্রে বরাবরই ভাইয়া তার একমাত্র ভরসা। এবার ভাইয়া পক্ষে থাকলে তো বেঁচেই যাবে। আর বাবার পক্ষ হয়ে কথা বললে মিশকাতের কথা বলে দিবে। যদিও ভাইয়ের প্রতি তার ভরসা আছে। তবু এবার একটু ভয়-ও লাগছে। মিশকাতের সঙ্গে কথা হয়েছে দুপুরের আগে। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। বলেছে আবার রাতে ফোন করবে। আরিন্তা-ও এই মুহূর্তে তার সাথে কম কথা বলতে চেয়েছিল। ভালোই হয়েছে মিশকাত আজ বারবার ফোন বা ম্যাসেজ করছে না।

সন্ধ্যায় আরিন্তা নাশতা খেতেও নিচে এল না। মেরিনা আজ সন্ধ্যার নাশতায় সমুচা আর চা করেছেন। পেলব বসে খাচ্ছিল। মেরিনা বারকয়েক গলা তুলে আরিন্তাকে ডেকেছেন। পেলব শুধাল,
“খাওয়ার সময় এতবার ডাকা লাগে কবে থেকে ওকে? শরীর খারাপ না কি আবার?”
মেরিনা বললেন,
“না, শরীর ঠিকই আছে। আজ রুম থেকে তেমন বেরোয়নি।”
“কেন?”
মেরিনা চিন্তিত মুখে বললেন,
“আমার মনে হয় বিয়ের ব্যাপারটা ওর কানে গেছে। এই বিষয়ে কথা ওঠার পর থেকেই ওকে চুপচাপ দেখছি।”
পেলব সমুচায় কামড় দিয়ে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল,
“দাও, ওর খাবার দিয়ে আসি।”
মেরিনা কিছুটা অবাক হয়ে বললেন,
“তুই?”
“হ্যাঁ। কথা আছে ওর সাথে।”

মেরিনা আরিন্তার খাবারটা গুছিয়ে দিলো। পেলব নিজের খাবারটুকু দ্রুত শেষ করে এক হাতে চায়ের কাপ, আরেক হাতে সমুচার বাটি নিয়ে চলল আরিন্তার রুমে। আরিন্তা পড়ার টেবিলে বসে ছিল। তার সামনে খোলা বই। দৃষ্টি বইয়ে আটকে থাকলেও সে অন্যমনস্ক। মাথায় অনবরত ঘুরছে বিয়ের বিষয়টা। কখন না তার বাবা তাকে ডেকে বিয়ের কথা বলে বসে। পেলব দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল,
“আরি?”
প্রথম ডাকেই আরিন্তার ধ্যান ভাঙল। নড়েচড়ে বসে সে বলল,
“দরজা খোলাই আছে ভাইয়া।”
পেলব দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। তার হাতে খাবার দেখে আরিন্তা হেসে বলল,
“সূর্য কি আজ ভুল দিকে উঠেছিল?”
পেলব আরিন্তার টেবিলে খাবার রেখে বলল,
“মা যে চেঁচিয়ে ডেকেছে, তা কানে শুনিসনি? কতবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসবে তোর জন্য? আজ না কি রুম থেকে বেরোসনি?”
আরিন্তা সমুচা চিবোতে-চিবোতে বলল,
“এই খবর শুনে আমার মুখ দর্শন করতে এসেছ না কি?”
“কথা আছে তোর সাথে। খাওয়া শেষ কর আগে।”

সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তার মুখ থেমে গেল। ভাই কোন বিষয়ে কথা বলবে, তার মন সেটা টের পেয়ে গেছে। মুখের সমুচাটুকু কোনোমতে গিলে নিয়ে আরিন্তা বলল,
“বলো, খেতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“চা শেষ কর।”
আরিন্তা বাকি সমুচাটুকু একেবারে মুখে পুরে নিল। পেলব বলল,
“এত তাড়াহুড়া করছিস কেন? কথা তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।”
“চা খুব গরম। তোমার কথা বলো, শুনতে-শুনতে খাচ্ছি।”

পেলব একটু সময় নিল। তারপর ধীর গলায় শুধাল,
“ডক্টর নিয়াজকে তো চিনিস, না?”
আরিন্তার বুকের ভেতর ধক করে উঠলেও স্বাভাবিকভাবেই মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, খালুর চেকআপ করানোর সময় দেখেছিলাম তিনবার।”
“তাকে কেমন মানুষ মনে হয় তোর?”
“আমার সাথে তো কথা হয়নি, দেখা হয়েছে শুধু। বাবার মুখে শুধু প্রশংসা শুনেছিলাম। হয়তো ভালো মানুষ।”
“তোর কাছে কেমন লাগে?”
“আমার কাছে আবার কেমন লাগবে? সবার কাছে যেমন লাগে, তমনই।”
পেলব মায়ের কথার প্রেক্ষিতে আর ইতিউতি না করে সোজা প্রশ্ন করল,
“ডক্টর নিয়াজ যে তোকে পছন্দ করে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানিস?”
আরিন্তা-ও সোজাসাপ্টা স্বীকার করল,
“হুম।”
“সবাই যে রাজি তা জানিস?”
“হুম।”
“তোর কী মতামত?”
“এখনও আমার অনার্স শেষ হয়নি ভাইয়া। এমন তো কথা ছিল না।”
“সে ব্যাপারে আমি ভেবেছি। তুই বললে আমি আপাতত বিয়ে পরিয়ে রাখার কথা বলব। অনার্স শেষ করেই না হয় শশুরবাড়ি যাবি।”
“তার কী প্রয়োজন? অনার্স শেষ করে একেবারেই না হয় বিয়ে করে শশুরবাড়ি চলে যাব।”
“ততদিন পর্যন্ত কি ডক্টর নিয়াজ বসে থাকবে?”
“কেন বসে থাকবে? তাকেই যে আমার বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই।”
“তা না। এমন পাত্র হাতছাড়া করতে চাইছে না কেউ।”
“আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছা নেই ভাইয়া। তুমি বাবাকে বলে দাও ডক্টর নিয়াজকে ‘না’ বলে দিতে।”

পেলব ভ্রুকুটি করে বলল,
“আমি তো তোকে এখনই শশুরবাড়ি গিয়ে সংসার করতে বলছি না। বিয়ে করে রাখতে কী সমস্যা তোর?”
“আমার ইচ্ছা নেই।”
“কেন নেই? বাড়িতে থাকলে তো তোর পড়াশোনার কোনোরকম ক্ষতি হবে না। তাহলে আর কী সমস্যা?”
এবারে আরিন্তা কিছুটা বিরক্ত হলো। বলল,
“তোমরা আমাকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলে কেন সবাই?”
“তোকে তাড়াতে চাইছে কে? আশ্চর্য! আমি তো বলছি তুই বাড়িতেই থাকবি। ডক্টর নিয়াজের মতো সবদিক থেকে পারফেক্ট মানুষ কোথায় পাব আমরা তোর জন্য?”
“সবদিক থেকে পারফেক্ট মানুষকেই কেন বিয়ে করতে হবে? ডক্টর নিয়াজ ছাড়া কি দুনিয়ায় ছেলের অভাব? কপালে যে আছে, তাকে এমনিতেই পেয়ে যাবে।”
“উনি নিজে তোকে পছন্দ করেছে। বুঝতে পারছিস না কেন?”
“করুক। উনি পছন্দ করেছে বলেই আমাকে বিয়ে করতে হবে? উনি কি বিশ্বসেরা সুদর্শন পুরুষ?”
“বিশ্বসেরা না হোক, সুদর্শন-ই তো। যথেষ্ট ভালো মানুষ-ও।”
“তোমাকে কি এবার বাবা পটিয়ে তার পক্ষে কথা বলাচ্ছে?”
পেলব মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“পক্ষে কথা বলার কী আছে? আমি তো সবসময় তোর ভালো চেয়ে এসেছি। এবারেও ভালো ভেবেই বিয়েতে মত দিতে চাইছি। এই পর্যন্ত ডক্টর নিয়াজের মতো অন্য কোনো পাত্রকে আমার এত পছন্দ হয়নি।”
“তাহলে এক কাজ করো, তুমিই বিয়ে করে নাও।”
“ফাজলামি করিস না আরি। এত অবুঝ হলে চলে না। জীবনের কথাও ভাবতে হয়?”
“তোমার কি ধারণা আমার জীবন শেষ হওয়ার পথে?”
“এটা কোন ধরনের কথা?”
“সোজা ধরনের কথা বলছি, তা-ও তো তোমার ভালো লাগছে না। আর কী বলব?”
“বিয়ে তো এক সময় করতেই হবে।”
“যখন করতে হবে তখন করব।”
“তাহলে এখন সবার পছন্দে করলে কী সমস্যা?”
“অনেক সমস্যা।”
“ডক্টর নিয়াজকে কি তোর পছন্দ না?”
“অপছন্দের কারণ নেই।”
“তাহলে কি তোর নিজের কোনো পছন্দ আছে?”

আরিন্তা ঝুপ করে থেমে গেল। মুখে ভর করল এক ঝাঁক দুশ্চিন্তা। ডক্টর নিয়াজকে পেলবের এত পছন্দ হয়েছে মানে সে সত্যি-সত্যিই বিয়েতে রাজি। এজন্যই বোনকে রাজি করাতে লেগেছে। আরিন্তা অতি দ্রুত ভাবছে এবার সে কী বলবে। মিশকাতের কথাটা বলে দিবে? পেলব তো সবসময় তার ভরসার জায়গা। মিশকাতের কথাটা বুঝিয়ে বললে কি সে বুঝবে? মিশকাতের সঙ্গে তো তার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। হয়তো মানতে পারে। কিন্তু যদি না মানে? যদি কোনো ঝামেলা হয়? চিন্তায় আরিন্তার এলোমেলো লাগছে। গুছিয়ে রাখা কথাগুলো সে খুঁজে পাচ্ছে না। ঠিকঠাক কোনো কথা তার মাথাতেই আসছে না। তার চিন্তিত মুখ লক্ষ্য করে পেলবের টনক নড়ল। সে দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোর পছন্দের কেউ আছে না কি?”
আরিন্তা এবারেও চুপ রইল। পেলব ভরসা জুগিয়ে বলল,
“থাকলে বলে দে। আমি না হয় খোঁজ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলব। সমস্যা নেই তো।”
আরিন্তা অসহায় মুখ তুলে বলল,
“ভাইয়া, আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে।”
“কিসের চিন্তা?”
“বাবা আমার ওপর চটে যায় কি না।”

পেলবের বুঝতে আর বাকি রইল না সত্যিই আরিন্তার পছন্দের মানুষ আছে। অথচ এতদিন সে জানত আরিন্তার এমন কেউই নেই। বিয়ে করলে সে পরিবারের পছন্দেই করবে। সেজন্যই ডক্টর নিয়াজের প্রতি সে এতটা আগ্রহ দেখিয়েছে। পেলব শুধাল,
“ছেলে কে? নাম কী?”
আরিন্তা চোখ নামিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
“মিশকাত খাঁন।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৫.
আরিন্তার মুখে মিশকাতের নাম শোনার পর পেলব কয়েক মুহূর্তের জন্য পাথুরে মূর্তি বনে গেল। যেন সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে ভুলে গেল তার কী বলা উচিত, কেমন রিয়্যাক্ট করা উচিত। আরিন্তার নত মুখ দেখে সে নিশ্চিত হলো সে সত্যি বলছে। সত্যিই মিশকাত তার পছন্দের মানুষ। পেলব মনে-মনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেও প্রথমেই সে নিজের উত্তেজনা মুখে প্রকাশ করল না। রয়েসয়ে আরিন্তার কাছে গিয়ে বলল,
“মিশু তোর পছন্দের মানুষ?”
আরিন্তা ধীর গতিতে মাথা ঝাঁকাল। পরপরই পেলবের জেরা শুরু হলো,
“ও জানে?”
এবারেও আরিন্তা মাথা ঝাঁকাল।
“ও তোকে পছন্দ করে?”
এবারেও যখন আরিন্তা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল, পেলব সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,
“তাহলে কি তোদের মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে?”
আরিন্তা পূর্বের ন্যায় মাথা ঝাঁকাল। পেলব জানতে চাইল,
“কত দিনের সম্পর্ক?”
আরিন্তা নত মস্তকে নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“চার বছর।”
পেলব অবাক হয়ে বলল,
“চার বছর মানে! কীভাবে কী হলো খুলে বল তো।”
আরিন্তা একবার দ্বিধান্বিত চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকাল। পেলবের মুখে কেবল বিস্ময় ছাড়া মনের অবস্থাটা সে ধরতে সক্ষম হলো না। পেলব বলল,
“বল, এমন একটা খবর বলেই যখন ফেলেছিস, তখন তো সবটা আমার জানা দরকার।”

আরিন্তা প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। লজ্জা, ভয় দুটোই তাকে জাপটে ধরেছে। তবু শেষমেশ পেলবের ভরসায় একে-একে সে মিশকাতের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রথম থেকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। পেলব শান্ত মুখে সমস্তটাই শুনল। মাঝে দুই-একটা প্রশ্ন ছাড়া কোনোরকম বাঁধা-ও দিলো না। তার বিস্ময়ের মাত্রা যেন প্রতি মুহূর্তে বেড়েই চলল। নিজের কথা শেষ করে আরিন্তা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার উত্তর জানার আশায়। এবারেও পেলবের মুখে গভীর চিন্তা ছাড়া কিছুই সে খুঁজে পেল না। অধৈর্য হয়ে নিজেই শুধাল,
“ভাইয়া, তোমার কিছু বলার নেই?”
পেলব মাথা দুলিয়ে বলল,
“বলার তো আছে অনেক কথাই। আচ্ছা, তুই বলছিস তোদের সম্পর্কের কথা এই পাঁচ বছরেও কেউ জানে না? মানে তোর কোনো বন্ধু-বান্ধবও না?”
“না। এই প্রথম তুমি জানলে।”
“বুঝলাম। মিশু তাহলে তোর সাথে যোগাযোগ করার জন্যই ফোন পাঠিয়েছে?”
“হুঁ।”
“আচ্ছা, থাক তাহলে। আমি যাই।”
পেলব চলে যাচ্ছে শুনে আরিন্তা লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অসহায় মুখে বলল,
“ভাইয়া, তুমি কিছু তো বলো। কী করবে এখন তুমি?”
পেলব বলল,
”দেখি কী করতে পারি।”
“আমি বিয়ে করতে পারব না। প্লিজ তুমি সবাইকে আটকাও।”
“বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে দেখি।”
আরিন্তা চমকে উঠে বলল,
“তুমি কি বাবাকে বলে দিবে?”
পেলব সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা আরিন্তার ফোনটা তুলে পকেটে পুরে নিল। দরজার দিকে পা বাড়াতেই আরিন্তা ছুটে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে বলল,
“তুমি ফোন নিচ্ছ কেন?”
“দরকার আছে।”
“তুমি কী করতে চলেছ ভাইয়া, সত্যি করে বলো তো।”
কথাটা বলেই আরিন্তা মুখ ফুলিয়ে কেঁদে ফেলল। পেলব নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“রুমে থাক আপাতত। ডাকলে বেরোবি।”
“তুমি ঝামেলা করবে না তো? দয়া করে তুমি আমাকে একটু বুঝো ভাইয়া। আমি এখন শুধু তোমার ভরসায় আছি। মিশু ভাই বিয়ের ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না। ওনাকে কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। উনি সবসময় আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। তুমি আমার অনুরোধটুকু রাখো।”

পেলব আরিন্তার ভেজা চোখের দিকেও তাকাল না।। কোনোরকম প্রত্যুত্তর ছাড়াই দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। কান্নারত আরিন্তা অসহায়ের মতো দরজার কাছে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে। সে জানে না সামনে কী হতে চলেছে।

পেলব নিচে যাওয়ার পর আর কোনোরকম সাড়াশব্দ পায়নি আরিন্তা। বিচলিত ভঙ্গিতে সে একবার দরজার কাছে যাচ্ছে, বসছে, উঠছে, সারা রুম পায়চারি করছে। বাবার এখনও বাড়ি ফেরার সময় হয়নি। একবার ভাবছে নিচে যাবে। কিন্তু পেলব যে বলল আপাতত ঘরে থাকতে। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে বসেও তো থাকা যাচ্ছে না। মা-ও একবার আসছে না। রাতে মিশকাতের ফোন করার কথা। সে ফোন ঠিকই করবে, কিন্তু আরিন্তাকে পাবে না। আচ্ছা, পেলব ফোন রিসিভ করবে না তো? পেলব তার ফোন নিয়ে কী করছে, তা-ও সে জানে না। ফোন ধরার মতো অন্য কেউ না থাকায় নিরাপত্তা অবলম্বন করে ফোনে কোনো লক-ও রাখেনি সে। পেলব সহজেই ফোনের সবটা ঘেঁটে দেখতে পারবে। তার গ্যালারি ভর্তি মিশকাতের ছবি। মিশকাত একেকটা মুহূর্তের ছবি পাঠাতে-পাঠাতে তার গ্যালারি ভর্তি করে ফেলেছে। নিজের চেয়ে মিশকাতের ছবিই বেশি তার কাছে। মিশকাতের সঙ্গে তোলা তার আগের ছবিগুলোও আছে। সম্পর্ক থাকাকালীন ছবি তোলা বড়ো বিষয় নয়, বিষয়টা হচ্ছে পেলব তাদের ম্যাসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে কি না। বড়ো ভাই নিজের বন্ধুসম ভাইয়ের সাথে ছোটো বোনের প্রেমালাপ পড়বে, এটা নিশ্চয়ই সুন্দর বিষয় নয়। পেলবের তেমন কিছুই না বলে ফোনটা নিয়ে যাওয়ার কারণ উদ্ধার করতে গিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যাচ্ছে আরিন্তার। পেলবের হাবভাব বোঝার উপায় নেই।
অনেকদিন পর আজ আবার মায়ের ফোনের প্রয়োজন বোধ করছে আরিন্তা। মায়ের ফোনটা হাতে পেলে মিশকাতকে ম্যাসেজ করা যেত। এভাবেই তার সময় কা’টল। এক ঘন্টা, দু্ই ঘন্টা। তারপর যখন পুলক তালুকদার এলেন, তখন রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল। আরিন্তার বুকের ভেতর কাঁপছে। খাবার টেবিলে পেলব ওই প্রসঙ্গ তুলবে না তো? ভয়ে-ভয়ে সে নিচে গিয়ে দেখল ইতোমধ্যে সবাই খেতে বসে পড়েছে। আরিন্তা একবার ভাবল খাবে না বলে চলে যাবে। কিন্তু পুলক তালুকদার তাকে ডেকে আদুরে গলায় বললেন,
“আরি মা, খেতে বসো। এতক্ষণ লাগে আসতে?”
আরিন্তা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশের চেয়ারে বসল। তার খাবার বেড়ে রাখা ছিল। হাত ধুয়ে খাবারে হাত দিতেই পুলক তালুকদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“তোমার কি শরীর খারাপ মা? মুখটা অমন লাগছে কেন?”
আরিন্তা মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“না, এমনি।”
“ঘুম আসছে? তোমারা এ যুগের ছেলে-মেয়েরা রাত জেগেই স্বাস্থ্য খারাপ করো। এসব ভালো না। কদিন ঠিকমতো ঘুমাও, স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে যাবে।”

আরিন্তা পেলবের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝার চেষ্টা করছে পেলবের মতিগতি। অথচ পেলব নিশ্চিন্ত মনে চুপচাপ খাচ্ছে। আরিন্তার দিকে তাকাচ্ছে-ও না। ওদিকে পুলক তালুকদার আজ মেয়ের সাথে গল্প জমাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। একের পর এক প্রশ্ন করছেন, উপদেশ দিচ্ছেন। আরিন্তার কিছু লাগবে কি না, সে কোথাও বেড়াতে যেতে চায় কি না, খুব আগ্রহের সাথে তা-ও জানতে চাইছেন। আরিন্তা ঠিকই বুঝতে পারছে বাবার মনোভাব। বিয়ের আগে মেয়ের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করে তাকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টায় লেগেছেন তিনি। কিন্তু বাবার চেষ্টা দেখে আরিন্তার আনন্দের বদলে দুঃখ হচ্ছে। আসন্ন বিপদ যে কতটা ভয়ানক হবে, তা নির্ভর করছে পেলবের ওপর। কারণ আরিন্তা যদি বাড়িতে কাউকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়ে থাকে, সে একমাত্র তার বাবা। পুলক তালুকদার একবার রাগলে বাড়িঘর মাথায় তুলে ফেলেন। তার ওপর এসব প্রসঙ্গ কানে গেলে কী করবেন তা কল্পনা করেই আরিন্তার মাথা ঘুরে যাচ্ছে।

রোজকার মতো আজ আর তৃপ্তি করে খাওয়া হলো না আরিন্তার। প্লেটের খাবার ফুরাল না। কোনোমতে খাওয়া শেষ করেই সে উঠে ধীর পায়ে চলে গেল মা-বাবার ঘরে। মায়ের ফোনের খোঁজ করল। কিন্তু কোথাও পেল না। তারপর চলে গেল দাদির ঘরে। বৃদ্ধা খায়রুন নেসা ঘুমিয়ে পড়েছেন অনেক আগেই। একা-একা দাদির ঘরে ভালো লাগল না আরিন্তার। তবু দাঁড়িয়ে রইল। বাবা আর ভাই খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেই মায়ের কাছ থেকে ফোনটা চেয়ে নিবে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কান-ও সজাগ রাখল। পেলব ওই প্রসঙ্গে কথা তোলে কি না শোনার জন্য। কিন্তু পেলব এখনও চুপচাপ আছে। পুলক তালুকদার ডক্টর নিয়াজের বিষয়ে কথা বলছেন। তারা বেশি দেরী করতে চাইছেন না। সবার মতামত থাকলে দ্রুতই পাকা কথা সেরে ফেলতে চান। বাবার গল্প যেন থামছেই না। এদিকে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে আরিন্তার পা ধরে আসছে। পুলক তালুকদারের আগেই পেলব টেবিল ছাড়ল। পুলক তালুকদার উঠলেন আরও পরে। অবশেষে মেরিনা যখন টেবিলের থালা-বাসন গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন আরিন্তা দাদির ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মেরিনা তাকে দেখে বললেন,
“কী-রে? কিছু লাগবে?”
আরিন্তা মাথা দুলিয়ে বলল,
“তোমার ফোনটা কোথায় মা?”
“আমার ফোন দিয়ে এখন আর কাজ কী তোর?”
“দরকার ছিল একটু।”
“তোর ফোনের কী হয়েছে?”
“আমার ফোনে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই তোমারটা দরকার ছিল একটু।”
মেরিনা বললেন,
“ভাই-বোনের একসঙ্গে ফোনে সমস্যা দেখা দেওয়ার কারণ কী?”
“ভাইয়ার ফোনে সমস্যা?”
“হ্যাঁ, তা-ই তো বলল। খাওয়ার আগে আমার ফোন চেয়ে নিয়ে গেল। বলল ওর ফোনে সমস্যা হয়েছে, তাই আমারটা দিয়ে চলবে আপাতত।”

আরিন্তার মুখটা কালো হয়ে গেল। সে ঠিকই বুঝতে পারছে পেলব ইচ্ছা করে এই কাজটা করেছে, যাতে সে মায়ের ফোন ব্যবহার করতে না পারে। চুপসানো মুখে সে নিজের ঘরে ফিরে গেল। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। এতক্ষন নিশ্চয়ই মিশকাত কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে, ফোনে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে ম্যাসেজ-ও করেছে। কিন্তু এখন আর তার করার কিছুই নেই। আপাতত ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। দেখতে হবে সে কী করে বা কী বলে। তার আগে কোনো কিছুই ভাবা যাবে না। আজকের রাতটা তার দুশ্চিন্তা আর বিরহেই কা’টাতে হবে।

আরিন্তার ফোনে লাগাতার ম্যাসেজ করেছে মিশকাত। হোয়াটসঅ্যাপে তাকে না পেয়ে কন্টাক্ট নাম্বারে কল করেছে। কিন্তু বারবারই ফোন বন্ধ পাচ্ছে। আরিন্তার ফোন চার্জের অভাবে বন্ধ পড়ে থাকবে, এমনটা কখনোই হয় না। মিশকাতের সঙ্গে কথা বলার জন্য সে প্রতিদিন আগেভাগেই ফোন চার্জ দিয়ে রাখে। মিশকাত বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এত রাতে খালার ফোনে কল করাটাও ঠিক মনে হচ্ছে না। ভেবেচিন্তে সে পেলবকে কল করল। পেলব হয়তো তার ফোনকলের জন্য প্রস্তুত ছিল। রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবেই সে আলাপ শুরু করল। মিশকাত পেলবকে বলল,
“তোর জন্য তো এখনও কিছু পাঠানো হলো না। এবার ভেবেছি তোর জন্য কিছু পাঠাব। তোর কী লাগবে বল।”
“আমার আপাতত কিছুই লাগবে না।”
“তাহলে কী পাঠাব?”
“কিছুই পাঠানোর দরকার নেই এখন। যখন লাগবে চেয়ে নেব তোর থেকে।”
মিশকাত হেসে বলল,
“তুই চেয়ে নিতে-নিতে আমার ফেরার সময়-ও হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
“আরে নাহ্, তার আগেই চাইব। আমি নিলে ছোটো জিনিস নেব না কি? বড়োসড়ো কিছুর জন্য প্রস্তুতি নে। ততদিন পর্যন্ত বেশি-বেশি উপার্জন কর।”
“আচ্ছা, নিস তবে। বাড়ির সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
খালা-খালুর খোঁজ নেওয়ার পর মিশকাত প্রশ্ন করল,
“আরির কী খবর?”
পেলব পালটা প্রশ্ন করল,
“ভালোই। তোর সাথে কথা হয় না?”
“হয়। আজ ফোন করেছিলাম, বন্ধ পেয়েছি।”
“ওহ্! ওর ফোনে কী যেন সমস্যা হয়েছে শুনলাম।”
মিশকাতের কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত মুখে শুধাল,
“কী সমস্যা হয়েছে?”
“জানি না।”
“ওহ্ আচ্ছা। ঠিক করে দিস।”

মুখে মিশকাত স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও তার মনটা এখন একদমই ভালো লাগছে না। আরিন্তার নিজের ফোনে সমস্যা হলে মায়ের ফোন দিয়ে যোগাযোগ করল না কেন মেয়েটা? সে জানে না মিশকাত সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকে তার সঙ্গে এক দণ্ড কথা বলার জন্য? এই যে আজ সে কাজের ব্যস্ততার মাঝেও মনে-মনে অপেক্ষা করেছে কখন মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারবে, অথচ তার কোনো খবরই নেই। চাইলেও এখন মিশকাত পারবে না তার সাথে কথা বলতে। আরিন্তা তো এত বেখেয়ালি মেয়ে না। সে নিজেও মিশকাতের সঙ্গে কথা না বলে শান্তি পায় না। তবে মায়ের ফোন দিয়ে ফোন বা ম্যাসেজ করল না কেন? নিজের ফোনের সমস্যার কথাটা তো অন্তত জানাতে পারত।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-১২+১৩

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১২.
মিশকাত তখনই সুবর্ণাকে ফোন করে বলল রেডি হয়ে থাকতে। যাওয়ার সময় তাকে নিয়ে যাবে। পেলবকে-ও সাথে যাওয়ার জন্য বলল, কিন্তু পেলবের না কি কাজ আছে। আগামীকাল মিশকাতের সাথে ঢাকা যাবে, তাই কাজ সেরে রাখতে চায়। আরিন্তাকে বলার সঙ্গে-সঙ্গেই সে রেডি হতে ছুটেছে। আরিন্তাকে সাথে নিয়ে মিশকাত একটা অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিকাল চারটায়। মাঝপথে সুবর্ণা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে নিয়ে সোজা চলে গেল নতুন একটা রেস্ট্রন্টে। নতুন এই রেস্ট্রন্টে এর আগেও একবার আরিন্তা আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আসা হয়নি। এখানে ঘুরাঘুরি, ছবি তোলার জন্যও সুন্দর জায়গা আছে। সুবর্ণা এসেই মিশকাতের ফোন কেড়ে নিয়ে ছবি তুলতে লেগে পড়েছে। এই ফাঁকে মিশকাত আরিন্তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিচু স্বরে ডাকল,
“এই পোনি, চুপ আছিস কেন?”
আরিন্তা মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল
“তুমি কি চাইছো আমি গলা ফাটিয়ে গান করি এখানে?”
“তোর গান শুনতে চেয়েছে কে? তারপর রেস্ট্রন্টের সব কাস্টমার ভয়ে পালিয়ে গেলে কতৃপক্ষ আমাকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি শুনালে তো।”
মিশকাত বলল,
“আজ শেষ ঝগড়া করে রাখ। কাল তো চলেই যাচ্ছি।”
আরিন্তা ক্ষণকালের জন্য চুপ রইল। কী ভেবে আবার বলল,
“শেষ মানে কী বুঝাতে চাইছো? যখন ফিরবে তখন আবার নতুন করে ঝগড়া করব। ওহ্! তুমি যা মানুষ! ফোনেও না আবার ঝগড়া করো আমার সাথে।”
মিশকাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“ঝগড়া আমি করি, না তুই করিস?”
“তুমি করো। আমি উত্তর দিতে গিয়ে ফেঁসে যাই।”
“জাতি জানে কে কেমন।”
আরিন্তা আবারো মুখ বাঁকাল। মিশকাত আবার কোমল গলায় ডাকল,
“আরি?”
আরিন্তা কড়া গলায় বলল,
“একদম দুঃখী-দুঃখী কথা বলবে না আজ। গত দুমাসে তোমার দুঃখী-দুঃখী কথা শুনে-শুনে আমার সব মুখস্থ হয়ে গেছে। কাল চলে যাবে, আজ মনখুলে ভালো কথা বলো।”
“কী করব? তুই তো আমাকে কোনো দুঃখী কথা শুনাচ্ছিসই না।”
“তোমার মতো আমার এত দুঃখ নেই।”
“তাই?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“কাল থেকে চাইলেও আমাকে আর সামনে পাবি না, এটা ভেবে আফসোস-ও হয় না?”
আরিন্তা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“না। তোমার মতো আমি বুড়ো বয়সে অত আবেগে গলে পড়তে পারব না। কারণ আমি জানি আমি তোমায় আবার ফিরে পাব।”
“আর যদি আল্লাহ্ আমার কপালে আর দেশে ফেরা না লেখে?”

আরিন্তা অসহায় চাহনিতে মিশকাতের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরে বলল,
“তুমি কেন চাইছো আমি কাঁদি? বুঝতে পারছো না আমি কাঁদতে চাই না?”
“কারণ আমি যাওয়ার আগে তোর চোখে-ও আমাকে হারানোর ভয় দেখে যেতে চাই।”
“আমার এ ভয় নেই মিশু ভাই। যা আছে, তা শুধুই বিশ্বাস। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমরা আবার এক হব, হবই।”

এমন সময় তারা সুবর্ণার চোখে পড়ে গেল। আরিন্তাকে মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরে কথা বলতে দেখে সুবর্ণা এগিয়ে আসতে-আসতে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,
“একি! তোমরা কি আজ-ও ঝগড়া করছো?”
আরিন্তা চট করে মিশকাতের আস্তিন ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তোর ভাই ঝগড়াটে হলে আমি কী করব?”
মিশকাত শ্লেষের সুরে বলল,
“অ্যাহ্! ভালো মানুষগুলো।”
সুবর্ণা মিশকাতের হাতে ফোন ফেরত দিয়ে বলল,
“আপুর আর আমার ছবি তুলে দাও।”

আরিন্তা আর সুবর্ণার ছবি তুলে দিয়ে মিশকাত নিজেও ওদের সাথে কয়েকটা ছবি তুলল। এরমধ্যে তাদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এলে খেতে বসে পড়ল। কিন্তু সবসময়ের মতো আজ আর আরিন্তার মাঝে খাবার নিয়ে সেই পা’গলামি দেখা গেল না। তার যেন আজ অরুচি ধরে গেছে। কোনো খাবারই ঠিকমতো খেতে পারছে না। জোর করে খেতে চাইলে গলায় আটকে যাচ্ছে। সবটাই মিশকাতের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এরপর আরিন্তার জন্য সে লেমন জুস-ও অর্ডার করেছে। সুবর্ণা চিন্তিত মুখে বারবার বলে চলেছে,
“তোমার আজ কী হলো আপু? কিছুই খেতে পারছো না। মনে হয় তোমার রুচিতে সমস্যা হয়েছে।”
মিশকাত কেবল বলল,
“জোর করে খাওয়ার দরকার নেই। যতটুকু খেতে পারবি, ততটুকুই খা।”

কিন্তু শেষমেষ আরিন্তার আর পেটভরে খাওয়া হয়নি। রেস্ট্রন্ট থেকে বেরিয়ে মিশকাত বলল,
“তোদের কিছু লাগবে? তাহলে চল কিনে দিই।”
সুবর্ণা সুযোগ পেয়ে বলে উঠল,
“আজ তুমি নিজের ইচ্ছায় যা কিনে দাও।”
মিশকাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আরিন্তার দিকে তাকাল। আরিন্তা বলল,
“আমি গত সপ্তাহে কেনাকা’টা করেছি। এখন আর কিছু লাগবে না।”

মিশকাত তাদের নিয়ে গেল পরিচিত এক মার্কেটে। সুবর্ণাকে তার পছন্দের সুন্দর একটা ড্রেস কিনে দিলো। আরিন্তাকে দিতে চাইলেও সে নিতে রাজি হলো না। সুবর্ণা বলল,
“আপু ড্রেস না নিলে তাকে অন্যকিছু কিনে দাও।”
আরিন্তা বলল,
“আমার কিছুই লাগবে না বলছি তো।”
মিশকাত বলল,
“তোর না লাগলে তুই সাজিয়ে রেখে দিস। আয়, অন্য দোকানে যাই।”

মিশকাত নিজেই আগে-আগে চলে গেল অন্য দোকানে। দোকানে ঢুকে সে সারা দোকানে চোখ বুলিয়ে ভাবল কী কিনবে আরিন্তার জন্য। মেয়েটার মনের অবস্থা সে ঠিকই টের পাচ্ছে। তবু সে এমন ভাব করছে, যেন মিশকাত কোনোভাবেই তার মনের অবস্থা টের না পায়। সুবর্ণা-ও মিশকাতের সাথে একেকটা জিনিস দেখছে। শেষে সুবর্ণা-ই পরামর্শ দিলো আরিন্তাকে একটা হ্যান্ড ব্যাগ কিনে দিতে। মিশকাত নিজে পছন্দ করে একটা হ্যান্ড ব্যাগ কিনে দিলো। আরিন্তা চুপচাপ তা-ই নিয়ে নিল।

ফ্লাইটের একদিন আগেই মিশকাত বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা চলে এসেছিল। তার সাথে এসেছে পুলক চৌধুরী, পেলব, আরিন্তা আর সুবর্ণা। আরিন্তা, সুবর্ণার আসার কথা ছিল না। কিন্তু আসার আগে হঠাৎ করেই আরিন্তা তার বাবার কাছে বায়না ধরে সে-ও সাথে যেতে চায়। সাথে নেয় সুবর্ণাকে। দুজনের বায়না ফেলতে পারেননি পুলক তালুকদার। শেষমেষ সাথে নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় এসে তারা ওঠে আরিন্তার চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। সময় নিয়ে দুই বোনকে নিয়ে ঘুরেফিরে মিশকাতকে কিছু কেনাকা’টা-ও করে দিয়েছে পেলব। ফ্লাইটের দিন মিশকাত যখন রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন চুপিচুপি আরিন্তা এসে দাঁড়ায় তার দরজায়। মিশকাতকে ডাকতেই সে এক লাফে উঠে বসে পড়ে। আরিন্তা ভেতরে ঢুকে এগিয়ে যায় তার কাছে। তার হাতে ছোটো একটা বক্স। বক্সটা মিশকাতের হাতে তুলে দিয়ে সে বলল,
“এটা তোমার।”
মিশকাত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলল,
“পোনি দেখছি চালাকি শিখেছে।”
“চালাকির কী করলাম? খুলে দেখো তো।”

মিশকাত বক্স খুলল। বেশ সুন্দর একটা ঘড়ি। দামটা-ও সুন্দর-ই বলা চলে। মিশকাত ঘড়িটা দেখতে-দেখতে প্রশ্ন করল,
“এই অকাজ কখন করলি?”
আরিন্তা মিশকাতের হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে নিল। তারপর সেটা মিশকাতের হাতে পরিয়ে দিতে-দিতে বলল,
“বাড়ি থাকতেই কিনে রেখেছিলাম। সাথে নিয়ে যেয়ো এটা।”

মিশকাত নিজের ঘড়ি পরা হাতটা বারবার উলটে-পালটে দেখছে। ছোটোবেলায় ইদের মেলায় গিয়ে বাবা নতুন ঘড়ি কিনে দিলে যেমন আনন্দ হত, মিশকাতের মনে মনে হচ্ছে বহু বছর পর তার তেমন আনন্দ অনুভব হচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কারণ সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। আরিন্তা বলল,
“মিস্টার পোল্ট্রি, ওখানে গিয়ে নিজের যত্ন না নিলে আপনার একদিন কী আমার যতদিন লাগে।”
“পাবি কোথায় তুই আমাকে?”
“ফোনে তো পাব। আর শোনো, একদম বিদেশি সাদা চামড়ার মেয়েদের দিকে তাকাবে না।”
“তাহলে কি চোখ বন্ধ করে রাখব?”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ওসব মেয়েদের দেখলে দরকার পড়লে চোখ বন্ধ করেই রাখবে। ওদের স্বভাব ভালো না। তোমাকে ফাঁসিয়ে দিলে?”
আরিন্তার বাচ্চামি কথায় মিশকাত হেসে ফেলল। আরিন্তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল,
“নজর টিকা দিয়ে দে তবে।”

আরিন্তা থু-থু দেওয়া ধরতেই মিশকাত দ্রুত মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“পোনির বাচ্চা, এক মাস তোকে ফোন করব না, তখন শাস্তিটা পাবি।”
আরিন্তা তোয়াক্কা না করে বলল,
“পারলে কোরো না।”
“করবই না, দেখিস তুই।”
“ঠিক আছে, দেখার জন্য আমি চোখ মেলে রাখব চব্বিশ ঘন্টা। এখন ঘুম দাও চুপ করে।”

মিশকাতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিন্তা রুম থেকে চলে গেল। মিশকাত নীরব চোখে খোলা দরজায় তাকিয়ে রইল। বুক চিরে বেরিয়ে এল ধারালো দীর্ঘশ্বাস। এই অবধি কত আবেগী কথা বলেই না মেয়েটার লুকানো ব্যথাটা প্রকাশের চেষ্টা করেছে সে! অথচ মেয়েটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। মিশকাতের ধারণা তাকে শক্ত রাখার জন্যই আরিন্তার এমন শক্ত আচরণ। কিন্তু নিয়মটা ভাঙল মিশকাতের বিদায়বেলা। তার ফ্লাইট রাত নয়টায়। এয়ারপোর্টে তার সাথে সবাই গেছে বিদায় জানাতে। বিদায়বেলা যখন সুবর্ণা মিশকাতকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদল, তখন-ও আরিন্তা পাথুরে মূর্তির মতো নীরব চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর যখন মিশকাত তার কাছে এল, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল, আরিন্তা কথা খুঁজে পেল না। খুব চেষ্টা করল শেষবেলায় একবার ‘পোল্ট্রি’ ডেকে মিশকাতকে খেপিয়ে দিতে। কিন্তু মুখ দিয়ে কেন জানি টু শব্দটি বেরোলো না। তারপর যখন মিশকাতের ডান হাতটা তার মাথায় পড়ল, তখনই যেন আরিন্তার সমস্ত মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। শান্ত সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের মতোই আরিন্তা মিশকাতের বুকে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এমন মুহূর্তে আরিন্তার পাথুরে স্বভাবটা যেন মিশকাতকে পেয়ে বসল। সে তো চেয়েছিল যাওয়ার আগে আরিন্তার চোখে তাকে হারানোর ভয় দেখতে। এখন যখন মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে অসহায়ের মতো কাঁদছে, তখন কেন তার এত কষ্ট হচ্ছে? আরিন্তা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ফিরে এসো মিশু ভাই। তোমার পোনি অপেক্ষায় থাকবে।”
মিশকাত ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। আরিন্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজেও ফিসফিস করে বলল,
“আসব। ভালোবাসি তো। বউ ঘরে তুলতে হবে না?”
“মিশু ভাই?”
“হু?”
“আমিও ভালোবাসি।”

আরিন্তা মিশকাতের বুক থেকে সরে এল। দুহাতে চোখের পানি মুছে শেষবার হাসতে চেষ্টা করল। মিশকাতকে এই হাসিটা দেখানো যেন তার জন্য এ মুহূর্তে বাধ্যতামূলক। দুটো মানুষের ভেতরের উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ কেউ শুনতে পেল না। কেউ বুঝল না তাদের চোখের ভাষা, টের পেল না তাদের একে অপরকে হারানোর ভয়। সবাই ভেবে নিল মিশকাত চিরকাল আরিন্তাকে বোনের মতো ভালোবেসেছে বলেই বিদায়বেলায় তাদের এত দুঃখ। পেলব এগিয়ে এল বোনকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু এ ব্যথার কি কোনো সান্ত্বনা হয়? মিশকাত চোখের আড়াল হওয়ার সময়-ও একবার পিছু ফিরে চাইল। সুবর্ণাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আরিন্তার ছলছল চোখ জোড়া-ও তখন তার দিকেই আটকে। আরিন্তার মন চাইল এই মুহূর্তটা এখানেই আটকে থাকুক। ওই তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া এভাবেই তার চোখে চেয়ে থাকুক। কোনো দূরত্ব না পারুক এ দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। মিশকাতের বুকের ভেতর তখন নীরব ঝড়। গত দুমাস ধরে আরিন্তা তাকে যত বুঝ দিয়েছে, সব যেন এক নিমেষে লন্ডভন্ড হয়ে কোথাও হারিয়ে গেল। মিশকাতের কেবল মনে হলো এ দূরত্ব গোটা কয়েক দিনের নয়। এ দূরত্ব এত সহজে কমার নয়। দিনকে দিন বাড়তে-বাড়তে এ দূরত্বই হয়তো একদিন ক্ষুধার্ত বা’ঘের মতো গ্রা’স করে নিবে তার একমাত্র ভালোবাসার সমস্ত অস্তিত্ব। হতে পারে এ দূরত্ব ক্ষণিকের। হতে পারে এ দেখা শেষ দেখা। হতে পারে কোনো এক শুভলগ্নে আবারও চোখে চোখে হবে কথা। হতে পারে এ তৃষ্ণার্ত চোখ একটিবার তাকে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকে ম’রবে চিরকাল। ইশ্! অনিশ্চয়তারা-ও এত ভ’য়ঙ্ক’র হয়!

মিশকাতের কানের কাছে বারংবার ঝংকার তুলে চলল আরিন্তার বলা শেষ বাক্যটা, ‘আমিও ভালোবাসি।’

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১৩.
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে আরিন্তা। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে সে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো ধরতেই টেবিলে রাখা ফোনে ভিডিয়ো কলে বসে থাকা মানুষটা বলে উঠল,
“এই পোনি, তোকে এই গাঢ় রংয়ের লিপস্টিক পরতে বারণ করেছি না? রাখ ওটা।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি এটাই পরব। তোমার কী? তুমি তো আর দেখবে না।”
“এজন্য তোর উচিত আমি ফেরার আগ পর্যন্ত লিপস্টিকের সাথে ব্রেকআপ করা। এত সাজগোজ আমি ছাড়া অন্য ছেলেদের কেন দেখাবি?”
“ছেলেদের দেখানোর জন্য কেন সাজব? আমার সাজতে ভালো লাগে, আমি সাজব। তোমার হিং’সা হলে তুমি চোখ বন্ধ করে রাখো।”

আরিন্তা ঠোঁটে লিপস্টিক পরতে শুরু করল। মিশকাত হতাশ কন্ঠে বলল,
“তোকে যে আমি কবে সোজা করতে পারব রে পোনি!”
“আমি সোজাই আছি মিস্টার পোল্ট্রি। আপনার মনে যত প্যাঁচ।”
“পোনি রে, তোকে সামনে পেলে আমি-”
আরিন্তা তাকে থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“সামনে পাবে-ও না তুমি।”
“একদিন তো সামনে পাব। সেদিন সব শোধ তুলব।”
আরিন্তা হাসতে-হাসতে বলল,
“সেদিন তো তুমি আমাকে দেখেই কূল পাবে না।”
মিশকাত একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“তা ভুল বলিসনি। কতদিন তোকে দেখি না পোনি! ভীষণ ইচ্ছা হয় একবার কাছ থেকে দেখতে।”
আরিন্তা তাড়া দেখিয়ে বলল,
“এই, এখন একদম দুঃখী-দুঃখী ভাব আনবে না। আমি এখন বেরোব। দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার।”
মিশকাত বলল,
“তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।”
“পরে শুনব, ভার্সিটি থেকে ফিরে।”
“রিমা সুন্দরী আমাকে আবার ম্যাসেজ করা শুরু করেছে।”

আরিন্তার মুখোভাব সন্দিহান হয়ে উঠল। চোখে-মুখে দারুণ আগ্রহ নিয়ে সে বলে উঠল,
“কবে, কখন, কী বলল?”
মিশকাত মজা পেয়ে বলল,
“তোর দেরী হয়ে যাচ্ছে না? তাড়াতাড়ি বেরো। ভার্সিটি থেকে ফিরেই শুনিস।”
আরিন্তা মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, বেশি দেরী হবে না। তুমি বলো, আমি এখনই শুনব।”
“ওমা! এইমাত্রই না তাড়া দেখালি?”
“উফ্! তুমি বলো তো। কবে ম্যাসেজ করেছে?”
“গতকাল।”
“তারপর? কী বলল?”
“আমার খোঁজ-খবর নিল।”
“তুমি রিপ্লাই দিয়েছিলে?”
মিশকাত ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“দিয়েছিলাম। নরমালি খোঁজ-খবর নিয়েছে, এটুকুই। বেশি কথা বলার সুযোগ দিইনি।”
আরিন্তা সন্তুষ্ট হলো, না অসন্তুষ্ট হলো বুঝা গেল না। বলল,
“ওকে একদম সুযোগ দিবে না। কথা বাড়ালেই ও আরও ঝুঁকে পড়বে তোমার দিকে।”
“যে একদিকেই আজীবন ঝুঁকে পড়ে আছে, তার দিকে অন্য কেউ ঝুঁকলেই কী, না ঝুঁকলেই কী?”
আরিন্তা মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“মিশু ভাই, সব কথা উড়িয়ে দিয়ো না। ব্যাপারটা এত সহজ না।”
“সহজ কঠিন বুঝার মতো জ্ঞান আমার আছে। আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না বুড়ি পোনি। এখন আর আপনার দেরী হচ্ছে না?”
আরিন্তা সময়ের দিকে লক্ষ্য করে তাড়াহুড়া করে উঠে পড়ল। বলল,
“আসলেই দেরী হয়ে গেছে। রাখো, হ্যাঁ?”
“সাবধানে যাস। ফিরে ফোন করবি।”
“ঠিক আছে। রাখো।”

মিশকাত ফোন কে’টে দিলো। হাত থেকে ফোন রাখতে গিয়েও কী মনে করে আবার রাখল না। ফোনের ওয়ালের দিকে একমনে তাকিয়ে রইল। আরিন্তা বউ সাজার পর তারা চোখে চোখ রেখে যেই ছবিটা তুলেছিল, সেই ছবিটা ওয়ালে দেওয়া। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মিশকাতের বুকের কোণে কেমন এক চিনচিনে ব্যথা জেগে উঠল। গত অর্ধ মাস যাবত এই ব্যথাটা তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে। অথচ কেউ জানে না তার এ গোপন যন্ত্রণার খবর, কেউ না। কেবলমাত্র আরিন্তা জানে। কিন্তু এই মেয়ে তো আবার নতুন শক্তি অর্জন করেছে। মিশকাত একটু নরম হলেই সে উলটো শক্ত হয়ে মিশকাতের ধৈর্য বাড়িয়ে দেয়। অথচ মিশকাত ঠিকই টের পায় ওপরে শক্ত সাজা মেয়েটার মন তার জন্য ঠিক কতটা পো’ড়ে। ভেতরে-ভেতরে তার বিলাপ করে কান্নার আওয়াজ মিশকাতের কানে বাজে। ভিডিয়ো কলে মেয়েটার মুখ দেখলেই মিশকাত বুঝে যায় তার মনের আকাঙ্ক্ষা, লুকাতে চাওয়া আহাজারি। এরপরও মেয়েটার এক কথা,
“বাচ্চাদের মতো আবেগী হয়ো না তো মিশু ভাই। তোমার সাথে এসব যায় না। সময় কত দ্রুত কে’টে যাচ্ছে, টের পাচ্ছ? ধৈর্য ধরো না। স্রোতের বেগে সময় পেরিয়ে হুট করে একদিন চোখ মেলে দেখবে আমি বধূবেশে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য তো একটু অপেক্ষা করতেই হয়। তাই না?”

আজ সারাদিন ধরে আরিন্তার সাথে তেমন কথা হয়নি মিশকাতের। সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে বলে তাড়াহুড়া করে একটা ম্যাসেজ দিয়ে ভার্সিটি চলে গিয়েছিল। দুপুরের পরে মিশকাত একবার ভিডিয়ো কল করেছিল, কিন্তু আরিন্তা ভিডিয়ো কল কে’টে ম্যাসেজ করে বলেছে তার আজ ভালো লাগছে না। মিশকাত জোর না করে অডিয়ো কল দিয়েছে, তা-ও আরিন্তা কে’টে দিয়েছে। ম্যাসেজে বলেছে তার একটু মাথাব্যথা করছে, তাই এখন ঘুমাবে। ঘুম থেকে উঠে নিজেই মিশকাতকে ফোন করবে। মিশকাত-ও তাকে ঘুমাতে বলল। কিন্তু বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর-ও আরিন্তার ফোন এল না। রাত আটটার দিকে মিশকাত নিজেই আবার কল করল। এবার কল রিসিভ করল মেরিনা। ঘুমানোর আগে ফোন তার কাছেই রেখে গিয়েছিল আরিন্তা। মেরিনার সাথে কথা বলার মাঝেই মিশকাত সবার সাথে আরিন্তার কথা-ও জিজ্ঞেস করল। মেরিনা বলল আরিন্তা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। মিশকাত জানতে চাইল এই সময় আরিন্তা ঘুমাচ্ছে কেন। মেরিনা জানাল গতকাল মাঝরাত থেকে আরিন্তার ভীষণ জ্বর উঠেছে। সারাদিন ধরে মেয়েটা বিছানায় পড়ে আছে। ভার্সিটি যেতে পারেনি। কিছু খেতে-ও চাইছে না। মেরিনা অনেক জোরাজুরি করে কিছু খাবার খাইয়েছে ঔষধ খাওয়ানোর কথা বলে। মিশকাত এই খবর শুনে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। এই মেয়েটা যে তাকে চিন্তামুক্ত রাখার জন্য সারাদিন ধরে এড়িয়ে গেছে, তা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। মিশকাত শুধু মেরিনাকে বলল সে আরিন্তার সাথে কথা বলতে চায়। মেরিনা বলল সে আরিন্তার কাছে ফোন দিয়ে বলে দিবে মিশকাতকে ফোন করতে। মিশকাত ফোন রেখে অপেক্ষা করতে লাগল আরিন্তার কলের জন্য। মেরিনা গিয়ে আরিন্তাকে ফোন দিয়ে বলল,
“মিশু তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছে। ফোন করে কথা বলিস।”
আরিন্তা ঘ্যানঘ্যান করে বলল,
“আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
মেরিনা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“তোদের ভালো লাগে কখন? দেশে থাকতে ছেলেটা নিজে বাড়ি বয়ে এসে তোদের খোঁজ নিত। আর এখন দূরে গিয়েও তোদের থেকে একটু খোঁজ-খবর পাওয়ার ভাগীদার হয় না। উলটো নিজেই ফোন করে-করে সবার খবর নেয়।”
আরিন্তা মনে-মনে হাসল। তার মন বলল,
“মা, তুমি যদি জানতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমার ভাগনে আমাকে জ্বালিয়ে মা’রে! কাছে থাকতে যা-ও একটু শান্ত থাকতে পারত, দূরে গিয়ে আরও বেশি পা’গল হয়ে উঠেছে এই ছেলে।”

আরিন্তা উদাস গলায় বলল,
“তোমার ভাগনের মতো এত দরদী এখনও হয়ে উঠতে পারিনি।”
“বেশি কথা না বলে ফোন কর ওকে। আমার সাথে রোজ কথা বলার সময় ও তোদের কত কথা জিজ্ঞেস করে, জানিস?”
“আচ্ছা, করছি ফোন। একটু পরে করছি, তুমি যাও। আমি কথা বলে নেব।”
“আচ্ছা ফোন করিস কিন্তু মনে করে। তোর জন্য কিছু আনব, খাবি?”
আরিন্তা তীব্র অনীহায় মুখ কুঁচকে বলল,
“না, এখন কিছু খাব না।”
“আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফোন করিস ওকে।”
“আচ্ছা।”

মেরিনা চলে গেলে আরিন্তা ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বিছানায় একইভাবে চুপ মে’রে পড়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নিজের ফেসবুক আইডি লগইন করতেই মিশকাতের ম্যাসেজের নোটিফিকেশন পেল। ম্যাসেজ সীন করতেই আরিন্তার ভয় লাগল। এতগুলো ম্যাসেজ সীন না করে আইডি লগ আউট করে রাখার অপরাধে নির্ঘাত এক রাম ধমক কপালে জুটবে। আরিন্তা ম্যাসেজ সীন না করতেই মিশকাতের কল এল। ভিডিয়ো কল দেখে আরিন্তার আবার মাথায় হাত। ভেবেচিন্তে সে কল রিসিভ করল ঠিকই, কিন্তু ক্যামেরা অফ করে। ওপাশ থেকে মিশকাত ‘আরি’ বলে ডাকলে, সে ছোটো করে সাড়া দিলো,
“বলো, শুনছি।”
“কী শুনছিস তুই? ক্যামেরা অফ করেছিস কেন?”
“লাইট অফ করে ঘর অন্ধকার করে রেখেছি, তাই।”
“অন কর।”
“অন্ধকারে দেখতে পাবে না তো।”
“আমি অন্ধকারেই দেখব। তুই ক্যামেরা অন কর, নইলে আজ খবর আছে।”
মিশকাতের কথায় জেদের আভাস পেয়ে আরিন্তার সন্দেহ জাগল মা তার জ্বরের খবর দিয়ে বসে আছে কি না। সে মিনমিনে গলায় বলল,
“তুমি রাগ করছো কেন আজ?”
মিশকাত বেপরোয়াভাবে বলল,
“তোকে কী বলছি আমি, শুনছিস না?”

আরিন্তা গাল ফুলাল। কাঁথা টেনে ভালোভাবে কান অবধি ঢেকেঢুকে তবেই সে ক্যামেরা অন করল। ক্যামেরা অন করতেই মিশকাতের কুঁচকানো কপাল আর বিরক্তিভরা মুখটা চোখে পড়ল। কাঁথার ফাঁক দিয়ে মিশকাত শুধু আরিন্তার চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছে। তবু সে প্রথমেই কিছু বলল না এ বিষয়ে। প্রশ্ন করল,
“লাইট না কি অফ?”
আরিন্তা মিথ্যা বলল,
“অন করেছি মাত্র।”
“আচ্ছা? আজ কি বাংলাদেশে খুব শীত পড়েছে?”
“না, একটু ঠান্ডা লাগছে আমার। ফ্যানের রেগুলেটর নষ্ট হয়ে গেছে।”
“কবে?”
“আজকেই।”
“ও, একদিনের ফ্যানের বাতাসেই জ্বর এসে গেছে?”

ধরা পড়ে আরিন্তা দাঁতে জিব কা’টল। মিনমিনে গলায় বলল,
“মা তোমাকে কী বলেছে?”
“তোর যা বলতে লজ্জা লাগছিল তা-ই বলেছে।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করে বলল,
“কিসের লজ্জা?”
“এই যে সারাদিন পর আমাকে খালার থেকে শুনতে হয়েছে তার মেয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। অথচ তার মেয়ে আমাকে এই খবর না দিয়ে উলটো অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে ছিল। তার জ্বরের খবর শুনে যদি আমি কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলি, তা ভেবে খালার মেয়ে লজ্জায় পড়ে কিছু বলেনি।”

আরিন্তা বলল,
“আমি তোমার কাজের মধ্যে দুশ্চিন্তা দিতে চাইনি।”
“ও, আর সারাদিন ধরে যে কোনো খোঁজ-খবর ছিল না, তাতে বুঝি আমার দিন খুব ভালো গেছে?”
আরিন্তা চুপ করে রইল। ক্ষণিক নীরবতার পর মিশকাত বলল,
“পোনি, তুই কবে বুঝবি এত দূরে বসে আমি তোর জন্য কত চিন্তায় থাকি?”
“বুঝি বলেই তো চিন্তামুক্ত রাখতে চাই।”
“এভাবে কথা বন্ধ করে চিন্তামুক্ত রাখতে চাস? সারাদিনে একটাবার-ও যদি তুই আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলিস, তাতে-ও আমার মন হালকা থাকে। কিন্তু হুট করে কথা বন্ধ করলে নিজেকে আমার খুব অসহায় মনে হয়, জানিস? মনে হয় কাছে থাকলে এই ভোগান্তিগুলো পোহাতে হত না। কিন্তু আমার ভাগ্য-”

আরিন্তা মন খারাপ করে ডেকে বলল,
“মিশু ভাই, প্লিজ এভাবে কথা বোলো না। আমার দমবন্ধ লাগে। আর কখনো এমন ভুল করব না, প্রমিস।”
মিশকাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?”
“এখন একটু কম।”
“খালা বলল কিছু খেতে চাইছিস না? না খেয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে সুস্থ হয়ে যাবি?”
“খেতে ভালো লাগে না।”
মিশকাত অবাক হয়ে বলল,
“ভূতের মুখে রাম নাম শুনলাম মনে হচ্ছে?”
“মিশু ভাই, আমার এখন অসুখ হয়েছে।”
“অসুখ হলে তোর মতো খাদকদের উচিত ডবল খাবার গেলা। কারণ অসুখ হলে সবাই মুখের কাছে খাবার ধরে রাখে।”
“তোমার এত রুচি থাকলে তুমি ডবল খাবার গিলো।”
“আমি তো তোর মতো খাদক হতে পারিনি। তাছাড়া আমি খেলে সেই খাবার তোর পেটে-ও যাবে না।”
“মা আজ আমাকে কী বলেছে জানো?”
“কী?”
“বলেছে তুমি ফোন করলেই আমাদের এত খবর নাও, অথচ আমরা তোমার সাথে কথাই বলি না। খুবই নির্দয় হয়ে গেছি।”
মিশকাত হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বলল,
“ঠিকই তো বলেছে আমার খালা। এত নির্দয় আচরণ করা ঠিক না কিন্তু পোনি।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এসব পোল্ট্রির এত খবর নেওয়ার সময় নেই আমার।”
“তা এত সময় যায় কোথায় তোমার?”
“আমার হবু বরের জন্য সবটা সময় বরাদ্দ।”
“আর আমি কে?”
“উমম…মিস্টার পোল্ট্রি।”

সুবর্ণার নিজস্ব পার্লারের ইচ্ছাটা একটু-একটু করে পূরণ হওয়ার পথে এগোচ্ছে। তার এই ইচ্ছা পূরণে সাহায্য করেছে আরিন্তা। আরিন্তা প্রথমে মিশকাতকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছে সুবর্ণার ইচ্ছাটার কথা। মিশকাত ছাড়া আর কে সুবর্ণার ইচ্ছা পূরণ করবে? কিন্তু মিশকাতের পক্ষে একসঙ্গে পার্লার দেওয়ার মতো টাকা পাঠানো সম্ভব ছিল না। তাই আরিন্তা তাকে বুদ্ধি দিয়েছে সে যেন প্রতি মাসে সামর্থ অনুযায়ী সুবর্ণার জন্য আলাদা কিছু টাকা দেয়। সেই টাকাটা সুবর্ণা খরচ না করে জমাবে। তারপর আস্তে-আস্তে নিজের ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করবে। মিশকাতের এই বুদ্ধিটা সঠিক মনে হয়। তারপর থেকেই সে প্রতি মাসে সুবর্ণার জন্য আলাদা কিছু টাকা পাঠায় পেলবের কাছে, যাতে এ বিষয়ে আগে থেকে কেউ জানতে না পারে। জানলে হয়তো কেউ না কেউ বাঁধা দিবেই। সুবর্ণার পার্লারের সব টাকা পেলবের কাছে জমা। সুবর্ণা নিজেও এ কারণে টিউশনি শুরু করেছে। মিশকাত তাকে বারণ করেছিল। কারণ তার হাত খরচের টাকা নিয়মিত ঠিকই পেয়ে যায় সে। তবু সুবর্ণা ভেবেছে টিউশনি থেকে যা টাকা আসবে, তা সে জমা রাখবে। এতে যদি টাকা জমানো তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। বাবা-মায়ের এতে তেমন আপত্তি ছিল না। কারণ এমনিতেও সুবর্ণা গোটা বিকাল অবসরে কা’টায়। তাই দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা সে টিউশনের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। একটু-একটু করে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগোতে-এগোতে আরিন্তার ভেতরের প্রবল আগ্রহ আর উত্তেজনা দেখতে-ও মিশকাতের এখন ভালো লাগে। আজকাল তো তার মনে হয় বোনের স্বপ্নটা পূরণ করে দিতে পারলেই সে বড়ো ভাইয়ের একটা দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করতে পারবে। সুবর্ণা রোজ তার পার্লার নিয়ে আরিন্তার সাথে গল্প করে। কীভাবে শুরু করবে, কীভাবে সাজিয়ে তুলবে কত কী! নতুন কোনো আইডিয়া মাথায় এলেই সঙ্গে-সঙ্গে সে আরিন্তাকে জানায়। আরিন্তা-ও খুব আগ্রহের সাথে তার মতামত জানায়। মিশকাত পেলবের ওপর দায়িত্ব দিয়েছে ভালো এবং নিরাপদ জায়গা ঠিক করে দিয়ে সুবর্ণার পছন্দমতো পার্লার গড়ে দেওয়ার। পেলব-ও চুপচাপ নিজের দায়িত্ব পালন করছে। বলা বলে পূরণ হতে চলা এক স্বপ্নের পথে চারটা মুখ তাকিয়ে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-১০+১১

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১০.
ভার্সিটি ছুটি হয়েছে। এদিকে বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। অথচ আজ আকাশে মেঘের বালাই ছিল না বলে আরিন্তা ছাতা নিয়ে আসেনি। গতকাল আকাশে মেঘ দেখে ছাতা এনেছিল, কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। তাই আজ আর আনতে ইচ্ছা করেনি। প্রকৃতির মতিগতি বোঝা দায়। করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে আরিন্তার বিরক্তি ধরে গেছে। শিক্ষার্থীরা যারা ছাতা এনেছে তারা আগেভাগেই চলে গেছে। যারা আনেনি তারা দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখতে না পেয়ে যে যার মতো ভিজে-ভিজেই রাস্তায় নেমে পড়েছে গাড়ির খোঁজে। রাস্তায় আর ফাঁকা গাড়িও চোখে পড়ছে না। পুরো ভার্সিটি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আরিন্তার আর একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগল না। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সে রাস্তায় নেমে পড়ল। কিন্তু গাড়ি পেল না। যা-ও একটা পেল, তা-ও সে একা বলে যেতে চাইল না। উপায় না পেয়ে আরিন্তা ভিজে-ভিজেই হাঁটা ধরল। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় তেমন কোনো মানুষও চোখে পড়ছে না। একটু ভয়-ভয়ও লাগছে তার। এসব রাস্তায় পা’গল লোকদের চলাচল আছে। তাদের আরিন্তা প্রচণ্ড ভয় পায়। যতটা সম্ভব দ্রুত পা চালাচ্ছে সে। বাড়ির রাস্তা অবধি পৌঁছাতে পারলেই নিশ্চিন্ত। কিন্তু মাঝপথে গিয়ে আরিন্তার মনে হলো তিন রাস্তার মোড় থেকে কেউ তার পিছু নিয়েছে। তাড়াহুড়ায় স্পষ্ট চোখে না তাকালেও ঘাড় ঘুরিয়ে অস্পষ্ট চোখে এক পলক দেখে বুঝল একটা ছেলে ছাতা মাথায় দিয়ে তার পেছনে আসছে। হতে পারে সে এই রাস্তা ধরেই যাবে। আরিন্তা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত পা চালাল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তার পা থামতে বাধ্য হলো। পেছনে আসা ছেলেটা চোখের পলকে ছুটে এসে তার ডান পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে আগলে ধরে তাকে ছাতার নিচে টেনে নিল। আরিন্তা ভীষণভাবে চমকে উঠল। ভয়ে না, পরিচিত স্পর্শ আর পারফিউমের গন্ধে। পা থামিয়ে মুখ তুলে তাকাতেই মিশকাত শাসনের সুরে বলে উঠল,
“এমন বৃষ্টির মধ্যে কাকভেজা হয়ে ফেরার কী হয়েছে? বৃষ্টি থামা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে পারলি না?”
“বাড়াবাড়ি কোনোকিছুর জন্য আমি অপেক্ষা করি না। নিজের মতো এগিয়ে যাই।”
গম্ভীর মুখে কথাটা বলেই আরিন্তা মিশকাতের হাত সরিয়ে ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে আবার সামনে হাঁটা ধরল। এবার যেন তার প্রতিটা পদচারণায় রাস্তার স্বল্প পানিতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হলো। মিশকাত আবারো ছুটে গিয়ে আরিন্তাকে ছাতার নিচে টেনে নিল। এবার সে আরিন্তার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখল, যাতে চাইলেই ছাড়িয়ে চলে যেতে না পারে। ধমকের সুরে বলল,
“থাম, একদম ছুটাছুটি করবি না।”
আরিন্তা চাইলেও অবশ্য ছুটাছুটি করতে পারল না। তবে অভিমানে থমথমে মুখে ফুলানো গালে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। সেদিনের পর আজ তিনদিন হয়ে গেল সে মিশকাতের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। কই? একদিনও তো মিশকাত তার খবর নিতে যায়নি। রিমাও ভার্সিটিতে আসছে না। মিশকাতের কি একবার জানতেও ইচ্ছা হয়নি আরিন্তা কেন তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে? রাগ, অভিমান করেছে কি না তার-ও খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি? এই তার আরিন্তার জন্য ভালোবাসার পা’গলামি? হাতে মিশকাতের ঝাঁকুনি খেয়ে-ও আরিন্তা মিশকাতের দিকে তাকাল না। মিশকাত ডাকল,
“এই পোনি, অভিমানের পাহাড় এত বেশি উঁচু হয়ে গেছে?”
আরিন্তা অভিমানী স্বরে বলল,
“আমার কোনো রাগ, অভিমান নেই।”
“আমার ওপর রেগে থাকতে পারা মেয়ে না তুই। যতটুকু পারিস, অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখতে। কিন্তু অভিমান করার আগে তো কারণটা অন্তত ঠিকঠাক বুঝে নিতে হয়।”
“আমি তো গাধা। মানুষ ভুলভাল বুঝালে তা-ই বুঝি। ঠিক বুঝার আর দরকার নেই আমার।”
মিশকাত ক্ষণকাল চুপ করে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে বলল,
“আমি জানি তুই ওইদিন আমার ফোনে রিমার ম্যাসেজটা দেখেছিস। আমি মিথ্যা বলায় ভুল বুঝে বসে আছিস।”
“আমি কারোর কোনো কৈফিয়ত চাই না।”
আরিন্তার কথায় কান না দিয়ে মিশকাত বলে চলল,
“সেদিন হঠাৎ বাজারে রিমার সাথে দেখা। রিমা আমাকে জানায় সে একটা বিপদে পড়ে গেছে। আমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কথা বলতে চায়। আমি বলি খুব প্রয়োজনীয় কথা হলে আমাকে ম্যাসেজ করে পরে জানিয়ে দিতে। তারপর ও বলল আমি ওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করিনি। সেদিন আমি ওর রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করি। তারপর ও আমাকে ম্যাসেজ করে জানায় একটা ছেলে কদিন ধরে ওকে উত্তক্ত করছে। আজকাল আবার হু’মকিও দিচ্ছে ও প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে ওর ক্ষতি করবে। পরে জানতে পারি ছেলেটা আমাদের এলাকার। রিমা ওর বাবাকে বলার সাহস পাচ্ছিল না, নিজের ভাই-ও নেই, তাই আমাকে জানিয়েছে। ওইদিন যে আমাকে কলেজের সামনে যেতে বলেছিল, তা ওই ছেলের সাথে কথা বলানোর জন্যই। আমি আগেভাগেই ব্যাপারটা পাঁচকান হতে দিতে চাইনি, তাই কাউকে জানাইনি। তোকে তখন জানাইনি তোর এই ভুলভাল বুঝের কারণে। অথচ কে জানত তুই আগে থেকেই ভুল বুঝে বসে আছিস? পরে যখন ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছিলি না, ফোন-ও ধরছিলি না, তখন আমার এই ব্যাপারটা সন্দেহ হয়। দুদিন একটু ব্যস্ত ছিলাম। রিমার ব্যাপারটা নিয়েও ঝামেলায় ছিলাম। তোদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না বলে কথাও বলতে পারছিলাম না। আজ ভার্সিটি ছুটির পর আসব ঠিক করেছি, রওনা দিতে, না দিতেই শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির দিনে তো তোর কাছে জীবনেও ছাতা থাকে না, তাই ছাতা নিয়ে চলে এসেছি। আন্দাজ করেছিলাম মাঝরাস্তায় কাকভেজা অবস্থায় পাব।”
আরিন্তা সব কথা শোনার পরও চুপ করে আছে। সে ভাবছে এখানে ভুলটা কার। সে-ও আসল কারণটা জানত না, মিশকাত-ও ইচ্ছা করে তার থেকে দূরে থাকেনি। পুরো ব্যাপারটা ভুলের ওপরেই কে’টে গেছে। মিশকাত নিজেই আবার শুধাল,
“কিছু বলবি না?”
আরিন্তা এবার বলল,
“কী বলব?”
“কিছু খাবি?”
“এখানকার দোকান বন্ধ।”
“সামনের দোকান থেকে কিনে দিবো।”
আরিন্তা হ্যাঁ, না কিছু বলল না। আবারো চুপ হয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পর রাস্তার মাঝখান বরাবর একটা বাইক ছুটে গেল। বাইকে দুজন তরুণ, পেছনেরজন একহাতে ছাতা ধরে রেখেছে, আরেক হাতে সিগারেট। মুহুর্তের জন্য পাশ দিয়ে গেলেও সিগারেটের গন্ধ এসে লাগল আরিন্তার নাকে। সিগারেটের গন্ধ তার কাছে সবসময় খুব বাজে লাগে। মিশকাতের দিকে তাকিয়ে দেখল মিশকাতের তেমন কোনো হেলদোল নেই। এসব গন্ধ যেন তার সয়ে গেছে। আরিন্তা কী ভেবে এবার নিজে থেকে ডাকল,
“শোনো?”
মিশকাত সাড়া দিলো,
“হুম, বল।”
“তোমার কি এখন মাঝে-মাঝে কখনো সিগারেট খাওয়া হয়?”
মিশকাত হেসে ফেলল। বলল,
“ওই ছেলেটাকে দেখে এই প্রশ্ন মাথায় এল? তুই কি জানিস না?”
“আগে তো খেতে না, এখন খাও কি না জিজ্ঞেস করিনি তো কখনো।”
মিশকাত দুষ্টুমি করার জন্য বলল,
“যদি বলি খাই?”
আরিন্তা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি মিথ্যা কথা বলছো।”
“তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
“ওসব খাবে না কখনো।”
“সেটা তোর ওপর নির্ভর করছে।”
আরিন্তা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার ওপর?”
সামনেই একটা দোকান। দোকানে কয়েকজন ছেলেপেলে-ও বসে আছে। আরিন্তার শরীর ভেজা বলে মিশকাত সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। আরিন্তার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“পোনির স্থায়িত্ব যতদিন, পোল্ট্রির ভালো থাকার মেয়াদ ঠিক ততদিন।”
চোখের পলকে মিশকাত ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে এক ছুটে সামনের দোকানে ঢুকে পড়ল। আরিন্তা চুপ মে’রে সেদিকে তাকিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। জীবনে এমন কোনো মুহূর্ত কি সত্যিই আসবে, যখন সে মিশকাতের কাছ থেকে ছিটকে পড়বে শত মাইল দূরে? মিশকাত ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই। হাতে গরম সিঙ্গাড়া, সমুচার প্যাকেট আর একটা কোক। দোকান পেরোনোর সময় সে আরিন্তাকে একটু আড়াল করে রাখার চেষ্টা করল। দোকান পেরিয়ে গিয়ে প্যাকেট খুলে একহাতে ধরে, আরেক হাতে ছাতাটা নিয়ে সে আরিন্তাকে খেতে বলল। আরিন্তার বাঁ হাতে কোক। ডান হাতে মিশকাতের হাত থেকে সিঙাড়া নিয়ে খাচ্ছে আর হাঁটছে আরিন্তা। মাঝে-মাঝে মিশকাতের মুখেও তুলে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরিন্তা নরম গলায় ডাকল,
“মিশু ভাই?”
“হুম।”
“আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব বলে মনে হয় তোমার?”
মিশকাত কেমন অদ্ভুতভাবে বলল,
“মানুষ সব পারে রে পোনি।”
“তবে তুমি আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবে না কেন?”
“বেঁচে থাকলেই কি মানুষ ভালো থাকে? মানুষ ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকে, ভালো থাকা সবার কপালে থাকে না। মানুষ মানুষের ভালো থাকা কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।”
আরিন্তা বলল,
“আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।”
“ছাড়তে দিলে তো ছাড়বি।”
সিঙাড়ার চিটচিটে তেল মাখা হাতেই আরিন্তা মিশকাতের হাতের কবজি চেপে ধরল। করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আর এসব ছেড়ে যাওয়ার কথা বোলো না আমায়। আমার ভালো লাগে না এসব শুনতে।”
মিশকাত মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা, বলব না।”
“রিমার সমস্যার কোনো সমাধান হয়েছে?”
“ছেলের অভিভাবকদের জানানো হয়েছে। বখাটে ছেলে তো, অভিভাবক মানে না। তাই রিমার বাবা আর চেয়ারম্যানকে জানিয়ে এসেছি। আজ ডাকার কথা।”
“ওহ্ আচ্ছা।তুমি আমাকে আগে জানালেই পারতে। আমি কি কাউকে বলতে যেতাম?”
“মহিলা মানুষের পেটে এসব কথা থাকে না।”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে অমন ভাবো?”
“না, তুই তো একটা গা’ধী।”
“তুমি বুঝি ভালো মানুষ?”
“নিঃসন্দেহে।”
“অ্যাহ্! পোল্ট্রির ভাব কত!”
“পোনির চেয়ে পোল্ট্রির কদর বেশি।”
“তোমার মাথা।”

তখন মিশকাতের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। হঠাৎ করেই শমসের খাঁন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শরীরের ডানদিক প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে শমসের খাঁনকে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। মিশকাতের পরীক্ষার মধ্যে এই বিপদ তার মাথায় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ভাগ্যিস এবারেও দুঃসময়ের বন্ধু হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান পুলক তালুকদার। আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা সবসময় শমসের খাঁনের কাছে থাকেন। মিশকাত সেখানে সবসময় থাকতে পারে না। পরীক্ষার জন্য তাকে বাড়ি আসতে হয়। মিশকাত চলে এলে আবার পেলব যায়। আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা একা তো আর সবদিক সামলাতে পারবে না। পুলক তালুকদার আর মেরিনা সুযোগ পেলেই গিয়ে দেখে আসেন। শমসের খাঁনের অবস্থা দিন-দিন খারাপ হয়। পুলক তালুকদার ছাড়া তার এই লাগাতার চিকিৎসার খরচ জোগানো সম্ভব ছিল না। মিশকাত পরীক্ষার জন্য বাড়িতে এসে যে কটা দিন থাকে, সে কদিন তার সবকিছু এলোমেলো লাগে। চিন্তায় পড়াশোনাটাও ঠিকমতো করতে ইচ্ছা করে না। বাড়ি ফাঁকা বলে মেরিনার কথায় সে ওই বাড়িতেই থাকে। পেলবের রুমে থেকে পড়াশোনা করে। মেরিনা সবসময় তার খাবার-দাবারের দিকে বিশেষ নজর রাখার চেষ্টা করেন। আরিন্তা-ও সুযোগ পেলেই মিশকাতের সাথে গল্প করতে বসে পড়ে। কখনো মিশকাতকে তার দাদির ঘরে টেনে নিয়ে যায়। মিশকাতের মন খারাপ তার সহ্য হয় না। সে সবসময় চায় মিশকাতকে চিন্তামুক্ত রাখতে।
আজ সন্ধ্যায় মিশকাত পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিল। আগামীকাল তার পরীক্ষা আছে। মেরিনা সন্ধ্যার নাশতায় হালিম রান্না করেছেন। আরিন্তাকে বললেন মিশকাতকে ডেকে আনতে। আরিন্তা বলল,
“মিশু ভাই আজ একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। মনোযোগ নষ্ট করার দরকার নেই। তুমি তার বাটি দাও, আমি দিয়ে আসছি।”
মেরিনা মিশকাতের জন্য রাখা হালিমের বাটিটা আরিন্তার হাতে দিলো। তা নিয়ে আরিন্তা পেলবের রুমে গিয়ে দেখল মিশকাত চেয়ারে বসে টেবিলে মেলে রাখা বইয়ের ওপর মাথা ঠেকিয়ে পড়ে আছে। আরিন্তা কাছে যেতেই মিশকাত মাথা তুলে তাকাল। আরিন্তা হাতের বাটিটা টেবিলে রেখে বলল,
“মা হালিম বানিয়েছে। গরম-গরম খেয়ে নাও। তোমার কি মাথা ব্যথা করছে?”
মিশকাত হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল। আরিন্তা মিশকাতের কপালে হাত রেখে বলল,
“মাথা ব্যথার ঔষধ আছে। নিয়ে আসব?”
“নিয়ে আয়।”
আরিন্তা ছুটল মা-বাবার ঘরে। মেরিনার মাথা ব্যথার মলমটা নিয়ে আবার মিশকাতের কাছে ফিরে এল। মিশকাত হালিমের বাটি থেকে কয়েক চামচ মুখে দিয়েছে। আরিন্তা পাশে দাঁড়িয়ে মলম খুলে নিজেই আঙুলে নিয়ে মিশকাতের কপালে লাগিয়ে ঘষে দিতে লাগল। মিশকাতের ভালো লাগছে। সে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে। কিছু মুহূর্ত পর আস্তে-আস্তে বলল,
“দোকানটা ঠিকমতো খুলছি না। কী যে অবস্থা হবে!”
আরিন্তা বলল,
“দোকানের কথা এখন চিন্তা করতে হবে না। পরীক্ষা শেষ হলে ঠিকমতো খুলে বোসো।”
মিশকাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কয়েকটা দিনে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আল্লাহ্ বাবাকে সুস্থ করে তুললেও এরপর হয়তো সংসার টানাপোড়েনে পড়বে। ভাবছি পরীক্ষা শেষে কী করব।”
“কোনোকিছু আটকে থাকবে না। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাবা আছে না? তুমি এত চাপ কেন নাও?”
“আছে তো। দিন-দিন শুধু তার কাছে ঋণ বাড়ছেই।”
“কিসের ঋণ? তোমরা কি পর কেউ? চুপ করো তো তুমি। বাজে চিন্তা কোরো না। আল্লাহ্ চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে একসময়।”
তারপর আবার শুধাল,
“পরীক্ষা দিয়ে কি কালই কি তুমি ঢাকা যাবে?”
“হুম। পেলবের-ও তো পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। ও আর কতদিন থাকবে?”
“এবার আমাকে সাথে নিবে?”
“তোর না ক্লাস আছে?”
“কয়েকটা দিনে কিছু হবে না।”
“খালু যেতে দিবে?”
“মা বললেই যেতে দিবে। তুমি একবার মাকে বলো না। আমার যেতে ইচ্ছা করছে। খালা আর সুবর্ণা কত কান্নাকাটি করে ফোনে। ভালো লাগে না আমার।”
“আচ্ছা বলব।”
“হালিমটুকু খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“তুই খেয়েছিস?”
“না, গিয়ে খাব।”
“এখান থেকে খা।”
“না, আমারটা রাখা আছে। তুমি খাও তো। তোমার চুল টেনে দিবো?”
“লাগবে না, তুই গিয়ে খেয়ে নে আগে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

১১.
পেলবের এক চাচাতো ভাই দশ বছর যাবত আমেরিকা প্রবাসী। কথা ছিল পেলবের মাস্টার্স শেষ হলে তাকে-ও আমেরিকা নিয়ে যাবে। ভিসা, পাসপোর্ট সবকিছু গোছানো-ও শুরু করেছিল। সেই মুহূর্তে পুলক তালুকদার হঠাৎ বলে দিলেন পেলবের এখন আমেরিকা যাওয়া হবে না। তার বদলে ওই ভিসায় মিশকাত যাবে। পাসপোর্ট-ও মিশকাতের নামে করা হবে। হঠাৎ পুলক তালুকদারের এমন সিদ্ধান্তে সবাই অবাক হয়। আয়েশা খাতুন শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই না করে দেন। বাড়িতে তার স্বামী বিছানায় পড়ে আছে। একটু-আধটু হাঁটাচলা করতে পারলেও তার জন্য স্ক্র্যাচের ওপর নির্ভর করতে হয়। সুবর্ণা এখনও ছোটো। এমন পরিস্থিতিতে মিশকাত চলে গেলে সংসারটাই না এলোমেলো হয়ে যায়। পুলক তালুকদার শ্যালিকাকে বুঝান, এই মুহূর্তে মিশকাতের আর্থিক সচ্ছলতা খুব দরকার। শমসের খাঁন কবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার দোকানে বসতে পারবেন, তা অনিশ্চিত। মিশকাত দোকান চালাতে গেলে দোকানে অনেক পাওনা পড়ে যায়। বাকিতে এত পণ্য দিলে মানুষ সেই পাওনা সহজে মিটায় না। এদিকে আছে সুবর্ণার পড়াশোনার খরচ, হাত খরচ, সংসারের খরচ, শমসের খাঁনের ঔষধের খরচ। এতসব কীভাবে চলবে? সুবর্ণা বড়ো হচ্ছে। তাকে-ও তো বিয়ে-টিয়ে দিতে হবে। বিপদের সময় না হয় পুলক তালুকদার আপন ভেবে চিকিৎসার খরচ দিয়েছেন। তাই বলে সারা বছর তো আরেকটা সংসার চালানোর দায় তার নেই। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য হিসাবে এই দায়িত্ব এখন অবশ্যই মিশকাতকে নিতে হবে। তাছাড়া তার পড়াশোনা-ও শেষ। এখন এমনিতেও তার কাজ খুঁজতে নামতে হত। মেরিনা আর পেলব-ও এই সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছে। তারা-ও আয়েশা খাতুন আর মিশকাতকে বুঝিয়েছে। খালুর সব কথাই মিশকাতের যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এই মুহূর্তে এছাড়া আর কোনো উপায় সে চোখে দেখছে না। পেলব নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করে তাকে এমন সুযোগ করে দিয়েছে, পুলক তালুকদার নিজ দায়িত্বে তাকে আমেরিকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিবেন। তার জন্য এত ভালো সুযোগ আর কেউ করে দিবে না। অন্তত পরিবারের কথা চিন্তা করে তার রাজি হওয়া উচিত। আয়েশা খাতুনের চোখে পানি জমলেও শেষমেষ তাকে-ও রাজি হতে হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত জানার পর থেকে আরিন্তার সাথে এ বিষয়ে মিশকাতের কোনো কথা হয়নি। আরিন্তা-ও চুপচাপ আছে। ফোন করলে রোজকার মতোই স্বাভাবিক কথা হলেও ওসব প্রসঙ্গ কেউ টানে না।

একদিন সময় করে মিশকাত ভার্সিটি ছুটির সময় এল। আরিন্তা রিমার সাথে ছিল। দুজন গাড়ি ঠিক করতে গিয়ে মিশকাতকে লক্ষ্য করল। মিশকাত একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাত নাড়তেই আরিন্তা তাকে চিনতে পারল। রিমা বলল,
“মিশু ভাই তোকে ডাকছে মনে হয়।”
“হুঁ। তুই বরং চলে যা, আমি মিশু ভাইয়ের সাথে যাব।”
“আগে গিয়ে শুনে আয় কী বলে। এখন গেলে তো আমাদের সঙ্গেই যেতে পারে। এক পথেই তো যাব, আলাদা গাড়ি নেওয়ার কী দরকার?”

আরিন্তা বিরক্ত হলো। মিশকাত তাকে জানিয়ে এল না কেন? এই রিমা এখন পিছু নিলে তারা মনখুলে কথা বলবে কীভাবে? আরিন্তা যাওয়ার আগেই মিশকাত তাদের কাছে চলে এল। সে আসতেই রিমা হাসিমুখে শুধাল,
“কেমন আছেন ভাইয়া?”

মিশকাত রিমার সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার পর থেকেই রিমা মিশকাতের প্রতি যেন আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মাঝে-মাঝে ম্যাসেজ-ও করে। প্রথমদিকে মিশকাত দু-একটা উত্তর দিলেও, এখন আর দেয় না। রিমাকে প্রশ্ন করার আর সুযোগ না দিয়ে মিশকাত বলল,
“ভালো আছি। তুমি চলে যাও। আমার একটা কাজ আছে, কাজ সেরে আরিকে নিয়ে যাব।”
“কতক্ষণ লাগবে কাজ সারতে? বেশিক্ষণ না লাগলে তো একসঙ্গেই যাওয়া যায়।”
“না থাক, আমার একটু সময় লাগবে। তুমি চলে যাও।”
রিমা বিষণ্ণ মনে বলল,
“আচ্ছা। শুনলাম আপনি না কি আমেরিকা চলে যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কবে?”
“পাসপোর্ট করা হয়নি এখনও। একটু সময় লাগবে।”
“ওহ্! আপনি চলে গেলে আপনাকে মিস করব ভাইয়া।”
মিশকাত কথা এড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা, সাবধানে যেয়ো, হ্যাঁ? আসছি। আরি, চল।”

রিমা গাড়িতে ওঠার আগেই মিশকাত উলটো পথে হাঁটা ধরল। আরিন্তা-ও হাত নেড়ে রিমাকে বিদায় জানিয়ে মিশকাতের পিছু নিল। রিমা কয়েক মুহূর্ত মন খারাপ করে মিশকাতের চলে যাওয়া পথে তাকিয়ে থেকে গাড়িতে উঠে পড়ল। আরিন্তা মিশকাতের পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে বলল,
“তোমার রিমা সুন্দরী তোমাকে কত মিস করবে বলল। উত্তরে একটু সান্ত্বনা তো দিতে পারতে।”
মিশকাত আরিন্তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহা! এ কথা আগে মনে করিয়ে দিবি না? বেচারি ভাঙা মন নিয়ে চলে গেল।”
“আহারে! খুব কষ্ট লাগছে তোমার? ডেকে দিবো?”
“থাক, আপনার আর বেশি উপকার করার দরকার নেই। রা’ক্ষুসে পেটের কী অবস্থা? বেচারার ক্ষুধা পায়নি?”
“অপমান করছো, না? খাব না তোমার খাবার।”
“ঠিক আছে, তাহলে তো আমারই ভালো। পকেটের কিছু টাকা বেঁচে যাবে।”
“বাঁচাও টাকা। তারপর সেই টাকায় রিমা সুন্দরীকে উপহার কিনে দিয়ো, খুশিতে নাচবে।”
“বাহ্! তাহলে তো রিমা সুন্দরীর নাচ দেখতে পারব।”
আরিন্তা মুখ বাঁকাল। মিশকাত হেসে আরিন্তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“দাঁড়া এখানে।”

আরিন্তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মিশকাত পাশের দোকানে গেল। দোকান থেকে কিনে আনল দুটো চিপস, কিছু চকোলেট আর ঠান্ডা কোক। সেগুলো আরিন্তাকে সাধলে সে বলল,
“খাব না।”
“তুই আবার খাবারের ওপর রাগ করা শিখেছিস কবে থেকে?”
“আবারো অপমান করছো?”
মিশকাত ঠোঁট টিপে হাসল। খাবারগুলো আরিন্তার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আর কিছু বলছি না। নে খা। বলা তো যায় না এভাবে আর কটা দিন খাওয়াতে পারব।”

শেষের কথাটায় আরিন্তা চুপ হয়ে গেল। আর তর্ক না বাড়িয়ে চুপচাপ চিপসের প্যাকেট খুলে খেতে আরম্ভ করল। মিশকাত নিজেও একটা প্যাকেট খুলে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে ডাকল,
“আরি?”
“বলো।”
“আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে তো কিছু বললি না এখনো।”
আরিন্তা স্বাভাবিকভাবেই উলটো প্রশ্ন করল,
“কী বলব?”
“কিছু বলার নেই?”
“কী শুনতে চাও তুমি?”
“তোর কষ্ট হবে না?”
“এখনো তো কাছেই আছো, ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“লুকাচ্ছিস?”
“লুকাব কেন? তুমি বুঝি আজীবনের জন্য যাচ্ছ?”
“গেলে ফেরার কথা তো বলা যায় না। আবার কবে ফিরতে পারব, কবে আমরা মুখোমুখি হব নিশ্চয়তা নেই।”
“যেদিনই ফিরো, ফিরে দেখবে আমি বউ সেজে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
মিশকাত হাসল। বলল,
“পারবি অপেক্ষা করতে?”
“সন্দেহ কেন আছে তোমার মনে?”
মিশকাত ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না রে। এতগুলো বছর কীভাবে কা’টাব? কাউকে দেখতে পারব না, ছুঁতে পারব না।”
আরিন্তা বলল,
“বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না তো। দেখতে পারবে না কেন? প্রতিদিন নিয়ম করে সবার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলবে। আমাকে তোমার কল করতে হবে না, আমি নিজেই করতে পারব। সময় কত দ্রুত কে’টে যায়! প্রয়োজনে তুমি সুযোগ বুঝে দেশে আসার চেষ্টা করবে। অন্যদের মতো তোমার বছরের পর বছর প্রবাসী হয়ে কা’টাতে হবে না। নিজেকে একটু ঠিকঠাকমতো গুছিয়ে নিয়ে তারপর এসে দেশেই কিছু করবে। বিয়ের পর কিন্তু আমি তোমাকে দূরে যেতে দিবো না।”
মিশকাত চুপ করে রইল। তারপর আস্তে করে বলল,
“সময়টা দীর্ঘ, এতদিনে হয়তো তোর জন্য অনেক ভালো পাত্র আসবে-যাবে।”
“আসুক, এলেই কি আমি নাচতে-নাচতে বিয়ে করে নেব?”
“কিন্তু খালু?”
“তুমি কি আমাকে ভরসা করতে পারছো না?”
“তোকে ভরসা করতে আমার ভয় নেই। ভয়টা খালুকে নিয়ে। ভালো পাত্র পেলে সে অবশ্যই বিয়ের পেছনে পড়বে।”
আরিন্তা গায়ে না মেখে বলল,
“পড়ুক।”
“তখন কী করবি?”
“প্রয়োজনে বলে দিবো তোমার কথা।”
মিশকাত চমকে উঠে বলল,
“সাহস হবে তোর? অন্য কোনো ছেলে হলে তেমন ঝামেলা ছিল না, কিন্তু আমি-”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তোমার মাথায় কী ঢুকেছে মিশু ভাই? সবসময় তো তুমিই জোর গলায় বলো আমাকে হারাতে দিবে না। এখন নিজেই ভয় পাচ্ছ?”

মিশকাত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছু মুহূর্ত নীরব রইল। আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে সত্যিই তার মন কেমন যেন হয়ে গেছে। পূর্বের মনের জোর এখন ভীতিতে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে এতগুলো বছরে সে আরিন্তাকে হারিয়ে ফেলবে। মিশকাত দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বলল,
“আমি নিজেকে গোছাতে তোর থেকে হাজার মাইল দূরে সরে যাচ্ছি আরি। এই দূরত্ব যদি তোকে গ্রা’স করে নেয়, তাহলে আমি গোছালোর বদলে আরও অগোছালো হয়ে যাব। একদম শেষ হয়ে যাব।”

মিশকাতের অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে আরিন্তার ভীষণ মায়া লাগছে। অসহায় মিশকাতকে সে এর আগে শুধু দেখেছে তার খালু যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। সেদিন মিশকাতের চোখে ছিল বাবা হারানোর ভয়। আজ তার চোখে ভালোবাসা হারানোর ভয়। আরিন্তার ভীষণ ইচ্ছা করছে মিশকাতের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে। কিন্তু আশেপাশের মানুষের বাঁকা চাহনির জন্য সেই সাহসটা হচ্ছে না। তবু আরিন্তা মিশকাতের হাতের ওপর আলতো করে নিজের হাতটা ক্ষণিকের জন্য ছুঁয়ে দিয়ে কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,
“তুমি এখন এসব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো তো। আমাকে নিয়ে তোমাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমার ব্যাপার আমি সামলে নিতে পারব। তুমি শুধু সবসময় আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে, তাতেই হবে। বিয়ে আমি পোল্ট্রিকেই করছি, সে এক বছর পর হোক বা দশ বছর পর। পোল্ট্রি ছাড়া পোনিকে সহ্য করার মতো দ্বিতীয় কোনো মাথা আছে না কি জগতে?”
মিশকাত বলল,
“তবে থেকে যাস পোল্ট্রির হয়ে। আমি ফিরে যেন তোকে ঠিক এমনই দেখতে পাই।”
আরিন্তা একটু ভাবুক ভান ধরে বলল,
“ঠিক এমনই? না, একটু পরিবর্তন হতে পারে।”
“কী?”
“হতে পারে ততদিনে আমি আরও একটু বড়ো হব, একটু মোটা হব। তুমি এসে আমাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ে বলবে, একি কাণ্ড! রেখে গেলাম পোনি, ফিরে পেলাম হাতি!”

কথাটা বলে আরিন্তা নিজেই ফিক করে হেসে উঠল। মিশকাত-ও না হেসে পারল না। তারপর শ্লেষের সুরে বলল,
“এত বছরে খেয়ে-খেয়ে যে হাতি হবি, তা নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। তাই আমার অবাক হওয়ার-ও কারণ নেই।”
“সে যা-ই বলো, আমার জন্য চকোলেট পাঠাতে ভুল করলে তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ।”
“শিয়ালের মুখে মুরগি তুলে দেওয়ার মতো ভুল আমি করি না।”
আরিন্তা চোখ ছোটো করে বলল,
“তার মানে কী? তুমি আমার জন্য চকোলেট পাঠাবে না?”
“সন্দেহ আছে?”
“প্রচুর সন্দেহ আছে। তোমার মনে শ’য়তানি বুদ্ধির অভাব নেই।”
“তাহলে আমার কাছে আগেভাগেই চাস কেন চকোলেট?”
“আর চাইব না। তুমি তোমার রিমা সুন্দরীর জন্য পাঠিয়ো বস্তা-বস্তা চকোলেট। ফিরে এসে দেখবে তোমার জন্য সাজানো বরণ ডালা হাতে নিয়ে বধূবেশে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।”
মিশকাত বলে উঠল,
“আহা, কী দারুণ দৃশ্য!”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে মিশকাতের আস্তিন চেপে ধরে রাগত স্বরে বলল,
“আহাহাহাহা…খুব সুন্দর দৃশ্য, না? খুব শখ দেখার?”

মিশকাত আরিন্তার হাত সরিয়ে মাথায় মৃদু টোকা মে’রে বলল,
“হাত সামলা। রাস্তার মানুষজন গু’ন্ডা ভাববে।”
“ভাবুক।”
“আমার মতো একটা নিরিহ ছেলের সাথে এমন গু’ন্ডা মেয়ে দেখলে মানুষ আমাকে বলদ ভাববে।”
“অ্যাহ্! আসছে বলদ! তুমি বলদ হলে, বলদকে মানুষ কী বলবে?”
পরক্ষণেই আরিন্তার চোখ গেল রাস্তার পাশের ঝালমুড়ির ভ্যানগাড়ির ওপর। সঙ্গে-সঙ্গে সে বলে উঠল,
“মিশু ভাই, ঝালমুড়ি খাবে?”
মিশকাত উত্তর দিলো,
“ওটা খাবে হবে না, খাব হবে। খাদক মাইয়া।”
আরিন্তা ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,
“এক হলেই হলো। আমি খেলে তো তুমিও খাবে। চলো।”
“মাত্র না চিপস খেলি? চকোলেটগুলো-ও বাকি আছে এখনও?”
“আরে এসব পরেও খাওয়া যাবে। এসো তো।”
আরিন্তা আগে-আগে হাঁটা ধরল ভ্যানগাড়ির দিকে। মিশকাত মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বলল,
“কীভাবে পারিস এত গিলতে? মুখটার-ও তো একটু বিশ্রামের প্রয়োজন আছে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-৮+৯

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৮.
ইদের দিন। সকাল-সকাল মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের টেনেটুনে বিছানা ছাড়িয়েছেন। সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল রান্নাঘরে রান্নার ধুম লেগে গেছে। আরিন্তার মা, চাচি, ফুপি সবাই রান্নায় ব্যস্ত। ছেলেরা সবাই ইদের নামাজ আদায় করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সবার পরনে একই রকম শুভ্র পাঞ্জাবি। ঘর থেকে বেরোনোর আগে তাদেরকে সেমাই দেওয়া হলো মিষ্টি মুখ করার জন্য। সেমাই খেয়ে সবাই বেরোনোর সময় মেরিনা পেলবকে বলে দিলেন,
“নামাজ পড়ে মিশুকে নিয়ে আসিস।”
পেলব ঘাড় কাত করে বলল,
“আচ্ছা।”

ছেলেরা চলে যাওয়ার পর মেয়েরা নতুন জামা পরে সাজগোজ করতে লেগে পড়ল। ওদিকে মেরিনা আবার মিশকাতকে ফোন করেছে বাড়িতে আসতে বলার জন্য। এমনিতেও সে জানে মিশকাত আসবে, তবু তার বলতে হয়। মেরিনার কথার মাঝে আরিন্তা ফোন নিয়ে বলে বসল,
“মিশু ভাই, তুমি আসছো তো নামাজের পর?”
মিশকাত ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কেন? মতলব কী?”
“কোনো মতলব নেই। আজ খুশির দিন। কত রান্না হচ্ছে জানো? এসে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাবে।”
“ব্যস এটুকুই?”
আরিন্তা হেসে বলল,
“তোমরা সবাই এলে কুরবানি দেওয়ার পরেই কিন্তু আমরা সালামি অভিযানে নামব।”
“তা তো অবশ্যই।”
“এবার কোনো বড়োরা ছাড় পাবে না।”
“ছাড় দিলে তো পাবে।”
“তুমিও পাবে না।”
মিশকাত সন্দিহান কন্ঠে বলল,
“এই হচ্ছে আসল মতলব?”
“মতলবের কী আছে? তুমি তো বয়সে আমার চেয়ে বড়ো, সেই হিসাবে আমি তোমার থেকে সালামি পাওনা।”
মিশকাত বলল,
“তুই আমার কে যে তোকে আমি সালামি দিবো? ঘরের বউ হলে না হয় ভিন্ন কথা ছিল।”
“ভবিষ্যতে তো হব।”
“ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো খাতির নেই।”
আরিন্তা মুখ কালো করে বলল,
“তাহলে তুমি আমাকে এবারো সালামি দিচ্ছ না?”
“না।”
“তোমার আসারই দরকার নেই। একদম আসবে না আমাদের বাড়িতে।”
“আমি আমার খালার বাড়ি যাব, তোর কী?”
“না খাইয়ে রাখব।”
“খালার সামনে বলিস, আজকের মতো তোর কপাল থেকেই খাবার উঠে যাবে।”

ইদের নামাজের পর তালুকদার বাড়ির সামনে বিরাট এক গোরু কুরবানি হলো। মাংস কা’টাকা’টির কাজে যোগ দিতে হয়েছে বাড়ির ছেলেদেরও। মিশকাত গলা ভিজানোর জন্য বাড়ির ভেতরে গিয়েছে। উঠানোর বাঁ পাশের কলপাড়ে গিয়ে কোনোমতে হাত ধুয়ে সে ঘরে ঢুকল। পেছনের দিকের রান্নাঘরে সিমেন্টের চুলায় তার খালা এখনো রান্না করছে। এদিকে ঘরের গ্যাসের চুলায়-ও আরিন্তার ফুপি কাবাব ভাজছে। তাকে দেখে তিনি শুধালেন,
“মিশকাত, কিছু লাগবে?”
মিশকাত উত্তর দিলো,
“না ফুপু, পানি খেতে এসেছি। গলা শুকিয়ে গেছে।”
সঙ্গে-সঙ্গে ফুপু হাঁক ছাড়লেন,
“এই, কার হাত ফাঁকা আছে? মিশকাতকে একটু ঠান্ডা পানি দে। মেয়েগুলোর কি সাজগোজ হয়নি এখনো?”

সবার আগে কোটর থেকে বেরিয়ে এল আরিন্তা-ই। এমনিতেও তার সাজগোজ হয়ে গেছে। ফুপুর ডাক শুনেও কেউ রুম থেকে বেরোতে চায়নি। আরিন্তাকে বলতেই সে মুখে একটু অনীহা মেখে মনে-মনে ধেই-ধেই করে নাচতে-নাচতে চলে এসেছে। মিশকাতের সামনে এসেই আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“সালামি এনেছ? সালামি ছাড়া পানিও জুটবে না আজ।”
মিশকাত তার ডান পা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“সালাম কর। বেয়াদবের মতো সালাম ছাড়া সালামি চাইছিস কোন আক্কেলে?”
“আগে দেখি তোমার সালামি, বের করো।”
“কখনো দেখেছিস সালামি চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে কেউ সালাম দেয়?”
“নাহ্, দেখিনি। কিন্তু এখন দেখব। মানিব্যাগ বের করো তাড়াতাড়ি।”
“এখন আমি কাজে ব্যস্ত। পানি খাওয়া, খেয়ে কাজ সেরে আসি।”
“তুমি ছাড়াও কাজ করার অনেক মানুষ আছে ওখানে। অছিলা বাদ দাও, দেখি। মানিব্যাগ পকেটে না?”
বলতে-বলতে আরিন্তা মিশকাতের প্যান্টের পকেটে হাত ছোঁয়াতেই মিশকাত পিছিয়ে গেল। চোখ বড়ো করে বলল,
“হাত সামলে রাখ নির্লজ্জ মেয়ে। তোর ফুপু দেখলেই এক চিল্লানি দিবে। যা গলা!”
“দেখুক, তুমি আগে আমার সালামি বের করো।”

আরিন্তা আবারো মিশকাতের পকেট হাতড়াতে যেতেই মিশকাত তার হাত দুটো একসঙ্গে করে আরিন্তার নাকের কাছে ধরল। তার হাতে এখনো গোরুর রক্তের গন্ধ মিশে আছে। আরিন্তা নাক-মুখ কুঁচকে দ্রুত সরে গিয়ে বলল,
“মিশু ভাই, বিশ্রী গন্ধ তোমার হাতে।”

মিশকাত দাঁত কেলিয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে আবার আরিন্তার কাছে আসা ধরতেই আরিন্তা ছুটে পালাল। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে গ্লাসে ঢেলে সাধারণ পানির সাথে মিশিয়ে নিয়ে এল। মিশকাত পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,
“তোর জন্য একটা বিশাল সুযোগ আছে কোনোরকম ঘ্যান-ঘ্যান ছাড়াই আমার থেকে সালামি আদায় করে নেওয়ার।”
আরিন্তা মুখ ভেঙিয়ে বলল,
“তোমার থেকে এত সহজে সালামি আদায়! স্বপ্নেও সম্ভব না। কিপটা লোক একটা।”
“সিরিয়াসলি বলছি কিন্তু আমি।”
“তাহলে অবশ্যই এই সুযোগের মধ্যে কোনো ঘাপলা আছে। সেই ঘাপলাটা কী?”
“খুবই সহজ। খালা যখন গোরুর ভুঁড়ি নিয়ে বসবে, তখন তুই-ও বাকিদের সাথে ভুঁড়ি পরিষ্কার করবি। রাজি থাকলেই পেয়ে যাবি নগদ সালামি। সালাম-ও করা লাগবে না।”
আরিন্তা চোখ ছোটো করে বলল,
“বসে আছি আমি তোমার এই ব’দ বুদ্ধির পাল্লায় পড়তে। পানি গিলে বিদায় হও তাড়াতাড়ি।”
মিশকাত এক চুমুকে সবটা পানি গলাধঃকরণ করে গ্লাসটা ফেরত দিয়ে বলল,
“ভেবে দেখতে পারিস। বিশাল সুযোগ, এমন সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না।”
“প্রথমবার-ও লাগবে না তোমার বস্তাপচা সুযোগ।”
মিশকাত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“ওকে। তাহলে সালামির আশাও ভুলে যা।”

মিশকাত ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কী ভেবে আরিন্তা দৌড়ে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল,
“শোনো?”
মিশকাত পা থামাল। ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধাল,
“কী? রাজি?”
“না। আমাকে কেমন লাগছে বললে না কেন? আমার সাজ চোখে পড়ছে না?”
মিশকাত একটু মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল। আরিন্তার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“তোকে আবার কেমন লাগবে? সবসময়ের মতোই লাগছে।”
“সবসময় কি আমি সেজে থাকি?”
“না, আমার চোখে তুই সাজলেও যেমন, না সাজলেও তেমন, সেটা বুঝিয়েছি।”
আরিন্তা খুশি হয়ে বলল,
“তবু, বলবে তো আমাকে সুন্দর লাগছে কি না?”
মিশকাত চোয়াল ঝুলিয়ে বলল,
“সুন্দর! তুই আবার সুন্দর কবে থেকে? আমার কাছে তো সবসময়ের মতোই‌ পে’ত্নী লাগছে। মুখে ওসব কী মেখেছিস? ঠোঁটে তো আবার র’ক্ত-ও লেগে আছে। ইয়াক্! কার ঘাড় মটকেছিস এই ইদের দিনে?”

আরিন্তা কপাল কুঁচকে ফেলল। রাগত মুখে বলল,
“কারোর ঘাড় না মটকালেও তোমাকে দিয়ে শুরু করব। পেটের শ’য়তানি বের করে দিবো একদম।”
“আগে মুখ ধুয়ে আয়, যাহ্। নইলে ঘর থেকে বেরোলেও মানুষ ভয়ে পালাবে। সবাই তো আর আমার মতো সাহসী না।”
মিশকাত আবার হাঁটা ধরলে আরিন্তা বিরক্তির সুরে ডেকে বলল,
“মিশু ভাই, যত-ই বাহানা দেখিয়ে কে’টে পড়ো। তুমি কিন্তু সালামি না দিয়ে আজ একদম ছাড় পাবে না। পালাবে আর কোথায়?”
মিশকাত ফিরেও তাকাল না। একদমই না শোনার ভান করে খুব ব্যস্ত পায়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল।

গোরুর মাংস ভাগাভাগি করে বিলিয়ে দেওয়ার পর ছেলেরা সবাই হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসে খেতে বসেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে না হতেই শুরু হলো সালামি অভিযান। এই অভিযানে আগে নামল মেয়েগুলোই। আগে বড়োদের থেকে সালামি আদায় করে লাগল ভাইদের পেছনে। যাকে সামনে পেল তাকেই সালাম করে চেপে ধরল সালামির জন্য। মিশকাতের থেকে কোনোবারই কেউ এক পয়সা বের করতে পারে না। বের করবে কী? সে তো মানিব্যাগটাই বাড়িতে রেখে আসে। তারপর যখন সবাই সালামি চায়, তখন বলে, ‘আমি গরিব মানুষ। আমার টাকা তো দূর, মানিব্যাগ পর্যন্ত নেই। বিশ্বাস না হলে পকেট চেক করে দেখ।’
এবারেও সে একই কাজ করল। সবাই হতাশ হলেও আরিন্তা এবার নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই মিশকাতের পিছু ছাড়ছে না। এবার সে সালামি আদায় করেই ছাড়বে। ওদিকে মিশকাতের মা আয়েশা খাতুন মেরিনাকে ফোন করে বলেছে আরিন্তার ভাই-বোনদের নিয়ে তাদের বাড়ি পাঠাতে। পেলব গিয়েছিল খালার বাড়িতে মাংস দিতে, তাকেও বলে দিয়েছে সবাইকে নিয়ে আসতে। এমনিতেও সবার পরিকল্পনা ছিল বিকালের দিকে মিশকাতদের বাড়িতে যাবে। সেখান থেকে ইদের মেলা ঘুরতে যাবে। মিশকাতদের এলাকায় প্রতি ইদে বিশাল মেলা বসে। প্রত্যেকবারই তারা সবাই মিলে মেলায় যায়। বিকাল চারটায় আরিন্তারা সবাই মিশকাতের সঙ্গেই তাদের বাড়ি গেল। সেখান থেকে সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করে সুবর্ণাকে সাথে নিয়ে ছুটল মেলার উদ্দেশ্যে। বিশাল এক মাঠে মেলার আয়োজন। মাঠের চারপাশে বসেছে দোকান। ছোটোদের নানান রকম খেলনা, মেয়েদের সাজ-গোজের সরঞ্জাম, ঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, সবকিছুর দোকান বসেছে। নানান রকম মজাদার খাবারের দোকান তো আছেই। একপাশে আবার নাগরদোলা-ও বসেছে। মানুষের এত ভিড় যে, ঠেলাঠেলি করে ভেতরে ঠুকতে হয়। আরিন্তারা সবাই এক দোকানে ভিড় না জমিয়ে একেকজন একেক দোকানে ঢুকল। কারণ এক দোকানে সবাই ভিড় জমানো সম্ভব না। প্রত্যেক দোকানেই আগে থেকে ভিড় জমে আছে। এই সুযোগে আরিন্তা সুবর্ণাকে নিজের দলে টেনে মিশকাতের পেছনে লাগল। সুবর্ণাকে বলল মিশকাতের থেকে সালামি আদায় করবে। নিজের কিপটা ভাইয়ের থেকে সালামি পাওয়ার আশা নিয়ে সুবর্ণাও আরিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে চলল। মিশকাত দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ঘুরেঘুরে চারপাশের অবস্থা দেখছিল। আরিন্তা আর সুবর্ণা হাসিমুখে সামনে এসে উপস্থিত হতেই তার চোখ ছোটো হয়ে এল। সুবর্ণা কনুই দিয়ে আরিন্তাকে হালকা গুঁতা মে’রে ইঙ্গিত দিলো তাড়াতাড়ি মুখ খুলতে। কিন্তু আরিন্তার আগে মিশকাতই প্রশ্ন করে বসল,
“কী মতলব?”
সুবর্ণা উত্তর দিলো,
“আমরা মতলব না তো, তোমার বোন।”
আরিন্তা মিষ্টি করে হেসে বলল,
“মিশু ভাই, এখানে শুধু আমি আর সুবর্ণা আছি। আমাদের সালামিটা দিয়ে দাও, আমরা কাউকে বলব না।”
মিশকাত চোয়াল ঝুলিয়ে এমনভাবে তাকাল যেন ভিখারির কাছে ভিক্ষা চাওয়া হয়েছে। বলল,
“আমি কি উপার্জন করি, আমার পেছনে লেগেছিস সালামির জন্য?”
“আমি কি তোমার আস্ত মানিব্যাগটাই দিয়ে দিতে বলেছি? কটা টাকা সালামি দিবে, তা নিয়েও কিপটামি করো?”
“এটাকে কিপটামি না, অপচয় রোধ বলে। আমি ভালো ছেলে। যেখানে-সেখানে টাকা নষ্ট করি না।”
“আমাদের সালামি দিলে তোমার টাকা অপচয় হবে?”
মিশকাত দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“অবশ্যই, কারণ সালামি দিয়ে তোরা কোনো মহান কাজ করবি না। হাতে পেলেই পেটে চালান করবি।”
“দাও না। দোআ করব তোমায়।”
“কী দোআ করবি?”
“যাতে তুমি অতি শীঘ্রই সুন্দরী একটা বউ পাও।”
“তোর দোআ ছাড়াই আমি অতি শীঘ্রই সুন্দরী বউ পাব।”
“এমন কিপটামি করো কেন?”
“টাকা নেই, আমি ফকির।”
সঙ্গে-সঙ্গে সুবর্ণা প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
“মিথ্যা কথা বলো কেন? আব্বার দোকানে যে এ কদিন ইদের বেচা-কেনা করে দিলে, আব্বা তোমায় বাড়তি টাকা দেয়নি?”
মিশকাত কপাল কুঁচকে বলল,
“তোকে জিজ্ঞেস করেছে কেউ?”

আরিন্তা কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজি না। সে ঠেলেঠুলে মিশকাতকে পাশের দোকানে ঢুকিয়ে বলল,
“সালামি লাগবে না। কিছু কিনে দাও।”
মিশকাত চোখ পাকিয়ে তাকালে আরিন্তা বলল,
“চোখ পাকিয়ে লাভ নেই। আমরা তোমায় মোটেও ভয় পাই না।”
মিশকাত তবু মোচড়া-মুচড়ি করছে। দোকান ভর্তি মানুষ তাদের কাণ্ড লক্ষ্য করে মুখ টিপে হাসছে। দুজনের পিড়াপিড়িতে শেষমেষ মিশকাত প্রশ্ন করতে বাধ্য হলো,
“কী কিনবি?”
সুবর্ণা সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের সাজানো চুড়িগুলো দেখিয়ে বলল,
“আমি এই চুড়িগুলো কিনব।”
আরিন্তা গলার গহনা দেখিয়ে বলল,
“দেখো, এগুলো কী সুন্দর! আমি এর একটা নেব।”
মিশকাত বলল,
“বাইরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়া। আমি কিনে আনছি। ঘ্যাঁন-ঘ্যাঁন করলে কিচ্ছু পাবি না।”

আরিন্তা আর সুবর্ণা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল। পাঁচ মিনিটের মাথায় মিশকাতও দোকান থেকে বেরিয়ে এল। তার হাতে একই রংয়ের দুমুঠো কাঁচের চুড়ি। আরিন্তা আর সুবর্ণা আহাম্মকের মতো তার হাতের চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের হাতে দুমুঠো চুড়ি গুঁজে দিয়ে মিশকাত বলল,
“নে, আমার পকেট থেকে একশো বিশ টাকা দান করে দিলাম। সন্তুষ্ট থাক।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৯.
মেলায় সবার সাথে পাল্লা দিয়ে নাগরদোলায় চড়ে এখন আরিন্তার মাথা চক্রাকারে ঘুরছে। তাই আর বেশি দেরী না করে তাড়াতাড়ি তারা বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়ি ফিরে আরিন্তা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারেনি। চাচাতো বোনের ছোট্ট মেয়েটার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম থেকে উঠে টের পেল বাড়িতে মেহমানের সংখ্যা বেড়েছে। তার খালা, খালু আর মিশকাত এসেছে। সুবর্ণা বিকালেই তাদের সাথে চলে এসেছিল। আরিন্তাকে দেখেই সুবর্ণা ছুটে এল। তাকে দারুণ আনন্দিত দেখাচ্ছে। হাসিমুখে বলল,
“আপু, জানো কী হয়েছে?”
“কী?”
“এই দেখো।”

সুবর্ণা তার বাঁ হাত তুলে নেড়ে দেখাল। তার হাতে মেলায় পছন্দ করা সেই চুড়িগুলো। কিন্তু মিশকাত তো তখন এগুলো কিনে দেয়নি। আরিন্তা সুবর্ণার চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে-দেখতে শুধাল,
“এগুলো আবার কখন আনলি?”
“ভাইয়া এনে দিয়েছে।”
“কখন?”
“জানি না। একটু আগে এসে হাতে ধরিয়ে দিলো।”
“ও।”
“তখন কিনে দিলে কী হত বলো তো? শুধু-শুধু ঢং করল।”

আরিন্তা ভাবছে তার জন্যও তাহলে গহনাটা এনেছে কি না। ভাবনা নিয়েই সে গেল মিশকাতের খোঁজে। মিশকাত পেলবের ঘরে সবার সাথে গল্পে মজে ছিল। আরিন্তা তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাইফুল বলে উঠল,
“আরি, ইদের দিন এত আনন্দ রেখে কেউ পড়ে-পড়ে ঘুমায়? এদিকে আয়, বোস এখানে।”
আরিন্তা একবার আড়চোখে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বসব না। দাঁড়িয়েই থাকি।”

সবাই আবারও যার-যার মতো গল্পে মত্ত হলো। দুই মিনিটের মাথায় আরিন্তা বুঝতে সক্ষম হলো এরা দলবেঁধে রাতে ঘুরতে বেরোনোর পরিকল্পনা আঁটছে। আরিন্তা পেছনে দাঁড়িয়ে মিশকাতের চুল টান মা’রল বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই মিশকাত ব্যথাগুলো গিলে নিল। ইচ্ছা হলেও সবার সামনে মুখ খুলতে পারল না। বিরক্ত হয়ে আরিন্তা যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার চলে গেল। তারপর থেকেই মিশকাত ছিল সুযোগের সন্ধানে। এক সুযোগে সে পকেট থেকে ফোন বের করে এমন একটা ভাব নিল, যেন তার অতীব জরুরী কল এসেছে। এক্ষুনি রিসিভ না করলে অনেক কিছু বন্যার জোয়ারে ভেসে যাবে। তার অজুহাত কেউ ধরতে পারল না। আরিন্তা টেবিলে বসে ছিল এক বাটি গোরুর মাংস নিয়ে। একমনে বসে সে কাঁটাচামচ দিয়ে মাংস মুখে পুরছে আর বাঁ হাতে ধরা মেরিনার ফোনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মিশকাতের ভ্রু কুঁচকে এল। ধীর পায়ে সে পেছন দিক দিয়ে এগিয়ে গেল। আরিন্তার পেছনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল আরিন্তা তার বান্ধবীর সাথে ম্যাসেজে কথা বলছে আর এভাবে হাসছে। শেষ ম্যাসেজটায় আরিন্তা লিখেছে, ‘প্রেমিকগুলোর মাথায় কি এমনই গোবর ঠাসা থাকে?’

মিশকাত আরিন্তার মাথার পেছন দিকে টোকা মে’রে বলল,
“পোনি থেকে প্রেমিকবিশেষজ্ঞ হয়েছিস?”
আরিন্তা মাথা তুলে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল,
“তোমাকে নিয়ে তো আর কথা বলছি না। ও ওর প্রেমিকের কথা বলছে। তোমাকে ডেকেছে কে?”
“একটু আগে প্যাঁচার মতো মুখ করে পেছনে দাঁড়িয়ে চুল টেনেছে কে?”
আরিন্তা ফোন রেখে নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করল,
“তুমি আবার মেলায় গিয়েছিলে?”
মিশকাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“গিয়েছিলাম তো।”
“একা?”
“বন্ধুদের সাথে।”
“ওহ্।”
“কেন?”
“সুবর্ণা চুড়ি দেখাল, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

মিশকাত মাথা দোলাল। আরিন্তার মনে ঠিক কী চলছে, তা বুঝেও না বোঝার ভান করল। আরিন্তার মন খারাপ না হলেও কিঞ্চিত অভিমান হলো। সে-ও তা মিশকাতকে বুঝতে দিলো না। চুপচাপ কাঁটাচামচে মাংস গেঁথে মুখে পুরতে যেতেই মিশকাত ঝুঁকে পড়ে তার হাত টেনে নিয়ে মাংসের টুকরাটা নিজের মুখে পুরে নিল। আরিন্তা বাটি এগিয়ে ধরে শুধাল,
“খাবে?”
“তুই-ই খা। আমি তোর মতো রা’ক্ষস না। পেট ভর্তি।”

কথাটা বলেই মিশকাত আরিন্তার চুলে হালকা টান মে’রে দ্রুত কে’টে পড়ল। আরিন্তা চোখ-মুখ কুঁচকে মিশকাতের চলে যাওয়া পথে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার ফোনে মনোযোগ দিলো। ম্যাসেজ সীন করে উত্তর না দেওয়ায় তার বান্ধবী লাগাতার ম্যাসেজ করেই চলেছে।

দীর্ঘ পরিকল্পনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো সবাই মিলে বাইক রাইডে বেরোবে। ঘুরেফিরে রেস্ট্রন্টে খাওয়া-দাওয়া করে আসবে। এ কথা শুনে আরিন্তার ফুপি বিরক্ত মুখে বললেন,
“ইদের দিনে কী মর্জি শুরু করেছিস? বাড়িতে যে পাতিল ভর্তি রান্না হয়েছে, ওসব কে খাবে?”
পেলব বলল,
“ফিরে এসে ওসব সাবার করে ফেলব ফুপি। চিন্তা কোরো না।”
“বাইরে খেয়ে এসে তোরা আবার ঘরের খাবার শেষ করবি? বোকা পেয়েছিস আমাকে?”
মিশকাত হেসে বলল,
“কেউ না খেলেও আমাদের আরি রা’ক্ষসী আছে ফুপু। চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
মিশকাতের কথায় মজা করে দু-একজন তাল মিলাল। আরিন্তা গাল ফুলিয়ে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার মাথা যে আস্ত আছে এটাই বেশি। কবে যেন ওটা-ও গিলে ফেলি।”

সবার ঘ্যানঘ্যানের চাপে পড়ে বড়োরা অনুমতি দিতে বাধ্য হলো। এরপর শুরু হলো মেয়েদের আরেক দফা সাজ-গোজের পালা। ওদিকে আরিন্তা সাজতে বসে তব্দা খেয়ে বসে আছে। তার সাজগোজের সরঞ্জামের মধ্যে মেলায় পছন্দ করা সেই গয়নাটা এল কোত্থেকে? মুহূর্তেই অবশ্য বুঝতে বাকি রইল না তাকে একটু চমকে দেওয়ার জন্যই এমন করা হয়েছে। খুশিমনে সেজেগুজে আরিন্তা নিচে এসে দেখল ছেলেগুলো একেকজন বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করছে। সবার মাঝে আরিন্তা কেবল মিশকাতের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। মিশকাত আরিন্তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসির রেখাটুকু দেখেই মনের উচ্ছাস টের পেল। মেয়েরা সবাই বেরিয়ে এলে খায়রুন নেসা বললেন,
“ওলো ঢংগীরা, রাইত-বিরাইতে এমন সাজগোজ কইরা ঘোরতে যাইতাছোস? মাইনষে দেখলে তো বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আইব।”
পেলব বলল,
“ভালোই তো হবে দাদি। এই অছিলায় সবকটাকে বিদায় করা যাবে।”
আরিন্তা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বুড়ি, তোমার নাতি নিজের সুবিধার লাইগা হা কইরা আছে। বুঝলা?”
খায়রুন নেসা হেসে বললেন,
“রঙ্গিলাও তো ভালোই সাজছে। আইজকা আমার নাতজামাই পিছন-পিছন বাইত আইব।”
মিশকাত উত্তর দিলো,
“দেখো গিয়ে তোমার নাতজামাই বাড়ির গেইটে অপেক্ষা করছে কি না।”

পেলব আর মিশকাত আগে থেকেই বাইকের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। একেকটা বাইকে দুই বা তিনজন করে উঠল। সুবর্ণাকে মিশকাতের বাইকে উঠতে বললে সে কিছুতেই রাজি হলো না। কারণ ভাইয়ের সাথে থাকা মানেই বোবার মতো পথচলা। এই সুযোগে আরিন্তা খুব সমর্থন দেখিয়ে সুবর্ণাকে পেলবের বাইকে দিয়ে নিজে চড়ে বসল মিশকাতের বাইকে। মিশকাতের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে নিচু স্বরে বলল,
“মিস্টার পোল্ট্রি, গেইটের সামনে এসে জামাই না পেয়ে খুবই দুঃখ বোধ করছি। তাই আপনার কাছে এলাম।”
“এখান থেকে সোজা কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ের শখ মিটিয়ে দিবো।”
কথাটা বলেই মিশকাত বাইক স্টার্ট করল। সবাই পাশাপাশি বা সামনে-পেছনে বাইক চালাচ্ছে আর জোরো-জোরে কথা বলছে। মিশকাত ইচ্ছা করেই বাইকের স্পিড কমিয়ে সবার পেছনে বাইক চালাচ্ছে। আরিন্তা সামনের সবার কথা স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে গোমড়া মুখে বলল,
“মিশু ভাই, তুমি ঠেলাগাড়ির স্পিডে বাইক চালাচ্ছ কেন?”
মিশকাত বলল,
“রকেটের স্পিডে চালাব? পেছন থেকে তুই হাওয়ায় উড়ে গেলে পরে যেন তোর বাপ আমাকে জেলে না ঢুকায়।”
“রকেটের গতিতে চালাতে যাবে কেন? সবাই যেমন চালাচ্ছে, তেমনভাবে চালাও। বাইকে বসে ঠেলাগাড়ির ফিল এলে ভালো লাগে?”
“ঠিক আছে। তাহলে তোকে রকেটের ফিলই দিচ্ছি। বসিস কিন্তু শক্ত হয়ে, উড়ে গেলে আমি নির্দোষ।”

মিশকাত বাইকের স্পিড বাড়াতে যাচ্ছিল। আরিন্তা আগেভাগেই দুহাতে তাকে চেপে ধরে বলল,
“একদম শ’য়তানি করবে না। আমি কিন্তু সাইফুল ভাইয়ার বাইকে চলে যাব।”
মিশকাত বলল,
“সাহস থাকলে যা। দেখি তারপর তোর সাইফুল ভাইয়া তোর হাত-পা কী করে আস্ত রাখতে পারে।”
“গুন্ডা সাজা হচ্ছে?”
“উঁহু, হিরো-হিরো ফিল হচ্ছে। বাইকের পেছনে বসে এক সুন্দরী এভাবে জাপটে ধরে রাখলে হিরো ফিল না এসে উপায় আছে?”
আরিন্তা সঙ্গে-সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল। বিড়বিড় করে বলল,
“হিরোর বডিগার্ড এসেছে।”
মিশকাত ঘাড় একটুখানি ঘুরিয়ে বলল,
“ভুল বললি। হিরোইনের বডিগার্ড বললে মানা যেত।”

সামনে থেকে আরিন্তার চাচাতো বোন ঘাড় ঘুরিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“এই মিশকাত, তুমি অমন পেছনে পড়ে আছো কেন?”
আরিন্তা গলা উঁচিয়ে উত্তর দিলো,
“পেটে খাবার কম পড়ে গেছে, তাই মনে হয় শরীরে শক্তি নেই।”
“ইদের দিন পেটে খাবার কম পড়েছে?”
মিশকাত বলল,
“আরে না। পেছনে একটা জলহস্তী বসিয়েছি তো, তাই বাইক সামনে এগোতে চাইছে না।”

মিশকাতের কথা শুনে সবাই হু-হা করে হেসে উঠল। আরিন্তা মিশকাতের কোমরের কাছে গুঁতা মা’রল। মিশকাত ঠোঁট চেপে হাসছে। কিছুক্ষণ পর আরিন্তা মিশকাতের কাঁধের কাছে থুতনি ঠেকিয়ে ডাকল,
“মিশু ভাই, শোনো।”
মিশকাত সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“তুমি আমায় বললে না কেন ওই গয়নাটা এনেছ? আমাকে সরাসরি দিলে কী হত?”
“তাহলে কি আর এত অভিমান দেখা হত?”
“আমার অভিমান দেখতে বুঝি তোমার ভালো লাগে?”
“কী জানি!”
“ঢং না করে যখন চেয়েছিলাম, তখনই কিনে দিতে পারতে।”
“এনে দিয়েছি এটাই বেশি, শুকরিয়া আদায় কর। অন্য কোনো কথা থাকলে তা বল।”
“কী কথা বলা যায়?”
“কোনো কথা খুঁজে না পেলে বিয়ের কথা বল।”
“মাথায় শুধু ওই একটা শব্দই ঘোরে?”
“তো আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন কী কথা বলবি? তোর মতো রেডিওর আবার এই প্রশ্ন করা লাগে? চব্বিশ ঘন্টাই তো মুখ চলতে থাকে।”
“বিয়ে-বিয়ে করো, বিয়ের পর রেডিও শুনতে-শুনতে কালা হয়ে যাবে।”
“ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আমার বউয়ের ব্যাপার আমি দেখে নেব। তুই নিজের চরকায় তেল দে।”
“বউটা কে হবে?”
“পোনি।”
“তাহলে এটা আমারো ব্যাপার।”

ইদের একদিন পর মিশকাতদের বাড়িতে সবার দাওয়াত পড়েছে। আয়েশা খাতুন নিজেই দাওয়াত করেছেন। বোনের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মেরিনা বারবার নিষেধ করেছিল, কিন্তু আয়েশা খাতুন শোনেননি। টাকা খরচ হলেও তার এবার দাওয়াত করার ইচ্ছা জেগেছিল। সারা বছর তো বোনের বাড়িতে খেয়েই গেলেন, খাওয়াতে আর পারলেন কই? গতকাল রাতেই শমসের খাঁন বাজার করে রেখেছিলেন। সকাল থেকেই আয়েশা খাতুন আর সুবর্ণা কাজে লেগে আছে।
আরিন্তারা আসতেও বেশি দেরী করেনি। মেরিনা আর তার ননদ সবাইকে তাড়া দিয়ে উপস্থিত হয়েছে দুপুরের আগেই। আয়েশা খাতুনের সঙ্গে হাতে-হাতে কাজও এগিয়ে দিতে লেগে পড়েছেন। মিশকাত দোকানে ছিল। এসেছে দুপুরের আজানের সময়। তখন বাড়ি ভর্তি মেহমান। নিজের ঘরটাও ফাঁকা পেল না। সেখানে সুবর্ণা, আরিন্তা আর তার দুজন চাচাতো, ফুপাতো বোন বিছানায় গোল হয়ে বসে লুডু খেলছে। সঙ্গে চিৎকার, চেঁচামেচি তো আছেই। মিশকাত দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
“কী করছিস তোরা এখানে?”
একসঙ্গে চার জোড়া চোখ পড়ল মিশকাতের ওপর।
আরিন্তা বলল,
“দেখতেই তো পাচ্ছ কী করছি।”
মিশকাত ঘরে ঢুকে বলল,
“হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। এখন বেরো সব এখান থেকে।”
আরিন্তার চাচাতো বোন বলল,
“কেন ভাইয়া? আপনার ঘরে কি বউ আছে যে আপনি এলে বেরিয়ে যেতে হবে?”
“থাকতেও তো পারে।”
“অদৃশ্য ভূ’ত হয়ে থাকে?”
“ভূত না, পেত্মী। যেকোনো সময় তোদের ঘাড়ও মটকে দিতে পারে।”

আরিন্তা সূক্ষ্ম চোখে তাকাল। মিশকাত সেদিকে তাকিয়ে না থেকে পকেট থেকে ফোন, মানিব্যাগ বের করে রেখে জামা-কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে বলল,
“এসে যেন একটাকেও না দেখি এখানে।”

মিশকাত গোসল সেরে আসার আগেই অবশ্য লুডু খেলার সমাপ্তি ঘটল। আরিন্তা সময় দেখার জন্য টেবিলের ওপর থেকে মিশকাতের ফোন হাতে তুলে পাওয়ার বাটন অন করতেই সময়ের আগে লকস্ক্রিনে ভেসে ওঠা নোটিফিকেশনে চোখ আটকাল। রিমার ফেসবুক আইডি থেকে ম্যাসেজ, ‘আজ বিকালে একবার দেখা করতে পারবেন? আমি কলেজের সামনে অপেক্ষা করব।’
ফোনের পাসওয়ার্ড জানা সত্ত্বেও আরিন্তা ম্যাসেজ অন করে দেখার সুযোগ পেল না। বোনদের তাড়াতে ফোন জায়গামতো রেখে চলে যেতে হলো। কিন্তু তার মনের ভেতরের খচখচানি কমল না। রিমা মনে-মনে মিশকাতকে পছন্দ করে। এ কথা আরও এক বছর আগেই রিমার মুখেই সে শুনেছিল। কিন্তু মিশকাতকে বলার সাহস পায়নি বলে রিমা মিশকাতের সামনে মুখ খুলতে পারেনি। এমনকি রিমা ফোন কেনার পর মিশকাতকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠিয়েছিল। কিন্তু মিশকাত আজ পর্যন্ত তাকে অ্যাকসেপ্ট করেনি। পছন্দের মানুষের ফ্রেন্ড লিস্টে ঝুলে থাকার দুঃখ রিমা কদিন আগেও আরিন্তার কাছে প্রকাশ করেছিল। তাহলে এখন মিশকাতের ফোনে রিমার ম্যাসেজ এল কোত্থেকে? এর মানে তো মিশকাত রিমাকে অ্যাকসেপ্ট করেছে, আর তাদের মধ্যে কথাও হয়। এই একটা কথার সূত্র ধরে আরিন্তা কিছুতেই নিজের মনকে শান্ত রাখতে পারল না। খাওয়ার আগ মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে মিশকাতকে প্রশ্ন করে বসল,
“মিশু ভাই, রিমার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়?”
মিশকাত কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো,
“তোর বান্ধবীর সাথে আমার কিসের যোগাযোগ হবে?”
“ওর তো ফোন আছে। আপনাকে ম্যাসেজ করে না?”
“ফোন থাকলেই আমাকে ম্যাসেজ করবে? মনের মধ্যে কী চলছে তোর? ব্যাপার কী? ভয়ে আছিস রিমা সুন্দরীর প্রেমে পড়ে যাই কি না?”
“এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
কথাটা বলেই আরিন্তা সরে গেল।
সূত্র মিলছে না। মিশকাত অস্বীকার করে আরও গুলিয়ে দিলো। মিশকাত তাকে মিথ্যা বলবে, এ যেন তার কল্পনাতীত ছিল। নিজের মস্তিষ্ক কেমন অগোছালো মনে হলো আরিন্তার। দুশ্চিন্তায় এত-এত খাবারের আয়োজনেও তার ক্ষুধা হারিয়ে গেল। খাবার দেখলেই পেটে ক্ষুধা অনুভব করা আরিন্তা কেবল সবার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে বহু কষ্টে কয়েক লোকমা ভাত মুখে তুলল। সবাই অবাক হলে অজুহাত দেখাল তার পেটের মধ্যে সমস্যা হচ্ছে, তাই খেতে পারছে না। অথচ আসল সমস্যাটা তার মনে ছিল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০৭

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৭.
আরিন্তা দুহাত ভর্তি মেহেদি পরেছে। আনন্দের দিনগুলোতে তার এমন হাত ভর্তি মেহেদি পরতে ভালো লাগে। সারাক্ষণ রাঙা দুটো হাত দেখতে-ও খুশি-খুশি লাগে। দুহাত মেহেদিতে রাঙিয়ে আরিন্তা ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে উঠল। তখনও সবার মেহেদি পরা শেষ হয়নি। মিশকাত আরিন্তার ভাইদের সাথে কার্ড খেলছিল। আরিন্তা গিয়ে মিশকাতকে ডাকল,
“মিশু ভাই, আমার হাতের কয়েকটা ছবি তুলে দাও।”

মিশকাত কিছু বলার আগেই আরিন্তার দু বছরের বড়ো চাচাতো ভাইটা বলে উঠল,
“আমি তুলে দিচ্ছি। আয়।”
আরিন্তা মিশকাতের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“না, মিশু ভাই-ই তুলুক। মিশু ভাই, এসো।”
মিশকাত বলল,
“সাইফুল-ই তুলুক।”
“তুমি ওঠো।”
“কোথায় তুলতে হবে?”
“ঘরের সামনের ফুল গাছের ওখানে মেহেদির ছবি সুন্দর আসে। চলো।”
মিশকাত হাতের কার্ড রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমরা খেলো। আমি এক্ষুনি ছবি তুলে দিয়ে চলে আসছি।”
মিশকাত উঠে পড়ল। আরিন্তা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ছবি তুলতে। খুঁজো না কেউ।”
আরিন্তার ফুপু শুনে প্রশ্ন করলেন,
“এই রাত-বিরেতে বাইরে কোথায় যাচ্ছিস ছবি তুলতে?”
“অন্য কোথাও না। ঘরের সামনেই।”
“ওহ্! আচ্ছা যা। অন্ধকারের দিকে যাস না যেন।”
“আরে না, ফুল গাছের ওখানে। লাইট আছে তো বাইরে, সমস্যা নেই।”

আরিন্তা নিজেই আগে লাফিয়ে-লাফিয়ে বাইরে নেমে ফুল গাছের কাছে চলে এল। মিশকাত এল তার পেছন-পেছন। ছবি তোলার জন্য আরিন্তাকে প্রস্তুত হতে বলে মিশকাত ফোনের ক্যামেরা অন করে আরিন্তার দিকে ফোন তাক করল। বলল,
“কীভাবে তুলবি? ঠিক করে বল তাড়াতাড়ি।”

আরিন্তা ছবি তুলতে এলেও ছবির দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাল না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নীরব চোখে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মিশকাত বলল,
“ছবি তুলবি, না চলে যাব? দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না আমি।”
আরিন্তা শুধাল,
“তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?”
প্রশ্ন শুনে মিশকাত আরিন্তার চোখের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে উলটো বলল,
“আজ অবধি কবে করতে পারলাম?”
আরিন্তা বলল,
“তোমাদের বাড়িতে তখন হুট করে রাগ দেখালে, এখানে এসে হতে আমার দিকে তেমন তাকাচ্ছ-ও না। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছো। সেজন্যই গতকাল থেকে মিথ্যা বাহানা দেখিয়ে আমাদের বাড়িতেও আসোনি।”
“কারো রাগ বোঝার মতো বুদ্ধি ঘিলুতে জন্মেছে?”
“তার মানে তুমি সত্যিই রেগে আছো? কেন?”
“কারো ওপর আমার কোনো রাগ নেই।”
“রাগের কারণটা তো বলবে। আমি কী ভুল করেছি যে, বলা নেই কওয়া নেই হুট করে তুমি রেগে বসে আছো?”
“তুই ছবি তুলবি, না আমি চলে যাব?”
“বলবে তো আমি কী করেছি। না বললে আমি কীভাবে বুঝব?”
“আমাকে কারোর বুঝার দরকার নেই। বুঝার জন্য চারপাশে কত ছেলে আছে! আমার পেছনে সময় দেওয়ার কোনো মানে হয় না কি?”
“এক মিনিট, কত ছেলে মানে? এ কথা দিয়ে কী বুঝাতে চাইছো তুমি?”
“কিছুই না।”
“উঁহু, কিছু তো একটা ঝামেলা আছেই। নইলে অন্য ছেলেদের কথা আসবে কেন? বলো তো কী হয়েছে।”

হাতের মেহেদির দিকে খেয়াল নেই আরিন্তার। ভুল করে সে সেই হাতেই মিশকাতের হাত ধরতে গেল। মিশকাত সঙ্গে-সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এই, হাত সরা।”
“ওহ্! খেয়াল নেই। বলো, অন্য ছেলেদের কথা কেন বললে? কখনো তুমি ব্যতীত অন্য কারো সাথে আমাকে দেখেছ?”
“কেন? তোর সাইফুল ভাইয়া আছে না?”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে বলল,
“সাইফুল ভাইয়া কটা ছবি তুলে দিতে চাইল আর অমনি তুমি তাকে হিংসা করে বসলে? তুমি জানো না তাকে আমি ভাইয়া ডাকি? সব ভাইয়ারা-ই কি তোমার মতো সাইয়া হবে? অদ্ভুত কথা!”
মিশকাত হুট করে রাগত মুখে বলে উঠল,
“তো কাকে নিয়ে এত ব্যস্ত গতকাল থেকে যে, আমার খবর নেওয়ার-ও সময় নেই? গতকাল থেকে না আমার ম্যাসেজের উত্তর এসেছে, না এসেছে মিসকল। কিসের এত ব্যস্ততা?”

এতক্ষণে আরিন্তা বুঝতে সক্ষম হলো মিশকাতের রাগের আসল কারণ। গতকাল কাজিনমহল আসার পর থেকে সে এতটাই মেতে ছিল যে মায়ের ফোনের ধারেকাছেও যায়নি। ভেবেছিল তার কাজিনমহলের ডাক পড়লে মিশকাত বাড়ি আসবে, তখন তো দেখা হবেই। অথচ মিশকাত যে তার ওপর অভিমান করেই বাড়ি আসেনি, তা সে বুঝতেই পারেনি। আরিন্তা মুখোভাব এবং কন্ঠস্বর নরম করে বলল,
“আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আপুদের আর ভাইয়াদের ফোন পেলে বাড়ি আসবে, তাই আর ফোনের কাছে যাইনি।”
“তা যাবি কেন? সময় ছিল ফোন ধরার?”
“জানো তো সবাই এলে কত হৈ-হুল্লোড় চলতে থাকে।”
“সে-ই, তখন আর মিশকাত নামক কাউকে মনে থাকে না। এত ভিআইপি মানুষের ভিড়ে কি আর নগন্য মানুষের অস্তিত্ব থাকে?”
“নিজেকে তুমি নগন্য বলছো?”
“বলছি না, অনুভব করছি মানুষের আচরণে।”
“তোমার মনে হয় তুমি আমার কাছে কোনোদিন নগন্য ছিলে?”
মিশকাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“সময় এলেই টের পাওয়া যায়। নগন্য হয়েছি বলেই তো মানুষের কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছি। অস্তিত্বহীন মানুষকে তো আর কারোর প্রয়োজন পড়ে না।”

আরিন্তা চুপ রইল। তার কান্না পাচ্ছে। মিশকাতের অভিমান এতটাই গাঢ় হয়ে গেল যে তার কাছে নগন্য, অস্তিত্বহীন হওয়ার অভিযোগ তুলছে? কই? সে তো কোনোদিন এক মুহুর্তের জন্য-ও এমনটা ভাবেনি। প্রতিটা দিন যার সাক্ষাতের অপেক্ষায় সে তির্থের কাকের মতো পথ চেয়ে থাকে, সে কি করে নগন্য হয়? প্রতিটা মুহুর্ত যে তার গোটা চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা জুড়ে বিরাজ করে, সে কি করে অস্তিত্বহীন হয়? আরিন্তা ছলছল চোখে বলল,
“আমি এক অস্তিত্বহীন চরিত্রকে কেন মস্তিষ্কের দলিল দিয়ে দিয়েছি মিশু ভাই? এখন যে আমার মস্তিষ্কের নিউরনে-নিউরনে তার দখল, কল্পনা জুড়ে তার বিচরণ, এ তো বড্ড অবিচার হয়ে গেল। আচ্ছা? এ অবিচার ঠিক কতদিন যাবত চলে এসেছে? কত মাস হলো? কত বছর? মনে আছে তোমার? আমার হিসাব নেই কেন? মস্তিষ্কের দখল অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে বলে?”

মিশকাত খানিক থমকাল। আরিন্তার ছলছল চোখ জোড়ার ওপর বেশিক্ষণ দৃষ্টি ধরে রাখতে পারল না সে। লম্বা কয়েকটা দম নিয়ে চাপা স্বরে ধমকে উঠল,
“একদম কথা ঘুরাবি না পোনি।”
“কথা তো ঘুরাচ্ছি না। তুমিই তো বললে তুমি আমার কাছে নগন্য, অস্তিত্বহীন। যে আমার কাছে নগন্য, অস্তিত্বহীন, আমি কেন তার জন্য উতলা হয়ে থাকি বলতে পারো? কেন তাকে ভেবে ভেবে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকি? আমার তো উচিত নিজেকে চাঁদ আর তাকে নগন্য বামুন ভাবা। তা কেন পারি না আমি? চাঁদের জায়গা দখল করে-ও আমি কেন এত পাগল?”

এরপর আর মিশকাতের অভিমান ধোপে টেকার ক্ষমতা রাখেনি। কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে সে কেবল দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে। তারপর যখন আরিন্তার চোখের চিকচিকে পানিটুকু বিলীন হতে দেখল, তখন কন্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বলল,
“চাঁদ আর বামুনের মাঝে যতই আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকুক, আকাশের চাঁদ কিন্তু মাটিতে থাকা বামুনকে অনুসরণ করেই চলে। বামুন যেদিকে হাঁটে, চাঁদ-ও তার সাথে হাঁটে। উলটা পথে হাঁটার সাধ্য তার নেই, কোনোদিন হবে-ও না। সে যত মূল্যবান-ই হোক, এই নগন্য বামুনের সাথেই তাকে পথ চলতে হবে।”
“তা বুঝলে কেন বামুন চাঁদের ওপর অভিমান জমিয়ে অভিযোগ তোলে? কেন চাঁদকে কাঁদায়?”
“কারণ এই চাঁদটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত। এই চাঁদের ভাগ আমি ভুল করেও কাউকে দিবো না, চাঁদ নিজে চাইলে-ও না।”
আরিন্তা অভিমানি কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, চাঁদ চাইবে অন্য কাউকে নিজের ভাগ দিতে। চাঁদ তো আর ভালোবাসতে জানে না, যত ভালোবাসা শুধু বামুন একা-ই বাসতে জানে।”
মিশকাত আরিন্তার ফোলানো গাল টিপে দিয়ে বলল,
“আমার চাঁদ কত অভিমান-ও করতে জানে!”

আরিন্তা মিশকাতের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“শুরুটা তুমি করেছ। সবসময় তুমি এমন করো। বলা নেই কওয়া নেই, হুটহাট অভিমান করে রেগেমেগে বসে থাকো। প্রতিবার রাগ ভাঙাতে-ও হয় আমাকেই। কোথাও দেখেছ মেয়েরা সবসময় ছেলেদের রাগ ভাঙায়? তুমি কেন এমন?”
মিশকাতের সহজ উত্তর,
“আমি এমন-ই, আজীবন এমন-ই থাকব। আজীবন তুই আমার রাগ, অভিমান ভাঙাবি, আজীবন আমি তোকে ভালোবাসব। তুই আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল, তুই ছাড়া আর কার কাছে আমি নিজেকে জমা রাখব? তুই না বুঝলে, কে আমায় বুঝবে? আমি তো আর কাউকে আমায় বুঝার সুযোগ দিইনি, কোনোদিন দিবো-ও না। যেদিন তুই আমার কারণে ক্লান্তি অনুভব করবি, সেদিন বলিস।”
“বললে কী করবে? মুক্তি দিয়ে দিবে?”

মিশকাত এমনভাবে হাসল, যেন আরিন্তা কোনো মজার কথা বলেছে। সে হাসিমুখে বলল,
“মুক্তি দেওয়ার জন্য তো আমি তোকে বুকের খাঁচায় বন্দী করিনি। আমার বুকের খাঁচা থেকে এই জীবনে তোর মুক্তি নেই। যেদিন তুই ক্লান্ত হয়ে পড়বি, সেদিন আমাদের সম্পর্কের নতুন একটা নাম দিয়ে নতুন করে আবার পথচলা শুরু করব, যাতে সেই সম্পর্কে ক্লান্তি নামক শব্দ তোকে স্পর্শ করতে না পারে।”
আরিন্তা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করব না খারাপ লোক।”
“তো কাকে বিয়ে করবি?”
“কাউকে না। আমি জীবনে বিয়েই করব না।”
“আচ্ছা? তো আমি কাকে বিয়ে করব?”
“কাউকে না।”
“কিন্তু আমি তো বিয়ে করব-ই। বিয়ে করে তোর মুখ বেঁধে সারাদিন সামনে বসিয়ে রাখব, যেন ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করতে না পারিস।”
“ঠিক আছে, আমি কারো সাথে আর ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করব না। তুমি আমার কে হও যে আমি তোমার সাথে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করব?”
মিশকাত ঠোঁট চেপে কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবুক মুখে বলল,
“তাই তো! তুই আমার কে হোস?”
তারপর বলল,
“দাঁড়া একটু, আসছি।”
মিশকাত ঘরের ভেতর ছুট লাগালে আরিন্তা চেঁচিয়ে উঠল,
“আমাকে বাইরে একা রেখে কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমার ভয় লাগে না?”
“এক্ষুনি আসছি, এক মিনিট।”
মিশকাত ঘরে ঢুকে আরিন্তার চাচাতো বোনের পাশ থেকে একটা মেহেদি তুলে নিতেই প্রশ্নের মুখে পড়ল,
“মেহেদি দিয়ে কী করবে তুমি?”
মিশকাত বলল,
“আরির হাতের এক জায়গা থেকে উঠে গেছে আমার হাতে লেগে। সেজন্য রাগ করেছে, ছবি তুলছিল তো।”
“ওর এখনো ছবি তোলা হয়নি? এখানে আসতে বলো, আমি ঠিক করে দিই।”
“সমস্যা নেই। একটুখানি জায়গা, আমি ঠিক করে দিতে পারব।”

মেহেদি হাতে মিশকাত ফিরে আসতেই আরিন্তা রাগত স্বরে বলল,
“তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে দৌড় দিলে?”
মিশকাত প্রত্যুত্তর করল না। এগিয়ে গিয়ে বলল,
“হাত সামনে মেলে ধর।”
“কেন?”
“বলেছি তাই।”
আরিন্তা তার এক হাত মেলে ধরল। মিশকাত আরিন্তার হাতের ফাঁকা জায়গাটুকুতে মেহেদি লাগাতে নিতেই আরিন্তা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কী করছো?”
মিশকাত বিরক্ত মুখে আরিন্তার হাতটা টেনে নিয়ে মেহেদি দিয়ে ফাঁকা জায়গায় ইংরেজি অক্ষরে ছোটো করে লিখল, মিশু। আরিন্তা চুপ করে তার কাণ্ড দেখল। নাম লিখে মিশকাত বলল,
“এখন শুধু হাতে আমার নাম খোদাই করে দিলাম, বিয়ের পর জীবনে খোদাই করে দিবো। তখন বুঝবি আমি তোর কে।”
আরিন্তা বলল,
“বকবক বাদ দাও। আমি এই হাত এখন সবার সামনে কীভাবে দেখাব?”
“সেটা তোর ব্যাপার।”
“অকাজ করে এখন এটা আমার ব্যাপার, না?”
মিশকাত হাতের মেহেদি রেখে বলল,
“এখন তুই ছবি তুলতে চাইলে তোল, নইলে আমি ঘরে চলে গেলাম।”
আরিন্তা ছবি তুলল ঠিকই। কিন্তু সারাটা সময় সে গাল ফুলিয়ে মিশকাতকে বকে চলল। মিশকাত শুধু মুচকি-মুচকি হাসল। তার হাসির কারণে আরিন্তার রাগ আরও বাড়ল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০৬

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৬.
আরিন্তা নিজেকে এই কঠিন লজ্জার হাত থেকে বাঁচতেই মৃদু কন্ঠে ডেকে উঠল,
“মিশু ভাই।”

ডাক শুনেই সুবর্ণা লাফিয়ে উঠল। মিশকাত-ও দৃষ্টি ফিরিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সুবর্ণার হাত থেকে নিজের ফোনটা ছোঁ মে’রে কেড়ে নিয়ে রাগত স্বরে বলল,
“তুই আমার ফোন ঘাঁটছিস কোন সাহসে?”
সুবর্ণা বলল,
“আপু ছবি তুলবে। মায়ের ফোনের ক্যামেরা তো ভালো না। তাই তোমারটা চাইতে এসেছে।”
“এই চাওয়ার নমুনা?”
“তুমি ওয়াশরুমে ছিলে, ফোনটা সামনে পড়ে ছিল বলে লক খোলার চেষ্টা করছিলাম।”
“ফের আমার ফোন ধরলে খবর আছে তোর। আর ও এমন ভূ’ত সেজে বসে আছে কেন রাত-বিরেতে?”
আরিন্তাকে ইশারা করে প্রশ্নটা করল মিশকাত।

আরিন্তা কপাল কুঁচকাল। যার জন্য করি চুরি, সে-ই বলে চোর! শুধুমাত্র মিশকাতের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য সে লজ্জা-শরম জলাঞ্জলি দিয়ে খালার কাছ থেকে সবকিছু চেয়ে এনে এত কষ্ট করে বউ সাজল, অথচ সেই ব্যক্তিই এখন তাকে ভূ’ত বলছে? সুবর্ণা বলল,
“ভূত মানে কী? আপুকে কী সুন্দর লাগছে, দেখেছ তুমি?”
আরিন্তা দুপা এগিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাকে ভূ’তের মতো লাগলে তোমার বউকে লাগবে পে’ত্নীর মতো।”
মিশকাত দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“সন্দেহ নেই, আমার বউ-ও তো তোর মতোই এভাবে সাজবে। শত হলেও তোরা মেকআপ সুন্দরী জাতি।”
সুবর্ণা বলল,
“বাজে না বকে ফোনটা দাও, আপুকে ছবি তুলে দিই।”
“তোর হাতে আমার ফোন দিবো, মাথা খারাপ আমার? তোর মডেলকে প্রস্তুত কর, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”
সুবর্ণা নাকচ করে বলল,
“না, তুমি সুন্দর করে তুলতে পারবে না। আমাকে দাও।”
“আমি না পারলে তুই পারবি? এসেছে আমাকে ফটোগ্রাফী শেখাতে। তুললে তোল, না তুললে ভাগ এখান থেকে।”
সুবর্ণা বিরক্ত মুখে বলল,
“কিছুক্ষণের জন্য ফোনটা দিলে কী আমরা তোমার ফোন খেয়ে ফেলব?”
“খেতেও পারিস। তোদের মতো রা’ক্ষসীদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। শুধু ফোন কেন, তোরা আমার মতো আস্ত মানুষ-ও গিলে ফেলতে পারিস।”

সুবর্ণা আরিন্তার দিকে তাকাল। আরিন্তা বলল,
“আচ্ছা তুলুক। দেখি কত সুন্দর করে তুলে দেয়।”
আরিন্তা এগিয়ে গিয়ে ভালোভাবে দাঁড়িয়ে বলল,
“নাও, তোলো।”
মিশকাত ক্যামেরা অন করে কয়েকটা ছবি তুলল। তারপর বলল,
“বিছানায় উঠে বোস। বসে পোজ দিলে সুন্দর ছবি উঠবে।”
সুবর্ণা-ও বলল,
“হ্যাঁ আপু, ওপরে উঠে বসো।”

আরিন্তা বিছানার কাছে এগিয়ে গেলে সুবর্ণা তার হাত ধরে বিছানায় উঠতে সাহায্য করল। তারপর আরিন্তাকে বিছানার মাঝ বরাবর বসিয়ে শাড়িটা সুন্দর করে মেলে দিলো। মিশকাত সুবর্ণাকে বলল,
“তুই নাম।”
সুবর্ণা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। মিশকাত পরপর কয়েকটা ছবি তুলে বলল,
“একভাবেই বসে আছিস কেন? পোজ দে। পোজ না দিলে কী ছবি তুলব?”

আরিন্তা পোজ কী দিবে? মিশকাত ছবি তোলার বাহানায় যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাতেই তার পোজের বারোটা বেজে গেছে। কেন জানি তার অস্বস্তি লাগছে। তার অস্বস্তিটা ধরতে পেরে মিশকাত সুবর্ণাকে বলল,
“তোর রুমে না আর্টিফিসিয়াল ফুল আছে? ওগুলো নিয়ে আয় তো।”

বুদ্ধিটা সুবর্ণার পছন্দ হলো। সে সঙ্গে-সঙ্গে ছুটল ফুল আনতে। সুবর্ণা যেতেই মিশকাত ধপাস করে বিছানায় উঠে বসল। মুখোমুখি বসে আরিন্তার চোখের দিকে তাকাতেই আরিন্তা চোখ নামিয়ে নিল। মিশকাত ডান হাতের তর্জনী আঙুল আরিন্তার থুতনিতে ঠেকিয়ে মুখ তুলে মুগ্ধ কন্ঠে বলল,
“মা শা আল্লাহ্। আমার ঘরে এই সুন্দর ফুলটা আজীবন ফুটে থাকুক।”
আরিন্তা মিনমিনে কন্ঠে বলল,
“দয়া করে তুমি এভাবে তাকিয়ে থেকো না।”
“কেন?”
“তুমি বুঝতে পারছো না আমার লজ্জা লাগছে?”
মিশকাত হেসে বলল,
“বরের সামনে কিসের লজ্জা বউ?”
মিশকাতের মুখে ‘বউ’ ডাকটা আরিন্তার কানে কী যে মধুর লাগল! আরিন্তা লাজুক হাসল। বলল,
“বর হতে অনেক দেরী।”
“যেদিনই হই, বরটা তো আমিই হব।”
আরিন্তা বলল,
“তবে এইমাত্র যেভাবে বউ ডাকলে, সেভাবে আরেকবার ডাকো তো।”
মিশকাত ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কেন? আজই বউ হতে ইচ্ছা করছে?”
“আহা! বলো না।”
মিশকাত হাসিমুখে ডাকল,
“ও পোনি বউ।”
আরিন্তা প্রশস্ত হাসল। মিশকাত তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল,
“এই পোনি, চল বিয়ে করে ফেলি।”
আরিন্তা বলল,
“সময় আসুক।”
“কবে আসবে সেই সময়?”

সুবর্ণার আগমনের কারণে আরিন্তার উত্তরটা আর মিশকাতের পাওয়া হলো না। সুবর্ণা নিজের রুম থেকে আর্টিফিসিয়াল ফুল এনেছে। ফুলগুলো সে আরিন্তার হাতে দিলো। সুবর্ণা আর মিশকাত মিলে আরিন্তাকে বিভিন্ন পোজ দেখিয়ে দিলো। আরিন্তা সেভাবে-সেভাবে পোজ দিয়ে ছবি তুলল। সুবর্ণা আফসোসের সুরে বলল,
“ইশ্! আপুকে এত্ত সুন্দর লাগছে। এখন যদি তার ভবিষ্যৎ বরটা এখানে থাকত। তাহলে কাপল পিক-ও তোলা হয়ে যেত।”
মিশকাত আরিন্তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তারপর সুবর্ণাকে বলল,
“ভালোই খাটাচ্ছিস, এক গ্লাস পানি খাওয়া তো সুবর্ণা।”

সুবর্ণা টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল পানির বোতল খালি। মিশকাত যে নিজেই পানির বোতল খালি করে রেখেছিল, সে খবর কেউ জানল না। সুবর্ণা বোতল নিয়ে আবার গেল পানি আনতে। মিশকাত সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে আরিন্তার পাশে বসল। আরিন্তা চমকে উঠে বলল,
“কী হলো?”

মিশকাত সেলফি ক্যামেরা অন করে এক হাতে আরিন্তার বিপরীত বাহু আগলে ধরে বলল,
“চোখের সামনে নতুন বউ একা বসে ছবি তুলছে, তা কি কোনো প্রকৃত প্রেমিক মানতে পারে? কাপল পিক তোলা অত্যাবশ্যক।”
আরিন্তা মুচকি হেসে ভ্রুকুটি করে বলল,
“শখ আর মেটে না?”
“না, চল বিয়ে করি।”
“তাহলেই সব শখ মিটে যাবে?”
“জীবনে শখের কি শেষ আছে রে পোনি? তোকে ঘিরে আমার শখ তো আজীবন থাকবে।”
আরিন্তা মিশকাতের পেটে কনুইয়ের গুঁতো মে’রে তাড়া দিলো,
“তাড়াতাড়ি ক্লিক করবে, না সুবর্ণা আসার অপেক্ষায় আছো?”

মিশকাত সঙ্গে-সঙ্গে ক্লিক করল। পরপর দুটো ছবি তুলল। একটা চোখে চোখ রেখে, আরেকটা আরিন্তা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় মিশকাত তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মুহুর্তে। দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি। দুটো ছবি তুলতেই আরিন্তা মিশকাতকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়েছে, আর তুলতে হবে না। এই দুটোই তুমি সারাদিন দেখো। মায়ের ফোনে তো আর এই ছবি নেওয়া যাবে না।”

সুবর্ণা পানি নিয়ে এলে মিশকাত পানি খেয়ে আবারো আরিন্তার কয়েকটা ছবি তুলল। এবারে ছবি তুলল বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। আরিন্তা মিশকাতকে বারবার করে বলে দিলো,
“মনে করে কিন্তু ছবিগুলো মায়ের ফোনে পাঠিয়ে দিবে।”
মিশকাত বলল,
“কিসের ছবি? আমাকে কিছু না দিলে কোনো ছবি দেওয়া হবে না। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।”
“কয়েকটা ছবির জন্য তুমি ঘু’ষ চাইছো? ছিহ্!”
“ঘুষ মানে কী? বল কষ্টের ফল। এই যে আঁকাবাঁকা হয়ে শ’খানেক ছবি তুললি। এসব তুলতে আমার কষ্ট হয়নি?”
আরিন্তা সে কথা পাত্তা না দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আর কিছুই পাবে না তুমি। ছবি এক সময় দিবেই।”


দুদিন পর কুরবানি ইদ। আরিন্তাদের বাড়ি মেহমানে ভরপুর। তার ছোটো চাচার বাড়ি তাদের বাড়ির সাথেই। ইদ এলেই তার বিবাহিত চাচাতো ভাই-বোনেরা গ্রামের বাড়ি চলে আসে। সাথে আছে আরিন্তার বড়ো ফুপুর পরিবার। তারা-ও দুটো ইদে-ই সদর থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে আসার চেষ্টা করেন। তিন ভাই-বোন মিলে প্রতিবার কুরবানি দেন। ইদ এলেই আরিন্তাদের বাড়িতে খুশির আমেজ বয়ে আনে ছোটো চাচা আর বড়ো ফুপুর পরিবার। এবারেও তাই হয়েছে। ইদের দুদিন আগেই সবাই গ্রামের বাড়িতে হাজির। আরিন্তার চাচাতো, ফুপাতো ভাই-বোনের সংখ্যা সব মিলিয়ে দশ জন। এই দশ জন যে কদিন একত্রিত থাকে, সে কদিন বাড়িটা কিছুতেই শান্ত থাকে না। সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। এবার সবাই একত্র হয়ে কেউ বিশ্রাম নেওয়ার কথাও ভাবেনি। কবে, কখন, কী করবে, না করবে তার পরিকল্পনা করতে বসে গেছে। তারা এসেছে বিকালে। তারপর অর্ধেক রাত পর্যন্ত গল্প, আড্ডাতেই কা’টিয়ে দিয়েছে। ঘুমাতে গিয়েছে রাত দুইটার দিকে। পরদিন অর্থাৎ ইদের আগেরদিন তাদের আরও হৈ-হুল্লোড় করে দিন পার হয়েছে। সারাদিন সবাই মিলে বাড়িতে এটা-ওটা করেছে। নারকেল গাছ থেকে ডাব পেড়ে খেয়েছে, আম গাছ থেকে পাকা আম পেড়ে খেয়েছে, মেরিনার হাতে বানানো বিভিন্ন আচার খেয়েছে। আরিন্তাদের বাড়ির পেছনের দিকে ঘাট বাঁধানো একটা বড়ো পুকুর আছে। দুপুরবেলা সেই পুকুরে সবাই মিলে ঘন্টা দুয়েক সাঁতার কে’টেছে। দুপুরে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকালে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের যেন আজই ইদ। পাশাপাশি গ্রামে থাকার সুবাদে মিশকাত আর সুবর্ণার সাথেও আরিন্তার চাচাতো-ফুপাতো ভাই-বোনদের ভালোই সখ্যতা আছে। ছোটোবেলা থেকেই খালার বাড়ি এলে তাদের সাথে মেলামেশা হত মিশকাত, সুবর্ণার। এবার এসে হতেই তারা মিশকাতকে বারবার ফোন করেছে সুবর্ণাকে নিয়ে আসতে। কিন্তু মিশকাত এটা-ওটা কাজের বাহানায় এড়িয়ে চলেছে। তাই গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে সবাই হুট করে ঠিক করল মিশকাতের বাড়ি যাবে তাদের না জানিয়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। দল বেঁধে হাঁটতে-হাঁটতে চলে গেল পাশের গ্রামে। তারপর উপস্থিত হলো মিশকাতের বাড়ি। এক দল মেহমান দেখে আয়েশা খাতুন অবাক হলেন। খুশিও হয়েছেন অবশ্য। সবাইকে ডেকে নিয়ে ঘরে বসিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আপ্যায়নে। মিশকাত তখন কলপাড়ে গোসল করছিল। একদল ছেলে-মেয়েদের কথাবার্তার আওয়াজ তার কানে গিয়েছে। বুঝতেও বাকি নেই এই দল কোত্থেকে এসেছে। গোসল সেরে সে যখন হাত দিয়ে ভেজা চুল ঝাড়তে-ঝাড়তে ঘরে ঢুকেছে, তখন তার পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। ঘরে ঢুকেই তাকে একদল মানুষের কড়া দৃষ্টিতে পড়তে হলো। সে চাইল মৃদু হেসে কুশল বিনিময় করতে, কিন্তু তারা শুরু করল জেরা। কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের চাপে সে গতকাল থেকে এই পর্যন্ত আরিন্তাদের বাড়ি যেতে পারেনি, এটাই সবার প্রশ্ন। সুবর্ণা শুনে বলে বসল,
“গুরুত্বপূর্ণ কাজ আবার কী? ভাইয়া তো গতকাল থেকে বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই বসে আছে।”

এ কথা শুনে বেঁধে গেল একেকজনের নানান অভিমানি কথা। তারা এখন মিশকাত আর সুবর্ণাকে সাথে নিয়ে তবেই যাবে। মায়ের আগমনের সু্যোগে মিশকাত কোনোমতে সবার হাত থেকে ছাড় পেয়ে ঘরে ছুটল। আয়েশা খাতুনকে বেশি কিছু করতে দেয়নি আরিন্তার কাজিনমহল। গরমের কারণে তারা কেবল এক গ্লাস করে ঠান্ডা শরবত খেতেই রাজি হয়েছে। আর কিছু খেতে চায় না বলে আয়েশা খাতুন বলেকয়ে তাদের জন্য গাছ থেকে পাড়া লিচু এনে দিয়েছেন। মিশকাত গিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে থাকায় আরিন্তা নিজেই দরজার কাছে গিয়ে হাঁকডাক শুরু করল। মিশকাতের জন্য রাখা শরবত নিয়ে এসেছে সে। মিশকাত দরজাটা অর্ধেক খুলে গম্ভীর মুখে বলল,
“কী সমস্যা?”
আরিন্তা বলল,
“এতক্ষণ লাগে রেডি হতে? তোমার শরবত এনেছি, নাও।”
মিশকাত আরিন্তার হাতের শরবতের গ্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“আমি বলেছি শরবত খাব? সর সামনে থেকে।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করল। মিশকাতের মুখোভাব লক্ষ্য করে বলল,
“কী হয়েছে? এটুকু সময়ের মধ্যে আবার মাথায় বাড়ি মা’রল কে?”
“তোকে আমি সরতে বলেছি, সর। আজাইরা ক্যাঁচাল করিস না এখন।”

আরিন্তা কিছু বলতে চাইলেও বেশি কথা বাড়াতে পারল না। কারণ তার গোটা কাজিনমহল এখানে উপস্থিত। সে শরবতের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে বলল,
“আচ্ছা, এটা খেয়ে নাও।”
মিশকাত বলল,
“খাব না।”
“খেতে কী সমস্যা?”
“যেতে বলেছি না তোকে?”
আরিন্তা মুখ কালো করে বলল,
“খাবে না তুমি?”
“না।”
“সত্যি খাবে না?”
“মিথ্যার কী আছে?”
“ঠিক আছে, খেয়ো না। আমি নিজেই খেতে জানি।”

আরিন্তা এক নিমেষেই গ্লাসের সবটুকু শরবত ঢকঢক করে গলাধঃকরণ করে ফেলল। মিশকাত শুধু তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। এসব কাণ্ড তার কাছে স্বাভাবিক। আরিন্তা-ও ফাঁকা গ্লাস নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চলে গেল।

মিশকাত আর সুবর্ণাকে নিয়ে তাদের গ্রামটা একটু ঘুরে সবাই আবার আরিন্তাদের বাড়ি ফিরে এসেছে। সন্ধ্যায় ড্রয়িংরুমের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুরু হলো মেহেদি পরার আয়োজন। যারা ভালো মেহেদি পরাতে পারে তারা একে-একে সবাইকে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। আরিন্তা কখনোই ভালো মেহেদি ডিজাইন পারে না। তবু সে একেকজনের হাতে মেহেদি পরানোর জন্য জোরাজুরি করছে। মেয়েরা কেউই তার কাছে মেহেদি পরতে রাজি হয়নি। তারা সুন্দর ডিজাইন চায়। বাচ্চাগুলোকে পটিয়ে আরিন্তা তাদের ছোটো-ছোটো হাতে ইচ্ছামতো আঁকিবুঁকি করে চলল। আঁকাবাঁকা ফুল, লতাপাতা আর পাখির ছবি এঁকে বাচ্চাদের মন জয় করার চেষ্টা চলছে তার। বাচ্চারা-ও এসবেই খুশি। তাদের ধারণা আরিন্তা-ই এখানে সেরা মেহেদি আর্টিস্ট। মেহেদি পরার আয়োজনে বাদ পড়েছে ছেলেরা। তারা কেউ মেহেদি পরতে রাজি ছিল না। কোনোমতেই তাদের রাজি করানো যায়নি। দু-একজনকে শুধু জোর-টোর করে তাদের বউ বা প্রেমিকার নামের প্রথম অক্ষর সেঁটে দেওয়া হয়েছে হাতের তালুতে। এতে-ও বাদ পড়ে রইল মিশকাত। কারণ এখনো পর্যন্ত সবাই তাকে সিঙ্গেল বলেই জানে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।