Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 277



যদি তুমি বলো পর্ব-১০+১১

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ১০
আফনান লারা

তিথির বাবা মহাশয় তার মহাশয়াকে ডেকে তুলার জন্য একটা স্টিলের বাটি খুঁজছেন।তিথির মায়ের ঘুম খুবই গভীর।যার কারণে সকাল বেলার মৃদু আওয়াজে ডাকার ফলে তার ঘুম ভাঙ্গার কথাই না।
অনেক খুঁজে স্টিলের বাটিটা বের করে তিনি বাজানো শুরু করে দিলেন।ওমনি লাফিয়ে উঠে বসলেন মিসেস শায়লা।
তিনি চোখ বড় করে জানতে চাইলেন সকালে এত বিদঘুটে পদ্ধতিতে তাকে ঘুম থেকে তোলার কারণ কি।

সুলতান সাহেব তখন ফিসফিস করে বললেন,’তোমার মেয়েকে দেখতে এসেছে এক সনামধন্য পরিবার।জলদি তৈরি হয়ে তাদের সামনে যেয়ে বসো’

‘এ্যাহ?আবার?তানিয়ার না বিয়ে ঠিক হলো?’

‘এরা এসেছে তিথির জন্য’

এ কথা শুনে মা জলদি উঠে পড়লেন তৈরি হবার জন্য।
ওদিকে রিদম পাত্রের খালা দুজনের সাথে ভুলভাল যা পারছে আনাবসানাব বলেই চলেছে।
ঠিক সে সময় তানিয়া একটা ঝাড়ু নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বললো,’বান্দর!সকাল সকাল এত ভাষণ শুরু করলি ক্যান?অবশ্য তুই তো ভাষণ দেস আর শোনে কাউয়া জনতা,ভাল মানুষ শোনেনা!’

এ কথা বলে তানিয়া চেয়ে দেখে পাত্রের খালা আর বোন ওর দিকে তাকিয়ে আছে।তানিয়া হাতের ঝাড়ুটা পেছনে লুকিয়ে দাঁত কেলিয়ে সালাম দিলো এরপর এক পা এক পা করে রিদমের পিছনে লুকিয়ে উঁকি দিয়ে বললো,’আপনারা কারা?’

ওনারা নিজেদের পরিচয় দিলেন তানিয়া আর রিদমকে।
এরপর তারা তিথির কথা জানতে চাইলেন।তখন তানিয়া বলে সে ঘুমাচ্ছে।তখন বেলা এগারোটা বাজে।
তানিয়া মুচকি হাসি দিয়ে বললো,’আসলে কাল আমরা রাতের দুইটায় ঘুমাইছি তো।তাই টুকুর উঠতে দেরি হচ্ছে।আমি উঠাই আনি।আপনারা বসুন,এই রিদম তুই তো শরবত বানাতে পারিস।শরত বানিয়ে ওনাদের দে!”

রিদম মাথা চুলকে তাই চলে গেলো।এরই মধ্যে তিথির মা এসে ওনাদের সালাম দিয়ে কথা বলতে বসে গেলেন।
তানিয়া ঝাড়ু ফেলে তিথিকে জাগাতে এসে হাজির।তিথি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।মাথা বালিশের তলায়।
তানিয়া ওর বালিশটা কেড়ে নিয়ে বলে,’টুকু উঠো!তোমায় দেখতে পাত্রপক্ষ এসেছে,জলদি উঠো!’

এ কথা শুনে তিথি উঠলো।চোখ ডলে বললো,’ছেলে কি করে?’

‘ময়দা মাখে,সেটাকে চিকন করে সিদ্ধ করে।তারপর শুকায়’

এটা বলে তানিয়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।তিথি ভ্রু কুঁচকে বলে,’ময়রা?’

‘আরে ধুর!মজা করতেছি।তুমি উঠো তো।ফ্রেশ হয়ে আমার বেগুনী রঙের জামাটা পরো।ওটা পরলে তোমায় বেগুনী পরীর মতন লাগে।জলদি করো’

তানিয়া জোরপূর্বক তিথিকে উঠিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।এরপর গেছে রান্নাঘরে।
রিদম তিন গ্লাস শরবত তৈরি করে রেখেছে।নিয়ে যাওয়াই ধরছিল তখন তানিয়া ওকে থামিয়ে বলে,’তোর তো পুরান অভ্যাস।চিনির জায়গায় নুন দেস,নুনের জায়গায় চিনি।আজ অবধি তোকে বোয়াম চিনাইতে পারি নাই।দাঁড়া টেস্ট করে দেখি’

এই বলে তানিয়া মুখে দিয়ে ফুরুত করে আবার ফেলে দেয় সব।রিদম পুরান ভুল আবারও করেছে।সে শরবতে চিনির জায়গায় লবণ দিয়ে দিছে।
তানিয়া ওরে কিছুক্ষণ বকাবকি করে বললো বাসায় কিছু নাই।সে যেন তিনটা ডিম পোজ করে নেয়।অন্তত এগুলা দিলেও মান বাঁচবে।
রিদম মাথা নাড়িয়ে ডিম ভাজি করতে চলে যায় আর তানিয়া শরবতের ট্রে নিয়ে ওনাদের সামনে রেখে আসে।

তারপর তানিয়া এসে দেখে তিথি তৈরি।বিয়ে করা নিয়ে এতদিন তিথির তেমন ইন্টারেস্ট না থাকলেও এখন আছে কারণ এখন তার পিছুটান নাই।যাকে নিয়ে সংসার পাততে চেয়েছিল সে মানুষটা একটা ধোকাবাজ বলে এখন তার নতুন একটা মানুষকে বিয়ে করতে কোনো সমস্যা লাগেনা।হয়ত মাঝে মাঝে খারাপ লাগবে এই ভেবে যে এতগুলো দিন কার পেছনে ব্যয় করেছে সে।

চুলগুলোকে ক্লিপ দিয়ে বেঁধে তিথি ওনাদের সামনে এসে হাজির হয়।
সালাম দিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে।পাত্রের খালা ওকে নিজের পাশে বসতে ডাকলেন তখন। তিথি ও তাই করে।
তিনি তিথির পুরো নামটা জিজ্ঞেস করলেন।এর বেশি একটা প্রশ্ন ও তিনি করলেন না।
সেই সময় রিদম তিনটা ডিম পোজ নিয়ে এসে হাজির।ওনাদের খেতে দিয়ে সে বলে ‘মাস্টার শেফের উইনার ছিলাম।আমার রান্না খেলে খুশিতে মরে যাবন।নিন খান’

পাত্রের খালা হাসি দিয়ে ডিম নিয়ে মুখে দিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন।তারপর ডিমটা রেখে দিলেন তিনজনেই।
রিদম ভাবছে এত মজা হয়েছে যে হাত থেকে বাটি রেখে প্রশংসা করতে চায় তারা।তাই সে লজ্জায় লাল হয়ে চোখে হাত দিয়ে ঢেকে ফেললো।
তানিয়া ওনাদের মুখের চাহনি দেখে একটা বাটি থেকে ডিম একটু তুলে মুখে দিয়ে বুঝলো রিদম নুনের জায়গায় চিনি দিয়ে ডিম ভাজি করে এনেছে।সে কপালে ঠাস করে বাড়ি একটা দিয়ে এরপর রিদমের কান টেনে ধরে ওনাদের সামনে থেকে নিয়ে গেলো।ওনারা কেউই ডিমের ভাল খারাপ টেস্ট নিয়ে কিছু বলেননি।

তিথিকে চলে যেতে বলে তারা তিথির বাবা মায়ের সাথে অনেক কথাই বললেন।তিথি অবশ্য সেসব শুনতে যায়নি,কিন্তু তানিয়া আর রিদম আড়ি পেতে সব শুনেছে।এবং বুঝেছে ওনারা হয়ত কথাটা আগাতো চান,আর তাই কাল তিথির বাবা মাকে ওনারা বাসায় দাওয়াত দিয়ে চলে গেছেন সবাই।
বাবা ভীষণ চিন্তাভাবনায় আছেন।কি করা উচিত তার। সেটা ভাবতে গিয়ে পরে ঠিক করলেন হয়ত এবার তিথিকে বিয়ে দেয়ার আসল সময় এসে উপস্থিত হয়েছে।তাই আর সাত পাঁচ না ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আগামীকাল ওদের বাসায় যাবার।

তানিয়ার ফোনে আজ একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে।সে রিসিভ করতেই কিছুক্ষণ স্তম্ভিত রয়ে যায়।এরপর হঠাৎ ব্যাগ গুছিয়ে সে বের হয়ে গেলো।
এসে উপস্থিত হলো একটা খোলামেলা নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে।

সে বসে বসে পা নাড়ছে চিন্তায়।অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর তার সামনে এসে দাঁড়ায় ইশান।
তানিয়া মুচকি হাসি দেয় তখন।ইশান চেয়ার টেনে বসে বলে,’বলো কি খাবে?স্ট্রভেরী স্যান্ডুইচ? ‘

‘এখনও মনে আছে ভাইয়া?’

‘হ্যাঁ’

ইশান ওয়েটারকে ডেকে খাবারের অর্ডার দেয়।এরপর বলে,’তোমার টুকুর বাসায় আজ বিয়ের প্রস্তাব গিয়েছিল তাই না?’

‘হ্যাঁ,কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?’

ইশান তখন সানগ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলে,’পাত্র আমি’

এটা শুনে তানিয়া চোখ বড় করে ফেলে।পরপরই খুশিতে তার মন ভরে যায়।সে বলে এটা হলে খুব ভাল হবে।
তখন ইশান বলে,’কিন্তু তোমার একটা হেল্প করতে হবে আমায়।সে জন্যই তোমায় কল দিয়ে এখানে এনেছি’

‘কি ভাইয়া?’

‘বিয়েটা হবে কিন্তু তিথি যেন কোনোভাবেই না জানে তার বিয়ে ইশতিয়াকের সাথে হচ্ছে’

‘সেটা কিভাবে সম্ভব? বিয়ের আগে তো একবার হলেও আপু ছেলেকে নিজ চোখে দেখতে চাইবে।’

‘সেটা জানি।সেটার ব্যবস্থা আমি করতে পারবো।তা নিয়ে ভাবছি না।কিন্তু যাতে সে কোনোভাবে আমায় না চিনে সেই দিকটা তোমার দেখতে হবে।তোমার বাবা,মা,ভাই কেউই আমাকে চিনেনা।তারা দেখলে সমস্যা নেই।
একমাত্র তুমি চিনো,তুমি পারবেনা এ কাজ?’

‘কিন্তু ওর সাথে এমন লুকোচুরি কেন?বিয়ের পরে তো দেখা হয়েই যাবে’

‘তুমি জানো, তিথি আমার কথা শুনলে বিয়েটা কখনওই করবেনা’

‘কেন করবেনা ভাইয়া?আপনি তো এখন ওয়েল সেটেলড্।সে রাজি হয়ে যাবে।বলে দেখুনই না!’

ইশান হাসে।খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে,’সব শুনলে রাজি তো হবেই!কিন্তু আমি চাইনা সে জানুক।আশা করি তুমি আমার এই অনুরোধ রাখবে’

তানিয়া মাথা নাড়ে।এরপর বলে ওঠে,’আপুকে অনেক ভালবাসেন তাই না?’

ইশান তার ফোনে একটা ভিডিও দেখছিল তখন।সম্ভবত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ।তিথি তার বাসা থেকে বের হচ্ছে আর তার নামার সিঁড়িতে কেউ একজন তেল ঢালছে।
সেটা দেখে ইশান হাসলো এরপর তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,’হ্যাঁ,অনেক বেশি ভালবাসি’
——–
তিথিকে হাসপাতালে এনে বেডে শুইয়ে রাখা হয়েছে আর তার ডান পা উপরে তোলা।
আগামী বিশ/বাইশ দিনের মতন তার পায়ে এই ব্যান্ডেজ এবং চোট,দুটোই থাকবে।
তিথি বারবার বলছে সিঁড়িতে তেল ছিল,তেল আসলো কি ভাবে,তদন্ত করতে।
কিন্তু কেউ তার কথার পাত্তা দিচ্ছেনা।সকলে ওর বিয়ের কথা নিয়ে চিন্তা করছে। ছেলে নাকি জাপান চলে যাবে পঁচিশ দিন পর।সে এর আগে বিয়ে করে নিতে চায়।
তিথি গাল ফুলিয়ে রাখলো আর পা টার দিকে চেয়ে রইলো।তার কাছে কেমন যেন পরিকল্পিত মনে হচ্ছে সব।
চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ১১
আফনান লারা

তিথির বেশ ভালমতন মনে আছে সিড়িতে তেলজাতীয় কিছু একটা ছিল,যাতে পা রাখতেই সে পড়ে যায় এত উপর থেকে।
কয়েকদিন ধরে ওর সাথে সব খারাপই হচ্ছে।মনে হয় যেন জীবনে কুফার আগমন ঘটেছে।
ওমনি তিথি শুনতে পেলো তার ভাঙ্গা পায়ের সামনে দাঁড়িয়ে তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করছে।তিথিকে তানিয়ার কাছে রেখে সকলে মিলে নাকি আজ পাত্রের বাড়ি যাবে।
তিথি ইশান নাম শুনে সন্দেহ করলেও পরে যখন শুনলো ছেলে ব্যবসায়ী তখন আর সন্দেহ রাখেনি।তবে রিদমকে বলেছে আসার সময় একটা ছবি তুলে আনতে।সে দেখবে ছেলেটা দেখতে কেমন।
তানিয়াকে তিথির কাছে রেখে সকলে মিলে ইশানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
যেতে প্রায় দু ঘন্টার মতন লেগে যায় তাদের।এর কারণ হলো তারা মেইন রোড দিয়ে এসেছে।আর মেইন রোডে ছিল প্রচুর জ্যাম।
ইশানদের বাসার ভেতর ঢুকে তারা তো সবাই অবাক।এত বড় বাসার ছেলের জন্য কিনা তাদের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব এসেছে!
কিন্তু বাসায় ঢুকে তারা কোথাও ইশানের মাকে দেখে নি।তারা জানতো বাসায় কেবল ইশানের মা আর দুটো বোন থাকে।তবে বোনদের দেখলেও মায়ের অনুপস্থিতি তাদের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া করছিল। তখন ইশানের খালা এসে তাদের আপ্যায়ন করতে করতে জানান ইশানের মা একটু অসুস্থ,তিনি ঘুমাচ্ছেন।বেলা এগারোটার সময় তিনি ঘুমাচ্ছেন,মেয়ে পক্ষের মানুষ আসার পরেও আসলেন না। এসব তাদের মাথার ভেতর চরকির মতন ঘুরছিল তাও তারা খালাদের মিষ্টি ব্যবহারের কাছে হার মেনে সকলে সোফায় এসে বসলেন।
তামিয়া এবং ইকরা এসে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। ইশান বলেছিল তামিয়াকে থাকতে।কিন্তু তিথি থাকলে সে যেন ধারের কাছেও না থাকে।কারণ তিথি ওকে চিনে ফেলতে পারে।
ইশান নিজেই নেই বাসায়।আসতে কিছু সময় লাগবে।সবাই বাসা দেখতে ব্যস্ত। সাথে ইশানের খালারা তো আছেনই,ননস্টপ বকবক করেই চলেছেন।
মিসেস শায়লা করিডোর দিয়ে যাবার পথে দেয়ালে কিছু দাগ দেখে থেমে যান।এরপর বলেন,’এখানে মনে হয় ছবি রাখা ছিল, তাই না?’

‘হ্যাঁ,ফ্রেম ঠিক করাতে সরানো হয়েছে।ঐ আর কি”

খালারা তিথি না আসার কারণ ও জানতে চাইলেন।তখন বাবা তিথির দূর্ঘটনার কথা জানান সবাইকে।
সব কথা শেষে জনাব সুলতান ইশানকে দেখতে চাইলেন।ঠিক সেইসময় ইশান এসে উপস্থিত হয় সেখানে।সালাম দিয়ে সবার মাঝে গিয়ে বসে সে।
ইশানকে চোখের দেখা দেখে তিথির বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।এবারের ছেলেটা সব দিক দিয়েই পারফেক্ট।
ইশানের বাসা,ব্যবসার সব কথা শুনে তিথির বাবার মনে ভয় জেগে উঠলো যৌতুক দেয়া নেওয়া নিয়ে।এটাই মোক্ষম সময় বলে তিনি ইশানের সামনেই কথাটা পেশ করলেন।জানতে চাইলেন তার কোনো চাহিদা আছে কিনা।
ইশান তখন কথাটা শুনে মুচকি হাসলো এরপর বললো,’চাহিদা একটাই।আপনাদের মেয়েকে দিয়ে দিবেন একেবারে’

এটা বলে সে উঠে চলে যায়।রিদম ইশানদের ছাদে চলে গিয়েছিল।ইশানের ছবি তোলার কথা তার মনে নেই।যখন তার মনে পড়লো তখনই সে ছুটে আসলো বাসায়।ইশান তখন তার রুমে গায়ের শার্ট খুলছিল।রিদম লুকিয়ে তার কয়েকটা ছবি তুলে পালিয়ে যায় ওখান থেকে।
——
তানিয়া ফোনে রকিবের সাথে কথা বলছিল আর তিথি তার পা টাকে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করছে।জীবনে কখনও তার সাথে এমন ঘটনা ঘটেনি।হঠাৎ করে সব যেন একসাথে ঘটে চলেছে।এর কারণ টা কি!
‘কোনো সিক্রেট লাভারের উদয় হলো নাকি?কিন্তু সমস্যা হলো সিক্রেট লাভার হলে সে আমায় সিঁড়ি দিয়ে ফেলছে কেন?
এটা মনে হয় সিক্রেট এনিমি’

তানিয়া রকিবের সাথে কথা বলতে বলতে অন্য কেবিনে চলে গেছে।এরই মধ্যে সেখানে এসে হাজির হয় একজন ডাক্তার।তিনি তিথির অনুমতি ছাড়াই ওর পায়ের ব্যান্ডেজটা চেক করছিলেন। অনেক দেখাদেখির পর্ব শেষ করে তিনি চেঁচিয়ে নার্স ডাকলেন।এরপর বললেন এত কম দামী ব্যান্ডেজ কেন লাগানো হয়েছে।এটা বলে ধমকে নার্সকে দিয়ে ভাল মানের একটা ব্যান্ডেজ আনিয়ে পুনরায় ব্যান্ডেজ খুলে সেটা লাগিয়ে দিলেন ।তিথি চুপচাপ দেখছে সব।
‘কাহিনী তাহলে এটা!আমায় পাহাড় থেকে ফেলে দিবে,তারপর পাহাড়ের তলা থেকে কুড়িয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাবে।কি অদ্ভুত মানুষ!’

তিথিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ডাক্তার থতমত খেয়ে ঐ জায়গা থেকে চলে যাওয়া ধরতেই তিথি বলে উঠে ‘থামুন! শুধু একবার বলেন সাধারণ ব্যান্ডেজ আর দামী ব্যান্ডেজের তফাৎ কি?’

ডাক্তার পেছনে ফিরে হাসি দেয়।এরপর বলে,’আপনাকে বলা প্রয়োজন বোধ করছিনা’

এটা বলে তিনি হাওয়া।তিথি এবার নিশ্চিত হলো এটাকে নিশ্চয় সেই লোক পাঠিয়েছে যে এসব কিছুর পেছনে দায়ী।নরমাল ডাক্তার হলে তিথির প্রশ্নের জবাব দিতো!
——
ইশানদের বাসায় আজ তিথির পরিবারের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।এত সময় হয়ে যাবার পরেও ইশানের মায়ের দেখা মিলছেনা বলে এতক্ষণ মনে মনে হাঁশপাঁশ করলেও সুলতান সাহেব শেষমেশ কথাটি বলেই ফেললেন।
ইশানের মাকে একবার আসতে বললেন।কথাটা পাশের রুম থেকে ইশান ও শুনলো।সে তখন হাতে ঘড়ি পটছিল।
ঘড়িটা পরতে পরতে সে সোজা মায়ের রুমে আসে।
মা অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছেন।
ইশান চেয়ার একটা টেনে নিয়ে মায়ের মুখের সামনে বরাবর বসে।
মা ওকে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললেন সাথে সাথে।
ইশান তখন বললো,’তুমি ঘুমাচ্ছো না।যদি ঘুমিয়ে থাকতে তাহলে পা নাড়তে না এতো!ওদের সামনে যাচ্ছো না কেন মা?’

‘আমি মুনিয়ার সাথে তোর বিয়ে দিতে চাই।অন্য কোনো মেয়ের সাথে না।আর সে মেয়ে যদি হয় তিথি তবে তো জীবনেও না’

‘তিথি আমার উপযুক্ত ‘

মা উঠে বসে ধমকে বললেন,’১১ বছর আগে যখন তুই ঐ মেয়েকে পাগলের মতন ভালবেসেছিলি,সে কি করেছিল মনে নেই তোর?
তোর এই মাকে কত কাঁদিয়েছিল, মনে নেই তোর?’

‘মনে আছে মা’

‘তাহলে কেনো সেই মেয়েকেই তুই ঘরের বউ করে আনতে চাইছিস বাবা?কেন?সে তোর যোগ্য না’

‘যোগ্য।তবে সে যেটা করেছে তার শাস্তি অবশ্যই সে পাবে।কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাকে আমি এ জীবনে হারিয়ে ফেলবো।আমি একবার তাকে চেয়েছি,পাইনি।এরপর কত শ্রম করে এখন এই জায়গায় পৌঁছে তাকে আমি একবার মাত্র চেয়েই পেয়ে যাচ্ছি।।।।। ‘

‘তো?তার যে অপরাধ ছিল সেটার কি হবে?’

‘সেটার শাস্তি ও সে পাবে।তুমি এত ভেবোনা মা।তুমি একবার ওদের সামনে যাও।ওরা তো কোনো দোষ করেনি’

‘করেছে!মেয়ে যেরকম,তার পরিবার ও সেরকমই হবে’

‘ওরা অনেক ভাল।ট্রাস্ট মি!একবার আসো!

ইশান জোর করে মায়ের হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে নিলো।এরপর ওনাদের কাছে নিয়ে আসলো আবারও জোর করে।

সুলতান সাহেব ইশানের মাকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন।ওনাকে তাদের সাথে বসে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য রিকুয়েস্ট ও করলেন তিনি।
মিসেস আরাফাত গাল ফুলিয়ে ইশানের সাথে বসেন ওখানে।
ইশান তখন বলে তার মা একটু অসুস্থ। সবাই যেন খাবার খাওয়া শুরু করে।
খাবারের এক সময়ে তিথির বাবা হঠাৎ জানতে চাইলেন ইশানদের গ্রামের বাড়ি কোন জায়গায়।তখন ইশান বললো,’মিসরিপুর।’

‘মিসরিপুর?কি বলো!আমরাও তো সেই গ্রামের।তোমার বাড়ি কোন দিকে?’

‘মিসরিপুরের পশ্চিমে মওলানা বাড়ি’

‘চিনিনা,তবে হয়ত গেলে দেখলে চিনবো।আরেহ বাহ!আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি আমাদের গ্রামের ছেলে হবে।অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’

রিদম ইশানের ছবিগুলো গ্যালারিতে দেখতে দেখতে হাসছিল।সে গিয়ে তিথিকে দেখিয়ে টাকা খাবে।সেই ভাবনাতেই তার মন আকুপাকু করছে এখন থেকে,কেবল টাকা খাবে বলে।
—-
তিথি পায়ের ব্যান্ডেজটা নাড়তে নাড়তে হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে।
সে মুচকি হাসি দিয়ে নার্সকে ডাক দেয় উঁচু স্বরে।তখন নার্স আসতেই সে জানায় তার বার্থডে কেক খেতে ইচ্ছে করছে,তার এই আবদারের কথা শুনে অন্য কোনো নার্স হলে ঝাড়ি দিতো আর নয়ত পরিবারের লোককে ডাকার কথা বলতো।কিন্তু এখানে হলো তার উল্টো।নার্স ওর কাছে জানতে চাইলো সে কি ফ্লেভারের কেক খাবে।
তিথি মনে মনে জানতো এমন কিছুই হবে।তখন সে স্ট্রভেরি ফ্লেভারের একটা কেক আনতে বলে।তার কথা শুনে নার্স চলে যায়।
তিথি ভাবছে আর কি অর্ডার দেয়া যায়।এমন কিছু করতে হবে যাতে করে ঐ নার্স বিরক্ত হয়ে যায় তারপর তার স্যারকে কল দিয়ে বিষয়টা জানায়।এরপরই তার স্যার নেক্সট পদক্ষেপটা নেবে!সেও প্রস্তুত।দেখা যাক পানি কতদূর গড়ায়!

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৮+৯

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৮
আফনান লারা

পরেরদিন আদিল তিথিকে একটা নির্জন জায়গায় দেখা করতে বলে।জায়গাটি খুব বেশি দূরে না হলেও তিথির অপরিচিত।সে কোনোদিন ঐ জায়গায় যায়নি।যেতে ভয় হচ্ছিল,সে আদিলকে বলেও দিয়েছিল অন্য জায়গায় দেখা করতে কিন্তু আদিল নাকি তার ফিলিংস পাবলিক প্লেসে কনফেস করতে পারবেনা।এত দিনের চেনা বলে তিথি আর মানা করলোনা।ভাবলো আদিল তো আর চরিত্রহীন না।সেটা হলে এতদিনে সে ঠিকই বুঝতো।

এসব ভেবেই তিথি একা একাই ঐ নির্জন জায়গায় এসে পৌঁছায়।মেইন রোড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটারের মতন পথ হাঁটতে হয়।তারপর আসে একটা ছোটখাটো নদী।নদীর সামনে বড় বড় ভিনদেশী গাছ।সম্ভবত এটা কোনো ধনী ব্যাক্তির নিজস্ব সম্পত্তি।সুন্দর করেই ফলফলাদির গাছ দিয়ে নদীর এপাশটা ভরাট করেছে।
তিথি নদীরের শান্ত ঢেউয়ের বাতাসে হাঁটতে হাঁটতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিল।বেশ কিছু সময় পর তার ফোনে কল আসে আদিলের।
আদিল জানতে চায় সে পৌঁছেছে কিনা।তিথি ওকে দ্রুত আসতে বলে তখন।কারণ তার বাসায় ফিরে তানিয়ার বিয়ের শপিংয়ের জন্য যেতে হবে।
আদিল ওকে পাঁচ মিনিটে আসার কথা বলে কলটা কাটে।তিথি এবার নদীর খুব কাছে এসে স্বচ্ছ পানির দিকে চেয়ে ছিল।তার বারবার মনে হচ্ছে আশেপাশে কেউ তাকে দেখছে।অথচ কোথাও কারোর কোনো উপস্থিতি নেই।
হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে তিথি পেছনে তাকায়।আদিলকে সামনে দেখে দম ফেলে সে।
এরপর ব্রু কুঁচকে বলে,’বলো কি বলবে।’

‘তিথি তুমি কি সত্যিই আমায় ভালবেসে ফেলেছো?’

‘এইসব কেমন কথা?’

‘জাস্ট আনসার টা দাও’

‘আমি তোমায় ভালবেসেছি কিন্তু তুমি তো বাসোনি।নাটক করেছো’

আদিল হাসি দিয়ে বলে,’হ্যাঁ,আমি বাসিনি।তবে এটা সিওর যে তুমি বেসেছো?’

‘অবশ্যই,আমি তো আর তোমার মতন নাটক করিনি’

আদিল তখন একটা জয়ের হাসি হেসে তিথিকে ওখানে রেখেই চলে যাওয়া ধরে।তিথি আগাগোড়া কিছুই বুঝলোনা।আদিল তো তাকে কত কথা বলার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে।তাহলে এখন আবার চলে যাচ্ছে কেন?
তিথি ছুটে এসে আদিলের সামনে দাঁড়ায় এরপর বলে,’এটা বলার জন্যই এত দূর আনলে আমায়?’

আদিল তিথির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর বলে,’আচ্ছা আমি যদি বলি আজ আমার সাথে এই জায়গায় থেকে যেতে।সারাটা বিকেল,সারাটা রাত।থাকবে? ‘

‘মানে কি বুঝাতে চাইছো?’

‘মানে এই যে আমার সাথে একটা রাত কাটাতে পারবে?তুমি তো বলেছো আমায় সত্যিকারের ভালবাসো!’

তিথির মেজাজ গেলো খারাপ হয়ে।সে আদিলের মুখ থেকে আর কথা বের হতে দেয়নি।মুখের উপর দুটো থাপ্পড় মেরে দিয়েছে ততক্ষণে।এরপর চিৎকার করে বলে,’মানুষ যাকে ভালবাসে,সে মানুষটা যদি তাকে একই রকম ভাবে ভালবাসতো তবে তোমার এই প্রস্তাব ঠিক ধরা যেতো। থাকতাম এক রাত!তাছাড়া ভালবাসার মানুষকে কেউ অবৈধ আকারে চায়না কখনওই।সবসময় বৈধ আকারে চায়।
কিন্তু তুমি তো বলেই দিয়েছো,তুমি আমায় ভালবাসো না
তবে এক রাত কেন!একটা ঘন্টাও আমি তোমার সাথে কাটাতে প্রস্তুত নাহ।তুমি এতদিন সাধু সেজে এখন আসছো সোজা একসাথে থাকার প্রস্তাব নিয়ে?তোমার ভাগ্য ভাল আমি আজকে দামী হিল পরে এসেছি।নাহয় স্যান্ডেল থাকলে ওটা দিয়ে পিটিয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে ফেলতাম।সময় থাকতে আমার চোখের সামনে থেকে সরো।’

এট বলে তিথি নিজেই উল্টো দিকে হাঁটা ধরে।আদিল দাঁড়িয়ে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখছিল।
তখন ওর পাশে এসে দাঁড়ায় ইশান।এরপর বলে,’পরিকল্পনায় একটা ভুল হয়ে গেলো।বড় ভুল!তোমার বলা উচিত ছিল তুমি ওরে অনেক ভালবাসো। আমি শুধু দেখতে চাই সে তোমার সাথে থাকতে রাজি হয় কিনা!ভুলটা কেন করলে!’

আদিল মাথায় হাত দিয়ে বললো তার আসলেই ভুল হয়ে গেছে।তারা যখন এসব আলাপ করছিল তখনই হটাৎ ইশান দেখে তিথি ঐ পথ থেকেই উধাও।এতক্ষণ ওকে হেঁটে চলে যেতে দেখছিল তারা।মূহুর্তের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেলো মেয়েটা!
ইশান আদিলকে রেখে তিথিকে খুঁজতে ছুটলো।একসাথে খোঁজার উপায় নেই।
চারদিকে রাস্তা গেছে।সে কোন রাস্তাতে গেছে সেটা বোঝা মুশকিল।
ইশান তাও অন্ধকারে তীর ছোঁড়ার মতন একটা রাস্তার দিকে পা বাড়ায়।
তিথির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সে রাস্তাটার শেষ প্রান্তে চলে আসে।এখানটায় একটা পুরান ফ্যাক্টরি ছাড়া আর কিছুই নেই।ফ্যাক্টরিটা তালাবন্ধ। ইশান ওটার চারপাশে ঘুরে এসে ফিরে আসার জন্য পেছনে মুড়তেই দেখে তিথি দাঁড়িয়ে আছে।
ইশান ওকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও ভাবতে থাকে এবার তার কি হবে।সে তো ধরা খেতে চায়নি।

‘সেদিন আমাকে লিফট দেয়া সেই ছেলেটা আর এই ছেলেটা তাহলে একই?হাতের ব্রেসলেটটাও একই!’

ইশান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।তিথি কাছে এসে ইশানের মাথার ক্যাপটা টান দিয়ে সরিয়ে বলে,’এই ফাটা দাগটা আমিই দিয়েছিলাম তাই না?’

ইশান ক্যাপটা আবার পরে বলে,’কিসব বলছো?মোটেও তেমন কিছুনা।আমার জন্মদাগ এটা’

‘তাই?’

তিথি এবার আরও কাছে এসে ইশানের কপালে চাপ দিলো জোরেসোরে।ওমনি ইশান ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে।
তিথি মুচকি হেসে বলে,’জন্মদাগে চাপ দিলে ব্যাথা হয়?’

ইশান কিছু বলেনা।তিথি এবার ওর মাস্কটা ধরতে নিতেই ইশান ওর হাত ধরে বলে,’আমি দিলেই তবে পারবে,তার আগে এত বেশি করতে পারবেনা ‘

এই বলে ইশান সামনের দিকে হাঁটা ধরে।তিথি ও ওর পিছু আসতে আসতে বললো,’আমার পিছু নিয়ে কি লাভ হচ্ছে আপনার? কি বুঝাতে চান আপনি?তুমি বলবো নাকি আপনি?আসলে আপনার বয়স কত!’

ইশান চুপচাপ হাঁটছে।তিথি আবার বললো,’কতদিন হলো আমাকে এভাবে ফলো করছেন?উত্তর দিন!’

ইশান যেতে যেতে তিথির সামনে থেকে উধাও হয়ে যায়।কোথাও সে নেই।তিথি ওর হাঁটার গতির সাথে না পেরে পিছিয়ে গেছিলো।এখন কোথাও সে ইশানকে দেখছেনা।
কিন্ত তিথি জানে সে কি করলে ইশানকে আবারও হাতের কাছে পাবে।
তাই সে মেইন রোডে এসেও আবারও সেই নির্জন জায়গাটিতে প্রবেশ করে।যতদূর চোখ যায়,সে হাঁটতে থাকে।
সে জানে,ইশান তার পিছু নেবেই।

এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় তিথি জেদের বশে পড়ে এতদূর এসে এখন মনে মনে পস্তাচ্ছে।মানুষের ভয় আছে,ভূতের ভয় আছে।
এই ছেলেটাকে হাতের নাগালে পাবার জন্য আর কি যে করতে হবে তাকে!
ভূত টূত নাকি!এই আসে,আর এই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে তিথি থেমে গেলো।
পাঁচ ছয়টা লোক কাঁধে জাল নিয়ে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল।তিথিকে দেখে তারাও থেমে যায়।এখন ওখানে থাকা অবস্থায় কিরকম বিশ্রি ভাবে তারা তিথির দিকে তাকিয়ে ছিল।
সন্ধার অন্ধকারে ঐ কালো কুচকুচকে লোকগুলোর লালসা তিথি দেখতে না পেলেও তার বুকের ভেতর ভয় কাজ করছিল।ঢোক গিলে সে আশেপাশে তাকায়।
তাহলে কি ওর ধারণা ভুল!ইশান আজ আর এদিকে আসবেনা।
এখন এদের থেকে কিভাবে বাঁচা যায়!
তিথি এক পা এক পা করে পিছিয়ে দিলো এক দৌড়।কিন্তু তার দূর্ভাগ্য ঐ পথের উঁচুনিচু রাস্তায় হোচট খেয়ে সে পড়ে বেশিদূর যেতে পারেনি। হাত ছিলে গেছে, সাথে মনে হয় পায়ের নখেও কিঞ্চিত ব্যাথা সে পেয়েছে।
আশপাশ থেকে মাছোর তীব্র গব্ধ ভেসে আসছিল তার মানে ঐ লোকগুলো তিথির খুব কাছে চলে এসেছে।
তিথি এখন কি করবে!

লোকগুলো তিথিকে দেখে চুপচাপ চলে গেছে।ওরা চলে যাবার পর তিথি উঠে বসে ভাবছে তারা কিছু করলোনা কেন?
তারপর ইশানের কথা মাথায় আসায় তিথি উঠে চারিদিকে খোঁজ করলো ওর।কিন্তু কোথাও তো কেউ নেই
তবে লোকগুলো এভাবে তেড়ে এসেও কিছু না করার কারণ কি!
নিশ্চয় ইশান আশেপাশেই আছে।ওকে দেখেই চলে গেছে।

অন্ধকার বেড়ে যাওয়ায় তিথি আর ওকে খুঁজে সময় বাড়ালোনা।কি করে যে এত জলদি সময় কেটে গেল!মেইন রোডে এসে তিথি গাড়ীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে এবার।
এটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।আদিল তাকে এমন একটা জায়গায় এনে ছেড়ে গেছে যেখানে লোকাল গাড়ী পাওয়াই যায়না।সন্ধ্যায় সবাই শপিংয়ে যাবে বলেছিল।তার এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে।বাসায় না গিয়ে সোজা শপিংমলে উপস্থিত হতে হবে।

তিথি গাড়ীর অপেক্ষায় রোডের পাশের মাইলফলকে উঠে বসে আছে।পা ব্যাথা হয়ে গেছে তার।অন্ধকার হতে হতে এবার এমন হলো যে তিথি দূর পাল্লার গাড়ীর আলো ছাড়া আর কিছুই দেখছেনা।
‘ঐ আদিলের বাচ্চা আর একদিন বলুক দেখা করবে!যমুনা নদীর পানি গেলাবো ওরে!শখ কত আমার সাথে শুবে!’

তিথি দাঁতে দাত চেপে পা দোলাচ্ছিল,তখনই ইশান গাড়ী এনে তার সামনে দাঁড় করায়।
গাড়ীর ভেতর আলো জ্বলছিল বলে ইশানকে সে দেখেছে।এরপর মাইলফলক থেকে নেমে সে বললো,’আপাতত ক্লাসমেটই ভাবি!!
এখনও যাওনি তুমি?আমি জানতাম।আমাকে ফলো করতেছিলা তাই না?’

ইশান চুপ করে সামনে তাকিয়ে আছে।তিথি গাড়ীর দরজা ধরে বলে,’আমাকে ঐ নির্জন এলাকায় একা ছেড়ে দিয়ে এসেছো,এখন আবার লিফট দিতে চাও!বাহ!’

কথা বলতে বলতে তিথি গাড়ীর দরজাটা খোলার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ।
ইশানকে বকাঝকা করতে করতে সে দরজাটা খোলার কাজ করছিল।কিন্তু কোনোমতেই পারছেনা সে।
ইশান এবার বিরক্ত হয়ে একটু ঝুঁকে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে দেয়।
এরপর বলে,’পুরান অভ্যাস এখনও যায়নি’

এটা শুনে তিথি কপাল কুঁচকে বলে,’পুরান অভ্যাস মানে!’

চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৯
আফনান লারা

গাড়ীতে নিরবতা চলছে দুজনেরই।কিন্তু তিথি মোটেও চুপচাপ বসে নেই।সে তার ব্যাগে থাকা আয়নাটাকে বাম পাশে নিয়ে সেই আয়নায় ইশানের চোখগুলো দেখছে।এই চোখ তার অনেক চেনা মনে হয় কিন্তু সেই মানুষটা কে ছিল ওটাই মিলাতে পারছেনা।ইশান যেন বুঝে গেলো।সে তিথির আয়না বরাবর তাকালো এবং তিথির এই কার্যকলাপে অবাক হলোনা একটুও।যেন সে অনেক আগে থেকেই জানতো।
তিথি হকচকিয়ে চশমাটা তুলে নিজের লিপস্টিক ঠিক করার নাটক করছে।
ওমনি ইশান এক হাত গাড়ীতে রেখে আরেক হাত এগিয়ে তিথির লিপস্টিকে আঙ্গুল দিয়ে লেপটে বললো,’এবার দেখো আয়নায়,ঠিক আছে কিনা’

‘আশ্চর্য! এমন করলে কেন?’

‘তোমার লিপস্টিক ঠিক আছে তাও তুমি আয়নায় সেটা দেখার নাটক করছিলে।তাই আমি সত্যি সত্যি লিপস্টিক এলোমেলো করে দিলাম যাতে করে তোমার আয়না দেখা সার্থক হয়’

ইশানের এমন উদ্ভট কথায় তিথি রেগে আগুন।তাও কিছু বলতে পারলোনা।কারণ সে এই ছেলের গাড়ী করে ফিরছে।এখন বেশি তালিবালি করলে তারে হয়ত মাঝ পথেই নামিয়ে দেবে।

তিথি ঢোক গিলে গেলো পুরো রাগটা।এরপর হাত দিয়ে ঠোঁট ঠিক করে মূর্তির মতন বসে থাকলো।
ইশান মিটমিট করে হাসতে থাকে।
তিথি ইশানের গাড়ীর সামনের গ্লাসে হাত রেখে বলে,’ঠিক করে ফেলেছেন?’

‘হ্যাঁ।আচ্ছা একটা কথা জানো তিথি?’

‘কি?’

‘কাঁচ ভাঙ্গলে বিয়ে দ্রুত হয়।’

‘তোহ?কার বিয়ে হবে?আমার তো হচ্ছেনা।আমার ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে তবে’

‘তোমারও হবে অপেক্ষা করো’

‘আমার না হয়ে তোমার হোক।আমার বাবা এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা নাই।
—–
ইশান তিথিকে শপিংমলের সামনে নামিয়ে দেয়।তিথি পেছনে ফিরে বলে,’তোমার মুখ ঢেকে রাখো কেন?কপালের জন্মদাগের মতন মাস্কের ভেতরেও কি জন্মদাগ আছে?

ইশান কিছু না বলেই ওখান থেকে চলে যায়।
তিথি এরপর ঠিক করে যে করেই হোক এই ছেলের মুখটা দেখে নিতে হবে।তবেই যত রহস্যের গোড়া আছে সব সমাধান হবে।

তিথিকে শপিং মলের বাহিরে দেখে তানিয়া বের হয়ে এসে বকাঝকা শুরু করে দেয়।তার আসার কথা ৭টায়।এখন বাজে সাড়ে আটটা।
তিথি কানে ধরে ক্ষমা চায়।খুব একটা দেরি হয়নি,সবাই বেনারসী পছন্দ করতে ব্যস্ত এখন।
তিথিকে নিয়ে তানিয়া সেই জায়গায় এনে বসায়।তানিয়া বলে ওর পছন্দ খুব একটা মানানসই না।তিথি যেন ওর হয়ে পছন্দ করে দেয়।
তিথি সব শাড়ীতে চোখ বুলিয়ে একটা শাড়ীতে হাত রাখে।ওমনি পাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলাও শাড়ীটা ধরে নেয়ার জন্য।

তিথি পাশে তাকায়,তাকিয়ে দেখে মিসেস আরাফাত।
ওনাকে দেখে তিথি প্রথমে চিনতে না পারলেও দু মিনিটের মাঝামাঝিতে চিনে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।এরপর সালাম দেয়।
মিসেস আরাফাত ওর সালাম নেয় এরপর চশমাটা ঠিক করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন তিনি। যেন তিনি ওকে দেখতেও চাননা,কথা তো দূরে থাক।

তিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওনার দিকে।ওর মা,বোন বাবা কেউই মিসেস আরাফাতকে দেখেননি।তিথি একাই দেখেছে।

তিথি ও কিছু আর বললোনা।সে বসে পড়লো আগের জায়গায়।মিসেস আরাফাত ঐ শাড়ীটা কিনে তিথিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন,’মুনিয়া এদিকে আয় তো!দেখি তোকে কিরকম লাগে।আমার ইশতিয়াকের বউ বলো কথা!’

এ কথা শুনে তিথি আরও অবাক হয়ে যায়।তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে এরপর চারিদিকে তাকায় সে।কোথাও ইশতিয়াকে সে দেখেনা।
হুট করে তানিয়া এসে ওকে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চায় তার কি হয়েছে।শাড়ী চয়েস কেন করছেনা।
তিথি কোনো মতে একটা শাড়ী বেছে দেয় ওকে।

ইশতিয়াকের বিয়ে!
মুনিয়া শাড়ীটা আয়নার সামনে গিয়ে গায়ে জড়িয়ে দেখছিল।
মিসেস আরাফাত মুখ বাঁকিয়ে আবারও বললেন,’দেখলেন রফিক সাহেব!আমার ছেলের বউকে?কোটিতে একটা।যেমন সুন্দর,তেমনি শিক্ষিত।ও তো মাস্টার্স করতে বিদেশ চলে যাবে।সেটা জানেন?
ইশতিয়াকের সাথেই চলে যাবে।আমি বাপু সেই রকমের শাশুড়ি না যে ছেলের বউকে আটকে রাখবো।ওদের যদি ইচ্ছা থাকে বিদেশ যাবার,তবে যাবে।সমস্যা নেই,আমি আটকাবোনা।’

তিথি চুপচাপ সব শুনছে আর মুনিয়াকে দেখছে।খুব ইচ্ছে হলো ইশতিয়াককে দেখার।সে এখন কেমন আছে!কোথায় আছে!
বেশ কিছু সময় পর ওপারে একজন লোককে সে বিল পে করতে দেখে।পরনে নীল রঙের শার্ট।মুনিয়া ছুটে গিয়ে লোকটার পাশে দাঁড়ায়।ওর জন্য মুখ দেখা যাচ্ছিল না।তিথি বুঝে যায় ওটাই ইশতিয়াক।
সে ও ওদিকে এগোয় দেখার জন্য।কিন্তু আফসোস সে দেখতে পাবার আগেই লোকটা কোথায় যেন চলে গেছে।কোথাও আর সে নীল রঙের শার্টট পরা কাউকে দেখতে পেলোনা।
তানিয়া তখন তিথিকে ডাকতে এসে বলে তারা জুয়েলারি সেকশনে যাবে।সে যেন দ্রুত আসে।সময় নষ্ট না করে।

তিথি ওদিকটা দেখতে দেখতেই চলে যায়।

——
গাড়ীতে মিসেস আরাফাত বললেন,’মুনিয়াকে এই শাড়ীতে বেশ মানাবে ‘

ইশাহ চুপচাপ গাড়ী চালাচ্ছিল।সে জানতোনা মা এই শপিংমলে এসেছে।অর্ধেক পথ যাবার পর মা কল দিয়ে জানান উনি এখানে আছেন।এদিকে তিথিও এখানে।তাই ইশান মল থেকে নতুন আরেকটি জামা কিনে পরে নেয় যাতে তিথি ওকে চিনতে না পারে।

এক সময়ে মা হঠাৎ করে বললেন এই শাড়ী নাকি মুনিয়ার বিয়ের শাড়ী।তখন ইশান বলে,’ভালোই তো,তবে মুনিয়ার বিয়ে খাচ্ছি আমরা’

এ কথা শুনে পরক্ষনেই মা বললেন, ‘ওর বিয়ে মানেই তো তোর বিয়ে!’

এ কথা শুনে ইশান গাড়ী থামিয়ে দেয়।এরপর বলে,’আগেও বলেছি আমি ওরে বিয়ে করতে পারবোনা’

‘পারতে হবে,আমার ও তো শখ জাগে একটা পুত্রবধুর।তোর বিয়ে হবে,বাচ্চা হবে ছোট ছোট বাচ্চাগুলো সারা বাসায় ঘুরঘুর করবে।আমার এখন বয়স হয়েছে।এসব শখ করা কি অস্বাভাবিক? ‘

ইশান কিছু বলেনা গাড়ীটা আবারও স্টার্ট দেয়।
——–
বাসায় ফিরে তিথির পুরো পরিবার এতটাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ছিল যে সবাই না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।পরেরদিন সকাল দশটা বেজে গেলেও কারোর ঘুম ভাঙ্গেনা।
বুয়া এসে দরজা ধাক্কিয়ে চলেও গেছে,তাও কেউ ওঠেনি।
ঠিক দশটা দশ মিনিটে তিথির বাবা সবার আগে ঘুম থেকে ওঠেন।এরপর চোখ ঘঁষতে ঘঁষতে তিনি ডাইনিংয়ের কাছাকাছি আসেন তখনই কলিংবেল বাজার আওয়াজটা তিনি পান।
পানির বোতলটা হাতে নিয়েই তিনি যান দরজা খুলতে।
খুলে দেখেন দুজন ভদ্র মহিলা আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তারা সালাম দিয়ে দিলো সবার আগে।তিথির বাবা সালাম নিয়ে ওনাদের ভেতরে আসতে বললেন।তিনি তখনও ঘুমের ঘোর থেকে বাহিরে বের হতে পারেননি।হা করে শুধু মেহমানদের মুখ দেখে চলেছেন।মহিলা দুজন আর সে মেয়েটি এসে বসে সোফায়।তারপর মহিলা একজন বললেন,’আপনার বড় মেয়ে বাসায় আছে?’

‘তিথি?আছে তো।আপনারা চেনেন ওকে?’

‘জ্বী চিনি।আমি হলাম করুনা হাওলাদার।আমার বাড়ি খুলনায়।এখানে আমার বোনের বাসায় এসেছি।তো ভাবলাম বোনের ছেলের জন্য একটা মেয়ে বেছে দিই,আমি নাকি ভাল বাছতে পারি।সে সূত্রে আপনাদের মেয়ের কথা শুনলাম।’

তিথির বাবার এবার যত ঘুম ছিল সব উঠে গেছে।তিনি হাতের বোতলটা রেখে ওনাদের পাশের সোফায় বসে পড়লেন।এরপর জানতে চাইলেন ছেলে কি করে।

ছেলের খালা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,’ব্যবসা করে।বিরাট বড় ব্যবসা’

‘কিসের ব্যবসা?’

‘ব্যবসাটা আসলে বিদেশে,জাপানে।জাপানের একটা নাম করা নুডুলসের কারখানার মালিক আমাদের ছেলে।’

খালা ২য় জন মশকরা করে বললেন,’চিন্তা করবেন না।আপনার মেয়েকে সারাদিন ঐ নুডুলস খেতে হবেনা।আমাদের ছেলে তারে দুনিয়ার সব খাবারের টেস্ট করাবে।’

এই বলে সবাই হাসাহাসি শুরু করে দেয়।
তিথির বাবা বুঝতেছেন না কি করবেন।তারপর ভাবলেন একবার তিথির মাকে ডেকে আনলে ভাল হয়।এই বলে তিনি চলে গেলেন ভেতরের রুমের দিকে।

রিদম ব্রাশ মুখে ঢুকিয়ে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল।সোফা দখল করে তিনজন নারীকে দেখে সে থেমে যায়।চোখ ডলে বলে,’আপনারা কি সত্যি এসে বসে আছেন নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?’

‘আমরা তো হুর পরী না বাবা।স্বপ্ন হবার কি আছে?

‘কখন বললাম আপনারা হুর পরী?দেখে তো শাঁকচুন্নি ইয়ে মানে আন্টি মনে হয়।’

শাঁকচুন্নি কথাটা সে গালের ভেতরে রেখেই বললো।কেউ শুনলোনা।শুধু শুনলো রিদম আর গল্পের পাঠকেরা।

বড় খালা বললেন,’তা তোমার নাম কি বাবা?’

রিদম মুখের ভেতর থেকে ব্রাশ বের করে কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বললো,’হ্যালো কিউটিস!আই এম মুখেশ আম্বানি’

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৬+৭

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৬
আফনান লারা

তানিয়া তার কলেজের দোলনায় বাঁদরের মতন ঝুলছিল।কলেজের পিওন আর একজন স্যার এসে ওকে থামানোর চেষ্টা করছেন তাও পারছেন না।সে ঝুলছেই তো ঝুলছেই।
এটা নতুন না।তানিয়া প্রায় সময় এমন করে।তার বাসায় দোলনা নেই,আনলেও একদিনের ভেতরে রিদম সেটাতে ঝুলে ঝুলে দড়ি ছিঁড়ে ফেলে।এদিকে তানিয়ার দোলনার প্রতি অনেক শখ।
তাই কলেজে এসে এই শখ মেটায়।স্যার ওকে বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন।তিথি কলেজে এসে দেখে সব ছাত্রছাত্রী চলে গেছে।শুধু তানিয়া রয়ে গেছে।
তিথি এসে ওর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’তোর যে আর এক মাস পর বিয়ে সে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই?’

এ কথা শুনে তানিয়ে ঝুলতে ঝুলতে পেছনে তাকায়।এরপর বলে,’কিসের টেনসন?আমি বিন্দাস’

‘নাম!’

তিথি জোর করে ধরে নামায় ওকে।এরপর ওকে নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে ফুটপাত দিয়ে চলতে চলতে বলে,’একটা কথা বলবি!রকিবকে তোর ভাল লেগেছে?’

‘খারাপ না।’

‘তোর তো বোকা ছেলে পছন্দ ছিলনা।তোর পছন্দ চালাক চতুর ছেলে।সবসময় বলতি বোকা টাইপের ছেলেরা মায়ের কথায় উঠে বসে, তুই নাকি কখনও বোকা ছেলে বিয়ে করবিনা।এটাও বলতি তোর জামাই হবে হ্যান্ডসাম।আর পেলি মেদ-ভূড়ি হওয়ালা একটা বয়স্ক লোক।আমার চাইতেও অনেক বড়।তোর থেকে তো আরও বেশি বড়।কি করে সংসার করবি?চাপে পড়ে হ্যাঁ বলার কি দরকার ছিল!’

‘আমি চাপে পড়ে করিনি।হ্যাঁ এটা ঠিক যে আমার অনেক চাহিদা ছিল,অনেক স্বপ্ন ছিল জীবনসঙ্গী নিয়ে।কিন্তু সেদিন রকিবের সাথে কথা বলে বুঝলাম সংসারে চেহারা কিংবা অতি চালাক হওয়া ম্যাটার করেনা।সংসার তার সাথেই করা যায় যার কাছে দিনশেষে মানসিক শান্তিটা মিলবে।আমি সেদিন বুঝেছি রকিব আমার জন্য একেবারে ঠিক।জানো টুকু! আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম,কখনও যদি আমার আর তার পার্সোনাল কিছু ঝামেলা ঘটে,সে কথাটা কার সাথে শেয়ার করবে,কিংবা কার কাছে পরামর্শ চাইবে, তখন সে বললো দোষটা আমার হলে সে নিজে নিজে ঠিক করবে আর দোষ তার হলে আমার কাছে এসে পরামর্শ চাইবে।এমন আরও অনেক প্রশ্ন আমি করেছি, শুধু জানতে চেয়েছিলাম সে আজীবন বোকাই থাকবে নাকি সংসার জীবনে এসে সে দায়িত্ব নেয়া শিখবে”

‘তা মানে তুই সিরিয়াস? ‘

‘ইয়েস!’

তিথি খুশি হয়ে তানিয়ার কপালে চুমু খায়।তার ছোট বোন অনেক বড় হয়ে গেছে।চলতে চলতে তারা ফুচকাওয়ালা মামাকে দেখে থেমে যায়।আজ অনেক টক দিয়ে ফুচকা খাবে দুজনে।খাবার সময় তানিয়া বলে ওঠে তিথি তো ওকে বিয়ে দিয়ে হালকা হবে,কিন্তু তিথির বিয়ের কি হবে?’

‘আর মনে করিয়ে দিস না।আদিল যে চিট করেছে,সেটা ভুলতে আমার অনেক দিন লাগবে’

‘আমি তোমায় শুরুতেই বলেছিলাম আদিল ভাইয়া সুবিধার না!’

কথা বলতে বলতে তিথি ফুচকার বিল নিয়ে মামাকে দিতেই উনি বললেন লাগবেনা।তখন তিথি বলে কেন লাগবেনা।সেইসময় মামা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন দূরে একটা ছেলে চলে যাচ্ছে,বিলটা সে দিয়েছে।ছেলেটা হঠাৎ করে এসে ওদের বিলটা দিয়ে চলে গেলো মাত্র।যাবার সময় ইশারা করে গেছে।তিথি আর তানিয়া কথা বলায় এতটাই ব্যস্ত ছিল যে তারা খেয়ালই করে নাই।
তিথি তো ছাড়ার মেয়ে না।সে হাতের ব্যাগ তানিয়ার হাতে ধরিয়ে, দিলো এক ছুট।ছেলেটা পকেটে হাত দিয়ে হাঁটছিল।তিথি ছুটতে ছুটতে ওর অনেকটা কাছে এসে গেছিলো কিন্তু তার আগেই ছেলেটা গাড়ীতে উঠে যায়।গ্লাস কালো রঙের ছিল বলে গাড়ীর ভেতরে তিথি কিছুই দেখেনা।সে বাহিরে থেকে চিল্লাচিল্লি করে কিন্তু গাড়ীর ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয়নি।গাড়ীটা ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
তিথির কাল রাতের কথা মনে পড়ায় সে গাড়ীর নাম্বার চেক করে দেখে এটা অন্য একটা গাড়ী।তবে মনে হয় মানুষ একটাই।
তিথি এবার রাগ করে নিচু হয়ে মাটি থেকে কিছু একটা নিয়ে গাড়ীর ভেতর মারবে বলে ঠিক করে কিন্তু মনে হয় গাড়ীর ভেতরের মানুষটা তার এই স্বভাবের সাথে পরিচিত।সে গাড়ীটা দ্রুত চালিয়ে চলে যায় ওখান থেকে।
তিথি রাগে চেঁচামেচি করতেছিলো একা একা,তখন তানিয়া ওর পাশে এসে বলে,’তোমার কোনো সিক্রেট লাভার আসলো নাকি টুকু?’

এ কথা শুনে তিথির হাত থেকে কঙ্করটা পড়ে যায়।নামটা শুনে মূহুর্তেই তার সারা শরীর কেঁপে ওঠে।তার চোখের সামনে কতগুলো স্মৃতি ভেসে ওঠে আচমকা।
তানিয়া তখন মুখটা মলীন করে বলে,’সরি টুকু। আমার আসলে হঠাৎ মনে আসলো,তাই বলে দিছি।আমি কিন্তু ভুলিনি,তুমি কি ভুলেছো?’

তিথি কিছু বলেনা।রিকশা একটা দাঁড় করিয়ে উঠে পড়ে চুপচাপ।
——-
গাড়ীতে ইশান ছিল এবং তার বড় বোন তামিয়া ছিল।
(তামিয়া নামটা আমার একজন ভক্তের অনুরোধে দেয়া।)

তামিয়া ইশানকে বলে’একবার শাস্তি দিস,দাঁত কেলিয়ে হাসিস।আবার ওকে কেয়ার ও করিস।ঠিক কি চাইছিস?এইসব না করে বড় কোনো শাস্তি দে!যেন জন্মের শিক্ষা পেয়ে যায়।
তিথি কি করেছে তোর সাথে সেটা কি ভুলে গেছোস?তোর উচিত কেয়ার না করে বরাবরের মতন শাস্তি দেয়া।’

ইশান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গাড়ী চালাতে থাকে।
তারপর কি মনে করে গাড়ী থামিয়ে আদিলকে কল দিয়ে তার কাজটা বুঝিয়ে দেয় তাকে।
——
বাসায় আসার পর থেকে তিথির মন ভাল না।কোনো একটা কারণে সে ভার হয়ে বসে আছে।বেশ কিছু সময় পর তার ফোনে একটা কল আসে। অপরিচিত নাম্বার থেকে।
তিথি শুয়ে থেকেই ফোন নিয়ে কানে ধরে।

‘তিথি!’

আদিলের গলার স্বর শুনে তিথি উঠে বসে সঙ্গে সঙ্গে।কলটা কাটতে যাবে তখনই আদিল বলে ওঠে,’কল কাটবানা প্লিজ।তিথি আমি জানি তোমার সাথে আমি খুব খারাপ করেছি।আমায় একটা সুযোগ দেবে নিজেকে শুধরানোর?প্লিস তিথি’

‘সুযোগ তোমায় আমি বহুবার দিয়েছি।আর দিবোনা।এরপর আর আমায় কোনোদিন ফোন দিবেনা তুমি’

‘তিথি একবার শোনো আমার কথা।আমি চাই তোমার সাথে দেখা করে বিষয়টা মিটিয়ে নিতে।প্লিজ একবার দেখা করবে?আমি কথা দিচ্ছি,আমার সব শুনে যদি তোমার কাছে মনে হয় আমি ক্ষমার অযোগ্য,তখন তুমি চলে যেও।আমি আর কখনও তোমায় কল করবোনা’

যতই হোক,এতগুলো বছরের প্রেম।তিথি তো ভালবেসেছিল।তাই আদিলের কথায় সে রাজি হয়।তবে খুশি হয়ে না।আদিল জোর করছে বলেই কাল দেখা করবে বলে ঠিক করে সে।

রকিব তানিয়াকে বিকেলে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলে।এদিকে তানিয়া একা যেতে একটু লজ্জা পাচ্ছিল,বন্ধুবান্ধবের সাথে শত রেস্টুরেন্ট ঘোরা হলেও,একা একটা ছেলের সাথে ঘোরা অন্য বিষয়।
তাই সে তিথিকে নেবে বলে ঠিক করে।
দুই বোন তৈরি হয়ে বেরিয়েও যায়।কিন্তু যাবার পথে মা ওকে থামিয়ে বললেন তিথি যেন রকিবের সামনে না যায়।
কেন বললেন তা তিথি বুঝতে পারলো,কিন্ত তানিয়া বুঝলোনা।সে এর ব্যাখা জানতে চাইছে।তিথি তখন কথা ঘুরিয়ে ওকে নিয়ে চলে আসে ওখান থেকে।
রিকশায় করে দুজনে সেই রেস্টুরেন্টে চলে আসে।তিথি এমন একটা কেবিনে বসে যেখান থেকে তানিয়া,রকিবকে দেখা গেলেও ওরা ওকে দেখতে পাবেনা।
তিথি বসে বসে বোর হচ্ছিল বলে সে একটা নুডুলস অর্ডার করে।
সে কাঁচামরিচ একদমই খেতে পারেনা।খেলেই তার দম বন্ধ হয়ে যায়।এরকম অবস্থা থাকে প্রায় এক দু ঘন্টা ধরে।
এ কথা তিথির কাছের মানুষ ছাড়া আর কেউ জানেনা।
অল্প সময়ের মধ্যে তিথিকে তার অর্ডার করা নুডুলসটা দিয়ে দেয়া হলো।সে নুডুলস পেয়ে মহা খুশি।খুঁজে দেখলো কোথাও কাঁচা মরিচ আছে কিনা।
কিন্তু কোথাও সে পায়নি কোনো মরিচ।নুডুলস সমাান্য সবুজ রঙের কেন সেটা ও জানতে চাইলো ওয়েটারের কাছে।
তখন ওয়েটার বলে এটা ফুড কালার।
তিথি আর সাত পাঁচ না ভেবে প্রথবারেই বড় এক চামচ নুডুলস মুখে দিয়ে চিবিয়ে গিলেও ফেলেছে।
গিলে ফেলার পরই তার মনে হলো ওটা ফুড কালার ছিল না,এরা নুডুলসে কাঁচামরিচ বেটে দিয়েছে।তিথি মাথায় হাত দিয়ে পানির জন্য হাঁপাতে লাগলো।টেবিলে একটু পানিও নেই।তার বুক জ্বলছে আগুনের মতন।মুখের চেয়েও বুক জ্বলাটা তার কাছে বেশি কষ্টের মনে হয়।
তার মাথা ঘুরছে।দম পুরো বন্ধ হয়ে আছে।
সে রেগে চেঁচামেচি করতে করতে বলে,’নুডুলসে কেউ কাঁচামরিচ বাটা দেয়!কেস করবো আমি!ভোক্তা অধিকারের কেস!’

তখন ওয়েটার দুজন এসে বলে এটা ফুড কালার।তিথি তাও চিৎকার করতে থাকে।এরপর ওয়েটার দুজন ওকে দেখিয়ে নুডুলস কয়েক চামচ খেয়েও দেখায়।তিথির নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা।
এরা এত ঝাল কি করে খাচ্ছে!তাহলে সে খেতে পারেনাই কেন!
মরিচ আর ফুড কালারের আকাশ পাতাল তফাৎ!
তিথির মরে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়ে গেছে।
ওয়েটার দুজন মুচকি হেসে চলে গেলো ওখান থেকে।তিথি যে এত পানি পানি করছে তাও কেউ তাকে পানি এগিয়ে দিলোনা।
শেষে আর সইতে না পেরে তিথি কান্না করতে থাকে।কারণ তার পেট জ্বলছিল।
চেঁচামেচির আওয়াজ তানিয়ার কানে পৌঁছায়।সে রকিবকে রেখে ছুটে এসে দেখে তিথির হাল বেহালৃ
সে দ্রুত পানি এনে ওকে খাইয়ে দেয়,তাও তিথির অবস্থার কোনো উন্নতি হয়না।এই সময়ের মাঝে ওয়েটারটা সেইই নুডুলসের বাটি গায়েব করে ফেলেছে।
তানিয়া ভয় পেয়ে গেলো,সে কি করবে না করবে।সে আরও পানি আনতে ছুটলো অন্যদিকে।তখন সেখানে তিথির সামনে এসে দাঁড়ায় ইশান।মুখে আগের মতন মাস্ক লাগানো।
এই সব কিছু ইশানেরই করা।
তিথি ইশানকে খেয়াল করেনি।সে ঝালে মাথা ঠোকড়াচ্ছে টেবিলে।
ইশান কাছে এসে তিথির মুখ টিপে ধরে।তিথি চোখ বন্ধ করে পানি পানি করছিল।
ইশান ওমনি তিথির মুখ খুলে ওর মুখের ভেতর আঙুল দিতেই তিথি ঐ জায়গাতেই বমি করে দেয় সবার সামনে।
বমির পরেই তার যত হাঁপানি সব আস্তে আস্তে থামে।পেটে যে জ্বালা করছিল সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
তিথি টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে ইশানের দিকে তাকায়।ইশান এক বোতল পানি ওর সামনে রাখে এরপর ওখান থেকে চলে যায়।
তিথি কিছুই বলেনা।শুধু তাকিয়ে থাকে।সেই অজ্ঞাত ছেলেটা আর ইশানের মাঝে কি কোনো যোগসূত্র আছে!
হাঁটা চলা,ভঙ্গিমা সব এক রকম মনে হয় তাদের দুজনের।

ইশাম যাবার সময় ওয়েটারের হাতে টাকা দিয়ে চলে যায়।কাজটা সে করিয়েছিল।তিথিকে কাতরাতে দেখতো তার আনন্দ লাগে!ভীষণ আনন্দ।
চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৭
আফনান লারা

তানিয়া পানির বোতল নিয়ে ছুটে আসছিল তখনই তার ধাক্কা লাগে ইশানের সাথে।ইশান তানিয়াকে দেখে চোখ ঢাকার চেষ্টা করে কিন্তু তানিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ‘ইশতিয়াক ভাইয়া!’

এটা শুনে ইশান চলে যাওয়া ধরে কিন্তু তখনই তানিয়া ওর পথ আটকে দাঁড়ায়।ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সে।
ইশান বুঝে যায় তানিয়াকে ধোঁকা দেয়া যাবেনা।
তানিয়া বলে,’আপুর স্মৃতি শক্তি কম হলেও আমার অনেক বেশি,এটা তুমি জানো ভাইয়া!পালানোর কারণ কি?পালাবো তো আমরা!’

ইশান ভাবে এখন তানিয়ার কাছে সব স্বীকার করলে তার যত পরিকল্পনা আছে সব বাতিল হয়ে যাবে।তাই সে তানিয়াকে সরিয়ে দ্রুত চলে গেলো।কোনো কথাই বললোনা।
তিথি মাথায় হাত দিয়ে তখন তানিয়ার কাছে এসে দাঁড়ায়।ইশানকে চলে যেতে দেখে সে বলে,’এই ছেলেটা আমাকে অনেক ডিস্টার্ব করে জানিস!’

‘তাকে চিনো আপু?’

‘চিনবোনা কেন!আমার ভার্সিটিতে নতুন এসেছে’

‘ওহ!তার মানে এই টুকুই চেনো!’

‘আর কি চিনবো?তবে জানিস!ওর চোখটা কার সাথে যেন মেলে!আমার ঠিক মনে পড়ছেনা।তোর কি মনে পড়ে?আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের কারোর এমন চোখ ছিল?আমার পেটে আসছে কথা কিন্তু মুখে আসছেনা’

তানিয়া বুঝে গেছে ইশান চায়না সে তিথিকে ওর পরিচয় জানাক।তাই তানিয়া আর বেশি কিছু বলেনি তিথিকে।
এরই মাঝে রকিব তিথিকে দেখে অবাক হয়ে যায়।দুজনের চেহারায় এত মিল।তিথি একদম ছবির সে মেয়েটির মতই।
রকিব তব্দা খেয়ে বসে আছে।তখন তিথি বলে ‘সরি,এতদিন পরিচিত হইনি।আমি তিথি, তানিয়ার বড় বোন’

‘ওহ আচ্ছা,এবার বুঝলাম।আপনাকে কাল দেখিনি’

‘আসলে আমি বাসায় ছিলাম না।আচ্ছা আপনারা কথা বলুন।আমি আসি’

তিথি তানিয়াকে থাকতে বলে সে চলে যায়।
বাহিরে এসে ইশানকে চারিদিকে খোঁজে।এরপর দেখা হলে গলা টিপে সব কথা সে বের করে নিবে।
কোমড়ে হাত দিয়ে ওসবই ভাবছিল তিথি,
সেসময় তার সামনে এসে দাঁড়ায় মিয়াজুল করীম আঙ্কেল।
ইশান দূর থেকে তিথিকে দেখছিল এতক্ষণ। ওমনি মিয়াজুল আঙ্কেলকে দেখে তার মাথা হেট হয়ে যায়।কি করে সে এই আপদ দূর করবে তাই ভাবে এবার।

‘তিথি মা কেমন আছো?’

তিথি কোমড় থেকে হাত ছাড়িয়ে চোখ বড় করে তাকায়।অনেকক্ষণ দেখার পরেও সে চিনতে পারেনা।
এরপর আঙ্কেল বললেন,’ওহ হো!তোমার তো আবার ভোলার স্বভাব আছে,আরে আমায় চিনতে পারছোনা?তোমার বান্ধবী সনির বাবা আমি’

‘সনি?সনি সনি!ওহ মনে পড়েছো।ঐ যে সব সাবজেক্টে ফেল করতো।সেই সনি?’

‘হ্যাঁ।এই তো চিনতে পারলে!ইশাননন……’

এটা বলতেই দুটো লোক এসো মিয়াজুল আঙ্কেলকে দুপাশ থেকে ধরে তিথির সামনে থেকে নিয়ে গেলো।তিথি ভাবছে আঙ্কেল ইশানের নাম নিলেন কেন!

লোক দুটোকে ইশান পাঠিয়েছিল।আর একটু থাকলেই আঙ্কেল হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিতো, কি একটা ঝামেলা!সব জায়গায় গিয়ে হাজির হয়ে যায়।
তিথি মুখ ঘুরিয়ে ইশানকে খুঁজতে থাকে।কিন্তু কোথাও না পেয়ে সে একাই রিকশাতে উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, আঙ্কেল ইশানের নাম নিলো কেন!কোন ইশান!
———-
ঐদিন মিয়াজুল আঙ্কেলকে ইশান তিথির অসুস্থতার দোহায় দিয়ে বাসায় আনা রোধ করেছিল।তারপর আঙ্কেলকে হোটেলে এনে কিছু খাইয়ে ভুলভাল বুঝিয়ল বিদায় ও করেছিল সে।
এসব ভাবতে ভাবতে ইশান ফোন বের করে আদিলকে কল দিয়ে বলে কাল যেন কাজটা সে ঠিক ঠাক করতে পারে।
ফোন রাখতেই ইশানের মায়ের কল আসে।
ইশান ভয়ের কারণে ধরতে চায়নি কিন্তু না ধরেও যে উপায় নেই।রিসিভ করতেই হলো।রিসিভ করতেই মা জানতে চাইলেন সে কোথায়।
তখন ইশান জানায় অফিসের কাজে বাহিরে এসেছে।মা ওকে বেশি কিছু বললেন না শুধু বললেন সে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে।তিনি ওকে দেখতে চান।

এদিকে মাথা ফাটার দাগ,দাগের জায়গাতেই স্থির।এই দাগ দেখলে মা কত হাজার প্রশ্ন যে করবেন,অসুস্থ ও হয়ে যেতে পারেন।
এদিকে মানাও করা যাবেনা।মা মুখ ফুটে যেতে বলেছেন যখন।
———
মাথায় একটা ক্যাপ পরে ইশান বাসায় ফিরে মায়ের সামনে আসে।মা ওকে দুইদিন না দেখে কান্নাকাটি করতে করতে ওকে জড়িয়ে ধরেন।এরপর জানতে চান সে কোথায় ছিল। কেন বাসায় ফেরেনি।
ইশান মায়ের পিঠে হাত রেখে তিথির কথা ভাবছিল।এই এক নারী তার মাকে কাঁদিয়েছিল,এই এক নারী তার জীবন তছনছ করেছিল।এবং এই এক নারীকেই সে সম্ভব ভালবেসেছিল!
তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।চোখ মুছে সে মাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
মা ওর হাত ধরে রেখে সোফায় বসে বললেন,’তোর ফুফাতো বোন মুনিয়া এসেছে।তোকে দেখার জন্য কত অপেক্ষায় ছিল।কিন্তু তুই তো আসছিসই না!সারপ্রাইজ দিবে বলে সে একবার কল ও করেনি। যা ওর সাথে গিয়ে কথা বলে আয়,আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে’

ইশান মাথা নাড়িয়ে চলে যাওয়া ধরতেই মা ওর হাতটা ধরে ফেললেন।এরপর ওর হাতে তিনি একটা আংটির বক্স দিলেন।
ইশান প্রতিমাসে মায়ের একাউন্টে অনেকগুলো টাকা ট্রান্সফার করে।সেই টাকা থেকে মা এই আংটিটা কিনেছেন।হীরের আংটি।
আংটির বক্সটার দিকে চেয়ে রইলো ইশান।তখন মা বললেন,’ওকে আজ পরিয়ে দিবি।আমি চাই তুই মুনিয়াকে বিয়ে করে সংসার জীবনে পা রাখ।আমার বিশ্বাস মুনিয়া তোর জীবনটাকে পূর্ণতা দেবে।’

ইশান কিছু বলেনা।বক্সটা নিয়ে তার রুমে চলে আসে।আসতেই দেখে তার বারান্দায় মুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে তার খোলা চুলগুলো উড়ছিল।সে অন্যমনস্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।
ইশান আস্তে করে রুমে ঢুকে বক্সটা তার আলমারিতে রেখে দেয়।এরপর সে চলে আসে তামিয়ার রুমে।মুনিয়া তখনও কিছুই টের পায়নি।
ইশান তামিয়ার রুম থেকে একটা আংটি নিয়ে ফেরত আসে আবার।এরপর মুনিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
মুনিয়া ইশানের গায়ের গন্ধ পেতেই চোখ বুজে অন্যদিকে ফিরে যায়।
তখন ইশান বলে,’লজ্জা পেলে তোর লস।এই রিং কিন্তু পাবিনা’

তখন মুনিয়া আড় চোখে ইশানের হাতের দিকে তাকায়।তার হাতে একটা রিং ছিল।
সে হাতটা বাড়িয়ে ধরে ওর দিকে।ইশান মুচকি হেসে রিংটা বারান্দার রেলিংয়ের উপর রেখে বলে,’কোনো নারীর অনামিকা আঙ্গুলে রিং পরানোর কারণ জানিস?এর ভিন্ন ব্যাখা আছে তবে আমি যে ব্যাখা জানি সেটাই বলছি।।।নারীর অনামিকা আঙ্গুলে রিং পরানো মানে তাকে জীবনসঙ্গী করার প্রথম ধাপে সই করছি।’

এই বলে ইশান রিংটার দিকে ইশারা করে বলে,’রিংটা পরে নে’

‘তুমি পরিয়ে দেবেনা?’

‘আমি তো তোকে জীবনসঙ্গী বানাতে চাইনা,তাহলে ১ম ধাপের সই কেন করবো?’

এটা বলে ইশান তার রুমে চলে আসে।মুনিয়া সেই রিং নিয়ে ইশানের সামনে এসে দাঁড়ায়।ওর হাতটা ধরে বলে,’আমি চাই তোমার স্ত্রী হতে, করবেনা?তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো?’

‘সেটা তোর জানার বিষয় না।রিং দিয়েছি,নিজে নিজে পর ইচ্ছে হলে।’

এটা বলে ইশান তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।মুনিয়া রিংটা নিজে নিজে পরে বের হয়ে আসে।তখন ইশানের মা ডাইনিং টেবিল সাজাচ্ছিলেন। মুনিয়াকে দেখে তিনি বললেন,’কিরে?ইশান কোথায়?’

‘ওয়াশরুমে’

‘মন খারাপ কেন?রিং পরায়নি?’

এটা বলে তিনি মুনিয়ার হাত ধরলেন।কিন্তু তার কেনা রিং আর এই রিংয়ের কোনো মিল তিনি পেলেন না।মুনিয়া রোবটের মতন দাঁড়িয়ে ছিল।
ইশানের মা ভাবছেন তাহলে তার রিংটা ইশান কার জন্য রেখেছে।

ইশান মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আলমারি থেকে সেই রিংয়ের বক্সটা বের করে তার কোটের পকেটে ভরে রাখে।কাল এই রিং তার আসল মালিকের কাছে যাবে।
ক্যাপটা পরে মুচকি হাসি দিয়ে ইশান পেছনে তাকাতেই দেখে তার মা দাঁড়িয়ে।

‘রিংটা কাকে দিবি তুই?’

‘কাউকে না’

‘তাহলে মুনিয়াকে দিলিনা কেন?’

‘সে রিংটার যোগ্য না’

‘ তাহলে কে যোগ্য?আচ্ছা,তুই কি এখনও তিথির কথা ভাবছিস ইশান?তার জন্য রেখেছিস?’

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-৪+৫

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৪
আফনান লারা

তিথি হাতে এতটাই ব্যাথা পাচ্ছিল যার কারণে সে ইশানের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় তৎক্ষনাৎ।কিন্তু তার এই কাজে যেন ইশান একটা সুযোগ পেয়ে যায়।ওমনি সে গাড়ীটা স্টার্ট দিয়ে তিথির চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো।
তিথি হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ইশানের চোখ দুটো কল্পনা করছে।ওর মাথার রক্তের কারণে চোখ দেখেও আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি তিথি।তবে খারাপ লাগলো সে অনেক বেশি আঘাত দিয়ে ফেলেছে ভেবে।
তার এই হাতের ব্যাথার কাছে ঐ ছেলের মাথা ফাটা আরও অনেক বেশি!
তিথি ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল,ওমনি তার হাতের ফোনটা বেজে ওঠে।বাবার নাম্বার থেকে কল।
তিথি শুরুতে ভয় পেয়ে যায়।সুরাইয়াদের গেইটের পাশে থাকা সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে ঢোক গিলে সে কলটা রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে বাবা বলে উঠলেন,’তিথি মা!মাফ করে দিয়েছি।চলে আয়’

‘সত্যি বাবা?আবার জোর করবেনা তো?’

‘জোর করতে যাবো কেন!তোর বোন তানিয়াকে রকিবের পরিবার পছন্দ করেছে,এখন তারা আমার ছোট মেয়েকেই বউ করে নিয়ে যাবে বলে সকলে সম্মতি দিয়ে রিং পরিয়ে চলে গেছে’

তিথি মাথায় হাত দিয়ে ফেললো এ কথা শুনে।রিদমের মুখ থেকে তানিয়ার কৃতকলাপ শুনে সে ভেবেছিল তানিয়া ঠাট্টা করছে।কিন্তু সে যে এরকম সত্যি সত্যি বিয়েটা পাকাপোক্ত করে নেবে তা তিথি কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি।
যাই হোক!এক দিক দিয়ে ভালই হলো।তিথিকে আপাতত কয়েক মাস কেউ জোরাজুরি করবেনা বিয়েতে।
এই খুশিতে তিথি এক ছুটে সুরাইয়ার বাসায় ঢুকে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে ভাবে সে এখন গেলে এত বড় বাসার দরজা লক করবেটা কে!
পরে তার মনে পড়লো সুরাইয়া তিথিকে একটা এক্সট্রা চাবি দিয়ে গেছিলো,প্রয়োজনে বের হতে চাইলে যাতে বের হতে পারে।তাই সে ঐ চাবি দিয়ে বাসার দরজা লক করে বের হয়।কিন্তু এত রাতে রাস্তায় একটা রিকশাও তার চোখে পড়েনা।তিথি মনে মনে ভাবছিল ইশানের কথা,ওমনি তার সামনে এসে দাঁড়ায় ইশানের গাড়ী।তিথি ভয় পেয়ে যায় প্রথমে তারপর নিজেকে ঠিক করে সে গাড়ীর ভেতর তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে।গাড়ীতে এখন অন্য একটা লোক বসা।
লোকটা তিথির দিকে চেয়ে বললো উঠতে।তিথি তখন মানা করে দেয়।তখন সেই লোকটি বলে তাকে বলা হয়েছে তিথিকে তার বাসায় দিয়ে আসার জন্য।
কিন্তু তিথির ভয় হতে লাগলো তাই সে নাকচ করে দেয় আবারও।সে কিছুতেই যাবেনা।
তিথির এতবার করে মানা করে দেয়ায় গাড়ীটা চলে যায়।এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর একটা সিএনজি আসে সেই রোড দিয়ে।তিথি খুশি হয়ে ঐ সিএনজিটাই ভাঁড়া করে।
কিন্তু সে জানেনা সিএনজিটা ইশানের পাঠানো।
সিএনজিতে করে তিথি তার বাসায় পৌঁছায় খুব দ্রুত।সেখানে এসে দেখে সকলের মুখে মুখে হাসি।এভাবে তাদের সম্মান বেঁচে যাবে তারা কেউই ভাবতেই পারেনি।পাত্রপক্ষ চলে গেছে একটু আগে।
তানিয়া নতুন বউয়ের মতন বসে বসে হাতের আংটিখানা দেখে চলেছে।তিথিকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছেনা।তিথি মুখ বাঁকিয়ে তার রুমে যাওয়া ধরতেই দেখে রুমটা ভেতর থেকে বন্ধ।
দরজায় লেখা—–
“”””
আপনি ভু্ল জায়গায় এসেছেন।এই রুমটি এখন আর আপনার নেই।মনে আছে? আজ সকালে এগারোটা বারো মিনিটে সই করেছিলেন?দলিল দেখতে হলে ৫ চাপুন।দলিল দেখতে না হলে ৩ চাপুন। আর রুমে থাকতে হলে পা চাপুন’

তিথি দরজা ধাক্কিয়ে বললো,’এই রিদইম্মা!বাদাইম্মা!দরজা খোল!আমার ঘুম আসতেছে’

রিদম তখন বলে,’সরি!এখানে রিদম নামের কেউ থাকেনা ‘

তিথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’মহারাণী ভিক্টরিয়ার নাতিন !দরজা খুলেন প্লিজ!’

ওমনি রিদম এসে দরজা খুলে বলে,’দলিলে লেখা আছে তুমি যদি বাসায় আবার ফিরে আসো তবে আমার পা টিপে দিবা ডেইলি পনেরো মিনিট।আর আমাকে রুহ আফজা মিল্ক শেক বানিয়ে খাওয়াবা সপ্তাহে সাতদিন’

‘করবো রে ভাই।থাম! ‘

এটা বলে তিথি রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে।শুতেই তার চোখে রাজ্যের ঘুম এসে যায়।
সকালে তিথির ঘুম ভাঙ্গে সুরাইয়ার কলে।তিথি ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই সুরাইয়া বললো আজ তাদের ইংরেজী ক্লাসে ম্যাম নাকি যারা অনুপস্থিত থাকবে তাদের সাময়িক পরীক্ষায় নাম্বার কমিয়ে দেবে।এটা শুনে তিথি লাফ দিয়ে উঠে বসে।তারপর ঘড়িতে দেখে আর আধ ঘন্টা আছে ম্যামের ক্লাস শুরু হবার বাকি।

তিথি জলদি উঠে ওয়াশরুমের দিকে ছোটে।দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে টেবিলের উপর থেকে ব্রেড আর কলা একটা নিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সে বেরিয়ে যায়।যাবার সময় দেখা হয় বাবার সাথে।বাবা ওর একটু আগেই বেরিয়েছিলেন অফিসের জন্য।বাবা তিথিকে বললেন বাইকে উঠতে। তিনি ওকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেবেন।

যাবার অনেকটা পথে বাবা চুপই ছিলেন।তিথি মনে করলো বাবা তার উপর রাগ করে আছেন।তাই কিছু সময় পর সে বললো,’আচ্ছা বাবা তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’

‘নাহ রে মা’

‘সরি বাবা’

‘ইটস ওকে।তুই তো জানিসই আমি তোকে সব স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি।তাও কাল ভয় পেয়ে গেছিলাম।রকিবের পরিবারের সামনে কি করে মুখ দেখাবো সেইসব ভাবতে গিয়ে।কিন্তু আমার তানিয়া মা আমার মান রাখলো।এখন তোকে একটা কাজ দেবো।তানিয়া আসলে আমাদের সম্মান বাঁচাতে রকিবকে বিয়ে করতে চায় নাকি নিজের মতেই চায় সেটা তোকে জানতে হবে।জানিস তো,তানিয়া একটু অন্যরকম,ছোট কাল থেকেই। ওর মন বুঝতে আমার বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়।তাও বুঝিনা তার মনের ভেতর কি আছে।তুই মা আমার এই কাজটা করে দিবি?’

‘দেবো।করে দিলে,কি দিবে বলো?’

‘তোর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিবো তোকে’

‘পছন্দ নেই বাবা’

তিথির মলীন মাখা সুরের কথাটি শুনে বাবা বললেন,’কেউ কষ্ট দিয়েছে মা?তবে একটা কথা শুনবি?কেউ যখন কারোর হৃদয় ভাঙ্গে,ঠিক তখনই অন্য একটা জায়গায় অন্য একটা মানুষের হৃদয় তৈরি হয় এই ভাঙ্গা হৃদয়টাকে জোড়া লাগাবার জন্য।তোর জন্য ও তাই আছে।ভাবিস না’

তিথি খুশি হলো বাবার কথা শুনে।খুশি মনে সে তার ডিপার্টমেন্টে আসা ধরতেই দেখে ম্যাম আসছে এদিকেই। এটা দেখে তিথি খুব দ্রুত ঢুকতে যায় ক্লাসে, ওমনি তার সাথে ধাক্কা লাগে একটা ছেলের।
ধাক্কা খেয়ে তিথি তার কালকে রাতের হাতের চোটে ব্যাথা পায়।তারপর বিরক্ত হয়ে বলে,’দেখে হাঁটতে পারো না!’

এটা বলে সে তাকিয়েই ছিল।কিন্তু যে ছেলেটা তাকে ধাক্কা দিয়েছে সে ওর দিকে আর তাকায়নি।সোজা গিয়ে একটা সিটে বসে পড়ে।তিথি হাত ঘঁষতে ঘষতে এসে সুরাইয়ার পাশে বসে আবারও তাকায় ছেলেটার দিকে।ছেলেটির মুখে মাস্ক ছিল।তখন তিথির মনে পড়ে সাবিনা ম্যাম মাস্ক নিয়ে অনেক কথা শোনান।এটা মনে পড়ায় সে ব্যাগ হাতায় কিন্তু কোনো মাস্ক পায়না,তার স্পষ্ট মনে আছে সে তার ব্যাগে মাস্ক সবসময় রাখে।

তিথি যখন এসব ভাবছিল তখন সেই ছেলেটা তার হাতে থাকা তিথির নীল রঙের মাস্কটা জানালা দিয়ে ফেলে দেয়।
তিথি তার মাস্ক ব্যাগের বাহিরে পিন দিয়ে আটকে রাখে।ছেলেটা তখন ধাক্কা দেয়ার সময় মাস্কটা নিয়ে নিছিলো।
সাবিনা ম্যাম ক্লাসে ঢুকে পুরো ক্লাসরুমে চোখ বুলিয়ে দেখলেন তিথি বাদে সবাই মাস্ক পরে এসেছে।
তখন ম্যাম ওকে দাঁড়াতে বললেন।

‘কি ব্যাপার তিথি?মাস্ক পরোনি কেন?’

‘ম্যাম মাস্ক আনতে ভুলে গেছি।আমার ব্যাগেই ছিল!কিন্তু এখন পাচ্ছিনা’

‘পুরোনো বাহানা।যাই হোক ক্লাস থেকে বের হও।বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো ক্লাস এটেন্ড করবে’

তিথি মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলো।
ম্যাম বই বের করে পড়ানোতে মন দিয়েছেন।সেই ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকিয়ে ছিল।তার চোখে তিথির এই হাল দেখে আনন্দ ফুটছিল। সে এতটাই খুশি হচ্ছিল যে তার জোরে জোরে হাসতে মন চাইলো কিন্তু সে হাসবেনা!কাউকে বুঝতে দেয়া যাবেনা সে ইচ্ছে করে তিথিকে বকা খাইয়েছে ম্যামকে দিয়ে।
তিথি গাল ফুলিয়ে রেখে ম্যামের দিকে তাকিয়ে আছে।এভাবে আর কত তাকানো যায় বলে সে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আজ কারা কারা এসেছে।সবাইকে চিনলেও একটা ছেলেকে সে চিনতে পারলোনা।সেই মাস্ক পরা ছেলেটা।তখনই ম্যাম এটেন্ডেন্স ডাকলেন সে ছেলেটার।নাম ইশান আরাফাত।ম্যাম এটাও বললেন ইশান নতুন স্টুডেন্ট।
তিথি চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ছিল।ছেলেটা তখন ওকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে এটা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল।
ম্যামের ক্লাস শেষ হবার পর তিথি এসে সুরাইয়ার পাশে বসে।তখন সুরাইয়া তার কালকে রাতের লং ড্রাইভ নিয়ে কথা বলা শুরু করে।তিথির মন সেদিকে নয় বরং ইশানের উপর ছিল।কিন্তু ইশান এমন ভাবে তার পাশের ছেলেটার সাথে কথা বলছে যেন সে জানেই না তিথি তার দিকো তাকিয়ে আছে কিন্তু সে বেশ জানে তিথি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।জেনেশুনেও না জানার ভান করে সে পাশের ছেলেটির সাথে তার কলেজ লাইফ নিয়ে কথা বলছে।
ছেলেটির নাম রাজু।রাজু ইশানের কাছে জানতে চায় সে কোন কলেজে পড়েছে।ইশান যখন কলেজের নাম বলে তখন ছেলেটি আশ্চর্য হয়ে যায়।এত বড় কলেজ থেকে পড়ে এসে ইশান কিনা এই ভার্সিটিতে ভর্তি হলো, তখন রাজু জানতে চাইলো সে কি চান্স পায়নি ভাল ভার্সিটিতে।
ইশান মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,’নাহ পাইনি।আমি দূর্বল ছাত্র’

‘দূর্বল ছাত্র হলে এতো বড় কলেজে পড়লে কিভাবে?’

‘তখন মেধাবী ছিলাম।এখন দূর্বল হয়ে গেছি। অনেক দূর্বল!’

এটা বলে ইশান পেছনে ফিরে তিথির দিকে তাকায়।তিথি সেইসময় সুরাইয়ার ফোনে ওর ছবি দেখছিল।
চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৫
আফনান লারা

সাবিনা ম্যামের ক্লাস শেষ হয়ে যাবার পর ছিল মিজান স্যারের ক্লাস।সম্ভবত স্যার আজ আসবেননা।পঁয়তাল্লিশ মিনিটের এই ক্লাসটি তাই অনেক বেশি বোরিং হয়ে গেছে।তিথি সুরাইয়াকে বললো তারা ক্যানটিন থেকে ঘুরে আসবে।কিন্তু তিথিদের ভার্সিটির নিয়ম হলো ক্লাস টাইমে কেউ ক্যানটিন কিংবা ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করতে পারবেনা।
এখন যেহেতু স্যারের ক্লাস নেই,তারা যেতেই পারে।এই ভেবে ওরা দুজন বেরিয়ে গেলো।
ইশান মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোন বের করে ডিপার্টমেন্টের অফিস সহকারী কামালকে কল দেয়। কল দিয়ে খবরটা সে সাবিনা ম্যামের কাছে জানাতে বলে,নিজের পরিচয়টা দেয়না আর।
ঠিক তাই হলো।কামাল সোজা গিয়ে সাবিনা ম্যামকে বলে এসেছে ক্লাসের কিছু স্টুডেন্ট ক্লাস টাইমে বাহিরে আড্ডা দিতে গেছে।ম্যাম তো রেগে আগুন।
ম্যাম সোজা ক্লাসে ছিলেন এরপর জানতে চাইলেন ক্লাসে কারা উপস্থিত নেই।
একজনে জানিয়ে দিলো ওটা তিথি আর সুরাইয়া।
ম্যাম নাম শুনে যাবার সময় বলে গেলেন ওরা আসলে যেন ডিপার্টমেন্টের অফিসে যেতে বলে।
তিথি আর সুরাইয়া ক্যানটিনে বসে চাউমিন খেয়ে খুশি মনে ক্লাসে আসতেই জানতে পারে ম্যাম ওদের ডেকেছে।
তিথি কিছু বুঝতে না পারলেও সুরাইয়া আন্দাজ করে নেয় তারা যে ক্লাসে ছিল না তাই হয়ত ম্যাম শাস্তি দেবে বলে ডেকেছিল।সে ভয়ে চুপসে যায়,এদিকে তিথি বলে এ কারণে না।ক্লাসে তো স্যার আসেনি তবে বের হলে কি সমস্যা!
সে বেশ সাহস নিয়ে ডিপার্টমেন্টোর অফিস রুমে আসে।
ম্যাম তখন একটা ছেলেকে ঝাড়ি দিচ্ছিল।ওদেরকে দেখে ছেলেটাকে বিদায় করেন তিনি এরপর তিথির দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমরা কি ভার্সিটির রুলস গুলা সব ভুলে গেছো?’

ওমনি সুরাইয়া কানে ধরে বললো,’ম্যাম সরি,আর এমন হবেনা’

‘ভুল করে সরি বলে কোনো লাভ নেই আমার কাছে।আজ যে এসাইনমেন্ট আমি দিয়েছি সেটা ডাবল লিখে আনবে,ফটোকপি দিতে পারবেনা।যাও এখন’

তিথি মন খারাপ করে ক্লাস থেকে বের হতেই দেখে ইশান নামের ছেলেটা অন্যদিকে মুখ করে হাঁটা ধরেছে।এতক্ষণ সে এখানেই ছিল।
তিথি সুরাইয়াকে ক্লাসে যেতে বলে সে ইশানের পিছু পিছু এসে দ্রুত হেঁটে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।
ইশান ভাবেনি তিথি হঠাৎ সামনে চলে আসবে।সে মাথা নিচু করে রাখে।তিথি হাত ভাঁজ করে বলে,’তোমার বাসা কোথায়?’

‘গুলশান’

‘গুলশান?এতদূর থেকে আসো?’

‘হ্যাঁ’

‘কিসে করে আসো?’

‘কা…. নাহহহ,বাসে করে আসি’

‘বাসে আসতে তো পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবার কথা।তুমি রওনা হও কখন?আচ্ছা তোমার কপালে কি হয়েছে দেখি’

ইশান হাত দিয়ে কপাল ঢাকতে ঢাকতে বলে,’জন্মদাগ’

‘জন্মদাগ?দেখে তো নতুন দাগ মনে হলো।কিভাবে ফাটলো?’

‘ফাটেনি।এটা জন্মদাগ’

‘বয়স কত তোমার?ফেইল করেছো কলেজে?তোমাকে কেমন বড় বড় লাগে’

‘২৩বছর’

‘আমার তো মনে হয় সাতাশ বছর।মাস্ক খুলো তো!তোমাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে’

ওমনি ইশান ওখান থেকে চলে যায়,আর একটা কথাও না বলেই।তিথির সন্দেহ আরও গাঢ় হয় তখন।ছেলেটাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন!
সুরাইয়ার ডাকে তিথির মন ঘুরে যায়।সে চলে যায় ওর কাছে।এদিকে ইশান যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।আরও সাবধানে থাকতে হবে।কিন্তু ম্যামের শাস্তিটা আরও কঠিন হলে ভাল লাগতো।এত সহজ শাস্তিতে তো মন ভরছেনা!

ভার্সিটি ছুটি হবার পর তিথি ভাবলো একবার তানিয়ার কলেজে গিয়ে ওকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরবে।তাই সে বাহিরে বেরিয়ে বাসের অপেক্ষা করছিল, ইশান সবেমাত্র তার গাড়ীতে উঠবে ওমনি তার আর তিথির চোখাচোখি হয়।তিথি আর একটুর জন্য ওকে ধরে ফেলতো কিন্তু তার আগেই ইশান তার গাড়ী থেকে দশ হাত সরে দাঁড়ায়।
তিথি গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে যায় আবার।এটা অন্য রঙের গাড়ী ছিল।কালকের গাড়ীটাতে তো তিথি ইট দিয়ে নাজেহাল করে রেখে দিয়েছে।
তিথি ওদিকে চোখ বুলাতে যেয়ে আবার ইশানকে দেখে ফেলে।তারপর একটু এগিয়ে বললো,’কি হলো বাসে উঠবে না?’

ইশান এ কথা শুনে ভয় পেয়ে যায়।সে ভাবে তিথি বুঝে গেলো নাকি সব!কিন্তু তখনই তিথি সামনের বাসটাতে ওঠার সময় বললো,’এটা মনে হয় গুলশানের একটু আগে যাবে,চলো’

এই বলে রীতিমত জোর করেই সে ইশানকে বাসে ওঠায়।ইশান ওর পাশে বসে পকেট হাতাচ্ছিল।তার কাছে কার্ড বাদে খুচরো পয়সা নেই।তিথির সাথে টেক্কা দেয়া যে কঠিন তা সে জানতো,কিন্তু এত কঠিন তা জানতোনা।ইশান বারবার এদিক সেদিক করছিল বলে তিথি জানতে চাইলো কোনো সমস্যা কিনা।তখন ইশান না বলে চুপ করে থাকে।একটু পরেই কন্ডাকটর আসলো ভাড়া নেয়ার জন্য।ইশান না পারছে কার্ডের কথা বলতে আর না পারছে তার কাছে টাকা না থাকার কথা বলতে।তিথি তার ভাড়া বের করে দিয়ে দিয়েছে,ইশান দিচ্ছেনা বলে সে কিছু বলতে যাবে ওকে ওমনি পিছনের সিট থেকে আদিল হাত বাড়িয়ে ইশানের ভাড়াটা দিয়ে দেয়।
ইশান পেছনে ফিরে আদিলকে দেখে মুচকি হাসে।আদিল যে এ বাসে উঠেছে তা ওরা কেউই জানতোনা।তিথি তো আদিলকে দেখে রেগে আগুন।সে ইশানের কাছে জানতে চাইলো ও আদিলকে চেনে কিনা।ইশান কিছু বলার আগেই আদিল বললো,’আমার ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট হয়”

‘তোমার ছোটভাই আমার থেকে এক বছরের ছোট।তার ক্লাসমেট এই বুইড়া বেটা?’

‘বুড়ো কোন বলছো!ইশান আমার চাইতেও ইয়াং”

‘আমি চোখ দেখেই বয়স বলে দিতে পারি।যাই হোক তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।আগে যদি জানতাম তুমি এই ছেলের পরিচিত তবে এই ছেলেটার সাথে আমি কোনো কথা বলতাম না’

এট বলে তিথি বাস থামাতে বলে।কিন্তু বাস তখন এমন রোডে ছিল যে থামানোর প্রশ্নই আসেনা।
তিথি তাও দাপট দেখিয়ে চলন্ত বাস থেকে নামার চেষ্টা করে।ইশানকে হটিয়ে নিচে পা রাখতে যেতেই বাসের গতির সাথে না পেরে হোচট খায় সে।আদিল উঠে গেছিলো ওকে ধরার জন্য কিন্তু ইশানই বোধহয় তিথির জন্য যথেষ্ট।

ইশান এক হাতেই তিথিকে ধরে ফেলেছে।তবে যেভাবে ধরেছে সেটা তিথির পছন্দই হয়নি।সে হাতটা সরিয়ে ইশানের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বললো,’আর কোনোদিন টাচ করলে!!’

এরপর সে চলে যায়।আদিল এসে ইশানের পাশে বসে তখন ।
ইশান আদিলের ঘাড়ে হাত রেখে বলে,’তুমি টাচ করেছিলে কখনও?’

‘না স্যার’

‘অনেক ঝাঁঝালো হয়ে গেছে তিথি’

‘আগে কেমন ছিল স্যার?’

‘আগে নম্র ছিল,মুখ দিয়ে কথা বের হতোনা।আর এখন সে পুরোটাই বদলে গেছে। আগেকার তিথি আর এখনকার তিথির মাঝে আমি আকাশ পাতাল তফাৎ দেখি।তবে এই রুপটাই ভাল,গেমস খেলতে দারুণ লাগছে আমার’

‘কিন্তু স্যার বিপদ তো বাঁধিয়ে ফেললেন।মাথা কতটা ফেটে গেছে।বড় ম্যাডাম দেখলে কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বানিয়ে দেবেন’

‘আর তাই কাল রাত থেকে আমি বাসায় ফিরিনি।হোটেলে ছিলাম।এখনও হোটেলেই যাবো।তোমায় আরেকটা কাজ দিবো।সেটা আগামীকাল করবে।আমি টেক্সট করে জানিয়ে দিবো।কাজটা সাবধানে করবে।’

‘ঠিক আছে স্যার’

কন্ডাকটর ওদের দুজনের কথা শুনলো।আর ভাবলো এতক্ষণ আদিল ইশানকে তুই তুকারি করে কথা বলছিল,কিন্তু তিথি চলে যাবার পর সে আবার স্যার ডাকছে।কাহিনী কি!!!
———-
তিথি গাল ফুলিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে।যে আদিলকে দেখলে তার মনে ফুলের মেলা বসতো,আজ সেই আদিলকে দেখে তার গায়ে আগুন জ্বলছে।লাভা ভাসছে চারিদিকে!
কতটা ধোকাবাজ!! তাও একটুও অনুতপ্ত না সে!দিব্যি আরামসে অফিসে যাচ্ছে!
‘আমার দরকার ছিল ধরে বাসে সবার সামনে গনপিটুনি দেয়া।এরপর বাসে দেখলে একবার হলেও মাইর খাওয়াবো।আমাকে নিয়ে গোমস খেলার ফল ওকে ভুগতেই হবে!’

আদিল নেমে যাবার পর ইশান ও নামে বাস থেকে।হোটেলে যাবে নাকি বাসায় যাবে সেটা নিয়ে কনফিউশানে আছে।
কপালের দাগ ডাক্তারকে বলেও মেটানো গেলোনা।সার্জারি করা ছাড়া নাকি উপায় নাই।
সার্জারি করতে হলে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে,ততদিন বাসায় না ফিরলে মা অন্য কিছু ভেবে আবারও দুঃচিন্তা করবে।
যাবো তো কোনদিকে যাবো!!

ইশান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে নেয়।দম বন্ধ হয়ে আসে এভাবে মাস্ক পরে থাকতে থাকতে।ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করছিল কি করবে না করবে ওমনি তার সামনে এসে দাঁড়ায় মিয়াজুল করিম আঙ্কেল।
ওনাকে দেখে ইশান শুরুতে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো।তারপর কি আর করবে কথা না বললে আরও বিপদ হবে ভেবে সে সালাম দেয় ওনাকে।

‘ইশান!কত বড় সারপ্রাইজ! তুই কোথায় ছিলি এত বছর?’

‘এ্যাব্রোড’

‘বাহ!একেবারে সাহেব হয়ে ফিরেছিস!তোকে তো শুরুতে চিনতেই পারি !তিথি কোথায়?’

ইশান ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকায় তারপর বলে,’তিথি বাসায়।’

‘বাচ্চা কয়টা এখন তোদের?তিথিও কি তোর সাথে বিদেশ ছিল?আমাকে তোর বাসায় নিবিনা?আমি তো এখানেই থাকি।একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।চা খেতে মন চাইলো।আমার বউয়ের হাতের চা ভাল না বুঝলি!তিথির হাতের চা খাবো।চল!’

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-২+৩

0

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ২
আফনান লারা

লোকটার ওরকমভাবে নিজেকে লুকানোটাকে ভালভাবে দেখলোনা তিথি। সে এ পাশের মেয়েটার কোনো কথার জবাব না দিয়েই লোকটাকে দেখার চেষ্টায় মত্ত।
কিন্তু মেয়েটা বোধহয় চাইছেনা সে এরকমটা করুক।তাই সে তিথির হাতটা ধরে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো আর বললো সে যেন তাড়াতাড়ি ঠিকানা বলে।
তিথির হাত ধরেছে তাও সে কিছু না বলেই ঐ ছেলেটার লুকোচুরি দেখে চলেছে।
মেয়েটার টানাটানিতে এক সময় বিরক্ত হয়ে তিথি বললো,’রাখেন তো আপু!লিফট দিছেন বলে কি মাথা কিনে নিছেন আমার?দেখছেন না আমি ড্রাইভারকে দেখতেছি।আপনি নিজেও দেখেন।কেমন চোরের মতন বারবার চোখ লুকাচ্ছে।’

ওমনি গাড়ী থেমে গেলো।শোনা গেলো এক লাইন
‘গেট আউট’

এটা শুনে তিথির বকবকানি বন্ধ,সাথে ঐ মেয়েটার টানাটানিও বন্ধ।
তিথি গাল ফুলিয়ে বললো,’গেট আউট তো অবশ্যই হবো কিন্তু তার আগে আপনার মুখ দেখে তারপর আউট হবো।দেখি?’

এটা বলেই তিথি এগিয়ে ছেলেটার মাস্কে হাত দিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয় এবার।
বাধ্য হয়ে পাশের মেয়েটা তিথিকে আটকায় আর বলে,’শোনো ও আমার ভাই হয়।সে এরকম থাকতে পছন্দ করে।ফাজলামি করিওনা’

এটা শুনে তিথি থামে এরপর বলে কথাটা আগে বললেই হতো।সে চুপচাপ ব্যাগপত্র গুছিয়ে নামা ধরতেই ছেলেটা বললো,’এড্রেস দাও’

এটা শুনে তিথি এমন ভাবে তাকালো যেন ছেলেটা শুদ্ধু পুরো গাড়ীটাকে সে চিবিয়ে খেয়ে নেবে।এক লাথি দিয়ে গাড়ীর দরজা খুলে সে বের হয়ে বলে,’আমাকে একবার গেট আউট বললে ঐ জায়গায় আমি জীবনে গেট ইন হইনা।জাহান্নামে যাও ভাই বোন দুইজনে!’

এটা বলে তিথি দরজাটা বন্ধ করে পেছনে চেয়ে দেখে মরুভূমির মতন একটা জায়গায় সে নেমেছে।দূর দূরান্তে কোথাও কোনো গাড়ী নেই।এদিকে তার সামনের গাড়ীটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে।ভেতরে বসা সে মেয়েটি টু শব্দ ও করছেনা।যেন তার ভাই যেটা বলবে সেটাই হবে।
আর ঐ ছেলেটি এমন ভাবে বসা যেন সে চাইছে তিথি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুবা নত হয়ে গাড়ীতে ঢুকতে পারে।
তিথি ও কম না,সে তার ব্যাগ উঠিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।পায়ের ব্যাথাকে তোয়াক্কা না করেই সে তার বান্ধুবীর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে হেঁটে হেঁটেই।
———
পাত্রপক্ষকে আরও কিছু সময় ধরে রাখার জন্য তিথির বাবা,মা খালা,ফুফু সবাই সব করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারাও জেনে গেছেন তিথি পালিয়েছে।কি করে ওকে খুঁজে বের করবে সেটা চিন্তা না করে তারা ভাবছেন কি করে এই পরিবারকে আটকানো যায়।এত বড় বংশ হাতছাড়া করা যাবেনা।
তিথিকে কেউই খোঁজার চিন্তা করেনা,সকলে নানা পদ্ধতিতে পাত্রপক্ষর সেবা করে চলেছে।
তিথির ছোট বোন তানিয়া তখন টিউশন থেকে ফিরেছে।সে তিথির দু বছরের ছোট।গায়ের রঙ তিথির থেকেও চাপা হলেও তার চেহারায় একেবারে মায়ায় ভর্তি।দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটা তিথি।কারণ উচ্চতায় আর গড়নে দুজনেই প্রায় একই রকম।
তানিয়াকে দেখে পাত্রপক্ষ শুরুতে খুশি হয়ে গেলো।তারা ভাবলেন এটাই তিথি।ছেলেটি কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে।তানিয়া বেশ বুঝতে পেরেছে এরাও ওকে দেখে গুলিয়ে ফেলেছে।সে কিছুক্ষণ পাত্রর পেটের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’আসসালামু আলাইকুম দুলাভাইয়া’

এটা শুনে সকলে অবাক।পাত্রকে দুলাভাই কেন ডাকছে?তারা তখনও জানতোনা তিথির ছোট বোন আছে।
পাত্র হকচকিয়ে গেলো।তানিয়া পাত্রকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার ভূড়ির দিকে তাকাচ্ছিল বারবার।
পাত্র শেষে লজ্জা পেয়ে পেটে হাত দিয়ে ফেলে।
পাত্রর খালা তানিয়াকে প্রশ্ন করে সে কি তিথি নয়?

তানিয়া রিদমের মতনই অনেক বেশি দুষ্টু স্বভাবের।তার বিয়ে করার অনেক শখ থাকলেও তিথি অবিবাহিত বলে কেউ তাকে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছিল না।এখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবে বলে সে ঠিক করে এদের সাথে কিছু সময় মজা করবে।বিয়ে বিয়ে খেলবে।
সে গলায় ঝুলানো ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে ঐ খালার সামনে বসে বলে,’একটু মজা করলাম।কিছু মনে করবেন না।আমি খুব মজার মানুষ’

খালামণি হাসি দিয়ে বললেন,’ছবিতে ধবধবে সাদা মনে হলেও বাস্তবে দেখি চাপা।ফিল্টার মোরে ছবি দিয়েছিলে বুঝি?’

‘নাহ তো!ফিল্টার আমি কখনওই দিই নাই।মনে হয় ফোনের দোষ।আপনাদের ফোনের দোষ। কেউ ছবি পাঠালে ফোনের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে দেখবেন।
কাউয়ারেও ধলা মনে হবে তখন।তাছাড়া আমি রোদে পুড়ে টিউশন থেকে আসলাম তো!এই সময়ে এমনিতেও আমাকে কাজের বেডির মতন লাগে।আপনারা বসুন আমি ফেইস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে আসি।আমার রুপের আগুনে তারপর সবাইকে ঝলসায় দেবো”

এটা বলে তানিয়া উঠে বলে,’আবারও মজা করলাম।ঝলসাবোনা।আদর দিবো উম্মাহ খালামণি’

এটা বলে তানিয়া চলে গেলো।পাত্রর খালা পাত্রর মায়ের কানে ফিসফিস করে বললেন,’মাইয়া বেশি কথা বলে।আমাদের রকিবকে কি মানাবে?রকিব তো একদম কম কথা বলে।এই মাইয়া তো সবার মাথা খাবে’

‘আপা দেখেন না কি হয়।একটা দোষ দিয়ে তো বিয়েসাদি বাদ দেয়া যায়না।তাছাড়া আমাদের রকিবের ও তো দোষগুণ আছে’
———
‘হ্যালো মহেন্দ্র সিং ধনী স্পিকিং!হু আর ইউ?’

‘আমি’

‘টুকু! জানো এখানে কি হচ্ছে?’

‘জানতে হবেনা,শোন আমি কি বলি।বাবাকে বলবি আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবোনা।যদি মানে তবেই আমি ফেরত আসবো।আর বলবি আমি কোনো ছেলের সাথে পালাই নাই, একা একা পালাইছি’

‘আরে শোনো,তোমার জায়গায় তানিয়া টুকু বিয়ে করে নিচ্ছে তো!’

‘তানিয়া?ওহ হ্যাঁ আমি তো ভুলেই গেছি তানিয়ার স্বভাবের কথা।ওকে চালিয়ে যেতে বল।আমি রাখছি।পাত্রপক্ষ গেলে আমায় একটা মিসড কল দিবি’

এই বলে তিথি ফোন রাখে।সে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তার বান্ধবীর বাসায় এসে পৌঁছেছে।পাত্রপক্ষ চলে গেলেই সে বাড়ি ফিরবে।ফেসবুকে ঢুকে তিথি দেখে আদিল তাকে ব্লক দিয়ে দিয়েছে।
আদিল তিথির জীবনে হুট করেই এসেছিল,তার চলে যাওয়াটাও হুট করেই ঘটে গেলো।
দেড় বছর আগে ভার্সিটিতে তাদের প্রথম বার দেখা হয়।তিথি যখন ফার্স্ট ইয়ারে,আদিল ছিল ফাইনাল ইয়ারে।একটা কলেজ অনুষ্ঠানে তাদের দেখা হয়,এরপর আলাপআলোচনা। তারপর থেকে তিথি খেয়াল করে আদিল নিজ থেকে ইন্টারেস্টেড অনেক বেশি।তিথিও বাধা দেয়নি।সেও জড়িয়ে যায় সম্পর্কে।
তবে তাদের সম্পর্কটা ছিল আর ১০টা সম্পর্ক থেকে ভীষণ আলাদা।আদিল কখনও তিথিকে স্পর্শ করেনি,কখনও কোথাও ঘুরতে গেলে মাঝে এক হাত দুরত্ব রেখে হাঁটতো।হাত ধরতোনা কোনোদিন।তার কথাবার্তায়,চালচলনে সর্বদা মনে হতো সে নাটক করছে।
কিন্তু তিথি প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি,সে ভাবতো আদিল হয়ত বেশ ভাল একটা ছেলে।যা করবে বিয়ের পরে করবে।এই নিয়ে আদিলের প্রতি সফট কর্ণার তৈরি হয়েছিল তিথির মনে। তার থেকেই ভালবাসার সৃষ্টি।কিন্তু আদিল যে নিমিষেই সব শেষ করে দিয়ে চলে যাবে তা তিথি মানতে পারছেনা।অবশ্য তার প্রতিদিনই মনে হতে আদিল হয়ত তাকে বিয়ে করা নিয়ে সিরিয়াস না।
এই মনে হওয়াটা যে সত্যি হয়ে যাবে তা কে জানতো!

তিথি গালে হাত দিয়ে তার বান্ধবী সুরাইয়ার বারান্দার দোলনায় দোল খাচ্ছিল।সেইসময় সুরাইয়া তার জন্য কফি বানিয়ে এনে তার দিকে ধরে বলে,’আমার আব্বু আম্মু বিয়ের দাওয়াতে বরিশাল গেছে ভোরে।আমি এখন তোর ভাইয়ার সাথে লেট নাইট ড্রাইভে যাবো।ফিরতে রাত তিনটাও বাজতে পারে আর আমার বড় বোন তো বাসায় নেই।কালই শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে।একা বাড়িতে থাকতে পারবি?’

‘কেন পারবোনা?আমি অনেক সাহসী!’

‘তাহলে ভাল।তারপরেও এত বড় ফ্ল্যাট।সাবধানে থাকবি।ভয় পেলে আমায় কল দিয়ে লাভ নাই।আমি ফোন অফ করে বিন্দাস ইঞ্জয় করবো’

‘ওতো ভাবতে হবেনা,আমি যে টেনসনে আছি,তাতে ভূত সামনে এসে হ্যালো বললেও আমার কিছু যায় আসবেনা’

সুরাইয়া মুচকি হাসি দিয়ে রেডি হতে চলে যায়।তিথি কফিতে চুমুক দিয়ে দোলনা থেকে উঠে বারান্দার রেলিংয়ের উপর মগটা রেখে চোখ বন্ধ করে বাতাস নেয় গায়ে।তারপর চোখ খুলতেই সে দেখে সুরাইয়াদের বিল্ডিংয়ের সামনে সেই সাদা গাড়ীটা এসে দাঁড়িয়ে আছে।তিথি আশ্চর্য হয়ে যায় এক মূহুর্তে।
অনেকক্ষণ দেখে সে ভাবে এটা হয়ত অন্য গাড়ী।তাও তার কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিল বলে সে সুরাইয়াকে ডাক দেয়।সুরাইয়া আসার পর সে গাড়ীটা ওকে দেখায়।তখন সুরাইয়া ওকে জানায় এই বিল্ডিংয়ের প্রায় সবারই গাড়ী আছে,তাদের কারোর হতে পারে।
তিথির মন তাও কেমন কেমন করছিল।সে বারান্দায় আর থাকলোনা।ভেতরে এসে গ্লাস টান দিয়ে বারান্দা লক করে বিছানায় এসে বসে কফিটা শেষ করে।
চলবে♥

যদি তুমি বলো💌
পর্ব ৩
আফনান লারা

তানিয়ার সেজেগুজে পাত্রপক্ষকে মাতিয়ে রাখার কথা এখনও বাবা মা কিংবা বাকি কেউই জানেন না।তারা সবাই এক রুমে উপস্থিত হয়ে ভাবছেন কি করে পাত্রপক্ষের কাছে তারা মুখ দেখাবেন।এদিকে ফুফু হঠাৎ বলে দিলেন তিথি নেই যখন, তানিয়াকেই দিয়ে দিতে।অন্তত মুখ বাঁচবে।
সেসময় তিথির বাবা জনাব সুলতান বলেন সেটা সম্ভব নয়।তিথির আর তানিয়ার চেহারায় অমিল একটু হলেও আছে,ওনারা ধরে ফেলতে পারেন।
তাই সত্য কথা বলতে তিনি যেই না বের হলেন,ওমনি দেখলেন গোলাপি রঙের শাড়ী পরে তানিয়া ওদের সামনে নতুন বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে।হাবভাব দেখে মনে হলো তারাও টের পায়নি এটা তিথি।
তিনি কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলেন আসলে হচ্ছে টা কি।
তানিয়া শাড়ীর আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,’আমাকে আপনাদের কেমন লেগেছে?’

রকিবের খালা জোরপূর্বক হেসে বললেন ফেস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে আসায় এখন মোটামুটি লাগছে দেখতে।
এই শুনে তানিয়া চট করে তার মুখোমুখি বসে বলে,’এসব তো কিছুই না।আমি যখন সাবান দিয়ে গোসল করে বের হই তখন আমাকে আকাশের পরীর মতন লাগে।’

রকিব মিটমিট করে হাসছিল।সে বয়সের দিক দিয়ে বড় হলেও তার স্বভাব চরিত্র সবই একটু বোকাসোকা টাইপের।তানিয়ার উড়নচণ্ডী ভাব তার দারুণ লাগলো কিন্তু মা খালার ভয়ে চুপ করে থাকলো সে।
এই মেয়েটা বউ হলে তার আপত্তি থাকতোনা।কিন্তু বড়দের সামনে তো আর এটা বলা যায়না।সামনে কি হয় তাই দেখার পালা।
সুলতান সাহেব পুরোটা বুঝতে পেরে একটু এগিয়ে এসে বললেন,’আমাদের মেয়েকে কেমন লাগলো আপনাদের?’

রকিবের বাবা তখন ওনার হাত ধরে টান দিয়ে পাশে বসিয়ে আলাপ জুড়ে দিলেন,তিনি এতক্ষণ উধাও ছিলেন কেন সেই নিয়ে আলাপ।বিয়ের কথাটা আরও পরে বলবেন বলে ঠিক করলেন তিনি।
এত বড় পরিবার,সকলের মত থাকা জরুরি।
এই সময়টাতে তানিয়া রকিবকে চোখ মেরে তার রুমে চলে গেলো হঠাৎ।রকিব তখনই তার মাকে বলে সে ওয়াশরুমে যাবে।
ওমনি রিদম এসে তাকে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নিয়ে নেয়।

‘দুলাভাই,আপনার কি আমার টুকুকে ভাল লেগেছে?’

রকিব লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।রিদম ওর লাল হওয়া দেখে হাঁটতে হাঁটতে বললো,’জানেন?আমি হচ্ছি অমিতাভ বচ্চনের বাল্যকালের দোস্ত।একসাথে কত যে বিসকুট চুবিয়ে চা খেয়েছি।বুড়ো হয়ে আমাকে সে ভুলেই গেছে।এই যে দেখেন আমি কিন্তু ভুলিনি ওকে।আমার স্মৃতি শক্তি প্রখর।যাই হোক,আমি কিন্তু আপনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাচ্ছিনা,টুকুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।টুকু আমায় একশো টাকা দিবে বলেছে তাই।তাছাড়া আমি মুফতে কোনো কাজ করিনা।এই যে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।আপনারও কিন্তু বকশিশ দিতে হবে আমায়’

রকিব পকেট হাতিয়ে দুইশ টাকার নোট বের করে। রিদম তখন বলে,’মেয়ে ছেলে সমান নয়।ছেলেরা একটু বেশি হয়।টুকু একশো দিছে যখন, তখন আপনি দিবেন আরও একশো বাড়িয়ে।
যদি নারী পুরুষ সমান হয়ে যায় তাহলে কি হবে জানেন?কিছুই হবেনা।শুধু পুরুষ, পুরুষ থাকবেনা।বেডা=বেডি হবে।বুঝতে পারছেন দুলাভাই?’

রকিব অনেক ভেবে দুইশ টাকার নোটটা রিদমকে দিয়েই দিলো।এর আগে এমন খরচা করার সময় অবশ্যই সে মাকে জানিয়ে করতো।আজ জানাতে পারলোনা বলে মনের ভেতর কেমন খুটখুট করছে।
——–
তিথিকে রেখে সুরাইয়া চলে গেছে।তিথি সময় কাটাতে ফোনটা হাতে নেয়, কিন্তু দেখে ফোনে চার্জ কম।তাই ফোন চার্জে দিয়ে ওদের বাসার টিভি অন করে বসে।কিছু সময়ের মধ্যেই কারেন্টাও হঠাৎ করে চলে যায়।তিথির এবার হালকা পাতলা একটু ভয় হতে লাগলো। সিনেমায় দেখেছে এরকম কারেন্ট চলে গেলেই ডাকাত এসে হামলা করে।
তিথি অনেক খুঁজে একটা টর্চ লাইট পায়,তারপর সেটা জ্বালিয়ে খাটের উপর বসে থাকে।এরপরেও ওর ভয় কাটছিল না বলে লাইটটা নিয়ে খাটের তলায় গিয়ে লাইট অফ করে ফেলে সে।রোডের ল্যাম্প পোস্টের আলো রুমের ভেতরে আসছিল।তিথির নিজের লাইটটা অফ করার কারণ হলো কেউ যাতে তাকে হামলা করতে আসলে তাকে না দেখে।
তিথি ভয়ে ভয়ে মুখে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে আছে।কারেন্ট আসার নামও নিচ্ছেনা।অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর তিথি শুনতে পেলে কারোর হাঁটার শব্দ।তিথির ভয় এবার চরম পর্যায়ে চলে গেছে।ঢোক গিলে সে মুখটা ভাল করে চেপে বসে থাকলো।হাঁটার শব্দটা আরও কাছ থেকে শোনা যায় এবার।
তিথি চিন্তা করছে যে মানুষটা হাঁটছে,সে ভেতরে ঢুকলোই বা কেমন করে।তার ভাবনার মাঝেই সেই মানুষ ঐ রুমে প্রবেশ করে।দেখে একটা ছেলে মনে হলো।
তিথির সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে।ঢোক গিলে সে বোঝার চেষ্টা করছে মানুষটা আসলে কি করবে।
সে দেখে ঐ মানুষটা কোনো কিছু না হাতিয়ে,কেবল হেঁটে সব জায়গায় কাকে যেন খুঁজছে।তিথি বেশ বুঝতে পারলো এই ছেলে কোনো চুরির উদ্দেশ্যে আসেনি।তার উদ্দেশ্য অন্য কিছু।
ছেলেটা বাথরুমের দরজা খুলেও চেক করে এবার।তিথি হাতের টর্চ লাইটটা মুঠো করে ধরে।খাটের তলায় চেক করতে আসলেই মুখের উপর বাড়ি মেরে দিবে।
ছেলেটা রুম ছেড়ে চলে যাওয়া ধরলো ওমনি কি ভেবে সে খাটের কাছে এসে দাঁড়ালো আবার।তিথি তৈরি হয়ে আছে বাড়ি দেবার জন্য।
যেইনা সে ছেলে খাটের তলায় দেখার জন্য মাথা নিচু করলো ওমনি তিথিও কোনো কিছু না দেখেই দিয়ে দিলো এক বাড়ি।তাও যেনতেন বাড়ি না।একেবারে মাথা ফেটে যাবার মতন বাড়ি।
সেই ছেলেটা মাথা হাত দিয়ে বসে পড়ে।তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে।
তিথি খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ফোন খুঁজতে থাকে।টর্চ লাইট তো ঐ ছেলের সামনে পড়ে আছে।
ফোন খুঁজে সে ছেলেটার দিকে ফ্ল্যাশ অন করে ধরে।ছেলেটা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।প্রচণ্ড ব্যাথা পেয়েছে।

‘কে আপনি?কি চাই?’

তিথির কথা শুনে ছেলেটা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে যায়,
পেছনে একবারও না তাকিয়ে সে দৌড়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।
তিথি যেন আরও সাহস পেয়ে গেলো।সে ও ছুটলো ছেলেটার পিছু পিছু।তিথি আলোতে খেয়াল করে ছেলেটার হাতের দিকে।ঐ ছেলের হাতের সবুজ রঙের ব্রেসলেটটা দেখে তিথি সিওর হয়ে যায় এটাই সেই ছেলেটা যার গাড়ী করে সে এখানে এসেছিল।
এবার সে আরও দ্রুত দৌড়ায়।
কিন্তু অন্ধকারে নিমিষেই ছেলেটা উধাও হয়ে গেলো কোথায় যেন।
কোথাও আর খুঁজে পেলো না তিথি ঐ ছেলেটাকে।

ছেলেটা চলে যেতেই কারেন্ট ও চলে আসে।তিথি এবার ফোনের আলো নিভিয়ে তার রুমে আসতেই দেখে ফ্লোরে রক্ত কয়েক ফোটা পড়ে আছে।তার মানে ঐ ছেলেটার মাথা ফেটেছিল!

তিথি এক দৌড়ে বারান্দার গ্লাস খুুলে দেখে গাড়ীটা তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে।
——-
‘ইশান?আর ইউ ওকে?’

‘ইয়াহ্,আই এম ফাইন।তিথি বলে কথা,মাথা তো ফাটাবেই!আসার পথে হাসপাতাল হয়ে আসবো।তুই টেনসন নিস না।আর মাকে বলার দরকার নেই’

‘তোর ফাটা মাথা দেখে মা এমনিতেই বুঝে যাবে,আমার আর কিছু বলতে হবেনা।যাই হোক,তুই কি এখনও ঔখানে আছিস?’

‘সুরাইয়া আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।আমি বলে কিছু করিনি।কিন্তু আমার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে ফাটা মাথা নিয়ে পালাতো না।খারাপ কিছু করতো।ওকে একা রাখা যাবেনা।সুরাইয়া ফিরলে তারপর আমি এখান থেকে চলে আসবো।তুই ঘুমিয়ে পড়’

ইশান ফোন রাখতেই দেখে তার গাড়ীর সামনে তিথি দাঁড়িয়ে আছে। সে এটা কল্পনাও করতে পারেনি।তিথি কোমড়ে হাত দিয়ে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল যেন আজ রফাদফা হয়ে যাবে।
ঠিক তাই।তার পেছনের হাতে ছিল একটা ইট।সে ইটটাকে ছুঁড়ে মারলো ইশানের কারের গ্লাসের উপর।ওমনি গ্লাস ফেটে চুরমার।ইশান দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে।

‘আমার থেকে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব। ‘

এটা বলে তিথি এগিয়ে এসে ফোনের আলো জ্বালালো।কিন্তু ইশানের মুখে সেই মাস্কটা তখনও ছিল।তিথি হাত বাড়িয়ে মাস্কটা সরাতে নিতেই ইশান ওর হাত ধরে ফেলে এরপর বলে,’আমি না চাইলে তুমি কিছু করতে পারবেনা।
যদি তুমি বলো,তবেই পারবে’

এটা বলে ইশান তিথির হাত মুচড়ে ধরে টান দেয়,ওমনি তিথির হাতে ভাঙ্গা কাঁচ লেগে কেটে যায় অনেকটা অংশ।ইশান তখন বলে,’আমি নায়ক এবং ভিলেন, দুটোই!’

চলবে♥

যদি তুমি বলো পর্ব-০১

0

যদি তুমি বলো💌
সূচনা পর্ব
আফনান লারা

তিথিকে আজ দেখতে আসবে মস্ত বড় এক পরিবার।পাত্রের পরিবারের সদস্য সংখ্যা গুনে গুনে ছাপ্পান্ন জন।
একেবারে যৌথ পরিবার।পাত্রর বয়স এই তো ত্রিশ ছুঁই ছুঁই।
তিথির কাছে সেটা সমস্যা ছিল না মোটেও।তার কাছে সমস্যা হলো আসলে কিছুই না।পাত্র কিংবা পাত্রের পরিবার নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই।অভিযোগটা এক জায়গায় আর তা হলো সে বিয়েটাই করবেনা।কেন করবেনা তার কারণটি হলো সে অন্য কাউকে ভালবাসে।যাকে ভালবাসে তাকে সে এই নিয়ে ছাপ্পান্ন বারই ফোন দিয়েছিল।কিন্তু ওপাশের মানুষটাকে কল দিলেই ভয়েস আসে তিনি ব্যস্ত আছেন।একটু পর কল করতে।
তিথি একবার ভাবে এরকম কাপুরুষের সাথে রাগ করে ত্রিশ বছরের এই ছেলেটাকে বিয়ে করে নেওয়াই বুঝি উত্তম ।পরে ভাবে এত গুলো দিনের প্রেম,কি করে ভোলা যায়।ছেলেটা যখন পাশে এসে বসবে তখনই তো আদিলের কথা মনে পড়ে যাবে।আদিলকে ছাড়া এইসব তো সে কল্পনাও করতে পারেনা।
বারান্দার গ্রিল ধরে মাথা ঠুকরাচ্ছিল তিথি।পেছন থেকে ওর ছোট ভাই রিদম এসে ওকে ঝাপটে ধরে বললো,’টুকু,ভোউউউউউউউউ!’

তিথি বিরক্ত হয়ে দিলো এক চড়।রিদম গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর বললো ‘তোমার এই ছেলের সাথে বিয়ে হবেনা দেখিও।আমি অভিশাপ দিলাম’

তিথি অন্যদিকে মুখ করে বললো,’অনেক ধন্যবাদ’

রিদম মুখ বাঁকিয়ে ড্রয়িং রুমে ফেরত এসে সাজিয়ে রাখা মিষ্টির থালা থেকে দুটো নিয়ে পগারপার হয়ে গেছে।
এদিকে তিথি সাতান্ন তম বার আদিলকে কল করে।
এইবার আদিল ধরে কলটা।
তিথি কল রিসিভ হয়েছে দেখে শুরুতেই আদিলকে এক গাদা গালি ছুড়ে দেয়।তার এত রাগ হচ্ছিল যে আদিল সামনে থাকলে সে ওকে আজ খুনই করে ফেলতো।
আদিল ওর বকাঝকা শুনে শান্ত গলায় বলে,’আমি তোমাদের বাসার কাছের পার্কটাতে এসে বসে আছি,দশ মিনিটের জন্য আসবে?’

‘নিশ্চয়তা দাও আমাকে নিয়ে পালাতে পারবে?’

আদিল অবাক হলো তিথির এমন কথায়।তার আর তিথির সম্পর্ক প্রায় দেড় বছরের।প্রেমের সম্পর্ক মানে অন্তত একবার হলেও হাতটা ধরা।কিন্তু আদিল আজ অবধি তিথিকে ছুঁয়েও দেখেনি।সেও ছোঁয় না,তিথিও নিজ থেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেনা।কেন করেনা তার পেছনে আবার ইতিহাস আছে!
তিথির এমন উদ্ভট কথার জবাবে হ্যাঁ বা না নিয়ে কিছুই বললোনা আদিল।শুধু বললো সে যেন দ্রুত চলে আসে পার্কে।
তিথি ধরে নিলো আদিল তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হবার সময় তার মনে হলো আদিলকে সে যতটুকু চিনে, এই ছেলেটা যেকোনো সময়ে পাশা পালটাতে পারে।বিশ্বাসের মার নাই!
তাই সে একটা ছুরি নিলো সাথে।যদি সে বলে সরি তিথি আমি তোমায় বিয়ে করতে পারবোনা,তুমি ঐ ত্রিশ বছরের ছেলেটাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও তবে গর্দভটার পায়ে আচ্ছা করে কুপিয়ে আসবে।অন্য কোথাও কোপাবে না।নাহয় মরে যাওয়ার চান্স আছে।ভালবাসার মানুষকে কি করে খুন করা যায়?
ছুরিটা ব্যাগে পুরে তিথি বাহিরের রুমে উঁকি দেয়।
মা,খালা আর ফুফু মিলে রান্নাঘরে খাসির মাংস রাঁধছেন।আজ পাত্রপক্ষকে দুপুরে খাওয়াবে তারা।ওরা নাকি আংটিও পরিয়ে যেতে পারে।
রিদমের একটা পা দেখা যায় সোফার তলা থেকে।সম্ভবত এক কেজি মিষ্টি সে সাবাড় করে ফেলেছে।
ওকে পাত্তা না দিয়ে তিথি পা টিপে টিপে দরজাটা খোলার জন্য হাত রাখতেই রিদম বললো,’টুকু ব্যাগটা আমি আগাইয়া দেবো?’

তিথি পেছনে ফিরে ফিসফিস করে বলে,’নো থ্যাংকস!’

‘যাওয়ার আগে এখানে একটা সই করে যাও।’

এটা বলে রিদম সোফার তলা থেকে একটা কাগজ আর কলম বের করে দিলো ফ্লোরে।তিথি বিরক্ত হয়ে ব্যাগটা রেখে নিচে বসলো।রিদমের কথা না শুনলে এক চিৎকারে সবাইকে ড্রয়িং রুমে এনে হাজির করবে সে।
কাগজটা পড়ে তিথি দেখলো তাতে লেখা আছে

“”””আমি রিদমের টুকু বলছি।আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আজ যে পালিয়ে যাচ্ছি এরপর থেকে আমার রুমটা রিদমের নামে দলিল করে দিলাম।এই রুম নিয়ে আমার কোনো দায় দাবি থাকবেনা।””’

সই এর জায়গায় তিথি সই করে কাগজটা সোফার তলায় ঠেলে দিয়ে সে বেরিয়ে গেলো।
দ্রুত যেতে হবে।পার্কটা খুব বেশি দূরে না।

অনেক কষ্টে গায়ের ভারী শাড়ীটাকে আর ব্যাগটাকে বয়ে এসেছে তিথি।পার্কে এসে এদিক সেদিক চোখ বুলাতেই আদিলের দেখা পেলো সে।আদিল পার্কে বসে ফোন টিপছিল।
তিথি ওর কাছে এসে বলে ফেললো এখনই বিয়ে করবে তারা।আদিল কথাটা শুনে এমনভাবে তাকালো যেন সে বিয়ের ব নিয়েও ভাবছেনা।
তিথি বিরক্ত হলো ভীষণ।আদিলের আসলে সমস্যা টা কোথায়!
তার মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে আদিল ওকে পাশে বসতে বললো।

তিথি ও বসলো ওর পাশে।তারপর বললো বিয়ে না করলে কিসের জন্য ডেকেছে।
সে কি চায় তিথির অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাক!

‘না চাইনা।শোনো তিথি,আমি আজ তোমায় একটা কথা বলতে এখানে ডেকেছি।আমি আসলে!!’

ওমনি তিথি তার ছুরিটা বের করে আদিলের দিকে ধরে বললো,’সিনেমার ডায়ালগ দিতে হবেনা।বিয়ে করবানা বলে দিছোনা?ব্যস আর কোনো ডায়ালগ দিওনা।আমি বেশ ভালমতনই জানি তুমি আমায় বিয়ে করবেনা।সম্পর্কের শুরু থেকেই দেখেছি কেমন মাঝখানে এক হাত দূরুত্ব রেখে চলো তুমি।
শুধু চলে যাওয়ার আগে বলে যাও এরকম নাটকের কি দরকার ছিল?এটা সম্পর্ক ছিল নাকি গেমস ছিল?কেন খেললে এমন গেমস?’

আদিল তার ফোনে কার সাথে যেন মেসেজ করছিল।তিথি ভাবলো হয়ত কোনো মেয়ে,৩য় ব্যাক্তি।সে ওমনি আদিলের ফোনটা কেড়ে নেয়।তাতে লেখা ছিল,’বস’

এটা দেখে তিথি আর মেসেজ পড়েনা,ফোনটা পাশে রেখে দিয়ে বলে,’আমার ফিলিংস নিয়ে খেলে কি পাইলা?’

আদিল মুচকি হাসি দিয়ে বলে,’অনেক কিছুই পেয়েছি।’

তিথির মাথাটা আরও গরম হয়ে যায়।কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারেনা।প্রচণ্ড রেগে গেলে ওর মাথা কাজ করেনা,মাথা ঘোরায়।প্রেশার বেড়ে যায়।আর তাই চুপ করে সে বসেই থাকলো।আদিল তার ফোনটা নিয়ে আবারও মেসেজ করছে।তিথি তখন তার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে।আর দশ মিনিট পর পাত্র পক্ষ আসার কথা।তিথি তার ফোন নিয়ে বাসায় একটা কল দেয়।বাসার নাম্বারে কল আসলে সেটা সবসময় রিদম রিসিভ করে।এবারও তাই হলো।

‘হ্যালো,অরিজিৎ সিং স্পিকিং!!হু আর ইউ?’

‘আমি’

‘টুকু! তুমি বিয়েও করে নিছো?সেটা জানাতে কল দিছো?’

‘পাত্রপক্ষ এসেছে?’

‘আসতেছে।বাবা নিচ তলা থেকে আনতে গেছে,ঐ তো এসেও গেছে।আসসালামু আলাইকুম’

‘ছেলে কেমন?’

‘সবই ঠিক আছে কি তার পেট দেখি দশ তলা!’

‘আর কিছু?’

‘সবই ঠিক আছে কিন্তু মানুষ এত বেশি কেন!একুশ,বাইশ তেইশ,পঞ্চাশ ছাপ্পান্ন।টুকু তুমি আর বাসায় ফিরিও না।’

তিথি ফোনটা রেখে দেয়।আদিল পার্কের বাহিরে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছে।
তিথি ব্যাগটা রেখে ওর সামনে গিয়ে বলে,’তুমি সত্যি সম্পর্কটার ইতি টানতেছো?’

‘হ্যাঁ।আমার সময় শেষ’

‘ক্যানসার?কাল পরশু মরে যাবা?তাই কুরবানি দিচ্ছো নিজেকে?’

‘ওসব কিছুনা।তবে আমি তোমায় বিয়ে করতে পারবোনা।যদি করি তবে কুরবানি আমায় হতে হবে’

‘মানে কি!আশ্চর্য। এরকম করে কথা কেন বলছো!’

আদিল রিকশা পেয়ে উঠেও গেছে।তিথির দিকে টাটা দিতে দিতে সে বললো,’ওল দ্যা বেস্ট’

তিথি রাগ করে পায়ের জুতা খুলে রিকশার দিকে মেরে বললো,’তোর অল দ্যা বেস্টের গুষ্টি-তুষ্টি!’

রিকশা চলে গেলো বহুদূর।তিথি খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাস্তায় কাঠগোলাপের ছড়াছড়ি। ফুলগুলো দেখে মেজাজটা আরও খারাপ হলো তিথির।এই ফুল দিয়েই আদিল তাকে প্রোপোজ করেছিল।রাগ করে পার্কে এসে ব্যাগটা তুলে সে তার একটা বান্ধবীকে কল করে।আপাতত ঐ পাত্রপক্ষ চলে যাওয়া অবধি ওর বাসাতেই থাকবে।খালি পায়ে হেঁটে যাবার সময় পায়ে বিঁধে গেলো কাঁচ।পার্কে কাঁচ ফেললো কে!
পায়ের পাতা ধরে কাঁচটা ফেলে হাঁটতে গিয়ে হলো মহাঝামেলা।হাঁটতেই পারছেনা সে।কোনোমতে রোডে এসে একটার রিকশার খোঁজ করছে এখন।জুতা গুলাও নিয়ে গেছে ঐ ছেলেটা!!!
“”কি অভিশাপ দিলে ওর আক্কল হবে!
হুমমমমম!তোর বউয়ের কারেন্ট থাকবেনা।এটাই ঠিক আছে।সারাদিন সৌরবিদ্যুৎ চলবে।বর্ষাকালে বন্যা বইবে’

হাসি দিয়ে তিথি খেয়াল করে তার সামনে একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়িয়েছে।তার ভেতরে বসে থাকা মেয়েটি ইশারা দিয়ে তিথিকে উঠতে বলছে।কিন্তু তিথি হাত নাড়িয়ে না করে দেয়।এরপর মেয়েটা জানালার কাঁচ নামিয়ে বলে,’তোমার পায়ে জুতা নাই দেখলাম,মনে হয় বিপদে পড়েছো।ভাবছি হেল্প করলে সওয়াব পাবো,উঠে এসো’

তিথির সন্দেহ হলো তাই সে মানা করে দেয়।কিন্তু মেয়েটা তাকে রিকুয়েস্ট করতে থাকে।এদিকে তিথিও বিপদে পড়ে আছে, এই হেল্পটা তার দরকার ছিল।
ইতিউতি না ভেবে সে উঠে পড়ে।বসতেই তার মনে পড়লো গাড়ীতে বসে তিথির পা কিভাবে দেখলো এই মেয়েটা।সে ওমনি প্রশ্নটা সেই মেয়েটিকে করে।মেয়েটি তখন হাসিমুখে বলে,’আমি এতক্ষণ জানালার ওপাশেই ছিলাম।তাই দেখেছি।তোমায় দেখেই এই পাশে চলে এলাম।তুমি কি সন্দেহ করছো?আমি কিন্তু তোমায় কিডন্যাপ করবোনা।’

তিথি আড় চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে।হঠাৎ তার চোখ চলে যায় ড্রাইভারের সিটে বসা ছেলের দিকে।ছেলেটা মুখে মাস্ক পরে ছিল,আর বারবার বাম হাত দিয়ে নিজের যে টুকু মুখ দেখা যায় সেটা লুকানোর চেষ্টা করছিল।তিথি মাথা উঁচু করে আরও ভালভাবে দেখার চেষ্টা করে ওমনি সেই মেয়েটা তিথির দিকে ফিরে বলে,”কোথায় যাবে?ঠিকানা তো দাও।তোমায় নামিয়ে দিবো’

চলবে♥

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-২৯ এবং শেষ পর্ব

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৯.
ভোর পৌনে পাঁচটা। নামাজের সময়। শমসের খান অভ্যাসবশত আজান শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই জেগে উঠেছেন। স্ত্রীকেও ডেকেছেন। আয়েশা খাতুন উঠে বসতেই শমসের খান দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
“ভোরবেলা মেইন দরজা খোলা কেন?”
আয়েশা খাতুন লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে বলে উঠলেন,
“কী বলেন! দরজা খোলা থাকবে কীভাবে?”
“কেউ কি বাইরে গেছে না কি?”
“ভোরবেলা বাইরে যাবে কে? কেউ তো ওঠেইনি। দেখেন আবার চোর পড়ছে না কি। ও আল্লাহ্! দেখি সরুন।”

আতঙ্কিত হয়ে আয়েশা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন সত্যিই মেইন দরজা খোলা। শমসের খাঁন বললেন,
“কাল রাতে দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গিয়েছিল না কি কেউ?”
“আরে না, আমিই তো দরজা আটকেছিলাম। তাড়াতাড়ি দেখেন তো সবাই ঘরে আছে কি না। আমার তো ভয় লাগছে।”

শমসের খাঁন সব ঘরের দরজায় চোখ বুলাতে গিয়ে দেখলেন ছেলের ঘরের-ই দরজা খোলা। ভেতরে লাইটও জ্বলছে। স্ত্রীকে ডাকতে-ডাকতে তিনি ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলেন বিছানা ফাঁকা। শুধু তাই নয়, বিছানাসহ পুরো ঘরের লণ্ডভণ্ড অবস্থা। মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে ঝড় বয়ে গেছে। তার চেয়েও অবাক করা কাণ্ড হচ্ছে আলমারির তালা ভেঙে জিনিসপত্র সব জিনিস মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা। শমসের খাঁন দৌড়ে গিয়ে আলমারির দরজা খুলতেই তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। টাকার ড্রয়ার সম্পূর্ণ ফাঁকা। আয়েশা এসব দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। তার চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ সবাই চমকে উঠেছে। আতঙ্কিত হয়ে ঘুম জড়ানো চোখে ছুটে এসেছে। মিশকাতের ঘরের এমন অকল্পনীয় অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত। কিছু যে একটা ঘটেছে তা সবার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এই মুহূর্তে মিশকাতের খোঁজ করা আগে প্রয়োজন ভেবে তাকে ফোন করা হলো। তিন-চার জন মিলে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। ফোন বন্ধ বলছে। সবার চোখে-মুখে ভীতি। আরিন্তার মন কেন জানি বলছে মিশকাত নিজেই কিছু একটা ঘটিয়েছে। আচ্ছা, সে এখান থেকে বাঁচতে সরে যায়নি তো? গেলেও এভাবে যাওয়ার তো মানে নেই। আয়েশা, মেরিনা রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে বসেছেন। সবাই মিলে বাড়ির বাইরে চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও মিশকাতকে পেল না। শেষে নিয়াজ দুজন ছেলে সাথে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল খোঁজ নিতে। যদি কেউ দেখে থাকে! সেই যে সকালে তারা বেরুল, গোটা সকালে আর বাড়ি ফিরল না। এলাকা চষে বেড়াল। থানায়ও জানানো হয়ে গেছে। ওদিকে বাড়িতে শোকের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে নোভা-ও প্রচণ্ড চিৎকার করছে। বড়োদের অবস্থা দেখে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। আরিন্তা কাকে সামলাবে কূল পাচ্ছে না। আপন মনের অবস্থা না হয় চাপা-ই পড়ে থাকল।

গোটা দিন কে’টে গেল। মিশকাতের কোনো খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নিয়াজ ফোন করে জানাল মিশকাতকে পাওয়া গেছে। তারা বাড়ি ফিরছে। সবার সারাটা দিনের অশান্ত মন যেন শান্ত হলো এবার। সন্ধ্যার পর গাড়ির শব্দে সবার বুকের ভেতর কামড় দিয়ে উঠল। আরিন্তা তখন ঘরে বসে নোভাকে দুধ পান করাচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ির শব্দের সঙ্গে আয়েশার গগনবিদারী চিৎকার কানে আসতেই সে নোভাকে কোলে চেপে ছুট লাগাল। তার আতঙ্কিত পা দুটো দরজাতেই থমকে গেল। উঠানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দানবের মতো অ্যাম্বুলেন্সটা গলা তুলে বিপজ্জনক হাঁক ছাড়ছে। তার আওয়াজে বুক কেঁপে ওঠে। নিয়াজ, পেলব আর দুজন ছেলে মিলে তার ভেতর থেকে বের করল সাদা কাপড় মোড়ানো লম্বাচওড়া এক দেহ। দেহটা উঠানে রাখতেই আয়েশা, মেরিনা আর্তনাদ তুলে লুটিয়ে পড়লেন তার ওপর। হতভম্ব আরিন্তার মস্তিষ্ক হঠাৎ খনিকের জন্য সজাগ হয়ে ঘটনা অনুধাবন করল। পরক্ষণেই তার মনে হলো মাথাসহ শরীরটা ভীষণ ভার হয়ে আসছে। দুচোখে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতেই সে বাড়ি কাঁপিয়ে ‘ও আল্লাহ্!’ বলে এক চিৎকার দিয়েই শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। তার শরীরটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে দেখেই নিয়াজ ছুটে এল। নিয়াজের আগে মিশকাতের চাচি আরিন্তাসহ নোভাকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছে। চারদিকের অস্বাভাবিক পরিবেশ বুঝতে না পেরে অবুঝ নোভা হঠাৎ ভয়ে কেঁদে উঠল। নোভাকে পেলবের কাছে দিয়ে নিয়াজ দ্রুত আরিন্তাকে বুকে আগলে ধরে কাউকে পানি আনতে বলল। এক মেয়ে পানি এনে দিলো। নিয়াজ আরিন্তার মাথার তালুতে, চোখে-মুখে পানির ছিটা দিতে লাগল।

ইতোমধ্যেই উঠানে ভীড় জমে গেছে। চারদিকের মানুষজন ছুটে এসেছে। উঠানের মরদেহের পাশে আয়েশা, মেরিনাসহ তার জায়েরা সমানে আর্তনাদ করে চলেছেন। আয়েশা, মেরিনা একটু পরপর জ্ঞান হারাচ্ছেন। মানুষজন আরও হৃদয়বিদারক কান্না দেখলেন শমসের খাঁনের। উঠানে লুটিয়ে পড়ে মাটি আছড়ে, বুক আছড়ে অসহায়ের মতো কাঁদছেন মানুষটা। তার বুক যেন কিছুতেই এই কষ্ট বহন করতে পারছে না।

আরিন্তার জ্ঞান ফিরতেই সে নিয়াজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠেপড়ে দৌড় লাগাল। এক দৌড়ে গিয়ে মরদেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে। সাদা কাপড়ের ফাঁকে বেরিয়ে আছে কেবল নিষ্পাপ মুখটা। সারা মুখে শুকিয়ে থাকা রক্তের দাগ। কপালে আঘাতের চিহ্ন। তবু যেন ওই মুখে নেই বিষাদের ছায়া। গোটা পাঁচ বছর পর যেন আরিন্তা সেই সহজ, স্বাভাবিক মুখে দেখতে পেল তার মিশু ভাইকে। মিশকাতের প্রাণহীন দেহের ওপর আছড়ে পড়ে আরিন্তা করুণ সুরে আর্তনাদ তুলল,
“ও আল্লাহ্, এ কী করলে! আমার মিশু ভাই… কী করলে খোদা!”
মিশকাতের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে সে বাচ্চাদের মতো ডাকল,
“ও মিশু ভাই, মিশু ভাই, ওঠো। এমন কোরো না, আমি মানতে পারব না মিশু ভাই। ওঠো না তুমি। তোমাকে আর কষ্ট দিবো না মিশু ভাই। আমায় মাফ করো। এত বড়ো শাস্তি তুমি আমায় দিয়ো না। তোমার পায়ে পড়ি মিশু ভাই, একবার ওঠো।”

আরিন্তা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মিশকাতের পা জড়িয়ে ধরল অনুনয়-বিনয় করল। কিন্তু তার এই করুণ ডাক আজ আর মিশকাতের কান অবধি পৌঁছাল না। মিশকাত একবার চেয়ে দেখল না তার প্রাণভোমরা তার জন্য গলাকা’টা মুরগির মতো ছটফট করে কাঁদছে। মহিলারা আরিন্তাকে সামলাতে পারল না। তারা ধরতে এলেই আরিন্তার শরীরে যেন দ্বিগুণ শক্তি ভর করে। মেরিনাকে আঁকড়ে ধরে আরিন্তা অনুরোধ করল,
“ও মা গো, তোমার আদরের ভাগনেকে উঠতে বলো। আমি বেঁচে আছি কেন মা? আল্লাহ্ আমাকে কেন আগে নিল না? আমি সহ্য করতে পারছি না মা। আমার মিশু ভাইকে উঠতে বলো।”

মেরিনা মেয়েকে কী সান্ত্বনা দিবেন? তাকেই সামলাচ্ছে আরেকজন। নিয়াজ অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাড়িতে পা রাখা এমন কোনো মানুষ নেই, এ বাড়ির মানুষগুলোর কান্না দেখে যার চোখে এক ফোঁটা জল না বেরিয়েছে। আজ পেলবের চোখ-ও শুকিয়ে নেই। চারপাশের মানুষজন যখন মিশকাতের মৃ’ত্যুর ঘটনা নিয়ে বলাবলি করছিল, তখন আরিন্তার কানে যায় এ সাধারণ মৃ’ত্যু নয়, খুন। এ কথা শুনতেই আরিন্তার মাথায় কী এক চিন্তাধারা খেলে গেল! পেলব সামনে আসতেই সে আচমকা হিংস্র বাঘের মতো ভাইয়ের ওপর আক্রমণ করে বসল। দুহাতে পেলবের গলা চেপে ধরে হুঙ্কার ছাড়ল,
“তুই এই সর্বনাশ করেছিস না? তুই আমার মিশু ভাইকে শেষ করে দিয়েছিস। তুই ছাড়া আর কেউ এই জা’নোয়ারের মতো কাজ করতে পারে না। আমার মিশু ভাইকে তুই-ই শেষ করে দিয়েছিস। তোকে আমি আর ছাড়ব না পাষণ্ডের বাচ্চা।”

পেলব গলা থেকে আরিন্তার হাত সরিয়ে দুহাতে আটকে বুঝাতে চাইছে,
“শান্ত হ বোন। কী বলছিস? এসব আমি করব কেন? তোর মাথা ঠিক নেই। শান্ত হ।”
“তুই করবি কেন? এই তুই জানিস না তুই কী করতে পারিস? তোর কারণে সব হইছে। তুই আমাকে মরার মতো বাঁচিয়ে রেখেছিস। এই তুই, তুই আমার মিশু ভাইয়ের সম্পূর্ণ জীবন নষ্ট করেছিস। তাতেও তোর শান্তি হয়নি? শেষমেষ পশুর মতো জানটা কেড়ে নিলি? এই জা’নোয়ার, তোর কি ম’রার ভয় নেই?”

নিয়াজ আরিন্তাকে জোর করে পেলবের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তা-ও আরিন্তা সরতে চাইল না। নিয়াজকে বলল,
“ছাড়ো আমাকে। তুমি ওকে চেনো না। আমার চেয়ে ভালো ওকে কেউ চেনে না। ওর মাঝে হৃদয় বলতে কিছু নেই। ও নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। তুমি ওকে ধরো। ও আমার মিশু ভাইকে খু’ন করছে। আমার মিশু ভাই-”

আরিন্তা আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিয়াজ অনবরত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলল,
“শান্ত হও প্লিজ। পা’গলামি কোরো না।”
“আমার মন মানছে না গো। আমি তো সব মেনে নিয়েছিলাম। ওই মানুষটা নিজের সবটা ত্যাগ করেছিল আমার ভালোর জন্য। তার সাথেই কেন এমন অবিচার হলো। তার সাথে বারবার কেন এমন অবিচার হয় বলতে পারো? সে তো জীবনে কোনো অন্যায় করেনি।”
“শান্ত হও, শান্ত হও আরিন্তা, একটু শান্ত হও। মেয়েটা ভয় পেয়েছে তোমার কান্না দেখে। আল্লাহ্ কখন কাকে নিয়ে যান, বলা যায় না।”
“আল্লাহ্ আমায় কেন নিল না? এইদিন দেখানোর জন্যই তোমরা আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলে? আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি তোমায় বুঝাতে পারব না। আমি সব সহ্য করে নিয়েছিলাম। এই আঘাত আমি সইব কী করে? আমার দমবন্ধ লাগছে। ও নোভার আব্বু, ওই মানুষটাকে একবার উঠতে বলো না। বলো না পোনি তাকে ডাকছে, বলো না।”

আরিন্তা পুনরায় ছুটে গেল মিশকাতের নিশ্চল, ঘুমন্ত দেহের পাশে। অসহায়ের মতো আহাজারি করল,
“ও মিশু ভাই, ওঠো না মিশু ভাই। তুমি আমায় বকবে না? তোমার পোনি আর তোমার সাথে ঝগড়া করবে না, বিশ্বাস করো। আর তোমায় কষ্ট দিবে না। ওঠো না…।”

খানিক বাদে আবারও আরিন্তা জ্ঞান হারাল। আরিন্তার বিলাপ চারপাশের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করছে বুঝতে পেরে নিয়াজ মেয়েদের দিয়ে অজ্ঞান আরিন্তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। আয়েশা, মেরিনার একই অবস্থা। শমসের আলী চিৎকার থামিয়ে এখন অনুভূতিশূন্য, ভাবলেশহীন সিক্ত চোখ মেলে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মানুষের বাবা হারালে না কি পরিবারের প্রাণ হারিয়ে যায়? তার তো ছেলে হারিয়ে পরিবারের প্রাণ হারানোর অনুভূতি হচ্ছে। এই ছেলেটাই তো তার পরিবারের প্রাণ ছিল। গোটা পরিবারকে দায়িত্ব নিয়ে নিজের কাঁধে তুলে রেখে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছিল। এই প্রাণ ছাড়া তার পরিবার কীভাবে টিকে থাকবে? পাঁচ বছর বাদে ছেলেকে এক পলক দেখেও তারা শান্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু কোনোদিন না দেখার যন্ত্রণা কীভাবে সহ্য করবেন? কীভাবে মেনে নিবেন পরিবার জুড়ে ছেলের অভাব? বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে যে ছেলে পরিবারকে বাঁচাতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল, সে ছেলের বিদায় মেনে নেওয়া কি এত সহজ? মিশকাতের বাবা-মায়ের তো মনে হচ্ছে তাদের শরীর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটাই হুট করে খসে পড়েছে।

আত্মীয়-স্বজনরা বোনের বিয়েতে এসে সাক্ষী হলেন ভাইয়ের করুণ মৃ’ত্যুর। সুবর্ণাকে কিচ্ছু জানানো হয়নি। জানানো হয়েছে তার শ্বশুর-শাশুড়ি আর স্বামীকে। তার বিয়ের মাত্র দ্বিতীয় দিন। সে আশায় ছিল পরদিন বউভাতে আপনজনদের দেখার। তার শ্বশুরবাড়িতে বউভাতের জন্য আজ থেকেই নানান প্রস্তুতি চলছে। এরমধ্যে তার বর হঠাৎ তাকে নিয়ে কোথাও যাবে শুনে অবাকই হয়েছিল। তবু সারপ্রাইজ ভেবে যেতে রাজি হয়েছিল। বাড়ি যাওয়ার পথ তার জানা নেই। তার ওপর রাতের অন্ধকার। তাই গাড়িতে বসে বুঝতে পারছিল না কোথায় যাচ্ছে। পথ শেষ হচ্ছে না দেখে সে অধৈর্য হয়ে পড়ায় তার বর বলেছে একটু দেরী হবে। তার বর তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। বিয়ের ব্যস্ততার মাঝে ঠিকঠাক ঘুমাতে না পারাতে মেয়েটা গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে। মাঝরাতেও জানালা দিয়ে নিজের এলাকা চিনতে তার ভুল হলো না। সে অত্যাশ্চর্য মুখোভাব নিয়ে বরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এ তো আমাদের এলাকা! আপনি আমায় আমাদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন? কেন?”
“এসেই তো পড়েছি। আরেকটু একটু ধৈর্য ধরো।”

সুবর্ণার হঠাৎ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো। কোনোকিছু স্বাভাবিক মনে হলো না। সে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল,
“কী ব্যাপার বলুন তো? বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“সমস্যা হবে কেন? চুপ করে বসো।”
“না, না, আমার ভালো লাগছে না কিছু। এতরাতে আপনি আমায় কিছু না বলে আমাদের বাড়ি আনবেন কেন? কালই তো বউভাত। আমার বাবা ঠিক আছে তো? বলুন না।”
“তোমার বাবা একদম ঠিক আছে। প্যানিক হয়ো না তুমি।”
সুবর্ণা নিজের কোলের ওপর চোখ বুলিয়ে বলল,
“আমার ফোন কোথায়? দেখি, ফোন দিন। নিশ্চয়ই কিছু খারাপ হয়েছে। ফোনটা দিন।”
“ফোন দিয়ে কী করবে এখন?”
“ভাইয়ার সাথে কথা বলব।”
“এখন আর কথা বলতে হবে না। এসে পড়েছি। তুমি নিজেকে শান্ত করো প্লিজ। এমন টেনশন করলে শরীর খারাপ হবে।”

গাড়ি বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই সুবর্ণার কানে ভেসে এল এক পরিচিত কন্ঠের আহাজারি। তার মায়ের কন্ঠ। সঙ্গে-সঙ্গে সে কান খাঁড়া করে আতঙ্কিত মুখে বলে উঠল,
“মা কাঁদছে।”
“কোথায়?”
“আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমার বাবা কী হয়েছে? আল্লাহ্!”

সুবর্ণা প্রায় কেঁদেই ফেলল। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে থামাল বাড়ির ভেতরে। রাত তখন আড়াইটা। গাড়ির দরজা খুলে তাড়াহুড়া করে নেমে দাঁড়াতেই সুবর্ণা দেখল উঠানেই চেয়ার পেতে বসে আছে তার বাবা। এলাকার কয়েকজন মানুষও দেখা যাচ্ছে। গোটা বাড়িটা কেমন ঝিম মে’রে আছে। কেমন থমথমে পরিবেশ! সুবর্ণা এগিয়ে গিয়ে বাবাকে ডাকল। শমসের খাঁন সাড়া দিলেন না। পাথরের ন্যায় বসে রইলেন। সুবর্ণা গায়ে হাত দিয়ে ডাকার পর কেবল চোখ তুলে তাকালেন। মেয়ের মুখটা দেখেই তার দুচোখ বেয়ে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সুবর্ণা ভেজা চোখে জানতে চাইছে,
“কী হয়েছে বাবা? ও বাবা, বলো না।”

শমসের খাঁন উত্তর দিতে পারছেন না। তার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। ছোটো চাচার ঘর থেকে পুনরায় মায়ের আহাজারি ভেসে আসতেই সুবর্ণা সোজা হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল চাচার ঘরের দিকে। তার চাচার ঘরটা টিনের তৈরি। দরজা ভেজানো ছিল। সুবর্ণা এক ছুটে বারান্দায় উঠে এসে দেখল খাটিয়ার পাশে বসে তার কান্নারত মা। খালা, চাচিদের হাতে তাসবি। কেউবা কোরআন পাঠ করছে। সবার চোখে জল। তার মন বলল চাচা নেই। কিন্তু মায়ের পাশে আরিন্তাকেও দেখতে পেল। কেমন পাথুরে মূর্তির মতো বসে আছে! মনে হচ্ছে এতটুকু জ্ঞান নেই। সুবর্ণা রুদ্ধশ্বাসে মায়ের কাছে গিয়ে বসতেই আয়েশা খাতুন তাকে দেখে এক চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
“সুবর্ণা রে, তোর ভাই শেষ রে সুবর্ণা। আমার বুক খালি করে দিছে রে মা।”

সুবর্ণা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। অবিশ্বাস্য চোখে খাটিয়ায় শায়িত দেহের দিকে তাকালে ওপাশ থেকে তার চাচি মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দিলো। নিমেষেই সুবর্ণা ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল,
“ও আল্লাহ্ গো…আমার ভাই! ও মা আমার ভাইয়ের কী হয়েছে? ও ভাই, ও ভাই তোমার কী হলো? ও আপু, আমার ভাই এখানে শুয়ে আছে কেন? ও ভাই গো…।”

সুবর্ণার ছটফটানিতে আরেক দফা কান্নার রোল পড়ে গেল। এই তো গতকালই তার ভাই তার বিদায়ে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদল। সেই ভাই আজ তাকেই কাঁদিয়ে আজীবনের জন্য বিদায় নিল, এ যেন তার কল্পনার বাইরে। সারাদিন সে ভাইয়ের ফোনে অনেকবার ফোন করেছিল। বন্ধ পেয়ে যখন বাবাকে ফোন করেছিল, বাবা বলেছিল ভাই ব্যস্ত। ফোনটা হয়তো চার্জ দিতে ভুলে গেছে। সুবর্ণা জানে তার ভাই আজকাল দরকারের বাইরে খুব সহজে ফোনের খবর রাখে না। তাই সে বাবার কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিল। এখন টের পাচ্ছে তার বাবার মিথ্যা বলার কারণ, তার বর কেন মিথ্যা বলে তাকে এই অবধি নিয়ে এসেছে।

আরিন্তা দুর্বল হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে পড়া সুবর্ণাকে ধরতে চাইল। কিন্তু তার নিজের শরীরেই এক ফোঁটা শক্তি নেই। চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। তার কন্ঠ বসে গেছে, গলা দিয়ে কথা বেরোতে চাইছে না। সুবর্ণার গায়ে হাত দিয়ে সে মৃদু স্বরে বলল,
“তোর ভাই আজীবনের শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছে রে সুবর্ণা। তোর ভাইয়ের আর কোনো দুঃখ নেই। সব কষ্ট ভুলে ঘুমিয়ে পড়েছে।”

সারাটা রাত রাতজাগা পাখির মতো মানুষগুলো জেগে রইল। কাঁদল, আহাজারি করল, জ্ঞান হারাল, কখনোবা থম মে’রে রইল। এভাবেই পেরিয়ে গেল ভয়ঙ্কর এক রাত। সকালের আলো ফুটতে দেখেই নতুন করে যেন সবার বুকে ব্যথা জেগে উঠল, ভয় হলো। সময় ফুরিয়ে আসছে। এরপর এই প্রাণহীন দেহটাও তাদের কাছে থাকবে না। চিরদিনের জন্য মিশে যাবে আপন ঘরে। কেউ আর কোনোদিন তাকে দেখতে পাবে না, ছুঁতে পারবে না। এলাকায় মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সকাল আটটায় জানাজা। মুরব্বিরা জানাজার আগে আর কোনো নারীদের মুখ দেখাবে না বলে দিলো। দেখলেন কেবল আয়েশা খাতুন। মিশকাতের মৃ’তদেহ জানাজার জন্য মসজিদে নিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও আরিন্তা আর সুবর্ণা শেষ এক নজর দেখার জন্য খুব অনুনয়-বিনয় করল। তাদের জোরাজুরিতে শেষে অল্প সময়ের জন্য মুখ দেখাল। দুই বোন মিলে আবারও পরিবেশ ভারী করে তুলল। আরিন্তা মিনমিনে স্বরে বিলাপ করল,
“তুমি মুক্ত মিশু ভাই, সব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত। অনেক ভালো থেকো। তোমার বুকে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো না হয় আমিই বহন করে রাখব। তবু তুমি এখন থেকে ভালো থেকো। পারলে তোমার পোনিকে মাফ করে দিয়ো।”

মুরব্বিরা সরে যেতে বললে আরিন্তা-সুবর্ণা খাটিয়া আঁকড়ে ধরে বসে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে উঠল। সম্ভব হলে যেন তারা এই মানুষটাকে এভাবেই নিজেদের কাছে রেখে দিত। কিন্তু তা যে অসম্ভব। পাঁচ বছর পর বাড়িতে পা রাখা ছেলেটাকে চার দিনের মাথায় শমসের খাঁন কাঁধে তুলে চিরকালের জন্য বাড়ি থেকে বিদায় দিলেন। তাদের বড়ো শখের প্রথম সন্তান। ছোট্টবেলা থেকে যে গোটা বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছিল। যে ছিল সবার প্রাণ। বুকে পাথর চেপে আজ সেই সন্তানের জানাজা পড়ে রেখে এলেন মাটির গভীরে, সম্পূর্ণ একা। পারলে শমসের খাঁন নিজের বুকটা চিরে ব্যথাদের থেকে বাঁচতে চাইতেন। মিশকাত আজ সত্যিই মুক্তি পেয়েছে। তার বুকে জমে থাকা দীর্ঘদিনের অসহ্য যন্ত্রণাদের ফেলে রেখে গেছে নিজের পরিবার, পরিজন, একমাত্র ভালোবাসার মানুষটির হৃদয়ে।

বাড়ি জুড়ে এক মিশকাত খাঁন হারানোর শোক ছড়িয়ে আছে। কেউ যেন ঘোর থেকেই বেরোতে পারছে না। এখনও সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়। তবু নিয়াজ থেমে নেই। পুলিশদের সঙ্গে সে সবসময় যোগাযোগ করে চলেছে। পুলিশ তাদের মতো তদন্ত চালাচ্ছে। নিয়াজ বেশিদিন এখানে থাকতে পারেনি। তাকে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু আরিন্তাকে সে কোনোভাবেই সাথে নিতে পারেনি। পুলক তালুকদার নিজেই তারপর বলেছিলেন কটা দিন রেখে যেতে। আরিন্তাকে রেখে যাওয়ার সাহস তার হচ্ছিল না। শেষে আরিন্তার জেদে রেখে যেতে হয়েছে। যাওয়ার আগে সে সুবর্ণাকে বারবার করে অনুরোধ করে বলে গিয়েছে কষ্ট হলেও সে যেন আরিন্তার দিকে একটু খেয়াল রাখে। তাছাড়া আরিন্তা এখনও শোকের ছায়া থেকে বেরোতে পারেনি। তাই ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়েও তার চিন্তা হয়।

জোরালো তদন্তে অপরাধী সামনে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। মাত্র দশ দিনের মাথায় খু’নী ধরা পড়েছে। তাতেই বেরিয়ে এসেছে এই হ’ত্যাকাণ্ডের মূল কাহিনি। হ’ত্যাকারী তিনজন যুবক। দুজন মিশকাতের নিজের এলাকার, একজন পাশের এলাকার। নিজের এলাকার দুজন ছেলেই একসময় তার বন্ধু ছিল। তারা ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে খেলাধুলা করেছে। তাদের জবানবন্দিতে জানা গিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড তাদের পরিকল্পিত। মিশকাত আসার পরপরই তারা পরিকল্পনা করে রেখেছিল। পরিকল্পনামাফিক ঘটনার রাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন, তখন তারা মিশকাতকে ফোন করে। মিশকাত তখনও জেগে ছিল। মিশকাত ফোন রিসিভ করলে তারা তাকে বাইরে ডেকে এনেছিল দরকারি কথা আছে বলে। তারা বলেছিল তাদের একজন খুব বিপদে পড়েছে, তাই মিশকাতের সাহায্য দরকার। মিশকাত বাইরে এলে তবেই তাকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সবটা বলবে। বন্ধুরা বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে বাড়ির সামনে চলে এসেছে ভেবেই মিশকাত গায়ে টি-শার্ট আর হাতে ফোনটা নিয়েই বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল। রাস্তায় গিয়ে বন্ধুদের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সেখান থেকেই তারা এটা-ওটা বুঝিয়ে তাকে নিয়ে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গলের কাছে এসেই তারা মিশকাতকে আটকে ফেলেছিল। তার থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে জানতে চেয়েছিল সে কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। জেদি মিশকাত তাদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয়নি। তার জেদের কারণেই তার গায়ে হাত তোলা হয়েছিল। একের পর এক আঘাতের পরও যখন সে মুখ খোলেনি তখনই ছেলেগুলোর মাথায় র’ক্ত চড়ে উঠেছিল। জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা লাঠি রেখে তারা রামদা দিয়ে কো’পানোর ভয় দেখাচ্ছিল। শেষমেষ মিশকাতের মুখ বেঁধে সেই রামদাতেই মিশকাতের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লা’শে পরিণত করা হয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা দেহ থেকে প্রাণটুকু বেরোনোর অপেক্ষা না করেই তার দেহটা বস্তাবন্দি করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল জঙ্গলের ওপাশের পরিত্যক্ত পুকুরে। তারপরেই তারা বাড়ি এসে দরজা খোলা পেয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়েছিল মিশকাতের ঘরে। নিঃশব্দে সারা ঘর তন্নতন্ন করে আলমারির চাবি খুঁজেছিল তারা। চাবি না পেয়ে শেষমেষ কৌশলে তালা ভেঙে পেয়ে গিয়েছিল নিজেদের কাঙ্ক্ষিত সম্পদ। তারপর সেসব বন্টন করে নিয়েছিল তিনজন।
সম্পূর্ণ ঘটনার নিশ্চয়তায় তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মাধ্যমে এই মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। সাথে তাদের চুরি করা অর্থ-ও মিশকাতের পরিবারের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

আগামীকাল আরিন্তাকে নিতে আসবে নিয়াজ। এতদিন সে এ বাড়িতেই ছিল। প্রতিদিন গিয়ে দূর থেকে দেখে এসেছে মিশকাতের কবরটা। আজ সে অনেকবার করে মিশকাতের কাছে গিয়েছে। আজ আবারও তার চোখ দুটো বারংবার বাঁধ ভাঙছে। আগামীকাল চলে গেলে আবার কবে সে মিশু ভাইয়ের কাছে আসতে পারবে নিশ্চয়তা নেই যে। এরমধ্যে সুবর্ণা একবার শশুরবাড়ি গিয়ে এসেছে। শত হলেও সে নতুন বউ। ভাইয়ের মৃ’ত্যুশোকের কারণে তাদের বউভাতের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছিল। সুবর্ণার বর বলেছে এসব শোক কা’টিয়ে ওঠার পর সে নিজেই একদিন আয়োজন করে সবাইকে দাওয়াত করবে। ওসব পরেও করা যাবে। সুবর্ণার সবচেয়ে বড়ো দুশ্চিন্তা ছিল বাবা-মাকে নিয়ে। তার বর তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে এসব নিয়ে যেন সে দুশ্চিন্তা না করে। শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব সে নিজেই নিতে পারবে। ছেলে হারানো বাবা-মায়ের আরেক ছেলে হয়ে উঠতে তার কোনোরকম আপত্তি নেই। সুবর্ণা যেন কপাল করে এই লোকটাকে নিজের জীবনে পেয়েছে।

মিশকাতের আলমারিতে একটা লাগেজ পাওয়া গিয়েছিল। বাড়ি এসে সবকিছু সুবর্ণার হাতে আনপ্যাক করালেও ওই লাগেজটা সে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। সুবর্ণাকে বলেছিল সে চলে যাওয়ার পর এটা আরিন্তাকে দিতে। লাগেজের তালাও ভাঙা ছিল। কিন্তু সুবর্ণা সেটা কারোর হাতে দেয়নি। নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। আজ আরিন্তাকে একা ডেকে সে লাগেজটা তার হাতে তুলে দিলো। তদন্তের সময় আরিন্তা এই লাগেজের কথা শুনেছিল। কিন্তু তখন সুবর্ণা সবাইকে বলেছিল এই লাগেজে জামাকাপড় আছে। সুবর্ণা যখন বলল এটা আসলে তার, আরিন্তা ভেতরের জিনিসটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। লাগেজ খুলে ভেতরে পেল লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি। সঙ্গে কিছু সাজগোজের সরঞ্জাম। হতবাক হয়ে আরিন্তা সেগুলো হাতে নিয়ে বসে রইল। সুবর্ণা বলল,
“এগুলো হয়তো ভাইয়া ওখানে যাওয়ার পরপরই কিনেছিল তোমার জন্য। কী পাগল ছিল আমার ভাইটা! ভাগ্যে কী লেখা আছে না জেনেই-”

বেনারসিটা দুহাতে জড়িয়ে আরিন্তা কেঁদে ফেলল। এই বেনারসি গায়ে জড়িয়ে তার মিশকাত খাঁনের বউ হওয়ার কথা ছিল। আর আজ বেনারসি আছে, মিশকাত খাঁন নেই। সে-ও আজ অন্যের ঘরের বউ। একসময় সুবর্ণা বলে উঠল,
“জানো আপু? কেন জানি মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় এই হ’ত্যাটা আমার ভাই ইচ্ছা করে বরণ করে নিয়েছিল। ওর বুকের ভেতর অনেক যন্ত্রণা আটকে ছিল। হয়তো সেসব থেকে মুক্তি পাওয়ার লোভেই ও চুপ ছিল। শেষমেষ মুক্তি পেল, বলো? আমার সবচেয়ে বড়ো দুঃখ কী জানো? আমার ফুলের মতো ভাইটার এই করুণ পরিণতি প্রাপ্য ছিল না।”

পরদিন খুব ভোরবেলা আরিন্তা সেই বেনারসি গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো। বাড়ির সবাই তখন ঘুমে। শমসের খাঁন মসজিদে গিয়েছেন। আয়েশা নামাজে বসেছেন। নোভার পাশে সুবর্ণা ঘুমিয়ে আছে। এই সুযোগে বেনারসি পরে সে চুপিচুপি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সোজা বাড়ির সামনে চলে গেল। মিশকাতের কাছে। দূর থেকে সে চেয়ে রইল মিশকাতের পানে। এখানে এলেই তার মনে হয় মিশু ভাই তার দিকে চেয়ে আছে। আরিন্তা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। খালু ফিরবে কথাটা মনে হতেই সে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। যাওয়ার আগে সে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আপনমনে বলে গেল,
“মিশু ভাই, দেখো, তোমার কেনা বেনারসি পরেছি। তোমার পোনিকে ভালো লাগছে? আজ চলে যাচ্ছি অন্যের সংসারে। তুমি তো চাও আমি ওখানে ভালো থাকি, তাই না? চিন্তা কোরো না। আমি তোমার এই চাওয়াটুকু পূরণ করে রাখব। তোমার পোনি সবসময় ভালো থাকবে। তুমি জানতে চেয়েছিলে না ভালোবাসার এতটুকু অংশ অবশিষ্ট আছে কি না? আজ শুনবে? শোনো, তোমায় যতটুকু ভালোবেসেছি, গোটা জীবন ফুরিয়ে গেলেও আমি বোধ হয় এত ভালো কাউকে বাসতে পারব না। হ্যাঁ, আমার স্বামী আছে। তাকে আমি নিরাশ করি না, কোনোদিন করব না। কেউ কোনোদিন জানবে না এই সংসারী সুখী মেয়েটার বুকের ভেতর ঠিক কী পরিমাণ ব্যথা জমে আছে। লোকে আমায় মন্দ বলুক, নিন্দা করুক। তবু আমি এক জীবন ভালোবাসার মানে তোমাকেই বুঝব। তুমি বরং অনুভূতিতে বেঁচে থেকো এক জনম। আমি শেষ অবধি সেই অনুভূতি বয়ে বেড়াব। আসি, ভালো থেকো মিশু ভাই।”

মিশকাতের ভালোবাসায় মোড়ানো চাঁদটা বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছে। মিশকাত তাকে পিছু ডাকছে না। তার এক জীবনের চাঁদাসক্তি যে বিরহবিধুর হয়েই ফুরিয়ে গেল।

~সমাপ্ত~

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-২৭+২৮

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৭.
সুবর্ণার বিয়ে। এই নিয়ে যেন আরিন্তার আনন্দের শেষ নেই। শুনে হতে সে এটা-ওটা পরিকল্পনা করছে। মনে করে-করে প্রয়োজনীয় সব জিনিসে লাগেজ গোছাচ্ছে। চোখের সামনে যে মেয়েটাকে বড়ো হতে দেখেছে, একটু-একটু করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে দেখেছে, সবসময় যাকে পাশে পেয়েছে; দুদিন পর সেই মেয়েটার বিয়ে। ভাবতেই আরিন্তার ভীষণ ভালো লাগছে। আরিন্তার বিবাহিত জীবনের পাঁচটা বছর কেটে গে’ছে। এই পাঁচ বছরে এমন কোনো মুহুর্ত নেই, যখন এই মেয়েটা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আপনজনদের রূপ আরিন্তা দেখেছে। সে ভেঙেছে, গড়েছে, জীবনকে নতুন করে সাজিয়েছে। যে জীবনের অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষদের মাঝে এই মেয়েটি গুরুত্বপূর্ণ একজন। সুবর্ণার ধৈর্যের প্রশংসা আরিন্তা সবসময় করে। এই পাঁচ বছরে সে নিজের সেই ছোট্ট পার্লারটাকেও ভালো জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। তার পরিচিতিও বেড়েছে। আয়েশার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়া। সংসার জীবনের যে সুখ তিনি ধরে রাখতে পারেননি, সে সুখ তিনি মেয়ের কপালে দেখতে চেয়েছিলেন। তার সেই ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। মায়েরা বোধ হয় এমনই। নিজেদের যত না পাওয়ার দুঃখ তারা মেয়েদের দিয়ে ঘোচাতে চায়। নিজেদের না পাওয়া সুখ তারা মেয়েদের সুখে মিটিয়ে নেয়।

নিয়াজকে আরিন্তা আগে থেকেই বলে রেখেছিল সুবর্ণার বিয়ের দুদিন আগেই তারা গ্রামে যাবে। নিয়াজ যেন কাজের বাহানা না ধরে, সে কারণেই তার এই ঘোষণা। নিয়াজও তা ভোলেনি। ভুলবে কী করে? সে জানে সচরাচর আরিন্তা খুব আয়োজন করে এমন বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহী না। সে শান্তিপ্রিয় মানুষ। নিরিবিলি পরিবেশে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সুবর্ণার বিয়ে নিয়ে তার এত আগ্রহ দেখতে নিয়াজের ভালো লাগছে। তাই তো আরিন্তার ইচ্ছায় বিয়ের ঠিক দুদিন আগেই সে আরিন্তাকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছে। সঙ্গে তাদের দুই বছরের মেয়ে নোভা। গ্রামে পৌঁছে তারা নিজেদের বাড়িতে না গিয়ে একবারে খালার বাড়ি উঠেছে। সুবর্ণা বারবার করে বলে দিয়েছিল আরিন্তা যেন আগে-আগে চলে যায়। তার কথা ফেলতে চায়নি আরিন্তা। বাড়ি পৌঁছে খালা-খালুর সাথে দেখা করেই আরিন্তা মেয়েকে খালুর কোলে দিয়ে সুবর্ণার সঙ্গে গল্প করতে বসে পড়েছে। আয়েশা টেবিলে হালকা নাশতা দিয়েছে। নিয়াজ বসে খাচ্ছে আর আরিন্তার গল্প শুনছে। আরিন্তা অনেক কথা বলে ফেললেও সুবর্ণা সবসময়ের মতো বকবক করছে না খেয়াল করে আরিন্তা জিজ্ঞেস করল,
“তোর মন খারাপ কেন?”
সুবর্ণা মাথা দুলিয়ে বলল,
“মন খারাপ না।”
“তাহলে মুখ এমন লাগছে কেন?”
“এমনি।”
“এমনি? সত্যি কথা বল।”

নিয়াজ বলে উঠল,
“আহা! দুদিন পর মেয়েটার বিয়ে। তোমাকে দেখে ওর খারাপ লাগতে পারে। বোঝো না?”
আরিন্তা সুবর্ণার কাঁধে হাতের ভর দিয়ে বসে হেসে বলল বলল,
“আরে ওসব কিছু না। আমরা তো রোজ ফোনে বকবক করি। সুবর্ণা, একটা জিনিস ভাব। তোর বিয়েতে কিন্তু আমাদের ক্ষতি নেই। এতদিন তুই একা বলে যখন ইচ্ছা আমার কাছে যেতে পারিসনি। বিয়ের পর বরের ঘাড় ধরে নিয়ে চলে যাবি।”

নিয়াজ ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ে হওয়ার আগেই তুমি ওকে এসব শিখাচ্ছ? দু-একটা উপকারী কথা বলো, যা ওর কাজে লাগবে।”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তুমি চুপ করে খাও তো। আমাদের কথার মাঝে ঢুকছ কেন?”
“তো আমাকে এনেছ কেন?”
“এনেছি ভালো করেছি। এখন গিয়ে তোমার আদরের শালাবাবুর খোঁজ করো যাও।”
“পরে যাব।”
“কেন? আসার সময় তো আগে শশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলে।”

নিয়াজ সুবর্ণাকে বলল,
“দেখেছ? যেভাবে বলছে, মনে হচ্ছে ওটা আমার বাবার বাড়ি।”
আরিন্তা বলল,
“তোমারই তো। আমার মা বাদে।”
“অ্যাহ্! মা কেন বাদ যাবে? বাবার বাড়ি আমার হলে, মা-ও আমার।”
“চুপ করো। আজকাল তুমি ঝগড়া শিখে গেছ।”
“সঙ্গদোষ, বোঝো না?”

সুবর্ণা দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমরা ঝগড়া করো কবে থেকে? বাড়িতেও এমন ঝগড়া করো?”
নিয়াজ বলল,
“আরে ধুর! না, না। আমাকে তুমি ঝগড়া করতে দেখেছ কোনোদিন?”
“মাত্রই তো দেখলাম।”
নিয়াজ একটু হোঁচট খেয়ে বলল,
“ওই… তোমার বোন মাঝে-মাঝে তর্ক বাঁধিয়ে বসে।”

আরিন্তা প্রতিবাদ করে বলে উঠল,
“আসছে সাধু! এখন সব দোষ আমার, না?”
নিয়াজ বলল,
“তোমার বোন কি তোমাকে চেনে না?”
আরিন্তা সুবর্ণাকে চেপে ধরল,
“এই সুবর্ণা বল। আমি কি কোনোদিন তোর সাথে ঝগড়া করেছি? জীবনেও করিনি। শুনিয়ে দে তো একটু মশাইকে।”

ভেতরের ঘর থেকে সেই মুহুর্তে সুবর্ণার ডাক পড়ল,
“সুবর্ণা, আমার ফোন কোথায়?”
সুবর্ণা গলা বাড়িয়ে উত্তর দিলো,
“আমার কাছে।”

এদিকে ডাক শোনার সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তা হতভম্ব হয়ে বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে। সুবর্ণার মুখের দিকে অবাক প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
“মিশু ভাই?”
সুবর্ণা থমথমে মুখে মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো,
“কাল রাতে এসেছে। আসার কথা আগে থেকে কাউকে জানায়নি। কাল রাতে হঠাৎ বাড়ি এসে উপস্থিত হওয়ার পর আমরাও সবাই অবাক হয়েছি।”

ভেতরের ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেয়েই আরিন্তা এক ছুটে গিয়ে সুবর্ণার ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো। মিশকাত দরজা খুলে বেরিয়েই এমনভাবে সুবর্ণার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে চমকে উঠল। অথচ এগিয়ে গিয়ে দেখল সুবর্ণা বসার ঘরে বসে আছে। তবে তাকে প্রশ্ন করতে হলো না। প্রশ্নের উত্তর সে সুবর্ণার বিপরীতে বসা পুরুষকে দেখেই পেয়েই গেল। সে একবার নিয়াজের দিকে, আরেকবার সুবর্ণার ঘরের বন্ধ দরজায় তাকাল। নিয়াজ নিজেই জায়গা ছেড়ে উঠে মিশকাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। হাসিমুখে বলল,
“কী খবর মিশকাত? বহু বছর পর দেখা।”
নিয়াজ হাত মিলিয়ে বলল,
“এই তো ভাই ভালো। আপনার কী খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ্ ভালো রেখেছে ভাই।”
“কখন এলেন?”
“কিছুক্ষণ আগেই। তুমি এসেছ জানতাম না।”
“হুট করেই আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কাউকে জানিয়ে আসিনি।”
“যাক, সুবর্ণার জন্য দারুণ সারপ্রাইজ। এসো, বসো। হ্যান্ডসাম হয়ে গেছো আগে থেকে আরও।”

মিশকাত মুচকি হাসল। নিয়াজের সঙ্গে বসতেই নিয়াজ নানান গল্প জুড়ে দিলো। মিশকাতের প্রবাস জীবন, কাজকর্মের ব্যাপারে জানতে চাইল। সুবর্ণা মিশকাতের ফোন ফেরত দিয়ে উঠে পড়ল। মিশকাত তাকে প্রশ্ন করল,
“মা কই রে?”
সুবর্ণা বলল,
“বাইরে।”

নিয়াজ সুবর্ণাকে বলল,
“বসো, ওঠো কেন?”
“আপনাদের কাজের কথা কী শুনব? কথা বলুন। আমার কাজ আছে।”

সুবর্ণা নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো। আরিন্তা নিজের লাগেজ থেকে জিনিসপত্র বের করছিল। দরজা খুলে সুবর্ণাকে দেখে আবার গিয়ে কাজে হাত লাগিয়ে বলল,
“সুবর্ণা, বাবুকে নিয়ে খালু কোথায় গেল রে?”

সুবর্ণা দরজা ভেজিয়ে গিয়ে বিছানায় এক পা তুলে বসে বলল,
“কোথায় আর গিয়েছে? বাইরেই আশেপাশে কোথাও গেছে হয়তো।”
“ওকে কিছু খাওয়াতে হবে। বাসে বমি করেছিল মেয়েটা। পেট খালি, তবু মুখে খাবার দিতে পারিনি। একটু দেখ তো কোথায় গিয়েছে। নইলে এই মেয়েকে নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ালেও তার ক্ষুধা পাবে না। কী যে মুশকিল একে নিয়ে!”

আরিন্তার ব্যস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সুবর্ণা শুধাল,
“পালালে কেন আপু?”
আরিন্তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আরে ধুর! কিসের পালিয়েছি? পাঁচ বছর ধরে অন্যের সংসার করছি, মেয়ের মা হয়েছি। দুদিন পর বুড়ি হয়ে যাব। পালানোর আর বয়স আছে না কি?”
“সামনে তো পড়তেই হবে একসময়।”
“যখনকারটা না হয় তখনই দেখা যাবে। তুই যা তো, বাবুকে নিয়ে আয়। আর একটু কিছু খাবার নিয়ে আসিস তো ওর জন্য।”
“আচ্ছা যাচ্ছি।”

সুবর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল নিয়াজ আর মিশকাত হাসিমুখে গল্প করেই চলেছে। তাকে বাইরে যেতে দেখে নিয়াজ বলল,
“সুবর্ণা, নোভাকে একটু নিয়ে এসো তো বোন। ওকে কিছু খাওয়াতে হবে।”
“ওকে আনতেই যাচ্ছি।”

আয়েশা নিয়াজ-আরিন্তাকে পায়েস খেতে দিয়েছিলেন। গল্পের তালে পড়ে আরিন্তা খায়নি। নিয়াজ ভাবল এটাই নোভাকে খাওয়ানো যাবে। তাই সে মিশকাতকে বলল,
“একটু বসো তো। এটা একটু দিয়ে আসি। মেয়েকে খাওয়াতে পারবে।”

মিশকাত মাথা দোলাল। তাকে বসিয়ে রেখে নিয়াজ গেল আরিন্তাকে পায়েসের বাটি দিয়ে আসতে। ঘরে গিয়ে আরিন্তাকে বলল,
“নাও, বাবুকে এই পায়েসটুকু খাইয়ে দিয়ো।”
“টেবিলে রাখো।”

নিয়াজ টেবিলের ওপর বাটিটা রেখে আরিন্তার ব্যস্ত মুখটা লক্ষ্য করে বলল,
“মিশকাতের সঙ্গে কথা বললাম।”
আরিন্তা কাজে মনোযোগ দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“ভালো।”
“কাজের ভালোই উন্নতি হয়েছে।”
“উন্নতিই তো ভালো।”

নিয়াজ কিছু মুহূর্ত চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। এরপরও আরিন্তা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে দেখে সে কাছে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে আলতো করে আরিন্তার গলা জড়িয়ে ধরল। আরিন্তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হেসে শুধাল,
“কী?”
“কিছু না।”
“একটা ঘুম দিতে পারতে। ক্লান্ত লাগছে না?”
“উঁহু। একটু বেরুব। বাবুকে খাইয়ে তুমি একটু ঘুমিয়ে নিয়ো।”
“আচ্ছা, যাও। তাড়াতাড়ি ফিরো। জামাটা পালটে যাও।”
নিয়াজ আরিন্তার কপালের কিনারায় চুমু খেয়ে সরে গেল। আরিন্তা ভাঁজ করে রাখা জামাকাপড় থেকে তাকে একটা শার্ট বের করে দিলো।

সুবর্ণা গিয়ে বাবার কাছ থেকে নোভাকে নিয়ে এসেছে। মিশকাত মাত্রই বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছে। সুবর্ণাকে মিষ্টি একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে সে তাকিয়ে রইল। বাচ্চাটা একদম ওর মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। সুবর্ণা যখন তাকে ছবি পাঠিয়েছিল, তখনই সে বুঝে গিয়েছিল এ কার প্রতিচ্ছবি হতে চলেছে। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুবর্ণা সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আরি আপুর মেয়ে।”
মিশকাত বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“মা শা আল্লাহ্।”
বাচ্চাটা কেমন গোল-গোল চোখে মিশকাতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত মুখ তাকে আদর করছে বলেই হয়তো। সুবর্ণা বলল,
“কোলে নিবে? এমনিতে ও খুব চঞ্চল মেয়ে। তবে সবার কোলে চড়তে পছন্দ করে।”
মিশকাত বলল,
“কার মেয়ে দেখতে হবে না!”
“নাও।”
সুবর্ণা নোভাকে কোলে দিতে চাইলে মিশকাত বলল,
“ওকে না খাওয়ানোর জন্য এনেছিস? যা, খাওয়াতে দিয়ে আয়।”
“ও হ্যাঁ, যাই।”

সুবর্ণা নোভাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতে-যেতে বাচ্চাটার সাথে বিড়বিড় করে বলল,
“মামাটা পচা, না? নোভা সোনাকে কোলে নেয়নি। চলো মায়ের কাছে যাই।”

মিশকাত আপন মনে হাসল। সে হাসিতে ঠিক কার প্রতি তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল, বুঝা গেল না। সে তো এখন নিজেকেই তাচ্ছিল্যের তালিকার শীর্ষে ঝুলিয়ে রেখেছে। সুবর্ণার ঘর থেকে অতি পরিচিত কন্ঠটা ভেসে আসছে। তার সঙ্গে নিয়াজ আর সুবর্ণার-ও। বুঝা যাচ্ছে মেয়েকে খাওয়ানোর মিশনে নেমেছে তিনজন। একটু বাদেই শোনা গেল আরিন্তার রাগত কন্ঠস্বর। রেগেমেগে সে বলছে,
“এই তুমি সরবে সামনে থেকে? জোর না করলে তোমার মেয়ে কোন বেলা খাবার গিলে শুনি? পারলে নিজে খাওয়াও, নইলে নিজের কাজে যাও।”

নিশ্চিতভাবে নিয়াজ মেয়েকে জোর করতে বারণ করার ফলেই ঝাড়িটা খেয়েছে। বেচারা! একসঙ্গে বাইরে যাবে বলে মিশকাত নিয়াজের জন্য অপেক্ষা করছিল। এরপর আর সে বসল না। চুপচাপ উঠে বাইরে চলে গেল।

অন্ধকার রাস্তায় ফোনের আলো ফেলে পথ চলছে মিশকাত আর নিয়াজ। নানান কথার মাঝেই মিশকাত বলে বসল,
“ভাই, অনেক ধন্যবাদ।”
“কেন?”
“তাকে ভালো রাখার জন্য।”
“এটা আমার দায়িত্ব। আমি কিন্তু সবটাই করেছি নিজের জন্য। তাই আমাকে ধন্যবাদ জানানোটা যৌক্তিক মনে করছি না।”
“আপনার কাছে অযৌক্তিক মনে হলেও, আমার কাছে যৌক্তিক। আমি জানতাম সে ভালো থাকবে। কিন্তু এতটা ভালো থাকবে, বুঝিনি।”

নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“সে নিজেকে ভালো রাখতে শুরু করেছিল আমার জন্য, কিন্তু বাঁচিয়ে তো রেখেছিল অন্যের জন্য।”
মিশকাত বলল,
“সবই এখন পুরোনো রূপকথা। সময় আর পরিস্থিতি সব পালটে দেয়। মানুষের বাঁচার কারণ পালটানোও অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
“সত্যিই কি তাই?”
“সবটা পেয়ে যাওয়ার পরও আপনার সন্দেহ আছে?”
“সবটা?”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে হেসে পুনরায় বলল,
“মিশকাত, এই একটা জায়গায় এসেই আমি নিজের কাছে হেরে যাই, বুঝলে? এজন্য কখনো নিজেকে প্রশ্ন করি না এতকিছু পেয়ে যাওয়াকে ‘সবটা’ বলে কি না। একটা সিক্রেট কী জানো? আমার পরিচিত সব মানুষ আমাকে খুবই হিংসামুক্ত পুরুষ হিসাবে চেনে। কিন্তু কেবলমাত্র আমি জানি আমি ঠিক কতটা হিংসুটে। কেন জানো? কারণ এই গোটা পৃথিবীতে আমি শুধু একজন ব্যক্তিকেই হিংসা করি, এবং সেই একমাত্র ব্যক্তিটি তুমি।”

মিশকাত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধাল,
“কারণ?”
“কারণ সবকিছু পেয়ে যাওয়ার পরও আমার নিজের কাছে মনে হয় তুমি যা পেয়েছ, তা পাওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। যে আরিন্তাকে তুমি পেয়েছিলে, তাকে আমি কোনোদিনই পাব না। আমি যে আরিন্তাকে পেয়েছি, সে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। এককথায় ভেঙেচুরে অবশিষ্ট যে অংশটুকু থাকে, সেটুকুই আমি পেয়েছি।”
“মানুষ পেয়ে হারায়, আর আপনি পেয়েও সন্তুষ্ট নন?”
“অবশ্যই সন্তুষ্ট। আমার জীবনে এটা অনেক বড়ো একটা পাওয়া। শুধু আমার আজন্মের আফসোস একটাই, তোমার বর্ণনার আরিন্তাকে আমি আবিষ্কার করতে পারিনি।”

আরিন্তার কাছে নিয়াজ খোলা ডায়রি হলেও, তার অগোচরে একটা কাজই সে করছে। নিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। গত পাঁচ বছর ধরেই তার নিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, যা আরিন্তা কখনও টের পায়নি। মিশকাতের বুঝে আসত না এই লোক কী ভেবে নিয়মিত তার খোঁজখবর নেয়। স্ত্রীর প্রাক্তনকে ঘৃণা না করে এত কদর করতে দেখে সে সত্যিই অবাক হত। তবে সে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যায়নি। নিয়াজ বয়সে তার চেয়ে বড়ো হলেও, খুবই বন্ধুসুলভ। যোগাযোগের এক পর্যায়ে তার সাথে মিশকাতের আলাদাই একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যার সবটাই বন্ধুত্বের। নিয়াজ চাইলেই পারত পুরোনো কথা তুলে তাকে আরও ভেঙে দিতে। কিন্তু সে তা ভুলেও করেনি। মিশকাতের মনে হয় নিয়াজ মানুষটাই এমন যে মানুষকে ভাঙতে নয়, নতুন করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সে খুব সুন্দর এক অনুপ্রেরণা।

নিয়াজ হেসে বলল,
“ভাই, আপনি না আমাকে হিংসা করেন? তাহলে এত কদর করার কারণ কী? আপনার তো আমাকে ঘৃণা করা উচিত।”
“জানি না কেন তোমার প্রতি আমার ঘৃণা আসে না। আমার সবসময় মনে হয়েছে তোমার পাশে থাকা দরকার, আমি সেটাই করার চেষ্টা করেছি। তাতেও বা তোমাকে বুঝাতে পারলাম কই? হাজারবার বললাম জীবনকে একটা শেষ সুযোগ দাও। শুনলে তো না-ই।”

মিশকাত মাথা নেড়ে বলল,
“এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অসম্ভব কাজ ভাই। মানুষ আমাকে গর্দভ বলতে পারে, দেবদাস বলতে পারে, বলুক। আমি যে কী পেয়েছিলাম, কী হারিয়েছি আর কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছি; তা শুধুই আমি জানি। দুনিয়ার কেউ আমার বেঁচে থাকার গল্প জানে না। কেউ জানে না গত পাঁচ বছরে আমার একেকটা দিন ঠিক কীভাবে কে’টেছে। পাঁচ বছর আগে যে মিশকাত বেঁচে ছিল, তার চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল, বেঁচে থাকার আক্ষেপ ছিল। আজ আপনি যে মিশকাতকে দেখছেন সে বেঁচে থাকার তাগাদায় বেঁচে আছে। তার ভেতরে প্রাণ, হৃদয় বা অনুভূতি বলতে কিছু আছে কি না সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে একটা পরিবার তার ওপর বেঁচে আছে। বাঁচা, ম’রার আক্ষেপ আর আমার নেই ভাই। আক্ষেপ ছিল শেষবার কাছের মানুষদের একবার যেন দেখতে পারি, এটুকুই। আপনি আবার একজন ভেবে রাগ করবেন না।”

নিয়াজ ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“রাগ করা আমার সাজে না। তুমি কিংবা আরিন্তা, কারোর ওপরেই আমার রাগ নেই। রাগ করার কারণটাই তো অযৌক্তিক, যেখানে তোমাদের কোনো হাতই ছিল না। অন্তত আমার মতো পরিস্থিতি আর যন্ত্রণা বোঝা মানুষদের কাছে অযৌক্তিক হওয়া উচিত। তোমার মতে তুমি বাঁচা থেকে ম’রেছ, আমার মতে আমি ম’রা থেকে বেঁচেছি। এই এক বাক্যেই তো আমার সব বোঝা উচিত। মানুষ আমাকে কী বলবে, তাতে আমারও কিছু আসে-যায় না। আমি জানি আমি যথেষ্ট বুঝদার, এবং আমি যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই যা উচিত মনে হয় তা-ই করি। ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে আমি জানি না। কিন্তু আমি তোমাদের সামনে অন্তত মুখোশ পরে থাকতে চাই না। কারণ তুমি হারিয়েছিলে বলেই আমি পেয়েছিলাম, তুমি ভেঙেছিলে বলেই আমি গড়ে উঠেছিলাম।”

“আমার জীবনে আমি আপনার মতো মানুষ দ্বিতীয়টি দেখিনি। আপনার মতো মানসিকতার মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।”
“আরে ধুর! লজ্জা দিয়ো না তো। যা হওয়ার ছিল হয়ে গেছে। তুমি খুব শক্ত মানুষ। যা-ই বলো, আমি তোমার জীবনের নতুন অধ্যায় দেখার অপেক্ষায় আছি।”

মিশকাত পরিস্থিতি সামলে নিয়ে ফাজলামি করে বলল,
“ভাই, বউ নামক এক্সট্রা প্যারা আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন, বয়ে বেড়ান, শুভকামনা। আমাকে এরমধ্যে টানবেন না।”

তারা দুজন বাজারে গিয়ে একসঙ্গে চা, নাশতা খেল। গল্প করে অনেকটা সময় কা’টিয়ে দিলো। ফেরার আগে মিশকাত বাড়ির সবার জন্য গরম চটপটি নিয়েছে। তা দেখে নিয়াজ হেসে বলল,
“পেলবের কাছে শুনেছিলাম এখানকার চটপটি আমার বউয়ের খুব পছন্দ। প্রতিবারই সে এলে পেলব তার জন্য কিনে নিয়ে যায়, কিন্তু সে খায় না। তার ওপর আজকাল আবার গ্যাস্ট্রিক বাঁধিয়ে বসেছে। বাইরের খাবার খায় না।”
মিশকাত চটপটির প্যাকেটটা নিয়াজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“অন্যেরটা খাবে কেন? দায়িত্ব তো এখন আপনার।”

বসার ঘরে টিভি চলছিল। আরিন্তা, সুবর্ণা আর তার চাচাতো বোনরা বসে টিভি দেখছিল আর গল্প করছিল। আরিন্তার কোল জুড়ে নোভা ঘুমিয়ে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে নিয়াজ, মিশকাত এসে উপস্থিত হলো। বেখেয়ালে আরিন্তা ফিরে তাকাতেই অতি পরিচিত দুটি চোখে আটকে গেল। ক্ষণিকের জন্য দুজনের যেন গোটা জীবনটা এসে থমকে গেল এই একটি মুহুর্তে। বুকের ভেতর ঘাপটি মে’রে বসে থাকা যন্ত্রণারা ফোড়ন কা’টতেই মিশকাত চোখ সরিয়ে নিল। পরমুহূর্তেই আরিন্তা উঠে দু’পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“কেমন আছো মিশু ভাই?”
মিশকাত বোধ হয় হাসিটাকে জোরপূর্বক দখলে রেখে কথার কথা বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো। আমার মেয়েকে দেখেছ?”
মিশকাত মাথা দুলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তোর মতো হয়েছে। দোআ রইল।”
“আমার মেয়েকে তুমি কোলে নিবে না?”

মিশকাত আরিন্তার কোলে ঘুমন্ত নোভার দিকে তাকাল। এ যেন চাঁদের কোলে আরেকটি চাঁদ। মেয়েটাকে দেখলেই তার কেমন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হয়। তাই এখনও কোলে নেয়নি। এবারে যেন সে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না। হাত বাড়িয়ে দিলো। আরিন্তা হাসিমুখে নোভাকে তার কোলে তুলে দিলো। মেয়েটাকে বুকে নিয়ে মিশকাত তার কপালে চুমু খেল। হাত বুলিয়ে আদর করে মৃদু হেসে বলল,
“তোর মেয়েটাকে আমায় দিয়ে দে তো আরি। শুনলাম তুই আর আগের মতো বাঁদর নেই, ভদ্র মেয়েটি হয়ে গেছিস। ওকে আমার কাছে রেখে চঞ্চল বানিয়ে ফেলব।”
আরিন্তা যেন সোজাসাপ্টা বলে দিলো,
“রেখে দাও।”

নিয়াজ চটপটির প্যাকেট আরিন্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তার চেয়ে চলো আমরা মিশকাতের জন্য একটা সুন্দরী বউ খুঁজে আনি। মেয়ে এমনিতেই পেয়ে যাবে। কী বলো?”
আরিন্তা কেবল হাসল। চটপটির পরিমাণ দেখে বলল,
“এত চটপটি এনেছ কী করতে?”
“সবাইকে ভাগ করে দাও, আর তুমিও খাও।”
“আমি খাব না। আমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয় জানো না? সুবর্ণা, সবাইকে একটু ভাগ করে দে তো।”

আরিন্তা চটপটির প্যাকেটটা সুবর্ণার হাতে দিয়ে দিলো। নিয়াজ বলল,
“আজ একটু খাও। কিছু হবে না। মিশকাত আরও সবার জন্য এতগুলো নিয়ে এল।”
আরিন্তা হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আমি আসলে স্বাস্থ্যের তাগাদায় পুরোনো অভ্যাসগুলো ছেড়ে দিয়েছি। সরি মিশু ভাই।”
মিশকাত-ও হাসির ছলে উত্তর দিলো,
“যাক ভালো। তোর বরের টাকা বেঁচে গেছে। ভাগ্যিস ভাই সেই খাদকের কবলে পড়েনি!”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৮.
গায়ে হলুদের দিন সকালেই মেরিনা চলে এসেছেন। আরিন্তা, মিশকাতের আসার খবর পেলব পেয়েছে। কিন্তু কাজের বাহানায় সে ও-বাড়ি যায়নি। কিন্তু না গিয়েও তার উপায় রয়নি। সে বিয়ে করেছে গতবছর। দুদিন আগেই তার বউ বাবার বাড়ি গিয়েছিল। সে বলে দিয়েছে সন্ধ্যার আগে তাকে সুবর্ণার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে। বউকে নিয়ে পেলব অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগমুহূর্তেই উপস্থিত হয়েছে। সুবর্ণাকে তখন স্টেজে বসানো হয়েছে। সবাই সেখানেই ছিল। পেলব এসেই সবার আগে আরিন্তার খোঁজখবর নিল। নিয়াজের সাথে কুশল বিনিময় করল। বিপরীতে দাঁড়ানো মিশকাতের সঙ্গে চোখাচোখিও হলো তখনই। জীবনে প্রথমবারের মতো মিশকাতের সামনে সে ভীষণ রকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অস্বস্তি অনুভব করল। অথচ তাকে চমকে দিয়ে মিশকাত দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে তার সাথে কোলাকুলি করতে-করতে বলল,
“আরে ভাই, আমার উপকারী বন্ধু যে। কী খবর?”

স্পষ্ট খোঁচা অনুভব করে পেলব ‘ভালো, তুই?’ ছাড়া কথাই বাড়াতে যায়নি। তার পাশের শাড়ি পরিহিতা পরিচিত মুখ দেখে মিশকাতই আবার হেসে বলল,
“ভাবি না? কেমন আছেন?”
পেলবের স্ত্রী একগাল হেসে বলল,
“এই তো ভাইয়া ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। তা কী খবর আপনাদের? প্রেম-ট্রেম করে বিয়েও করে ফেললেন! এমন ভাগ্য কজনের হয়? মানাতে গিয়েই তো দাঁত ভেঙে যায়। আপনাদের রাজকপাল বটে!”
“কী যে বলেন ভাইয়া!”

পেলব আরিন্তার কোল থেকে নোভাকে নেওয়ার অজুহাতে সেখান থেকে সরে গেল। পেলবের স্ত্রী ছাড়া কারোরই তা ধরতে অসুবিধা হলো না। মিশকাত তাচ্ছিল্য হাসল। পেলবের বিয়ের গল্প সে সুবর্ণার কাছে সবটাই শুনেছিল। নিজের কলেজেরই এক মেয়ের সঙ্গে পেলব টানা দুই বছর প্রেম করেছিল। গতবছর মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়াতে পেলব বাধ্য হয়ে বাবা-মাকে জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। ভালো পরিবার পেয়ে দুই পক্ষের কারোরই আপত্তি ছিল না। একমাত্র ছেলের বিয়েতেও পুলক তালুকদার ত্রুটি রাখেননি। বড়ো আয়োজন করেছিলেন। আরিন্তা বিয়েতে উপস্থিত ছিল নিমন্ত্রিত অতিথির মতো। একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে তার না ছিল আগ্রহ, না ছিল আনন্দ। পেলব আশাই করে নিয়েছিল এ বেলায়ও বোনের কাছে তাকে কড়া কথা শুনতে হবে। কিন্তু আরিন্তা তাকে কেবল একটা কথাই বলেছিল, ‘নিজের বেলায় ষোলো আনা সবাই বোঝে, অন্যের বেলায় এক আনাও না।’
পেলব সেদিন উত্তর দিতে পারেনি। আরিন্তার মুখে এ ধরনের কথা শুনতে-শুনতে তার বোঝা হয়ে গেছে কথাগুলো তার প্রাপ্য। শুধু স্বীকার করতেই যত আপত্তি, এই যা!

বিয়ের দিন সকালে মিশকাতকে একা ডেকে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া, খালু এসেছে। দেখা করেছ?”
“হ্যাঁ, দেখা হলো।”
“কী বলল?”
“কী বলবে? এমনি খোঁজখবর নিল ওখানকার।”
“ও।”

সুবর্ণা হঠাৎ মিশকাতের একহাত মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
“ভাইয়া, একটা কথা বললে রাখবে?”
“বল।”
“তুমি আর যেয়ো না। এখানেই থেকে যাও প্লিজ।”
“তুই কি চাস না আমি একটু যন্ত্রণামুক্ত থাকি বোন?”
“চাই ভাইয়া। আমি বুঝি তোমাকে। কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর বাবা-মা তো একদম একা হয়ে পড়বে। মানলাম বাবা এখন সুস্থ। তবু তাদের একা করে আমরা দুজনই দূরে থাকব, এটা আমি মানতে পারছি না।”
“চিন্তা করিস না। আজীবন কি আর ওখানে থাকব? একসময় তো আসতেই হবে।”

সুবর্ণার চোখে জল। সে অসহায় মুখে অনুরোধের সুরে বলল,
“অনেক তো হলো, এবার নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে আনো না।”
“সরিয়ে তো নিয়েছি সেই কবেই। সরিয়ে নিয়েছিলাম বলেই তো সবাই ভালো আছে। আর কীভাবে সরতে বলছিস সুবর্ণা?”
“নিজের ভালো থাকার দিকে কি তুমি তাকাবে না? এভাবে তো আর গোটা জীবন কা’টানো যায় না।”

মিশকাত সন্দিহান মুখে বলল,
“হঠাৎ আবার এসব তুললি কেন? তোর কোনো ননদ ঠিক করেছিস না কি আমার জন্য?”
“ফাজলামি কোরো না তো। আমার কি চিন্তা হয় না তোমার জন্য? তোমার এই ছন্নছাড়া জীবন দেখতে কি আমার ভালো লাগে? সবাই ভালো আছে দেখেও, তুমি কেন ভালো থাকবে না?”
“কে বলল আমি ভালো নেই? ভালো না থাকলে এমন বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে সবার সাথে কথা বলতে পারতাম?”
“ভাইয়া প্লিজ। পুরোনো সব বাদ দাও। ভাগ্যের ওপর কারোর হাত নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। কারো জন্য কারোর জীবন থেমে থাকে না, এটা কি তুমি বুঝতে পারছ না? চোখের সামনেই তো দেখছ তার প্রমাণ। তুমি চাইলেই পারো নতুন করে শুরু করতে।”
“সব হবে, সব হবে। আমি ভালোই থাকব। অযথা ভাবিস না তো। তুই এখন আমাকে রেখে শুধু নিজের কথা ভাব।”

সুবর্ণার কান্নার গতি বেড়ে গেল। মিশকাতের বুকে পড়ে সে কাঁদতে-কাঁদতে বলল,
“তুমি বোঝো না কেন ভাইয়া? তোমার জন্য আমার কত কষ্ট হয়। আজকাল আমার এত কষ্ট বাবা-মায়ের জন্যও হয় না, জানো? আমরা সবাই থাকতেও তুমি কেন একা? সবাইকে ভালো রেখে তুমি কেন ভালো থাকতে পারো না? তোমার কী হবে ভাইয়া? তোমার এমন পাথরের মতো রূপ দেখতে আমার ভালো লাগে না, মানতে পারি না আমি। আমার ভাই এমন ছিল না।”

মিশকাত ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“শান্ত হ বোন। আমি ভালো থাকব দেখিস তুই। কাঁদিস না। সবাই তাকিয়ে আছে।”

মেরিনা কাছেই ছিল। একজনকে ডেকে তিনি সুবর্ণাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। সুবর্ণাকে মিশকাতের থেকে সরিয়ে ঘরে নিয়ে গেলে মেরিনা এগিয়ে এলেন। তার দুচোখ ভর্তি টলমলে জলধারা। মিশকাত বলল,
“খালা, তুমিও এখন শুরু কোরো না। অনেক কাজ আছে।”
মেরিনা আঁচলের কোণে চোখের জল মুছে বললেন,
“তুই আমাকে মাফ করবি না বাবা?”
“কিসের মাফ? কী বলছ তুমি খালা? তুমি আমার সাথে কোনোদিন কোনো অন্যায় করেছ? আমি তোমাকে চিনি না? আমার মায়ের থেকে বেশি আহ্লাদ আমি তোমার থেকে পেয়েছি। আমি তোমার আদর ভুলিনি।”
“তোর পরিবর্তন দেখলে আর মনকে মানাতে পারি না রে বাপ। এমন হবে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি আমি।”

মিশকাত খালাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
“খালা, তোমার মিশু ভালো আছে। কেঁদো না। তুমি শুধু দোআ করো আমার জন্য। তোমাদের দোয়া-ই আমাকে ভালো রাখবে।”

সারাদিন ধরে মিশকাতের ব্যস্ততার শেষ নেই। বোনের বিয়েতে কোনো আয়োজনের কমতি রাখেনি সে। বিয়ের কথা ওঠার পর থেকেই সুবর্ণা রোজ তার আসার কথা জিজ্ঞেস করত। কত যে অনুনয়-বিনয় করত মেয়েটা! বিয়েতে একমাত্র ভাই অনুপস্থিত থাকবে, এ ব্যাপারটা নিয়ে সে খুবই মন খারাপ করে ছিল। মিশকাত আসার কথা ভাবেওনি। পরিচিত কয়েকটা মুখ দেখার জন্য বুকের ভেতর ছটফট করলেও সে আসার সাহস করেনি। কারণ সে জানত তার আগমন মোটেই সহজ হবে না। পরিস্থিতি আজন্ম তার প্রতিকূলেই থাকবে। সে চায়নি এত বছর পর তার আগমন কারো জীবনে কোনোরকম প্রভাব ফেলুক। সে চায়নি জিইয়ে রাখা ক্ষত জাগিয়ে তুলে নিজেকে নতুন করে র’ক্তাক্ত করতে। তবু বোনটার কান্নার শব্দ পাথরের মতো এড়িয়ে যেতে পারেনি সে। তাই তো কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে এসে উপস্থিত হয়েছিল বোনের সামনে। সেই মুহূর্তে বাবা-মা-বোনের চমকিত মুখের হাসি আর আনন্দাশ্রু দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। সে চাইলেই পারত আরও আগে এই মানুষগুলোকে দেখে যেতে। কিন্তু সে কখনো ওই সাহসটাই করতে পারেনি।

খুব বেশিদিন থাকার ইচ্ছা তার নেই। যেটুকু ইচ্ছা ছিল, তা-ও আছ শূন্যের কোঠায় নেমে গেল আজকের দিনের সবচেয়ে জঘন্য মুহূর্তটির মুখোমুখি হয়ে। আরিন্তা শাড়ি পরেছে, সেজেছে। সে দেখেছে, দগ্ধ হয়েও চোখ সরিয়ে নিয়েছে। দুচোখ ভরে দেখার অধিকার যে তার আর নেই। খুব সূক্ষ্মভাবে নিজেকে সামলে নিতে জানে সে। এসে হতেই তার প্রমাণ সে দিয়েছে। কিন্তু আজ এত করে ফিরিয়ে রাখা চোখ দুটির সামনেই যখন তার আকাঙ্ক্ষিত নারীটিকে অন্য পুরুষ বুকে জড়িয়ে মুখ জুড়ে আদুরে চুম্বন এঁকে দিলো; সেই অলুক্ষুণে মুহুর্তে তার মনে হয়েছিল সে নিজের সমস্ত ধৈর্য কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। মনে হয়েছিল এই আগমন তার জীবনের জঘন্যতম একটি ভুল। দুর্ঘটনাবশত মুখোমুখি হওয়া ঘটনা থেকে মুখ ফিরিয়ে সে যে গোটা দিন কীভাবে নিজেকে ব্যস্ততায় ডুবিয়ে রেখেছে, তা কেবল সে-ই জানে। এরমধ্যে তার মন সিদ্ধান্ত-ও নিয়ে ফেলেছে, ছুটি থাকলেও সে থাকবে না। বিয়ের ঝামেলা মিটলেই ফিরে যাবে। জোকারের মতো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে এই নরকযন্ত্রণার মধ্যে থেকে নিজের অবশিষ্ট অস্তিত্বটুকু-ও এভাবে শেষ করার কোনো মানেই হয় না।

বোনের বিদায়ে ভাইয়ের এমন বুকফাটা আর্তনাদ ইতিপূর্বে গোটা এলাকায় দেখা যায়নি। যেমনি চিৎকার করছে সুবর্ণা, তেমনি মিশকাত। মানুষজন অবাক হয়ে মিশকাতের কান্না দেখছে আর আফসোস করছে, বোনটাকে খুব ভালোবাসত ছেলেটা। ভাইয়ের কান্না দেখে সুবর্ণা আরও ভেঙে পড়েছে। সে জানে তার ভাইয়ের এ কান্না কেবল তাকে আরেক পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার কষ্টেই নয়, এ কান্নার আরও এক রং আছে। ঘনকালো রং, যা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এ আর্তনাদ বহু বছরের চাপা দেওয়া ব্যথাদের মুক্তি দেওয়ার গোপন কৌশল। কেউ তা জানে না, কেউ জানবেও না। মিশকাতকে আর চাচাতো ভাই আর নিয়াজ শান্ত করার চেষ্টা করছে। আরিন্তা অদূরে দাঁড়িয়ে কেবল চেয়ে-চেয়ে দেখছে। তার পা দুটো এক কদমও সামনে এগোতে পারছে না। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিষাদময় অশ্রুরা। সুবর্ণার বিদায় হয়ে যাচ্ছে, অথচ সে তার কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কে বলতে পারে? অমন আর্তনাদ তাকেও পেয়ে বসে কি না! সুবর্ণা নিজেই এসে তাকে জাপটে ধরে হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। ধরা গলায় নিচু স্বরে বলল,
“আপু গো… আমার ভাইটা শেষ হয়ে গেল। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না।”
আরিন্তা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড় করিয়ে রাখল। হাত তুলে কেবল সুবর্ণাকে একবার জড়িয়ে ধরে বলল,
“কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তোকে দেখতে যাব।”

সুবর্ণাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরও কান্নার আওয়াজ কমেনি। সবার চোখে জল। মিশকাতের সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে তার বাবা, মা, খালা। মেরিনা তাদের কাছ থেকে সরে এসে মেয়ের কাছে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিলেন। আরিন্তার কান্নায় নেই এতটুকু শব্দ। বোধ হয় শব্দেরা সব ফুরিয়ে গেছে পাঁচ বছর আগেই। সে এখন আর্তনাদ করে কাঁদতে ভুলে গেছে। মিশকাতের কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“এই মানুষটা কত দিনের জমানো কান্না নিয়ে বসেছে মা? থামছে না কেন?”
মেরিনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন,
“ভেতরে চলে যা আরি।”
“ভয় পেয়ো না মা। ওভাবে কাঁদার সাহস আর আমার নেই। একজনের মেয়ের মা হয়ে অন্যের জন্য কাঁদতে নেই, আমি জানি।”

মিশকাত রাতের খাবার খায়নি। তার চাচি তার জন্য এক গ্লাস দুধ নিয়ে যাওয়া ধরেছিল। তার থেকে গ্লাস চেয়ে নিয়ে আরিন্তা মিশকাতের ঘরের সামনে উপস্থিত হয়েছে। মিশকাত দরজা খুলেই বসেছিল। আরিন্তা দরজায় টোকা দিয়ে বলল,
“আসব?”
মুখ তুলে তাকিয়ে আরিন্তাকে দেখে মিশকাত হেসে বলল,
“আয়। অনুমতি নেওয়া-ও শিখেছিস দেখছি! নিয়াজ ভাই শিক্ষা দিতে পেরেছে তাহলে।”

আরিন্তা ভেতরে এসে দুধের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে বলল,
“চাচি দিয়েছে, খেয়ে নাও।”
মিশকাত গ্লাসটা হাতে নিল। আরিন্তা তবু দাঁড়িয়ে রইল। মিশকাত কেমন অতিথিদের মতো বলল,
“বসবি? বোস।”
আরিন্তা মাথা নেড়ে বলল,
“বসব না। তুমি আছো কতদিন?”
“কয়েকটা দিন হয়তো। শিওর না।”
“তুমিও চলে যাওয়ার পর খালা-খালু একদম একা হয়ে যাবে।”
“জানি। কিছু করার নেই।”

আরিন্তা আমতা-আমতা করে শুধাল,
“নিজেকে নিয়ে কী ভাবলে?”
মিশকাত খুব সহজভাবে উত্তর দিলো,
“নতুন করে আর কী ভাবব? জীবন তো কোথাও থেমে নেই।”
“যেভাবে চলছে একে কি থেমে থাকা বলে না?”

মিশকাত মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, বলে না। কিছু থেমে নেই বলেই তুই আজ অভিজ্ঞ গৃহিণী হতে পেরেছিস, আর আমি অভিজ্ঞ প্রেমিক।”
“ঠিকই বলেছ। আমাকে অভিজ্ঞ গৃহিণী বানানোর জন্য আর নিজেকে অভিজ্ঞ প্রেমিক বানানোর জন্যই এত বছরে ভুল করেও একবার খবর নাওনি। তাই না?”
“সবই তো বুঝিস। নতুন করে বলার আর কী দরকার?”
“কারণ তোমার এমন জীবনের জন্য নিজের কাছে আজন্ম আমিই দায়ী হয়ে থাকব।”
“কেন? আমি তো তোকে দায় দিইনি। বরং মুক্ত জীবন দিয়েছি।”

আরিন্তা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“হ্যাঁ, মুক্ত জীবন দিয়েছিলে বলেই তো সেদিনের সেই আবেগী, ভেঙে পড়া আমি তোমার মতোই শক্ত পাথরে পরিণত হতে পেরেছিলাম। ওই যে লোহা যেমন আগুনে পুড়ে শক্ত হয়, অনেকটা সেরকমই।”
“আরি, মিশু চাইলে অনেককিছুই করতে পারত, করতে পারে। সে পা’গল, কিন্তু অমানুষ না। আমি পুড়ে কয়লা হয়েছি। আমার ভেতরের কয়লা পুড়তে-পুড়তে ছাই হয়ে যাক, তার বিনিময়ে হলেও তুই ভালো থাক।”
“ভালো আছি মিশু ভাই। আমরা সবাই খুব ভালো আছি। তুমিও ভালো থেকো।”

আরিন্তা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ মিশকাত বলে উঠল,
“শেষ একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি? সেসব ভালোবাসার এক বিন্দুও কি অবশিষ্ট নেই?”
আরিন্তা জবাব দিলো,
“সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। থাকলেও দিতে নেই। সংসার নামক শিকলে আর বাস্তবতার বেড়াজালে বন্দী সেসব উত্তর।”
“নিয়াজ ভাই তার বউকে খুব ভালোবাসে। তাকে ভালোবেসে ভালো রাখিস।”
আরিন্তা মাথা দুলিয়ে বলল,
“রাখব।”

আরিন্তা চলে গেল। মিশকাত ফিরে তাকাল না। কেবল টের পেল একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা বুকের বাঁ পাশ বেয়ে গোটা হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মিশকাত পাত্তা দিলো না, হেসে উড়িয়ে দিলো।

দখিন দুয়ার খুলে
পাখিদের কলতানের বদলে,
তুমি শুনছ তোমার বদ্ধ দুয়ারে বন্দী
নিজের গুনগুন কান্নার সুর।
কেউ শোনে না!
তোমার ফুলেভরা উচ্ছসিত হৃদয়ে
লেপ্টে আছে কালচে লাল রক্তের ছোপ,
কেউ দেখে না!
তোমার রঙিন বসন্ত বিষাদের গাঢ় স্পর্শে
কালো হয়ে আছে,
কেউ জানে না!
আদতে কেউ জানতে পারে না।

আরিন্তা ঘরে গিয়ে দেখল খাটের মাঝখান জুড়ে নোভা শুয়ে আছে। পাশে বসে নিয়াজ মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। আরিন্তা এগিয়ে গিয়ে নিয়াজকে বলল,
“ঘুমিয়ে পড়েছে তো। শুয়ে পড়ো তুমি।”

আরিন্তা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত নোভার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলো। এই মেয়েটা যবে থেকে তার জীবনে এসেছে, তবে থেকেই তার জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা আরও একগুণ বেড়ে গেছে। নিয়াজ শুধাল,
“কোথায় ছিলে?”
“মিশু ভাইয়ের সাথে কথা বললাম একটু।”

সহজ স্বীকারোক্তি করে আরিন্তা সরে যাওয়া ধরতেই নিয়াজ আচমকা তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। আরিন্তা খানিক চমকাল। অথচ তাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইল নিয়াজ। ক্ষণকাল চুপ থেকে আরিন্তা মাথা হেলিয়ে তাকিয়ে নিয়াজের গালে হাত রেখে শুধাল,
“কী হয়েছে?”
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না। তোমাকে প্রয়োজন।”
“আমি আছি তো।”

আরিন্তা নিয়াজের হাত সরাতে চাইল। নিয়াজ সরাতে দিলো না। কেমন অনুরোধের সুরে বলল,
“একটু থাকো না।”

আরিন্তা বুঝল নিয়াজের মনে কী চলছে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে সে নিয়াজের চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি না আমার শক্তি হয়ে আমাকে ভরসা দিয়ে শক্ত করে তুলেছ? নিজে কেন মনোবল হারাচ্ছ? এত বছরেও বিশ্বাসযোগ্য হতে পারলাম না?”
“তুমি ছাড়া কাকে বিশ্বাস করব আমি?”
“তাহলে এসব কী?”

নিয়াজ নীরব রইল। খানিক বাদে মৃদু শব্দে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার নোভার আম্মু।”
আরিন্তা মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
“নোভার আব্বুকেও নোভার আম্মু ভালোবাসে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-২৫+২৬

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৫.
নিয়াজ প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আরিন্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিন্তা একটু ভেবে বলল,
“আন্টির কাছে আজ আপনার ব্যাপারে অনেক কথা শুনলাম। কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে আমি কনফিউজড।”
“সে মিথ্যা বলার মানুষ না।”
“কীভাবে বুঝলেন? আপনি তো শুনলেনই না কী কথা বলেছে।”
“তাকে আমি ছোটোবেলা থেকে চিনি, বুঝা কঠিন কিছু নয়। তারপর বলো কী কথা বলেছে?”

আরিন্তা হোসনে আরার বলা কথাগুলোই একে-এক পুনরাবৃত্তি করল। নিয়াজ চুপচাপ শুধু শুনছে দেখে সে আবার শুধাল,
“কথা বলছেন না কেন? এসব কি সত্যি? আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনি চাপা স্বভাবের মানুষ।”

নিয়াজ হতাশ মুখে বলল,
“আন্টি এসব কথা বলেছে তোমাকে?”
“বলল তো। আপনি কি সত্যিই এমন?”
“যদি হয়ে থাকি?”
আরিন্তা ভাবুক হয়ে বলল,
“হলে কি আমি এতদিনে বুঝতাম না?”
“কখনও বুঝতে চেয়েছিলে?”

আরিন্তার মুখ আটকে গেল। পরক্ষণেই বলল,
“আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছি। আমাকে প্রশ্ন করতে বলিনি।”
নিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“সব হাসিখুশি মুখের আড়ালে স্বাভাবিক জীবন থাকে না। কিছু হাসিমুখের আড়ালের জীবন অস্বাভাবিক রকমেরও হয়। তোমাকে তেমনই এক জীবনের গল্প বলব, শুনবে?”
আরিন্তা‌ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“গল্প?”
নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল,
“হুঁ, একটা ছোট্ট ছেলের বড়ো হওয়ার গল্প।”
“শুনব।”
“আমি গল্প বলতে অভ্যস্ত নই। তুমি কিন্তু বিরক্ত হলে বোলো।”
“বিরক্ত হব না, বলুন।”

নিয়াজ নড়েচড়ে বসে গল্প বলতে শুরু করল,
“গল্পটা যে ছেলেকে নিয়ে, তার ছোটোবেলাটা ছিল খুবই চমৎকার। একদম স্বপ্নের মতো সুন্দর। তার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে এমনভাবে আদর করত, যেন সে রাজপুত্র। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের ছেলেকে অবশ্য রাজপুত্র ভাবারই কথা। সে ছিল মায়ের খুবই বাধ্য ছেলে। বাবা-মাকে নিয়ে পরিবার হওয়ায় মা-ই ছিল তার সকাল থেকে রাতের একমাত্র সঙ্গী। বাবা কর্মব্যস্ত মানুষ ছিলেন। ছেলেকে দেওয়ার জন্য সময় পেতেন খুব কম। ছেলেটার মা তাকে এত বেশি ভালোবাসত যে সে একটু ব্যথা পেলেও মায়ের চোখেই‌ আগে পানি এসে যেত। স্কুলে ছেলেটার অনেক বন্ধু ছিল। কিন্তু মায়ের সান্নিধ্যই তার সবচেয়ে পছন্দের ছিল। আত্মীয়-স্বজন যারা তাকে খুব আদর করত, তাদের সাথেও সে মিশতে পছন্দ করত। মা প্রতিদিন নিজ হাতে তার পছন্দমতো খাবার বানিয়ে দিত, স্কুলে যাওয়ার আগে যত্ন করে রেডি করিয়ে দিত। এমনকি হাতের কাজ রেখে প্রতিদিন ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসত, আবার ছুটির পর নিয়েও আসত। ছেলেটা তখন ঠিক বুঝত না পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি সে। বুঝল কখন জানো?”

আরিন্তার ভালো লাগছিল এক সুখী বাচ্চার গল্প শুনতে। সে কৌতুহল নিয়ে শুধাল,
“কখন?”
“যখন তার মা তাকে লোকে লোকারণ্য পৃথিবীর মাঝে একা ছেড়ে দিয়ে আজীবনের জন্য দূরে চলে গেল, তখন।”

আরিন্তার মুখটা আচমকা কালো মেঘে ছেয়ে গেল। নিয়াজ একটু থেমে পুনরায় বলতে শুরু করল,
“ছেলেটাকে তার বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবাই খুব বুঝানোর চেষ্টা করেছিল, তার মা কিছুদিনের জন্য দূরে গেছে। কিন্তু ছেলেটা বুঝত মা আর তার কাছে ফিরবে না। সকাল থেকে রাতের একমাত্র সঙ্গী হারানোর দুঃখ তার ছোট্ট হৃদয়ে হাতুড়ি পেটার মতো আঘাত করেছিল। সময়-অসময় সে মায়ের জন্য কাঁদত। মানুষ বলত সময়ের সঙ্গে আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সময় গেল, ছেলেটার কান্নাও থামল, কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। বরং ছেলেটা আরও বেশি এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। বাবা তাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারে না বলে খালার কাছে পাঠাতে চেয়েছিল। সবাই রাজি ছিল, একমাত্র ছেলেটা ছাড়া। নিজের ঘর, মায়ের স্মৃতি ছেড়ে কোথাও শান্তি খুঁজে পাবে না বুঝেই সে কোথাও যেতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে বেতন-ভাতা দিয়ে লোক ঠিক করে বাবা তার হাতে ছেলের দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল। বাবা তাকে সময় দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করত। কিন্তু ছেলেটার জন্য সে সময়টুকু বড্ড কম ছিল। কিন্তু বাবারও কিছু করার ছিল না। ওই মানুষটাকে তার ভাই-বোনরা দ্বিতীয় বিয়ে করার তাগাদা দিয়েছিল বহুবার। কিন্তু সে কোনোভাবেই রাজি হয়নি। কারণ সে ছেলের জন্য চিন্তিত ছিল, ছেলের মাকেও সে অনেক বেশি ভালোবাসত। এসব নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলতে-চলতে এক পর্যায়ে এসে ভাই-বোনের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। কেউই তার পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।”

আরিন্তা অসন্তুষ্ট মুখে বলল,
“এ কেমন ভাই-বোন! তারপর?”
“তারপর বছরের পর বছর কা’টল। ছেলেটার জীবনের সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল। পড়াশোনা নিয়েই তার সময় কে’টে যেত। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়া তার জীবনে সে আর কিছুই পায়নি। মায়ের অভাব তাকে কুড়ে-কুড়ে খেয়েছে, কিন্তু সে তা কাউকে বলেনি। স্কুল আর বাসার মধ্যে থাকতে-থাকতে সপ্তাহে একদিন আর বাবার সাথে তার বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করত না। তবু মাঝে-মাঝে বাবা জোর করে ঘুরতে নিয়ে যেত। বাবা যখন বুঝতে পেরেছিল ছেলেটা অল্প বয়সে একা হয়ে পড়েছে, তখন সে খুব বুঝাতে চাইত সে ছেলের পাশে আছে। কিন্তু ততদিনে ‘একাকিত্ব’ নামক ভয়ানক রোগ ছেলেটাকে পেয়ে বসেছিল। একা থাকতে-থাকতে সে বন্ধু-বান্ধবও হারিয়ে ফেলেছিল। নতুন বন্ধুত্ব গড়তে তার মন টানত না। স্কুল, কলেজে সহপাঠীরা তার সাথে ভাব জমাতে চাইত। কিন্তু সে চুপচাপ থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। তারপর একদিন সে নিজের লক্ষ্য পূরণ করে কিঞ্চিৎ আনন্দিত হলো। ততদিনে তার বাবা শয্যাশায়ী। ছেলেটা তখন বাবার মতো কর্মব্যস্ত হলো। আর বাবা পেল তার একাকিত্ব জীবন। নিজের একাকিত্বের অভিজ্ঞতা থেকে বাবার একাকিত্ব তার ভালো লাগত না। ছেলেটা নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন ছিল। সেজন্য বাবা-ই তার জীবনের কথা চিন্তা করে রীতিমতো বিয়ের তাগাদা দিতে শুরু করেছিল। ছেলেটা তখন বাবার চিন্তা ছাড়াও অনুভব করেছিল, সত্যিই এবার তার নিজের একজন মানুষ প্রয়োজন। নিজের মানুষের প্রয়োজনবোধ করার পর থেকেই না অনেক অদ্ভুত সব জল্পনা-কল্পনা তাকে জাপটে ধরেছিল। সবসময় তার মনে হত নিজের একটা মানুষ হলেই তার একাকিত্ব ঘুঁচবে। নিজের জীবনের যত একাকিত্বের গল্প সে নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছে, যত কথা সে সবার থেকে লুকিয়েছে, সেসব কথা সে ওই মানুষটাকে বলবে। নিজেকে মুক্ত করে দিবে তার কাছে। যেসব সময়গুলো তার অযথা কেটে গেছে, সেসব সময়গুলো সে ওই মানুষটাকে নিয়ে সাজিয়ে তুলবে। ওই মানুষটার সঙ্গে সম্পূর্ণ এক নতুন, অন্যরকম জীবন গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা তাকে লোভী করে তুলেছিল। সত্যিই ছেলেটা লোভ করতে শিখেছিল, ভালোবাসা পাওয়ার লোভ। সে খুব করে চেয়েছিল তার নিজের একটা মানুষ হবে যে তাকে খুব ভালোবাসবে, যত্ন করবে, তাকে এত সময় দিবে যে ছেলেটা একসময় নিজের জীবনের যত অভাব, একাকিত্ব ভুলে যাবে। সব দুঃখ, না পাওয়া ভুলে তার জীবন একজন মানুষে আটকে পড়বে। জানো? ছেলেটা ঠিকই নিজের একজন মানুষ পেয়েছে। কিন্তু সময়, যত্ন, ভালোবাসা দূর, তাকে নিজের মানুষ দাবি করতেও তার দুবার ভাবতে হয়। ছেলেটার জন্য আমার খুব বেশি করুণা হয়, জানো তো? আমি চাই ছেলেটার নিজের মানুষটারও তার ওপর একটু করুণা হোক। আচ্ছা আরিন্তা, এক জীবনে ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখ কি করুণায় মিটে? না মিটুক, মনটা অন্তত একটু সান্ত্বনা তো পাবেই। তাই না? হতভাগা ছেলেটার জীবনে এর বেশি আর কীইবা পাওয়ার আছে?”

আরিন্তা শান্ত চোখে নিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। গল্পের শুরুর দিকে নিয়াজের মুখোভাব খুবই সিরিয়াস ছিল। কিন্তু শেষ করতে-করতে সেই মুখে কিছু চাপা বিষাদের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। গলার স্বরও পালটে গেছে। এই মুহূর্তে আরিন্তার কাছে তাকে ঠিক হোসনে আরার বর্ণনার নিয়াজ মনে হচ্ছে। নিয়াজ চুপ হয়ে যাওয়ায় আরিন্তা শুধাল,
“আপনার গল্প শেষ হয়েছে?”

নিয়াজ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আরিন্তা পুনরায় শুধাল,
“আর কিছু বলার নেই?”
“তুমি আরও শুনতে চাও?”
“না। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর চাই। গল্পের ছেলেটার নাম কি ডক্টর নিয়াজ মাহমুদ?”

নিয়াজ মেকি হাসল। সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“খালা তোমাকে যা বলেছে, মিথ্যা কিছু বলেনি। আমার জন্য তার খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগা থেকেই তোমাকে ওসব কথা বলেছে। কিছু মনে কোরো না।”

নিয়াজ উঠে টেবিলে ফিরে গেল। ল্যাপটপটা হাতে তুলে বলল,
“ধন্যবাদ।”
আরিন্তা জানতে চাইল,
“কেন?”
“কেন জানি ভেতরটা হালকা লাগছে।”

নিয়াজ আবিরের ল্যাপটপ ফেরত দিতে যাচ্ছিল। আরিন্তা পেছন থেকে বলে উঠল,
“আপনার মতো একজন মানুষের ভালোবাসার জায়গায় করুণা চাইতে কি আত্মসম্মানে লাগে না?”
নিয়াজ ক্ষণিকের জন্য পা থামিয়ে উত্তর দিয়ে গেল,
“বাইরের মানুষের করুণা তো চাইনি। যারটা চেয়েছি সে আমার ঘরের মানুষ। আমার মতো মানুষের জন্য ঘরের মানুষের ভালোবাসার অভাবের কাছে আত্মসম্মান কেন, গোটা জীবনটাই ব্যর্থ। আমার জায়গায় থাকলে হয়তো বুঝতে ‘না পাওয়া’ ঠিক কাকে বলে।”

এতদিন পর আরিন্তাকে অনলাইনে পেয়ে সুবর্ণা ফোন করেছে। সে জানাল নিয়াজ-আরিন্তার কাপল পিক দেখেছে। প্রশংসা করে বলল,
“তোমাদের খুব সুন্দর লাগছিল আপু।”
আরিন্তা তাকে থামিয়ে দিয়ে শুধাল‌,
“মিশু ভাই ফেসবুকে নেই?”
“আছে। কিন্তু আগের মতো রেগুলার না। মাঝে-মাঝে এলেও বুঝা যায় না। অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস অফ করে রেখেছে।”
তারপর সুবর্ণা মিনমিনিয়ে বলল,
“তোমাদের ছবি দেখেছে।”
আরিন্তার বুকের ভেতর কামড় দিয়ে উঠল। প্রশ্ন করল,
“কী বলল?”
“তেমন কিছু না। শুধু বলল তোমাদের একসঙ্গে মানিয়েছে।”
“সত্যিই কি মানিয়েছে? মন থেকে বলা কথা এটা?”
“জানি না। প্রয়োজনের বাইরে তো কোনো কথা বলে না আমাদের সাথে। তার কথা বাদ দাও।”
“সে কি বাদ দেওয়ার মতো বিষয় সুবর্ণা?”
“না হলেও দিতে হবে আপু। তোমার বর্তমান, ভবিষ্যতের সঙ্গে যার জীবন জড়িয়ে আছে, তার কথা ভাবো। সে ছাড়া বাকি সব তোমার কাছে বাদ দেওয়ার মতোই বিষয়।”
“আমি মাঝনদীতে পড়ে আছি রে বোন। এই অনুভূতি তুই বুঝবি না।”
“তোমার সামনে বাঁচার পথ আছে আপু, তা আঁকড়ে ধরো। মাঝনদীতে না ডুবে নতুনভাবে বাঁচো। কে বলতে পারে? হয়তো সুখের এক নতুন পথ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সেদিকে পা বাড়াও আপু। যত কষ্ট হোক, নিজেকে একটু সুযোগ দাও।”
আরিন্তা চোখ বন্ধ করে বড়ো করে দম নিল। ঢোক গিলে মৃদু স্বরে ডাকল,
“সুবর্ণা?”
“বলো আপু।”
“মিশু ভাইকে জিজ্ঞেস করিস তো, এক আকাশে স্থায়ীভাবে বাস করা এক চাঁদ কখনও অন্য আকাশে জায়গা বদল করতে পারে কি না। উত্তরটা আমাকে জানাতে হবে না।”

নিয়াজের ভাই-বোনরা সবাই তার পেছনে লেগেছে বাইরে যাওয়ার জন্য। আজকের ডিনার তারা বাইরে করতে চায়। আবির সবাইকে আরও উসকে দিচ্ছে। এমনিতেই আরিন্তা এখানে আর থাকতে চাইছে না। তার ওপর এই রাতে আবার তাকে টানাহেঁচড়া করলে অসন্তুষ্ট হয় কি না ভেবে নিয়াজ রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আরিন্তা নিজেই বলে বসল,
“সবাই যখন এত করে বলছে চলুন। এখানে তো আপনার কোনো কাজও নেই। রাজি না হওয়ার কী আছে?”

ব্যস, এটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল নিয়াজকে রাজি করাতে। সবাই মিলে হৈ-হৈ করে বেরিয়ে পড়ল রাতের শহরে। এদিক-ওদিক না ঘুরে সোজা ঢুকে পড়ল পছন্দের রেস্টুরেন্টে। ভুঁড়ি ভোজের সঙ্গে চলল জমিয়ে আড্ডা। তাদের হা-হা, হি-হির শব্দে পাশের টেবিলের মানুষজন রীতিমতো অতিষ্ট। নিয়াজ অনেকবার থামাতে চেয়েও এদের মুখ বন্ধ করতে পারেনি। অন্যদের থামাবে কী? তার নিজের বউয়ের মুখটাই তো আজ থামছে না। সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে-ও আজ কোমর বেঁধে গল্প করতে লেগে পড়েছে। এই ব্যাপারটা অবশ্য তার মন্দ লাগছে না। মেয়েটাকে এমন স্বাভাবিক, হাসিখুশি দেখা তার কাছে সৌভাগ্য মনে হয়। সবসময় তার এমন সৌভাগ্যের মুহূর্ত যে আসে না!

ফেরার সময় ফুটপাত থেকে আবির তার বউকে ফুল কিনে দিলো। মালা কিনে হাতেও জড়িয়ে দিলো। হাসিমুখে ভালোবাসা নিবেদন করল। তার বউ ভীষণ খুশি হলো। নিয়াজকেও সে টেনেটুনে সাথে নিয়ে ফুল কিনিয়েছে। কিন্তু নিয়াজ তার মতো করে আরিন্তাকে ভালোবাসা নিবেদন করতে পারেনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফুলের গোছা আরিন্তার হাতে তুলে দিয়েছে। আরিন্তার মুখেও কেবল ‘ধন্যবাদ’ ছাড়া তেমন পৃথিবীর সকল সুখ পেয়ে যাওয়ার মতো আনন্দের দেখা মিলেনি। আবির হতাশ মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“ইয়া মাবুদ! এসব দিন দেখাতেই বেছে-বেছে এই নিরামিষ দুটোকে জুটি মিলিয়ে দিয়েছিলে?”

এর আগেও নিয়াজ একবার আরিন্তার জন্য অনেকগুলো ফুল কিনে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। আরিন্তা সেগুলো ছুঁয়েও দেখেনি। টেবিলের ওপর অবহেলায় পড়ে থেকে যখন ফুলগুলোর পাপড়ি ঝরে গিয়েছিল, তখন নিয়াজ নিজেই আবার সেগুলো নিয়ে ফেলে দিয়েছিল। ভেবেছিল এবারে আরিন্তা নিজেই ফুলগুলো ফেলে দিবে। কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে বাড়ি ফিরে আরিন্তা ফুলগুলো টেবিলের ওপরের ফুলদানিতে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। যারপরনাই অবাক-ই হয়েছে নিয়াজ। এমনকি আরিন্তা ঘুমাতে গিয়েও বলেছে আজ বাইরে থেকে ঘুরে এসে তার ভালো লাগছে। সবসময় ঘরবন্দী থাকতে-থাকতে তার দমবন্ধ লাগছিল। আরিন্তা যখন চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন নিয়াজ হঠাৎ তাকে ডাকল,
“আরিন্তা?”
আরিন্তা চোখ বন্ধ রেখেই সাড়া দিলো,
“হুঁ?”
“সব কথাই তো শুনলে। শুধু একটা কথা বলা হয়নি তোমায়। শুনবে?”
“বলুন।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি। স্ত্রী বলে কথার কথা বলছি না। সত্যিই ভালোবাসি।”

আরিন্তার চোখ জোড়া ঝট করে খুলে গেল। সহসা সে কোনো উত্তর দিতে পারল না। নিয়াজ ব্যাকুল হয়ে পুনরায় ডেকে উঠল,
“আরিন্তা? কিছু বলবে না?”
“কী বলব?”
“তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে রাগ করবে না?”
“কেন ভালোবাসেন?”
“কেন বাসব না? বউ তো একটাই। একমাত্র বউ ভালোবাসার মতো মানুষ হলে আমি ভালো না বেসে যাব কোথায়?”
“আপনাকে কে বলেছে আমি ভালোবাসার মতো মানুষ?”
“কেউ বলেনি। এতদিনেও কি উপলব্ধি করতে পারব না?”
“উপলব্ধি কীভাবে করলেন? আমি তো কখনও আপনাকে ভালোবাসিনি।”
“কিন্তু আমি তো বেসেছি। তুমি ভালোবাসোনি কারণ তোমার ভালোবাসার মানুষ ছিল, আছে। আমি ভালোবেসেছি কারণ অনেক অপেক্ষার পর আমার ভালোবাসার মতো একটা মানুষ হয়েছে।”
“তাতে কী লাভ, সে-ই যদি আপনাকে ভালো না বাসে?”
“জানি না। তুমি আমায় ভালো না বাসলেও আমার ভালোবাসার অধিকারটুকু অন্তত তুলে নিয়ো না আরিন্তা। তোমার ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট থেকেও আমায় বেশি পোড়াবে তোমাকে ভালোবাসতে না পারার কষ্ট। তুমি কি এরপরও রাগ করবে আরিন্তা?”

আরিন্তা মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলো,
“করব না।”
“তোমাকে ভালোবাসি জেনেও তুমি রাগ করবে না?”
“না‌।”

নিয়াজ লাফিয়ে উঠে বসল‌। আচমকা তার কাণ্ডে আরিন্তা ফিরে তাকাল। নিয়াজ তার দিকে এগিয়ে বসে আনন্দিত মুখে শুধাল,
“তুমি সত্যিই রাগবে না?”
আরিন্তা পালটা প্রশ্ন করল,
“না রাগলে আপনি খুশি হবেন?”
“অনেক খুশি হব।”
“ঠিক আছে। আর রাগ করব না।”

নিয়াজ হাসিমুখে বলল,
“দেখেছ? আমি বলেছি না তুমি ভালোবাসার মতোই মানুষ? আচ্ছা? তুমি কি জানো আমি তোমাকে এত ভালোবেসে ফেলেছি কীভাবে?”
“না।”
“রোজ রাতে তুমি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকো, তখন আমি চুপচাপ বসে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।”

আরিন্তা অবাক হয়ে বলল,
“সত্যি?”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে বলল,
“সত্যি। ঘুমের মধ্যে তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। একদম নিষ্পাপ, কোমল ফুলের মতো লাগে। আমার চোখ ফেরাতে কষ্ট হয়। তখন আমার কী ইচ্ছা করে জানো?”

আরিন্তা দুপাশে মাথা নাড়ল। নিয়াজ বলল,
“তোমার কপালে চুমু খেতে ইচ্ছা করে। ভীষণ ইচ্ছা করে। কিন্তু তুমি কাঁদবে বলে আমি নিজেকে আটকে রাখি। ভালোবাসার মানুষের থেকে নিজেকে আটকে রাখা খুব বেশি কঠিন, জানো? তবু আমি তোমায় কাঁদাতে চাই না। আচ্ছা আরিন্তা, আমি যদি তোমার কপালে চুমু খাওয়ার অনুমতি চাই, তুমি অনুমতি দিবে?”

নিয়াজের চোখে-মুখে-কন্ঠে আকুল আবেদন। যেন কতশত বছর পর সে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে। আরিন্তার চোখ ভরে জল চলে এল। প্রিয় মানুষটির দুচোখে টলমল জল দেখে নিয়াজ ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল,
“তোমাকে আমি জোর করছি না। কাঁদবে না প্লিজ। তোমার কান্নার শব্দ আমার বুকে খুব বিঁধে। তুমি জানো না রোজ সেই শব্দ সহ্য করতে আমার কী কষ্ট হয়! প্লিজ আরিন্তা। আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিলাম। তোমাকে কোনো অনুমতি দিতে হবে না।”

আরিন্তা তাকে স্তব্ধ করে দিয়ে বলে উঠল,
“অনুমতি দিলাম।”
নিয়াজ পুরোদস্তুর অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আরিন্তা পুনরায় ধরা গলায় বলল,
“কী? শুনছেন না? আপনাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”
“সত্যি?”

এরপর আরিন্তা মুখে উত্তর না দিয়ে হাত তুলে নিজের কপালের ওপরে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিলো। নিয়াজ রোবটের মতো ঝুঁকে পড়ে আরিন্তার কপালের ঠিক মাঝ বরাবর চুমু খেল। ক্ষণিকের নয়, দীর্ঘ চুমু। সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তার চোখের টলমলে জল সব কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল‌। নিয়াজ তার কপাল থেকে ঠোঁট জোড়া সরিয়ে নিয়ে তার ভেজা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমি কী করলে তোমার এই চোখের পানি চিরতরে বন্ধ করতে পারব আরিন্তা? ভালোবাসা কি শুধু কাঁদাতেই পারে? কান্না ভুলিয়ে দিতে পারে না?”

উত্তরে আরিন্তা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে উঠল। নিয়াজ বিচলিত হয়ে উঠল,
“আরিন্তা? সরি আরিন্তা, কেঁদো না প্লিজ। আমি আর তোমার কাছে এমন আবদার করব না। প্লিজ, শান্ত হও।”

আরিন্তা থামল না। নিয়াজ তার চোখের পানি মুছে দিলো, সে কিছু বললও না। নিয়াজ কেমন বিপাকে পড়ে গেল। না পারল সরে যেতে, না পারল মেয়েটাকে থামাতে। শেষমেষ সে সব ভাবনা-চিন্তা, সংকোচ, দূরত্ব ভেদ করে আকাশ-পাতাল না ভেবে আরিন্তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। সে ধরেই নিল আরিন্তা তার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মেয়েটা নড়লও না। সে যেভাবে বুকে তুলে নিয়েছে, সেভাবেই তার বুকে পড়ে অশ্রু বিসর্জন দিলো। কেবল তার হাত দুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রইল বিছানার চাদর। নিয়াজের বুকের ভেতর এক মিশ্র অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। একদিকে মেয়েটার কান্নার শব্দ তার বুকে আঘাত করল। আরেকদিকে এই প্রথমবার মেয়েটাকে নিজের বুকে পেয়ে তার কেমন ‘না পাওয়া’ কিছু আকস্মিকভাবে পেয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ অনুভব হলো। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তার মনে। নিয়াজ এক হাত তুলে পরম আদরে আরিন্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কোমল কন্ঠে বলল,
“ছিঁচকাদুনে মেয়ে, স্বামীহারা মেয়েদের মতো কেঁদো না। তোমার স্বামী এখনও বেঁচে আছে। তুমি রাখলে সে মৃত্যুর আগ অবধি তোমার পাশে থাকবে। হৃদয়ের কাছাকাছি গিয়েও কি তুমি তার কথা শুনতে পারছো না? ওই হৃদস্পন্দন বলছে সে তোমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৬.
খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন পুলক তালুকদার। খেতে মন টানছে না। আজ বাড়িতে বড়ো কাতলা মাছ রান্না হয়েছে। ছোটোবেলা থেকে আরিন্তার পাতে তিনি নিজ হাতে কাতলা মাছের মাথাটা তুলে দিতেন। মেয়েটা খুব পছন্দ করে খেতে। আজ প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল মেয়েটা তার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খায় না। বাড়ি আসতেই তাকে রাজি করানো কঠিন। প্রতিবার নিয়াজকে দিয়ে বলেকয়ে রাজি করিয়ে তাকে বাড়ি আনা হয়। তা-ও সে খুব বেশিদিন থাকে না। নিয়াজের সঙ্গে আসে, আবার তার সঙ্গেই চলে যায়। নিয়াজের ব্যস্ততার মাঝে পেলব কতবার বোনকে আনতে গিয়েছিল। কোনোবারই মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেনি। পুলক তালুকদার ফোন করে বারবার আসার অনুরোধ করেন। সে দোনামোনা করে এড়িয়ে যায়। যে দুয়েকটা দিন সে বাড়ি এসে থাকে, ততদিন প্রয়োজনের বাইরে বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে না। এমনকি এক টেবিলে খেতেও বসে না। অথচ পুলক তালুকদার বাজার থেকে মেয়ের জন্য তার পছন্দের মাছ, মাংস, সবজি বেছে-বেছে নিয়ে আসেন। পেলব প্রতি বেলায় বাইরে গেলেই বোনের পছন্দের খাবার ছাড়া খালি হাতে বাড়ি ফিরে না। অথচ আরিন্তা যেন নির্লিপ্ত। কিছুতেই তার নেই পূর্বের মতো আনন্দ। এখন আর সে পছন্দের খাবার পেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। প্রতি ঘন্টায় তার রাক্ষুসে ক্ষুধা পায় না। সময়-অসময়ে খাওয়ার রুচি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ফলস্বরূপ তার স্বাস্থ্যেরও যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকালে বাবা-মায়ের বুকের ভেতর হুঁ-হুঁ করে ওঠে। পেলব বারবার করে নিয়াজকে বলে দেয় বোনের খাবারের দিকে বিশেষ নজর রাখতে। নিয়াজ যথেষ্ট চেষ্টাও করে, কিন্তু একরোখা মেয়েটার অভ্যাসগুলো সে কিছুতেই পরিবর্তন করতে পারে না।

এবার প্রায় এক মাস হতে চলল আরিন্তা বাড়ি আসে না। মেয়ের মুখটা দেখার জন্য পুলক তালুকদারের মন বড়ো উদগ্রীব হয়ে আছে। আজও ফোন করে কত করে বললেন আসার জন্য। তার এক কথা, নিয়াজের ছুটি নেই। পুলক তালুকদার নিজে আনতে যাওয়ার কথা বললেন, তাতেও যে তার মত নেই তা কথার সুরেই স্পষ্ট। পেলব খেতে এসে দেখল বাবা খাবার না খেয়ে ব্যথিত মুখে বসে আছে। প্রশ্নভরা চোখে সে মায়ের দিকে তাকাল। মেরিনা স্বামীর ওপর রাগ ঝাড়তে না পেরে রাগত স্বরে ছেলেকে বললেন,
“শখ করে বোনের গলায় পাড়া দিয়ে বিয়ে দিয়েছিলি না? বোনকে সুখী করে নিজেরাও নিশ্চিন্ত থাকার জন্য? তাহলে আর এত ঢং কিসের তোদের? দেখ সুখ, দেখ কত সুখের সাগরে ভাসছে তোর বোন। এখন আর তোদের অত চিন্তা কিসের? যেমন আনন্দে থাকতে চেয়েছিলি, থাক। রোজ-রোজ আমার যেন কোনো নাটক দেখতে না হয়। এসব নাটক দেখার শখ আমার চিরতরে ঘুচে গেছে। আর দেখার ধৈর্য নেই।”

পেলব বলল,
“মা, তুমি আবার শুরু করলে?”
“না বাপ, আমার আর শুরু করারও কিছু নেই, শেষ করারও কিছু নেই। আমার কী হারিয়েছে, আমি কেমন আছি তাতে তো তোদের কিছু যায়-আসে না। আমার বোন যখন ইচ্ছা আমার কাছে আসে না, সুবর্ণা আসে না, আমি গেলে আমার বোনের মুখে ওর ছেলের খবর শুনে অস্বস্তিতে পড়তে হয়, আমার মিশু আমার সাথে আর আগের মতো মনখুলে কথা বলে না, আমার জন্মের মেয়েটা পর্যন্ত আমার কাছে আসে না, তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে-শুনতে আমার বুক ভার হয়ে যায়; এসবে কার কী আসে-যায়? এসব আমারই কপালের দোষ। আর সবাই নির্দোষ।”

মেরিনা কাঁদতে-কাঁদতে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত পায়ে টেবিলের কাছ থেকে সরে গেলেন। পেলব, পুলক তালুকদার কেউই কিছু বলতে পারল না। কিছু সময় দুজনেই মুখবন্ধ করে বসে রইল। বাবা খাবারে হাত দিচ্ছে না বলে পেলবের-ও খাবার নেওয়া হচ্ছে না। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর পুলক তালুকদার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“খেয়ে নে।”

পেলব প্লেটে খাবার নিল। পুলক তালুকদার ভাত চিবোতে-চিবোতে কিছু একটা চিন্তা করে বললেন,
“কাল বরং ঢাকা যা।”
হঠাৎ ঢাকা যাওয়ার আদেশে পেলব খাওয়া থামিয়ে বলল,
“কেন?”
“আরিকে আনতে।”
“লাভ কী? আসবে না তো।”
“গিয়ে দেখ। এবার তো অনেকদিন হয়ে গেল।”
“কতবারই তো গেলাম।”
“এবারও যা। তুই যেতে না পারলে আমিই যাব।”

পেলব ছোটো একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কাল আমার কাজ আছে, পরশু যাব।”
“নিয়াজকে ফোন করে জানিয়ে দিস।”
পুলক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

কোমরে ওড়না গুঁজে আরিন্তা রাতের খাবার রান্না করছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আজ রান্না বসাতে দেরী হয়ে গেছে। মায়ের মন খুব খারাপ ছিল। কারণটাও তার অজানা নয়। তাই সে আজ একটু বেশি সময় কথা বলেছে। তার রান্না যখন শেষের দিকে তখন নিয়াজ বাড়ি এসেছে। রান্নাঘরের আলো জ্বালানো দেখেই সে বুঝতে পেরেছে আজ রান্না করতে দেরী হয়েছে। হাত খালি করে সে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। আরিন্তা তখন তরকারি নাড়ছে। নিয়াজ নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে তার কোমর জড়িয়ে কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়াল। আরিন্তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এক হাত তুলে নিয়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধাল,
“ক্লান্ত?”
নিয়াজ হ্যাঁ-সূচক মাথা দোলাল।

“চা করে দিবো?”
“উঁহু। তোমার রান্না শেষ হয়েছে?”
“এই তো শেষ। তরকারিটা নামিয়ে বাসন ধুবো ‌শুধু‌।”

নিয়াজ আরিন্তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তাহলে এটুকু আমি করছি। তুমি গিয়ে রেডি হও, বাইরে যাব।”
আরিন্তা ভ্রুকুটি করে বলল,
“এখন কিসের বাইরে যাব? রান্নাবান্না হয়ে গেছে। খেয়ে ঘুমানো লাগবে না?”
“না, লাগবে না। কতদিন হয়ে গেছে বাইরে যাওয়া হচ্ছে না তোমাকে নিয়ে।”
“তা কি অন্য এক সময় যাওয়া যাবে না? আমার এখন যেতে ইচ্ছা করছে না।”
“আমার ইচ্ছা করছে। যাও গিয়ে রেডি হও।”
আরিন্তা চোখে-মুখে অনিচ্ছা নিয়ে বলল,
“কাল যাই? আপনারও তো বিশ্রাম দরকার।”
নিয়াজ ত্যাড়া কন্ঠে বলল,
“ঘুরতে গেলেই আমার বিশ্রাম হয়ে যাবে। যাও।”
“তরকারিটা নামিয়ে যাই।”
“এটুকু আমিই করতে পারব। তুমি যাও তাড়াতাড়ি।”
“আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
“ফ্রেশ হওয়া যাবে।”

আরিন্তাকে ঠেলেঠুলে নিয়াজ রান্নাঘর থেকে বের করে দিলো। তারপর নিজেই বাকি কাজে হাত লাগাল।

আলস্যতা নিয়েই আরিন্তা রেডি হয়েছে। কোনোমতে পোশাকটা পালটে সে চুল আঁচড়ে নিয়েছে। এরমধ্যেই নিয়াজ হাতের কাজ শেষ করে বাবাকে খাবার দিয়ে এসেছে। নিয়াজ যখন রেডি হচ্ছিল তখন আরিন্তা গেল আতাউর রহমানকে তাদের বাইরে যাওয়ার কথা জানাতে। আতাউর রহমান খাচ্ছিলেন। সে যখন বলল, ‘বাবা, আপনার ছেলে এই রাত-দুপুরে আবার বাইরে যেতে চাইছে।’
আতাউর রহমান হাসলেন। একসময় এদের সম্পর্ক নিয়ে তার যত দুশ্চিন্তা ছিল। তারপর হঠাৎ-ই সবকিছু পালটে গেল। এখন তাদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখে তার আনন্দের অন্ত নেই। আতাউর রহমান হাসিমুখে বললেন,
“নিয়াজ বলেছে আমাকে। যাও মা, সমস্যা নেই।”
“একটু পর তো আপনার ঔষধ আছে।”
“আমি মনে করে খেতে পারব। চিন্তা কোরো না। যাও, ঘুরে এসো। কত আর বাসায় বসে থাকবে? ঘুরে এলে ভালো লাগবে।”
“আপনার আর কিছু লাগবে?”
“না মা। আমি খাওয়া শেষ করে রুমে চলে যাচ্ছি। যাও তুমি।”

নিয়াজ-আরিন্তা একসঙ্গে রেস্ট্রন্টে ডিনার করেছে। একসঙ্গে রাতের শহর ঘুরেছে। আরিন্তা ফেরার নাম নিচ্ছে না বলে নিয়াজও তাড়া দেয়নি। অথচ কাল সকালে তার অফিস আছে। শেষমেষ রাত বাড়ছে দেখে সে বলল,
“ফিরবে না?”
আরিন্তা বলল,
“বাইরে ভালো লাগছে।”
“আসতে তো চাওনি।”
আরিন্তা মুচকি হাসল। তারপর বলল,
“আর একটু থাকি?”
“আচ্ছা থাকো।”

নিয়াজের পকেটে ফোন ভাইব্রেট করে উঠল। তার না, আরিন্তার ফোন। মেয়েটা যতবার বেরোয় হাতে ব্যাগ নেয় না। তার না কি খালি হাতে ঘুরতেই ভালো লাগে। বাড়তি জিনিস বোঝা মনে হয়। ফোনটাও সে হাতে রাখতে চায় না। তাই নিয়াজের কাছে জমা দিয়ে রাখে। পকেট থেকে ফোন বের করে সে আরিন্তাকে দিলো। আরিন্তা ফোন হাতে নিয়ে শুধাল,
“কে?”
“নাম‌ নেই। বাহিরের দেশের নাম্বার।”

স্পষ্ট দৃষ্টিতে নাম্বার চেক করতে গিয়ে কান্ট্রি কোড দেখেই আরিন্তার বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। এত দিন, এত মাস পর হঠাৎ তার কল! সবকিছু ঠিক আছে তো? সে একবার নিয়াজের মুখে চাইল। নিয়াজ মৃদু স্বরে বলল,
“রিসিভ করো।”

আরিন্তা ফোন রিসিভ করে কানে ধরল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। মন বলল ওপাশ থেকে এক্ষুনি সেই কন্ঠটা ডেকে উঠবে, ‘এই পোনি।’
কিন্তু অতি নরম এক কন্ঠস্বর ডাকল,
“আরি?”
আরিন্তা অস্বাভাবিক শ্বাসটাকে সামলে নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
“মিশু ভাই?”
“চিনতে পেরেছিস?”
“না চেনার কথা ছিল?”
“কত কথাই তো ছিল।”
আরিন্তা চুপ রইল। মিশকাত প্রশ্ন করল,
“ডক্টর নিয়াজ কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“আর তুই?”
“আমি? আমি তো ভালোই থাকি।”
“সত্যি-সত্যি ভালো থাকিস, মিথ্যা না।”
“থাকব।”
“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবি না?”
“কেন? সে কি আমি জানি না?”

মিশকাত মৃদু শব্দে হাসল। সে হাসির শব্দ যেন আরিন্তার হৃদয়ে শত অপ্রকাশিত অভিযোগের ফলা ছুঁড়ে দিলো। আরিন্তা বলল,
“সব ঠিক আছে ওখানে?”
“কেন? এত মাস পর ফোন করেছি বলে অবাক হয়েছিস?”
“তুমি কি আমার প্রশ্নের সোজা কোনো উত্তর দিবে না মিশু ভাই?”
“আমার এত সাহস আছে না কি? বল কী জানতে চাস।”
“এতদিন পর হঠাৎ ফোন করলে যে?”
“করতাম না বিশ্বাস কর। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ফোন না করার। তোর ফোন নাম্বার সেভ ছিল। কতবার ফোন করব ভেবেও করিনি। আজ কীভাবে যেন ভুল করে ফেলেছি। আজকের পর আর করব না। আমার যা-ই হোক, ভুল করেও তোর জীবনে আমি ব্যাঘাত ঘটাব না।”
“তুমি ভুল করে কল করেছ আমায়?”
“আসলে আজ লতিফের সাথে কীসব ছাইপাশ খেলাম। তারপর থেকেই না কী করব বুঝতে পারছি না। তোর সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছা করছিল‌।”

আরিন্তা সন্দিহান মুখে শুধাল,
“তুমি কি ড্রিংক করেছ?”
মিশকাত কেমন অপরাধ স্বীকার করা বাচ্চাদের মতো বলল,
“খেতে চাইনি বিশ্বাস কর। লতিফ বলল বুকের যন্ত্রণা কমবে, তাই খেয়েছি। বুকের যন্ত্রণা সহ্য করতে কষ্ট হয় জানিস? মনে হয় দমটা ফুরিয়ে যাবে। আমি জানি তো তুই এসব পছন্দ করিস না। আজ ক্ষমা কর, ঠিক আছে পোনি? আর কোনোদিন খাবো না প্রমিস।”

আরিন্তা ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। নাক টেনে বলল,
“তুমি কি আমার অপরাধবোধ কমতে দিবে না মিশু ভাই? কেন আমাকে দিন-দিন আরও অপরাধী করে তুলছ?”
“ধুর পা’গলি! তুই তো আমার নিষ্পাপ চাঁদ। আমার চাঁদকে কোনোদিন এক ফোঁটা দোষ আমি দিয়েছি? ওহ্ হ্যাঁ! তুই না কি জানতে চেয়েছিস এক আকাশে স্থায়ীভাবে বাস করা এক চাঁদ কখনো অন্য আকাশে জায়গা বদল করতে পারে কি না? বাস্তবে হয়তো পারে না। কিন্তু দুঃস্বপ্নে পারে। এসব বাজে ঘটনা দুঃস্বপ্নেই ঘটে। আমার জীবনটা না সেই দুঃস্বপ্নের মধ্যেই আটকে আছে। বাস্তব জীবন তো আমার থেকে হারিয়ে গেছে সেই কবেই।”

আরিন্তার নীরব কান্নার গতি বাড়তেই মিশকাত বলল,
“কাঁদছিস? দেখেছিস, বলেছিলাম না আমি ফোন করলেই তোর জীবনে ব্যাঘাত ঘটবে? কাঁদিস না। আমি আর ফোন করব না। এবার-ই শেষ। অন্যদের মতো আমি বলব না তুই আমাকে ভুলে যা। তোর মতো ঘাড়ত্যাঁড়া মেয়ে তো আমার কথা শুনবে না। শুধু বলছি, ভালো থাকিস। আমার পোনিকে হারাতে দিস না, যত্নে রাখিস।”

আরিন্তা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল,
“আমাকে তুমি ভালো থাকতে বোলো না মিশু ভাই। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি, কিন্তু ভালো থাকার মতো শাস্তি আমি সহ্য করতে পারব না। ভালো থাকা আমার কাছে এখন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়েও কঠিন।”
“আমি চাই তুই ভালো থাক। তুই খুব ভালো থাক আরি। নিজেকে একদম অবহেলা করবি না। আমি জানি ডক্টর নিয়াজ তোকে ভালো রাখতে চায়। তাকে হতাশ করিস না।”
“আর তুমি? আমি যদি বলি আমিও চাই তুমি ভালো থাকো, তুমি আমার কথা শুনবে?”
“তোকে কেউ দিন-রাত ভালো রাখার চেষ্টা করছে। তার জন্য হোক বা নিজের জন্য, তোর ভালো থাকা উচিত।”
“এমন কেউ যদি তোমার জীবনেও আসে?”
“তুই চাস আসুক?”
“তোমাকে শেষবার এক নজর দেখা ছাড়া এই স্বার্থপর জগতের কাছে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।”
“চাইতে তোর মানা নেই রে। তুই সবকিছু চাস, শুধু তোর পোল্ট্রির জীবনে দ্বিতীয় কারো দখল ছাড়া। শেষবার আমাদের সাক্ষাৎ অবধি আমি বেঁচে থাকি চাইলে অন্তত ওসব চাস না। কেবলমাত্র ওই মুহুর্তের জন্য আমার নাকের ডগায় শ্বাসটা আটকে আছে।”
আরিন্তা কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“তবে কেন তুমি আমার ভালো চাও? আমার সংসার জীবনের সুখ চাওয়ার মতো শাস্তি তুমি আমায় কেন দিলে মিশু ভাই? স্বার্থপর আমি তো এক মুহুর্তের জন্য চাইনি তুমি অন্য কারো সাথে সুখী হও। তাহলে তুমি কেন চাইলে?”
“হয়তো আমি তোর মতো করে ভালোবাসতে পারিনি। তাই তোর মতো স্বার্থপরও হতে পারিনি। যে গোলক ধাঁধায় তোর জীবন আটকে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তোর মৃ’ত্যু আমি কী করে চাইতাম রে? জানিস তো? স্মৃতি হচ্ছে বিষাক্ত সাপ। একবার দংশন করলে সেই বিষ দিন-দিন ছড়িয়ে পড়ে গোটা জীবনটাকে মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। আমি নিজে ম’রে গেলেও তোর এমন দিন দেখতে চাই না।”
“তোমার কি মনে হয়? এভাবে বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে? তুমি মরে গিয়ে আমাকে তুমি আদৌ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে?”
“মরছি না তো। বেঁচেই তো আছি। তুইও বেঁচে থাক। মুখে হাসি নিয়ে বেঁচে থাক। কী-রে? পারবি না?”
“পারছি বলেই তো এখনও পর্যন্ত টিকে আছি।”
“থাক, টিকে থাক। আমি এসে যেন তোর হাসিমুখ দেখতে পাই। মনে থাকবে?”
“তুমি কবে আসবে মিশু ভাই?”

মিশকাত এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বরং মিছে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
“আমার কাজ আছে। শোন, ডক্টর নিয়াজকে আমার তরফ থেকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দিস। আমার চাঁদকে ভালোবেসে ভালো রাখার জন্য আমি তার কাছে এক জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। রাখছি, ভালো থাকিস কিন্তু।”
“তুমি কি সত্যিই আর ফোন করবে না?”

আরিন্তার শেষ প্রশ্নটা শোনার অপেক্ষাও মিশকাত করল না। কল কে’টে দিলো। আরিন্তা পেছনে ঘুরে নিয়াজকে পেল না। একটু আগেই তো সে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আরিন্তা এগিয়ে গিয়ে দেখল নিয়াজ গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরিন্তা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে দুহাত বাড়িয়ে দিলো। ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। মুহুর্তেই আরিন্তা তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিয়াজ নীরবে তার পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। আরিন্তা শান্ত হলো অনেক সময় পর। নিয়াজ তখন বলল,
“বাসায় চলো।”
আরিন্তা তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
“আপনার কি এখনও জানতে ইচ্ছা করছে না আমি কেন আপনাকে স্বামীর অধিকার দিয়েছি, কেন মেনে নিয়েছি?”

নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরিন্তা যখন থেকে তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই তার দৈনন্দিন জীবনে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। একাকীত্ব আর তাকে কুঁড়ে খায় না। কত ব্যথা এই মেয়েটা তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কখনও সে এই প্রশ্নের উত্তর শোনার সাহস করেনি। আরিন্তা এমন কতবার জিজ্ঞেস করেছে সে কেন জানতে চায় না, কে তার কৌতুহল নেই। কোনোবারই সে এসব সিরিয়াসভাবে নেয়নি। মূলত সে নিতে চায়নি। কারণ সে জানে আরিন্তার উত্তর তার জন্য একদমই সুখকর হবে না। মেয়েটা তার কষ্টের গল্প জানার পর থেকেই নিজে তার কষ্টের কারণ হতে চায় না, তাকে ভালো রাখতে চায়, ভালো রাখার সবরকম চেষ্টাও সে করে। তার জীবনের দুর্ঘটনার শাস্তি সে নিয়াজকে দিতে চায় না। আজকাল আর নিজের দুঃখও সে নিয়াজের সামনে প্রকাশ করে না। নিয়াজ বরাবরই তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে। তাকে ভালোবাসায় কোনোরকম খাদ সে রাখেনি। এতকিছুর পরও যে মেয়েটা মন থেকে ভালো থাকতে পারে না, তা তার অজানা নয়। মেয়েটা তার সংসার জীবনে সুখ এনে দিয়েছে। কিন্তু সেই সুখের এক অংশও সে নিজের জন্য নেয়নি। নিয়াজের জন্য হলেও আরিন্তা নিজেকে যথেষ্ট গুছিয়ে নিয়েছে। নিয়াজ চায় না পুরোনো ব্যথা তুলে মেয়েটাকে আবার এলোমেলো করে দিতে।

আজও আরিন্তার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে নিয়াজ গাড়ি থেকে টিস্যু বের করে এনে আরিন্তার অশ্রুভেজা চোখ-মুখ মুছে দিলো। আরিন্তা হাল না ছেড়ে পুনরায় বলল,
“আপনার জানতে ইচ্ছা করে না আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি কি না?”
নিয়াজ আরিন্তার গালে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে আদুরে গলায় বলল,
“তুমি আমার জন্য যা করো তা-ই তো আমার কাছে ভালোবাসা। এই যে আমার অগোছালো জীবনটাকে তুমি নিজের হাতে গুছিয়ে দিলে, আমার সমস্ত বাজে স্মৃতির জায়গায় তুমি রোজ কত সুন্দর স্মৃতি সাজিয়ে দিলে, আমার নিত্যদিনের হাসির কারণ হলে; এসব ভালোবাসা ছাড়া আর কী? এরপরও আমি প্রশ্ন কেন করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার কাছে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বিষয় নেই আরিন্তা।”
“আমি মিশু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলায় আপনি কষ্ট পেয়েছেন?”
নিয়াজ মাথা দুলিয়ে বলল,
“নাহ্। তুমি তো কেঁদেকে’টেই আমায় বড়ো কষ্টটা দিচ্ছ।”
“আপনি ভয়ও পাচ্ছেন না?”
“কিসের ভয়?”
“আমাকে হারানোর।”

নিয়াজ খানিক থমকাল। পরক্ষণেই আরিন্তার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
“কোথায় হারাবে? আমি জানি তুমি আমার। তুমি আমায় ছাড়বে না। তোমাকে কেড়ে নেওয়ার মতো দুঃসাহস-ও আমি কাউকে দিবো না। রাত বাড়ছে, বাসায় চলো।”

পথেই আরিন্তা সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িতে পৌঁছে গাড়ি পার্কিং করেও মেয়েটার ঘুম ভাঙতে ইচ্ছা করল না নিয়াজের। সিটবেল্ট খুলে সে মেয়েটার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থেকে তার বুকের ভেতর কেমন কেঁপে-কেঁপে উঠল। আরিন্তাকে আলতো করে সে বুকে আগলে নিল। কপালে, গালে একের পর এক ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে সে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তার ব্যাকুল মন বারংবার আহাজারি করছে,
“সৃষ্টিকর্তা যেন আমায় এমন কোনো দিন না দেখায় যেদিন তোমাকে হারিয়ে আবারও আমায় অসহায় হতে হবে। এরপর আর আমি এমন একাকীত্ব মেনে নিতে পারব না। তুমি আমার ধৈর্যের শেষ সীমা।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-২৩+২৪

0

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৩.
নিয়াজের খালার বাড়িতে পৌঁছে আরিন্তার মনে হলো তার শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। তবু সে নতুন বউ। মুখ রক্ষার্থে নানান জনের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করতে হয়েছে। তারপর নিয়াজের সাথে রুমে এসেই সে শরীর ছেড়ে বিছানায় বসে পড়ল। এই মুহূর্তে বিছানাটাকেই তার সবচেয়ে আপন মনে হচ্ছে। ইচ্ছা করছে জগত-সংসার ভুলে নিশ্চিন্তে এক লম্বা ঘুম দিতে। কিন্তু তার ইচ্ছায় ঘন্টা বাজিয়ে নিয়াজের খালা হোসনে আরা এসে দরজায় দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডেকে বললেন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে যেতে। তারপরই তিনি ছুটলেন টেবিলে খাবার সাজাতে। আরিন্তার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়াজ বলল,
“জার্নিতে তো তেমন কিছুই খেলে না। ফ্রেশ হয়ে এসো। খাওয়া-দাওয়া করে তারপর বিশ্রাম নিয়ো।”

আরিন্তা হতাশ মুখে বিনা বাক্যে ফ্রেশ হতে চলে গেল। দুজন ফ্রেশ হয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে দেখল বিরাট আয়োজন। আদরের ভাগনে আর তার নতুন বউয়ের আপ্যায়নে হোসনে আরার কমতি নেই। বেছে-বেছে নানান পদ রান্না করিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো খাবারেই আরিন্তার রুচি নেই। তার দুচোখ ভর্তি ঘুম। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসছে। হোসনে আরা প্লেট ভর্তি খাবার দিতে চাইলেন। আরিন্তা বাঁধা দিয়ে বলল সে এখন এত খেতে পারবে না। অনেকদিন পর খালার বাড়ির রান্না নিয়াজ মজা করে খেলেও, আরিন্তা অল্প পরিমাণ খাবার নিয়েও সবটুকু শেষ করতে পারেনি। হোসনে আরা জোর করতে চাইলে নিয়াজ নিষেধ করে দিলো। নিয়াজের আগেই আরিন্তা খাবার শেষ করে রুমে ফিরে গেল। এখন আর তার বাঁধা নেই। দ্রুত বিছানায় উঠে সে গা এলিয়ে দিলো। কিন্তু খানিক বাদেই তার মাথাটা চিনচিন করে ব্যথায় ধরে গেল। দীর্ঘ জার্নির ফল এটা। নিয়াজ রুমে ফিরে দেখল আরিন্তা দুহাতে কপাল চেপে শুয়ে আছে। এমন কিছুই সে সন্দেহ করছিল। এগিয়ে গিয়ে শুধাল,
“তোমার কি মাথাব্যথা করছে?”
আরিন্তা চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলো,
“একটু।”

নিয়াজ নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। গত এক মাসে এই মেয়েকে সে যতটুকু চিনেছে, তাতে এটা তার ভালোভাবেই বুঝা হয়ে গেছে যে, এই মেয়ে নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে স্পষ্ট করে বলতে নারাজ। ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করে নিয়াজ এক গ্লাস পানিসহ ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ওঠো, খেয়ে নাও।”
আরিন্তা বলল,
“এটুকু মাথাব্যথা ঘুমালেই সেরে যাবে। ঔষধ লাগবে না।”
“তোমার চোখ-মুখের অবস্থা দেখেছ? ডক্টর আমি, তুমি না। ওঠো।”

তর্ক না টেনে আরিন্তা উঠে ঔষধ খেয়ে পুনরায় একইভাবে শুয়ে পড়ল। নিয়াজ গ্লাস রেখে আবার এগিয়ে গিয়ে আরিন্তার পাশে বসল। হাত বাড়িয়ে আরিন্তার কপাল থেকে দুহাত নামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার মাথা টিপে দিই, ঘুমাও।”

আচমকা আরিন্তা হকচকিয়ে গেল। নিয়াজ কপালে হাত ছোঁয়ানোর আগেই সে ঝট করে উঠে বসল। কপাল কুঁচকে বলল,
“কোনো দরকার নেই। দয়া করে আমাকে বিব্রত করবেন না। আমি একটু ঘুমাতে চাই।”

নিয়াজের খারাপ লাগালেও সে মুখে প্রকাশ করল না। মাথা দুলিয়ে উঠে রুম থেকে চলে গেল।

নিয়াজের খালাতো ভাই আবিরের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এসে আরিন্তার মনে হচ্ছে আজই বিয়ে। বর-কনের একসঙ্গে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। চারদিকে দুই পক্ষের আপনজন, আত্মীয়-স্বজনে গিজগিজ করছে। সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করে আজকের অনুষ্ঠানকে আরও আনন্দময় করার চেষ্টা করছে। কোলাহল আজকাল আরিন্তার চরম শত্রু। নিরিবিলি পরিবেশেই তার মন শান্ত থাকে। চারদিকের এত রঙিন আলো তার চোখে বেরঙিন লাগছে। একা একপাশে দাঁড়িয়ে সে শুধু সবার আনন্দ দেখছিল। মাঝ থেকে নিয়াজের খালাতো বোনগুলো তাকে চেপে ধরে ফেলল বিপাকে। মেয়েরা সবাই একরকম হলুদ রংয়ের শাড়ি পরেছে। আরিন্তাকেও তার একটা শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো। অনিচ্ছাভর্তি শরীরে শাড়িটাকে এখন তার বোঝা মনে হচ্ছে। নিয়াজ আজ একটু ব্যস্ততার মধ্যে আছে। মাঝে একবার সে আরিন্তাকে এক পলক দেখেছিল। হলুদ শাড়ি পরে মেয়েটা প্যাঁচার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। শাড়িতে মেয়েটাকে দারুণ মানায়। অথচ বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে যেচে শরীরে শাড়ি জড়ায়নি। নিয়াজের মনে হচ্ছে শাড়ি পরিহিতা আরিন্তার মুখে এক টুকরো মিষ্টি হাসির রেখা থাকলে, মেয়েটাকে এক টুকরো চাঁদের মতো সুন্দর লাগত। কিন্তু মেয়েটা হাসতে চায় না। নিয়াজ জানে না এই মিষ্টি মেয়েটার হাসির সৌন্দর্য কেমন। ঠিক কতটা সুন্দর তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা। এখনও অবধি হাসিখুশি এমন কোনো মুহুর্ত তাদের জীবনে আসেনি। তবে নিয়াজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কোনো এক শুভক্ষণে এমন মুহুর্তের সাক্ষী হওয়ার।

হাতের কাজ শেষ করেই নিয়াজ আরিন্তার খোঁজ করল। খুঁজতে গিয়ে মেয়েদের ভীড়ের মাঝে আরিন্তাকে চোখে পড়ল। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েরা হাত নেড়ে নাচছে। আরিন্তাকে বোধ হয় ওরাই টেনেটুনে নিয়ে গেছে। নিয়াজ হাতের ইশারায় তার এক বোনকে বুঝাল আরিন্তাকে ডেকে দিতে। আরিন্তাকে ডেকে দিলে সে নিয়াজকে দেখেই ভীড় থেকে বেরিয়ে চলে এল। নিয়াজ তার মুখের অবস্থা দেখে শুধাল,
“খুব বিরক্ত হচ্ছ?”
আরিন্তা মুখ ফুলিয়ে উত্তর দিলো,
“এত চেঁচামেচি আর সাউন্ড বক্সের শব্দ মাথায় লাগছে।”
“বাইরে যাবে?”
“এখন কীভাবে?”
“এখন সবাই ব্যস্ত। বাইরে থেকে হেঁটে এলে তোমার মাথা হালকা হবে। চলো।”
“আন্টি‌ যদি খোঁজ করে?”
“বেশি দূরে যাব না।”

নিয়াজ হাঁটা ধরলে আরিন্তা-ও তার পিছু নিল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ-ই বলা চলে। চার পা এগোতেই তারা হোসনে আরার ননদের মুখোমুখি হলো। মহিলা বোধ হয় খেয়াল করেছে তারা এখনও বর-কনেকে হলুদ ছোঁয়ায়নি। তাই তাদের দেখেই ডেকে নিয়ে গেল স্টেজের কাছে। আরিন্তা বিরক্ত মুখে নিয়াজের দিকে তাকাল। তার এখন রাগ লাগছে নিয়াজের ওপরেই। সে কেন তার কাছে আসতে গেল? তার কাছে আসার কারণেই এই মহিলার চোখে পড়তে হলো। নিয়াজ চোখের ইশারায় আরিন্তাকে অনুরোধ করল একটু সহ্য করে নিতে।

বর-কনেকে হলুদ ছুঁয়ে উঠতে গিয়ে আরেক বিপদে পড়তে হলো। সবাই মিলে নিয়াজ-আরিন্তাকে জেঁকে ধরল ছবি তোলার জন্য। যেহেতু তারা নতুন দম্পতি, অবশ্যই মিষ্টি কিছু ছবি তোলা বাঞ্ছনীয়। আরিন্তা ছবি তুলতে রাজি নয়। তার কথা ভেবে নিয়াজ-ও বারণ করতে চাইল। কিন্তু ভাই-বোনদের মিলিত কন্ঠের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ল। তার ওপর বড়োরা-ও ছোটোদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসল। অগত্যা আরিন্তাকে নিয়াজের পাশে দাঁড়াতে হলো ছবি তোলার জন্য। দুজনের মাঝে দুরত্ব দেখে ফটোগ্রাফার আরিন্তাকে বলল,
“ম্যাম, আরেকটু ক্লোজ হয়ে দাঁড়ান।”
আরিন্তা নিয়াজের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল। এরপর ফটোগ্রাফার বলল,
“অন্য পোজে দাঁড়ান।”

নিয়াজ-আরিন্তা দুজনেই কনফিউশনে পড়ে গেল। বিয়ের পর থেকে এই অবধি তাদের সুন্দর কোনো পোজে ছবি তোলা তো দূর, এক ফ্রেমে ছবিই তোলা হয়নি। বিয়ের দিন ছবি তুলতে আরিন্তা নারাজ ছিল। সেদিন নিয়াজ ভেবেছিল আরিন্তা বেশি লজ্জায় পড়ে গেছে। তাই সে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা ছাড়া অন্য কোনো পোজে ছবিও তোলেনি, কাউকে জোর করতেও দেয়নি। আজ সে জানে আরিন্তা আসলে লজ্জায় নয়, মনের অনিচ্ছায় ছবি তুলতে চায় না। অথচ আজ নিয়াজ না চাইলে-ও আরিন্তা ছবি তুলতে বাধ্য। তাদের মুখের অবস্থা থেকে এক মহিলা বলে উঠল,
“বিয়ের এতদিন হয়ে গেছে, এখনও দুজন ছবি তুলতে গিয়ে পোজ খুঁজে পাচ্ছ না! না কি সবার সামনে লজ্জা পাচ্ছ? লজ্জা কোরো না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। এখনই তো সময় এমন সুন্দর মুহূর্তগুলো ধরে রাখার। মনের আনন্দে ছবি তোলা।”

এরপরও দুজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফটোগ্রাফার নিজেই বলল,
“দুজন দুজনের দিকে তাকান।”

নিয়াজ আরিন্তার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“তাকাও প্লিজ। সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।”

আরিন্তা তাকাল। কিন্তু সে সরাসরি নিয়াজের চোখে চোখ রাখতে পারল না। তার দৃষ্টি আটকে রইল নিয়াজের নাকের কাছে। পাশ থেকে আবির বলে উঠল,
“ভাবি, ভাইয়ের বুকের কাছে হাত রাখুন। এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।”

আরিন্তা হাত তুলে খুব হালকা করে নিয়াজের বুকের একপাশে রাখল। এই ছবি তোলার পরপরই ফটোগ্রাফার বলে বসল,
“স্যার, ম্যামের কপালে কিস করুন। সুন্দর ছবি আসছে আপনাদের।”

সঙ্গে-সঙ্গে আরিন্তা ছিটকে সরে দাঁড়াল। নাকচ করে বলল,
“আর তুলতে হবে না।”
নিয়াজ-ও বলল,
“থাক, যথেষ্ট ছবি তোলা হয়েছে। এবার অন্য সবার ছবি তুলুন।”

আবির উঠে এসে বলল,
“ভাই, বিয়ের এক মাস পরে এসেও দেখি আগের মতোই আনরোমান্টিক রয়ে গেলে। ভাবিকেও এখন নিজের মতো বানাচ্ছ, না?”

নিয়াজ নিচু স্বরে বলল,
“আবির, এখানে অনেক মানুষ। আরিন্তা লজ্জা পাচ্ছে। বাদ দে এসব।”
“এত লজ্জার কী আছে? তোমরা নতুন কাপল। দিন-রাত সুন্দর মুহূর্তের ছবি তুলে জমাতে থাকবে। তা না। আজ পর্যন্ত তোমাকে ভাবির সঙ্গে একটা কাপল পিক পর্যন্ত আপলোড করতে দেখলাম না। আজ ছবি না তুলিয়ে তোমাদের ছাড়ছি না। আজকের এই ছবি দুজনের প্রোফাইলে সেঁটে দেওয়া হবে। কী বলিস তোরা?”

তাদের ভাই-বোন সবাই হৈ-হৈ করে গলা মিলাল। অর্থাৎ সবাই একমত। রাগে আরিন্তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠছে। তবু সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। এই মানুষগুলো তো আর তাদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েনের খবর জানে না। তাদের কাছে এসব খুবই স্বাভাবিক। সবার জোরাজুরিতে শেষমেশ হার না মেনে উপায় পেল না আরিন্তা। শরীর শক্ত করে পুনরায় সে ছবি তুলতে দাঁড়াল। তবে ছবি তোলার সময় নিয়াজ তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল না। তার কপাল আর নিয়াজের ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত দূরত্ব বজায় রাখল। এতে আর কেউ বাড়াবাড়ি করল না। এই ছবি তোলার পর আর আরিন্তা এক মুহুর্ত-ও স্টেজে দাঁড়াল না। অতি দ্রুত স্টেজ থেকে নেমে সরে পড়ল। রাগে, দুঃখে, লজ্জায় তার কান্না পাচ্ছে।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেক রাত করে। এখন রাত প্রায় দুটো। শাড়ি পালটে মাত্রই আরিন্তা শুয়েছে। শরীরটা অনেক হালকা লাগছে তার। শরীরের মতো মনটা হালকা নেই। পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। বিছানায় যাওয়ার আগে আরিন্তা মিশকাতের দেওয়া ফোনটা বের করে নিয়েছে। বর্তমানে তার কাছে দুটো ফোন থাকে। একটা মিশকাতের দেওয়া, আরেকটা নিয়াজের। মূলত নিয়াজের দেওয়া ফোনটাই তার ব্যবহার করা হয়। আগের ফোনটা কেবল স্মৃতি হাতড়াতে কাজে লাগে। এই ফোনটা হাতে পাওয়ার পর থেকে সে অনলাইনে যাওয়া তো দূর, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ আইডি লগইন করার সাহস করে উঠতে পারেনি। এই ফোনটায় রোজ সে গ্যালারি ঘুরে বেড়ায়। প্রতিটা ছবি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে। মিশকাতের স্মৃতিচারণা করে। দেখতে-দেখতে বুক ভারি হয়ে এলে কাঁদে। একসময় কান্না থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ ছবি ঘাঁটতে গিয়ে বারবার তার চোখে ভেসে উঠছে নিয়াজের সাথে ছবি তোলার মুহূর্তগুলো। মিশু ভাই তাকে অন্য পুরুষের সংস্পর্শে সহ্য করতে পারে না। সে দেখলে নিশ্চয়ই ভীষণ রাগ করত? রাগে কদিন কথাবার্তা বন্ধ করে বসে থাকত। তারপর যেদিন কথা বলত, সেদিন অযথাই বকাঝকা করত। পরপরই আরিন্তার মনে পড়ল সুবর্ণার বলা কথা। মিশু ভাই নিয়াজের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চায় না। কেন চায় না? হতে পারে নিয়াজ নির্দোষ। কিন্তু মিশু ভাই নিজেই তো বলেছিল আরিন্তাকে ভালোবাসার অধিকার সে ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের নেই। নিয়াজ কি সেই পুরুষদের কাতারের একজন নয়? কেন সে মেনে নিল? আরিন্তার ওপর কি তার সত্যিই কোনো রাগ নেই? কোনো অভিযোগ নেই? আরিন্তা যে নিজের কথা রাখতে পারল না, তার জন্য অপেক্ষা করল না; এই অপরাধের শা’স্তি দিতে সে আসবে না? তার এত সহজ ক্ষমা তো আরিন্তা এক জনমেও মানতে পারবে না। এরচেয়ে শা’স্তিস্বরূপ তার হাতে মৃ’ত্যু মেনে নেওয়া ঢের সহজ।

নিয়াজ রুমে এসে আরিন্তাকে দেখতে পেল বিধ্বস্ত অবস্থায়। আগের ফোনটা হাতে নিয়ে সে কাঁদছে। এই দৃশ্য নতুন নয়। গত একমাস ধরে দেখতে-দেখতে এই দৃশ্য নিয়াজের সয়ে গেছে। তবে মন সয়ে নিতে পারে কি না তা কেবল সে-ই জানে। রোজ রাতে আরিন্তাকে এমন অবস্থায় দেখলে নিয়াজ তাকে একা ছেড়ে দেয়। কাজের অজুহাতে হয় বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে, নয় ড্রয়িংরুমে। কিন্তু এখানে তার কোনোটাই করা যাবে না। খালার বাড়ির এই রুমের সাথে বারান্দা-ও নেই। নিয়াজ নিঃশব্দে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ল। আরিন্তার কান্না থামেনি। ক্ষণে-ক্ষণে ফোঁপানোর শব্দ আসছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর নিয়াজ বলল,
“তুমি কি আজকের ব্যাপারটায় কষ্ট পেয়েছ? তাহলে আমি সরি। ওরা এমন করবে জানলে আমি তোমাকে ডাকতাম না।”

আরিন্তার কোনো সাড়া না পেয়ে ফের বলল,
“আরিন্তা? আর কেঁদো না প্লিজ। এমনিতেই গতকাল থেকে মাথাব্যথা তোমার পিছু ছাড়ছে না। ঘুমিয়ে পড়ো। কাল আবার হৈ-হুল্লোড় সহ্য করতে হবে। শুনছো?”

আরিন্তা এবার মুখ খুলল। ভেজা গলায় বলল,
“আপনাকে না বলেছি আমার প্রতি এত খেয়াল দিবেন না?”
“তোমার প্রতি খেয়াল না দিলে আর কার প্রতি দিবো? আমার তো দ্বিতীয় কোনো বউ নেই খেয়াল দেওয়ার জন্য।”
“আমি আপনার কেউ না।”
“ভুল বললে। আমি তোমার কেউ না হতে পারি, তুমি সবসময়ই আমার বিয়ে করা বউ।”

আরিন্তা হুট করে উঠে বসে নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি অধিকার দেখিয়ে কথা বলছেন কেন? আমি কি আপনাকে মেনে নিয়েছি? আশ্চর্য!”
আরিন্তার অশ্রুসিক্ত ফোলা চোখে তাকিয়ে নিয়াজ বলল,
“বারবার কেন ভুলে যাও আমার তোমাকে জয় করার চেষ্টা করার কথা?”
আরিন্তা বিরক্ত মুখে বলল,
“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আমার ভালোবাসা পালটাবে না? এক মাসেও যা আপনি পাননি, তার আশা নিয়ে কীভাবে বসে আছেন?”
“আশা করতে তো দোষ নেই। ভালোবাসা না পেলাম। কে বলতে পারে? করুণা তো পেতে পারি। করুণা পেলে হয়তো এক ফোঁটা ভালোবাসা কপালে জুটেও যেতে পারে।”
“আপনাকে বুঝানোই বেকার।”

কথাটা বলেই আরিন্তা আবার শুয়ে পড়ল। এবার সে হাত থেকে ফোন রেখে দিয়েছে। হয়তো ঘুমাবে। নিয়াজ কন্ঠস্বর নরম করে বলল,
“ভেবো না, গত একমাসে যে তোমার ওপর জোর খাটায়নি, আগামী এক বছরেও সে জোর খাটাবে না। কিন্তু শেষ অবধি তোমাকে জয় করে নেওয়ার এক বিন্দু আশা-ও আমি ছাড়ব না। তোমার মনের ওপর আমার হস্তক্ষেপ নেই। রাখা সম্ভব-ও না। আমি জানি তোমার মনে আমার জন্য কোনো জায়গাই নেই। তবে এরজন্য আমি তোমাকে দোষারোপ করি না। কারণ আমি তোমার মনকে বুঝতে পারি। কোনোদিন হয়তো তুমি-ও আমায় বুঝবে। সেই দিনের অপেক্ষা আমি এক মুহুর্তের জন্যও ছাড়ব না। আমি আমার অপেক্ষা আর ধৈর্যের ফল দেখতে চাই।”

আরিন্তা বিপরীত দিকে মুখ করে শুয়ে চুপচাপ কথা শুনছিল। নিয়াজ থামলে সে থমথমে মুখে উত্তর দিলো,
“যা ইচ্ছা করুন। না বলেছে কে? আপনার ধৈর্যের ফল পেলে মিষ্টি বিলাতে ভুলবেন না।”

নিয়াজ হাসল। হাসিমুখে বলল,
“ওহ্! ভালো কথা মনে করলে। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। আজ হলুদ শাড়িতে তোমাকে খুবই মিষ্টি লাগছিল। দৃষ্টি আটকে যাওয়ার মতো সুন্দর। শাড়ি পরলে আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাব, এই শঙ্কাতেই বোধ হয় তুমি শাড়ি পরো না। তাই না?”
“আপনার মতো ব্যক্তি অযথাও প্রেমে পড়তে পারে।”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছ। তবে একটু ভুল আছে। আমার মতো ব‌্যক্তি অযথা যার-তার প্রেমে পড়ে না। শুধু বউয়ের প্রেমে পড়ে। তোমার বর যে খুবই লয়াল, অন্তত এটা মানতে তুমি বাধ্য।”
আরিন্তা মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আপনি না আমাকে ঘুমাতে বলেছেন? এখন ঘুমাতে দিচ্ছেন না কেন?”

নিয়াজ ঘুরে শুয়ে আফসোসের সুরে বলল,
“আচ্ছা, ঘুমাও, ঘুমাও। আর বিরক্ত করছি না। দেখি আর কতদিন বিবাহিত সিঙ্গেল জীবন কা’টাতে হয়। আহারে! বেচারা নিয়াজের জন্য আমি ছাড়া কারো মায়া-ই জন্মাল না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২৪.
আজ আবিরের বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সামনে আবার বৌভাত বাকি আছে। কিন্তু আরিন্তার আর এই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে থাকতে ইচ্ছা করছে না। নিয়াজকে সে জিজ্ঞেস করেছিল কবে বাড়ি ফিরবে। নিয়াজ সঠিকভাবে বলতে পারেনি। কাজের তাগিদে তারও চলে যাওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু খালার অনুরোধের কারণে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আরিন্তা আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। নিয়াজ বুঝতে পারেনি সে ঘুমিয়ে পড়েছে কি না। নিয়াজ এসে বিপরীতে শোয়ার পরও আরিন্তার কোনো হেলদোল দেখা গেল না। আবিরের বিয়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়াজ খেয়াল করেছে। আবির আর তার বউ কত খুশি ছিল! বিয়ের সম্পূর্ণ মুহূর্ত তারা বেশ আনন্দিত মনে উপভোগ করেছে। দুজনের মুখেই ছিল প্রশান্তির হাসি। নিয়াজের চোখে বারবার তাদের বিয়ের দিনটি ভেসে উঠছিল, যেদিন সে খুশি থাকলেও আরিন্তার মনভর্তি ছিল আর্তনাদ। এমনকি এক মাসেও ওই মুখে সে হাসি ফোটাতে পারেনি, পারেনি ওই মনের আর্তনাদ ঠেলে একটু জায়গা খুঁজে নিতে। সম্ভবত একজন পুরুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজের স্ত্রীকে অন্য এক পুরুষের জন্য কষ্ট পেতে দেখা, কাঁদতে দেখা। আর নিয়াজ সেই কঠিন কাজটাই ধৈর্যের সাথে করে এসেছে এই আশায় যে, একদিন আরিন্তা তাকে বুঝবে। এমন কোনো সম্ভাবনা এখনও অবধি না দেখা গেলেও সে হাল ছাড়ছে না। তবু সে একজন বিবাহিত পুরুষ। নিজের স্ত্রীর সংস্পর্শে যাওয়ার, তার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার-ও আছে। মুখে সে আরিন্তাকে যতই বুঝাক সে অপেক্ষা করবে। প্রকৃতপক্ষে নিজের মনের আকাঙ্ক্ষা চাপা দিয়েই সে দিনাতিপাত করছে। তবু আরিন্তাকে বুঝতে দিচ্ছে না, এই যা।

রোজ রাতে নিয়াজ ঘুমন্ত আরিন্তার অজান্তেই মিনিটের পর মিনিট তার মুখে চেয়ে থাকে। ওই সময়গুলো নিজেকে ঘোর থেকে টেনে আনা তার জন্য ঠিক কতটা জটিল,তা কেবল সে-ই জানে। আজ আরিন্তা জেগেই ছিল। কিন্তু সে বিপরীত দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকায় নিয়াজ বুঝে উঠতে পারেনি। কিছুক্ষণ বিপরীত পাশ থেকেই আরিন্তার দিকে তাকিয়ে থেকে সে উঠে বসল, মেয়েটার মুখটা দেখার আকাঙ্ক্ষায়। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে তাকাল আরিন্তার মুখে। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। কী মায়াবী মুখ! নিষ্পাপ ফুলের মতো মিষ্টি। এই ঘুমন্ত ফুলপরীর মুখে চেয়ে থাকতে-থাকতে কবে যে নিয়াজ প্রেমে পড়েছে, খেয়ালই নেই। এখন এই মুখটা বেশিক্ষণ চোখের আড়ালে থাকলে তার অশান্তি লাগে। এখন সে টের পায় মন বেচারা আরেকজনের ওপর তার সুখ-শান্তি আরোপ করে দিয়েছে। অথচ যার ওপর আরোপিত হয়েছে সে তার সুখ-শান্তির খবরই রাখে না। রোজকার মতো আজও আরিন্তার মুখে তাকিয়ে থেকে একসময় নিয়াজ ঘোরে চলে গেল। তার ভীষণ সাধ জাগল আরিন্তার কপালে একটা চুমু খাওয়ার। রোজই জাগে, কিন্তু সে নিজেকে ফিরিয়ে নেয়। আজও ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কেন জানি মনটা আজ ভীষণ অবাধ্য হয়ে উঠল। তাকে বুঝাল, আরিন্তা তার স্ত্রী। নিজের স্ত্রীর কপালে চুমু খাওয়া অপরাধ নয়। তাছাড়া আরিন্তা ঘুমিয়ে আছে। চুমু খেলেও সে জানতে পারবে না। তার অজান্তে চুমু খাওয়া যদি ভুল হয়, হোক। তবু তার হাজারটা ইচ্ছার মধ্যে ছোট্ট একটা ইচ্ছা তো পূরণ হবে। মনের সঙ্গে তর্ক করতে-করতে নিয়াজের মাথায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। সে একবার ভাবছে সরে যাবে, আবার ভাবছে কপালে একটা চুমু খাওয়াই যায়। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে ভাবনার এক পর্যায়ে নিয়াজ হঠাৎ করেই আরিন্তার দুপাশে হাত ঠেকিয়ে ঝুঁকে পড়ে কপালে চুমু খেল। কিন্তু আরিন্তার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে তাকে নিজে থেকে সরতে হলো না। ঠোঁট সরানোর আগেই আচমকা ভয়ানক এক ধাক্কায় তার শরীরসহ মাথাটা ছিটকে গিয়ে ঠেকল খাটের হেডবোর্ডে। সঙ্গে-সঙ্গে মাথাটা ঝিমঝিম করে ব্যথায় ধরে গেল। চমকিত নিয়াজ মুখ বিকৃত করে ডান হাতটা মাথার পেছনে চেপে ধরে সামনে তাকাল। চোখের সামনে আরিন্তার রাগান্বিত মুখটা ভেসে উঠল। দৃষ্টি আটকাল আরিন্তার রক্তবর্ণ ধারণ করা চোখ দুটিতে। রাগে গজগজ করতে-করতে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,
“দয়াভর্তি শরীর থেকে দয়া খসে পড়েছে আপনার? ঘুমের মধ্যে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন? অথচ মুখে মিষ্টি বুলি আওড়ান, আপনি আমার ওপর জোর খাটাবেন না। জানতাম একদিন ঠিকই আসল রূপ বেরিয়ে আসবে। এই আপনার উঁচু মন-মানসিকতা?”

নিয়াজ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল। মাথার যন্ত্রণায় সহসা সে কী বলবে বুঝেও উঠতে পারল না। আরিন্তা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যখন দেখল সে মাথা থেকে হাত সরাচ্ছে না, তখন কিঞ্চিত ভড়কে গেল। বুঝল নিয়াজের মাথায় আসলেই বেশি লেগেছে। নিয়াজের মতো সে-ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। কী করা উচিত, কী বলা উচিত ঠিক করতে পারল না। খানিক পর আমতা-আমতা করে শুধাল,
“আপনার মাথায় অনেক লেগেছে?”
নিয়াজ ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,
“কিছু হয়নি। ঘুমিয়ে পড়ো।”

আরিন্তা পুনরায় কিছু বলার আগেই নিয়াজ বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল। আরিন্তা সেদিকে তাকিয়ে মূর্তির ন্যায় ঠাঁয় বসে রইল। কিছুক্ষণ আগের রাগ কোথায় গেল বুঝতে পারল না সে। রাগ ধরে রাখবে কীভাবে? রাগ উঠতে-উঠতেই তো সে অকল্পনীয় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তারই বা কী দোষ? তখনও তার ঘুম গাঢ় হয়নি। নিয়াজ অমনভাবে কাছে যেতেই কাঁচা ঘুম ছুটে গেছে। অকস্মাৎ নিয়াজ চুমু খেয়ে তাকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। নিয়াজের থেকে সে এমনটা আশা করেনি বলেই রেগেমেগে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাকে আঘাত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় হয়ে গেছে। নিয়াজ ওয়াশরুম থেকে বেরোলো প্রায় দশ মিনিটের মাথায়। ততক্ষণ আরিন্তা থম মে’রে বসেই ছিল। নিয়াজ এসে এক মুহুর্ত-ও সময় নষ্ট না করে নিজের মতো শুয়ে পড়ে আরিন্তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ঘুমাও।”

যেন কিছুই হয়নি। আরিন্তা একবার জিজ্ঞেস করতে চাইল মাথার ব্যথা কমেছে কি না। নিয়াজ ওদিক ফিরে শুয়ে পড়ায় আর মুখ খোলা হলো না। মনের মধ্যে খচখচানি নিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল।

হোসনে আরা সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। তার কাজ প্রায় শেষের দিকে। সবাই খেতে বসে গেছে। শেষমেষ আর কাউকে কাজে হাত দিতে দেননি তিনি। আরিন্তা এসে সাহায্য করতে চাইলে বললেন,
“কাজ করতে হবে না মা। খেতে বসে পড়ো। নিয়াজ কোথায়?”
“ঘুমাচ্ছে।”
“এখনও ওঠেনি? তাহলে তুমি গিয়ে খেতে বসো। ও পরে খেয়ে নিবে।”
“আমিও পরে খাব। এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।”

হোসনে আরা জোর করলেন না। বরং কিছু সময় চুপ থেকে নিচু স্বরে বললেন,
“তোমার সাথে কথা বলা দরকার। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সময়-সুযোগ হচ্ছে না।”
আরিন্তা কৌতুহলী হয়ে বলল,
“জি আন্টি বলুন।”
“দুলাভাইয়ের সাথে যতবার ফোনে কথা হয়, তিনি তোমার খুব প্রশংসা করেন।”
আরিন্তা মৃদু হাসল। হোসনে আরা পরপরই বললেন,
“কিন্তু তিনি তোমাদের নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছেন। কদিন ধরেই আমাকে এ কথা বলছেন।”
“কিসের দুশ্চিন্তা?”
“কিছু মনে কোরো না মা। আমি তোমার মায়ের মতো। সেই হিসেবেই কিছু কথা বলছি। দুলাভাই সম্পর্কে তোমার শশুর। তাই নিজে কিছু বলতে পারেননি। আমাকে তোমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে যা বলেছেন, আর আমি যা খেয়াল করেছি, তাতে তার দুশ্চিন্তা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তোমাদের বিয়ের অনেকদিন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও তোমাদের দেখে মনে হয় না বাকিদের মতো তোমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক। আমরা সংসার জীবনে অনেক বছর কা’টিয়ে ফেলেছি মা। সম্পর্কের খাদ চোখে পড়ে যায়। লাজ-লজ্জা ভুলে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তোমাদের মধ্যে কি কোনো সমস্যা চলছে? কোনো সমস্যা মনে হলে নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাদের নিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হতে চাই মা।”

আরিন্তা খানিক ইতস্তত বোধ করল। কিন্তু কোনোরকম ইতি-উতি না করে একটু ভেবে উত্তর দিলো,
“বুঝতে পেরেছি আন্টি। আসলে আমার-ই একটু সমস্যা হচ্ছে ওনার সাথে মানিয়ে নিতে।”

হোসনে আরা মাথা দুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“বুঝি গো মা। তোমার আর দোষ কোথায়? আমাদের নিয়াজটাই অন্যরকম। ওর ব্যাপারে তুমি কতটা জানো জানি না। না জানলে জেনে নেওয়া উচিত। আমার বোন চলে যাওয়ার পর থেকে নিয়াজটা খুব একা হয়ে পড়েছে। দুলাভাই কাজের তাগিদে ওকে তেমন সময় দিতে পারেনি। নিয়াজ ছোটোবেলা থেকেই শান্ত ছেলে। মাকে হারানোর পর ও আরও শান্ত হয়ে গেছে। আজ অবধি ওর কোনো সমস্যা তো দূর, নিজস্ব কোনো কথাই কারও সাথে শেয়ার করে না। সব কথা চেপে রাখে। তুমি ওর স্ত্রী। বাকি জীবন ওর সঙ্গে কা’টাবে। তোমার কাছে অন্তত ওর নিজেকে চেপে রাখা ঠিক না। কিন্তু আমার ছেলেটা বোধ হয় তা-ই করছে।”

আরিন্তা ভেবেছিল হোসনে আরা তার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তার কথা শুনে বুঝল তিনি তাদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন বুঝতে পারলেও, সঠিক কারণ ধরতে পারেননি। তার ভাষ্যমতে তাদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার জন্য নিয়াজ দায়ী। কিন্তু আরিন্তা জানে প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই দোষী। নিয়াজ তো সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতেই চায়। তার কারণেই পিছিয়ে আছে। কিন্তু হোসনে আরার কথাগুলো আরিন্তাকে ভাবাল। কারণ তার বর্ণনার নিয়াজকে আরিন্তা আজ অবধি দেখেনি। প্রথম থেকেই সে নিয়াজকে যথেষ্ট মিশুক প্রকৃতির দেখে আসছে। কপালে মৃদু ভাঁজ ফেলে আরিন্তা বলল,
“কই? ওনাকে দেখে তো এমন মনে হয় না। আমি তো স্বাভাবিক-ই দেখছি।”
“তুমি স্বাভাবিক দেখছ, কারণ ও দেখাচ্ছে। শুধু তোমাকে না, সবাইকেই দেখায়। এই যে দেখছো না আমার সাথে খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে? একবার যদি জানতে চাই দিনকাল কেমন কা’টছে, কোনো সমস্যা আছে কি না, কখনোই উত্তর দিবে না। একদম গম্ভীর হয়ে যাবে। আস্তে-আস্তে বুঝবে।”

আরিন্তা উত্তর না দিয়ে ভাবছে সত্যিই নিয়াজ এমন কি না। তার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে হোসনে আরা দুঃখিত কন্ঠে বললেন,
“ছেলেটা প্রয়োজনের সময় মাকে পায়নি। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তুমি ওর পাশে থেকো। তোমার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমার ছেলেটাকে একটু সহ্য করে নাও। তোমাকে সবসময় পাশে পেলে দেখবে ও নিজেকে বদলানোর ভরসা পাবে মনে। অনেক ভালো একটা মানুষ পেয়েছ তুমি, যত্নে রেখো। এরপরও যদি তোমার মনে হয় আমার ছেলে সহ্যসীমার বাইরে, তবে আমাকে জানিয়ো। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব ওকে বুঝানোর। তবে তুমি নিজে আগে চেষ্টা করো। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে ওর মন বদলে দিতে। আমার কথাটা রেখো মা। আমার ছেলেটাকে আমি একটু সুখী দেখতে চাই।”

হোসনে আরা আরিন্তার এক হাত মুঠোয় চেপে ধরে অনুরোধ করলেন। আরিন্তা বিপাকে পড়ে বলল,
“আচ্ছা আন্টি। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে দেখব। আপনি চিন্তা করবেন না।”

হোসনে আরা আরিন্তাকে পাঠালেন খাওয়ার জন্য নিয়াজকে ডেকে আনতে। আরিন্তা গিয়ে দেখল নিয়াজ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বসে আছে। সে যখন বলল আন্টি তাকে খেতে ডাকছে, নিয়াজ সঙ্গে-সঙ্গে উঠে হাঁটা ধরল। আরিন্তা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশ্ন করে বসল,
“আপনার মাথা কি এখনও ব্যথা করছে?”
নিয়াজ তাড়াহুড়া করে চলে যেতে-যেতে উত্তর দিলো,
“না, না। কিসের ব্যথা?”

আরিন্তার মনে হলো নিয়াজ তার থেকে পালিয়ে বাঁচল। আজ দেরী করে ঘুম থেকে উঠল কি তার সামনে না পড়ার বাহানা খুঁজতে? খেতে বসেও নিয়াজ খুব স্বাভাবিকভাবে চুপচাপ খেয়ে চলল। আরিন্তা তাকে খেয়াল করল। হোসনে আরার বলা কথাগুলো তার মনে পড়ছে। সত্যিই কি এই সুন্দর মনের মানুষটার এত মিশুক স্বভাব লোক দেখানো? এরমধ্যে হোসনে আরা এসে বলে বসলেন,
“নিয়াজ, বউয়ের সাথে সবসময় গাল ফুলিয়ে থাকবে না বাবা। এমনিতেই বাড়িতে কথা বলার মানুষ নেই। দুলাভাই আর কতক্ষণ কথা বলে? তুমিও চুপচাপ থাকলে মেয়েটার একা-একা লাগবে। বুঝেছ?”

নিয়াজ অবুঝের মতো খালার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল। হোসনে আরা খাওয়া শেষ হওয়া অবধি এমন অনেক আদেশ দিয়েই চললেন। নিয়াজ যেন আরিন্তাকে ঠিকমতো সময় দেয়, তার মন খারাপ না করে, তার খেয়াল রাখে, বাকিদের মতো তার সাথেও গাম্ভীর্যতা না দেখায়, তার সাথে সব কথা শেয়ার করে, এসবই তার আদেশ। নিয়াজ শুধু শুনছে আর মাথা নেড়েই চলেছে। আরিন্তার হাসি পাচ্ছে। বেচারা জানেই না তাকে এসব আদেশ কেন দেওয়া হচ্ছে, অথচ আন্দাজে তাল মিলাচ্ছে।

খাবার টেবিল থেকেও মুক্তি মিলেও মিলল না। কোত্থেকে আবির তার ভাই-বোনদের নিয়ে এসে আ’ক্রমণ করে বসল। তাদের অভিযোগ সেদিন যে কাপল পিক তোলা হলো, তা নিয়াজ-আরিন্তার প্রোফাইলে যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এখনও অবধি সে কথা রাখা হয়নি। এখন তাদের দাবি, এই মুহূর্তে নিয়াজ-আরিন্তাকে তাদের কথা রাখতে হবে। তারা নিজেরা দুজনের প্রোফাইল পালটে দিবে। তাই দুজনের ফোন চেয়ে বসল। নিয়াজ চোখ পাকিয়ে নিষেধ করল। কিন্তু তারা শুনল না। আবিরের বোন মিকা গিয়ে রুম থেকে দুজনের ফোন উদ্ধার করে নিয়ে এল। জোরাজুরি করে দুজনের ফোন আনলক করাল। নিয়াজের ফোনের ওয়ালপেপারে তাদের বিয়ের ছবি দেখা গেলেও, আরিন্তার ওয়ালপেপারে তার নিজের ছবিও না দেখে আবির আফসোসের সুরে নিয়াজকে বলল,
“দেখো, তুমি ভাবিকে কতটা আনরোমান্টিক বানিয়ে ফেলেছ। এ যুগে কোনো বিবাহিত মেয়ের ফোনের ওয়ালপেপার এমন খাঁ-খাঁ করতে দেখেছ?”

সর্বপ্রথম তারা নিয়াজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নিয়াজের ছবি সরিয়ে কাপল পিক বসিয়ে দিলো। তারপর আরিন্তার প্রোফাইলে ঢুকতে গিয়ে দেখল তার ফোনে ফেসবুক অ্যাপই নেই। সবাই চরম বিস্ময় নিয়ে আরিন্তার দিকে তাকাল। নিয়াজের আরেক খালাতো ভাই অবাক হয়ে বলল,
“ভাবি, আপনি তো দেখি পীর-দরবেশ পর্যায়ে চলে গেছেন। আপনার ফোনে ফেসবুক অ্যাপই নেই!”
আরিন্তা বলল,
“আমি ফেসবুক চালাই না।”

মিকা প্রতিবাদ করে বলল,
“মিথ্যা কথা বোলো না ভাবি। আমি কিন্তু তোমার ফেসবুক আইডি পেয়ে রিকোয়েস্ট-ও দিয়েছি। কিন্তু তুমি এখনও অ্যাকসেপ্ট করনি।”
“ওই আইডি আগে চালাতাম। এখন চালাই না।”
“বিয়ের আগেও ওই আইডিতে পোস্ট করেছ তুমি। এখন চালাও না কেন? ভাইয়া কি তোমাকে বারণ করেছে?”
“নাহ্।”
“তাহলে কী সমস্যা? আজকাল ফেসবুক ছাড়া সময় কা’টে? তার ওপর তুমি একা মানুষ, সারাদিন বাসায় সময় কা’টাও কীভাবে? নাও, ওই আইডি লগইন করো। এখন থেকে ওটাই আবার ইউজ করবে।”
“না মিকা। আমার ভালো লাগে না ফেসবুক চালাতে। প্লিজ জোর কোরো না।”

নিয়াজ বলল,
“যা ভালো লাগে না বলছে তা নিয়ে জোর করিস না।”
আবির বলল,
“তুমি চুপ থাকো। তোমাকে দিয়ে জীবনে কিছু হবে না।”
নিয়াজ চোখ বড়ো করে বলল,
“কথাবার্তা সাবধানে বল, আমি তোর বড়ো ভাই।”
“কচু।”

আগের আইডি লগইন করার সাহস আরিন্তা করতে পারছে না। আইডিতে ঢুকলেই যে মিশকাতের আগের ম্যাসেজ সামনে আসবে, তা সে নিশ্চিত। তার মুখোভাব লক্ষ্য করে নিয়াজও আঁচ করতে পারল সে ওই আইডিতে ঢুকতে চায় না। দুজন বারবার নাকচ করলেও ভাই-বোনরা কিছুতেই ছাড় দিলো না। উলটো বলল আইডি না চালালে প্রোফাইল পালটে আবার লগআউট করে দিতে। তারা ফেসবুক অ্যাপ ইন্সটল করে আরিন্তাকে দিয়ে আইডি লগইন করিয়ে ছাড়ল। নিয়াজের প্রোফাইলে যেই ছবি দিয়েছে, সেই ছবিই আরিন্তার প্রোফাইলে দিয়ে তবেই তারা ক্ষান্ত হলো।

সারাদিনে আরিন্তা অনেকবার ফেসবুকে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেল। ম্যাসেজ দেখারও সাহস হলো না, আইডি লগআউট করাও হলো না। ইতোমধ্যে তার প্রোফাইলের ছবিতে পরিচিত মানুষ, বন্ধু-বান্ধবরা রিয়্যাক্ট, কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে একজনকেই আরিন্তা খুঁজে পেল না। রাতে একা বসে সে সাহস করে ম্যাসেজে ঢুকল। ইনবক্স ভর্তি পরিচিত অনেক মানুষের ম্যাসেজ জমে আছে। প্রথমদিকের ম্যাসেজগুলো গত দু-তিন দিন আগের। আরিন্তা সেগুলো ডিঙিয়ে নিচে গেল। অনেকগুলো আইডির পর কাঙ্ক্ষিত নামটিতে তার আঙুল থামল। ‘পোল্ট্রি’ নামক মানুষটির আইডির ছবি উধাও। আরিন্তার বিয়ের পরদিন দেওয়া শেষ ম্যাসেজটি ভেসে আছে স্ক্রিনে। আরিন্তার দৃষ্টি সেই ম্যাসেজে আটকে আছে। কী অদ্ভুত ম্যাসেজ! ‘দোআ রইল।’ কিসের দোআ দিয়েছিল সে? আরিন্তার সংসার জীবনে সুখী হওয়ার দোআ? অনেকটা সময় নিয়ে আরিন্তা ইনবক্সে ঢুকল। খুব সম্ভবত মিশকাত অ্যাক্টিভ স্ট্যাটাস অফ করে রেখেছে। ইনবক্সে ঢুকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল পরপর বহু ম্যাসেজ। প্রথমগুলো আরিন্তার বিয়ের আগে যখন পেলব তার ফোন কেড়ে নিয়েছিল, তখনকার। ম্যাসেজ দেখেই বুঝা যাচ্ছে মিশকাত কতটা দুশ্চিন্তায় ছিল তখন। যোগাযোগ করার চেষ্টায় বারবার ম্যাসেজ করেছে, কল করেছে। আরিন্তার ফোনে সমস্যা হয়েছে শোনার পর আর ম্যাসেজ করেনি সে। তারপর আবার ম্যাসেজ করেছে আরিন্তার বিয়ের পরদিন। আরিন্তার সাথে কথা হওয়া সত্ত্বেও সে ম্যাসেজ করেছে। হয়তো সে তখন জানত আরিন্তা এই আইডিতে আসবে না। শেষের ম্যাসেজগুলোতে সে ডক্টর নিয়াজের প্রশংসা করেছে, আরিন্তার নতুন জীবনের সুখ কামনা করেছে, দোআ করেছে। কত স্বাভাবিক সেই ম্যাসেজগুলো! অথচ একসময় এই মানুষটাই তাকে অন্য পুরুষের পাশে কল্পনাও করতে পারত না। রেগেমেগে একাকার কাণ্ড করে ফেলত। রাগের মাথায় অন্য পুরুষকে খু’ন করার কথাও সে বলে বসত। এসব ম্যাসেজ লেখার সময় সেই মানুষটার মনের অবস্থা কল্পনা করেই আরিন্তা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সে মিশকাতের আইডিতে ঢুকল। এখনকার কোনো পোস্ট-ও নেই। তবে কি সে এখন আর এই আইডি চালায় না? অবশ্যই না চালানোই স্বাভাবিক। আরিন্তার মতো দৃষ্টিতে পড়ার ভয় হয়তো তার মনেও আছে। অনেকক্ষণ আরিন্তা মিশকাতের আইডি ঘাঁটাঘাঁটি করে আগের পোস্ট দেখল, ছবি দেখল। সেসব সময়গুলোতে কতই না খুশি ছিল মানুষটা! আর এখন? কথা না হলেও তাকে হারানোর পরের অবস্থা আরিন্তার অজানা নয়। মানুষটাকে সে ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে।

নিয়াজ টেবিলে বসে আবিরের ল্যাপটপ ঘাঁটাঘাঁটি করে কী সব দেখছিল। আরিন্তাকে সে ঠিকই খেয়াল করেছে। তবু ‘টু’ শব্দটি করেনি। নিজে-নিজে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে থামার পর আরিন্তা হঠাৎ গলা তুলে ডাকল,
“শুনুন?”
নিয়াজ চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আরিন্তা বলল,
“এদিকে আসুন।”

অতিশয় অবাক হয়ে নিয়াজ চেয়ার ছেড়ে উঠে যন্ত্রের মতো এগিয়ে গেল। আরিন্তা তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,
“তোমার কি মাথাব্যথা করছে?”
“আপনার কি আমাকে দেখলেই মনে হয় আমার মাথাব্যথা করছে? না কি এটা আপনার আমাকে যখন-তখন ঔষধ গেলানোর ধান্দা? আপনাকে না বলেছি আপনার ডাক্তারি ঘরে টিকবে না?”
“যখন-তখন কান্নাকাটি করতে দেখলে মনে তো হবেই। আমার ডাক্তারির আর কী দোষ?”
“আপনার মাথাব্যথার কী অবস্থা তা বলুন।”

নিয়াজের হাতটা অটোমেটিক চলে গেল তার মাথার পেছন দিকে। আঘাতটা জোরেশোরেই লেগেছিল কাল। এখনও হালকা ব্যথা আছে। সে উত্তর দিলো,
“ব্যথা নেই।”
“ব্যথা আছে। আপনি লুকাচ্ছেন। গতকাল আপনাকে আঘা’ত করার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করে অমন রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। সরি।”
“আরে সরি বলার কিছু নেই। আমি ঠিক আছি। বাদ দাও তো।”

হেসে উড়িয়ে দিয়ে কথাটা বলে সে চেয়ারে ফিরে যাওয়া ধরলে আরিন্তা বলে উঠল,
“আমি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছি, চলে যেতে তো বলিনি।”
নিয়াজ থেমে গিয়ে শুধাল,
“পারমিশন নিয়ে যেতে হবে?”
“না। আপনার সাথে কথা আছে। বসুন এখানে।”
“কী কথা?”
“জরুরী কথা।”
নিয়াজ বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“আমার সাথেও তোমার জরুরি কথা থাকে? কী দিন এল!”
আরিন্তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“শুনবেন তো আগে।”
“ল্যাপটপটা বন্ধ করে আসছি।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।