বিরহবিধুর চাঁদাসক্তি পর্ব-০৭

0
157

#বিরহবিধুর_চাঁদাসক্তি
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৭.
আরিন্তা দুহাত ভর্তি মেহেদি পরেছে। আনন্দের দিনগুলোতে তার এমন হাত ভর্তি মেহেদি পরতে ভালো লাগে। সারাক্ষণ রাঙা দুটো হাত দেখতে-ও খুশি-খুশি লাগে। দুহাত মেহেদিতে রাঙিয়ে আরিন্তা ছবি তোলার জন্য পাগল হয়ে উঠল। তখনও সবার মেহেদি পরা শেষ হয়নি। মিশকাত আরিন্তার ভাইদের সাথে কার্ড খেলছিল। আরিন্তা গিয়ে মিশকাতকে ডাকল,
“মিশু ভাই, আমার হাতের কয়েকটা ছবি তুলে দাও।”

মিশকাত কিছু বলার আগেই আরিন্তার দু বছরের বড়ো চাচাতো ভাইটা বলে উঠল,
“আমি তুলে দিচ্ছি। আয়।”
আরিন্তা মিশকাতের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“না, মিশু ভাই-ই তুলুক। মিশু ভাই, এসো।”
মিশকাত বলল,
“সাইফুল-ই তুলুক।”
“তুমি ওঠো।”
“কোথায় তুলতে হবে?”
“ঘরের সামনের ফুল গাছের ওখানে মেহেদির ছবি সুন্দর আসে। চলো।”
মিশকাত হাতের কার্ড রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমরা খেলো। আমি এক্ষুনি ছবি তুলে দিয়ে চলে আসছি।”
মিশকাত উঠে পড়ল। আরিন্তা চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ছবি তুলতে। খুঁজো না কেউ।”
আরিন্তার ফুপু শুনে প্রশ্ন করলেন,
“এই রাত-বিরেতে বাইরে কোথায় যাচ্ছিস ছবি তুলতে?”
“অন্য কোথাও না। ঘরের সামনেই।”
“ওহ্! আচ্ছা যা। অন্ধকারের দিকে যাস না যেন।”
“আরে না, ফুল গাছের ওখানে। লাইট আছে তো বাইরে, সমস্যা নেই।”

আরিন্তা নিজেই আগে লাফিয়ে-লাফিয়ে বাইরে নেমে ফুল গাছের কাছে চলে এল। মিশকাত এল তার পেছন-পেছন। ছবি তোলার জন্য আরিন্তাকে প্রস্তুত হতে বলে মিশকাত ফোনের ক্যামেরা অন করে আরিন্তার দিকে ফোন তাক করল। বলল,
“কীভাবে তুলবি? ঠিক করে বল তাড়াতাড়ি।”

আরিন্তা ছবি তুলতে এলেও ছবির দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাল না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নীরব চোখে মিশকাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মিশকাত বলল,
“ছবি তুলবি, না চলে যাব? দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না আমি।”
আরিন্তা শুধাল,
“তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?”
প্রশ্ন শুনে মিশকাত আরিন্তার চোখের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে উলটো বলল,
“আজ অবধি কবে করতে পারলাম?”
আরিন্তা বলল,
“তোমাদের বাড়িতে তখন হুট করে রাগ দেখালে, এখানে এসে হতে আমার দিকে তেমন তাকাচ্ছ-ও না। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছো। সেজন্যই গতকাল থেকে মিথ্যা বাহানা দেখিয়ে আমাদের বাড়িতেও আসোনি।”
“কারো রাগ বোঝার মতো বুদ্ধি ঘিলুতে জন্মেছে?”
“তার মানে তুমি সত্যিই রেগে আছো? কেন?”
“কারো ওপর আমার কোনো রাগ নেই।”
“রাগের কারণটা তো বলবে। আমি কী ভুল করেছি যে, বলা নেই কওয়া নেই হুট করে তুমি রেগে বসে আছো?”
“তুই ছবি তুলবি, না আমি চলে যাব?”
“বলবে তো আমি কী করেছি। না বললে আমি কীভাবে বুঝব?”
“আমাকে কারোর বুঝার দরকার নেই। বুঝার জন্য চারপাশে কত ছেলে আছে! আমার পেছনে সময় দেওয়ার কোনো মানে হয় না কি?”
“এক মিনিট, কত ছেলে মানে? এ কথা দিয়ে কী বুঝাতে চাইছো তুমি?”
“কিছুই না।”
“উঁহু, কিছু তো একটা ঝামেলা আছেই। নইলে অন্য ছেলেদের কথা আসবে কেন? বলো তো কী হয়েছে।”

হাতের মেহেদির দিকে খেয়াল নেই আরিন্তার। ভুল করে সে সেই হাতেই মিশকাতের হাত ধরতে গেল। মিশকাত সঙ্গে-সঙ্গে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এই, হাত সরা।”
“ওহ্! খেয়াল নেই। বলো, অন্য ছেলেদের কথা কেন বললে? কখনো তুমি ব্যতীত অন্য কারো সাথে আমাকে দেখেছ?”
“কেন? তোর সাইফুল ভাইয়া আছে না?”
আরিন্তা কপাল কুঁচকে বলল,
“সাইফুল ভাইয়া কটা ছবি তুলে দিতে চাইল আর অমনি তুমি তাকে হিংসা করে বসলে? তুমি জানো না তাকে আমি ভাইয়া ডাকি? সব ভাইয়ারা-ই কি তোমার মতো সাইয়া হবে? অদ্ভুত কথা!”
মিশকাত হুট করে রাগত মুখে বলে উঠল,
“তো কাকে নিয়ে এত ব্যস্ত গতকাল থেকে যে, আমার খবর নেওয়ার-ও সময় নেই? গতকাল থেকে না আমার ম্যাসেজের উত্তর এসেছে, না এসেছে মিসকল। কিসের এত ব্যস্ততা?”

এতক্ষণে আরিন্তা বুঝতে সক্ষম হলো মিশকাতের রাগের আসল কারণ। গতকাল কাজিনমহল আসার পর থেকে সে এতটাই মেতে ছিল যে মায়ের ফোনের ধারেকাছেও যায়নি। ভেবেছিল তার কাজিনমহলের ডাক পড়লে মিশকাত বাড়ি আসবে, তখন তো দেখা হবেই। অথচ মিশকাত যে তার ওপর অভিমান করেই বাড়ি আসেনি, তা সে বুঝতেই পারেনি। আরিন্তা মুখোভাব এবং কন্ঠস্বর নরম করে বলল,
“আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আপুদের আর ভাইয়াদের ফোন পেলে বাড়ি আসবে, তাই আর ফোনের কাছে যাইনি।”
“তা যাবি কেন? সময় ছিল ফোন ধরার?”
“জানো তো সবাই এলে কত হৈ-হুল্লোড় চলতে থাকে।”
“সে-ই, তখন আর মিশকাত নামক কাউকে মনে থাকে না। এত ভিআইপি মানুষের ভিড়ে কি আর নগন্য মানুষের অস্তিত্ব থাকে?”
“নিজেকে তুমি নগন্য বলছো?”
“বলছি না, অনুভব করছি মানুষের আচরণে।”
“তোমার মনে হয় তুমি আমার কাছে কোনোদিন নগন্য ছিলে?”
মিশকাত তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“সময় এলেই টের পাওয়া যায়। নগন্য হয়েছি বলেই তো মানুষের কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছি। অস্তিত্বহীন মানুষকে তো আর কারোর প্রয়োজন পড়ে না।”

আরিন্তা চুপ রইল। তার কান্না পাচ্ছে। মিশকাতের অভিমান এতটাই গাঢ় হয়ে গেল যে তার কাছে নগন্য, অস্তিত্বহীন হওয়ার অভিযোগ তুলছে? কই? সে তো কোনোদিন এক মুহুর্তের জন্য-ও এমনটা ভাবেনি। প্রতিটা দিন যার সাক্ষাতের অপেক্ষায় সে তির্থের কাকের মতো পথ চেয়ে থাকে, সে কি করে নগন্য হয়? প্রতিটা মুহুর্ত যে তার গোটা চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা জুড়ে বিরাজ করে, সে কি করে অস্তিত্বহীন হয়? আরিন্তা ছলছল চোখে বলল,
“আমি এক অস্তিত্বহীন চরিত্রকে কেন মস্তিষ্কের দলিল দিয়ে দিয়েছি মিশু ভাই? এখন যে আমার মস্তিষ্কের নিউরনে-নিউরনে তার দখল, কল্পনা জুড়ে তার বিচরণ, এ তো বড্ড অবিচার হয়ে গেল। আচ্ছা? এ অবিচার ঠিক কতদিন যাবত চলে এসেছে? কত মাস হলো? কত বছর? মনে আছে তোমার? আমার হিসাব নেই কেন? মস্তিষ্কের দখল অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে বলে?”

মিশকাত খানিক থমকাল। আরিন্তার ছলছল চোখ জোড়ার ওপর বেশিক্ষণ দৃষ্টি ধরে রাখতে পারল না সে। লম্বা কয়েকটা দম নিয়ে চাপা স্বরে ধমকে উঠল,
“একদম কথা ঘুরাবি না পোনি।”
“কথা তো ঘুরাচ্ছি না। তুমিই তো বললে তুমি আমার কাছে নগন্য, অস্তিত্বহীন। যে আমার কাছে নগন্য, অস্তিত্বহীন, আমি কেন তার জন্য উতলা হয়ে থাকি বলতে পারো? কেন তাকে ভেবে ভেবে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকি? আমার তো উচিত নিজেকে চাঁদ আর তাকে নগন্য বামুন ভাবা। তা কেন পারি না আমি? চাঁদের জায়গা দখল করে-ও আমি কেন এত পাগল?”

এরপর আর মিশকাতের অভিমান ধোপে টেকার ক্ষমতা রাখেনি। কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে সে কেবল দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে। তারপর যখন আরিন্তার চোখের চিকচিকে পানিটুকু বিলীন হতে দেখল, তখন কন্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বলল,
“চাঁদ আর বামুনের মাঝে যতই আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকুক, আকাশের চাঁদ কিন্তু মাটিতে থাকা বামুনকে অনুসরণ করেই চলে। বামুন যেদিকে হাঁটে, চাঁদ-ও তার সাথে হাঁটে। উলটা পথে হাঁটার সাধ্য তার নেই, কোনোদিন হবে-ও না। সে যত মূল্যবান-ই হোক, এই নগন্য বামুনের সাথেই তাকে পথ চলতে হবে।”
“তা বুঝলে কেন বামুন চাঁদের ওপর অভিমান জমিয়ে অভিযোগ তোলে? কেন চাঁদকে কাঁদায়?”
“কারণ এই চাঁদটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত। এই চাঁদের ভাগ আমি ভুল করেও কাউকে দিবো না, চাঁদ নিজে চাইলে-ও না।”
আরিন্তা অভিমানি কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, চাঁদ চাইবে অন্য কাউকে নিজের ভাগ দিতে। চাঁদ তো আর ভালোবাসতে জানে না, যত ভালোবাসা শুধু বামুন একা-ই বাসতে জানে।”
মিশকাত আরিন্তার ফোলানো গাল টিপে দিয়ে বলল,
“আমার চাঁদ কত অভিমান-ও করতে জানে!”

আরিন্তা মিশকাতের কাছ থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“শুরুটা তুমি করেছ। সবসময় তুমি এমন করো। বলা নেই কওয়া নেই, হুটহাট অভিমান করে রেগেমেগে বসে থাকো। প্রতিবার রাগ ভাঙাতে-ও হয় আমাকেই। কোথাও দেখেছ মেয়েরা সবসময় ছেলেদের রাগ ভাঙায়? তুমি কেন এমন?”
মিশকাতের সহজ উত্তর,
“আমি এমন-ই, আজীবন এমন-ই থাকব। আজীবন তুই আমার রাগ, অভিমান ভাঙাবি, আজীবন আমি তোকে ভালোবাসব। তুই আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল, তুই ছাড়া আর কার কাছে আমি নিজেকে জমা রাখব? তুই না বুঝলে, কে আমায় বুঝবে? আমি তো আর কাউকে আমায় বুঝার সুযোগ দিইনি, কোনোদিন দিবো-ও না। যেদিন তুই আমার কারণে ক্লান্তি অনুভব করবি, সেদিন বলিস।”
“বললে কী করবে? মুক্তি দিয়ে দিবে?”

মিশকাত এমনভাবে হাসল, যেন আরিন্তা কোনো মজার কথা বলেছে। সে হাসিমুখে বলল,
“মুক্তি দেওয়ার জন্য তো আমি তোকে বুকের খাঁচায় বন্দী করিনি। আমার বুকের খাঁচা থেকে এই জীবনে তোর মুক্তি নেই। যেদিন তুই ক্লান্ত হয়ে পড়বি, সেদিন আমাদের সম্পর্কের নতুন একটা নাম দিয়ে নতুন করে আবার পথচলা শুরু করব, যাতে সেই সম্পর্কে ক্লান্তি নামক শব্দ তোকে স্পর্শ করতে না পারে।”
আরিন্তা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে বিয়ে করব না খারাপ লোক।”
“তো কাকে বিয়ে করবি?”
“কাউকে না। আমি জীবনে বিয়েই করব না।”
“আচ্ছা? তো আমি কাকে বিয়ে করব?”
“কাউকে না।”
“কিন্তু আমি তো বিয়ে করব-ই। বিয়ে করে তোর মুখ বেঁধে সারাদিন সামনে বসিয়ে রাখব, যেন ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করতে না পারিস।”
“ঠিক আছে, আমি কারো সাথে আর ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করব না। তুমি আমার কে হও যে আমি তোমার সাথে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করব?”
মিশকাত ঠোঁট চেপে কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবুক মুখে বলল,
“তাই তো! তুই আমার কে হোস?”
তারপর বলল,
“দাঁড়া একটু, আসছি।”
মিশকাত ঘরের ভেতর ছুট লাগালে আরিন্তা চেঁচিয়ে উঠল,
“আমাকে বাইরে একা রেখে কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমার ভয় লাগে না?”
“এক্ষুনি আসছি, এক মিনিট।”
মিশকাত ঘরে ঢুকে আরিন্তার চাচাতো বোনের পাশ থেকে একটা মেহেদি তুলে নিতেই প্রশ্নের মুখে পড়ল,
“মেহেদি দিয়ে কী করবে তুমি?”
মিশকাত বলল,
“আরির হাতের এক জায়গা থেকে উঠে গেছে আমার হাতে লেগে। সেজন্য রাগ করেছে, ছবি তুলছিল তো।”
“ওর এখনো ছবি তোলা হয়নি? এখানে আসতে বলো, আমি ঠিক করে দিই।”
“সমস্যা নেই। একটুখানি জায়গা, আমি ঠিক করে দিতে পারব।”

মেহেদি হাতে মিশকাত ফিরে আসতেই আরিন্তা রাগত স্বরে বলল,
“তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে দৌড় দিলে?”
মিশকাত প্রত্যুত্তর করল না। এগিয়ে গিয়ে বলল,
“হাত সামনে মেলে ধর।”
“কেন?”
“বলেছি তাই।”
আরিন্তা তার এক হাত মেলে ধরল। মিশকাত আরিন্তার হাতের ফাঁকা জায়গাটুকুতে মেহেদি লাগাতে নিতেই আরিন্তা হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কী করছো?”
মিশকাত বিরক্ত মুখে আরিন্তার হাতটা টেনে নিয়ে মেহেদি দিয়ে ফাঁকা জায়গায় ইংরেজি অক্ষরে ছোটো করে লিখল, মিশু। আরিন্তা চুপ করে তার কাণ্ড দেখল। নাম লিখে মিশকাত বলল,
“এখন শুধু হাতে আমার নাম খোদাই করে দিলাম, বিয়ের পর জীবনে খোদাই করে দিবো। তখন বুঝবি আমি তোর কে।”
আরিন্তা বলল,
“বকবক বাদ দাও। আমি এই হাত এখন সবার সামনে কীভাবে দেখাব?”
“সেটা তোর ব্যাপার।”
“অকাজ করে এখন এটা আমার ব্যাপার, না?”
মিশকাত হাতের মেহেদি রেখে বলল,
“এখন তুই ছবি তুলতে চাইলে তোল, নইলে আমি ঘরে চলে গেলাম।”
আরিন্তা ছবি তুলল ঠিকই। কিন্তু সারাটা সময় সে গাল ফুলিয়ে মিশকাতকে বকে চলল। মিশকাত শুধু মুচকি-মুচকি হাসল। তার হাসির কারণে আরিন্তার রাগ আরও বাড়ল।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে