Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 280



হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৩৩+৩৪

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৩|
#শার্লিন_হাসান

শুভ্র কুমিল্লায় চলে গেছে দুইদিন আগে। আজকে শুক্রবার। সেরিন ভাবলো শাড়ী পড়া যাক। যেহেতু এই বিল্ডিংয়ে তেমন মানুষজন থাকেনা। দুই তিনজন ভাড়াটিয়া। তারাও তাঁদের মতো ব্যস্ত। ছাদে তেমন কেউই যায় না। সেরিন নামাজ পড়ে লান্স করে নেয়। শুভ্রকে বলেছে সে শাড়ী পড়বে আজকে। শাড়ী পড়ে পিকচার তুলে দিবে। শুভ্র কিছু বলেনি। কল রেখে সেরিন ব্লাক কালার জর্জেট শাড়ী পড়ে নেয়। সিদরাত,আয়াশ সহ তারা ছাদে যায়। সেরিনের কোমড় অব্দি চুল ছাড়া। কানের পিঠে একটা সাদা কাঠগোলপ গুঁজানো। সিদরাতকে দিয়েই পিকচার,কয়েকটা ভিডিও করিয়ে নেয় সেরিন। এরই মাঝে কোথা থেকে তাতান এসে হাজির হয়। সেরিনের মোটেও পছন্দ হয়নি বিষয়টা। তাতান সেরিনকে দেখে হা করে তাকিয়ে রয়। সেরিন চলে যেতে নিবে তাতান এসে পথ আটকায়। সেরিন দাঁড়িয়ে রয়। তখন তাতান বলে,
“আপনি? কেমন আছেন?”

“ভালো। আপনি?”

“ভালো। আপনাকে কালো শাড়ীতে দারুণ মানায়।”

” ধন্যবাদ।”

“আরে,আরে আপনার ফুলটা পড়ে যাচ্ছে তো!!”
সেরিন হা করে তাকিয়ে রয়। তাতান তার অনুমতি না নিয়েই কাঠগোলাপটা তার কানের পিঠ থেকে নিজের হাতে নিয়ে পুনরায় সেরিনকে পড়িয়ে দেয়।

“আপনার সাহস তো কম না আমার অনুমতি না নিয়েই টাচ করেছেন।”

” ভুল হয়ে গেছে আপু। অনুমতি নিলেই ভালো হতো শুধু টাচ না অন্য কিছুও করা যেতো।”

“এক থাপ্পড় দিয়ে গালের দাত সব পেলে দেবো গো***পুত! তুই চিনিস আমায়? আমার নাম সেরিন পাটওয়ারী মিশাত। তোর মতো লুজার কে কীভাবে ঠিক করতে হয় সবই আমার জানা আছে। শা’লা ক্যারেক্টর হলো ভা’ঙা ব্রিজের মতো নড়েচড়ে। শক্ত না! ভাঙা ব্রিজে ইট সিমেন্ট দিয়ে শক্ত করে নিস তাহলে আমার টাইপের মেয়েদের টাচ না তাঁদের থেকে চু’মু ও খেতে পারবি। এনি ওয়ে ধন্যবাদ দিতে হবে না আমি আবার একটু পরোপকারী। নেক্সট টাইম হাই হ্যালো করতে আসলে তোর জায়গা মতো এমন একটা কিক মারবো, ফিউচার সাথে চোখ টাও অন্ধ হয়ে যাবে। এমনিতেই চার চোখ লাগানো লাগে। তখন সুন্দরী রমনী খুঁজতেই কষ্ট হয়ে যাবে ফিউচারে মাঠে/খাটে খেলাধূলা করা তো পরের হিসাব। সো বি কেয়ারফুল!!”

কথাটা বলে সেরিন তেজ দেখিয়ে চলে আসে। দু’চারটা চ-ড় মারতে পারলে ভাল্লাগতো তবে যা বলেছে মনের সাধ মিটেছে। আরো বাজে দুটো গা’লি দিতে পারলে বোধহয় আরো ভালো হতো।

বাসায় ঢুকেই শাড়ী চেন্জ করে নেয়। মেজাজ তার তুঙ্গে উঠে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। তাতানের কত বড় আস্পর্ধা তাকে টাচ করলো।

“আচ্ছা কেউ ইচ্ছে করে এমনটা করছে না তো? এই তাতান কা’নাকে দেখে গাধা টাইপ লাগে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ নাটকীয়। কে আবার আমার পেছনে পড়লো?

ধূর! কে আবার পড়বে? এই ছেলের ক্যারেক্টারে সমস্যা।”

সেরিন নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে এই কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।

সন্ধ্যায় আবার শুভ্র কল দেয়। সেরিনের মনটা খারাপ তবে শুভ্রকে বুঝতে দেয়না। শুভ্র সুন্দর ভাবেই বলে,
“পিকচার দাওনা?”

“আরে ভালো লাগছে না। পরে দিবো।”

“আগে আমি দেখবো তারপর তোমার অডিয়েন্স!”

“ঠিক আছে।”

“মুড অফ কেনো সেরিন?”

“এই কী সেরিন,সেরিন করছেন? ভালোবেসে একটা সুন্দর ডাকনাম ও তো দিতে পারেন। আসলেই আপনি সবার মতোই!”

“ওতো লুতুফুতু করার সময় নেই।”

“আজব! এখানে লুতুফুতুর কী হলো? আমি আপনার বউ আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আর এটা একটা ভালোবাসা প্রকাশ বুঝলেন? কী আর বুঝবেন মাথায় তো সমস্যা আপনার।”

“এই তুমি আমায় আর কত খোঁটা দিবা?”

“যতদিন পর্যন্ত না আপনার রুলস যায়।”

“সেটা আমৃত্যু পর্যন্ত থেকে যাবে।”

“বা’ল! ”

“আবার গা’লি দিচ্ছো?”

“ভাল্লাগেনা!”

“দেখো সেরিন সব বলো,করো ঠিক আছে কিন্তু এই গা’লি? তুমি জানো তোমার কত গুনাহ হয়?”

“আর বলবো না।”

“তোমার গা’লি না দেওয়ার প্রমিসটা লোকাল বাসের মতো হয়ে গেছে আজকাল।”

“চুপ যাবেন?”

“আচ্ছা যাও পড়তে বসো।”

“এমনিতে মুড অফ পড়ার কথা না বললেও পারতেন।”

“তাহলে ঘুমাও যাও! আমার অফিসের কাজ আছে।”

“আচ্ছা যাচ্ছি! আগে বলুন ‘ভালোবাসি বউ’।”

“তুমি বলো।”

“আমি আপনায় আগে বলেছি আপনি আগে বলবেন।”

“ঠিক আছে।”

“বলুন?”

“তুমি ফাজিল হয়ে গেছো সেরিন।”

“সেম টু ইউ। আপনিও ফাজিল হয়ে গেছেন।”

“আসলেই ফাজি তুমি।”

“এবার বলুন তো?”

” আই লাভ ইউ!”

“আই লাভ মি টু! থ্যাংকিউ স্যার।”

“এটা কী হলো?”

“ত্যাড়ামী।”

“আর বলবো না।”

“আচ্ছা থাক।ভালোবাসি!”

“ধন্যবাদ আপু।”

“এই আমি তোর কোন জন্মের আপু?”

“আবার তুই তোকারী করছো?”

“ওহ্! আমি আপনার কোন জন্মের আপু? আর কখনো আপু বললে ব্লক মে’রে দিবো মনে রাখবেন।”

“আচ্ছা বায়!”

“কী এক করলার জুশ কপালে জুটলো রে ভাই। এতো তেজ কেন আপনার?”

” তেজী মানুষের থেকে দূরে থাকুন প্লিজ ম্যাম!”

“বায়!”

সেরিন কল কেটে দেয়। শুভ্র ও আর কল ব্যাক করে না। সেরিন মনে,মনে শুভ্রর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে।
” মানে মানুষ এতো ত্যাড়া কেমনে হয় ভাই? এতো করলার জুশ কেনো? আমার মতো মিষ্টি মেয়ের জামাই হওয়া চাই আমার থেকেও মধুর। তা না কী কোথাকার তেজী,করলার জুশ কপালে জুটলো।”

**********

দেখতে,দেখতে প্রায় পনেরোদিন কেটে যায়। শুভ্র পুনরায় ঢাকা আসে। সেরিনের কনসার্ট আগামীকাল সন্ধ্যায়। শুভ্র সহ যাবে। ঢাকা থেকে সিলেট যাবে কনসার্টে। সেরিন অনেক বেশী নার্ভাস তবুও নিজেকে স্ট্রং রাখছে। সকালের নাস্তা করে তারা বেড়িয়ে পড়ে। মিউজিক একাডেমির কিছু টিচার সাথে সেরিনের টিম,শুভ্র সহ তারা যাবে। সেরিন শুভ্রর পার্সোনাল কারে করেই রওনা হয়। পুরোটা পথ শুভ্রকে এটা,ওটা খোঁচাখুঁচি, বকাঝকা ইত্যাদি,ইত্যাদির মাধ্যমে কাটিয়েছে সেরিন। শুভ্র ও সব কথা শোনেছে ধৈর্য সহকারে। ধমক দিলেও আবার সমস্যা। মেয়েটা কান্না করতে,করতে যাবে।
জ্যাম ঠেলে প্রায় বিকেলের দিকে তারা সিলেট পৌঁছায়। সেখানেরই বুকিং দেওয়া একটা হোটেলে উঠে তারা। সেরিন শাওয়ার নিয়ে হাল্কা নাস্তা করে নেয়। সন্ধ্যা আটটায় তাঁদের কনসার্ট শুরু। এর ফাঁকে তার টিমের সাথে বসে কিছুক্ষণ রিহার্সেল করে।

সময় মতো নিজেকে রেডি করে নেয় সেরিন। আজকে সে বাঙালি মেয়ে সেজেছে। শালীন পোষাকে। থ্রিপিসের, কপালে একটা কালো টিপ। মুখে নেই তেমন সাজ। এই সিম্পল লুকেই সেরিনকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আটটা বাজতে বেশী দেরী নেই। নিজেকে ঠান্ডা রাখে সেরিন। শুভ্র যাওয়ার সময় তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। গালে হাত স্পর্শ করে বলে,
“এই যে আমি আছি তোমার পাশেই। একদম ভয় পাবা না।”

সেরিন মাথা নাড়ায়। একসাথে তারা বেড়িয়ে পড়ে।
ফাইনালী সেই মূহুর্তটা এসেই পড়েছে। সেরিন মাইক হাতে স্টেজে যায়। সাথে তার টিম আছে। একেকজন একেক টিউন বাজাচ্ছে। সেরিন আজকে দু’টো গান গাইবে। “অনিকেত প্রান্তর” এবং “নিঠুর মনোহর”।
শুভ্র ফোন হাতে ভিডিও করছে। সেরিন বরাবরই ভালো গায়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অনুষ্ঠান শেষ হতে অনেকেই অটোগ্রাফ নিতে এসেছে।পিক তুলেছে। কেউ,কেউ ফুলও দিয়ে গেছে। সেরিন হাসিমুখে সব গ্রহণ করেছে। পাশে শুভ্র ও দাঁড়ানো আছে। সেরিনকে কেউ,কেউ জিজ্ঞেস ও করেছে, ” আপু কী সিঙ্গেল”? সেরিন শুভ্রর দিকে একনজর তাকায়। তার দৃষ্টি সেরিনের দিকে তাও কঠোর দৃষ্টি। সেরিন মুচকি হেঁসে বলে,
“না আমি ম্যারিড।”
তখন একটা মেয়ে শুভ্রকে দেখিয়ে বলে,
“এই ভাইয়া আপনি কী সিঙ্গেল?”
সেরিন নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“উনি আমার হাজব্যান্ড!”

সেরিন শুভ্রকে দেখে অনেকে, “মাশাল্লাহ” বলেছে। তাঁদের মিটআপ অনুষ্ঠান শেষ হতে সেরিন শুভ্রর সাথে পিকচার তোলে। হোটেলে যেতে যেতে প্রায় বারোটার উপর বেজে যায়। সেরিন আজকের দিনেও অনেক প্রশংসা পেয়েছে। যেটার জন্য সে আলহামদুলিল্লাহ।
রাতের ডিনার আসতে শুভ্রই খাইয়ে দেয় সেরিনকে। দু’জন মিলে কিছক্ষণ গল্প করে শুয়ে পড়ে। সেরিনের পরম শান্তি এবং সুরক্ষিত জায়গা সেই শুভ্রর বক্ষ:স্থল!

পরের দিন সিলেট থেকে সোজা কুমিল্লায় আসে সেরিন। দীর্ঘ পথ জার্নি করে চৌধুরী বাড়ীতে আসে। এদিকে আর্থ শশীর বিয়ের তোরজোর চলছে। সেরিনের কনসার্টের জন্য লেট করা হয়েছে। আগামী কাল থেকে শপিং শুরু হবে। চৌধুরী পরিবারের সবাই কুমিল্লায় এসেছে গতকাল। আজকে শুভ্র এবং সেরিন। সবার সাথে দেখা করে সেরিন রুমে চলে যায়। বাকীরা সেরিনের কনসার্ট ভিডিও দেখছে। আদ্রিতা,অধরা,আর্থ থেকে শুরু করে বাড়ীর সবাই। বেশ প্রশংসাও করে সেরিনের ভয়েসের। আরফিন চৌধুরী বিডি এসেছেন কয়েকদিন।

সন্ধ্যায় সবাই খোশগল্প করতে বসে। তাঁদের সাথে সেরিন ও আছে। বিশেষত বিয়ে নিয়ে প্লানিং।
সবার মাঝ থেকে শুভ্র সেরিনকে রুমে ডাকে। বিষয়টায় সেরিন বেশ লজ্জা পায়। তবে একটু চিন্তা হয়। এর আগে কখনো এভাবে ডাকেনি। হয়ত সিরিয়াস কোন বিষয়। সেরিন ও তড়িঘড়ি রুমে যায়। শুভ্র সোফায় বসে আছে। কপালে তার হাত ঠেকানো। সেরিনের অস্তিত্ব টের পেতে শুভ্র উঠে দাঁড়ায়।
তখন সেরিব শুধায়,
“কী হয়েছে?”

“ঢাকায় তোমায় কেনো পাঠিয়েছিলাম?”

” গানের প্রিপারেশন নেওয়ার জন্য।”

“আর তুমি কী করেছো?”

” আপনার রুলস মেনে চলেছি।”

“ওটা তো জাস্ট শো অফ! ছিঃ সেরিন ছিঃ তুমি এমনটা করতে পারলে? এখনি আমি থাকা সত্ত্বেও তুমি মেয়ে পরপুরুষের ছোঁয়া গায়ে মাখতে পেরেছো সেই তুমি একটু উপরে উঠলে কী করবে আমার জানা আছে। তুমি আমার হাত ছেড়ে দিতে দু’বার ও ভাববে না। লিসেন! তুমি চলে গেলে আমার কিছু যায় আসেনা। আমি তেমাকে হারানোর ভয় করিনা। আমি ভয় করি আমার ভালোবাসা হারানোর। পবিত্র ভালোবাসা যেটা প্রথম এবং একবার একজনের প্রতি তৈরী হয়েছে। দ্বিতীয় কারোর ভাগ হবে বা সেটায়। আমি শুভ্র তোমায় হারানোর ভয় করছি না। আমি শুভ্র আমার চঞ্চলপরীর ভালোবাসা হারানোর ভয় করছি।”

“আমি কী করেছি?”

” তোমার কী কমন সেন্স টুকুও নেই? সব কিছুতে এমন বাচ্চামো পছন্দ না আমার।”

“ক্লিয়ার করে বলবেন তো?”

“এই তুমি নাটক করছো?”

“কিসের নাটক? নাটক করছেন আপনি!”

“সেরিনননননন!”

চিৎকার করে উঠে শুভ্র। সেরিন ভয়ে কেঁপে উঠে। ধমকটা ভীষণ জোরেই ছিলো। শুভ্র তার ডান বাহু চেপে ধরে। সেরিন ব্যাথায় শুভ্রর থেকে নিজের বাহু ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কোন লাভ হয়নি! শুভ্র আজকে ভীষণ ক্ষেপেছে। সেরিনের কর্ণিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শুভ্র তাকে ছেড়ে জোরে ধাক্কা দেয়। যার ফলে সেরিন মেঝেতে পড়ে যায়। চিল্লিয়ে বলে,

” আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা ও করবেনা তুমি । লিভ মি! জাস্ট লিভ মি! আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও তুমি। নাহলে গাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো আমি। ”

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩৪|
#শার্লিন_হাসান

“আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা ও করবেনা তুমি । লিভ মি! জাস্ট লিভ মি! আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও তুমি। নাহলে গাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো আমি। ”

শুভ্রর কথায় সেরিন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। উঠে দাঁড়াতে শুভ্র পুনরায় বলে,
“তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি আমি।”

“গুড! আপনার সাথে আর আমার সাথে যা হয়েছে বেশ হয়েছে। আপনি আসলে আমায় বিশ্বাস করেন না। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসা থাকা আর সম্পর্ক টিকার প্রশ্নই উঠে না।”

“ডিভোর্স চাই তোর?”

“আপনি দিলে আমার তো কিছু করার নেই।”

“ডোন্ট ওয়ান্না টক! জাস্ট মোভ ওয়ে ফ্রম দ্যা ফ্রান্ট!!”

সেরিন কিছু বলেনা। পুরো ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করতে গেলে শুভ্র তাকে শিওর থাপ্রাবে। এমনিতে মাথা গরম হয়ে আছে। সেরিন কথা না বলে বেলকনিতে চলে যায়। শুভ্রর বেশ রাগ হয় সেরিনের মুখের উপর বলা কথায়। সেরিন বেলকনিতে গিয়ে বাইরে এক ধ্যাণে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রর এমন আচরণের “আ” টাও সে বুঝেনি। শুধু মুখের উপর বলে দিয়েছে। আর পরপুরুষ কে? কার ছোঁয়া বা গায়ে মেখেছে সেরিন? চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করে। কনসার্ট,ঢাকায়, একাডেমিতে কোথাও ছেলেদের সাথে কথা বলেনি। শুভ্র তো ছিলোই!! তাহলে কী এমন?

শুভ্র পুনরায় ভিডিওটা দেখে। সেরিন জর্জেট ব্লাক কালার শাড়ী পড়া। শাড়ীটা পাতলা সেরিনের ফর্সা উদর বোঝা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে! তারউপর ছেলেটাও তার কানের পিঠে ফুল গুঁজে দিচ্ছে। সেরিন একটা টু শব্দ ও উচ্চারণ করছে না। শুভ্র বেশ অবাক হয়। সেরিন এটা কীভাবে পারমিশন দিলো? মাথা কাজ করছে না শুভ্রর। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সোফায় বসে থাকে। একজন সার্ভেন্ট এসে ডাক দেয় খাবার খাওয়ার জন্য। শুভ্র না করে দিয়েছে। তারা কেউ ডিনার করবে না। উঠে দরজাটাও লক করে দেয় শুভ্র।

শুভ্র,সেরিন ডিনারে আসেনি সবাই অবাক। অনেক মাস পর চৌধুরী পরিবারের সবাই একসাথে। রাতের ডিনার টা করবে সবাই একসাথে সেখানে শুভ্র সেরিন মিস্টেক। সেরিন তো হাসিমুখে আড্ডা দিচ্ছিলো। শুভ্র তাকে ডেকে নেওয়ার পর কী হয়েছে কারোরই বোধগম্য নয়। তবে শুভ্র যেহেতু একবার বারণ করে দিয়েছে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

ঘড়ির কাটা বারোটা। সেরিন এখবো বেলকনির দোলনায় বসে আছে। এক ধ্যাণে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রুমে যাবে না শুভ্র রেগে আছে। বাইরে যেতে পারবে না তাঁদের পার্সোনাল ম্যাটার বাকীরা জেনে যাবে।

খাটে শুয়ে আছে শুভ্র। সেরিন রুমে আসেনি তা নিয়ে তার একটুও মাথা ব্যাথা নেই। যা খুশি হোক সেরিনের শুভ্রর কিছু যায় আসেনা। যে মেয়ে কথার খেলাপ করে তার থেকে আর কিছু এক্সেপ্ট করার মতো নেই।

বাড়ীর পূর্ব দিকের কবর স্থানে চোখ যেতে সেরিনের গা হিম শীতল হয়ে যায়। তারউপর দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। গাছের পাতা নড়ছে। চারপাশে লাইট জ্বললেও সেরিনের ভয় কাজ করছে। নিজের রাগ জেদকে আর প্রশ্রয় দিতে পারেনি সেরিন। উঠে রুমে চলে যায়। কাবাড থেকে একটা কম্বল নামায়। খাটের উপর থেকে বালিশটা নিয়ে ডিভানের উপর চলে যায়। শুভ্র সেরিনের কান্ড দেখছে। তারা কেউই কারোর সাথে কথা বলছে না। শুভ্র নিজেকে শান্ত রেখে বলে,

“তুমি যেদিন ব্লাক শাড়ী পড়েছিলে সেদিনের ছেলেটা কে ছিলো? তোমার কানে ফুল গুঁজে দিয়েছিলো।”

“জেনে কী করবেন?”

“বেশী হয়ে যাচ্ছে না? আমি প্রশ্ন করেছি তুই উত্তর দিবি। জেনে কী করবো না করবো সেটা আমার ব্যপার। তোকে সে-সব জানতে হবে না।”

“ওর নাম তাতান….

” বাহ্ নামটাও জানো?”

“কথাটা তো শেষ করতে দিন।”

“আর কিছু বলতে হবে না তোর।”

সেরিনও আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। শুভ্র সেভাবেই বসে রয়। সেরিন ছেলেটার নাম ও জানে! শুভ্রর রাগে শরীর জ্বলছে। তার বউ কেন অন্য ছেলের নাম মুখে নিবে? কেনো?

********

পরের দিন সকালে সেরিনের ঘুম ভাঙে শুভ্রর এলার্ম ঘড়ির শব্দে। উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। মাহীকে কল দিয়ে বলেছে সে কলেজ শেষে যাবে। যাতে এসে তাকে নিয়ে যায় মাহী। শুভ্রকে কিছুই জানায়নি সেরিন। শুভ্র ও ইন্টারেস্ট দেখায়নি। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলে রাখে সেরিন। পাটওয়ারী বাড়ীতে তার জামাকাপড় সবই আছে। ব্যাগে করে আর কিছুই নিতে হবেনা। সবার সাথে বসেই নাস্তা করে নেয় সেরিন। তবে কেউ কোন প্রশ্ন করেনি। শুভ্র সেরিন কেউ কারোর দিকে ফিরেও তাকায়নি। নাস্তা করে যে যার মতো বেড়িয়ে পড়ে।

অনেকদিন পর সেরিন কলেজ এসেছে। নিশাতের সাথে দেখা হতে কথা বলে সেরিন। সেরিনের মন খারাপ দেখে নিশাত জিজ্ঞেস করে, “তোদের আবার জামেলা হলো নাকী? আজকে মনটা আর মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেনো?”

“না এমনিতে কিছু হয়নি!”

“আরে ইয়ার আমি তোর ফ্রেন্ড। আমার কাছে না বললে কার কাছে বলবি?”

“না আসলে একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। এমনিতে মিটে যাবে। হয়না ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া।”

“ওকে!”

সেরিন পিটির সময় হতে নিশাত সহ পিটিতে দাঁড়িয়ে যায়। শুভ্রও আসে পিটিতে। তবে আজকে কোন ভাষণ দেয়নি সে। ব্যপারটা আজকাল আর শকিং না। শুভ্র অনেকটা চেন্জ হচ্ছে। স্টুডেন্ট রাও একটু শান্তি পাচ্ছে। পিটি শেষ করে ক্লাসে এটেন্ড করে সেরিন। আজকেও আকাশ,জুম্মানের মুখোমুখি হয়। সেরিনকে দেখে তারা ও তাকায়। সবাই জানে সেরিন চলে গেছে। আবার আসলো কেন? আকাশ, জুম্মান সেরিনকে দেখে বলে,
“এবার তো কিছু একটা করা যাবে। এই মেয়েটাকে এতো সুন্দর লাগে একটু আধটু ফ্লার্ট আর র‍্যাগিং না করলে নাই হয়।”

জুম্মানের কথায় আকাশ শুধায়,
“সেদিন তো শুধু বোতল মারলাম। আজকে দেওয়ালের সাথে দুই চারটা বা’রি ও মারা যাক।”

“আরে না! একে এমন অবস্থা করবো। একবারে সন্মান নিয়ে টানাটানি হওয়ার মতো অবস্থা।”

“ফাঁকা রুমে?”

“দেখা যাক!!”

কথাগুলো বলে তারাও ক্লাসে মনোযোগ দেয়। সেরিন মাঝের সারিতে বসেছে। এক টেবিলে একজন করেই বসে। তার ডান পাশে ছেলেদের সারির টেবিল। বাম পাশে মেয়েদের সারির টেবিল। সেরিনের টেবিলের সোজা আবার জুম্মান আর আকাশ বসেছে। সেরিন বিষয়টা খেয়ালে নেয়নি। সে ক্লাসে মনোযোগ দেয়। তার পেছনে নিশাত বসেছে। ছয় ছয়টা ঘন্টা শেষ করে ছুটি হয়। সেরিন উঠে দাঁড়ায়। তাঁদের আবার ল্যাব ক্লাস আছে একটা। বেশী ভীড় দরজায় তাই একটু লেট করে বের হয় সেরিন। তার বের হতে,হতে শেষের দিকে পড়ে যায়। তার পেছনে আবার জুম্মান,আকাশ। সেরিন তড়িঘড়ি ক্লাস রুম থেকে বের হয়। করিডোরে হালকা ভীড় সেরিন ভীড়ের মধ্যে ঢুকে যেতে নিবে। পেছন থেকে কেউ তার ওরনায় টান দেয়। সেরিন ফিরে তাকতে দেখে আকাশ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সেরিন ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দেয় আকাশের গালে।
তেজী স্বরে বলে,
“ঘরে তো মা বোন নেই! থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতি নারীদের কীভাবে সন্মান করতে হয়।”

“এই সুন্দরী আমায় চ’ড় মেরেছে।”

কিছুটা উঁচু স্বরে কথাটা বলে আকাশ। তখন জুম্মান চুলগুলো পেছনে নিয়ে বলে,
“আজকের তোকে দেওয়ালের সাথে ঠুকিয়ে,ঠুকিয়ে মারবো।”

মূহুর্তে কিছুটা ভীড় জমে যায়। মূহুর্তে কথাটাও বাতাসের গতিবেগে শুভ্রর কানে পৌঁছায়। শুভ্র মিটিংয়ে ছিলো। তবে সেরিনের কথা শুনে মিটিং ছেড়েই বেড়িয়ে আসে। দোতালায় দ্রুত উঠে যায়। শুভ্রকে দেখে আকাশ,জুম্মান কিছুটা ভয় পায়। সেরিনকে দেখে শুভ্র জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে এখানে?”

“এই ছেলেটা আমার ওরনা ধরে টান দিয়েছে। তারপর আমি চ’ড় দিয়েছি। জুম্মান বলেছে, আমায় নাকী দেওয়ালে সাথে ঠুকিয়ে,ঠুকিয়ে মারবে।”

“কথাগুলো কী সত্যি আকাশ,জুম্মান?”

তখন জুম্মান বলে,
“স্যার সেরিন আমাদের কলেজ থেকে বের করার পরিকল্পনা করছে।”

“তোকে আমি সেটা জিজ্ঞেস করিনি। ও যা বলেছে তা সত্যি কী?”

“না স্যার!”

পাশ থেকে আকাশ বলে। সেরিন তখন শুধায়,
“মিথ্যে বলবি না একদম।”

“তুমি চুপ থাকো।”

শুভ্র ধমকে বলে সেরিনকে। সেরিনের কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তাকে এভাবে কেনো অবিশ্বাস করছে?
“প্রথম দোষের পর সব ভালোই কী সন্দেহ জনক হয়?”

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-৩১+৩২

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩১|
#শার্লিন_হাসান

সেরিন আজকাল একটু বেশী দুঃসাহস দেখাচ্ছে। শুভ্রর থেকে দূরে তাই এমন। সামনে গেলে একবারে ভদ্র মেয়ে হয়ে যাবে সে। তার মেঝো শাশুড়ী আম্মুর বাসায় থেকে বেড়ানো শেষ হতে চলে এসেছে তার আন্টির বাসায়। পড়াশোনা তার ভালো লাগে না এই কথাটাই শুভ্রর কাছে বলতে পারেনা সে। প্রাইভেট আর মিউজিক একাডেমি নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটে তার। শশীর বোর্ড এক্সাম শেষ। সেরিন পারছে না এখনি বিয়েটা দিয়ে দেয়। কিন্তু চৌধুরী পরিবারের যা ব্যস্ততা। বিয়ে বলে কথা! অনেক লেট হবে। সেরিনের এতো লেট সহ্য হচ্ছে না। এখন আরকী! আর্থর বিয়ের ডেট ফিক্সড করার সিদ্ধান্ত আসলে চৌধুরী পরিবার সবাই কুমিল্লায় ব্যাক করবে। সেরিনের ও হয়ত তাদের সাথেই যাওয়া হবে। তার বরটা! মনে,মনে কত বকা দেয় সেরিন। তার লাইফ আর তার বরের দেওয়া রুলস। সত্যি এই রুলস তার জীবনের সব সুখ শান্তি শেষ করে দিয়েছে।
সময়টা গৌধূলি লগ্নে প্রায়। ছাঁদে মৃদু বাতাস বইছে। সেরিন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তার থেকে অনেকটা দূরত্বে তাতান দাঁড়িয়ে। যদিও সেরিন তাকে পাত্তা দেয়না। তাতান এদিকটায় এসে সেরিনকে দেখে হেঁসে বলে,
“হেই সেরিন! কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?”

সৌজন্যতার খাতিরে কথাটা বলে সেরিন। তখন তাতান বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমি কিন্তু আপনার একজন ভক্ত। আপনার সব ভিডিও আমি দেখি। আমি মিউজিক একাডেমিতে আছি। আপনি হয়ত খেয়াল করেননি।”

“ধন্যবাদ! আসলে এদিকওদিক তাকানোর সময় নেই আমার। তাই খেয়াল করিনা।”

“আচ্ছা সমস্যা নেই। আজান হয়ে যাবে বাসায় চলে যান।”

সেরিন মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে যায়। মাগরিবের নামাজ আদায় করে বই নিয়ে পড়তে বসে সে। কুমিল্লায় কবে ব্যাক করবে সেই চিন্তায় তার রাতের ঘুম হারাম। তারউপর শুভ্র তার কথাকে বেশী পাত্তা দেয়না। এই নিয়ে সেরিনের বেশ রাগ। ওভার থিংকিং সাইডে রেখেস সেরিন পড়ায় মনোযোগ দেয়।

***********
“তুমি ভীষণ বা’জে মেয়ে নিশাত। ভীষণ বেয়াদ’ব! তোমার মতো বা’জে মেয়ের সাথে রিলেশন কেনো পাত্তা দেওয়াটাই আমার ভুল। তবে নিজেকে ওতো কিছু ভাবার দরকার নেই। আমি থাকতে আমার বোনের সংসারে কোন থার্ড ক্লাস মানুষের নজরের প্রভাব ফেলতে দিবো না।”

কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে মাহি। মাহির কথায় নিশাত পাল্টা শুধায়,
“তুমি নিজেই একটা ফাল’তু মাহী। আর আমি না তোমার বাবার বন্ধুর মেয়ে আর না তোমার ছোট বেলার সঙ্গী যে লুতুফুতু করবো তোমার সাথে। আমি তোমাদের শত্রু পরিবারের মেয়ে। আসলেই আমি বা’জে মেয়ে অবশ্য শত্রুদের সাথে শত্রুদের মিষ্টি ভাব চলে না।”

“সেই তো নিজের খোলসা থেকে বের হওয়ার কথাই ছিলো। তাহ এতোদিন এতো হুজুর সাজলি কেনো? আজলেই যারা বেশী ভালো সাজে না তাঁদের মধ্যেই আসল ভেজালটা থাকে।”

“কাম অন মাহিরবাবু! আপাতত এক্স! আমার আসলে তোমাদের পরিবার নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। আমার বাপ ভাইয়ের আগের জমের জমিজামা নিয়ে থাকলে থাকতে পারে। বাট আনার তো শুভ্রর পরিবারের উপর ক্ষো’ভ! হ্যাঁ শুভ্রকে আমার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে বাট তোমার বোন মাঝখান দিয়ে বা হাত ঢুকালো। এই জন্যই অবশ্য আমায় নিজের আসল রুপে আসতেই হলো।”

“তোর যে গাজা খোর ভাই! সে করবে সমাজসেবা আর মানবসেবা। ওটা তো নিজেই চলতে আটজন লাগে। আর তোর বাপ! সে তে আরেক লোভী। আরেকজনের হক নষ্ট করে নিজে ভোগ করতে চায়।”

“খবরদার আমার পরিবারে নিয়ে কিছু বলবি না।”

“এই চুপ থাকবি তুই? লজ্জা করে না তোর। আমার বোন তোকে সত্যিকারের বন্ধু ভেবেছে। এটাই সবচেয়ে বড় ভুল।”

“হেই ইউ! এসব সত্যিকারের সম্পর্ক ধুয়ে ধুয়ে পানি খা যা। কাজে লাগবে! আসলেই তোর সাথে প্রেম করাটাই ভুল ছিলো আমার। যাই হোক তোর বোন আমায় তার ভাইয়ের বউ বানাতে চেয়েছে হইনি। আমি মিস করবো না। তোর বোন তারউপর সুন্দরী আমার ভাইয়ের বউ বানানোই যায়। এক বিয়েতে কিছু যায় আসেনা। এমনিতে শুভ্র স্যার আরো পাঁচটা বিয়ে করে এক বাচ্চার বাপ হলেও তাকে আমি বিয়ে করতে রাজী আছি।”

“বেয়াদ’ব মেয়ে। আমি থাকতে আমার বোনের কোন ক্ষতি হতে দেবো না।”

“তুই ঘুমা কাজে দিবে! সব ব্যবস্থা করা শেষ। এখন শুধু তোর বোন ডিভোর্স পেপারে সাইন করা বাকী। খুব শীঘ্রই সেটাও হবে। আল্লাহ হাফেজ মাহির’বাবু।”

নিশাত কল কেটে দেয়। মাহীর বেশ রাগ হয়। মনে,মনে বি’শ্রী কয়েকটা গা’লি নিশাতের নামে দান করে। তবে তার শুভ্রর উপর বিশ্বাস আছে। শুভ্র তার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড সেজন্য শুভ্রর সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ও আছে। সে এক কথার মানুষ! আর শুভ্র যেহেতু কথা দিয়েছে সেরিনকে আগলে রাখার সে তো আগলে রাখবেই। যতই যাই হয়ে যাক না কেন! শুভ্রর এই ব্যপারটা বরাবরই মুগ্ধ করে মাহীকে। দেরী না করে শুভ্রকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে মাহী। তবে নিশাত নিয়ে একটা শব্দ ও উচ্চারণ করে না সে।

********

সারাদিনের ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে সেরিনকে কল দেয় শুভ্র। কল রিসিভ হতে সেরিন সালাম দেয়। শুভ্র সালামের জবাব দিয়ে বলে,
“পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“সে তার মতো চলছে আমি আমার মতো। আর আমার খেয়েদেয় কাজ নেই কে কীভাবে চলছে সেটার খোঁজ নেওয়ার।”

“ফা’জিল তোমার পড়াশোনার কথা বলছি আমি।”

“কুমিল্লায় নিলে বলবো পড়াশোনার কথা।”

“এইজন্যই তোকে কুমিল্লায় আনতে চাই না আমি। ফা’জিল মেয়ে একটা। এই তোর কুমিল্লায় কী রে হ্যাঁ? এতো কিসের তাড়া আমার কাছে আসার জন্য? চুপচাপ মন দিয়ে পড়াশোনা কর।”

“এই আপনি তুই তোকারী করছেন?”

“তোর থেকে শিখা এটা। খারাপ লাগছে না? আমার ও লাগে যখন তুই আমায় তুই তোকারী বলে কথা বলিস।”

“আর বলবো না।”

“নেক্সট লাইন প্লিজ?”

“ভালোবাসি।”

“তোহ্!”

“ব আকার ল।”

“এই জন্যই তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। দিনদিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছো তুমি। কথায়,কথায় গা’লি না দিলে হয়না তোমার? আর এতো ভালোবাসা কী হ্যাঁ? দিনদিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছো। এখন এই মূহুর্তে গালি দেওয়ার কারণে তোমার ভালোবাসা গ্রহণ করলাম না।”

“এই আপনি আমায় ছোট করলেন?”

“একটা কথাই বলবো লজ্জা নারীর ভূষণ।”

“তোহ? আপনি তো লজ্জা পান। আমার ওতো লজ্জা পেতে হবে না। আর দু’জন লজ্জা পেতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমি লজ্জা পেলে আর বাবুর আম্মু হওয়া লাগবে না। দেখবেন আমাদের পরে যারা বিয়ে করবে দু’মাস না যেতে তারাও ট্রিপল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দুই যুগ গেলেও কিছুই হবে না।…….
শুনুন না….”

সেরিন ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে কল অনেক আগে কেটে গেছে। শুধু, শুধু সে বাক্যব্যায় করলো। প্রচুর রাগ হয় শুভ্রর প্রতি। সাত পাঁচ না ভেবে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দেয় শুভ্রকে। এমনকি তার আন্টির ফোন থেকেও ব্লক করে দেয়। রাতের ডিনার করে ঘুমানের জন্য রুমে আসে সেরিন। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে তার শান্তি,শান্তি ফিল হচ্ছে। শুভ্র রাগ দেখিয়েছে এখন সে ব্লক করে দিয়েছে।
“ওয়াও কী জোশ ব্যপারটা! সেরিন এবার তোর বর তোর জন্য অস্থির হয়ে উঠবে। দেখবি কীভাবে মিউমিউ করে তোর কাছে আসে। এই মানবকে সোজা করার জন্য এর থেকে ভালো ঔষধ আর কিছুই নেই।”

**********

পরের দিন সকালে, সেরিন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। আজকে দুটো প্রাইভেট আছে তার। প্রাইভেট শেষ করে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। লান্স করে আবার একাডেমিতে চলে যায় । সেখানে আদ্রিতার সাথে ভালো সময় কাটে। তবে তাদের একটা কনসার্ট আছে। যেটায় মেইন লিডার থাকবে সেরিন। সে মাইক হাতে গান করবে। যদিও খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে তবে এটা একটা খুশির খবর সেরিনের জন্য। তার পথচলা মাত্র শুরু হতে চলেছে। খুশি হলেও কিছুটা নার্ভাস সেরিন।

ক্লাস শেষ করে আদ্রিতার থেকে বিদায় বিয়ে বাসায় আসে সেরিন। তার আন্টিকে কিচেনে রান্না করতে দেখে। কিন্তু ডিনার তো আছেই আবার রান্না কেন? সেরিন ভাবে না। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। ত্রস্ত পায়ে কিচেনে যায়। তার আন্টি তাকে কফিট মগ এগিয়ে দেয়। সেরিন সেটা নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে মৃদু চেঁচিয়ে বলে,
“আপনি?”

শুভ্র দ্রুত সেরিনের কাছে আসে। এক হাতে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। সেরিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ধমকে বলে,
“তোমার সাহস অতিরিক্ত বেড়ে গেছে সেরিন। মেয়ে তুমি আমায় ব্লক করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছ। আর কী,কী করতে পারো আমার ধারণা হয়ে গেছে।”

“আরে আপনি ভুল বুঝছেন।”

“ডোন্ট ওয়ান্না টক!”

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩২|
#শার্লিন_হাসান

(প্রাপ্তবয়স্ক মনস্কদের জন্য উন্মুক্ত)

শুভ্র দ্রুত সেরিনের কাছে আসে। এক হাতে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। সেরিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ধমকে বলে,
“তোমার সাহস অতিরিক্ত বেড়ে গেছে সেরিন। মেয়ে তুমি আমায় ব্লক করার মতো দুঃসাহস দেখিয়েছ। আর কী,কী করতে পারো আমার ধারণা হয়ে গেছে।”

“আরে আপনি ভুল বুঝছেন।”

“ডোন্ট ওয়ান্না টক!”

“আর করবো না ব্লক।”

“ডোন্ট ওয়ান্না টক সেরিন।”

কথাটা বলে শুভ্র খাটের উপর বসে। আঙুল দিয়ে কপাল স্লাইড করতে থাকে। সেরিন ভয়ে কিছু বলছে না। এমনিতে শুভ্র রেগে আছে। সেরিন কফির মগ নিয়ে সেভাবে দাঁড়িয়ে রয়। রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। সেরিন চুপচাপ দরজা খুলে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। লিভিং রুমে বসেই কফিটা শেষ করে কিচেনে যায়। তার আন্টির রান্না প্রায় শেষ। সেরিন প্রশ্ন করে,
“শুভ্র কখন আসলো আন্টি?”

“তুমি আসার কিছুক্ষণ আগেই।”

“তোমায় কল দিয়েছে?”

“হ্যাঁ!”

সেরিন কিছু বলেনা। আয়াশ,সিদরাত তারা শুভ্রর সাথে কথা বলছে। এটা,ওটা মজা করছে। শুভ্রও তাঁদের সময় দিচ্ছে। সেরিন সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তারা দু’জন দু’জনের সাথে রাগ করে আছে। রাতে ডিনার করতে একসাথে বসলেও সেরিন খেতে পারেনি। কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে পড়ে। সেরিনের খাবার না খেয়ে উঠে পড়াটা শুভ্রর পছন্দ হয়নি। সে চুপচাপ নিজের খাওয়াটা শেষ করে। সেরিন সোফার উপর বসে ফোন স্ক্রোল করছে। সানজিদা শারমিন শুভ্রর কফি দেন। শুভ্র কফির মগ নিয়ে রুমে চলে যায়। সেরিন সোফায় বসে রয়। ঘড়ির কাটা এগারোটা। তখন সানজিদা শারমিন বলেন,
“এখানে বসে আছো কেন? যাও রুমে যাও। সারাদিন বাইরে দৌড়াদৌড়ি গিয়ে রেস্ট করো।”

“যাবো একটু পর। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

সানজিদা শারমিন গুড নাইট বলে চলে যান রুমে। সেরিন শুভ্রর ব্লক খোলে দেয়। ফেসবুক স্ক্রোল করছে সে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে তার। মূলত শুভ্রর ধমকটা পছন্দ হয়নি। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে শুভ্র তাকে ডাক ও দিচ্ছে না। সেরিন উঠে লিভিং রুমের লাইট অফ করে নিজের রুমের দিকে যায়। দরজা লক করে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায়। শুভ্র খাটের উপর আধশোয়া হয়ে ফোন স্ক্রোল করছে। সেরিন ফ্রেশ হয়ে চুলে বেনুনি করে। শুভ্রর সাথে একটা কথাও বলেনি সে আর না আজকে বলবে। লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে, চুপচাপ নিজের বরাদ্দকৃত জায়গায় শুয়ে পড়ে সেরিন। সেরিনকে এমন চুপচাপ দেখে শুভ্র কিছু বলেনা। খাটের পাশের টেবিলের উপর থেকে ছোট্ট ফুলের তোড়াটা হাতে নেয়। ছোট্ট করে শুধায়,
“সেরিন! ”

সেরিন কোন সায় দেয়না। শুভ্র তাকে পুনরায় ডাকে। সেরিন উঠে বসে। শুভ্রর দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
“কী হয়েছে? এতে ডাকাডাকি করছেন কেন? দেখুন আপনার মতো ওতো ধমকা-ধমকি করার বা ঢং করার মুড আমার নেই। আমি প্রচুর টায়ার্ড! ”

“আমি মনে হয় খুব সুখে আছি। তুমি মেয়ে আমাকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এনেছো আবার এখন ইগো দেখাচ্ছো?”

“এক্সকিউজ মি!! আমি আপনাকে বলিনি ঢাকায় আসতে। থাকুন না কুমিল্লায়। বউ দিয়ে কী হবে? হুদাই আমি বিয়েটা করে নিজের স্বাধীনতা ন’ষ্ট করলাম।”

“আমি তোমায় স্বাধীনতা দেইনা?”

সেরিন চুপসে যায়। এই লাইনটা অগ্রিম বলে ফেলেছে সে। সেরিনকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্র শুধায়,
“এইবারের মতো ক্ষমা করলাম। নেক্সট টাইম এই লাইন মুখে আনলে খবর আছে।”

“আর বলবো না।”

“তুমি সবসময় বলবো না,করবো না বলো। তারপর ঠিকই একই কাজই করো সেরিন।”

“আরে বা’ল একবার বললাম তো।”

“আবার গা’লি দিচ্ছো?”

“আর দিবো না।”

“এর আগে কয়বার এই কথাটা বলেছো?”

“হ্যাঁ বলেছি। বলতেই পারি। আমি এক কথা একশ বার বলবো এটা অন্য হিসাব বাট আপনি এক কথা এক বারের বেশী আমার কানের সামনে বলবেন না।”

“ফাজি’ল হয়ে গেছো তুমি। মাই-র দিবো যেদিন সেদিন বুঝবা।”

“আচ্ছা আসুন আপনায় আমি আদর করি। আপনি যেহেতু মাই-র দিবেন।”

“একটু তো লজ্জা রাখো সেরিন। লজ্জা নারীর ভূষণ।”

“যাহ্ গোলা***পুত! তোর আর বাবা হতে হবে না।”

“আসতাগফিরুল্লাহ! সেরিন তুমি এতো বা’জে গালি দেও?”

“আসলে লোক লজ্জার ভয়ে বলতে পারিনা। এই গালিটা আমার ভীষণ পছন্দের।”

(দ্রঃ ইট’স মি🥲 ইন ফিউচারে নিজের জামাইকে বলবো)

কথাটা বলে সেরিন মুখে হাত দিয়ে ফেলে। এই গালিটা এভাবে দিয়ে ফেলবে ভাবতে পারেনি। এই বুঝি শুভ্র তাকে চ’ড় দিলো।

“আচ্ছা যাও তোমার কথাটা রাখবো। এতেদিন ধরে পাগলামি করছো।”
কথাটা বলে শুভ্র সেরিনের অধরে নিজের অধর ছোঁয়ায়। শুভ্র নিজে থেকে তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। সেরিন তার প্রেমিক-পুরুষের ছোঁয়া নিজের সর্বাঙ্গে মাখছে। মূহুর্তে দু’জন অন্তর্নিহিত হলো ভালোবাসার উম্মাদনা থামাতে।

************

পরের দিন সকালে সেরিন শাওয়ার নিয়ে আসতে শুভ্র তাকে গতকাল সন্ধ্যায় আনা ফুলের তোড়াটা দেয়। রাতে তো দেওয়া হয়নি। সেরিন নেতিয়ে পড়া ফুলগুলোতে হাত ভোলায়। সাদা এবং কালো গোলাপ। শুধু ফুল না, সেরিনের জন্য এক কার্টুন চকলেট ও এনেছে শুভ্র। সাথে দুটো টেডিবিয়ার। একটা লাভ শেপের তাতে “Love you Bow” লেখা আরেকটায় “SorrY Mrs Chowdhury”

সেরিন গিফ্ট গুলো দেখে হাসে। শুভ্র সহ সকালের নাস্তা করে নেয়। সিরাত,আয়াশ নাস্তা করে স্কুলে চলে যায়। সানজিদা শারমিন রান্নায় ব্যস্ত। সেরিন তাকে হেল্প করে রুমে চলে আসে। শুভ্র খাটে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছে। সেরিন ও চুপচাপ তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। শুভ্র ফোন রেখে তার বউয়ের চুলে বিলি কেটে দেয়। সেরিনের কপালে অধর ছুঁইয়ে বলে,
“এখন আমার সাথে কুমিল্লায় যাবা নাকী পরে?”

“এখন তো আমার একটা কনসার্ট আছে সেটার প্রি-পারেশন নিতে হবে। এটা আমার প্রথম কনসার্ট এন্ড স্বপ্নপূরণের পথে মাত্র পা রাখবো।”

“আই হোপ তোমার এই জার্নিটা ভালো কাটবে। দেখো হয়ত এই একটা কনসার্ট দিয়ে তুমি অনেকটা জনপ্রিয় হতে পারো।”

“কী জানি!”

“এই সেরিন তুমি কখনো পরিচিত মুখ হলে বা অনেকটা এগিয়ে গেলে আমায় ভুলে যাবে? বা ধরো তোমার কাছে অনেক টাকা পয়সা হলো, আমার থেকে বেটার কেউ আসলো তাহলে কী আমার হাত ছেড়ে দিবা?”

“এই আপনি পাগ’ল হয়ে গেছেন? আমি একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ আছি। আর শুনুন আমি বাবুর পাপাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার জীবনের প্রথম প্রেমটা তার প্রতি এসেছিলো। এবং আমার প্রেমিক পুরুষ থেকে সে আমার অর্ধাঙ্গ। আমি কখনো হাত ছাড়বো না।”

“দেখা যাবে।”

“এ্যাই অ্যাম সিরিয়াস। আচ্ছা আপনি আমায় হারানোর ভয় করেন?”

“তুমি অবুঝ নও সেরিন। আর আমি অনুভূতি প্রকাশ করতে পছন্দ করি না।”

“আচ্ছা সেসব বুঝলাম। এবার বলুন ” বউ ভালোবাসি।” আপনি এখন অব্দি আমায় ভালোবাসি বললেন না।”

“বলবো না।”

“আপনি আমায় ভালোবাসেন না।”

“তুমি ভালোবাসা প্রকাশ করছো আমি শুনছি। একদিন আমি প্রকাশ করবো সেদিন নাহয় তুমি শুনে যেও। আর তৃতীয় দিন দু’জনেই ‘ভালোবাসি’ বলার উত্তরে ‘আমিও ভালোবাসি’ বলবো।”

“ঠিক আছে।”

শুভ্র কিছু বলেনা। সেরিনও চুপচাপ। মনে,মনে ভাবছে,
” সব কিছুতেই কী রুলস দেওয়া লাগে ভাই? না শুভ্র স্যার তো জানেনা তাকে আমি ভয় পাই সেখানে হাত ছাড়ার কথা ভাবা বিলাসিতা। আর উনি এটা আমায় জিজ্ঞেস ও করলো। জানি করলার জুশ আমায় ভালোবাসে কিন্তু প্রকাশ করেনা। আমার মতো মিষ্টি একটা মেয়ের কপালে এমন করলার জুশ জুটলো। অবশ্য জুটেনি নিজেই কান্না রান্না করে জুটিয়েছি। সবই কপাল! যাই হোক মানুষটা সঠিক হলে ভালোবাসা মন্দ না! আমার মানুষটা সবসময় আমার থাকুক এবং আমার শুধুই আমার থাকুক।”

মুচকি হাসে সেরিন। শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
“শুনছেন? আপনি আমার থাকবেন এবং আমার শুধুই আমার থাকবেন। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কারোর সাথে কম্পেয়ার করতে পারবো না। আর না কারোর সাথে তার ভালোবাসার কম্পেয়ার করতে চাই।”

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-২৯+৩০

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৯|
#শার্লিন_হাসান

এরই মাঝে কেটে যায় একমাস। সেরিনের এক্সাম শেষ! কয়েকদিন পর সে ঢাকায় ব্যাক করবে। শশীর বোর্ড এক্সাম শুরু হওয়ার ও বেশীদিন বাকী নেই। অক্ষরের বিয়েটা আর্শিয়ার সাথেই হয়েছে। তেমন একটা অনুষ্ঠান করে না হলেও ঘরোয়া ভাবেই হয়েছে। অক্ষর ও বেশীদিন বিডিতে নেই। সময়টা বিকেল। সেরিন রেডি হচ্ছে শুভ্রর সাথে ঘুরতে বের হবে। যেহেতু তাঁদের দেখা হতে অনেক লেট আছে।
সেরিন ব্লাক কালার শাড়ী শুভ্র ব্লাক পান্জাবি। শশী,আর্থ ও যাবে তাঁদের সাথে। দুই কাপল একসাথে। সেরিন লেট লতিফা যেটা শুভ্রর অপছন্দের তালিকায় একনাম্বার। বউ বলে কিছু বলেনা। অন্য কেউ হলে ধমকিয়ে ওইভাবে আধসাজেই নিয়ে যেতো। শুভ্র বসে,বসে ওয়েট করছে সেরিনের জন্য। আর্থ অলরেডি শশীকে নিয়ে গাড়ীতে বসে আছে। শুভ্র,সেরিন আসলেই তারা বের হবে।

প্রায় আধঘন্টার মতো শুভ্র ওয়েট করে বসে ছিলো। তার ধৈর্য আর কুলোচ্ছে না। রুমে গিয়ে দেখে সেরিনের মেকআপ কমপ্লিট হয়েছে। তাও হালকা মেকআপ এটাতে তার এতো সময় গেছে এখনো চুলে হাত ও দেয়নি। শুভ্র কিছুটা তাড়া দেখিয়ে বলে,
“আর পাঁচ মিনিট! এরপর লেট হলে আর কখনো তোমায় নিয়ে বাইরে বের হবো না।”

“আমার চুল কীভাবে বাঁধবো? ”

“আমি কী করে বলবো?”

“ধুর!”

সেরিন সামনে একটা সিঁতি করে চুলগুলো ছেড়ে দেয়। তড়িঘড়ি নিজের ফোনটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। শুভ্র রেগে গেলে আবার সমস্যা। যেই এক বদলোক কপালে জুটেছে। সেরিনের সম্পূর্ণ বিপরীত! পান থেকে চুন খসলে রাগ করে বসে থাকে। কিছু বলা ও যায়না তাতেও রাগ করে। মাঝেমধ্যে সেরিনের নিজেকে ম্যাচিউর লাগে আর শুভ্রকে ইমম্যাচিউর মনে হয়। নাহলে একটা মানুষ এতো তেজ আর রাগ দেখাতে পারে?

সেরিন গোমড়া মুখ করে শুভ্রর পেছন,পেছন যায়। চুপচাপ পেছনে শুভ্রর সাথে বসে পড়ে। সামনে আর্থ,শশী। শুভ্রকে এতো লেটে আসতে দেখে আর্থ বলে,
“দিনদিন মেয়েদের মতো হয়ে যাচ্ছে। ওরা নাহয় মেকআপ করে তুমি ও কী মেকআপ করো? এতো লেট কেন?”

“আমার যে প্রতি’বন্ধী বউ আছে ভুলে গেছিস? এটা কী রে ভাই? সবকিছুতে লেট! আর তাড়াহুড়ো করলে তাড়াহুড়ো।”
তখন সেরিন শুধায়,
“আমি প্রতি’বন্ধী? ”

“দেখতে ভালো মেয়েদের মতো হলেও আচার আচরণ কিছুটা ওইরকম।”

“আসলে আগে আমি ভালোই ছিলাম। এক অটিস্টিকের সাথে বিয়ে হলো তার স্বভাব পুরোটা এখন আমার মাঝে। এটার নতুন নাম প্রতি’বন্ধী।”

“আমি অটিস্টিক?”

“তা নয়ত কী রে ভাই? আমি তো আগেই জানতাম আপনার মাথায় সমস্যা। ওই যে রুলস দিতেন। সেটা ফ্যাক্ট না! আপনি স্বীকার করে নিন এটাই আসল কথা।”

“তেমায় নিয়ে আর কখনো যদি ঘুরতে বের হয়েছি তো আনার নামটাই পাল্টে দিও।”

“আর আমি সেরিন যদি আপনার সাথে কোথাও গিয়েছি তো আনার নামটাও আপনি পাল্টে দিয়েন।”

তাঁদের দুজনের ঝগড়া আর্থ,শশী বসে,বসে দেখছে। আর্থ ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ গাড়ী চালাচ্ছে। ওইদিকে শুভ্র, সেরিন ঝগড়া করেই যাচ্ছে। তারা দাউদকান্দি তিতাস থানার দিকে যাবে কাশবাগানে। যদিও তিতাস এখন উপজেলা করা হয়েছে।

বেশীক্ষণ সময় লাগেনি তাঁদের। তিতাস কাশবাগানে এসে পিকচার,ভিডিও করে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো তাারা। শরতের বিকেল, সুন্দর আকাশ,মৃদু বাতাস বেশ উপভোগ করার মতো। অনেক্ক্ষণ সময় কাটিয়ে তারা সন্ধ্যার দিকে রওনা হয় একটা রেস্তেরার দিকে। দাউদকান্দির ‘নিরিবিলি রেস্তোরাঁয়’ যায় তারা। সেখান থেকে হালকা খাওয়া-দাওয়া করে বেড়িয়ে পড়ে। বাড়ী ফিরতে,ফিরতে প্রায় নয়টার উপরে বেজে যায়। আর্থ সেরিন,শুভ্রকে গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে শশীকে পাটওয়ারী বাড়ীতে দিয়ে আসে। শুভ্র সামনে,সেরিন কিছুটা পেছনে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করবে। তখন সেরিনের চোখ যায় কব’রস্থান আর বাড়ীর পেছনের দিকে। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো সেদিনের কথা। শুভ্রর প্যারায় আর মনে থাকে নাকী এতো কথা। কয়েকদিন পর তো ঢাকায় চলেই যাবে আর কবে দেখবে বাড়ীর পেছনের রহস্য?

আনমনা হয়ে ভেতরে যায় সেরিন। বাকীরা লিভিং রুমে কেউ আসছে তো কেউ বসে আছে। আরফিন চৌধুরী বিডির বাইরে আছেন। আয়মান চৌধুরী এবং সুলতানা খানম ঢাকা থেকে বাড়ী এসেছেন কয়েকদিন হলো। শুভ্র তাঁদের সাথে বসে কথা বলছে। সেরিন নিঃশব্দে উপরে যায়। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। আজকাল এতো প্রেশার ভালো লাগছে না তার। পড়াশোনা আবার মিউজিক একাডেমি তারউপর রেজাল্ট খারাপ হলে শুভ্র তার খবর করে দিবে। পড়াশোনা যেই কঠিন সেরিনের ফিউচার বাদ দিয়ে কান্না করতে মন চাচ্ছে। শুভ্রকে বলতে মন চাচ্ছে পড়াশোনা করবো না আমি। এসব ভালো লাগে না। তারউপর ইন্টারের পড়া যেই কঠিন। প্রাইভেট আর ল্যাব ক্লাসে দৌড়াতে,দৌড়াতে জীবন অর্ধেক তেজপাতা। শুভ্র তার জামাই ভালো হলেও টিচার হিসাবে আজো ব’জ্জাত রয়ে গেলো। একটা রুলস ও চেঞ্জ করেনি। অবশ্য এখনো শুভ্রর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে ভুলে না সেরিন।

শুভ্র রুমে এসে দেখে সেরিন চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ঘড়ির কাটা সাড়ে নয়টা। আজকে পড়াশোনা হয়নি সেরিনের, সেটা শুভ্রর মনে আছে ভালো করেই। ফ্রেশ হয়ে সেরিনকে ডেকে তুলে শুভ্র। ভীষণ টায়ার্ড সেরিন তাও উঠে বসে। কখন আবার এই লোকের টেম্পারেচার গরম হয়ে যায়।

“কফি আনবো নাকী এখন?”

“পড়ালেখা নেই?”

“আমি বিয়ে করেছি কী পড়ালেখা করার জন্য নাকী? এই দেখুন আমি একটা মানুষ রোবট নই। এই বা’লের পড়াশোনা আমার জন্য না। প্লিজ আমায় মন দিয়ে সংসার করতে দিন। পড়াশোনা করতে চাইনা আমি।”

“কমপক্ষে উচ্চ-মাধ্যমিকটা তো দিতে হবে।”

“তাহলে ঢাকায় পাঠানোর দরকার নেই। এতো প্যারা আমি নিতে পারবো না।”

“একবছরের কোর্স করো না? তারপর নাহয় চলে এসো।”

“ভাল্লাগে না তো।”

“আচ্ছা চলো তোমায় গল্প শোনাই।”

শুভ্রর কথায় সেরিন মাথা নাড়ায়। শুভ্র হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়ে তার হাতের উপর সেরিনের মাথা। শুভ্র তখন বলে,
“জানো তো? আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার আম্মুর এতো আদরের ছিলাম। আমার আম্মু না তখনকার একজন অভিনেত্রী ছিলেন। আমার বাবা আর মায়ের বিয়েটা লাভ ম্যারেজ ছিলো। তাদের ও সুন্দর একটা গল্প ছিলো। তবে আমার আম্মু তার ক্যারুয়ার বিয়ের পর সব ছেড়ে দেন। নিজের সংসারে মনোযোগ দেন। কী জানি! এতে সুখে কার নজর লাগে। আমি যখন দেশের বাইরে চলে যাই তার দুইমাস না যেতেই আমার আম্মু নাকী রোড এক্সিডে’ন্টে মা-রা যায়। আদৌ এর সত্যতা আমার জানা নেই। তারপর শোনলাম বাবার জীবনে নতুন নারী আসলো। অবশ্য আমার দাদীনের জন্য যদিও সে আব্বুর নতুন বিয়ের ছয় মাসের মাথায় গত হোন। জানো তো আমি না ভীষণ হার্ট হয়েছি। আমার বাবা তো আমার মাকে ভালোবাসতো তাহলে কী করে এতো সহজে নতুন কারোর সাথে জীবন বেঁধে নিলো? আমি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে বিডি আসি। অবশ্য আমার দাদার ইচ্ছেতে টিচার পদটা বেছে নেই। আমাদের কলেজের অনেক বেশী নাম-ডাক আছে, ছিলো। মাঝখানে একটু সমস্যা হয় তেমন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এটার দায়িত্ব নেয়নি। র‍্যাগিং,রাজনীতি কিছুটা ঢুকে পড়ে। আমি যখন জয়েন করলাম তখন সবটাই চেঞ্জ করার চেষ্টা করি। আমার বাবা,আমার পরিবার রাজনীতির সাথে যুক্ত তবে আমি ছাত্রদের কোন দল বা লীগ করে দেইনা। ওদের ক্যারুয়ার গড়ার বয়স এখন! আমার বাবার পেছনে দৌড়ানোর দরকার নেই। তার জন্য যথেষ্ট মানুষ আছে। আসলে তোমরা বলো আমার মাথায় প্রব্লেম আমি উল্টাপাল্টা রুলস ক্রিয়েট করি। এটা আমি আমার স্টুডেন্টদের ভালো ভেবেই করি। তাঁদের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য করি। আমি আসলে এতোটা রুড ছিলাম না। তবে সব ঠিক ঠাক করার জন্য একটু তো রুড হতেই হয়। এতোসব কিছুর পরেও আমার সুন্দর একটা মন আছে যেই মনে বসত করে একটা মেয়েফুল। মেয়েফুলটা আমার ভীষণ প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী।”

“সবই বুঝলাম। আসেন এবার আদর করি আপনায়।”

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|৩০|
#শার্লিন_হাসান

সেরিনের কথায় শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি আসলেই একটা ঠোঁটকাটা সেরিন। মুখে কিছু আটকায় না।”

“এ্যাই আপনি কী পরপুরুষ? দেখুন আপনি আমার বিয়ে করা জামাই তো আপনায় আদর বা করলে কাকে করবো?”

“পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।”

সেরিন মুখ ভেংচি কাটে সেই সাথে পড়ালেখার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে। কী এক পড়ালেখার ভূত তার বরের মাথায় ঢুকলো! তার জীবনটা তেজপাতা করে দিচ্ছে। শুভ্র সেরিনের দিকে তাকিয়ে রয়। জানে সেরিন তার চৌদ্দ গুষ্টি ধুয়েমুছে দিয়েছে অলরেডি। কিছু বলাও যায়না মেয়েটাকে মনে,মনে এই পর্যন্ত কত হাজার গা’লি যে দিলো হিসেব নেই।

*******
পরের দিন সেরিন কলেজে যায়। নিশাতের সাথে তার দেখা হয়। অবশ্য অনেকদিন হলো পাটওয়ারী বাড়ীতে যাওয়া হয়না। সেরিন মাহীর সাথে নিশাতের সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করে। যদিও আজকাল এসব খোঁজ নেওয়া হয়না সেরিনের। নিশাত প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলে,
“তা সংসার জীবন কেমন কাটছে তোদের?”

“আরে এটা পরেও বলা যাবে। আমি যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা তো বল?”

“না এমনিতে মাহীকে জাস্ট আমি বড় ভাইয়ের মতো ভাবতাম। আমাদের মাঝে কোন রিলেশন ছিলো না।”

“আর ইউ ম্যাড? তাহলক এতোদিন কী ছিলো? ভাইয়া সিরিয়াস!”

“এই কোন ম্যাচিউর ভালো ছেলেরা প্রেম করতে আসবে না তারা ডিরেক্ট বিয়ে করে। লাইক শুভ্র স্যারের মতো। সবটা হালাল ভাবে! এসব দুইদিনের দুনিয়ায় প্রেম আবার কী?”

“যাহ তোকে আমার ভাইয়ের বউ বানাবো না।”

“হতে চাই ও না।”

নিশাতের কথায় সেরিন বেশী পাত্তা দেয়না। হয়ত রাগ করে বলছে। দু’জনে ক্লাস শেষ করে বাইরে আসে।

“ঢাকায় যাচ্ছিস কবে?”

“এই তো সামনের উইকে।”

“ওহ্! আচ্ছা দোয়া রইলো তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য।”

নিশাত বিদায় জানিয়ে চলে আসে। সেরিন চৌধুরী বাড়ীর উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে। কলেজ চত্বর পেড়িয়ে রাস্তার সাইডে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েও থেমে যায়। একটা গাড়ী তার দিকেই আসছিলো। সেরিন কিছুটা থমকে যায়। গাড়ীটা আর থামেনি সোজা রাস্তায় চলে যায়। খুব সাবধানতার সাথে সেরিন রাস্তা পার হয়। বাড়ীর গেট দিয়ে ঢুকে সোজা পেছের সাইডে চলে যায়। মাথার উপর যে একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো মনে নেই সেরিনের। বাড়ীর পেছনে যায় শুধু দেওয়াল আর কিছুই নেই। সেরিন কিছুটা অবাক হয়। হাত ভোলায় দেওয়ালে। সব মিথ্যে মনে হলেও কিছু সত্য আড়ালে আছে সেরিন বিশ্বাস করে। দেওয়ালে টোকা মেরে বুঝার চেষ্টা করে ভেতরে ফাঁকা আছে কীনা।

তখন কারোর পায়ের শব্দে সেরিন ভয় পেয়ে যায়। জান্নাতুল ফেরদৌস তার কাছেই আসছে। সেরিন নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“এই দুপুর বেলায় এদিকে কেনো? দেখছো না কবরস্থান? ”

“এটা কার ক’বর?”

“তোমার বড় শাশুড়ীর।”

“উনি মা-রা গেলো কীভাবে?”

“হার্ট অ্যাটাক করে।”

“ওহ্!”

সেরিন আর কথা বাড়ায়না। জান্নাতুল ফেরদৌসকে পাশ কাটিয়ে চলে আসে।

বিকেলে শুভ্র বাড়ী আসতে সেরিন ব্যপারটা বলে। শুভ্র সেসবে পাত্তা দেয়না। সে এসব কে সেরিনের ওভার থিংকিং বলে ভেবে নিয়েছে।

সন্ধ্যায় সেরিন কিচেনে যায়। আজকে বুয়াই রান্না করছে। জান্নাতুল ফেরদৌস আজকে আর আসেনি। সেরিন নিজের কাজ সেরে রুমে চলে যায়।
শুভ্র ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো। সেরিন তার চিঠি সমূহ বের করে। শুভ্রর সামনে দু’টো চিঠি দিয়ে বলে,
“এগুলো তো আমি দেইনি। এই একে খুঁজে পেয়েছেন?”

“যেই দিয়েছে তোমার খুব ঘনিষ্ঠ কেউই এই কাজটা করেছে।”

“এমাহ! আমি যে আপনায় চিঠি দিতাম এটা কেউই জানতো না। এমনকি নিশাত বা শশীও না।”

“তুমি বড্ড বোকা সেরিন। এখনো মানুষ চেনোনি।”

“হইছে ভালো হইছে আমি বোকা। আপনি একমাত্র চালাক। যান সরুন তো! কথায়,কথায় আমায় ছোট প্রমাণ না করলে হয়না। ক্লিয়ার করে কথা তো জীবনেও বলেননা।”

“এই তুমি এমন ত্যাড়ামী করছো কেন?”

সেরিন চিঠিগুলো হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। উঠে যেতে নিবে শুভ্র হাতে টান দিয়ে বসিয়ে দেয়। চোখ রাঙিয়ে বলে,
“বেশী বেড়ে গেছ তুমি। মাইর চেনো মাইর? মাইর দিবো সত্যি!”

“ক্লিয়ার ভাবে কথা বলুন?”

“চিঠি গুলো সুন্দর ভাবে রেখে দাও। এগুলো আমার জিনিস তুমি ছুড়ে ফেলার কেউ না।”

“এগুলো তো আমিই দিয়েছি।”

“দিয়েছো! এখন তোমার অধিকার নেই এসবের উপর। লাইক তোমার অবস্থা, গিফ্ট দিয়ে আবার ফেরত চাও,অধিকার খাটাতে চাও।”

সেরিন চিঠিগুলো ড্রয়ারে রেখে দেয়। আর বেশীদিন নেই কুমিল্লায়। সে ঢাকায় ব্যাক করবে। অথচ শুভ্রর একটু মন খারাপ ও হচ্ছে না। সেরিন কতগুলো মাস দূরে থাকবে ভাবলেই মন খারাপ তার। অথচ শুভ্রর এসবে মাথা ব্যথা নেই।

********

এরই মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। সেরিন ঢাকায় শুভ্র কুমিল্লায়। শশীর বোর্ড এক্সাম ও শুরু হয়ে এখন শেষের দিকে। সেরিনের ব্যস্ত সময় কাটছে। তার আন্টি আর আন্টির বাচ্চা, সিদরাত আর আয়াশের সাথেও তার বেশ ভালো সময় কাটে। মাঝেমধ্যে ছাদে যায়। আদ্রিতার সাথে মিউজিক একাডেমিতে ডেইলি দেখা হয়। শুভ্র বলেছে আদ্রিতার সাথে গিয়ে কয়েকদিন তার মেঝো আম্মুর বাসায় থেকে আসতে। আয়মান চৌধুরী, সুলতানা খানম তারাও সেখানে আছে। সেরিন আজকে ক্লাস শেষ করে সন্ধ্যার দিকে আদ্রিতা সহ রওনা দেয়। শুভ্রর বউ আসবে জেনে মিরা ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। বেশী কাছে থাকতে না পারলেও সেরিনকে সবাই যথেষ্ট আদর যত্ন করে। তাদের বড় ছেলের বউ বলে কথা।

সেরিন যেতে তাকে নিয়ে মিরা ইসলাম ব্যস্ত হয়ে পড়েন।আজকাল অধরা আর আদ্রিতার পাত্তা মেলে না তার কাছে। আরাফ চৌধুরী ও সেরিনকে বেশ স্নেহ করেন। বাসায় প্রবেশ করতে সুলতানা খানম এগিয়ে আসেন। সেরিনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু একে দেন।

“আমাদের সাথে একবার গিয়ে কুমিল্লায় ঘুরে এসো।”

“তোমার ছেলে শোনলে বকা দিবে। ওনার জন্যই আমি কিছু বলতে পারি না। জানোই তো ধমক একটা দিলে চারদিন অজ্ঞান থাকার মতো অবস্থা।”

“আচ্ছা শুভ্রকে বলে দিবো।”

সেরিন ভেতরে যায়। মিরা ইসলাম এসে তাকি জড়িয়ে ধরে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। আদ্রিতা ফ্রেশ হয়ে আসতে সেরিন যায়। তাকে এতোক্ষণ বাকীরা সবাই ঘিরে রেখেছে। “শুভ্রর বউ” সম্মোধন টা সেরিনের বেশ ভালোই লাগে। একসময় এই ডাকটা শোনার ইচ্ছে ছিলো। এখন তা পূরণ হয়েছে। সন্ধ্যাটা সবার সাথে বেশ ভালোই কাটে সেরিনের। যদিও শুভ্রর সাথে আজকে কথা হয়নি তার। সবার থেকে একটু আড়াল হয়ে শুভ্রকে কল দেয় সেরিন। তার মনে অভিমান স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। কুমিল্লায় বসে,বসে শুভ্র রুলস বানায় সেরিনের জন্য। বিষয়টা সেরিনের বিরক্ত লাগে। শুভ্রর কাছে যাওয়ার বায়না ও করতে পারেনা। মুখের উপর ধমকে না করে দেয়।

“কথা বলছো না কেন?”

শুভ্রর কড়া কন্ঠে সেরিনের ধ্যাণ ভাঙে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
“আমি কুমিল্লায় যাবো।”

“আর্থর বিয়ের সময় এসো।”

“বাবু হলে কোলে নিতে দিবো না কিন্তু।”

“আগে নিজে বড় হও তারপর বাবুর চিন্তা। আর আমার বাবুকে আমি কোলে নিবো। এটায় কারোর পারমিশনের দরকার নেই। শুভ্র নিজের রুলসে চলতে পছন্দ করে। আর তুমি, যা বলি তাই সুন্দর ভাবে পালন করবা নাহলে বাবুর আম্মু বানাবো না তোমায়।”

“এই ফাউ আলাপ করার জন্য কল দিয়েছি নাকী আমি? আমার সময় আর টাকা দু’টোই লস। শালা আমার কপাল টাই খারাপ।…

” তুমি গা’লি দিচ্ছো আবার?”

“এমাহ আপনি মিস করেন না আমার গালি গুলো?”

“বেয়া’দব মেয়ে।”

“তোর ন আকার না ন ঈকার নী র…

” চ’ড়িয়ে সোজা করে দেবো ফাজিল মেয়ে কোথাকার। এই তুই তোকারী আর একবার করে দেখো শুধু!”

“কী করবি বল? এই তোকে আমি ভয় পাইনা। একদম ভয় পাইনা। আমি সত্যি কুমিল্লায় যাবো দেখবো তুই কী করতে পারিস। আর তোকে বলছি চোখ এদিকওদিক কোন মেয়ের দিকে গেলে তোর চোখ তুলে এনে স্যুপ বানিয়ে কাটা চামচ দিয়ে খাবো।”

“এই তুমি আমায় থ্রেট দিচ্ছো?”

“ভাগ্য ভালো থ্রেট দিচ্ছি এখন অব্দি তোর মাথায় থা’প্পড় দেইনি। এই তুই এসব আজাইরা রুলস কোথা থেকে আমদানী করিস বলতো? আমার জীবনটা শেষ তোর রুলস মানতে,মানতে।”

“দেখো পাখি তুমি মাথা গরম করো না। আচ্ছা সমস্যা নেই কুমিল্লায় চলে এসো তোমার একটু ব্রেক প্রয়োজন সাথে বাবুর পাপার আদর। আচ্ছা চলে এসো।”

“ঠিক ধরেছেন।”

“আচ্ছা বাবুর আম্মু তুমি চলে এসো তাড়াতাড়ি। তোমায় আদর করবো।”

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-২৭+২৮

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৭|
#শার্লিন_হাসান

পরেরদিন প্রায় বারোটার দিকে শুভ্র রেডি হয়ে বসে আছে। কুমিল্লায় যাবে তার কাজ আছে। আজকে কলেজ যায়নি সে! তখন সেরিন ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। হাতে তার ভেজা তোয়ালে। শুভ্রকে এমন সেজে বসে থাকতে দেখে সেরিন জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাবেন?”

“কুমিল্লায়।”

“এতো সেজেগুজে যাওয়ার কী আছে?”

“তোহ যাবো না? তুমি কী বলো আমি পাগলের মতো যাবো?”

“আপনার বড় কিডনিটা কই জানি?”

হাতের তোয়ালটা সোফার উপর রেখে খাটে বসে থাকা শুভ্রর কাছে যায় সেরিন। আশেপাশে হাতড়ে কিছুই ফেলো না সে। শুভ্র তাকিয়ে আছে তার দিকে। তখন সেরিন হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার আইফোনটা দিন তো?”

শুভ্র পকেট থেকে ফোন বের করে সেরিনের হাতে দেয়। সেরিন কী করলো কে জানে! পাঁচ মিনিটের মাথায় ফোনটা আবার ফেরত দেয় শুভ্রকে। শুভ্র হোয়াইট এবং ব্লাক কালারে নিজেকে সাজিয়েছে। সেরিন তার শার্টের কলারে হাত ভোলায়, মুখ এদিকে-ওদিক করে দেখে। শুভ্র বিরক্তি নিয়ে সেরিনের হাত সরিয়ে দেয়।

“তোমার হাত থেকে ময়লা আমার সাদা শার্টে লেগে যাবে।”

“আমি মাত্র শাওয়ার নিয়ে এসেছি ময়লা আসবে কোথা থেকে?”

“তাহলে এমন হাতাহাতি করছো কেন?”

“শার্ট চেন্জ করুন।”

“জানি আমায় বেশী সুন্দর লাগছে তাই হিংসে হচ্ছে তোমার। অন্য মেয়েরা না তাকিয়ে থাকে। আমি জানি তো তুমি একটা হিংসুটে মেয়ে।”

সেরিন কাবাড থেকে একটা শার্ট বের করে শুভ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“হোয়াইট আর ব্লাক শার্ট পড়ে বাইরে বের হওয়া নিষেধ।”

“তুমি যে নিজের পিক ফেসবুকে আপ দাও। তখন তো কত ছেলেরা তোমায় দেখে আমি কিছু বলি?”

“আপনাকে আমি বারণ করেছি নাকী কিছু বলতে?”

কথাটা বলে সেরিন শুভ্রর ফেসে দৃষ্টি পাত করে। সেরিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্র বলে,
“যেভাবে তাকাচ্ছো নজর তো তুমি লাগিয়ে দিবে। মানুষ আর কী তাকাবে। আমি জানি আমি সুন্দর এভাবে তাকিয়ে আর বুঝাতে হবেনা।”

“আরে আপনার ঠোঁট গুলো সুন্দর লাগছে। চুমু খাওয়াই যায়!”

“আমি এখন বাইরে বের হবো।”

“চুমু খেলে প্রেগন্যান্ট হবেন না যে বাইরে বের হলে মুখ দেখাতে পারবেন না।”

“তোমার মুখে কিছু আটকায় না।”

সেরিন শুভ্রকে আর কিছুই বলার সুযোগ দেয়নি। শুভ্রর পাশে বসে নিজের অধর জোড়া শুভ্রর অধরে ছুঁয়ে দেয়। শুভ্র সেরিনকে কিছুটা ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুভ্রর হাব-ভাব সেরিনের পছন্দ হলো না। হাতের কাছে থাকা শার্টটা শুভ্রকে দিয়ে বলে,
“চেন্জ করে আসুন তো।”

“আরে আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।”

“আজকে রুমে জায়গা হবে না।”

“সমস্যা নেই। আমাদের বাড়ীতে কী জেনো একটা আছে। রুমে,রুমে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য বেশী মানুষ থাকলে দেখা যায়না সেটাকে। একা থাকলে আসে আর চোখের সামনে ঘুরঘুর করে সাদা শাড়ী পড়ে। তুমি দেখবা বাট একটা শব্দ মুখ দিয়ে বের করলে তোমার গলা চেপে ধরবে।”

“তাড়াতাড়ি চলে আসবেন প্লিজ। আমি ছোট কাকীমার কাছে গেলাম। আপনি আসলে তারপর রুমে আসবো।”

“ঠিক আছে। আমি গেলাম।”

শুভ্র কয়েক কদম ফেলতে সেরিন তাকে থামিয়ে দেয়। শুভ্রর সামনে দাঁড়িয়ে কপালে আঙুল রেখে বলে,
“বাইরে যাওয়ার সময় কপালে চুমু দিয়ে যেতে হয়।”

শুভ্র চুপচাপ সেরিনের কপালে চুমু দিয়ে বেড়িয়ে যায়। শুভ্র যেতে সেরিন কোনরকম তৈরী হয়ে ওরনাটা নিয়ে সুলতানা খানমের রুমের দিকে ছুটে। তখন সুলতানা খানম সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। এই পরিবারে সবারই ব্যস্ততার শেষ নেই।চ তার শাশুড়ী,ছোট শাশুড়ী তারা বেশীরভাগই ল্যাপটপের সাননে বসে থাকে। আর্থ তার বড় বাবার রাজনীতি নিয়ে সময় কাটায়। আয়মান চৌধুরী আর্থকে হেল্প করে আবার তিনি ঢাকা চলে যান। আর্থর বাবা মা,বোন তারা সব ঢাকায়। আদ্রিতাও ঢাকায়। নিজেদের স্টাডি,ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। বাকীরা অফিস, বিজন্যাস আর রাজনীতি নিয়ে।

সুলতানা খানমের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের রুমের দিকে যায় সেরিন। তিনি কলে কারোর সাথে কথা বলছেন। সেরিনকে দেখে কল কেটে দেয়। অনুমতি পেতে সেরিন ভেতরে প্রবেশ করে। জান্নাতুল ফেরদৌস সেরিনকে এটা,ওটা জিজ্ঞেস করে। এক পর্যায়ে তিনি মালিথা পরিবারের কথা তোলেন। সেই সাথে আর্শিয়া এবং আর্শিয়ার আম্মুর কথা। সে কী প্রশংসা করলেন আর্শিয়ার। সেরিনের পছন্দ হয়নি বিষয়টা। তবে কিছু বলছেও না। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
“চেয়েছিলাম আর্শিয়াকে শুভ্রর সাথে বিয়েটা দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা আরো মজবুত করবো। কী জানি শুভ্রর কী হলো। সেখানে তো সব ঠিকই হয়েছিলো। তোমার তো বয়স অল্প! সেই সাথে শুভ্রর সাথেও তেমন যায় না।”

“আসলে ঠিক বলেছেন শুভ্রর সাথে আমার যায় না কারণ আমি শুভ্রর থেকেও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করি।”

সেরিনের কথায় রাগ হয় জান্নাতুল ফেরদৌসের। কিন্তু তিনি প্রকাশ করেননা। হাসি মুখে বলেন,
“যাই হোক! ছেলে দু’টো একই পরিবারে গেলো। তাঁদের লাইফ তাদের চয়েজ।”

“ঠিক বলেছেন। যার, যার জীবন তার, তার পছন্দ। এসব নিয়ে বেশী খোঁচাখুঁচি ও ভালো না। এমনিতে আমি মেয়েটা খুব ভালো তবে কেউ অপমান করলে আপস করি না। দুই লাইন শোনালে চার লাইন শুনিয়ে দিতে পারি।”

জান্নাতুল ফেরদৌস আর কিছু বলেননা। সেরিন তার রুম থেকে প্রস্থান করে। আজকে শুভ্র আসুক শুধু। এই আর্শিয়ার জন্য তাকে ছোট করলো। কে বলেছে আর্শিয়াকে দেখতে যেতে?

ভূতের ভয় ত্যাগ করে সেরিন রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। বেলকনিতে যায়! সেখানে একটা দোলনা জুলানো আছে। বেলকনির সামনে বাগান বিলাসের ফুল ফুটে আছে। গেটের দিকে নজর দেয় সেরিন। রোড দিয়ে কত গাড়ী আসা যাওয়া করছে।

শুভ্র বাড়ী ফিরতে,ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেরিন মাগরিবের নামাজ পড়ে সবে বসেছে। তখন শুভ্র তার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। সেরিন জিজ্ঞেস করে,
“কী আছে এটায়?”

“তোমার জন্য চকলেট।”

“ওহ্!”

সেরিন প্যাকেটটা রেখে বসে পড়ে। শুভ্র ফ্রেশ হয়ে এসেও দেখে সেরিন আনমনা হয়ে বসে আছে। চকলেটে হাত দেয়নি।

“যাও আমার কফিটা নিয়ে আসো।”

সেরিন সোজা নিচে যায়। কিচেনে যেতে একজন বুয়া একটা ট্রেতে দুটো কফির মগ এগিয়ে দেয়। তখন আবার জান্নাতুল ফেরদৌস কিচেন আসেন। সেরিন তাকে দেখে বলে,
“আপনি কিচেনে?”

“না আসলে রান্না করবো।”

“কেনো? সারাদিন অফিসের কাজ করে রান্না করার মুড থাকে?”

“না আমার ভালো লাগে।”

“আমি আসছি আপনায় হেল্প করবো।”

“ঠিক আছে এসো।”

সেরিন ট্রে নিয়ে উপরে যায়। টেবিলের উপর ট্রে রেখে চলে আসে। সেরিনের এমন ইগমোর শুভ্র বুঝতে পারছে না। নিজের কফির মগ নিয়ে সোফায় বসে শুভ্র।

সেরিন জান্নাতুল ফেরদৌসকে রান্নায় হেল্প করে। শাশুড়ী বউমা মিলে রাতের ডিনার তৈরী করে। তখন জান্নাতুল ফেরদৌস আলাদা প্লেটে খাবার তুলে রাখেন। সেরিন কৌতুহল দমাতে না পেরে বলে,
“ওই পুরোনো প্লেটের খাবার কার জন্য?”

“এমনিতে! আমি সবসময় রাখি।”

“ওহ্!”

সেরিনের সন্দেহ হয়। তবে কিছু বলেনা। তখন আবার একজন সার্ভেন্ট এসে তাকে বলে, শুভ্র ডাকছে। সেরিন উপরে যায়। রুমে প্রবেশ করতে শুভ্র রাগী স্বরে বলে,
“পড়ালেখা নেই তোমার? নিচে এতো সময় কী?”

“রান্নায় হেল্প করছিলাম।”

“বাড়ীতে যথেষ্ট কাজের লোক আছে। তোমার এখন এসব করার সময় না।”

সেরিন কিছু বলেনা। বই নিয়ে বসে পড়ে। শুভ্রও আর কিছু বলেনি।

“আগামী কাল থেকে ক্লাসে রেগুলার হইবা। আর ঢাকায় ব্যাক করতে হবে না।”

সেরিন কিছু বলেনা। শুভ্র ধমকে বলে,
“কী বলেছি শুনেছো তো? তোমার তো আবার মনে থাকে না।”

“শুনেছি।”

“তো প্রতিবন্ধীর মতো চুপ করে বসে আছো কেন? কিছু তো বলবা।”

“বেশী কথা বললে আপনি বিরক্ত হবেন।”

“তোমার আজকে আবার কী হয়েছে? মুড এমন কেনো?”

“তো হবে না? আর্শিয়াদের বাড়ী গিয়েছিলেন কেনো? আর্শিয়া সুন্দরী তো সেই সুন্দরীকেই নিজের বউ করতেন। কে বলেছে সেরিনকে বিয়ে করতে? আসলে আপনি আর্শিয়াকেই ডিজার্ভ করেন আর আমি আপনার থেকেও বেটার কাউকে।”

“তোমায় এসব কে বললো?”

“যে বলেছে,বলেছে।”

“না বললে কী আর করার।”

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৮|
#শার্লিন_হাসান

“তো হবে না? আর্শিয়াদের বাড়ী গিয়েছিলেন কেনো? আর্শিয়া সুন্দরী তো সেই সুন্দরীকেই নিজের বউ করতেন। কে বলেছে সেরিনকে বিয়ে করতে? আসলে আপনি আর্শিয়াকেই ডিজার্ভ করেন আর আমি আপনার থেকেও বেটার কাউকে।”

“তোমায় এসব কে বললো?”

“যে বলেছে,বলেছে।”

“না বললে কী আর করার।”

“আপনি এমন ত্যাড়া কেনো? একনাম্বারের তেঁতো লোক! আচ্ছা শুনুন আজকে শাশুড়ী আম্মা আমায় ছোট করে কথা বলেছে। আমায় নাকী আপনার সামনে মানায় না! আর্শিয়া হলে ঠিক হতো।”

“আরে ওনার কথায় কান দিও না তো। উনি এমনই!”

কথাটা বলে শুভ্র সেরিনকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো। সেরিন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে হেঁসে দেয়। সেরিনকে হাসতে দেখে শুভ্র তার কপালে অধর ছোঁয়ায়।

“যাও ড্রেসিং টেবিলের উপর কিছু ফুল রাখা আছে। দেখো তোমার পছন্দ হয় কীনা!”

সেরিন শপিং ব্যাগ আনে। তাতে বেলিফুল,গোলাপ ফুলের মালা আবার ফুলের হাতের চুড়ি, ফুলের ক্রাউন আছে। সেরিন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আজকে তো শাড়ী পড়িনি।”

“এখন পড়বা?”

“শিওর?”

“যাও আমি ওয়েট করছি।”

সেরিন কাবাড থেকে একটা শাড়ী বের করে মেরুন কালারে। পাশের চেন্জিং রুমে গিয়ে চেন্জ করে আসে। সাজগোছ নিয়ে সে পাক্কা। বিশমিনিটের মধ্যে শাড়ী পড়ে আসে সেরিন। কোমড় অব্দি সরু চুলগুলো এলোমেলো। সেরিন আসতে শুভ্র তাকে হাতের চুড়ি আর মাথার ক্রাউন পড়িয়ে দেয়। মুচকি হেঁসে বলে,
‘এতোগুলা ফুল তাঁদের সৌন্দর্যে তোমায় মুড়িয়ে নিয়ে তোমার সৌন্দর্যকে শোভা দিচ্ছে। কিন্তু তুমি কী জানো? সবগুলো ফুলের মধ্যে এই ‘মেয়েফুলটি’ আমার ভীষণ পছন্দের।’

“আপনি জানেন? আমায় নিয়ে এতো সুন্দর কমপ্লিমেন্ট দেওয়া মানুষটা আমার ভীষণ প্রিয়!”

শাড়ী পড়ার উসিলায় সেরিন আজকের মতো পড়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। রাতে সবার সাথে ডিনার করে রুমে আসে। তার ব্যক্তিগত পুরুষের বুকে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়। এই জায়গাটা সেরিনের সবচেয়ে শান্তির।

********

অনেকদিন পর শুভ্রদের কলেজে পা রাখে সেরিন। নিশাতের সাথে তার অনেকদিন পরেই দেখা হয়। দুই বান্ধবীর সে কী আনন্দ! অনেকে সেরিনকে প্রশ্ন করছে ঢাকা থেকে চলে আসলো কেন। সেরিনের একটাই উত্তর, ‘পরিবার ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না। আর পড়াশোনার প্রেশার বেশী মিউজিক একাডেমিতে যাওয়ার সময় নেই।’

আর কেউই কিছু বলেনা। সেরিন পড়াশোনা নিয়ে আজকাল একটু বেশী সিরিয়াস। নাহলে তার যেই বর!গলার উপর মাথা তার একটাই আছে। তবক মাঝেমধ্যে শুনতে পায় শুভ্রর বিয়ে নিয়ে গসিপ হচ্ছে। সেরিন সেসব শুনে আর হাসে।

এভাবেই সেরিন শুভ্রর ব্যস্ত জীবন কাটছে। সেরিন তার গান, পড়াশোনা, শুভ্র এসব নিয়ে সুন্দর একটা সময় কাটাচ্ছে।
সেদিন রাতে ডিনার করে সেরিন কিচেনের দিকে যায়। ভেতরে জান্নাতুল ফেরদৌস আছেন। বাকীরা সবাই অনেক্ষণ আগেই উপরে চলে গেছে। মূলত শুভ্রর কফির জন্যই কিচেনে যায় সেরিন। পুরো লিভিং রুম ফাঁকা। জান্নাতুল ফেরদৌসকে দেখে কিছুটা সরে আসে সেরিন। সেদিকটায় আর যায় না।

খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বেড়িয়ে আসে জান্নাত। এক হাতে তার টর্চ লাইট! সেরিন খেয়াল করে তিনি লিভিং রুম এবং বাইরের লাইট অফ করে দিয়ে মেইন ডোর খুলে বেড়িয়ে যান। সেরিন অন্ধকারে হাতড়ে লাইট অন করে। পাশে একটা টেবিল রাখা সেখান থেকে একটা ক্যান্ডেল নেয়। সেটা জ্বালিয়ে সেরিন ও বাইরে যায়। চারদিকে অন্ধকার তারউপর এই সাইডে কবরস্থান। হালকা মৃদু বাতাস বইছে। মোমবাতির আলো বাতাসে নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে। সেরিনের গা কাটা দিয়ে উঠে। সে জানে না কোনদিকটায় যাবে। কবরস্থানের সোজা বাড়ীর পেছনের দিকে যায় সেরিন। কিছুই দেখতে পেলো না সে। শুধু সাদা দেওয়াল! সেরিন কখনো বাড়ীর পেছনে আসেনি। এই প্রথম তাও মধ্যরাতে। মোমবাতির আলোয় সাদা দেওয়ালে সেরিনের অবয়ব ভয়ংকর রকমের দেখা যাচ্ছে। সেরিন মনে,মনে দোয়া দুরুদ পড়ে বাড়ীর ভেতরে চলে যায়। শুভ্রর কফি বানবে কী মোমবাতি হাতে নিয়েই কোনরকম রুমে যায়। সে ভীষণ নার্ভাস। ভেতরে এসেই মোমবাতি হাত থেকে ফেলে দেয়। হাত-পা ভীষণ রকমের কাঁপছে তার। সেরিনের অবস্থা দেখে শুভ্র কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তড়িঘড়ি সেরিনকে ধরে এনে বিছানায় বসায়।

“সেরিন তুমি ভয় পেয়েছো?”

“বাড়ীর পেছনে কিছু আছে।”

“তুমি কী দেখেছো?”

“কেউ আছে বাড়ীর পেছনে যার জন্য প্রতিদিন আম্মু খাবার নিয়ে যায়।”

কথাটা নার্ভাসের ঠেলায় আন্দাজি ঢিল মারে সেরিন। তবে সে শিওর না। শুভ্র ও কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়। সেও এই ব্যপারটা দেখতে গিয়েছিলো তখন মাথায় আঘাত পায়। সেরিনকে রেখে বেলকনিতে যায় শুভ্র। বাইরে অন্ধকার। তাঁদের বাড়ীর সামনে আর পশ্চিম সাইডে সিসি ক্যামেরা লাগানো তবে পূর্ব সাইডে লাগানো নেই। ওইদিকে কেউ যায় ও না। বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে পাশেই তাদের বাড়ীর দেওয়াল তেমন জায়গাও নেই। শুভ্র আর কিছু বলেনা। সামনে সেরিনের ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। তার কয়েকদিন পর ঢাকায় পাঠিয়ে দিবে শুভ্র। আর এক্সাম দিবে না একবারে উচ্চমাধ্যমিক এসে দিবে। আপাতত মিউজিক একাডেমিতে ক্লাস করবে।

শশীর ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বেশী দেরী নেই। সেজন্য আর্থর সাথে যোগাযোগ তেমন নেই। সে পড়াশোনা নিয়ে বিজি। এক্সামের পরপরই তাদের বিয়ে।

সাহিনূর পাটওয়ারী অক্ষরের জন্য মেয়ে দেখছেন। কোন ভাবে মালিথা পরিবারের একমাত্র মেয়ে আর্শিয়ার খোঁজ পান। তিনি এখন আর্শিয়াকে ছেলের বউ করার জন্য পড়েছেন। অক্ষর দেশে এসেছে অনেক দিন হলো। যাওয়ার সময় ও ঘনিয়ে এসেছে। এবার আর দেরী করবেন না তিনি। মালিথা পরিবারের একমাত্র মেয়েকে খান বাড়ীর পূত্র বঁধু করে নিয়ে আসবেন।

*******

কলেজে শুভ্র নিজের রুমে বসে আছে। ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা চলছে তার কলেজে। তখন একটা মেয়ে আসে তার রুমে। মেয়েটাকে চিনতে ভুল হয়নি শুভ্রর। এটা আর কেউ না নিশাত। শুভ্রর থেকে অনুমতি ও নেয়নি নিশাত সোজা রুমে ঢুকে যায়। নিশাতের কাজে শুভ্র কিছুটা অবাক হয় তবে তেমন পাত্তা দেয়না। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বর।

“শুভ্র আজকাল চিঠি আসে না বুঝি?”

“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। এখন আমি তোমার বান্ধবীর জামাই নই টিচার। ওকে? আর শুভ্র বলার আগে সাথে স্যার বা চৌধুরী পদবিটা ইউস করো।”

“আমি আমার লিমিট একটুও ক্রস করিনি মিস্টার শুভ্র চৌধুরী ওরফে আমার সতীনের একমাত্র বর।”

“বাহ্! তা বলবো তোমার বান্ধবীকে তার কাছের বান্ধবী তারই বরের দিকে নজর দিয়েছে। চালাকী করতে চেয়েছো তুমি তাইনা? তোমার দেওয়া ভুলভাল চিঠি আমি পুড়িয়ে দিয়েছি।”

“চিঠি পুড়েছে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি। এক উপায় না থাকলে অন্য উপায় তো আছে। কী জেনো নাম? আচ্ছা আমার ভাইকে চেনেন?”

“এসব চিনে আমার কোন কাজ নেই।”

“গুড! যখন কাজে লাগবে চিনে নিবেন প্লিজ।”

নিশাত হেঁসে বেড়িয়ে আসে। শুভ্র চিন্তিত হয়ে বসে পড়ে। এই নিশাত মেয়েটার পরিচয় আসলে কী? আর সেরিনের সাথে সম্পর্ক কবে থেকে? মেয়েটা তো আস্ত কালসাপ। শুভ্র বুঝতে পারছে ঘরে বাইরে তার সবই শত্রু। অথচ কেউই বুঝতে পারছে না। কোন একটা স্ক্যান্ডাল রটে গেলে সমস্যা। চিন্তা জেনো পিছু ছাড়ছে না তার।

সেদিনের মতো কলেজের কাজ শেষ করে বাড়ীতে আসে শুভ্র। বাড়ীতে তেমন কেউই নেই। আয়মান চৌধুরী, সুলতানা খানম, আর্থ সবাই ঢাকা। তার বাবা আরফিন চৌধুরী বিডির বাইরে আছে ইউকে-তে। বাড়ীতে শুধু সেরিন, শুভ্র আর শুভ্রর মা। কাজের বুয়া তেমন কেউই নেই একজন আছে।

সেরিনের ভালো লাগছে না চৌধুরী বাড়ীতে। পাটওয়ারী বাড়ীতে যাওয়ার জন্য মনে উতলা হয়ে আছে। শুভ্রকে বলতেও পারছে না। কারণ তার এক্সাম চলে আর শুভ্র সেরিনকে একমুহূর্তের জন্যও দূরে রাখতে রাজী না।

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-২৫+২৬

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৫|
#শার্লিন_হাসান

সেরিন মুচকি হেঁসে বলে,
“কঠোর ব্যক্তিত্বের সুন্দর মনের মানুষটা।”
তখন শুভ্রকে মেহের বলে,

‘জিজু তুমি কী দেখো আয়নায়?”
তখন শুভ্র মুচকি হেসে আয়নায় সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আকাশ থেকে নেমে আসা চঞ্চল পরীটা আমার অর্ধাঙ্গিনী।”

উপস্থিত সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে। আরফিন চৌধুরী তাদের দুই হাত এক করে চার হাত করে দেন। শুভ্র এবং সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘সবসময় একে অপরের পাশে থেকো। সুন্দর একটা অধ্যায় শুরু করো। অনেক দোয়া এবং শুভকামনা রইলো তোমাদের জন্য।’

সেরিন শুভ্রর দিকে পলক ফেলে। তখন তুষি এবং সুলতানা খানম মিষ্টি সাথে খেজুর নিয়ে আসেন। সবাইকে মিষ্টি মুখ করান। সেরিন,শুভ্র খেজুর খায়। তাঁদের বিয়ে সম্পূর্ণ হতে ফটোশুট চলে কিছুক্ষণ। চৌধুরী পরিবারের সবাই লান্স করতে বসে গেছে। আর্থ,মাহী,অক্ষর, কিরণ পাটওয়ারী খাবার সার্ভ করছে।
এদিকে সেরিন শুভ্রকে নাচাচ্ছে। মানে ভিডিও বানাচ্ছে মিররে। শুভ্র নিরামিষ হলেও সেরিনের কথায় ভাবভঙ্গি চেন্জ করে ভিডিওতে আসতে হচ্ছে। শুভ্র মেয়েটার দিকে তাকায়! সে এসব একদম পছন্দ করে না বললে ভুল হবে এসব ছবি,ভিডিও,শো অফ করে না। কিন্তু তার বউটা সম্পূর্ণ তার বিপরীত। পিক তুলে ফেসবুক ওয়ালে ঝুলাতে হবেই হবে। ভিডিও বানাতেই হবে।

তাঁদের পিক তোলা হতে খাওয়ার জন্য বসে পড়ে। সব কাজিনরা মিলে একসাথে বসেছে। শশী,মেহের,রাফা,সাফা,শুভ্র,সেরিন,অক্ষর, আদ্রিতা,অধরা। আদ্রিতা মেয়েটা সেরিনের পাশেই বসেছে। সে যে ভীষণ খুশি সেরিনকে দেখে। তাঁদের বাকী গল্প চৌধুরী বাড়ীতে হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে তারা সবাই ফ্যামিলি পিকচার তুলে। চৌধুরী পরিবারের সাথে সেরিনের শশুর শাশুড়ী,শুভ্র এবং সেরিন। তাঁদের মেইন ছোট্টো পরিবার।

সবশেষে তাঁদের বিয়ের জন্য একটা কেক আনা হয়। সেটাই কেটে খাওয়া হয়। ভীষণ সুন্দর একটা দিন কাটে তাঁদের। পাটওয়ারী বাড়ী থেকে বিদায় নিতে,নিতে সন্ধ্যার পর হয়ে যায়। সেরিনের সাথে শশী,মেহের,সাফা,রাফা,মাহী যাবে। তারা রুম সাজিয়ে আবার একটা,দুইটার দিকে চলে আসবে পাটওয়ারী বাড়ীতে। যেহেতু তাঁদের নিজস্ব গাড়ী নিয়েই যাবে সেজন্য জামেলা হবে না।

সেরিনকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ীতে রওনা হয় আটটার দিকে। বিদায়ের সময় সেরিনের সে কী কান্না! তবে একটু অভিমান জমেছে তার বাবার উপর সাথে শুভ্রর উপর ও। সেসব এখন প্রকাশ করবে না তবে অভিনান তোলা রইলো।

অক্ষর সেরিনকে বিদায় দিয়ে বাকীদের থেকেও বিদায় নিয়ে তার বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়। বাড়ীতে যাবে কী! তার তো মন ভীষণ খারাপ। শুভ্র কীভাবে থাবা মেরে তার জিনিস নিয়ে গেলো। ভাবলে রাগে শরীর জ্বলে অক্ষরের। সে চাইলে জোর করে সেরিনকে বিয়ে করতে পারতো। করেনি! কারণ তার পারিবারিক শিক্ষা এতোটাও ঠুনকো নয়। পছন্দ করেছে, অনুভূতি জমিয়েছে তবে প্রকাশ করেনি। সেজন্য কারোর কাছে হাসির পাত্র হয়নি! সামনে তার জন্য ভালো কেউ আছে এটাই মনে করে অক্ষর।

নতুন বউ চৌধুরী বাড়ীতে প্রবেশ করে। সেরিন এর আগে কখনো এই গেট দিয়ে প্রবেশ করেনি। বাইরে থেকেই বাড়ীর আকৃতি ভেবে নিয়েছে। তবে তার কল্পনার থেকে কোন অংশে কম নয় বাড়ীটি। বিশাল লিভিং রুমের একটা সোফায় সেরিনকে বসানো হয়। সার্ভেন্ট তাদের সবাইকে ওয়েলকাম ড্রিং দেয়। সেই সাথে কফি, টুকটাক খাবার দেয়।

কাজের বুয়া রান্না অনেকটা চাপিয়ে নিয়েছে। তবে জান্নাতুল ফেরদৌস ফ্রেশ হয়ে কিচেনে উঁকি মারেন।
বাকীরা সেরিনকে নিয়ে গল্পে বসেছে।

শুভ্র নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে। সেরিনকে নিয়ে বাকীরা গল্প করছে। সেও তাতে যোগ দেয়। তবে বেশী কথা বলেনা। কী জানি একটা বলবে আর সেটা সেরিনের পছন্দ হবে না। তখন সেরিন সবার সামনেই তাকে তুই তোকারী, গা’লি দিবে। শুভ্র সব বিশ্বাস করতে পারলেও সেরিনের রাগ আর তুই তোকারী উইথ গা’লি না দেওয়াকে বিশ্বাস করে না। ওটা যেকোনো জায়গায় চলে আসে।

আর্থ, মাহী,মেহের,সাফা তারা শুভ্রর রুম ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে। তবে বাকীরাও ভাগ আছে এটায়। তারা এখন গল্প করছে বাকীদের সাথে।

মিরা ইসলাম শশীকে দেখছে। মেয়েটাও তাঁদের বাড়ীতে আসবে বেশী দেরী নেই। বেশ শান্তশিষ্ট,নিরব প্রকৃতির। কথাবার্তায় কী যে মাধুর্যতা। মেয়েটাকে দেখলেই কাছে টেনে আদর করতে মন চায়। কিন্তু তার যেই ছেলে! প্রকাশ না করলেও জানে ছেলেটা কেমন ঠোঁট কাটা। কখন বলে বসে আম্মু ওটা আমার হক। ওতো আদর করতে হবে না।

ভাবতে মুচকি হাসেন মিরা ইসলাম। তাঁদের গল্প,আড্ডায় রাত প্রায় বারোটা বেজে যায়। সবাই রাতে হালকা ডিনার করে নেয়। সেরিন চেঞ্জ করার সুযোগ পায়নি। তাকে আগে,আগে শুভ্রর রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শুভ্র কফির মগ নিয়ে রুমের সামনে আসতে তাকে আটকে দেওয়া হয়। এমনিতে সে প্রচুর টায়ার্ড। সেজন্য আর বেশী কিছু বলেনি। টাকার বান্ডেল আর্থর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” তোর বিয়েতে তার থেকে দ্বিগুণ উশুল করবো আমি।”

“ঠিক আছে সমস্যা নেই। শালিকা মহলের কাছে তোমায় ছেড়ে দিয়ে আমি বাসর ঘরে ঢুকবো। বলবো যা দরকার আমার ভাই দিবে। কেউ আবার নেগেটিভ ভাবে নিও না।”
মাথা চুলকে বলে আর্থ। তখন শুভ্র তার পিঠে দুটো লাগিয়ে বলে,
“মুখটা সামলা ছোটো। সেরিন জানলে তোর খবর করে দিতো এখনি।”

“খবর মানে ওই সেরিন আমার আর্থর মুখটাই ভে’ঙে দিতো।”

মনে, মনে বলে শশী। টাকা নিয়ে বাকীরা সরে যায়। শুভ্র রুমে ঢুকেই দরজা লক করে দেয়। সেরিন তার জামাকাপড় বের করতে ব্যস্ত। তখন শুভ্র কফির মগ রেখে বলে,

“নতুন বউরা লজ্জা,লজ্জা মুখ করে বসে থাকে। আর তুমি লজ্জা তো নাই আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছো?”

“লজ্জা পেয়ে লাভ আছে বলুন? সেই তো আপনিই! আর ওতো লজ্জা পেলে চিঠি দিতাম না।”

শুভ্র কিছু বলেনা। সে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। সেরিন গহনা খুলে চেন্জ হতে চলে যায়। অনেকক্ষণ পার হতে শুভ্র উঠে বেলকনিতে যায়। রাত অনেক গভীর। নিচের দিকে তাকাতে দেখে অন্ধকারে কেউ বাড়ীর পেছন দিক থেকে এসে মেইন ডোর দিয়ে প্রবেশ করছে। আশ্চার্য ব্যপার লাইট এখন অফ কেনো? পাটওয়ারী বাড়ীর সদস্যরা চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে। শুভ্রর কৌতুহল বেড়েই চলেছে। না আর নিজেকে দমিয়ে রাখা সম্ভব না। রুমে এসে ফোনের ফ্লাশ অন করে বাইরে বের হয়। পুরো বাড়ী অন্ধকার। হাত মেললে হাত দেখা যাবে না। লিভিং রুমে ড্রিম লাইট ও অন করেনি কেউ। শুভ্র ফোনের ফ্লাশ দিয়েই মেইনডোর খোলে বাইরে বের হয়। বাইরের লাইট অন আছে। সাত পাঁচ না ভেবে বাড়ীর পেছনে যায় শুভ্র। কিন্তু নতুন কিছুই পেলো না বা দেখলো না। শুভ্র লম্বা করে একটা শ্বাস নেয়। পেছনে শুধুই দেওয়াল এখানে কিছুই নেই। দ্রুত পা ফেলে প্রস্থান করে শুভ্র। এসব শুধুই তার চোখের ভুল। আর বাড়ীর প্রত্যেকটা কোণ সম্পর্কে ধারণা আছে শুভ্রর। তারউপর সিসি ক্যামেরা তো আছেই। অন্ধকার কিছুই নেই এই বাড়ীতে।

রুমে আসতে দেখে সেরিন বসে আছে সোফায়। তার হাতে ফোন। শুভ্রকে দেখে অনেকটা চমকে যায় সেরিন। শুভ্র ফোনটা বেডের পাশের টেবিলটায় রাখে। সেরিনের দিকে একনজর তাকায়। ব্লাক কালার শাড়ী পরিধান করেছে মেয়েটা। সেরিন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“এই কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”

“বাইরে।”

“এতো রাতে?”

“না বেলকনি দিয়ে দেখলাম কেউ বাড়ীর পেছন থেকে ভেতরে প্রবেশ করছে।”

“মাথাটা গেছে আপনার। এই রাতে বাইরের লোক তাও বাড়ীর ভেতরে? সবাই টায়ার্ড তাই ঘুমাচ্ছে।”

“হুম হয়ত আমার দেখার ভুল।”

“চলো তোমায় একটা কিছু দেখাই।”

শুভ্র উঠে সেরিনের হাত ধরে। তাকে নিয়ে বেলকনিতে যায় শুভ্র। হাত দিয়ে বাড়ীর সামনের পূর্ব সাইডের একটা কোণ দেখায় শুভ্র। সেরিন সেদিকটায় তাকায়। শুভ্রর হাত খামচে ধরে বলে,
“এই রাতে আপনি আমায় সাদা দেওয়াল দেখাচ্ছেন? এটা তে কারোর ক’বর মনে হচ্ছে। এই আপনার মতলব টা কী? আপনি আমায় রাতের বেলায় এসব কী দেখাচ্ছেন?”

“আরে ওটা আমার আম্মুর ক’বর।”

“কিন্তু আপনার আম্মু তো ওই আন্টি।”

“না ওনি আমার আসল মা না।”

সেরিন আর কিছু বলেনা। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বলে,
“আচ্ছা চলুন আমার ঘুম পাচ্ছে।”

শুভ্র ও আর কথা বাড়ায়না। তারা দুজনে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র বেলকনির দরজা লাগিয়ে দিয়ে খাটের কাছে আসতে,আসতে দেখে সেরিন চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। মনে হয় বেশী টায়ার্ড। শুভ্র ডাক দিবে যদি গা’লি শোনে সেইজন্য ভয়ে ডাক দিচ্ছে না।

বিছানায় গা লাগাতেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যায় সেরিন। শুভ্র সেরিনের পাশে শুয়ে পড়ে। উপরে খাঁচার মতো ফুলগুলো ঝুলছে। কত সুন্দর একটা মূহুর্ত অথচ তার বউ ঘুমাচ্ছে। শুভ্র যতটা দেখায় ততোটাও আনরোমান্টিক না। কিন্তু সেরিন যতটা শো অফ দেকায় ততোটা রোমান্টিক না। শুভ্র আজা ইরা ওভার থিংকিং করছে। পরক্ষনে মনে পড়ে সেরিনের জন্য কিছু গিফ্ট এনেছিলো। কিন্তু দিবে কী? মেয়েটা তো ঘুমিয়ে গেছে। সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো এমনকি ঘুমানোর সময়ও।

শুভ্রর জল মার্কা বাসর কাটলো। এই শোকে তো চার দিন তালে পাথর হয়ে থাকতে হবে। সমান্য গিফ্ট দিবে সেটার ও সুযোগ নেই। বাকী সব তো পরের হিসাব। সেরিন এখনো ছোটো। তার শশুরকে দেওয়া কথা মনে পড়ে শুভ্রর। আহারে শশুর মশাই কী একটা বাচ্চা আমার কপালে জুটিয়ে দিলেন। থাক আমিই তো নিলাম একে।

সকাল বেলা শুভ্রর এলার্মে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে যায় সেরিনের। তার মাথার পাশের টেবিলটায় রাখা এর্লাম। চোখ বন্ধ করে হাতড়ে সেটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারে। পড়ার কোন শব্দ হয়নি দেখে সেরিন পিটপিট চোখ মেলে তাকায়। সামনে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সেরিন তড়িঘড়ি উঠে শুভ্রর কাছে যায়। কী বলবে,কী করবে ভেবে পাচ্ছে না তারউপর ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। সেরিন একবার এদিকে যায় তো আরেকবার ওইদিকে। ব্যথা সত্যি পেয়েছে নাকী পায়নি সেটা জানে না। সে ফাস্ট এইড বক্সের জন্য ছুটাছুটি করছে। শুভ্র কপাল থেকে হাত সরিয়ে সেরিনের কান্ড দেখছে। সবগুলো ড্রয়ার টেনেটুনে শেষ। কয়টা খোলতে পেরেছে কয়টা পারেনি লক করা। তবে ফাস্ট এইড বক্স সে আবিষ্কার করতে পারেনি। হতাশ হয়ে শুভ্রর কাছে এসে বলে,
“বেশী ব্যথা পেয়েছেন? ঘড়িটা মাথায় গিয়ে লেগেছে?”

“আমি তোমাকে একবার ও বলেছি ঘড়িটা আমার মাথায় লেগেছে বা ব্যথা পেয়েছি?”

“ওহ কই না তো বলেননি।”

“তাহলে ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছো কেন?”

“না আসলে। আমি ভেবেছিলাম?”

“ভেবেছো ভালো করেছো এখন এটা এক্সপ্লেইন করতে হবে না।”

“এমাহ সকাল,সকাল মুড এতো কড়া কেন?”

শুভ্র সেসবে পাত্তা দেয়নি। শুভ্রর এমন মেজাজ দেখানো সেরিন ও বেশী পাত্তা দেয়নি। সে আশেপাশে তাকিয়ে ফ্লোর থেকে ঘড়িটা তুলে টেবিলের উপর রেখে দেয়।

ফ্রেশ হয়ে আসতে দেখে শুভ্র ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। সেরিন সেসবে পাত্তা দেয়নি। সে নিচে যায়। বাড়ীর কেউই এখনো উঠেনি। ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে সকাল ছয়টা বাজে। সেরিনকে দেখে একজন সার্ভেন্ট কফির মগ দিয়ে বলে,
“শুভ্র স্যারের কফি।”

“এতো তাড়াতাড়ি?”

“স্যার নামাজ পড়ে কফি খেয়ে হাঁটতে বের হোন সবসময়।”

সেরিন কফির মগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্রর সামনে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার কফি।”

“তোমার থেকে কফি চেয়েছি আমি?”

“না।”

“তো?”

শুভ্র উঠে বেলকনিতে যায়। সেরিনও পেছন,পেছন কফির মগ নিয়ে যায়। শুভ্র তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। শুভ্র বেলকনি থেকে রুমে আসে। সেরিন ও রুমে আসে। সে বাইরে যায় লিভিং রুমে। সেরিনও কফির মগ নিয়ে তার পেছনে ঘুরতে থাকে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করিয়ে রুমে আসে শুভ্র। সেরিন সেই কফির মগ নিয়েই রুমে আসে। শুভ্র সোফায় বসতে সেরিন কফির মগ পুনরায় এগিয়ে দিয়ে বলে,
“স্যরি! আসলে আমার প্রচুর ঘুম এসেছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। যাই হোক যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে সেই তো সকাল হলে আপনি এভাবেই আমায় ঘুরাতেন আপনার পেছনে।”

” কিছুই ঠিক হয়নি! গতকাল রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর শাস্তি এটা। এই যে আমার পেছনে তোমায় ঘুরালাম কিছুক্ষণ।”

“আরে আমি এখনো বাচ্চা গতকাল রাতে জেগে থাকলেও….

” তো তোমার কী মনে হয় গতকাল রাতে আমি তোমার সাথে বাসর করতাম?”

সেরিনের কথায় পোড়ন কেটে বলে শুভ্র। সেরিন চুপসে গিয়ে দৃষ্টি নত করে নেয়।
#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৬|
#শার্লিন_হাসান

“তো তোমার কী মনে হয় গতকাল রাতে আমি তোমার সাথে বাসর করতাম?”

সেরিনের কথায় পোড়ন কেটে বলে শুভ্র। সেরিন চুপসে গিয়ে দৃষ্টি নত করে নেয়। শুভ্র কফিতে চুমুক দেয়। সেরিন খাটের উপর গিয়ে বসে। তখন শুভ্র বলে,
“ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়ে আসছে। আবার তো তোমার তৈরী হতে লেট হবে।”

“হোক সময়। ভাল্লাগেনা আমার ঘুম আসছে।”

“তাহলে ঘুমাও। আমি জাগিয়ে দেবো।”

সেরিন আর কথা বাড়ায়না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। শুভ্র কফিটা শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।

বাকীরা অনেকটা লেট করে ঘুম থেকে উঠে। ব্রেকফাস্ট করার সময় হতে শুভ্র সেরিনকে ডেকে তুলে। তারা দু’জন এক সাথে নিচে যায়। সেরিন তার শাশুড়ীদের সাথেই বসেছে। সামনের সারিতে শুভ্র,আর্থ,আয়মান চৌধুরী তারা বসেছে। আর্থ শুভ্রকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কেমন কাটলো ফুলসজ্জা? ”

“ভীষণ বাজে।”

“থাক সামনে আরেকবার আছে। তখন সুন্দর কাটলেই হবে।”

“ছোট ছোটর মতো থাকতে পারিস না? বড় ভাই,ভাবীর পার্সোনাল ম্যটারে ঢুকছিস কেন?”

“কিসের ছোট? কে ছোটরে ভাই? আমি হাইটে তোমার থেকে কোন অংশে কম না। বয়সটা তো ম্যটার করে না।”

তাঁদের নাস্তা খাওয়া হতে সেরিন আদ্রিতা আর অধরার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগামী কালকে পাটওয়ারী বাড়ীর সদস্যরা আসবে। শুভ্র ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে চলে যায় কলেজের উদ্দেশ্য। আজকে একটু লেট হয়ে গেছে তার। আদ্রিতার সাথে যত কথা আছে আজকের মতো শেষ করে সেরিন। অনেকটা সমশ তাঁদের সাথে কাটিয়ে শুভ্রর রুমে আসে সেরিন। রুমটা গুছিয়ে নিয়ে শুভ্রকে কল লাগায়। বেশ কয়েকবার রিং হতে শুভ্র কল তোলে। তখন সেরিন বলে,
“আচ্ছা চিঠিগুলো কোন ড্রয়ারে?”

“তিন নাম্বার ড্রয়ারে। চাবি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে।”

“আচ্ছা।”

“শোনো? ”

“বলুন?”

“তুমি আজকে চিঠি পাঠিয়েছো?”

“মাথা খারাপ আপনার? আমি চিঠি পাঠাবো কেন? আর কখনই বা পাঠাবো? আপনি তো সাথেই ছিলেন।”

“তাহলে কে পাঠালো?”

“জানি না।”

সেরিন মুখের উপর কল কেটে দেয়। সে ড্রয়ার থেকে চিঠি বের করে তাতে হাত ভোলায়। তবে কয়েকটা চিঠি অচেনা লাগলো। যেগুলো সে দেয়নি তবে তার হ্যান্ড রাইটিং এর মতোই। সেরিন চিঠিগুলো সাইড করে রাখে। শুভ্র আসলেই জিজ্ঞেস করবে।

********

শুভ্রর বিয়ের খবর কোন ভাবে তার স্টুডেন্টদের কেউ জেনে যায়। তবে তার বউ কে সেটা কেউ জানে না। জানে শুধু বিয়ে করেছে। বিশেষ করে কলেজের স্টুডেন্টরা জানে। সেকন্ড ইয়ার টু ফাস্ট ইয়ার। অনেকের দিল ভে’ঙে গেছে। তারউপর শুনেছে রিলেশনের বিয়ে। সত্য মিথ্যে সেসব জানার প্রয়োজন নেই হুজুগে বাঙালি বলে কথা।

শুভ্র কলেজ ছুটি হতে বেশী লেট করেনি। সোজা বাড়ীতে চলে আসে। আর্থ,আয়মান চৌধুরী বাজারে গেছে। আগামী কালকের অনুষ্ঠানের বাজার। শুভ্র শাওয়ার নিয়ে লান্স করতে চলে যায়। বাকীরা করে নিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। শুভ্র রুমে আসতে দেখে সেরিন কলে কারোর সাথে কথা বলছে। সেসবে আর পাত্তা দেয়নি শুভ্র। সেরিন কল কেটে শুভ্রর সামনে দু’টো চিঠি রাখে। শুভ্র ব্রু কুঁচকে শুধায়,
“এগুলোতে কী হয়েছে?”

“এগুলো কে দিয়েছে আপনায়?”

“তুমি!কেনো?”

“আমি দেইনি। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন কোন চিঠি দেইনি। আর পরে যখন দিলাম ধরাই তো খেয়ে গেলাম।”

“তোহ এতোগুলা চিঠি কে দিলো?”

“বাকীগুলো কই?”

” ভালো লাগেনি। টান আসেনি তাই পুড়িয়ে ফেলেছি।”

“গুড। এবার একে খুঁজে বের করুন যে বা হাত ঢুকাতে চেয়েছে।”

“আচ্ছা করবো একটু সময় দাও।”

সেরিন চিঠিগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। সোফায় বসতে,বসতে বলে,
“আচ্ছা বলুন তো সেদিন আমায় চ’ড় মারতে গিয়েছিলেন কেন?”

“কবে?”

“ওই যে সেন্সলেস হয়ে গেলাম।”

“যেই মেয়ে আমার ধমকে সেন্স লেস হয়ে যায় সেই মেয়ে এখন আমায় ধমকায়।”

“আরে বলুন তো?”

“তুমি তো ঢাকায় চলে যাইবা। তাই একটু কিছু লিখে দিয়েছিলাম। কী লিখেছি আপাতত মনে নেই। সেদিন কোন কারণে রাগ উঠেছিলো তোমার ফুফির উপর। আর আমি তোমার রুমের লেখাগুলো দেখেই বুঝে নিয়েছি তুমি চিঠি দেও আমাকে।”

সেরিন হা হয়ে যায়। মুখ বাকিয়ে বলে,
“ওই উল্টাপাল্টা ঘুরানো লেখা আপনি এক দেখায় বুঝে নিয়েছেন?”

“তোহ কেমন লাগে? নিজেকে এতো চালাক ভাবো তুমি?”

“না।”

“কী জেনো লেখা ছিলো?”

“Nizar Roshat rbuab Apaap”

“প্রথমটা আরজিন এর উল্টাপাল্টা দ্বিতীয়টা শুভ্রর লাস্ট দুটো অক্ষর আর মিশাত নামের লাস্ট চারটা অক্ষর। বাকীটা হলো বাবুর পাপা।”

“যাই হোক আপনার মতো চালাক ব্যক্তিকে যতটুকু বেকা বানিয়েছি আমার মতো মেয়ে সেটাই কম কী?”

“আসলেই! যাই হোক তুমি পাশ করেছো জিতেছো।”

“আসতাগফিরুল্লাহ আমি টিচার বিয়ে করেছি। ছিঃ! আপনার লজ্জা করলো না আমার বাড়ী বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে।”

“এই তুমি খোটা দিচ্ছো?”

“না।”

**********

পরের দিন সকালে চৌধুরী বাড়ীতে কাজের ব্যস্ততা পড়ে যায়। পাটওয়ারী বাড়ীর মেহমান আসবে। তবে শুভ্র বা সেরিন এখন যাবে না। তারা কয়েকদিন পর যাবে। সেরিনকে অফ হোয়াইট কালারের গাউন পড়ানো হয়। খুবই সিম্পলের মধ্যে একটা গাউন। নেই তেমন কোন সাজ। তবে তার চুলগুলো ফুল দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। সবাই মিলে সুন্দর একটা দুপুর কাটালো। প্রায় সন্ধ্যার দিকে বিদায় নিয়ে সবাই চলে যায়। সেরিন শুভ্রর দিনগুলো সুন্দরই কাটছে। তবে সেরিনকে পুনরায় টিসি নিয়ে শুভ্রর কলেজে চলে আসবে। মিউজিক একাডেমি তে এখন আর যাওয়া হবে না। কী জানি! আবার কবে এডমিশন নেয়।

এরই মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। সেরিন এখনো কলেজে নিয়মিত হয়নি। হবে আস্তেধীরে তবে বাড়ীতে শুভ্র তাকে ভালোই গাইডলাইন দেয়। সময়টা সন্ধ্যা বেলা। নাস্তা করে শুভ্র ল্যপটপ নিয়ে বসেছে। সেরিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আজকাল ফোনে একটু বেশী সময় দিচ্ছে সেরিন। যেটা শুভ্রর পছন্দ না। ক্যারিয়ার গড়ীর বয়সে কিসের আবার ফোন? শুভ্র প্রথমে কিছু বলেনি। সেরিনের কথা ছিলো সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসবে। কিন্তু সেসবে তার হেলদোল নেই দেখে শুভ্র প্রথমে বলে,
“সেরিন ফোন রাখো।”

“শশীর সাথে কথা বলছি।”

“আমি এক কথা দুইবার বলতে পছন্দ করি না।”

“তাতে আমি কী করবো শুনি? আমার কাজ দেখেই তো…..

শুভ্র চোখ গরম করে বলে,
” আবার বলো কথাটা?”

“না থাক। আচ্ছা রেখে দিচ্ছি ফোন।”

সেরিন ফোন বিছানায়া রেখে বই একটা হাতে নিয়ে শুভ্রর সামনের সোফায় বসে। তখন শুভ্র ধমকে বলে,
“এর পর থেকে ত্যাড়ামী করলে বা ফোন নিয়ে বসে থাকলে একটা থা’প্পড় দেবো একবারে কালা হয়ে যাইবা।”

“আমি বিয়ে করেছি কেনো শুনি?”

“কেনো?”

“জামাইকে নিয়ে পিক তুলতে। জামাইয়ের সাথে রোমান্স করতে পড়ালেখা করার জন্য না।”

“তোমার বাপ শর্ত দিয়েছে তার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। সো এখন এসব পিকচার, রোমান্স সাইডে রেখে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো।”

“আরে বিয়ের পর কিসের আবার ক্যারিয়ার?”

“আসলে তুমি একটা বেয়াদ’ব। বিয়ের পর কিসের ক্যারিয়ার মানে? বিয়ে হয়েছে বলেই কী সব শেষ? তোমায় সংসার করতে হবে না। তুমি ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। নিজের অবস্থান শক্ত করো।”

“আপনার মতো কয়জন এভাবে ভাবে বলুন তো? সবাই তো বলে বিয়ের পর মেয়েদের কিসের পড়ালেখা কিসের আবার ক্যারিয়ার। ঠিক আপনি যেভাবে আমার বাবাকে কথা দিয়েছেন এমন অনেকেই দেয়। কিন্তু দিনশেষে দেখা যায় এসবের দাম থাকে না। দুইদিন না যেতে বাচ্চা তখন বলে কিসের ক্যারিয়ার আর পড়াশোনা মনোযোগ দিয়ে সংসার করো আর বাচ্চা সামলাও।”

“এসব ভাবার জন্য সুন্দর একটা মন মানসীকতা লাগে।”

“ভালো। কিন্তু আপনি জানেন কী আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে আর নেই। পড়ালেখা যেই কঠিন।”

“তাহলে তোমায় বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দেবো। একবারে উচ্চ মাধ্যমিক হলে নিয়ে আসবো। এমনকি তুমি আমার উপর স্ত্রীর অধিকার খাটাতে পারবে না এই দেড়বছরে। কলেজে গেলে একবারে অচেনা। আগে তো বেশী প্যারা দেইনি এখন বেশী দেবো। বুঝবে শুভ্র কী জিনিস। আর
তুমি এসব ফাজলামো বাদ দিয়ে সিরিয়াস হও। নাহলে তোমায় সিরিয়াস বানাতে সময় লাগবে না আমার।”

“দুই লাইন কথার জন্য ছয় লাইন জ্ঞান। ভাই কী হিটলার কপালে জুটলো। ফাঁকিবাজি করা যাবে না। আলাহ আমার কী হবে? আমি শুধু মানুষকে দেখাই আমি পড়াশোনায় সিরিয়াস এবং পড়াশোনা পছন্দ করি। কিন্তু আমি তো জাস্ট শো অফ করি। পড়াশোনা আমি ভালো লাগে না। আবার ক্যারিয়ার!”

সেরিন চুপচাপ কথাগুলো ভাবে। এগুলো প্রকাশ করলে থাপ্পড় দিয়ে শুভ্র তাকে সোফা থেকে ফেলে দিবে। তবুও সাহস নিয়ে বলে,
“আসলে বলছিলাম….

” পড়া শেষে কথা।”

সেরিনের কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তাকে দেড় বছরে পাগ’ল বানিয়ে দিবে। বিরক্তি নিয়ে পড়ায় মনযোগ দেয় সেরিন। শুভ্র ল্যাপটপে কাজ করছে। সেরিন ভুলভাল পড়ছে। তাও মেজাজ দেখিয়ে!

সেরিন শুভ্রর সাথে কথা বলেনা। তার জীবনের সুখ সব কেড়ে নিয়েছে তার জামাই আর পড়ালেখা। এই বাড়ীতে থাকলে পড়ালেখা ওই বাড়ীতে গেলে পড়ালেখা সাথে শুভ্রর ইগনোর সহ্য করতে হবে। ডিনার করে খাটের এক কোণে শুয়ে পড়ে সেরিন। একটা কথাও বলেনি সে শুভ্রর সাথে। কিন্তু তাতে শুভ্রর কিছুই যায় আসে না। সে জানে মন ভালো হলে সেরিন নিজেই তার কাছে আসবে। দুজন খাটের দুই মেরুতে অবস্থান করেছে। কেউই কারোর সাথে কথা বলছে না। সেরিন পড়ালেখার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে। একমাত্র পড়ালেখা। পড়ালেখার জন্য আজকে তার স্বামীর সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-২৩+২৪

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৩|
#শার্লিন_হাসান

পরের দিন সকালে প্রায় দশটার দিকে ঘুম ভাঙে পাটওয়ারী বাড়ীর রাজকন্যাদের। সবাই ফ্রেশ হয়ে একসাথেই নাস্তা করতে বসে। তুষি আসে পিঠার প্লেট নিয়ে। টেবিলের উপর প্লেটটা রাখতে,রাখতে বলে,

“সাফা,রাফা,মেহের,শশী রেডি হয়ে হয়ে মাহী সহ গিয়ে ঢালা গুলো দিয়ে আসবে।”

“কিসের ঢালা কাম্মা?”

ব্রেডে জেল মাখতে,মাখতে বলে সেরিন। প্রতিত্তোরে তুষি বলে,
“বিয়ের ঢালা। ছেলেদের বাড়ী দিয়ে আসবে।”

“বিয়েটা কার?”

তখন সিহান পাটওয়ারী এসে বলেন,
“সেরিন ব্রেকফাস্ট করে রুমে যাও আমি আসছি। কিছু কথা আছে।”

সেরিনের আর কফিতে চুমুক দেওয়া হলো না। খাওয়া ভেতরে যাচ্ছে না তার। এভাবে হুটহাট! কার সাথে না কার সাথে। সেরিনের মনে হচ্ছে তার ঢাকা থেকে আসাটাই ভুল হয়েছে। কোনরকম খেয়ে উঠে রুমে চলে যায় সেরিন। সেরিন রুমে প্রবেশ করার পেছন দিয়ে সিহান পাটওয়ারী আসেন। তার দরজায় নক করেন।

কান্না করার সময় কারোর ডিস্টার্ব সেরিনের পছন্দ না। তবে দরজা তো খোলতেই হবে। মনে হচ্ছে কান্নাটা এই অসময়ে না আসলেই হতো। মনে,মনে শুভ্রকে বকছে তো সাথে নিজেকেও। তার উপর যে ডিস্টার্ব করছে তার উপর ও বিরক্ত আসলো। সেরিনের মনে হচ্ছে তাকে কেউ শান্তি দিবে না। চোখ মুছে দরজা খুলে দেয় সেরিন। তখন সিহান পাটওয়ারী ভেতরে প্রবেশ করেন। সোফায় বসতে,বসতে বলেন,
“আগামী কালকে তোমার বিয়ে। তবে পরিকল্পনা আরো একসপ্তাহ আগে থেকেই। ডেট ও ফিক্সড তোমাকে জানানো বাকী ছিলো আরকী। একটু পর তোমার যদি কোন শপিং বাদ থাকে তাহলে কুমিল্লায় যাবে। রেডি হয়ে নিও। সন্ধ্যায় হলুদ/মেহেদী করা হবে।”

সিহান পাটওয়ারীর কথায় সেরিনের জন্য চোখে বৃষ্টি ঝড়ছে। সে বিয়ে করবে না। আর কাকে করবে? বলা নেই কওয়া নেই। সেরিন নিজেকে যথাসাধ্য শক্ত রেখে বলে,

“হঠাত বিয়ে? আর কার সাথে না কার সাথে হচ্ছে। আমি এভাবে বিয়ে করতে পারবো না বাবা।”

“আমরা সবাই ছেলে দেখে রেখেছি। আর আমার উপর বিশ্বাস রাখো।”

“কিন্তু….!”

“আমি জানি আমার মেয়ের পছন্দ অপছন্দ। সো সেভাবেই সব হবে।”

“বাবা।”

“ভরসা রাখো।”

সিহান পাটওয়ারী বেড়িয়ে যান।
মাহী বাজার থেকে কয়েক ব্যাগ ফুল কিনে আনে। তাছাড়া আগামী কালকে চৌধুরী পরিবারকে সুন্দর ভাবে ওয়েলকাম করার জন্যও কিছু ডেইজি ফ্লাওয়ার,কিছু ভিন্ন কালারের রোজ আনে। সেগুলো ভিন্ন,ভিন্ন ভাবে প্যাক করা। যাতে দু’টো ডেইজি ফুল আর একটা গোলাপ ফুল সবার হাতে,হাতে যায়।

সাফা,রাফা, মেহের তারা হাল্কা খাবার খেয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শশী আর মেহের যায় গার্ডেনে। হোয়াইট কালারের দেওয়ালের সামনে ছোট,ছোট ঘাস সেখানে জায়গা স্থির করে মেহেদীর আর হলুদের জন্য ডেকোরেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তুষি পিঠা ঢালায় নিয়ে সেটা সাজায়। দু’টো ঢালায় পিঠা নেওয়া হতে রাফা সেটা প্যাক করে নেয়।
অতঃপর তারা তিনজন রেডি হয়ে নেয়। শশী আর্থকে মেসেজ দিয়ে জানায় তারা আসবে।

সাফা সেরিনের রুমে যেতে দেখে সে কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলছে। সাফা তাকে বলে,
“বোকা মেয়ে এতো কান্না করছো কেন?”

‘এই আমার বিয়েটা কোন জায়েদ খানের সাথে দিচ্ছে?”

“আরে জিজু জায়েদ খান না তোমার পছন্দের হিরোর মতো।”

“আমি তাকে দেখতে চাই।”

“আমার কাছে তো পিক নেই। তবে ওনাদের পরিবার চৌধুরী পরিবার।”

“ইয়া আল্লাহ কোন চৌধুরী এসে জানি কপালে জুটে।”

সাফা যেতে সেরিন শুভ্রকে মেসেঞ্জারে কল লাগায়। কয়েকবার রিং হতে রিসিভ হয়। সেরিন নিজের কান্না আটকে রাখতে না পেরে কেঁদেই দেয়। শুভ্র সেরিনের কান্নার আওয়াজ শুনে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সেরিনের কান্না শেষ হতে বলে,
“আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আপনি কিছু করুন না।”

“আমি একটু ব্যস্ত আছি।”

“তোর বা’লের ব্যস্ততা পকেটে ঢুকা। তুই আসবি কীনা বল? না আসলে আমি নিজে চলে আসছি তোর বাড়ীতে।”

“আল্লাহ কী বলে এই মেয়ে? এই কথায়,কথায় বা’ল কী হ্যাঁ?”

শুভ্র কিছুটা ধমকে বলে। সেরিন চুপসে গিয়ে বলে,
“আর বলবো না।”

“দেখো আমি আসতাম। কিন্তু তুমি যা গা’লি দেও তোমায় বিয়ে করলে আমার বাচ্চারাও এমন গা’লি দিবে। আর শুভ্রর বাচ্চা শুভ্রর মতো ভদ্র হওয়া চাই। সেজন্য বাবুর আম্মু তুমি না ভদ্র-সভ্য কোন মেয়েই হবে।”

” আর গালি দেবো না। আমি ভালো হয়ে যাবো। তাহলে বাবুরাও আর গা’লি দিবে না।”

“তোমাকে বিশ্বাস নেই। পান থেকে চুন খসলে তুমি গা’লি দেও। আমি তোমার টিচার সবাই আমাকে ভয় পায় অথচ তুমি একমাত্র মেয়ে যে কীনা আমায় ভয় তো দূরে থাক তুই তোকারী করো।”

“আর করবো না।”

“সবসময়ই তুমি আর করবো না,বলবো না বলো। পরে ঠিকই যেই সেই।”

“আপনি আমায় বেশী মাথায় তুলে ফেলেছেন।”

“তোলা লাগে নাকী? তুমি যেই মেয়ে নিজেই মাথায় উঠে যাও।”

“এই সত্যি আমি চলে আসবো কিন্তু।”

“এসেও লাভ নেই সোনা। আমি আমার বিয়ের শপিংয়ের জন্য বেড়িয়েছি পরিবারের সাথে। তুমি সুন্দর ভাবে বিয়েটা করে নেও। একবারে লক্ষী মেয়ের মতো। একদম কান্না কাটি করবে না। আর বিয়েতে কী গিফ্ট লাগবে বলো? আমি তোমায় সেই গিফ্টটই দেবো। তবুও আমার জন্য কেঁদো না।”

“কিছু চাই না আমার। আমার আপনাকে চাই।”

“আমি তো আরেকজনের জন্য ফিক্সড। বললাম না আম্মু ওইদিন রিং পড়িয়ে আকদ অর্ধেক সেরে নিয়েছে।”

“বাবু হলে কিন্তু কোলে নিতে দেবো না।”

নাক টেনে কথাটা বলে সেরিন। শুভ্রর হাসি পাচ্ছে। এই মেয়ের মাথা থেকে এখনো বাবুর ভূত নামেনি। শুভ্র হাসি থামিয়ে কঠোর গলায় বলে,
“তোমার বাবু আমি কোলে নিতে যাবো ও না। আচ্ছা বলো তো আমার বউকে কী গিফ্ট দেওয়া যায়?”

“জানি না।”

“তাহলে কাঁদুনি কাঁদতে থাকো। আল্লাহ হাফেজ।”

শুভ্র কল কেটে দিতে সেরিন মেসেজ দেয়। মেসেজ ডেলিভারিড হলোও সীন হয়নি। শুভ্র সেরিনকে রেস্ট্রিকশনে ফেলে রেখেছে। সেরিন আর উপায় দেখছে না। শুভ্রর উপর রাগ হলেও সে নিজেকে শক্ত করে নেয়। বিয়েটা হাসিখুশি ভাবেই করবে সে। দরকার হলে হাসি না আসলেও জোর করে হাসি আনবে। সেইসব হলুদের ভিডিও আপ দিয়ে শুভ্রকেও দেখাবে বিয়েতে সে কতটা খুশি ছিলো। ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে শশীদের কাছে যায় সেরিন। তারা প্রায় রেডি। মাহী এসে ঢালা গুলো গাড়ীতে নিয়ে যায়। সেরিন শশীকে চুপিচুপি বলে,
“প্লিজ আমার বরের একটা পিক তুলে আনিস।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

তারা তিনজন মাহী সহ বেড়িয়ে পড়ে। শুভ্রদের বাড়ী থেকে সেরিনদের বাড়ীর ব্যবধান মাত্র ত্রিশ টাকার ভাড়া। ওতোটাও কাছে না আবার দূরেও না। মাহী গাড়ী ড্রাইভ করছে। তার পাশে সাফা বসা। পেছনে রাফা আর শশী। তারা ফোন নিয়ে ব্যস্ত।

চৌধুরী বাড়ীর গেট দিয়ে গাড়ী প্রবেশ করে। তখন আর্থ আসে। মাহীর সাথে হ্যান্ডশেক করে। আর্থ তার শালিকা সাফা,রাফার সাথে হায় হ্যালো দেয়। অতঃপর সার্ভেন্ট দিয়ে ঢালা ভেতরে পাঠানো হয়। শশী মেহেদীর ঢালা যেটা ফুল দিয়ে সাজানো। সেটা নেয়। রাফা চকলেটের ঢালা। আর সাফা ফুলভর্তি ঢালাটা নেয়।

ভেতরে যেতে তাঁদেরকে ওয়েলকাম ড্রিংস দেওয়া হয়। সেই সাথে কিছু ফ্লাওয়ার্স। হালকা নাস্তা করে। শুভ্র আর আয়মান চৌধুরী কুমিল্লায় গেছে। তাই দেখা হয়নি তাদের। একটু আধটু দুষ্টুমি করে শশী আর্থর সাথে বাইরে আসে। আর্থর আইফোন দিয়ে তাঁদের বাড়ীর বাগান বিলাসের সাথে কিছু পিকচার তুলে নেয়। ঢালার সাথে তোলা পিক বাগান বিলাসের পিক আপ দিয়ে দেয়। সে জানে সেরিন দেখলেও বাড়ীটা চিনতে পারবে না। কারণ কখনো আসেনি এই বাড়ীতে।

চৌধুরী বাড়ী থেকে তারা সবাই আসার পেছন দিয়ে সেরিনের জন্য ঢালা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। অধরা এসেছে সকালে তার মেঝো আম্মুদের সাথে। আদ্রিতা আর অধরা গাড়ীতে বসে। ড্রাইভার তাঁদের পাটওয়ারী বাড়ীতে দিয়ে আসবে।

শুভ্ররা গতকাল সেরিনের আর পাটওয়ারী বাড়ীর সদস্যদের জন্য শপিং করলেও আজকে চৌধুরী ফ্যামিলির জন্য। তড়িঘড়ি ঢালা প্যাক করা যদিও হয়ে গেছে। সুলতানা খানম, আর্থ, আদ্রিতা, আয়মান চৌধুরী মিলে করেছে। জান্নাতুল ফেরদৌস এসবের আশেপাশে ও ঘেঁষেননি। আর্থর মতে বেচারির আংটি খোয়া গেছে সেই শোক করছে।

পাটওয়ারী বাড়ীতে আসতে তাদের তিনজনকে ওয়েলকাম ড্রিং দেওয়া হয়। সুন্দর ভাবেই আপ্পায়ন করা হয়। সেরিনের রুমে নিয়ে ঢালা গুলো রাখা হয়। বাকীরা কাজে ব্যস্ত হলেও সেরিন মন খারাপ করে নেই। সে ঢালার ভিডু নিয়ে ডে দিচ্ছে। শুভ্র সীন করার আশায় প্রহর গুনছে সে। সেরিন কতটা হ্যাপি সেটা দেখানো ট্রাই করছে। কিন্তু শুভ্র যেই ব্যস্ত মানব সীন করে কীনা সন্দেহ।
সেরিনের কিছু কেনাকাটা ছিলো। তবে বিয়েটা যেহেতু ঘরোয়া ভাবে হচ্ছে বেশী দরকার নেই। এবারের মতো সাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে।

মাহী, তাঁদের লিভিং রুমের এক পাশটায় কিনে আনা; বিভিন্ন কালারের পাতলা পর্দা দিয়ে, সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাড়ী জুড়ে ফুলের সুভাসের আনাগোনা। সেরিনের রুমেও কিছু ফ্লাওয়ার্স রাখা হয়। তবে বেশীর ভাগ রজনীগন্ধা আর গোলাপ।

সাফা, রাফা সেরিনের জন্য ফুলের গহনা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গাদা ফুলের সাথে সাদা ফুল দিয়ে। ইয়াররিং আর টিকলি বানায়। আর ওদের জন্য খোঁপায় দেওয়ার জন্য মালা। অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা কমপ্লিট হয়ে যায়।

প্রায় তিনটার দিকে শাওয়ার নিয়ে বাগানের কাছে আসে শশী আর মেহের। মাহীকে বলে বাজার থেকে আনা হলুদ পাতলা ওরনা গুলো টানিয়ে দেওয়া হয়। দুই পাশে হলুদের লম্বা, লম্বা মালা গুলো জুলিয়ে দেওয়া হয়। একবার সিম্পল ডেকোরেশন। তবে থিমের সাথে মিল রেখে ছোট্ট, ছোট্ট ভাজের ভেতর হলুদ গোলাপ রাখা হয়। তাঁদের হলুদ শেষ হলে এগুলো সব ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে।

পাঁচ জন মিলে হাত লাগায় সেজন্য ঘন্টার মধ্যে তাঁদের ডেকোরেশনের কাজ কমপ্লিট হয়ে যায়। সেরিন অলরেডি সাজতে বসে গেছে।

তাঁদের কারোরই বেশীক্ষণ সময় লাগেনি। একজন আরেক জনকে হেল্প করায় তাড়াতাড়ি সাজা,রেডি হওয়া কমপ্লিট হয়ে গেছে।

তুষি,সাইয়ারা,সাহিনূর পাটওয়ারী তারা ফল,পিঠা হাল্কা কিছু সেখানে রাখে। যেহেতু তারা তারাই ওতো বেশী কিছু রাখার প্রয়োজন মনে করেনি।

পড়ন্ত বিকেলে সবাই মিলে বসে। প্রথমে ফটোশুট করে নেয় সবাই। কিছু ভিডিও! সেরিন দাঁড়িয়ে নাচে। তাঁদের সুন্দর মূহুর্তের ভিডিও ক্যাপচার করে নেয়। সিহান পাটওয়ারী, কিরণ পাটওয়ারী তারাও আছে। অক্ষর সন্ধ্যায় আসবে জানায়। কেউই বেশী মাথায় নেয়নি ব্যপারটা। তারা তাঁদের মতো ব্যস্ত। মাগরিবের আগে তারা অনুষ্ঠান শেষ করে নেয়। রাতে মেহেদী দিতে বসবে ওতো প্যারা নেই।

শুভ্র কুমিল্লা থেকে ফিরে দুপুরের দিকে। সন্ধ্যায় তারা ও ছোটোখাটো কিছু করবে। সেজন্য কেক,ফুল আনে। বিকেলের দিকে বিশাল ড্রয়িং রুমের একটা কোণ আর্থ,আদ্রিতা,অধরা মিলে ডেকোরেশন করে নেয়। শুভ্র বসে,বসে সেরিনের দেওয়া ডে গুলো দেখছে। গতকাল রাতের কেকের ডে থেকে শুরু করে ঢালার,এমনকি হলুদের পিক,ভিডিও আপলোড দেওয়া শেষ। শুভ্র ডে দেখে আইডি স্টক করে। হলুদের পিক গুলো খুটিয়ে,খুটিয়ে দেখে। মেয়েটাকে মাশাল্লাহ ভীষণ সুন্দর লাগছে। শুভ্র দেখেই ‘মাশাল্লাহ’ বলে। বিশেষ করে কমেন্টস গুলো পড়ে। বেশীরভাগ সৌন্দর্যের প্রশংসা করলেও অনেকের মন ভেঙে গেছে। শুভ্র সেসব কমেন্টস গুলো চেক দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। সোজা মেসেন্জারের ঢুকে মেসেজ চেক দেয়। সেরিন বেশী মেসেজ দেয়নি। তবে কমও দেয়নি। বেশীরভাগ তুই তোকারী করে দেওয়া মেসেজ। একটা মেসেজ বেশী হাসি পায় সেটা হলো, “এখন এমন ভাব দেখিয়ে ইগনোর করেন। যখন সত্যি অন্য কারোর হয়ে যাবো তখন নদীতে ঝাপ দিলে, ফ্লোরে শুয়ে গড়াগড়ি খেলে, দেওয়ালে মাথা ঠুকলেও কোন কাজ হবে না। ( ভদ্র মেয়ে দেখে গালিটা অপশনাল রাখলাম)।”

#চলবে

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং 🖤)

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৪|
#শার্লিন_হাসান

💞(বিয়ে স্পেশাল)💞

“এখন এমন ভাব দেখিয়ে ইগনোর করেন। যখন সত্যি অন্য কারোর হয়ে যাবো তখন নদীতে ঝাপ দিলে, ফ্লোরে শুয়ে গড়াগড়ি খেলে, দেওয়ালে মাথা ঠুকলেও কোন কাজ হবে না। ( ভদ্র মেয়ে দেখে গালিটা অপশনাল রাখলাম)।”

শুভ্র মুচকি হেসে অফলাইনে চলে আসে। এদিকটা সামলানোর কাজে ব্যস্ত সবাই। শুভ্রর এতো ব্যস্ততার ভীড়ে ভুলেই গেছে তার মায়ের ক’বর টা যিয়ারত করা হয়নি। শুভ্র তার মায়ের চেহারাটা মনে করে। বেলকনিতে আসে শুভ্র। তার মায়ের ক’বরটা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। মনে,মনে শুধায়, “আম্মু তোমার শুভ্র নতুন জীবনের সূচনা হতে যাচ্ছে। ওপার থেকে দেখছো তো সব? জানো তো মেয়েটা ভীষণ চঞ্চল। তার কাজকর্মে একদম আমার মন খারাপ হতে দিবে না। হ্যাঁ আম্মু তোমার শুভ্রকে মেয়েটা ভালোবাসে। পাগলামী করে। ইশশ তুমি থাকলে দেখতে কীভাবে তোমায় ও মাতিয়ে রাখতো। ভীষণ আদুরে মেয়েটা। বকা দিলে চুপসে গিয়ে স্বীকারোক্তি দেয়, ‘আর করবো না,বলবো না।’ মাফ করলে সেই আগের মতোই। মেয়েটার চঞ্চলতা সবসময় তার চোখে,মুখে ব্যক্তিত্বে লেগে থাকুক। এই চঞ্চলতায় কখনো গম্ভীরতায় রুপান্তরিত না হোক।”

আদ্রিতার ডাকে শুভ্র রুমে যায়। শুভ্রকে বলা হয়েছে রেডি হতো। একটু কেক কাটবে,পিকচার নিবে ব্যাস!

সেরিন শশীকে জিজ্ঞেস করছে তার বরের পিক তুলে আনেনি কেনো? শশী সুন্দর ভাবে বলে দিয়েছে বর শপিং করার জন্য কুমিল্লা গেছে। সেরিনের খটকা লাগে। কারণ তখন শুভ্র ও কুমিল্লায় গেছে শপিং করতে। তাও তার বিয়ের জন্য! আবার শুভ্রদের ও চৌধুরী পরিবার। দু’টো জিনিস মিল পেলেও বাকী কিছুই তো পাচ্ছে না। সেরিন জানে সে চালাক কিন্তু আজকাল চালাকি কাজে লাগছে না। এই তো চালাকী করে বলতো সে সিঙ্গেল, প্রেম ভালোবাসা,বফ এসব তার ভাগ্যে নেই। কিন্তু সেই একজনের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে একবারে তলিয়ে গেছে। শশীকেও বুঝতে দেয়নি সে যে শুভ্রর উপর ফিদা বা তাঁদের কথা হতো। তার মতে ভালোবাসা গোপনে সুন্দর। ভীষণ গোপনে। তবে চিঠি দেওয়ার ব্যপারটা অনেক ভেবে চিন্তে মাথায় আনে। এমনকি তার ফ্রেন্ড নিশাতকেও জানতে দেয়নি। সে যেদিন কলেজে পা রাখে সেদিন শুভ্রর এট্টিটিউড, রুলস,ব্যক্তিত্ব নিয়ে শুনেছে। কয়েকদিন যেতে সে উপলব্ধি করেছে। এই সেই শুভ্র যে চার তলায় বসে এক চিৎকার দিবে পুরো ক্যাম্পাস কাঁপানোর মতো। সে যা বলে তাই!পিটিতে দাঁড়িয়ে তার দেওয়া ভাষণ গুলো প্রথমে শোনলেও পরে বিরক্তি চলে আসে। কিন্তু এটা নিয়ে সিনিয়ররাও বিরক্ত। রোদের মধ্যে বসিয়ে ভাষণ দেওয়া। অনেক ভেবেচিন্তে সেরিন সিদ্ধান্ত নেয় চিঠি আদানপ্রদান করবে। প্রথম চিঠিটা লিখে ধরা খেলেও ঘাবড়ে যায়নি সেরিন। কারণ সেদিন স্বীকারোক্তি দিলে শুভ্র তাকে থা’প্পড় দিয়ে কালা বানিয়ে দিতো এটা শিওর। তাই তো দ্বিতীয় চিঠিটা একটু গড়মিল করে শুভ্রর সন্দেহে গড়মিল করে দেয়। নিজের ভাবনায় নিজে হাসে। কী লাভ হলো এতোকিছু করে? সেই তো পরিবারের পছন্দে কাকে না কাকে বিয়ে করতে হচ্ছে। তবে সেরিনের সন্দেহ হয় এটা শুভ্র হয়ত বা!

সন্ধ্যায় অক্ষর আসে। সেরিনের সাথে টুকটাক কথা বলে। বিয়েটা হুট করে হলেও সেরিন খুশি। অক্ষর আর তেমন কিছুই বলেনি।

সন্ধ্যা পেরিয়ে যায় মাহী,অক্ষর,রাফা মিলে ভেতরে মেহেদীতে বসার জন্য জায়গা ঠিক করে। ছোট্ট করে ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করে। টাইলসের উপর বিছানার মতো করে নেয়। কুশন, ভাজের মধ্যে গোলাপ, বিভিন্ন রকমের ফুল, ঢালা ভর্তি মেহেদী,ফুল,কেক এসব দিয়ে সাজানো হয়।

সেরিন অফ হোয়াইট কালারের গাউন পড়েছে। বাকীরা গাঢ় (Moss) কালারের কুর্তি পড়েছে। সেরিনের আম্মু,কাকীমা আর ফুফি তারা গ্রীন কালারের শাড়ী। ছেলেরা মেরুন কালারের পাঞ্জাবি।

সেরিন নিশাতকে ভিডিও কল দেয়। আসার পর তাঁদের দেখা হয়নি তবে মাহীর থেকে জেনেছে নিশাত কুমিল্লায় নেই। সে ঢাকায় গিয়েছে আর এখন আসা পসিবল না। তবে যখন বিয়েতে বড় করে অনুষ্ঠান হবে তখন থাকবে। নিশাত সেরিনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে। প্রায় নয়টা বেজে যায় তাঁদের মেহেদীতে বসতে,বসতে। প্রথমে পিক,ভিডিও করে তারপর কেক কাটে। এভাবে অনেক্ক্ষণ আড্ডা দিয়ে এগারোটার দিকে মেহেদী দিতে বসে তারা। শশী,রাফা,সাফা,মেহের তারা সবাই সুন্দর ব্রাইডাল মেহেদী দিয়ে দিতে পারে। শশী আর মেহের সেরিনকে মেহেদী দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাফা আর সাফা দু’জনে তুষি আর সাইয়ারাকে দিয়ে দেয় মেহেদী।

মাহী সাইডে এসে ভিডিও কল করে শুভ্রকে। তারাও ছোটখাটো ভাবে অনুষ্ঠান করেছে। যদিও শুভ্র মেহেদী পড়বে না। তার বোনেরা আর মায়েরা পড়বে। সে কেক টেক কেটে সোফায় বসে আছে। আর্থ সহ মাহীর সাথে কথা বলছে। একপর্যায়ে আর্থ বলে,
“ভাবীকে দেখাও তো। আমার ভাই লজ্জায় বলতে পারছে না। যতই হোক স্টুডেন্ট বলে কথা।”

“তোর আমাকে নিয়ে বাড়িয়ে এক লাইন না বললে হয়না? কিসের স্টুডেন্ট হ্যাঁ? ও আমার কলেজে পড়াশোনা করে না। এখন ও আমার উডবি। আর ওকে আমি দেখেছি। যেই মেয়ে খাবার খেতে লেট হতে পারে বাট ফেসবুকে পিক আপ দিতে লেট হবে না।”

শুভ্রর কথায় মাহী শুধায়,
“তোহ দিবে না? আগামীতে আমার বোন সেলিব্রিটি হবে।”
মাহী ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে সেরিনকে দেখায়। তাঁদের মেহেদী পড়ার কিছু ভিডিও নিয়ে শুভ্রকে দেয়। এছাড়া সেরিনের মেহেদী নাইটে তোলা পিকচার সবই এখন শুভ্রর কাছে আছে।

আর্থ শশীকে দেখছে। মেয়েটা সেজেছে। পিক দিয়েছে আর্থকে। আজকাল বোনের বিয়ের ব্যস্ততার জন্য আর্থকে চিনে না শশী। এই নিয়ে কিঞ্চিৎ অভিমান জমেছে। তবে এখন প্রকাশ করবে না সে। একটু ব্যস্ততা কমুক তারপর।

আদ্রিতা,অধরা, সুলতানা খানম এবং মিরা তারা মেহেদী লাগাচ্ছে। আর্থ ও তাঁদের পাশে বসে আছে। শুভ্র উপরে সোফায় বসা। আয়মান চৌধুরী ও আছে। জান্নাতুল ফেরদৌস রাতের খাবার নিয়ে তদারকি করছেন। সেদিনের মতো তিনি খাবার সাইড করে ঢেকে রাখেন।

হাতের কাজ শেষ করে তিনি নিজেও মেহেদী লাগানোর জন্য বসে পড়েন। আর্থ শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ছক্কা তো তুমি মারছো ভাই। তোমার বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা নেই। বিয়ে করবা না। শেষ! আকদ আগে আমার হলো আর বিয়েটা তুমি করে নিচ্ছো।”

“ছোটরা পরের ধাপে। আগে তোর বিয়েটা হলে মানুষ নিশ্চয়ই বলতো তোর তর সয় না। চৌধুরী বাড়ীর ছেলেরা একটু রয়ে-সয়ে বিয়ে করে বুঝলি।”

” হুম বুঝেছি। সেজন্য তোমারও উচিত ছিলো একটা বছর পর ভাবী যখন মাধ্যমিক পাশ করতো তখন বিয়েটা করার।”

শুভ্র আশেপাশে তাকিয়ে মাথা চুলকায়। আর্থ মানেই তার সন্মান শেষ। আরফিন চৌধুরী, আরাফ চৌধুরী, আয়মান চৌধুরী, আর্থ,শুভ্র তারা রাতের ডিনার করে নেয়। বাকীরা পরে খাবে তাঁদের মেহেদী লাগানো শেষ হলে।

সিহান পাটওয়ারী নিজে ভাত মাখিয়ে সেরিনকে খাইয়ে দিচ্ছেন। তার বড্ড আদরের মেয়ে। আগামী কালকে নতুন অধ্যায় শুরু করবে। শশী সেরিন দু’জনই বেশী আদরের। মাহিকে নিয়ে তাঁদের ওতো মাথা ব্যথা নেই তাঁদের পরিবারে মেয়েদের প্রায়োরিটি আগে।

বাবার হাতে আরাম করেই ভাত খাচ্ছে সেরিন। বড্ড মন খারাপ তার। এখন যেমন বিয়ে হলে কেমন পরপর লাগবে। যতই আগলে রাখুক তখন নতুন পরিচয় হয়ে যাবে। ছোট বেলা থেকে যেই ঠিকানায় বেড়ে উঠা, যেই বাড়ীটাকে নিজের বাড়ী বলে দাবি করতো সেটা এখন থেকে ‘বাবার বাড়ী’ বলে সম্মোধন করা হবে। আর বরের বাড়ীকে ‘শ্বশুর বাড়ী’। নিজের চেনাজানা রুমটাকে নিজের বলে দাবি করতেও ইতস্তবোধ হবে। আসলে মেয়েদের নিজেস্ব কোন বাড়ী হয়না। তবে তাদের ছাড়া বাড়ী পরিপূর্ণ ও হয়না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যতই আদরের রাজকন্যা হোক একদিন বিদায় নিয়ে পরের ঘরে যেতেই হবে।

বাবা মেয়ের কান্ড দেখছে বাকীরা। শশী খাবারের প্লেট এনে সিহান পাটওয়ারীকে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“বড় বাবা সেরিনের খাওয়া শেষ এখন আমায় খাইয়ে দাও।”

“হ্যাঁ অবশ্যই।”

সিহান পাটওয়ারী শশীকেও খাইয়ে দেন। তাদের আড্ডা খুনসুটিতে সময় কাটলেও বাকীরা একটু ব্যস্ত আগামী কালকের জন্য। সেরিন বসে,বসে আফসোস করছে ইশশ যদি তার বরের নাম্বার থাকতো তো আড্ডা দিতে পারতো।

***********

পরের দিন শুভ্র শুভ্র কালারের পাঞ্জাবি পড়ে,মাথায় টুপি দিয়ে রেডি হয়ে নেয়। নামাজ আদায় করে তার আম্মুর কব’র যিয়ারত করে নেয়। নির্দিষ্ট সময় তারা বেড়িয়ে পড়ে পাটওয়ারী বাড়ীর উদ্দেশ্য।

লিভিং রুমের এক কোণে সাদা বেলীফুলের মালা সাথে গোলাপ ফুল দিয়ে পর্দার মতো টানানো হয়। দুই পাশে দু’টো সোফা রাখা হয়। ফুলগুলো অনেকটা ঘন করে লাগানো হয় যাতে এই পাশ থেকে ওই পাশের ব্যক্তিকে তেমন একটা বোঝা না যায়।

সেরিনকে রেডি করানো হয়। বেবি পিংক কালারের কাতান শাড়ীতে সাজানো হয়। চুলগুলো খোঁপা করে তাতে গাজরা,গোলাপ ফুল লাগানো হয়। সিম্পলের মধ্যে একটা ডায়মন্ডের নেকলেস,টিকলি,কানে দুল। মেকআপ নাই বললে চলে। মেহেদী রাঙা হাতের মুঠো ভর্তি চুড়ি। দোপাট্টা বেঁধে দেওয়ায় হয়। সেরিন নিজের রুমেই পিকচার তুলে নেয়। আয়নায় নিজেকে দেখে। আজকে এতো সিম্পল লুকে তাকে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশীই সুন্দর লাগছে।

সেরিনকে রুমে বসিয়ে দিয়ে তার বোনেরা যায় মেইন দরজার সামনে। চৌধুরী পরিবার চলে এসেছে। সবাইকে ওয়েলকাম করা হচ্ছে তাদের হাতে ফুলের ছোট্টো তোড়া দিয়ে। তবে শুভ্রর জন্য বড় ফুলের তোড়া রাখা হয়। সবাই ভেতরে যেতে সবার লাস্টে শুভ্রর প্রবেশ সাথে আছে আর্থ, আদ্রিতা,অধরা। তার শালিকা মহল তাকে চেপে ধরেছে টাকার জন্য। শুভ্রও খোঁচাখুঁচি করে না। যা চেয়েছে তাই দিয়ে দিয়েছে। তবে সামনে আরো বেশী দিতে হবে এটা সে জানে। শুভ্রকে ভেতরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেওয়া হয়। ওপর পাশে কনে বসবে আর হাতের ডান সাইডের সোফায় কাজী সাথে ছেলের বাবা বসবে।

সবাইকে কোল্ড ড্রিং দেওয়া হয়। শশী,মেহের তারা গিয়ে সেরিনকে নিয়ে আসে। সেরিন মাথা নিচু করেই আসে। সোফায় বসানো হলে তার পাশে শশী আর রাফা বসে। শুভ্র সামনে টানানো পর্দার ফাঁক দিয়ে সেরিনের অবয়ব দেখার চেষ্টা করছে। তখন আবার আর্থ তার পিঠে চাপড় মারে। শুভ্র নড়েও না চড়েও না একবারে ভদ্র ছেলে। কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে। বিয়ে পড়ানোর সময় পিতা আরফিন চৌধুরী শুভ এবং মাতা তেহেজিব তটিনীর একমাত্র ছেলে আরজিন চৌধুরী শুভ্র’ সেরিনের বুঝতে বাকী নেই শুভ্র সাহেবের সাথেই সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে। তবে বেশী এক্সপ্রেশন দিতে না পারলেও মনে,মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়েছে সেই সাথে শুকরিয়া আদায় করেছে সেরিন। কাজীর কবুল বলা তার মুখে লেগে থাকতে,থাকতে সেরিন তিনবার কবুল পড়ে নেয়। শুভ্র বুঝে না মেয়েটার ধৈর্য কম নাকী তাড়া বেশী? তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হতে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। অতঃপর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দু’টো সোফা সামনে আনা হয়। ফুলের পর্দাটা আর্থ আর শশী দুইজনে সরিয়ে নেয়। শুভ্র সেরিনের ইয়া বড় দোপাট্টা সরিয়ে তার মুখখানা দেখে। মাশাল্লাহ বলতে ভুলেনি শুভ্র। সেরিনও পলক ফেলে শুভ্রকে দেখে মুচকি হাসে। সেরিনের বিশ্বাস হচ্ছে না মানুষটা তার! তাদের দেখাদেখি শেষ হতে শুভ্রকে সেরিনের বসে থাকা সোফায় বসানো হয়। আয়না দু’জনের হাতে দেওয়া হয়। তখন শশী সেরিনকে বলে,
“বনু আয়নায় কী দেখছো?”

“সুন্দর একটা পরী পাশে তার জ্বীনকে নিয়ে বসে আছে।”

বাকীরা সেরিনের কথায় হেঁসে দেয়। শুভ্র নিজেও হাসে। তার নামটাও না! আরজিন মানে জিন শব্দটার সংমিশ্রণ। তখন আর্থ বলে,
“ভাবী এবার সিরিয়াস ভাবে বলো তো? ”

সেরিন মুচকি হেঁসে বলে,
“কঠোর ব্যক্তিত্বের সুন্দর মনের মানুষটা।”
তখন শুভ্রকে মেহের বলে,

‘জিজু তুমি কী দেখো আয়নায়?”
তখন শুভ্র মুচকি হেসে আয়নায় সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আকাশ থেকে নেমে আসা চঞ্চল পরীটা আমার অর্ধাঙ্গিনী।”

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-২১+২২

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২১|
#শার্লিন_হাসান

হুম! একজনের প্রেমেই ভালো ভাবে পড়লাম। চঞ্চল মেয়েটার এতো গুণ এতো বুদ্ধি কোথা থেকে আসলো? যাই হোক তুমি পাশ করেছো।”

“ইয়ে না মানে বাবুর আব্বু এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”

শুভ্র হাসে। তার হাসিটা স্নিগ্ধ লাগছে। মনে হয় সে প্রচুর খুশি। একহাতে আজকের চিঠিগুলো নেয় শুভ্র। দু’টো চিঠি এসেছে। একটর উপর অভিমান বার্তা লেখা শুভ্র সেটাই আগে খুলে দেখলো।
চিঠিটা,
অভিমান বার্তা:
‘বাবু আব্বু’
জানেন? বাবুর আম্মু মানে আমি একটা হার্টলেস মেয়ে মানুষ। সহজে কাউকে মনে বসাই না। যদি বলে ছেলে মানুষদের ইগনোরের কথা আমার মনে হয় আমি প্রথম হবো। না কোন ছেলে ফ্রেন্ড আছে, না ছেলে কাজিনের সাথে তেমন ভাব। বাট একজন ছেলে ছিলো যাকে প্রথম বার দেখে আমি তার এট্টিটিউডে ফিদা হয়ে যাই।
তবে অনেকটা এড়িয়ে যেতে চাইতাম। কিন্তু আমি তো তার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছি যেটা থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব না। চেহারা,কথাবার্তা, সৌন্দর্যের প্রেমে পড়লে হয়ত ভুলে থাকা যেতো কারণ তার থেকেও সুন্দর পুরুষ পৃথিবীতে আছে। কিন্তু আমি তো তার ব্যক্তিত্বে ডুবে যাই আর হুট করেই আমি তার মাঝে মজে যাই। তবে আমি তার সবটাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি! তাকে চিঠি দিয়ে চিন্তায় ফেলতে আমার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে!সে ব্যস্ত মানুষ, আমি যে ব্যস্ত নই এমনটাও না। আমার হাজারটা ব্যস্ততা থাকলেও তাকে চিঠি লেখার জন্য সময় আমি বের করি। আচ্ছা সে কেনো বুঝে না আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি? সে আমায় বকা দিক আমি শোনবো তাও ছেড়ে গিয়ে অন্য কারোর কারোর না হোক। কারন, ভালোবাসি তো! সবাইকে ইগনোর করে একমাত্র তাকে নিয়ে বুকে আশা পুষি। চিঠি লিখে তো আর সব বলা যায় না তবুও আমি লিখি। কিন্তু সে বুঝেও না বুঝার মতো করে থাকে। সে আমায় একটুও ভালোবাসে না। আবার ঠিকই কিছু হলে আমায় বকা দিতে আসে। আবার আমার গোপনে আমার ভয়েসের প্রশংসা ও করে! আমি তো সবই জানি! করতে হবে না প্রশংসা। সে আমার কোন কথাই রাখেনা। আমায় একটু প্রায়োরিটি ও দেয়না। ব’দলোক একনাম্বারের। আচ্ছা বলুন তো এতোক্ষণ কাকে এসব বললাম?
হ্যাঁ আপনাকে বলেছি। থাক আর কিছু বলবো না। যাই হোক বাবুর আম্মু অভিমান করেছেএএএএএ……!

শুভ্র চিঠিটা পড়ে হাসে। দ্বিতীয় চিঠিটা বের করে পড়ে সেখানে লেখা,
“আপনায় পাবো না বুঝেছিলাম সেদিন। তাই তো দূরে সরে যাওয়ার জন্য উতালা হয়ে গেলাম। কই আপনি তো ভালোবেসে হাত বাড়িয়ে আমায় আগলে নিলেন না? আপনি আমায় ভালোবাসেন না তাই তো আমায় অনুভব ও করতে পারেন না। যাই হোক আর হয়ত চিঠি আসবে না। ভালোবাসিইইইইইইইই!”

শুভ্র চিঠিগুলো একপাশে রেখে তাকায়। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
“সেরিন তুমি তো চালাকী করলে। আমি তো প্রথমেই বুঝেছিলাম এটা তুমি। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিটায় তুমি আর্থ আর আমায় তালগোল পাকিয়ে লিখেছো। আর হ্যাঁ বললাম না? তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার। যতদূরে সরে যাও রবে আমার।”

সেরিনের কেমন জেনো হাত কাঁপছে। মনে অদ্ভূত ঝড় তুলছে। নিজের ব্যালেন্স রাখতে পারছি না। মনে হয় এক্ষুনি পড়ে যাবে। শুভ্রকে সে ভয় পায়। ভয় পাওয়ারই কথা। ধমকা ধমকি, বদমেজাজি তাকে সব স্টুডেন্ট ভয় পায়। সেখানে সেরিন নগন্য একজন ব্যক্তি। সেরিনের অবস্থা বুঝে শুভ্র বলে,
‘রিলেক্স। এতো ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি ধমকা ধমকি করি ঠিক আছে কিন্তু আমার কঠোরত্বের পেছনে সুন্দর একটা মন ও আছে। বুঝলে? এবার বলো ধরা দিলে না কেনো?”

“আর আমি ধরা দিলে বুঝি আপনার মনে আমায় নিয়ো জায়গা হতো? দু’টো থাপ্পড় দিয়ে তো দেওয়ালে পোস্টার বানিয়ে জুলিয়ে দিতেন।”

সেরিনের কথায় শুভ্র হাসে। পরক্ষণে বলে,
“চলো বাড়ীতে যাওয়া যাক। কেউ দেখলে কিছু বলবে না তবে বা’জে ধারণা পোষণ করবে।”

সেরিন মাথা নাড়ায়। তখন শুভ্র বলে,
” আমি আগে যাচ্ছি তুমি একটু পর আসো। হ্যাঁ আমাদের বাড়ীর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আমি আসবো পাঁচ মিনিটের মধ্যে।”

সেরিন পুনরায় মাথা নাড়ায়। শুভ্র দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। প্রায় আটটা বেজে যাচ্ছে। শুভ্র চৌধুরী বাড়ীর গ্যারেজে যায়। একজন সার্ভেন্টকে বলে তার কারের চাবি আনিয়ে নেয়। সবার কারের শেষের দিকে শুভ্রর কার রাখা। কারণ সে তেমন একটা কার নিয়ে বাইরে যায় না। তার কর্মস্থল যেহেতু তার বাড়ীর সাথেই।

সেরিন চৌধুরী বাড়ীর গেটের সামনে আসতে তখন শুভ্র আসে কার নিয়ে। ডোর খুলে দিতে সেরিন আশেপাশে তাকায়। তখন শুভ্র বলে,
“কেউ কিছু বলবে না। তুমি বোসো না?”

“বাড়ী যেতে হবে তো।”

“সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ম্যানেজ করে দিবো। আমার অনেক কথা আছে তোমার সাথে।”

সেরিন বসতে শুভ্র গাড়ী স্টার্ট দেয়। শুভ্র গাড়ী ড্রাইভ করছে আর বলছে,
“শোনো তোমার লেখা ভীষণ সুন্দর। তবে প্লান টাও নোবেল প্রাপ্ত। মানে কতটা গভীর ভাবে পরিকল্পনা করে কাজটা করা হয়েছে। আচ্ছা তোমার মনে একটু ভয় আসেনি? যদি সিসি ক্যামেরায় আমি তোমায় দেখে নিতাম।”

“দেখলেও চিনতে পারবেন না। আমি মুখ ঢেকেই আসতাম।”

“তোহ আর্থ আর আমায় গুলিয়ে ফেললে কেনো?”

“ইচ্ছে করেই। নাহলে সেরিনের গাড়েই দোষটা পড়তো। নামটা গুলিয়েছি যাতে আপনার ধারণা নড়বড়ে হয়ে যায়। যাই হোক সেরিন পাশ করেছে।”

“পাশ করলে লাভ হবে না। আমার বিয়ে ঠিক।”

“কোথায়?”

“গতকাল মেয়ে দেখতে গিয়েছে পরিবার। আম্মু তো রিং টিং পড়িয়েও ফেলেছে।”

“ওহ! তো আমায় গাড়ীতে বসালেন কেনো?”

“তুমি রেগে যাচ্ছো?”

“কিছু না।”

“যাই হোক তোমায় ধন্যবাদ আমায় নিয়ে এভাবে লেখার জন্য। আসলে মুড অফ থাকলে তোমার লেখা গুলো পড়ে হাসতাম আমি। হ্যাঁ তোমার চঞ্চলতা ঠিক আছে। সবসময় এমন হাসিখুশি থাকো দোয়া করি এজ এ টিচার হিসাবে তোমার বাবুর না হওয়া আব্বু হিসাবে বলো। যাই বলো!”

“শা’লা এমনে,এমনেনি তোরে কই মডুলাস। কত নাটক যে তুই দেখাইলি। এখন আবার নাটক করার জন্য আমায় নিয়ে আসছে। বা’লের প্রশংসা লাগবে না আমার। এই বা’ল বলার জন্য পা’গলের মতো কেউ গাড়ী নিয়ে ছুটে? যাহ বা’ল আজকের দিনটাই খারাপ। সেজন্য ধরা পড়ে গেলাম সেই সাথে ওনার বিয়ের কথাও শোনতে হলো।”

মুখটা বাঁকিয়ে মনে,মনে কথাগুলো বললো সেরিন। শুভ্র সেরিনের ফেসের রিয়েকশন দেখে মুখ টিপে হাসছে। শুভ্র পুনরায় বলে,
“আসলে তুমি অনেক বেশী ছোট একটা মেয়ে। বলা যায় খেলনা দিয়ে খেলার বয়স এখনো পার হয়নি তোমার। আবার কিসের বাবুর আম্মু,আম্মু করছো? লজ্জা-শরম কিছুই অবশিষ্ট নেই তোমার মাঝে।”

“আপনি আমায় জ্ঞান আর অপমান করার জন্য নিয়ে এসেছেন? আসলে আপনি একটা করলার জুশ। প্রতিদিন করলা খান সেজন্য মুখ দিয়ে তেতো কথা ছাড়া কিছুই বের হয়না। গাড়ী থামান আমি নেমে যাবো।”

“তোমার কাছে টাকা নেই যে অন্য গাড়ী দিয়ে যাবে।”

“সেটা আপনায় ভাবতে হবে না। বা’লের ভাষণ দেওয়া আর শেষ হলো না আপনার। একটা কথা মনে রাখবেন আমি সেরিন যদি আপনায় আমার বাবু কোলে নিতে দিয়েছি তো আমার নামটাই পাল্টে দিবেন।”

“তোমার বাবু আমি কোলে নিবো কেন? আমি আমার বউয়ের বাচ্চা বাবুকে কোলে নিবো। আর তোমার কার সাথে না কার সাথে বিয়ে হয়। আমি যাবো নাকী তোমার বাবুকে দেখতে?”

“আপনায় আমি কোলে নিতে দিলে তো নিবেন।”

“তোমার বাবু আমি কোলে নিবো না।”

“গাড়ী থামনননননন!”

শুভ্র গাড়ী থামায় না। সেরিনের জেলার্সি মুখটা দেখছে আর মজা নিচ্ছে শুভ্র। সেরিন বাইরের দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। তখন শুভ্র বলে,

“আল্লাহ আমি স্টুডেন্ট নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছি। আসতাগফিরুল্লাহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এমন বাচ্চা মেয়েকে কেনো যে গাড়ীতে তুললাম।”

সেরিন কিছু বলেনা। শুভ্র তখন সেরিনদের বাড়ীর দিকে গাড়ী ঘুরায়। সেরিনের কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তাকে একটুও প্রায়োরিটি দেয়না। সে যে অভিমান বার্তা দিয়েছে সেটাতেও হেলদোল নেই। শুধু,শুধু সময় আর ঘুম নষ্ট করে এসব লিখলো। তাও গাড়ীতে বসিয়ে কত খোঁটা। সে নাকী বাচ্চা হ্যানত্যান। একটু প্রশংসার জন্য কেউ প্রপোজ করার মতো রিয়েকশন নিয়ে এভাবে গাড়ীতে বসায়? দূর সেরিন করলার জুশ তোর হবে না। তার বিয়ে ঠিক। হুদাই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলি।

শুভ্র পাটওয়ারী বাড়ীর গেটের সামনে গাড়ী থামাতে সেরিন নেমে পড়ে। শুভ্রর সামনে এসে বলে,

“অন্য কাউকে বাবুর আম্মু বানিয়ে দেখিস শুধু। তোর খবর আছে। এই একদম আমি তোকে ভয় পাইনা। প্রথমদিন থেকেও না। আর তোর বা’লের প্রশংসা আমার লাগবে না। এমন কত হাজার প্রশংসা আমার অডিয়েন্স আনায় ডেইলি দেয়। তোর প্রশংসা তোর পকেটে ঢুকা। আগামী কালকে যদি তোর পরিবারকে না পাঠিয়েছিস তো তোকে তোর বাড়ীতে গিয়ে খু’ন করে আসবো। মনে রাখিস শুধু!”

সেরিন থ্রেট দিয়ে ভেতরে চলে যায়। শুভ্র হা হয়ে বসে আছে। সিরিয়াসলি তাকে এভাবে বলতে পারলো সেরিন? তাও তুই তোকারী করে? শুভ্র কী সেরিনকে বেশী মাথায় তুলে ফেলেছে? মেয়েটার কত বড় সাহস হলে তাকে চিঠি দিয়েছিলো আবার আজকে ধরা পড়েছে তাও একটু ভয় পায়নি। কী সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটার আসলেই ভীষণ সাহস! শুভ্র গাড়ী ঘুরিয়ে চৌধুরী বাড়ীতে চলল আসে।

সেরিন নিজের রুমে এসে দরজা অফ করে দেয়। বিরক্ত লাগছে সব কিছু। কেনো যে ধরা পড়ে গেলো। এতোদিন ধরা পড়লো না। ভুল হয়েছে চিঠিটা করিডোরের বেঞ্চের উপর রেখে দিলেই ভালো হতো। অন্তত শুভ্রর মুখে অন্য মেয়ের নামটা শুনতে হতো না।৷ সেরিনের দেখতে ইচ্ছে করছে কে সেই মহীয়সী নারী যে তার বাবুর আব্বুর উপর নজর দিয়ে বসেছে।

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২২|
#শার্লিন_হাসান

কান্না কাটি শেষ করে সেরিন ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসে। চুপচাপ নাস্তা করতে দেখে অনেক বাজার এসেছে। তাঁদের পরিচিত একজন সব বাজার লিভিং রুমের এক কোণে রাখে। মাহী ও পেছন দিয়ে বাজার আনছে। তার কাকীমা তুষি রেডি হয়ে নিয়েছে। তারা কুমিল্লা যাবে। সিহান পাটওয়ারী এবং কিরণ পাটওয়ারী সহ।
সেরিন চুপচাপ নাস্তা খাচ্ছে তখন আবার অক্ষর আসে। সেও সেরিনের সাথেই নাস্তা করতে বসে। কেউ কোন কথা বলেনি। তবে অক্ষরের মনে প্রশ্ন এতো বাজার কিসের? কোন গেস্ট আসবে নাকী?

পরক্ষণে ভাবলো হয়ত তাঁদের পরিবারের জন্যই। তারা তো এভাবেই বাজার করে নেয়। অক্ষর আবার বিকেলে চলে যাবে।

******

সবার সাথে বসে নাস্তা করে শুভ্র। তখন আরফিন চৌধুরী জিজ্ঞেস করেন,

“আর্শিয়াকে তোমার কেমন লাগলো?”

“হুম ভালো। তবে দুইদিন পর আমার বিয়ে পাটওয়ারী বাড়ীতে।”

শুভ্রর কথায় আরফিন চৌধুরী আয়মান চৌধুরীর দিকে তাকান। সেও হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়ায়। আর্থ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খাবার খাচ্ছে। তবে তার বেশ হাসি পাচ্ছে জান্নাতুল ফেরদৌসের জন্য। বেচারির রিংটা খোয়া গেলো মাঝখান দিয়ে। তখন আরফিন চৌধুরী বলেন,
“সবাই রাজী তো?”

“হুম।”

“তাহলে আর কথা নেই। বিয়েটা অনুষ্ঠান করে হবে?”

“না পরিবারের কয়েকজন গিয়েই হবে। খুবই গোপনে। আদ্রিতা তো এসেছে এখন অধরা চাচ্চু,কাকীমাকে বলো চলে আসতে।”

“সে বলা যাবে। এখন সবকিছুর ব্যবস্থা তো করতে হবে।”

“বলছিলাম যে এখানে বিয়েটা না হলে হয়না? আর্শিয়া সেরিনের থেকে কম কোন অংশে?”

মাঝখান দিয়ে কথাটা বলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তখন আরফিন চৌধুরী বলেন,
“কথা মাঝে বা হাত ঢুকানো আমার পছন্দ না। এটা সম্পূর্ণ শুভ্রর ইচ্ছে। বিয়েটা ও করবে তুমি বা আমি না।”

“বাবা তুমি আবার বিয়ে করতে চাইছো?”

মাঝখান দিয়ে আর্থ আবার কথাটা বলে। আরফিন চৌধুরী কটমট চোখে তাকায়। আর্থ হেঁসে দিয়ে বলে,
“না ঠিকই বলেছো। ওনার উচিত হয়নি বা হাত টা ঢুকানো।”

“তোমার ও উচিত হয়নি আমাদের মাঝে নাক গলানোর।”

কঠোর গলায় বলেন আরফিন চৌধুরী। মূহুর্তে থমথমে নিরব পরিবেশ। আদ্রিতা আর্থর দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার ভাইটা একটু বেশী বলে সবসময়। তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে শুভ্র এবং আরফিন চৌধুরীর কথা শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে আদ্রিতা।
তখন মৌনতা বজায় রেখে শুভ্র বলে,
“আজকে সন্ধ্যায় কুমিল্লা যাবো। যা,যা কেনাকাটা আছে করে নেবো। বাকী গুলো আগামী কালকে।”

“তাহলে ঠিক আছে। পাটওয়ারী পরিবার আসবে না বাড়ীতে?”

“আসার আর কী আছে। আমাদের যা কথা হওয়ার আগেই হয়ে গেছে। আর ওনাদের মেয়েকে জায়গা দেওয়ার জন্য রুমের অভাব নেই সো নতুন করে কিছুই দেখার নেই।”

শুভ্রর কথায় সম্মতি দেন আরফিন চৌধুরী। তাদের দলের কয়েক জনকে বলে সবকিছুর বন্দোবস্ত করতে। আরফিন চৌধুরী এসিস্ট্যান্ট সাথে আয়মান চৌধুরী এবং আর্থর ও কয়েকজন বিশ্বস্ত ছেলে তাঁদের ডাকা হয় চৌধুরী বাড়ীতে। কিছু হেল্প লাগবে সেজন্য।

সেদিনের মতো শুভ্র কলেজে চলে যায়। তার রুমে এসে চিঠিগুলো আবার পড়ে আর হাসে শুভ্র। বেচারী সেরিনের অভিমান বার্তায় সায় দেয়নি সে। বাকী কথা পরে বলবে সেজন্য বেশী গুরুত্ব দেয়নি।

*************

শপিং শেষ করে বাড়ী ফিরতে,ফিরতে রাত হয়ে যায়। তবে চৌধুরী পরিবারের গাড়ীর সাথে তাদের গাড়ী জ্যামে দেখা হয়েছে। তার আসছে আর চৌধুরী পরিবার মাত্র যাচ্ছে। সবকিছু তাড়াতাড়ি হচ্ছে বিধায় তেমন একটা উত্তেজনা নেই। বাড়ীর রাস্তায় আসতে তুষি বলে,
“ভাইয়া সেরিন জানে তো ওর বিয়ে?”

“বলবো একটু পর। গিয়ে আগে ফ্রেশ হই।”

বাড়ীতে এসে ফ্রেশ হতে সাইয়ারা কোল্ড ড্রিং দেয়। সেই সাথে খাবার বেড়ে দেয়। শশী শপিং ব্যাগ গুলো সব তাঁদের গেস্ট রুমে নিয়ে রেখেছে। একটু পর দেখবে।

তবে সেরিনকে কিছুই জানানো হয়নি। সিহান পাটওয়ারী বলেনি তাই কারোরই সাহস হয়নি বলার। যদি বকা শোনতে হয়। এই পরিবারের কর্তা সিহান পাটওয়ারী। তার মত আর কথা ছাড়া কিছুই হয়না। আর একবার মত দিয়েছে মানে এটাই হবে। কেউ কিছু বলার ও সাহস করতে পারে না।

শশী লিভিং রুমে এসে বলে,
“আসো না তাড়াতাড়ি আমার ধৈর্য কুলোচ্ছে না।”

“তাহলে তুমি তোমার ফুফিকে আর জেম্মাকে নিয়ে দেখে নেও। তবে সেরিনকে এখন ডেকো না। আমাদের কাজ আছে।”

সিহান পাটওয়ারী বলেন। তখন শশী তার ফুফিকে আর জেম্মাকে টেনে সেই রুমে নিয়ে দরজা অফ করে দেয়।
বিয়ের ব্যপারটা মোটামুটি সবাই জানে। শুধু সেরিন ছাড়া। সাহিনূর পাটওয়ারী কিছু বলতে পারছেন না। সিহান পাটওয়ারীর মুখের উপর কিছু বলার সাহস ও তার নেই। যথেষ্ট শ্রদ্ধা ভক্তি করেন তিনি তার বড় ভাইকে।

চৌধুরী পরিবারের মেয়ে সদস্যদের জন্য শাড়ী, শারোরা কেনা হয়েছে। পুরুষদের জন্য পাঞ্জাবি। যদিও পরে বড় করে অনুষ্ঠান হবে। সেগুলোতে আর হাত দেয়নি শশী। সে হলুদের জামাকাপড় দেখছে। সেরিনের জন্য কাঁচা হলুদ কালারের জর্জেট লং গাউন সাথে সি গ্রীন কালারের জর্জেট ওরনা। স্টোনের কাজ করা সেরিনের জন্য কেনা হয়েছে। শশীর ভীষণ পছন্দ হয় গাউন টা। সেসব রেখে বাকী জামাকাপড় দেখে।তার জন্য সী গ্রীন কালারের শারোরা কেনা হয়েছে। সাফা,রাফা,সেরিনের কাজিন মেহেরের জন্য ও শারোরা। তবে ভিন্ন কালারের।

সবকিছু প্যাক করার জন্য ঢালা ও আনা হয়েছে। একটু পর নাকী রাফা,সাফা আসবে। মেহেরের টা শিওর নেই।
মাহী গিয়েছে হয়ত মেহেরকে আনার জন্য।

শশী সেসব রেখে সেরিনের রুমে যায়। তখন সেরিন ফোনে ব্যস্ত। সে বাইরের দুনিয়ার খবর জানে কীনা সন্দেহ। লাইট অন করতে দেখে সেরিন মন খারাপ করে শুয়ে আছে। শশী তাকে টেনে বসায়।

“আজকে রুম থেকে বের হওনি কেনো?”

“এমনিতে! ভাল্লাগে না।”

“বফের সাথে ঝগড়া?”

“ইন্টারেস্টিং আমার বফ আছে?”

“নেই তো জানি।”

“হুম।”

তার পেছন দিয়ে মেহের সেরিনের রুমে প্রবেশ করে। সেরিন মেহেরকে দেখে নেমে হাগ করে। এর পেছন দিয়ে রাফা,সাফা আসতে তারা কিছুক্ষণ আলিঙ্গন করে। সেরিনকে নিয়ে লিভিং রুমে যাওয়া হয়। তবে সবই আগের মতো।

সেরিন সেখানে বসেই শুভ্রকে নক দেয়। মেসেজটা কিছুটা এরকম,
“কই আপনি?”

সাথে,সাথে সীন হতে রিপ্লাই আসে,
“কুমিল্লায় এসেছি। কোন দরকার?”

“আমার চকলেট লাগবে। প্লিজ পাঠিয়ে দিন।”

“কাকে দিয়ে পাঠাবো?”

“আপনি আসুন। গেট দিয়ে প্রবেশ করে সোজা বিল্ডিংয়ের উত্তর সাইডে আমার বেলকনির সামনে আসবেন।”

“লেট হবে। এই রাত বারোটা একটা বাজতে পারে।”

“সমস্যা নেই আপনি আসবেন এটাই আসল কথা।”

“ঠিক আছে।”

সেরিন মেসেজ সীন করে বেড়িয়ে পড়ে লাইন থেকে। যদিও দুপুরে একটু কথা হয়েছে তাঁদের। সেটাও সেরিনের আজাইরা বকবক। তাকে একটুও প্রায়োরিটি দেয়না মেইন টপিক এটাই। নাহলে এই প্রায়োরিটির উপর একশ মেসেজ দেওয়া হয়েছে। শুভ্র মেসেজ পড়ে আর হাসে। মেয়েটাকে যা চঞ্চল ভেবেছে তার থেকেও ওভারঅল। সেরিন আড্ডা রেখে খুশি মনে রুমে চলে আসে। ব্যাগ থেকে একটা শোপেজ বের করে। সেটাতে একটা কাপল আর উপরে লেখা “Babur PaPa” সেটা প্যাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেরিন।

সেরিন যেতে তারা চারজন রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিয়ে ঢালা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চৌধুরী পরিবারে মেয়ে মাত্র দু’জন। তাঁদের জন্য একটা আর মহিলা তিনজন তাদের জন্য আরেকটা। মিষ্টি, ফল সব কিছু ঢালায় প্যাক করে নিতে,নিতে অনেকটা সময় কেটে যায়।

কুমিল্লা থেকে ফিরতে,ফিরতে রাত বারোটা বেজে যায়। তবে শুভ্র আর্থ আর আয়মান চৌধুরীকে বাড়ীর সামনে নামিয়ে দিয়ে পাটওয়ারী বাড়ীর দিকে গাড়ী নেয়। মাহীকে মেসেজ দিয়ে বলে গেট খোলা রাখতে। শুভ্র গেটের সামনে গাড়ী রেখে ভেতরে প্রবেশ করে সেরিনকে নক করে। সোজা সেরিনের বেলকনির সামনে চলে যায়। বেলকনিতে একটা দরজা লাগানো আছে যেটা দিয়ে বাইরে যাওয়া যায় আবার ভেতরে আসা যায়। শুভ্র একটা কার্টুন সেরিনের হাত ধরিয়ে দিতে সেরিন ‘ধন্যবাদ’ জানায়। শুভ্র আর কিছু বলেনা। সেরিন প্যাক করে রাখা শোপেজের বক্সটা শুভ্রকে দেয়। শুভ্র চুপচাপ সেটা হাতে নেয়। তবে সেরিন কথা না বলে থাকতে পারলো না। শুভ্র বায় বলতে সেরিন বলে,
“একদম এক পা ও নড়বেন না। নাহলে খবর আছে।”

“এই তুমি এতো থ্রেট দেও কেনো?”

“দিবো না?”

“আচ্ছা বলো কী বলবে?”

“বলুন যে…”

“বলো?”

“সেরিন।”

“তারপর?”

“সেরিন আমি তোমাকে ভালেবাসি।”

“পারবো না। তোমায় না বলেছি আমার আকদ হয়ে গেছে।”

“তোর আকদের নানীর….

বলার আগে শুভ্র বলে,
” একবারে থাপ্পড় দিয়ে বেলকনির গ্রিলে জুলিয়ে দেবো। এতো গালি কার থেকে শিখেছো তুমি? আমি কে হই ভুলে গেছো? বে’য়াদব মেয়ে! আর কখনো আমার সামনে গা’লি দিয়ে দেখো শুধু তোমার কী হাল করি। এখন আসি সময় নেই এসব ফাল’তু কথা বলার।”

শুভ্র মেজাজ দেখিয়ে চলে যায়। সেরিন সেদিকে তাকিয়ে রয়। হাতের বক্সটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে আসে। শুভ্র তাকে কতগুলো বকা দিলো। -“আসলেই কী বেশী গা’লি দেই আমি?”

নাহ আর গা’লি দেওয়া যাবে না। সেরিন কার্টুন খোলতে দেখে পুরো কার্টুন ভর্তি চকলেট সাথে ছোট্টো একটা চকলেট কেক। যেটার উপরে লেখা, ‘Ugly meye vlo hoye jao’

সেরিন কিছু চকলেটস খায়। বাকী গুলো সাফা,রাফা,মেহেরের জন্য রেখে দেয়।

শুভ্র বাড়ী ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার খাটটা কেমন জেনো নড়বড় করছে। যাই হোক চেন্জ করতে হবে হয়ত। শুভ্র আর মাথা ঘামায় না সেসবে।

রাত তিনটায় কাজ শেষ করে সেরিনের রুমে আসে ওরা চারজন। আজকে তারা পাঁচজন একসাথে ঘুমাবে। ঘুমাবে বললে ভুল হবে গল্প করেই সময় পার করে দিবে। রুমে আসতে সেরিন থমথমে মুখ করে কেকটা ওদের সামনে রাখে। সাথে চকলেট গুলোও। কিছু পিকচার তুলে এই তিনটা বাজেই ডে দেয় সেরিন। কেক টেক কেটে আড্ডা দিতে,দিতে ফজরের আজান দিয়ে দেয়। আড্ডা ছেড়ে তারা এবার শুয়ে পড়ে।

#চলবে

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং🖤)

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-১৯+২০

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৯|
#শার্লিন_হাসান

দিনটা শুক্রবার। চৌধুরী বাড়ীর সদস্যবৃন্দ নিজেদের সব ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে তৈরী হয়ে নেয়। সময়টা সাড়ে বারোটার মতো। সবার সাথে শুভ্র ও নিজেকে তৈরী করে নেয়। জুমার নামাজ নামাজ আদায় করে তারা গাড়ীতে বসে।
আর্থ, শুভ্র তারা একসাথে যাবে। বড়রা ফ্যামিলির বড় কারে করে পাটওয়ারী বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়। শুভ্র কিছুটা মন মরা হয়ে আছে। আর্থ তাকে খোঁচা মেরে বলে,
‘ভাবী নেই দেখে?’

‘কিসের ভাবী? আমার বিয়ে করা বউ না যে ভাবী বলবি তুই।’

‘আরে ইয়ার এতো চাপ নেওয়ার কিছু হয়নি। অন্য জায়গায় পাত্রি দেখছি। বাবার বন্ধুর মেয়ে! জোশ হবে ব্যপারটা।’

‘হুহ্!’

শুভ্র কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। পাটওয়ারী বাড়ীতে আসে তারা সবাই। লিভিং রুমে সবার আনাগোনা। কিরণ পাটওয়ারী এবং সিহান পাটওয়ারী, অক্ষর তারা খাবার সার্ভের দায়িত্বে আছে। দুপুরের খাবার খেয়ে তারা সবাই কথাবার্তা বলে। বিশাল লিভিং রুমের একপাশে ছোট্ট করে ডেকোরেশন করা। ডেকোরেশন সোফার সামনে ছোট্ট টেবিলের উপর তিনটা কেক রাখা। সাথে কেক জাতীয় কিছু খাবার রাখা। শশীকে আনা হলে আর্থকে নিয়ে সোফায় বসানো হয়। সেখানেই তারা দু’জন দু’জনের অনমিকা আঙুলে রিং পড়ায়। কিছু পিকচার ক্যাপচার করে নেয় সবাই। শশীর দু’জন মেয়ে কাজিন! রাফা এবং সাফা একটা ছেলে কাজিন রিহাভ আছে তাঁদের সাথে। রাফা সেরিনকে ভিডিও কল দিয়ে দেখাচ্ছে। রাখার পেছনেই শুভ্র দাঁড়ানো। সেরিনে হাসিমুখ টা তার চোখে ভাসছে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে মেয়েটা। শুভ্র তাকে দেখছে। কেক টেক কেটে সবার সাথে পিকচার তুলে নেয় সবাই। বিকেলের দিকে তাঁদের জন্য নাস্তার হরেকরকমের আইটেম রাখা হয়। অক্ষরের সাথে শুভ্র,আর্থর পরিচয় হয়। শুভ্রর বিরক্ত লাগছে অক্ষরকে। তারউপর অক্ষর মাহির থেকে তার ফোন নিয়ে সেরিনকে ভিডিও কল দিয়ে শুভ্রর পাশে বসেই কথা বলছে। যেখানে শুভ্রর প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে অন্য প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্ট আসলে তাকে গেট আউট বলে তাড়িয়ে দেয় শুভ্র সেখানে তার পার্সোনাল গায়িকাকে নিয়ে তার সামনেই রংঢং করে কথা বলছে। শুভ্র হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নেয়। কপাল স্লাইড করে। ব্লুটুথ কানে গুঁজে গান শোনে যাতে অক্ষরের কথা কানে না আসে। তবুও মাঝেমধ্যে ফোনের স্ক্রিনে নজর পড়ে যায় তার। সেখানেও সেরিন হাসি মুখে অক্ষরের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। অক্ষর আর্থ,শশীকে দেখাচ্ছে পেছনের ক্যমরায়। তখন আবার শুভ্র উঠে অক্ষরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তার হাতের ধাক্কায় ফোন ফ্লোরে পড়ে যায়। ঘটনাটা এক্সিডেন্টলি হলেও শুভ্র প্রচুর খুশি হয়েছে।

অক্ষর ফোন উঠিয়ে দেখে কিছুই হয়নি। সেরিন জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে? হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো কীভাবে?’

‘শুভ্র ভাইয়ার হাতের ধাক্কা লেগে।’

‘ওহ্! আচ্ছা রাখি আমি বায়।’

‘বায়।’

সেরিন কল কেটে হাসতে থাকে। তার কেনো জেনো ভীষণ হাসি পাচ্ছে। তবে সে ভীষণ মিস করছে সবাইকে। অক্ষরের সাথেও তার কথা বলা কমাতে হবে। সে চায়না অক্ষর তার প্রতি দুর্বল হয়। সে নাহয় এজ এ সিস্টার হিসাবে কথাবার্তা বলবে। বাট অক্ষর! সে তো সেসব মানবে না।

পাটওয়ারী বাড়ী থেকে সন্ধ্যায় কফি পান করে সবাই বিদায় নেয়। চৌধুরী পরিবার যেতে শশী তার রুমে এসে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়ে। পেছন দিয়ে সাফা রাখা আসে। তারাও শশীর পাশে বসে। রাফা বসততে,বসতে বলে,
‘ওই যে ফর্সা করে লম্বা ছেলেটা কে রে?’

‘শুভ্র স্যার?’

‘কী জানি! দেখে শুভ্র,শুভ্রই লাগে।’

‘বল তাকে দিয়ে তোর কী কাজ?’

‘ভালো লেগেছে তাকে। কথাবার্তায় কঠোরত্বো প্রকাশ পেয়েছে। যাই হোক গম্ভীর লোকটাকে আমি ভালো লেগেছে। একটু সেটিং করিয়ে দে।’

‘সিরিয়াস?’

‘হুম।’

রাফার কথায় শশী বলে,
‘ওনার ফেসবুক আইডিটা নিয়ে নে, আরজিন চৌধুরী শুভ্র। এবার যা করার করতে পারিস। আই হোপ ইমপ্রেস হবে না।’

‘ইমপ্রেস হবে না কেন?’

‘আরে ভদ্র এবং বুদ্ধিমান লোকেরা কখনো প্রেম করে না। তার ডিরেক্ট বিয়ে করে।’

‘তো সমস্যা কী কয়দিন কথা বলে ডিরেক্ট বিয়ে।’

শশী আর জবাব দেয়না। সে ফ্রেশ হয়ে কড়া করে কফি খেয়ে। লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। তাকে যাতে আর কেউ ডাক না দেয়।

এদিকটা সামলে সাফা,রাফা,রিহাভ,অক্ষর,মাহী তারা আড্ডা দিতে বসে। বিশেষ করে বিয়ে নিয়ে প্লানিং তাঁদের। রাখা বার-বার মাহিকে বলছে,

‘শুভ্র স্যারকে ইমপ্রেস করবো। প্লিজ ভাই হেল্প কর।’

রাফার কথায় বাকীরা কথা থামিয়ে তার দিকে তাকায়। রাফা ও বোকা বনে যায়। সে কী এমন বললো যে এভাবে তাকাতে হবে? তখন রাফা বলে,
‘এভাবে তাকানোর কিছুই হয়নি। আমি তো আমার মাইন খুঁজছি।’

তখন মাহি শুধায়,
‘তোমার মাইন অন্য কারোর ইনবক্সে সাইন করছে। সো প্যারা নিও না! অক্ষর ভাইয়াকে কাজে লাগাও।’

তখন অক্ষর বলে,
‘ছেলে দেখলেই কী নিজের সম্পত্তি মনে হয় নাকী? আর সবাই সিঙ্গেল বসে নেই। সবারই একজন করে মাইন আছে।’

‘তাহ আমাদের অক্ষর ভাইয়ার মাইন টা কে?’

রিহাভ শুধায়। তখন অক্ষর বলে,
‘হুম আছে তো একজন!’

‘ভিনদেশী নাকী?’

‘না বাঙালি অষ্টাদশী কন্যা ।’

অক্ষরের কথা সবাই তার দিকে তাকায়। রাফার শরীর আগুনের মতো জ্বলছে। অক্ষর আর মাহী তাকে ঠান্ডা মাথায় অপমান দিলো। করবে না সে প্রেম! ছেলেদের থেকে দূরে থাকবে। ও কী ওদের মতো বারো রাইস নাকী যে প্রেম করবে। আর বললেই কী প্রেম হয়ে যায়? একদম না! অক্ষরকে অ’পমানের জবাব না দেওয়া অব্দি শান্তি নেই রাফার।

সেদিনের মতো তাা তাঁদের আড্ডা পাট চুকিয়ে নেয়। সবাই ক্লান্ত তাই যে যার মতো শুয়ে পড়ে।

*******

সেরিন সকাল,সকাল ঘুম থেকে উঠে কফির মগ নিয়ে আয়াশের সাথে ছাদে যায়। কেউই উঠেনি তেমন তাই তো ছাঁদে আসার দুঃসাহস দেখিয়েছে সে। আয়াশ,সেরিন দুজন রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সামনের গেটের পরের মেইন রোড দেখছি। মানুষের আনাগোনা দেখা দিয়েছে। তখন আবার ছাঁদে আসে এক যুবক। সেরিন তাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের বরণ! সেরিনের মুখটা চেনাচেনা লাগলেও ক্যাচ করতে পারছে না আপাতত। ছেলেটা ছাঁদের এক কোণে গিয়ে কিছুটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে নিচ্ছে। সেরিন চুপিসারে সরে আসে আয়াশকে নিয়ে। সেরিনের যাওয়া টের পেয়েও আড়চোখে তাকায় তাতান। হ্যাঁ মেয়েটাকে সে চেনে। সুন্দর গান গাইতে পারে। তাতান ছোটোখাটো একজন ফ্যান। সেরিনের ফেসবুক পেজ ফলো করে সে! মোটামুটি মেয়েটার ভালো অডিয়েন্স আছে। আর সেদিন মিউজিক একাডেমিতে দেখেছে। এডমিশন নিয়েছিলো মেয়েটা।

সেরিন ফ্লাটে ঢুকে কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে তার আন্টির কাছে কিচেনে যায়। সে নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত। সেরিনকে দেখে সানজিদা শারমিন বলেন,
‘পড়তে যাও দু’দিন পর এক্সাম। আমি নাস্তা দিয়ে আসবো।’

‘আরে খালামনি পড়বো এখন একটু একটা গান দেখি। বিকেলে সেটার ভিডিও বানাবো।’

‘আচ্ছা যাও।’

সেরিন রুমে এসে ফোন হাতে নেয়। একটা গান সে নেয় সেটা হলো, ‘এই অবেলায় তোমারি আকাশে’ সেরিন গানটা শোনে। এর আগে একবার কোন ভিডিওতে শুনেছিলো ভালো লেগেছে। সময়ের অভাবে তেমন ঘেঁটে দেখা হয়নি। তবে আজকে সে ঘেঁটে দেখছে। ফেসবুক ক্রোল করার সময় শার্লিন হাসানের লেখা ধারাবাহিক চলমান গল্প #হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ সামনে আসে। গল্পটায় দুষ্টুমিষ্টি ক্যামিস্ট্রির সেরিন প্রতিদিন গল্পটা পড়ে।🤭
গল্প পড়া শেষ করে সে গানটা শোনে,

এই অবেলায়, তোমারি আকাশে, নিরব আপোষে
ভেসে যায়
সেই ভীষন শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়
কেউ কোথাও ভালো নেই যেন সেই
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়?
কতকাল আর ভুল অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।(ক্রমশ)

সেরিন গানটা শোনে তার প্রিয়দের তালিকায় যুক্ত করল নেয়।

সময়টা ব্যস্ততায় কাটলেও একটু অবসন্নতা! ভেতর জুড়ে মন খারাপ তার। তবুও সেসব উপেক্ষা করে নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে। কিছু জিনিস না পাওয়াতে সুন্দর। কিছু গল্প অপূর্ণতাতে মানান সই! কিছু চাওয়া বিসর্জন দিয়ে স্থান ত্যাগ করাই উত্তম।

******

রবিবার দিন সকালে শুভ্র কলেজে উপস্থিত হয়। আজকে তার জন্য রঙিন বক্সে মোড়ানো কোন উপহার এসেছে। শুভ্র রঙিন বক্স টা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কেচি দিয়ে স্কচটেপ কেটে ভেতরে কী আছে দেখে। তেমন কিছু না শুধু একটা লাভসেপের কুশনের মতো যেটা উপরে লেখা, ‘Babur Papa’ সাথে কয়েকটা চিরকুট। তাতে লেখা,
‘ভেবেছিলাম চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দেবো। গত দুইদিন দিতে পারিনি। মাত্র একটা চিঠি দিয়েছি কিন্তু মন টানে না তাই তো গতানুগতিক ধারায় চিঠি দিয়েই যাচ্ছি। কেমন আছো বাবুর আব্বু?’

শুভ্র চিঠি দেখে মেজাজ হারায়। গত চিঠিটা ও আবোলতাবোল লেগেছে তার কাছে। এই চিঠিটা তো একবারে বিরক্তিকর। অপরিচিতার লেখা এমন ডাস্টবিন মার্কা হতে পারে না। শুভ্রর ডাউট ফিল হচ্ছে। অপরিচিতা এমন চিঠি লেখে বিষয়টা হাস্যকর লাগলো। শুভ্র সিদ্ধান্ত নেয় চর চিঠি গ্রহণ করবে না যাই আসবে সে ডাস্টবিনে ছিঁড়ে ফেলে দিবে।

সেরিন এক্সাম দিয়ে বাসায় আসে দেড়টায়। শাওয়ার নিয়ে লান্স করে রেডি হয়ে নেয়। মিউজিক একাডেমিতো যাবে সে। সন্ধ্যার মধ্যে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরবে। নিজের ব্যাগে পানির বোতল,হাল্কা খাবার সাথে ফোনটাও নিয়ে নেয়। একাডেমিতে বসেই আজকে একটা ভিডিও মেক করবে।

রিকশা ধরে একাডেমির গেটের সামনে আসে সেরিন। তার মতো কয়েকজন ও নতুন এসেছে। কেউ বা অনেকটা এগিয়ে। গিটার বাজানো সেরিন মোটামুটি আয়ত্ত করতে পারলেও হারমনিয়াম আরো অনেক কিছু যেগুলো এখনো পারে না সে। গিটারের অনেক ধাপ আছে সেরিন সেসব আয়ত্ত করেনি এখনো।

গান প্রেকটিস করে তার সাথের কয়েকটা মেয়ের সাথে সে একটা ফাঁকা জায়গায় গিটার নিয়ে বসে। সেরিন তার অনলাইন ফ্লাটফর্মের ছোট্টো পরিচয়ের কথাও তাঁদেরকে বলে। একটা মেয়ে নাম তার আদ্রিতা আয়াত চৌধুরী। সেরিনকে বলে,
‘তোমায় অনেক আগে থেকেই আমি ফলো করি। আমার বড় ভাইয়াও তোমার গান শুনে মেবি। এবং সে তোমার অনেক বড় ফ্যান। তবে প্রকাশ করে না। আমার ভাইটা ইন্ট্রোভার্ট আর রাগী।’

সেরিন হাসে। তবে তার সাথের আরেকটা মেয়ে বলে,
‘ভাইয়া কী স্টাবলিস্ট? তাহলে বলো মিশাতকে তার বউ বানানোর ব্যবস্থা করবো।’

তখন আদ্রিতা বলে,
‘হ্যাঁ আমার ভাইয়া জব করে আমার দাদুর প্রতিষ্ঠানে।মিশাত বললে আমি আমার জন্য হলেও ভাইয়ার বউ বানাবো। কারণ এতো কিউট সুইট মিশুক মেয়েকে হাত ছাড়া করতে রাজী নই আমি।’

আদ্রিতার কথায় বাকীরাও হাসে। সেরিন তার ভিডিও অন করে। তাদের সাথের একজন গিটারে অনেকটা পারদর্শী। সে গিটার বাজায়! সেরিন গান গায় বাকীরাও মাঝেমধ্যে তাল মেলায়।

সন্ধ্যার মধ্যে সেরিন তার কাজ শেষ করে আদ্রিতার সাথেই বেরোয়। আদ্রিতার বাসা সেরিনের বাসার আগের রোডে। তাই একসাথে একই রিকশায় উঠে দু’জন। যদিও শুধু নামটাই তাঁদের জানা। এছাড়া কেউই তারা তাঁদের গ্রামের বাড়ী বা কিছুই জানে না। আদ্রিতা মেয়েটা বেশ মিশুক। সেরিন সন্ধ্যার শহরটা দেখছে। তখন আদ্রিতা বলে,
‘তুমি ভিডুটা আপ দিবা কখন?’

‘এই তো অবসর হয়েই্।’

‘আমি তোমায় নক আর রিকুয়েষ্ট দেবো। একসেপ্ট করে নিও।’

‘আচ্ছা করবো।’

দুজনে কথাবার্তা বলে আদ্রিতা তার বাসার সামনে নেমে সেরিনকে বিদায় দেয়। সেরিন চুপচাপ বসে সামনে দেখছে। গেটের সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তাতানের সাথে তার চোখাচোখি হয়। সেরিন চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে যায়।

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২০|
#শার্লিন_হাসান

এরই মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। সেরিনের ও এক্সাম শেষ হয়। আগামী কালকে সে কুমিল্লা যাচ্ছে। যদিও এখন কেউই নেই তাঁদের বাড়ীতে। সবাই সবার জায়গায়। তবুও সেরিন ভীষণ এক্সাইটেড তার পরিবারের কাছে যাবে।
ঢাকা শহরে এসে অল্পদিনে কয়েকজন বন্ধু পেয়েছে সেরিন। তবে আদ্রিতা মেয়েটা একটু বেশী কাছের হয়ে গেছে। সেরিন জেনেছে তার গ্রামের বাড়ী ও কুমিল্লা।

সেরিন নিজের টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নেয়। তবে বাড়ীতে তার সবই আছে। মাহী এসেছে সন্ধ্যায়। আগামী কালকে সেরিনকে নিয়ে কুমিল্লায় যাবে।

যদিও তাঁদের ভাই বোনের সন্ধ্যাটা আড্ডা গল্পে শেষ হয়েছে। শশীর এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানের সব ঘটনা এ টু জেড শুনে নিয়েছে সেরিন। যদিও তার আফসোস নেই না থাকায়।

*******

সন্ধ্যায় শুভ্র চিঠি সমূহ ভাজ করে যত্ন সহকারে রাখে। লাস্ট চিঠিটার পরের চিঠিগুলো হযবরল তাই শুভ্র সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। এরপরের চিঠিগুলো সে ছুঁয়েও দেখেনি তবে নজরে এসেছে চিঠি নিয়ম করে আসতো। শুভ্রর মনে হয় কেউ এসবে বা হাত ঢুকাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে তো জানে না শুভ্র ঠিক কতটা চালাক।

তখন আবার আর্থ আসে শুভ্রর রুমে। শুভ্রকে চিঠি নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে সে বলে,
‘চিঠি, চিঠি আর চিঠি তা বাবহর আম্মুকে পেলে তো?’

‘আগামী কালকে পাবো আশা করি।’

আন্দাজি কথাটা বলেছে শুভ্র। আর্থ ও মজার ছলে নিয়েছে কথাটা। তবে সে শুভ্রকে বিয়ের জন্য রাকী করাতে এসেছে। তাহলে আগামী কালকে তারা তার বাবার বন্ধুর মেয়েকে দেখতে যাবে। শুভ্র আর না করেনি! সেও বলেছে আগামী কালকেই যাবে। আর্থ ও খুশি হয়ে প্রস্থান করলো। শুভ্র বুঝেছে সেরিনকে সে যতই নিজের করতে চাইলে তার থেকে দ্বিগুণ দূরত্ব তৈরী হচ্ছে। সেরিন তার হবে না! কিন্তু সেরিন চলে যাওয়ার পর শুভ্রর খারাপ লেগেছিলো। সেদিন টিসি দিয়েছিলো সেরিন হাসিমুখে শুভ্রর রুম ত্যাগ করলেও শুভ্রর মোটেও ভালো লাগেনি। মেয়েটা এতো খুশি কেন তার থেকে পালানোর জন্য? শুভ্র এখনো সেরিনের পেজ ফলো করে। বেশী ভিডিও না আপ দিলেও যা দেয় সেটাই দেখে। তাতেই জেনো শুভ্রর ভালো লাগা কাজ করে।

কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও আজকাল রাতের খাবারের দায়িত্ব জান্নাতুল ফেরদৌস নেন। ব্যপারটা সুলতানা খানমের কাছে কেমন জেনো লাগে। রাতে ল্যাপটপ রেখে তিনি কিচেনে যান। তখন জান্নাত সালাদ কাটছিলো চুরি দিয়ে। সুলতানা খানমকে দেখে বলেন,
“কিছু বলবে?”

“আজকাল তুমি রান্নাবান্না নিয়ে বেশী মাথা ঘামাচ্ছো না?”

“হুম ঘামাচ্ছি কারণ আমি বড় বউ। আমার দায়িত্ব বেশী।”

“উঁহু! তুমি বড় নও। বড় একজন ছিলো তার অনুপস্থিতিতোও তাকেই আমরা বড় মানবো। বলো যে বড় ভাবীর দায়িত্বটা তোমার উপর পড়েছে। তবে যাই বলো তার মতো কিছুই হচ্ছে না।”

“সুলতানা…..”

“যেটা সত্য সেটাই বললাম। আসলেই ভাবী কার এক্সিডেন্টো মা’রা গিয়েছিলো?”

“তোহ কী? তুমি কী বুঝাতে চাইছো তাকে আমি মে”রেছি?”

“না সেটা না। তবে তার অভিনয় কিন্তু দারুণ ছিলো। সে নিত্যান্ত একজন ভালো মানুষ ছিলো সেজন্যই তার পেছনে এতো শত্রু পড়েছিলো।”

“ভালো মানুষের পেছনে শত্রু থাকে এটাই স্বাভাবিক।”

সুলতানা খানম আর কথা না-বাড়িয়ে চলে আসেন। বাকীরাও আস্তে,আস্তে নিচে আসছে ডিনারের জন্য। দশটায় সবাই ডিনারের জন্য বসে পড়ে। আগামী কালকে তারা শুভ্রর জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। এটাই ফিক্সড করা হয়েছে।

শুভ্র ও সবার সাথে হাসিখুশি ভাবে কথা বলে রুমে এসেছে। মেয়ে পছন্দ হলেও বিয়েটা করবে না শুভ্র। সবার জ্বালা যন্ত্রণায় মত দিয়েছে। কী জানি! যদি তার বাবার কথা বা সন্মানের কথা ভেবে বিয়েটা করে নিতে হয়।

********

পরের দিন সকালে সেরিন মাহী কুমিল্লার উদ্দেশ্য রওনা হয়। তিন ঘন্টার ট্রেন জার্নি করে তারা দাউদকান্দি আসে। সেখান থেকে সোজা পাটওয়ারী বাড়ীতে। বাড়ীর পথেই চৌধুরী বাড়ী সাথে “মিসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী হাইস্কুল এন্ড কলেজ” যেটা শুভ্রদের। সেরিন সেদিকটায় চোখ ভোলায়। তবে ইন্টারেস্টিং কিছুই দেখেনি। বারোটার দিকে পাটওয়ারী বাড়ীতে আসে তারা। সেরিনকে দেখে শশী জেনো খুশিতে আটখানা। সে তো প্রায় বিশ মিনিটের মতো সেরিনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। একে,একে সেরিন সবার সাথে দেখা করে। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয় সেরিন। বড্ড মায়া হয় নিজের সাজানো রুমটার জন্য! তবুও মায়া ত্যাগ করাই উত্তম।

চৌধুরী পরিবারের সবাই এসেছে মিনিস্টার আয়ান মালিথার ‘মালিথা’ ভিলাতে। চৌধুরী পরিবারকে সুন্দর ভাবে আপ্পায়ন করা হয়। আয়ান মালিথার স্ত্রী তিথির সাথে জান্নাতুল ফেরদৌসের ভাব আগে থেকেই। এখন তাঁদের সম্পর্ক আরো প্রগাঢ় হবে ভাবতে ভীষণ খুশি জান্নাতুল ফেরদৌস। বলা যায় তারাও ছোট বেলার বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন।

শুভ্র বসে আয়ান মালিথার সাথে কথা বলছে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে শুভ্রর ভালো লাগলো। কে জানে তার মেয়েটা কেমন হয়?

ভাবনা গুচ্ছ একদিকে তুলে রেখে শুভ্র সটান হয়ে বসে। এই মূহুর্তে কনেকে আনা হবে। মেরুন কালারের থ্রিপিস পড়া সুন্দরী সুশীলা কন্যা। মুখে নেই তেমন কোন প্রসাধনী। আয়ান মালিথার একমাত্র মেয়ে আর্শিয়া মালিথা। সবাইকে সালাম দিতে জান্নাতুল নিজের পাশে তাকে বসালেন। তিনি খুশি আটখনাার বদলে ষোলো খানা হয়ে নিজের হাতপর রিংটা দেরী না করে আর্শিয়ার হাতে পড়িয়ে দিলেন। তার কাজে বাকীরাও কিছুটা হতভম্ব। শুভ্রর তো রাগ উঠে যায়। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল রাখে। বাকীরা হাবার মতো তাকিয়ে আছে।

আর্শিয়াকে দেখাদেখি হলে কিছুই বলেনা চৌধুরী পরিবার। আয়মান চৌধুরী আরফিন চৌধুরীকে দমিয়ে রেখে নিজে সবার উদ্দেশ্য বলেন,
“শুভ্র যা বলে তাই হবে। বিয়েটা ওর, অর্ধাঙ্গিনী ওর হবে। আমাদের পছন্দের বা মতের কোন প্রশ্নই উঠে না এখানে।”

সবাই আয়মান চৌধুরীর কথাটা পছন্দ করলেও জান্নাতুল পছন্দ করলেন না। আয়মান চৌধুরী কী ইনডিরেক্টলি বুঝাতে চেয়েছে বিয়েটা হবে না। আর উনি নিজের শখের আংটিটা খোয়ালেন?

সেদিনের মতো মালিথা ভিলা থেকে বিদায় নিয়ে চৌধুরী পরিবার চলে আসেন।

*******

পরেরদিন সকালে শুভ্র রেডি হয়ে বেড়িয়ে যায় কুমিল্লার উদ্দেশ্য। সিহান পাটওয়ারীকে সে একান্ত ডেকেছে। তার ডাকে সায় না দিয়ে থাকতে পারলেন না সিহান পাটওয়ারী। তিনিও কুমিল্লার উদ্দেশ্য রওনা হোন।

নিদ্দিষ্ট সময়ে শুভ্রর দেওয়া ঠিকানায় আসেন তিনি। তার পেছন দিয়ে শুভ্র আসে। শুভ্র কফি অর্ডা দিয়ে চোখের চশমাটা খোলে। সিহান পাটওয়ারীর মুষ্টিবদ্ধ হাতে হাত রেখে শুভ্র বলে,

‘আংকেল আমি পার্সোনাল ভাবে আপনায় ডেকেছি। তবে আমি আমার লাইফ স্টাইল, ব্যাকগ্রাউন্ড, পার্সোনালিটি নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। ছেলে হিসাবে একটা রিকুয়েষ্ট করবো। যেটা আমার জায়গায় আমার হয়ে আমার বাবা করলে আপনি ফেলতে পারতেন না।”

“বলো কী রিকুয়েষ্ট? ”

“সেরিনকে আমি বিয়ে করতে চাই। আমি জানি আপনারা সবাই অক্ষরের জন্য অপেক্ষা করছেন। বাট অক্ষরের আগে আমি ওকে চেয়েছি।”

“কিন্তু আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো না এখন। অক্ষরের কাছেও না।”

“আমার কাছেও না?”

“দেখো সেরিন অনেক ছোট। মাত্র আঠারো তে পা রেখেছে। এখনি যদি বিয়ে দিয়ে দেই তো ওর স্বপ্ন আশা সবই তো অপূর্ণ?”

“আমি জানি ওর স্বপ্ন একদিন মাইক হাতে গান গাইবে। ওর একটা পরিচয় হবে। তবে সত্যি বলতে যদি টিচার হিসাবে বলেন ওর স্বপ্নটাকে আমি এপ্রিসিয়েট করি। আমিও ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি একদিন ও হাতে মাইক ধরে গান গাইবে। হাজারো মানুষের মুখে ওর নাম থাকবে। আংকেল আমি ওকে হেল্প করবো এজ এ হাসবেন্ড হিসাবেও,টিচার হিসাবেও।”

“কিন্তু….”

“কোন কিন্তু না আংকেল। চিন্তা করবেন না আপনার মেয়কে আমি ফুলের মতো সাজিয়ে আনবো ফুলের মতো করেই রাখবো। আমি শুভ্র! হ্যাঁ এই শুভ্র কথা দিচ্ছে আপনার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ থেকে শুরু করে সমস্তটার দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন করবে। একদিন আপনার মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরে প্রাউড ফিল করে বলবে, ‘বাবা আমি আমার স্বপ্ন ছুঁতে পেরেছি।’ আর বেশী কিছু বলতে চাইনা আপনায়।”

“ঠিক আছে। রাজী হলাম আমি। তবে ভেবো না আমার মেয়ের দায়িত্ব নিচ্ছো বলে বা লোভ। আমার সামর্থ্য আছে ওকে ওর স্বপ্নে পৌঁছে দেওয়া। তবে তোমাকে বাড়ী থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে আর তুমি সেরিনকে চাচ্ছো। আমি জানি তুমি ভীষণ ভালো একটা ছেলে। সেজন্য ভরসা পেলাম। তোমার কথাটা পেলতে পারলাম না।”

“তাহলে বিয়েটা কবে হচ্ছে?”

“সাহিনূর আমার বোন কখনোই বিয়েটা হতে দিবে না। আর আমি চাই হুট করে একদিন তোমরা আসো আর বিয়েটা হোক। যাতে সবাই সারপ্রাইজড হয়ে যায়।”

“আমি চাই সেরিন নিজেও যাতে বিষয়টা না জানে এখন।”

“জানবে না তোমার আর আমার মাঝেই থাকবে।”

সেদিনের মতো তারা কথাবার্তা বলে বেড়িয়ে পড়ে।

*******
সন্ধ্যায় পাটওয়ারী বাড়ীতে আসে অক্ষর। মূলত সেরিনকে দেখার জন্যই। অনেক অপেক্ষার পর সেরিনের দর্শন পায় অক্ষর। খুশিতে আটখানা সে। সেরিনকে দেখেই বলে,
“কেমন আছো বউ?”

“ভালো।”

সেরিনের ভালো লাগেনি কথাটা। ‘বউ’ শব্দটা শুধু মাত্র একজনের মুখ থেকেই সে শুনতে চেয়েছে। কিন্তু তার তো হেলদোল নেই সেসবে। অক্ষরকে বেশী পাত্তা দেয়নি সেরিন। তবে সে জেনো আঠার মতো লেগেছিলো।

বেলকনিতে বসে ডায়েরি লিখছে সেরিন। ছোট,ছোট পৃষ্ঠায় লিখছে কিছু। একটা বড় অভিমান বার্তা কারোর জন্য। লেখা শেষে রুমে চলে আসে। ফোনে এলার্ম সেট করে শুয়ে পড়ে সে। আদ্রিতার মেসেজ আসে। মেয়েটা নাকী কুমিল্লায় এসেছে। সেরিন আদ্রিতার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে। নেট ওফ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

*******

নামাজ আদায় করে কফিটা শেষ করে শুভ্র কলেজের কাছের দীঘির পাড়ে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে এদিকটায় আসতে দেখে দপ্তরি এসেছে। তখন সাতটা বাজে! কলেজ প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করছে তারা। শুভ্র তার অফিসকক্ষে যায়। নিজেকে দেওয়ালের একপাশের লুকিয়ে নেয়। আজকেও নিশ্চয়ই অপরিচিতা আসবে চিঠি দিতে। যেহেতু সেরিনের সাথে বিয়েটা হবে সেহেতু একটু চিঠির মালিককে দেখার ইচ্ছে হলো।

অপরিচিতা ওরনাটা ভালো ভাবে মাথায় পেছিয়ে মুখটা ঢেকে গেট দিয়ে প্রবেশ করে। দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষের বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ে। বাকীরা তো বাইরে ভেতরে কেউই নেই। ত্রস্ত পায়ে দোতালায় যেতে দেখলো একজন করিডোর দিয়ে আসছে। নিজেকে কিছুটা আড়াল করে নেয় সে। তবে অন্য একজনের সামনে পড়লে সমস্যা ছিলো না। সেই দপ্তরি জানে সে যে আসে।

সাবধানতার সাথে শুভ্রর রুমের দিকে যায় অপরিচিতা।শুভ্রর রুমের দরজা খোলা। সেদিকটায় যাবে নাকী চিঠি গুলো করিডোরে রাখা বেঞ্চের কোণে রাখবে ভাবছে। পরক্ষণে ভাবলো অন্য কেউ যদি চিঠিগুলো ফেলে দেয়। তাই তো সে সিসি ক্যামেরার দিকে একনজর তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। টেবিলের উপর চিঠিগুলো রেখে পা বাড়াতে তার ওরনায় টান পড়ে যায়। আচমকা এমন হতে ভয় পেয়ে যায় সে। মুখ থেকে মাথা থেকে ওরনা সরে গিয়েছে তার। চুলগুলো এলোমেলো! শুভ্র মুচকি হেসে ওরনাটা বাবুর আম্মুকে বউ সাজানোর মতো করে গোমটা তুলে দেয়।

“হুম! একজনের প্রেমেই ভালো ভাবে পড়লাম। চঞ্চল মেয়েটার এতো গুণ এতো বুদ্ধি কোথা থেকে আসলো? যাই হোক তুমি পাশ করেছো।”

“ইয়ে না মানে বাবুর আব্বু এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”

শুভ্র হাসে। তার হাসিটা স্নিগ্ধ লাগছে। মনে হয় সে প্রচুর খুশি। একহাতে আজকের চিঠিগুলো নেয় শুভ্র। দু’টো চিঠি এসেছে। একটর উপর অভিমান বার্তা লেখা শুভ্র সেটাই আগে খুলে দেখলো।
চিঠিটা,
অভিমান বার্তা:
‘বাবু আব্বু’
জানেন? বাবুর আম্মু মানে আমি একটা হার্টলেস মেয়ে মানুষ। সহজে কাউকে মনে বসাই না। যদি বলে ছেলে মানুষদের ইগনোরের কথা আমার মনে হয় আমি প্রথম হবো। না কোন ছেলে ফ্রেন্ড আছে, না ছেলে কাজিনের সাথে তেমন ভাব। বাট একজন ছেলে ছিলো যাকে প্রথম বার দেখে আমি তার এট্টিটিউডে ফিদা হয়ে যাই।………

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-১৭+১৮

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৭|
#শার্লিন_হাসান

ডক্টর শুভ্রকে ব্যান্ডেজ করে মেডিসিন লিখে দেয়। সবাই শুভ্রর রুমে ভীড় জমিয়েছে। শুভ্রকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কোন উত্তরই দিচ্ছে না সে। আরফিন চৌধুরী রেগে আছেন। তার বাড়ীতে কে আসলো পারমিশন ছাড়া। দারোয়ান কোথায় ছিলো ইত্যাদি,ইত্যাদি। তাঁদের কলেজের সাথেই যেহেতু বাড়ী তাই তেমন সিকিউরিটি রাখেনি মানুষ আসা যাওয়া করে এমনিতেও। তবে বিল্ডিংয়ের চারপাশটায় সিসি ক্যামেরা লাগানো। এখন একমাত্র ভরসা সিসিটিভি ফুটেজ।

শুভ্রকে নিয়ে সবাই একটু বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। সিসিটিভি ফুটেজ পরেও চেক করা যাবে। আর্থ শুভ্রকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। তবে খবরটা পাটওয়ারী বাড়ীতে চলে যায়। সেরিন না শোনলেও নিশাতের থেকে পায় খবর তখন প্রায় রাত বারোটার উর্ধ্বে। মাহি নাকী নিশাতকে বলেছে। সেরিনের নিজেকে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী মনে হলো। তবে নিশাতের সাথে কথা বললো। সেরিনের মতে একাবারে ঠিক হয়েছে। মাথায় বা’রি মেরেছে ভালোই করেছে যদি এবার মাথা ঠিক হয়। রুলস কিছুটা কমে আসে। সেরিন নিজেই তো সেই কবে বারি টা মারতো শুধু পারমিশন নেই। বহুত জ্বালিয়েছে শুভ্র তাঁদের। এখন কয়েকদিন বেড রেস্টে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা সেরিনের টিসি মনে হয়না এই জনমে পাবে। এটা ভেবে খারাপ লাগছে।

পরের দিন সকালে শুভ্র কলেজে উপস্থিত হয়। এটা নিয়ে অনেকের মনে আঘাত লেগেছে। ভেবেছে শুভ্র আসবে না একটু চিল করবে। তার আর হলো না। সেরিন তো সেই খুশি আজকে তার টিসি নেওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। খুশি মনে পিটি শেষ করে শুভ্রর রুমে উপস্থিত হয় সেরিন। তখন শুভ্র কিছু পেপার্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। সেরিনকে দেখে ভেতরে আসার পারমিশন দেয়। সেরিন ও একা গাল হেঁসে ভেতরে যায়। শুভ্র তাকে দেখে বলে,

‘এতো তাড়া কিসের ঢাকা যাওয়ার?’

‘আসলে স্যার এই কলেজটা আমার একদম পছন্দ না। সেজন্যই এতো তাড়া।’

‘ঘুমাও তাহলে টিসি পাবা না।’

‘কিন্তু কেনো স্যার?’

‘আমার কলেজের নামে বদনাম করেছো মানে এই কলেজেই তোমায় থাকতে হবে।’

‘ওটা তো জাস্ট কথার কথা। এমনিতে কলেজ ক্যাম্পাস সাথে মডুলাস মার্কা রুলস একদম ঠিক আছে। আসলেই ঠিক আছে আপনার দেওয়া রুলস গুলো। আমার ধৈর্য থাকলে অবশ্যই মানতাম আর থেকে যেতাম।’

‘প্রশংসা করলে নাকী অপমান?’

‘আরে না প্রশংসা। এবার আমার টিসি?’

শুভ্র একটা পেপার্স এগিয়ে দেয় সেরিনকে। সেরিন সেটা দেখে ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে আসে। দরজার সামনে আসতে পেছন থেকে শুভ্রর গাওয়া গুনগুন করে গান কানে ভাসছে। সেরিন শোনার চেষ্টা করছে। শুভ্র গুনগুন করে গাওয়া বাদ দিয়ে একটু জোরেই গায়,
‘তুমি আর তো কারোর নও শুধু আমার।
যত দূরে সরে যাবে রবে আমার।
তবে আজ কেন একা আমি?’

সেরিন পেছনে তাকাতে শুভ্র মলিন হেঁসে বলে,
‘তোমার মতো ওতো ভালো গাইতে পারি না।’

‘আসলেই!’

সেরিন প্রস্থান করতে শুভ্র হাসে। ভেবেছিলো সেরিন বলবে, ‘না সুন্দর হয়েছে।’ তা না অহংকার করে চলে গেলো। সেরিন যেতে শুভ্র আজকে আসা চিঠিটা হাতে নেয়। তাতে লেখা, ‘হয়ত মাঝেমধ্যে চিঠি আসবে। আমার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বাবুর আব্বু।তবে হ্যাঁ একদিন হুট করে সামনে এসে সারপ্রাইজ দিবো আপনায়। সেদিন ফিরিয়ে দিলে খবর আছে। তবে একটা অভিমান বার্তা আছে আপনার জন্য। অচিরেই সেটা পেয়ে যাবেন। দোয়া করবেন বাবুর আম্মু আর বাবু যাতে সুস্থ থাকে।’

চিঠি পড়ে শুভ্রর মুখ দিয়ে একটা কথাই বের হলো সেটা হলো, ‘বাবু সুস্থ থাকা মানে? আসলেই কী অপরিচিতা প্রেগন্যান্ট? তাহলে তো বাবুর আব্বু আমি না। ধুর অন্যের বাচ্চা আমার গাড়ে চাপাতে আসে। যাক বাঁচলাম চিঠিগুলো কী তাহলে ভুল জায়গায় আসে?’

না তাহলে আমার নাম আর আর্থর নাম ওই অপরিচিতা জানবে কীভাবে?’

টিসি নিয়ে মনের আনন্দে ক্লাসে মনোযোগ দেয় সেরিন। আজকেই শেষ ক্লাস। ভাবতে কী যে আনন্দ লাগছে তার। তবে আনন্দটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। কোথা থেকে ভরা পানির বোতল এসে ঠাস করে সেরিনের কপালে লাগে। সেরিন পানির বোতল হাতে নিয়ে পাশে তাকাতে দেখে আকাশ ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ক্লাসে থাকা টিচার সেরিনের দিকে তাকায়। পাশে বসা মেয়েটাও সেরিনের কপাল দেখে। মূহুর্তে ফুলে লাল হয়ে গেছে। সেরিন কপালে হাত রাখে। ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করছে তার।

আকাশকে দাঁড় করায় স্যার। ধমক দিয়ে বলে,
‘ওকে বোতল ছুঁড়লে কেন?’

‘স্যার বোতলটা ওরই। একটু আগে নিয়েছিলাম পানির জন্য। এখন ওকে দিতে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম ও হাতে নিতে পারবে।’

আকাশের সাজানো মিথ্যে কথা শোনে সেরিনের বেশ রাগ হয়। তবে এখন জামেলা বাড়াতে মন চাচ্ছে না। মাথা ব্যাথা করছে তার। সেরিনকে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে পাঠানো হয়। স্যার কল দিয়ে বলে দিয়েছে। তবে এটা বলেনি কীভাবে কী হয়েছে।

আকাশ বসতে,বসতে জুম্মানকে বলে,
‘ভেবেছিলাম চোখটাই ন’ষ্ট করে দিবো। ভাগ্য ভালো কপালে পড়েছে। যাই হোক ব্যাথা ভালোই পেয়েছে।’

‘সাব্বাশ! আজকে একটা ট্রিট পাবো বড় ভাইয়ার থেকে।’

********

সেরিনের কপালে বরফ দেওয়া হয়। ডক্টর আনানো হয়। শুভ্র তো বকেই যাচ্ছে সেরিনকে কীভাবে কী হলো সেটাও বলছে না মেয়েটা। নিশাত সেরিনকে আগলে রাখছে। শুভ্র বার কয়েক জিজ্ঞেস করার পর কিছুই বলেনি তারা। নিষেধাজ্ঞা থাকায়! শুভ্র তো নাছোড়বান্দা। সেরিন কিছু বলেনি দেখে আর তাকে ধমক দিয়ে জো করেনি। যদি আবার সত্যি সেন্স লেস হয়ে যায়। তবে নিশাতকে তো ছাড়া যায় না। ধমক একটা দিয়ে শুভ্র শুধায়,
‘ও কিসের সাথে আঘাত পেয়েছে? সত্যি করে বলো?’

‘ও..ওই হাটার সময় স্যার দেওয়ালের সাথে।’

নিশাতের কথায় শুভ্র ধমকে বলে,
‘হ্যাঁ চোখ তো কপালে লাগিয়ে হাঁটো। বেশী ছটফট করলে এমনই হবে। আমার কলেজ থেকপ চলে যাবে সুস্থ মতোই যাও। পরে তো তোমার বাবা আমায় ধরবে তার মেয়েকে আমি মেরে পাঠিয়েছি।’

মিশাত, সেরিন দু’জনে চুপ। কিছুক্ষণ পর শুভ্র সেরিনকে গাড়ী ঠিক করে দিয়ে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। মাহিকে বলে দেয় দেয়ালের সাথে আঘাত পেয়েছে সেরিন।

********

চৌধুরী বাড়ীতে আরেক ঝড় উঠেছে। সেটা হলো গতকাল সন্ধ্যার সিসিটিভি ফুটেজ কেউ ডিলিট করে দেয়। ব্যপারটা কেমন জেনো! সবার মাথায় তালগোল পাকানোর মতো হয়ে গেছে। তবে আর্থ বেশ ভালো বুঝেছে এই চার দেওয়ালের মাঝে এমন কিছু আছে যেটা তাঁদের সবার অবগত নয়। কিছু তো আছে যেটা তারা কেউই জানে না তবে একজন ব্যক্তি জানে। যে প্রথমবারের মতো ধরা পড়তে গিয়েও পড়েনি। আরফিন চৌধুরী এই নিয়ে চিল্লাচিল্লি করেছে সন্ধ্যা থেকে। আয়মান চৌধুরী সুলতানা খানমকে বকাঝকা করছে। কেনো সবকিছুতে নজর রাখে না। অবশেষে শুভ্রর মা জান্নাতুল ফেরদৌস সিদ্ধান্ত নেন, ‘বাড়ীর সার্ভেন্ট, কাজের বুয়া সব চেন্জ করার।’

এতে সবাই একমত দেয়। জান্নাতুল ফেরদৌস শুভ্রর পাশে বসা। তিনি শুভ্রর কফির মগ এগিয়ে দিতে,দিতে বলেন,
‘গতকাল সন্ধ্যায় যা হলো! এখন আবার সিসিটিভি ফুটেজ উধাও। এসব কী এমনি এমনি হয়ে যায়? কারোর তো হাত আছে এসবের পেছনে।’

তখন আর্থ বলে,
‘যেখানে ফুটেজ,ল্যাপটপ, মেশিন রাখা ওই রুমটায় কে প্রবেশ করেছে লাস্টে সেটা কেউ দেখেছো?’

আর্থর কথায় সুলতানা খানম বলেন,
‘আমরা সবাই ব্যস্ত। এসবে নজর রাখবে কে? যেমন তুমি তোমার চাচ্চু, ভাইয়া তারা বাইরে দৌড়াদৌড়ি করে। আমি ভাবী অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শুভ্র তো কলেজ নিয়ে। আর ভেতরে সার্ভেন্ট আর কাজের লোকই থাকে। তারাও তাঁদের মতো ব্যস্ত।’

তাঁদের এতোসব চিন্তা ভাবনায় শুভ্রর অনিহা। এসবে তার মনোযোগ আসছে না। সবার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে শুভ্র নিজের রুমে চলে যায়। আজকে কাজ করার ইচ্ছে নেই তাই ল্যাপটপের সামনে বসেনি। মাথা ব্যথা করছে প্রচুর সেজন্য মেডিসিন নিয়ে শুয়ে পড়ে। গতকাল সে মাথায় আঘাত পেলো আজকে সেরিন! তাঁদের মধ্যে কিছু একটা মিল আছে। ভেবে শুভ্র হাসে। যদিও সেরিন চলে যাবে আর আসবে না তার ক্যাম্পাসে।

সেরিনকে নিয়ে এক্সট্রা চিন্তা ঢুকে গেছে কিরণ পাটওয়ারীর মনে। তার মনে হয় কেউ কোন কারণে সেরিনের পেছনে পড়েছে। আগামী কালকে সেরিন ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। কিরণ পাটওয়ারী নিজে তাকে নিয়ে যাবে। সেজন্য তুষি সেরিনের একটু বেশী যত্ন করছে। যদিও সেরিন অলওয়েজ স্ট্রং। আজকের রাতটা সে তার রুমটা ঘুরেঘুরে দেখছে। তার সাজানো রুমটা আবার কবে না কবে আসা হয়।

দেওয়ালে তার নাম বসানো সাথে স্পেশাল কিছু লেখা বসানো। তাতে হাত ভোলায় সেরিন। নামটা এমন ভাবে বসানো না ভাবলে কেউ বুঝতে পারবে না কী লেখা। সেরিন নি৷ জের কাজে নিজেই হাসে।

********

বাবুর আব্বুর দেওয়া চিঠিটা পড়ে মুচকি হাসে অপরিচিতা। মনে,মনে বলে,
‘হুট করে একদিন দেখা হবে আমাদের। হয়ত গল্পের পূর্ণতায় নাহয় গল্পের শূন্যতায় কল্পনার শহরে। তবে তুমি ভুলে যেও না আমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে।’ (কপি করা নিষেধ)
লেখা:শার্লিন হাসান

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৮|
#শার্লিন_হাসান

দীর্ঘ তিনঘন্টার বাস জার্নির পর ঢাকায় এসে পৌঁছায় সেরিন এবং কিরণ পাটওয়ারী। সেরিনের আন্টির বাসায় তারা প্রথমে যায়। সেরিনের আন্টি সানজিদা শারমিন তাঁদের জন্য লান্স রেডি করে। ফ্রেশ হয়ে সেরিন তাঁদের সাথে দুপুরের লান্স করে নেয়। বাসায় সানজিদা শারমিনের একটা মেয়ে এবং ছেলে আছে তবে তারা স্কুলল। তারা একজন ফাইভে আরেকজন সেভেনে পড়ে। টুকটাক গল্প করে সেরিন রুমে এসে রেস্ট নেয়। আগামী কালকে নতুন কলেজে যাবে সে। এই বাসায় এর আগেও আসা যাওয়া থাকা হয়েছে। অনেকটা নিজের বাড়ীর মতোই সেরিনের কাছে। মা আন্টি একই হিসাব! সেরিনকেও তার আন্টি অনেক বেশী আদর যত্ন করে।

সন্ধ্যায় তারা নাস্তা করে। সেরিন তার আন্টির ছেলে মেয়ে সিদাত এবং আয়াশের সাথে টুকটাক গল্প করে। সিদাত একটু বুঝরুক হলেও আয়াশ একটু কমই। তবে সেরিনের কাছে দু’জনই ছোট বন্ধুর মতো। সেও ছোট বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করে।

সেরিন তার প্রয়োজনীয় জামাকাপড়,জিনিসপত্র আনলেও তার গিটার টা আগে নিয়েছে। সে এখানের গানের স্কুলে এডমিশন নিবে। পার্ট টাইমটা তার শখের পেছনে ওয়েস্ট করবে।

শশীর কল আসতে সেরিন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে শশী অভিমানী স্বরে বলে,
‘থেকে গেলে খুব কী ক্ষতি হতো?’

‘না হতো না। তবে ক্ষতি না হলেও ক্ষত হতো।’

‘হুম! ভালো। তোকে অনেক বেশী মিস করি চঞ্চল মেয়ে।’

‘আমি ও মিস করি। আবার তাড়াতাড়ি দেখা হবে আমাদের।’

‘আমার এক্সামের আগে আসবি? প্লিজ,প্লিজ!’

‘আচ্ছা দেখি।’

‘দেখি না তোকে আসতে হবে। বায় দ্যা ওয়ে তুই চলে যাওয়ার পর ফুফি কী বলেছে জানিস?’

‘কী?’

‘বলেছে সেরিনকে ঢাকা নেওয়ার কী আছে? শশী তো এখানেই পড়াশোনা করছে। বেশী সমস্যা হলে কলেজ এক্স চেন্জ করে নেক। আর অক্ষর তো তিন দিন পর বিডি আসছেই।’

‘অক্ষর ভাইয়া আসলে সবাই নিশ্চয়ই বেশী মজা করবে। কত প্লানিং করবে,পিকনিক করবে তাই না?’

‘সে তো করবেই। ফুফির একমাত্র ছেলে তাও কতবছর পর দেশে আসবে। বিয়েটা করে নে তাহলে আরো বেশী মজা হবে।’

‘ধুর! কিসের বিয়ে?’

‘তোর রুমে কিছু পেপার্স দেখলাম রঙিন। এগুলো আবার কবে আনলি? সাথে নিয়ে যাসনি?’

‘মনে ছিলো না। থাক আমি কয়েকদিন পর যাবো দরকারী কিছু আনবো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

কিছুক্ষণ কথা বলে সেরিন রেখে দেয় কল।

*******

এরই মাঝে কয়েকদিন কেটে যায়। অক্ষর দেশে আসে। সেরিন নতুন কলেজে এডমিশন নেয়। কুমিল্লা আর যাওয়া হয়নি তার। সবার জীবন সুন্দর ভাবে চলছে। তবে অক্ষর সেরিনকে দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। দিনটা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা। চৌধুরী পরিবার সবাই বসেছে এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করা নিয়ে। আগামী কাল শুক্রবার এনগেজমেন্ট হবে। পাটওয়ারী বাড়ীতে জানিয়ে দেওয়া হয়। আর্থর এন্গেজ, বিয়ে হয়ে যাবে অথচ শুভ্রর বিয়ের খবর নেই। তবে তাকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করা হয়েছে পছন্দের কেউ থাকলে বলতে প্রস্তাব পাঠাবে। শুভ্র না বলে। তার পছন্দের কেউই নেই। তবে আরফিন চৌধুরী ঠিক করেন অন্য কোথাও মেয়ে দেখবেন। দুই ভাইকে একসাথেই বিয়েটা দিবেন।

এতে আয়মান চৌধুরী সম্মতি দেয়নি। আর্থও দেয়নি।তাতে কী আরফিন চৌধুরী ঠিক করে নিয়েছেন তার এক বন্ধু মিনিস্টারের মেয়ে তার জন্য প্রস্তাব পাঠাবে। কথাটা প্রকাশ করতে জেনো লিভিং রুমে বোম পড়লো। শুভ্র মূহুর্তে মেজাজ হারায়। আয়মান চৌধুরী তাকে চোখ দিয়ে ইশারা করছে চুপ থাকার জন্য। তাঁদের এই কথা ওই কথার মাঝে আর্থ সাহস করে বলে উঠে,
‘সেরিন পাটওয়ারী মেয়েটা কেমন বাবা?’

‘ভালোই তো।’

আরাফ চৌধুরী এবং আরফিন চৌধুরী উৎসুক হয়ে বসে আছে। তখন আর্থ বলে,
‘ভাবছি দুই ভাই এক বাড়ীতে বিয়ে করবো।’

‘ওনাদের মেয়েকে ওনারা বিয়ে দিবেন না এখন।’

গম্ভীর মুখ করে বলে শুভ্র। শুভ্রর কথায় আর্থ বলে,
‘তুমি চুপ থাকো। দিবেনা কেনো? অবশ্যই দিবে!’

‘তোহ আমি তো সেদিন বলেছিলাম।ওনারা হ্যাঁ না কিছুই বলেননি।’

আয়মান চৌধুরীর কথায় আরাফ চৌধুরী বলেন,
‘তোহ সেরিনের জন্য কী গেছে? ভাইয়া তো বললো তার কোন বন্ধুর মেয়ে আছে। শুভ্রর জন্য যোগ্য পাত্রী সেই হবে। আর সেরিন অনেক ছোট! শুভ্রর সাথে যায় না। আর অন্যদিকে স্টুডেন্ট ব্যপারটা বা’জে দেখায়।’

আরাফ চৌধুরীর কথায় আর কেউ কিছু বলেনি। সেদিনের মতো তাঁদের কথাবার্তা শেষ হতে নিজেদের কাজে যে যার মতো রুমে চলে যায়। কাজের বুয়া
ডিনারের জন্য রান্না বসায়। জান্নাতুল ফেরদৌস সেসবে হেল্প করছেন। তবে নিরা এবং সুলতানা খানম তারা তাঁদের অফিসের কাজে ব্যস্ত।

রান্না বান্না শেষ হতে বুয়াকে টেবিল সাজাতে বলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। বুয়া যেতে তিনি নরমাল একটা প্লেটে কিছু ভাত এবং দুপুরের রান্না করা তরকারি নেয়। তাও খুবই স্বল্প পরিমানে। সেটাও একসাইডে ঢেকে রেখে দেন তিনি।

আর্থ শশীর সাথে কলে কথা বলছে। বিশেষ করে শুভ্রর জন্য আফসোস করছে সে। শশীকে বলছে কিছু একটা করতে। তখন শশী বলে,
‘অক্ষর ভাইয়া দেশে এসেছে। আর ফুফি থাকতে সেরিনকে অন্য কোথাও দিবে না। প্রয়োজনে অপেক্ষা করবে দুইবছর। তাও সেরিনকে তার ছেলের বউ হিসাবে চাই।’

‘তোমার ফুফির এতো শখ কেন? আমার ভাইয়ার বাবুর আম্মুকে অন্যের বাবুর আম্মু বানানোর।’

‘এহহ বাবুটা বুঝি সেরিনের সাথেই আছে?’

‘নেই যাই হোক! ইন্টারেস্টিং! ভাইয়াকে কেউ বাবুর আম্মু সেজে চিঠি দেয়।’

‘তোহ? তাই বলে আমার বোন বুঝি সেই বাবুর আম্মু?’

‘সেটাই কেউ জানে না এখনো।আমার ভাইটাও দেখো! দুনিয়া কাঁপায় অথচ তার হৃদপিণ্ড কাঁপায় কোন এক অষ্ঠাদশী অপরিচিতা!’

‘ভালোই তো! তা বাবুর আম্মুর চিঠি পড়ে শুভ্র স্যার খুশি হোন নাকী বিরক্ত হোন?’

‘দাঁড়াও জিজ্ঞেস করছি।’

আর্থ উঠে সোজা শুভ্রর রুমে চলে যায়। শুভ্র ল্যাপটপে ব্যস্ত। আর্থ তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ব্রো বাবুর আম্মুর চিঠিতে তুমি বিরক্ত?’

শুভ্র তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,
‘হঠাত তার কথা কেন?’

‘বলো না?’

‘আরে না এসব আমি ভাবি না। বিরক্ত তো দূরের কথা।’

‘চিঠি আসেনা?’

‘আসে তো!’

‘আজকে এসেছে?’

‘হুম! গতকাল ও এসেছে।’

‘তোহ বলো না?’

‘হুম ভালো। তবে অপরিচিতা ভীষণ ছটফটে চঞ্চলতা। তার লেখার ধরণে বুঝা যায়।’

‘তুমি বিরক্ত কীনা সেটা বলো।’

‘না একদম না! ব্যপারটা ভালো লাগে।’

আর্থ প্রস্থান করে। শশী হেঁসে বলে,
‘তোমার ভাই কাকে চায়? অপরিচিতা বাবুর আম্মু নাকী সেরিনকে?’

‘কাউকেই চায় না। অপরিচিতার চিঠি সুন্দর। আর সেরিনের গানের ভয়েস। দু’জন আলাদা ব্যক্তি!’

‘ভালো।’

আর্থ শশীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয়। পুনরায় নিজের ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ে।

********

পাটওয়ারী বাড়ীতে অক্ষর এবং সাহিনূর পাটওয়ারী আসেন। মাহি এবং কিরণ পাটওয়ারী বাজার থেকে এসেছে একটু আগে। শশীর কয়েকজন মেয়ে কাজিন আগামী কালকে আসবে। অক্ষরকে কোল্ড ড্রিং দেয় শশী। তবে তার কফি লাগবে। শশী নিজে কফি বানিয়ে অক্ষরের জন্য নিয়ে আসে। সেরিনের রুমের ফ্যানের নিচে বসেছে অক্ষর। রুমটা সাজানো গোছানো হলেও রুমের মালিক নেই। কত বছর হয়েছে সেরিনকে দেখেনি অক্ষর তবে দেওয়ালে জুলানো ফটোর অ্যালবাম গুলো দেখছে। এর আগেও এখানেই চোখ ভোলাতো সে। অবশ্য মনে,মনে জব্দ করে নিয়েছে রুমটায় একদিন তার ও অধিকার থাকবে।এবং সেটা খুব শীঘ্রই। মাহি অক্ষরের সাথে বসে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অক্ষরের কথায় মাহি সেরিনকে ইন্সটায় ভিডিও কল দেয়।
তখন সেরিন প্রেকটিক্যাল লেখছিলো। মাহির কল পেতে রিসিভ করে সালাম দেয়। মাহি এক গাল হেঁসে বলে,
‘অক্ষরের সাথে কথা বল। বেচারা তোকে দেখার জন্য উতালা হয়ে আছে।’

কথাটা বলে অক্ষরকে ফোনটা দেয়। সেরিন নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নেয়। তখন একটা সুমিষ্টি শান্ত পুরুষালি কন্ঠ সেরিনের কানে আসে৷ সেটাতে সে খুব ভ্দ্র ভাবে বলছে,
“কেমন আছো সেরিন?’

প্রতিত্তোরে সেরিন বলে,
‘আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?’

‘এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তা কুমিল্লায় আসছো কবে?’

‘এক্সাম দুইদিন পর। লেট আছে!’

‘গান কেমন চলছে?’

‘মোটামুটি তেমন সময় হয়না।’

‘হ্যাঁ যাই হোক আগে তোমার পড়াশোনা। গানের জন্য সময় আছে সামনে।’

‘হ্যাঁ!’

সেরিন অক্ষরের মুখের আদল খেয়াল করে। গোলাপী অধর জোড়ায় কী প্রানবন্তর হাসি। সেরিন ও হাসে। অক্ষরের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিয়ে নিজের লেখায় মনোযোগ দেয় সেরিন।

অক্ষর উঠে দেওয়ালে সেরিনের লাগানো নাম গুলো দেখে। Serin Patwary Mishat. সাথে Music Lover
ঠিক ঠাক লাগলেও পরের নামগুলো কেমন জেনো! Nizar Roshat rbuab Apaap.

মাহীকে ডেকে আনে অক্ষর। লেখা গুলো দেখিয়ে বলে,
‘এগুলো কী কোন ব্র্যান্ডের মেম্বারদের নাম?’

‘কী জানি! সেরিন ভালো জানে।’

অক্ষর আর সেসব নিয়ে ভাবেনি। সে প্রস্থান করে। তার আম্মু এবং মামনিরা কাজে ব্যস্ত। শশী বড়দের খাবার সার্ভ করে দেয়।

******

চৌধুরী বাড়ীতে সবার খাওয়া দাওয়া হতে যে যার রুমে চলে যায়। সার্ভেন্ট, কাজের বুয়া তারাও খেয়ে দেয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়ে। জান্নাতুল ফেরদৌস এই দিকটা ফাঁকা করে খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে বাইরের সব লাইট অফ করে দেয়। মেইনডোর দিয়ে বেড়িয়ে সে বাড়ীর পেছনের দিকটায় চলে যায়। তখন আবার আর্থ ও ফোন হাতে লিভিং রুমে আসে। পানি নেওয়ার জন্যই! মেইনডোর খোলা! কেউ তালা দেয়নি বাইরের যে কেউ প্রবেশ করতে পারবে ভেতরে। আর্থ জগটা টেবিলের উপর রেখে ফোন কানে নিয়েই বাইরে আসে। কিছুটা ঘাবড়ে যায় সে। কল কেটে ফোনের ফ্লাশ অন করে। জোরে চেঁচিয়ে সার্ভেন্ট দের ডাকে। আর্থর ডাকে বাকীরাও বেড়িয়ে আসে। আর্থ চেঁচিয়ে বলে,
‘কী কাজ করো তোমরা? রাত বাজে বারোটা! বাইরের লাইট অফ কেনো? বাড়ীতে আউটডোর কে আসে না আসে কিছুই তো সিসিটিভিতে উঠবে না। এই জন্যই সেদিন শুভ্র ভাইয়ার উপর অ্যাটাক হয়েছে। এখন যদি আমি যেতাম নিশ্চয়ই আমার উপর ও এট্যাক হতো। বাইরে শত্রুর অভাব নেই তারউপর তোমরাও শুরু করলে। কারোর কোন ক্ষতি হলে কাউকে ছাড়বো না আমি। লাইট অন করো।’

একজন সার্ভেন্ট তড়িঘড়ি লাইট অন করে। আর্থর চেঁচামেচি দেখে একজন বলে,
‘লাইট অন ছিলো। কেউ বাইরে গিয়েছে হয়ত।’

‘কে যাবে বাইরে?’

‘এখানে যিনি উপস্থিত নেই তিনিই। আর হয়ত ওনি এসব জানেন। রাতের বেলায় লাইট অফ হয়ে যাওয়া। শুভ্র স্যারের উপর অ্যাটাক হওয়া।’

তখন আয়মান চৌধুরী সবাইকে দেখে বলেন,
‘ছোট বৌদি আমাদের সাথে নেই।’

‘কী হয়েছে এতো ভীড় আর চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?’

জান্নাতুল ফেরদৌস সিঁড়ি দিয়ে নামতে, নামতে বলেন। বাকীরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আর্থ সব বলে। জান্নাতুল ফেরদৌস ক্ষিপ্ত মেজাজে বলেন,
‘আগামী কালকে এনগেজড সেরে তারপর সব কয়টাকে আমি ছাঁটাই করছি। আমাদের বাড়ী থেকে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’

কেউ আর কিছুই বলেনি। যে যার মতো পুনরায় রুমে চলে যায়।

********

‘এতো, এতো আনন্দের মাঝে কেউ একজনের মনে একরত্তি শান্তি মিলছে না। কারোর জন্য মনটা হাহাকার করছে। খুব করে তার কাছে টানছে। কিছু,কিছু সময় অনেক কিছু মিথ্যে মনে হয় তো আবার সত্যি বলেও প্রমাণিত হয়। মন টানে! ইশশ আড়ালে কেউ আছে। একটু তো ঘেঁটে দেখা দরকার। কেউ আমায় স্মরণ করছে। কারোর পাশে আমায় টানছে। ভীষণ করে টানছে! তবুও যে বাস্তবতায় এসব নিত্যান্ত মিছে নাটক আর কল্পনা মনে হয়।’

#চলবে

হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-১৫+১৬

0

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৫|-|১৬|
#শার্লিন_হাসান
|১৫|
‘মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ। শুভ্র বিয়েটা হবে তো?’

শুভ্র মাথা চুলকায়। তখন আবার সিহান পাটওয়ারী আসে সাথে তার বোন সাহিনূর পাটওয়ারী। শুভ্র ভদ্র মহিলার দিকে একনজর তাকায়। এনি সেই মহিলা যার জন্য এখন তাদের দুই ভাইকে বিয়ে করার জন্য তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে। সাহিনূর পাটওয়ারী সামনের সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়েন। সিহান পাটওয়ারী শুভ্র,আয়মান চৌধুরী এবং আরাফ চৌধুরীর সাথে কথা বলেন।

চৌধুরী পরিবারের বাকী সদস্যদের আসতে একটু লেট হয়। তবে সবাই আসে! একমাত্র জান্নাতুল ফেরদৌস ছাড়া। অবশ্য আর্থর এতে কিছু যায় আসে না। তার বিয়েতে সে না থাকলেও কিছু যায় আসবে না। সুলতানা খানম আর মিরা তুষি এবং সাইয়ারার সাথপ এটা ওটা হেল্প করছে। ভীষণ মিশুক প্রকৃতির তারা দু’জন। সেরিন ও তাঁদের সাথে কথা বলে।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে শশীকে আনা হয়। মেরুন কালারের শাড়ীতে শশীকে সাজানো হয়। শশীকে আনা হতে আর্থ তার দিকে হা করে তাকিয়ে রয়। পাশ থেকে শুভ্র তাকে ধাক্কা দিতে নজর সরিয়ে ফ্লোরে স্থির করে আর্থ। শশীকে দেখতে গিয়ে সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো তার শ্রদ্ধেয় পিতা মাতা যে এখানে উপস্থিত আছে। সে সবার সামনে আর যাই হোক বাবা নায়ের সামনে ভালো একটা ছেলে। বেপাশ কথাবার্তা ও বলে না তাঁদের সামনে। শশীকে দেখা হতে মিরা ইসলাম এক জোড়া বালা তার হাতে পড়িয়ে দেয়। চৌধুরী পরিবারের সবাই মোটামুটি গোল্ডের কিছু না কিছু শশীকে দিয়েছে। শুধু আর্থর তরফ থেকে কিছুই দেয়নি। সে তো এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড হলে সেদিন দিবে। তাঁদের দেখাদেখির পালা শেষ হতে আয়মান চৌধুরী বলেন,

‘পাটওয়ারী সাহেবরা একসাথে দুই মেয়েকে বিয়ে দিন। নেচে গেয়ে! যেহেতু শুনেছি ওদের বেড়ে উঠা সবকিছুই টুইনের মতো। আমাদের তো আরেকটা ছেলে আছেই! সমস্যা নেই।’

তখন সাহিনূর পাটওয়ারী বলেন,
‘সেরিনকে আমার অক্ষেরের বউ করবো। এটা আমার অনেক আগপর ইচ্ছে। আমার ছেলের ছোট্ বেলায় ঠিক করে নিয়েছি আমি শশী বা সেরিন যেকোন একজনকে নিবো। যেহেতু শশীর বিয়ে ঠিক অফকোর্স সেরিনই আমার ছেলের বউ হবে। নেক্সট উইকে অক্ষর দেশে আসছে। সমস্যা নেই আপনারা চাইলে ওঁদের বিয়েটা একসাথেই হবে।’

সাহিনূর পাটওয়ারীর কথায় মূহুর্তে শুভ্রর মাথা গরম হয়ে যায়। কপালে আঙুল দিয়ে স্লাইড করছে। আর্থ তাকে থামিয়ে,থামিয়ে রাখছে। কারণ শুভ্র রেগে একটা ধমক দিলে সাহিনূর পাটওয়ারী চারদিন অজ্ঞান থাকবে।

তখন আয়মান চৌধুরী বলেন,
‘না আপনার ছেলের জন্য বলিনি। আমাদের চৌধুরী পরিবারের ছেলের জন্য বলেছি।’

‘ব্যপারটা মন্দ হতো না।’

আরাফ চৌধুরী বলেন। কিন্তু পাটওয়ারী পরিবারের কেউই কিছু বলেনি। তবে মূহুর্তে প্রসঙ্গ পাল্টে নেয় সিহান পাটওয়ারী। তার কথার ধরনে বুঝায় মেয়েকে এখন বিয়ে দিবে না সে। কারোর সাথেই না।

শুভ্র আর্থকে নিয়ে উঠে ভেতরের দিকে যায়। মাহি সহ আছে তাঁদের সাথে। মাহি তাঁদের কে দেখিয়ে দিচ্ছে কোনটা কার রুম। শুভ্র কোন কথা কানে না নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়ে। মাহি আর্থর সাথে কথা বলছে।
শুভ্র রুমে প্রবেশ করতে খেয়াল করে রুমটা বেশ পরিপাটি হলেও দেওয়ালে একটা ছবির এলবাম সেটা সেরিনের। সোফায় উপর একটা গিটার রাখা। রুমের দেওয়ালে কত স্টাইলের তোলা সেরিনের ছবি জুলানো। সেই সাথে লাইটিং করে ডেকোরেশন করা। রুমটা শুভ্রর পছন্দ হয়। তবে পড়ার টেবিলের সামনে এসে একটা কাগজ জাতীয় কিছু রাখে শুভ্র।

কোথা থেকে তড়িঘড়ি সেরিন রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র একসাইডে দাঁড়ানো। সেরিনের সেদিকে খেয়াল নেই। সে কোন দরকারে টেবিলের সামনে যেতে একটা খাম দেখে। মূহুর্তে মেজাজ বিগড়ে যায় তার। খামটা হাতে নিয়ে সাইডে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,
‘ছাতার মাথার চিঠি এখানে আসলো কীভাবে? কোন বা’লই কাজে লাগে না।’

বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকাতে খেয়াল হয় আস্ত একটা মানুষ দাঁড়ানো। শুভ্র তার দিকে রক্ত চক্ষু করে তাকিয়ে আছে। সেরিনের গলা শুকিয়ে আছে। এমনিতে সে শুভ্রকে ভয় পায়। তার ওই ভয়েস যেটা দিয়ে ধমক একটা দেয় আর ক্যাম্পাস কেটে উঠে। সেরিনের মনে পড়ে তাদের রুম গুলো সাউন্ড প্রুফ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে! যাতে শুভ্র ধমক দিলে বাইরে না যায়। দেরীও হয়নি শুভ্র হাত উঠিয়ে জোরে এক ধমক দিয়ে বলে,
‘হাউ ডেয়ার ইউ। এক থাপ্পড় দিয়ে কানা বানিয়ে দেবো বলে দিলাম তুমি…’

বলার আগে সেরিন ঠাস করে নিচে পড়ে যায়। আর্থ মাহিও সেই মূহুর্তে রুমে আসে। সেরিনকে পড়তে দেখে তারা শুভ্রর দিকে তাকায়। সে হাত সেভাবে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মাহি তড়িঘড়ি সেরিনের কাছে যায়। আর্থ শুভ্রকে খোঁচা মেরে বলে,
‘ছিহ্! আমার শালিটাকে তুমি এখনি অজ্ঞান করে দিলে? বাসর করা লাগবে না তোমার। বিয়েই হবে না দেখো।’

‘চুপ থাকবি তুই? এমনিতে মাথা গরম তার উপর মেয়েটা যা বেয়াদবি করলো।’

‘ও অজ্ঞান হয়ে গেছে ভাই।’

ওপাশ থেকে মাহি বলে। শুভ্র এবং আর্থ ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যায়। তখন আর্থ বাইরে গিয়ে তুষিকে ডেকে আনে সেরিন অজ্ঞান হয়ে গেছে। মূহুর্তে কথাটা জেনো বা’জ পড়ার মতো ছিলো। সবাই হতদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সাইয়ারা এবং তুষি সেরিনকে কিছুক্ষণ ডাকে। মাহি সেরিনকে কোলে নিয়ে খাটের উপর শুইয়ে দেয়। বাকীরা বোকার মতো ডাকাডাকি করছে। যা দেখে শুভ্রর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। তেজ দেখিয়ে বলে,
‘ও এভাবে উঠবে না। ডক্টর আনানো হোক।’

শুভ্রর কথায় কিরণ পাটওয়ারী আর দেরী করেননি ডক্টরকে কল লাগান। বাকীরা বসে,বসে গসিপ করছে সেরিন কীভাবে অজ্ঞান হলো। আর্থ শুভ্রকে বকেই যাচ্ছে। কেনো সেরিনকে সে ধমক দিতে গেলো।

সবাই মূহুর্তে নিরব হয়ে সেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ডক্টর আসতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে সিহান পাটওয়ারী। তার মেয়ের আবার কী হলো? ডক্টর সেরিনকে দেখে বলে,
‘সেরিন কিছু নিয়ে ভয়ে ছিলো। আর ভীষণ ভয় পেয়েছে মেয়েটা। চিন্তা করবেন না ঘন্টা খানেকের মধ্যে
জ্ঞান চলে আসবে।’

‘ঘন্টা খানেক সময় লাগবে কেনো? এখনি জ্ঞান আসবে না কেনো?’

শুভ্র পাল্টা প্রশ্ন করে ডক্টরকে। ডক্টর শুভ্রকে দেখে কিছুটা হতদন্ত হয়ে পড়ে। আমতাআমতা করে বলে,
‘অজ্ঞান হলে তো আর সাথে,সাথে জ্ঞান চলে আসেনা তাই না? একটু তো লেট হয়ই।’

‘এসব পুরনো গল্প। আমায় এসব শেখানো লাগবে না।’

শুভ্রর এমন রিয়েক্ট করা কারোরই সুবিধার ঠেকছে না। আর্থ তার মুখে হাত দিয়ে তাকিয়ে নিয়ে প্রস্থান করে। লিভিং রুমে আসতে শুভ্রকে কয়েক গা লাগিয়ে দেয় আর্থ।

‘ভাই কন্ট্রোল মানলাম ওর প্রেমে উ’ষ্ঠা খেয়েছিস। তো বড়রা আছে তো!’

‘তুই চুপ থাক তো। আমায় রিজেক্ট করলো এই পাটওয়ারী পরিবার? আমার মতো ছেলে পাবে তো তারা? লাগবে না এই পাটওয়ারী পরিবার বিয়ে করা। কত সেরিন আসবে আর যাবে শুভ্রর জন্য।’

‘তাহলে তোর বিয়েটা ক্যান্সেল?’

‘হুম।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘

শুভ্র সোফায় এসে বসে পড়ে। তার তো সাহিনূর পাটওয়ারীকে কয়েকটা ধমক দিতে মন চাচ্ছে। সেরিন মেয়েটা তো খুব সাহসী। শুভ্রর খুব তো বদনাম করতো বুক ফুলিয়ে। এখন ধমক একটা খেয়েই এই অবস্থা? শুভ্র ভাবছে আসলেই তার ধমকে মানুষ অজ্ঞান হয়? হবেই তো! সে তো যেখানে যায় সেই জায়গাটাই নিরব। ত্যাড়া রগের স্টুডেন্ট ও তখন সোজা। শুভ্র ভাবছে তার ধমকা ধমকি টা একটু হলেও কমাবে।

সেরিনকে নিয়ে মোটামুটি বসাই ব্যস্ত হলেও চৌধুরী পরিবারের সবাই আফসোস করছে তার জন্য। শশী তাকিয়ে আছে সেরিনের দিকে। আর্থ শশীকে দেখছে। আয়মান চৌধুরী শুভ্রর পাশে এসে বসে। মুখে গম্ভীর্যতা টেনে বলে,
‘ধমক দিয়েছো তুমি?’

‘হুম।’

হতাশ হয়ে যায়ন আয়মান চৌধুরী। কী আর করবে সম্মোন্ধ। যেখানে শুভ্রর ধমকে মেয়েটা অজ্ঞান সেখানে বিয়েশাদি ইম্পসিবল। তখন আর্থ এসে বলে,
‘চাচ্চু শুভ্র ভাই বিয়ে টিয়ে করবে না। ক্যান্সেল। এখন আমারটার এন্গেজ ডেট ফিক্সড করে নিও।’

আয়মান চৌধুরী শুভ্রর দিকে তাকাতে শুভ্র হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়ায়। সেদিনের মতো সবাই বিদায় নিয়ে আসে। কল দিয়ে এনগেজমেন্ট ডেট ফিক্সড করার কথা বলে। শুভ্র নিজের গাড়ী নিয়ে একাই চলে আসে। গাড়ীতে বসে সেরিনের বাবা আর ফুফির গুষ্টি উদ্ধার করে নেয় সে। পরক্ষণে নিজেকেই গা’লি দেয়।
‘শুভ্র সেরিনের বাতাস পেয়েছিস? করা লাগবক না তোর বিয়ে। বিয়ের নানী টুট…….’

‘আচ্ছা আমি কী দেখতে খারাপ? বয়সের ছাপ কী পড়ে গেলো? শুভ্র লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখে। সাদা রঙের পাঞ্জাবিতে তাকে সত্যি শুভ্র লাগছে। শুভ্র বাড়ীতে এসে নিজের রুমে চলে যায়। করবে না সে বিয়ে।

আয়মান চৌধুরী, আর্থ এবং সুলতানা খানম তারা এক কারে করে আসে। শুভ্রকে নিয়ে তাঁদের হাসি থামছেই না। আসলেই হাস্যকর ঘটনা ক্রিয়েট করলো। ধমকা ধমকি ঠিক আছে তাই বলে এমন ধমক যে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। তারউপর এতো রাগা রেগেছে বেচারা যে এতোদিন বিয়ের জন্য লাফালাফি করলেও এখন বিয়ে করবে না সে।

******

রাতের দিকে সেরিন উঠে বসে। তার সামনে তার ভাইমাহি আর তার চাচ্চু কিরণ পাটওয়ারী বসে আছে। সেরিনকে দেখে কিরণ পাটওয়ারী উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছো আম্মু? সাপ? নাকী ভূত দেখেছো?’

সেরিন ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যায়। কঠোর গলায় বলে,
‘দেখেছিলাম একটা জ্বীন। চাচ্চু ওটার চোখ গুলো দেখে আমি বেশী ভয় পেয়ে গেছি। জানো চাচ্চু ওই জ্বীন আমায় এতো জোরে ধমক দিয়েছে যে ভয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ওই জ্বীন অনেক লম্বা চাচ্চু। তারউপর সাদা পোষাক পড়ে জ্বীন সেজে এসেছে। চাচ্চু আমি যে হার্ট অ্যাটাক করিনি এটাই শুকরিয়া। চাচ্চু আমায় প্লিজ দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক দাও। নাহলে আমি মরেই যাবো জ্বীনের ভয়ে।’

#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৬|
#শার্লিন_হাসান

সেরিন ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যায়। কঠোর গলায় বলে,
‘দেখেছিলাম একটা জ্বীন। চাচ্চু ওটার চোখ গুলো দেখে আমি বেশী ভয় পেয়ে গেছি। জানো চাচ্চু ওই জ্বীন আমায় এতো জোরে ধমক দিয়েছে যে ভয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ওই জ্বীন অনেক লম্বা চাচ্চু। তারউপর সাদা পোষাক পড়ে জ্বীন সেজে এসেছে। চাচ্চু আমি যে হার্ট অ্যাটাক করিনি এটাই শুকরিয়া। চাচ্চু আমায় প্লিজ দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক দাও। নাহলে আমি মরেই যাবো জ্বীনের ভয়ে।’

সেরিনের কথায় মাহি ভিডিও অফ করে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। সেরিন মাহির দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
‘থোতমা টা বন্ধ রাখবি? আমি মরি আর ওনার ঈদ লেগেছে। চাচ্চু ওই জ্বীন যাতে আর আমাদের বাড়ী না আসে প্লিজ।’

‘না,না আর আসবে না। চিন্তা করো না জ্বীনকে তাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কিরণ পাটওয়ারীর কথায় সেরিন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। উঠে কিচেনে যায়। কড়া করে এক মগ কফি বানিয়ে নিজের রুমে আসে। লাইট নিভিয়ে বেলকনিতে যায় সেরিন। যেখানে রাখা দোলনাটায় বসে কফিতে চুমুক দেয় আর বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে নিজের দৃষ্টি স্থির রাখে। কেমন জেনো শূন্য লাগছে নিজেকে। কিছু একটার বড্ড অভাব অনুভব হচ্ছে। সেরিন নিজের মন খারাপকে বেশী পাত্তা দেয়নি। গিটার হাতে নেয়। কী মনে হতে ফেসবুকে একটু ঢু মারে। ভাবে তার অডিয়েন্সের সাথে একটু আড্ডা দেওয়া যাক। অন্ধকার বেলকনিতে বাইরের মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। তাতেই সেরিন গিটারে সুর তুলছে। নিজের মতো করে গান গাইছে সে।

বিকেল থেকে শুভ্রর মন খারাপ। কোন কাজে মন বসাতে পারছে না। সেরিনের গাওয়া গান শুনছিলো শুভ্র। এখন সেরিনের লাইভ দেখছে আর নিশ্চুপ হয়ে গান শুনছে। অনুভব করার চেষ্টা করছে। সে সেরিনের গানের অনেক বড় ভক্ত। যদিও কখনো প্রকাশ করবে না। তাঁদের দু’জনের মন খারাপ! একজন মন ভালো করতে গান গাইছে তো আরেকজন সেই গাওয়া গান শুনে নিজের মন ভালো করছে।

******

পরের দিন সকালে সেরিন প্রাইভেট পড়ে ক্লাসে এটেন্ড করে। তার টিসি মনে হয়না এই জনমে পাবে। হয়ত তার পরিবারের সুবাদে যদি পায়। বাট অন্য স্টুডেন্ট হলে কখনোই পেতো না। শুভ্রর রুলসের মধ্যে একটা হলো, নিজে স্বইচ্ছায় গাড় ধাক্কার সাথে টিসি দিয়ে বের করে দেয়। আরেকটা হলো, টিসি দিবে না মানে দিবেনা। হাজারটা কারণ দেখালেও। আর তার উপর কথা বলার সাহস ও কারোর নেই।

শুভ্র পিটি থেকে এসে নিজের রুমে ঢুকে। আজ-কাল তার মাথাটা গরম হয়ে যায়। সেজন্য কারোর সাথে কথা বলেনা। কখন কার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলে ঠিক নেই। শুভ্রর মনে হচ্ছে আর কয়েকটা চিঠি আসলে ভালো হতো। চিঠি পড়ে হাসতো শুভ্র। শুভ্রর কী মনে হতে করিডোরে যায়। ডাস্টবিনের পাশে কয়েকটা খাম পায়। মূহুর্তে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে শুভ্রর। খামে দু’টো চিঠি পায় শুভ্র। একটায় লিখা,
‘বাবুর আব্বউউউউ! বাবুর আম্মুকে চাই না তাইনা? যদি ভাগ্যে থাকলে কখনো তোর বাবুর আম্মু হইনা তাহলে বাবুকে দেখা, ছোঁয়া তো দূরে থাক।কোলে নিতেই দিবো না।’

শুভ্র চিঠি পড়ে হাসে। দ্বিতীয় চিঠিটায় লেখা,
‘বাবুর আব্বু সত্যি ভালোবাসিইইইইইইইই আপনায়।’

শুভ্র চিঠিগুলো আগের চিঠির সাথে রেখে দেয়। সে জানে এখন সিসিটিভি ফুটেজ চেক দিলে বাবুর আম্মুকে পেয়ে যাবে। কিন্তু জানার ইচ্ছে নেই। অপরিচিত বাবুর আম্মুর চিঠি পড়ার মধ্যে যে অনুভূতি জেনে গেলে সেটা কাজ করবে না। শুভ্র আর সাত পাঁচ না ভেবে বড় একটা কাগজে লিখে,

‘বাবুর আম্মুকে খুঁজে বের করা কোন ব্যপার না। তবে আমি খুঁজতে চাই না আর। এই অপরিচিতার চিঠি গুলো পড়তে চাই। হুট করে একদিন সত্যি বাবুর আম্মু বানানোর প্রথম ধাপ (বিয়ে) করে নিবো। এনি ওয়ে এতো বাবুর আম্মু হওয়ার জন্য লাফালাফি করছো তো
দূরে সরে যাচ্ছো কেন? হুম! এতো গুণবতী হতে হবে না চঞ্চল মেয়ে। চিঠি পাঠ করে তো….. অন্য আরেকদিন বলবো। তেমন ভালো লিখতে পারি না বাবুর আম্মু।’

ইতি
‘বাবুর আব্বু’

শুভ্র কাগজটা একটা খামে রেখে ডাস্টবিনের পাশে রেখে দেয়। উপরে লিখে দেয়, ‘বাবুর আম্মুর জন্য’ চিঠিটার উপর ভারী কিছু রেখে দেয়। শুভ্র জানে আগামী কালকে আবার আসবে চিঠি। তার এসিস্ট্যান্ট সাথে দপ্তরি দেরকে বলে দেয় তার করিডোর বা রুমে যাতে কেউ না আসে। আর না ঝাড়ু দেয় আগামী কাল।

নিশাতের সাথে বসে,বসে এটা ওটা বলছে সেরিন। শশীর এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড হলেও বিয়ে তার এক্সামের পর হবে। একবারে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে। নিশাত সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এমন মন মরা হয়ে বসে আছিস কেন? আচ্ছা এতো কিছু থাকতে হাসিখুশী থাকবি তা না মুখ একটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস।’

‘আমার সব আছে শুধু একটা জিনিস নেই। যার না থাকাটা সব পূর্ণতাকে শূন্য করে দেয়। এতো পূর্ণতার মাঝে একটা শূন্যতাই মনে হাহাকার করে। ভালো থাকতে দেয়না আমায়।’

‘হুম! প্রেমে পড়লে এমনই হয়।’

‘আজব কার প্রেমে পড়লাম? শোন সেরিন কারোর প্রেমে পড়েনি আর না কখনো পড়বে। আমার সুন্দর জীবনে প্রেমের আগমন করে অসুন্দর জীবন গড়তে চাই না।’

‘এটা ভুল কথা। প্রেম জীবনে বলে কয়ে আসে না। কখন কার প্রেমে পড়ে যাই বলতে পারি না। আমরা হুটহাট প্রেমে পড়ি। আর যার প্রেমে পড়লাম ওই মানুষটাকে নিয়ে দিনরাত এক করে ভাবতে থাকি। যতই ব্যস্ত থাকি মাথায় সেই ব্যক্তির নামটাই ঘুরে। এবং সেই ব্যক্তির একটু দর্শন পাওয়া, তার সাথে কথা বলতে পারা অনেকটা শান্তি লাগে মনে। প্রেমে পড়ার অনুভূতি যেমন সুন্দর এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনেক ভয়ানক।’

সেরিন মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শোনে। তবে কোন কিছু বলেনি। তার এসব জেনে কাজ নেই। সে তো কারোর প্রেমে পড়েনি আর না কাউকে ভালোবাসে।সেরিনকে চুপ থাকতে দেখে নিশাত বুঝে ওর এসবে আগ্রহ নেই।

*******

শশীর সাথে আর্থ বিয়ে হবে তাঁদের প্রেম আছে কথাটা কোনভাবে লিক হয়ে যায়। অনেকে ভালো ভাবে নিলেও অনেকে নিতে পারেনি। কারোর কারোর মতে, ‘চৌধুরীদের সাথে পাটওয়ারীদের সম্পর্ক ভালো। আর পাটওয়ারীদের একজন মেয়ে হলেও চৌধুরী বাড়ীতে যেতো।’

কারোর কারোর মতে লো’ভে পড়ে বিয়ে দিচ্ছি এই ছোট মেয়ের। যদিও আর্থ শশী অনেকটাই ঠিক আছে বয়সের দিক দিয়ে। হয়ত পড়াশোনায় একটু গ্যাপ। সেরিনের ও পড়াশোনায় গ্যাপ আছে। প্লে,নার্সারি শেষ করতে,করতে দুই বছর গেলো।

কথাগুলো সেরিনের কানে আসে। সে জানেনা তার বাবারা সেসব খবর পেয়েছে কীনা! সেরিনের জেনো আরো এক্সট্রা চিন্তা ঢুকে গেলো মনে। তারউপর অক্ষর দেশে আসতে বেশীদিন নেই। শুভ্র টিসি দিচ্ছে না। ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না। সেরিন রাগ নিয়ে তার বাবার রুমে যায়। না চাইতেই চিৎকার চলে আসে। চিল্লিয়ে বলে,
‘ওই জ্বীনের বাচ্চা জ্বীনকে বলো টিসি দিতে আমি আর একমূহুর্ত ওই কলেজে যেতে চাইনা। আর আমায় নিয়ে ঢাকা কবে যাবে? কিছুই হচ্ছে না। পরিকল্পনা করে বসে থাকলেই শুধু হয়। বাবা তুমি আজকাল আমার কোন কথাই শোনছো না।’

সিহান পাটওয়ারী মেয়ের চিৎকার শোনে আর একমূহুর্ত ও দেরী করেনি। সোজা শুভ্রকে কল লাগায়। সেরিন পাশে বসা। সিহান পাটওয়ারীর কল রিসিভ করে শুভ্র সালাম দেয়। সিহান পাটওয়ারী সালামের জবাব নিয়ে বলেন,
‘আগামী কালকে সেরিন যাবে। ওর টিসি দরকার। তুমি দিয়ে দিও! ঢাকা পাঠিয়ে দেবো ওকে।’

‘আংকেল আমার কলেজ কী খারাপ বলুন? ঢাকা গেলে এতো প্যারা ও নিতে পারবে না। আর ওকে কেউ র‍্যাগ বা কিছু বলবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আপনার ভালো রেজাল্ট চাই তো নাকী?’

শুভ্রর কথায় সেরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। জানতো শুভ্র এমন কিছুই বলবে। সেরিন তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সিহান পাটওয়ারী বলেন,
‘রেজাল্ট চাই তবে সেটা পরিশ্রম করে। শুধু রেজাল্ট হলেই হবে না ওকে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে।’

‘তাহলে ওর জন্য হোম টিউটর রেখে দিন। আর মাথায় যদি সত্যি কিছু না ঢুকে তো আমার কাছে পাঠান দু’টো বা’রি মেরে ঠিক করে দেই মাথা। তাহলে কথা বলার আগে ব্রেনে সেট-আপ হয়ে যাবে।’

সেরিন তার বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে বলার জন্য। সিহান পাটওয়ারী বলেন,
‘না সেসব কিছু না। সেরিন চায়না এই কলেজে। ও ওর আন্টির বাসায় চলে যাবে। সেখান থেকেই পড়াশোনা করবে।’

‘আচ্ছা আগামী কালকে আসতে বলুন।’

শুভ্রর কথায় সেরিন কিছুটা শক খায়। এতো তাড়াতাড়ি মেনে নিলো? তাতে কী? সেরিনের টিসি ফেলেই হলো।

***********

চৌধুরী বাড়ীতে বিয়ে নিয়ে সব প্লানিং চলছে। যদিও শুভ্র এসবে নেই। তবে আজকে আর্থর জোরাজুরিতে সে সবার সাথে নিচে আসে। বাকীরা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেও শুভ্র উঠে তাঁদের মেইন ডোর খোলে বাইরে আসে। ছোট,ছোট সবুজ ঘাস ভর্তি গার্ডেনে পা রাখতে অন্ধকারে কারোর সরে যাওয়া টের পায় শুভ্র। দু’পাশে গাছ থাকলেও কেউ লুকালেও সেটা দেখা যাবে। তাঁদের বাড়ীটাও না! সামনে অনেকটা গাছ, বাগানবিলাস, মাঝখানে শান দিয়ে বাধাইকৃত ধোয়া সাদা রাস্তা। শুভ্রর খেয়াল হয় লাইট অফ করা। কিন্তু সবসময় তো সন্ধ্যার সাথে,সাথে লাইট অন থাকে। শুভ্র সার্ভেন্টকে আদেশ দেয় বাইরের লাইট সব অন করে দিতে। তখন চোখে পড়ে রাস্তার পাশে সাদা একটা ব্যাগ। শুভ্র কৌতূহল ধমাতে না পেরে সাদা ব্যাগটা হাতে নেয়। ঠিক তখনি তার মাথায় কেউ জোরে আঘাত করে। শুভ্রর থেকে ব্যাগ নিয়ে সেই ব্যক্তি গেট দিয়ে পালিয়ে যায়। শুভ্র মাথার পেছনে হাত দিতে র’ক্তে তার হাত ভিজে উঠে।

#চলবে