Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 267



প্রিয় ভুল পর্ব-৯+১০

0

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন সকালে মীরা ঔষধ আনতে বের হয়ে ফোন করে ওর বান্ধবী লিপির কাজিন পাভেলকে। পাভেল একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী। ওদের সংগঠন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়, প্রায় প্রতি বছরই শীতে গরম কাপড়ও বিতরণ করে, তাছাড়া দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগী যারা টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারে না তাদেরক আর্থিক সাহায্য করে। মীরা নিজেও গত বন্যার সময় ওর পরিবার আত্নীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সাহায্য তুলে জমা করেছিলো ওদের সংগঠনে। শীতের সময় কাপড় জোগাড় করে দিয়েছিলো বেশ কয়েকবার। মীরা নিজে স্কাউটের সদস্য হওয়ায় বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ছোটবেলা থেকেই সক্রিয় ছিলো। সেই সুবাদে পরিচয় পাভেলের সাথে।

লিপি প্রথমেই বলেছিলো পাভেলকে ব্যাপারটা জানাতে। কিন্তু কেম যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকেছে ওর কাছে। পরে লিপি সব জানিয়েছিল পাভেলকে। ও কাগজপত্র চেয়ে পাঠিয়ে ছিলো মীরার কাছ থেকে। মীরা ওকে দিয়ে ছিলো সবই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মীরার টাকাটা জরুরি দরকার ছিলো। আর ওদের সংগঠন তো জমানো টাকা দেয় না, টাকা তুলে তারপর দেয়। সেক্ষেত্রে সময় লাগে অনেক। তার উপর কাগজপত্র যাচাই বাছাইয়ের একটা ব্যাপার থাকে। সে জন্য মীরা সে আশা বাদ দিয়ে নিজেকে বন্ধক রেখেছিলো রাহাতের কাছে।

এতদিন এইসব ঝামেলায় এ কথা ভুলেই গিয়েছিল মীরা। গতরাতে লিপি কল করায় মনে পরে কথাটা। কেন জানি তখন ওর মনে হয় এটা হয়তো রাহাত নামক রাহুর বলয় থেকে নিজেকে বের করে আনার একটা রাস্তা হলেও হতে পারে। শেষ চেষ্টা যে করবে তার জন্য মানসিক শক্তি নেই ওর।

আজ সকালে খবর এসেছে কিছু টাকা জমা হয়েছে, তা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে। লিপি সব খুলে বলেছ পাভেলকে৷ কর্তৃপক্ষ যদি জানে যে রাজিবের চিকিৎসা হয়ে গিয়েছে তাহলে তারা আর সাহায্য করবে না। পাভেল বললো-
: ” দেখো মীরা লিপি সব বলেছে আমাকে, আমি জানি তুমি কী রকম পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছো। তাছাড়া তুমি কেমন মেয়ে, আমি তা জানি, শুধু তোমার জন্য এ কাজটা করছি আমি। জানা জানি হলে আমার এতো দিনকার রেপুটেশন নষ্ট হবে, তুমি ব্যাপারটা সাবধানে হ্যান্ডেল করবে প্লিজ, ভিজিটিং এ যদি আসে তাহলে তাদেরকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমরা যা বলছি তা সব সত্যি”
: ” আমার নিজের ও তো কত দরকার টাকা গুলো, আপনার রেপুটেশন আমি নষ্ট হতে দিবো না ভাইয়া৷ আপনি শুধু আমাদেরকে উদ্ধার করুন, আমার হাতে সময় খুব কম”

দুদিন পর পাভেল মীরাকে কিছু টাকা দেয় পাভেল। বলে এটা সাবধানে রাখতে। এ সপ্তাহের মধ্যে আবার কিছু টাকা আসার কথা আছে, তবে সমস্যা হচ্ছে টাকাটা এবার ফান্ড ম্যানেজার নিজে হসপিটালে ভিজিট করার পর দেয়া হবে। তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বাকী টাকা পাবে তোমরা।

মীরার মাথায় বাজ, কারন ওরা তো বাসায় এসে পরেছে। হসপিটালে তিনি আসবেন কিভাবে? লিপি আর কোচিং এর স্যার বুদ্ধি দিলো কোন এক বাহানায় রাত করে ইমারজেন্সীতে যেতে। তারা অনেক সময় অবজারভেশনে রাখতে রোগীকে হসপিটালে রাখে কিছুক্ষণ। বাকীটা আমরা ম্যানেজ করে নিবো।

সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ হলো। পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালে গেলো ওরা। ডাক্তার অবজারভেশনে রাখলো রাজিবকে। কিন্তু সমস্যা হলো ম্যানেজার সেদিন এলো না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা, সিচুয়েশন সব অনুকূলে রাখা খুব টাফ। কারন পরদিনই যদি আবার যায় হসপিটালে একই বাহানায় হসপিটালের লোকেরা বুঝে যাবে।

পরদিন পাভেল হসপিটালের এক ওয়ার্ড বয়কে কিছু টাকা দিয়ে ঠিক করলো৷ তবে সে ওয়ার্ডে কোন বেড দিতে পারবে না, কারন বেড সব সময় ফুল থাকে। ও যা পারবে তা হচ্ছে একটা স্ট্রেচারে করে হসপিটালের কোন এক জায়গায় ওকে রাখতে পারবে। টেস্ট করাবার রুম গুলোতে সবচেয়ে বেশী ভিড় হয় সরকারী হাসপাতাল গুলোতে। পরে লিপি বুদ্ধি দিলো স্ট্রেচারে রাজিবকে শুইয়ে রেখে ওরা এক্সরে রুমের বাইরে অপেক্ষায় থাকা মানুষ গুলোর মধ্যে মিশে থাকবে। যেন ওরাও অপেক্ষায় রয়েছে এক্সরে করাতে।

ইঁদুর কপালে বলে একটা কথা আছে না? মীরার হচ্ছে সে দশা। কাজ শেষ করে চলে যাচ্ছিলো একে একে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলো। খালি হয়ে যাচ্ছিলো ভিড়ে গিজগিজ করা জায়গাটা। সব লোকের শেষ হয়ে গেছে এবার ওদেরকে ডাকবে। লিপি তাই স্ট্রেচার নিয়ে সরে গেলো অন্যপাশে। একটু পরে কোন রোগী না থাকায় তালা দিয়ে এক্স-রে রুমের লোকটা বাইরে চলে গেলো। তবুও ম্যানেজার ব্যাটার আসার নাম নাই। আসলে তারা এমনি, হুট করে চলে আসে।

এত লম্বা সময় শুয়ে থেকে রাজিবের পিঠে ব্যাথা অনুভূত হওয়ায় রাজিব একটু হাঁটাহাঁটি করবে বলে উঠতে নিতেই মীরা দৌড়ে এসে শুইয়ে দেয় ওকে। রেগে গিয়ে বলে এমন কেন করছো তুমি, সারাদিন তো শুয়ে বসেই থাকো। আজকের দিনটাই তো শুধু”
রাজিব কিছুটা আহত হয় মীরার আচরণে। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর লজ্জায় বলতে পারছে না। এত পেরেশানির মধ্যে রয়েছে চার চারটা মানুষ তাদের ও খাওয়ার নাম গন্ধ নেই। ও কি করে বলে নিজের ক্ষুধার কথা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। এক এক জন করে জমতে লাগলো এক্সরে করাতে আসা মানুষের ভিড়। মীরা এক সময় তাদের সাথে মিশে গেলো। এই প্রথম মীরার এমন ভীড় ভালো লাগলো।

অবশেষে সন্ধ্যার আগে হসপিটালে আসেন ফান্ড ম্যানেজার রুহুল আমীন। তাকে পাভেল বোঝায় যে ওরা এক্সরে করানোর জন্য অপেক্ষা করছে। এমন সময় গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এসে হাজির ওয়ার্ড বয় কুদ্দুস। এসেই চিৎকার চেঁচামেচি করছে স্ট্রেচার চেয়ে। এক বেলার কথা বলে সারাদিন পার করে ফেলেছে বলে রাগারাগি করে সে। লিপি তাকে সাইডে নিয়ে শান্ত করে। বলে এজন্য ওরা তাঁকে বাড়তি কিছু দিবে। তিনি কিছুটা শান্ত হলেন বটে তবে ব্যাপারটা চশমার ফাঁকে চোখ গলিয়ে দেখলো ফান্ড ম্যানেজার রুহুল আমীন। তিনি কি বুঝলেন তা জানা নেই, তবে বললেন তিনি আবার একদিন আসবেন রাজিবের খোঁজ নিতে। মীরা যেন সমুদ্রে পরলো। আরো একদিন আসবে মানে এমন হ্যাপার আয়োজন আরো একদিন সাজাতে হবে!

তবুও ভালো, রাজিবের সাথে কথা বলে চলে যান রুহুল আমীন সাহেব। বলেন আমি নিজেও ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবো ওকে। রাজপুত্রের মতো চেহারা ছেলেটার। টাকার অভাবে ম’র’বে? দেখি কি করা যায়। এই কেইসটা আমি স্পেশাল ভাবে দেখবো বলে মীরার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে চলে যান তিনি। মীরার মায়া হলো এ লোকটার প্রতি। আচ্ছা ওরা এই লোকটাকে কি ঠকাচ্ছে? রুহুল এসাহেব চলে গেলে মীরা রাগত কন্ঠে রাজিবকে বলে-
” ওঠো এবার, অনেক কষ্ট করলে আমাদের জন্য”

রাজিব কিছু বলে না, চুপ করে উঠে বসে সামনে থাকা একটা চেয়ারে। মীরার কেমন খারাপ লাগে ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে ভাবে এভাবে না বললেও পারতো। কিন্তু কি করবে মীরা, ভিতরে এত এত মানষিক চাপ, কুটিলতা নিয়ে সহজ ব্যাবহার আসে না।

পরের সপ্তাহে মীরা মোট পেলো আশি হাজার টাকা।
বানিজ্য মেলায় অর্থ সংগ্রহ ভালো হয়। তাই টাকার অংকটা বেশী এবার। তাছাড়া রুহুল আমীন সাহেব সব জায়গা থেকে কালেক্ট করা টাকা গুলো রাজিবকেই দিতে বললো। কারন কাগজপত্রে তারা কোন ঝামেলা পান নি। এগুলো তো সত্যিই সমস্যা ছিলো রাজিবের।

রাজিবের চিকিৎসায় পুরো তিন লক্ষ খরচ হয় নি, সেখানে হাজার পঞ্চাশের মতো অবশিষ্ট আছে। আর সেই সংগঠন থেকে হাতে এসেছে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার। মোট এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা মীরা একসাথে রাখে। ওর হাতে সময় আছে মাত্র ন’দিন। এর মধ্যে টাকাটা জোগাড় করে রাহাতকে ফিরিয়ে দিবে মীরা।

এদিকে হঠাৎই চট্টগ্রামে বিভীষিকাময় এক অ*গ্নি*কা*ণ্ড ঘটলো। এর আগে এমন বিপর্যয়, এত মানুষের মৃ’ত্যু দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ। ঢাকা থেকে কাপড় খাবার যে যা পারছে সাহায্য পাঠাচ্ছে। তারা এখন সেখানে সাহায্য পাঠাতে ব্যাস্ত। আপাততঃ রোগীর চিকিৎসায় সাহায্য করা বন্ধ রেখেছে তারা। মীরার আর কোন পথ খোলা রইলো না।

অন্ততঃ লাখ দুই টাকা জোগাড় হলেও ফিরিয়ে দিতে যেতে পারতো রাহাতের কাছে। তাও সম্ভব হচ্ছে না পঁচিশ হাজার টাকা কম থাকায়। একেকটা দিন যায় আর একটি করে চিন্তার ভাঁজ যোগ হয় মীরার কপালে। এদিকে কোচিং-এর ভাইয়া একটা পরামর্শ দেন। কলেজে গিয়ে স্টুডেন্টদের কাছে সাহায্য চাইতে। মীরা ক্ষীণ স্বরে বলে এ ভিক্ষাটাই ছিলো বাকী। চল এটাও করে ফেলি, বলেই অপ্রাকৃতস্তের মতে হাসে মীরা। লিপি অপলক চেয়ে দেখে বিশ্রী সেই হাসিটা।

চলবে…

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব -১০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

খুব শীত পরেছে এবার। মীরা সুতির থ্রি-পিছ পরেছে। গায়ে পাতলা একটা চাদর। তাও পুরাতন। পাশের ঘরের ভাবী দিয়েছে ওকে ওর গরম কাপর না থাকায়। কম্বল একটা দিয়েছে লিপি। যদিও তা একজনের মাপের। এদিক টানে তো ঐদিকে ফাঁকা। রাতে এ নিয়ে হাসাহাসি করে দুজনে। যেন সিঙ্গেল কম্বল থাকাটা ভীষণ মজার।

বাড়িতে থাকতে শীতের দিনে প্রায় সবসময়ই পাখা ছাড়া নিয়ে ইরার সাথে রাগারাগি হতো মীরার। ইরার শীত সহ্য ক্ষমতা কম। দুনিয়ার সর্বনিন্ম তাপমাত্রা হয়তো ওর পা দুটিতেই রেকর্ড হবে। এত ঠান্ডা পা যে মীরার গায়ে লাগলে খুব রাগ করতো মীরা। বেচারীর পা দুটো এত ঠান্ডা হয়ে থাকতে যে ঘুমাতেই পারতো না । মাঝে মাঝে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ওর পা গরম করে দিতো মীরা। মোটা উলের মজা এনে দিতো ইরাকে। তবে মীরা কিন্তু উল্টো মেরুর লোক। গায়ে কম্বল দিলেও ফ্যান না চললে ঘুম আসে না তার। এ নিয়েই দু-বোনে বাঁধতো বিপত্তি। মা মীরাকে খুব বকতো ওর এ স্বভাবের কারণে৷ এত ছোট ব্যাপার ও এডজাস্ট করতে পারতো না। আর এখন কত কি করতে হচ্ছে সংসারটাকে বসাতে।

গরম কাপড়ের অভাবে যখন ঠান্ডায় নাকাল মীরা, ঐ সব দিনের কথা হঠাৎ মনে পরলো ওর। এ কদিনের দৌড়াদৌড়ি, মানসিক চাপ, অনিশ্চয়তায় ও ভুলতে বসেছে ওর পরিবারের কথা, বাবার কথা, ছোট্ট বোন ইরার কথা। মা’কে ও ভালোবাসে, তবে তার জায়গা সবার শেষে। মীরার আজকের এ জীবণের জন্য সবাই ওকে দায়ী করলেও মীরা যদি বলো- ” আমার মা দায়ী আমার এ পরিণতির জন্য” ভুল হবে না খুব একটা। যদিও মীরা এমনটা ভাবে না। ও নিজেকেই দায়ী করে সবকিছুর জন্য। সে দীর্ঘ গল্প অন্য কোন দিন হবে। তবে বাবা আর ছোট বোনটার জন্য মন পোড়ে মীরার।

খিলক্ষেতের মেইন রোড ছেড়ে অনেকটা ভিতরে রাহাতের ক্ষণিকালয়। মনে মনে ভাবছিলো ও চিনবে তো। সেই যে একবার এসেছিলো তাও তো রাত করে। তবে গ্রামীণফোনের বিশাল সাইজের বিলবোর্ড দেখে ও মুচকি হাসলো। ঐ যে একটা এ্যাড চলছে না ইদানীং টিভিতে, একটা মেয়ে অনেকগুলো বয়োমে কথা জমা করছে। সেই এড ফুটে উঠেছে বিলবোর্ডে। ভীষণ সুন্দর হয় গ্রামীণ ফোনের এ্যাড গুলো। একেবারে হৃদয়ে ধাক্কা দেয়, চোখ ভিজিয়ে দেয় নিজের অজান্তেই।

মীরা বামের গলি ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। সকাল সাড়ে দশটা। লোকজন তেমন নেই পথে। শীতের দিন তার উপর আবাসিক এলাকা। লোকজন তেমন নেই একটা। এখানকার লোকেরা হাঁটতে ও যায় গাড়িতে করে। মিনিট পাঁচেক পর মীরা পৌঁছে গেলো “ক্ষণিকালয়ের” সামনে৷ গেইটের দারোয়ান যেন ওরই অপেক্ষায় ছিলো। মুচকি হেসে অভিবাদন জানালো যেন ওকে। আচ্ছা ও তো কাওকে জানিয়ে আসে নি, তাহলে লোকটা ওকে চিনলো কিভাবে?
এসব বাড়িতে তো পরিচিত ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। তবে…!

ভিতরে ঢুকতেই খোলা দরজা দেখে মীরার বুকটা ধক করে উঠে। এ দরজা দিয়ে এখন ভিতরে প্রবেশ করাটা ওর জীবণ বদলে দেবে। হয় ও রাহাতকে মানাতে পারবে, নয়তো বন্দী হবে রাহাতের সোনার খাঁচায়। ধীর পায়ে ঢুকতেই দেখলো জেরিন আসবাবপত্রের ধুলো পরিষ্কার করছে। সবকিছু চকচকে। আভিজাত্য পরিপূর্ণ এ আবাস, ধুলোর এখানে প্রবেশ নিষেধ। তবুও নিয়ম করে হয়তো জেরিন এসব পরিস্কার করে, এটাই হয়তো ওর নিয়মিত কাজ।

মীরার আগমনে সাড়া দেয় না জেরিন। নিজের কাজে ব্যাস্ত জেরিন খেয়ালই করে নি যে ড্রইংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন। বিশাল কাঠের অলংকৃত দ্বারে মৃদু করাঘাত করে মীরা জেরিনের মনোযোগ আকর্ষণে। দ্রুত ভীত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকায় জেরিন। অসময়ে কে এলো তাই ভেবে হয়তো। মীরাকে দেখে ওর ভীতি ভাব বদলে গেলো হাসিতে। হাতের ফার্নিচার পরিস্কারের ব্রাশটা পাশে রেখে মীরার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে –
: ” শুভ সকাল ম্যাডাম, এত সকাল সকাল? আজ কি আপনার আসার কথা ছিলো? ”
: ” আপনার স্যার আছেন বাড়িতে? ”
উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলো জেরিনকে।
: ” স্যার উঠেছেন, শাওয়র নিচ্ছেন হয়তো, আপনি বসুন উনাকে আমি বলি আপনি আসার কথা। ”

বলে দ্রুত পায়ে চলে যায় জেরিন। মীরা একটা সোফার এক কোণে বসে জেরিনের চলে যাওয়া দেখছে। মেয়েটা শ্যাম বর্ণের। তবে ভিষণ মিষ্টি চেহারা, ব্যাবহার ও এত আন্তরিক যে মাঝে মাঝে কেমন অস্বস্তি হয় মীরার। আচ্ছা এ মেয়েটা এখানে নিরাপদে আছে তো? নাকি ওকেও রাহাতের….

এসব ভাবতেই কেমন একটা ভাবনা ওকে ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে তা ভেবে মীরার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত ঘেমে জবজবে হয়ে আছে। দেখার মতে অনেক কিছু রয়েছে এ বিশাল ঘরে, আগের বার যখন এসেছিল এক পলক দেখেছিলো তখন। কিন্তু এত অভিজাত জিনিস ওকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। মাথা নিচু করে কেমন ভাবনায় বুদ হয়ে আছে ও।

ঠিক কত সময় পার হ’য়েছে জানে না, বুজে থাকা চোখ খুলে দেখতে পেলে এক জোড়া পা, মস্তিষ্ক জানান দিলো পা জোড়ার মালিক রাহাত। ধীর গতিতে মাথা তুলে এক পলক দেখলো রাহাতের দিকে। ক্যাজুয়াল একটা টিশার্ট পরে আছে রাহাত, প্যান্টটা জিন্সের। কে বলবে অল্প বয়সী এ ছেলে পাক্কা ব্যাবসায়ী। বয়স কত হবে আন্দাজ করতে চেষ্টা করে মীরা। ছাব্বিশ নাকি আটাশ?

রাজিব বলেছিলো ওর ব্যাবসায়ীক খ্যাতি ছাড়িয়ে গেছে বাবার রেকর্ড ও। ওর বাবা ওকে আশীর্বাদপুষ্ট মনে করে। ওর জন্মের পরই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে বোরহান সাহেবের। মূর্খ বোরহান ভেবেছিলো ছেলেকে বিদেশ পড়তে পাঠাবে। কিন্তু ছেলেটা পড়াশোনা বেশী করে নি। তা নিয়ে অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন তারা। শেষে নিজের ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দিলেন। কিছু অন্ততঃ করুক। ছেলের পড়াশোনা না করাটা শাপে বর হলো বোরহান সাহেবের জন্য। রাহাত শুধু সুদর্শনই নয়, বুদ্ধির দৌড়েও এগিয়ে অনেক দূর।
একটা সময় পর ওর পরিশ্রম, তত্বাবধান, আর পরামর্শে বোরহান সাহেব ডিঙিয়েছেন সাফল্যের সিঁড়িগুলো। তাই কখনোই বোরহান সাহেব কোন কিছুতে শাসন, বারন করতেন না রাহাত কে। ফল স্বরূপ এত ভালো গুনের, সুদর্শন রাহাতের যাতায়াত শুরু হলো গণিকালয়ে। ধরলো ম’দ, সহ নানান নেশা।

এ ছেলের হাত ভালো। যাই ধরে সোনা হয়ে যায়, এমনটাই বলেছিলো রাজিব। যদিও ওর বাবা তার পুরাতন ব্যবসা নিয়েই রয়ে গেছেন। তার ব্যাপ্তি বেড়েছে কিন্তু পরিবেশ বদলায় নি বোরহান। সেই সাদামাটা পোশাক আর জীবণের প্রথম কেনা জীর্ণ বাড়িটায়ই রয়ে গেছেন তিনি। বিশাল জমি পরে থাকলেও সেখানে নতুন আর আধুনিক ভবন তৈরীর কথা ভাবেননি হয়তো। তা না হলে আজকালকার দিনে এত বিশাল জয়গা ফেলে রাখে?

রাহাত নিজেও তাই। ওকে দেখে কেও বলবে না এ ছেলে তলে তলে এত সম্পদের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে। তবে এসব সম্পদ ও বৈধ উপায়ে রোজগারে করা। আসলে ব্যাপার হচ্ছে কেও যখন একবার রাস্তা চিনে ফেলে উপরে উঠার, সে যদি কোন কারনে নিচে পরেও যায়, আবার সে পথ খুঁজে বের করে উপরে উঠার। রাহাত অল্প বয়সেই সে রাস্তার খোঁজ পেয়েছে। বিভিন্ন ব্যাবসায় ওর ইনভেস্ট করা আছে। সেখান থেকে নিয়মিত লভ্যাংশ জমা হয় ওর একাউন্টে। আপনার হয়তো ভাবছেন লোখিকা গল্পটাকে চুইংগামের মতো অযথা টানছে। না গল্পের প্রয়োজনে এ বর্ণনাটুকু করা হচ্ছে। তা আপনারা বুঝতে পারবেন আরো কিছুটা সামনে এগুলে।

তো, কোথায় যেন ছিলাম? ওহ্ মীরার সামনে রাহাত বেচারাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি আমি!

এরপর,
মীরা উঠে দাঁড়ায় রাহাতকে দেখে। কিছুক্ষণ আগে তোলা চোখ দুটিকে সংকোচে নামিয়ে ফেলে মীরা। নিজেকে কেমন তুচ্ছ মনে হয় ওর রাহাতের সামনে। যেন কোন ঋণগ্রস্ত প্রজা দাঁড়িয়ে রয়েছে তার ভূস্বামীর সামনে।

রাহাত বললো-
: ” বসো”
মীরা অনেক সংকোচ নিয়ে বসলো, যতটুকু গুটিয়ে রাখা যায় নিজেকে তার সবটুকু চেষ্টা করলো ও।
: ” এত সকালে?, কি মনে করে?”
কাতর চোখে এক পলকের জন্য তাকায় মীরা রাহাতের দিকে, চোখ দিয়ে কিছু বলবার ব্যার্থ চেষ্টা হয়তো। কিন্তু রাহাত এসব কিছু বুঝলো না, আবার প্রশ্ন করলো-
: ” এত সকালে এসেছো কেন? নিশ্চয়ই কোন দরকারে এসেছো ”

মীরা অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে। রাহাতের চেকবাহী খামে দেয়া তারিখ পার হয়ে গেছে অনেক দিন। এর মধ্যে রাহাত একটা বারের জন্য ও ফোন করে নি মীরাকে। তার উপর ওর বাড়িতে আসায় উল্টো জিজ্ঞেস করেছে কেন এসেছে? এ ছেলের মাথায় কি চলছে? ও কি ভুলে গেছে যে মীরাকে ও টাকা ধার দিয়েছিলো কয়েকটা শর্ত সাপেক্ষে?

একটু সময় নিয়ে কথাগুলো গুছায় মীরা। কথা শুরু করার আগে ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে সেন্টার টেবিলের উপরে রাখে মীরা। মীরার উল্টো দিকে বসা রাহাত বিরক্ত মুখে সেখানে তাকায় সেখানে। রাহাত ও হয়তো আন্দাজ করছে কিছু একটা নিজের মতো করে। এরপর মীরা একদমে বলে পুরো কথাটা। ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো রাহাত তা মনযোগ দিয়ে শোনে। মীরা যখন কথা শেষ করে চুপ করে বসে ওর হাত খুঁটছে, রাহাত মীরাকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” তোমার কথা শেষ হয়েছে? ”
: ” হুম” ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দেয় মীরা।

অট্টোহাসিতে ফেটে পরে রাহাত। মীরা দ্রুত মাথা তুলে তাকায় সেদিকে। প্রাণবন্ত হাসি সেটা। এত সুন্দর লাগছে রাহাতকে, ও ঠিক মিলাতে পরছে না এর সাথে নারিন্দার বাসার সেই রাহাতকে। হাসি থামিয়ে রাহাত জিজ্ঞেস করে –
: ” নাশতা করে এসেছো?”
মীরা যেন বুঝতে পারলো না ঠিক রাহাতের কথা, যেন রাহাত অজানা কেন ভাষায় কথাটা জিজ্ঞেস করলো ওকে।
“চলো আমিও নাশতা করি নি, দু’জন একসাথে নাশতা করি”

মীরা এমন শান্তিপূর্ণ কিছু আশা করে নি। মনে মনে ভাবে-
” আচ্ছা এটা কি দূর্যোগের আগের স্থবিরতা? ”

চলবে…

প্রিয় ভুল পর্ব-৭+৮

0

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব-৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরা এ মুহূর্তে ত্রিমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। এক রাজিবের অসুস্থতা। দুই চিকিৎসার একটা টাকাও জোগাড় হয় নি, তিন ওর এইচএসসি পরীক্ষা। এবছর যদি কোন কারনে পরীক্ষাটা ছুটে যায় ওর, তাহলে পড়ালেখা সারা জীবনের জন্য চুলোয় যাবে তা ও জানে। কারন জীবণ যে পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে ওকে তাতে পড়ালেখা বিলাসিতা।

পরীক্ষা পড়াশোনা ব্যাপারটা অপশনাল। সবার আগে রাজিবের সুস্থতা। এদিকে রাহাতকে ফোন করায় ও জানিয়েছে কাগজপত্র সব তৈরি। আজ বিকেলে ওকে দেখা করতে হবে একটা রেস্টুরেন্টে।

অনেক ভেবে মীরা লিপিকে সাথে নিলো। প্রথমে ভেবেছিলো নিবে না ওকে। পরে ভাবলো জীবণে বেঁচে থাকাই যখন দাবা খেলার শেষ চালের মতো কঠিন, সেখানে আত্মসম্মান নিয়ে বন্ধুর সাথে লুকোচুরির কোন মানে হয় না। এ মানুষ ওকে এই বিপদেও আগলে রেখেছে। ওর কাছে লুকানো মানে দুঃখ ভাগ করে নেবার এক জনকে হারিয়ে ফেলা। তাই সঙ্গী করলো ওকে মীরা।

ধানমন্ডির সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে বসলো দুজনে। রাহাতই ঠিকানা দিয়েছে। আসার পথে রিকশায় বসে একটি কথাও বলে নি মীরা। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত লিপির কাছে কোন মুখে বলবে ও। যা বুঝার বুঝুক ও। রাজিবের চিকিৎসার জন্য টাকা চাই ওর। শুধু এটুকুই জানে মীরা। মীরা ওদের জন্য কফি অর্ডার করলো দুটো।

ওরা এসেছে পনেরো মিনিটের মতো। রাহাতের খবর নেই। হঠাৎ ফোন করে ও মীরার ফোনে। এ ফোনটাও রাহাতের দেয়া। গতবার যখন দেখা হলো এটা দিয়েছিলো রাহাত যোগাযোগ করার কথা ভেবে।

রাহাত ওপাশ থেকে বলে-
: ” কাকে নিয়ে আসছো তুমি? মীরা এতগুলো টাকা দিবো তোমাকে আমি তো কাওকে সাক্ষী রাখি নি, তাহলে তুমি কেন ওকে নিয়ে এসেছো। এসবের মানে কি? আমি অন্য কারো সামনে আসবো না তো। তোমরা চলে যাও, আজ দেখা হবে না,”
: “টাকাটা কালই লাগবে আমার, আজ আপনি না এলে আমার খুব বিপদ হয়ে যাবে”
: ” ওকে সাথে আনার আগে কথাটা তোমার ভাবা উচিত ছিলো”
: “আমার ভুল হয়ে গেছে ”
: ” ভুল তো ভুলই, এটা তো আর শোধরানো যাবে না, তারচে বরং আমি হাজার বিশেক….
: ” না, না, বিশ হাজারে কিচ্ছু হবে না, কালই অপারেশন এর সব টাকা জমা করতে হবে”
: ” তাহলে কি আর করা, সব তো তোমার কথা মতো হবে না, তাই না?”
: ” প্লিজ, একটু বোঝার চেষ্টা করুন…”
: ” এত বোঝাবুঝির কাজ নেই, আমি এত কিছু বুঝি না, তোমার কি মনে হয় আমার বিয়ের জন্য মেয়ের অভাব যে এতগুলো টাকা তোমাকে দিয়ে বিয়ে করতে হবে? অভাব না, ভাল্লাগছে তোমাকে, তাই মূল্য পরিশোধ করছি”
: ” প্লিজ এমন করবেন না, রাজিব হসপিটালে একা রয়েছে। সকাল হলেই ওর…”
: ” ওহ্ মীরা, এত ঘ্যান ঘ্যান করো না তো, আমি ব্যাবসায়ী মানুষ, আমি শুধু ডিল বুঝি, নাথিং এলস্ ”
: ” আমার বন্ধুকে চলে যেতে বলি তাহলে?”
: ” কিছু বালার দরকার নেই,
: ” প্লিজ এমনটি করবেন না”
: ” ওকে, ওয়েট। এক কাজ করো এখান থেকে বের হয়ে ওকে মাঝপথে নামিয়ে দিবে তুমি। আমার গাড়ি আমি পাঠাবো তুমি যেখানে থাকবে সেখানে। গাড়ির ড্রাইভার তোমাকে যেখান নিয়ে যাবে সেখানই তোমায় আসতে হবে। যদি রাজি থাকো তাহলে ম্যাসেজে বলো আাময় , এত কথা বলার সময় নেই আমার, রাখি”

বলেই কলটা কেটে দেয় রাহাত। মীরা ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দু’হাতে মুখটাকে চেপে স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছু সময়। ভিতরে কিছু একটা দলা পাকাচ্ছে। মুখ, চোয়াল কেমন যেন আঁকড়ে আসছে। কান্নার পূর্বাভাস। তবে কান্নাটা যেন বেরুবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না।

গত কয়েকটা মাসে মীরা কেমন বদলে গেছে। আবেগী মীরা খুব বেশি প্র্যাক্টিক্যাল হয়ে গেছে আজকাল। অনুভূতির চেয়ে বাস্তবতাকে বেশী মূল্য দেয় ও। যে বিদ্যাটা কিছুদিন আগেও জানা থাকতো যদি, তাহলে জীবণটা হয়তো অন্য রকম হতো।
দু হাতে শরীরের ভর রেখে বসে মীরা। কিছু একটা ভেবে মীরা লিপিকে বলে-
: ” চল, চলে যাই রাহাত আসবে না আজ, তোকে সাথে এনেছি তো তাই”
: ” কেমন বদ, মনের ভিতরে শয়তানী বুঝলি?”
বলতে বলতে উঠে ওরা।

কাউন্টারে কফির দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পরে দুজনে । রিকশায় উঠে একটা ম্যাসেজ টাইপ করে ফোন দিয়ে। লিপি কি যেন বলছে অনবরত। সেদিকে মন নেই মীরার। সেটাকে পাঠিয়ে ফোনটা ব্যাগে রাখতেই ওপাশ থেকে উত্তর আসে।

রিকশা যখন ঢাকা কলেজের সামনে এলো রিকশা ওয়ালাকে থামতে বলে, ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নেমে যায় মীরা । বলে নীলক্ষেতে ওর কোন কাজ আছে। লিপিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায় মীরা।

রাহাতকে বলা লোকেশনে পৌঁছে দেখে ওর পৌঁছানোর আগেই গাড়ি পৌঁছে গেছে সেখানে। কালো রঙের টয়োটা করোলা এক্স মডেলের গাড়িটা দূর থেকে দেখেই শরীর কেমন ভারী অনুভূত হয় ওর। গাড়ির মালিককে ও এত ভয় পায় যে তার ব্যাবহৃত জড় এই গাড়ি দেখেই মীরার কেমন গলা শুকিয়ে গেছে। আর এগুতে পারছে না ও। মনে হচ্ছিল পায়ের তলার মাটি যেন কামড়ে ধরে রেখেছে ওর পা দুটোকে। কিন্তু কিছুই করার নেই ওর, মন না চাইলেও ওকে যেতেই হবে সেখানে। কারন ভাগ্যের কাছে আত্নসমর্পণ করেছে ও । যে ভাবেই হোক যেতে ওকে হবেই।

দশ কদম দূরের পথটা মীরা বেশ সময় নিয়ে পাড়ি দিলো। অপেক্ষায় থাকা ড্রাইভার দরজা খুলে দিলো ওকে দেখে। ড্রাইভার ওকে এর আগেও একদিন এগিয়ে দিয়ে গেছে বাসার কাছে, রাহাতের সাথে দেখা করার পর। তাই আজ তার ওকে চিনতে সময় লাগলো না। আর মীরা এমন এক মেয়ে যাকে একবার কেও দেখলে হাজর মানুষের ভিড়ে ও খুঁজে বের করতে পারবে যে কেও। বেশ লম্বা মীরা, বাঙালী মেয়েরা স্বাভাবিক যেমনটা লম্বা হয় তারচে বেশী। ওর হাইট দেখে সবাই বলতো এর জন্য বর খোঁজা মুশকিল হয়ে যাবে। কেউ কেউ আবার হেসে বলতো, এর বর হবো নাটা(বেটে) । লম্বা মেয়েদের বর হয় নাটা। কিন্তু রাজিব এক্কেবারে পারফেক্ট ওর জন্য। পাশাপাশি যখন হাঁটে দুজন। সবার চোখ ফেরানো দায় হয়। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির রাজিবকে বেশ মানায় মীরার পাশে। মীরা কখনো ওর উচ্চতা মেপে দেখে নি। তাই ও জানে না ওর উচ্চতা কত। তবে অনুমান বলে পাঁচ ফিট ছয়-সাত তো হবেই।

গাড়ি পৌঁছে গেলো একটা বিশাল লোহার গেইটওয়ালা বাড়ির ভিতরে। নাম ফলকে লেখা “ক্ষণিকালয়”।
গাড়ি ঢুকার পর গেইটটা যখন আটকালো দারওয়ান মীরার ভিতরটা কেমন দুপ করে উঠলো। গাড়ি থেকে বেরুতেই একটা মেয়ে মীরাকে দোতলায় নিয়ে গেলো। সন্ধ্যা হওয়ায় চারপাশ দেখতে পেলো না মীরা। তবে একটু বুঝলো বাড়িটা বেশ জায়গা নিয়ে করা। ড্রইং রুমে বসতে নিলো মীরা। মেয়েটি হেসে বললো – ম্যাডাম এখানে না, আমার সাথে আসুন। মীরা মেয়েটির পিছন পিছন গেলো। সিড়ি বেয়ে দেতলায় উঠতে একটা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো মেয়েটি। হাত দেখিয়ে রুমে ঢুকতে ইশারা করলো সে।

ভুতরে ঢুকে বুঝলো এ ঘরটা রাহাতের। খাটের উপরে বড় করে একটা ছবি টানানো। ক্যাজুয়াল লুকের ছবি। সেখানে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না মীরা। রুমে থাকা সোফাটায় বসলে মীরা দেখতে পেলো খাটের উপর কিছু রাখা। মেয়েটি জুস নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো তখনি। জুসটা ওর হাতে দিয়ে বললো-
: ” ম্যাডাম স্যার বলেছে আপনাকে তৈরী হতে, আপনাকে নিয়ে স্যার একটা পার্টিতে যাবে”
মীরার বুক থেকে পাথর নামে, কত কি ভেবেছে ও, এখানে এনেছে ওকে তাই। পার্টিতে যাওয়া মানে ও সেইফ। পার্টিতে এতগুলো মানুষের সামনে নিশ্চয়ই অসভ্যতা করতে পারবে না ও।

এমন সময় তৈরী হয়ে ড্রেসিং রুম থেকে বের হয় রাহাত। এই প্রথম বার রাহাতকে ভালো ভাবে দেখে মীরা। পুরোদস্তুর ভদ্রলোক। কে বলবে এ লোকটার ভিতরটা এত কুৎসিত। মীরাকে দেখেই রাহাত বলে-
: ” জলদি তৈরি হও মীরা, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে, ”
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় ও। মীরা কিছু একটা বলতে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তার আগেই রাহাত চলে যায় রুমের বাইরে।

মেয়েটি ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে বলে-
: ” মে আই হেল্প ইউ ম্যাডাম ”
মীরা বলে-
: “প্লিজ”

বিছানার উপর একটা শাড়ি, ম্যাচি ব্লাউজ আর কিছু অর্নামেন্টস রাখা। মীরা সবচেয়ে অবাক হলো রাহাত একটা হিজাব ও এনেছে। এরপর খেয়াল করলো ব্লাউজটা ফুল হাতার৷ দেখেই বোঝা যায় নতুন কেনা সব। হেল্পিং হ্যান্ড মেয়েটাকে মীরা তার নাম জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটা জানালো ওর নাম “জেরিন”।

জেরিন মীরাকে মার্জিত ভাবে তৈরী করিয়ে দিলো। মীরা ওর এক রিসিপসনিস্ট বান্ধবীর কাছে শুনেছিলো ওর বস ওকে একবার পার্টিতে যাওয়ার জন্য নেটের শাড়ি দিয়েছিলো। সেটা এতটাই পাতলা ছিলো যে বলিউডকেও হার মানায়। এই নিখিল বঙ্গদেশে তিনি এরকম শাড়ি কোথায় পেলো হেসে জিজ্ঞেস করেছিলো মীরা। পরে শুনেছিলো সেটা না পরে যাওয়ায় ওর চাকরী চলে গিয়েছে । সে দিক দিয়ে রাহাত সভ্যই বলা চলে।

মীরা এমনিতেই সুন্দরী। শাড়ি পরলো ওকে আরো সুন্দর দেখায়। সাজটা নিজের মতো করে জেরিনকে বললো তাকে জানাতে যে ও তৈরি। রাহাত এসে মীরার দিকে একবার তাকালো শুধু। অস্ফুটস্বরে বললো- ” মাশাল্লাহ ” মীরা তুমি যদি আমার বৌ হও, এটা হবে আমার জীবণের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আল্লাহ আমার এ ইচ্ছ কবুল করুন, আমীন। চলো….

বলেই হাত বাড়িয়ে ওকে আগে যেতে ইশারা করে রাহাত। ওর পিছন পিছন আসে রাহাত। গাড়িতে পেছনের সিটে দুজন দু প্রান্তে বসে। মীরা ভেবেছিলো গাড়িতে হয়তো রাহাত ব্যাড টাচের চেষ্টা করবে। কিন্তু মীরার এ চিন্তায় পানি পরলো। ব্যাড টাচ তো দূরের কথা, আর একবারও তাকালো না ও মীরার দিকে। এমন ভাবে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে দেখছে যেন ঢাকা শহরে নতুন এসেছে। মীরা মনে মনে ভাবে টাকার কথাটা বলবে। আবার ভাবে, এখন না, পার্টিতে গিয়ে সুবিধামতো বলবে।

অবশেষে গাড়ি থামলো অফিসার্স ক্লাবের সামনে। গাড়ির দরজা খুলে রাহাত বেরিয়ে দ্রুত পায়ে মীরার দিকের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগলো ওর কাছে। ভালো না মন্দ তা বুঝলো না, তবে কিছু একটা মনে হলো ওর…

মূল হলে পৌঁছানোর পুরোটা পথ রাহাত মীরার হাত ধরে রাখলো৷ মীরা অস্বস্তিতে বার কয়েক হাতটা ছাড়িয়ে নিলেও, রাহাত মনে করে তা আবার লুফে নিচ্ছে ওর হাতের মুঠোয়। এমন একটা অনুভূতি রাজিবের কাছ থেকে পাওয়ার কথা ছিলো মীরার। কিন্তু এত সুন্দর অনুভূতি ভাগ করে নিতে হচ্ছে ভুল একটা মানুষের সাথে।

ঢুকতেই এক ওয়েটার এসে ওয়েলকাম ড্রিংকস দিলো দুজনকে। সেটা হাতে নিয়ে এদিক সেদিক তাকালো রাহাত। যেন কাওকে খুঁজছে ও।

একটু পর বুঝলো এটা একটা রিসিপশন পার্টি। খুব সম্ভবত কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা ধণাঢ্য ব্যাবসায়ীর ছেলের রিসিপশন এটি। এমন জমকালো অনুষ্ঠানে এর আগে কখনো আসা হয় নি মীরার। মধ্যবিত্ত পরিবারের মীরা এসবে অভ্যস্ত না। রাহাতকে দেখে বর তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে রেখে এগিয়ে এলো রাহাতের দিকে। কুশল বিনিময় করে নিয়ে গেলো বৌর সাথে পরিচয় করাতে। বর বললো-
” নোভা উনি মি: রাহাত, রাহাত গ্রুপের চেয়ারম্যান”
আর উনি…. বলে বিরতি নেয় বর লোকটা, কারন ওনার কাছে রাহাতের পাশের মেয়েটির পরিচয় ক্লিয়ার না। রাহাত উনার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো-
” শী ইজ মাই ওয়াইফ মীরা”
মীরা চমকিত দৃষ্টিতে তাকায় রাহাতের দিকে। বৌটার যেন মনে ধরলো না মীরার পরিচয়টা। হঠাৎই কেমন চেহারাটা বদলে গেলো। মীরা মনে মনে ভাবলো –
মেয়েরা তাদের চেয়ে বেশী সুন্দর কাওকে সহজে মেনে নিতে পারে না তাই হয়তো….

নতুন বৌ দামী একটা লেহেঙ্গা পরে আছে, গা ভরতি গহনা। নিশ্চয়ই দামী কোন পর্লার থেকে সেজেছে। মাশাল্লাহ সুন্দর লাগছে তাকে। তবুও কমলা বেগুনী কম্বিনেশনের জামদানী শাড়ি, আর সাদামাটা সাজের মীরা যেন দ্যুতি ছাড়াচ্ছে চারপাশে। সেটা মীরা খেয়াল না করলেও লক্ষ্য করেছে প্রত্যেকে।

মীরা সেখান থেকে একটু দূরে সরে ভাবতে লাগলো, রাহাতের বাবার গার্মেন্টস এর ব্যাবসা। কিন্তু রাহাত গ্রুপ নামে কিছু তো ও শুনে নি রাজিবের কাছে। এমন সময় রাহাত ডাকে মীরাকে। এমন ভাবে ডাকছে যেন সত্যি মীরা ওর ওয়াইফ।

মীরা বুঝতে পারলো ওরা রাহাতের বন্ধু। তাই না যাওয়ার বাহানায় উঠতে গিয়ে ব্যাথা পাওয়ার ভঙ্গি করতেই রাহাত সহ সবাই ওর কাছে আসে। রাহাত ব্যাস্ত ভাঙ্গিতে বলে-
: ” কি হলো?”
: ” না, না, তেমন কিছু না, উঠতে গিয়ে শাড়ি জুতায় আটকে গেছে ”
: ” মীরা মিট মাই ফ্রেন্ডস….
ও হচ্ছে অনিক, ও পিয়ুস, আর ও হচ্ছে লোরা ওরা আমার আমার স্কুল ফ্রেন্ড।

মীরার মাথা চক্কর দিতে থাকে ব্যাবসায়ী দাওয়াতে স্কুল ফ্রেন্ড আসলো কোত্থেকে?
হঠাৎ লোরা বলে উঠলো-
” মামা তুই কিন্তু জিতছস, মাশাল্লাহ, পরির মতো বউ পাইছিস। এট লিস্ট ও নোভার চেয়ে হাজার গুন সুন্দরী ”
: “শাট আপ লোরা”
রাগান্বিত কন্ঠে বলে রাহাত।
লোরা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় রাহাতের কথায়। পিয়ূস কথা ঘুরিয়ে বলে-
: ” চলতো খেতে বসে পরি”
: ” চল, চল, ” বলো অনিক।

রাহাত বলে তোরা এগুতে থাক আসছি আমরা। মীরার মাথায় কেমন ঘুরতে থাকে কয়েকটা শব্দ – স্কুল ফ্রেন্ড, মাই ওয়াইফ, আর নোভা…..

অনুষ্ঠানের সব ফর্মালিটি শেষ করে সেখান থেকে বের হতে সাড়ে ন’টার মতো বেজে যায়। আরো কিছু সময় থাকবে ভাবলেও মীরার তাড়া দেওয়ার কারনে জলদি বেরিয়ে পরে ওরা। এমন সাজ পোশাকে বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে মীরা রাহাতের সাথে গিয়ে কাপড় বদলে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। ফেরার সময় ও দুজন গাড়ির দুই প্রান্তে বসে ফিরে। মীরা কেমন যেন চিনতে পারে না রাহাত কে। এই কি সেই রাহাত যে নোংরা চোখ বুলিয়ে দিতো ওর সারা শরীরে…

মীরার মনে হয় কোন কারনে রাহাত আপসেট। রাহাতের বাড়ি ফিরে জলদি কাপড় বদলে নিলো মীরা। মেকাপ তুলে একেবারে সাধারণ হয়ে গেলো ও। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই দেখে……..

চলবে…..

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

অনুষ্ঠানের সব ফর্মালিটি শেষ করে সেখান থেকে বের হতে সাড়ে ন’টার মতো বেজে যায়। আরো কিছু সময় থাকবে ভাবলেও মীরার তাড়া দেওয়ার কারনে জলদি বেরিয়ে পরে ওরা। এমন সাজ পোশাকে বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে মীরা রাহাতের সাথে গিয়ে কাপড় বদলে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। ফেরার সময় ও দুজন গাড়ির দুই প্রান্তে বসে ফিরে। মীরা কেমন যেন চিনতে পারে না রাহাত কে। এই কি সেই রাহাত যে নোংরা চোখ বুলিয়ে দিতো ওর সারা শরীরে। মীরার মনে হয় কোন কারনে রাহাত আপসেট।

রাহাতের বাড়ি “ক্ষণিকালয়ে” ফিরে জলদি কাপড় বদলে নিলো মীরা। মেকাপ তুলে একেবারে সাধারণ হয়ে গেলো ও। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই মীরা দেখে জেরিন একটা খাম হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দেখে মিষ্টি হেসে জেরিন বললো-
: ” স্যার এটা আপনাকে দিতে বলে গেছেন”
: ” কি এটা? ”
: ” তা তো জানি না ”
: ” আপনার স্যার কোথায়? আমার একটু কথা ছিলো তার সঙ্গে ”
: ” স্যার তো চলে গিয়েছেন আপনাকে পৌঁছে দিয়েই। যাওয়ার সময় আমাকে বললো আপনাকে যেন এটা দিয়ে দিই ”
: ” ওহ্, ধন্যবাদ ” বলে আন্তরিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা জেরিনের হাত থেকে খামটা নিলো মীরা। হাতে নিয়ে খামটা খুললো মীরা সাবধানে, মনে মনে ভীষণ উৎসুক ও । খুলে দেখে খামের ভিতরে সাইন করা ৩ লক্ষ টাকার একটা চেকের পাতা । জিনিসটা দেখে অবাক হলো মীরা। রাহাত চলে গেলো! কাগজপত্রে কোন সাইন ফাইন না করিয়েই দিয়ে দিলো এতগুলো টাকা? স্ট্রেন্জ…!

খামে চেকটা পুরে সেটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে দ্রুত রওনা হলো মীরা। পেছন থেকে জেরিন ডেকে বললো ম্যাডাম স্যার ড্রাইভারকে বলেছে আপনাকে পৌঁছে
দিতে। অনুগ্রহ করে আপনি একা যাবেন না। তাহলে স্যার এসে আমার সাথে রাগারাগি করবে।

মীরার ভালোই হলো। এত রাতে খিলক্ষেত থেকে ঢাকা মেডিক্যাল পৌঁছাতে বহু হ্যাপা পোহাতে হতো ওকে। এদিকে রাতও প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। মীরা গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললো ঢাকা মেডিক্যাল যেতে।

গাড়িতে বসে একেবারে কিনারে চেপে বসলো মীরা। যেন গাড়ি ভর্তি মানুষ, গা বাঁচাতে তার এই চেষ্টা। তার উপর কাঁধ ব্যাগটাকে এমন ভাবে আগলে রাখলো যেন ও কোন রিকশায় বসা। একটু ঝাঁকি লাগলেই পরে যাবে সেটা। গাড়ি চললো খুব স্পিডে। এই তো কদিন আগে- এত রাতে বাইরে থাকার কথা কল্পনা ও করতে পারতো না মীরা। অথচ কত কি করতে হচ্ছে ওকে। নিজেকে বাজি রেখে এক কামুক পুরুষের বাড়ি গিয়েছিল ও, সেখন থেকে তার স্ত্রী সেজে পার্টিতেও গিয়েছিল তার সাথে। এত রাতে একা ফিরছে ও। জীবণ ওর কাঁধে বয়সের চেয়ে অনেক গুণ বেশী ওজনধারী কষ্টের ভার দিয়ে দিয়েছে। তাই নিজের উপর বিদ্রুপ হাসি হাসলো ও।

বেখেয়ালি মীরা এখন পর্যন্ত দুবার খামটা খুলে দেখেছে। একবার খুলেছে সেটা সত্যিই চেক কিনা তা পরখ করতে। কাগজপত্রে সই ছাড়াই রাহাতের মতো মানুষ দিয়ে দিলো এতগুলো টাকা। যার কাছে আবেগের কোন দাম নেই, যে ডিল ছাড়া কিছু বুঝে না। নিজের দেখাকে তাই অবিশ্বাস ঠেকলো ওর। কিছুক্ষণ না যেতেই আবার সেটা বের করে দেখে সিগনেচার আর টাকার অঙ্কটা তখন ঠিকঠাক দেখেছে তো? মীরা হঠাৎ ওর নিজের কান্ডেই লজ্জা পেলো যেন। মুচকি হেসে বাতাসের বেগে মুখের সামনে ভীড় করা চুল গুলোকে কানের পেছনে গুঁজে ব্যাগটাকে আরো কাছে টেনে ধরে নিজের সাথে। আসলে এই একটা মাত্র চেকের পাতা এখন মীরার জীবণে অন্ধের নড়ি যেন।

মীরা মুখটাকে বাড়িয়ে দিলো গাড়ির জানালা দিয়ে। গাড়িটা খুব স্পিডে চলছে জ্যাম না থাকার কারনে। দমকা বাতাস মীরার সব ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা মুছে দিচ্ছে। মীরা এখন আর কিছুই ভাবতে চায় না। না রাহাত, না ওর পরীক্ষা। এই টাকাগুলো দিয়ে আগে রাজিবকে সুস্থ করে তুলবে ও। তারপর যা হবে দেখা যাবে। এগারেটার মধ্যে মীরা পৌঁছে যায় হসপিটালে। সেখানে গিয়ে পাশের বেডের খালার কাছে ক্ষমা চায় দেরি করার কারনে। তাকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল মীরা। তিনি অনেক ভালে মানুষ, রাগ তো করেনই নি উল্টো মীরার জন্য আফসোস করলেন অকপটে। এ বয়সে এত দায়িত্ব নিয়েছে ও। আল্লাহ অবশ্যই এর পুরস্কার দিবেন তা বলে আস্বস্ত ও করলেন। দুজনে খেয়ে কেন মতে শুয়ে পরলো মীরা রাজিবের পাশেই। পরদিন রাজিবের অপারেশন হবে। পুরো টাকাটাও জোগাড় হয়ে গেছে। সে উত্তেজনায় দু চোখের পাতা এক হলো না মীরার।

সরকারি হসপিটাল যে কি এক আজব জায়গা তা যারা না গিয়েছে তারা বললে বিশ্বাসই করবে না। টাকা ছাড় এখানে কোন কথা চলে না। পদে পদে টাকা। কিছু টেস্ট করার জন্য বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলে তারা। আবার কখনো কখনো সেখন থেকে লোক আসে স্যাম্পল কালেকশন করতে। মীরা ভাবে এত বড় হসপিটাল যে সরকার তৈরী করে দিয়েছেন তাঁরা কি পারে না এসব টেস্ট গুলো এখানেই করানোর ব্যবস্থা করতে৷ রাজিবের পাশের সিটে থাকা রোগীর স্ত্রী বলেন-
: ” বুঝলা না মা, এটা তাগোরের ব্যাবসা৷ সরকার এগুলা জানে না কিছুই, ওগোর সাথে এ হসপিটালের লোকেগো লগে চুক্তি, মা গো আমরা তে আসি আমাগো একমাত্র কাওরে চিকিৎসা করাইতে কিন্তু তাগো কাছে তো হাজার হাজার রোগী আসে প্রতিদিন। এটা তাগোর কাছে ব্যাবসা, আর উপরি কামাই করার একটা রাস্তা”

মীরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। একটা মানুষ কত অসহায় হলে সরকারি হাসপিটালের বারান্দায় অবধি থাকতে রাজি হয়। তা তারা বুঝে না। এর সাথে ডাক্তারদের এমন ব্যবসায়িক আচরণ, অধিকন্তু আয়া, বুয়াদের যন্ত্রণা। রোগী স্ট্রেচারে করে এক্সরে করাতে নিবে তো পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়। ফিরবার পথে আবারও পঞ্চাশ।

মীরা খরচ বাঁচাতে একজনকে বলে ছিলো খালা আমিই পারবো নিতে। এর উত্তরে আয়া কর্কশ ভাবে বলেছিলো-
” দেখি মেয়ে কে দেয় তোমারে স্ট্রেচার?”
তারা দেড় ঘন্টা স্ট্রেচার আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো, বসিয়ে রেখেছিলো মীরাকেও। এদিকে দেরিও হয়ে যাচ্ছে। জীবণের এত এত ঘোর প্যাঁচ আর নিষ্ঠুর দিক আগে দেখে নি মীরা। একই ওয়ার্ডের পরিচিত এক মহিলা যিনি মাস খনিক হলো এখানে আছেন তিনি বললেন –
” কাম হবে না মা, দিয়ে দাও। এরা চিনে শুধু ট্যাকা ”

ঐ মহিলাকেও কিছু অশ্রাব্য কথা শুনিয়ে দিলেন তিনি। কষ্টে মীরার কান্না পায়। মানুষ এত নিষ্ঠুর, কঠোর কি করে হয়। এদের মনে কি দয়া মায়ার ছিটেফোঁটা ও নাই।

সবকিছু ঠিকঠাক করে রিপোর্ট গুছিয়ে রাখে মীরা। কিন্তু অপারেশন এর ডেট আরো তিন দিন পিছিয়ে যায়। অপারেশন এর ডেট পরিবর্তন হওয়ায় মীরা ভীষণ কষ্ট পায়। অপারেশন টা না হওয়া পর্যন্ত যেন ওর শান্তি নেই।

অবচেতন ভাবে শুয়ে থাকা রাজিব আধো চোখ মেলে দেখে কেবল মীরার ব্যাস্ত সমস্ত রূপ। কেমন চোখে তাকায় যেন রাজিব । কিছুটা সংকোচ, লজ্জা, আর মৃত্যু ভয় এক করা সেই দৃষ্টিতে। এক্সরের সিরিয়াল কিংবা উপর নিচে উঠার জন্য লিফটের অপেক্ষার সময়টুকু কেবল ফুরসত পায় যেন মীরা । সে সময় টুকুতে রাজিব কেবল তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। একটু যদি তাকায় মীরা ওর দিকে। মীরা প্রতি বারই ওর মাথয় হাত বুলিয়ে মুচকি হাসে। কোত্থেকে এত প্রাণশক্তি পায় মীরা তা খুঁজে পায় না রাজিব। হসপিটালে ভর্তি, এতগুলো টাকার জোগাড়। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে এসব তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি কোন দুশ্চিন্তা করো না। মীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আল্লাহ ওর পরীক্ষা নিচ্ছে। এবং ওকে এ পরীক্ষায় জিততে হবেই।

তিনদিন পর অবশেষে দীর্ঘ সময় ব্যাপী হওয়া অপারেশনটা সম্পন্ন হলো ভালো ভাবেই। রাজিবের কিছু বন্ধু ছিলে সেদিন মীরার সাথে। রাজিবের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ডাক্তাররা যতটুকু আশা করেছিলেন তারচে বেটার রেসপন্স করেছে ওর শরীর। তাই দ্রুতই তারা ছেড়ে দিলেন ওকে। বাড়ি ফিরে মীরা লেগে গেলো রাজিবের সেবায়৷ রাজিব এখন অনেকটা সুস্থ।

বাড়ি ফিরে একটু সুস্থ হতেই রাজিব প্রথম কথাটা বলে- মীরার কাছে ক্ষমা চেয়ে। মীরাকে এত বিপদে ফেলে দেওয়ার জন্য। এবং কৃতজ্ঞতা জানায় এ বিপদেও ওর পাশে থাকার জন্য। একজন ভালো স্ত্রী, আদর্শ স্ত্রী হওয়ার যতগুলো মানদণ্ড রয়েছে তার সবগুলোকে ছড়িয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে মীরা। তা ভাষায় প্রকাশ না করলেও ঠিক বুঝেছে রাজিব। তবে টাকার ব্যপারটা জিজ্ঞেস করলেই রহস্যজনক ভবে মীরা তা এড়িয়ে যায়।

এমনি করে ভালোই কাটছিলো ওদের দিন। জমানো টাকা খরচ করায় ওদের সংসারে সুখের বান বইছে যেন। এ অসুস্থতাটা যেন ওদেরকে আরো কাছে টেনে এনেছে দুজনের বোঝাপড়ার দিক থেকে।

অবাক ব্যাপার এই যে এ কয়দিনে একবারের জন্য ও মীরাকে কল দেয় না রাহাত। মীরা সংসার, অসুস্থ স্বামীর সেবায় ভুলেই গিয়েছিল রাহাতের কথা।

হসপিটাল থেকে ফিরার পথে দশ দিনের ঔষধ কিনেছিলো মীরা। তা শেষ হয়ে যাওয়ায় ফাইলের কাগজ হতে রাজিবের পেসক্রিপশন খুঁজতেই কি একটা পরে যায় কাগজের মাঝ থেকে। সেটাকে তুলে নিতেই মীরা দেখে সেটা চেকবাহী সেই খামটা। খামটাকে দেখে মীরার শরীরে কেমন একটা ঝাঁকুনি দিলো। সারা শরীর হঠাৎই ঘেমে জবজবে হয়ে যায় পৌষের শীতের রাতে ।

একটা খাঁকি রঙের বিশেষত্বহীন খাম দেখে হঠাৎ কেন বিচলিত হলো মীরা?

খাম হাতে মেঝেতে বসে পরলো ও । হঠাৎই ওর ভালো থাকার, সুখে থাকার তারটা যেন ছিঁড়ে গেলো। বিছানায় শুয়ে থাকা রাজিব মীরাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো – কি হয়েছে মীরা?
মীরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে হাসিটাকে কেমন অকৃত্রিম মনে হয় রাজিবের কাছে। ” কিছু না, শুয়ে পরো তুমি, তেমার ঔষধ আনতে হবে কালই ” রাজিব ভাবে টাকার ভাবনায় হয়তে মীরা এমন বিচলিত। রাজিব শোয়া থেকে উঠে বসে সহসা মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে-
” অনেক তে করলে মীরা, এবার থামো তুমি। আমার আর কোন চিকিৎসার দরকার নেই। তুমি পাশে থাকলে আমি এমনিতেই সেরে উঠবো ” কথা গুলো শুনে মীরার চোখ বেয়ে পানির মৃদু স্রেত বয়ে যায়।
আলিঙ্গনরত মীরা হাতের খামটা তুলে ধরে চোখের কাছে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে খামটার নিচের এক কোণটায় । যেখানে লেখা রয়েছে রাহাতের কাছে মীরার ফিরে যাওয়ার তারিখ। অনেক কথা তবুও কিভাবে বলবে ও যে ওর প্রিয়তমকে আমনিভাবে আলিঙ্গন করার মোট সময়ের উল্টো গোনা শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। যা শেষ হতে খুব বেশি বাকী নেই। খামে লেখা তারিখটা তাই বলছে যেন তারস্বরে, যা বিদীর্ণ করে দিচ্ছে মীরার শ্রবণেন্দ্রীয়।

চলবে…

প্রিয় ভুল পর্ব-৫+৬

0

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

একদিন মাঝ রাতে হঠাৎ রাজিবের কাশির শব্দে ঘুম ভাঙে মীরার। ধরমর করে উঠতে উঠতে বমি করে বিছানা ভাসায় ও। হঠাৎ কেন এমন বমি হলো কিছুই বুঝতে পারে না মীরা। কোন কিছু বুঝতে না পেরে
দৌড়ে পাশের ঘরের সামাদ ভাইকে ডাকে। তারা স্বামী স্ত্রী এসে দেখে রাজিব নিস্তেজ হয়ে পরে আছে।

সামাদ ভাই ফার্নিচারের দোকানের আসবাবপত্র ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেবার কাজ করে। তিনি গ্যারেজে গিয়ে দ্রুত তার ভ্যান এনে রাজিবকে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যালে৷ কর্তব্যরত চিকিৎসক ওকে ইমারজেন্সিতে ভর্তি করে। দ্রুত তারা রাজিবের চিকিৎসা শুরু করে। ভোর রাতের দিকে তারা মীরাকে ডাকে রাজিবের ম্যাডিক্যাল হিস্ট্রি জানতে।

মীরা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতেই মধ্য বয়স্ক ডাক্তার চাশমার ফাঁক দিয়ে বিরক্ত মুখে তাকিয়ে মীরাকে জিজ্ঞেস করে-
: “কি ব্যাপার?”
: “আমি ১০২ নম্বর বেডের রোগী…. ”
: ” রোগীর গার্ডিয়ান কেও নেই?” ডাক্তার সম্ভব বড় কাওকে আশা করেছিলেন।
: ” মানে আমি.., আমি রোগীর স্ত্রী”
: ” এটুকু ছেলে আবার বিয়েও করেছে? ”
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে –
: “এসো, তুমি করেই বললাম, তোমার বয়সী আমার একটা মেয়ে আছে। কিছু মনে করো না মা”
: ” না, না, সমস্যা নেই স্যার ”
মীরাকে বসতে বলে রিপোর্ট গুলো দেখতে দেখতে
ডাক্তার ওকে জিজ্ঞেস করে –
: ” বিয়ের বয়স কতদিন? ”
: ” সামনের পঁচিশ তারিখে চার মাস হবে ”
: ” রোগী মদ্যপান করতো কি?
অবাক হয়ে মীরা জবাব দেয়-
: ” রাজিব কখনো মদ্যপান করে না। এমন কি ধুমপান ও না। তবে….”
: ” তবে কি? ” উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার।
: ” মাস তিনেক আগে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে সু*ই*সা*ই*ড এটেম্প করেছিলো ও”
: ” আই সি!, রিলেশনশিপ কেস?”
মৃদু মাথা নেড়ে জবাব দেয় মীরা।
: দেখ মা রাজিবের হার্টে ব্লক হয়েছে। আমি খুবই দু:খিত, নববিবাহিত দম্পতি তোমরা, তবুও বলতে হচ্ছে দ্রুত চিকিৎসা করতে না পারলে ওর মৃ’ত্যু ঝুঁকি প্রবল।

কথা গুলো শুনে মীরার দুনিয়াটা হঠাৎ যেন দুলতে শুরু করে। ও কি কিছু ভুল শুনলো? কিন্তু সামনে বসে থাকা ডাক্তারের আহত চেহারাই সাক্ষী ও যা শুনেছে তা সত্য। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তেই জ্ঞান হারায় মীরা। ঐ দিকে রাজিব শয্যা শায়ী। এদিকে মীরার অবস্থা খারাপ। ওদের এমন অবস্থা দেখে ওদের প্রতিবেশী ভ্যান চালক সামাদ কল করে রাজিবের আত্মীয়দের ফোনে। কেওই ফোন রিসিভ করে না। খুব সম্ভবতঃ রাত হওয়ায় ফোন সাইলেন্ট করা। কিংবা ওর নম্বর দেখে কেও কল রিসিভ করছে না।

ফোন লিস্ট ঘেটে খবরটা দেয়া যাবে এমন কাওকে পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা চালাতে থাকে সামাদ৷ এত গুলো ফোন করলো সামাদ, শেষ পর্যন্ত ফোন ধরলো রাজিবের বন্ধু তন্ময়। ওকে ঠিকানা দিয়ে দ্রুত আসতে বললো হসপিটালে।

ভোরের দিকে ঘুৃম ভাঙলে মীরা কেঁদে বুক ভাসায়।
আল্লাহ এ কোন ওর সাথে এমনটা করলো। ও তো ভালোই ছিলো ঐ কুঁড়ে ঘরটাতে। শুধু ভালোবেসে এক সাথে পাশে থাকতে চেয়েছে ও, এরচেয়ে বেশি কিছু তো ও চায় নি। আল্লাহ কেন ওর এটুকু সুখ ও কেড়ে নেবার ব্যাবস্থা করেছে।

রাজিবের বোনকে ফোন করে জানালো সামাদ ভাই, তার স্বামী তাকে আসতে দিবে না। বিকেল নাগাদ রাজিবের মা এলেন হসপিটালে। তিনি এসে এক চোট ঝাড়লেন মীরাকে। অলক্ষ্মী, অপায়া ইত্যাদি বলে গালাগাল করলেন। অবাক ব্যাপার হলো রাত হতেই তিনি চলেও গেলেন।

এরপর একে একে কেটে গেলো তিনদিন। না কোও হসপিটালে এলো না, এমনকি কেও ফোন ও করলো না। মীরা বড়ই অবাক হলো তাদের এমন আচরণে। রাজিবের বন্ধু নাজমুলকে এ ব্যাপারটা বললে ও বললো –
” ভাবী সৎ মা তো, তাই এমন করতে পারলেন ?”
কথাটা শুনে ধাক্কা খেলো ও। সৎ মা মানে?।
নাজমুল মীরার চেয়ে ও বেশী অবাক হয়ে বলে-
” কেন আপনি জানেন না যে এটা ওর সৎ মা? ”
“না তো, ও আমাকে কিছু বলে নি তো এ ব্যাপারে।”

টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় রাজিবকে নিয়ে বাসায় ফিরলো মীরা। এত বড় অপারেশন, এতগুলো টাকার প্রয়োজন। কোন কূল কিনারা করতে পারলো না মীরা। আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় দাঁড় করালে ওকে? দিনরাত লুকিয়ে কাঁদে মীরা। রাজিব ও নির্বিকারে চোখের পানি ফেলে। বেচারী মীরাকে কোন বিপদে ফেলে দিল ও।

ধীরে ধীরে জীবণের এই বাঁকে নিজেকে অভিযোজিত করে নিলো মীরা। একমাত্র আয়ের উৎস্য কোচিং এর চাকরীটাতে মীরা যেতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। কোচিং এর সবাই আগে থেকেই জেনেছে এ ব্যাপারটা, হসপিটালে রাজিবকে দেখতেও গিয়েছিলেন সবাই মিলে। কাজে ফিরলে মীরাকে তারা সাধ্য মতো সাহায্য করার আশ্বাস দিলো। মীরার কোচিং থেকে পাওয়া টাকায় কোনমতে দিন চললেও রাজিবের ওষুধ পত্রের খরচ জোগাড় করতে পারে না।

একদিন মীরা ওর বন্ধু লিপিকে নিয়ে গেলো রাজিবদের বাড়িতে। তারা মীরাকে বাড়িতেই ঢুকতে দিলো না। লোহার গেইটে তালা মরা অবস্থায়ই কোন কালে রাজিব কি অকাজ করেছে তার ফিরিস্তি দিলেন তিনি। রাজিবের কারনে কোথায় কত দেনা হয়ে আছে তারও মোটামুটি একটা হিসেব দিলেন তিনি মীরাকে। ওর বান্ধবী লিপি হেসে বললো-
: ” চলরে মীরা, যে পরিস্থিতি তিনি দেখালেন তাতে রাজিবকে সাহায্য করবে কি উল্টো তাদের এই সব দেনা সবার আগে তোর পরিশোধ করা উচিত ” কথাটা শুনে আর্দ্র চোখে ও তাকালো লিপির দিকে। সে দৃষ্টি হতাশা আর পথ হারাবার।

রাতে বাড়ি ফিরার পথে মীরা সবজি কিনে রান্নার জন্য। সাথে দুটো ডিম। দোকানির কাছে একশত টাকা ভাংতি না থাকায় ব্যাগে ভাংতি টাকা খুঁজতে থাকে মীরা। এমন সময় পাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে।
” কত হইছে মামা? ”
এ কন্ঠ এর আগেও শুনেছে মীরা, খুচরা খোঁজা বন্ধ করে তড়িৎ গতিতে তাকায় সে কন্ঠের উৎসের দিকে। দেখে রাহাত ওর পাশে দাঁড়িয়ে। মীরার হাতে থাকা সব কিছু পরে যায়, দ্রুত মীরা চলে আসে সেখান থেকে। রাহাত ও মীরার পিছু পিছু হাঁটে। ওর হাতে মীরার ফেলে দেয়া জিনিসের ব্যাগ।

: ” মীরা তোমার জিনিসগুলো তো নিয়ে যাও ”

বাড়ি ফিরে কাঁদতে থাকে মীরা। একসময় নিজের সৌন্দর্য নিয়ে খুবই আহ্লাদিত ছিলো মীরা। যা আজ ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানেই যাচ্ছে সবাই ওর বিপদে পাশে থাকার নাম করে নোংরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে৷

একমাত্র ভরসা যাকে নিয়ে, এসব নোংরামির বিরুদ্ধে যার রুখে দাঁড়াবার কথা, সে লোকটা নিজেই দাঁড়াতে পারে না অন্যের সাহায্য ছাড়া। ওর দুনিয়াটা এত বদলে গেলো কেন। এত কষ্ট থাকার পরও কত সুখে ছিলো ওরা দুজন। কদিন ছিলো সে সুখ। হাতের আঙুলে গুনে হিসেব করা যাবে তার। মাঝরাতে মীরা কাঁদতে থাকে বাড়ির কথা ভেবে। মনে মনে ভাবে তাদেরকে কষ্ট দেবার শাস্তি হয়তো খোদা এমনি করে দিচ্ছে ওকে।

সে রাতের পর আরো একদিন রাহাতকে দেখেছিলো মীরা। না দেখার ভান করে হাঁটলেও রাহাত পিছু পিছু গিয়েছিলো ওর। দিনের আলো থাকায় এবার আর ভয় পায় নি মীরা। এক সময় বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ও। রাহাতের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে- এমন পিছু পিছু আসার মানে কি?

রাহাত বিশ্রী ভাবে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে বলে-
” তুমি জানো না কি চাই আমি? ” অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নেয় মীরা। এমন নোংরা লোকেদের সাথে কথা বলাই মানে এদেরকে প্রশ্রয় দেয়া। উল্টো ঘুরে হাঁটা দিতেই, রাহাত বলে-
” আমি জানি মীরা রাজিবের অবস্থা বেশী ভালো না।
তোমার এখন অনেক বিপদ। তোমার টাকার অনেক দরকার। আর আমার দরকার তোমাকে। যত টাকা লাগে আমি তোমাকে দিবো, দরকার হলে ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো ওকে। আমার চাওয়া একটাই তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসবে আমার কাছে”

কথাটা শুনে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় মীরা। ওর ইচ্ছে হয় যে মুখ দিয়ে এমন নোংরা কথা বললো ও সেখানে এক দলা থুতু দিতে। কিন্তু ইচ্ছে হলেও মানুষ সব করতে পারে না।

দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে চলে যায় মীরা। রাহাত দূর থেকে ওর শরীরের বাঁকে বাঁকে চোখ বুলাতে থাকে।

কোচিং এ এসে কাজে ডুবে যায় মীরা। এই কাজে ব্যাস্ত থাকার সময়টা মীরা সব ভুলে যায়। একদিন ছোট ক্লাসের পরীক্ষার খাতায় নম্বর যোগে ভুল করে মীরা। কোচিং এর মালিক যিনি সে স্যার এসে খুব রাগারাগি করে এ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে। মীরার বুঝতে বাকী থাকে না যে এ রাগের উৎস কোথা থেকে এসেছে। মীরার অন্য কেন উপায় না থাকায় এমন পরিবেশে ও এসব সহ্য করে পরে আছে। অথচ তার ডাকে সারা দিলেই সব সহজ হয়ে যাবে ওর জন্য। একদিকে রাহাত, অন্য দিকে এই কোচিং-এর মালিক।

রাতে বিছানায় শুয়ে রাজিবকে দেখতে থাকে মীরা। প্রতিটা দিন কেমন কষ্টের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে ও। মাঝে মাঝে মীরার ইচ্ছে করে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে৷ কিন্তু রাজিবকে ও বড্ড ভালোবাসে। এই বেচারা এখন বড় অসহায়। এমন দূর্দিনে কেও নেই এক মীরা ছাড়া। রাহাতের কথাগুলো ভাবে মীরা।
” তোমার দরকার টাকা, আর আমার দরকার তোমাকে”
কি নোংরা, কি বিভৎস কথা। লিপি আজ বলেছিলো আবীরের কথা। আবীর যদি জানে তাহলে অবশ্যই ওর পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু ওর সামনে দাঁড়াবার মুখ নেই মীরার। আজ টাকার জন্য চোখের সামনে কষ্ট পেতে দেখছে প্রিয় মানুষটিকে। কান্না আর কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই মীরার। টাকা এমন এক জিনিস যা ওকে জীবণের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা দিয়েছে।

অনেক ভেবে মীরা সিদ্ধান্ত নেয় রাহাতের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার। হোক না এক অমানুষের নামে এ জীবণটা। তবুও ওর ভালোবাসা তো বেঁচে থাকবে….

চলবে…..

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব-৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মাঝ রাতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় মীরার। ঘুম থেকে উঠেই কিছু মনে করতে পারে না স্বপ্নের কথা। বিছানা থেকে উঠে পানি খায় ও। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে বিছানায় রাজিব পুঁটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। শীত করছে বোধহয় ওর, এটা ভেবে চাদর টেনে দেয় গায়ে। পুরাতন এ চাদরটা তাসলিমা ভাবি দিয়েছিলো।

শীত আসছে সামনে, গায়ে দেওয়ার কোন কাঁথা বা কম্বল কিছুই নেই ওদের। কথাটা ভাবতেই বুকটা কষ্টে ছেয়ে যায়। ওর বাবার বাড়িতে ওদের সবার জন্য একটা করে আলাদা কাঁথা আর কম্বল আছে।
ওদের পাশের বাড়ির এক বৌয়ের বাবার বাড়ি যশোর। তারা কি সুন্দর কাঁথা তৈরী করে, তা দেখে মীরার মা ওদের দু বোনের জন্য যশোর থেকে এত সুন্দর কাঁথা বানিয়ে এনেছেন যে গায়ে দিতে মায়া হয়। এক রাঙা নতুন কাপড়ের মধ্যে বাহারী রঙের সুতার কাজ করা। একটা সাদা রঙের আরেকটা হলুদ। সাদা কাঁথায় লাল, সবুজ আর নীল সুতায় কাজ করা। হলুদটায় বেগুনী, খয়েরী, আর টিয়া রঙের সুতার কাজ। পুরো কাঁথার পাড়ে সুন্দর করে কুশিকাটার কাজ করা। দুটে কাঁথা তৈরী করতে ওর মা তাকে মজুরি দিয়ে ছিলো চার হাজার টাকা। সেগুলো তিনি আগে ভাগেই তৈরী করে রেখেছেন মেয়েদের বিয়ের সময় দিয়ে দিবে তাই। পরে যদি এমন লোক না পান সেই ভয়ে। তার উপর মেহমানদের জন্য ও আলমারীতে কত সুন্দর সুন্দর কাঁথা আছে। মীরার সৌখিন মায়ের একটা আলমারী ভরা শুধু চাদর আর কাঁথা দিয়ে৷ মানুষের একেক নেশা থাকে। মীরার মায়ের নেশা শপিং করা। দেখা গেলো মার্কেটে গেলো, কোন একটা জামা বা জুতা চোখে লাগলো, সেটা হাতে নিয়ে সে ভাবতে থাকে কার গায়ে বা পায়ে লাগবে এটা। এমন কোন মাস নেই সে চাদর বালিশের কভার না কিনে। অল্প কিছু দিন ব্যাবহার করেই একে ওকে দিয়ে দেয়। তাদের বাড়িতে যদি একসাথে বিশ জন মেহমান ও আসে তবুও কাঁথা বালিশের অভাব হবে না।

অথচ মীরা, বিছানায় বিছানোর জন্য চাদর একটাই, ময়লা হলে এটাকেই ধুয়ে, শুকিয়ে বিছানায় বিছাতে হয়। আর গায়ের চাদরটা, শীতের আগমনী এই দিনগুলোর শেষ রাতে এই পাতলা চাদরটা পিপাসিত পথিকের কাছে এক ফোটা জলের মতো। যা আছে কিন্তু পোষায় না ঠিক।

এ মুহূর্তে একটা কম্বল কেনার কথা চিন্তাও করতে পারে না ও। অথচ টিনের চালার এ ঘরটায় শেষ রাতে বাতাস আসে হুহু করে। তখন মনে হয় যেন ঠান্ডা বাতাস দাঁত বসিয়ে দিচ্ছে শরীরে। ও ভাবে মনে মনে গরমই ভালো। শীত কেন এলো। একটা কথা মনে পরে ওর। সৈয়দ মুজতবা আলীর মুসাফির বইতে একটা কথা আছে – হিট হার্টস, কোল্ড কিলস।
কথাটা সত্যি। গরম কষ্ট দিলেও মানুষ মানিয়ে নিতে পারে সহজে, কিন্তু শীতের রাতে গরম কাপড় না থাকলে ঘুম একবার যদি ভাঙে আর ঘুম আসে না।

চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতেই চোখদুটো ভিজে যায় ওর। ভেজা এই চোখে আবীরের চেহারাটা ভেসে উঠে হঠাৎ। মহূর্তেই চোখ খুলে মীরা। না, না, ওকে ভাবার যোগ্যতাও নেই আমার। যে ক্ষতি আমি ওর করেছি তা জীবণেও পূরণ হবার নয়। জীবণের এই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওর মনে হয় যে ও অন্যায় করেছে আবীরের সাথে, কিন্তু এতদিন একটা বারের জন্য ও অনুতপ্ত হয় নি মীরা আবীরকে ভেবে।

মনে পরে বিয়ের দিন সকালে আবীর এসেছিলো মীরার সাথে দেখা করতে। মীরা দেখা করে নি, ও জানতো ও না যে সেদিন রাতেই বিয়ে হবে ওর। জানলে ও আবীরের সাথে দেখা করে সব খুলে বলতো ওকে। আবীর নিশ্চয়ই ওকে সাহায্য করতো। তাহলে অন্তত ওর জীবণের খাতায় এই কালো দাগটা পরতো না।

আবীর বেচারা ওর বাবা ময়ের কারনে কষ্ট পেলো। ওর বাবা মা এ কাজটা চালাকি করে করেছে তা জানে মীরা। কারন তারা রাজিবের সাথে কথা বলেছিলো। প্রথম প্রথম অবশ্য রাজিই হয় নি তারা। কি সব কথা শুনেছে ওর সম্পর্কে, সেগুলো দিনরাত তবজির মতো জোপেছে ওর সামনে। কোন মতেই তারা ঐ ছেলের কাছে বিয়ে দিবে না ওকে। ওর মা জাহানারা বলেছেন – তারচে বরং তুই চলে যা বাড়ি ছেড়ে, তবুও আমরা ওকে মেনে নিবো না।

এদিকে মীরার পাগলামি দেখে ওর বাবা মোজাম্মেল বলেছিলেন যে রাজিবের সাথে বিয়ে দিবে ওর, তবে এখন না। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ওকে।

এদিকে রাজিবকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলে ঐদিকে আরেক জায়গায় বিয়ে ঠিক করে তারা চুপিচুপি।

সেদিন মীরাকে তারা বলেছিলো আবীরের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে ওকে। মীরা তখন বলেছিলো আমাকে দেখতে আসার কি আছে, ছোট থেকে তো তাদের সামনেই বড় হয়েছি আমি। মীরা চিৎকার চেচামেচি করলে তারা ওকে বুঝ দিয়েছিলো তারা আসতে চাইছে, এখন না করবে কিভাবে। দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। মীরা কিছুটা শান্ত হয়, বলে এই কিন্তু শেষ। ওর বাবা কেমন একটা হাসি দিয়ে বলেছিলো- ” ঠিক আছে মা এই শেষ ”

আসলেই সেটাই শেষ ছিলো তাদের হিসেবে। ভেবেছিলো হয়তো- ” একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই হলো, তারপর বিয়েটা বদলে দিবে ওকে ”

কিন্তু মীরার হিসেব যে রাত পেরুলেই উল্টে যাবে তারা তা ভাবে নি একটি বারের জন্য ও। সেদিনই যে ওর বিয়ে হয়ে যাবে তা ক্ষুনাক্ষরেও টের পায় নি মীরা। তাই তো পরদিনই এমন একটা কান্ড বাঁধায় ও।

ওর প্ল্যান ছিলো বাবা মা এমন করলো ওর সাথে, ও চলে গেলে দুদিন অন্ততঃ পার হবে ওকে খুঁজে পেতে, ততক্ষণে ওরা বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু আল্লাহর কি লীলা খেলা, যে দোকান থেকে মীরা ফোন করে ছিলো রাজিবকে সে দোকানের মালিক ছিলো আবীরের এক বন্ধু। সেই বন্ধুই সাথে সাথে ঘটনাটা জানায় আবীরকে। আবীর সেই নম্বর নিয়েই মীরার বাবা সহ পৌঁছে যায় রাজিবের দোকানে, মীরার তাসলিমা ভাবীদের বাড়ি পৌছানোর আগেই। তখনো চেষ্টা করলে আবীর ফিরিয়ে আনতে পারতো মীরাকে। কিন্তু কেন জানি কিছু করবার অনেক ইস্যু থাকা সত্ত্বেও কিছুই করে না আবীর। কারন ও জেনে গেছে মীরাকে ও ফিরিয়ে নিতে পারলেও ওর মনটা বাঁধা আছে রাজিবের কাছে। একসাথে ঘর করলেও যা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাই মুক্তি দেয় ও মীরাকে। মীরার বাবা মা ও তাই কোন চেষ্টাই করে না ওকে খুঁজে পেতে। ফলাফল এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে শুরু করা সংসারটা এখন যেন কচু পাতায় থাকা এক বিন্দু পানি। টলমল করে দুলছে। এই বুঝি গড়িয়ে গেলো, পরে গিয়ে বিলিন হয়ে গেলো।

চারপাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে, টিনের চালের ফাঁক ফোকড় দিয়ে আলো ঢুকছে ঘরে। সে আলোতে রাজিবকে দেখছে মীরা। দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে ও, কেমন যে শ্রীহীন হয়ে পরছে ওর মুখটা। প্রায় রাতেই জ্বর আসে, খাবারে ও অরুচি এসেছে খেতেই চায় না ইদানীং। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে রাজিবের দিকে অপলক দেখছে আর মনে মনে বলছে- ” সবাই বলে আমি ভুল করেছি, খোদা সবার এই কথা, এই ভাবনাটাকে তুমি ভুল প্রমাণ করে দাও, আর কিছুই চাই না আমি ”

একটু পরে উঠেই পরের দিনের কাজ শুরু করে দেয় মীরা। এখানে ভাগের চুলায় রান্না করতে হয়। ও তাই একটু সকালে উঠে যাতে কারো সাথে না বাঁধে। খোলা বাড়ির এই লোক গুলো কেমন যে ঝগড়াটে স্বভাবের। উনিশ-বিশ হলেই বিশ্রী ঝগড়া শুরু করে দেয়। মীরা এসবে অভ্যস্ত না। তাই কষ্ট হলেও একটু আগে উঠে সব কাজ শেষ করে ফেলে। যাতে কারো সাথে কোন কিছু নিয়ে ঝগড়ায় না জড়াতে হয় ওকে।
তাছাড়া মানুষগুলো ওর অবর্তমানে রাজিবের খোঁজও রাখে। মানুষগুলো ঝগড়াটে হলেও তাদের মন ভালো। আসলে অন্য পরিবেশে ও বড় হয়েছে তাই তাদের সাথে হয়তো তাল মিলাতে পারে না ও। তারচে সকালে একটু আগে উঠলে সব কাজ দ্রুত শেষ হয়। ফলে তারা শান্তি মতো রান্না করে দুজন। অনেকটা গিভ এন্ড টেক এর মতো।

সব কাজ শেষ করে দুজনে খায় একসাথে। রাজিবকে ওর ঔষধ খাইয়ে, দুপুরের খবার আর ঔষধ গুছিয়ে বেরিয়ে পরে মীরা। হঠাৎ ব্যাগের সাইড পকেটে ভাংতি খুঁজতে গিয়ে একটা কার্ড পরে যায়। মীরা সেটাকে তুলে দেখে কার্ডে লেখা
” রাহাত গার্মেন্টস “, সেটাকে ভিতরে ঢুকাতে ঢুকাতে রাতের কথা মনে হয় ওর। ভাবে কোচিং এ গিয়ে কল করবে ও রাহাতকে।

হেঁটে এসে পৌঁছাতে আজ দেরি হয়ে যায় মীরার। এসে দেখে ও দেরি করায় ওর ক্লাসটা করাচ্ছে তমাল স্যার। যে ওকে বই,খাতা, আর এ চাকরীটা দিয়ে সাহায্য করেছিলো। তমাল স্যার ক্লাস করাচ্ছে ভেবে ওর আরেক কলিগ রুমির ফোন থেকে ফোন করে কার্ডে দেয়া নম্বরটাতে। রাহাত রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো-
: কে?
: আমি মীরা,
: ওহ্ মীরা, মাই সুইট হার্ট, আমি জানতাম তুমি আমাকে কল দিবেই। কারন তোমার চারদিকে ঘোর অমানিশা। আমি ছাড়া তোমাকে আর কেও আলো দেখাতে পারবো না। তারপর ডার্লিং কবে হচ্ছে আমাদের বিয়েটা?
কথাগুলো শুনে বিরক্ত লাগলেও কিছুই করার নেই মীরার। একটু সময় নিয়ে ও বলে-
: আসলে আমার কিছু কথা ছিলো।
: বলো, বলো ডার্লিং, তুমি বলবে নাতো কে বলবে, বিয়ের পর আমি কোন কথাই বলবো না, সব তুমিই বলবে। আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনবো সে কথা রাজরানি হয়ে থাকবে তুমি আমার কাছে।

কথাগুলো শুনে কেমন অস্বস্তি হয় মীরার। এই লোকের ভালো কথা শুনতেও অসহ্য লাগে ওর। অথচ এর কাছেই বিক্রি হতে চলেছে ও। এমন সময় মীরা বলে যে তার দেয়া প্রস্তাবে ও রাজি। তবে শর্ত হচ্ছে আগে রাজিব সুস্থ হবে। তারপর ওর যা করাতে বলবে সব করবে, তার আগে যেন কোন ভাবেই ওকে হ্যারেস না করে রাহাত।

মীরার এমন প্রস্তাবে রাজি হয় না রাহাত। বলে-
: ” বোকা পেয়েছো আমাকে, রাজিব সুস্থ হয়ে যাক আর তোমারা হাওয়ায় মিলিয়ে যাও। না, না, তা হবে না আমার জান পাখি”

কথাটা বিশ্রী লাগে ওর কানে। তবে রাহাত মীরাকে পাওয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না, তাই ও নিজেও একটা প্রস্তাব রাখে মীরার কাছে। কন্ট্রাক পেপারে সাইন করতে হবে মীরাকে। সেখানে এ ব্যাপারে লেখা থাকবে। মীরা রাজি হয় এতে। রাজিবের অপারেশন হলে ওকে ওর পাশে থাকতে হবে। তাই মীরার এমন চাওয়া। রাহাত বলে সবকিছু তৈরি করে ও জানাবে। মীরা যেন তখন ওর দেয়া ঠিকানায় চলে আসে। মীরা জানায় ও আসবে।

সেখানে ব্যস্ত হয়ে যায় মীরা পরবর্তী ক্লাসে ঢুকে। ক্লাস শেষ করে কলেজে যায় এডমিট কার্ড আনতে। পরীক্ষার বাকী আর মাত্র কয়েক দিন। এদিকে অসুস্থ রাজিব অন্য দিকে রাহাত। সব মিলিয়ে দিশেহারা মীরা কিছুই বুঝতে পারে না।

ছাত্রী কমনরুমে ঢুকে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকে মীরা। এমন সময় ওর বান্ধবী লিপি ওকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। মীরা প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে সবটা খুলে বলে লিপিকে। লিপি ওর খুব ভালো বন্ধু। ওকে বলাটা দোষের কিছু হবে না। বরঞ্চ কাওকে কিছু না বলতে পেরে ও কেমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে পরে গেছে।

সবটা শুনে লিপি বলে –
: কাজ হাসিল করে সটকে পরতে পারবি তে?
অসহায় ভাবে তাকায় মীরা ওর দিকে, লিপি ভেবেছে মীরা হয়তো কাজ হাসিল করতে রাহাতকে ভাও দিচ্ছে। কিন্তু মীরাযে সত্যি নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারে নি লিপি। পরে মীরা চেপে যায় বাকী কথা, যতটুকু বুঝেছে ও বুঝুক। নিজেকে আর নীচে নামাতে পারবে না ও।

মীরা চুপ করে বসে থাকে। লিপি বলে- চল ক্যান্টিনে যাই। মীরা কি মনে করে যেন হঠাৎ ওকে বলে-
: রাহাতের কাছে যেদিন যাবো যাবি আমার সাথে?
: জানাইস, যাবো নি। এখন চলতো….

চলবে…

প্রিয় ভুল পর্ব-৩+৪

0

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাত কত হয়ে গেছে, কারো আসার কোন নাম নেই। না জবা আন্টির না রাজিবের। রাজিব এমনিতে ন’টায় বাড়ি ফিরে। আজ দেরি করছে কেন ও? মীরার খুব রাগ হচ্ছে রাজিবের উপর। বেছে বেছে আজই কেন দেরি করছে ও ?

পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ, পানির বোতলে পানি শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হলো প্রস্রাবের বেগে তল পেট ফেটে যাচ্ছে। রুম থেকে বেরিয়ে বামে সোজা ফ্ল্যাটের শেষে বাথরুম। কিন্তু বের হতে ভরসা পাচ্ছে না । কারন রাহাত ঘরের আশেপাশে হাঁটছে। কান সজাগ থাকায় মীরা তা টের পাচ্ছে ।

কাঁচের বোতল আর গ্লাসের সংঘর্ষে টুংটাং শব্দ হচ্ছে একটু সময় পরপর। রাহাত কি তাহলে ম’দের বোতল বের করছে। খালি বাড়ি পেয়ে ও এমন করছে হয়তো। ওদের বাড়ি ও যা খুশি করতে পারে। এতে ওর বলার সাধ্য কি?

নানান উদ্ভট চিন্তায় মীরার অবস্থা খারাপ। দুঃশ্চিন্তায় আর ভয়ে মাথা দপদপ করছে ওর। মাথা ব্যাথা শুরু হলো একটু পরেই। আল্লাহকে ডাকছে মীরা। এ মুহূর্তে তিনিই শুধু পারবেন সাহায্য করতে।

ভয়ে তন্দ্রার মতো এসে পরেছিলো ওর। এমন সময় কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে বসলো। কতক্ষণ পার হয়েছে? বুঝতে পারছে না । ও বের হলো না দরজা খুলতে। দেরি দেখে দ্বিতীয় দফায় কলিংবেল বাজালো দড়জার ওপাশে অপেক্ষারত’রা । মীরা ঘর থেকে বেরই হলো না গেইট খুলে দিতে। এর বেশ পরে রাহাত দরজা খুলে দিলো।

ঘরে থেকেই বুঝলো মীরা যে জবা আন্টিরা এসেছে। অন্ধকার ঘরে বুঝলো না ক’টা বাজে তখন। সে রাতে জবা আন্টিরা ফিরেছে বেশ রাতে তা আন্দাজ করলো মীরা। রাজিব এলো তারও বেশ পরে। রাজিব দরজা নক করলো-
: “মীরা… ”
দৌড়ে এসে দরজা খুললো ও। ঘর অন্ধকার দেখে রাজিব জিজ্ঞেস করলো-
: মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে কি?
: কোথায় ছিলে তুমি রাজিব…
আর্তনাদের কন্ঠে বললো মীরা।
: কি হয়েছে মীরা?
উদ্বেগের কন্ঠে জিজ্ঞাসা রাজিবের।

এতক্ষণ ধরে যে ভয়, দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ ভর করে ছিলো মীরার উপর তার বাঁধ ভাঙলো যেন কান্নার জলে। রাজিব কেবল জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কি হয়েছে?
উত্তরে মীরা কেবলই কাঁদছে। এরকম অভিজ্ঞতা ওর জীবণে এই প্রথম।
রাজিব শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-
: বাড়ির কথা মনে পরছে?
: রাজিব আমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকবো না।
: কেন?
এবারো কান্না করছে ও। কথা বলতে পারছে না।
মীরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রাজিব বলে-
: একটা খুশির খবর আছে মীরা।
মীরাকে শান্ত করতে হয়তো কথাটা বললো রাজিব। কিন্তু মীরা কাঁদছেই। একটু বিরতি নিয়ে রাজিব বললো-
: রাহাত ভাই তার একটা দোকানে আমাকে ম্যানেজার রেখেছে। বলেছে দোকানের সামনের জায়গায় আমি চাইলে নিজে মাল তুলে বিক্রি করতে পারবো।

কথাটা শুনে মীরা এক ঝটকায় রাজিবের বুক থেকে মাথাটা তুলে তাকালো ওর দিকে। রাজিব আরো বললো-
: তিনি বেতন দিবেন দশ হাজার, আর আমার সাইডের ব্যাবসা থেকে যা আসে। এখন তো বেতন মোটে চার হাজার। এক ঝটকায় এত বেতনের চাকরীতে সুযোগ দিলো। বললো বিয়ে করেছিস এখন তো খরচ আছে অনেক। যে সুযোগ দিলেন তিনি, আমার বাবার কাজ করে দিলো জানো তো? বড় ভালো লোক তিনি।

অন্ধকারে মীরার চেহারার অভিব্যাক্তি দেখে নি রাজিব। তাহলে শেষের কথা গুলো বলতো না ও । মীরা রেগে গিয়ে বললো-
: তোমার বাবার কাজ করে দেয়া ভালো লোক কি করেছে জানো?

রাজিব ঘরের বাতি জ্বেলে দিলো। ওকে বসিয়ে বললো কি হয়েছে মীরা?
কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বলে মীরা। রাজিব শুনে স্তব্ধ। বললো –
: কি বলছো তুমি?
: কি বলছি শোন না তুমি?
: আমাকে ফোন দাও নি কেন তুমি?
: ফোনের টাকা ছিলো না।

রাজিব উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো। একটু পর মিন মিন কর অস্পষ্ট কন্ঠে বললো-
: তুমি কোন ভুল করছো না তো? না মানে…

কথাটা শেষ করতে পারে না রাজিব, অগ্নি মূর্তি ধারন করে মীরা। চিৎকার করে বলে-
: ভুল হচ্ছে মানে? আমাকে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?

চিৎকার শুনে দরজায় কড়া নাড়লো রাহাত, কিরে কি হলো এত রাতে? কোন সমস্যা?

রাজিব বলে-
: না, ভাই কোন সমস্যা না।

মীরা রাগত কন্ঠে বলে-
: যাও, তোমার বাপ আসছে।

কথাটা শুনে রেগে যায় রাজিব, জোরে একটা চড় মারে মীরাকে। কান্না ভুলে মীরা তব্দা খেয়ে যায়। কি হলো তা যেন বুঝতে পারছে না ও।

খাটের এক কোণে বসে কান্না শুরু করে মীরা। এই প্রথম রাজিব ওর গায়ে হাত তুললো। তাও অন্য একটা মানুষের জন্য, যে ওর বৌকে অসম্মান করেছে।

রাজিব বুঝতে পারে কাজটা ওর ঠিক হয় নি। খাটে উঠে মীরার কাছে গিয়ে ওর মাথা তুলতে চেষ্টা করে ও। ক্ষমা চায় ওকে চড় দেয়ার জন্য।

মীরা রাজিবের কাছে কেন জানি রাগ করে থাকতে পারে না। কোন না কোন ভাবে ও ঠিক মীরার রাগ ভাঙিয়ে দেয়।

মীরাও বুঝলো এটা রাগ করার সময় না। এখান থেকে বের হতে হবে দ্রুত। মীরা বললো রাজিব আমি আর একদিনও এখানে থাকতে পারবো না। রাজিব কেমন চিন্তায় পরে গেলো। মীরাকে শান্ত করে বললো তুমি শান্ত হও, তুমি যা বলবে তাই হবে জান। এখন হাতমুখ ধুয়ে খাবার খাই চলো।

মীরা রাজিবকে দাঁড় করিয়ে বাথরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই দেখে রাহাত ওর দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। মীরা দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো, রাজিব তখন বাথরুমে। ভয়ে যদি রাহাত আবার আসে। যদিও এ সময়ে আসবে না রাহাত। এতটা বোকা ও না।

রাজিব রুমের সামনে এসে দেখে দরজা আটকানো। এটা দেখে রাজিব বুঝলো মীরার ব্যাপারটা সিরিয়াস। রুমে ঢুকে খেয়ে শুয়ে পরলো ওরা। মীরা ওকে কেমন আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছে। যেন কেউ দাঁড়িয়ে দরজার কাছে, এক্ষুনি এসে ঝাপিয়ে পরবে ওর ওপর।

নানান চিন্তা ভিড় করলো রাজিবের মাথায়। এ মুহূর্তের পরিস্থিতি বিবেচনায় রাহাত ভাই ওকে অনেক বড় একটা সুযেগ দিয়েছে ঘুরে দাঁড়াতে। কিছুদিন অন্ততঃ এখানে থেকে গুছিয়ে নিক নিজেদেরকে। কারন এ মুহূর্তে রাজিবের কাছে কানা কড়িও নেই যে একটা ঘর ভাড়া করবে, ঘর ভাড়া করলেই তো হবে না, আসবাবপত্র কিনতে হবে, খাওয়া খরচও আছে, পকেটে কানা কড়ি নেই, হিসাব মিলবে কি করে। সবদিক বিবেচনা করে এই সুযোগটাকেই বড় করে দেখলো ও। জীবণে সুযোগ সবসময় আসে না। ঐ মার্কেটে দোকান থেকে বাইরে বেশী বিক্রি হয়। এ ব্যাবসার আদ্যোপান্ত ওর জানা। ঘুরে দাঁড়ানো তো ছয় মাসের ব্যাপার।
মীরার ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিয়ে শুয়ে শুয়ে টাকা গুনতে লাগলো ও। যেন ওর হালকা ভাবে নেয়া ব্যাপারটাই সমাধান এ সমস্যার। ঐ যে একটা গল্প আছে না কাকের- যে মাংস চুরি করে এনে চোখ বুজে ছিলো, আর মনে মনে ভেবেছিলো কেও দেখছে না ওকে। সে-রকম আরকি। সবশেষে রাজিব ভাবলো পরদিন সকালে মীরাকে বোঝাবে। অথচ একবারও ভাবলো না রাহাত কোন লাভে ওকে এত বড় সুযোগ দিলো।

———
গলার আধ ভরি সোনার চেইনটা বিক্রি করে দিলো মীরা। সে টাকা দিয়েই নতুন বাসার এডভান্স দেয়া হলো। কেনা হলো চলার মতো কিছু জিনিসপত্র। একটা তোষক, দুটো বালিশ, কিছু রান্নাবান্নার সরঞ্জাম। তাসলিমা ভাবী কয়েকটা পাতিল, ভাত খওয়ার প্লেট, বাটি পাঠালেন। খুপরি ঘর হওয়া সত্ত্বেও
নতুন সংসারে মীরা খুব খুশি। ওর মধ্যে কোন গ্লানি নেই যে আবীরের বৌ হলে ও একটা পাঁচতলা বাড়ির মালিকের ব্যাবসায়িক ছেলের বৌ হতো। আর আজ ওর একটা সিদ্ধান্তে ঠাঁই হয়েছে খুপরি ঘরে। বরের পকেটে ফুটা পাই নেই। বিয়ে যে হয়েছে তা ওর আংটি বিক্রির টাকায়৷ আর আজ যে ঘর ভাড়া করলো সন্ধ্যায় তার জন্য গলার চেইন বিক্রি করতে হয়েছে ওকে। রাজিব ওর পাশে আছে সেই বড় ওর কাছে। পৃথিবীতে কোন অলংকার নেই যার মূল্য রাজিবের চেয়ে বেশী । কিন্তু মনে মনে রাজিব খুবই বিরক্ত মীরার উপর। একমাত্র ওর জন্য এত বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো।

রাতে মীরার সংসারের প্রথম রান্নাটা করে আনলো মীরা। রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে গরমে হাসফাস লাগে ওর।
যা গরম পরেছে। ফ্যানটা কেনা হয়নি রাত হয়ে যাওয়ায়। “কাল সকালে সবার আগে এ কাজটা করতে হবে ” ভাবলো মীরা।

গুছগাছের সবকাজ শেষ করে রাতে খেয়ে শুয়ে পরলো দুজন। রাজীব পাশ ফিরে শুয়ে আছে খালি গায়ে। মীরা গায়ের ওড়নাটা পাশে রেখে শুয়ে পরলো রাজিবের পাশে। পেছন থেকে রাজিবকে আলিঙ্গন করে মীরা বললো-
: জানো রাজিব আজ আমি অনেক সুখি, তুমি আমার জন্য এত বড় সুযোগ পায়ে মাড়িয়ে এলে। আমি অনেক ভাগ্যবতী রাজিব।

কোন প্রতিক্রিয়া করে না রাজিব। ভান ধরে ঘুমিয়ে পরার। মীরা ওর পিঠে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে-

: হয়তো অনেক টাকা পয়সাওয়ালা স্বামী আমি পেতাম, কিন্তু আমি জানি তোমার মতো ভালো কেও আমাকে বাসতে পারতো না।

রাত বারোটা ঘরের আলো নিভানো, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকায় মীরা জানতেও পারলো না কি বিরক্তি, রাগ আর ঘৃণা মিশে ছিলো রাজিবের চোখেমুখে।

চলবে…

#প্রিয়_ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
৪.
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দুই মাস তেরো দিন বিয়ের বয়স হলো আজ। রাজিব কোন কাজ জোগাড় করতে পারে নি এখনো। রাজিব আগে যেখানে চাকরী করতো, সে মার্কেটে অন্য দোকানে চাকরীর জন্য গিয়েছিলো ও। ভালো কাজ জানা সত্ত্বেও রাজিবকে কেও রাখে নি কাজে। কারন ওকে কাজে রাখলে রাহাত সমস্যা করবে। রাহাতের বাবা এ মার্কেট সমিতির সভাপতি। তাই সাবাই তাকে সামলে চলে।

রাজিব অন্যান্য কাজও খোঁজার চেষ্টা করে। বিয়ে যখন করেই ফেলেছে সংসারের দায়িত্ব ও তারই। তাছাড়া এ পর্যন্ত মীরা ওর সর্বোচ্চটুকু করেছে। বিয়ের খরচ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত খরচ হয়েছে তা সবটাই মীরার দেয়া। এ ব্যপারটাও ওকে ভাবায়। এদিকে চেইন বিক্রির টাকাও প্রায় শেষের দিকে।

এত খারাপ খবরের মধ্যে একটা ভালে খবর হচ্ছে মীরা ওর কলেজের স্যারের সাথে দেখা করে টেস্ট পরীক্ষা না দিতে পারা সত্ত্বেও বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি নিয়ে আসে।

বিয়ের পর যে একটা সময় পার করলো মীরা। ভুলেই গিয়েছিল টেস্ট পরীক্ষার কথা। তাছাড়া বই পত্রও ছিলো না ওর কাছে। মীারার বন্ধুরা রাজিবের ফোনে ফোন করে ওর বাসা খুঁজে দেখা করে ওর সাথে। ওকে সাহস দেয়, পরীক্ষাটা দেওয়ার জন্য। মীরা বলে ওর বর্তমান অবস্থা আর কাছে বই খাতা না থাকার কথা। পরে অবশ্য বইপত্রের জন্য মীরার দুই বান্ধবী অনেক সাহস নিয়ে মীরাদের বাড়ি গেলে ওর মা বলেন- বই খাতা নাকি তারা পুরিয়ে ফেলেছেন। আশাহত হয়ে ফিরে আসে তারা। যদিও যাওয়ার আগেই এমন কিছুই ভেবেছিলো ওরা।

মীরা কষ্ট পায় না তাদের এমন আচরণে। কারন যা ও করে এসেছে তাদের সাথে, সে হিসেবে এ তো কিছুই না। পরে ওদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বেশ কয়েকটা বই জোগাড় করে দেয়, সাথে বিভিন্ন নোট এর ফটোকপি। কোচিং এর স্যারও অফিস থেকে সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে পাওয়া বই থেকে ওর প্রয়োজনীয় বই দেয় মীরাকে। পরীক্ষার বাকী আর মাত্র দুই মাস, ভালো করে পড়াশোনা করতে বলেন স্যার। যাতে ফেল না করে কোন বিষয়ে। বর্তামানে ওর যা পরিস্থিতি তাতে পরীক্ষায় ভালো করা ওর জন্য চ্যালেন্জিং। তাই স্যার ওকে সরাসরি বললো যাতে খারাপ না করে কোন বিষয়ে।

মীরা ওদের বন্ধুদের এ সাহায্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারন ওরা পাশে এসে না দাঁড়ালে হয়তো মীরা পরীক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তাও করতো না।

স্বচ্ছল পরিবারে বড় হওয়া মীরা, ঘুপচি ঘরে শুরু করা সংসার জোড়াতালি দিয়ে একাই টেনে নিচ্ছিলো। ও দেখছে যে রাজিব অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুই করতে পারছে না। পড়াশোনা করেছিলো ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। তারপর থেকে কাজ করেছে গার্মেন্টসের লোকাল কারখানার ম্যানেজার হিসেবে। শিক্ষিত, চটপটে আর সুদর্শন হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই সবার মধ্যমনি হয়ে ওঠে ও। এত এত ছুটি কাটানোর পরও রাজিবকে ছাড়িয়ে দেয় না বোরহান। কারন মিষ্টিভষী রাজিব খুব সুন্দর ভাবে সব কাস্টমারের সাথে ডিল করে। বোরহান সাহেব বেতন কম দিলেও বাউণ্ডুলে রাজিবকে এদিক সেদিক ঘুরতে প্রায়ই ছুটি দিতো। এই এক সুযোগের জন্য বেশী বেতনের চাকরী পাওয়া সত্ত্বেও পরে থাকে বোরহান সাহেবের দোকানে। কারন অন্যান্য মালিকেরা এত ছুটিছাটা পছন্দ করে না।

ওর কাজ ছিলো কারখানা আর দেকানের মালপত্রের হিসাব রাখা। পাইকারি বিক্রেতাদের লেনদেনের হিসেব রাখা। এ কাজের বাইরেও কারখানায় সময় দিতো ও। ইদ-চাঁদে কাজের চাপ পরলে কখনো কখনো প্যাকেজিং, কোয়ালিটি চেকিং এর কাজও করতো ও। অতিরিক্ত এ কাজ গুলো ও করতো ছুটি মঞ্জুরের আশায় বোরহান তাই রাজিবকে পছন্দ করতো। এই ঘুরতে যাওয়ার ছুটি মঞ্জুরের জন্য এটা সেটা করতে করতে এ ব্যবসার অনেক কাজ শিখে গেছে ও। হাতের কাজ বলতে কেবল এই এক কাজই পারে রাজিব। তাই কাজ খোঁজার দুনিয়াটা ছোট ওর কাছে । ওর বন্ধুরা সবাই ভার্সিটিতে পরে। তাই ওরা কেও কোন রকম সাহায্য করতে পারে না।

চক্ষু লজ্জায় না পারে নিচু কেন কাজ করতে। তাসলিমা ভাবীর বর শাহআলম ফল বিক্রি করে বাজারের ফুটপাতের দোকানে। ফুটপাতের এই দোকান নিতেও তাকে এডভান্স করতে হয়েছে সত্তর হাজার টাকা। তাও দেকান নিয়েছে বছর পাঁচ আগে। এই টাকাটা শাহআলম জেগাড় করেছে অনেক ধার দেনা করে। রোজগার মোটামুটি ভালোই হয়। কিন্তু তার পক্ষে রাজিবকে দোকানে রাখা সম্ভব না। কারন তার দোকানের কাজ যা তিনি একাই করতে পারেন৷ তাছাড়া যদিও লোক রাখাও লাগে তাহলে ছোট কোন ছেলেকে রাখলেই হবে। তাকে দুই হাজার টাকা বেতন দিলেই হয়ে যাবে। এদিকে রাজিবকে পাঁচ হাজারের কমে রাখা সম্ভব না। বরং আরো বেশী বেতন হলে ওর জন্য ভালো হয়। তাই এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারে না তিনি।

কোচিং থেকে ফিরে মীরা দেখে রাহাত উবু হয়ে শুয়ে আছে। ব্যাগ আর বইপত্র রেখে হাতমুখ ধুতে যায় ও। এসে ডাক দেয় রাজিবকে। দুপুরে খায় নি নিশ্চয়ই। ওকে ডেকে তুলে একসাথে খাবার খায় দুজন। রান্না বিশেষ কিছু না, দুটো ডিম সিদ্ধ করে মাঝখানে কেটে চার টুকরো করে আলু আর টমেটো দিয়ে রান্না করেছে মীরা, সাথে পাতলা মসুর ডাল। মীরা ভাজি করে না খরচ বাঁচাতে। দুপুর আর রাতে খায় তরকারি দিয়ে। সকালে অবশিষ্ট ভাত পানি দিয়ে রেখে দেয়, বাসি তরকারি কিংবা একটা ডিম ভেজে খেয়ে ফেলে দুজনে।

রাজিব আর মীরা দুজনেই ভালো পরিবারের সন্তান। দুজনের বেড়ে ওঠাই স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে। তবুও জীবণের হঠাৎ এমন ছন্দপতনে ওরা যেন মানিয়ে নিয়েছে দু’জনে। ভালোবাসা আছে তাই হয়তো সম্ভব হয়েছে তা। তা না হলে আধ-পাকা টিনের ঘরে থাকা ওদের জন্য অসম্ভব। যেখানে দিনের বেলা সূর্যের তাপে ঘরটা যেন জলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে থাকে। গরম থেকে বাঁচতে ফ্যান ছাড়াবে তারও জো নেই। ফ্যান ছাড়লে সেটা টিনের চালের তাপ টেনে আনে।
খাট নেই ওদের, তোষকের ফ্লোরিং বিছানাটা এমন তেঁতে থাকে যে শুয়ে থাকাটাও যন্ত্রণার হয়ে যায়।
মীরা চালের বস্তা ভিজিয়ে বিছিয়ে রাখে মেঝেতে। তাতে লাভ কি হয় তা জানে না মীরা। পাশের ঘরের ভাবীর দেখাদেখি কাজটা করেছে ও। রাতের বেলা ঘুমানো যেন আরো কষ্টের। ঘরটার সারাদিনের তাপ যেন ধীরে ধীরে গরম নিঃশ্বাসের মতো ছাড়ে। শেষ রাতের দিকে ঠান্ডা হতে থাকে ঘর। তার কিছু পরেই আবার পরের দিনের সূর্য উঠে ঘর তাঁতানোর কাজে লেগে পরে। ওরা যে বাড়িটাতে থাকে তার আশেপাশে কোন গাছ কিংবা বিল্ডিং না থাকায় ছাঁয়া পরে না। কম টাকায় এর চেয়ে ভালো ওদের কাজে জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। এ বাড়ির ভাড়া মাত্র পনেরোশ টাকা। এক চুলায় রান্না করে তিন জন, বাথরুম আট ঘরের ভড়াটিয়ার জন্য মাত্র একটা। তবুও দিনশেষে ওরা দুজনই বিশ্বাস করে – ওরা নিশ্চয়ই একদিন এখান থেকে ভালো অবস্থানে পৌঁছাবো।

রাতে রাজিব মীরার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে- তুমি আমার যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশী ভরসা করেছো আমায়, রাজকন্যা হলেও রানীর মতো রাখতে পারছি না তোমাকে। এখন পর্যন্ত সংসারের ঘানি একাই বইছে। এর মূল্য আমি কি দিয়ে পরিশোধ করবো তা জানি না। কিন্তু দেখো মীরা, একদিন আমাদের ড্রয়ার ভরা টাকা থাকবে, আর তুমি ইচ্ছে মতো খরচ করবে সেখান থেকে নিয়ে। তখন তোমাকে প্রতিদিন ডিম রান্না করতে হবে না, পায়ে হেঁটে এত দূরের কলেজে যেতে হবে না। তোমার নিজের গাড়ি থাকবে। তুমি রানীর মতো হাঁটবে আমার চারপাশে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখবো তোমাকে।
মীরা এর উত্তরে বলে-
” এত সুখ আমি আশা করি না রাজিব, তুমি আমার পাশে থাকলে, আমাকে আগলে রাখলে কোন কষ্টই
গায়ে লাগে না আমার। আমি সবসময় সুন্দর আর ভালো মনের একটা বর চাইতাম, না টাকাপয়সা না বাড়ি গাড়ি কিচ্ছু না। বাবা আমাদেরকে অনেক আদরে মানুষ করেছেন। কেন শখ অপূর্ণ রাখে নি। “তোমাকে ভালো বেসে বিয়ে করে ভুল করেছি”
আমার বাবা মায়ের এ ধারনাটা শুধু ভুল প্রমাণ করে দাও। আমি আর কিচ্ছু চাই না রাজিব, কিচ্ছু না….

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-১+২

1

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

গ্রীষ্মকাল শেষ ক্যালেন্ডারের হিসেবে বর্ষাকাল চলছে। তবুও সূর্যের যে তেজ তাতে মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটাকে সে ঝলসে ফেলতে চাচ্ছে তার তাপে। রাস্তাঘাট মোটামুটি জনমানব শূন্য। যারাও আছে সবাই দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলো মীরা। গতকাল রাতে ওর জীবণটা এক ঝটকায় ৩৬০° ঘুরে গেছে। ওর মা এমন কিছু করবে তা ও জানতো। কিন্তু যা ঘটেছে গতরাতে তা ওর মায়ের ভাবনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওর মা নিজেও হয়তো এতটা আশা করেন নি। অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে ও। যে করেই হোক বাসা থেকে ওকে বের হতেই হবে। এবং তা আজকের মধ্যেই। তা না হলে সব শেষ হয়ে যাবে। এরপর আর কিছুই করার থাকবে না ওদের।

বাসা থেকে কোচিংয়ের কথা বলে বের হয়েছে মীরা।সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। যদিও এখন তার বের হওয়া এক প্রকার নিষিদ্ধ তবুও মীরা মাকে বলেছে স্যারকে বলে আসবো যে ও সামনের কয়েকদিন আসতে পারবে না। কোচিং-এর সীটগুলো যেন ওর জন্য স্যার আলাদা করে রাখেন। কথাটা শুনে মীরার মা জাহানারা কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকালো মীরার দিকে। সন্দেহ, আর অবিশ্বাস মিশে ছিলো সে দৃষ্টিতে। যেতে দেওয়াটা রিস্কি কিন্তু, না যেতে দেওয়াটাও ঠিক হবে না। যত যাই হোক পড়াশোনা তো চালিয়ে যেতে হবে। কি একটা ভেবে তিনি বললেন-” দ্রুত আসবি, আধঘন্টা সময় দিলাম। তোকে নিয়ে মার্কেটে যাবো তুই ফিরলে।”

ওর মা জাহানারার মুখ থেকে কথাটা শুনে বুক থেকে পাথর নামে ওর। কথাটা যে কাজে দিবে ভাবতেই পারে নি ও। মীরা দ্রুত কি যেন চিন্তা করে ওর জরুরী কাগজপত্র গুলো ব্যাগে নিলো। মা বাথরুমে, বের হওয়ার ব্যাস্ততায় তার সাথে দেখাও হলো না শেষবারের মতো। ছোট বোন ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বেরিয়ে গলো মীরা। ইরা অবাক হয়ে তাকালো বোনের দিকে। বোন এত ভালো কবে থেকে হলো। সারাদিন দুবোনে ঝগড়া লেগেই থাকে। আজ হঠাৎ কি হলো? ইরার ভাবুক চেহারাটা ব্যাস্ততায় লক্ষ্যই করলো না মীরা। ছুটলো যেন উল্কার বেগে।

এখন দিনের মধ্যভাগ। বাসা থেকে বের হয়ে সোজা বামে হাঁটা ধরলো ও কিন্তু ওর কোচিং যেতে হয় ডানের পথ ধরে। গরমে নাস্তানাবুদ অবস্থা ওর। তারাহুরায় ছাতাটাও আনতে ভুলে গেছে ও। ছাতা ছাড়া ও কখনো চলাফেরা করে না। চারপাশে তাকিয়ে মাথায় লম্বা করে ঘোটমটা টেনে নিলো ও। এরপর দ্রুত হাঁটা ধরলো। যা করার জলদি করতে হবে। সময় অনেক কম ওর হাতে।

প্রথমে ওদের এলাকা থেকে দূরের একটা ফোনের দোকানে গেলো মীরা। ও যে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে তা রাজিবকে জানাতে হবে। রিং বাজলো কয়েকবার। রাজিব ফোনটা ধরলো না। আরেকবার চেষ্টা করতেই ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে এলো-
: “হ্যালো মীরা”
: ” হ্যাঁ, তুমি কিভাবে বুঝলে আমিই ফোন করেছি? ”
কাতর কন্ঠে রাজিব বলে-
: ” কাল রাত থেকে আমি অনেক চিন্তায় আছি, এত দ্রুত সব শেষ হয়ে যাবে আমি বুঝতে পারি নি”
: ” বুঝতে কি আমি পেরেছি, তুমি এত ভেঙে পরছো কেন? আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাই তুমি কি আমাকে এখন ভালোবাসো না?”
: ” ব্যাপারটা তা না মীরা, খবরটা পেয়ে আমি ভেবেছিলাম সব শেষ হয়ে গেছে”
: ” আমি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি তোমার কাছে, তুমি এখন এসব বলছো। আমি কি চলে যাবো তাহলে?”

কথাটা বলতেই মীরা লক্ষ করলো দোকানী ওর দিকে কেমন চোখে যেন তাকাচ্ছে। একটু দূরে সরে গেলো মীরা। বাকী কথাগুলো বললো সাবধানে গলা খাঁদে নামিয়ে । রাজীব ওকে কি একটা বললো। এ পাশ থেকে তা বোঝা গেলো না কিছু।

মীরা একটা রিকশা নিলো তাঁতীবাজারের। রিকশায় উঠে নানান চিন্তা ভর করলো ওর মনে। হাতের আংটিটার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ও। সেটাকে হিং*স্র ভাবে খুলে ফেললো এক মুহূর্তে। যেন এ আংটিটা ওর শত্রু। যাকে ও ঘায়েল করে ফেলেছে ।

আংটিটা বিক্রি করে সাত হাজার টাকা পাওয়া গেলো। এটাই যক্ষের ধন ওদের কাছে। জুয়েলার্সের দোকান থেকে বেরিয়ে আরেকটা রিকশা নিলো ও। হুডটা তুলে দিতে বললো ড্রাইভারকে। হুড তোলা সত্ত্বেও মীরার শরীর পুরে যাচ্ছে যেন গরমে। ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেলো ও। হঠাৎ মনে পরলো সকাল থেকে ও না খাওয়া। ক্ষুধাটা এর পর থেকেই পেট এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে।

রিকশা থামিয়ে একটা বেকারীর সামনে নামলো ও। একটা স্যান্ডুয়েচ আর কোক কিনলো সেখান থেকে। তারপর রিকশা চলতে শুরু করলো। রিকশায় বসেই স্যান্ডুয়েচ আর কোক খেলো মীরা। কোক শেষ করে বোতলটাকে রিকশা থেকে দূরে ছুড়ে ফেললো ও। মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। মনে মনে ভাবছে আমাকে আর পায় কে? যতক্ষণে জানবে সবাই ততক্ষণে আমি মিসেস রাজিব হয়ে যাবো। ওর চোখেমুখে খুশির আভা, কোন অপরাধবোধের ছিটেফোঁটাও ছিলো না।

মিনিট পনেরো পর ও পৌঁছে গেলো রাজিবের বলা ঠিকানায়। সেখানে পা দিতেই ওর যুদ্ধ জয়ের মনোভব ম্লান হয়ে গেলো। তাসলিমা ভাবী ওকে দেখে দ্রুত ঘরে ঢুকিয়ে বললো-
: ” আসছো ভইন? ঐ দিকে তো ঘটনা রইট্যা গেছে। ”
: “মানে?”
: ” আবীর তো তুমাগো বাড়িত গেছিল, হেয় জানলে কমতে তুমি যে পালাইছো?”

কথাটা শুনে দপ করে বসে পরে মীরা। ওর মুখে কোন রা নেই। ভাবী ওকে বাকী কথা বলতে লাগলো-
: “তোমার মামা আর বাবা রাজিবের দোকানত গেছে, আমারে ফোন করি সব কইলো রাজিব একটু আগে ”

মীরা ভাবতে লাগলো ওর ভাগ্যটা এমন কেন। কাঁদতে থাকে মীরা। ভাবী স্বান্তনা দিলে বলে-
: “আল্লাহই জানে ভাবী, কি চলছে ওর উপর দিয়ে”
: ” আল্লারে ডাকো ভইন, আল্লারে ডাকো।
——————–

গতকাল এ সময়ে মীরাদের ড্রইংরুম ভর্তি মানুষ ছিলো। সবার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ছিলো চোখে পরার মতো। এত সুন্দর বর-বৌ, যেন মানিক জোড়। চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই তা উবে গেছে কর্পূরের মতো। বিয়ে বাড়িটা কেমন যেন শোকের বাড়িতে পরিণত হয়েছে।

সবার মুখেও একই কথা। গেলিই যদি বিয়ের আগেই যেতি, অন্ততঃ ছেলেটার কলঙ্ক হতো না। যত যাই হোক, মানুষ কিন্তু ঠিকই বলবে ছেলের বিয়ে হয়েছিল একবার। বৌ বিয়ের পরদিনই পালিয়ে গেছে।

মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে আবীর।
যে জীবণ গত রাতে ও শুরু করে গিয়েছিল এ ঘরটাতে আজই তা শেষ হয়ে গেলো। আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতা নড়ে না। এ কেমন হুকুম তার। এ জীবণে কখনো ও কারো ক্ষতি করে নি। বড়দের সম্মাণ, ছোটদের স্নেহ, করতো। মেয়েদের থেকে নজর বাঁচিয়ে চলতো, সম্মান করতো মেয়েদেরকে। সবদিকে সমান নজর ওর বিদ্যা, বুদ্ধি, টাকা,পয়সা সব দিকে অলরাউন্ডার। পুরো পরিবারটাকে ধরে রেখেছে ও এক অদৃশ্য বাঁধনে। খালা কি ফুফু সবার খোঁজ খবর রাখে নিয়মিত। আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে বাজে কথা বলে নি কখনো। সিগারেট, নেশা এসব ছুঁয়ে ও দেখেনি কোনদিন। সারা জীবন এত ভালো হয়ে চলার এ পুরস্কার আল্লাহ দিলো ওকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অভিমান হলো ওর।

বিয়ের আগে ও বারবার ওর মাকে জিজ্ঞেস করেছিলো মেয়ে রাজি কি না। ওর মা বলেছিলো –
: ” মেয়ে কিরে মেয়ের চৌদ্দগুষ্টি রাজি, আমার ছেলে লাখে একটা”
: ” মেয়ের চৌদ্দ গুষ্টিকে আমি বিয়ে করবো না, মেয়েকে করবো, আপনি ভালোভাবে খবর নেন। ”

ছেলের ফুপু খুব গরম হয়ে গেছেন। কথা শুনাচ্ছেন মেয়ের মা-বাবা কে। তিনি বলেন- আমার সোনার টুকরা ছেলের এমন বেইজ্জতি। আমি এদের দেখে নেবো। আজকের মধ্যে ডিভোর্সের কাগজ দিয়ে দিবেন আমাদের। আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ছেলেকে এরচেয়ে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো।

আবীরের বাবা সুলতান তার বোনকে থামান। বলেন- আহা কি শুরু করলি সাহানা।

বড় ভাইয়ের ধমকে কিছুটা শান্ত হয় সাহানা। আবীরের মা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। ছেলেকে বিয়ের জন্য খুব পিড়াপিড়ি করে রাজি করিয়েছিলেন তিনি। ছোট বোনকে বিয়ে দিয়ে বিয়ে করবে বলেছিলো আবীর। তিনিই তার বান্ধবী মমতাজের মেয়েকে ছেলের বৌ বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কালো ছেলের জন্য পরীর মতো বৌ আনবে এই এক স্বপ্ন ছিলো তার। আর কেন চাওয়া পাওয়া ছিলো না তার। কালো হলে কি হবে আবীর দেখতে খুবই সুদর্শন আর মায়াবী ছিলো।
স্কুলে স্যাররা ওকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলতো।

ক্ষুনাক্ষরেও ভাবে নি আবীর এমন কিছু হবে ওর জীবণে। ওর খুব ইচ্ছে করে মাকে চিৎকার করে বলতে – “দেখো মা, তোমার লাখে একটা ছেলের ভাগ্য কতো সুন্দর… ”

ছেলেরা কাঁদতে পারে না। ওর কান্না গুলো হয়তো একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস রূপে বেরিয়ে যাচ্ছে। কারন ইতোমধ্যেই একটু একটু করে ওর মনে স্বপ্ন বুনা শুরু হয়েছে মীরাকে নিয়ে।

ড্রইংরুম থেকে উঠে বেরিয়ে যায় আবীর। মনে মনে বলে- অনেক ভালো থেকো তুমি মীরা।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন বিকেলে মীরার বড় খালার বাসায় আবীর আর মীরার ডিভোর্স হলো। ছেলেদের পক্ষের ছেলের মা আর বাবা আর ফুফু এসেছিলেন, আর মীরার পক্ষের শুধু মীরার বাবা মোজাম্মেল সাহেব। এক কোণে দুই হাতের উপর ভর দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। এই নিরীহ গোবেচারা মানুষটার মাথা উঁচু রাখার অধিকার তার মেয়ে কেড়ে নিয়েছে গতকাল। কত ভালোবাসেন তিনি মেয়ে দুটেকে। একমাত্র ছেলেটা সবার ছোট হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদেরকে তিনি বেশীই ভালোবাসেন। ছোটবেলা তার মা মারা গেলেন। মায়ের ভালেবাসার অভাব তাকে খুব কষ্ট দিতো। পরিবারে মা, মেয়ে, স্ত্রী কত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতেন তিনি। স্ত্রী জাহানারা যখন অন্তঃস্বত্বা হলো নামজের বিছানায় তিনি কেবল দোয়া করেছেন যেন একটা মা আসে তার ঘরে।

আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। জাহানারার অনেক শারীরিক জটিলতা শেষে মীরার জন্ম যেদিন হলো, গোবেচারা এই মানুষটার সে কি কান্না। খুশির আনন্দের আর দোয়া কবুলের সে কান্না দেখে কেঁদেছিলো প্রতিবেশীরাও । বিবাহিত জীবণের ষোলোটি বছর পর জন্ম হয়েছিল মীরার। কত লোক বলেছিলো – জাহানারা বন্ধ্যা। ওর কোনদিন বাচ্চা হবে না। মোজাম্মেলের চাচা-চাচীরাও ২য় বিয়ের ব্যাপারে বলতো ইনিয়ে বিনিয়ে। কিন্তু মোজাম্মেল তার ধার ধারতো না। আল্লাহর উপর ভরসা ছিলো তার। সাধ্য মতো সবরকম চিকিৎসা তিনি করিয়েছেন স্ত্রীর। একসময় বিরক্ত হয়ে জাহানারা ডাক্তার দেখানে, ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দিনরাত আল্লাহর কাছে একটা সন্তান চাইতেন। ষোলো বছরের দীর্ঘ সাধনার ফল এই- ” মীরা ”

নতুন মায়েরাও অনেকসময় দেখা যায় নিজের সদ্যজাত বাচ্চাকে ঠিকঠাক কোলে নিতে পারে না, ভয় পায় এই বুঝি পরে গেলো। কিন্তু মোজাম্মেল সাহেব সেই ছোট্ট মীরাকে কি সুন্দর করে কোলে নিতেন। চল্লিশ দিন না পেরুলে ছোট বাচ্চা বাইরে বের করা নিষেধ এমনি চল ছিলো গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু তিনি সদ্যজাত মীরাকে সকলে ঘুম থেকে উঠলেই সুন্দর করে তৈরী করে কোলে নিয়ে ঘুরতে বেরুতেন । যাতে এই ফাঁকে তার স্ত্রী ঘরের সকল কাজ সেরে ফেলতে পারেন। সেই অভ্যাসটা রয়ে গেলো বড় বয়স পর্যন্ত। কোথাও যেতে হলে বাবাই মীরার একমাত্র ভরসা। জামা কিনবে কি বই, খাতা, কলম। বাবাই ওর সব সময়ের সঙ্গী। সেই মীরা এমন একটা কাজ করার সময় একটুও ভাবলো না ওর বাবার সম্মানের কথা। তিনি ঠিক মীরার বিপরীতে বসা। কিন্তু মীরার দিকে একবারও তাকান নি এ ঘরে ও ঢোকা পর্যন্ত।

আবীরের ফুফু অনেক কথা শুনচ্ছে মীরা আর রাজিবকে।
: ” এতই যদি ভালোবাসা তাহলে কেন বিয়ের আগেই চলে গেলো না। কেন আমার ভাতিজাকে কলঙ্কিত করলো ও”

যেন জবাব চাইছেন তিনি মীরার কাছে। মীরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে, রাজিবের পিছনে। যেন রাাজিব ওর ঢাল, কথার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য।

আবীরের আসার কথা থাকলেও আবীর আসে নি। লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে হয়তো। আবীরের সই পরে নেয়া হবে। কর্কশ ভাবে আবীরের ফুপু সাহানা বললো-
: “এই নির্লজ্জ মেয়ে সই করো এখানে, তুমি আমার মেয়ে হলে, তোমার চামড়া তুলে লবণ দিতাম আমি, অসভ্য মেয়ে কোথাকার ”
এত সব শুনেও মীরা যন্ত্র চালিত পুতুলের মতো সই করে দিলো উকিলের দেখনো জায়গায়। সই করার পরই তারা চলে গেলো দ্রুত ঘর ছেড়ে। মীরার খালা পারভীন বললো- “কি ভুল যে করলি একদিন ঠিক বুঝবি, কিন্তু তখন বুঝেও কোন লাভ হবে না” কথাটা শেষ করেই তিনি চলে গেলেন অন্য ঘরে। ঘরে কেবল রইলো মীরা, রাজিব আর মাথা নত করা মোজাম্মেল সাহেব।

রাজিব মীরাকে কি একটা ইশারা করে। মীরা দৌড়ে ওর বাবার পায়ে পরে। কান্না জড়ানো গলায় বলে “বাবা আমরা ভুল করে ফেলেছি, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। মীরার বাবা তেমনি বসে। দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তার। এ মুখ আর মেয়েকে দেখাবেন না তিনি। কোন উত্তর না দিয়েই দাঁড়িয়ে যান তিনি। গলা উঁচু করে বলেন- পারভীন, পারভীন…
: ” জ্বী ভাই, ”
: ” শোন, আজ থেকে আমার বড় মেয়ে মৃত, আমি
এক মেয়ে এক ছেলের বাবা”
: ” চুপ করেন ভাই, আপনার উত্তেজিত হওয়া বাড়ন।
: ” মৃ’ত্যু যন্ত্রণায়ও হয়তো এর চেয়ে কম কষ্টের, যতটা কষ্ট আমি এখন পাচ্ছি, তুমি হয়তো ভাবছো রাগে কষ্টে কি না কি বলছে দুলাভাই, দুদিন পর সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, আমি বেঁচে থাকতে এ সম্পর্ক কোন দিনও মেনে নিব না ”

বলেই পারভীনের বাসা থেকে চোখ মুছতে মুছতে
বেরিয়ে যান মীরার বাবা মোজাম্মেল সাহেব । দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা পারভীনকেও দেখা গেলো ওড়নার কিনারা দিয়ে চোখ মুছতে। সে অবস্থায়ই তিনি কর্কশ গলায় বললো –
: ” বের হ তুই, আমার ফেরেশতার মতো দুলাভাইকে লোক সমাজে হাসির পাত্র বানিয়েছিস তুই। এত কিছুর পরও এত বোঝালাম, তাও যখন বুঝলি না, আমাদের কাছেও তুই তাহলে মৃ’ত। যা তোর এই পাপী চেহারা দেখাবি না আমাদের কেন দিন।”

এমন সময় পারভীনের স্বামী লিটন বললেন-
: ” কি শুরু করলা তুমি পারভীন? বাচ্চা মানুষ না বুঝে ভুল করে ফেলেছে”
আগের চেয়েও কঠিন গালায় পারভীন বললো-
: ” যে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও এমন স্বীদ্ধান্ত নিতে পারে
সে আবার কিসের বাচ্চা। ওর হয়ে তোমার তোমার দালালী করা লাগবে না” এরপর মীরা আর রাজীবকে উদ্দেশ্য করে পারভীন বলে-
: “এই বের হ আমার বাড়ি থেকে, তোকে দেখলেই আমার হাত পা জ্বলে ”

অসহায় চাহনিতে তাকিয়েও কোন লাভ হলো না মীরার। তাদেরকে বের করে অনেক জোরে দরজাটা আটকে দিলেন পারভীন। মীরা কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলো, রাজিবের চোখমুখ শক্ত। এত অপমান এর আগে কোন দিন কেও করে নি ওকে। আবীরের ফুফু মহিলাটাকে চাবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় ওর। আর এই মহিলাও কম কি, মীরার আত্মীয় বলে চুপচাপ সহ্য করলো সব তা নাহলে……

মীরার জীবণে দুঃসময় শুরু হয়েছে তা মীরা ঠিক টের পেয়েছে। গতকাল বিকেলে মীরা আর রাজীব কোর্টে বিয়ে করে তারপর সোজা গিয়েছিল রাজিবদের বাড়িতে। ততক্ষণে তাদের সব জানা হয়ে গেছে ছেলের খবর। রাজিবের মা ওদেরকে বাড়িতে উঠতে দেয় নি। কারন মীরা রাজিবের অযোগ্য তা না, রাজিবের বড় ভাই এখনো অবিবাহিত। তাকে রেখে রাজীব বিয়ে করেছে এটাই ওর অপরাধ। তিনি অশ্রাব্য ভাষায় কিছু কথা শোনালেন মীরাকে। যেন সব দোষ মীরার। মীরা নাকি তার ছেলের মাথা খারাপ করেছে। আর মীরার যে আগে বিয়ে হয়েছিল আবীরের সাথে তা আর তাদের অজানা নেই রাজীবের বোন এসে আরো কথা শেনালো ওদেরকে। ভাইকে এও বললেন- দুনিয়াতে কি মেয়ের আকাল পরছে যে বিয়াইত্তা মেয়ে বিয়ে করা লাগবে তোর? হারামজাদা। এই মা*গী আমার ভাইকে কি দেখিয়ে ভুলাইছে আল্লাহ জানে”

এতকিছুর পরও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো ওরা দুজন। যদি একটু জায়গা দেয় ওদেরকে। কিন্তু সে আশার গুরে বালি। রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি দুজনের কাওকেই।

রাত এগারোটা,
রাস্তায় হাঁটছে দুজন, কি করবে কোথায় যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ওরা। রাজিবের আত্নীয় স্বজন ঢাকায় তেমন নেই বললেই চলে। আর মীরার কোন আত্নীয় ওকে ঠাঁই দিবে না তা জানে মীরা। উপায়ন্তর না দেখে রাজীব ওর মালিকের বাসায় যায়। তাসলিমা ভাবির বাসায় এখন যাওয়াও সম্ভব না। কারন আজ সকালে তাদের বাড়িতে মেহমান এসেছে গ্রাম থেকে। এজন্য ভাবি ওদের বিয়ে তে থাকতে পারে নি।

ওর মালিকের বাড়ি বংশাল। একটা রিকশা নিয়ে রওনা হলো দুজনে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলো ওরা সেখানে। মালিক ওদেরকে দেখে অখুশি হলো। তার দোকানে মীরার বাড়ির লোকজন এসেছিলো গতকাল। সেদিন রাজিব অস্বীকার করেছিলো মীরার খোঁজের কথা। এমনকি তারা চলে যাবার পরও মালিক বোরহান ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো। তখনো রাজিব অস্বীকার করেছে। তাহলে আজ এসবের মানে কি। রাজিব বোরহানের হাতে ধরে। বলে – ওদের যাওয়ার কেন জায়গা নাই।

মালিকের স্ত্রী জবার মায়া হলো ওদেরকে দেখে। তিনি ওদেরকে বাড়িতে রাখতে অনুরোধ করলো তার স্বামীকে। বোরহান সাহেব কপট রাগ দেখিয়ে স্ত্রী জবাকে বললেন- করো তোমার যা মনে চায়। আজকের রাতটাই শুধু। কাল সকালে চলে যাবা। আর হ্যা তোমাকে আমি চাকরিতেও রাখবো না। রাজিব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ একটি কথাও বললো না। ও জানে মালিক রাগী হলেও মানুষ ভালো।

পরদিন ওদের চলে যাবার কথা থাকলেও আজ পনেরো দিন হয় ওরা মালিকের বাড়িতে আছে। রাজিব কাজে যাচ্ছে নিয়মিত। মীরা এদিকে জবাকে ঘরের কাজে টুকটাক সাহায্য করে। ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছোট মেয়েটাকে পড়ায় বিকেলে । জবার বড় ভালো লাগে মীরাকে। একদিন কথায় কথায় বলে-
: ” তুমি কি দেখে এ ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পরলে বলো তো? আকাইম্মা ভাদাইম্মা গুলা কি সুন্দর মেয়ে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলে। আর আমার ছেলের জন্য মেয়েই পাই না বিয়ে করাবো। মেয়ে সুন্দর হয় তো ফ্যামেলি ভালো না, ফ্যামেলি ভালো হয় তো মেয়ে সুন্দর না। জানো আমি তোমার মতো একটা বৌ খুঁজছি রাহাতের জন্য”
কথাটা শুনে প্রথম বারের মতো জবাকে খরাপ লাগে মীরার। কথাটা কেমন কানে বাজে ওর।

তবুও ভালোই চলছিলো ওদের নতুন জীবণ। খাওয়া পরার চিন্তা নেই। যেন নিজের বাড়িতেই আছে। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে কেও ছিলো না। জবার ননদের বাচ্চা হয়েছে সবাই মিলে তাকে দেখতে গিয়েছে। মীরা বাড়িতে একা। এমন সময় বাড়ির কলিং বেল বাজে৷ ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ছ’টা বাজে, মীরা ভাবে রাজীব আসবে রাত ন’টা নাগাদ।
আজ এত জলদি রাজিব এসে পরলো ?

গেইট খুলে দেখে জবার বড় ছেলে রাহাত। রাহাতকে দেখে মীরা দ্রুত ওর ঘরে চলে যেতে নেয়। ও মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: বাড়ির সবাই কোথায়?
মীরা হাঁটা থামিয়ে উত্তর দেয় –
: “আপনার ছোট ফুফুর বাড়িতে গেছে ”
: ” ও”

রাহাত ছেলেটাকে কেমন যেন পছন্দ হয় না মীরার। কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যখনি মীরা ওর দিকে তাকায় তখনি দেখে রাহাতের দৃষ্টি হয় ওর বুকে না’হয় কোমরে। মীরা হাঁটতে হাঁটতে ওড়না মেলে পুরো শরীরটাকে আবৃত করলো ওর দৃষ্টি থেকে বাঁচতে।

মিনিট দশেক পর, ওর রুমের দরজায় নক করলে রাহাত, “চোর হলেও ইমানদার” ভাব। বললো ওকে চা করে দিতে৷ অনন্যোপায় মীরা গেলো রান্নাঘরে। কোনমতে চা তৈরী করে ওকে দিতে ঘুরতেই দেখে রাহাত ওর পিছনে দাঁড়িয়ে।

মীরা কেঁপে উঠে ওকে এখানে দেখে। থতমত খেয়ে বলে-
: “আপনার চা ”
চায়ের কাপ ধরতে গিয়ে মীরাকে ছুঁয়ে দেয় রাহাত। মীরার গা রি রি করে। সেখান থেকে বের হতে চেষ্টা করতেই চায়ের কাপ পাশে রেখে পিছন থেকে মীরার হাত ধরে রাহাত, বলে-
: ” এমন রূপ নিয়ে কেন ঐ হতচ্ছাড়াকে বিয়ে করলে তুমি, ও কি তোমার যোগ্য? আমাকে দেখো, আমার বাবার গাড়ি বাড়ি সব আছে। দুদিন পর এ সব কিছুর মালিক হবো আমি। তুমি ওকে ডিভোর্স করে দাও, আমি তোমাকে বিয়ে করবো”
: ” ছাড়েন আমাকে? অসভ্যের মতো কি করছেন, কি বলছেন? হাত ছাড়েন না হলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো”
: ” ছাড়তে বললে ছেড়ে দিলাম, তুমি যা বলবে, তাই হবে। চিৎকার করবে বললে। এ বাড়ির চারপাশে কত জায়গা ফাঁকা পরে আছে দেখোনি। কেউ শুনবে না তোমার চিৎকার। আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। তাই বিয়ে করবো বলছি। এ মুহূর্তে ইচ্ছে করলে আমি কিন্তু সব পেতে পারি, এতে তোমার অনুমতিও নিতে হবে না আমাকে। কিন্তু আমি ভদ্র ছেলে, তোমাকে ভদ্র প্রস্তাব দিলাম। কালকের মধ্যে জানাবা আমায়। বাকী সব কিছু আমি ম্যানেজ করবো। মা’র তোমাকে বেশ পছন্দ হইছে, বাবাকে ম্যানেজ করতে না পারলে তোমাকে বিয়ে করে আলাদা বাসায় থাকবো। ”

মীরার এসব শোনার ইচ্ছে না থাকলেও শুনতে হচ্ছে, কারন রান্নাঘরের দড়জা আগলে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত। মীরা অধৈর্য্যের মতো বললে- ” পথ ছাড়ুন ”

পথ ছাড়তেই দৌড়ে যেতে লাগলো মীরা। রাহাত ল্যাং মেরে ফেলে দিলো ওকে। এরপর হাত বাড়িয়ে দিলো সাহায্যের ভনিতায়। বললো-
” ল্যাং কেন মারলাম জানো? তুমি বা তোমরা দুজন কতো অসহায় তা প্রমাণ করতে”

মাটিতে ভর দিয়ে উঠে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দড়জা আটকে দিলো মীরা। কাঁদতে লাগলো ভয় পেয়ে। মনে মনে বলতে লাগলো রাজিব তুমি জলদি বাড়িতে আসো, আমি আর এক মুহূর্ত ও থাকবো না এ বাড়িতে।

চলবে…

বধূবরণ পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0

#বধূবরণ- শেষ পর্ব
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

‘ভাই, হৈমী ভাবিকে ওই মা ছু গন্ডার লোকেরা তুলে নিয়ে একটা গোডাউনে রাখছে। গ্রামের পূর্ব দিকের গোডাউন।’

রাজীবের ছোট ভাই হারুন বড্ড সাবধানে ফিসফিস করে কথাটা বলল ফোনের ওপাশে থাকা সাঈদকে। সাঈদ শুনে চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস টানে নিজের মধ্যে। তারপর লাল চোখে চেয়ে জানায়,

‘তুই সাবধানে থাকিস, ওরা যেনো তোকে না দেখে। আমি আসছি। তুই গোডাউনের দিকে নজর রাখিস। ফোনের লোকেশন অন করে রাখ, আমি ট্রেস করছি।’

সাঈদ ফোন রেখে পকেটে পুড়ে। সাইদের পাশে শাহেদ, হৈমীর আম্মা এবং রয়েছে পুরো চেয়ারম্যান বংশ। সাঈদ ফোন রেখে পাশে থাকা তার বড় ভাই সুবাসের দিকে তাকাল। তীব্র জেদ মাখা গলায় সরাসরি বললো,

‘আমি হৈমীকে আনতে যাচ্ছি। আমার আসার আগে বিয়ের সব ব্যবস্থা করে রাখো। আজকেই আমি হৈমীকে ঘরে তুলব, এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।’

চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ কিকবু বলতে এগুলেন,

‘এভাবে এত হুট করে-‘

‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। হুট করেই সবকিছু হবে এখন থেকে। তোমাদের জন্যে, ঠিক তোমাদের জন্যে হৈমীর আজকে এই অবস্থা। আই উইল নট ডেফিনিটলি ডু অ্যানি মার্চি অন অঅ্যানিওয়ান ফ্রম নাও, স্পেশালি যখন সেটা হৈমীর ব্যপারে। আজকে যা হচ্ছে সব-‘

সাঈদ চিৎকার করে কথাগুলো বলে থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে থাকে।সাহেদ এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান, তবে সঙ্গেসঙ্গে আটকে ফেলে সাঈদ। বড্ড নরম থাকার চেষ্টা করে বলে,

‘আঙ্কেল, হৈমী আমার বউ। এটা আপনার যাই করেন না কেন, কোনভাবেই মিথ্যা করতে পারবেন না। আইন অনুসারে এখন হৈমীর প্রতি তার স্বামীর সবচেয়ে বেশি অধিকার।আমি যখন বলেছি হৈমী আমার কাছে সেইফ থাকবে, মানে থাকবে। সেটা দুনিয়া উল্টে গেলেও ওকে সেইফ রাখবো আমি সাঈদ। আমি এ ব্যাপারে কোনো না শুনতে চাইনা, আর না কেউ না বললে আমি শুনবো। দরকার হলে আমার বউ আমি তুলে নিয়ে আসার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু আমি এটা চায়নি দেখে এতোদিন কিছুই করিনি। কিন্তু আজকের পর নো মোর ভালমানুষী।’

শাহেদ কিছু বলবেন তার আগে চেয়ারম্যান বললেন,

‘ভাইজান, ছেলেটা আগে হৈমীকে নিয়ে আসুক, আমরা বসে এ ব্যাপারে কথা বলছি।’

সাঈদ লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে ঘুরে বাড়ির বাইরে যেতে যেতে চেচিয়ে বলে গেল,

‘আমি ফিরে আসার আগে যেন সব ব্যাবস্থা করে রাখো, ভাইয়া।’
_______________
হারুনের লোকেশন ট্রেস করে করে এগুচ্ছে সাঈদ। হারুন এক পর্যায়ে কল করে প্রায় কেঁদেই বলে ফেললো,

‘ভাই, ওরা বোধহয় ভাবির সাথে খারাপ কিছু করতে চাইছে। গোডাউনের ভেতর থেকে ভাবির চিৎকার শুনতে পাচ্ছি।’

সাঈদ কথাটা শুনে লোম অব্দি দাঁড়িয়ে গেলো। বুকের ভেতর জঘন্যভাবে ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। গাড়ির স্পিড দ্বিগুণ বাড়িয়ে সাঈদ বললো,

‘তুই থাক হারুন ওখানে। ভেতরে গিয়ে একা কিছুই করতে পারবি না তুই। আমি আসছি।’

একটু থেমে,

‘ওরা ওকে কিছুই করবে না হারুন , আমি করতে দেবো না। ওর সমস্ত কিছুর উপর আমার অধিকার, ওই জা নো য়া রের বা চ্চা দের নয়।’

সাঈদ গাড়ির স্পিড আরও বাড়াল। ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলো পুর্ব দিকের গোডাউনে। সাঈদকে দেখে হারুন সাঈদের পেছনে এসে দাঁড়াল। সাঈদ গাড়ি থেকে নেমে এক দৌঁড়ে গোডাউনের সামনে চলে এলো। দরজা ভেতর থেকে লকড। সাঈদ সাতপাচ চিন্তা না করে এক লা থি দিয়ে দরজা ভেঙে দিলো। সঙ্গেশঙ্গে দৃষ্টিগোচর হলো, হৈমীর ক্লান্ত মুখের ছবি। হৈমীর উপরে শুয়ে ধস্তাধস্তি করছে মাছু। হৈমীর চোখেমুখে কান্নার ফোয়ারা বইছে। বারবার বাঁচার জন্যে মাছুর গায়ে থা প্প ড়, কি ল ঘু ষি দিচ্ছে। সাঈদ আর ভাবতে পারলো না। দ্রুত দৌঁড়ে গিয়ে হৈমীর উপর থেকে মাছু কে তুলে কু ত্তা র মতো মারতে লাগল। হৈমী ছাড়া পেতেই গায়ে খুলে ফেলা শাড়ি জড়িয়ে হাটু গেড়ে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। কান্নার কারণে রীতিমত শ্বাসকষ্ট হয়ে গেছে। ঠিকভাবে নিশ্বাসটাও নিতে পারছে না। সাঈদ মা রতে মা রতে সবগুলোকে প্রায় আধাম রা করে ফেলেছে।তারপরও থামে হৈমীর মৃদু স্বরের আওয়াজ শুনে,

‘সা ঈ দ, থা মুন।’

সঙ্গেসঙ্গে সাইদের হাত থেমে যায়। চোখ ঘুরিয়ে পাশে চায়। হৈমীর শাড়ি গায়ে এলোমেলো জড়ানো। শরীরের অনেক নিষিদ্ধ অঙ্গ দৃশ্যমান। সাঈদ পেছনে তাকাল। হারুন এতোক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছিল। সাইদের এমন তাকানো দেখে সে বুঝতে পারল কিছু। মাথা নত করে বললো,

‘আমি বাইরে আছি ভাই। দরকার পড়লে ডাইকেন।’

কথাটা বলে মাথা না তুলেই চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো হারুণ। সাঈদ হাতে ধরে থাকা মাছুর কলার ছেড়ে দিল। মাছু লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। কুকিয়ে উঠল ব্য থায়। একপর্যায়ে ব্য থায় জ্ঞান হারালো। সাঈদ ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। তার লাল চোখ হৈমীর দিকে কাতর হয়ে চেয়ে আছে। হৈমী মাথা হালকা কাত করে কান্নামাখা চোখে চেয়ে রইল সাঈদের দিকে। সাঈদ অবশ দেহের ন্যায় হাঁটু গেড়ে বসে পরে হৈমীর ঠিক সামনে। শরীরে জ খম অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গিয়ে হৈমীর কপালে চুমু বসায়। হৈমী সঙ্গেসঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডান চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়ায়। হৈমী চোখ বন্ধ অবস্থায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সাঈদ সঙ্গেসঙ্গে হৈমীর গায়ে তার শার্ট খুলে জড়িয়ে দিয়ে বুকে চেপে ধরে। হৈমী চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সাঈদের কান্না আসছে হৈমীর এহেন অসহায় অবস্থা দেখে।সে ঠোঁটে দাঁত চেপে হৈমীর পিঠে হাত বুলাতে থাকে। হৈমী কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে শুধু,

‘আমি অপবিত্র হয়ে যেতাম সাঈদ।আমার আজ সব শেষ হয়ে যেতে পারত। ওরা-ওরা আমাকে কেমনে এসব। আমার গায়ে ওদের ছোয়া। আমার ঘেন্না হচ্ছে সাঈদ। সাঈদ, আমি আমি অপবিত্র -‘

সাঈদ আর শুনে না। শুনতে চায়ও না কিছু। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে হৈমীর মুখ দুহাতে তুলে চুমু বসায় ঠোঁটে। হৈমীর চোখের জল নাক গড়িয়ে ঠোঁটে আসতেই সাঈদের ঠোঁটের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে আবার। হৈমী একপর্যায়ে নিজেই মোহিত হয়ে গেলো। আজকে যা ঘটেছে ভুলার জন্যে, সাইদের গলা জড়িয়ে কিছুটা উঁচু হয়ে নিজেই পাগলের মত চুমু খেতে থাকে ঠোঁটে। সাঈদ ব্যা থা পায়, তবুও মুখ বুজে সহ্য করে নেয়।একটা দুটো ব্য থা হোক না, বউটা তো ওরই।
________________________
হৈমী নিজে বড্ড অবাক হয়েছ। গোডাউন থেকে সোজা চেয়ারম্যান বাড়ি ফিরেছে তারা। দু পরিবারের সকল মানুষকে নিজের সামনে দেখে ভয়ে, আতঙ্কে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সাঈদের পেছনে লুকায়। সাঈদ টান দিয়ে হৈমীকে সবার সামনে আনে। জোর গলায় পরিচয় করায় হৈমীকে সবার সঙ্গে,

‘আমার বউ, হৈমী বিনতে শাহেদ।সবাই থাকুন, ও ফ্রেশ হয়ে আসুক। আমাদের বিয়ে খেয়ে তারপর যাবেন।’

হৈমীকে নিয়ে দ্রুত সাইদের ঘরে ছুটে গেলো অনন্যা। দ্রুত বিয়ের শাড়ি গহনা পড়িয়ে নিচে নিয়ে আসলো।
কাজী এলেন। বিয়ে পড়ানো হলো বড্ড তাড়াহুরোয়। হৈমীকে কবুল বলতে এটুকু সময় দেওয়া হয়নি। কবুল বলার সঙ্গেসঙ্গে সবাই আলহামদুল্লাহ বলে উঠেন। হৈমী কী হলো কিছুই বুঝতে পারলো না। যা হলো, যেমন কোনো ঝড়! মুহূর্তেই হৈমীর জীবন পাল্টে গেলো।এখন থেকে সে সাঈদের বউ, স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী। ভাবতেই শিহরণে কেপে উঠছে বারবার হৈমী।

বাসর ঘরেও ঢুকে গেলো খুব দ্রুতই কেমন করে। ফুলে সজ্জিত বিছানায় হৈমী হাটু গেড়ে বসে আছে। সাঈদ আর তার ভাই-বোন, কাজিনের কথা শোনা যাচ্ছে বাইরে। সাঈদকে তারা কোনমতেই বাসর ঘরে ঢুকতে দেবে না। আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা, তারপর বাসর। সাঈদ বলল,

‘ক্যাশ নাই এতো। ভাগ।’

ভিড়ের মধ্যে অনন্যা উকি দিয়ে বললো,

‘ক্যাশ নাই, কার্ড আছে তো। ওটাই দাও।আমরা নিয়ে নেব নিজেদের টাকা।’

সাঈদ না পেরে শেষ অব্দি কার্ড দিল। তারপর চোখ পাকিয়ে বললো,

‘পঞ্চাশ এর উপরে এক টাকা খরচ হলে তোদের একটাকেও আর আস্ত রাখব না। মনে থাকে যেনো।’

ভাই বোনেরে হৈ হল্লোর করে কার্ড নিয়ে গেল। সাঈদকে তারপর বাসর ঘরে ঢুকার অনুমতি দেওয়া হল।

দরজা লাগানোর শব্দে হৈমী আড়চোখে তাকাল সাঈদের দিকে। সাঈদ আজ সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। হিরো লাগছে একদম তাকে। হৈমী বিছানা থেকে উঠে সালাম করল সাঈদকে। সাঈদ হৈমীকে নিচে থেকে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। হৈমী সাঈদের বুকে নিশ্চিন্তে পরে থাকল। একপর্যায়ে সাঈদ হৈমীর চুলে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘তুই তৈরি হৈমন্তী? ক্যান আই লাভ ইউ?’

হৈমীর গা যেমন শিরশির করে উঠল। সম্মতিস্বরূপ জোরে সাইডের পিঠে আঁচড় কাটল। সাঈদ মৃদু হাসলো। হৈমীকে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগোতে এগোতে বলল,

‘আজ আর তুই আস্ত থাকবি না হৈমন্তী।কা মড়ে-কু মড়ে তোকে আজ শেষ করে দেওয়া হবে। আমার এতদিনের ধৈর্য্য আর সহ্য হচ্ছে না।একদম না।’

#সমাপ্ত

বধূবরণ পর্ব-০৪

0

#বধূবরণ-৪র্থ পর্ব
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

সাঈদের বাইক একটা ক্যাফের সামনে এসে থামে। গ্রাম থেকে বেশ দূরে ক্যাফেটা। সাঈদ বাইক থেকে নেমে চাবি খুব ভাব নিয়ে পকেটে রাখে। তারপর বসে থাকা হৈমীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-নেমে আয়।

হৈমী খুব দ্বিধায় পরে গেল। আশেপাশে মানুষ তেমন নেই। খুব নিরিবিলি ক্যাফে। হৈমী কাঁপতে থাকা হাত সাঈদের হাতে রাখল।সাঈদ খুব শক্ত করে সেই হাত নিজের হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে হৈমীকে বাইক থেকে নামালো। হৈমী নামলে সাঈদ হৈমীর বাম পাশ থেকে হৈমীর কাধটা আগলে ধরে সামনে এগুলো। হৈমী আলগোছে মাথা তুলে সাঈদের মুখের দিকে তাকালো। সাইদের মুখের ডান পাশটা দেখা যাচ্ছে। কী নিখুঁত সেই মুখের ধরন। হৈমীর বুক কেপে উঠল উত্তেজনায়। হৈমী আরও একটু চেপে দাঁড়াল সাঈদের পাশে। নাকে সাঈদের ব্র্যান্ডের পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে। ভেসে যাচ্ছে হৈমী।

সাঈদ ক্যাফেতে প্রবেশ করলে, একটা ছোটো হালকা পাতলা গড়নের ছেলে দৌঁড়ে আসলো। এসেই সাঈদের সামনে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো। সাঈদ এক হাতে হৈমীকে আগলে রেখে অপর হাতে বেশ স্মার্টলি হ্যান্ডশেক করলো। ছেলেটা ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে, হৈমীর পাশে চোখের ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো,

-ভাই, ভাবী নাকি?

সাঈদ হালকা হাসলো। বললো,

-হ্যাঁ।

-ভাবির বয়স তো একদম কম। ভাইকে সামলাতে পারেন তো ছোট ভাবি?

হৈমীকে কথাটা জিজ্ঞেস করেই হু হা করে হেসে উঠলো ছেলেটা। ছেলেটার সাথে সাঈদও হালকা হাসলো। হৈমী দুজনের হাসি দেখে তব্দা হয়ে চেয়ে রইল তাদের দিকে। সাঈদ এক ফাঁকে লুকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,

-আসলেই সামলানো যায় আমাকে, রাব্বির ছোট ভাবী? আমি তো তার ভাবির কাছে এলেই কেমন বেসামাল হয়ে পড়ি, জানে সে?

হৈমী অবাক চোখে তাকালো সাঈদের দিকে। পরপর মাথা নত করে ফেললো। রাব্বি তারপর তাদের একটা আলাদা নিরিবিলি জায়গা বেছে বসার জন্যে বললো। সাঈদ হৈমী মুখোমুখি বসলো। রাব্বি তাদের ম্যানু দেখতে বলে চলে গেল অপরদিকে। সাঈদ ম্যানু সোজা হৈমীর দিকে এগিয়ে বললো,

-কী খাবি অর্ডার দে।

হৈমী ম্যানু হাতে নিয়ে চোখ বুলালো। সাঈদের একটা কল এসেছে। সে কল রিসিভ করে কথা বলছে। হৈমী ম্যানু দেখে যারপরনাই অবাক, বিস্মিত। সামান্য কফির দাম ৫৬০ টাকা। কফিতে কী মেশায় এরা।এত এত কফির নাম সে এ জীবনেও শুনেনি। পাস্তা পাওয়া যায়, দাম ১৩৯০ টাকা। পাস্তা ঘরে বানায় হৈমী। কই ঘরে বানাতে সবে ২০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যায়। এখানে ১৩৯০? হৈমী কী অর্ডার দিবে খুঁজে পেলো না। ম্যানু হাতে চুপচাপ বসে রইলো। সাঈদ কথা বলা শেষ করে ফোন বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখলো। হৈমীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-কী খাবি পছন্দ হয়েছে? কফি খাস? ক্যাপাচেনো চলবে? নাকি এক্সপ্রেসো? তারপর ভারি খাওয়া যাবে।

হৈমী এক নজর ক্যাপাচেনো আর এক্সপ্রেসোর দাম দেখে নিলো। ক্যাপচেনো-১১০০ টাকা! এক্সপ্রেসো-১২৩০ টাকা। দাম দেখে হৈমীর কফি খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেল। সাঈদ একপর্যায়ে রেগে গেলো। বললো,

-ম্যানু খেতে তোকে দেওয়া হয়নি। সেটা থেকে অর্ডার করতে দেওয়া হয়েছে। এত কী দেখিস ম্যানুতে?

হৈমী ম্যানু শব্দ করে টেবিলে রাখলো। আশেপাশে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললো,

-আমরা এখানে কেন এসেছি? দাম দেখেছেন সবকিছুর? আমার এক মাসের হাত খরচ থেকেও বেশি একটা সাধারণ কফি। আমরা অন্য রেস্টুরেন্টে যাই, চলুন।

সাঈদ এ কথা শুনে কিছুক্ষণ হৈমীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরে চেয়ারে হেলান দিয়ে সোজা বসে সরাসরি হৈমীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

-তোকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?
-আপনি।

হৈমী মিনমিন করে জবাব দেয়।সাঈদ আবার জিজ্ঞেস করে,

-এখানের বিল কে দিবে?
-আম-আপনি।
-টাকার চিন্তা করছেটা কে?
-আম-আমি।

সাঈদ এবার ঝুঁকে এলো হৈমীর দিকে। তারপর চোখে চোখ রেখে বললো,

-অর্ডার নাও, অ্যান্ড রাইট নাও।

হৈমী সঙ্গেসঙ্গে চোখ খিঁচে জবাব দেয়,

-পাস্তা আর কফি।

সাঈদ হৈমীর ভয় পাওয়া দেখে হাসলো হালকা। চোখ বন্ধ থাকায় হৈমী হাসি দেখলো না। সাঈদ আবার সোজা হয়ে বসল। তারপর ওয়েটার ডেকে অর্ডার দিয়ে দিলো। দেরি হবে খাবার আসতে। তারা বানিয়ে দিবে নতুন করে অর্ডার দেওয়ার পর। হৈমী আর সাঈদ চুপচাপ বসে আছে। হৈমী এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্যাফের ডেকোরেশন দেখছে। সাইদ দেখছে হৈমীকে স্বয়ং। একপর্যায়ে সাঈদ উঠে হৈমীর পাশে বসে গেল। গায়ে ধাক্কা লেগে হৈমী পাশে তাকালো। সাইদকে নিজের এত কাছে দেখে ভড়কে গেলো ও। সাঈদ হাত বাড়িয়ে হৈমীর হিজাব ঠিক করে দিলো।হৈমী বললো,

-খুলে গেছে হিজাব? তাড়াহুরো করে বেঁধে এসেছিলাম।

সাঈদ মাথা নেড়ে ঠিক আছে বললো। তারপর এতক্ষণে কাঙ্ক্ষিত কথা তুললো,

-বিয়ে করে তো গায়ে হাওয়া লেগেছে। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিস। আমি চলে গেলে খবরদার কারো সঙ্গে অ্যাই মিন ছেলেদের সঙ্গে কথা বলবি না।আমি ফিরে এসে যেন যেমনে রেখে যাচ্ছি, অমনি পাই। কী মনে থাকবে?

হৈমী মাথা নাড়লো। পরে বললো,

-সেই রাস্তা বিয়ের আগেই বন্ধ করে রেখেছেন, জানেন না?

-তাও তো রোজ লাভ লেটার কম পাস না। শোয়েব কে? আজকাল পেছনে ঘুরছে শুনলাম? খবরদার হৈমন্তী। নেক্সট ডে, সোজা গিয়ে একটা থা প্প ড় দিয়ে সরাসরি বলবি, অ্যাই অ্যাম ম্যারিড। কী, বলতে পারবি না?

শোয়েব এর কথাও সাঈদের কানে গেছে। ছেলেটা খুব সাবধানে হৈমীর সাথে কথা বলতে আসে। নিজেকে অনেক আড়াল করে। সেটাও জেনে গেছে। আর কতকিছু যে জানে কে জানে।হৈমী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বললো,

-থা প্প ড় লাগবে না। আমি ভালো ভাবে বলে দিবো, হবে না?

সাঈদ হাসলো একটু। কী নিষ্পাপ তার হৈমন্তী!
___________________
সাঈদ চলে গেছে আজ প্রায় দেড় মাস। যাবার পর প্রথম কদিন কল দেওয়া হত তার। আপাতত তার ১৫ দিন ধরে মাস্টার্স এক্সাম চলছে। তাই কল করার সময় পাচ্ছে না বলে সে আগেই জানিয়েছে হৈমীকে। হৈমী শুনে, প্রতিবাদ করে না। সাঈদ আর যাই করুক, পড়াশোনায় সে বড্ড ভালো। এ ব্যাপারে সে এটুকু ফাঁকি দেয়না।এজন্যে আরও সে বাড়ির বড্ড আদরের।

এই ফাঁকে, কদিন আগে হৈমীকে এসে দাওয়াত দিয়ে গেছে চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট মেয়ে, সাইদের ছোট বোন অন্যনা। চেয়ারম্যান বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশে একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার করা হবে। চেয়ারম্যান বংশের অনেকেই থাকবেন সেখানে। চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ চাইছেন, হৈমীকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবেন এবার। বিয়ে আল্লাহর রহমতে হয়ে আছে, এখন চেয়ারম্যান বাড়ির বউকে সবার সামনে আনা উচিত। বিয়ে করবে না করবে না করে ছেলে তাদের সোজা তুলে এনে বিয়ে করে নিয়েছে।কাউকে তেমন জানানো যায়নি বিয়ের কথা। মূলত হৈমীর জন্যেই এই গেট টুগেদার আয়োজন।

হৈমীকে নিজে এসে দাওয়াত দিয়ে গেলো অনন্যা ও সাঈদের বড় ভাবী। সঙ্গে যাবে হৈমীর পুরো পরিবার। তবে অনন্যা বলছে, হৈমীকে দুপুরের আগেই নিয়ে যাবে নিজের সঙ্গে। শাহেদ মানা করবে করবে করেও শেষ অব্দি রাজি হয়েছেন। তিনি মূলত চাইছেন না, বিয়েটা এখনই প্রকাশ পাক। কিম্তু চেয়ারম্যান বাড়ির মানুষের তোপের মুখে পরে শেষ অব্দি গড়িমসি করে রাজি হয়ে গেছেন।

হৈমী সেদিন দুপুরের আগেই তৈরি হয়ে আছে। আজকে হৈমী শাড়ি পরেছে। আকাশি রঙের তাঁতের শাড়ি। শাড়িটা আজকের জন্যে হৈমীকে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে উপহার দেওয়া হয়েছে। সেদিন কথার ফাঁকে, হৈমী শুনেছে অনন্যার থেকে। আজকে সাঈদ গ্রামে আসছে। আপাতত সে রাস্তায়। এই ফিরলো বলে। অনন্যা নয়, বরং সাঈদ নিজে হৈমীকে নিয়ে যাবে তাদের বাড়ি। এতদিন তৃষ্ণার্থ কাকের ন্যায় সাঈদকে দেখার আশায় হৈমী রীতিমতো মা রা যাচ্ছিলো। আজকে তার সঙ্গে অবশেষে দেখা হচ্ছে। খুশিতে হৈমী সময়ের আগেই তৈরি হয়ে বসে থাকলো।

একপর্যায়ে হৈমীর মোবাইলে কল এলো। অচেনা নম্বর। হৈমী কল ধরলো। ওপাশ থেকে সাইদের কণ্ঠস্বর কেউ একজন নকল করে বললো,

-হৈমন্তী, আমর-আমি বাড়ির বাইরে। দ্রুত আয়। তোর হাতে গুণেগুনে ঠিক ২ মিনিট সময়।

হৈমী কথাটা শুনে আর আগেপিছে দেখার সুযোগ পেলো না। খুশিতে হিতাহিত জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে দ্রুত শাড়ি একটু তুলে বাবাকে বলে দৌঁড় লাগালো উঠোনের বাইরে। খুশিতে হৈমীর চোখ চিকচিক করছে।

উঠোনের বাইরে পা রাখতেই, শাড়ির আঁচলে টান খেলো। হৈমী আটকে গেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখে মাছু গু ন্ডা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হৈমীর দিকে এগিয়ে আসছে। হৈমী বোকা হয়ে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। তারপর অবস্থা বুঝে দৌঁড় দিতে আরম্ভ করতেই শাড়ির আঁচল হৈমীর গায়ের সঙ্গে শক্ত করে পেঁচিয়ে মুখে রুমাল চাপে মাছু। মিনিট খানেক ধস্তাধস্তির পরপরই হৈমী জ্ঞান হারায়। মাছু হৈমীকে কাঁধে তুলে গাড়িতে তুলে নেয়। হৈমীর শাড়ির আঁচলের একটা ছোট টুকরো ছিঁড়ে মাটিতে পরে থাকে। হৈমীকে নিয়ে ওরা চলে যায় লুকানো কোন জায়গায়। যেখানে সাঈদ তাদের কক্ষণও খুঁজে পাবে না।
_________________
সাঈদ হৈমীদের উঠোনের সামনে এসে বাইক থামায়। তারপর বাইকে বসেই কল দেয় হৈমীকে। ওপাশ থেকে কল ধরে না কেউই। সাঈদ এবার বিরক্ত হয় অনন্যাকে কল লাগায়। ওপাশে কল ধরলে সাঈদ ধমকে উঠে,

-তুই হৈমীকে বলিস নি আমি নিতে আসবো তাকে?

অনন্যা সঙ্গেসঙ্গে রিপ্লাই দেয়,

-আমি বলেছি ভাইয়া। হৈমী ভাবি তো এ কথা শুনে দুপুরের আগেই শাড়ি পরে রেডি ছিলো। আমাকে রেডি হয়ে নিজেই কল করেছে, ছবিও পাঠিয়েছে।

সাঈদ অবাক হলো। তারপর কল কেটে দিলো। ভাবলো বাড়ির ভেতরে যাবে। বাইক থেকে নামলে, একটু এগোতেই পায়ে বাজে শাড়ির আঁচলের টুকরো। সাঈদ কিছুটা অবাক হয়। কোমর ঝুঁকিয়ে আঁচল হাতে তুলে নেয়। শাড়িটা চিনতে তার একবিন্দুও অসুবিধা হলো না। এ শাড়ি সে হৈমীর জন্যেই ঢাকা থেকে নিজে কিনে পাঠিয়েছে। কিন্তু শাড়িরো আঁচল এভাবে ছিঁড়ে পরে আছে কেন মাটিতে? সাঈদ কিছুক্ষণ হাতে থাকা শাড়ির আঁচলের দিকে চেয়ে থাকলো। তারপর হঠাৎই মনে পড়লো কিছু একটা।সঙ্গেসঙ্গে চোখ দুটো বড়বড় হয়ে এলো সাঈদের। দৌঁড়ে হৈমীর বাড়ির দিকে ছুটে গেলো সে। শাহেদ তৈরি হচ্ছেন চেয়ারম্যান বাড়ি যাবার জন্যে। সাঈদ বাড়ির উঠোন পেরিয়ে সোজা শাহেদের রুমে ঢুকে গেল। শাহেদ সাঈদকে এ অবস্থায় দেখে কিছু প্রশ্ন করতে যাবেন, তার আগেই সাঈদ মাথার চুল খামছে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

-হৈমী বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছে আঙ্কেল?

শাহেদ অবাক হলেন। সাইদের অবস্থা দেখে তার মোটেও সুবিধার লাগছে না। তিনি উত্তর দেন,

-ঘণ্টা খানেক আগে। তোমার বোন এসে নিয়ে গেছে।

সাঈদ জবাব দেয় এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে,

-হৈমী আমাদের বাড়ি যায়ই নি আঙ্কেল। কেউ ওকে তুলে নিয়ে গেছে। এই দেখুন ওর ছেড়া শাড়ির আঁচল। এটা উঠোনের বাইরে পরে ছিলো।

সাঈদ বড্ড হাপিত্যেশ করছে। বারবার আঙুল নিয়ে নাকের নিচের ঘাম মুছছে। অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে তার। হৈমীর আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে রাগে মাথাটা ফে টে যাচ্ছে সাইদের। কে সে? কে হাতে পারে? হৈমী ঠিক আছে তো? যদি হৈমীর কিছু হয়, সাঈদ তাদের বংশের নাম ধাম কাম সবকিছু ধ্বংস করে দিবে, সাঈদকে চেনে না তারা। সাঈদ বিড়বিড় করে গালি দিলো, ‘জা নো য়া রে র বাচ্চাদের একবার হাতে পেলে টুকরো টুকরো করবো আমি সাঈদ!’

#চলবে

বধূবরণ পর্ব-০৩

0

#বধূবরণ-৩য় পর্ব
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

-হৈমীরে, তোর গলার তিলে এটা কী লাভ বাইট দেখছি আমি?

হৈমী কথাটা শোনামাত্রই স্কুলের সাদা ওড়না গলায় ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে কলম দিয়ে খাতায় আঁকিবুকি করতে করতে বলল,

-উহু! কালকে রান্না করার সময় মাটির চুলো থেকে আ গু নে র ফুলকি এসে পড়েছে! সেরকম কিছু না!

নিশি শুনে, বিশ্বাস হল না কথাটা নিশির। সে আরেকটু এগিয়ে এসে হৈমীর গলা থেকে ওড়না সরাতে নিলে হৈমী তাৎক্ষণিক দূরে সরে গেল। কথা ঘুরিয়ে বলল,

-শুনলাম তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। রাজীব জানে?

নিশি এবার মুখ ভার করে বসল। একহাত বেঞ্চের উপরে রেখে মাথাটা হাতের উপরে ঠেস দিয়ে রেখে চাইল হৈমীর দিকে। তারপর বলল,

-হাঁ এসেছিল। সাঈদ ভাই সব সামলে নিয়েছেন আবার। রাজিবকে কল করে আমাদের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। রাজীব এসে তো সেইরকম একটা কান্ড ঘটালো বাড়িতে। বাবাকে হাতেপায়ে ধরে আমাদের বিয়ের জন্যে রাজি করাল।

হৈমী অবাক হয়ে গেল। কাল রাতেই তো ও বাড়ি থেকে এলো হৈমী। সাইদের মুখে তো তেমন কোনো কথা শুনেনি। তার বান্ধুবির সঙ্গে খাতির দেখাচ্ছে, অথচ তাকেই মুখ খান দিয়ে বলল না? অ স হ্য পুরুষ!

হৈমী বললো,

-তা আমরা তোর বিয়ে খাচ্ছি তাহলে খুব দ্রুত! কী বলিস?

কথা বলে আনন্দে নিশির শরীরের উপর কৌতুকপূর্ণ হেসে ঢলে পরল হৈমী! নিশি মুখ ভেংচালো। হৈমীকে সোজা করিয়ে আবার জায়গায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

-উহু বাছাধন, এখন নয়! আরও দু বছর পর।রাজীব চাকরি পেলে তবেই আব্বা বিয়ে দেবেন নচেৎ নয়!

-সে আর কী? রাজীব চাকরি পেতে আর কতদিন! ঠিক পেয়ে যাবে। দেখা যাবে, দু বছরের আগেই আমরা তোর বিয়ে খেয়ে নিয়েছি।

নিশি লজ্জা পেয়ে হাসল। তারপর হুট করে কিছু মনে পরে গেল যেমন নিশির। বলে উঠল,

-অ্যাই হৈমী! আসার সময় দেখলাম সাঈদ ভাই তার চ্যালাপ্যালাদের নিয়ে মাছু গুন্ডা কে শা সা চ্ছে। কলার ধরে রাগে চিৎকার চেচামেচি করছে। তুই কী কিছু বলেছিস ঊনাকে?

হৈমী আঁতকে উঠল। সাঈদ শহর থেকে গ্রামে ফিরলে, রোজ এমন কোনও না কোনও ঘটনা ঘটেই। হৈমী গ্রামের ঘটা কিছুই তাঁকে বলে না। অথচ হৈমীর অসুবিধার কথা তার সবসময় নখদর্পণে থাকে বটে। কিভাবে জানে সে, এতদিন হৈমী জানত না। এখন জানে। ওই রাজীবের একটা ছোট ভাই আছে। নাম হারুন। তাকে রোজ হৈমী নিজের সামনে পেছনে দেখতে পায়। হৈমীর ধারণা সে হৈমীর উপর সাইদের কথামতো নজর রাখে। এখানকার সব খবরাখবর সে সাইদকে ট্রান্সফার করে। হৈমী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বইখাতা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,

-আমার ঠেকা পরেনি তাকে এসব বলতে। জেনেছে নিশ্চয়ই সাঙ্গপাঙ্গ থেকে।গ্রামে এলেই মা রা মা রি করা যেন একটা অভ্যাস হয়েছে তার। যেন মজাদার কোনো অভ্যাস। ছিঃ।

নিশি হইহই করে উঠল যেমন। মেয়েটা একদম সাইদের ব দ না ম শুনতে পারে না। যেন সাঈদকে নয়, কেউ সাইদের ব দ না ম করে স্ব য়ং নিশির গায়ে আ গু ন লাগিয়ে দিয়েছে। সেটাই হল এবারও। নিশি এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল,

-ধুর ওমন বলিস না। সাঈদ ভাই তোকে ভালো——

-চুপ। আর তার হয়ে সাফাই গাইবি না একদম। মা ই র লাগাব ধরে। ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি যাবি চল।
________________________
একদিন পর, দুপুরে তখন হৈমী ঘরে পড়াশোনা করছে। হঠাৎ ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফোন বেজে উঠল হৈমীর। ফোনটা বেশ আগে সাইদের দেওয়া। তখন অবশ্য সাঈদ ততটা লাগামছাড়া ছিল না। কথাবার্তায় হৈমীর সাথে বড্ড সভ্য ব্যবহার করত। আর এখন? পুরোই অ স ভ্যে র জাত! কথাবার্তায় বেলাজ ব্যবহার উপচে পরে যেমন। হৈমী আসপাশ ভালো করে দেখে নিল। কেউ নেই। আশপাশে কেয়াকেও দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় খেলতে গেছে। হৈমী উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বদ্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ফোন কানে ধরল! ওপাশ থেকে হাই-হ্যালোর কোনও ধার ধরতে দেখা গেল না সাঈদকে। সরাসরি জানানো হল,

-বাড়ির বাইরে আছি, ২ মিনিটের মধ্যে আয়। আর হিজাব বেধে আসবি। স্টাইল করে না, সবকিছু ঢেকে আসবি। সবকিছু মানে সবকিছুই!

হৈমী রেগে গেল খানিক। তবে রাগ প্রকাশ না করে বলল,

-আমি আসব না। আব্বা বাইরে চাল শুকাচ্ছেন। দেখতে পেলে মা ই র লাগাবেন আমাকে।

-তুই আসবি আর এক্ষুনি আসবি! নাহলে আমিই ভেতরে আসছি! আসব?

হৈমী তড়িগড়ি করে বলল,
-না, আসা লাগবে না আপনার। আমি আসতেসি! দাঁড়ান আপনি!

-ওকে। হিজাবের কথা ভুলবি না।

হৈমী ফোন কেটে দিল। কী বলে বের হবে ভাবছে বসে বসে। পরে ভাবল, নিশির কথা বলে যাওয়াই যাবে। হৈমী চটজলদি জামা পাল্টে হিজাব বেঁধে নিল। দরজা খুলে বের হয়ে উঠোনে বাবার কাছে আসল। হৈমীর বাবা শাহেদ হাত দিয়ে চাল মেলে দিচ্ছেন মাদুরে। হৈমীকে এতো সেজেগুজে বেরুতে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন,

-কই যাচ্ছ?

-আব্বা, ওই নিশির ভাতিজির জন্যে আজকে ঘরোয়াভাবে সিন্নি করা হচ্ছে ওদের বাড়ি। নিশি আমাকে দাওয়াত দিয়েছে।

শাহেদ আশেপাশে তাকালেন। একটু দূরে কালো বাইকের মধ্যে সাঈদ হেলান দিয়ে ফোন দেখছিল। শাহেদ সেটা দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। মেয়ে কথা লুকাতে শিখে গেছে। বাহ! বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন ঘুরতে চাইছে, ঘুরুক। তার এখন এসব অদেখা করে যাওয়ার সময়। নাহলে যে জামাই পেয়েছেন মেয়ের জন্যে। বাধা দিলে দেখা যাবে পুরো গুষ্টিসমেত তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে। শাহেদ গম্ভীর গলায় বললেন,

-ঠিকাছে যাও। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবে। মাগরিবের নামাজ ঘরে এসে পড়ো যেন।

-জি আচ্ছা আব্বা!

হৈমী বাড়ির উঠোনের গাছপালা সব হাত দিয়ে সরিয়ে সাঈদের পাশে এসে দাড়াল। সাঈদ হৈমীকে দেখে হৈমীর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়েই ফোন পকেটে রাখল। দুহাত জিন্সের পকেটে পুড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল হৈমীর দিকে। তারপর দুহাতে হৈমীর কোমর পেঁচিয়ে ধরে হৈমীর কাঁধে মুখ লুকাল। হৈমী আচমকা আচরণে থরথর করে কেপে উঠল যেমন। দুহাতে সাঈদকে ঠেলে দেবার চেষ্টা করলে সাঈদ হৈমীকে চেপে ধরে কাঁধে মুখ লুকানো অবস্থায় ফিসফিস করে বললো,

-অ্যাই মিসড ইউ হৈমন্তী! ব্যাডলি, ইউ নো?

সাঈদের নেশালো কথা শুনে শিরশির করে উঠল হৈমীর সারা গা! সঙ্গে সাঈদের মাতাল স্পর্শ। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে হৈমী। হৈমী খুব কষ্টে মুখ খুলে,

-আব্বা দেখবেন। ছাড়ুন।

সাঈদ তাৎক্ষণিক ছাড়ল না। কিছুসময় নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার পর তারপর ছাড়ল। বাইকে উঠে ইঞ্জিন চালু করে বলল,

-উঠে বস, আমরা আজকে সারাদিন ঘুরব। পারলে রাতটাও হোটেলে কাটিয়ে নেব, কী বলিস? আমার বাচ্চাদের আসার ব্যবস্থা করতে হবে না?

হৈমী বাইকের পেছনে বসতে যাচ্ছিল। সাঈদের কথা শুনে বুকে ফুঁ দিয়ে দ্রুত দু পা সরে দাড়াল। সাঈদ হৈমীর রিয়েকশন দেখে হেসে উঠল শব্দ করে। তারপর আঙ্গুলের ডগা হৈমীর কপালে রেখে ছোট্ট করে গু তো দিয়ে বলল,

-ব দে র হাড্ডি। উঠে বস। আমরা খাওয়া দাওয়া করতে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি।

হৈমী শ্বাস ফেলল এবার। সাইদের কাঁধে হাত রেখে বাইকে চেপে বসল। সাঈদ শো করে বাইক চালু করল। বাইকের স্পিড বড্ড বেশি। হৈমীর হিজাব খুলে যাচ্ছে বাতাসের ঝাপটায়। হৈমী একসময় প্রশ্ন করল,

-আমরা আজকে এভাবে ঘুরছি কেন?

সাঈদ পাশের আয়নায় হৈমীর মুখের দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-আমি চলে যাচ্ছি। এবার ফিরতে এক মাসের উপরে লাগবে।

হৈমী কথাই বলতে ভুলে গেল যেন। এত দ্রুত চলে যাচ্ছে? এলো তো সবে পাঁচ দিন হল। হৈমী আনমনে প্রশ্ন করল,

-এক মাস কেন? প্রতিবার তো ১৫ দিনেই চলে আসেন!

সাঈদ হৈমীর কথা শুনে বাকা চোখে তাকাল। ঠোঁটে দুষ্ট হাসি রেখে বলল,

-হঠাৎ আমার প্রতি এত মায়া? আর ইউ গোয়িং টু মিস মি?

হৈমী সঙ্গেসঙ্গে মুখ ভেঙ্গাল। দ্রুত অপরপাশে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

-উহু, মোটেও না।

মিথ্যা বলেছে হৈমী। সে বড্ড মিস করে সাঈদ যখন শহরে চলে যায়। প্রতিবার পাঁচ দশদিনের কথা বলে ১৫ দিনেও আসে না গ্রামে। আর এবার স্বয়ং বলছে এক মাস। তার মানে যাবে বেশ কদিন, ফিরবে না। কষ্টে হৈমীর বুকটা জ্বা লা করতে লাগল। তবুও হৈমী স্বীকার করলো না। প্রকাশ করল না সাঈদের সামনে। নাহলে লাগামছাড়া সাঈদ এ যাত্রায় তাকে মুক্তি দেবে না। বেলাজ কথা দিয়েই খু ন করে ফেলবে হৈমীর ছোট্ট মনটা!

#চলবে

বধূবরণ পর্ব-০২

0

#বধূবরণ -২য় পর্ব
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

সাঈদ ছেড়ে দিল না, বরং হৈমীর গলায় ক্রমাগত নাক ঘষে উইস্কি স্বরে বলে,
-প্লিজ ডোন্ট গো, না! আই ওয়ানা ফিল ইউ এভ্রি সেকেন্ড অব মাই লাইফ,হৈমন্তী!

হৈমী স্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইল বরংচ! গলায় খোঁচা দাড়ির স্পর্শ শরীরের প্রতিটা লোমকূপ অব্দি দাঁড়িয়ে দিচ্ছে। হৈমী আলগোছে হাত তুলে বুকের উপর শুয়ে থাকা সাইদের চুলে হাত বুলিয়ে দিল। খানিক পর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
-যেতে হবে। এই অল্পবয়সে আব্বা রাজি হবেন না মোটেও! জেদ দেখাবেন না!

সাঈদ কথাটা শোনামাত্রই বেশ জোরেশোরে কামড় বসিয়ে দিল হৈমীর গলার দু ইঞ্চি নিচে থাকা কালো তিলে। ব্যথায় আহ্ করে উঠল হৈমী! সাঈদ মাথা তুলে ত্যারা করে বলল-
-তুই কচি খোকি নাকি? আজ বিয়ে হয়েছে কাল বাচ্চাও হয়ে যাবে। আসছে অল্পবয়স! তোর বাপেই তো তোর মাকে আরও অল্পবয়সে বিয়ে করেছে। আর আমি করলেই তোর বাপের গায়ে লেগে গেল? ধান্দাবাজ!

হৈমী রাগ দেখাল।শুরু হয়েছে আবার বাপ নিয়ে কথাবার্তা! অসভ্য! হৈমী রেগে সাঈদের চুল থেকে হাত সরিয়ে নিল। সাঈদ টের পেতেই জোর করে হাত আবার নিজের চুলে রেখে দিল। হৈমী অগ্যতা সাইদের চুল ব্রাশ করতে করতে বলল,
-বেশি বলবেন না। আব্বাদের সময় এসব চলত। এখন যুগ বদলেছে।
-তাই? তা তোর বয়স কত বলত? ১৭ তো হবে!
-কেন?
-আমি যতদূর জানি তোর মায়ের ১৬ বছর বয়সে তুই এক বছরের ছিলি। আসছে যুগের কথা বলতে আমাকে! যুগ বদলে নাই। তোর বাপ আমার বিরুদ্ধে চ ক্রা ন্ত করছে। নিজে এই বয়সে বাপ হয়েছে, আর আমাকে এখন বাপ হতে সুযোগ দিচ্ছে না। আনবিলিভেবল!

সাঈদ কথাটা বলে সোজা হয়ে উঠে বসে বিছানায়! বিছানায় হেলান দিয়ে কোলে বালিশ রেখে হাতের তালু চিবুকে ঠেকিয়ে ঠাঁই চেয়ে রইল হৈমীর দিকে। হৈমী উঠে বসল। কানের পেছনে চুল গুঁজে ইতিওতি চেয়ে বলল,
-খেতে চলুন, আমরা চলে যাব!

সাঈদ হামি তুলে রুমের একপাশটা ভালো করে দেখে নিল।কী দেখল সে-ই নিজে জানে। তারপর হঠাৎ করেই বলল,
-বাচ্চাদের থাকার জন্যে রুমটা কাল থেকেই সাজানো শুরু করে দিতে হবে। ছয় মাস লেগে যাবে পুরো রুম সাজাতে। আর চারমাস ওয়েট করলেই বেবি হাজির। আইডিয়া কেমন বুচি?

হৈমী অবাক হল খানিকটা। প্রশ্ন করল,
-বাচ্চা, এক বছর কী বলছেন? এক বছরের মধ্যে কার বাচ্চা আসবে ঘরে? আপনার আত্মীয়ের? আপনার বড় আপু বিদেশ থেকে ফিরছেন নাকি?

সাঈদ বাকা হাসল! বিছানা ছেড়ে উঠে কাভার্ড থেকে টাওয়াল আর ট্রাউজার নিয়ে হৈমীর পাশে দাঁড়িয়ে হুট করে হৈমীর গালে চুমু খেয়ে চলে গেল বাথরুমে। হৈমী গালে হাত দিয়ে থম করে বসে রইল, বাথরুম থেকে শুনতে পেল সাঈদ বলছে-
-আমার নিজের বাচ্চা ল্যান্ড করিয়ে তোর বাপের সকল আজগুবি শর্ত আমি ভেঙে ফেলব জেনে রাখ হৈমন্তী! সো বি রেডি ফর মাই বেবিস, বেবী!
————————-
হৈমীরা রাতে খাওয়াদাওয়া করে চলে গেল বাড়িতে। সাঈদ হৈমী বেরিয়ে যেতেই উপরের ঘরে যাচ্ছিল। পথে পেছন থেকে ওবায়দুল্লাহ বলে উঠেন,
-উকিলের কাগজগুলো নিয়ে রিডিং রুমে আসো সাঈদ! কাজ করতে হবে আমার সঙ্গে! অনুর মা, চা পাঠিয়ে দিয়ো আমাদের বাপ ছেলের জন্যে!
-আম্মু, আমার জন্যে কফি!

সাঈদ কথাটা বলে কাগজ আনতে চলে গেল। মনেমনে সাঈদ বাবার উপরে ফুলে আছে। বারবার তার তীক্ষ চোখ ঘুরেফিরে উবায়দুল্লার উপরে পরছে! ওবায়দুল্লাহ এসব অগ্রাহ্য করে মৃদু হেসে রিডিং রুমে চলে গেলেন।এতদিনে ছেলের বি ষ দাঁত ভাঙতে পেরে তিনি যারপরনাই খুশি, আনন্দিত! তার বেপরোয়া ছেলেকে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। এ পৃথিবীতে চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না, এটা তার ছোট ছেলে প্রায় ভুলতেই বসেছিল। এবার তার সুবুদ্ধি হলে হয়!

রিডিং রুমে বাপ ছেলে অনেকরাত ভর কাজ করল। নতুন বাড়ি কিনে ভাড়া দিতে চাইছেন ওবায়দুল্লাহ! কাগজ পত্রের হিসাব সেটার জন্যে মেলানো। আজকাল বাড়ি ভালো লাগলে কাগজ ঠিক থাকে না। একটা ঝুট ঝামেলা লেগেই থাকে কাগজে। সাঈদ উকালতি নিয়ে পড়াশোনা করছে। তাই বাড়ির সব উকিল সম্পর্কিত কাগজ পত্র সেই দেখাশোনা করে। কাজের ফাঁকে সাঈদ কফির কাপে চুমুক দিয়ে মাথা নিচু করে কাগজে চোখ বুলিয়ে বলল,
-আমাকে ফাঁসিয়ে কী মজা পেলে? বিয়েটা হয়েই গেছিল!

ওবায়দুল্লাহ এ প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি হেসে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। তারপর বলেন,
-দরকার ছিল! মেয়েটা এখনো অল্পবয়সী! তোমার কাছে আসার বয়স তার হয়নি!
-আমার বয়স হয়েছে এটাই যথেষ্ট ছিল! ঝামেলা কেন করলে? নাতি নাতনী দেখার শখ নেই তোমার?

ওবায়দুল্লাহ ছেলের লাগামহীন কথা শুনে বিষম খেলেন বোধহয়! পরপর কাগজ এর আরেকটা ফাইল ঠাস করে সাইদের সামনে রেখে রেগে বললেন,
-অসভ্য ছেলে, কাজ কর বসে। কাজের সময় উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা খাবে না!

সাঈদ এ কথা শুনে কলমটা দুই আঙুলের মাঝখান থেকে ছেড়ে ঠাস করে টেবিলের উপর রেখে দিল। চেয়ারের দু হাতলে আরাম করে হাত রেখে বসে সরাসরি চোখ রাখল ওবায়দুল্লাহর দিকে। তারপর বলল,
-আম নট ইন মুড এনিমোর! অ্যাই হ্যাভ এ ডিসিশন! এখন, এই মুহূর্ত থেকে বাড়ির কোনও কাগজ পত্র দেখাশোনা করব না আমি! আমার মাথা গরম, বউ ঘরে না আসা অব্দি মাথা ঠান্ডা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি মাথা গরম অবস্থায় কাগজ দেখা মানে কোটি টাকার লোকসান! উল্টো সিদ্ধান্তে তোমার ক্ষতি! ঘরে বউ আসুক, মাথা ঠান্ডা হলে তারপর আমি আবার কাগজ পত্র দেখাশোনা করব। বাট ফ্রম নাও, ইটস ক্লোজড! বাই! গুড নাইট বা-ব্বা!

বাবা উচ্চারণ একটু টেনেটুনে বলে সাঈদ সাঈদ জ্যাকেট চেয়ারের হাতল থেকে নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে চলে গেল নিজের রুমে! উবায়দুল্লাহ হা হয়ে দেখতে লাগলেন জেদি ছেলের চলে যাওয়া! সাঈদ একবার বলেছে কাজ করবে না, তাঁকে হাজার বলেও কাজ করানো যাবে না! জেদ যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান! কার থেকে পেয়েছে এত জেদ? হাসলেন উবায়দুল্লাহ! যৌবল কালে তার নিজের মধ্যেও তেমন উত্তপ্ত জেদ ছিল! বটে! জেদের বশে পরিবারের অমতে জড়িয়েছেন রাজনীতিতে! আজ গ্রামের মুখপাত্র তিনি! সবই এই জেদের ফসল!
জিনঘটিত ব্যাপারস্যাপারে ছেলেকে দোষারোপ করে খুব লাভ নেই ভেবেই দমে এলেন উবায়দুল্লাহ!
————————————-
হৈমী বিছানায় বসে স্কুলের হোমওয়ার্ক পড়ছে। পাশে নয় বছরের বোন কেয়া শুয়ে মোবাইলে কার্টুন দেখছে। বেশ রাত হয়েছে! হৈমী বই পাশে রেখে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ল! কেয়া এখনও মোবাইল দেখছে,হৈমী হাত থেকে টান দিয়ে মোবাইল নিজের হাতে নিয়ে নিল! কেয়া রেগেমেগে তাকালে হৈমী বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,
-কী? এভাবে তাকাস কেন? আম্মাকে ডাকব? এত রাতেও মোবাইল দেখিস? ঘুমা!

কেয়া ধমক খেয়ে ঠোঁট উল্টাল! তারপর বলল,
-ঘুম আসে না আপু! আরেকটু দেখি না কার্টুন! দাও।

হৈমী হাসল! পরম মমতায় বোনের ছোট্ট দেহ নিজের সঙ্গে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-আপু মাথায় হাত বুলাচ্ছি! ঘুম চলে আসবে, হুঁ?

কেয়া হৈমীর বুকের সঙ্গে মিশে গেল একদম। হৈমী আলতো হাতে কেয়ার মাথায় হাত বুলাচ্ছে! কেয়া নাকে হৈমীর গায়ের গন্ধ শুঁকে বলল,
-আপু, তোমার গতরে কেমন আম্মা আম্মা গন্ধ করে! আম্মার স্নো পাউডার তুমি মাখো? আমাকেও একটু মাখিয়ে দিবে?

হৈমী হাসল! বলল,
-কালকে সকালে দেব! এখন ঘুমা! এ্যাই, চোখ বন্ধ!

কেয়া খানিক কথা বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে পরল! হৈমীর ছোট্ট মাথায় তখনো ঘুরছে রাতে সাঈদের কথা! বাচ্চা? ওদের তো বিয়ে মানা হয়নি! বাচ্চা এখন কোথা থেকে আসবে? ধুর! সাঈদ ও না! একদম যা তা! তবুও—-উম, তবুও তো সে হৈমীর বড্ড শখের পুরুষ!

#চলবে

বধূবরণ পর্ব-০১

0

#বধূবরণ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#সূচনা_পর্ব

কেমন হয়েছে জানাবেন!ভ

‘চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে বাল্যবিবাহ করেছে’-
মুহূর্তেই কথাটা ছড়িয়ে গেল পুরো সীমান্তপার গ্রামে। দলে দলে লোকেরা জমা হচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে। এতে অবশ্য মহিলাদের সংখ্যার আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে সাঈদ বসার ঘরে বসে আপেল চিবুচ্ছে আরাম করে। বাইরে তার বউকে নিয়ে এত কোলাহল মাতামাতি যে তার খুব একটা ভালো লাগছে না সেটা তার ফুলে উঠা নাক দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। সাঈদ এর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে হৈমী। দাঁড়িয়ে আছে বললেও ভুল হবে, বলা উচিত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। হৈমী অসহায় চোখে সাঈদের দিকে চেয়ে রইল। চিন্তায় আপাতত অস্থির সে। আব্বা হয়তো বাড়ি থেকে লাঠি নিয়ে ছুটে আসছেন তাঁকে মেরে ফেলার জন্যে। বাড়িতে গেলে আম্মার হাতে উদোম কেলানি খেতে হবে ভাবতেই গা রীতিমত জমে যাচ্ছে হৈমীর। হৈমী অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে, একটাপর্যায়ে সাঈদ পা নামিয়ে সোফায় সোজা হয়ে বসে ধমকে বলল,
-এই তুই দাঁড়ায় আসস কেন তুই? সোফা নাই আমার ঘরে? বস!

হৈমী তীক্ষ চোখে সাঈদের দিকে তাকাল। পরপর রোবটের মত সোফায় বসে পরল। পাশ থেকে সাঈদের আম্মা ধমকে উঠেন,
-এই তুই ওরে বকস কেন? সাহস বেড়ে গেছে? এমনিতেই বিয়ে করে আনসোস ওরে এই বয়সে। বাইরে তোর বাপ মাইনসের লগে যুদ্ধ করে। চেয়ারমেনের পোলা এত ভালো কাজ করছে, মানুষ তো চিল্লাইবই। একদম চুপ করে বসে থাক বজ্জাতের জাত!

সাঈদ এসব কথা শুনলে তো! সে আরামে আরেকটা আপেল ফলঝুরি থেকে নিয়ে চিবুতে থাকল।

রাতে হৈমীর আব্বা এলেন চেয়ারম্যান বাড়ি। চিন্তায় মুখ কালশিটে পরে গেছে তার। হৈমী তার আব্বাকে দেখে গুটিসুটি মেরে সাইদের মায়ের পেছনে লুকিয়ে পরে। হৈমীর আব্বা এবিং চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ মুখোমুখি বসে। দুজনের চোখেই হতাশা ভাব। ছেলে মেয়েদের এমন কাজে দুজনেই যারপরনাই লজ্জিত। কিছুক্ষণ পর সাঈদ উপরের সিঁড়ি বেয়ে ঘুমঘুম চোখে নিচে নেমে আসে। নিজে বড় এক সোফায় বসে টান দিয়ে হৈমীকেও নিজের পাশে বসিয়ে দেয। হৈমী হতবম্ব। লজ্জায় দিশেহারা। মিনমিন করে মাথা নত করে বলে,
-আব্বার সামনে এসব কী ধরনের আচরণ? লজ্জা নাই?বেহায়া পুরুষমানুষ!

সাঈদ অবাক হবার ভান করে বলল,
-লজ্জা? কীসের জন্যে পাব? তোকে কী আমি সবার সামনে চুমু খেয়েছি? নাকি খোলা দরজায় পরিবার পরিকল্পনা করছি? আমি তো যথেষ্ট ভদ্র পোলা হয়েই বসে আছি তোর বাপের সামনে! তাও তোর হচ্ছে না? অসভ্যতা কাকে বলে তাহলে দেখিয়ে ফেলি?

হৈমী অসহায় চোখে চেয়ে দেখল সাঈদকে। তারপর বিড়বিড় করে গালিগালাজ করতে করতে সরে বসতে চাইল খানিক। অথচ সঙ্গেসঙ্গে সাঈদ কোমরে চিমটি কেটে নিজের সঙ্গে পুনরায় চেপে ধরে রাখল। হৈমী কোমরের চিনচিনে ব্যথায় স্তব্ধ হয়েই রয়ে গেল।

দূর থেকে হৈমীর আব্বা মেয়েছেলের কাজ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কথা তুললেন,
-দেখুন চেয়ারম্যান সাহেব, ছেলেমেয়ে যা করার করে ফেলেছে। বিয়ে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। আল্লাহর হুকুম। তবে আজকে আমি মেয়ে ঘরে নিয়ে যাব। সংসার করার মত আমার মেয়ে ততটা বড় হয়ে যায়নি এখনো।

ওবায়দুল্লাহ আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। সাঈদের মুখের অঙ্গভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে এখানে একটা বো -ম ব্লা- স্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাঈদ কিছু বলার জন্যে মুখ খুলবে তার আগেই ওবায়দুল্লাহ একদমে বলে উঠেন,
-আমি রাজি। মেয়ে আপনি ঘরে নিতে পারেন। আমরা নাহয় দু তিন বছর পর ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দেব। চিন্তা নেই।

সাঈদ কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। পরপর নাক ফুলিয়ে বলে উঠে,
-আনবিলিভেবল। আমার বউ আমি দিচ্ছি না। মগের মুল্লুক নাকি?

হৈমী এবার লজ্জায় সাইদের হাঁটুতে বেশ জোরেসরে অগোচোর চিমটি কাটল। সাঈদ ব্যথায় আহ্ বলে আওয়াজ করলে সবার চোখ এসে পরে সরাসরি সাঈদের দিকে। হৈমী অপ্রস্তুত হয়ে পরে। সাঈদ হাটু ঘষে হৈমীর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে বলে,
-কিছু না, পোকা কামড় দিয়েছে। আম ফাইন। ইউ গাইজ কন্টিনিউ!

সবাই আবার কথা বলায় মন দিল। শেষপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, হৈমীকে ঘরে দেওয়া হবে। বছর খানেক পর, হৈমীর বিশ বছর হবার পর বিয়ে আবার ধুমধাম করে দেওয়া হবে তাদের। ব্যাস। সাঈদ তাৎক্ষণিক সোফা ছেড়ে উঠে ধূপধুপ পা ফেলে উপরে চলে গেল। হৈমী অসহায় মেয়ে হয়ে এসব দেখল তাকিয়ে। সেই যে গেল,এখন অব্দি তার মুখদর্শন করা যায়নি তথাপি।

হৈমীরা আজ রাতে খেয়ে তারপর বাড়ি যাবেন। রাতে খাবার টেবিলে সাঈদকে অনেকবার ডাকা হল। উপরের বদ্ধ রুমের ভেতর থেকে সাঈদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিল থেকে হৈমীকে তুলে পাঠানো হোল সাঈদের ঘরে।

দরজাটা ভেতর থেকে লক। হৈমীর হাতে সাঈদের মায়ের ধরিয়ে দেওয়া সাইদের রুমের চাবি। এ ঘরে সাঈদ যখনই থাকে, দরজা লক থাকে। আর ঘরের চাবি থাকে একমাত্র সাঈদের মায়ের হাতে। আঁচলের কোণে বেধে রাখেন তিনি চাবির ঝোঁটা!

বদ্ধ ঘরের ভেতর সাঈদের সাড়াশব্দ না পাওয়া গেলেও হৈমী জানে, সাহেব রেগেমেগে আ গু নের ফু ল কি বনে আছেন! তাঁকে ঘাটতে গেলেই হৈমীর ম র ন। তুলে এক আ ছা ড় দেবে সে হৈমীকে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোনো।
তবুও হৈমী ঘরে ঢুকল। সাঈদকে হাতে বেধে নিয়ে যাওয়ার আদেশপ্রাপ্ত সে। আদেশ অবশ্য শিরোধার্য! হৈমী ঘরে ঢুকেই হা। জিনিসপত্রের একই বিগিদিস্তা অবস্থা। ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হায়রে! মায়া লাগে না মানুষটার এটুকু? এভাবে কেউ এত দামি জিনিস ভাঙে? পর্দাটাও হ্যাঙ্গার থেকে খুলে নিচে পরে আছে। কাচের ফুলদানি ভেঙে টেলিফোনের পাশে অসহায় অবস্থায় পরে। আহা! কী মনোরম দৃশ্য! মন চাচ্ছে, হৈমীকে নয়, সাইদকে ধরে আ ছা ড় দেওয়া উচিত এসব কাজের জন্যে। কিন্তু কার সাধ্য? চেয়ারম্যান বাড়িতে সাঈদ রেগে যাওয়া মানে, হুলস্থুল কান্ড। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ার সুবাধে সাঈদ সবার বড্ড আদুরে। আদরের পরিমাণ এতই বেশি যে, কেউ সাঈদের দিকে আঙুল তুললে ওবায়দুল্লাহ নিজে তাকে শা সি য়ে আসেন। বড় ছেলে আবার বড্ড ভদ্র। ছোটটাই হয়েছে যত অসভ্যের জাত!

হৈমী প্রথমে মেঝে যা পারে কিছুটা পরিষ্কার করে রাখল। পর্দা হেঙ্গারে ঝুলিয়ে টাঙিয়ে দিল। টেলিফোন ঠিকঠাক করে টি টেবিলের উপরে রাখল। শুধু কাচের জিনিসে হাত দিল না। হাত কেটে গেলে সাঈদ মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে নির্ঘাত! এবার বিছানায় ঘুমন্ত সাঈদের পানে তাকাল। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মহাশয়। উদোম গা। ব্লাঙ্কেট কোমর অব্দি ঢেকে রেখেছ। পিঠে ভাসমান ফুলে ফেঁপে উঠা মাস্যাল! ইস! বান্দা হট আছে! হৈমী নিজের চিন্তায় নিজেই হকচকিয়ে উঠল। দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হল। অর্থাৎ হবার ভান করল। জলজ্যান্ত এমন আইটেম সামনে থাকলে কেউই ঠিক থাকবে না। হৈমী বুঝে পায় না, তার মধ্যে সাঈদ কী দেখল? এতটা, ঠিক এতটা পাগল কী দেখে হল? হৈমীর মধ্যে পাগল করার মত কিছুই নেই, সত্যি কিছু নেই। অথচ হৈমী জানে, পুরো গ্রামের মেয়েরা সাঈদ বলতে উন্মাদ! এক কথায়, জান হাজির! তার ঘোলা চোখ, আকর্ষণীয় দেহের মাস্যাল, সুদর্শন মুখ। সবকিছুই নজরকারা। তারপরও কেন হৈমী? হৈমীই কেন? কার কেউও তো হতে পারত! হৈমী নিজের অবাস্তব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমন্ত সাইদের পাশে এসে বসল। হালকা স্বরে ডাক দিল,
-উঠুন, এই যে? শুনছেন। আপনার মা খেতে ডাকছেন আপনাকে। উঠুন!

সাঈদ এর মধ্যে কোনো নড়চড় দেখা গেল না তেমন। ডাকতে ডাকতে হাল ছেড়ে দিয়ে হৈমী মুম ফুলিয়ে বসে রইল পাশে।
এক পর্যায়ে কী মনে করে সাঈদের ঘন চুলে হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বড্ড নরম স্বরে বলল,
-উঠবেন না? আমি চলে যাচ্ছি!

হৈমী উঠে চলে যেতে নিলে হঠাৎ সাঈদ টান দিয়ে হৈমীকে বিছানায় শুইয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। আচমকা আতঙ্কে হৈমী কই মাছের ন্যায় ছটফটিয়ে উঠল যেমন। গলায় ঠোঁটের ছোয়া পাওয়ার সাথেসাথে সেই ছটফটানি কমে গেল। চোখ খিঁচে সুড়সুড়ি হজম করার চেষ্টা করে বলল,
-ছাড়ুন, আমার দেরি হচ্ছে!

সাঈদ শুনে না, বরং হৈমীর গলায় ক্রমাগত নাক ঘষে উইস্কি স্বরে বলে,
-প্লিজ ডোন্ট গো, না! আই ওয়ানা ফিল ইউ এভ্রি সেকেন্ড অব মাই লাইফ,হৈমন্তী!

#চলবে