Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 266



প্রিয় ভুল পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭+৪৮

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার বোন ইরার বিয়ে। পিয়াসার কাছ থেকে কথাটা জেনেছে মীরা। মীরার মা মিসেস জাহানারা চাচ্ছেন স্বামীর মৃ’ত্যুর পর হাতে টাকাপয়সা থাকতে থাকতে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। যদিও ইরার বয়স এখন সতেরো, ও নিজে বিয়ের জন্য মানসিকভাবে তৈরী না। কিন্তু জাহানারা মেয়েকে একপ্রকার জোর করেই বিয়েতে রাজি করিয়েছেন । পাছে বাবা-ছাড়া মেয়েটা বড় জনের মতো কোন ভুল না করে বসে। এ বয়সেই তো মীরা ভুল মানুষের সাথে ঘর ছেড়েছিলো। ঘর ছাড়ার পর মীরা কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছে তা তো তাদের অজানা ছিলো না। মীরার সেইসব কষ্টের কথা শুনে গোপনে চোখের পানি ফেলেছেন তিনি। তবুও মেনে নেন-নি মেয়েকে। এখন যে মীরা প্রতিষ্ঠিত, ভালো অবস্থানে আছেন সে কথাও লোকমুখে শুনেছেন জাহানারা। মীরার মনের জোর ভালো তাইতো পরিশ্রমে ঘুরিয়েছে ভাগ্যের চাকা। কিন্তু তার ছোট্ট মেয়ে ইরা একেবারে আত্মভোলা। পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বোঝেন না৷ যতটা না আর্থিক অসঙ্গতি তারচে বেশী অন্য চিন্তা। দিনকাল ভালো না। একটা কিছু খারাপ হওয়ার আগেই মান-সম্মানের সাথে মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচেন তিনি। কিন্তু ইরা তাকে একটা কথাই বোঝাতে চেয়েছে, যে ও মীরা না, এবং এমন কিছু ও কক্ষণো করবে না। কিন্তু জাহানারা মেয়ের কথা কানে তোলেনি। তিনি ইমোশনালি জব্দ করেছেন মেয়েকে। মেয়ে রাজিও না আবার অমতও না। ইরা মনে মনে তাই ভীষণ রাগ বড় বোনের প্রতি। মীরার করা ভুলের শাস্তি পেতে হচ্ছে ওকে। ছোটবেলা থেকেই দু’বোনের মধ্যে কেমন একটা শীতল সম্পর্ক। পাখা ছাড়া থেকে শুরু করে বাতি নেভানো। দু’জনের পছন্দ বিপরীত। একজন উত্তরে তো আরেকজন দক্ষিণে৷ এ পর্যন্ত কোন একটা বিষয়ে মতের মিল ছিলো না ওদের। তার উপর মীরার এমনি করে চলে যাওয়া, এরপর বাবা-মায়ের সমাজের চোখে ছোট হওয়া এসব ব্যাপার খুব কাছ থেকে দেখে বোনের প্রতি বিরূপ ধারণাটা কমে নি বরং তা দিনেদিনে পরিণত হয়েছে ঘৃণায়। সেই ঘৃণার ইমারতে শেষ ইটটা যুক্ত হলো মীরার কৃতকর্মের ভয়ে মায়ের তড়িঘড়ি করে ওর বিয়ে ঠিক করর বিষয়টা। ইরা ভালো ছাত্রী, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এমনটাই ওর ইচ্ছে ছিলো৷ কিন্তু জীবণ হঠাৎ ওকে কোথায় এনে দাঁড় করালো৷ এরজন্য ও দায়ী করে মীরাকে। ও এমনটা করেছিলো তাই মা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। ভয় পাচ্ছেন ওকে ভরসা করতে। মীরার সার্টিফিকেট দিয়ে বিচার করছে ইরাকে। এজন্য ওর মন ভয়াবহ খারাপ। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত কেবল কাঁদে। এত কষ্টের পড়াশোনা, সব নষ্ট হয়ে যাবে। কত স্বপ্ন ছিল, কিছু করার। সব আজ ভেসে যাচ্ছে।

যদিও জাহানারা ওকে যথাসম্ভব বুঝিয়েছেন কেন ওর বিয়েটা এখন হওয়া জরুরি। ওদের পরিবারে বলতে গেলে এখন কোন গার্জিয়ান নেই, তার উপর বাপম’রা মেয়েদের বিয়ে দেয়া একটু কষ্টসাধ্যও বটে। হাতে এখন টাকাপয়সা রয়েছে। দুদিন বাদে তাও ফুরাবে। সংসারের দায়িত্ব নিবে সেরকম বড় তো হয়নি ওদের ছোট ভাই নাজিব। মেয়ের জামাই জাহানারাদের সংসার দেখবে এমন আশা করেন না তিনি। বাড়ি ভাড়া আর গ্রামের জমিজিরাত যা আছে তাতে ছেলে নিয়ে ঠিক চলে যাবে তার। কিন্তু যুবতি মেয়ে ঘরে রাখা আর তাকে চোখে চোখে রাখার মতো সাহস, শক্তি কোনটাই নেই তাঁর। মীরা তাকে আছাড় দিয়ে গিয়েছিল সেই কবে, স্বামীর মৃ’ত্যু’র পর ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেছেন তিনি। গত মাসে তিনতলা থেকে একটা মেয়ে পালিয়ে গেলো। দিনকাল খুবই খারাপ। আজ কালকার ছেলে মেয়েদের মতিগতি বোঝার উপায় নেই। তাই তিনি আর মানসিক চাপ নিতে পারছেন না। ভালো ছেলে পেয়েছেন। গত মাসে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছেলে ইরাকে দেখেছে। অকপটে জানিয়েছে মাকে। মা মিসেস রেবেকা খোঁজখবর নিয়ে নিজেই এসেছেন ইরাদের বাড়িতে। ইরাকেও পছন্দ হয়েছে তারা ও।

ইরা ওর বড় বোন মীরার মতো অনিন্দ্য সুন্দরী না হলেও ওর সৌন্দর্য ও ফেলনা নয়। দুই বোনের মধ্যে পার্থক্য গায়ের রঙে। ইরার গাত্রবর্ণ মীরার মতো দুধে আলতা নয়, ওর গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, ইরা গায়ের রঙ পেয়েছে ওর দাদীর মতো। এছাড়া ওরও মীরার মতো কাটা নাক, পাতলা ঠোঁট, দীঘল কালো চুল আর অতিরিক্ত যা আছে তা হচ্ছে ইরার গভীর দুটি চোখ। এত মায়া চোখ দুটোয়, চোখের বিচারে ইরাও কম যায় না মীরার চেয়ে । কিন্তু এত যত্ন করে, সময় নিয়ে সমাজ দেখে না। তারা সৌন্দর্যের বিচার করে গায়ের রঙ দিয়ে। সেই সুবাদে মীরা এগিয়ে।

কোন দাবী দাওয়া নাই, মা মিসেস রেবেকার চারটি ছেলে, মেয়ে নেই কোন। তিনি তার বড় ছেলের জন্য বউ না তার কন্যাহীন বাড়ির জন্য একটা মেয়ে চেয়েছেন জাহানারার কাছে। তাদের বিনয়ী কথাবার্তা, পরিবার, সব পছন্দ হয়েছে জাহানারার। ছেলেও কম বয়সী। মানুষ পড়ার পাশাপাশি ব্যাবসা করে আর এ ছেলে ব্যাবসার পাশাপাশি অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হবে। আত্নীয় স্বজন সবাই খুশি এমন সম্বন্ধ পেয়ে। এমন কর্মঠ, শেলফমেইড, সোনার টুকরো ছেলে জামাই হিসেবে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের। সবই ঠিক আছে কিন্তু ছেলেদের বাড়ি না থাকায় একটু আমতা আমতা করেছিলেন জাহানারা। কিন্তু ওর খালা পারভীন বলেছেন- ” ওরা তো ঢাকার স্থানীয়ই, বাড়িও ছিলো আগে, মেট্রোরেলের জন্য সরকার জায়গাটা নিয়ে নিলো, এখন ভাড়া এপার্টমেন্টে থাকে, জায়গা খুঁজছে বাড়ি করার জন্য। বিরাট ব্যাবসা একা দেখে। ছেলে কর্মঠ বড়ি করা তো সময়ের ব্যাপার মাত্র, তুমি অমত করো না। দিনকাল খারাপ, পাছে ও না মীরার মতো…” কথাটা শেষ না করলেও শেষটা যে কি তা তার অজানা না। তাই তিনি খোঁজখবর নিতে বলেন ওদেরকে।

একমাসের মধ্যেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। খুব সাধারণ ভাবেই বিয়ের আয়োজন করবে বলে ঠিক করেন জাহানারা। বাবা মা’রা যাবার পর এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করা অনুচিত। খোদার অশেষ রহমতে মীরা বর্তমানে ইরার বিয়ের খরচ বহন করতে সামর্থ্য। এই তো কিছুদিন আগের কথা ঐ যে ব্যাংকের টাকার মিশনে যে সাহায্য করেছে মজিদ, ওর বিয়ের বৌয়ের যাবতীয় কেনাকাটা করে দিয়েছে মীরা। বিয়ের শাড়ি থেকে লেহেঙ্গা, কানের দুল থেকে চুড়ি, মেকআপ থেকে আইল্যাশ, এমনকি বিয়ে আর বৌ-ভাত দুই অনুষ্ঠানের জন্য দুটো আলাদা হ্যান্ড ব্যাগ ও কিনে দিয়েছে মীরা।

ওমন বিয়েতে এমন কেনাকাটা ওদের ভাবনার অতীত, তবুও কিছু কিছু জায়গায়, পরিস্থিতিতে টাকার হিসেব করে না মীরা। জীবনে চলতি পথে কিছু মানুষ থাকা লাগে চারপাশে , যারা যে কোন পরিস্থিতিতে আপনার প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় হাজির হবে। ওর জীবণে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যার জন্য এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।

কিন্তু বোনটার এমন বিয়ে হচ্ছে ভেবে কষ্ট পাচ্ছে ও। গোপনে কিছু করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারবে কি কিংবা গ্রহণ করবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে মীরা। ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি কথা বলেন পিয়াসার সাথে। যদিও পিয়াসা কোন সমাধান দিতে পারে না।

দেখতে দেখতে ইরার বিয়ের দিন এগিয়ে এলো৷ ঘরেয়া আয়োজনে বিয়ে হবে ঠিক করলেও শেষ পর্যন্ত বাড়ির ছাদে ছোট্ট করে আয়োজন করা হয়েছে। আত্নীয়দের মধ্যে যাদের না বললেই না তাদেরকে দাওয়াত করলেন জাহানারা। পিয়াসারাও গেলো সে দাওয়াতে। মীরার মন ভয়াবহ খারাপ, একমাত্র ছোট বোনটার বিয়ে তবুও যেতে পারছে না, কিছু করতে পারছে না।

অবশেষে বিয়ে হয়ে গেলো ইরার, মেয়েকে তেমন কিছুই দেন নি তিনি, সত্যি বলতে দিতে পারেন নি। তারা কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন এ ব্যাপারে। তাই বলে তো মেয়েকে একেবারে খালি হাতে দিতে পারেন না তিনি। বড় মেয়ে মীরার জন্য কিছু গহনা তৈরি করেছিলেন মীরা ছোট থাকতে। মীরা তো নিজের কপাল নিজেই পুড়ালো৷ জাহানারার ছোট বোন পারভীন এই গহনা দিয়েই ইরাকে বিদায় করার পরামর্শই দিয়েছেন তাকে, কিন্তু এত ঘৃণা কষ্ট থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ইরাকে দিতে পারলেন না তিনি। শত হলেও তিনি তো মা। নতুন করে গহনা গড়লেন ইরার জন্য, মেয়ে জামাইয়ের জন্য গড়ালেন আংটি, আর চেইন। এসবেই বেরিয়ে গেলো অনেকগুলো টাকা। ছেলে পক্ষও তাদের তরফ থেকে গহনা দিলো আরো একসেট, স্বর্ণের পুরো ছড়াছড়ি অবস্থা। ইরাকে সবগুলো গহনাই পরানো হলো। রানীর মতো লাগছে ইরাবতীকে। বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে এসেছে ছেলে পক্ষ। তাদের সাজ পোশাক আর বহর দেখে এলাকা সুদ্ধ মানুষের মুখে মুখে সে বিয়ের গল্প। কত বড় বাড়ির লোক এরা তা যেন না বলেই বলে দিচ্ছে তাদের সাজ পোশাক বহরে। মীরাদের তিনতলা ছোট্ট বাড়ি। এমন বাড়ির মেয়ে এত ভালো জায়গাতে বিয়ে হচ্ছে। সকলে মন থেকে দোয়া করছে, এবার বুঝি এ বাড়ির বড় মেয়ের করা কৃতকর্ম ঢাকবে। সবাই ভুলেই যাবে এ বাড়ির বড় মেয়ের কেলেঙ্কারির কথা, সবার মুখে থাকবে কেবল ইরার ইরাবতী হয়ে উঠার গল্প। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দোয়া করে মীরা। ইরাবতী সুখি হোক। কোন দুঃখ ওকে না ছুঁক।

পরদিন থেকে সবকিছু আগের মতোই চলতে শুরু করে। মীরাদের দুঃখ করে সময় নষ্ট করার সময় কই? বাসা থেকে বেরিয়ে মীরা সোজা গেলো গাড়ির শো-রুমে। পাভেলও এলো কিছু পরে। গত সপ্তাহে পাভেল দেখে, ফাইনাল করে গেছে গাড়ি। আজ মীরা এসে পেমেন্ট কম্পলিট করে গাড়ি পাঠানোর ঠিকানা দিয়ে দিলো তাদেরকে । এরপর মীরা গেলো নিজের অফিসে। গাড়ি দুপুরের আগে পৌঁছে গেলো ঠিকানা মতো।

দুপুরের পর মীরার ফোনে একটা কল এলো। ফোনটা দেখে রিসিভ করলো না মীরা। সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো ও। একটু পরে অফিসের টেলিফোন বেজে উঠে। অভ্যস্ততায় সেটাকে রিসিভ করে মীরা। ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: এইডা যে তোমার কাম তা আমি জানি, কেন এমন করতে গেলা তুমি? – কথাটা বললেন ওদের পুরাতন কারখানার মার্কেট কমিটির সভাপতি
“মুখলেস চাচা”। যিনি ফোনে না পেয়ে টেলিফোনে কল করেছেন মীরাকে৷ তিনিনসেই মুখলেস চাচা, যিনি মীরাকে যে মেয়ের মতো ভালোবেসে রাজিবের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন বহু আগেই। কিন্তু মীরা তা মনে রাখে নি, মিথ্যে ভালোবাসায় তার পরামর্শ কাজে লাগায় নি। একটু পর আবার ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: কি গো মা, কথা কও না ক্যা?

উত্তরে কেবল মুচকি হাসে মীরা। এরপর বলে-
: এটা আমার পক্ষ থেকে ওদের জন্য গিফট চাচা।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দুপুরের পর মীরার ফোনে একটা কল এলো। ফোনটা দেখে রিসিভ করলো না মীরা। সাইলেন্ট করে পাশে রেখে দিলো ও। একটু পরে অফিসের টেলিফোন বেজে উঠে। অভ্যস্ততায় সেটাকে রিসিভ করে মীরা। ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: এইডা যে তোমার কাম তা আমি জানি, কেন এমন করতে গেলা তুমি? – কথাটা বললেন ওদের পুরাতন কারখানার মার্কেট কমিটির সভাপতি
“মুখলেস চাচা”। যিনি ফোনে না পেয়ে টেলিফোনে কল করেছেন মীরাকে৷ তিনিনসেই মুখলেস চাচা, যিনি মীরাকে যে মেয়ের মতো ভালোবেসে রাজিবের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন বহু আগেই। কিন্তু মীরা তা মনে রাখে নি, মিথ্যে ভালোবাসায় তার পরামর্শ কাজে লাগায় নি। একটু পর আবার ওপাশ থেকে ভেসে আসে-
: কি গো মা, কথা কও না ক্যা?

উত্তরে কেবল মুচকি হাসে মীরা। এরপর বলে-
: এটা আমার পক্ষ থেকে ওদের জন্য গিফট চাচা।

: মা-গো, আমারে আল্লাহ ট্যাকা,পয়ছা, ইজ্জত বহুত দিছেন, কিছুরই কমতি নাই। গাড়ি কি আমি কিনা দিবার পারতাম না?

: চাচা আমি কিন্তু কোনভাবে আপনাকে হেয় করতে গাড়িটা পাঠাই নি, আপনি তো সবই জানেন আমার ব্যাপারে। আমি আসলে একটা কিছু করতে পারার লোভ সামলাতে পারি নি। সম্ভব হলে আরো বেশী ই দিতাম। আমার বোন-বোন জামাইর জন্য এটা কোন গিফট ই না। ওরা আরো বেশী কিছু ডিজার্ভ করে। কিন্তু আমি আমার সাধ্য মতো…

: হইছে, হইছে তোমার লগে কথা পারমু আমি! যাক গা দিছো ভালোকথা ছব ভুইল্যা বোনেরে কই বিয়া দিলা আগুনে নাকি পানিতে আইয়্যা দেইখা যাইও।

: ছি চাচা, আমি জানি না আপনারা কেমন?
আপনি এত বড় ব্যাবসায়ী, চাচী কত্ত ভালো মানুষ। আপনার ছেলেরাও সোনার টুকরো ছেলে। আপনার এত থাকা সত্ত্বেও নিজেরা নিজেদের যোগ্যতায় যে যার পথে প্রতিষ্ঠিত। ঢাকাইয়্যা ছেলেরা তো বেশীরভাগই বাবার সম্পদ নেড়েচেড়ে আর বাড়ি ভাড়ার টাকায় চলে। সেদিক থেকে ভাবলে আপনার চারটি ছেলেই ব্যাতিক্রম, আর আপনারা স্বার্থক বাবা মা। আপনারা এত উঁচু মনের আর ধন-সম্পদের মালিক হয়েও আপনাদের বড় ছেলের জন্য আমার বোনকে পুত্রবধূ করে এনেছেন। খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নুয়ে যাচ্ছে।

: আরে ধূর, কি যে কও। একটা কথা ছুন মা, আমি তোমার কথা মতো তোমার বোনেরে দেখবার গেছি, এটা কথা ছত্যি, তয় মাইয়্যা, পরিবার, বাপ মা পছন না হইলে আমি কইলাম ছমন্দ করবার মানুছ না। আমারে তো তুমি চিনো-ই, আমি নিজে যা ভালা মনে করি তাই করি। কাওরে খুছি করবার লাইগ্যা আমি আমার পোলার জীবণ গুটিতে লাগামু, এইটা তোমার মনে হইলো? আমি ছব খোঁজ খবর নিয়া আগে বাড়ছি, তোমাগো পরিবারে বড় মাইয়্যার অকালে এক পোলার হাত ধইরা ভাইগা যাওয়া ছাড়া আর কোন কেলেম নাই, আর যে বড় মাইয়্যা ভাইগা গেছে হেরে আমার চেয়ে ভালো চিনে কেডায়? তার উপর তোমার বাবা সাঁচ্চা দিলের মানুছ, ব্যাবসা করছে৷ ট্যাকা কামাইছে হক উপায়ে। মানুছটা মইরা গেছে মাগার তারে এখনো মানুছে ভুলে নাই। ছোন মা খোদায় দিল দেইখ্যা বিচার করে। আমি মানুছ বিচার করি এলেম দেইখ্যা। আমাগো পরিবার ট্যাকা পয়ছা দিয়া আগায়া আছে আর তোমরা আগায়া ছিক্ষা দিয়া। আমাগো বংছে আমার বড় পোলায়ই পয়লা গ্রেজুয়ট না কি জানি কয় হেইটা, আর তোমাগো বংশে তোমরা তিন পুরুছ ছিক্ষিত। তুমিও তো কত কিছুর ভিতর দিয়া পড়ালেখাডারে চালায়া গেছো।

তোমার চাচী বহুত আগে পোলার বউ হিছাবে দুইটা শর্ত দিছিলো পোলারে, যদি নিজে পছন কইরা থাকে হেল্ল্যাইগা। এক হইলো- মাইয়্যার বয়ছ হইতে হইবো কম, যাতে নিজের মেয়ের মতো কইরা বড় করবার পারে।

আর দুই হইলো- মাইয়্যা পড়লােখায় হইতে হইবো ক্ল্যালাসের ফাস্ট। যাতে বিয়ার পরও পড়ালেখা কইরা ভালো কিছু হইবার পারে।

ছৌন্দর্য হইলো গিয়া তিন নম্বরে। সেদিক বিবেচনায় তোমার বইন পাশ। তাছাড়া আমার পোলারও পছন হইছে তোমার বইনেরে। আর কি চাই কও? আমরা পোলার বউ না ঘরে মাইয়্যা আনবার চাইছি । যে ঘর ভইরা গুরগুর কইরা হাঁটবো। লেখাপড়া কইরা বড় কিছু হইবো। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছে। আমরা তো মা কিছু হইবার পারি নাই, পোলারাও ব্যাবছার হাল ধরতে গিয়া পড়ালেখাটারে ২নম্বরে জায়গা দিছে। এহন আল্লার কাছে দোয়া করবা নাতি-নাতকুরগো জানি ছিক্ষায় বড় করা পারি।

(কথাগুলো শুনে আনন্দে চোখের পানি এসে পরে মীরার৷ সত্যি ওর বোন ভাগ্যবতী৷ মেয়েরা কেন যে শ্বশুর শ্বাশুড়ি পছন্দ করে না! বিয়ের পর কত অযুহাত দাঁড় করিয়ে আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু যৌথ পরিবারে থাকাটা যে কি আনন্দের, কি সুখের তা ওরা জানে না)

অপর পাশে চুপ থাকতে দেখে মোখলেস চাচা ভাবে লাইন কেটে গেছে, তাই তিনি বলেন-
: কিগো মা আছো? নাকি লাইন কাইটা গেছে?
নাক মুছে মীরা বলে-
: না চাচা, আছি। আমি জানি আপনাদের কাছে আমার বোন অনেক ভালো থাকবে৷ তাই তো চাচীর কাছে আপনাদের ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন জেনে নিজের বোনের কথা বলেছিলাম চাচীকে।
: হ মা, ইরার সবচেয়ে বড় পরিচয় হইলা তুমি। আমি বুদ্ধিমান কিছু মানুছের চারপাছে থাকবার চাই।
: কি যে বলেন চাচা,
: না, মা একটুও বাড়ায়া কই নাই। কই থেইকা কই আইছো তোমরা, একমাত্র বুদ্ধি ছম্বল কইরা। জীবণে জ্ঞানডাই হইলো আছল। তাইতো আমি এলেমেরে ছম্মান করি।
: চাচা এসব আপনার বিনয়। আরেকটা কথা চাচা গাড়িটা যে আমি পাঠিয়েছি তা ওদেরকে বলবেন না প্লিজ৷ বলবেন আপনি নতুন বৌ-মাকে উপহার দিলেন।
: ছরি মা, মিছা কথা আমি কইতে পারমু না মা।
: আমি দিয়েছি জানলে ইরা এটা ব্যবাহারই করবে না হয়তো, প্লিজ চাচা সময় হলে না হয় বলবেন সত্যিটা। প্লিজ…
: আইচ্ছা তবে আমারো শর্ত আছে, তুমি আমাগো বাড়িতে আইছা দেইখা যাইবা।
: আসবো ইনশাআল্লাহ, ওরা যখন নাইওরে যাবে আমি এসে দেখে যাবো৷
: আইচ্ছা মা, ভালো থাকো, রাখি
: আপনিও ভালো থাকবেন তালই, আসসালামু আলাইকুম। -বলেই একটা হাসি হাসে মীরা। জবাবে মোখলেস চাচাও সালামের উত্তর দেয় হেসে৷

ফোনটা রেখে রিভলভিং চেয়ারটায় শরীরের ভর ছেড়ে বসে মীরা। নিজেকে অনেক হালকা লাগে ওর। পিয়াসর কাছে যখন শুনেছিলো ও যে ইরাকে বিয়ে দিতে ভালো ছেলের খোঁজ করছেন ওর মা। তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল সবটা জেনে। আজ ওর করা ভুলের খেসারত দিতে হবে ওর বোনকে। এত অল্প বয়সে বিয়ে, তার উপর কেমন না কেমন পরিবারে গিয়ে পরে ও। এসব ভাবনায় ও বুদ।
একটা ভুল কিভাবে একটা পরিবার একটা প্রজন্ম বয়ে বেড়ায় তারই যেন সাক্ষী ও নিজে। ভুলের মাসুল পরিবার হিসেবে ইরা ভোগ করছে আর প্রজন্মের হিসেবে নূহা।

এরই সপ্তাহ খানিক পরে মোখলেস চাচার স্ত্রী রেবেকা নিজেই ফোন করেন মীরাকে। ওর তো বেশ জানাশোনা আছে। পরিচিতদের মধ্যে তার ছেলের জন্য ভালো মেয়ে খুঁজে দিতে৷ তিনি ঘটক দিয়ে ছেলের বিয়ে দিবেন না৷ ঘটকরা একটা সত্য বললে তিনটা বলে মিথ্যা৷ তাই জানাশোনার মধ্যে কাওকে খুঁজছেন। কেমন মেয়ে চাই প্রশ্ন করলে তিনি তা ছেলের বৌয়ের জন্য নিজের ইচ্ছার কথা জানান মীরাকে। অল্প বয়সের, পড়ালেখায় ভালো সুন্দরী মেয়ে খুঁজছেন তিনি। মীরা তখন নতুন আউটলেট নিয়ে ব্যাস্ত। ওর বোনের কথা তখন মনেই হয় নি। মীরা ওদের এপার্টমেন্টের নয় তলার এক মেয়েকে দেখিয়েছে রেবেকা চাচীকে৷ পরিবার পছন্দ হলেও মেয়ে তাদের পছন্দ হয় না। এত সুন্দর মেয়ে পছন্দ না হওয়ার কারন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- “মেয়ের বয়স নাকি একটু বেশী”

এরপর কেটে যায় অনেক দিন। মীরা এক প্রকারে ভুলেই যায় এসব কথা৷ হঠাৎ একদিন পিয়াসার ফোন কলে জানতে পারে ওদের পাশের বাড়ির জিকুর জন্য নাকি ইরার প্রস্তাব এসেছে। জিকু একসময় মীরার পিঁছু পিঁছু ঘুরতো, আর এখন ইরার জন্য সম্বন্ধ! কথাটা শুনে গা রিরি করে ওর। জিকু যেন নাম বদলানো আরেক রাজিব। অর্থসম্পদ ওদের অনেক আছে কিন্তু ও নিজে ফালতু একটা ছেলে৷ আজ এই মেয়ে তো কাল অন্য মেয়ে। সমবয়সীদের কাছে সমবয়সীদের আসল খবর থাকে। মীরা আর জিকু সমবয়সী। তাই ও জিকুর আসল চেহারাটা চেনে। ভয় হয় ওর, ওর মতামত জানাবে এমন কোন উপায় নেই, আর ওর মতামত তারা শুনবেনই বা কেন?

এক রাতে কি ভেবে হঠাৎ রেবেকা চাচীর কথা মনে হয় ওর। আবার ভাবে নয়-তলার রেহনুমা কত সুন্দরী, তাকেই পছন্দ হলো না তার, ইরার গায়ের রঙতো একটু ময়লা। তার উপর ওর বাবাও নেই। তারা কি বাবা হীন এক পরিবারে ছেলে বিয়ে দিবেন?
পরপর দুটো দিন এ ভাবনাই কেবল ভাবতে থাকে ও।
তাকে কি বলবে ইরার কথা?

অবশেষে “বললেই দেখি কি হয়” ভেবে ইরার কথা বলেন তাদের। তারা মীরার বোন বলে আগ্রহ দেখায়৷ যদিও মীরা আগেই বলেছিলো আমার বোনের গায়ের রঙ…। কথাটা শেষ করতে দেন না রেবেকা চাচী। বলেন ঠিকানা দাও দেখে আসি। দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাবে না।

এরপরের গল্প সবার জানা। আল্লাহ সহায় ছিলেন তাই তো মীরার কথা গোপন রেখে বিয়েটা হয়েই গেলো ইরাবতীর। আল্লাহ ওর মাকে চিন্তামুক্ত করেছেন। ভালো ছেলের কাছে সসম্মানে মেয়েকে তুলে দেওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। খোদার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোন শব্দই যেন উপযুক্ত না। এমন ঘর, এমন বর, শ্বশুর শ্বাশুড়ির ভালোবাসা। এত ভালোবাসা সত্যি কপাল লাগে।

এদিকে বিয়ে বাড়িতে পুরো হুলস্থুল কান্ড নতুন গাড়ি নিয়ে। মোখলেস চাচা গাড়ির চাবি হাতে আগে যান তার স্ত্রীর কাছে। সব খুলে বলেন তাঁকে। তারপর তিনি নতুন বৌয়ের কাছে গিয়ে বললেন-
: মা তুমি আমাগো বউ না আমাগো মইয়্যা। এটা তোমার জন্য উপহার…
তিনি সচতুর ভাবে এড়িয়ে যান কে দিয়েছে সে কথাটা। তিনি কিন্তু বলেন নি “এটা তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার”। বলেছেন-
এটা তোমার জন্য উপহার…
কার তরফ থেকে তা উহ্য করে রেখেছেন।

ইরা যেন একটু বেশীই চমকিত হয়েছিলো। একে তো বিয়ের ঘোর কেটেই বের হতে পারে নি মেয়েটা তার উপর এত দামী গাড়ি। বেশ কিছুটা সময় লাগে ওর ব্যপারটা বুঝতে৷ তারপর তিনি যখন ওর হাতে গাড়ির চাবিটা গুঁজে দেন, ইরা তখন তার হাত ধরে কেঁদে ফেলে তার এমন ভালোবাসা দেখে।

ঘরসুদ্ধ মানুষ অবাক হয়ে দেখে বৌ-শ্বশুর বনাম বাবা-মেয়ের ভালোবাসা। ইরা যেন ওর বাবার হাত ধরেছে আর মোখলেস চাচা তার সদ্যজাত কন্যাকে।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দেশের স্বনামধন্য পোশাক ব্র্যান্ড নতুন উদ্দ্যোক্তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে উদ্দ্যোক্তা মেলার আয়োজন করেছেন বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানকার আয়োজকেরা দেশের বৃহৎ, মাঝারী, ক্ষুদ্র পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের এক ছাদের নিচে করতে এ আয়োজন করেছেন। এখানে তারা নিজেদের তৈরী পন্য নিয়ে অংশ গ্রহণ করবে। যাতে তারা তাদের আইডিয়া, মতামত একে অপরের সাথে শেয়ার করতে পারে, এখান থেকে নতুন আইডিয়া জেনারেট করতে পারে। টুম্পার এক বান্ধবী ঐ অনুষ্ঠানে ভলেন্টিয়ারের কাজ করছে। ওকে জিজ্ঞেস করেছে ও এ কাজটা করতে চায় কি না। টুম্পা যাবে কি না তা মীরাকে জিজ্ঞেস করতে মীরা বললো –
: অবশ্যই যাবি, এ ধরনের প্রোগ্রামে কত বড় বড় লোকের আগমন হয়, নতুন নতুন মানুষ নতুন নতুন আইডিয়া, নতুন অভিজ্ঞতা তুই অবশ্যই যাবি।
: কিন্তু আপা এক সপ্তাহ টানা যেতে হবে, তাই…
: আমার একটু কষ্ট হবে তুই না থাকলে, তবে তোর ঐখানে যাওয়াটাও জরুরী। নতুন নতুন আইডিয়া আমার সাথে শেয়ার করবি, তাই না তোকে দিচ্ছি যেতে।

টুম্পা হেসে দেয় মীরার বলার ভঙ্গি দেখে। যেন মীরা তার নিজের লাভেই টুম্পাকে যেতে দিচ্ছে, তা নাহলে দিতোই না।

পরের সপ্তাহে টুম্পা নিয়মিত যাওয়া শুরু করে ঐ ইভেন্টের প্রস্তুতির কাজে। দ্বিতীয় দিন বাসায় ফিরে মীরাকে টুম্পা বলে-
: আপা আপনি কেন অংশগ্রহণ করছেন না?
: আমি! আমি কিভাবে পারটিসিপেট করবো? আমার তো নিজস্ব কোন প্রেডাক্ট নাই, পরের মালামাল এনে বিক্রি করি।
: আপনি কি মেন্টালি মেনে নিয়েছেন যে “মীরা ফ্যাশন” আপনার কিছু না? ওটার মালিক এখন রাজিব ?
টুম্পার মুখে রাজিব কথাটা শুনে কেমন যেন ঘাবড়ে যায় মীরা। টুম্পা সবসময় রাজিবকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করে। আজ রাজিব বলাতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ওর। ব্যাপারটা টের পেয়ে টুম্পা বলে-
: কি অস্বস্তি হচ্ছে রাজিব বলায়?
মীরা সোজা হয়ে বসে ওর প্রশ্নের বিপরীতে। যা স্পষ্ট করে কথাটার ওর মনের ঘরে আঘাত করার ব্যাপারটা। স্মিত হেসে টুম্পা বলে-
: আপনার মানসিক স্থিতি দেখতেই কথাটা ইচ্ছে করে বলেছি আমি। বাদ দিন আপনাকে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া যাবে না।
এবার মীরা নড়েচড়ে বসে বলে-
: শোন চিন্তাভাবনা ছাড়া জীবণে আমি একটা কাজই করেছিলাম, যা আমার জীবণটাকে উলোট পালোট করে দিয়েছে। এখন যা কিছু আমি মানসিক ভাবেই বল বাস্তবিক ভাবেই বল ভাবি বা করি তা অনেক চিন্তা ভাবনা করেই করি। প্রতিটা কাজের আমার নিজস্ব কিছু প্ল্যান রয়েছে।
: কি প্ল্যান আছে শুনি? বললাম তার অবর্তমানে কারখানার মালামাল গুলো চুরি করার কথা, শুনলেন না, বললাম আগুন লাগিয়ে দেন কারখানায়, তাও শুনলেন না। আমার নিজেরই তিতা লাগে এসব এখন।
এত ধৈর্য আপনার আসে কোত্থেকে? এসব কিচ্ছা কাহিনি শেষ করে নতুন করে জীবণ শুরু করুন।
: আমার গল্পে নতুন করে শুরু করা বলতে কোন অধ্যায় নেই। রজিব আর মীরার গল্প একই সাথে শেষ হবে।
: তাহলে নূহা? ওর কি হবে? নাকি আপনি ভুলেই গেছেন যে আড়াই বছর বয়সী আপনার একটা মেয়ে আছে?
মীরা উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে টুম্পার দিকে৷ সত্যি যেন ও ভুলে গেছে নূহা নামে একটা মেয়ে আছে ওর। সেই উদ্ভ্রান্ত ভাব লুকাতে ব্যাস্ত ভাবে বললো-
: কেন তোরা দেখবি না ওকে?
: আপা এগুলো গা ভাসানো কথাবার্তা, এসব কথাবার্তা আপনার সাথে যায় না। প্লিজ আপনার মনে কি আছে আমাকে বলুন। আমি শুনতে চাই।
: তুই অনেক করেছিস আমার জন্য, এ বয়সে জীবণের অনেক রঙ ও দেখে ফেলেছিস। আমি এসব আমার মধ্যে রেখেছি যদি কোন ঝামেলা হয় তুই যাতে না ফেঁসে যাস।

কথাটা বলেই এমন ভাবে হাসলো মীরা যেন খুব মজার কিছু বলেছে ও। টুম্পা মীরার বিপরীতের চেয়ারটা টেনে বসে হাতদুটো ধরে ওর, মাথাটা ওর দিকে ঝুঁকিয়ে বলে-
: আপনি খু*ন-খারাবি কিছু ভাবছেন কি?
উত্তরে মুচকি হাসে মীরা, কিছুসময় মৌণ থেকে বলে-
: মাজেদা খালা এত হাইপার মেজাজের, এত বেশী কথা বলেন তিনি, তবুও তাকে কেন রেখে দিলাম আমি জানিস? রান্না তিনি মজার রাঁধেন এটা সত্যি তবে স্ট্রং পয়েন্ট হচ্ছে তার মাছ কাটা। তিনি যেদিন প্রথম এলেন মনে আছে তোর ভাইয়ের গ্রাম থেকে আনা পাঁচ কেজি ওজনের কাতলার মাথা তিনি কেটে ফেলেছেন অবলীলায়। অথচ তার হাতের থাবা আমার চেয়েও ছোট। কথাটা বলে মীরা ওর থাবাটা এগিয়ে দেয় টুম্পার দিকে৷ টুম্পা মীরার থাবা দেখে কেমন যেন ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে আরেকটু পিছিয়ে যায়। ওর মনে পরে ইদানীং মীরা বাজার থেকে বড় বড় মাছ আনায় মাজেদা খালাকে দিয়ে। নিজ হাতে কাটে সেগুলো। এমনকি মস্ত বড় ব*টিও তৈরী করে এনেছে করবানীর ঈদে কামাড়ের দোকান থেকে। দোকানি বলেছিলো-
: “এমুন বড় বডি বানায় না আজকাল মানুষ, এইডা দিয়া মানুষও কাইট্টা লাইতে পারবেন আফা”-বলে অট্টহাসি হেসেছিলেন দোকানি। কোরবানির ঈদ হওয়ায় ব্যাপারটা গায়ে মাখে নি টুম্পা। কিন্তু এখন যেন সবগুলো ডট মিলে যাচ্ছে একেরপর এক।

টুম্পা আবারো মীরার কাছে এসে বলে, এসব ভাবনা বাদ দেন আপা, মশা মারতে কামান দাগা কেন। ওকে ফাইন্যান্সিয়ালি পঙ্গু করে দেন ব্যাস, লাথি মেরে বের করে দিয়ে নিজে নতুন করে শুরু করুন। ব্যাংকে সেদিন আবীর ভাই তো ….

কথাটা শেষ করতে দেয় না মীরা দাঁড়িয়ে পরে রাগান্বিত গলায় বলে, আমার গল্পে আবীর নেই টুম্পা। এ কথা আর যেন তোর মুখে না শুনি। বলেই বেরিয়ে পরে বসার ঘর থেকে।

তারপর দুইদিন যায় যার যার মতো করে। রাজিব ব্যাস্ত টাকা ম্যানেজ করতে। ব্যাবসার ডাল সিজন চলছে এখন। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসাটা চালিয়ে রাখাটাই বড় চ্যালেন্জ।

ট্রেনিং এর চতুর্থ দিন টুম্পা মীরার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। মীরা দেখেও না দেখার ভান করে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ধুলো ঝাড়তে থাকে। টুম্পা মনে মনে ভাবে রাতের বেলা কেও ধুলো ঝাড়ে?

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সাহস সঞ্চয় করে বলে-
: একটা কথা বলতে এসেছিলাম,
: কি কথা? -রাগান্বিত কন্ঠে বলে মীরা
: পাাপাশি দুটো স্টল খালি আছে, আমার মনে হয় আপনার নিজের সেখানে অংশ নেয়া উচিত।
: কি নিয়ে যাবো সেখানে? আলু, পটল?
: ভাইয়াকে বলে…
তড়াক করে তাকায় মীরা ভাইয়া কথাটা শুনে। যেন রাজিব সম্বোধনটাই আশা করেছিলো ও।
: ভাইয়াকে বলে কি?
: আপনি মনে মনে সব যে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন তা তো তিনি জানেন না। আপনি আপনাদের প্রোডাক্ট নিয়ে যাবেন সেখানে, স্পেশালি গাউন গুলো নিয়ে।

নরম চাহনিতে তাকায় মীরা, টুম্পা কথাটা বলে চলো যায় ওর ঘরে। রাতে রাজিবকে মীরা টুম্পার আইডিয়াটা শেয়ার করে। রাজিবের পছন্দ হয় আইডিয়া। ব্যাবসার যা অবস্থা যাচ্ছে। এতে করে পরিচিতিটা যদি বাড়ে একটু। রাতের বেলা মোটামোটি ফাইনাল হয় কথাবার্তা। পরদিন সকালে স্টল না দেখেই টুম্পার কাছে বুকিং মানি দিয়ে দেয় মীরা। যদিও স্টলটা একটু পেছনের দিকে, তবুও দুপুরের দিকে ওরা বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখতে যায় ওরা৷ স্টলটা পেছনে হাওয়ায় আয়োজকেরা স্পেস একটু বেশী দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছে। তবে পেমেন্টটা বেশী বলে মীরার কাছে ফিসফিস করে বলে রাজিব, বাকী সব ঠিকঠাক। বাকী সব ঠিক থাকলে আসছে সপ্তাহে হতে যাচ্ছে মূল ইভেন্ট।

সেদিন রাতেই রাজিব এসে গাইগুই শুরু করে দিচ্ছে, ও ইনিয়েবিনিয়ে বলছে নিজের জন্য আলাদা স্টল বুকিং করতে। বলে-
: শোন তোমার এখন নিজের গ্রো করার সময়, তুমি কেন আলাদা স্টল নিয়ে নিচ্ছো না, আলাদা পরিচিতি পাবে তোমার বিজনেসটা।
মীরা হেসে বলে-
: কেন ‘মীরা ফ্যাশন’ কি তোমার একার নাকি, তুমি বরং কেও না এ বিজনেসের। এটার পরতে পরতে আমার জ্ঞান, শ্রম, ঘাম, মিশে আছে। আর সেটা এমন ভাবে মিশেছে যে চাইলেও তা মুছে ফেলতে পারবে না তুমি।

কথাটা শুনে কেমন একটা অট্টহাসি হেসে রাজিব বলে-
: আরেহ্ আমি কি তা বলেছি?
কৃত্রিমতা মিশানো সে হাসিটায় বিশ্রী দেখালো ওকে।

মীরা রাজিবের আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারে। রাজিবের প্রতি ঘৃণাটা যেন শক্তপোক্ত হলো ওর এমন আচরণে। মীরা এমনিতেই যে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে তা মেনে নিতে পারছে না রাজিব। তারউপর এই ব্র্যান্ড আর মীরা একজায়গায় পরিচিতি পাক সেটা ও চাচ্ছে না।

রাতটা ভেবে মীরা সিদ্ধান্ত নেয় নিজে একটা স্টল নেয়ার। কিন্তু অলরেডি সব স্টল বুকিং হয়ে গেছে। শুনে ভেঙে পরে ও এখন কি করবে মীরা তাই কেবল ভাবছে। বেহায়ার মতো যাবে মীরা ফ্যাশনের প্রতিনিধি হয়ে নাকি যাওয়াটা স্থগিত করবে।

এদিকে ইরা নতুন গাড়িতে করে নাইওরে গিয়েছে বাবার বাড়ি। ইরার বর ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওর কাজে গেছে। জাহানারা বললো-
: “আজ না গেলে হয় না বাবা?”
লজ্জিত ভঙ্গিতে ইরার বর মুরসালীন বলে-
: “ভীষণ জরুরী কাজ মা, না গেলেই নয়”
বরকে বিদায় করে ইরা গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসলো সবার সামনে। মিমিক্রি করে দেখালো বাড়ির কে কিভাবে হাঁটে, কথা বলে, আরো বললো ওর শ্বাশুড়ি শ্বশুড়ের ওকে আদর করার গল্প, সবশেষে গাড়ি উপহার পাবার গল্পটা। সকলেই মুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনছে ওর কথা। জাহানারা এসবে পাত্তা দিচ্ছে না এমন একটা ভাব বজায়ে রেখে সকলকে নাশতা দিচ্ছে। তিনি বরাবরই এসব আবেগকে বাক্সবন্দি করে রাখতে পছন্দ করেন, পছন্দ করেন আড়াল থেকে গোপনে ভালেবাসতে।
যেটা প্রকাশ পেয়েছে ইরার বিয়ের গয়না তৈরীর সময়। এত কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও গাঁটের পয়সা থেকে নতুন গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন ছোট মেয়েকে। মীরার জন্য যা রেখেছিলো তাতে হাত দেন নি। তবে দূর থেকে দাঁড়িয়ে মেয়ের এই গল্পটা, গল্প বলার ধরনটা উপভোগ করছেন তিনি। গোপনে চোখও মুছছেন ওড়নায়। কে বলবে এই মেয়েই বিয়ে করবে না বলে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিলো দুদিন আগে?

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

তুমুল ব্যাস্ততায় উদ্দ্যোক্তাদের ঐ মেলা শেষ হয় সেবার। বেচা বিক্রি তেমন না হলেও অনেক পরিচিতি পায় ওদের বিজনেসটা । মীরার আপন করা, সহজে মিশতে পারার গুণে নানান মানুষের সাথে পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব ও হয় অনেকের সাথে, অনেকের সাথে হয়েছে পরিচয়ের চেয়ে বেশী কিছু। ফোন নম্বর, ঠিকানা আদানপ্রদান, বাড়ির তৈরী খবার শেয়ারিং সহ আরো কত কি। শিখেছে পরিস্থিতি মোকাবিলা, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকা সহ আরো কত কি। বাড়তি পাওনা হিসেবে বহু দিন পর যেন আনন্দের অন্য রূপ দেখতে পেয়েছে ও এখানে এসে। সকলেই এত আন্তরিক, দিলখোলা যেন সকলে মিলে একটা পরিবার।

এক একটি উদ্দ্যোক্তা এক একটি গল্প। ভেঙে যাওয়া মীরা এখানে এসে সবচেয়ে বেশী যা শিখেছে তা হচ্ছে হার না মেনে এগিয়ে যাওয়া। দৌড়াতে না পারো হাঁটো, হাঁটতে না পরো হামাগুড়ি দাও, তবুও থেমে থেকো না। সবমিলিয়ে ভালোই কাটে তিন তিনটা দিন। মীরা রাজিবের ঐ স্বার্থপর মার্কা আচরণে ভেবেছিলো যাবে না প্রোগ্রামে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভেবে যেন মন স্থির করে যাওয়ার। যদিও টুম্পা অনেক ইনসিস্ট করেছে অনেক।

মীরা আর মীরা ফ্যাশন একসাথে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারটা অনেকেই জানতো না। সকলকে তো আর ধরে ধরে বলা যায় না যে আমিই মীরা, মীরা ফ্যাশনের ওনার। তবে শেষের দিন পুরস্কার আর সার্টিফিকেট বিতরণের সময় নাম ঘোষণা করায় সকলে দেখে মীরাকে। সঞ্চালিকা ঘোষণা করে- ‘মীরা’ দা ওনার অফ মীরা ফ্যাশন”। সকলের করতালিতে মুখরিত হয় পুরো হল ঘরটা। মীরার পাশে বসা রাজিবের দিকে তাকায় মীরা। যেন বিশাল কোন অর্জন বুঝিয়ে দিতে ডাক এসেছে তার, এমনি ভাব তার চোখমুখে। রাজিব খুব কষ্টে হেসে ওকে ইশারায় যাওয়ার জন্য বলে। মীরা যাওয়ার আগে রাজিবের হাতের উপরে হাত রেখে আলতো করে চাপ দেয় একটা৷ এটা উদযাপনের আনন্দ শেয়ারিং না ওনারশীপ কেড়ে নেয়ার উদযাপন তা বুঝতে পারে না রাজিব। মীরা রাজিবের পাশ থেকে উঠে রওনা দেয় স্টেজের দিকে। পার্পল রঙের ফ্লোর টাচ গাউন পরা মীরাকে রানীর মতো দেখাচ্ছিলো তখন। সকলেই তাকিয়ে দেখছে মীরা ফ্যাশনের ওনার অনিন্দ্য সুন্দরি মীরাকে৷

ও খুব সাধারণ কিছু আনতে যাচ্ছে, পুরস্কার হিসেবে একটা কাচের ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট নামের কাগজের একটা টুকরো। কিন্তু এগুলোর চেয়ে বেশী যা আনতে যাচ্ছে তা হলো ওর হারিয়ে ফেলা কর্তৃত্ব, মুছে ফেলা সম্মান। যে ব্যাবসা গড়ে তুলেছিলো ও রক্ত পানি করে, তারই মালিকানা যেন ফিরে এলো এই ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেটের মাধ্যমে, তাও হল ভর্তি মানুষের সামনে৷ অসাধারণ কিছু ফিরে পাবার সুখ কাজ করছে ওর ভিতরে। চোখে ভেসে উঠছে কষ্টের সেই এক একটি দিন। মনে মনে টুম্পাকে কৃতজ্ঞতা জানায় ও এ অনুভূতির স্বাদ নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

টুম্পা স্টেজে ছিলো ভলেন্টিয়ার হিসেবে, ওখান থেকে লক্ষ্য করে সকলে করতালি দিলেও রাজিব গা এলিয়ে বসে বৃদ্ধাঙ্গুল কামড়ে কি যেন ভাবছে। কি আর ভাববে ও, হাত কামড়াচ্ছে এই ভেবে যে কি ভুলটা করলো ও মীরাকে এখানে আসতে দিয়ে। এখন আর ভেবে কি হবে? যা ও কেড়ে নিয়েছো তা ওরি হাত ধরে প্রকৃতি মীরাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে হল ভর্তি মানুষের সামনে। ব্যাপারটা হজম করা সত্যি কষ্টের রাজিবের জন্য।

রাজিব কাজ আছে বলে চলে যায় অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই। মনে মনে ভাবে না এলেই ভালো হতো। আবার ভাবে না এলে কি ওর পরিচয় এনাউন্সমেন্ট কর বন্ধ করতে পারতো ও? ওর উচিতই হয় নি মীরাকে এখানে আনা। এদিকে ওরা বাড়ি ফিরে আসে অনুষ্ঠান শেষে। ফিরবার পথে দুজনে আলাপ হয় রাজিবের মনের বর্তমান স্থিতি নিয়ে। বাড়ি ফিরে তিনদিন পর দুপুরে বাড়িতে ভাত খায় মীরা। এ তিনদিন বাইরেই খেতে হয়েছে। আজ খালা রেঁধেছেন চিংড়ির দোপেয়াজা, কলমি শাক দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা, কুমড়ার বিঁচি ভর্তা, চ্যাপা শুঁটকির বাগার দেয়া ভর্তা আর বোম্বাই মরিচ দিয়ে পট শাকের ডাল, এসব খাবার পোলাও গোশতোরে বলে ঐদিকে থাকো। কোথাও গেলে নাকি ঐখানকার স্থানীয় খাবার ট্রাই করতে হয়, কিন্তু মীরা যেখানেই যাক সবার আগে খুঁজে ভাত আর ডাল। তরকারির ব্যাবস্থা না থাকলেও হবে। ও হচ্ছে ডালে ভাতে বাঙালি। একবার থাইল্যান্ডে গিয়ে ও বাঙালি হোটেল খুঁজে ডাল ভাত আর করলা ভাজি দিয়ে ভাত খেয়েছে। ইন্ডিয়া গেলেও ও মুসলিম হেটেল খুঁজে সবার আগে। চাইনিজ কি সুইডিশ কোন খাবারই মুখে রুচলেও পেট ভরেনা ওর। অনলি ডাল ভাত ইজ রিয়েল। খেতে বসে সেই গপ্পই হয় মীরা আর টুম্পার।

মীরার ব্যাবসা ভালোই চলছে। তবে ঐ প্রোগ্রাম থেকে ফিরে মীরার মনে একটা ব্যাপার খচখচ করে। পরের তৈরী জিনিস বিক্রি করার চেয়ে নিজের উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করা বেশী লাভজনক। ইন্ডিয়া থেকে প্রোডাক্ট এনে বিক্রি করায় লাভের অংকটা ছোট হয়ে আসে। যার থেকে মাল গুলো কিনে তাকে একটা লাভ দিতে হয়, ওগুলো দেশে আনতে সরকারকে দিতে হয় ট্যাক্স তার উপর পরিবহন খরচ তো আছেই। তাই মীরা ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করে। যদিও হিউজ সেল হওয়ায় ওর তা পুষিয়ে যায়। সেদিক থেকে নিজে কিছু করা চ্যালেন্জিং। কিন্তু পাভেল আর টুম্পা এ বিজনেস শুরু করার কথা আগেই বলেছিলো। ওরা পরামর্শ দিয়েছিলো নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর, আগের মতো করখানা দিতে৷ কিন্তু মীরা রাজি হয় নি কারন তখন ওর কাছে ব্যাবসা শুরু করার মতো ক্যাশ ওর কাছে ছিলো না, বিশ লাখ টাকা যেটা ছিলো তা দিয়ে শুরু করলেও বিপদ ছিলো, টাকা কোথায় পেলাম তা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরী হতো রাজিবের মনে। কিন্তু এখন ও চাইলেই শুরু করতে পারবে৷ বিশ লাখ টাকা যদিও ইরার বিয়েতে গাড়ি উপহার দিতে খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু ওর কাছে যা আছে তা দিয়ে ছোট পরিসরে হেসে খেলে শুরু করা যাবে।

সেটা নিয়েই আলেচনা হয় টুম্পার সাথে। টুম্পা কিছুই বলে না এবার, যেন খাবার খাওয়ায় মনযোগী সে, মীরা কি বলছে ও শুনতেই পাচ্ছে না। টুম্পার এমন অগ্রাহ্যেরও শক্ত কারণ আছে। আর সেই কারনটা হচ্ছে – ও বহু আগে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলো মীরাকে, মীরার ব্যাবসা শুরু করার পুঁজি না থাকার বাহানায় টুম্পা বুদ্ধি ও দিয়েছিলো রাজিবের কারখানায় ডাকাতি করতে৷ ব্যাবসা শুরু করার কথা মনে ধরলেও ডাকাতির ব্যাপারটা হাস্যকর লেগেছিল ওর। টুম্পার অল্প বয়স, শরীরের রক্ত গরম, সবকিছু সহজ ভাবে তাই। কিন্তু মীরা তো আর ভুল করতে পারে না, তাই প্রতিটি কদম ওকে ফেলতে হয় পরিস্থিতির যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ করে। নিজে বড় হওয়াই তো একমাত্র লক্ষ্য না ওর, রাজিবকে গুড়িয়ে দেয়া, ওকে নিঃস্ব করে রাস্তায় নামানোটাও ওর লক্ষ্য। কাজ যা পারে, অভিজ্ঞতা যা হয়েছে তা দিয়ে খেয়ে পরে সুন্দর ভাবে নূহাকে নিয়ে ঠিক জীবণ পার করতে পারবে।

এদিকে প্রোগ্রামের ব্যাপারে মনে মনে রাজিব বিরক্ত। তবে আশার কথা এই যে ওদের অনলাইন সেল বেড়েছে ইদানীং। পরিচিতদের মধ্যে অনেকের খুচরা অর্ডার আসতে শুরু করে। এই ডাল সিজনেও অনলাইনের বিক্রি দিয়ে একটু যেন দাঁড় হতে পারে কারখানাটা। অনলাইন সেলে বিক্রি কম হলেও লাভ বেশী। তাই রাজিব মন্দের ভালে হিসেবে মেনে নেয় ওখানে যাওয়াটা। মনকে স্বান্তনা দেয় “যতই ওড়ো তুমি মীরা, নাটাই কিন্তু আমার হাতেই আছে, এসবের মালিক তুমি, সবাই তা জানলেও কাগজপত্র কিন্তু অন্য কথা বলবে” নিজেকে ওয়ার্ন করে মনে মনে বলে “এরপর সতর্ক থাকতে হবে, ব্যাবসার ক্রেডিট ওকে আর নিতে দেয়া যাবে না”

এদিকে ইরাবতীদের হানিমুনে পাঠিয়েছে ওর শ্বশুর। সে কাহিনি হার মানাবে থ্রিলার গল্পকে। ইরাকে ওর শ্বশুর জিজ্ঞেস করেছিলেন হানিমুনে কোথায় যেতে চায় ও। ইরা বলেছে “সবাই মিলে যেখানে গেলে ভালো হয় সেখানে” মোখলেস সাহেব হেসে বলেছিলেন- “আরে সে তো কত্ত যামু আমরা, অহন তো তোমরা যাইবা মা” ও তাঁকে বলেছে- সবাই না গেলে ও কোথাও যাবে না” ওর কথার ধরনে মনে হয় যেন কোন ছোট্ট মেয়ের আবদার তার বাবার প্রতি। হুট করে বিয়ে হওয়ায় স্বামীর সাথে তেমন শখ্যতা গড়ে উঠেনি এখনো ওর যতটা শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে হয়েছে। দেবররা শুনে হাসে, বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কে বড় হওয়ায় ওরা ইরাকে সম্মান করে ওরা। মেঝো দেবর মুস্তাকীম বলে- ভাবী এটা পারিবারিক ট্যাুর কিংবা বনভোজন না, যে সবার যেতে হবে” টেবিলের সবাই হেসে দেয় ওর কথা শুনে। ইরার চোখে পানি এসে পরে সকলের এই অট্টহাসি দেখে। চোখের পানি লুকিয়ে ও অভিমানি সুরে বলে- ” সবাই না গেলে লাগবে না আমার হানিমুন ” বলেই খাবারের প্লেট হাতে ওর ঘরে চলে যায় ও।

মুরসালীন পরে বিপদে, বৌ টেবিল ভর্তি মানুষের সামনে রাগ করে চলে গেলো। এমন সময় ওর যাওয়া উচিত ঘরে বউকে স্বান্তনা দিতে কিন্তু তা ঠিক হবে কিনা তা ভেবে কিনারা করতে পারে না ও। এই মেয়ের হাবভাব কিছুই বুঝে না ও। শ্বশুর বাড়িতেও ইরা ওকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলো। ঐ বাড়িতে চলে আসার দিন রাতের খাবারের সময় চিংড়ি রান্না করেছিলো ইরার মা, না বললেও ইরা জোর করে মুরসালিনের পাতে দেয় সেটা, ওর এলার্জির সমস্যা হওয়ায় খেতে আপত্তি জানায় ও। নিজের পাত থেকে তুলে ইরাকে দেয়, রেগে ইরা বলে ” জানেন আপনি? আপনার জন্য বড় চিংড়ি আনতে মা এখানে না পাওয়ায় কারওয়ান বাজারে লোক পাঠিয়েছে? না খেলে মা কষ্ট পাবে না, বলুন?

উপায় না দেখে চিংড়ির কারিটা খায় মুরসালীন, রাতের বেলা চিংড়ি তার ম্যাজিক দেখানো শুরু করে। শরীরে জায়গায় জায়গায় ফুলে উঠে লাল হয়ে যায়। এটা দেখে ইরা ভয় পেয়ে যায়, মুরসালীন বলে- “এবার বুঝেছো চিংড়ি কেন খেতে চাই নি” এসব দেখ কেঁদে ফেলে ইরা, ভাইকে ডেকে ফার্মেসি হতে এলার্জির ঔষধ আনায়। মুরসালিন ওর ব্যাস্ততা দেখে বলে- “আরে এত হাইপ হচ্ছো কেন? ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে” ওর কান্না থামেই না, বাড়িসুদ্ধ লোক মুখটিপে হাসি শুরু করে দিয়েছে ওর এই কান্ড দেখে কি যে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার লজ্জায় ওর কান লাল হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে বিয়ে করার ঠেলা যাকে বলে। এজন্যই ও ইরাকে বিয়ে করতে চায় নি। জ্ঞান বুদ্ধি যা সব ঐ বিদ্যায়। এই যে এখন উঠে গেলো টেবিল থেকে, হিতাহিত জ্ঞান থাকলে করতো এ কাজ? এখন না পারছে থাকতে টেবিলে না যেতে পারছে ঘরে ওকে স্বান্তনা দিতে।

ইরার শ্বাশুড়ি মিসেস রেবেকা মুরসালিনকে এ যাত্রায় রক্ষা করেন, তিনি ধমক দেন ছেলেদেরকে, বলেন “ওর অজ্ঞতাটাই দেখলি তোরা, ওর সরলতাটা তোদের চোখে পরলো না? গাধা পোলাপান যত্তসব” বলে ইরার ঘরের দিকে যান।

মুরসালিন চা খেতে খেতে মুচকি হেসে ভাবে ঠিকই তো, এভাবে তো ভেবে দেখিনি। টেবিল থেকে উঠে মুরসালিনও যায়, ওর পিছু পিছু যায় বাকী সকলে। কন্যাহীন এ বাড়িতে ইরা যেন হ্যামিলনের বাঁশি ওয়ালা। যেখানেই যায় ও বাকী সব ওর পিঁছু পিঁছু। কাজের কাজ না পরলেও সকলের খেয়াল রাখে খুব যত্ন করে। শ্বাশুড়ির মাথায় তেল দিয়ে দেয়া, শ্বশুরের বারোমাস গরম পানি লাগে গোসলে। প্রতিদিন নিয়ম করে বালতি ভর্তি গরম পানি বাথরুমে রেখে ডাকতে যান তাকে। রাতের ঔষধ খাওয়ানো, ঘুমের জন্য বিছানা তৈরি, মশারী খাটানো এমন টুকিটাকি কাজ ও খুব যত্ন নিয়ে করে দেয় ও । যদিও এ বুদ্ধিটা ওর খালামনি শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ঐ বাড়িতে সবাইকে এমন ভাবে ভালোবাসবি, সকলের যত্ন করবি যাতে সকলে তোকে চোখে হারায়। কাজ করার লোক বেতন দিয়ে পাওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা খুব দামী জিনিস এর কেন মূল্য হয় না, তোকে তরা ভালোবেসে গ্রহণ করেছে, ভালোবেসেই তার দাম দিস তুই”

সত্যি কথাগুলো খুব কাজে লেগেছে ইরার। কাজের কাজ কিছুই পারে না এক ভালোবাসা ছাড়া। কাজ শিখতে তো পুরো জীবণই পরে আছে সামনে তাই ভালোবাসাটাকেই অস্ত্র বানায় ও।

এদিকে ঘরে গিয়ে আলাপ আলোচনা করে সকলে মিলে যাওয়া ঠিক হয়। মুখেলস সাহেব ছেলেকে বলেন “ওর পাসপোর্টটা বানাইতে দিয়া দিছ, পাসপোর্ট হইয়্যা গেলে ছবাই মিল্লা কাশ্মীর ঘুরবার যামু” আপাততঃ যাওয়া ঠিক হয় বাঙালীর জাতীয় ঘুরবার জায়গা কক্সবাজারে। তবে মোখলেস চাচা একটু চালাকি করলো ইরার সাথে। যাওয়সর দিন বের হওয়ার জন্য ব্যাগপত্র সব গুছানো হয়েছে। রাতের বাস রওনা হবে সকলেই তৈরী। এমন সময় একটা নাটক ফাঁদলেন তিনি। তার বোন অসুস্থ বলে রয়ে গেলেন তারা। ইরা, মুরসালিনকে বললেন- “তোমরা যাও আমরা নাহয় কাল-পরছু আহি” কি আর করবে বেচারী ইরা, অসুস্থ বোনের খবর শুনে তার তো এমন যাওয়াটা শোভন না,এটুকু ঠিক বোঝে ও, তাই সে যাত্রায় স্বামীর সাথেই রওনা দেয় ও৷

মুখলেস সাহেব এ চালটাই চেলেছেন, ইরার কথা তিনি শুনলেন আবার শুনলেন না। ছেলে আর ছেলে বৌয়ের মধ্যে জড়তা এখনো আছে। ওদের সহজ হওয়ার একটু সুযোগ দেয়া দরকার ভেবেই এ গল্পটা ফাঁদলেন তিনি। আর ইরাকে আজ আসি কাল আসি করে ওদের যাওয়ার চতুর্থ দিন সপরিবারে হাজির হলেন ওদের হোটেলে। সকলকে একসাথে দেখে ইরার চোখে পানি চলে আসে। শ্বাশুড়ি ইরাকে জড়িয়ে ধরেন, বলে “কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে?”

সকলে ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেতে হোটেলে গেলেন সকলে। নাশতা অর্ডার দিতে গেলো মুরসালিন।
খাওয়ার সময় মুখলেস সাহেব লক্ষ্য করলেন ইরা মুরসালিনকে তুমি করে বলছে। ওদের সম্পর্কের এমন উন্নতি দেখে মুচকি হেসে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিলেন তিনি।

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৪১+৪২+৪৩+৪৪

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পাভেল বনানীর একটা রিনাউন্ড কফি শপে বসে অপেক্ষা করছে মীরা আর টুম্পার জন্য। পয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় ওরা যোগ হলো পরপর । টুম্পাও কারখানা থেকে এসে যোগ দেয় মীরার একটু পরে । একসাথে বের হলে সন্দেহ হতে পারে তাই। মীরা এসে কোনমতে বসেই ওর দেরির কারন ব্যাখ্যা করলো। থানায় যা যা হয়েছে তার একটা বিবরণ দিলো সংক্ষিপ্ত আকারে। মীরা যে সেখানে পাভেল আর মকবুলের আটকের কথা ভেবে ওর কি পরিমাণ উদ্বেগে ছিল তা-ও বললো। মীরা বললো-
: ” আমি তো ভাবছি তোমরা এ্যারেস্ট, এখন গিয়ে দেখি বাইক আর বাইকের মালিক”
কথাটা বলে ওড়না দিয়ে ঘাম মুছলো ও। যেন ঐ সময়ের উদ্বেগের কিছুটা আঁচ ওর চোখেমুখে পরলো । কফির অর্ডার দিয়ে মীরা আবারো বললো-
: “তোমার ভাই তো মাশাল্লাহ তোমার চেয়েও সুন্দর। তাকে তো আমি কখনো দেখি নি এর আগে, তা কিভাবে ম্যানেজ করলে তাকে ?”
পাভেল হেসে বলে-
: ” আমাদের পরিবারের আমিই একটু কম সুন্দর, বাকী সবাই মাশাল্লাহ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আফগানি। তাই পরিবারের সবার চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং গড়পড়তা লোকেদের চেয়ে একটু ভিন্ন, শুধু এ পরিবারের বৌ গুলো.. ”
টুম্পা ওদের কথা কিছুই বুঝে না, মীরার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে –

: ” মানে কি? থানার ঐ লোকটা আমাদের নিজেদের লোক? আই মিন পাভেল ভাইয়ার বড় ভাই?”
ততক্ষনে মীরার পছন্দের কফি এসে গেছে। মীরা কফির মগে চুমুক দেওয়ার অপেক্ষা করলো না। ছোট্ট একটা সিপ দিয়ে বললো-
: ” হুম, বাইকের মালিক পাভেলের বড় ভাই সোহেল”
টুম্পাকে যেন কেও জোরে একটা ধাক্কা দিলো, এমনি ‘থ’ মেরে গেলো। ওকে স্বাভাবিক করতে পাভেল বললো-
: ” একটুতেই এত অবাক!”
মীরা টুম্পার পক্ষে বললো-
: ” আরেহ্ বাসায় এখন কথা বলাই মুশকিল, যখন বাইরে থাকি তখন টুম্পা থাকে কারখানায়, আর বাসায় যখন ফিরি তখন রাজিবের জন্য এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হয় না। এমনিতেই গতরাতে ধরা পরি পরি করেও বেঁচে গিয়েছি। তোমার সাথে কথা শেষ করে দেখি রাজিব পিছনে দাঁড়ানো”
: ” ও এজন্যই তুমি শেষের দিকে আবোলতাবোল বকছিলে, লিপির খেয়াল রেখো, ওর যত্ন নিও, আর হ্যা কোন হসপিটালে যাবে বলে ঠিক করেছো? ”
হাত কানে রেখে ফোনে কথা বলার ভঙ্গিতে কথাগুলো ব্যাঙ্গের সুরে বললো পাভেল। মীরা ওর এমন অভিনয় দেখে কফির মগ নামিয়ে হাসতে লাগলো। হাসির দমকে একটু কফি ছিটকে পরলো ওর ওড়নায়। কফির মগটা টেবিলে রেখে মীরা সেটা পরিষ্কার করতে করতে বললো-
: ” আমাদের বারান্দাটা বেশ বড়। টিএসসি থেকে গাছ, ল্যাম্প, বাবুই পাখির বাসা এগুলো সংগ্রহ করে অনেক যত্ন করে গুছিয়েছি। বারান্দার পাশের দেয়ালে হাত পাখার ডিজাইনের একটা আয়না আছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পরলো আয়নায়। দেখলাম রাজিব আমাকে এদিক-সেদিক খুঁজছে। পরে বারান্দায় তাকিয়ে আমাকে দেখে এগিয়ে এলো, তাই ওসব আবোলতাবোল বকছি। তারাহুরো করে ফোনটা কেটে দিলে ওর সন্দেহ হতো। তবে আমি যে বার ফোন দিয়ে কথা বলেছি সেটা নিয়ে ভীত ছিলাম। এ বুঝি জিজ্ঞেস করে এই ফোন কার, বা কবে নিলে। টাকার শোকে বেচারা এতটাই কাতর যে ব্যাপারটা হয়তো খেয়ালই করে নি”
টুম্পা সবাধন করে দিয়ে বলে-
: ” তবুও আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে”
পাভেল টুম্পার কথায় সায় দিয়ে বলে-
: ” হুম, তা ঠিক”
টুম্পা এবার পাভেলকে জিজ্ঞেস করে –
: ” বললেন না, সোহেল ভাইয়াকে কিভাবে ম্যানেজ করলেন?”
: ” ভাইয়া মীরাকে চিনে, চিনে বলতে ও যে আমাকে ব্যাবসা গুছিয়ে দিয়েছে তা আমাদের পরিবারের সবাই-ই জানে। আমি তো বোহেমিয়ান ছিলাম, পড়াশোনা, ক্লাব আর সংগঠন নিয়ে ছিলাম। আমার পরিবারের কেও-ই আমাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলো না। শেষ কষ্টটা দিলাম একা বিয়ে করে। আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে আমাদের পরিবারে এটাই প্রথম। সবার অমত ছিলো এ বিয়েতে। লিপির পরিবার কি আমার কেও-ই মানতে পারে নি এ বিয়েটা। সে থেকে আমি একপ্রকার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। গত বছর বাবার মেজর একটা অপারেশন হয়, আমি তার পুরো খরচটা দিয়েছিলাম। ভাইয়ার চাকরী ছিলো না তখন। বাবার ঐ অসুস্থতাই ছিলো পরিবারে আমার ফিরে যাওয়ার টিকিট। নতুন করে ভাইয়াকেও এখন আমার মতো ব্যাবসা গুছিয়ে দিলাম। মোটের উপর মীরার কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। ওর কোন উপকার করতে পারলে ভাইয়া কেন আমাদের পরিবারের কেও-ই না করবে না ” এবার মীরা বলে-
: ” হয়েছে থামো এবার, তোমরা আমার জন্য যা করেছো সে দিক থেকে এটা আর তেমন কি? টাকা না পয়সা না জাস্ট পথ চিনিয়ে দিয়েছি আমি”
: ” মাঝে মাঝে একটা ভালো পরামর্শ কোটি টাকার চেয়েও উপকারী হয়, তুমি মাছ না দিয়ে আমাকে মাছ ধরা শিখিয়েছো, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ” – বলে পাভেল।
: ” কৃতজ্ঞতা পর্ব শেষ হলে বলুন প্ল্যান কার ছিলো?” – বলে টুম্পা।
: ” প্ল্যান আর কি, টাকাগুলো ছিনিয়ে নিতে দরকার ছিলো বাইক, ভয় দেখানোর জন্য ছুড়ি, আর মানকি ক্যাপ। এগুলো সব জোগাড় হলেও বাইক নিয়ে ঝামেলায় ছিলাম। কারটা নিবো, আবার ধরা পরে যাবো কি না। শেষে কোন ব্যাবস্থা না করতে পেরে ভাইয়ার কাছে গেলাম। সবকিছু খুলে বললাম, ভাইয়া সব শুনে চলে গেলো থানায় জিডি করতে, আর আমি চলে এলাম তার খয়েরী রঙের হিরো স্প্লেন্ডার ১০০ সিসির বাইক খানা নিয়ে”
: ” মাই গড, আপনি তো সেই খেলা খেললেন” – বললো টুম্পা।
: ” এ ব্যাপারটায় একটা জিনিস রিয়েলাইজ হলো, তা হচ্ছে জীবণে প্ল্যান করে কখনো কিছু হয় না, প্ল্যান করলাম কি আর হলো কি” – বলে হাসে পাভেল।
: ” টাকাগুলো কি করেছো?”- বললো মীরা
: ” ব্যাংকে রাখি নি সন্দেহ হতে পারে কারো, সামনে ইদ তুমি চাইলে টাকাটা গোল্ডে ইনভেস্ট করতে পারো, বেশী দামে বিক্রি করতে পারবে। টাকা বাড়ানোর এরচেয়ে সর্ট কার্ট ওয়ে আপাততঃ আমি দেখছি না” – বলে পাভেল।
: ” টাকাটা পরে থাক, বাড়ার দরকার নেই, কি করতে কি হয়, এটা একটা বাড়তি টেনশন। তার উপর ইন্ডিয়া যাচ্ছি আমি, ভিসা হয়ে গেছে। টিকিট কাটলেই চলে যেতে পারবো যখন তখন” – বলে মীরা।
: ” এ্যাস ইউর উইশ, যখন বলবে তখনই হাজির হয়ে যাবো টাকা নিয়ে”
: ” বিজনেস না স্টর্ট করবেন বললেন” – মীরার উদ্দেশ্যে বললো টুম্পা।
: ” এ মুহূর্তে বিজনেস টা শুরু করার পিক আওয়ার। সামনে সিজন, বিফল হওয়ার কোন চান্স নেই, তবে আমি তাড়াহুরো করে আর কোন ভুল করতে চাই না। তাই সময় নিচ্ছি। তাছাড়া এ মুহূর্তে বিজনেস টা শুরু করলে রাজিব জানতে পারলে সমস্যা করবে। আমি ধাক্কাটা ওকে আকস্মিক ভাবে দিবো। যাতে ওর কোন কিছু বোঝার আগেই সব শেষ হয়ে যায়”
: “তাও আরোকটু ভেবে দেখেন, তার সব সাইড হয়ে গেলে, আপনার দাঁড়ানোর একটা জায়গা, একটা সোর্স অফ ইনকাম দরকার। আর এটা তো রাতারাতি তৈরী হয়ে যাবে না, আগে থেকে এটাকে তৈরী করা দরকার ” – নিজের মতামত যোগ করে টুম্পা।
: ” তোর কি মনে হয় এটা আমি ভাবি নি?” – টুম্পার উদ্দ্যেশে বলে মীরা।
: ” আমি জানি আপু, আপনি অনেক চালাক” বলে টুম্পা।
: ” কথাটা চালাক হবে না টুম্পা, বুদ্ধিমতি হবে, মীরা চালাক না, বুদ্ধিমতি” – পাভেল বললো টুম্পাকে।
মীরা স্মিত হেসে বলে-
: ” শোন তোমরা, আমি চালাক না বুদ্ধিমতি তা জানি না, তবে জীবণে অনেক ভুল করেছি তো তাই সবকিছু অনেক হিসাব করে করি, ভালোর খারাপটা আগে দেখি, ভালো কিছু ভাবার আগে ভেবে নেই বিপরীত হলে কি করবো। পোড় খাওয়া আমার এখন ভুল খুব কম হয়” একটু বিরতি নিয়ে মীরা বলে-
: ” কারখনার অবস্থা এখন শোচনীয়, ভিতরে ভিতরে ভাঙন শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেই, ওটাকে বাঁচাবো ভেবেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজের হাত গুটিয়ে নেওয়ার। যা হচ্ছে হোক, যদিও ব্যাপারটা ভীষণ পেইনফুল। কিন্তু অনেক ভেবে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যাবসাটায় কম হলেও রাজিবের কন্ট্রিবিউশান রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যায় না। তাই এই হাত গুটানো, আমি এখন যা-ই করি বা করবো তাতে আমার একার কনট্রিবিউশন থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে কেও না বলতে পারে- রাজিবের কন্ট্রিবিউশান এর কথা, ওর সব কিছু মুছে দিবো আমি আমার জীবন হতে ”
: ” ইউর লাইফ, ইউর চয়েজ, আই অলওয়েজ রেসপেক্ট ইউর ডিসিশন ” – বলে পাভেল।
এরপরও কথা হলো বেশ কিছু সময় পর্যন্ত পরবর্তী করণীয় ব্যাপারে। বিকেল থাকতেই বেরিয়ে গেলো ওরা। সিদ্ধান্ত হলো
কিছু টাকা নিয়ে মীরা ইন্ডিয়া যাবে। সেখান থেকে কিছু সিগনেচার প্রোডাক্ট আনবে। রিস্টার্ট করবে ওর পুরাতন, ঝিমিয়ে পরা পেইজটাকে। মীরা ফিরবার পথে টুম্পাকে বললো-
: ” তোর পাসপোর্টটা করিয়ে ফেল টুম্পা, পরের বার ইনশাআল্লাহ আমরা দুজন একসাথে ইন্ডিয়া যাবো”
: ” কবে যাচ্ছেন আপনি?”
: ” আগামীকাল ”
: ” ভাইয়ার এমন পরিস্থিতিতে আপনি যাবেন, ব্যাপারটা ওভার ডোজ মনে হবে না?”
টুম্পার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকায় মীরা, চোখ ফিরিয়ে টুম্পা বলে-
: ” ম্যানেজ করবেন কিভাবে?”
: ” বলবো পিয়াসা টিকিট কেটে ফেলেছে ”
: ” বাই এয়ার?”
: ” অনেক তো বাঁচালাম টাকা, কি হলো দিন শেষে? আমি এদিকে কষ্ট করে করে টাকা সেইভ করেছি আর ও? ও অন্য দিকে উড়িয়ে এসেছে, টাকার আর মায়া করবো না বাকী জীবনে। কি হবে এত পেরেশানি হয়ে? দেওয়ার মালিক তো ঐ একজন”

টুম্পা কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে দেখে মীরাকে। কষ্ট, শোক মানুষকে বদলে দেয়। হয় ভালো করে দেয়, নয় তো খারাপ। কিন্তু মীরার সবটা দেখে টুম্পা ভাবে কোনটা হয়েছে মীরাপুর? ভালোটা? নাকি খারাপ?”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ইদানীং রাজিব খুব পেরেশানিতে আছে। একদিকে কাজের চাপ, সামনে রোজার ইদের সিজন তাই, কয়েকদিন আগে হাত ফসকে বেরিয়ে গেলো কচকচে বিশ লাখ টাকা। এত সুন্দর, রোডসাইড
ফ্ল্যাটটা এত কমে পেয়েও টাকার জন্য বুকিং করা গেলো না, হাতছাড়া হয়ে গেলো। সেটার ধাক্কা সামলে না উঠতেই সাথীর যন্ত্রণা শুরু হলো। মান অভিমান, কান্নাকাটি, ঝগড়া, কথা কাটাকাটি আরো কত কি।

ওর বাবা-মা বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করেছেন। পাত্রের লন্ডনে বিশাল ব্যাবসা। দেখতেও নাকি রাজপুত্রের মতো। গত রাতে রাজিবকে, মীরাকে সাথীর মা ফোন করেছেন। ঢাকা শহরের আত্মীয় বলতে তাদের তো কেবল ওরাই আছে । তিনি সাথীকে ভালো ভাবে বুঝানোর জন্য ওদেরকে অনুরোধ করেছেন। তিনি মীরাকে বললেন-
: ” মোগো কতা তো বেকই জানো, নতুন কইরা আর কি কমু, তোর মামুর খবরও তো তোগো অজানা না। এই ছেমড়িরে রাজিই করান যাইতেয়াছে না। ওরে তোরা বুজাও বাবা। পড়ালেহার বাহানায় ও রাজিই হয় না। দুনিয়ায় কত মাইয়্যারা বিয়ার পর লেহাপড়া করতাছে। তুই ক বাবা এমন পোলা সবসময় পায়া যায়? ”

ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিলো। উত্তরে মীরা ওকে ডেকে এনে বুঝাবে বলে তাকে আস্বস্ত করেন। সাথীকে রাজি করানোর, বুঝানোর। রাজিবের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোনও করে সাথীকে। কিন্তু সাথী মীরার ফোন রিসিভ করে না।

এদিকে সাথী তো এ খবর শুনার পর থেকেই কান্নাকাাটি শুরু করে দিয়েছে। ওর বাবা-মায়ের এমন পাত্র হাতছাড়া করতে না চাওয়াটা কোন অযৌক্তিক কিছু না। ঘরে এতগুলো বোন ওরা। ওদেরকেও তো বিয়ে দিয়ে দিতে হবে? ওদের অসুস্থ বাবা এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাই তাদের ইচ্ছা এবার সাথী শক্ত-পোক্ত, প্রতিষ্ঠিত কাওকে বিয়ে করে ছোট বোন-গুলের দায়িত্ব নিক।

তিন বছর হতে চললো রাজিবকে বিয়ে করেছে। এখনো কিছুই করতে পারেনি রাজিব। না পেরেছে বিয়ের ব্যাপারে সবাইকে জানাতে, না পেরেছে ওকে কিছু করে দিতে। ওর সাথে থেকে কি লাভ সাথীর? ঐ বৌয়ের নামে তো ঠিকই বাড়ি করে দিয়েছো, আর ও একটা ফ্ল্যাট চাইলো, তাও নিজেদের থাকার জন্য তিনবছরেও তা দিতে পারলো না রজিব । এসব বলেছিলো সাথী কথা কাটাকাটির সময়। অথচ ও একটা বারও বুঝলো না রাজিব এবার ওর সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে। এ সময়ে সাথীর কি উচিত ছিলো না রাজিবের পাশে থাকার? রাজিব সবই বুঝে কিন্তু কিছুই যেন করার নেই ওর। রাজিব পড়লো অকুল পাথারে। ও জানে ফ্ল্যাটটা ওর নামে কিনে দিতে পারলে হয়তো বিয়ের এ ধাক্কাটা সামলানো সহজ হতো। কিন্তু তাও তো হলো না। মনে মনে এসবই ভাবছিলো রাজিব।

রাজিব চারদিকে অন্ধকার দেখে। টেনশনে মাথাও ঠিকঠাক কাজ করে না ওর। সাথী রাগ করে বরিশাল চলে গেছে সকালে। বৌ রাগ করে বাপের বাড়ি গেলে তাকে স্বামীরা রাগ ভাঙিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু এখন তো এটাও সম্ভব না৷ ফোনটাও রিসিভ করে না সাথী। ইমো, হোয়াটসএপেও ব্লক করে দিয়েছে রাজিবের নম্বর৷ কি যে দমবন্ধ মুহূর্তে আছে রাজিব তা কাওকে বলতেও পারে না। কাজেকর্মে মন নেই। বিকেলে একটা বড় অর্ডার রিসিভ করার কথা ছিলো। সেখানে যাওয়ার কথা ভুলে গেছে ও। বাসায় ফিরেছে জলদি। ঘরে বাইরে কোথাও যেন শান্তি পাচ্ছে না ।

খাওয়া দাওয়া শেষে রাতে মীরা জানায় –
: ” একটা কথা বলবো”
রাজিব কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। সেখানে যেন নিরব সম্মতি কথাটা শোনার। এরপর মীরা বললো-
: “কি করে যে বলি কথাটা?”
: ” কি কথা?” – কথাটা বলে জিজ্ঞেসু চোখে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে রাজিব। মীরা চুল আঁচড়ানো রেখে ওর দিকে ঘুরে বলে-
: ” আসলে বিশ লাখ টাকার ব্যাপারটা পিয়াসাকে বলিনি, ওর তো আবার সব ব্যাপারেই হাসাহাসির স্বভাব। এ বিষয়ে ও মজা করলে তা নিতে পারতাম না আমি তাই। এদিকে ও আমার ভিসা হয়েছে শুনে
আগামীকাল বিকেলের ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছে । কি যে ঝামেলায় পরলাম”
রাজিব ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে ফোন স্ক্রলিং শুরু করলো। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে কি যেন খুঁজছে ও। মীরা ওর কাছে বসে জিজ্ঞেস করলো –
: ” জানি এ সময় তোমার আমাকে প্রয়োজন, বলতো কি করি আমি?”
কি যেন ভাবলো রাজিব কিছু সময়। তারপর বললো-
: ” ব্যাগপত্র গোছাও, সমস্যা নেই, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার হাত একেবারে ফাঁকা, তুমি খরচ করে আসো আমি পরে দিয়ে দিবো নি টাকা হাতে আসলে”
: ” ছিঃ ছিঃ আমি বুঝি জানি না? তুমি এটা নিয়ে ভেবো না, ইন্ডিয়া ঘুরতে আর কতই বা খরচ। ওটা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মীরা। রাজিব এদিকে ভাবছে- “ও যাক তাহলে, এ মুহূর্তে ওর কাছে ধরা পরাটা ঠিক হবে না। এমনিতেই এতগুলো টাকা লোন এনে দিয়েছে, এখন এসব জানাজানি হলে আর রক্ষা নেই, তারচে ভালো ও ঘুরে আসুক, এদিকে আমিও একটু গুছিয়ে নিই”

বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে মীরা রাজিবকে এড়িয়ে চলে। বিছানায় আসে রাজিব ঘুমানোর পর। সেদিন রাতে রাজিব সব ভুলে কাছে পেতে চেয়েছিলো মীরাকে। কিন্তু মীরা ওর হাত চেপে ধরে কপট ধমক দিয়ে বলে-
: ” কয়েকদিন ধরে টেনশনে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না তোমার , মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমানোর চেষ্টা করো”

অন্য সময় হলে এ পরিস্থিতিতে একটা অসভ্য কথা বলতো রাজিব। কিন্তু এখন তা মনে চাইলো না। বাধ্য ছেলের মতো মীরার বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো ও। মীরা ওদের মাঝখানে নিজের একটা হাত রাখলো দুজনের মধ্যেখানে দেওয়ালের মতো করে। আরেকটা হাত দিয়ে ওর মাথার চুল টেনে দিতে লাগলো। তেল দেওয়ার ভঙ্গিতে আঙুল বুলিয়ে দিলো মাথায়। ম্যাজিকের মতো কাজ হলো তাতে। রাজিব ঘুমিয়ে পরলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।

পরদিন রাজিব কারখানায় যাবার পরই মীরা বেরিয়ে পরে মতিঝিলের উদ্দেশ্য। সেখানে পাভেলের কাছ থেকে নেয়া পাঁচ লক্ষ টাকা ভারতীয় রুপিতে কনভার্ট করে ও। উদ্দেশ্য সেখানে গিয়ে ব্যাবসার উদ্দ্যেশ্যে মালামাল কেনা। নিউমার্কেটে কিছু কেনাকাটা সেরে মীরা বাড়ি ফিরে দু’টোর মধ্যে। বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে মেয়েকে সময় দেয়। কয়েক দিন মেয়ে থেকে দূরে থাকবে ও তাই। ব্যাগপত্র বেশী নিবে না সাথে। ওর জিমে যাওয়ার ছোট্ট ব্যাগটায় দুইটা প্যান্ট, টপস আর লং শার্ট নিয়ে নিলো, স্কার্ফ, আর ওড়না নিলো কয়েকটা। বাকী কাপড় সেখানে কিনে পরার ইচ্ছে আছে ওর। ইন্ডিয়া গেলে ও এমনিতেও কম কাপড় নেয়৷ ওখান থেকে কিনেই পরে বেশীরভাগ সময়। প্রসাধনী হিসেবে ওর সবসময়ের সঙ্গী সানব্লক ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার, কাজল আর আপলে রেড শ্যাডের লিপস্টিক নিলো ছোট্ট একটা পাউচে। খালার হাতে কিছু টাকা দিয়ে গেলো যাওয়ার আগে। দরকারে এটা সেটা কিনে দিবে নূহাকে তাই।

বিকেল চারটায় বাসা থেকে বের হলো মীরা। ফ্লাইট রিসিডিউল হয়ে সন্ধ্যা সাতটায় মুভ করেছে। বের হতে হতে মীরা কল করলো রাজিবকে। বললো-
: ” রাজিব আমি মাত্র বের হলাম, তুমি জলদি বাড়ি ফিরে মেয়েকে সময় দিও এই কটা দিন”
রাজিব একটু যেন মনঃক্ষুণ্ন হলো। ও ভেবেছিলো মীরা হয়তো এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বলবে রাজিবকে। সব কূল হারানো রাজিব মুখিয়ে ছিলো মীরার এমন আহ্বানের অপেক্ষায়। কথা শেষ করে
ফোনটা টেবিলে রেখে অফিস ঘরের রিভলভিং চেয়ারটায় শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে জীবণের নানান হিসাব করছে রাজিব।

বিগত জীবণ, সাথী, গত কয়েকটা দিন, সাথীর এমন স্বার্থান্বেষী আচরন। এসব হিসাব নিকাশের শেষে রাজিব একটু যেন খোঁজ পেয়েছে মীরার বিশাল মনটার। সন্ধ্যা থেকে রাত হয়েছে। বেরিয়ে যাবে এখন। ফোনটা হাতে নেয় রাজিব। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে মীরাকে লিখে – “উইল মিস্ ইউ”
ম্যাসেজটা সেন্ড হয় কিন্তু সীন হয় না….

কেন জানি আজ জলদি বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে রাজিবের। মীরা বলেছে এই কটা দিন জলদি বাড়ি ফিরতে তাই হয়তো। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাইরে বেরুতে চায় রাজিব। কিন্তু মেয়ে দীর্ঘ দিনের অনভ্যস্ততায় বাবার কাছে ভিড়ে না খুব একটা। জোর করে কোলে নিয়ে আদর করতে গেলে কান্না জুড়িয়ে দেয় নূহা। মাজেদা খালা বলেন-
: ” ওয় এহন ঘুমাইবো, তাই এমন করছে”

বিরক্ত রাজিব রেগে গিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে দেন মাজেদা খালার কোলে। তার কোলে গিয়ে নূহা শান্ত হলো। একটু পরেই ঘুমিয়ে পরলো। সবটা সোফায় বসেই লক্ষ করলো রাজিব।

মেয়েকে মাজেদা খালার কাছে ঘুমাতে দেখে নিজের ঘরে ফিরে রাজিব। ফোনটা খুলে দেখে ম্যাসেজটা সীন হয়েছে কিনা। নাহ্ এখনো ম্যাসেজটা খুলে দেখেনি মীরা। ঘড়িতে খেয়াল করে দেখে রাত দশটা বাজে, এতক্ষণে তো ওদের পৌঁছে যাওয়ার কথা। দ্রুত ফেসবুকে সার্চ করে মীরাকে। হঠাৎ ভিতরটা কেমন পাক দিয়ে উঠে। ওর মতো মীরাও কি অন্য কারো সাথে অভিসারে…

ফেসবুকে মীরার সাথে এড নেই রাজিবের। অনেক আগে ঝগড়া করে রাজিবই ব্লক করে দিয়েছিলো মীরাকে। অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পার মীরার আইডি আনব্লক করে রাজিব। নিউজফিডে গিয়ে দেখে মীরার আইডি থেকে আধ ঘন্টা আগে একটা ছবি পোস্ট করা হয়েছে । মীরা চেক-ইন করেছে পার্কস্ট্রিটের একটা অভিজাত হোটেলে তার সামনে দাড়িয়েই দুজনের হাস্যজ্জ্বল ছবি। মীরার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি আর কেও না, পিয়াসা-ই।

নিজেকে খুব ছোট মনে হলো রাজিবের। নিজে খারাপ তো তাই অন্যকে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে বাঁধে না ওর। এমনকি নিজের স্ত্রী সম্পর্কে ও। হঠাৎ
নজরুলের বিখ্যাত একটা পঙ্কক্তির কথা মনে পরলো ওর- ” আমরা সবাই পাপী,
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি”

ম্যাসেন্জাে অফলাইন দেখাচ্ছে ওকে, তারমানে ওরা এখন হোটেলের বাইরে। বহুদিন পর ম্যাসেন্জারে মীরাকে একটা ম্যাসেজ দেয় ও। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে যায় রাজিব। সেই ম্যাসেজটা ছিলো-
” ঘুমাতে গেলাম বৌ,
হোটেলে ফিরে আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখো ”

আজ বহুদিন পর রাজিব দুটি কাজ করলো। এক মীরাকে ম্যাসেন্জারে ম্যাসেজ দিলো আর
বৌ বলে ডাকলো মীরাকে।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

কোলকাতায় এসে মীরা মোটাদাগে চিল করা যাকে বোঝায় তা-ই করছে। পারফেক্ট মি-টাইম। সংসার, স্বামী, মেয়ে, ব্যাবসা এসব শব্দ গুলো প্লেনে উঠার আগে ঝেড়ে ফেলেছে ও মাথা থেকে। এই মীরা যেন অন্য কেও।

প্রতিবার ইন্ডিয়ায় এলেই খরচ বাঁচাতে টাকার হিসেব করে কম দামে হোটেল খুঁজলেও এবার ও উঠেছে পার্ক স্ট্রিটের “দ্যা পার্ক হোটেলে”। হোটেলটি বিশাল বড়, সুন্দর এবং অভিজাত। এমন হোটেলে থাকার এক্সপেরিয়েন্স এটাই প্রথম ওর। টাকাতো কম সেইভ করলো না, দিনশেষে ও শূন। সেইভ করাটা দোষের না, কিন্তু অপাত্রে সেইভ করাটা ভুল হয়েছে ওর, ভুল হয়েছে ভুল মানুষকে বেছে নিয়ে । যার মাশুল দিতে হচ্ছে ওকে সেই শুরুর দিন থেকে। যদিও এসব ভাবনা বাদ দিয়েছে ও বেশ আগেই। এসব ভাবলে কিংবা চিন্তা করলে তো আর পরিস্থিতি বদলে যাবে না। তারচে বরং মীরা মন দিয়েছে সমাধানে, পথ খুঁজেছে এ ভুল থেকে বের হওয়ার।

কোলকাতা পৌঁছানোর পরদিন খুব সকালে বেরিয়ে পরে ওরা। প্রিন্টের লং শার্টের সাথে কালো জিন্স পরিহিত মীরার গলায় ঝুলানো আছে ক্যানোনের ডি-ফিফটি মডেলের ক্যামেরা। ক্যামেরাটা বেশ আগে কেনা হলেও তেমন ব্যাবহার করা হয় নি। প্রতিবারই এসে স্যাম্পল কালেকশন করার জন্য দৌড়ের উপর ছিলো ও আর রাজিব। খাওয়ারই খবর থাকতো না কোন কোন সময়। আবার ছবি তোলা! ছবি তোলার অবকাশ ছিলো না কোন। এবার যেন মীরা অন্য রকম এক কোলকাতাকে এক্সপ্লোর করলো। কোলকাতার এই সৌন্দর্য যেন আগে এতবার এসেও অদেখা ছিলো ওর।

মীরার ছবির হাত ভালো। বেশ কিছু ছবি তুললো ও। শ’পাঁচেক তো হবেই। ছবি তোলা যে মীরার শখ ছিলো তা যেন অনেক দিন পর মনে পরেছে ওর। ক্যামেরাটা সাথে এনেছিলো কি যেন মনে করে। কিন্তু এখন নিজের চোখে কোলকাতা শহরটাকে বন্দি করছে ক্যামেরার লেন্সে। ছবি তুলছে ব্যাস্ত কোলকাতার ট্যাক্সি, বাস, ট্রাম এর, স্ট্টিট ফুড সহ বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপনার যেমন – ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মর্বেল প্যালেস, সেন্ট পল ক্যাথিড্রল, কফি হাউজ, কলেজ স্ট্রিট, কোলকাতা ইউনিভারসিটি, প্রিন্স জেমস এর ঘাটের, যেটি বাবু ঘাট নামে পরিচিত। বিদ্যাসাগর ব্রিজ থেকে শুরু করে হাওড়া ব্রিজ। গাড়ি করে ঘুরবার শহর কোলকাতা না, এখানকার প্রতিটি বাড়িই যেন এক একটি ইতিহাস। হেঁটে দেখলে পা ব্যাথা হয়ে যায় তবুও আঁশ মিটে না।

রোডসাইট একটা দোকানে বেলী ফুল দেখে পিয়াসা কিনতে যায়। ফুল কিনতে গেলে দোকানির পেছনে লাল একটা দালান চোখে পরে মীরার। দোকানিকে জিজ্ঞেস করে আপনার পেছনের এ বাড়িটায় কেও থাকে? লোকটা মুচকি হেসে বললো-
: ” বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বুঝি?
মাথা নেড়ে উত্তর দেয় মীরা। লোকটা তখন আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন – “কথা বলার ভঙ্গিতেই বুঝেছি, বাড়িটা বৃটিশ আমলেঅস্ত্রাগার হিসেবে ব্যাবহার হতো, এখন পরিত্যাক্ত”

একটু পথ হাঁটলে সামনেই হাওড়া ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজে এর আগে ও আসে নি। পায়ে হেঁটে অনিন্দ্য সুন্দর এই ব্যাস্ত ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই হাওড়া রেল স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছে গেলো ওরা। যদিও কোন কাজ নেই, শুধু ঘুরবে বলে যাওয়া। ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে স্টেশন এটি। ১৬৮ বছরের পুরনো এই স্টেশনটির প্ল্যাটফর্ম সংখ্যা ২৩টি ও রেলপথ ২৬টি। এত কাছে এসে এটা ঘুরে না দেখলে পাপ হবে পাপ। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভাবনার জগতে ও যেন চলে গেলো অনেক বছর পেছনে। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহনের দীপার কাছে। যে গল্পে ও প্রথমবারের মতো শুনেছিলো হাওড়া রেল স্টেশন কথা। ব্যাপারটা পিয়াসাকে বললে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে গেলো ওরা দুজনে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলো হলো।

পায়ে হেঁটে সেখান থেকে ঘাটে গেলো ওরা। সেখান থেকে লঞ্চে করে পার হলো হুগলি নদী। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে কোলকাতার বুকে। দিনের চেয়ে রাতের হাওড়া ব্রিজ যেন শতগুণ বেশি সুন্দর। বাহারী আলো দিয়ে সাজানো পুরো ব্রীজ। সেই আলো হুগলি নদীর বুকে রঙ ছড়াচ্ছে যেন। সেদিন বেশ রাত করে ফিরে ওরা। রাতের স্তব্ধ কোলকাতা যেন আরো বেশী সুন্দর। দিনের বেলা পায়ে পায়ে মানুষ। নিরানব্বই শতাংশই বাংলাদেশী। খুব ক্ষুধা পাওয়ায় ওরা রাতের খাবার খায় বাইরের মুসলিম হোটেলে।

রাতে রুমে ফিরে মীরা একটু হিসাবপত্র নিয়ে বসে পরদিন কি করবে তার এটা ফর্দ তৈরি করে। পরদিন বের হয় কেনাকাটায়। এত টাকা সাথে আনা সত্বেও কেনাকাটার কাজ ২য় দিনেও শুরু করে না। ও একটু মার্কেট স্টাডি করতে চায় ও। বাইরের ঘোরাফেরা শেষে বিকেলে হোটেলের অসম্ভব সুন্দর লাউন্জটাতে বসে ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে মীরা। দেশে গুটি কয়েক পেইজ কাজ করে ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট নিয়ে। যারা ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে তারা কি কি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে, মার্কেটে কোনটার ডিমান্ড বেশী, কোনটায় লাভ বেশী থাকবে ওর রিসার্চ সেটা নিয়েই। পিয়াসা কিছুটা বিরক্ত হয়। ঘুরতে এসে কেন এমন খুটুরমুটুর?
মীরা কিছুই বলে না, কেবল মৃদু হাসে।

তৃতীয় দিন মীরা পুরোদমে কেনাকাটা শুরু করে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী ডিমান্ড এখানকার হাতের কাজোর জামাগুলোর। বিভিন্ন সাইজ, কাজ, আর রঙের বেশ কিছু জামা, টু-পিস, ব্যাগ, জুতা, শাল, এগুলো নিলো। এতগুলো টাকা আনা সত্বেও ওর মোট কেনাকাটা এক লক্ষ ও ছাড়ালো না। কারন কোন প্রকারের রিস্ক নেয়া যাবে না। প্রথমবার এসব নিলো পেইজে এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য। বিক্রি হলে হবে না হলে ও নিজে এগুলো ব্যাবহার করে ফেলবে।

কেনাকাটা যা করার একদিনেই তিনবারে শেষ করলো। পরদিনটা রাখলো ঘুরার জন্য। এখানকার স্ট্রিট ফুড, হলুদ ট্যাক্সি করে কোলকাতা শহরটা ঘুরে দেখা সবচেয়ে বেশী আনন্দের ছিলো। এ তিন দিন রাজিবকে একবারও কল করে নি মীরা। রাজিব কল করলে মীরা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। “তোমার কল করার দরকার নেই, ফ্রী হয়ে আমিই কল করবো তোমাকে “- ম্যাসেজটা দেখে কেমন বুকের ভিতর মুচড়ে উঠে রাজিবের। আঘাতটা বেশী হওয়ার কারন হচ্ছে এই রাজিবই ঠিক একই কথা বলেছিলো মীরাকে মালদ্বীপ ভ্রমণের সময়৷ এখন রাজিব যেন রিয়েলাইজ করতে পারে কথাটা শুনে মীরার মনের অবস্থা কি হয়েছিলো।

এদিকে রাজিবের টাকার শোকে মত্ত থেকে বড় অর্ডারটা কেনসেল হয়ে যায়। গোডাউন ভর্তি তৈরী মালামাল। এ সময়ে এত বড় অর্ডার ক্যানসেল হওয়া মানে বড় রকমের ধাক্কা খাওয়া। টাকার ব্যাপারটা একপ্রকার চাপাই পরে গোছে। রায়সাহেব বাজারে জোড়া খুনের তদন্তে তারা ব্যাস্ত। জোড়া খুনের ব্যাপারটা এখন টক অব দা কান্ট্রিতে পরিনত হয়েছে। উপর মহল থেকে চাপ আসছে খু’নি খুঁজে বের করার জন্য।
তাদের সময় নেই এই ব্যাপারে তদন্ত করার। থানায় গেলে তারা বিরক্ত হন, পরে আসতে বলেন। সেদিক বিবেচনায় টাকা পাওয়ার আশা বাদ। আশার কথা হচ্ছে সাথী ফিরে এসেছে। বিয়ের ব্যাপারটা আপাততঃ ধামাচাপা দেয়া গেছে। সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। সে পর্যন্ত সময় চেয়েছে ও। এ এক দিকে ও কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু সাথী প্রকাশ্যে আসার নিয়মিত তাগাদা দিতে ভুলে না। তবে ব্যাবসার ব্যাপারে রাজিব কি করবে বুঝতে পারছে না। মীরাকে এসময় এ ব্যাপারে বলা ঠিক হবে কি না তা ভাবতে থাকে রাজিব। বিয়ে, সংসারের ঘানি টানা, রাজিবের অসুস্থতা, নতুন করে ব্যাবসা দাঁড় করানো, বার দুয়েক মিস ক্যারেজ, প্রেগ্ন্যাসি, একটার পর একটা ঝামেলা যেন অপেক্ষায় ছিলো ওর। ওর দিকে কখনো খেয়ালই করে নি, বেচারী যখন নিজ থেকে রিফ্রেশমেন্ট খুঁজে নিয়েছে ওকে প্যারা দিয়ে লাভ নেই।

চারদিন ঘুরাঘুরি শেষে দেশে ফিরে ওরা, সাথে ব্যাপক শপিং, অনেক ছবি আর একগাদা মধুর স্মৃতি নিয়ে। দেশে ফিরে পুরোদমে ছবি তোলা শুরু করে ওর নতুন প্রোডাক্টের। নিজেই মডেল হয় নিজের ব্র্যান্ডের । ঢাকার বিভিন্ন হ্যারিটেড লোকেশনে হয় এসব শুট৷ ওর মৃতপ্রায় পেইজটাকে আইটি এক্সপার্ট দিয়ে সাজিয়ে নেয়। পুরোদমে কাজ শুরু করে ইদকে টার্গেট করে।

রাজিব যেন ওকে একেবারেই কাছে পাচ্ছে না ব্যাবসার বর্তমান অবস্থা, আর্থিক পরিস্থিতির ব্যাপারে ডিসকাস করতে। ঐ যে একটা অভিযোগ ছিলো না মীরার রাজিবের প্রতি? তুমি আমার কাছেই রয়েছো, কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পারছি না ” রাজিবের হয়েছে তেমনি দশা, মীরা বাড়িতেই আছে, গেস্ট রুমটাকে বানিয়েছেন স্টুডিও। সেখানেই এক দেয়াল ডেকোরেশন করেছে, অপর দেয়ালের সেলফে রেখেছে মালামাল। সারাদিন ব্যাস্ত থাকে ও ল্যাপটপ নিয়ে। রাতেও ব্যাস্ত দেখা যায় ওকে। প্রায়ই রাজিব ঐ ঘরটাতে গিয়ে বসে থাকে। তাকিয়ে দেখে ব্যাস্ত মীরাকে। মীরার কোন ভাবান্তর হয় না ওর আসা যাওয়ায়। ও ওর কাজ করে যায় মন দিয়ে। এক রাতে রাজিব মীরাকে বলে-
: ” আল্লাহ তো আমাদের কম দেয় নি, তবুও তোমার কেন এসব করা লাগবে?”
কোন উত্তর দেয় নি মীরা রাজিবের এ প্রশ্নের। ভেবেছিলো সময়-ই এ প্রশ্নের উত্তর দিবে।

দেখতে দেখতে মীরার আনা সব মালামাল বিক্রি হয়ে গেলো রোজার আগেই। একান্ত নিজের জন্য যা কিনেছিলো তাও দিয়ে দিলো ও কাস্টমার স্যাটিসফেকশনের জন্য। দ্বিতীয় বার মাল আনালো হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে। তারা কেজি হিসেব করে কুরিয়ারে মাল পাঠিয়ে দিয়েছে মীরার ঠিকানায়। মীরা ভেবেছিলো ইদের হাইপে হয়তো বিক্রি এত, ইদ শেষে হয়তো এত বিক্রি হবে না। মীরার এ ধারনা ভুল প্রমাণ করে চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছিলো। ইদের পর মীরা আবারো যায় ইন্ডিয়া। এবার রাজিব গতবারের মতো ওত স্বাচ্ছন্দ্যে পারমিশন দেয় নি। মীরাও পরোয়া করে নি ওর পারমিশনের।

মীরা এত মালামাল সাথে নিতে পারবে না তাই অর্ডার করে কুরিয়ায় পাঠিয়ে দিতে বলে৷ আর প্রথম বারের মতো সঙ্গে করে নিয়ে যায় কসমেটিকস আইটেম। ফেসওয়াস থেকে শুরু করে বডি স্ক্রাব, লিপলাইনার টু মেকআপ রিমুভার। ওর প্রিফারেন্সে ছিলো স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলো। আগের স্ট্র্যাটেজি তো জানাই ছিলো মীরার। অস্ত্র জমা করেছে মীরা ট্রেনিং তো জমা করে নি। রাজিব ওর নিজ হাতে গড়া ব্যাবসা কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু ওর অভিজ্ঞতা তো নিয়ে নেয় নি।

তাইতো মীরা ফেসবুক গ্রুপ, ইন্সট্রাগ্রাম পেইজ সব জায়গায় বিচরন করা শুরু করে ও নতুন করে, নতুন নামে “বিভা” যার অর্থ আলো, কিরণ, সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পেইজ গ্রুপ দুটোই।

কোরবানীর ইদে এক সপ্তাহের মাথায় ফেসবুক গ্রুপে বিক্রি হয় এক হাজার পিস ফুলকড়ি ওড়না। ঐ সময়টাতে ট্রেন্ডি ছিলো এ জিনিসটা। এবার রাজিব একটু নড়েচড়ে বসে। সাফ জানিয়ে দেয় এসব চলবে না ওর বাড়ি তে। “ওর বাড়ি!” চেতনাহীন মীরা যেন জেগে উঠলো ওর এই কথায়। একদিনের মধ্যে ফ্ল্যাট খুঁজে ও। পরদিন সব মালপত্র শিফট করে সেখানে। সাপে যেন বরই হলো। একমাসের মধ্যে কাস্টোমাররা এখানে এসে কেনাকাটা শুরু করলো। বাসা বাড়ি হওয়ায় একটু সমস্যা হলো প্রথমে। সেখান থেকে আইডিয়া এলো আউটলেট এর। অনেকে পরামর্শ দিলো আউটলেট খুলবার। অনেক ভেবে, খুঁজে ছয় মাসের মাথায় মীরা ধানমন্ডিতে খুলে ওর প্রথম আউটলেট। উদ্ভোদন করায় রাজিবকে চিফ গেস্ট করে।

রাজিব যত ওকে দাবিয়ে রাখতে চায় মীরা ততই যে গর্জে উঠে। একদিকে ভঙ্গুর হচ্ছে রাজিবের মীরা ফ্যাশন, অন্য দিকে স্বমহিমায় ছড়িয়ে পরছে মীরার নতুন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান “বিভা”। রাজিব ততদিনে টের পেয়েছে মীরা ওর হাতের বাইরে চলে গেছে। ব্যাপারটা ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। স্ত্রী স্বাবলম্বি হয়ে যখন স্বামীকে ছাড়িয়ে যায় কত জন পুরুষ তা মানতে পারে, উৎযাপন করতে পারে? রাজিবের মতো ছোটলোকেরা তো তা পারেই না….

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার সেই দুটো ঈদই পার হলো যেন আচ্ছন্নের মতো। ও পুরোদমে ব্যাস্ত ছিলো ব্যাবসা নিয়ে। কোরবানির ইদের ছয় মাসের মাথায় আউটলেটের বুদ্ধিটা একটু ঝুকিপূর্ণ হলেও এ যাত্রায় উৎরে গেছে ও। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রে মাঠে নামতে চাইলে আপনার ব্যাকাপ থাকা লাগবে৷ রাজিব তো যখন ওর একার ছিলো তখনো ও আপন ছিলো না। এখন তো ও শাখা খুলে বসেছে আরেকটা। ও শুধু নিজের টুকু বুঝে নিতে জানতো, তা হোক টাকা-পয়সা, নিজের শখ পূরণ কিংবা বিছানার অন্তরঙ্গতা। কার কি আসলো গেলো তাতে ওর মাথা ব্যাথা নেই।

কিন্তু কিছু মানুষের মানসিক সাপোর্ট, পাশে থাকা ওকে এ ঝড়ের দিনেও সমলে চলতে সাহায্য করেছে। মাজেদা খালা মীরার অবর্তমানে নূহার মায়ের দায়িত্ব পালন করছে, টুম্পা সবকিছুতে ভালোর মন্দ দিকটা খুঁজে সামনে এনে দিচ্ছে, সাহস দিচ্ছে স্রোতের বিপরীতে ভাবতে। কারখানার পাঠ চুকিয়ে ও যুক্ত হয়েছে মীরার সাথে। এতে আপত্তি ছিল না রাজিবের। ও বরং খুশি টুম্পার বিদায়ে। তাছাড়া রাত-বিরাতে মীরাকে এদিক সেদিক যাওয়া লাগে, তখন টুম্পা হয় ওর সঙ্গী। আর পাভেল? যত কাজই থাকুক ওর, ইন্ডিয়র পার্সেল এলে বুঝে নেওয়ার সময় সাথে যায় ও। কুরিয়ার অফিসে মেয়ে দেখলে পাত্তা দেয় না তারা। ইদানীং অবশ্য ওকে ডাকা বন্ধ করেছে মীরা। এতদিনে শিখে নিয়েছে পাত্তা আদায় করার কৌশল। গলার স্বর উঁচু তারে উঠেছে মীরার, শক্ত হয়েছে পা আর বৃদ্ধি পেয়েছে ভার বহন ক্ষমতা।বিয়ের পর থেকে অদৃশ্য ভার কাঁধে বয়ে বয়ে কাঁধ আর হাত দু’টোই শক্ত হয়েছে ওর৷ ব্যাবসায়ীক কাজ তো আর একদিনের ব্যাপার না, যে শেষ হয়ে যাবে। তাই দুজন ছেলে স্টাফ নিয়েছে ও। দুইজন মেয়ে আগে থেকেই ছিলো অফিসে। মেয়ে দুজনই অফিসে অর্ডার নেয় আর ডেলিভারি রেডি করে। ছেলে দুটি জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ, যখন যেখানে যেমন দরকার তেমনি কাজ করে। কখনো মালামাল রিসিভ করে আনে, কখনো দেয় ডেলিভারি। অফিসের শেলফ মেরামত থেকে শুরু করে বাথরুমের ট্যাপ। ছেলেমেয়ে চারজন মীর বলতে অজ্ঞান, ওকে ঘিরেই যেন আবর্তিত হয় ওদের দিন। কি মায়ায় বাঁধে মানুষকে মীরা! একবার যে সংস্পর্শে আসে মায়া কাঁটতে পারে না আর। অথচ যাকে বেঁধে রাখাটা জরুরি ছিলো, বাঁধন ছিঁড়ে সেই চলে গেছে অন্যত্র।

হঠাৎ পাওয়া এ সাফল্যের জন্য কিছু জিনিস ছাড় দিতে হয়েছে ওকে। কিছু পেতে হলে কিছুতো ছাড় দিতেই হয়৷ সত্যি বলতে সংসার, স্বামী, সন্তান, এ শব্দগুলো কেমন এড়িয়ে চলা শিখে গেছে মীরা। দুজনের মধ্যে ‘দূরত্ব’ শক্ত করে জায়গা করে নিয়েছে। রাজিব ইদানীং রাতেও ফিরে না, সে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই ওর। আপাততঃ কাজ পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা। সে সম্ভাব্য ঝড় সামাল দিতে সেটাতেই মনযোগ দিচ্ছে ও।

টুম্পা কত বলেছে ছেড়েই তো দিয়েছেন সব, স্বামী, নিজের কষ্টে গড়া ব্যাবসা, তাহলে এ সম্পর্কটাকে কেন বয়ে বেড়ানো। উত্তরে মীরা বলেছিলো- “ওকে যে ধাক্কা দিবো, আমার তো সেই শক্তি আগে সঞ্চয় করে নিতে হবে, এমনি ছেড়ে দিলে তো সেই কবেই দিতাম ছেড়ে”

ব্যাবসার ঘূর্ণিবাতে যতই ব্যাস্ত থাকুক এ ব্যাপার গুলো ভুলে না মীরা। রাজিব, সাথী, বিশ্বাসঘাতকতা এ শব্দ গুলো প্রতি রাতে ঝালিয়ে নেয় পুরোনো পড়ার মতো করে। মীরার কাছে ওর ব্যাবসা, ফেইসবুক পেইজ যেন নে’শাদ্রব্য। যতক্ষণ এর সান্যিধ্যে থাকে ততক্ষণ যেন ভুলে যায় এসব। জীবণে মনে করার মতো সুখ কই? ভুলতে চাওয়া যন্তণাই তো দিনেদিনে বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। নতুন একেকটা দিন একটু বেশী জটিল হচ্ছে আগের দিনের চাইতে। তবুও যত্ন করে প্রতি রাতে মীরা খোলে ওর সেই প্যানডোরা বক্স।

দেখতে দেখতে সেই বিশ লক্ষ টাকা শোধের তৃতীয় কিস্তির সময় আসে। আগের দুটো ঠিক সময় মতো শোধ দিয়েছে রাজিব। কিন্তু ওর হাত এখন ফাঁকা। ঈদের সিজনে এত টাকা একসাথে পেয়ে ওর মাথা নষ্ট অবস্থা। সবসময় এমনি বানের মতো টাকা আসবে তাই-ই ভেবেছিলো কি না কে জানে। এ টাকা দিয়ে যে বাকী নয়মাস টুকটুক করে চলতে হবে তা তো রাজিবের অজানা না । তাও এত টাকা হাতে পেয়ে সাথীকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে রাজিব। বৌ তার এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাকে হাতে রাখতে ফ্ল্যাট নামক তাবিজ দিয়ে বশীকরণ করতে চাচ্ছে। তবে কষ্টের ব্যাপার হলো ফ্ল্যাটটা দেরীতে দেওয়ার জরিমানা হিসেবে ওকে গুনতে হয়েছে আগের চেয়ে বেশী অংকের টাকা৷ নগদ টাকায় কেনায় একটু স্বস্তি। মোটা অংকের ছাড় পেয়েছে ওরা। ফ্ল্যাট ওরা বেশ বড়ই নিয়েছে। আগে যেটা কিনবে ঠিক করেছিলো তার চেয়েও বড়। এমনকি মীরার থাকা ফ্ল্যাটের চেয়েও। মীরারা থাকে ১৪০০ স্কয়ার ফিটের বাসায়। যেখানে তিনটা বিশাল বেডরুম, দুইটা বাথরুম, একটা ড্রইং রুম সাথে ডাইনিং স্পেস। রান্নাঘরের সাথে ছোট্ট একটা স্টোর রুমের মতো আছে। সেটাকেও ইচ্ছে হলে ঘরের মতো ব্যাবহার করা যায়। সেখানেই খাট আর আলমারি পেতে থাকেন মাজেদা খালা। সমস্যা হচ্ছে ঐ ঘরটার জানালা একটা। আর সাথীকে কিনে দিয়েছে ১৮০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। ওরা মানুষ মাত্র দুজন, ওদের এত বড় বাসা কি কাজে লাগে তা বুঝে আসে না মীরার। যেন মীরাকে টক্কর দিতেই এ কাজটা করেছে সাথী। মনে মনে বলে মীরা- “এমন টক্কর সারাজীবন যেন দিতে পারিস তুই। এর বেশী ক্ষমতা যেন তোকে খোদা না দেন। যত যাই করিস, এর চেয়ে আগে তো যেতে পারবি না। যারাই অন্যকে টক্কর দেয় তাদেরকে ইশ্বর সবসময় পিছনেই রাখেন।

এ খবরটা পাওয়া দুঃসাধ্য ছিলো মীরার জন্য। ইশ্বর সহায়, এ খবরটা ও পেয়েছিলো কারখানার সুপারভাইজার শিউলি আপার থেকে ! তার বিবেক তাকে মীরা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। রাজিবের নতুন বাসার সমস্ত কাজকর্মের জন্য বিশ্বস্ত কাওকে খুঁজ ছিলো রাজিব। একা এত বড় বাসায় থাকতে ভয় হচ্ছিল সাথীর। যখন তখন, রাতবিরাতে এ বাহানায় আটকে রাখে ও রাজিবকে। এ কাজে শিউলি আপার চেয়ে কাওকে বিশ্বস্ত মনে হয় নি রাজিবের। তাই তার কর্মক্ষেত্র কারখানা থেকে বদলে সাথীর বাসায় স্থানান্তর করেছে রাজিব। বেতন যা তাই থাকবে, খাওয়া থাকাটা উপরি পাওনা। তিনি সারাদিন থাকে ঠিকই কিন্তু রাতে ফিরে আসেন। তখন সাথী আটকে রাখতে চায় রাজিবকে৷ কোন কোন দিন পারে তো কোন কোন দিন পারে না।

শিউলি আপার এদের এসব দেখে কেমন যেন কষ্ট হয়। এত সুন্দরী মেয়ে মীরা, কারখানার মালিকের স্ত্রী, তবুও এতটুকু অহংকার নেই মনে এত্ত ভালো মন। তার স্বামী গোপনে বিয়ে করে সংসার পেতে বসে আছে? দুয়ে দুয়ে চা মিলাতে সময় নেয় যদিও, তবুও বিবেক তাকে মীরার কাছে পৌঁছে দেয়। কথাটা নিজ থেকেই জানিয়েছেন তিনি মীরাকে । দায়িত্ব মনে করেছেন জানানোটাকে। তিনি জানতেন না যে মীরা ইতিমধ্যে জানে ব্যাপারটা। মীরা কিছুই লুকায় নি, সবটা খুলে বলেছে তাকে।

সেই যে বর্ষার তপ্ত দুপুরে বেরিয়েছিল মীরা সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সব। মীরার সংসারের যুদ্ধ, রাজিবের কঠিন অসুখের ব্যায়বহুল চিকিৎসার খরচ জোগাতে নিজেকে বাজি রাখা, ঘুরে দাঁড়ানো, কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাবসার উন্নতি, রাজিবের বহুগামিতা, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা, পরপর দুইবারের মি’স’ক্যারেজ, রাজিবের অবর্তমানে নূহার জন্ম, প্রেগ্ন্যাসি পরবর্তী ইনফেকশন, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, সাথীর আর ওর বিয়ে, ব্যাবসা থেকে ওকে দূরে রাখা, সবকিছু নিজের নামে করে নেয়া, আর? এত কিছুর বিনিময়ে প্রকৃতির পুরষ্কার হিসেবে বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে না পারার শাস্তি।

শিউলি আপা অঝোরে কেঁদেছেন সবটা শুনে। এত ভালো একটা মানুষ, যে এতটা ত্যাগ স্বীকার করলো তার স্বামীর জন্য, সেই স্বামীই তার বুকে ছুড়ি বসিয়েছে। মীরা শুধু টুম্পার ব্যাপারটা লুকিয়েছে শিউলি আপার কাছে, টুম্পার সম্মান ক্ষুন্ন হোক তা মীরা চায় না। বহুগামিতা শব্দে মুড়ে দিয়েছে ওকে ডহ অনেককে।

শিউলি আপা সাহস দিয়েছেন, কথা দিয়েছেন পাশে থাকার। মীরার দলটা তিনিই ভারী করে দিচ্ছেন। ঐ যে উপরওয়ালা একজন আছেন তিনি । তা না হলে একা মীরার এ যুদ্ধটা চালিয়ে নিতে কষ্ট হতো।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন রাতে রাজিব ইনিয়েবিনিয়ে লোনের কিস্তিটা দিতে বলে মীরাকে। মীরা শুনেও না শোনার ভাব করে বসে থাকে। রাতে বিছানায় এসে রাজিব আবার তোলে কথাটা। মীরা চুল আচড়ানো রেখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, ড্রেসিং টেবিলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-
: ” ঐ যে ইন্ডিয়া গেলাম আমি, পিয়সার সাথে, বলেছিলে ম্যানেজ করে ঘুরে আসো তারপর হাতে টাকা আসলে দিবো নি , দিয়েছিলে? দাও নি, ধার করে বিদেশ ভ্রমণ করে আসলাম আমি। মালপত্র যা আনলাম তাও ধার করে। ঈদের তাগাদায় কত্তগুলো টাকা পেলে, তবুও আমাকে সাহায্য করার কথা ভাবো নি একবার ও । এমনকি এতগুলো টাকা কোথায় পেলাম আমি তাও জিজ্ঞেস করো নি একটা বার। তারপর ঢুস করে বলে দিলে তোমার বাড়িতে চলবে না এসব। দু’টো মাসও সাপোর্ট করলে না, সোজা হয়ে দাঁড়ানো রেখে এত্তগুলো টাকা এডভান্স করে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হলো। সেখানেও লোন করতে হলো একগাদা টাকা৷ সেসব শোধ করতে আমি দিনরাত এক করে ফেলছি। মেয়েটাকে সময় দিতে পারছিনা, সংসারে মনযোগ নেই, তুমি কই যাও কি করো কোন খবর নাই আমার টাকার টেনশনে। কিসের ভিতরে দিনরাত যাচ্ছে তা কেবল ইশ্বর আর আমি জানি। মনে মনে ভেবেছি তোমার থেকে টাকা নিয়ে বড় লোনটা ক্লিয়ার করবো উল্টো তুমি আমাকে বলছো ব্যাংক লোনের টাকা শোধ করতে?
: না মানে, আসলে ব্যাবসরা অবস্থা বেশী ভালো না, হাতটা ফাঁকা তাই….

: মালেক সাহেবকে বলো এখন, তার কাছ থেকে সাহায্য নাও।

কিছু বলে না রাজিব। কি-ই বা বলবে ও। রাজিব টাকা পয়সার কি করেছে তা জানে না, জানতেও চায় না মীরা করুকগে যা মন চায়। তাতে ওর কি? ও তো কেবল দিন গুনছে রাজিবের নিঃস্ব হওয়ার অপেক্ষায়। যাকে বলে
ধনে আর জনে নিঃস্ব হওয়া।

রাত পেহাতে কত দেরী পান্জেরী?
সেদিন হয়তো আর বেশী দূরে না…..

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯+৪০

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু : Mahabuba Metu
পর্ব: ৩৭

ভর দুপুরে মীরা রিকশা-যোগে ক’ব’র’স্থা’নে পৌছায়। ঘড়িতে সময় তখন দুপুর দেড়টা। ভাদ্রের তপ্ত রোদে জনজীবন তখন অতিষ্ঠ, জরুরি কোন কাজ না থাকলে মানুষ এ সময়টা বেরুতে চায় না ঘর থেকে । কিন্তু মীরা বেছে বেছে রোদ মাথায় করেই এলো এখানটায়। মীরা যখন ক’ব’র’স্থা’নের ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো, দমকা বাতাাস স্বাগত জানালো ওকে। এক দন্ড দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে পুরো জায়গাটাকে দেখে নিলো মীরা, জায়গাটা পুরো ফাঁকা। চলাচলের রাস্তা যদি ফাঁকা থাকে সেটাকে দেখতে কিন্তু অস্বস্তি হয়, আর এটা তো ক’ব’র’স্থা’ন এখান অস্বস্তি আরো বেশি হওয়ার কথা।

মীরা ভীতু প্রকৃতির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ওর একটুও ভয় করলো না সেখানে যেতে। বাবাকে দেখার ইচ্ছে ভয়কে উপেক্ষা করেছে যেন। সেখানে পা রাখার সাথে সাথে ওর মনে হলো ও ভিন্ন কোন জগতে পা দিলো ও । যেখানে শব্দদের প্রবেশ নিষেধ, সম্পর্কের মায়াবী বাঁধন যেখানে তুচ্ছ, দুনিয়ার চাকচিক্য যেখানে অর্থহীন। নিরব, শান্ত, কোমল আত্নীক শান্তি ছড়িয়ে আছে চারদিকে। যত যাই করুক মানুষ, যতই হোক ব্যাস্ত, দিন-শেষে এটাই তো সব মানুষের শেষ গন্তব্য।

একই রকম দেখতে অনেকগুলো সারি সারি ক’ব’র, দেখতে যেন ধাঁধার মতো। তা সত্ত্বেও বাবাকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি ওকে। ধীর পায়ে বাবার খুব কাছে এসেছে মীরা। ধীরে-সুস্থে মাথার কাছটায় বসে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় মাটিতে। ওর হাত বুলানোর যত্নে মনে হচ্ছে ও যেন মাটিতে না হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর বাবার গায়ে। ঘুমানোর আগে নূহার শরীরে হাত বুলায় যেমন তেমনি। বাবাকে কত দেখতে ইচ্ছে হতো ওর, হ্যা শুধু বাবাকেই। কিন্তু পারতো না, কারন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন তার বড় মেয়ে ম’রে গেছে। আবীরের সাথে ডি’ভো’র্সে’র দিন মৃ’ত ঘোষণা করেছিলেন তিনি মীরাকে। তারপর আর দেখা নাই, কারো সাথেই না। মীরা চেষ্টা ও করে নি, কি করে করতো? এই মুখ দেখানোর কোন রাস্তাই খোলা রাখেনি মীরা। বিয়ের পরপরই যে তাদের অভিমান ভাঙাবার চেষ্টা, তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দিবে সে সময়টাও জীবণ ওকে দেয় নি। জীবণ এই রুষ্ঠ ওর প্রতি যে ওকে ব্যাস্ত রেখেছে ভুলের রাজ্যে। মাঝে মাঝে মনে হয় এসব যেন পূর্ব নির্ধারিত। তা না-হলে সবাই কিভাবে বুঝলো যে ও ভুল করতে যাচ্ছে? এখন না বুঝলেও যখন টের পাবে ভুলের গন্ধ তখন আর কিছুই করার থাকবে না। নাক দিয়ে একটা শব্দ তৈরী করলো মীরা। নিজেকে ধিক্কার দিলো যেন।

বাবাকে শেষ দেখার চেষ্টা করলো যখন তারা মীরাকে সফল হতে দেয় নি। মাকে দেখে যে মন শান্ত করবে তাও পারে নি ও। মীরাকে নিজের চেহারা না দেখানোর কত চেষ্টা ছিলো সেদিন ওর মায়ের । ভাইটাকে দেখে নি ও, বোধহয় ব্যাস্ত ছিলো। আর
ইরা মুখ শক্ত করে বসে ছিলো সেদিন। ওকেই একমাত্র দেখতে পেয়েছিলো মীরা। কিন্তু মীরার দিকে অবহেলা কিংবা দয়ার চোখে ও তাকায় নি ইরা। নিজেকে মীরার ন’র্দ’মার কীটের চেয়েও নগন্য মনে হয়েছিলো তখন । মীরা পালানোর পর বাবা-মাকে কিসের ভিতর দিয়ে যতে হয়েছিল তা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে? এটাই হয়তো ইরার মীরাকে ঘৃণা করার কারন। যাক ঘৃণা তো করেছে! এই ওর অনেক মীরার কাছে।

অথচ বাবাকে এখন দেখতে এসেছে মীরা বাঁধা দেওয়ার কেও নেই। নিথর শুয়ে আছেন তিনি ক’ব’রে নামের ঘরটায়। বাঁধা দেওয়ার সামর্থ ইশ্বর তাকে দিতেন যদি, তিনি ঠিকই বাঁধা দিতেন।

চারপাশে চোখ বুলায় মীরা। এখনো তেমনি ফাঁকা চারপাশ। এ সময়টা পুরো ফাঁকা থাকবে জায়গাটা, তাই বেছে বেছে ও এই ভর দুপুরেই এখানটায় এসেছে। তপ্ত দুপুরে বিশাল এ ক’ব’র’স্থা’নটাকে এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে যে রাতের নিস্তব্ধতার কথা মনে পরে যায়। শহরের কোলাহল, জ্যাম, অশান্তির ভীড়ে এই এক শান্তির জায়গা। এখানে এলে পার্থিব ভাবনা ফিঁকে হয়ে যায়। পরকালের চিন্তা মনে গাঁথে।

আজ একটা বিশেষ কারণে এখানে এসেছে মীরা ।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মীরা কথা বলছে। যেন কোন কাজের পরিকল্পনার আলাপ করছে ও। আজ ও এসেছে বাবার কাছে দোয়া চাইতে। জীবণের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করছে মীরা। নতুন করে স্বপ্ন বুনা শুরু হবে আজ থেকে। তা বাবাকে জানাতেই যেন ওর এখানে আসা।

বাবার সাথে দেখা শেষ করে, এখানকার অফিসে যায় মীরা। সেখানে গিয়ে দেখে পরিচালক লোকটা এখানে নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মীরা। ও যখন এ রুমটায় ঢুকেছে সূর্য তখন মাথার উপর ছিলো৷ সূর্য তার গন্তব্যের পথে একটু হেলে গেছে। তবুও লোকটার আসার নাম গন্ধ নেই। অপেক্ষা জিনিসটা খুবই কষ্টের। অবশেষে তিনি এলেন সাড়ে তিনটার কিছু পরে। মীরাকে দেখে লোকটার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। যার মানে তিনি মীরাকে চিনতে পেরেছেন। মীরা মৃদু হেসে দাঁড়িয়ে সালাম দেন। লোকটা ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ভিতরে যেতে নিলে মীরা বলে-
: ” আমি আড়াইঘন্টা ধরে আপনার সাক্ষাতের অপেক্ষায় বসে আছি, যদি দু’টো মিনিট সময় দিতেন”
লোকটার চেহারায় কাঠিন্য ভাব স্পষ্ট। চোখের দৃষ্টি ক্রখর, তা দেখে বেঝাই যায় অনেক দখেছেন তিনি। কিন্তু ঐ রাতে এমন ছিলো না, রাত হলে কি চেহারার কাঠিন্য বোঝা যায় না, পড়া যায় না চোখ? এসব হাবিজাবি চিন্তা করতেই লোকটা বললো-
: ” গত দিনের মত উদ্ভট কিছু না তো?”
উত্তরে মীরা মিষ্টি করে হাসে, বলে-
: ” আমি বরাবরই একটু ডিফরেন্ট কি না”
: ” অনকে মানুষ দেখেছি আমি, আপনার মতো বাবাকে ভালোবাসতে কাওকে দেখি নি ”

মলিন একটা হাসি হেসে মীরা মনে মনে বলে- ” কি জানেন আপনি আমার ব্যাপারে? কিচ্ছু না, আমি আমার বাবাকে অসম্ভব ভালোবেসে অনেক যত্ন করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি”

লোকটা গটগট করে তার অফিস কক্ষে চলে যায়।
মীরা অফিস ঘরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে কাল বিলম্ব না করে একটা আর্জি জানিয়ে আসে সেখানকার পরিচালকের কাছে। সে ওর কথাটা শুনে চুপচাপ থাকে৷ মীরার আর্জি সে রাখবে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। তার উত্তরের অপেক্ষা ও করে না মীরা। উঠে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। সত্যি দু’মিনিটের বেশী নেয় নি ও। কারন ওর পেশ করা আর্জি পূরণ হতে অনেক সময় রয়েছে ওদের হাতে। এটা তাকে আগাম জানিয়ে দেয়া আর’কি। ফিরবার পথে মীরা কিছু টাকা দানবাক্সে ফেলে বাড়ি চলে আসে।

বাড়ি ফিরে মীরা ফ্রেশ হয়। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ওরও তন্দ্রার মতো আসে৷ কিন্তু চেখে মুখে পানি দিয়ে তন্দ্রাকে ভাগিয়ে দেয় ও। দুপুরের খাওয়া বিকেলে শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মাগরিবের আজান পর্যন্ত কাজ করে ও। নামাজের পর একটা কল আসে মীরার ফেনে। তারপর তৈরি হয়ে কি এক কাজে বাইরে যায় ও।

সেদিন রাতে মীরা রাজিবকে বলে পিয়াসার সাথে ও ইন্ডিয়া যাবে৷ কথাটা রাজিবকে এমন ভাবে বললো মীরা যেন ওর অনুমতি চাচ্ছে না, ও যে যাবে ইন্ডিয়া সেটা জানিয়ে রাখলো। রাজিব ভুরু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। কিছু সময় পর কি ভেবে যেন কপালের ভাঁজ গুলো মিলিয়ে গেলো। না শোনার ভান করে ফোন স্ক্রোলিং চালু রাখলো। মীরা বেশ অবাক হলো। যে লোক বন্ধুদের সাথে দেখা করতে দিতে উসখুস করে, বন্ধুর বিয়ে কিংবা বেবী শাওরে যেতে পারমিশন নিতে যাকে অনেক অনুনয় বিনয় করতে হয় তার এত সহজে স্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণে যাওটা মেনে নেয়া কেমন অস্বাভাবিক লাগার কথা না? মীরার ও লাগে। মনে মনে ভাবে – “রাজিব হয়তো ভাবলো কাজ হাসিলের আগে এখন ওকে রাগানো ঠিক হবে না” মীরা ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগালো। আজকের তারিখটা টুকে রাখলো একটা ডায়েরিতে। ডায়েরি কভারে কালার পেন দিয়ে মোটা করেলেখা ছিলো – সেকেন্ড ইনিংস।

পরদিনের ব্যাংকের কাজ শেষ হলো বারোটার মধ্যে। সপ্তাহ-খানেক সময় লাগবে লোন পাশ হতে জানালেন ম্যানেজার। সেখান থেকে বেরিয়ে রাজিব চলে গেলো কারখানায় মীরা চলে গেলো বাড়িতে। গুছিয়ে রাখা কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো আবার ইন্ডিয়া এম্বাসিতে ভিসার আবেদন করতে। সেখান থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।

মীরা খবর নিয়ে জেনেছে রাজিব যে বলেছিলো মালেক সাহেব (যেটা ওর নিজের ওকে দেয়া ছদ্ম নাম) মানে ও নিজে কলাবাগানে ফ্লাট কিনছে সেটা মিথ্যা কথা। ওরা ফ্ল্যাট কিনছে ওয়ারীতে। পুরান ঢাকার এখানকার ফ্ল্যাটগুলোর দাম মোটামুটি নাগালের মধ্যে। তাছড়া ঐদিকটা নিরিবিরি, ওয়ারী রাজধানী ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা , এখানে থাকাটাও নিরাপদ, পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। তার উপর সাথী পড়াশুনা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে হিসেবে কলাবাগান থেকে ওয়ারী ভার্সিটি থেকে কাছে। যদিও এটা একমাত্র কারন না ওয়ারীতে ফ্ল্যাট কিনবার। ভার্সিটিতে তো আর একবছর যাওয়া আসা। রাজিব সাথীর পড়াশোনার ব্যাপারটা পছন্দ করে না। মেয়ে-মানুষের সক্ষমতা, যোগ্যতা যত কম স্ত্রী হিসেবে তারা তত পারফেক্ট। ঐ এক মীরাকে নিয়েই তো যন্ত্রণার শেষ নেই। মীরার সবচেয়ে অপছন্দের জিনিস হচ্ছে – ওর জ্ঞান আর
আত্ন-বিশ্বাস। তুই মেয়ে মানুষ তুই সামলাবি সংসার, বাচ্চা-কাচ্চা। তোর এত কিসের দরকার। তাই তো ও আহ্লাদ দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে মীরার অনলাইন পেইজ।।

রাজিব অবশ্য সাথীর গ্রো-আপের গতিটাকে মন্থর করতে একটা ফন্দি এটেছিলো। ও সাথীকে জানিয়েছিলো ওর একটা ছেলে চাই। এ চাওয়ায় আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশী ছিলো ওর পড়াশোনা বন্ধ করার ফন্দি। সাথী সোজা না করে দিয়েছে। এখনো জানাতেই পারলো না বিয়ের কথা, তার উপর বাচ্চা। সাথী এত কাঁচা মেয়ে না। তাই ও রাজিবের এ আবদারটা আমলে নেয় না । নিয়মিত বার্থ কন্ট্রোল পি’ল নেয় । যদি রাজিবের ব্যাপারটা পছন্দ না। সাথী রাজিবকে বোঝায় ইদে-চাঁদে ওকে এখনো বাড়ি ফিরতে হয়। এখন এ আবদার রাখা ওর সম্ভব না। রাজিবের জারিজুরি শেষে একটু যেন থিতু হয় ও। বেশী বাড়াবাড়ি করলে শেষে ওর কাঁধেই ঝামেলা বাড়বে।

এদিকে দেখতে দেখতে লোন দেওয়া দিন এগিয়ে আসে। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মীরা। গোসল শেষ পূর্বনির্ধারিত ড্রেসটা পরে নেয় ও। দশটার সময় বাসা থেকে বেরুয় ওরা। সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে যায় ব্যাংকে। ব্যাংকটা শাহবাগে, আর ওদের বাসা কাঁটাবনে । প্রতিদিনের মতো বাইকেই গেলো দুজনে। ব্যাংকে গিয়ে লোনের যাবতীয় ফর্মালিটি শুরু করলো এগারোটা নাগাদ। ব্যাংক ম্যানেজারের ব্যাবহার অতিশয় আন্তরিক ঠেকলো মীরার কাছে। যাওয়ার সাথে সাথে চা-কফি নিয়ে হুলুস্থুল শুরু করে দিলেন ভদ্রলোক। ওরা জানালো চা খেয়েই বেরিয়েছে, কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই মানছেম না। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে চা-কফি না খাইয়ে ছাড়বে না।
তিনি মীরার প্রতি খুব বেশী এটেনশন দিচ্ছেন। পাশে যে রাজিব আছে তাকে মোটের উপর উপেক্ষাই করলেন তিনি। ভদ্রলোক বয়স হিসেবে মীরার বাবার সমবয়সী তবুও কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন মীরার শরীরের যত্রতত্র। সুন্দর হওয়ার এ আরেক জ্বালা। যদিও এসবে অভ্যস্ত মীরা। কাগজে সাইন করানের ছুতায় লোকটা মীরার হাত ছুঁয়ে দিলো একবার । এরপর মীরা সোজা হয়ে বসলো, বললো আপনি মার্ক করে দিন কোথায় কোথায় সাইন করতে হবে। তিনি কম দিয়ে টিক দিয়ে দেখিয়ে দেন কোথায় সাইন করতে হবে, মীরা কাগজটা ওর কাছে নিয়ে সাইন করে দেয়৷ মীরা প্রথমে সংকোচ অনুভব করলেও রাজিবের বিরক্তি বাড়াতে সহজ হলো, ও নিজেও গদগদ ভাব দেখালো ম্যানেজারের প্রতি। যদি মনে মনে বু’ই’ড়া-খা’টা’স বলে গালি দেয় ও লোকটাকে। লোকটা ম্যাডাম ম্যাডাম বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন। তার হাবেভাবে প্রকাশ করছেন তিনি মীরাকে লোনটা খুবই ঝামেলা করে ম্যানেজ করে দিয়েছে। রাজিব মনে মনে খুবই বিরক্ত তার এমন তেলতেলে আচরনে। কিন্তু টাকাটা ওর দরকার তাই ইচ্ছে হলেও কোন শক্ত কথা বলতে পারে না ও।
টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে রাজিব মীরাকে বললো রিকশা করে বাসায় চলে যেতে। কিন্তু…

” ঠিক আছে, তুমি সাবধানে যেও ” – বলে মীরা রিকশা নিলো একটা, আর রাজিব সিকিউরিটির কথা ভেবে কাঁধে নেয়া ব্যাগটা ঘুরিয়ে বুকের দিকে নিলো।

শাহবাগ থেকে বাইকটা সোজা চলে গেলো পুরান ঢাকার লক্ষ্মী-বাজারের দিকে। সাথীকে সেখানেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখে রাজিব। ভার্সিটির যাতায়াতের সুবিধার জন্য । বৃহস্পতিবার হওয়ায়
নয়াবাজার সিগনালের দিকে বেশ জ্যাম পরে। ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ হওয়ায় এ রোডটায় এমনিতেই জ্যাম লেগেই থাকে তার উপর সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। জ্যামটা মিনিট পাঁচেক স্থায়ী ছিলো। জ্যামটা ছাড়ার সাথে সাথেই কোত্থেকে দু’জন লোক এসে রাজিবের দিকে ছুড়ি তাক করে ওর ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে এত সময় পর সিগন্যাল ছেড়ে দেয়ার কারনে সবার মনোযোগ ছিলো গাড়ির স্টার্টিং-এ। হতভম্ব রাজিব উপায়ন্তর না দেখে গাড়িটাকে ঘুরিয়ে পিছু নেয় ওদের। রাজিবের গাড়িও তখন চলমান। কিন্তু রায়সাহেব বাজারের দিকে আবারো সিগন্যাল পরে। ঐ বাইকটা দ্রুত সে সিগন্যাল পার হয়ে যায়। রাজিবের সামনে গাড়ি থাকায় ও আর পিছু নিতে পারে না সেই বাইকটার। বাইকটাকে রাজিব সেখানে ফেলেই নিকটবর্তী বংশাল থানায় সাহায্যের জন্য যায়। কিন্তু ততক্ষণে কচকচে এক হাজার টাকার নোটের বিশ লাখ টাকা নিয়ে হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায় দুজন।
আর এদিকে মীরার গোপন ফোনটায় ম্যাসেজ আসে- ” মিশন কম্পলিট ”
ম্যাসেজটা পড়ে সেটা ডিলিট করে ক্রুর হাসি হাসে মীরা।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা – মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া কেও কপি করবেন না)

থানায় বসে থেকেই রাজিব কল করে ওর সব সময়ের দুঃখ সুখের সাথী মীরাকে। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ননা করে জলদি আসতে বলে বংশাল থানায়। মীরা বলে আমিতো উত্তরা আসছি ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারে। আমার পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলাম, সেটাকে তুলতে। সার্ভারে কি না-কি সমস্যা হচ্ছে তাই দেরি হচ্ছে। বেশী সময় লাগবে না, তুমি চিন্তা করো না। আমি যত দ্রুত সম্ভব আসছি। কথাটা মিথ্যা ছিলো। ও তখন সিএনজিতে, গাড়ি তখনো পৌঁছায় নি যমুনা ফিউচার পার্কে। গাড়ি এখন বাড্ডা রোডে।
মিথ্যে বলার কারন হচ্ছে রাজিবের এই ঘোর বিপদে এবার মীরা ওর পাশে থাকবে না। এবার আর বিপদে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিবে না ওকে৷ একা একা লড়ে দেখুক বিপদ কত যন্ত্রণার উদ্রেক করে মনে। মীরা তাই এবারকার স্ত্রী হিসপবে দায়িত্বটা কেবল হা-হুতাশ আর আফসোস করেই শেষ করলো।

রাজিবের হার্টের সমস্যার দরুন সব-রকমের ঝামেলা, বিপদ-আপদ সব মীরা একাই ফেস করেছে এতটা বছর। মানসিক চাপ কি বলে তা বুঝতেই দেয় নি রাজিবকে, পাছে ওর দূর্বল হার্টে এর প্রভাব পরে।
ওর জীবণটা হাসপাতালের পাখার মতো। একমাত্র লোডশেডিং না হলে হাসপাতালের পাখার যেমন কেন বিশ্রাম নেই। তেমনি ওর ও। রাতে ঘুমের সময় ছাড়া ওর ও কোন প্রকার বিশ্রাম নিষিদ্ধ যেন।

যে কোন ব্যাবসায়ই বেশ কয়েকটা ইনভেস্টের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে ইদ-পূজার সিজন গুলোতে। এক ইনভেস্ট আটকে থাকে মালামাল কেনায়, একটা ইনভেস্ট থাকে কাস্টমারদের বাকীর খাতায়, আরেকটা চলমান খরচের জন্য। হাতে সব-সময় নগদ টাকা রাখতেই হয়। এদিকে ব্যাবসাটা মূলত তিনটা সিজনেই বেশ ভালো চলে। বাকী সময়ে চলে টুকটুক করে। কোন কোন মাসে খরচের টাকাও উঠে না এমনো হয়। লাভ-ক্ষতি মিলিয়েই ব্যাবসা, এজন্যই তো ব্যাবসা হালাল। ডাল সিজনটা মীরাকে চলতে হতো ব্যালেন্স করে। কিন্তু কোন কোন সময় দেখা যেতো টাকার জন্য স্টাফদের বেতন কি কারখানার ভাড়া দেয়া যাচ্ছে না। সেই সব সময়ে টাকা পয়সার দরকার হতো। রাজিব কখনোই এসবে পাত্তা দিতো না। উল্টো কখনো কখনো ঐ দুঃসময়ে ও নতুন মডেলের বাইক কিংবা এ্যাপেলের লঞ্চ করা আপডেট ফোন কিনবার ভুত চাপতো ওর মাথায়। রাগে, বিরক্তিতে, কষ্টে ঐ ঘোর দুঃসময়েও সেগুলোর জন্য মীরা টাকা দিতো ওকে। ও যেন মীরার শখ করে পোষা হাতি। যার থাকায় তেমন কোন উপকার নেই অথচ পুষতে বিশাল খরচের ধাক্কা।

এসব পরিস্থিতিতে মাঝেমাঝে মীরার নিজের গড়া গহনা বিক্রি করে দিতো, কখনো ব্যাংকে যে টাকাগুলো জমাতো ডিপিএস আকারে সেগুলোও ভেঙে টাকা ব্যাবসায় লগাতো। রাজিবের সাথে এসব ব্যাপারে আলাপ হতো খাবার টেবিলে। অথচ রাজিব একটা বারও বলতো না যে তোমার গায়ের স্বর্ণ কেন বিক্রি করবে। আমার বাইক তো দুই-তিনটা একটা বিক্রি করে দিলেই তো এ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, কথাগুলো বলার জন্য ও বলতো না, একটা বারও না।

সেই যত্নে পালা-পোষা হাতি এখন মীরার ঘর ভাঙতে মরিয়া৷ কবে যেন মনের মালিকানাও বদলে নিয়েছে সন্তর্পণে। এসব ভাবনা ওকে কষ্ট দেয়। তাই বলে এসব ভাবনা বন্ধ করে দেয় নি ও। কষ্টের সাথে যার অপূর্ব রসায়ন তাকে কষ্টের কথা বলে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ আছে? আরো অনেক কষ্ট পাওয়ার আর দেওয়ার আছে ওর।

এরমধ্যে অনেকবার ফোন করেছে ও রাজিবকে। খবরা-খবর নিয়েছে, ও কেন আসতে পারছে না তার মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে। মীরা জানিয়েছে কি এক কারনে ওকে নাকি ইনভেস্টিগেশন করবে এখানকার স্টাফরা। রাজিবের মীরাকে কি দরকার উল্টো মীরা এমন গল্প করলো যেন এ মুহূর্তে রাজিব ওর পাশে থাকলে এত সমস্যা ওকে ফেস করতে হতে না। রাজিব বলে-
: ” আমার যা হওয়ার তাতো হলোই, চিন্তা করো না
তোমার আপডেট জানাও আমাকে, দরকার হলে আমি আসবো উত্তরা”
মীরা মনে মনে বলে-” তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবো আমি? মাথা খারাপ! তা তো সেই কবে বাদ দিয়েছি সোনা ”

মীরার ধারনা কম করে হলেও প্রতিদিন দুই হাজার লোক ইন্ডিয়ার ভিসার জন্য আবেদন করেন। একেক জন হতে ৫০০ টাকা করে নিলে ওদের কত আয়, তা থেকে স্টাফদের বেতন, অফিসের ভাড়া এসব বাদ দিয়ে তাদের লাভের মোটামুটি একটা হিসেব ও করে ফেলে লাইনে অপেক্ষা করতে করতে। ব্যাবসায়ী হওয়ার এই এক সমস্যা। যদিকে তাকায় সেদিকেই ব্যাবসা দেখে ও। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করা লাগলো না, বাইশ নম্বর কাউন্টারে পাসপোর্ট রিসিভ করতে যেতে হলো। পাসপোর্ট জমা দিতে অনেক সময় লগে। কিন্তু পাসপোর্ট রিসিভে তেমন সময় লাগে না। তাই ফিনিশিং হিসাবটা পরের জন্য তুলে রাখলো।

পাসপোর্ট রিসিভ করে মীরা একাই ঘুরতে থাকে যমুনা ফিউচার পার্কে। আড়ং, রঙ সহ বেশ কয়েকটা দেশীয় ব্র্যান্ডের আউটলেটে ঘুরে। ফুড কোর্টে গিয়ে পছন্দের খাবার অর্ডার করে। এক্কেবারে পাক্কা “মি টাইম” সেলিব্রেট করা যাকে বলে। তারপর ধীরে সুস্থে বেরিয়ে একটা সিএনজি নেয় বাড়ি ফিরতে। সিএনজিতে উঠে ফোন করে রাজিবকে। জেনে নেয় কোথায় আছে রাজিব। ফোনটা করে ফর্মালিটি হিসেবে। প্রথম ধাক্কায় এত কঠোর হওয়া যাবে না, তাও খেয়াল রাখে মীরা। তাহলে তা চোখে ঠেকবে। ওর পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার সব ধকলের গল্প আবারো শুরু করে মীরা। ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারকে ধুয়ে দেয় একচোট। এক ফাঁকে আফসোস করে এতগুলো টাকা হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায়। মিথ্যে সাহস দেয় রাজিবকে৷ বলে-
: “একদম চিন্তা করো না রাজিব, আমি আছি তো” অথচ মনে মনে বলে- “চিন্তা কাকে বলে? কতপ্রকার ও কি কি সব তোমাকে টের পাওয়াবো সোনা একটু অপেক্ষা করো।

বাড়ি ফিরে দেখে রাজিবের বয়স এক দিনেই বেড়ে গেছে কয়েক বছর। ওর দীঘল চোখে দিশেহারা। ঠিক যেন শিকারীর ফাঁদে আটকা পরা কোন হরিণ। মীরার মনে পরে এই চোখের মায়ায় পরেই অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রেমে পড়েছিলো ও রাজিবের। অথচ কত কত ছেলেকে রিফিউজ করেছিলো ও। কিন্তু ওকে না করতে পারে নি। সেই ভাবনাটা বন্ধ করে মীরা মর্তে ফিরে যেন। ব্যাগপত্র ফেলে দৌড়ে যায় ওর কাছে। আর রাাজিব? কান্নাটা বাকী ছিলো শুধু। কোন কথা না বলেই যেন বলে দিচ্ছিলো কতটা ভেঙে পরেছে ও। রাজিবের পাশে ওর হাতটা নিজের হাতে নেয় মীরা। তারপর সাহস দিতে বলে-
: ” বিশ লক্ষ টাকা কোন টাকাই না রাজিব, তুমি যে সহিসালামতে ফিরেছো এই অনেক। আমার কষ্ট হচ্ছে শুধু এটাই ভেবে যে তুমি তো সৎ একটা নিয়ত করে টাকাটা লোন করেছিলে। তারপর ও আল্লাহ এমন করলো? ” আর মনে মনে বলে- ” হা’রা’মী ফ্যাট কিনবি না না, এবার কিন ফ্ল্যাট, তোর নিয়তই তো ভালো ছিলো না”

ক্ষণকালের বিরতির পর ওর কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে-
: ” উঠো তো, তোমার বিশাল ব্যাবসার একটা কোণা ও না এই টাকাটা। টাকা গেছে ২০ লাভ তুমি কোটি টাকার চিন্তা করে ফেলেছো। এসব ভাবা বাদ দাও তো, উঠো ”
এতক্ষণে রাজিব বাবাজির সোনায় বাঁধা মুখে খানা খুলে ক্ষীণ গলায় বলে-
: “পুলিশ বলেছে এটা নন-প্রোফেশনলাল লোকেদের কাজ। যে ছুড়ি ওরা পেয়েছে তা দেখে তারা এটা নিশ্চিত হয়েছে। ওটা আসলে ফল কাটার ছুড়ি ছিলো”।

মীরা মনে মনে বলে-” গাধা গুলো ছুড়ি ফেলে এসেছে আবার, আমাকে বললোনা তো কিছু!”
মীরা রাজিবকে বলে আচ্ছা বাদ দাও, উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো। যা গেছে গেছে তা নিয়ে ভেবে কি হবে।আমার পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে”
: ” পুলিশ বলেছে নন-প্রোফেশনাল তো, দেখেন আপনার পরিচিতর মধ্যে কেও কি না, তারউপর ব্যাগে যে টাকা ছিলো তা ওরা জানলো কি করে, নিশ্চয়ই কাছের কেও এটা করিয়েছে অথবা ইনফরমেশনটা লিক করেছে”
এবার মীরা কিছুটা ভীমড়ি খায়। কাজটা যতই ওয়েল প্ল্যান হোক না কেন ধরা পরার রিস্ক কিন্তু এখনো আছেই। নিজেকে সামলে বলে-
: ” আচ্ছা সেসব পরে ভাববো দুজন মিলে, এখন চলো তো”
: ” তোমার কাওকে সন্দেহ হয়? ”
: ” আমার কাকে সন্দেহ হবে? টাকা নিয়েছে তোমার কাছ থেকে, আমি কিভাবে কাকে সন্দেহ করবো?”
: ” কাছের কেও করেছে বললো তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা লোনের ব্যাপারটা টুম্পা কি জানে?”
: “কি যে বলো তুমি, ও জানলেই বা কি, কে আছে ওর এই শহরে?”
: ” শোন যাকে দিয়ে যা অবিশ্বাস্য মনে হয়, যা আশা করা যায় না, সেই কিন্তু ঐ কাজ করে বসে”
মীরা মুখ শক্ত করে রাজিবের চোখে তাকিয়ে বলে-
: ” রাজিব আমিও তোমার থেকে এমন কিছু আশা করি নি, কিন্তু দিনশেষে কি হলো বলো?’
এবার ধাক্কা খাওয়ার পালা রাজিবের। ওতো এমনিতেই ভাঙাচোরা, তার উপর এমন কথায় ওর আত্না শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তোতলানো সুরে বলে-
: ” মানে? ”
মীরা মুচকি হেসে বলে-
: ” এই যে বললাম পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে তাও তুমি উঠছো না ”
কথাটা শুনে চোখেমুখের অস্বাভাবিকতা দূর হতে থাকে।
: ” আশার কথা এই যে পুলিশ ওদেরকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আটক করবে বলেছে”
: ” এদেশের পুলিশ! আচ্ছা দেখা যাবে এবার উঠো তো”

রাজিবের চলার ক্ষমতা টুকুনও যেন বিশ লাখের সাথে নিয়ে গেছে ওরা। মীরা উঠতে সাহায্য করবার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়েও নূহার কান্নার শব্দ সেখানে দৌড়ে যায়। প্রকৃতিও হয়তো চায় না মীরা রাজিবকে বাড়িয়ে দিক সাহায্যের মমতা মাখা হাতটা। তাইতে অসময়ে কাঁদিয়ে দিয়েছে নূহাকে মীরাকে ওর থেকে দূরে সরাতে।

চলবে।

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৯ (বোনাস পর্ব)
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

টেবিল ভর্তি রাজিবের পছন্দের খবার কিন্তু রাজিবের মন নেই সেখানে। যতই টাকা থাকুক এতগুলো টাকা হাত ফসকে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারছেনা ও। তারচে বড় কথা সাথী কি ভাববে? ওর কাছে রাজিবের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে।

মীরা কথাবার্তা চালু রেখে ওকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। কারন ব্যাপারটা ও যত দ্রুত হজম করবে ততই মীরার জন্য ভালো। খাবার শেষে ঘরে এলে মীরা রাজিবকে জিজ্ঞেস করে-
: ” টুম্পার কথা কেন মনে হলো তোমার?”
: ” না, মানে ও তো জানতো যে আজ টাকাটা পাবো তাই…”
: ” টাকা আনার কথা মাজেদা খালা জানে, সুরমা ও জানে। তারও কি তাহলে তোমার সন্দেহের তালিকায় রয়েছে”
: ” পুলিশ জিজ্ঞেস করলো কাওকে সন্দেহ হয় কি না”
: ” রাখো তোমার পুলিশ, এসব ভাবা বাদ দাও বুঝলা, খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরো, পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে দাও”
: ” এতগুলো টাকা?”
: “ভেবো না রাজিব, একটা সিজনের লাভ এটা, যাই হোক বুঝে চললে ম্যানেজ হয়ে যাবে, এর চেয়ে কত কষ্টে দিন কেটেছে আমাদের। তোমার মনে আছে? একটা চাদর গায়ে দিয়ে দুই দিক থেকে দুজন টানাটানি করে শীত পার করেছি৷ সেদিক থেকে তো খোদা কত ভালো রেখেছে আমাদের। আমি একটুও ভাবছি না টাকার কথা। টাকা তো আসবে যাবে তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো, তাহলে….!”

কথাটা মীরা পূর্ণ আবেগ দিয়ে বললো। রাজিব খাওয়া রেখে তাকিয়ে রইলো মীরার দিকে,ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি। এ চাওনি মীরার চেনা, লোহা গলে যাবে এ চাওনি তে। তাই চোখ ফিরিয়ে নেয় মীরা, পাছে না ওর মনটা নরম হতে শুরু করে। দু’ফোটা পানিও পরে চোখ থেকে। এ রাজিব, ওর চাওনি, মিথ্যা ভালোবাসা, সাথী, আর রাজিবের বিশ্বাসঘাতকতা।
চোখের পানির এই ছিলো কারন। ঝড়ের কবলে পরা নাবিকের মতো দিশেহারা রাজিব ভেবে নিয়েছে ওর বিপদ থেকে ফিরে সহিসালামতে আসা এই চোখের পানির কারন। মীরা প্লেট হাতে চলে যায় রান্নাঘরে। সেখানে গিয়ে সিংকে হাত রেখে কাঁদতে থাকে। কিছু সময় পর রাজিবও আসে সেখানে। মীরার কাঁধে হাতে রেখে দাঁড়ায় ও। চোখ মুছে ঘুরে দেখে ওকে। রাজিব জড়িয়ে ধরে মীরাকে। মীরা ইদানীং রাজিবের স্পর্শকে পড়তে পারে। কোনটা কামনা, লালসা, বর কোনটা ভালোবাসা। এই মূহুর্তের এ স্পর্শ পবিত্র, এ স্পর্শ অনুতাপের। কে জানে রাজিব কি ভাবছে এখন, হয়তো ভাবছে ওর পাপ আর বিশ্বাসঘাতকতার কথা।

মীরা ওর বুকে আর আগের মতো উম খুঁজে পায় না। ও কেমন সাফোকেটেড ফিল করে। তবুও আলতো করে পরে থাকে ওই বুকের উপর। ওর মনে হচ্ছে ও জড়িয়ে আছে কোন ক্যাকটাসকে, যার গা ভর্তি কাঁটা যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে।

রাজিবকে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। মাথার কাছে বসে হাত বুলাতে থাকে। ছোট্ট বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে পরে রাজিব। মীরা ওকে ঘুম পাড়িয়ে চলে আসে বারান্দায়। লুকানো ফোনটা বের করে কল করে ওদেরকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই মীরা বলে-
: ” তোমরা কি গাধা? ঐ ছুড়িটা কোন দুঃখে ফেলে এসেছো ওখানে? ”
: ” আরেহ্ হাত কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছিলো আপা, কিভাবে যে আসছি আল্লাহ জানে”
: ” যাই হোক তোমাদের কেও চিনতে পারে নি তো?”
: ” আরেহ্ না আপা, আমারা গাড়ি উড়ায়া নিয়া আসছি”
: ” ব্যাগটা কি করেছো? ”
: ” আপনে যা কইছেন তাই করছি আপা, সোজা পুড়ায়া ফেলছি”
: ” ভালো করেছো, শোন তোমাদের কত দিতে হবে তা রেখে বাকীটা পাভেলের বাসায় পৌঁছে দিও। আর সম্ভব হলে গা ঢাকা দিয়ে দাও”
: ” কি যে কন আপা, আপনার কোন কাজে লাগতে পারাটাই আমাগো সবচেয়ে বড় মুজুরী, ট্যাকার ব্যাগ আমরা পাবেল ভাইগো বাসায় দিয়া আসছি ”
: ” না, না, তোমরা এত বড় ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছো, তোমাদের পারিশ্রমিক নিতেই হবে ”
: ” আপা, আপনে আমাগো বইন, মাথার উপরে আপনে থাকলেই হইবো, এমন কাম তো ডেলিই করি, এডা না’হয় মাগনা করে দিলাম”
: ” তোমাদের এই সাহায্য আমি মনে রাখবো ভাই, যে কোন বিপদে আমাকে স্মরণ করবে”
: ” হ আপা, ভালো থাকেন”
: ” আচ্ছা ভাল থাকো”

ছেলেটার নাম মকবুল, যে মীরা থাকতে প্রতি মাসে কারখানা থেকে চাঁদা নিয়ে যেতো। যে এলাকায় কারখানা সেখানে ইদ, চাঁদ, পূজা, নেতার মৃ’ত্যু বার্ষিকী, নেতার বাপের মৃ’ত্যু বার্ষিকী, নেতার শ্বশুর, শাশুড়ীর শ্রা’দ্ধ, শালার বিদেশে ভ্রমণ উপলক্ষে চাঁদা দিতে হতো। ব্যাপারটা সিলি শোনালেও এটাই সত্যি। এমনো মাস ছিলো দুইবার আসতো, তখন মজা করে মীরা জিজ্ঞেস করতো কি ব্যাপার? এ মাসে না টাকা নিয়ে গেলে। মজা করে মকবুল বলতো- ” নেতার শালীরে ব্ল্যাকে ঢাকা ভারছিটি ভর্তি করবো। ট্যাকার সর্ট পরছে তাই আবার আসলাম। মীরারা কিন্তু বিরক্ত হতো না। যা পারতো দিতো। কারন যা দিতো তার বিনিময়ে যা শুনতো তা বেশী মজার ছিলো ওর কাছে। একবার টাকা নিতে এসে মকবুল বললো-
: ” বুজলেন আপা, নেতার বাগান বাড়ির পায়খানা বানাইবো, ট্যাকার টান পরছে তাই এই মাসে আবার আইলাম। মীরা হেসে খুন হয়ে যেতো। যতটা না কথাগুলো শুনে। তারচে বেশী ওর বলার ভঙ্গির জন্য। ওর বাবা মা’রা গেলো নেতার মিছিলে বোমা বি’স্ফো’রণে তার উপর মা ডায়াবেটিসের পেশেন্ট। ও এখন নেতার চামচামি করে কোন মতে দিন পার করে। কিন্তু মায়ের চিকিৎসা খরচ তো এভাবে চলে না। মীরা ওর মাকে নিয়ে বারডেমে যায়। প্রতি মাসে একবার করে যেতে হতো ঔষধ আনতে। পরে মীরা জানতে পারে সরকার থেকে গরিবদের জন্য ফ্রী ঔষধের ব্যাবস্থা আছে। এত ব্যাস্ততা সত্ত্বেও মীরা আবারো তাকে সেখানে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তারদেরকে বলে ফ্রী ঔষধের ব্যাবস্থা করে দেয়। এরপর থেকে প্রতি মাসে ফ্রী ঔষধ পায় ওর মা। ব্যাবস্থাটা মীরাই করে দিয়েছিলো। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে এ কাজ করে দিতে পেরে ধন্য মনে করছে নিজেকে। যদিও তা বছর তিনেক আগের কথা। তবুও মকবুল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পেলে কার্পণ্য করে না।

“Do good for others. It will come back to you in unexpected ways ” – এ কথাটা তার সত্যতা না জানি কত বার জানান দিয়ে যাবে ওর জীবণে। ইশ্বর ওর প্রতি এতটাও রুষ্ট নন, রাজিবের ভালোবাসা পায়নি তো কি হয়েছে এমনি কত কত মানুষের ভালোবাসায় পূর্ণ মীরার জীবণ।

পাভেলকে ফোন করে মীরা। বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় ওদের।
পাশ ফিরে মীরা আৎকে উঠে। পর্দা ধরে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রাজিব। মীরা থতমত খেয়ে বলে-
: ” তুমি! ঘুমাও নি?”
: ” ঘুম আসছে না, তুমি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? ”
: ” চলো…”

মীরার মনে তখনো চিন্তার যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, চলছে। রাজিব কি শেনেছে ওর কথা?

রাতটা মীরার পার হয়েছে চিন্তা আর আতংকে। শেষ রাতে চোখটা বুঝে এসেছিলো ওর।

মীরার ঘুম ভাঙে রাজিবের ডাকে। ওকে ডেকে তৈরী হচ্ছে ও। বলে-
: ” শোন মীরা, জলদি ওঠো । সাব ইন্সপেক্টর সারোয়ার কল করেছে। তারা নাকি ছিনতাইকারীকে আটক করেছে। আমাকে যেতে বললো সনাক্ত করতে” খবরটা জানিয়েই বেরিয়ে যায় রাজিব। মীরা রাজিবকে থামিয়ে বলে-
: ” আমিও যাবো তোমার সাথে। তুমি আমাকে দশটা মিনিট সময় দাও চেন্জ করতে। বলেই ছোট ফোনটা মুঠোয় পুরে চলে যায় বাথরুমে। বেশ কয়েকবার ফোন করে মকবুল আর পাভেলকে। কাওকেই পায় না ফোনে। পাভেলের ফেন ধরছে না আর মকবুলের ফোন বন্ধ। এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় তাড়া দেয় রাজিব- “জলদি করো মীরা”

মীরা কোনমতে ফ্রেশ হয়ে থানার উদ্দেশ্যে বের হয় রাজিবের সাথে। মনে মনে খোদাকে ডাকে। বলে- ‘রক্ষা করো খোদা”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

থানায় যাওয়ার পথে জ্যাম তেমন ছিলো না। শুধুমাত্র যে সিগন্যাল এ ঘটনা ঘটেছে সেখানে ছোটখাটো একটা জ্যাম পরলো। তাও গাড়ি থামাতে হলো না। ও জ্যাম পর্যন্ত আসতে আসতেই সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছিলো। রাজিব ঐ ফাঁকে গাড়ি স্লো করে মীরাকে ঘটনার স্থান আর বিবরণ দুটোই দিচ্ছিলো। মীরা নিরব, কোন কিছুতে মনযোগ দিতে পারছে না। ওর ভিতরে চিন্তা, অস্থিরতা, ওদের ধরা পরার উদ্বেগ। রাজিবের পেছনে দুই পা দু’দিকে দিয়ে বসে থাকা মীরা হাতের নখ খুঁটছে। যেন সব গন্ডগোল হাতের নেইল পালিশটায়। এতে ওর উদ্বেগটা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। মীরা পেছনে থাকায় ওর চেহারার অস্থিরতা, উদ্বেগ কেনটাই তেমন খেয়াল করেনি রাজিব। কারন ওর মনোযোগ ঐ দিনের ঘটনার বিবরনে। লক্ষ্য করলেও অবশ্য কোন সমস্যা হতো না, ব্যাপারটা খারাপ ভাবে নিতো না ও । ওটাকে বিশ লাখ টাকার ছিনতাইয়ের শোক বলে চালিয়ে দেয়া যেতো। কারন এসব বিষয়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের হা-হুতাশ চোখে পরার মতো হয় । যার স্বামীর এতগুলো টাকা লাপাত্তা তার এমন উদ্বেগ বেমানান না।

যথা সময়ে বংশাল থানায় পৌঁছালো ওরা। বাইক টা সাইডে রেখে রাজিব, মীরা থানার ভিতরে ঢুকে। সাব ইন্সপেক্টর সারেয়ার সাহেবের খোঁজ করতেই একজন তাদেরকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তিনি ওদেররকে আগেই একটা মোটর সাইকেলের সামনে নিয়ে যান, উদ্দশ্য রাজিবের বয়ানে নিশ্চিত হওয়া, যে ওটাই সেই ছিনতাইকারীর মোটরসাইকেল কি না। রাজিব ঐদিন বাইকটার পিঁছু করেছিলো। তাই সেটাকে সনাক্ত করতে বেগ পেতে হলো না ওকে। রাজিব মটোরসাইকেলটায় হাত রেখে সারোয়ার সাহেবকে বললো-
: ” হ্যা, এটাই সেই দিনের সেই বাইক, খয়েরী রঙের
হিরো স্প্লেন্ডার, হান্ড্রেড সিসির বাইক” -কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো রাজিব। উত্তেজনা প্রকাশ পেলো ওর বলার ভঙ্গিতে। যেন বাইক না, খুঁজে পেয়েছে বিশ লক্ষ টাকার হদিস। এরপর সারোয়ার সাহেব ওদেরক ভিতরে আটক করা ব্যাক্তির সামনে নিয়ে গেলেন। তিনি এ বাইকের মালিক।

লোকটাকে আপাদমস্তক দেখলো রাজিব। পুরোদস্তুর ভদ্র চেহারার লোক। দেখে মনেই হয় না এর পক্ষে এ কাজ সম্ভব। লোকটা মীরার দিকে এক পলক তাকিয়েই সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো রাজিব। যে লোক একজন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না, সে ছিনতাই করবে বিশ লক্ষ টাকা? মনে মনে ব্যাপারটা লক্ষ করে ভাবে রাজিব।

লোকটাকে দেখে বুক থেকে পাথর নামে মীরার। এখানে মকবুল কিংবা পাভেল কেওই নেই। সবকিছু প্ল্যান মতো এগুচ্ছে তাহলে। তারা কি কথা বলছে এবার সেদিকে মনোযোগ দিলো মীরা।

লোকটা আত্মপক্ষ সমর্থন করছেন, বলছেন যে তার মোটরসাইকেল গত পরশু সন্ধ্যায় চুরি হয়েছিলো। সেদিন রাতেই তিনি তার লোকাল থানার বাইক মিসিং নিয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি করেছেন। সেটার কপিও তার কাছে রয়েছে। এখানে আসার আগে সেটা সাথে করে নিয়ে এসেছেন তিনি। সাব ইন্সপেক্টর সারোয়ার তা দেখেছেন এবং ঐ থানায় যোগাযোগ ও করেছেন। ঘটনা সত্যি, গত পরশু রাত সাড়ে দশটায় ঐ থানায় জিডি এন্ট্রি হয়েছিল। তবুও সম্ভব্য সকল ক্লু যাচাই করতে চান তিনি। জিজ্ঞেস করেন-
: ” দেখেন তো মি: রাজিব, উনাকে চিনতে পারেন কিনা?”
ভদ্রলোকের চোখে-মুখে লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানের মিশ্রত একটা ভাব ফুটে উঠেছে। রাজিব তাকে একপলক দেখে, সারোয়ার সাহেবকে বলেন-
: ” সেদিনের ঘটনার দুজনের কারোরই সাথেই এ ভদ্রলোকের চেহারায় কিংবা শারীরিক গঠনে কোন সাদৃশ্য নেই” সাব ইন্সপেক্টর সারোয়ারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। তিনি আবারো বলন –
: ” ভালো করে দেখুন”
: ” হুম, দেখেছি”

তিনি এ ফাঁকে কি মনে করে যেন মীরাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। এটা তদন্তের অংশ নাকি কু-দৃষ্টি তা জানে না মীরা। কারন লোকটা মীরার দিকে তাকাতেই মীরা তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মানুষ মিথ্যা বললেও তার চোখ মিথ্যা বলে না। ভয় পাওয়াটা এখানেই।

সারোয়ার সাহেব তাদেরকে টেবিলের দিকে আসতে হাত দিয়ে ইশারা করেন। টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করেন-
: ” আর কিছু মনে পরেছে ওদের ব্যাপারে?”
: ” না, তেমন কিছুই মনে পরার নেই, আমি সবই আপনাকে বলেছি”
সারোয়ার সাহেব রাজিবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন-
: ” সত্যি বলছেন?”
থতমত খেয়ে রাজিব বলে-
: ” হ্যা”

সারোয়ার সাহেব এবার মীরার সাথে একা কথা বলতে চান। মীরার ভীতি হয় কথাটা শুনে। রাজিব উঠে অন্য টেবিলে বসে।

প্রায় দশ মিনিট নানান প্রশ্ন করেন তিনি মীরাকে। ছিনতাইয়ের ব্যাপারে কাওকে সন্দেহ হয় কি না?
রাজিবের বন্ধু মহলের কেও হতে পারে কিনা?
ওর কোন শত্রু আছে কি?
রাজিব সাহেবের জুয়া খেলার অভ্যাস আছে কি না?

মীরা ভদ্রলোকের খেলাটা বুঝেছিলো। তাই দৃঢ় ভাবেই তার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেয় ও। এবং তার শেষ প্রশ্নটা – ” রাজিব সাহেবের জুয়া খেলার অভ্যাস আছে কি না? ” এ সময় মীরা চুপ করে থাকে, ইচ্ছে করেই। তার ইনভেস্টিগেশন অন্য দিকে মুভ করতে। হয়তো তার ঘাঁটাঘাঁটিতে নতুন কিছু বেরিয়ে এলো।

মীরার এই বুদ্ধি প্রবল৷ এ গুনটার শুরু ওদের বর্তমানে থাকার ফ্ল্যাটটা কেনার সময় থেকে। নগদ টাকায় ফ্ল্যাট কেনার পূর্ণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে টাকা লোন করেছিলো মীরা। কারন ব্যাংক লোন দেওয়ার আগে যে খাতে লোনের টাকা ব্যায় হবে তা খতিয়ে দেখে। ফ্ল্যাট কিনবার লোনের ব্যাপারেও তারা রিয়্যাল স্টেট কম্পানির খোঁজ খবর, ফ্ল্যাটের দামের তুলনা, পূর্ববর্তী মালিকানা, কাগজপত্র ইত্যাদি বিষয়ে ইনভেস্টিগেশন করে। ওর ফুপাতো বোন পিয়াসার বর প্রথম ফ্ল্যাট কিনবার সময় ধরা খেয়েছিলো। ভদ্রলোকের কাছে যে ফ্ল্যাট বিক্রি করেছিলো তা এর আগেই বিক্রি করা হয়ে গিয়ে ছিলো অন্য একজনের কাছে । পরে অবশ্য মামলা মোকাদ্দমা করে টাকা তুলতে হয়েছিল। যদিও বেচারা পুরো টাকাটা ফেরত পাননি। সেই থেকে শিক্ষা নিয়ে মীরা ওদের ফ্ল্যাট কিনবার সময় পুরো টাকাটা ওর কাছে ক্যাশ থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিলো। সেই খেলাটাই ও এখানে খেললো। যাদের সাথে ওঠা বসা ওর, জু’য়া বিচিত্র কিছু না। কে জানে তারা এমন কিছু পেলে হয়তো ঘটনাটা উল্টেও যেতে পারে।

মনে মনে ভাবে ” ম’দ, জু’য়া, না’রী, এ তিনটা যে পুরুষকে একসাথে গ্রাস করে সে শেষ” জু’য়ার ব্যাপারটাই জানার বাকী আছে মীরার ওর সম্পর্কে। যদিও ওর শেষ হওয়া না হওয়ায় মীরার কিছু আসে যায় না। মীরা কি করবে তার সিদ্ধান্ত ও নিয়ে নিয়েছে যা অপরিবর্তনীয়। অনেক বার মীরা নিজের চিন্তা, সিদ্ধান্তকে ভাবনার সুতোয় রিফু করেছে। এখন মীরা যখনি একপলে ওর বিবাহিত জীবণের পিছন ফিরে তাকায় দেখে অসংখ্য জোড়াতালি আর রিফুতে ভরতি সেটা। ভাবনার সুতোয় টান পরেছে এখন। যার জন্য একমাত্র দায়ী রাজিবের এই বি’শ্বা’স’ঘা’ত’ক’তা।

সেখান থেকে বেরিয়ে পরে ওরা। পুলিশ ঐ ভদ্রলোককে ও ছেড়ে দেন। রাজিব আসার সময় ভদ্রলোকের সাথে হ্যান্ড-শ্যাক করে। মীরাও দুঃখ প্রকাশ করে তার এমন ভোগান্তির জন্য। লোকটাও ওদের টাকাগুলোর জন্য স্বান্তনা দেয়। শেষে যে যার গন্তব্যে রওনা দেয়।

সেখান থেকে কারখানায় যায় রাজিব, সঙ্গে মীরাও। ওর যা মানসিক অবস্থা কিছু হিসাবপত্র করতে রাজিব মীরাকে কারখানায় যাওয়ার কথা গতকাল রাতেই বলেছিলো। মীরা বলেছিলো যাবে। কারখানায় যাবার আগে ওরা নাশতা করতে জয়কালী মন্দিরের কাছের সুপার হোটেলে ঢুকলো দুজনে। ঠিক কবে ওরা একসাথে বাইরে খেয়েছে মীরা খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তা ভাবছিলো। এমন সময় রাজিব বললো –
: ” এত এত টাকা পয়সা নিয়ে ঘুরাঘুরি করি, কখনো এমন হলো না, আর এবার”
: ” আরেহ্ বাদ দাও, টাকার কথা আর একবার বললে কিন্তু আমি এখন ঝগড়া করবো তোমার সাথে। তুমি জনগনের সেবা করতে জমি, বাড়ি বন্ধক রাখিয়েছো। তোমার সম্মানের কথা ভেবে নিজে জিম্মা হয়ে টাকা এনে দিলাম। তাও তোমার নিজের কাজে না আরেক জনের বিলাসী ফ্ল্যাট কিনায় সাহায্য করতে। এখন তোমার মালেক সাহেব করবে কোন সাহায্য লোন পরিশোধ করতে?”
রাজিব চুপ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। নিরবতার ভাষাকেই বেছে নিলো ও এখন। গুমোট অবস্থার অবসান হলো নাশতা এলো। রুটি, মিক্সড সবজি, গরুর পায়ার নেহারী। সময় নিয়ে নাশতা খেয়ে ওরা রওনা দিলো ওদের কারখানায়।

কারখানায় গিয়ে অফিস ঘরে ঢুকলো ওরা। মীরাকে দেখে ম্যানেজারের মুখ হঠাৎই অন্ধকার হয়ে গেলো। বুঝাই গলো তিনি অসন্তুষ্ট মীরার। চোখে চোখ পরায় তা প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলো মীরা। লোকটা যদিও এখন তিনি অতিশয় বিনয় প্রদর্শনে তার সবটুকু শক্তি খরচা করছেন তা ঢাকতে। তবে তার এই তেলতেলে ভাবটা তার অসৎ থাকাটাকে ঘোষণা করছে নিরবে। ব্যাপারটা চোখে পরার মতো। এটুকু জ্ঞান, মানুষ চেনার ক্ষমতা মীরার এত বছরে হয়েছে। হিসাবপত্রে যে ঘাপলা আছে তা মীরা ঠিকই বুঝে ছিলো গতবারের সাক্ষাতে। কত শ্রম, সময় আর ত্যাগের বিনিয়োগে আজ এই অবস্থানে মীরা ফ্যাশন। অথচ রাজিব তা এই লোকটার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে আজ এখানে তো কাল ওখানে করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রাজিব যদি নিজে খেটে এটাকে দাঁড় করাতো কখনোই এটা করতে পারতো না। এত যত্নে, কষ্টে তৈরী ব্যাবসাটার নিরব ভাঙন টের পাচ্ছে মীরা। কি করবে মীরা এখন? এটাকে সরাবে দুদিন পর তো রাজিব ওকেই সরিয়ে দিবে। এসব কথার যোগ বিয়োগে ব্যাস্ত মীরার সংবিৎ ফিরে একটা ফোন কলে। গ্রাম থেকে রাজিবের মামাতো ভাই পলাশ ফোন করেছেন। কথা বলার এক ফাঁকে ও জানালো পলি গেছে নেপালে ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে, আর আগামী মাসের সাত তারিখে ছোট মামার মেয়ে সাথীর বিয়ে। ছেলে লন্ডন প্রবাসী। বিয়ের পর ওকেও নিয়ে যাবে সাথে করে। কথাটা শুনে মুচকি হাসে মীরা, ফোনটা কানে রেখেই রাজিবের দিকে তাকায় ও।

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫+৩৬

0

প্রিয় ভুল
লোখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

অবশেষে বাড়ি পৌছায় সবাই। শোকেসে তুলে রাখা সব বাসন বের করে ডাইনিং স্পেসে সবাই একসাথে খেতে বসে৷ খাওয়া শেষ সুতা কাটে যে ছটফটে ছেলেটা সে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি উপলক্ষে হঠাৎ খাওয়াইলেন আফা তা তো কইলেন না? কি দুয়া করমু? ”
মলিন হাসি হাসে মীরা বলে-
: ” আমার বাবা মারা গেছেন আজ চারদিন, আমাদের পরিবারে চারদিনর দিন আত্মীয় স্বজনদেরকে খাওয়ানোর নিয়ম আছে। আমার আত্নীয় বলতে তো তোমরাই, এটাকে আমার বাবার চারদিনের খরচ ভাবতে পারো ”

মাজেদা খালার হাতে থাকা পানির জগটা পরে গেলো মীরার কথা শুনে। এ মেয়েটা কি হ্যা, বাপ ম’রছে চারদিন আর এ কথা এখন কয়?

টুম্পাও মীরার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর মীরা ব্যাস্ত সবার থেকে নিজের চোখ লুকাতে। সবার সামনে আবার শেষবারের মতো বাবাকে না দেখতে পারার কষ্টটা পানি হয়ে গড়িয়ে পরে সেই ভয়ে…

কথাটা শুনে পুরো ঘরে যেন নিঃস্তব্ধতা নেমে এলো।
সেখান থেকে মীরা সবাইকে কোক দিতে বলে কি এক বাহানায় বারান্দায় চলে যায়। মাজেদা খালাও ভাঙা জগের টুকরো না পরিষ্কার করেই মীরার পিছু পিছু যায় । গিয়ে দেখে মীরা চোখ মুছছে, মাজেদা খালাকে দেখে হাসার চেষ্টা করে ও। মাজেদা খালা মুখ গম্ভীর করে বলেন-
: ” খালা আপনে কি কন তো?
হাসার চেষ্টা করে মীরা বলে-
: ” কেন খালা?”
: ” আমি তো ভাবি আমরা আপানর অনেক আপন, কিন্তু এত বড় কথাডা লুকায়া গেলেন আমাগোরতে? ক্যান খালা?”
মীরা মুখে হাসি বিস্তৃত করে বলে-
: ” আর কত বলতাম নিজের দুঃখের কথা খালা? কষ্ট তো পিছুই ছাড়ছে না আমার। সুখ কি জিনিস তা আমি ভুলেই গেছি। দুঃখ ভাগ করার যে ব্যাপারটা তা আমার কাছে অন্যকে শাস্তি দেয়া মনে হয়, মানে হয় যাকে বলছি, আমি আমার যন্ত্রণার ভাগ তাকে দিচ্ছি। তাই সব কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। তাছাড়া আর কি-ই বা বলতাম বলেন। বলার মতো কিছু থাকলে তো?
: ” আপনের বাপে মরছে, আর কিছু না পারতাম নামাযে দোয়া তো করতে পারতাম।
: ” খালা কি বলতাম আমি বলেন? বলতাম যে – ” জানেন খালা আজ না আমার বাবা মা’রা গেছেন, সেদিন দুপুরে খবরটা শুনে আমি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম এতদিন পর। সেই যে তপ্ত দুপুরে বেরিয়েছিলাম আমি, রাজিবের হাত ধরে। এত বছর পরে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে গিয়েছিলাম আমি। কেও আমার সাথে কথা বলে নি, কেও না। সবাই আমাকে ঐখানে দেখে বিরক্ত হয়েছিল, এমনকি আমার মা-ও আমাকে দেখা দেননি, আমি আসার খবর শুনে লম্বা একটা ঘোমটা টেনেছেন, পরপুরুষ দেখলে যেমন মা চাচীরা ঘোমটা টানেন তেমন। দৌড়ে ঘর থেকে এসে লা’শে’র খাট আগলে বসে ছিলেন তিনি, আমি যাতে বাবাকে দেখতে না পারি। সকলে আমার সাথে এমন দুর্ব্যাবহার করলো খালা বলার মতো না, তবুও বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম, শেষবারের মতো বাবাকে দেখতে যদি পাই। কিন্তু কেও আমাকে আমার বাবা যে আমার জন্মের খবরে আনন্দে কেঁদে ছিলো, আমাকে যত্ন করে লালন পালন করেছিলো, যে আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেছিলো তাকে দেখতে দিলো না। আমার মা চিৎকার করে সবাইকে বলেছেন আমি নাকি আমার বাবাকে খুন করেছি, আমার জন্যই নাকি তার এ পরিণতি। সবাই আমাকে চলে যেতে বলছিলো কিন্তু আমি তবুও দাঁড়িয়ে ছিলাম একটা বার বাবাকে দেখার আশায়। বাড়িওয়ালী আন্টি মাকে বললেন- ” আপা বড় মেয়ে এসেছে, যা হয়েছে হয়েছে, শেষ বারের মতো বাপটারে দেখতে দিন আপা”
উত্তরে মা বললো-
বাবাকে দেখলে নাকি তার আত্না কষ্ট পাবে, তিনি নাকি সুস্থ থাকতেই বলে গেছেন – “ও যেন আমার লা’শ না দেখতে পায় “। এরপর আমার মা এমন পাগলামি শুরু করলো যে আমার খালামনি আমার হাত টেনে ঘর থেকে বের করে দিলেন। দড়জার ওপাশে দাঁড়িয়ে আমি শুনছিলাম আমার মায়ের আর্তনাদ। আমাকে দেখে তিনি স্বামীর শোক ভুলে আমার দেয়া কষ্টের ফিরিস্তি শুরু করলেন। লাশ আগলে বসেই রইলেন, নিশ্চিত করলেন আমার বাবাকে না দেখতে পারাটা । মা আমার এমনি শোকাতুর যে আমাকে বের করে দেওয়ার পরও বাবার লাশ আগলে বসেই ছিলেন। সবাই বলছে যে চলে গেছে মীরা, এখন ছাড়েন, চলে গেছে ও। কিন্তু তিনি যেন কাওকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
আমি সেদিন বাবাকে দাফন করা পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলাম, যদি কারো একটু মায়া হয়, দেখতে দেয় আমাকে। কিন্তু না আমার সামনে আমার বাবার কবর খোড়া হলো, সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে শরিয়তের সমস্ত বিধান সম্পন্ন করে কবরে নামানো হলো। কবরের প্রথম মাটি দিলো আমার ছোট ভাই।
কবর দেয়া শেষ হলে আমার ছোট ভাই বোন দুজন কবরে কান্নায় লুটিয়ে পরে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমি এসব। নিজেকে তখন অস্পৃশ্য মনে হচ্ছিল। তা না হলে আমি কেন যেতে পারছি না। ওদের মতো আমিও কেন কবরের উপর আছরে পরতে পারছি না। নিজেকে ভীষণ পাপী মনে হচ্ছিল। তা না হলে কেন আমার সাথে এমন হবে”

বলতে বলতে বারান্দার মেঝেতে বসে পরে মীরা। টুম্পা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওকে। মাজেদা খালা মাথায় হাত বুলায়৷ কিন্তু তিনিও জানেন এ যন্ত্রণা মুছবার শক্তি কারো নেই। তবুও মিছে চেষ্টা করেন তিনি।

দুপুরের খাবারের পর নিজ হাতে সবাইকে পায়েস বেড়ে দেয় মীরা। পায়েস খেয়ে বাড়ি চলে যায় সবাই। আজ ওদেরকে ছুটি দিয়েছে মীরা। সবাই চলে গেলে মীরাকে ঘরে যেতে বলেন মাজেদা খালা। এসব না ভেবে শুয়ে রেস্ট নিতে বলেন ওকে। মীরা খাটে শোয়া অবস্থায় বলে- ” খালা এমন কোন সুইচ থাকতো যদি, যা টিপে ভাবনার স্রোত বন্ধ করে দেয়া যেতো, যত দামই হতো, আমি কিনতাম”
টুম্পা মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-
: ” এখন একটু ঘুমান, আপনার অনেক কাজ সামনে, বাবাহীন পরিবারে আপনার কাঁধেই এখন তাদের দায়িত্ব, এ কথা ভুললে চলবে?”
: ” এসব ভেবেই তো চুপ করে আছি আমি, তোর কি মনে হয় আমার এত সাহস যে -রাজিবকে অন্য কারো সাথে যাওয়ার জন্য আমি নিজে ওকে তৈরি করে দিতে পারতাম ? আমি চেয়েছি ও দূরে থাক আমার কাছে, তা না হলে ও আমাকে এই ক্ষতবিক্ষত অবস্থাতেই খুবলে খেতো। আমার বাবা মা’রা গেছেন, তাকে শেষ বারের মতে না দেখতে পারা আমি আমার সামনেই তাকে মাটি দিতে দেখেছি, কতটুকু কষ্ট, শোক আমার ভিতরে? ও কিচ্ছু টের পায় নি আমার দুঃখ কষ্টের। ভিতরে ভিতরে আমি বিধ্বস্ত, ভঙ্গুর, এরি মধ্যে ও আমাকে সেই রাতে ও ঘুমের ঘোরে বিছানায়…..”

টুম্পা ধমকের সুরে চুপ করতে বলে ওকে। মীরা ওর চোখের পাতা বন্ধ করলো টুম্পার আদেশে। কিন্তু ওর চোখ দুটো? সোজা শুয়ে থাকা মীরার দু চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। চোখ দুটোর কাওকে ভয় ডর নেই, ও কাওকেই শুনে না, কারোরই মানে না।

এত কষ্ট একটা মানুষ কিভাবে সইতে পারে? প্রতিষ্ঠিত একজনের সাথে বিয়ে ভেঙে বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করলো রাজিবকে,
অসুস্থতা ভুগেছিলো যখন, মীরা জমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিলো রাজিবকে।
শূন্য পকেটে শুরু করা সংসারের ঘানি একাই বয়েছে মীরা, যার দায়িত্ব ছিলো রাজিবের।
পরিশ্রম, মেধা আর ধৈর্য গুনে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। স্বনামধন্য ব্র্যান্ড তৈরী করেছে, যার পরতে পরতে মীরার ঘাম, পরিশ্রম, মেধা, নির্ঘুম রাত মিশে আছে। এত এতসব অবদান যার তাকে রাজিব পুরস্কৃত করেছে সতীন উপহার দিয়ে৷ হায়রে জীবণ। একটা ভুল সিদ্ধান্ত যে মানুষকে কোন জায়গা থেকে কোথায় নিয়ে যায় তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ হচ্ছে মীরা। একমাত্র খোদা ছাড়া ওট উঠে দাঁড়ানোর সব পথই বন্ধ। নামাযের বিছানায় বসে তাই ভাবে টুম্পা। আল্লাহ সুবাহানাতাআলার কাছে প্রার্থনা – আল্লাহ যেন তার সহায় হন, তাকে এ ঝড় মোকাবেলা শক্তি দেন- আমীন….

রাত তখন একটা, একটু আগে ফোন রেখেছে রাজিব। বেশ সময় নিয়ে কথা বলেছে আজ ও মীরার সাথে। ওর গদগদ ভাব দেখে মীরা মনে মনে ভাবে সামনে হয়তো কোন কাজ হাসিল করার পায়তারা করছে ও। সবকিছু ভেবে কান্না পায় ওর কি করলো ও, মা, বাবা, আবীর, সবার চেহারা এক এক করে ভাসতে থাকে মানসপটে। তারা আজ নীরার এমন দূর্দশা দেখে হাসছে৷ শোয়া থেকে উঠে বসে ও। মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে আস্তে করে বিছানা থেকে উঠে। সোজা চলে যায় বারান্দায়। সেখানে বিছিয়ে রাখা শতরঞ্জিতে বসে ও। বসেই আনমনে তাকিয়ে থাকে ও, আকাশে আজ চাঁদ তারাদের দেখা নেই, মেঘেদের দৌরাত্ম্যে লুকিয়ে পরেছে যেন। ঘন কালো, সাদা মেঘেদের ছুটে ছুটিতে পৃথিবীর আবর্তন বোঝা যাচ্ছে। কতক্ষণ সময় গেলো বোঝা গেলো না। চোখজোড়া আকাশে নিবদ্ধ হলেও মনটা চল গেছে সেই ক’ব’র’স্থানে। যেখানে ওর বাবাকে শুইয়ে রেখে এসেছে সবাই। বাবাকে খুব মনে পরছে মীরার। বাবা মায়ের প্রতি করা অন্যায়, তাদেরকে দেয়া কষ্টের কথা এতদিন ভুলে ছিলো মীরা। নতুন করে মায়ের দেয়া সেসব ফিরিস্তি আবার মনে করিয়ে দিলো সেসব। হঠাৎ একটা কল আসে ওর ফোনে। সাইড থেকে ফোনটা নিয়ে কথা শেষ করে ঘড়িতে তাকায় ও। রাত তখন পৌণে দুইটা। ঘরের দরজা লক করে পার্কিং থেকে ওর স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পরে মীরা। সিকিউরিটি ওকে জিজ্ঞেস করলো-
: ” এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম?”
: ” আমার বাবাকে দেখতে?”
: ” উনি কি অসুস্থ? ”
না শোনার ভান করে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পরে মীরা। লোডশেডিং চলছিলো তখন। অন্ধকার কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে মীরা সামনের দিকে। চারদিকে অন্ধকার হওয়ায় দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটি আলোক বিন্দু ধীরে ধীরে গলির মোড় পেরিয়ে নেমে গেলো বড় রাস্তাটায়।

চলবে..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মেইন রোড ধরে স্কুটি চালিয়ে ঠিক ত্রিশ মিনিটের মধ্যে মীরা পৌঁছে সেই ক’ব’র’স্থানে যেখানে ওর বাবাকে দা’ফ’ন করা হয়েছিলো চারদিন আগে। স্কুটি থেকে নেমে মীরা দেখে পাভেল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। সেই পাভেল যে ওর বন্ধু লিপির কাজিন, যে রাজিবের অসুখের সময়
দাতব্য সংস্থা হতে অর্থ যোগাড় করে দিয়েছিলো। পাভেল মীরাকে স্কুটি থেকে নামতে দেখে ইশারায় কি একটা বলে ভিতরে ঢুকে পরে । মীরা স্কুটিটা সাইড করে ধীর পায়ে যায় ওর পিছু পিছু। মীরা যখন মেইন ফটক পেরিয়ে ক’ব’র’স্থান প্রবেশ করে
দূর থেকে ও দেখে রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা ঘরে ঢুকলো পাভেল, মীরাও ধীর গতিতে হেঁটে কিছু সময় পর ঢুকলো সে ঘরটায়। বিশেষত্বহীন একটা ঘর ছিলো সেটা। পুরো ঘরটাতে গোলাপজল আর আগরবাতির সুভাসে ম-ম করছে। মীরা ঘরে ঢুকতেই গন্ধটা নাকে ধাক্কা লাগে। একটু পর মাথাটা কেমন চক্কর দেয় ওর। কত ভয়ানক কাজ করতে এসেছে ওরা তা হয়তো আগে থেকে হিসেব করে আসে নি এখানে। আবেগের উপর ভর দিয়ে যে কাজটা করেছে তা এখানে এসে টের পেয়েছে মীরা, এতক্ষণ যেন ও জ্ঞান হারা ছিলো। পাভেল বেচারা বাছবিচার না করে আজ্ঞাবহের মতো ওকে সিকিউরিটি দিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে।

ঘরের এক কোণে নিচু চৌকিতে একজন মহিলা নামায পড়ছেন। খুব সম্ভবতঃ তাহাজ্জুদর নামাজ পড়ছেন তিনি। মহিলাকে নামায পড়তে দেখে পাভেল বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। মীরা এ ফাঁকে ঘরটার চারদিকে চোখ বুলায়৷ ঘরটার একপাশের দেয়ালে বেতের একটা রেক রাখা। সেখানে মুর্দা গোসল করাবার বিভিন্ন উপকরণ সাজানো। উপরের তাকে সারি করে রাখা আছে প্যাকেট করা সাবান, আতরের বোতল আর আগরবাতির বাক্স। আরেকটা তাকে কাফনের কাপড়। রেকের পাশের দেয়ালে কিছু প্লাস্টিকের বালতি, মগ, বেলচা আর ঝাড়ু রাখা। বেওয়ারিশ লাশগুলো যখন আসে এখানে সেগুলোকে গোসল করানোর জন্য এ ব্যাবস্থা।

কিছুক্ষণ পর দুজনের কথপোকথন শুনে মীরা। একজন পাভেল তা বুঝলেও অপরজন কে তা বুঝতে পারে না মীরা। কৌতুহলী মীরা উঁকি দিয়ে দেখে বাইরে এক লোকের সাথে কথা বলছে পাভেল। ভদ্রলোক ঢুকে ভিতরের ঘরে গেলেন।ওদেরকে দেখে মহিলা জায়নামাজ ভাঁজ করে রেখে দিলেন। একটু পরে ভদ্রলোক ফিরে এসে বললেন-
: “এদিকে আসুন”
লোকটা ভিতরের বারান্দায় নিয়ে গেলো ওদেরকে। সেখানে দাঁড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললেন-
: ” দেখুন, আপনি আহমেদ সাহেবের ছোট ভাই তাই আপনাকে আসতে বলেছি, অন্য কেও হলে ফোনেই না করে দিতাম। আপনারা কি আর্জি নিয়ে এসেছেন তা কি জানেন ? ”
মীরার দিকে তাকিয়ে কাচুমাচু করে পাভেল, যার অর্থ এর উত্তর আমি জানিনা, তুমি দাও। লোকটা কোন সন্তুষ্ট উত্তর না পেয়ে বলেন-
: ” দেখুন ক’ব’রস্থ করার সাথে সাথেই মৃ’তে’র শরীরে পচন শুরু হয়ে যায়, আপনারা জোর করলে ক’ব’র খুঁড়ে লা’শ দেখাতে বাধ্য আমি, কিন্তু ধর্মীয় বিধিনিষেধ বলে তো কিছু আছে নাকি? এখন যদি এটা করেন আপনারা, কি লাভ হবে তাতে? শুধু শুধু মুর্দাটাকে পেরেশানি করা হবে। তার উপর পচনশীল দেহটাকে দেখে বাজে একটা স্মৃতি বয়ে যাবেন জীবণ ভর। সেটা কি ভালো হবে? মীরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি অবনত রেখে কথাগুলো বললেন তিনি”
মীরা কি বলবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। গত দিনটা পুরোটাই আশায় কেটেছে বাবাকে দেখতে পাবার। সেই আশাটায়ও জল পরলো?” ভেতর থেকে ভদ্রমহিলা এসে বলেন-
: ” মা, ম’র’তে তো একদিন হবেই সবাইকে, যদি শোনেন তো একটা কথা বলি?”
মহিলার দিকে ছলছল চোখে নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে মীরা, সেই চুপ থাকায় কিছু একটা উত্তর খুঁজে নিলেন তিনি। তারপর বললেন-
: ” মৃ’ত লোকটাকে নিয়ে এমন নাড়াঘাঁটা করিয়েন না, তার জন্য দোয়া করেন, নেক-কার সন্তান হন, আল্লাহ যেন তারে বেহেশত নসীব করেন সে প্রার্থনা করেন। এসব করে কি হবে বলেন?”

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মীরা। ভেতর থেকে লোকটা এসে ওদের চুপ থাকা দেখে কবরের সামনে নিয়ে যায় ওদেরকে। মীরা এই প্রথম একক ভাবে কবরটার দখল পেয়ে কান্নায় ভেঙে পরে। পাগলের মতো কাঁদতে থাকে ও বাবার সব স্মৃতি মনে করে। ভদ্রমহিলা মীরাকে শান্ত হতে বলে। ভিতরে যার এত অশান্তি তাকে শান্ত হতে বলা?

কাঁদতে কাঁদতে কবর থেকে এক মুঠো মাটি বেঁধে নেয় ওর হাতের রুমালে । তারপর বসে থাকা মীরা লোকটার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলে-
: ” আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন”
লোকটা টাকাগুলো না নিয়ে বলে-
: ” প্রতিদিন পাঁচ বার নামাজ হয় ওই মসজিদে, প্রতিবার নামাজে সকল মু’র্দা’র জন্য দোয়া করা হয়, এর জন্য আলাদা করে টাকা দেওয়া লাগবে না, একান্তই যদি ইচ্ছে হয় ফিরবার পথে মসজিদের সামনে দানবাক্স পাবেন সেখানে দিয়েন” – বলে লোকটা সালাম দিয়ে চলে যায়।

মীরার কাঁধে হাত রেখে পাভেল বলে সাড়ে তিনটা বাজে মীরা চলো বাড়ি ফিরে যাই। মীরা ধীরে ধীরে উঠে বসে। থুম মেরে বসে থাকে কিছু সময়। তারপর উঠে সোজা ফিরার পথ ধরে। পাভেল এবার পিছু পিছু যায় ওর। এসে দেখে স্কুটির লক খুলছে মীরা। পাভেল বলে-
: ” স্কুটিটা আমিই চালাই, তুমি পেছনে বসো ” পাভেলের গলায় অনুরোধ না আদেশের সুর।

কোন উত্তর না দিয়ে চাবিটা এগিয়ে দেয় পাভেলের দিকে। একটু দূরত্ব রেখে বসে মীরা। কেও কোন কথাই বলে না চলতি পথে, বাড়ি থেকে একটু দূরে স্কুটি থামিয়ে নেমে পরে পাভেল৷ কে দেখলে কি ভাববে এ ভেবে। নেমে গেলেও হেঁটে হেঁটে ওর পিছু যায় পাভেল। দূর থেকে মীরার স্কুটিটাকে ওদের বাড়ির পার্কিং এ ঢুকতে দেখে উল্টো হাঁটা দেয় ও। পকেট থেকে ফোনটা বের করে টেক্সট করে বাড়ির পথে রওনা হয় পাভেল।

চাবি দিয়ে মেইন গেইট খুলে ও যখন ওর ফ্ল্যাটে ঢুকে, চারদিকে তখন ফজরের আজানের ধ্বনি ওঠে। রুমে ঢুকে গোসল করে ফজরের নামায পড়ে মীরা৷ নামাজের বিছানায় বসে দোয়া করতে থাকে বাবার আত্নার শান্তির। আর খোদার কাছে ফরিয়াদ করে এ যন্ত্রণাময় জীবণের অবসানের, আর রাজিবকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার শক্তিটুকু খোদা যেন ওকে দেয়। নিরবে চোখের পানি ফেলে মীরা। কেঁদে সেজদায় লুটিয়ে পরে ও, কেন এমন হলো, কেন ও সবার কথা শুনলোনা, এত অবাধ্য কেন হলো বাবা-মায়ের।

নামাজ শেষ হলেও বেশ কিছু সময় বসে থাকে জায়নামাজে। সেখানে বসা অবস্থাই মেয়ের শরীরে হাত বুলিয়ে মীরা ভাবে-
: “মেয়েটা না থাকলে এক্ষুনি খু’ন করতাম শু’য়’রে’র বাচ্চা রাজিবকে। আজকের আমার যত দুঃখ কষ্ট, তারজন্য দায়ী একমাত্র রাজিব। যার জন্য শুধু সেক্রিফাইজই করে গেলাম সংসার জীবণের বিনিময়ে পেয়েছি ধোঁকা, প্রতারণা, আর যন্ত্রণা।

সারারাত জেগে মীরা, এখন যেন টলতে চুরু করেছে ও। ঘুম যেন ঘিরে ধরে ওকে চারপাশ থেকে। অন্ধকার ঘরে পা টিপে টিপে বিছানায় শোয় ও, পাছে মেয়েটা না জেগে উঠে। বিছনায় শুয়ে সময় দেখতে ফোনটা হাতে নিলে সেখানে ভেসে থাকা ম্যাসেজটা চোখে পরে ও। পাভেলের ম্যাসেজ চল্লিশ মিনিট আগে এসেছে। সেখানে লেখা-
: ” এত দেরি হলো কেন মেইন গেইট খুলতে?
” সিকিউরিটি কি ঘুমিয়ে ছিলো? ”
“আমি গেলাম মীরু ”
পরপর আসা তিনটি ম্যাসেজ। তার মানে মীরার বাড়ি পৌঁছান অব্দি দাঁড়িয়ে ছিলো পাভেল । মীরা ভেবেছিলো স্কুটি থেকে নেমেই চলে গেছে ও । কিন্তু দেরী হয়েছে গেইট খুলতে তা দেখেছে ও, মুচকি হাসে মীরা। যার এমন ক্রেজি বন্ধু থাকে তার জীবনের ষোলো আনাই মিছে এ কথা বলাটা অন্যায়। এই দুনিয়ায় ওই একমাত্র লোক যাকে আঁধার রাতে যে কেন সমস্যায় ডাকা মাত্র এসে হাজির হয়। জীবণ আমার এতটাও মন্দ নয়।

মীরা রিপ্লে ম্যাসেজে লিখা-.
: ” এভাবেই পাশে থাকবে সবসময়, কেমন?”

কি প্রেম প্রেম গন্ধ খুঁজছেন আপনারা?
না ওদের মধ্যে এমন কিছু নেই। পাভেল বিবাহিত, ও বিয়ে করেছে লিপিকে। তিন বন্ধুর এই সার্কেলটি এখনো টিকে আছে মিথ্যে দুনিয়ায়। লিপির তো কিছুই অজানা না, সেই বাড়ি পালানো থেকে শুরু করে রাজিব, রাহাত, টুম্পা তারপর সাথী। মীরা মনে রেখেছে ওরা ওর দুর্দিনে পাশে ছিলো। তাই তো পাভেল যখন বিয়ে করলো মীরা নিজ দায়িত্বে সংসার গুছিয়ে দিয়েছে ওদের। দাতব্য সংস্থার কাজে তো আর সংসার চলবে না, তাই টাকা দিয়ে না বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করে ছোটখাটো একটা ব্যাবসাও ধরিয়ে দিয়েছে ও পাভেলকে। সেই কৃতজ্ঞতা তো আছে। ওরা ভালো বন্ধু এবং এত রাতে ও যে মীরাকে নিয়ে এক জায়গায় গিয়েছে তা লিপিরও অজানা না। মিথ্যে মায়ার দুনিয়ায় এই বন্ধু গুলো ভালো থাকুক। প্রচলিত একটা কথা আছে না – “Do good for others. It will come back to you in unexpected ways ” – কথাটা সত্যি।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙে মীরার। চোখটা মাত্র লেগে এসেছে এমন সময়ই বেল! চারদিকে আলো এখনো ফুটে নি। গায়ের চাদর সরিয়ে সাইড টেবিলে রাখা মোবাইলে দেখে ঘড়িতে সময় এখন ছয়টা পঞ্চাশ। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে গেইটের কাছে গিয়ে ডোর হোলে চোখ রাখে ও। দেখে দরজার ঐ প্রান্তে রাজিব দাঁড়িয়ে। হাতে লাগেজ আর নতুন একটা ব্যাগ কাঁধে। ওকে এত সকালে এখানে দেখে মাথাটাই গরম হয়ে যায় মীরার। গত রাতের বাবার সাথে দেখা শেষ বাড়ি ফিরেছিলো চারটায়, নামায পড়ে বিছানায় গিয়েছিল পাঁচটা দশে। বিছানায় গেলেই কি ঘুম আসে? বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে মেয়েটাও উঠে গেলো। ওকে ফিডিং করিয়ে, ডায়াপার চেঞ্জ করে একটু আগে ঘুমিয়ে ছিলো ও, এই তো একটু আগে আর এখনি উনি এসে হাজির।
এত সকালে আসার কি দরকার ছিলো? সাথীর বাসায় গিয়ে উঠলেই তো হতো। বিরক্তি চেপে দরজা খুলে মীরা । মুখে কপট হাসি এঁকে স্বাগত জানায় রাজিবকে। যেন এতদিন পরে স্বামীর প্রত্যাবর্তনে আহ্লাদিত ও। মীরা অনুযোগের গলায় বললো-
: ” কাল রাতেও তো কথা বললাম, তখন তো বললা না সকালে যে আসছো, এয়ারে এসেছো?”

ঘরে ঢুকে জুতা খুলতে খুলতে বলে-

: ” এয়ারে আসবো না তো কি? ওখান থেকে বাই রোড আসার কি কোন সিস্টেম আছে?” – কথাটা বলও থতমত খেয়ে যায় রাজিব, যেন নিজের কর্মকান্ড নিজেই এক্সপোজ করে দিলো এমন একটা ভীত ভাব ওর চোখেমুখে। নাটুকে মীরাও কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে রাজিবের দিকে, যদিও মনে মনে বলে – ” তা তো আমি জানি সোনা, মালদ্বীপ থেকে এয়ারেই আসা লাগে” মীরা মুখে কিন্তু বললো ভিন্ন কথা, অবাক ভঙ্গিতে বললো-
: ” মানে? আমরা তো বাই রোডেই গেলাম গতবার, বাই রোড যাওয়া কি বন্ধ করে দিলো ইন্ডিয়া? খবরে তো কিছুই বললো না”
: ” আরেহ্ কত কথা বলে, আমার জরুরি কাজ আছে তাই এয়ারে এলাম” চোখ না পড়ে ফেলে সে ভয়ে চোখ সরিয়ে নেয় রাজিব। মীরা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে-
: ” ওহ্, তাই বলো, আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি ঝটপট কিছু একটা তৈরি করে দিই, পরে নাশতা খেয়ো” – বলেই ঘর থেকে বের হতে নেয় মীরা। রাজিব তখনি বলে-
: “না, না কিছু খাবো না, তুমি শুধু এককাপ চা করে দেও”
: ” কেন? বাইরে নাশতা করেছো তোমরা?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মীরা তাকিয়ে যেন জেরা করছে ও
: ” তোমরা মানে?” চোখেমুখে বিষ্ময় রাজিবের।
: ” আরেহ্ মালেক সাহেব না গেলো তোমার সাথে? ”
: ” ওহ্” – দেহে প্রাণ ফিরে যেন ওর এ কথা শুন, ও যে মালেক সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলো ইন্ডিয়ায় তা মীরার মনে থাকলেও নিজেই ভুলে গেছে । মীরা ওর জিনিসপত্র গুছিয়ে একপাশে রেখে চা করতে রান্নাঘরে গেলো। দুধ, চিনি আর চা-পাতা একসাথে দিয়ে চট জলদি চা তৈরী করে নিলো ও। কারন ও জানে ঢং করে, সময় নিয়ে চা তৈরী করার সময় রাজিব দিবে না। গোসল শেষ হতে যদি দেখে চা নিয়ে হাজির হয় নি তাহলে হয়তো ওকে খুঁজতে (পড়ুন চা খুঁজতে) রান্নাঘর অবধি এসে পরবে।

দ্রুত চায়ের কাপ নিয়ে রুমে এসে দেখে রাজিবের গোসল শেষ। ওকে চা দিয়ে মীরা লাগেজ খুলে ময়লা কাপড় বের করতে। কাজের আপা প্রচুর সাবান খরচ করে। তাই ও নিজে কাপড়ে সাবান মেখে রাখে। তাতে সবানও বাঁচে, কাপড়টাও কিছু সময় ভিজে থাকার কারনে ভিতর থেকে ময়লা পরিষ্কার হয়। তাই ওর ময়লা কাপড়গুলো আলাদা করতে লাগেজ খোলে মীরা।

স্বামীর ভাগ নিলেও স্বামীর কাপড় ধোয়া আর পরিচর্যার (যেমন সপ্তাহে একদিন ফেসপ্যাক লাগানো, পেডিকিওর ম্যানিকিওর করা) দায়িত্ব কিন্তু সাথী নেয় নি। এসব করে ধরা খাবে নাকি মীরার হাতে। ভাবতেই লাগেজের ডালা খুলে মীরা। কত কি করতে হয় মানুষকে, অপ্রিয় মানুষকে ভালোবাসার অভিনয়, তার সঙ্গে আহ্লাদিত হওয়ার নাটক, বিছানা ভাগ করে নেয়া আরো কত কি? ময়লা কাপড় গুলো আলাদা করতেই একটা প্যাকেট হাতে পড়ে ওর। কাগজের শক্ত ব্যাগটা খুলে দেখে সেখানে সরু ফিতার কিছু একটা, পরে ব্যাগ হাতিয়ে দেখে নাইট গাউন রাখা, নিচে আরেকটা প্যাকেট। মীরা ব্যাগটা উপুড় করে ধরে ফ্লোরে। মেরুন আর গাঢ় নীল রঙের দুটি নাইট গাউন ছিটকে পরে একসাথে, অন্যপাশে একটা টপস টাইপ ড্রেস। ড্রেসটা খুবই সুন্দর। নাইট গাউনটা হাতে নিয়ে পুলকিত ভঙ্গিতে মীরা বলে
: ” আমার জন্য বুঝি?” – বলেই ট্রায়াল দিতে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মীরা, দেখে সাইজে কেমন হয়। রাজিব তড়িৎ গতিতে ওর কাছে বলে –
: “এখানে তোমার কিছু নেই। এগুলো মালেক সাহেব তার স্ত্রীর জন্য এনেছেন”
রাগান্বিত কন্ঠে মীরা বলে-
: ” মালেক সাহেব তার স্ত্রীর জন্য এনেছেন, তো এটা এখানে কেন? আর বুড়ো লোক তার বৌর জন্য এমন হট জিনিস এনেছেন, তুমি তোমার স্ত্রীর জন্য কি এনেছো?”
: ” আরেহ্ ভুলে এসেছে মনে হয় ” হাত থেকে থাবা দিয়ে সেটা নিয়ে ব্যাগে ভরে ওর কাবার্ডে তুলে রাখলো ব্যাগটা। এসে খাটের সামনে বসে দেখে ওটাতে থাকা টপসটা ফ্লোরে পরে আছে। সেটা তখন দেখে নি ও, সেটা দেখে হাতে তুলে রাজিব। আবার আলমারি খুলে সেখানে রাখা ব্যাগে টপসটা ভরে রাখে সে । মীরার মনটা ছোট হয়ে গেলো ওর এমন আচরণ দেখে। ও খুব ভালো করেই জানে এগুলো সাথীর জন্য আনা, এবং এ-ও জানে এক স্ত্রীর সাথে গিয়ে অন্য জনের জন্য গিফট আনার কথা ভাবাও অন্যায়। তাই হয়তো রাজিবের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মীরার জন্য কিছুই আনা হয় নি। মীরা কাপ হাতে রুম থেকে বেরুতে মনে মনে ভাবে –
: ” আমি না হয় বাদ, মেয়েটার জন্য… ” – পরক্ষণে ভাবে পুরুষরা যখন অন্য নারীর কাছে যায় তখন সে তার পরিবার, সন্তান এদেরকে মনের ঘর থেকে বের করে তার কাছে যায়। মনের ঘরে এদের বাস থাকলে একজন পুরুষ কখনো অন্য নারীতে মজে না।
নিজের প্রতি অবজ্ঞা, অবহলো মেনে নেয়া যায়, কিন্তু সন্তানের প্রতি ? নূহা তো ওরই মেয়ে। ওকে যদি ভালোবাসতো রাজিব! তাহলে অন্ততঃ নিজেকে অবজ্ঞা করার কষ্ট ভুলে থাকতো। কিন্তু নূহাকেও তেমন একটা ভালোবাসে না ও। জন্মের পর পর আলাদা ঘরে থাকতে শুরু করলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বলে। মীরাও মেনে নিয়েছিলো কারন সকল দায়িত্ব যখন ও মাথায় তুলে নিয়েছে। তাহলে ওর মাথাটা ঠান্ডা রাখাটাকে মীরা কর্তব্য ভেবেছে ও। কিন্তু ঘর আলাদা হওয়ার সাথে সাথে মেয়ে-বাবার বন্ধন ও যেন আলাদা হয়ে গেলো। মেয়ের অসুখ বিসুখের খবর নেওয়ার খেয়াল থাকে না রাজিবের, সন্ধ্যায় ডায়াপার আনার কথা বললে রাতের বোল ফেরার সময় ভুলে যায় ও, জামাকাপড় কিংবা সস্তা কোন খেলনাও নিজ থেকে হাতে উঠে নি ওর। মীরা ওর বেখেয়ালি ভাবটাকে জানে তাই গায়ে মাখে নি এতদিন। কিন্তু নতুন একজনকে যখন অন্বেষণ করলো ও দেখলো তার প্রতি রাজিবের যত্নের শেষ নেই। তাকে শপিং এ নিয়ে যাচ্ছে, মুভি দেখছে, দেশ ঘুরছে, ব্যাবসার কথা বলে বিদেশে যাচ্ছে। তখন ওর ইচ্ছার, সময়ের, এনার্জির কোন ঘাটতি পরে না। যত টান পড়ার মীরার কাছে এলেই পড়ে । মীরা কাপ টা সিংকে রেখে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটা দীর্ঘশ্বাস নাকে বাড়ি খেয়ে মিলিয়ে যায় শূন্য। কানে বাজতে থাকে আত্নীয়দের ঐ কথা –
” কি ভুল যে করলি, একদিন ঠিক বুঝবি”
সত্যি কি ভুল যে করেছে ও তার প্রমাণ দিতে রাজিবের এতটুকু ক্লান্তি নেই। চোয়ালটা আকড়ে আসে। যা কান্নার পূর্বলক্ষণ। কল ছেড়ে গতরাতের বাসন পরিষ্কারে মন দেয় মীরা৷ এটেনশন ডায়ভার্ট যাকে বে। কাঁদবে না ও আর। কাল রাতে নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছে ও আর কাঁদবে না ও রাজিবের কোন প্রসঙ্গ নিয়ে।

রাজিব এগারেটা নাগাদ বেরিয়ে গেলে মাজেদা খালা আর টুম্পা নাশতার টেবিলে বসে আলাপ করে মীরা সম্পর্কে। টুম্পা মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” আপনার জন্য কি আনলো আপনার প্রাণের স্বামী মালদ্বীপ থেকে? ”
: ” মজা নিস না টুম্পা”
: ” মজা নিবো না আবার, কি একটা সুযোগ গেলো হাত থেকে, বললাম কাজটা উনি আসার আগেই করে ফলি, আর উনি দিন কাটালেন কেঁদে বুক ভাসিয়ে। শায়েস্তা করবে তো দূরের কথা রাজিবকে তো ঘৃণাই করতে পারলো না এত কিছু জানার পরও। কি বললেন সেদিন-
: “খু’ন করবো, মে’রে ফেলবো ওকে” – এসব যে কেবলি ফাঁকা বুলি, তা আর বুঝতে বাকী নেই আমার”

শান্ত চোখে তাকায় মীরা টুম্পার দিকে, বলে-
: ” সব কিছুর উত্তর না হয় সময়ের কাছেই তোলা রইলো” বলে উঠে পরলো মীরা।

টুম্পা মীরার কাথা আর চাহনির মর্ম উদ্ধার করতে পারলো না। রেডি হয়ে প্রতিদিনের মতো কারখানায় চল গেলো। আর মীরা একটা কাগজপত্রের ফাইল নিয়ে বেরিয়ে গেলো একটু পর।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব – ৩৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাজিব সকাল সকাল বাড়ি ফিরেই চা খেয়েই ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি করে। সব মেইন পেপারস্ একটা ফাইলে বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরে । মীরার তখন মন ভালো ছিলো না, তাই এসব দেখা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করেনি অসময় পেপারস্ ঘাঁটাঘাঁটির কারন। কিন্তু হঠাৎ-ই মীরার কেমন অস্বস্তি হয়। ফাইল ঘেঁটে দেখে মেইন পেপারস গুলো সেখানে নেই। তারমানে সাথে করে সেগুলো নিয়ে গেছে ও। মীরা তাই সবগুলো কাগজের জেরক্স কপি একটা ফাইলে নেয়। নাশতা খাওয়া শেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাগজপত্র যাচাই করতে ওর পরিচিত এক উকিলকে দেখাতে যায়। হঠাৎ করে রাজিবের সাকলে কাগজপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করায় টনক নড়ে ও।

যদিও ও জানে যে প্রোপার্টি যা আছে তার ফিফটি-ফিফটি পার্টনার ওরা দুজনে। আসলে সত্যতা কতটুকু তা জানতেই ওর এই যাচাই। মাথায় কাঁঠাল ভেঙে তো কম খেলো না রাজিব। এখন দেখতে গেলো মাথাটা আছে নাকি এটাও খেয়ে ফেলেছে। কাগজপত্র দেখানোর পর সারাদিন ব্যাস্ততায় দরুন বেশ রাতে বাড়ি ফিরলো মীরা। বাসায় ফিরে দেখে রাজিব ইতিমধ্যে এসে পরেছে বাড়িতে। ওকে দেখে মীরা হতভম্ব, ঘড়িতে চোখ বুলায় মীরা। আসলে সময় কত তার হদিস নেই ওর। ঘড়িতে সময় এখন ন’টা। রাত ন’টা ওর বাড়ি ফিরার জন্য বেশ রাত। এত জলদি তো রাজিব বাড়ি ফিরে না সচরাচর, মনে মনে এসব ভাবছে ও। রাজিব টিভিতে খেলা ক্রিকেট দেখছিলো, সোফাতে বসেই মাথা ঘুরিয়ে মীরাকে দেখে রাজিব। দ্রুতই আবার চোখ ফিরায় টিভির পর্দায়৷ সেখানে চেয়েই
গম্ভীর গালয় রাজিব প্রশ্ন করে-
: ” কি ব্যাপার? কোথায় ছিলে তুমি? ”
হাতের ফাইলটা সু-কাবার্ডের পেছনে চালান করে মীরা বলে-
: ” পিয়াসার শরীর অসুস্থ ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, তুমি এত জলদি এসে পরলে?”
: ” কেন সমস্যা হয়ে গেলো?”
হেঁটে ওর সামনে এসে মীরা বলে-
: ” এসব কেমন কথা রাজিব? আমার কি বাইরে কোন কাজ থাকতে পারে না? তুমি যে প্রতিদিন আটটায় কারখানা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও এত দেরি করে বাসায় ফিরো আমি কখনো তোমাকে এভাবে বলি ? হঠাৎ মীরার এমন কড়া কথায় কাজ হয়, তখন রিমোট দিয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করতে করতে রাজিব নরম সুরে বলে-
: “জরুরি কাজ ছিলো বললামই তো সেটা শেষ করেই ফিরে এলাম, এসে দেখি তুমি বাসায় নেই”
: ” ফোন করলে না কেন?”
: ” এমনিই ”

মনে মন মীরা বলে- ” এমনিই? হা’রা’মি একটা”

মীরা ব্যাগপত্র সোফার উপরে রেখে ফ্রেশ হয়। ফ্রেশ হয়ে নূহাকে ফিডিং করায়। তার আগে খালাকে খাবার গুলো গরম করে টেবিলে দিতে বলে। নূহা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পরলো। ও যেন ওর মাকে দেখার অপেক্ষায়ই এতক্ষণ জেগে ছিলো।

রাতের খাবার টুম্পা আর খালা আগেই সেরে ফেলে। আগে মীরা সবসময় রাতের খাবারটা রাজিবের সাথে খেতো । ইদানীং সাথীর যেদিন মর্জি হয় সেদিন একসাথে খায় ওরা। খেতে বসে মীরা জিজ্ঞেস করে-
: “কি জরুরী কাজ ছিলো বললে?”
: ” কিছু টাকার দরকার বুঝলে মীরা, ভাবছি আমাদের বাড়িটা মর্টগেজ রেখে ব্যাংক থেকে লোন নিবো”
: “টাকার দরকার! কেন? সিজনের জন্য তো মালপত্র স্টক করা হয়ে গেছে। কারখানা ভাড়া, স্টাফদের বেতন সবই তো ক্লিয়ার, তার উপর মার্কেটে কত টাকা ডিউ আছে আমাদের। তাহলে? ”
এতকিছুর খবর জানে মীরা তা দেখে একটু অবাকই হয় রাজিব। সেটাকে চেপে রেখে তরল গলায় বলে-
: ” আছে একটা কাজ পরে বলবো তোমায় ”
অন্য সময় হলে কোন উচ্চবাচ্য করতো না মীরা, কিন্তু এখন সময়টা বড় কঠিন। মীরা ফুলকপি আর শিং মাছের তারকরিটা প্লেটে নিতে নিতে বলে-
: ” কি কাজ না বললে আমি লোনের পেপার সাবমিট করতে যাবো না” ঐ জমিটা মীরার নামে সত্যিই রেজিস্ট্রি করা আজ দুপুরেই সেটা নিশ্চিত হয়েছে মীরা। সেই জোড়েই ও কথাটা বলতে পারলো। কারন ওর নামে জমি, লোন নিতে হলে ওকে লাগবে। মীরার এমন কন্ঠের সাথে রাজিবের দেখাদেখি হয় না অনেকদিন। সেই যে সংসার শুরুর দিনগুলোতে কর্তৃত্ব ছিলো ওর, মীরা যেন ক্ষুরধার ছুড়ি ছিলো। তারপর রাজিবের ভালেবাসায় মজে দিনে দিনে তার ধার কমে এসেছে ক্রমশ। ওর দিকে তাকিয়ে রাজিব যেন মূর্তি হয়ে গেছে। তারপর রাজিব আগের চেয়ে আরো তরল সুরে বলে-
: ” টাকাটা খুব দরকার, ঈদের পর তাগাদা তুলে লোন পরিশোধ করে দিবো”
মীরা এবার কিছুটা নরম হয়, ও বলে –
: ” কি এমন দরকার যে আমাকে বলা যাচ্ছে না?”
: ” মালেক সাহেব সস্তায় একটা ফ্ল্যাট পেয়েছে কলাবাগানে। নগদ টাকায় কিনলে বড় এমাউন্টের ডিসকাউন্ট পাবে। তার টাকা কিছু শর্ট পরেছে। কত সময় তার কাছ থেকে নিয়ে চলেছি, এখন বড় মুখ করে চাইলন?”
: ” কত টাকা?”
: ” এই ধরো লাখ বিশেক ”
: ” বিশ লাখ ! ফ্ল্যাটের দাম কত?”
: ” সত্তর লাখ ”
: ” তাদের না নিজের বাড়ি বলেছিলে তুমি?”
এবার বাছাধন থতমত খেতে শুরু করে, খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-
: ” আরে তার স্ত্রী যৌথ পরিবারে আর থাকতে চাচ্ছে না, তাই…”
: ” এই বয়সে তাদেরকে ভীমরতিতে ধরেছে নাকি, দুদিন পর মেয়ে বিয়ে দিবে”
: ” আরেহ্ কি বলো, তাদের মেয়ে তো ছোট, মাত্র ষোলো বছর বয়স”
: ” আমরা যখন বিয়ে করি, আমার বিয়ে তখন ষোলো বছর ছিলে, সে হিসেবে বললাম ”
অনেক আবেগ নিয়ে কথাটা বললো মীরা। কিন্তু রাজিব আবেগের ধার ধারলো না, বললো-
: ” আমি সব কাগজপত্র তৈরী করে রেখেছি, তুমি শুধু কাল সকালে গেলেই হবে”
: ” শেনো রাজিব, পরের উপকার করা ভালে কিন্তু নিজের সব বিলিন করে না, কারখানা ছাড়া সম্পদ বলতে এই বাড়িটাই রয়েছে আমাদের। তার ফ্ল্যাট কিনাটা বিলাসিতা, এমন যদি হতো তার ব্যাবসার লেকসান কিংবা শারিরীক অসুস্থতার জন্য টাকা লাগবে। আমি না বলতাম না, নিজে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতাম তাকে৷ কিন্তু বিলাসিতার জন্য আমাদের একমাত্র সম্পদ মর্টগেজ রাখতে দিবো না আমি”
: ” বড় মুখ করে চেয়েছিলেন টাকাটা”
: ” পারলে দাও অন্য ব্যাবস্থা করে, রাখো তার বড় মুখ” – বলেই প্লেট হাতে রান্নাঘরে চলে যায় মীরা। মীরা এসে দেখে রাজিব পাতে ভাত রেখেই হাত ধুচ্ছে বেসিনে। মীরা দেখে বলে-
: ” খাবার ফেলে উঠে পরলে যে? ”
কোন কিছু না বলেবই আহত চেহারায় রুমে চলে যায় রাজিব। এর বেশি কিছু করার নেই ওর। কারন এসব যে মীরার পরিশ্রম আর রক্ত পানি করা টাকায় কেনা তা এখনো মনে আছে ওর। মীরা হেসে মনে মনে ভীষণ বলে- ” মালেক সাহেবের স্ত্রী, না? তারমানে ফ্ল্যাট কিনবার পায়তারা হচ্ছে নতুন করে? কিন্তু বিকেলে যে ছক তৈরী করে এসেছি তাতে তো তাহলে কিছুটা বদল আনা দরকার” টেবিল পরিস্কার করতে করতে এসব ভাবে মীরা।

রুমে এসে দেখে রাজিব উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। মীরা ঘরের বাতি অফ করে ড্রইং রুমে এসে বসে৷ কি যেন ভাবে ও, তারপর টুম্পার ঘরে গিয়ে নক করে আস্তে করে। টুম্পা দরজা ফাঁক করে মীরাকে দেখে দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। টুম্পা দরজাটা লক করে দেয়। ভিতরে বসে দুজনের কথা হয় অল্প কিছু সময়। আজ বিকেলে পাভেল, টুম্পা, আর মীরা একটা কফি শপে বসেছিলো, লিপি প্রেগন্যান্ট হওয়ায় ওকে আসতে মানা করে মীরা। সেখানে পরবর্তী করনীয় হিসেবে একটা ছক করে ওরা৷ রাজিবের সাথে এখন কথা বলে মনে হচ্ছে ছকটাতে একটু বদল আনতে হবে। মিনিট সাতেক পর রুমে ফিরে যায় মীরা। গিয়ে চুল আঁচড়ায়, হাতে-পায়ে লোশন দিতে দিতে বলে-

: ” রাজিব ঘুমিয়ে গিয়েছো? ”
পাশ ফেরা অবস্থাতেই ও একটা শব্দ করে জানান দেয় ওর জেগে থাকাটাকে। ঘুরে তাকানোটাকেও অপ্রয়েজন মনে করলো ।

: শোন, কাল ব্যাংকে যেতে পারবো না, কাল আমার একটা কাজ আছে ”

কথাটা শুনে তাড়াক করে ঘুরে রাজিব, মীরা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সেটা দেখতে পেলো ঘুরে না তাকিয়েও । রাজিবের চোখে-মুখে হঠাৎ খুশির বান। রাজিব বিছানা থেকে নেমে ওর কাছে এসে বলে-
: ” বাঁচালে আমায়, লজ্জায় পরে যেতাম একেবারে”
মীরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, একটু আগেও রাজিব ঘুরে কথা বলাটা দরকার মনে করে নি, আর এখন মিনিটের ব্যবধানে ওর আচরন বদেলে গেলো। ও এমনি, মীরার চোখে তা ধরা পরে নি এতদিন। কারন অন্ধ বিশ্বাস নামের একটা পট্টি বাঁধা ছিলো ওর চোখে। যা খসে পরেছে এখন।

মীরা ওকে ছাড়িয়ে বলে-
: “হইছে আর ঢং করা লাগবে না ”
বলেই বিছানায় চলে যায় ও। রাজিবও ওর সাথে ইন্টিমেট হতে চেষ্টা করে। শারিরীক অসুখের বাহানায় রাজিবকে দূরে সরিয়ে দেয় ও। রাজিবও বাধ্য ছেলের মতো দূরত্ব রেখে শোয়। কিন্তু এই-সেই গল্প ফাঁদে ফ্লাটের বিবরণ নিয়ে। ফ্ল্যাট যে মালিক সাহেব না ও নিজেই কিনছে তা বেঝা যাচ্ছে ওর কথাবার্তায়।

মীরার ভালো লাগেনা এসব আলাপ। রাজিবকে বলে-
: ” তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, মালিক সাহেব না, ফ্ল্যাট কিনছো তুমি”
কাচুমাচু করে রাজিব বলে-
: ” আরেহ আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো কি-না.. ”
: ” রাজিব মাথা ব্যাথা করছে আমার, কাল শুনি ফ্ল্যাটের গল্প? ”
: “মাথা টিপে দিবো?”
: “নাহ্ থাক, এসবে অভ্যস্ত হতে চাই না”
চাপা কষ্ট নিয়ে মীরা কথাটা বললো তা খেয়াল ই করলো না রাজিব। সরে গিয়ে শুয়ে পরলো।

পরদিন দুপুরে আবার দেখা করে ওরা। পাভেল জিজ্ঞেস করে –
: ” কাজটা তাহলে কবে শুরু করতে চাও? ”
: ” যতদ্রুত সম্ভব, এই নাও টাকা টুম্পাকে নিয়ে সব কেনাকাটা শেষ করে ফেলো। আমি ওদের প্রত্যেকের সাথে কথা বলে এসেছি গতকাল, ওরা যখন ডাকবো তখনি আসতে প্রস্তুত”
: ” তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে কি?” – উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে টুম্পা।
: ” আর দেরি করলে এ বছরে আর সুযোগ হবে না, শুরুতেই ধাক্কা খাবে প্ল্যানটা” – বলে পাভেল।
: ” টাকা পয়সাও তো তেমন নেই আমাদের হাতে” বলে টুম্পা, কারন ও জানে মীরার ক্যাশ ক্যাপিট্যালের খবর।
: ” আল্লাহ ভরসা , তোমরা শুরু করো” – বলে মীরা। এরপর কফি শেষ করে বেরিয়ে পরে ওরা যে যার গন্তব্যে। মীরা এই দুপুরে রিকশা যোগে পৌঁছে যায় বাবার সাথে দেখা করতে…

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৩১+৩২

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার প্রাণের স্বামী মহামতি রাজিব পৌঁছে ফোন করেছিলো ওকে। মীরা নিজের অসুস্থতাকে আড়াল করে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছিলো ওর সাথে ।

যেতে কতক্ষণ লাগলো?
রাতে কিছু খেয়েছে কি-না?
কোথায় উঠেছে?
হোটেলে রুম একা নিয়েছে নাকি ঐ ভদ্রলোকের সাথে রুম শেয়ার করেছে?
এরকম আরো অনেক অসংলগ্ন কথা জিজ্ঞেস করে মীরা পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা প্রমাণে। রাজিবও মুখস্থ পড়ার মতো সব গুলো উত্তর ঠিকঠাক দেয় মীরাকে। সবজান্তা মীরাও মিলিয়ে নেয় উত্তর গুলো।

কথার এক ফাঁকে রাজিব বলে – ব্যাস্ততার জন্য সবসময় কথা বলা যাবে না, সময় সুযোগ বুঝে ও নিজেই কল করবে মীরাকে। মীরার কল করার দরকার নেই। মীরা অনুগত স্ত্রীর মতো বলেছিলো-
: ” কোন সমস্যা নাই, তুমি সময় মতো খাওয়া দাওয়া করো, আর আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখো”
: ” ঠিক আছে ” -রাজিব বলেছিলো। মীরা পরে কি বলেছিলো তা শোনার সময় হয়নি রাজিবের। কিংবা অসুস্থ মেয়েটার খবর নেওয়ারও না।

মীরার সাথে কথা বলায় কত্ত অনাগ্রহ ওর। সময় কত দ্রুত বদলায়। একটা সময় এই রাজিবই রাত জেগে কথা বলতো মীরার সাথে। মীরার পরদিন দুপুরে ঘুমানোর সুযোগ থাকতো। কিন্তু রাজিবের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা কাজ করতে হতো। কত্ত বলতো মীরা-
: ” ফোন রাখো, ঘুমাও তুমি, সকালে কাজে যেতে হবে তোমায়। আমি দিনে ঘুমাতে পারবো তোমার তো সেই সুযোগ নাই”
রাজিব বলতো-
: ” তোমার সাথে কথা বলতে ক্লান্তি আসে না আমার, কথা না বললেই বরং সারাটা দিন এলোমেলো লাগে। দমবন্ধ হয়ে আসে”

এখন বোধহয় উল্টে গেছে সব। মীরার সাথে কথা বললেই বরং দম বন্ধ লাগে রাজিবের। তাইতো ফোনটা রাখতে এত তারাহুরো ওর।

ডিজুস সিম ছিলো দুজনেরই আর সেই সময় রাতে ডিজুস-ডিজুস কল ফ্রী ছিলো। দিনে তেমন কথা হতো দুজনে। সব কথা মনের বাক্সে তোলা থাকতো রাতের অপেক্ষায়। সেই দিন, সেই রাজিব কোথায় গেলো? রক্ত মাংসের খাঁচাটা ওর পাশে থাকে কেবল। ওর ভিতরকার আত্নটা, প্রেমিক মনটা জীবণের দৌড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

হঠাৎ কিছুদিন আগে সিলেট ভ্রমণের দিনগুলোর কথা মীরার মনে পরে। রাত-দুপুরে কি কান্ড টা-ই না করেছিলো রাজিব হোটেল রুমটায় । কাছে পাবার আকুলতা, ছুঁয়ে দেবার তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে থাকতো ও।ঐ সবটাই কি রাজিবের শরীরের ক্ষুধা ছিলো? ওতে কি ভালোবাসা ছিলো না? এসব ভাবতেই মাথা ঝিম ধরে যায়। বসা থেকে আলগোছে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পরে ও। কিছুক্ষণের মধ্যে তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। ভাগ্যিস ঘুম বলে কিছু রয়েছে, ইদানীং ঘুমটাকে বড় ভালেবাসে মীরা। কারন ততটুকু সময়ই কষ্ট ভুলে থাকা হয় ওর। বাকীটা সময় বেতন ভুক্ত কর্মচারীর মতো দায়িত্ব নিয়ে নিয়মিত যন্ত্রণা ভোগ করে ও। এতটুকু ফাঁকি দেবারও জো নেই।

মীরার মাথায় সেলাই হয়েছে চারটা। ঐখানকার চুল টুকু কেটে ফেলায় কেমন যেন অদ্ভুদ দেখাচ্ছে ওকে। ওর মনের অদ্ভুত অবস্থাটার চেহারায় ফুটিয়ে তোলার সবটুকু দায়িত্ব নিয়েছে ঐ ক্ষতটা৷

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর মাজেদা খালা ওকে স্যুপ তৈরি করে দিয়েছেন। সেটা খেয়ে ওষুধ খেয়েছে মীরা বাধ্য মেয়ের মতো। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিয়েছে যে মনে মনে তার আবার অবাধ্যতা কিসে?

কথাগুলো ভেবে আড়ালে কাঁদে মাজেদা খালা। তার ইচ্ছে হয় ঐ মা*গীকে মাছ কাটার মতো টুকরো টুকরো করে কাটে। কিন্তু এটা অলীক ভাবনা ছাড়া কিছুই না। মীরার জন্য তার মনটা খুচখুচ করে। টুম্পা দু-একবার ঘেঁষে ছিলো মাজেদা খালার কাছে। উদ্দেশ্য ঘটনা কি তা জানা। মাজেদা খালা ওকে পাত্তা দেয় নি। আগে থেকেই দেয় না। ওদের দুজনের বনাবনি হয় না। সরল মাজেদা খালা একেক সময় কি সব কথা বলে শুনে টুম্পা হাসলেই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে যান। তাই তাকে সামলে চলে টুম্পা। তবে আজকের ঘটনা অন্য।

রাত বাড়তেই হঠাৎ মাজেদা খালার দরজায় নক করে টুম্পা। তিনি তখন নূহাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। দরজা ফাঁক করে মৃদু কন্ঠে বলে-
: ” আসবো খালা? ”
ওকে দেখে লম্বালম্বি তিনটে ভাঁজ পরলো তার কপালে যা তার বিরক্তির প্রকাশ করছে। এসব পাত্তা না দিয়ে স্মিত হেসে ঘরে ঢুকে টুম্পা তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই ।

পা টাকে ভাঁজ করে বসার জায়গা করে দেয় খালা। খালার পা ভাঁজ করে বসতে জায়গা করে দেয়াটা জানান দিচ্ছে পরিস্থিতি অনুকূল। এটা দেখে টুম্পা তার পায়ের কাছে বসে। এদিক সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: ” খালা এ বাড়িতে আমি যা আপনিও তা-ই, আমদের জন্য মীরাপু অনেক করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার কি হয়েছে জানার জন্য আমার মন অস্থির হয়ে আছে, ঘটনা কি তা কি আমার জানার অধিকার নেই?”

মাজেদা খালা কিছু সময় থুম মেরে বসে থেকে হঠাৎই হাউহাউ করে কেঁদে দেন। অঝোরে পানি পরে তার চোখ দিয়ে৷ টুম্পা অবস্থা বেগতিক দেখে তার কাছে গিয়ে তাকে স্বান্তনা দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলেন। জিজ্ঞেস করে – কি হয়েছে খালা?
উত্তরে তিনি কেবলই কাঁদে।

সরল এ মানুষটা অল্প কয়েক মাসেই ভালোবাসা দিয়ে এ বাড়িতে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে। যার দরুন তাকে তার আগে আসা টুম্পা ও মনে মনে সমীহ করে। আর এই যে কান্না, এটা যেন সেই নিঃস্বার্থ ভালেবাসারই বহিঃপ্রকাশ।

তাকে স্বাভাবিক হতে সময় দেয় টুম্পা। এতদিন দূরে থাকায় মনে মনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় ওর। খালার এত কান্না নিরবে যেন দিয়ে দিচ্ছে মীরাপুর মনের ক্ষয়ক্ষতির প্রমান। কারখানায় যে কিছু হয় নি তা টুম্পা খুব জানে। করন ও ঢাকায় এসেই সোজা কারখানায় চলে গিয়েছিল । শুধু মাত্র রাজিবের অনুপস্থিতি ছাড়া তেমন কিছুরই বদল নেই। সব ঠান্ডা, স্বাভাবিক। কি হলো তাহলে? কেনই বা মাথা ফাটালো মীরাপু, কেনই বা কাঁদছেন খালা৷

বেশ কিছু সময় পর মুখ খুলেন খালা। টুম্পার কাছে লুকানোর কিছুই নেই তা জানপন তিনি। তারা তিনজন যখন একসাথে খেতে বসে তখন খোলামেলা আলোচনা হয় সব ব্যাপারে। তবে রাজিবের বিয়ের ব্যাপারটা বলবে কি না তা বুঝতে পারেন না তিনি। তবে টুম্পার জানবার আকাঙ্খাকে ও উপেক্ষা করতে পারেন না। টুম্পাকে তিনি শুধু বলেন-
: ” অনেক খারাপ কিছু হইছে খালার লগে, তয় আমি তুমারে কইতে পারমু না। খালা নিজেই বলবো নে তোমারে কাল সকালে। আমি পাগল মানুষ কি বলতে কি বলি”
শেষের কথাটা যে তিনি টুম্পাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন তা টুম্পা ঠিক বুঝেছে। টুম্পা তার আরো কাছে গিয়ে বলে-
: ” আপনি না বললেও আমি ঠিক বুঝতে পারছি কত বড় বিপদ ঘনিয়ে এসেছে আপুর জীবণে। আমরা যদি এখনো কথা ছোড়াছুড়ির খেলা খেলতে থাকি তাহলে….”
: ” কথার খেলা না মা, ঘটনাডা হের ব্যাক্তিগত। তিনি তোমারে জানাইতে চান কি না তিনিই জানেন।
আগ বাড়ায়া আমি কিছু কইতে চাই না, তবে এইডা সত্য আমাগো এহন তার পাশে থাকা লাগবো”

এরপর বেশ কিছু সময় কথা হয় দুজনের। এত দেরি করে ঢাকায় ফিরবার কারনও জানায় ও মাজেদা খালাকে৷ টুম্পার ছোট ভাই এক মেয়েকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। তা নিয়ে অনেক হুলুস্থুল হয়েছিল ওদের বাড়িতে। এমন অবস্থায় ওর থাকাটা জরুরি ছিলো । সবকিছু ঠিকঠাক করে আসতেই এত দেরি হলো।

টুম্পা উঠে নিজের ঘরে যেতে নেয় । খাবার দাবাড় সবই পরে আছে টেবিলে। কারোরই ক্ষুধা কিংবা খাওয়ার মন নেই। বিপদে যে মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলো, দিয়েছিলো ভরসার আশ্রয় তার বিপদ দেখে খাবার খাওয়ার মন কিংবা ক্ষুধা থাকার কথা না।

নিজের ঘরে যাওয়ার আগে টুম্পা মীরার ঘরে উঁকি দেয় একবার। দেখে মীরা কেল-বালিশে মুখ গুজে কাঁদছে। ধীর পায়ে মীরার কাছে যায় টুম্পা। খাটের ঐ পাশে গিয়ে ওর কাছ ঘেঁষে বসে। অবাক চোখে দেখে টুম্পা আত্মসম্মান আর দৃঢ়তার পাহাড় মীরা কিভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে ধ্বংসস্তুপের মতো। টুম্পা পেছন থেকে মীরার মাথায় হাত রাখে, ধ্যান ভঙ্গের মতো চমকে পেছন ফিরে মীরা। টুম্পাকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করে ও। টুম্পা বলে-
: ” এত রাত হয়েছে, এখনো ঘুমান নি কেন আপনি?”
: ” আজ সারারাত আমি জেগে থাকবো টুম্পা। আমার শান্তি, ঘুম, সব সাথে করে নিয়ে গেছে রাজিব”
: ” ভাইয়া কি প্রথমবার যাচ্ছে ইন্ডিয়া, এর আগেও তো কতবার গিয়েছে, এতে ঘাবড়ানোর কি আছে? ”
: ” রাজিব ইন্ডিয়া যায় নি, গিয়েছে মালদ্বীপ, সাথীকে সাথে নিয়ে, আর ওকে নিজ হাতে তৈরী করে দিয়েছি আমি”

সাথী নামটা প্রথম বারের মতো শুনলো টুম্পা। কিছু বুঝতে না পেরে চুপ থেকে মীরাকেই সুযেগ দিলো আরো কিছু বলবার। মীরা যেন তা বুঝতে পেরেই আবার বলতে শুরু করলো, ও যেন কলের পুতুল। যন্ত্রনা, কষ্ট,আবেগ, কিছুই যেন নেই সেই কথা বলবার ধরনে। সোজা বসে বাইরের জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মীরা বললো-
: “একটা মেয়ে কতটা অসহায় হলে স্বামীর গোপন প্রণয়ের কথা জেনেও তাকে তৈরী করে, তারই প্রণয়িনীর কাছে পাঠায়, টুম্পা তুই তো দেখেছিস কত কষ্টে গড়া আমার ব্যাবসা, আর এ সংসার। আজ আমি নিঃস্ব রে। আজ আমি এক্কেবারে নিঃস্ব। আমার আমি ছাড়া আর কিছুই নেই আমার”
: ” কি হইছে বলবেন আপু?”
: ” আড়াই বছর আগে রাজিব গোপনে ওর মামাতো বোনকে বিয়ে করেছে, কলাবাগানের একটা ফ্ল্যাটে
ওকে রেখেছে। এখানেই শেষ না, ও আমাকে আমার নিজের কষ্টে গড়া ব্যাবসা থেকে বের করে দিতে বহু আগেই প্ল্যান করে রেখেছে। পুরাতন কর্মচারী বাদ দেয়া, কারখানা বদলানো, জয়েন্ট একাউন্ট ক্লোজ, নতুন জমি ওর নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন, এ-সবই ওর সেই পরিকল্পনার অংশ”
টুম্পা যেন স্তব্ধ হয়ে যায় মীরার মুখে এসব শুনে। কিছু সময় মৌন থেকে অস্ফুটস্বরে বলে-
: ” ভাইয়া কেন করলো এমন? কিভাবে পারলো এমন করতে? ”
: ” তোকে বলা হয়নি, বলার প্রয়োজন হয়নি কখনো তাই- রাজিবকে বিয়ে করার আগে আবীর নামে একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল আমার। বিয়ের পরদিনই আমি পালিয়ে এসেছিলাম রাজিবের কাছে, কাগজে-কলমে বিয়ে ছাড়া কিছুই ছিলো না আমার আর আবীরের মধ্যে। কিন্তু রাজিবের ধারনা আমি ব্যাবহৃত । এত সুন্দর ও কেন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়েকে বৌ হিসেবে মেনে নিয়ে জীবণ পার করে দিবে? তাইতো আনকোরা মেয়েকে বিয়ে করে মনের দুঃখ ঘুচিয়েছে ও”
: ” ছি আপু! কি বলছেন আপনি?
: ” হুম এটাই সত্য”
: ” আবীর! এই আবীর কি সেই আবীর যার সাথে ব্যাংকে আমাদের দেখা হয়েছিল একবার? ”
: ” হুম, ওই সেই আবীর, যার জীবণটাকে নিজ হাতে নষ্ট করেছি আমি, আমার পাপের খাতা অনেক ভারীরে টুম্পা, বাবা-মাকে কষ্ট দিয়েছি, নির্দোষ একটা মানুষকে কষ্ট দিয়েছি, শুধু কষ্ট দিয়েছি কিরে, তার জীবণটাকে ধ্বংস করে দিয়েছি। বেচারা লজ্জায়, ঘৃণায় এক মায়ের এক পুত্র হওয়া সত্ত্বেও আবার বিয়েটাও করতে পারে নি। সমাজ একটা নির্দোষ ছেলেকে বিবাহিতের তকমা লাগিয়ে ছোট চোখে দেখে, এই পাপের শাস্তি কি আমি পাবো না ভেবেছিস? দেখিস না কত্ত ভালো আছি আমি। চারদিক থেকে ধ্বংস ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আমার ধ্বংস অনিবার্য। কেও ঠেকাতে পারবে না এটাকে। কেও না….
: ” চুপ করেন আপু, আর একটা কথাও না।
আপনি ছাড়া রাজিব অচল, ও যদি সব কেড়েও নেয় তাও ঠিক দাঁড়াতে পারবেন আপনি। সব শেষ হয়েছে কিন্তু যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা তো আপনার শেষ হয়ে যায় নি। তাছাড়া এত সহজে কেন তাকে ছেড়ে দিবেন আপনি?

মহাভারতে আছে- যুধিষ্ঠির বনবাস থেকে ফিরে এসে, দুর্যোধনের কাছে মাত্র পাঁচটা গ্রাম চেয়েছিল পাঁচ ভাইয়ের জন্য। উত্তরে দুর্যোধন বলেছিলো- “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী”- এর মানে “সুক্ষ্ম সুচের অগ্রভাগে যতটুকু মাটি আটে, যুদ্ধ ছাড়া ততটুকু মাটিও যুধিষ্ঠিরকে দিবে না দুর্যোধন”

আর আপনি এত কষ্টে গড়া ব্যাবসা, সংসার সব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসে আছেন? এত সহজে হার মেনে নিয়েছেন। খেলা শুরুর আগেই পরাজয় মেনে নিয়েছেন? আমি যে মীরাকে চিনি সে দুর্যোধনের মতো বলিষ্ঠ। এত সহজে হার মানার মানুষ সে না।

কথাটা শুনে টুম্পার দিকে তাকায় মীরা। সে তাকিয়ে থাকায় কিছু একটা ছিলো। কি ছিলো তা জানে না টুম্পা, কারন মীরাকে এরকম ভাবে তাকাতে এর আগে ও দেখেনি কখনো।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখাঃ মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন বেশ সকাল করেই ঘুম থেকে উঠে মীরা। উঠার কিছু পরই মাথায় ভোঁতা একটা যন্ত্রণা অনুভব করে ও। অসুস্থ হওয়ায় ওকে কেও ডেকে তুলে নি, মন আর মাথা দুটোর জন্যই ওর বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু জীবণ ওকে যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে বিশ্রাম বড় উঁচু দরের শব্দ। এখন ওর যুদ্ধ করার সময়, নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। বাড়িতে বসে বিশ্রাম করার মানে হচ্ছে যন্ত্রণার রোমন্থন করা। তাছাড়া এটুকু ক্ষত আর কি, কত্ত ক্ষত বুকে নিয়ে দিব্যি স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে ও আজকাল।

গায়ের চাদরটা সরিয়ে সটান নেমে পরলো মীরা। মন আর শরীর কিন্তু এক কথা বললো না। দাঁড়ানোর সাথে সাথে ঝিম ধরে গেলো মাথায়। ভোতা যন্ত্রণাটা তীক্ষ্ণ হতে থাকলো ক্রমশ। পাত্তা না দিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা দিলো ও, হাঁটার প্রতিটি কদমের সাথে মাথার ক্ষত-স্থানটাতে টান পরতে লাগলো। বাথরুমের বেসিনের আয়নাটা ঘোলা হয়ে গেছে। হঠাৎ মীরার মনে পরে ও রাজিবকে বলেছিলো –
: ” আমার মন মেজাজ, শারীরিক অসুস্থতা বুঝার জন্য বাথরুমে ঢুকে এই আয়নায় তাকাবে”
: ” মানে! ”
: “যেদিন দেখবে এটা নোংরা আর ঘোলা হয়ে আছে তার মানে আমার মন, মেজাজ, শরীর তিনটাই খারাপ ”
: ” এর সাথে মন, মেজাজ, শরীরের সম্পর্ক? ”
: ” তুমি তো জানো আমার পরিস্কারের বাতিক আছে, এটা ঘোলা থাকা মানে আমার মন, মেজাজ, শরীর ভালো নেই”

কথাটা মনে হতে অনেক স্মৃতি মনে পরে মীরার। এ ঘর, এ ঘরের প্রতিটি কোণে কত কত স্মৃতি জমা আছে! আজ তারা যেন মীরাকে সেসব মনে করিয়ে দিয়ে ধিক্কার দেয়। মীরা বাথরুমের দরজা আটকে ওয়াল ক্যাবিনেট খুলে হ্যান্ড ওয়াশের বোতল রিফিল করলো, ওডোনিলের নতুন প্যাক ও রিফিল করলো, ও যেন নিজের মনোযোগটাকে রাজিব নামের দ্বীপ থেকে টেনে এই বাথরুমে নিয়ে এলো। অখন্ড মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলো সব কাজ। তারপর ভাবতে লাগলো আজকের দিনের ওর কর্ম পরিকল্পনা। টুকিটাকি পরিষ্কারের কাজ শেষ করে বাথরুমে সাবধানে মুখ ধোয় ও। রান্নাঘরে গিয়ে সসপ্যানে পানি বসায় চা তৈরির জন্য।

বাসনপত্রের টুংটাং শব্দে মাজেদা খালার ঘুম ভাঙে। ততক্ষণে চা তৈরি করা হয়ে গেছে মীরার। মাজেদা খালা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেন – তিনটা কাপে চা ঠালছে ও। কি অবস্থা শরীরের , কেন এ শরীর নিয়ে এসব করতে এসেছে তার কিছুই জিজ্ঞেস করলো না খালা, টুম্পাকে ডেকে মুখ ধুয়ে টেবিলে এলো চা খেতে। মীরা ততক্ষণে ফুড কনটেইনারের রাখা বাকরখানি সাজিয়ে নিয়েছে প্লেটে। ওদের চা গুলো ঢাকা দিয়ে রেখেছে গ্লাসের ঢাকনা দিয়ে । চোখেমুখে যে দুঃশ্চিতার ছাপ ছিলো গত রাত অবধি এখন তা নেই। যেটুকু অস্বাভাবিকতা চোখেমুখে তা কেবলই অসুস্থতাজনিত ক্লান্তি।

টুম্পা এবং মাজেদা খালা পরপর চেয়ার দুটি টেনে নিয়ে পাশাপাশি বসলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাপ দু’টি তাদের দিকে এগিয়ে দিলো মীরা। এক এক করে যে যার কাপ টেনে নিলো। কাপ আর চামচের নিজেদের মধ্যে টুংটাং শব্দে বলা কথাবার্তা ছাড়া টেবিলে তখন জমাট বাঁধ নিরবতা। বাসাটা বেশ উচুতে হওয়ায় বাইরের কোলাহলের প্রবেশ নিষেধ এখানে। অনেক কিছু বলার এবং শোনার আছে প্রত্যেকের, এক একজনের মাথায় যেন প্রশ্নের ঝাঁপি। কিন্তু নিরবতা কে ভাঙবে তারই অপেক্ষা করছে যেন তারা তিন জনের প্রত্যেকে৷

বেশ কিছু সময় পর জমাট বাঁধা স্তব্ধতা ভাঙার দায়িত্বটা মাজেদা খালা নিজেই নিলেন। তিনি বললেন –
: ” খালা বাজার শ্যাস ট্যাকা দিয়েন বাজারে যাইতে হইবো ”
টুম্পা তাকিয়ে আছেন তার দিকে, আর কথা পেলো না খুঁজে উনি, অসুস্থ মানুষটা কেমন আছে, শরীরের অবস্থা কেমন তা জিজ্ঞেস না করে তিনি বাজারের খবরদারি করছে।

মীরা বললো-
: ” টুম্পা আমার ঘর থেকে পার্সটা নিয়ে আয় তো বুবু”

তীব্র অনিচ্ছা আর বিরক্তি নিয়ে টুম্পা মীরার ঘরে যায় ওর পার্স আনতে। এসে দেখে মীরা মাজেদা খালাকে বাজারের লিস্ট তৈরী করে দিচ্ছে। মীরা বলছে-
: ” বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ আনবেন খালা, যত বড় পান, রুই, কাতলা, আইড়, বোয়াল, যেটা পান, সেটাই আনবেন তবে মাছ হতে হবে সবচেয়ে বড়”
: ” বড় মাছ কেন খালা? মেমান আইবো নি?”
: ” আরে না, বড় বড় মাছ কেটে হাত পরিষ্কার করেন খালা, কখন কোন কাজে লাগে বলা তো যায় না” বলেই কেমন একটা হাসি হাসে মীরা। হাসিটা কেমন যেন চোখে লাগে মাজেদা খালার। অশিক্ষিত খালা জানে না সাহিত্যের ভাষায় এ হাসিকে “অপ্রকৃতস্থ” হাসি বলে। যা পার্স হাতে দাঁড়িয়ে থাকা টুম্পা খেয়াল করে হতবাক হয়ে । মানসিক চাপ, তার উপর মাথার আঘাতে মাথা টাথা নষ্ট হয়ে গেলো নাকি মীরাপুর?

টুম্পার ভাবনাকে বেশীদূর এগুতে দেয় না মীরা। মুখ থেকে সেই হাসিটা মুছে মীরা টুম্পার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বসতে বলে ওকে। টুম্পা ওর চোখ জোড়া মীরার দিকে নিবদ্ধ করেই চেয়ারটাতে বসে। বেখেয়ালে টুম্পার হাত লেগে পানির গ্লাস পরে যায় নিচে। সেটাকে টুম্পা তুলতে গেলে মীরা নিষেধ করে। মীরা নিজে এক একটা টুকরা পিরিচে যত্ন করে তুলে। মাজেদা খালা ঝাড়ু এনে কাঁচের গুড়ে গুলো তুলে নিয়ে রান্নাঘরে রাখা ডাস্টবিনে ফেলে আসে। তারপর আবারও চেয়ার টেনে বসে তিনজন, এবার মুখোমুখি বসেছে তারা। মীরা একদিকে, টুম্পা আর মাজেদা খালা দুজন নিজেদেরববিপরীতে বসেছেন। পাখির চোখে তাদের বসার ধরনাট অনেকটা ত্রিভুজাকৃতির দেখায়৷ তাদেরকে মুখোমুখি বসাতেই যেন গ্লাসটার নিজের এই আত্নত্যাগ।

বেশ সময় নিয়ে নাশতা সারে তারা। তেমন কথা হয় না তাদের। সবাই ব্যাস্ত একে অন্যের মনের গতিবিধি লক্ষ্য করতে।

খালা বাজার শেষে ফিরে আসলে মীরা মেয়েকে গোসল করিয়ে, খাবার খাইয়ে, আদর করে রেডি হয় কারখানায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। টুম্পা আর মীরা একটা রিকশা নিয়ে রওনা দেয়।

আধঘন্টার মধ্যে জ্যাম ঠেলে ওরা পৌঁছে যায় কারখানায়। এতদিন পর কারখানায় গিয়ে মীরার কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে নিজেকে। কর্মচারীদের ছাড়া ছাড়া আচরণে নিজেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ ক্যালেন্ডারের মনে হয়৷ আগের কর্মচারীরা সমীহ করার পাশাপাশি ভালো ও বাসতো মীরাকে। কিন্তু এখনকার সবাইও সমীহ করে তবে ছোঁয়াছুঁয়ির বাড়নে অদৃশ্য দূরত্ব রেখে চলে। মীরার বাবার বয়সী একজন ওকে আপনি বলে সম্বোধন করে। অথচ আগের কারখানার জলিল চাচা ওকে মীরামা বলে ডাকতো। একটু যারা ছোট তারা আপু ডাকতো, আর সমবয়সীরা তুমি করেই বলতো ওকে। ঐ লোকগুলো পরিবারের মতো ছিলো। অফিস রুমে বসে মীরা ভাবে- “ঐ লোকগুলোকে ছাড়িয়ে দেওয়ার সময় চুপ থাকাটা আমার বিরাট ভুল হয়ে গেছে। কলম মুখে দিয়ে কি যেন ভাবছে ও। কি আর ভাববে বেচারী? পেপার ওয়েটটা ঘুরাতে ঘুরাতে নিজেকে প্রশ্ন করে ও- “আর কত ভুল করবে তুমি মীরা? রাজিবকে তখন তোমার থামানো উচিত ছিলো”

অগত্যা স্বান্তনা দেয় নিজেকে, যা হয়ে গেছে তা ভেবে লাভ নেই, সামনে যাতে আর ভুল না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। অফিস ঘর থেকে ফোন বুকটা ব্যাগে ঢুকায় মীরা। কাজটা করতে গিয়ে নিজেকে চোর চোর লাগে ওর। সেখান থেকে বেরিয়ে সকলের সাথে আলাপ করতে বসে মীরা। একেক জনের কাজ ও দেখিয়ে দেয়। কোন কাজ কিভাবে কম কষ্টে সুন্দর করা যায় তাই শিখায় ওদের। মীরাকে কারখানার মেঝেতে বসতে দেখে অস্বস্তির শেষ নেই ওদের। মীরা যেন কোন পুতুল, একে সাজিয়ে রাখা চলে। মেঝেতে বসানো যায় না।

মীরা ওদের বেতন, বোনাস ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচলা করে। মোটামোটি পুরো কারখানাটার সামারী নিতে চাচ্ছে। কতটুকু পারছে তা জানছে না তবে চেষ্টার নেই।

কারখানার নতুন স্টাফরা দুপুরে বাড়ি যায় লাঞ্চ করতে। মীরা সবাইকে বললো আজ ও নিজে সবাইকে দুপুরে খাওয়াবে। তখন ঘড়িতে বাজে দুপুর সাড়ে এগারোটা। মাজেদা খালাকে বলে সকাল বেলা আনা কাতলা মাছটার পুরোটাতে লবন মেখে কড়া করে ভাজতে। আর বিশজনের আন্দাজে ভাত রান্না করতে। মাজেদা খালার মাথা গরম অবস্থা। বললেই হলো, এতগুলো মানুষের ভাত রাঁধা এত সোজা? এরচেয়ে বরং একশো জনের পোলাও রান্না সহজ। মীরা শুধু বলে-
: ” খালা আপনি পারবেন, এবং খুব ভালো ভাবেই পারবেন” মীরার এ কথায় তার মেজাজ আরো খারাপ হয়। গড়গড় করে কি বলে যেন খালা ফোন কেটে দেয় মীরার মুখের উপর। স্মিত হাসে মীরা ওর মুখের উপর ফোন কেটে দেয়া দেখে।

টুম্পা খালাকে ফোন করে বলে – খালা বসা ভাত বসিয়ে দেন। ভাতের মাড় ফেলার ঝামেলা থাকবে না। আমাদের গাইবান্ধায় আমরা ভাতের মাড় গালি না, বসা ভাত বসাই।
খালা টুম্পাকে বলে-
: ” পন্ডিতি না করে বাসায় আহ জলদি”

মীরা পরে টুম্পাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় খালাকে সাহায্য করতে, টুম্পার সাথে নাজমা নামের এক ষোড়শী ও যায় মীরাদের বাড়িতে।

এই ফাঁকে মীরা ম্যানেজারকে ডেকে কারখানার হিসাবপত্রের খাতা দেখে, কেমন যেন দেখায় ম্যানেজারকে। তিনি সম্ভবত মীরার এমন তদারকি পছন্দ করছেন না। মীরা বেশ সময় নিয়ে খাতা গুলো দেখে ম্যানেজারকে বলে-
: ” ম্যানেজার সাহেব, এখন থেকে প্রতিদিনের হিসাব প্রতিদিন করবেন। কেমন?”
মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি সম্মতি জানান। মীরা বুঝেছে একে চার্জ করে লাভ নেই বরং ঠিল দিয়ে নিজের দিকে আনার চেষ্টা করাই ভালো হবে।

মাজেদা খালা দেড়টার মধ্যে রান্না তো করে ফেলেছে কিন্তু এত খাবার কারখানায় পাঠাবে কি করে? মীরা নিজের আহাম্মকি বুঝতে পেরে সবাইকে বলে তোমরা রিকশা করে আমাদের বাসায় চলে আসো। মুহূর্তেই কারখনায় যেন ইদের খুশি নেমে এলো। রাজিব ওদের সাথে ঠিকঠাক কথাই বলে না, যতটুকুও বলে তাও উঁচু মেজাজে। হয় ধমক, নাহয় গালাগাল। সেদিক বিবেচনায় তাদের বাড়ি গিয়ে খাওয়া তো এদের কাছে অলীক কল্পনা।

প্রতি রিকশায় তিনজন করে পাঠিয়ে মীরা কারখানার সুপারভাইজার শিউলী আপার সাথে এক রিকশায় রওনা করে। প্রথমে তো উঠতেই চান নি তিনি মীরার সাথে। গায়ে ময়লা কাপড়, আর নিজের আর মীরার অবস্থানের ফারাক বিচার করে। কিন্তু মীরা হাত ধরে তাকে রিকশায় তোলেন। সাথে ঘুচিয়ে ূদেয় দুজনকার মধকার দূরত্ব। রিকশায় উঠেছেন তিনি সত্যি তবে সংকোচে যতটুকু সম্ভব নিজের গা বাঁচিয়ে আড়ষ্ট হয় বসে আছেন জড় পদার্থের মতো।

তার আড়ষ্টতা দূর করতে মীরা এই সেই বলে। পরিবারের কথা, ভাইবোন , এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। তবুও মীরার উষ্ণতা যেন শিউলীর আড়ষ্ঠতার দেয়াল ভেদ করতে পারে না। তবুও হাল ছাড়ে না মীরা। কারন ও জানে কারখানায় তার অবস্থা কত দৃঢ়।

অবশেষে বাড়ি পৌছায় সবাই। শোকেসে তুলে রাখা সব বাসন বের করে ডাইনিং স্পেসে সবাই একসাথে খেতে বসে৷ খাওয়া শেষ সুতা কাটে যে ছটফটে ছেলেটা সে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি উপলক্ষে হঠাৎ খাওয়াইলেন আফা তা তো কইলেন না? এত মজার খাওন খাইয়্যা কি দুয়া করমু আমরা ? ”
মলিন হাসি হাসে মীরা বলে-
: ” আমার বাবা মারা গেছেন আজ চারদিন, আমাদের পরিবারে চারদিনর দিন আত্মীয় স্বজনদেরকে খাওয়ানোর নিয়ম আছে। আমার আত্নীয় বলতে তো তোমরাই, এটাকে আমার বাবার
চারদিনের খরচ ভাবতে পারো ”

মাজেদা খালার হাতে থাকা পানির জগটা পরে গেলো মীরার কথা শুনে। এ মেয়েটা কি হ্যা, বাপ ম’রছে চারদিন আর এ কথা এখন কয়?

টুম্পাও মীরার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর মীরা ব্যাস্ত সবার থেকে নিজের দৃষ্টি লুকাতে। সবার সামনে আবার শেষবারের মতো বাবাকে না দেখতে পারার কষ্টটা পানি হয়ে গড়িয়ে না পরে সেই ভয়ে…

চলবে…..

প্রিয় ভুল পর্ব-২৭+২৮+২৯+৩০

0

প্রিয় ভুল
লেখা- মাহবুবা মিতু
পর্ব : ২৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

খুব সকালে বাড়ি ফিরে ওরা। রাজিব একটু ঘুমিয়ে নেয়। ঘুমাবার আগে বলে দশটার দিকে ওকে ডেকে দিতে। মীরা এসে লাগেজের কাপড় বের করা শুরু করে। এটা যত না জমে যাওয়া কাজের তাগাদা তারচে বেশী নিজেকে ব্যাস্ত রাখার বাহানা। বিশাল বালতিতে লাগেজের সব কাপড় সাবান গুলে ভিজায় ও। কল ছেড়ে এক এক করে ধোয় সেগুলো। কাপড় ভেজানো বালতি থেকে এক এক করে কাপড় নামায়। ময়লা জায়গা গুলো ব্রাশ দিয়ে ঘষে ময়লা তুলে। কিছ সময় কেচে পানি দিয়ে ধুয়ে এক এক করে সবগুলো কাপড় ধুয়ে নেয় ও। এত কাপড় ধুতে কতক্ষণ লেগেছিল ওর তা জানে না ও। তবে থমকে যাওয়া সময়ের গতি লব্ধি হয় বাথরুমের দড়জায় টোকা পরার শব্দে, দরজাটা ধোয়া কাপড়ের বালতিতে ভিড়ানো ছিলো। ত্রিশ লিটার পানির বালতিটা ভরে গেছে ধোয়া কাপরের স্তুপে। এখানে বেশীরভাগ কাপড়ই নূহার। ছোট বাচ্চাদের এই এক সমস্যা। প্রচুর কাপড় চোপড় নষ্ট করে এরা।

অনেক কষ্টে দরজা ভিড়িয়ে রাখা বালতিটা সরিয়ে দরজা খুলে দেখে নতুন ছুটা কাজের মেয়ে সুরমা ভীত মুখে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে কেমন বোকা হাসি হাসে মীরা, যেন ওর ধোয়ার জন্য কাপড়গুলো না রেখে নিজে ধুয়ে ফেলায় অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে নিজে । ওর হাসি সেই সেই অন্যায় লাঘবের সামান্য প্রবোধ।

: “আফা কি হইছে আফনের?”
মীরা কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো হাসে। সেখানে দাঁড়িয়ে ও শুনছে রাজিব চিৎকার চেচামেচি করছে। এতক্ষণ ও যেন ঘোরের মধ্যে ছিলো। রাজিবের চিৎকারে ওর চেতনা ফিরে। মীরা মনোযোগ দিয়ে শোনে রাজিবের কথাগুলো।

রাজিবের চিৎকারের সারমর্ম হচ্ছে – দশটায় ডাকার কথা, এগারো টা বেজে গেলো, তবুও কেন ডাকলো না ওকে। ওর ঘুম ভেঙেছে সুরমার আসার কলিং বেলের শব্দে। বাথরুম থেকে দৌড়ে যায় মীরা ঘরে, গিয়ে দেখে রাজিব গোসল করতে বাথরুমে ঢুকেছে। দৌড়ে বাধ্য স্ত্রীর মতে স্বামীর জামাকাপড়, ঘড়ি, মানিব্যাগ সব সামনে বের করে রাখে। জুতার কাবার্ড থেকে জুতা গুলো ও বের।

বাথরুমে থেকে বের হয়ে রাজিব আরেক দফা রাগ ঝাড়ে মীরার উপর। মীরা কেমন বেকা চাহনিতে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ যেন ভীনদেশী ভাষায় কথা বলছে রাজিব যা বোধগম্য হচ্ছে না মীরার। কাপড় চোপড় পড়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় রাজিব ।

ততক্ষণে সুরমা মীরার ধোয়া সব কাপড় পুরো ছাদ জুড়ে মেলে দিয়ে এসেছে। ব্যাবহৃত ক্লিপ টান পরায় রান্না ঘরের কাবার্ড থেকে নতুন দুই পাতা ক্লিপ নামিয়ে নিয়ে গেছে ও।

পুরো বাড়ির ফার্নিচারের ধুলো ঝেড়ে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ঝড়ের গতিতে ঘর মুছে চলে যায় সুরমা। মীরা ভেজা জামা পরেই বসে আছে মেঝেতে।

সুরমা কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার সময় বলে-
: ” যাইগা আফা”
মীরার কোন ভাবান্তর হয় না সুরমার কথায়। দরজা ভেতর থেকে লক করে চলে যায় সুরমা। মীরা যেন একলা হওয়ার অপেক্ষায়ই ছিলো এতক্ষণ ধরে। ঘরের সব জানালা বন্ধ করে ড্রইং রুমের মেঝেতে বসে আয়োজন করে গগন বিদারী চিৎকার শুরু করে মীরা। রাজিবের সদ্য খুলে রেখে যাওয়া টিশার্ট ধরে কান্নায় লুটিয়ে পরে ও। এই প্রথম স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কান্নার সময় পেলো ও। তাই তো কান্নার এত গভীরতা, এত প্রখরতা। কাঁদতে কাঁদতে মীরার মনে পরে সেই সব দিনের কথা, ভুলের কথা। বার বার মনে পরে বাবার শেষ কথাটা, খালা আর আত্মীয়দের করা ভবিষ্যৎ বানীর কথা। কতটা স্বচ্ছ ছিলো তাদের ভাবনা আর কতোটা অন্ধ মীরা। তাই তো সম্পর্কের এতসব ফাঁকফোকর দেখে ও তা মেরামতে ব্যাস্ত রেখেছে নিজেকে। কিন্তু ওর অগোচরে ও যে তৈরী হতে পারে ফাঁকফোকর তা একবারও ভাবতে পারে নি ও।

কি সীমাহীন বিপদ ধেঁয়ে আসছে ওর জীবণের উপকূলে তার আভাস ও পেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যে
বিপদের বুনন অনেক যত্ন করে তৈরী করছে ও নিজেই।

একজন সন্তান বিপদে পরে সবার আগে কার কথা মনে করে? নিশ্চিয়ই বাবা-মায়ের, নিজের পরিবারের, আত্নীয়ের । কিন্তু মীরার এই পথটা মীরা নিজেই চির জীবনের মতো শেষ করে দিয়ে শুরু করেছিলো রাজিবের সাথে পথচলা । নিজের সবটুকু উজার করে ভালবেসে ছিলো রাজিবকে, গড়ে তুলেছিলো নিজেদের ভালো থাকার একমাত্র অবলম্বন ফ্যাশন ব্র্যান্ড “মীরা”। এ নামটাও ভালোবেসে রাজিবের ই দেয়া। ভালেবাসা..!
এ শব্দটার প্রতি কেমন ঘৃণা জন্মে গেছে ওর।

বাবা, মা, ইরা, আর ছোট্ট ভাই নাজিবের কথা আজ খুব মনে পরছে ওর। সবারর চেহারাগুলো চোখে ভাসছে স্লাইডের মতো। চোখ বন্ধ করে তাদের দেখছে মীরা। হাস্যজ্ব্যল একেকটি মানুষ, আর প্রিটি মানুষকে নিয়ে একটি সুখী পরিবার। সত্যিকারের সুখী জীবণের শেষ স্মৃতি দেখতে দেখতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় কখন যেন মেঝেতেই ঘুমিয়ে পরে ক্লান্ত মীরা।

দেড়টার দিকে রান্নার খালা মাজেদা আসে ওদের ফ্ল্যাটে। তার কাছে একটা চাবি থাকে সব সময়। সে চাবি খুলে ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে। বারোটার দিকে আসার কথা ছিলো তার। এখন বাজে দেড়টা। ছেলের সাথে দেখা করতে ছেলের মাদ্রাসায় গিয়েছিল সকালে। আসতে আসতে দেরি করে ফেলেছেন তিনি।

মাজেদা খালা এখন মীরাদের বাসায়ই থাকেন। রান্নার কাজ আর নূহার দেখাশোনা করেন। তার স্বামীর অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয় হওয়ায় মাস ছয়েক আগে মাজেদা খালা অসহায় অবস্থায় সাহায্যের জন্য আসে মীরার কাছে। মীরা সব শুনে এত বছর কেন ছিলো এই বদ লোকটার সাথে, আর কেন তাকে বহু আগেই ছেড়ে চলে আসে নি তাই তাকে গালমন্দ করে নিয়ে আসে ওদের বাড়িতে। সে থেকে এ বাড়ির একজন তিনি।

গেইট খুলে মাজেদা খালা দেখে মীরা মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পরে আছে। দৌড়ে গেইট খুলে মীরার কাছে যান তিনি। নূহা ও ডাকে-
মা…
মা……
মাজেদা খালাও ডাকে মীরাকে। মীরা জেগে মাজেদা খালাকে দেখে হঠাৎ কেমন যেন আবেগী হয়ে আবার কান্না শুরু করে তাকে জড়িয়ে ধরে। মাজেদা খালা জিজ্ঞেস করে-
: ” ও খালা, কান্দেন ক্যান? খালা, কি হইছে, ভাইয়ে কিছু কইছে?

উত্তরে মীরা কেবল কাঁদে আর কাঁদে।
নূহা ওর মাকে কাঁদতে দেখে কেমন ভড়কে যায়। কিছুক্ষণ পর নূহাও কান্না জুড়ে দেয় মাকে পাগলের মতো কাঁদতে দেখে।

নূহাকে শান্ত করান মাজেদা খালা। মীরাকে বলে-
: ” খালা মাইয়্যাডা ভয় পাইতাছে, কান্দন থামান। না কইলে বুঝুম কন দেহি? ও খালা কি হইছে কন না ক্যান? ”

মীরা তখন নূহাকে কোলে নিয়ে আর্তনাদের সুরে বলে –
: ” খালাগো আমার সব শেষ ”
: ” কি হইছে খালা, কি শ্যাষ? ”
: ” নূহার বাবা বিয়ে করছে আজ আড়াই বছর”

মাজেদা খালা যেন বুঝতে পারছে না মীরা কি বলছে। কিংবা নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না তাই নিশ্চিত হতে আবারো জিজ্ঞেস করে মীরাকে-
: ” কি কইলেন খালা?”
: ” খালা আপনি যা শুনছেন তাই বলছি আমি, নূহার বাবা ওর মামাতে বোনকে বিয়ে করছে”

কথার সত্যতা প্রমাণের পর মাজেদা খালা উবু হওয়া থেকে বসে পরলো। মনে হলো যেন মীরার সাথে নড়ে গেছে তার নিজেরও ভিত। মাথায় হাত দিয়ে বললো-
: ” কি কন আপনে এগুলা, যে ভাই আপনেরে এত ভালেবাসে সে এমন একটা কাম কেমনে করলো?
: ” ভালোবাসা না খালা ওটা ওর অভিনায় ছিলো আমাকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার”

বেশ কিছু সময় মৌন মাজেদা খালা। ঘনটার আকস্মিকতা হজম করতে সময় লাগছে তার।
মীরা তখনো কাঁদছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ।

বেশ খানিকটা পর জমাট বাঁধা নিরবতা ভেঙে মাজেদা বলেন-

: “খালা আপনে আমারে আগুনের তে বাঁচাইয়া আপনের ঘরে জায়গা দিছেন। আপনার তো মা-বাপ আত্নীয় স্বজন কেও নাই যার কাছে আপনি যাইবেন। কি করলো এইডা ভাইয়ে? কেমনে করলো? হের বুকটা একটু কাইপ্পা উঠলো না কামডা করার সময়?

থুম মেরে বসে থাকে মীরা সেখানে, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরা নূহাকে মীরার কোল থেকে নিয়ে পাশের সোফায় শুইয়ে দিয়ে আসে মাজেদা খালা। তারপর মীরার কাছে আসেন তিনি, একেবারে সামনাসামনি বসেন। ঘটনার পুরোটা জানতে চান মীরার কাছ থেকে। মীরা একে একে সব বলে – গত ছয় দিনের সব ঘটনা।

মাজেদা খালা নূহার জন্মের সময় মীরার সাথে হসপিটালে ছিলো। দীর্ঘ আটদিন একটানা, একসাথে থাকার ফলে নিজেদের অনেক কথা, গল্পের বিনিময় হয়েছিল সেখানে। সেই সুবাদে মীরার সব ঘটনা জানে মাজেদা খালা। মাজেদা খালাও তার সব বলেছিলো মীরাকে। তাই এসব বলতে কোন দ্বীধা হয় না মীরার। বরং কাওকে কথাগুলো বলতে পেরে হালকা লাগে ওর। সব শুনে তিনি মীরাকে বলেন-

: “খালা আমার জীবণে দেখা সবচেয়ে শক্ত মাইয়্যা হইলেন আপনে। এহন ভাইঙ্গা পরলে কাম চলবো?
আপনেরে আরো শক্ত হইতে হইবে”
: ” স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতারচ্ছি এ পথচালার শুরুর দিন থেকে। আমি আর পারছি না খালা। আমি অনেক ক্লান্ত, চোখ বুজে আসছে আমার ক্লান্তিতে। মনে হচ্ছে জীবণ মৃ’ত্যু’র সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমি”
: ” কতো মানুষরে বাঁচার আশা দেন, সাহস দেন, আর আপনিই এত ভীতু। এই মাইয়্যাডার দিকে তাকায় দেহেন তো? সোফায় ঘুমিয়ে থাকা নূহার দিকে ইঙ্গিত করে খালা।

: “এর কি দোষ? এর তো কোন ভুল নাই। ভুল করছেন আপনারা, ওয় কেন তার ভোগান্তি পায়াইবো?”

নূহার দিকে ফিরে সোফাটা ধরে আবার কাঁদতে শুরু করে ও। যেন সেই সোফাটাই ওর একমাত্র অবলম্বন। কিছুসময় পর মীরা ঘুমন্ত নূহার চুলগুলো মুখ থেকে সরাতে সরাতে বলে-
: ” মারে তোরে আমি পয়মন্ত ভাবছিলাম, তোর উছিলায় তোর বাবা শুধরে গেছে এটাই মেনে বসে ছিলাম আমি। কিন্তু তুই কত্ত দূর্ভাগা। আমার জীবণের এই ঝড়ের প্রভাব তোর জীবণেও পরবে রে মা, এর জন্য আমিই দায়ী, আমি না পারলাম ভালো সন্তান হতে না পারলাম ভালো মা হতে। আমারে তুই ক্ষমা করিস না মা, কোন দিনও ক্ষমা করিস না”

মাজেদা খালাও নিশ্চুপে কেঁদে যান। দুনিয়ায় কত্ত ভাষা, তবুও এই অসীম ধৈর্যের শক্ত মেয়েটাকে স্বান্তনা দেওয়ার কেন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না সে।

চলবে…

প্রিয়_ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ঐ ঘটনা জ্ঞাত হওয়ার পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে মীরা। ইদানীং ওর অগোছালো ভাব, ওর বিহ্বলতা ঠিক যেন খাপ খায় না আগের প্রাণ-শক্তিপূর্ণ মীরার সাথে। যেখানে বসে থাকে বসেই থাকে, খাওয়ার ঠিক নাই, গোসলের ঠিক নাই, বাইরে যায় না, মেয়ের যত্ন করে না। ওকে দেখে মনে হয় ওর অতি প্রিয় কেও মা’রা গেছে। যার বিয়োগের শোক, পুরোনো মধুর স্মৃতি ওকে তাড়িত করছে ক্ষণে ক্ষণে, যা ভুলে স্বাভাবিক হতে পারছে না ও। কিভাবেই বা পারবে এই সেই রাজিব যে ওকে না পাওয়ার ভয়ে আ’ত্ন’হননের পথ বেছে নিয়েছিলো। অনেক গুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে মৃ’ত্যুকে আপন করে নিয়েছিলে মীরাকে হারিয়ে। মীরা অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছিল যখন বাবা-মা কে বোঝাতে তখন বাবা-মায়ের কথা ভেবে সরে আসতে চেয়েছিলো এ সম্পর্ক থেকে। যার ফলাফল ছিলো রাজিবের ঐ আ’ত্ন’হ’ননের চেষ্টা।

লুকিয়ে মীরা হসপিটালে গিয়ে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো-
: ” কেন এমন করেছিলে?”
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আধ ম’রা রাজিব উত্তরে বলেছিলো-
: ” আমি, আমার জীবণ, আমার নিঃশ্বাস তোমার নামে, তুমিই যদি না থাকো তাহলে এ জীবণ দিয়ে কি হবে?”
হসপিটালে বসে রাজিবের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলো মীরা –
: “এর দাম আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মনে রাখবো, বেঁচে থাকতে আমি তুমি ব্যাতিত কাওকে গ্রহণ করবো না”

সে দিনটা মীরার কাছে সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো। টিন সেটের ঐ খুপরি ঘরের দিনগুলোতে কষ্ট যখন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখে ছিলো ওকে। অভাব, এমন দমবন্ধ পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার কষ্ট, স্বামীর অসুস্থতা এসব যখন নিত্য দিনের সঙ্গী ছিলো-
চোখ বন্ধ করে ও কেবল সেই দিনটার কথা ভাবতো। দমবন্ধ ঐ জীবণে মনটা ভরে উঠতো ঠান্ডা এক হাওয়ার দাপটে।

আচ্ছা রাজিব কি ভুলে গেছে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে, ওর চিকিৎসার জন্য যখন অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো তখন এক একটি দিন কিভাবে পার করতো মীরা? কত ছলনা, কত নিচ হতে হয়েছিলো মীরাকে। রাহাতের ব্যাপারটা না হয় ও জানে না আর বাকী সব? বাঁচানোর মালিক খোদা কিন্তু এই যে ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে এখন, এর আয়োজন করতে কেও কিন্তু ওর পাশে ছিলো না সেসব দিন গুলোতে। না ওর বাবা-মা-ভাই-বোন।
আর এই সাথী?
কোথায় ছিলো সে?
সেকি জানে রাজিবের হৃদয়ের ঐ দুটি ফুটা মীরার জোড়া দেয়া? আর রাজিব, এত বদলে গেলো ও, এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো। একটা বার বুক কেঁপে উঠেছিলো ওর? বিয়ের রেজিস্টারে সই করার সময় হাত কেঁপে উঠে নি ওর?

অথচ এই রাজিব যার জন্য এত এত মেয়ে পাগল থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলো বিবাহিত মীরাকে, এ বিষয়ে কথা তুললে রাজিব মীরাকে থামিয়ে দিতো, ভুলে থাকতে বলতো ঐসব কথা। মীরাকে বিয়ে করে ঘর ছাড়া, সমাজ ছাড়া হয়েছিলো। বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করে কত লোকের কটু কথাও কম শুনতে হয়নি ওকে। এটাও কি কম ত্যাগ? তারপরও শক্ত হাতে আগলে ধরেছিল সে মীরাকে। রাহাতের দেয়া এত বড় সুযোগ ও ছেড়ে এসেছিলো ওর কথাকে মূল্যায়ন করতে। ঠিক কবে মীরাকে আগলে রাখার এই বাঁধন আলগা হয়ে গেলো? কবে থেকে বদলে গেলো রাজিব? জানতে খুব ইচ্ছে হয় মীরার। এক একবার মনে হয় ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে এসব। কিন্তু সামলে নেয় আবার নিজেকে। তাই এসব ভুলে থাকতে ওকে মৃ’ত ভাবা ছাড়া উপায় আছে কি।

সত্যি বলতে মীরার ভাবনাটা অনেকটা এমনই, রাজিব নামের মানুষটার প্রাণ বায়ু এখনো উপস্থিত, সে দিব্যি খাচ্ছে, ঘুমুচ্ছে, কাজকর্ম ও করছে ঠিকঠাক। তবুও ওর মনের ছোট্ট ঘর জুড়ে রাজিব নামে যে সত্তা ছিলো তা এখন বিলীন হয়ে গেছে। ওর কাছে রাজিব নামের মানুষটা মৃ’ত’ই।

যারা মীরার ভিতর থেকে গুড়িয়ে যাওয়ার খবর জানে না তারা ওকে এ অবস্থায় দেখে টিপ্পনী কাটে। দ্বিতীয়বার মা হওয়ার আশংকা করে, স্মিত হাসে মীরা। নূহা না থাকলে ঠিক খু’ন করতো ও রাজিবকে। তারপর যদি জেলেও গিয়ে থাকতে হতো কেন আপত্তি থাকতো না ওর। কিন্তু নূহার কারনে এসব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে মীরা। সরে আসে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ভাবনা থেকেও।

মৃত্যু শোকও মন্থর হয়ে আসে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। মীরাও চেষ্টা করছে সব কিছু ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর। মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়া জিনিসটা সহজ না যদিও। যাকে ভুলে থাকবে সে যদি চারপাশে ঘুরঘুর করে সেটা যে কি যন্ত্রণার তা কেও জানে না ভুক্তভোগী ছাড়া। তবে মানিয়ে নেয়াটা সহজ হয়েছে মাজেদা খালার দরুন। তিনি মীরার ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া মনের এক একটি টুকরো খুঁজে খুঁজে দিচ্ছে মীরাকে। মীরাও সেই টুকরো জুড়ে জুড়ে পাজল মিলিয়ে নিচ্ছে। অনেক ভেবেছে ও, রাজিবকে শেষ করে দেয়ার কথাও যে ভাবে নি তা নয়। তবে যা কিছু কেড়ে নিয়েছে রাজিব ওর থেকে, তা না ফিরিয়ে কিছু করবে না ও। ঠান্ডা মাথায় সব করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে ও সব নিয়েছে। মীরাও ভালোবেসেই মে’রে ফেলবে ওকে। তাই রাজিবের সাথে ও স্বাভাবিক থাকে মীরা। আগের মতোই কারখানার খোঁজ নেয়। রাতের খাবারের টেবিলে আলাপ হয় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনে কে জিতবে তা নিয়েও বাজি হয় দুজনে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় সুখি একটা পরিবারের ছবি এটি। মাজেদা খালা মাঝপ মাঝে মীরার এমন আলগা ভাব দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলে। মাঝপ মাঝে সেও বুঝতে পারে না মীরার মনে আসলে কি চলছে।

মাঝে মাঝে ওদের কেনা জমির উপর যে বাড়ি বানাবে ওরা তার নকশা ঠিক করে দুজন মিলে। মীরা কপট ঝগড়া করে কমদামি টাইলস ব্যাবহারের জন্য।

কোন কোন দিন দুজন মিলে বাড়ির বারান্দা কিংবা
ঘরের সিলিং এর ডিজাইন অথবা একটা কিছু ঠিক করে। ইদানীং কেন কোন ব্যাপারে কিছু আলাপ হলে পরদিন এসে তা সংশোধন করিয়ে নেয় রাজিব। মীরার বুঝতে বাকী থাকে না সে সংশোধনের কারন। সাথীর মতামত ও যে ওর কাছে গ্রহণযোগ্য তা প্রমাণের প্রমাণ হিসেবে সংশোধন ফাইলের ছবি তুলে নিয়ে যায় রাজিব। মীরা সব বুঝতে পেরে মুচকি হাসে৷ ও রাজিবকে বাঁধা দেয় না। কারন ও চায় না রাজিব সতর্ক হোক। জেনে যাক যে ও সব জানে। তাই ইদানীং রাজিবের এমন অসংলগ্ন আচরণে মজা পায় মীরা। ন্যাটা মেয়েটার দম আছে বলতে হবে। কেমন পোষ মানিয়েছে বদমেজাজি রাজিবকে।

মীরা সব বুঝেও বুঝে না, দেখেও দেখে না। রাজিবের শরীরের আঁচড়ের দাগ, অন্য পারফিউমের গন্ধ এসব নিয়ে কোন মাথাই ঘামায় না মীরা। তবে রাজিবকে রাখে দৌড়ের উপর। শরীরে আঁচড়ের দাগে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে – কিসের দাগ এটা, ওহ্ নূহার নখ বড় হয়ে গেছে। কেটে দিতেই মনে থাকে না। ভিন্ন পারফিউমের গন্ধ সম্পর্কে কথা ও বলে স্বাভাবিক কন্ঠে। রাজিবকে দিশেহারা করে ও-ই পথ দেখিয়ে দেয়। ইদানীং এ জিনিসটায় খুব মজা পায় মীরা। রাজিবের মুখভঙ্গি তখন হশ দেখার মতো। মীরা মানসিক ভাবে ওকে টর্চার করে। তবে অশান্তি করার সুযোগ থাকলেও করে না। কারন ও জানে কোন রকম অশান্তি মীরার প্ল্যানের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই অনেক সুতো ছাড়ে মীরা, উড়ুক ঘুড়ি ইচ্ছে মতো। সময় হলে তা গুটিয়ে নিবে ও।

তবে আজকাল মীরার সবচেয়ে বেশী কষ্ট হয় রাজিবের সাথে একই খাটে পাশাপাশি শুতে। রাজিবের শরীরের সাথে মীরার শরীরের যখন ছোঁয়া লাগে তখন মীরার গায়ে আগের মতো শিহরণ খেলে না। শরীরের রক্ত গুলো জমে যেতে শুরু করে। কেমন যেন ঘেন্না লাগে ওর, যেন রাজিব অস্পৃশ্য। নোংরা লেগে আছে রাজিবের গায়ে। অন্তরঙ্গ হওয়া তো আরো বিশ্রী ব্যাপার। সেখানে না থাকে কামনা, না থাকে সুখ।

আজ মাথা ব্যাথা, কাল ভাল্লাগছে না, পরদিন ক্লান্তির বাহানা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখে মীরা রাজিবের কাছ থেকে। রাজিব ওকে ঘাটে না তেমন। মীরার সাথে অন্তরঙ্গতার ওভারটাইমের কাজটা থেকে ছুটি পেয়ে সেও যেন শান্তির ঘুম ঘুমোয়। ঐ বাড়ি হয়ে এসে এমনিতেই চোখ বুজে আসে রাজিবের। সারাদিন ধকল তো কম যায় না। একটা সংসার একটা বউ পালতেই কত কষ্ট, এদিকে দু-দুটি সংসার, বউ সামলনো মুখের কথা। তার উপর সাথী ইদানীং খুব প্যারা দিচ্ছে প্রকাশ্যে আসতে চেয়ে। রাজিব কোনমতে ভুলিয়ে ভালিয়ে দিন আর রাত পার করছে। ছোট্ট মেয়ে তো ভোলাতে কোন বেগ পেতে হয় না ওকে। যখনই এ প্রসঙ্গে কথা উঠে রাজিব সাথীকে শপিং করতে টাকা দিয়ে, নতুন কোন রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা বলে ভুলিয়ে দেয়। এত দিক সামলে বাড়ি ফিরে মেয়েকে সময় দিতে হয়। মীরার সাথে আহ্লাদ করা লাগে। বিছানার যে ব্যাপার এটা এখন উপরি পাওনা রাজিবের। নূহা পেটে আসার পর থেকেই মীরার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় চলে রাজিব। বোকা মীরা স্বামীর এই কামের উপোসকে সমুন্নত করেছিলো উচ্চ আসনে। অথচ তার কতো আগেই রাজিব সাথীর সাথে সম্পর্কে ছিলো। এসব ভেবে ঘনিষ্ঠতা যখন একেবারেই এড়াতে পারে না, তখন চোখ ঢেকে রাখে। যেন চোখ ঢাকলেই এড়িয়ে যেতে পারলো ও এসব থেকে।

অনেকের কাছে মীরার এ ব্যাপার গুলে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। তারা বলতে পারে – আরে তোমার স্বামীই কি পৃথিবীতে প্রথম দ্বিতীয় বিয়ে করেছে?
না করে নি। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করতে ধর্মে কোথাও বলে নি। তার উপর রাজিব ওর নিজের গড়া ব্যাবসা থেকে বের করে দিচ্ছে ওকে। যাতে বাকী জীবণ নতজানু হয়ে থাকে মীরা সবকিছু জানার পরও। এত কিছু হওয়ার পরও সব হজম করা সত্যি কি এত সোজা?
সত্যি কি মীরার এসব উদ্বেগ, কষ্ট অতিরঞ্জন?

শ্রান্ত রাজিব ঘুমিয়ে গেলে পাশে শুয়ে মীরা তাকিয়ে থাকে রাজিবের দিকে। এই কি সেই রাজিব?
মনে মনে বলে-
কিভাবে শেষ করবো তোমায়?
ধীরে ধীরে, নাকি একবারেই ?

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৯

বরিশাল থেকে আসার পর মীরা নিয়মিত যোগাযোগ করে মামী শ্বাশুড়ি আর ননদ দেবর দের সাথে। ঐ কটা দিনেই খুব আপন করে নিয়েছিলে ও সবাইকে।
তাই তারা তাদের সংসার, সুখ, দুঃখ সব মীরার সাথে ভাগ করে নিতে দ্বিধা বোধ করে নি। মীরাও বরাবর ধৈর্যশীল মনোযোগী শ্রোতা। এই গুনটা এক নম্বর গুন মানুষের কাছে প্রিয় হবার। কারন সব সময় সব যুগেই মানুষ অপরের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে চায়। নিজের সুখ, দুঃখ, গল্প, কথা শুনাতে ভালোবাসে, ভালোবাসে যে তাকে মনযোগ দেয় তাকেও।

শুধু মামীরাই না, মামারাও ভীষণ ভালোবেসে ফেলে ওকে। হাটে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে কি খেতে পছন্দ, বিয়ের শত ব্যাস্ততায়ও সকাল, বিকাল, চা, নাশতা ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে কি না তার খোঁজ রাখতো। কার থেকে কে বেশী খাওয়াবে, কার থেকে কে বেশী ভালোবাসবে নিরবে একটা প্রতিযোগিতা চলেছে চার ঘরে। খুব ভালোই লেগেছে তাদের এমন সরল ভালোবাসা। ফিরবার সময় প্রত্যেক মামী একটা করে শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন মীরাকে।

এমনকি ওর বড় মামা শ্বশুর যাকে সবাই সামলে চলে তার সাথে ও বেশ শখ্যতা গড়ে উঠে মীরার। অথচ তাকে এখনো এলাকা সুদ্ধ মানুষ ভয় পায়, এই বড় মামা আসছেন শুনলেই নাকি পুরো বাড়ি হয়ে যেতো ভূতের বাড়ি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যদিও এসবের তীব্রতা কমে এসেছে। তবুও সবাই সমীহ করে চলে তাকে। বাকী তিন ভাই ও, মূলত সবাই তারা তাকে সম্মান করে।

এলকার বিচার আচার এখনও তিনিই করেন। তিনি বাড়ির মেয়ে বউদের সাথে কথা বলেন না। সেই মামা মীরার সাথে তার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্প করে। দুঃখ প্রকাশ করে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ছেলেদেরকে পড়াশোনা করাতে না পারায়। কত মানুষের চাকরীর তদবির তিনি করে দেন। অথচ নিজের একটা ছেলেকেও স্কুল পাশ করাতে পারলন না, কোন চাকরীতে ঢুকিয়ে দিতে পারলেন না সেই আক্ষেপ ও প্রকাশ করেন তিনি।

সেঝো মামী মীরার এমন আপন করে নেয়ার দক্ষতা দেখে বলেছিলেন- “তুই তো জাদুকন্নি, মোর খুব ইচ্ছা অয় কোন মায়ের পেডে তোর জন্ম তারে দেখতো, আবার আইলে হেরে লইয়্যা আইবি”

এমন আপন করে নিয়েছিলো যারা তাদের সাথে যেগাযোগ না রাখে কেমনে। তাছাড়া মীরার শ্বশুড়বাড়ির দিকের আত্মীয় বলতে কেবল তাদেরকেই চিনে মীরা। তাই নিয়মিত কথা হয় তাদের সাথে।

বরিশাল থাকতে সব মামীদের সাথেই ভালো সম্পর্ক হয়েছিল মীরার। ছোট মামীর চারটা মেয়ে, ছেলে নেই কোন৷ মামাও অসুস্থ হয়ে বিছানায় বেশ কয় বছর। তাই তিনি মীরাকে বলেছিলেন- ঢাকায় তো মীরার কত জানাশোনা। এত বড় ব্যবসা দেখাশোনা করে ও, তার মেয়েদের জন্য যেন ঢাকায় ভালো পাত্র খুঁজে দেয় মীরা। পরপর দুই বোন বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে, বড় মেয়ে সাথী কে বিয়ে না দিলেই না। মীরা তাকে বলেছিলো-
: “মামী আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সাথীর বিয়ের দায়িত্ব আমি নিলাম, এত সুন্দর ও ইনশাআল্লাহ ভালো ঘর আর ভালো বর খুঁজে দিবো আমি” (মীরা কি তখন জানতো ওর নেয়া দায়িত্ব বছর খানিক আগেই ওর স্বামী পালন করে ফেলেছে)

একে একে সবার সাথে কথা বলে ছোট মামীকে কল করলো যখন তখন তিনি স্মরণ করে দেন ওর নেয়া দায়িত্বের কথা৷ মীরার মনে হয় কথাগুলো বলে দিতে পারতো যদি।

তখন মীরার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে। সত্যি একটা ছেলে ঠিক করবে কি ও সাথীর জন্য। এটা নিয়ে রাজিবকে বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়। মীরার কথা শুনে গলা শুকাক দুজনের। আতংকে কাটুক কিছু দিন।

পরে আবার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে মীরা। হিতে বিপরীত হবে না তো, থলের বিড়ার বেরিয়ে আসবে না তো আবার?

সেদিন দুপুরে সবার সাথে কথা বলে ফোনে রাখার একটু পরেই ফোন করে পিয়াসস। ফোন পেয়ে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দেখায় ওকে। মীরা নূহাকে টুম্পার কাছে রেখে বেরিয়ে পরে।
কোথায় যাচ্ছে কখন ফিরবে কিছুই বলে না ও। টুম্পাও কিছু জিজ্ঞেস করে না। মাঝখানে সন্ধ্যায় একাবর ফোন করলে মীরা বলেছিলো ওর আসতে ঘন্টা খানিক লাগবে। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে মীরা বাড়ি ফিরে রাত দশটাও পরে। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে গেইট খুলে ভিতরে ঢুকে ও। নূহার ঘুম ভাঙার ভয়ে রাতের বেলা কলিংবেলে বাজানো নিষেধ এ বাড়িতে। তাই এই বিকল্প ব্যাবস্থা৷ রুমে ঢুকে গোসল করে মীরা, কিছুনা খেয়ে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দেয় বিছানায়৷ একটু ঘুমের বড্ড দরকার ওর।

সেদিন বেশ রাত করে রাজিব বাসায় এলো । রাত দেড়টা কি দুটো হবে। ঘুমে মগ্ন মীরার উঠতে দেরি হয়। রাজিব প্রচন্ড রেগে যায় দেরি করে গেইট খোলায়। রাজিবের মাথা গরম অবস্থা দেখে ঘুম পালায় মীরার চোখ থেকে। বাড়িতে মাজেদা খালা নেই, তিনি তার বোনের বাড়ি গেছেন অসুস্থ বোনকে দেখতে। রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় রাতে ফিরেন নি তিনি। ফোন করে বলেছেন কাল সকাল সকাল এসে পরবেন। মীরার তাই খেয়াল ছিলো না গেইট খোলার কথা। রাতের বেলা সব সময় তিনিই খোলেন গেইট।

ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে রাজিব, চোখেমুখে রাজ্যের শ্রান্তি। ইদানীং অনেক পেরেশানি যায় ওর। নতুন ডিজাইনার খালি ভুল করে। ডিজাইনের কাজ মীরা ছেড়ে দেওয়ার পর পেরেশানি বেড়েছে রাজিবের। আগে মীরা ডিজাইন বিল্ডআপা, তা স্যাম্পল ম্যানকে বুঝিয়ে দেয়া, ডিজাইনের ড্রেস তৈরি হলে তা সংশোধন সবই করতো যখন তখন। ছুটি, মাপা ওয়ার্কিং আওয়ার এসব ও কখনোই হিসেব করতো না। ভবাতো নিজেদের কাজ। কিন্তু যারা টাকার বিনিময়ে কাজ করে তাদের কেন এত সব দায়। ডিজাইন তৈরীর জন্য টাকা, তা ঠিকঠাক না হলে আবার সংশোধন করার সময় টাকা৷ টাকা কোন বিষয় না রাজিবের কাছে, কাজটার পারফেকশনই এই ব্র্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক।

মীরা সেই দিকের সুতোটাই আলগা করে দিয়েছে। বরিশাল থেকে ফিরে আসার পরপরই। এবার বাছাধন বোঝো মীরা কি জিনিস। রাজিবের শক্তিশালী দিক মার্কেটিং, আর মীরার ডিজাইন এবং ম্যানেজম্যান্ট। রাজিব তো কবে থেকে ওকে সরাতে চাইছে, কিন্তু মীরা ওকে দেওয়া অবসরকে ভালোবাসা ভেবে ওয়ার্ক ফ্রম হোম যখন চালুও হয় নি তারও আগে থেকে ঘরে বসে কাজ করে যাচ্ছিলো। এসব ঘটনা জানার পর নিজেকে ঘুরে দাঁড় করানোর যে কাজ হাতে নিয়েছে মীরা এটা তার একটা অংশ।

গ্লাসে পানি ঢালার শব্দে সংবিৎ ফিরে মীরার। যদিও মীরা জবুথবু হয়ে বসে আছে ওর পাশের চেয়ারে, কিন্তু দুই মনের দুরত্ব এখন পৃথিবীর দীর্ঘ সাগর সমান। ঐ যে বলেছিলো একসময় মীরা ওকে তুমি আমার পাশেই আছো, তবুও তোমাকে ছুঁতে পারছি না আমি। সেই সব দিনে রাজিবের ভেতরকে না ছুঁতে পারার কারন এখন জানে মীরা।

এসব ঘটনা না জানলে এ সময় হয়তো অভিমান করতো ও । কিন্তু এ রাজিবের সাথে “অভিমান” বড়ই বিলাসী শব্দ। কষ্ট পেয়েছে এটা সত্যি কিন্তু এর কোন স্বান্তনা কিংবা মান ভাঙানো এসব আশা করে না মীরা। কিন্তু ওর এতটুকু বোঝা উচিত মেয়েটা অসুস্থ। নূহা অসুস্থ হলে সারাদিন কোলে করে রাখতে হয় ওকে। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম হারাম হয় যায় তখন। সংসারের প্রতি উদাসীন রাজিব শুরু থেকেই। ঘরের টুকটাক কাজ কিংবা বাজার সবসময় হয় ও নিজে করেছে না হলে ম্যানেজারকে দিয়ে করিয়েছে। মেয়ের অসুখ, মাসের বাজার, বিভিন্ন বিল, এসব শব্দের সাথে জানা শোনা রাজিবের আদৌ কোনদিন ছিলো কি না তা ভাবতে পারে না মীরা। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে উঠে রাজিব বল-

: ” আগামীকাল ইন্ডিয়ায় যাচ্ছি আমি, মালেক সাহেব যাবেন, তার সাথে আমিও যাবো তিন-চারদিন থাকবো হয়তো”

মীরা শুনেও না শোনার ভান করে বাসনপত্র গুছিয়ে নেয়৷ সবকিছু গুছানো হলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে দেখে রাজিব ঘুমে বেহুশ। নিজেকে নিজেই স্বান্তনা দেয় মীরা। মনে মনে বলে-
: ” নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কি আছে মীরা, এ আর নতুন কি?”

চোখ বন্ধ করে ভাঙা ঘুমটাকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে ও। ক্লান্তিতে তন্দ্রার মতো একটা আবেশ গ্রাস করে পুরো শরীরকে। হঠাৎ কি মনে করে যেন উঠে বসে মীরা। সাইড টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নেয় ও। ফেসবুকে ঢুকে দ্রুত লগইন করে ওর ফেইক ফেইসবুক একাউন্ট “ব্রোকেন এ্যান্জেল” এ, যেটা দিয়ে “সাথী” কে নিয়মিত ফলো করে মীরা৷ ঢুকে দেখে সাথী শপিং টাইম ক্যাপশনে ছবি পোস্ট করেছে আধ ঘন্টা আগে। ছবি গুলো দেখে অবাক হয় না মীরা। এ আর নতুন কি? কিন্তু শেষের কয়েকটা ছবিতে রাজিবও আছে, তবে তা পাশ থেকে তোলা, মুখ না দেখা গেলেও মীরার একটু বুঝতে বাকী থাকে না যে এটাই সেই রাজিব যার হৃদয় জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলো মীরা কোন একদিন, আর তার বিনিময়ে প্রতিনিয়ত মীরার হৃদয় ভাঙার খেলায় মত্ত সেই রাজিব। যেন মীরার হৃদয় সস্তা কোন খেলনা, চাইলেই ভাঙা যায়, এটা ভাঙা খুব বেশী দোষের কিছু না।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে ছবিগুলো “মালদ্বীপ ট্যুর” নামের এলবামে রাখা। তার মানে কি- ওরা মালদ্বীপ যাচ্ছে কাল? সংসারের কাজকর্ম, অসুস্থ মেয়ের জ্বালা, সাথী সংক্রান্ত মানসিক নিপিড়ন তার সাথে ওদের প্রমোদ ভ্রমণের এই আগাম খবরটা যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হয় মীরার কাছে। অথচ কয়েকদিন আগে গ্রুপ ট্যুরে মানালি যেতে চেয়েছিলো মীরা। রাজিব বলেছিলে সামনে সিজন এবসময় যাওয়াটা ঠিক হবে? মীরা প্রশ্নটার উত্তর নিজই খুঁজে নিয়েছিলো৷ তাই এসব নিয়ে আর কথা বাড়ায় নি । অথচ কাল ওরা যাচ্ছে মালদ্বীপে। ঘুম, ক্লান্তি উড়ে গেছে মীরার কাছ থেকে। অনিদ্রার সাথে মিতালি পাতিয়ে সাইড টেবিলের পাশে বসে এসবই ভাবছিলো মীরা। একটা সময় মীরার ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। রাগ, অভিমান, কষ্ট, ভালেবাসা, কিচ্ছু নেই সেখানে। অনুভূতিহীন মীরা কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে সাইড টেবিলের পাশে, নিজেই জানে না।

ভোরের দিকে রাজিব ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখে মীরা দুই হাঁটুর উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। বাথরুমের কাজ সেরে পাঁজা কোলে মীরাকে খাটে শোয়ায় রাজিব। রাতের ব্যাবহারের জন্য বৌ হয়তো অভিমানে ওখানে বসে আছে- এটাই ভেবে নেয় ও । এ অভিমান দীর্ঘায়িত করা যাবে না ভেবে অভিমান ভাঙানোর জন্য ওর কাছে থাকা একমাত্র ঔষধ প্রয়োগ করে মীরার উপর। অনেকদিন পর রাজিব ভীষণ যত্ন করে কাছে টেনে নেয় মীরাকে৷ ঘুমন্ত মীরার না জাগলেও ওর শরীর জেগে উঠে সেই ডাকে। মীরার অন্তঃসারশূন্য মন সব ভুলে আগের মতো মেতে উঠে আদিম ভালোবাসায়।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ৩০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দীর্ঘ সে রাত শেষে সকালে যখন ঘুম ভাঙে রাজিবের বেষ্টনীতে নিজেকে আবিষ্কার করে মীরা। পর্দার ফাঁক গলে দিনের প্রথম আলো ঢুকে অন্ধকার ঘরটা আলোয় ভরে উঠায় ঘুম ভেঙে গেছে ওর। সাবধানে পাশ ফিরে মীরা, অপলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে রাজিবকে। কি মায়াময় চেহারা রাজিবের! অথচ কি নির্দয় ভাবে শান্তি কেড়ে নিয়েছে ও মীরার। প্রতিনিয়ত অভিনয়ের মোড়কে মুড়ে রেখেছে নিজেকে মীরার কাছ থেকে। ধীরে ধীরে বের করে দিতে চাচ্ছে ওর নিজের গড়া ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। আচ্ছা ওর কি মনে নাই এই যে আজকে মহীরুহ হলো এই ব্যাবসা তাতে মীরার অবদান কতটুকু ছিলো। সেই সব কষ্টের দিনের কথা ভাবলে গা কেঁপে উঠে ওর। সেই সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলতো ওর কাজ। কারখানার শুরু হলো যখন এতগুলো কর্মচারীকে বাজার করে একা হাতে কেটে বেছে রান্না করে খাইয়েছে। ওদের বাসায় গ্যাস থাকত না। তাই ফজরের নামাজের পর রান্নাবান্না শুরু করতো ও। ঘরের কাজ শেষ করে কারখানার কাজে সাহায্য করতো । কোন কাজ না জানা সত্ত্বেও এই কাজ সেই কাজ করেছে। অল্পদিনে শিখেছে মেশিন চালানো। কাজের চাপ বাড়লে দিনরাত এক করে দিতো কাজ করে করে। কর্মচারীদের ছুটি, ওয়ার্কিং আওয়ার ব্যাপারটা ছিলো। কিন্তু মীরার সার্ভিস ছিলো অল টাইম। দিনে গড়ে ঘুমাতো পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা। তবুও নিরলসভাবে কাজ করে যেতো ও, ভাগ্যের চাকা ঘুরবার জন্য। ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে ঠিকই, সাথে সাথে ঘুরে গেছে রাজিব ও।

একটা সময় কত গর্ব হতো ওর – এত সুন্দর স্বামী পেয়ে। কত কত মানুষের ভীড়ে সবাই ওদেরকে দেখতো, কেও কেও বলতো রাজযোটক। মনের আনন্দ গোপন করে এমনি ভাব করতো মীরা যেন -“এ আর এমন কি? এতো ওর পাওনাই ছিলো।

ফেসবুকে ছবি দিলেই লাভ রিয়্যাক্ট আর কমেন্ট বক্স ভরে যেতো সুন্দর সুন্দর মন্তব্যে। কেও কেও বলে- লাভলি কাপল, কেও বলে মেইড ফর ইচ আদারস্, আসলেই কি ওরা লাভলি কাপল? কিংবা মেইড ফর ইচ আদারস্?

ছোটবেলায় অনিন্দ্য সুন্দরী মীরাকে মজার ছলে নানী-দাদী শ্রেণির প্রায় সকলে বলতো- ” এত সুন্দর তুই, তোর কপালে দেখিস কালো বর আছে” নাক সিটকানো মীরা বিরক্ত হতো এসব কথায়। ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবে চাওয়া-পাওয়ার অভিলাষ ওর খুবই সীমিত ছিলো সেই থেকেই । সুন্দর-সুদর্শন একজনকে স্বামী হিসেবে চায় ও, ব্যাস।

এতই একনিষ্ঠ ছিলো সে চাওয়া যে – খোদা ওকে ফিরালেন না। মনের খবরের হেলদোল না থাকা মীরা খুশি কেবল সুদর্শন বর পেয়ে। জীবণ যে শুধু রূপে চলে না, আর সুন্দর হওয়া যে কোন যোগ্যতা না তা কি কখনো ভাবার সময় পেয়েছিলো মীরা? পায় নি হয়তো।

কুচকুচে কালো আবীরের সাথে বিয়ের দিন মীরা মনে মনে শাপ দিয়েছিলো তাদের প্রত্যেককে যারা খুব ছোটবেলায় ওকে বলেছিল – ” তোর কপালে দেখিস কালো বর আছে ”

তারপরের গল্প সবার জানা। গর্ব আর অহংকারে অন্ধ মীরা বুদ হয়ে ছিলো মিছে ভালোবাসায়। ওর গোপন যে অহং ছিলো রাজিবকে নিয়ে তার ভিত পতনের জন্য সাথীর আবির্ভাব হয়েছে ওর জীবণে। আচ্ছা ও যদি এমন অহং বা গর্ব না করতো, দুনিয়ায় থেকে লুকিয়ে রাখতো রাজিবকে, ফেসবুকে ছবি না দিতো তাহলে মনে হয় আল্লাহ এ শাস্তিটা দিতো না। নানান হাবিজাবি ভাবনা ভিড় করে মীরার মনে। ভাবনার অগোছালো ভাব দেখে হেসে দেয় মীরা, এটা হবারই ছিলো। ও নিজের ঘাড়ে দোষ নিচ্ছে রাজিবকে সাধু সাভ্যস্ত করার জন্য। ওর দোষ কি এতে?

হ্যা দোষ একটা আছে মীরার, সেটা হচ্ছে রাজিবকে ও নিরেট ভালোবেসে ছিলো। যে ভালোবাসায় কোন ফাঁকফোকর ছিলো না, ছিলো না অবিশ্বাস। মনে মনে জিজ্ঞেস করে –
“কেন আমার সাথে এমন করলে রাজিব?
আমার অপরাধ কি ছিলো?
চোখ থেকে পানি গড়িয়ে কানে ঢুকে যায় মীরার। কানের পানি মুছে মীরা।

মীরার উপর রাখা রাজিবের হাতটা সাবধানে সরায় ও, তারপর বিছনা থেকে উঠার সময় পেছন থেকে মীরার হাত ধরে রাজিব। ভীত চিত্তে মীরা পিছন ফিরে তাকায়, ওর মনের কথা শুনে ফেলেনি তো রাজিব? বোকা মীরা পিছন ফিরে দেখে রাজিব মুচকি হেসে ওর হাত ধরে এখনি যেতে নিষেধ করছে।

অন্য সময় মীরার কাছে এটা হতো রোমান্টিক কোন মুভি থেকে তুলে আনা মিষ্টি এক দৃশ্য। কিন্তু রাজিবের সবজান্তা মীরা অনেক কষ্টে একটা মুচকি হাসি হেসে রাজিবের – “কিছুক্ষণ আর না’হয় রহিতে কাছে ” – আবেদনটি নাকচ করে নেমে পরে খাট থেকে।

বাথরুমে ঢুকে অনেক সময় নিয়ে গোসল করে ও। শরীরে সাবান মাখতে মাখতে ভাবে- জীবণ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? ও কি গা ভাসিয়ে দিচ্ছে এই প্রতিকূল স্রোতে? নাকি শক্ত হাতে ভেসে থাকছে স্রোত শান্ত হওয়ার অপেক্ষায় ? কি ভেবে যেন দ্রুত গোসল শেষ করে ও।

গোসল শেষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দেখে মীরা। আলো ঝলমলে সকাল এখন, তবুও এ আলো দূর করতে পারছে না ওর মনের অন্ধকার। অনেকক্ষণ কাঁদে মীরা। মনে পরে রাজিবের সাথে ভালোবাসায় ডুব থাকা সেই সব দিন গুলোর কথা। যেই স্মৃতিই ছিলো স্বজনহারা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অবলম্বন, আর রাজিবের ভালোবাসা ছিলো মীরার ভালো থাকার রসদ।

মনে মনে বলো- নিজেকে আরো শক্ত করতে হবে মীরা, ওকে বুঝতে দেয়া যাবে না তুমি সব জানো। তাহলে রাজিব তো গেছে বহু আগেই, বাকী সব যাবে তোমার। মেয়েকে নিয়ে দাঁড়াবার পথ থাকবে না। চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে মীরা। এত ভাঙলে চলবে কেন ওর।

লম্বা করে শ্বাস নেয় ও, যেন প্রকৃতি থেকে
চার্জ শেষ হওয়া মনের ব্যাটারিতে কিছুটা চার্জ নিলো । তারপর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দার রেলিং এ পিঠ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ও। নিশ্বাঃসের সাথে যেন বের করে দেয় ভেতরকার সকল কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা। এরপর মনের গভীরে রাজিবের প্রতি অবশিষ্ট ভালোবাসার উৎস্যমুখ বন্ধ করে দেয় ওরই করা অবহেলায় তৈরী দেয়াল দিয়ে। সেখান থেকে ফিরে রান্নাঘরে গিয়ে নাশতা তৈরী করে মীরা। রাজিবের পছন্দের বউয়া-ভাত আর নানান পদের ভর্তা। অনেক হ্যাপার কাজ এটা জানে মীরা, তবুও মাঝে মাঝে তৈরি করে ও। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচা রসুন, পটলের খোসা, কুমড়োর বিঁচি, কালো জিরা, ইলিশ মাছের কানকো, আর চ্যাপা শুটকির ভর্তা। রাজিবের ঘুম ভাঙে চ্যাপা শুঁটকির গন্ধে। ঘুম থেকে উঠে ও সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। গিয়ে দেখে মীরা চুলোয় শুটকি আর মরিচ, পেয়াজ দিয়ে ব্লেন্ডারে তৈরী করা পেস্ট চুলোয় ভাজছে। রাজিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে –
: ” আহা..! সকাল সকাল এতো কষ্ট করতে গেলে কেন? এমনিতেই রাতে ভালো ঘুম হয় নি তোমার”
উত্তরে মীরা ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি হাসে।
: ” কাল রাতের জন্য সরি”
মুচকি হেসে মীরা বলে-
: ” ঠিক কোন কারনে?”
: ” মানে!”
: ” অনেক কারন জমা হয়ে আছে তোমার সরি হওয়ার জন্য, ঠিক কেন কারনে তুমি সরি, আমি বুঝতে পারছি না”
রাজিব নিশ্চুপ হয়ে যায় মীরার এ কথা শুনে। মীরা গম্ভীর এ পরিস্থিতি উৎরে দিতে হেসে ওকে বলে-
: ” কাল নুহাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো আমাদের, তোমার মনে ছিলো? কি এমন জরুরি কাজে ব্যাস্ত ছিলে তুমি যে আসতে পারলে না?”
: ” আসলে…”
: ” থাক, আসল নকল হিসেব পরে হবে, এখন যাও গোসল শেষ করে জলদি আসো” -বলেই রাজিবকে ঘুরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে তাগাদা দেয় ও। রাজিব চলে যেতেই মীরা ভাবে আসলে যে কি তা জানি আমি রাজিব। তারপর নিজেকে স্বান্তনা দেয়- মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে শপিং-এ যাওয়া বেশী জরুরি যার কাছে, সেখানে আমি কি? আমার জায়গা কোথায়?

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে খাবার গুলো টেবিলে জমা করে মীরা৷ সুন্দর করে সাজিয়ে বাথরুম থেকে ফিরলে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ায় রাজিবকে। মীরা বসে বসে ওর তৃপ্তি করে খাওয়াটা দেখে। খাওয়া শেষে রাজিব বলে-
: ” অনেক দিন পর পেট পুরে খেলাম, ভাল্লাগছে ভীষণ।

খাবারগুলো টেবিলে রেখেই রাজিবকে তৈরী হতে সাহায্য করতে গেলো মীরা। মীরা সব কাজ ফেলে রাজিবের লাগেজ গোছায়। আলমারি থেকে তোলা কাপড় বের করে দেয়। কেডস্, সানগ্লাস, ঘড়ি, সাজিয়ে রাখে। রাজিব বাথরুম থেকে বের হয়ে এসব দেখে বলে-
: “আরেহ্ এসব কি করছো?”
: ” শোন জীবণ ভরে তো হুড়োহুড়ি করে কাজই করলা, এবার দু-একটা দিন এদিক সেদিক ঘুরো”
: ” ঘোরাঘুরির সময় কই?”
মীরা কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। রাজিব কেমন চুপসে যায় সে দৃষ্টির বিপরীতে। মীরা হেসে বলে- এদিকটা না হয় আমিই সামলাবো, তোমার কেন চিন্তা নেই” রাজিব বলে-
: ” আরেহ্ না, তার দরকার নাই, আমি ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছি। তোমার পেরেশানির কেন দরকার নাই, দু’টো মাত্র দিন। তাছাড়া নূহাও অসুস্থ। তুমি ওকে সময় দাও”

হঠাৎ ফোন আসায় ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পরে রাজিব। মীরা এ ফাঁকে কোন টিশার্ট, কেন প্যান্ট পরবে ও তা নিয়ে বেশ কিছু সময় এক্সপেরিমেন্ট চললো রাজিবের উপর, আসল ব্যাপার হচ্ছে কি কথা বলে তা শোনা। ওপাশ থেকে কি বলছে তা শোনা যাচ্ছে না, তবে রাজিব ক্রমাগত বলে যাচ্ছে- ” এই তো আর আধঘন্টার মতো লাগবে” কথাটা যতটা না ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিকে শুনাচ্ছে রাজিব, তারচেয়ে বেশী মীরাকে।

অবশেষে রাজিব তৈরি হলো। মীরা নিজ হাতে তৈরী করে দিলো ওকে সতীনের সাথে প্রমোদ ভ্রমণে যেতে। সানগ্লাস ম্যাচিং করে দিলো, ঘড়িটা পরিয়ে দিলো।

বারবার ঘড়ি দেখার ব্যাপারটায় রাজিব যেন নিরবে মীরাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।অস্থিরতায় বোঝা যায় আজ ওর অনেক তাড়া।
মীরা তাই দেরি করালো না আর ওকে। মেয়েকে কোলে দিয়ে সুন্দর মতো বিদায় দিলো। যাওয়ার আগে রাজিব মীরাকে জড়িয়ে ধরে নূহার কপালে চুমো খায় একটা। মীরা মনে মনে ভাবে – ছল করা এত সহজ? আচ্ছা মীরার কি কান্না করা উচিত এ সময়ে?
: “সাবধানে থেকো” – রাজিবের এ কথায় ধ্যান ভঙ্গ হয় মীরার। অনেক দূর পর্যন্ত বিছিয়ে দেয়া আবেগের জাল গুটিয়ে মীরা সরে গেলো ওর সামনে থেকে। পানির বোতল এগিয়ে দিলো ওর হাতে। তারপর ওর বের হওয়ার আগে বললো-
: ” তুমিও সাবধানে থেকো, পৌঁছে কল দিও”
: ” তুমি কোন চিন্তা করবে না, আমি পৌঁছে জানাবে”

দরজা আটকে মীরা ডাইনিং টেবিলের সামনে যায়। নূহাকে মাজেদা খালার কোলে দিয়ে কি ভেবে যেন ঘুরে দাঁড়ায় দেয়ালের দিকে। হঠাৎ কি মনে করে নির্মম ভাবে দেয়ালের সাথে নিজের মাথা ঠুকে ও। একবার, দুবার, পরপর তিন বার। হঠাৎ করে মীরার এমন আচরণে ভরকে যায় মাজেদা খালা, নূহাকে সোফায় বসিয়ে যতক্ষণে যায় সে মীরার কাছে ততক্ষণে মীরার কপাল বেয়ে গাঢ় রক্ত পরছে চুইয়ে চুইয়ে । মাজেদা খালা মীরাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলে-
: ” পাগল হইছেন আপনে খালা?”
মীরা দু হাতে মুখ চেপে কান্না করতে থাকে। রাগান্বিত কন্ঠে মাজেদা খালা বলেন-
: ” শয়তান মাথারী, জামাইরে সাইজাইয়া গুছাইয়া পাঠায়া এহন ঢং করে ”

দৌড়ে গিয়ে ফাস্টএইড বক্স এনে ক্ষত জায়গায় তুলা চেপে ধরেন তিনি। মীরা উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ও যেন কান্না ভুলে গেছে এখন। যে যন্ত্রণার ও বুকে বয়ে চলেছে গত কয়েকটা দিন ধরে তার চেয়ে মাথার এ ক্ষত যে কত তুচ্ছ তা কিভাবে বোঝাবে মীরা মাজেদা খালাকে?

কিছুতেই রক্ত বন্ধ না হওয়ায় মাজেদা খালা নূহাকে টুম্পার কাছে দিয়ে মীরাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। দীর্ঘ দিন গ্রামে থেকে গতকাল রাতে ঢাকায় ফিরেছে টুম্পা। ও এসবের কিছুই জানে না এখনও। তাই ঘটনাটা হজম করতে কষ্ট হয় ওর। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে না ও এসবের ।

হাসপিটালে পৌঁছে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে যখন মীরার মাথার চুলগুলো কেটে ক্ষত স্থানে সেলাই করছিলো ডাক্তার, রাজিব তখন সাথীর হাত ধরে সদ্য উড়া বিমান থেকে ঢাকা শহর দেখাচ্ছিলো সাথীকে। অসীম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন চোখ জোড়া এত উঁচু থেকে জায়গার বিবরণ দিতে পারা সত্ত্বেও মীরার বেলায় খুব কাছে থেকে ওর এই একই চোখ জোড়া যেন ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে যায়। এই যে অনিহা, অবহেলা, উপেক্ষা এগুলোর হিসাব মিলাতে পারবে কি রাজিব?

চলবে…

প্রিয় ভুল পর্ব-২৩+২৪+২৫+২৬

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ২৩

তিন দিন ঘোরাফেরা শেষে সিলেট থেকে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় ফিরে ওরা। সকালে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে নিয়েই রাজিব চলে যায় কারখানায়। তিনদিনের অবকাশের পর ব্যাস্ত হয়ে পরে কারখানার কাজে আর মীরা ঘরের কাজে। ঘরদোরের ধুলো ঝারা, ময়লা কাপড় ধোয়র জন্য বুয়াকে বুঝিয়ে দেয়া।
এক জায়গায় থেকে ঘুরে ফিরলে সপ্তাহ লেগে যায় জমে যাওয়া কাজ শেষ করতে।

তার মধ্যে ওরা ঢাকায় ফেরার পরদিনই বড় মামার মেয়ে লাবনী তার ছোট ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির। তিনি এসেছেন ছোট ভাই আসদের বিয়ের কেনাকাটা করতে। তারা বিশাল লিস্ট করে নিয়ে এসেছেন। মীরাকে লাবনী বলে-
: ” ঢাকায় আইছি তোগরে নিয়া যাইতে, হের লগে
ছোডর বিয়ার শপিং ও কইরা নিয়া যামু”
: ” ঠিকাছে আপা, আগামীকাল সকালে কাজকর্ম শেষ করে নিয়ে যাবো নি আপনাকে”
: ” হুন মীরা, অনেক বড় ঘরের মাইয়্যা আনতাছি, বুঝলি? এমন কেনাকাটা কইরা দিবি জানি বেগ্গলের চোখ কপালে উডে। ট্যাকা পয়সা কোন সমস্যা না”
: ” ঠিক আছে আপা, আপনি এখন ফ্রেশ হয়ে আসেন টেবিলে খাবার দিয়েছি”

তারা সকাল সকাল আসায় রাজিব বাইরে থেকে নাশতা কিনে দিয়ে গেছে তাদের জন্য। নশতা খেয়ে মীরা রান্নাঘরে গেলো তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করতে। রান্নার ফাহিমা খালা গেছেন বাড়িতে। তিনি আসবেন আগামী পরশুদিন।

সেদিন রান্না আর গল্পে কটলো ওদের পুরোটা দিন। সাথে করে আনা হাঁস, কেটে বেছে রান্না করে দিলেন তিনি। মীরা হাঁস বাছতে পারে না তাই। ব্লেন্ডারে চাল গুড়ো করে সিদ্ধ করে রুটি বানালেন। মীরার ছোট্ট মেয়ে, তাই ওর হেসেলের পুরো দায়িত্ব নিলো লাবনী। একেক রকমের দেশি রান্না করে করে শিখাচ্ছেন তিনি। রতার হাবভাবে একবারও মনে হয় না তিনি এবারই প্রথম এসেছেন এ বাড়িতে। মনে হচ্ছে তিনি মীরার আপন ননাশ, যে প্রায়ই বেড়াতে আসেন এ বাড়িতে।

রাতের বেলা সবাই মিলে চালের রুটি আর হাঁসের গোশত দিয়ে রাতের খাবার সেরে নিলো। কে বলবে সে আগের রাত জার্নি করে এসেছেন? প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই মানুষটার মনে অনেক কষ্ট। হাসতে হাসতে এমন কথা বললেন যে মীরার হৃদয় এফোড় ওফোড় হয়ে গিয়েছিলো দুঃখের ভারে। অথচ তার বলার ভঙ্গিতে মনে হয় কি মজার কথা বললেন তিনি। অনেক কথা হয় দু’জনে। গ্রামের কথা, সংসারের কথা, ছেলে মেয়ে আর স্বামীর বহুগামিতার কথা। তিনি এমন অকপটে সব বললেন যেন বড় বোন তার দুঃখের কথা বলছে ছোট বোনের কাছে। মীরাও ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো শুনলো সব। এত সুন্দর তিনি তবুও বেঁধে রাখতে পারেন নি স্বামীকে৷ মজার জিনিস দেখানোর কথা বলে তিনি তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর ছবি দেখালেন। কোন দিক দিয়েই তার সাথে ঐ মেয়ের তুলনা হয় না। না রূপে, না গুণে না পারিবারিক অবস্থানে। মানুষের মন কত বিচিত্র। এত সুন্দর স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও লোকটা বিয়ে করেছে তার চেয়ে দেখতে অসুন্দর, অশিক্ষিত এক মেয়েকে। তবুও হাসছেন তিনি, বাঁচেন নিজের মতো করে। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে স্বামীর সাথে কোন সম্পর্ক নেই তার। না তিনি তার সংসার ছেড়ে আসেন নি, তার সংসারেই রয়ে গেছেন, তার ছেলেমেয়ে মানুষ করছেন জমিজিরাত সব দেখাশোনা করছেন, শুধু মনের যে সম্পর্ক দিয়ে ঐ সংসারে বসবাস শুরু হয়েছিল তাদের তা শেষ হয়ে গেছে। ক্ষমা চেয়েছিলেন তার স্বামী, ক্ষমা করেও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিছানা ভাগ করে নিতে পারেন নি আর। কত শক্ত মানসিকতার মানুষ হলে এমনটা সম্ভব? সমাজে এখনো রাতের বেলা স্বামীর আহ্বানে না বলতে পারাটা শক্ত করে প্রচলিত হয় নি, সেখানে তিনি নিজেকে ঘিরে রেখেছেন অদৃশ্য দেওয়াল দিয়ে। কত কষ্ট, অভিমান আর দৃঢ়তা মনে থাকলে এমনটা সম্ভব তা তার দিকে তাকিয়ে ভাবে মীরা।

মীরা প্রথমে অসময়ে আগমনে বিরক্ত হলেও তার মন মানসিকতাকে ভালোবেসে ফেলে৷ হাসিমুখে দুই দিন লাগিয়ে সমস্ত কেনাকাটা করে দেয়। সাথে বৌভাতে পরার জন্য ওর এনে রাখা লেহেঙ্গাটাও দিয়ে দেয় উপহার হিসেবে। বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও লাবনী খুবই মিশুক একজন মানুষ হওয়ায় মীরার ভীষণ ভালো লাগে তাকে। যাওয়ার দিন তো মীরাকে নিয়েই যাবে সাথে করে। মীরার না যাওয়ার এই সেই কত বাহানা। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে কথা দিতে বাধ্য হয় মীরা, যে ওরা অবশ্যই আসাদের বিয়েতে যাবে।

তারা চলে যাবার পর নূহা অসুস্থ হয়ে যায়। রাজিব বলে দেখো ওর শরীর যদি ঠিক না হয় তাহলে তো যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু নূহার শরীর পরদিনই ভালো হয়ে গেলো। রাজিব পরদিন সকালে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে-
: ” এই দাওয়াতে যাবো না বলে সিলেট ঘুরে এলাম, অসুস্থ মেয়েও সুস্থ হয়ে গেলো, না যেয়ে আর উপায় রইলো না, কি আর করা, ব্যগপত্র গোছগাছ করে নাও”

মীরার মনে একটু সংকোচ, খুতখুত ভাব। গ্রামের মানুষের কথাবার্তা কেমন যেন। তারা হাসতে হাসতে এমন কথা বলে। হঠাৎই মনে হলো মীরার সেই দূর সম্পর্কের খালা শ্বাশুড়ির কথা। রাতে মীরা রাজিবকে বলে-
: ” গ্রামে যেতে সংকোচ একটাই বুঝলা, হুট করে কেও ঐ সম্পর্কে… ”
: ” কথাটা শেষ করতে দেয় না রাজিব, দীর্ঘ চুমো এঁকে দেয় মীরার ঠোঁটে”
ব্যাপারটায় বিরক্ত হয় মীরা, ওকে ধাক্কা দিয়ে পাশে ফেলে দিয়ে বলে-
: ” সব সময় এমন ভাল্লাগে না রাজিব, আমি সিরিয়াস একটা কথা বলছি”
: ” আমিও কি কম সিরিয়াস? নূূহার ঘুমানোর অপেক্ষা করছি সেই কখন থেকে। এখন তো তুমি আমার থেকে নূহারই বেশী”
: ” আমি কি বলেছি তুমি বুঝেছো? ”
: ” কে কি বললো দেখার টাইম নাই আমার, আমার বৌয়ের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব আমার, দুটো বেজে গেছে আর দেরি করায়ো না, আসো তো”
: ” আজকে আমার ভালো লাগছে না রাজিব, আমি অনেক ক্লান্ত ”
: ” তোমার ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছি সোনা”
: ” উফ্ রাজিব, সরো তুমি! ”
: ” এতক্ষণ অপেক্ষায় রেখে এসব বাহানা চলবে না আমার জান” বলেই রাজিব ডুব দেয় মীরাতে। মীরার যেন রাজিবের সাথে তাল মেলানো ছাড়া আর কিছুই করার রইলো না।

অনেক দিন আগে এক রাতে মীরা ফিরিয়ে দিয়েছিলে অর্ধ মাতাল রাজিবকে। সে রাতে রাজিব টুম্পার দুয়ারে কড়া নেড়েছিলো নোংরা মন নিয়ে৷ এরপর বহদিন দূরে ছিলো দুজনে৷ তারপর যখন আবার এক হলো দুজনে তখন থেকে আর কখনোই রাজিবকে ফিরায় না মীরা। যত খারাপ লাগা, অস্বস্তি আর ক্লান্তি থাকুক না কেন কখনো না বলে নি ও । আজ অজপাড়াগাঁয়ের লাবনী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে মীরাকে ওর মন কতো নড়বড়ে।
রাজিব সব সময়ই বিছানায় একটু বেশীই এগ্রেসিভ। মীরা একটা সময় এটাকে ওর ভালোবাসা প্রকাশের ধরন হিসেবে দেখতো। কিন্তু টুম্পার ঘটনার পর মীরা টের পেতে শুরু করলো রাজিবের এই বেপরোয়া ব্যাপারটা ভালোবাসা না। শরীরের ডাকে ওর বিপরীত কাওকে দরকার, সেটা হোক মীরা কি টুম্পা কিংবা রাস্তার কেন মেয়ে, তাতে কিছু যায় আসে না।

লাবনী আপুর সাথে বিয়ের মার্কেট করতে যাার সময় একটা পাগল মেয়েকে দেখেছিলো মীরা নীলক্ষেতের পেট্রোল পাম্পের সামনে বসে থাকতে। মেয়ে না ঠিক তার বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের ঘরে হবে। তার জামা ভেদ করে পেটটা যেন বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে। জানান দিচ্ছে শরীরের অস্বাভাবিকতার খরব। জ্যাম থাকায় মীরা লক্ষ্য করে ছিলো তাকে। তার গায়ের জামাটা আঁটসাঁটে, অনেক দিন গোসল না করার কারনে শরীরে ময়লা, চুল আর হাত-পায়ে ময়লার আস্তরণ, মুখ দিয়ে ও লালা পরে। অথচ পেটটা ফোলা৷ মেয়ে হওয়ার সুবাদে ও জানে বুকের কাছ থেকে পেট এমন গোলাকারে ফুলে উঠে কোন কারনে, মহিলাটি অন্তঃসত্তা। এর পেছনের কারন ভাবতে গিয়ে মীরার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। নিশ্চয়ই তাকে রাতের আঁধারে কামুক কোন জানোয়ার…. আর ভাবতে পারে না ও।
কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে এর সাথে মিলন অসম্ভব। এরা এমন শ্রেণির লোক, যাদের কা*ম কমাতে একটা শরীর চাই শুধু। ভালোবাসা বলে তাদের কিচ্ছু নেই। মীরা মনে মনে ভাবে প্রযুক্তি কত উন্নত হচ্ছে দিন দিন, এমন কোন যন্ত্র কি আবিষ্কার হবে কোনদিন যাতে এমন পাগলদের গর্ভের সন্তানের বাবাকে পরিচয় সহ খুঁজে পাওয়া যাবে?

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ২৪

অবশেষে বরিশাল যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। মীরা, রাজিব, নূহা গেলো টুম্পা গেলো ওদের গ্রামের বাড়িতে। ওদের সাথে বরিশাল যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করলেও টুম্পা কি মনে করে যেতে চাইলো না। একই সাথে রওনা দিলো দুজন দুই প্রান্তে। ওরা চললো দক্ষিণের বরিশাল আর টুম্পা উত্তরের গাইবান্ধায়।

লঞ্চ টার্মিনালে এসে এত এত লঞ্চের ভিড়ে রাজিব চেষ্টা করলো ভালো একটা লঞ্চের কেবিন ভাড়া করতে। মীরা এর আগে কখনো লঞ্চে ভ্রমণ করে নি। তাই ওর প্রথম লঞ্চ ভ্রমণের সুন্দর স্মৃতি উপহার দিতে রাজিবের এই বাড়তি চেষ্টা। অবশেষে ওর উঠলো পারাবাত-১৮ নামের লঞ্চে। ভাগ্য ভালো যে ওরা অনায়াসেই বিজনেস ক্লাসের একটা কেবিন পেয়ে যায়। সপ্তাহান্তে এই লঞ্চের কেবিন পাওয়া টাফ। সেদিকে ওরা ভাগ্যবান। মীরা কেবিনে ঢুকেই কাঁধের ব্যাগটা রেখে পুরো কেবিনটা ঘুরে দেখলো। পুরো কেবিনে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন চোখে পরার মতো। এমনকি বাথরুমেও সিলিং এ লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করা৷ এ ব্যাপারটা আধিক্য মনে হয়েছে ওর কাছে। এমনি তে কিং সাইজ খাট, ওয়াল মিরর, সোফা, সবকিছুই ছিলো গুছানো। রুমে ঢুকে নূহাকে রাতের খাবার খাওয়ায় মীরা। একটু পরেই ঘুমিয়ে পরে ও। তারাহুরোয় কিছু খেয়ে আসতে পারে নি ওরা। তাই রাজিব বাইরে থেকে হালকা কিছু খাবার নিয়ে নিয়েছিলো সাথে। সেটাই ওরা দুজন মিলো খায়। “সাড়ে আটটায় লঞ্চ ছাড়ার কথা থাকলেও নয়টা বাজে এখনো লঞ্চ ছাড়ার কোন নাম গন্ধ নাই” – বার্গার খেতে খেতে কথাটা বললো মীরা।

খানিক বাদে লঞ্চটা শব্দ করে উঠলো, মীরা টের পেলো লঞ্চটা চলতে শুরু করেছে। ঘড়িতে সময় তখন নয়টা দশ। লঞ্চ ছাড়ার পর কেমন যেন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় মীরার। বাইরে দেখার জন্য সামনের দেয়ালের পর্দা সরাতেই মীরা দেখে রুমের সাথে এটাচ একটা বারান্দা। খুশিতে একটা লাফ দিলো যেন ও। গ্লাস খুলে বারান্দায় ঢুকে দেখলো সেটাকে। ছোট্ট একটা বারান্দা, একটা বেসিনও দেয়া আছে পাশে একটা চেয়ার রাখা। এটা যেন ওর বাড়তি পাওয়া, রুমে ঢুকে আধশোয়া রাজিবকে টেনে নিয়ে যায় সেখানে। রাজিব ওর খুশি দেখে নিজেও খুশি। সেখানে রাখা চেয়ারে বসে নদী দেখছে মীরা, মনের উচ্ছাস প্রকাশ পাচ্ছে ওর কথায়।
রাজিব ওর পেছনে দাঁড়ায়, দেখে মনে হচ্ছে মনযোগ দিয়ে শুনছে ও মীরার কথা কিন্তু হাত নেড়ে নেড়ে বলা মীরার কথার কিছুই যাচ্ছে না ওর কানে, ও দেখছে আনন্দিত মীরাকে। আলোআঁধারির এ রহস্যময় জায়টায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছে ওর প্রিয়তমাকে। সাথে ভাবছে – “এত অল্পতেই খুশি হয় মীরা” ব্যাপারটা মন ভালো করে দেয় ওর।

মৃদুমন্দ বাতাসে মীরার খোলা চুলগুলোও খুশিতে নাচছে যেন ওরই মতো । সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজিব হঠাৎ ওর কাঁধে হাত রাখে। লম্বু রাজিবকে দেখতে মাথাটা উচুতে তুলে ও, কি ভেবে যেন ওর দিকে হেসে বলে-
: “থ্যাংকস্ ফর এভরিথিং মাই ডিয়ার”

রাজিব মীরাকে চেয়ার থেকে নামিয়ে দাঁড় করায়, হঠাৎ কি হলো বুঝে উঠে না মীরা। তারপর দেখে ওকে দাঁড় করিয়ে নিজে চেয়ারটাতে বসেছে রাজিব, তারপর ছোট্ট বাচ্চার মতো ওর কোলে টেনে নেয় মীরাকে। মাথার অবাধ্য চুলকে বশে আনতে হাত বুলিয়ে গুছানোর চেষ্টা করে রাজিব। কিন্তু মীরার লম্বা, ঝরঝরে চুল গুলো বশ মানে না রাজিবের। হেরে যাওয়ার ভঙ্গিতে ওর অবাধ্য চুলে ডুব দেয় রাজিব। কানের কাছটাতে আলতো করে কামড় দেয়। হঠাৎ এমন আচরণে কেমন যেন কেঁপে উঠে মীরা। এ ছেলেটা এমনি, কখন কি করে বসে বোঝা মুশকিল। মীরা ঘুরে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজিবকে, গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে পরে রাজিবের প্রশস্ত বুকে। এ যেন বাঁচার জন্য লুকানো।

এমনি করে ওরা বসে ছিলো অনেকক্ষণ। ধীরে ধীরে লঞ্চটি লোকালয় ছেড়ে অন্ধকারের ডুবে থাকা কোন এক অঞ্চলে প্রবেশ করলো। ছোট ছোট আলোক বিন্দু ভেসে আছে নদীর যত্রতত্র । আলোক বিন্দু গুলো কি জানতে চাইলে রাজিব বলে এগুলো মাছ ধরার নৌকা। অন্ধকার, খোলা বারান্দা, পানিতে গলে যাওয়া চাঁদ আর নদীর মিতালী দেখছে দুজনে।

মীরা কোল থেকে নিচে নেমে বাইরের দিকে উকি দিলেই দেখে জোছনা রাতের চকচকে চাঁদ ও যাচ্ছে ওদের সাথে সাথে। অপার্থিব দৃশ্য একেই বলে হয়তো। ঐদিনের চাঁদটা কেমন অন্য রকম লাগে ওর। এটা চোখের ভ্রান্তি নাকি সত্যি সেদিকে মাথা ঘামায় না ও। জীবনে প্রথম বারের মতো দেখে চাঁদের অপরূপ সৌন্দর্য্য। চাঁদ নিয়ে কোন গান বা কবিতাকে বারাবাড়ি ভাবতো ও এতদিন। আজ নিজে ভুল প্রমাণিত হয়ে কেমন আনন্দ লাগছে। এ আনন্দ প্রকৃতিতে নিজেকে আত্নসমর্পণ করার আনন্দ।

নদীতে ছোট-বড় নৌকা দেখা যাচ্ছে। বালু বোঝাই স্টিমারও দেখা যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। রাত একটার দিকে রাজিব মীরাকে বলে চলো লঞ্চের ইলিশ ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে আসি। মীরা নূহার কথা ভেবে যেতে চায় না। পরে ঘুমন্ত নূহাকে ক্যারিয়ার ব্যাগে রাজিব ওর কোলে নেয়। তারপর রুম লক করে যায় খাবারের দোকানের দিকে। সেখান থেকে আলু ভার্তা, ইলিশ মাছ ভাজা আর ঘন ডাল দিয়ে পেট পুরে ভাত খায় ওরা। খাওয়া শেষে লঞ্চের ছাঁদে উঠে দুজনে । ছাদে উঠে মীরার বিষ্ময়ের শেষ নেই। দুই দিকে কেবল অথৈ পানি। কোন দিকে কোন কিনারা চোখে পরলো না ওদের। পরে ওরা জানতে পারে লঞ্চ এখন দেশের গভীর ও প্রশস্ততম নদী মেঘনার বুক চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে।

বেশ কিছু সময় থাকার পর ওরা রুমে চলে আসে নূহারে জেগে যাওয়ার দরুন । রুমে এসে মীরা ব্যাস্ত হয়ে পরে নূহাকে নিয়ে। আর রাজিব বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টানতে থাকে। নূহা ঘুমিয়ে পরলে মীরা রাজিবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, মীরার উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেট টা ফেলে দিয়ে
কোলে তুলে নেয় ওকে। তারপর রুমে এনে খাটে শুইয়ে দেয়। আধশোয়া মীরা রহস্যময় হাসি হেসে বলে-
: ” তুমি কি ভালো হবা না”
রাজিব ওর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে-
: ” নাহ্”
রাতটা কাটলো দুজনের ভালোবাসায় ডুবে, আর গল্প করে। হাসি, মজায় কাটলো প্রথম লঞ্চ ভ্রমণের স্মরণীয় রাতটি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে পরলো দুজন। ভোর ছ’টায় লঞ্চ পৌঁছালো তার গন্তব্য। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে নেমে পরে ওরা। বাস যোগে পৌঁছে গেলো রাজিবের মামা বাড়ি। ওদেরকে দেখে সবাই ভীষণ খুশি হয়। রাজিবের মামীরা এলো রাজিবের বৌকে দেখতে। মীরাকে দেখে সবাই অবাক। এত সুন্দর বউ রাজিবের। এদের এত অবাক হওয়ার কারণ বোঝে না মীরা। তারা নিজেরাও অনেক সুন্দর। ধান, নদী, আর খালোর জন্য বিখ্যাত বরিশালের মেয়েগুলো ও অসম্ভব সুন্দর হয়। তা আগেই জানতো মীরা। তারপরও ওকে দেখে তাদের অবাক হওয়াটা মানতে পারে না ও।

সকালের নাশতা শেষে বিয়ের আয়োজন দেখতে যায় ওরা। ননদদের সাথে হলুদের ডালা নিয়ে যায় বৌদের বাড়ি। রাজিব এখানে এসে যেন বহু ব্যাস্ত হয়ে পরেছে। বন্ধু, ভাইব্রাদার নিয়ে মশগুল ও। মীরা অবশ্য ব্যাপারটাকে সহজ ভাবেই নেয়। ও যখন ওর বন্ধুদের সাথে থাকে তখন ফোন দিয়ে বিরক্ত করে না ও। বিয়ে হয়েছে বলে কি পার্সোনাল স্পেস ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে? তবে রাজিবের ব্যাপারটা উল্টো, কই যাও? কেন যাও? যেতেই হবে নাকি? না গেলে হবে না? ইত্যাদি প্রশ্নে জর্জরিত করে ও মীরাকে৷ তবুও মীরা ওর বেলায় এমনটা করে না। যাতে ও বুঝে যে মীরা ওকে ওর স্পেস দেয়, ও যেটা দেয় না মীরাকে। কিন্তু রাজিব এটাকে পুরুষ হিসেবে ওর পাওনা মনে করে। ব্যাপারটা অনেক পরে বুঝেছে ও।

গ্রামের বিয়ে মানেই অনেক আনন্দ আর মজা। বিয়ের রীতিনীতি, রঙ দিয়ে খেলা, সব কিছু অন্য রকম লাগে মীরার। এদের আন্তরিকতা ও মুগ্ধ করে মীরাকে। সবাই ভীষণ ভালো মনের মানুষ। এত সরল যে অবাক হয় মীরা এি ভেবে যে এ যুগেও এমন মানুষ আছে। এই সরলতাটাই এদের অসাধারণত্ব। এদিকে এখানে আসার পর নূহার সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে আসাদের ছোট বোন সুরভী। ওকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো সব ওই করে । এ বাড়িতে ছোট কোন বাচ্চা না থাকায় ওরা সবাই নূহাকে যেন লুফে নেয়। রিতীমত কাড়াকাড়ি অবস্থা। মীরা তাই মন মতো উপভোগ করতে পারছে আনন্দ অনুষ্ঠান।

সন্ধ্যা হতেই ননদদের লাইন লেগে যায় মীরার কাছে সাজবে বলে। মীরা ধৈর্যের সঙ্গে সবাইকে পরিপাটি করে দেয়। শেষে নিজেই ঠিকঠাক তৈরি হতে পারে না। ঐদিকে অনুষ্ঠান শুরু করতে ওর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। মন মতো সাজতে না পেরেও মন খারাপ করে না ও। এতগুলো মানুষ খুশি, এই কি কম পাওয়া? শেষে হলুদের জন্য নির্ধারণ করা শাড়ি পরে চুলটাকে কোনমতে খোপা করে ও। ঝটপট হালকা একটা সাজ সাজে ও। মুখে ফেস পাউডার বুলিয়ে ভ্রু একে, চোখে কাজল, আর ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক দিয়ে চলে যায় হলুদের স্টেজে।

হালকা একটা সাজ দিয়েছে ও, তবুও মীরার সৌন্দর্য চোখে পরার মতো। এক ননদ ওকে দেখে বলে- ” ভাবী তুমি তেমন সাজো নি, তাতেই এ অবস্থা, আর সাজলে কি অবস্থা হইতো?”
বাকীরা সবাই হেসে যোগ দিলো ওর সাথে। অবশেষে মীরা যাওয়া পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটু পরে
সেখান থেকে সরে গিয়ে মীরা ভিড়ের মধ্যে রাজিবকে খোঁজে। কোথাও নেই ও, তাই একটা কল করে ওকে। ফোনটা কেটে দিচ্ছে ও। মীরা ভাবে এখানেই আসছে তাই হয়তো ফোন কেটে দিচ্ছে রাজিব। এটা ভাবতেই হঠাৎ পুরো উঠোন অন্ধকার হয়ে যায়। জেনেরেটরের কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো ভাবতেই কে যেন মীরার মুখ চেপে ধরে ওকে একপাশে সরিয়ে নেয়। ভয়ে জমে যায় মীরা। এ আবার কোন বিপ! চেষ্টা করে মুখে রাখা হাত টেনে সরাতে, কিন্তু পারে না। মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন দপদপ করছে ওর –
কে টেনে নিচ্ছে ওকে?
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৫

অবশেষে মীরা যাওয়া পর অনুষ্ঠান শুরু হয়। একটু পরে সেখান থেকে সরে গিয়ে মীরা ভিড়ের মধ্যে রাজিবকে খোঁজে। কোথাও নেই ও, তাই একটা কল করে ওকে। ফোনটা কেটে দিচ্ছে ও। মীরা ভাবে এখানেই আসছে তাই হয়তো ফোন কেটে দিচ্ছে রাজিব। এটা ভাবতেই হঠাৎ পুরো উঠোন অন্ধকার হয়ে যায়। জেনেরেটরের কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো ভাবতেই কে যেন মীরার মুখ চেপে ধরে ওকে একপাশে সরিয়ে নেয়। ভয়ে জমে যায় মীরা। এ আবার কোন বিপ! চেষ্টা করে মুখে রাখা হাত টেনে সরাতে, কিন্তু পারে না। মাথায় কেবল একটাই প্রশ্ন দপদপ করছে ওর –
কে টেনে নিচ্ছে ওকে?
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

খুব দ্রুত ঐ ভয়ংকর সময়ের সমাপ্তি হলো। মীরার মুখ থেকে হাত সরিয়ে পাশে দাঁড়ালো লোকটা। বাচ্চাদের চুপ করানোর মতো মুখে তর্জনী ধরে স্ স্ স্ শব্দ করলো, যার মানে চুপ থাকার নির্দেশ। তারপর মুখ থেকে তর্জনী নামিয়ে সামনে ঐ হাত দিয়েই একটা ঝোপের দিকে দেখিয়ে দিলে। মীরা তখন অন্ধকারের ঐ মূর্তি দেখায় ব্যাস্ত, মস্তিষ্ক হিসাবনিকাশ করছে তাকে চিনতে পারার জটিল অংক। জমাট বাঁধা অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধু তার দৈহিক অবয়ব ছাড়া। তারপর একটা কন্ঠে ভেসে এলো-
: “মোরে কি দেহ, যেইয়্যা দেহাইতে আনছি হেইয়া দেহ, মোরে পরেও দেখতে পারবা”

দৈহিক গঠন আর কন্ঠ পুরোপুরি বিপরীত। শারীরিক সামর্থ্য আর দৈহিক গঠণ পুরোদস্তুর পুরুষের মতো, কিন্তু কন্ঠ মেয়েলি। বলিষ্ঠ হাত আর ওকে পুরো তুলে নিয়ে এতদূর পর্যন্ত তুলে নিয়ে আসায় মীরা একবারও ভাবে নি যে তাকে তুলে এতদূর বয়ে আনা মানুষটা কোন পুরুষ না। তার দেখিয়ে দেয়া নির্দেশ অনুসরণ না করায় ধমকানোর সুরে ফিসফাস করে বললো-
: ” আহ্ ভাবী তুমি এত বোকা ক্যা এ্যা, মোরে দেখার কিচ্ছু নাই, যেইয়্যা দেহাইতে আনছি হেইয়া দেহ”

এবার মীরা নিশ্চিত হলো ওকে বয়ে আনা মানুষটা একটা মেয়ে। মেঝো মামার ছোট মেয়ে পলি। ভাবী ডাকায় ও নিশ্চিত হলো এ ব্যাপারে। অনূর্ধ্ব উনিশ ফুটবল দলের খেলোয়ার সে। তাই শারীরিক সামর্থ্য আর বলিষ্ঠতা একটা গড়পড়তা মেয়ের চেয়ে উন্নত।

এরপর দ্রুত মুখ ফিরিয়ে চোখ নিবন্ধ করলো ওর দেখিয়ে দেয়া স্থানে। কেও একজন গাছের নিচে এক পায়ে ভর করে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। একটা মেয়ে দাঁড়ানো পাশে, পাশে দাঁড়ানো ব্যাক্তি যে একটা মেয়ের তা শাড়ির অবয়বে বোঝা যাচ্ছে। চাঁদনী রাত হওয়ায় তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটার হাত ধরে আছে গাছে হেলান দেয়া ব্যাক্তি। মেয়েটাকে দেখা গেলেও ছেলেটা কে তা বোঝা যাচ্ছে না। কারন ছেলেটা মীরা দের দিক থেকে একটু বেঁকে দাঁড়ান, তাছাড়া এখানে কেও আসতে পারে, ওদের দেখতে পারে তা হয়তো ক্ষুণাক্ষরেও টের পায় নি ওরা।
মীরা অবাক কন্ঠ পলিকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” এরা কারা পলি?”
: ” দেহ দি চিনো কি না?”
: ” অন্ধকারে তো তোমাকেই চিনি নি, তুমি চিনছো এদের?”
: ” যার লগে এত বছর ঘর করলা তারে চিনলা না?”
মীরা যেন কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। বেশ কিছু সময় মৌণ থাকে মীরা। ঘটনার আকস্মিকতা হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে হয়তো ওকে। বেশ কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন। ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর বাতাসে ডালপালা নড়ার শব্দ নিরবতাকে আরো গাঢ় করে তুলে। মৌণ হয়ে মীরা জিজ্ঞেস করে –
: ” রাজিবের সাথে মেয়েটা কে?”
কন্ঠে কোন বিস্ময় ছিলো না মীরার। এসব অনেক দেখেছে ও এমন একটা ব্যাপার ছিলো ওর কন্ঠে। পলি মীরার দৃঢ়তা দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এরচেয়ে বেশী কিছু ঘটবে বলে ভেবেছিলো ও হয়তো। পলি বললো
: ” ছোড কাকার লাউঙ্গা মাইয়্যা সাথী, হেয় তো তোমার শ্বশুড়বাড়ি থাইক্যা পড়ালেহা করতো, আমরা তো জানি ওরেই বিয়া করবো রাজিব ভাইয়ে, এতদিন পর পুরাতন প্রেমিক দেইখ্যা প্রেম উতলায়া উঠছে, বে*শ্যা মাগী একটা”
: ” চলো পলি”
: ” ওগো হাতে নাতে ধরবা না”
: ” পলি আমি এতদিন ধরে ভাঙা ডিমে তা দিয়ে আসছিলাম, তবে মজার ব্যাপার কি জানো? আমি জানতাম কি করছি আমি, সবকিছু জেনেও না জানার, দেখেও না দেখার ভান করতে করতে আমি এখন অভ্যস্ত”
: ” ভাবি কি কও এগুলা, তোমার কথার আগামাথা কিছুই তো বুঝলাম না”
মীরা পলির থুতনি ধরে বলে-
: ” বুঝতে হবে না, এসব নিয়ে এখন হুলস্থুল করলে বিয়ে বাড়িতে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান গুলো শেষ হোক ভালোয় ভালোয়। তারপর এ ব্যাপারে…”
: ” তুমি ভাবী খুব শক্ত মাইয়্যা, মুই হইলে দাও দিয়া এট্টা কোঁপ দিতাম, পরে যা হইতো দেইখ্যা নিতাম”

মীরা আর পলি সন্তর্পণে চলে আসে বাড়ির পেছনের এই জংলা মতো জায়গাটা হতে। সেখান থেকে বের হতে হতে কল করে মীরা রাজিবকে। তখনো ফোনটা কেটে দিচ্ছে রাজিব। মীরা তারপর বাড়িতে ঢুকে পলির হাত ছেড়ে অনুষ্ঠানের মানুষগুলোর ভিড়ে মিশে যায়। পলি কোমড়ে হাত দিয়ে মাথা চুলকায় ব্যাপারটা হলো কি তা ভেবে।

বাড়ির পিছন থেকে বাড়ি ফিরবার পথ দু’টো। একটা সরাসরি বাড়ির দিকে, আরেকটা ঢাল বেয়ে নেমে ঘুরে আসবার। সে রাতে রাজিব ফিরে বেশ দেরি করে। তবে আগে সেখান থেকে বের হয় সাথী। মীরা সেই পথটাতেই চেয়ার নিয়ে বসে ছিলো। সাথী মীরাকে দেখে কেমন থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- ভাবী অনুষ্ঠান রেখে আপনি এখানে বসে কেন?
কথা বার্তা স্পষ্ট এবং আঞ্চলিক টান বিবর্জিত। দাঁড়িয়ে ওর কাছে গিয়ে মুচকি হাসে মীরা বলে
: ” তোমার আসার অপেক্ষায় বসে আছি”

কথাটা শুনে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো সাথী। মীরা ওকে সহজ করতে ওর হাত ধরে বললো-
: ” এত চমকালে কেন? মজা করলাম, ওখানে এত লোক, গরম লাগছিলো তাই এখানে বসেছিলাম, তুমি ওখানে কোত্থেকে বেরুলে”
তোতলানো কন্ঠে সাথী বললো-
: ” আমার বান্ধবীকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, এত রাত হয়ে গেছে তাই”
: ” তোমাকে কে এগিয়ে দিয়ে গেলো?”
: ” আমি একাই চলতে পারি, গ্রামের মেয়ে আমি”
: ” বান্ধবী বুঝি শহরের?”
এমন সময় রাজিব বেরুলো সেখান থেকে। ওরা যে এখানে তা বুঝতে পারে নি ও, মীরার কাছে এসে বললো
: ” আরে এতদিন পর এলাম তাই…”
রাজিবকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে মীরা বললো-
: ” তাই এত দেড়িতে ছাড়লো বুঝি?”
: ” হ্যা ”
মজার ভঙ্গিতে বললো রাজিব।
মীরা সাথীর সামনে থেকে সুন্দর করে রাজিবের হাত আগলে ধরে চলে গেলো। সাথী বরফের মতো জমে থাকলো ঐখানটায়।

হলুদের খাবার দেয়া হয়েছে। মীরা আর রাজিব পাশাপাশি চেয়ারে খেতে বসেছে। সাথী নির্লজ্জের মতো ওদের বিপরীতে রাখা চেয়ারটাতে বসলো। সম্ভবত রাজিবের একটু আগে বলা কথা আর স্ত্রীর সাথে রাজিবের আচরণ দুটোর অনুপাতের অংক করতে বসেছে ও। রাজিব স্বাভাবিক ভাবেই বিরিয়ানি খাচ্ছে। স্বভাবিক মীরাও, মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে, রাজিবকে দিয়ে সালাদ আনাচ্ছে, পানি ঢেলে দিতে বলছে। রাজিবকে খাইয়েও দিচ্ছে দুএকবার। সাথী আড়চোখে দেখছে এসব। ওদের এক মামাতো ভাই ট্রে তে করে আরো বিরিয়ানি নিয়ে আসে। সাধে মীরাকে, মীরা বলে-
: ” এক চামচ দাও পলাশ বেশী দিও না”
রাজিবকে সাধতে গেলে রাজিব বলে-
: ” আরে আর দিস না”
: ” আরে ওর খাওয়া নিয়ে চিন্তা করিও না পলাশ, ও ক্রাশ খেয়ে বসে আছে”
পলাশ মুচকি হাসে মীরার কথা শুনে, রাজিব খাওয়া রেখে তাকায় মীরার দিকে। মীরা সুন্দর একটা হাসি হেসে বলে-
: ” এত সুন্দর শাড়ি পরেছি, তুমি ক্রাশ খাওনি বলো?”
রাজিব কিছুটা শান্ত হয়, ওর কথাবার্তা কেমন বেখাপ্পা লাগে ওর কাছে, যদিও সাথীর সাথে কি কথা হয়েছে তা জানে না রাজিব। তা জানলে তো কিছু একটা ঠিক বুঝবে। মীরা বুদ্ধি করে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলো যে ও বুঝিয়ে দিলো ও জানে, আবার তা বললোও না স্পষ্ট করে। রাতে নূহাকে ঘুম পারাতে আগেই ঘরে চলে যায় মীরা। রাজিব তখনো বাইরে ছিলো। হয়তো কথা ও হয়েছে সাথীর সাথে।

মীরা শাড়ি খুলে, ফ্রেশ হয়ে অপেক্ষায় ছিলো রাজিবের মুখোমুখি হওয়ার। ও অবাক হচ্ছে যে এত বছরেও রাজিব কখনোই সাথীর ব্যাপারে একটা কথাও কোনদিন বলে নি। পলিকে ম্যাসেজ দেয় মীরা। সাথীর নম্বর চেয়ে। সাথে সাথে ম্যাসেন্জারে নম্বর পাঠায় পলি। নম্বরটা মুখস্থ করে ম্যাসেজটা ডিলিট করে দেয় মীরা। আজ রাতে রাজিবের ফোনে চেক করবে নম্বরটা সেভ করা আছে কি না। মীরার ভিতরের কষ্টটা রাতের বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো সমান তালে। অপেক্ষা শুধু রাজিবের ঘরে ফেরার।

দেড়টা বাজতে চললো রাজিব আসার নাম নেই। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উঠে বসে মীরা। উঠে দরজা খুলে দেয় মীরা। দরজা খুলে দেখে সেখানে রাজিব না অন্য কেও দাঁড়িয়ে। মীরা বলে-
: ” তুমি এতো রাতে পলাশ”
: ” ভাবী একটু বাইরে আসবেন?”
:” কেন কোন দরকার?”
: “একটা জিনিস দেখাবো আপনাকে”
: “নূহাকে একা ঘরে রেখে..”
মীরা আসলে এত রাতে পলাশের সাথে যেতে চাইছে না।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পলাশ বলে-
: ” ভয় নাই ভাবী, পলি বাইরে দাঁড়ায়া আছে, ও বড় কাকার ঘরে আসে না, তাই আমিই ডাকতে আসলাম আপনাকে”

মীরা উঁকি দিয়ে দেখে পলি বাইরে দাঁড়ায়ি আছে। মীরাকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়ে পলি। আসলে বড় কাকাদের সাথে ওদের সম্পর্ক ভালো না তাই এদের ঘরে আসে না পলি দের পরিবারের কেও। পলির খেলাধুলার ব্যাপারে ওর বড় কাকা অনেক কথা শুনিয়েছিলো সেসব নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছিল তাদের মধ্যে। সেই থেকে তাদের কথা বন্ধ। এমনকি একই উঠোনে ঘর হওয়া সত্ত্বেও পলিদের পরিবারের কেও আসে নি আসাদের হলুদের অনুষ্ঠানে।

মীরা দরজা আটকে ধীর পায়ে বের হয় ঘর থেকে। পলাশ ঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায় পুকুরের দিকে। যেন ডেকে আনা পর্যন্তই ওর কাজ ছিলো। কাজ শেষ তাই চলে যাচ্ছে। পলি বলে –
: “তুমি ব্যাডি বালা লোক না, হাতে নাতে ধরার সুযোগ পায়েও ধরলা না ”
: ” পলি, পলাশ জানে কিছু?”
: ” জানে মানে! পলাশই তো আমারে কইলো জিনিসটা তোমারে দেহাইতে”

অবাক হলো মীরা। ওর চোখে ভেসে উঠেলো খাবার সার্ভ করার সময়কার হাসির কথাটা। মীরা বললো-
: ” এত রাতে ডাকলা?”
: ” সবাই মিল্লা ঢলাঢলি করতাছে স্টেজে, তুমি গিয়া তোমার জামাইরে নিয়া আস”

মীরার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। মীরা ভেবেছিলো শেষ পর্যন্ত দেখবে কখন ঘরে আসে রাজিব। এতক্ষণ বিয়ে বাড়িটা আলোয় ঝলমলে ছিলো তাই হঠাৎ আলো বন্ধ হওয়ায় কেমন অন্ধকার লাগছে চারপাশ। মীরা পলিকে রেখেই অন্ধকারে রওনা দিলো স্টেজের উদ্দেশ্যে। পলি দেখলো অন্ধকারে কেমন মিলিয়ে গেলো একটা মানব মূর্তি। যার দৃঢ়তা ওকে কেমন গুড়িয়ে দিচ্ছে ভিতর থেকে। কতটা পুড়লে এত ধৈর্য হয় তার হিসাব করতে ব্যার্থ হয় টিনএজের দাড় প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া পলি। অংকে ও বরাবরই ভীষণ কাঁচা।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সব অনুষ্ঠান ভালো ভাবে শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা করে ওরা। যেই পথে এসেছিলো সেই পথেই ফিরে যাচ্ছে ওরা। বাড়ির সামনে থেকে বাস, বাস থেকে নেমে লঞ্চ। ফিরবার সময়ও বিলাসবহুল একটা লঞ্চে রওনা করে ওরা। কিন্তু যে মন নিয়ে এসে ছিলো মীরা তার ভাঙাচোরা টুকরো গুলো অনেকে কষ্টে কুড়িয়ে কোন মতে তা বয়ে চলছে ও। ওর ভিতরকার অনুভূতির কোন নাম খুঁজে পায় না ও। এটা কি ঘৃণা, নাকি বিরক্তি, লজ্জা নাকি ভালোবাসা হারাবার ভয়? ফেরার পথে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করেছে মীরা। রাজিব ওর থুম ধরে থাকা দেখে জিজ্ঞেস করলো –
: ” কি ব্যাপার? বাইরে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের মতো মুখ কেন আমার বউয়ের? ”
: ” মাথা ব্যাথা করছে”
: ” দাও নূহাকে ঘুম পারাই আমি, তুমি একটু রেস্ট নাও”

এক পলক তাকায় মীরা রাজিবের দিকে। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পরে মীরা। নানা হিসাবে ব্যাস্ত ওর মস্তিষ্ক আর ভাঙাচোরা মন। কি করবে, কি করা উচিত, তার কিছুই বুঝতে পারছে না ও। নূহাকে ঘুম পারিয়ে রাজিব রাতের খাবারের জন্য ডাক দেয় মীরাকে। সজাগ থাকা সত্ত্বেও মীরা সারা দেয় না, পাশ ফেরা অবস্থায় পরে থাকে৷ রাজিব বাইরে থেকে গেইট আটকে খাবারের দোকানের দিকে রওনা দেয়। মীরা সাথে সাথেই বিছানা ছেড়ে নিচে নামে। এ কেবিনটার কোন বারান্দা নেই। তবে বড় একটা জানালা আছে। মীরা সেখানে গিয়ে বাইরে তাকায়।

ওরা বরিশাল আসার সময় চাঁদটা তার পূর্ণ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলো আকাশে। আজ পাঁচ দিন পর চাঁদটা ক্ষয়ে গিয়েছে সত্যি কিন্তু সৌন্দর্য তাতেও কমে নি, এটা আলাদা এক সৌন্দর্যে মেলে ধরেছে নিজেকে।

জীবণটাকে অর্থহীন মনে হয় মীরার । একবার ভাবে লাফ দেয় লঞ্চের বারান্দায় গিয়ে। এত ভুল যার জীবণে তার বেঁচে থাকা মানে ভুলের ইমারতে আরেকটা ইট যোগ করা, যার কোন মানেই হয় না। চোখ দুটো ভিজে যায় ওর। এত ভালোবাসা, বিশ্বাস, ত্যাগ এসবের কোন দামই নেই।

এমন ভাবনার সাথে সাথেই নূহা কেঁদে উঠে ঘুম থেকে।
ওড়না দিয়ে চোখ মুছে মীরা, চিন্তার জাল গুটিয়ে মেয়ের কাছে আসে ও ৷ পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে দিলে আবার ঘুমিয়ে পরে নূহা।

আবার ভাবনার বুননে মন দেয় মীরা। ছোট্ট এ জীবণে ধাক্কা তো কম খেলো না ও, তবে গত কয়েকটা দিন যার ভিতর দিয়ে গিয়েছে ও তা ভেঙে ফেলেছে পূর্বের সকল ধৈর্যের রেকর্ড। ওর জীবনে ও সবচেয়ে যাকে ভালোবেসেছে, আগলে রেখেছে, যাকে আবর্তন করে ঘুরছিলো মীরার জীবন নামের গ্রহ, সে আবর্তিত হচ্ছে অন্য কাওকে কেন্দ্র করে। কি মজা না ব্যাপারটা!?

রাজিবের প্রতি নূন্যতম ঘৃণাও অবশিষ্ট নেই মীরার। কারন ও ঘৃণা পাবারও অযোগ্য। ঘটনার সবটুকু যখন জেনেছিলো মীরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে নি। এ কানটাকে যে এ জীবণে কত বার দ্বিধায় ফেলেছে মীরা রাজিবের ব্যাপারে শুনে তাই এখন আর আগের মতো বেগ পেতে হয় না ওকে ঘটনার আকস্মিকতায়। বরং তা সামলে উঠে হামলে পরে তার সমাধান খুঁজতে। মীরার অভিযোজিত এই ব্যাপারটায়ই ভড়কে গিয়েছিলো পলি। কারন গড়পড়তা মেয়েরা স্বামীর এমন কথা শুনে ভেঙে পরে, দিশেহারা হয়ে যায়। কিন্তু মীরা এক্কেবারে ভিন্ন।

নূহা জন্মের আগেই মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এটাই শেষ সুযোগ রাজিবের । কিন্তু মহামতি রাজিব মীরার শেষ সুযোগের আলটিমেটাম ঘোষনা করার আগেই এমন কিছু করেছে যা মীরার টিকে থাকার ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মীরার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল রাজিবকে ওর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সেইসব দিন গুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় নিজেকে বিক্রির বিনিময়ে ওকে সারিয়ে তোলার সেই সব ঘটনা। মানুষ এত দ্রুত অতীত ভুলে কিভাবে?

মীরার মনে আছে ডিমের তরকারি ছিলো ওদের সংসারে গরুর গোশতের তরকারির সম মর্যাদার খাবার। সেই রাজিব এখন বুফে ডিনার করে একেকদিন একেক রেস্টুরেন্টে। কিন্তু মীরা তা জানে ও না। রাতে বাড়ি ফিরলে বলে বন্ধুদের সাথে এখানে সেখান গিয়েছে, সেখানেই সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করে এসেছে।

মীরা এখনও ইন্ডিয়ায় বাই এয়ারে না গিয়ে বাসে ঝুলে ঝুলে সারাদিন খরচ করে যশোর গিয়ে বেনাপোল বর্ডার হয়ে, হাজার হাজার মানুষের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে বাই রোডে ইন্ডিয়া যায়। আর সেই রাজিব ঘুরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে, থাইল্যান্ডের পাতায়ায়, মালেইশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুর। অথচ সেই বুফের ডিনার কিংবা বিলাসবহুল প্রমোদ ভ্রমণে ঠাঁই হয় নি ওর দুঃসময়ের সঙ্গী, ওর সহধর্মিণী মীরার। ব্যাপার গুলো এত কষ্টের, যে বুক ভারী হয়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় ও মাঝে মাঝে। এত কষ্ট কেন ওর? কেন এত মানিয়ে নেয়া সত্ত্বেও একছত্র ঠাঁই হলো না রাজিবের মনে?

মীরা একটা বারের জন্য ও বুঝতে পারে নি এই নূহার জন্মের আগেই রাজিবের ঐ গদগদে ভালোবাসা ওর নীলনকশার অংশ। মীরার কেমন ঘিনঘিন লাগে রাজিবের ভালোবাসার ভান ধরে করা আদর, স্পর্শ, আর আলিঙ্গনের কথা ভেবে। এত সব জেনে, শুনে, দেখে মীরার কেবল একটা কথাই বের হয় ভেতর থেকে। অনেক হয়েছে মীরা আর না…

কিন্তু এলোমেলো এ জীবণ গোছানো তো খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার চেয়েও কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কারন রাজিবের একছত্র অধিপত্যে ওর তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যাবসা। মিছে ভালোবাসায় গদগদ মীরা সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আর রাজিব অন্যায় ভাবে রাজ্য দখলের চেয়েও নোংরা খেলা শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই।

বরিশাল না এলেই ভালো হতো। এত কিছু দেখতো ও না, জানতো ও না। যা জেনেছে ও কি হতে পারে তা অনুমান করতে পারবেন আপনারা? যা হয়েছে তা মীরার অনুমানেরও বাইরে। আর আপনাদের ও?

মীরা প্রথমে ভেবেছিলো এসব মিথ্যা। কিন্তু সাথীর ফেসবুক আইডি ওর বড় বড় হোটেল, রেস্তোরাঁয় চেক ইন, দামী দামী পোশাক( যা মীরাদের প্রতিষ্ঠানে তৈরী) এসব তো আর মিথ্যা না। তার উপর সাথীর থাকা বাসা, ওর লাইফস্টাইলের খরচ দেয়া সম্ভব না ওর বাবার পক্ষে। কোত্থেকে আসে এসব? একটা অবিবাহিত মেয়ে ঢাকায় একা কোথায় থাকে তারও হদিস জানে না ওর বাবা মা। কি ভাবছেন? লিভ-ইন করছে রাজিব সাথী। আরে নাহ্ ব্রো!
বলছি, ওয়েট এ সেকেন্ড।

সাথী রাজিবের বিবাহিতা স্ত্রী। যাকে রাজিব সময় দেয় দিনের বেলা। মাল কেনা, তাগাদার কথা বলে বিদেশ ঘুরিয়ে আনে, বন্ধুদের সাথে ঘুরার কথা বলে চেক ইন দেয় শহরের নামকরা সব পানশালায়। এটা যে কত বড় ধাক্কা মীরার জন্য তার কিছুটা দুলুনি টের পেয়েছেন আপনারা ও। মীরার হাতে পলাশ যখন ওদের কাবিন-নামাটা দিয়েছিলো মীরার হাতটা তখন থরথর করে কাঁপছিলো। ওকে দেখে মনে হয়েছিলো হাতের কাগজটা ওর মৃত্যু পরোয়ানা যেন। চোখ থেকে দু’ফোটা পানি ও গড়িয়ে পরেছিলো কাবিন নামার সেই ফটোকপিটাতে। পলাশকে তখন মীরা বলেছিলো-

: ” এখন এসব আমাকে দেখানোর মানে কি? ”
কোন কথাই বলতে পারে নি পলাশ। মাথা নিচু করে বসে ছিলো অপরাধীর ভঙ্গিতে। বেশ কিছক্ষণ নিরব থেকে মীরা যখন চলে আসতে উঠে দাঁড়ালো পলাশ বলেছিলো –
: “আমি আপনার ব্যাপারে এতসব জানতাম না, বড় আপা ( বড় মামার বড় মেয়ে লাবণী) যখন ঢাকা থেকে ফিরে এলো, আপনার ব্যাপারে এত এত প্রশংসা করতে লাগলো যে ভাইয়ার বলা আপনার বিরুদ্ধে কথাগুলো যে অপবাদ তা টের পেলাম আমি। তার পর থেকে অনুশোচনায় ভুগছি । আমার অপরাধ গ্লানি বেশী কারন ঐ বিয়েতে আমি ছিলাম সাক্ষী হিসেবে, তাই এসব জানালাম আপনাকে যদি এতে পাপ কিছুটা মোচন হয়”
: ” সাথী জানতো না যে রাজিব বিবাহিত? ”
: ” হুম”
: ” তারপরও…”
: ” আসলে ভাইয়া এমন একটা কথা বলেছিলো যা আমি আপনাকে এখন বলতে পারবো না”
: ” তাহলে অর্ধেক কেন বললে? খুব তো ভালো ছিলাম আমি মিথ্যা মায়ায় ডুবে”
: ” আপনার ভালোর জন্য বলেছি”
: ” আমার যে ভালো করে দিয়েছো সাক্ষী থেকে, তোমার এ ঋণ আমি ইহ জনমে ভুলতে পারবো কি না তা জানি না, বলবে কি , কি অভিযোগ ছিলো ওর আমার প্রতি? ”
বেশ কিছু সময় মৌন থেকে পলাশ বলে-
: ” আপনার আগে নাকি বিয়ে হয়েছিল, ঐ ছেলের সাথে….”
: ” থাক, বুঝেছি আমি বলতে হবে না আর পুরোটা।
দুই হাতে মুখ চেপে অনেক কাঁদে মীরা। কার জন্য কি করলো সেই দুঃখই পোড়াচ্ছে ওকে। পলাশ সময় দিলো মীরাকে৷ কাঁদুক তিনি, না হলে দম আটকে মরে জাবেন তিনি। পলাশ যেন স্বান্তনার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কান্না থামার অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই নেই করবার।

বেশ কিছু সময় পর কিছুটা শান্ত হয় মীরা, চোখ, নাকের পানি ওড়নার কিনারে মুছে, শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বলে-
: ” শোন পলাশ সে রাতে কাবিন হয়েছিল আমার আর আবীরের, আমি আর আবীর সে রাতে যার যার বাড়িতে ছিলাম। কালিমার বিয়ে ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কিছুই ছিলো না। ও কোনদিন এসব আমাকে জিজ্ঞেস করে নি, করলে হয়তে ওর ভুল ধারনাটা পরিষ্কার হয়ে যেতো। যাক গে তোমাকে এসব বলে লাভ কি?”
: ” আমাকে ক্ষমা করবেন ভাবী ভাইয়া যা বলেছে তা ছেঁকে মার্জিত ভাবে যেটুকু বলা যায় সেটুকুই বলেছি আমি”
: ” একটা উপকার করবে আমার? ”
: ” একবার বলে দেখেন ভাবী, আমার এ পাপ মোচনে সব করতে প্রস্তুত আমি”
: ” তোমার কোন পাপ নেই পলাশ, তুমি সাক্ষী না দিলেও ওদের বিয়েটা আটকে থাকতো না। আমি যে সব জানি তুমি এটা ওদেরকে বলো না। সবদিকে ভেঙে পরেছি আমি, আমি একটু সময় নিয়ে দাঁড়াই, নিজেকে সামলে নিয়ে চলে যাবো ওদের জীবণ থেকে”

কথাটা বলে সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মীরা।

মীরা সে রাতে ঘুমুতে পারে নি। এক এক করে রাজিবের সব চাল মনের দরজার সামনে আসে ওর। দাওয়াতে আসবে না বলেও মীরাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ের দাওয়াতে নিয়ে আসাটাও রাজিবের পরিকল্পনারই একটা অংশ। রাজিব মীরাকে এসব জানাতেই নিয়ে এসেছে এখানে। যাতে কষ্ট করে ওকে কিছু বলতে না হয়। হয়তো সাথীর পক্ষ থেকে চাপ ছিলো ওর প্রকাশ্যে আসার।

রাজিব ও তাই ওর আখের গুছিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকে যে যৌথ একাউন্ট ছিলো ওদের দুজনের নামে, তাও ব্যাংকিং ঝামেলার কথা বলে ক্লোজ করে দিয়ে নিজের নামে একা একাউন্ট খুলেছে, মীরা জানে এ ব্যাপারটা। এমনকি পুরাতন কর্মচারী ছাঁটাই করাটাও ছিলো রাজিবের একটা চাল। পুরাতন সবাই জানতো এ প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে মীরার কি ত্যাগ আর পরিশ্রম ছিলো। তাইতো ভবিষ্যতে কোন ঝামেলা যাতে না হয় তাই সব কর্মী ছাটাই করে দিয়েছে রাজিব। মিথ্যা ভালোবাসায় অন্ধ মীরা স্বামীর কৃত্রিম ভালোবাসা কিনেছে এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার বিনিময়ে। দিন শেষে না রইলো স্বামীর ভালোবাসা না ওর ব্যাবসা। এতটা খারাপ মানুষ হয় কি করে?

কি করবে ভেবে পাচ্ছে না মীরা। অনেক চিন্তা ভাবনার পর একটা সিদ্ধান্তে আসে মীরা। যুদ্ধে নামার আগে প্রতিটা যোদ্ধা জানে – ” হয় মা’রো নয় ম’রো। যুদ্ধ বিদ্যা না জানলেও এটা বুঝতে পেরেছে মীরা ঠিকই। এ যুদ্ধ নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর যুদ্ধ।

এমন সময় কেবিনের দরজা খোলার শব্দ কানে আসে মীরার। মীরা মুচকি হেসে বলে-
: ” কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
: ” এই তো রাতের খাবার নিয়ে এলাম”

মীরার ওড়না বিছিয়ে খাবার নিয়ে বসে দুজন। রাজিব মনোযোগ দিয়ে ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে খাচ্ছে। আর মীরার মনোযোগ রাজিবের দিকে। একটা মানুষ এত সুন্দর অভিনয় করে কিভাবে? মনে মনে ভাবে মীরা। হঠাৎ মীরা বলে-
: ” জানো ছোটবেলায় ক্লাস সিক্সে থাকতে একক অভিনয়ে জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পেয়েছিলাম আমি ”
রাজিব খাওয়া বন্ধ করে তাকায় ওর দিকে। তুলে নেয়া হাত নামিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে –
: ” হঠাৎ এ কথা কেন?”
: ” মনে পরলো এ কথাটা তুমি জানো না, বলা হয় নি কখনো, তুমি স্কুলে থাকতে সবচেয়ে ভালো কিসে ছিলে? ”
: ” তীরন্দাজে”

মীরা এবার খাওয়া থামিয়ে তাকিয়ে থাকে রাজিবের দিকে। তারপর হঠাৎ কেমন একটা হাসি হাসে মীরা। হঠাৎ মীরার এমন হাসি দেখে ভড়কে যায় রাজিব। কি হলো মেয়েটার মনে মনে ভাবে রাজিব। আর মীরা ভাবে –
: ” তোমার খেলা শেষ রাজিব, তুমি যেভাবে সব কেড়ে নিয়েছো আমার থেকে তা হারানোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেলো আজ থেকে”

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-১৯+২০+২১+২২

0

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ১৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সেদিনটা তুমুল ব্যাস্ততায় কাটে মীরার। অনলাইনে পাঁচটা অর্ডার আসে ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে। সামনে ইদ হওয়ায় প্রচুর মালামাল স্টক করা হচ্ছে কারখানায়। কারন যে কোন উপলক্ষ সামনে করে সব মেটেরিয়ালের দাম বেড়ে যায়। স্টাফরা তাই ব্যাস্ত সেগুলো আনলোড করায়। তখনকার সময়ে প্রোডাক্ট ডেলিভারির ব্যাপারটা এত সহজ ছিলো না। এখনকার মতো এত ডেলিভারি কোম্পানি ও ছিলো না। তাই কারখানার দুজন স্টাফকে দুপুরের পর সাইকেল দিয়ে পাঠানো হতো অর্ডার পৌঁছে দিতে। ওদের সেদিন মালপত্র আনলোডের কাজ থাকায় মীরা ওর স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে পরে ডেলিভারিগুলো পৌঁছে দিতে। যাওয়রা আগে ডিরেকশন গুছিয়ে নেয় মাথায়। একে একে ডেলিভারি দেয় ওয়ারী, মতিঝিল, বেইলী রোড, খিলগাঁও, মালিবাগ, ধানমন্ডি এরিয়াতে। সেদিনের চতুর্থ ডেলিভারিটা ছিলো বেইলি রোডে। মেরুন রঙের একটা পার্টি গাউনের অর্ডার ছিলো সেটা।

আসপাশের লোকের থেকে জিজ্ঞেস করে বাসাটা খুঁজে বের করে মীরা। বেইলী রোড চিনলেও এ জায়গাটায় আগে আসে নি মীরা। তাই সবসময়ই ও ডেলিভারি দিতে এলে এমনি সাহায্য নেয় লোকেদের। বাড়ি নম্বর ১২৭/এ, ফ্ল্যাট নং ৩০২। ফোন করে তাকে নামতে বললে তিনি রিকুয়েষ্ট করে উপরে আসার। তার বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। মীরা সবসময় বাড়ির বাইরেই ডেলিভারি দেয়। ভিতরে যায় না কখনো। বাচ্চার কথা শুনায় আর দ্বিমত না করে মীরা সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে। কলিং বেল দিয়ে অপেক্ষা করে মীরা। তিনতলায় উঠে একেবারে ঘেমে কাঁদা হয়ে যায়। ওড়না দিয়ে সে ঘাম মুছে মীরা। দ্বিতীয়বার বেল চাপে না, পাছে বাচ্চাটা উঠে পরে।

বেশ কিছু সময় পর গেইট খুলে একটা মেয়ে। গেইট খুলে সরি বলে এত সময় অপেক্ষা করানোর জন্য, আর ধন্যবাদ দেয় দ্বিতীয়বার বেল না চাপার জন্য। দ্রুত কথাটা শেষ করে মীরাকে আপাদমস্তক দেখে ভীষণ অবাক হয় সে। বলে-
: ” আরে মীরাপু যে ! ”

যদিও মীরার কিছুটা সময় লাগে তাকে চিনতে। যা মাথায় নিয়ে ঘুরছে বেচারী না চিনবারই কথা। তার উপর এত বছর পর দেখা। দুই দেখার মধ্যে সময়ের পার্থক্যের চেয়ে মেয়েটার ওজনের পার্থক্য বেশী হওয়ায় মীরার ওকে চিনতে বেশী অসুবিধা হয়। তবে যখন চিনতে পারে মীরার মাথায় আকাশ ভাঙে যেন। সংক্ষিপ্ত কুশলাদি বিনিময় করে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসতে চায় ও। কিন্তু মেয়েটি ওকে ছাড়ে না। হাত টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। জিজ্ঞেস করে কেমন আছো আপু? উত্তরে কি বলবে ভেবে পায় না মীরা।

আচমকা মীরার হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে সে। মীরা যেন এখান থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচে। ওর দিকে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে। কারন ওর সামনের সোফায় বসে রয়েছে আবীরের ছোট বোন ফিওনা। সেই আবীর যাকে বিয়ে করে পরদিনই পালিয়ে এসেছিলো মীরা। নিরপরাধ এক ছেলের জীবণের সাদা পাতায় কালো দাগ এঁকে দিয়ে চলে এসেছিলো ও।

মীরার কেমন অস্বস্তি লাগে। কেন দেখা হলো এর সাথে। এমনিই কি কষ্ট কম ওর জীবণে। নিশ্চয়ই কথা শুনাতে ঘরে এনে বসিয়েছে ওকে ফিওনা।

ফিওনা ওকে বসিয়ে রেখে জুস আর বিস্কুট নিয়ে এলো। তারপর মীরাকে স্বাভাবিক হতে সময় দিলো কিছুটা।
বেশ কিছু সময় পিনপতন নীরবতা। তারপর ফিওনা বললো-
: ” তারপর কেমন আছো মীরাপু? ”
: ” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তোমরা সবাই কেমন আছো? ”
: ” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি সবাই। আমার বিয়ে হলো চার বছর। বাবুর বয়স আটমাস। আলহামদুলিল্লাহ শ্বশুর বাড়ির লোকেরা খুব ভালোবাসে আমাকে।
: “যাক ভালো হলেই ভালো, খালা-খালু? ”
: ” মা মা’রা গেলো তিনবছর হলো। বাবা প্যারালাইজ হয়ে বিছানায় তার পর থেকেই। বুঝলা খুবই হার্ড টাইম যাচ্ছে আমাদের ”

মীরার খুব ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করে আবীর কেমন আছে? কিন্তু জিজ্ঞেস করবার মুখ ওর নেই।

মীরা কি ভেবে যেন জিজ্ঞেস করলো –
: ” খালুকে দেখাশোনা করে কে?”
: ” পার্মানেন্ট বুয়া রাখা আছে, সেই দেখাশোনা করে”
তোমার খবর বলো-
: ” এই তো ভালোই আছি আলহামদুলিল্লাহ। ”
: ” বিজনেস উমেন বনে গেছো। তুমি ডেলিভারি দিতে আসবে ভাবি নি, এর আগেও ড্রেস নিয়েছি তোমার পেইজ থেকে”
: ” তুমি জানতে এটা আমার পেইজ?”
: “হুম, জানতাম তো ”
: “আচ্ছা আসি ফিওনা, কারখানায় আজ বড় শিপমেন্ট এসেছে, তা আনলোড করায় ব্যাস্ত সবাই, তাই আমি ডেলিভারি দিতে বেরিয়েছি, আরো একটা ডেলিভারি রয়েছে”
ক্ষণকাল চুপ থেকে ফিওনা বলে-
: ” তুমি চলে যাওয়া দিয়ে সেই যে দুঃসময়ের শুরু হলো এখনো তা পিছু ছাড়ে নি আমাদের। তুমি তো দিব্যি ভালো আছো সংসার, ব্যাবসা নিয়ে আমার ভাইটা এখনো বিবাগী। মেয়ে দেখতে গেলেই শুনতে হয়- “নিশ্চয়ই ছেলের কোন সমস্যা আছে, তা না হলো বৌ কেন বিয়ের পর দিনই পালায়? ”
অসহায় দৃষ্টিতে মীরা তাকায় ফিওনার দিকে। বলে-
: ” ভাইয়া বিয়ে করেন নি এখনো? ”
কিছু সময় কেমন একটা অসহায় দৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে থাকে ফিওনা। সে দৃষ্টি যেন অনেক কিছু বলছে মীরাকে। কিছু সময় পর ফিওনা হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে-
: ” না, মা থাকতে বলতো আমাকে বিদায় করে বিয়ে করবে, কিন্তু মা চলে যাবার পর কেও তাকে এ কথা বলে সুবিধা করতে পারে না, কেও জোর করলে বলে-
‘বিয়ে একটা করতে হয় জীবনে, করেছিলাম, ব্যাস এসব নিয়ে আমাকে কেও যন্ত্রণা দিও না ‘

কথাটা বলে আরো কিছু সময় চুপ দুজনেই। মীরার খুব কষ্ট হয়, নিজের সিদ্ধান্তের জন্য। আবীর নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ, স্বামী হিসেবেও ভালোই হতো। ওর মনে পরে বিয়ে পড়ানোর পর দুজনকে এক রুমে রেখে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলো যখন আবীর মীরাকে বলেছিলো-
” আমি খুবই কৃতজ্ঞ খোদার প্রতি, যে তুমি আমার স্ত্রী ”
উত্তরে মীরা ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলো। অল্পভাষী আবীরের এ কথাটাকে ন্যাকামী মনে হয়েছিলো তখন। লাজুক আবীর মীরার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, মনে হয়তো নববধূকে ছুঁয়ে দেখার বাসনা লুকিয়ে ছিলো। কিন্তু আকদের পর দু’জন দুই বাড়ি ফিরে যায়। তাছাড়া ওদের অনুষ্ঠানের তারিখও দেয়া ছিলো। তাই আবীরও সংযত করেছিলো নিজেকে। বাইরে থেকে আবীরের ফেরার ডাক পরলে হাতে একটা বক্স দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিল সে। আর বলে গিয়েছিল –
” আজ যাই আমি, খুব দ্রুত আমাদের দেখা হচ্ছে ”

ও বের হতেই বাক্সটাকে ছুড়ে ফেলে ব্যাঙ্গ করেছিলো ওর কথাগুলোকে। সত্যি ভালেবাসা চিনতে না পারাটা ভুল ছিলো। এসব ভাবতেই নিঃশব্দের এই আবরণ ভাঙে ফিওনার বাচ্চার কান্নায়। কান্নাটাকে বড় মধুর মনে হলো ওর। কারন এ কান্না ওদের অস্বস্তিকর কথার তার কেটে দিয়েছে। সুযোগ করে দিয়েছে মীরার প্রস্থানের।

বাচ্চা কোলে নিয়ে ফিওনা এসে বললো-
দেখো মেয়ের কান্ড, কতক্ষণ হলো ঘুমিয়েছে? ঘুম এত কম এর, জানো না।

মীরা বাচ্চাটালে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
: ” নাম কি ওর? ”
: ” উমাইজা”
: ” বাহ্ মিষ্টি নাম”
আদর করে বললো-
: “উমাইজা ওর বাবার মতো হয়েছে দেখতে”
: “হুম, বাবা বলতে অজ্ঞান, সারাদিন আমি রাখি, বাবা এলে আমি কে?”
: ” সব মেয়েরাই বাবাদেরকে বেশী ভালোবাসে”

কথাটা বলে অপরাধের পাল্লাটা যেন আরো বাড়ে।
কিছু অনুভূতি গলার কাছে পাক খাচ্ছে, চোখের পানি
মীরার অনুমতির অপেক্ষায় বের হাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। মনে মনে বলে- ” ভালো থাকুক সব বাবারা”

: “আচ্ছা আসি, ভালো থেকো তোমরা। আমাদের বাসায় এসো” বলে উঠে পরে মীরা।

কথাটা শুধু বলার জন্য বলা। বাসায় আসতে বললো কিন্তু কোন ঠিকানা দিলো না। ফর্মালিটি আর কি। ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বাবুর হাতে দিয়ে দ্রুত চলে আসে সেখান থেকে মীরা । ফিওনাকে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, শেষ সিঁড়ি কাছে আসার সময় বললো-
: ” দোয়া করো আমাদের জন্য ”
: ” তুমিও”

দ্রুত পায়ে চললো মীরা। মাথায় ঘুরছে কেবল ফিওনার কথা গুলো।

জীবণ…!
একটা সিদ্ধান্ত সব কেমন এলোমেলো করে দেয়।
আবীর বিবাগী, মীরা আছে অশান্তিতে, রাজিবের অধঃপতন।

ভাবনার জালে ঘিরে থেকেই অর্ডার ডেলিভারি দিয়ে কারখানায় আসে মীরা। রাজিবকে সেখানে পায় না ও । এক হিসেবে ভালোই হয়েছে দেখা হয় নি। সব কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরে মীরা। ঘরদোর গুছগাছ করে রাতের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে যায় । আজ রাজিবের পছন্দের খাবার তৈরি করে ও। সরিষা ইলিশ, চিংড়ির দোপেয়াজা, লাউশাক ভাজি, আর ভুনা ডাল। সব তৈরি হলে টেবিলে বসে অপেক্ষা করে রাজিবের। ওর হাতে বই-
” নিঃসঙ্গতার একশো বছর ” গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা অমর সৃষ্টি এ উপন্যাস। একটা উক্তি রয়েছে উপন্যাসটিতে ” দুজনের মধ্যে যার ভালোবাসা কম সে-ই সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে ”

বেশ রাতে বাড়ি ফিরে রাজিব। মনকে শান্ত রাখতে বইয়ে ডুব দেয়া মীরার সময়ের খেয়াল নেই। বাইরে থেকে চাবি দিয়ে গেইট খুলতেই ভিতর থেকে গেইট খুলে দেয় মীরা। রাজিব ভরকে যায় মীরাকে দেখে। বলে-
: ” ঘুমাও নি তুমি?”
: ” না ”

কোন কথা না বলে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয় রাজিব। এ ফাঁকে রান্নাঘরে যায় মীরা। খাবার গরম করতে গিয়ে ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই মীরার খেয়াল হয় দেড়টা বাজে।
ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খেতে আসে রাজিব। মীরা ওকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের জন্য ও খাবার নেয় প্লেটে। রাজিব মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” এখনো না খেয়ে জেগে আছো কেন? ”
কোন উত্তর দেয় না ও, না শোনার ভান করে ।

সুন্দর করে খাবার খাওয়ায় মীরা রাজিবকে। রাজিব মনে মনে ভীত গত রাতের ঘটনায়। এজন্যই এত রাত করে বাড়ি ফেরা। ভেবেছিলো মীরা ঘুমিয়ে থাকবে। কিন্তু মীরার এই স্বাভাবিকতা রাজিবকে কনফিউজড করে। মীরাকে কি তাহলে কিছু বলে নি টুম্পা? মীরার দিকে তাকিয়ে মীরার মন পড়ার চেষ্টা করে রাজিব। কিন্তু ইন্দ্রজালে ঢেকে রাখা মীরাকে পড়বার ক্ষমতা হারিয়েছে রাজিব বহু আগেই।।আজকাল তাই আর বৃথা চেষ্টা করে না সময় নষ্টের কথা ভেবে । স্বাভাবিক ভাবে খাবার খেয়ে রুমে ঢুকে রাজিব। মীরা বাসনপত্র গুছিয়ে ঘরে এসে দেখে রাজিব মশারী টানিয়ে মাত্র শুয়ে পরেছে। বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মীরা রাজিবকে বলে-
: ” বের হও তো, কথা আছে তোমার সাথে।”
রাজিবের হার্টবিট থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো এ কথা শুনে। চোখেমুখে স্বাভাবিকতা টেনে রাজিব বলে-
: ” লাইট অফ করে বিছানায় এসে বলো”
: ” না, ড্রাইংরুমে এসো ”
বলে ড্রইংরুমে চলে যায় মীরা। অগত্যা রাজিব মশারীর ভিতর থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে যায়। গিয়ে দেখে মীরা বসে আছে। রাজিব ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি ব্যাপার? ”
: “ব্যাপার কি তা তো আমার চেয়ে ভালো তোমার জানার কথা, তুমিই বলো কি ব্যাপার? ”
: ” মানে?”
: ” গতরাতে তুমি টুম্পার ঘরে কেন গিয়েছিলে? ”
: ” টুম্পার ঘরে? ”
: ” এখন আবার বলো না কোন টুম্পা? ”
: “মানে?”
: ” মানে বুঝতে পারছো না তুমি?
টুম্পা…! টুম্পা…!”
: ” আরে ওকে কেন ডাকছো?”
: ” তুমি বুঝতে পারছো না তো, তোমাকে বোঝাতে ওকে ডাকছি, এদিকে আয় তো টুম্পা…
রাজিব বুঝে গেছে ওর জারিজুরি শেষ”

একটু পর টুম্পা এসে ওদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। মীরা টুম্পাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি হয়েছিল গতরাতে বল”
রাজিব রেগে টুম্পাকে বলে –
: “তুমি যাও এখান থেকে। অভদ্র মেয়ে কোথাকার”
: ” অভদ্র কি ও না তুমি? রাতের বেলা একটা মেয়ের ঘরে ঢুকে তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়াটা কি ভদ্রতা?”
: “আমি কথা বলছি তোমার সাথে আগে ওকে যেতে বলো”
: ” না, ও এখানেই থাকবে?”
দুজনের কথা কাটাকাটি শুনে টুম্পা চলে যায় সেখান থেকে। রাজিব ও চলে যাবার সাথে সাথেই মীরার কাছে এসে হাত চেপে ধরে বলে-
: ” আমার ভুল হয়ে গেছে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ভুল করে ফেলেছি আমি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও”
: ” ছিঃ রাজিব তোমার এত অধঃপতন হয়েছে। দাওয়াতের ঐ মহিলা আমার মায়ের বয়সী, টুম্পা কি দেখতে আমার চেয়ে বেশী সুন্দর? আমি সব ছেড়ে তোমার ভালোবাসার জন্য তোমার কাছে চলে এসেছি, আর তুমি?
রাজিবের কাধে ঝাঁকুনি দিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করে –
” কেন করলে তুমি এমন? ”

রাজিব দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে রাখে।
মীরা কান্না করতে থাকে। আজ সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে বড় ঘৃণা হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছিল ছাঁদ থেকে লা’ফ দিয়ে জীবণ যন্ত্রণা শেষ করে দেয়।

মীরার পায়ের কাছে বসে ক্ষমা করে দিতে বলে। আমি কেন ক্ষমা করবো, ক্ষমা করবে টুম্পা। রাজিব মীরাকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

মীরা কোন কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে জীবণের হিসেব নিয়ে। বাবা, মা, আবীর, একটা ভুল, আর রাজিব এ শব্দ গুলো মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় দপদপ করছে ওর। শরীর জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি, তবুও ঐ শব্দ গুলো ঘুমাতে দিচ্ছে না ওকে। অসহ্য এ যন্ত্রণা সে রাতে জাগিয়ে রেখেছিলো মীরাকে।

মীরা পরদিন টুম্পার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলো ওর স্বামীর হয়ে। হাত ধরে অনুরোধ করেছিলো যাতে এ ব্যাপারটা কোনদিনও পিয়াসাকে না জানায় ও। টুম্পা ও কথা দিয়েছে এ কথা কাওকে কোনদিন বলবে না ও। মীরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো টুম্পা ওকে ভুল না বুঝায়।

এ ঘটনার পর ছয়মাস দুজনের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিলো না। কথাবার্তা হতো টুকটাক। এ ব্যাপারটার পর মীরা অনেক চিন্তা ভাবনা করেও টুম্পাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় নি। কারন টুম্পা ভালো তাই ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে মীরাকে খুলে বলেছে সব, অন্য কেও যে বলবে তার গ্যারান্টি কি?
তাছাড়া টুম্পা মীরার দুনিয়ায় অবিচ্ছেদ্য একজন হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজনহীন এই দূর্গম পৃথিবীতে টুম্পাই একমাত্র সহায় ওর।

সময়ের আবর্তনে রাজিবের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে, বিছানা ভাগ করেছে দুজনে ঠিকই কিন্তু ঐ ঘটনার পর সম্পর্কের কোথায় যেন একটা তার ছিড়ে গেছে। তা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত মীরা। আর রাজিবের কোন দায় নেই যেন ছেড়া তার জুড়তে….

চলবে…

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ২০ ( সদ্য রান্নাকৃত ধোঁয়া উঠা নতুন পর্ব 😅)
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার ডেলিভারির ডেট এগিয়ে এসেছে। এবারকার চেক-আপের সময় আরেক দফা আলট্রাসাউন্ড করে সম্ভাব্য ডেট দিয়েছে ডাক্তার, এর আগে যদি কোন সমস্যা হয় তাহলে চলে আসবে আর না হলে সেই ডেইট অনুযায়ী আসবে হসপিটালে এডমিট হতে। আর হ্যা ডাক্তার এও বলেছেন- মীরা রাজিব দম্পতির ঘর আলো করে রাজকন্যা আসছে।

খবরটা শুনে খুবই খুশি মীরা, খুশি রাজিবও। তাদের অসম্পূর্ণ জীবণকে কোন একজনের আগমনে পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে এই খুশি ভাগ করে নেবার মতো সেই টুম্পাকেই পেলো। টুম্পা বললো-
: ” মন থেকে মেয়ে চেয়েছিলেন, আল্লাহ আপনার বাসনা পূর্ণ করেছেন”
: ” ও আমাদের জন্য পয়মন্ত বুঝলি। ওর উছিলায় আল্লাহ আমাদের সব ঠিক করে দিক।”
: “আমীন ”
: ” আমীন”

দিন চলছে তার নিজস্ব গতিতে,একই সাথে জীবণ নদীও। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ছোট্ট এই পরিবারের মানুষের জীবণে। মসলা কষানোর গন্ধ সহ্য হয় না মীরার, ভাত রান্নার ঘ্রাণেও বমি হয়। প্রেগন্যান্সির শুরুতে নাকি সবার এমন হয় কিন্তু ওর বেলায় হলো উল্টো। শেষের দিকে এসে এমন অবস্থাটা ওর জন্য ভারী হয়ে গেছে। রাজিব রান্নাঘরে তাই থাই গ্লাস লাগিয়ে দিয়েছে। রান্নার সময় নতুন রান্নার খালা মাজেদা দরজা আটকে নেয়। মসলা কষানোর পরিবর্তে মেখে তরকারি রান্না হয়, প্রথম যখন রান্নার কাজে যোগ দিলেন তিনি মীরা তাকে দেখে বলেছিলো –
: “পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে খালা। মাছ, মাংস ভালো করে ধুয়ে নিবেন, আর নাগা দিতে পারবেন না, দেখছেনই তো আমার অবস্থা।
উত্তরে তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেছেন-
: “খালা আমারে কাম শিখাবেন না, আমি উচ্চ বংশের মাইয়্যা । নিজের পছন্দে জামাই হারামজাদারে বিয়া কইরা আজ আমি মাইনষের বাড়িত কামে ভর্তি হইছি”

ভর্তি হওয়ার কথা শুনে হেসে দেয় টুম্পা। রেগে গিয়ে বলেন আফা আপনি হাসলেন ক্যান? মীরা টুম্পাকে ধমক দিয়ে ভিতরে চলে যেতে বলে। আর মাজেদা খালাকে বলে-

: ” কবে থেকে কাজে আসবেন? ”
: ” আপনে কইলে এহন থেইক্যাই, তয় খালা আমার একটা কথা”
: ” কি কথা?”
: ” একমাসের বেতন এডবান্স লাগবো ”
: ” এটা কি শর্ত নাকি প্রয়োজন? তাছাড়া আপনাকে কাজে রাখবো কি না….”
কথাটা শেষ করতে দেয় না মাজেদা খালা, মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে আজকের রান্না খাইয়্যা পছন্দ হইলেই ট্যাকাডা দিয়েন। ট্যাকাডা আমার বড় দরকার।
: ” আজ তো বাজার নেই বাসায়”
: ” সমস্যা নাই, যা আছে তাই রানমু”

বাসায় শাক সবজি দিয়ে ভর্তি ছিলো ফ্রিজ। মাছ মাংস সব শেষ আছে কেবল একটা কাতল মাছের মাথা। মীরা সবকিছু বের করে তার সমনে দিতেই পান খেয়ে কালো করে ফেলা দাঁত বের করে তিনি বলেন –
: “নাই মানে এগুলান দিয়া আমি দশ পদ রানতে পারমু। আপনে কয় পদ খাইবেন কন”
: ” এত পদ কে খাবে, আমরা মানুষ মোটে তিনজন, আপনাকে নিয়ে চারজন, চারজনের খেতে যতটুকু লাগে ততটুকু রাঁধেন”

তাকে মসলা পাতি সব দেখিয়ে দিয়ে মিরা বসেছে ল্যাপটপ নিয়ে। নতুন জামার ডিজাইন করছে ও। কাজ করলে সময়-জ্ঞান থাকে না ওর। তবুও একবার উঁকি দিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। গিয়ে দেখে রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত তিনি। সব কিছু পরিপাটি করে কেটে বেছে আলাদা আলদা পাত্রে রেখে দিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন ছবি তোলার জন্য সাজিয়ে রেখেছেন। আর নিচে বসে ইয়া সাইজের মাথা কাটছেন তিনি। তার মাছের মাথা কাটা দেখে হতবাক মীরা। এতবড় মাথা মীরা জীবণেও কাটে না। সিদ্ধ করে রান্না করে নয় তো কাজের আপা রেবেকাকে দিয়ে দেয়। বড় মাছের মাথা সাধারণত রাজিব বাজার থেকেই কেটে আনে। পাঁচ কেজি ওজনের এই মাছটা টুম্পার ভাই গত সপ্তাহে গ্রাম থেকে এনেছিলো। মাছটা টুম্পা কাটতে পারলেও মাথাটা কাটতে পারে নি। তাই এটা এভাবেই পরে ছিলো। ভেবেছিলো রেবেকাকে দিয়ে দিবে। কিন্তু তিনি অনায়াসে মাথাটা কেটে ফেললেন।

মীরা ঘরে ফিরে এসে আবারও কাজে ব্যাস্ত হয়ে যায়। একটু পর মাজেদা খালা ওর ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে-
: ” আফা মুগের ডাল আছে”
ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে মীরা বললো-
: “নিচের কাবার্ডের বামে দিকে বড় হরলিকসের বয়ামে আছে”

একটু পর আবার দেখতে গেলো কি করছেন মাজেদা খালা। গিয়ে দেখেন হাত দিয়ে ধনেপাতা ছিড়ে তরকারিতে দিচ্ছে। এটা দেখে মীরা বললো-
: ” ঐ যে খালা চপিং বোর্ড আর চাকু আছে ঝুলানো, ঐটা দিয়ে কাটেন”
: ” খালা হাত দিয়া ছিড়া দিলে ঘ্রাণ কইব বেশী”

মীরা মনে মনে ভাবে একটু আগে বললো আপা, এখন আবার খালা, এর মাথায় সমস্যা আছে কি। ভাবতে ভাবতে গোসলে গেলো ও।

গোসল সেরে এসে দেখে টেবিলে ধোঁয়া উঠ গরম ভাত, কাতল মাছের মুড়িঘণ্ট, একটা বাটিতে মিষ্টি কুমড়া, পটল, সিম, মূলা, বেগুন, লাউ শাক দিয়ে নিরামিষ টাইপ তরকারি, আলু টমেটো দিয়েও কাতল মাছের মাথা রেঁধেছে। শশা, টমেটোর সালাদ, কাগজি লেবু। দেখে মীরার ক্ষুধা যেন বেড়ে গেলো। টুম্পা আর মাজেদা খালাকে ডাকলো টেবিলে। টুম্পা টেবিলে বসলেও মাজেদা খালা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো, বললো-
: ” আইজ আমার পরীক্ষা, পাশ না ফেল সে খবর না হুইন্যা খাওয়া নামবো না গলা দিয়া”

মীরা তাকে বসাতে ব্যার্থ হয়ে শুরু করলো খাওয়া। প্রথমে নিলো নিরামিষ মতো তরকারিটা। পাতে নিতেই দেখে মাছের মাথা টুকরো করে দেয়া। খেতে খেতে বলে-
: ” আমি তো ভেবেছিলাম এটা নিরামিষ”
: ” না, না এটারে আমাগো গায়ে ছ্যাচড়া কয়”
: ” একটা মাথা দিয়ে কয় পদ রেঁধেছেন? ”
: ” কইলাম না এত বড় মাথা দিয়ে কম কইরা হইলেও দশ পদ রানতে পারতাম, আপনে চাইরজনের কথা কইলেন তাই….”

অনেকদিন পর পেট ভরে ভাত খেয়েছিলো সেদিন মীরা।
মাজেদা খালার হাতের রান্না এত চমৎকার যে যাই রাঁধে তাই অমৃতসম মনে হয় খেতে। বাজার কি আছে তা নিয়ে ভাবনা নেই। যেদিন মাছ-মাংস না থাকে সেদিন খাওয়াটা আরো যুত হয়। শাক,ভর্তা, ভাজি।

প্রেগ্ন্যাসির এই সময়টাতে আগের মতো এত দৌড় ঝাঁপ শরীরে কুলোয় না। মীরার শরীরে নতুন করে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডায়েবিটিস ধরা পরেছে, সাথে থাইরয়েডের কিছু সমস্যার ও উদ্ভব হয়েছে। ওজন বেড়ে ৬৩ থেকে দাঁড়িয়েছে ৮৯ তে । যদিও নিয়ম করে কারখানায় যায় ও। তবে খুব কষ্ট হয় খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠতে। মাঝপথে কয়েকবার জিরিয়ে নিতে হয়। আগে দিনের মধ্যে কতবার যে সিঁড়ি বইতো মীরা তার কোন ইয়াত্তা নেই। কিন্তু এখন একবার উঠনামা করতেই জান যায় যায় অবস্থা। রাজিব যদিও নিষেধ করে ওকে আসতে। কিন্তু মীরা শোনে না।

হসপিটালে যাবার জন্য সবকিছু গোছগাছ করছে মীরা আর টুম্পা। কিছু কেনাকাটা ও বাকী রয়েছে। টুম্পা তার লিস্ট করে রেখেছে বলেছে ভার্সিটিতে যাবার সময় নিউমার্কেট থেকে কিনে আনবে।

কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে হসপিটালে থাকবে কে? যদিও টুম্পা পাশে আছে সব সময় কিন্তু টুম্পা নিজেই তো বাচ্চা মেয়ে। মাজেদা খালা বলেছেন চিন্তা করবেন না আফা, আমি থাকবো আপনার সাথে। তার ভরসায় কিছুটা নিশ্চিত হয়েছে মীরা। আসলে বিপদের এ সময়টা কোনমতে কেটে যাক তাই মনে মনে প্রার্থনা করে ও।

এই টোটাল প্রেগ্নেন্সির জার্নিটাই মীরার জন্য ভীষণ চ্যালেন্জিং। কারন রাজিবের সব কিছুতে এমন গা ছাড়া ভাব, দায়িত্ব জ্ঞানহীণতা, ওর বহুমুখীতা, সম্পর্কটাকে কেমন ভঙ্গুর করে দিয়েছে। সবাই বলে একটা বাচ্চা হলে এমন বাউণ্ডুলে ছেলেরা সন্তানের দিকে চেয়ে বদলে যায়, ঘরমুখো হয়।

এই যে এমন বেখেয়ালি, দায়িত্ব জ্ঞানহীন রাজিবের বাচ্চার মা হওয়া, এটা ওদের ভাঙাচোরা সম্পর্ক মেরামতের একটা চিকিৎসা ও বটে। অনেক ভেবে চিন্তে মীরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সাথে নিয়েছে আরো কঠিন এক সিদ্ধান্ত।

এ সিদ্ধান্তটা নিয়েছে এক্কেবারে সন্তর্পণে। ও ব্যাতিত কেও জানে না এই সিদ্ধান্তের কথা, আর তা হলো- “এটাই রাজিবের শেষ সুযোগ। এর পরও যদি রাজিব না শুধরায় তবে মীরা ত্যাগ করবে রাজিবকে৷ জীবনে ভুল করে সেই ভুলকে ভুল জেনেও বয়ে যাবার মতো ভুলটাকে আর দীর্ঘায়ীত করবে না মীরা। আট বছর অনেক সময়।

কিন্তু মীরার সব হিসাব কিতাব উল্টে দেয় ওর অসুস্থতা আর দীর্ঘ সময় ব্যাবসা থেকে দূরে থাকা। প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় ডায়েবিটিস হাওয়ায় সিজারিয়ান অপারেশন বেশ কিছু জটিলতার ভিতর দিয়ে শেষ হয়। সিজারের ঘা শুকাতে আরেক বিপত্তি। ঘা তো শুকায়ই নি উল্টো দুই দু’বার ইনফেকশন হয়। দ্বিতীয় বার এমন অবস্থা হলো যে সেলাই কেটে পরিষ্কার করে আবার সেলাই করাতে হলো। এ ব্যপারটা আরেকবার সিজার হওয়া চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। ড্রেসিং করার সময় যে কি কষ্ট! যারা এ যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছে একমাত্র তারাই বুঝবে। সবকিছু মিলিয়ে মীরা একেবারে ঘরবন্দী। নিজের জীবণই বাঁচে না, আবার ব্যবসা।
এদিকে রাজিবের আবির্ভাব হয়েছিল মীরার আদর্শ স্বামী রূপে। মীরার যত্ন, মেয়ের যত্ন, রাত জেগে মেয়েকে দুধ খাওয়ানো, ডায়াপার বদলানো এসব নিজ দায়িত্বে করতো ও, আবার দিনে কারখানায় সময় মতো চলে যেতো। পুরো সময় দিতো কারখানায় । মীরা রাজিবের এমন পরিবর্তনে গোপনে আপ্লূত হয়। কৃতজ্ঞতা জানায় খোদার প্রতি। সদ্যজাত নূহার নরম, তুলতুলে আঙুল স্পর্শ করে মনে মনে ভাবে দিন ঘুরলো আমার।

উল্টো দিকে রাজিব যেন এরই অপেক্ষায় ছিলো। মীরার এ অসুস্থতাকে পুঁজি করে ব্যাবসার একছত্র আধিপত্যে অধিষ্ঠিত হয় রাজিব। ইদের ছুটির পর কাজে যোগ দেয়া পুরাতন সকলকে ছাঁটাই করে সে। মীরা এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে রাজিব বলে- ” বুঝলা মীরা, স্টাফ বেশী পুরাতন হলে তাদের শিকড় গজিয়ে যায়। তাই তাদের বাদ দিলাম। তাছাড়া আগের চেয়ে কম বেতনে নতুন কর্মচারীদেরকে পাওয়া গেছে। ইদানীং বেতন বাড়ানো নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল”

ব্যাবসা মীরার চেয়ে কোন অংশে কম বোঝে না রাজিব,তা জানে মীরা। তবে এতদিন মীরার অধিপত্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলো সে। বাইরের টুকটাক কাজ তখন করতো। মীরা রাজিবের কাজের প্রতি এমন সিরিয়াসনেস দেখে খুশি হয় ভীষণ। ও এসব টাকা পয়সা, ব্যাবসায়ীক আধিপত্য কিছুই চায় না। ও চায় যত্নবান, দয়িত্বশীল, একজন স্বামী। যে সব সময় ওকে ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রাখুক। যাতে ওদের সম্পর্কের বিষয়ে সবার করা ভবিষ্যৎ বানী যে ভুল তা প্রমাণ করতে পারে। আর কিচ্ছু চায় না ও।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয় মীরা। সুস্থ হয় ওদের জরাজীর্ণ সম্পর্ক। যদিও রাজিবের মনের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কি ছিলো তা অজানাই রয়েছে মীরার কাছে। দিন মাস বছর চলছে, ছোট্ট মেয়ে নূহা এখন হাঁটতে শিখেছে। মীরা এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। ওর দিন কাটে মেয়ের জন্য নতুন রেসেপির এক্সপেরিমেন্ট করে। একা হাতে বাচ্চা পালা সোজা কথা? তারপর ও নতুন নতুন ডিজাইন গুলো কাস্টমাইজড করার ব্যাপারগুলো এখনো চেক করে মীরা। ইন্টারনেটের সুবাদে ওয়ার্ক ফ্রম হোম যে ব্যাপারটা কোভিড থেকে প্রচলিত, তার বহু আগেই এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে নতুন ড্রেস গুলোর ডিজাইন এডিট এবং ফাইনাল করতো ও। মেয়ের ছয় মাস হওয়ার পর ও অফিসে গিয়ে কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রাজিব অনেক যত্ন করে নিষেধ করেছে, হাতে হাত রেখে বলেছে – “অনেক তো করলে, ঋণের বোঝা এমনিতেই অনেক বাড়িয়ে ফেলেছো তুমি। এবার আমাকে কিছু করতে দাও, একটু রেস্ট নাও”

খুশীতে কেঁদে দিয়েছিল ও, রাজিবকে জড়িয়ে ধরে।
মীরা এখন ভীষণ সুখী। যত কাজই থাকুক রাজিবের সময় মতো বাসায় খেতে আসতেই হতো ওকে। রাজিব প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে মধুর এ যন্ত্রণাটাকে সাদরে মেনে নেয়। যত কাজই থাকুক ফ্যামেলী লাইমটা ও খুব ভালো করে মেন্টেইন করতো। যতো রাত-ই হোক বাড়ি ফিরতে, মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতো, এটুকু মেয়েও বাপ বলতে অজ্ঞান। সন্ধ্যা হলেই মটকা মেরে ঘুমিয়ে থাকে। বাপ যেই ঢুকে ঘরে ওমনিই তিনি সজাগ হয়ে ঝাপিয়ে পরে বাবার কোলে। এটাকেই হয়তো বলে রক্তের টান। ইদানীং এ জিনিসটা খেয়াল করে মীরা, ছোট্ট মেয়ের এমন টান দেখে বাবাকে ভীষণ মিস করে। ওর বাবার বেলাও কি এমনটাই হতো। ছোট্ট মীরা এমনি করেই কি ঝাঁপিয়ে পরতো ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত বাবার কোলে?
আর বাবা…..

ওর বাবা ওর জীবণের শ্রেষ্ঠ পুরুষ৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলে-
” কেমন আছো তুমি বাবা ?”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ২১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

গ্রাম থেকে মেহমান এসেছে মীরাদের বাড়ি। ভদ্রলোক মীরার বড় মামা শ্বশুর। এর আগেও দুই বার এসেছিলেন তিনি। দুইবারই ছেলেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিলেন। সেই ছেলে নাকি গতমাসে দেশে ফিরেছে তার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছেন এবার, অথচ গত মাসে যে সে ছেলেকে নিতে এসেছে এসবের কিছুই জানে না ওরা। ব্যাপারটা নিয়ে মীরা কিছুটা বিরক্ত। কারণ এ বাড়িটা রাজিবদের গ্রামের সকল আত্নীয়ের স্টপিজ। আত্নীয় স্বজন আল্লাহর রহমত তা জানে মীরা কিন্তু এদের কথাবার্তা কেমন জানি। একবার এক খালা শ্বাশুড়ি এলেন, তিনি রাজিবের মায়ের ফুফাতো বোনে। সেবার এসে একটানা আঠারো দিন ছিলেন। আদরযত্নে কোন ত্রুটি করে নি মীরা। একদিন বিকেলে তিনি মীরাকে তেল দিয়ে দিতে বললে মীরা তাকে সুন্দর করে তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেন। চিরুনীর চুল পরিস্কার করতে করতে ভদ্র মহিলা ওকে প্রশ্ন করেন –
: ” আগের জামাই তোরে ছাইড়া দিছিল ক্যান মা? ”
মীরার কান দিয়ে ধোঁয়া উঠা অবস্থা, ওর মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে যেন। কোন কথা না বলে মীরা চলে গিয়েছিলো সেখান থেকে। রাতে রাজিব বাসায় এলে মীরা রাজিবকে কথাটা বললে রাজিব বলে-
: ” এ কথা উনি পেলো কই? ”
: ” এটাতো তোমার জানার কথা ”
: ” দাঁড়াও এক্ষুনি জিজ্ঞেস করছি”
: ” না, না এখন জিজ্ঞেস করতে হবে না, বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করবে ”

সেই যাত্রায় এ কথার উৎস্য জানা না গেলেও অনেক পরে জেনেছে এ কথাগুলো গ্রাম অব্দি পৌঁছে দিয়েছেন রাজিবের সৎ মা।

ভদ্রলোক এসেই রাজিবকে বলেছিলো আসার কারন। রাজিব তা জানিয়েছিলো মীরাকে। মীরা তাই অফিসিয়ালি দাওয়াতের অপেক্ষায় আছে। পরদিন বিকালে চা নাশতা দিয়ে মীরা ফাহিমা খালাকে বললো পোলাও গোশত রান্না করতে৷ রাতের লঞ্চে তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন। ভদ্রলোক মীরাকে ডেকে পাঠালেন। কিছু না জানার ভঙ্গিতে বসলেন তার সামনে। ভদ্রলোক গলা পরিস্কার করে বললেন-
: ” বৌ, গত মাহে আসাদ দ্যাশে ফিরছে, তিন মাহের ছুটিতে আইছে দ্যাশে ”
মজা করার ভঙ্গিতে মীরা বললো-
: ” ও আচ্ছা, এমনি তো হয়। এখান থেকে বিদেশে যায় সবাই, আর ফিরার সময় যখন লাগেজ ভরে নিয়ে আসে সোজা ঢাকা টু বরিশাল চলে যায়, এখানে আসলে যদি ভাবী কিছু রেখে দিই ”
: ” না, মা এবার সত্যি তাড়া আছিলো। পাত্রী দেখে রেখেছি মোরা বিয়ে আগামী হপ্তায়। তোমাগো দাওয়াত করতে আইছি। তোমরা কিন্তু দুইদিন আগেই চইল্যা যাবে”
: ” দেখি মামা, গ্রামের বিয়ে তো, এতদূরের পথ, চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ ”

এ কথাটা রাজিব শিখিয়ে দিয়েছে মীরাকে। রাজিবের এ মামাকে খুব বেশি পছন্দ না। ভদ্রলোকের সম্পদ, টাকাপয়সার কোন অভাব নেই। গ্রামে যথেষ্ট নামডাক রয়েছে তার। বিশাল চালের মিল রয়েছে, কয়েকশো লোক কাজ করে সেখানে। এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ভদ্রলোক রাজিবের মায়ের সম্পাত্তি ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয় নি। যতটুকু ও দিয়েছিলো তাও হাতছাড়া হয়ে যায়।

রাজিবের বাবার একবার এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তখন ওর মা কোন উপায় না পেয়ে ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলো সাহায্যের জন্য। ভাই তাকে নিজে সাহায্য করতে না পারলেও অন্য ভাবে সাহায্য করেছিলেন সেবার। একদিনের মধ্যে তার ভাগের জমিটা ন্যায্য দামে নগদ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এজন্য রাজিবের মায়ের কৃতজ্ঞতার শেষ ছিলো না। ভাগ্যিস ভাই ছিলো, তা না হলে কি হতো এ অসময়ে। ফিরবার সময় ভাই প্রতিবারের চেয়ে বেচী করে চাল, ডাল, সরিষার তেল, সব তুলে দিয়েছিলেন লঞ্চে। বিদায় বোলায় যে পানি এসেছিলো রাজিবের মায়ের চোখে তা কেবল ভাইয়ের থেকে বিদায়ের শোকেই না তাতে অসীম কৃতজ্ঞতা ও মিশে ছিলো। বাড়ি ফিরবার সেই পুরো পথটাতে রাজিবের মা ওকে শুধু বলেছিলো দূর্দিনে মামার এমন ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর কথা। এবং এও বলেছিলো- ” সবসময় এ কথাটা মনে রাখিস্” রাজিব সত্যি মনে রেখেছে সে কথা।

ওর বিয়ের আগে বড় মামার মেয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলো ওরা বরিশাল। একাই গিয়েছিলো রাজিব, বাবার শরীর ভালো না থাকায় ওকেই পাঠিয়েছিলো তারা। অনেক বছর পর এলো এখানটায়, সেই যে মাকে রেখে গিয়েছিলো। আর আসা হয় নি। এ কারনে পথঘাট চিনতে কেমন অসুবিধা হয় ওর। কিন্তু একটু এগুতেই পুকুর পাড়ের নারকেল ঝাড়, আর তার পাশেই খোলা জমি দেখে দাঁড়িয়ে পরে ও। একটা পূর্ণ ছবির খন্ড খন্ড চিত্র মিলিয়ে নিচ্ছে মস্তিষ্ক। মানসপটে পুরো ছবিটা তৈরী হলো যখন, ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
যেন অনেক বছর পর মা’কে দেখলো। সেখানটায় দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পরলো ও। জংলা মতো জায়গাটা একেবারে সমান হয়ে গেছে। সময়ের আবর্তে ভালোবেসে মাটি আর উঁচু কবরটা নিজেদের দূরত্ব ঘুচিয়ে সমান হয়ে গিয়েছে। কবরের কোন চিহ্ন নেই এখানে। ছোট ছোট পশুদের অভয়ারণ্য হয়েছে এখন জায়গাটা। একটা বিড়াল কি যেন খুঁজছে। থুম মেরে দাঁড়িয়ে পরে রাজিব।
কালের অনেক কিছু ঝাপসা মনে পরে রাজিবের।

রাজিবের মা মা’রা গিয়েছিল হার্ট অ্যাটাক করে। তখনকার সময় এ জিনিস কি অনেকে তা বোঝেও না। হসপিটালে না পৌঁছাতেই দমটা বেবীর মধ্যেই বেড়িয়েই গেলো। কত বয়স ওর তখন দশ কি এগারো। বন্ধুদের সাথে নাক্কিমুট খেলছিলো ও। মা মা’রা গেছে কোন হেলদোল নেই। যেন এমন ঘটনা সূর্য উঠা আর ডোবার মতো প্রাত্যহিক ব্যাপার।
পড়শীরা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলো-
: ” মা’টারে শেষ বারের মতো দেখে আয় বাবা”

কেও মারা গেলে যে কাঁদতে হয় তা ও জানতো না ও।
বোনের মৃ”ত্যু’র খবর পেয়ে চার ভাই দৌড়ে এলো ঢাকায়। যদিও তারা পৌছাল পরদিন বিকেলে। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে বড় মামা ঘোষণা করলো- “মোগো বইনেরে মোরা বাড়িত ক’ব’র দিমু”

রাজিবের বাবা ছিলো ছাপোষা মানুষ। তাদের কথার বিপরীতে যে কিছু বলবে তার সাহস কিংবা ইচ্ছা কোনটাই ছিলো না। কারন স্ত্রীকে যে দাফন করবে তার টাকাটাও ছিলো না তার কাছে। সেদিক বিবেচনায় চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছেন তিনি।
আধঘন্টার মধ্যে কফিন, বরফ, চা-পাতা দিয়ে তারা তাদের একমাত্র বোনকে লঞ্চে করে নিয়ে গেলো বরিশাল।

দীর্ঘ পথের যাত্রা আর তাদের অপেক্ষায় দেরির জন্য অর্ধগলিত হওয়া লা’শ’টা বহন করতে চাইলোনা কোন লঞ্চই। উপায় না পেয়ে পুরো লঞ্চ ভাড়া করে ঢাকা থেকে বরিশাল নেয়া হলো রাজিবের মায়ের লা’শটাকে। মধ্যে খানে লা”শ”টাকে রেখে চারদিকে ঘিরে রয়েছে পরিচিত জনেরা। যেন মহোৎসবে কোন মেয়ে যাচ্ছে তার বাবার বাড়ি নাইওরে।

ভাইয়ের শোকে গাছের পাতা পর্যন্ত ঝড়ে পরে। চার ভাইয়ের একমাত্র বোন যে ছিলেন তিনি। সেই সব দিনের কথা আর এই কবরের বর্তমান হাল যেন মিলে নি। এত আদরে যাকে এতদূর বয়ে নিয়ে আসা তার আজ এমন বেহাল অবস্থা। তবে কবেরের এই বেহাল দশা বড় মামাকে অপছন্দ করার কারন না, সে গল্প ভিন্ন।

সেবার বিয়ে খেয়ে কিছুদিন ছিলো ও বরিশাল। ঘুরে ফিরে দেখবে বলে। সমবয়সী মামাতো ভাইদের সাথে ঘুরলো এদিক সেদিক। একদিন বিকেলে চোখ পরে বাড়ির ঠিক অপরদিকে বিশাল এক স্কুল হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে রাজিব স্কুলের নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করে। তখন বড় মামার সবচেয়ে ছোট যে ছেলে সে বলে-
: ” মোর আব্বায় এ জমি স্কুল তৈয়ারের লেইগ্যা দান করছে”
কথাটা জেনে গর্বে বুকটা ভরে উঠে রাজিবের। মা ঠিকই বলেছিলো। তার বড় ভাই মানুষ না ফেরেশতা। সত্যি! এখনকার দিনে ঐ জমির বাজার মূল্য কল্পনাতীত। এতগুলো জমি স্কুল তৈরির জন্য দান করা চারটে খানি কথা!

রাজিবের ফিরবার দিন নতুন বৌ নাইওরে এসেছিলো, রাজিব তাদের থেকে বিদায় নিতে গিয়ে দেখে নতুন বউ তার ননদ-দেবরদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত। রাজিব স্মিত হেসে বলেছিলো-
: ” যাই বু, ঢাকায় গেলে জামাই নিয়া ঘুরে আইসো আমাগো বাড়িত্তে”
হাস্যজ্জল মুখে রাজিবের বু বলেছিলো-
: “মোর শ্বশুর বাড়ি বেড়াবি না ভাই, বোনডারে কই বিয়া দিলি দেখতে যাবি না”
: ” পরেরবার অবশ্যই যাবো বু, এবার না”
কথা বলতে বলতে অনভ্যস্ততায় নতুন বৌয়ের মাথার ঘোমটা পরে যায়। রাজিবের চোখ কেন জানি তার গলার সোনাদানার দিকে গেলো। কেমন জানি চেনা চেনা লাগলো সেগুলো। ঘর থেকে বের হতে বের হতে ভাবে ঠিক এমন দেখতে সোনাদানা ছিলো ওর মায়ের। মারা যাবার আগের বছর বাবার চিকিৎসার টাকা নিতে বরিশাল আসার সময় পথে হারিয়ে যায় সেগুলো।

মনে মনে ভাবে দেখতে একরকম হলেই তো জিনিস এক হয় না। বু-র থেকে বিদায় নিয়ে একে একে সব মামীদের ঘরে যায় ও তাদের থেকে বিদায় নিতে। সবশেষে মেঝো মামীদের ঘর, তারা সবচেয়ে নিরীহ এই বিশাল বাড়িতে। এই বাড়ির এত জৌলুশ এদিকটায় এলে ফিকে মনে হয়। তবে রাজিবের এ মামা সৎ একজন মানুষ। কারো সাতেপাঁচে নেই নিজেদের মতো থাকেন। মেঝো মামীর সাথে দেখা করতে গেলে সে বলে-
: ” আইলা, আবার চইল্যাও যাইতাছো, মোরা তো গরিব তাই মোগো ঘরে বেড়াইলি না, যারা তোগো আগে পাছের সব খাইছে তারাই তোগো আপন”
মেঝো মামা মামীকে ধমকের সুরে বললেন –
: ” আহ্ কি শুরু করলা, খ্যাম দেও তো ”
: ” আপনে চুপ থাকেন, হারা জীবন তো থামায়াই রাখলেন মোরে। ওর মা মোর ননই ছিলো না, মোর সইও ছিলো। হ্যার লগে যে বেইনসাফ হইছে তা ওরে না কইলে মোর পাপ হইবো।

বিপদে পরা বইন আইছে সাহায্য চাইতে, বিপদে পরলে মানুষ কই যায় আপনজনের কাছেই তো? বড় মিয়া কি করলো- চালাকি কইরা জমিডা কিন্না লইলো, আর হ্যার বৌ কিনলো সোনাদানা। এই জিনিস আমার বাপের বাড়ি থইক্যা বিয়াতে ওর মায়রে দিছিলো আমার বাপে। এতদিন হেয় পিন্দছে ফাঁকে ফাঁকে। এহন মাইয়্যারে বিয়াত লগে দিয়া দিছে।

এসব শুনে রাজিব আহত গলায় বলে-
: ” থাক মামী, সব জিনিস কপালে থাকা লাগে”
: ” আরে আল্লা ত আছে একজন, তর মার তে কাইড়া নিছে, হের তে নিছে আল্লায়, ফান্দে পইরা জমি দান করছে স্কুল করতে। জনদরদী! হ্যাহ্ বুনের সম্পদ মারি খাইয়্যা এহন জনদরদী হইছে।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখাঃ #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ২২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

বড় মামার এ কাহিনী মীরার জানা আছে বেশ আগে থেকেই। তবুও ওরা দু’জনই সাধ্যমতো সমাদর করে তাদের। কখনো খরাপ চোখে দেখেন না। তিনি যা করার করেছে, তার হিসেব তিনি দিবেন। কিন্তু দাওয়াতে যাবে না বলে আগেই সিদ্ধান্ত নেয় ওরা দুজনে। তবে বিয়ের উপহার হিসেবে মীরা বৌয়ের জন্য ওদের কারখানার সবচেয়ে দামী লেহেঙ্গাটা টুম্পাকে জলদি বাড়ি নিয়ে আসতে বলে। টুম্পা আধ ঘন্টার মধ্যে কাজ শেষ করে লেহেঙ্গা সুন্দর করে প্যাক করে বাসায় নিয়ে আসে। মামা কোন মতেই এটা নিবে না তার সাথে। তিনি বলেন-
: ” তোরা ভাইর বিয়াত উপহার দিবা, যাওয়ার সময় লগে করি নিয়া আসিও, মোক কেন দিচ্ছ”

ভদ্রলোককে শেষ পর্যন্ত দেওয়ায়ই গেলো না লেহেঙ্গা টা। দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতের লঞ্চে তিনি রওনা দিলেন নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।

এদিকে মীরার মনে খুঁতখুঁত ছিল লেহেঙ্গাটা না দিতে পারায়। রাজিব মীরাকে বলে –
: ” লেট ইট গো, তার টাকাপয়সা কম নেই । তিনি এরচেয়ে ভালোও কিনে দেবার সামর্থ্য রাখেন। আমরা যখন যাচ্ছি না, এত প্যারা খাচ্ছ কেন?”

মীরা রাজিবের কথার যুক্তির কাছে ধরাশায়ী হয়ে চুপ হয়ে যায়। প্রসঙ্গে বদলে রাজিব বলে-
: ” তারচে বরং চলো দূরে কোথাও ঘুরে আসি ”
মীরার চোখেমুখে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। মন পড়তে কবে শিখলো এই লোকটা? মনের উচ্ছাস খুব কষ্টে চেপে মীরা বলে-
: ” না থাক”
: ” সত্যি থাকবে?”
: ” না, মানে…”
রাজিব সোফা থেকে উঠে মীরার কাছ ঘেঁষে বসে, তারপর ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: “কোথায় যাবা? সমুদ্রে নাকি পাহাড়ে?”
মীরা আর কোন রাখঢাক করে না, ওর কাঁধে মাথা রেখে বলে-
: ” ভালোবেসে যেখানে নিয়ে যাবা তুমি”
: ” সবকিছু গোছগাছ করো, আগামীকাল রাতে আমরা রওনা দিবো”
মীরা রাজিবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে-
: “ওকে”

পরদিন মহা ব্যাস্ততায় কাটে মীরার প্যাকিং নিয়ে। প্রথমে সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা থাকলেও নূহার কথা ভোবে তা স্কিপ করা হয়। ওরা যাচ্ছে সিলেট। কাছেপিঠে ঘোরাঘুরি করবে। ব্যাবসা, ব্যাস্ততা থেকে দূরে থাকা মানেই হ্যাপিনেস। তার উপর দূরে ট্যাুর। উপচে পরা খুশি সবার চোখেমুখে।
ওরা দুই রুম আগে থেকেই রিসার্ভ করে রাখে ফোন করে। সময় মতো পৌঁছে যায় ওদের ছোট্ট পরিবারটা। দুই রুমের একটাতে থাকে রাজিব, আরেকটাতে মীরা আর টুম্পা।
যথারীতি রাজিব ওর পছন্দের জায়গায় ঘুরিয়ে আনে ওদেরকে। প্রথম দিন ওরা যায় শাহজালালের মাজারে, আর জাফলং হয়ে ফিরবার পথে লালা খাল হয়ে । পরদিন মালিনীছড়া চা-বাগান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, সহ অনেক জায়গায় ঘুরে ওরা। সারাদিন দৌড়ের উপর ছিলো ওরা সকলেই, সাতটায় হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে রুমে এসে পরে সবাই। প্ল্যান পরদিন হয় এখানকার কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে দেখবে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমে ঢলে পরে সকলে। নূহা এমনিতেই অনেক লক্ষ্মী একটা বাচ্চা। তেমন জ্বালাতন করে না। সে রাতে নূহাও ঘুমিয়ে পরলো জলদি। হঠাৎ রাত সাড়ে এগারোটায় কল করে রাজিব মীরাকে। তন্দ্রালু মীরা ফোন রিসিভ করতেই রাজিব বলে-
: ” নূহা ঘুমিয়েছে?
: ” হুম”
: ” তুমি ঘুমিয়ে গেছো?”
: ” বলো সমস্যা নেই ”
: ” বের হবে? তোমাকে নিয়ে রাতের শহর দেখতে বেরুবো ভাবছি”
: ” দশ মিনিটের মধ্যে আসছি ”
বলেই খুব সাবধানে নামলো খাট থেকে। নাইট গাউন খুলে সুন্দর একটা সাদা ড্রেস পরে মীরা। সাজগোজের সময় নেই তাই হাতে পাউডার নিয়ে ঝটপট মুখে মেখে নেয় ক্লান্তির কারনে তৈরী হওয়া ডালনেস লুকাতে। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ভ্রু জোড়া একে একটা নুড লিপগ্লস দেয় ঠোঁটে। ব্লু-লেডি পারফিউমটা মাখে গায়ে, ব্যাস। বের হওয়ার আগে টুম্পাকে ডাকবে কি ডাকবে না তা ভেবে শেষমেষ না ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেরিয়ে পরে।

রুমের দরজা খুলতেই দেখে রাজিব দরজার সামনে অপেক্ষা করছে। কাকতালীয় ভাবে রাজিবও একটা সাদা পাঞ্জাবী পরে আছে। ওকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দেয় রাজিব। কি একটা খোঁজার বাহানায় কিছু না বলেই নিজের রুমে ঢুকে রাজিব। মীরাও কি হলো? বলতে বলতে ওর পিছু পিছু গেলে রাজিব ঘুরে দরজা আটকে মীরাকে জাপ্টে ধরে চুমু খায়। রাজিবের এমন কান্ডে তব্দা খেয়ে যায় মীরা। তারপর ও নিজেও যোগ দেয় সে কর্মযজ্ঞে। ভালোবাসার উষ্ণ আদানপ্রদান শেষ হলে মীরা বলে-
: “আমার সব লিপগ্লস খেয়ে ফেললে তুমি”
রাজিব ওর কথার ওজন আর বিপরীতে তার সিরিয়াসনেস দেখে হেসে বলে-
: ” আমার তো তোমাকেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, সবসময়ই খুব অল্পতে বেঁচে যাও তুমি”
মীরা রাজিবের পাঞ্জাবীর হাতা খামচে ধরে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলে –
: ” বাইরে যাওয়ার কথাটা কি তাহলে বাহানা ছিলো?”
: “আরে নাহ্, তোমাকে দেখতে হট লাগছিলো তাই নিজেকে একটু পুড়িয়ে নিলাম ”
: ” হেহ্, চলো, নাকি আরেকটু পুড়ার শখ হয়েছে? ”
মাথা দুপাশে নেড়ে না বলে রাজিব।

জামা, ওড়না ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে রাজিব, দুজন মিলে নিচে নামে ওরা। মীরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা টেক্সট করে টুম্পাকে। ওরা নেমে দেখে রাত অনেক হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর মানুষ রাস্তায়। মীরা রাজিবকে বললো-
: ” চা/কফি কিছু দরকার এ মুহূর্তে”

একটু হাঁটতেই একটা কফিশপ পেলো ওরা। দুজনেই কোল্ড কফি নিলো। হাঁটতে হাঁটতে বেশ সময় নিয়ে শেষ করলো কফিটা। ততক্ষণে অনেক দূরে এসে পরেছে ওরা হাঁটতে হাঁটতে। অনেক কথা হয় দু’জনে। জীবণের পাওয়া – না পাওয়ার, আনন্দ-বেদনার, সুখ-দুঃখের হিসেব কষে দুজনে, কথা বলতে বলতে নির্জন এক রাস্তার বাঁকে পৌঁছে যায় ওরা। মীরা বসতে চায় কিছুক্ষণ। রাস্তাটা খুব সুন্দর প্রকৃতি এবং আধুনিকতার সুন্দর সমন্বয় করে তৈরী করা। পাশাপাশি দুজন বসে গল্প করলো কিছুক্ষণ। এদের টপিকের অভাব নেই গল্প করার। যে টপিকেই গল্প শুরু হোক না কেন শেষের দিকে তা ঘুরেফিরে বিজনেসেই টার্ন নেয়। ব্যাবসার প্রসারে করনীয় সম্পর্কে আলোচনা হয় দুজনে।

বেশকিছু সময় পর ওরা উঠে উল্টোদিকে রওনা দিলো। পুরো রাস্তায় মীরা রাজিবকে ধরে হাঁটছিলো। রাজিবও উপভোগ করছিলো সময়টাকে। ক্ষুধা লাগায় দুজন মিলে স্ট্রিট সাইড বিক্রি করা পিৎজা খায় দুজনে। কোল্ড ড্রিংকস হাতে ফিরে আসে হোটেলে। রুমের কাছে এসে বিদায় নিতে নিলে মীরাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে নেয় রাজিব। মীরার অবাক হওয়ার শেষ নেই যেন। ঠিক তার এক ঘন্টা পর মীরা ওর রুমে ফিরে এসে ছিলো।

রুমে এসে দেখে নূহা আর টুম্পা এখনো ধুমছে ঘুম। ম্যাসেন্জারের ম্যাসেজও চেক করে নি টুম্পা। তাই সেটা রিমুভ করে দেয় ও নিজের ফোন থেকে। বাথরুমে গিয়ে গোসল সেরে চুলগুলো মুছে বারান্দায় কাপড় শুকাতে গিয়ে দেখে কেও একজন দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। জলন্ত সিগারেটের আগুনের উঠানামা ছাড়া কিছুই দেখে না মীরা। দ্রুত কাপড় মেলে চলে যাবে এমন সময় এগিয়ে আসে সেই জলন্ত আগুন ধরে রাখা ব্যাক্তি। প্রথমে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় ও, পরে অভয় দিয়ে লোকটা বলে-
: ” আরেহ্ আমি”
কন্ঠ শুনে মীরার ধরে প্রাণ ফিরে পায়। কাপড় শুকাতে দিয়ে চলে যেতে নেয় মীরা, রাজিব ওকে দাঁড়াতে বলে রুম থেকে ফোন নিয়ে আসে। সেটার টর্চের আলো ফেলে মীরার উপর। সদ্যস্নাত সুন্দরী মীরাকে দেখে রাজিব বলে-
: ” মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না তুমি আমার বউ”
বলতে বলতে মীরার ঘরের বারান্দায় চলে আসে রাজিব। জড়িয়ে ধরে মীরার কাঁধে নাকমুখ ঘষতে থাকে ও।
: ” তোমার কি হইছে বলো তো? হঠাৎ এত প্রেম উৎলে উঠলো তোমার”
: নূহা হওয়ার পর তুমি আরো বেশী সুন্দর, বেশী আবেদনময়ী হয়ে গেছো, নদী বর্ষায় যেমন কানায় কানায় পূর্ণ হয়, মা হওয়ার পর তুমিও তেমনি…”
: ” হইছে, আমি এখন যাই”
: ” একটু দাঁড়াও ”
বলেই আবারও মীরাকে জড়িয়ে ধরে ওর শরীরের ঘ্রাণ নিতে থাকে রাজিব । মীরা কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে রাজিবকে বলে ওর বারান্দায় চলে যেতে। রাজিব নাছোড়বান্দা ও ছাড়েও না, যায় ও না। মীরা রাজিবকে বলে-
: ” কিছুই বুঝলাম না ব্যাপারটা”
রাজিব বলো-
: ” একটু সময় দাও বুঝিয়ে দিচ্ছি ”
দু’জন একটা সময় দরজার কাছে এসে পরে, ভিড়ানো দরজাটা খুলে যায় হাট করে। শব্দে রুমে শুয়ে থাকা টুম্পা জেগে বলে-
: ” কে?”
মীরা রাজিবের হাতে একটা কামড় দিয়ে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। রাজিবকে চলে যেতে বলবার সুযোগও হয় না মীরার। রাজিব বেচারা হাতটা অন্য হাত দিয়ে ডলতে ডলতে মুচকি হেসে সাবধানে নিজের বারান্দায় চলে যায়।

খাটে শুয়ে মিটিমিটি হাসে মীরা। রাজিব সবসময়ই একটু বেশী এগ্রেসিভ। কপট রাগ দেখালেও ব্যাপারটা মীরার ভালোই লাগে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মীরা বলে-
: ” আল্লাহ সবসময় এমনি ভালোবাসায় ডুবিয়ে রেখো আমাদের। কারো নজর লাগতে দিও না”

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-১৫+১৬+১৭+১৮

0

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ১৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

টুম্পাকে নিয়েই সেদিন বিকেলে ডক্তার দেখতে গেলো মীরা। বেরুতে দেরি হওয়ায় এসে দেখে ওর সিরিয়াল চলে গেছে অলরেডি। বিরক্ত হয়ে বসে পরলো মীরা। টুম্পা পায়চারী করছে। মীরা টুম্পাকে এত ভালো বাসলেও সবসময় মীরার থেকে দূরত্ব রেখে চলে। এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দূরত্ব। যতই ভালো বাসুক তিনি টুম্পার আশ্রয়দাতা তা ও সবসময় মনে রাখে।

মীরাও এ দূরত্ব ঘুচাতে চেষ্টা করে না। ওর ভয় পাছে মনের সব দুঃখ কষ্ট বলে ফেলে ওকে। তাছাড়া মীরার মনে হয় ওদের সম্পর্কে এ দূরত্বটা জরুরী। দু’জন আন্তরিক ভঙ্গিতে চললেও মীরাও আচরণে কিছুটা গাম্ভীর্য রাখার চেষ্টা করে। ও যে টুম্পাকে কতটা পছন্দ করে বা ভালোবাসে তা বুঝতে দিতে চায় না মীরা। ভয় হয় ওর, রাজিবের মতো টুম্পাও যদি সুযোগ নেয় এ অকৃত্রিম ভালোবাসার। “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় ” তাই এ ভালেবাসাটাকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখে।

মীরাকে টুম্পা ওয়েটিং স্পেসে বসিয়ে বললো-
: ” আপা ক্লান্ত লাগছে খুব, ক্যান্টিন থেকে কফি খেয়ে আসি। মীরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে যেতে বললো টুম্পাকে। অন্য কেও এ কথা বললে মীরা বলতো আহারে কষ্ট দিলাম তোকে। কিন্তু মীরা তা চেপে গেলো। ফোনটাকে ব্যাগে রেখে চারপাশে তাকাল মীরা। প্রত্যেক রোগীর সাথে তাদের হাসবেন্ড এসেছে। একমাত্র মীরা আর আরেকটি মেয়ের সাথে হাসবেন্ড নেই।

মীরা এসেছে টুম্পাকে নিয়ে, আর ঐ ছোট্ট মেয়ে খুব সম্ভবতঃ ওর মা’কে নিয়ে এসেছে। মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হলো মীরা। এত ছোট মেয়ে যার নিজেরই খেলার বসয় শেষ হয় নি, সে আবার মা হতে চলেছে। বাল্য বিবাহ ব্যাপারটা গ্রামেও এখন দেখা যায় না। আর শহরে এমনটা চোখে ঠেকলো মীরার।

মেয়েটা নিছকই ছেলেমানুষ। বার বার বোরকার খিমার খুলে মুখ বের করছে, আর ওর মা রাগারাগি করে তা ঢেকে দিচ্ছে। মেয়েটার তাতে ভাবান্তর নেই যেন। মহিলাও নিকাব দিয়ে পুরো শরীর আবৃত করে রেখেছেন। বোরকা পরার অনভ্যস্ততায় তার বুক উন্মুক্ত, যত চেষ্টা তার সবই মুখ ঢাকতে।

তার আচরনে প্রকাশ পাচ্ছে অস্বস্তি ও। নিজের খেলার বয়সে মা হয়েছে মেয়ে। এটাই যে তার অস্বস্তির কারন তা ঠিক বুঝতে পারছে মীরা। পেশাকে-আশাকে তাদেরকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মনে হলো মীরার। মহিলার হাতের লুই-ভিটন ব্যাগটা অরিজিনাল। সেইম এই ব্যাগটা রাজিবের এক ব্যাবসায়িক বন্ধু মীরাকে ওদের এনিভার্সেরিতে উপহার দিয়েছিলো।

একটু পর একটা লোক এসে সেই সম্ভ্রান্ত মহিলাকে কি যেন বললো রাগি রাগি চেহারা করে। মেয়েটার ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাকে বুঝতে পারলো সে মেয়েটির বাবা। ধাক্কা লাগলো মীরার তাকে দেখে। তিনি পুরোদস্তর ফর্মাল পোশাকি। মীরা পাঞ্জাবী, দাঁড়ি, টুপি আশা করেছিলেন মেয়ের বাবার কাছ থেকে। এমন একটা পরিবারের মেয়েকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলে? কেমন খটকা লাগলে মীরার৷

রোগী বাকী তিনজন। সবশেষে মীরার সিরিয়াল। তাই চারপাশ দেখায় মনোযোগী মীরার কেমন যেন উদ্ভট লাগলো পুরো ব্যাপারটা। ঐ ছোট্ট মেয়েটা আইসক্রিম খাচ্ছে। খুব সুন্দর দেখতে মেয়েটা। ধূসর চোখ, কাটা নাক, ঠোঁট। কি চলছে ওর ছোট্ট শরীরটার ভিতরে তা নিয়ে ওর যেন কোন বিকার নেই। এই মেয়েটার বর’কে পেলে বকে দিত মীরা। ও না হয় অবুঝ, যে এ কাজ করতে পেরেছে সে নিশ্চয়ই অবুঝ না। একটু সময় দিতে পারতো মেয়েটাকে।

অবশেষে মেয়েটার সিরিয়াল এলো। মেয়েটা রুমে যাওয়ার আগে কি মনে করে যেন ছুয়ে দিলে মীরাকে। মীরা কেমন পুলক অনুভব করলো ওর স্পর্শে, মেয়েটার ধূসর চোখে চোখ রেখে একটা হাসি বিনিময় করলো মেয়েটার সাথে।

আধঘন্টার মতো সময় চলে গেলো। তারা বের হওয়ার কোন নাম নেই।অধৈর্য মীরা উঠে হাঁটা শুরু করে। টুম্পা জিজ্ঞেস করলো ক্ষুধা লেগেছে কি না। মীরা না বলায় একটা নিরিবিলি জায়গায় বসলো টুম্পা। অবশেষে বের হলেন তারা।

মীরা রুমে প্রবেশ করলেই দেখলেন ডাক্তার এতটাই চিন্তামগ্ন যে মীরার আগমন তার দৃষ্টিগোচর হয় নি। মীরা চেয়ার টেনে বসাতে সে শব্দে তার চেতনা ফিরলো যেন। দ্রুত একটা কৃত্রিম হাসি টেনে নিলেন অভিবাদন জানাতে। মীরা বসে তার ফাইলটা এগিয়ে দিলো। সবরকম চেকাপ ফাইল দেখে ডাক্তার জানিয়েছেন এভরিথিং ইজ ফাইন। একটা আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখাতে বলা হলো। আল্ট্রাসাউন্ড ব্যাপারটা নিয়ে মীরা খুব কিউরিয়াস। কি বাবু হবে যদি জানা যায়। সেখানে গিয়েও দেখা হলো সেই দম্পতির সাথে। মেয়ের আল্ট্রা করে রিপোর্টের অপেক্ষায় তারা। মীরার আল্ট্রাসাউন্ডে জানা গেলো ওর গর্ভের বাচ্চাটা মেয়ে বাবু। খুব খুশি হলো মীরা।

যদিও রাজিবের এসবে কোন ইন্টারেস্ট নেই। প্রথম দিকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো মীরা তখন বলতো- প্রথম বাচ্চা আল্লাহ যা দিয়ে খুশি, আমিও তাতেই খুশি। মীরা কিন্তু একথা শুনতে চায় নি। মীরা ভেবেছিলো মেয়ে বাবু নিয়ে রাজিবের কোন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটবে হয়তো ওর কথায়। কিন্তু তা না হওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলো ও। বাচ্চাটা তো রইলোই না। এবার আর এসব জিজ্ঞেস করার মানসিকতা, পরিস্থিতি কোনটাই ছিলো না। তবে মীরা মনে মনে একটা মেয়ে চাইতো খোদার কাছে৷ তাতে যদি ঘরমুখো হয় রাজিব।

রিপোর্ট আনতে আনতে ডাক্তারের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ায় আগামীকাল আসা ছাড়া কোন উপায় নেই। তাই রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলো ওরা। রিকশায় বসে বসে মাথায় কেবল ঐ বাচ্চা মেয়েটার অস্বাভাবিক প্রেগ্ন্যাসি, মা-বাবার আতঙ্কিত মুখ আর ডাক্তারের চিন্তামগ্নতা ভাবাচ্ছে। গাণিতিক ক্যালকুলেশনে যার রেজাল্ট খুবই খারাপ কিছু দাঁড়ায়। মেয়েটা কারো লালসার শিকার নয় তো?
এসব ভাবনা চারপাশ থেকে জেঁকে ধরে মীরাকে। মীরা এসব ভাবতেই পেটে হাত দিয়ে ওর অনাগত মেয়ের ভবিষৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরে। আর মনকে বুঝায়, না এরকম কিছু হয় নি। এত নিষ্পাপ চেহারার বাচ্চা মেয়ে কারো লালসার শিকার হতে পারে না । নিশ্চয়ই এটা ওদের দু’জনের ভালোবাসার ফল৷

বাসায় ফিরে টুম্পাকে এক কাপ চা দিতে বলে মীরা।টুম্পার পরীক্ষা চলে এসেছে, মীরা তাই চা নিয়ে আসার সময় টুম্পাকে বললো-
: ” তুই আগামী এক মাস লাঞ্চ এর পর বাসায় চলে আসবি, এ এক মাস মন দিয়ে পড়বি শুধু। পিয়াসা যেন না বলে, যে তোকে দিয়ে শুধু কাজই করিয়েছি”
টুম্পা বললো-
: “আপা বিকেল বিকেল ফিরলেও হবে, লাঞ্চ এর পর আসা লাগবে না”
: ” তুই কথা কম বল”
: ” আপা, সামনে ইদ, অফিসে এ সময় কাজের চাপ বেশী থাকে, আপনি প্লিজ আমাকে ভরসা করুন। আমি বিকেলে এসে সব শেষ করতে পারবো।
: ” ঠিক তো?”
মৃদু হেসে টুম্পা বলে-
: ” হ্যা”
বলে টুম্পা নিজের ঘরে চলে গেলো। টুম্পা এ ফ্ল্যাটের একেবারে ভিতরের দিকের স্টোর রুমের পাশের ঘরটাতে থাকে।

মীরার প্রথম সন্তান মেয়ে এ কথাটা কাওকে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। খুশি ভাগ করে নেয়া যাকে বলে। কিন্তু কাছেপিঠে কাওকে পেলো না কথাটা বলার মতো। এত বড় এ পৃথিবী, পাঁচশ কোটি মানুষ এ পৃথিবীতে। কিন্তু এ খুশির খবরটা বলার মতো মানুষ ওর নেই। চোখটা ভিজে উঠলো মীরার এসব ভেবে। পরক্ষণেই ভাবলো আজ অনেক খুশির দিন। মীরার চাওয়া পূর্ণ হতে চলছে। আজ কোন কান্নাকাটি করবে না ও। ফোনটা নিয়ে রাজিবকে ফোন করে বললো তাড়তাড়ি বাড়ি ফিরতে। রাজিব বললো ও কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে।

বিছানায় শুয়ে মেয়েদের সুন্দর নামের তালিকা খুঁজছে মীরা গুগল থেকে। মেয়ে যেহেতু তাই বাবার নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখবে বলে ঠিক করলো মীরা। হঠাৎ মনে হলো পিয়াসাকে কল করে জানাবে ব্যাপারটা। পিয়াসর সাথে অনেকদিন কথা হয় না। এরপর বেশ কিছু সময় পিয়াসার সাথে কথা হলো মীরার। পিয়াসা মেয়ে হওয়ার কথাটা শুনে খুশি হলো ভীষণ। বললো আসছে বুধবার ও আসবে মীরাকে দেখতে। দীর্ঘ কথা শেষ করে মিরার খেয়াল গেলো ডায়েরির পাতায়। সেখন থেকে কতগুলো নাম প্রথমিক ভাবে ঠিক করলে মীরা-

রাকা অর্থ পূর্ণিমা
রাইকা অর্থ প্রিয়
রেহনুমা অর্থ পথ প্রদর্শক
রাজিবের মতামত নিয়ে আরো কিছু নাম ভেবে কোন একটা ফিক্সড করে ফেলবে বলে ঠিক করে মীরা।

রাজিব সে রাতে সত্যি জলদি ফিরে আসে। সাথে নিয়ে আসে মীরার প্রিয় চিকেন বারবিকিউ পিৎজা উইথ এক্সট্রা চিজ। রাজিবকে ভীষণ রকম এক্সাইটেড দেখা যায়। রাজিব জানায় ওরা এগারোজন মিলে “ড্রিম ইলাভেন” নামে একটা প্রেজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছে। এ প্রোজেক্ট তার দীর্ঘ পথযাত্রা শেষ করবে তখনই যখন এগারো জনের প্রত্যেকের একটি করে ফ্ল্যাট আর একটি করে লাক্সারি গাড়ির মালিক হবে। আপাততঃ ওরা এগারেজন টাকা একত্রে করে একটা মিচুয়াল বিজনেসে ইনভেস্ট করবে। সেখন থেকে আসা প্রফিট জমিয়ে জমি কিনবে৷ ধীরে ধীরে বাড়ির কাজ শুরু হবে। একটা সময় পর নিজেদের লাক্সারিয়াস ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট আর গাড়ি হবে। রাজিবকে বেশ উচ্ছাসিত দেখায় বলে মীরা মনোযোগের সাথে কথাগুলো শুনে রাজিবের। বিজনেস প্ল্যান পছন্দ হয় মীরার। কিন্তু কাদের সাথে শুরু করছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এসব নিয়ে এখন কথা বলা ঠিক হবে না। কারন মীরা জানে খতিয়ে দেখার খাতিরে করা প্রশ্ন গুলোতে বিরক্ত হয়ে রাজিবের মুড নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এসব এড়িয়ে যায় মীরা। এসব কথা পরে হবে। এখন না হয় এই সুখেই ভাসা যাক দুজনে। অনেকদিন পর মীরাকে খুব খুশি দেখায় সবকিছু মিলিয়ে।

পিৎজা খেতে খেতে মীরা রাজিবকে বলে আজকের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। রাজিবও মনোযোগ দিয়ে শুনছে মীরার কথা। সবশেষে মীরা রাজিবকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” বলো তো কে আসছে আমাদের ঘরে?
মা নাকি বাবা?
একটু ভেবে রাজিব চেয়ার থেকে নেমে মীরার পেটে কান পেতে কিছু একটা অনুভব করতে চেষ্টা করলো। প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও ব্যাপারটা ভীষণ আনন্দ দেয় মীরাকে। ঠিক এমন সময় রাজিব বাবু একট কিক্ করে উঠে। খুশিতে রাজিব কান্না করে দেয়। মীরাও কেঁদে ফেলে রাজিবের উচ্ছাস দেখে।
: ” মীরা এটা আমার সন্তান। আমি বাবা হতে যাচ্ছি, ও আমাকে বাবা বলে ডাকবে?”
অশ্রুসিক্ত চোখে মীরা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় রাজিবকে।

: ” এই কিক্ টা আমাকে প্রথম বারের মত অনুভব করালো – ” I’m going to be Baba….!”

রাজিব মীরার হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে চুমু খায়। রাজিব এভাবেই পায়ের কাছে বসে থাকি খানিকটা সময়।

মীরা ভাবে বড়রা ঠিকই বলে-” বাচ্চা সত্যি বাহির মুখী বরদেরকে ঘরমুখো করে” জীবণকে এমন ভাবে কখনো হয়তো উপলব্ধিই করে নি রাজিব। এখন থেকে করবে হয়তো। মীরা রাজিবের মাথায় চুমু খায় একটা। আর মনে মনে বলে- “জীবন সুন্দর ”

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন বিকেলে মীরা আবার গেলো হসপিটালে রিপোর্ট দেখাতে। শুধুমাত্র রিপোর্ট দেখাবে বলে বেশী বেগ পেতে হলো না। ডাক্তারের এসিস্ট্যান্ট সিরিয়াল ছাড়াই ভিতরে যেতে ইশারা করলেন। মীরার রিপোর্ট সবই নরমাল। কিন্তু রক্তে হিমোগ্লোবিন ভীষণ কম। খাওয়া দাওয়ায় যত্ন নিতে বললেন ডাক্তার। নতুন কি একটা ঔষধ লিখে দিলেন রক্ত বৃদ্ধির জন্য । বিশেষ কিছু মাছ, সবজি, ফল সাজেস্ট করলেন সাথে এও বললেন দিন পনেরো পর যেন আবার আসেন ভিজিটে।

আজকে মীরার সাথে রাজিব এসেছে। প্রেগ্ন্যাসির এই দীর্ঘ জার্নিতে আজ প্রথম বার ওর সাথে এলো রাজিব। তার উপর এত দ্রুত কাজ শেষ হওয়ায় মীরা মনে মনে ভাবে দুজন মিলে অনেক দিন বসা হয় না কোথাও। কাজ আর টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ভালোবাসার তারটা কোথায় যেন আলগা হয়ে গেছে। আজ দুজনে নিরিবিলি বসবে কোথাও, অনেক কথা বলবে দু’জনে।

সেখান থেকে বেরুতেই একদল লোকের জটলা দেখা যায় হসপিটালের পার্কিং-এর সামনে। সামনে একটা স্ট্রেচার, খুব সম্ভবতঃ কেও মা’রা গেছে। মীরা ব্যাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেখনে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না ও। তবে একজন মহিলা মাটিতে গড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো মতো কাঁদছে তা লোক জর হওয়া সত্ত্বেও বোঝ যাচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের কেও কেও কাঁদছে। হসপিটালে আনাগোনা লোকগুলোর কেও কেও উঁকি দিচ্ছে। মীরা এ সময়ে এসব এড়িয়ে যেতে চায়। তাই সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পার্কিং থেকে রাজিবের বাইক বের করবার অপেক্ষা করে মীরা। এমন সময় হঠাৎ সিকিউরিটির লোক এসে সেখানে থাকা সবাইকে সরিয়ে দেয়। সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে ও কিন্তু কান বন্ধ করার উপায় তো নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশ কিছু কথা শুনতে পেলো মীরা। ক্রন্দনরত মহিলা নিজেকে দুষছেন এ মৃ’ত্যু’র জন্য।

প্রিয়জনের বিয়োগ এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শোক। দুনিয়ায় অর্থ, সম্পদ, বাড়ি গাড়ি সব চলে গেলে, হারিয়ে ফেললেও তা ফিরিয়ে পাওয়া সম্ভব। শুধু মাত্র প্রিয় জন, কাছের মানুষ ম’রে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাদের কষ্টটাকে অনুভব করতে পারলো মীরা। চোখ বন্ধ করে মন থেকে দোয়া করলো মৃতের জন্য৷ আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশত নসীব করেন।

এমন সময় রাজীব গাড়ি নিয়ে এসে হর্ণ দেয় একটা মীরার মনযোগ আকর্ষণের জন্য। বাইকের পেছনে সাবধানে উঠে বসে মীরা। রাজিবের বাইকটা যখন গাড়িটার সামনে দিয়ে পার হচ্ছিল হঠাৎ বাতাসে স্ট্রেচারে থাকা মৃতের মুখ থেকে চাদরটা সরে গেলো। যেন মীরাকে দেখতেই তার চাদর সরিয়ে মুখ বের করা। মীরা এক মুহূর্তের জন্য ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়।
গতকালের সেই বাচ্চা হবু মা’টা । যে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিলো হসপিটালে। মীরা দ্রুত চারপাশে তাকালো আরো ওর সন্দেহের সমীকরণ মিলাতে। অবশেষে মীরা মেয়েটার বাবাকে দেখলো সিঁড়িতে বসে কাঁদছে, হঠাৎ দেখে চিনতে পারে নি মীরা তাকে। তার গায়ের কাপড় দেখে তাকে চিনলো মীরা। এরকম একটা শার্ট রাজিবের জন্য কিনেছিলো মীরা। তাই ও দ্রুত ক্যাচ করতে পারে লোকটাকে । এতক্ষণ তাকে চেনাই যাচ্ছিল না, এই শার্ট টার জন্য চিনতে পারলো।

একদিনে লোকটার বয়স এক যুগ বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। মলিন চেহারা, ক্লান্ত দৃষ্টি, উস্কেখুস্কো চুল। এ-সব মিলিয়ে তাকে বড় অচেনা মনে হচ্ছিল মীরার। আর মাটিতে লুটিয়ে কান্না করা মহিলাটি কি ঐ মেয়ের মা। পাশে পরে থাকা লুই ভ্যাটনের সে ব্যাগটা যেন সাক্ষী দিচ্ছে মীরাকে যে- মীরা এ সে-ই তুমি যাকে ভাবছো।

তিনি আজ আর নিজেকে লুকাতে বোরকা পরেন নি। নিজেকে লুকিয়ে রাখার ব্যাস্ততা শেষ করে চলে গেলো মেয়েটি। দামী সুতি থ্রিপিস গায়ে তার। তাই দুজনকেই চিনতে সমস্যা হচ্ছিল এতক্ষণ মীরার।

মীরার মাথায় কতগুলো চিন্তা ঘুরছে এখন। লম্বা পার্কিং পেরিয়ে গাড়িটা যখন মীরার দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পরলো তখন মীরার মাথায় থাকা সমীকরণটা মিলে গেলো পুরোটাই।

গতকালের ভাবনাই ঠিক ছিলো। মেয়েটাকে কোন লো’লু’প পশু তার লা’ল’সার শিকার করেছে।

হসপিটাল থেকে বেরুবার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মীরা রাজিবকে বলেছিলো ধানমন্ডি লেকে নিয়ে যেতে। সে হিসেবেই গাড়ি চালাচ্ছে রাজিব৷ হঠাৎ মীরা রাজিবকে বললো –
: ” বাসায় চলো রাজিব, আমার শরীরটা ভাল্লাগছে না”
: ” কেন কি হলো হঠাৎ? ”
: ” না, কিছুনা, বাসায় চলো প্লিজ”
রাজিব ভুল পথে ইউটার্ন নিয়ে বাড়ির রাস্তায় গাড়ি ঘুরালো। জিজ্ঞেস করলো শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটালে ঘুরাবো?
: ” না, না বাসায় চলো তুমি, আমি ঠিক আছি”

মীরা বাড়ি ফিরে কেবল সেসব কথাই ভাবতে লাগলো। ইচ্ছে হচ্ছিল এ নরপশুটাকে খু’ন করতে। এরা কেন এমন অমানুষ। এদের ভিতরে কি হৃদয় বলে কিছু নেই? তাদের পুরোটা শরীরই কি কা’মে ভরা?

পাশে বসে থাকা রাজিব জিজ্ঞেস করলো –
: ” মীরা কি হলো হঠাৎ? বাইরে বসবে বলে ঠিক করেও চলে এলে ”

মীরা ক্রুদ্ধ চোখে তাকালে ওর দিকে, এই যে মানুষটা, এও তো পুরুষ। এ-ও তো সুযোগ সুবিধা মতো কাওকে একলা পেলে ঠিকই খুবলে খাবে।

মীরার চোখে তাকিয়ে রাজিব বললো-
: ” রেগে আছো কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি ”
মনে মনে রাজিব ভাবতে লাগলো- ” ও এত কেন রাগান্বিত, কেও কি কিছু বললো ওকে?
(ঐ যে একটা কথ আছে না- ঠাকুর ঘরে কেরে? আমি কলা খাই না। তেমনি….)

মীরার রাজিবের চিন্তিত মুখ দেখে ভাবনার ঘোর কাটলো। স্বাভাবিক হয়ে বললো-
: ” তোমাদের পুরুষদের তো হৃদয় বলে কিছুই নেই। মেয়েদেরকে একদলা মাংস ছাড়া কিছুই ভাবতে পারো না, তাই না?”
: ” কি বলছো এসব তুমি”
: ” ঠিকই বলছি আমি”
: ” তোমাকে কে বলেছে এসব, নাম বলো একেবারে পুতে ফেলবো শালাকে”
: ” কে কি বলবে, আমি সব বুঝি ”
বলেই কাঁদতে থাকে মীরা। রাজিব ভ্যাবাচেকা খেয়ে মীরার কাছে এসে ওকে ধরতেই কান্নার স্রোত যেন আরো বাড়ে, সে অবস্থায়ই বলে-
: ” তোমাদের পৌরুষ শুধু মেয়ে মানুষ দেখলেই জেগে উঠে, তোমরা একবারও ভাবো না সে মেয়েটা কি এসবের উপযুক্ত নাকি না, আজ যে মেয়েটা মরলো, এমন কত মেয়ে প্রতিদিন তোমাদের মতো লোকের লালসার বলি হয় তার খোঁজ কে জানে? আমি খুব করে চাইতাম আমার একটা মেয়ে হোক। কিন্তু এ সমাজে মেয়েরা নিরাপদ না, এমনকি পরিবারেও না। ঐ মেয়েটার সাথে এমন কাজ করেছে ওরই আপন চাচাতো ভাই, মেয়ের মা তাই বলছিলে কেঁদে কেঁদে”
বলেই মুখ চেপে কাঁদতে থাকে মীরা।

রাজিব বুঝতে পারে মীরা হসপিটালের ঐ মেয়ের মৃ’ত্যু’র বিষয়ে কথা বলছে এতক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বুক থেকে পাথর নামে যেন ওর।

স্বান্তনার স্বরে রাজিব বললো-
: ” সবাই কি এক? ”
: ” তোমরা সবাই এক ”

আর কোন কথা বাড়ায় না রাজিব। এখন তর্ক করার সময় না। ভেবেই শুইয়ে দেয় মীরাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
: ” এজন্যই মন খারাপ? ”
বেশ কিছু সময় পর শান্ত হয়ে মীরা হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।
: ” এসব ভেবো না, ঘুমিয়ে পরো”

কাঁথা টেনে পাশ ফিরে চোখ বুঝে মীরা। চোখ দুটে বুঝতেই ওর চোখে ভেসে উঠে গতকালের সেই মেয়েটির ওকে ছুঁয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি। আর কানে বেজে উঠে – থার্টি সেভেন – নুহা । মেয়েটির নাম ছিলো নুহা।
কি সুন্দর, নিষ্পাপ মেয়েটি। কতই বা বয়স হবে ওর, এ বয়সেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হলো এক অমানুষের লালসার জন্য। চোখ বেয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে মীরা৷ কি ভেবে যেন হঠাৎ চোখ দুটো খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে রাজিবকে বলে-
: ” শোন আমাদের মেয়ে হলে ওর নাম রাখবো নুহা, কেমন? ”

চোখ কুঁচকে রাজিব হাতের ফোনটাকে নামিয়ে কিছু সময় চেয়ে থাকে মীরার দিকে। মীরা যেন অজানা কোন ভাষায় বললো কিছু ওকে। এরপর বলে-
” ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও তো ” বলে ফোনটাকে পাশে রেখে মীরার গা ঘেঁষে শুয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে রাজিব। আরামে চোখ বুঁজে আসে মীরার।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ১৭

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙে মীরার। সূর্য তখনো উঠে নি। চারদিকে কেমন মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। নিচে তাকিয়ে দেখে নিচের গাছের পাতাগুলো নেচে উঠছে বাতাসের দাপটে। উপর থেকে তাকালে মনে হয় নিচে সবুজের পারাবার। সামনে তাকালে দূরে থাকা রেললাইন দেখ যায়। তার শব্দ কেবল গভীররাতেই পাওয়া যায়। উচুতে বাসা থাকার এই এক মজা। এক দৃশ্যে এসব দেখে নেয়া যায়।

বারান্দার গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাস ধরতে চেষ্টা করে মীরা। কিন্তু বাতাস অনুভব করা যায় মাত্র, একে কি ধরা যায়? কাছেই আছে কিন্তু অদৃশ্য। রাজিবকে ও ওর বাতাসের মতো মনে হয়। তাই তো সেদিন ও রাজিবকে বলেছিলো- ” তুমি কাছেই আছো আমার, কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পারছি না ”

ভালোবাসা ভাগ্য বরাবর খারাপ মীরার। বিয়ে হতে না হতেই রাজিবের কত বড় অসুখ ধরা পরলো। অসুখ হওয়ার আগে যে কটাদিন ছিলো সেই দিনকটাই মীরার জীবণের সবচেয়ে মধুময় দিন ছিলো৷ এরপর নববধূ মীরা স্বামীকে বাঁচাতে কত কি না করে ছিলো। রাজিব সুস্থ হলেও ওকে বেশ খানিকটা সময় দিয়েছিলো মীরা।

রাতের বেলা পাশে শুয়ে থাকা রাজিব, রাজিবের উন্মুক্ত পিঠ, শরীরের গন্ধ, জাগিয়ে তুলতো মীরার আদিম প্রবৃত্তি। ধৈর্য ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে মীরা। এমন কি রাহাতের কাছ থেকেও শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলো ও। আল্লাহ সহায় ছিলো বলে এমনটা পেরেছিলো । শেষ পর্যন্ত রাহাত খুব ভালো বন্ধু রূপে আবির্ভাব হয়েছিল ওর জীবণে। মীরার ফিরিয়ে দেওয়া সেই দুই-লক্ষ টাকা রাহাত ফেরত দিয়েছিলো মীরাকে৷ বলেছিলো
: ” এটা তোমাদের জন্য আমার পক্ষ হতে উপহার ”
প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিলো না মীরা। এত অল্প বয়সে জীবণে এত বড় বড় চমক পেয়েছে ও জীবণে যে কেমন হতবাক হয়ে ছিলো আগে থেকেই। তাই ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগে ওর। যদিও টাকাটা মীরা রেখে চলে এসেছিলো শেষ পর্যন্ত। রাহাতকে ছোট্ট করে বলেছিলো – ভেবে জানাবে ৷

মীরার ভয় ছিলো এটা আবার কোন নতুন ফন্দি না তো রাহাতের। মাস খানেক পর মীরার কোচিং-এর ঠিকানায় একটা চিঠি আসে। সে খামে ছিলো একটা চিঠি, আর তার ভেতরে আরো একটা খাম। খামের নাম ঠিকানা দেখে মীরা ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো খামটা। এখানে এটা পড়া ঠিক হবে না তা ভেবে। বাড়ি ফিরেও চিঠিটা পড়বার সুযোগ হচ্ছিলো না মীরার। সেদিন রাজিব সিলেট যাচ্ছিলো ওর এক বন্ধুর সাথে। সুস্থ হলে সেখানে যাবার নিয়ত করেছিলো রাজিব। যাওয়ার কথা মীরারও ছিলো। কিন্তু দুজন গেলে খরচ বেশি হবে তাই মীরা বলেছিলো –
: ” টাকাপয়সার সমস্যা যেহেতু, তুমি একাই যাও। নিয়ত করেছিলে তুমি, আমার না গেলেও হবে”
রাজিব আহত চোখে তাকিয়ে ছিলো মীরার দিকে।।সান্ত্বনার সুরে মীরা বলেছিলো-
: “মন খারাপ করো না লক্ষ্মীটি, পরিস্থিতি তো বুঝতে হবে তাই না? আমাদের যখন অনেক টাকা হবে আমরা দুজনে একসাথে অনেক ঘুরবো, কেমন?”

টাকা মীরার জীবণে এসেছিলো ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসায় হাত ধরে ঘুরাঘুরিটা আর হয় নি। যত বার ওরা এদিক সেদিক ঘুরতে গিয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ওদের ব্যাবসা। তো সে রাতে মীরা রাজিবকে বিদায় দিয়ে, ঘরের সব কাজ শেষ করে বের করেছিলো চিঠিটা। মনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা, কি লেখা আছে এতে? মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ছিলো মীরা।

প্রিয় মীরা,
চিঠিটা যখন তোমার হাতে পৌঁছোবে ততদিনে আমি
পৌঁছে গেছি তোমার থেকে যোজন যোজন দূরের দেশ ইংল্যান্ডে। সব কাজ শেষ করে রাতের অবসরে তুমি যখন চিঠিটা পড়ছো আমার এখানে তখনো রাত হয়নি হয়তো, আমি তখন ব্যাস্ত হয়তো আমার কাজে। এ শহরে সবাই ব্যাস্ত। কারো সময় নেই দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে খোঁজ নেয় করো৷ কেমন আছো? এ কথাটাও তারা হাঁটা চালু রেখে জিজ্ঞেস করে। উত্তর যখন দিই তখন হয়তো সেই শব্দ গুলো তার শ্রুতি সীমার বাইরে চলে যায়। তাই ইশারায় কুশল বিনিময়ই একমাত্র ভরসা। এসব জানা আমার।

কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। চিঠি আমি জীবনেও লিখি নি। এ লেখাটা চিঠি কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে আমার। এটাকে আমার আত্মা পক্ষ সমর্থন ও বলতে পারো। যাকগে শোন তাহলে-

আমাদের বাড়িতে যখন উঠেছিলো চোখের সামনে তোমাদের ভালোবাসাময় জীবণ দেখে হিংসার আগুনে জ্বলছিলাম আমি। রাস্তার একটা ছেলে রাজিব, কি ছিলো ওর? বেতনই বা কত ছিলো ? তবুও কেন ওর এত সুন্দর স্ত্রী, এত সুখ? সহ্য করতে কষ্ট হতো খুব। এত কেন সুখী ওরা? সব থেকেও আমি কেন অসুখী? তাই তো তোমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তোমাকে আমার করে পেতে চেয়েছিলাম। রাজিবের চিকিৎসার অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতে চেয়েছিলাম তোমাকে।

আমি অনেক বড় একটা অন্যায়ের শুরু করেও তার শেষ করতে পেরেছিলাম খারাপ কিছু ঘটার আগেই। তাই কৃতজ্ঞতা ইশ্বরের কাছে। আমি ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘড়ে’ চাপাচ্ছিলাম আর একটু হলেই। সেই অন্ধকারে আমাকে পথ দেখিয়ে ছিলো লোরা নামের বন্ধু রূপি সেই মেয়েটা। দোষটা আমারই ছিলো আমিই সবজির বাজারে গিয়ে হয়তো বই খোঁজার মতো ভুল করেছি। অপাত্রে ভালোবাসা খুঁজেছি, কষ্টও পেয়েছিলাম ভীষণ। যার তাড়না আমাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিলো। ভালোবাসার ফোয়ারা নিয়ে আমার পাশেই যে কেও ছিলো, তা খেয়ালই করি নি আমি কোন দিন । তুমি জেনে খুশি হবে যে আমি আমার সেই দুঃসময়ের বন্ধু যে সেই স্কুল থেকে আমাকে আগলে রেখেছিলো এতটা বছর ধরে তাকে আমি স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেছি। তার ভালেবাসার টানেই আমি চলে এসেছি এ দূরদেশে। তুমি হয়তো এখন ভাবছো এত জলদি ভালোবাসাবাসি হয়ে গেলো। লোরা তো আগে থেকেই ভালোবাসতো আমায়, ওর দিক থেকে এ্যাফোর্ট শতভাগ আগে থেকেই, নতুন করে যা করতে হয়েছে তা হলো আমার দিক থেকে তার অনুভব করা। টানা একটা মাসের প্রতিটি রাত শুধু আমি লোরার একটা কথাই শুধু ভেবেছি। অভিমানী কন্ঠে সে একদিন বলেছিলো- ” দুনিয়াটা এমন কেন রে? কেও পায় না আবার কেও চায় না ”

ওর এ কথা বলার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি আমাকে অনেক ভালোবাসে ও। এরপর আমার ভেতরে ও পরিবর্তন হতে শুরু করে। কিন্তু তা খুবই ধীর গতির হওয়ায় টেরই পাই নি। একসময় লক্ষ্য করলাম কেমন সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা হচ্ছে ভিতরে। কি, কেন, কিভাবে কোন উত্তরই নাই আমার কাছে। হঠাৎ এক রাতে ঘুম ভেঙে গেলো। শত চেষ্টায় ও আর ঘুম এলো না। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো সে যন্ত্রণা। সংকোচ, দ্বিধা একপাশে সরিয়ে ফোন করলাম ওকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই ঘুম মাখা এক কন্ঠ হ্যালো বলেছিলে। তারপরই বলেছিলাম – “লোরা বিয়ে করবি আমাকে? ”
কি বলছি আমি তা ভাবতে হয়তো একটু সময় লেগেছিল লোরার । ঘটনার আকস্মিকতায় নেশ কিছু সময় চুপ থেকে ফোনটা কেটে দিয়েছিলো ও। এত বছর যাকে এক মনে চেয়েছে, সে আজ নিজে ধরা দিয়েছে। ব্যাপারটা হজম করা কি চাট্টিখানি কথা? এপাশ থেকে আমিও ফোন করেই যাচ্ছি, ধরছিলো না ও। উপায় না দেখে চলে গিয়েছিলাম ওর বাড়ির সামনে। কারন পরদিন বিকেলেই ওর ইংল্যান্ড যাবার ফ্লাইট। পড়াশোনা আমার কিছু না হলেও বন্ধুরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ও ওখানে অনার্স-মাস্টার্স করে দেশে ফিরছিলো চাকুরী বাকরির চেষ্টা করতে। সুবিধা করতে না পারায় সেখানেই ফিরে যাচ্ছিল পিএইচডি করতে। আমি কোন সময় নিতে চাই নি। সরাসরি বাবা-মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। সে যাত্রায় ওর যাওয়াটা পিছিয়ে গেলো পনেরো দিন। নিকটবর্তী শুক্রবারে বিয়ে করি আমরা। তুমি যেদিন আমার বাড়িতে এসেছিলে টাকা ফেরত দিতে তখন আমি “বিবাহিত” ছিলাম। লোরা চলে গেছে বিয়ের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে৷ পাছে জয়েনিং ডেট মিস হয়ে যায়। এদিকে আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম ওর সাথে থাকার জন্য। দেশে ফিরবো কিনা জানিনা, হয়তো ফিরবো, হয়তো না। অনেক বললাম নিজের কথা। এবার শোন কি বলি-

কেমন আছো তোমরা? আশাকরি ভালোই আছো। ভালো থাকো এ দুআ করি। চিঠির ভিতরে আরেকটা খাম রয়েছে। সেখানে একটা চেক রয়েছে দু’লক্ষ টাকার। এ টাকাটা তোমাদের নতুন জীবণ শুরু করার জন্য আমার পক্ষ হতে উপহার। এটা দিয়ে কিছু করার জন্য নতুন করে শুরু করো। আমি জানি তুমি পারবে। যে মেয়ে শূন্য হাতে স্বামীর চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে পারে, সে পারবে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। তোমার স্বামী সম্পর্কে কিছুই বলবো না আমি। তবে একটা কথা সেদিনও বলেছিলাম এখনো বলবো- ভুল করেছো তুমি, ইউ ডিজার্ভ বেটার দেন……

ভালো থেকো মীরা৷ তোমার জীবণ ভালোবাসাময় হোক, এ দোয়াই করি ইশ্বরের কাছে।

ইতি,
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী রাহাত

সে রাতে মীরা চিঠির শেষ লাইন কয়টার মর্ম না বুঝলেও সাত বছরের সংসার জীবণে তার সত্যতা পেয়েছে ধীরে ধীরে।

এটা সত্যি যে মীরা পেরেছে। রাহাতের দেয়া সেই টাকা দিয়ে শুরু করা ব্যাবসা আজ আলোর মুখ দেখেছে। কিন্তু মীরার জীবণ ভালোবাসাময় হয় নি শেষ পর্যন্ত। এজন্য মীরা নিজেকে দোষী ভাবে।
মনে মনে আবীরকে কষ্ট দেয়াটা অপরাধবোধ জাগায় ওর মনে। তা না হলে কেন এমন হবে?

” যার সাথে ভুল হয় সে একটা সময় তা কাটিয়ে উঠে কোন না কোন ভাবে। কিন্তু যে ভুল করে অপরাধবোধ তার পিছু জীবণেও ছাড়ে না ”
অপরাধবোধ মীরার পিঁছু ছাড়ে নি। ও যত গতি বাড়াচ্ছে সামনে এগিয়ে যেতে, অপরাধবোধও তত গতিতে ওর পিছু ছুটছে। আচ্ছা এর থেকে মুক্তির কি কোন পথ নেই?

ভাবনায় ছেদ পরে ফোন কলের শব্দে। কাছে গিয়ে দেখে কারখানা থেকে ফোন এসেছে। রাজিবকে ডেকে তুলে তৈরী হয়ে যেতে বলে মীরা। আজ ও একটু দেরিতে যাবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজিব ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়। মীরা বিছানায় শুয়ে থাকে। রাতে ঘুম হয় না ওর। এটা নতুন রোগ না ওর। এ রোগের জন্ম হয়েছিলো এক শীতের ভোরে। সে গল্পটা ভুলে থাকতে চায় মীরা। কারন সেটা এত নোংরা গল্প যে- এসব আর ভাবতে চায় না ও। তবুও সে সকাল রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ওর, যত চেষ্টাই করে সেই ঘটনা কিছুতেই পিছু ছড়ে না ওর। একটু অবসর পেলেই ধেয়ে আসে ওর দিকে তেড়ে।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ১৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ঘটনাটা প্রায় বছর খানেক আগের। আট দশটা শীতের সকালের মতো সেদিন ও কুয়াশার স্তর ভেদ করে সূর্যের আলো প্রবেশ করেছিলো পৃথিবীর বুকে।
ঘাস লতাপাতায় কুয়াশার শিশির হয়ে আছড়ে পরা কণাগুলো রোদের তাপে বিলিন হওয়ার পথে। বাড়ির পাশে মসজিদের পেছনে কবরস্থান হওয়ায় বেশ গাছপালা ঘেরা জায়গাটি। সেই সুবাদে পাখিদের আনাগোনা এখানটায় চোখে পরার মতো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও পাাখির কলতানে ঘুম ভাঙে মীরার। ঘুম থেকে উঠে মীরা পাশে তাকিয়ে দেখে রাজিব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে ওকে অনেক সুন্দর দেখায়। ওর দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি হাসে মীরা। এ হাসি খোদার তরে কৃতজ্ঞতার হাসি।

সাবধানে খাট থেকে নামে মীরা। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়। ঘুমানোর সময় শব্দ করা রাজিবের অপছন্দ তাই।

রান্নাঘরে গিয়ে নাশতা তৈরী করতে করতে রাজিব উঠে পরে ঘুম থেকে। কোন মতে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পরে ও। যদিও আজ সকাল সকাল কাপড়ের রোল ঢোকার কথা কারখানাতে, এ সময় একজন থাকতে হয় মাল ঠিকঠাক বুঝে নিতে। তবুও আজ যেন রাজিবের খুব তাড়াহুড়ো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকাল সড়ে আটটা মাত্র। ব্যাপারটা মীরা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়।

রাজিবকে বিদায় দিয়ে পরটা রোল করে চা দিয়ে খাচ্ছিলো ও, আর অফিসের ফোনটাতে পেইজের নোটিফিকেশন চেক করছিলো। এক কাস্টমারের সাথে কথা বলা শেষে অর্ডার কনফার্ম হলে নাম ঠিকানা কপি করে লিখে রাখে প্যাডে। এই স্লিপটাই প্রোডাক্টের ব্যাগে স্ট্যাপলার করে পাঠানো হবে তাদের ঠিকানায়। তবে ইদানীং টুম্পার পরামর্শে সেগুলোকে কিপ নোটে সেইভ করে রাখে মীরা। ওর পরামর্শ হলো এই কাস্টোমার গুলোকে একমাস পরে ফোন দিয়ে ড্রেসের ব্যাপারে মতামত জানবো আমরা। তাদের রিভিউ ও জানা হবে, একটা ভালো সম্পর্ক ও তৈরী হবে পেইজ আর কাস্টমারের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমার রিপিট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। ওর কথাটা হালকা ভাবে নিলেও পরে কাজে এসেছিলো। ইতিমধ্যে একটা ফেসবুক কমিউনিটি তৈরী হয়ে গিয়েছে ওদের বিজনেস পেইজের নামে। যারা পেইজ থেকে কেনাকাটা করে তারা রিভিউ দেয় সেখানে৷ আর রিভিউ পোস্ট করলেই পরবর্তী অর্ডারের ডেলিভারি চার্জ ফ্রী করে দেয়া হয়।

এই এক ট্রিক মীরার বিজনেসটা অনলাইন প্লাটফর্মে শক্ত একটা জায়গা তৈরি করে নেয়। শুরুটা কঠিন হলেও ঐ সব রিভিউ দেখে গ্রুপের অনেক মেম্বার অর্ডার করতো। কেও কে পেইজ থেকে ছবি নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করতো ড্রেসের ডিটেইলস জানতে। অনেকে যারা ইতিমধ্যে ড্রেসটা নিয়েছেন তারা মতামত জানাতো। টুম্পার এই এক আইডিয়া ব্যাবসার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো।

নাশতা খাওয়া শেষ হলেও মীরা অবাক হয় টুম্পা এখনো উঠে নি। শরীর খারাপ কিনা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে লক করা। এমনিতে টুম্পা দরজা লক করে না। এ বাড়ির কোন দরজাই রাতে লক করা থাকে না। মীরা উল্টো হাতে ঠকঠক করে বেশ কয়েকবার টোকা দেয়। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে আপা উঠেছি আমি….

ওর ঘুম ভেঙেছে দেখে সেখান থেকে ফিরে আসে ও। দুপুরের রান্নার জোগাড় করে কি একটা কাজে ওর রুমে আসতেই দেখে দরজা তখনও আটকানো। তৎক্ষনাৎ ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে , কিছু হলো কি মেয়েটার?

তরকারির চুলার আঁচ কমিয়ে টুম্পার ঘরে আবারো নক দেয় মীরা।
টুম্পা..
টুম্পা……

: “আপা আমি জেগেই আছি”
: “শরীর খারাপ?
: “গেইট খোল ”

বেশ কিছু সময় পর গেইট খুলে টুম্পা। মলিন মুখ, রাত জাগা চোখ দুটি ফোলা। ওর এ অবস্থা দেখে মীরা জিজ্ঞেস করে –
: ” কি হইছে? বাড়িতে কোন খারাপ খবর?”
না সূচক মাথা নেড়ে নিচে তাকিয়ে থাকে ও।
: ” শরীর খারাপ? ”
আবারো মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দেয় টুম্পা।
অধৈর্য স্বরে মীরা জানতে চায়-
: “তো কি হয়েছে বলবি তো?”
ফ্লোরে বসে পরে কাঁদতে থাকে টুম্পা। মীরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় টুম্পার এমন আচরণে।ওর কাছে বসে মীরা ওর মুখ তুলতে চেষ্টা করে বলে-
: ” কি হয়েছে বল, না বললে বুঝবো কি করে?”
কান্না যেন থামেই না। তখন টুম্পার মীরাদের কাছে আসার মাস ছয়েকও হয় নি। হোম সিকনেস বলে একটা কথা আছে। মীরা প্রাথমিক ভাবে ভেবে নেয় সেটাই হয়তো। ওকে ওর বিছানায় বসিয়ে মীরা ধমকের সুরে বলে-
: ” কাঁদবিই কি শুধু? নাকি বলবিও কিছু? ”
মীরার ধমকে কাজ হয়। টুম্পার কান্নারত কন্ঠে বলে-
: ” ভাইয়া….”
: ” ভাইয়া কি? বকেছে রাজিব তোকে?”
মাথা নেড়ে না বলে টুম্পা। মীরার হাত ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি হয়েছে বল আমাকে?”
বেশ কিছু সময় নেয় টুম্পা। এ সময়টুকুতে মীরার মাথায় চলতে থাকে জটিল সমীকরণের হিসাব। কয়েকটা সম্ভাব্য উত্তর ওর তৈরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু টুম্পা যা বলেছে তা ওর সমীকরণের যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ এর বাইরের কিছু। নিজের কানকে প্রথমে ভুল মনে করে মীরা। কিন্তু টুম্পা যখন ওর কান্নার কারনের বিশদ ব্যাখ্যা বলতে শুরু করে মীরার মনে হয় পাহাড় থেকে কেও ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। কাজের আপা এসেছেন হয়তো। সেখান থেকে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে উঠে গেইট খুলে দেন মীরা৷ তিনি ঘরে ঢুকলে সেখান থেকে টুম্পার ঘরে ঢুকে সাবধানে দরজাটা লক করে দেয় মীরা। বিপদ সংকুল জাহাজের দিশেহারা নাবিকের মতো দেখায় তখন মীরাকে। বিশাল ঝড়ে আছড়ে পরার অবশ্যাম্ভী পরিনতি জেনেও চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করে-
: ” এর আগেও কি এমন হয়েছিল? ”
মাথা নেড়ে না জানায় টুম্পা।
: ” ওর সামনে বলতে পারবি এ কথা?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলে ও। কি একটা ভেবে টুম্পাকে কাছে টেনে আদর করে মীরা। বলে-
: ” তোকে আমি শক্ত মেয়ে ভাবতাম, তুই তো বেশ বোকা ”
আরেক দফা কান্না শুরু হয় ওর। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
: ” এত আবেগী হলে জীবণ চলবে না, উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে কারখানায় যা। একটা অর্ডার রিসিভ করেছি আমি, ঠিকানা লেখ আছে গিয়েই পাঠিয়ে দিবি, দুপুরের আগেই যেন পৌঁছে যায় সেটা”

বলেই সেখান থেকে চলে আসে মীরা। ওর কাছে নিজেকে শক্তিশালী পরিচয় দিলেও, তরকারি টা কাজের আপাকে দেখতে বলে নিজের ঘরে ঢুকে সোজা বাথরুমে চলে যায় ও। বেসিনের আয়নাতে চোখ রেখে টুম্পার বলা কথাগুলো মাথাতে গোছায় ও। তারপর হঠাৎ ওর দুচোখ বেয়ে পানির ধারা পরতে থাকে। মুখ চেপে কান্না করে মীরা। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না বের হয় তাই দ্রুত পানির ট্যাপ ছেড়ে খালি বালতি পেতে দেয়।

ওর বিশার গোসল ঘরের মেঝেতে শুয়ে পরে ও। বসে থাকার শক্তি নেই যেন। আজ প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করে মীরা সত্যিই ওকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়াটা অনেক বড় ভুল ছিলো ওর।

কতক্ষণ শুয়ে ছিলো সেভাবে খেয়াল নেই মীরার।
“” গত রাতে ওর এক বন্ধুর বৌভাতের দাওয়াত ছিলো। এর সাথে নতুন বন্ধুত্ব রাজিবের। ব্যাবসা সূত্রে পরিচয়। তাই তাকে চিনে না মীরা। এই প্রথমবার মীরাকে রাজিব সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে নানান ব্যস্ততায় এটেন্ড করা হয় নি ওর নতুন বন্ধু বান্ধবের দাওয়াতে। সত্যি বলতে রাজিবও জোড় করে বলে নি কখনো, মীরারও ইচ্ছে হয় নি সব মিলিয়ে যাওয়া হয় নি এর আগে।

তো মীরা শাড়ি পরে ছিলো, আর রাজিব সুট বুট। যেমন সুন্দরী মীরা, তেমনি রাজপুত্রের মতো রাজিব। দু’জন সে অনুষ্ঠানের শান বাড়িয়েছে যেন। এমন কেও নেই যে ওদের দিকে দেখে নি। অতি নাকউঁচু মানুষটাও আড় চোখে দেখেছে ওদেরকে। রাজিবের তৈরী এ পরিচিত মহলে সবার সুন্দর সুন্দর মন্তব্য আর প্রশংসার বন্যায় ভাসছেন দুজনে। উপস্থিত সকলের মধ্যে এক মহিলা কেমন কন্ঠে যেন রাজিবকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” রাজিব উনি তোমার ওয়াইফ?”
রাজিব কিছু একটা বলতে গেলে মীরা রাজিবের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রাজিবের হাত দু’হাতে চেপে ধরে বলে-
: ” হুম, রাজিব আমার হাসবেন্ড, এবং ওর কোথাও কোন শাখা নেই ”
কথাটা শুনেই অট্টহাস্যে ফেটে পরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই। মীরার মুখেও চোরা হাসি। এসে অবধি দেখছে এই মহিলার ছোট নাই বড় নাই এর ওর গায়ে ঢলে পরছে, কথা বলছে গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে। মায়ের বয়সী মহিলা রাজিবকে বলছে তুমি করে আর মীরাকে উনি। তাই মহিলাকে একটু শায়েস্তা করবার এ সুযোগটা হাতছাড়া করলো না মীরা।

মহিলা মুখ কেমন করে, হাসিতে যোগ দিলেন। যদিও হাসিটা মেকি ছিলো। তার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক খুব সম্ভবতঃ উনি মহিলার হাসবেন্ড তিনি বললেন-
: ” তোমার ওয়াইফ তো দেখছি যেমন- সুন্দর তেমনি প্রতুৎপন্নমতি, মাশাল্লাহ তোমরা রাজযোটক। দোয়া করি আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুন।

মীরা এ দুটি শব্দ প্রথমবার শুনলো, রাজিবকে কথাটা বলায় রাজিব বললো আগে বাংলার প্রফেসর ছিলেন। এসব ছেড়ে এখন ব্যবসায়ী বনে গেছেন।

সেখানে গিয়ে আরো অনেকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। আরো দেখা হয় “পলাশ গার্মেন্টস” এর সেবাহানের সাথেও । লোকটার সাথে ঐ মহিলাও ঢলাঢলি করছে। ব্যাপারটা রাজিবকে বললে ও বলে-
: ” এ মহিলা ডেঞ্জারাস জিনিস, বারে যায় নিয়মিত জানো?”
: ” জানবো কি করে, আমি তো তোমার মতো বারে যাই না নিয়মিত , তাই না? ”
কথাটা শুনে চোখমুখ কেমন শক্ত হয়ে যায় রাজিবের। খুব সম্ভবতঃ রাজিব ভাবছে এ খবর মীরা পেলো কোথায়?

মীরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে চলো বর বৌর সাথে ছবি তুলে আসি। কেমন একটা আমতা আমতা ভাব করে মীরার পিছু পিছু গেলো রাজিব। ছবি তোলা শেষ হলে মীরার এক বান্ধবী নায়রার সাথে দেখা হয়। অনেক বছর পর দেখা। এ অনুষ্ঠানের বৌ নায়রার কাজিন হয়। মীরা পরিচয় করিয়ে দেয় রাজিবকে। একটু পর রাজিব বলে-
” তোমরা কথা বলো, আমি আসছি, এক্সকিউজ মি”

মীরা এতদিন পর পরিচিত কাওকে পেয়ে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে। দুজনেই স্কুল ফ্রেন্ড ছিলো।
নায়রা কথা প্রসঙ্গে মীরাকে জিজ্ঞেস করলো –
” আমি সোমার কাছে অনেক আগে শুনেছিলাম তুই নাকি ইন্টার পরীক্ষার আগে পালিয়ে বিয়ে করেছিস, ও ভীষণ দুঃখ করেছিলো। বলেছিলো ছেলে নাকি তোর উপযুক্ত না৷ নোভার ওর বর নিয়ে যা গরিমা, বাব্বাহ্। বর নিয়ে বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা আমার কাছে ফালতু লাগে বুঝলি? ঘরে দুজন চুলাচুলি করে আর ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে – “মেইড ফর ইচ আদারস্”, হুহ্ লেইম পিপল।

মীরা কিঞ্চিৎ অহং এর সুরে বলে-
: ” হুম, যাই বলিস তোদের সবার মধ্যে আমার বরই সবচেয়ে সুন্দর, মাশাল্লাহ” তোদের গেটটুগেদার এর ছবি দেখেছি আমি, লাবিবার সাথে এড আছে আমার। সে সুবাদে দেখেছি।

উত্তরে নায়রা বলে-
: “হুম, তাই তো দেখছি, তোর বর দেখলে ওর দম্ভ ভাঙবে বুঝলি ”

এরপর বেশ কিছু সময় কথা বলে দুজন, সংসার, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। একটা সময় ওর বর ডাকলে চলে যায় নায়রা, ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করে দুজনে। বলে কথা হবে নি ফেসবুকে। ওকে..?

এরপর মীরা রাজিবকে খুঁজতে থাকে৷ শেষে ওকে পায় ড্রিংকস সেকশনে। সেখানে বসে বেশ কয়েক জন ড্রিংস করছে। সাথে রাজিবও।

চোখমুখ শক্ত করে মীরা তাকায় রাজিবের দিকে। রাজিব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত উঠে পরে। মীরা দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে পার্কিং এ অপেক্ষা করে।

রাজিব সুবোধ বালকের মতো বাইক মীরার সামনে দাঁড় করায়। গাড়িতে বসে মীরা রাজিবকে কিছুই বলে না। রাজিব আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে-
: ” সবাই চেপে ধরলো তাই হালকা…”
: “হইছে আর সাধু সাজতে হবে না”
রাগত কন্ঠে বলে মীরা। সে যাত্রায় কিছুই বলে না মীরা। আজ ওর মনটা খুশি। তাই এসব নিয়ে কোন কথা তুললো না। অনেক রাত হওয়ায় মীরা ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে। রাজিব ও ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আসে। মীরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে।

রাজিব ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করলে মীরা ঘুম ঘুম কন্ঠে নিষেধ করে। নিষেধ করা সত্ত্বেও রাজিব গা ঘেঁষে আরো কাছে আসে মীরার। এলোমেলো ভাবে ছুঁয়ে দিতে থাকে ওকে। মীরা রাজিবের হাত আটকে রাখে ওর পেটের কাছে, কিন্তু রাজিব সেখানেও মীরার শরীরকে জাগিয়ে তুলতে তান্ডব শুরু করে।
মীরা ভীষণ রেগে যায় ওর এমন আচরণে। আজ সারাদিন ও দৌড়ের উপর ছিলো। রাজিব জোর করায় দাওয়াতে গিয়েছিলো ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও। সত্যি বলতে মীরা একটু বেশীই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলো।
রাজিব তাই রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর-ই কি রাজিব….. “”

টুম্পার কন্ঠে সংবিৎ ফিরে ওর। উঠে মুখে পানি দিয়ে বেরুতেই খেয়াল হয় জামাকাপড় সব ভিজা। টুম্পাকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে-
: ” ড্রয়ার থেকে কাপড় দে তো টুম্পা, একেবারে ভিজে গিয়েছি”
টুম্পা কাপড় দিলে মীরা আড়ালে থেকে বলে-
: ” নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পর, আমার আসতে আজকে একটু লেট হবে”

কাপড় বদলে ঘরে ফিরে দেখে টুম্পা বেরিয়ে গেছে। ফোনটা হাতে নেয় মীরা রাজিবকে কল করার উদ্দেশ্যে। একবার রিং হতেই কি একটা ভেবে কেটে দেয় মীরা। ভাবে কথাগুলো ফোনে বলার চেয়ে সামনাসামনি বলাই ভালে হবে।

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-১১+১২+১৩+১৪

0

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব : ১১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাহাত দাঁড়িয়ে আছে মীরার অপেক্ষায়, অনেক শক্তি সঞ্চয় করে মীরা বললো-
: ” আমার ক্ষুধা নেই, আপনি খেয়ে আসুন আমি বরং অপেক্ষা করি আপনার জন্য ”
: ” না, না তা হবে না, চলো তো।” এমন আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন মীরা ওর খুব কাছের কেও।

: “এত ভয় কেন পাচ্ছে তুমি, নাশতা খেতে বলেছি , তুমি এমন ভাব করছো যেন…”
নিরুপায় মীরা পুরো কথা শেষ না করেই উঠে দাঁড়ার, টেবিল থেকে খামটা নিতে নিলে রাহাত বলে –
: ” উহু, ওটা ওখানেই থাক”

খামটাকে সেন্টার টেবিলে রেখেই মীরা পিছু পিছু চলে রাহাতের। এ বাড়ির খাবারের ব্যাবস্থা দোতলায়। মীরা ধীর পায়ে চললো ওর পিছু পিছু।

টেবিলটা খুব সুন্দর করে গোছানো। একটা চেয়ার টেনে দিলো রাহাত মীরাকে। ওকে বসতে দিয়ে ঠিক ওর বিপরীতে বসলো নিজে। খবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে একে একে সবগুলো খাবার নিজ হাতে বেড়ে দিলো। এসব খেয়াল করলো না মীরা কারন ওর মনে এখন অন্য কিছু চলছে। রাহাত যদি ওকে আটকে ফেলে তাহলে কি কি হতে পারে ওর সাথে তাই ভবছে ও।

হঠাৎ চামচ পরে যাওয়ার শব্দে মীরার যেন ধ্যান ভঙ্গ হয়। সামনে তাকিয়ে দেখে সুসজ্জিত খাবারের প্লেট। পরোটা, গরু গোশতের ভুনা, সবজি, ডাল আর ডিম। পাশে আছে জুসের গ্লাস । এমন খাবার ও অনেকদিন চোখেই দেখে না। সংসার জীবণের বয়স পাঁচমাস হতে চললো, গরুর গোশতের কেজি তিন’শ হওয়া সত্ত্বেও একদিনও গোশত রান্না হয় নি ওর ঘরে। প্লেট থেকে চোখ যখন রাহাতের দিকে গেলো। মিষ্টি হেসে ইশায়ার বললো শুরু করতে। মীরার কেমন সংকোচ হয় এত খাবার আর ওর ব্যাবহারে।

রাহাত নিজের মতো করে খেতে শুরু করে। মীরাও পরটার এক কোণ থেকে একটু ছিড়ে সবজির বাটিতে হাত বাড়ায়। প্রথমেই গোশতের বাটিতে হাত দিতে কেমন লজ্জা লাগে ওর। মনে হয় তিনি যদি কিছু ভাববেন।

মীরা পরোটা মুখে দিয়ে বুঝলো পরোটাটা ঘিয়ে ভাজা। মীরার ওর মায়ের কথা মনে পরলো। ওর মা বাড়িতে নশতা তৈরীর সময় সবার জন্য একটা করে পরোটা তৈরী করতো। সেটা তিনি গ্রাম থেকে আনা ঘি দিয়ে ভাঁজতেন। আর সেটা পরিবেশন করতেন গরম গরম। মীরা দেরি করে উঠতো। তাই ওর পরেটাটা ভাজা হতো ও ঘুম থেকে উঠার পরই। কত আদরে বড় হ’য়েছে মীরা। এসব এখন গল্প। সোনালী রূপকথার গল্প।

রাহাত হঠাৎ বলে উঠলে-
: ” বিফটা খাচ্ছে না কেন? বিফ খেতে কোন সমস্যা?
: ” না, তা নয়”
: “আমাদের বাবুর্চি খুব ভালো রান্না করে এটা, খেয়েই দেখো ”

মীরা ভীষণ ক্ষুদার্থ ছিলো। গতরাতের যা ভাত ছিলো তা দুজনের কম হবে, একজনের আবার বেশী। তাই ও না খেয়েই রওনা করে। তাছাড়া চিন্তায় ওর ক্ষুধাও লাগে নি তখন। কিন্তু খেতে বসে, সামনে এত খাবার দেখে ক্ষুধাটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জেগে উঠেছে। রাহাতের উষ্ণ আন্তরিকতায় মীরা কিছুটা স্বাভাবিক হলো। কারন মেয়েরা চোখের চাউনি দেখেই বলে দিতে পারে সেটা কৃত্রিম নাকি খাঁটি। মেয়েদের এ বিশেষ ক্ষমতাটা বিল্ড ইন। এজন্য বয়সের বিচারে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ম্যাচুরিটি আগে আসে।

প্রথম পরোটাটা শেষ করে ও। আরেকটা পরোটা নিতে কেমন লজ্জা লাগে, তাই জুসের গ্লাসে চুমুক দেয়। রাহাত তাকিয়ে দেখে ওর প্লেটের পরোটা শেষ, দ্রুত ও আরেকটা পরোটা তুলে দিলো মীরার প্লেটে। মীরা কপট নিষেধ করলেও তা ধোপে টিকলো না। রাহাত ওর বাটিতে আরো গোশতের টুকরা তুলে দিলো। মীরা বাটিটা সরিয়ে নিলো, তা না হলে রাহাত দিতেই থাকতো। মীরা খুব তৃপ্তি করে খেলো। সত্যি গোশতের কারিটা খুব ভালো রাঁধেন তিনি। মনে মনে ভাবে মীরা। রাজিবটার কথা ভেবে কষ্ট হয় মীরার। ওকে রেখে এত ভালো ভালে খাবার খাচ্ছে ও।

এমন সময় হঠাৎ রাহাত পরোটার টুকরো দিয়ে গোশতো নিতে নিতে বলে-

: ” বুঝলে মীরা, আমরা যারা অনেক পেয়ে যাই, কিছুই না চাইতে, তারা তখন ভাবি যে কোন কিছু পাওয়া খুব সোজা ”
হঠাৎ এমন কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলো না মীরা। কিছু সময় বিরতি নিয়ে রাহাত আবার বললো-
” যে দাওয়াতে আমরা গিয়েছিলাম, সেটা আমার প্রাক্তন প্রেমিকার রিসিপশন ছিলো”

মীরা ব্যাপারটা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলো, লোরা মেয়েটার কথাতে। মনে মনে তা ভাবে মীরা।

: “একটা জিনিস হয়তে খেয়াল করো নি তুমি, ওর আর তোমার মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে, তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তখন আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে তুমি “নোভা”,

একটু থামলো রাহাত, জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিলো ও। মীরা চোখ ফিরিয়ে নিলো ওর থেকে। মনে মনে ভাবলো মিল? কই আমি তো কোন মিল দেখলাম না।

বিরতির পর রাহাত বললো-

” তোমরা যখন এসে উঠলে আমাদের বাসায়, তখন আমি বিচ্ছেদের যে কষ্ট, যন্ত্রণা, তার সাগরে সাঁতার না জানা প্রাণের মতে ডুবছি, আর উঠছি। নোভা আমাকে ত্যাগ করেছে। কারন কি তা আমি তোমাকে বলবো না। তবে ব্যাপারটা আমাকে পোড়াচ্ছিলো। আর এদিকে তুমি আর রাজিব ভালোবাসায় ডুবে থাকা কপোত-কপোতীর মতো আমারি চোখের সামনে ঘুরঘুর করছো। রাজিবকে তুমি খাবার ঘরে নিয়ে খাওয়াচ্ছো, ওর গোসলের সময় কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকছো। এসব দেখে আমার অসহ্য লাগছিলো। আমার বাবার, আমার এত এত সম্পদ, টাকা পয়সা থাকা সত্ত্বেও কেন আমি সুখি হতে পারলাম না। আর রাজিব! রাস্তার এক ছেলে, যার বাবার ঠিক নেই পকেটে কানাকড়ি ও নেই। আমাদের একজন অধস্তন কর্মচারী যার বেতনের সংখ্যা মাত্র চার ডিজিটের। তার কেন এত সুন্দর স্ত্রী, তার জীবণে কেন এত সুখ?

মীরা নিজের স্বামী সম্পর্কে এমন বাজে কথা শুনে কাতর চোখে তাকায় রাহাতের দিকে। রাহাত বুঝতে পারে ওর এভাবে বলা উচিত হয় নি। তাই কথা থামিয়ে ছোট্ট করে বলে-
” সরি, এভাবে বলা ঠিক না হয় তো, কিন্তু তুমি কি জানো ‘রাজিব’ সম্পর্কে? কিচ্ছু না। কি দেখে ভালোবাসলে ওকে? ও সুন্দর রাজপুত্রের মতো তাই? জানো তো সুন্দর স্বামী পাশে দাঁড় করিয়ে শো-অফ করার জন্যই পারফেক্ট, আর কিছুর জন্যই না। যেসব মেয়েরা সুন্দর স্বামী নিয়ে শো-অফ করে, তারা ভিতরে ভিতরে মারাত্মক অসুখি। আমার দেখা বহু মেয়ে রয়েছে যাদের সুদর্শন স্বামী নিয়ে লোক সম্মুখে গৌরবের শেষ নেই, অথচ আড়ালে তারা কোন না কোন কারনে কাঁদে। হয় আর্থিক অস্বচ্ছতা, নয়তে স্বামীর চরিত্রে সমস্যা। এ দুটোর একটা তো থাকবেই। কারো কারো তো একসাথে দুটিও থাকে। হা.. হা… হা…..

আচ্ছা বাদ দেই সেসব কথা, ইউর লাইফ, ইউর চয়েস। পড়াশোনায় আমার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট কি জানো? এস্ট্রোলজি। একাডেমি সার্টিফিকেট না থাকলেও ইন্টারেস্ট থেকে বেশ কিছু পড়াশোনা আছে আমার এ বিষয়ে। এবং আমার সেই ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে – তোমাদের….

মীরা কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বলে-
” একটু পানি….”

রাজিবকে বিয়ে করে যে ও ভুল করেছে তা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে ওর। রাহাতের কাছে নতুন করে আর শুনতে চায় না এ বিষয়ে। তাই পানির কথাটা বলে টপিক চেঞ্জ করলো মীরা।

রাহাত পানি এগিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো- কোথায় যেন ছিলাম? ও আচ্ছা –
তারপর ঐ যে সেদিন! তোমাকে চা বানিয়ে দিতে বললাম, বিচ্ছেদের কষ্ট ভুলতে সেদিন আমি ড্রিংকস্ করে বাড়ি ফিরে ছিলাম। ঐ সময়কার করা অভদ্রতার জন্য আমি দুঃখিত। আমি আসলে তুমি, বা তোমরা কত অসহায় তা নিয়েই খেলতে চেয়েছিলাম তোমাদের সাথে। তারপরও খেলাটা চালিয়ে গেলাম সুস্থ মস্তিষ্কেও। বাড়িতে তোমার সাথে, বাইরে রাজিবের। কি চেয়েছিলাম জানে? টাকা দিয়ে কিনতে তোমাদের।

কিন্তু সেদিন বিকেলের পর আমার ভাবনার জগতের একটা পরিবর্তন হলো লোরার ফোন কলে। ঐ যে যেদিন তুমি তোমার বন্ধু কে নিয়ে এসেছিলে যে আমার সাথে দেখা করতে, সেদিন।

লোরা জানতো, আমি মানসিক ভাবে কতটা ভেঙে পরেছি নোভার চলে যাওয়ায়। তাই ও সবসময় আমাকে সাপোর্ট করতো, মোটিভেট করতো ঘুরে দাঁড়াতে। সেদিন বিকেলের পর হঠাৎ ঘুম ভাঙলো যেন আমার। বুঝতে পারলাম আমি নোভার আমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আমি তোমাকে দিতে চাচ্ছি। তুমি তো আমাকে ভালো বাসোই না, এবং কোন দিনও তা সম্ভব না। টাকা দিয়ে হয়তো তোমার মালিকানা পাবো, কিন্তু এই যে তুমি জিম্মি হচ্ছো আমার কাছে, তাও অন্য একজনকে ভালোবেসে। কত গভীর তোমার ভালোবাসা। ঘর ছেড়েছো, বাবা-মা ছেড়েছো, পড়াশোনার কথা তোমার জন্য ভাবা এখন পাপ, এত ত্যাগ করে যার হাত ধরলে তার পকেট শূন্য। তার উপর এত বড় রোগ ধরা পরলো হানিমুন পিরিয়ড শেষ না হতেই, আর নোভা এত ভালোবাসি ওকে, টাকা-পয়সার ও অভাব নেই আমার তবুও আমার হাতটা ছেড়ে দিলো মেয়েটা। নাক দিয়ে একটা শব্দ বের করলো ও। যাতে দুঃখ, যন্ত্রণা, হতাশা মিশে আছে। যদিও দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করতে চাইলো রাহাত কিন্তু পারলো না। শেষে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠে পরলো টেবিল থেকে। মীরা নিরব শ্রোতা, কিছুই বলার নেই যেন ওর। রাহাত হাত ধুয়ে আসতেই মীরা গেলো হাত ধুতে। রাহাত জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে বসলো দোতলার ড্রাইং রুমে। মীরাকে ইশারা করলো ওর সামনে বসতে।

মীরার ভয় কেটেছে এতক্ষণে। যা বলার তা তো বলেই দিয়েছে ও, ঐ খামে দুই লাখ আছে বাকীটা পরে দিবে ও জোগাড় করে। টাওয়ালে হাত মুছে রাহাতের বিপরীতে থাকা সোফায় বসলো মীরা।

রাহাত মীরার চোখে তাকিয়ে বললো-
” কেন এমন হলো আমার সাথে বলো তো মীরা?
মীরা কি বলবে বুঝতে পারলো না। এমন পরিস্থিতিতে কিই বা বলার আছে? তারচে চুপ থাকাই শ্রেয়। মীরা সে পথটাই বেছে নিলো…

চলবে….

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ১২

: ” কিরে ব্যাটা আছস কেমন? ”
: ” আলহামদুলিল্লাহ আপনাগো দোয়ায় ভালোই আছি চাচা ”
: ” তুই তো ব্যাটা চমতকারি দেখায়া দিলি, মার্কেটে আয়া সারা পারলি না, ধাপা ধাপ উইঠা গেলি। ক তো তোর কাহিনি কি?
বিনিত ভঙ্গিতে হেসে রাজিব বলে-
: ” কি যে বলেন , কই আপনি আর কই আমি? কিসের সাথে কিসের তুলনা। ”
: ” কথা প্যাচাইছ না, আজকে বাইছ বছর ধইরা এই ব্যাবছা করি আমি মুখলেছ ,পায়ের নিচের মাটি ছক্ত করতে বহুত টাইম লাগছে আমার। আর তুই!
: ” সবই আল্লাহর দয়া ”

মার্কেটের রাঘব-বোয়াল মুখলেস রাজিবকে এ কথা বলতে ডেকেছে তা ক্ষুণাক্ষরেও আশা করে নি রাজিব। একই মার্কেটে মুখোমুখি কারখানা ওদের। দুজনের কারখানাই রেডিমেড পেশাক তৈরীর।

রাজিবের প্রথমে শুরু ছিলো স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের দেয়া কাপড় সেলাই করে। নিজ বাড়িতেই মাত্র তিনটি মেশিন দিয়ে শুরু করেছিলো ওরা। এত কিছু রেখে এ কাজ শুরু করার কারন হচ্ছে রাজিবের একমাত্র এই কাজের আদি অন্ত সম্পর্কে জানাশোনা আছে।
তখন পাশের কারখানার ভিয়া হয়ে কাজ পেতো ওরা। অতিরিক্ত লোড হওয়ায় প্রথমে কাজ গুলো রাজিবকে দিয়ে করিয়ে নিতো তারা। পরে অবশ্য নিয়মিতই কাজ দিয়েছিলো রাজিবকে। কারন স্বনামধন্য ঐ প্রতিষ্ঠানের কাজ সরাসরি পেতে লাখ খানিক টাকা জামানত দিতে হয়। সে টাকা আর পরিচিতি ছিলো না ওদের সেই সময়ে । তাই বাধ্য হয়েই ভিয়া হয়েই কাজ শুরু করে ওরা। তবে রাজিব জানতো প্রাপ্য টাকার চেয়ে অনেক কম পাচ্ছে ওরা। তবুও নিরূপায় ওরা মুখ বুজে পরিশ্রম করে গিয়েছে দিনরাত। ওরা দুজনেই বুঝেছিলো ভাগ্য পরিবর্তনের একমাত্র উপায় যদি কিছু থাকে তা হচ্ছে পরিশ্রম, তার সাথে মীরার ক্ষুরধার বুদ্ধি রাজিবকে এগিয়ে নিয়েছিলো কঠিন পরিস্থিতি উৎরে অনেক দূরে।

মীরা প্রথমে কোন কাজ পারতো না। সুতা কাটতো, আয়রন আর প্যাকেজিং এর কাজগুলো করতো। চারজন কর্মচারী ছিলো তখন। তাদেরকে তিনবেলা রেঁধে খাওয়াতো। সকালে উঠে নিজ হাতে বাজার করা, কাটা-বাছা রান্না সবই একা হাতে করতো মীরা। ওদের কর্মচারী চারজন রাতে ঘুমাতে করখানায় বিছানা পেতে। খাওয়া, থাকা যেহেতু ওরাই দেখতো তাই কম বেতনে ছেলে গুলোকে দিয়ে কাজ করাতে পারতো ওরা। এটা একটা এডভান্টেজ ছিলো ওদের নতুন ব্যবসা দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে।

মীরা কারখানার দেখাশোনা করতো আর রাজিব বাইরের সব কাজ মালপত্র আনা, পৌঁছে দেয়া৷ পরে অবশ্য মীরা দেখে দেখে অনেক কাজ শিখে। প্রায় তিন বছর ওরা নিজ বাড়িতেই কাজ চালিয়ে গেছে ভিয়া হয়ে। সেই অভিজ্ঞতায় ভ্যারাইটি কাপড়, ডিজাইন আর সময় ভিত্তিক মার্কেটে চাহিদার ব্যাপারটায় ওরা বেশ দক্ষ হয়ে ওঠে।

একদিন হঠাৎ রাতের খাবারের সময় মীরা বলে আমরা ইসলামপুর থেকে নিজেরা কাপড় কিনে কেন শুরু করছি না?
রাজিব চমকে উঠে ওর কথা শুনে। কারন কিছুদিন ধরে ও নিজেও মনে মনে এরকমই কিছু ভাবছিলো।
রাজিব মুচকি হেসে বলে-
: ” জানো এ কথাটাই ঘুরছিলো মাথায়, শব্দ হয়ে বের হয় নি শুধু, তোমার কি মনে হয় মীরা আমরা পারবো? ”
: ” অবশ্যই পারবো”
: ” তাহলে ওদের কাজটা বন্ধ করে দিই কি বলো?”
: ” আরে না, না, কোন তাড়াহুড়ো না। আপাতত আমরা অল্প পরিসরে শুরু করবো। তুমি মার্কেট খুঁজো আগে। যাদেরকে আমরা আমাদের তৈরী কাপড় গুলো বিক্রি করবো ”

রাজিব যেন অন্ধকারে দিশা পেলো। আর্থিক অপ্রতুলতার দরুন এসব ভাবনা প্রকাশের সাহস ও পাচ্ছিলো না এতদিন। তবে মীরা যখন নিজ থেকে বললো তাহলে অবশ্যই পারবে ওরা।

যে কথা সেই কাজ, রাজিব আরো দুটো মেশিন কিনে আলাদা করে ওদের কাজ অল্প পরিসরে শুরু করে।
মীরা মার্কেট ঘুরে ঘুরে কাপড়ের অনুসঙ্গ জিনিসপত্র কিনে। বিয়ের আগে ও কখনোই রেডিমেড জামা পরতো না। নিজে মার্কেট ঘুরে ঘুরে কাপড়, লেইস, পাইপিন, টারসেল কিনে ডিজাইনার ড্রেস তৈরি করতো। আত্নীয় মহলে সবাই ওকে বলতো ফ্যশন ডিজাইনার। সেই জ্ঞান ও প্রয়োগ করলো নতুন কাজে। তৈরী করা শুরু করলো পার্টি ড্রেস।

প্রথম প্রথম অন্যের তৈরী করা ট্যাগ যা রেডিমেড কিনতে পাওয়া যেত তাই জুড়ে দিতো কাপড়ে। মীরা বলেছিলো আমাদের কাপড়ের কোয়ালিটি, ডিজাইন তো অন্যদের চেয়ে আলাদা আর সুন্দর। আমরা কেন নিজের নামে ট্যাগ তৈরি করছি না। মীরার বুদ্ধিতে একটা ট্যাগ তৈরী করে ওরা। পরে ওরা তৈরি করে ওদের নিজের স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র ব্র্যান্ড। মীরা বলেছিলো-
” আপাততঃ আমরা মার্কেট ধরবো, লাভ করবো অতি সামান্য। আমাদের টার্গেট বেশী লাভ করা না হবে বেশী বিক্রি। তাহলে কম লাভ করলেও বিক্রি বেশী হওয়ায় তাতে পুষিয়ে যাবে” সে অনুযায়ী কাজ শুরু হলো। রাজিব স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ভালেবাসা স্বরূপ তার ক্ষুদ্র সেই ব্র্যান্ডের নাম দিয়েছিলো “মীরা”।

তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বাড়ে। একটু গুছিয়ে উঠলো যখন বুদ্ধি করে দুজনে পাসপোর্ট তৈরি করে ইন্ডিয়ায় গেলো। ওখানকার কাপড়ের ডিজাইন, কোয়ালিটি, দেখতে। বেশ কিছু ড্রেস কিনে আনে ওরা এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য। সে সব ড্রেস থেকে ডিজাইন হুবুহু কপি করে না ওরা। সেটাকে আরো মডিফাই করে নতুন কিছু তৈরী করে মীরা।
” Steal Like An Artist ” এর মতো। যদিও এই বইয়ের লেখক এ বইটা তখন অবধি লিখে নি।
প্রথম এক্সপেরিমেন্ট পিছ টা নিজের জন্য রাখতো মীরা। ততদিনে অনেকের দেখাদেখি ওরাও ওদের বিজনেস টাকে অনলাইনে মুভঅন করলো। ধীরে ধীরে নিজে ফটোসেশান করতে শুরু করে নিজের ব্র্যান্ড আর অনলাইন পেইজের জন্য। অপরূপ সুন্দরী মীরা হয়ে গেলো ওর নিজেরই ব্র্যান্ডের মডেল।

ওদের কারখনা ঢাকা থেকে একটু ভিতরে ছিলো।
পরিবহন সমস্যা হওয়ায় বাড়ি থেকে মার্কেটে শিফট করে ওর কারখানা। কারন মীরার অনেক পরিশ্রম হয়ে যায় বাড়িতে কারখানা থাকায়। তবুও মীরা বললো কারখানার কাছাকাছি বাসা নিতে, যাতে মীরা দিনে অন্তত একবার কারখানায় গিয়ে তদারকি করতে পারে। রাজিব তাই করলো। বাসা নিলো কারখনার কাছাকাছি। লোকাল মার্কেট গুলোতে ততদিনে ওদের কারখানায় তৈরি লেডিস শার্ট, টপস, কুর্তি আর পার্টি ড্রেসের চাহিদা বাড়ছে দিনে দিনে। অনলাইনে ও অর্ডার আসে টুকটাক। যদিও মানুষ ততদিনে অভ্যস্থ হয়ে উঠে নি অনলাইন কেনাকাটায়।
তবুও ভাল একটা অবস্থানে পৌঁছে যায় ওরা। এই হচ্ছে “মীরা” ক্লথিং ব্র্যান্ড এর পিছনের গল্প।

একই ফ্লোরের অপর পাশের মুখলেসের নিজস্ব ব্র্যান্ড রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তার ব্যাবসায়িক ব্যাপ্তি বিশাল। বড় বড় মার্কেটে তার বাঁধা কাস্টোমার কয়েকশত। তার মাল যায় বিভাগীয় শহরগুলোতেও। সে হিসেবে রাজিব বিগেনিং স্টেজে। ও আপাততঃ ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে ওদের কাপড় গুলোর সাপ্লাই দিচ্ছে। অনলাইনে বিক্রি খুবই কম। তিনি ওকে কেন এসব কথা বলছে তা বুঝতে পারছে না রাজিব।

মুখলেস বিকট হাসি হেসে বললেন –
: ” আমি সোজা মানুষ আমার সেজা কথা। তুই এখানে কারখানা রাখা পারবি না, আগামী মাছে কারখানা খালি কইরা দিবি। তুই যা ছুরু করছস ভবিছ্যতে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হইবার পারছ। সেই সুযোগ আমি তরে দিবার চাই না। তরে ভালোবাসি তাই ছুন্দর মতো কইয়া দিলাম”

কথাটা শেষ করে একটা অট্টহাসি হাসলো মুখলেস।
পান মুখে অট্টাহাসি হাসায় কিছুটা বিকট দেখালো তাকে। হান্টেড মুভির রাক্ষসের মতো লাগলো। যেন এ মাত্রই র*ক্ত খেয়ে এসেছেন তিনি।

রাজিব এ পরিস্থিতিতে কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। রিজিক আল্লাহ নির্ধারিত, আরেক জন একই ব্যাবসা করলে তাকে শেষ করে দিতে হবে। এটা যে কত ছোট মানসিকতা তা মুখলেস নিজেও জানে না হয় তে। ও বললো- হুট করে কোথায় যাবে আমি, এত মালপত্র নিয়ে। আমি মীরার সাথে আলাপ করে দেখি।

ধীর চোখে চেয়ে তিনি বললেন-
: ” তুই কি বৌয়ের কথা ছাড়া চলস নারে রাজিব ?
বলেই আবারে হাসেন সে। তার সাথে যোগ দেয় তার পাশে বসা মানুষ গুলে। একটু বিরতি নিয়ে বলেন-
: ” যাক গা, দেখ আলাপ করে। আলাপ যা মন চায় কর, কিন্তু এখান থেইক্যা তোরে চইলা যাইতে হইবো এটা হলে ছেস কথা। ”

রাজিব কুর্তি, টপসের পাশাপাশি পার্টি ড্রেসের কাজ শুরু করেছে বছর খানিক হলো। জমানে সব টাকা ইনভেস্ট করেছে নতুন প্রোজেক্টের মালপত্র কেনায়। সমানে ইদ, পূজা এরি মধ্যে তার খারাপ নজরে পরে গেলো। এত এত কাপড়, মালপত্র কিনে রাখা। এগুলো নিয়ে জায়গা বদল করা খুবই কঠিন কাজ। তাছাড়া কারখানা মার্কেটে থাকার উপকার হচ্ছে নিত্য নতুন কাস্টোমার পাওয়া যায়। এখান থেকে হুট করে কোথায় যাবে ওরা? ভাবতে ভাবতে বাড়ি পৌঁছায় রাজিব।

মীরা একটু আগে ফিরেছে বাইরে থেকে। একটা অনলাইন ডেলিভারি ছিলো। যদিও কারখানার পলাশ যায় ডেলিভারি দিতে। আজ ওর শরীর খারাপ হওয়ায় আর মেয়ে কাস্টমার হওয়ায় নিজেই গলো ও। তবুও দুজনের জন্য শরবত করে এনে জিজ্ঞেস করলো রাজিবের মন খারাপের কারন।

শরবত হাতে নিয়ে রাজিব সব খুলে বললো ওকে। মীরা জানে এ মুহূর্তে জায়গা বদল ওদের ব্যাবসার জন্য ক্ষতিকর। এখন সময় অতিরিক্ত কাজ করে মালপত্র স্টক করে রাখার। আর এ সময়ই এমন ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পরেছে ওরা। তাছাড়া সময় চেয়ে নিবে তারও উপায় নেই। কারন মুখলেস মার্কেট সমিতির সভাপতি। তার উপর কথা বলার কেও নেই। গত ছ’বছর ওরা ব্যাবসা করছে। এমন পরিস্থিতিতে পরে নি এর আগে কখনো। মীরা বললো তুমি চিন্তা করো না। আমি একটু ভেবে দেখি। আল্লাহ সহায় হলে উপায় একটা ঠিক বের হয়ে যাবে।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু : Mahabuba Metu
পর্ব: ১৩

মীরাদের এখনকার বাসাটা বারো তলা। ওরা থাকে লিফটের নয় তলায়। বারান্দাটা দক্ষিণমুখী আর সামনে তিনতলা মসজিদ হওয়ায় আলো বাতাস পাওয়া যায় প্রচুর। কাপড় শুকাতে দিলে ঘন্টার কাটা না ঘুরতেই তা শুকিয়ে মচমচে হয়ে যায়।

বেখেয়ালি মীরা এতদিন কাপড় শুকাতে দিয়ে সারাদিনেও খবর নিতো না, পরদিন আবার যখন কাপড় শুকাতে দিতে আসতো তখন সেগুলো তুলে নিত। কত কত নতুন জামার রং যে জ্বলে গেছে অল্প দিনে তা খেয়ালই করে নি ও।

যদিও এখন হ্যাল্পিং হ্যান্ড রয়েছে কাপড় ধোঁয়া আর ঘরের কাজ করার জন্য। তাছাড়া কারখানার ম্যানেজার টুম্পাও মীরা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ছোট ছোট কাজগুলো ও নিজের থেকেই করে দেয়। গাছে পানি দেয়া, কাপড় বারান্দায় থেকে এনে ভাঁজ করে জায়গা মতো রেখে দেয়া, বুয়ার অনুপস্থিতিতে রান্না ঘরের অলিখিত দায়িত্ব ওর। মীরা যে ওকে ভরসা করে ভুল করে নি তার প্রমাণ টুম্পা দিয়েছে বেশ কয়েকবার। ওদের বন্ডিংটা এত সুন্দর যে বাইরে থেকে কেও দেখলে ঠিক বলবে এটা মীরার বোন। টুম্পাকে একেবারে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে মীরা।

টুম্পাকে এনে দিয়েছিলো মীরার চাচাতো বোন পিয়াসা। মীরার এ চাচাতো বোনের সাথে ওর দেখা হয়েছিলো ইন্ডিয়ায়। ট্রেনে করে কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে। দীর্ঘ এই ট্রেন যাত্রাপথে দু’বোনের মধ্যে অনেক দিন পর বেশ কথা হয়। খোঁজ নেয় দু’জন দু’জনের। সেখানে গিয়েও ওরা একসাথেই ঘুরেছিলো। বিদেশ বিভুঁইয়ে নিজের লোক পেয়ে ভালো হয়েছিলো দুই পরিবারেরই। এরপর দেশে ফিরে নিয়মিত কথা হয় দুজনের। সেই পিয়াসা মীরাকে বলেছিলো টুম্পাকে একটা কাজ জোগাড় করে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পেয়েও মেয়েটা রাজনীতির বেড়া কলে পরে বিশ্রী ভাবে চলে এসেছে সেখান থেকে ।

পিয়াসাই টুম্পার একমাত্র পরিচিত এত্ত বড় শহরে। ওদেরও পরিচয় ট্রেন ভ্রমণের সময়। শ্বশুরবাড়ি গাইবান্ধা থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরছিলো পিয়াসারা। পাশের সিটে গাইবান্ধা থেকে একাই ঢাকা যাচ্ছিলো টুম্পা। প্রথমে পিয়াসা দীনভাবাপন্ন এই মেয়েটাকে এড়িয়ে চললেও পিয়াসার ছোট ছেলেটা একটুর জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো এই টুম্পার জন্য। পিয়াসা অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ টুম্পাকে বলেছিলো ঢাকায় ওর যদি কোন প্রয়োজন হয়, অবশ্যই যেন পিয়াসাকে নক দেয়।

সরল এই মেয়েটার জটিল এই শহরে এসেই যে পিয়াসাকে প্রয়োজন হবে তা হয়তো ভাবতে অবকাশ পেয়ে উঠে নি দুজনের কেওই । মাস দুয়েকের মধ্যেই সিনিয়রদের বুলিং এ
লাঞ্চিত হয়ে টুম্পা এক সকালে এসেছিলো পিয়াসার কাছে।

কতটুকু অসহায় হলে এমন অল্প পরিচিতের কাছে সাহায্য চাইতে আসে মানুষ। তবুও পিয়াসা আন্তরিক ভাবে দেখেছে ব্যাপারটা।

কিছুদিন পিয়াসার বাড়িতে টুম্পাকে রাখার পর ওর শ্বাশুড়ি পিয়াসাকে বলে “এমন শিক্ষিত মেয়েকে তো আর ঘরের কাজের জন্য রাখা যায় না। কোন কাজের হুকুম করতে চোখে ঠেকে, তুমি ওর অন্য ব্যাবস্থা করো মা”

পিয়াসা বুঝতে পারে শ্বাশুড়ির ওকে এ বাড়িতে রাখতে অনিহার কারন। পিয়াসার উঠতি বয়সের এক লাফাঙ্গা দেবর থাকায় ওর শ্বাশুড়ি টুম্পাকে রাখাতে অসম্মতি জানাচ্ছে তা না বললেও বুঝে পিয়াসা। নিরূপায় পিয়াসা তখন নক করে মীরাকে। ওর গার্মেন্টস ব্যাবসাটা ভালোই চলছে। অনেকগুলো ওয়ার্কার রয়েছে ওর কারখানায়। ও টুম্পাকে ঠিক একটা ব্যাবস্থা করে দিতে পারবে।

মীরার তখন একজন ওয়ার্কার দরকার ছিলো এটা সত্যি। কিন্তু মীরার শিক্ষিত কাওকে লাগবে না, ওর ওখানকার কাজ জানে এমন অভিজ্ঞ কাওকে দরকার।

পিয়াসা সব খুলে বলে, খুব করে অনুরোধ করে, যে কোন কাজের জন্য হলেও ওকে যেন মাথা গোঁজার একটা জায়গা ঠিক করে দেয়৷

রোগা, শুকানো হাড় জিরজিরে এক মেয়ে টুম্পা । কাপড় চোপড় আর শরীরে অভাবের ছাঁপ স্পষ্ট। অভাব অনটনে তরুণ বয়সের দ্যুতি তার রং ছড়াতে পারে নি, চাপা পরে আছে ঐ দুষ্ট গ্রহের তলে। মীরার মায়া হয় টুম্পা মেয়েরার জন্য। বিশ্বাস করতে কেন জানি দ্বিধা হয় না ওর। রেখে দেয় নিজের কাছে। কিছুদিন পর ওকে ভালোবাসে তুলে দেয় কারখানার ম্যানেজারের দায়িত্ব। বেতন ঠিক করে খাওয়া থাকার সব খরচ বাদে পাঁচ হাজার টাকা। টুম্পা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। থাকার জায়গাটাই ওর ভীষণ দরকার ছিলো। টাকাগুলো যেন ওর উপরি পাওনা।
মনে মনে ভাবে মীরার দয়ার এ ঋণ ঠিক শোধ করবে একদিন।

নতুন কাজ, নতুন পরিবেশে টুম্পা নিজেকে মানিয়ে নেয় খুব দ্রুত। এরিমধ্যে একদিন কারখানায় ছুটি হলে হঠাৎ টুম্পা এসে মীরার হাত ধরে বলেছিলো-
: ” এত ক্যান ভালোবাসেন আমারে আপা?
আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস তো ভুলও হতে পারে, ঠকও তো হতে পারি ”
উত্তরে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে টুম্পার ধরা হাতে, ওর হাত, চোখে চোখ রেখে মীরা বলেছিলো-

: ” ভালোবাসাটা আমার জীবণের জন্য কালরে টুম্পা। জীবণের সবচেয়ে বড় জায়গায় ভুল করে বসে আছি আমি, করা সেই ভুলটাকে ভুল জেনেও দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজের এই চিন্তাটাকে ভুল প্রমাণ করতে। যদিও দিনশেষে পারবো কি না তা জানি না। তাই বলে মানুষকে বিশ্বাস করতে ভুলিনি আমি। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, জানিস তো?
অপলক দৃষ্টিতে ক্ষণকাল চুপ থেকে মীরার থেকে দৃষ্টি
মুষ্টিবদ্ধ সেই হাতে নিয়ে টুম্পা বলেছিলো-

: “আপা আপনার বিশ্বাসের কোনদিন অমর্যাদা করবো না, আপনি আমার জন্য আশীর্বাদ ”

মনে মনে মীরা বলেছিলো-
: ” তুই ও ”

মীরার ঢাকায় আসার আগে টুম্পা কারখানার মেয়েদের সাথে ঘুমাতো। টুম্পার কাজের প্রতি একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর সততা দেখে মীরা ওকে ঢাকায় বাসা নিয়েই রেখে দিয়েছে নিজের বাড়িতে। তাছাড়া মীরার ঘরে নতুন এক জনের আগমনের দিন ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় আত্নীয়রা সবাই
কাছাকাছি থাকে, যত্ন নেয় হবু মায়ের। কপাল পোড়া মীরার তো সে ভাগ্য নেই। এরমাত্র পিয়াসা আসে মাঝেমধ্যে। তার উপর কত দিকে কত কাজের দেখভাল করা লাগে মীরার এ শরীর নিয়েও। রাজিবটা যে বড্ড বেখেয়ালি।

এ সময় এক জন কাওকে দরকার হয় পাশে । আগের বারের মি*সক্যা*রেজ ভীতির সঞ্চার করেছে মীরার মনে। টুম্পা তাই আগের চেয়ে বেশী খেয়াল রাখে মীরার। টুম্পা আগের বার থেকেই পড়াশোনা, কারখানার কাজকর্ম করেও বাড়ির কাজে হাত লাগাতো । যত্ন করতো মীরার। শরীরে, পায়ে, পেটে তেল মালিশ, করে দিতো নানি দাদীদের মতো করে। কাজ থেকে ফিরলে শরবত এনে দিতো সাথে সাথে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। বরংচ এবার ওর তদারকি বেড়েছে আগের বারের চেয়ে। মেয়েটা ওকে নিয়ে এমন ব্যাস্ত হয়ে পরে যে মীরার মাঝে মাঝে ভয় হয় ওকে নিয়ে। তবুও সে ভয় অমূলক প্রমাণিত হয় বারংবার। দিনশেষে টুম্পার মতো একজনকে পেয়ে মীরা খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়।

মীরা দিনের একমাত্র চা টা নিয়ে ওর রুমের সাথের লাগেয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে। প্রেগ্ন্যাসির এ সময়টাতে চা খাওয়াটা বিশেষ তদারকি করে টুম্পা। ডাক্তার বলেছে না খেতে। অতি জরুরি হলে দিনে এক কাপ, তার বেশী না। এ মেয়েটার হাতের চা ছাড়া অন্য কোথাওকার চা মুখে রুচে না ওর, তাছড়া ওর তৈরী করা চা না খেলে মীরার ক্লান্তি নড়ে না শরীর থেকে। তাই লুকিয়ে-চুরিয়ে খায় না ও। দিন শেষে এই এক কাপই ভরসা।

চায়ে চুমুক দিয়ে চির পরিচিত এই চারপাশে চোখ বুলায় মীরা। এত আগ্রহ আর যত্ন নিয়ে দেখে যেন এবারই প্রথম দেখলো ও এ দিকটাকে। যদিও দৃষ্টিনন্দন কিছুই নেই দেখবার মতো। তবুও যা আছে তাকেই নিজের মতো করে নিয়েছে ও।
আশেপাশে সার দেয়া বিল্ডিং। একেকটা বিল্ডিং আরেকটার উচ্চতার সীমানাকে ভাঙতে ব্যাস্ত যেন।

চায়ের ক্যাফেইন অনান্য দিন ফাঁকা করে দেয় ওর মাথাটাকে। এই চা খেয়েই ঐ দিনকার মতো সব কাজের সমাপ্তি হয় যেন অঘোষিত ভাবে, এর পরই ঘুমুতে যায় মীরা। চা খেলে ঘুমের সমস্যা হয় অধিকাংশের। তবে এই চা পান ওর ঘুমের কোন ব্যাঘাত ঘটায় না। বরং ক্লান্তি দূর করে প্রশান্তি এনে দেয়।

চা প্রায় শেষ, তবুও মাথাটা ফাঁকা হচ্ছে না। চারদিক থেকে দুঃশ্চিন্তা জেঁকে আসছে যেন। শেষ চুমুক দিয়েও মাথাটা খালি হলো না। চা শেষ করে কোন কিছুই ভাবতে পারছে না মীরা। বারবার মীরার মনে পরছে বিকেলের রাজিবের বলা ঐ কথাগুলো। যদিও রাজিবকে ও যা বলেছিলো তা নিছক ওকে স্বান্তনা দিতে। ওর হার্টের কন্ডিশন ভালো না। অতিরিক্ত স্ট্রেস ওর জন্য ঝুঁকি। তাই মীরা ঢাল হয়ে আগলে রাখে রাজিবকে। যার উল্টো আগলে রাখার কথা ছিলো মীরাকে।

মীরা এ জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে আজকের এ জায়গায় পৌঁছেছে। দিনের পর দিন যে-সব কঠিন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সে সময় গুলোতে মীরা অধৈর্যের মতো খোদাকে দুষেছে। কিন্তু এখন মীরা পিছন ফিরে তাকালে সাহস আর শক্তি পায়। ও মনে মনে বিশ্বাস করে ওর জীবণে যা খারাপ তা শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু ভালো কিছু হওয়া পালা। খোদা ওর বিশ্বাসকে সত্যি করে দিয়েছে। একটা সময় জীবণ যখন অতল সমুদ্রে ভাসিয়েছে ওকে, ভেসে থাকতে যাই ধরেছে তাই যেনো ক্রুর হাসি হেসে পালিয়েছে সাহায্য না করে। খোদাকে ভরসা করা মীরার সময় বদলেছে এখন। যদিও এই সবকিছুর একমাত্র কৃতিত্ব মীরা নামের ছোট্ট সে মেয়েটার। তবুও কখনোই তা ওর আচরণে প্রকাশ করে না ও। অনুগত স্ত্রীর মতো স্বামীর মতামতকে প্রাধান্য দেয়৷ রাজিবও তাই, ছোট থেকে ছোট সিদ্ধান্তও মীরাকে না জিজ্ঞেস করে নেয় না ও৷ এমনকি ওদের এ্যানেভার্সারির কেকটার বেলায় পর্যন্ত। বাসায় ফিরবার সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করবে-
: ” মীরা কেকের উপর কি লেখা থাকবে?”
মীরা খানিকটা বিরক্ত হয়, এমন হাঁদারাম কেন ছেলেটা। এটুকু কাজও কি ও নিজ থেকে ভেবে করতে পারে না?

মাঝে মাঝে আবার হাসিও পায়। কিন্তু দু’জনে যখন ঝগড়া হয়, মীরা তখন রাজিবকে বলে-
” তুমি একটা বদের হাড্ডি, সব চিন্তা আমার মাথায় দিয়ে রাখো কোন কিছু না বোঝার বাহানায়, আর নিজে সব সম চিল মুডে থাকো”

উত্তরে রাজিব কি বলে তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। রাজিবের সব দায়িত্ব ওর কাঁধে চাপানোর ব্যাপারটা মীরা প্রথম প্রথম উপভোগ করতো। নিজেকে বিশেষ ভাবতো, স্বামীর এই কাজটাকে ভালোবাসা মনে হতো। কিন্তু যখন ব্যাবসার পরিধি বাড়তে থাকে তখন এটা বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে করে শেষ৷ রাজিবের যেন কোন হেলদোল নেই। সে ব্যাস্ত নতুন কোন মডেলের বাইক এসেছে, নতুন ফিচারের ফোন, বয়াবসায়ীদের সাথে প্রমোদভ্রমণে। অথচ মীরা এখনো একটা স্মার্টফোন কিনে নি। রাজিবের এতবার ফোন বদলালো কিন্তু কিনবার সময় ওর কি একটা বারও মনে হয় না মীরার জন্য নিই একটা। এসব ভেবে কষ্ট পায় মাঝে মাঝে। যদিও এসব বিলাসিতা ভেবে এড়িয়ে যায় মীরা ।

পৃথিবীর যত যা সৃষ্টি রয়েছে তা সবার আগে প্রসেস হয় মানুষের মস্তিষ্কে। পরবর্তীতে তা বাস্তবে রূপ পায়। মীরা মানসিক এ পরিশ্রম করতে করতে ক্লান্ত। সব কাজ ওয়ার্কাররা করে দিয়ে যায়। কিন্তু চিন্তার ভারটা তো কেও নেয় না। ওরা তো পর, নিজের মানুষটাই তো স্বার্থপর। তার সাথে যোগাযোগ ঐ বেডরুমের বিছানায়। মাঝে মাঝে এসব ভেবে মীরার মনে হয় সত্যি কি ও ভুল করলো ওকে জীবণসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়ে।

হঠাৎ সবার করা ভবিষৎ বাণী ভেসে উঠে চোখের সামনে। মস্তিষ্ক তখন ব্যাস্ত হয়ে যায় নিজের ভুলকে ভুল জানার পরও সবার চোখে ঠিক প্রতিষ্ঠিত করার কদর্য খেলায়। খেলাটা যে কতটা কদর্য তার পরিমাপ জানে মীরা। তবুও এমন ভাবে বুঝায় নিজেকে যেন সে সম্পর্কে ও অজানা।

মনে মনে খুব বিরক্ত হয় মীরা রাজিবের ওপর। ও কেন মুখলেছ চাচাকে বলেছে -যে মীরাকে জিজ্ঞেস করে নিই। ওর মাথায় কি কোন বুদ্ধি নাই। ও তখন যদি তাকে বলতে পারতো যে – ” এটা বললেই তো হয় না, সময় লাগবে, সময় দেন আমাদের ” তাহলে ব্যাপারটায় কোন আশা থাকতো। কিন্তু ওর ঐ বলা কথায় প্রকাশ হয় তার অন্যায় আদেশে নিরবে মৌনতা প্রদর্শন। এ ছোট্ট ব্যাপারটা কি বুঝে না রাজিব। ঘুরে বারান্দার চেয়ার টেনে বসে মীরা। পায় ঝিঁঝি ধরে গেছে। চেয়ারে বসে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে মীরা ভাবে তবুও কাল ও মার্কেটে যাবে মুখলেছ চাচার সাথে কথা বলতে। এ ছাড়া অন্য উপায় নেই আর। হঠাৎ চোখ গেলো বিছানায়। কেমন বিশ্রীভাবে শুয়ে আছে রাজিব। হাতপা ছুঁড়ে, যেন কোন মা’তাল নেশায় আছন্ন হয়ে শুয়ে আছে। অন্ধকার ঘর তবুও বারান্দার আলোয় দৃশ্যটা চোখে পরলো মীরার।

ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা। আজ সন্ধ্যায় একটা হলুদের প্রোগ্রামের জন্য দেড়শো ড্রেসের অর্ডার আনতেই এ শরীর নিয়েই গুলশান গিয়েছিলো মীরা। জ্যামের কারনে বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছিল মীরার। রাজিব তাই অসুস্থ স্ত্রীর বাড়ি ফিরবার অপেক্ষায় না থেকে মনোযোগ দিয়েছে নিজের ঘুমে। রাজিবের এই শ্রী হীন ঘুমটাই যেন প্রমাণ করে মীরার সুখে থাকার সঙ্গা।
ডানপক্ষ = বামপক্ষ (প্রমাণিত)

এসব চিন্তাকে ডালপালায় বাড়তে না দিয়ে মীরা দ্রুত ওঠে বিছানায় যায়। মুখে বালিশ চেপে কাঁদে, দুনিয়ার কেও জানে না মীরার এই অ’সুখের কথা। কাওকে কোন দিনও এটাকে জানতে দিবে না মীরা। শুধু নিরব সাক্ষী মীরার এই বলিশটা…

চলবে…

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ১৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

আজ সকালে অনেকদিন পর খাবার টেবিলে দেখা হয় রাজিবের সাথে মীরার, কারন গত রাতে অনেক দেরিতে ঘুম আসায় মীরার আজ ঘুম থেকে উঠেছে বেলা করে।

রাজিব চুপচাপ এমন ভঙ্গিতে নাশতা খাচ্ছে, যেন ও ছাড়া কেও নেই এখানে, কিংবা মীরা ওর অপরিচিত কেও। মীরা বসে আছে টেবিলের অপরপ্রান্তে। অবাক চোখে দেখছে রাজিবকে। অপরপ্রান্তে বসা লোকটা আর যেই হোক মীরার সেই রাজিব না যে মীরাকে না পাওয়ার আশঙ্কায় নিজের জীবণ রাখাকে অর্থহীন ভেবে আ’ত্নাহুতি দিয়েছিলো। ইশ্বর ঐ দিন রাজিবকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, বাবা-মা’র অবাধ্য মীরাকে শাস্তি দিতে।

মীরা পরোটা রোল করে চায়ের মধ্যে ডুবাতে ডুবাতে
ভাবে রাজিব মীরার জীবনে শুধুমাত্র একটা শো-পিসের মতো। যার থাকাটা শোভা বাড়ায়, না থাকাটাও কোন সমস্যার না।

মীরা ভেবেছিলো রাজিবের এ গা বাঁচানো স্বভাব, দায়িত্বহীনতা, সংসারের প্রতি অবহেলা একটা বাচ্চা নিলে ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু মীরার গত মিসক্যারেজের সময় যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলো মীরা, স্বামী নামের এ লোকটা কোন কিছুতেই পাশে ছিলো না। না ফিন্যান্সিয়ালি, না ফিজক্যালি। তিনি তখন তার ব্যাবসায়ী পার্টনারদেরকে নিয়ে দুবাই গিয়েছিলেন প্রথমবারের মতো। খবরটা শুনেও তিনি আসতে পারেন নি কারন পুরো ট্রাভেলিং প্রোগ্রামে তার অনেক দায়িত্ব। এ অবস্থায় তিনি কিভাবে এসব ফেলে চলে আসবেন। মীরা কষ্ট পায় নি ওর আচরণে। বরঞ্চ মনে হয়েছে ও এলেই ঝামেলা বাড়বে আরো। ওকে দেখলে রাগ বেড়ে যেতো মীরার। তখন মনে মনে ভেবেছে এবার ফিরলে আর বাড়িতে ঢুকতে দিবে না ওকে। পরোক্ষণে কি ভেবে যেন শান্ত হয়ে যায় মীরা। এ ছেলে জাদু জানে। অনেক কিছু বলবে ভেবে রাখলেও কিছুই বলতে পারে না ত রাজিব সামনে এলে। তার উপর জীবণে আফসোস রাখতে চায় না মীরা। তাই সুযোগের পর সুযোগ দিয়ে যায় ও।

স্ত্রীকে চেনা যায় স্বামীর অভাবের সময়, আর স্বামীকে চেনা যায় স্ত্রীর অসুখের সময়। মীরা ওর সংসার জীবণে রাজিবের অর্থনৈতিক দৈন্যতা, এবং অসুস্থতা দুটোর সাথে যুদ্ধ করা শুরু করেছে হাতের মেহেদীর রঙ না ফুরাতেই।
কিন্তু রাজিব…!
হঠাৎ কি ভেবে মীরা হেসে ফেললো। রাজিব চায়ের কাপ ঠোঁটে থাকা অবস্থায় তাকালো মীরার দিকে। কাপটাকে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো
: ” হাসলে যে…? ”
: ” এমনিই ”

উঠে চলে গেলো রাজিব। যে এ বিষয়ে জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। বাসার রান্নার খালাকে বললো দড়জা লক করে দিতে। জুতার বেল্ট আটকাতে আটকাতে খালার অপেক্ষা করছে রাজিব।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। বলবে না বলেও ঠিক করে মীরা রাজিবের উদ্দেশ্যে বললো-
: ” আজকে ডাক্তারের কাছে আপয়েনম্যেন্ট আছে সন্ধ্যে ছয়টায়”
: ” ওহ্,”
ঘড়িতে কি যেন ভেবে রাজিব মীরার দিকে তাকিয়ে বললো-
: ” টুম্পাকে নিয়ে যেতে পারবে না? ”
শান্ত চোখের দৃষ্টিটা চায়ের কাপ থেকে ফিরিয়ে নেয় রাজিবের দিকে। বলে-
: ” কিসের এত ব্যাস্ততা তোমার? কি করো তুমি?
কিছু বলে না রাজিব। মীরা এখন খুব কম কথা বলে ওর সাথে। উত্তর না পেয়ে মীরা আবার বলতে শুরু করে-
: “বলোতো- গত একমাসে সবচেয়ে বেশী মাল গেছে কোন মার্কেটে? সবচেয়ে বড় এমাউন্ট পাওনা আছে কার কাছে? আচ্ছা এটা বলো কারখানার কোন কর্মচারীটাকে বাদ দেয়া হয়েছে গত সপ্তাহে?

রাজিব নিশ্চুপ। কি একটা ভাবছে যেন।

: ” এ শরীর নিয়েও আমি মাত্র দেড়শ পিস ড্রেসের অর্ডার নিতে গুলশান গিয়েছিলাম কাল সন্ধ্যায়। কেন বলোতো…?
যাতে কাজের কোয়ালিটি দেখে ভবিষ্যতে তাদের পরিচিতদের থেকে আরো অর্ডার পাই আমরা। এটা শুধু প্রোডাক্ট সেলই না, ওয়ান কাইন্ড অফ মার্কেটিং”

: ” আমি কাল….

কথাটা শেষ করতে দেয় না মীরা। রাগত্ব স্বরে বলে –
: ” কাজের কাজ তো কিছুই করো না। ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে থাকো। মোখলেছ চাচাকে কাল বলেছো- কথা বলে নিই মীরার সাথে। কেন এতটুকু কমনসেন্সে কি তোমার নাই। তুমি কি এটুকুও বুঝো না যে ঐখানে কি বলা উচিত। তুমি যদি তখন বলতা- বললেই তো চলে যাওয়া যায় না, সামনে ইদ-পূজার সিজন। সময় দিন আমাদের, আমরা কারখানা ঠিক করে চলে যাবো, এ কথাটা বলতে পারতে না?
: ” তুমি জানো মীরা তার সাথে পেরে উঠবো না আমরা, তিনি মার্কেট কমিটির সভাপতি”
: ” ন্যায়-অন্যায় বলতে পেরে উঠতে হয় না রাজিব, মেরুদণ্ডে জোর থাকা লাগে”

কথাটায় কিছুটা অপমানিত মনে হলো রাজিবকে । মীরার দ্রুতই বুঝলো এভাবে বলাটা ঠিক হয় নি। চেয়ার থেকে উঠে রাজিবের কাছে গিয়ে মীরা ওর হাতটা ধরে বলে-
: ” কোন সমস্যাকেই তুমি নিজের মনে করে সমাধান করছো না রাজিব। পিঠ বাচিয়ে চলছো তুমি, সব দায় আমার কাঁধে চাপিয়ে। কত কম্পিটিশন বর্তমানে তা তুমি ভালো জানো।
এত ব্যাস্ত থাকো তুমি যে – তুমি আসে পাশেই আছো আমার, কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পারছি না মনে হচ্ছে। আমাদের সম্পর্কটা এমন কেন হলো রাজিব?”
: ” সুযোগ পেলেই এই এক গান, এসব কথা আর ভাল্লাগে না। সব দায়িত্ব তো তোমার মীরা। কি করা লাগবে বলো তা করি কি না তা দেখো। প্রতিদিন তোমার এই একই অভিযোগ”
: ” সব কাজ কি বলে কয়ে করানো যায় রাজিব? কারখানার পিচ্চি ছেলে নাহিদও বুঝে কোনটার পরে কোনটা করতে হবে, আর তুমি এ প্রতিষ্ঠানের মালিক…! ”
: ” মালিক!
তাচ্ছিল্যের সাথে শব্দটা উচ্চারণ করে ক্ষণকাল চুপ থাকে রাজিব। তারপর কি যেন ভেবে বলে-
: ” তুমি তো জানো আমি বেখেয়ালি, এমনটা যে নতুন হচ্ছে তা তো না? ”
: ” ভুল হয়ে গেছে রাজিব, তোমার শারীরিক অসুস্থতার কথা ভেবে সব দিক সামাল দিতাম আমি। এখন আমি অসুস্থ এখনো কি সব তোমাকে বলে কয়ে করাতে হবে?
: ” উফ্ মীরা এসব আর ভাল্লাগে না আমার, তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছো”

এ কথা শুনে মীরা আর একটা কথাও বলে না। ধীর পায়ে চলে যায় সেখান থেকে। আর রাজিব অনেক শব্দ করে দরজাটা আছড়ে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘর থেকে রাধুনি খালা বের হয়ে কিছু বুঝে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরিস্থতি আঁচ করতে না পেরে দরজা আটকে আবার চলে যায় তার কাজে।

অনেক কাঁদে মীরা। টুম্পা বাসায় নেই। আজ ওর প্রথম বর্ষের ফর্মফিলাপের শেষ তারিখ। ও ভার্সিটিতে গেছে সকাল সকাল। তাই স্বান্তনা দেবার কেও নেই। কিছু সময় বসে থেকে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয় মীরা। কারখানায় যেতে হবে। মুখলেছ চাচার সাথে কথা বলতে হবে।

আলমারি থেকে সুন্দর একটা জামা বের করে পরলো মীরা। মুড ঠিক করার চেষ্টা করলো৷ এসব ভেবে বসে থাকলে চলবে না। ঐদিকে তাহলে সব পরে থাকবে। এ সময়টা হবু মায়ের শরীরে হরমোনের কত খেলা চলে। মনের অবস্থা এই ভালো তো এই মন্দ। এসব ব্যাপারে মনে হয় কিছুই জানে না রাজিব। ও এমনি, শুরু থেকে এটাকে ব্যাক্তিত্ব মনে হলেও মীরা এখন এই এক দিকটার জন্য অসহ্য বোধ করে। মীরার জীবণের একমাত্র লায়াবিলিটি রাজিবকে একপাশে সরিয়ে সোজা মার্কেটে গেলো ও। প্রথমে নিজের জন্য একটা সুন্দর স্মার্ট ফোন কিনলো মীরা। দেশী-দশে ঘুরলো একটু। এরকম প্রায়ই ঘুরাঘুরি করে মীরা মার্কেট এনালাইসিস করতে। এখন ও যে কোন ড্রেস দেখলেই বলতে পারবে কোনটা আড়ং এর ড্রেস, কোনটা রং এর, কোনটা অন্জনস্ এর, কোনটা সেইলরের, কোনটা ইয়েলোর।

আড়ং ঘুররার সময় সেখান থেকে দুটো ম্যাটারনিটি ড্রেস নিলো মীরা। এটা সুন্দর স্টিলের কৌটার মতো জিনিসটাকে হাতে নিয়ে সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করলো মীরা জিনিসটা কি? মুচকি হেসে মেয়েটি জানালো এটা পানদান। নানি-দাদিদের পানের বাটার ছোট্ট ভার্শন। সাজানো পান রাখা থাকে এখানে। সাথে আগেরকার বেবী ট্যাক্সির মিনিয়েচারটাও পছন্দ হলো মীরার, সেটাকেও নিলো ও। পেমেন্ট কম্পিলিট করে ফিরবার সময় সেখান দাঁড়িয়ে নতুন কেনা ফোন দিয়ে মিরর ক্লিক করলো একটা । এটা ওর একমাত্র ছবি প্রেগ্ন্যাসি জার্নির। মনে মনে ভাবলো এ সময়টাকে উপভোগ করা উচিত। এমন সময় তো বার-বার আসবে না।

সেখান থেকে বেরিয়ে রং থেকে ব্যাগ নিলো টুম্পার জন্য। ফুড কোর্টে গিয়ে হালকা স্ন্যাক্স খেয়ে একটা আইসক্রিম নিলো ও। সময় নিয়ে শেষ করলো সেটা। মনে মনে ভাবলো টুম্পাকে নিয়ে এসে একটা মুভি দেখতে আসবে সিনেপ্লেক্সে। তারপর ফুরফুরে মেজাজে গেলো ওদের করাখানায়। কি ভেবে যেনো ওদের কারখানায় না ঢুকে বামের মুখলেছ চাচার কারখানায় ঢুকলো মীরা। মীরাকে দেখে সবাই কাজ রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মীরাকে এ কারখানার সব ছেলেমেয়ে-ই লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে। এত সুন্দর যে অনেক খুঁজে ও কোন খুঁত খুঁজে পায় না ওরা। দীন এ কর্মচারী গুলো ভাবে মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে। এত সুন্দর নাক, এত সুন্দর চোখ, ঠোঁট, তেমনি চুলের গোছা। লম্বা চওড়া এত সুন্দর যে ঠিক যেন দেবী প্রতিমা। মাঝে মাঝে মেয়েগুলোর অসহ্য বোধ হয় মীরাকে দেখে। যাকে এত কষ্ট করে দেখতে হয় সবসময় সে এসেছে ওদের ঢেরায়, একটা চাপা উচ্ছাস সবার মধ্যে টের পেলো মীরা। মুচকি হেসে একজনকে জিজ্ঞেস করলো – মুখলেছ চাচা কোথায়?
মেয়েটা কাছে এসে বললো-
: “ভিতরের অফিস ঘরে আছে। আমি গিয়া বলে আসি আপনি আসছেন”
: ” থাক তোমার কষ্ট করে যাওয়া লাগবে না, আমিই যাচ্ছি”
বলে মীরা পা বাড়ালো অফিস ঘরের দিকে। যাকে বললো কথাটা সে তো আকাশে উড়ার মতো অবস্থা, তার সাথে কথা বলেছে মীরা। খুশিতে কুটকুট অবস্থা।

ঘড়িতে দুপুর তিনটা, এত সময় কেটে গেছে খেয়ালই নাই মীরার। মুখলেছ সাহেব বাড়ি থেকে আনা খাবারের টিফিন ক্যারিয়ারটা মাত্র খুলে সাজিয়েছেন এমন সময় মীরা ঢুকে বললো-
: ” ইশ্ অসময়ে এসে পরলাম চাচা”
কিছুটা বিরক্ত চেপে গিয়ে মুখলেছ বললেন-
: ” আরে অছময় বইলা কিছু আছে নিহি ব্যাবছায়ী জীবনে। তা কি মনে কইরা আইলা এই গরিবখানায়। বহো, বহো।
চেয়ারে বসে খাবারের দিকে তাকিয়ে মীরা বললো-
: ” চাচা আপনার খাবার দেখে তো ক্ষুধা লেগে গেলো”
: ” ছময় তো কম হয় নইক্যা, ক্ষুধা তো লাগবোই। ওই কুদ্দুস আরেকটা প্লেট লিয়া আয় মীরা মার লাইগ্যা ”
: ” আমি খেলে আপনার কম পরে যাবে না চাচা? ”
: ” মা রিজিক হইলো আল্লার দান, তোমার রিজিক এইখানে দুপুরে খাবা তাই লিখা ছিলো তাই হইলো। তাছাড়া তোমার চাচির দিলটা বহুত বাড়া, প্রতিদিনই ভাত বেছি হয়। খাওয়া ছেষ কইরা দিয়া দিই কাওরে। হাত ধুয়া আহ মা, কম পরবো না”
হাত ধুতে ধুুতে মীরা হাসিমুকে বলে-
: ” রিজিক আল্লাহর দান, তবুও মানুষ মানুষকে হিংসা করে। কত বোকা তারা তাই না চাচা!
অবাক চোখে তাকায় মুখলেছ। কথাটা যে মীরা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তা ঠিক বুঝেছেন তিনি।

মীরা দুই প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বললো-
: “চাচীর মন এত বড়, সব বেশী বেশী করে দিয়ে দেয়, আর আপনি এমন কেন চাচা, রাজিব বললো আমাদের নাকি চলে যেতে বলছেন ” কথা বলতে বলতে ভাজি দিলো দুই প্লেটের এক কিনারায়, তার পাশে লেবু আর কাঁচামরিচ সাজিয়ে নিলো মীরা। সবগুলো কথা মীরা তার দিকে না তাকিয়েই বললো। সাজানো প্লেট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো-
: ” চাচা আপনার তো চারটা ছেলে তাই না? ”
মাথা নিচু করে খাচ্ছে মুখলেছ, বাকপটু এ লোকটার কথার ডেরায় শব্দের টান পরেছে হয়তো। মীরা তার অস্বস্তি কাটাতে বললো-
: ” এটা কিসের ভাজি চাচা? ”

: “লাউয়ের খোছার ভাজি, মজা না? তোমার চাচীর রান্না বহুত মজা”
: ” চাচিকে জিজ্ঞেস করবেন আমাকে তার এ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে রাখবে কি না, বেতন দিতে হবে না, খওয়া আর কাপড় দিলেই হবে ” কথাটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো মীরা। ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো মুখলেছ। তারপর বললো-
: ” তুমি মা যা পারো তা এ দুনিয়ায় খুব কম মানুছই পারে। তোমার অন্য দিকে মন দিয়া কাম নাই। বেছি বেতন দিয়া রান্নার লোক রাইখা নিবা। তুমি যেইটা করতাছো সেইটাতেই মনযোগ দাও।
: ” কি মনযোগ দিবো চাচা, এ অবস্থায় আপনি যদি উঠায়ে দেন আমাদের কোথায় যাবো তাই ভেবে দিশেহারা আমি”
: ” রাজিব হারামজাদারে দেখলে শরীল জ্বলে আমার, তোমার এ অবস্থায় ও গায়ে বাতাছ লাগায়া ঘুরে। ওর উপর বিরক্ত হয়া কথাটা বলছিলাম মা”
সর্ষে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে মীরা বললো-
: ” চাচা রিজিক আল্লাহর দান, এটা যদি বিশ্বাস করেন তাহলে কখনোই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববেন না। আমি জানি আপনি আমাদেরকে ভালোবাসেন। কারখানা শুরুর সময় কত কত দিন সুতা, বকরোম আপনার কারখানা থেকে নিয়ে কাজ করেছি, ওভারলক মেশিন নষ্ট থাকায় কতদিন আপনার মেশিন গুলো ব্যাবহার করেছি। সেই আপনি যদি আমাদের মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নেন তাহলে এ অবস্থায় কই যাবো আমরা। সবই তো জানেন আপনি। রাজিব শুধু নামেই মালিক। সব দিক দেখতে হয় আমাকে।
: ” আমারে আর লজ্জা দিও না মা, বাদ দাও ঐছব কথা, তোমারে আমি একটা পরামর্শ দিই- কারখানার কাগজপত্র গুলান তুমি তেমার নামে বদলায়া ফেলো। ওর মতিগতি ভালা না। আমার চারটা পুলা, কুন মাইয়্যা নাইক্ক্যা, তুমি আমার মাইয়্যার মতো, জানি ও তোমার ছামী, তবুও কথাটা গুরুজন ভাইবা বললাম তোমারে।

পাতের শেষ লেকমা খাবার মুখে পুরে মীরা বললো-
: ” অনেকদিন পর পেট ভরে মন ভরে খেলাম চাচা। চাচীকে সালাম দিবেন আমার। আর হ্যা ধন্যবাদ আপনাকে। আমিও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি ইদানীং”
: ” আরেকটা কথা মা, পলাশ গার্মেন্টস এর সেবাহান কিন্তু লোক ভালা না। ওর লগে রাজিবরে মিছতে না কইরা দিবা। হালার কিন্তু মইয়্যা মানুছ নিয়া ক্যালেঙ্কারীর বদনাম আছে। হুনি রাইতে রাইতে নাকি কেলাবে যায়, ছেখানে মদ-জুয়া-নারীর আছর বছে। রাজিবরেও নাকি দেখছে কেও কেও।
: ” আচ্ছা চাচা, বলে ভালো করেছেন। দেখবো আমি ব্যাপারটা। আজ আসি চাচা। আমাদের মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েন না।
জিভ কামড় দিয়ে না সূচক ভঙ্গি প্রকাশ করে তিনিবললেন-
: ” যাও মা”

গেইটের কাছে এগিয়ে আবার ফিরে বসে মীরা। মুখলেছ তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: “কি মা কিছু বলবা? ”
ব্যাগ থেকে পানের কেসটা বের করে এগিয়ে দিয়ে মীরা বলে-
: “এটা আপনার জন্য, ঘুষ না কিন্তু, ভালোবেসে এনেছি”
পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করে মুখলেছ।

চলবে….