Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 265



প্রিয় ভুল পর্ব-৮৫+৮৬+৮৭+৮৮

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দীর্ঘ একুশ দিন কাজকর্ম সবকিছু ছেড়ে একটানা হাসপাতালে ছিলো মীরা। যদিও ওর থাকাটা এত সহজ ছিলো না, ওর চাচীরা প্রথমে ওকে এলাউ করে নি। একটা অচেনা অজানা মেয়ে। ও যে আবীরের স্ত্রী ছিলো তা জানতেন না। তারা তাই মীরাকে চিনতে পারেনি। পরে মীরার মা জাহানারা বলেন –

: “দেখুন আমরা ওদের প্রতিবেশী ছিলাম। ওদের পরিবারের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। আবীর আমার নিজের ছেলের মতো”

পরে ফিওনা তাদের থাকার পারমিশন দেয়ায় তারা মেনে নেয় তাদের থাকার ব্যাপারটা। তবে এ মেনে নেয়াটাতেও তাদের একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিলো। আবীর ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি, আর তাদের ঘর সংসার, ছেলেমেয়ে পরে আছে চট্টগ্রামে”, আর এমন ধরনের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার৷ ঘর সংসার ছেড়ে এত দীর্ঘ সময় এখানে পরে থাকা তাদের সম্ভব না। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছে না।

আবীরকে ভর্তি করার ১ম দিনে বুকের জ*খ*মের অপারেশন হয়। রক্তের প্রয়োজন পরে চার ব্যাগ। ফোন করে দুই ঘন্টার মধ্যে রক্ত জোগাড় করে মীরা। নানান জায়গা থেকে এদেরকে এক করতে বিশাল হ্যাপা পোহাতে হয় ওকে। যদিও মার্কেটের অনেকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে মীরাকে। তারা চট্টগ্রামের মানুষ এখানে পরিচিত কেউ না থাকায় এ ব্যাপারে কিছুই করার ছিলো না আবীরের দুই চাচার। এই এক ব্যাপারেই মীরার অবস্থান শক্ত হয়ে যায় তাদের কাছে।

দ্বিতীয় দিনেও যখন আবীরের জ্ঞান ফিরলো না তখন তারা নড়েচড়ে বসলেন। এখানে থাকতে এলাউ না করা অচেনা মেয়ের প্রতি ব্যাবহারের সুর হঠাৎ বদলে গেলো তাদের। আবীরের বড় চাচী ইনিয়ে বিনিয়ে জাহানারাকে বললেন তার স্বামীর সামনে ইলেকশন এ সময় বাড়িতে কত লোকজন আসে, তার এখন বাড়িতে থাকা কতটা জরুরি। আর ছোট চাচী বললেন তার মেয়ের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, ছেলেমেয়ে তো এমনিতেই ফাঁকিবাজ। শেষ সময়ের প্রস্তুতি খারাপ হলে রেজাল্টেও প্রভাব পরবে৷ এসব কথার বাহানায় তারা অচেতন আবীরকে একা মীরা আর জাহানারার হেফাজতে রেখে সত্যি সত্যি চট্টগ্রাম ফিরে যায় শুধুমাত্র তাদের বাড়ির কাজের ছেলে বিপুলকে হসপিটালে রেখে। তাদের অজুহাত ছিলো শক্ত আর মীরার জন্য তাদের এসব অজুহাত ছিলো ব্লেসিং। তারা থাকলে হয়তো আবীরের কাছেই ঘেঁষতে পারতো না মীরা।

তারা চলে যাবার পর হাসপাতালের কেবিনটাকেই নিজের ঘর বানায় মীরা। সারাদিন হসপিটালে থাকে, আর রাতে ওর মা থাকে আবীরের কাছে থাকে।

এমনিতেই একজন রোগীর সাথে দুজন লোক থাকা লাগে। তবে আবীরের দাদা বাড়ির কাজের ছেলে বিপুল নিতান্তই ছোট ষোল-সতেরো বছর বয়স। ওকে দিয়ে ঔষধ পত্র কেনা যায় কিন্তু দীর্ঘ দেহী আবীরকে যখন স্ট্রেচারে তুলে এক্সরে রুমে কিংবা টেস্ট করাতে এদিক-সেদিক নিতে হয় তখন মীরা আর বিপুলের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। যেদিন কোন টেস্ট কিংবা পরীক্ষা করানোর থাকতো সেদিন মীরা আগেভাগেই ফাহাদকে ডেকে পাঠাতো।

হাসপিটালের পুরো জার্নিতে ফিওনা অল টাইম কানেক্টেড ছিলো মীরার সাথে। ও নতুন একটা পরিবেশে গিয়েছে মাত্র কিছু দিন হলো। বেবী ডেলিভারির ডেটও নিকটবর্তী। তবুও দেশে আসতে চেয়েছে ও ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ অবস্থায় ওকে আসতে নিষেধ করলো মীরা। যদিও মীরা ফিওনার অসুস্থতার চেয়ে বেশী জোড় দিয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে ওর দেশে না আসার গুরুত্বতে । বুঝিয়েছে যে ও যদি এখন ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য দেশে আসে তাহলে মীরার উপস্থিত অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। ফিওনা মীরার কথাগুলো বুঝতে পেরে দেশে আসার ব্যাপারটা স্থগিত করে। তবে ওর বুক ফেটে যায় ভাইয়ের এমন দূরাবস্থা দেখে।

মীরা ওকে শান্ত করে, ভরসা দেয় পরিস্থিতি যাই হোক আবীরের এ অবস্থায় ওর পাশে থাকার। প্রতিনিয়ত আপডেট জানায় আবীরের শরীরের অবস্থার।

টানা দুটো দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মীরা। তারা সকলেই যে সত্যি সত্যি এ অবস্থায় ওকে ফেলে চলে যাবে তা প্রথমটায় বিশ্বাস করে নি। ভেবেছিলো বড়দের কেউ অন্ততঃ থাকবে। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো মীরা। সাথে অনিশ্চয়তা ও ছিলো ওর বাঁচা ম*রা নিয়ে। একটা চাপা অস্বস্থিকর অপরাধবোধ কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ওকে।

অবশেষে তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে আবীরের। কিন্তু জ্ঞান ফিরার পর আবীরের মীরাকে দেখে হজম করাটা কষ্টের ছিলো ৷ জ্ঞান ফিরার পর মীরাকে পাশে দেখে চোখমুখ কেমন হয়ে যায় আবীরের। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় ও মীরার থেকে। যেন ওকে দেখবে বলে আশা করে নি।

কথা বলার শক্তি না থাকলে কি হবে তেজ ছিলো তার টইটম্বুর। আবীরের মীরাকে দেখে বিপুলকে ক্ষীণ কন্ঠে বলা প্রথম কথাটা ছিলো-

: “ও এখানে কেন?”

এটুকু কথা বলতেই সব শক্তি খরচ হয়ে গেলো যেন ওর। মুখ খানা সাধ্যমতন শক্ত করে বিপুলকে জিজ্ঞেস করে –
: “ফোন কোথায় আমার?”

ফোনটা ওর হাতে দেয় বিপুল। বাম হাতে ব্যান্ডেজ। কিরকম একটা লোহা দিয়ে সোজা করে রাখা হাতটা। পায়ের হাড়ে রড দিয়ে টানা দেয়া। এক হাত দিয়ে ফোনটা ধরতে গিয়েও ফেলে দেয় আবীর। এমন সময় জাহানারা আসে কেবিনে। এখন মীরার বাড়ি ফিরার সময় হয়েছে। দিশেহারা মীরা মাকে দেখে যেন দিশা পেলো। ওর সজ্ঞানে আসাতে যতটা উৎফুল্ল হয়েছিলো, ততোটাই মুষড়ে পরেছিলো ওর দৃষ্টি সরিয়ে নেয়াতে। মাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে তরিঘরি করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো মীরা কেবিন থেকে।

জাহানারা হাসিমুখে কাঁধের ব্যাগটা রেখে বিপুলের উদ্দেশ্যে বললো-

: “জ্ঞান ফিরলো কখন”

বিপুল আবীরের এমন আচরন আর মীরার তৎক্ষণাৎ কেবিন ত্যাগে ভ্যাবাচেকা খেয়ে উত্তর দিতে ভুলে গেলো। তিনি বোরকা খুললেন, তারপর আবীরের মাথার কাছে বসে ওর মাথায় হাত রাখে জিজ্ঞেস করেন –

: “কেমন আছো বাবা?”

জোড়াতালি মৃদু হেসে ভালো থাকার উত্তরটা দেয় আবীর। জাহানারা সস্নেহে আবীরের চুলে হাত বুলিয়ে বলে-

: “তিনদিন পর তোমার জ্ঞান ফিরলো, জমে-মানুষে টানাটানি এর আগে আমি কখনো দেখিনি বাবা। তোমার চাচাতো কিছু করার সুযোগই দিলেন না আমাকে, হুট করে চলে গেলেন”

: “আপনারা অনেক কষ্ট করলেন…” যন্ত্রণায় আবীর অস্ফুট স্বরে বলা কথাটা শেষ করতে পারে না।

জাহানারা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন-

: “কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমরা এখানে আসিনি বাবা। তোমার মা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন, সে পরিচয়ে আমারা এখানে এসেছি। তোমার মা আমাদের সকল দুঃসময়ে আমাদের পাশে ছিলেন, আজ ও নেই, তাই তোমার এমন দুঃসময়ে পাশে থাকার তাগিদ অনুভব করছি বাবা ”

অস্ফুট স্বরে আবীর বলে-

: “কোন কৈফিয়ত চাইনি আমি চাচী, আপনি থাকুন কিন্তু ও যেন…” কথাটা শেষ করতে পারেনা ও। অনভ্যস্ততায় হাত নড়ে ব্যাথা অনুভূত হয় ওর। ব্যাথার যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে যায় ওর। জাহানারা ওর হাতটা সোজা করে দেন।

হসপিটালের সেই রাতটা কোন মতে কাটে ওর। পরদিন সকাল হতেই আবীর কল করে ওদের ঢাকার বাড়ির দেখাশোনা করা সোবাহান চাচাকে। দুপুরের দিকে তিনি হসপিটালে এলে আবীর তাকে একটা লোক ঠিক করে দিতে বলেন, দিনের বেলায় এখানে থাকার জন্য। অথচ মীরা ওকে দেখাশোনা করার জন্য অপর প্রান্তের সোফায় বসে আছে তীর্থের কাকের মতো। এরকম পরিস্থিতিতে ও একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কত সুন্দর উপেক্ষা করছে আবীর। মীরা যেন নো-বডি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর এই উপেক্ষা করাটা নির্বিকার দেখে মীরা। মীরা যে নো-বডি আবীরের কাছে তার প্রমাণ এসব কথাবার্তা।

অথচ ওর চাচীরা চট্টগ্রাম ফিরে যাবার পর অচেতন আবীরের পাশে বসে পুরো একটা রাত কটিয়ে দিয়েছে মীরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর যন্ত্রণা কাতর মুখ দেখেছে। হাত দেখেছে, চোখ দেখেছে, চুল দেখেছে, আসীম মমতায় ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়েছে। ডান হাতটা ধরে কেঁদেছে আবীরের এমন অসহায় অবস্থা দেখে। মীরার কেবলি মনে হয়েছে আজকের এ পরিস্থিতির জন্য ও-ই একা দায়ী। ওর প্রতি সায়নের থাকা সব ঘৃণা, নিরপরাধ আবীরের বুকে উপর্যুপরি ছু*রিকাঘা*তে ঝড়ে পরেছে। আবীর যদি তা জানতে পারে? কখনো কি ক্ষমা করবে? এ মীরাই যে ওর জীবণের সকল যন্ত্রণার উৎস্য। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হয় মীরার, আবীর যেন ওকে বলছে- “Why me?

এত বছর গ্রামে থাকা সোবাহান চাচা তার পরিচিত এক মহিলাকে এনে দিয়েছিলেন আবীরের দেখাশোনা করতে। জাহানারা নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আবীর তাকে অনুরোধ করে এ বিষয়ে নিষেধ না করতে।

ভদ্রমহিলার নাম জরিনা, বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন এর মধ্যে হবে। হাড়জিরজিরে শরীর, রোগীর চেয়েও বেশী রোগী দেখায় তাকে৷ দিনরাত পান চাবান আর যখন তখন ধুমসে ঘুমান। কাজের কাজ একটাই করেন, আবীরের ফুটফরমাশ খাটা, ঔষধ, খাবার নিয়ম করে খাওয়ানো।

আবীরের উগ্র আচরণ, মীরা থাকার পরও ওর সেবার জন্য নতুন লোক নিয়োগ সত্যেও মীরা কিন্তু কেবিন ছাড়ে না, ও ঠিকই থেকে যায়। সারা সারা দিন হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি ছাড়া করার কিছু না পেয়ে কেবিনের সোফায় বসে নতুন ড্রেসের ডিজাইন করে মীরা। এতে যদি আবীরের অগ্রাহ্যতা ভুলতে পারে কিছুটা।

আবীরের জ্ঞান ফিরার পর কাজ ফুরায় মীরার, ডাক্তার এলে ওর বর্তমান পরিস্থিতির আপডেট দেয়া, রিপোর্ট সময়মত বুঝে এনে চেক করানো, আবীরের খাবার ঔষধ সব রেডি করে জরিনা খালার হাতে দেয়া। এই ওর কাজ পুরো দিনে। না একটা কথা না একটু দৃষ্টির বিনিময়, কোনটাই হয় না দুজনের মধ্যে।

আর জরিনা খালা ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে তৈয়র ডালে বাগার দেয়ার মতো আবীরকে সময় মতো খাবার আর ঔষধ পরিবেশন করে। এত কিছুর পরও মীরা এখানে থেকে যাওয়ায় আবীরের চোখেমুখে টানা বিরক্তি দেখে মীরার এক-আধবার মনে হয়ে বেরিয়ে যায় এখান থেকে। কিন্তু পরোক্ষনেই মন শান্ত করে, বেচারার এ অবস্থার জন্য ওই দায়ী এটা ভেবে।

অবশেষে একুশ দিনের চিকিৎসা শেষে ডাক্তাররা রিলিজ দেয় ওকে। বুকের কাছে যে ক্ষতের জন্য চট্টগ্রামের চিকিৎসকেরা ইমিডিয়েট ঢাকায় পাঠিয়েছিলো আবীরকে তা সহজেই সেরে গেছে এন্টিবায়োটিক এর ফুল ডোজে। চা*কুর উপর্যুপরি আঘাতে জ*খ*ম*টা মারাত্মক ছিলো, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারিয়েছিলো ও। কয়েক ব্যাগ রক্ত ওকে দিতে হয়েছিলো ওকে। অপারেশনের পরও টানা তিনদিন সেন্স লেস ছিলো ও। ডাক্তাররা বলেছেন : “হৃদপিণ্ডের খুব কাছ থেকে ঘেঁষে গেছে চাকুটা, একটুর জন্য হৃদপিণ্ডে ক্ষত হয় নি, পেশেন্টের লাক ভালো যে বাই এয়ারে করে সময় মতো হসপিটালে তাকে আনা হয়েছে, তা নাহলে রোগীকে বাঁচানোই মুশকিল হতো। ইশ্বর তাকে দ্বিতীয় জীবণ উপহার দিয়েছেন”

সত্যি এ যাত্রায় বেঁচে গেলো আবীর। তবে বা হাতের একটা হার ভেঙে গিয়েছিলো ওর, পায়ের হাড়েও ফাটল ছিলো, সেটা জোড়া নিতেই সময় লাগবে আরো৷ ডাক্তার ঔষধ গুলো নিয়মিত নিতে বলেছে আর অতি-প্রয়োজন ছাড়া হাঁটাহাটি নিষিধ করেছে।

দীর্ঘ একুশ দিনের চিকিৎসা শেষে নিজ বাড়ি ফিরছে আবীর। হসপিটাল থেকে জাহানারা তার বাড়িতে নিতে চেয়েছিলো আবীরকে। এতদূর থেকে ওকে দেখাশোনার জন্য আসা যাওয়াটা তার শরীরের জন্য ভারী হয়ে যাবে। কিন্তু আবীর বলেছে –

: “তার দরকার নেই চাচী, অনেক করলেন আপনি, আপনার এ ঋণ শোধ করবার না”

জরিনা খালা অস্ফুটে বলে – “হাসপাতালে রাইতে আর কাম কি, সব কাম তো দিনের বেলা। হেয় আইয়্যা তো খালি ঘুমাইছে, দৌড়াদৌড়ি সব তো ঐ আফায় করছে”

জরিনা খালার এ কথা শুনে চোখ কটমট করে তাকায় আবীর তার দিকে, এসব দেখে তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন। জাহানারা ওর বিছানাপত্র রেখে চলে যান, মীরা বলে-

: ” ইরার মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিবে, তুমি ইরার বাসায় যাও মা, খালাকে ঔষধ গুলো বুঝিয়ে দিয়ে আমি একটু পরে আসছি”

জাহানারা বেরিয়ে গেলে মীরা খালাকে নিয়ে বাড়িঘরের ধুলো পরিষ্কার করে। আবীরের যাতায়াতের কোন সমস্যা যাতে না হয় সে অনুযায়ী আসবাবপত্র গোছগাছ করে।

সব কিছুর গুছগাছ করতে বিকেল হয়ে এলে খালাকে পাঠায় বাইরে থেকে খাবার আনতে। খালা জানান খাবারের ব্যাবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে খাবার আনিয়েছে আবীর। মীরা বের হওয়ার আগে তাকে বললেন-
: “তাহলে উনাকে খাবার খাইয়ে বিকেলের ঔষধ দিয়ে দিয়েন, আমি যাই”

এদিকে ও বেসিনে মুখ ধুয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পরে। দুপুর পেরিয়ে গেছে সেই কখন, সকালেও তারাহুরোয় কিছু খেয়ে আসেনি ও। গেইট আটকাতে সোবাহান চাচাকে ডাকলে তিনি এসে বলেন-

: “আন্টি, আবীর চাচায় আপনারে ডাকছে”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না মীরা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ও চাচার দিকে৷ কথাটা বলে বাইরে চলে যান তিনি কি যেন কিনতে। মীরা মনে মনে ভাবে- “আবীর ওকে ডাকছে!”

অপমান করে তাড়িয়ে দিতে কি? নাকি
আর যেন না আসে মীরা এ বাড়িতে এটা বলতে?

মীরা মৃদু হাসে, এসব ওর পাওনা, মনে মনে ভাবে মীরা আবীর বলার আগে ও নিজেই বলে দিবে- “চিন্তা নেই আমি আর কখনো আসবে না এ বাড়িতে….”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সব কিছুর গুছগাছ করতে বিকেল হয়ে এলে খালাকে পাঠায় বাইরে থেকে খাবার আনতে। খালা জানান খাবারের ব্যাবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে খাবার আনিয়েছে আবীর। মীরা বের হওয়ার আগে তাকে বললেন-

: “তাহলে উনাকে খাবার খাইয়ে বিকেলের ঔষধ দিয়ে দিয়েন, আমি যাই”

এদিকে ও বেসিনে মুখ ধুয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পরে। দুপুর পেরিয়ে গেছে সেই কখন, সকালেও তারাহুরোয় কিছু খেয়ে আসেনি ও। গেইট আটকাতে সোবাহান চাচাকে ডাকলে তিনি এসে বলেন-

: “আন্টি, আবীর চাচায় আপনারে ডাকছে”

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না মীরা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ও চাচার দিকে৷ কথাটা বলে বাইরে চলে যান তিনি কি যেন কিনতে। মীরা মনে মনে ভাবে- “আবীর ওকে ডাকছে!”

অপমান করে তাড়িয়ে দিতে কি? নাকি

আর যেন না আসে মীরা এ বাড়িতে এটা বলতে?

মীরা মৃদু হাসে, এসব ওর পাওনা, মনে মনে ভাবে মীরা আবীর বলার আগে ও নিজেই বলে দিবে- “চিন্তা নেই আমি আর কখনো আসবে না এ বাড়িতে….”

কিছুটা সময় নিলো ও ধাতস্থ হতে তারপর পা থেকে কেডস জোড়া খুলে ধীর পায়ে গেলো ভিতরের দিকে। মেইন ফটক হতে আবীরের ঘরের দূরত্ব বড়জোর পঞ্চাশ ফুট হবে, তবুও ওর মনে হলো অনন্তকাল ধরে ও হাঁটছে আবীরের কাছে পৌঁছানোর জন্য। অবশেষে ওর ঘরের দরজার কাছে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো ও, এই পৃথিবীতে মীরা কোন মানুষের পরেয়া করে না,

একমাত্র এই মানুষটার কাছে নিজেকে এত ছোট মনে হয়, ও মেনেই নিয়েছে এ লোকটার কাছে ও নো-বডি।

ঠিক যেন আবীর মহাজন আর মীরা ঋণগ্রস্থ প্রজা।

কিছুক্ষণ পর দীর্ঘ শ্বাস চেপে ঘরে ঢুকে মীরা, দেখে আবীর টি-টেবিলে খাবার নিয়ে পা ঝুলিয়ে খাটে বসে পানি ঢালছে গ্লাসে, একটা গ্লাস ভরা আরেকটা ভরছে। মীরাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই টি টেবিলের প্লেটটা অপর দিকে ঠেলে দিতে দিতে বলে-

: “বসো এখানে ”

দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করছে আবীর মীরাকে! শান্ত, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। যেন প্রায়ই একসাথে খপতে বসে ওরা।

মীরা আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। যেন আবীর কি বলছে ও বুঝতে পারছে না। মীরাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবীর মাথা উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে –

: “বসো, এত কাজ করলে না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো? ”

মীরা তখনো দাঁড়িয়ে। আবীর ওর দিকে তাকিয়েছে, ওকে ওর সামনে বসতে বলছে, দুপুরে খেয়ে যেতে বলছে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর। আবীরের দিকে দৃষ্টি রেখেই টি-টেবিলের বিপরীতে রাখা চেয়ারটাতে আজ্ঞাবহের মতো বসে মীরা। আর কোন ভুল করতে চায় না মীরা ওকে নিজের করে পাওয়ার পথে।

মীরার দিকে থাকা প্লেটে ভাত বেড়ে, নিজের প্লেটটাও টেনে নেয় আবীর। মাথা নিচু করে কাঁদছে মীরা, আবীরের ওর দিকে তাকানো, ওর সাথে সামান্য কয়েকটা কথা বলা ওর মনে কি অনাবিল শান্তির ফোয়ারা বইয়ে দিচ্ছে, তা ভাষায় বর্ননা করা ওর সাধ্যের বাইরে। ওর মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে ও যদি ম*রে যায় ওর কোন আফসোস থাকবে না জীবনের প্রতি। যদিও এ ভাবনাটা খুব ছেলেমানুষী শোনাচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্য।

আবীর স্বাভাবিক ভাবেই খাবার খাচ্ছে। একটা হাত ভাঙা তাই অন্য এক হাতেই ভরসা হওয়ায় তালগোল পাকিয়ে ফেলছে আবীর। মীরা প্লেট সামনে রেখে মাথা নিচু করে কাঁদছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে আবীর রূঢ় গলায় বলে-

: “এই মেয়ে, কাঁদছো কেন তুমি? ”

মীরা হাতের উল্টোদিকে চোখ মুছে, এটা ওর ছোটবেলার অভ্যাস। ওর হাতের উল্টোদিক দিয়ে চোখ মোছা দেখে হেসে দেয় আবীর। দ্রুত সেটা গোপনও করে সামনে বসা মীরার কাছ থেকে। তারপর বলে-

: ” খাবার সামনে নিয়ে কাঁদতে হয় না”

একটু সাহস সঞ্চিত করে মীরা বলে-

: ” জীবণে কান্না অবিচ্ছেদ্য যার তার খাবার সময়ই কি আর ঘুমের সময়ই কি? ”

চোখ তুলে তাকায় আবীর মীরার দিকে। মীরার দৃষ্টি তখন প্লেটের দিকে, সবজি দিয়ে ভাত মাখাচ্ছে ও।

এরপর পিনপতন নীরবতা ঘরজুড়ে। পানির গ্লাস নিতে নিয়ে সেটা হাত ফসকে পরে গেলো আবীরের হাত থেকে। কাঁচের ঝনঝন শব্দ ঘরটার গুমোট ভাব কাটিয়ে দিলো। মীরা দ্রুত প্লেট নামিয়ে বললো-

: “আমি দেখছি আপনি বসুন”

বলে কাঁচের টুকরো গুলো সাবধানে তুললো। সেগুলো সরিয়ে হাত ধুয়ে আবার খেতে বসলো মীরা। আবীরের এক হাত এখনো জোড়া লাগেনি পুরোপুরি। তাই এক হাতেই সব করতে হচ্ছে ওকে। মীরাকে বিব্রত না করতে পানি খাওয়া স্থগিত রাখে আবীর, কারন ওর এখন পানি খেতে হলে নিজে খেতে পারবে না, কারুর সাহায্য নিতে হবে। আর কাছেপিঠে মীরা ছাড়া দ্বিতীয় কেও নেই। এ অস্বস্তিটা ও মীরাকে দিতে চায় না ।

খাওয়া শেষ করে বসে আছে আবীর, মীরার ক্ষুধা মরে গেছে, কোনমতে খাওয়া শেষ করে ও। আবীর উঠে হাত ধুতে উঠতেই যাবে এমন সময় মীরা বলে-

: ” হাত ধুতে উঠতে হবে না, আমি…. ”

আবীর ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলে-

: “না বসো তুমি, খাওয়া শেষ করো আমি পারবো যেতে”

বলেই আবীর উঠতে গিয়েই চোট পেলো হাতে। ও কারো সাহায্য না নিয়ে এখন চলতে পারে না। মীরা প্লেট নিচে রেখে বলে-

: “সবসময় জিদ করা ঠিক না”

বলেই রান্নাঘরে যায় ও হাত ধোয়ার জন্য পাত্র আনতে। আবীর মনে মনে বলে-

:”জিদ করলাম কই? একটু পরে আমাকে যে একলা করে চলে যাবে তুমি তখন তো সব একাই করা লাগবে…”

মীরার আনা সে পাত্রে হাত ধোয় আবীর। মীরা দ্রুত খাওয়া শেষ করে টি-টেবিলের সব কিছু সরিয়ে নেয়।

এবার ওকে যেতে হবে। খালাকে ডেকে ঔষধ পত্র সবকিছু খালাকে বুঝিয়ে দেয় ও। এন্টিবায়োটিক ঔষধ যেন কোন ভাবেই মিস না হয় তাও বার বার বলে দেয় ও। খালা ভাবলেশহীন ভাবে বলে-

: “পানের বাডা এখন রাইখা, একটু বাদেই ভুইল্লা যাই, আমি এতকিছু কেমনে মনে রাখমু? ”

মীরা জানে তার ব্যাপার, তাই বললো-

: “অন্ততঃ ঔষধ খাওয়ার কথাটা মনে করিয়ে দিতে পারবেন তো? ”

খালা পান খেয়ে লাল করা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলেন – ” হ, তা পারমু”

মীরা চাচাকে – আবীরের জন্য ডাক্তারের সাজেস্ট করে দেয়া ব্যায়াম, দুবার হাঁটানো এসব তাকে বুঝিয়ে দেন। সবকিছু দেখিয়ে দিয়ে মীরা ভদ্রতাসূচক আবীরের কাছ থেকে বিদায় নিতে যায়, মাথা নিচু করে বলে-

: “আমি যাই তাহলে, ভালো থাকবেন”

ঘর বসে মীরা কথা সব শুনেছে আবীর এতক্ষণ ধরে, মীরা বিদায় নিতে ঘরে ঢুকলে জানালার দিকে দৃষ্টি রেখে ও মীরাকে প্রশ্ন করে –

: “কেন তুমি আর আসবে না এ বাড়িতে? ”

কি উত্তর দিবে মীরা এ প্রশ্নের?

কোন উত্তর না পেয়ে আবীর মৌন কন্ঠে বললো-

: “তোমার সাথে অনেক হিসেব আছে আমার, আর যেহেতু আসবে না সেগুলো এখনি করে ফেলা ভালো হবে৷ বসো তুমি। নাকি কোন তাড়া আছে?”

শেষের প্রশ্নটা আবীর ট্রিক করে বললো। মীরা যদি এসব থেকে পালাতে চায় তাহলে ওকে এখান থেকে চলে যাওয়ার স্কোপ করে দিলো ও।

কিন্তু মীরা ওকে অবাক করে দিয়ে ব্যাগটা টি-টেবিলে রেখে ধীর ভাবে বসলো। কিছুটা সময় নিয়ে আবীর বললো-

: “সত্যি আর আসবে না?”

মাথা তুলে তাকায় মীরা আবীরের দিকে, মনে মনে বলে- আমি সারাজীবনের জন্য আসতে চাই, নিন না আপন করে”। মীরা তাকাতেই চোখ সরিয়ে নেয় আবীর, কেমন একটা সংকোচ কাজ করে ওর।

: ” দেখলে তো?

আমি কত লাইফ-লেস একটা মানুষ। জীবন-মৃ*ত্যুর সন্ধিক্ষণে পাশে দাঁড়াবার ও কেউ নেই আমার। তোমারা না থাকলে আমার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরাটা এত সহজ হতো না। ধন্যবাদ আমার এত বাজে ব্যাবহারের পরও শেষ পর্যন্ত আমার পাশে থাকার জন্য”

মীরা এখনো ওর দিকেই তাকানো নির্বিকার ভাবে। ও যেন আরো কিছু শুনতে চাচ্ছে আবীরের কাছে। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো-

: “করলাম আর কই? আমাকে তো কিছু করার সুযোগই দেন-নি আপনি”

মুচকি হাসে আবীর মীরার কথা শুনে৷ মীরা মাথা নীচু রেখেই আঁড়চোখে দেখে আবীরের নদীর মতো শান্ত হাসি। মনে মনে বলে-

“সর্বনাশ, এ ছেলের হাসি এত সুন্দর? ”

হাসি মুছে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবীর বলে-

: “আমি জানি এটা তোমার বিনয়, ডাক্তার নার্স সবাই বলেছে আমার সুস্থতায় তোমার ভূমিকা কতটুকু। আমি আমার বিহেভিয়ার এর জন্য সরি”

: “আমি কিছুই মনে করি নি, এরচে বেশী আমার প্রাপ্য”

: ” ঐসব কথা থাক, তুমি ভালো থাকো

এই দোয়া করি”

এবার আবীরের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মীরা বলে-

: ” সত্যি আপনি চান আমি ভালো থাকি?”

কেমন অস্বস্তিতে পরে যায় আবীর। নিজের হাতের আঙুল খুঁটছে ও, মীরা তাই দেখছে চেয়ে। ওর মনের ভিতরকার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয় এতে।

তারপর ঘর জুড়ে নিরবতাদের দখল। দুজনেই অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না হয়তো। ঘরের ভিতরের এ অস্বস্থি কাটানোর দায়িত্ব নিলো মীরা। উঠে দাঁড়িয়ে বললো-

: “আসি তাহলে…”

আবীর মীরার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম আবীর একটানা মীরার চোখে তাকিয়ে রইলো। এবার আর সংকোচ, লজ্জা, বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো না যেন নিরব থেকেই চোখ দিয়ে বলতে চাইছে অব্যাক্ত কথা। মীরাও আসি বলে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ম্লান একটা হাসি হেসে বেরিয়ে গেলো মীরা। আবীর চেয়ে কেবল ওর চলে যাওয়া দেখলো। কেমন একটা কষ্ট বুকের ভিতরে পাক দিয়ে উঠলো৷

সোবাহান চাচা রুমে এসে বললো –

: “মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেন?”

: ” ভবিষ্যতে যেন না কাঁদতে হয় তাই”

কথাটা বলে খুব সাবধানে শুয়ে পরলো আবীর। চাচা সবকিছু ঠিক জায়গায় রেখে বেরুতেই আবীর চাচাকে বললো যাওয়ার আগে লাইটটা বন্ধ করে দিতে৷ চাচা বললো-

: “সন্ধ্যা বেলা ঘর অন্ধকার রাখতে হয় না”

কাপালে হাত রেখে চোখ ঢেকে রাখা অবস্থায় আবীর বললো-

: “অন্ধকার যার জীবনের পাড়ায় পাড়ায় তার সন্ধ্যাই কি আর রাতই কি?”

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লাইট বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো সোবাহান চাচা। তিনি যাবার পরই আবীর ওর কপালের উপরে রাখা হাত সরিয়ে বোবা কান্নার জল গুলো মুছলো। মনে মনে বললো-

: “তুমি ভালো থাকো মীরা” অতীতেও চেয়েছি, আজও চাই, সারাজীবন এটাই চাইবো। আমার মতো পঙ্গু, সহায়সম্বলহীন লোকের সাথে গাঁট ছাড়া কেন বাঁধবে তুমি। কত সুন্দর ভবিষ্যৎ সামনে পরে রয়েছে তোমার। আজ আবীর বুঝতে পারলো- “ভালোবাসা মানে কেবল নিজের করে পাওয়ার জন্য আঁকড়ে ধরা না, কখনো কখনো নিঃস্বার্থ ভাবে মুক্ত করে দেওয়া”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

আবীরের বাসা থেকে বের হয়ে সোজা ইরার বাসায় যায় মীরা। কান্নায় আছড়ে পরে বোনের বুকে। ইরা স্তম্ভিত, শেষ পর্যন্ত আবীর ওকে ফিরিয়ে দিবে তা ভাবতে পারেনি ও। ইরা চুপ থেকে বোনকে কাঁদতে দিয়েছে। কাঁদুক ও, কেঁদে মনের ভার হালকা করুক। ইরা সেদিন বোনকে ওর কাছেই রেখেছে। মুরসালীন গিয়ে নূহা আর মাজেদা খালাকে নিয়ে এসেছে। রাতে ফোন করেছে আবীরকে। আবীর ইরার ফোন রিসিভ করে নি। এতে আবীরের উপর চরমভাবে ক্ষেপেছিল ইরা। এত দেমাগ কেন লোকটার? ভুল একটা হয়েছে, বুঝতে পেরে সে ভুল স্বীকার করে তা সংশোধন করতে আবীরের জীবনের একজন হতে চেয়েছে। মীরার জন্য কি ছেলের অভাব হবে দেশে?

সেদিন রাতটা থেকে পরদিনই নিজ বাড়িতে চলে গেছে মীরা৷ বুকে পাথর বেঁধে ফিরেছে স্বাভাবিক ব্যাস্ততা মূখোর জীবণে। জীবণের সকল ঝড়ের মতো এবারেও সামলে উঠেছে মীরা, তবে কোথায় যেন একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে বুকের ভিতরে । যে ক্ষত দেখ যায় না, কিন্তু অনেক যন্ত্রণার উদ্রেক করে মনে।

মীরার মা প্রথম প্রথম প্রতিদিন একবার করে দেখতে যেতো আবীরকে। পরে আবীর কিছুটা সুস্থ হলে তাকে প্রতিদিন এত কষ্ট করে এতদূর আসতে নিষেধ করে। জাহানারা এখন প্রতিদিন না গেলেও ফোনে খোঁজ নেয় নিয়মিত। ধীরে ধীরে সবাই যার যার জীবণে স্বাভাবিক, আবীর, মীরা, ইরা, জাহানারা।

আবীরের উপর হামলার ঐ ঘটনার বিস্তারিত বিপুলের কাছে জানার পর মীরা আবীরের অপারেশন এর পরপরই গিয়েছিলো সায়ানের কাছে। ওকে অবশ্য বাড়ি পায় নি মীরা, ওর মা বলেছে দুদিন আগে নাকি ব্যাংকক গিয়েছে ও। তার মানে ঘটনার পরদিন দেশ ছেড়েছে ও। এতে করে এ ঘটনা যে সায়নেরই কাজ তা পরিষ্কার হয় মীরার কাছে। সায়নের মা মীরাকে স্বান্তনা দিতে চাইলেও মীরা কিছু চলে গেছে সেখান থেকে। এরপর মীরা সোজা গিয়েছে সায়নের বাবার অফিসে। মীরা তাকে সব খুলে বলে তাকে, সাথে এ-ও বলে যে এ ঘটনার একটা বিহিত তাকে করতে হবে, এবং তিনি কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপে না হলে আইনের দারস্থ হতে বাধ্য হবে ও তাও বলে মীরা।

তিনি মীরার সবটা শুনে সায়নের উপর রেগে আগুন হয়ে যান। তার সামনে ইলেকশন, এর মধ্যে এসব ঝামেলা। তিনি শান্ত হয়ে মীরাকে কথা দেন ব্যাপারটা তিনি নিজে দেখবে। মীরা তাকে সাতদিন সময় বেঁধে

দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

চট্টগ্রামে ঐ আতর্কিত হামলার জন্য অজ্ঞাত ব্যাক্তিকে

দায়ী করে সেখানে মামলা করে আবীরের চাচারা। এত বড় ঘটনা ঘটে গেলো, হাসপাতালেও থাকতে পারলো না কেও, মামলাটা করে তারা তাদের দায়িত্বের সবটুকু পালন করে ফেলেছে যেন। যদিও এসব মামলা করতে নিষেধ করেছিলো আবীর। কারন এ ঘটনার সাথে মীরাও জড়িত, এতে করে মীরার সমস্যা হতে পারে ভেবে আবীর সব জেনেও ব্যাপারটা চেপে গেছে। একটু সুস্থ হওয়ার পর চাচাকে অনুরোধ করে মামলা তুলে নিতে বলেছিলো আবীর৷ আবীরের দুই চাচা খুব হম্বিতম্বি করলো ওর এমন অনুরোধে। বাড়ি বয়ে এসে এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে যাবে, আর তারা বসে থাকবে? সাথে এও বলে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা তা তারা দেখে নিবে।

সত্যি বলতে আবীরের চাচারা এ ঘটনাটাকে বিরোধীদলীয় লোকেদের কার্যকলাপ বলে পাবলিক সেন্টিমেন্ট তাদের দলের পক্ষে নিতে চাইছিলো। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবীর খুব কষ্ট পায়, সবাই সবার স্বার্থ নিয়ে ব্যাস্ত৷ এদিকে অসুস্থ আবীরকে দেখার লোক নেই কিন্তু ঐদিকে এই মামলার ব্যাপারে থানায় যেয়ে এসে দিন কাটছে তাদের।

সত্যি কত্ত অসহায় আবীর!

আবীর এখন দেয়াল ধরে ধরে একা হাঁটার চেষ্টা করছে। বুকের ক্ষত পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে। হাতের হাড় জোড়া ধরেছে।পায়ের হাড় জোড়া নিতেই সময় লাগছে। শরীরের সব ভর বহন করে কিনা তাই তাকে বশ মানাতে সময় লাগছে আবীরের। তবুও হাল ছাড়ে না আবীর। চেষ্টা চালিয়েই যায়। নিয়ম করে দু’বেলা হাঁটে ও।

এদিকে মীরার এলসি সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাংকে যায় মীরা। যাবতীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও সমস্যা কেন হচ্ছে তা জানতে চায় ও। তার এর কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি। ঐদিন মীরা ব্যাংকে থাকা অবস্থায়ই ব্যাংক ম্যানেজারের কেবিনে একজন লোক আসে। ম্যানেজার বসা থেকে দাঁড়িয়ে তেলতেলে গলায় বসতে বলেন তাকে। পাশে তাকিয়ে মীরা দেখে লোকটা আর কউ নয় রাজিবের বন্ধু মিলন।

মীরাকে দেখে কেমন একটা হাসি হাসে মিলন, সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে উঠে দাড়ায় মীরা তখনই নিচু গালায় মিলন বলে-

: “শুনলাম ঢাকা থেকে লোক চট্টগ্রামে গিয়ে তোমার স্বামী, আইমিন তোমার প্রথম স্বামীর উপর নাকি এ্যাটাক করেছে? ”

অগ্নিদৃষ্টি চেয়ে থাকে মীরা মিলনের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে- “আপনিও আছেন এসবের মধ্যে ?”

ক্রুর হাসি হেসে মিলন বলে-

: “তুমি বলেছিলে না আমাকে তোমার মনে থাকবে, আমি তো সেই ব্যাবস্থাই করছি” কথাটা শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মীরা মিলনের দিকে, তারপর আর এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না মীরা। চেয়ারে রাখা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরে সেখান থেকে।

সেখান থেকে বের হতেই ফাহাদের কল আসে ওর ফোনে। ফাহাদ মীরাকে জলদি কারখানায় আসতে বলে। মীরা কল কেটে আচ্ছন্নের মতো রিকশায় করে কারখানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ ফাহাদ না বললেও ওর কন্ঠস্বর খারাপ কিছুর আভাস দিচ্ছে ওকে। কারন ইদানীং ওর বাইরের প্রোডাক্ট সেলিং বিজনেসটা ভালো চললেও ম্যানুফ্যাকচারিং বিজনেসটা ডাল যাচ্ছে। এলসি সমস্যার জন্য সময়মতো মালামাল আনতে পারছে না বাইরে থেকে, তারজন্য দেশ থেকেই বেশী দামে কিনতে হয়েছে কাঁচামাল, রয়েছে তৈরী মালামাল বায়ারদের কাছে পৌঁছানোর অনিশ্চয়তাও সবকিছু মিলিয়ে মীরা দিশেহারা যেন।

কারখানায় পৌঁছে মীরা জানলো ওদের সুইজারল্যান্ড ইউরোপের স্বনামধন্য একটা কম্পানি যা ওদের কারখানার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ডিল ছিলো সেটা ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে। মাথায় বাজ পরে মীরার। এই কাজটার জন্য স্পেসিফিক কাপড় রিলে রিলে কিনে স্টক করেছে ওদের কারখানার স্টোর রুম, বাসার অফিসঘর সহ দুটো রুমে। এমনকি মীরার বাসার ডাইনিং ও দখল সেই কাপড়ের রিলে।

তৎক্ষনাৎ মীরা কল করে ঐ কাজ যার মাধ্যমে পেয়েছিলো তাকে। আনোয়ার সাহেব জানান পার পিস মাত্র ২৫ পয়সা রেটের পার্থক্যে কাজটা হাতবদল হয়ে গেছে।

মীরা রাগারাগি করে বলে দেখেন ব্যাপারটা ২৫ পয়সার না, ব্যাপারটা ভরসার, বিশ্বাসের। এত কম টাকার পার্থক্য এ যাবৎকালে আমি দেখি নি। অফিসিয়ালি কাজটা আমি পেয়েছি, এটা তো আমারই করার কথা। লোকটা রাগান্বিত কন্ঠে বলে-

: “টেন্ডারের কাজটা আমি পেয়েছিলাম মীরা, আমি যেখানে কম পাবো সেখান থেকেই করাবো, তুমি দেখছো ২৫ পয়সা, আর আমি এটাকে গুন করছি ৭ ডিজিটের সংখ্যা দিয়ে”

মীরা শান্ত গলায় বলে-

: “পার পিছ ২৫ পয়সা লাভ করে কত আয় হবে আপনার? আমার স্টক করা মালামালের দাম তারচে বেশী এবং কাজটা না পেলে ক্ষতির অংকটা দাঁড়াবে তারচেয়েও বেশী”

: “দেখো মীরা আমার এতকিছু বোঝার দরকার নাই, তুমি কাজটা পাচ্ছো না এটাই ফাইনাল ”

: “আমি ৩০ পয়সা কম নিবো আমার দেয়া রেটের থেকে, কাজটা আপনি আমাকেই দিন”

: “মীরা তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, আশাকরি বুঝবে ব্যাবসার অনেক কিছু আমাদের হাতের বাইরে থাকে। ৩০ পয়সা কেন, অর্ধেক কম মজুরিতেও কাজটা পাবে না তুমি, বাকীটা বুঝে নিও, আর আমাকে ভুল বুঝো না”

বলেই কলটা কেটে দেয় আনোয়ার, মাথায় বাজ পরে যেন মীরার। এই কাপড় গুলো ও স্পেসিফিক এই কাজটার জন্য কিনেছিলো। এই এত এত জার্সি কাপড় দিয়ে মীরা কি করবে? ওর নিজের কারখানার কাজও লেডিস ড্রেস নিয়ে সেখানে এসব কাপড়?

আর কত পরীক্ষা নিলে খোদার পরীক্ষা নেয়া শেষ হবে

ভাবতেই চোখ ফেটে পানি পরে ওর। কোনকিছু না বলেই বাড়ি ফিরে যায় ও। বাসায় ফিরে দেখে নূহা মাজেদা খালার সাথে মেঝেতে বসে পান খাচ্ছে। ওকে অসময়ে দেখে ভড়কে গেলো নূহা। কারন নূহাকে এসব চা-পান খেতে মীরা নিষেধ করে দিয়েছে আরো আগে থেকে। নূহা খুব বুদ্ধিমতী কন্যা মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো নিজের দোষ ঢাকতে। ব্যাপারটা বুঝেও হজম করলো মীরা। ভিতরকার কষ্ট দূর করতে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে আষ্টেপৃষ্টে। চোখ ভেঙে পানি বেরুলো ওর। জীবণে সবকিছু পেয়ে এভাবে যখন নষ্টই হবে তবে কেন এলো এসব আমার জীবণে? মনে মনে ভাবে ও।

মেয়ের কাঁধে গরম পানির স্রোত বয়ে যাওয়ায় মেয়ে মীরাকে ছেড়ে বলে-

: “মা, তুমি দুঃখ পেয়েছো? আমি আর পান চাইবো না মাজেদা আপার থেকে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও মা”

মীরা মেয়ের কপালে চুমু আঁকে, তারপর নূহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে থাকে কিছুক্ষণ। মাজেদা খালা অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে। মীরা মেয়েকে কোলে করে নিজের ঘরে চলে যায়। যাওয়ার আগে মীরা খালাকে বলে-

: “এসব ওকে দিয়েন না খালা”

মাজেদা খালা এতক্ষণ ভয়ে ছিলো মীরার কথাটা অস্বাভাবিক ঠেকলো তাঁর কাছে৷ তারচে বরং সবসময়ের মতো রাগারাগি করলে বোধহয় শান্তি লাগতো তার। সবকিছু ভুলে বিকেলে মায়ের বাসায় যায় মীরা। ইরাও আসবে আজ। খাওয়া দাওয়ার পর ব্যাবসার বিষয়ে আলাপ করতেই ইরা বলে-

: “ওরা তোকে একা পেয়ে এমন নাচনটা নাচাচ্ছে, ভেবেছে মেয়ের বাপ নেই, বড় ভাই নেই, স্বামী নেই এর সাথে যা খুশি করা যায়। আজ যে কাজটা আনোয়ার করলো তা নিঃসন্দেহে অন্যায়। কিন্তু প্রতিবাদ করার জন্য মীরার একার কন্ঠ এত লোকের ভীড়ে ক্ষীণ শোনাবে। মুখলেস চাচা অসুস্থ হপয়ায় তাকেও এসব জানাতে চায় না মীরা। অনেক তো করলো লোকটা না চাইতেই। আর জ্বালাতন করতে চায় না ও তাকে।

মীরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চায়ের কেটলির দিকে, তারপর বলে-

: ” আমি আমার অনিবার্য পতন দেখতে পাচ্ছি ইরা, সাইড বিজনেস না থাকলে আমি এতদিনে 0 হয়ে যেতাম৷ নদীতে থেকে পানি নিয়ে সমুদ্রে ঢেলছি। যতই ঢালছি অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে তা লবণাক্ত পানির ভীড়ে। আমি এখন কি করবো বল? সব টাকা এই কাপড় কেনায় ইনভেস্ট করেছি আমি এখন শূন্য”

: “বিপদে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে শান্ত থাকা, মাথা ঠান্ডা রাখ, আল্লাহ নিশ্চয়ই একটা ব্যাবস্থা করে দিবেন”

মীরা কাপ হাতে তখনো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুর্কি সিরামিকের সাদা নীল বাহারী কাজ করা কেটলির দিকে।

সেদিন বেশ কিছু বিষয়ে নিয়ে কথা হয় মীরার ইরার সাথে, নূহার কথা বলার ধরন, বাজে অঙ্গ ভাঙ্গি, চা-পান খাওয়া লক্ষ্য করে মীরা। সবটা শিনে ইরা বলে

এতদিন নূহা ছোট ছিলো এখন ও বড় হচ্ছে, তার মানে এই না যে মাজেদা খালার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।

নূহাকে নিজে সময় দেয়ার পরামর্শ দেয় ইরা। মীরাও এমনটাই ভাবছিলো যে নূহাকে আর পুরোপুরি মাজেদা খালার জিম্মায় রাখা ঠিক হবে না, দুদিন পর স্কুলে যাবে এমনটা হতে দিতে থাকলে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে। মীরার সব কূলই তো গেলো। অন্তত মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলে মীরার সব দুঃখ ঘুঁচে যাবে।

কথায় কথায় আবীরের প্রসঙ্গ উঠলো মীরা বললো- : “আমি কিছু শুনতে চাই না ইরা”

ইরা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ মৌণ দুজনেই, তারপর স্তব্ধতা ভেঙে মীরা বলে-

: “ইগো কি আমার কম ছিলো বল? আমার নিজেকে খুব হীন মনে হয় এ মানুষটার সামনে তার ঐ ইগোর জন্য ”

ইরা বারন সত্ত্বেও বললো-

: ” এটা তার ইগো না আপা৷ আমি কল করেছিলাম তাকে, তিনি বলেছেন –

‘তিনি সহায়সম্বলহীন, পঙ্গু মানুষ, তুই তারচেয়ে ভালো

ডিজার্ভ করিস'”

আবীর মীরার ভালো চাচ্ছে, কিন্তু মীরাকে চাচ্ছে না।

মীরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় ইরার দিকে, একটু পর ইরা দেখলো মীরার চোখে নিচটা চিকচিক করছে, কিন্তু মীরার তাতে লুকানোর কোন চেষ্টা নেই। শেষটায় ইরাই মীরার সামনে থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। মীরা সোফাতে আর ইরা বারান্দার গ্রীলে হাত রাখা, দুই বোনেরই চোখে জল।

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

কিভাবে যেন মীরার ব্যাপারটা মোখলেস সাহেবের কান অবধি পৌঁছে যায়। তিনি ব্যাপারটা নিয়ে আনোয়ারের সাথে কথা বলেন। আনোয়ার মোখলেস সাহেবকে সমীহ করে তবে এ বিষয়ে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করতে তাকে অনুরোধ করে তিনি। ফোন রাখার আগে তিনি মুখলেস সাহেবকে বলেন –

: “মেয়েটার সাথে এমন হচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করতে বা বলতে পারছি না, অদৃশ্য শেকলে হাত বাঁধা বলে। তবে ওকে আপনি সাবধান করে দিয়েন, সামনে ওর অনেক বিপদ”

মোখলেস সাহেব চিন্তায় পরে যান। তিনি নিজে বিছানায় পরা, তার ছেলেরাও শান্তি প্রিয় কারো কোন সাতে পাঁচে কখনোই থাকে না। এ ব্যাপারে ওরা কিছু করতে চাইলেও কেও ওদের কথা আমলে নিবে না। মেয়েটা এত কষ্ট করে এতদূর অবধি পৌঁছে আজ হেরে যাবে কিছু দুষ্ট লোকেদের বিপরীতে?

মীরাকে এসবের কিছুই বলেন না তিনি। ওর প্রতি হওয়া অন্যায়টাকে চেপে গিয়ে উল্টো ভরসা আর সাহস দেন লোকসান সামলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। লাভ লোকসান মিলিয়েই ব্যবসা, তাই তো খোদা হালাল করেছেন ব্যাবসাকে। মীরা বুঝে যে এ পথের যাত্রায় ও একা।

সেদিনই মীরা সব কাগজপত্র আর মালামাল স্টকের প্রমাণ নিয়ে সায়নের বাবার কাছে যায় এসবের সুরাহা চাইতে। তিনি এই সকল প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দ দেখভাল করার লোক বলে না, বরঞ্চ তিনি ওর অনিষ্টকারী সায়নের পিতা বলে। প্রথমটায় সবকিছু দেখে তিনি ব্যাপারটা দেখবেন বলে এড়িয়ে যান, আজ নাকি বিজিএমইএ এর সভাপতি নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করা শুরু হবে। প্রথম মনোনয়ন পত্রটা তাকেই নিতে হবে, তাই তার এতো তাড়া। কথাটা শুনে রেগে যায় মীরা, বলে-

: “আজ সবে শুরু মনোনয়ন পত্র সংগ্রহের, আরো দশ দিন সময় আছে তা সংগ্রহ করার, এমন তো না যে প্রথমটা নিলে কিছু ভোট বেশী পাবেন আপনি। আগের ব্যাপারটাও আপনি দেখছি বলে হোল্ড করে রেখেছেন, আপনি আপনার দিকটাই কেবল বুঝছেন, বুঝেছি আপনার সাথে কথা বলে কোন লাভ হবে না, আমাকে যেখানে গেলে লাভ হবে সেখানেই যেতে হবে”

মীরার এমন কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন তিনি। বলেন-

: “কতোবড় স্পর্ধা তোমার, তুমি জানো কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো?”

মীরা চড়া কন্ঠে জবাব দেয় –

: “হ্যা আমি জানি, আমি বিজিএমইএ- এর সাবেক সভাপতির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যে তার মানসিক বিকলাঙ্গ ছেলের সকল অপকর্মের প্রশ্রয়দাতা”

মীরার রাগান্বিত মুখ দেখে তিনি তরল সুরে বলেন-

: ” বুঝতে কেন পারছো না সামনে ইলেকশন, এসব দেখাবার সময় এখন আমার নেই, আমাকে সময় দিয়ে সাহায্য করো, নির্বাচন হোক তারপর…. ” কথাটা তাকে শেষ করতে না দিয়ে মীরা বলে-

: “সাবেক সভাপতি হয়েই সময় নেই ছেলের অপকর্মের সুরাহা করবার, সভাপতি নির্বাচিত হলে যে আপনি বদলে যাবেন না তা কে জানে?”

: ”মীরা তুমি বাড়াবাড়ি করছো, আমি তোমাকে স্নেহ করি বলে এখান অবধি আসতে পারো তুমি। তা নাহলে এতক্ষণে… ”

: “ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন তো?”

: “ইউ ক্রস ইউর লিমিট, গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার। আর হ্যা ঠিক ধরেছো কিছুই করবো না আমি, যা পারো করো গিয়ে”

বলেই মীরাকে তার কেবিনে রেখেই বেরিয়ে পরেন তিনি। মীরা যেন চোখে অন্ধকার দেখে। এমন শত্রুর সাথে লড়বে সে শারিরীক কিংবা আর্থিক সামর্থ্য ও ওর নেই।

বাড়ি ফিরে মীরা কেবল এসবই ভাবতে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে কিনা ভাবে তা-ও। কিন্তু তাদের সাথে লড়বে কিভাবে ও?

এমনি ভাবনয়া জর্জরিত মীরার কাছে পরদিন ফোন আসে জাহানারার, তিনি জানান যে এখন তিনি আবীরকে দেখতে হসপিটালে আছেন। আবীর নাকি পরে গিয়ে ভাঙা পায়েই চোট পেয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুদিন আগে, আজ কিছুটা সুস্থ হয়ে খবরটা জানাতে ফোন করেছে নাকি ও জাহানারাকে।

মীরা মনে মনে হোয়াটস্ নেক্সট?

জাহানারা মেয়ের কথা না বুঝে জিজ্ঞেস করলো

: ” কিহ্?”

মীরা কিছু নাহ্ বলে ফোন রেখে যায়।

মায়ের ফোন রাখতেই মীরার বাসায় পুলিশ আসে, প্রথমটা ঘাবড়ে যায় মীরা৷ পুলিশ যেন ওকে ঘাবড়ে দিতেই এসেছিলো। এতদিন ধরে ব্যবসা করছে, কেউ কোনদিন ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেট দেখতে কারখানায় আসে নি, আজ সোজা ওর বাসার ঠিকায় পুলিশ এসেছে এসব দেখতে। মীরা বুঝে এসব ওকে হয়রানি করা ছাড়া কিছুই না।

সেদিন মন বিক্ষিপ্ত থাকায় কোথাও যায় না মীরা৷ পরদিন সকালে মীরা মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে কোন হসপিটালে আছে আবীর । মায়ের সঙ্গে কথা শেষ করে বাসা থেকে বেরিয়ে মীরা আবীরকে দেখতে হসপিটালে যায়।

হাসপাতালে মীরাকে আসতে দেখে মুচকি হাসে আবীর, যার মানে হয়তো-

: ” এসেছো তুমি?”

মীরাও কোন কিছু না বলে উত্তরের বিনিময় করে হাসিতেই। একটু দূরে থাকা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করে-

: ” হাসপাতালে কি খুব ভালো লাগে থাকতে যে আবার চলে এলেন তারাহুরো করে? ” উত্তরে আবীর স্বাভাবিক ভাবে বলে-

: “হ্যা খুব ভালো লাগে, আমার সেবার কারার একজন, খাবার খাওয়ানোর জন্য একজন, ডাক্তারের কাছে দৌড়ানোর জন্য একজন রয়েছে, এত লোক আমাকে আগলে রাখার তাই প্যাম্পারিং পিরিয়ডটা বাড়াতেই..”

: “হুম, বুঝেছি” বলে মৌণ হয়ে যায় মীরা।আসলে আবীরের যে দেখার কেউ নেই তাই যেন ওর কথায় ফুটে উঠলো করুন ভাবে।

আবীর বিষয়টা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ এড়াতে মীরাকে জিজ্ঞেস করে –

: তারপর কি অবস্থা ব্যবসার ”

উত্তরে মীরা বলে-

: ” আমার বিগ 0 হওয়ার কাউন্টডাউন স্টার্ট হয়ে গেছে”

ব্যাপারটা শুনে কেমন চমকে উঠে যেন আবীর। তারপর বলে-

: “ব্যাপারটা কি জানতে পারি কি? ইফ ইউ হ্যাভ নো প্রবলেম ”

কোমল দৃষ্টিতে তাকায় মীরা আবীরের দিকে। তারপর একে একে সবটা খুলে বলে ওকে। পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শোনে আবীর। মাঝখানে কোন কথা বলে না, সবটা শুনে তারপর বলে-

: “নিঃসন্দেহে ওরা পাওয়ারফুল লোক, তা না’হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে একজনকে এভাবে মেরে আসতে পারে? ”

এবার একটু নড়েচড়ে বসে মীরা, মীরার ডিটেইলিং এ আবীরের উপর হামলার ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে মীরা। লোকটার সামনে ও এমনিতেই নিজেকে ছোট অনুভব করে তাই ব্যাপারটা চেপে গেছে। কিন্তু হাতে নাতে ধরা পরে মীরা যেন আরো একটু গুটিয়ে গেলো নিজের মধ্যে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আবীর বললো-

: “হুম, বুঝেছি”

: ” গতকাল বাসায় পুলিশ এসেছিলো”

অবাক হয়ে আবীর জিজ্ঞেস করলো –

: “কেন?”

মীরা হেসে উত্তর দিলো-

: “ট্রেড লাইসেন্স দেখতে”

উত্তর শুনে আবীর ও হেসে দেয়, তাতে যোগ দেয় মীরাও।

: “শোন ব্যাপারটা ফানি হলেও এসব ঘটনা আদতে অন্য কিছুর ইঙ্গিত। আমার মনে হয় তোমার সামনে এখন দুটো পথ খোল-

১. ওদের কাছে ধরা সায়ী হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, আর

২. নিজেকে ওদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী গড়ে তোলা৷

মীরা অবাক হয়ে বলে- ১ম পথটা আমার জানা, কিন্তু ২য় পথটা অসম্ভব, আমি ফিন্যন্সিয়ালি পুরোপুরি ব্রোকেন অবস্থায় আছি, সামনের মাসে স্টাফদের বেতন কারখানা ভাড়া জোগাড়েই ঘাম বেড়িয়ে যাবে আমার।

মুচকি হেসে আবীর বলে-

: ” এত এত বিপদ দেখছো তুমি? আর আমি দেখছি একটা গ্রেট অপার্চুনিটি”

: “গ্রেট অপার্চুনিটি?”

: “ইয়েস”

মুখ তুলে আবীরের দিকে মীরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-

: ” কি সেটা?”

: “হোয়াই আর ইউ নট পার্টিসিপেটিং ইন ইলেকশন?”

: “হোয়াট? মাথা ঠিকাছে আপনার?”

: “আপাততঃ এই পা-টা ছড়া বাকী সবই ঠিক আছে আমার”

মীরা হেসে দেয় আবীরের ফানি কথা শুনে, তারপর বলে-

: ” এই নির্বাচনে মানুষ কেন আমাকে ভোট দিবে?”

: ” সাবেক সভাপতির দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, তার ছেলের ক্ষমতার অপব্যবহার এসব সকলের জানা। মনে মনে সবাই ক্ষুব্ধ তাদের প্রতি,
তাদের এসব উইক পয়েন্ট গুলো তুলে ধরা আর তোমার সাথে করা অন্যায় হাইলাইট করলে ভোটাররা তোমার পক্ষে যাবে। আরেহ্ আমার পা ভাঙার ভুয়া ইস্যু দিয়ে বড় চাচা ইলেকশনে জিতে গেলো আর তোমার সাথে করা সত্যি অন্যায়টাকে ঢাল করে লড়তে পারবে না? সবাই সবটা জানে, বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি গতবারও জিতেছে, এবারও সম্ববতঃ তুমি না দাঁড়ালে বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাবেন তিনি”

মীরার হঠাৎ মনে পরে তার স্ত্রী বলেছিলেন -ছেলের পুত্রবধূ হওয়ার পর এই চেয়ারে মীরাকে বসাতে চান তিনি” দ্যাটস মীন মীরার মধ্যে সে কোয়ালিটি আছে”

তখনি আবীর বলে-

: “দেখো এতগুলো টাকা লোকসান খেলে, প্রতিনিয়ত ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছো তাদের দ্বারা, তোমার আর হারাবার আছে কি? নিজের ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তোমার শেষ চেষ্টাটা অনন্ত করো উচিত।

আবীরের চোখে তাকায় মীরা। আবীর মাথা ঝাঁকিয়ে ভরসা দেয় ওকে, যে তোমার এটা অবশ্যই করা উচিত।

মীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে

: ” আচ্ছা আমি ভেবে দেখবো”

এরপর সন্ধ্যা হতেই আবীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে মীরা। সন্ধ্যার পরের সময়টুকু এখন থেকে মেয়ের জন্য বরাদ্দ বলে ঠিক করেছে মীরা। তবে মেয়ের সাথে ব্যাস্ত থাকলেও আবীরের পরামর্শ মাথায় খেলতে থাকে অঙ্কের মতো।

এর দু’দিন পর মাঝ-রাতে মীরার কাছে খবর আসে কারখানায় কিভাবে যেন আগুন লেগে গিয়েছে। মীরার তে হাত-পা ঠান্ডা অবস্থা। ওরা মীরাকে শান্ত হতে বলে জানায়- কারখানায় রাতে থাকা কর্মচারীরা আগুণ তৎক্ষনাৎ দেখে ফেলায় এ যাত্রায় আগুন নিভাতে সক্ষম হয় ওরা। কথাগুলো শুনে ভিতরকার কাঁপন স্বাভাবিক হলেও রাগে শরীর কাঁপতে থাকে, দাঁত কিড়মিড় করে বলে-

: ” তোদের বাপ-ছেলেদের সত্যি আমি দেখে নিবো, আমার হারাবার কিছুই নাই, সব শেষ করে দিয়েছিস তোরা এবার হয় তোরা ধ্বংস হবি নাহয় আমি”

চলবে…………

প্রিয় ভুল পর্ব-৮১+৮২+৮৩+৮৪

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)।

পুরো রাতটা এক রকম নিদ্রাহীন কেটেছে মীরার। নিজের সাথে দ্বন্দ্ব চলে পুরোটা সময় জুড়ে। একটা দিন কেটে গেলো নানান ব্যাস্ততায়। আবীর আগামীকাল ঢাকা ছাড়বে, এটাই অবশিষ্ট সুযোগ ওর হাতে।

হঠাৎ করে ওর নানীর বলা একটা কথা মনে পরে। তিনি বলতেন ভাল কাজে অনেক বাঁধা। আবীরের মুখোমুখি হতে তাই হয়তো এত কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে ওকে। ভাগ্য ওকে নিয়ে যতই খেলুক এর শেষ দেখতে চায় মীরা।

শেষরাতে তন্দ্রার মতো অনুভূত হয় ওর। তবুও ঘুমায়না ও, এই ঘুম কাল হয় যদি। আবীর কাল যাবে এটা জানে, কিন্তু কখন যাবে তা জানে না৷ শত চেষ্টা করেও মীরা ফিওনার সাথে কনটাক্ট করতে পারে নি, এ বিষয়ে জানতে। দূরদেশে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময়ের যাত্রা।

তাই মীরা কোন প্রকার রিস্ক নিতে চায় না। সকালটা কোনমতে হলেই আবীরের বাসায় যাবে ও। এটা ওকে পারতেই হবে। আবীরের উত্তর হ্যা/না যাই হোক শেষ অবধি ওর মুখোমুখি না হতে পারলে সারাজীবন একটা গিল্টি ফিল কুড়ে কুড়ে খাবে ওকে। উত্তর যদি না ও হয়, মনে স্বান্তনা থাকবে নিজের সামর্থের সবটুকুো চেষ্টা করেছে ও।

আরো একটা রাত ভোর হওয়ার অপেক্ষায় ও। ফজরের আজান হতে এখনো বাকী ভেবে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ও। মনে গোপন ভীতি থাকার কারনে এর আগে কখনো তাহাজ্জুদ পড়া হয় নি ওর। কোন জ্বী*ন নাকি আসে তাহাজ্জুদ পড়ার সময়। তবে ও এটাও
শুনেছে যে তাহাজ্জুদ এতোই মর্যাদাপূর্ন যে, এ নামাজ পড়া ব্যাক্তির দোয়া লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আল্লাহ তাআলা তাহাজ্জুদ পড়া ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন। তার দোয়া কবুল করেন।

ভগ্নহৃদয় নিয়ে আল্লাহ মুখী হয় মীরা। নামাজের সিজদায় কান্না করে সব যন্ত্রনার কথা ভেবে। আল্লাহর সাহায্য চায় ও এসব থেকে পরিত্রান পেতে। নামাজ শেষ হতেই ফজরের আজান শুরু হয় চারিদিকে। মীরা ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে সকাল হওয়ার। ভোরের প্রথম আলো ফুটলে ঘরের ঘড়ির দিকে তাকায় ও। সকাল সাড়ে পাঁচটা বাজে। তৎক্ষনাৎ মাজেদা খালাকে মেয়ের পাশে থাকতে বলে বেরিয়ে পরে ও। রিকশা কিংবা সিএনজি খুঁজে সময় নষ্ট করতে চায় না ও। তাই গ্যারেজে নিজের স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে যায় আবীরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মীরা থাকে ধানমন্ডি, আবীরদের সাবেক বাড়ি পুরান ঢাকায়।

নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা মেডিকেল কলেজ পরিয়ে, একে একে বংশাল, নয়াবাজার, ইংলিশ রোড, ধোলাইখাল পেরিয়ে কাঠের পুলের দিকে গেলো স্কুটিটা। সেখান থেকে ধুপখোলা বাজার, ধুপখোলা মাঠ ছেড়ে ১৩ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে পুকুর পাড়ের দিকে মুভ করলো। শীতের সকাল, পথে কোন প্রকার ঝামেলা পোহাতে হলো না ওকে। তাই ইচ্ছে করেই অনেকটা পথ ঘুরে এলো ও। কত বছর পর এলো এদিকটায়। মীরার ভীষণ অবাক লগলো ১৩ নম্বর বাসস্ট্যান্ড না দেখে। একজনকে জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন বাস স্টপিস নাকি অনেক বছর হলো উঠে গেছে এখান থেকে।

রাস্তা বেশ ফাঁকা বিশ মিনিটের মধ্যে ও পৌঁছে গেলো আবীরের এলাকায়। এখানে কত এসেছে ও মায়ের হাত ধরে মনিকা আন্টিদের বাসায় বেড়াতে, সে অনেক বছর আগের কথা, কত বদলে গেছে চারপাশ।
গলি পেরিয়ে রাস্তার বাঁক ঘুরতেই বিশল ঝোপের বাগানবিলাস ওয়ালা একটা গেইট দেখলেই ওরা বুঝতো যে মনিকা আন্টিদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা। ঐ বাগান বিলাশ গেইট বিশিষ্ট বাড়িটা ছিলো ওদের কাছে ল্যান্ডমার্ক। এখন সেখানে উঠেছে বিশাল বিল্ডিং। মীরা কেমন ভড়কে যায়। ওর স্মৃতিতে থাকা মনিকা আন্টির বাড়িটা ভেঙে যদি নতুন করে কোন বিল্ডিং তৈরি করা হয় তাহলে তো মীরা নতুন বাড়িটা চিনতে পারবে না। স্কুটি একটা বিশাল সাইড করে রেখে হাঁটতে থাকে মীরা। ঘড়িতে সময় এখন ছয়টা। একটু হাঁটতেই মীরা পেয়ে গেলো মনিকা আন্টিদের বাড়ি। খুশিতে পানি চলে আসলো চোখে যেন বাড়ি খুঁজে না ও পেয়ে গেছে আবীর নামের গোটা মানুষটাকে। ওর এ আনন্দ অমূলক না। খুব কাছের কোন বন্ধুর সাথে অনেক বছর পর দেখা হলে আপনি যখন দেখবেন বন্ধুটি আগের মতোই রয়েছে, একটুও বদলায় নি, তখন ঠিক এই আনন্দটাই আপনার হবে।
তবে একটা জিনিস বেশ ভালো লাগলো ওর, জায়গাটা
আধুনিকতায় ছেয়ে গেলেও এখনো বেশ নিরিবিলিই আছে আগের মতো।

আশেপাশের অনেক জৌলুশ পূর্ণ বাড়ির ভিড়ে এ বাড়িটা যেন নির্মোহের প্রতীক। সামনে বিশাল জায়গা রেখে তৈরী করা বাড়িটা এখনো তেমনি রয়েছে। অথচ অনেকেই এরচেয়ে কম জায়গায়ও পাঁচ তলা বাড়ি বানিয়ে বসে আছেন।

এত বছর পরেও বাড়িটাকে আগের মতোই দেখবে ভাবেনি ও। কাছে গিয়ে লোহার ফটকটায় হাত রাখলো ও। আগে এই দরজাটা হলুদ রঙের ছিলো। এখন এতে ধূসর রঙ দিয়ে পেইন্ট করা হয়েছে।

দরজা ঠেলতেই দেখে বাড়ির মেইন দরজা খোলা। মীরা ভীত মন নিয়ে পকেট গেইটটা খুলে ঢুকলো বাড়িটাতে।
একটা দমকা বাতাসের সাথে আসা মিষ্টি গন্ধ এসে অভ্যর্থনা জানালো ওকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ও, চোখ বুলাতে থাকে পুরো বাড়িটায়। দোতলা বাড়ি, মস্ত পাকা উঠোন, আর বিশালাকার গাছগুলো।

আগে বাড়ির সামনের অংশটায় বাগানের মতো ছিলো। মনিকা আন্টির গাছ ভিষণ পছন্দ ছিলো৷ এখন তিনি নেই তাই বাগান যে থাকবে না তা তো সোজা হিসেব । তবে বিশালকার আমগাছটা এখনো মাথার উপরে দাঁড়ি আছে ছায়া হয়ে। আম গাছটার কাছে গিয়ে মীরা গাছটাকে আলতো করে ছুয়ে দিলো ও আঙুল দিয়ে৷ অনেকদিন পর কাছের কাওকে দেখে ছুয়ে- “কিরে? কেমন আছিস? “- জিজ্ঞেস করার মতো। একটু এগুতেই পেয়ারা গাছ। এ গাছটা খুব ছোট ছিলো, মীরা যখন এসেছিলো। কিশোরী বয়স ছিলো তার, এখন সে মধ্যবয়সী পৌঢ় যেন। উত্তুরে বাতাসের দমকে ডাল পাতাগুলো নড়ে উঠলো, কেমন একটা শব্দ হলো তাতে, ঠিক যেন ষোড়শী তরুণীর খিলখিল হাসি।

সামনে এগুতেই মীরা দেখলো বাড়ির ভিতরের দরজা হাট করে খোলা, দেখে মীরার মনটা উচাটন হয়ে উঠলো, এত সকালে দরজা খোলা? চলে গেলো না তো? দ্রুত দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। এর কথা ফিওনা বলেছে মীরাকে। তিনি আবীরের দূর সম্পর্কের আত্নীয়। আবীরের বাবা মারা যাবার পর বৃদ্ধ ছেলেদের কাছ থেকে বিতারিত হয়ে তিনি এ বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন। তার দায়িত্ব এ বাড়ি আর আবীরের দেখাশোনা করা।

মলিন মুখ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন-
: “কাকে চাই?”
মীরা তোতলানো স্বরে বলে-
: “আ…আবীর ভাইয়া আছেন?”
: ” হুম, আসুন ভিতরে আসুন….”
মীরা ভয় পেয়ে ছিলো কেন, কি দরকার এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন, কিন্তু সহজে বসার ঘর অবধি পৌঁছে মনে সাহস জন্মালো ওর। বৃদ্ধ বললেন –
: “আপনি বসুন আবীর মর্নিং ওয়াক শেষে গোসলে গেছে এক্ষুনি এসে পরবে”

এত শীতের মধ্যেও মীরার ঘাম হতে শুরু করে, সেন্টার টেবিলে থাকা পানির জগ থেকে পানি নিয়ে পুরোটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মীরা। বুকের মধ্যে ধুকপুকানির শব্দ ও শুনতে পাচ্ছে যেন। মনটাকে অন্য দিকে ডায়ভার্ট করে ও। খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে ঘরের আসবাব। আদিকাল থেকেই আবীরের পরিবার বনেদি ছিলো। আবীরের বাবার প্রেসের ব্যাবসা ছিলো।
তখনকার সময় থেকেই সব আধুনিক জিনিস, আসবাবপত্র দেখা যেতো ওদের বাড়িতে।

মা বলতো এদিকটায় যখন ভাড়া থাকতেন তারা একমাত্র ওদের ঘরেই রঙিন টিভি, ফ্রিজ, এসি, টেলিফোন ছিলো। দূরে দূরের লোকেরা এসে জড়ো হতো টিভি দেখতে৷ জত কত লোক বিদেশ থেকে ফোন দিতো ওদের ফোনে। আবীরের মা ছিলেন খুবই মিশুকে। সবার সাথে আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো তার। তাই আভিজাত্যের তফাৎ কখনওই সম্পর্কের জন্য দেয়াল হয়নি মীরা দের সাথে।

হঠাৎ মীরার মনে হলো ২য় তলার এ বসার ঘরে বসে জানালা দিয়ে পুকুর দেখা যেতো আগে। কথাটা মনে হতেই সেদিকটাতে তাকালো ও। না, এখন আর আগের মতো পুরো পুকুর দেখা যায় না। বিশালাকার আম গাছের একটা অংশ এ ঘর থেকে দেখতে পাওয়া পুকুরটাকে ঢেকে দিয়েছে এত বছরে একটু একটু করে।

বসার ঘরের বড় দেয়ালে নানান ওয়ালম্যাটের পাশাপাশি পারিবারিক ছবি টানানো, ফিওনার বিয়ের সময়কার ছবি। হাস্যজ্জ্বল বধূ বেশী ফিওনার দুই পাশে বাবা মা, আর পেছনে মৃদু হাসিতে আবীর দাঁড়ানো বোনকে আগলে ধরে আছে। কি সুন্দর পারিবারিক ছবি। কিন্তু ছবির তিনজনই আবীরের কাছ থেকে এখন অনেক দূরে। আবীরকে একলা করে দেয়ার খেলাটা শুরু হয়েছিল মীরাকে দিয়ে, তারপর মনিকা আন্টি চলে গেলেন এক বর্ষার রাতে। আবীরের বাবা বেশ কিছু বছর সঙ্গ দিয়েছে ছেলেকে। যখন মা*রা গেলেন, বয়স নব্বই বছর ছুঁইছুঁই, আর কত? তিনিও চলে গেলেন অগ্যস্ত যাত্রায়। ফিওনা চলে গেলো স্বামীর কাছে। আবীর একা এত বড় বাড়িটায় থেকে কি করবে? তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার। আপনজন কেও নেই এখানে, এত বড় শহরটা খুব ভারী হয়ে গেছে তার জন্য।
ব্যাবসা গুটিয়ে কেন যাচ্ছে? এমন প্রশ্নে এই উত্তর ছিলো ফিওনার। এমন সময় হঠাৎ বাথরুমের দরজা খেলার শব্দ কানে এলো। সামান্য এ শব্দেই সোজা হয়ে বসল মীরা। এক জোড়া পা চলে গেলো ভিতরের দিকের ঘরে। দুজন লোকের কথোপকথনের টুকরো আলাপ ম্লান ভাবে শোনা গেলো এখানে বসেই। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলো মীরা কয়েক গজ দূরের আবীরের জন্য।

মীরার মাথার শিরা দপদপ করছে ওর, হাত-পা ঘামছে বারবার। একটু পরপর ও মুখ মুছছে, ঘোমটা টানছে। এ এক অন্য রকম ভীতি। “পৃথিবীর সকল ভীতি দুষ্ট লোকেদের বিপরীতে হয়, কিন্তু ভালো লোকের বিপরীতে যে ভীতির উদ্রেক হয় তা ভীষণ কঠিণ আর ভয়ংকর। এর বর্ননা করার ভাষার জন্ম পৃথিবীতে আজও হয়নি।

আরো এক গ্লাস পানি ঢাললো মীরা। মনের অস্থিরতায় হাত কেঁপে টেবিলের উপর পানি পরে গেলে খানিকাটা। মীরা সেটা অগ্রাহ্য করে পানির গ্লাস মুখে দিতেই দরজায়র চৌকাঠে দাঁড়ালো থ্রি – কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি শার্ট পরা আবীর৷ পানি খাওয়া রেখে উঠে দাঁড়ালো মীরা৷

আবীর!
“খুব তারাতাড়ি দেখা হবে আমাদের ” বলা সেই আবীর। অথচ জীবণ দুজনকে মুখোমুখি করতে সময় নিলো বারো বছর, মানে এক যুগ!

বেশ চমকানো দৃষ্টিতে মীরার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলো আবীর, দৃশ্যপট যে কোন ভ্রম নয় তা নিশ্চিত হতেই আবীর জিজ্ঞেস করলো-
: “কি ব্যাপার?”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার মাথার শিরা দপদপ করছে ওর, হাত-পা ঘামছে বারবার। এ এক অন্য রকম ভীতি। “পৃথিবীর সকল ভীতি দুষ্ট লোকেদের বিপরীতে হয়, কিন্তু ভালো লোকের বিপরীতে যে ভীতির উদ্রেক হয় তা ভীষণ কঠিণ আর ভয়ংকর। এর বর্ননা করার ভাষার জন্ম পৃথিবীতে আজও হয়নি।

আরো এক গ্লাস পানি ঢাললো মীরা। মনের অস্থিরতায় হাত কেঁপে টেবিলপর উপর পানি পরে গেলে খানিকাটা। মীরা সেটা অগ্রাহ্য করে পানির গ্লাস মুখে দিতেই দরজায়র চৌকাঠে দাঁড়ালো থ্রি – কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি শার্ট পরা আবীর৷ পানি খাওয়া রেখে উঠে দাঁড়ালো মীরা৷

আবীর!
“খুব তারাতাড়ি দেখা হবে আমাদের ” বলা সেই আবীর। অথচ জীবণ দুজনকে মুখোমুখি করতে সময় নিলো বারো বছর। মানে এক যুগ!

বেশ চমকানো দৃষ্টিতে মীরার দিকে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলো আবীর, দৃশ্যপট যে কোন ভ্রম নয় তা নিশ্চিত হতেই আবীর জিজ্ঞেস করলো-
: “কি ব্যাপার?”

মীরা উত্তর দেয়া ভুলে গিয়ে তাকিয়ে আছে আবীরের দিকে। ওর চৌকাঠে পা দেয়ার সাথে সাথে মিষ্টি একটা সুবাস পুরো ঘরের দখল নিয়েছে। সদ্য গোসল শেষ করা আবীরের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কপালের দিকে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে চুলগুলো ভালো ভাবে মোছা হয়নি, এখনো ভেজা।
দীর্ঘদেহী আবীরের দাঁড়ানো দৃঢ়, দৃষ্টি স্বচ্ছ, চোয়াল শক্ত, চোখেমুখে বিরক্তি ভাব এতই প্রকট যে চেহারায় বিরক্তির চেয়ে রাগি ভাব ফুটে উঠেছে বেশী মাত্রায়।

অপর প্রান্তে কোন প্রকার উত্তর না পেয়ে দরজায় টোকা দিলো আবীর। সেই শব্দে সংবিৎশক্তি ফিরে পেলো যেন মীরা। কাচুমাচু করে, দৃষ্টি স্থানান্তর করলো আবীরের থেকে মাটিতে। যেখানে আজ নিজের ব্যাক্তিত্ব, সম্মান গুড়িয়ে পরেছে আবীরের সামনে। কি বলবে মীরা উত্তরে? তার খোঁজ চালায় মনের গভীরে। ঘরে দিকে এক কদম এগিয়ে আবীর চোখমুখ কঠিন করে বললো-
: ” তুমি এখানে?”
এবার কিছু না বললেই নয়, মীরা ওর থেকে চোখ সরিয়ে তোতলানোর মতো করে বলে-
: “আপনি নাকি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আজ?”
আবীর চোখমুখ আগের মতোই শক্ত রেখে বলে-
: “তো?”
এবার মীরার মন ক্ষুন্ন হয় একটু, এ প্রশ্নেই উত্তর হওয়া উচিত ছিল হ্যা কিংবা না। তা না বলে উনি বললেন “তো…?”
মীরা আবীরের এমন এটিটিউট হজম করে বলে-
: ” আসলে….
আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি ”
: ” তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই”
: ” বেশী সময় নেবো না, অল্প কিছু কথা…”
কথাটা শেষ করতে পারে না মীরা৷ আবীর চোখমুখ আগের চেয়েও শক্ত করে বলে-
: “তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে, সময় কোনটাই আমার নেই। সাড়ে আটটায় আমার ট্রেন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে”

এক ফাঁকে ঘড়ি দেখে নেয় মীরা, সকাল ০৬:৫০ বাজে ঘড়িতে। মীরা অসহায় মুখ করে আবীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আবীরের দৃষ্টি অন্যদিকে।

আবীরের মীরার দিকে না তাকানোর সামান্য এই কাজটুকুতে যে ওকে কত্তখানি অগ্রাহ্য মিশানো তা ঠিক টের পায় মীরা। এসবের জন্য আগে থেকেই তৈরীই ছিলো ও । এগুলো ওর ঋণ, আবীরের কাছে। মনে সাহস রেখে মীরা আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে-

: “আমি জানি, আমি যা করেছি তাতে আমার প্রতি আপনার এই বিরক্তি যৌক্তিক। কিন্তু আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আমার কথাগুলো প্লিজ একটু শুনুন”

আবীর দাঁড়ানো থেকে ঘরের ভিতরে ঢুকে মীরার ঠিক বিপরীতে সোজা হয়ে বসে। তারপর বলে-
: “বলো, কি বলবে তুমি?
আমার ভুল হয়েছে,
আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন?
এগুলোই তো?

তোমার মতো মেয়ের প্রতি কোন রাগ, ঘৃণা, অভিমান কিছুই নেই আমার। আর ক্ষমার কথা বলবে তো, সেটার তো প্রশ্নই আসে না, কারন তুমি ক্ষমার অযোগ্য। তুমি একজনকে বিয়ে করলে, তাকে ডিভোর্স না দিয়েই অন্য আরেক জনকে বিয়ে করলে পরদিন, যা মনে চাইলো তাই করলে। ঠিক ভুল, ন্যায়, অন্যায় কিছুই চিন্তা করলে না। চাইলে আমি আইনি জটিলতার ফাঁদে ফেলে তোমার জীবন নরক করে দিতো পারতাম। কিন্তু আমি তা করি নি। আমি তো দয়া করেছিলাম তোমাকে”

কথাটা শুনে আবীরের দিকে তাকায় মীরা। এত শক্ত কথা জানে আবীর? জানবে নাই বা কেন? কতকিছু ফেইস করতে হয়েছে ওকে, এক মীরার জন্য। ক্ষণকালের বিরতি শেষে আবীর আবারো বলে-

: “আমি বিয়ের আগে দেখা হওয়ার সময় বার বার তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমার এ বিয়েতে মত আছে কিনা? উত্তরে কি বলেছিলে তুমি আমাকে? বলো?

মীরার মনে পরে সে দিনের কথা। উত্তরে কি বলেছিলো স্পষ্ট মনে পরে তা-ও।

আবীর তখনো বলতে থাকে-
: “তোমার মনে যখন অন্য কিছু ছিলো তাহলে কেন তুমি বিয়েটা করলে?, কেন আমার জীবণটা নষ্ট করলে? কেন সমাজের চোখে হেয় করলে আমাকে? আজ বারো বছর পর তোমার মনে হলো তুমি ভুল করেছো, তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত? তুমি এলে আর আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিবো ভেবেছো? হুহ্”

তাচ্ছিল্য মাখা এই ধ্বনিটা উচ্চারিত করে আবীর মনের উচাটন দূর করতে পুকুর দেখতে পাওয়া সেই জানালার দিকে তাকায়, পরিষ্কার, শান্ত পুকুর। ক্রমাগত বাতাস তার গায়ে আলপনা এঁকে দিচ্ছে যত্ন করে। অপরপ্রান্তে বসে মীরা তখনো কাঁদছে মাথা নত করে। আজ ওর শুনবার পালা যেন।

একটু পর আবীর বলে-
: ” তোমার জন্য ঐ বিয়েটা ছিল নাথিং ,
কিন্তু কখনো কারো দিকে না তাকানো আমার কাছে ঐ বিয়েটাই ছিলো এভরিথিং” তুমি চলে যাও, আমার কোন কথা নেই তোমার সাথে, ক্ষমা চাইতে এসেছে তো? যাও দিলাম ক্ষমা করে। সুখে থাকো তুমি”

ক্রন্দনরত কন্ঠে মীরা বলে-
: “আমি জানি যে আমি আপনার কাছে সত্যি লুকিয়ে অনেক বড় অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি বলতে চেয়েও বলতে পারি নি। বাবা-মা ইচ্ছে করেই আমাদের দেখা করার দিনে ইরাকে সাথে দিয়েছিলো যাতে আমি কি বলি তা তারা ইরার কাছে শুনতে পারে। আর আমি যদি সেদিন সত্যিটা বলতাম ও বাবা-মাকে সব বলে দিতো। সে ভয়ে আমি….. কান্নার দমকে কথাটাও শেষ করতে পারে না মীরা। নিজেকে সামলে নিয়ে ও আবারো শুরু করে-

: “আমার বাবা-মা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে রাজি করিয়ে ছিলো। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি আপনার জীবন নষ্ট করতে চাই নি।

কথাটা শুনে যেন আবীর জ্বলে উঠলো। বিরক্ত কন্ঠে বললো-
: ” কি বললে? জীবন নষ্ট করতে চাই নি! হুহ্
কিন্তু করেছো তো? একটা নির্দোষ মানুষের জীবণ থেকে সব রঙ কেড়ে নিয়েছো তুমি। কোন অপরাধ না করেও সমাজের কাছে আমাকে, আমার পরিবারকে কত ছোট হতে হয়েছে, কত কথা শুনতে হয়েছে তা তুমি জানো? কেন? কি অপরাধ ছিলো আমার? আমার পরিবারের? বলো?, জবাব দাও?” রাগে আবীরের চোখমুখে যেন আগুন বেরুচ্ছে৷ কপালের কাছের শিরা ফুলে গেছে।

মীরা কাঁদতেই থাকে৷ সত্যি একটা নির্দোষ মানুষের জীবণকে নরক করে দিয়েছে ও। এ ভুল ক্ষমার অযোগ্য। তবুও মীরা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে-

: “ঐ রাতে শুধু আংটি পরানোর কথা ছিলো, পর দিন আমি পালিয়ে যাবো৷ কিন্তু আপনার মা কাজী ডেকে এনে সেদিন রাতেই বিয়েটা করিয়ে দিলেন। বিয়েটা যে এত জলদি হয়ে যাবে আমি তা ক্ষুণাক্ষরেও টের পাইনি”

দুই হাতে মুখ চেপে মীরা বলতে থাকে-

: “যে ভুল আমি করেছি তার চেয়ে হাজার গুন শাস্তি আমি পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি। আপনাকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজে ও কখনো সুখী হইনি, না পেয়েছি সম্মান, না ভালোবাসা। আপনার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ পরিবার থেকেও পরিবার ছাড়া হয়ে ভেসে বেরিয়েছি। সংসার বলতে যা ছিলো তা একাই টেনে নিতে হয়েছে আমাকে। যার জন্য এতকিছু করেছি তার প্রতারণর স্বীকার হয়েছি। এখানেই শেষ নয় এসবের শাস্তি স্বরূপ নিজের বাবাকেও শেষ বারের মতো দেখতে দেয়া হয় নি আমাকে। এরচেয়ে বড় শাস্তি কি আছে পৃথিবীতে? ”

এবার যেন একটু থমকে গেলো আবীর। সত্যি মীরার জীবণের উপর দিয়ে কি ঝড় গেছে তা তো আবীরের অজানা নয়। দূর থেকে সবই জানে ও।

মীরা কান্না থামিয়ে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে। আবীর এবার মীরার দিকে তাকায় একপলক। ওর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার গল্প আবীরের জানা। আটপৌরে পোশাক পরিহিত মীরার চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি, চোখের নিচে নিদ্রাহীনতার ছাপ স্পষ্ট । তবুও এসব খুঁত যেন ম্লান মীরার সৌন্দর্যের কাছে। হঠাৎ আবীরের নজর পরে মীরার ওড়না দিয়ে চোখ মোছা হাতে। কিছুক্ষণের জন্য সময় যেন থমকে যায় ঐ হাত জোড়ায়।

গতকাল এয়ারপোর্টে ফিওনার বর বিদায় নেয়ার আগে আবীরকে বলেছিলো – “মীরা আপনার জীবণে ফিরে আসতে চায়। ও এলে ওকে ফিরিয়ে দিয়েন না। ইগো, আত্মসম্মান এসবের তলে ভালো থাকা, সুখে থাকাটাকে চাপা পরতে দিয়েন না। কতদিন আর একা থাকবেন বলেন? মানুষ বাঁচে কতদিন? ” উত্তরে আবীর কিছুই বলেনি। সত্যি বলতে পারে নি বলতে।

মীরা যে সত্যি ওর জীবণে ফিরতে চায় তা না বলেও বলে দিচ্ছে ওর হাতের চুড়ি গুলো। আটপৌরে এমন জামার সাথে এ চুড়ি বড্ড বেমানান। তাছড়া এ চুড়ির বেশ চল ছিলো এক যুগ আগে। এখন এমন চুড়ি পাওয়া যায় না, কাওকে পড়তেও দেখা যায় না। বিয়ের দিন প্রথম দেখা হওয়ার উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য নিজের পছন্দে শাড়ি আর চুড়ি কিনেছিলো আবীর। সেই চুড়ি গুলো চিনতে ভুল হয় না আবীরের। মীরার মায়ের বাড়ির আলমারিতে এতদিন অযত্নে পরে ছিলো চুড়িগুলো। প্যাকেট পর্যন্ত খোলা হয় এতদিনেও। ফিওনার সাথে দেখা করতে যাওয়ার দিন মায়ের বাড়ি আসবাবপত্র গোছগাছের সময়ে জিনিসটা নজরে পরে মীরার। সেদিনই ও ব্যাগে করে নিয়ে নিয়েছিলো চুড়ি জোড়া। আবীরের সঙ্গে অনাকাঙ্খিত সেই দেখা হওয়ার সময়ে চুড়ি গুলো মীরার ব্যাগেই ছিলো।

চুড়ি গুলো দেখে সব রাগ যেন পানি হয়ে যায় আবীরের। আনমনে বলে ফেলে-

: কেন করলে তুমি এমন, কি লাভ হলো এসব করে?
কেও তোমাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তুমি বেছে নিয়েছো দয়া”

চোখ মুছে মীরা মাথা নত করেই বলে-
: ” আরেকটা বার না হয় দয়া করুন আমাকে, নিজের ভুলটাকে শুধরে নিতে, যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো আমি”

আত্মসম্মানে দৃঢ় মীরার এ আত্মসমর্পণ ওর অসহায়ত্ব না, বরং অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আবীরের নিখুঁত ভালোবাসার কাছে বশ্যতা স্বীকার।

মীরার চোখে চেয়ে থাকে আবীর। যেন মীরার মনের ভিতরটা দেখবার চেষ্টা করছে ও।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

চুড়ি গুলো দেখে সব রাগ যেন পানি হয়ে যায় আবীরের। আনমনে বলে ফেলে-

: কেন করলে তুমি এমন, কি লাভ হলো এসব করে?
কেও তোমাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তুমি বেছে নিয়েছো দয়া”

চোখ মুছে মীরা মাথা নত করেই বলে-
: ” আরেকটা বার না হয় দয়া করুন আমাকে, নিজের ভুলটাকে শুধরে নিতে, যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো আমি”

আত্মসম্মানে দৃঢ় মীরার এ আত্মসমর্পণ ওর অসহায়ত্ব না, বরং অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে আবীরের নিখুঁত ভালোবাসার কাছে বশ্যতা স্বীকার।

মীরার চোখে চেয়ে থাকে আবীর। যেন মীরার মনের ভিতরটা দেখবার চেষ্টা করছে ও। সে চাহনিতে ভিন্ন কিছু ছিলো। বেশীক্ষণ চোখে চোখ রাখতে পারে না মীরা, ডুবে যাওয়ার ভয়ে সরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ বসে থেকে মীরা বলে-

: ” আমি জানি আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, আপনাকে পরামর্শ দেবার যোগ্যতাও নেই আমার। জোড় করে যে আপনার যাওয়া আটকাবো সে অধিকারও নেই। তবে যদি আপনি সুযোগ দেন আমার মতো অধমের করা ভুলে আপনার জীবণটা এভাবে যে এলোমেলো হয়ে আছে সেটাকে গুছাতে চাই আমি”

কপাল কুঁচকে আবীর রূঢ় কন্ঠে বলে-
: “তোমার জন্য জীবণ এলোমেলো তা কে বললো তোমাকে?”
: ” না, মানে…. ”
: ” তুমি কি ভেবেছো? তোমার দেয়া কষ্ট নিয়ে আমি দেবদাস হয়ে বসে আছি?”
: ” না, না, তা না”
মুখে না বললেও মীরা আবীরের দিকে চেয়ে মনে মনে বলে “আমি জানি আবীর আপনার সব কাগজপত্রে স্পাউসের জায়গায় এখনো আমিই আছি, কাগজপত্রে তো জায়গা দিয়েই রেখেছেন, এবার মনে একটু জায়গা দিলেই হয়”
: “বিয়ে একটা করতে হয়, করেছিলাম, এরপর কি হয়েছে তা আমার চেয়ে ভালো জানো তুমি, এখনো একা আছি এটা আমার চয়েজ”

এরপর ঘর জুড়ে নিরবতার দখল। শব্দের উপস্থিতি যা আছে তা উত্তুরে বাতাসের। হুহু করো বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। জানালার থাই গ্লাসগুলো তিরতির করে কাঁপছে বাতাসের দমকে।

মীরা সুতির একটা জামা পরে এসেছে, তারাহুরো করে আসায় গরম কাপড় গায়ে দিতে ভুলে গেছে বেচারী। আর এতক্ষণ ভয়, জড়তায় ডুবে থাকা মীরার হুঁশ ছিলো না শীত গরমের। এখন জানালা দিয়ে আগত বাতাসে কেঁপে উঠে মীরা। বাতাস থেকে বাঁচতে গায়ের ওড়নাটা সাবধানে টেনে নিলো গায়ে। আবীরের চোখ এড়ায় না মীরার বাতাস থেকে বাঁচার ব্যাপারটা।

কিছু সময় পর সোফা থেকে উঠে গিয়ে জানালাটার গ্লাস টেনে দেয় আবীর। ওর হাত গ্লাসে থাকা অবস্থায়ই মীরা বেহায়ার মতো বলে-
: ” এখানকার বাতাস থেকে নাহয় রক্ষা করলেন আমাকে, কিন্তু বাইরের সবকিছু থেকে…?”
সেখানে দাঁড়িয়েই আবীর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মীরার দিকে। না বলেও সে দৃষ্টি যেন বলছে অনেক কথা, বিবরণ দিচ্ছে অনেক অতীতের। মীরা তা দেখে মাথা নিচু করে ফেলে।

সেখান থেকে এসে সোফায় বসে আবীর। ঘড়ি দেখতে দেখতে ঝাঁঝালো গলায় বলে –
: “শেষ হয়েছে তোমার কথা? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মীরা। যত বেহায়াপনাই করুক, নিজেকে যত নিচেই নামাক, আবীরের দৃঢ় মন যে এক চুলও গলে নি তার টের পায় ওর কথার ঝাঁঝে। এখনো মাথা নিচু ওর। বেশ কিছুটা সময় পর মীরা ক্ষীণ কন্ঠে বলে-
: ” জীবণে সত্যের মুখোমুখি হয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত আমিও নিয়েছিলাম, কিন্তু একা থাকার চয়েজ আপনার জন্য যত সহজ তা আমার জন্য ততোটাই কঠিন। সৎ, সাহসী, আত্মনির্ভরশীল হয়েও আমার দিকে বাড়ানো লোভী, নোংরা হাত গুলোকে আমার প্রতিহত করতে হয়। ইদানীং এসব নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল এসব এড়িয়ে চলতে চলতে বড্ড ক্লান্ত আমি। নিজেকে ঐ লোভী মানুষগুলোর বিপরীতে এত ছোট, হীন মন হয় যে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নিজেকে নিঃশেষ করে দিই। মেয়েটার কথা ভেবে তা পারি না”
কথা গুলো বলে চুপ করে থাকে মীরা। সায়ানের অভদ্রতার কথা মনে করে চোখ উপচে পানি পরে ওর।
এসব নিয়ে সত্যি ও ভীষণ ডিসটার্ব আজকাল। নিরব কান্নার জল মুছে মীরা আবারো বলতে শুরু করে-

: “সবাই জানে আমি একজন সফল মানুষ, এ বয়সে আট-দশ জনের চেয়ে অনেক বেশী কিছু অর্জন করেছি আমি। এতকিছু পেয়েও ভিতরে ভিতরে যে আমি কতটুকু অপূর্ণ তার খোঁজ কেও রাখে না,
কথাগুলো শুনে আপনার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে আমি ভীষণ স্বার্থপর, এত বছর পর আজ নিজের প্রয়োজনে আপনার দুয়ারে এসেছি। ভাবতে পারেন, অনেক কে পাবো আমি আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য কিন্তু আমার মনে হয় আমার জীবণ পাজল এর মিসিং পার্টটা আপনার কাছে, আমি আপনাকে আমার পাশে চাই”

কথাটা বলে আবীরের দিকে তাকায় মীরা। কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেন্টার টেবিলে রাখা শো পিসটার দিকে। ঠিক যেন অতীতের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে ও সেখনটাতে। এত নিরবিচ্ছিন্ন মনযোগী সেখানে যেন মীরার কোন কথাই ও শুনতে পাচ্ছে না।

কিছুনসময় চুপ থেকে কেমন একটা ঘোরলাগা চোখে তাকায় আবীর মীরার দিকে, শান্ত মৌন কন্ঠে ও বলে-
: ” বিয়ের পরদিন তোমার মনে চাইলো তুমি চলে গেলে, এক যুগ পর এসে বললে আমার জীবণ পাজলের মিসিং পার্ট আপনার কাছে, মানে তোমার যখন যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই করছো, জীবণকে তুমি কি মনে করো? কোন খেলা? যে খেললে খেললাম না খেললে নাই? ঠিকই বলেছো তুমি আসলেই একটা স্বার্থপর। এতটা বছরে একটা বারও কি তোমার মনে পরেছে যে কেমন আছি আমি? আজ তুমি দুঃখ,কষ্টে আছো বলে আমাকে তোমার মনে পরেছে, আজ যদি ঐ ভদ্রলোকের সাথে সুখে থাকতে? তাহলে আমার কথা ভাবতে তুমি? কখনোই না। তাহলে আমি কেন তোমার ইচ্ছার পুতুল হবো বারবার?

কিছুটা সময় চুপ থাকলো আবীর, চোখ জোড়া আবার সেই শো পিস এ নিবন্ধ করে বললো-

: “আমার জায়গায় তুমি নিজেকে বসাও তো,
তুমি কি এত সহজে পারতে ব্যাপার গুলো মেনে নিতে। মাথা দুপাশে নেড়ে বললো- ” পারতে না” এত বছরে আমি আমার জীবণকে গুছিয়ে নিয়েছি, ঐখানে তোমার কোন জায়গা নেই”

কথাগুলো শেষ হতেই একটা লোক এসে দাঁড়ায় দরজার চৌকাঠে, লোকটা আবীরকে বলে
: “স্যার গাড়ি রেডি”
মীরাকে আর কিছু বলতে সুযোগ না দিয়েই উঠে পরে আবীর। ড্রাইভারকে বলে লাগেজ দুটো গাড়িতে তুলতে, বলেি নিজের রুমে গিয়ে তৈরী হয় বেরুবার জন্য।

মীরা সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে মুখ ঢেকে৷ ড্রাইভার আবীরের লাগেজ দুটো গাড়িতে তোলে। মিনিট তিনেক পর তৈরী হয়ে বের হয় আবীর৷ জিন্সের সাথে কালো হুডি পরেছে সে। পায়ে সাদা ক্যাজুয়াল কেডস। হাতে ওয়ালেট আর ঘড়ি, ঘড়িটা সম্ভবতঃ গাড়িতে বসে পরবে বলে হাতে নেয়া।

চাচাকে সব চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে ও। এমন ভাবে কথাগুলো বলছে যেন আবীর আর চাচা বাদে তৃতীয় কেউ নেই পুরো বাড়িতে। মীরা অপলক তাকিয়ে দেখে আবীরকে, আপাদমস্তক ব্যাক্তিত্ববান একজন মানুষ, এতকিছুর ভিতর দিয়ে গেলো ঐ ঘরে কিন্তু কত শান্ত মৌন ভাবে কথা বলছে সে চাচার সাথে।যেন কিছুই হয় নি। খুব কষ্ট হয় মীরার এই ভেবে যে এ মানুষটা ওর নিজের হতে পারতো। কিন্তু ও নিজেই এই ছেলেটাকে রিক্তহস্তে ফেলে এসেছে বিয়ের পরদিন-ই সেই এক যুগ আগে।

আবীরকে অপলক দেখতে দেখতে এসব ভাবছে মীরা। ও জানে যতটুকু ক্ষত ওর মনে এখন তারচে বেশী ক্ষত নিয়ে এতবছর একা আছে আবীর।

কথা শেষে চাচাকে আলিঙ্গন করে আবীর বিদায়ের আগে। বৃদ্ধ ঐ লোকটাকে ভীষণ হিংসে হয় মীরার। তার জায়গায় কল্পনা করে নিজেকে। কত ভাগ্যবান সে আবীর তাকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলো। এসব দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই যেন মীরার। তবে আশা একটা বার দয়া করে তাকায় যদি আবীর ওর দিকে…

কিন্তু………..
শেষ বারের মতো আবীর তাকায় ও না মীরার দিকে। কথা শেষ করে গটগট করে নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে। এ যেন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার শব্দ না, মীরার মনের নদীর পাড় ভাঙার শব্দ।

শেষ আশাটাও যখন ভেস্তে গেলো ওর, ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বেবা কান্নায় ফেটে গেলো বুকটা। তবুও অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায় ও ৷ ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি একধাপ নেমে দেখলো আবীরকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে আসা ফিওনাদের গাড়িটা বেরিয়ে গেলো মূল ফটক দিয়ে। চাচা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় দিচ্ছে ওকে। তার চোখেও পানি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই তা দেখলো মীরা। এ দৃশ্য দেখার পর সিঁড়িতেই বসে পরলো ভাঙা ইমারতের মতো । জীবণের একমাত্র ভুলটাকে সংশোধন করার চেষ্টায় এতদূর এসেও ও তা পারলো না।

“মানুষটা কোন সুযোগই দিলো না ওকে”।
বিরবির করে বলতে থাকে মীরা- “এটাই তোর শাস্তি মীরা, এই ভুলের বোঝা বয়ে চলবি তুই সারাজীবন।
এটাই তোর শাস্তি নিরপরাধকে কষ্ট দেবার, একটা পরিবারকে সমাজের চোখে হেয় করার”

বেশ কিছু সময় পর উঠে দাঁড়ায় মীরা, এখানে থাকলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে। আবীরের চলে যাবার দৃশ্য কুড়ে কুড়ে খাবে ওকে। তাই সাহস করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পরে ও। মেইন ফটক দিয়ে বেরুতে ধাক্কা খায় ও, শীতের দিন, তবুও তেমন ব্যাথা অনুভত হয় না ওর।

কাঁপা হাতে স্কুটিটাকে আনলক করে মীরা। জলদি বাড়ি যেতে হবে ওকে, জলদি। স্কুটিটা ধীর বেগে চলছে বাড়ির দিকে। মীরার চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে ঘন ঘন। মনের দ্বিতীয় স্বত্বাটা বলছে ওকে- “এত কাঁদার কি আছে? আবীরকে ছেড়ে আসার দিন তো খুব বিজয়ীর হাসি হেসেছিলে তুমি, তবে আজ কেন ওকে না পেয়ে কাঁদো? একযুগ আগের মতো আবীরও আজ তোমাকে রিক্তহস্তে ফিরিয়ে দিলো। এবাড বুঝো কিসের ভিতর দিয়ে গেছে ও, আর দুটো পরিবার।

গত কয়েক দিনের ক্লান্তি আর ঘুমহীন রাতের ধকলের সাথে আবীরের অবজ্ঞাটা যেন খুব ভারী হয়ে গেলো মীরার পক্ষে। যার ফলাফল হাটখোলা রোডে গাড়ি টার্ন নিতে গিয়ে বাসের সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে পরে গেলো ও। কোন যন্ত্রণাই হলো না ওর, পিচঢালা রাস্তায় পরে গিয়ে কেবল দেখলো কলকলিয়ে আসা গরম র*ক্তে*র সরু একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে কানের কাছ দিয়ে। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এলো ওর। শত চেষ্টায় ও চোখজোড়া খুলে রাখতে ব্যার্থ হলো ও।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৪

(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দীর্ঘ ঘুম ভাঙার পর মীরার যখন জ্ঞান ফিরলো ও নিজেকে তখন হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলো। বিছানার পাশেই মেঝেতে ওর মা নামায পড়ছেন। সময় কত তা বুঝতে চেষ্টা করলো মীরা।

চারপাশের নিস্তব্ধতায় মনে হচ্ছে ওর মা ফজরের নামাজ পড়ছেন। মীরা শোয়া থেকে উঠে বসতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। মাথা উঁচু করতেই তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা অনুভূত হতে লাগলো ওর মাথার বামপাশে, চারপাশ ঘুরতে শুরু করলো, শরীরটাও কেমন গুলিয়ে উঠলো, মীরা আর বসে থাকতে পারলো না, শুয়ে পরলো সাথে সাথে। বিছানায় শুয়েই মীরা ব্যাথার উৎস্য খুঁজতে মাথায় হাত দিলো। বুঝতে পারলো মাথায় ব্যান্ডেজ করা।

শুয়ে পরে মীরা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলে ও চারপাশের ঘূর্ণন থামাতে৷ কিছুক্ষণের তাকিয়ে থাকাই মনের উপর চাপ বাড়িয়েছে ওর। কিছু মনে পরছে না ওর। কি ? কেন? কিভবে? এই প্রশ্নের খোঁজ চলছে মনে মনে। একটু বাদেই সবটা মনে পরতেই চোখ গড়িয়ে নোনাধরা বয়ে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে উঠে –

: “আবীর….!”

নামাজ শেষ করে ওর মা দ্রুত মীরার কাছে আসে, মেয়ের মুখে,শরীরে হাত বুলিয়ে কেঁদে দেন তিনি।

দ্রুত যান ডাক্তার ডাকতে। ওর কেবিনের বাইরে অপেক্ষায় থাকা লোকটা মীরার জ্ঞান ফিরার কথা শুনে কেবিনে ঢুকে। মীরা বিছানায় শুয়েই দেখতে পায় তাকে। ধীর পায়ে কাছে আসে সে। তাকে আসতে দেখে মৃদু হাসে মীরা। সে হাসিতেও যন্ত্রণা অনুভব হয় ওর মাথায়। তবে মীরা সে হাসি থামায় না। হাসতে হাসতে চোখ বেয়ে পানি পরে। মীরার শিয়রের কাছে দাঁড়ায় সে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-

: ” আমি সরি মীরা”

মীরা মাথায় রাখা হাতটা ধীরে টেনে ওর দুইহাতে চেপে গালের সাথে ধরে রেখে বলে –

: “আপনি কেন সরি বলছেন? সরি তো বলবো আমি?” আই এম সরি আবীর! আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন, সত্যি আমি….” কথাটা শেষ করতে পারে না মীরা। মাথার যন্ত্রণায় চোখমুখ কুচকে পাশ ফিরে ও।

ক্ষীণ কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে মীরার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সায়নের চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। মীরার হাসি দেখে ওর মনের বোঝা হালকা হয়ে গিয়েছিলো এই ভেবে যে আবীরের কাছে কষ্ট পেয়ে সায়নকে বুঝি মেনে নিলো মীরা, কিন্তু অর্ধচেতন মীরা ওকে আবীর ভেবে কাছে টেনে নিয়েছে! হাত ছেড়ে সরে দাঁড়ায় সায়ন। যেন ৪৪০ ভোল্টের শক খেয়েছে । দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও মীরার যন্ত্রণা কাতর মুখের দিকে।

এমন সময় ডাক্তার আসেন কেবিনে। ভোর রাত হওয়ায় ডাক্তারকে ডেকে তুলে আনতে সময় লাগলো কিছুটা। ডাক্তার এসে মীরাকে পরীক্ষা করে, প্রেশার মাপতে মাপতে মীরাকে জিজ্ঞেস করেন- ব্যাথা এখনো আছে কিনা? মীরা ইশারায় ব্যাথার কথাটা জানালো ডাক্তারকে। ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলো খুব বেশী নাকি সহনীয়? মীরা মাথায় হাত রেখে কেমন একটা মুখভঙ্গি করলো, যাতে ডাক্তার স্পষ্ট বুঝতে পারলো যন্ত্রণার তীব্রতা। নার্সকে কি একটা বলে ওর মা জাহানারাকে জানালো প্রেশার ঠিক আছে, টেনশনের কিছু নেই, ব্যাথা লাঘবে হালকা ঔষধ দিয়ে দিচ্ছে। আরেকটা দিন উনি থাক এখানে, আগামী পরশু আপনারা তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। বলেই ডাক্তার চলে গেলো কেবিন ছেড়ে। তার আগেই বেরিয়ে গেলো সায়ন, ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও।

মাথায় ব্যান্ডেজ করায় ওকে দেখতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
কানের কাছে মাথায় আাঘতে ফেটে গেছে মীরার, রক্তক্ষরণ হয়ে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল ও। দীর্ঘ আঠারো ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো মীরার। ওর চেহারা ফুলে গেছে, চোখেমুখে যন্ত্রণা আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু এমন তৃপ্তির ঘুম মীরা শেষ কবে ঘুমিয়েছে তা ও জানে না। বেশ ভালো লাগছে ওর। মাথার যন্ত্রনাটা না থাকলে ও এখনি চলে যেতো বাড়িতে।

ডাক্তার চলে গেলে মীরার মা ফোন করে ইরাকে জানায় মীরার জ্ঞান ফিরার খবর। মীরা চোখ বন্ধ রেখেই ক্ষীণ কন্ঠে ওর মাকে নূহার কথা জিজ্ঞেস করলো। জাহানারা বললো- “নূহা মাজেদার কাছে আছে। হাসপাতালে ওকে আনা হয়েছিলো, তোকে ব্যান্ডেজ পরা দেখে আতংকিত নূহা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তাই ওকে বাসায় রাখা হয়েছে”

মীরা কিছুটা স্বস্তি পেলো, একমাত্র মাজেদা খলাার কাছে থাকলেই মীরা নিশ্চিন্ত থাকে। কারন নূহা খাওয়া, ঘুম নিয়ে মাঝেমাঝে খুব মর্জি করে। এত মর্জি সহ্য করে কেও ওকে খাওয়াতে কিংবা ঘুম পাড়াতে পারে না, এক মাজেদা খালা ছাড়া।

সকাল হতেই হালকা খাবার খেয়ে ঔষধ খেলো মীরা। কিছুক্ষণ পরেই আবার ঘুমিয়ে গেলো ও। শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি, এ ক্লান্তি উপেক্ষা করার শক্তি ওর নেই। এরমধ্যে সকালে মুখলেস চাচা, তার স্ত্রী, ইরা এসে দেখে গেলো ওকে। ইরা আর জাহানারার মধ্যে টুকটাক কথা কাটাকাটি হলো কেবিনের বাইরে। তাদের কথার বিষয়বস্তুু – “মীরার স্বামী হিসেবে আবীরের যোগ্যতা”

পক্ষের বক্তা মীরার একমাত্র বোন ইরা, আর বিপক্ষের বক্তা হিসেবে রয়েছেন মীরার মা-জননী জাহানারা। তিনি আবীরের অযোগ্যতা, দাম্ভিকতা, আর মীরাকে ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, আর ইরা বললেন এত বছর পর গিয়েছে ওকে নিয়ে নাচবে নাকি? ঠিকই করেছে ফিরিয়ে দিয়েছে, তুমি হলে তোমার ছেলেকে দিতে এমন মেয়েকে এত বছর পর মেনে নিতে। পরের বেলায় বলা সহজ, নিজেকে ঐ জায়গায় বসাও। তাহলেই উত্তর পাবে সব প্রশ্নের। এমন সময় সায়ন এসে পরায় দুই মা-মেয়ে চুপ মেরে যায়। সায়নে দেখে ইরার পিত্তি জ্বলে যায়। মনে মনে বলে-

: “এখানে এই আপদ এলো কোত্থেকে? ”

আবীরের মীরাকে ফিরিয়ে দেয়ার এ ঘনটানর পর জাহানারা পারেন তো সেন্সলেস মীরাকে এ অবস্থায়ই বিয়ে দিয়ে তুলে দেয় সায়নের হাতে৷ কিন্তু ধর্মে বিধিনিষেধ আছে এ বিষয়ে। বিয়ের সময় পাত্রপাত্রী দু’জনকেই বিয়েতে সজ্ঞানে সম্মতি দিতে হবে। কেবিনে তারা আছেন আর সায়ন ওয়েটিং রুমে।

এদিকে মোখলেস সাহেবও অসুস্থ, তবুও মীরার জ্ঞান ফিরবার কথা শুনে ঘরে থাকতে পারেন নি ইরার শ্বাশুড়ি রেবেকা । সাত সকালেই দৌড়ে চলে এসেছেন এ রোগী ঘরে রেখে। তবে খোঁজখবর নিয়ে ইরার শ্বাশুড়ি জাহানারার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ইরা এসব সহ্য করতে না পেরে হাসপাতালে থাকার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চলে যায় শ্বাশুড়ির সাথে। জাহানারা আটকায় না মেয়েকে। তিনি বরং পারলে এগিয়ে দিয়ে আসেন ইরাকে। ইরা বুঝতে পেরে খুব বিরক্ত হয় মায়ের প্রতি।

গতরাত থেকে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে সায়ন।সেখানে বসে মীরার খোঁজ খবর নিয়েছে ও। অপেক্ষা করেছে মীরার জ্ঞান ফিরবার৷ মীরার মা কিছুই লুকায় নি ওর কাছে। কোথায় গিয়েছিলো ও? কিভাবে কি হলো? সব। ব্যাপারটাতে জাহানারার একটা চালাকি আছে, তিনি এসব বললেন যাতে সায়ন ওকে অসহায় ভেবে আগলে ধরে মীরাকে। সায়নও মনে মনে খুশি ছিলো আবীর মীরাকে ফিরিয়ে দেওয়ায়। গোপন কৃতজ্ঞতাও ছিলো ওর আবীরের প্রতি। এবার মীরাকে পেতে ওকে আর ঠেকায় কে?

কিন্তু এসব কি হলো?

মীরার মনে এখনো আবীর?

খুব চিন্তিত দেখায় সায়নকে। কিছুক্ষণ বসে থেকে জাহানারাকে বলে বেরিয়ে যায় সায়ন।

———-

পর দিন বাড়ি ফিরে মীরা। শরীরের ধকল সামলে উঠলেও মনের ধকল এখন সামলে উঠতে পারেনি ও।

কাজে না ফিরলেও ফোনে ফাহাদ আর তমাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে নিয়মিত। বাসায় রেস্ট নেয়ায় মীরার শরীর কিছুটা স্টেবল এখন।

বাড়ি ফিরার বেশ কিছুদিন পর মীরাকে ফোন করে ফিওনা। এতদিন এসব কোনমতে ভুলে ছিলো ও। ফিওনার ফোন যেন লুকিয়ে রাখা বেদনার পাহাড় উন্মোচিত হলো ওর সামনে। অঝোরে কাঁদে মীরা ফিওনার সাথে কথা বলার সময়। মীরাকে স্বান্তনা দেবার ভাষা জানা নেই ফিওনার। ফিওনা জানায় এ বিষয়ে আবীরের সাথে কোন কথাই বলেনি ও। কারন ও প্রতিজ্ঞা করেছে এ বিষয়ে আর কোন কথা কোনদিন বলবে না। ফিওনা মীরাকে শক্ত হতে বলে। আর বলে ওর কথা বাদ দাও তুমি, দেশে কি ছেলের অভাব নাকি? মীরা উত্তরে ফিওনাকে কান্নারত অবস্থায় বলে-

: “তোমরা কি পেয়েছো আমাকে? একবার বলো আমি পারবো, আবার বলো দেশে কি ছেলের অভাব নাকি? আমি কি এত সহজে হার মানবো ভেবেছো? ঢাকা ছেড়ে গেছেন তিনি, দেশ তো ছেড়ে যায় নি, আর দেশ ছেড়ে গেলেই কি? আমি ঠিক তাকে খুঁজে নিবো ”

মীরার এ কথা শুনে এবার ফিওনার কান্নার পালা। কেঁদে কেঁদে ফিওনা বলে-

: “ঐ বেয়াদবটা তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, আর তুমি ওর কথা ভেবে কাঁদছো? ”

: “ফিওনা উনি এখনো আমাকে ভালোবাসে, আমি তা জানি”

: “এটা তো সবাই-ই জানে, এ আর নতুন কি? ভালো না বাসলে কেউ কারে জন্য এত বছর অপেক্ষায় থাকে? ”

: “তুমি একটু খাস মনে দোয়া করো আমার জন্য, তার অভিমানের দেয়াল আমি যেন ভাঙতে পারি”

ফোন রেখে থুম মেরে বসে থাকে মীরা। কিছুতেই মনের অস্থিরতা কাটছে না যেন।

সেদিন সন্ধ্যায় মীরাকে দেখতে ওর বাসায় আসে সায়ন। সায়নকে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মীরা ওকে রূঢ়ভাবে বলে বাসা থেকে চলে যেতে। সায়ন মাটি কামড় দিয়ে বসে থাকে। সায়নের মীরাকে জি*ম্মি করার ঐ ঘটনার পর এটাই ওদের প্রথম দেখা হওয়া। মীরা মনের রাগ ক্ষোভ সব ঝাড়ে ওর উপর।

সায়ন নিজেকে কুল রেখে মীরার সব কথা শুনে। শেষে কেবল একটা কথাই বলে- “মীরা সব সত্যি, কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনাকে বিয়ে করতে চাই এটাও সত্যি ”

এ কথা শুনে মীরা আর ধৈর্য রাখতে পারে না। বলেই ফেলে-

: “আমি আর যাই করি, তোমাকে কোনদিন বিয়ে করবো না এটা তুমি জেনে নাও। এখন বের হও আমার বাসা থেকে ”

এবার সায়ন আউট অব কন্ট্রোল হয়ে যায়, সেন্টার টেবিলে থাকা ফুলদানি ফেলে দিয়ে বলে-

: “মাথা ঠান্ডা রেখে অনেক কথা হয়ে, এবার খেলা হবে, হয় তুমি আমার হবা নয়তো তোমার জীবণ আমি জাহান্নাম বানিয়ে দিবো”

: ” তোমার যা মন চায় কোরো, এখন আমার বাসা থেকে বের হও”

বলেই দরজা খুলে দাঁড়ায় মীরা। সায়ন বাসা থেকে যাওয়ার আগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। মীরা ওর মুখের উপর দরজা আটকে দেয়। এতকিছুর মধ্যে সায়নকে মেনে নিতে পারছে না। এমনিই ও আকণ্ঠ ঝামেলায় ডুবে।

এরমধ্যে সায়ন!

পরদিন মীরার ব্যাংকে একটা জরুরি কাজ থাকায় ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বের হতে হয় ওকে। কাজ শেষ করে ফিরতেই ফোন আসে ফিওনার। কলটা রিসিভ কারা যাচ্ছে না, বারবার কেটে যাচ্ছে। মীরা ভাবে নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছে যেহেতু বাড়ি গিয়ে ওয়াইফাই দিয়ে কল করবে। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখে বাসায় ইরার ওর মা এসেছে, তারা আসবে বলে রেখেছিলো গতকাল। মীরা বাসায় এসে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে নাশতা তৈরি করছে তাদের জন্য। ভুলেই যায় ফিওনারকে কল ব্যাক করার কথা।

এমন সময় কার একটা কল এলে ফোনটা হাতে নেয় মীরা। কথা শেষে ফোন রাখতে গিয়ে দেখে হোয়াটসঅ্যাপ এ ম্যাসেজ এসে লোড হয়ে আছে। ভিতরে ঢুকতেই মীরার চোখ চড়কগাছ। ঘন্টা দুয়েক আগে এক গাদা ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে ফিওনা। জিব কামড়ে সেগুলো সীন করে মীরা। ম্যাসেজগুলো দেখে ওর পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেলো।

ম্যাসেজে ভাসছে র*ক্তা*ক্ত আবীরের ছবি, কে বা কারা যেন আবীরকে মেরে র*ক্তা*ক্ত করে ফেলে গেছে একা বাড়িতে। এসবই লেখা আছে তাতে। আবীরের অবস্থা গুরুতর দেখে ওকে ওর চাচারা আকাশপথে ঢাকায় আনছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। মীরা চুলা বন্ধ করে ফোন করে ফিওনাকে৷ ফিওনার ফোন এ্যাঙ্গেজ। ফোন করতে করতে মীরার কানে একটা কথা বাজতে থাকে- “হয় তুমি আমার হবা নয়তো তোমার জীবণ আমি জাহান্নাম বানিয়ে দিবো”
সায়ন!

চলবে……

প্রিয় ভুল পর্ব-৭৭+৭৮+৭৯

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

হাসপাতাল ভ্রমণের যাত্রা দীর্ঘ হয়েছিল সেবার। মীরা সুস্থ হতে না হতেই ইরাকে নিয়ে হসপিটালে এডমিট করতে হয়েছিলো। কন্যার মাতা হয়েছে আমাদের ইরাবতী । খোদা ঐ বাড়িতে প্রথম সন্তান হিসেবে কন্যা উপহার পাঠিয়েছেন। সকলের মনেই বাঁধ ভাঙা আনন্দ। সবচেয়ে বেশী খুশি মুরসালিন আর মোখলেস সাহেব। মুরসালিনের খুশি প্রথম বাবা হওয়ার জন্য হলেও মোখলেস সাহেব খুশি ছিলেন ভিন্ন কারনে।

ইরার শ্বাশুড়ি রেবেকার কন্যার মাতা হওয়ার ইচ্ছের চেয়ে মোখলেস সাহেবের কন্যার পিতা হবার ইচ্ছে বেশী ছিলো। তাই তো মীরার মেয়ে হতে চাওয়ার আবদারে তার মনের পাথর গলে পানি হয়ে গিয়েছিলো। শত্রু থেকে নির্নিমেষে হয়েছিলেন অভিভাবকহীন মীরার পিতা, শুভাকাঙ্ক্ষী। সেসব পুরাতন গল্প।

মেয়ের জন্ম হওয়ার পর দীর্ঘ হসপিটাল যাত্রা শেষে কোথায় ফিরবে ইরা তা নিয়ে দুই বাড়ির লোকেদের মধ্যে টানাটানি অবস্থা। ইরার মা জাহানারা চাচ্ছেন ইরাকে নিজের কাছে রাখবেন। কিন্তু ইরার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি এমনকি মুরসালিন ও কেউই তাদের ইরাকে এমন অবস্থায় বাপের বাড়ি যেতে দিবেন না। দুই পরিবারের এমন টানাটানির বিবাদ মিটায় মীরা।

মীরার মেয়ে নূহার জন্মের সময় তিনি দূরে ছিলেন। তাই ইরাকে কাছে রাখার ইচ্ছেটা প্রবল জাহানারার। মীরা ওর মায়ের বালিকা সূলভ আচরনকে পাত্তা না দিয়ে তাকে বুঝালেন তাদের পরিবারে প্রথম সন্তান আগমনের এমন বাঁধ ভাঙা আনন্দ মলিন না করতে। জাহানারা পরে বুঝেছেন, মেয়ের কথা মেনেও নিয়েছেন। মুখলেস সাহেব অনুরোধ করেছেন এই কটা দিন বেয়াইন সাহেবা যাতে তাদের বাড়িতে এসে অবশ্যই থাকেন।

এজ-ইউজুয়াল ডেলিভারি শেষে চারদিনেই বাড়ি ফিরে সকলে৷ কিন্তু ইরার মেয়ের কিছু জটিলতার দরুন ওদেরকে হাপিটালে থাকতে হয়েছে বারো দিন। যেই জটিলতার মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরলো ওরা, তা বলার মতো না৷ সব ঝামেলা মিটিয়ে ওরা সুস্থ ভবে বাড়ি ফিরেছে এই অনেক তাদের জন্য।

জাহানারা সব মান অভিমান ভেঙে ব্যাগপত্র গুছিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি রওনা হয়েছেন। দুই বাড়ি দৌড়াদৌড়ি তার জন্য বেশী চাপের হয়ে যাবে। এদিকে মীরারও সব কাজ শেষ করে ইরা আর নতুন বাবুকে দেখে আসতে সময় বের করতে হচ্ছে।

ইরার ডেলিভারির এত ঝামেলার মধ্যে সায়নের ব্যাপারটা একেবারেই মাথায় ছিলো না ওর। তবে ঝামেলা শেষে একদিন অফিসে এসে ডাকযোগে আসা একটা ইনভাইটেশন কার্ড দেখে চমকে যায় মীরা। সেটা খুললে দেখে একটা বড় বিদেশী অর্গানাইজেশনের ইভেন্টে একমাত্র বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মীরাকে তারা ইনভাইট করেছে। অথচ মীরা জানে ওর চেয়ে শতগুণ ভালো প্রতিষ্ঠান রয়েছে বাংলাদেশে যারা এটা পাওয়ার যোগ্য। সেদিক বিবেচনায় মীরা চুনোপুঁটি ও না। ইনভাইটেশন কার্ডটা পেয়ে মীরার মনে পরে সায়নের কথা। এটা ওরই কাজ। কার্ডাটাকে পাশে রেখে ফোন বুক থেকে একটা নম্বর খুঁজে বের করে তাতে কল করে মীরা৷ সালাম দিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে তার সাথে দেখা করতে চায় ও । তিনও জানান আজ বিকেলেই তিনি ব্যাক্তিগত কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছেন আসছে রবিবার দেশে ফিরবে। তিনি মীরাকে বললো মঙ্গলবার দেখা করতে৷ মীরার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় একসপ্তাহের ধাক্কা। অথচ দেখ করাটা জরুরি ছিলো। উপায়ন্তর না দেখে মীরা সালাম দিয়ে ফোন রেখে দেয়। তমা জিজ্ঞেস করে-

: “কাকে ফোন করলেন?”

: “বিজিএমইএ এর সভাপতি কে”

: “ইভেন্টের প্রস্তুতি শুরু করবো?”

মীরা তমার দিকে তাকিয়ে বলে-

: “আমরা এ ইভেন্টে যাচ্ছি না”

কেন তা জানতে চাইলো না তমা, মীরা আপু যখন বলেছে ভেবে চিন্তেই বলেছে। তাছাড়া তিনি বিস্তারিত বলার প্রয়োজন মনে করলে পরে তা অবশ্যই বলবেন। তাই তমার এত চাপ নেই জানার৷ তবে একটা বিষয়ে মনে কিছুটা জিজ্ঞাসা আছে ওর। সাহসের অভাবে তা পারছে না তমা৷ তা হচ্ছে – “বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত কোথায় ছিলেন মীরা আপু?

তার এমন অবস্থাই বা হয়েছিলো কিভাবে?

এমন সময় একটা ফোন আসে মীরার। মীরা ফোনটা তমাকে রিসিভ করতে বলে। আর বলতে বলে:

: ” বলবি মীরা আপু দেশের বাইরে আছে, দেশে আসলে আপনার কথা বলবো”

তমা ফোন রিসিভ করে বলে –

: “কে?”

ও পাশ থেকে সংকোচ মাখা কন্ঠে বলে-

: ” আমি দীপা”

: “কি ব্যাপার?”

: “এটা মীরার ফোন না?”

: ” হ্যা কি ব্যাপার?”

: ” উনাকে ফোনটা দিন একটু ”

: “মীরা আপু দেশের বাইরে আছে, এ সপ্তাহ পর ফিরবেন, তিনি দেশে আসলে আপনার কথা বলবো”

বলেই তাকে কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে ফোনটা রেখে দেয় তমা। ফোন রেখে তমা বের হতেই মীরা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে –

: “জিজ্ঞেস করলি না কে?”

: “বলার হলে তো আপনি নিজ থেকেই বলতেন”

মুচকি হেসে মীরা বলে :

: “আই লাইক ইট, বোস চেয়ার টেনে ”

তমা চেয়ার টেনে বসলে মীরা বলতে শুরু করে এই ফোন কলর পেছনের গল্প-

ইরার মেয়েকে কিছু সমস্যার জন্য ঢাকা শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হয়েছিলো। সেখানে দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম আমি আর মুরসালিন। ঐদিকে ইরা ছিলো হসপিটালে। একদিন বাসায় ফিরতে সিএনজি ধরতে শ্যামলী শিশু মেলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম । এমন সময়ে কেও একজন আলতো করে আমার কাঁধ হাত রেখে ডাকে আমাকে । চমকে ফিরে তাকালাম আমি, জীবণ আমাকে তো কম চমক দেখায় নি এটুকু বয়সে। ফিরে দেখি একটা মধ্যম গড়ণের সুন্দরী মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে৷ মেয়েটা সংকোচে বললো-

: “মীরা আমি আপনাকে চিনি, একটু কথা বলা যাবে আপনার সাথে?”

ঢাকা শহরে এমন কথা বলতে চেয়ে অনেকেই অনেক ধরনের অকারেন্স করে, তবে স্যালাইন আর ঔষধ হাতে থাকা বিশেষত্বহীন মেয়েটাকে আমার তেমন সন্দেহ হয় না। তাই আমি বললাম-

: ” জ্বী বলুন”

: “আপনি আমাকে চিনেন না, আমি দীপা, পুরান ঢাকার নবাবপুরে থাকি”

মীরা মনে মনে ভাবে “দীপা!”

মেয়েটা ক্ষণকালের বিরতি শেষে বলে

: ” আমার স্বামী সোহরাওয়ার্দী হসপিটালে ভর্তি আজ পনেরো দিন, একটা অপারেশন করাতে হবে, সরকারি হাসপাতাল তো সিরিয়াল পেতে সময় লাগছে তাই”

এ পর্যন্ত শুনে মীরা ভাবে হয়তো সাহায্য চাইতে এসেছে ও, কিন্তু এখন তো ওর কাছে সাহায্য করার মতো টাকা নাই। এসব সাতপাঁচ ভাবতেই মেয়েটা কেঁদে ক্ষমা চায় মীরার কাছে। মীরা প্রথমে বিরক্ত হলেও ওর নিপাট কান্না দেখে আপ্লুত হয় ওর মনও। তবু্ও শক্ত খোলসটা মুখে এঁটেই রেখে মীরা জিজ্ঞেস করে –

:” কাঁদবেন না, রোগ যিনি দিয়েছেন, নিরাময়ও তিনিই করবেন”

মেয়েটা চোখের পানি মুছে বলে-

: “আমি কাঁদছি অন্য কারনে”

: “অন্য কারনে?”

: “হ্যাঁ, আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে”

: “ক্ষমা! ”

: “হ্যা ক্ষমা, আসলে আপনার মন এত বড় যে আপনার সামনে দাঁড়াতেই লজ্জা হচ্ছে, কিন্তু নিজের ভুলের ক্ষমা চাওয়ার এমন সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করতে পারলাম না, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন ”

: ” ক্ষমা কেন চাইছেন তাই বুঝলম না, তাছাড়া আমি কোন বাজে কিছু সাথে নিয়ে বয়ে বেড়াই না, যা যখন হয় তা সেখানেই ক*ব*র দিয়ে সামনে এগিয়ে যাই, তা যদি না পারতাম তাহলে আজকের আমার বেঁচে থাকাটাই দায় হতো, এসব বাদ আপনি বলুন কেন ক্ষমা চাইছেন?”

: ” আপনি আমার স্বামীর জীবণ বাঁচিয়েছেন এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ, আর আমি আমার ব্যবহারের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি”

এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় মীরা, ও যেন একটু একটু করে চিনতে পারছে ওর সামনের দাঁড়ানো মেয়েটাকে।

মেয়েটা মীরার হাত নিজের দুই হাতে মুঠো করে কেঁদে ফেলে৷ বলে-

: “আসলে আমাদের কিছুই তো নেই, যেটুকুই তা ওর পাবে দাদা বাড়ি থেকে। সেদিন ওর বাবার সম্পত্তির ভাগিদার বাড়বে ভেবে আপনার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন করানোর জন্য ওর বাবার ভোটার আইডি কার্ড চেয়ে পাঠানো মহিলাকে আমি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, আমি এতই হীন, নীচ যে…. ”

কথাটা শেষ করতে পারে না দীপা। পথের মধ্যে কান্নায় ভেঙে পরে ও মীরার দুই হাত চেপে ধরে। মীরা ওকে স্বান্তনা দেয়, আর বলে-

: “আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন দীপা, ভালোই হয়েছে তা নাহলে শুধু একটা পরিচয় নিয়ে জীবন ভর…..। আমি চাইনা ওর ছায়া আমার মেয়ের জীবণে পরুক। আসি দীপা আপনাকে আমার মনে থাকবে”

বলেই সেখান থেকে একটা সিএনজি ডেকে উঠে পরেছিলাম আমি”

অবাক হয়ে তমা জিজ্ঞেস করে –

: “দীপা কি রাজিবের বর্তমান স্ত্রী? ”

মীরা রিভলভিং চেয়ারটায় শরীর ছেড়ে দিয়ে বলে-

: “হ্যা”

: “আচ্ছা গত মাসে বড় একটা এমাউন্ট ডোনেট করলেন এটা কি দীপার স্বামীর জন্য ছিলো?”

: “হ্যা ঐ টাকাটা নূহার বাবার চিকিৎসার জন্য দান করা হয়েছিল ”

কথাটা শুনে মীরার চোখের দিকে তাকায় তমা, মীরাকে পড়ার ব্যার্থ্য চেষ্টা করে ও। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে-

: ” অন্য কোন অনুভূতি ছিলো কি?”

: “তুই এখনো চিনিস নাই আমাকে, ও ম*রে গেলেও আমার কিছু আসবে যাবে না, ও আমার কাছে সেই নিলামের দিন থেকেই মৃ*ত”

চলবে…….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মাস হতে চললো দেশে এসেছে লোরা। এবার বেশ সময় হাতে নিয়েই ফিরেছে, রাহাত আসেনি। ও শেষের দিকে এসে ফিরবে ওদেরকে নিয়ে৷ লোরার বাড়ি তৈরীর জন্য জায়গা কিনেছে বেশ আগেই। সেখানে বাড়ির কাজ শুরু করবে। তার আগে জায়গাটা লোরা দেখাতে চায় মীরাকে। মীরা বলেছে সব হবে, আগে আমার বাসায় আসবে তুমি, সেখানেই আলাপ হবে।

মীরা ওদেরকে নিজের বাসায় দাওয়াত করেছিলো।

লোরা ওর ছেলে আর ছোট বোনকে নিয়ে আসবে মীরার বাড়িতে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। তবে মীরা ওদেরকে ঢাকার ভাড়া বাসায় দাওয়াত করেনি। দাওয়াত করেছে ওর গাজীপুরের বাড়িতে। গাজীপুরের বাড়ির কথা শুনে খুশিই হয় লোরা। এতে করে বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি তৈরীর একটা ধারনা পাওয়া যাবে।

মীরার গাজীপুরের বাড়িটা একটু ভিতরের দিকে। গাজীপুর মাস্টার বাড়ি ছেড়ে, গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকেও সেখানে যেতে আধঘন্টার মতো লাগে৷ তবে রাস্তাঘাট এখন বেশ সুন্দর। যখন জায়গা কিনেছিলো তখন রাস্তার বাজে অবস্থায় নাকাল ছিল ওরা। এ নিয়ে রাজিবের ও কম কথা শুনতে হয় নি ওর। তবে এত এত ভুলের মধ্যে এই কাজটা ওর জন্য বর পাওয়ার মতো । জমির দাম বেড়ে ডাবল হয়েছে এ কয় বছরে। এক বিঘার চেয়ে একটু কম এই জায়গাটা মীরা আট বছর আগে কিনেছিলো দেড় লক্ষ প্রতি কাঠা করে। যদিও পুরোটা একবারে কিনতে পারেনি ও। প্রথমে কিনেছিলো আট কাঠা। জায়গার মালিক ভদ্রমহিলা তার স্বামীর চিকিৎসা করতে খাস জমি বিক্রি করেছিলেন। ততদিনে মীরার সাথে জমির মালিক মহিলার বেশ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ও জায়গা দেখতে গিয়ে এক-দুই দিন যাই থাকতো তাদের বাড়িতে বেড়াতো। ওরা সেখানে গিয়ে বাজার সদাই, রান্নাবান্না করে তাদের বাড়িতে বেড়াতো। বাবা-মা পরিবারহীন মীরার ওটা যেন পরিবার ছিলো। মীরার গাছের ভীষণ শখ, ও প্রায়ই এমন গিয়ে গাছপালা লাগিয়ে আসতো। তাকে বলতো এসব দেখে রাখতে। এমনি করে যেতে আসতে তাদের একজন হয়ে উঠেছিলো মীরা।

মহিলার কোন ছেলে নেই। স্বামীর মারা গেলেই তা তার ভাসুর দেবেরের ছেলেরা দখল করবে। ভদ্রমহিলার স্বামী তাই অসুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকতেই স্ত্রীর নামে সব সম্পত্তি লিখে দেন যাতে তার অবর্তমানে কেও সম্পদ জবরদখল করতে না পারে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের আত্মীয়রা খুব সমস্যা করছে। ভদ্রমহিলা এখন নিজ বাড়ি ছেড়ে তার বাবার বাড়িতে থাকেন। এমন বিপদে পরে তিনি মীরাকে অনুরোধ করেছিলেন বাকী জায়গাটা ও কিনে নিতে। তিনি সবকিছু খুলেই বলেছে মীরাকে। মীরাও শুরু থেকে জানতো কিছুটা। কিন্তু মীরার এত টাকা তখন ছিলে না। মীরা বলেছে খালাম্মা আমি সবটা যে কিনবো এত টাকা আমার এখন নাই। তিনি মীরাকে বলেছেন তুমি শুধু জমি দখলে নাও, বাড়ির কাজ শুরু করো। টাকা না-হয় পরে দিয়ে দিও। কাগজপত্রও ঐ ভাবেই তৈরী করো। আমার এক মেয়ে আগের ঘরের হতে পারে কিন্তু মেয়ে দুটোর মা তো আমি-ই। ওদের একটা ভবিষ্যৎ আছে৷ ওদেরকে বিয়ে দিতে হবে৷ তোমার থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে আমার দুই মেয়ের বিয়ে দিবো। এখন তো বড়টা মাত্র কলেজে ভর্তি হবে। ছোটটা পড়ে ক্লাস এইটে আমার হাতে এখনো বছর পাঁচেক সময় আছে।

মীরা তাঁকে বলেছিলেন-

: “আপনি যে আমাকে এত ভরসা করছেন, আমি যদি চিট করি আপনার সাথে?

ভদ্রমহিলা মীরার দিকে চেয়ে থেকে বলেছিলেন-

: ” যে কষ্ট করে বড় হয় সে অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না। কারন সে জানে কষ্টের কত যন্ত্রণা, আমি যদি জায়গাটা এখন বিক্রি করতে না পারি ওরা দখলে নিয়ে নিবে, তাছাড়া তুমি ভিন্ন কাওকে যে খুঁজবো তাও আমার পক্ষে এখন সম্ভব না। চারদিকে সুযোগ সন্ধানী।

আমার কিছু হারানোর ভয় নাই মা, আমার সবটাই চলে যেতো, তুমি যদি জায়গাটা নাও, টাকাগুলো পাই তবে এটা আমি বাড়তি পাওনা ধরে নেব”

মীরা নিষ্পলক চেয়ে ছিলো তার দিকে৷ এ যুগে এত সরল মানুষ হয়?

মীরা চিট করেনি তার সাথে। তার করা ভরসার দাম দিয়েছে ও৷ তিন বছর সময় নিয়ে বাকী দশ কাঠা জমির দাম পরিশোধ করেছে। একদাগে আঠারো কাঠা জমি কিনবার গল্প এটা।

জমি বিক্রির টাকাটা তার খরচ হয়ে যেতে পারে ভেবে মীরা দায়িত্ব নিয়ে অন্যত্র জমি কিনে দিয়েছে তাকে৷ সেখানে ঘর তুলে নিজে থাকেন ভাড়াটিয়াও আছে সাত জন। সেই টাকায় তার সংসার চলে। বড় বোনের মতো ভালো ছেলে খুঁজে বিয়ে দিয়েছেন তার বড় মেয়েকে। মীরার এমন ভালোবাসা ভদ্রমহিলার সেই সময়ে করা ভরসা দাম। এমন সুযোগ না পেলে হয়তো মীরা এক দাগে এত জমি কিনবার কথা ভাবতেও পারতো না। সে-সব পুরোনো গল্প। জীবণ মীরাকে এতটাও ঠকায়নি। এমনি কুড়িয়ে পাওয়া ভালোবাসায় মীরার জীবন পূর্ণ ছিলো। এমন পাওয়া ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে জুটে?

অবশেষে লোরা ওর ছেলে আর ছোট ভাই বোনকে নিয়ে আসে মীরার গাজীপুরের বাড়িতে৷ গাড়ি পার্কিং এ রেখে লোরার চক্ষু চড়কগাছ। ছবির চেয়েও সুন্দর আর প্রাণবন্ত মীরার এই বাড়ি। মেইন রাস্তা থেকে একটু ভিতরের এই বাড়িটার মূল প্রবেশ দাঁড়ের দুই পাশে দুটি বিশাল শিমুল গাছ আগলে রেখেছে যেন গেইটটাকে৷ পুরো বাড়ির দখল যেন গাছেদের হাতে৷ গাছ দিয়ে এত সুন্দর আর যত্ন করে বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে যে বাড়িটাতে ঢুকে চোখ যেন শান্তি পেলো। গাড়ি থেকে নেমে গাছগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে ভিতরে ঢুকলো লোরা। হাঁটা পথটা সুন্দর করে বাঁধানো। একপাশে গাড়িবারান্দা অন্য পাশে বসবার জায়গা করা হয়েছে। ভিতরে ঢুকে প্রশান্তিতে মন ছেয়ে গেছে। এত অল্প জিনিসে, এত সাধারণ আসবাবপত্রের সাথে যত্নের ছোঁয়া মিশিয়ে কি সুন্দর বাড়ি তৈরি করেছে মীরা।

ভিতরে ঢুকে আপ্যায়ন করতে সুযোগ দেয় নি লোরা মীরাকে৷ হেঁটে হেঁটে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখেছে ও সবার আগে৷ এ বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে প্রথম তলার দেয়ালের উচ্চতা। প্রাচীন আমলের বাড়িগুলোর মতো বেশ উচু প্রথম তলাটা। ছয়টা বেড রুম। চারটা বাথরুম, ড্রাইং ডাইনিং মিলে ছোট্ট একটা বাড়ি এটা। বাড়ির পেছনে সুন্দর সুইমিং পুল। পাশেই দিন শেষে বসবার ছোট্ট একটু জায়গা। খোলামেলা এই বাড়িটা পুরো জায়গাটার ঠিক মাঝখানে করায় আলো-বাতাসে ভরপুর সব ঋতুতে। গ্রীষ্মের গরম, কিংবা বর্ষার বৃষ্টি বিলাস উপলক্ষ্য যাই হোক সব সাজে সাজিয়ে নিবে সে নিজেকে।

ভিতরে ঢুকে লোরা আরো টের পায় মীরার কতটুকু যত্নে গড়া এই বাড়িটা। দেয়ালে সুন্দর সুন্দর হাতের তৈরী ক্রাফট ওয়াল পিস, মেঝের শতরঞ্জি, সাইড টেবিল, বুকশেলফের শো পিস খুবই সাধারন তবে একটু আলাদাও। এগুলো সব দেশ-বিদেশের নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে কিনছে ও। পুরো বাড়িটাতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এক অপূর্ব মিশেল, আর ভিন্টেজ ভাইভ। মানুষ টাকা খরচ করে দেশি জিনিসে বিদেশি আদল তৈরী করে। এ দিকে মীরা হেঁটেছে উল্টো। ও বিদেশী জিনিস তৈরি করিয়েছে দেশীয় আদলে। আসবাব তৈরীর সময় জ্ঞান সবখান থেকে নিয়েছে, কিন্তু তৈরীর সময় তা দেশীয় আদলে বদলে দিয়েছে। ২য় তলার বিশাল বসবার ঘরের দুটো দেয়াল কাঁচের, যা ইচ্ছে মতো খোলা বন্ধ করা যায়, আর বাকী দুটো দেয়ালের একটাতে বিশাল বুকশেলফ৷ যাতে রয়েছে তিন হাজার দেশী বিদেশি বই। আরেকটাতে সেম প্যাটার্নের সেলফ ভরে আছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের এক একটা টুকরো। গ্রাম বাংলার ঢেকি, মাছ ধরার পোলো, কুলা, টেরাকোটার পুতুল, পাত্র, নকশিকাঁথার ফ্রেম, জামদানী কাপড়ের তৈরী ফটোফ্রেম। যেটাতে হাস্যজ্জ্বল মীরা, নূহা, ওর মা, ভাই, বোন, মোকলেস চাচা, তার স্ত্রী, মুরসালিন ওর বাকী তিনভাই সকলে৷ মীরা যাদেরকে ওর নিজের পরিবার মনে করে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি ব্যাপারে নিষেধ থাকায় ছোট্ট এ ফ্রেমটায় ছবি রেখেছে ও। পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে লোরার যেন ক্লান্তি নেই। লোরার সবচেয়ে যা পছন্দ হয়েছে তা হচ্ছে মীরার বাথরুম। বিশাল সাইজের এই বাথরুমের ফিটিংস গুলো সব বাইরে থেকে আনানো। গাছেদের আধিপত্য সেখানেও রয়েছে সমানতালে। মীরার খুব ভাল লাগে লোরার এ বাড়িটা এত পছন্দ হওয়ায়। কারন ওর মনে তো ভিন্ন কিছু চলছে।

দুপুরের পর খাওয়াদাওয়া করে গল্প জুড়ে ওরা। লোরা বলে –

: “আমি দেশে ফিরে আসবো খুব শীঘ্রই। তুমি কথা দিয়েছিলে আমাদের বাড়িটা নিজে দায়িত্ব নিয়ে করে দিবে। নিজের বাড়ির মতো যত্ন নিয়ে করে দিবে, বুঝলে

এক্কেবারে তোমার এই বাড়িটার মতো করে”

মীরা খাওয়া থামিয়ে বলে –

: “যদি এ বাড়িটাই তোমাদের হয়? ”

এবার অবাক হওয়ার পালা লোরার। বলে-

: “আরে ধূর, এটা আবার হয় নাকি?”

: ” খুব হয়, তেমার পছন্দ না হলে আর তুমি ভারী বোধ না করলেই হলো”

: “আরে না না, কত যত্ন, সময় নিয়ে করেছো তুমি অপছন্দ করার উপায় আছে?”

: “তোমারটাও তো যত্ন, সময় নিয়ে করতে হবে, তারচে বরং এটাই নাও”

: ” কোন তাড়াহুড়ো নাই আমার, তুমি সময় নাও”

: “লোরা, তুমি আর রাহাত আমার জন্য যা করেছো তার বিনিময়ে এ বাড়ি কিছুই না, আজ আল্লাহ আমাকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন যে আমি চাইলেই এমন একটা বাড়ি তৈরী করতে পারবো। সত্যি বলতে এ বাড়িটা আমাকে আমার অতীত মনে করে দেয়। আমি এর থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছি, তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে না এই অতীত থেকে মুক্তি পেতে?”

এবার যেন জব্দ হলো লোরা। মীরাকে জিজ্ঞেস করলো

: “মীরা, কত টাকার এসেট এটা?”

: “তিন লক্ষ টাকা মাত্র, যেটা রাহাত এক যুগ আগেই পেইড করে দিয়েছিলো”

খাওয়া রেখে লোরা অবাক চোখে তাকায় মীরার দিকে, মীরা মুচকি হেসে মাথা ঝাকায়, যার অর্থ সত্যি।

লোরা জানে কোন তিনলক্ষ টাকার কথা মীরা এখন বলছে। রাহাতের দেয়া মীরার ব্যাবসা শুরুর সেই তিন লক্ষ টাকা এই পুরো বাড়িটার দাম ধরেছে মীরা।

বিকেল চা নাশতা খাওয়ার সময় বাড়িতে আসে মীরার ব্যাক্তিগত এডভোকেট রামীম, সব কাগজপত্র তিনি আগেই তৈরি করে এসেছেন। লোরা অবাক হয় এমন সময়ে এডভোকেট এর আগমনে। সবটা শুনে লোরা বিরক্ত হয়ে বলে- “আর ইউ ক্রেজি মীরা? আমি এখনো রাহাতের সাথে কোন আলাপই করি নি। পাগলের মতো উকিল টুকিল ডেকে অস্থির”

মীরা হেসে বলে – “আজ জানলে তুমি! আমি যে পাগল? ”

—————–

এরপর কেটে গেছে বেশ কটা দিন। শীত পুরো খুঁটি গেড়ে বসেছে প্রকৃতির বুকে। মীরার প্রিয় ঋতু শীত, যদিও আলসেমি লাগে কাজকর্ম করতে তবুও। মীরার নিজেকে খুব হালকা বোধহয় আজকাল। কারন ওর এই জোরপূর্বক ঋণমুক্তি ওকে আরো যেন শক্তিশালী করেছে মননের দিকে। সত্যি এ বাড়িটায় রাজিব নামের একটা অংশ মিশে ছিলো। বাড়ির মূল ফটকের যে শিমুল গাছ দুটো সেদুটো রাজিবের নিজ হাতে লাগানো। সুইমিংপুলের ডিজাইন ওর রাতজাগা পরিশ্রমে তৈরী করা। দীর্ঘ দেয়াল, বসার ঘরে বেডরুমের কাঁচের দেয়াল তৈরী ওর মস্তিষ্ক প্রসূত ভাবনা। মেঝের টাইলস, বাথরুমের ফিটিংস এগুল ও ঘুরে ঘুরে করেছে।

এগুলো চাইলেও বদলে ফেলা যাবে না রাজিবের মতো। তাছাড়া রাহাত, লোরা অনেক করেছে মীরার জন্য। মানসিক, আর্থিক এমন সাপোর্ট ওদের থেকে না পেলে আজকের মীরা হারিয়ে যেতো জীবণের ঘর্ণিবাতে। কিন্তু মীরা শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছে এসবের। সাহস, শক্তি জুগিয়েছিল এসব মানুষেরা। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে, ঋণ মুক্ত হতে দিনরাত এক করে দিয়েছে ও।।

মীরা এখন অনেক ক্লান্ত। উদ্দেশ্যহীন এই ব্যাস্ততা কিসের জন্য? এসব প্রশ্ন খুব খোঁচায় ইদানী ওকে।

ওর একটু বিশ্রাম দরকার। কারখানায় কাজের চাপ কম থাকায় বাড়িতেই থাকে বেশীরভাগ সময়। নিয়ম করে দেখে আসে ইরার মেয়েকে। অবসরের এ দিনগুলো যত স্বস্তির ততোটাই কষ্টের। কিছু কথারা চারপাশে ঘিরে ধরে মীরাকে এই অবসরে। মনে করিয়ে দেয় তুমি এখনো ঋণমুক্ত হও নি প্রিয়। আরো বড় ঋণ রয়ে গেছে তোমার।

মীরার ভীষণ কান্না পায়, একটা মানুষের জীবণের বারোটা বছর ও গুম করে ফেলেছে। এর শোধ ও কিভাবে দিবে? আদৌ পারবে কি?

এমনি ভাবনা ঘেরা এক বিকেলে মীরার বাড়ি আসে ফিওনা। যন্ত্রণার ষোলোকলা পূর্ণ হলো যেন। ফিওনা এসেছে বিদায় নিতে ও চলে যাচ্ছে আগামীকল। অনেকের সাথে দেখা হয় নি, অনেক কাজও বাকী, তবুও সব ফেলে মীরার দরজায় এসেছে ও। মীরা খুব বুঝে কেন তুমুল ব্যাস্ততার এ সময়ে ওর কাছে এসেছে ফিওনা।

মীরা কিছু না বোঝার ভান করে উষ্ণ আন্তরিকতায় আপ্যায়ন করে ওকে। ফিওনা যেন কথা হাতরে খুঁজছে ওর শব্দভান্ডার থেকে, কিন্তু পাচ্ছে না। শেষটায় ফিওনা তুলেই ফেললো কথাটা। গলা ঝেড়ে বলল-

: “আমি জানি তুমি কি ভাবছো?”

: “কি ভাবছি?”

: “ভাবছো কেন এলাম?

: ” আরেহ্ না”

: “মীরা আমি তোমার বয়সে বড়, কিন্তু সম্পর্কের দিকে ছোট, যে সম্পর্ক তুমি না মেনে চলে গিয়েছিলে। আমি আমার ভাই দু’জনেই কিন্তু এই সম্পর্কটাকে বয়ে চলেছি, তুমি অন্য কারো স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাকে আমার ভাবীই ভাবতাম। যাই হোক ঐদিন তো সবই শুনলে নিজের কানে। আমি এসব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছি, কসম কেটেছি ভাইয়ের সাথে এসব নিয়ে আর কিচ্ছু বলবো না ওকে। কিন্তু ভাইটার কষ্টে আমার বুক ফেটে যায় জানো। তবুও এ অবস্থার একটা সমাধান না করে চলে যেতে হচ্ছে আমাকে। আমি কত অসহায় দেখেছো।

এমন অবস্থায় ঝরঝর করে কেঁদে দেয় মীরা। শ্লেষ্মা জারানো গলায় বলে-

: ” আমি অনেক ভেবেছি ফিওনা, কিন্তু কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না, এসব ভাবতে ভাবতে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়, তবুও কোন দিশা পাই না আমি, জানিনা আমি এসব ঠিক করতে পারবে কি না”

: “কেও যদি এসবের সমাধান করতে পারে সেটা একমাত্র তুমিই, তুমি পারবে মীরা অবশ্যই পারবে”

: ” আমি সব দিক ভেবে দেখেছি ফিওনা, আমার পক্ষে এত কষ্টে, শ্রমে গড়া ব্যাবসা ছেড়ে উনার সাথে গ্রামে যাওয়া সম্ভব না, যতটা না ব্যাবসার মায়া তারচে বেশী ঐখনকার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা ভেবে। ধরো সব ছেড়ে গেলাম আমি কিন্তু গ্রামের সবাই জানে এত বছরেও উনি বিয়ে করেন নি। তারউপর আমার মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসবাস করা, এটা অসম্ভব ফিওনা”

: ” তুমি এত মাথা মোটা কেন মীরা, এটা যে ওর অভিমানের কথা তা তো আমার মেয়েটাও বুঝবে, আর তুমি বুঝলে না, ও জানে তুমি এটা কখনোই মানবে না, তাই এটা বলেছে”

: “তাহলে?”

: “ক্লাসে যখন বাচ্চারা চেচামেচি, শোরগোল করে তখন টিচাররা কি করে মীরা? ওদের করা শোরগোলের চেয়ে বেশী শব্দ করে ওদের মনোযোগ নেয়, তোমাকেও তাই করতে হবে, ও তোমাকে ভালোবেসে অন্তরালে চলে গেছে , তুমুল ভালবাসা দিয়ে তোমাকে ওকে সেখান থেকে বের করে আনতে হবে”

কেমন একটা ঘোরলাগা চোখে তাকায় মীরা ফিওনার দিকে। ফিওনা ওর হাতটা ধরে বলে-

: ” পারবে না?”

মীরা মাথা নিচু করে ছিলো এতক্ষণ, ওর জিজ্ঞাসা শুনে ক্রন্দনরত মীরা তাকায় ফিওনার দিকে। ফিওনা মীরাকে ইশারায় আশ্বাস দেয়। কিছু না বলেও সে আশ্বাস যেন বলছে- “তুমি অবশ্যই পারবে মীরা”

এরপর আরো অনেক কথা হয় দুজনে। উঠবার আগে ফিওনা বলে- “আমি আগামীকাল চলে যাবো, পরশু আবীর ঢাকা ছাড়বে। একদিন সময় তোমার হাতে। ফেলে যেহেতু তুমিই চলে গিয়েছিলে, অভিমানী ওকে তুলে নিতে দোষ কি? ”

মীরা তখনো নতমুখী৷ এবার উঠে পরে ফিওনা। যাওয়ার আগে বলে-

“তোমাদের পূর্নমিলন হবে কি না জানি না মীরা, কিন্তু তুমি সবসময়ই আমার ভাইয়ের বৌ হয়েই থাকবে আমার কাছে। আল্লাহ তোমাদের মনের ইগো দূর করে দুজনকে আবারো এক করুক” অন্য মনস্ক মীরা অস্ফুটস্বরে বলে উঠে “আমীন”

ফিওনা হেসে দেয় ওর মুখে আমীন কথাটা শুনে৷ বেরিয়ে গিয়েও আবারো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মীরাকে। সহাস্য কন্ঠে বলে সুম্মা আমীন। মীরাও হেসে দেয় কি হলো তা বুঝে।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

বিদায় নিয়ে চলে গেলো ফিওনা। দেশ থেকে শেকড় তুলে আগামীকাল চলে যাচ্ছে ও। ফিওনা যাবার পরও বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো দড়জার চৌকাঠে। মেয়েটা ওকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে গেল, কিন্ত সঙ্গে দিয়ে গেলো আশা নামের ভেলা। এই ভেলা দিয়ে দূর্গম সাগর ও পারবে কি পাড়ি দিতে? এই এক প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথাতে।

কিভাবে কি করবে তা ভাবতে ভাবতে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় মীরার। এত ভেবেও চিন্তার কূলকিনারা করতে পারে না ও। যতটা সহজে বলে গেলো ফিওনা ততোটাও সহজ না ব্যাপার গুলো। তার উপর আবীর নিজে ব্যাপারটা কিভাবে দেখে সেটাও ভাববার বিষয়। মীরা আনমনে ভাবে এসব। এমন সময় ফোন আসে ম্যানেজার ফাহাদের। ওদের পরবর্তী কাজের জন্য ব্যাংকে করা এল.সি এর আবেদন অজানা কারনে ক্লোজ করে দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মীরা প্রথমে উদ্বিগ্ন হলেও কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে ব্যাপারটা। ওদের টিন সার্টিফিকেট, বিন সার্টিফিকেট সবই আপ-টু-ডেট। তারপর কেন এটা রিজেক্ট হবে তা বেশ ভালো করেই টের পায় মীরা৷ গত সপ্তাহে ও, সায়নের বাবা এবং মায়ের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে দেখা করেছে৷ বাবা ছেলে এক জোট। তারা সবকিছুই সহজ চোখে দেখে। এসি গাড়িতে বসে সানগ্লাস চোখে দিয়ে কি রোদের তেজ কত তা বোঝা যায়? এরা বাপ-বেটা দুজনই সানগ্লাস চোখে আঁটা পাবলিক। সায়ন মীরার বয়সের পার্থক্য কম করে হলেও পাঁচ বছর বেশী, তার উপর মীরা সংসার করেছে ওদের বয়সের পার্থক্যের চেয়েও বেশী সময়। প্রায় আট বছর, মেয়েও আছে একটা। এসব কোন সমস্যাই না এদের চোখে। তার মানে এটা না যে সায়নের ভালোবাসা মিথ্যে। কিন্তু ওর ভালোবাসার গন্তব্যের উদ্দেশে হাঁটা পথটা ভুল। পিছুপিছু ঘোরা, যখন তখন ফুল পাঠানো, সবার চেয়ে স্পেশাল ভাবে মীরাকে দেখা, ভালোবাসি ভালোবাসি ফর্মেটেড কথাবার্তা, টেক্সট এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো।

কিন্তু জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে জিম্মি করা? আর মীরার সার্বাঙ্গে ওর শরীর লেপ্টে আলিঙ্গনরত অবস্থায় করা গভীর চুম্বন? এগুলো চরম প্রাকারের বাড়াবাড়ি ছিলো। এ পর্যন্ত ভেবে মীরার শরীরে একটা কম্পনের সৃষ্টি হয়। চুম্বন ব্যাপারটা কত মধুর যদি তার শুরুটা হৃদয় থেকে হয়। কিন্তু সায়নের ভালোবাসার শুরুটা মীরার বাইরের আদল দেখে। নিঃসন্দেহে মীরা সুন্দরী, লাস্যময়ী, নিখুঁত ওর গায়ের গড়ন। উচ্চতা, ওজন, গায়ের রঙ, মুখের আদল, চোখ, নাক, ঠোঁট এমনকি চুল ও মোহনীয় ওর। ওকে দেখলে বুকে হৃদকম্পন বাড়ে সকল পুরুষের। কৈশোর না পেরোনো মীরারকে পুত্র বধূ করতে কত ছেলের বাবা-মা আলাদা সমীহ করতো ওর বাবা-মাকে তার ইয়ত্তা নেই। এসব এড়াতে খুব ছোট থেকেই ওকে ওর বাবা স্কুল, কোচিং এসবে নিজে দিয়ে আসতো আবার নিয়ে আসতো। নিজের ব্যাবসা থাকায় এ দায়িত্ব পালনে মীরার বাবাকে বেগ পেতে হয়নি।

নিখুঁত এ সৌন্দর্যের জন্য গোপন অহংও ছিলো মীরার। বান্ধবীদের বলেছিলো ওর মতো সুন্দর কাওকে ছাড়া বিয়েই করবে না ও। সময়ের আর্বতনে দেখা হয় মীরার রাজপুত্র রাজিবের সাথে। রাজার ছেলের চেয়ে কোনদিকে কম না রাজিব। গায়ের রঙ সুন্দর, বাঙালি ছেলেদের গড় উচ্চতার চেয়েও লম্বা ছিলো রাজীব , চওড়া কাঁধ, চ্যাপ্টা শরীর, টিকালো নাক, সুন্দর মায়া ভরা একজোড়া চোখ, যেন কোন শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত ছবি মানুষ সে। বাউণ্ডুলে হওয়া সত্ত্বেও এই চোখেই ডুবে মরেছিলো মীরা। ওদের প্রেম যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে ছিলো আর হুট করে মীরার বাবা অসুস্থ হলে এসব ঝামেলা এড়াতে আবীরের মা নিজ থেকে মীরাকে একমাত্র ছেলের বৌ করতে প্রস্তাব রেখেছিলেন জাহানারার কাছে। আবীর শিক্ষিত, ভদ্র, ব্যাবসায়ী ছেলে, বয়সের পার্থক্য একটু বেশী আর গায়ের রঙ কালো। এ ছাড়া সোনার টুকরো ছেলে ও। আবীরের মা তার কালো পুত্রের জন্য লুফে নিতে চেয়েছিলো সুন্দরী মীরাকে , আর মীরার মা মেয়ের গোপন কেলেঙ্কারির ঢাকতে আর এসব ঝামেলা এড়াতেই বিয়ের পরামর্শ রাজি হয়েছিলেন। জাহানারা আর আবীরের মা দুজন মিলে বুদ্ধি করে আংটি বদলের দিন বিয়ে পড়িয়ে দেয় ওদের।

কিন্তু সায়ন ওর হৃদয় স্পর্শ করার আগেই ওর শরীর স্পর্শ করে ফেলেছে আবেগের তাড়নায়। যে আবেগ ওকে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করে দিয়েছিলো। ঐ দিনের স্মৃতিতে ঘেন্নায় আকন্ঠ তিক্ততা অনুভূত হয় ওর। অথচ চুম্বন ব্যাপারটা কত মধুর যদি তার শুরুটা হৃদয় থেকে হয়।

এই একটা বিষয় না ঘটলে মীরা হয়তো ওর ব্যাপারটা ভেবে দেখতো। অন্ততঃ আবীরের কথাগুলো নিজ কানে না শুনলে এটা অবশ্যই ভেবে দেখতো মীরা৷ মীরা ওর বাবার সাথে কথা বলার সময় ওর অপারগতা জানিয়েছে। তিনি তো নাছোড়বান্দা, তিনি মীরাকে বলেছেন-

: “যা হয়েছে বাদ দাও মামনী, তুমি গুণী মেয়ে আমার ছেলে অধম। নিজ গুণে ক্ষমা করে দাও। তোমার যে সকল এক্সকিউজ তার কোনটাই ভ্যালিড না। তোমার বয়স, মেয়ে নিয়ে সায়নের কোন সমস্যা নেই, ছেলের যেহেতু কোন সমস্যা নেই, আমারও নেই, ছেলে খুশি তো আমি খুশি।

মীরা অস্বস্তির কন্ঠে বলেছিলো-

: ” কিছু মনে করবেন না স্যার, সরি টু সে -আজ আপনার ছেলে খুশী তাই সব এক্সকিউজ ইন-ভ্যালিড মনে হচ্ছে আপনার। কাল যদি ওর মনে হয় আমি, আমার মেয়ে ওর পাশে বেমানান তাহলে ঠিক এমনি করে মরিয়া হয়ে যাবেন আমাকে ত্যাগ করতে, যতটা মরিয়া এখন গ্রহণ করতে”

তিনি সহাস্যে শরীরটা টেবিলের কাছে ঝুঁকিয়ে বলেন-

: “আমি গুণের কদর করি, তুমি গুণী মেয়ে, অনেক প্রশংসা তোমার এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে। আমি চাই তুমি পুত্র বধূ হয়ে এই পদের ভবিষ্যৎ অধিকারী হও, উত্তরাধিকার সূত্রে না, নিজ যোগ্যতায়, আর তুমি তা পারবে। তুমি সময় নাও, ভেবে আমাকে জানাও। আমার ছেলে হাজারে একজন, আমি খুব করে চাই এটা হোক”

মীরা এরপর আর কিছুই বলেনি। বেশ কিছু সময় বসে থেকে সালাম দিয়ে চলে এসেছে।

সায়নের মায়ের সাথে দেখা করার সময় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি মীরাকে তাকে বোঝাতে। তিনি বরং ওকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এসব থেকে পিঁছু ছাড়াতে। জানিয়েছেন মীরাকে নিয়ে তার স্বামীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। তিনি মীরাকে টোপ হিসেবে ব্যাবহার করতে চান, যাতে উনার মেয়াদপূর্তির পর মীরাকে সে জায়গায় বসাতে পারেন। ব্যাপারটা যদিও মীরা তিনি না বলতেই বুঝেছিলেন।

এত কিছুর পরও যে সায়নের সাথে কথা হবে তা বুঝতে পারেনি ও। এটা মীরার এক প্রকার অনিচ্ছাকৃত আলাপ। কিন্তু মীরা এই ঝামেলাটা বয়ে নিতে চায়নি বলেই এই বার্তার আদান প্রদান। হোয়াটসঅ্যাপে সায়ন বলেছিলো- “আমি প্রতিযোগিতা চাই না মীরা, আমি সমঝোতা চাই” মীরা উত্তরে কেবল বলেছিলো- “তুমি আমার প্রতি একসময় কৃতজ্ঞ থাকবে তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছি বলে” এরপর সবগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে ও সায়নকে৷ জীবনসঙ্গী আর যেই হোক সায়ন তো অবশ্যই না, সে হিসেব ও কষে ফেলেছে ও। কিন্তু ও জানে এর পরিনাম খারাপও হতে পারে ওর ভবিষ্যতের জন্য। তাই বলে কি নিজের বেঁচে থাকাটা এমন নরক করবে ও? আরেক জনের ক্ষণিলের মোহ হিসেবে ধরা দিবে?

সব চিন্তার বোঝা একপাশে রেখে মীরা নূহাকে তৈরি করে গেলো ইরার বাসায় ওর মেয়েকে দেখতে। গিয়ে দেখে ওর মা জাহানারা আজ আসেনি। নতুন বাচ্চা মায়েদের দেখতে আসা লোকেরা ঘিরে রাখে। আত্মীয়দের কেওনা কেও প্রতিদিনই নিয়ম করে আসছে ইরাকে আর ওর বাচ্চাকে দেখতে।

মীরা একটা সময় ঘর ফাঁকা পেয়ে ইরাকে বললো ফিওনা আসার কথাটা । ইরা ওর দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ইরা যেন মীরার মনের গতি দেখতে চাইছে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে।

কথা বলায় দক্ষ মীরার এখনকার কথাবার্তায় অগোছালো ভাবটা ইরা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। ওর এই ভাবটা প্রকাশ করছে আবীরের প্রতি ওর সূক্ষ্ণ অনূভুতির আবির্ভাবের বিষয়টা। ইরা বোনের এমন তালগোল পাকানো কথাবার্তায় মনে মনে খুশি খুব। ও সবসময় বোনকে সুখে দেখতে চেয়েছে। ঘাড়ত্যাড়া মীরা যে বিষয়টা নিয়ে ভাবছে এই অনেক ওর জন্য। আর আবীর ভাই নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ।

সবচেয়ে মজার বিষয় ইরা আর ফিওনা দুজন মিলেই আজকের এই দিনটার রূপকার। একদিকে ফিওনা ওর ভাইয়ের একাকিত্ব জীবনযাপনের কথা বলেছে ইরাকে, আর অন্যদিকে ইরা ওর বোনের অস্থিতিশীল জীবণের কথা শেয়ার করেছে ফিওনার কাছে। ফিওনার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তে তোড়জোড় বাড়ে চার হাত এক করার কর্মজজ্ঞে। ইরা ওর এই অবস্থায়ও পরপর তিনবার বাইরে দেখা করেছিলো ফিওনার সাথে। মীরার ফিওনার বাসায় যাওয়া, ঠিক ঐ সময়ে দীর্ঘ দিন না আসা আবীরের ফিওনার বাসায় আসা এসব ওদের দুজনের প্ল্যানের অংশ। লাভের মধ্যে বড়তি পাওনা টুকু যোগ করেছে সায়নের পাগলামি। ওর এমন পাগলামি ওদের দুজনের এক হওয়ার যাত্রাটাকে ত্বরান্বিত করেছে আগুনে ঘিঁ দেয়ার মতো। শাপে বর যাকে বলে। ওদের দু’জনের এত দিনকার মিলিত এই চেষ্টার ফল চোখের সামনে দেখছে ইরা।

কিন্তু সমস্যা একটা এখনো রয়েছে। সেটা হচ্ছে ইরার মা জাহানারা। তিনি বরাবরই মীরাকে বিয়ে দিতে চান, কিন্তু আবীরের ব্যাপারে তিনি কেমন যেন নিরব। ফিওনার সাথে আলাপের পর একদিন এসব ব্যাপারে আলাপ তুললে তিনি আবীরের বিষয়ে তার অনিচ্ছার কথা জানান। তিনি আর তার তিন বোন মিলে আলাপ করেছে ব্যাপারটা। আবীর নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে কিন্তু সমাজে ওর ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে পুরুষ হিসেবে ওর অক্ষমতা। পুরুষ মানুষ বউ থাকতে পরনারীর দিকে হাত বাড়ায়। আর আবীর কিনা একাই কাটিয়ে দিচ্ছে জীবণ। যদি এটা মিথ্যেই হতো তাহলে এত বছর একা কিভাবে কাটায় একজন পুরুষ মানুষ।

ইরার কথাটা শুনে রাগে বিরক্তি ধরে গেছে মায়ের প্রতি। একটা মানুষ যে নাকি ভালোবেসে তার মেয়েকে স্ত্রীর পরিচয়ে বয়ে গেছে, বিনিময়ে তার কাঁধে আজ মিথ্যা অপবাদের বোঝা। ইরা ওর মাকে বোঝাতে চেয়েও সফল হয়নি। তিনি বলেছেন আমার যুবতী মেয়ে, ঐ ছেলের বয়স এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। আমি মীরার জন্য অন্য ছেলে দেখবো। ছেলের অভাব নাকি দেশে।

ইরা চুপ করে চেয়ে ছিলো ওর মায়ের দিকে, মানুষ কত্ত হিপোক্রেট। এই তিনিই তার কিশোরী মেয়েকে জোড় করে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছিলেন এই আবীরের কাছেই। তখন বয়স কোন সমস্যা ছিলো না।

অথচ আজ বয়সের পার্থক্যের উদাহরণ, অক্ষমতার
অপবাদ দিচ্ছে আবীরের কাঁধে, যে অক্ষমতার অপবাদ তার মেয়েই এঁকে দিয়েছিলো নির্দোষ আবীরের শুভ্র চরিত্রে।

পরিবার, পাত্র পাত্রী সবই এক, বদলে গেছে কেবল সময়। মীরা সময়ের ঘূর্ণনে এখন বিরাট অবস্থা সম্পন্ন ব্যাবসায়ী, আর আবীর সন্নাস জীবণে ব্রতী এক পুরুষ।

মীরা ইরাকে জানায় রাতে মায়ের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে। ইরা আতংকিত হয় এ কথা শুনে। ওতো সবটা খুলে বলতে পারছেনা বোনকে। আল্লাহর কি ইশারা এমন সময়েই মীরার মা জাহানারা উপস্থিত। ইরার তো মাথা গরম অবস্থা। এমন বিপদের সামাল কিভাবে দিবে ও। মনে মনে খোদাকে ডাকতে থাকে ও।

মীরা এখন সবকিছুই ওর মাকে জানিয়ে করে। অবাধ্যতার পুরষ্কার তো ও পেয়েছে এক জীবণে। আর অবাধ্য হতে চায় না ও। মীরার ধারনা মা কথাটা শুনল খুশিই হবে।

ইরার ঘরে বসে মীরা জাহানারাকে কথাটা বলে-

: “মা ফিওনা এসেছিলো আজ আমার বাসায় বিদায় নিতে, ওরা কাল আমেরিকা চলে যাচ্ছে”

: “হুম ওদের ভাড়াটিয়া মনসুরের বৌ বলেছে আমাকে”

: ” অনেক কথাই হলো ওর সাথে”

এ কথা শুনে তিনি মীরার দিকে তাকালেন। ইরার তখন মাথাঘোরা অবস্থা। একজন বুনো ওল তো অন্যজন বাঘা তেঁতুল। জাহানারার চোখ যেন জ্বলে উঠলো কথাটা শুনে। তবুও তিনি চুপ করে রইলেন ওর কাছ থেকে পুরোটা শুনতে। মীরা মাথা নিচু করে বললো-

: “আমার জীবণের প্রথম অন্যায়টা আমি আবীর ভাইয়ের সাথে করেছি। সমাজের চোখে একমাত্র আমার কারনে আজও তিনি কটাক্ষের স্বীকার । বিয়ে না করে একলা জীবণ পার করছেন কাগজপত্রে আমাকে স্ত্রী করে। আমি আমার এ অন্যায়টা সংশোধন করতে চাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীকাল তার সাথে দেখা করবো”

মীরার কথা শেষ না হতেই তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান, বাজখাঁই কন্ঠে বলেন-

: “সিদ্ধান্ত তো সব নিয়েই নিয়েছিস দুই বোন মিলে, তাহল আমাকে জানাচ্ছিস কেন? তোর জীবণ তুই যা খুশি কর। আমার কি?”

ইরা ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন-

: “মা আস্তে কথা বলো, এটা তোমার নিজের বাড়ি পাও নি”

মেয়ের কথায় সংবিৎ ফিরে জাহানারার। তিনি এখন মেয়ের শ্বশুর বাড়ি, তার এত বাজখাঁই কথাবার্তা এখানে চলবে না। তিনি যেন কিছুটা ধাতস্থ হলেন। অভিমানী কন্ঠে বললেন-

: “প্রথম ভুল করলি রাজীবের হাত ধরে গিয়ে, এখন আবার ভুল করতে যাচ্ছিস, যা। কর যা মন চায় ”

মীরা ভীষণ অবাক হয় ওর মায়ের এমন আচরণে। তারাই এতদিন ওকে বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিচ্ছিলো। আজ তিনি এমন কেন করছেন? সেটা ও বুঝতে চেষ্টা করছেন মায়ের দিকে চেয়ে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারছেন না। ইরা ওকে উদ্ধার করলো, বললো-

: “আসলে আপা, মা নাকি কি সব শুনেছে আবীর ভাই সম্পর্কে, তার নাকি কি সমস্যা আছে, এজন্য তিনি বিয়েশাদি করেন নি…”

মীরা ইরার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এ ব্যাপারটা মীরাও জানে, রাজীব ওকে রেখে ২য় বিয়েটা করেছিলো এ জাতীয় অপবাদ ওর কাঁধে দিয়ে৷ অথচ বিয়ের পর দু’চারটা কথা বলেছিলো কেবল আবীর মীরার সাথে ইন্টিমেসি তো দূরের কথা। অথচ সমাজ এদিকে আবীরের জীবণ নষ্ট করেছে বৌ না রাখতে পারার অক্ষমতা দেখিয়ে, রাজীবকে করেছে একজনের ব্যাবহৃত জিনিস নিয়ে সংসার পাতার অভিযোগ। মীরারও ঘর ভেঙেছে সেই কারনে। নোংরা সমাজ কাওকেই সব ভুলে নতুন করে বাঁচতে দেয় নি।

মীরার কাছে সব কিছু পরিষ্কার। মীরা মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবে- মা যা বলছেন হয়তো ভবিষ্যতে মীরার আবার অসুখী হওয়ার কথা ভেবে। কিন্তু মীরা তো সবটা জানে। ওর নিজেকেও তো একই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিলো একটা সময়। ও ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলে-

: “মা, তুমি না বললে ‘প্রথম ভুল করলি রাজীবের হাত ধরে গিয়ে’ আমি সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে সেই প্রথম ভুলটাই ঠিক করতে চাই”

বলেই উঠে দাঁড়ায় মীরা। এত কথা-কাটাকাটি করার মন মানসিকতা এখন নেই ওর। সেখান থেকে বেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় মীরা।

চলবে…

প্রিয় ভুল পর্ব-৭৩+৭৪+৭৫+৭৬

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দেশে ফিরে নতুন প্রোডাক্টের লাইভ আর মালামাল গোছগাছ করতে করতে দুদিন গন। দেশে ফিরার তিনদিনের দিন মীরা নিজেই কল করে ফিওনাকে। জানায় ওর দেশে আসার কথা৷ ফিওনা মীরাকে বলে তুমি তো মহাব্যাস্ত, আগামী শুক্রবার সকালে এসে পরো, সারাদিন থেকো। কিন্তু ব্যাস্ত মীরার এত সময় কই? মীরা বলে ও অবশ্যই আসবে তবে সকালে না বিকেলে। ফিওনা তাতোই রাজি হয়।

বৃহস্পতিবার ওর আউটলেট থেকে বের হওয়ার সময়
আড়ং থেকে বেশ কিছু শো পিস কিনলো মীরা। বিদেশে সিফ্ট হয় যারা তাদের জন্য আড়ং এর শো পিস আদর্শ গিফট। আড়ংয়ের এক একটা শেপিস যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। কাজ শেষে বাসায় ফিরে গুছগাছ করে মায়ের বাসায় যায় মীরা। দুপুরে খেয়ে সেখান থেকে ফিওনার বাসায় যাবে বলে ঠিক করে।

পরদিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরপরই মীরা বের হয় বাসা থেকে। নূহাকে সাথে নিবে ভেবেছিলো ও। কিন্তু নূহা ভাতঘুমে ডুব দেয়ায় ওকে আর সাথে নিতে পারে নি ও। বাসা থেকে বেরিয়ে বেকারী থেকে কিছু খাবারের আইটেম নিয়ে রিকশায় চড়ে রওনা দেয় মীরা। মনের মধ্যে কেমন যেন উচাটন ভাব ওর। এই মেয়েটা দেশ ছেড়ে চলে গেলে আবীরের সম্পর্কে জানাশোনার পথও বন্ধ হয়ে যাবে। দুই বন্ধবীর তৈরী করা সম্পর্ক নষ্ট করেছিলো মীরা। কিন্তু ফিওনা ঝড়ো বাতাস সত্ত্বেও নিভে যেতে দেয় নি সে প্রদীপের আলো, আগলে রেখেছে অনেক কষ্টে। অথচ সম্পর্কটা অন্যরকম হতে পারতো, আর জীবণটাও। এসব ভাবনাকে একপাশে রেখে দিলো ও। এসব ভেবে এখন কি হবে? সবকিছু তো এত সহজ না।

রিকশা অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলো বেইলী রোড। শুক্রবার হওয়ায় রাস্তা ফাঁকা। ওদের বাড়িটা মীরার আগেরই চেনা। ড্রেসে ডেলিভারিতে এসেছিলো বহু আগে একদিন। সোজা পথ, সহজ ডাইরেকশন। গলির সামনে স্বপ্নের বিশাল আউটলেট। বামে ঢুকে বিশাল বাগানবিলাস গাছের ঝোপ ওয়ালা বাড়িটাই ওর শ্বশুরবাড়ি। ধীর পায়ে মীরা পৌঁছে গেলো ফিওনার বাড়ির সামনে। কলিংবেল চাপতেই একটা মেয়ে এলো দরজা খুলতে। মীরা মুচকি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো-

: “ফিওনা আছে?”

: ” আপনি মীরা আন্টি?”

: “হ্যা”

: “আসুন, মামী ভিতরে আছে”

জুতা খুলে বসার ঘরে ঢুকতেই মীরা দেখলো ফিওনা এসেছে ওর রুম থেকে। মীরাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো ওকে ফিওনা। ফিওনার সাথে সাথে মিষ্টি একটা সুগন্ধ ও অভ্যর্থনা জানালো মীরাকে। মীরা হুট করে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে অস্বস্তি ফিল করলেও, ওর আন্তরিকতায় মীরা ঐ অস্বস্তি উবে গেলো। মীরাও গভীর মমতায় চোখ বন্ধ করে ওকে আলিঙ্গন করাটাকে উপভোগ করলো। মীরার হঠাৎ ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো, এই মেয়েটা ওর কত্ত আপন হতে পারতো তা ভেবে।

ফিওনা ওকে বসিয়ে সফ্ট ড্রিংকস আনতে গেলো। নাশতা সব আগেই তৈরী করা। ফিওনা বললো-

: “তারপর কেমন আছো মীরাপু?”

মনে মনে হাসে মীরা, এটা ওর সিগনেচার আস্ক। একই ধরন, একই চলনে উচ্ছাস নিয়ে সবার আগে এই কথাটাই জিজ্ঞেস করবে ও, যতবার দেখা হবে। কথাটা ভেবে হেসে দেয় মীরা। মীরার হাসি দেখে অবাক হয়ে ফিওনা জিজ্ঞেস করে –

: “হাসলে যে”

: ” তুমি একটুও বদলাওনি তাই ভেবে”

: “বদলে যাওয়ার কথা ছিলো কি?”

উত্তরে মৌণ থাকে মীরা, এই মৌণতাই এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো।

গুমোট ভাব বিরাজ করলো চারপাশে, দুজনের প্রত্যেকেরই জানা আছে সব, তবুও সব ভুলে মিলিত হয়েছে দুজনে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মীরা বলে

: “বাসায় কেও নেই?”

: “ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে ছিলো আজ, ছোট মেয়েটা ঘুমিয়ে পরলো তাই আমি চলে এসেছি, বাকীরা সব সেখনেই আছে”

: ” আমার জন্য চলে আসতে হলো?”

: “আরে আজ আকদ ছিলো, আমি আর থেকে কি করতাম, অনুষ্ঠান হবে দুই সপ্তাহ পরে, তাই আফসোস করা লাগবে না তোমার ”

: ” কেমন আছো তোমরা সবাই?”

: “সবাই বলতে আমরা ভালোই আছি, বাবা গতবছর মারা গেছেন, ভাইয়া ব্যাবসা বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলেছেন, গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন বলে”

মীরার প্রশ্ন করার আগেই ফিওনা যেন উত্তর দিয়ে দিলো ওর জিজ্ঞাসার। মীরা অবাক হওয়ার ভান করে বললো-

: ” কেন?”

যেন এই প্রথম ও শুনলো খবরটা। যদিও এ খবর ও বেশ কিছুদিন আগেই পেয়েছে। ফিওনা এড়িয়ে গেলো প্রশ্নটাকে নাশতা আনার বাহানায়, বুঝতে পেরে মীরাও চেপে গেলো ব্যাপারটা। মীরা ফিওনাকে জিজ্ঞেস করলো-

: “তোমার বড় মেয়ে?”

: “ও রয়ে গেছে অনুষ্ঠানে”

: “তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি, তারাও কি যাবেন সাথে?

: ” না, এই বাড়িঘর ছেড়ে তারা কোথাও যাবে না”

: “ওহ্, সবাই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ”

: “হুম, কি করবে বলো, আমি সবসময় আমার বরের সাথে থাকতে চাই, সেটা হোক দেশ, কি বিদেশ, আমি কেবল ওর সঙ্গ চাই, তাইতে চাকুরীবাকরি সব ছেড়ে ছুড়ে ছুট লাগিয়েছি। দিনশেষে পরিবারই তো সব তাই না?

মীরার কেমন অস্বস্তি হয় কথাটা শুনে। ও তো বানের জলে ভাসা এখন। আচ্ছা ওর মেয়ে আর ও দুজন মিলে কি পরিবার হয় না? হয় বোধ-হয়। মনে মনে ভাবে মীরা৷ ফিওনা মীরাকে বলে –

: ” তুমি কত সুন্দর হয়ে গেছো মীরাপু, আমাকে একটু টিপস দিও রোগা হওয়ার”

কথাটা শুনে হাসে মীরা। তারপর বলে-

: ” যত সুন্দর আমি, ততোই মন্দ আমার ভাগ্য”

: “হুম, আমার খুব আফসোস হয়, আমার কাছে অতীত মুছবার ক্ষমতা থাকতো যদি, আমি তোমার পালিয়ে যাওয়াটা আটকাতাম”

মীরা মনে মনে ভবে- “আমিও”

: “তারপর তোমার মেয়ের ছবি দেখি, ওকে সাথে আনলে না কেন? ”
ফোনের গ্যালিরি খুলে ছবি দেখিয়ে বলে-

: ” আসার সময় ঘুমিয়ে পরলো”

: “কফি খাবে?”

: ” হুম, খাওয়া যায়”

ফিওনা কফি তৈরি করতে গেলে মীরা ওর নিজের ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পরে। মিনিট সাতেক পর কফির মগ হাতে ফিওনা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো-

: “বিয়ে করছো না কেন?”

মীরা যেন অবাক হয়ে গেলো ওর এমন প্রশ্নে। কফিতে চুমুক দেয়া অবস্থা চকিতে তাকালো ফিওনার দিকে৷ অন্যমনস্কতায় গরম কফিতে জিহ্বা পুড়ে গেলো হয়তো। ফিওনা নিজেকে সামলে বলে-

: “সরি অকওয়ার্ড প্রশ্ন করে ফেললাম”

: ” ইট’স ওকে, এসব শুন আমি অভ্যস্থ, আসলে এসব নিয়ে ভাবছি না”

: ” না ভাবলে তো চলবে না, ভাবতে হবে, একটা
কথা তেতো হলেও সত্য, কমবয়সী বিধবা বা সিঙ্গেল মাদারেরা তাদের সমাজের স্থিতিশীলতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং সাংসারিক জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝছো যে আমি কি বলছি?

মীরা একটু নড়েচড়ে বসে, ফিওনা এ বিষয়ে এভাবে বলবে ও কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি, তাই ওর অবাক হওয়াটা যেন একটু বেশীই। কফির মগ সেন্টার টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসে মীরা৷ এটা ওর উত্তর ভাবার প্রস্তুতি যেন।

ফিওনা ওর কোন জবাব না পেয়ে বললো-

: আমি তোমার সাহস, আত্ননিয়ন্ত্রণক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তোমাকে অসম্মানিত করছি না। নিঃসন্দেহে তুমি সাহসী, বুদ্ধিমতি, আত্মনির্ভরশীল একজন, তোমার মতো পরিস্থিতিতে পরা মেয়েরা নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা ভাবে, কিন্তু তুমি ঘুড়ে দাঁড়িয়েছো।

আমি শুধু অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আলোচনা করছি। জৈবিক চাহিদা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়, এর বিরুদ্ধাচারণ করাটাই বরং প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এবং তোমাকে ইন্ডিভিজুয়াল ধরে জাজ করার সময় কারোই নেই। আর তুমি না চাইলেও পুরুষরা তোমাকে অসহায় ভেবে নিয়ে তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবেই। এসব নি:সন্দেহে নোংরামি, তবে মানবপ্রকৃতি এভাবেই কাজ করে। তুমি নিজেকে সামলাতে পারবে, কিন্তু তোমাকে দুর্বল ভেবে তোমার প্রতি লোভের হাত বাড়ানো কয়টা পুরুষকে তুমি সামলাবে?” – কথাগুলোই একটানা বলে ফিওনা, মীরাকে হয়তো ধাতস্থ হতে সময় দিলো।

মীরা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকলো কফির মগের দিকে। ফিওনার কথা শুনে সদ্য ঘটে যাওয়া নোংরা ঘটনাটা মনে পরে গেলো ওর। সত্যি এ ঘটনাটা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে যত শক্তিশালীই হও তুমি মেয়ে, পুরুষের আগে তুমি কিচ্ছু না! নাথিং!

ফিওনা যেন ওকে সম্মোহন করবার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। মীরাকে এমন ভাবনায় রেখেই ও আবারে শুরু করলো-

: “মীরাপু দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের সোসাইটি এখনও ওরকম নয় যে একজন কমবয়সী বিধবা/ সিঙ্গেল মাদার সেখানে ইজ্জত রক্ষা করে সম্মানের সাথে একা বাঁচতে পারে। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক, সিদ্ধান্ত অবশ্যই তোমার। সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখানোর বিশ্রী প্রতিযোগিতায় মানুষ এমনটা ভাবে, যে আমি সবার ভাবনার বিপরীতে আলাদা কিছু করবো।
কিন্তু সমাজকে অস্বীকার করে কোন মানুষ স্বস্তিতে বাঁচতে পারে না। দেখো সমাজ, সমাজের লোক তোমার জীবণ যাপন করবে না, তোমার জীবণের কঠিন দিনগুলো, সাফারিং গুলো তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তাহলে তাদেরকে দেখানোর জন্য, তাদের চোখে নিজেকে আলাদা প্রমাণের চেষ্টা কেন?
তুমি আবার ভেবো না কথাগুলো তোমাকে কোন ইনটেনশন থেকে বলেছি, আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, কাজ, ব্যাস্ততা, খ্যাতি এসবে ডুবে থাকা তুমি জীবণের এই হিসেবটা করার সময় পাচ্ছো না হয়তো। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন”

এতক্ষণ পরে মুখ খুললো মীরা-

: “তুমি এসব বলতেই আসতে বলেছো তোমার বাসায়?”

: “ছিহ্ আপু, এই চিনলা তুমি আমাকে? সত্যি বলোতো আমি যা বলছি এক বিন্দু মিথ্যা আছে তাতে?”

মীরা আর্দ্র চোখে তাকায় ফিওনার দিকে, কথা গুলো ওভর ডোজ হয়ে গেছে ভেবে ফিওনা মীরার পাশের সোফতে এসে ওর হাতটা ধরে বলে –

: ” তোমাকে কষ্ট দেয়ার কোন ইন্টেনশন আমার নাই, আর আমার ভাইয়ের হয়েও কথাগুলো বলছি না, ওকে অনেক বুঝিয়েছি লাভ হয় নি, ওর হিসাব বাতিল খাতায়। সোজা বলে দিয়েছে বিয়ে ও করবে না। আমি কোন স্বার্থোদ্ধারেও কথা গুলো বলছিনা, বিশ্বাস করো”

: ” ফিওনা মিথ্যা বলবো না যে এসব নিয়ে আমি ভাবি না, বাসা থেকেও উঠতে বসতে মাথা খাচ্ছে সকলে,
এখনো কেন বিয়ে করিনি?, কেন করছি না? এটা নিয়ে আমার চেয়ে অন্যের দুঃখ বেশি । কোথাও কারো সাথে দেখা হলে ইনিয়েবিনিয়ে এসব কথাবার্তা বলে। এখন তাই এদেরকে এড়িয়ে চলি। এই এড়িয়ে যাওটাকে মানুষ নাম দিয়েছে অহংকার। আগে কষ্ট পেলেও ইচ্ছে করেই এখন এসব পাত্তা দেই না । মানুষ একটা সহজ বিষয় বোঝে না যে দিন শেষে কেউই একা থাকতে চায় না । বিয়ে, সংসার, সন্তান, সুস্থতা, সম্পদ এগুলো ভাগ্যে থাকা লাগে । কেউই শখ করে একা থাকে না ”

: “চেষ্টা তো করতে হবে? জীবণকে আরেকটা সুযোগও দিতে হবে। কত বয়স তোমার? মেরেকেটে ২৬ কি ২৮? এ বয়সে অনেকে বিয়েও করে না। আমার এক ক্লাসমেইট ৩০+ এখনো ওর বিয়েই হয় নি, তো ও কি হাল ছেড়ে দিয়েছে? দেয় নি, জীবণের এই পথটা অনেক বড়, দুদিন পর মেয়ে বড় হবে, ওকে বিয়ে দিবে, তখন হয়ে যাবে একা। এত এত ব্যাস্ততা হঠাৎ যখন ফুরিয়ে যাবে তখন? শোন জৈবিক চাহিদাটা নাহয় সরিয়েই রাখলাম, দিনশেষে মন খুলে কথা বলারও তো একজন থাকা লাগে তাই না? জীবণের উপর এমন অন্যায় তুমি করো না মীরাপু। যাকেই হোক বিয়ে করে সুখী হও।

: “ফিওনা আমি যতটা না আমার জন্য ভাবছি তার চেয়ে বেশী ভাবছি মেয়েটার কথা। ওর বাবাকে ও এখনো চিনে না, এদিকে ওর বাবা ওর দায়িত্ব নিবে না, আমি আমার মাথার উপর ছাদ চাই না ফিওনা, মেয়েটার মাথার উপর হাত রাখার এক জনকে চাই। বলো কে আছে এমন যে আমার আগে আমার মেয়েকে প্রাধান্য দিবে। আমি অনেক সেকেন্ড ম্যারেজ দেখেছি, যেখানে আগের ঘরের ছেলেমেয়ে নিয়ে অশান্তি হয়, কলহ বাঁধে, আমি আমার সুখের জন্য মেয়ের জীবণ নরক করতে পারবো না। বলা সহজ ফিওনা, বাস্তব অনেক কঠিন”

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। কে এলো ভাবতেই ফিওনা ডোর হোলো চেয়ে দেখে দারজার ওপাশে ওর একমাত্র ভাই আবীর ওর বড় মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ানো। হাত-পা হিম হয়ে যায় ওর। আতংকিত চোখে ফিওনা তাকায় ড্রইংরুমে থাকা মীরার দিকে। মীরারও ফিওনার তাকানো দেখে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায় শীরদাঁড়া বরাবর। আতংকে মীরা হঠাৎ উঠে বারান্দায় চলে যায়। ফিওনা কিছু না বললেও মীরা বেশ বুঝে নেয় দরজার ওপাশে কে দাঁড়ািয়ে!

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। কে এলো ভাবতেই ফিওনা ডোর হোলো চেয়ে দেখে দারজার ওপাশে ওর একমাত্র ভাই আবীর ওর বড় মেয়েকে নিয়ে দাঁড়ানো। হাত-পা হিম হয়ে যায় ওর। আতংকিত চোখে ফিওনা তাকায় ড্রইংরুমে থাকা মীরার দিকে। মীরারও ফিওনার তাকানো দেখে শীতল একটা স্রোত বয়ে যায় শীরদাঁড়া বরাবর। আতংকে মীরা হঠাৎ উঠে বারান্দায় চলে যায়। ফিওনা কিছু না বললেও মীরা বেশ বুঝে নেয় দরজার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে!

মীরাকে নিরাপদ দূরত্বে দেখে দরজা খুলে ফিওনা, দৌড়ে ঘরে ঢুকে মা’কে জাপটে ধরে রোদেসী। তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফিওনা, এমতবস্থায় আবীর মুচকি হেসে বলে-

: “কিরে ভিতরে আসতে দিবি না?”

: ” কেন আসছিস তুই আমার বাসায়? ”

: “বাপ্রে রাগ এখনো কমে নাই দেখি ”

: “তুই আমার কে যে তোর উপর রাগ করবো, মানুষ আপন লোকদের উপর রাগ করে, আমি তোর কিছু হই বল?”

বলেই দরজাটা ছেড়ে বসার ঘরে এসে বসে ফিওনা। আবীর ঘরে ঢুকে মেইন ফটক আটকে বসে ফিওনার ঠিক বিপরীত সোফাতে। যেখানে একটু আগে বসে ছিলো মীরা। গা এলিয়ে বসে আবীর, তারপর ভাগ্নী রোদেসীকে বলে-

: “তোর মা আমার উপর পুরো ক্ষ্যাপা, একটু বোঝা তোর মাকে”

রোদেসী মুচকি হেসে বলে-

: “কি বোঝাবো মামা, আমাকে শিখিয়ে দাও”

: ” তুই তোর মাকে বল- তোর নিরিহ মামার সাথে এমন না করতে”

রোদেসী আজ্ঞাবহের মতো বলে-

: ” মা তুমি আমার নিরিহ মামার সাথে এমন করো না”

ফিওনা মাথা নিচু করে কাঁদছিলো এতক্ষণ। একমাত্র বড় ভাইয়ের জীবণ এমন হলে কাঁদবারই তো কথা। মেয়ের কথা শুনে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে, তারপর রোদেসীকে বলে-

: ” তুমি ভেতরে যাও মা, আমি তোমার মামার সাথে কথা বলবো”

রোদেসী চিন্তিত মুখে বলে-

: ” মামাকে বকবে নাতো?”

যেতে বলেছি না মা, বড়দের কথার মাঝে থাকতে হয় না, তুমি যাও তোমার মামাকে বকবো না”

: “প্রমিজ? ”

: “হুম প্রমিজ”

আবীরের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো রোদেসী ভিতরে যাওয়ার আগে বলে-

: “আমাকে তুমি পিৎজা খাওয়াতে নিবা বলছো কিন্তু, মনে থাকে যেন” বলেই চলে যায় রোদেসী। ও যাওয়ার পর ফিওনা যথাসম্ভব গম্ভীরমুখে আবীরকে বলে-

: ” সেদিন তো খুব রাগ দেখিয়ে চলে গেলি, আজ কেন এসেছিস তুই?”

শান্ত কন্ঠে আবীর বলে-

: ” সেদিন তোর সাথে ঐভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত হয় নি, আসলে মেজাজ খারাপ ছিলো তখন। আজ আমি তোকে সরি বলতে এসেছি”

: ” সরি বললেই কি না বললেই কি? তুই তো তোর সিদ্ধান্তে অটল, নিজের জীবণ নিয়ে তুই যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছিস। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে তুই এমন করতে পারতি?”

: “ইমোশনাল কথাবার্তা বাদ দে, এসব বিষয়ে কথা বলতে আমার আর ভালো লাগে না, বেশ তো আছি আমি, আমার কোথায় দুঃখ দেখিস তুই আমি বুঝি না। একা থাকা যে কি শান্তির তা তোকে কে বোঝাবে”

: ” জীবণে চলার পথে কত মানুষের কত কিছু হয়, তাই বলে কি মানুষের জীবণ থেমে থাকে? তুই সেই এক যুগ আগেই পরে আছিস, সময় কিন্তু পরে নেই, সময় কিন্তু ঠিকই চলছে তার নিজস্ব গতিতে। একটা মেয়ে তোকে বিয়ে করে পরদিন পালিয়ে গেলো, এতে তোর দোষ কোথায়? তুই কেন মুভ অন করতে পারছিস না, কেন সেখনেই আটকে আছিস?”

: ” আটকে আছি কে বললো? বেশ তো আছি, তখন বয়স ছাব্বিশ ছিলো এখন আটত্রিশ ”

: ” আটকে যদি না-ই থাকিস তবে কেন তুই এত বছরেও বিয়ে করলি না? কেন তোর সব পেপারস্ এ ম্যারেইটাল স্ট্যাটাসে ম্যারেইড লিখা, কেন তোর পাসপোর্টে স্পাউসের জায়গায় “জিনিয়া আবেদীন মীরার নাম? বলবি আমায়?

: ” এ বিষয়ে এর আগেও বহুবার কথা হয়েছে, নতুন করে কিছু বলার নাই”

ফিওনা রাগান্বিত কন্ঠে বলে-

: ” আজ শেষ বারের মতো জানতে চাই আমি বল কেন? ”

বোনের অগ্নিমূর্তির সামনে কেমন নড়বড়ে হয়ে যায় আবীর। কিছু সময় মৌন থেকে আবীর বলে-

: ” তুই জানিস আমি খুবই সাদামাটা, নির্বিবাদী মানুষ,
বিয়ে জীবনে একটা করতে হয় করেছিলাম, বিয়ের পরদিন গিয়েছিলাম পাসপোর্ট তৈরি করতে। সেখানে স্পাউসের নাম দিতে হয়, দিলাম, সবকিছু শেষ করে বাড়িতে ফিরে শুনি এ কাহিনি। বল তখন কি করতাম আমি ওকে খুঁজতাম নাকি পাসপোর্টে ম্যারেইটাল স্যাটাস আর স্পাউসের নাম সংশোধন করতে যেতাম”

: “সে তো নূহ নবীর আমলের কাহিনী তুই ইয়ার্কি করবি না আমার সাথে, আমি মোটেও ইয়ার্কি করার মুডে নাই। এর পর তুই পাসপোর্ট রিনিউ করছিস দুই বার। এবারও কেন স্পাউসের নাম রেখে দিছিস তুই”

ফিওনার এমন যুক্তিযুক্ত কথার বিপরীতে চুপ করে বসে থাকে আবীর। এর উত্তর নেই ওর কাছে।

: ” কথা বলছিস না কেন? কেন তুই এত বছরে ও মুভ অন করলি না?, কেন ঐ মীরাতেই আটকে রইলি তুই?”

ফিওনার মুখে মীরার নাম শুনে কেমন যেন চমকে যায় আবীর। এর আগে ওদের মধ্যে কথাবার্তা হলে কখনো ওর নাম মেনশন করা হতো না। এমনকি ওদের মা বেঁচে থাকতেও মীরার নাম কেও তুলতো না বাড়িতে। ফিওনা
চুল খোঁপা করতে করতে বলে-

: “তোকে বললাম মীরাতেই আটকে আছিস যখন আমি ওর পরিবারের সাথে কথা বলি, নাহ্ সেইখানেও তোর সমস্যা ”

আবীর মুচকি হেসে বললো-

: ” তুই একটা মাথা মোটা, সহজ হিসেব বুঝিস না, ও যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো ওর বয়স তখন মাত্র ষোলো ছিলো, ষোলো বছরেই আমাকে মানতে পারে নি, আর এখন ওর বয়স আটাশ, তাছাড়া শুনেছি ও এখন মিলিয়নিয়ার, বিশাল ব্যাবসায়ী মানুষ। ওর কি বরের অভাব হবে? ও কোন দুঃখে নিঃস্ব আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? বুঝা আমাকে”

: ” তুই নিঃস্ব?! তোর এটাই সমস্যা, তুই নিজেকে নিঃস্ব মনে করিস। আল্লাহর রহমতে এখনো যা আছে তা দিয়ে তোর জীবণ পার হয়ে যাবে হেসেখেলে। এসব ভুগিজুগি কথা তুই বাদ দে”

প্রসঙ্গ এড়াতে আবীর বলে –

: “আচ্ছা ভেবে জানাবো তোকে”

: “কোন ভাবাভাবি নাই, এক্ষণ বলবি তুই”

একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলে-

: ” এমন ভাবে বলছিস যেন আমার হ্যা/না এর উপর ঝুলে আছে ব্যাপারটা”

: ” অনেকটা তেমনই, ইরার সাথে আমার কথা হয়েছে, ও বলেছে ওর মেয়েকে বাবার মতো ট্রিট করবে এমন কাওকে খুঁজতে বলেছে মীরা। মেয়েটা এখনো দেখেইনি ওর বাবাকে? ওকে বলা হয়েছে ওর বাবা বিদেশ থাকেন। বাচ্চাকাচ্চা তোর অনেক পছন্দ, এটা কোন সমস্যা না সেটা আমি জানি। আর তুই না বললেও আমরা ঠিকই বুঝি এখনো তুই মীরাতেই আটকে আছিস। আবেগ লুকাতে গিয়ে জীবণের সবচেয়ে সুন্দর সুযোগ হারাতে বসেছিস তুই। আবার তোদের এক হওয়ার এ সুযোগটা হারাস না ভাই আমার, হয়তো খোদাও তাই চায়। তোদের দুজনকে আরেকটা সুযোগ দিতে।

: “তাঁর সাথে (আল্লাহর) আমার অনেক অভিমান বুঝলি, আমি কখনো কারো সাথে ফ্লার্ট করি নি, কারো টাকাপয়সা মেরে খাইনি, কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করি নি। তিনি এর উপহার হিসেবে জীবণে সব দিলেন। আবার কেড়েও নিলেন। মায়ের পছন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম তা সত্যি কিন্তু ছোট থেকেই ওকে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। যেদিন আমাদের বিয়েটা হলো সেদিন আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের একজন ছিলাম। কিন্তু তিনি আমার সুখ সহ্য করলেন না, পরদিনই সব এলোমেলো করে দিলেন”

: “যা হওয়ার তা হয়েছে, এতেই হয়তো তোদের দুজনের মঙ্গল ছিলো। সে-সব বলে মন খারাপ করে সময় নষ্ট করার দরকার কি বল? আমি তাহলে তাদের সাথে কথা বলি?”

আবীর ফিওনার দিতে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে, তারপর এলিয়ে দেয়া শরীরটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে টেবিলে রাখা পানির গ্লাস ঘুরাতে ঘুরাতে বলে-

: “তুই না বললি তিনি(আল্লাহ) হয়তো চান আমরা আবার এক হই, আমি মেয়ে সহ-ই বিয়ে করবো ওকে। ওর মেয়েকেও আমি আমার পরিচয়ে বড় করবো, তবে আমার একটা শর্ত আছে”

: “কি শর্ত?”

: ” আমি সবকিছু গুটিয়ে নিয়েছি গ্রামের বাড়ি চলে যাবো বলে, ও যদি সব ছেড়ে ছুড়ে আমার সাথে সেখানে যেতে পারে আমার কোন আপত্তি নেই”

ফিওনা স্তব্ধ হয়ে যায় ওর কথা শুনে, বসা থেকে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে-

: “তুই জানিস কি বলছিস? ”

: “আমি যা বলেছি ভেবেই বলেছি, তিনি যদি সত্যি চান আমরা আবার এক হই তাহলে এটাই আমার শর্ত”

ফিওনা রেগে বলেন-

: “তুই ফাতরামি শুরু করছিস আমার সাথে? এটা তো পাগলও বুঝবে যে- ওর এত কষ্ট, পরিশ্রমে তৈরী ব্যাবসা, যা এখন সাফল্যের শীর্ষে দাঁড়িয়ে তা ফেলে ও তোর সাথে যাবে না”

কিছু সময় স্তব্ধ বসে থেকে ফিওনা আবারো বলে-

: “আমি বুঝে গেছি ভাই যা বোঝার, তোর লাইফ তোর ডিসিশন, এটলিস্ট আমার কোন গিল্ট থাকবে না, কারন আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি তোর জীবণ স্যাটেল করার। আমি বাকী জীবণে আর কোনদিন এ বিষয়ে কোন কথা বলবো না, খোদার কসম করে বললাম। তুই যা এখন”

: ” রাগ করলি? আচ্ছা যাচ্ছি এক কাপ কফি হবে?”

চোখের পানি মুছে ফিওনা রান্নাঘরের দিকে যায় আবীরের জন্য কফি আনতে৷ এদিকে আবীর থুম মেরে বসে থাকে। জটপাকানো মাথার তার খুলতে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বলাতে বারান্দায় যায়। ও তো জানে না মীরা সেখানেই দাঁড়িয়ে। ওকে আসতে দেখে ভীত মীরা বারান্দার আরো পিছনের দিকে চলে যায়। রোদে শুকাতে দেয়া কাপড় আড়াল করে রাখে মীরাকে আবীরের কাছ থেকে । মিষ্টি একটা গন্ধে বারান্দাটা ভরে গেলো ওর আগমনে। ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরায় আবীর। নিকোটিনের গন্ধ দখল নেয় বারান্দার বাতাসের। দূর থেকে শুকাতে দেয়া কাপড়ের ফাঁক থেকে লুকিয়ে তা অবলোকন করে মীরা।

আবীর!
কতোদিন পর দেখলো মীরা ওকে। কত দিন না ঠিক কত বছর! ওদের বিয়ের দিন রাতে শেষ দেখা হয়েছিল মুখোমুখি দুজনের। আবীর বলেছিলো শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে। না সে দেখা হয় নি আর দুজনের। এমনকি ডিভোর্সের দিনও আসেনি আবীর।

এত ভালোবাসা বুকে তবু্ও শর্ত কেন মুখে? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় মীরার। না কোন ভালোবাসা থেকে এ জানতে চাওয়া না, এত বছর নিজেকে মীরার বিবাহিত স্বামীর পরিচয় বয়ে নেয়ার তরে এ জানতে চাওয়া মীরার। মীরা খুব বুঝতে পারে শর্তের আড়ালের অভিমানকে। কিন্তু অভিমান ভাঙার মতো শক্তি, সাহস, সামর্থ্য কোনটাই নেই ওর।

জ্বলন্ত আগুন সিগারেট শেষ করার আগেই দিনের আলো শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামে চারপাশে। সন্ধ্যার লালচে আলোয় কেমন যেন অসহায় দেখায় আবীরকে। মীরার ইচ্ছে করে কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে৷ কিন্তু যা ভাবা যায় তা করা কি এত সহজ?

মীরার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। এই সাদামাটা, নির্বিবাদী মানুষটার জীবণ নষ্টের জন্য ও একমাত্র দায়ী। মাগরিবের আজান পরে চারপাশে একযোগে। মীরা চেখ বন্ধ করে মনে মনে বলে- খোদা তুমি যা জানো তা আমি জানি না, যদি এতেই আমার কল্যান থাকে তবে এই পাপ মোচন করার একটা সুযোগ তুমি আমাকে দাও”

সিগারেট শেষ করে আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে আবীর। দমকা একটা বাতাস বারান্দার কাপড় গুলোকে নাড়িয়ে যায়। নাহ্ এতে আবীরের দৃষ্টি গোচর হয় নি মীরা। নিকোটিনের গন্ধ গুলো সরিয়ে নিতে এসেছিলো তারা। এরপর ধীরে ধীরে আবারো আবীরের শরীরের আতরের সু-মধুর গন্ধে ভরে উঠে চারপাশ। মীরা মনে মনে ভাবে এটা কি নিছক একটা ঘটনা নাকি কোন কিছুর ইঙ্গিত?

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সেদিন ফিওনাদের বাসা থেকে বের হয়ে মীরা সোজা চলে যায় ওর নিজের বাসায়। রাতে মায়ের বাসা থেকে খেয়ে ফিরবার কথা থাকলেও রিকশা নিয়ে ও নিজের বাসায় পৌঁছে যায় ৷ ভরাক্রান্ত মন নিয়ে রুমে ঢুকে জুতা, ব্যাগ সবকিছু রাখার পর নিজের ঘরে ঢুকে বিছানার সম্মুখ প্রান্তে থুম মেরে বসে থাকে ও৷

একা ঘরে তখন যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ফিওনা আর আবীরের বলা কথা গুলো একে একে।

ফিওনার একটা কথা ওর মনের ভিতরে যেন তীরের ফলার মতো বিঁধে আছে এখনো “আমার কাছে অতীত মুছবার ক্ষমতা থাকতো যদি, আমি তোমার পালিয়ে যাওয়াটা আটকাতাম” এত সব সমস্যা, বিপত্তির ঐ একটাই কারন। একটাই সমাধান যেন।

ওদের দুই ভাইবোনের মধ্যে ফিওনা সুন্দর, আর আবীর কালো, ফিওনা মোটা, আবীর এখনো আটত্রিশ বছর বয়সেও নিজের ফিটনেস ধরে রেখেছে। আবীর লম্বা, ফিওনা খাটো। দুই ভাইবোনের এমন হাজারো অমিলের মধ্যে একটা মাত্র মিল হচ্ছে “ওদের কথা বলার সহজ ভঙ্গি” কোন কপটতা নেই, রাখ ঢাক নেই, সহজে ওরা কত কঠিন আবেগকে শব্দে রূপান্তর করে বলে ফেলে সামনে থাকা মানুষটাকে। এমন অনেকেই আছে যারা সহজ কথা, সহজ আবেগটাও প্রকাশ করতে পারে না অপর দিকের মানুষটার কাছে, এজন্যই হয়তো একসাথে বছরের পর বছর থেকেও চেনা যায় না কাছের জনকে৷ যেমন মীরা নিজে চিনতে পারেনি একই বিছানা ভাগ করে নেয়া রাজিবকে। এরা দু’ভাইবোন কত কঠিন বিদ্যা আয়ত্ত করে বসে আছে তা হয়তো নিজেরাও জানে না।

মীরা ঠিক বুঝে ফিওনা ওকে ইন্টেনশনালি বলে নি কথাগুলো। সবকিছু একপাশে রেখে ও মীরার ভালো চায়। এজন্যই হয়তো ফিওনা ওকে বোঝানোর সময় বলেছিলো- “ভাইয়ের হিসাব বাতিলের খাতায়” তার মানে এসব নিয়ে বেশ আগে থেকেই যুদ্ধ হচ্ছে দু’ভাইবোনে। মীরা নিজের কানে না শুনলে হয়তো বুঝতেই পারতো না আবীরের জীবণটা কতটা এলোমেলো করে দিয়ে ও বের হয়েছিলো বিয়ের পরদিনের মধ্য দুপুরে। ভাবনার ঠিক এই মুহুর্তে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো মীরা। চোখ বন্ধ করতেই চোখে ভেসে উঠলো বিয়ের রাতের সেই ক্ষণেক দেখা করার মুহূর্তটা। ধ্বংসস্তুপের মতো এককোণে বসে থাকা নবোঢ়া মীরার সামনে লাজুক দৃষ্টিতে দূরত্ব রেখে বসেছিলো ওর স্বামী আবীর! হ্যা মীরার স্বামী আবীর।

না কাছ ঘেঁষে বসার চেষ্টা, না কোন ছুতোয় হাতধরা, না চোখে চোখ রেখে তাকানো। দূরত্ব রেখে বসে নব বিবাহিতা স্ত্রীকে বলেছিলো ভালোবাসার আবেগমাখা প্রথম উক্তি – “খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হচ্ছে”

কত সরল বিবৃতি সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর প্রতি।

রাগে ঘৃণায় বুদ থাকা মীরা একবারও তাকিয়ে দেখেনি আবীরের দিকে। তবে আজকের গোধূলির রহস্যময় আলোতে দেখা আবীরের চেহারা ভাবতেই দুই চোখ গড়িয়ে পানি পরে মীরার। এতদিন ও জানতো যে আবীর বিয়ে করেনি, কিন্তু আজ যা জানলো, নিজ কানে যা শুনলো তাতে ও আবীরের জীবণ শুধু এলোমেলোই না, ধ্বংসস্তূপও করে দিয়েছে তা খুব বুঝেছে ও। নিজের সুখ খুঁজতে গিয়ে ও অন্য একজনকে শেষ করে দিয়েছে। এতদিন ধরে দেখেছে মেয়েরা শত অবহেলা, বঞ্চনা, সহ্য করেও স্বামীর পরিচয় নিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়৷ কিন্তু আবীর! একটা ছেলে হয়ে নিজে বিবাহিতের তকমা লাগিয়ে, পাসপোর্টে স্পাউসের নাম রেখে দিয়ে নিরবে লালন করেছে মীরার প্রতি ওর অকৃত্রিম ভালেবাসার।

সংসার করলে কিংবা বন্ধুত্বে, এমনকি মা-মেয়েতেও, দুটো মানুষ যখন একসাথে থাকে খুব স্বাভাবিক ঝগড়া, অভিমান হয়েই থাকে। তখন একে অপরকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শত্রু। কেও কারো ছায়াও মাড়ায় না, কখনো কখনো তো খু*ন করার কথাও ভাবে। কিন্তু এতবড় ক্ষতি করার পরও আবীর মীরাকে ওর জীবণের অংশ করে বয়ে বেড়িয়েছে সন্তর্পণে।

মীরার হঠাৎ মনে পরে আবীরের বলা ঐ শর্তের কথা। মীরা খুব টের পায় এমন শর্তের তলে এত বছরকার জমানো অভিমানের। কিন্তু যা ও করে এসেছে এক যুগ আগে তাতে আবীরের কাছে যাওয়াটাই তো শক্ত, ওকে বোঝানো, ওর অভিমান ভাঙানো তো অসম্ভব মীরার পক্ষে। তার উপর ফিওনার থেকেও কোন প্রকার সাহায্য পাবে না ও। কারন ফিওনা কসম কেটে বলেছে এসব বিষয়ে ও আর একটা কথাও বলবে না ও কোনদিন। তাহলে?

বিছানা ছেড়ে উঠে বসে মীরা৷ চোখ মুছে ভাবে চমৎকার ঐ মানুষটা এমন বিশ্রী লাইফ ডিজার্ভ করে না। ঠিক এমন সময় বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দরজার ডোর হোলে চেয়ে দেখে কেও নেই। মাজেদা খালা নূহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে ওকে খুশি করতে এমন করে মাঝে মাঝে। ভাবতেই দরজার সামনের কেচি গেইটের তালা খুলে৷

দরজা খুললে মীরা কাওকে দেখেনা আশেপাশে। হঠাৎ ওর চোখ পরে দরজার সামনে একটা ফ্লাওয়ার বুকের দিকে। অসম্ভব সুন্দর এই বুকের সবগুলো ফুল সাদা টিউলিপ। যেন শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছে সে। ফুলগুলো দেখে উচাটন মনের পারদ কেমন দপ করে নিন্মমুখী হয় মুহূর্তেই। তবে আশেপাশে কেও নেই। কে দিলো? ভুল করে এখানে এনে রাখেনি তো? এসব

ভাবতেই বুকেটা তুলে নেয় মীরা।

দরজা আটকে কে পাঠালো ভাবতে ভাবতে সেখানে থাকা কার্ডটা খুলে দেখলো সেখানে কার্সিভ হ্যান্ডরাইটিং এ লেখা – Sorry…

ছোট্ট একটা শব্দই এর প্রেরকের ঠিকানা যেন ঘোষনা করলো নিঃশব্দে। তখনই মীরা বুঝে গেলো এটা ভুল না ঠিক ঠিকানায়ই পৌঁছেছে। ফুলের বুকেটা বিছানার উপর রেখে সোফায় বসলো মীরা৷ শরীর এলিয়ে দিয়ে ও চলে গেলো ফ্লাশ ব্যাকে….

এওয়ার্ড অনুষ্ঠানের পর পরই বার্ষিক বনভোজনের এক অনুষ্ঠানে দাওয়াত পায় মীরা। ওদের ব্যাবসায়িক কমিউনিটিতে প্রতিবছরই এমন আয়োজন করে। প্রত্যেকের নিজ নিজ বায়ারদের মেইন কন্ট্রাক্ট সবমিটেরর পর বছরের এ সময়টা সবারই প্রায় মন্দা চলে। অনেকে অবশ্য এখান ওখান থেকে সাব কন্ট্রাক্টের কাজ দিয়ে স্টাফদের এঙ্গেজ রাখে৷ টানাটানির এ কাজে লাভ হয় না তেমন, তবে স্টাফদের বেতন, কারখানার আনুসাঙ্গিক খরচ উঠে যায়। তাই এ সময়টা নিজেদেরকে চাঙা রাখতে অনেকেই এমন প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করে। মাঝে মাঝে কারখানায় হয় চড়ুইভাতি। এবারও তার ব্যাতিক্রম না।

মীরা প্রতিবারই যাবার চেষ্টা করে। এবারও যাবে বলে মন ঠিক করে। মা, মাজেদা খালা, নূহা আর মীরা এ চারজনের জন্য টিকিট বুক করে মীরা। তমা, ফাহাদ দুজনের কেওই যাবে না। তমার পরদিন পরীক্ষা আর ফাহাদের নিজের বিয়ের জন্য পাকা মেয়ে দেখার কথা আছে৷

এবারকার বনভোজনটা বনে হবে না, হবে নদীতে। ঢাকা – চাঁদপুর – ঢাকা। সে অনুযায়ী সবকিছু প্রিপ্রেয়ার করছিলো মীরা। আগের দিন হিসাবপত্র করতে বেশ রাত হয় মীরার৷ আউটলেট গুলোর হিসেব ও দিনেই শেষ করেছে। কারখনায় নতুন মালপত্র ঢুকেছে তাই বাড়তি এই ঝামেলার জন্য এত দেরি হলো আজ। কারখানা থেকে বের হতে হতে সাড়ে দশটার মতো বেজেছে। বাড়ি ফিরবার পথে ফাহাদ বলেছিলো মীরাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা। মীরা নিষেধ করে বলেছে ও একা যেতে পারবে, ও বরং তমাকে যেন ওর বাড়িব অবধি পৌঁছে দেয়।

যেই ভাবা সেই কাজ। মীরা পরদিন পরার জন্য ড্রেস তৈরী করেছিলো, ভেবেছে চাঁদপুর নেমে কয়েকটা ছবি তুলে নিবে। বনভোজন ও হবে সাথে ফটোশুট ও।

সেই ব্যাগটা নিয়ে রিকশা নিয়ে নেয়৷ রিকশা কিছুদূর চলতেই চানখারপুল মোচরে একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় ওদের রিকশার সামনে। রাত সাড়ে দশটা বাজে, এ জায়গাটা রাতেরবেলা নিরিবিলিই থাকে। প্রায়ই দেখা যায় নেশাখোরদের আড্ডা। মীরা ভাবে গাড়িটা ইউটার্ন নিবে হয়তো। কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে যখন দুটো ছেলে তেড়ে এলো ওদের রিকশার দিকে তখন মীরা সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই যেন বুঝে গেলো সব। কি করবে তা ভাবার আগেই যা হওয়ার তা হয়ে গেলো। মীরাকে গাড়িতে তুলে নিলো ওরা, গাড়িতে উঠেই সেন্স লেস হয়ে গেলো মীরা৷ চোখ টেনে মেলে রাখতে পারছে না মীরা, নিশ্বাসের সাথে কিছু একটা শরীরে ঢুকে ক্রমশ অবচেতন করে দিচ্ছে ওকে। প্রাণপণে চেষ্টা করে ও চোখ খুলে রাখার। কিন্তু একটা সময় মীরার সব চেষ্টা যেন ম্লান হয়ে ওরে। চোখ বন্ধ করার আগে মীরা দেখলো গাড়িটা সেখান থেকে মুভ করে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠে দ্রুতবেগে চলছে।

শীতের রাতে অন্ধকার ঐ রাস্তায় কেও জানলোও না

কি হয়ে গেলো। মধ্যবয়সী রিকশা ড্রাইভার কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে আছে। সংবিৎ ফিরলেই ঝামেলা এড়াতে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পরেন তিনি। রিকশায় রয়ে গেলো মীরার নডুন ড্রেস ভর্তি ব্যাগটা।

যখন মীরার জ্ঞান ফিরলো তখন ওর সময়জ্ঞান নেই। ঠিক কতক্ষণ পর ওর ঘুম ভাঙলো ও তা জানে না। একটা সুসজ্জিত ঘরে শুয়ে ছিলো ও। মাথায় হালকা ব্যাথা অনুভূত হয় ওর। ঐদিন রাতের ঘটনাটা মনে পরতেই ব্রেইনকে যথাসম্ভব ফোর্স করলো ও।

কে সে?

যার নির্দেশে ও এখন এইখানে ?

ভীত সন্ত্রস্তা মীরা বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে খাট থেকে পা দুটোকে নামলো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পানির কথা ভাবতেই সাইড টেবিলের গ্লাসের দিকে চোখ গেলো মীরার। গ্লাসটা হাতে নিয়ে পানি সবটুকু পানি খেলো এক নি:শ্বাসে। গ্লাসটাকে সেখানে নিঃশব্দে রেখে উঠে দাঁড়ালো ও। ভয়ের দখল তখনো ওর মন জুড়ে।

পা টিপে টিপে জানালার কাছে গেলো ও। ভারী পর্দা সরাতেই দেখলো বাইরে খোলা জায়গা। একপাশে যত্ন করে তৈরী করা বাগান, আর অন্যপাশে বসার জন্য কটেজ টাইপ ব্যাঙের ছাতার আকৃতির বিশাল ঘর। যার চারপাশই খোলা। সেখানে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। চারপাশের ঘন অন্ধকার আর নিশ্ছিদ্র স্তব্ধতা জানান দিচ্ছে এখন মধ্যে রাত। কান পেতে দূর থেকেও কোন শব্দ শুনতে পেলো না ও। পর্দা ছেড়ে সময় দেখতে ঘরে ঘড়ি আছে কিনা তা খুঁজতেই চোখ আটকে গেলো কিং সাইজ লাক্সারিয়াস ফ্লোর বেডের উপরের বিশাল দেয়ালে থাকা নিজের ছবির ওপর। ছবিটা ল্যান্স স্কেপে তোলা । সাইড টেবিলে রাকা ল্যাম্পের আলোটা এমন ভাবে রাখা যেন ছবিটাকে দেখাতেই সব চেষ্টা তার। দ্রুত পায়ে ছবিটার কাছে গেলো মীরা। লাল টুকটুকে গাউন পরে রিকশায় বসে হুড ফেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিলো মীরা, তখনকার তোলা ছবি এটি। এটা যে প্রোগ্রামের দিনকার তোলা ছবি, তা বুঝে গেলো ও মুহূর্তেই। মীরার দিকে ফোকাস করে তোলা ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার করা। ও যে রিকশায় বসে ছিলো তা একটুও বোঝা যাচ্ছে না। ছবিটায় এত সুন্দর করে তোলা এবং এডিট করা যে তাতে প্রোফেশনাল কাজের ছাপ স্পষ্ট, এবং ছবিটা দামী লেন্সে তোলা।

ছবিতে মীরা বাম হাত উঁচু করে বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করছে। এত আবেদনময়ী লাগছে ছবিটা যে মীরার নিজেরই নিজেকে নিয়ে গর্ব হলো। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে গ্রীক পুরাণের নার্সিসাস মনে হলো। যে নিজের সৌন্দর্যে এত গর্বিত ছিল যে যারা তার প্রেমে পড়ত তাদেরকে সে প্রত্যাখ্যান করে দিত। পার্থক্য কেবল নার্সিসাস পুরুষ আর মীরা মহিলা।

ছবিটার কাছে গিয়ে ভুল ভাঙে ওর। এটা কোন ফটোগ্রাফ না, বিশাল ক্যানভাসের উপর হাতে আঁকা পেইন্টিং এটি। নিচে লেখা সিগনেচারে গতকালকের তারিখ দেয়া। তারমানে এটা আঁকা শেষ হয়েছে গতকাল।

ছবিটায় হাত বুলায় ও। শিল্পীর কি সুন্দর আঁকার হাত! সেখানে দাঁড়িয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখলো মীরা। দামী আসবাবে ঘেরা চারপাশ। ব্লেজার রাখার জায়গা, ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা প্রসাধন দেখে রুমটা যে কোন পুরুষের তা খুব বুঝতে পারলো মীরা। এতক্ষণ এটাকে কোন রিসোর্ট ভাবলেও এখন ও বুঝে গেছে এটা কোন ভাড়া করা রিসোর্ট না। এটা করো ব্যাক্তিগত বাংলো বাড়ি।

পা টিপে দরজার কাছে যেতেই দেখলো দরজাটা খোলা৷ দরজা খুলতেই মীরা দেখে হলরুমের বিশাল টিভিতে মানি হাইস্ট সিরিজ দেখছে কেও। পর্দাতে ভেসে আছে হাত-পা বাঁধা টোকিওর ভয়ার্ত মুখ। এ যেন মীরার আরেক রূপ। ভয়ার্ত টোকিওকে টিভির স্ক্রিনে রেখেই সেখান থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুমে তাকায় মীরা। পুরো রুমটা অন্ধকার এবং ফাঁকা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে অন্ধকার ঘরটায় টিভির দিকে মুখ করে রাখা সোফায় একটা মাথা জেগে উঠলো এদিক ফিরে শব্দের উৎস দেখবে বলে। ঐ জেগে উঠা মাথাটা এদিকে ফিরে দেখার আগেই মীরা দরজা আটকে ফেলে ভিতর থেকে…

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পা টিপে দরজার কাছে যেতেই দেখলো দরজাটা খোলা৷ দরজা খুলতেই মীরা দেখে হলরুমের বিশাল টিভিতে মানি হাইস্ট সিরিজ দেখছে কেও। পর্দাতে ভেসে আছে হাত-পা বাঁধা টোকিওর ভয়ার্ত মুখ। এ যেন মীরার আরেক রূপ। ভয়ার্ত টোকিওকে টিভির স্ক্রিনে রেখেই সেখান থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুমে তাকায় মীরা। পুরো রুমটা অন্ধকার এবং ফাঁকা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে অন্ধকার ঘরটায় টিভির দিকে মুখ করে রাখা সোফায় একটা মাথা জেগে উঠলো এদিক ফিরে শব্দের উৎস দেখবে বলে। ঐ জেগে উঠা মাথাটা এদিকে ফিরে দেখার আগেই মীরা দরজা আটকে ফেলে ভিতর থেকে।

টিভির শব্দ হঠাৎ থেমে গেলো। ভয়ে মীরার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। একটা শব্দ ক্রমাগত দরজার কাছে আসছে। থপ, থপ, থপ, থপ…

এ যেন পায়ের শব্দ না, মীরার হৃদয়ে হাতুড়ি পেটা করছে কেও। দরজার সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। একেবারে দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো কেও। দরজায় কড়া নাড়লো। এমন ভয়, ত্রস্ততার অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি মীরার। কি করবে কিছুই ভাবতে পারছে না ও। রুমের চারপাশে তাকিয়ে ওর ফোন খোঁজার চেষ্টা করলো মীরা। ফোনটা বিছানার পাশেই ছিলো। দৌড়ে গিয়ে ফোনটাকে তুলে নিলো ও।

ফোনটা সুইচঅফ করা। ফোনটা খুলতে খুলতে আশেপাশে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করলো এটা কোথায়, কিংবা কে ওকে তুলে এনেছে তা জানতে কোন ক্লু পায় কি-না তার খোঁজে । আলমারীর দরজা খোলার শব্দের সাথে আরো একটা দরজা খোলার শব্দ এলো পেছন থেকে।

যে দরজাটায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ও কিছুক্ষণ আগে সেটা আলমারি যে দেয়ালে সেখনেই, এবং সে দরজাটা ওর চোখের সামনে বন্ধ। খোঁজাখুঁজি রেখে থমকে দাঁড়ালো মীরা, ওর হৃদপিণ্ড বন্ধ হবার জোগাড়। পিছন ফিরে যে দেখবে তারও সাহস নেই। ধীর গতিতে পায়ের শব্দটা কাছে আসছে ওর। পেছনে কে তা দেখার ইচ্ছা এবং ভয় দুটো অনুভূতির যুদ্ধ চলছে তখন মনে। শেষমেশ ইচ্ছাটাই জিতলো। ঘুড়ে দাঁড়ালো মীরা। টিশার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন!

সায়ন!? ওকে দেখে ভয়, ত্রস্ততা সব উবে গিয়ে

মেজাজ বিগড়ে যায় মীরার। ও বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে-

: “তুমি?”

সায়ন মুচকি হেসে বলে-

: “কেন অন্য কাওকে আশা করেছিলে?”

মেজাজ আরো খারাপ হয় মীরার, কত বড় অভদ্র বয়সে বড় কারো অনুমতি না নিয়েই তুমি করে বলছে। মীরা রাগী কন্ঠে বলে-

: ” এসবের মানে কি?”

সায়ন ধীর পায়ে কাছে আসতে আসতে বলে-

: “আমি যায় চাই তা-ই পাই, আর আমি যদি তা না পাই, তাহলে কেও-ই তা পায় না”

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে মনে ভয় ধরে যায় মীরার। যেন কিছু ভর করেছে ওর উপর। এ সায়নকে মীরা চিনে না। চোখেমুখে কিসের যেন একটা আদল, তখনো ধীর পায়ে কাছে আসছে ও। আলমারি ছেড়ে দরজার কাছে যেতে চায় মীরা। যাতে ও এখান থেকে বের হতে পারে। কিন্তু সায়ন ওর কাছাকাছি এসে পরলে মীরা ওকে সেখানেই থামতে বলে। সায়ন আজ্ঞাবাহের মতো থামে,

: “কি চাও তুমি? এসব কেন করছো?”

: ” সেই কবে থেকে বলছি আমি তোমাকে নিজের করে পেতে চাই” বলে আবারো মীরার কাছে আসতে থাকে সায়ন।

: ” আর এক কদমও আসবে না তুমি”

সায়ন মীরাকে যেন শুনতে পেলো না, ও তখনো আসছে মীরার কাছে। মীরা বুঝে গেছে রাগারাগি , বিরক্তি দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। তখন মীরা সাহস করে কপট রাগী কন্ঠে ওকে বলে-

: ” দেখো সায়ন তুমি আমার থেকে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট, তাছাড়া আমি তোমাকে আমার ছোট ভাইয়ের চোখে দেখি৷ তুমি এই মুহূর্তে আমাকে আমার বাসায় পৌঁছ দিয়ে আসবে”

: “যদি না দিই”

এবার মীরার যেন ধৈর্যচ্যুত হয়, রাগে ওর শরীর কেঁপে ওঠে, ও সায়নের কাছে তেড়ে গিয়ে বলে-

: ” এসব করে তুমি কি প্রমাণ করতে চাও, তুমি বিশ্ব প্রেমিক? ফালতু ছেলে কোথাকার, নাক টিপলে এখনো দুধ বের হয় সে ছেলেপেলের এটিটিউট, সাহস দেখে বিরক্ত লাগে, তুমি এই মুহূর্তে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবে” বলেই আলমারির কাছে পরে যাওয়া ফোনটা তুলতে যায় মীরা। এমন ভাব যেন ওর কথা মেনে নেয়া ছাড়া সায়ন নিরুপায়।

মীরার মুখে ঐ কথাটা শুনে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন সায়নের। ও মীরার দিকে তেড়ে এসে মীরাকে ওর দিকে ঘোরায়, মীরা কিছু বোঝার আগেই মীরার দুই কান চেপে ধরে। কি হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে মীরা ঝাড়া দিয়ে ওর হাত সরিয়ে তৎক্ষনাৎ সায়নের গালে একটা থাপ্পড় দেয়।

তারপর ফোন হাতে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে নেয় ঘর থেকে। সায়ন গালে হাত রেখেই পিঁছু নিয়ে অন্য হাত দিয়ে মীরার হাত চেপে ধরে। এবার মীরা সত্যি ভয় পায়। সায়ন টেনে মীরাকে কিছুমাত্র ভাবার অবকাশ না দিয়ে মীরার দুই হাত চেপে ধরে আলমারীর গায়ে৷ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ও মীরার চোখে। মীরা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সায়নের সাথে পেরে উঠে না। সায়ন রাগি গলায় বলে-

: “আমার নাক টিপলে এখনো দুধ বের হবে না, আমি খোকা! ”

তারপর কি ভেবে হুট করে গভীর চুমু খায় সায়ন মীরার ঠোঁটে। সায়নের কাছ থেকে বাঁচতে দুই হাত দিয়ে ওকে দূরে সরাতে চেষ্টা করে মীরা। কিন্তু শরীরের সব শক্তি এক করেও মীরা ওর থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারেনা। সায়ন গভীর চুমু একে দেয় মীরার ঠোঁটে। ততক্ষণে ওকে আটক রাখা হাত দুটোর একটা মীরার পিঠে আরেকটা মীরার মাথায় রেখেছে সায়ন। মীরা ছাড়া পেয়ে দুই হাতে সরাতে চাইছে ওকে।

দীর্ঘ চুমু খাওয়া শেষে সায়ন যখন মীরাকে ছাড়ে মীরা জড় পদার্থের মতো আছড়ে বসে পরে মাটিতে। যেন ভুমিকম্পে আছড়ে পরেছে কোন ইমারত।

বেসামাল মীরার হাত লেগে সেখানে থাকা কাঁচের ল্যাম্পশেড পরে ভেঙে যায়। কাঁচের একটা টুকরোতে হাত কাটে মীরার। সায়নের এসবে খেয়াল নেই। ওর খাটে বসে সায়ন বলে-

: ” আমি জানি না কোন দিকে আপনার আমাকে অযোগ্য মনে হয়? আমি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি মীরা৷ আর আমি কেবল আপনার জীবনসঙ্গীই না, নূহার বাবাও হতে চাই”

মীরা যেন এসব কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ও দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদছে। সায়ন মীরার কাছে এসে সরি বলে ওর দিকে তাকাতেই দেখে মীরার হাত দিয়ে দরদর করে রক্ত পরছে। মীরার হালকা গোলাপী রঙের জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে। কাঁচের টুকরোটা অর্ধেক ওর হাতে গাথা বাকীটা বাইরে।

সায়ন ওর হাত টেনে দেখতে চাইলে একটা বড় কাঁচের টুকরো নিয়ে নিজের গলার কাছে ধরে মীরা। সায়নকে বলে ওর থেকে দূরে সরতে। সায়ন পাগলের মতো করতে থাকে রক্ত দেখে, ওকে হসপিটালে নিতে চায় ও। কিন্তু মীরা এসব কিছুই শোনে না। ওকে সরে যেতে বলে মীরা, যাতে ও এখান থেকে বেরুতে পারে। সায়ন সেখান থেকে সরে বারবার ক্ষমা চায় ওর এমন আচরণের জন্য। মীরা অনেক কষ্টে টালমাটাল ভাবে উঠে দাঁড়ায়। সায়ন ওর এ অবস্থা দেখে কাঁদছে। বলছে মীরা আপনাকে হসপিটালে নিতে হবে, প্লিজ আমার কথা শুনুন। আমি ক্ষমা চাইছি আমার আচরণের জন্য আপনি যা শাস্তি দিবেন আমি তাই মাথা পেতে নিবো৷ আপনি প্লিজ হাত থেকে ওটা ফেলে দিন।

মীরা টালমাটাল ভাবে হাঁটতে থাকে দরজার দিকে। একটু হাঁটতেই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পরে দরজার চৌকাঠে।

পরদিন মীরার জ্ঞান ফিরে হাসপাতালের বেডে।ওর সামনে বসা মীরার মা, মাজেদা খালা। ওর জ্ঞান ফিরার খবর শুনে ডাক্তার আসে রুমে, দরজার বাইরে কাঁচের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সায়ন। ভিতরে ঢুকবার সাহস কিংবা শক্তি কোনটাই নেই ওর।

সেবার মীরার হাতের কব্জিতে ল্যাম্পের মোটা কাঁচের টুকরো গেঁথে গিয়ে দুটো ধমনী ছিড়ে যায়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে মীরা সেদিন জ্ঞান হারিয়েছিলো। আছড়ে পরায় মাথাতেও চোট লাগেছিলো সামান্য।

জ্ঞান ফিরার পর ওর মা জাহানারা বলেন-

: “এ ছেলে সময় মতো তোকে হাসপাতালে না আনলে শরীরের সব রক্ত বের হয়ে তুই মারা যেতিরে মা। এ ছেলে সাক্ষাৎ খোদা প্রেরিত দূত”

মীরা শান্ত কন্ঠে বলেছে-

: “তোমার দূতকে জিজ্ঞেস করলে না আমাকে কোথায়/ কিভাবে পেলো?”

জাহানারার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তারপর ও জোড়াতালি ভাবে বলে-

: “তখন জিজ্ঞেস করার মতো পরিস্থিতি ছিলো না”

পাশ থেকে ইরা বলে-

: “বুঝলি আপা গতকাল এর বাবা-মা হাসপাতালে এসেছিলো।তোর প্রতি দেখানো সমবেদনার এক ফাঁকে ওর মা তার ছেলের তোকে পছন্দ তা বলেছেন মাকে। মা তো দুই পায়ে রাজি আমি বলেছি আগে আপার সাথে কথা বলে তারপর না হয়… ”

ইরাকে থামিয়ে দিয়ে জাহানারা বলেন-

: “তুই চুপ থাক, বেশী কথা বলে, দুইটা দিন ধরে ঐ বেঞ্চটাতে শুয়ে-বসে কাটিয়েছে, কতবার বলেছি বাড়ি চলে যাও, যায় নি। কাজ, নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছে। আজকাল দিনে এমন ছেলে হয় না মা”

: “তুমি ঠিকই বলেছো এমন ছেলে যে হয় না তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে, যাই হোক আজ কি বার?

ইরা উত্তর দেয়-

: ” মঙ্গলবার ”

মনে মনে ভাবে মীরা- তারমানে রবিবার হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে।

: “শোন মা, ওকে তুমি ২টো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে- বৃহস্পতিবার থেকে মীরা কোথায় ছিলো? আর কোত্থেকে পেয়ে ও আমাকে হাসপাতালে এনেছে?

যদি এর উত্তর ও দিতে পারে তাহলে ও যেন আমাকে মুখ দেখায়। মা আর কিছুই বলে নি, ওর শরীরের অবস্থা ভেবে। তবে পরে বোন ইরার কাছ থেকে ও জানতে পারে তারা সরাসরি জাহানারাকে বলেছে মেয়ে না নিতে পারার কথা। একমাত্র ছেলে ডিভোর্সিকে পছন্দ করেছে তাতে রাজি হয়েছে কিন্তু মেয়ে মেনে নেয়া সম্ভব না, মা ও গদগদ গলায় বলেছেন – সমস্যা নেই নূহাকে তিনি তার কাছে রেখে দিবেন।

এসব শুনে মীরার মাথায় আগুন ধরে যায়। রাতে ওর মাকে ঠান্ডা গলায় বলেন-

এ বিষয়ে তুমি কিছু না বললেই আমি খুশি হবো, আমার জীবণ সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা আমিই নিবো।

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৬৯+৭০+৭১+৭২

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

দুজনে তারও আধ ঘন্টা পর পৌঁছুলো ভ্যানুতে। ভাড়া মিটিয়ে হলে প্রবেশ করলো দুজনে। তমা গেলো রেম্প ইভেন্টের ড্রেসিং রুমে ওদের পোশাক পরে রেম্প হয়ে গেছে কিনা তার খবর নিতে। আর মীরা প্রবেশ করলো মূল ফটকের লাল গালিচা দিয়ে।

ওকে রিসিভ করবার জন্য কেও না থাকলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হল ভর্তি সাকলে তখন মঞ্চের নাচ দেখা রেখে দেখছে অনিন্দ্য সুন্দরী মীরাকে। আলো-আঁধারি হলের মধ্যে পথ চিনিয়ে নিতে কেও না থাকলেও মীরার আগমনে একটা স্পটলাইট পথ দেখাচ্ছে ওকে। মনে মনে হাসে মীরা, কারন ও জানে এটা কার কাজ। ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোয় ও। তারপর ভিতরে গিয়ে ইন্টারপ্রেরিওরদের জন্য রাখা নির্ধারিত আসনে বসে মীরা। আশেপাশে পরিচিত জনদের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে ও। সকলে মুগ্ধ হয়ে দেখে মীরাকে। এত সুন্দর মীরা এত সুন্দর ড্রেস পরেছে চোখ ফেরানো দায় ওর থেকে।

পরিচিতদের মধ্যে সুজানা আপু জিজ্ঞেস করলো –

: “হেই, এত দেরী কেন করলে?”

: “আরে আপু, সব দোষ ঐ বিদেশী কূটনৈতিকের”

পাশে বসা ফ্লোরা আপু বললেন-

: “কূটনৈতিক পর্যন্ত পৌঁছে গেছো, বাহ বেশ লম্বাতো তোমার হাত”

মীরার হাসছিলো সুজানা আপুর সাথে, কথাটা খোলাসা করতে, ফ্লোরার এমন নোংরা ইংগিত পূর্ণ কথা শুনে ওর চোখ সরু হয়ে যায়, এই বদ মহিলা শুরু থেকেই মীরাকে অপছন্দ করে, সবসময় মুখিয়ে থাকে কোন একটা বাহানায় কিছু একটা শোনানো যায় কিনা। এমন মানুষ দুনিয়ার সব জায়গাতেই থাকে। যখন আপনার সাথে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পরিশ্রম দিয়ে পাল্লা দিতে পারে না, তখন তারা হিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে মুখিয়ে থাকে অন্যকে ঐ আগুনে জ্বালাতে।

এরা সব কিছুর ভালো দিক, সৌন্দর্য দেখার আগে জহুরী চোখ দিয়ে খুঁজে বের করে খুঁত গুলোকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এদের বেহেশতে নিলেও এরা সেখানকার খুঁত বের করে ফেলবে (আল্লাহ মাফ করুন)। এরা জীবণেও ভালো হবার নয়। এদের অন্তরে খোদা মোহর মেরে দিয়েছেন। কিন্তু পুড়ে পুড়ে খাটি হওয়া মীরাকে ভাঙা এতো সোজা? আগে এসবের শক্ত উত্তর দিতো, সেরের উপর সোয়া সের যাকে বলে। তবে আজকাল মীরা তা করেনা, নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার চেয়ে চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করে। তাই মীরা এসব এড়িয়ে চলে, তবে আজকের ইংগিতটা কুৎসিত, নোংরা। ওর মজা করে বলা কথাটার যে এমন মানে তিনি বের করবেন মীরা তা ভাবতেও পারেনি। মীরা চোখ সরু করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় তমা এসে বলে-

: “হ্যা আপু, ঠিক বলছেন মীরাপুর হাত বেশ লম্বা, তা না হলে দেশের সবচেয়ে বড় ম্যাগাজিনের কভারে আসা চাট্টি খানি কথা? আর আগামী মাসে থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক ইভেন্টে আমাদের যোগ দেয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনি তো বদ্ধ কুয়াতেই পরে আছেন, তাই নদীর আর সমুদ্র আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এজন্যই হুঁশ করে একটা কথা বলে ফেললেন। কোন কথার কি মানে তা আপনি ভেবেই বলেছেন, আর আমরাও হাত দিয়ে ভাত মেখে খাই, আমরাও বুঝি। যদিও আপনাকে দোষ দেয়া যায় না, আপনার জ্ঞানের দৌড় যতটুকু আপনি তো ততটুকুই বলবেন”

ফ্লোরা আমতা আমতা করতে থাকে, মীরা এখন মুখচোরা হলেও তমা বরাবর মুখপোড়া। মীরা তমাকে কপট ধমক দিয়ে বলে আরেহ্ এই কথায় এত কথা, ধূর, আসলে আপা হয়েছে কি বিদেশি কূটনীতিকের বিদায়ে পূর্ব ঘোষণা ব্যাতীত রাস্তা বন্ধ ছিলো বেশ কিছু সময়ের জন্য , তাই দেরি হয়ে গেলো, আর এ কথার কত মানে করে ফেলেছো তোমরা। তমা তুই বস তো।

পেছনের সিটে গিয়ে বসে তমা, ফ্লোরার দিকে মুখ নিয়ে ফিসফাস করে বলে-

: ” থাইল্যান্ডের ইভেন্টের পর তুরষ্ক যাবো আমরা, একটা শো এটেন্ড করতে। গতকালই ভিসার জন্য এপ্লাই করতে গিয়েছিলাম গুলশানের তুর্কি এম্বাসিতে, কে বলতে পারে বলুন, আগামী বছর হয়তো আমাদের পোষাক নিয়েই যোগ দিবো আমরা সেই ইভেন্টে। আপু স্রোতহীন কুয়া থেকে প্লিজ বের হন, তা না হলে স্রোতহীন কূয়ার পঁচা পানিতে থেকে আপনি-ও একদিন পঁচে যাবেন। দেখতেই পারবেন না, বাইরের দুনিয়াটা কত বড়, কত সুন্দর, কত রোমাঞ্চকর”

ফ্লোরা চোখমুখ শক্ত করে শোনে কথাগুলো। মীরা তখন কথা বলছে মুনিয়ার সাথে, সে এখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডের ওনার, অথচ তার কথাবার্তা, সাজপোশাকে কোন আড়ম্বরতা নেই, কত মিশুক আর আন্তরিক তিনি। তমা জানে আজ তিনজন এওয়ার্ড পাওয়াদের মধ্যে একজন মুনিয়া। মীরাকে নিয়েও আশবাদী ও। তবে চান্স 50/50। বাকীটা দেখা যাক কি হয়।

ইভেন্ট ইনভাইটেশন কার্ডে দেয়া অনুষ্ঠান সূচীতে একটু পরিবর্তন হয়েছে। মীরার আসতে দেরী হওয়ায় রেম্প শো পেছানো হয়েছে। ব্যাপারটাতে ভিষন অবাক হয়েছে ও সাথে বিরক্ত ও। কারন এতে সবাই অন্য মানে খুঁজে বের করবে। ব্যাপারটা জানার পর থেকে এওয়ার্ডটা আজ না পাক ও এমনটাই দোয়া করছে মনে মনে। তা নাহলে সকলের ওর এওয়ার্ড পাওয়াটাকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে বলতে একটুও বাঁধবে না। যদিও ওর ড্রেস, প্রাইজ রেঞ্জ, পেইজের ফলোয়ার সংখ্যা, মেলায় বিক্রি হওয়া এমাউন্ট সব কিছুর বিবেচনায় ও মনোনয়ন এ এসেছে। ঐ একজনের ঐ এক কাজের জন্য মীরার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পার্স থেকে ফোন বের করে মীরা হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করেন একজনকে-

: ” এমনটা না করলেই ভালো হতো, মানুষ এর অন্য মানে খুঁজে বের করবে”

: “লোকে কি বলবে তা ভাবার লোক তো আপনি নন”

: ” আমার নিজরই অস্বস্তি হচ্ছে, তেমার এসব কাজে আমার পরিশ্রম, মেধাকে মানুষ অবমূল্যায়ন করবে পক্ষপাতিত্তের তকমা লাগিয়ে”

: “ইশ্ তা যদি পারতাম আমি! ধন্য মনে করতাম নিজেকে,

: “দিস ইজ টু মাচ সায়ন”

: “আপনি হ্যা না বলা পর্যন্ত এমন চলতেই থাকবে”

: “তুমি বয়সে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট আমার, আমার একটা মেয়ে আছে তাও তুমি জানো, এ বিষয়ে আর একটা কথা হলে আমি তোমাকে ব্লক করবো”

: “আমাদের নবী (সাঃ) এর প্রথম বিবি খাদিজার সাথে তার বয়সের পার্থক্য কত ছিলো জানেন? পনেরো বছরের, আর এদিকে আমি মাত্র পাঁচ বছরের ছোট, তাও আপনার হিসেবে। দুজনের ডেথ অফ বার্থ
মিলালে এত হবে না বলে আমি শিউর”

: “তোমাকে ভদ্র বলে জানতাম, ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতাম, দিনশেষে তুমিও সবার কাতারে দাঁড়িয়ে গেলে”

: “সবার কাতার মানে? আমি কি বলেছি আপনার সাথে প্রেম করবো, বা লিভ ইন? আমি সরাসরি বলেছি আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই? এমন সাহস ক’জনের আছে বলুন তো”

: “বাজে কথা রাখো, আজ যেন আমাকে কোন এওয়ার্ড দেয়া না হয়, এটুকু অনুরোধ তুমি রাখো আমার, আমি মানুষের নোংরা কথা নিতে পারবো না”

: “এখানে আমার কোন হাত নেই, সত্যি! জুড়ি বোর্ড যদি মনে করে আপনি এওয়ার্ডের উপযুক্ত, আপনি পাবেন, না মনে করলে পাবেন না, এখানে আমার কোন এখতিয়ার নেই, তবে সেরা দশজনের থেকে চারজনের নাম কাটা পরার পরও আপনার নাম আছে, এটুকু কেবল দেখেছি আমি”

: “শোন ছেলে তুমি আমাকে আর কখনো ফোন কিংবা টেক্সট করবে না”

: “আপনি যে বাড়িতে থাকেন তার অপজিটের বাড়ি ভাড়া নিবো আমি, আপনার ফ্যাক্টরির পাশে নিজের ব্যাবসার ওয়ার হাউজ বানাবো, আপনার যে আউটলেট বসুন্ধরা আর ধানমন্ডিতে সেখানেও আউটলেট করবো দরকার হলে, পালায়ে কই যাবেন আপনি?”

: “দিস ইজ টু মাচ”

: “এ কথা আপনি আগেও বহুবার বলেছেন”

: ” তোমার টাকা আছে বলে টাকার বড়াই করছো? কিন্তু এসব করে কোন লাভ নেই”

: ” এটাকে টাকার বড়াই মনে হলো আপনার? এটা টাকার বড়াই নয়, এটা আপনার প্রতি আমার ভালোবাসার বড়াই”

ম্যাসেজটা দেখে সবগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে ওকে মীরা। এওয়ার্ডটার উপযুক্ত হওয়ার পরও মনে মনে প্রার্থনা করে এটা যেন না পায় ও। ফ্লোরার মতো মানুষের অভাব নেই, তাছাড়া নিজের কাছেই তো নিজেকে ছোট মনে হবে। দশবার যদি নিজেকে এর উপযুক্ত মনে হয়, অন্ততঃ একবার মনে হবে এটা কারো অনুগ্রহ। বহু পাগলের পাল্লায় পরেছে ও, কিন্তু এর পিছুটান ছাড়াতেই পারছে না ও।

এইসব ভাবনার ঘোর কাটলো রেম্প শোর এনাউন্সমেন্টে। একে একে প্রদর্শিত হলো অংশগ্রহণারী সকলের ড্রেস। মিরার টোটাল চারটা ড্রেস ছিলো। চারটা ড্রেসই গাউন ছিলো। অন্য সকলে যেখানে ড্রেসের মধ্যে কামনীয় ভাব ফোটাতে ব্যাস্ত, ব্যাস্ত শরীরের স্প*র্শ*কা*তর ভাজগুলো ফুটিয়ে তুলতে
মীরা সেদিকে মূল ফোকাস রেখেছে সৌন্দর্যে। যাতে ওর ড্রেস পরিধেয় কাওকে আব*দন*ময়ীর চেয়ে সুন্দর, স্নিগ্ধ লাগে। এ নিয়ে টিপ্পনী কম শুনেনি ও। কারন দুনিয়াটা নিজেকে আবেদ*নম*য়ী দেখাতে ব্যাস্ত, স্রোতের বিপরীতে হাঁটা মীরা প্রাধান্য দিয়েছে ড্রেস ফেন্সি হতে হবে নট সে*ক্সি। মডেলদের অনেকই এমন ড্রেস পরতে নাকচ করেছে। মীরা সেদিক বিবেচনায় তুলনামূলক কম পপুলার মডেলদের পেয়েছে ওর ড্রেস পরে পারফর্ম করানোর জন্য। তবুও সন্তুষ্ট মীরা। তবে কালার কম্বিনেশন, এক্সেসরিসের ব্যাবহার, ড্রেস ব্যাবহারে কম্ফোর্ট ফিল, প্রাইজ রেঞ্জ এসব দিকে ওর ড্রেস গুলো নজর কারে সকলের। প্লাস সাইজের একজন মডেলের ড্রেসটা সবচেয়ে বেশী নজর কারে সকলের। স্থুলকায় কেও যে রেম্পের মডেল হতে পারে এমন কনসেপ্ট মীরার মনেই বোধহয় প্রথম এসেছে। ও ওর ফ্যাক্টরির এক প্লাস সাইজ স্টাফকে বেছে এনেছে এখানে পারফর্ম করার জন্য। টানা এক সপ্তাহ ট্রেইন করা হয়েছে ওকে হাঁটার ধরন রপ্ত করতে। মেয়েটা বেশ চটপটে ছিলো, অল্প সময়ের মধ্যেই ও শিখে নিয়েছে রেম্পে হাঁটার বেসিক জ্ঞান। মীরা ওকে সাহস দিয়েছে, বলেছে তুই কেবল হেঁটে চলে যাবি বাকীটা আমি সামাল দিবো। এই এক ভিন্ন চিন্তা সকলের থেকে মীরাকে অনন্য করে তুললো সকলের কাছে। বিজনেস ক্লাসের প্রথম সারির মুনিয়াকেও প্রশংসা করতে দেখা গেলো ভিন্ন কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করার দরুন। ভবিষ্যতে তিনিও প্লাস সাইজের মডেল নিয়ে কাজ করবে বলে আশা প্রকাশ করে মীরার কাছে । মীরা অকপটে এপ্রিশিয়েট করেন তাকে।

হঠাৎ উপরের দর্শক সারীতে একজনে চোখ আটকে গেলো মীরার, দূর থেকে তাকে দেখা যায় থামস আপ করে মীরাকে এপ্রিশিয়েট করতে। মীরা মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নেয় সেদিক থেকে। মীরার এমন আচরণে হাসতে দেখা যায় তাকে। মনে মনে সে বলে ” আপনাকে আমার হতেই হবে মীরা, এটা এখন আমার জীবনের একমাত্র গোল”

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

একে একে তিন ধাপে মঞ্চে উঠে বাকী সকলের ড্রেস। ক্রিয়েটিভিটির কত রূপ তা এখানে এলে দেখা যায়। একেক জনের ভাবনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে একেক জন। রেন্ডম কিছু মডেল ক্যাটওয়াক করে স্টেজে আসছে তাদের মধ্যে থেকে একজন একজন করে সামনে এগুচ্ছে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে তাদের পরিহিত ড্রেসের বহর।

জুরি বোর্ডের মেম্বাররা পয়েন্ট এড করছে মডেলদের নম্বর ট্যাগ দেখে । একেকটা পোশাকের আইডেন্টিটি তাদের ট্যাগ নম্বর। কে কোনটার ওনার তা জানার কোন উপায় নেই। একমাত্র উদ্যোক্তারা নিজেই চিনছে নিজেদের ড্রেস গুলোকে। সেই হিসেবে কোন মডেল যদি বেশী এপ্রিসিয়েশন পায় তখন তাদেরকে সহকর্মীরা অভিনন্দন জানাচ্ছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটা ড্রেস নজর কারলো সবার। তার মধ্যে একটা মডেলের পরা গাউনে চোখ আটকে গেলো সকলের। খোদ মীরাকেই তাক লাগিয়ে দিলো সেটা।

জামদানী কাপড়ের তৈরী গাউন! জামদানী জিনিসটার প্রতি আমাদের বাঙালির ফ্যাসিনেশন আছে। জামদানি শাড়ি ঘরের মেয়ে বৌদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে। স্বদেশী জিনিসের প্রতি অপত্য মমতা সকলেরই থাকে, এটা ভিন্ন কিছু না। আর আজ সেই জামদানী কাপড়ের গাউন উঠে এসেছে মঞ্চে। বলতেই হয় ইনক্রেডিবল! অফ হোয়াইট কালারের বেসের উপর গোল্ডেন জরির কাজ। আনারকলি স্টাইলের এ গাউনটার দুটো অংশ। ভিতরেরটা মূল গাউন, উপরে লং কোটি। এতে ব্যবহৃত জামদানী কাপড়টা গাউন তৈরির জন্যই বুনন করানো হয়েছে। তা না হলে আনারকলি জামা কাটিংয়ে নিচের পাড়ে এলোমেলো হয়ে যেতো। কোটিটা সবচেয়ে সুন্দর৷ ইচ্ছে করলে আলদা ভাবে পরা যাবে। মডেল একেবারে সামনে এসে মুভ-অন করার আগে কোটিটা খুলে ছেলেদের ব্লেজারের মতো হাতে ভাজ করে রাখলো। যেন অর্ধেক পথেই তার গরম লেগে গেছে। আসলে এ কাজটা তিনি ইচ্ছে করেই করেছেন ড্রেসটার স্পেশালিটি বোঝাতে। সকলে দারুণ এপ্রিসিয়েট করলো এ কাজকে। মীরাও তালি দিতে দিতে রুমানাপুকে জিজ্ঞেস করলো এটা কার ড্রেস আপা, রুমানা আপু চোখ মঞ্চে নিবন্ধ রেখেই উত্তর দিলো এটা “পিংক ক্লোজেট” -এর ড্রেস৷ পিংক ক্লোজেট? মীরার হাসিমুখ মূহুর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে যায়। চোখ রোমানা আপুর থেকে দ্রুত ফিরিয়ে নেয় সেই জামদানী গাউনে। দূর থেকে যতটুকু দেখা সম্ভব দেখে নিলো মীরা। কারন “পিংক ক্লোজেট” এর ওনার মীরার বিনি পয়সায় কেনা চিরশত্রু “মিলন মাহমুদ” এর। মীরা সকলের তালে নিজেও হাততালি দেয়৷ আর মনে মনে ভাবে এত সুন্দর আইডিয়া মিলনের মাথায় এলো? তৃতীয় স্লটে চমৎকার কিছু ড্রেসের ক্যাটওয়াক দেখা গেলো। কিন্তু তা দেখাতে মন নেই মীরার। একটা ভাবনা মনে খুত খুত করছে। এমন প্যাটার্নের ড্রেস আগে ওরা তৈরী করতো একসময়। বিশাল ঘের, হাতের ডিজাইন, কোমরের কাছটায় এডজাস্টেবল এলাস্টিক, থ্রি কোয়ার্টার হাতায় ছেলেদের শার্টের মতো কাপ স্টাইলিস একটা ভাইব দেয়া, ক্লাসিক আনারকলির সাথে নতুন ট্রেন্ডের সংযোজন। তখনকার সময়ে মেয়েদের ছেলেদের মতো পোশাক পরার ট্রেন্ড বেড়ে গিয়েছিল। সবকিছু সেম টু সেম, “মীরা ফ্যাশন” এর ঐরকম দেখতে ড্রেসটার ডিজাইন পুরোপুরি রিডেক্ট করেছিলো রাজিব। মীরা রাজিবের এমন মাতব্বরিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলো, কারন নতুন কাজ তোলার চেয়ে ডিজাইন কাস্টমাইজ বেশ ভালো হতো ওর। মীরা কোন খসড়া ডিজাইন তুললে তাতে কিছু সংযোজন বিয়োজন করে সুন্দর কিছু দাঁড় করাতে পারতো রাজিব। তবে এত ড্রেসের মধ্যে ঐ ড্রেসটা মনে থাকার কারন হচ্ছে হাতের এমন ডিজাইন নিয়ে বেশ হাসাহাসি ও হয়েছিল মীরা আর রাজিবের মধ্যে। রাজিব বলেছিলো দেখো এটাই এই ড্রেসের স্পেশালিটি হবে, রাজিবের কথা সত্যি হয়েছিল। ওদের ঐ ড্রেসটা তখনকার সময়ে টপ সেলিং ছিলো। এমনও হয়েছিল যে অনেকে অর্ডার করার সময় বলেছিলো- “ঐ যে একটা ড্রেস আছে না আপনাদের, যেটার হাতায় শার্টের মতো কাপ ডিজাইন করা, ঐটা” সত্যি এটাই এর ডিজাইনারকে মনে করিয়ে দিলো । পিংক ক্লোজটের এই ড্রেসে অতিরিক্ত যা এড ছিলো তা হচ্ছে কোটিটা। মানে এটা মীরা ফ্যাশনের আগেরকার ডিজাইন ড্রেস এর নতুন সংস্করণ।

মীরা মনে মনে ভাবে – আচ্ছা অনেক আগে একবার শুনেছিলো রাজিব মিলনের ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছে, ও কি এখনো আছে সেখানে? এমন সব ভাবনায় বুদ মীরার সংবিৎ ফিরলো কফির আগমনে৷ মীরা হাসিমুখে ওয়েটারের কাছ থেকে কফি নিলো৷ এমন বিদখুটে মূহুর্তে ধোয়া উঠা এক কাপ গরম কফি ওর মানসিক চাপ কিছুটা মন্থর করলো। এরপর ইভেন্টের একে একে সবগুলো পার্ট সুন্দর ভাবে শেষ হলো। মীরার এখনকার সবচেয়ে ভালোলাগার সেগমেন্ট হচ্ছে বিজনেস সারভাইভাল স্টোরি। এই সেগমেন্টে পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে সবাই তাদের বিজনেস সারভাইভাল স্টোরি শেয়ার করেন। এককেটা সারভাইভাল স্টোরি যেন একেকটা মহাকাব্য। যদিও পাঁচ মিনিট খুব অল্প সময় তবুও একেকটা গল্প যেন অনুপ্রেরণা দেয় উদ্দ্যোমী, সাহসী, আর পরিশ্রমী হওয়ার। মীরাও ওর সারভাইভের গল্প বলে। তবে স্বজ্ঞানে এড়িয়ে যায় ওর জীবণের প্রথম ইনিংসের সারভাইভাল স্টোরি। যা বলা হলে আমরা নিশ্চিত নির্দ্বিধায় ও জিতে নিতে বেস্ট সারভাইভাল এওয়ার্ড।

এই সেগমেন্টের পর এনাউন্সমেন্ট হলো লাঞ্চে যাওয়ার অনুরোধ। লাঞ্চের পরপর এওয়ার্ড সেরেমনি হবে। লাঞ্চে বসে খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে সকলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে কোন কোন ড্রেস বেস্ট হতে পারে। সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। ফলাফল প্রকাশের আগে তো সকলের মনেই বেস্ট হওয়ার সম্ভাবনাময় স্বপ্ন ঝুলে থাকে, তা হোক রেম্পে কিংবা লাইফের অন্য কোন পরীক্ষায়। মীরা নিজেও ভীষণ চিন্তিত। গতকালের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর প্লাস সাইজ নিয়ে কাজ করাটাই শেষ ভরসা ছিলো। এবং এটাকে তখন পর্যন্ত এক্সট্রা অর্ডিনারী ভেবে বসেছিলো ও। কিন্তু কেও যে ওকে বিট করার জন্য আগে থেকেই তৈরীই ছিলো তা ও ভাবেনি। নিজেকে গ্রান্ড ভাবলে যা হয় আরকি। মনে মনে ও বকলো নিজেকে। আর ভাবলো শত্রুকে কখনো দূর্বল ভাবা ঠিক না। বেশ কিছু দিন আগে ও শ্রী গোপীনাথ গোস্বামীর সম্পাদিত চাণক্য নীতি নামে একটা বই পড়েছিলো, যেখানে অনেক বিষয়ে চাণক্যর নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা আছে। তার একটা অংশে চাণক্য শত্রুদের সম্পর্কে সর্বদা তটস্থ থাকতে বলেছেন। যে ব্যক্তি শত্রুদের ক্ষেত্রে অসতর্ক হয়ে পড়ে তার ক্ষতি হতে পারে। চাণক্য নীতি অনুসারে মানুষের দু’ধরণের শত্রু রয়েছে। একজন শত্রু যিনি উপস্থিত হন এবং অন্যটি যিনি দূর থেকে শত্রুতা করেন। এই উভয় ধরনের শত্রু সম্পর্কে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে সর্বদা সজাগ এবং সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া রয়েছে চাণক্যের সেই নীতিতে। কারণ শত্রুরা কেবল তখনই আক্রমণ করে যখন সে অসতর্ক বা দুর্বল থাকেন। চাণক্যের মতে শত্রুকে কখনোই দুর্বল মনে করা উচিত না। শত্রুকে শত্রু হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত এবং তাকে ছোট এবং দুর্বল হিসাবে ভাবা অনুচিত । শত্রুর প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা, শত্রু কী করছে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত থাকা উচিত। প্রতিক্রিয়া না জানাতে পারলেও, শত্রুর ক্রিয়াকলাপকে কখনোই উপেক্ষা করা উচিত না। মীরার ভুলটা করেছে এখানেই। প্রতিপক্ষকে ছোট ভেবেছে। পুরাতন শত্রুকে ও ভুলে গেলে কি হয়েছে, শত্রু তো ওকে ভুলে নি। যার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে ও গতরাতে।

এমন সময় মীরার একটা ফোনকল আসে। এক রেগুলার কাস্টোমারের কল। ওপাশ থেকে একরাশ কথা শোনান তিনি মীরাকে। তার কথার সারমর্ম এই যে- আজ রাতে তার এ্যানিভার্সেরী পার্টি। তার অর্ডার করা ড্রেস গতকাল পৌঁছানোর কথা ছিলো, আজ এত বেলা চলে যাবার পরও সেটা কেন পৌঁছালো না। মীরা এত চাপ মাথায় নিয়েও যথেষ্ট কুল থেকে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। মীরা বলেছে-

: “গতকাল একটা সমস্যা হওয়ার কারনে ড্রেস ডেলিভারি ডিলে হয়েছে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না আপু, সন্ধ্যার মধ্যেই ড্রেস পৌঁছে যাবে”

কল কেটে ঘড়িতে দেখে মীরা। আড়াইটা বাজে এখন। অনুষ্ঠান পাঁচটার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। অনুষ্ঠান স্থল আর ডেলিভারি পয়েন্টের মধ্যে মনে মনে দূরত্বের একটা ছক কষে মীরা। এমন সময় তমা আসে মীরার কাছে৷ মীরা বলে তুই বস, আমি একটু আগেই খাওয়া শেষ করলাম। তমা কার কল ছিলো জানতে চাইলে মীরা বলে-

: “গ্রীণ রোডের সেই রিপিট কস্টমারটা”

: “কি বললেন তাকে?”

: “কি আর বলবো, যা ছিলো কপালে তা তো হয়েছেই, শুধু শুধু রেগুলার এই কাস্টোমারের নেগেটিভ রিভিউ নিয়ে লাভ কি? বলেছি সন্ধ্যার আগে পৌঁছে দিবো ড্রেস”

: “পারবেন?”

: “পারবো মনে হয় ”

: “গতকালের ঘটনাটা কে ঘটিয়েছে আপনি কাওকে সন্দেহ করেছেন? ”

: “নাহ্ ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো”

: “আপু ওটা মোটেই এক্সিডেন্ট ছিলো না, ওটা প্রি-প্ল্যান করা কাজ। আমার গুবরে মাথায় এটা বুঝলাম আর আপনি ইন্টেল্যাকচুয়ালি স্মার্ট হয়েও বুঝেননি এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন আপনি?

উত্তরে ড্রিংকস পানরত মীরা একটা রহস্যময় হাসি হাসলো৷ এ হাসিটা ও ঠোঁট দিয়ে না, হাসলো চোখ দিয়ে। যার মনে হচ্ছে কিছু একটা লুকাচ্ছেন তিনি ওর কাছে।

তমা ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটলো না, এমন সময় পাশে দাঁড়ানো ফ্লোরার হাত থেকে ড্রিংকস গড়িয়ে পড়ে মীরার গাউনে, দ্রুত দাঁড়িয়ে পরে মীরা। ট্যিস্যু দিয়ে ড্রেস মুছতে থাকে। ফ্লোরা সরি বলেই কেটে পরে সেখান থেকে। যেন সরি বলেই তার অ*প*কর্মের সব দায় শেষ হয়ে গেলো।

মীরা দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। এত চাপ, এত উটকো ঝামেলা, এত শত্রু এরা কি জীবণেও পিছু ছাড়বে না ওর? ড্রেস পরিষ্কার করা রেখে ও ওয়াশরুমের দামী মার্বলে পাথরের বেসিনে দুই হাতে সব ভর ছেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই এসব ভাবতে থাকে । একটু পরে মাথা তুলে আয়নায় তাকায় ও । অনিন্দ্য সুন্দরী, সাকসেসফুল বিজনেস উমেন, গোছানো ক্যারিয়ার এমন সব বিশেষণে মোড়া ওর নাম। সকলে বলে – “ভাগ্যের জোড় আছে মেয়েটার, তা নাহলে এ বয়সে এত কিছু?” অথচ এত এত সাকসেসের সাথে কত যন্ত্রণা যে পাশাপাশি জায়গা করে আছে ওর জীবণে তা কেও জানে না। ওর একটা দুর্ভাগ্যের কথাই কেবল সকলে জানে। তা হচ্ছে রাজিবের সাথে ওর ডি*ভো*র্স। তবে সমাজ পুরোটা জানে না, জানতেও চায় নি কখনো, সমাজ মোটাদাগে তকমা লাগিয়ে দিয়েছে “মেয়ে মানুষের কামাই থাকলে জামাই লাগে না” মীরার ইচ্ছে করে, এমন ভাবা প্রতিটি মানুষকে ও ধরে ধরে বলে কেন এত ভালোবেসেও ওদের বিয়েটা টিকলো না, কিন্তু আফসোস ও তা পারেনা। এসব ভাবতেই ফ্ল্যাশ ব্যাকে চলে যায় মীরা গত রাতে –

“গতপরশু ড্রেসিং রুমে সকালেই তাদের ড্রেস গুলো এনে জমা করেছিলো মূল ইভেন্টের জন্য। মডেলদের ড্রেস বুঝিয়ে দেয়ার পর, ট্রায়াল চলে, সন্ধ্যার দিকে সব কাজ শেষ হওয়ার সময় ভেন্যুতে কি এ বিষয়ে ছোটখাটো ঝামেলা বাঁধে। তাই সকলে সেখানে দৌড়ে যায়, সকলের সাথে সাথে মীরাও যায় কি হয়েছে তা দেখতে। পরদিন ইভেন্ট থাকায় সেখান থেকেই জলদি ফিরে যায় বাড়িতে।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো ইভেন্টের প্রথম দিন। মীরা সারাটা সময় মেলায় ব্যাস্ত ছিলো। এদিকে ফোন আসে মীরার এক মডেলের, ফাইনাল ট্রায়াল দিতে গিয়ে দেখে ওর ড্রেসটা নাকি ছেড়া। একেবারে বুকের কাছটায় ব্লে*ড/এন্টি*কা*টা*র জাতীয় কিছু দিয়ে পোচ দেয়া। মীরা দ্রুত সেখানে গিয়ে ড্রেস হাতে বসে পরে সোফাতে। কারচুপি কাজ করা ফ্লপি এই ড্রেসটা সবচেয়ে দামী এবং সুন্দর ড্রেস ছিলো ওর সবগুলো ড্রেসের মধ্যে, এবং শুধুমাত্র এই ড্রেসটাকেই রেম্পের জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো টানা একমাস কাজ করে। এটাকে সংশোধন করবে তার সময় কিংবা মন মানসিকতা কোনটাই নেই ওর। রেম্পের একদিন আগে মন ভেঙে যায় মীরার। উপায় না পেয়ে ঐ মডেলের বডি সাইজ অনুযায়ী ড্রেস খুঁজে ওয়ার হাউজে রাখা স্টক থেকে। ৩৬” সাইজের একটা ড্রেসও নেই সেখানে ইভেন্টে পরার মতো, যা আছে তা অতি সাধারণ মানের। এসব ভেবে হঠাৎই ওয়ার হাউজের মেঝেতে বসে পরে ও। এখন অন্য কোন ড্রেস মানে অন্য মডেল। এত অল্প সময়ে মডেল খোঁজা, তাঁকে ট্রায়াল দেয়া এসব অসম্ভব। উপায়ন্তর না দেখে কাস্টমারের ডেলিভারির জন্য প্যাকিং করা একটা ড্রেস প্যাকেট খুলে বের করে। যেটা আজ গ্রীণ রোডের ঐ কাস্টমারের এ্যানিভার্সেরি পার্টিতে পরার কথা ছিলো। ডেলিভারি আগামীকাল দেয়ার কথা। ইভেন্ট শেষে ও নিজে সেটা পৌঁছে দিবে ভাবে মনে মনে। এটুকু রিস্ক নেয় মীরা, এছাড়া উপায় নেই। সেই আপুটাই ওকে কল করেছিলো একটু আগে। শুনিয়েছেন এক রাশ কথা।

এসব ভাবতেই মুনিয়া আপু আসেন ওয়াশরুমে। মীরাকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন –

: “মীরা তুমি কি কোন কারনে চিন্তিত? ”

: “না, আপু, এমনিই মাথা ধরেছে”

কথাটা শুনে তিনি ব্যাগ থেকে প্যারাসিটামল বের করে দিলেন ওকে, ধন্যবাদ দিয়ে মীরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। আরেকটু দাঁড়ালে হয়তো মুনিয়া আপু ওর চোখের পানি দেখে ফেলবে সে ভয়ে। দুনিয়ার কাছে মীরা আয়রন লেডি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও যে কত্ত ভঙ্গুর তা কেও জানে না, কাওকে ও তা জানতেও দেয় না ও। কারন যারাই জেনেছে তারাই পরবর্তীতে তার সুযোগ নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা শোনাতে ছাড়ে নি। তাই আয়রন লেডির মুখোশটা মুখে এটে রাখে ও। কি হবে এদেরকে দুঃখ বলে? শক্ত থাকার অভিনয়ের ফলশ্রুতিতে মানুষকে ও বলতে শুনেছে, “এত কঠিন মানুষ হয়?” তখন মনে মনে হাসে মীরা। আর বলে কত শক্ত যে আমি, তার সাক্ষী কেবল আমার ঐ জায়নামাজ।

হল রুমে ফিরে এসে দেখে এওয়ার্ড এনাউন্সমেন্ট এর জন্য চিফ গেস্ট বিজিএমইএর সভাপতি অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন। দ্রুত নিজ আসনে বসে মীরা। একে একে তারা তাদের বক্তব্য রাখেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও মেয়েদেরকে এপ্রিসিয়েট করলেন। কথা দিলেন পাশে থাকার। তারপর এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। এখনি একে একে ঘোষণা হবে –

বেস্ট ফ্যাশন হাউজ এওয়ার্ড

বেস্ট এক্সিলেন্সি এওয়ার্ড

বেস্ট বিজনেস সারভাইভার এওয়ার্ড

সরগরম হলটা মুহূর্তেই নিশ্ছিদ্র নিরবতায় ছেঁয়ে গেলো। প্রথমে বেস্ট ফ্যাশন হাউজ এওয়ার্ড ঘোষণা হবে। অনেক গল্প কথার পর এওয়ার্ড প্রদানকারী গেস্ট জানালেন এবারের ইভেন্টে বেস্ট ফ্যাশন হাউজ এওয়ার্ড পেয়েছেন মুনিয়া আপুর “রিদম অফ লাইফ ফ্যাশন হাউজ”

মীরা ভীষণ খুশি হয় মুনিয়াপু এ এওয়ার্ড পাওয়ায়৷ যেন ওর খুব কাছের কেও এটা পেয়েছে। উনি এটার একমাত্র উপযুক্ত বলে মনে করে মীরা। মুনিয়া আপু তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে নিজের মনোভাব জানালেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সকলের প্রতি, আরো কৃতজ্ঞতা জানালেন সকল সহকর্মীদের প্রতি যাদের থেকে প্রতিনিয়তই তিনি শিখছেন।

এরপর ঘোষণা হবে- “বেস্ট এক্সিলেন্সি এওয়ার্ড ”

এ ক্যাটাগরিতে তিনজনকে পুরষ্কৃত করা হবে। এওয়ার্ড দিতে মঞ্চে এলেন স্বনামধন্য ফ্যাশন হাউজ ওনার “সালমান মুরশেদ ” তিনি স্বল্প কথায় তার বিজনেস স্টোরি শেয়ার করলেন সকলের সাথে। তারপর ঘোষণা করলেন একে একে তিনজনের নাম-

তিনজনে মধ্যে –

© প্রথমে ঘোষণা করা হলো-

” মুনিয়া শেহতাজ ” দা ওনার অফ “রিদম অফ লাইফ ফ্যাশন হাউজ” তিনি মনোনীত হয়েছেন প্রথম বারের মতো সোনালী আঁশ খ্যাত পাট -এর তৈরী সুতার পোষাকের জন্য।

© দ্বিতীয় জন হচ্ছেন

“মিলন মাহমুদ ” দা ওনার অফ “পিংক ক্লোজেট”

তিনি মনোনীত হয়েছেন দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) (GI- Geographical Indication) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া জামদানির পোষাকের নতুন ধরন নিয়ে কাজ করায়।

© তৃতীয় জন হচ্ছেন

“জিনিয়া আবেদীন মীরা” দা ওনার অফ “মীরা ফ্যাশন” তিনি কাজ করেছেন ফ্যাশন সচেতনতায় পিছিয়ে পরা প্লাস সাইজের সম্প্রদায়ের জন্য।

একে একে তিনজনকে মঞ্চে আসার অনুরোধ করেন উপস্থাপক। মীরার এই সাকসেস এ ওকে কনগ্রচুলেট করে তমা। মীরা আনন্দের অনুভূতি ভাগ করে নেয় তমাকে আলিঙ্গন করে, তমাও উষ্ণ অভিবাদনে যুক্ত করে ওকে। তারপর উইনার তিনজন পৌঁছায় মঞ্চে।

“রিদম অফ লাইফ ফ্যাশন হাউজের পক্ষে – মুনিয়া”

“মীর ফ্যাশনের পক্ষে – মীরা” এবং

“পিংক ক্লোজের পক্ষে – রাজিব”

হ্যা সেই “রাজিব” যে মীরার জীবণ গল্পে এক সময় ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার ছিলো। তবে আজ সে যে মঞ্চে উঠেছে জীর্ণ, মলিন বেশে, নিতান্ত অনিচ্ছায়, অপারগতায়, মালিকের আজ্ঞাবহ হয়ে, কিংবা কে বলতে পারে এত বছর পর মীরার সামনে দাঁড়ানোর এ সুযোগটা হাতছাড়া না করতে ।

আজ অনেক বছর পর রাজিবের সাথে দেখা হলো মীরার। নিলামের ঐদিনের পর থেকে রাজিব আর একবারও ওর সামনে আসার সাহস করেনি। মীরার অবর্তমানে মেয়েকে দেখে গেছে বাসায় এসে। মীরা কড়া নিষেধ করে দিয়েছে মাজেদা খালাকে ওকে যেন আর ঢুকতে দেয়া না হয়। এরপর আর আসে নি ও। সন্তর্পণে মেনে নিয়েছে ওর পরাজয়, খর্বিত করা বাবার অধিকার। আজ অনিচ্ছুকভাবে মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলো দুজনে। মীরার হঠাৎ অস্বস্তি হতে থাকে রাজিবকে দেখে। স্মৃতির বাক্স হতে মীরার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ওদের প্রথম প্রেমে পরা, পালিয়ে বিয়ে, ওর সাথে কাটানো সুন্দর আর অ*ন্তর*ঙ্গ সব মুহূর্ত গুলো। মীরা সামনে তাকিয়ে দেখে মিলন মাহমুদ তার আসনে বসে পায়ের উপর পা তুলে থুতনিতে হাত রেখে রহস্যময় হাসি হাসতে। মীরার আর বুঝতে বাকী থাকে না যে মিলন ওকে কুপোকাত করতেই রাজিবকে মঞ্চে পাঠিয়েছে।

মাঝখানে মুনিয়া আপুকে রেখে রাজিবের অপর প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় মীরা হাস্যজ্জ্ব্যল মুখে। অনেক ভেঙে গড়া মীরা আজ আর ভাঙবে না। জীবণ উপন্যাসে দুএকটা খারাপ গল্প হয়তো থাকে, তাতে গোটা জীবণটা খারাপ হয়ে যায় না, রাজিব তেমনি মীরার জীবণ উপন্যাসের একটি খারাপ গল্প মাত্র।

একে একে তিনজনের হাতে তুলে দেয়া হয় “বেস্ট এক্সিলেন্সি এওয়ার্ড ” মীরার সাথে হ্যান্ডশ্যক অবস্থায় বিজিএমইএর সভাপতি মীরাকে বলেন- আই নো ইউ মীরা, ইউ আর এ ব্রেভ গার্ল। তিনি সহাস্যে বিজয়ীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে এত অল্প বয়সে এত বড় জায়গায় পৌছানোর জন্য স্পেশাল কনগ্রেচুলেশন জানায় ওকে৷ মীরা একটু ঘাবরে যায় তার “আই নো ইউ মীরা” কথাটা শুনে। কারন তিনি সেই অসভ্য, অভদ্র সায়নের বাবা, আর সায়ন তার একমাত্র পুত্র …

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

প্রোগ্রাম শেষ করে গ্রীণরোডে ডেলিভারির ড্রেসটা নিয়ে তমাকে রেখেই বেরিয়ে পরে মীরা। তমা আর ফাহাদ সবকিছু গুছিয়ে ফিরবে। উবার কল করে ও যখন গাড়িতে উঠে ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকলেও, আকাশ ছিলো মেঘলা। বৃষ্টি নামি নামি করছে, মীরা মনে মনে ভাবে লোকেশনে পৌঁছানোর আগে বৃষ্টি না হলেই হলো। গাড়িতে বসে মীরা প্রথমে কল করেন মুখলেস চাচাকে৷ তিনি ওর জীবণে যতটুকু করেছেন ততটুকু করবার সুযোগ ও ওর নিজের বাবাকেও দেয়নি। লোকটাকে খোদা নিজে পাঠিয়েছেন ওর জীবণ গুছাতে। নাহলে মিলনের আগে তার লাগার কথা ছিলো মীরার পিছনে। মুখলেস চাচা ভীষণ খুশি হন এমন খবরে। বলেন “আমি ত আগে থেইক্কাই জানতাম এটা তুমি পাইবা, যাক গা মিষ্টি খামু মা জননী, মিষ্টি ছাড়া কোন কথা হইবো না” মীরা হেসে বলেছে ও নিজে মিষ্টি নিয়ে আসবে তাদের বাড়িতে। তারপর মীরা ওর মাকে কল করে জানায় সু-খবরটা। ওর মা ভীষণ খুশি হয়, ওর এই খবরে। বলেন এ খুশি উপলক্ষ্যে রাতে তার বাসায় খেতে। ইরা আর মুরসালিনদের পরিবারের সবাইকে ও আসতে বলবেন তিনি। এমন সময় ইরার ম্যাসেজ আসে, অভিনন্দন জানিয়ে, মীরা ভাবে ও নিশ্চয়ই খবর পেয়েছে তমার কাছ থেকে। ব্যাগ থেকে এওয়ার্ডটা বের করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে মীরা। সেটাতে চুমু খেয়ে স্বপ্ন বুনে এরচেয়ে ভালো কিছু অর্জনের। এমন সময় সায়নের ম্যাসেজ আসে ফোনে –

“এটি প্রথম বিজয় হতে পারে,তবে এটিই শেষ অর্জন নয়, অভিনন্দন প্রিয়। আরো অনেক কিছু অর্জন করার বাকী”

মীরা উত্তরে ধন্যবাদ জানায় সায়নকে।

প্রত্যোত্তোরে সায়ন লেখে- “আপনার এয়ই পথচলায় আমাকে নেন না সঙ্গী করে”

ম্যাসেজটা নোটিফিকেশন বার থেকেই পড়ে মীরা। সওয়্যাইপ করে মুছে দেয় আন-সিন ভাবে। এ ছেলের সব কথার শেষ কথা এই এক কথায়ই। দুনিয়ায় মেয়ের অভাব? এত সুন্দর পোলা তুই, তোর বাবার এত টাকাপয়সা, এত অল্প বয়সে ব্যাবসায় স্যাটেল হয়ে গেছিস, তোর মেয়ের অভাব হবে? তোকে কেন বিয়াইত্তা, বয়সে বড়, এক বাচ্চার মাকে বিয়ে করতে হবে? ফাজিল ছেলে। এর কথা শুনলেই গা জ্বলে, ভাব ভালোবাসা এসব তো বহু পরের ব্যাপার। মনে মনে বকে মীরা সায়নকে। “ফালতু ছেলে কোথাকার ”

এসব ভাবনাকে একপাশে সরিয়ে মীরা এওয়ার্ডটার একটা ছবি তুলে পাঠায় সুদূর লন্ডনে থাকা লোরা, এবং কানাডায় থাকা টুম্পাকে। এওয়ার্ডটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের মেঘলা আকাশে আনমনে চেয়ে থেকে মনে করতে থাকে প্রোগ্রামে রাজিবকে দেখতে পাওয়ার ঘটনাটা। এত বছর পর শুধু একটি বারের জন্য দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিলো দুজনের, তারপর আর একবারও না। জীবন কত অদ্ভুত! কত কাছে থাকা দুটি মানুষের মধ্যে সময়ের আবর্তন কত দূরত্ব সাজিয়ে দেয় নিপুন হাতে। গাড়ির জানালায় মুখ রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে মীরা। ভাবে ওরা দুজন একসাথে পরিশ্রম করলে আজ কোথায় পৌঁছে যেতো “মীরা ফ্যাশন”। বাতাসের বিপরীতে ছুটছে গাড়ি, মীরার ভীষণ ভালো লাগছে, চলন্ত গাড়ির স্পিড ওর চুল উড়িয়ে দিচ্ছে তাই । আনমনে মুখের কাছে আসা চুলগুলো পেছনে গুঁজে দিচ্ছে ও, অবাধ্যের মতো তারা আবারো সামনে এসে পরছে, বিরক্ত করতে মীরাকে৷

গাড়িটা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলো ঠিকানায়, মীরা অনেক বছর পর ঠিকানা খুঁজে ডেলিভারি পৌঁছে দিতে এলো কাস্টমারের দোরগোড়ায়।

কলিংবেল শুনে দরজা খুলে মেয়েটা এমন অবস্থায় মীরাকে দেখে তাজ্জব। ডেলিভারি পৌছুতে দেরি হওয়ার জন্য সরি বলেছে মীরা, কাস্টমার মেয়েটা নিজেও খুব লজ্জিত তার ঐরকম ব্যাবহারের জন্য। মীরা নিজে আসবে ড্রেস নিয়ে এটা কল্পনাও করেনি ও। সংকোচ মীরার ও ছিলো, নিতান্ত অনিচ্ছায় একবার পরা ড্রেস দিতে হলো তাকে, আর কোন উপায় ছিলো না ওর। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এই ভুলের জন্য মীরা ড্রেসটার দাম নেয় নি তার কাছে। মীরা ড্রেসটা তাকে তার এনিভার্সেরির গিফট হিসেবে উপহার দিয়েছে ৷ তিনি মীরাকে দেখেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়৷ কে এসেছে, কি হচ্ছে, কি বলছে, কি বলবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। সে যেন একটা ঘোরে আটকে গেছে স্বয়ং মীরাকে দেখে, যে মীরা এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের ওনার সে তার বাড়ির দোরগোড়ায় তা ভাবতেই পারছেনা সে।

মীরা তাকে ঘোরের মধ্যে রেখেই বেরিয়ে পরলো। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। কিছু মুহূর্ত কি একটা ভাবলো মীরা। তারপর একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে পলিথিন চেয়ে ওয়ালেট, ফোন পেঁচিয়ে নিলো ও, যদিও ব্যাগটা ওয়াটারপ্রুফ, বাড়তি সতর্কতা হিসেবে করলো ও কাজটা । তারপর রিকশা ডাকলো একটা, গাউনের ঘের আগলে উঠে পরলো সেটাতে। ড্রাইভার পিলিথিন দিলে সাটাকে ফিরিয়ে দিলো। তোলা হুডটাকে নিজ হাতে নামিয়ে দিলো নিচে। এসব দেখে ড্রাইভার ওর দিকে কেমন বিরক্ত চোখে দেখলো একবার। রিকশা চলতে শুরু করার পর গাড়ির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গলো বৃষ্টির বেগ। আশেপাশের অনেকেই ঔৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে লাল টুকটাকে এক পরীকে। সে যেন একটু আগে টলটলে জলে অবগাহন করে এসেছে, যাচ্ছে নিরুদ্দেশের যাত্রায়। বৃষ্টির পানিতে মুহূর্তেই ভারী গাউনটা শরীরে লেপ্টে গেছে। মীরার গাল, কাঁধ, খোলা চুল চুইয়ে চুইয়ে পরছে বৃষ্টির ধারা। প্রকৃতি যেন ওকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে নিপুন হাতে। এক হাত উঁচিয়ে বৃষ্টির পানিকে ধরার চেষ্টায় ব্যাস্ত মীরা। এমন একটা দৃশ্য যে কারো মাথা খারাপ করার জন্য যথেষ্ট। মীরা তো এমনিতেই সুন্দরী, তারউপর এমন সাজপোশাকে বৃষ্টিতে অবগাহন করবার দৃশ্য আগুন ধরাবে মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকোষে। মীরার এমন উদ্দেশ্য ছিলোনা মোটেই। ও ওর অর্জনকে এভাবেই সেলিব্রেশন করতে চেয়েছে। তাই এমন আনন্দ, একটু ফুরসত, মেঘলা আকাশ আর ঝুম বৃষ্টিতে ভিজবার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ও।

মীরা মনে মনে ভাবে “দুঃখের ক্ষত সারাতে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঔষধ” আজ রাজিবকে এত বছর পর দেখেও কত স্বাভাবিক ও। যেন রাজিব কোন আগন্তুক, তাই ওর সাথে হঠাৎ দেখা হওয়াটা একটুও বিচলিত করেনি ওকে। কত শক্ত হয়েছে মীরা মনের যত্নে। মীরার বরং হাসি পেয়েছে কেঁদেকেটে একসার করা সেইসব দিনগুলোর কথা ভেবে। কত বোকা ছিলো ভেবেই হাসি পেলো। যারা প্রেমের বিরহে আ*ত্ন*হু*তি দেয়ার কথা ভাবে তাদেরকে পেলে মীরা নিজের জীবণ থেকে পাওয়া এ শিক্ষাটা দিতো । যে ভাই ছ্যাকা খেয়ে ম*র*বে ডিসিশন নিয়ে ফেলেছো বেশ ভালো কথা,

তবে আমার কথা হচ্ছে ডেটটা পিঁছিয়ে দেও৷ এক সপ্তাহ, এক মাস, কিংবা এক বছর, এরপর ফেসবুকে অনলি মী করে একটা পোস্ট দেও, যে আমি অমুকের সাথে বিচ্ছেদের কষ্ট সইতে না পেরে আগামী অমুক তারিখে আত্ম*হুতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর দিন যেতে থাকলে জীবনকে ভালোবেসে এসব ডিসিশনের কথা ভুলে যাবে তুমি, বছর ঘুরলে যখন তোমার ফেসবুক মেমরীতে সেসব পোস্ট আসবে, তখন মনে হবে সেই গাঁ*জাখু*রি ডিসিশনের কথা তখন এমন একটা কাজের জন্য তুমি লজ্জিত থাকবে, তোমার বোকামি দেখে তোমার হাসি পাবে।

তবে এত বছর পর দেখা হয়ে মীরার কষ্ট হয়নি বলা ঠিক হবে না, কষ্ট হয়েছে, মিলন যখন মীরার সামনে রাজিবের সাথে দূর্ব্যবহার করলো, ত্রস্ত হয়ে পরে যাওয়া কাপড়গুলো তুলতে থাকা রাজিবের মুখটা দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে মীরার। কাজটা মিলন মাহমুদ মীরাকে কষ্ট দিতেই করেছেন তা ও ঠিক জানে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়েছে মীরা। অকারনেই ব্যাগের ভিতরে কিছু খোঁজার বাহানায় না দেখার ভান করে দ্রুত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেছে ওদেরকে মীরা ভ্যেনু থেকে। সময় তার আপন যত্নে মীরার মনের ক্ষতের নিরাময় করে দিয়েছে৷ কৃতজ্ঞতা জানায় মীরা খোদার প্রতি, সাথে সেইসব মানুষদের প্রতি যারা ওকে ভেঙে গড়ে উঠতে পাশে ছিলো ছায়ার মতো৷ আগলে রেখেছিলো পরম মমতায়।

এমন ভাবনার ঘোর কাটে একটা বাইক থেকে ক্রমাগত হর্নের শব্দে। মীরা চেয়ে দেখে ওর পাশের বাইকে থাকা একটা ছেলে বাজাচ্ছে হর্ণ। মীরা তাকালে ছেলেটা ওকে ইশারায় কি যেন বললো। মীরা কিছু বোঝার আগেই বাইকটা পাশ কাটিয়ে গেলো ওদের রিকশাকে। পরক্ষণে মীরা বুঝতে পারে ছেলেটার কোন বদ মতলব নেই, ওর ফ্লপি গাউনের ঘের বাইরে ঝুলে আছে বলেই সতর্ক করতেই হর্ণ দিয়ে তার এই মনোযোগ আকর্ষণ। পুরো দুনিয়া যখন চোখ দিয়ে নিরাভরণ করে দেখে মীরাকে তখন ব্যাতিক্রম এদেরকে ভালো লাগলো মীরার। একটা মুচকি হাসি হাসলো ও। মনে মনে দোয়া করে বিনিময় করলো কৃতজ্ঞতা।

হঠাৎ উত্তুরে বাতাসে কাপন ধরলো ওর শরীরে। মুভি/ছবিতে দেখেছে মীরা এমন পরিস্থিতিতে নায়করা তার কোট এগিয়ে দেয় ঠান্ডা থেকে বাঁচাতে। মীরার এমন কেও নেই যে ওকে বাঁচাবে। কত কত জায়গায় সিঙ্গেল হওয়ায় ঝামেলায় পরতে হয়েছে ওকে তার ইয়ত্তা নেই।

হঠাৎ ইরার একটা কথা কানে বাজলো, এসব ঝামেলা শেষ হলে এসব ভেবে দেখতে বলেছিলো ও। এসব না ভাবার জন্য ঝামেলা কিংবা কাজের চাপই কি একমাত্র কারন? নিজেকে প্রশ্ন করে মীরা। হঠাৎ রিকশা থেমে যায় এরিয়ার বড় গেইটের সামনে। মীরা তাকে আরেকটু ভিতরে যেতে বলে। অবশেষে মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাড়ি পৌছুলো মীরা। কাপড় বদলে দ্রুত গোসল করে ও। রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে স্যুপ বের করে স্যুপ তৈরী করে, আরেক চুলায় বসায় চা৷ যে ভিজা ভিজেছে আজ হাঁচি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তাই চা আর স্যুপই ভরসা।

খাওয়া শেষ করে একটা ট্যাবলেট খেয়ে ঘুম দিলো ও। গত কয়েকটা দিন খুব প্রেসারের মধ্যে দিয়ে গেছে ও। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে ওর। মুহূর্তেই ঘুমে বুদ হয়ে গেলো মীরা। মায়ের বাড়ি যাওয়ার আগে একটু ঘুমানো যাক কয়েক ঘন্টা।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৭২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে মায়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো মীরা। মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে গেলো সেখানে। গিয়ে দেখে ওর আগেই সকলেই পৌঁছে গেছে সেখানে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় জলদি পৌঁছানো মীরা আজ লেট।

কথাবার্তা শেষ করে টেবিলে বসলো সকলে খাবার খেতে। টেবিলের কাছে গিয়ে মীরা দেখে টেবিলে বিশাল কেক। ভীষণ অবাক হয় ও। সেই কখন এসেছে ও, এ কেকের খবর এতক্ষণ অবধি পায়নি ও। এমনকি নূহাও বলেনি। মীরার বিস্মিত মুখ দেখে সকলের মতো নূহাও হাসছে মিটমিট করে। কেক আসার সময় মুরসালিন নিয়ে এসেছে। ইরার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আসতে পারেননি। মুখলেস সাহেবের শরীর অসুস্থ থাকায়। কেক কেটে মীরা প্রথমে বড় টুকরো করে কেটে বাক্সে তুলে রাখলেন। তারপর সবাইকে খাইয়ে দিলেন। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ড্রইং রুমে আড্ড বসলো সকলে মিলে। এ কথা,ও কথার পর নেক্সট ডেসটিনেশন কি তা জানতে চাইলো মুরসালিন। মীরা ওর পরবর্তী ডেসটিনেশন কি তা এখনো ঠিক করে নি, তবে ধারদেনা শোধ করে ও এখন স্বাধীন ভাবে ব্যাবসায় বসতে চায়, সে কথাই বললো মীরা। মুরসালিন নিজের বিজনেস প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করলো মীরার সাথে। আসছে মাসে একটা কারখানা কিনতে যাচ্ছে সে বিষয়েও আলাপ করলো মীরার সাথে। মীরা কারখানা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিটেইল বললো ও। ডিটেইল শুনে হঠাৎ মীরার মুখটা পানসে হয়ে গেলো।

খাওয়া আড্ডা শেষে রাত এগারেটায় বের হলো ওরা। কেকের বক্স হাতে রিকশায় করে প্রথমে নিকটবর্তী মিষ্টির দোকানে গেলো মীরা, তারপর মিষ্টি নিয়ে গেলো মুখলেস সাহেবের বাড়িতে। রাত বেশী হওয়ায় খুব অল্প সময় বসলো ওরা। অনেক রাত হওয়ায় মুখলেস সাহেব ওদেরকে তাদের বাসায় থাকতে বলেন রাতটা, কিন্তু মীরা কুশলাদি বিনময় করে বেরিয়ে যায়৷ আজকের এ আনন্দের ভাগিদার তিনিও, তাই মীরা তাকে ভুলেননি। দেরি হওয়া সত্ত্বেও পৌঁছে গেছে তার সাথে খুশি ভাগ করতে।

রিকশায় বসে নূহা ফিরবার পথে বললো মা এটাই ঢাকা তো? চুপ করে থাকে মীরা ওর এই প্রশ্নে। কারন মীরা জানে এরপর নূহা কি বলবে। এই মেয়েটা না এমনি, ছোট্ট তবুও হঠাৎ হঠাৎ এত বড় হয়ে যায় বলার মতো না। এইতো সেদিন ও মীরাকে জিজ্ঞেস করলো-

: “মা তুমি কিন্তু একটা ভুল কথা বলেছো আমাকে?”

: “ভুল কথা!”

: ” হ্যা ভুল কথা, তুমি বলেছো আমার বাবা বিদেশে থাকেন, কিন্তু ছোট নানু সেদিন বড় নানুকে জিজ্ঞেস করলো নূহার বাবা এখন কোথায় থাকে? আর নানু বললো ঢাকায়ই থাকে”

মীরা হতবাক হয়ে গেছে ওর কথা শুনে। ওর মা জাহানারার সাথে রাগারাগি ও করেছিলো এসব ব্যাপারে যখন তখন কথা বলার কারনে। জাহানারা তার ছোটবোন পারভীন জিজ্ঞেস করাতে সেদিন এ কথা বলেছিলো। এমনিতে এ বাড়িতে এ বিষয়ে কখনো কথা হয় না। ঐ ঘটনার পর ইদানীং নূহার এই এক জিদ, ওর বাবার কাছে যাবে। তাই মীরা বুঝে গেছে এরপর কি বলবে নূহা। এতবছর এসব চেপে গেছে ও, এখন? আর ওর বাবা? সে তো নিজেই আছে কত পেরেশানিতে। ঐ যে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে এসেছে মীরা ওকে, এরপর আর দাঁড়াতে পারেনি সে। তাই সে-ও মেনে নিয়েছে সন্তানের প্রতি তার অধিকার খর্ব করার ব্যাপারটা। বেচারার মেয়ের ভালো চেয়েই হয়তো এ মেনে নেয়া। দূর্মূল্যের এ বাজারে কারখানার ম্যানেজারি পোষ্টের এত অল্প বেতনে তার নিজের জীবণ ধারণ করাই তো কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারউপর বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে একটা। তাই আগ বাড়িয়ে ঝামেলা বাড়াতে চায়নি সে। মীরার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, ওর কি নূহাকে দেখতেও ইচ্ছে হয় না? আবার মনে পরে বাবার অধিকার যখন ছিলো, তখনো সে কি ওর বাবা ছিলো?

ওর বাবার বর্তমান সম্পর্কে এসব কথা মীরা না জানতে চাইলেও জানে। আশেপাশের এমন অনেক কাজের লোক আছে মীরার, যারা বিনেপয়সাতে এত ভালো সার্ভিস দেয় ওর জন্য যে বলার মতো না।

মীরা তাই রাতের ফাঁকা ঢাকাকে ওর ব্যাগে পুরে রাখলো সেখান থেকে একটা টয় বের করে। খেলনাটা একটা টায় ব্যাংক, একটা কুকুর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে পয়সা নিয়ে যায়। ছোটবেলায় মীরারও ঠিক এমন একটা খেলনা ছিলো। সেটা দেখেই চোখ আটকে গেছে মিষ্টির দোকানের সামনের গিফট শপে দেখে। ভেবেছিলো বাড়িতে গিয়ে দিবে ওকে, উপায়ন্তর না দেখে সেটা এখনি দিলো ও, মেয়ের মুখ বন্ধ করতে। কিন্তু কতদিন পারবে তা জানেনা মীরা।

পরদিন সকালে মীরা ফেসবুকের ব্লক লিস্ট থেকে ফিওনার আইডিটা খুঁজে আনব্লক করে। ম্যাসেজে গিয়ে একটা “হাই” লিখে। মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই একটিভ ছিলো ফিওনা। এরপর প্রাত্যহিক কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরে ও ৷ বিকেলের দিকে ম্যাসেজ আসে ফিওনার থেকে। কুশলাদি বিনিময়ের পর ফিওনা জানালো সামনের মাসের শেষের দিকে ওরা পুরো পরিবার মিশিগান চলে যাচ্ছে। ওর বর থাকে সেখানে, ওকে নিয়ে যাবে তার কাছে। মনে মনে ভাবে মীরা দেশের সবাই চলে যাচ্ছে বিদেশে। ফিওনা মীরাকে খুব করে বলে যাওয়ার আগে অবশ্যই একদিন দেখা করতে। মীরা জানায় ও অবশ্যই আসবে একদিন।

ফিওনা মেয়েটাকে ভীষণ ভালো লাগে মীরার। কত ভালো ওর মন। মীরা নিজেকে জিজ্ঞেস করে- ওর নিজের ভাইয়ের জীবণ যদি কেও এমনি ভাবে নষ্ট করতো, ও কি পারতো তার সাথে এভাবে হাসিমুখে কথা বলতে? না, কখনোই পারতো না। কিন্তু ফিওনা সেই শুরু থেকে একইরকম। আন্তরিক, হাস্যজ্জ্বোল, প্রানবন্ত। প্রতিটি মানুষেরই কিছু বিশেষত্ব থাকে। ফিওনার এটাই হয়তো বিশেষত্ব, অতীত মুছে ফেলার, ক্ষমা করে দেয়ার এমনি ক্ষমতা মীরার থাকতো যদি! মীরা যে কথা জিজ্ঞেস করতে কথা শুরু করেছিলো তা চেপে যায় ও। জিজ্ঞেস করতে পারেনা। ভাবে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা হলে কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নিবে, যে এত সুন্দর সাজানো-গোছানো ব্যাবসা গুটিয়ে দিচ্ছেন কেন তিনি?

এরমধ্যে একবার ইন্ডিয়া যায় মীরা। মালপত্রে একটা ঝামেলা বাঁধে ওর, ইদানীং প্রায়ই ভুল মাল পাঠচ্ছেন তারা৷ ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ভুল। সেটার বিষয়ে আলাপ করতে এবং প্রয়োজনে নতুন সেলারের খোঁজ নিবে ও।এরমধ্যেই ফিওনা দুইনার নক দিয়েছে ওকে। ও বলেছে ও ইন্ডিয়া আছে এখন, দেশে ফিরলে অবশ্যই নক দিবে তাকে। সেখানকার কাজ শেষ করে দেশে ফিরে মীরা চারদিনের দিন। তমার আজমির শরীফ খুব দেখর ইচ্ছা, একবার বলেছিলো কথাটা মীরাকে। মীরা কথাটা মনে রেখে পরদিন রওনা দেয় দিল্লি। অথচ এয়ারপোর্টে প্লেনে উঠার আগ পর্যন্ত তমা জানত না আজমির শরীফ যাচ্ছে ওরা সে কথাটা। ওকে সেখানে নিতে গিয়ে খরচ হয়ে গেলো তিনদিন। খুব ভালো সময় কাটে ওদের সেখানে। ঐ তিনদিন মীরা মাজার শরীফে মোনাজাতরত অবস্থায় কেবল নিজের মাঝে নিজেকে খুঁজেছে। এখানে অনেকেই তার মনের অভিলাষ নিয়ে আসে, আল্লাহ নাকি এখান থেকে খালি হাতে কাওকে ফেরান না৷ মীরা নামাজের পর মনে মনে ভাবে কি চাইবে ও? হঠাৎ ওর মনে ভাসে মুখলেস চাচার কথা, এখানে আসার আগে তিনি ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মীরা সৌজন্য সাক্ষাৎ ভেবে গেলেও সেখানে কোন সৌজন্যতা ছিলো না। বেশ কিছু শক্ত কথা তিনি মীরাকে শুনিয়েছেন সেদিন একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে । মীরা মাথা নিচু করে শুনেছে সব। সব ঠিক বলেছেন তিনি। ওর বাবা থাকলেও এভাবেই বলতেন হয়তো৷ কিন্তু ঐ ঘটনায় মীরার কোন দোষ ছিলো না। হ্যা একটা দোষ অবশ্যই ছিলো। মীরা সুন্দরী এবং সিঙ্গেল মাদার। এই মীরার দেষ।

সবকিছু বাদ দিয়ে তিনি মীরাকে বিয়ের ব্যাপারটা ভাবতে বলেন। মাথার উপরে কেও থাকলে এমনটা হতো না। সব সত্যি, তবে মীরা ওর পারসোনালিটি , ইমোশন, স্ট্যাটাস এগুলোকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো কাওকে আপন করার কথা ভাবতে পারেনা। ও নিজের কথা ভাবে না, যে কেও ওকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাইবে, সায়নের মতো ছেলে মীরা বলতে অজ্ঞান, এমন হাজারো সায়ন মেনে নিবে ওকে ওর সৌন্দর্য আর কৃতিত্বের বিচারে। কিন্তু মীরা জীবনসঙ্গী হিসেবে নিজের জন্য স্বামী চায় না, নূহার জন্য বাবা চায়। কে আছে এমন যে মীরার স্বামী হওয়ার আগে নূহার বাবা হতে চাইবে। ও জানে এমনটা হওয়া সম্ভব না। তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না ও। কিন্তু মুখলেস সাহেব মীরার ভালো চায় বলেই তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দিতে চায় ওকে৷ মীরা খুলেই বলেছে ওর মনে যা ছিলো। তার সাথে লুকোচুরির সম্পর্ক না মীরার। তিনি সব জানেন মীরার। আত্নসমর্পণ করেছে বাবাতুল্য এ মানুষটার কাছে। অঝোরে কেঁদেছেন ঐ অপমানের কথা ভেবে।

স্বান্তনা দিয়েছেন তিনি, সাহস দিয়েছেন পাশে থাকার।
তবুও ভাবতে বলেছেন বিষয়টা নিয়ে। তিনি বলেছেন- তুমি মত দাও মা , আল্লাহ নিশ্চয়ই এমন কাওরে মিলায়্যা দিবো, আমরা ছবাই মিল্লা খুঁজমু । ইরা চা দিতে এসে ফাঁক দিয়ে কি এক কথা তুলতে চেয়েছিলো সেখানে, মুখলেস সাহেব ইশারায় থামিয়ে দেয় ওকে। এ কথার পর মীরা হ্যা না কিছুই বলেনি। চুপচাপ বসে থেকে চলে আসে সেখান থেকে। বরাবরের মতো মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নেন মুখলেস সাহেব সহ সকলে।

মীরা জানে এসব ওর মা জাহানারা আর বোন ইরার কাজ। এরা জানে মীরা সবার সাথে গাইগুই করলেও এই এক জায়গায় মীরা পার পাবে না।

মীরা এখন মুনাজাতে দোয়া করে, আমাকে তুমি শক্তি দাও খোদা, আমি যে আর সইতে পারছিনা। পরের রাকাতে সিজদায় গিয়ে আবারো অঝোরে কাঁদে মীরা।

মীরার কান্নার একটা গোপন কারন আছে, মীরা এতদিন নিজেকে অনেক স্ট্রং ভাবতো, ঐ এক ঘটনা মীরাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মীরা কত দূর্বল। কারন একটাই মীরা মেয়ে মানুষ। এ সমাজে পুরুষ শব্দটা পৌরুষ বহন করলেও মেয়ে মানুষ শব্দটা একটা গালি, একটা অবজ্ঞা, একটা তাচ্ছিল্ল্যের শব্দ।

প্রথম জীবণে রাহাতের করা অপমানজনক ঘটনাটাই ছিলো ওর একমাত্র ভয়ংকর অতীত। আর এবারের ঘটনাটা ছাড়িয়ে গেছে মীরার অতীত জীবণের সব ভয়ংকর ঘটনার রেকর্ডকে। মুনাজাতে সে কথা মনে করে অঝোরে কাঁদেতে থাকে মীরা।

চলবে…

প্রিয় ভুল পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭+৬৮

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সেদিন সন্ধ্যার আগে ইরার শ্বাশুড়ি ইরাকে বলে-
: “মাগরিবের নামায পড়ে আমি হসপিটালে যাবো। তুমি ওকে নিয়ে থাকতে পারবে না? ”
শ্বাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে ইরা ভীত কন্ঠে বলে-
: ” মা ভাইয়ারাও তো কেও নেই, একা এত বড় বাসায়…..”
ইরার শ্বাশুড়ি যেখানেই যায় ওকে সাথে করে নিয়েই যায়, আজ তিনি একা যাবেন, কথাটা ইচ্ছে করেই বললেন ইরাকে। ইরা নিজ থেকে যেতে চায় কি-না তা দেখবার জন্য। ইরা কিছু-মূহর্ত পর বলে-
: ” মা আমি আপনার সাথে গেলে কি কোন সমস্যা?”
তিনি কিছুক্ষন মৌন থেকে বলেন-
: “না, না, কোন সমস্যা না, পাছে তুমি যেতে অনিচ্ছুক হও কিনা তাই বলিনি”
: ” না মা, আমি বাবাকেও বলেছি, তাকে দেখবার ইচ্ছার কথা, আপনি যদি না যাওয়াটা ভালো মনে করেন, তাহলে আমি বড় চাচীদের ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকি এতক্ষণ? ”
: ” না, না, কোন দরকার নাই, আমার সাথে ছাড়া ও বাড়ি একা কখনো যাবা না তুমি। তার সবগুলো বউ একেকটা চালাকের একশেষ, তুমি আমাদের সবাইকে ভালোবেসে, ঘরের মেয়ের মতো মিশে গেছো এ পরিবারে, তাই তাদের হিংসার শেষ নাই। কি না কি বলে তোমার কানে বিষিয়ে দিবে, তার দরকার নাই বাবা, তুমি বরং নামাযটা পড়ে তৈরি হয়ে নাও। আমরা একসাথেই যাব হসপিটালে। কথাগুলো বলে তিনি ড্রইংরুমের ব্যালকনি থেকে তার ঘরে চলে গেলেন।

ইরার ভালো লাগলো শ্বাশুড়ির এমন অকপট স্বীকারোক্তি। এত অকাজ করার পরও তারা ওর ভালোটাকেই বেছে নিয়েছে ওকে মূল্যাশন করতে।
ঐদিন ও নিজ কানে বড় চাচীকে বলতে শুনেছে – “বাড়ির বৌগো এত আল্লাদ কিছের, আল্লাদ দিয়া মাথায় উঠায়োনা”

ওর শ্বাশুড়ি উত্তরে তাকে বলেছেন –
: ” ভাবী ও এই বাড়ির বৌ তা ঠিক আছে, ওর বয়স কত তাও-তো দেখতে হবে”

: “হইছে, আর সাফাই গাওয়া লাগবো না, আমাগো বিয়া হয় নাই কম বয়ছে? আমরা কি এমন পা তুইলা বইছা আছিলাম নিহি, ঘরের ছব কাম একা হাতে করছি। ননদ, দেবরগো কাপড় পর্যন্ত ধুয়া পিন্দাইছি”

উত্তরে ইরার শ্বাশুড়ি চুপ থেকেছেন। কষ্ট তাকেও কম করতে হয়নি। বড়-জায়ের তো মাথার উপর একমাত্র শ্বাশুড়ির জ্বালা ছিলো, আর তার উপর শ্বাশুড়ি তো ছিলোই বাড়তি জ্বালা হিসেবে ছিলেন এই বড়-জা নিজে। তিনি শ্বাশুড়ির চেয়ে বেশী জ্বালিয়েছেন তাকে। এমনকি নিজের ছেলের বৌ গুলোর সাথেও এই এক তরফদারী। জ্বালানোর, তরফদারীর এই চক্র ভাঙতে চান তিনি। তাই শুরু থেকেই অন্যভাবে তৈরী করেছে বৌ-শ্বাশুড়ির সম্পর্ককে। নিজের বৌ থাকাকালীন সময়ের কষ্ট, না পাওয়া, ছোট ছোট আবেগ অনুভূতি গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি যেমনটা আশা করতেন তেমনি শ্বাশুড়ি হয়েছেন ইরার কাছে।

ইরা নামায পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। নূহাকেও ব্যাগ থেকে জামা, ডায়াপার বের করে তৈরী করে। নিজের রাবার দিয়ে একটা পোনিটেল করে দেয়। সামনের ববকাট চুলগুলো আঁচড়ে দিয়ে চুমুনখায়। মাশাল্লাহ কি সুন্দর দেখতে নূহা।

ইরা নিজে তৈরী হচ্ছিলো আর নূহা অপরদিকে ইরার লিপস্টিক দেখে তা মাখার চেষ্টা করে। ইরা ওর এ কান্ড দেখে হেসে দেয়। লিপস্টিক যে ঠোঁটে দেয় তা-ও সে জেনে গেছে এ বয়সে। পরে ওর হাত থেকে সেটা নিয়ে ভুজংভাজাং ভাবে তা দিয়েও দেয় ওর ঠোঁটে। লিপস্টিক দিয়েছে ভেবে সেই খুশি সে। ইরার শ্বশুড়ি উঁকি দিলে বেরিয়ে পরে ওরা ৷

একসাথে নিচে নেমে তারা গাড়িতে করে হসপিটালে রওনা করে। নূহাকে ইরা নিজের কোলেই রেখেছে। কোলে বসে নূহা দুষ্টামি করছে ইরার সাথে। ওর বোরকার স্টোন গুলো একটা একটা করে খুঁটছে নূহা, ইরা যত নিষেধ করছে, নূহা এক একটা স্টোন খুলে নিষিদ্ধ কাজটা করে ফেলার অপরাধবোধ পাশকাটিয়ে আনন্দে খিলখিল করে হাসছে। ইরার শ্বাশুড়ি পাশে বসেই দেখছিলেন তা। কে বলবে তাদের প্রথম দেখা মাত্র কয়েকঘন্টা আগে হয়েছে। ওদের আনন্দ যেন এত কাছে থাকা তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। কারন তার মনে খুটখাট চলছে। তিনি বের হওয়ার আগে স্বামীকে জানিয়েছেন ইরার হসপিটালে আসার কথা। কি হতে যাচ্ছে তা ভেবেই ফোনের দুইপ্রান্তের দু’জনই বেশ চিন্তিত। কোনকিছু বলা যত সহজ নিজে তা মানা ততোই কঠিন। ইরা ওকে বলা গল্পের বাবা-মাকে কঠোর বলেছে। কিন্তু বাবার লা*শ দেখতে যাওয়া মীরার প্রতি কোন মমত্ব তখন ইরার হয় নি। হলে ও, ওর ভাই অন্তত ওর মাকে বোঝাতে যেতো যে এই দেখাটা চিরজীবনের জন্য শেষ দেখা।

তার এমন উসখুস ভাব দেখে ইরা বলে-
: “মা আপনি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত? ”
তিনি অপ্রস্তুত কন্ঠে বলেন –
: ” নাতো”
আবার নূহা ওকে ব্যাস্ত করে রাখে। ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই তারা হসপিটালে পৌঁছে যায়। তারা গাড়ি থেকে সেখানে নেমেই দেখেন- মুরসালিন ফার্মেসি থেকে ঔষধ নিয়ে ভিতরের দিকে যাচ্ছেন। রেবেকা একটা ডাক দিলেন ওকে, তিনি তার ছেলেকে দেখে একটু যেন ভরসা পেলেন। ছেলের সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্র ইরাকে পেছনে ফেলেই দ্রুত পায়ে ওর কাছে যান তিনি । ইরা নূহাকে হাঁটিয়ে আনছে৷ দূরন্ত নূহা একবার এদিকে যায় তো একবার ঐদিকে যায়। ওকে সামলে নিতেই দুজনের মধ্যে ব্যাবধান বেড়ে যায়৷ ইরা তাকিয়ে দেখেন তারা কি যেন বলছেন নিজেদের মধ্যে। মুরসালিন ইরাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কথা বলছে মায়ের সঙ্গে। তাদের দুজনের কপালের ভাঁজ, কুঁচকানো চোখ, মলিন মুখ, শূন্য দৃষ্টি বলে দিচ্ছে দুশ্চিন্তাগ্রস্ততার কথা। কেমন অস্বস্তি হয় ইরার। মনে মনে ভাবে- “এটা এ পরিবারবের কোন কালো রহস্য নয়তো?”
পরোক্ষণে নিজেকেই নিজে ধমক দেয়, কি সব ভাবছি আমি। এমন কিছু হলে তো বাবা-মা দুজন একত্রে এ বিপদ সামাল দিতো না। ভাবতেই ইরা বেপরোয়া নূহাকে কোলে নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা দেয়।

ঐপাশে রেবেকা বেগম সিঁড়ির কাছে এসে ইরার দিকে চোখ পরতেই থমকে দাঁড়ান, ইরার কথা এতক্ষণে যেন মনে পরলো তার। অপরাধবোধ লুকানোর জন্য একটা হাসি হাসলেন তিনি। মুরসালিন ও ইরাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলো, কপট, প্রাণহীন সেই হাসি, এক পলক চেয়েই ইরা চোখ সরিয়ে ওর অগ্রাহ্যতা ওকে ফিরিয়ে দিলো। মুরসালিন নূহাকে ইরার থেকে নিজের কোলে নিলো। ইরার সবকিছু কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে। একজনকে দেখতে এসেছে ও, এত রাখঢাক, এত গোপন কথার কি আছে তা কিছুই বুঝতে পারছে না ও। অবশেষে লিফটে উঠে ফ্লোর সিক্সে প্রেস করে মুরসালিন ইরার কাছটায় দাঁড়ায়। ইরা অস্পৃশ্যে মতো ছোঁয়া বাঁচায় যেন মুরসালিনের থেকে। অবশেষে ওরা পৌঁছে যায় কাঙ্খিত ফ্লোরে। পৌঁছেই দেখে মোখলেস সাহেব রিপোর্ট হাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন ফোনে। ওদেরকে দেখে ফোন রেখে ওদের কাছে এসে দাঁড়ান তিনি। স্ত্রীর সাথে চোখাচোখি হলে দু’জনেই চোখ বাঁচিয়ে নেয় যেন। যেনো চোখাচোখি হলেই পর্দা ফাস হয়ে যাবে। হাসি মুখে পথ দেখিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ইরাকে বলেন-
: ” তুমিও আইবা ভাবার পারি নাইক্যা”
: “একা বাসা তাই…”
কেবিনের কাছে এসে মোখলেস সাহেব আর্দ্র কন্ঠে বলেন-
: “খাঁড়াও মা মা জননী, কয়ডা কথা কইয়্যা লই তোমার লগে”
ইরার থমকে দাঁড়ায়, একটা মাত্র দরজার পার্থক্য এত এত রহস্যের। ওর ভিতরকার অস্থিরতা রক্তের সাথে মিশে বাড়িয়ে দিচ্ছে শরীরের রক্তচাপ , শীততাপনিয়ন্ত্রক হসপিটাল হওয়া সত্ত্বেও ইরার শরীরের ঘাম তা জানান দিচ্ছে। মুখলেস সাহেব ইরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন-
: “আমরা যে তোমারে কত্ত ভালোবাছি তা কি তুমি জানো?”
ইরার আবারো অস্বস্তি হয় এ জায়গায় এমন কথা শুনে, তারা প্রত্যেকে যে ওকে অকৃত্রিম ভালোবাসেন তা ও জানে এবং এ ভালোবাসার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। এ কথা এখানে জিজ্ঞেস করার কোন যৌক্তিক মানে খুঁজে পায় না ও। ওর কৌতুহলি দৃষ্টি আর কন্ঠে মৌনতা দেখে মোখলেস সাহেব আবারো বলেন-
: ” জীবণে চলার পথে যাই হোউক, আমগো এই ভালেবাছার কমবেছ হইবো না, যে কুন ব্যাপারে তুমি যাই বুঝো মা জননী এই অধমেগো ভুল বুইঝো না”

ইরার সন্দেহ পাকাপোক্ত হয় তার এমন অপ্রাসঙ্গিক কথায়, নিশ্চয়ই ঐখানে গরমিল কিছু রয়েছে। মনে মনে সম্ভব্য কিছু ভাবতে থাকে ও-
ঐ মেয়ের বিয়ের পরদিন ডিভোর্স দেয়া স্বামী কি মুরসালিন? / নাকি ঐ মেয়ে ওর শ্বশুরের অন্য পক্ষের স্ত্রীর? / নাকি ঐ মেয়ে ওর শ্বাশুরির আগের ঘরের ?

এসব হাবিজাবি ভাবতেই কেবিনের দরজায় ধাক্কা দেয় ইরা নিজেই। দরজা খুলতেই হাসপাতালের কেবিনের চিরাচরিত দৃশ্য চোখে পরে ওর। বিছানায় শোয়া রোগী, শিয়রের কাছে আপন কারো বিনিদ্র জেগে থাকা। কেবিনেটের উপরে ফল, জুস, পানির বোতল, কয়েকটা বাক্স, ঔষধপত্র।

এতকিছু উপেক্ষা করে ইরা মনোনিবেশ করলো বিছানায় শায়িত রমনীর দিকে। বুক অবধি টানা সাদা চাদর, মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকায় তার আদল বোঝা গেলো না। তাকে পুরোপুরি দেখতে তার কাছে গেলো ইরা, ইরাকে দেখে তন্দ্রালু মাজেদা খালা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এ যে বিছানায় শায়িত মীরার সহোদরা ইরা তা কেও না বলে দিলোও বুঝতে একটুও সময় লাগে না তার। চাপা নাক, জোড়া ভ্রু, পাতলা গোলাপি ঠোঁট সবই এক। দুজনের পার্থক্য বুঝাতেই যেন খোদা গায়ের রঙে একটু তফাৎ করে দিয়েছেন। মীরার গাত্রবর্ণ দুধেআলতা, আর ইরার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।

ইরা একেবারে বেডের কাছে গিয়ে বেডে ঘুমিয়ে থাকা দুপুরের গল্পের মনের জোর ওয়ালা মেয়েটাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়, ও যেন হসপিটালের কেবিনের দরজা খুলেনি, খুলে ফেলছে গ্রীক পুরাণের “প্যান্ডোরা বক্স”। যা খোলার আগ পর্যন্ত ওর জীবণে সুখ, হাসি, আনন্দ ব্যাতিত অন্য কিছুই ছিলো না। এই প্যান্ডোরা বক্স খুলে ও ওর জীবণে লজ্জা, ঘৃণা, দুঃখের জায়গা দিলো। আকন্ঠ তিক্ততায় ভরে উঠলো শায়িত তার মুখশ্রী চিনতে পেরে, পরক্ষনেই মনে পরলো তার লান্ড ভন্ড জীবণের ঝড় গুলোর কথা। সবকিছুর হিসেব করতে ওর সময় লাগলো ক্ষণকাল। এরপর আর দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ইরা। এতটুকু মেয়ের এত চমক সহ্য হয়?
ও সেন্সলেস হয়ে ঝড়ে ভাঙা গাছের মতো করে মেঝেতে পরে গেলো।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

স্বামী হিসেবে সাকলায়েন আর যেমনই হোক টাকাপয়সায় ওর টান বড্ড কম। আয় রোজগার তো নেই, তবুও যেখান থেকে যাই এসেছে হাতে নিজের খরচেরটা রেখে তুলে দিয়েছে সাথীর হাতে। সংসারে বানের স্রোতে আসা অঢেল টাকা খরচের যেন রাস্তা নেই। এই উপচে পরা টাকার স্রোতে ওর চারিত্রিক ত্রুটি, অবহেলা, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার দোষগুলো ঢাকা পরে গেছে। চরিত্রে সকলেরই টুকটাক সমস্যা থাকে, সাথীর মেইন ফোকাস টাকাপয়সা। ছোট থেকেই নিদারুন অর্থকষ্টে বড় হয়েছে ওরা। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, সমাজ ওকে শিখিয়েছে টাকা কি জিনিস! তাই টাকাপয়সার ব্যাপারে ওর এমন ভাবনা।

নিজের ফ্ল্যাট থাকায় বাসাভাড়া লাগে না, সামান্য ইউটিলিটি বিল শোধ করে বাকিটা মনমতো খরচ করে। “এদিন এমনিই যাবে” ভাবা সাথী বোনকে ঢাকায় এনে দেশের প্রথম সারির একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলো, বিয়ের সেই বছরই কিস্তিতে কিনলো গাড়ি। গয়নাগাটি ও করলো কিছুকিছু। নিজে তদারকি করে বাবা মায়ের ঘরদোর ঠিক করে দিয়েছে ও। গ্রামে বেড়াতে গেলে সবার জন্য হাতভর্তি কেনাকাটা, দান খয়রাত, অবহেলিত লোকদের সাহায্য করা, এসবে মজে থেকেছে সাথী। ওর বর সাকলায়েনকে পরিচয় করিয়েছে দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসিন এর মতো, যার অর্থ এবং দানের প্রাচুর্য প্রচুর, গ্রামে খুব সুনাম তার। উঠতি বয়সের মেয়েরা সাথীর এমন সুখ আর ওর পরিবরের এমন আকস্মিক উত্থান দেখে মনে মনে সাথীর ভাগ্যকে হিংসা করে, গোপনে দোয়ায়, নামাজে সাথীর বরের মতো বর পেতে চায়। শুধু উঠতি বয়সের মেয়েরাই না, গ্রামের সকলের মুখে মুখে একটাই কথা এমন মেয়ের জামাই যেন সকালের হয়। যে বাবা-মা আগে নিজেদের সীমাবদ্ধতার, প্রয়োজনের কথা ফোন করে জানাতো সাথীকে, তারা এখন ফোন করে অভাবী-দুস্থ কারো জন্য সাহায্য চেয়ে। সাথীও সাধ্যমতো সাহায্য করতে পিছুপা হতো না। অন্যের অনুগ্রহে বড় হওয়া পরিচয় ঘুচতে থাকে দানের সুবাদে৷ বেশ সুখেই কাটছিলো ওদের দিন। সকালে উঠে আগে পান্তা খেতো ওরা, কোনোদিন শাকভাজি, তো কোনদিন কাঁচামরিচ পেয়াজ। চারচারটা মেয়ের সংসারের খরচ সামাল দেয়ার জন্য একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বলতে সাথীর বাবাই একমাত্র ছিলেন৷ সবসময় তিনি সংসার খরচের আগে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েছেন। তারপর যা থাকতো তা দিয়ে কোনমতে টেনেটুনে চলতো সংসার। ছেলে নেই তার মেয়েরাই তার একমাত্র ভরসা। মানুষ হয়ে চাকুরি বাকরি করে বাবা-মায়ের দুঃখ বুঝবে৷ দুঃখ বুঝেছে মেয়েরা, তার কষ্টও স্বার্থক হয়েছে। জীবনের সায়হ্নে আসা সাথীর বাবা কাদের মিয়া এখন তৃপ্ত, সন্তুষ্ট। তার সব দায়িত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদের মতো আগাগোড়া বুঝে নিয়েছে বড় মেয়ে৷ এখন যেন তার ম*রে*ও সুখ।

সাথীর বোন মিথিও সারাজীবন কষ্টে মানুষ হলেও হঠাৎ এ প্রাচুর্যের মধ্যে এসে কেমন ভড়কে যায় প্রথমটায়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সাথে মিশে দ্রুত খাপ খেয়ে নেয় শহরের আদলে। শো রুমের ড্রেস, দামী ব্যাগ-জুতা, ইম্পোর্টেড ওয়াচ, দামী গাড়িতে করে যাতায়াতে যে আভিজাত্য, সুন্দরী মিথি যেন সবসময় এসবেই অভ্যস্থ, আর এসব যেন ওর জন্যই সাজে। কোন প্রকার জড়তা নেই বেশী পানিতে পরা অল্প পানির মিথির। সকলে জানে ওর বাবা বিরাট ব্যবসায়ী, গ্রামে অঢেল সম্পদ, প্রতিপত্তির কথাও জানে কেও কেও। দুদিন আগেও যে ওর লজ্জা নিবারনের কাপড়টা পরতে হতো অন্যের কাছে চেয়ে তা-ও দিব্যি ভুলে গেছে ও। এসব নোংরা অতীতকে এমন ভাবেই ভুলে গেছে ওরা যেন এমনটা কখনো ছিলোই না।

কিন্তু ইদানীং দিনকাল ভালো যাচ্ছে না সাকলায়েনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নির্বাচনে ওদের দলের পদপার্থী নেতা এবার বিপুল ভোটের ব্যাবধানে হেরে যায়। আয় রোজগারের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে ও নিঃস্ব প্রায়। টাকা পয়সা না থাকলে মন মেজাজও ভালো থাকে না৷ এদিকে নিজের অম্যতব্যয়ী জীবণের খরচের সাথে ও যুক্ত করেছে আরো উপরী খরচা। সাথীর সাথে পাতানো সংসার খরচ, ওর এই সেই বায়না, চাহিদা তার উপর শালী মিথির পড়ার খরচও যোগ হয়েছে। মুরগী জ*বা*ই করার আগে যেমন খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে এটাকে ও সেভাবেই ধরে নিয়েছিলো। কিন্তু এখননতা গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাকলায়েনের হঠাৎ এমন বিপর্যয়ে অভিজাত লাইফ লিড করা সাথী-মিথিরা কেমন বিপাকে পরে যায়। সাকলায়েনের যেন বোধ ফিরে আসে, এতবছর তোমাদেরকে দেখেছি আমি, এখন তোমরা আমাকে দেখো। সাথী অঢেল টাকা হাতে পেয়ে এত কিছু করলেও পায়ের নিচে মাটি শক্ত করার কথা দূরে থাক মাটিই করতে পারেনি। আয় রোজগার না থাকলে যে একটা মাস অন্ততঃ চলবে সে টাকাটাও জমা নাই ওদের হাতে৷ টাকা হাতে এলেই হয় শপিং এ চলে গেছে, নয়তো জুয়েলার্সের দোকানে। এখন এত বছর ধরে এমনি লাইফ লিড করে, মানুষের কাছে বড় সেজে যে অবস্থা দাড়িয়েছে তাতে হঠাৎ এমন বিপর্যয় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ওদের।

সবার জীবণেই উত্থানপতন থাকে কিন্তু ওদের যা ছিলো তারচে বেশী শে-অফ করা ওরা কিভাবে নিজেদের এমন জীবণ এডজাস্ট হবে? মেনে নেয়ার চেয়ে বড় ব্যাপার বাইরের মানুষ কি ভাববে ওদের ব্যাপারে? দিন পনেরো কোনমতে চললেও এর পর যেন আর চলেই না সংসার নামের গাড়ি। ব্যাবসা কিংবা চাকরী করলে অন্তত একটা অপেক্ষা থাকতো সুদিনের। কিন্তু সাকলায়েন তো কোন কাজই পারে না, ছাত্র থাকা অবস্থা থেকে এমনি ভাবে তৈরী করে নিয়েছিলো ওর ঐ বায়বীয় ক্যারিয়ার।

সাথী সাকলায়েনের সাথে আলাপ করে ব্যাবসা শুরুর কথা বলে। দরকার পরলে জমানো সব গয়না বিক্রি করে দিবে ইনভেস্টের জন্য। সাকলায়েন ব্যাবসার ব্যাপারে ক’অক্ষর গোমাংস। সারাজীবন পরের চাটুকারিতা করে পার করা ওর ব্যাবসা জ্ঞান আসবে কোত্থেকে। ও পারে দোকান দোকান থেকে চাঁদা তুলতে, পারে কলেজের ভর্তি, পরীক্ষার ফি/রেজিষ্ট্রেশন এর সময় গায়েবী স্ক্রল নম্বরের নামে হাজার হাজার টাকা তুলতে৷ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ভর্তিতেই লাগতে আড়াই থেকে তিন হাজার সেখানে ওরা এই গায়েবী স্ক্রল নম্বর কয়েক হাজার টাকায় বেচে টাকার পাহাড় করে ফেলতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত গুলো ডিপার্টমেন্ট, এত এত স্টুডেন্ট, বছরে ভর্তি, আর পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন চলতেই থাকে। তার মধ্যে এই সেই উপরী ধান্ধা তো আছেই। বিভিন্ন তহবিলের টাকা, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এসব থেকেও আয় হতো ভালোই। এমন যার ক্যারিয়ার তার ব্যবসা জ্ঞান না থাকাই স্বাভাবিক। তবুও সাথী সব গয়না বিক্রি করে ব্যাবসায় বসায় সাকলায়েনকে। একটা ডিপার্টমেন্টন্টাল স্টোর দিয়েছিলো অনেক বড় করে। কিন্তু এতদিন যে আরাম আয়েশ, সুযোগ সুবিধা ছিলো তার খেসারত ও কিছু দিতে হচ্ছে তাকে। বর্তমান ভিপি এসে আগের ভিপিকে দৌড়ের উপর রেখেছে মামলা হামলা দিয়ে। শান্তি নেই তাদের চ্যালাদেরও। তবুও আতঙ্কে, বাস্তবিক পরিস্থিতিতে সাকলায়েন সত্যি বুঝেছিলো রোজগারের রাস্তা তৈরীর প্রয়েজনীয়তা। তাই প্রাণপণে চেষ্টা করছিলো ব্যাবসাটাকে দাঁড় করাতে। কেনমতে চলেছিলোও তা টুকটুক করে। কিন্তু অপজিশন পার্টির মামলায় সাকলায়েনকে হঠাৎ যেতে হলো জেলে, মাস ছয়েক পরে আয়ব্যায়ের হিসাবে পাওনার চেয়ে দেনাই বেশী দাঁড়িয়েছে টাকার অংক। বছরের মাথায় বিক্রি করতে হয়েছিল ফ্ল্যাট। মাস ছয়েকে সেই টাকাও শেষ হয়ে গেলো কর্পূরের মতো।

কম টাকায় বাসা ভাড়া করেছিলো ঢাকার একটু ভিতরকার দিকে। একদিকে সংসার খরচ অন্যদিকে স্বামীকে জেল থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা। সবদিকেই দেখতে হয়েছিলো সাথীকে একা হাতে। মীরার মতো সাথী নিজেই ধরেছিলো সংসারের হাল। দু’জনে পেরেও ছিলো তা, তবে দু’জনের পথই আলাদা। মীরা জ্ঞান, শ্রম বেচে খেয়েছে আর সাথী, মিথি খেয়েছে শ*রী*র বেচে।

———-

: “এসব প্যাচাল যদি পারিস তাহলে তোর আর আসার দরকার নাই আমার বাসায়” উত্তপ্ত কন্ঠে কথাটা বললো মীরা।
: “তুই আমাকে ঝাঁটা মারলেও আমি আসবোই, বলে লাভ নাই”- আমের আচার খেতে খেতে শান্ত কন্ঠে বললো ইরা।

আচারের টকের চোটে ইরা জিভ দিয়ে টাক দেয় তালুতে। জীবণেও আচার না খাওয়া ওর ইদানিং আচারের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। প্রেগ্ন্যাসিতে এমন হয়, মীরার ও নূহা পেটে থাকার সময় পোড়ামাটি খাওয়ার ক্রেভিং ছিলো। একেকজনের একেকটার ক্রেভিং হয় এমন সময়ে। মাজেদা খালা খুব ভালে আচার বানায়। মীরা কয়েক বয়াম পাঠিয়েছিলো অসুস্থ ইরাকে দেখতে গিয়ে। সেগুলো নাকি শেষ করে ফেলেছে ও এ কয়দিনেই।
: “মা’র বাসায় যাবি এ বৃহস্পতিবার? আমিও তাহলে যাবো, তুই না গেলে একা ভালো লাগে না। এ সপ্তাহে একটা ইভেন্ট আছে তিনদিনের, সেখানে জয়েন করে, একটু ব্রেক নিবো সামনের সপ্তাহটা, ক্লান্তিতে শরীর ডুবে আছে, মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগে, আমার একটু রিফ্রেশমেন্ট দরকার”

ইরা মীরার কথাটা পুরোপুরি উপেক্ষা করে বললো-
: ” আপা শোন, এই যে তোর অসীম গতিতে ছুটে চলা, তোর ডেসটিনেশন কি? তা-কি তুই জানিস? ”
: ” কোন ডেসটিনেশন নাই, আয় করো, খরচ করো, মেয়েটাকে মানুষ করো, এই হচ্ছে, হবে যতদিন বাঁচি”
: ” দিনশেষে মন খুলে কথা বলবার কেও নাই বলে এই ক্লান্তি, আগে তো টুম্পা ছিলো, এখন তো টুম্পাও বিয়েসাদী করে সংসারী হয়েছে, আপা এজন্যই
তোর এমন দমবন্ধ লাগে”
আড় চোখে তাকায় মীরা ইরার দিকে, এবার ইরা কি বলবে তা ও জানে,
: ” সবাইকে তো গুছিয়ে দিলি, তুই নিজেই তো এলেমেলো ”
: “তারপর? ”
: “মানে?”
: “মানে ঘুরেফিরে সেই পুরাতন কাসুন্দি”
ইরা বোনের কাছে এসে বসে ওর হাত চেপে ধরে, তারপর কাতর কন্ঠে বলে-
: ” অনেক বছর তো থাকলি একা, এবার….”
: “কতবার বলবো এসব প্যাচাল পিটবি না আমার সাথে?”
: ” দুদিন পরে মেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, মেয়ে যখন দেখবে সবার মা এবং বাবা আছে, আর ওর শুধু মা আছে, ওর মনে তখন কি চাপ পরবে ভেবেছিস তুই”
: ” সবার সব থাকে না ইরা”
: “এটা তুই বুঝবি, আমি বুঝবো, অবুঝ ও কি এটা বুঝবে?”
: “তোরা যা বলিস তা এত সহজ না ইরা”
: “সহজ ভাবলেই সহজ, একবার ভাবতো ঐ যে মানুষটার জীবণটা যে আজও এমন অগোছালো এর জন্য কে দায়ী? মায়ের বাসা যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিস তুই, মা এসব বুঝায় বলে তোকে। তুই কি বরাবরই অবাধ্যই থাকবি বাবা-মায়ের প্রতি”
উত্তেজিত হয়ে মীরা বলে-
: “ইরা সবকিছু এত সহজ কেন ভাবিস তোরা? অপরাধবোধে আমি ওর সামনে দাঁড়াতেই সাহস পাই না, আর তোরা কিভাবে বলিস ওর সাথে সংসার শুরু করতে? আর আমার একার চাওয়ায় কিছু আটকে আছে?”
: ” তোর প্রতি তার টান আছে বলেই সে আজও পর্যন্ত স্যাটেল হতে পারলো না, বাবা মা*রা যাবার পর থেকে তিনি ভীষণ একা হয়ে পরেছে”
: “দূর থেকে এমন মনে হচ্ছে ইরা, আসলে ওর ভিতরেও এমন দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে। সবকিছুকে এত সহজ ভাবিস না”
: “ফিওনা নিজে সেদিন মায়ের কাছে এসেছে, কথা বলেছে এ ব্যাপারে, তারমানে ওরাও এমন কিছু ভাবছে”
: “আমার পক্ষে সম্ভব না ইরা, একটা সন্তান নিয়ে আমি….
কিছু সময় চুপ থেকে মীরা আবার বলে-
: “ইরা এসব আমার ভাবনাতেই হয় না, বাস্তবে কি করে হবে?”
: “আপা মন থেকে চাইলেই সম্ভব, তার জীবণটা তুই নিজ হাতে নষ্ট করেছিস, তাই প্রথম পদক্ষেপটা তোরই নেয়া উচিত, ফলাফল যাই হোক দায় মিটানোর চেষ্টাটা অন্ততঃ করা উচিত তোর”
: “এত বছর পর এভাবে ফেরা যায় না ইরা, আমার পক্ষে সম্ভব না”

মৌণ হয়ে অন্যত্র তাকিয়ে থাকে ইরা, তারপর বলে-
: “আপা, যাই বলিস তুই, আমি বরাবরের মতো এখনো বলবো আবারও ভুল করছিস তুই”
মীরা রুক্ষ কন্ঠে বলে-
: ” ভুল তো কম করিনি এ জীবণে, আবীর না-হয় আমার “প্রিয় ভুল” হয়েই থাক…

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার তত্ত্বাবধানে নেয়ার পর গত তিন বছরে “মীরা ফ্যাশন” উত্তরোত্তর উন্নতি করেছে। যতটা সহজে বলা গেলো কথাটা একা পথচলাটা কিন্তু এত সহজ ছিলো না। একা কেন বললাম?

নিলাম পরবর্তী সময়ে বিজনেসটাকে ঢেলে সাজানোর ঐ কঠিন সময়ের পথটা মীরাকে একাই পাড়ি দিতে হয়েছিল, কারন কারখানা বুঝে পাওয়ার পরের মাসেই মীরার ছায়াসঙ্গী টুম্পাকে চলে যেতে হয় ওর প্রিয়জনের কাছে। ওদের বিয়েটা হয়েছিলো বেশ আগেই, গোপনে, ফয়সাল কানাডায় যাওয়ার আগেই সন্তর্পণে সেরে ফেলেছিলো বিয়েটা। টুম্পাদের যা পারিবারিক স্থিতি তাতে ভবিষ্যতে ওদের অর্থনৈতিক ব্যাবধান আরো বেড়ে যাবে ভেবে এমন সিদ্ধান্ত নেয় ফয়সাল। টুম্পাকে ভীষণ ভালোবাসে ও, ওকে জীবণ সঙ্গী হিসেবে পেতে চায় যে কোন কিছুর বিনিময়ে। তাই নিশ্চিন্ত হতে বিয়েটা সেরে ফেলে কানাডা পাড়ি দেয়ার দিনই ।

শেষ মূহুর্তের সিদ্ধান্ত হলে যা হয়, ফয়সালের বন্ধুরা সব তৈরী করে রেখেছিলো৷ ফয়সাল কোনমতে পৌঁছে সই করে টুম্পাকে একবার মাত্র আলিঙ্গন করেই গাড়িতে উঠে পরেছিলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ব্যাপারটা অনেক পরে জেনেছিলো মীরা। ফয়সাল যাওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করছে টুম্পাকে ওর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অনেক বছরের চেষ্টায় যখন তা সফল হয় তখন এমন এক সময় যে মীরার টুম্পাকে বেশ প্রয়োজন। সময় চেয়েছিলো টুম্পা ফয়সালের কাছ থেকে। কিন্তু মীরাযে শুধু পেয়েই গেছে টুম্পার থেকে তাই ওকে বড্ড প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তখনই ছুটি দিয়েছিলো ও টুম্পাকে। ব্যাবসায়িক চাপ সত্ত্বেও সে সময় টুম্পার প্রবাস জীবনের দরকারি কেনাকাটা করেছিলো দুজন মিলে। ঠা*ডা পরা গরমের দিনে শীত প্রধান দেশ কানাডার জন্য গরম কাপড় খুঁজে পুরো বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, হকার্স মার্কেট চষে বেড়িয়েছে ওরা। ফিরবার পথে ফুচকা, হালিম, জিলাপি, নয়তো স্টার কাবাবে ঢু মেরেছে দুজনে। টুম্পার যেদিন ফ্লাইট ছিলো মীরার সেদিন জরুরী একটা কনফারেন্স এটেন্ড করার কথা ছিলো। কিন্তু মীরার জীবণে টুম্পার প্রায়োরিটি কনফারেন্সের আগে। টুম্পাদের পরিবারের ঢাকায় কোন আত্নীয় না থাকায় মীরার বাসায়ই উঠেছিলেন তারা। কাজে ব্যাস্ত থাকা মীরা ছুটি নিয়েছিলো সবরকম দায়-দায়িত্ব থেকে, টুম্পার বাড়ির লোকদের আপ্যায়ন করতে। ঐ দুটো দিন মীরার ঘোরের মধ্যে কেটেছে। পরিবার বিচ্যুত মীরা নিজের পরিবারের সাথে নতুন এ পরিবারটাকেও পেয়ে ছিলো। টুম্পাকে সরিয়ে ততদিনে ইশ্বর ওর জীবণের ব্যালেন্স রক্ষা করেছে ইরাবতীকে ফিরিয়ে দিয়ে। এবার আর ঘৃণাভরে না, পরম মমতায় আগলে নিয়েছে ইরা বোনকে। মাকে সবটা বলেছে কিসের ভিতর দিয়ে গেছে ওর জীবণ। মায়ের সাথে বোনের দূরত্ব কমাতে ইরার ভূমিকা ছিলো চোখে পরার মতো। ইরার শ্বশুর শ্বাশুড়িও বুঝিয়েছেন তাকে। মেয়েটা অনেক তো পেলো কষ্ট এবার একটু বুকে টেনে নিন ওকে।

মা-তো? মন নরম হয়েছে তারও। একটু সময় লাগলেও দুটো পরিবার এক হয়েছে মাঝখানে অনেক বছরের ব্যাবধানের পর। এজন্য মীরা মোখলেস সাহেবের কাছে কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর কোন ভাষা, বাক্য ব্যায়ে এ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন যথার্থ হবে তার জানা নেই মীরার। মুখলেস সাহেব পরম মমতায় বেঁধে ফেলেছেন ওদের দুই বোনকে। তিনিও কৃতজ্ঞ ওদের প্রতি। মেয়ের জন্ম না দিয়েও দুই দুটি মেয়ের বাবা হয়েছেন তিনি। তার একটাই চাওয়া, ওরা এমনি অকৃত্রিম ভালোবাসে যেন তাকে সবসময়।

আরেক দিকে বিজনেসে ফিন্যান্স ইনভেস্টর লোরাকে পেয়ে সমন্বয় হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যালেন্স।
লোরা ওর দেয়া টাকাটা ধার হিসেবে দিলেও মীরা টাকাটা ইনভেস্টরের ইনভেস্ট হিসেবেই নিয়েছে। টাকাটা কিভাবে দিবে তা মীরা জানতে চাইলে লোরা বলেছে তুমি চাইলে একসাথে দিও, না পারলে মান্থলি ইন্সটলমেন্টে। মীরা মান্থলি ইন্সটলমেন্টকে প্রেফার করেছে। তাতে ওর উপর চাপ কম পরবে। তবে এই একবছর সময় চেয়েছে ও একটু ঘুরে দাঁড়াতে, যাতে ভঙ্গুর এ ব্যাবসাটকে স্মুথলি দাঁড় করাতে পারে। লোরা সনান্দে সময় দিয়েছে। টাকা রিটার্নে লোরা বছর খানিক সময় দেয়াতে মীরা সাহস পেয়েছে বিজনেসকে ঢেলে সাজাতে। তবে এ একবছর ব্যাবসার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে লোরার একটা অংশ আলাদা করে রেখেছে মীরা ২য় মাস থেকে। যে সময়টাতে পাশে দাঁড়িয়েছে লোরা তাতে কোন কিছুতেই এর প্রতিদান হবে না। এমনকি ওর বর রাহাতের অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই মীরার৷ আল্লাহ ওদের দুজনকে এর উত্তম প্রতিদান দিক। এমন দোয়া মীরা সবসময় ওদের জন্য করেছে। তবে লোরার একটা অনুরোধ ও আছে – দেশের বাইরে থাকার দরুন বাংলো প্যাটর্নের বাড়ি তৈরীর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না ওদের, মীরার গাজীপুরের বাড়ির মতো স্নিগ্ধ সুন্দর, গাছঘেরা একটা বাড়ি তৈরীর তদারকি ওকে করে দিতে হবে, এমনি আবদার ছিলো লোরার। মীরা সহাস্যে গ্রহণ করেছে লোরার এ আর্জি।

বিজনেস রিস্টার্ট করার প্রথম বছরটা মীরা একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে বিজনেসটাকে সময় দিয়েছে। বিজনেসের সাসটেইনেবলিটির জন্য এর কোয়ালিটি, প্রোডাক্টের আপটুডেট ডিজাইন, মার্কেট ডিমান্ড, রিজেনেবল প্রাইজ রেঞ্জ, সাপ্লাই চেইন, বায়ার ডিলিং সব কিছুতে কঠোর নজরদারি রেখেছে। দেশবিদেশের স্বনামধন্য পোশাক ব্র্যান্ডের বিজনেস স্ট্র্যাটেজি, চ্যালেন্জ, ওয়ার্কিং প্রসেস সম্পর্কে পাড়াশোনা করেছে প্রচুর ৷ জয়েন করেছে বিভিন্ন কনফারেন্স, ফেয়ার আর বাৎসরিক ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে। ঘুরে দাঁড়নের গতি মন্থর হলেও পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি ওকে। প্রতিবন্ধকতা যে ছিলো না তা বললে ভুল হবে। প্রতিবন্ধক তো সেই কবেই তৈরী ছিলো মীরার জন্য। যা ও আবিষ্কার করেছে নিলামের দিন। সেই অদৃশ্য প্রতিবন্ধক মিলন এখনো মীরার পিছু ছাড়েনি। ঠিক কোন দামে মীরা কিনেছিলো এমন শত্রু মাঝেমধ্যে ওর খুব ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করে মিলনকে।

কম দামে প্রোডাক্ট ছাড়া, মার্কেটে বাকীতে মালামাল দেয়া, বছর জু্ড়ে ছাড়, ডিসকাউন্ট ইত্যাদি দিয়ে মীরাকে হারাতে গিয়ে বাজার নষ্ট করেছে মিলন। ও একা নেই ওর সঙ্গী হয়েছে নিঃস্ব, ভঙ্গুর রাজিবকে। রাজিব এত কিছু করে এখন মিলনের ফ্যাক্টরির ম্যানেজার হিসেবে আছে।

এতকিছুর পরও দমে যায়নি মীরা, মাটি কামড়ে পরে ছিলো ও দিন পেরিয়ে মাস, আর মাস পেরিয়ে বছর ধরে। মাসের পর মাস লাভের মুখ দেখা তো দুরে থাক টার্গেট মতো বিক্রিই হয় নি, এদিকে কারখানা ভাড়া, স্টাফদের বেতন, সংসার খরচ এগুলো তো আছেই। তবুও কিন্তু কোয়ালিটিতে আপোষ করেনি ও । নিজেকে শান্ত রেখে ব্যাবসাটাকে টেনে নিয়ে গেছে সামনের দিকে।

মাঝেমাঝে ক্লান্ত, অবশ্রান্ত ওর মনে হয়েছিল সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাক কোথাও, এমন কোথাও যেখানে ওকে না কেও চিনবে, না কেও জানবে। কি হবে এত খেটে, পরিশ্রম করে। কিন্তু দিনশেষে নূহার আদুরমাখা বুলি, মায়াভরা হাসি, দুষ্টুমিতে মীরার সকল কষ্ট, ক্লান্তি কর্পূরের মতো উবে যেতো, সারাদিনের যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত মীরা নূহার কাছাকাছি এসে বেঁচে থাকার কারন খুঁজে পেতো।

টুম্পার চলে যাওয়ার পর মীরা অনেক ভেবে ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টের বিজনেসটার দায়িত্ব পুরপুরি ফাহাদকে দিয়ে দেয়। কারখানাকে টেনে তুলবার রসদের যোগান আসে ওর সেই বিজনেস থেকে। দুটো মেইনটেইন করা টাফ ছিলো। তবে মীরা বিশ্বাস করে – ইচ্ছা, সৎ সাহস, আর পরিশ্রমী হলে সবাই সব করতে পারে। তার জন্য যা দরকার তা হচ্ছে ম্যানেজম্যান্ট। মীরা কষ্ট হলেও নিয়ম করে প্রতিদিন একবার আউটলেট গুলোতে ঢু দিতে চেষ্টা করতো। মাসের শেষ দিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরতো হিসেব করে। ফাহাদ তার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে মীরার কাজকে সহজ করে দেয়। মীরাও ওর যোগ্যতা আর বিশ্বস্ততার মূল্যায়ন করে মোট ব্যাবসার ৫ শতাংশ হারে লাভ দেয় ওকে। যাতে ব্যাবসাটার প্রতি ওর নিষ্ঠা শতভাগ বজায় থাকে সবসময়।

——

সেদিন বিকেলেই নিজের বাড়ি ফিরে যায় ইরা, যাওয়ার আগে বলে যায় কাজকর্মের ব্যাস্ততা শেষ হলে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে। মীরা বরাবরের মতো এবারও পাত্তা দেয়নি। ওর সব ফোকাস এখন সামনের সম্মেলনে বেস্ট পারফর্ম করা। ইতোমধ্যে ওখানে ওদের ড্রেস গুলো পাঠিয়ে দিয়েছে স্টলে সাজাতে। কিছু ড্রেস পাঠিয়েছে রেম্পের মডেলদের জন্য। পরশু থেকে দুইদিনের সম্মেলন শুরু হবে। তাই চেকলিস্ট চেক করে করে আগেভাগে কাজগুলো গুছিয়ে রাখছে মীরা।

দেখতে দেখতে সম্মেলনের দিন এসে গেলো। নূহাকে নিয়ে মীরা মাজেদা খালাকে ওর মায়ের বাড়িতে যেতে বলে। কারন আজকের সারাদিন ওকে ওখানেই থাকতে হবে। মীরা খালাকে বলেছেন রাতে ফিরবার সময় তাদেরকে নিয়ে আসবে। তারা বেরিয়ে গেলো মীরার আগেই। নূহা ওর মা’কে জড়িয়ে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়। নানু এখন নূহার খুব ভালো বন্ধু।

তাড়াহুড়ো করলে যা হয়, একটা দরকারী কাগজ খুঁজে পাচ্ছিলো না মীরা। এমন ইভেন্টে যাওয়ার সময় প্রতিবারই টুম্পাকে ভীষণ মিস করে মীরা। মেয়েটাকে ফোন দেয়া হয় না। নোটপ্যাডে এক কোণে ঝটপট লিখলো Call tumpa…। ইতোমধ্যে নতুন এসিস্ট্যান্ট তমা সময়ে আগেই এসে পৌছে গেছে বাড়ির সামনে। ম্যাসেজে জানিয়েছে তা। টুম্পা যাওয়ার পর পরই ওকে নিয়োগ দিয়েছে মীরা। গত কয়েকবছর কাজ করার সুবাদে মোটামুটি সবকিছু নখদর্পনে এসে গেছে তমার। মীরা বেরিয়ে একটা সিএনজি করে রওনা দেয়।

ইভেন্টে গেলে সেলের চেয়ে বেশী হয় ব্যাবসায়িক পরিচিতি। নতুন নতুন মানুষ, বিজনেস আইডিয়া, প্রতিবন্ধকতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। সবচেয়ে ভালোলাগে পরিচিত মানুষগুলোর সাথে দেখা হওয়াটা। যারা এত বছর একসাথে কাজ করে, অভিজ্ঞতা, পরামর্শ, মতামত শেয়ার করে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে চলেছে এতদিন ধরে। সেদিন মোটামুটি ভালোই কাটে। গতবারের চেয়ে এবার তুলনামূলক সেল বেশী হয় মীরার। মীরা এ বছর ড্রেসের দাম মেকিং চার্জে, প্রফিট না রেখে বিক্রি করেছে। যাতে বেশী মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়।

মেলার সব কাজ শেষ করে রাতে ফিরবার সময় মায়ের বাসায় রাতের খাবার খেয়ে নূহা আর মাজেদা খালাকে নিয়ে বাসায় ফিরে মীরা। খাওয়াদাওয়া করে আসায় দ্রুত শুয়ে পরে ওরা। নূহা ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই মীরার। উদ্যোক্তার সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠান আগামীকাল। টপ পরর্ফম লিস্টে ওর নামও রয়েছে। ওর চেয়ে বড় বড় উদ্যোক্তাও রয়েছে সেখানে। তাদের মধ্যে তিনজনকে বেস্ট এক্সিলেন্স এওয়ার্ড দেয়া হবে। এত জন সেরা উদ্যোক্তাদেরকে টপকে বেস্ট এক্সিলেন্স এওয়ার্ড পাওয়া টাফ। তবুও স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই। আগামীকাল এওয়ার্ডটা ওর ঘরেই আসবে এমন প্রত্যাশাই করছে ও।

নূহা ঘুমিয়ে পরলে আলগোছে বিছানা ছাড়ে ও। আগামীকালের জন্য ড্রেস, এক্সেসরিস গুছিয়ে রাখার জন্য ড্রেসিং রুমে যায়। গিয়ে দেখে ওর পেইজের সবচেয়ে সুন্দর গাউনটা এনে রেখেছে তমা। লাল রঙের গাউনটা ব্রাইডাল কালেকশন হিসেবে করেছিলো মীরা। তমাকে হোয়াটসএ্যাপে একটা বকা দিলো এটা কেন এনেছে ও তা বলে। তমা উত্তরে একটা হাসির ইমোজি পাঠিয়েছে। তারমানে ও ইচ্ছে করেই এ কাজটা করেছে। উপায় না পেয়ে সেটার সাথে মেচিং জুয়েলরী গুছিয়ে রাখে। জুয়েলরী বলতে একটা সোনার চেইন আর হীরা বসানো পেনডেন, কানে ছোট্ট দুল। হাতের ব্রেসলেট, আর সিম্পল রিং।
আগামীকাল ওর জন্য একটা বিশেষ দিন। কারন নমিনেশনে মিলনের পেইজের নামও রয়েছে। তাই এওয়ার্ড পাওয়ার ইচ্ছেটা এত তীব্র ওর।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

গতরাতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিলো। বেশ কয়েক বছর ধরেই মীরা লক্ষ্য করেছে প্রকৃতির হিসেবে গন্ডগোল হচ্ছে, গরমের দাপট প্রায় পুরো বছরজুড়ে থাকছে। বছরের ছয় ঋতুর অস্তিত্ব কেবল বইপত্রেই বিদ্যমান, আদতে বছর ঘুরছে তিন ঋতুতে। গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত। সময়ের হিসেবে বর্তমানে হেমন্তকাল হলেও দিনের বেলা গুমোট গরম, আর শেষ রাতে শীত শীত । এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের অবস্থা নাকাল।

গত কয়েকদিনের গুমোট গরমের পর এরকম একটা বৃষ্টির ভীষণ দরকার ছিলো। চারপাশে আজ অন্যরকম স্নিগ্ধতা। বাড়িতে হুট করে কোন প্রিয়জন এলে যেমন আনন্দ লাগে, তেমনি লেগেছে গতরাতের বৃষ্টিটাকে, খুব কাছের কোন প্রিয়জনের হুট করে আগমণ যেন। বৃষ্টি এলে বাকী সকলে যখন দোর, জানালা বন্ধ করে, মীরা তার ঠিক উল্টো। ও বাড়ির সব জানালা দরজা খুলে দেয়৷ মুহূর্তেই ঘরদোর স্নিগ্ধ, ঠান্ডা বাতাসে মোহিত হয়ে যায়।
আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙেছে মীরার। অন্যদিন হলে বিছানা ছাড়তো না ও। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়তে হলো ওকে। ঘুম থেকে উঠে ওর ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দাটায় প্রতিদিনের মতো আজও দাঁড়ালো ও । ঝুল টবে ঝুলে থাকা মানিপ্ল্যান্টের পাতার কিনারায় শিশিরের মতো বৃষ্টির পানি আটকে আছে ফোটায় ফোটায়। দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। সামনে তাকাতেই ওর খেয়াল হলো বাড়ির সামনের আমগাছের পাতা গুলোর রঙ মলিন হতে শুরু করেছে। খুব শীঘ্রই বর্ণহীন হয়ে ঝড়ে পড়ার অপেক্ষা ওদের। বেশ কয়েকবছর ধরেই এমন দেখে আসছে ও, এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না।
এ সময়টা প্রকৃতি রুক্ষ রূপ নেয়, ঝড়ে পরার জন্য। ঝড়ে পরা যে সবসময় বেদনার না, তাই যেন এরা বলে যায় বছর ঘুরে বারবার। নতুন করে তৈরী হতেই ওদের এই ঝড়ে পরা, এই আত্মত্যাগ। প্রকৃতি আমাদের অনেক কিছু শিখায়, কিন্তু আমাদের চোখ বাঁধা অদৃশ্য ভবিষ্যতের স্বপ্নে, বাস্তব দেখার সময় এক মুহূর্তে ও নাই অদেখা ভবিষ্যতের তৈরীতে।

বারান্দার উত্তর দিক থেকে দমকা বাতাসের ঝাপটা লাগে মীরার শরীরে। এক রাশ প্রশান্তির বিনিময় করে প্রতিদিন এরাই মীরার ক্লান্তিকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। উত্তুরে এ বাতাস, পাতার ঝড়ে পরার জন্য তৈরী হওয়া, হাত-পায়ের চামড়ায় টান ধরা,
জানান দিচ্ছে শীতের আগমনকে। শীত রওনা দিয়ে দিয়েছে, প্রকৃতিতে এলো বলে। গতরাতে ওর মা জাহানারাও বলেছিলেন যে এটা শীত নামানো বৃষ্টি। বুক ভরে শ্বাস নেয় মীরা। ম্যাট টেনে পনেরো মিনিটের জায়গায় পাঁচ মিনিট ইয়োগা করে আজ ব্যাস্তার দরুন। প্রতিদিনকার জীবণের এই রেট-রেসে নামার আগে নিজেকে এটুুকু সময় দেয় ও৷ সেখান থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে মীরা বাথরুমে গেলো ফ্রেশ হতে। রুমে এসে মেয়ের কাপড় গোছগাছ করে সামনে রাখলো, তারপর মেয়ের বইপত্র ব্যাগে গুছিয়ে দিলো ও, নূহার মিসকে বলা হয়েছে আজ তিনি যেন ওকে ওর নানু বাড়িতে গিয়ে পড়ায়। নূহা এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বলে মিসকে ওর মায়ের বাড়ি চিনিয়ে রেখেছে মীরা। এ বছরে স্কুলে ভর্তির সময় নূহার ভীষণ অসুখ করে। ধানমন্ডি নিবেদিতা হসপিটালে টানা পনেরো দিন ভর্তি রাখতে হয়েছিলো ওকে। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি, ওর সুস্থ হওয়ায় জানুয়ারি মাসটা কেটে গেলো, ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি হয়ে গেলো পুরোপুরি সুস্থ হতে। নূহার হার্টের এই সমস্যাটা বেশ ছোটবেলায়ই ধরা পরেছে। ছোট্ট বলে অস্ত্রপোচার করা হয়নি। ওষুধের দ্বারা ঠিক করতে চেষ্টা করেছেন ডাক্তাররা। হাসপাতাল, অপারেশন, ডাক্তার এসবের ঝামেলায় তাই সাড়ে পাঁচবছর হওয়া সত্ত্বেও স্কুলে দিতে পারেনি মীরা নূহাকে৷ ইরা অবশ্য বলেছিলো ওকে বছরের মাঝামাঝি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দিতে, রাজি হয়নি মীরা। ওর ইচ্ছা মেয়েকে বাংলা মিডিয়ামেই দিবে। তাই মিস রেখে পড়ানো হচ্ছে ওকে। মীরার মেয়ের পড়ার ব্যাপারে কোন প্যারা নাই। ও গতানুগতিক মায়েদের মতো পড়ো, পড়ো করে মাথা নষ্ট করে না। পড়া, আর বইয়ের তলে চাপা পরে ওর শৈশবের আনন্দ নষ্ট হোক তা ও চায় না। পড়াটাকে আনন্দময় করার যত চেষ্টা ওর। তাইতো শত কষ্ট হলেও রাতের বেলা বই পড়িয়ে শোনায় মীরা নূহাকে। আর নূহা? এ বয়সেই ওর বইয়ের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০০-তে।

মেয়েটা এমনিই বাবা ছাড়া বেড়ে উঠছে। আশেপাশের বাচ্চাদের বাবা মা, পরিবার এমন ছবি দেখে “বাবা কোথায়?” এমন প্রশ্নের মুখোমুখি ও হয়েছে মীরা বেশ কয়েকবার। মীরা প্রথমে এড়িয়ে গেলেও, এখন আর এড়াতে পারে না। মীরা প্রথমে ভেবেছিলো বলবে- “মা*রা গেছে” কিন্তু মৃ*ত্যুর মতো এত জটিল একটা টার্মটার সাথে এত অল্পবয়সে নূহাকে পরিচয় করাতে মন চায়নি মীরার, তাই বেখেয়ালে একদিন নূহার এই প্রশ্নের উত্তরে মীরা বলেছে- “তোমার বাবা বিদেশ থাকেন ” জাস্ট বলার জন্য বলা। সেদিন আর্ট স্কুলে নতুন এক বন্ধুকে নূহা বলছে ওর বাবা বিদেশ থাকেন। অথচ একই শহরে বাস করছে ওরা, একই আকাশের নিচে। তবুও গত তিনবছরে কারো সাথে কারো দেখা নেই। এসব ভাবতেই মনকে শক্ত করলো মীরা। এসব ভেবে লাভ কি? শুধুই হৃদয়ে র*ক্ত*ক্ষ*রণ। সুযোগ সন্ধানী কিছু পুরুষ ব্যাতীত মীরার এই অন্ধকার অতীত নিয়ে কেও নাড়াচাড়া করে না। মীরার মায়ের বাড়ির লোকেরা, ইরার শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়, খুব কাছের আপনজন সবাই এমন ভাব যেন এমন একটা অতীত ছিলোই না কোনোদিন। আর নূহা! ও যেন আকাশ ফুঁড়ে এসেছে মীরার কোলে। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে মীরার। এমন একটা সাপোর্টিভ পরিবেশের জন্যই মীরা দ্রুত ওভারকাম করতে পেরেছে।

এসব ভাবনাকে মাথা থেকে বের করে ও গেলো রান্নাঘরে নূহার জন্য খিচুড়ি বসাতে, যদিও নূহা বড় হওয়ার পর খিচুড়ি তেমন খেতে চায় না, তাও দুই-এক চামচ খেলেও সেটা ওষুধের মতো কাজ করবে ভেবে রান্না করলো ও। খিচুড়ি বসিয়ে ও গেলো গোসলে। গোসল শেষে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে চটপট ড্রেসটা পরে নিলো ও৷ ড্রেস পরে, চুল অর্ধেক স্ট্রেট করে দৌড়ে গেলো রান্নাঘরে। মেয়ের খিচুড়ি যে চুলায় ভুলেই গিয়েছিলো ও। চুলার আঁচ কমিয়ে রান্নাঘরের প্লাগে স্ট্রেটনার লাগিয়ে চুল এবং খিচুড়ি দুটোর খেয়ালই রাখলো মীরা। সবচুল স্ট্রেট হওয়ার আগেই খিচুড়ি তৈরী হয়ে গেছে। মুরগীর স্টক আগেই তৈরী ছিলো বলে দ্রুত তৈরী হলো খিচুড়ি। মেয়েটার পেট নরম গতকাল থেকে৷ তাই সকাল সকাল পেলাউর চাল, অর্ধেক কাঁচা কলা আর আগে তৈরী করে রাখা মুরগীর স্টক দিয়ে খিচুড়ি করলো ও এই সকালে। মাজেদা খালা দেখলে দিবে বকা। এত ব্যাস্ত দিনে কেন ও এমন ঝামেলা করতে গেলো তাই বলে, তিনি ও-তো পারতেন রাঁধতে। কিন্তু মীরার তাকে বেশী হ্যাপা দিতে চায়নি। নূহার খাবার তৈরীর জন্য যাতে তার নূহার থেকে দূরে না থাকতে হয় তাই ওর এই হ্যাপা পেহানো সেই শুরু থেকে, এতবছরে এটা অভ্যাস হয়ে গেছে ওর । আর ঝমােলা? এতো মীরার নিত্যদিনকার সঙ্গী। বরং ঝামেলাহীন দিনকে বড্ড বিবর্ণ লাগে ওর।

চুল স্ট্রেইট করা হলে দ্রুত সাজলো ও। “ও এমনিতেই সুন্দর, সাজলে ওকে সুন্দর লাগে না”-এমন একটা কথা কেও একজন বলতো ওকে। ভেবেই হাসি পেলো ওর। সাজগোছ শেষ করে নূহা, মাজেদা খালাকে রেখেই বাইরে থেকে দরজা লক করে বেরিয়ে যায় ও। সকাল সকাল না বেরুলে পৌঁছুতে দেরি হবে। বাসা থেকে বের হয়েই মীরা ওর মা জাহানারাকে কল করে জানায় ওর বেরুনোর কথা, ফোন রাখার আগ মূহুর্তে মীরা বলে-
: ” মা, শোন…
আজ আমার একটা বিশেষ দিন, তুমি আমার জন্য একটু দোয়া করো তো…”
কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দেয় ও। মেয়ের কথা শুনে জাহানারা হাসে। জীবণের এই দ্বিতীয় ইনিংসে প্রতিটি কাজে যাওয়ার আগে এমনিভাবে দোয়া চায় মীরা মায়ের কাছে। বাবা-মায়ের অবাধ্যতার প্রমাণ ওর কষ্ট, যন্ত্রণাময় অতীত জীবণ। আর বাবা মায়ের দোয়া, সাপোর্ট যে কি তা ও খুব টের পেয়েছে গত তিনবছরের জীবণে। মীরার জীবণে একাকিত্ব ছাড়া বাকী সবকিছুই সাফল্যের নামান্তর। ঐ একলা থাকাটাই মীরার সাকসেসফুল হওয়াটা ঝুলে আছে সমাজের চোখে। তার উপর রাজিবের সাথে ছাড়াছাড়ির পর ফেসবুকের ইনবক্স, রাতবিরাতে ফোনকল এসব বেড়ে গেছে। পরিচিত জনদের মধ্যে অনেকেরই একা মীরার প্রতি সদয় হয়ে খোঁজখবর নেয়া বাড়িয়ে দিয়েছিলো হুট করেই। তারা ব্যাবসা, সংসার, ছোট্ট মেয়ে কিভাবে সামলায় মীরা তা নিয়ে প্রশংসা দিয়ে কথা বলা শুরু করলেও সে কথা শেষ হতো একা থাকা কষ্টের জীবণের আফসোস নিয়ে। মীরা যখনই কথার এমন টোন ধরতে পেরেছে তখনি হয় ফোন রেখে দিয়েছে নয় এড়িয়ে গেছে। অপমানও করেছে কাওকে কাওকে। এক বাড়িতে তো বাড়িওয়ালা আর তার বিবাহ উপযুক্ত ছেলে দু’জনেই উঠেপড়ে লেগেছিলো ওর পিঁছু৷ তার উপর বাড়ির মা, মেয়ে বউদের বাঁকা দৃষ্টি। তাদের চোখে ডিভোর্সি,একা থাকা সুন্দরী মীরা এক আতংকের নাম। কত্ত ইনসিকিউরড এরা নিজের ছেলে, ভাই, আর বরদের ব্যাপারে। তার উপর এক শ্রেণীর অকর্মণ্যরা তো রয়েছেই, যারা বাবা, স্বামী, ভাইদের ঘাড়ে বসে খেয়ে,পরে থেকে নির্ভেজাল হিংসা করে মীরাকে। তাদের ওকে খাটো করে বলা কথা, ওর সাকসেস মানতে না পারা হিংসাই প্রমাণ দিতো তাদের অকর্মণ্যতার। তারা পিঠ পিছে নানা কথা বলতো মীরার ব্যাপারে। মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু। কথাটা যে কত্ত সত্যি তা একলা চলে খুব টের পেয়েছে মীরা।

তবুও জীবণের শত ব্যাস্ততায়ও এসব থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে ওকে। চরিত্রে কাঠিন্য এনে, কর্কশ কন্ঠে কথা বলে, ব্যাবহারে অসৌজন্যমূলক হয়ে বাঁচতে হয়েছে এদের থেকে। তবুও সবসময় পুরোপুরি পেরে উঠেনি ও। যার বদৌলতে বাড়ি বদল করতে হয়েছিল গত তিন বছরে বেশ কয়েকবার। সমাজে একা থাকা বিশেষ করে সিঙ্গেল মাদারদেরকে মনে করে এরা পুরুষ বিবর্জিত হয়ে পুরুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। একটু চেষ্টা করলেই এদের নাগাল পাওয়া সহজলভ্য। আর বিছানায় টানা তো আরো সহজ। একটা মেয়ে যে একলা নিজের জীবণ বয়ে চলতে পারে তারা তা ভাবে না। সুযোগ সন্ধানী এ পুরুষগুলো তাদের সে*ক্স স্টার্ভ ভাবে। যৌণতা পুরুষ নারী উভয়ের জীবণেরই স্বাভাবিক বৃত্তি। তবে সমাজে এমন অনেক নারীর উদাহরণ রয়েছে যারা অল্প বয়সে সন্তান নিয়ে বিধবা হয়েও বাকী জীবণ একা পার করেছে। এমন পুরুষের সংখ্যা কত?

এর ব্যাতিক্রমও যে কেও নেই, তা বলবে না মীরা। সমাজের এমন অনেক মানুষও আছে যারা পুরুষ হয়েও নির্লোভ সাহায্য করেছে মীরাকে, মেয়ে, মা, বৌ হয়েও মীরাকে বাঁকা নজরে দেখেনি। অকপট প্রশংসায় প্রেরণা দিয়েছে ওকে।

তবে মীরার খারাপের মুখেমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতাই বেশী। বেশ কয়েকবার এসব ঝামেলা হওয়ার দরুন ওর মা বলেছিলো ওদের বাড়ির নিচতলাটায় এসে পরতে। কিন্তু মীরা যায়নি, কারন ওর মনে হয়েছে এতে ওর সাফল্যে ওর পরিশ্রম, মেধার খাটো হওয়ার সুযোগ থাকবে। তাছাড়া ওদের বাড়ির নিচতলাটায় বেশ কয়েকটা ভাড়ার দোকান বের করার দরুন জায়গা বেশ ছোট। এই অজুহাতে মীরা এখানে আসা বাতিল করেছে। আর ওর মা এবং ইরা এসব উটকো ঝামেলাকে পুঁজি করে এসব এড়ানোর জন্য হলেও বিয়ে করতে তাগিদ দেয় মীরাকে। তাদের কথাবার্তায় মনে হয় মীরা যেন অবিবাহিত এক মেয়ে।
——–

বিদেশী কুটনৈতিক আসার কারনে রাস্তা বন্ধ থাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র পৌঁছুবার পথে প্রচুর জ্যাম ছিলো। তমা গাড়ির জানালা দিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছে, সামনে কতগুলো গাড়ি আছে তা দেখছে বারবার। গুগল করে জ্যামের এরিয়া আর দূরত্ব ও দেখছে। ওর এমন আচরণে অস্থিরতার প্রকাশ পাচ্ছে। মীরা নিজেকে ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা করছে। স্পিচে কি বলবে তা গুছিয়ে নিচ্ছে মনে মনে। কলম দিয়ে প্যাডে লেখা স্পিচের দুইএকটা শব্দ বাদ দিচ্ছে কখনো বা যুক্ত করছে এক আধটা লাইন। ওর পৌঁছুবার কোন তাড়া নেই যেন। তমা একটু অবাক হয় মীরার আচরনে। মীরা দীর্ঘ সময় ওর তাকিয়ে থাকা লক্ষ্য করে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে – কি?
তমা মাথা নেড়ে উত্তর দেয় কিছু না।
ওর অবাক হওয়া দেখে মীরা হেসে বলে-
: “আমদের দুজনের চিন্তা তো তুই একসাথে করে ফেলছিস, তাই কুল আছি, দেখে আমাদের হাতের বাইরে যা তা নিয়ে ভেবে কি হবে? এইযে জ্যামে বসে আছি, এতে আমাদের কিন্তু কোন দোষ নেই, তাছাড়া কিছু করারও নেই তাহলে, ফালতু ভেবে কি হবে? অনুষ্ঠান সূচি দেখ, দেড়ি হলে বড়জোর রেম্প শোটা মিস হবে, কি আর করা, ইউটিউব থেকে দেখে নিবো নাহয়। তুই কান্দিস না প্লিজ..
: ” আপু, আমি কাঁদছি না ”
: “তাহলে মুখটা গোমড়া করে রাখিস না, কি সুন্দর লাগছে তোকে, মাশাল্লাহ”
: “আপু আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে, মনে হচ্ছে দেবলোক থেকে মর্তে পরী এসেছে ”
মীরা মুচকি হেসে বলে-
: “মাশাল্লাহ বল”
তমা ফিক করে হেসে বলে-
: “মা-শা-আল্লাহ”

দুজনে তারও আধ ঘন্টা পর পৌঁছুলো ভ্যানুতে। ভাড়া মিটিয়ে হলে প্রবেশ করলো দুজনে। তমা গেলো রেম্প ইভেন্টের ড্রেসিং রুমে ওদের পোশাক পরে রেম্প হয়ে গেছে কিনা তার খবর নিতে। আর মীরা প্রবেশ করলো মূল ফটকের লাল গালিচা দিয়ে।
ওকে রিসিভ করবার জন্য কেও না থাকলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হল ভর্তি সাকলে তখন মঞ্চের নাচ দেখা রেখে দেখছে অনিন্দ্য সুন্দরী মীরাকে।

চলবে…..

প্রিয় ভুল পর্ব-৬১+৬২+৬৩+৬৪

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাজিব তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো একা পরে থাকে পুরো বাড়িটাতে। মীরা চলে যাবার পরপর মিলনও চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়-
: “আজ যা ঘটলো এটা তোমার নিজের কামাই, কি সুন্দর সংসার ছিলো তোমার! সুন্দরী স্ত্রী, ফুটফুটে একটা বাচ্চা, সাজানো ব্যাবসা, সমাজিক প্রতিপত্তি কিসের কমতি ছিলো তোমার? দিনের পর দিন তুমি পরনারী নিয়ে মেতে ছিলে, আজ তোমার এই দুর্দিনে কোথায় তারা?

কিছু সময় চুপ থাকে মিলন, তারপর আবারো বলে-
তুমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে না? আমার বৌ এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কেন ভালোবাসে আমায়? ওর কাছে আমার প্রতি একটা ভরসা আছে, যে যাই করি ওর জায়গাটা এ পৃথিবীতে অন্য কাওকে দেবো না আমি। মেয়েরা কিসের নিজেকে সপে দেয় জানো?
শুদ্ধতম ভালোবাসায়, যার একছত্র অধিপত্য কেবল তারই থাকবে। আর তুমি – রিলিফের চালের মতো জনে জনে বিতরন করেছো তা। আমি আগে যদি ভাবীর এসব কথা জানতাম কক্ষনো আসতাম না তোমার হয়ে সুপারিশ করতে। আমার লজ্জা লাগছে যে আমি তোমার মতো দুশ্চরিত্রের বন্ধু। ছিহ্ রাজিব! ছিহ্!

মিলন রাজিবের দোষে আরো রঙ মিশাতে ভুলে না। যতটুকুতে রাজিব ভিতর থেকে আরো গুড়িয়ে যাবে, উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকুও পাবে না তারচেয়ে বেশী রঞ্জিত করে তুলে ধরে ওর দোষ গুলোকে। রাজিব তো আগে থেকেই ভাঙা, মীরা ওকে গুড়িয়ে দিয়ে গেলো এই তো একটু আগে। এখন মিলনের কথাগুলো ওভার ডোজের মতো প্বার্শ প্রতিক্রিয়া করা শুরু করে। দূর্বল হৃদয়ের রাজিব কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো হয়ে যায়। মিলন কি বলছে তা যেন ওর কানেই ঢুকে না৷ মিলন বেরিয়ে যাবার সময় ও কেবল দেখলো ওর চলে যাওয়া, রাগান্বিত কন্ঠে কি বললো বুঝলো না কিছুই, তারপর ক্রমশ ঝাপসা হতে শুরু করে ওর চারপাশের দৃশ্যপট। একটা সময় ও আর মাথা সোজা করে রাখতে পারলো না। তবে মাথা তখনো পরিষ্কার কাজ করছে। ওর মনে হচ্ছে ঘরে যাওয়া উচিত, কিন্তু ও এ-ও বুঝলো এ ও পারবে না। তবুও চেষ্টা করলো ঘরের বিছানা অবধি যাবার। অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ও তা পারলো না, ড্রইং রুমের ওয়াকিং স্পেসের পাশে নূহার প্লেয়িং জোনের কাছটায় পরে গেলো রাজিব, ওর অনিয়ন্ত্রিত পতনের কারনে নূহার টেন্ট, খেলনাপাতি সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বাম হাতটা পরলো বেকায়দায়, সেটাকে তুলে আনতে গিয়ে ও ঘটালো আরেক বিপত্তি। অপর দিকে রাখা নূহার বাড়ি, রান্নাঘর, বাসনকোসন ছোট্ট নূহার সাজানো সংসার সব তছনছ হয়ে গেলো তারপর ব্ল্যাকআউটের মতো চোখ বুজে এলো, রাজিবের তখন মনে হলো মেয়ের সংসারটাও গুড়িয়ে দিলাম, এরপর কেবলি প্রবল আচ্ছন্নতা, ওর মনে হলো মৃ*ত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ও। এমন অবস্থায় ও মুখে একটা হাসি ফুটলো রাজিবের, এসব যন্ত্রণা চোখে দেখার চেয়ে মৃ*ত্যুই ভালো। সবসময় বেঁচে থাকার স্বাদ নিয়ে ব্যাস্ত থাকা রাজিব সানন্দে গ্রহণ করলো মৃ*ত্যুকে।

———————

মাটির তৈরী জিনিস পোড়াবার আগে যেমন পানি লাগলে গলে যায়, শুকালে ভয় থাকে ভেঙে যাবার তেমনি সম্মান আর সামঞ্জস্যহীন সম্পর্কগুলোও ভঙ্গুর হয়। ঠিক সাথী আর সাকলায়েনের সংসারের মতো। ওদের সংসারের তার কাটে খুব অল্পেই, পাঠকের কল্পনার চেয়েও দ্রুততর সময়ে। কারন দুজনই অধৈর্য আর অসংযম চুড়ান্ত রূপ। দুজনেই জীবণে চলার পথে সময়ের কাছে যাই পেয়েছে তা হয় ছিনিয়ে নিয়েছে নয়তো আদায় করে, অর্জন করা কি তা না জানে সাথী, অজানা সাকলায়েনেরও । দুজনে দুই দিকে থেকেও জীবণকে দেখেছে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে। লো*ভ, ভো*গ, এ শব্দ দুটি যেন ওদের চরিত্রের বর্ননায় ওদের প্রতিশব্দ। একজনের লো*ভ নিত্য নতুন মেয়েতে, তো আরেক জনের ধনবান পুরুষে। দুজনের কেউরই কিন্তু বিবেকের দেয়ালে ধাক্কা লাগেনি বিবাহিত কারো সাথে সম্পর্ক তৈরীতে। সাথীর যেমন বিবাহিত ফুফাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরীতে বিবেকের দংশন হয়নি, সংকোচ হয়নি সন্তানসম্ভবা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাকে বিয়ে করতে, সাকলায়েন তো ছাড়া গরু। ওর কাছে মূল্যবোধ তো বহুত দামী শব্দ, ওর মতো হীন লোকেদের কাছে মূল্যবোধের মতো অদৃশ্য সত্তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আল্লাহ ঠিক মিলিয়ে দিয়েছে মানিক-রতন।

সাথীর বাবা মা, বোনেরা সপ্তাহ খানিক থেকে চলে গেছে বাড়িতে। ধান বোনার সময় এখন, তাছাড়া সবার স্কুল কলেজ সব ঐদিকেই, লম্বা ছুটিতে সবার পড়ালেখার ক্ষতি হবে। তারা যাবার আগে সাথী ওর বাবা-মাকে বলে রেখেছে কলেজ পড়ুয়া মিথির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে ঢাকায় এনে নিজের কাছে রাখার কথা, তারা অমত করেননি, বরং খুশিই হয়েছেন মেয়ের এমন আবদারে । এ কথা শুনে কলেজ পড়ুয়া মিথি খুব খুশি আর ওর পরের দুই বোন স্মৃতি ও প্রীতি মনে মনে হিংসে করতে শুরু করে মিথিকে, ইশ্ কত্ত ভালো হতো ঢাকায় এই এত সুন্দর বাসাটায় ওরাও থাকতে পারতো যদি। কিন্তু ছোট দুই বোন তো জানে না, আজ যাকে হিংসা করছে ওরা তার কি করুন, নির্মম দিন ওর জীবণের চারিপাশে পরিখা করে রেখেছে ওরই জন্য।

তারা চলে যাবার পরই ছন্দ পতন শুরু হয় ওদের। টাকা সাকলায়েন অনেক কামাই করে। টাকার অভাব হয় না ওর, সংসারের খরচ, নিজের জন্য কেনাকাটা, ঘরদোর নতুনভাবে সাজানো। ওর যার অভাব হয় তা হচ্ছে সঙ্গ। রাজিব ছায়ার মতো সবসময় ওর পিছনে থেকেছে। প্রায় সন্ধ্যায় ওরা বেড়াতে বেরুতো৷ রাতের খাবারটা বাইরেই খেতো। নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, হোটেল এক্সপ্লোর করাই যেন একত্রে সময় কাটানোর বাহানা একটা। দু’জনেই দুজনের সঙ্গ ভালোবাসতো। আর সাকলায়েন? বিয়ের পর কেমন যেন বদলে গেছে ও। আগে রাজিবের অনুপস্থিতিতে যতটুকু কদর ওর করতো এখন ওর পুরো দখলদারি পেয়েও ওর তৃষ্ণা যেন উবে গেছে। রাতে এসব বিষয়ে কথা বললে রেগে যায় ও, ক্রুদ্ধ স্বরে বলে-
: “এই বা*লের প্যাচাল ভাল্লাগে না বুঝছো?”
সাথী কেমন যেন হয়ে যায় ওর আচরণে। প্রমিক সাকলায়েন আর স্বামী সাকলায়েনকে যেন মিলাতে পারে না। দু’জন দু’দিকে ফিরে শুয়ে থাকলেও সাকলায়েনের শেষ রাতের আদরে বিগলিত হয়ে সব ভুলে যায় সাথী।

————————-

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাজেদা খালাকে কিছু টাকা দিয়ে দরকারী জিনিস কিনতে পাঠায় মীরা। দোকানের স্টাফদের দিয়ে মালপত্র সরিয়ে বড় ঘরটা ফাঁকা করে ওদের থাকার জন্য। মাসের অর্ধেক তার উপর ঘর খোঁজার মানসিককাতাও নেই ওর। আপাততঃ চলার জন্য যা না হলেই নয় তা আনার দায়িত্ব দেয় ওদের। এগুলো বুঝিয়ে কি এক কাজে বাইরে যায় মীরা। টুম্পা ও যায় ওর সাথে। ঘরের এত কাজ দেখে মাজেদা খালা তার বোনকে ফোন করে ডেকে পাঠায় নূহার খেয়াল রাখতে। তিনি প্রায়ই আসেন এ নূহাকে দেখতে।

মীরার চলে যাবার পর পরই ওয়ার হাউজের এ বাসাটায় আসেন মোখলেস চাচা। তিনি মীরার কারখানা নিলামের খবর পেয়ে মীরাকে কল করেছিলেন , মীরা রিসিভ করেনি। উপায় না দেখে ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে কেও গেইট না খোলায় আউটলেটের ম্যানেজার ফাহাদকে কল দিয়ে জানতে পারে ওরা ওয়ার হাউজে শিফট করেছে গত রাতে৷ কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারেন না মুখলেস সাহেব , তবে ঘোর অমানিশায় যে মীরা রয়েছে তা বুঝতে বাকী থাকে না এ মানুষটার। খবর পাওয়া মাত্র ঠিকানা নিয়ে তিনি এসেছেন এখানে। কিন্তু মীরা ততক্ষণে বারিয়ে গেছে। মাজেদা খালাকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে তিনি সবটা খুলে বলেন। কারন মাজেদা খালা তাকে ইরার বিয়ের কথাবার্তা হওয়ার সময় থেকে চিনেন।

সবটা শুনে কেমন থমকে যান ভদ্রলোক । মেয়েটাকে অনেক আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যা ওর লিখনে ছিলো তা তো খন্ডানো যাবে না। তা না হলে এত বুঝদার একটা মেয়ে সব ওর হাতে ছেড়ে দেয়ার মতো ভুল কেন করব? দুটো মেশিন দিয়ে শুরু করা ব্যাবসার আজ অর্ধ কোটি টাকার থেকে ডাক শুরু হবে। তিনি এসেছেন ওর সহায় হতে৷ কিন্তু মীরা তার সাহায্য নিবে না, তাও তিনি ভালে করে জানেন। তাইতো মীরা ফোন ধরছে না তার। ঠিক এ মূহুর্তে দোয়া করা ছাড়া কোন পথ খোলা রাখেনি মীরা। মাজেদা খালা চা এনে দেখেন লোকটা রুমাল দিয়ে তার চোখ মুছছেন। মাজেদা খালা চায়ের কাপ সামনে রাখলে উঠে পরেন তিনি।

——————–

বিকাল পাঁচটা,
উইল পাওয়ার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ এর মেইন ব্রাঞ্চে “মীরা ফ্যাশন” এর কারখানা, ওয়্যার হাউজ, গোডাউনের সকল মালপত্র, ফেসবুক পেইজ, সমস্ত কিছু বিক্রির উদ্দেশ্য নিলামের ডাক বসিয়েছেন। সম্ভাব্য ক্রেতারা যথাসময়েই উপস্থিত হয়েছে। সবচেয়ে করুন বিষয় হচ্ছে এ নিলামের সভাপতি পর্ষদের দায়িত্বে থাকা তিনজনের একজন মার্কেট সমিতির সভাপতি মোখলেসুর রহমান ওরফে মোখলেস চাচা। তার জন্য আজ অনেক কষ্টের দিন। অনেক কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও কিছুই করার নেই তার। এমনকি এখানে না এসেও উপায় ছিলনা তার। তিনি অসুস্থতার বাহানায় এড়িয়ে যেতে চাইলে ডেট পরিবর্তনের কথা জানায় তারা। এতে এই দীর্ঘ ঝামেলা আরো দীর্ঘায়িত হবে ভেবে শেষমেশ এসে উপস্থিত হন তিনি। কিন্তু তার দৃষ্টি অবনত। তিনি মনে মনে চাচ্ছেন কোনমতে এই দু-এক ঘন্টা কেটে যাক, আর উনি বাড়ি ফিরে যান।

সম্ভব্য ক্রেতাদের প্রায় সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন এর দাম কত অবধি উঠতে পারে তা নিয়ে। এমন সময় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকে মালিক পক্ষের রাজিব আর ওর বন্ধু মিলন। এদের অপেক্ষায়ই দেরি করছিলেন তারা। রাজিব বেহুশ হয়ে পরে থাকার দরুন এত দেরি, তা তাদেরকে জানালেন মিলন। মিলন রাজিবকে বসিয়ে বাইরে যায়। রাজিব যেন অন্য গ্রহের কেও, আসা অবধি মাথা নিচু করে দুহাতের আঙুল খুঁটছে। কোথাও একটা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।

মিলন বাইরে গিয়ে কল করে কাকে যেন। রাগান্বিত কন্ঠে গালাগাল করে এখনো না পৌঁছানোয়। অবশেষে একটা ব্যাগ হাতে পৌঁছয় তার ছোট ভাই সুমন। সুমনকে যা বলার তা গত রাতেই তোতাপাখির মতো পড়িয়েছে মিলন। “যে করেই হোক মীরা ফ্যাশন আমার চাই” – কথাটা বলে কাঁধে সাহসদায়ী চাপড় দিয়ে হাসি মুখে ভাইকে ভিতরে যেতে পথ দেখায় মিলন। দু-হাত দুই পকেটে ঢুকিয়ে এদিকওদিক দেখে সে । কেও আবার দেখলো কি-না তার পরখ করলো আড়চোখে। তারপর ভিতরে ঢুকলো।

অবশেষে নিলামের ডাক শুরু হয়। নিলাম শুরু হয় ৫০ লক্ষ ১ হাজার থেকে। মিনিট পাঁচের ব্যাবধানে তা নানা হাত ঘুরে চলে যায় ৭০ লাখের ঘরে। সেই অংকটাও মিলনের ভাই সুমনেরই দেয়া৷ সুমন এসব ব্যাবসাপাতির কিছুই বুঝে না, ভাইয়ের খাতিরে অফেিস হতে ছুটি নিয়ে এখানে আসা।

মিলনের মুখে হাসি। এরচেয়ে বেশি দামে কোন গাধা কিনবে এটাকে? মিলন তো টাকার দামের জিনিস কিনতে আসে নি, এসেছে ইমোশন কিনতে, মীরার ব্র্যান্ড কিনতে, ধ্বংস করতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে।

নিলাম ঘোষণাকারী ডাক দেন-
৭০ লক্ষ্য এক
৭০ লক্ষ্য দুই

এমন সময় নাটকীয়ভাবে হলরুমে প্রবেশ করে মীরা।
৭০ লক্ষ্য তিন বলার আগেই মীরা বলে উঠে-
৭৫ লক্ষ।
পুরো ঘরভর্তি মানুষ মেয়েলি গলার স্বরে পেছন ফিরে তাকায়। এতক্ষণে মোখলেস চাচাও মাথা তুলে দেখেন সেই কন্ঠস্বরের উৎসের দিকে। ঘরভর্তি সকলের দৃষ্টি মীরার দিকে, কেবল একজন ছাড়া, আর সে হচ্ছে রাজিব। মিলনের কপালে বিরক্তির ভাজ পরে মীরাকে দেখে। মনে মনে বলে- “এ আবার এলো কোত্থেকে? ”

৭৫ লাখের বেশী আর দাম কে দিবে?
নিলাম ঘোষণাকারী আবারো ডেস্কে চাপড় দিয়ে বলে –
৭৫ লক্ষ্য এক
৭৫ লক্ষ্য দুই
এমন সময় সুমন বলে উঠে ৭৭ লক্ষ।
মীরা এক মূহুর্ত না ভেবে বলে ৮০ লক্ষ। এবার সুমন
বলে ৮৫ লক্ষ্য। মীরা আবারো ক্ষণকালও ব্যায় না করে বলে ৯০ লক্ষ। পুরো হল ভর্তি মানুষ অবাক হয়ে একবার সুমনকে দেখে তো আরেকবার মীরাকে৷ সুমন বিরক্ত হয়, এই ছাতার কারখানা কিনতে ৯০ লক্ষ? হুহ্ ৯০ লক্ষ দিয়ে এমন কারখানা তিনটা দেয়া যাবে। এসব ভেবে চেপে যায় সুমন।
নিলাম ঘোষনাকরী বলেন-
৯০ লক্ষ্য এক
৯০ লক্ষ্য দুই
৯০ লক্ষ্য তিন

অভিনন্দন আপনাকে, আজ থেকে মীরা ফ্যাশনের মালিক হচ্ছেন, নাম কি আপনার? মীরার হাত থেকে আসা আবেদনপত্র তার কাছে পৌঁছালে নাম দেখতে কাগজে চোখ বুলায় সে। তারপর একবার কাগজ দেখে তো আরেকবার মীরাকে। তারপর বিষ্ময় চেপে তিনি আবারো বলেন-
আজ থেকে মীরা ফ্যাশনের মালিক হচ্ছেন “জিনিয়া আবেদীন মীরা”

মুখলেস চাচা অস্ফুটস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে চোখের পানি ছেড়ে দেন। আর মীরা দাঁড়ানো থেকে বসে পরে একটা চেয়ার টেনে। টুম্পা ওর বসে পরার ভাঙ্গি দেখে বলে- “অভিনন্দন আপা”
মীরা ফ্যালফ্যাল করে টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলে- “আলহামদুলিল্লাহ”

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

নিলাম সম্পন্ন হওয়ার পর ধীরে ধীরে সকলে চলে যায়। সভাপতি পর্ষদের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে। বাম দিকের কলামে থাকা মিলন, রাজিব বসে আছে, ওদের দুই সারি পেছনে বসে সুমন। মিলন বারবার অস্থিরতার মধ্যে উঠছে আর বসছে, দুএকবার চোখ রাঙানিও দেখিয়েছে সুমনকে। সেই চোখ রাঙানি দেখার পর হতে অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে বসে আছে সুমন, ব্যাপারটা দূর থেকে লক্ষ্য করে টুম্পা। এদিকে রাজিব এখনো চেয়ারের দুই পাশে দুই হাত দিয়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে অবনত মস্তকে। জীর্ণ শরীর মন মাথাটুকু তুলে রাখার শক্তি সরবারহে ব্যার্থ আজ।

ডানদিকের কলামে থাকা মীরা বেশ কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। “মীরা ফ্যাশন” – এর নিলাম ডাকার খবর শোনার পর থেকে গত কয়েকটা দিন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে ওর। কেবলমাত্র একটা দিকেই ফোকাস ছিলো ওর- বেদখল যেন না হয় ওর পরিশ্রম, রক্ত, ঘামে তৈরি “মীরা ফ্যাশন”। চারপাশে কি হচ্ছে তার কোন হুশ ছিলোনা ওর। একটা তুমুল ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে এ কয়দিনে, ডি*ভো*র্সের মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন কিছু ছিলো না ওর জন্য, কঠিন যা ছিলো তা হচ্ছে রাজিবের মুখোমুখি হওয়া। যাকে ভালোবেসে সাঁতার না জানা মীরা জীবণ সমুদ্র পাড়ি দিতে ঘর ছেড়েছে, ঝড়, ঝাপটা বিপদ মোকাবিলা করে আগলে রেখেছে রাজিবকে, প্রতিকূলতায় অকুল সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে ভেবেছে ওকে নিয়েই এই অকূল পাথার পাড়ি দিয়ে তীরে উঠবে একদিন। সে কিন্তু ওকে মনে রাখেনি, সে মীরার বিশ্বাস ভেঙে মিথ্যে মরিচীকার লোভে অকূল সমুদ্রে মীরার হাত ছেড়ে ধরেছে অন্য হাত, অন্য ঠাঁই।

জীবণ মীরাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছে। সবগুলো পরিস্থিতিই মীরা সামাল দিয়েছে দৃঢ়তার সঙ্গে, কিন্তু বিশ্বাস ভাঙা এই মানুষটার মুখোমুখি হয়ে ঐ সম্পর্কচ্ছেদ করার সিদ্ধান্তের মতো মানসিক চাপ এর আগে ও কখনো ফেইস করেনি। কিন্তু এবারও মীরা পেরেছে দৃঢ়তার সাথে সেটা করতে। কিন্তু ভিতর থেকে কতটুকু গুড়িয়ে গেছে তা কেও জানবে না। কেও জানবে না মুখের হাসির নিচে লুকানো আছে কান্না, কেও জানবেনা ঐ কাজল দেয়া চোখের নিচে সেই কান্নারই জল শুকানোর রেখা লুকিনো আছে। বুকের বা পাশে যে হৃদয়টা তাকে যে কত কত বার রিফুর সূচের মুখোমুখি হতে হয়েছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। বুক ভরে নিশ্বাস নেয়াটা আজ বড্ড কষ্টের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঝড় ওকে সামাল দিতে হয়েছে একা হাতে, কারন ওকে জানার পথ ও নিজে মুছে দিয়েছে অনেক আগে, আর যতদিনে হুশ ফিরেছে ওর ততোদিনে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ভুলের রাজ্যে।
——–

বসুন্ধরা শপিং মলে নতুন দোকান নেবার জন্য কিছু টাকা ওর ক্যাশ ছিলো। দোকান না নেয়ায় সে টাকাগুলো ক্যাশই ছিলো। তবে সেখান থেকে বেশ কিছু টাকা ফ্ল্যাট বন্ধকীদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট ফিরিয়ে আনতে খরচ হয়েছিল। ওর নিজের যত গহনা ছিলো সব বিক্রি করে দিয়েছিলো একদিনের মধ্যে। দাম ভালোই পেয়েছে তাঁতীবাজারে পরিচিত লোক থাকায়। অর্ধেকের বেশী টাকার টান ছিলো তখনো।

কার কাছে চাইবে ও এতগুলো টাকা?
কে পারবে দিতে? এই প্রশ্ন মনে আসতেই বেশ কয়েকজনের কথা মাথায় এসেছিলো। খবর পেয়ে
সেদিন রাতে পাভেল ওর নিজের তাগাদায় পাওয়া সব টাকা দিয়েছিলো, সবমিলিয়ে সাত লক্ষ টাকা ছিলো ওখানে। মাজেদা খালার তার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া জমি বিক্রির আড়াই লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছিলেন মীরার হাতে। তারপরও অনেক টাকা বাকী। মীরা প্রথমেই ভেবেছে তারা যেহেতু কোটির কাছাকাছি টাকা পাওনা হয়েছে রাজিবের কাছে, তাই কারখানার সম্ভাব্য দাম কোটি পর্যন্ত উঠবে৷ সে হিসেবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু বিকাল অবধি সবার সব টাকা মিলিয়ে যা হয়েছিলো তাতেও ঐ অংক পূরণ হয় নি। মোখলেস চাচা সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। মীরা বলেছে একটু চেষ্টা করি চাচা, না পারলে আপনি তো রইলেনই, পরে নাহয় জানাবো আপনাকে।

মীরা কোন মতোই মুখলেস চাচার থেকে টাকাটা নিতে চায়নি, কারন তিনি এখন কেবল ওর ব্যাবসয়িক প্রতিবেশী , প্রতিদ্বন্দ্বীই না, তিনি এখন ইরার শ্বশুরও।

উপায় না দেখে মীরা কল করে লোরাকে। মীরার রাহাতের সূত্রে পরিচিত হয়েছিল লোরার সাথে, কিন্তু রাহাতের চেয়ে লোরা এখন বেশী ক্লোজ ওর, এত বছরের জানাশোনায় দুজনেই দুজনের নাড়িনক্ষত্র সব জানে। এমনকি সাথীদের গ্রামের বাড়িতে যে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিলো লন্ডন থেকে সেই ফেইক সম্বন্ধের পাত্রও লোরার ভাই রাকিন ছিলো। ওদের প্ল্যান ছিলো লন্ডনি পাত্রের লোভে পরা সাথীর আসল চেহারা উদ্ঘাটন করা। কিন্তু ও যে আগেই উদ্ঘাটিত হয়ে বসে আছে সাকলায়েনের কাছে তা তো আর ওরা জানতো না। সাকলায়েন জাত গুন্ডা, রাজিবকে ছেড়ে দেয়া সহজ হলেও সাকলায়েনের চোখে ফাঁকি দিয়ে রাকিনকে বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না ওর জন্য। ওদের প্ল্যান এটা হলে কি হবে, ইশ্বরতো এরচেয়ে নিখুঁত প্ল্যান সাজিয়ে রেখেছিলেন সৃষ্টির শুরুর দিন থেকেই। তাইতো হাতে-নাতে নিজ গৃহেই উন্মোচিত হলো প্রিয়তমা স্ত্রীর আসল রূপ।

তো মীরা লোরার কাছে ধার চায়নি। সবটা খুলে বলে নিজের ধ্বংসপ্রায় বিজনেসের জন্য ইনভেস্টর হতে বলেছিলো লোরাকে। লোরা মীরাকে পছন্দ করে ওর সৎ, পরিশ্রমী আর কর্মঠ, গুণের জন্য। লোরা বলেছে আমি এসব বিজনেসের কিছু বুঝিনা, কত লাগবে বলো সবটা আমার কাছে না থাকলেও দেশ থেকে ম্যানেজ করে দিচ্ছি। মীরা শান্ত কন্ঠে বলেছে টাকাটা তুমি ধার হিসেবে দিলেও আমি ইনভেস্টর হিসেবেই নিবো।

পরে লোরা রাহাতের সাথে কথা বলে জানাবে বলে ফোন রেখে দেয়। মীরা ভাবে ঠিক কাজটাই করেছে ও। যারা না চাইতেই অনেক দেয়, তাদের কাছ থেকে হাত পেতে নিতে সংকোচ হয়।

একঘন্টা পর কল আসে লোরার। টাকা পাঠাবে ও মীরার একাউন্টে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টাকাটা ঢুকবে দুদিন পর। কিন্তু টাকাটা আগামীকালই লাগবে। উপায়ন্তর না পেয়ে লোরা কোনভাবে বাংলাদেশ থেকেই ম্যানেজ করে টাকাগুলো। কিছু টাকা মীরাও ধার করে পরিচিত জনদের থেকে। সবমিলিয়ে পুরো টাকার জোগাড় রীতিমতো হুলুস্থুল একটা কান্ড ছিলো ওদের জন্য। কারো নাওয়া নাই খাওয়া নাই একটাই টেনশন শেষ পর্যন্ত পারবে তো। সেদিন রাতেও মীরা শেষ পর্যন্ত পারবে কি না এমন দোটানা নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিল। রাজীব নামের মানুষটা তো আটপৌরে অসুখ ওর। নতুন এই চাপ নিয়ে বেঁচে যে ছিলো এই এক আচ্শর্যের বিষয়। সব কাগজপত্র নিয়ে চেক দিয়ে মীরা আর টুম্পার বেরুবার সময় মীরা মিলনের কাছটায় থমকে দাঁড়ায়। টুম্পা বুঝতে পারে না ওর দাঁড়ানোর কারন। একটু যেন অবাক হয় মীরার এমন থমকে যাওয়ায়। মিলনের চোখে চোখ রেখে মীরা বলে
: “আমি আসলে একজনের সাথে জিততে এসেছিলাম, ফিরলাম দুজনের কাছে জিতে। আমার বাবা বলতেন- ‘প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়’ ছোটবেলায় এ কাথার অর্থ না বুঝলেও আজ এই কথার মর্ম আমার কাছে পরিষ্কার। আপনাকে আমার মনে থাকবে মিলন ভাই, সাবধানে থাকবেন”

বলেই গটগট করে বেরিয়ে পরে মীরা, রাজিব তখনো অবনত মস্তকে নিচে তাকানো৷ এত বছর ধরে অবহেলা করা মীরার দিকে তাকানোর শক্তি, সাহস কোনটাই ওর নেই আজ। আর মিলন মুষ্টিবদ্ধ হাত দেয়ালে আঘাত করে, মিলনের কানে বাজতে থাকে মীরার শেষ কথাটা “আপনাকে আমার মনে থাকবে মিলন ভাই, সাবধানে থাকবেন”। এত বড় সাহস ওর, একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে বলে গেলো এ এমন কথা!

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সমিতির অফিস থেকে বেড়িয়ে সবগুলো কাগজপত্রের ফটোকপি করে মীরা। এদিকটায় কমার্শিয়াল স্পেস হওয়ায় প্রচুর ভীড় হয় দোকান গুলোতে। টুম্পা পরে করার কথা বললেও মীরা ওর কথা অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কাজ শেষ হতে বেশ কিছু সময় চলে যায়। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা ধরে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বাসায় ফিরবার পথে রিকশায় বসে টুম্পা মীরার সাথে কথা বলার ফুরসত পেলো যেন। ও মীরাকে জিজ্ঞেস করলো-
: “আপা মিলন ভাইয়ের সাথে এভাবে কেন কথা বললেন আপনি? “দুজনের কাছে জিতে যাওয়া”
আর “প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়” মানে কি এসব কথার?

টুম্পার এমন জিজ্ঞাসায় কোন হেলদোল নেই মীরার। ও যেন টুম্পার এতগুলো কথার কিছুই শুনেনি। টুম্পা মীরার হাতটা ধরে। দেখে মীরা কাঁপছে। চকিত কন্ঠে টুম্পা বলে-
: আপা! আপনার কি খারাপ লাগছে?
বেশ কিছু সময় মৌন থাকে মীরা। টুম্পা ওর থুতনিতে হাত দিয়ে ওর দিকে মুখ ফিরায় মীরার, ধ্যান ভঙ্গের মতো দৃষ্টিতে তাকায় ও টুম্পার দিকে। তারপর স্মিত হেসে বলে-
: নারে, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি, কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
টুম্পা ওর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে ওর কোলে এনে বলে-
: জানি আপা কিসের ভিতর দিয়ে যে গেলেন আপনি, আল্লাহ সহায় ছিলো বলে। এমন অবস্থায় আমি থাকলে ফিট হয়ে যেতাম।
মীরার অধরে বক্র হাসি ফুটে উঠলো।
টুম্পা বললো-
: “সত্যি! ”
মীরা নিজের হাত নিজের কাছে ফিরিয়ে এনে বললো –
: আমি সবটা ওকে কেন দিয়ে এসেছিলাম জানিস? শুধু ওকে বোঝানোর জন্য আমি কত শক্ত, আর ও কত্ত ভঙ্গুর!
কিছু সময় মৌন থেকে মীরা, তারপর আবারও বলে-
: তুই জিজ্ঞেস করলি না- “দুজনের কাছে জিতে যাওয়া” আর “প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়” মানে কি এসব কথার?
অবাক হয় টুম্পা, ও ভেবেছিলো মীরা অন্যমনস্কতায় শুনতে পায়নি এসব। তারপর মীরা বলে-
: মুখলেস চাচা নিলামে জমা হওয়া পেপারস্ দেখে আমাকে আগেই জানিয়েছিল মিলনের অভিসন্ধির কথা। প্রথমটায় তিনিও বুঝতে পারেন নি, মিলনের ভাই সুমনের নামে কাগজপত্র থাকার দরুন। পরে সিকিউরিটি পার্সন আর নমিনির নাম দেখে অবাক হন মুখলেস চাচা, তিনি সুমনকে জিজ্ঞেস করে মিলন ওর কে হয়? সুমন গর্বের সঙ্গে মিলনের পরিচয় দেয়। প্রথম ধাক্কাটা সামলে তিনি ব্যাবসায়িক অভিজ্ঞতার আলাপ সূত্রে জানতে পারে সুমন একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সরল সুমন এখানে যে ভায়া হয়ে নিলামে এসেছে তাও চাচাকে বলে অকপটে। বেচারা!

মুখলেস চাচা কে? তা মিলন জানলেও সুমনের তা জানার কথা না। ও কর্পোরেট ভুবনের বাসিন্দা। ঐ যে একটা কথা আছে না “মানুষ যতই পা ধরে টেনে নিচে নামাতে চাক, খোদা যদি মাথা ধরে উপরে উঠায় কারো সাধ্য নাই ক্ষতি করার”

তখন আমার কাছে পরিষ্কার হয় মিলনের ওর প্রতি হঠাৎ এমন উদার হওয়ার কারন। সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হলে মাথায় রক্ত উঠে যায়, যে ব্যাবসাটাকে এলেবেলে ভাবে রক্ষা করতে চাইলাম, সেটা হয়ে গেলো জীবণ ম*র*ণের ব্যাপার। মরিয়া হয়ে গেলাম এটাকে বাঁচাতে। এজন্যই তখন বলেছিলাম-
“প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে ধার কমে যায়” মিলনের ব্যাপারটা না জানলে হয়তো এতটা মরিয়া হতাম না এটাকে রক্ষা করবার, আর “দুজনের কাছে জিতে যাওয়ার ব্যাপারটা তো বুঝেছিস-ই”

টুম্পা এসবের কিছুই জানতো না, তবে কাছ থেকে যখন মীরাকে দেখেছে বেশ কয়েকবার ও বলতে চেয়েছে – “অনেক হইছে আপা, বাদ দেন। আল্লাহ চাইলে এরচেয়ে বড় কারখানা হবে ভবিষ্যতে
আমাদের” কিন্তু এমন দৃঢ়তা, চেষ্টা, “মীরা ফ্যাশন”-এর প্রতি অপত্য আবেগ দেখে বলার সাহস হয়নি টুম্পার। এমন ভাবনার ছেদ পরলো মীরার কথায়-
: জীবণে কষ্ট তো খোদা কম দিলো না, এ কয়দিনে আমি কেবল একটাই দোয়া করেছি- ” আমার কষ্টে গড়া সম্পদ রক্ষার সামর্থ্য তুমি আমাকে দাও”
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি আমাকে তা দিয়েছেন।

ভাঙা রাস্তায় বর্ষার বৃষ্টির দরুন আরো নাকাল অবস্থা। ওদের রিকশাটা একটা গর্তকে পাশ কেটে পেরুতে গিয়ে ডান দিকে ওভারটেকিং করলো। সরু গলিটায় উল্টোদিকের ব্যাটারি চালিত রিকশার দ্রুত আগমনে ড্রাইভার ভড়কে সাইড করতে গিয়ে ঐ রিকশার সাথে খেলো ধাক্কা। মীরা পরে যেতে লাগলো। ও শক্ত হাতে রিকশার হুড ধরে কোনমতে বসলো। দুই রিকশার সংঘর্ষে অপর রিকশাওয়ালা গালাগাল শুরু করলো ওদের ড্রাইভারের। মীরা বুঝলো দোষ ওদের রিকশার ড্রাইভারেরই । তাই কোন মতে কাটিয়ে দিতে লাগলো ড্রাইভারের হয়ে ক্ষমা চেয়ে। অপর রিকশার ভদ্রলোক তার ড্রাইভারকে বুঝিয়ে চালাতে বললেন। তার দুটো কথা শোনানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা এড়িয়ে গেলেন। এমনকি তাকালেন না পর্যন্ত ওদের রিকশার দিকে। মীরার লোকটার এমন অগ্রাহ্য করার ব্যাপারটা কেমন যেন বুকে বিঁধলো, কি মনে করে যেন মনে পরলো আবীরের কথা। আবীরও তো এমনি ভাবে অগ্রাহ্য করেছে মীরার অপরাধকে। ডি*ভো*র্সের দিন সামনাসামনি আসেনি পর্যন্ত। সেদিন ওর মুখ খুলে কিছু বলা লাগতো না, সেদিন ওদের মুখোমুখি হওয়াটাই অনেক কিছু বলা হতো মীরাকে।
মীরা কী শক্ত? এমন মানুষগুলো ওর চেয়ে ঢের শক্তিশালী। ভাবনার ছেদ পরে রিকশা থামলে। বাসায় পৌঁছে গেছে ওরা, রিকশা থেকে নেমে অল্প বয়সী ড্রাইভারকে মীরা বলে-
: “দেখেশুনে গাড়ি চালাবে, তুমি রাস্তায় বেরুলে বাড়িতে পরিবার তোমার ফিরবার অপেক্ষায় থাকে”

ছেলেটা লাজুক হাসি হেসে মাথা চুলকায়, এ হাসিতে ওর করা অপরাধের স্বীকারক্তি লুকানো যেন। । মীরা ভাড়া দিয়ে নেমে গেলো বাড়ির সামনে।

বাসায় ফিরে মনে পরে রান্নাবান্নার কোন খবর নাই, মীরা ভুলেই গেছে বাসায় গ্যাস কেটে নিয়ে গেছে আজ সকালে। “অভগা যেখানে যায় দড়িয়া শুকায়ে যায়” দ্রুত ব্যাগ থেকে খুচরা টাকা বের করে মাজেদা খালাকে বলেন বাইরে থেকে খাবার আনতে। মাজেদা খালা ভাবলেশহীন ভাবে হাম তুলে বলেন-
: “মুখলেস চাচা দিয়া গেছে খাওন, আপনে ফেরেশ হন, আমি খাওন দেই” মীরা যখন ঐ অফিস থেকে বের হয় তখন সন্ধ্যা সাতটা, মুখলেস চাচা তখনো ওখানে ছিলো। এখন রাত নয়টা বাজে, এরিমধ্য তিনি বাড়ি ফিরে খাবার নিয়ে, তা পৌঁছেও দিয়েছেন এ বাড়িতে! মীরা একটুও অবাক হয় না লোকটার এমন ম্যাজিকে।

গোসল সেরে খাবার খায় মীরা, তারপর ফোনগুলো বন্ধ করে ঘুমাতে যায় ও। নূহাও যেন ওর মায়ের ক্লান্তি টের পেলো। কোন রকম বিরক্ত না করে আজ দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পরলো মায়ের পাশে। এত দ্রুত ঘুম এসে পরলো যে ঘরের বাতি জ্বালানো তা টেরই পেলো না মীরা। টুম্পা বাথরুমে যেতে এসে বাতি নিভিয়ে দিয়ে যায় অনেক পরে।

যখন মীরার সেই গভীর ঘুম ভাঙে তখন ভোর পাঁচটা। মীরার সারা শরীর ব্যাথায় অবশের মতো মনে হয়, মুখে কেমন সিদ্ধ সিদ্ধ ভাব, পানি মুখে দিলে পানির স্বাদ ও অন্যরকম লাগে। গায়ের তাপ না পরখ করেও মীরা বুঝলো ওর গায়ে ভীষণ জ্বর! এতদিনকার চিন্তা, পেরেশানি, দৌড়াদৌড়ির সমষ্টি যেন এ জ্বর। বাথরুমে যেতে উঠতে চেষ্টা করে দেখে ও মাথাই তুলতে পারছেনা। অনেক কষ্টে, বাথরুম থেকে এসে আবার শুয়ে পরে। বিছানায় যাওয়ার পরপরই ভীষণ জ্বরে কাবু হয়ে কেমন অচেতন হয়ে যায় ও।

———-

পরদিন শুক্রবার,
এ বাড়িতে শুক্রবার মানে রান্নার তোরজোর। সপ্তাহের একটা দিন দুপুরে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করার সুযোগ পায়। অন্যান্য দিন গুলোতে খাবার পৌঁছে যায় যার যার ঠিকানায়। ওদের আগের বাড়ির দারওয়ান যে ছিলো, বাড়ি মেট্রোরেলের জন্য সরকারকে দিয়ে দিলে তার চাকরীটা চলে যায়, বাড়িই নেই, দারওয়ান দিয়ে কি হবে? কিন্তু এ বুড়ো মানুষাটর গতি কি হবে ভেবে মোখলেস চাচা রেখে দেন তাকে, তবে তার এখনকার কাজ হচ্ছে চাচা আর তার চার পুত্রের দুপুরের খাবার পৌঁছে দেয়া, বাড়ির বাজার সদাই করা, আর সপ্তাহে একদিন গ্রাম থেকে খাঁটি দুধ আর সরিষার তেল আনা।

আজও রান্নার তোরজোর, তবে চাপটা একটু বেশী। মোখলেস চাচার এক মেয়ে আছে, তার বাড়িতে গ্যাস লাইন কেটে যাওয়ায় খাবার দিতে হবে সেই বাড়িতে। ইরা রান্নার সময় শ্বাশুড়ির কাছেকাছে থাকে। এটা-ওটা করে দেয়, রান্না শিখে, এটা কেন হলো, ওটা কেন করলেন, এটা কিভাবে করলেন এসব প্রশ্নে মাতিয়ে রাখতো। এখন প্রশ্নের পরিমান একটু কমেছে৷ শ্বাশুড়ি কোন কাজে এদিকসেদিক গেলে ও চুলোর সামনে দাঁড়ায়। ভারপ্রাপ্ত গিন্নী সাজা আরকি!

এমনি ইরাকে রান্নাঘরে একা পেয়ে মুরসালিন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুখ ঘঁষে ওর ঘাড়ে। এমন অতর্কিক আক্রমণের চোটে ইরার হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পিতলের খুন্তিটা পরে যায়। ঝনঝন শব্দে মুরসালিনের মা ঘর থেকেই পান মুখে হাঁক দেন- “কি হলো বৌমা?”
মুরসালিন ইরার ঘাড়ে একটা চুমু খেয়ে ভদ্রলোকের মতো গটগট করে নিজের ঘরে চলে যায়। ইরা খুন্তি তুলে সিঙ্কে ধুতে ধুতে বলে -“কিছু না মা বিড়াল আসছিলো”
ইরার শ্বাশুড়ি রেবেকা ঘরে বসা অবস্থায় মুখ বাঁকিয়ে বলেন- “বিড়াল!?”

মুরসালিন ‘বিড়াল’ কথাটা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকায় ইরার দিকে, ইরা খুন্তি উঁচিয়ে ওকে মার দেয়ার ভঙ্গি করে হেসে দেয়। মুরসালিন এদিকে আবার আসবে ভাবতেই ওর মাকে দেখে নিজের ঘরে চলে যায়। তিনি রান্নাঘরে পৌঁছে বলেন-
:”বিড়াল আসলো কোত্থেকে? হ্যা, এ বাড়িতে তো বিড়াল আসে না কখনো”

ইরা কি বলবে ভাবতেই মোখলেস সাহেব রান্নাঘরে আসেন তার গোসলের গরম পানি চাইতে। ইরা তার গরম পানি দিতে বাথরুমে যায় বালতি আনতে। এ যাত্রায় গরম পানি ইরাকে মিথ্যা বলা থেকে বাঁচালো।

ঘরে এসে মুরসালিনের দিকে তেড়ে যায় ও, আর মুরসালিন ওকে জাপটে ধরে বলে-
: ” আমি বিড়াল?”
: “বিড়াল তা নয়তো কি? কেমন স্বভাব খোদা খোদা, সময় নাই অসময় নাই এসব কি হুম? ”
: “এসব হচ্ছে বৌকে আদর করা, কিপ্টা তুমি এসবের কি বুঝবা?”
: “আমি কিপ্টা না?”
: “না তো কি? আমার দিকে তোমার কোন খেয়াল আছে? সারাদিন সারা বাড়ি ঘুরো, একটা দিন বাড়ি থাকি একটু স্বামী সেবা করবা কি উল্টো আমি স্ত্রী-সেবা করলে বিড়াল, টিড়াল কি সব হাবিজাবি বলো”
: ” ওরে আমার বৌ-সেবক স্বামীরে। আপনার সেবা পেয়ে আমি ধন্য। যখন তখন জাপটে ধরা, এদিক সেদিক চুমু খাওয়া, চুলের খোঁপার কাঠি টেনে চুল খুলে ফেলা, ওড়না ধরে টান দেয়া এগুলো কি স্ত্রী-সেবার নমুনা?”
মুরসালিন ওর ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে ফিসফিস করে বলে-
: “এগুলো তাহলে কি?”
: ” এগুলো সেবা না, এগুলো হচ্ছে আমাকে পাগল করার নমুনা”
তড়াক করে তাকায় মুরসালিন ইরার দিকে, বলে-
: “পাগল হও তুমি? হুহ্ পাথর গলে তবু তুমি গলো না”
ইরা হেসে বলে-
: “সত্যি তো?”
: “সত্যি নয়তো কি?, এই যে যখন সুযোগ পাই
এত ভালোবাসা দিই, তুমি তার শোধ দাও? সব পাওনা রাতের খাতায় তুলে রাখো”
ইরা ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে খাটে বসায় ওকে। তারপর হঠাৎ মুরসালিনের দুই কানে দুই হাত রেখে কিছু বলবার ভঙ্গি করে মুখ কাছে নিয়ে – গভীর এক চুমু আঁকে মুরসালিনের ঠোঁটে। তারপর মুরসালিনকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালায় ঘর থেকে।

ইরা রান্নাঘরে গেলে দেখে শাকগুলো কুটা বাকী। সেগুলো নিয়ে বসে পরে ও। হাইডোজ ওষুধ পরেছে মুরসালিনের উপর, এখন আর এদিকে আসবে না। তাই কাজে মন দিলো ও। এমন সময় ইরাকে দেখে মুখলেস সাহেব রান্নাঘরের কাছটায় টুল নিয়ে শাক বেছে দিতে বসেন। এ কাজটা তিনি বরাবর যত্নের সাথে করেন। ইরা প্রথম যখন এ বাড়িতে এলো তখন তো জানতোনা যে তিনি এ কাজটা তার স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে করেন। ও আসার পর থেকে দুজন মিলে করে এ কাজটা। শাক এ বাড়ির সকলের পছন্দের খাবার৷ এমন কোন দিন নাই যে শাক রান্না হয় না এ বাড়িতে। শাক কাটতে কাটতে শ্বশুর পুত্রবধূ গল্প করে। আজ ইরার কৌতুহল ওর শ্বশুরের মুখ বোলা মেয়েকে নিয়ে। মোখলেস সাহেব প্রথমটায় ভেবেছিলো এড়িয়ে যাবে ব্যাপারটা। পরে কি মনে করে যেন একেবারে শুরু থেকে শুরু করে মেয়ে না থাকা মোখলেসের পাতানো মেয়ের গল্প-

তিনি শুরু করেন-
সেই মেয়ের বাড়ি পালানো,
বিয়ে করা স্বামীকে ডিভোর্স না দিয়ে আরেকজনের হাত ধরে বেরিয়ে পরা।
প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স।
দ্বিতীয় স্বামীর সাথে সংসার শুরু।
এ পর্যন্ত শুনে অবাক হয় ইরা, এতো ওর বোন মীরার গল্পের সাথে পুরো মিল। ইরার চেহারা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় এ পর্যন্ত শুনে। তারপর ওর গল্পবাজ শ্বশুর নাটকীয় ভঙ্গিতে গল্পের পরের অংশ বলে যান। ইরার সন্দেহ সঠিক হলেও এ গল্পের দ্বিতীয় অংশ ইরার অজানা থাকায় ফ্যাকাশে ভাব দ্রুত মুছে যায়।

তারপর মোখলেস সাহেব –
তার মেয়ের দ্বিতীয় স্বামীর কাজ না থাকায় গায়ের গয়না বিক্রি করে সংসার চালানো, হঠাৎ ঝড়ের মতো আসা ওর স্বামীর অসুখ, শূন্য হাতে কোন পরিবারের সাহায্য ছাড়াই ব্যায়বহুল সেই চিকিৎসায় ঐ মেয়ের ভূমিকা, অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ করা, পায়ের নিচে মাটি করার জন্য পরিশ্রম শুরু করা, জীবণে পানি ঢেলে না খাওয়া মেয়ের এতগুলো মানুষকে রেঁধেবেড়ে খাওয়ানো, কারখানার দেখাশোনা করা। দুটো মেশিন থেকে বিরাট কারখানায় রূপান্তর সবটা বলে যায় ক্রমানুসারে। এ যেন কোন রূপকথার গল্প। দুঃখের পরে সুখের প্রতিচ্ছবি। এমনটাই তো হয় গল্পে।

এরপরে কি হতে পারে? মোখলেস সাহেব প্রশ্ন ছুড়ে দেন পুত্রবধূ ইরার কাছে-
ইরা হাসিমুখে বলে- “তারপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিলো….”

মোখলেস সাহেব ম্লান মুখে মাথা নিচু করে ফেলেন। তাকে দেখে ইরা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে মন খারাপ হওয়ার মতো এমন কিছু তো ও বলেনি। তাহলে…
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে ইরা। শাক বাছা শেষের দিকে তখন। তারপর তিনি শুরু করেন এ গল্পে তৃতীয় অংশ। যে অংশে দায়িত্বহীনতা, অবি*শ্বাস, প্র*তা*রণা, জা*লি*য়াতি, নোং*রা*মিতে ভরপুর। ওর স্বামীর সংসারের কোন দায়িত্ব পালন না করা, দেরি করে বাড়ি ফেরা, ম*দ, জু*য়া, মেয়ে মানুষ নিয়ে মেতে থাকার গল্পগুলো বলে যান একে একে। ইরা স্তব্ধ হয়ে শুনে সবটা। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো যখন মোখলেস সাহেব ঐ মেয়ের স্বামীর গোপনে ২য় বিয়ের কথা শোনে ইরা চোখের পানি যেন আর বাঁধ মানে না, কেঁদে ফেলে ইরা৷ এই প্রথম বার মুখ খুলে বলে-
” ঐ জা*নো*য়ারটাকে গু*লি করে মা*রে না কেন সে? ”

এটা শুনে বক্র হাসি হাসেন তিনি, বলেন এখানেই শেষ না মা-জননী। গল্প আরো অনেক বাকী। মেয়ে হওয়ার পর মেয়েটা ওর স্বামীকে ব্যাবসার পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। তখনো তো জানতো না ওর এ কাহিনি, আর ওর অ*মা*নুষ স্বামী – এ সুযোগে নিজের নামে সব লিখে নেয় বৌর কাছ থেকে। দুইদিকেই সংসার মেন্টেইন করে চলে সুন্দর মতো। স্বামীর ২য় বিয়ের আড়াই বছর পর সবটা জানতে পারে ও। তারপর ধীরে ধীরে গুছাতে থাকে নিজেকে। সবটা মেনে নিয়েছে ও, দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা, খারাপ চ*রিত্র, অমিতব্যায়ীতা সব, কিন্তু ওর ২য় বিয়ে মেনে নেয়াটা কষ্টের ছিলো ওর জন্য। এরপর ওর ঘুরে দাঁড়ানো, নিজের ব্যাবসা শুরু করা, ঐ প্রতারকের প্রতারিত হওয়া, জেলে যাওয়া সবটা বলেন তিনি। এমনকি দেনার দায়ে কারখানার নিলাম ডাক, সে নিলামে ঐ মেয়ের নিলামে জিতে হারানো ব্যাবসা নিজের অধিনে ফিরিয়ে আনা মোটকথা গতকাল অবধি সবটা সারমর্ম করে বলেন তিনি।

এ পর্যন্ত শুনে ইরার মুখে হাসি ফুটে। তারপর বলে-
: “ঐ হা*রা*মীটা*কে ডিভোর্স দেয় নি এখনো? ”
: “হুম, গতকাল নিলাম ছিলো তার আগেরদিন ডি*ভো*র্স দেয় ও তাকে। ”

মাশাল্লাহ এই মেয়ের মনের জোর আছে বাবা, তার জন্য দোয়া রইলো মন থেকে।

: “মেয়েটা এখন বড় একা, আপনজন বলতে আড়াই বছরের মেয়ে ছাড়া কেও নেই”
: “কেন তার বাবা মা?”
: “তারা ওকে মেনে নেয় নি, এমনকি বাবার লা*শ*টাও দেখতে দেয়া হয়নি ওকে”
: “এত কঠোর মানুষ হয়! আহারে মেয়েটা তো তাহলে জনম দুঃখী”
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন মোখলেস সাহেব, বলে- একবার ভাবো তো আত্মীয়পরিজনহীন একটা মেয়ে আর ওর আড়াই বছরের বাচ্চা, কিভাবে ও পাড়ি দিবে বাকী জীবণ”
: “বাবা আমি ভাবতেই পারছি না, ঐ মেয়ের পরিবারের উচিত ওকে ক্ষমা করে দেয়া, ভুল যা করেছে তার শাস্তি উনি পেয়েছেন”
কথাটা মনপুত হয় মোখলেস সাহেবের। তারপর ম্লান হেসে বলেন- “পরিবার ওকে মানবে না কখনো, অথচ মেয়েটা আড়ালে আবডালে ওর পরিবারকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছে। বোনের ভালো বিয়ে দিয়েছে, ছোট ভাইটাকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা করছে”
: ” আমার মনে হয় না সবটা জানলে কারো পক্ষে তার উপর এখনো অভিমান করা সম্ভব”
: “কি জানি কি আছে কপালে”
: “তাকে একদিন আসতে বলেন না আমাদের বাড়িতে, কাছ থেকে তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ”
মুচকি হেসে তিনি বলেন-
: “ও এ বাড়িতে আসবে না কোনদিন, তুমি যাবে ওকে দেখতে? ”
ইরা এমন দাওয়াতে অপ্রস্তুত অনুভব করে, মনে মনে বলে- “কেন আসবেন না উনি এ বাড়িতে?”

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সেদিন দুুরের খাবার দিতে গিয়ে মোখলেস সাহেব দেখেন মীরা অসুস্থ। জ্বরে কাতর মেয়েটা অচেতন অবস্থায় পরে আছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে টুম্পা বলে-
: “বিকেলে ডাক্তারের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে”
মোখলেস সাহেব মীরার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলায়, চোখ মেলে মীরা, অচেতন অবস্থায়ই ডেকে উঠে-
: “বাবা!”
জীর্ণ শরীরের জীর্ণতা চোখ অবধি পৌছে গেছে যেন। ফ্যাকাশে, পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে মীরা মোখলেস চাচার দিকে। প্রাণশক্তিপূর্ণ মেয়েটার এমন দৃষ্টিতে কেমন যেন মুষড়ে পরেন তিনি, একটু পরে পানি এসে পরে তার চোখে। অচেতন মীরা ভাবছে বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মীরা আবারো ডাক দেয়-
: “বাবা, তুমি এসেছো? ”
চোখ মুছে মোখলেস সাহেব বলেন-
: “হ মা, আমি আইছি, কোন ডর নাইক্কা তোমার”
তারপর আবারো তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো নিশ্চুপ হয়ে যায় মীরা”

চোখ মুছে মোখলেস সাহেব মাজেদা খালাকে বলেন-
: ” ওর যা অবস্থা, বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হইবো না”
মাজেদা খালা উদ্বেগের সাথে বলেন-
: “শুক্রবার তো সবার ছুটি, আমরা দুইটা মাইয়্যা মানুষ হেরে কমনে নিমু হাসপাতালে? ”

মোখলেস সাহেব ফোন করে মুরসালিনকে এ বাসায় আসতে বলে। ও এসে এম্বুলেন্স ডেকে মীরাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শুক্রবার হওয়ায় হাসপাতালে ডাক্তার ছিলো না। পরে মোখলেস সাহেব কাকে যেন ফোন করে ডাক্তার আনায়। অল্পবয়সী ডাক্তারের চোখেমুখে বিরক্তি। সামান্য জ্বরে ভোগা রোগী নিয়ে এত হম্বিতম্বি? পাওয়ারফুল লোক এদের সাথে বাড়াবাড়ি চলে না। তাই তিনি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে মীরার। নার্সকে বলা হলো সারা শরীর স্পঞ্জ করে দিতে। সবার আগে গায়ের তাপটা কমানো দরকার তারপর বাকী চিকিৎসা। খাওয়া ঔষধ আর শরীর স্পঞ্জ করানোয় শরীরের তাপটা কমে এলো মিনিট পনেরোর মধ্যে। এরপর স্যালাইন দেয়া হলো রোগীকে, কারন রোগীর শরীর ডিহাইড্রেট। অচেতন থাকায় মুখে খাবার দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে মীরার মেয়ে নূহা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়৷ খুব সম্ভবত হাসপাতালে ওর ভালো লাগছে না। ওর মায়ের শরীরে স্যালাইন আর শ্বাসকষ্টের জন্য অক্সিজেন দেয়ায় ও ভয় পেয়েছে। মাজেদা আর টুম্পা দু’জনেই হসপিটালে। তাদের কারোরই নূহাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া কিংবা ওকে নিয়ে একা থাকা সম্ভব না। উপায়ন্তর না পেয়ে মোখলেস চাচা বললেন-
: “ওরে নাহয় আমি আমাগো বাড়িত নিয়া যাই”
টুম্পা আর মাজেদা খালা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেও আপত্তি করে না। এটাই ভালো হবে, রোগী নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে হাসপাতালে নূহাকে নিয়ে ঝামেলা হবে। ওর সময় মতো খাওয়া, ঘুম, পটি এখানে থেকে এগুলো মেইনটেইন করা কষ্ট হবে ভেবে ওরা আপত্তি করে না, তাছাড়া তাদের বাড়িতে মোখলেস সাহেবের স্ত্রী, ছেলের বৌ রয়েছে, তারা নূহাকে দেখে রাখতে পারবে।

মোখলেস চাচা মুরসালিনকে থাকতে বলে ফিরে যেতে লাগলো বাড়িতে। মাজেদা খালা বলেন-
: “সমস্যা নাই, থাকন লাগবো না ভাইয়ের, আমরা তো আছিই, কোন সমস্যা হইলে ফোন দিমুনি আপনেগো”

মোখলেস চাচা কিন্তু কিন্তু করে, টুম্পা ভরসা দিলে তিনি কিছু টাকা মাজেদা খালার হাতে দিয়ে বেরিয়ে পরেন।

আসার পথেই নূহা মোখলেস সাহেবের কাঁধে ঘুমিয়ে পরেছে। বাসায় ফিরে দেখে কেওই খাওয়াদাওয়া করেনি। মোখলেস সাহেবের স্ত্রী রেবেকা বেগম নূহাকে নিজের ঘরে শুইয়ে দিতে বললেও মোখলেস সাহেব নূহাকে ইরার ঘরে শুইয়ে দেয়। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে চোখ সরু করে তাকন তিনি স্বামীর দিকে। এ তাকানের উত্তর দেন তিনি স্মিত হেসে। যার মধ্যে লুকানো ছিলো কোন অভিসন্ধির আভাস। ওকে রেখে বাইরে এসে জিজ্ঞেস করে তারা খেয়েছে কিনা? মিসেস রেবেকা জানায় তারাও না খেয়ে বাড়িতে বসে চিন্তা করছে রোগীর জন্য। মোখলেস সাহেব ফ্রেশ হতে যান খাবার বাড়বার অনুরোধ করে। অবশেষে সবাই চারটার দিকে একসাথে দুপুরের খাবার খায়৷ খাবার খেতে খেতে আলাপ হয় রোগীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।

খাওয়া শেষে বিশ্রামের জন্য যে যার ঘরে যায়। ইরাদের মায়ের পরিবারে বাচ্চাকাচ্চা নেই বললেই চলে। তাই বাচ্চাকাচ্চার প্রতি তেমন টান নেই ওর। কিন্তু ঘুমন্ত এই শিশুটিকে দেখে কেমন যেন মায়া লাগে ওর। মায়া লাগার কারন লুকিয়ে থাকা সম্পর্কের টান না, মায়া লাগছে এই ভেবে যে-
এত বড় পৃথিবীতে এক মা ছাড়া কেও নেই মেয়েটার। কাত হয়ে শুয়ে এক হাতে মাথার ভার রেখে মনোযোগ দিয়ে দেখছে এই অপূর্ব মানব শিশুটিকে। ছোট কপাল, পাতলা ভ্রু, সরু নাক, গোলাপি ঠোঁট, সুঠাম স্বাস্থ্যের গুলুমুলু বাবু। যারা বাচ্চা পছন্দ করে না, তারাও একবার ছুঁয়ে দিতে চাইবে।

ইরা ঘুমন্ত বাবুটার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে পরম মমতায়। এত মায়ায়ই যদি দিলো খোদা মায়া করার লোক কেন কেড়ে নিলো এই অবুঝের কাছ থেকে? -মনে মনে ভাবে ইরা। মাথার চুলে হাত বাড়ানোর দরুন জেগে উঠলো সে, ইরার চোখে চোখ রেখে একটা মুচকি হাসির বিনিময় করেই পাশ ফিরে শুয়ে পরলো বাবুটা। যে কুশল বিনিময় করলো ও। ইরার কেমন ধাক্কা লাগে ঐ বাবুটার চোখ আর হাসি দেখে। এই চোখ, এমন হাসি যেন ওর খুব চেনা। মাথাটা বালিসে দিয়ে মনে করতে লাগলো কোথায় দেখেছে এমন চোখ, এমন হাসি? মনে করতে পারছেনা। এমন সময় মুরসালিন এসে ওর পাশে শোয়, তারপর বাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলে-
: তারপর আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?
ইরার চিন্তায় ছেদ পরে এমন কথা শুনে, মুরসালিনকে ধাক্কা দিয়ে ও একটা লাজুক হাসি হাসে। বলে-
: “আগে আমি বড় হয়ে নিই”
: “মানে? তুমি ছোট?”
: ” শিশ্……. আস্তে, ঘুম ভেঙে যাবে ওর, মুরসালিন ওর নাক চেপে বলে ভালোবাসাবাসিতে তো বড়দের ও ফেল করে দাও, এখন আবার বলো ছোট? ”
: আপনার কথার কোন মাথামুণ্ডু নাই, এই বলেন আমি কৃপণ, এই বলেন ভালোবাসাবাসিতে বড়দেরও ফেল করে দিই, মাথা কি ঠিক আছে?”
: “মাথা আমার ঠিকই আছে, ঐসব তো বলি তোমাকে ক্ষেপিয়ে দিতে। ভরদুপুরে ওমন আদর পেতাম বলো যদি তোমায় না-ই ক্ষেপাতাম?”
ইরা কুশন দিয়ে একটা বারি দেয় মুরসালিন কে। মুরসালিন তা ধরে ফেলে ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে বলে-
: ” শিশ্……. আস্তে, ঘুম ভেঙে যাবে ওর”
ওর কথা ওকে ফিরিয়ে দেয়ায় হেসে দেয় ইরা। মুরসালিন এ ফাঁকে একটা চুমু খাওয়ার চেষ্টা চালায় ইরা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলায় চুমু আর ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছায় না। এটা দেখে মুরসালিন ওর দুই হাত পিছমোড়া করে তারপর বলে-
: “বেশী চালাক হয়ে গেছো না? এখন বাছাধন কি করবে তুমি? ”
ইরা উসখুস করতে থাকে হাত ছাড়ানোর জন্য। ও কি আর পারে বলিষ্ঠ মুরসালিনের সাথে? তারপর এক হাতে চুলে গোঁজা কাঠিটাকে টেনে খুলে ফেলে ও, ইরাবতীর দীঘল কালো চুল সবদিকে ছড়িয়ে যায়। তারপর সেই চুলে নাকমুখ ডুবিয়ে হাত ছেড়ে দেয় ইরার। ইরাও বশীভূতের মতো জাপটে ধরে মুরসালিনকে। কানেকানে ফিসফিস করে মুরসালিন বলে-
: “আমাদের বাড়িতে মা একমাত্র মেয়েমানুষ ছিলো, তারপর তুমি এলে, এখন যদি আমাদের একটা মেয়ে আসে মন্দ হবে না কিন্তু! ”
: “এসব কি আমার হাতে? যদি ছেলে হয়?
: “আল্লাহ চাইলে মেয়েই হবে, আগে তো খেলা শুরু করতে হবে নাকি? ফলাফল তো পরের বিষয়”
: “আপনি একটা অসভ্য ”
: “তোমার কি মনে হয় আমি এমনিভাবে বাইরের লোকেদের সাথে কথা বলি? বৌর সাথেও যদি রাখঢাক করে কথা বলতে হয় তাহলে…”
: “অনেক ভদ্রলোক ভাবছিলাম আপনাকে”
: “আমি কি অভদ্র নাকি?”
মুখ বাকিয়ে ইরা পাশ ফিরে শোয়। মুরসালিন শোয় নূহার ঐপাশে। ইরার হাত নূহার শরীরে। মুরসালিন ইরার হাতের ওর আলগোছে নিজের হাতটা রেখে বলে-
: “মেয়েটা এমন ছবি না দেখেই বড় হবে, বাবা মায়ের ভালোবাসা না দেখে বড় হবে, ব্যাস্ত মাকে ছাড়া একা-একাই বেড়ে উঠবে। মপয়েটার কি সুন্দর মায়াবী মুখ, কিন্তু ভাগ্য? ততোটাই মন্দ”
মুরসালিন নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়,পাছে বাবুটা উঠে যায়। নড়ে উঠতে দেখে একটু দূরে সরে মুরসালিন। ইরা কথা বলতে নিষেধ করে ইশারায়। উপায়ন্তর না পেয়ে মুরসালিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পরে ও। আর ইরা যেন ফুরসত পায় ঐ চোখ, আর হাসির রহস্য উদ্ধারে। এমন চোখ আর এমন হাসি…….

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯+৬০

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাজিব জেল থেকে বেরিয়েই খবর পেয়েছিলো পাওনাদারেরা টাকা না পেয়ে ওর কারখনায় তালা মেরে দিয়েছে। ও মিলনের বাড়ি আছে আজ তিনদিন। মিলনের বউ শুরু থেকেই ওকে তেমন একটা পছন্দ করে না, সেটা রাজিব আগে থেকেই জানে, কেন পছন্দ করে না তা জানে না রাজিব। অনেক ভেবেছে তার অপছন্দের সম্ভাব্য কারন। সুদর্শন রাজিবের জন্য মেয়েরা মরিয়া হলেও তিনি বরাবর দৃষ্টিতে একটা সূক্ষ্ণ অবজ্ঞা ছুঁড়ে দেন যেন রাজিবের উদ্দেশ্যে৷ ভদ্রমহিলা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী, শিক্ষিত, শরীরের বাঁধন শক্ত, আর মিলন পুরো তার উল্টো। ওরও পড়ালেখা তো তেমন হলোই না , দেখতে কুচকুচে কালো, অন্ধকারে ঠাওর করা যায় না এমন,গড়পড়তা হাইট এই ছেলে এমন মেয়ে কিভাবে হাত করলো এটাই এক চমক সকল বন্ধুদের কাছে। যাই হোক রাজিবের শরীরটা এখন মোটামুটি সুস্থ, সময় মতো খাবার, সেবাযত্ন যে পাচ্ছে এটাই আচ্শর্যের ব্যাপার। চমকিত তো কম হলো না এ কয়দিনে, প্রিয় স্ত্রীর করা মামলায় জেলখানা দেখে এলো, কাটিয়ে এলো তিনদিন, বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে পেলো, ওর উচিত ছিলো অনৈতিক এ কাজ করায় ওদেরকে শায়েস্তা করা, উল্টো নিজে মার খেয়ে হসপিটালে ঘুরে এলো কতদিন, একে একে তো সবই গেলো, প্রিয়তমা স্ত্রী, তাকে কিনে দেয়া ফ্ল্যাট, কারখানা। এখন একমাত্র অবলম্বন মীরা৷ জেল হতে বের হওয়ার পর থেকে ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে যেন একমাত্র অবলম্বনের কাছ থেকে। মীরার সামনে কিভাবে দাঁড়াবে তা ভেবে পাচ্ছে না, কিন্তু যেতে ওকে হবেই, না গিয়ে উপায় নেই।

এদিকে মিলনের কাছে পাওনাদারেরা খবর পাঠিয়েছে, তারা রাজিবের সাথে দেখা করতে চায়। হয় এদিক নাহয় ওদিক, দ্রুত কোন একটা ফয়সালা চান তারা। সেদিন রাতে মিলন পরামর্শ দিলো কারখানাটা বিক্রি করে দেয়ার। কারখানা বিক্রি করলে তাদের ঋণ দিয়ে রাজিবের কাছে কিছু অবশিষ্ট থাকবে। আর যদি তাদেরকে কারখানা দিয়ে দেয় তবে সেটা বোকামি হবে। মিলনের মুখে কারখানা বিক্রির কথা শুনে কেমন যেন চমকে যায় রাজিব। জেলে যাওয়া অবধি অনেক অধঃপতনের কথা ভেবেছে ও, কিন্তু কারখানা বিক্রির কথা মাথায় আসেনি একটি বারের জন্যও। তাই একথা শোনামাত্র চমকে উঠলো ও। মিলন বুঝতে পারে ওর ব্যাপারটা। অপরদিকের সোফা হতে এসে বসে রাজিবের পাশে, কাঁধে হাত রেখে বলে –
: আমি বুঝতে পারছি তোমার ভিতরে কি চলছে এ কথাটা শুনে। কিন্তু এটাই সত্য, যত জলদি তুমি মেনে নিবে সত্য ততোই তোমার মঙ্গল। মিলন ছেলেটা বরাবরই এমন, মন রাখতে, ভরসার ছলেও আশা জাগানিয়ায় ও মিথ্যা বলে না। সত্যটাকে টেনে সামনে এনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়৷ এটা ওর চমৎকার একটা দিক, তবে রাজিব এখন সত্য জানতে চাচ্ছে না, ও মিথ্যা হলেও একটু ভরসা চাচ্ছে যে ওর সব ঠিক হয়ে যাবে, সব! ও ওর ব্যাবসা ফিরে পাবে, মীরার ভালোবাসা ফিরে পাবে !

যদিও ভিতরে ভিতরে ওর খবর হয়ে গেছে কোথায় পৌঁছে গেছে ও। একে একে মনে পরছে বেহিসেবী সব হিসেব গুলো। কত কত টাকা কাগজের মতো উড়িয়ে বেরিয়েছে দেশ থেকে বিদেশে, শহর থেকে বন্দরে। অথচ আজ ও নিঃস্ব। এখান থেকে বের হয়ে কোথাও যে যাবে সেই ভাড়াটা পর্যন্ত ওর নেই।

খানিকক্ষণ মৌণ হয়ে বসে থেকে মুখ তুলে রাজিব। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পানির গ্লাসের দিকে। চোখেমুখে কেমন যেন দৃষ্টি। হঠাৎ হাভাতের মতে গ্লাসটাকে কেড়ে নেয় ও, যেন জলদি না করলে অন্য কেও সেটা নিয়ে নিবে। একটানে শেষ করে সবটুকু পানি। তৃষ্ণা বেড়ে গেছে হয়তো ওর। দেখে মনে হচ্ছে পানি না ও পান করলো শক্তি সঞ্চয়কারী কোন পানীয়। মিলন অবাক হয় ওর এমন আচরণে। একটার পর একটা ধাক্কায় ছেলেটার না মাথা খারাপ হয়ে যায়। মিলনের দিকে চেয়ে ফিচেল হাসি হেসে বলে-
: ” আমি এখন কি করবো? ”
যেন খুব মজার কিছু জিজ্ঞাসা করছে ও মিলনের কাছে। ওর হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় মিলন। বলে –
: “তোমার কি মনে হয়, কি করলে ভালো হবে? ”
: ” মিলন, তুই জানিস না আমার মাথাটা এক্কেবারে ফাঁকা হয়ে আছে, কোন জ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি, কিচ্ছু নেই, কেবলি একটা ট্রেন ছুটছে ভো ভো করে”
এ পর্যায়ে সোফা হতে নেমে মিলনের পায়ের কাছে বসে ওর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে চেপে ধরে কেঁদে ফেলে রাজিব, শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বলে-
: “তুই শুধু মীরার কাছে আমাকে ফিরিয়ে দে, আর কিছুই চাই না আমি, মীরা আমার থাকলে সব হবে আমার, ওর সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি, যা ক্ষমার অযোগ্য”
কান্না জড়ানো কন্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে মিলনের হাঁটুতে মুখ গুঁজে ও। যেন মিলনই সবকিছুর একমাত্র সমাধানকারী। মিলনের চোখের কোণেও পানি জমে, মিলনের বৌ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সব, রাজিবকে অপছন্দ করা তার চোখও আর্দ্র হয় এ দৃশ্যে।

মিলন ওর হাত ধরে বলে-
: “উঠে বস তুমি, দেখি কি করা যায়”

বেশ সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয় রাজিব। মিলন বলে-
: “তোমার জীবণে যে ঝড় তুমি ডেকে এনেছো তা এখনো থামে নি কিন্তু, এখন যদি তুমি এত ভেঙে পরো তাহলে হবে? তোমাকে শক্ত হতে হবে এ ঝড় মোকাবিলা করার জন্য”
রাজিবের দৃষ্টি অবনত, মিলনের ড্রইংরুমে সেন্ট্রাল টেবিলের নিচে বিছানো দামী তুর্কি কার্পেটে বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে অবিশ্রান্ত খুটছে। এ দৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে সে কর্মযজ্ঞ। সে অবস্থায়ই রাজিব বললো-
: ” কি করবো তাহলে, শান্ত হয়ে বসে থাকলে ঝড় কি থেমে যাবে?”
মিলন সন্তুষ্ট হয় ওর কথা শুনে, তারমানে রাজিব ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এরপর মিলন বলে-
: “শান্ত হলে ঝড় থামবে না তা ঠিক, তবে উপায় বের হবে”
: “মিলন তুই আমার কারখানাটা কিনে নে, পাওনাদারদের টাকা দিয়ে যা থাকে তা তোর কাছে রাখ, সবার আগে মীরার সাথে আমাকে একটা মিটমাট করে দে, ওর সামনে দাঁড়াবার সাহস, সামর্থ্য কোনটাই নেই আমার”

মিলনের ঠোঁটে মিহি একটা হাসি ফুটে উঠে, খুব খেয়াল করে না দেখলে চোখে পরবে না তা। এ হাসি রহস্যময়ী মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যময়। ওর মনপুত হয় রাজিবের কথাটা, কারখানা কিনে নেয়ার ভাবনাটা ও নিজেও ভেবেছিলো, কিন্তু কিভাবে কথাটা তুলবে তা বুঝতে পারছিলো না। ও তো এটাই চায়, যত টাকা লাগুক “মীরা ফ্যাশন” কিনে নিবে মিলন, তারপরের ভাবনা গুলো অনেক আগেই ভেবে রেখেছে মিলন। ও বস্তুগত সম্পদ কিনবে না মিলন, কিনবে ব্র্যান্ড, মীরা ফ্যাশনের খ্যাতি, ওদের বিস্তৃত মার্কেট। এরপর প্রোডাক্টের কোয়ালিটির লো করে “মীরা ফ্যাশনের নাম ডুবাবে, নিশ্চিহ্ন করে দিবে ওর ব্যাবসায়িক প্রতিদ্বন্ধীকে। এ আশায়ই তো এত তোয়াজ করছে রাজিবকে। কারন ও নিজেও জানে ” দেয়ার আর নো ফ্রী লাঞ্চ ইন দা ওয়ার্ল্ড ”
—————-

সাথী সেজেগুজে হসপিটালে গিয়ে দানপত্র, আর ডিভোর্সের কাগজে রাজিবের সই নেয়ার দিনই ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কোন রীতিনীতির তেয়াক্কা না করে সাকলায়েনকে বিয়ে করেছে। এটা ওদের দু-জনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। ওদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা ঠিক কবে হয়েছিলো তা জানা না গেলেও সম্পর্কের গভীরতার টের পাওয়া গিয়েছে সাকলায়েনের সাথীর বাড়িতে রাত্রীবাস থেকে। রাজিব রাতে সাথীর বাসায় থাকতে পারতো না, সেই সুযোগেই ওদের নিষিদ্ধ প্রণয় ত্বরান্বিত হয়েছে সে হিসেব এখন সোজা।

পাঁচ লক্ষ টাকার কাবিনে, সাকলায়েনের চ্যালাদের সাক্ষী রেখে বিয়ে করে ওরা। বৌয়েরা বিয়ে করে স্বামী গৃহে যায়, আর সাকলায়েন উঠেছে নতুন বৌয়ের ফ্ল্যাটে। ছন্নছাড়া সাকলায়েনের একটা গতি হলো যেন। নিজেদের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ও আজ এখানে, কাল ওখানে থাকতো। নেশা করার কারনে ওর বাবা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন সেই কবে। রাগে ক্ষোভে বাড়িমুখো হয় নি এত বছরেও। একটা ভাড়া ফ্ল্যাটে ফ্রি-তে থাকতো ও, সিনিয়র নেতার বাড়ি। মেয়েদের আনাগোনা নিষিদ্ধ করে দেয়ায় ওর হ’য়েছে বিপত্তি। তাই আজ এখানে তো কাল ওখানে। মে’য়ে আর ম’দ এ দুটো জিনিস ছাড়া সাকলায়েনের দিন অসম্পূর্ণ। আর মেয়েরা এসব বাজে, বেকার, নেশাখোর, ভাদাইম্মা, ছেলেদেরকেই অন্ধের মতো ভালোবাসে৷ আর আবীরের মতো ভদ্র, কর্মঠ ছেলেরা কষ্ট পায়, বাকী জীবণ সেই কষ্ট বুকে নিয়ে নারী বিবর্জিত হয়ে কাটিয়ে দেয়।

সুখেই কাটছে ওদের দিন, সাথী বাড়িতে জানায় ওদের বিয়ের কথা। বাবা-মা, ছোট তিন বোন খবর পেয়ে ঢাকায় ওদের দেখতে আসে। সাথী তাদেরকে বলে এটা ওদের নতুন সংসার৷ রাজ্য, আর রাজপুত্র দেখে সাথীর বাবা-মা খুশিই হন। মনে মনে ওর বাবা-মা মেয়ের একা বিয়ে করার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। মেয়ের এত ভালো বিয়ে তারাও দিতে পারতেন না হয়তো। এবার ছোট তিনজনের গতি হবে ভেবে খুশি হন তারা। এদিকে সাকলায়েন ও খুশি। তবে ওর খুশির কারন ভিন্ন। সুন্দরী তিন শালী দেখে না’রী লো’ভী সাকলায়েনের চোখ চকচক করে বিশ্রী কামনায়। মনে মনে ছোটবেলার জেলে আর সাত ভুত গল্পের মতো মনে মনে আওড়ায় ” একটা খাব দুটো খাব সব কটাকে চিবিয়ে খাব”

———————

রাজিব নিজেকে সামলে নিয়েছে, যত যাই হোক সত্যের মুখোমুখি তো হতেই হবে। এভাবে সত্যি থেকে চোখ সরিয়ে রাখলেই সত্যি বিলিন হয়ে যাবে না।
মিলনও রাজিবের স্বাভাবিকতা দেখে মন ঠিক করেছে রাজিবকে কালই নিয়ে যাবে ওদের নীলক্ষেতের বাসায়। পরদিন সকালে নাশতা খাওয়া শেষে মিলন গেছে তৈরী হতে। রাজিব সোফায় বসে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছে, আর ভাবছে কিভাবে কি বলবে মীরাকে। মিলন কাপড় বদলে এসে, মুচকি হেসে সহজ ভঙ্গিতে বলে-
: “চলো, তোমার ব্যাবস্থা করে আসি”
উত্তরে রাজিবও হাসে না ঠিক চেষ্টা করে হাসার, কিন্তু সে হাসিতে প্রাণ নেই। কেমন যান্ত্রিক হাসি যেন।
দরজার হাতলে হাত দিতেই কল আসে মিলনের ফোনে। জুতা পরতে পরতে কল রিসিভ করে মিলন। মুহূর্তেই একটু আগের চাঞ্চল্য উবে যায়। সোজা হয়ে দাঁড়ায় ও। আরেকটা জুতা পরায় কোন ব্যাস্ততা দেখা যায় না মিলনের। কল কেটে ও রাজিবকে জানায় পাওনাদারদেরা কল করেছে, তারা বাড়ির নিচে অপেক্ষা করছে। উপায়ন্তর না দেখে মীরার বাসায় যাওয়া স্থগিত করে তাদের সাথে আলোচনায় বসেন ওরা। তাদের সাথে কথাবার্তা হয় পুরো আধঘন্টা। পুরো সময় মাথা নিচু করে রাখে রাজিব। সব কথা হয় মিলন আর তাদের মধ্যে। তাদের দাবী হয় পুরো টাকা দিতে হবে, না-হয় তারা কারখানা বিক্রি করে তারা তাদের পাওনা টাকা নিয়ে নিবে৷ সব শুনে
আজকের দিনটুকু সময় চায় মিলন। কাল সকালে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে। তারা প্রথমে মানতে চায়নি, অনেক তো দিলো সময়, কাজের কাজ কিছুই হলো না। মিলন অনেক বলে কয়ে নিজে জিম্মা হয় বলে আপনারা ওকে নয়, আমাকে আজকের দিনটুকুু সময় দিন, পরে তারা মেনে নেয়। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সময় দেয় তারা, এরমধ্যে টাকা না পেলে বিকেলে সবাইকে ডেকে কারখানার সম্ভব্য ক্রেতাদের নিয়ে বসবে তাদের সমিতির অফিসে। চলে যান তারা, এরমধ্যে মিলন ভাবনায় পরে যায়। এখন যদি ও কিনতে চায় কারখনা, রাজিব টাকাটা ধার চাইতে পারে ওর কাছ থেকে। পরে তো না ও বলা যাবে না লজ্জায়। আর সেটা দিলে
রাজিবকে ধার দেয়া হবে, তাতে মালিক রাজিবই থেকে যাবে। যদি অন্য কাওকে দিয়ে কারখানাটা কিনতে পারে? ভাবতেই ওর ছোট ভাইয়ের কথা মনে পরে।

একটু ভেবে মিলন বের করলো আগামীকালের করনীয়। কাল সকাল পর্যন্ত সময় লাগবে না, আজই ভেবে নিলো মিলন রাজিবের ভবিষ্যৎ। কাল সকালে কোন টাকা পাবে না তারা। বিকেলে নিলামে উঠবে “মীরা ফ্যাশন”

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সকালের পাওনাদারদের সাথে আলোচনায় মীরার সাথে দেখা হওয়া পিছিয়ে যায়। মিলনের কাজ আছে, এখন আর যাওয়া সম্ভব না, তবে বিকেলের দিকে ও সময় করতে পারবে, তখন যাবে বলে ঠিক করে।

মিলন চলে যায় ওর কাজে। রাজিব ফিরে আসে এ বাড়িতে ওকে থাকতে দেয়া ঘরটায়। ছোট্ট একটা ঘর। একটা খাট, প্লাস্টিকের ওয়ারড্রব আর চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই ঘরটায়। এমনকি বিশাল দক্ষিণমুখী জানালায় পর্দাও নেই। সেই ভোর সকাল হলেই আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে যায় রাজিবের। খুব সম্ভবত এ বাড়ির সবচেয়ে দামী জিনিস ওদের ড্রইংরুমের কার্পেটটা। এটাও মিলন নিজে কিনেনি। উপহার পেয়েছিলো এক বায়ারের কাছ থেকে। সরাসরি তুর্কী থেকে আনা সেটা। এত টাকা এরা রাখে কোথায়? ঘরে ভালো একটা আসবাবপত্র নেই। যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু নিয়েই এদের সংসার। অথচ মিলন না ধরা দিলেও মিলন যে কোটিপতি তা জানে রাজিব।

রাজিবের এসব অপছন্দ। ওর ঘরে ভারী পর্দা দেয়া থাকে ও না উঠা পর্যন্ত। এমনকি নূহা ঘুম থেকে উঠে পরলেও মীরা ঘরের পর্দা তুলতো না, মেয়েকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ করতো, নাশতা খাওয়াতো। ঐ বাড়িতে এ নিয়ম এতই শক্ত পোক্ত ছিলো যে আড়াই বছর বয়সী নূহাও ওর বাবা ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঐ ঘরে যেতো না।

নূহার কথা ভাবতেই বুকে একটা মোচর দিয়ে উঠলো রাজিবের। নূহা, ওর আদরের মেয়ে, যার অস্তিত্বে রাজিব সদা বিরাজমান। জন্মের পর পর বাবা মেয়ের সম্পর্কটা ঠিকঠাক গড়ে উঠতে পারে নি স্বাভাবিক ভাবে। তখন রাজিব সাথীকে আবিষ্কারের নেশায় মত্ত ছিলো তাই । অলীক সুখের খোঁজে ও নিজে এতই ব্যাস্ত ছিলো যে ঠিক কবে মেয়ের সাথে ওর এত দূরত্ব হয়ে গেছে মনে করতে পারছে না এখন। ওর প্রতি মেয়ের ও কোন সফট কর্নার নেই হয়তো, বাড়িতে থাকা সময়টুকুতে কাছে এসে বাবার আদর চাইতো যখন, রাজিব ওকে ফোন দিয়ে পাশে বসিয়ে রাখতো। রাজিবের কাছে তখন মেয়ের চেয়ে দেশের খবর, কিংবা ক্রিকেট বেশী জরুরি মনে হতো। অসুস্থ হলে নূহাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, মীরা তা জানালেও এই সেই বাহানায় এড়িয়ে যেতো রাজিব। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ওয়েটিং রুমের দীর্ঘ লাইন ওর বিরক্ত লাগতো। এমনি অসংখ্য অবহেলা জমে জমে তা হয়তো পৃথিবীর দীর্ঘ পর্বতকেও ছাড়িয়ে গেছে উচ্চতার বিচারে। আচ্ছা নূহা কি ক্ষমা করবে ওর এই বাবাকে?

মহা ব্যাস্ত রাজিবের হাতে ইদানীং অনেক সময় অতীত ভাববার। সাথীর ধাক্কাটা পাওয়ার পর থেকে এসব কিছু হঠাৎই দৃশ্যমান হয়েছে ওর কাছে। একেবারে শুরুর দিন থেকে বর্তমান পর্যন্ত করা প্রতিটি ভুল চোখে বিঁধছে ফলার মতো। এত এত ভুলে ভরা জীবণ? আর কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ও?এসব ভাবতে ভাবতে আলো ঝলমলে ঘরটায়ই অবেলায় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় ও। ইদানীং এমনি হচ্ছে। যখন তখন গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে যায় ও।
শত চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারে না। কি জানি এটা আবার কোন রোগের পূর্বাভাস কিনা?

বিকেলে মিলন এসে ঘুম ভাঙায় রাজিবের। ঘুম থেকে উঠে খাওয়াদাওয়া শেষে তৈরী হতে বলে মীরার সাথে দেখা করার জন্য। রাজিব খুব দ্রুত শেষ করে সব কাজ। পেটে ক্ষুধা না থাকলে খাওয়াটাও হয়তো স্কিপ করতো ও। খাওয়া শেষে তৈরী হওয়া বলতে মিলনের দেয়া লুঙ্গি বদলে ঐ এক শার্ট আর প্যান্ট যেটা পরে জেলে গিয়েছিল ও তা পরে নেয় রাজিব। আর তো কিছু নেই।

তৈরী হয়ে মিলনের সাথে নেমে রিকশা নেয় ওরা। “এমন সময় বাসায়ই থাকবে মীরা” – মনে মনে ভাবে রাজিব। বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মাত্র কয়দিনের ব্যাবধানে কেমন অচেনা লাগে বাড়িটাকে। নিচ থেকে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে নিজেদের ফ্ল্যাটটা। একচিলতে বেলকনি ছাড়া কিছুঔ চোখে পরে না রাজিবের। এত উঁচুতে বাসা হওয়া সত্ত্বেও না গুনেই ঠিক চিনে নিজেদের বেলকনি। কারন একমাত্র ওদের বেলকনিতেই রাণী গোলাপী বাগানবিলাস গাছ লাগানো। যার পুরোটাই বেড়ে উঠেছে বারান্দার বাইরে। বারান্দার গাছ নিয়ে কম ঝামেলা করে নি রাজিব। মশার অযুহাতে ফেলে দিতেও উদ্যত হয়েছিলো একবার। মীরা অনুরোধ করে রেখেছিলো সেগুলো। ও কেবল ঝঞ্ঝা দেখেছিলো বারান্দায় কিন্তু আজ প্রথম বারের মতো গাছগুলোতে খেয়াল করলো ও। কি ভীষণ সুন্দর লাগছে এত উঁচুতে থেকেও। এত দূরত্বে থাকার পরও বাগান বিলাস চিনিয়ে দিচ্ছে বেলকনির মালিকের রুচির সৌন্দর্যকে। কারন এই পাশের একটা বারান্দায় ও কোন গাছ নেই, একমাত্র আটতলায় ওদের বারান্দায়ই এই বাগান বিলাস নিজের শোভা ছড়িয়ে দিচ্ছে এত উঁচুতে থেকেও এই নিচ অবধি ৷ ঐ বাগান বিলাস গাছটা যেন মীরা। সবসময় নিজের শোভায় রাঙিয়ে রাখতে চেয়েছে নীচ, ছোটলোক রাজিবের জীবণকে৷ আর রাজিব? ব্যাস্ত ছিলো প্রাণহীন কাগজের ফুল নিয়ে। যা দুমড়ে যায় মুচড়ে যায়, যার থেকে নতুন জীবণের আবির্ভাব অসম্ভব। কিন্তু বাগান বিলাস ওরফে মীরা ঝড় ঝঞ্ঝায় টিকে থাকে, যদি ডাল ভেঙেও যায়, শুকিয়েও যায় তবুও সেখান থেকে জন্ম দিতে পারে নতুন প্রাণের।

অনেক সাহস নিয়ে উপরে উঠে রাজিব। কলিংবেল মিলনই দেয়৷ ও যতদ্রুত এখান থেকে যেতে পারে এ-ই কেবল ভাবছে মনে মনে। অবশেষে কাঠের সুন্দর কারুকার্য করা দীর্ঘ দরজা খুললেন মাজেদা খালা। তার চোখেমুখে বিরক্তি আর অবহেলা মিশানো দৃষ্টি। তিনি রাজিবকে উপেক্ষা করে মিলনের দিকে তাকিয়ে বললেন-
: ” কি ব্যাপার?”
যেন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রক্ত মাংসের রাজিবকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, রাজিব যেন অদৃশ্য এই দৃশ্যপটে। রাজিব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে, যদি তিনি একটিবার অন্তত তাকান ওর দিকে। জাস্ট একবার, তাহলেই যেন রাজিবের অস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু মাজেদা খালা সেই ধার ধারলেন না। তিনি মিলনের সাথে কথা বলে দরজা ছেড়ে ভিতরে যেতে জায়গা করে দিলেন। রাজিব বুঝতে পারছে না ওকে ভিতরে ঢুকতে দেয়া হবে কিনা। কিন্তু না মিলন ঢুকার পরও খালা দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলের গিঁট খুলছে পান বের করছেন দেখে রাজিব এ ফাঁকে ঢুকে পরলো। নিজের বাড়িতে এসেছে ও তবুও ভিতরে ঢুকতে পারার জন্য চাপা আনন্দ হচ্ছে ওর! নিজেই আবাক হয় ও, নিজ গৃহে এসে আনন্দিত হওয়ার কি আছে?

ভিতরে ঢুকে যখন জানলো মীরা বাসায় নেই ওর ভাবটা কেমন বদলে গেলো। নিজের ঘরে ঢুকে, নিজ হাতে কাপড় বের করে সেজা গেলো বাথরুমে। দাড়ি কেটে দীর্ঘ সময় নিয়ে শ্যাম্পু করে গোসল করলো রাজিব। নোংরা জীর্ণ রূপ নিয়ে ভিতরে ঢুকলেও ফিরে এলো আগের রাজিব হয়ে। ভুরভুর করে বেরুনো আফটার শেভের গন্ধে মিলন টের পেলো রাজিব ঘরে ঢুকেছে। ফোনে আটকে থাকা অবনত দৃষ্টি তুলে তাকায় মিলন, রাজিবকে দেখে চিরচেনা রূপে। একটা গোসল বদলে দিলো পনেরো মিনিট আগের রাজিবকে। রাজিব যেন গোসল করে সকল গ্লানি, ক্লান্তি, চিন্তা ধুয়ে এসেছে। ওর চোখেমুখে আত্নবিশ্বাসী ভাব। রাজিব মিলনের পাশে বসতেই মিলন বললো-
: ” দশ মিনিটের মধ্যে আসছে মীরা”
মিলনের কথা শুনে রাজিবের সেই ভাবটা হঠাৎ
উবে গেলো, ভয় হতে শুরু করলো। মীরা যেন মীরা না ও যেন প্রাণ কেড়ে নেয়া যমদূত। ওর ভয় উড়িয়ে দিতে দু হাতের রূপার চুড়ি গুলে ঝুমঝুম করে বাজিয়ে এ ঘরে এলো নূহা। ওর চোখ-মুখে চেনা হাসি৷ গুটুর মুটুর করে কাছে এসে নিয়মিত দূরত্বে দাঁড়ায় ও। রাজিব কোলে নিতে হাত বাড়ালে দুই হাত না উঁচিয়ে এক হাত এগিয়ে দেয় নূহা। সেটা কোলে উঠার জন্য না, ফোন নিতে। ফোন নিতে দুই হাত উঁচিয়ে ধরা লাগে না এক হাতই যথেষ্ট। নুহার কাছে রাজিবের চেয়ে এন্ড্রয়েড ফোনের কদর বেশী, বাবার চাইতে ও ফোনকে বেশী ভালোবাসে। ফোনকে রাজিবের বড্ড হিংসা হচ্ছে এখন। ওরই দোষ কি রাজিব তো ওকে এভাবেই ট্রিট করতো। ফোন দিয়ে পাশে বসায় রাজিব নূহাকে। নূহা দেখে “বেবী শার্ক ” আর রাজিব ওর ঔরসজাত বেবীকে।

এমন সময় কলিংবেল বাজলো। রাজিবের আত্না
শুকিয়ে গেলো যেন এই শব্দে। এ যেন কলিংবেল না মহাপ্রলয়ের আগের ইশরাফিলের শিংগার ফুৎকার। রান্নাঘর থেকে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে দ্রুত এলেন মাজেদা খালা। মাথায় কাপড় ঠিক করে দরজার হাতলে চাপ দিয়ে দরজা খুললেন তিনি। কি ভেবে তিনি দরজার দুটো পাল্লাই পুরোপুরি খুলে ফেললেন। হয়তো কোনার সোফায় বসা রাজিবকে মীরার আগমন দেখাতে। মিলন উঠে দাঁড়ালো তার আগমনে, রাজিবের দেখার সাহস নেই ঐ দিকটায়, মাথা নিচু করে বসে আছে ও। ঘরে ঢুকলো কেও, জুতা খোলার শব্দ পাওয়া গেলো। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো সে। কে তা এখনো জানে না রাজিব, মীরাও হতে পারে আবার টুম্পাও। ঘরে ঢুকলো সে সালাম দিয়ে বললো-
: “দাঁড়িয়ে কেন? আপনি বসুন”
স্বাভাবিক স্বরে বলা কথা, কিন্তু কন্ঠে ঝনঝনানি স্পষ্ট। প্রতিটি শব্দ যেন ধারালো চাকু। রাজিব না তাকিয়েও বুঝলো এ কন্ঠের মালিক আর কেও না ‘মীরা’। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো রাজিব। যেন চোখ বন্ধ করলেই দুনিয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে ও। নূহা ফোন রেখে মায়ের কাছে গেলো। নূহাকে কোলে নিলো মীরা। মিলনের উদ্দেশ্যে বললো-
: ” আর দশটা মিনিট সময় নিচ্ছি ভাইয়া, বাইরে থেকে এসেছি তো একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি”
মিলন বললো-
: “সমস্যা নেই আপনি আসুন”

নিজের ঘরে গেলো মীরা, বসে রইলো কিছু মুহূর্ত। অনেক কিছু ভেবে চোখ আর্দ্র হতে চাইলো। তখনি উঠে বাথরুমে গেলো ও। আজ ওকে ভেঙে পরলে হবে না। আজ ওর জীবণের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। ঝটপট গোসল সারলো মীরা। চুল আচরে তৈরী হয়ে নিলো প্রত্যহিক প্রসাধনে।

ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট পরেই এলো বসার ঘরে। রাজিবের পাশের সোফায় বসলো সহজ ভঙিতে। অপরদিকের সোফাতে বসলে ওর মুখোমুখি হবে, ওর দিকে চোখ যাবে তাই ওকে একপাশে রেখে মিলনের মুখোমুখি বসলো মীরা। সোফায় বসে কাকে যেন একটা কল করলো। একঘন্টার মধ্যে বাসায় আসতে বললো তাকে। কাকে আসতে বললো?, কেন বললো? তার কিছুই বোঝা গেলো না। তারপর সোজা হয়ে বসে মীরা বললো –
: “তারপর বলুন কি খবর?”
মিলন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো যেন মীরার সামনে। কতকিছু ভেবে এসেছে বলবে। এখন সব এলোমেলো হয়ে গেলো সামনাসামনি এসে। যেন অপরাধী রাজিব না ও নিজে। তোতলানো সুরে বললো-
: “আসলে… ”
: ” বন্ধুর হয়ে সুপারিশ করতে এসেছেন?”
: “না, তা নয়, আসলে কিভাবে শুরু করি”
: “আচ্ছা শুরুটা না হয় আমিই করি?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালে মিলন মীরার দিকে। কথার আটঘাট বাঁধা মীরাকে বেশ আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে এখন। অনেক পোড়া সোনা যেম খাঁটি হয়ে উজ্জ্বল হয় তেমনি ঔজ্জ্বল্য ওর চোখেমুখে, এর দমকের সামনে দমিয়ে যাচ্ছে মিলন। আর রাজিব তখনো অবনত মস্তকে চোখ বন্ধ করে শ্রবণ করছে সে কন্ঠ আর মনে মনে ডাকছে ইশ্বরকে।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট পরেই এলো বসার ঘরে। রাজিবের পাশের সোফায় বসলো সহজ ভঙিতে। অপরদিকের সোফাতে বসলে ওর মুখোমুখি হবে, ওর দিকে চোখ যাবে তাই ওকে একপাশে রেখে মিলনের মুখোমুখি বসলো মীরা। সোফায় বসে কাকে যেন একটা কল করলো। একঘন্টার মধ্যে বাসায় আসতে বললো তাকে। কাকে আসতে বললো?, কেন বললো? তার কিছুই বোঝা গেলো না। তারপর সোজা হয়ে বসে মীরা বললো –
: “তারপর বলুন কি খবর?”
মিলন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো যেন মীরার সামনে। কতকিছু ভেবে এসেছে বলবে। এখন সব এলোমেলো হয়ে গেলো সামনাসামনি এসে। যেন অপরাধী রাজিব না ও নিজে। তোতলানো সুরে বললো-
: “আসলে… ”
: ” বন্ধুর হয়ে সুপারিশ করতে এসেছেন?”
: “না, তা নয়, আসলে কিভাবে শুরু করি”
: “আচ্ছা শুরুটা না হয় আমিই করি?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালে মিলন মীরার দিকে। কথার আটঘাট বাঁধা মীরাকে বেশ আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে এখন। অনেক পোড়া সোনা যেম খাঁটি হয়ে উজ্জ্বল হয় তেমনি ঔজ্জ্বল্য ওর চোখেমুখে, এর দমকের সামনে দমিয়ে যাচ্ছে মিলন। আর রাজিব তখনো অবনত মস্তকে চোখ বন্ধ করে শ্রবণ করছে সে কন্ঠ আর মনে মনে ডাকছে ইশ্বরকে।

মিলন থতমত ভাবে বলে-
: ” আসলে ভাবী, আমি এখানে বিচার করতে আসিনি। আমি বিচার করার কে বলেন?”
: ” বিচার করার কেও না হলে সুপারিশ করারও কেও না আপনি, আপনার কিছু বলার থাকলে শুনতে হবে আমাকেও”
মিলন কায়দা করতে না পেরে চুপসে যায়।
পায়ের উপর পা তুলে সোজা হয়ে বসে মীরা৷ তারপর সবলিল ভঙ্গিতে আমি এক্কেবারে শুরু থেকে শুরু করছি, কথাগুলো আপনার অসংলগ্ন মনে হতে পারে। কথাগুলো এ পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক।

: “তো আমার নানার গ্রামের বাড়ি আর উনার দাদার গ্রামের বাড়ি একই এলাকায়। আমার নানু বাড়ির দুই তিন বাড়ি পর ঐ বাড়ি। আমার দাদা-দাদী না থাকায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হতো না। ছোট বেলায় গ্রাম বলতে নানা বাড়ির স্মৃতিই ভেসে উঠে। উনার মা মারা যাবার পর থেকে উনি উনার দাদর বাড়িতেই থাকতেন, সেখানেই উনার বেড়ে ওঠা। আর আমরা ঈদ কিংবা আম-কাঁঠালের ছুটিতে বেড়াতে যেতাম। সেই সুবাদে ছোট বেলা থেকেই মুখ চেনা থাকলেও কথা হতো না তেমন। বড় হওয়ার পর মাত্র দুইদিনের আলাপে আমাদের মধ্যে প্রেম হয়৷ তখন আমি মাত্র ক্লাস টেনে পড়ি। উনার বড় চাচার ছেলে পারভেজ তখন এলাকার কাউন্সিলর ছিলেন। সেই সুবাদে উনার এলাকায় বেশ নামডাক ছিলো তখন, অবশ্যই তা খারাপ দিকে। তখন তার ফোন থাকলেও আমার নিজের কোন ফোন ছিলো না। তাই আমাদের প্রেম চলতো ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান থেকে।

একবার নানী অসুস্থ হলো আমরা তাকে দেখতে গেলাম পুরো পরিবার মিলে। তখন ঘোরতর বর্ষা চারদিকে। সে বছর বন্যা অনেকদিন স্থায়ী ছিলো। নানীদের বাড়ির চারপাশের রাস্তাও পানিতে ডুবে আছে। রাস্তা থেকে নানীর বাড়ি যাবার একমাত্র উপায় নৌকা। এতদিন পর গ্রামে এসেছি, পরদিনই লুকিয়ে দেখা করেছি দুজনে। সেদিন কথা বলার সময় মামা দেখে ফেলেন আমাদের। সে নিয়ে শুরু হয় হুলুস্থুল। কারন আগই বলেছি এলাকায় বাজে ছেলে হিসেবে উনার তখন বেশ নামডাক। পড়াশুনা তেমন করতো না, মারামারিতে, গ্যন্জামে সিদ্ধহস্ত। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মামা এটা মেনে নিতে পারেননি। এদিকে নানী অসুস্থ এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাকে এভাবে রেখে আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়াও অসম্ভব। উপায় না দেখে মামা মামীরা আমাকে কড়া নজরদারিতে রাখতে শুরু করলেন। এসব দেখে তার মাথা খারাপ অবস্থা। তিনি তার চাচাতো ভাই পারভেজকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠালেন আমাকে বিয়ে করার জন্য। তখন আমি কলেজে উঠেছি মাত্র। আর উনি এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

আমার বড় মামা রেগে আগুন। কত বড় সাহস পারভেজের, উনি কোন সাহসে তার গুন্ডা, ভাদাইম্মা ভাইয়ের হয়ে তার ভাগনীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ এসব ব্যাপার নিয়ে তৈরী কলহ খুব অল্প সময়ে পারিবারিক বিবাদে রূপ নেয়৷ দুই পরিবারেরই প্র্যাস্টিজ ইস্যু। তারা মেয়ে দিবে না, আর তােদের পরিবার যে করেই হোক এই মেয়ে নিবেনই, এমন অবস্থা।

এরমধ্যে এক রাতে আমি আমার মামতো বোনদের সাথে ঘুমিয়ে আছি কাচারি ঘরে। এমন সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে ভিতরে ঢুকে একজন। তার পিছনে আরো অনেকে। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিলো। প্রথমে ডাকাত ভেবেছিলাম, পরে গলার স্বর শুনে বুঝেছিলাম তিনি। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। আমি যেন পিস্তল হাতে এই লোকটাকে চিনতে পারছিলাম না। বোনেরা চিৎকার শুরু করলে ওদেরকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে চুপ করতে বলে। ওদের বোবা আহাজারি, কান্না শুনেও কেও এদিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে না। কারন তারা এখানে আসার আগে সবগুলো ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে এসেছে। টর্চ জ্বেলে তিনি আমাকে নেমে আসতে বলেন।

তারপর তারা নৌকায় করে আমাকে নিয়ে গেলো। যাবার আগে বাড়ির সামনের সব নৌকা উল্টে দিলো। আমি ভয়ে শেষ, “কাকে ভালোবাসলাম আমি? মামা, মামীরা তো তাহলে ঠিকই বলেছিলো ও ভালো ছেলে না” এই ভেবে। আমার ভয়, কান্না দেখে তার চাচতো ভাই পারভেজ ধমক দিলো তাকে। “কিরে কার লগে ভাব ভালোবাসা করলি? এত রিস্ক নিয়া তুলে আনছি খুশি হইবো কি? কি ভ্যাভ্যা করতাছে, আরে আমগো প্রেমিকারা তো বিয়ার আগেই…….! খুব বাজে কথা ছিলো সেটা। রাত গভীর হচ্ছে, নৌকা কোথায় যাচ্ছে জানি না। কাঁদতে কাঁদতে আমি কখন ঘুমিয়ে পরলাম তার খেয়াল নেই। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে আবার শুরু হয় আমার কান্না। উনি খুব করে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে উনি যা করেছেন তা আমাকে ভালোবাসেন বলেই। আমি কিছুতেই কিছু বুঝি না, কাঁদতেই থাকি, বাবার কাছে যাবো বলে। উপায়ন্তর না পেয়ে তারা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে গ্রামে তাদের বাড়িতে। ভেবেছিলো এক রাত বাইরে থেকে বদনাম হয়েছে মেয়ের, তাই বিয়ে না দিয়ে উপায় কই মেয়ের বাবা-মায়ের? কিন্তু খবর পেয়ে আমার মা আমাকে তাদের বাড়ি থেকে আনে, আমার কাছে সবটা জেনে খুব কাঁদলেন সারাদিন। বাড়ির শোকের বিষয় অসুস্থ নানীর থেকে সরে আমার দিকে এসে পরলো। রাতের বেলা তারা এলেন, মা তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করলেন। জলে থেকে কুমিরের সাথে তো লড়াই চলে না। ঐখানে থাকা অবস্থায় তাদের সাথে তাল দিয়ে চলেন মা । বললেন যে ঢাকায় গিয়ে সবাইকে জানিয়ে আমাকে তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবেন। এই ভাব ধরে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় আসি সবাই, এই আসাই শেষ আসা।

ঢাকায় এসে আমার মা পুরোপুরি বদলে যান। যা গেছে গেছে, আমাকে অনেক বুঝিয়ে ফিরানোর চেষ্টা করে। এদিকে এ গল্পের বদৌলতে আমি হয়ে গেলাম কলেজে সকলের মধ্যমণি। সকলের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম যা আমি ফেলে এসেছি তা এদের(আমার সহপাঠীদের) ফ্যান্টাসি। ধীরে ধীরে আমি বুঝে গেছি কত ভালো বাসলে কেও এমন করতে পারে প্রেমিকার জন্য। আমিও মরিয়া হয়ে খুঁজছিলাম আবার এক হওয়ার রাস্তা। বান্ধবীদের সাহায্য নিয়ে আবার কথা বলা শুরু করলাম গোপনে। এদিকে বাবা-মা ও আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু করলেন। এসব শুনে উপায়ান্তর না দেখে এইচএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় আসেন তিনি ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার ছুতায়। খুব সম্ভবতঃ আপনাদের সেখানেই পরিচয়। কি ভাগ্য আমার আমাদের ঢাকার বাড়িও একই এলাকায়।

এদিকে ও ঢাকায় তা আমার বাবা মা জেনে আমাকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে শুরু করলো। পাত্র খোঁজা নিয়ে ও তোরজোর শুরু করলেন। এমন সময় আমার ময়ের বান্ধবী সব জেনে তার একমাত্র ছেলের বিয়ের জন্য প্রস্তাব রাখলেন। আপনি হয়তো জানেন না, আবীর নামের সেই ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিলো আমার। যার ঢাকায় বাড়ি আছে, নিজের ব্যাবসা আছে, যে কর্মঠ, প্রতিষ্ঠিত। সেই তাকে ছেড়ে বিয়ের পরদিন আমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছি বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি দিয়ে। সবাই বলেছে অনেক বড় ভুল করছি আমি। কিন্তু আমি কারো কথা শুনিনি। ভালোবাসায় অন্ধ আমি ভালোমন্দ, ঠিক ভুল কিছুই খুঁজিনি। খুঁজেছি একটা ভালেবাসার মানুষ, বিশ্বাস্ত কাঁধ।

তখন ও কি করতো জানেন? মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনের চাকরী করতো। সেখানকার চাকরীও চলে গেলো বিয়ের কয়েকদিনের মাথায়। বিয়ের পর তিন মাস খরচ চালিয়েছিলাম গয়না বিক্রি করে। তারপর হঠাৎ অসুস্থ হলেন উনি, আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। চাঁদা তুলে, মানুষের থেকে চেয়ে, দাতব্য সংস্থার সাহায্য নিয়ে কিভাবে যে তার চিকিৎসা করালাম তা কি তিনি ভুলে গেছেন? এরপর তিনি সুস্থ হবার পর শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবার। কোনদিন কাজ না করা আমি কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছি, তার সাক্ষী আমার এই হাতদুটো। কারখানার স্টাফদের রান্না করে খাইয়েছি, কারখানার দেখাশোনা করেছি তা কি উনি দেখেন নি? কারখানা যখন একটু বড় হতে শুরু করলো তিনি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতেন, কি? কিভাবে? করতাম তার খোঁজ ও রাখতেন না। আমার কাজের চাপ, শারীরিক অসুস্থতা, পরিবার থেকে দূরে থাকার হতাশায় কোনদিনও পাশে থাকেন নি উনি, তিনি কেবলি আমার শয্যসঙ্গী, তার সাথে যত বোঝাপড়া সবই বিছানায়। এত এত চাপে ক্লান্ত আমাকে তিনি মানুষ ভাবেননি কখনো, ভেবেছেন Wife, আমিও সব রাগ, ক্ষোভ, ক্লান্তি একপাশে রেখে স্বামীর দায়িত্বশীল স্ত্রী হতে চেয়েছি।

তারপরও তিনি পর নারীর দিকে হাত বাড়িয়েছে। আমার কারখানার স্টাফ থেকে শুরু করে, মাঝবয়েসী মহিলা কেওই বাধে নি ওর রুচিতে। প্রতিদিন ক্লাবে গিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা, সপ্তাহান্তে প্রমোদ ভ্রমণ, সেখানে ম’দ আর মে’য়ে নিয়ে রাত্রীবাস এসব খবর তো আপনিও জানেন । সব বুঝেও চোখ বন্ধ করে তার একটার পর একটা করা ভুলকে ঢেকে রেখেছি সমাজের কাছ থেকে। মানুষের আমাকে নিয়ে করা ভবিষ্যৎ বানীকে ভুল প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেই সেই ভুলকেই বয়ে চলেছি বছরের পর বছর। ভেবেছিলাম শুধরে নিবে, বদলে যাবে।
কিন্তু দিনশেষে কি পেয়েছি জানেন?

অবিশ্বাস
প্রতারনা
বিশ্বাসঘাতকা

কথাগুলো বলে দু হাতে মুখ চেপে রাখে মীরা। মেয়েটার চোখের পানির বাঁধ এতক্ষণে ভাঙলো বলে।

ওড়ানায় মুখ মুছে সোজা হয় ও, কান্না, আর আবেগকে পাশে রেখে বলে এখানেই শেষ নয় ও আমার সাথে চিট করে ব্যাংক একাউন্ট, বিজনেস পেপার সব নিজের নামে করে নিয়েছে। আমার নিজের রোজগার টাকায় কেনা বাড়ি বন্ধক রেখে আরেকজনকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। দিনশেষে কি হলো?

সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার কি জানেন ভাই-
আমার বাবার মৃ*ত্যুর খবর পেয়ে তার লা’শের সামনে গিয়েও বাবাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারি নি এই ভুল আগলে রাখার শাস্তি হিসেবে। মা’কে ভুল বুঝেছি বছরের পর বছর।

এবার আপনি বলেন যাকে পেতে এত ত্যাগ করলেন, সেই পাগলপ্রায় প্রেমিক যদি আপনার সাথে চিট করে, আপনি বর্তমান সত্ত্বেও অন্য কাওকে ভালোবাসে, বিয়ে করে, গোপনে আপনার সবকিছু নিজের নামে করে নেয়, তাহলে আপনি কি করতেন?

এতক্ষণে সোফায় হেলান দিয়ে বসে মীরা। এত কথা একসাথে বলে ও ক্লান্ত। ওর পাশের সোফায় বসা রাজিব তখনো উবু হয়ে দুই হাতের মুখ ঢেকে রেখেছে। যেন চেহারা দেখাতেও লজ্জা পাচ্ছে ও। হাতের ফাঁক গলে ফোঁটায় ফোঁটায় পরছে চোখ সমুদ্রের জল। দামী তুর্কি কার্পেট তা শুষে নিচ্ছে মুহুর্তেই।

অপরদিকের সোফায় বসা মিলন দুই হাত দুপাশে রেখে মাথাও নিচু করা। এ কার হয়ে বাড়ি বয়ে এসেছে ও সুপারিশ করতে। ওর নিজেরই ইচ্ছে হচ্ছে একে একলা করে দিতে।

এমন সময় কলিংবেল বাজে। উঠে গিয়ে মীরা দরজা খুলে। জড়তা হীন কন্ঠে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানায় দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে। বলে-
: “একেবারে ঠিক সময়ে এসেছেন এডভোকেট রামীম”

একটা কালো হ্যান্ড ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকেন তিনি। তাদের সামনে এসে সবাইকে হ্যালো বলে অভিবাদন জানালেন। রাজিব তখন মাথা নিচু করে বসে। মিলন তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এ সময়ে এডভোকেট! হজম করতে পারছে না বিষয়টা। রামীম সাহেব মিলনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে হাত বাড়িয়ে দিলো সংবিৎ ফিরে মিলনের, হ্যান্ডশেক করা ভুলে মিলন একপাশে সরে জায়গা করে দেয় তাকে বসতে। লোকটা হাসিমুখে বসে সেন্টার টেবিলে ব্যাগটা রেখে কাগজপত্র বের করেন। যেন কি করবেন তা সব পূর্ব নির্ধারিত, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে কাগজগুলো ঠিক করে এগিয়ে দিলেন মীরার দিকে, যেন তার ভীষণ তাড়া। কাল বিলম্ব না করে পেপারস্ গুলোতে সাইন করলো মীরা। তারপর তা ফিরিয়ে দিলো এডভোকেটের কাছে। তিনি “মি: রাজিব” বলে সসম্মানে সেটা এগিয়ে দিলেন রাজিবের দিকে। রাজিব যেন এতক্ষণ কি হলো কিছুই জানে না, ভাবলেশহীন দৃষ্টি ওর চোখে-মুখে। চোখ রক্ত বর্ণ হয়ে আছে। সাইড টেবিলের টিস্যু বক্স থেকে ট্যিসু নিয়ে চোখ মুছে ও। তারপর আজ্ঞাবহের মতো কাগজগুলো হাতে নেয়। মনোযোগ দিয়ে পড়ে কাগজটা, একটু খানি পড়েই বুঝে ফেলে কি এই কাগজ। কাগজ নামিয়ে রেখে মীরার দিকে তাকায় রাজিব। ভীতি আর বিষ্ময় মেশানো সে দৃষ্টি মীরা চেয়েও দেখে না। একটা বারের জন্য ও তাকায় না ওর দিকে। কাগজটা রেখে কান্নায় ভেঙে পরে ও। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে রাজিব। টুম্পা এতক্ষণ এদের সামনে আসেনি। কান্না শুনে নোংরা রাজিবের এ পরিণতি দেখার লোভ সামলাতে পারলো না ও। মাজেদা খালা আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আজ তার কেন জানিননা আজ প্রথমবারের মতো খারাপ লাগছে রাজিবের জন্য। এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরেকবার ভাবতে বলেছিলেন তিনি মীরাকে। মীরা শান্ত কন্ঠে বলেছে- ” আপনি কি চান, এমন দুঃশ্চিত্র, লম্পট, দায়িত্ব জ্ঞানহীন কেও ক্ষমা পেয়ে যাক ? ”
আর কিছু বলার সাহস হয়নি মাজেদা খালার। আর
টুম্পা বলেছে- আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমি আপনার পাশে থাকবো।

মীরা তাই নিজের সাথে নিজে বুঝেছে। এ কয়টা দিন কেবলি এসব ভেবেছে। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলস্বরূপ এডভোকেট রামীম আজ এখানে।

কাগজগুলো ছিড়ে ফেলে রাজিব। টুকরো টুকরো করে। জীবণের সকল ভুলের রাগ আর ক্ষোভের বলি হয় ঐ কাগজগুলো। এডভোকেড রামীম কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পরেন রাজিবের এমন আচরণে। মীরা পরিস্থিতি সামলে নিতে তাকে আরেক সেট কাগজ তৈরী করতে বলে আসতে বলেন। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করেন তিনি।

মীরা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভিতরের রুমে গিয়ে নূহাকে কোলে নিয়ে ফিরে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তারপর নূহাকে মাজেদা খালার কাছে দিয়ে নিচে চলে যেতে ইশারা করে। মাজেদা খালা আর টুম্পা নিচে চলে যায়। এরপর ও মিলনের উদ্দেশ্যে বলে-
: ” এখন, এই মুহূর্তে আমরা এক কাপড়ে চলে যাবে এ বাড়ি ছেড়ে। কাজটা আগেও করতে পারতাম। পাছে আমার না কোন দোষ হয়, এমনিতেই কোন দোষ না করেই অনেক দোষের ভাগী আমি। তাই আপনাদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। এই ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে আমি কিছু টাকা লোন এনেছিলাম, সেটা ফেরত দিয়ে পেপারস নিয়ে এসেছি গতকাল, এই যে সেই কাগজ” কথাটা বলে একটা ফাইল তুলে দেয় মীরা মিলনের হাতে। তারপর একে একে আলমারী, গাড়ি, কারখানার সকল চাবি বুঝিয়ে দেন মীরা তাকে। মিলন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কেবল, সে যেন বোবা কেও৷ মনের ভাব প্রকাশের ভাষা জানা নেই তার। সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে মীরা বলে-
: ” আজ থেকে আমার কিংবা আমার মেয়ের কোন দাবিই রইলো উনার উপর। সকল দাবি আমরা ছেড়ে দিলাম”
বলেই উঠতে গেলেই রাজিব ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় ওর সাথে সাথেই, খপ করে ধরে মীরার হাত, বলে-
: ” কোথায় যাবে তুমি আমাকে ছেড়ে?, চললাম বললেই হলো? এত সহজ সব শেষ করে দেয়া? আমি আমার সব পাপ, সব অপকর্ম, সকল ভুল স্বীকার করছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও মীরা। তুমি তো জানো এক তুমি ছাড়া আর কেও নেই আমার, কেও না”
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় মীরা, এত সহজে হাত ছাড়িয়ে নিতে পারবে ভাবতে পারে নি ও।
রাজিব এত দূর্বল!

সেখান থেকে কোনমতে উঠে মীরার পায়ে পরে রাজিব। মীরা পা ছাড়াতে অনেক চেষ্টা করেও না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে।

চোখ উপচে পানি পরতে থাকে মীরার। এমন দিনের স্বপ্ন তো ও দেখেনি কোনদিন। তাহলে কোন পাপর শাস্তি স্বরূপ খোদা ওকে এ কষ্ট দিচ্ছে। একে একে মনে পরে ওর সবকিছু। বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া, তাদের কথা না শোনা, একজন নির্দোষকে কলঙ্কিত করা। এসবের শাস্তি পাচ্ছে ও। কিন্তু নূহা! ওর তো কোন দোষ নেই, ও কেন স্বাভাবিক একটা পরিবার পাবে না, বাবা মায়ের ভালোবাসার মাঝে বেড়ে উঠবে না। ওর কি দোষ? মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভেবে কষ্টে বুক ভারী হয়ে গেলো। সেই কষ্টের শোক একত্রে করে পা ছাড়িয়ে নিলো ও এক ঝটকায়। রাজিব ভারসাম্যহীন ভবাে বসে থাকার দরুন ঝিঁটকে পরে গেলো মেঝেতে। মীরা মিলনকে বললো-
: ” ডিভোর্স পেপার এ বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে যাবে, আমি চললাম মিলন ভাই, ভালো থাকবেন ”

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

নিজের কষ্টে গড়া সোনার সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে মীরার নিজেকে বড্ড ভারী মনে হতে লাগলো। হাত-পা, পুরো শরীর ফুলে আছে যেন। এ বাড়ির লিফট বিকেল থেকে বন্ধ। মীরাকে এখন আটতলা থেকে নামতে হবে সিঁড়ি ভেঙেই। সুন্দর দামী টাইলসের সিঁড়ি গুলো দিয়ে নামতে নামতে মীরার মনে হচ্ছিল এ যাত্রা যেন কোনদিন শেষ হবে না। অনন্তকাল ধরে মীরা এমনি সিঁড়ি বেয়ে নামতেই থাকবে নামতেই থাকবে। থেকে থেকে কান্নার জলেপূর্ণ হচ্ছে ওর চোখ, দৃষ্টি মাঝে মাঝেই ঘোলা আর ঝাপসা হয়ে আসছে। দু-একবার সিঁড়ি থেকে পরে যাবার উপক্রম হয়েছিলো এই বিড়ম্বনার দরুন। দুইবারই সিঁড়ির রেলিং ধরে পরে যাওয়া থেকে বেঁচেছিলো কোন মতে। নিজেকে আর বয়ে নিতে পারছে না যেন মীরা। পানি উপচে পরা চোখ ওড়নার কিনারায় মুছছে নিয়মিত বিরতিতে। শান্ত করতে চেষ্ট করছে বিক্ষিপ্ত মনকে, বুঝিয়ে বলছে “অনেক কাজ বাকী, এখন এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না তোকে মীরা” মনকে দেয়া প্রবোধে কাজ হলো। কান্নাটা কোনমতে বাগে এনেছে ও। তবে আটতলা থেকে নিচ পর্যন্ত নামাটা ওর কাছে এভারেস্ট জয় করার সমান মনে হচ্ছে আজ।

অন্ততকালের এ যাত্রা শেষে নিচে নামতেই দেখে পার্কিং-এ টুম্পা নূহার সাথে খেলছে, আর মাজেদা খালা মুখ ভার করে ভাবুক দৃষ্টিতে বসে আছেন। মীরাকে দেখে দাঁড়ালেন তিনি, টুম্পাও নূহাকে নিয়ে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। মীরা নূহাকে কোলে নিয়ে টুম্পাকে বলে রিকশা ঠিক করতে।

মীরার আদেশ শুনে আজ্ঞাবহের মতো রিকশা ঠিক করতে যায় টুম্পা, মীরা কেমন যেন টালমাটাল ভঙ্গিতে পরে যেতে নেয়। মাজেদা খালা মীরার এ অবস্থা খেয়াল করে নূহাকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। যা কিছুর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, দাঁড়িয়ে যে আছে এখনো, এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। মীরার মুখের দিকে চেয়ে চোখ ভিজে যায় তার। চোখের এ পানি লুকাতে তিনি নূহাকে নিয়ে গেইটের কাছে যায়। মীরা ভারসাম্যহীনের মতো বসে পরে সিঁড়ির গোড়ায়। মাথাটা ভনভন করছে, চারপাশ ও দুলছে মনে হচ্ছে। রিকশা ঠিক করে নূহা আর টুম্পা উঠলো একটাতে, অপরটায় মাজেদা খালা উঠলেন মীরাকে নিয়ে। রিকশায় বসে মীরার একবার তাকায় বাড়িটার দিকে, ওর ফেলে আসা জীবণের দিকে, শেষ বারের মতো। কত স্মৃতি এ বাড়িতে ওদের জীবণকে ঘিরে। সবকিছু আজ শেষ হয়ে গেলো। ভুল নামের এ অধ্যয়ের সমাপ্তি হলো আজ। যার শুরু হয়েছিলো বর্ষা নামের গ্রীষ্মের তেজে তাঁতা এক দুপুরে।

হঠাৎ মীরার চোখ যায় ওর স্কুটির দিকে। লাল টুকটাকে স্কুটিটা যেন মীরাকে বলছে-
: ” আমাকে নিলে না সাথে? আমি তো ছিলাম তোমার কষ্টের দিনগুলোতে তোমার পাশে”
এমন সময় রিকশা চলতে শুরু করলে রিকশাওয়ালার কাঁধে হাত দিয়ে থামাতে বলে মীরা। অল্পবয়সী রিকশাচালক ছেলেটা বিব্রত হয় মীরার এমন ডাকে। রিকশা থামলে তার কাঁধে ভর দিয়ে নামে মীরা। হেসে বলে-
: “কিছু মনে করো না ভাই, আমার ছোট ভাইটা তোমার বয়সী”
বহু কষ্টে সেখান থেকে নেমে ব্যাগে থাকা স্কুটির চাবিটা বের করে মীরা। সিকিউরিটির রুমে গিয়ে তাকে সেটা দিয়ে বলেন-
: “চাবিটা আপনার স্যারকে দিয়ে দিবেন মনে করে”
বলে এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না ও। দ্রুত রিকশায় উঠে বলে- “চলো ভাই”।
রিকশা চলতে শুরু করে গন্তব্যের উদ্দেশে।

মীরাদের রিকশা গুলো থামে ওর ওয়্যার হাউজের ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে। এ বাড়ির দুই তলায় ওদের এই ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ই, তবে বাস করার মতো উপযোগী না এখনো। মাল পত্রে ঠাসাঠাসি।
কিন্তু ওর তো এখানে ছাড়া আর কেন জায়গা নেই গিয়ে দাঁড়াবে৷ জীবণে এ পরিস্থিতিতে এমন সময়ে মেয়েরা তার পরিবারের কাছে ফিরে যায়। ওর সেই উপায়ও নেই, সবইতো নষ্ট করে এসেছে নিজ হাতে। মীরার খুব মনে পরে ওর পারভীন আন্টির বলা কথাগুলো। তিনি বলেছিলেন- ” কি ভুল যে করলি একদিন ঠিক বুঝবি, কিন্তু তখন বুঝেও কোন লাভ হবে না” – সত্যি ও সব ভুল বুঝেছে, কিন্তু এখন বুঝে কোন লাভ নেই। সেই সব দিন, ওর বাবার ওকে মৃ*ত ঘোষণা করা সব সব মনে পরে মীরার। পুরো রাস্তাটাই নিরবে কাঁদতে থাকে মীরা। এ কান্না যেন চোখ দিয়ে কেবলি জল গড়িয়ে পড়া। আবেগ অনুভূতির কোন অভিব্যাক্তি নেই ওর চোখেমুখে। একটু পর পর মীরার পাশে বসা মাজেদা খালা ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেন, এ আবার কেমন কান্না? কতটুকু চাপ মনের মধ্যে থাকলে এভাবেও কাঁদে মানুষ!

বাসায় ফিরতে ফিরতে কোলেই ঘুমিয়ে পরে নূহা। দুপুরে সে ঘুমায় নি আজ। তাই তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পরলো। এ ফ্ল্যাটটায় একটা ঘরই কেবল খালি। সেখানে সামনের অংশে অফিস ডেস্ক আর ভিতরের দিকে রেস্ট করার জন্য শুধু একটা মেট্রেস রাখা। সে ঘরে থাকা ম্যাট্রেসে বালিশ ছাড়া শুইয়ে দিলো ও নূহাকে। এসে অবধি ঘরকে থাকার উপযোগী করছে টুম্পা আর মাজেদা খালা দুজন মিলে।

মোটামুটি গোছগাছ সব শেষ। রাত দশটা হতে চললো, মাজেদা খালা খাবার কিনে আনতে বাইরে গেলেন। টুম্পা নূহার খাবার তৈরীর জন্য গরম পানি করছে। টুমটাম জিনিসপত্র কিছু আছে এখানে, চা তৈরীর পাত্র, মুড়ি মাখা তৈরীর জন্য চপিং বোর্ড, চাকু, খাবার গরম করার পাত্র৷ কিছু বাসনকোসন, চামচ, বাটি। তবে রান্না করার তৈজসপত্র নেই এখানে৷ “কালকে সকাল সকাল গিয়ে এগুলো আনিয়ে নিতে হবে” – মনে মনে ভাবে টুম্পা।

পানি গরম করে পটে ভরে রেখে রুমে এসে দেখে মীরা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। খুব সম্ভবতঃ কারো সাথে চ্যাট করছে তিনি। টুম্পা এ পরিস্থিতিতে মীরার মনের জোর দেখে একটুও অবাক হয় না।

মিনিট পাঁচেক পর, একটা কল আসে মীরার ফোনে। মীরা তখন বাথরুমে। টুম্পা বাথরুমের দরজায় নক করে বলে- “আপু ইউকে থেকে লোরা আপু কল করেছে”

একটু বাদেই বের হয়ে কল ব্যাক করে মীরা। ওপাশে কি বলে তা শোনা না গেলেও মীরার কথা শোনে টুম্পা-
: “হ্যা, হ্যালো”
: ———
: ” হ্যাঁ, আজ দুপুরেই ঢুকেছে, আমি সাথে সাথেই ইনফর্ম করেছিলাম তোমাকে ”
: ———-
: ” ও আচ্ছা, টেনশন হওয়ারই কথা, তুমি বাড়ি ফিরলে ওকে বলে দিও”
: ———-
: ” থ্যান্কংস এ লট ডিয়ার, কথাগুলো হয়তো ওকেও বলতে পারতাম না আমি, তুমি এগিয়ে না এলে এসব কল্পনা করার সাহসও হতো না হয়তো”
: ——
: ” আচ্ছা আর বলবো না, দোয়া করো আমার জন্য”

টুম্পা কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলো না, তবে বোঝার চেষ্টাও করলো না। কারন সময় গেলে ওর কৌতুহলী সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে ও। অপেক্ষা করাটা সহজাত হয়ে গেছে ওর। কিছু কাগজপত্র ঠিক করে আবার যেন কাকে কল দিলো বারান্দায় গিয়ে৷ এমন সময় নড়েচড়ে উঠে নূহা, না খেয়ে ঘুমানোর ফল। গরম পানিতে সেরেল্যসক গুলে নূহাকে খাওয়ায় ও। তারপর ব্রেস্ট ফিডিং করাতে মেয়ের পাশে শোয় মীরা । এই মেয়ে আড়াই বছর বয়স হতে চললো তবুও এ অভ্যাসটাকে ছাড়াতে পারলো না। এখন থেকে হার্ডলি এটাকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করবে ও।

টুম্পা কাগজ প্রিন্ট করে ওটা হাতে নিয়ে ফিরে এসে অবাক হয় মীরাকে ঘুমিয়ে পরতে দেখে। মাজেদা খালা আসার আগেই জেগে উঠা নূহাকে ফিড করাতে গিয়েই ঘুমিয়ে পরে মীরা। কাগজটা পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয় ও। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তার ছাঁট আসছে জানালা দিয়ে৷ জানালা খোলা রেখেই পর্দাগুলো টেনে দেয় পানির ছাঁট থেকে বাঁচতে। খুলে দেয় অপরদিকের জানালাও। স্তব্ধ, গুমেট প্রকৃতি যেন কথা বলা শুরু করেছে বৃষ্টির আগমনে। বাতাসের দমকে কাছাকাছি এসে আবার দূরে সরে যাচ্ছে গাছগুলো। যেন গোপন কোন কথা বলে নিরাপদে সরে যাওয়া। আজ সারা বেলা আকাশে মেঘ ছেঁড়া রোদ ছিলো। এসময়ে বৃষ্টিটার খুব দরকার ছিলো। বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাস ঘর থেকে গুমোট ভাবটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সাথে করে।

একটু পরেই মাজেদা খালা ভিজে চুপচুপে হয়ে খাবার নিয়ে ফিরলেন। নূহার সকালের জন্য বিস্কুট, জুস ও কিনে এনেছেন তিনি। এখানে ফ্রিজ না থাকায় জুসটাকে পানির বালতিতে চুবিয়ে রাখলেন।
এসে বাথরুমে গিয়ে কাপড় বদলে নিলেন। মীরা না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে দেখে কষ্ট পেলেন তিনি। যদিও তার সন্দেহ ছিলো মীরাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে। উপায়ন্তর না দেখে কিনে আনা খাবার পাতে বাড়েন তিনি।

কোনমতে খাবার খেয়ে ৭/৬ ফিট ম্যাট্রেসটায় আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে পরেন তারাও। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, মীরার অতীত ধুয়ে নিয়ে যেতেই যেন প্রকৃতির এই নিবেদন। থেকে থেকে খুব কাছের চালে পরা বাজগুলো যেন মীরার ভেতরকার আত্নচিৎকরের উদ্গিরণ।

টুম্পা আর মাজেদা খালা দুজনের কারো চোখেই ঘুম নেই,কিন্তু দিব্যি ঘুমুচ্ছে মীরা৷ টুম্পা ভাবছে – “শেষ পর্যন্ত রাজিবটাকে শিক্ষা দিতে পারলো মীরা” লোকটা যে কত নোংরা তা ওরচে ভালে কে জানে। আর মাজেদা খালা ভাবছে – ” ক্যান সব দিয়া দিলো খালুরে, হেয় তো এডির মালিক না” এসব ভাবতে ভাবতে সময়ের আবর্তে ঘুমের অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে পরে তারাও।

বেশ রাতে ঘুম ভাঙে মীরার। আবছা করে চোখ খুলে দেখে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ওর কাছে বসে আছে ইরা। হাত ঠেলে ডাকছে ওকে। মীরা যেন আগের দিনগুলোতে ফিরে গেছে। বাবার বাড়িতে থাকার সময় যেমনি ডাকতো ইরা তেমনি ভাবে ডাকছে এখন ওকে। আবছা করে আবার তাকায় মীরা, দেখে সবসময়ের মতো ওর মা জাহানারা গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। এতদিনের দূরত্বে, কাছে আসাটা ভার হয়েছে তার৷ কেঁদে কেঁদে ইরা ডাকছে ওকে-
: “ওঠ আপা, আমরা তোকে নিতে এসেছি”
: ” আমাকে ক্ষমা করেছিস তোরা? তোরা তো বলেছিলি ওর সাথে সম্পর্ক থাকলে কোনদিনও আমাকে ক্ষমা করবি না, বিশ্বাস কর ওর সাথে সব সম্পর্ক চূর্ণ করেছি আজ,
ইরা কেঁদে বলে-
: “আমরা তা জানি আপা, তাইতো তোকে নিতে এসেছি”
: “ওর কোন ছায়া থাকবে না কাল থেকে আমার জীবণে। ওর দেয়া, ওর ছোঁয়া, ওর স্পর্শ আছে এমন কিছুই আনিনি আমি আমার সাথে। এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছি নিজের গড়া ঘর থেকে। আমি কোন টান রাখতে চাই নি, আমি চাইনি এমন কিছু থাকুক যা ওর কথা, স্মৃতি আমাকে মনে করিয়ে দিবে। মাজেদা খালা বকেছে আমাকে। কেন তাকে দিয়ে দিচ্ছি সব? আমি তো এসব চাই নি! আমি চেয়েছিলাম ভালোবাসা। তাই যখন হলো না টাকাপয়সা দিয়ে করবো কি? টাকাপয়সা কামাই করার পথ তো খোদা আমাকে চিনিয়েই দিয়েছে”

: ” থাক, এসব বলে কোন লাভ নেই, চল তুই আমাদের সাথে, ঐ যে দেখ মা এসেছেন তোকে নিয়ে যেতে”

: ” দাঁড়া আমার মেয়েটাকে নিয়ে নিই”
: ” না, ওকে না”
: “মেয়েটাকে নিবি না তোরা সাথে?”
: “না আপা, ওকে কেন নিবো, ও তো রাজিবের সন্তান, নোংরা রাজিবের রক্ত আছে ওর শরীরে”
: ” এভাবে বলিস না প্লিজ, ও যতটুকু রাজিবের ততোটুকু তো আমারও”
: ” রাজিব সংক্রান্ত সব তুই ছেড়ে এসেছিস, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি, কারখানা এগুলো সব তোর নিজের গড়া তবুও ওর পিছুটান ছাড়াতে এসব ছেড়ে এসেছিস তুই৷ তাহলে নূহা?”
: ” ও আমার মেয়ে ইরা”
এবার ওর মা জাহানারা এগিয়ে আসে ওর কাছে, মুখ কালো করে বলে-
: ” আমরা কেবল তোকে নিতে আসছি, ওকে না”
: “মা ও আমার মেয়ে, ওকে ফেলে আমি কিভাবে যাবো?”
: ” তুই ও তো আমারি মেয়ে ছিলি, কষ্ট দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলেও গিয়েছিলি, তখন তোর মনে ছিলো না যে আমার কত কষ্ট হবে তুই এমনটা করলে?”
ক্রন্দনরত অবস্থায় মীরা হাতজোড় করে বলতে থাকে-
: “মা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো, ভুল হয়ে গেছে আমার, বড্ড ভুল হয়ে গেছে”

এমন সময় উঁচু থেকে স্টিলের কিছু পরে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভাঙে মাজেদা খালার। এ বাড়িতে বিড়ালের আনাগোনা আছে। বিড়ালই হয়তো খাবারের লোভে এসে কিছু ফেলে গেছে। তিনি খোলা জানালায় গলে আসা মেঘ কাটা চাঁদের আলোতে দেখেন মীরা ঘুমের ঘোরে বলছে- “মা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে তুমি ক্ষমা” মীরার গায়ে ধাক্কা দেন তিনি, মীরা হুড়মুড়িয়ে উঠে শোয়া থেকে। উঠে দেখে কোথায় ইরা কোথায়ই বা জাহানারা। তারা কেও নেই অন্ধকার এই ঘরটায়। ওর হুঁশ হয় যে তারা বাস্তবে না এসেছিলো ওর স্বপ্নে। বাস্তবে এমনটা সম্ভব না কোনদিনই কারন ও তাদের কাছে মৃ*ত। আর এই ডেথ সার্টিফিকেট ওর বাবা নিজ হাতে লিখে গিয়েছিলেন। দু হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে মীরা। চিৎকার করে বলতে থাকে- “মা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো”

চলবে……

প্রিয় ভুল পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫+৫৬

0

#প্রিয়_ভুল
#মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৫৩-৫৪

মীরার সাথে দেখা করবে ভেবে মিলনের বাসা থেকে বের হলেও রাজিব সাথীর বাসার দিকে রওনা হলো। সে বাসা থেকে বের হয়েই গত তিন দিনের ঘোর কেটে বাইরে বেরুলো যেন ও। এ মুহূর্তে মীরার কাছে যাওয়ার চেয়ে সাথীর সাথে কথা বলা বেশী দরকার। সাথী ওকে কিভাবে ট্রিট করে তা দেখেই সিদ্ধান্ত হবে মীরার প্রতি বিনত থাকবে ও নাকি উদ্ধত । সাথীর কথা ভাবতেই একদলা বিশ্রী অনুভূতি পাক দিয়ে উঠলো ওর মনে, “মা’গীকে কেচে লবণ দিতে পারলে গা জুরাতো” – একদলা থুথু ফেলে সাথীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো মনে মনে বলে ও। ওর জন্য এত কিছু করেছি আমি আর ও-ই কিনা শেষমেশ শ্রীঘর দেখালো আমাকে। মুহূর্তেই রাজিবের মাথা প্রচন্ড গরম হলো। এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে- “রাস্তার কুকুর দিয়ে ওকে না খাওয়ালে আমার নাম রাজিব না” রাস্তায় পরে থাকা সেভেন-আপ এর বোতলে লাথি দিয়ে মনে মনে বলে ও। ভাবটা এমন যেন লাথিটা বোতলকে না দিলো সাথীকে। বোতলটা অনেকদূর পৌঁছে দিতে পেরে শান্ত হলো ও। তার
একটু পরই ভাবনাটা বদলে গেলো ওর। মারধোর করাটা এখন বুদ্ধির কাজ হবে না, পরে হিতে বিপরীত হতে পারে। পরক্ষণেই শান্ত করে নিজেকে। ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে, এবং ও তা পারবে। এতটুকু আত্মা বিশ্বাস ওর নিজের প্রতি আছে। থাকবে না-ই বা কেন? ওকে বিয়ে করেছে তো ক’বছর হতে চললো তবুও বাচ্চা নিতে দেয়নি রাজিব, বাচ্চা নেয়া মানেই তো কয়েক বছরের জন্য বৌয়ের দখলদারি সন্তানের হাতে তুলে দেয়া৷ সব নজর এক ধাক্কায় চলে যায় সন্তানের দিকে। তার উপর এই সেই, কত উটকো দায়িত্ব নিতে হয় স্ত্রী, সন্তানের। এটা হারে হারে টের পেয়েছে ও মীরার মিসক্যারেজের সময়। প্রতিবার যখন কনসিভ করেছে মীরা রাতে রাজিবের আচরন বদলে যাওয়ার কারনে আলাদা বিছানায় ঘুমিয়েছে ওরা৷ আরে রাত মানেই তো কা’মের দিন শুরু হয়। ও বহু কষ্টে অপেক্ষায় থেকেছে রাতের পর রাত। যত্ন নিয়েছে, ধৈর্য ধরেছে মীরার রাজিবের বিছানা সঙ্গী হিসেবে তৈরী হওয়ার অপেক্ষায়৷ কিন্তু এই মেয়ে যত সুন্দর ততই ভঙ্গুর। কিছু থেকে কিছু হলেই বিছানা নিয়ে নেয়, এত্ত নাজুক। এমন চললো পরপর তিনবার। ততদিন অনিচ্ছাকৃত অপেক্ষায়ই ছিলো ও। বঃহিগামী যে ও হয়নি তা বললে পাপ হবে, সপ্তাহে এক-আধবার গিয়েছিলো। কিন্তু বাইরে গিয়ে ও বাড়ির টেস্ট পায়নি। কতজনে ছোঁয়া জিনিস, গা বাঁচিয়ে সব করতে হয়েছে, ঘিন ঘিন ও লেগেছে, রাজিব কিনা অতি সাফসুতরো মানুষ, তাছাড়া ফুল ফিলিংস ও আসে না বাইরের কোথাও। বৌর মতো আন্তরিকতা দেখায় না ওরা, টাকায় কেনা যন্ত্র যেন। ধর তক্তা মার পেরেক। কাজ শেষ টাকা দাও, চলে যাও।

সাথীকে বিয়ে করাটা ছিলো রাজিবের ফ্যান্টাসি। আগের দিনে রাজরাজারা উপপত্নী রাখতো সেই খেয়ালেই জুটিয়ে ছিলো সাথীকে। প্রথমে ভেবেছিলো উপরে উপরে খেয়ে পাততাড়ি গুটাবে। কিন্তু মেয়ে ছোট হলে কি হবে বুদ্ধির পারদ খুব উঁচুতে। পড়াশোনায় ভালো, বুদ্ধিমতিও ছিলো, তা রাজিব আগে থেকেই জানতো। তার উপর সাথীর সাথে আগের একটা সম্পর্ক ছিলো ওর, যখন ওদের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো। তখনো ফ্রি-কিক দেয়ার চেষ্টা করেছিলো বেশ কয়েকবার। কিন্তু পারে নি, সেই না পাওয়াটা আবার জেঁকে বসেছিলো মীরা যখন কনসিভ করলো তৃতীয়বার তখন। ওদের মধ্যে খোলামেলা কথা হতো প্রায়ই। ডা’র্টি-টক এ সাথী যেন পিএইচডি করা৷ কথা বললই শরীর গরম হয়ে যায় অবস্থা। মীরা যখন ব্যাস্ত গত দুই দুইটা মিসক্যারেজের ধকল সামলে পেটের বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনার চেষ্টায়, রাজিব এদিকে সাথী নামের দ্বীপটাকে আবিষ্করের নেশায় মত্ত। পরে এই দূর্দমনীয় ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে একবার সাথীকে অফার করলো সেন্ট মার্টিন যাওয়ার, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ার মতো। ঢিল টাকে ঠিকই ক্যাচ করেছিলো সাথী। রাজিব তখন নতুন নতুন গাড়ি, দামী পোশাক, দামী ফোন ব্যাবহার করতো। বাড়ির জন্য জায়গাও কিনেছে শুনছে, ব্যাবসাও ভালোই চলছিলো, ভালো না চললে এত কিছু করা যায়! রাজিবের দেয়া এটা সেটা গিফট পেয়ে সাথীর তখন মাথা নষ্ট অবস্থা। হালকা কথাবার্তাতেই এ অবস্থা? বিয়ে করলে তো রাজরানি হয়ে থাকবে ও । এ ব্যাপারটাও হালকা ইঙ্গিত দিয়েছে রাজিব বেশ কয়েকবার।

সব জানতো সাথী, থাকুক না বৌ ঘরে, তাতে কি? বাড়িতে ওর আরো তিনটা বোন আছে । সাথীই সবার বড়, ওর একটা হিল্লে হলে বাকীদের কথা আর ভাবতে হবে না। রাজিবের বৌ আছে এ দূর্বলতাকে সামনে এনে বোন গুলোর ভালো বিয়ে দিতে পারবে। সবকিছু বিবেচনায় সাথী পা বাড়ায় এ পথে।

সেন্ট মার্টিনের সেই প্রোমদ ভ্রমণেই এক রিসোর্টের বন্ধ কামড়ায় অবৈধ ভাবে প্রথম এক হয়েছিলো ওরা। তিনদিন ছিলো সেখানে। সেই তিনদিন সাথী উজার করে দিয়েছে নিজের সবটুকু, ফ্রী ট্রায়ালে টিকে যেতে। রাজিব তো সুখের বানে ভাসে যেন। দীর্ঘ খরার পরে বান ডাকে যেমন তেমনি। ঢাকায় ফিরে দেখে মীরার আবারো মিস’ক্যারেজ হয়েছে। তার মানে উপোস এর যাত্রা দীর্ঘ হবে আরো, কমসে কম দুই-তিন মাসের ধাক্কা। রাজিব সবদিক ভেবে ঐ তিনদিনে সাথীর দেওয়া স্বর্গ সুখের উপহার হিসেবে ঢাকায় ফিরার তিনদিনের মাথায় দশ লাখ এক টাকা দেনমোহরে বিয়ে করে সাথীকে।

সাথী দেখতে সুন্দরী, শক্ত শরীরের বাঁধন, ডাগর চোখ, দীঘল চুল, বিছানায় কুল প্লেয়ার। একদম যেমনটা মীরাকে পেতে চাইতো ও সেরকম। সবচেয়ে যেটা বেশী আকর্ষিত করেছে রাজিবকে তা হচ্ছে সাথীর ভার্জিনিটি। মীরা সৌন্দর্যের মানদণ্ডে কোন অংশে কম যায় না সাথীর থেকে৷ সাথী বরং একটু খটো ওর চেয়ে। কিন্তু মীরাকে বিয়ে করে একটা আক্ষেপ থেকেই গেছে রাজিবের । অন্যের এঁটো করা খাবার মীরা। এসব নিয়ে প্রথম প্রথম মাথা ব্যাথা ছিলো না রাজিবের। মীরার মতো সুন্দরীকে বিয়ে করে জীবণ ধন্য মনে হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতেই টনক নড়ে ওর, সমাজ, সমাজের মানুষ ওর চোখ খুলে দিয়েছিলো। ওরা সকলে একই এলাকার হওয়ায় মীরা,আবীর, রাজিব সম্পর্কে সকলেই জানতো। দুএকজন ইনিয়েবিনিয়ে কি সব বলতো। কেও কেও তো সরাসরিই বলে ফেলতো এসব খোলামেলা ভাবে। কিন্তু মীরা এসব ব্যাপার এড়িয়ে গেছে সবসময়। ওদের সম্পর্কের হাল বরাবরই ছিলো মীরার হাতে, আর রাজিব ছিলো ছাপোষা বিড়ালের মতো। যার কাজই ছিলো মীরার পায়ে পায়ে ঘোরা। ও কেবল ওকে পেতে চাইতো এট এনি কস্ট। তবে অনেক পরে খেয়াল হয়েছিল ওর সব। আমাদের সমাজে একটি মিথ ব্যাপকভাবে প্রচলিত, কোনো নারীর সতীত্ব আছে কিনা তা প্রমাণ করতে পারবেন, যদি তার প্রথম মিলনে রক্তপাত হয়। সেসব কথাবার্তা চলাচালি হতো যখন তখন রাজিবের হুঁশ হয় এক্কেবারে প্রথম বার যখন মিলন হলো ওর আর মীরার বিছানায় কোন রক্ত পায়নি রাজিব। তার মানে আবীরের সাথে ওর অনিচ্ছায় হওয়া অন্তরঙ্গতা চেপে গেছে মীরা?

কিন্তু এটি কি আসলেই সত্য?
এই প্রচলিত ধারনার মধ্যে এক বিন্দু সত্য নেই। সব নারীরই প্রথম সহবাসে রক্তপাত হয়না। মেয়েদের উচ্চতা এবং ওজন, দৈহিক গঠন ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, তেমনি নারীর হাইমেনের গড়ন ও আকৃতিও বিভিন্ন রকম হয়। কারো হাইমেন অনেক পুরু, কারো বা খুব পাতলা, কারো বা প্রাকৃতিকভাবেই কোন হাইমেন নেই।

অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই, হাইমেন এমনিই অপসারিত হয়ে থাকে, যেমন ব্যায়াম করলে, বাইসাইকেল চালালে, এমন কি ঘোড়ায় চড়লেও।

বিশেষ করে যাদের হাইমেন প্রাকৃতিকভাবেই পাতলা বা ছোট বা উভয়ই, তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে হাইমেনেরও অপসারিত হবার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই যে নারীর হাইমেন ছোট ও পাতলা, তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম যৌনমিলনে রক্তপাত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। উল্লেখ্য যে, যার হাইমেন একবার আপনা হতেই ছিঁড়ে গেছে বা অপসারিত হয়েছে, তার প্রথম বারের মিলনে কখনই রক্তপাত হবেনা।

এসব তো জানে না মূর্খ রাজিব। সেই আক্ষেপ দিয়েই শুরু করেছিলো সাথীর সাথে কথা বলা। এবং এই অবৈধ মেলামেশার বৈধতা ছিলো ঐ এক মিথ বিশ্বাসে।

সাথী ছিলো লোভী। ওর নজর ছিলো বড় কিছু হাতিয়ে নেয়ার। ফ্ল্যাট কিনে দিতে গান শুরু করেছিলো সেই কবে থেকে, ভুংভাং বুঝিয়ে ওকে রেখেছিলো রাজিব এত বছর, কিনে দিলো তো এই সেদিন। তবে এটাই রাজিবের ভুল হয়েছে চালে। আরো কিছুদিন মূলা ঝুলিয়ে রাখা উচিত ছিলো। যে যার উপযুক্ত না তা পেয়ে গেলে তার ক্ষমতা বেড়ে যায়। অল্প পানির মাছ বেশী পানিতে পরলে যা হয় আর কি! তারই নমুনা ওর নামে করা মামলা, আর ফলাফল তিনদিনের কারাবাস। কত বড় সাহস ! রাগে চিরবির করতে করতে একটা রিকশায় উঠে রাজিব।

(এ পর্বে ব্যাবহৃত ম্যাডিক্যাল টার্ম গুগল থেকে রিসার্চ করে সংগ্রহীত। এটা ছেলেদের ভিতরে ভিতরে একটা প্রকট সমস্যা পার্টনারের সতীত্ব নিয়ে। তাই খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন মনে করেছি)

পর্ব- ৫৪

মুরসালিন সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে কাজ শেষ করে ফোন করে ওর মাকে। ইরাবতীর তো ফোন নেই। মা’কে ফোন করে বলে-
: ” পিচ্চিকে বলো তৈরী হতে, কোথায় নাকি কি কাজ আছে বলছিলো।
মুরসালিনের মা মিসেস রেবেকা হাসি হাসি মুখে ধমক দেয় ছেলেকে, বলেন-
: “এসব কেমন কথা! ও শুনলে কষ্ট পাবে না? ”
: “মা, ভুল বলছি আমি? ও তো পিচ্চিই”
: ” হোক ছোট, ও তোমার স্ত্রী বাবা, স্ত্রীকে সম্মান করতে হয়। দেখো না তোমার বাবা কিভাবে সম্মান করেন আমাকে? মানুষ শুনলে কি বলবে বলো? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে আমরা?”
: “আচ্ছা মা হয়েছে, সরি, এখন শোন মহামান্য ভদ্রমহিলাকে বলো আমার আসতে দশ মিনিটের মতো লাগবে, তিনি যেন তৈরী হয়ে থাকেন” – বলেই কলটা কেটে দেয় মুরসালিন। রেবেকা হাসেন, মনে মনে বলেন- আচ্ছা পাগল ছেলেতো আমার।

এ পরিবারে বাবা-মায়ের সাথে ছেলেদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তারা অন্যভাবে ছেলেদের বড় করেছেন। বন্ধু হয়ে ছেলেদের পাশে থেকেছেন দু’জনই। তাইতো এত ভালো সম্পর্ক সকলের মধ্যে।

ইরাবতী তৈরী হয়ে গেলো মুহূর্তেই। বাইরে যাবে এ খুশিতে। বাইকে উঠার অভ্যাস নাই ওর। কিভাবে উঠবে, বসবে বুঝতেই পারছেনা ও। অনেক কষ্টে দু’জনের মাঝে এক পাহাড় দূরত্ব রেখে বসলো ওর পিছনে। মুরসালিন বিরক্ত চোখে একবার তাকালো লুকিং গ্লাস দিয়ে। কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছে ও। তারপর ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। ইরা ইতস্তত ভাব দেখে সাবধানে গাড়ি এগিয়ে নিলো ও। থামলো একটা সুপারশপে। কি না কি কিনলো ও। ফোনে ব্যাস্ত থাকা অবস্থায় টাকাটা ইরার হাতে দিলো পেমেন্ট করতে। ইরা পেমেন্ট করে ফিরে এলো বাইরে। বললো-
: “কাজ শেষ, বাসায় চলুন”
: ” কোন বাসায়?”
: ” কোন বাসায় মানে! আমাদের বাসায়”
: ” আমাদের বাসা…” কনফিউজড হয়েছিল মুরসালিন। বললো
: ” দুইতলায় নাকি সাত তলায়? ”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইরা ওর দিকে, তারপর হেসে বললো-
: “দুই তলা এখন আমার বাবার বাড়ি, আমাদের বাড়ি হচ্ছে সাত তলায় ”
মুরসালিন তাকিয়ে দেখলো ওর হাসিটা৷ হাসলে এক গালে টোল পরে ইরার। ও হাসলে ইচ্ছে করে গাল টেনে দিতে। কিন্তু পারে না, কেমন যেন সংকোচ হয়।

ইরা বসতে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে পরেছে মুসিবতে। কিভাবে রাখবে কিভাবে ধরবে বুঝতে পারছে না। মুরসালিন এ অবস্থা দেখে বলে-
“দাও এটা আমাকে”
ওর হাত থেকে নিয়ে হ্যান্ডেলে ঝুলায় ও। তারপর বসতে বলে ওকে। এমনি সময় একটা বাইক পাস করে ওদেরকে পেছনে মেয়েটা যেন ছেলেটার গায়ের সাথে লেপ্টে বসা। মুরসালিন ইশারা করে বলে দেখেছো কিভাবে বসেছে? মুচকি হাসে ইরা। আগের মতোই দূরত্ব রেখে বসলো ও। বাইক স্টার্ট দিয়ে একটু এগিয়েই মুরসালিন শক্ত ব্রেক করলো একটা। পরে যাওয়ার ভয়ে ইরা খামচে ধরলো ওর পাঞ্জাবীর বুকের কাছের অংশটা। একটা বোতাম খুলে গেলো সাথে সাথে। এক ধাক্কায় ইরাবতী মুরসালিনের এক্কেবারে কাছে এসে পরলো। এবার কিন্তু আর নড়তে পারলো না ও ভয়ে, চলতি গাড়ি থেকে পরে যায় যদি। ঐ সময়টুকুতে কিছু একটা হলো ইরার। বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো কিছু একটা খেলে গেলো মুরসালিনের শরীর থেকে ওর শরীরে। গাড়ি কোথাও থামলো না, একটানা চললো। বাড়ির সামনে বাইকটা থামলে ব্যাগটা নিয়ে পালিয়ে বাঁচলো যেন ইরা। মুরসালিন একটু চিন্তায় পরে গেলো। ছোট মানুষ কি করতে কি বুঝে? গাড়ি পার্ক করে বাসায় এলো ও। ঘরে ঢুকে দেখে ইরা ঘরে নেই, খুঁজতে খুঁজতে ওকে পাওয়া গেলো মায়ের কাছে। মা শুয়ে আছে ও তার পাশেই শোয়া৷ বাসায় এসে শুয়ে পরা! কাছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি, কিছু হয়তো জিজ্ঞেস ও করছেন। কেনাকাটার ব্যাগটা খাটের নিচে ছেঁচড়ে পরে আছে।

এই বজ্জাত মেয়ে ইজ্জত রাখবে না ওর, মা কি ভাববে যে ছেলের সাথে বাইরে গেলো, কি এমন হলো যে বাইরে থেকে এসেই এমনি তার কাছে এসে এভাবে পরে রইলো। লজ্জায় তক্ষুনি বাইরে বেরিয়ে গেলো ও। মনে মনে বকলো ওকে। ফোনও নেই একটা যে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে। এসব ভাবতেই বাইক বের করে আবার বাইরে গেলো মুরসালিন।

এদিক সেদিক ঘুরে বাসায় ফিরলো দেরিতে। যাতে মায়ের সাথে দেখা না হয়। মেয়ে বজ্জাত হলেও ভালে আছে। বিয়ের পর থেকে যেত রাতই হোক অপেক্ষায় থাকে এবং ও নিজে গেইট খুলে। আজও তা-ই হলো, গেট খুললো ইরা। প্রতিদিন গেইট খুলে দাঁড়িয়ে হেসে দেয়। আজ তা করলো না সোজা চলে গেলো ওর ঘরে। ইরার এমন আচরণে মনে পরে গেলো বিকেলের হার্ড ব্রেকের কথা। ব্যাপারটা যে ও ইচ্ছে করে করেছে তা কি বুঝতে পেরেছে ও। মুরসালিনের কেমন সংকোচ হয় ওর সামনে যেতে। কি করবে ভাবতেই ভুলে যাওয়ার ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলো প্রতিদিনের মতো। এটা সেটা জিজ্ঞেস করে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে ওকে। ও উত্তর দিচ্ছে, কিন্তু মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। এমন অবস্থায় ভাত দিতে বলে বাথরুমে ঢুকলো ও। কি করবে কি করবে ভাবতেই বেরিয়ে খেতে গেলো। আজ ইরাবতী খাবার দিয়ে রুমে চলে যেতে লাগলেন। মুরসালিন পিছন থেকে ডেকে বললো-
: “কোথায় যাও?”
: ” আমার ঘুম পেয়েছে ”
: “রাতে খেয়েছো?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলে ইরা। তারপর রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। মুরসালিন ভাত খায় সময় নিয়ে। ঘুমিয়ে গেলে রুমে যাবে ভাবে। নিঃশ্চয়ই বিকেলের ব্যাপারটায় আড়ষ্ট হয়ে আছে৷ এ জিনিসটার ভায়-ই পাচ্ছিলো ও। মুরসালিন ওর বন্ধু হয়ে মনের দরজায় কড়া নাড়তে চেয়েছে। এভাবে যে আড়ষ্ট হয়ে যাবে ও তা ভাবে নি একবারও। রুমে এসে ডাকে ইরাকে-
: “ঘুমিয়ে গেছো?”
কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। বেচারা মুরসালিন মনে কষ্ট নিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরে। মৃদু আলোতে একবার চেষ্টা করে ওকে দেখার। চুপিচুপি বলে- “এত কেন কষ্ট দিচ্ছো আমায়?”
কোন ভাবান্তর নেই ওর। শেষ রাতে অনেক বৃষ্টি হয়। রাতে এসি ছাড়াই ছিলো, তার উপর তুমুল বৃষ্টি। শীতে পুটুলি পাকিয়ে আছে পিচ্চি ইরা। বাথরুম থেকে এসে এসি অফ করে কাঁথা গায় দেয় ও। রুমে একটাই কাঁথা ছিলো ইরার মায়ের দেয়া নকশীকাঁথা। নতুন কাঁথার আগমনে পুরাতনটা গন। সেই কাঁথার ঢেকে দিলো ইরাকেও। ইরা ঘুমের চোখেই টেনে নিলো তা। মুরসালিন কি মনে করে পেছন থেকে আলতো করে ধরলো ইরাকে। ঘুমন্ত ইরা যেন পুটুলি হয়ে ঘেঁষে এলো ওর বুকের কাছটায়। নকশীকাঁথার উমের সাথে সাথে মুরসালিনের শরীরের উম টুকুও শুষে নিলো ইরা। প্রথমবারের মতো এত কাছে এসে চুলের ঘ্রাণে পাগল হওয়ার জোগাড় ওর। ইরার গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ এলো ওর নাকে। অনেক কিছুর ইচ্ছে হলো নারীসঙ্গ বিবর্জিত মুরসালিনের। কিন্তু সাহস হলো না। পরে
এত টুকুতেই খুশি হলো মুরসালিন। এই বা কম কি?
মুচকি হেসে অর্ধেক ঘুম পুরো করায় মনোযোগ দিলো ও ।

পরদিন ইরা ঘুম ভেঙে নিজেকে আবিষ্কার করলো মুরসালিনের আষ্টেপৃষ্ঠে। কেমন দ্যুতি খেললো ওর শরীরে। অস্বস্তিতে হাত সারতে নিলেই ঘুম ভেঙে যায় মুরসালিনের। এমন অবস্থায় দুজনই মুখোমুখি। লজ্জায় ইরার মুখ হঠাৎই আরক্ত। মুরসালিন যেন এভবে থাকাটাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইলো। তাকিয়ে রইলো ওর চোখের দিকে৷ ইরা হাসফাস করতে লাগলো। ছুটতে চাইলো ওর থেকে, মুরসালিন ও ছেড়ে দিলো সুন্দর এ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে। সকালের পর ইরাবতীর আর দেখা নাই। পরে চিরকুট লিখে যায় একটা বাক্সের নিচে। সেখানে লেখা ছিলো – “আমার কুট্টি বউটার জন্য” ইরা খুলে দেখে একটা নতুন স্মার্টফোন সেখানে। চিরকুুটটা কি মনে করে যেন গালের সাথে ধরে রাখে ইরা, এটা যেন চিরকুট না সাক্ষাৎ ওর বর মুরসালিন।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাজিব রিকশা থেকে নেমে ওয়ারীর বাড়ির মেইন ফটকে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তিনদিন আগেও এই বাড়িটা ওর কাছে এক টুকরো শান্তির জায়গা ছিলো। অথচ এখন কেন জানে না বড্ড অপরিচিত লাগছে ওর। স্বাবলম্বী মীরার কাছে রাজিব স্বামী কম ঝাড়ি খাওয়ার লোক ছিলো বেশী। এই সেই নিয়ে ধমকের সুরে কথা বলে তটস্থ করে রাখতো মীরা ওকে। হোক সেটা বাসায় কিংবা কারখানায়৷ কারখানার স্টাফ গুলো পর্যন্ত এসব দেখে পাত্তা দিতো না ওকে। যাই করতো তাতেই ঝাড়ি। সবকিছুতে তার মাতব্বরি, গোটা সংসার জীবণে মানসিক যন্ত্রণা, কাজের চাপ, দায়িত্বপর বোঝা ছাড়া কিছুই দেয়নি মেয়েটা। কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়ার কথা বললে – কাজ, খরচ আর ঘুরতে যাওয়াটা প্রয়োজন না বিলাসিতা তার একটা বিশদ সমীক্ষা দাঁড় করাতো। সেই সব শোনার পর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে ম’রে যেতো। কারখানার প্রয়োজনে ইন্ডিয়া যেতো যখন সারাদিন নষ্ট করে বাই রোডে যেতো খরচ বাঁচাতে। অথচ অল্প কিছু টাকা দিয়েই বাই এয়ারে সুন্দর মতো যাওয়া যেতো। সবকিছুতে বিশ্রী হিসাব!

রাজিব খুব চাইতো মীরার মতো সুন্দরী বউ নিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষকে দেখাতে, কিন্তু মীরার প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে “কাজ”, বিয়ের পরপর আর্থিক সংকুলান ছিলো না কোথাও যাওয়ার, কিন্তু যখন অল্প অল্প টাকা আসতে শুরু করলো মীরা তখন নিজেদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ব্যাবসা বাড়ানোর ধান্ধায় থাকলো। লোভী মেয়ে একটা!
কি হবে এত টাকা দিয়ে? মনে যদি সুখই না থাকে? সারাদিন পর মীরা বাড়ি এসেও কটমট করতো। একটা বার খবরও নিতো না খেয়েছে কিনা? কি করছে কোথায় আছে? স্বামীর সেবা নাহয় বাদই দিলো রাজিব, খোঁজখবর তো করে মানুষ। না বলতে পারতো দুটো শান্তির কথা, রাতের বেলা না পারতো তার শরীরে হাত দিতে৷ ইন্টিমেট হওয়ার ব্যাপারে তার ইচ্ছাই শেষে কথা। যেমন করে পেতে চাইতো ও মীরাকে, তেমন করে পেতো না। লাইফে না ছিলো ফ্যান্টাসি না ছিলো রোমান্স। ছিলো শুধু টাকার হিসেব আর বড়লোক হওয়ার ধান্ধা। তারপর রাজিব বুঝে গেলো ওর ভাব, নিজের মতো করে থাকতে শুরু করলো৷ গা বাঁচিয়ে চলার শুরু সেখান থেকেই। থাক তুই তোর পোদ্দারি নিয়ে।

প্রথমে শুরু করলো ডোন্ট কেয়ার মুড চালু করে। মীরা অসুস্থ, কারখানায় যেতে পারে নি- ডোন্ট কেয়ার, অসুস্থতার তিনদিন, ডাক্তারের কাছে নিতে হবে- ডোন্ট কেয়ার, ও বাইক কিনবে বলে ঠিক করেছে অথচ মাসের শেষ মালপত্র আনার টাকা নেই-ডোন্ট কেয়ার। মীরা বিরক্ত ছিলো ওর আহাম্মকি চালে। এত প্রেসারের পর ওর এসব আহাম্মকি, মাল কিনতে গিয়ে ভালো ভাবে চেক করে না। বস্তায় উপরে ভালো মাল থাকে ভিতরে ঝুট ভরা থাকে। এসব না দেখেশুনেই কিনতো, ফলে বড় অংকের টাকা লোকসান হতো। এক কাপড় আনতে বললে অন্যটা নিয়ে আসা, কোথাও কোন বিষয়ে কারো সাথে কথা কাটি হলে সবসময় প্রতিবাদ না করে নিরপেক্ষ থাকা, ব্যবসায় মন নেই অথচ নাম করার স্বপ্নে বড় কাজের অর্ডার পেতে টেন্ডার পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়া, অথচ ঐ বিশাল কাজ করার মতো ম্যান পাওয়ার, যন্ত্রপাতি, টাকা ওদের নেই। শেষে ঐ ইচ্ছা মাঠেই মা’রা পরতো৷ স্টাফদের বেতনের টাকায় হুট করে কখনো বাইক কিনে নিয়ে আসলো, কিংবা নতুন মোবাইল। পাওনা টাকা আদায়ে হয়ে যায় দয়ার সাগর। আয়ব্যয়ের হিসাবে কোন হুঁশ থাকে না তার। কারখানা চালাবার টাকা নেই অথচ তার ঘুরতে যেতে হবে, নতুন কিছু কিনতে হবে। মোট কথা আগাগোড়া অপরিনামদর্শীতায় মোড়া এক মানুষ রাজিব । ওকে দিয়ে চার আনা পয়সা কোথাও থেকে আসা তো দূরের কথা, মাতব্বরি খাটিয়ে উল্টো টাকা নষ্ট করতো। মীরা তাই একটু একটু করে কারখানার টাকাপয়সা নাড়াচাড়ার ক্ষমতাটা ধীরে ধীরে খর্ব করে। আর এদিকে কি সুন্দর থিউরি বের করেছে রাজিব মাতব্বরি করে মীরা, ফোনে খোঁজ নেয় না, কটমট করে। অথচ রাজিব কি নিতো মীরার খোঁজ? মেয়ে হয়ে টাকা পয়সার ডিল করতো, বায়ারদের সাথে মিটিং, পাওনা টাকা আদায়, যে মানুষটা সারাদিন গাধার খাটুনি খাটে এতকিছুর পরও তার থেকে সুন্দর ব্যাবহার আশা করা! ও কি রোবট! আর কি বললো রাজিব লোভী মেয়ে! হ্যা মীরা বড্ড লোভী, তাইতো নিজেদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে, বেকার, লম্পট, দায়িত্ব জ্ঞানহীন রাজিবকে বিয়ে করে ভুল যে করে নি তা প্রমাণ করতে দিনরাত এক করে দিয়েছে। অথচ ও স্বীকারই করলো না এই হিসাব, মিতব্যয়ীতা মীরাকে কোত্থেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আচ্ছা ওর কি মনে নেই ওর ব্যায়বহুল চিকিৎসার কথা? এর অর্থের জোগান দিতে গিয়ে কি ত্যাগ করেছিলো মীরা তা হয়তো কোনদিনই জানবেনা এই অকৃতজ্ঞ রাজিব। নাই বা জানুক, ও যে কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছে সেসব দিনে তা তো দেখেছে, এত সহজ সবকিছু ভুলে যাওয়া! এইযে ওদের থাকার ফ্ল্যাট, গাজীপুরের বাড়ি এগুলো কি আদৌ সম্ভব হতো ওর মত অমিতব্যয়ী হলে, হতো না। এসব বুঝিয়ে আর কি হবে? এ যেন অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করা ।

সাতপাঁচ ভেবে ভিতরে গেলো রাজিব৷ লিফটে করে পৌঁছে গেলো ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায়। কলিংবেলে চাপ দিলো ও, কলিংবেল বাজছে কিন্তু কেও আসছে না গেইট খুলতে। প্রথমে ভেবেছিলো কেও নেই ভিতরে, চলে আসতেই নিয়েছে এমন সময় স্টিলের কিছু একটা পরার শব্দে আবার ফিরে এলো ও। তারপর একটানা বেল বাজালো ও। ওর রাগ উঠতে শুরু করলো। সেই রাগ কলিংবেলের শব্দের সাথে জানান দিলো ভিতরের মানুষগুলোকে। অবশেষে আলুথালু ভাবে গেইট খুললো সাথী, গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বললো-
: “কি হইছে? এখানে কি তোমার ?”
“এখানে কি?! ” কথাটা শুনে মেজাজের পারদ উঠে গেলো উঁচুতে, কিন্তু মাথা এখন গরম করা যাবে না, তার সেই হুঁশ হারায়নি রাজিব তখনো। ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করলে গেইট আগলে দাঁড়ায় সাথী, বলে-
: “কোথায় যাচ্ছো?”
রাজিব না শোনার ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকায়, ওকে ঠেলে ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করে। সাথী ততই বাঁধা দেয় ওকে ভিতরে ঢুকতে, বলে-
: ” কেন আসছো তুমি? এটা আমার বাড়ি”
এবার রাজিব মুখ খোলে, শান্ত কন্ঠে অসহায় মুখো ভঙ্গী করে বলে-
: “আর আমি?”
: “তুমি কি? কোন সম্পর্ক নেই আমার তোমার সাথে”
: ” নাই বললেই তো নাই হয়ে যায় না” বলে সাথীকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে রাজিব।

ভিতরে ঢুকে নিজে যেন জীবণের সেরা ধাক্কাটা খেলো ও ৷ পায়ের নিচের মাটিটা দুলে উঠলো হঠাৎ। রাজিব দেখে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ধরে ওর সাদা, ফিরেজা রঙের চেক ছাপার সাত হাত লুঙি পরে দাড়িয়ে আছে লম্বাচওড়া একজন। ভুত দেখার মতো চমকে গিয়ে রাজিব বলে-
: “উনি কে?, এখানে কি করছে?”
সাথী যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে রাজিবের প্রশ্নে, মাথাটা মুহুর্তে গরম হয়ে যায় রাজিবের, এতক্ষণে ভালো ভাবে খেয়াল হয় সাথীর আলুথালু বেশ, শরীর কাপড় ঠিক করতে করতে গেইট খোলা এসব কিছুর মানে বুঝতে দেরি হয় না ওর, তেড়ে গিয়ে সাথীর চুলের মুঠি ধরে রাজিব। মুখ বিকৃত করে বলে-
: “বে’শ্যা মা’গী আমারে জেলে দিয়ে তুই ঘরে ব্যাডা ঢুকাইছিস?”
যতটা বেগে রাজিব তেড়ে গেছে সাথীর দিকে, তারচে
বেশী বেগে লোকটা রাজিবের দিকে এসে মারতে থাকে রাজিবকে। এলোপাতাড়ি মার যাকে বলে।চোখেমুখে, বুকেপিঠে কোথাও বাদ নাই, লোকটা যেন চোর ধরেছে হাতেনাতে। তাই এমন উদম প্রহার,
মাথায় লাগা আঘাতটা বেশী জোড়ালো ছিলো। ব্যাথায় রাজিবের চোখ ঘোলা হয়ে আসে, কেন জানি না ঘুম পাচ্ছে ওর, গত কয়েকদিনের মানসিক, শারীরিক কষ্টের সাথে এই মারধরের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার। একটানা মারের পর শার্টের কলার ধরে ফোন করে কাদেরকে যেন, সাথী লোকটাকে কাতর গলায় বলে-
: “ছেড়ে দাও ওকে, শুধু শুধু ঝামেলা কেন করছো”
লোকটার আচরনের চেয়ে সাথীর কথা বলার ভঙ্গিতে বেশী অবাক করলো রাজিবকে, ওর কথার ধরনই বলে দিচ্ছে এ লোক ওর হঠাৎ পাওয়া না। বহুদিনের চেনাজানা না হলে এমন গলায় কথা বলা যায় না। ঐ অবস্থায়ই রাজিব বললো –
: “এই ছিলো তোর মনে, আমি এত সব করলাম তোর জন্য, আর তুই ফুর্তি করস অন্য ব্যাডা নিয়া” যতটুকু সম্ভব গলা চড়ানোর চেষ্টা করলো ও, কিন্তু তা শোনালো হাস্যকর।
এ কথা শুনে লোকটা তার শক্তপোক্ত হাত দিয়ে চড় দেয় রাজিবকে একটা। একহাতে ওর কলার ধরে রেখেছে তাই চড়টাই দিতে পারলো। ঠোঁটের কোণ ফেটে র’ক্ত পরতে শুরু করে সাথে সাথে। শক্ত হাত আর মার দেয়ার ধরনই বলে দেয় এই হাত মারধোর করায় অভ্যস্ত। সাথী লোকটার কাছে গিয়ে বলে-
: প্লিজ সাকলায়েন, ছেড়ে দাও ওকে, ওকে মেরে কি লাভ ওতো এমনিই ম’রে আছে। ডিভোর্স তো দিয়েই দিয়েছি, শুধু কেন মারধোর করে সময় নষ্ট করছো, বলে মিহি একটা হাসি হাসে ও রাজিবের দিকে তাকিয়ে। কিছুদিন আগেও এ হাসিতে বুকে ব্যাথা লাগতো রাজিবের, এত সুন্দর! অথচ আজ ঘৃণা লাগছে দেখে। হঠাৎ মাথায় ঐ নামটা ঘুরতে থাকে সূক্ষ্ম যন্ত্রণার মতো।

সাকলায়েন,
সাকলায়েন….
নামটা পরিচিত মনে হয় রাজিবের। মার খেয়ে আধমরা হলেও মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে নামটা। এ নাম বহুবার রাজিব সাথীর মুখে শুনেছে। কারন সাকলায়েন ওর ভার্সিটির বড় ভাই ওরফে রাজনীতি করা নেতা। রাজিব বিছানায় সক্রিয় হলেও হার্টের ঐ অপারেশনের পর শারীরিক ভাবে একটু দূর্বল। তাই এত ধকল সইলো না ওর শরীর। সাকলায়েন কে তা
মনে পরতেই জ্ঞান হারায় রাজিব।

চলবে…….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৬.
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরাকে ফোন করা হয়েছিলো হাসপাতাল থেকে। মীরা ফোনই রিসিভ করে নি। উপায় না দেখে মিলনকে ফোন করেছিলো রাজিব। মিলন এসেছে হাসপাতালে। রাজিবের অবস্থা দেখে চোখকে বিশ্বাস হয় না ওর এমনি অবস্থা। দীর্ঘদেহী, সুন্দর ছেলেটা পোঁতানো মুড়ির মতো চুপসে গেছে কেমন। মাথায় চুল কেটে সেলাই করতে হয়েছে, ঠোঁটের কোণা ফেটে লালচে হয়ে আছে, চোখের নিচে কালশিটে পরেছে। পুরো সাদা মুখটা লালচে হয়ে আছে। যন্ত্রণায় পুটুলি পাকিয়ে আছে বেডের এককোনায়। যেন অন্য কারো জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ও। ডাক্তার ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জন্য অবজারভেশনে রেখেছে। মিলন আসার পর MRI করানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। মিলন বন্ধু হিসেবে টাকাপয়সা না হয় দিতে পারবে কিন্তু ওর চিকিৎসার সাথে সেবাটাও দরকার। উপায়ন্তর না দেখে মীরাকে কল দেয় মিলন। মিলনকে রাজিবের বন্ধু হিসেবে চিনে মীরা কিন্তু শখ্যতা তেমন নেই। মীরা মিলনের নম্বর দেখে খালাকে দিয়ে কল রিসিভ করায়। মিলন ফোন রিসিভ হলে জিজ্ঞেস করলো কে? খালা তার পরিচয় দেন। মিলন রাজিবের কথা তুলতেই মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে খালা বলেন-
: “খালায় তো দেশের নেই, ভারতে গেছে, আসবো কাল পরশু নাগাদ”
কবে আসবে? মিলনের এ প্রশ্ন করার অপেক্ষা না করেই কথাগুলো বলে দিলেন তিনি একটানে, মুখস্থ পড়ার মতো। মিলন ঘাগু লোক ওর বুঝতে বাকী থাকলো না কিছু। নিজের ফোন রেখে বিদেশ যাবে মীরা? এসব তো বাচ্চা-পোলাপান ও বুঝবে। ব্যাপারটা বুঝে নরম গলায় মিলন বললো দেখেন –
: “লোকটা অসুস্থ, বিছানায় পরে আছে, ওর এখন সেবা দরকার। ভুল ও করেছে ঠিক কিন্তু এ সময়টা ভুল ঠিক বিচারের না। আত্নীয়, পরিবার থাকতে ও কষ্ট পাবে সেটা ঠিক কথা না”
পিত্তি জ্বলে উঠে মীরার, পরিবার! আছে না আরেকটা, দিক তাদের ফোন, করুক তারা সেবা, আমি কেন? মীরা তো জানে না, আরেক পরিবারই তার এ দশা করেছে।

তবে শেষ পর্যন্ত খালাকে পাঠায় মীরা। খালা হাসপাতালে গিয়ে অবস্থা দেখে ভিমড়ি খায়। এ কি অবস্থা রাজিবের! অনেক পরে রাজিবের জ্ঞান হলে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে মার খাওয়ার কথা, কথাগুলো যেথেষ্ট মায়া মাখানো ছিলো। কিঞ্চিৎ অসহায়ত্ব মিশাতেও ভুলে নি রাজিব। মাজেদা খালা হেসেছে। মনে মনে বলেছে – “কোন কাম হইতো না”

মাজেদা খালা পরদিন সকালে যখন বাড়ি এলো খাবার আনতে, রাজিব আকুতির স্বরে জিজ্ঞেস করে কোথায় যায় সে? হেসে বলেন- “পালাই না আমি, খাওন আনতে বাড়িত যাই” বাসায় ফিরে বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসেন তিনি। শক্ত খাবার খাওয়া নিষেধ তাই ওর জন্য নরম খাবারও তৈরী করে আনেন তিনি। মিলন এসেছিলো দেখে গেছে ওকে। লোকটা এ সময় ওর পাশে না থাকলে ম”র’ণ ছিলো রাজিবের।

তৃতীয় দিন বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়া হয় রাজিবকে। মাজেদা খালা দুপুরে চলে গেছে বাসায়। যাওয়ার আগে পানের বক্স, রুমাল ইত্যাদি যখন গুছচ্ছিলেন তিনি, বিছানায় শেয়া অবস্থায় “আমায় নিয়ে যাবেন না?” রাজিবের এমন কাতর প্রশ্নে মৃদু তাচ্ছিল্য মাখা হাসি হাসেন, বলেন- “আপনারে যে তিনদিন সেবা করছি, এট্টুকি অর্ডার ছিলো, বাসায় নিয়া যাওনের অর্ডার নাই” এ কথাটুকু শিখিয়ে দেয়নি মীরা, মাজেদা খালা নিজ থেকেই বলেছেন। তিনি চলে যাবার পর একঝাঁক ছেলে নিয়ে হাসপাতালে আসে সাকলায়েন, সাথে সাথীও। তিন ধাপে ফাউন্ডেশন মেখে সেজেছে সাথী৷ ড্রেসের সাথে মিলিয়ে আইশ্যাডো, আইলাইনার, এমনকি আইল্যাশও পরেছে । কায়দ করে কন্টুরিং ও করেছে মুখের মেদ আর ডাবলচিন ঢাকতে৷ দামী জমকালো একটা ড্রেস পরেছে। পারফিউমের উগ্র গন্ধে ধুপ করে মাথা ধরে যায় রাজিবের। এমন সাজপোশাকে কেও হাসপাতালে আসে? আসেপাশের বেডের লোকগুলো তাই বলছে। বেশী সময় নেয়নি ওরা দুটো কাগজে বেশ কয়েকটা সই নিয়েছে ৷ কিসের কাগজ? কেন সই করবে ও? এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে নি ও। চুপচাপ সই করে দিয়েছে। দুটো কাগজের একটা ছিলো ফ্ল্যাটের দানপত্র, আরেকটা ডিভোর্স। সবই তো গেলো ওর, হারানোর কিছুই নেই৷ যাওয়ার আগে সাথী রাজিবের গালে আদর করে থ্যাংকস্ দিয়ে যায়। কি নির্মম আদর!

ওরা চলে যাবার ওর রাজিব মিলনকে ফোন দেয় ওকে বাসায় নিয়ে যেতে। অজানা কারনে এসব ঝামেলার ব্যাপার এড়িয়ে না গিয়ে ওকে নিজের বাসায় নিয়ে যায় মিলন। “দেয়ার আর নো ফ্রী লাঞ্চেস ইন ওয়ার্ল্ড” কি ভেবে যেন এ কথাটা মাথায় আসে হঠাৎ রাজিবের। মিলন যে শেষ পর্যন্ত ওকে নিজের বাড়ি নিতে আসবে তা ভাবতে পারেনি রাজিব। থাকনা মিলনের কেন স্বার্থ, কিংবা স্বার্থের উপরে ভালোবাসা। অভাবনীয় ব্যাপার তো কম হলো না এ কয়দিনে। মনে মনে এমন অনেক অভাবনীয় কিছুর প্রস্তুতি নেয় ও, ভালো মন্দ দুটেরই। কারন ও টের পেয়েছে, পাপ আর অন্যায়ের পাল্লাটা ওর বড্ড ভারী।

————
পুরোদিন কাজের প্রেসার ছিলো মুরসালিনের । ব্যাংক থেকে টাকা তোলা, সেখান থেকে ফিরে ঢাকার বাইরে নতুন একটা জায়গায় যেতে হয়েছে মাল নিয়ে। পরিচিত হতে মালাগুলো অন্য কাওকে দিয়ে না পাঠিয়ে নিজেই গেছে মুরসালিন। বড় পার্টি, ভবিষ্যতের জন্য সুসম্পর্ক দরকার। বিপত্তি বাঁধে দুপুরের দিকে মাল পৌঁছে ফেরার সময়। ফোনটা হাত থেকে পরে পাওয়ার অফ হয়ে যায়। অনেকবার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। অনেক বছর বয়স হয়েছে ফোনটার। বাস ধরার ব্যাস্ততায় ব্যাপারটা যে কাওকে জানাবে তাও ভুলে গেছে ও। দূরের পথ ঢাকায় ফিরতেও লম্বা সময়ের বাস জার্নি। সারাদিনের ক্লান্তি থাকলেও গত রাতের ঘটনাটা বারবার আলোড়িত করেছে ওর মনকে। মনে মনে ভাবে “ভাব ভালোবাসা বুঝে না এমন একটা ভাব, অথচ জড়িয়ে ধরলে অস্বস্তিবোধ করে, আবার মুখ দেখাতে লজ্জাও পায়! ”
এসব ভাবতেই দীর্ঘ যাত্রাটাকে যেন বড় মধুর লাগে ওর। কারখানা, মার্কেট, ব্যাংক, স্টাফ, তাগাদা, টাকাপয়সা এসবের দখলে ওর জীবণ। দীর্ঘ বাস জার্নি একটু যেন ফুরসত দিলো ওকে ইরাবতীকে ভাবার। ইরাবতীর ছোট ছোট রাগ, অভিমান, যত্ন, অজ্ঞতা, লজ্জা পাওয়া, অস্বস্তির প্রকাশ, দায়িত্ব ফলানো কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না মুরসালিনের। তবে দুজনের মাঝে ক্ষীণ একটা দূরত্বের বসবাস। কিভাবে ঘুঁচাবে ও এই দূরত্ব?

বাসটা যখন পাশের ক্ষেত, কখনো নদী, কখনো বিশাল আকাশ পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, ইরার কাছে পৌঁছানোর আকুলতা যেন আরো বাড়ে, এ আকুলতাকে আরো দীর্ঘায়িত করে গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি। কি এক বিশেষ কারনে ইন্জিন থেকে ধোঁয়া বেড়িয়ে বিকল হয় বাস। ঢাকায় তো ফিরতেই হবে, এদিকে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, উপায় না দেখে বাস থেকে নেমে অন্য বাস ধরে ঢাকায় পৌঁছাতে।
ভেঙে ভেঙে আসতে গিয়ে বেশ রাত হয়ে যায়। জার্নির ধকল, ক্লান্তি তার সাথে ক্ষুধা কাতর করে দিচ্ছে ওকে। কখন বাড়ি পৌঁছাবে এ এক তাড়না। কখন দেখবে সেই মুখ সেই মধুর অপেক্ষা। বাড়ির কাছে এসে এক মুহূর্তে সব ক্লান্তি উবে যায় বাষ্পের মতো। চনমনে একটা মুডে ঘরে ফিরে মুরসালিন। কলিংবেল চাপার সাথে সাথে গেইট খুলে যায়, যেন দরজার ওইপাশে কলিংবেলের শব্দ শুনে গেইট খুলতে কেও দাঁড়য়েই ছিলো। হাসি হাসি মুখে তাকায় ও প্রতিদিনের মতো, না ইরাবতী দরজা খুলে নি আজ, দরজা খুলেছে ওর বাবা মুখলেস সাহেব। তার মুখে ঘোর অমানিশা, তাকে দেখে হাসি মিলিয়ে যায় মুরসালিনের, জবাব দেওয়া ভঙ্গিতে বলে-
: “গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো, তাই….”
রাগী গলায় বলেন – “একটা ফোন তো করবে” গেইট আটকে ছেলের পিছু পিছু আসেন তিনি, ওয়াকিং স্পেস পেরিয়ে মুরসালিন দেখলো বাড়ির সকলে ড্রইং রুমে বসা, ওর বাবা ফোন খুঁজে কল করেন ওর মেঝো ভাইকে, বলেন- “হ্যালো মুস্তাকিম, বাসায় এসে পর, তোর ভাই বাড়ি ফিরছে”

মুস্তাকিম খুঁজতে গেছে ওকে! তাদের দিকে না তাকিয়ে ঘড়িতে দেখলো মুরসালিন। রাত দেড়টা! এত সময় কখন হলো? ঘড়ি থেকে চোখ নামিয়ে চোখ গেলো ইরার দিকে। চোখমুখ ফোলা ওর, চোখ পরতেঔ কেমন একটা মুখ করে ঘরে চলে গেলো ও। এরমধ্যে ওর মা মিসেস রেবেকা শুরু করলো বকা- “কেমন ননসেন্স তুমি, দুপুর থেকে ফোন বন্ধ, একটা বার ফোন করে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি, নতুন জায়গায় গিয়েছে, তার উপর ফোন বন্ধ এতগুলো মানুষ চিন্তায় শেষ” রাগে গজগজ করে তার রুমে চলে গেলেন তিনি, ওর বাবাও গেলো তার পিছুপিছু। ছোট ভাই দুটো ঘরের দিকে কি এক ইশারা করে চলে গেলো। এবার ও বুঝলো ইরার চোখমুখ ফোলার কারন। হাতের ব্যাগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে ওর ঘরে যায় মুরসালিন। কোথাও নেই, বাথরুমের দরজা ভেজানো, এরপর বারান্দায় যায় ও। গিয়ে দেখে এক হাতে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আরকে হাতে চোখ মুছছে ইরা।

কিছু সময় মৌণ থেকে কথা গুছাতে থাকে ও, আসলেই গাধামি হয়ে গেছে ফোন না করায়। ইরার কাছে যায় ও, ওর কাঁধে হাত রেখে বলে- আসলে…. কথাটা শুরু করতেই মুরসালিনের বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে থাকে ইরা, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুরসালিনকে, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে ও, এরপর শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বলতে –
” আমার বাবা যেদিন মা’রা গেলেন, এমনি ফোন বন্ধ ছিলো সারাদিন, চিন্তায় অস্থির হয়ে বসে ছিলাম আমরা সকলে। কোথায় গেলেন তিনি, তার সম্ভাব্য হিসেব করলাম সবাই । কিন্তু একটা বারের জন্য ও আমরা কেও ভাবি নি মা’রা গেছেন তিনি। ব্যবসার কাজে রাজশাহী গিয়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক, তার ফোনটা হয়তো ভিড়ের মধ্যে চুরি করে নিয়ে গেছে কেও, মানিব্যাগও পাওয়া যায় নি, সেটাও কেও হাতিয়েছিলো হয়তো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর দীর্ঘ রাত। আমাদের কাছে খবর এলো শেষ রাতে। ভাগ্যিস পকেটে একটা মানি রিসিট ছিলো। সেই সুবাদে খবর পেয়েছিলাম। বিশ্বাস করেন আমরা কেও একবারের জন্যও ভাবিনি বাবা মা’রা গেছেন। আজ দুপুর থেকে ফোন করছি যেমন আমি তেমনি মা, বাবা, ভাইয়ারা। কেওই পাচ্ছি না আপনাকে। সকলে শান্ত থাকলেও আমি পারিনি। কারন বাবার স্মৃতি আমাকে তাড়া করছিলো পুরো সময় জুড়ে। আমার কেবলি মনে পরছে ঐ দিন, সেসব কথা। কেন আপনি একটা বারও ফোন করে জানালেন না, কেন?

মুরসালিন পাথর হয়ে জড়িয়ে আছে ওকে, কথা বলবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না ও। ইরাবতীর রাগ দেখেছে, অজ্ঞতা দেখেছে, লজ্জা দেখেছে, যত্ন দেখেছে। বুকের মধ্যে ওর জন্য যে এত ভালোবাসা লুকানো তা দেখেনি। এই বন্ধ ফোন, বিলম্বিত যাত্রা ইরার লুকিয়ে রাখা ভালোবাসার ডালাটা যেন খুলে দিলো এক পলকেই। নিজেকে বড্ড সুখী মনে হয় মুরসালিনের, ইরাকে হঠাৎ-ই লোমশ হাতজোড়া দিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওর সুঠাম বাহুতে, কারন এমনি ভালোবাসায় ও ডুবে থাকতে চায় আরো কিছুক্ষণ….

চলবে….

প্রিয় ভুল পর্ব-৪৯+৫০+৫১+৫২

0

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

উদ্দ্যোক্তাদের ঐ সম্মেলন থেকে আসার পর থেকে মীরার মাথায় কেবল বিজনেস শুরু করার পোকা কিলবিল করতে থাকে। কিন্তু বিজনেস শুরু কর তো মুখের কথা না। প্রচুর ক্যাশ টাকার দরকার। এ মুহূর্তে ওর কাছে কোন ক্যাশ নেই। মাল এক স্লট আসছে তো আরেক স্লটের অর্ডার করে রাখতে হচ্ছে। সেটা বিক্রি হতে হতে পরবর্তী স্লট মাল কিনবার টাকা গোছগাছ করতে হচ্ছে। আশার কথা এই যে ওদের আউটলেটে সারা বছরই টুকটাক ভালোই বেচাকেনা চলে। ইন্ডিয়ার প্রোডাক্ট বেচা বিক্রি তো চলছেই, সাথে যুক্ত হয়েছে থাইল্যান্ড আর চায়না থেকে প্রোডাক্ট আনা। এসবের মধ্যে ব্যাগ, জুতা, কসমেটিক প্রোডাক্টও রয়েছে।

বাংলাদেশে ফেসবুক লাইভ ফিচারটা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। অধিকাংশ ফেসবুক ব্যাবহারকারীই এটাকে আড্ডা দেবার কাজে ব্যাবহার করছে। একদিন “বিভা ফ্যাশনের” ফেসবুক গ্রুপটাতে লাইভে এসে আড্ডা দিলো মীরা। কিছুটা সাই ফিল করে বেশী রাতে লাইভ হয়েছিল সেদিন। তবুও বেশ ভালো রেসপন্স পাওয়া গেলো। লজ্জা ভাঙার পর থেকে সময় পেলেই লাইভে আসতো ও। গ্রুপের মেয়েদের নানান গল্প, কথায় ভালোই সময় কাটতো । গ্রুপটা যেন ওর সেকেন্ড হোম। আস্তে আস্তে লাইভে সাজগোজের টিউটোরিয়াল দেখাতো মীরা । ও কোন মেকআপ আর্টিস্ট না, তবে নিজে যা পারতো তাই শেয়ার করতো সকলের সাথে। ওদের ফ্ল্যাটে যে রুমটা ডেকোরেশন করেছিলো অফিস আর ফটোবুথের জন্য সেটা এখন গোডাউনের মতো ব্যাবহার করে৷ সেখানে বসেই লাইভে গ্রুপের মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতো ও। কোন কোনদিন হিজাব টিউটোরিয়াল তো কোনদিন মেকআপ। সারাদিন ব্যাস্তসময় পার করে প্রতিদিনের ঐ এক-আধ ঘন্টাই যেন মীরার রিফ্রেশমেন্ট। ঘিন্জি এ জীবণটায় বেঁচে থাকার টনিক । আগে সময় পেলে লাইভে আসতো মীরা আর এখন শত কাজ থাকলেও সময় বাঁচিয়ে রাখে ও লাইভের জন্য। লাইভ চলাকালীন সময়ে একেক জন ওর পেছনের সেলফে থাকা প্রোডাক্টের ডিটেইল জানতে চায়। এরপর থেকে লাইভ আড্ডায় জানিয়ে দেয়া হতো আপকামিং প্রোডাক্ট সম্পর্কে।
সেই থেকে দুই একটা প্রোডাক্ট দেখানো ও স্টার্ট হয় লাইভে। সকলের থেকে ভালো রেসপন্স পেয়ে লাইভ হওয়া নিয়মিত করে মীরা। ওদের কাছে যে হিউজ আইটেম আর ভ্যারিয়েসনের প্রোডাক্ট রয়েছে যে প্রতিদিন লাইভ হলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখান থেকে এত মাল দেখানো পসিবল হয় না। কারন মালপত্র এখানে বস্তা , কিংবা বাক্স বন্দি। তাই রাতের গেডাউন থেকে লাইভ করার বদলে লাইভ শুরু হলো দিনের বেলা আউটলেটে। আর ফেসবুক গ্রুপ থেকে মুভ হলো ফেইসবুক পেইজে । পেইজে তেমন রেসপন্স পাওয়া যায় নি শুরু থেকে। তবুও ওরা চালিয়ে রাখে নিয়মিত ফেসবুক লাইভ হওয়া। আর এই কনসিসটেন্সিটাই হয়েছিল মীরার ব্যাবসা সম্প্রসারণের তুরুপের তাস।

এর সব ক্রেডিট আউটলেটের স্টফ ফাহাদের। ও আগে দামী একটা ব্র্যান্ডের বসুন্ধরা আউটলেটে জব করতো। মালিকের ছেলের সাথে ঝামেলা করায় চাকরি থেকে ওকে বিদায় করে দিয়েছেন তারা।

প্রথম যখন এসেছিলো ও ছোটখাটো ছেলেটাকে দেখে কেমন যেন ভরসা পায়নি মীরা, তবে ফাহাদের উপর ভরসা না থাকলেও পাভেলের উপর মীরার ভরসা আছে শতভাগ। মীরা একজন ম্যানেজার খোঁজায় পাভেলই ফাহাদকে এখানে দিয়ে গেছে। ও নিশ্চয়ই বুঝে শুনেই ওকে পাঠিয়েছে।

ফাহাদ ক্লাস টেন পাশ একটা ছেলে। মধ্যম গড়নের ছেলেটার হাসি ভুবন ভোলানো। মুখে একটুকরো হাসি যেন লেগেই থাকে সবসময়। খুব ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল ওকে। স্ট্রাগল করা ছেলে কাজ দেখলেই বোঝা যায়৷ আউটলেটের ম্যানেজার হওয়া সত্ত্বেও যখন সামনে যে কাজ পরে দ্বিধা না করে করে ফেলে। মীরার ভালো লাগে ব্যাপারটা।

ফাহাদের বড় ব্র্যান্ডের সাথে বিভিন্ন জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় ও। ভরসা না করতে পারা ফাহাদ তার খেলা দেখাতে শুরু করলো কিছুদিনের ভিতরে। ওর পরামর্শে প্রোডাক্টের প্যাকেজিং, ট্যাগ, দাম ইত্যাদিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে হলো মীরাকে। মনে মনে মীরা বিরক্ত হলেও মেনে নিচ্ছিলো সব, ওর কাজের পরিধি বুঝতে। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে একটা মালের ক্রয় খরচ+পরিবহন খরচ+ট্যাক্স মিলিয়ে যা হয় তার বিক্রিও প্রায় সেইম। এক পয়সাও লাভ হয় না সেখান থেকে। কিন্তু এটা যে ওর একটা পলিসি ছিলো তা মীরা বুঝতে পেরেছিলো কিছুদিন বাদে৷ ওদের মেইন ফোকাস থাকে বেশী বিক্রির উপর। বাজার দখল যাকে বলে। মার্কেটে এখন প্রচুর কম্পিটিশন, সেখানে নতুন একজনের জায়গা করে নেয়া চাট্টি খানি কথা না। ফাহাদের কথা হচ্ছে আগে সব কাস্টমার ক্রিয়েট করো, তারপর সময়বুঝে পুরাতন হিসাব বুঝে নেয়া৷ মীরা কেমন যেন চোখে দেখতো ফাহাদকে। মনে মনে ভাবতো – “এ ছেলে আমাকে ডুবাতে আসে নি তো?” ওর এমন তাকানো দেখে মিষ্টি করে হাসতো ফাহাদ, বলে-
: ” এখান থেকে যে লাভ টুকু আপনি আশা করেছিলেন বা যে পরিমান টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে আপনি তা হিসেব করে রাখুন। এর দুইগুণ তিনগুণ টাকা যদি ফেরত না আনতে পারি আমি আমার নাম বদলে ফেলবো”
মীরা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে-
: “না পারলে তোমার হিসেব সোজা দুটো মাত্র খাসির মামলা, আর আমার মামলা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা শেষ সম্বলের ”
ফরহাদ বলে-
: “দুটো খাসি! মানে?”
: “আরে বুঝলে না? নাম বদলাতে ছেলেদের দুটো খাসি জ’বা’ই দিলেই হয়”
এবার ফরহাদ হেসে দেয়। বলে-
: “আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন”
: ” ঠিকাছে করলাম ভরসা, ছয় মাসের মধ্যে যদি পরিবর্তন না দেখি আমি ভিন্ন কিছু ভাববো”
: ” ছয় মাসও অনেক সময়” বলে উঠে পরে ফাহাদ।

একে একে বেশ কিছু সিগনেচার আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে “মীরা ফ্যাশন”। ফেসবুক গ্রুপ আর পেইজে দশহাজার টাকার কনটেস্ট ঘোষনা করে। এই কনটেস্টের পেস্টটি হিউজ রিচ পায়। অর্গানিক ওয়েতেই পেইজটা বাড়তে থাকে ধুপধাপ করে। এর সাথে যুক্ত হয় নির্দিষ্ট এমাউন্টের কেনাকাটার উপর ফ্রি শিপিং। এরপরের কাহিনি পুরো গল্পের মতো। সেল এত পরিমানে বাড়লো যে প্রি-অর্ডার নিতে হলো। আউটলেটে মাল ঢোকার দুএকদিনের মধ্যেই আউটলেট প্রায় ফাঁকা৷ শিপমেন্ট পৌছুতে দেরি হওয়ার কারনে প্রি-অর্ডার নেয়ার ধারনাটা যোগ হয়৷ অধিকাংশ কাস্টমাররা এ ব্যাপারে সাপোর্ট করে মীরাকে।

এদিকে রাজিব ব্যাস্ত ওর ব্যাবসা নিয়ে। ব্যাবসার যখন ডাল সিজন চলে মালিকরা তখন বেশী ব্যাস্ত থাকে। মীরাও ব্যাস্ত সবকিছু মিলিয়ে। রাতে এখন দুজন দুই ঘরে ঘুমায়। আগে বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরেই বেশ রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করতো মীরা। রাজিবের ঘুমের সমস্যা হওয়ায় মীরা এখন গেস্ট রুমে আস্তানা গেড়েছে। এটা শুধু কাজের বাহানা না, রাজিবের কাছ থেকে দূরত্ব তৈরীর একটা উপায়ও। এ ব্যাবস্থা বেশ কিছু দিন থেকে। তা প্রায় বছর খানেক তো হবেই। এতে অবশ্য কোন আপত্তি ছিলো না রাজিবের। ওর যা শারীরিক চাহিদা তা তো বাইরে থেকে পূরণ করেই বাড়ি আসছে। কিন্তু মীরা ভুলে গেছে ও যে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আবেগ,অনুভূতি, ভালোবাসা, কাম এগুলোকে একটা বাক্সে ভরে সেটাতে তালা দিয়ে চাবিটা ফেলে দিয়েছে বাস্তবতার সাগরে । ওর মনে পরে না শেষ মিলনের কথা, মনে পরে না শেষ চুমু খাওয়ার কথা কিংবা রাজিবের শক্ত সামর্থ্য বাহু দিয়ে মীরার নরম শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলার স্মৃতি। এগুলো ভাবলেই গা রি-রি করে ঘেন্নায় মনে হয় আগাগোড়া কাম মোড়া ছিলো তাতে, এতটুকু ভালোবাসাও ছিলো না সেখানে। রাজিব কখনোই কোনকিছুতে মীরার বারন মানতো না, কষ্ট হোক কি যন্ত্রনা তা দেখার সময় তার থাকতো না কখনোই, বরাবরই এগ্রসিভ ও। এটাকে মীরা ভালোবাসা প্রকাশের একটা ধরন ভাবতো। এভাবেই রাজিব ট্রেইন করেছে ওকে। যে এ যন্ত্রণা মধুর যন্ত্রণা। আমাকে তৃপ্ত করার এ কষ্টেই লুকিয়ে রয়েছে সুখ। এটাই ব্রত হওয়া উচিত প্রতিটি স্ত্রীর, স্বামীকে তৃপ্ত করা। কিন্তু মীরা ভেবে পায় না ও কবে তৃপ্ত হয়েছে। চোখ বন্ধ করে ভাবে মীরা দু-চোখ বেয়ে পানির ধারা নেমে যায়। গত নয় বছরে তৃপ্ত ও হয়েছিল একবার – “নুহাকে প্রথম কোলে নিয়ে” এটাই মনে হয় ওর জীবণের প্রথম এবং শেষ তৃপ্তি।

টুম্পা প্রায়ই বলে এখনো কেন ওর কাছেই রয়ে গেছেন আপনি। নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন, পায়ের নিচের মাটি এখন শক্ত। তবুও কেন ঐ নর্দমার কীটটার সাথে একই ছাদের নিচে থাকা। উত্তর দেয়নি মীরা। কারন ওর নিজের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু ইশ্বরের পরিকল্পনা ছিলো অন্য।

আমি জানি আপনাদেরও নিশ্চয়ই এমন কখনো কখনো হয়েছে যে আপনি কোন একটা ব্যাপারে কিছু ভেবে রেখেছেন, কিন্তু পুরো প্লট উল্টে ঘটে গেছে ভিন্ন কিছু। আপনি কি পরিকল্পনাকারী নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা এরচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী। মীরারও হয়েছিলো তাই।

ফাহাদের পরামর্শে বসুন্ধরা সিটিতে বিভা ফ্যাশনের দ্বিতীয় আউটলেট খোলার কথা চিন্তা করে মীরা। সে হিসেবেই সবকিছু গোছগাছ করে ও। কিছু টাকা ক্যাশ ছিলো বাকীটা ব্যাংক লোন। ওর নামের বাড়ির ব্যাংক লোন তো এখনো পরিশোধ হয় নি, তাই বাধ্য হয়ে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র রেখে লোন নেয় ও। রাজিব সেটা জানে। মীরা বসুন্ধরায় দোকান নেয়ার ব্যাপারে আলাপ করেছিলো রাজিবের সাথে।

যেদিন দোকানের কাগজপত্র ফাইনাল করার কথা সেদিন সকালে কিছু লোক আসে ওদের বাসায়। লোকগুলোকে ভদ্রলোক আর রাজিবের পরিচিত হওয়ায় ভিতরে বসতে দেন তিনি।

মীরা তাদেরকে জানান – গতকাল রাতে রাজিব একটা জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে গেছে। লোকগুলো এ কথা শুনে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়৷ তাদের চেহারায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ঠিক কি তা বুঝতে পারছে না মীরা। তিন’জনের মধ্যে সবচেয়ে যে বয়স্ক সে বলে- “আপনার স্বামী আমাদের থেকে মোটা অংকের লোন করেছেন। আজ দিই কাল দিই করে দুই বছরেরও বেশী সময় ধরে কেবলি ঘুরাচ্ছে। সুদ আাসলে সে টাকা এখন কোটি ছুঁইছুঁই। আমরা তিনজনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামীকালের মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আমদের না দিলে আমরা আপনার স্বামীর এগেইন্সটে মামলা করবো” কথা যা বলার ঐ একজনই বললো৷ বাকী দুজন বিরক্তি মাখ দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কথা শেষ হলে বেশ কিছু সময় বসে ভদ্রলোক উঠে পরেন, আরো কিছু বলবেন ভেবেছিলেন হয়তো, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে পারছেন না, তার উসখুস করছেন।
তার দেখাদেখি বাকী দুজনও উঠে পরলো। তারপর চলে গেলেন তারা।

মীরা সকালটা খুব সুন্দর ভাবে শুরু হয়েছিলো আজ। কারন আজ ওর বিজনেসের ইতিহাসে একটা বিশেষ দিন। কিন্তু লোকগুলোর কথা শুনে ওর খুশি মুহূর্তেই উবে গেলো। কি করলো ও এত টাকা নিয়ে৷ আর বেছে বেছে তাদের আজকেই আসতে হলো। কান্না চলে আসে মীরার। পরোক্ষণেই মীরার মনে পরে রাজিব জানে যে ওর কাছে এখন ক্যাশ টাকা আছে। ও কি ভেবেছে আমি ওকে বাঁচাবো এদের হাত থেকে এই টাকাগুলো তাদেরকে দিয়ে?

মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকে মীরা। এমন সময় ফোন আসে ফাহাদের। দশটার সময় যাওয়া কথা। এখন না বের হলে দেরি হয়ে যাবে। মীরা ফোন রিসিভ করে ফাহাদকে বলে- ” ফাহাদ একটা সমস্যা হয়ে গেছে, আমি দোকানটা এখন নিতে পারবো না, তাদেরকে তুমি না বলে দিও” -ফাহাদকে কিছু বলতে সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে কাঁদতে থাকে মীরা। সেখানে যাওয়রা জন্য তৈরী টুম্পা ভয়ে দৌড়ে এদিকে আসে মীরার কান্না শুনে, দেখে মীরা মেঝেতে বসে মুখ চেপে কাঁদছে।

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরাকে কাঁদতে দেখে টুম্পা ভীষণ অবাক হয়। “কি হলো আবার” ভাবে মনে মনে। মীরার কাছে বসে টুম্পা ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে – “কি হয়েছে আপা?”
মীরা তখনো কাঁদছে। টুম্পাকে যেন দেখছেই না ও। কিছুটা সময় মীরাকে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলে, মীরা ওড়ানা দিয়ে মুখ চেপে সোফার উপরে থাকা পেপারস গুলো এগিয়ে দেয় ওর দিকে। টুম্পা কিছুই বুঝতে পারে না। কাগজগুলো নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে ও। কাগজগুলো দেখে টুম্পাও স্তম্ভিত। কাগজ গুলোর একসেট মীরার কারখানার দলিলের ফটোকপির আর আরেক সেট ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে টাকা ধার নেয়ার চুক্তিপত্র। যেটাতে কয়েকটা লাইন নিয়ন রঙের হাইলাইটার দিয়ে হাইলাইট করা, যেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে “যদি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত না দেয়, তবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকবে”

টুম্পা স্তম্ভিত এসব দেখে। ভাবে “একটা মানুষ এত নীচ কিভাবে হতে পারে!” টুম্পার এবার রাগ উঠে মীরার উপর, রাজিবকে এসব জানাতে না বলেছিলো ও। কিন্তু মীরা ওকে সব জানিয়েছে। দোকানের বায়নাপত্র, ব্যাংক লোনের ব্যাপর সব। কারন জিজ্ঞেস করলে বলেছে – “ওর প্ল্যান হিসেবে আরো মাস ছয়েক ওর এ বাড়িতে থাকা লাগবে। এত বড় একটা ব্যাপার ওকে না জানালে ও কোন না কোন ভাবে ঠিকই জানবে, পরে দেখা যাবে অন্যের কাছে শুনে ঘরে এসে ঝামেলা করতে পারে” কিন্তু কি তার প্ল্যান তাই আজও জানলো না টুম্পা। এসব ভাবতেই ফাহাদ কল করে টুম্পাকে। জিজ্ঞেস করে –
: “কি হলো হঠাৎ করে? ”
: ” ভাইয়ার একটা ফাইন্যান্সিয়ালি প্রবলেম হ’য়েছে, তাই…”
টুম্পার কথা শুনে তড়াক করে তাকায় মীরা। বস থেকে উঠে ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আছাড় মেরে ফেলে একটা চড় মারে টুম্পার গালে। টুম্পা এক্কেবারে ‘থ’ বনে যায়। এটা কি করলো মীরা আপু! টুম্পা অবশ্য কথাগুলো তাকে খোঁচা মেরেই বলেছে, পরোক্ষ ভাবে বোঝাতে যে তিনি আবার ভুল করতে যাচ্ছেন। চড় মেরেই শেষ হয় নি, রেগে কাঁদতে কাঁদতে মীরা বলে-
: “তোর কি মনে হয় আমি পাগল? আমার এত কষ্টের টাকা আমি ঐ জানোয়ারকে বাঁচানোর জন্য খরচ করবো? হুহ্, আর নাহ্, অনেক খেলেছে রাজিব আমাকে নিয়ে ভেবেছিলাম ওকে মে’রে টুকরো টুকরো করে আমি কুকুরকে দিয়ে খাওয়াবো। কিন্তু নাহ্ খোদা আমাকে সে সুযোগ দিবে না, তিনি তিল তিল করে বিছিয়ে রাখা জাল কেটে বের করে নিলো ওকে। আমার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখলো ঐ সৌন্দর্যের মোহ দিয়ে আরো না জানি কতজনের জীবণ নিয়ে খেলার সুযোগ দেয়ার জন্য”

টুম্পা স্তম্ভিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে, হাত দিয়ে গাল ঘষছে। চড়টা মীরা জোরেই দিয়েছে। এ মুহূর্তে ওর কষ্ট পাওয়া কথা, রাগ হওয়ার কথা মীরার আচরনে।
ওর নিজেরই কত রাগ বিরক্তি রাজিবের উপর, যে রাজিব ওর নিজের কেও না, আর মীরা? মীরা রাজিবের স্ত্রী, একজন নীতিহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন, চরিত্রহীন পুরুষের স্ত্রী ও। যাকে ভালোবেসে ও ঘর ছেড়েছে, নিজের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে তৈরী ব্যাবসা ছেড়েছে, বাপটাকেও শেষ বারের মতো দেখতে পায় নি, ওর তাহলে কষ্ট কতটা।
কথাগুলো শুনে টুম্পা মীরার কাছ ঘেঁষে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলে-
: “আপা আমি সরি, আসলে আমি ভেবেছিলাম আপনি আবার ওর ফাঁদে পা দিচ্ছেন”
মীরার কান্নার বেগ যেন বেড়ে যায় টুম্পার আলিঙ্গনে৷ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। যেন তাদের পরম কারো মৃ’ত্যু খবর এসেছে।

ওদের কান্নার শব্দে নূহার ঘুম ভেঙে যায়। নূহা ঘুম থেকে উঠে কান্নার উৎস্য খুঁজতে খুঁজতে বসার ঘরে এসে পরে। নূহাকে দেখে আলিঙ্গন ছেড়ে ওকে কোলে নেয় টুম্পা। মীরা চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। মেয়েটা ওকে কাঁদতে দেখলে ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে যায়। টুম্পা মীরার কাছে এলে নূহা ঝাঁপিয়ে পরে মায়ের কোলে। চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে-
: “তোমাল কি হয়েছে মা?”
আড়াই বছরের নূহা এখন আধো আধো বুলিতে শব্দ জুড়ে বাক্য তৈরী শিখেছে। মীরা ওড়ানায় মুখ মুছে হাসি হাসি মুখে বলে- ” কিচ্ছু হয়নি মা”
মুখ কালো করে নূহা মাকে দেখে কিছুক্ষণ, তারপর বলে
: ” তোমাকে কে মেলেছে?”
এ কথা শুনে আবারো কান্না আসে ওর। এটুকু মেয়েকে ওর কষ্ট ছুঁতে পারলো কিন্তু এত্ত বড় রাজিব কখনো ওর দুঃখ বোঝে নি। অনেক কষ্টে কান্না আটকে মীরা বলে-
: “কেও মারে নি মা, চোখে পোকা পরেছে”
এর উত্তরে নূহা বলে-
: ” আমি পোকাকে মেলে দিবো এ্যা”
নূহার কপালে চুমু খেয়ে মীরা বলে আচ্ছা মেরে দিও। এমন সময় মাজেদা খালা ঘরে ঢুকে। তিনি নিচে গিয়েছিলেন কি যপন কিনতে। এসে ঘরে থমথমে পরিবেশ দেখে কাওকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, নূহাকে ডেকে বললো-
: “আসো নানু, চলো আমরা নাশতা খাই”
খালা নূহাকে কোলে নিয়ে বাসার ঐ দিকটাতে চলে গেলো। কি হয়েছে তার কোন কিছু জানতে খালার কোন তাড়া নেই। এটা তার একটা ভীষণ ভালো দিক। এ মুহূর্তে মীরা যে কি হয়েছে তা বর্ণনা করার মতো অবস্থায় নেই তা তিনি বুঝে নূহাকে নিয়ে ওকে একটু একলা থাকতে সুযোগ করে দিয়েছে। এই বুঝটাও অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ও নেই।

খালা আলে গেলে মীরার কাছের মেঝেটায় বসে ওর হাতদুটো ধরে টুম্পা। তরপর বলে-
: ” জীবন আপনাকে যে-ভাবে টেনে হেঁচড়ে সামনে নিয়ে গেছে তাতে এমন খু’ন খারাবির কথা আপনার চিন্তা করাটা, এমন কিছু ভাবা দোষের কিছু না। কিন্তু দেখেন তা করলে কি হতো? কোন না কোন ভাবে ধরা পরে জেলে যেতেন আপনি, তারপর? মেয়েটার বাবা থাকতেই তো নাই, আর মা? বাবাকে খু’নের অভিযোগে জেলে। কি পরিস্থিতি ফেস করতে হবে ওকে? বড় হওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে ও ধাক্কা খাবে এটা শুনে শুনে। ট্রমার ভিতর দিয়ে বেড়ে ওঠা যে কি পেইনফুল তা আমার চেয়ে ভালে কে জানে?”
কথাগুলো বলে কেঁদে দেয় টুম্পা। মীরা ওর কান্না দেখে সোজা হয়ে বসে৷ এতদিন ধরে একসাথে থাকা, কোনদিন টুম্পাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি ওর কষ্টের কথা, ওর যে কষ্ট থাকতে পারে তা তো কখনো ভাবেই নি মীরা। মীরা মেঝেতে ওর মুখোমুখি বসে। বলে –
: “আমি অনেক স্বার্থপররে টুম্পা। নিজের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে তোর কষ্টের খোঁজ নেই নি কখনো, এতদিন তো খুব শুনলি আমার দুঃখ গাঁথা, আজ তুই বলবি আমি শুনবো, বল বোন আমার তোর সব কষ্টের কথা আমাকে বল আজ”
টুম্পার কান্নার বাঁধ যেন আলগা হয়েছে আজ, কান্না পরিণত হয়েছে হেঁচকিতে। দৌড়ে গিয়ে পানি আনে মীরা। টুম্পাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ও। কান্না থামিয়ে পানিটা পান করে টুম্পা৷ শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বলে- আমার দুঃখ গাঁথা শোনার সময় এটা না আপা, শুধু এটুকু জানুন বাবা মায়ের করা ভুলের জন্য জীবণের প্রতিটি পদে পদে মানুষের কাছে লাঞ্চিত হতে হয়েছে আমাকে৷ কেও কোনদিন সুস্থ ভাবে বাঁচতে দেয় নি আমাকে, ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও মানুষ আমাকে মনে করিয়ে দিতো ঐ সব কুৎসিত অতিতের কথা।
তাই তো আমি সবসময় কঠিন নজরে রাখি আপনাকে, আপনি যাতে এমন কিছু না করেন যার খেসারত আমার মতো নূহাকে জীবণভর বয়ে যেতে হয়।

টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে মীরা। বলে-
: তুই আগের জন্মে আমার বোন ছিলিরে টুম্পা। তা না হলে কেন আমার জন্য এতটা ভাববি তুই? আমাকে মাফ করে দে বোন। আমার মাথা ঠিক ছিলো না তখন৷ তাই তোকে….

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই কলিংবেল বাজে। বেসিনে চোখ মুখ ধুয়ে গেইট খুলতে যায় টুম্পা৷ মীরা যায় ওর রুমের বাথরুমে। গেইট খুলে দেখে ফাহাদ এসেছে বাসায়৷ আসলে কি হয়েছে তা জানতে দৌড়ে এসেছে ও। মীরা এসে ওকে দেখে বলে- তুমি এসেছো? ভালোই হয়েছে এসেছো, তুমি মুরসালীন ভাইকে গিয়ে বলো “আমদের এ স্পেসে হবে না, আরো বেশী স্পেস লাগবে, তাদের বড় যে দোকানটা খালি হবে চারমাস পর, আমরা ওটা নিবো, তুমি যাও গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলো ব্যাপারটা। আমার শরীরটা ভালোমনা, তা না হলে আমিই গিয়ে তাকে বলে আসতাম”
কথাটা শুনে তাকিয়ে থাকে ফাহাদ কারন ঐ দোকানটার এডভান্স, ভাড়া এখনকার ঠিক করা দোকানের চেয়ে তিনগুণ বেশী। এত টাকা কোথায় পবেন তিনি চার মাস পর? ফাহাদ অবাক হলেও, টুম্পা কিন্তু একটুও অবাক হয় না, কারন এত বছরে ও ঠিক বুঝেছে মীরা না ভেবেচিন্তে কিছু বলে না।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

চিন্তা ভাবনার অথৈ সাগরে পরে যায় মীরা। এতদিন ধরে সাজানো পরিকল্পনা অনুযায়ী একটু একটু কাজ করে যাচ্ছিল ও। এখন তো পরিস্থিতি পুরোই বদলে গেছে৷ ও নিজেও ভেবে পাচ্ছেনা কি করলে কি হবে?

সকাল থেকে সেসবই ভেবে যাচ্ছে ও। রাজিবের এসব নোংরামী ভাবতেই কান্না পায় ওর। একটা মানুষ এত খারাপ কি করে হয়? কত বড় বদের বদ টাকার ঘ্রাণ পেয়েই পাওনাদারদের বাড়ি দেখিয়ে
সটকে পরেছে৷ হারামজাদা! ও কি ভেবেছে টাকা গুলো রয়েছে আমার কাছে, লোকগুলো এলেই তাদেরকে দিয়ে দিবো টাকা? হুহ্, ওকে যদি ঋণ খেলাপির অভিযোগে পুলিশ নিয়েও যায় তবুও একটা কানাকড়িও বের করবো না আমি- মনে মনে ভাবে মীরা৷

এদিকে ইরাবতীরা সাত দিনের দিন ঢাকায় ফিরেছে। মুরসালিনের শরীর সামান্য অসুস্থ, তেমন কিছু না সামান্য সর্দি-জ্বর। তাই তড়িঘড়ি করে ঢাকায় ফিরছে তারা। যাবার সময় বাসে করে গেলেও ওরা ফিরছে প্লেনে করে। এটা যে ইরার প্রথম প্লেনে চড়া তা এক ফাঁকে ও জানালো ওর শ্বাশুড়িকে। ওর শ্বাশুড়ি মিসেস রেবেকাও ইরার মতোই হেসে বললেন- “পাসপোর্ট হোক, তারপর আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো” ইরা ওর শ্বাশুড়ির কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে দেয়৷ কারন তিনি হুবহু ইরার কথা বলার ধরনে ইরাকে মিমিক্রি করেছেন। রেবেকা চোখ পাকিয়ে বলে- “কেন হয় নি?” ইরা হাসতে হাসতে বলে- “হয়েছে, হয়েছে! ”

মুরসালিন দূর থেকে দেখছে তাদের এসব, ইরা মুরসালিনের স্ত্রী কম, ওর বাবা-মায়ের পুত্রবধূ-ই বেশী। তারা আসছে থেকে ইরার দখল তাদের হাতে৷ তারা যে ওকে আগলে রেখেছে তা না, তারা চাচ্ছে ওরা দুজন আলাদা করে সময় কাটাক। কিন্তু ইরার সে খেয়াল নেই৷ ও ঘুরে ফিরে সেই তাদের সাথেই।
দেখা গেলো বীচে হাঁটার সময় ওদের দুজনকে পিছনে রেখে সবাই সামনে হাঁটছে, একটা সময় মুরসালিনের খেয়াল হয় ও একা৷ ইরা হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তাদের দিকে চলে গেছে তা টেরও পায় নি । মুরসালিন ইরার হাত ধরে পিছন থেকে সটকে পরতে চেয়েছিলো একবার। ইরাকে একবার বললো- চলো আমরা ঐ দিকটাতে যাই, গাধা মেয়েটা বলে- “দাঁড়ান বাবাকে বলে আসি” রেগে মুরসালিন বলে- ” যাও গিয়ে বলে আসো” মনে মনে বলে “গাধা একটা, ওকে ধরতে গেলেও মনে হয় বলবে দাঁড়ান বাবাকে বলে আসি” ইরা ওর রাগ দেখে সেখানেই চোখ-মুখ কালে করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুনিয়ার কিছুই বুঝে না সে রাগ দেখানোয় অভিমান করাটা ঠিকি-ই বুঝেন। মুরসালিন ওর তপ্ত মেজাজ সামলাবে নাকি বৌর মান ভাঙাবে তাই বুঝে না। এ কোন ফ্যাসদে ফেললো ওর বাবা-মা ওকে। প্রেম ভালোবাসা, স্বামী, স্ত্রী এসব সম্পর্ক যেন ওর জানার সীমানার বাইরে। সব কথা ঘুরে ফিরে শেষ হয় ওর পড়াশোনায় গিয়ে৷ বাসে থাকার সময় হঠাৎ ব্রেক ধরায় বাসটা সামনে ঝুঁকে যায়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইরা তখন গম্ভীর ভাবে ওকে জিজ্ঞেস করে – “এমন কেন হলো জানেন? ” ঠিক যেন মুরসালিনের স্কুলের জাফর স্যার। মুরসালিন মাথা নেড়ে না বলে, ইরা সহজভাবে বলে- ” এটা হচ্ছে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের চমৎকার একটা উদাহরণ। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে……. ” এর পর শুরু হয় তার লেকচার, ঐ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত আরো কিছু উদাহরণ যোগ করতেও ভুলে না সে। ও বিয়ে করেছে না স্কুলে ভর্তি হয়েছে তাই বুঝতে পারে না।
মুরসালিন ভাবে স্কুলে থাকতে সাইন্স সাবজেক্ট গুলোতে ফাঁকি দিয়েছিলো তাই খোদা ইরাকে ওর জীবণে পাঠিয়েছেন। এসব ভাবনা রেখে মুখে হাসি টেনে বলে-
: “যাও বলে আসো, না হলে আমাদের তার আবার খুঁজবে ”
ইরা এবার সহজ হয়ে বলে- ” তাই তো যেতে চাচ্ছি, আমাদের না পেয়ে যদি খুঁজতে থাকেন” মুরসালিন বলে- “যাও যাও, জলদি যাও” ইরা বলে আপনি দাঁড়ান আমি এক্ষুনি বলে আসছি” মুরসালিন হেসে দেয় ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে৷ প্রথমে ভেবেছিলো ঢং করে কথা বলে ইরা। কিন্তু এতদিনে ও বুঝে গেছে ওর কথা বলাটাই এই আদলেরই, একটু আদুরে আদুরে ভাব আছে। এসব ভেবে হাসে ও। বিয়ে, বৌ, বাবা-মা এসব নিয়ে ওর অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। চাচাতো ভাই শুভ, অভি ওরা বিয়ের পরপরই একে একে আলদা সংসারে থিতু হয়েছেন। চাচীর দু’টো ছেলে থাকা সত্ত্বেও একা ঐ বিশাল বাড়িতে থাকতেন। অসুখ বিসুখ, ভালোমন্দ দেখার কেও নেই। যদিও ওর বড় চাচী একটু অন্য ধাতের ছিলেন। সব সময় বউদের সাথে লেগেই থাকতেন। এটা এখানে কেন, ঐটা কোথায় গেলো, এটা এভাবে করে নাকি, দিনরাত কেবল ডাক দিতো কাজে। অথচ তিনি একটা বার বুঝতে চাইতেন না প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা, চেতনা, কাজের ধরনে স্বতন্ত্র । তিনি চাইতেন তার অর্ধেক বয়সের বউরা তার মতো পরিপাটি করে কাজ করুক। অথচ একটা বার ভেবেও দেখে নি যে এই বউরা তার বয়সী হলে তার চেয়ে বেশী এক্সপার্টও তো হতে পারে! সবসময় তুলনা আর কটকট। ছেলেরা এসব বুঝতে পেরে আলাদা হয়ে গেছে। প্রতিদিন ঘ্যান ঘ্যান থেকে একবার কেঁদে কেটে আলাদা হওয়াকে শ্রেয় মনে করেছে। শেষ বয়সে চাচা মারা যাবার পর চাচী
নিদারুণ কষ্ট পেয়ে মারা গেলেন। মুরসালিনের মা রেবেকা খুব কাছ থেকে দেখেছেন এসব। শিক্ষা নিয়েছেন বড় জা-এর কাছ থেকে। ছেলের বিয়ের জন্য তাই বউ না খুঁজে, মেয়ে খুঁজেছেন। আজকালকার দিনে আনকোরা মনের বৌ পাওয়া খুব টাফ। এখনকার দিনে ছেলেপেলেরা তো কলেজে নাম লিখানোর আগে অন্যের নামে মন লিখে দেয়। এসব দিক থেকে ভাবলে খুব একটা খারাপ হয়নি ওর সাথে। মনের দরজার প্রথম তালাটা খুলতে পারলেই হলো, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঢাকায় ফিরে মুরসালিনের জ্বর আরো বেড়ে যায়। ইরাবতী সব কাজে আকাইম্মা হলেও কাওকে যত্ন করায় ওস্তাদ। বড় বোন যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গলো, হঠাৎ করেই বড় হয়ে যেতে হয়েছিল ওকে। বোনের শোক কাটাতে তার জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলো ও। বোন কিভাবে বাবাকে যত্ন করতো, সময় মতো ওষুধের কথা মনে করিয়ে দিতো, অসুখ হলে খাবার খাওয়া নিয়ে জোড় করতো। এসব তখন ও করা শুরু করলো। সেই থেকে ও যত্নের ব্যাপারে খুব পাকা, আর মানুষ তো যত্নেরই কাঙাল। এ বাড়ি আসার পর থেকে সবার সাথে সম্পর্ক সহজ হওয়ার এটা বড় কারন ইরার যত্ন। সেটা হোক মানুষ কিংবা বারান্দার গাছ।

তো বাসায় ফিরে ইরা পুরো দখল নিলো মুরসালিনের। ওর মাথায় পানি ঢালা থেকে শুরু করে জলপট্টি দেয়া, সময়ে সময়ে জ্বর চেক করা থেকে শুরু করে ঔষধ খাওয়ানে সব ও একাই করতে লাগলো৷ আড়াল থেকে ইরার এ কান্ড দেখে হাসেন ওর শ্বাশুড়ি রেবেকা। মাঝরাতে হুট করেই অনেক জ্বর এসেছিলো মুরসালিনের। ইরা বাথরুমে যেতে উঠে ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখে অনেক জ্বর। বাথরুমে যাওয়া রেখে ও জলপট্টি দেয় ওকে। মুরসালিন নিজে উঠে বাথরুমে গিয়ে মাথায় পানি দিয়ে আসে। একটু পাউরুটি খেয়ে ঔষধ খেয়ে শুয়ে পরে। সকাল হলে জ্বরটা কমে মুরসালিনের। ফ্রেশ হয়ে ও অফিসে যেতে নিলে বাঁধ সাজে ইরা৷ যতই বোঝাক ওর জরুরি কাজটা সেরেই ও চলে আসবে, কিন্তু ইরা কিছুতেই মুরসালিনকে যেতে দিবে না। অবশেষে ওর শ্বশুর এসে এর সমাধান করেন। তিনি ইরার সাপোর্ট করে মুরসালিনকে অন্ততঃ আজকের দিনটা রেস্ট নিতে বলেন। উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য ছেলে এবং স্বামীর মতো বাসায় থেকে যান মুরসালিন।

সকালের নাশতা নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে ইরা, ছোটখাটো একটা যুদ্ধ জয় করেছে ও। মুরসালিন খাটে বসে আছে মলিন মুখে। ইরা খাবার সামনে দিলে বলে – ” আমি নিজে খেতে পারবো রাখো তুমি” ইরা ওর রিডিং ডেস্কে রাখে খাবারটা। মুরসালিন উঠে নিজ হাতে কিছুটা খাবার খেয়ে উঠে পরে, ঔষধ এগিয়ে দেয় ইরা৷ বলে – জানেন মায়ের ঘরের ক্যাকটাস গাছটায় ফুল ফুটেছে আজ। গাছটার বয়স নাকি পাঁচ বছর। এ গাছ গুলোতে ফুল ফোটা খুব রেয়ার৷

ইরার দিকে চেয়ে মুরসালিন বলে- ” দুনিয়ার সব বুঝো তুমি, শুধু আমার মন বোঝো না” -বলেই ড্রইং রুমে চলে যায় ও। ইরার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর কথা শুনে। মুরসালিনের বলা কথার মর্ম উদ্ধার করতে পারে না ও।

এদিকে রাজিব আছে টেকনাফে। ওর এক ব্যাবসায়ী বন্ধু বাংলো বাড়ি করেছে এখানে জায়গা কিনে, সেটা দেখতে এসেছে ও। ওর মধ্যে ঋণ, টাকাপয়সা এসব কোন চিন্তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। গতরাতে সকলে মিলে ড্রিংকস্ করে এখন ম’রার মতে ঘুমাচ্ছে। এদিকে সাথী ওকে ফোন করেই যাচ্ছে, ফোন রিসিভ করার মতো অবস্থায় নেই ও। সাথীর মাথা গরম হয়ে আছে, আজ ওর বান্ধবীর গায়ে হলুদ। অনুষ্ঠানে যেতে শাড়ি, গহনা সব আগে থেকেই রেডি করতে গিয়ে আলমারির ড্রয়ারে হাত দিয়ে দেখে সেখানে সবকিছু কেমন এলেমেলো। কি ভেবে সব গুছাতে গিয়ে দেখে ফ্ল্যাটের পেপারস মিসিং। সেটা কোথায় তা জানতে কল করেই যাচ্ছে সাথী। ওর হাত-পা কাঁপছে কিছুদিন ধরে রাজিবের টাকাপয়সার টানাটানি চলছে, তারমানে কি….?

মনে কেমন কু’ডাক ডাকে সাথীর৷ রাজিবকে বিয়ে করে সাথী না পেয়েছে সম্মান, না পেয়েছে স্বীকৃতি,
পাওয়ার মধ্যে পেয়েছে এই ফ্ল্যাটটাই। এটা নিয়েও যদি রাজিব কোন কাহিনি করে তাহলে ওর কপালে খারাবি ডেকে ছেড়ে দিবে ও। সাথী কি জিনিস তা ও এখনো টের পায় নি। ওকে বিয়ে করেছে বলে পড়ালেখার ছুতো দিয়ে লন্ডনের পাত্রটাকেও না করে দিয়েছে ও, যদিও ছেলেটা প্রায়ই কল করে সাথীকে। সাথীও ছেলেটাকে ব্যাক-আপ হিসেবে হাতে রেখেছে। বলা তো যায় না কাকে কখন কোন কাজে লাগে।

অবশেষে পরদিন শুক্রবার বাড়ি ফিরে রাজিব। সাথী ফ্ল্যাটের কাগজের কথা জিজ্ঞেস করলে কাহিনি ফাঁদতে থাকে রাজিব। ও খুব সমস্যায় পরে ফ্ল্যাটের কাগজ রেখে কিছু টাকা লোন করেছে। এসব শুনে সাথীর মাথা গরম অবস্থা। ও যা ভেবেছিলো তাই!
ও তো মীরা না যে স্বামীর সব দোষ ধুয়েমুছে সাফ করে মেনে নিবে। ও পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, এতকিছু বুঝতে চায় না ও, রাতের মধ্যে ফ্ল্যাটের কাগজ ফেরত না এনে দিলে ও মীরার কাছে সব ফাঁস করে দিবে বলে হুমকি দেয় । ও জানে রাজিবের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা মীরা। সারা দুনিয়া নষ্ট করলেও এ জায়গাটা ওর বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কারন মীরা হচ্ছে রাজিবের ঢাল। এসব নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয় দুজনে, এক পর্যায়ে রাজিব গায়ে হাত তুলে সাথীর৷ মাথা আর ঠোঁটের কাছটা ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়৷ রাগে উন্মাদ রাজিব দরজা জোরে বারি দিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। কত বড় সাহস সাথীর ওকে শাসায়! ওর জন্য কি না করেছে ও! আর ওর দূর্দিনে এমন আচরণ?

আর এদিকে সাথী ভাবে – অনেক সহ্য করেছে ও, আর না, এর একটা কিনারা হওয়া উচিত। এ অবস্থায়ই সাথী কল করে ওর ভার্সিটির এক বড় ভাইকে। সুন্দরী চরিত্রহীনদের তো ভাই ব্রাদারের অভাব হয় না। সেই বড় ভাই এ অবস্থায় ওকে হসপিটালে না গিয়ে থানায় গিয়ে মামলা করার পরামর্শ দিলেন। সাথী বুঝে গেছে যে রাজিব এখন ফতুর৷ ওর সাথে বাস করাটাকে তাই দীর্ঘ করতে চায় না ও। তাই একজন উকিলের সাথে পরামর্শ করে পরবর্তী করনীয় ঠিক করে ও। ডিভোর্স দিতে চাইলেও উকিল তাকে এ মুহূর্তে ডিভোর্সের পথে হাঁটতে না বলেন। তার পরামর্শে আপাততঃ ওর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করে সাথী।

সেদিন রাতেই নারী নির্যাতন মামলায় নিজ বাসা থেকে আটক হয় রাজিব, অবশেষে মীরার সামনে উন্মোচিত হলো রাজিব সাথীর বিয়ের রহস্য। মীরা তো ভিতরে ভিতরে আগে থেকেই ভাঙা, নতুন করে এসবের মুখোমুখি হয়ে এবার যেন গুড়িয়ে গেলো ও। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসী চোখে দেখে রাজিবকে৷

রাজিবের হাতে সময় কম, পুলিশের সামনেই তাই হাত জোর করে ক্ষমা চায় রাজিব। মীরা তো আগে থেকেই জানতো সবকিছু, তবুও যেন আরেকবার স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো এই রাজিবকে দেখে। অবশেষে পুলিশ ওকে তাদের গাড়িতে করে নিয়ে গেলো হাজতে। আর পরদিন সকালে পাওনাদারদেরা এ খবর পেয়ে ঋণ খেলাপি মামলা করে রাজিবের নামে৷

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

জ্বর কমেছে মুরসালিনের। তবে খওয়া দাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে। বিকালে বাইরে বের হতে নেয় ও। ইরা মুরসালিনকে তৈরী হতে দেখে বলে-
: “আমাকে নিবেন সাথে?”
মুরসালিন ওর দিকে তাকিয়ে বলে-
: ” একটা কাজে যাচ্ছি আমি”
: ” আমি কি একবারও বলেছি ঘুরতে যাচ্ছেন আপনি? আপনার কাজ আছে, আমারও একটা কাজ আছে, আমার একটু সুপারশপে যেতে হবে, নিয়ে যাবেন আমাকে?”
: “একজনের কাছ থেকে টাকা পাই, টাকাটা আনতে যাচ্ছি, সেখান থেকে এসে নিয়ে যাবো নি?”
: ” এক কাজ করলে হয় না? আপনি টাকাটা আনতে যেখানে যাবেন সেখানকার কাছাকাছি কোন সুপারশপে আমি নামলাম, আর আপনি টাকাটা রিসিভ করতে গেলেন?”
: ” না, কতক্ষণ না কতক্ষণ লাগে, ছোট মানুষ তুমি পরে কি করতে কি করবে, পথ হারালে বিপদ”
: “কোন সমস্যা হবে না”
: “আমি ব্যাবসায়িক কাজে যাচ্ছি, সেখানে কতক্ষণ না কতক্ষণ লাগে তার কোন ঠিক নেই, আর তোমাকে সুপারশপে রেখে আমি টাকা রিসিভ করতে যাবো এটা কোন কাজের কথা না। তুমি এখনো যথেষ্ট ছোট, তাই অনেক কিছুই বুঝো না, এই যে এখন আমার সাথে যেতে চাইছো এটাও তোমার ছোট হওয়ার পক্ষে একটা উদাহরণ”
: “আমি ছোট মানুষ না? জানেন খালামনি বলে দিয়েছেন যে এখন আমি আর ছোট নই, আমি এ বাড়ির বড় বৌ, এখন আমার অনেক দায়িত্ব। সংসার, শ্বশুর শ্বাশুড়ি, দেবরদের দেখাশোনা করা, খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব” কেমন চোখে তাকায় মুরসালিন, শান্ত গলায় বলে-
: ” আর যাকে ঘিরে এরা, সেই বরের কথা বলেনি কিছু?”
এবার মুচকি হেসে দিলো ইরা, বললো –
: “হুম, নানু বলেছেন- বরের খেদমত করতে”
: ” তো কি খেদমত করো তুমি?”
: ” করি না বলছেন? কাল জ্বর এলো আমি রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিলাম, সকালে আপনার কাজে যাওয়া পন্ড করলাম, জোর করে খাওয়ালাম, সময় মতো ঔষধ দিলাম তারপরও আপনি এ কথা বললেন?”
: ” আজ যদি মুস্তাকিম কিংবা আমার অন্য কোন ভাইয়ের জ্বর হতো তুমি কি করতে?”
: ” কেন ওনাদেরকেও এমনি টেককেয়ার করতাম”
: “গুড, দ্যাটস মাই পয়েন্ট – আমার অন্য ভাইয়েদের বেলায়ও তুমি তাই-ই করতে। আমার বাকী ভাইয়েরা আর আমি কি এক তোমার কাছে?”
এবার ইরা তব্দা খেয়ে যায় মুরসালিনের কথা শুনে, একটু ভেবে বলে-
: “না”
: ” তো?”
মাথা নিচু করে কেমন আরক্ত হয়ে যায় ইরা, মুরসালিন ইরাকে বলে-
: ” তারমানে আমি সবার চেয়ে স্পেশাল কেও, তাইতো?”
মুখ তুলে তাকায় ইরা, মুরসালিন ওর তাকানো দেখে হেসে দেয়, যা দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয় ইরা।।দাঁড়ানো থেকে বসে পরে ওদের ঘরের খানদানি পালঙ্কের এক কোণে। মুরাসলিন ওর কাছে এসে পাশাপাশি বসে, ক্ষণকাল চুপ থেকে বলে-
: ” বিয়ের সম্পর্কটার অলৌকিক একটা শক্তি আছে, কোথাকার তুমি, কোথাকার আমি বাঁধা পরলাম বিয়ে নামের বন্ধনে, এর আগে কিন্তু কেও কারো সাথে কথাও বলি নি কোনদিন, একদিন কেবল দেখিছিলাম, তবুও কবুল বলার পর এক পলকেই কেমন আপন হয়ে গেলাম আমরা তাই না?”
মাথা নেড়ে সায় দেয় ইরা, কিছু সময় মৌণ থাকে ও, ব্যাস্ত হয়ে যায় বিছানায় আঁকা বুকি করায়, তারপর বলে-
: ” আমার এখন আপনাকে খুব ভালো বন্ধু মনে হয়”

এবারো হেসে দেয় মুরসালিন, তারপর বলে –
: ” বিয়ে সম্পর্কটা তৈরী হয় ভালোবাসা থেকে, যত্ন, বন্ধুত্ব এটা ভালোবাসার একটা অংশ, তোমার স্কুলের যে বন্ধুর কথা বলেছিলে, কি যেন নাম? উম… মনে পরেছে রামিন, ও আর আমি কি এক?”

ইরা যেন চিন্তার সাগরে পরে গেলো। ওকে সহজ করতে মুরসালিন বললো-
: ” তুমি আমার সাথে এক বিছানায় শোও, রাতদুপুর যখন তখন বাইরে বেরোও, কত্ত দূরে আমরা একসাথে ঘুরতে গিয়েছি, ওর সাথে কি এমনি সব পরবে?”
ইরা মুরসালিনের গায়ে একটা চাপড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলে-
: ” ছিহ্”
মুরসালিন হেসে বলে-
: ” দেখো ওর বেলায় এসব ভেবেই তুমি ছিহ্ বলছো, তার মানে আমরা বন্ধুর থেকে বেশী কিছু, তাই কি? ”
ইরা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে, এর উত্তর জানার ব্যাকুলতা যে ওর চোখেমুখে। আর মুরসালিনের চাহনিতে সেই উত্তর দেওয়ার নেশা। যেন কোন সম্মোহনী দৃষ্টিতে আটকা পরেছে দুজন। ফোন কল এলে ওদের সংবিৎ ফিরে যেন। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মুরসালিন। আর কেমন একটা কাঁপন নিয়ে বিছানায় টলে পরে যেন ইরা। এরপর বিছানায় শরীর এলিয়ে এসব-ই ভাবতে থাকে মুরসালিনের বলা কথাগুলো।

এদিকে রাজিবের ধনাঢ্য বন্ধু মিলন ওর এ খবর শুনে দৌড়ে যায় থানায়। বিপদে বন্ধুর পাশে থাকা যাকে বলে। সেই কলেজে মিলনের সাথে পরিচয় রাজিবের। একসাথে কাজও করেছিলো রাহাতের বাবা বোরহান সাহেবের দোকানে। কাজ ছেড়ে যৌতুকের টাকায় মিলন যখন ব্যাবসা শুরু করলো এক রাজিব ছায়ার মতো ওর পাশে ছিলো, দিন ঘুরেছে আজ মিলন ফর্মে এসে গেছে। মিলনের সুখে দুঃখে সবসময় পাশে ছিলো রাজিব, তা মিলন ভুলে যায়নি। মীরা যখন একা লড়ে যাচ্ছিলো ব্যাবসা নিয়ে রাজিব তখন আড্ডা দিতো মিলনের কারখানায়। রাজিবের খুব কাছ থেকে দাঁড়াতে দেখা “মীরা ফ্যাশন” এর দেখা সকল চালচিত্রের সারাংশটুকু রাজিব মিলনকে পরামর্শ দিতো পরবর্তী করণীয় হিসেবে। মার্কেট ডিমান্ড স্টাডি করা, কোয়ালিটি মেইনটেইন, দাম কমলে মালামাল স্টক করা, পাইকারদের সাথে যোগাযোগ তৈরী করা সহ অসংখ্য পরামর্শ পেয়েছে মিলন ওর থেকে। পরোক্ষভাবে রাজিব ছিলো মিলনের মেন্টর। সে হিসেবে রাজিবকে মিলন দরকারী মনে করেছে। একটা মানুষ তো আর সব জায়গায়, সবার কাছে ওর্থলেস না, তাই না? তবে রাজিবের কিছু খারাপ দিক থাকার পরও মিলন ওর সাথে মিশে কেবল ওর ভালোটা কে-ই গ্রহণ করছে। একই সাথে কত কত বার ওরা ব্যাবসায়িক পার্টিতে, ক্লাবে, বারে, ভ্রমনে, গিয়েছে, নিজ হাতে নেশা ধরানো পানীয় ওকে ঢেলে দিয়েছে ও বহুবার, কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজে তা একবিন্দুও পান করেনি, বহু নারীতে আসক্ত রাজিবের প্রোমোদ ভ্রমণের সময় মেয়ে নিয়ে রাত কাটালেও, পাশের ঘরেই একা ঘুমিয়ে ছিলো মিলন। মিলন ব্যাক্তি রাজিবকে অপছন্দ করলেও ব্যবসায়িক জ্ঞান বুদ্ধির মানুষ রাজিবটাকে বড্ড ভালোবাসে।

থানা থেকে রাজিব অনেক অনুনয় বিনয় করে কনেস্টেবলের ফোন চেয়ে ফোন করে সাহায্য চায় মিলনের থেকে। কারন ওর জানা হয়ে গেছে ওকে এখান থেকে বাঁচাতে আসবে না মীরা। এটা ভাবাও অপরাধ ওর জন্য।

খবর পেয়ে মিলন থানায় এলে সব খুলে বলে ওকে রাজিব । অনুরোধ করে এ বিপদ থেকে ওকে বের করতে। মিলন বড় উকিল ধরে ওকে জামিনে বের করতে। উকিল জানায় ডাবল মামলা হয়েছে ওর নামে, এ অবস্থায় জামিন পাওয়া টাফ। সত্যি টাফ!. তবুও টাকা ঢাললে সবই হয়, তিনদিন লাগলো ওকে জামিনে বের করতে।

থানা থেকে বের হয়ে কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না ও, মিলন ওকে ওর বাসায় নিয়ে যায়। এতদিন যত যাই হয়েছে মীরা বলে ছিলো একজন পিছনে ঢাল হয়ে, সব কিছু থেকে বাঁচানোর জন্য। আর সেই ঢালই নিজ হাতে ভাঙতে শুরু করছিলো ও চার বছর আগে। গত দুই দিন আগে যেটা পুরোপুরি ভেঙে গেছে, ঘরভর্তি মানুষের সামনে। তাই সেটাও হারাতে বসেছে ও এখন। একে একে সবকিছু ভেবে দিশেহারা ও। ওর জীবণ অপরিনামদর্শীতা, অমিতব্যয়ীতা, বহুগামিতা এই তিন জিনিস ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্ধ ছিলো ও, মিথ্যের পর্দা দিয়ে বাঁধা ছিলো ওর চোখ। যা সাথী খুলে দিয়েছে। কি না করেছে ও সাথীর জন্য? ওর পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে, দামী দামী ড্রেস, ট্রেন্ডি জুতা, ব্যাগ, শাড়ি, কিনে দিয়েছে যখন তখন। নতুন ফোন, দামী ক্যামেরা এসব দিতে হয়েছে মান ভাঙাতে৷ প্রায় প্রতিদিনই বড় বড় রেস্টুরেন্টে চেক ইন করেছে। বছরে দুই থেকে তিন বার ইন্টারন্যশনাল ট্যুর করেছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। যার প্রত্যেকটিতে রাজিবকে গুনতে হয়েছিল অঢেল টাকা। সবশেষে ওর নামে কেনা ফ্ল্যাট! এই অপয়া ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে ছিনতাইকারী নিয়ে গেলো বিশ লাখ, গত ঈদের ব্যাবসা থেকে আয় করা টাকার সবটা খরচ হলো ওকে ফ্ল্যাট দিতে গিয়ে, তাতেও হয় নি, ঐ ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে মোটা অংকের টাকা ধার করতে হয়েছিল ওকে। যা একবছরে সুদ আসলে কোটির অংক ছুঁই ছুঁই। যারা সময় মতো টাকা ফিরত না পেয়ে ঋণখেলাপীর মামলা করেছে ওর নামে। এসব ভাবনায় কেবল বুদ হয়ে ছিলো গত কয়েকটা দিন। এখনো তাই ভাবছে কেবল। কি হলো, কি করলো ওর কার জন্য?

মিলনের স্ত্রী চা-নাশতা দিয়ে গেছে বহু আগে।চা-টাও ঠান্ডা হয়ে গেছে। গোসল থেকে এসে মিলন ওকে গম্ভীর ভাবে বসে থাকতে দেখে বলে-
: ” যা হয়েছে, তা হবারই ছিলো, সব কিছুরই একটা সীমা আছে, তুমি সব কিছুর সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলে। এখন এসব ভেবে কোন লাভ নেই, তোমার হিসেবের খাতা পুরোটাই লস”

রাজিব তখনো মাথা নিচু করে বসা, মুখ তুলে তাকানোর শক্তিটাও যেন ওর নেই। মিলন ওর কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে, মুখ তুলে তাকায় ও। এ তিনদিনে যেন ওর বয়স বেড়েছে কয়েক বছর, চিন্তায় চোয়ালের কাছটায় ঝুলে গেছে, চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ, কপালে চিন্তার ভাঁজ, তিনদিনের কারাবাস ওর পোশাকে, শরীরে, মনে দাগ কেটেছে গভীর ভাবে। তাই তো জামিনে মুক্তি পেয়েও ওর আচ্ছন্নতা কাটছে না। এখনো যেন ও কারাবাসেই রয়েছে। আচরণের আড়ষ্টতা বলে দিচ্ছে এমন আকস্মিক পট পরিবর্তন সামলে উঠতে পারেনি ও। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে মীরার মুখাপেক্ষীটা বেশী ভাবাচ্ছে ওকে। করন এ মেয়েটা অনেক করেছিলো ওর জন্য। বিনিময়ে ও মীরাকে কি ফেরত দিয়েছে?
এসব হিসেবে মিলাতে গিয়ে দু-হাতে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে রাজিব। মিলন পাশে বসে ওর, এ দিনটার অপেক্ষায়ই ছিলো ও এতদিন ধরে।

চলবে.. :