প্রিয় ভুল পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫+৫৬

0
181

#প্রিয়_ভুল
#মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ৫৩-৫৪

মীরার সাথে দেখা করবে ভেবে মিলনের বাসা থেকে বের হলেও রাজিব সাথীর বাসার দিকে রওনা হলো। সে বাসা থেকে বের হয়েই গত তিন দিনের ঘোর কেটে বাইরে বেরুলো যেন ও। এ মুহূর্তে মীরার কাছে যাওয়ার চেয়ে সাথীর সাথে কথা বলা বেশী দরকার। সাথী ওকে কিভাবে ট্রিট করে তা দেখেই সিদ্ধান্ত হবে মীরার প্রতি বিনত থাকবে ও নাকি উদ্ধত । সাথীর কথা ভাবতেই একদলা বিশ্রী অনুভূতি পাক দিয়ে উঠলো ওর মনে, “মা’গীকে কেচে লবণ দিতে পারলে গা জুরাতো” – একদলা থুথু ফেলে সাথীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো মনে মনে বলে ও। ওর জন্য এত কিছু করেছি আমি আর ও-ই কিনা শেষমেশ শ্রীঘর দেখালো আমাকে। মুহূর্তেই রাজিবের মাথা প্রচন্ড গরম হলো। এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে- “রাস্তার কুকুর দিয়ে ওকে না খাওয়ালে আমার নাম রাজিব না” রাস্তায় পরে থাকা সেভেন-আপ এর বোতলে লাথি দিয়ে মনে মনে বলে ও। ভাবটা এমন যেন লাথিটা বোতলকে না দিলো সাথীকে। বোতলটা অনেকদূর পৌঁছে দিতে পেরে শান্ত হলো ও। তার
একটু পরই ভাবনাটা বদলে গেলো ওর। মারধোর করাটা এখন বুদ্ধির কাজ হবে না, পরে হিতে বিপরীত হতে পারে। পরক্ষণেই শান্ত করে নিজেকে। ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে, এবং ও তা পারবে। এতটুকু আত্মা বিশ্বাস ওর নিজের প্রতি আছে। থাকবে না-ই বা কেন? ওকে বিয়ে করেছে তো ক’বছর হতে চললো তবুও বাচ্চা নিতে দেয়নি রাজিব, বাচ্চা নেয়া মানেই তো কয়েক বছরের জন্য বৌয়ের দখলদারি সন্তানের হাতে তুলে দেয়া৷ সব নজর এক ধাক্কায় চলে যায় সন্তানের দিকে। তার উপর এই সেই, কত উটকো দায়িত্ব নিতে হয় স্ত্রী, সন্তানের। এটা হারে হারে টের পেয়েছে ও মীরার মিসক্যারেজের সময়। প্রতিবার যখন কনসিভ করেছে মীরা রাতে রাজিবের আচরন বদলে যাওয়ার কারনে আলাদা বিছানায় ঘুমিয়েছে ওরা৷ আরে রাত মানেই তো কা’মের দিন শুরু হয়। ও বহু কষ্টে অপেক্ষায় থেকেছে রাতের পর রাত। যত্ন নিয়েছে, ধৈর্য ধরেছে মীরার রাজিবের বিছানা সঙ্গী হিসেবে তৈরী হওয়ার অপেক্ষায়৷ কিন্তু এই মেয়ে যত সুন্দর ততই ভঙ্গুর। কিছু থেকে কিছু হলেই বিছানা নিয়ে নেয়, এত্ত নাজুক। এমন চললো পরপর তিনবার। ততদিন অনিচ্ছাকৃত অপেক্ষায়ই ছিলো ও। বঃহিগামী যে ও হয়নি তা বললে পাপ হবে, সপ্তাহে এক-আধবার গিয়েছিলো। কিন্তু বাইরে গিয়ে ও বাড়ির টেস্ট পায়নি। কতজনে ছোঁয়া জিনিস, গা বাঁচিয়ে সব করতে হয়েছে, ঘিন ঘিন ও লেগেছে, রাজিব কিনা অতি সাফসুতরো মানুষ, তাছাড়া ফুল ফিলিংস ও আসে না বাইরের কোথাও। বৌর মতো আন্তরিকতা দেখায় না ওরা, টাকায় কেনা যন্ত্র যেন। ধর তক্তা মার পেরেক। কাজ শেষ টাকা দাও, চলে যাও।

সাথীকে বিয়ে করাটা ছিলো রাজিবের ফ্যান্টাসি। আগের দিনে রাজরাজারা উপপত্নী রাখতো সেই খেয়ালেই জুটিয়ে ছিলো সাথীকে। প্রথমে ভেবেছিলো উপরে উপরে খেয়ে পাততাড়ি গুটাবে। কিন্তু মেয়ে ছোট হলে কি হবে বুদ্ধির পারদ খুব উঁচুতে। পড়াশোনায় ভালো, বুদ্ধিমতিও ছিলো, তা রাজিব আগে থেকেই জানতো। তার উপর সাথীর সাথে আগের একটা সম্পর্ক ছিলো ওর, যখন ওদের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো। তখনো ফ্রি-কিক দেয়ার চেষ্টা করেছিলো বেশ কয়েকবার। কিন্তু পারে নি, সেই না পাওয়াটা আবার জেঁকে বসেছিলো মীরা যখন কনসিভ করলো তৃতীয়বার তখন। ওদের মধ্যে খোলামেলা কথা হতো প্রায়ই। ডা’র্টি-টক এ সাথী যেন পিএইচডি করা৷ কথা বললই শরীর গরম হয়ে যায় অবস্থা। মীরা যখন ব্যাস্ত গত দুই দুইটা মিসক্যারেজের ধকল সামলে পেটের বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনার চেষ্টায়, রাজিব এদিকে সাথী নামের দ্বীপটাকে আবিষ্করের নেশায় মত্ত। পরে এই দূর্দমনীয় ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে একবার সাথীকে অফার করলো সেন্ট মার্টিন যাওয়ার, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ার মতো। ঢিল টাকে ঠিকই ক্যাচ করেছিলো সাথী। রাজিব তখন নতুন নতুন গাড়ি, দামী পোশাক, দামী ফোন ব্যাবহার করতো। বাড়ির জন্য জায়গাও কিনেছে শুনছে, ব্যাবসাও ভালোই চলছিলো, ভালো না চললে এত কিছু করা যায়! রাজিবের দেয়া এটা সেটা গিফট পেয়ে সাথীর তখন মাথা নষ্ট অবস্থা। হালকা কথাবার্তাতেই এ অবস্থা? বিয়ে করলে তো রাজরানি হয়ে থাকবে ও । এ ব্যাপারটাও হালকা ইঙ্গিত দিয়েছে রাজিব বেশ কয়েকবার।

সব জানতো সাথী, থাকুক না বৌ ঘরে, তাতে কি? বাড়িতে ওর আরো তিনটা বোন আছে । সাথীই সবার বড়, ওর একটা হিল্লে হলে বাকীদের কথা আর ভাবতে হবে না। রাজিবের বৌ আছে এ দূর্বলতাকে সামনে এনে বোন গুলোর ভালো বিয়ে দিতে পারবে। সবকিছু বিবেচনায় সাথী পা বাড়ায় এ পথে।

সেন্ট মার্টিনের সেই প্রোমদ ভ্রমণেই এক রিসোর্টের বন্ধ কামড়ায় অবৈধ ভাবে প্রথম এক হয়েছিলো ওরা। তিনদিন ছিলো সেখানে। সেই তিনদিন সাথী উজার করে দিয়েছে নিজের সবটুকু, ফ্রী ট্রায়ালে টিকে যেতে। রাজিব তো সুখের বানে ভাসে যেন। দীর্ঘ খরার পরে বান ডাকে যেমন তেমনি। ঢাকায় ফিরে দেখে মীরার আবারো মিস’ক্যারেজ হয়েছে। তার মানে উপোস এর যাত্রা দীর্ঘ হবে আরো, কমসে কম দুই-তিন মাসের ধাক্কা। রাজিব সবদিক ভেবে ঐ তিনদিনে সাথীর দেওয়া স্বর্গ সুখের উপহার হিসেবে ঢাকায় ফিরার তিনদিনের মাথায় দশ লাখ এক টাকা দেনমোহরে বিয়ে করে সাথীকে।

সাথী দেখতে সুন্দরী, শক্ত শরীরের বাঁধন, ডাগর চোখ, দীঘল চুল, বিছানায় কুল প্লেয়ার। একদম যেমনটা মীরাকে পেতে চাইতো ও সেরকম। সবচেয়ে যেটা বেশী আকর্ষিত করেছে রাজিবকে তা হচ্ছে সাথীর ভার্জিনিটি। মীরা সৌন্দর্যের মানদণ্ডে কোন অংশে কম যায় না সাথীর থেকে৷ সাথী বরং একটু খটো ওর চেয়ে। কিন্তু মীরাকে বিয়ে করে একটা আক্ষেপ থেকেই গেছে রাজিবের । অন্যের এঁটো করা খাবার মীরা। এসব নিয়ে প্রথম প্রথম মাথা ব্যাথা ছিলো না রাজিবের। মীরার মতো সুন্দরীকে বিয়ে করে জীবণ ধন্য মনে হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতেই টনক নড়ে ওর, সমাজ, সমাজের মানুষ ওর চোখ খুলে দিয়েছিলো। ওরা সকলে একই এলাকার হওয়ায় মীরা,আবীর, রাজিব সম্পর্কে সকলেই জানতো। দুএকজন ইনিয়েবিনিয়ে কি সব বলতো। কেও কেও তো সরাসরিই বলে ফেলতো এসব খোলামেলা ভাবে। কিন্তু মীরা এসব ব্যাপার এড়িয়ে গেছে সবসময়। ওদের সম্পর্কের হাল বরাবরই ছিলো মীরার হাতে, আর রাজিব ছিলো ছাপোষা বিড়ালের মতো। যার কাজই ছিলো মীরার পায়ে পায়ে ঘোরা। ও কেবল ওকে পেতে চাইতো এট এনি কস্ট। তবে অনেক পরে খেয়াল হয়েছিল ওর সব। আমাদের সমাজে একটি মিথ ব্যাপকভাবে প্রচলিত, কোনো নারীর সতীত্ব আছে কিনা তা প্রমাণ করতে পারবেন, যদি তার প্রথম মিলনে রক্তপাত হয়। সেসব কথাবার্তা চলাচালি হতো যখন তখন রাজিবের হুঁশ হয় এক্কেবারে প্রথম বার যখন মিলন হলো ওর আর মীরার বিছানায় কোন রক্ত পায়নি রাজিব। তার মানে আবীরের সাথে ওর অনিচ্ছায় হওয়া অন্তরঙ্গতা চেপে গেছে মীরা?

কিন্তু এটি কি আসলেই সত্য?
এই প্রচলিত ধারনার মধ্যে এক বিন্দু সত্য নেই। সব নারীরই প্রথম সহবাসে রক্তপাত হয়না। মেয়েদের উচ্চতা এবং ওজন, দৈহিক গঠন ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, তেমনি নারীর হাইমেনের গড়ন ও আকৃতিও বিভিন্ন রকম হয়। কারো হাইমেন অনেক পুরু, কারো বা খুব পাতলা, কারো বা প্রাকৃতিকভাবেই কোন হাইমেন নেই।

অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই, হাইমেন এমনিই অপসারিত হয়ে থাকে, যেমন ব্যায়াম করলে, বাইসাইকেল চালালে, এমন কি ঘোড়ায় চড়লেও।

বিশেষ করে যাদের হাইমেন প্রাকৃতিকভাবেই পাতলা বা ছোট বা উভয়ই, তাদের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে হাইমেনেরও অপসারিত হবার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাই যে নারীর হাইমেন ছোট ও পাতলা, তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম যৌনমিলনে রক্তপাত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। উল্লেখ্য যে, যার হাইমেন একবার আপনা হতেই ছিঁড়ে গেছে বা অপসারিত হয়েছে, তার প্রথম বারের মিলনে কখনই রক্তপাত হবেনা।

এসব তো জানে না মূর্খ রাজিব। সেই আক্ষেপ দিয়েই শুরু করেছিলো সাথীর সাথে কথা বলা। এবং এই অবৈধ মেলামেশার বৈধতা ছিলো ঐ এক মিথ বিশ্বাসে।

সাথী ছিলো লোভী। ওর নজর ছিলো বড় কিছু হাতিয়ে নেয়ার। ফ্ল্যাট কিনে দিতে গান শুরু করেছিলো সেই কবে থেকে, ভুংভাং বুঝিয়ে ওকে রেখেছিলো রাজিব এত বছর, কিনে দিলো তো এই সেদিন। তবে এটাই রাজিবের ভুল হয়েছে চালে। আরো কিছুদিন মূলা ঝুলিয়ে রাখা উচিত ছিলো। যে যার উপযুক্ত না তা পেয়ে গেলে তার ক্ষমতা বেড়ে যায়। অল্প পানির মাছ বেশী পানিতে পরলে যা হয় আর কি! তারই নমুনা ওর নামে করা মামলা, আর ফলাফল তিনদিনের কারাবাস। কত বড় সাহস ! রাগে চিরবির করতে করতে একটা রিকশায় উঠে রাজিব।

(এ পর্বে ব্যাবহৃত ম্যাডিক্যাল টার্ম গুগল থেকে রিসার্চ করে সংগ্রহীত। এটা ছেলেদের ভিতরে ভিতরে একটা প্রকট সমস্যা পার্টনারের সতীত্ব নিয়ে। তাই খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন মনে করেছি)

পর্ব- ৫৪

মুরসালিন সেদিন বাসা থেকে বের হয়ে কাজ শেষ করে ফোন করে ওর মাকে। ইরাবতীর তো ফোন নেই। মা’কে ফোন করে বলে-
: ” পিচ্চিকে বলো তৈরী হতে, কোথায় নাকি কি কাজ আছে বলছিলো।
মুরসালিনের মা মিসেস রেবেকা হাসি হাসি মুখে ধমক দেয় ছেলেকে, বলেন-
: “এসব কেমন কথা! ও শুনলে কষ্ট পাবে না? ”
: “মা, ভুল বলছি আমি? ও তো পিচ্চিই”
: ” হোক ছোট, ও তোমার স্ত্রী বাবা, স্ত্রীকে সম্মান করতে হয়। দেখো না তোমার বাবা কিভাবে সম্মান করেন আমাকে? মানুষ শুনলে কি বলবে বলো? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে আমরা?”
: “আচ্ছা মা হয়েছে, সরি, এখন শোন মহামান্য ভদ্রমহিলাকে বলো আমার আসতে দশ মিনিটের মতো লাগবে, তিনি যেন তৈরী হয়ে থাকেন” – বলেই কলটা কেটে দেয় মুরসালিন। রেবেকা হাসেন, মনে মনে বলেন- আচ্ছা পাগল ছেলেতো আমার।

এ পরিবারে বাবা-মায়ের সাথে ছেলেদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তারা অন্যভাবে ছেলেদের বড় করেছেন। বন্ধু হয়ে ছেলেদের পাশে থেকেছেন দু’জনই। তাইতো এত ভালো সম্পর্ক সকলের মধ্যে।

ইরাবতী তৈরী হয়ে গেলো মুহূর্তেই। বাইরে যাবে এ খুশিতে। বাইকে উঠার অভ্যাস নাই ওর। কিভাবে উঠবে, বসবে বুঝতেই পারছেনা ও। অনেক কষ্টে দু’জনের মাঝে এক পাহাড় দূরত্ব রেখে বসলো ওর পিছনে। মুরসালিন বিরক্ত চোখে একবার তাকালো লুকিং গ্লাস দিয়ে। কেমন আড়ষ্ট হয়ে আছে ও। তারপর ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো। ইরা ইতস্তত ভাব দেখে সাবধানে গাড়ি এগিয়ে নিলো ও। থামলো একটা সুপারশপে। কি না কি কিনলো ও। ফোনে ব্যাস্ত থাকা অবস্থায় টাকাটা ইরার হাতে দিলো পেমেন্ট করতে। ইরা পেমেন্ট করে ফিরে এলো বাইরে। বললো-
: “কাজ শেষ, বাসায় চলুন”
: ” কোন বাসায়?”
: ” কোন বাসায় মানে! আমাদের বাসায়”
: ” আমাদের বাসা…” কনফিউজড হয়েছিল মুরসালিন। বললো
: ” দুইতলায় নাকি সাত তলায়? ”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইরা ওর দিকে, তারপর হেসে বললো-
: “দুই তলা এখন আমার বাবার বাড়ি, আমাদের বাড়ি হচ্ছে সাত তলায় ”
মুরসালিন তাকিয়ে দেখলো ওর হাসিটা৷ হাসলে এক গালে টোল পরে ইরার। ও হাসলে ইচ্ছে করে গাল টেনে দিতে। কিন্তু পারে না, কেমন যেন সংকোচ হয়।

ইরা বসতে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে পরেছে মুসিবতে। কিভাবে রাখবে কিভাবে ধরবে বুঝতে পারছে না। মুরসালিন এ অবস্থা দেখে বলে-
“দাও এটা আমাকে”
ওর হাত থেকে নিয়ে হ্যান্ডেলে ঝুলায় ও। তারপর বসতে বলে ওকে। এমনি সময় একটা বাইক পাস করে ওদেরকে পেছনে মেয়েটা যেন ছেলেটার গায়ের সাথে লেপ্টে বসা। মুরসালিন ইশারা করে বলে দেখেছো কিভাবে বসেছে? মুচকি হাসে ইরা। আগের মতোই দূরত্ব রেখে বসলো ও। বাইক স্টার্ট দিয়ে একটু এগিয়েই মুরসালিন শক্ত ব্রেক করলো একটা। পরে যাওয়ার ভয়ে ইরা খামচে ধরলো ওর পাঞ্জাবীর বুকের কাছের অংশটা। একটা বোতাম খুলে গেলো সাথে সাথে। এক ধাক্কায় ইরাবতী মুরসালিনের এক্কেবারে কাছে এসে পরলো। এবার কিন্তু আর নড়তে পারলো না ও ভয়ে, চলতি গাড়ি থেকে পরে যায় যদি। ঐ সময়টুকুতে কিছু একটা হলো ইরার। বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মতো কিছু একটা খেলে গেলো মুরসালিনের শরীর থেকে ওর শরীরে। গাড়ি কোথাও থামলো না, একটানা চললো। বাড়ির সামনে বাইকটা থামলে ব্যাগটা নিয়ে পালিয়ে বাঁচলো যেন ইরা। মুরসালিন একটু চিন্তায় পরে গেলো। ছোট মানুষ কি করতে কি বুঝে? গাড়ি পার্ক করে বাসায় এলো ও। ঘরে ঢুকে দেখে ইরা ঘরে নেই, খুঁজতে খুঁজতে ওকে পাওয়া গেলো মায়ের কাছে। মা শুয়ে আছে ও তার পাশেই শোয়া৷ বাসায় এসে শুয়ে পরা! কাছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি, কিছু হয়তো জিজ্ঞেস ও করছেন। কেনাকাটার ব্যাগটা খাটের নিচে ছেঁচড়ে পরে আছে।

এই বজ্জাত মেয়ে ইজ্জত রাখবে না ওর, মা কি ভাববে যে ছেলের সাথে বাইরে গেলো, কি এমন হলো যে বাইরে থেকে এসেই এমনি তার কাছে এসে এভাবে পরে রইলো। লজ্জায় তক্ষুনি বাইরে বেরিয়ে গেলো ও। মনে মনে বকলো ওকে। ফোনও নেই একটা যে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে। এসব ভাবতেই বাইক বের করে আবার বাইরে গেলো মুরসালিন।

এদিক সেদিক ঘুরে বাসায় ফিরলো দেরিতে। যাতে মায়ের সাথে দেখা না হয়। মেয়ে বজ্জাত হলেও ভালে আছে। বিয়ের পর থেকে যেত রাতই হোক অপেক্ষায় থাকে এবং ও নিজে গেইট খুলে। আজও তা-ই হলো, গেট খুললো ইরা। প্রতিদিন গেইট খুলে দাঁড়িয়ে হেসে দেয়। আজ তা করলো না সোজা চলে গেলো ওর ঘরে। ইরার এমন আচরণে মনে পরে গেলো বিকেলের হার্ড ব্রেকের কথা। ব্যাপারটা যে ও ইচ্ছে করে করেছে তা কি বুঝতে পেরেছে ও। মুরসালিনের কেমন সংকোচ হয় ওর সামনে যেতে। কি করবে ভাবতেই ভুলে যাওয়ার ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলো প্রতিদিনের মতো। এটা সেটা জিজ্ঞেস করে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে ওকে। ও উত্তর দিচ্ছে, কিন্তু মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। এমন অবস্থায় ভাত দিতে বলে বাথরুমে ঢুকলো ও। কি করবে কি করবে ভাবতেই বেরিয়ে খেতে গেলো। আজ ইরাবতী খাবার দিয়ে রুমে চলে যেতে লাগলেন। মুরসালিন পিছন থেকে ডেকে বললো-
: “কোথায় যাও?”
: ” আমার ঘুম পেয়েছে ”
: “রাতে খেয়েছো?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলে ইরা। তারপর রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। মুরসালিন ভাত খায় সময় নিয়ে। ঘুমিয়ে গেলে রুমে যাবে ভাবে। নিঃশ্চয়ই বিকেলের ব্যাপারটায় আড়ষ্ট হয়ে আছে৷ এ জিনিসটার ভায়-ই পাচ্ছিলো ও। মুরসালিন ওর বন্ধু হয়ে মনের দরজায় কড়া নাড়তে চেয়েছে। এভাবে যে আড়ষ্ট হয়ে যাবে ও তা ভাবে নি একবারও। রুমে এসে ডাকে ইরাকে-
: “ঘুমিয়ে গেছো?”
কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। বেচারা মুরসালিন মনে কষ্ট নিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরে। মৃদু আলোতে একবার চেষ্টা করে ওকে দেখার। চুপিচুপি বলে- “এত কেন কষ্ট দিচ্ছো আমায়?”
কোন ভাবান্তর নেই ওর। শেষ রাতে অনেক বৃষ্টি হয়। রাতে এসি ছাড়াই ছিলো, তার উপর তুমুল বৃষ্টি। শীতে পুটুলি পাকিয়ে আছে পিচ্চি ইরা। বাথরুম থেকে এসে এসি অফ করে কাঁথা গায় দেয় ও। রুমে একটাই কাঁথা ছিলো ইরার মায়ের দেয়া নকশীকাঁথা। নতুন কাঁথার আগমনে পুরাতনটা গন। সেই কাঁথার ঢেকে দিলো ইরাকেও। ইরা ঘুমের চোখেই টেনে নিলো তা। মুরসালিন কি মনে করে পেছন থেকে আলতো করে ধরলো ইরাকে। ঘুমন্ত ইরা যেন পুটুলি হয়ে ঘেঁষে এলো ওর বুকের কাছটায়। নকশীকাঁথার উমের সাথে সাথে মুরসালিনের শরীরের উম টুকুও শুষে নিলো ইরা। প্রথমবারের মতো এত কাছে এসে চুলের ঘ্রাণে পাগল হওয়ার জোগাড় ওর। ইরার গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ এলো ওর নাকে। অনেক কিছুর ইচ্ছে হলো নারীসঙ্গ বিবর্জিত মুরসালিনের। কিন্তু সাহস হলো না। পরে
এত টুকুতেই খুশি হলো মুরসালিন। এই বা কম কি?
মুচকি হেসে অর্ধেক ঘুম পুরো করায় মনোযোগ দিলো ও ।

পরদিন ইরা ঘুম ভেঙে নিজেকে আবিষ্কার করলো মুরসালিনের আষ্টেপৃষ্ঠে। কেমন দ্যুতি খেললো ওর শরীরে। অস্বস্তিতে হাত সারতে নিলেই ঘুম ভেঙে যায় মুরসালিনের। এমন অবস্থায় দুজনই মুখোমুখি। লজ্জায় ইরার মুখ হঠাৎই আরক্ত। মুরসালিন যেন এভবে থাকাটাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইলো। তাকিয়ে রইলো ওর চোখের দিকে৷ ইরা হাসফাস করতে লাগলো। ছুটতে চাইলো ওর থেকে, মুরসালিন ও ছেড়ে দিলো সুন্দর এ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে। সকালের পর ইরাবতীর আর দেখা নাই। পরে চিরকুট লিখে যায় একটা বাক্সের নিচে। সেখানে লেখা ছিলো – “আমার কুট্টি বউটার জন্য” ইরা খুলে দেখে একটা নতুন স্মার্টফোন সেখানে। চিরকুুটটা কি মনে করে যেন গালের সাথে ধরে রাখে ইরা, এটা যেন চিরকুট না সাক্ষাৎ ওর বর মুরসালিন।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাজিব রিকশা থেকে নেমে ওয়ারীর বাড়ির মেইন ফটকে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তিনদিন আগেও এই বাড়িটা ওর কাছে এক টুকরো শান্তির জায়গা ছিলো। অথচ এখন কেন জানে না বড্ড অপরিচিত লাগছে ওর। স্বাবলম্বী মীরার কাছে রাজিব স্বামী কম ঝাড়ি খাওয়ার লোক ছিলো বেশী। এই সেই নিয়ে ধমকের সুরে কথা বলে তটস্থ করে রাখতো মীরা ওকে। হোক সেটা বাসায় কিংবা কারখানায়৷ কারখানার স্টাফ গুলো পর্যন্ত এসব দেখে পাত্তা দিতো না ওকে। যাই করতো তাতেই ঝাড়ি। সবকিছুতে তার মাতব্বরি, গোটা সংসার জীবণে মানসিক যন্ত্রণা, কাজের চাপ, দায়িত্বপর বোঝা ছাড়া কিছুই দেয়নি মেয়েটা। কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়ার কথা বললে – কাজ, খরচ আর ঘুরতে যাওয়াটা প্রয়োজন না বিলাসিতা তার একটা বিশদ সমীক্ষা দাঁড় করাতো। সেই সব শোনার পর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে ম’রে যেতো। কারখানার প্রয়োজনে ইন্ডিয়া যেতো যখন সারাদিন নষ্ট করে বাই রোডে যেতো খরচ বাঁচাতে। অথচ অল্প কিছু টাকা দিয়েই বাই এয়ারে সুন্দর মতো যাওয়া যেতো। সবকিছুতে বিশ্রী হিসাব!

রাজিব খুব চাইতো মীরার মতো সুন্দরী বউ নিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষকে দেখাতে, কিন্তু মীরার প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে “কাজ”, বিয়ের পরপর আর্থিক সংকুলান ছিলো না কোথাও যাওয়ার, কিন্তু যখন অল্প অল্প টাকা আসতে শুরু করলো মীরা তখন নিজেদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ব্যাবসা বাড়ানোর ধান্ধায় থাকলো। লোভী মেয়ে একটা!
কি হবে এত টাকা দিয়ে? মনে যদি সুখই না থাকে? সারাদিন পর মীরা বাড়ি এসেও কটমট করতো। একটা বার খবরও নিতো না খেয়েছে কিনা? কি করছে কোথায় আছে? স্বামীর সেবা নাহয় বাদই দিলো রাজিব, খোঁজখবর তো করে মানুষ। না বলতে পারতো দুটো শান্তির কথা, রাতের বেলা না পারতো তার শরীরে হাত দিতে৷ ইন্টিমেট হওয়ার ব্যাপারে তার ইচ্ছাই শেষে কথা। যেমন করে পেতে চাইতো ও মীরাকে, তেমন করে পেতো না। লাইফে না ছিলো ফ্যান্টাসি না ছিলো রোমান্স। ছিলো শুধু টাকার হিসেব আর বড়লোক হওয়ার ধান্ধা। তারপর রাজিব বুঝে গেলো ওর ভাব, নিজের মতো করে থাকতে শুরু করলো৷ গা বাঁচিয়ে চলার শুরু সেখান থেকেই। থাক তুই তোর পোদ্দারি নিয়ে।

প্রথমে শুরু করলো ডোন্ট কেয়ার মুড চালু করে। মীরা অসুস্থ, কারখানায় যেতে পারে নি- ডোন্ট কেয়ার, অসুস্থতার তিনদিন, ডাক্তারের কাছে নিতে হবে- ডোন্ট কেয়ার, ও বাইক কিনবে বলে ঠিক করেছে অথচ মাসের শেষ মালপত্র আনার টাকা নেই-ডোন্ট কেয়ার। মীরা বিরক্ত ছিলো ওর আহাম্মকি চালে। এত প্রেসারের পর ওর এসব আহাম্মকি, মাল কিনতে গিয়ে ভালো ভাবে চেক করে না। বস্তায় উপরে ভালো মাল থাকে ভিতরে ঝুট ভরা থাকে। এসব না দেখেশুনেই কিনতো, ফলে বড় অংকের টাকা লোকসান হতো। এক কাপড় আনতে বললে অন্যটা নিয়ে আসা, কোথাও কোন বিষয়ে কারো সাথে কথা কাটি হলে সবসময় প্রতিবাদ না করে নিরপেক্ষ থাকা, ব্যবসায় মন নেই অথচ নাম করার স্বপ্নে বড় কাজের অর্ডার পেতে টেন্ডার পাওয়ার জন্য ঘুষ দেয়া, অথচ ঐ বিশাল কাজ করার মতো ম্যান পাওয়ার, যন্ত্রপাতি, টাকা ওদের নেই। শেষে ঐ ইচ্ছা মাঠেই মা’রা পরতো৷ স্টাফদের বেতনের টাকায় হুট করে কখনো বাইক কিনে নিয়ে আসলো, কিংবা নতুন মোবাইল। পাওনা টাকা আদায়ে হয়ে যায় দয়ার সাগর। আয়ব্যয়ের হিসাবে কোন হুঁশ থাকে না তার। কারখানা চালাবার টাকা নেই অথচ তার ঘুরতে যেতে হবে, নতুন কিছু কিনতে হবে। মোট কথা আগাগোড়া অপরিনামদর্শীতায় মোড়া এক মানুষ রাজিব । ওকে দিয়ে চার আনা পয়সা কোথাও থেকে আসা তো দূরের কথা, মাতব্বরি খাটিয়ে উল্টো টাকা নষ্ট করতো। মীরা তাই একটু একটু করে কারখানার টাকাপয়সা নাড়াচাড়ার ক্ষমতাটা ধীরে ধীরে খর্ব করে। আর এদিকে কি সুন্দর থিউরি বের করেছে রাজিব মাতব্বরি করে মীরা, ফোনে খোঁজ নেয় না, কটমট করে। অথচ রাজিব কি নিতো মীরার খোঁজ? মেয়ে হয়ে টাকা পয়সার ডিল করতো, বায়ারদের সাথে মিটিং, পাওনা টাকা আদায়, যে মানুষটা সারাদিন গাধার খাটুনি খাটে এতকিছুর পরও তার থেকে সুন্দর ব্যাবহার আশা করা! ও কি রোবট! আর কি বললো রাজিব লোভী মেয়ে! হ্যা মীরা বড্ড লোভী, তাইতো নিজেদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে, বেকার, লম্পট, দায়িত্ব জ্ঞানহীন রাজিবকে বিয়ে করে ভুল যে করে নি তা প্রমাণ করতে দিনরাত এক করে দিয়েছে। অথচ ও স্বীকারই করলো না এই হিসাব, মিতব্যয়ীতা মীরাকে কোত্থেকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আচ্ছা ওর কি মনে নেই ওর ব্যায়বহুল চিকিৎসার কথা? এর অর্থের জোগান দিতে গিয়ে কি ত্যাগ করেছিলো মীরা তা হয়তো কোনদিনই জানবেনা এই অকৃতজ্ঞ রাজিব। নাই বা জানুক, ও যে কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছে সেসব দিনে তা তো দেখেছে, এত সহজ সবকিছু ভুলে যাওয়া! এইযে ওদের থাকার ফ্ল্যাট, গাজীপুরের বাড়ি এগুলো কি আদৌ সম্ভব হতো ওর মত অমিতব্যয়ী হলে, হতো না। এসব বুঝিয়ে আর কি হবে? এ যেন অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করা ।

সাতপাঁচ ভেবে ভিতরে গেলো রাজিব৷ লিফটে করে পৌঁছে গেলো ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায়। কলিংবেলে চাপ দিলো ও, কলিংবেল বাজছে কিন্তু কেও আসছে না গেইট খুলতে। প্রথমে ভেবেছিলো কেও নেই ভিতরে, চলে আসতেই নিয়েছে এমন সময় স্টিলের কিছু একটা পরার শব্দে আবার ফিরে এলো ও। তারপর একটানা বেল বাজালো ও। ওর রাগ উঠতে শুরু করলো। সেই রাগ কলিংবেলের শব্দের সাথে জানান দিলো ভিতরের মানুষগুলোকে। অবশেষে আলুথালু ভাবে গেইট খুললো সাথী, গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে বললো-
: “কি হইছে? এখানে কি তোমার ?”
“এখানে কি?! ” কথাটা শুনে মেজাজের পারদ উঠে গেলো উঁচুতে, কিন্তু মাথা এখন গরম করা যাবে না, তার সেই হুঁশ হারায়নি রাজিব তখনো। ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করলে গেইট আগলে দাঁড়ায় সাথী, বলে-
: “কোথায় যাচ্ছো?”
রাজিব না শোনার ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকায়, ওকে ঠেলে ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করে। সাথী ততই বাঁধা দেয় ওকে ভিতরে ঢুকতে, বলে-
: ” কেন আসছো তুমি? এটা আমার বাড়ি”
এবার রাজিব মুখ খোলে, শান্ত কন্ঠে অসহায় মুখো ভঙ্গী করে বলে-
: “আর আমি?”
: “তুমি কি? কোন সম্পর্ক নেই আমার তোমার সাথে”
: ” নাই বললেই তো নাই হয়ে যায় না” বলে সাথীকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে রাজিব।

ভিতরে ঢুকে নিজে যেন জীবণের সেরা ধাক্কাটা খেলো ও ৷ পায়ের নিচের মাটিটা দুলে উঠলো হঠাৎ। রাজিব দেখে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার ধরে ওর সাদা, ফিরেজা রঙের চেক ছাপার সাত হাত লুঙি পরে দাড়িয়ে আছে লম্বাচওড়া একজন। ভুত দেখার মতো চমকে গিয়ে রাজিব বলে-
: “উনি কে?, এখানে কি করছে?”
সাথী যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে রাজিবের প্রশ্নে, মাথাটা মুহুর্তে গরম হয়ে যায় রাজিবের, এতক্ষণে ভালো ভাবে খেয়াল হয় সাথীর আলুথালু বেশ, শরীর কাপড় ঠিক করতে করতে গেইট খোলা এসব কিছুর মানে বুঝতে দেরি হয় না ওর, তেড়ে গিয়ে সাথীর চুলের মুঠি ধরে রাজিব। মুখ বিকৃত করে বলে-
: “বে’শ্যা মা’গী আমারে জেলে দিয়ে তুই ঘরে ব্যাডা ঢুকাইছিস?”
যতটা বেগে রাজিব তেড়ে গেছে সাথীর দিকে, তারচে
বেশী বেগে লোকটা রাজিবের দিকে এসে মারতে থাকে রাজিবকে। এলোপাতাড়ি মার যাকে বলে।চোখেমুখে, বুকেপিঠে কোথাও বাদ নাই, লোকটা যেন চোর ধরেছে হাতেনাতে। তাই এমন উদম প্রহার,
মাথায় লাগা আঘাতটা বেশী জোড়ালো ছিলো। ব্যাথায় রাজিবের চোখ ঘোলা হয়ে আসে, কেন জানি না ঘুম পাচ্ছে ওর, গত কয়েকদিনের মানসিক, শারীরিক কষ্টের সাথে এই মারধরের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার। একটানা মারের পর শার্টের কলার ধরে ফোন করে কাদেরকে যেন, সাথী লোকটাকে কাতর গলায় বলে-
: “ছেড়ে দাও ওকে, শুধু শুধু ঝামেলা কেন করছো”
লোকটার আচরনের চেয়ে সাথীর কথা বলার ভঙ্গিতে বেশী অবাক করলো রাজিবকে, ওর কথার ধরনই বলে দিচ্ছে এ লোক ওর হঠাৎ পাওয়া না। বহুদিনের চেনাজানা না হলে এমন গলায় কথা বলা যায় না। ঐ অবস্থায়ই রাজিব বললো –
: “এই ছিলো তোর মনে, আমি এত সব করলাম তোর জন্য, আর তুই ফুর্তি করস অন্য ব্যাডা নিয়া” যতটুকু সম্ভব গলা চড়ানোর চেষ্টা করলো ও, কিন্তু তা শোনালো হাস্যকর।
এ কথা শুনে লোকটা তার শক্তপোক্ত হাত দিয়ে চড় দেয় রাজিবকে একটা। একহাতে ওর কলার ধরে রেখেছে তাই চড়টাই দিতে পারলো। ঠোঁটের কোণ ফেটে র’ক্ত পরতে শুরু করে সাথে সাথে। শক্ত হাত আর মার দেয়ার ধরনই বলে দেয় এই হাত মারধোর করায় অভ্যস্ত। সাথী লোকটার কাছে গিয়ে বলে-
: প্লিজ সাকলায়েন, ছেড়ে দাও ওকে, ওকে মেরে কি লাভ ওতো এমনিই ম’রে আছে। ডিভোর্স তো দিয়েই দিয়েছি, শুধু কেন মারধোর করে সময় নষ্ট করছো, বলে মিহি একটা হাসি হাসে ও রাজিবের দিকে তাকিয়ে। কিছুদিন আগেও এ হাসিতে বুকে ব্যাথা লাগতো রাজিবের, এত সুন্দর! অথচ আজ ঘৃণা লাগছে দেখে। হঠাৎ মাথায় ঐ নামটা ঘুরতে থাকে সূক্ষ্ম যন্ত্রণার মতো।

সাকলায়েন,
সাকলায়েন….
নামটা পরিচিত মনে হয় রাজিবের। মার খেয়ে আধমরা হলেও মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে নামটা। এ নাম বহুবার রাজিব সাথীর মুখে শুনেছে। কারন সাকলায়েন ওর ভার্সিটির বড় ভাই ওরফে রাজনীতি করা নেতা। রাজিব বিছানায় সক্রিয় হলেও হার্টের ঐ অপারেশনের পর শারীরিক ভাবে একটু দূর্বল। তাই এত ধকল সইলো না ওর শরীর। সাকলায়েন কে তা
মনে পরতেই জ্ঞান হারায় রাজিব।

চলবে…….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৬.
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরাকে ফোন করা হয়েছিলো হাসপাতাল থেকে। মীরা ফোনই রিসিভ করে নি। উপায় না দেখে মিলনকে ফোন করেছিলো রাজিব। মিলন এসেছে হাসপাতালে। রাজিবের অবস্থা দেখে চোখকে বিশ্বাস হয় না ওর এমনি অবস্থা। দীর্ঘদেহী, সুন্দর ছেলেটা পোঁতানো মুড়ির মতো চুপসে গেছে কেমন। মাথায় চুল কেটে সেলাই করতে হয়েছে, ঠোঁটের কোণা ফেটে লালচে হয়ে আছে, চোখের নিচে কালশিটে পরেছে। পুরো সাদা মুখটা লালচে হয়ে আছে। যন্ত্রণায় পুটুলি পাকিয়ে আছে বেডের এককোনায়। যেন অন্য কারো জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ও। ডাক্তার ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার জন্য অবজারভেশনে রেখেছে। মিলন আসার পর MRI করানো হয়েছে। রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা। মিলন বন্ধু হিসেবে টাকাপয়সা না হয় দিতে পারবে কিন্তু ওর চিকিৎসার সাথে সেবাটাও দরকার। উপায়ন্তর না দেখে মীরাকে কল দেয় মিলন। মিলনকে রাজিবের বন্ধু হিসেবে চিনে মীরা কিন্তু শখ্যতা তেমন নেই। মীরা মিলনের নম্বর দেখে খালাকে দিয়ে কল রিসিভ করায়। মিলন ফোন রিসিভ হলে জিজ্ঞেস করলো কে? খালা তার পরিচয় দেন। মিলন রাজিবের কথা তুলতেই মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে খালা বলেন-
: “খালায় তো দেশের নেই, ভারতে গেছে, আসবো কাল পরশু নাগাদ”
কবে আসবে? মিলনের এ প্রশ্ন করার অপেক্ষা না করেই কথাগুলো বলে দিলেন তিনি একটানে, মুখস্থ পড়ার মতো। মিলন ঘাগু লোক ওর বুঝতে বাকী থাকলো না কিছু। নিজের ফোন রেখে বিদেশ যাবে মীরা? এসব তো বাচ্চা-পোলাপান ও বুঝবে। ব্যাপারটা বুঝে নরম গলায় মিলন বললো দেখেন –
: “লোকটা অসুস্থ, বিছানায় পরে আছে, ওর এখন সেবা দরকার। ভুল ও করেছে ঠিক কিন্তু এ সময়টা ভুল ঠিক বিচারের না। আত্নীয়, পরিবার থাকতে ও কষ্ট পাবে সেটা ঠিক কথা না”
পিত্তি জ্বলে উঠে মীরার, পরিবার! আছে না আরেকটা, দিক তাদের ফোন, করুক তারা সেবা, আমি কেন? মীরা তো জানে না, আরেক পরিবারই তার এ দশা করেছে।

তবে শেষ পর্যন্ত খালাকে পাঠায় মীরা। খালা হাসপাতালে গিয়ে অবস্থা দেখে ভিমড়ি খায়। এ কি অবস্থা রাজিবের! অনেক পরে রাজিবের জ্ঞান হলে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে মার খাওয়ার কথা, কথাগুলো যেথেষ্ট মায়া মাখানো ছিলো। কিঞ্চিৎ অসহায়ত্ব মিশাতেও ভুলে নি রাজিব। মাজেদা খালা হেসেছে। মনে মনে বলেছে – “কোন কাম হইতো না”

মাজেদা খালা পরদিন সকালে যখন বাড়ি এলো খাবার আনতে, রাজিব আকুতির স্বরে জিজ্ঞেস করে কোথায় যায় সে? হেসে বলেন- “পালাই না আমি, খাওন আনতে বাড়িত যাই” বাসায় ফিরে বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসেন তিনি। শক্ত খাবার খাওয়া নিষেধ তাই ওর জন্য নরম খাবারও তৈরী করে আনেন তিনি। মিলন এসেছিলো দেখে গেছে ওকে। লোকটা এ সময় ওর পাশে না থাকলে ম”র’ণ ছিলো রাজিবের।

তৃতীয় দিন বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়া হয় রাজিবকে। মাজেদা খালা দুপুরে চলে গেছে বাসায়। যাওয়ার আগে পানের বক্স, রুমাল ইত্যাদি যখন গুছচ্ছিলেন তিনি, বিছানায় শেয়া অবস্থায় “আমায় নিয়ে যাবেন না?” রাজিবের এমন কাতর প্রশ্নে মৃদু তাচ্ছিল্য মাখা হাসি হাসেন, বলেন- “আপনারে যে তিনদিন সেবা করছি, এট্টুকি অর্ডার ছিলো, বাসায় নিয়া যাওনের অর্ডার নাই” এ কথাটুকু শিখিয়ে দেয়নি মীরা, মাজেদা খালা নিজ থেকেই বলেছেন। তিনি চলে যাবার পর একঝাঁক ছেলে নিয়ে হাসপাতালে আসে সাকলায়েন, সাথে সাথীও। তিন ধাপে ফাউন্ডেশন মেখে সেজেছে সাথী৷ ড্রেসের সাথে মিলিয়ে আইশ্যাডো, আইলাইনার, এমনকি আইল্যাশও পরেছে । কায়দ করে কন্টুরিং ও করেছে মুখের মেদ আর ডাবলচিন ঢাকতে৷ দামী জমকালো একটা ড্রেস পরেছে। পারফিউমের উগ্র গন্ধে ধুপ করে মাথা ধরে যায় রাজিবের। এমন সাজপোশাকে কেও হাসপাতালে আসে? আসেপাশের বেডের লোকগুলো তাই বলছে। বেশী সময় নেয়নি ওরা দুটো কাগজে বেশ কয়েকটা সই নিয়েছে ৷ কিসের কাগজ? কেন সই করবে ও? এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে নি ও। চুপচাপ সই করে দিয়েছে। দুটো কাগজের একটা ছিলো ফ্ল্যাটের দানপত্র, আরেকটা ডিভোর্স। সবই তো গেলো ওর, হারানোর কিছুই নেই৷ যাওয়ার আগে সাথী রাজিবের গালে আদর করে থ্যাংকস্ দিয়ে যায়। কি নির্মম আদর!

ওরা চলে যাবার ওর রাজিব মিলনকে ফোন দেয় ওকে বাসায় নিয়ে যেতে। অজানা কারনে এসব ঝামেলার ব্যাপার এড়িয়ে না গিয়ে ওকে নিজের বাসায় নিয়ে যায় মিলন। “দেয়ার আর নো ফ্রী লাঞ্চেস ইন ওয়ার্ল্ড” কি ভেবে যেন এ কথাটা মাথায় আসে হঠাৎ রাজিবের। মিলন যে শেষ পর্যন্ত ওকে নিজের বাড়ি নিতে আসবে তা ভাবতে পারেনি রাজিব। থাকনা মিলনের কেন স্বার্থ, কিংবা স্বার্থের উপরে ভালোবাসা। অভাবনীয় ব্যাপার তো কম হলো না এ কয়দিনে। মনে মনে এমন অনেক অভাবনীয় কিছুর প্রস্তুতি নেয় ও, ভালো মন্দ দুটেরই। কারন ও টের পেয়েছে, পাপ আর অন্যায়ের পাল্লাটা ওর বড্ড ভারী।

————
পুরোদিন কাজের প্রেসার ছিলো মুরসালিনের । ব্যাংক থেকে টাকা তোলা, সেখান থেকে ফিরে ঢাকার বাইরে নতুন একটা জায়গায় যেতে হয়েছে মাল নিয়ে। পরিচিত হতে মালাগুলো অন্য কাওকে দিয়ে না পাঠিয়ে নিজেই গেছে মুরসালিন। বড় পার্টি, ভবিষ্যতের জন্য সুসম্পর্ক দরকার। বিপত্তি বাঁধে দুপুরের দিকে মাল পৌঁছে ফেরার সময়। ফোনটা হাত থেকে পরে পাওয়ার অফ হয়ে যায়। অনেকবার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। অনেক বছর বয়স হয়েছে ফোনটার। বাস ধরার ব্যাস্ততায় ব্যাপারটা যে কাওকে জানাবে তাও ভুলে গেছে ও। দূরের পথ ঢাকায় ফিরতেও লম্বা সময়ের বাস জার্নি। সারাদিনের ক্লান্তি থাকলেও গত রাতের ঘটনাটা বারবার আলোড়িত করেছে ওর মনকে। মনে মনে ভাবে “ভাব ভালোবাসা বুঝে না এমন একটা ভাব, অথচ জড়িয়ে ধরলে অস্বস্তিবোধ করে, আবার মুখ দেখাতে লজ্জাও পায়! ”
এসব ভাবতেই দীর্ঘ যাত্রাটাকে যেন বড় মধুর লাগে ওর। কারখানা, মার্কেট, ব্যাংক, স্টাফ, তাগাদা, টাকাপয়সা এসবের দখলে ওর জীবণ। দীর্ঘ বাস জার্নি একটু যেন ফুরসত দিলো ওকে ইরাবতীকে ভাবার। ইরাবতীর ছোট ছোট রাগ, অভিমান, যত্ন, অজ্ঞতা, লজ্জা পাওয়া, অস্বস্তির প্রকাশ, দায়িত্ব ফলানো কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না মুরসালিনের। তবে দুজনের মাঝে ক্ষীণ একটা দূরত্বের বসবাস। কিভাবে ঘুঁচাবে ও এই দূরত্ব?

বাসটা যখন পাশের ক্ষেত, কখনো নদী, কখনো বিশাল আকাশ পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়, ইরার কাছে পৌঁছানোর আকুলতা যেন আরো বাড়ে, এ আকুলতাকে আরো দীর্ঘায়িত করে গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি। কি এক বিশেষ কারনে ইন্জিন থেকে ধোঁয়া বেড়িয়ে বিকল হয় বাস। ঢাকায় তো ফিরতেই হবে, এদিকে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে, উপায় না দেখে বাস থেকে নেমে অন্য বাস ধরে ঢাকায় পৌঁছাতে।
ভেঙে ভেঙে আসতে গিয়ে বেশ রাত হয়ে যায়। জার্নির ধকল, ক্লান্তি তার সাথে ক্ষুধা কাতর করে দিচ্ছে ওকে। কখন বাড়ি পৌঁছাবে এ এক তাড়না। কখন দেখবে সেই মুখ সেই মধুর অপেক্ষা। বাড়ির কাছে এসে এক মুহূর্তে সব ক্লান্তি উবে যায় বাষ্পের মতো। চনমনে একটা মুডে ঘরে ফিরে মুরসালিন। কলিংবেল চাপার সাথে সাথে গেইট খুলে যায়, যেন দরজার ওইপাশে কলিংবেলের শব্দ শুনে গেইট খুলতে কেও দাঁড়য়েই ছিলো। হাসি হাসি মুখে তাকায় ও প্রতিদিনের মতো, না ইরাবতী দরজা খুলে নি আজ, দরজা খুলেছে ওর বাবা মুখলেস সাহেব। তার মুখে ঘোর অমানিশা, তাকে দেখে হাসি মিলিয়ে যায় মুরসালিনের, জবাব দেওয়া ভঙ্গিতে বলে-
: “গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেলো, তাই….”
রাগী গলায় বলেন – “একটা ফোন তো করবে” গেইট আটকে ছেলের পিছু পিছু আসেন তিনি, ওয়াকিং স্পেস পেরিয়ে মুরসালিন দেখলো বাড়ির সকলে ড্রইং রুমে বসা, ওর বাবা ফোন খুঁজে কল করেন ওর মেঝো ভাইকে, বলেন- “হ্যালো মুস্তাকিম, বাসায় এসে পর, তোর ভাই বাড়ি ফিরছে”

মুস্তাকিম খুঁজতে গেছে ওকে! তাদের দিকে না তাকিয়ে ঘড়িতে দেখলো মুরসালিন। রাত দেড়টা! এত সময় কখন হলো? ঘড়ি থেকে চোখ নামিয়ে চোখ গেলো ইরার দিকে। চোখমুখ ফোলা ওর, চোখ পরতেঔ কেমন একটা মুখ করে ঘরে চলে গেলো ও। এরমধ্যে ওর মা মিসেস রেবেকা শুরু করলো বকা- “কেমন ননসেন্স তুমি, দুপুর থেকে ফোন বন্ধ, একটা বার ফোন করে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি, নতুন জায়গায় গিয়েছে, তার উপর ফোন বন্ধ এতগুলো মানুষ চিন্তায় শেষ” রাগে গজগজ করে তার রুমে চলে গেলেন তিনি, ওর বাবাও গেলো তার পিছুপিছু। ছোট ভাই দুটো ঘরের দিকে কি এক ইশারা করে চলে গেলো। এবার ও বুঝলো ইরার চোখমুখ ফোলার কারন। হাতের ব্যাগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে ওর ঘরে যায় মুরসালিন। কোথাও নেই, বাথরুমের দরজা ভেজানো, এরপর বারান্দায় যায় ও। গিয়ে দেখে এক হাতে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আরকে হাতে চোখ মুছছে ইরা।

কিছু সময় মৌণ থেকে কথা গুছাতে থাকে ও, আসলেই গাধামি হয়ে গেছে ফোন না করায়। ইরার কাছে যায় ও, ওর কাঁধে হাত রেখে বলে- আসলে…. কথাটা শুরু করতেই মুরসালিনের বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে থাকে ইরা, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুরসালিনকে, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে ও, এরপর শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বলতে –
” আমার বাবা যেদিন মা’রা গেলেন, এমনি ফোন বন্ধ ছিলো সারাদিন, চিন্তায় অস্থির হয়ে বসে ছিলাম আমরা সকলে। কোথায় গেলেন তিনি, তার সম্ভাব্য হিসেব করলাম সবাই । কিন্তু একটা বারের জন্য ও আমরা কেও ভাবি নি মা’রা গেছেন তিনি। ব্যবসার কাজে রাজশাহী গিয়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক, তার ফোনটা হয়তো ভিড়ের মধ্যে চুরি করে নিয়ে গেছে কেও, মানিব্যাগও পাওয়া যায় নি, সেটাও কেও হাতিয়েছিলো হয়তো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপর দীর্ঘ রাত। আমাদের কাছে খবর এলো শেষ রাতে। ভাগ্যিস পকেটে একটা মানি রিসিট ছিলো। সেই সুবাদে খবর পেয়েছিলাম। বিশ্বাস করেন আমরা কেও একবারের জন্যও ভাবিনি বাবা মা’রা গেছেন। আজ দুপুর থেকে ফোন করছি যেমন আমি তেমনি মা, বাবা, ভাইয়ারা। কেওই পাচ্ছি না আপনাকে। সকলে শান্ত থাকলেও আমি পারিনি। কারন বাবার স্মৃতি আমাকে তাড়া করছিলো পুরো সময় জুড়ে। আমার কেবলি মনে পরছে ঐ দিন, সেসব কথা। কেন আপনি একটা বারও ফোন করে জানালেন না, কেন?

মুরসালিন পাথর হয়ে জড়িয়ে আছে ওকে, কথা বলবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না ও। ইরাবতীর রাগ দেখেছে, অজ্ঞতা দেখেছে, লজ্জা দেখেছে, যত্ন দেখেছে। বুকের মধ্যে ওর জন্য যে এত ভালোবাসা লুকানো তা দেখেনি। এই বন্ধ ফোন, বিলম্বিত যাত্রা ইরার লুকিয়ে রাখা ভালোবাসার ডালাটা যেন খুলে দিলো এক পলকেই। নিজেকে বড্ড সুখী মনে হয় মুরসালিনের, ইরাকে হঠাৎ-ই লোমশ হাতজোড়া দিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওর সুঠাম বাহুতে, কারন এমনি ভালোবাসায় ও ডুবে থাকতে চায় আরো কিছুক্ষণ….

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে