প্রিয় ভুল পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯+৬০

0
189

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

রাজিব জেল থেকে বেরিয়েই খবর পেয়েছিলো পাওনাদারেরা টাকা না পেয়ে ওর কারখনায় তালা মেরে দিয়েছে। ও মিলনের বাড়ি আছে আজ তিনদিন। মিলনের বউ শুরু থেকেই ওকে তেমন একটা পছন্দ করে না, সেটা রাজিব আগে থেকেই জানে, কেন পছন্দ করে না তা জানে না রাজিব। অনেক ভেবেছে তার অপছন্দের সম্ভাব্য কারন। সুদর্শন রাজিবের জন্য মেয়েরা মরিয়া হলেও তিনি বরাবর দৃষ্টিতে একটা সূক্ষ্ণ অবজ্ঞা ছুঁড়ে দেন যেন রাজিবের উদ্দেশ্যে৷ ভদ্রমহিলা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী, শিক্ষিত, শরীরের বাঁধন শক্ত, আর মিলন পুরো তার উল্টো। ওরও পড়ালেখা তো তেমন হলোই না , দেখতে কুচকুচে কালো, অন্ধকারে ঠাওর করা যায় না এমন,গড়পড়তা হাইট এই ছেলে এমন মেয়ে কিভাবে হাত করলো এটাই এক চমক সকল বন্ধুদের কাছে। যাই হোক রাজিবের শরীরটা এখন মোটামুটি সুস্থ, সময় মতো খাবার, সেবাযত্ন যে পাচ্ছে এটাই আচ্শর্যের ব্যাপার। চমকিত তো কম হলো না এ কয়দিনে, প্রিয় স্ত্রীর করা মামলায় জেলখানা দেখে এলো, কাটিয়ে এলো তিনদিন, বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে পেলো, ওর উচিত ছিলো অনৈতিক এ কাজ করায় ওদেরকে শায়েস্তা করা, উল্টো নিজে মার খেয়ে হসপিটালে ঘুরে এলো কতদিন, একে একে তো সবই গেলো, প্রিয়তমা স্ত্রী, তাকে কিনে দেয়া ফ্ল্যাট, কারখানা। এখন একমাত্র অবলম্বন মীরা৷ জেল হতে বের হওয়ার পর থেকে ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে যেন একমাত্র অবলম্বনের কাছ থেকে। মীরার সামনে কিভাবে দাঁড়াবে তা ভেবে পাচ্ছে না, কিন্তু যেতে ওকে হবেই, না গিয়ে উপায় নেই।

এদিকে মিলনের কাছে পাওনাদারেরা খবর পাঠিয়েছে, তারা রাজিবের সাথে দেখা করতে চায়। হয় এদিক নাহয় ওদিক, দ্রুত কোন একটা ফয়সালা চান তারা। সেদিন রাতে মিলন পরামর্শ দিলো কারখানাটা বিক্রি করে দেয়ার। কারখানা বিক্রি করলে তাদের ঋণ দিয়ে রাজিবের কাছে কিছু অবশিষ্ট থাকবে। আর যদি তাদেরকে কারখানা দিয়ে দেয় তবে সেটা বোকামি হবে। মিলনের মুখে কারখানা বিক্রির কথা শুনে কেমন যেন চমকে যায় রাজিব। জেলে যাওয়া অবধি অনেক অধঃপতনের কথা ভেবেছে ও, কিন্তু কারখানা বিক্রির কথা মাথায় আসেনি একটি বারের জন্যও। তাই একথা শোনামাত্র চমকে উঠলো ও। মিলন বুঝতে পারে ওর ব্যাপারটা। অপরদিকের সোফা হতে এসে বসে রাজিবের পাশে, কাঁধে হাত রেখে বলে –
: আমি বুঝতে পারছি তোমার ভিতরে কি চলছে এ কথাটা শুনে। কিন্তু এটাই সত্য, যত জলদি তুমি মেনে নিবে সত্য ততোই তোমার মঙ্গল। মিলন ছেলেটা বরাবরই এমন, মন রাখতে, ভরসার ছলেও আশা জাগানিয়ায় ও মিথ্যা বলে না। সত্যটাকে টেনে সামনে এনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়৷ এটা ওর চমৎকার একটা দিক, তবে রাজিব এখন সত্য জানতে চাচ্ছে না, ও মিথ্যা হলেও একটু ভরসা চাচ্ছে যে ওর সব ঠিক হয়ে যাবে, সব! ও ওর ব্যাবসা ফিরে পাবে, মীরার ভালোবাসা ফিরে পাবে !

যদিও ভিতরে ভিতরে ওর খবর হয়ে গেছে কোথায় পৌঁছে গেছে ও। একে একে মনে পরছে বেহিসেবী সব হিসেব গুলো। কত কত টাকা কাগজের মতো উড়িয়ে বেরিয়েছে দেশ থেকে বিদেশে, শহর থেকে বন্দরে। অথচ আজ ও নিঃস্ব। এখান থেকে বের হয়ে কোথাও যে যাবে সেই ভাড়াটা পর্যন্ত ওর নেই।

খানিকক্ষণ মৌণ হয়ে বসে থেকে মুখ তুলে রাজিব। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পানির গ্লাসের দিকে। চোখেমুখে কেমন যেন দৃষ্টি। হঠাৎ হাভাতের মতে গ্লাসটাকে কেড়ে নেয় ও, যেন জলদি না করলে অন্য কেও সেটা নিয়ে নিবে। একটানে শেষ করে সবটুকু পানি। তৃষ্ণা বেড়ে গেছে হয়তো ওর। দেখে মনে হচ্ছে পানি না ও পান করলো শক্তি সঞ্চয়কারী কোন পানীয়। মিলন অবাক হয় ওর এমন আচরণে। একটার পর একটা ধাক্কায় ছেলেটার না মাথা খারাপ হয়ে যায়। মিলনের দিকে চেয়ে ফিচেল হাসি হেসে বলে-
: ” আমি এখন কি করবো? ”
যেন খুব মজার কিছু জিজ্ঞাসা করছে ও মিলনের কাছে। ওর হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় মিলন। বলে –
: “তোমার কি মনে হয়, কি করলে ভালো হবে? ”
: ” মিলন, তুই জানিস না আমার মাথাটা এক্কেবারে ফাঁকা হয়ে আছে, কোন জ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি, কিচ্ছু নেই, কেবলি একটা ট্রেন ছুটছে ভো ভো করে”
এ পর্যায়ে সোফা হতে নেমে মিলনের পায়ের কাছে বসে ওর হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে চেপে ধরে কেঁদে ফেলে রাজিব, শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বলে-
: “তুই শুধু মীরার কাছে আমাকে ফিরিয়ে দে, আর কিছুই চাই না আমি, মীরা আমার থাকলে সব হবে আমার, ওর সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি, যা ক্ষমার অযোগ্য”
কান্না জড়ানো কন্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে মিলনের হাঁটুতে মুখ গুঁজে ও। যেন মিলনই সবকিছুর একমাত্র সমাধানকারী। মিলনের চোখের কোণেও পানি জমে, মিলনের বৌ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সব, রাজিবকে অপছন্দ করা তার চোখও আর্দ্র হয় এ দৃশ্যে।

মিলন ওর হাত ধরে বলে-
: “উঠে বস তুমি, দেখি কি করা যায়”

বেশ সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয় রাজিব। মিলন বলে-
: “তোমার জীবণে যে ঝড় তুমি ডেকে এনেছো তা এখনো থামে নি কিন্তু, এখন যদি তুমি এত ভেঙে পরো তাহলে হবে? তোমাকে শক্ত হতে হবে এ ঝড় মোকাবিলা করার জন্য”
রাজিবের দৃষ্টি অবনত, মিলনের ড্রইংরুমে সেন্ট্রাল টেবিলের নিচে বিছানো দামী তুর্কি কার্পেটে বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে অবিশ্রান্ত খুটছে। এ দৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে সে কর্মযজ্ঞ। সে অবস্থায়ই রাজিব বললো-
: ” কি করবো তাহলে, শান্ত হয়ে বসে থাকলে ঝড় কি থেমে যাবে?”
মিলন সন্তুষ্ট হয় ওর কথা শুনে, তারমানে রাজিব ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এরপর মিলন বলে-
: “শান্ত হলে ঝড় থামবে না তা ঠিক, তবে উপায় বের হবে”
: “মিলন তুই আমার কারখানাটা কিনে নে, পাওনাদারদের টাকা দিয়ে যা থাকে তা তোর কাছে রাখ, সবার আগে মীরার সাথে আমাকে একটা মিটমাট করে দে, ওর সামনে দাঁড়াবার সাহস, সামর্থ্য কোনটাই নেই আমার”

মিলনের ঠোঁটে মিহি একটা হাসি ফুটে উঠে, খুব খেয়াল করে না দেখলে চোখে পরবে না তা। এ হাসি রহস্যময়ী মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যময়। ওর মনপুত হয় রাজিবের কথাটা, কারখানা কিনে নেয়ার ভাবনাটা ও নিজেও ভেবেছিলো, কিন্তু কিভাবে কথাটা তুলবে তা বুঝতে পারছিলো না। ও তো এটাই চায়, যত টাকা লাগুক “মীরা ফ্যাশন” কিনে নিবে মিলন, তারপরের ভাবনা গুলো অনেক আগেই ভেবে রেখেছে মিলন। ও বস্তুগত সম্পদ কিনবে না মিলন, কিনবে ব্র্যান্ড, মীরা ফ্যাশনের খ্যাতি, ওদের বিস্তৃত মার্কেট। এরপর প্রোডাক্টের কোয়ালিটির লো করে “মীরা ফ্যাশনের নাম ডুবাবে, নিশ্চিহ্ন করে দিবে ওর ব্যাবসায়িক প্রতিদ্বন্ধীকে। এ আশায়ই তো এত তোয়াজ করছে রাজিবকে। কারন ও নিজেও জানে ” দেয়ার আর নো ফ্রী লাঞ্চ ইন দা ওয়ার্ল্ড ”
—————-

সাথী সেজেগুজে হসপিটালে গিয়ে দানপত্র, আর ডিভোর্সের কাগজে রাজিবের সই নেয়ার দিনই ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কোন রীতিনীতির তেয়াক্কা না করে সাকলায়েনকে বিয়ে করেছে। এটা ওদের দু-জনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। ওদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা ঠিক কবে হয়েছিলো তা জানা না গেলেও সম্পর্কের গভীরতার টের পাওয়া গিয়েছে সাকলায়েনের সাথীর বাড়িতে রাত্রীবাস থেকে। রাজিব রাতে সাথীর বাসায় থাকতে পারতো না, সেই সুযোগেই ওদের নিষিদ্ধ প্রণয় ত্বরান্বিত হয়েছে সে হিসেব এখন সোজা।

পাঁচ লক্ষ টাকার কাবিনে, সাকলায়েনের চ্যালাদের সাক্ষী রেখে বিয়ে করে ওরা। বৌয়েরা বিয়ে করে স্বামী গৃহে যায়, আর সাকলায়েন উঠেছে নতুন বৌয়ের ফ্ল্যাটে। ছন্নছাড়া সাকলায়েনের একটা গতি হলো যেন। নিজেদের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ও আজ এখানে, কাল ওখানে থাকতো। নেশা করার কারনে ওর বাবা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন সেই কবে। রাগে ক্ষোভে বাড়িমুখো হয় নি এত বছরেও। একটা ভাড়া ফ্ল্যাটে ফ্রি-তে থাকতো ও, সিনিয়র নেতার বাড়ি। মেয়েদের আনাগোনা নিষিদ্ধ করে দেয়ায় ওর হ’য়েছে বিপত্তি। তাই আজ এখানে তো কাল ওখানে। মে’য়ে আর ম’দ এ দুটো জিনিস ছাড়া সাকলায়েনের দিন অসম্পূর্ণ। আর মেয়েরা এসব বাজে, বেকার, নেশাখোর, ভাদাইম্মা, ছেলেদেরকেই অন্ধের মতো ভালোবাসে৷ আর আবীরের মতো ভদ্র, কর্মঠ ছেলেরা কষ্ট পায়, বাকী জীবণ সেই কষ্ট বুকে নিয়ে নারী বিবর্জিত হয়ে কাটিয়ে দেয়।

সুখেই কাটছে ওদের দিন, সাথী বাড়িতে জানায় ওদের বিয়ের কথা। বাবা-মা, ছোট তিন বোন খবর পেয়ে ঢাকায় ওদের দেখতে আসে। সাথী তাদেরকে বলে এটা ওদের নতুন সংসার৷ রাজ্য, আর রাজপুত্র দেখে সাথীর বাবা-মা খুশিই হন। মনে মনে ওর বাবা-মা মেয়ের একা বিয়ে করার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। মেয়ের এত ভালো বিয়ে তারাও দিতে পারতেন না হয়তো। এবার ছোট তিনজনের গতি হবে ভেবে খুশি হন তারা। এদিকে সাকলায়েন ও খুশি। তবে ওর খুশির কারন ভিন্ন। সুন্দরী তিন শালী দেখে না’রী লো’ভী সাকলায়েনের চোখ চকচক করে বিশ্রী কামনায়। মনে মনে ছোটবেলার জেলে আর সাত ভুত গল্পের মতো মনে মনে আওড়ায় ” একটা খাব দুটো খাব সব কটাকে চিবিয়ে খাব”

———————

রাজিব নিজেকে সামলে নিয়েছে, যত যাই হোক সত্যের মুখোমুখি তো হতেই হবে। এভাবে সত্যি থেকে চোখ সরিয়ে রাখলেই সত্যি বিলিন হয়ে যাবে না।
মিলনও রাজিবের স্বাভাবিকতা দেখে মন ঠিক করেছে রাজিবকে কালই নিয়ে যাবে ওদের নীলক্ষেতের বাসায়। পরদিন সকালে নাশতা খাওয়া শেষে মিলন গেছে তৈরী হতে। রাজিব সোফায় বসে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছে, আর ভাবছে কিভাবে কি বলবে মীরাকে। মিলন কাপড় বদলে এসে, মুচকি হেসে সহজ ভঙ্গিতে বলে-
: “চলো, তোমার ব্যাবস্থা করে আসি”
উত্তরে রাজিবও হাসে না ঠিক চেষ্টা করে হাসার, কিন্তু সে হাসিতে প্রাণ নেই। কেমন যান্ত্রিক হাসি যেন।
দরজার হাতলে হাত দিতেই কল আসে মিলনের ফোনে। জুতা পরতে পরতে কল রিসিভ করে মিলন। মুহূর্তেই একটু আগের চাঞ্চল্য উবে যায়। সোজা হয়ে দাঁড়ায় ও। আরেকটা জুতা পরায় কোন ব্যাস্ততা দেখা যায় না মিলনের। কল কেটে ও রাজিবকে জানায় পাওনাদারদেরা কল করেছে, তারা বাড়ির নিচে অপেক্ষা করছে। উপায়ন্তর না দেখে মীরার বাসায় যাওয়া স্থগিত করে তাদের সাথে আলোচনায় বসেন ওরা। তাদের সাথে কথাবার্তা হয় পুরো আধঘন্টা। পুরো সময় মাথা নিচু করে রাখে রাজিব। সব কথা হয় মিলন আর তাদের মধ্যে। তাদের দাবী হয় পুরো টাকা দিতে হবে, না-হয় তারা কারখানা বিক্রি করে তারা তাদের পাওনা টাকা নিয়ে নিবে৷ সব শুনে
আজকের দিনটুকু সময় চায় মিলন। কাল সকালে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে। তারা প্রথমে মানতে চায়নি, অনেক তো দিলো সময়, কাজের কাজ কিছুই হলো না। মিলন অনেক বলে কয়ে নিজে জিম্মা হয় বলে আপনারা ওকে নয়, আমাকে আজকের দিনটুকুু সময় দিন, পরে তারা মেনে নেয়। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সময় দেয় তারা, এরমধ্যে টাকা না পেলে বিকেলে সবাইকে ডেকে কারখানার সম্ভব্য ক্রেতাদের নিয়ে বসবে তাদের সমিতির অফিসে। চলে যান তারা, এরমধ্যে মিলন ভাবনায় পরে যায়। এখন যদি ও কিনতে চায় কারখনা, রাজিব টাকাটা ধার চাইতে পারে ওর কাছ থেকে। পরে তো না ও বলা যাবে না লজ্জায়। আর সেটা দিলে
রাজিবকে ধার দেয়া হবে, তাতে মালিক রাজিবই থেকে যাবে। যদি অন্য কাওকে দিয়ে কারখানাটা কিনতে পারে? ভাবতেই ওর ছোট ভাইয়ের কথা মনে পরে।

একটু ভেবে মিলন বের করলো আগামীকালের করনীয়। কাল সকাল পর্যন্ত সময় লাগবে না, আজই ভেবে নিলো মিলন রাজিবের ভবিষ্যৎ। কাল সকালে কোন টাকা পাবে না তারা। বিকেলে নিলামে উঠবে “মীরা ফ্যাশন”

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সকালের পাওনাদারদের সাথে আলোচনায় মীরার সাথে দেখা হওয়া পিছিয়ে যায়। মিলনের কাজ আছে, এখন আর যাওয়া সম্ভব না, তবে বিকেলের দিকে ও সময় করতে পারবে, তখন যাবে বলে ঠিক করে।

মিলন চলে যায় ওর কাজে। রাজিব ফিরে আসে এ বাড়িতে ওকে থাকতে দেয়া ঘরটায়। ছোট্ট একটা ঘর। একটা খাট, প্লাস্টিকের ওয়ারড্রব আর চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই ঘরটায়। এমনকি বিশাল দক্ষিণমুখী জানালায় পর্দাও নেই। সেই ভোর সকাল হলেই আলোর ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে যায় রাজিবের। খুব সম্ভবত এ বাড়ির সবচেয়ে দামী জিনিস ওদের ড্রইংরুমের কার্পেটটা। এটাও মিলন নিজে কিনেনি। উপহার পেয়েছিলো এক বায়ারের কাছ থেকে। সরাসরি তুর্কী থেকে আনা সেটা। এত টাকা এরা রাখে কোথায়? ঘরে ভালো একটা আসবাবপত্র নেই। যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু নিয়েই এদের সংসার। অথচ মিলন না ধরা দিলেও মিলন যে কোটিপতি তা জানে রাজিব।

রাজিবের এসব অপছন্দ। ওর ঘরে ভারী পর্দা দেয়া থাকে ও না উঠা পর্যন্ত। এমনকি নূহা ঘুম থেকে উঠে পরলেও মীরা ঘরের পর্দা তুলতো না, মেয়েকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে ফ্রেশ করতো, নাশতা খাওয়াতো। ঐ বাড়িতে এ নিয়ম এতই শক্ত পোক্ত ছিলো যে আড়াই বছর বয়সী নূহাও ওর বাবা ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঐ ঘরে যেতো না।

নূহার কথা ভাবতেই বুকে একটা মোচর দিয়ে উঠলো রাজিবের। নূহা, ওর আদরের মেয়ে, যার অস্তিত্বে রাজিব সদা বিরাজমান। জন্মের পর পর বাবা মেয়ের সম্পর্কটা ঠিকঠাক গড়ে উঠতে পারে নি স্বাভাবিক ভাবে। তখন রাজিব সাথীকে আবিষ্কারের নেশায় মত্ত ছিলো তাই । অলীক সুখের খোঁজে ও নিজে এতই ব্যাস্ত ছিলো যে ঠিক কবে মেয়ের সাথে ওর এত দূরত্ব হয়ে গেছে মনে করতে পারছে না এখন। ওর প্রতি মেয়ের ও কোন সফট কর্নার নেই হয়তো, বাড়িতে থাকা সময়টুকুতে কাছে এসে বাবার আদর চাইতো যখন, রাজিব ওকে ফোন দিয়ে পাশে বসিয়ে রাখতো। রাজিবের কাছে তখন মেয়ের চেয়ে দেশের খবর, কিংবা ক্রিকেট বেশী জরুরি মনে হতো। অসুস্থ হলে নূহাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, মীরা তা জানালেও এই সেই বাহানায় এড়িয়ে যেতো রাজিব। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ওয়েটিং রুমের দীর্ঘ লাইন ওর বিরক্ত লাগতো। এমনি অসংখ্য অবহেলা জমে জমে তা হয়তো পৃথিবীর দীর্ঘ পর্বতকেও ছাড়িয়ে গেছে উচ্চতার বিচারে। আচ্ছা নূহা কি ক্ষমা করবে ওর এই বাবাকে?

মহা ব্যাস্ত রাজিবের হাতে ইদানীং অনেক সময় অতীত ভাববার। সাথীর ধাক্কাটা পাওয়ার পর থেকে এসব কিছু হঠাৎই দৃশ্যমান হয়েছে ওর কাছে। একেবারে শুরুর দিন থেকে বর্তমান পর্যন্ত করা প্রতিটি ভুল চোখে বিঁধছে ফলার মতো। এত এত ভুলে ভরা জীবণ? আর কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ও?এসব ভাবতে ভাবতে আলো ঝলমলে ঘরটায়ই অবেলায় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় ও। ইদানীং এমনি হচ্ছে। যখন তখন গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে যায় ও।
শত চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারে না। কি জানি এটা আবার কোন রোগের পূর্বাভাস কিনা?

বিকেলে মিলন এসে ঘুম ভাঙায় রাজিবের। ঘুম থেকে উঠে খাওয়াদাওয়া শেষে তৈরী হতে বলে মীরার সাথে দেখা করার জন্য। রাজিব খুব দ্রুত শেষ করে সব কাজ। পেটে ক্ষুধা না থাকলে খাওয়াটাও হয়তো স্কিপ করতো ও। খাওয়া শেষে তৈরী হওয়া বলতে মিলনের দেয়া লুঙ্গি বদলে ঐ এক শার্ট আর প্যান্ট যেটা পরে জেলে গিয়েছিল ও তা পরে নেয় রাজিব। আর তো কিছু নেই।

তৈরী হয়ে মিলনের সাথে নেমে রিকশা নেয় ওরা। “এমন সময় বাসায়ই থাকবে মীরা” – মনে মনে ভাবে রাজিব। বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মাত্র কয়দিনের ব্যাবধানে কেমন অচেনা লাগে বাড়িটাকে। নিচ থেকে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে নিজেদের ফ্ল্যাটটা। একচিলতে বেলকনি ছাড়া কিছুঔ চোখে পরে না রাজিবের। এত উঁচুতে বাসা হওয়া সত্ত্বেও না গুনেই ঠিক চিনে নিজেদের বেলকনি। কারন একমাত্র ওদের বেলকনিতেই রাণী গোলাপী বাগানবিলাস গাছ লাগানো। যার পুরোটাই বেড়ে উঠেছে বারান্দার বাইরে। বারান্দার গাছ নিয়ে কম ঝামেলা করে নি রাজিব। মশার অযুহাতে ফেলে দিতেও উদ্যত হয়েছিলো একবার। মীরা অনুরোধ করে রেখেছিলো সেগুলো। ও কেবল ঝঞ্ঝা দেখেছিলো বারান্দায় কিন্তু আজ প্রথম বারের মতো গাছগুলোতে খেয়াল করলো ও। কি ভীষণ সুন্দর লাগছে এত উঁচুতে থেকেও। এত দূরত্বে থাকার পরও বাগান বিলাস চিনিয়ে দিচ্ছে বেলকনির মালিকের রুচির সৌন্দর্যকে। কারন এই পাশের একটা বারান্দায় ও কোন গাছ নেই, একমাত্র আটতলায় ওদের বারান্দায়ই এই বাগান বিলাস নিজের শোভা ছড়িয়ে দিচ্ছে এত উঁচুতে থেকেও এই নিচ অবধি ৷ ঐ বাগান বিলাস গাছটা যেন মীরা। সবসময় নিজের শোভায় রাঙিয়ে রাখতে চেয়েছে নীচ, ছোটলোক রাজিবের জীবণকে৷ আর রাজিব? ব্যাস্ত ছিলো প্রাণহীন কাগজের ফুল নিয়ে। যা দুমড়ে যায় মুচড়ে যায়, যার থেকে নতুন জীবণের আবির্ভাব অসম্ভব। কিন্তু বাগান বিলাস ওরফে মীরা ঝড় ঝঞ্ঝায় টিকে থাকে, যদি ডাল ভেঙেও যায়, শুকিয়েও যায় তবুও সেখান থেকে জন্ম দিতে পারে নতুন প্রাণের।

অনেক সাহস নিয়ে উপরে উঠে রাজিব। কলিংবেল মিলনই দেয়৷ ও যতদ্রুত এখান থেকে যেতে পারে এ-ই কেবল ভাবছে মনে মনে। অবশেষে কাঠের সুন্দর কারুকার্য করা দীর্ঘ দরজা খুললেন মাজেদা খালা। তার চোখেমুখে বিরক্তি আর অবহেলা মিশানো দৃষ্টি। তিনি রাজিবকে উপেক্ষা করে মিলনের দিকে তাকিয়ে বললেন-
: ” কি ব্যাপার?”
যেন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রক্ত মাংসের রাজিবকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না, রাজিব যেন অদৃশ্য এই দৃশ্যপটে। রাজিব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে, যদি তিনি একটিবার অন্তত তাকান ওর দিকে। জাস্ট একবার, তাহলেই যেন রাজিবের অস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু মাজেদা খালা সেই ধার ধারলেন না। তিনি মিলনের সাথে কথা বলে দরজা ছেড়ে ভিতরে যেতে জায়গা করে দিলেন। রাজিব বুঝতে পারছে না ওকে ভিতরে ঢুকতে দেয়া হবে কিনা। কিন্তু না মিলন ঢুকার পরও খালা দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলের গিঁট খুলছে পান বের করছেন দেখে রাজিব এ ফাঁকে ঢুকে পরলো। নিজের বাড়িতে এসেছে ও তবুও ভিতরে ঢুকতে পারার জন্য চাপা আনন্দ হচ্ছে ওর! নিজেই আবাক হয় ও, নিজ গৃহে এসে আনন্দিত হওয়ার কি আছে?

ভিতরে ঢুকে যখন জানলো মীরা বাসায় নেই ওর ভাবটা কেমন বদলে গেলো। নিজের ঘরে ঢুকে, নিজ হাতে কাপড় বের করে সেজা গেলো বাথরুমে। দাড়ি কেটে দীর্ঘ সময় নিয়ে শ্যাম্পু করে গোসল করলো রাজিব। নোংরা জীর্ণ রূপ নিয়ে ভিতরে ঢুকলেও ফিরে এলো আগের রাজিব হয়ে। ভুরভুর করে বেরুনো আফটার শেভের গন্ধে মিলন টের পেলো রাজিব ঘরে ঢুকেছে। ফোনে আটকে থাকা অবনত দৃষ্টি তুলে তাকায় মিলন, রাজিবকে দেখে চিরচেনা রূপে। একটা গোসল বদলে দিলো পনেরো মিনিট আগের রাজিবকে। রাজিব যেন গোসল করে সকল গ্লানি, ক্লান্তি, চিন্তা ধুয়ে এসেছে। ওর চোখেমুখে আত্নবিশ্বাসী ভাব। রাজিব মিলনের পাশে বসতেই মিলন বললো-
: ” দশ মিনিটের মধ্যে আসছে মীরা”
মিলনের কথা শুনে রাজিবের সেই ভাবটা হঠাৎ
উবে গেলো, ভয় হতে শুরু করলো। মীরা যেন মীরা না ও যেন প্রাণ কেড়ে নেয়া যমদূত। ওর ভয় উড়িয়ে দিতে দু হাতের রূপার চুড়ি গুলে ঝুমঝুম করে বাজিয়ে এ ঘরে এলো নূহা। ওর চোখ-মুখে চেনা হাসি৷ গুটুর মুটুর করে কাছে এসে নিয়মিত দূরত্বে দাঁড়ায় ও। রাজিব কোলে নিতে হাত বাড়ালে দুই হাত না উঁচিয়ে এক হাত এগিয়ে দেয় নূহা। সেটা কোলে উঠার জন্য না, ফোন নিতে। ফোন নিতে দুই হাত উঁচিয়ে ধরা লাগে না এক হাতই যথেষ্ট। নুহার কাছে রাজিবের চেয়ে এন্ড্রয়েড ফোনের কদর বেশী, বাবার চাইতে ও ফোনকে বেশী ভালোবাসে। ফোনকে রাজিবের বড্ড হিংসা হচ্ছে এখন। ওরই দোষ কি রাজিব তো ওকে এভাবেই ট্রিট করতো। ফোন দিয়ে পাশে বসায় রাজিব নূহাকে। নূহা দেখে “বেবী শার্ক ” আর রাজিব ওর ঔরসজাত বেবীকে।

এমন সময় কলিংবেল বাজলো। রাজিবের আত্না
শুকিয়ে গেলো যেন এই শব্দে। এ যেন কলিংবেল না মহাপ্রলয়ের আগের ইশরাফিলের শিংগার ফুৎকার। রান্নাঘর থেকে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে দ্রুত এলেন মাজেদা খালা। মাথায় কাপড় ঠিক করে দরজার হাতলে চাপ দিয়ে দরজা খুললেন তিনি। কি ভেবে তিনি দরজার দুটো পাল্লাই পুরোপুরি খুলে ফেললেন। হয়তো কোনার সোফায় বসা রাজিবকে মীরার আগমন দেখাতে। মিলন উঠে দাঁড়ালো তার আগমনে, রাজিবের দেখার সাহস নেই ঐ দিকটায়, মাথা নিচু করে বসে আছে ও। ঘরে ঢুকলো কেও, জুতা খোলার শব্দ পাওয়া গেলো। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো সে। কে তা এখনো জানে না রাজিব, মীরাও হতে পারে আবার টুম্পাও। ঘরে ঢুকলো সে সালাম দিয়ে বললো-
: “দাঁড়িয়ে কেন? আপনি বসুন”
স্বাভাবিক স্বরে বলা কথা, কিন্তু কন্ঠে ঝনঝনানি স্পষ্ট। প্রতিটি শব্দ যেন ধারালো চাকু। রাজিব না তাকিয়েও বুঝলো এ কন্ঠের মালিক আর কেও না ‘মীরা’। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো রাজিব। যেন চোখ বন্ধ করলেই দুনিয়া থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে ও। নূহা ফোন রেখে মায়ের কাছে গেলো। নূহাকে কোলে নিলো মীরা। মিলনের উদ্দেশ্যে বললো-
: ” আর দশটা মিনিট সময় নিচ্ছি ভাইয়া, বাইরে থেকে এসেছি তো একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি”
মিলন বললো-
: “সমস্যা নেই আপনি আসুন”

নিজের ঘরে গেলো মীরা, বসে রইলো কিছু মুহূর্ত। অনেক কিছু ভেবে চোখ আর্দ্র হতে চাইলো। তখনি উঠে বাথরুমে গেলো ও। আজ ওকে ভেঙে পরলে হবে না। আজ ওর জীবণের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। ঝটপট গোসল সারলো মীরা। চুল আচরে তৈরী হয়ে নিলো প্রত্যহিক প্রসাধনে।

ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট পরেই এলো বসার ঘরে। রাজিবের পাশের সোফায় বসলো সহজ ভঙিতে। অপরদিকের সোফাতে বসলে ওর মুখোমুখি হবে, ওর দিকে চোখ যাবে তাই ওকে একপাশে রেখে মিলনের মুখোমুখি বসলো মীরা। সোফায় বসে কাকে যেন একটা কল করলো। একঘন্টার মধ্যে বাসায় আসতে বললো তাকে। কাকে আসতে বললো?, কেন বললো? তার কিছুই বোঝা গেলো না। তারপর সোজা হয়ে বসে মীরা বললো –
: “তারপর বলুন কি খবর?”
মিলন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো যেন মীরার সামনে। কতকিছু ভেবে এসেছে বলবে। এখন সব এলোমেলো হয়ে গেলো সামনাসামনি এসে। যেন অপরাধী রাজিব না ও নিজে। তোতলানো সুরে বললো-
: “আসলে… ”
: ” বন্ধুর হয়ে সুপারিশ করতে এসেছেন?”
: “না, তা নয়, আসলে কিভাবে শুরু করি”
: “আচ্ছা শুরুটা না হয় আমিই করি?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালে মিলন মীরার দিকে। কথার আটঘাট বাঁধা মীরাকে বেশ আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে এখন। অনেক পোড়া সোনা যেম খাঁটি হয়ে উজ্জ্বল হয় তেমনি ঔজ্জ্বল্য ওর চোখেমুখে, এর দমকের সামনে দমিয়ে যাচ্ছে মিলন। আর রাজিব তখনো অবনত মস্তকে চোখ বন্ধ করে শ্রবণ করছে সে কন্ঠ আর মনে মনে ডাকছে ইশ্বরকে।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৫৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিট পরেই এলো বসার ঘরে। রাজিবের পাশের সোফায় বসলো সহজ ভঙিতে। অপরদিকের সোফাতে বসলে ওর মুখোমুখি হবে, ওর দিকে চোখ যাবে তাই ওকে একপাশে রেখে মিলনের মুখোমুখি বসলো মীরা। সোফায় বসে কাকে যেন একটা কল করলো। একঘন্টার মধ্যে বাসায় আসতে বললো তাকে। কাকে আসতে বললো?, কেন বললো? তার কিছুই বোঝা গেলো না। তারপর সোজা হয়ে বসে মীরা বললো –
: “তারপর বলুন কি খবর?”
মিলন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো যেন মীরার সামনে। কতকিছু ভেবে এসেছে বলবে। এখন সব এলোমেলো হয়ে গেলো সামনাসামনি এসে। যেন অপরাধী রাজিব না ও নিজে। তোতলানো সুরে বললো-
: “আসলে… ”
: ” বন্ধুর হয়ে সুপারিশ করতে এসেছেন?”
: “না, তা নয়, আসলে কিভাবে শুরু করি”
: “আচ্ছা শুরুটা না হয় আমিই করি?
বিস্ফোরিত চোখে তাকালে মিলন মীরার দিকে। কথার আটঘাট বাঁধা মীরাকে বেশ আত্নবিশ্বাসী দেখাচ্ছে এখন। অনেক পোড়া সোনা যেম খাঁটি হয়ে উজ্জ্বল হয় তেমনি ঔজ্জ্বল্য ওর চোখেমুখে, এর দমকের সামনে দমিয়ে যাচ্ছে মিলন। আর রাজিব তখনো অবনত মস্তকে চোখ বন্ধ করে শ্রবণ করছে সে কন্ঠ আর মনে মনে ডাকছে ইশ্বরকে।

মিলন থতমত ভাবে বলে-
: ” আসলে ভাবী, আমি এখানে বিচার করতে আসিনি। আমি বিচার করার কে বলেন?”
: ” বিচার করার কেও না হলে সুপারিশ করারও কেও না আপনি, আপনার কিছু বলার থাকলে শুনতে হবে আমাকেও”
মিলন কায়দা করতে না পেরে চুপসে যায়।
পায়ের উপর পা তুলে সোজা হয়ে বসে মীরা৷ তারপর সবলিল ভঙ্গিতে আমি এক্কেবারে শুরু থেকে শুরু করছি, কথাগুলো আপনার অসংলগ্ন মনে হতে পারে। কথাগুলো এ পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক।

: “তো আমার নানার গ্রামের বাড়ি আর উনার দাদার গ্রামের বাড়ি একই এলাকায়। আমার নানু বাড়ির দুই তিন বাড়ি পর ঐ বাড়ি। আমার দাদা-দাদী না থাকায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে খুব একটা যাওয়া হতো না। ছোট বেলায় গ্রাম বলতে নানা বাড়ির স্মৃতিই ভেসে উঠে। উনার মা মারা যাবার পর থেকে উনি উনার দাদর বাড়িতেই থাকতেন, সেখানেই উনার বেড়ে ওঠা। আর আমরা ঈদ কিংবা আম-কাঁঠালের ছুটিতে বেড়াতে যেতাম। সেই সুবাদে ছোট বেলা থেকেই মুখ চেনা থাকলেও কথা হতো না তেমন। বড় হওয়ার পর মাত্র দুইদিনের আলাপে আমাদের মধ্যে প্রেম হয়৷ তখন আমি মাত্র ক্লাস টেনে পড়ি। উনার বড় চাচার ছেলে পারভেজ তখন এলাকার কাউন্সিলর ছিলেন। সেই সুবাদে উনার এলাকায় বেশ নামডাক ছিলো তখন, অবশ্যই তা খারাপ দিকে। তখন তার ফোন থাকলেও আমার নিজের কোন ফোন ছিলো না। তাই আমাদের প্রেম চলতো ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান থেকে।

একবার নানী অসুস্থ হলো আমরা তাকে দেখতে গেলাম পুরো পরিবার মিলে। তখন ঘোরতর বর্ষা চারদিকে। সে বছর বন্যা অনেকদিন স্থায়ী ছিলো। নানীদের বাড়ির চারপাশের রাস্তাও পানিতে ডুবে আছে। রাস্তা থেকে নানীর বাড়ি যাবার একমাত্র উপায় নৌকা। এতদিন পর গ্রামে এসেছি, পরদিনই লুকিয়ে দেখা করেছি দুজনে। সেদিন কথা বলার সময় মামা দেখে ফেলেন আমাদের। সে নিয়ে শুরু হয় হুলুস্থুল। কারন আগই বলেছি এলাকায় বাজে ছেলে হিসেবে উনার তখন বেশ নামডাক। পড়াশুনা তেমন করতো না, মারামারিতে, গ্যন্জামে সিদ্ধহস্ত। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মামা এটা মেনে নিতে পারেননি। এদিকে নানী অসুস্থ এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাকে এভাবে রেখে আমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়াও অসম্ভব। উপায় না দেখে মামা মামীরা আমাকে কড়া নজরদারিতে রাখতে শুরু করলেন। এসব দেখে তার মাথা খারাপ অবস্থা। তিনি তার চাচাতো ভাই পারভেজকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠালেন আমাকে বিয়ে করার জন্য। তখন আমি কলেজে উঠেছি মাত্র। আর উনি এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

আমার বড় মামা রেগে আগুন। কত বড় সাহস পারভেজের, উনি কোন সাহসে তার গুন্ডা, ভাদাইম্মা ভাইয়ের হয়ে তার ভাগনীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়৷ এসব ব্যাপার নিয়ে তৈরী কলহ খুব অল্প সময়ে পারিবারিক বিবাদে রূপ নেয়৷ দুই পরিবারেরই প্র্যাস্টিজ ইস্যু। তারা মেয়ে দিবে না, আর তােদের পরিবার যে করেই হোক এই মেয়ে নিবেনই, এমন অবস্থা।

এরমধ্যে এক রাতে আমি আমার মামতো বোনদের সাথে ঘুমিয়ে আছি কাচারি ঘরে। এমন সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে ভিতরে ঢুকে একজন। তার পিছনে আরো অনেকে। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছিলো। প্রথমে ডাকাত ভেবেছিলাম, পরে গলার স্বর শুনে বুঝেছিলাম তিনি। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। আমি যেন পিস্তল হাতে এই লোকটাকে চিনতে পারছিলাম না। বোনেরা চিৎকার শুরু করলে ওদেরকে পিস্তলের ভয় দেখিয়ে চুপ করতে বলে। ওদের বোবা আহাজারি, কান্না শুনেও কেও এদিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে না। কারন তারা এখানে আসার আগে সবগুলো ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে এসেছে। টর্চ জ্বেলে তিনি আমাকে নেমে আসতে বলেন।

তারপর তারা নৌকায় করে আমাকে নিয়ে গেলো। যাবার আগে বাড়ির সামনের সব নৌকা উল্টে দিলো। আমি ভয়ে শেষ, “কাকে ভালোবাসলাম আমি? মামা, মামীরা তো তাহলে ঠিকই বলেছিলো ও ভালো ছেলে না” এই ভেবে। আমার ভয়, কান্না দেখে তার চাচতো ভাই পারভেজ ধমক দিলো তাকে। “কিরে কার লগে ভাব ভালোবাসা করলি? এত রিস্ক নিয়া তুলে আনছি খুশি হইবো কি? কি ভ্যাভ্যা করতাছে, আরে আমগো প্রেমিকারা তো বিয়ার আগেই…….! খুব বাজে কথা ছিলো সেটা। রাত গভীর হচ্ছে, নৌকা কোথায় যাচ্ছে জানি না। কাঁদতে কাঁদতে আমি কখন ঘুমিয়ে পরলাম তার খেয়াল নেই। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে আবার শুরু হয় আমার কান্না। উনি খুব করে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে উনি যা করেছেন তা আমাকে ভালোবাসেন বলেই। আমি কিছুতেই কিছু বুঝি না, কাঁদতেই থাকি, বাবার কাছে যাবো বলে। উপায়ন্তর না পেয়ে তারা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে গ্রামে তাদের বাড়িতে। ভেবেছিলো এক রাত বাইরে থেকে বদনাম হয়েছে মেয়ের, তাই বিয়ে না দিয়ে উপায় কই মেয়ের বাবা-মায়ের? কিন্তু খবর পেয়ে আমার মা আমাকে তাদের বাড়ি থেকে আনে, আমার কাছে সবটা জেনে খুব কাঁদলেন সারাদিন। বাড়ির শোকের বিষয় অসুস্থ নানীর থেকে সরে আমার দিকে এসে পরলো। রাতের বেলা তারা এলেন, মা তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করলেন। জলে থেকে কুমিরের সাথে তো লড়াই চলে না। ঐখানে থাকা অবস্থায় তাদের সাথে তাল দিয়ে চলেন মা । বললেন যে ঢাকায় গিয়ে সবাইকে জানিয়ে আমাকে তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবেন। এই ভাব ধরে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় আসি সবাই, এই আসাই শেষ আসা।

ঢাকায় এসে আমার মা পুরোপুরি বদলে যান। যা গেছে গেছে, আমাকে অনেক বুঝিয়ে ফিরানোর চেষ্টা করে। এদিকে এ গল্পের বদৌলতে আমি হয়ে গেলাম কলেজে সকলের মধ্যমণি। সকলের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম যা আমি ফেলে এসেছি তা এদের(আমার সহপাঠীদের) ফ্যান্টাসি। ধীরে ধীরে আমি বুঝে গেছি কত ভালো বাসলে কেও এমন করতে পারে প্রেমিকার জন্য। আমিও মরিয়া হয়ে খুঁজছিলাম আবার এক হওয়ার রাস্তা। বান্ধবীদের সাহায্য নিয়ে আবার কথা বলা শুরু করলাম গোপনে। এদিকে বাবা-মা ও আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু করলেন। এসব শুনে উপায়ান্তর না দেখে এইচএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় আসেন তিনি ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার ছুতায়। খুব সম্ভবতঃ আপনাদের সেখানেই পরিচয়। কি ভাগ্য আমার আমাদের ঢাকার বাড়িও একই এলাকায়।

এদিকে ও ঢাকায় তা আমার বাবা মা জেনে আমাকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে শুরু করলো। পাত্র খোঁজা নিয়ে ও তোরজোর শুরু করলেন। এমন সময় আমার ময়ের বান্ধবী সব জেনে তার একমাত্র ছেলের বিয়ের জন্য প্রস্তাব রাখলেন। আপনি হয়তো জানেন না, আবীর নামের সেই ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিলো আমার। যার ঢাকায় বাড়ি আছে, নিজের ব্যাবসা আছে, যে কর্মঠ, প্রতিষ্ঠিত। সেই তাকে ছেড়ে বিয়ের পরদিন আমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছি বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি দিয়ে। সবাই বলেছে অনেক বড় ভুল করছি আমি। কিন্তু আমি কারো কথা শুনিনি। ভালোবাসায় অন্ধ আমি ভালোমন্দ, ঠিক ভুল কিছুই খুঁজিনি। খুঁজেছি একটা ভালেবাসার মানুষ, বিশ্বাস্ত কাঁধ।

তখন ও কি করতো জানেন? মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনের চাকরী করতো। সেখানকার চাকরীও চলে গেলো বিয়ের কয়েকদিনের মাথায়। বিয়ের পর তিন মাস খরচ চালিয়েছিলাম গয়না বিক্রি করে। তারপর হঠাৎ অসুস্থ হলেন উনি, আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। চাঁদা তুলে, মানুষের থেকে চেয়ে, দাতব্য সংস্থার সাহায্য নিয়ে কিভাবে যে তার চিকিৎসা করালাম তা কি তিনি ভুলে গেছেন? এরপর তিনি সুস্থ হবার পর শুরু হলো আরেক যুদ্ধ। পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবার। কোনদিন কাজ না করা আমি কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছি, তার সাক্ষী আমার এই হাতদুটো। কারখানার স্টাফদের রান্না করে খাইয়েছি, কারখানার দেখাশোনা করেছি তা কি উনি দেখেন নি? কারখানা যখন একটু বড় হতে শুরু করলো তিনি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতেন, কি? কিভাবে? করতাম তার খোঁজ ও রাখতেন না। আমার কাজের চাপ, শারীরিক অসুস্থতা, পরিবার থেকে দূরে থাকার হতাশায় কোনদিনও পাশে থাকেন নি উনি, তিনি কেবলি আমার শয্যসঙ্গী, তার সাথে যত বোঝাপড়া সবই বিছানায়। এত এত চাপে ক্লান্ত আমাকে তিনি মানুষ ভাবেননি কখনো, ভেবেছেন Wife, আমিও সব রাগ, ক্ষোভ, ক্লান্তি একপাশে রেখে স্বামীর দায়িত্বশীল স্ত্রী হতে চেয়েছি।

তারপরও তিনি পর নারীর দিকে হাত বাড়িয়েছে। আমার কারখানার স্টাফ থেকে শুরু করে, মাঝবয়েসী মহিলা কেওই বাধে নি ওর রুচিতে। প্রতিদিন ক্লাবে গিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরা, সপ্তাহান্তে প্রমোদ ভ্রমণ, সেখানে ম’দ আর মে’য়ে নিয়ে রাত্রীবাস এসব খবর তো আপনিও জানেন । সব বুঝেও চোখ বন্ধ করে তার একটার পর একটা করা ভুলকে ঢেকে রেখেছি সমাজের কাছ থেকে। মানুষের আমাকে নিয়ে করা ভবিষ্যৎ বানীকে ভুল প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেই সেই ভুলকেই বয়ে চলেছি বছরের পর বছর। ভেবেছিলাম শুধরে নিবে, বদলে যাবে।
কিন্তু দিনশেষে কি পেয়েছি জানেন?

অবিশ্বাস
প্রতারনা
বিশ্বাসঘাতকা

কথাগুলো বলে দু হাতে মুখ চেপে রাখে মীরা। মেয়েটার চোখের পানির বাঁধ এতক্ষণে ভাঙলো বলে।

ওড়ানায় মুখ মুছে সোজা হয় ও, কান্না, আর আবেগকে পাশে রেখে বলে এখানেই শেষ নয় ও আমার সাথে চিট করে ব্যাংক একাউন্ট, বিজনেস পেপার সব নিজের নামে করে নিয়েছে। আমার নিজের রোজগার টাকায় কেনা বাড়ি বন্ধক রেখে আরেকজনকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। দিনশেষে কি হলো?

সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার কি জানেন ভাই-
আমার বাবার মৃ*ত্যুর খবর পেয়ে তার লা’শের সামনে গিয়েও বাবাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারি নি এই ভুল আগলে রাখার শাস্তি হিসেবে। মা’কে ভুল বুঝেছি বছরের পর বছর।

এবার আপনি বলেন যাকে পেতে এত ত্যাগ করলেন, সেই পাগলপ্রায় প্রেমিক যদি আপনার সাথে চিট করে, আপনি বর্তমান সত্ত্বেও অন্য কাওকে ভালোবাসে, বিয়ে করে, গোপনে আপনার সবকিছু নিজের নামে করে নেয়, তাহলে আপনি কি করতেন?

এতক্ষণে সোফায় হেলান দিয়ে বসে মীরা। এত কথা একসাথে বলে ও ক্লান্ত। ওর পাশের সোফায় বসা রাজিব তখনো উবু হয়ে দুই হাতের মুখ ঢেকে রেখেছে। যেন চেহারা দেখাতেও লজ্জা পাচ্ছে ও। হাতের ফাঁক গলে ফোঁটায় ফোঁটায় পরছে চোখ সমুদ্রের জল। দামী তুর্কি কার্পেট তা শুষে নিচ্ছে মুহুর্তেই।

অপরদিকের সোফায় বসা মিলন দুই হাত দুপাশে রেখে মাথাও নিচু করা। এ কার হয়ে বাড়ি বয়ে এসেছে ও সুপারিশ করতে। ওর নিজেরই ইচ্ছে হচ্ছে একে একলা করে দিতে।

এমন সময় কলিংবেল বাজে। উঠে গিয়ে মীরা দরজা খুলে। জড়তা হীন কন্ঠে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানায় দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে। বলে-
: “একেবারে ঠিক সময়ে এসেছেন এডভোকেট রামীম”

একটা কালো হ্যান্ড ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকেন তিনি। তাদের সামনে এসে সবাইকে হ্যালো বলে অভিবাদন জানালেন। রাজিব তখন মাথা নিচু করে বসে। মিলন তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এ সময়ে এডভোকেট! হজম করতে পারছে না বিষয়টা। রামীম সাহেব মিলনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে হাত বাড়িয়ে দিলো সংবিৎ ফিরে মিলনের, হ্যান্ডশেক করা ভুলে মিলন একপাশে সরে জায়গা করে দেয় তাকে বসতে। লোকটা হাসিমুখে বসে সেন্টার টেবিলে ব্যাগটা রেখে কাগজপত্র বের করেন। যেন কি করবেন তা সব পূর্ব নির্ধারিত, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে কাগজগুলো ঠিক করে এগিয়ে দিলেন মীরার দিকে, যেন তার ভীষণ তাড়া। কাল বিলম্ব না করে পেপারস্ গুলোতে সাইন করলো মীরা। তারপর তা ফিরিয়ে দিলো এডভোকেটের কাছে। তিনি “মি: রাজিব” বলে সসম্মানে সেটা এগিয়ে দিলেন রাজিবের দিকে। রাজিব যেন এতক্ষণ কি হলো কিছুই জানে না, ভাবলেশহীন দৃষ্টি ওর চোখে-মুখে। চোখ রক্ত বর্ণ হয়ে আছে। সাইড টেবিলের টিস্যু বক্স থেকে ট্যিসু নিয়ে চোখ মুছে ও। তারপর আজ্ঞাবহের মতো কাগজগুলো হাতে নেয়। মনোযোগ দিয়ে পড়ে কাগজটা, একটু খানি পড়েই বুঝে ফেলে কি এই কাগজ। কাগজ নামিয়ে রেখে মীরার দিকে তাকায় রাজিব। ভীতি আর বিষ্ময় মেশানো সে দৃষ্টি মীরা চেয়েও দেখে না। একটা বারের জন্য ও তাকায় না ওর দিকে। কাগজটা রেখে কান্নায় ভেঙে পরে ও। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে রাজিব। টুম্পা এতক্ষণ এদের সামনে আসেনি। কান্না শুনে নোংরা রাজিবের এ পরিণতি দেখার লোভ সামলাতে পারলো না ও। মাজেদা খালা আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আজ তার কেন জানিননা আজ প্রথমবারের মতো খারাপ লাগছে রাজিবের জন্য। এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরেকবার ভাবতে বলেছিলেন তিনি মীরাকে। মীরা শান্ত কন্ঠে বলেছে- ” আপনি কি চান, এমন দুঃশ্চিত্র, লম্পট, দায়িত্ব জ্ঞানহীন কেও ক্ষমা পেয়ে যাক ? ”
আর কিছু বলার সাহস হয়নি মাজেদা খালার। আর
টুম্পা বলেছে- আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমি আপনার পাশে থাকবো।

মীরা তাই নিজের সাথে নিজে বুঝেছে। এ কয়টা দিন কেবলি এসব ভেবেছে। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলস্বরূপ এডভোকেট রামীম আজ এখানে।

কাগজগুলো ছিড়ে ফেলে রাজিব। টুকরো টুকরো করে। জীবণের সকল ভুলের রাগ আর ক্ষোভের বলি হয় ঐ কাগজগুলো। এডভোকেড রামীম কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পরেন রাজিবের এমন আচরণে। মীরা পরিস্থিতি সামলে নিতে তাকে আরেক সেট কাগজ তৈরী করতে বলে আসতে বলেন। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করেন তিনি।

মীরা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভিতরের রুমে গিয়ে নূহাকে কোলে নিয়ে ফিরে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তারপর নূহাকে মাজেদা খালার কাছে দিয়ে নিচে চলে যেতে ইশারা করে। মাজেদা খালা আর টুম্পা নিচে চলে যায়। এরপর ও মিলনের উদ্দেশ্যে বলে-
: ” এখন, এই মুহূর্তে আমরা এক কাপড়ে চলে যাবে এ বাড়ি ছেড়ে। কাজটা আগেও করতে পারতাম। পাছে আমার না কোন দোষ হয়, এমনিতেই কোন দোষ না করেই অনেক দোষের ভাগী আমি। তাই আপনাদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। এই ফ্ল্যাট বন্ধক রেখে আমি কিছু টাকা লোন এনেছিলাম, সেটা ফেরত দিয়ে পেপারস নিয়ে এসেছি গতকাল, এই যে সেই কাগজ” কথাটা বলে একটা ফাইল তুলে দেয় মীরা মিলনের হাতে। তারপর একে একে আলমারী, গাড়ি, কারখানার সকল চাবি বুঝিয়ে দেন মীরা তাকে। মিলন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কেবল, সে যেন বোবা কেও৷ মনের ভাব প্রকাশের ভাষা জানা নেই তার। সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে মীরা বলে-
: ” আজ থেকে আমার কিংবা আমার মেয়ের কোন দাবিই রইলো উনার উপর। সকল দাবি আমরা ছেড়ে দিলাম”
বলেই উঠতে গেলেই রাজিব ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় ওর সাথে সাথেই, খপ করে ধরে মীরার হাত, বলে-
: ” কোথায় যাবে তুমি আমাকে ছেড়ে?, চললাম বললেই হলো? এত সহজ সব শেষ করে দেয়া? আমি আমার সব পাপ, সব অপকর্ম, সকল ভুল স্বীকার করছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও মীরা। তুমি তো জানো এক তুমি ছাড়া আর কেও নেই আমার, কেও না”
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় মীরা, এত সহজে হাত ছাড়িয়ে নিতে পারবে ভাবতে পারে নি ও।
রাজিব এত দূর্বল!

সেখান থেকে কোনমতে উঠে মীরার পায়ে পরে রাজিব। মীরা পা ছাড়াতে অনেক চেষ্টা করেও না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে।

চোখ উপচে পানি পরতে থাকে মীরার। এমন দিনের স্বপ্ন তো ও দেখেনি কোনদিন। তাহলে কোন পাপর শাস্তি স্বরূপ খোদা ওকে এ কষ্ট দিচ্ছে। একে একে মনে পরে ওর সবকিছু। বাবা-মাকে কষ্ট দেয়া, তাদের কথা না শোনা, একজন নির্দোষকে কলঙ্কিত করা। এসবের শাস্তি পাচ্ছে ও। কিন্তু নূহা! ওর তো কোন দোষ নেই, ও কেন স্বাভাবিক একটা পরিবার পাবে না, বাবা মায়ের ভালোবাসার মাঝে বেড়ে উঠবে না। ওর কি দোষ? মেয়েটার ভবিষ্যৎ ভেবে কষ্টে বুক ভারী হয়ে গেলো। সেই কষ্টের শোক একত্রে করে পা ছাড়িয়ে নিলো ও এক ঝটকায়। রাজিব ভারসাম্যহীন ভবাে বসে থাকার দরুন ঝিঁটকে পরে গেলো মেঝেতে। মীরা মিলনকে বললো-
: ” ডিভোর্স পেপার এ বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে যাবে, আমি চললাম মিলন ভাই, ভালো থাকবেন ”

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৬০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

নিজের কষ্টে গড়া সোনার সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে মীরার নিজেকে বড্ড ভারী মনে হতে লাগলো। হাত-পা, পুরো শরীর ফুলে আছে যেন। এ বাড়ির লিফট বিকেল থেকে বন্ধ। মীরাকে এখন আটতলা থেকে নামতে হবে সিঁড়ি ভেঙেই। সুন্দর দামী টাইলসের সিঁড়ি গুলো দিয়ে নামতে নামতে মীরার মনে হচ্ছিল এ যাত্রা যেন কোনদিন শেষ হবে না। অনন্তকাল ধরে মীরা এমনি সিঁড়ি বেয়ে নামতেই থাকবে নামতেই থাকবে। থেকে থেকে কান্নার জলেপূর্ণ হচ্ছে ওর চোখ, দৃষ্টি মাঝে মাঝেই ঘোলা আর ঝাপসা হয়ে আসছে। দু-একবার সিঁড়ি থেকে পরে যাবার উপক্রম হয়েছিলো এই বিড়ম্বনার দরুন। দুইবারই সিঁড়ির রেলিং ধরে পরে যাওয়া থেকে বেঁচেছিলো কোন মতে। নিজেকে আর বয়ে নিতে পারছে না যেন মীরা। পানি উপচে পরা চোখ ওড়নার কিনারায় মুছছে নিয়মিত বিরতিতে। শান্ত করতে চেষ্ট করছে বিক্ষিপ্ত মনকে, বুঝিয়ে বলছে “অনেক কাজ বাকী, এখন এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না তোকে মীরা” মনকে দেয়া প্রবোধে কাজ হলো। কান্নাটা কোনমতে বাগে এনেছে ও। তবে আটতলা থেকে নিচ পর্যন্ত নামাটা ওর কাছে এভারেস্ট জয় করার সমান মনে হচ্ছে আজ।

অন্ততকালের এ যাত্রা শেষে নিচে নামতেই দেখে পার্কিং-এ টুম্পা নূহার সাথে খেলছে, আর মাজেদা খালা মুখ ভার করে ভাবুক দৃষ্টিতে বসে আছেন। মীরাকে দেখে দাঁড়ালেন তিনি, টুম্পাও নূহাকে নিয়ে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। মীরা নূহাকে কোলে নিয়ে টুম্পাকে বলে রিকশা ঠিক করতে।

মীরার আদেশ শুনে আজ্ঞাবহের মতো রিকশা ঠিক করতে যায় টুম্পা, মীরা কেমন যেন টালমাটাল ভঙ্গিতে পরে যেতে নেয়। মাজেদা খালা মীরার এ অবস্থা খেয়াল করে নূহাকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। যা কিছুর ভিতর দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, দাঁড়িয়ে যে আছে এখনো, এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। মীরার মুখের দিকে চেয়ে চোখ ভিজে যায় তার। চোখের এ পানি লুকাতে তিনি নূহাকে নিয়ে গেইটের কাছে যায়। মীরা ভারসাম্যহীনের মতো বসে পরে সিঁড়ির গোড়ায়। মাথাটা ভনভন করছে, চারপাশ ও দুলছে মনে হচ্ছে। রিকশা ঠিক করে নূহা আর টুম্পা উঠলো একটাতে, অপরটায় মাজেদা খালা উঠলেন মীরাকে নিয়ে। রিকশায় বসে মীরার একবার তাকায় বাড়িটার দিকে, ওর ফেলে আসা জীবণের দিকে, শেষ বারের মতো। কত স্মৃতি এ বাড়িতে ওদের জীবণকে ঘিরে। সবকিছু আজ শেষ হয়ে গেলো। ভুল নামের এ অধ্যয়ের সমাপ্তি হলো আজ। যার শুরু হয়েছিলো বর্ষা নামের গ্রীষ্মের তেজে তাঁতা এক দুপুরে।

হঠাৎ মীরার চোখ যায় ওর স্কুটির দিকে। লাল টুকটাকে স্কুটিটা যেন মীরাকে বলছে-
: ” আমাকে নিলে না সাথে? আমি তো ছিলাম তোমার কষ্টের দিনগুলোতে তোমার পাশে”
এমন সময় রিকশা চলতে শুরু করলে রিকশাওয়ালার কাঁধে হাত দিয়ে থামাতে বলে মীরা। অল্পবয়সী রিকশাচালক ছেলেটা বিব্রত হয় মীরার এমন ডাকে। রিকশা থামলে তার কাঁধে ভর দিয়ে নামে মীরা। হেসে বলে-
: “কিছু মনে করো না ভাই, আমার ছোট ভাইটা তোমার বয়সী”
বহু কষ্টে সেখান থেকে নেমে ব্যাগে থাকা স্কুটির চাবিটা বের করে মীরা। সিকিউরিটির রুমে গিয়ে তাকে সেটা দিয়ে বলেন-
: “চাবিটা আপনার স্যারকে দিয়ে দিবেন মনে করে”
বলে এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না ও। দ্রুত রিকশায় উঠে বলে- “চলো ভাই”।
রিকশা চলতে শুরু করে গন্তব্যের উদ্দেশে।

মীরাদের রিকশা গুলো থামে ওর ওয়্যার হাউজের ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে। এ বাড়ির দুই তলায় ওদের এই ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ই, তবে বাস করার মতো উপযোগী না এখনো। মাল পত্রে ঠাসাঠাসি।
কিন্তু ওর তো এখানে ছাড়া আর কেন জায়গা নেই গিয়ে দাঁড়াবে৷ জীবণে এ পরিস্থিতিতে এমন সময়ে মেয়েরা তার পরিবারের কাছে ফিরে যায়। ওর সেই উপায়ও নেই, সবইতো নষ্ট করে এসেছে নিজ হাতে। মীরার খুব মনে পরে ওর পারভীন আন্টির বলা কথাগুলো। তিনি বলেছিলেন- ” কি ভুল যে করলি একদিন ঠিক বুঝবি, কিন্তু তখন বুঝেও কোন লাভ হবে না” – সত্যি ও সব ভুল বুঝেছে, কিন্তু এখন বুঝে কোন লাভ নেই। সেই সব দিন, ওর বাবার ওকে মৃ*ত ঘোষণা করা সব সব মনে পরে মীরার। পুরো রাস্তাটাই নিরবে কাঁদতে থাকে মীরা। এ কান্না যেন চোখ দিয়ে কেবলি জল গড়িয়ে পড়া। আবেগ অনুভূতির কোন অভিব্যাক্তি নেই ওর চোখেমুখে। একটু পর পর মীরার পাশে বসা মাজেদা খালা ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেন, এ আবার কেমন কান্না? কতটুকু চাপ মনের মধ্যে থাকলে এভাবেও কাঁদে মানুষ!

বাসায় ফিরতে ফিরতে কোলেই ঘুমিয়ে পরে নূহা। দুপুরে সে ঘুমায় নি আজ। তাই তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পরলো। এ ফ্ল্যাটটায় একটা ঘরই কেবল খালি। সেখানে সামনের অংশে অফিস ডেস্ক আর ভিতরের দিকে রেস্ট করার জন্য শুধু একটা মেট্রেস রাখা। সে ঘরে থাকা ম্যাট্রেসে বালিশ ছাড়া শুইয়ে দিলো ও নূহাকে। এসে অবধি ঘরকে থাকার উপযোগী করছে টুম্পা আর মাজেদা খালা দুজন মিলে।

মোটামুটি গোছগাছ সব শেষ। রাত দশটা হতে চললো, মাজেদা খালা খাবার কিনে আনতে বাইরে গেলেন। টুম্পা নূহার খাবার তৈরীর জন্য গরম পানি করছে। টুমটাম জিনিসপত্র কিছু আছে এখানে, চা তৈরীর পাত্র, মুড়ি মাখা তৈরীর জন্য চপিং বোর্ড, চাকু, খাবার গরম করার পাত্র৷ কিছু বাসনকোসন, চামচ, বাটি। তবে রান্না করার তৈজসপত্র নেই এখানে৷ “কালকে সকাল সকাল গিয়ে এগুলো আনিয়ে নিতে হবে” – মনে মনে ভাবে টুম্পা।

পানি গরম করে পটে ভরে রেখে রুমে এসে দেখে মীরা ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। খুব সম্ভবতঃ কারো সাথে চ্যাট করছে তিনি। টুম্পা এ পরিস্থিতিতে মীরার মনের জোর দেখে একটুও অবাক হয় না।

মিনিট পাঁচেক পর, একটা কল আসে মীরার ফোনে। মীরা তখন বাথরুমে। টুম্পা বাথরুমের দরজায় নক করে বলে- “আপু ইউকে থেকে লোরা আপু কল করেছে”

একটু বাদেই বের হয়ে কল ব্যাক করে মীরা। ওপাশে কি বলে তা শোনা না গেলেও মীরার কথা শোনে টুম্পা-
: “হ্যা, হ্যালো”
: ———
: ” হ্যাঁ, আজ দুপুরেই ঢুকেছে, আমি সাথে সাথেই ইনফর্ম করেছিলাম তোমাকে ”
: ———-
: ” ও আচ্ছা, টেনশন হওয়ারই কথা, তুমি বাড়ি ফিরলে ওকে বলে দিও”
: ———-
: ” থ্যান্কংস এ লট ডিয়ার, কথাগুলো হয়তো ওকেও বলতে পারতাম না আমি, তুমি এগিয়ে না এলে এসব কল্পনা করার সাহসও হতো না হয়তো”
: ——
: ” আচ্ছা আর বলবো না, দোয়া করো আমার জন্য”

টুম্পা কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলো না, তবে বোঝার চেষ্টাও করলো না। কারন সময় গেলে ওর কৌতুহলী সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে ও। অপেক্ষা করাটা সহজাত হয়ে গেছে ওর। কিছু কাগজপত্র ঠিক করে আবার যেন কাকে কল দিলো বারান্দায় গিয়ে৷ এমন সময় নড়েচড়ে উঠে নূহা, না খেয়ে ঘুমানোর ফল। গরম পানিতে সেরেল্যসক গুলে নূহাকে খাওয়ায় ও। তারপর ব্রেস্ট ফিডিং করাতে মেয়ের পাশে শোয় মীরা । এই মেয়ে আড়াই বছর বয়স হতে চললো তবুও এ অভ্যাসটাকে ছাড়াতে পারলো না। এখন থেকে হার্ডলি এটাকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করবে ও।

টুম্পা কাগজ প্রিন্ট করে ওটা হাতে নিয়ে ফিরে এসে অবাক হয় মীরাকে ঘুমিয়ে পরতে দেখে। মাজেদা খালা আসার আগেই জেগে উঠা নূহাকে ফিড করাতে গিয়েই ঘুমিয়ে পরে মীরা। কাগজটা পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয় ও। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তার ছাঁট আসছে জানালা দিয়ে৷ জানালা খোলা রেখেই পর্দাগুলো টেনে দেয় পানির ছাঁট থেকে বাঁচতে। খুলে দেয় অপরদিকের জানালাও। স্তব্ধ, গুমেট প্রকৃতি যেন কথা বলা শুরু করেছে বৃষ্টির আগমনে। বাতাসের দমকে কাছাকাছি এসে আবার দূরে সরে যাচ্ছে গাছগুলো। যেন গোপন কোন কথা বলে নিরাপদে সরে যাওয়া। আজ সারা বেলা আকাশে মেঘ ছেঁড়া রোদ ছিলো। এসময়ে বৃষ্টিটার খুব দরকার ছিলো। বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাস ঘর থেকে গুমোট ভাবটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো সাথে করে।

একটু পরেই মাজেদা খালা ভিজে চুপচুপে হয়ে খাবার নিয়ে ফিরলেন। নূহার সকালের জন্য বিস্কুট, জুস ও কিনে এনেছেন তিনি। এখানে ফ্রিজ না থাকায় জুসটাকে পানির বালতিতে চুবিয়ে রাখলেন।
এসে বাথরুমে গিয়ে কাপড় বদলে নিলেন। মীরা না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে দেখে কষ্ট পেলেন তিনি। যদিও তার সন্দেহ ছিলো মীরাকে খাওয়ানোর ব্যাপারে। উপায়ন্তর না দেখে কিনে আনা খাবার পাতে বাড়েন তিনি।

কোনমতে খাবার খেয়ে ৭/৬ ফিট ম্যাট্রেসটায় আড়াআড়ি ভাবে শুয়ে পরেন তারাও। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, মীরার অতীত ধুয়ে নিয়ে যেতেই যেন প্রকৃতির এই নিবেদন। থেকে থেকে খুব কাছের চালে পরা বাজগুলো যেন মীরার ভেতরকার আত্নচিৎকরের উদ্গিরণ।

টুম্পা আর মাজেদা খালা দুজনের কারো চোখেই ঘুম নেই,কিন্তু দিব্যি ঘুমুচ্ছে মীরা৷ টুম্পা ভাবছে – “শেষ পর্যন্ত রাজিবটাকে শিক্ষা দিতে পারলো মীরা” লোকটা যে কত নোংরা তা ওরচে ভালে কে জানে। আর মাজেদা খালা ভাবছে – ” ক্যান সব দিয়া দিলো খালুরে, হেয় তো এডির মালিক না” এসব ভাবতে ভাবতে সময়ের আবর্তে ঘুমের অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে পরে তারাও।

বেশ রাতে ঘুম ভাঙে মীরার। আবছা করে চোখ খুলে দেখে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ওর কাছে বসে আছে ইরা। হাত ঠেলে ডাকছে ওকে। মীরা যেন আগের দিনগুলোতে ফিরে গেছে। বাবার বাড়িতে থাকার সময় যেমনি ডাকতো ইরা তেমনি ভাবে ডাকছে এখন ওকে। আবছা করে আবার তাকায় মীরা, দেখে সবসময়ের মতো ওর মা জাহানারা গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। এতদিনের দূরত্বে, কাছে আসাটা ভার হয়েছে তার৷ কেঁদে কেঁদে ইরা ডাকছে ওকে-
: “ওঠ আপা, আমরা তোকে নিতে এসেছি”
: ” আমাকে ক্ষমা করেছিস তোরা? তোরা তো বলেছিলি ওর সাথে সম্পর্ক থাকলে কোনদিনও আমাকে ক্ষমা করবি না, বিশ্বাস কর ওর সাথে সব সম্পর্ক চূর্ণ করেছি আজ,
ইরা কেঁদে বলে-
: “আমরা তা জানি আপা, তাইতো তোকে নিতে এসেছি”
: “ওর কোন ছায়া থাকবে না কাল থেকে আমার জীবণে। ওর দেয়া, ওর ছোঁয়া, ওর স্পর্শ আছে এমন কিছুই আনিনি আমি আমার সাথে। এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছি নিজের গড়া ঘর থেকে। আমি কোন টান রাখতে চাই নি, আমি চাইনি এমন কিছু থাকুক যা ওর কথা, স্মৃতি আমাকে মনে করিয়ে দিবে। মাজেদা খালা বকেছে আমাকে। কেন তাকে দিয়ে দিচ্ছি সব? আমি তো এসব চাই নি! আমি চেয়েছিলাম ভালোবাসা। তাই যখন হলো না টাকাপয়সা দিয়ে করবো কি? টাকাপয়সা কামাই করার পথ তো খোদা আমাকে চিনিয়েই দিয়েছে”

: ” থাক, এসব বলে কোন লাভ নেই, চল তুই আমাদের সাথে, ঐ যে দেখ মা এসেছেন তোকে নিয়ে যেতে”

: ” দাঁড়া আমার মেয়েটাকে নিয়ে নিই”
: ” না, ওকে না”
: “মেয়েটাকে নিবি না তোরা সাথে?”
: “না আপা, ওকে কেন নিবো, ও তো রাজিবের সন্তান, নোংরা রাজিবের রক্ত আছে ওর শরীরে”
: ” এভাবে বলিস না প্লিজ, ও যতটুকু রাজিবের ততোটুকু তো আমারও”
: ” রাজিব সংক্রান্ত সব তুই ছেড়ে এসেছিস, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি, কারখানা এগুলো সব তোর নিজের গড়া তবুও ওর পিছুটান ছাড়াতে এসব ছেড়ে এসেছিস তুই৷ তাহলে নূহা?”
: ” ও আমার মেয়ে ইরা”
এবার ওর মা জাহানারা এগিয়ে আসে ওর কাছে, মুখ কালো করে বলে-
: ” আমরা কেবল তোকে নিতে আসছি, ওকে না”
: “মা ও আমার মেয়ে, ওকে ফেলে আমি কিভাবে যাবো?”
: ” তুই ও তো আমারি মেয়ে ছিলি, কষ্ট দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলেও গিয়েছিলি, তখন তোর মনে ছিলো না যে আমার কত কষ্ট হবে তুই এমনটা করলে?”
ক্রন্দনরত অবস্থায় মীরা হাতজোড় করে বলতে থাকে-
: “মা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো, ভুল হয়ে গেছে আমার, বড্ড ভুল হয়ে গেছে”

এমন সময় উঁচু থেকে স্টিলের কিছু পরে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভাঙে মাজেদা খালার। এ বাড়িতে বিড়ালের আনাগোনা আছে। বিড়ালই হয়তো খাবারের লোভে এসে কিছু ফেলে গেছে। তিনি খোলা জানালায় গলে আসা মেঘ কাটা চাঁদের আলোতে দেখেন মীরা ঘুমের ঘোরে বলছে- “মা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে তুমি ক্ষমা” মীরার গায়ে ধাক্কা দেন তিনি, মীরা হুড়মুড়িয়ে উঠে শোয়া থেকে। উঠে দেখে কোথায় ইরা কোথায়ই বা জাহানারা। তারা কেও নেই অন্ধকার এই ঘরটায়। ওর হুঁশ হয় যে তারা বাস্তবে না এসেছিলো ওর স্বপ্নে। বাস্তবে এমনটা সম্ভব না কোনদিনই কারন ও তাদের কাছে মৃ*ত। আর এই ডেথ সার্টিফিকেট ওর বাবা নিজ হাতে লিখে গিয়েছিলেন। দু হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে মীরা। চিৎকার করে বলতে থাকে- “মা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করো”

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে