কিছুদিন পেরোতেই প্লাবন আবার বায়না ধরল সে মামার বাড়ি যাবে। এ বিষয় নুহাশ সাহেবের কানে যেতেই তিনি কিছুটা রাগ করলেন। বারবার বেড়াতে যাওয়ার আবদার করলে পড়াশোনা উচ্ছন্নে যাবে। প্রণয়া কখনো এই ধরণের আবদার করেনি, সে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী ছিল সবসময়। ভালো রেজাল্টও করত। কিন্তু ছোটো ছেলে যে কার মতো হয়েছে কে জানে?
নুহাশ সাহেব প্লাবনকে ঘরে বাঁধতেই মূলত নির্মলকে তার প্রাইভেট টিচার হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত নিল। প্রণয়া অবশ্য জানে প্লাবন প্রাইভেট কিংবা বাসায় টিচার রাখা একদম পছন্দ করে না। সে বরাবরই এই ব্যাপারটায় নাক সিটকায়৷ এছাড়া এখানে চা বাগানের মাঝের কোনো বাড়িতে প্রাইভেট টিচার রাখা সম্ভব নয়। এজন্য কখনো নুহাশ সাহেব সে চিন্তা করেননি। কিন্তু এবার নির্মল কাছেই থাকায় সেই সুযোগ পেল।
অবশ্য প্রণয়ার চিন্তায় জল ঢেলে প্লাবন হাসিমুখে পড়তে রাজি হয়ে গেল। যা দেখে প্রণয়া হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। সামান্য ক’টা চিপস, বিস্কুট খাইয়েছে বলে নির্মলকে টিচার হিসেবে মেনে নিলো সে? কেমনে সম্ভব?
প্লাবন প্রণয়াকে আরও চমকে দিয়ে নিজের এলোমেলো বই-খাতা গুছাতে শুরু করে দেয়। আগামীকাল থেকে নির্মল তাকে পড়াতে আসবে। আর আজ রাতে সে গোছানোতে হাত দিয়েছে, যেই দৃশ্য প্লাবনের বেলায় বিরল। প্লাবন হঠাৎ ভাবনায় ডুবে যাওয়া প্রণয়াকে টেনে বাস্তবে ফেরালো। প্রণয়া পলক ফেলে প্লাবনের দিকে চাইতেই প্লাবন বলল,
–“আপু, আমার ইংরেজি খাতাটা পাচ্ছি না। খুঁজে দাও না।”
প্রণয়া অস্ফুট স্বরে বলল,
–“বই-খাতার সাথেই আছে। ভালো করে খুঁজ!”
প্রণয়ার কথা শুনে প্লাবন আবার খুঁজল। পেয়েও গেল কিছু সময়ের মধ্যে। প্রণয়া হঠাৎ বলল,
–“এই, তুই কী সন্ধ্যার সময় বা রাতে বের হয়েছিস?”
প্রণয়ার কথায় প্লাবন তার কাজ থামিয়ে ভ্রু কুচকে তাকায়।
–“কী বলছ তুমি আপু?”
–“নির্ঘাত তোর ঘাড়ে জিন চেপেছে প্লাবন, নয়তো তুই এসব অস্বাভাবিক কাজ করছিস কীভাবে? মাকে বলব হুজুর ডাকাতে?”
প্লাবন জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হতাশ গলায় বলল,
–“তোমরাও না আপু, পড়তে বসলেও সমস্যা না বসলেও সমস্যা। তোমাদের এত সমস্যা কেন আমার পড়ালেখা নিয়ে?”
উত্তর নেই প্রণয়ার কাছে। ফাঁকিবাজ ছেলে হঠাৎ পড়াশোনায় ধ্যান দিচ্ছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগাটাই স্বাভাবিক। আর এই ফাঁকিবাজটা নাকি নির্মলের সংস্পর্শে এসে এরকম পড়ছে? অবিশ্বাস্য! প্রণয়ার শুরু থেকেই মনে হতো নির্মল জাদুটোনা জানে। নয়তো যে-ই তার সংস্পর্শে যাচ্ছে সেই কেন ওই মানুষটার ভক্ত হয়ে যাবে?
প্রণয়ার বরাবরের মতোই জিন, ভূতের গল্প পছন্দ। প্রায়ই ফোনে ভূত এফএম রেডিয়োতে ছেড়ে রাখে। এবং কানে হেডফোন গুঁজে নীরবে সে সকল গায়ে কাঁটা দেওয়া কাহিনী শুনে। ভয়ে তটস্থ হলেও প্রণয়ার এগুলোই ভালো লাগে। অবসরে যখন একা বসে আকাশ দেখে, তখন চট করে কোনো এক নির্দিষ্ট জিনের কাহিনী তার মাথায় ঘুরপাক খায়৷ আর প্রণয়া শুরু থেকে শেষ অবধি সেই কাহিনীতে বিচরণ করে, আপন মনেই সেই কাহিনীর চরিত্রদের আগে পরে অবস্থান নিয়ে বলত। যেমন- এই চরিত্রের এটা করা উচিত হয়নি, ওভাবে চাইলেও এসব ঘটতে পারত ইত্যাদি। তাই তার কথায় জিন কিংবা জাদুটোনা শব্দগুলো প্রায়ই শোনা যায়। প্রণয়ার যেন নেশা এসব শোনা। তার অবস্থা এমন যে, সে সারা রাত না ঘুমিয়ে থাকতে পারবে তবুও এগুলো শোনা ছাড়তে পারবে না। সে যতই ভয় পাক না কেন, শক্ত হয়ে শুনবেই।
*******
আবছা আলোয় কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। প্রণয়া সবে ব্রাশ করে বেরিয়েছে উঠোনে। হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। তার প্রায় রোজকার-ই অভ্যাস উঠোনে দাঁড়িয়ে একনজরে চা বাগান দেখা। কুয়াশা এবং চায়ের খুঁনসুটিগুলো ইদানীং বেশ টানছে তাকে।
অবশ্য প্রতিদিন এই চা বাগান দেখতে দেখতে বিরক্ত কিংবা একঘেয়ে হওয়ার কথা। প্রণয়ার একঘেয়েমি আসেও, তবে সেটা ক্ষণস্থায়ী। কয়েক দিনেই সেই একঘেয়েমি দূর হয়ে যায়। চা বাগান যেন প্রায়ই তাদের নিজেদের রূপ বদলায়। যা সাধারণ নজরে না এলেও প্রণয়া ঠিক বুঝতে পারে তাদের পরিবর্তন। হয়তো চায়ের বিশাল সম্রাজ্যও জানে, প্রণয়া নামের এক ফুল যে কি না তাদের সঙ্গে বসবাস করছে এবং সে চায়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে!
এই চা বাগানের সঙ্গে প্রণয়ার যেন অদৃশ্য নিবিড় সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। মানুষের সাথেও বুঝি উদ্ভিদদের এই অদৃশ্য সম্পর্ক সম্ভব? কেন নয়, নির্দিষ্ট মানুষটার মায়া এবং যত্নের মাধ্যমেই তো একটি উদ্ভিত বেড়ে ওঠে এবং তার সর্বাচ্চ ফলনটা তার মালিককে দেয়। তবে এখানে একা প্রণয়ার সাথে শুধু একটি গাছ নয়, অসংখ্য বিস্তৃত চা বাগান যেন প্রণয়ার বন্ধু হয়ে উঠেছে। প্রণয়া চায়ে চুমুক দিয়ে আপনমনে বলল,
–“চা বিলাস।”
–“শুভ সকাল।”
আচমকা পুরুষালি কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই প্রণয়া চমকে পিছে ফিরে তাকাল। নির্মল দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে। প্রণয়া চোখের দেখায় পরখ করে নিল নির্মলকে। একটা টাউজার এবং শার্ট পরেছে সে। আজ আবারও সেই কালো শার্ট। শার্টের হাতা কনুই অবধি গুটানো। বুকের দিকে একটা বোতাম খোলা। প্রণয়ার বলতে ইচ্ছে করল, “আপনার শীত করছে না?”
কিন্তু প্রণয়া মুখে সেরকম কিছু বলল না। নির্মলের কথার পিঠে মৃদু গলায় বলল, “শুভ সকাল।”
–“চাচা বাসায়?”
প্রণয়া ঘাড় নাড়িয়ে বোঝাল, ‘না।’
নির্মলও যেন সহসা বুঝে নিল প্রণয়াকে। সে চট করে টাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করে বলল,
–“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
প্রণয়ার একবার নির্মলকে বলতে ইচ্ছে করল বাসায় যেতে। কিন্তু নির্মল অধর প্রসারিত করে প্রণয়াকে বলল,
–“আসছি।”
বলেই সে বিদায় নিয়ে চলে গেল। প্রণয়া একমনে চেয়ে রইলো নির্মলের যাওয়ার পানে। হঠাৎ পলক ফেলে প্রণয়া নিজের দিকে তাকাল। তার গায়ে একটি শাল। আর সেখানে নির্মল এভাবে খোলামেলা পোশাকে বেরিয়ে গেল?
পাহাড়ে প্রায়ই শীত থাকে। নির্মল কী তা জানে না, নাকি ইচ্ছাকৃত শীতের পোশাক এড়িয়ে গেল? প্রণয়া হঠাৎ-ই উপলব্ধি করল এই নির্মল নামের স্বল্প চেনা মানুষটাকে নিয়ে প্রণয়া একমনে ভেবে যাচ্ছে। চটজলদি প্রণয়া নির্মলের ভাবনা বাদ দিল।
খাবার টেবিলে স্ব-পরিবারে নাশতা করতে বসেছে প্রণয়া। আজ সে কলেজ যাবে। তাই একদম তৈরি হয়েই বসেছে। প্লাবনও একদম তৈরি স্কুলের জন্য। প্লাবন অবশ্য আজ স্কুল যেতে চায়নি, গাঁইগুঁই করছিল। কিন্তু ফাহিমার ধমকে প্লাবন মুখ ভার করে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এখনো মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে মন খারাপ করে আছে।
নুহাশ সাহেব খাওয়ার মাঝে নিজেই বললেন,
–“নির্মল গেল শহরের দিকে, মায়ের জন্য নতুন শীতের কাপড় আনার জন্য। সে বুঝতে পারেনি পাহাড়ি অঞ্চলে এরকম শীতল আবহাওয়া। এছাড়া আমারও বলতে মনে ছিল না।”
প্রণয়া চুপ করে শুনল বাবার কথা। ফাহিমা বলল, “ছেলেটা আসলেই লক্ষী। নীলু আপা ভাগ্য করে এমন সন্তান পাইছে।”
প্লাবন এবার মায়ের কথায় ফোড়ন কেটে বলল,
–“আমিও তো লক্ষী। শুধু তোমরা আমার লক্ষী ভাবটা চোখে দেখো না।”
সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সে নিচে চলে আসল। নিচে আসতেই ফাহিমা তাকে কাজে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“আমি একটু তোর নীলু চাচীর কাছে যাচ্ছি। তুই কষ্ট করে নির্মলকে চা এবং নাশতা দিয়ে আসিস। না জানি নীলু আপা একা একা কী করছেন।”
ফাহিমার মুখ জুড়ে চিন্তার রেশ। প্রণয়া কিছু বলতে চাইল, কিন্তু সেই সুযোগ হলো না। তার আগেই ফাহিমা গায়ে শাল জড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। প্রণয়া থমকে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই কিছুক্ষণ। হঠাৎ উপর থেকে শোনা গেল প্লাবনের হাসির শব্দ। সে কিছু একটা বলছে এবং হাসছে। নির্মলের গলা অবশ্য শোনা যাচ্ছে না।
প্রণয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। চা বানিয়ে দিয়ে গেছে ফাহিমা। অতটা ঠান্ডা হয়নি। তাই কাপে চা ঢেলে সাথে আরেক প্লেটে বিস্কুট নিয়ে উপরে চলে গেল।
পড়ার ঘরের মুখে আসতেই দেখল প্লাবন মুখস্থ পড়া বলার চেষ্টা করছে নির্মলকে। হাত নাড়িয়ে, বৃদ্ধাঙ্গুল মুঠোতে চেপে, কনিষ্ঠ আঙুলে চোখের কোণ খুঁচিয়ে নানান ভঙ্গিতে মুখস্থ বলছে। বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আটকিয়েছে তার।
প্রণয়া দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। মনোযোগ দিয়ে দেখল ভাই এবং নির্মলকে। নির্মলের সমস্ত মনোযোগ যেন প্লাবনের উপর। আর প্রণয়ার বোধহয় নির্মলের উপর। নির্মলের বাম পাশটা দেখা যাচ্ছে। প্লাবনের মুখস্থ বলা শেষে নির্মল তাকে কিছুটা ভুল ধরিয়ে দিতেই নির্মল পরপর দু’বার হাঁচি দিয়ে উঠল। তখনই হুঁশ ফিরল প্রণয়ার। চোখের পলক ফেলে সে হাতে থাকা চায়ের দিকে তাকাল। চায়ের নিস্তব্ধতাই যেন প্রমাণ দিচ্ছে চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু নির্মল যেভাবে হাঁচি দিয়েছে তাতে করে তাকে ঠান্ডা চা খাওয়ানো যাবে না। তার চাইতেও বড়ো বিষয় সম্মানেরও একটা ব্যাপার আছে। প্রণয়া এই প্রথম নির্মলকে চা সার্ভ করবে, আর প্রথমবারেই ঠান্ডা হলে নাক থাকবে? প্রণয়া চট করে ট্রে-টা দরজার পাশে মেঝেতে রেখে ঠান্ডা চা এক চুমুকে শেষ করে ফেলল। অরঃপর চায়ের কাপ নিয়ে ছুটল নতুন করে চা আনতে। নতুন করে চা এনে ট্রে হাতে প্রণয়া ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেতেই নির্মল, প্লাবন দরজার দিকে তাকাল। প্রণয়া চট করে অনুভব করল তার মাথায় জড়ানো ওড়নাটা মাথায় নেই। ছোটাছুটির দরুণ সেটা ঘাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। ট্রে-তেও হাত বন্দি, আবার চাইলেও উলটো পথে ঘর ছেড়ে বের হতে পারবে না। বের হওয়াটা দৃষ্টিকটু। উপায়হীন প্রণয়া চোখ তুলে নির্মলের পানে তাকাতেই চোখা-চোখি হয়ে গেল।
প্রণয়ার ভেতরটা আকস্মিক ধুকপুক করতে লাগল। কেমন যেন অস্থির, শক্ত ভাবও তাকে ঘিরে ধরল। নির্মল চোখ সরিয়ে নিলেও প্রণয়ার অস্বস্তি ভাব কাটল না। সে টেবিলে নাশতা রেখে মিনমিন করে নির্মলের উদ্দেশে বলল,
–“আপনার জন্য নাশতা!”
নির্মল মাথা উঁচিয়ে প্রণয়ার দিকে তাকাল। প্রণয়া ট্রে টেবিলে রেখে এক ফাঁকে ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নিয়েছিল। নির্মল হাসি বজায় রেখে বলল,
–“এসবের কী প্রয়োজন ছিল?”
–“প্রয়োজনের কথা বলে লজ্জা দিবেন না। আপনি মাস্টার সাহেব, মাস্টারদের যত্ন করতে হয়।”
প্রণয়া আর কিছু বলল না। নির্মলকেও কিছু বলার সুযোগ না গিয়ে চটপট পায়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
নির্মল প্লাবনকে পড়ানো শেষ করে প্রণয়াদের বাড়ি থেকে বের হতেই চৌকাঠ থেকে সুরেলা কণ্ঠের ডাক কানে এলো। নির্মল পিছে ফিরে তাকাতেই তিনটি হলদে বাতির ঝকঝকে আলোয় নারীমূর্তি দেখতে পেল, সেটা প্রণয়া। প্রণয়া কণ্ঠে কিছুটা জড়তা মিশিয়ে বলল,
–“থাকলে খেয়ে নিবেন। দেখলাম তখন নাকের সর্দি মুছেছেন। প্যারাসিটামল হলে হয়তো জ্বরটা আসবে না।”
নির্মল অবাক হলো ভীষণ। প্রণয়াও নিজের কাণ্ডে অবাক। কী হলো ব্যাপারটা? সে নির্মলকে কী কিছু বলল যা তার বলা উচিত ছিল না? নির্মল কিছু মুহূর্তের জন্যে থমকালেও মুচকি হেসে বলল,
–“ধন্যবাদ আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য। আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি প্যারাসিটামল একটা খেয়ে নিব। আজ আসছি, শুভ রাত্রি।”
নির্মল চলে গেলেও প্রণয়া থমকে রইলো। এই প্রথম সে নির্মলের মুখে আপনি সম্বোধন খেয়াল করল। মুহূর্তেই অনুভব করল তার ভেতরটা ক্রমাগত আনন্দ মিছিল করে বেড়াচ্ছে। সুখে সুখ মিলেমিশে যাচ্ছে। প্রণয়া নির্মলের থেকে অনেকটা ছোটো হলেও নির্মল তাকে আপনি সম্বোধন করছে। যেকোনো নারীই চায় পুরুষ তাকে সম্মান করুক। কিন্তু সেই সম্মানটা এত উপচে পড়ে সরাসরি প্রণয়ার বুকে গিয়ে বিঁধবে কে জানত? আচ্ছা, নির্মল কী কথার জাদু জানে?
প্রণয়ার চোখ-মুখে একরাশ লাজের বিচরণ। মুখ ছোটো করে নুহাশ সাহেবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। নুহাশ সাহেব ফোলা চোখে মেয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নির্মলের কাছে আবারও দুঃখিত বলল। নির্মল একপলক প্রণয়ার পানে তো আরেক পলক নুহাশ সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। নির্মল এবার অধর নাড়িয়ে বলল,
–“প্লিজ চাচা, বারবার সরি বলে আমাকে লজ্জিত করবেন না। উনি ছোটো মানুষ, ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক।”
প্রণয়া কোণা চোখে নির্মলের দিকে তাকাল। প্রণয়ার নির্মলকে বলতে ইচ্ছা করল, “আমি মোটেও ছোটো মানুষ নই।”
কিন্তু বাবার সামনে বলার সাহস পেল না।
তখন প্রণয়ার চিৎকার শুনে নুহাশ সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়, সঙ্গে ফাহিমারও। মেয়ের এমন চিৎকারে দুজনই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দ্রুত পায়ে সব লাইট জ্বালিয়ে বাইরে আসতেই দেখল উঠোনে নির্মল দাঁড়িয়ে আছে আর প্রণয়া বসা ছেড়ে উঠে ভেতরে আসতে নিচ্ছিল। নুহাশ সাহেবকে দেখে প্রণয়া যেম প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। তর্জনী তুলে বাহিরে ইশারা করে বারবার বলছিল,
–“বাইরে কালো পোশাকধারী চোর এসেছে বাবা।”
নির্মল তখন ডেকে বলল,
–“আমি চোর নই চাচা। আমি নির্মল!”
নির্মলের নাম শুনে প্রণয়া দমে যায়। পিছে ঘুরে হলদে আলোয় চট করে দেখে নেয় নির্মলকে। পরমুহূর্তেই নির্মলকে চোর ভেবে কী ধরণের বোকামী করেছে ভাবতেই প্রণয়ার মুখ ছোটো হয়ে যায়। নুহাশ সাহেব প্রণয়াকে বেশ বকল এত রাতে বাইরে বসে থাকার জন্য। কে বলেছিল এই গভীর রাতে বাইরে এসে বসতে? ঘটল তো এখন অঘটন? নির্মলের সামনে বাবার বকা খেয়ে প্রণয়া আরও লজ্জায় কাবু হয়ে পড়ে। তাইতো নির্মল কয়েকবার বারণ করল নুহাশ সাহেবকে। নুহাশ সাহেব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“তুমি এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে নির্মল?”
–“কারেন্ট চলে যাওয়ার পর ঘুম আসছিল না চাচা। এছাড়াও রাতের বেলা চা বাগান ঘোরার আলাদা শখ ছিল অনেকদিনের। এজন্যে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরে চলে আসি!”
বলেই নির্মল থামে। একপলক প্রণয়ার দিকে চেয়ে আবার বলল,
–“বাড়ির কাঠের গেটটা অবধি আসতেই ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গেল। তাই অন্ধকারে হাতড়ে কিছু দূর এগিয়ে আসতেই কারেন্টের তার প্যাঁচিয়ে পড়ে গেলাম।”
নুহাশ সাহেব উঠোনের মাঝে তারের গোছা দেখে বেশ রাগ করল। আপনমনে বললেন,
–“এগুলো না আমি মজিবকে পাশে সরিয়ে রাখতে বলেছিলাম? এই গাধার জ্ঞান হবে কবে?”
পরক্ষণেই নুহাশ সাহেব আবার বললেন,
–“ঠিক আছে নির্মল, তুমি তবে ঘরে যাও। রাত-বিরেতে অনেক বিরক্ত করে ফেলেছি।”
নির্মল আলতো হেসে বলল,
–“না, না আঙ্কেল। সেরকম কিছু না!”
নুহাশ সাহেব এবার প্রণয়ার দিকে চেয়ে তাকে ভেতরে যেতে বলল। সকলে মিলে ভেতরে প্রবেশ করলেও প্রণয়া আবার ফিরে এলো। নির্মলকে পিছুডাক দিল সে।
–“এই যে শুনুন!”
মেয়েলি ডাকে নির্মল থমকে পিছে ফিরে দাঁড়ায়। হলদে বাতির আলোটা প্রণয়ার মুখশ্রীতে এসে পড়েছে। প্রণয়া তার কপালে পড়া চুল কানে গুঁজতেই নির্মল বলল,
–“জি?”
–“রাতের বেলা ঘুরতে বের হন ভালো কথা, তবে কালো পোশাক পড়ে বের হবেন না। কালো পোশাক দিনে যেমন সুন্দর রাতে তেমনই ভয়ংকর!”
নির্মল কিছুটা শব্দের সাথে হাসল। প্রণয়া আবছা আলোয় প্রথমবারের মতো আপাদমস্তক নির্মলকে লক্ষ করল। নির্মলের শ্যামলা মুখের নকশা, মুখ জুড়ে থাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বাতাসে মৃদু দুলে ওঠা চুল সবই দেখল। এও ভাবল, নির্মল তার থেকে হাইটে কত বড়ো হতে পারে? কাছাকাছি দাঁড়ালে হয়তো ধারণা নিতে পারবে। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে নির্মল বেশ লম্বা। মোটকথা হচ্ছে, নির্মল এক দেখায় একজন সুপুরুষ।
নির্মল হাসি থামিয়ে বলল,
–“ঠিক আছে, আপনার কথা মাথায় থাকবে৷ এখন গিয়ে ঘুমান। আমি আসছি!”
বলেই নির্মল যেতে নিলে প্রণয়া আবার থামিয়ে দিলে বলল,
–“আরেকটা কথা!”
নির্মল জিজ্ঞাসু চোখে চাইলে প্রণয়া আবার বলল,
–“আমি ছোটো নই!”
নির্মল অধর বাঁকিয়ে হেসে বলল,
–“এটাও মনে রাখার চেষ্টা করব।”
নির্মল চলে গেল। কিন্তু প্রণয়া ঠায় একই স্থানে দাঁড়িয়ে রইল আনমনে। হঠাৎ পেছন থেকে ফাহিমা প্রণয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন,
–“এই, ভূতে ধরেছে নাকি? এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ঘরে। আমি দরজা লাগিয়ে শুতে যাব!”
প্রণয়া চমকে মায়ের দিকে চেয়ে আবার উঠোনে তাকাল। যেই স্থানে নির্মল দাঁড়িয়ে কথা বলেছে সেই স্থানেই তার চোখ জোড়া থমকে।
–“চলো আম্মা।”
প্রণয়া রুমে এসে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখে ঘুম ধরা দেওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। ততক্ষণে নিশ্চুপে তাকিয়ে রইল সিলিং-এর দিকে। কেমন ঘটঘট শব্দের সাথে সিলিং ফ্যানটা চলছে। আচমকা প্রণয়া বুকের বা পাশটায় হাত দিল। দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে যেন সেথায়। কিন্তু কেন? এই কেন-র কোনো উত্তর মিলল না প্রণয়ার। চোখে ভাসছে আবছা নির্মলকে। প্রণয়া নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বুজল।
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে প্রণয়া সর্বপ্রথম রান্নাঘরে গেল। ফাহিমা ততক্ষণে দ্রুত হাতে নাস্তা তৈরি করছে। প্রণয়া রুটির দিকে তাকাতেই দেখল রুটির সংখ্যা নিত্যদিনের চাইতে কিছুটা বেশি। তা দেখে প্রণয়া ভ্রু কুচকে বলল,
–“কেউ আসবে নাকি?”
প্রণয়ার কথা শুনে ফাহিমা শক্ত চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, “তুই গতকাল যা কীর্তি করেছিস তাতে কারো না এসে উপায় আছে?”
ফাহিমা থেমে আবার বললেন,
–“তোর বাবা নির্মলকে এবং ভাবীকে নাস্তার দাওয়াত দিয়েছে। ওরাই আসবে।”
এ কথা শুনে প্রণয়া হঠাৎ বলল, “তাহলে আমাকে নাস্তা আগে আগেই দিয়ে দাও। আমি খেয়ে উঠে যাই।”
প্রণয়ার প্রস্তাবে ফাহিমা নাকোচ করল না। শুধু বলল, “নিজের প্রয়োজন মতো পরোটা আর তরকারি নিয়ে বোস টেবিলে।”
প্রণয়ার খাওয়া যখন মাঝপথে তখনই হঠাৎ প্রবেশ করল নুহাশ সাহেব এবং নির্মল। তাদের দেখে প্রণয়ার খাওয়া থেমে যায়। চটজলদি ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে নুহাশ সাহেব এবং নির্মল কথা বলতে বলতে খাবার টেবিলে এসে বসেছে। নির্মল প্রথম ইতঃস্তত হয়েছিল প্রণয়ার সাথে টেবিলে বসতে। নুহাশ সাহেব সেসব ইতঃস্ততার ধার ধারলেন না অবশ্য।
প্রণয়া প্লেট নিয়ে উঠে যেতে নিচ্ছিল, তখন নুহাশ সাহেব তাকে থামিয়ে বললেন, “খাওয়ার মাঝপথে উঠতে নেই। শেষ করো খাবার।”
অগত্যা, প্রণয়া না চাইতেও বসে পড়ল। ফাহিমাও দ্রুত হাতে নুহাশ সাহেবদের খাবার নিয়ে আসলেন। ফাহিমা নীলুফাকে না দেখে নির্মলকে তার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে নির্মল বলল, “মা একটু পরে আসবে চাচী। কী যেন গোছাচ্ছে।”
প্রণয়া খেতে শুরু করলেও মাথা উঠিয়ে, স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে না। চোরের মতো করে রুটির অংশ মুখে পুরছে সে। যেন নির্মল প্রণয়ার খাওয়ার দিকেই চেয়ে থাকবে। তবে এরকম কিছুই হলো না। প্রণয়া যতবারই নির্মলের দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে ততবারই নির্মলকে হয় একমনে খেতে দেখেছে নয়তো তার বাবার দিকে তাকাতে দেখেছে। এতে প্রণয়া কিছুটা স্বস্তি পায়।
আজ নির্মলের চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। যা প্রণয়া দেখে ভাবছিল, “এত কম বয়সে চোখের সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলেছে নাকি?”
নুহাশ সাহেব হঠাৎ নির্মলকে প্রশ্ন করলেন,
–“আমি ডাকার আগে কোনো চাকরিতে ঢুকেছিলে নাকি?”
–“হ্যাঁ আঙ্কেল। একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছিলাম!”
–“তাহলে তো ভালোই ছিল। খামাখা আমার ডাকে চলে আসলে। সেখানেই তো একটা ব্যবস্থা হতে পারত।”
নির্মল উত্তরে কিছু না বললেও চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তে শুকনো হেসে বলল,
–“চাইলে ভালো ব্যবস্থা সম্ভব ছিল, কিন্তু আমি চাইছিলাম না মাকে কেউ কটু কথা বলুক। আমি এমন একটি জায়গা খুঁজছিলাম যেখানে কেউ আমার ছোটোবোনের অন্যায়ের জন্য আমার মাকে কথা শোনাবে। জানেন তো চাচা, মানুষদের তিক্ত কথা ধারালো অস্ত্রের মতো অপরজনকে আঘাত করে।”
এই পর্যায়ে নু্হাশ সাহেব নীরব হয়ে গেলেন৷ ফাহিমা রান্নাঘর থেকে সব শুনলেন। খুব মায়া হচ্ছে তাঁর নির্মলের প্রতি। নুহাশ সাহেব প্রসঙ্গ বদলে বললেন,
–“যাক, তুমি যেহেতু স্কুল টিচার ছিলে চাইলে প্লাবনকে পড়াতে পারবে। আমার ছেলে এতটা চঞ্চল হয়েছে যে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।”
নির্মল হাসল। বলল, “নিয়ন্ত্রণেই আছে চাচা, আপনি বোধহয় ওকে নিয়ে বেশি চিন্তিত।”
প্রণয়ার ততক্ষণে খাওয়া শেষ। সে প্লেট নিয়ে উঠে যায়। আড়চোখে একবারের জন্য নির্মলকে পরখ করতে ভুলেনি।
এখন বিকাল। বিকালের কমলা আলো প্রণয়ার মুখে এসে পড়েছে। সে এই আবেশী রোদ নীরবে গায়ে মাখিয়ে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নজর স্থির অবশ্য উঠোনে। উঠোনে কিছু পর্যটক এসেছে। তাদের সাথেই মজিব দাঁড়িয়ে।
বাড়িতে নুহাশ সাহেব না থাকলেও মজিব সারাদিন বাড়িতেই থাকে। বাড়ির পরিচর্যা, বাইরে থেকে কে আসছে কেন আসছে সেসব নজরে রাখা। যতই হোক চা বাগানের মাঝে দুজন মেয়ে মানুষ একা বাড়িতে থাকছে, এই বিষয়টা নুহাশ সাহেব মানতে পারতেন না। এজন্য একদিন কোথা থেকে মজিবকে ধরে আনল। মজিবের বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। তার গ্রামও বেশ দূরে। মাসে দুদিন ছুটি পায় পরিবারকে চোখের দেখায় দেখে আসার জন্য। স্বভাবসুলভ মজিব কিছুটা সরল। কিছু সরল মানুষকে “বোকা” বলা হয়। মজিব সেই বোকা শ্রেণির সরল। কাজে ভুল করাও তার অন্যতম স্বভাবের মধ্যে পড়ে। নুহাশ সাহেব তার কাজে খুশি হয়েছেন এমনটা খুব কম চোখে পড়েছে। তবে সবকিছুর মাঝে তার একটি বিশেষ গুণ রয়েছে। তিনি দারুণ তর্ক করতে জানেন। কেউ যদি কখনো তার সাথে লাগতে আসে, তিনি সিলেটি ভাষায় সেই মানুষটাকে একদম ধুঁয়ে দেয়। তর্ক করতে পারা মানুষ কীভাবে বোকা হতে পারে প্রণয়ার বুঝে আসে না। তবুও এই বোকা-সোকা মজিব আঙ্কেল যখন দুদিনের জন্য গ্রামে যায়, তখন পুরো চা বিলাস কেমন শূন্য শূন্য লাগে। যেন গুরুত্বপূর্ণ একজনের অস্তিত্ব নেই।
এই মুহূর্তে মজিব নিজেই পর্যটকদের বাড়ি সম্পর্কে টুকটাক বলছেন, তারা যখন ছবি তুলছে মজিব একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন। পর্যটক আসলেও তাদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ নিষেধ। নয়তো কতজন যে ব্যাকুল চোখে ঝুল বারান্দায় চেয়েছিল তার হিসেব নেই। আজও একই ঘটনা ঘটল। একজন পর্যটক ঝুল বারান্দা দেখে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করল উপরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মজিবের গলা দিয়ে “না, অনুমতি নেই!” ব্যতীত আর কোনো শব্দই আসছে না। প্রণয়া অবশ্য সরে গিয়েছিল তাদের উপরে তাকানোর আগেই।
সন্ধ্যার সময় প্রণয়া আবারও একই জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। পর্যটক’রা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। প্রণয়া একমনে সবুজ চা বাগানে চোখ বুলালো। সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহূর্তে এই বাগান কতটা স্নিগ্ধ লাগছে। যতই দেখুক না কেন প্রাণ জুড়াতে চায় না। কাঠের গেট খোলার শব্দ শুনে প্রণয়া চট করে নিচে তাকাল। প্রণয়া দেখল নির্মল হাতে কিছু খাতা-পত্র নিয়ে চা বিলাসে প্রবেশ করছে। প্রণয়া নিজের অজান্তেই চেয়ে রইলো এক মনে। নির্মলের আশেপাশে খেয়াল নেই। সে নিজ খেয়ালে হিসাব-নিকাশের বিস্তর ব্যস্ত। খাতায় চোখ বুলাতে বুলাতেই বাম পাশের পথ দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। তাকে ঘরে ফিরতে দেখে প্রণয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। কিছুক্ষণ আগেই না দেখল নীলুফাকে তাদের ঘরে আসতে? অবশ্য প্রণয়ার ভাবনার মাঝেই নির্মল আবার বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার হাত জোড়ায় কোনো খাতা-পত্র ছিল না। তবে প্রণয়ার মনে এক প্রশ্ন হানা দিল। “বাবার পছন্দের পাত্র এই সন্ধ্যাবেলায় কোথায় যাচ্ছে?”
নির্মলের বাবা মারা যায় বেশিদিন হয়নি। প্রায় মাস তিনেক হবে হয়তো। নির্মলের একটি ছোটো বোন আছে। নাম তার নোভা। নোভা হঠাৎ-ই অন্যকারো হাত ধরে পালিয়ে গেল। পালিয়ে যাওয়ার পরপরই সুস্থ, সবল নির্মলের বাবা সম্মানহানির কারণে স্ট্রোক করলেন। স্ট্রোক করার পর শয্যাশায়ী ছিলেন প্রায় মাসখানেকের মতো।
নির্মলের বাবার বাজারে যেই দুটো দোকান ছিল তার একটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, নির্মলের বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে। এরপর থেকে নির্মল-ই কোনো রকমে টেনে-টুনে সংসার চালাত। কিন্তু সেই বাবাও বেশিদিন টিকেনি।
মেয়ে এবং স্বামীর শোকে নীলুফাও অনেকটা ভেঙে পড়েন। লোকের বিষাক্ত, তিক্ত কথাবার্তাও তিনি সইতে পারছিলেন না। বাবা মারা যাওয়ার পর নির্মলও যেন কেমন হয়ে গেল। রোজ রোজ মাকে প্রতিবেশিদের তিক্ত প্রশ্নের অতলেও রাখতে পারছিল না। মোটকথা, সুনামগঞ্জ এবং প্রিয় মাতৃভূমি তাকে দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। এজন্য হঠাৎ-ই যোগাযোগ করল নুহাশ সাহেবের সাথে।
নুহাশ সাহেবের সঙ্গে নির্মলের বাবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আবার এটাও বলা যায়, নির্মলের বাবাই নুহাশ সাহেবের ঘটকালি করেছিল ফাহিমার বিষয়ে। তাইতো বিপদের দিনে নুহাশ সাহেবকেই মনে পড়ল। নির্মল নুহাশ সাহেবকে কল করে বলেছিল,
–“আমার একটা চাকরির দরকার চাচা। আপনার হাতে কোনো চাকরি আছে?”
সেই মুহূর্তে নুহাশ সাহেবের কাছে সেরকম চাকরির খোঁজ ছিল না। পাহাড়ি এলাকার চা বাগানে থাকে নুহাশ সাহেব। সে তো আর নির্মলের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিতে পারবে না। তাই সেই মুহূর্তে অবশ্য দুঃখী মনেই নির্মলকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। নির্মলও কোনো রকম অভিযোগ করেনি। হাসি মুখে কল কেটেছে।
নুহাশ সাহেব সেদিন যেমন হতাশও হয়েছেন তেমনই নির্মলের সাবলীল, সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন। তাইতো যখন নতুন ম্যানেজারের কথা ওঠল তখনই মাথায় নাড়া দিল নির্মলের ব্যাপার। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই যোগাযোগ করেন নির্মলের সাথে।
নুহাশ সাহেব অবশ্য এই ভেবে ভয় পেয়েছিলেন নির্মল অন্যত্র চাকরি পেলো নাকি? নির্মলের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবশ্য সেই ভয়, দ্বিধা কেটে গেছে। তার এই ভেবে আফসোস হচ্ছিল এতদিন যাবৎ বেকার ছেলেটাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারেনি। অর্থ সাহায্য করে নির্মলকে কখনোই নিচু দেখাতে চাননি নুহাশ সাহেব।
সন্ধ্যার পর নীলুফা ফাহিমার সঙ্গে বসে বিভিন্ন আলাপে ব্যস্ত। ফাহিমা যেমন নীলুফাকে পেয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এই বিশাল চা বাগানের মাঝে ফাহিমার গল্প করার মতো বিশেষ কেউ নেই। মেয়েটাও সেভাবে গল্প করে না, সারাদিন কেমন মুখ ভার করে রাখে যেন কতদিনের বিরহে ভুগছে। এ নিয়ে ফাহিমাও কম কথা শোনায় না প্রণয়াকে। কিন্তু তবুও প্রণয়ার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়নি। তাই ফাহিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর এমনিতেও মায়েদের মেয়ের সামনে জিভের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। তার বয়সী কথাবার্তা চাইলেও সব সময় মেয়ের সাথে বলা যায় না।
প্রণয়া সিঁড়িতে বসে আছে হাতে পাঠ্যবই নিয়ে। সিঁড়ির লাইটটা জ্বালানো নেই, প্রণয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। সিঁড়িটা বাড়িতে ঢুকতেই ডানপাশে। কাঠের সিঁড়িতে আবার লম্বা করে কাঠের রেলিং। প্রণয়া মূলত নীলুফার প্রতি আগ্রহী। তাই দূরে বসেই মা এবং আন্টির আলাপ নীরবে শুনছে। বৈঠকঘরের আলো এতটাও তীক্ষ্ণ নয়, তাই সেই আলো সিঁড়ি অবধি পৌঁছাতে পারেনি।
প্রণয়া শুনল নীলুফাদের বাজে পরিস্থিতি। একে একে নোভার পালিয়ে যাওয়া, নির্মলের বাবার মৃ%ত্যু, নির্মলের কষ্ট করে সংসার চালনা সবকিছুই। প্রণয়া শুনে অবশ্য কিছুটা আহত হলো। না জানি কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে এখানে এসেছে।
নীলুফার শুকনো, ভাঙা মুখের মায়া টেনেছে প্রণয়াকে। মানুষটাকে সরল-ই লেগেছে প্রণয়ার। তবে সে এখনো মহান নির্মলকে চোখের দেখা দেখতে পারেনি। দুপুরে নাকি খেতে এসেছিল। প্রণয়া তখন কোথায় ছিল কে জানে?
–“এই আপু! তুমি এখানে চোরের মতো বসে আছ কেন?”
প্লাবনের আচমকা বলা কথায় প্রণয়া ঘাবড়ে গিয়ে পিছে ফিরে তাকায়। প্লাবনের গলার স্বর প্রয়োজনের চাইতে বেশি ছিল। ফলে ফাহিমা, নীলুফার কানেও সেই গলা পৌঁছায়। প্রণয়া তা বুঝতে পেরে রাগ দেখালো প্লাবনকে। ধমক দিয়ে বলল,
–“এভাবে ভূতের মতো পিছে এসে দাঁড়িয়েছিস ভালো কথা, মুখ এত চলে কেন তোর? আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে চোর লাগে?”
প্লাবন মুখ চেপে হাসে বোনকে খেলাতে পেরে। ফাহিমা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
–“এই, তোদের না পড়তে বসতে বললাম? তোরা এখানে কী করিস?”
প্রণয়া আবছা আলোয় পুণরায় প্লাবনকে গরম মেজাজ দেখিয়ে নেমে এলো। সভ্য, মাথায় কাপড় দেওয়া প্রণয়াকে দেখে নীলুফার মুখে হাসি ফুটল। প্রণয়া তার দিকে চেয়ে বিনয়ের সাথে হেসে বলল,
–“চা বানিয়ে দেই তোমাদের?”
ফাহিমার মুখটা শুকিয়ে গেল মেয়ের কথা শুনে। ইশ! কথায় কথায় নীলুফার সামনে নাস্তা দিতেই ভুলে গেছে। এজন্য মেয়েকে বাঁধা দিল না। প্রণয়া নীরবে চলে গেল রান্নাঘরে। পেছন থেকে ফাহিমার গলা শুনতে পেল,
–“প্রণয়ার হাতে চা বানানোর জাদু আছে। প্রতিদিন একবার হলেও ওর হাতের চা খেতে হয় আমার।”
.
রাত এখন বেশ গভীর। পুরো চা বাগানের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। গভীর রাতে তো আরও গা ছমছমে পরিবেশ। তার ওপর ইলেক্ট্রিসিটি নেই। প্রণয়া গায়ে চাদর জড়িয়ে দরজার বাইরে বসে আছে। তাদের সদর দরজার সামনে ছাউনি দেওয়া। ছাউনির নিচে বেতের জোড়া সোফা এবং মাঝে একটি টি-টেবিল। প্রণয়া অবশ্য সেখানে বসেনি। সে সোজা মেঝেতেই বসল দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
গভীর রাতের গা ছমছমে এই পরিবেশে কারোই মূলত সাহস থাকার কথা নয়। তবুও প্রণয়া এই ভয় ভয় অনুভূতিতে সাময়িকের জন্য নিজের থেকে ছিন্ন করে এই দুঃসাহসিক কাজটা করল। সঙ্গে অবশ্য মোম আর একটি ম্যাছ রেখেছে। হাতে একটা লোহার চুড়িও পরেছে শুনেছে আগুন এবং লোহা সাথে থাকলে নাকি খারাপ নজর সহজে লাগে না। এছাড়া বের হওয়ার আগে আয়াতুল কুরসিও পড়তে ভুলেনি সে।
প্রণয়া ঠায় বসে রইলো সে স্থানে। আকাশে চাঁদ নেই, আশেপাশে আলোর চিহ্নও নেই। কারেন্ট আসলে ছাউনির নিচের হলদে বাতিটা জ্বলে উঠবে, যা সারা রাত বিরতিহীন জ্বলে। প্রণয়া কারেন্ট আসার অপেক্ষায় বসে রইলো। অপেক্ষা নীরব হলেও মস্তিষ্ক থেমে নেই। মস্তিষ্কে ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরছে অসংখ্য ভাবনার মেলা। বেশি নাড়া দিচ্ছে নির্মলের ভাবনা। আজ পুরো দিনেও একবারের জন্যেও দেখেনি নির্মলকে। এখন নিশ্চয়ই মা ছেলে ঘুম। এই গভীর রাতে ঘুমাবে সেটাই স্বাভাবিক। বরং রাত জাগা পাখির মতো প্রণয়ার জেগে থাকাটা অস্বাভাবিক।
প্রণয়া মনোযোগ দিয়ে অবশ্য কোথাও চাইতে পারছে না। যখনই কোথাও একটু নজর স্থির করতে চাইছে তখনই ভয় নাড়া দিয়ে উঠছে বুকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চা বাগানের মাঝে এভাবে বসে থাকা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব? সময় যত যেতে লাগল প্রণয়ার সাহসও ততটাই নিভে আসতে লাগল। তবুও প্রণয়া একই ভাবে বসে রইলো।
ওদের কাঠের সাদা-মাটা গেটটার কাছে আলোটা আসতে আসতে হঠাৎ নিভে গেল। আলো নিভলেও অদৃশ্য তাণ্ডব থামল না। কাঠের দরজার এক নিজস্ব শব্দে সেই দরজা খুললও আবার লাগালও। সঙ্গে শোনাল সেই একই পায়ের শব্দ। প্রণয়ার তখন গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। ভয়ে কথা বলার শক্তিও খুইয়ে বসেছে সে। কাউকে ডাকার সাহস অবধি পাচ্ছে না। যে-ই পায়ের শব্দটা প্রণয়ার কাছাকাছি এলো ওমনি ধপাস করে একটা শব্দ হলো। এই শব্দ শুনে প্রণয়ার প্রাণ-ভোমরা একদম যায় যায় অবস্থা।
ঠিক তখনই কারেন্ট এলো। কিছু স্থান জুড়ে হলদে আলো বিস্তৃত হলো। প্রণয়া দেখতে পেল কালো পোশাকধারী এক লোক উঠানে বসে রয়েছে। আলোর সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়া যেন তার বাকশক্তি ফিরে পেল। মুহূর্তে-ই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ক্রমাগত চেঁচিয়ে বলল,
সদ্য বিবাহিত স্বামীর কোলে একটি তিন বছরের বাচ্চা ছেলে। সেই বাচ্চা বঁধুরূপে প্রণয়াকে দেখে অনবরত কাঁদছে এবং প্রণয়ার স্বামীকে বলছে,
–“এই মা ভালো না বাবা। আমাকে মেরেছে এই মা।”
প্রণয়া অবাক হয়ে বাচ্চাটির দিকে চেয়ে ঘনঘন মাথা নাড়াল। সে যে মারেনি এই বাচ্চাকে। ছুঁয়েও দেখেনি এখন অবধি। প্রণয়া কৈফিয়ত দিতে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি ওর গায়ে হাত অবধি দেইনি। মারা তো দূরে থাক।”
কিন্তু প্রণয়ার স্বামী তা মানতে নারাজ। সে চেঁচিয়ে ধমক দিয়ে উঠল প্রণয়াকে। প্রণয়া তার স্বামীর হাত ধরে বোঝাতে চাইলে স্বামী তাকে ধাক্কা দিল। প্রণয়া নিজেকে সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে কপালে আঘাত পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম ভেঙে যায়। হকচকিয়ে উঠে বসে প্রণয়া। চারপাশে নজর বুলিয়ে বুঝল এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।
প্রণয়া নিজের ওপরই চরম বিরক্ত হলো। মুখ-ভঙ্গি এরকম যেন সকাল সকাল তেঁতো কিছু মুখে তুলেছে। পরপর বিরক্ত হলো মায়ের ওপরও। মা এসব কী আজারে সিরিয়াল দেখে? এদের ভিত্তিহীন সিরিয়ালের গল্প প্রণয়ার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে! মায়ের সাথে গতকাল একটু বসেছিল টিভির কাছে, ফলস্বরূপ এই সকালেই এমন তিক্ত স্বপ্ন। প্রণয়া কপাল কুচকে মিনমিন করে বলল, “ধুর!”
.
সবুজ, শ্যামলা সৌন্দর্যে ভরপুর শ্রীমঙ্গল। বাতাসে ভেসে বেড়ায় চা পাতার নেশালো ঘ্রাণ। এক ঝাঁক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল আকাশ জুড়ে। গাছ-গাছালির পাতা, ডালের ফাঁক ফোকর দিয়ে চা বাগানে প্রবেশ করেছে নরম, আবেশী রোদ। প্রণয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে চা বাগানের সৌন্দর্যে নজর বুলাচ্ছে। এই সৌন্দর্য প্রণয়ার জন্যে নতুন কিছু নয়।
উপর থেকে ড্রোনের শুট নিলে দেখা যাবে সমগ্র সবুজের মাঝে এক টুকরো বাড়ি। সেই বাড়িটার নাম চা বিলাস। সেই চা বিলাস বাড়িটা প্রণয়াদের৷ চা বাগানের মাঝামাঝিতে তাদের বাড়িটা। প্রায় একুশ শতাংশ জমি মিলিয়ে উঠান আর বাড়িটা। কাঠের দো’তলা বাড়ি এবং তার চারপাশে খোলা উঠান। উঠোনের আশপাশ জুড়ে আবার কাঠের বেড়া। এই বাড়িটা প্রণয়ার দাদার ভীষণ শখের গড়া। তিনি প্রতিনিয়ত চিন্তা করতেন কী করলে বাড়িটার সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে? জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি বাড়ির প্রতি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তাইতো স্ত্রী মূর্ছা যাওয়া সত্ত্বেও এই বাড়িতে দুজন কাজের লোক নিয়ে একাই থাকতে শুরু করে দিলেন।
স্থানীয় বাচ্চাদের কাছে এই চা বিলাস ভূতুড়ে বাড়ি লাগলেও পর্যটকদের কাছে এই বাড়ি চোখ ধাঁধানো সুন্দর। চা বিলাসের দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে পাতাবাহার ঝুলে পড়েছে নিচের হলদে বাতি অবধি। কত মানুষ যে এ বাড়ির সামনে এসে ছবি তুলে গেছে। তাদের এ বাড়ি আসা নিয়ে আলাদা ভিজিটের প্রয়োজন হয় না। পর্যটক’রা নিজেদের মতো করে এসে ঘুরে চলে যায়। আর প্রণয়া শুধু তাদের নীরবে দেখে যায়।
প্রণয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে চলে যায়। কলেজের পোশাক পড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখল প্রণয়ার মা অর্থাৎ মিসেস ফাহিমা নাস্তা তৈরি করে ফেলেছে। ঘড়ির কাঁটা এখন ছয়টার ঘরে। ছয়টা বেজে পঁয়ত্রিশ। প্রণয়া খাবার টেবিলে বসলেও খাবারে হাত দিল না। মূলত প্রণয়া তার বাবা অর্থাৎ নুহাশ সাহেবের অপেক্ষায় বসে রইলো। নুহাশ সাহেব প্রতিদিন ফজরের পরপর বেরিয়ে যায় তার কুড়ি বিঘা চায়ের বাগানে চোখ বুলাতে। আশেপাশে মসজিদ নেই বললেই চলে। তাই ফজরের নামাজটা নুহাশ সাহেবের ঘরেই পড়তে হয়।
প্রণয়াকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নুহাশ সাহেব মিনিট তিনের মধ্যেই এলেন। তবে তার স্বাভাবিক মুখে অস্বাভাবিক রাগ জ্বলজ্বল করছে। যা মা-মেয়ে দুজনেই লক্ষ্য করলো। নুহাশ সাহেব খাবার টেবিলে বসেই কঠিন গলায় স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন,
–“প্লাবনকে কালকের মধ্যে বাসায় দেখতে চাই রোকসানা। স্কুল-স্টুল কী যাবে না? এত মানুষের বাসায় বেড়ানো কিসের?”
শেষ দুটি বাক্য নুহাশ সাহেব গলার স্বর বাড়িয়েই বললেন। প্রায় ধমকই বলা চলে। প্লাবন প্রণয়ার ছোটো ভাই। সবে ক্লাস ফোরে পড়ছে। প্লাবন সহজে বাড়ি থাকতে চায় না। মামাদের বাড়ি বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করে। তাইতো প্রণয়ার বড়ো মামা আসলেই আবদার করে প্লাবনকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রণয়া আজও বুঝে না, মামা বাড়িতে এত কী মজা পায় সে?
প্রণয়া, ফাহিমা দুজনেই এই পরিস্থিতিতে চুপ থাকল। ফাহিমা আশ্বাসের সুরে স্বামীকে বলল,
–“আচ্ছা প্রণয়ার বাবা। আপনি শান্ত হন। আমি আজই কল করে বলব ভাইকে। কাল সকালের মধ্যেই প্লাবনকে বাড়ি দিয়ে যাবে।”
নুহাশ সাহেব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। যা প্রণয়ার চোখ এড়াল না। সকালে নিজের ঘর থেকে বাবার ফুরফুরে গলাই তো শুনেছিল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে কী এমন হলো যে বাবা এতটা তেঁতে আছে? চা বাগানে কিছু হলো নাকি?
প্রণয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা করল না নুহাশ সাহেবকে। রয়েসয়ে কিছুটা সময় নিয়েই জিজ্ঞেস করল,
–“কী হয়েছে বাবা? বাগানে বা কারখানায় কী কোনো সমস্যা হয়েছে?”
নুহাশ সাহেব কিছুটা নিভে এলো। তবুও গলায় তেজ মিশিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
–“শু* বাচ্চা ইমরানে হিসাবে ভালো রকম গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রাখছে। কর্মচারীরাও বলল, কত টাকা নাকি মেরে দিছে। এর নামে যদি আমি মামলা না ঠুকছি!”
ইমরান নুহাশ সাহেবের ম্যানেজার ছিল। যে কী না নুহাশ সাহেবের এত বড়ো চা ব্যবসার হিসাব-নিকাশ রাখত। সেই লোক যদি বিশ্বাসঘাতক হয় তাহলে রাগ তো হবেই। প্রণয়া বলল,
–“বের করে দিছ না?”
–“তা আর বলতে? ও এখন জুতারও যোগ্য না। যে মানুষ বিশ্বাস ভঙ্গ করে আর যাই হোক, মানুষের কাতারে পড়ে না।”
–“তো এখন কী করবা? নতুন ম্যানেজার কাকে বানাবা? বিশ্বাসযোগ্য কেউ আছে?”
এই পর্যায়ে নুহাশ সাহেব নিশ্চুপ রইলেন। তারপর নাস্তায় আর কোনো কথা হলো না। খাওয়া শেষে নুহাশ সাহেব মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কলেজের উদ্দেশ্যে। এদিকের কিছু রাখাইন মেয়ে এবং স্থানীয় এক দুইজন কলেজ যায়, নুহাশ সাহেব ওদের সাথে প্রণয়াকে অটোতে উঠিয়ে দেন। রাস্তা থেকে কলেজ যেতে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট-ই লাগে। যার কারণে বেশ আগে আগেই বের হতে হয় প্রণয়াকে। ক্লাস শুরু হয় আবার নয়টা, সাড়ে নয়টা থেকে।
প্রণয়া অটোতে বসে সারি সারি সবুজ চা বাগানে নজর স্থির রাখল। প্রণয়ার চোখে যেন জ্বলজ্বল করছে এক টুকরো সবুজ রং। প্রণয়ার পুরো নাম প্রণয়া শেখ। এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছে। গায়ের রং আহামরি ফরসা না হলেও কিছুটা পরিষ্কার। এছাড়া তার মুখের মায়া, টানা ছোটো চোখ, কোমড় অবধি আঁকা-বাঁকা চুল সবটাই একজন সুন্দরীর পরিচয় বহন করে। তবে তার গায়ের রঙের চাইতে মুখের মায়া বোধ হয় সকলকে বেশি আকৃষ্ট করে। প্রণয়া স্বভাবতই শান্ত স্বভাবের। খুব মেপে মেপে কথা বলার মানুষ। নিরিবিলি, শান্তিপ্রিয় মানুষও সে।
প্রণয়ার জন্ম হয় সিলেট শহরে। নুহাশ সাহেবের ছোটো থেকেই শখ ছিল শহরে থাকার। এজন্যে ফাহিমাকে নিয়ে প্রথমে শহরেই থাকত। শহরেই মোটামুটি বেতনের একটা চাকরিও করত। অথচ প্রণয়ার দাদার অঢেল সম্পদ, চায়ের বড়ো ব্যবসা। এসবকে তুচ্ছ করে নুহাশ সাহেব তার শখ মিটিয়েছেন।
প্রণয়ার বয়স যখন চৌদ্দ-পনেরো তখনই প্রণয়ার দাদা অসুখে ভুগে হঠাৎ মারা গেলেন। দাদা গত হওয়ার পরপর নুহাশ সাহেব আচমকা বদলে গেলেন। শহুরে চাকরি ছেড়ে পরিবার নিয়ে সোজা চলে গেলেন বাবার ভিটেতে। প্রণয়ার বাবা দাদার একমাত্র ছেলে হওয়ায় সব সম্পত্তি তার নামেই হয়ে গেল। তাই নুহাশ সাহেব তার বাবার ব্যবসাকে আবার আঁকড়ে ধরলেন। মারা যাওয়ার আগে নুহাশ তার অসুস্থ বাবার হাত ধরে কথা দিয়েছিলেন এই চা সাম্রাজ্য তিনি সামাল দিবেন।
নুহাশ সাহেব ব্যবসায় হাত দিলেও তাকে অনুতপ্ত বোধ বেশ কুড়ে কুড়ে খায়। বাবার শেষ সময়ে পাশে থাকতে পারেননি। মাকে হারিয়ে ফেলার পরেই নুহাশ সাহেব শ্রীমঙ্গল ছেড়েছিলেন। তার শখ, চাওয়ার তীব্রতা এতটাই বেড়ে যায় যে একা বাবা কী করে এখানে থাকবেন মাথতেও আসেনি। ভেবেছিলেন বিশ্বস্ত দুজনের সঙ্গে আছেন, আর চিন্তা কিসের? মাসে দুই একবার বাবার সাথে দেখা করে আসলেই হবে। তাই করতেন।
প্রণয়ার দাদা নুহাশকে প্রতিবার ব্যাকুল চিত্তে বলতেন,
–“নাতি-নাতনি গুলাকে নিয়ে এখানেই থেকে যা নুহাস। একা একা ভালো লাগে না।”
এখন সেই মানুষটা আর নেই। তবে থেকে গেছে এক বুক আফসোস এবং অনুতপ্ত বোধ।
বিকালে প্রণয়া ঝুল বারান্দায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে রইলো। মাথার নিচে এক হাত দিয়ে পলকহীন চোখে ভাসা ভাসা মেঘের আকাশ দেখতে লাগল। এদিকে নেটওয়ার্ক তেমন নেই বললেই চলে, যার ফলস্বরূপ প্রণয়ার সেরকম মোবাইলের প্রতি আসক্তি নেই। নুহাশ সাহেব চার মাস আগে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিল মেয়েকে। কিন্তু সেটা বেশিরভাগ সময়ে অবহেলাতেই পড়ে থাকে। প্রণয়ার সময়গুলো এভাবেই শুয়ে বসে একাকী কাটে। হয় ঝুল বারান্দায়, নয়তো উঠান ঘুরে। বিকাল সময়টা একটু বেশি-ই অবসর কাটে। এই সময়ে বাড়িতেও তেমন কাজ-টাজ থাকে না।
পরেরদিন সকাল এগারোটার মাঝেই বড়ো মামা প্লাবনকে নিয়ে এলেন। প্রণয়া সেদিন কলেজ যায়নি। বাড়ি থেকে কলেজ যেহেতু দূরের পথ এজন্য কলেজে খুব কম যাওয়া – আসা করে সে। সপ্তাহে দুই বা তিন দিন যায়।
প্লাবন তো ফিরেই গল্প জুড়ে বসল। সেখানে গিয়ে কী করেছে, কী খেয়েছে, কোথায় ঘুরেছে ইত্যাদি। প্রণয়া এক্ষেত্রে নীরব স্রোতার ভূমিকা পালন করল। সন্ধ্যার পরপর নুহাশ সাহেব ফিরলেন। ফিরেই জানালেন,
–“নতুন ম্যানেজারের খোঁজ পেয়ে গেছি!”
নতুন ম্যানেজার হিসাবে কাকে নির্বাচন করল, তার পরিচয় কী এসব সম্পর্কে বিশেষ কিছু বললেন না নুহাশ সাহেব। তবে নুহাশ সাহেবকে বেশ নির্ভার এবং শান্ত লাগছিল। মোটকথা, নুহাশ সাহেবের কপালে যেই চিন্তার ভাজ পড়েছিল সেই ভাজটা আজ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক হলেও প্রণয়া আগ্রহ দেখালো না।
.
ঠিক দুই দিন পর খুব সকালে নুহাশ সাহেব বললেন তাদের খালি দুটি ঘর পরিষ্কার করে দিতে। খালি দুই ঘর পেছনের দিকে ছিল। এমনিতে দোতলা মিলিয়ে মোট পাঁচটা ঘর প্রণয়াদের। চাইলে বাড়িয়ে আরও দুই তিনটা ঘর তোলা সম্ভব উত্তর দিকটায়।
নুহাশ সাহেবের হঠাৎ ঘর পরিষ্কার করার কথায় ফাহিমা অবাক হয়। তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করল,
–“দুটো ঘর হঠাৎ খালি করতে বললেন যে? কে আসবে?”
–“বাড়ির সদস্য-ই আসবে। আমি দুজন কাজের লোক পাঠাব। ওরাও তোমাদের সাহায্য করে যাবে।”
বলেই নুহাশ সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সময় মতো দুজন মহিলাও আসে সাহায্য করতে। প্রণয়া বাবার কথায় বেশ অবাক হয়েছে। বাবাকে প্রশ্ন করল না মা করেছে ভেবে। তবে নুহাশ সাহেব তো বিশেষ কিছুই বললেন না। কে আসবে বাড়িতে?
দুপুরের মধ্যে ঘর পরিষ্কার হয়ে যায়। এক ঘরে পুরাতন একটা খাট আছে। সেই পুরাতন খাটে ফাহিমা নতুন চাদর বিছিয়ে দেয়। নুহাশ সাহেব যেহেতু ঘর পরিষ্কার করতে বলেছেন সেহেতু মেহমান কেউ আসবেনই। আরেক রুম প্রায় ফাঁকা। একটা তোষক আর একটা ল্যাপ ছাড়া তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই।
তবে বিপত্তি ঘটল প্রণয়ার বেলায়। সে হঠাৎ-ই জ্বর এবং মাথা ব্যথায় কাবু হয়ে গেল। তাইতো বিকাল থেকে বিছানাতেই পড়ে রইল। সন্ধ্যার পরপর নিস্তব্ধ বাড়িটায় হঠাৎ নতুন মানুষের গলা শোনা গেল। প্রণয়ার ঘরটা দোতলায় হওয়ায় সেরকম স্পষ্ট কিছু শুনল না। শুধু নুহাশ সাহেবের গলাই শোনা গেল। তবে কী বাবার অতিথি চলে এসেছে? সে রাতে বাবার অতিথিদের আর নিজ চোখে দেখা হলো না প্রণয়ার। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল খুব দ্রুতই।
পরেরদিন সকাল আটটা বাজে প্রণয়ার ঘুম ভেঙে যায়। ফরজের নামাজ মিস হয়ে যাওয়ায় প্রণয়া কিছুটা আহত হলো। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে অনুভব করল সারা গা জুড়ে নিদারুণ ব্যথা। তবুও প্রণয়া নিচে গিয়ে হাত মুখ ধুঁয়ে নেয়। বাড়িতে নুহাশ সাহেব নেই। প্রণয়ার একবার পেছন দিকে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল যে কে এসেছে? কোনো পুরুষ মানুষ থাকতে পারে এই শঙ্কায় এলোমেলো প্রণয়া আর সেদিকে আগায় না। সে বাড়ির ভেতরে মায়ের কাছে চলে যায়। ফাহিমা মেয়েকে দেখে বলল,
–“জ্বর কমেছে? দেখি আয় তো কাছে, কপাল ছুঁয়ে দেখি।”
ফাহিমা প্রণয়ার কপালে হাত দিয়ে বুঝল জ্বর নেই তেমন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। প্রণয়া বলল,
–“গতকাল সন্ধ্যায় কে আসল আম্মা?”
মুহূর্তেই ফাহিমার অধরে হাসি খেলে যায়। হাসি বজায় রেখে বলল,
–“নীলু আপা আসছে। নির্মলও আসছে। নির্মল এখন তোর বাবার নতুন ম্যানেজার।”
নামগুলো প্রণয়া প্রথম শুনেছে। অথচ ফাহিমা এমন ভাবে বলল যেন প্রণয়ার কতদিনের চেনা-জানা তারা। প্রণয়া ভ্রু কুচকে বলল,
–“ওনারা কারা আম্মা?”
ফাহিমা বোধ হয় ভুল বুঝতে পারে। জিভে কামড় দিয়ে বলল,
–“ওহ! তুই তো ওদের চিনিস না। নীলুফা আমার গ্রামের মানুষ। আত্নীয়তার সম্পর্ক আমাদের মাঝে না থাকলেও আত্মিক সম্পর্ক আছে। ওরাই আসছে সুনামগঞ্জ থেকে। সেই ছোট্ট নির্মল এখন যে কত বড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও একটা দুঃসংবাদ, নির্মলের বাবা আর নেই।”
শেষ কথাটা বেশ দুঃখী স্বরেই বলল ফাহিমা। প্রণয়া আর কিছুই বলল না। চুপচাপ শুনে গেছে। ফাহিমা দুপুরের খাবারটা প্রণয়ার হাত দিয়েই পাঠাল নির্মলদের ঘরে। প্রণয়া এই কাজে বেশ বিরক্ত হয়েছিল। তবে সে ঘরে গিয়ে দেখতে পেল জীর্ণশীর্ণ এক ভদ্রমহিলা সবে যোহরের নামাজ পড়ে জায়নামাজ ছেড়ে উঠছেন। উনি-ই বুঝি নীলুফা আন্টি?
নীলুফা বাহিরের দিকে নজর যেতেই প্রণয়াকে দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে শুকনো মুখে ফুটে ওঠে তার সুন্দর হাসি। তিনি ব্যস্ত গলায় বললেন,
–“তুমি বুঝি প্রণয়া? আসো আসো ভেতরে আসো!”
প্রণয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সালাম দিল নীলুফাকে। নীলুফা সালামের উত্তর দিয়ে প্রণয়াকে ভেতরে এনে বসিয়ে দিলেন। প্রণয়া ঢেকে রাখা বাটির খাবার নীলুফার দিকে বাড়িয়ে বলল,
–“মা পাঠিয়েছে!”
নীলুফা হাসি-মুখেই সে খাবার নিলেন। সঙ্গে বললেন,
–“এসবের কী প্রয়োজন ছিল?”
প্রণয়া কিছু বলল না। জোরপূর্বক শুধু হাসল। আলাপ-আলোচনায় প্রণয়া অপটু। তাই বেশিক্ষণ বসল না। কাজের ছুতোয় চলে আসল বাড়ি। বাড়ি এসে দেখল নুহাশ সাহেব এসেছেন। নুহাশ সাহেব মেয়েকে সামনে পেয়ে নির্মলের নামে প্রশংসার ঝুলি নিয়ে বসলেন। নির্মল নাকি প্রথম দিনেই বেশিরভাগ হিসাব ধরে ফেলে। কোথায় কী ত্রুটি আছে সেটাও মিলিয়েছে মোটামুটি। প্রথমদিন-ই নির্মলের কাজের প্রতি এত স্পৃহা দেখে নুহাশ সাহেব ভীষণ সন্তুষ্ট। শুধু অসহায় প্রণয়া সেসব নীরবে গিলে নিল।
প্লাবন স্কুল থেকে ফিরে খেলতে গিয়েছিল। খেলা থেকে ফিরে সেও গলায় উচ্ছাস ঢেলে বলল,
–“নির্মল ভাইয়া কত ভালো জানো আপু! আমাকে বাসায় পৌঁছেও দিল আবার দেখো চিপসও কিনে দিল। নির্মল ভাইয়াকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে!”
প্রণয়া এই পর্যায়ে এসে বিরক্ত হলো। একটা মানুষ এসেছে সবে। তাকে যাচাই-বাছাই না করেই তাকে নিয়ে এত লাফালাফির কারণ বুঝল না সে। প্লাবনের এত এত প্রশংসা শুনে ভাবল, নির্মল নামের লোকটা তো এত আহামরি কেউ নয়। তবে সবাই কেন সেই নির্দিষ্ট মানুষটার প্রশংসায় ব্যস্ত? কী এমন পানি পড়া খাইয়েছে এই লোক? কে এই নির্মল? প্রণয়া তাকে নিজ চোখে দেখতে চায়!
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
বছর কয়েক পরের ঘটনা….
একদিন ভোরে মীরাদের বাড়ির মেইন গেইটের কলিং বেইল বাজছে, আগের রাতেই পিয়ালীর আকদ অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে বাই-এয়ারে ঢাকায় ব্যাক করেছে ওরা। বাড়ির কেয়ারটেকার অসুস্থ, তাই এসেই তাকে ছুটি দিয়েছে আবীর।
শোয়া থেকে উঠে বেড রুম থেকে ড্রাইংরুমে আসে মীরা কে এসেছে তা দেখতে। এ ঘরের জানালা দিয়ে গেইটের দিকটা দেখা যায়। তাকিয়ে দেখে পিয়ালী দাঁড়িয়ে। বেশ অবাক হয় মীরা ওকে এত সকালে এখানে দেখে, আরো বেশী অবাক হয় ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে। এ ছেলেটা আবার কে?
গায়ে ওড়না জড়িয়ে চাবি হাতে বের হয় মীরা। মেইন গেইটের তালা খুলতেই পিয়ালী “ভাবী” বলে জড়িয়ে ধরে মীরাকে। চিন্তিত মুখে তাকায় মীরা ছেলেটার দিকে। অস্বস্তিতে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। আলিঙ্গন মুক্ত করে মীরা ” ভেতরে আসো” -বলে বাড়ির ভিতরে আনে ওকে। পিছু পিছু ছেলেটাও ঢুকে বাড়িতে, দরজা আটকে মীরা ওদেরকে বাড়ির ভেতরে আনে।
বসার ঘরে ওদেরকে রেখে বেড রুমে যায় আবীরকে ডাকতে। মীরার পিছুপিছু আসে পিয়ালী। কান্না করে যা বলে তা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় ওর। যদিও এমন কিছুই আশংকা করেছিলো ও। তবুও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হয় ওর। নিজের কিশোরী বয়সে ফিরে গেলো মীরা। ঠিক এমন একটা জায়গায় ও নিজে ছিলো দেড় যুগ আগে। ও যে ভুল করেছিলো তেমনি একটা ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে আবারো। এমনটা ভাবতেই ছেলেটার দিকে তাকায় মীরা একপলক। রাজীবের প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পায় ও তার মাঝে। সুন্দর, সুঠাম, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী যুবকের চোখেমুখে উদ্ধত ভাব। একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে আসার মতো এত গর্হিত অপরাধ করেও তার মধ্যে অনুতপ্ততার ছিটেফোঁটাও নেই। যেমনটা ছিলো না রাজিবের। জীবনে চলার পথের অনেক বাঁধা অনেক বিপত্তি অনেক পরিণত করেছে ওর চোখকে। এ চোখ ভুল দেখে না কখনো।
মীরা ঠান্ডা মাথার মেয়ে, ওদেরকে চা, নাশতা দিয়ে বসতে বলে নূহাকে তৈরি করতে যায় ও। নূহারও স্কুলের সময় হয়ে গেছে। গাড়ি এসে পরবে একটু পরেই।
ঝটপট নূহাকে তৈরি করে গাড়িতে তুলে দিতে যায় মীরা। সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় ওদের কথোপকথন। ছেলেটা ঝাড়ি দিচ্ছে ওকে এখানে কেন এলে তা বলে। মীরা শব্দ করে জুতা জোড়া কাবার্টে রাখে, যেটার কোন প্রয়োজনেই ছিলো না, ওদেরকে ওর উপস্থিতি জানানো ছাড়া।
কাবার্টের শব্দে নিরবতা নেমে এলো ঘরে। মীরা একপলক চেয়ে দেখে দুজন দুজনের বিপরীতের সোফায় বসে আছে। দুজনের কেউই চা-নাশতার কিছুই ছোঁয় নি।
গাম্ভীর্য একটা ভাব নিয়ে চা হাতে ঘরে ঢুকে মীরা। তারপর পিয়ালীর পাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করে –
: “কাজটা কি তোমরা ঠিক করেছো?”
মাথা নত করে রাখে দুজনই, আঙুল খুটছে ছেলেটা, যাতে অস্থিরতা ফুটে উঠে স্পষ্ট ভাবে। একটু পরে টের পেল পিয়ালী কাঁদছে। নিজের ওই সময়টাতে এক মুহূর্তের জন্য আবার ফিরে গেলো মীরা। পিয়ালীর মত এমনই অন্ধ ছিলো সে রাজীবের প্রতি, ঠিক ভুল, ন্যায়-অন্যায়ের সীমানা তখন অস্পষ্ট ছিলো ওর কাছে। একটা মানুষকে নিজের করে পাওয়াটাই তখন ছিল মুখ্য বিষয়, তাকে পেতে গিয়ে ভুল হচ্ছে কি সঠিক তা দেখবার সময় ছিল না ওর। তবে মীরার জীবণে ভুল শুধরে দেয়ার মতো কেউ ছিলো না। পিয়ালীর জীবনে ও আছে। সব ঠিক করে দিবে ও।
ভাবনার জাল ছিঁড়ে মীরা আবার প্রশ্ন করে পিয়ালীকে-
: “এখন কি করতে চাও তোমরা? ”
এবার মুখ খুললেন স্বয়ং নবাবজাদা। হুম, দেখতে শুনতে, আচারে, স্বভাবে নবাবি ঠাট আছে তার। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট কন্ঠে বললেন-
: “আজই বিয়ে করবো আমরা”
মীরা শক্ত গলায় বলে-
: “বিয়ে কি ছেলেখেলা যে করবো বললেই করা যাবে? গতরাতে বিয়ে হয়েছে ওর। যার সাথে হয়েছে ও এখনো তার স্ত্রী। তার সাথে ছাড়ছাড়ি না হলে আবার বিয়ে কিভাবে সম্ভব?”
পিয়ালী মীরার দিকে এগিয়ে এসে ওর হাত দুটো ধরে বলে-
: “ভাবী আমরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসি, আমার কিংবা তাউসিফ কারোর পক্ষেই অন্য কাওকে মেনে নেয়া সম্ভব না ”
: “ভালোবাসো দুজন কিন্তু দায়িত্ব তো সব তুমিই নিয়ে নিয়েছো কাঁধে,”
মাথা তুলে তাকায় তাউসিফ মীরার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মীরা পিয়ালীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে- “দিনশেষে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মুসলিম, মুসলিম রীতিনীতিতে বিয়ের ব্যাপারে অনেক নিয়মকানুন রয়েছে সেগুলো মেনে চালাও আমাদের কর্তব্য, তাছাড়া তোমাদের মনে যখন এসবই ছিলো তাহলে বিয়ের আগে কেন চলে গেলে না? একটা নির্দোষ ছেলে তাহলে এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়তো না। ওর দোষটা কি এখানে? কেন তোমরা ওর সাথে এমন অন্যায় করলে ”
কান্না জড়ানো গলায় পিয়ালী বলে-
: “ভাবী আমি জানি আমি আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওর ব্যাপারে বহুবার বাবা মা, চাচিকে বলেছি। তারা আমার কথার পাত্তাই দেননি, বরঞ্চ দিনের পর দিন মানসিক শারীরিক অত্যাচার করেছে। নিজেদের পছন্দে বিয়ে ঠিক করেছে, এমনকি কোন কিছু না জানিয়ে আকদের আয়োজন ও করে ফেলেছে। তাদের এসব কি অন্যায় না? নাকি তারা বাবা মা বলে তাদের কোন অন্যায় অন্যায় না? ”
: “দেখো পিয়ালী কাটাকাটির খেলা খেলতে বসিনি আমি, যেটা অন্যায় সব অবস্থাতেই অন্যায়। ”
মীরা তাউসিফের দিকে চেয়ে বলে –
: ” কিছু মনে করো না, এখন তুমি চলে যাও। ওর ভাই বাসায় আছে তো তোমাকে দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। আমি একটু ভেবে দেখি কি করা যায়।
কোনমতে বাহানা দিয়ে তাওসিফকে বাসা থেকে বের করলো মীরা। ওর মনে যা আছে তা তো আছেই।
তাউসিফ বের হওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে আসে আবীর। চমকে যায় পিয়ালীকে ওর বাড়ির ড্রইংরুমের সোফতে বসে থাকতে দেখে। তাউসিফ উঠে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আবীর অবাক কন্ঠে বলে-
: “কি ব্যাপার? ”
যদিও সবটাই বুঝেছিলো ও, তবুও যেন আবারো শুনতে চাইছে ওর ভাবা ভাবনাটা মিথ্যে প্রকাশের মিথ্যে খেলায়। কিন্তু মীরা তাই বললো যা ও ভেবে ফেলেছিল মুহূর্তের মধ্যেই।
সবটা শুনে মাথায় আগুন জ্বলে যেন আবীরের। মাথা নিচু করে কান্না করা পিয়ালীর দিকে তেড়ে যায় আবীর রাগান্বিত ভাবে। যেন নিজেরবসাথে হওয়া অন্যায়টার প্রতিবাদ করতে একটা সুযোগ পেয়েছে ও। রাগান্বিত কন্ঠে বলে-
: ” এত যখন ভালেবাসা তবে আগে কেন বাড়ি ছাড়িস নি, কি দোষ ঐ ছেলেটার? কোথায় পেলি তুই এত সাহস একটা মানুষের জীবন নিয়ে খেলার? ”
: ” আমাকে তোরা মাফ করে দে ভাইয়া”
: ” আমরা কে মাফ করার? তুই জানিস এ সমাজ, সমাজের মানুষ কি করবে ওর সাথে? বেঁচে থেকেও মরে যাবে ও। তোর কোন অধিকার নেই একটা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার। মীরা ফোন করো বাড়িতে, বলো ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা।
আবীরের এমন মূর্তি এর আগে দেখেনি মীরা। ছোট বোনকে শাসন করার অধিকার আছে ওর। ওরাও বড় বলে সম্মান করে আবীরকে। তবে আবীরের এই কাঠিন্য কষ্ট দিলো মীরাকে। নিজের করা অপরাধের সূক্ষ্ণ যন্ত্রণাও বাজতে থাকলো বুকে। ও-ও তো এমনি করেছিলো আবীরের সাথে। কিন্তু মীরার মতো সবার জীবনে ভুলটা “প্রিয় ভুল” হয়ে ফিরে আসে না। কারন আবীরেরা রাজীবদের তুলনায় শক্তিশালী হলেও সংখ্যায় খুবই নগন্য।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৬.১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সেদিন নূহা স্কুল থেকে ফিরলে সবকাজ ফেলে রেখে আবীর ওদের নিয়ে রওনা দেয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আবীর যেন মরিয়া হয়ে গেছে এ অঘটন রুখতে, যে করেই হোক এ অন্যায় ও রুখবেই। কড়া নজরদারিতে পিয়ালীকে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামে। তবে মীরার এসবে মত ছিলো না। মীরা আবীরকে বোঝাতে চেয়েছে এ সময় এমন হটকারিতা ঠিক হবে না, তাতে হীতে বিপরীত হতে পারে। এ যুগের ছেলেপেলে আবেগী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ওর পরামর্শ ছিলো পিয়ালী থাকুক কিছুদিন এখানে, বাড়িতে সবার মাথা ঠান্ডা হলে ওকে নাহয় দিয়ে আসবো, কিন্তু আবীর সে কথায় কান দেয় নি, উল্টো রাগান্বিত হয়ে বলেছে-
: “তুমি এসবে একদম নাক গলাবা না, তুমি কি বুঝবে এসবের? আসছে চোরের সাক্ষী মাতাল…”
কথাটা বলে মীরার সামনে থেকে হনহন করে চলে গিয়েছিল আবীর। আবীরের এমন আচরণে খুব লজ্জিত, আর অপমানিত বোধ করেছিলো মীরা৷ ও তো এমনিতেই পুড়ছিলো ভিতরে ভিতরে নিজের করা অপরাধের কথা ভেবে। পিয়ালী কোন অঘটন না ঘটায় তাই ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে চেয়েছে মীরা। এর বেশী কিছু না, আর আবীর! কি বললো ও?
চোরের সাক্ষী মাতাল? মানে কি এ কথার?
মানে ও নিজেও যে একই কাজ করেছিলো দেড় যুগ আগে সেটার তুলনা দিলো দিলো আবীর? এতটা বছর পর? কতটা বদলে গেছে ও, আবীর তা জানে না?
আবীর দেখে না ওর ঐ ভুলের জন্য কতটা অনুতপ্ত ছিলো ও?
মীরার কেন, যে কোন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষের অবশ্যই রিয়্যাক্ট করা উচিত এসব কথার বিপরীতে।কিন্তু না, এখন মীরা এ ব্যাপারে কোন রিয়্যাক্টই করবে না। আপাততঃ এ ঝামেলাটা মিটমাট হোক, পরে দেখা যাবে আবীরকে, এর ঝাল ঠিক সুদ উসুলে তুলবে মীরা।
ঠিক এই রুলসটা ওদের সংসারে শান্তি বজায় রাখে। একজন আগুন হলে অন্যজন হয় পানি, একজন কঠিন তো অপরজন তরল, দুজনের একজন কেউ রেগে গেলে অপরজন তাকে ঘাটে না। এ রুলসটা সকল দম্পতির মানা উচিত। কারন কথা কাটাকাটির খেলায় জিতার জন্য পুরো দুনিয়ার লোক আছে ঘরের মানুষকে এসব থেকে বাইরে রাখে ওরা দু’জনই।
অবশেষে সন্ধ্যার মুখে চট্টগ্রাম পৌঁছালো ওরা। গাছপালার আড়ালে অন্ধকার জেঁকে বসেছে যেন হানা দিতে। এখানকার এ সময়টা কেমন রহস্যময় লাগে মীরার।
সারাটা পথ কেঁদে বুক ভাসিয়েছে পিয়ালী। ওর হাবেভাবে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে ও মীরাকে এখন ওর শত্রু ভাবছে। কারন মীরা ওকে বুঝিয়েছে – যে ছেলে সময়মতো বাড়ির লোকেদের সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে না, যে ছেলে ভালোবাসার টানে না বরং একসাথে তোলা কিছু ক্লোজ ছবি, ভিডিও, চিঠিপত্রের ভয় দেখিয়ে প্রেমিকাকে বাড়ির বাইরে টেনে আনে সে আর যাই হোক ভালো প্রেমিক, ভালো মানুষ না। রাজিব আর তাউসিফের পার্থক্য এখানেই। কে জানে দেড় যুগ আগে ফোন, ছবি তোলা, ভিডিও করাটা এত এভেইলেভল হলে রাজীবও হয়তো এমনটাই করতো।
বাড়ি পৌঁছানোর পর হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়। পিয়ালীর বাবা ওকে দেখেই তেড়ে আসে মারতে। মীরা আর আবীর থামায় তাকে। তখন পিয়ালী অগ্নিমূর্তি ধারন করে। কর্কশ কন্ঠে বলে- এখন কেন আলগা দরদ দেখাতে এসেছো তোমরা? সরে যাও, মেরে ফেলুক আমাকে, সেটাই ভালো।
মীরা স্তব্ধ চেয়ে থাকে পিয়ালীর দিকে। এসব নিয়ে রাগারাগির এক পর্যায়ে পিয়ালীর মা অজ্ঞান হয়ে পরেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায় তাকে নিয়ে। গাড়ি যোগে হসপিটালে পৌছানোর পর জানা যায় অতিরিক্ত টেনশনে প্রেশার হাই হয়ে মেজর হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন তিনি। তার পরিস্থিতি খুবই সংকটাপন্ন। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। পিয়ালীর বাড়ি পালানো রেখে ওর মায়ের অসুখের বিষয়টা সকলের চিন্তার কারন হলো।
এমন পরিস্থিতিতে পিয়ালীকে চোখে চোখে রাখার কথাটা কারো মাথায় না থাকলেও পিয়ালীর হবু বর পরোক্ষভাবে এক কাজটাইমযেন করে যত্নের সাথে। খবর পেয়ে হসপিটালে এসে স্বান্তনা দিতে সকলকে। একটা সময় একা বসে কান্না করতে থাকা পিয়ালীর কাছে গিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকে ওকে। বেচারা নতুন বর, লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আপ্লুত পিয়লীকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যাস্ত। পাশে দাঁড়ািয়ে থাকা নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে সে তার স্ত্রী পিয়ালীকে৷ বড়রা কি ভাববে? নিজের বাড়ির লোকই বা কি মনে করছে এসব যেন থোড়াই কেয়ার করছেন উনি। পিয়ালী প্রথমটাতে লোকটাকে পাত্তা না দিলেও একটা সময় ভেঙে পরে ওর মমত্বের কাছে। বাড়ির কেউ ওর সাথে কথা বলছে না, ওকেই দোষী ভাবছে এসবের জন্য। এত মানুষের ভিড়েও যেন একঘরে করে দিয়েছেন তারা ওকে।
পিয়ালীর বর আফনান ওর অবজ্ঞাকে পরিস্থিতির কারন ধরে নিয়ে ‘হাল ছেড়ো না মাঝি’র মতো লেগে থাকে নিরলস৷ টানা চারদিন পর জ্ঞান ফিরে পিয়ালীর মায়ের। জ্ঞান ফিরে পিয়ালীরও। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ধরাবাঁধা আসাটাকে বেখাপ্পা ভেবে হসপিটালে থাকার ডিউরেশন কমিয়ে আনে আফনান। বিপরীতে পিয়ালী টের পেতে থাকে গত চারদিনের মমত্ববোধের। তবে এখনো ভালোবাসে ও তউসিফকে। ভীতি কাজ করতে থাকে ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু সফটকপির জন্য। পঞ্চম দিন বাড়ি ফিরে মীরা আবীর। ঝড়ের তোরে কাটা পাঁচটা দিন কেউই কথা বলেনি কারোর সাথে। মীরা বলেনি অভিমানে, আর আবীর অপরাধবোধে। ঢাকায় ফিরবার দিন হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসে নূহাকে খুঁজে পায় না ওরা। চিন্তায় মীরা আবীরের গলা শুকিয়ে যায়। বাড়ির উল্টোদিকে শালবন আর তার সীমানায় ঝর্ণার পিচ্ছিল ঢালুর কথা ভেবে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয় ওর। আবীর কথাটা শুনেই দৌড়ে যায় সেদিকটায়। পিছু পিছু মীরাও যায় আবীরের। বাকীরাও এদিকসেদিক খোজা শুরু করে দিয়েছে। সেখনে পৌঁছে কিছুই দেখে না ওরা, না নূহা না ওর চিহ্ন। নিচে নামবে আবীর এমন সময় কল আসে আবীরের। আবীর কথা বলা অবস্থায় ধীর পায়ে নেমে যায় মীরা ঝর্ণার ঢাল বেয়ে। এ জায়গাটা নূহার অনেক পছন্দের। একা আসতে নিষেধ থাকায় সুযোগ পেয়ে এখনে আসলো কি-না তাই ভবাছে ও। আবীর ভবছে নিচে পরে গেলো কি-না। আবীরের কথা শেষ হতেই ও ঘুরে বলে নূহা পাশের বাড়ির ছাদে ঐ বাড়ির মেয়েদের সাথে নাকি খেলছে। কথাটা শুনে ফিরে আসে মীরা। কিন্তু তরতরিয়ে নামা গেলেও একা উঠতে পারছে না ও, আবীর সিগারেট ধরাতে গিয়ে চোরা চোখে দেখে মীরার চেষ্টা। সংকচে আবীরের সাহায্য ও চাচ্ছে না ও। নামার পথটার মুখে হাঁটু গেড়ে বসে আবীর, তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও চেপে যায়।
গত পাঁচদিন ওরা কথা বলে না একে অপরের সাথে। কিন্তু আবীরের আচার আচরণ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু মীরা যেন থুম ধরে আছে, ঝড় হয়ে ভেঙে পরারর জন্য। মীরা উপরে উঠে দ্রুত পায়ে রওনা দেয় মেয়ের দিকে। আবীর কাকে যেন ফোন দেয়। মীরা পিছন ফিরে তাকায় না একবারও। আবীর বুঝতে পারে কোন কথার দোষে মীরা এমন বেশে। থমকে দাঁড়ায় আবীর, মাথা চুলকে ওর দ্রুত গতির হাঁটা দেখে হেসে দেয়। যেন ছায়াও মাড়াবে না ও আবীরের।।
অবশেষে ছেলেমেয়ে নিয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বিদায় নিয়ে রওনা দেয় ওরা। বাই এয়ারে জলদি ঢাকা পৌঁছে গেলেও জ্যামের কারনে সাড়ে ১১টায় বাসায় পৌঁছে ওরা। এদিকে বাচ্চা দুজনেই ঘুমে কাঁদা। বাড়ি পৌঁছে ওদেরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে মীরা। বাথরুম থেকে ফিরে চুল ঝাড়ে, হাত-পায়ে লোশন দেয়। এমন সময় হঠাৎ পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। চমকে য়ায় মীরা ওদের আইপিএস আছে তাও আলো জ্বললো না কেন?
আশেপাশে চেয়ে দেখে আলো জ্বলছে ল্যাম্প পোস্টে। তারমানে বাড়ির কোথাওই সমস্যা হয়েছে। ভাবতেই ঘর থেকে বেরিয়েই দেখে ফ্ল্যাটের মেইন দরজা থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি আলোকিত। কাছে গিয়ে দেখে ছোট ছোট লাইটের সাদা জোনাকির মতো আলো দিয়ে সাজানো। দরজা বাইরে থেকে আটকে অবাক হয়ে আলোর পথ ধরে ছাদে যায় মীরা। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পা দিতেই পুরো ছাদ আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। দুই পাশ থেকে সকলে এসে উইশ করে মীরাকে ”হ্যাপি এনিভার্সেরী”। ভীষণ অবাক হয়ে যায় মীরা, বিয়ের ছয় বছরে এমন বিবাহ বার্ষিকীর উৎযাপন করে নি ওরা। ইরা, ওর বর, মীরার ভাই, ভাইয়ের বৌ, তমা, ফাহাদ, সকলেই উপস্থিত। তলে তলে এত বড় আয়োজন কখন করলো আবীর? গত পাঁচদিন তো চট্টগ্রামেই ছিলো ওরা। পুরো ছাদে চোখ বুলায় মীরা। সিম্পলি এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ছাদটাকে বলার মতো না। সবাই ঘিরে আছে ওদের দুজনকে। কিন্তু কাছাকাছি থেকেও যে ওরা কত দূরে আজ এক সপ্তাহ ধরে তা কাওকে টের পেতে দিলো না দুজনের কেউই।
তারপর কেক কাটা, খাওয়াদাওয়া, সবার হাসি কথোপকথন, আড্ডায় জমে উঠলো রাতটা। মীরা স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বললেও একবারের জন্য ও তাকায় নি আবীরের চোখে। মীরার মান ভাঙাতেই এই উদযাপনের আশ্রয় নিয়েছে ও। তবুও যেম মান ভাঙছে না প্রিয়ার৷ রাত অনেক হলে সকলকেই থেকে যেতে বলে রাতটা। নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসায় সকলেই ফিরে যায় নিজ নিজ বাড়িতে। মুরসালিন পৌঁছে দেয় ফাহাদকে, আর মীরার ভাই নাজিবদের সাথে যায় তমা আর ওর বরকে। ওকে বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরবে ওরা।
রাতে ঘরে ফিরে আবার সেই মূর্তি ধরে মীরা। এত কিছুতেও যেন মন গলেনি তার। বুঝতে পেরে আবীর কাপড় গুছাতে থাকা মীরাকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। এক মূহুর্তের জন্য যেন জমে যায় মীরা। তখনি তৎক্ষনাৎ ঘুরে দাঁড়ায় আবীরের দিকে। তারপর জমে থাকা অভিমানের মেঘ রূপান্তরিত হয় কথার বৃষ্টিতে। আবীরের কান যেন বধির। ও কেবল মীরার রাগান্বিত মুখভঙ্গি আর ঠোঁটে নড়ন দেখছে। হাত দুটো ও নাড়ছে মীরা সবসময়কার মতো। এটা ওর পুরোনো অভ্যাস। এটা ওর কথার অলংকার যেন। রাগলে ওর সুন্দরী বউটার মুখ আরক্ত হয়ে যায়। মীরাকে ও তাই শামারুখ ডাকে ভালোবেসে। এটা ওর আদুরে নাম।
আবীর বুঝলো পরিস্থিতি, যুক্তি, তর্ক, সবই আবীরের বিপক্ষে। মীরার বিপরীতে জিতবার একটা অবলম্বনই কেবল রয়েছে ওর। সেটারই আশ্রয় নিলো ও দিশেহারা হয়ে। হুট করে দুই কান চেপে ধরে মীরার যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র ঠোঁট জোড়াকে ডুবিয়ে নিলো নিজের ঠোঁট। হতচকিত মীরার রাগ যেন আরো বাড়লো। রাগে ক্ষোভে ফেটে পরা মীরা অনেক চেষ্ট করলো নিজেকে আলাদা করতে। ততক্ষণে আবীর মীরার পুরো দখল নিয়ে নিয়েছে ওকে দেয়ালের সাথে আটকে ধরে। ঘাড়ের কাছে চুমু খেয়ে আবীর মীরার কানে ফিসফিস করে বলে- ‘আই্ম সো সরি’ ক্ষমা না করে যাবে কোথায় তুমি?
চলবে……
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৬.২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
অভিমানের সব মেঘ ভালোবাসার বৃষ্টি নামিয়েছিল সে রাতে। অমবস্যার অন্ধকার রাতটা রঙিন আলোয় আলোকিত হয়েছিলো দুই নর-নারীর উদ্দাম ভালোবাসায়।
আবীর এসব ঝামেলা থেকে ফিরে কাজে ডুবে যায়। ডুব দেয় মীরাও। সামনের মাসে ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে জার্সি তৈরীর বড় অর্ডার সরাসরি পেয়েছে ওরা। এটা ওদের ফ্যাক্টরির এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্ডার হতে যাচ্ছে। গত ৫ দিন ঐসব ঝামেলার দরুন বাড়িতে থাকার কারনে কাজের তদারকিতে ঢিল পরায় কাজ একটু পিছিয়ে গেছে। তবে সময় এখনো আছে হাতে। সেখান থেকে ফিরে উদয়াস্ত কাজ করে ওরা। বেঁধে দেয়া সময়ে কাজ শেষ করতে ৩ রাত নাইট ডিউটি ও করায়। অবশেষে কাজ শেষ করে সময় মতোই শিপিং কম্পিলিট করে ওরা।
এদিকে চট্টগ্রামের বাড়ি থেকেও কল আসতে থাকে ওদের। দেশের বাইরে থাকা সবার উপস্থিতির সুবিধার্থে পিয়ালীর বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো ২ মাস পর। কিন্তু ছেলে এবং তার পরিবার চান যতদ্রুত সম্ভব বউ ঘরে তুলতে৷ এটা মূলত পিয়ালীর শ্বশুর বাড়ির লোকেদের ইচ্ছে না, ইচ্ছেটা পিয়ালীর বরের। তাছাড়া
মাঝখানে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, পিয়ালির বাড়ির লোকেরাও মেয়ে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে। তাই হুট করে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, দেশের বাইরে থাকা ওদের জন্য আর অপেক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় বিয়ের তারিখ পরে নিকটবর্তী শুক্রবারে।
সময়মতো ব্যাগপত্র নিয়ে পৌঁছে যায় আবীর-মীরা দম্পতি। বিয়ের তারিখ পরিবর্তন হওয়ায় সব কাজ ফেলে ছুটে আসে অনেকে। পিয়ালীর ভাই, ভাবী, ফিওনার বর আসতে না পারলেও দুটো বাচ্চা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একাই ছুটে আসে ফিওনা। একত্রে হওয়ার, আনন্দ উপভোগ করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করতে চায়-না ওরা। অবশেষে বুধবার বিকেলে শুরু হলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। পিয়ালীকে স্বাভাবিকই দেখালো। তবে মীরা ওর আগের ব্যাবহারের কথা ভেবে এড়িয়ে গেলো ওকে। তবে পিয়ালীর চোখে-মুখে লেপ্টে থাকা অনুতপ্ততা ঠিকই টের পোলো মীরা।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই ভীষণ সুন্দর করে সাজলো। বাড়িটা সেজে উঠলো নতুন করে। বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থাকায় বাড়িটা যেন নি:সাড় কঙ্কাল হয়ে থাকে সবসময়। ওরা এলেই প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় ছবির মতো সুন্দর এই বাড়িটায়৷
জমকালো হলুদের অনুষ্ঠান আরো রঙিন হয় হবু বর
আফনান এর আগমনে। ঐ বাড়ি থেকে বিয়ের শাড়ি গহনা দিতে আসা লোকেদের সাথে সেও এসেছে। ভাবটা এমন যেন অত্যান্ত অনিচ্ছায়, একান্ত বাধ্য হয়ে, ঠেকায় পরে এসেছে সে এখানে।
এমন সময় হবু বরকে পেলে এ বাড়ির ছেলেপুলেরা ছাড়বে কেন? বাড়ির ছোটবড় সকলে মিলে লুফে নিলো যেন হবু বরকে। বাড়ির ছোটরা একপ্রকার তুলেই আনলো তাকে। সংকোচ আর লজ্জায় সত্যি গুটিয়ে গেছে বেচারা, সবাই কেমন ভাবে নেয় বিষয়টা এটা ভেবে । কিন্তু এই কথা, হাসাহাসিটাকে সত্যি উপভোগ করলো পিয়ালী। ওকেও দেখা গেলো মিটিমিটি হাসতে। পাশাপাশি বসে থাকা দুজনকে এক পর্যায়ে দেখাগেলো ফিসফাস কথা বলতে। মীরা তো সেই লেভেলের অবাক। এদের এত ভাব হলো কবে?
ক্যামেরাম্যান খাওয়া শেষে এসে ব্যাস্ত হয়ে গেলো বর-কনের যৌথ ফটোশ্যুট করতে। ছবি তোলার সময় কোন আড়ষ্টতা ছিলো না দুজনের কারোরই। এত মিষ্টি লাগছিলো দুজনকে বলার মতো না। মীরা মন থেকে দোয়া করে দুজনের জন্য। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে ওর। একটা বিশাল খাদের কিনারা থেকে পিয়ালীকে টেনে আনতে পেরেছে ওরা শেষ পর্যন্ত। এর সবটুকু কৃতিত্ব আবীরের। ও শক্ত হাতে সামলেছে সবটা, জরুরী সব কাজ ফেলে পাঁচটা দিন থেকেছে চট্টগ্রামের বাড়িতে।
হবু বর-বউ দুজন নিজেদের মধ্যে ভাব করে নিলেও পিয়ালী কিন্তু এখনো গম্ভীর মীরার প্রতি। এটা গাম্ভীর্যতা নাকি সংকোচ তা বোঝা মুশকিল। সত্যি বলতে মীরার কোন আক্ষেপ নেই ওর দূর্ব্যাবহারের কারনে। পিয়ালী যে খাদের কিনারা থেকে বেঁচে ফিরেছে, সহজ হয়েছে আফনানের সাথে এটাই অনেক ওর জন্য।
ছবি তোলা খাওয়াদাওয়া শেষে জমাটি আড্ডা বসে সকলে মিলে৷ দফায় দফায় চা নিয়ে আসছে মীরা সকলের জন্য। ফিওনা মীরার হাতটা ধরে বলে-
: “খুব আপ্যায়ন হয়েছে, এবার বসো তো তুমি, খেলা জমে উঠেছে ” মীরা চেয়ে দেখে টেবিলে গোল করে বসে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলছে ওরা। চা সামলে বসে পরে মীরাও। তিন রাউন্ড পর বোতল চলে আসে মীরার দিকে।
বড় চাচার ছেলে জাদিদ মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
” ট্রুথ নাকি ডেয়ার?
মীরা সহাস্যে বলে- “ট্রুথ”
এবার আহনাফ বলে-
: ” জীবনের এ পর্যায়ে এসে পেছন ফিরে তাকালে সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটাকে মনে হয়? ”
একটু যেন ভাবতে সময় নেয় মীরা। তারপর ছোট্ট করে বলে-
: “আবীর”
সকলে উৎফুল্ল হাসিতে ফেটে পরে মীরার উত্তরে। মীরার চোখে চেয়ে মুচকি হাসে আবীরও।
এরপর এক এক করে একেকজনের পালা পরে। ঘুরতে ঘুরতে এবারবএকটু দেরি করেই আসে মীরার পালা।
পিয়ালীর ভাই প্বার্থ যে কিনা পড়াশোনা করে অস্ট্রেলিয়ায়, সে মীরাকে বলে –
: “ভাবী এমন কোন গল্প বলো যা সবার শোনা উচিত বলে মনে করো তুমি”
এটা কি ট্রুথ অর ডেয়ার খেলা হলো?
মাথা চুলকে মুচকি হাসে সে। তারপর বলে আপনার স্টোরি টেলিং স্কিল খুব ভালো। বলুন না একটা গল্প।
এবারও একটু ভাবে মীরা। গল্পতো কত আছে জীবনে, কোনটা বলবে ও?
তারপর মীরা বলে-
: গল্পটা এক অনিন্দ্য সুন্দরীর, যার প্রেম হয় এমন এক যুবকের সাথে যে ওকে ভালোবাসতো না, কেবল জিতে নিয়েছিলো বন্ধুর সাথে বাজিতে। অথচ মেয়েটা পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলে ওকে। অন্যত্র বিয়ে হওয়ার পরও ঘর ছাড়ে তাকে পাওয়ার আশায়।
গল্পের এ পর্যায়ে আবীর চমকে উঠে তাকায় মীরার দিকে। এ গল্প সকলের অজানা হলেও জানা আছে আবীরের।
আবারো বলতে শুরু করে মীরা-
: মেয়েটা বাবা মায়ের খুব আদরের হওয়া সত্ত্বেও বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করে ছেলেটাকে। আত্নীয় পাড়াপ্রতিবেশি সকলে বলেছিলো “একদিন ঠিক বুঝতে পারবে কত বড় ভুল করেছে সে”
আভিজাত্যে বড় হওয়া সে মেয়েটা ঘর বাঁধে বস্তির এক কুঁড়ে ঘরে। গায়ের গয়না বেঁচে চলতে থাকে তাদের সংসার। ছেলেটা সামান্য বেতনের চাকরী করলেও দুজনের সংসারের জন্য তা খুবই নগন্য থাকায় কাজে নেমে পরে মেয়েটাও। কোচিং সেন্টারের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেও সুন্দরী হওয়ার দরুন নানান ঝামেলায় কাটে ওর দিন। ওরই সৌন্দর্যের কারনে চাকরী হারায় মেয়েটার বর, কারন ছেলেটার মালিকের বদ নজর পরে ওর বউয়ের উপর। যে রূপ আর সৌন্দর্যের জন্য একটা সময় গোপন অহমিকা ছিলো মেয়েটার ঠিক সেই সময়টাতে তারই জন্য নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হতে থাকে মেয়েটার। স্বামীর চাকরি হারানোর পর উদয়াস্ত খেটে সংসারের ঘানি একাই টানতে থাকে মেয়েটি। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের প্রেক্ষাপট দুঃখে বদলে গেলেও মেয়েটা সুখী ছিলো ওকে পেয়ে।
এসবের ঘোর না কাটতেই ছেলেটার অনেক বড় একটা অসুখ হয়, যার চিকিৎসা অত্যান্ত ব্যায়-বহুল। কোন দিশা না পেয়ে মেয়েটাকে তার স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করে নিজেকে বন্ধক রেখে । শর্ত ছিলো মেয়েটার স্বামীর চিকিৎসা শেষ হলে মেয়েটা বিয়ে করবে ঐ লোককে। সে টাকাতেই চিকিৎসা হয় ওর৷ তবে ভাগ্য এবার সহায় হয় ওর, ওর বন্ধুরা দাতব্য সংস্থা থেকে ওর স্বামীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করে। ফেরত দিয়ে নিজের বন্ধক ছুটানোর জন্য চলে যায় তার কাছে। লোকটা মেয়েটাকে বন্ধকি থেকে মুক্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু টাকা গুলো উপহার দেয় নতুন করে কিছু করার শুরু করার জন্য। মেয়েটা আজও ওর জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রুর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে মজার ব্যাপার হলো অনেক, অনেক বছর পরে মেয়েটা জানতে পারে আসলে ঐ টাকাগুলো কোন দাতব্য সংস্থার দান ছিলো না।
গল্পের ঠিক এ পর্যায়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয়া আবীর তড়াক করে সোজা হয়ে বসে, তাকায় মীরার চোখের দিকে। যেন অলৌকিক কোন ক্ষমতা বলে নিজের চোখ দিয়ে বন্ধ করে দিতে চাইছে মীরার জবান। কাজটা করতে ব্যার্থ হয়ে সে মনে মনে ভাবে “গল্পের এ অংশটা ত মীরার জানার কথা না”
এবার আবীর মাথা নিচু করে বসে পরে। যেন এ অংশটা মীরার জানা হওয়ায় ও ভীষণভাবে লজ্জিত।
পিয়ালী জিজ্ঞেস করে –
: ” টাকাগুলো কে পাঠিয়েছিলো তবে?”
পিয়ালীর এমন প্রশ্নে টের পাওয়া যায় ওর মনোযোগের অখন্ডতা। ওর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে আবারো বলতে শুরু করে মীরা-
: ” ঐ টাকাগুলো পাঠিয়েছিলো তারই ফেলে আসা ১ম স্বামী, যাকে মেয়েটা কলঙ্কময় জীবন ছাড়া কিছুই দেয়নি, অথচ মেয়েটার সুখের কথা ভেবে গোপনে টাকাগুলো পাঠিয়েছিলো মেয়েটারই বন্ধুদের হাতে। চিকিৎসা তদারক করতে পাঠিয়েছিলো তারই কাছের এক বন্ধুকে । এই বন্ধুই এত বছর পরে সামনে এসে এত বছর আগের জট খুলেছিলো মেয়েটার সামনে।
একটু থামলো মীরা। এত বলে গলা শুকিয়েছে যেন ওর। গ্লাসে থাকা পানি পুরোটা শেষ করে একটু থমকে থাকে সে। আহনাফ কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করে –
: “তারপর? ”
মীরা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আবার শুরু করে-
: এরপর শুরু হয় মেয়েটার নতুন যুদ্ধ। নিজে পায়ে ঘুরে দাঁড়াবার। দিনরাত এক করে খাটা ক্লান্ত মেয়েটা হঠাৎ টের পায় ঘুরে দাঁড়াবার এ যুদ্ধটা ওর একার। দিন ঘুরবার ঐ সময়টাতে ওর স্বামী ব্যাস্ত ছিলো বাইক আর স্মার্ট ফোনের নতুন নতুন ভার্সন ক্র্যাক করায়। মেয়েটা ওর স্বামীকে ছাড় দিতো অসুস্থ ভেবে, এত বড় ধকল সামলে বেঁচে ফিরেছে, অতিরিক্ত স্ট্রেস, অতিরিক্ত পরিশ্রম ওর হার্টের জন্য হানিকর তাই, পরিণামে ঐ ছাড় পেয়ে পেয়ে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠে মেয়েটার প্রেমিক বর। দায়িত্বজ্ঞানহীন ঐ পুরুষটার দিন কাটতো টো টো করে। কাজ বলতে ব্যাবসার মার্কেটিংটা দেখতো সে অপরদিকে মেয়েটাকে দেখতে হতো পুরো ব্যাবসা সাথে সংসার ত রয়েছেই। বিয়ের অনেক বছর পেরুলেও সন্তান না হওয়ার যে যন্ত্রণা তা-ও একাই বয়ে যেতে হয়েছে ওকে। অনেক সাধনার পর একটা পরীর জন্ম হয় ওদের ঘরে। সবাই বলেছিলো ঘরে সন্তান এলে বোহেমিয়ান স্বামীর মন বসে যাবে। কিন্তু যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন। নিজের জন্মের মেয়ের প্রতিও মেয়েটার স্বামীর রাজ্যের অনিহা। মেয়ের অসুখ, বিসুখ ভালোমন্দ সব কিছুতেই গা ছাড়া ভাব তার। মেয়েটার ১ম স্বামী আর ওদের মেয়ের একটা বিষয়ে সাদৃশ্য থাকায় মাঝেমধ্যে হাসির ছলে বাজে কথা বলতেও ছাড় দেয়নি সে।
এত কিছুর পরও একটা সময় ও জানতে পারে ছেলেটা আবার বিয়ে করেছে ওর নিজেরই কাজিনকে। তাকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ের কারন হিসেবে দাখিল করেছে ১ম স্ত্রী বিবাহিত, ব্যবহৃত শরীর আনকোরা মেয়ে বিয়ের বাসনা। অথচ ঐ মেয়েটার প্রথমে অন্যত্র কাবিন হলেও কয়েকটা বাক্য বিনিময় ছাড়া কোন সম্পর্কই হয়নি মেয়েটার ১ম স্বামীর সাথে।
“একদিন ঠিক বুঝতে পারবে কত বড় ভুল করেছো তুমি ” সকলের বলা এই কথাটাই কেবল মাথায় ঘুরপাক খেতো।
ভুল যে ও করেছে তা মেয়েটি টের পেয়েছিলো অনেক আগেই। অথচ মেয়েটা সব জেন বুঝেও অন্ধ ছিলো, মগ্ন ছিলো সকলের বলা কথা ভুল প্রমাণের বাজে খেলায়। ভুল কে ভুল প্রমাণের খেলায় পুরো জীবণটাই শপে দেয় সে। বিনিময়ে অবহেলা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, সবচেয়ে কষ্টের বিষয় এই ছেলেটাকে বিয়ে করার অপরাধে মেয়েটাকে তার বাবার লা*শটাও দেখতে দেয়া হয়নি। একটা মেয়ে যার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলো দিনশেষে কি পেলো?
সংসারের প্রতি অনিহা, কাজকর্মে অনিহা, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি অনিহা একের পর এক তার করা অন্যায় মেনে নিয়েছে সে, নর্দমা থেকে তুলে ধুয়ে মুছে বিছানায়ও তুলেছে একাধিক বার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েটির সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় যখন নিজের গড়া ব্যাবসাটা সম্পূর্ণ নিজের নামে নিয়ে নেয় মেয়েটির বর। এত বড় প্রতারণার সাথে যোগ হয় গোপণে ২য় বিয়ের খবর। সব মিলিয়ে মেয়েটির প্রথমে স্বামী হত্যার পরিকল্পনা থাকলেও মেয়েটার জন্য বেঁচে থাকতে হবে বলে সরে আসে সে পথ থেকে।
এবার একটু থামে মীরা, এত আগের ঘটনা, কত কিছু ভুলে গেছে, কিছুটা আবছা হয়েছে স্মৃতি সময়ের স্রোতে। ফিওনা মীরার দিকে চেয়ে বলে-
: “তারপর ”
মুচকি হেসে আবার শুরু করে সে-
: “অনেক ঘটনা ভুলে গেছি আমি, যতটুকু শুনলে ঘটনা বুঝতে সুবিধা হবে তোমাদের ততটুকুই বলছি-
: ” মেয়েটা অবশেষে ডিভোর্স দেয় তার প্রেমিক স্বামীকে, যে তাকে ভালোবেসে ছিলো কিনা কোনদিন তা সে জানে না, তার কাছে ঐ মেয়েটি সুন্দরী, ওয়ান্ডারফুল ইন্সটুমেন্ট ফর এনজয় ছাড়া কিছু ছিলো না। ডিভোর্সের পরদিন নিজের গড়া ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান নিলামে উঠে স্বামীর দেনার দায়ে। অনেক কষ্টে নিজের জমানো টাকা, বন্ধুবান্ধবদের থেকে ধারদেনা করে সেটাকে নিলামে কেনে মেয়েটি। এরপর ভাগ্যক্রমে ঘুরেও দাঁড়ায় । ঘুরে দাঁড়ানোর এ পথে গুটি কয়েক মানুষ দেব দূত হয়ে এসেছিলে মেয়েটার জীবনে। যাদের সাহায্য ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব ছিলো।
সুন্দরী যুবতী ডিভোর্সি মেয়ে সমাজের একটা দায়, একটা বেঝা। একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও আশপাশের সকলে ২য় বিয়ে করার তাগিদ দেয়। কিন্তু একা থাকায় অনড় থাকে মেয়েটি। যে কষ্ট সে পেয়েছে ভালোবেসে সংসার গড়ে তার পুনরাবৃত্তি করতে চায় না সে।
তাছাড়া ও বিয়ে করলে স্বামী পাবে, কিন্তু মেয়েটা কি বাবা পাবে? কিন্তু সমাজ তাকে ছাড়বে কেন? পদে পদে, সর্বত্র লালসার শিকার হয় সে।
এই যে একটা ভুল, একটা ভুল সিদ্ধান্ত একে একে কতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করেছে…
যাকে ভালোবেসেছিলো, দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো সে তাকে কোনদিন ভালোই বাসে নি জিতে নিয়েছে বন্ধুর থেকে বাজীতে। আবীরদের সবচেয়ে ছোট কাজিন স্নেহা অস্ফুটে বলে উঠে-
: “তারমানে কি ভালোবাসা ভুল? ”
মীরা ওর চোখে চোখ রাত রেখে বলে-
: “অবশ্যই না, ভালোবাসা ভুল না, ভুল মানুষকে ভালোবাসা ভুল”
কথাটা বলেই পিয়ালীর দিকে তাকায় মীরা। পিয়ালী বুঝতে পারে এমন হতে পারা জীবনের খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছে সে।
মীরা নিজের দৃষ্টি গুটিয়ে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে-
: “হিন্দিতে একটা কথা আছে – ঝুকনে সে আগার আপকি রিসতে টিক যাতে হ্যে তো ঝুক যাও, লেকিন বার বার আপকো হি ঝুকনা পারতে হ্যে তো রুখ যাও”
সম্পর্কে যখন দুজনের সমান কন্ট্রিবিউশান না থাকে, একজনের অপরজনের প্রতি ভরসা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ না থাকে তাহলে সেখানে ভালোবাসা থাকে না। থাকে ভুল করবার দায়। যেটা দিনকে দিন বাড়তে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে, আর একদিন তার বিপরীতে নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয়।
বলেই থেমে থাকে মীরা।
বাজিতে যে ছেলেটা হেরেছিলো তার সম্পর্কে কিছু বললেন না ভাবী? কি হয়েছিল তার শেষে? তিনি কি বাজি হেরে গিয়ে এ গল্পের প্রেক্ষাপট থেকে সরে গিয়েছিল? একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে ফিওনা৷
চমকে উঠে মীরা ফিওনার মুখের কথা শুনে। অবাক হয় এমন প্রশ্ন শুনে। কেমন বেমালুম ভুলে গেছে ও এত বড় ব্যাক্তিকে, যে ওর জীবণ নাটকের এত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মনে পরার ভঙ্গিতে বলে-
: “নাহ্ বাজিতে হেরে গিয়ে সে থেমে থাকে নি, মেয়েটার বরের বন্ধু হওয়ায় তার সবটাই জানতো সে৷ খুঁজে খুঁজে দূর্বল দিক গুলো নিয়ে প্রতিশোধ নিতে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ শুরু করে সে। মেয়েটার বর এমনিতেই বেপরোয়া ছিলো, তার সাথে যোগ হয়েছিল ওমন বন্ধুর সান্নিধ্য। মেয়েটার সংসার, ব্যবসা এমন কোন কিছু নাই যেটাতে নাক গলায় নি সে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে নি সে। অথচ মেয়েটা তাকে কোনদিনই ভুলেও শত্রু ভাবে নি। সবকিছু টের পেয়ে যেদিন মুখোমুখি হয়েছিলো মেয়েটা তার – কথার বাণে জর্জরিত করে দিয়েছিলো শত্রুর অন্তর, এবং ক্ষমাও করে দিয়েছিলো তার কৃতকর্মের জন্য। পরে একদিন সকালে মেয়েটা হঠাৎ শুনতে পারে লোকটা নাকি আ*ত্ন*হ*ত্যা করেছে। স্বামীর বন্ধু হিসেবে সহমর্মিতা দেখাতে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো সেই মেয়েটি। সেখানে গিয়ে মাথায় আকাশ ভাঙে তার, সেদিনই মেয়েটা জানতে পারে এত বছরের সংসার যে ছিলো তার সেটা বাজির দানে জিতা একটা খেলা ছিলো৷ যেটা হেরেছিলো তার বন্ধুর বর আর জিতেছিলো নিজের প্রেমিক স্বামী। সংসার তো ভেঙে আগেই গিয়েছিলো, যতটুকু সহমর্মিতা ছিলো মানুষ হিসেবে ততটুকুও শেষ হয়েছিল সেদিন।
এরপর খেলাটা চলতে থাকে তার নিজস্ব গতিতে। বোতল ঘুরে, ঘুরে চলে সময়, সাথে গল্প। ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় পর পিয়ালীর দিকে মুখ করে থামে বোতল। জাদিদের নিয়মিত প্রশ্নের উত্তরে ট্রুথ নেয় পিয়ালী-
পিয়ালীর মা পেছন থেকে এসে বলে-
: ” ট্রুথ না ডেয়ার নেবে পিয়ালী, এবং মীরাকে জড়িয়ে টাইট একটা হাগ করবে”
পিয়ালীর মা খেলার বাইরে হলেও তার মন পরে আছে যেন টেবিলের কেন্দ্রে থাকা বোতলে মধ্যে। কেমন ইতস্তত ভাব হয় পিয়ালীর। মীরার ভাবসাব বোঝা যাচ্ছে না চা খাওয়ার ব্যাস্ততায়। সংকোচে জমে থাকা পিয়ালীকে নিজে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মীরা।
মীরার আচমকা আলিঙ্গনে স্তব্ধ পিয়ালীর কান্নার বাঁধ ভাঙে একটু পর । মীরা পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে ওকে। পিয়ালী কান্না জড়ানো গলায় বলে-
: “ভাবি আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি অন্ধ ছিলাম সত্যি, তবে সময় থাকতে চোখ খুলেছে আমার।
ওদের কান্না দেখে চোখ আর্দ্র হয় সকলের। এরপর আর খেলা জমে না, হলুদের আসরে পর্দা নামে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলার। যে খেলা অনেক না জানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে আবীরের। যা কোনদিনই স্বামী হয়েও জিজ্ঞেস করে নি মীরাকে।
ঘরে এলে মীরা দেখে আবীর শুয়ে পরে ঘুমের ভান ধরছে। অথচ অসুখবিসুখ ছাড়া ওরা দুজন সবসময় একসাথেই ঘুমোতে যায়। মীরা মুচকি হাসে ওর এই লুকোচুরি খেলা দেখে। কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে চোখ রাখে আবীরের দিকে। ঘুমিয়ে পরলো না তো? তবে আবীরের উশখুশ ভাব তখনো বিরাজমান। মনে মনে বলে মীরা-
: “শকের যে ডোজ পরেছে আজ রাতে আর ঘুম আসবে না”
হাত-পায়ে লোশন দেয়া শেষ হলে ছেলেকে পাশে রেখে আবীরের পাশে শোয় ও। চিত হয়ে শোয়া আবীরের বুকে মাথা রাখতেই নড়েচড়ে পাশ ফিরে সে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মীরা বলে-
: “আমি জানি আপনি এখনো ঘুমান নি”
কিছু সময় পর পাশ ফিরে আবীর। তারপর মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে, বাইরে উথাল পাথাল জোছনা, ঝরনার ধারে যাবে?”
ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসা মীরার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ফোটে। এক লাফে খাট থেকে নেমে চাদরে জরিয়ে নেয় নিজেকে। আবীরও ততক্ষণে তৈরী যাওয়ার জন্য।
সেই প্রথম দিনের মতোই সকলের দৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পেছনের দরজা ধরে বের হয় ওরা। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে বাড়ির অপরদিকের ঝাউ বনে হাঁটা দেয় ওরা। আকাশের চাঁদ, নিশুতিরাতে দেখা যাচ্ছে ঝাউবনের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে এক যুগল। ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে হাঁটছে মেয়েটা মাথা হেলিয়ে রেখেছে ছেলেটার গায়ে৷ যেন নিজের ভরের সবটুকু টানিয়ে নিচ্ছে ছেলেটাকে দিয়ে। টুকরো টুকরো কথা বলছে দুজনে। মাঝে মাঝে হাসির শব্দ ও আসছে। কে বলবে একটু আগেও অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলো দুজনে। ভালোবাসা এদেরকে এমনি ধাঁচে গড়েছে যে যত যাই হোক সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনে আগায় এরা দুজনের হাতে হাত রেখে।
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
ভালেবাসা আর দুজনের মিষ্টি বোঝাপড়ায় কেটে গেছে ওদের দিন, মাস, বছর। ওর ব্যাবসা গত কয়েক বছরে এমন স্থানে পৌঁছে গেছে যে ওকে এখন আর আগের মতো সময় দিতে হয় না। দেশের নামী দামী সব ডিজাইনার কাজ করে ওদের ব্র্যান্ডের সাথে। বিজিএমইএ এর সভাপতি হিসেবে কাজ করার বদৌলতে দেশ এবং দেশের বাইরে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে ওর। না তার মানে এই না যে নিজে সভাপতি হওয়ার ফায়দা নিয়েছে ও৷ কাজের চাতুর্যতায় ও এমনটা পেরেছিলো, সভাপতির পরিচয় ছিলো বাড়তি পাওনা। বিদেশী বায়াররা পণ্যের গুণগত মানকে, কাজকে মূল্যায়ন করে কাজের মালিকানাকে নয়। তবে এটা সত্যি যে এ পদ ওকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে বিজনেসটাকে ও দেখতে পেরেছে অন্য এঙ্গেল থেকে, যা ওকে পৌঁছে দিয়েছে অন্য লেভেলে। একেকজনের সমস্যা, প্রতিকূলতা দেখে শিখেছে মোকাবিলার ধরন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা, সৃজনশীলতা সহ অনেক কিছু।
কাজের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দিলেও এখনো মীরা ডিজাইন রিচেক, ফাইনাল টাচ্ দিতে ভুলে না। তবে সবদিক দেখে সারাদিনের কাজকর্মে ক্লান্ত মীরা কখনোই সংসারের দায়িত্বে অবহেলা করে নি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সংসারকে গুরুত্ব না দিয়ে সংসারের ফাঁকে ফাঁকে কাজকে শিডিউল করে নিয়েছে। ঘর সামলানোর জন্য মাজেদা খালা এখনো আছেন ওর পাশে। আগে বিজনেস, সংসার, সন্তান মীরাকে সবটা দেখতে হয়েছে এখন আবীর আসার পর থেকে সেটা সহজ হয়েছে। আবীর ওর জীবণে আসার পর দুঃসাহসী মীরা হয়েছে আরো অপ্রতিরোধ্য। আগে যখন মালামাল কিনবার ব্যাপার হোক, কিংবা কোন মিটিং এ এ্যাটেন্ড করা সবার আগে ভাবতে হতো কতগুলো শকুনের দৃষ্টি থেকে নিজের আত্নরক্ষায় ব্যাপারটা। একটা বিবাহিত মেয়ের জায়গা সকলের চোখে আলাদা সম্মানের। কারন তখন সকলের মাথায় বাজিয়ে দেখি একটু! – এ চিন্তাটা থাকে না। ফিওনার প্রতি মীরা কৃতজ্ঞ। সামাজিক স্থিতির এ দিকটা ওর অবগত ছিলো না যেন। চোখের উপরে আত্মসম্মানের নামে অহং, আর অজ্ঞতার যে পর্দা ছিলো তা সরিয়ে দিয়েছে ও এক নিমেষে।
মীরা বিজিএমইএ এর দায়িত্ব পালনের দ্বিতীয় অর্ধেকের দিকে হঠাৎই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। দুই বছর সুনাম আর নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে পড়াশোনা আর সংসারে।
একটা পুরো বছর ডেডিকেটেড পড়াশোনার পর ওর স্বপ্ন হয়েছে সত্যি। দেশের বাইরে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে থেকে শুরু হওয়া স্বপ্ন শেষ হয়েছিলো পৃথিবী বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনিং প্রতিষ্ঠান এফ.আই.টি এ পড়ার সুযোগের মধ্য দিয়ে। মীরা নিজেও এতটা আশা করে নি। মেন্টরের পরামর্শে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইনিং স্কুলে এপ্লাই করলেও পৃথিবী বিখ্যাত এফ.আই.টি এ পড়ার সুযোগ পাবে তা ও ভাবে নি। ইচ্ছে ছিলে লন্ডন ‘কলেজ অফ ফ্যাশনে’ পড়বে। লন্ডন শহরটা ওকে বেশ টানে। কিন্তু আমেরিকার এফ.আই.টি এ পড়বার সুযোগ প্রত্যাশার পারদের সর্বোচ্চ সীমানা ছুঁয়ে ওকে করেছে ধন্য। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে জুনে দেশ ছাড়ছে মীরা নিউইয়র্কের উদ্দ্যেশ্যে। প্রাপ্তির মুকুটে যুক্ত হবে সাফল্যের আরো একটি পালক। দেশে ছাড়ার আগে ব্যাবসার সবটা ফাহাদ আর আবীরকে বুঝিয়ে দিয়ে পাড়ি জমাবে ও। মীরার সফর সঙ্গী ছোট্ট নূহা। ওরা উঠবে আবীরের বোন ফিওনাদের বাড়িতে৷ ওরা এখন নিউইয়র্ক এর পার্শ্ববর্তী শহর ফিলাডেলফিয়ায় থাকে। খোদার কি লীল! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণ কেন্দ্র নিউইর্য়কে ও যাবে এটা সত্যি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিলো। তাই হয়তো ফিওনার বর প্রোমোশন পেয়ে উনার কোম্পানির ফিলাডেলফিয়ায় ব্রাঞ্চে শিফট হয়েছে আজ দুই বছর। আপাততঃ মীরা সেখানেই উঠবে। সত্যি বলতে বাধ্য হয়েছে ও সেখানে উঠতে৷ ফিওনা এত কাছাকাছি থেকে মীরাকে অন্য কোথাও উঠতে দিবে না। আবীরের ও যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু ব্যবসাটাও দেখা জরুরি ভেবে আবীরের দেশে থকাটাকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছে ওরা। একটা মোটে বছর কেটে যাবে দেখতে দেখতে।
অবশেষে নূহাকে নিয়ে মীরা রওনা দিলো নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট থেকে ফিওনা আর ওর বর রিসিভ করেছে ওকে। সেখানকার পরিবেশ, নিয়মকানুন, রাস্তাঘাট সবই নতুন ওর কাছে। ফিওনা নিজে মীরাকে পথঘাট, নিয়মকানুন সম্পর্কে দীক্ষা দিয়েছে। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনে নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়েছে মীরাকে। নূহাও ফুফু, ফুফাতো ভাই বোনদের সান্যিধ্যে প্রাণবন্ত। কথায় কথায় ও একদিন আক্ষেপ করে ওরা ভাইবোন একসাথে খেলে, ওর নিজের একটা ভাই থাকলে ভালো হতো। নূহার কথাটায় মীরা অস্বস্তি ফিল করলেও ফিওনার বর রুহুল আমীন বিষয়টা লাইটলি এভয়েড করে। রাতে ফিওনা মীরাকে এ ব্যাপারে ওদের কোন প্ল্যান আছে কি-না জানতে চায়। ফিওনা বলে-
“দেখো মীরা ব্যাপারটা যদিও তোমাদের ব্যাক্তিগত তবুও বলবো এবার মনে হয় তোমাদের এ বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত”
কথাটা শুনে মীরা চিন্তিত মুখে বলে-
: “আমরা সত্যি চেষ্টা করছি, সবটা আল্লাহর হাতে”
ফিওনা মীরার মুখ বিবর্ণ হওয়ায় জিজ্ঞেস করে –
: “এ বিষয়ে কথা বলায় তুমি কি কিছু মনে করেছো মীরা?”
: “না ফিওনা, আমার কিছু সমস্যার দরুন দেরী হচ্ছে, কিন্তু সমাজ আবীরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে”
: “ডাক্তার কি বলেছেন?”
: “বলেছেন সময় লাগবে”
: “তোমারা চেষ্টা করতে থাকো, দেখো কি হয়”
: “এখন তো আবার বছরের দূরত্ব হয়ে গেলো”
: “ভেবো না,দেখতে দেখতে চলে যাবে সময়, এসব নিয়ে আমরা ভাবছি না, আমার ভাই স্ত্রী কন্যা নিয়ে ভালো আছে এতেই আমরা সুখী”
মীরার ভীষণ ভালো লাগে নূহাকে নিয়ে ওদের ভাইবোনদের এমন পজেসিভ কথাবার্তায়। যেন নূহা সত্যি আবীরেরই অংশ।
নতুন পরিবেশ, পড়াশোনা, নানা দেশের নতুন বন্ধুবান্ধব সবকিছু মিলিয়ে এক অন্য ভূবণে নাম লিখিয়েছে ও। জীবণ ভুল সময়ে ভুল মানুষ এসে পরায়
হাসি, আনন্দে এক্সপ্লোর করার সময় ছাত্রজীবনটাকে পার করতে হয়েছে নজরবন্দী থেকে, তারপরের অংশটুকু জীবণের সাথে যুদ্ধ করে। নতুন এ জীবণটাকে ও খুব করে উপভোগ করছে নতুন করে৷ কলেজের পরীক্ষার বইগুলো জোগাড় করে দিয়েছিলো ওর বন্ধু আর কোচিং এর ভাইয়ারা। সে সব কথা, সে সব দিন ভুলেনি মীরা।
ক্লাসে হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে যায় মীরা। ক্লাসের মাঝখানেই টিচারকে জানায় ওর অসুস্থতার কথা। একা মীরা বাড়িতে যেতে পারবে কিনা তা জিজ্ঞেস করে টিচার, প্রয়োজনেফ সাথে কাওকে দিবে। মীরা তাকে বলে ও কমনরুমে কিছুক্ষণ রেস্ট করে তারপর বাসায় যাবে। কিছুটা গুড ফিল হওয়ায় একাই বাসায় পৌঁছে যায় ও। ভেবেছে হোম সিকনেস হয়তো। এ দেশে এসে মীরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ওর জীবণের, ওর অস্তিত্বের ঠিক কতটুকু বেদখল হয়ে গেছে আবীরের কাছে। প্রেম করার সুযোগ হয়নি ওদের, সময় আর স্থানের দূরত্ব সে আক্ষেপ ঘুঁচিয়েছে এবার। আবীর রয়েছে ৭৮৬৩ মাইল দূরের দেশে, সময়ের হিসাবও দুই দেশে দুই রকম, রাত জেগে কথা বলার কারনে মীরার ঘুম হয়না ঠিকঠাক। মীরা ভাবে বাসায় গিয়ে ঘুম দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাসায় গিয়ে ওর শরীর আরো অসুস্থ হয়ে পরে। এই অসুস্থতা, এমন খারাপ লাগাটা যেন মীরার পরিচিত। সন্দেহের বর্শবর্তী হয়ে ফিওনাকে ব্যাপারটা বলে মীরা। ফিওনা পাত্তা দেয় না, কারন ওর অসুখের কথাটা এই সেদিনই মীরা বলেছে ওকে। এসব ব্যাপারে উৎসাহ দেখালে পরে নেগেটিভ কিছু হলে কষ্ট পাবে বেচারী তাই তেমন উৎসাহ দেখায় না ও। বলে ডাক্তারের কাছে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে রাখবো। পরদিন থেকে শরীর আরো খারাপ হয়, গা-গোলানো ভাবটায় পুরোপুরি নিশ্চিত হয় মীরা। ফিওনা মেডিকেল শপ থেকে প্রেগন্যান্সির কিট এনে দেয় মীরাকে। বাথরুমে ঢুকে চেক করার পর কীট হাতে অনেকক্ষণ বসে থাকে মীরা। নূহা দরজা নক করে ডাকতে থাকে মাকে। ওর ডাকেই সংবিৎ ফিরে যেন ওর। বের হয়ে দেখে নূহা বসে আছে বাহিরে। খুশির এ খবরটা সবার আগে মীরা নূহাকেই জানায়৷ নূহাকে আগলে ধরে মীরা বলে- “নূহা বড় বোন হিসেব তুমি প্রমোশন পেতে যাচ্ছো”
মীরার জটিল এ কথার কিছুই বুঝে না ছোট্ট নূহা, মায়ের হাতে কীটটা দেখে জিজ্ঞেস করে “এটা কি”
উত্তরে মীরা বলে- “তোমার প্রোমশন-পত্র”
কিছু না বুঝেই দৌড়ে যায় নূহা ফুফুর কাছে, প্রোমোশন শব্দটার সাথে পরিচয় আছে ওর, ব্যাপাটা পজেটিভ কিছু তাও জানে ও। ফিওনা একটু পরেই আসে মীরার কাছে, মীরার চোখেমুখে অন্যরকম আভাই সবটা যেন বলে দিলো ফিওনাকে৷ মীরাকে জড়িয়ে ধরে ফিওনা কেঁদে দেয়। দোয়া করে- “ছেলে মেয়ে যাই হোক, সুস্থ একটা বাচ্চা আসুক তোমাদের ঘর আলো করে এই দোয়াই করি। ভাইয়াকে খবরটা বলেছো?
দুপাশে মাথা নেড়ে না বলে মীরা, ফিওনা আবার মীরার কাছে গিয়ে বলে ” খুশির এ খবরটা জলদি জানাও তাকে”
মীরার চোখ-মুখে লাজুকতা ছেঁয়ে গেলো। ফিওনা বললো-
: “খবরটা কি আমি দিবো”
চোখ তুলে তাকায় মীরা ফিওনার দিকে, ফিওনা ঘড়িতে তাকায়, দেশে এখন সময় ভোর চারটা, এখন জানানো ঠিক হবে না ভুল তা না ভেবেই ফিওনা কল করে আবীরকে৷ মীরার হঠাৎ এ অসুস্থতার কথা জানে আবীর। তবে এ অসুস্থতা যে ওর অক্ষমতার কুয়াশা দূর করতে আবির্ভূত হয়েছে তা হয়তো ভাববার অবকাশ দুজনের কেউই পায়নি। গত একটা বছর ধরে চেষ্টা করছে দুজনে। আবীরের এ বিষয়ে তেমন মাথাব্যাথা না থাকলেও মীরা ছিলো মরিয়া৷
মিরাকল হ্যাপেনস্।
ফিওনার সাথে কথা শেষ করে আবীর কল করে মীরাকে। লজ্জায় মীরা কথাই বলতে পারছেনা, উত্তর দিচ্ছে হু-হা তে। আচ্ছা এতে লজ্জার আছে কি? সব মেয়েরাই এ ব্যাপারটায় কেমন যেন লজ্জায় গুটিয়ে যায়।
এর ঠিক একমাসের মাথায় একদিন সকালে (সেদিন মীরার কোন ক্লাস না থাকায় মীরা বাড়িতেই ছিলো) কলিংবেলের শব্দে ফিওনা ব্যাস্ত থাকায় দরজা খুলতে যায় মীরা। দরজা খুলে ভীষণরকম অবাক হয় ও, কারন ওর সামনে হাস্যজ্জ্বল মুখে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর অনাগত সন্তানের পিতা আবীর!
চলবে……
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৪.১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সেদিন রাতে ”না জানিয়ে হঠাৎ কেন এলো এখানে? মীরার এমন প্রশ্নে আবীর বলেছে- “টাকাপয়সা, কাজ তো আসবে যাবে জীবণে কিন্তু এই সময় আর আসবে না মীরা। আমি আমাদের এই যাত্রাটাকে উপোভোগ করতে চাই, দেখতে চাই কাছ থেকে। তাছাড়া এ সময়ে আমার পাশে থাকাটাও কম জরুরী না। শেষের কথাটা একটু গর্বের ভঙ্গিতে বলে আবীর, মুচকি হেসে মীরা নাক টিপে দেয় ওর।
এ অবস্থায় ফিলাডেলফিয়া থেকে মীরার ক্লাস করতে যেতে সমস্যা হবে ভেবে আবীর ওর ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। খরচা একটু বেশী হলেও সেখানে গড়ে ওঠে ওদের তিনজনের নতুন সংসার। বড় বোন হলে তাও কথা ছিলো, কিন্তু ছোট বোনের বাসায়, সত্যি বলতে আবীরের ভালো লাগছিলো না ফিওনাদের বাসায় থাকাটা। ওর একটু প্রাইভেসি দরকার ছিল। একটা দীর্ঘ সময় থাকা হবে যেহেতু সেখানে তাই আলাদা বাসা নেয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেছে ও। তবে ওদের নতুন বাসা ফিওনা যথাসম্ভব গোছগাছ করে দিয়ে গেছে। ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছে নিয়মিত।
এরপর পরবাসে কাটানো দিনগুলোতে প্রেম নেমে এসেছিলো মীরা-আবীরের জীবণে। এই প্রেম যেন দু’জনকে নতুন করে চিনে নেবার, নতুন করে জানার। কারন জীবণের দৌঁড়ে এতটা ফুরসত পায়নি ওরা এর আগে। একটা ঘটনা বললে পরিষ্কার হবে বিষয়টা- আবীর নিজেদের ফ্ল্যাটে আসার পর একদিন গোসল শেষে টাওয়ালে সব চুল মুড়িয়ে নিয়ে আবীরের সামনে দাঁড়ায় মীরা, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় – “বলুন তো আমার চুলের রঙ কি?” যেন কঠিন কোন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ও আবীরের দিকে। প্রশ্ন শুনে আধশোয়া থেকে উঠে বসে আবীর, চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর, ভাবসাব দেখে হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেয় মীরা। মুখ বাকিয়ে বলে- “জানতাম পারবেন না আপনি” বলেই কাপড়গুলো আমারিতে তুলতে যায় ও। উঠে আবীর মীরার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে-
: “তোমার চুল স্ট্রেইট এবং ন্যাচারাল শাইনি। কুচকুচে কালো নয়, কালো আর বাদামী রঙের মিশেল, ”
বলেই চোখ খোলে আবীর, যেন চোখের পাতা বন্ধ করে সেখানটায় থাকা লেখাটা দেখে বলে দিলো ও। তারপর কপট ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে- “কি ঠিক হয়েছে?”
যেন উত্তর ঠিক না হলে কঠিনতম শাস্তির বিধান রয়েছে ওর জন্য স ভয়ে ও ত্রস্ত।
উত্তর শুনে মুচকি হাসে মীরা। ওর কাছে এসে চুল পেচিয়ে রাখা তোয়ালেটা আবীর খুলে ফেলে সযত্নে। তারপর বলে- “আমাকে জব্দ করা এত সোজা না বুঝলে মীরা, তুমি অন্ততঃ তোমার সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করো না, সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি, তোমাকে আমি তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী চিনি”
কথাটা অতিরঞ্জিত শোনালেও সত্যি। বিবাহিত জীবণের গত তিনটা বছরে মীরা প্রমাণ পেয়েছে এ কথার সত্যতা।
নতুন ফ্ল্যাটে অনেক ভালো সময় কাটে ওদের। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে মীরার এখানে। আবীরও তাই।
এখানে আসার পর আবীরের কাজকর্ম বলতে তো কেবল ফোনে খোঁজ নেয়া, বাকীটা সময় দুজনে মিলে সামলায় তিনজনের সংসারটাকে। নূহাও আবীরের দেখাদেখি মায়ের সেবা করে। বাপবেটি দুজনে যেন মীরার সেবায় ব্রতী। অনাগতের জন্য তাদের উচ্ছাসের শেষ নেই।
বাপবেটি দুজনে প্রায়ই গুটুর গুটুর করে। দেখলে মনে হবে নূহা না কোন বিশিষ্ট ব্যাক্তির সাথে কথা বলছে আবীর। এমনি মনযোগ এবং গুরুত্ব থাকে ওর নূহার কথায়। একদিন মীরা লুকিয়ে শোনে ওদের দু’জনের কথা, ওদের কথার বিষয়বস্তু “নূহা ভাই চায় না বোন” যেন নূহার চাওয়ার উপর নির্ভর করছে সব। নূহা বললো ওর একটা ভাই চাই। ভাই-ই কেন চাই? এমন প্রশ্নের উত্তরে নূহা বলেছে- ও ওর ভাইকে যত্ন করবে, গোসল করাবে, খাবার খাইয়ে দিবে, ঘুম পাড়াবে।
একটু ভেবে আবীর বললো- এটা তো তুমি বোনের বেলাও করতে পারবে। ভেবে দেখো বোন হলে ভালো হতো না? তুমি তো আমাদের মেয়ে আছোই, তোমার আরো একটা বোন আসলে ভালো হতো না?
একটু ভেবে নূহা বলে-
: “বোন থাকা ভালো কিন্তু ফিহা (ফিওনার ছেলে) ওর বোনকে ধরে মারে, ওর সব জিনিস, জামাকাপড় নিয়ে নেয় এইজন্যই তো আমার বোন পছন্দ না। শুনে আবীর হাসতে থাকে৷ আর বলে-
: ” ভাই-ই চাই তোমার?”
: “হ্যা বাবা, ভাই-ই চাই,
: “কি আর করা আমরা তাহলে আল্লাহকে বলি তিনি যেন একটা ভাই পাঠান তোমার জন্য”
: “তাই করছি আমি নামায পড়র সময়”
হেসে আবীর বলে-
: “কাল থেকে আমিও করবো ”
আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে মীরা দোয়া করে খোদার কাছে। ওদের ইচ্ছে যেন পূরণ হয়।
পুরোটা সময় আবীর মীরা আর নূহার খেয়ালে মগ্ন। মীরার শারিরীক কিছু সমস্যার জন্য বাড়তি যত্ন আবীরের মীরার প্রতি। সময় মত খাওয়া, হাঁটা, বিশ্রাম, মেডিটেশন, সবকিছু রুটিনে বেঁধে দিয়েছে আবীর। সাথে দেখছে নূহার পড়াশোনার দিকটাও। নানান ঘাটে পোড় খাওয়া মীরা সত্যি অবাক হয় ওর স্বামী ভাগ্যে। অথচ নূহা পেটে ছিলো যখন, কি নিদারুণ কষ্টে কেটেছে ওর সে সময়টা। প্রেগ্ন্যাসির পুরো জার্নিটাতে গোটা দিন কারখানায় সময় দিতে হয়েছে ওকে, রাতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইতো। না পেয়েছে অবসর, না যত্ন। ক্লান্তিতে ঘুমোতে যেতো ও উঠতো ক্লান্তি নিয়ে। টেককেয়ার করবে তো দূরের কথা,ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারটায়ও সময় দিতে পারতো না রাজিব।
এসব ভাবনায় যখন মন পুড়ে মীরার, সময় তখনি কোত্থেকে হাজির করে আবীরকে। ওর যত্ন ভালোবাসা মীরার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
এদিকে সময় ঘনিয়ে আসে নতুন অতিথির আগমনের।
নূহা আছে বলে মীরা মনেপ্রাণে চাইছে ওর একটা ছেলে হোক। অবশেষে জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে আবীর মীরার ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
পুত্রকে প্রথম বারের মতো কোলে নিয়ে মীরার চোখের পানির বাঁধ ভাঙে। এ মানবশিশু কেবল ওদের সন্তানই না, এটা আবীরের অক্ষমতা নিয়ে সমাজের করা কটুক্তির জবাব। এ বিষয়ে আবীরের কেন হেলদোল নেই। ছোট বাচ্চা কোলে নেয়ায় ওর বেশ ভয়। তবুও ওখানে থাকার সময়টা আবীর মধূ্ুর করেছে ওর যত্নে ভালোবাসায়।
দুই পরিবারের সবাই খুশি মীরার ছেলের খবরে। সকলে অপেক্ষায় রয়েছে কবে দেশে ফিরবে ওরা। মীরার ছেলের জন্য একেকজন একেকটা নাম রেখেছে। তবে শেষ পর্যন্ত মীরার রাখা নামটাই
টিকে সকলের বিপরীতে। “ফালাক”
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
সেদিন রাতে ”না জানিয়ে হঠাৎ কেন এলো এখানে? মীরার এমন প্রশ্নে আবীর বলেছে- “টাকাপয়সা, কাজ তো আসবে যাবে জীবণে কিন্তু এই সময় আর আসবে না মীরা। আমি আমাদের এই যাত্রাটাকে উপোভোগ করতে চাই, দেখতে চাই কাছ থেকে। তাছাড়া এ সময়ে আমার পাশে থাকাটাও কম জরুরী না। শেষের কথাটা একটু গর্বের ভঙ্গিতে বলে আবীর, মুচকি হেসে মীরা নাক টিপে দেয় ওর।
মীরার এ অবস্থায় ফিলাডেলফিয়া থেকে মীরার ক্লাস করতে যেতে সমস্যা হবে ভেবে আবীর ওর ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। খরচা একটু বেশী হলেও সেখানে গড়ে ওঠে ওদের তিনজনের নতুন সংসার। বড় বোন হলে তাও কথা ছিলো, কিন্তু ছোট বোনের বাসায়, সত্যি বলতে আবীরের ভালো লাগছিলো না ফিওনাদের বাসায় থাকাটা। ওর একটু প্রাইভেসি দরকার ছিল। একটা দীর্ঘ সময় থাকা হবে যেহেতু সেখানে তাই আলাদা বাসা নেয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেছে ও। তবে ওদের নতুন বাসা ফিওনা যথাসম্ভব গোছগাছ করে দিয়ে গেছে। ফোনে খোঁজখবর নিচ্ছে নিয়মিত।
এরপর পরবাসে কাটানো দিনগুলোতে প্রেম নেমে এসেছিলো মীরা-আবীরের জীবণে। এই প্রেম যেন দু’জনকে নতুন করে চিনে নেবার, নতুন করে জানার। কারন জীবণের দৌঁড়ে এতটা ফুরসত পায়নি ওরা এর আগে। একটা ঘটনা বললে পরিষ্কার হবে বিষয়টা- আবীর নিজেদের ফ্ল্যাটে আসার পর একদিন গোসল শেষে টাওয়ালে সব চুল মুড়িয়ে নিয়ে আবীরের সামনে দাঁড়ায় মীরা, ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় – “বলুন তো আমার চুলের রঙ কি?” যেন কঠিন কোন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ও আবীরের দিকে। প্রশ্ন শুনে আধশোয়া থেকে উঠে বসে আবীর, চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় ওর, ভাবসাব দেখে হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নেয় মীরা। মুখ বাকিয়ে বলে- “জানতাম পারবেন না আপনি” বলেই কাপড়গুলো আমারিতে তুলতে যায় ও। উঠে আবীর মীরার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে-
: “তোমার চুল স্ট্রেইট এবং ন্যাচারাল শাইনি। কুচকুচে কালো নয়, কালো আর বাদামী রঙের মিশেল, ”
বলেই চোখ খোলে আবীর, যেন চোখের পাতা বন্ধ করে সেখানটায় থাকা লেখাটা দেখে বলে দিলো ও। তারপর কপট ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলে- “কি ঠিক হয়েছে?”
যেন উত্তর ঠিক না হলে কঠিনতম শাস্তির বিধান রয়েছে ওর জন্য সে ভয়ে ও ত্রস্ত।
উত্তর শুনে মুচকি হাসে মীরা। ওর কাছে এসে চুল পেচিয়ে রাখা তোয়ালেটা আবীর খুলে ফেলে সযত্নে। তারপর বলে- “আমাকে জব্দ করা এত সোজা না বুঝলে মীরা, তুমি অন্ততঃ তোমার সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করো না, সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখছি, তোমাকে আমি তোমাকে তোমার চেয়েও বেশী চিনি”
কথাটা অতিরঞ্জিত শোনালেও সত্যি। বিবাহিত জীবণের গত তিনটা বছরে মীরা প্রমাণ পেয়েছে এ কথার সত্যতা।
নতুন ফ্ল্যাটে অনেক ভালো সময় কাটে ওদের। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কেটেছে মীরার এখানে। আবীরও তাই। সঙ্গিহীন সেই বিমর্ষ জীবণ যেন এখন গল্প।
এখানে আসার পর আবীরের কাজকর্ম বলতে তো কেবল ফোনে খোঁজ নেয়া, বাকীটা সময় দুজনে মিলে সামলায় তিনজনের সংসারটাকে। নূহাও আবীরের দেখাদেখি মায়ের সেবা করে। বাপবেটি দুজনে যেন মীরার সেবায় ব্রতী। অনাগতের জন্য তাদের উচ্ছাসের শেষ নেই।
ওরা দুজনে প্রায়ই গুটুর গুটুর করে। দেখলে মনে হবে নূহা না কোন বিশিষ্ট ব্যাক্তির সাথে কথা বলছে আবীর। এমনি মনযোগ এবং গুরুত্ব থাকে ওর নূহার কথায়। একদিন মীরা লুকিয়ে শোনে ওদের দু’জনের কথা, ওদের কথার বিষয়বস্তু “নূহা ভাই চায় না বোন” যেন নূহার চাওয়ার উপর নির্ভর করছে সব। নূহা বললো ওর একটা ভাই চাই। ভাই-ই কেন চাই? এমন প্রশ্নের উত্তরে নূহা বলেছে- ও ওর ভাইকে যত্ন করবে, গোসল করাবে, খাবার খাইয়ে দিবে, ঘুম পাড়াবে।
একটু ভেবে আবীর বললো- এটা তো তুমি বোনের বেলাও করতে পারবে। ভেবে দেখো বোন হলে ভালো হতো না? তুমি তো আমাদের মেয়ে আছোই, তোমার আরো একটা বোন আসলে ভালো হতো না?
একটু ভেবে নূহা বলে-
: “বোন থাকা ভালো কিন্তু ফিহা (ফিওনার মেয়ে) ওর বোনকে ধরে মারে, ওর সব জিনিস, জামাকাপড় নিয়ে নেয় এইজন্যই তো আমার বোন পছন্দ না। শুনে আবীর হাসতে থাকে৷ আর বলে-
: ” ভাই-ই চাই তোমার?”
: “হ্যা বাবা, ভাই-ই চাই,
: “কি আর করা, আমরা তাহলে আল্লাহকে বলি তিনি যেন একটা ভাই পাঠান তোমার জন্য” নুহা শান্ত গলায় বলে-
: “তাই করছি আমি নামায পড়র সময়”
হেসে আবীর বলে-
: “কাল থেকে আমিও করবো ”
আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে মীরা দোয়া করে খোদার কাছে। ওদের ইচ্ছে যেন পূরণ হয়।
পুরোটা সময় আবীর মীরা আর নূহার খেয়ালে মগ্ন। মীরার শারিরীক কিছু সমস্যার জন্য বাড়তি যত্ন আবীরের মীরার প্রতি। সময় মত খাওয়া, হাঁটা, বিশ্রাম, মেডিটেশন, সবকিছু রুটিনে বেঁধে দিয়েছে আবীর। সাথে দেখছে নূহার পড়াশোনার দিকটাও। নানান ঘাটে পোড় খাওয়া মীরা সত্যি অবাক হয় ওর স্বামী ভাগ্যে। অথচ নূহা পেটে ছিলো যখন, কি নিদারুণ কষ্টে কেটেছে ওর সে সময়টা। প্রেগ্ন্যাসির পুরো জার্নিটাতে গোটা দিন কারখানার কাজে সময় দিতে হয়েছে ওকে, রাতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতে চাইতো। না পেয়েছে অবসর, না যত্ন। ক্লান্তিতে ঘুমোতে যেতো ও উঠতো ক্লান্তি নিয়ে। টেককেয়ার করবে তো দূরের কথা,ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারটায়ও সময় দিতে পারতো না রাজিব।
এসব ভাবনায় যখন মন পুড়ে মীরার, সময় তখনি কোত্থেকে হাজির করে আবীরকে। ওর যত্ন ভালোবাসা মীরার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
এদিকে সময় ঘনিয়ে আসে নতুন অতিথির আগমনের।
নূহা আছে বলে নুহার মতো মীরাও মনেপ্রাণে চাইছে ওর একটা ছেলে হোক। অবশেষে জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে আবীর মীরার ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।
পুত্রকে প্রথম বারের মতো কোলে নিয়ে মীরার চোখের পানির বাঁধ ভাঙে। এ মানবশিশু কেবল ওদের সন্তানই না, এটা আবীরের অক্ষমতা নিয়ে সমাজের করা কটুক্তির জবাব। এ বিষয়ে আবীরের কেন হেলদোল নেই। ছোট বাচ্চা কোলে নেয়ায় ওর বেশ ভয়। তবুও ওখানে থাকার সময়টা আবীর মধূ্ুর করেছে ওর যত্নে ভালোবাসা দিয়ে।
দুই পরিবারের সবাই খুশি মীরার ছেলের খবরে। সকলে অপেক্ষায় রয়েছে কবে দেশে ফিরবে ওরা। মীরার ছেলের জন্য একেকজন একেকটা নাম রেখেছে। তবে শেষ পর্যন্ত মীরার রাখা নামটাই
টিকে সকলের বিপরীতে। “ফ্বালাক”
প্রবাসে খুব সুন্দর ভাবেই শেষ হয় মীরার পড়াশেনার পর্ব। শেষের দিকে অবশ্য ফ্বালাক এর জন্য একটু টাফ হয়ে গিয়েছিলো পড়াশোনায় কনসেন্ট্রেট করতে। এসাইনমেন্ট, গ্রুপ ওয়ার্ক, ফিল্ড ওয়ার্কে সময় দিতে হতো। তবে অনভিজ্ঞ আবীর সামলে নিতে পেরেছে, সাহায্য নিয়েছে বোন ফিওনার৷
দীর্ঘ দেড় বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে ডিগ্রি এবং নয় মাসের ফ্বালাক কে নিয়ে দেশে ফিরে ওরা৷ দেশে ফেরার পর আনন্দের যেন সীমা নেই সকলের ফ্বালাককে পেয়ে, যেমনি রাজকন্যা নূহা, তেমনি রাজপুত্র ফ্বালাক। নূহার পরে মায়ের সবটুকু রূপ শুষে নিয়ে নিয়েছে যেন সে। ওকে দেখলে কখনো মনে হয় ও আবীরের মতো দেখতে, তো কখনো মীরার মতো। কিন্তু নূহা বলে ফ্বালাক নাকি ওর মতো হয়েছে দেখতে। সকলে তাই মানে। স্কুল শেষে ও ভাইয়ের যত্ন করে৷ ওর কাপড় ভাজ করে, খাবার খেতে সাহায্য করে, ঘুম পাড়ায়। ফ্বালাক যেন জীবন্ত পুতুল ওর কাছে। দ্বিতীয় সন্তান এলে প্রথম জনকে একটু কম মনোযোগ, একটু কম এটেনশন দেওয়ার দরুন তাদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি হয়। ব্যাপারটা নূহার বেলায়ও হয়েছিলো। কিন্তু মীরা সুন্দর করে এটাকপ হ্যান্ডেল করেছে। বলেছে ওকে যত আদরই দেয়া হোক না কেন, সবসময় মনে রাখবে তুমি ওর সাত বছরের বড়, আর সাত বছর তুমি বেশী আদর পেয়েছো। তাছাড়া তুমি ওর বড় বোন, ওকে দেখে রাখা, ওকে আদর করা তোমারও দায়িত্ব। বোঝানোর ব্যাপারটায় কাজ হয়েছে ম্যাজিকের মতো। তবে সময় লেগেছে ভাইবোনের মধ্যে ভালোবাসা ব্যালেন্সে। আবীর ওর স্বত্ত্বার অংশ ফ্বালাককে ভালোবাসলেও নূহা এখনো ওর ফার্স্ট প্রায়োরিটি। ফ্বালাকের জন্মের পর মীরা একটু ভীত ছিলো আবীরের ভালোবাসায় মত্ত নূহার প্রতি টান বুঝি কমলো আবীরের। কিন্তু মীরার এই চিন্তাকে অমূলক প্রমাণ করেছে আবীর।
দেশে ফিরে ওদের অনুপস্থিতিতে ঝিমিয়ে পরা “মীরা ফ্যাশন”-কে চাঙ্গা করার কাজে লেগে পরে দুজনে। পড়াশোনায় নতুন করে অর্জিত জ্ঞানের সবটুকুকে কাজে লাগিয়েছে মীরা ওর ব্যাবসায়। সংসারে মাজেদা খালা তো আছেই, তার সাথে মীরার মা জাহানারা সারাদিন সময় দেয় মীরার ছেলেকে। যদিও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ট্র্যাকে ফেরে সব কাজ, ফলে কাজের পাশাপাশি সংসারটা, সন্তানকে ব্যালেন্স করে নেয় মীরা। এমনি করে কাটছে ওদের জীবণ।
অনেক বছর পর একদিন নূহার সংস্কৃতিক স্কুলে প্রদর্শনীর সমাপনী অনুষ্ঠানে মীরা আবীর দুজনেই উপস্থিত। নূহার আঁকা ছবি সেরা নির্বাচিত হয়ে প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে মেডেল আর সার্টিফিকেট দেয়া হয় বিজয়ীদের। নূহার একটা দলীয় নাচও ছিলো। কী সুন্দর সেজেছে নূহা। চোখে টানা কাজল পরা, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, ওর দীর্ঘ চুলগুলো খোঁপা করা, গাজরা ফুল গোঁজা তাতে। হালকা আসমানী রঙের শাড়ি পরেছে ও, গা ভর্তি ব্রোঞ্জ রঙের গহনা, কানে দুল মাথায় টিকলি। শাড়ির আঁচল মাথায় তোলা, যেন গায়ের বধূ সে। আলতা রাঙা হাত ভর্তি চুড়িতে। নূহা তে এমনিতেই সুন্দরী, এই সাজে আজ ওকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। সত্যি যেন কল্পনা রাজ্য থেকে উঠে আসা পরি সে।
মেয়ের এমন অর্জনে খুশি ওরা দুজনেই। শত ব্যাস্ততায়ও ওরা দুজনে চেষ্টা করে সন্তানদেরকে কোয়ালিটি টাইম দিতে। মানুষের যত কাজকর্ম, রোজগার, সঞ্চয় সবই তো পরিবারের জন্যই। তাই ওরা জীবণের জন্য কাজকে সাজিয়েছে, কাজের জন্য জীবণকে নয়। যদিও এসব কথা সবার জন্য প্রযোজ্য না, এখনো অনেককে হাড়ভাংগা খাটুনি খাটতে হয়, তারপরও পরিবারের তিনবেলার খাবারের সংস্থান করতে পারে না। কিন্তু মীরার পরিশ্রম ওকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে যে ও না গিয়েও কাজের সবটা ঠিকঠাক চালাবার ব্যাবস্থা আছে। কাজের এমন পরিস্থিতি তৈরীতে সময় লেগেছে দেড় যুগেরও বেশী। তবে মীরা কৃতজ্ঞ খোদার প্রতি। তাইতে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বেশ কিছু কাজ হাতে নিয়েছে ও। যদিও সেসব কাজ প্রাইমারী স্টেপে রয়েছে এখনো। তাই এগুলো আড়ালেই থাকুক।
তো সে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে একটু গিয়েই গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় ওদের। ওরা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপর। গাড়ির যা সমস্যা তাতে গ্যারেজে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মাথার উপর কড়া রোদ, একটুও ছায়া নেই কোথাও। উপায় না দেখে আবীর দ্রুত উবার কল করে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি এসে হাজির হয় ওদের সামনে। ফ্বালাক কাঁদছে গরমে, গাড়ি আসতেই শশব্যাস্তে গাড়িতে উঠে পরে মীরা। একপাশে আবীর বসা, মাঝখানে নূহা, মীরার কোলে ফ্বালাক, ওকে শান্ত করতেই ব্যাস্ত মীরা।
বেশ কিছু সময় পর গাড়ি সচিবালয়ের সামনে জ্যামে পরে। মীরা খেয়াল করে ড্রাইভার গাড়ির ভিতরকার লুকিং গ্লাসে বারবার পিছনে দেখছে। মীরার কেমন অস্বস্তি হলো৷ ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে আলাপ শুরু হলো ওর পুরস্কার নিয়ে। নূহা খুব খুশি প্রধান অতিথি ওকে অনেক আদর করেছে, ওর সাথে ছবি তুলেছে। জ্যাম ছাড়লে গাড়ি চলতে শুরু করে আবার। তবুও বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখছে লোকটা। না মীরাকে না নূহাকে দেখছে সে। মীরা ভাবলো এমন সাজগোছ করে আছে বলে দেখছে বোধহয়। কারন তার দৃষ্টিতে
নোংরা কিছু নেই। দয়াগন্জ সিগনালে আবার জ্যাম। পুরান ঢাকায় থাকার এই এক জ্বালা। যদিও জ্যামের রাজত্ব সব রাস্তাতেই, এখানটায় যেন একটু বেশী।
অবশেষে ধুপখোলা মাঠের সামনে গাড়ি থেকে নামলো। আবীর মানিব্যাগ থেকে টাকা দিতে গেলে ফ্বালাক ওকে টেনে নিয়ে যায় কনফেকশনারিতে
আইসক্রিম খাবে বলে। মীরা তখন ওকে বলে-
: “আচ্ছা তুমি যাও, আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি”
আবীর চলে গেলে মীরা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে। ড্রাইভার নূহার মাথায় হাত রেখে বলে-
: “কেমন আছো নূহা?”
কথাটা শুনে টাকা খোঁজা রেখে চকিতে তাকায় কন্ঠের উৎসে, নূহাও কিছুটা বিমূঢ় লোকটার কথা শুনে। মীরার মস্তিষ্ক তখন কন্ঠ আর চেহারায় মিল খুঁজছে কিছু একটার। একটা বার কেবল চোখে চোখ রাখে মীরা, না মীরা না দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে-ই। সে মীরাকে রেখে নূহাতে মনোযোগী। এবার প্রশ্ন-
: “কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
যেন অনেক জানার আছে তার নূহার ব্যাপারে। মীরা দ্রুত পাঁচশো টাকার নোটটা দিয়ে নূহার হাত ধরে হনহন করে চলে যায় বাড়ির দিকে। আবীরের তখনো আইসক্রিম কেনা পর্ব শেষ হয় নি। মীরাকে এমনি চলে যেতে কিছুটা চিন্তিত দেখায় ওকে। দ্রুত টাকা পরিশোধ করে মীরার পিছু যায় সেও।
বাড়িতে ঢুকে নূহা জিজ্ঞেস করে –
: “লোকটা কে মা?”
একটু ভেবে মীরা বলে-
: “আমি তাকে চিনি না মা”
: “আমাকে চিনলো কিভাবে সে?”
রেগে মীরা বলে-
: “আমি কি জানি তার?”
আবীর ঘরে এসে ঘটলো না আর মীরাকে। ও জানে এখন ওকে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। মাথা ঠান্ডা হলে ও নিজ থেকেই বলবে ব্যাপারটা কি।
রাতে খাওয়া শেষে বাসন গুলো সিংকে রাখছিলো মীরা। ভাত, তরকারির বোল হাতে আবীর যায় মীরার পিছু পিছু। মাজেদা খালা গ্রামে গেছেন, তাই এগুলো নিজেই সরিয়ে রাখছে মীরা।
আবীর মীরার মনের অবস্থা মেপে জিজ্ঞেস করলো –
: “বিকেলের ঘটনাটা কি?, নূহা বললো লোকটা নাকি চিনে ওকে? কে ছিলো সে? রাজীব কি?”
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
বাড়ি ফিরে নুহা কোন মতে আবীরকে জুতা খুলবার সুযোগ দিয়ে ওর হাত ধরে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখাতে নিয়ে যায়। যেন এ বাড়ির ট্যুর গাইড সে। কথা যেন ফুরায়ই না ওর, ওদের ঘর, লাগোয়া বারান্দা, বারান্দার সকল গাছ অপরাজিতার কোন গাছটায় নীল ফুল ফোটে কোনটায় সাদা, কোন গাছটার বয়স ওর চেয়েও বেশী তা বলে এক-এক করে। গাছ পর্ব শেষ হলে বারান্দা থেকে হাত ধরে টেনে আনে লিভিং রুমে। এরপর একুরিয়ামের মাছগুলো কোনটার কি নাম তা বলে এক এক করে। ছোট্ট নুহা একে একে পরিচয় করিয়ে দেয় লিও, স্যাম, পাপি, ম্যাড এর সাথে। কোন লিও, বা কোনটা পাপি এক রকম দেখতে সব গোল্ড ফিস গুলোর মধ্যে সব কেমন গুলিয়ে ফেলে আবীর। মীরা এক-আধবার ধমক দিয়েছে, বলেছে-
: “আহ্ নূহা কতদূর জার্নি করে এসেছেন তিনি, কেন একটু রেস্ট করতে দিচ্ছো না উনাকে?
আবীর কেমন চোখে ইশারা করে মীরাকে, যার অর্থ- ‘কেন বাঁধা দিচ্ছো?”
মীরা নাশতা খেতে ডাকলে আবীর ওকে কোলে করে নিয়ে বলে-
: “মা তোমার ক্ষুধা লাগেনি? আমার কিন্তু লেগেছে, চলো খেয়ে আসি, তারপর না হায় বাকী গল্প করবো কেমন?
নূহা হাত ধরে আবীরকে খাবার টেবিলের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে । তারপর দৌড়ে ওর ঘরে গিয়ে ওর ড্রাইং খাতা দেখাতে নিয়ে আসে। আবীর ওকে ওর পাশের চেয়ারটাতে বসিয়ে দিলে নূহা এক এক করে ছবির গল্প বলে ওকে। আবীরের নূহার সাথে আই কনটাক্ট করতে সমস্যা হওয়ায় নূহাকে তুলে বসায় খবার টেবিলে তারপর খাবার খায় আর নূহার আঁকা ছবির গল্প শোনে। নূহার কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে এটা সেটা প্রশ্ন করে আবীর। যাতে ওর মনোযোগের অখন্ডতা স্পষ্ট প্রকাশ পায়৷
অপরপ্রান্তের চেয়ারে বসে মীরা ভাবে নূহাটার বকবকে
আবীর না আবার ধৈর্য হারায়। জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম বাবাকে পেয়ে মেয়েটা আনন্দে আত্মহারা। বাবাকে কাছে পাওয়ার উত্তেজনায় বেচারী কোনটা রেখে কোনটা বলবে দিশা পাচ্ছে না যেন। এই ছবির গল্প করছে আবার ওর কোন বন্ধু ওর রঙ পেন্সিল ভেঙে ফেলেছে তার নালিশ ও করছে। আবার হয়তো ওর পছন্দের ফুল পাখি আর রঙের গল্প বলছে। মীরার ভয় হয় আবীরের না বিরক্তি ধরে যায় নূহার এমন আচরণে। মীরা ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে তাই নূহাকে ডেকে বলে –
: “খাওয়ার সময় এত কথা বলে না মা”
মায়ের কথা শুনে চুপচাপ থাকে নূহা।
খাওয়া দাওয়ার পর ঘন্টাখানেক রেস্ট নিয়ে ওরা মীরার মায়ের বাড়ি যায়। সেখানে ইরা ওর বরও যোগ দেয় ওদের সাথে। দুপুরের ভরপুর খাওয়াদাওয়া হয় সকলে। বিকেলে চা আড্ডা জমে। তবে সন্ধ্যায় ওদের সবাইকে ঐ বাড়িতে রেখে মীরা আর আবীর যায় মুখলেস চাচার সাথে দেখা করতে।
সেখানে যাওয়ার পর ওদেরকে একসাথে দেখে কান্নায় ভেঙে পরে মুখলেস চাচা। এ কান্না মীরাকে সুখি দেখে যেতে পারার আনন্দ উৎযাপনের। মন ভরে আবীর মীরাকে দোয়া করেন তিনি। রেবেকা আন্টি অসুস্থ থাকায় মীরা উঠে রান্নাঘরে চা বানাতে গেলে মুখলেস চাচা আবীরকে বলে –
: “বাবা মাইয়্যাটা বড়ই দুঃখী। দছ বছর ধইরা ওরে চিনি আমি, কোন দিন একটু ভালো থাকবার দেখি নাই। কোন না কোন ঝুট ঝমেলা লাইগাই ছিলো ওর আশপাশ। জীবণটা অনেক দুঃখ কষ্টের ভিতর দিয়ে পার করছে, সব দুঃখ, কষ্ট একা হাতে সামাল দিছে, খোদা তোমারে ওর ঢাল বানায়া পাঠাইছেন। আমি জানি তুমি অনেক ভালো পোলা। মাইয়্যা হিছাবে মীরাও সোনার টুকরা। আমি মন থাইক্যা দুআ করি আল্লাহ তোমাগো সুকি করুক। মাথা নত করে মুখলেস সাহেবর সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আবীর। ওদের প্রতি তার দোআ শুনে আবীর অস্ফুটে বলে –
” আমীন”
সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে রাত হয় ওদের। রেবেকা আন্টি অবশ্য খেয়ে যেতে জোড় করে অনেক। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় তাদেরকে এ ঝামেলায় ফেলতে চায় না মীরা। মীরা বলেছে- “আগে সুস্থ হন আপনি, একদিন সকাল সকাল এসে সারাদিন বেড়াবো আপনাদের এখানে।
মুখলেস চাচা ওদের বিয়েতে না যেতে পারলেও আবীরকে প্রথম দেখে উপহার হিসেবে দামী একটা ঘড়ি উপহার দেয় ওরা যাবার আগে। এটা তিনি আগে থেকেই আনিয়েছিলেন মুস্তাকিমকে দিয়ে। আবীর সানন্দে সেই উপহার গ্রহণ করেন।
সেখন থেকে ফিরতে সাড়ে আটটার মতো বাজে। সবার জন্য কিছু খাবার কিনে আবীর যেতো পথে। নাশতা টাইপ। গিয়ে দেখে আবার রান্নার ধুম পরেছে বাড়িতে৷ মীরার খালা পারভীন, তার বরও এসেছে আবীরকে দেখতে। আবীরকে দেখে কান্নায় ভেঙে পরেন মীরার ছোট খালা পারভীন৷ তিনি অসুস্থ থাকায় যেতে পারেন নি ওদের বিয়েতে। আবীর তাকে শান্ত করায়। তিনি আবীরের হাত ধরে বলে-
: “এক তোমার সাথে অন্যায় হওয়ার দরুন এত বছরেও আমি আমার ভাগনীর সাথে কথা বলি নি, ওর মুখ পর্যন্ত দেখি নি। সব ভুলে তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও বাবা”
তার কথা শুনে মনে হয় যেন তার বলবার অপেক্ষায় মীরাকে এখনো ক্ষমা করেনি আবীর “মনে মনে হাসে আবীর তার কথা, আর বাচন ভঙ্গী দেখে। মীরার খালাতো বোন রূহি বলে, আহা মা…
মীরার খালু আবীরকে পাশে ডেকে বলে-
: ” কিছু মনে করো না বাবা, অসুস্থ হওয়ার পর থেকে পারভীন এমন বোকা বোকা কথা বলে যে একেবারে অস্বস্থিতে পরে যাই, ওকে নিয়ে তাই বের হই না কোথাও তেমন একটা। সবাই তো আর ওর অসুখটা বুঝবে না, কে কখন কি মনে করে ফেলে, তাই ওকে নিয়ে যাই নি তোমাদের বিয়েতে।
দূর থেকে আবীর লক্ষ্য করে পারভীন আন্টির পাশে পাশেই থাকছেন তিনি, পানি খেতে হাত বাড়ালে পানি এগিয়ে দিচ্ছেন, নিজে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ওয়াশরুমে। হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন এ ঘর থেকে ও ঘরে। সত্যিকারের ভলোবাসা হয়তো এমনি হয়। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যার টান থাকে একে অপরের প্রতি । সেদিন অনেক রাত হয়ে যায় খাবার খেতে খেতে। জাহানারা তাদের বাড়িতে ওদের থাকতে বললেও রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের বাসায় ফিরে আসে মীরা৷ আগামীকাল চট্টগ্রাম থেকে ওর শ্বশুর বাড়ির সকলে আসবে এ বাড়িতে। সে কাজকর্ম ও কিছুটা এগিয়ে রাখা লাগবে।
মেহমানদের আয়োজনের জন্য রান্নাবান্নার বাজার সব সন্ধ্যায় করে দিয়ে গেছে ফাহাদ। মাজেদা খালা কি মশলাপাতি আনা বাদ গিয়েছে তা আনতে গেছে দোকানে। নিজেই তালা খুলে বাড়িতে ঢুকলো মীরা।
বাজার-সদাই সব গুছগাছ করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবার আয়োজন করছে মীরা। নূহা এখনো ওর বাবার সাথে আঠার মতো লেগে আছে। খাট জুড়িয়ে ফেলেছে সে গল্পের নানান বইয়ে৷ এতদিন ওর মা গল্প পড়ে শুনাতে৷ আজ হতে বাবার কাছ থেকে শুনবে বলে এসব হাজির করেছে ও। মীরা কাপড় বদলে ধমক লাগায় ওকে। বলে-
: “আজ অনেক ক্লান্ত আমরা, বাবা কাল শোনাবে গল্প, এখন ঘুমাও মা”
বাবার পাশে শোয়া নূহা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
: “আমি ঘুমাবো কেন?”
নূহার কথা শুনে হেসে দেয় আবীর। মীরাকে কপট ধমকের গলায় বলে-
: “ঠিকই তো বলেছে নূহা, ও “ঘুমাবো কেন?”
মেয়ের পক্ষ নেয়ায় আবীরের দিকে কুশন ছুড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে মীরা। উল্টো হয়ে শুয়ে থাকলেও মীরার কানটা ওদের দুজনের মাঝখানেই পরে ছিলো।
আবীর রূপকথার গল্প পড়ে শোনাচ্ছে নূহাকে। তা যেমন তেমন ভাবে না কন্ঠকে কখনো উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছে তো প্রয়োজনে খাদে নামাচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে, গল্প বলার ধরন দেখে পাশ থেকেই গল্প শুনে মীরা। বেশ কিছু সময় গল্প বলার পর আবীর নূহাকে বলে-
: “মা আমি অনেক ক্লান্ত আজ, তুমি কি আমার মাথাটায় হাত বুলিয়ে দিবে?”
শোয়া থেকে উঠে নূহা ড্রেসিং টেবিলের থেকে মাথা ঠান্ডার তেল এনে আবীরের মাথায় দিতে চায়, আবীর বলে আজ সকালে শ্যাম্পু করছি মা, আজ তেল দিবো না, তেল দিলে আমাকে পঁচা দেখায়৷
নূহা বলে-
: “বাবা এ তোল দিলে মাথা ব্যাথা, কেলান্তি সব চলে যাবে দেখো… চিন্তা নাই কাল আমি চুল ধুয়ে দিবো তোমার”
বলেই তেলের বোতলের ছিপি খুলে একগাদা তেল দিয়ে দেয় আবীরের মাথায়। তারপর তেল আর চুল নিয়ে দু’হাতে বেশ কিছুক্ষণ কর্মযজ্ঞ চালায় নূহা। চুলে বিলি কাটা ছোট ছোট আঙুলের স্পর্শে আরামে চোখ বুজে আসে আবীরের। নিচ থেকে চোখ তুলে নূহার দিকে চেয়ে মনে মনে বলে-
: ” এত সুখ অপেক্ষায় ছিলো আমার? একি স্বপ্ন না সত্যি? ”
নূহার দিকে তাকাতেই ভুলবেন ভুলানো হাসি হাসে নূহা।
আবীর ওকে বলে-
: “মা একটা চিমটি কাটো তো”
মুচকি হেসে নূহা মাথা নামিয়ে এনে বাবার কপালে একটা চুমু খায়। নিজের অজান্তেই চোখ গড়িয়ে পানি পরে আবীরের। মেয়ের থেকে তা লুকাতে দ্রুত চোখ মুছে ফেলে ও। ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভেসে ওঠে কষ্টে থাকা সেইসব প্রতিটি দিনের কথা। কত কষ্ট কত যন্ত্রনার ভিতর দিয়ে গিয়েছে ও প্রতিটা মুহুর্তে। বাবা মা চলে যাবার পর একা কাটানো এক একটা দিন যেন দুঃখের পাহাড় ডিঙিয়ে পরের দিনের ভোর দেখার মতো। ওর
এই সুখ সেই সব কষ্টের দিনগুলোর দামে কেনা।
তবে যুগ ঘুরে ওদের দুজনের এই এক যে হওয়া, নূহার মতো মিষ্টি মেয়ের বাবা হওয়া এসব সত্যি মিরাকল। আবীর ভাবে খোদার প্রতি যতই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর হোক ততোটাই কম হবে। এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা জানা নেই ওর। আবীরের ভাবনার জাল কাটে নূহার কর্মযজ্ঞে৷ পাশে থাকা চিরুনি নিয়ে যত্ন করে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে সে ৷ মাথা নুইয়ে ঝুঁটি করে দিবে কি না তাও জানতে চায় বাবার কাছে। গলা ধরে আসা আবীর মাথা নেড়ে না করলে মুখ কালো করে অভিমান করে সে। তখন নূহাকে তুলে হেসে আবীর জিজ্ঞেস করে –
: ” চুল বাঁধতে দিলে খুশি?”
মুচকি হেসে নূহা মাথা হ্যা সূচক ঝাঁকায়। আবীর ইশারায় বলে ওকে দেন, বাঁধো চুল।
দৌড়ে খাট থেকে নেমে নূহা ওর রাবার ক্লিপের বক্স নিয়ে চুল বাঁধতে বসে আবীরের। মোট তিনটা ঝুটি করে ও আবীরের মাথায়। পাশ ফেরা মীরাকে নূহা ডাকে বাবার চুল বাঁধা দেখাবে বলে। পাশ ফিরে মীরা বাপবেটির এমন কান্ড দেখে প্রথমটা তব্দা খেয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় মীরা। নূহাও বাবার কোলে লুকিয়ে লাজুক হাসি হাসে ওর মায়ের এমন হাসি দেখে৷ আবীরও যোগ দেয় ওদের সাথে। পাশ থেকে ফোন নিয়ে ঝুঁটি সহ তিনজনের সেলফি তুলে আবীর। তাতে মীরা চোখ বন্ধ করে হাসছে, নূহা বাবার কোলে বসে হাসছে ভি সাইন দিয়ে, এটা নূহা নতুন শিখেছে। ইদানীং ছবি তুলতে ক্যামেরা ধরলেই হাত উঁচিয়ে ভি-সাইন দেয় ও। ছবিতে দুজনের সাথে হাসছে আবীরও।
ছবিটা সিলি আর কাওকে দেখানোর মতো না হলেও ওদের প্রথম পারিবারিক ছবিই হয় সেটি। পাশের ঘর থেকে ওদের হাসাহাসি শুনতে পান মাজেদা খালা৷ তিনি তখন জায়নামাজ এ বসে এশার নামাজের মোনাজাত করছিলেন। ওদের ঘর থেকে আসা হাসির কল্লোলে মোনাজাতের একাগ্রতা নষ্ট হয় তার। নামাজে ব্যাঘাত তার অপছন্দ। তবুও আজ মোনাজাতরত অবস্থায় মুচকি হাসেন তিনি। মন থেকে দোয়া করেন খোদার কাছে- “যে পরিবার তিনি ঝড় ঝাপটা সামলে গড়ে দিয়েছেন তা যেন সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা তিনিই করেন”
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
নুহার ঘুমাতে ঘুমাতে বেশ রাত হয় সেদিন। ঘড়িতে সময় তখন দেড়টা। আবীরের বাহুতে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটি। ওয়াশরুম থেকে ফিরে মীরা দেখে আবীরও অপরদিকে মুখ করে ঘুমানো। বেচারার অনেক ধকল গেলো আজ, হুট করে লোকটা কেমন ঝামেলায় পরে গেলো। আচ্ছা, এসবে ও ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হচ্ছে না তো?
কিছু সময় খাটে বসে এসব ভাবতে থাকে মীরা,এরপর অপরদিকে থাকা পানির বোতল আনতে উঠে দাঁড়ায় মীরা। আবীরের দিকে গিয়ে বোতল হাতে ওর পাশে বসেই গ্লাসে পানি ঢেলে পানি পান করে ও। পানি পানরত অবস্থায়ই মীরার চোখ যায় আবীরের দিকে, ওকে বসতে দেখে পাশ ফিরে চোখ মুছছে আবীর। তৎক্ষণাৎ গ্লাস রেখে হাত ধরে ওর দিকে ঘুরায় আবীরকে। তখনো চোখ মুছছে আবীর। আবীরের আরো কাছে গিয়ে মীরা জিজ্ঞেস করে –
: “কি হয়েছে আবীর? আপনি কি কাঁদছেন?”
মুখে ‘না’ বললেও ওর স্বর যেনো বলছে সত্যটা। না উত্তর দিলেও তখনই মীরাকে জড়িয়ে ধরে রাখে আবীর। মীরার চুপ থেকে আবীরের ভেতরকার ঝড় বোঝার চেষ্টা করে।
নিচু হয়ে মীরা আরো দৃঢ় করে সে আলিঙ্গন। কিছুটা সময় এমনিই পরে থাকে ওরা। আবীরের একপাশের বাহুতে নূহা, অন্যহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে সে মীরাকে। আবীরের বুকে ভর দিয়ে মাথা উচু করে মীরা। কিছুটা সময় চুপ থেকে মন পড়ার চেষ্টা করে আবীরের, তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে-
: ” কি হয়েছে আবীর? ” উত্তর দেয়ায় ব্যাস্ততায় না গিয়ে আবীর সাবধানে নূহার মাথা নামায় ওর বাম বাহু থেকে। মীরাও সরে বসে, তারপর আধশোয়ার মতো বসে আবীর। পাশ থেকে পানি এগিয়ে দেয় মীরা ওকে। সেটা শেষ করে একটু যেন ধাতস্থ হয় আবীর তারপর বলে-
: “নূহা বোধহয় বাবা হিসেবে মেনে নিয়েছে আমাকে, সেই খুশিতে…” বলেই চোখ সরিয়ে নেয় ও। আবীরের পাশে এসে ওর কাঁধে মাথা রেখে বসে মীরা, তারপর বলে-
: “আমি ভাবলাম কি না কি?”
কিছু সময় মৌন থেকে আবীর বললো-
: “জানো জীবণের ঠিক এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে জীবন সত্যি সুন্দর”
মুচকি হেসে মীরা বলে-
: “এদিকে আমি কেবলি ভাবছিলাম – সবকিছু আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছি না-তো?”
: “না মীরা, সত্যি নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছে নূহাকে পেয়ে”
বাহু লগ্ন হয়েই মাথা উঁচু করে আবীরের দিকে চোখ রেখে মীরা বলে-
: “আর আমাকে?”
মুচকি হেসে মীরাকে জড়িয়ে রাখে আবীর। মীরার এমন প্রশ্নের উত্তর ভাষায় বর্ণনার ধার ধারলো না ও। মুচকি হাসি আর আলিঙ্গনেই যেন মিটিয়ে দিলো সে প্রশ্নের উত্তর।
মুখচোরা আবীর মীরাকে ওর সেইসব কষ্টের গল্প বলায় ব্যাস্ত। ও ওর জমে থাকা কথা বলায় যেন শান্তি পাচ্ছে। নূহার মতোই হয়তো দিশেহারা অবস্থা ওর, কোনটা রেখে কোনটা বলবে। মীরা মনোযোগ দিয়ে শুনছে কেবল। চুপ থাকাটা শ্রেয় মনে করছে ও, কারন কি বলতে গিয়ে কোনটা বলে ফেলে কষ্ট দেয় বেচারাকে, তাই একনিষ্ঠ মনোযোগী শ্রোতা হয়েছে ও আবীরের।
আবীর একে একে বলে মীরার প্রতি ওর ভালোবাসা, অন্যত্র বিয়ে করাতে সবার পিড়াপিড়ি, বিয়ে না করতে পারার কারনের সেই সব গল্প। না, তার মানে এই না যে ও মীরার এমনি ফিরবার অপেক্ষায় থেকেছে, দোয়া করেছে মীরার এমন দূর্ভাগ্যের জন্য। ও কেবল চেয়েছে “মীরা ভালো থাকুক, ভালো থাকুক ওর ভালোবাসা”
সবটা শুনে মীরা ক্ষমা চাইতে একটু কার্পণ্য করে না, ঠিক কতবার ক্ষমা চাইলে ওর ক্ষমা ঠিকঠাক হবে তা জানে না মীরা৷ আর আবীরও কার্পন্য করে না মীরাকে ভালোবাসতে।
তবে আবীরের এই হঠাৎ পাওয়া সুখের দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তকে রঙিন করতে মীরার সত্যি যেন ক্লান্তি নেই। নিজের সুখে আত্নস্থ হওয়া আবীরকে মীরা যেন নতুন সুখের দিগন্ত দেখাতে চায় ।
চোখে চোখ রেখে দুজনে পলকহীন চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। যেন “এত দেখি তবুও মন ভরে না ” দু জোড়া চোখ কথা বলে নিজেদের ভাষায়। হুট করেই আবীরের দিকে মুখ এগিয়ে নেয় মীরা। অন্যবারের মতো নিজেকে গুটায়নি আবীর, চেয়ে ছিলো মীরারই চোখের দিকে। কি ঘটে তার সাক্ষী হতে হয়তো। আবীরকে জড়িয়ে ধরে ওর কানের নিচে চুমু খায় মীরা। বাতিটা নিভিয়ে দেয় আবীর। যেন আলোরা না দেখে ওদের। আলো নিভে থাকা ঘরে বারান্দার বাইরে ল্যাম্পপোস্টোর ক্ষীণ রশ্মির বদৌলতে ভেসে উঠে এক জোড়া মানব-মানবীর মোশন পিকচার, যাতে দেখা যাচ্ছে – চুলের মুঠি ধরে নিজের ঘাড়ে আটকে থাকা মেয়েটিকে ছাড়িয়ে তার ঠোঁটে ডুব দিলো ছেলেটা, মেয়েটির হাত দু’টো সাঁতার না জানার মতো হাবুডুবু খেয়ে আঁকড়ে ধরে আছে ছেলেটির চওড়া পিঠে। যেনে নিচে পরে যাওয়া ঠেকাতে এই আপ্রাণ চেষ্টা তার।
এতোদিনকার অপেক্ষার শোধ মিটিয়ে দিতে মীরা বন্য, কিন্তু ভালেবাসার আদায়ে কোন তাড়া নেই আবীরের। ও মীরার মতো বন্য ভালোবাসায় পারদর্শী না৷ তবে ও নিজের মতো করে ভালোবাসে ও মীরাকে, খুব সাবধানে, অনেক যত্ন করে।
মীরা এমনিভাবে ভালোবাসায় অভ্যস্ত, ভালোবাসা কি? তা জানার শুরু থেকে এমনি দেখে আসছে ও। আক্রমনাত্মকতা আর বন্যতা। কিন্তু আবীর যেন ভালোবাসার এক শিল্পী, ওর কাছে টানা, জড়িয়ে ধরা, আলিঙ্গন কিংবা চুমু খাওয়া সবকিছুতে শান্ত একটা ভাব। কোন তাড়া নেই ওর, চোখে তাকাবে, মুখের কাছে আসা চুল সরাবে, গালে আদর করবে, মন পড়ার চেষ্টা করে যেন সে তখন মীরার। সাবধানে কাছে টেনে নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে ডুব দিবে মীরার ঠোঁটে।
এমনি করে রাত থেকে দিন হয় সেই দিন মিলায় গিয়ে রাত। আবীরের রঙহীন জীবণ মীরার ভালোবাসা আর যত্নে ওর নামের স্বার্থকতা পায়। নূহা আর মীরাকে পেয়ে কানায় কানায় ভরে ওঠে ওদের জীবণ। মীরার মনে থাকা ভয়কে অমূলক প্রমাণ করে আবীর ওদের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে।
নিজেদের কেনা এপার্টমেন্ট বিক্রি করতে চায় মীরা পরের মাসেই, এলাকা বদলে ফেলবে ও, ঐখানে সবকিছুর সুবিধা থাকা সত্ত্বেও। কেন? এর উত্তরে মীরা সবটা খুলে বলে আবীরকে। আবীর ওদের পুরান ঢাকার বাড়িতে উঠতে বললেও মীরার মন মানে না। কারন যে ভয়ে এখান থেকে শেকড় তুললো ও, সে ভয়টা তাহলে থেকেই যাবে। আবীর ওকে ভরসা দেয়া সবটা সামলে নেবার, নিজেদের এত সুন্দর বাড়ি থাকতে ভাড়া বাসায় ওঠা কেন?
মীরার মনে খুঁতখুঁত থাকলেও আবীরকে না করতে পারে না ও। অবশেষে পুরান ঢাকার নিজের বাড়িতে সব আসবাবপত্র নিয়ে উঠে মীরা। ওদের সে বাড়িতে উঠার পর বাইরে থেকে মনে হয় যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে এ বাড়ির। ল্যাম্প পোস্টের নিয়ন আলো যতটুকু আলো দিতো বাড়িটাকে ততোটুকুই আলো থাকতো সে বাড়িটায়। জনমানুষহীন সে বাড়িটায় আলো না যেন প্রাণ ছিলো না এতদিন।
আবীর নিজের পরিচয়ে জন্ম নিবন্ধন তৈরী করে নূহাকে স্কুলে দেয়, মীরার কাজ সব নতুন ঢাকার দিকে।
আবীরের বাড়ি ব্যাবসা সব পুরাণ ঢাকার দিকে হওয়ায়
নতুন ব্যাবসার কাজে ব্যাস্ত থাকলেও আবীর নিজের কাজের পাশাপাশি মেয়ের দায়িত্ব পালন করে নিষ্ঠার সাথে। নিজের কাজের রুটিনের মধ্যে নূহাকে দেখভাল করার এ কাজটা ও আবীর এড করে নিয়েছে।
ওকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া, স্কুল থেকে বাড়িতে আনা,
একদিন এক মজার ঘটনা ঘটে, সারা সন্ধ্যা নূহা কান্না করতে থাকে, আবীর বাসায় ফিরেও দেখে কাঁদছে নূহা। কেন তা জিজ্ঞেস করলে মীরা বলে- ওর আঁকা ওদের পারিবারিক ছবিটার ফ্রেম ভেঙেছে বলে ও কাঁদছে। মীরা আবীরের দিকে চোখ টিপে ফিসফিস করে বলে-
: “বোঝান আপনার মেয়েকে, বলেন যে কেঁদো না ভাই এনে দিবোখন” বলেই হেসে রান্নাঘরের দিকে যায় মীরা। আবীর কিভাবে কি বলে ঠান্ডা করেছে নূহাকে ও-ই জানে ভালো। দুর থেকে দুজনের দুষ্টামি দেখে মীরা। দুজনের মধ্যে কে বেশী বাচ্চা তার হিসাব চলে ওর মনে মনে।
রাতের বেলা ব্যাপারটা নিয়ে আবীরের সাথে কথা বলে মীরা। ও এ ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস। আবীর হেসে না বোঝার ভান করে বলে-
: “কি বলছো ক্লিয়ার করে বলতো.. ”
: “বোঝেন না আপনি হুহ্ ন্যাকা”
আবীর ওর গাল টেনে বলে-
: ” কি বুঝবো আমি আমি তো বাচ্চা মানুষ, তুমিই তো বলো”
: “নূহার ভাই লাগবে একটা”
: “যদি আরেকটা নূহা আসে”
: “যাই হোক আমি দেখে নিবো”
: “সোজা করে কেন বলছো না? ”
: “আর সোজা করে বলতে পারি না আমি”
: “এত তাড়া কিসের, কত ব্যাস্ত থাকো তুমি, এত বড় দায়িত্ব পালন করছো, এসব কমুক একটু তারপর নাহয়”
: “নাহ আর অপেক্ষা না”
: “সহজ করে কেন বলছো না মানুষের মুখে ঝামা ঘঁষে
দিতে চাও তুমি, যারা যারা পিঠ পিছনে আমার অক্ষমতার প্রশ্ন তোলে তাদের উত্তর দিতে চাও”
: “আরেহ এমন কিছু না”
: “এটাই সত্যি মীরা, কেন মিছে লুকানোর চেষ্টা করছো? আমার সসসক্ষমতা অক্ষমতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তুমি। এক যুগ আগেই তা জানো তুমি, আমাদের মধ্যে কিছুই ছিলো না, আর এক যুগ পরও উত্তর পেয়েছো তুমি। মানুষের চোরখে আমি সক্ষম নাকি অক্ষম ইটস ডাসেন্ট ম্যাটার, অনেক বড় দায়িত্ব পালন করছো তুমি, তোমার একটু সময় দরকার নিজেকে প্রমাণ করার। আর তো মোটে কয়েকটা দিন। তারপর সব বাদ দিয়ে না হয় ব্যাবসাটাই দেখবো দুজনে”
মীরার চোখে পানি চলে আসে, সত্যি এত এত চাপের মধ্যে ও মানুষের মুখে কুলুপ এঁটে দিতেই এমনটা ভেবেছে ও। আবীর কিভাবে ওর সবটা বুঝে যায়?
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৭
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
পরদিন সকালে আগে ঘুম ভাঙে আবীরের। সকালের ঝলমলে আলো অনুপ্রবেশকারীদের মতো ঢুকে গেছে ওদের ঘরটাতে। গত রাতে পর্দা টেনে দেবার কথা মনে ছিলো না ওর। সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে পর্দা টেনে দেয় আবীর। পিছন ফিরে দেখে বিছানার এক প্রান্তে কম্ফোর্টার মুড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে মীরা। ভাবতেই ভালো লাগছে পা থেকে মাথা অব্দি কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মীরা গতকাল থেকে ওর নামে লেখা হয়ে গেছে। এই প্রাপ্তি, হঠাৎ পাওয়া সুখ কোন স্বপ্ন নয় সত্যি।
আস্তে করে দরজা খুলে বারান্দায় যায় আবীর, পাছে ঘুম না ভাঙে মীরার, গত রাতটা দুজনের কেটে গেছে বোবা গল্প আর চাপা অনুভূতির আদান প্রদানে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ও সেখানটায়। ভাবতে থাকে ঘোর লাগা সময়, বেপরোয়া ভালোবাসা আর ছোট্ট মেয়ে নুহার কথা। আবীর মীরাকে পেয়ে যতটা সুখী, নুহাকে পাওয়াটা ততোটাই সৌভাগ্যের মনে করছে ও। কারন ও মনে করে খোদা ওর হেলায় ফেলে আসা সময়ের ক্ষতির কিছুটা হলেও পূরণ করে দিয়েছেন এই মেয়ের বাবা হওয়ার মধ্যে দিয়ে। নতুন এ সম্পর্কের বড় পাওনা এখনো বাকী। আর সেটা হচ্ছে নুহার সাথে প্রথম দেখা হওয়া। মীরাকে পাওয়াটা যেমন ভাবাচ্ছে তেমনি উচাটন ছোট্ট মেয়ে নুহাকে নিয়ে। মীরা না হয় মেনে নিলো আবীরকে মেয়ের বাবা হিসেবে, কিন্তু নূহা! আমরা ভাবি ছোটারা কিছু বুঝে না, কিন্তু বাচ্চা কাচ্চাদের সানিধ্য পছন্দ করা আবীর জানে ছোট্ট বাচ্চাদের অনুভূতি কতটা প্রখর। তাইতো ওর চিন্তা এই ব্যাপারটা নিয়ে৷
ভাবনার ছেদ ঘটে পিয়ালীর রুম থেকে ভেসে আসা গানের সুরে। এই মেয়েটার সকাল শুরু হয় গান দিয়ে। ওর পছন্দের গান সাজিয়ে তৈরী করা প্লেলিস্ট চলতে থাকে দশটা অব্ধি। গান শোনা নিয়ে কত বকা যে খেলো ও, তাও শুধরালো না। এসব ভাবতেই গানের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে আবীর- মিষ্টি কন্ঠের এক মেয়ে আনন্দের সাথে বলছে-
” দেখো আমার এ খুশিতে ঐ বাগানে ফুল ফুটে, সেই খুশিতে সূর্যটাও মুচকি হেসে উঠে” গানটা শুনে হেসে দেয় ও। চারপাশে চেয়ে দেখে বুনোফুলে ভরে গেছে এ দিকটা, আর অন্যদিকে গত তিন যাবৎ কুয়াশার দাপটে দেখা না দেয়া সূর্যটাও আজ খুব সকালেই কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি দিয়েছে আকাশে। এমন মিষ্টি কন্ঠের গান, অপরূপ প্রকৃতি আর আবীরের খুশি মিলেমিশে একাকার।
বেশ খানিকটা সময় পর আবীর রুমে এসে দেখে মীরা তখনো ঘুমিয়ে। ওকে ঘুমে রেখেই বাথরুমে যায় ও। মীরা উঠার আগে বাথরুমের কাজটা শেষ করতে। মিনিট পনেরো পর গোসল শেষ করে ও যখন রুমে এলো দেখলো মীরা উঠে ঝিম ধরে বসে আছে।
আবীর কোন রিস্ক না নিয়ে গোসল শেষে বাথরুম থেকেই একেবারে কাপড় পরে তৈরি হয়ে এসেছে। পাছে না বেইজ্জতি হতে হয়। বাথরুম থেকে বের হয়ে মীরাকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে মনে মনে ভাবে যাক বুদ্ধিমানের মতো একটা কাজ করেছি তাহলে।
তোয়ালেতে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আবীর খেয়াল করে মীরাকে। ওর গায়ের এলোমেলো বসন, খোলা চুল, ঘুমিয়ে চোখে মুখে ফুলে উঠা আদুরে ভাব এসব দেখায় অনভ্যস্ত আবীর যেন আবিষ্কার করলো ওর এই রূপ। ওর কাছাকাছি এসে মিষ্টি হেসে আবীর বললো-
: “শুভ সকাল”
উত্তরে মীরাও হাম তুলে বললো-
: “শুভ সকাল”
: “জলদি তৈরি হয়ে নাও, আমি নিচ থেকে কফি নিয়ে আসছি”
মীরা হু-হা কিছুই বলে না। বিছানা ছেড়ে নতুন কাপড় গোছাতে থাকে। মীরাকে ঘরে রেখে নিচে যায় আবীর।
মিনিট পনেরো পর দরজা নক করে ঘরে ঢুকে সে। ঢুকে দেখে এর মধ্যেই মীরা গোসল সেরে নতুন একটা শাড়ি পরেছে। সদ্যস্নাত মীরা, সারা শরীরের স্নিগ্ধ ভাব, চুল দিয়ে টিপটিপ করে পরা পানি এসব যেন পৃথিবীর অত্যাশ্চর্যের চেয়েও আশ্চর্য মনে হচ্ছে ওর কাছে। দুই কাপ কফির একটা ওর সামনে রেখে নিজের জন্য একটা নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের বিপরীতে থাকা শোকেসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় আবীর। সেখান থেকেই বিশাল আয়নায় দেখতে পাওয়া তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে থাকা মীরার দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলো সে। পুরোনো আমলের দীর্ঘ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় হঠাৎ তা লক্ষ্য করে মীরা। চোখা চোখি হতেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিয়েছে আবীর । তখনি ঘুরে তাকিয়েছে মীরা আবীরের দিকে। ফিরে দেখেছে আবীর হাতেনাতে ধরা পরে ঘুরে সাইড টেবিলে কি খুঁজবার বাহানা করছে।
মুচকি হাসে মীরা আবীরের এমন কান্ড দেখে। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে-
: “একটু এদিকে আসেন তো”
আবীর যেন শুনতেই পাচ্ছে না, মীরা তখন আবার বলে-
: “আমার চুলগুলো একটু মুছে দিবেন? ”
নতুন শাড়ি পরা মীরার দীর্ঘ চুলগুলো মুছতে সত্যি সমস্যা হচ্ছে।
এবার সে শুনতে পেলো যেন, মীরার কথাটা শুনে আবীর বললো – “পিয়ালীকে ডাকি? ও তোমার চুল মুছে দিক?”
কপট রেগে মীরা মনে মনে বলে- “পিয়ালী না…?”
তোয়ালে হাতে ওই যায় আবীরের কাছে, হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বলে-
: “এই সামান্য কাজে সকাল সকাল ওকে বিরক্ত করার কি আছে, নিন…
আবীরকে তেয়ালে দিয়ে কাছাকাছি খাটের এক কোনে
বসলো মীরা। আবীর সংকোচে চুল মুছে দিতে এগিয়ে এলো ঠিকই কিন্তু কাজটা করার চেয়ে বেশী মনোযোগ ছিলো ওর হাত যাতে মীরার শরীর না ছোঁয় সে ব্যাপারে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরো মনে মনে হাসে মীরা। ওকে সহজ করতে এই সেই গল্প করে। এক পর্যায়ে আবীরও সহজ হয় কথা বলায়। মীরাকে জিজ্ঞেস করে নুহার সম্পর্কে। ওর জন্মদিন, পছন্দ, অপছন্দ, প্রিয় ফুল, ফল, রঙ মোটমুটি সবকিছু।
এমন সময় পিয়ালী বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকে-
“ভাবী ভাবী….”
আবীর মীরার চুল ছেড়ে দরজার দিকে যায়। দরজা খুলে বলে –
: ” সকাল সকাল ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে ঘুমের বারোটা তো বাজিয়ে দিয়েছিস, এখন আবার আসছিস জ্বালাতে”
: ” দেখছো ভাবী, আমার ভাইতো এক রাতেই তোমার হয়ে গেলো, কি সব আবোলতাবোল বলছে”
মীরা কেমন তব্দা খেয়ে যায় ওর কথা শুনে। এ মেয়েরে কথা শিখাবার স্কুল কলেজে ভর্তি করা উচিত। কি আপত্তিকর কথাবার্তা। মীরা আবার মনে মনে ভাবে এটা মনে হয় আমার বেশী ভাবনার ফল। পরে আহনাফ পিয়ালীকে ডাকতে এলে পিয়ালী বলে-
: ” ভাবী মা তোমাদের দু’জনকে জলদি নিচে যেতে বলেছেন, মেঝো বৌ- মনির মা এসেছেন তোমাকে দেখতে, আমি চললাম”
ওরা চলে গেলে আবীরও বাইরে যায় মীরাকে জলদি তৈরি হতে বলে।
খুব দ্রুত তৈরী হয় মীরা। চওড়া পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পরে হালকা রঙের। হাতে চুড়ি গলায় হালকা হার, আর দুল। দ্রুত তৈরি হয়ে কফি শেষ করে মীরা কল করে আবীরকে, কোথায় যাবে ও তা না বুঝতে পেরে। কলটা কেটে দেয় আবীর। নিশ্চয়ই রুমের দিকে আসছে ও, তাই কল কেটে দিলো হয়তো, হলো ঠিক তাই।
আবীর দরজা নক করে রুমে ঢুকে দেখে পরিপাটি মীরাকে। না কোন উগ্র প্রসাধন কিংবা সাজের বহর নেই মীরাতে। নিপাট সরল মুখশ্রীর বাড়তি বলতে কেবল গাঢ় লিপস্টিক। হালকা রঙের শাড়ি, হালকা প্রসাধন চাকচিক্যের সবটুকু ঠোঁটের লিপস্টিকে। ফিওনা বলতো মেয়েরা চোখে মুখের ক্লান্তি, অনিদ্রায় তৈরী আন্ডার আই ডার্ক সার্কেল লুকায় গাঢ় লিপস্টিক পরে। মীরাও হয়তো সেই ট্রিকটাই ফলো করেছে। তবে চোখের নিচের অনিদ্রার ছাপ ওর আদুরে ভাব একটু ও ম্লান করতে পারেনি। বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে মাথায় ঘোমটা টানা মীরাকে। আবীর ওকে দেখার ঘোর কাটিয়ে বলে চলো বড়-বৌমনি ডাকছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি হাঁটে দুজনে। দিনের বেলা ওদের বাড়ি দেখার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ঘর থেকে বেরিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মীরা। এত সুন্দর এত সুন্দর…!
এজন্যই তো এ বাড়িটা দখল করতে স্থানীয় লোকেদের এত বাহানা। মানুষ টাকাপয়সা খরচা করে বাড়ির ভেতরে বাহিরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। আর এ বাড়িটাকে প্রকৃতি নিজ হাতে সাজিয়েছে তার সৌন্দর্যে।
বাড়ির পেছনে পাহাড়ের ঢাল। আর সামনে বনজঙ্গলের মতো। মীরা পাশে থাকা আবীরকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” সব এক রকমের এগুলো কি গাছ?”
: ” এটা শালবন” এখান থেকে সমতল যে পর্যন্ত চোখ যায় সবটুকু আমাদের দাদার সম্পত্তি”
: “এত সুন্দর বন! মাশাল্লাহ! মনে হচ্ছে কোন রিসোর্টে এসেছি ”
মুচকি হেসে আবীর বলে-
: “এই শালবনের শেষে একটা পাহাড়ি ঝরণা রয়েছে। সেটা দেখলে তোমার অনেক পছন্দ হবে”
: “নিয়ে যাবেন? ”
: “রাতে তৈরী থেকো, আবার ওদের দাওয়াত দিও না, শুনলে ওরাও পিছু নিবে”
মুচকি হাসে মীরা আবীরের এমন টোনের কথা শুনে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।
উঁচু সিঁড়ি বেয়ে নামতেই আন্দাজ না থাকায় মীরা পরে যেতে নেয়। আবীর দ্রুত নেমে হাত ধরে মীরার। মীরা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ালে হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় আবীর। কিন্তু মীরা দখল ছাড়ে না আবীরের হাতের। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবীর তাকায় মীরার দিকে, অন্য দিকে চেয়ে মুচকি হাসে মীরা, ওর হাসি দেখে আরো শক্ত করে ধরে মীরার হাত।
একেবারে ড্রইংরুমে পৌঁছানো অব্দি মীরার হাত শক্ত করে ধরে রাখে আবীর। ঘরভর্তি মুরুব্বিদের দেখে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে মীরা । কিন্তু আবীর! বেহায়ার মতো হাত ধরেই এগোয় সবার সামনে। আবীরের পেটে গুঁতো দেয় মীরা হাত ছাড়াবার ইশারায়। আবীরও নাছোড়বান্দা মীরার হাত ছাড়ে না কিছুতেই। “ঐ এসেছে তারা” আহনাফের ডাকে সবার দৃষ্টি ফিরে ওদের দিকে। শেষ মুহূর্তে আবীর আলগোছে হাত ছেড়ে দেয় মীরার । হাঁপ ছাড়লো মীরা সবার সামনে লজ্জিত হওয়া থেকে বেঁচে। তৎক্ষনাৎ তাকায় মীরা আবীরের দিকে, ভ্রু উঁচিয়ে চোরা হাসি ওর চোখে মুখে। ওর হাসি দেখে মীরাও হেসে ফেলে। এটা যেন আবীরের এক অন্য রূপ ধরা পরলো মীরার কাছে। নিঃশব্দে, গোপনে আবীর জানিয়ে দিলো ভালোবাসায় আমি কম যাই না প্রিয়।
মেঝো বৌ-মনির মা বলে উঠলো-
: “কি গো নাত-বৌ, এত হাসির কি হলো আমাদেরও বলো আমরাও হাসি”
মীরা কাছে এগুয়ে সালাম করে তাকে, মেঝো বৌমনি মীরাকে পরিচয় করিয়ে দিলো তার মায়ের সাথে। তার কাছেই বসতে জায়গা করে দিলেন তিনি, মীরা বসেই জিজ্ঞেস করলো তার হালহকিকত। কোন কৃত্রিমতা নেই মীরাতে মীরা যেন এদেরই একজন। সেই যে এ বাড়িতে রাতে এসেছিলো প্রথমবার সেদিনই এ বাড়ির সকলেই আপন করে নিয়েছে মীরাকে। তাই কথাবার্তায় কোন ঘেরাটোপ নেই মীরার। অতি আপনজনের মতো খোঁজ খবর নেয় মীরা তার, তার ছেলেমেয়ে, পরিবারের।
মীরাকে বেশ পছন্দ হয় তার। আবীরকে বলে-
: “কিরে ভাই এত সুন্দর বৌ, এত মিষ্টি কথাবার্তা, আচার-আচরণ কোত্থেকে আনলি একে হ্যা?
আমার ছেলের জন্য…..
মেঝো বৌ-মনি তার মাকে থামিয়ে বলে উঠলো-
: ” আবার সেই গান, বাজে কথ রাখো তো মা, নতুন বৌয়ের মুখ দেখেছো এখন সালামী দাও, এসব শুনতে শুনতে…”
মীরা মেঝো বৌ-মনিকে থামিয়ে বললো-
: “বলুক না, আমি কি বাইরের কেউ? আমি শুনছি আপনি বলুন নানী ”
পাশ থেকে মেঝো চাচা বলে উঠলো-
: “বুঝলে মীরা ছেলে মেয়েরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করলে সে যতই সুন্দর হোক, যত উপযুক্তই হোক তাতে বাবা মায়ের মন ভরবে না, তারা যদি কানা, খোঁড়া এনে দেয় তাও রাজপুত্র ”
মেঝো বৌ-মনি তার বরের পেটে গুঁতো দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। মীরা বুঝতে পারে তারা পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো হয়তো, এবং জামাই তার মনঃপুত হয় নি।
তাইতো সুযোগটাকে কেমন কাজে লাগিয়ে দিলেন তিনি। এক ঢিলে সব পাখি মেরে ফেলার মতো। এমনি করে চা, আড্ডা গল্পে কাটতে থাকে সময়। বৌভাত অনুষ্ঠান হবে আগামী পরশু।
সেদিন সারাটা সকাল সারাটা দুপুর মীরা ছিলো বাড়ির অন্য সকলের দখলে। আবীর পুরোটা সময়ই কাছে কাছে ঘুরছে মীরার। আহনাফ, জাদিদ ওরা কি এক কাজে ডেকেছিলো আবীরকে৷ ও এই সেই বাহানায় বাড়িতেই রয়ে গেছে। বাড়ির সকলে ব্যাস্ত বৌভাত অনুষ্ঠান আয়োজনে। আবীর ব্যাস্ত মীরাতে।
বড় চাচা দ্বিতীয় দফা চায়ের আবদার করলে মীরা নিজ থেকে বলে-
: “চা টা আমি তৈরি করি বৌ-মনি”
বড় চাচী না করলেও, মিষ্টি আবদারে এতটুকু করার অনুমতি চায় মীরা। শেষে আর না করতে পারে না সে।
মীরা চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলে সুযোগ খুঁজে আবীর সেখানে যাওয়ার। কিছু সময় আগের ব্যাপারটা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে৷ সেটা কতটুকু তা মাপতেই সেখানে যাওয়া দরকার।
উসখুস করে মেঝো চাচী বেরুতেই রান্নাঘরে ঢুকে আবীর। মীরাকে বলে-
: ” চায়ে চিনি বেশী দিও না, এ বাড়ির সাবার ডায়বেটিস আছে কিন্তু ”
: “এটা বলতেই এলেন বুঝি”
: “হ্যা, সাবাধান করতে এলাম, পাছে না বদনাম হয়ে যায় ”
: ” আপনাকে অনেক ভালো লোক মনে করেছিলাম, কিন্তু আপনি?”
: “আমি আবার কি করলাম”
: “কি করলাম নাহ?”
এমন সময় রান্নাঘরে ঢুকে পরে মেঝো চাচীর মা, তাকে দেখে রান্নাঘর থেকে বোরিয়ে যায় আবীর। উনি লোক ভালো না শেষে কি বলতে কি বলে বসেন তা ভেবে।
উনি বেরুতেই নানী মীরার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান। মীরার সৌন্দর্য, মীরার নাম, যশ, খ্যাতি এসবের অকৃপণ প্রশংশা করেন তিনি। মীরাও বিনীত ভাবে তার কথার উত্তর দেন। একটা সময় হঠাৎ গলা খাদে নামিয়ে বলেন…
: “শোনো নতুন বৌ নাতীর যে আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো তা কি তুমি জানতা?”
মীরা অসম্ভব সুন্দর এই পৌঢ়ার এমন কথায়, এমন বিশ্রী রূপে কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। ঐদিকে চায়ের দুধ উথলে উঠার শব্দে সংবিৎ ফিরলো যেন ওর। মীরা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দুধের জ্বাল কমিয়ে দিলো। পাশ থেকে নানী মীরার আরো কাছ ঘেঁষে বললো-
: “আরেহ আগের বৌ তো কয়েকদিন সংসার করেই চলে গেছে কি সমস্যা নাকি আছে ওর তাই, তুমি এত সুন্দর মেয়ে, এত নাম যশ শুনলাম তোমার, কি কপাল পুড়লো। তুমি জানলে নিশ্চয়ই বিয়েটা করতে না”
: “সংসার করেছে দেখেছেন আপনি”
: ” দেখি নাই মানে, আমরা আত্নীয় মানুষ আমাদের সামনে বিয়ে হলো, আমরা দেখবো না, কি পরীর মতো সুন্দর বউ ছিলো! তুমি কি সুন্দর? তারচে কয়েকগুণ বেশী সুন্দরী ছিল সেই মেয়ে, স্বামী সুখ না পেলে অর্থসম্পদ ধুয়ে পানি খাবে নাকি? তাই তো চলে গেছে”
: “নানী আমি তো শুনেছি আপনি আপনার এক নাতনীকে নাকি বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন উনার বৌ চলে যাবার পর, কথাটা কি সত্যি? ”
ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি এ কথা শুনে। কারন এ কথা এত দ্রুত তো নতুন বৌয়ের জানার কথা না। আসলে কথাটা মীরা জেনেছিলো ফিওনার কাছ থেকে। তাও বেশ কয়েকবছর আগে। তা তো তিনি জানেন না। আর তিনি যে মিথ্যা বলছেন তার বড় প্রমাণ মীরা নিজে। কারন এক যুগ আগে আবীরের যে বৌ ওকে রেখে চলে গিয়েছিলো সে তো অন্য কেউ না মীরা নিজেই।
পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে মীরা ওদের এক যুগ আগের ছবিটা বের করে দেখায়৷ তারপর বলে-
: “দেখেন তো নানী এই মেয়েটাই কি না?”
সপক্ষের প্রমাণ ভেবে হ্যা হ্যা শব্দে জোড়ালো করার চেষ্টা করে ব্যাপারটা। ফোন হাতে নিয়ে বলেন হ্যা এই যে প্রথম বিয়ের ছবি, দেখেছো আমি মিথ্যা বলিনি। আসলে নিজেদের কুকীর্তির কথা বলতেও খারাপ লাগে কিন্তু আপন ভেবে তোমাকে বললাম কথাটা৷
ফোনটা তার হাত থেকে মীরা ছিনিয়ে নিয়ে বলে-
: “আপন ভেবে বলেছেন তা ঠিক আছে কিন্তু কথাগুলো সব সত্যি কি?”
: “হ্যা সত্যি, তুমি চাইলে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো বড় বৌকে, আমার মেয়ে না হয় মিথ্যা বলবে সে তো আর মিথ্যা বলবে না, তাই না?”
এমন সময় মেঝো বৌমনি রান্নাঘরে ঢুকলে আলগোছে বেরিয়ে যান তিনি। মীরা কেমন বোকা বনে যান তার কথাবার্তায়। তিনকাল গেছে তার এককালও নেই৷ কি দরকারে এই মিথ্যা গুলো বললেন তিনি?
চা তৈরী শেষ হলে তা সার্ভ করতে যায় মীরা। মেঝো বৌমনির মা ঘোষেটি বেগম দলছুট হয়ে একটু দূরে বসে আছেন। মীরা চা হাতে তার দিকে এগিয়ে যান। তারপর গল্পের ভঙ্গিতে বলেন-
: ” আমাকে আপন ভেবে কথাগুলো বলে আপনি ভালোই করেছেন। তা না হলে ভবিষ্যতে আমার জন্য কিছু মানুষ চিনতে ভুল হতো”
হাসি হাসি মুখে তিনি বলেন-
: “তুমি আবার এসব বলো না যেন কাউকে”
: “আরেহ্ আমি কি পাগল! এসব কাওকে বলা যায়? ”
: “নিজ চোখে না দেখলে এসব বলতাম না” মীরা চোখমুখ শক্ত করে বলে-
: ” নানী তার বিয়ে আগে একটা হয়েছে তা সত্যি, কিন্তু বৌ আপনি নিজ চোখে দেখেন নি। দেখলে আপনি ঠিক জানতেন তার প্রথম বৌ আমিই ছিলাম”
কথার দমকে হাত কেঁপে উঠে তার, কিছুটা চা ছলকে পরে তার শাড়িতে। ফোনে থাকা বিয়ের দিনকার ওর একা ছবি দেখিয়ে বলে –
“মিলিয়ে দেখুন এটা ষোলো বছর বয়সী মীরার ছবি, আর এই যে এখন আমি” বলেই মুচকি হেসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ও। শকটা যে ৪৪০ এর চেয়ে বেশী ভোল্টোর হয়ে গেছে তা ঠিক বুঝতে পারে মীরা। লজ্জা থাকলে এ মহিলা এই জীবনে আর ওর মুখোমুখি হবে না।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
দুপুরে খাওয়ার পর মীরা একটু ঘুমিয়েছিলো। ঘরে থাকলে মীরার অস্বস্তি হতে পারে ভেবে আবীর সে সময়টা বাইরেই ছিলো। মীরার শরীরটা কেমন ক্লান্ত, গতরাতে দীর্ঘ জার্নির পরও ঘুম পুরোপুরি হয়নি তাই হয়তো। খুব আরামের ঘুম ঘুমালো মীরা। এমন শান্তির ঘুম শেষ কবে ঘুমিয়েছে তা ও মনে করতে পারছে না। ঘুমের মধ্যে কেমন একটা স্বপ্ন দেখলো ও। সেটাকে সুন্দর স্বপ্ন বলবে নাকি দুঃস্বপ্ন তা-ও বুঝতে পারছে না। ওর স্বপ্নটা ছিলো- ওরা পুরো পরিবার মিলে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে গিয়েছে। নূহা, ওর বাবার সাথে খুব আনন্দ করছে, আর মীরা দূরে বসে দেখছে আর হাসছে। হঠাৎ দেখলো ওরা একটা ছোট্ট বোটে বসে। বিশাল একটা ঢেউ হঠাৎ-ই আছড়ে পরলো ওদের ছোট্টো বোটে। তাতেই উল্টে গেলো বোটটা। পাথরের টুকরোর মতো পানিতে ডুবে গেলো ওরা একেএকে তিনজন। সাঁতার না জানা মীরা ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ, ডুবছে নূহাও, এ তিনজনের মধ্যে নূহার বাবাই কেবল সাঁতার জানা। কাকে বাঁচাবে সে? নূহা? নাকি মীরাকে? পানির নিচেই মীরা ওর হাত ছাড়িয়ে ইশারায় তাকে বললো নূহাকে নিয়ে উপরে উঠতে৷ তখনি মীরার হাত শক্ত করে ধরলো সে, কোলে তুলে নিলো নূহাকেও। আর তখনি প্যারাসুটের মতো কি এক ওয়াটার স্যুট চালু করলো নুহার বাবা, পানির মধ্যে উড়তে শুরু করলো ওরা, কিছু সময় পর ওরা পানির তলা থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর সাঁতরে পাড়ে উঠে ক্লান্ত শরীরে আছড়ে পরলো যেন তিনজনে। মীরা দ্রুত শ্বাস টানতে টানতে বললো- ভাগ্যিস তুমি এই ওয়াটার স্যুটটা নিয়ে এসেছিলে তা না হলে কি য়ে হতো! পাশ থেকে নূহা বললো- “জানো মা, আমি জানতাম বাবা ঠিক আমাদেরকে বাঁচিয়ে নিবে”
তখনি ঘুম ভাঙলো মীরার, পানি থেকে ডুবে উঠার ক্লান্তি, আর শ্বাসপ্রশ্বাসের দ্রুততায় তখনো রয়েছে। যেন বাস্তবেই ঘটেছে তা। আবীর রুমে ঢুকে বলে-
: ” এত আস্তে দরজা খুললাম তাও ঘুম ভেঙে গেলো তোমার?”
উত্তরে মীরা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। ওর
দ্রুত শ্বাস নেয়াটা খেয়াল করলো আবীর। দ্রুত কাছে এসে বললো-
: ” কি ব্যাপার? কোন ভয়ংকর স্বপ্ন টপ্ন দেখেছো নাকি?”
হ্যা সূচক মাথা নেড়ে অস্ফুটে মীরা বললো-
: “পানি”
আবীর দ্রুত জগ থেকে পানি ঢেলে দেয় ওকে। মীরা এক টানে শেষ করে গ্লাসের সব পানি। তখনি মাগরিবের আযান পরে চারদিকে।
আবীর খানিকটা দূরত্ব রেখেই বসা ওর থেকে। দেখছে মীরার শ্বাস-প্রশ্বাসের উঠানামা আর ওর ঘামে আর্দ্র মুখ। তোয়ালে এনে দিয়ে বলে-
: ” কয়েকটা দিন খুব স্ট্রেস গেছে তোমার, তাই হয়তো… ”
তুমি মাগরিবের নামাযটা পড়ে নাও, আমিও পড়ে আসি। নামায পড়লে দেখবে মনটা শান্ত হবে৷ বলেই নামাযের উদ্দেশ্যে বের হয় আবীর।
নামাযের পর চা নাশতার জন্য ডাক পরে ওদের। মীরা তখন নূহার সাথে কথা বলছিলো ফোনে৷ আবীর রুমে এসে মীরার কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। নূহা জিজ্ঞেস করলো-
: “কবে আসবে তুমি?”
মীরা উত্তরে বললো- “আগামীকাল মা ”
: “বাবা কবে আসবে? ”
: “বাবা এখনো টিকেট পায় নি মা, তবে বলেছেন যতদ্রুত সম্ভব আসবেন”
কথাটা বলেই ফোনের লাউডস্পিকার অন করে মীরা যাতে নূহার পাকা পাকা কথা শুনতে পায় আবীর। তখনি আদুরে গলায় নূহা বলে-
: “বাবা কি আবার আমাকে রেখে বিদেশ চলে যাবে? ”
: “না মা আমরা বাবাকে আর বিদেশ যেতে দিবো না”
: “আমি বাবার কোল থেকেই নামবো না'”
কথা শুনে হেসে দেয় মীরা, ছোট্ট মেয়েটার বাবাকে ঘিরে কত কথা। একটু পর মীরা নুহাকে প্রশ্ন করে –
: “শোন তোমার বাবা ফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কি আনবে তোমার জন্য? ”
: “আমার কিছু চাই না মা, বাবাকে বলো তার বসকে বলে এক্কেবারে বড়… ছুটি নিয়ে আসতে, বাবাকে যাতে আর না যেতে হয় আমাকে ছেড়ে।
: ” বসকে কি বলবে মা? তুমি একটু শিখিয়ে দিবে?”
: ” বাবা বসকে বলবে যে বাবাকে ছাড়া আমার খুব কষ্ট হয়, সবার বাবারা স্কুলে আসে, আমার বাবা বিদেশে তাই আসতে পারে না,
এমন সময় মীরা খুবই ইমোশনাল হয়ে লাউডস্পিকার অফ করে দেয়। আবীর ফোনটা মীররা থেকে হাতে নিয়ে আবার কথা চালু করতে ইশারা দেয় মীরাকে৷
মীরার হাতটা শক্ত করে ধরে আবীর, আস্তে করে বলে-
: “আমি কথা বলবো?”
মীরা ইশারায়-ই উত্তর দেয় ‘না’
তখন মীরা মেয়ের সাথে কথা শেষ করে ফোন রেখে দেয়৷ দু’জনে মৌন হয়ে বসে থাকে অনেকটা সময়। কেউ-ই বলবার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না যেন। এমন সময় দরজায় নক করে কেউ মীরা চোখমুখ মুছে নেমে গিয়ে দরজা খোলে। দেখে গেইটের কাছে আহনাফ এসেছে, পাশের বাড়ির মেয়ে বৌরা এসেছে নতুন বৌ দেখবে বলে। মীরা ”তৈরী হয়ে আসছি”- বলে ওকে বিদায় করে দরজা আটকে দিয়ে তৈরী হতে বসে নিচে যেতে। এমন সময় আবীর বলে-
: ” যা গেছে সব বাদ দিয়ে নতুন করে শুরু করা কি খুব কঠিন মীরা? তোমার জীবণের দুঃখ আর কষ্টের অতীত শেষ, আমায় কি তোমার ভরসা হয় না? ”
আহত চোখে তাকায় মীরা, আবীর ওর চোখে চোখ রেখে, ওর দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে-
: “আমায় ভরসা করো, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে,
মীরাও চক্ত করে ধরে আবীরের হাত।
মুখ ভার করে রেখো না, একটু হাসো…”
হাসার চেষ্টা করে মীরা, আবীর এতেই খুশী হয়, বলে চা পাঠাবো এখানে নাকি নিচে গিয়ে খাবে?
: “আপনি যান আমি আসছি”
: “ওকে জলদি তৈরী হও, আমি গিয়ে এক কাপ খাচ্ছি, তোমার সাথে আরেক দফা হবে”
মিনিট পনেরো পর তৈরি হয়ে একাই নিচে নেমে বসে মীরা। নীচতলার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় তোলার চেষ্টা করে সে, এমন সময় পিয়ালী ইশারায় আবীরকে দেখতে বলে সেদিকে। চায়ের কাপ ঠোঁটে ছুঁইয়ে আবীর মাথা ঘুরায় পিয়ালীর তাগাদা দেখে। বিষ্ময়ের দমকে চা ছলকে পরে যায় ওর গায়ে। সেটাকে হাতে রেখেই ও মনোযোগ দিয়ে চেয়ে দেখে আসমান থেকে নেমে আসা এক পরী শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে নিচ্ছে। গাঢ় বেগুনি ব্ল্যাউজ দিয়ে ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়ি পরেছে সে। এক হাত ভর্তি বেগুনী রঙের কাচের চুড়িতে। আরেক হাতে চওড়া বেল্টের কালো ঘড়ি। শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে তুলতে সম্মুখে তাকিয়ে নিচে নামছে সে। হতভম্ব হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে আবীর। এই পরীটা ওর বউ! এটা কি সত্যি? ”
মুচকি হাসে মীরা আবীরের তাকানো দেখে। ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করে – “কি?”
তখনি হেসে চোখ নামিয়ে নেয় আবীর। ঘর ভর্তি লোকের মনোযোগ তখন মীরাতে।
এ ওকে ফিসফিস করে বলছে- নতুন বউ কি সুন্দর দেখতে…। নিজেকেই নিজের হিংসা হতে থাকলো, আচ্ছা ওর আচরণ কি নার্সিসাসের মতো হয়ে যাচ্ছে? পরোক্ষণেই মনে হলে নার্সিসাস তার নিজের সৌন্দর্যে
বিমোহিত হয়েছিলো, আর ও বিমোহিত হচ্ছে ওর ভাগ্যের প্রতি। পাছে না নিজেরই নজর লাগে তাই ও অস্ফুটে বলে – “মাশাল্লাহ ”
পরদিন বৌভাত অনুষ্ঠান হবে। তাই বাড়ির বড়োরা মোটামুটি ব্যাস্ত। ব্যাস্ত বাড়ির অন্যান্যরাও। মধ্য মনি মীরা আবীরের তেমন কোন কাজ নেই। আবীর এই-সেই বাহানায় মীরার কাছাকাছি ঘুরঘুর করলেও, মীরা পরেছে বিপাকে৷ নতুন বউ বলে স্ট্যাচুর মতো বসে থাকা লাগছে, কেউ এলে তাকে সালাম করা তার সাথে কথাবার্তা বলা এটাই ওর কাজ। তারা কথা বলছে তো বলছেই। কথার গাড়ির কোন থামাথামি নেই। আবীর ঠিক বুঝতে পারে মীরা বোর হচ্ছে এসবে। মীরা উঠে চলে গেলে কাছেপিঠের আত্নীয়রা মন্দ ভাবতে পারে ওকে।
উপায়ন্তর না পেয়ে আহনাফের সাথে ছাদে যায় আবীর,যাবার আগে ফিসফিস করে মীরাকে – “উপরে যাচ্ছি আমি” বলেই সিঁড়ি ভেঙে ছাঁদে চলে যায় সে। অসহায় চোখে মীরা ওর চলে যাওয়াটা দেখে।
একটু পর বড় চাচী মানে আবীরের বড় বৌমনি মীরার কাছে আসে। এক কাপ চা আর একটা ঔষধ দিয়ে বলে-
: “তুমি উপরে চলে যাও মীরা, আবীরটার নাকি মাথা ব্যাথা করছে”
পাশে থাকা একজন বললো-
: “আহারে, আচ্ছা নতুন বৌ যাও তুমি, বরকে নিয়ে যেয়ো আমাদের বাড়িতে বেড়াতে”
মীরা স্মিত হেসে চা হাতে উঠে পরে। দোতলার সিঁড়িতে উঠেই হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন ও।
” মনে একটু চিন্তা আবীরের মাথা ব্যাথার কথা ভেবে, গিয়ে দেখে দরজা খুলে মীরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে আবীর। মীরা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলে অবাক কন্ঠে বলে “আপনার নাকি….”
কথাটা শেষ করতে দেয় না আবীর, ইশ্ শব্দে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় ওকে। মীরার হাত ধরে মীরাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দেয় ও। তারপর বলে-
: “কাপ রাখো ভারী কিছু গায়ে জড়িয়ে নাও”
মীরা স্তম্ভিত কন্ঠে বলে-
: “আপনার চা”
: “আরে রাখো চা, ওখান থেকে তোমাকে তুলে আনতে এসব তো ভুংভাং ছিলো, দেখলাম ওখানে বসে বোর হচ্ছো তাই”
মীরা একটু অবাক হয়, মুচকি হেসে বলে-
: “এত দুষ্ট বুদ্ধি আপনার? এত বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমান কিভাবে? ”
: “আরো কত বুদ্ধি আছে, মাথায় জায়গা হয় না ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রেখে ঘুমানো লাগে, এখন তুমি আছো তোমার কাছে রাখবো নি। আমাকে যতটা ভালো ভাবছো, ততটা ভালো কিন্তু আমি নই, পরিবেশ পরিস্থিতির জন্য ভালো আমি, এখন যা বলি শোন ভারী কাপড় কিছু নিয়ে নাও আমরা বাইরে যাবো এখন”
: “এত রাতে!”
: “মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে”
: “বাইরে যাবো কিভাবে? ”
: “ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে, পেছনের দরজা দিয়ে যাবো, কেউ টের পাবে না, চলো তো কথা বলা না থামালে এখানেই রাত কাবার হয়ে যাবে”
ওর এ কথা শুনে তারাহুরো করে মীরা একটা শাল টেনে নিলো লাগেজ থেকে। কোনমতে ওটাকে গায়ে জড়িয়ে নিলো। চুলগুলোকে কোনমতে টেনে আটকে নিলো ক্লিপ দিয়ে৷
দরজা আটকে সন্তর্পণে নিচে নামলো ওরা পেছনের দরজা দিয়ে৷ আবীর ওর হাত ধরে অনেক দূর ঘুরে বাড়ির অপজিটের শালবনে ঢুকলো। দ্রুত হেঁটে অনেকটা পথ পেরুনোর পর হাঁপিয়ে গেলো মীরা। হাঁটা থামিয়ে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে থেমে যায় ও। আবীরও থেমে যায় ওর পাশে, বলে- “খুব-কি কষ্ট হচ্ছে? আরেকটু পথ বাকী?”
মীরা হাঁপিয়ে গিয়ে বলে-
: ” আচ্ছা আমরা যাচ্ছি কোথায়? ”
: “চমৎকার একটা জায়গা দেখাবো তোমায়”
তারপর ধীর পায়ে হাঁটে দুজনে।
মিনিট পাঁচেক পর ওরা পৌঁছে গেলো সেই অপার্থিব জায়গাটায়। মীরা প্রথমটাতে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এত সুন্দর!
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলে যাওয়া ঝর্ণা। অন্ধকার রাতে ঝর্ণার জলের অস্তিত্ব শব্দ দিয়ে বুঝে নিচ্ছে মীরা। আরেকটু এগুতেই পানির প্রবাহমান ধারা দেখতে পায় ও । চাঁদের আলোয় ঝর্ণার জল রূপালী দেখচ্ছে। মনে হচ্ছে উপর থেকে কেউ যেন পাহাড়ের গা ধুয়ে দিচ্ছে। একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই মীরা দেখতে পেলো ঝর্ণার জল পাহাড়ের গা বেয়ে গিয়ে পরছে সরু নদীটাতে। সামনের দিকে যতদূর চোখ যায় ততখানিই নদীর দখলে। নদীর দুই পাড়ের ঘাসবন অন্ধকারে কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
মীরা আবীরকে জিজ্ঞেস করলো-
: “আচ্ছা নিচে নামা যাবে?”
: “নামবে?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলে মীরা।
: “পানি যেদিকটায় পরছে সেদিকটা পিচ্ছিল সেদিকে যাওয়া যাবে না। যে কোন সময় এক্সিডেন্ট হতে পারে”
: “না বলবেন না প্লিজ, বেশীদূর নামবো না, আমি শুধু ঝর্নার পানি ছুঁয়েই চলে আসবো, ঐ দিকটায় না গেলে আফসোসের শেষ থাকবে না প্লিজ…”
: “যদি যেতেই হয় তাহলে ঐ দিকটা দিয়ে নেমে যেতে হবে, তবে সাবধান। পা পিছলে পরে গেলেই কিন্তু শেষ”
: “সাবধানেই যাবো,”
: “আচ্ছা চলো,
পা টিপে টিপে এগোয় ওরা, মিনিট তিনেক পর অনেকটা পথ ঘুরে ওরা ঝর্ণার কাছে পৌঁছালো। ঝর্ণার এ জায়গাটা সমতল। সেখানটাতে দাঁড়িয়ে
হাত দিয়ে মীরা ঝর্ণার জল ছুঁলো মীরা। একটু পানি ছুঁড়ে মারলো আবীরের মুখে, হাসি মুখে বা হাতে সে পানি মুছে নিলো আবীর। তারপর হাত দিয়ে ইশারা করে বললো-
: ” এখানে এই জায়গাটায় ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় লুকাতাম আমরা”
মীরার সব মনোযোগ এখন ঝর্ণাকে ঘিরে। আবীরের কথার পিঠে কিছু বললো না ও। ও এখন যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে নদীর দৃশ্যটা বেশী সুন্দর। এ মুহূর্তে মীরার মনে হলো একটা নৌকা যদি থাকতো। পাথুরে পাহাড়, পেছনে শালবন, চাঁদের আলো, নদীতে ঝর্নার পানি গড়িয়ে পরা, নদীর দুই পাড়র রহস্যময় অবয়ব, সবটা মিলিয়ে অপার্থিব দৃশ্য একটা। এমন সময় নিস্তব্ধ বনে ঝর্ণার পানি আছড়ে পরার শব্দ ছাড়াও আরো কিছু শব্দ টের পায় ওরা। কিছুক্ষণ কান পেতে আবীর বুঝতে পারে বেশ কয়েকজনের সমাবেত পায়ের শব্দ । আবীর হঠাৎ মীরাকে চুপ থাকার ইশারা করে গুহার মতো জায়গাটায় টেনে নিয়ে গেলো। দুই পাথরের ছোট্ট খাঁজটা গুহার মতো দেখাচ্ছে, ছোট্ট বেলায় এখানেই লুকাতো ওরা। বড় বেলায়ও অনায়াসে ওদের দু’জনকে পুরে নিলো সে, বাইরে থেকে কেউ বুঝবেও না কেউ আছে এখানে। কিন্তু জায়গাটা এত সরু যে ওদেরকে আগেপিছে করে দাঁড়াতে হলো। মীরা কিছুই বুঝলো না। আবীর ফিসফিস করে বললো “শিশ্শ্শ্শ… ওরা এসেছে”।
আবীরের কথা মীরার কানে না যেন পৌছালো হৃদয়ে।
ভীত চোখে মীরা উপরে চেয়ে দেখে পিয়ালী, আহনাফ, জাদিদ, রোজি এ চারজনে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা কথাবার্তা হাসাহাসি করে, কি যেন বের করলো পা ঝুলিয়ে বসে। একটু পর ম্যাচের কাঠিতে আগুন জ্বেলে উঠলো, আবীর বুঝতে পারলো সিগারেট ধরাচ্ছে ওরা। পাছে কেউ দেখে ফেলে তাই এখানে এসে এই নিষিদ্ধ কর্ম সাধন করছে এরা। একে একে সে সিগারেটে টান দিলো পিয়ালী, আহনাফ, রোজি। তিনজনেই খুক খুক কাশছে। জাদিদকে স্টেবল দেখাচ্ছে। বোঝা গেলো এ চারজনের মধ্যে তিনজনের গুরু হচ্ছে জাদিদ বাবাজি। ঝর্ণার কাছ থেকে ওদের তিনজনের প্রথম ধুমপানের সাক্ষী হলো এরা দুজনে।
এদের ধুমপান পর্ব শেষ, কিন্তু তারপর ও কি এক গল্প ফেঁদেছে ওরা। কথা যেন ফুরায়ই না এদের। এদিকে আবীরের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধাক্কার ধকল আর নিতে পারছে না মীরা। এটুকু জায়গায় দুটো লম্বাচওড়া মানুষ ভাগাভাগি করে থাকাটা খুব টাফ। মীরার পিঠ লেগে আছে আবীরের বুকের সাথে। এমনি ভাবে দাঁড়িয়ে কিছুটা অস্বস্তি ও হয় মীরার। অস্বস্তি যে আবীরের ও হয়নি তেমন না, তবে ওদের কিছুই করার ছিলো না। বিবিসি পিয়ালী যদি জানে ওরা এখানে এসেছে, তাহলে পুরো বাড়ি তে জানবেই, পুরো দেশ জানলেও অবাক হবে না ও, পরে লজ্জার শেষ থাকবে না, তাই এমনি অস্বস্তিতে ডুবে ছিলো দুজনে অনেকটা সময়।
অবশেষে ওরা বাড়ির পথে হাঁটা দিলে মীরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। আবীর ও বেরুলো ওর পিছনে। কেমন একটা ঘোর লাগা কন্ঠে জরানো ভাবে “সরি ” বলে মীরাকে। মীরা তৎক্ষনাৎ বলে-
“সরি ফর হেয়াট?” অন্ধকারেই কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রশ্নের যুতসই উত্তর না দিতে পেরে
প্রসঙ্গ বদলাতে আবীর উপরে উঠার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখায়। মীরা সেদিকে ঘুরে একটা মুচকি হাসি হাসে৷ তারপর ধীরে ধীরে উপরে উঠে ওরা।
ফিরতি পথে পাশাপাশি হেঁটেছে ওরা দুজনে, কিন্তু বলবার মতো কোন কথাই খুঁজে পায়নি দুজনে। বাড়ির কাছে পৌঁছে আবীর বলে-
: ” মীরা!”
আবীরের সামনে থাকা মীরা পিছন ফিরে তাকালে আবীর বলে-
: ” সরি ফর আনইন্টেনশনাল টাচ্”
কথাটা শুনে মুচকি হাসে মীরা। মনে মনে ভাবে-
” এ ছেলে বড় কবে হবে?”
দৌঁড়ে গিয়ে হাগ করে দিবো নাকি একটা ঝটকা। পরোক্ষণেই মীরা ভাবে বি পেশনস্ মীরা। তারপরই ওকে রেখেই চোরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় মীরা।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
রুমে এসে মীরা কেবলি ভাবতে থাকে ঘোরলাগা ঐটুকু সময়ের কথা। প্রথমটাতে অনাহুত কেও ভেবে ওকে সরিয়ে নিয়েছিলো আবীর সেখানে, পরে ওরা কাছাকাছি এলে বুঝতে পারলো যে আগতোরা অনাহুত কেউ না, ওদের চাচাতো ভাইবোন। মাথা ব্যাথার কথা বলে দুজনে এখনে এসেছে জানলে আর রক্ষা ছিলো না, তাই ওখানেই ঘাপটি মেরে ছিলো তখন।
মীরার বার বার মনে পরে আবীরের ওকে টেনে নেয়ার
কথাটা। যে ছেলে চুল মুছতে গিয়ে হাতের নিজের ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাখে, তার পক্ষে এমন ইন্টেনশনালি টাচ অসম্ভব। কথাটা ভাবতেই কোমড়ের কাছে হাত রাখে সে। আবীরের সেই সময়কার ছোঁয়াটা যেন আবার অনুভব করতে চাইলো ও। পুরো শরীরে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলো মীরা, অদ্ভুত এক উচাটন শরীর আর মন জুড়ে। পুরুষসঙ্গে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় এই অনুভুতি চেনা মীরার। মনে মনে ভাবে “নাহ ঘুমিয়ে থাকা আবীরটাকে ওকেই জাগিয়ে তুলতে হবে”
ঠিক তখনি দরজায় টোকা পরে, নিশ্চয়ই আবীর হবে ভেবে অপেক্ষা করে ওর ঘরে আসার। কিন্তু বাইরে আবীরা না, রাতের খাবার খেতে ডাকছে পিয়ালী।
শোয়া থেকে উঠে শাড়ি ঠিক করে ও, তারপর ওর সাথেই নিচে নেমে যায় মীরা । নিচে গিয়ে দেখে খাবার ঘর ভর্তি সকলে থাকলেও আবীর নেই। রাতের খাওয়া দেরী হয়, জ*বা*ই করা গরুর কলিজা, ফুসফুস দিয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। খিচুড়ি রান্নায় দেরি হবে বলে মীরাকে খেয়ে নিতে বলে মেঝো বৌমনি। চা, গল্প আড্ডায় অনেক রাত অবধি গল্প হলো সকলে মিলে। আগামীকাল কি কি প্রোগ্রাম হবে তারও আলোচনা হলো। সবাইকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন বড়রা।
রান্না শেষ হলে প্রথম দফায় বাড়ির বড়রা খেতে বসলো। মীরা সবাইকে খাবার বেড়ে খাওয়ালো। পরের দফায় বাড়ির মেয়ে বৌ-রা বসলো। মীরাকে বসতে বললে মীরা পথের দিকে চেয়ে “পরে খাবো ” বললে বড় বৌমনি এক ধমক দেয়, রাত বাজে কয়টা খবর আছে? তারপর মুচকি হেসে বলে- “আরে তোমার বরকে ডাকতে পাঠিয়েছি। এক্ষুনি আসলো বলে ”
“বিয়ের পর থেকে আবীর সবসময় ওর কাছাকাছি ছিলো। ঝর্ণা দেখে ফিরেছে সেই কখন, এরপর আর তার দেখা নেই। এমনিতেই তো সহজ হতে পারছে না বেচারা, তার উপর ঐ আন-ইনটেনশনাল টাচ্ এর পর যেন আরো ফ্রিজ হয়ে গেছে সে” -খেতে খেতে ভাবে মীরা।
ঠিক তখন ঘরে ঢুকে আবীর। রোজি তখন আবীরকে ধমক দিয়ে বলে-
: ” ভাইয়া কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে না দেখে ভাবীর যায় যায় অবস্থা” কথাটা বলেই মীরার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে রোজি। মীরা মাথা তুলে চোখ বড় করে তাকায় ওর দিকে। আবীর রোজির মাথায় আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে খেতে বসে।
মীরা অপর পাশ থেকে লক্ষ্য করছিলো আবীরের খাওয়া। ডানে বামে না তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে সে। মীরার বিরক্ত লাগে ব্যাপারটা৷ মনে মনে ভাবে “এত সংকোচের কি আছে? তুই তোর বিয়ে করা বউয়ের কোমড়ে হাত রেখেছিস তাও বিপদে পরে” এত হাসফাস, এত অস্বস্তির কি আছে?
“ভাগ্যিস বিপদে পরেছিলো সে” – কথাটা ভেবে হেসে দেয় মীরা। এমন সময় খাওয়া শেষে হাত ধুতে যায় আবীর। খাবার শেষ না করেই মীরা যায় ওর পিছু পিছু। একে একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। ওর হাত ধুুতে ধুতে মীরা এসে হাজির সেখানে। ওকে দেখে নিজের হাত ধোয়া রেখে মীরাকে জায়গা করে দেয় আবীর দ্য জেন্টাল ম্যান। মীরা ঘুরে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়। আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে-
: “কি সমস্যা? ”
প্রথমটাতে বুঝতে পারেনা আবীর কি জিজ্ঞেস করলো মীরা, উত্তর না পেয়ে মীরা আবার জিজ্ঞেস করে –
: ” সমস্যা কি আপনার?”
এমন সময় আহনাফ হাত ধুতে এলে রাগী মুড নিয়ে তারাহুরো করে হাত ধুয়ে সোজা উপরে চলে যায় মীরা। আবীর কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখে।
হাত ধোয়ার পরও বেশ খানিকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে আবীর। বুঝতে পারে না কেন এত অস্বস্তি হচ্ছে ওর।
অবশেষে উপরে যায় আবীর, ওর ঘরের দরজার কাছে এসে দরজায় নক করতে হাত রাখে। নক করতে দরজায় হাত রাখতেই দেখে দরজাটা খোলা। দরজা ঠেলে দেখে ঘরের ভিতর অন্ধকার। পেছন ফিরে বাইরে তাকায় ও, পুরো বাড়ি আলোয় জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু রুমে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীর পায়ে রুমে ঢুকে ও। তখনি রহস্যময় ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দরজা। পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করে আবীর, কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে লাইট অন করতে সুইচ বোর্ডের দিকে এগুয় ও, এমন সময় একটা উষ্ণ হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করে। চকিতে ঘুরে দাঁড়ায় ও। বিয়ে বাড়ির মরিচ বাতির অল্প আলোয় অন্ধকার ঘরে ওর সম্মুখে ফুটে ওঠে একটা অবয়ব। কাল মুহূর্ত বিলম্ব না করে আবীরের বুকে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরে সেই অবয়বটা। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওকে। আবীরের হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতায় হাত যেন অসাড় হয়ে আসে, ভয় পায় হাত বাড়াতে এর থেকে বাঁচতে কিংবা একে আপন করে নিতে। অবয়বটা হাত ছেড়ে আবীরের হাত দুটো জড়িয়ে দিলো নিজের গায়ে, তারপর আবার আবীরের বিশাল বুকে আছড়ে পড়ে সে। দিশেহারা আবীর যেন এতক্ষণে দিশা পেলো। অবয়বটার তৈরী করা বন্ধন শক্ত করে সে তার বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে। কয়েকঘন্টা আগে মনে যে সংশয় ছিলো তা দূর হয় ওর। মীরা সেটাই বললো হয়তো এমন নিরব উত্তরে দিয়ে। মাথা উঁচিয়ে মীরা বলে-
: ” এত ভীতু কেন আপনি?”
মুচকি হাসে আবীর ওর কথা শুনে, তারপর বলে-
: “ভীতু আমি?”
: “তা নয়তো কি?”
জড়ানো অবস্থায়ই পেছনের দেয়ালে মীরাকে ঠেস দিয়ে মীরার খুব কাছে যায় আবীর, এত কাছ থেকে কেউই হয়তো দেখেনি কাওকে। দুজনের চোখেই অন্ধকার সয়ে এসেছে। আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছে দুজন দুজনকে। বেশ কিছু সময় একদৃষ্টিতে একে অপরকে দেখেছে ওরা , আবীরের চোখেমুখে দুষ্ট হাসির ঝিলিক, মীরার দৃষ্টিতে ভীতি।
আবীর মীরার কানের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলে-
: “আমি চিন্তিত তবে মোটেই ভীতু না ”
তারপর আচমকা মীরার ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুমু খায়। মীরার চোখ দুটো বিষ্ময়ে ভরে উঠে আবীরের হঠাৎ এমন বদলে যাওয়া দেখে। প্রথমটায় চমকিত হলেও, সময় লাগলো না সেই চমক কাটতে। হাত দুটো আবীরের থেকে আত্নরক্ষায় ব্যবহার না করে প্রসারিত করলো উষ্ণ আলিঙ্গনে। আলো আঁধারিতে অন্ধকারের গায়ে ভেসে উঠছে দুই নর-নারীর প্রথম প্রেমালিঙ্গণ।
ভালোবাসাবাসিতে কেউই কম যায় না কারো থেকে। মীরার এসবে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও আবীরের আনাড়ি ছোঁয়া মীরাকে গুড়িয়ে দিচ্ছে ভিতর থেকে।
সহ্য সীমা পেরিয়ে গেলে মীরাও নেমে পরে আবীরের ভালোবাসার শোধ মেটাতে। আলতো হাতে ওর দুই হাত আবীরের দুই গালের কাছে রেখে মাথাটা নিজের দিকে টেনে দীর্ঘ চুমু একে দেয় ওর ঠোঁটে। আবীর বুঝে উঠতে সময় নিলেও ছাত্র হিসেবে সবটুকু উজাড় করে নেমে পরে ভালোবাসার গুরুদক্ষিণা দিতে।
হঠাৎ মীরা আবীরকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গিয়ে বলে –
: “সরি”
আবীর ওর কাছে এসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে –
: “সরি কেন?”
মীরা মুখটা কেমন গোমড়া করে বলে-
: ” সরি ফর ইন্টেনশনাল টাচ্ ”
কথাটা শুনে যেন তেড়ে আসে আবীর মীরার দিকে। মীরাও ওর থেকে নিজেকে বাঁচাতে দৌঁড়ে খাটের অপর প্রান্তে যায়। কিন্তু ও জানে আজ ওর আবীরের হাত থেকে রক্ষা নাই।
ভালোবাসার সে দীর্ঘ রাতে ভেঙে পরে দুজনের জড়তার সব দেয়াল। সারাটা রাত আবীর মীরাকে আগলে রাখে ওর বুকে। আবাধ্য মীরা বারো বছরের ব্যবধানে পোষ মানে আবীরের।
পরদিন থেকে দুজনের জীবণটা একটু যেন বদলে যায়। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে চোখে চোখে কথা হয় দুজনে, ভালোবাসার আদান প্রদান হয় যখন তখন। সুযোগ পেলেই একটু ছুঁয়ে ফেলা, যখন তখন জড়িয়ে ধরা এসবও চলতে থাকে সমান তালে। না আবীর কিন্তু বেয়াড়া হয় নি, এখনো ভদ্রতার সীমানা মেনে চলে সে। সীমানা অতিক্রম করে মীরা। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে কথা বলতে বলতে সুযোগ পেলেই উড়ো চুমু পাঠায় সে। আবীর তার শোধ দিতে না পারলেও সাদরে গ্রহণ করে মীরার দান। কাজিনদের সম্মুখে ওদের আড়ালে যখন তখন তর্জনী দিয়ে পিঠে আলপনা আঁকে মীরা। আবীর না পারে সহ্য করতে না পারে শোধ দিতে৷ একটু সুযোগ পেলেই আবীরকে জড়িয়ে ধরে মীরা, কারো আসার শব্দ পেলেই, আলিঙ্গন ছেড়ে ভদ্র মেয়ের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। এবং তা এমন ভাবে যেন মুহূর্ত পূর্বে কিছুই হয়নি। আবীর হাসে ওর এসব কান্ড দেখে।
দুপুরে পিয়ালীর সাথে মীরাকে ঘরে যেতে দেখে আবীর। রাতের বৌভাত অনুষ্ঠানে সাজগোজের প্রস্তুতির আলাপে । খানিক বাদে ঘরে যায় আবীর। পিয়ালীকে বলে-
: “বৌমনি ডাকছে তোকে ”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিয়ালী বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
পিয়ালী বের হতেই দরজা আটকে দেয় আবীর। মীরা তখন কানের দুল কোনটা পরবে তা ঠিক করছিলো। আবীরকে ভর দুপুরে দরজা আটকাতে দেখে আবীরের দুষ্ট বুদ্ধির কিছুটা টের পা মীরা। না বোঝার ভান করে দুল দেখায় মনোযোগ দেয় ও। আবীর দূর থেকে দেখে কিছুক্ষণ মীরাকে। তারপর ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসা মীরার পিছনে এসে দাঁড়ায়। আয়নাতে মীরার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলে-
: ” তুমি এত্ত ফাজিল! বাব্বাহ্”
বসা থেকে আবীরের দিকে ঘুরে মীরা, তারপর কোনকিছু না বোঝার ভান করে বলে-
: “আমাকে আর ভালো থাকতে দিলে কই, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, এতদিন তো নিপাট ভদ্রলোক ছিলাম”
কথাটা শুনে মুখ ভেংচি দিয়ে বলে “হেহ্ ভদ্রলোক” বলেই গাল ফুলায় মীরা, ওকে রাগ করতে দেখে হেসে দেয় আবীর। মুগ্ধ চোরা চোখে মীরা আবীরের হাসি দেখে। তারপর বসে থেকেই জড়িয়ে ধরে আবীরকে। আবীরও জড়িয়ে রাখে ওকে। মীরা মনে মনে ভাবে-
: “নিজেকে কথা দিয়েছি আমি অনেক ভালোবাসবো তোমায় আবীর”
আবীর মীরার বৌভাত অনুষ্ঠান হবে রাতে। বিকেলের মধ্যে সব আত্মীয়রা এসে পরলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে সাদাসিধে হলেও বৌভাত অনুষ্ঠান তারা জাঁকজমকপূর্ণ করেছেন। ঢাকা থেকে মীরাদের বাড়ির সকলে এসেছে। মোখলেস চাচা অসুস্থ থাকায় তিনি আর তার স্ত্রী আসেননি শুধু। আবীর সুট বুট পরে ওদের বাড়ির বিশাল গ্রাউন্ড করা স্টেজে কি যেন করছে। এমন সময় মীরাকে নিয়ে আসা গাড়ি থামে বাড়ির সদর দরজার সামনে। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে মীরাকে সদরে অভ্যর্থনা জানায় আবীর। মুচকি হেসে আবীরের হাত ধরে গাড়ি থেকে নামে মীরা। বৌ সাজে
মীরাকে দেখে অস্ফুটে একটা শব্দ ফুটে উঠে- “মাশাল্লাহ “। বাড়ি ভর্তি লোকের কলরবে কেউ শুনতেই পায় না তা। দুজনের চোখই দুজনায় নিবন্ধ। এমনি সময় ফটোগ্রাফার সুন্দর একটা ছবি তুলে ওদের।
মীরা বৌভাত অনুষ্ঠানে নিজের ডিজাইন করা লেহেঙ্গা পরেছে। সাথে ডায়মন্ডের গহনা। মীরা গাড়ি থেকে নেমেই নিজের বাড়ির লোকেদের সাথে দেখা করতে যায়। ভারী লেহেঙ্গা পরে কষ্ট হওয়ায় আবীর হাত ধরে নিয়ে যায় ওকে। ওদের দুজনকে একসাথে দেখে সকলেই ভীষণ খুশি হয়। মীরার বাড়ির লোকেরা ও খুশি হয় মীরাকে সুখী দেখে। মীরার মা আবেগে কেঁদে ফেলেন। মীরা ওর মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে-
: ” কাঁদছো কেন মা?”
জাহানারা কান্না জড়ানে গলায় বলে-
: “এ কান্না আনন্দের রে মা, আজআমি খুব গর্বিতরে মা, নিজেকে ভুল প্রমাণিত হতে দেখে ”
টপিক চেন্জ করতে ইরা বলে-
: “আহ মা কি শুরু করলা আজকের দিনে?
আবীর পাশ থেকে বলে-
: “খালাম্মা নূহা…”
পাশ থেকে মীরা তাকায় ওর দিকে। তারপর বলে-
: “আগামীকাল কেবল আমি ফিরে যাবো ঢাকা, আপনি পরশুদিন বিদেশ থেকে বাই এয়ারে ঢাকায় আসবেন”
: “হ্যা এই ভালো হবে, আন্টির বুদ্ধিটা ফার্স ক্লাস হয়েছে”
ফিওনা, এসে মীরাকে স্টেজে তুলে। স্টেজে গিয়ে চমকে যায় মীরা। ওর সামনের দুটো টি-টেবিলে জুড়ে অনেকগুলো ডালা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ফল, কেক, পোলাও কোরমা এমনকি আস্ত খাসিও সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। মীরা ভীষণ অবাক হয়ে যায় তাদের এমন কান্ড দেখে। সেখানে গিয়ে দেখে কেকের মধ্যে লিখে রাখা ” আদরের বউ”। মীরার নিজেকে সত্যি অনেক ভাগ্যবতী মনে হয় এমন আমুদে একটা পরিবারের একজন হতে পেরে। আবীর নিজেও কম ভাগ্যবান না মীরাকে পেয়ে। যতটুকু জানা ছিলো তার উপর বাড়তি পাওনা যোগ হয়েছে মীরার বেয়াড়াপনা৷ এসব ভেবে মুচকি হাসে ও। অনুষ্ঠান শেষ হলে লেহেঙ্গা বদলে এসে সদলবলে ডালাতে হানা দেয় মীরা। গান, গল্প, আড্ডায় অনেক রাত অবধি দুই পরিবারের সকলে মিলে আনন্দ করে। অবশেষে সুন্দর ভাবে বৌভাত অনুষ্ঠান শেষ হয় ওদের। বোনকে খুশি দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে ইরা। মুরসালিন ওকে ধমক দিয়ে বলে-
” বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন তুমি?”
চলবে…..
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বসে আছে নুহা। গতকাল বাসায় এসেই ওর মা বলেছে আগামীকাল সকাল সাড়ে নয়টায় ওর বাবা আসছে দেশে । প্রথম বার বাবাকে দেখতে পাওয়ার উত্তেজনায় বেচারী রাতে ঘুমিয়েছে দেরী করে, বাবার জন্য কার্ড তৈরি করেছে সে, কিছুদিন আগে ভর্তি হওয়া ক্রাফট স্কুলে যেসব পাখি, প্রজাপতি তৈরী করা শিখেছে ও এ কয়েকদিনের মধ্যে তা দিয়েই কার্ড তৈরি করেছে নুহা। সাথে একটা পুরাতন ড্রইং ও লুকিয়ে ভরে রেখেছে খামে। যদিও আঁকা এই ছবিটাও রাখবে কিনা তা মা’কে জিজ্ঞেস করায় মা নিষেধ করেছিলো এটাকে খামে রাখতে। কিন্তু এটা বাবাকে দেখাতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওর।
রাতে মীরাও ঘুমিয়েছে দেরী করে। নূহা কি পরে যাবে, তা খুঁজে ঠিকঠাক করে রাখতে গিয়ে। নুহার কার্ড তৈরীতেও সময় লেগেছে অনেকটা। বাবাকে দেখার
খুশিতে সকালেও উঠে পরেছে মীরারও আগে। পাছে ভয় মা-না ওকে রেখেই বাবাকে আনতে চলে যায়।
ঘুম থেকে উঠে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, খাম টাকে চেক করে ও। তারপর যায় মাজেদা খালার ঘরে। ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। সেখান থেকে সকালের খাবার খেয়ে জামাকাপড় পরা শুরু করে ও। জামা পরে মেচিং ব্রেসলেট খুঁজতে ড্রেসিংটেবিল হাতানোর সময় খুটুরখাটুর শব্দে ঘুম ভাঙে মীরার। কম্বল থেকে মাথা বের করে শব্দের উৎস্য খুঁজে সে। চেয়ে দেখে ড্রেসিং টেবিলের উপর উঠে চুরির সেলফ থেকে ব্রেসলেট নেয়ার চেষ্টা করছে নূহা । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সময় তখন আটটা। মীরা উঠে নিঃশব্দে মেয়ের পিছনে গিয়ে নূহাকে উঁচু করে ধরে। চকিতে ভয় পেলেও মা’কে দেখে ধরা পারার হাসি হেসে দেয় ও। মীরাও অবাক হয়ে হেসে বলে-
: “আমাকে রেখেই চলে যাচ্ছিলে তুমি?”
: ” না মা, আমার তৈরি হতে তো অনেক সময় লেগে যায়, তাই আগে থেকে শুরু করলাম”
মীরা তখন নিজে তৈরি হওয়া রেখে মেয়েকে তৈরি করে দিলো। শীত হওয়ায় ফুল স্লিভের উলের টপ পরেছে ও, তার উপর স্লিভলেস ফ্লোরাল ড্রেস। রাতেই এসব ঠিক করে রেখেছিলো ও, তাই কোন গোলমাল হয় নি একা পরার পরও।
নুহার হালকা কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে ও। গলায় বেধে দিয়েছে ম্যাচিং রঙের কিউট একটা মাফলার। মাথায় লাল টুকটুকে “নিউজবয়” স্টাইলের হ্যাট। নূহাকে এক্কেবারে পরীর মতো লাগছে। পাছে না দেরি হয়ে যায় তাই তারাহুরো করে নূহা বললো-
: “মা মোজা, জুতা আমি পরে নিচ্ছি, তুমি জলদি তৈরী হও তো, সাড়ে আটটা বাজে, সময় কিন্তু বেশী নাই”
মেয়ের ব্যাস্ততা দেখে মীরা হেসে ফেলে, তাপর মুখ গম্ভীর করে ওর গাল টেনে বলে-
: “বাবাকে পেলে ভুলে যাবে আমাকে?”
নূহা কেমন দমে যায় মায়ের কথা শুনে, উত্তর খুঁজেপেতে খোঁজ চালায় শব্দের ডেরায়, কিন্তু কোন উত্তরই খুঁজে পায় না ও। মেয়েকে এমন চিন্তায় নাকাল হতে দেখে হেসে দেয় মীরা, তারপর বলে-
: “আমি রেডিই, শুধু শাড়ি পরবো, বেশী সময় লাগবে না। তুমি কি কি নিবে তা তোমার ব্যাগে ঢুকাও, আমার জাস্ট দশ মিনিট লাগবে।
সত্যি দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হলো মীরা। জামদানী শাড়ির সাথে রঙের মিল করে শাল নিয়েছে একটা, সাজ বলতে কেবল গাঢ় লিপস্টিক পরেছে ঠোঁটে।
বেরুবার আগে মাজেদা খালাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায় মীরা। বাড়িতে কেবল তিনিই রেয়েছেন। মা, ইরা, মুরসালিন ওরা গত রাতেই ওদের নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছে, পাছে বাবা-মেয়ের রসায়নে কোন অস্বস্তির তৈরী না হয়।
সকাল সকাল রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো, মীরা ড্রাইভারকে বলে গাড়িটাকে শাহবাগ হয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার কথা মতো সেখানে যায়। কয়েকটা টিউলিপ দিয়ে ছোট্ট দেখে একটা বুকে তৈরি করে দিতে বলে মীরা দেকানিকে। ছোট নেয়ার কারন হচ্ছে নূহার ধরতে সুবিধা হয় যেন।
সেটাকে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে ওরা। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো সরকারি বন্ধ থাকায়৷ গাড়িতে বসে ম্যাসেজে কথা হয় আবীর মীরার। আবীর খুব নার্ভাস নূহার ব্যাপারে। বোর্ড পরীক্ষার সময়কার মতো অস্থিরতা মনের মধ্যে তা জানায় আবীর। মীরা হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে- এত নার্ভাস ফিল করার কি আছে বলুন? উত্তরে আবীর বলে-
: ” বাচ্চাদের মন খুব সেনসেটিভ ”
সাহস আর ভরসা দিয়ে বলে –
: “আরেহ্ কিচ্ছু হবে না, টেক ইট ইজি”
অবশেষে এয়ারপোর্টে পৌছালো ওরা। ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট নূহা। আসেপাশের সকলেই ঘুরঘুর করে দেখছে ওদেরকে। মা মেয়ে দুজনই এত সুন্দর যে খুব মুডি মানুষটাও এক পলক দেখার ইচ্ছে দমন করতে পারছে না। কেউকেউ তো ওর ক্যাপ ধরে, আদর করছে, সেখানকার একজন মহিলা পুলিশ নূহাকে আদর করে কোলে তোলে। এতক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িফ থাকা পুলিশগুলোও ওর কাছাকাছি এসে আদর করলো ওকে। নাম জিজ্ঞাসা করলো ওর। আধোআধো বুলিতে আহ্লাদী কন্ঠে নূহা ওর নাম বললো। কাকে নিতে এসেছো এ প্রশ্নের উত্তরে নূহা বলে-
: “আমার বাবাকে..”
মীরা তাদের আরো কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে নুহাকে বললো-
: “নূহা তোমার বাবা এসে গেছেন ”
কর্মরত পুলিশের একজন ওদেরকে ভিতরে যাওয়ার সুযোগ করে দিলো।
মীরা ধন্যবাদ দিয়ে ভিতরে গেলো। ভিতরে ঢুকার ব্যাপারে ইদানীং রেস্ট্রিকশন জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। সে হিসেবে ওরা ব্লেসিং।
ভিতরে ঢুকে নূহা এটা সেটা প্রশ্ন করছে ওর মাকে। কোথায় বাবা? কখন আসবে? কোন দিক দিয়ে আসবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। মীরা ধৈর্য ধরে ওর উত্তর দেয়, আবীর টেক্সট করেছে যে- ও অন দা ওয়ে।
ডমেস্টিক ফ্লাইটে যেহেতু কোন চেকিং হয় না, ওর বেশী সময় লাগবে না। এক্সিট গামী লোকেদের ভিড়ে দূর থেকে মীরা আবীরের বিখ্যাত হাইট দেখেই সকলের মাঝে আলদা করে ফেলে আবীরকে। মীরা নূহার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলে –
: “ঐ যে ”
ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে এলো হাস্যজ্জ্বল আবীর। নূহার সব এক্সাইটমেন্ট যেন উবে গেলো হঠাৎই। ফুলের ছোট্ট বুকেটা মায়ের কাছে রেখেই মায়ের পেছনে লুকালো যেন ও। মীরা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পেছন থেকে সামনে আনতে চেষ্টা করলো নূহাকে। আবীর ইশারায় থামতে বললো মীরাকে। মীরা বলতে শুরু করলো গত রাত থেকে সকাল পর্যন্ত নূহার সব কর্মকাণ্ডের কথা। এরি মধ্যে নূহা মীরার শাড়ির আঁচলে ফাঁক দিয়ে চেয়ে দেখে আবীরকে। চোখে চোখ পরে যেতেই আবার পেছনে চলে যায়।
“কি জানি বেখাপ্পা লাগে হয়তো ওর বাবা হিসেবে আবীরকে। ওদের কাছেপিঠে সকলেই ফর্সা, এমনকি মাজেদা খালারও গায়ের বরন দুধ আলতা” এমনটাই ভাবে আবীর।
মীরা ডাকলো নূহাকে, বললো-
: “ফুল আর কার্ড যে আনলে বাবার জন্য দিবে না?
পেছনে দাঁড়িয়েই নিজের ব্যাগ খুলে কার্ড বের করে নূহা এগিয়ে দেয় আবীরের দিকে। আবীর কার্ড না ধরে হাত ধরে নূহার। বলে-
: “নূহা, মা আমার…..”
ওর মুখের কথা শুনে আবীরের দিকে তাকায় নূহা। পকেট থেকে চকলেট আর একটা গোলাপ বের করে নূহার হাতে দেয় আবীর। বাবা-মেয়ের প্রথম চোখাচোখি হয় তখনি। আবীরকে দেখেই চোখ নামিয়ে নেয় নূহা, লজ্জা পেয়েছে এমন ভাব ওর চোখ-মুখে। হাঁটু গেঁড়ে মেয়ের সমান সমান হয় আবীর। তারপর চুলগুলোতে হাত দিয়ে বলে-
: “মাশাল্লাহ, আমার মা তো ছবির চাইতেও অনেক বেশী সুন্দর ”
কথটা শুনে মায়ের দিকে তাকায় নূহা। যেন আবীরের কথার সত্যতা যাচাই করতেই ওর তাকানো। স্মিত
হেসে সম্মতি মীরা , যে সত্যি ও অনেক সুন্দর।
আবীর তখন নূহাকে প্রশ্নের সুরে বলে-
: “এত সুন্দর জামা কোত্থেকে এনেছো তুমি? ”
এতক্ষণে একটু যেন সহজ হলো নূহা, বললো-
: “এটা মা ইন্ডিয়া থেকে এনেছিলো”
আর এই ক্যাপটা?
: “আমেরিকায় আমার এক আন্টি আছে ফিওনা নাম, তিনি দিয়েছেন এটা আমাকে”
ক্যাপটা যে ফিওনা দিয়েছে তা আবীর জানতো না, সহজ হওয়ায় নূহাকে কোলে তুলে নিলো আবীর। সহজ ভাবেই আবীরের কোলে উঠলো নূহা। এয়ারপোর্টের ভিতর বাহিরে সকলে চেয়ে দেখছে ওদের। সকলেই হয়তো ভাবছে “এদের মাঝে কালো লোকটা বড্ড বেমানান” এমনটাই ভাবে আবীর। গাড়িতে বসে আবারো সংকুচিত হয়ে যায় নূহা। আবীর কার্ড খুলে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে। নূহা একসময় ওর মায়ের কানে কানে কি একটা বলে। আবীর হেসে মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি বললো ও? ”
মীরা হেসে বলে-
” ও জিজ্ঞেস করলো – ও কি সত্যি আমার বাবা?”
আবীর হেসে ওর কাছে আসে, তারপর বলে-
: “সত্যি আমি তোমার বাবা, দেখো না আমাদের কত মিল? এই যে তোমার ঠোঁটের কাছে তিল, এই দেখো আমারো। আর হ্যা আরো একটা মিল রয়েছে আমাদের, বলেই নূহার সামনে হাত মেলে ধরে আবীর বলে- আমার হাতের আঙ্গুল এগারোটা, তোমারও হাতের আঙ্গুল এগারোটা দেখো, বলেই দুটো হাত পাশাপাশি রাখে আবীর।
মীরার ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠে আবীরের এ কথাটা শুনে। হঠাৎ মীরার মনে পরে কুৎসিত এক অতীতের কথা। এই কথা, হ্যা ঠিক এই উধাহরণটা দেখিয়েই রাজিব নোংরা কিছু কথা বলেছিলো মীরাকে। চোখ উপচে পানি আসে মীরার। তৎক্ষনাৎ মীরা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চেখের পানি লুকায় ওদের থেকে। চোখের পানি মুছে মীরা যখন ওদের দিকে দেখে নূহা তখন আবীরের হাতে হাত রেখে আরো কিছু মিল খুঁজে।
একটু পরে দেখা যায় নূহা কুটুর কুটুর করে আবীরকে বলছে কার্ডের বিবরণ। একটু পরে আবীর বের করে খামের ভিতরে ভাজ করা কাগজের টুকরোটা। সেটা দেখে চোখ সরু হয় মীরার। হঠাৎই সব ভুলে মীরা নূহাকে নলে-
: ” এটা আনতে নিষেধ করেছিলাম না?”
অপরাধী ভঙ্গিতে হাসে নূহা। তখন নূহাকে কোলে টেনে নেয় আবীর। যেন শত্রুর সীমানা থেকে বাঁচিয়ে নিলো সে নূহাকে এমনি ভাব তার চোখে-মুখে। আবীর আর মীরা পাশাপাশি এখন। নূহার দিকে চেয়ে আবীর ছবিটা বুঝিয়ে দিতে বলে ওকে। নূহা লাজুক ভঙ্গিতে তাকায় মায়ের দিকে। যেন মা ওর শত্রুপক্ষের কেউ। আবীর ভরসার সুরে বলে-
: “আরেহ আমি আছি তো, ভয় পাচ্ছো কেন তুমি, কথাটা বলেই সামান্য পাশ ফিরে ছবিটাকে আড়াল করলো আবীর মীরার থেকে। তারপর নূহার থেকে বুঝে নিলো পুরো ছবির বিবরন।
” নূহা কয়েকটা বৃত্ত আর সরলরেখা দিয়ে চারজন মানুষের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলেছে ছবিটায়। ছবিতে দুটো মাথায় রশির মতো কিছু ঝুলছে বলে বোঝা যাচ্ছে ঐ দুটো মেয়ে। একটা আকাড়ে বড় আরেকটা আকাড়ে ছোট। আর বাকী দুটো বৃত্তর মাথায় এক রত্তিও চুল দেয় নি নূহা। তবে বড় ছেলেটার নাকের নিচে একটা টান দিয়েছে উল্টো ভি শেপের মতো। আবীর বুঝলো এটা বাবার মোছ, মীরার দিকে পাশ ফিরে আবীর বললো-
: “এবার আমার মোছ রাখা লাগবে বুঝলা”
ছবি দিয়ে নূহা ওর অর্ধেক চেহারা ঢেকে হাসতে থাকে। তারপর আবীর আরেকটা চুল, মোছহীন ছবিটার দিকে তর্জনী রেখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে-
: ” এটা কে?। নুহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে-
: “এটা আমার ছোট ভাই, দেখো না ও আমার চেয়েও ছোট” দুটো ছবির আকাড় মিলায় আবীর, সত্যি এটা নূহার ছবির চেয়ে একটু ছোট। খুব সুন্দর হয়েছে বলে ছবিটা ভাজ করে পকেটে নেয় আবীর। তারপর আবীরকে নূহা ওর বন্ধুদের গল্প বলতে শুরু করে। মনোযোগী শ্রোতার মতো অখন্ড মনোযোগে শুনে তা আবীর৷ একটু পর পর নূহার মুখের সামনে চলে আসা চুল গুলো সরিয়ে দেয় যত্ন করে।
নিশ্চুপ মীরা কেবলি চেয়ে দেখে ওদের বাবা-মেয়ের কথোপকথন। এই গাড়িতে বসে যত কথা নূহা আবীরকে বলেছে, কিংবা যতটা শুনেছে আবীর নূহাকে, তার শত ভাগের এক ভাগও রাজিব মনোযোগ দেয়নি ওর জন্মের সন্তানকে। নিজের জন্য স্বামী খোঁজে নি মীরা, সন্তানের জন্য বাবা খুঁজেছে। এবং ও তা পেয়েছে……
মনের ভিতর থেকে অনেক বড় ভার নামে মীরার। নিজের হালকা লাগে ভীষণ, যেন গাড়িটার ছাদ না থাকলে ও উড়েই যেতো মীরা।
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
আবীরদের বসার ঘরে ধপ করে বসে পরে মীরা। ব্যাপারটা যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না ও। আবীর এমনটা করতে পারলো?
হুট করেই চোখ উপচে নোনা পানির স্রোত গড়িয়ে পরলো দুই গাল বেয়ে। মীরা তখনো যেন সবটা বুঝতে উঠতে পারে নি। আবীর চলে যাওয়ার জটিল অংকে ব্যাস্ত ওর ব্রেইন জেনে গেছে আবীর নেই, এখন কাঁদা উচিত, তাইতো চোখ পূর্ণ নোনা জলে, অথচ মীরার চেহারায় কান্নার কোন লক্ষণ নেই, নিপাট সরল চিন্তামগ্ন মুখ। মন আর মাথার সংযোগ ঘটাতে ব্যার্থ মীরা তখনো হিসাব আবীর নামের জটিল অংকের হিসাব মেলাতে ব্যাস্ত।
কিছু সময় এমনি কাটার পর হঠাৎ-ই দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে মীরা। এতক্ষণে মন-মাথা দু’টোই বুঝলো চলে গেছে আবীর। ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আবীর পারলো ওর সাথে এমনটা করতে? আপনজন না ভাবুক, না দিক ওর জীবণে ঠাঁই, পরিচিত হিসেবেও তো ও জানতে পারতো ওর ঢাকা ছাড়ার খবরটা। এত কঠিন আবীরের হৃদয়, এত ঘৃণা ওর মীরার প্রতি, যে একটাবার জানানোটা ও প্রয়োজন মনে করলো না।
এমন সময় সোবহান চাচা চা নিয়ে ঘরে ঢুকে। তার ডাকে হুঁশ ফিরে যেন ওর। মীরাকে চা দিলে ঘড়িতে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় মীরা। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কি একটা করতে করতে, পিছন থেকে ডাকলে মীরা উত্তর দেয় – চা খাওয়ার সময় নেই চাচা, আজ আসি। বলেই দ্রুত বেরিয়ে পরে ওদের বাড়ি থেকে।
চওড়া গলির পথ টুকু পেরিয়ে মেইন রোডে অপেক্ষা করে “পাঠাও” এর কল করা গাড়ির অপেক্ষায়। মিনিট তিনেকের মধ্যে গাড়ি এসে হাজির হয় মেইন রোড সংলগ্ন ইস্টার্ন ক্লাব মাঠের সামনে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠে মীরা নক করে ফিওনাকে৷ মীরা আর ফিওনার দুই দেশের সময়ের পার্থক্য এগারো ঘন্টা। এখন স্থানীয় সময় এগারোটা পয়তাল্লিশ, তারমানে এখনো ঘুমিয়ে পরেনি ফিওনা, ওকে পাওয়া যাবে ফোন করলে। সাত-পাঁচ না ভেবে ফিওনাকে কল করে মীরা। ফোনটা বেজে কেটে যাচ্ছে, কেও রিসিভ করছে না।
ওকে কয়েকবার চেষ্টা করে না পেয়ে একটা টেক্সট করে মীরা। “call me, It’s urgent ” খুব সম্ভবত ফোনটা সাইলেন্ট। নতুন বাচ্চাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়তো, কিংবা ঘুমিয়ে পরেছে।
ফিওনাকে ম্যাসেজ করে নভোএয়ারের ওয়েবসাইট ভিজিট করে মীরা। ঢাকা-চট্টগ্রামের একটা টিকিট বুক করে ও গাড়িতে বসেই। ইদানীং জরুরি কাজে বাই এয়ারে হুটহাট করে ঢাকার বাইরে যাতায়াতে করতে হয়েছে মীরাকে। তাই টিকিট বুক করতে সময় লাগলো না ওর। ওয়েবসাইটে দেখাচ্ছে ডিপার্চার টাইম দুপুর একটা। এখন সময় এগারোটা পঞ্চান্ন। তারমানে ডমেস্টিক ঐ ফ্লাইট ধরতে সাড়ে বারোটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে মীরাকে। এত অল্প সময়ে যেতে পারবে ও?
এত খারাপের মধ্যে আশার খবর হচ্ছে আজ শুক্রবার। রাস্তায় আজ গাড়ির চাপ কম থাকবে। পথের দূরত্বের বিপরীতে সময় খুবই নগন্য। তবুও মনের মধ্যে কেন উচাটন, কোন চাঞ্চল্য নেই, মীরার৷ গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ধীর স্থির ভাবে বসে আছে ও। দেখলে মনে হবে ঘুমিয়ে আছে । কিন্তু চোখ বেয়ে পরছে নিরব কান্নার স্রোত। মনে একটাই জিদ ওর এত কিসের দেমাগ তার? এত কেন সাহস মীরাকে উপেক্ষা করবার৷
এরমধ্যে মীরা আবার ট্রাই করে ফিওনাকে। এবারও সেইম রিং হচ্ছে কেউ রিসিভ করছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা কল করে আবীরের বন্ধু টুটুলকে। আবীরের ব্যবসা থাকা কালীন দীর্ঘ সময় একসাথে কাজ করেছে টুটুল আবীরের সাথে। এবার অসুস্থ থাকাকালীন সময়েও টুটুল হসপিটালে এসে দেখে গেছে আবীরকে। আবীরের বন্ধু হওয়ার সুবাদে মীরাকে আগেই চিনতো টুটুল তবে হসপিটালেই ওদের প্রথম আলাপ হয়।
টুটুল আবীর ব্যবসায়ী হলেও ওরা ফ্যামেলি ফ্রেন্ডের মতো। তাই টুটুল ওদের দুজনের আদ্যোপান্ত সবটাই জানে। ও নিজেও চায় সব ভুলে আবীর, মীরা এক হোক আবার। ওদের এড্রেস চাইতে ফোন করে টুটুলকে সবটা খুলে বলতে হয় না মীরাকে। ও আবীরের গ্রামের বাড়ির এড্রেস চাওয়ায় কোন বাক্য ব্যয় না করে সেটা টেক্সট করে দেয় মীরাকে। টেক্সট পাঠিয়ে কল ব্যাক করে টুটুল নিজ থেকেই বলে-
: আসলে কি বলবো বলুন, আবীর ছেলেটা বরাবরই বর্ণচোরা। বুক ফেটে মরে যাবে তবুও মুখ ফুটবে না ওর। আমি জানি ও আপনাকে না বলেই বাড়ি চলে গেছে, সত্যি বলতে ও নিজেকে বোঝা মনে করছে আপনার জীবণে। কিন্তু আপনাকে যে ও এখনো ভালোবাসে সেটা না বললেও আমি টের পাই। তাইতো ওকে অনেক বুঝিয়েছি আমি, কিন্তু যতই বোঝাই ওর এক কথা- “মীরা আরো বেটার কাওকে ডিজার্ভ করে’ আপনি শক্ত করে ধরেন ওকে। জানি ও বাইরে থেকে দূর্ভেদ্য, কিন্তু সেটা ভেদ করতে পারলে দেখবেন ও কত কোমল, কত শুদ্ধ একটা মানুষ। নিজের বন্ধু বলে বলছি না, ও সত্যি চমৎকার একজন মানুষ।
উত্তরে মীরা চুপ ছিলো পুরোটা সময়। কথা শেষ করে টুটুল ফোন রেখে দিলে রাস্তায় নজর দেয় মীরা। টুটুলের কথা শুনে আরো রাগ হয় মীরার আবীরের প্রতি। ভালোই যখন বাসিস তবে কেন ছুটে পালানো?
বদের হাড্ডি একটা।
গাড়ি এখন মধ্য বাড্ডায় রয়েছে। আনমনে পথের দিতে তাকিয়ে থাকে মীরা। আবীরকে পাওয়াটা এত কেন কঠিন হয়ে যাচ্ছে? কেন এক পা এগুলো আবীর দশ পা পিছিয়ে যাচ্ছে?
এমন সময় সিগন্যালে আটকে পরে ওদের গড়িটা। ফোন বের করে গুগল ম্যাপ চেক করে মীরা, নাহ্ শুক্রবারের দুপুর হওয়ায় জ্যাম নেই কোথাও, রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই বকা চলে। এ সিগন্যাল ছাড়া গাড়ি রানিং রয়েছে পুরোটা সময় কোথাও কোন সিগন্যাল এ থামতে হয় নি। ফোনের ঘড়ি বলছে সময় এখন বারোটা বিশ।
মীরার মনে চাপা উচাটন, শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পারবে তো? মনে মনে ঠিক করে ও, যদি একটার ওই ফ্লাইট মিস করে মীরা। তাহলে আর কখনোই সামনা সামনি হবে না ও আবীরের।
এমনি একেকটা অভিমানী মেঘ এসে ভীড় করে মীরার মনের আকাশে। এরপর সময় কাটতে লাগলো সময়ের মতো করে…..
———————————–
এদিকে বাড়ির বাগানে আড্ডায় সকলের সাথে বসে আছে আবীর। বাড়ি ভর্তি কাজিনেরা সকলে মিলে ওর বড় চাচার ছোট ছেলে আহনাফের ব্যাচলর পার্টি করছে। পাশেই বড়রা বিকেলের চায়ের আড্ডায় মেতেছে। সন্ধ্যায় বারবিকিউ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ছেলেরা। একদল মেয়েরা ক্রাফট দিয়ে সাজাচ্ছে একপাশে। আরেক দল টেবিলে ফুড ডেকোরেশন করছে। কেউ লাইট লাগাচ্ছে তো কেউ সাউন্ড বক্সে সাউন্ড চেক করছে। সকলেই ব্যাস্ত কোন না কোন কাজে। এদের বেশীরভাগই দেশের বাহিরে থাকে। কেউ পড়াশোনা করে, কেউবা নিজের পরিবার নিয়ে সেখানে স্যাটেল। এদের একসাথে পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পাওয়া। সকলের চোখেমুখে খুশি উপচে পরছে যেন।
বড় চাচার ছোট ছেলের বিয়ের উপলক্ষে সকলে এলেও ফিওনা আসতে পারছে না। নতুন শহর, নতুন বাচ্চা সব মিলিয়ে ও অনুপস্থিত এখানে। চা খাওয়া শেষে বড়রা ভিতরে চলে গেলো। শীতের দিনে বেলা ছোট হওয়ায় দিনের আলো নিভু নিভু। মাগরিবের আজান পরলো বলে। এত কাজের মধ্যে লম্বু আবীরকে দেখা যাচ্ছে স্টেজে ব্যানরা আটকাতে। বাড়ি থেকে বিদুৎতের লাইন টানার কাজ করছে সায়মন। এমন সময় দুম করে বাড়ির সব আলো নিভে যায়।
ব্যানার রেখে আবির সায়মনকে রাগাতে থাকে। সন্ধ্যা হলো বলে, তবুও এখনো বাইরে কোন আলোর ব্যাবস্থা তো হলোই না উল্টো পুরো বাড়ির লাইন কেটে বসে আছে সে। সায়মন সহ অনেকেই চেষ্টা করছে, তবে সমস্যা কোথায় তা ধরতে পারছে না কেউ। কামাড়ের কাজ কি কুমোরকে দিয়ে হয়? বড় চাচী বাড়ির কাজের ছেলেকে পাঠিয়েছে মিস্ত্রির খোঁজে।
একটু পরে সন্ধ্যা নেমে এলো পাহাড়ের ঢালু বেয়ে। পাহাড়ি ঢালে গাছগাছালির ঘেরা আবীরদের দাদার বাড়িটা ওর দাদা এমন জায়গায় তৈরি করেছে যে দূর থেকে সূর্যাস্ত দেখে মনে হয় সূর্য ওদের বাড়ির পেছনে লুকালো যেন। পুরে বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় হুট করে চারপাশ যেন পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেলো । সাথে সাথে মাগরিবের আজান পরলো চারপাশে। অন্ধকারের মধ্যেই বড়রা নামাজে গেলো। বাইরে তখন ল্যাম্প দিয়ে কাজ চলছে।
আবীরও ওদের সাথে চেষ্টা করছে লাইন মেরামতের। এমন সময় আবীরকে ডাকতে আসে বাড়ির কাজের ছেলে বিপুল। ও বললো – কে নাকি এসেছে আবীরের খোঁজে। বিপুলের কথায় অবাক হয় আবীর। ওকে আবার খুঁজবে কে?
উঠে দাঁড়িয়ে বিপুলের পিছু যায় আবীর। আবীরকে পথ দেখিয়ে ভিতরের বাড়িতে যায় বিপুল। অন্ধকারে দূর থেকে গাছের নিচে একটা একটা অবয়ব চোখে পরে আবীরের। চারদিকে অন্ধকার, তবুও গাছের নিচে দন্ডয়মান সেই নারী মূর্তি দেখে অবাক হলো ও। এ অবয়ব, দন্ডয়মান নারী মূর্তিকে অন্ধকারে ও ঠিক চিনতে পারলো আবীর। ঠিক তখনই ওর হৃদপিণ্ড যেন খামচে ধরলো কেউ। হাঁটার গতি ধীর হয়ে গেলো। সেই নারী মূর্তি ওর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কি ভেবে যেন আশেপাশে দেখলো আবীর। নাহ্ বড়রা কেউ নেই এখানে। কাছাকাছি পৌঁছে আবীরই প্রথম প্রশ্ন করে তাকে-
: “তুমি এখানে!?”
আলো থাকলে হয়তে আবীর দেখতো ওর সামনে দাঁড়ানো অগ্নিমূর্তিকে, তখন হয়তো নিপাট এই প্রশ্ন করা কঠিন হতো ওর। সেদিক বিবেচনায় অন্ধকারটা বেশ উপকার-ই করলো আবীরের।
অস্ফুটে সেই দন্ডয়মান মুর্তিটি বললো-
: ” একটু বাইরে আসবেন? দুটো কথা সামনাসামনি বলতে আমি এতদূর এসেছি, কথা দুটো বলেই চলে যাবো?”
: “বাইরে কেন? ভেতরে আসো?”
: “নাহ্, থাক ভিতরে যাবো না আমি। আচ্ছা আপনাকে বাইরে যেতে হবে না, অনেক কষ্ট করলেন আপনি আমার জন্য আর আপনাকে কষ্ট দিবো না”
: “এভাবে কথা বলছো কেন তুমি?”
: “কিভাবে কথা বলবো আমি?
আবীর ঠান্ডা গলায় বললো –
: ” তুমি অনেক ক্লান্ত, চলো ভিতরে বসে কথা বলি ”
: “নাহ্, আমি এখানেই ঠিক আছি। এখন আপনি আমাকে বলেন – ” কেনো আমাকে না বলে এখানে চলে এসেছেন আপনি? অন্য সব কিছু বাদ পরিচিত হিসেবেও কি আমি জানতে পারি না আপনার ঢাকা ছাড়ার খবরটা?
: “দম্ভ নয়তো কি? আপনার এত অপমান, অবজ্ঞা, সহ্য করেও আমি আপনার দিকে এক পা এগুচ্ছি, তো আপনি দশ পা পিছিয়ে যাচ্ছেন, কেন?
কেন আপনি বার বার একই কথা বলেন-
“you deserve better”?
“you deserve better”?
এর উত্তরে মৌণ থাকে আবীর, কি বলবে বুঝতে পারে না । আবীরকে চুপ করে থাকতে দেখে মীরা কঠিন গলায় বলে-
: “আমি কি তাহলে ধরে নিবো আমি আপনার যোগ্য না, কিংবা আপনি আপনার মনের এক্সেস অন্য কাওকে দিয়ে রেখেছেন? ”
ম্লান হাসি হেসে আবীর বলে-
: “এরকম কিছুই না”
আবীরের হাসির শব্দে এবার যেন ধৈর্যচ্যুত হয় মীরা। ওর কাছে এসে কঠিন গলায় বলে-
: ” তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়? কেন আপনি বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? বলুন, কি সমস্যা আপনার, আমি না হয় একবার ভুল করেছিলাম, তার শাস্তিও যথেষ্ট হয়েছে।
অন্যত্র তাকিয়ে চুপ করে থাকে মরা। তারপর আবার আবীরের চোখে চোখ রেখে আগেরচেয়ে ও কঠিন গলায় বলে- “নাকি আমি বিবাহিত, এক বাচ্চার মা বলে আপনার আমাকে একসেপ্ট করতে…….
কথাটা শেষ করতে দেয় না আবীর মীরাকে। হাত দিয়ে মীরার মুখ চেপে ধরে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে-
: ” আমি যাকে ভালোবাসি তার ভালো মন্দ সবটা নিয়ে ভালোবাসি, তোমার মিনিং ফুল লাইফে আমার নামে একটা মিনিংলেস চ্যাপ্টার থাকুক তা আমি চাই না”
কথাটা বলেই মুখ থেকে হাত সরিয়ে দূরে সরে যায় আবীর। যেন ভুল করে অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে পরেছিলো ও। বুঝতে পেরেই নিরাপদে সরে গেলো।
থুম ধরে মীরা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আবীর এভাবে ওর মুখ চেপে ধরবে কল্পনা করে নি ও। কেন জানি মীরার রাগ হঠাৎ-ই পানি হয়ে গেলো। তারপর মৌণতা ভেঙে আহত কন্ঠে মীরা বললো-
: ” আপনি এমন কেন ভাবছেন? আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেই পথটা আপনার দেখানো। বিশ্বাস করুন
আপনাকে যদি আমার জীবণে পাই আমি আপনিই হবেন আমার লাইফের সবচেয়ে মিনিংফুল চ্যাপ্টার। আমার জীবণে অর্থ, ক্ষমতা, সম্মান সব আছে কিন্তু শান্তি নেই। জীবণে আপনার চেয়ে বেটার কাওকে হয়তো পাবো আমি, কিন্তু অন্ধকারে আমাকে না দেখেও যে আমার ক্লান্তি টের পায় তার মতো শান্তি এই দুনিয়ার কেউ আমাকে দিতে পারবে না”
চলবে……
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
বিয়ে বাড়ির ব্যাস্ততায় মুখর চারপাশ। সকলেই এই সেই নানান কাজে ব্যাস্ত। এদিকে মীরা ঢাকা ফিরে গেছে, মাঝখানে ঝড়ের গতিতে কত কিছু হয়ে গেলো তবুও আবীর যেন ঘোরের মধ্যেই রয়েছে এখনো। বিয়ের আয়োজন, কোলাহল, ব্যাস্ততা আবীর কে যেন ঐ অন্ধকার সন্ধ্যার কথোপকথনের ঘোর থেকে বের করতে পারছে না। সে কথোপকথন এ বুদ থাকতেই যেন ভালো লাগছে ওর।
একটু আগে বড় চাচী এসে তৈরী হওয়ার তাগাদা দিয়ে গেছে সকলকে। বৌ আনতে ঢাকায় যেতে হবে, বিয়ে পড়ানো হলে তাকে আবার বাড়িতে আনতে হবে। এতখানি পথ যাওয়া আসা, চাট্টিখানি কথা!
আবীরের উদাস ভাব দেখে মনে হচ্ছে ও না গিয়ে পারলে যেতো না। এমনিই চিন্তার নদীতে ডুবে থাকতো মীরাকে নিয়ে।
আবীরের অনাড়ম্বর জীবনে সারপ্রাইজ রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা। ঐদিন মীরার আবীরকে খুঁজতে খুঁজতে চিটাগং চলে আসাটা ওর জীবণের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ ছিলো। যদিও পূর্বতন বড় সারপ্রাইজটাও মীরাই দিয়েছিলো ওকে, বিয়ের পরদিন ওর দেয়া আংটি বিক্রি করে সে টাকা দিয়ে অন্য কাওকে বিয়ে করে।
আবীরের মনে কেমন যেন উচাটন আজ। ও বুঝে গেছে, যতই পালাতে চেষ্টা করুক, না বোঝার ভান ধরুক মীরা ওর জীবণ নাট্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তা না হলে যেই মেয়ে কিছু না বোঝার বয়সে বুঝেছিলো আবীরকে ত্যাগ করতে হবে, সেই মেয়ে এখন সব বুঝে, নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েও পিছু নিয়েছে ওর। এটা কি ওর দায় নাকি দয়া?
কথাটা মীরা ঢাকা ফিরে যাবার পর ওকে ফ্রেঙ্কলি জিজ্ঞেসা ও করেছিলো আবীর। উত্তরে মীরা বলেছিলো-
: ” এটা কি আপনি তা বুঝেন না? ”
আবীর ভাবলেশহীন ভাবে বলেছিলো-
: “না”
উত্তরে মীরা বলেছিলো-
: “এটা আর যাই হোক দায় কিংবা দয়া কিছুই না”
ঘড়িতে সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেছে। পিয়ালী এসে আবার তাগাদা দেয় আবীরকে, বলে-
: “কিরে ভাই, আমরা কি তোরে রেখেই রওনা দিয়ে দিবো? ”
শোয়া থেকে উঠে পরলো আবীর। যেন সত্যি ওকে রেখেই রওনা দিয়ে দিলো ওরা। তরপর বললো-
: “আরেহ দাঁড়া, আমাকে না নিলে তারা খেতে দিবে তোদের? হুহ্। ছেলেদের তৈরী হতে কি ছয় মাস নয় মাস লাগে?”
বলেই উঠে বসলো আবীর। পিয়ালী মুচকি হেসে বাড়ির চাচী-ফুফুদের খবর দিতে গেলো। তারা সকলে কি সব রিচুয়্যাল মেনে গোসল করালো বরকে। তারপর কাজিনরা সকলে মিলে শেরওয়ানি, পাগড়ি পরিয়ে তৈরি করলো বরকে। অবশেষে তৈরী হয়ে রওনা দিলো ওরা সাড়ে এগারোটার মধ্যে। গাড়ি স্মুথ ভাবে বিশাল দূরত্ব পেরিয়ে সাড়ে তিনটায় পৌঁছে গেলো কনের বাড়ি। কোন আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান না এটি, কেবল নিকট আত্মীয়দের নিয়ে সাদামাটা বিয়ে।
বিয়ে সাদামাটা হলেও গেইট ধরা, জুতা লুকানো সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলো কনে পক্ষের ছেলেপেলেরা। বর মহাশয় গেইটে কোন ঝুটঝামেলা, বার্গেনিং না করে ওদেরকে আটক করা সাঙ্গোপাঙ্গর ডিমান্ড ফুলফিল করে ভিতরে প্রবেশ করলো। কাজিনরা সকলে ফিসফাস করছে বরের হাবভাব দেখে।
মুখ পোড়া পিয়ালী বরের কানে কানে বললো-
: “এহে্ আর যে তর সহিতেছে না… তাহাদিগকে কি বলিবো বৌ-খানা আমাদিগকে জলদি বুঝাইয়া দিতে, আমরা তা হইলে তাহাকে লইয়া এইখান হইতে দ্রুত প্রস্থান করি”
বর বেচারা লাজুক মুখে রাগ দেখায় পিয়ালীকে মনে মনে বলে-
: “আহা, বেহায়াপনা বেশী হয়ে গেলো কি?”
এদিকে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়ে গেলো। বর বেচারার খাবারের দিকে মন নাই, তার মন পরে আছে কনের কাছে। কখন তাকে দেখবে।
আয়োজন ঘরোয়া হলেও কনে পক্ষ বিশাল ডালা সাজিয়ে হুলুস্থুল কান্ড করে ফেলেছে। দুপক্ষের ছেলেপেলেরা বরের সাথে খাবার খেলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে বিয়ের আসরে বসানো হয় বরকে। সুন্দর নেটের পর্দা আর ফুল দিয়ে দেয়াল করা হয়েছে বর কনের মাঝখানে। আবছা দেখা যাচ্ছে দু’পাশের সবকিছু।
একটু বাদে কনের দুই খালা নিয়ে আসে কনেকে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে মাথা তুলে কনেকে লুকিয়ে দেখে বর। কনেকে দেখে একটা ধাক্কার মতো খায় সে। মনে মনে ভাবে এমন একজনকে নিজের করে পাওয়ার জন্য শত বছর তপস্যা করা যায়৷
কনে নিজেও তাকায় বরের দিকে। মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নেয় সে। কনের খালারা তাকে বসিয়ে দেয় বরের অপর প্রান্তে।
বরের মেঝো চাচী বলেন-
: “কিরে বৌ এগুলো কোন শাড়ি পরেছে? আমরা তো এটা কিনি নি”
বর ফিসফাস করে পিয়ালীকে বলে- “এটা আমার ওকে দেয়া প্রথম উপহার ছিলো”
পীচ কালারের জমিনের উপর সোনালী সুতোর কাজ করা জামদানী গায়ে বউকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। একেবারে সাদামাটা সাজে সেজেছে সে। গলায় সিম্পল ডিজাইনের নেকলেস, কানে দুল কপালে টিকলি আর দুই হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। এ চুড়ি গুলোও বরের দেয়া প্রথম উপহার। কনেকে দেখে মুগ্ধতা সকলের চোখেমুখে। তারা নিজেরাও ভীষণ খুশি ঘরের ছেলের জন্য এমন বৌ পেয়ে।
অবশেষে কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করে।
মুসলিম আইনের চিরায়ত ধারার ন্যায় কাজী সবিস্তারে বিবাহ নামা পড়ে শুনানোর পর প্রথমে কনের পক্ষ হতে সম্মতি চান, বলেন-
: “বলুন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল”
উত্তরে কনে কাঁদতে শুরু করে, এটা ব্যাতিক্রম কিছু না। বিদায় মুহূর্তে সব কনেরাই বাবা-মার থেকে আলাদা হওয়ার কষ্টে কাঁদে, কিন্তু কনের কান্নার থামা থামি না দেখে বর বেচারা ঘাবড়ে যায়, মনে মনে ভাবে এত শক্তপোক্ত মনের মেয়েটা এমনি করে কাঁদছে কেন?”
কনের মা খালারা তাকে কবুল বলতে একপ্রকার জোরাজোরি করে। নিজের পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে হচ্ছে, তাহলে এত কান্নাকাটির কি আছে? কনের যেন কান্নার বাঁধ ভেঙেছে।
বর বেচারা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে উঠে দাঁড়ায়। বড়দের সম্মতি চেয়ে দুজনের মধ্যখানে দেয়া পর্দার দেয়াল ভেদ করে কনের কাছে যায়। দুই হাঁটুতে মাথা গুজে কান্না করা কনের কাঁধে হাত রাখে বর। মাথা তুলে হবু বরকে দেখে কান্না যেন আরো বাড়ে তার।
বর- বেচারা একটা বড়সড় ধাক্কা খায় কনেকে কাছ থেকে দেখে। বিয়ের কনে এমনও হয়? সাদামাটা সাজপোশাকের এই রমনী যেন বিশ্ব সুন্দরী, তার তুলনা কেবল সে নিজেই।
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে কনে। কনে বরকে দেখে তার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে-
: “আজকের এই দিনটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার”
এমন সময় বর মুচকি হেসে একটা তুলকালাম কান্ড করে ফেলে৷ পাশে থাকা মানুষগুলোকে অগ্রাহ্য করে কনের দুই গালে হাত রেখে তার কপালে চুমু খায়। এমন কান্ড দেখে কনে বেচারী ধাক্কা খেলো যেন। তাকে ধাতস্থ হতে সময় না দিয়ে বর তার কানে ফিসফিস করে বলে-
: “কাঁদছো কেন?”
উত্তরে কনে আবার কাঁদতে শুরু করে। কান্না জরানো কন্ঠে বলে-
: ” আপনাকে প্রথমে কিছু না বুঝেই পেয়েছিলাম, আর আজ আমি আপনাকে জয় করে নিয়েছো”
সেই খুশিতে কাঁদছি”
কনে কান্নারত অবস্থায় বরের হাত মুষ্টি বদ্ধ করে কনে জিজ্ঞেস করে –
: “এসব কি সত্যি ”
বর মুচকি হেসে বলে –
: “হ্যা সত্যি ”
মুষ্টি বদ্ধ অবস্থাতেই বর-কনের বিয়ে হয়। বিয়ে পড়ানোর পর এখন শুধু কনেকেই না কনের মাথার সাথে নিজের মাথা মিলিয়ে কাঁদতে দেখা যাচ্ছে আমাদের আজকের বিয়ের বর “আবীরকেও”
মনে মনে আবীর তখন বলছিল-
“আমি পাইলাম, অবশেষে আমি তাহাকে পাইলাম”
——————————-
ফিরে দেখা-
সেদিন মীরার কথা শেষ হলে আবীর শান্ত গলায় বলেছিলো-
: “মীরা এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। ঢাকায় ফিরে এ নিয়ে কথা বলবো আমরা, এখন তুমি ভিতরে চলো প্লিজ, বাইরে ঠান্ডা বাতাস তোমার সাথে কোন গরম কাপড়ও নেই”
কঠিন কন্ঠে মীরা তখন বললো-
: “নাহ্, কোন কিছুর দরকার নাই আমার, আপনার পিঁছু করতে করতে অনেক বেশী বেহায়াপনা দেখিয়ে ফেলেছি আমি, আর সম্ভব না, আপনি এখন আমার উত্তর দিন, ” আমাদেরকে, মানে আমি আর আমার মেয়েকে আপনি আপনার লাইফে এক্সেস দিবেন কি?” ছোট্ট কথায় উত্তর চাই হ্যা অথবা না। আমি আপনাকে কোন ফোর্স করবো না, কোন ব্যাখ্যাও চাইবো না।
সিম্পলি উত্তর দিবেন হ্যা অথবা না”
আবীর অন্যত্র তাকিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসি লুকানোর চেষ্টা করলো। অন্ধকারেও মীরার চোখ এড়ালো না ব্যাপারটা। এই হাসিই ফাসালো মীরাকে, এত সুন্দর হাসে ছেলেটা। পাশ থেকে মীরার দিকে মুখ ফিরিয়ে আবীর বলে-
: “এখনি দিতে হবে উত্তর? ”
আবীরের হাসি দেখে নিজের মেল্ড হওয়া মনটাকে জোড় করে শক্ত করে মীরা দৃঢ় ভাবে বললো-
: “হ্যা, ইট’স নাউ অর নেভার”
কথাটা শুনে আবীর আবার মুচকি হাসলো। বেপরোয়া এই মীরাকে দেখে কেমন যেন লাগছে, এই অনুভূতির নাম জানা নেই ওর। হাসিটাকে সংবরন করে যথাসম্ভব গম্ভীর ভাব নিয়ে কি যেন ভাবতে শুরু করলো আবীর। আবীরের ঠোঁটের হাসি তখনো মিলিয়ে যায় নি। অন্ধকার সয়ে যাওয়ায় মীরা তা স্পষ্ট দেখতে পেলো। ক্ষণকালের বিরতি পেরিয়ে আবীর বলল-
: ” আচ্ছা ঠিকাছে আমার উত্তর “হ্যা”, তবে আমার একটা শর্ত আছে”
মীরা যেন কোন গোলক ধাঁধায় পরলো শর্তের কথা শুনে। অস্ফুটে বললো-
: “শর্ত”
: “হ্যা”
মীরা তোতলানো স্বরে বললো-
: “কি…. শর্ত”
আবীর গলা পরিষ্কার করার ভঙ্গি করে চুপ থাকলো কিছু সময়, যেন কথা সাজিয়ে নিচ্ছে, তারপর ধীর কন্ঠে বললো-
: “শোন আমাদের দুজনের মধ্যে নূহা একটা বড় ফ্যাক্টর…
কথাটা শুনে কেঁপে উঠে যেন মীরা, পুরো কথাটা শুনবার ভয় ভর করে যেন ওর চোখেমুখে। সারাদিনের ক্লান্তি আর আবীরের অর্ধেক কথা দুটো যেন ওর মাথা ঘুরিয়ে দিলো। কেমন যেন টলতে লাগলো মীরা পুরো কথাটা নিজ থেকে জেনে ফেলার আশংকায়। আবীর মীরার একটু কাছে সরে এসে ওকে সাপোর্ট দিতে চাইলো। মীরা হাত দিয়ে আবীরকে থামনোর ভাঙ্গি করে পেছনের গাছটাকে এক হাতে ধরলো ভারসাম্য রক্ষা করতে। তারপর বললো –
: “আমি ঠিক আছি, আপনি বলুন”
কথাটা বলতে গলা কেঁপে উঠে ওর।
আবীর ওর চোখে চেয়ে বললো-
: ” শর্তটা হচ্ছে – নূহা যদি আমাকে বাবা হিসেবে মেনে নেয় তবেই আমি এ সম্পর্কে আমি এগুবো”
কথাটা শুনে মীরা এমন একটা ধাক্কা খেলো, গভীর কোন খাদে পরে যাবার অনুভূতি হতে লাগলো । আবীর দ্রুত মীরার হাত ধরে ওকে পরে যাওয়া থেকে আটকালো। আবীরের হাতে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো মীরা। নিজের দুই হাতে মুষ্টিবদ্ধ করলো আবীরের হাত দুটো। সেখানেই মাথা ঠেকিয়ে মুহূর্তেই কেঁদে ফেললো ও। আবীর যেন চমকে গেলো ওর কান্না দেখে। নিজের হাত ছাড়িয়ে মীরার নত মস্তক তুলে ধরলো। অস্ফুটে মীরা বললো-
: আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, বাকীটা শুনবার অপেক্ষায়। এজন্যই হয়তো বলে- ” মিথ্যের চেয়ে বেশি ভয়ংকর হলো অর্ধেক সত্য”
আবীর এবার মীরার হাত দুটো নিজের হাতে পুরে নেয়। ওর খুব ইচ্ছে করে মীরাকে জড়িয়ে ধরে, এতো দিনকার দূরত্বে ও তা পারে না। কিন্তু মীরা আবীরের সে ইচ্ছেটা পড়ে নেয় যেন, নিজের হাত ছাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে আবীরকে। ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিলো আবীরের। তবে মুহূর্তেই কি হলো বুঝতে পেরে ও নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় মীরার দিকে।
ঠিক তখনি অন্ধকার বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠেছিলো নানা রঙের আলোয়।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
আবীরের বড় চাচীর আবদারে চট্টগ্রামে বাড়িতেই বৌ তুলতে হবে আবীরকে। তিনি আবীরকে বলেছিলেন-
: ” এখানে থাকবি বলে এসে এক্সিডেন্টের পর আবার ঢাকার বাড়িতে রয়ে গেলি। তোর খুশি তুই কোথায় থাকবি। কিন্তু তোর বিয়েটা এ বাড়ি থেকে হোক তা চাই আমি। তোর মা-বাবা কেউ নেই, কোন দায়িত্বই তো পালন করতে পারিনি, এটুকু দায়িত্ব শুধু পালন করতে দে ”
না করে নি আবীর, চাচীর কাঁধেই বিয়ের সব দায়িত্ব দিয়েছে ও। ওর বাবা মা কেউ নেই, বোন একটা সেও পরে আছে বিদেশ বিভুঁইয়ে । এদিকে ভাবতে গেলে বড় চাচী আবীরকে ভারমুক্ত করেছেন। তাই ঢাকার বাড়িতে বৌ না তুলে বৌ তুলেবে চট্টগ্রামের দাদার বাড়িতে।
বৌ নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নেমেছে এখানটায়। গাড়িতে সামনের সিটে বসেই পিয়ালী যখন ওদের দাদাবাড়ী এলাকার সীমানা দেখাচ্ছিলো আর গল্প করছিলো তখন অন্ধকারের মধ্যেই অভিভূত হচ্ছে মীরা। দুইপাশে গাছে ঘেরা বিশাল প্রান্তর, বেশ খানিকটা পথ পেরুলে দুই একটা ঘর, বাড়ি, মানুষজন দোকানপাট দেখা যায়। তাছাড়া পুরো জায়গাটা যেন অন্ধকারে ডুবে আছে। মীরার মনে হয় ঠিক যেন কোন জনমানবহীন অরন্য যাত্রায় যাচ্ছে ও। অন্ধকার আর নিশব্দে ঘেরা চারপাশ। গাড়ির শব্দ কেবল চারপাশের নিরবতাকে ভেঙে খানখান করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ওদের সাথের দুটো গাড়ি সামনে চলে গেছে। ওরাই কেবল পিছনে রয়ে গেছে।
যেদিন সন্ধ্যায় মীরা প্রথমবার এদিকে এসেছিলো আবীরের খোঁজে সেদিন জায়গাটা ততোটা খেয়াল করে নি ও। সেদিন আবীরকে নিয়ে ওর চিন্তায় বুদ থাকাটা এতই গভীর ছিলো যে রাস্তার এই জনমানবহীনতা, নির্জনতা, তেমন একটা ছুঁতে পারে নি ওকে। কিন্তু আজ এদের সাথে এসেও সেদিনের কথা ভেবে ভয় হচ্ছে ওর। কি মারাত্মক কাজ ও করে ফেলেছিলো সেদিন। ঐদিন ড্রাইভার কিছুতেই আসতে চাইছিলো না এখানটায়। এত ভিতরের দিকে গেলে ফিরতি পথে প্যাসেন্জার পাওয়া যায় না তাই। মীরা প্রথমটা ভেবেছিলো বাড়তি ভাড়া আদায়ের বাহানা। তাই মীরাই বলেছিলো প্রয়োজনে দ্বিগুণ ভাড়া দিবে। তাই তো রাজি হয়েছিল ড্রাইভর লোকটা। এখন ও ভাবছে অচেনা এই নির্জন শহরটায় ড্রাইভার লোকটা যদি ওকে খু*ন করে পুঁতেও রাখতো কেও জানতো না ওর খবর। মীরার কেমন একটা কাঁপন অনুভব হয় হঠাৎ ঐদিন কার কথা ভেবে, পাশে বসা আবীর ওর কাঁপনের টের পেয়ে মীরার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে-
: “কোন সমস্যা? ”
তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে “না” বাচক উত্তর দেয় মীরা। কিন্তু মনে মনে ভাবে অনেক সাহসী কাজ সে করে ফেলেছিলো সেদিন, তাইতো মীরাকে ঐ বাড়িতে সেদিন দেখে আবীরের অবাক হওয়াটা ছিলো চুড়ান্ত পর্যায়ের।
আবীর আবার ওকে প্রশ্ন করে –
: “ঠান্ডা লাগলে গ্লাসগুলো তুলে দিই?”
মীরা এবারও উত্তর দেয় – “না”
ঠান্ডা ওর লাগছে তা সত্যি তবে উপভোগ ও করছে।
কি ভেবে যেন গাড়ির দরজার কাছে মাথা রেখে বাইরের দিকে দেখায় মন দেয় ও। দুপাশে ঘন জঙ্গলের মাঝখানে তৈরী করা সরু রাস্তা পেড়িয়ে যাচ্ছে ওদের গাড়িটা, চলছে তো চলছেই, এ যেন অনন্ত যাত্রা। এত দীর্ঘ পথ দীর্ঘ যাত্রা তবুও দেহ মনে ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও নেই মীরার। বরং এই পথ, ঢালু পথ বেয়ে ছুটে চলা, দুপাশের গাছ, মাঝেমাঝে উঁকি দেয়া চাঁদ, শীতের সন্ধ্যার বাতাস সবটাই যেন উপোভোগ্য। মীরার মনে হয় জীবণে এমন কিছু হয়েছে আজ, এমন কিছু পেয়েছে ও যে কোন ক্লান্তি, দুঃখ, জড়া ওকে আর ছুঁতে পারবে না কখনো।
হঠাৎই গাড়ির দু’পাশে পথের চিত্র বদলে গেলো । গাড়িরা গা ঝাড়া দিয়ে দু’পাশের গাছপালা ঝেড়ে সামনে এগুলো যেনো। কিছুক্ষণ হলো পাহাড় কাটা পথ ধরে এগুচ্ছে ওরা। তার মানে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে ওদের গাড়িটা।
পথের দু’ধারে কখনো পাহাড়ের মাটি, কখনো বা গাছ ঘিরে রাখা সবুজ পাহাড় দেখছে ও। পাহাড়কে সবুজে ঢেকে রাখাটা জানান দিচ্ছে এ পথ কত আগের, কত যত্নের তৈরি। বিশাল গাছগুলো যেন প্রহরা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন বৌ কে। কিন্তু মাঝেমাঝে দুপাশে ঘন গাছ থাকায় চাঁদ দেখতে পাচ্ছে না ও। মাঝেমধ্যে গাছের ফাঁকফোকড় বেয়ে চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে নতুন বউয়ের মুখ দেখতে। এমনি করে আধঘন্টার মতো গাড়ি চলার পর সমতল পথে উঠলো গাড়িটা। এতক্ষণ ধরে পাহারা দেয়া রাস্তার দুইপাশের ঝোপঝাড় গুলো হঠাৎ একপাশে সরে গেলো যেন। ওমনি একঝাঁক চাঁদের আলো বরন করে নিলো ওকে। অনেকক্ষণ বাদে চাঁদের আলোর দেখা পেয়ে মীরা আরো সেরে এলো গাড়ির জানালায় দিকে। ঠান্ডা বাতাসে চোখ বন্ধ করে মীরা কেমন একটা জংলি গন্ধের টের পেলো। গন্ধটা প্রথমে আগন্তুকের মতো ঠেকলেও ধীরে ধীরে কেমন পরিচিত লাগে ওর।
এদিকে নিজের আসনে গা এলিয়ে বসা আবীর গাড়ির জানালার ফাঁকে চাঁদের আলোতে দেখছে মীরার চুড়ি ভর্তি হাত। কেমন অপার্থিব সুন্দর দেখাচ্ছে দৃশ্যটা। ওর ইচ্ছে হচ্ছে হাত দুটোকে ওর নিজের কাছে টেনে রাখে। পাছে কি ভাবে মীরা তাই এই ইচ্ছেটা দমন করে। ভালো লাগে ভাবতে হাত কি পুরো মানুষটাই আজ ওর নামে লিখা হয়ে গেলো।
পিয়ালী ধারাভাষ্যকারের মতো তখনো বর্ননা করেই যাচ্ছে রাস্তার বর্ননা, বিশেষ কোন স্থান কিংবা কোন জায়গা ঘিরে ওদের ছোটবেলা কার মজার কোন স্মৃতি। পিয়ালীর বকবকে মন নেই কারোরই। নিজের কাজে পিয়ালীর অখন্ডতা দেখে সাহস করে মীরার হাতটা ধরেই ফেলে আবীর। চোখ খুলে মীরা ওর দিকে তৎক্ষনাৎ তাকায়, গাড়ির ভিতরটা অন্ধকার, তবুও মীরা যেন বুঝতে পারে আবীরের অব্যাক্ত কথা ” কি দেখছো অমন করে? আমার দিকেও তো একটু দেখো”
সত্যি বর বেচারাকে একলা করে এমন চন্দ্র বিলাস মোটেও ভালো কথা নয়। মুচকি হেসে মীরা আবীরের কাছ ঘেঁষে বসলো। আবীর তখনি ওর একটা হাত নিয়ে নিলো নিজের দখলে।
মীরার যেন তাড়া নেই হাত ছাড়িয়ে নেয়ার। বরং আবীরের শরীরের উষ্ণতার সবটুকু যেন শুষে নিচ্ছে ওর ঠান্ডা হাত।
একটু বাদে আবীর ফিসফিস করে বললো-
: ” নূহাকে কোথাও দেখলাম না কেন?”
: “পিয়াসা নিয়ে গেছে ওর বাড়ি, আমি চাই না ওর মাথায় মায়ের বিয়ের কোন স্মৃতি থাকুক”
: “মেয়েটাকে এখনো দেখতে পেলাম না, তুমি বড্ড পাষাণ ”
আবীরের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে মীরা বলে-
: “আমি যা করি ভেবেই করি, ও জানে আমি ওর মা, ওর বাবা বিদেশে থাকে, ও জানবে ওর বাবা এত বছর পর বিদেশ থেকে ফিরেছে। এই মেমরিটা তৈরী করতে আমার এই পাষাণ হওয়া। তাই আমি চাই আপনারা আরেকটু অপেক্ষা করুন, বাবার জন্য মেয়ের
অপেক্ষার ফল মিষ্টি হোক ”
এমন সময় পিয়ালী পিছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: “কিরে তোরা কি ফিসফাস করছিস?”
মীরা পিয়ালীর পিছনে ফেরা দেখে ওর হাতটা সরিয়ে নিতে চায়, আবীর তখন আরো শক্ত করে হাতটা ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে বলে-
: “কই ফিসফিস করছি? কানে বেশী শুনিস? বাতাসের শব্দে তোর এমন মনে হচ্ছে ”
মীরা কিছুক্ষণ হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। তারপর কি ভেবে যেন আবীরের কাঁধে মাথা রাখে। আবীর প্রথমে চমকে গেলেও, পরে ওর মাথাতে নিজের মাথাটা ছুঁইয়ে রাখে।
এমনি করে চলতে থাকে গাড়ি। মীরা ফিসফিস করে বললো-
: “আপনার দাদা আর জায়গা পায়নি বাড়ি করার, একেবারে বাংলাদেশের শেষ সীমানা বাড়ি করেছেন”
মুচকি হেসে আবীর বলে-
: “যুদ্ধের সময় এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে নামমাত্র দামে এই বিশাল বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি।
বাড়ির মধ্যে তাইতো হিন্দুয়ানা ভাব আছে। তুমি পুরো বাড়ি ঘুরলেই বুঝতে পারবে”
অবশেষে দীর্ঘ যাত্রা শেষে নতুন বৌ পৌঁছালো শ্বশুর বাড়ি। এখানে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমেই অবাক হওয়ার পালা শুরু নতুন বউয়ের। গাড়ি থেকে নামতেই দেখে ফিওনা বাড়ির মেইন ফটকে দাঁড়িয়ে ওদের বরন করার অপেক্ষায়। অচেনা সব মানুষের ভীড়ে ফিওনাকে দেখে মীরার সব দুশ্চিন্তা উবে গেলো মুহূর্তেই। মীরার সাথে সাথে অবাক হয় আবীরও। কিছুক্ষণ যেন সময় নেয় ও সবটা বুঝতে তারপর বিষ্মিত কন্ঠে বলে-
: “কিরে তুই?”
ওর এ বিয়েতে আগমন সত্যি অবিশ্বাস্য। আবীরকে পাশ থেকে আলিঙ্গন করলো ফিওনার বর। কানে কানে অভিবাদন জানালো নতিন জীবণের জন্য। মীরাও ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে কাঁদছে মেয়েটা। মীরাকে জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে ফিওনা বলে-
“তুমি পেরেছো মীরা, তুমি পাথরে ফুল ফুটিয়েছো। দোয়া করি অনেক সুখী হও তোমরা, আফসোস একটাই যে তোমাকে আবীরের বউ হিসেবে দেখতে
চেয়েছিলেন সেই দেখলো না” পাশে থাকা দুই চাচী স্বান্তনা দেয় ফিওনাকে।
নতুন বউয়ের আগমনে সবার উচ্ছাসে এ তিনজনে বিস্ময় মিলিয়ে গেলো। ফিওনা মীরার হাত ধরে ওকে বাড়ির ভিতরে নিতে। মুগ্ধ হয়ে চারপাশে চোখ বুলায় মীরা৷ বিশাল জায়গা নিয়ে করা দোতলায় বাড়িটা যেন আলোর ঝলকানিতে স্বাগত জানাচ্ছে ওকে।
বিয়ে বাড়িতে আলোর এমন সাজসজ্জা এর আগে মীরা কখনো দেখেনি। আলের বাহাদুরি দেখাতে কোন কার্পন্য করেনি লোকগুলো । বিশাল আলোর বেষ্টনি দূর থেকে ঘোষণা করছিলো যেন এর পুরো সীমানা।
প্রতিটি গাছ, বসার জায়গা, দোলনা, খেলার জায়গা সবকিছুই আলোয় আলোকিত। এরা যেন অন্ধকারে জানান দিচ্ছে নিজ নিজের অবস্থান।
একটু হেঁটে এগুতেই থমকে দাঁড়িয়ে মীরা মন ভরে দেখে নেয় কল্পনায় আঁকা এ বাড়িটি। কত কত গল্প শুনেছিলো মীরা এ বাড়ির। আজ মনে হচ্ছে বাড়িটি আবীরের মায়ের মানে মীরার শ্বাশুড়ির বর্ণনার চেয়েও সুন্দর। কোথাও কোন চাকচিক্যের বাড়তি বোঝা নেই।
সহজ সরল এ বাড়িটার বিশেষত্ব এর দরজা, জানালা, দীর্ঘ মোটা খুঁটি, লাল মেঝেতে। পুরো বাড়িটা লাল মেরুন রঙে রঙানো। বাড়ির খিলানে, খুটিতে, জানালায়, দরজায় কারুকার্য গুলো সাদা রঙের। যেন কারুকার্য গুলোকে ফুটিয়ে তুলতেই এই রঙের ব্যবহার করা হয়েছে।
বাড়ির ঠিক মাঝখানটা অর্ধবৃত্তাকারে সামনের দিকে বর্ধিত। অনেকটা বারান্দার মতো। নিচের এ বাড়তি অংশটুকু হাঁটাচলার প্যাসেজ হলেও উপরের দিকের বর্ধিত এ অংশটুকু বারান্দাই। বাড়িটা জমিদার বাড়ি না হলেও এটা যে কোন সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারের ছিলো তা সহজেই বোঝা যায়।
বাড়ির চাচীরা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বরন করে মীরাকে। তারপর সব কাজিনরা সিড়ির দিকে আটক করে বউকে।
পিয়ালী বলে-
দেখেছিস তোরা বউদের বাড়িতে কোন হাঙ্গামা করলো না সে, এখন আমাদের দাবী পূরন করো। হাসি মুখে আবীর বলে-
: “যা, কোথায় নিবি নিয়ে যা তোরা বৌকে”
আহনাফ বলে খুচরো কথায় কাজ নেই ব্রো৷ পঞ্চাশ চাইতাম তুমি ত্রিশ দিয়ে দাও বাকীটা আমি ম্যানেজ করে নিবো”
পাশ থেকে সাদমান বলে-
: আমার ভাইয়ের সাথে জুলুম করছিস তোরা। ত্রিশ না ভাইয়া তুমি পঁচিশ দাও, আর ভাবী বাকী পঁচিশ তুমি দাও”
পাশ থেকে সবাই হে হে করে হেসে উঠে। আহনাফ বলে, নেউ ঠ্যালা, নারীপুরুষ সমতা চাও না তোমরা এবার ভাবী বের করো পঁচিশ। মুচকি হাসে মীরা ওদের এসব কথা শুনে।
আবীর বলে-
: ” আমাকে আটকে রাখ তোরা ওকে যেতে দে, আমার বৌ ভীষণ ক্লান্ত”
কথাটা বলেই হুশ হয় ওর কি বকে ফেললো। উল্টো ঘুরে জিবে কামড় দেয় আবীর। বড় চাচী কান ধরে বলে-
: “বিয়ে হয়ে সারা গেলো না এখনি আমার বৌ”
আবীর তখন ওদেরকে বলে, এত টাকাতো ক্যাশ নেই, তাহলে উপায়?
আহনাফ বলে- “আরেহ্ চিল ব্রো উপায় আছে”
এরপর মোবাইল ব্যাংকিং এ ওর ভাগের টাকাটা পরিশোধ করে আবীর। মীরা খুশি মনে ওদেরকে ওর ভাগের ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দেয়। তারপর ফিতা কেটে মীরাকে নিয়ে যায় দোতলার সবচেয়ে বড় ঘরটাতে।
এ ঘরটাতেই থাকতো এ বাড়ির আদরে ছোট ছেলে মানে আবীরের বাবা। ভাইয়েরা বড় হচ্ছিল যখন তখন তিনি বলেছিলেন বড় ঘরটা তার চাই। দুই বড় ভাই তাই ভালোবেসে তাকেই এ ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভিতরে ঢুকে এমনি গল্প জুড়ে দিলেন আবীরের বড় চাচী। আবীরের মাকে একা বিয়ে করায় আবীরদের পরিবার ঢাকায় থাকলেও এ ঘরটা তাদের জন্যই বরাদ্দ ছিলো। ছোট ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও এত বছরেও এর মালিকানা কোন ভাই বা তাদের ছেলেমেয়ে কেও নেয় নি।
আবীর ফিওনা অবশ্য মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতো এ বাড়ি। কিন্তু আমৃত্যু এ বাড়িতে আর ফিরেন নি তিনি। এমনকি মা*রা গেলে তাকে যেনো ঢাকাতেই দাফন করা হয় তাই বলে গিয়েছিলেন। অথচ যাকে নিয়ে এতকিছু তিনি কিন্তু ইদে চাঁদে ঠিকই আসতেন শ্বশুর বাড়ি। ইদ কিংবা কোন উপলক্ষ এলে শ্বাশুড়ি বড় ছেলেকে পাঠাতেন ছেলের বৌ আর নাতি-নাতনীকে আনতে। সবাই ভেবেছিলো একসময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়েছিলো ঠিকই শুধু এ বাড়ির ছোট ছেলেটা ছাড়া।
পিয়ালী পাশ থেকে বলতে শুরু করে-
: “হেহ্ মা, কি কীর্তন শুরু করলা, মাত্র বাড়ি এলো মেয়েটা, সরো তো অনেক সময় পাবা এ গান শুনাবার। ওকে একটু একলা ছাড়ো, কতটা পথ পেড়িয়ে এসেছে বেচারি”
মীরার হঠাৎ মাথা ব্যাথা শুরু হয়। চারপাশে মানুষের কথাবার্তা, গানবাজনা, হৈ-হুল্লোড়ের মাথা ধরে গেছে হয়তো।
কোত্থেকে একটা কফির মগ নিয়ে হাজির হলো ফিওনা, ঘরে ঢুকেই বললো-
: ” নাও, ভাই পাঠিয়েছে, কিছুর দরকার হলে জানিও আমি আসছি ” বলে বেরিয়ে যায় ও। কফির মগ হাতে মুচকি হাসে মীরা। মনে মনে বলে-
: “আমার কি দরকার তা আমার চেয়ে ভালো জানা লোক এখন আছে আমার, আমার চিন্তা নাই”
মুচকি হেসে কফিটা ধীরে ধীরে শেষ করে ও। মগটাকে সাইড টেবিলে রেখে উঠে ফোনটা নিয়ে একে একে ফোন করে মা, নূহা, আর মুখলেস চাচাকে।
ধীরে ধীরে মীরার আশেপাশের ভীড় পাতলা হতে থাকে। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে কোলাহল। মাঝখানে একবার শুধু আবীর দেখা করে গেছে মীরার সাথে, আর তার খবর নাই। লোকটা ওকে এমনিভাবে বসিয়ে গেলো কোথায়?
একটু পরে রাতের খাবার নিয়ে আসে পিয়ালি আর ওর মা, মীরা এক ফাঁকে পিয়ালীকে জিজ্ঞেস করে আবীরের কথা। গাধা মেয়ে ওর মাকে বলে কিনা-
: “মা, আবীর ভাই কোথায় গেলো জানো কিছু? ভাবী জিজ্ঞেস করছে..”
মীরা মনে মনে বলে-
“আরেহ গাধী প্রশ্ন পর্যন্ত ঠিক আছে, ভাবী জিজ্ঞেস করছে.. এটা বলার কি দরকার ছিলো৷ পিয়ালীর মা মানে বড় চাচী নিজ হাতে মীরাকে খাইয়ে দিলো। বাড়ির লোকেদের সম্পর্কে এটা সেটা জিজ্ঞেস করলো। খাওয়া, আলাপ শেষ হলো তবুও আবীরের দেখা নেই।
আশেপাশের লোকই যেন কমে না ঘরে। অবশেষে মেঝো চাচী এসে ঘর থেকে সবাইকে বের করে দেয়। ঘরে বসেই মীরা শুনতে পায় বাইরে দাঁড়িয়ে পিয়ালীর সাথে কথা বলছে ভরাট কন্ঠের একজন। মীরা ভিতর থেকেই বুঝতে পারে যার অপেক্ষায় ও এতক্ষণ ধরে বসে আছে সে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে। কেমন একটা উচাটন ভর করে বুকে। সময়ের সাথে সাথে সেই উচাটন বড়তে থাকলো। এতক্ষণে ও যেন পুরোপুরি টের পেলো আবীরের মালিকানার। একটা মানুষের আধিপত্যের।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
আশেপাশের লোকই যেন কমে না ঘরে। অবশেষে মেঝো চাচী এসে ঘর থেকে সবাইকে বের করে দেয়। ঘরে বসেই মীরা শুনতে পায় বাইরে দাঁড়িয়ে পিয়ালীর সাথে কথা বলছে ভরাট কন্ঠের একজন। মীরা ভিতর থেকেই বুঝতে পারে যার অপেক্ষায় ও এতক্ষণ ধরে বসে আছে সে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে। কেমন একটা উচাটন ভর করে বুকে। সময়ের সাথে সাথে সেই উচাটন বড়তে থাকলো। এতক্ষণে ও যেন পুরোপুরি টের পেলো আবীরের মালিকানার। একটা মানুষের আধিপত্যের।
কি মনে করে হঠাৎ পিয়ালী ঢুকলো ঘরে, মীরার কানে কি এক গোপন কথা বলে ঠোঁট টিপে হাসলো সে। লজ্জায় লাল হলো মীরাও । এই মেয়ে আসলেই একটা গাধা, কখন কি বলবে তার হুঁশ নেই। কথা শেষ করে পিয়ালী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কি মনে করে আবার এগিয়ে এলো মীরার দিকে। তারপর মীরার শাড়ির উপর ঘোমটা দেয়া পাতলা ওড়নাটা টেনে ঘোমটাটা লম্বা করে দিলো। মীরা প্রথমটাতে বিরক্ত হলো, মনে মনে ভাবলো বুড়ো বয়সে কি সব আদিখ্যেতারে বাবা ! পরোক্ষণেই মনে হলো এমন রাত, এই অপেক্ষার অভিজ্ঞতা ওর দ্বিতীয় বারের মতো হলেও, আবীরের বিয়ে, ফুলশয্যা, নারীসঙ্গ সবকিছুর প্রথম আজ। তাই মনে মনে ভাবে নিজের তিক্ত অতীত টেনে আবীরের আজকের বিশেষ দিনটার রঙ কিছুতেই ম্লান হতে দিবে না ও। এত ভালোবাসবে আবীরকে যাতে ওকে নিজের করে পাওয়ার দীর্ঘ অপেক্ষার আক্ষেপ ঘুঁচে যায়।
তাইতো একবুক ভালোবাসার নিয়ে মধুর অপেক্ষায় নত মস্তকে বসে আছে আবীরের জন্য । পিয়ালী বেরুতেই আবীরকে ছোটবেলার রেলগাড়ী খেলার মতো ঠেলে পাঠিয়ে দেয় সব কাজিনরা মিলে। মীরা ওদের হাসাহাসি শুনে ওড়নার ঘেরাটোপ থেকে
তাকিয়ে দেখে ওকে ঠেলে পাঠিয়ে বাইরে থেকেই বিদায় হচ্ছে ওরা।
ওরা চলে যাবার পরও আবীর লাজুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে। ওর দৃষ্টি খাটের মধ্যে খানে বসে থাকা মীরার দিকে। মীরা তখনো নত মস্তকে জবুথবু হয়ে বসে আছে। আবীরের অস্তিত্বের টের পেয়ে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখার ভয়ে হুট করে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো ও।
ঘরে ঢুকে অবিশ্বাসী ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছে আবীর। জীবণের সুন্দরতম আজকের এই দিনটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এই ঘর, হ্যা এই ঘরেই নিজেকে বন্দি করেছিলো আবীর মীরা ওকে ছেড়ে চলে যাবার পর। লোকলজ্জার ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলো ও এই ঘরটাতে। কত কত নির্ঘুম রাত, বোবা কান্নার সাক্ষী এই ঘর, এই দেয়াল, এই মার্বেলের শীতল মেঝে৷ তাইতো ভাবতে অবিশ্বাস হয়, সত্যি এই ঘরেই এসেছে মীরা ওর বৌ হয়ে। দরজাটা বাম হাতে ঠেলে সামনে এগুলো আবীর, খুট করে একটা শব্দ হলো দরজা লক হওয়ার। সেই শব্দটা মীরাকে জব্দ করলো যেন। কেমন শক্ত হয়ে গলো ওর শরীর।
শান্ত পায়ে এগিয়ে এসে খাটের এক কোণে বসলো আবীর মীরার দিকে পিঠ দিয়ে। কি এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন ও এখনো। মীরা মাথা তুলে আবীরের পিঠ দেখতে পেয়ে মুচকি হাসলো। তখনি পিছন ফিরে চাইলো আবীর, চোখাচোখি হলো দুজনে। কেমন বোকা হাসি হাসলো আবীর। মুচকি হেসে সে হাসিতে যোগ দিলো মীরাও। এবার ঘুরে বসলো আবীর, মীরার দিকে তাকিয়ে বললো –
” বাবা অসুস্থ হওয়ার পর কাজেকর্মে এতটাই ডুবে ছিলাম যে বিয়ে নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা ছিলো না, মা প্রায়ই বলতো তার খুব শখ লাল টুকটুকে এক বৌ আনবে তার ছেলের জন্য। ঐদিন মা আমাকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো “আমার কোন পছন্দ আছে কিনা, মানে প্রেমটেমের ব্যাপারটা ঘুরিয়ে বলা আরকি” -বলে হাসলো আবীর।
যেন ওর বর্ননার ঐদিন ব্যাপারটা গত পরশুর ঘটনা।
তারপর আবার বলতে শুরু করলো-
” আমি মুখচোরা, কাজপাগল মানুষ আমার আবার প্রেম-ট্রেম”
বলে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো-
“সেদিন রাতে তোমার বাবাকে দেখে বাসায় ফিরে মা বললো – তোমার বিয়ের জন্য তোমার বাবা-মা পাত্র খুঁজছে। একটা সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন- আমার যেহেতু কোন পছন্দ মানে প্রেমটেম নেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি কি-না? প্রথমটায় একটু ধাক্কা খেলেও আমি কিন্তু অমত করিনি।
আবীরের মুখে এসব শুনে তড়াক করে তাকায় মীরা।
মনে মনে ভাবে- “এসব কি বলছে আবীর! আবীরের বাবা মা, কিংবা ওর নিজের বাবা কেউ-ই তো বেঁচে নেই এখন, তাহলে এসব বলার মানে কি!”
আবীর সলজ্জ চোখে ঘুরে বসে দেখে মীরাকে। কিছুসময় পর শেরওয়ানীর দুই পকেটেই কিসের যেন খোঁজ চালায় ও। বাম পকেট থেকে কি একটা বের করে মীরার আরো কাছে এগিয়ে এসে সংকোচে আলতো করে ওর বাম হাত ধরে আবীর, মীরা তখনো বিয়ের ওড়নার ঘেরাটোপ ভেদ করে ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে আবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে। হাতটা নিজের আয়ত্তে এনে বাম হাতের অনামিকা আঙুলে একটা আংটি পরিয়ে দিলো আবীর। হাসিমুখে বললো-
“এ আংটিটার একটা গল্প আছে, এটা আমার দাদীর আংটি, দাদী প্রথম দেখে মা’কে এটা দিয়েছিলেন, এটা মায়ের কাছে খুবই স্পেশাল, মা তাই এটা তার পুত্রবধূর জন্য তুলে রেখেছিলেন”
আবীরের কাছে থাকা হাতটা নিজের দৃষ্টি সীমানার কাছে এনে ওড়নার ফাঁক দিয়ে আংটিটা দেখে চমকে উঠে মীরা। একযুগ আগে তপ্ত দুপুরে যে আংটি বিক্রি করে বিয়ে করেছিলো কিশোরী মীরা আর বউন্ডুলে রাজিব এটা সেই আংটিই। কেমন ধাঁধায় পরে গেলো ও। বিস্ময় চেপে ওড়নার ভিতর থেকেই তাকালো ওর দিকে। আবীরের চোখেমুখে কেমন যেন ভাব।
এবারও নিরবতার ঘোর কাটলো আবীর, বললো-
জানো এ ঘরটা আমার অনেক দুঃসময়, দুঃখের সাক্ষী। তুমি আজ আমার হয়ে এ ঘরে এসেছো আমার কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।
কিছু সময় মৌন থাকে আবীর, দুই হাতে ওর মনের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে। কি যেন ভাবছে বেচারা মনে মনে। মীরা তখনো অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। ঘুরে নিচ থেকে পা তুলে মীরার কাছ ঘেঁষে বসে আবীর। একদৃষ্টে মীরার দিকে চেয়ে কি একটা ভাবে যেন। তারপর বলে-
“দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তুমি আমার হয়েছো, কখনো অবিশ্বাস হচ্ছে তো কখনো মিথ্যা মনে হচ্ছে। খুশিতে আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি মীরা। কি বলছি, কি করছি আমি নিজেই জানি না।
তারপর ধীর হাতে মীরার দীর্ঘ ঘোমটা তুলে ধরে মীরার মুখোমুখি হয়ে মুচকি হেসে অস্ফুটে বলে ওঠে-
” আমার নজরই না লেগে যায়”
ঠোঁট টিপে হেসে মীরা বলে-
: “মাশাল্লাহ বলেন”
কিছু যেন শুনতে পায় না আবীর, এমনিভাবে ওর চোখে চোখ রেখে চেয়ে থেকে। কিছু সময় পর আবীর শান্ত কন্ঠে বলে –
“এসব কি সত্যি মীরা? সত্যি কি তুমি আমার হয়েছো?”
দুপুরে যে ভুতে ধরেছিলো মীরাকে তা এখন চেপেছে আবীরের কাঁধে। ছেলেটার সত্যিকার ভালোবাসা, এত বছরকার অপেক্ষা, নানান প্রতিকূলতা ওকে অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তাইতো এতোদিনকার, এত বছরকার কাঙ্খিত মানুষটিকে কাছে পেয়েও দিশেহারা ভাব ওর চোখেমুখে।
আবীরের চোখে চোখ রাখে মীরা, কপাল কুঁচকে ভাবে
– “আবীরটা কি পাগল হয়ে গেলো? এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা, উদ্ভট প্রশ্ন, এসবের মানে কি ?
হুট করে কি একটা হয় মীরার- তারপর এসব যে স্বপ্ন নয় বাস্তব তার প্রমাণ দিতে হুট করেই আবীরের একটা হাত টেনে সেটাতে কামড় বসায়।
মীরার দিকে তাকিয়েই উফ্ করে উঠে আবীর।
ঝাঁঝালো গলায় বলে-
: এবার বিশ্বাস হলো তো?”
মুচকি হাসে আবীর ওর এমন কান্ড দেখে। তারপর
মীরাকে কাছে টেনে ওর কপালে চুমু খায়। তৎক্ষনাৎ লজ্জায় লাল হয়ে আবীরের বুকের মধ্যে লুকায় মীরা ।
আবীরও দুই বাহু প্রসারিত করে আগলে নেয় মীরাকে যেন অতি মূল্যবান কিছুকে লুকিয়ে রাখলো সে পৃথিবীর থেকে। মীরা এত শান্তি পেলো আবীরের বুকে লুকিয়ে। হঠাৎ মনে হলো ওর- ও তো এটাই চেয়ে এসেছে, দুনিয়ার থেকে পোড় খেয়ে খেয়ে, যে কেও একজন ওকে আগলে রাখুক, লুকিয়ে রাখুক পৃথিবীর থেকে।
কিছুক্ষণ পর মীরা বুঝতে পারলো আবীরের শরীর কাঁপছে। বন্ধনরত থেকেই উপরে তাকালো মীরা। একহাতে আগলে রেখেছে সে মীরাকে অন্য হাতে চোখ ঢেকে কাঁদছে।
এত বছরকার অপেক্ষা, প্রিয়জনকে না পাওয়ার কষ্ট সব যেন নোনা জল হয়ে বেরুচ্ছে আবীরের চোখ দিয়ে। আবীরকে আঁকড়ে ধরা মীরারও চোখ ভিজে আসে। আজ দু’জনই দু’জনকে জয় করে নিয়েছে ভালোবাসার দামে। এ কান্না সেই জয়ের উদযাপন।
এমনি ভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকে ওরা। মীরা সে বন্ধন আলগা করে চোখ মুছে দেয় আবীরের। তারপর অনুতাপের কন্ঠে বলে-
: “আমার করা একটা ভুল আমাদের দুজনের জীবণের এক যুগ কেড়ে নিয়েছে। আপনি আমাকে ক্ষমা কর দিবেন আবীর”
আবীর মীরার ঠোঁটে ডান হাতের তর্জনী রেখে ওর কথার স্রোত আটকায়। তারপর ধীর কন্ঠে বলে-
: ” একবার ভাবো তো আমাদের জীবণে ঐ ভুলটা যদি না থাকতো তাহলে এমনি মরিয়া হতে তুমি? আমি কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে এখানে কয়েকদিনের জন্য এসেছিলাম চট্টগ্রাম , তোমাকে বলে আসতে পারি নি। একেবারে চলে এসেছি ভেবে তুমি উড়ে চলে এসেছিলে আমার খোঁজে। এমন বেপরোয়া ভালোবাসা পেতে ঐরকম ভুল, দীর্ঘ প্রতীক্ষা এসব ব্লেসিং মনে হচ্ছে এখন। তুমি যদি ঐ ভুল না ও করতে কোনমতে যদি বিয়েটা টিকে যেতো আমাদের এখনকার মতোন এমন টান থাকতো দুজনার দুজনের প্রতি? কক্ষনও না, তখন দেখা যেতো আমাকে একাই বয়ে নিয়ে যেতে হতো সংসারটা”
: ” বিনয় না মীরা, একটা কথা জানো তো- “গড ইজ দ্য বেস্ট প্লানার” তিনি জানতেন এভাবে এক হওয়াটা আমাদের জন্য মঙ্গল। পেছনের সবকিছু পিছনে ফেলে নতুন করে শুরু করবো, দেখো অনেক সুখী হবো আমরা”
এমনি করে নানান টুকরো কথায় এগিয়ে যেতে থাকে বিশেষ রাতটা৷ কখনো টুকরো কথা, কখনো হাসির শব্দ ও শোনা যাচ্ছে ওদের ঘর থেকে।
আবীর একটা সময় বলে-
: “চলো তোমাকে একটা চমৎকার জিনিস দেখাবো”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধীর পায়ে নামতে নেয় মীরা। শাড়ির পাড়ে পা জড়িয়ে পরে যেতে নিলে ওর হাত ধরে আবীর। পা সামলে উঠে দাঁড়ায় মীরা। তারপর আবীর ওর হাত ধরে নিয়ে যায় ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দায়।
পুরনো ধাঁচের এ বাড়িটার এক একটা ঘর যেন এক একটা পৃথিবী, এত বিশাল! ঘর পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে চমকে যায় মীরা৷ এ যেন অপার্থিব সৌন্দর্য। কুয়াশায় পুরো দৃশ্যপট দেখা না গেলেও ঠিক বোঝা যাচ্ছে ওদের বাড়ির ঠিক পর থেকেই ঢাল বেয়ে নেমে গেছে যেন অরন্য ঘেরা পাহাড়টা এবং তা এত নিখুঁত ভাবে যে এ বাড়ির সীমানা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে
সবুজের সমুদ্রের কিনারায় থাকা এ বাড়িটা পৃথিবীর শেষ সীমানায় একটা দ্বীপ। এত সবুজ, পাহাড়ি ঢাল প্রকৃতির এমন নিখুঁত সাজসজ্জা এর আগে দেখেনি মীরা। ওর দেখা গ্রাম মানে ওর নানু বাড়ি দাদু বাড়ি আর এখনকার দৃশ্যপট পুরো আলাদা৷ মুগ্ধ চোখে এসব দেখে মীরা, আর মীরার মুগ্ধতা দেখে আবীর।
শীতের রাতের শেষ ভাগ, শনশন করে বাতাস আসছে।
হঠাৎ করে শীতে কেঁপে উঠে মীরা। আবীর পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো –
: “কি হলো? ”
: “কিছু না শীত করছে”
: ” ঘরে চলো তাহলে..”
: “না, ভালো লাগছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে”
: ” আচ্ছা, শালটা নিয়ে আসি তাহলে ঘর থেকে … ”
মীরা ওর হাত ধরে টেনে বলে-
: “যেতে হবে না, একটু পরেই রুমে চলে যাবো”
মীরা এখন খোলা বারান্দার রেলিং ধরে সামনে তাকানো। আর আবীর দেয়ালে হেলান দিয়ে দূর থেকে তাকানো মীরার দিকে৷ একটা সময় মীরা ব্যাপারটা খেয়াল করে মাথা নেড়ে কাছে ডাকে ওকে। হেসে মাথা নেড়েই “না” বলে আবীর। হাত বাড়িয়ে মীরা কাছে টেনে আনে ওকে৷ মীরার একাবারে কাছে এসে আবীর, মীরা ওর চুল নাড়ে আর বলে- “আপনার চুল গুলো নেড়ে দেয়ার কথা কত কত দিন মনে মনে ভাবতাম”
বাইরের খোলা প্রকৃতিতে সে শব্দ আরো জোড়ালো শোনালো। দ্রুত মীরা ওর হাত ঝাঁকিয়ে বললো-
“আস্তে, বাড়ির মানুষ কি ভাববে শুনলে?”
“কেউ কিছু ভাববে না, আমি কি অন্য কারো সাথে আছি নাকি? সবাই জানে আমি এখন আমার বিয়ে করা বৌর সাথে আছি”
আবীরের মুখে বৌ কথাটা শুনে ওর ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠে যেন। তখনো নিচে টাকা ভাগ বাটোয়ারার সময়ও আবীর যখন এ শব্দটা বলেছিলো তখনো এমনি কাঁপন ধরেছিলো ওর বুকে৷ মীরা আবীরের ধরা হাতটা ছেড়ে দিলো। পাছে ওর কাঁপন না টের পেয়ে যায় আবীর।
ব্যাপারটা বুঝে আবীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকায় ওর দিকে, ভীরু দৃষ্টিতে তাকায় মীরাও। না বলেও অনেক কথা বলা হয় দু’জনে। আবীর বাতাসে মীরার মুখের ওর আছড়ে পরা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। হঠাৎ মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিলো সে। এত কাছাকাছি দুজনে তবুও আবীরের মধ্যে এখনো কেমন সংকোচ, আড়ষ্টতা।
পাশাপাশি দাঁড়ানো মীরা আবীরের একটা হাত ধরে মাথাটা ওর কাঁধে রাখে। কিছু সময় মনের যুদ্ধ শেষে আবীর আরেকটা হাত দিয়ে পরম মমতায় কাছে টেনে নেয় ওকে। আবীরের দিকে তাকায় মীরা। আবীর ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়, আবীরের কাছে মীরাকে বুকের মধ্যে আগলে রাখাটাই যেন বেশী সুখের।
মীরাও ওকে আঁকড়ে ধরে সমান মমতায়, আর ভাবে – “থাকুক জড়তা ওর মধ্যে দূর্লভ জিনিস পাওয়া তো কষ্টসাধ্য হবেই। আমার কোন তারাহুরো নেই, প্রয়োজনে আমি না হয় আরো অপেক্ষায় থাকবে কখন আবীর গভীর বাঁধনে বাঁধবে আমাকে।
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৮৯
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
পরদিন সকাল হতেই হাসপাতালে গেলো মীরা আবীরের সাথে দেখা করতে। বাসার তৈরি নাশতা সাথে করে নিয়ে গেছে মীরা। খুদের ভাত আর ভর্তা। আবীরের মা এ খাবারটা খুব পছন্দ করাতেন। আরো একটা খাবার তার পছন্দ ছিলো তা হচ্ছে কাজীর ভাত, সাথে রকমারি ভর্তা । পাশাপাশি বাড়িতে থাকতে মীরার মা জাহানারা যখনই এ খাবারটা তৈরি করতো তার জন্য পাঠিয়ে দিতো। বাসা ছেড়ে চলে যাবার পরও দাওয়াত করলে পোলাও মাংস না রেঁধে তার জন্য এ খাবারটাই তৈরী করতেন তিনি। ফিওনা এসব পছন্দ না করলেও ভর্তা আবীরের ভীষণ প্রিয়, এটা জানে মীরা। আসলে দুটো পরিবার এত ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছে যে সবাই সবার পছন্দ অপছন্দ গুলো জীবণে চলতে পথে জেনে গেছে।
মীরা যখন হসপিটালে গেলো আবীর তখনো ঘুমে ছিলো। সোবাহান চাচা মীরাকে দেখে ডাকতে যায় আবীরকে কিন্তু মীরা নিষেধ করে বলে-
: “সমস্যা নেই চাচা, আমি বসি কিছুক্ষণ ”
ঘড়িতে সময় সাড়ে আটটা মাত্র। কথোপকথন এর এক পর্যায়ে চাচা বললো – আজ নাকি আবীরকে ডিসচার্জ দিবে। তবে তাকে হাঁটাচলা আপাততঃ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ডাক্তার। ভাঙা পায়ে আবার ব্যাথা পেয়েছে, তাই তাদের এই নির্দেশ।
সোবাহান চাচা কথা শেষ করে মীরার জন্য চা আনতে বাইরে গেলেন। মীরা সোফায় বসে দেখতে লাগলো ঘুমন্ত আবীরকে। ভাবতে থাকে হুট করে এখানে আসাটা ঠিক হলো কি? মানুষটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে ওর সাথে এটাই অনেক ওর জন্য। এতদিন কথাই বলে নি, এখন বলছে বলে এরকম পরিস্থিতিতে তাকে বিরক্ত করাটাকে তিনি কিভাবে নিবেন? এসব ভাবতেই একটা ফোন আসে মীরার, ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করতে করতে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে আবীরের। মীরা ফোন কানে নিয়ে অপরাধীর হাসি হাসে ঘুম ভাঙার অপরাধে ইশারায় সরি বলে বারান্দায় যায় কথা বলার জন্য।
ঘুম থেকে উঠে মীরাকে দেখে চমকে গিয়েছিলো আবীর। প্রথমে ভেবেছিলো অন্য কেও। পরে মীরার অপরাধী ভঙ্গিতে হাসা আর ইশারায় সরি বলতে মুখ উঁচু করায় নিশ্চিত হয়েছে যে মীরাই। ওর সরি বালার ভাবটা এমন যেন ওরা খুব কাছের কেউ, যেন কোনদিন দুজনের মাঝে কোন দেয়াল ছিলোই না। ওর অপারাধী ভঙ্গিতে হাসা আর ইশারায় সরি বলাটাকে বেশ উপভোগ করলো আবীর। মুচকি হেসে সাবধানে বিছানা ছেড়ে নামলো হাতমুখ ধুতে। কেবিন লাগোয়া বারান্দায় হওয়ায় মীরার ফোনে বলা কথাগুলো না চাইলেও ঘর থেকেই শুনতে পাচ্ছে আবীর, মীরা বলছে-
: “ফাহাদ এমনটা আবার যে হবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। তুমি ওয়ার হাউজে রাতের জন্য নিরাপত্তা প্রহরী বসাও, আমি একটা জায়গা দেখে দ্রুত ওগুলো সরিয়ে নিবো”
মীরার কথপোকথন আগাগোড়া সবটাই আবীরের কানে এলো। কথা শেষ করে মীরা রুমে এসে ফোনটা রেখে আবীরের দিকে চেয়ে বিনীত ভঙ্গিতে বললো-
: ” সরি আপনার ঘুম ভেঙে দিলাম”
আবীর তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলে
: ” ঘুম যখন ভেঙেই গেছে,বলে আর কি হবে?”
এতক্ষণে আবীর বিছানা ছেড়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে নিয়েছে।
মীরা মনে মনে ভাবে নরমালি অন্য কেউ হলে এরকম পরিস্থিতিতে বলতো- “আরে না, না, সরি বলার কি আছে” কিন্তু আবীর বরাবরই এমন, কাওকে ইমপ্রেস করার ধার ও ধারে না, “অলওয়েজ বি ইউর সেলফ” একটা মানুষ । মীরার আবীরের এ দিকটা পছন্দ। অতিরিক্ত চাকচিক্য নেই, পুরোটাই খাঁটি। সেই ছোট থেকে দেখছে সে বরাবর স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড, ভনিতা, পেচিয়ে কথা বলা এসব সবসময় এভয়েড করে মূল কথা বলে। মীরার আজও মনে আছে বিয়ের আগে আলাদা দেখা করার সময় আবীর সরাসরি মীরাকে জিজ্ঞেস করেছিলো- ” এ বিয়েতে তোমার মত আছে তো?” আবীর রাজিবের বিষয়টা জানতো, চাইলে তিনি প্রশ্ন করতে পারতো – “কারো সাথে এখনো কি সম্পর্ক রয়েছে তোমার? কিংবা “এখনো ভালোবাসো কাওকে?” ওকে বিন্দুমাত্র বিব্রত না করে সুন্দর শালীন জিজ্ঞাসা – “বিয়েতে মত আছে কিনা?”
এসব ভাবতেই আবীর তোয়ালে রেখে ঔষধের বাক্স খুলতে খুলতে বলে-
: “তারপর কোথায় বসছে প্রহরা?”
এরপর গতরাতের ঘটনা খুলে বললো মীরা আবীরকে। সবটা শুনে আবীর বলে-
: “তোমাকে তো বললাম এগুলো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা না, এবং এটাই শেষ না, সামনে আরো অনেক কিছু হবে যদি না তুমি শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াও। তুমি হয়তো গতকালের কথাটা সিরিয়াসলি নাও নি, কিন্তু এ ছাড়া তোমার ঘুড়ে দাঁড়াবার সব পথ বন্ধ”
: “কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না”
: “না বোঝার কি আছে? ফর্স্ট অফ অল – থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি করবে, তারপর সব পেপারস রেডি করে সংবাদ সম্মেলন করবে, তারা গত কয়েকদিন ধরে কিভাবে তোমাকে হ্যারেস করছে তার বিবরণ দিয়ে। তুমি যে ওর বাবার কাছে গিয়েও এর কোন সমাধান পাও নি, তাও বলবে, তারপর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টা এড করবে”
: ” মনোনয়ন পত্র….”
কথাটা শেষ করতে পারে না মীরা।
: “না, আজ নেয়া যাবে না সেটা, তাহলে পাবলিক সেন্টিমেন্ট ক্যাচ করা টাফ হবে, সবাই তোমাকে স্বার্থান্বেষী ভাববে, মনোনয়ন পত্র তোলার শেষ তারিখ কবে?”
: “২৭ নভেম্বর ”
: “আজ নভেম্বর ২১ তার মানে প্রায় সপ্তাহ খানিক সময় তোমার হাতে আছে। আগে উনার বিপক্ষের শক্তি গুলোকে একত্র করতে হবে তোমাকে, তাদেরকে বোঝাতে হবে তুমি নিজেও তাদের মতো ভুক্তভোগী। তারপর এমন পরিস্থিতি তৈরী করতে হবে যাতে তারা নিজেরাই তোমাকে তাদের প্রতিনিধি ভাবতে শুরু করে। এসবের মধ্যে ওরা অবশ্যই তোমার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কোনো না ঘটনা ঘটাবে, তখন সেটাকে পুঁজি করে ওদের সাথে লড়ার জন্য তুমি নির্বাচনে অংশ নেয়াটা বেছে নিবে, এটলিস্ট সবাই যাতে এটাই বোঝে, তবে একটা কথা না বললেই নয়, এর মধ্যে তোমাকে সাবধানে থাকা লাগবে, যে কোন সম যে কোন কিছু হতে পারে”
: “হারানোর কি আছে বলেন? এ পথে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই”
: “একটা উপায় কিন্তু আছে ?” বলেই খাবার আগের ঔষধ দুটো মুখ দেয় আবীর তারপর পানি খায় ধীরে সুস্থে।
মীরা তড়াক তাকায় আবীরের দিকে, কারন ও জানে আবীর এ কথাটা দ্বারা কি মিন করছে। মীরার তাকানো দেখে আবীর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
মীরা দৃষ্টি অবনত করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওড়নার টারসেল নড়াচড়া করতে করতে বলে-
: ” দুনিয়াতে এক আপনার কাছেই আমি হীন, ক্ষুদ্র। বাইরের পৃথিবীতে সবাই আমাকে কঠিন মানুষ হিসেবেই চিনে। নিজের অর্জিত সব ছেড়ে শূন্য হাতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমাকে সুখ, সৌন্দর্য, অর্থ, বৈভবের লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। ঠিক ভুলের সীমানায় এখন আমার টনক প্রখর, চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়েছিলাম তো… ”
: ” সরি আসলে কথটা…” এমন সময় চা নিয়ে কেবিনে ঢুকে সোবাহান চাচা। মীরা তাকে দেখে বলে-
: “বসেন চাচা একসাথে নাশতা করি”
চায়ের ফ্লাক্সটা রেখে তিনি বলেন, ফাইলটা দেখতে চাইছে ডাক্তার, তোমরা খাও আমি এটা দিয়া আসতাছি। বলে তিনি ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যান।
মীরা নিজের খাবারও নিয়ে এসেছে। এরপর একসাথে ব্রেকফাস্ট করে ওরা। খেতে খেতে আলাপ হয় দুজনে। পরবর্তী করনীয়র ছকটা মাথায় সাজিয়ে নেয় মীরা। আবীর ওকে সাহস দেয় ভয় না পাওয়ার। সাথে সাবধানতা অবলম্বনে আরো কিছু পরামর্শ।
খাওয়া শেষ করে ফিরার সময় নিজের ফোন খুঁজে পায় না মীরা। ফোন খুঁজে পেতে আবীরের ফোন থেকে মীরার ফোনে কল করতে বলে আবীর। ফোন হাতে নিয়ে নম্বর ডায়েল করতেই ফোন পাওয়া গেলো তোয়ালের নিচে। ওর ফোন আর আবীরের নম্বর দুটোই পেলো মীরা, একটা খুশির স্রোত বইলো মনের মধ্যে। অবশ্য আবীরের নম্বর পাওয়া কঠিন কিছু ছিলো না মীরার কাছে, ওর মায়ের ফোন থেকেই নিতে পারতো ও। মীরা আসলে ওর নম্বরটা আবীরকে দিতে পেরে খুশি। কারন এমন মুডি ছেলের পক্ষে মীরার নম্বর জোগাড় করা ভীষণ টাফ।
এরপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আবীর ডেকে বলে-
: ” God bless you with all the things you want”
মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে মীরা বলে-
: আমীন,
তারপর চোখ খুলে আবীরের চোখে চোখ রেখে বলে-
: “আল্লাহ যেন আপনার দোয়া কবুল করে আবীর”
মীরার মুখে নিজের নাম শুনে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায় আবীর। সুন্দর একটা হাসির বিনিময় করে দূর্গম এক জীবণের এক বুক স্বপ্ন নিয়ে হাসপাতালের কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় মীরা।
চলবে….
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯০
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
দুরন্ত গতিতে চলছে মীরার গত কয়েকটা দিন। যতটা দূর্গম ভেবেছিলো মীরা এ পথ তারচেয়েও দূর্গম। কত কত মানুষের কটাক্ষের স্বীকার হয়েছে ও, মুখোমুখিও হতে হয়েছে রক্তচক্ষুর। তবে ভালেবাসাও পেয়েছে অনেক। নানান নিগ্রহের স্বীকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যাবসায়ীদের অনেক ক্ষোভ, লাঞ্চনা, না পাওয়া, এ ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে।
টেন্ডার বানিজ্য, মালামালের মজুদকারীদের বাজার নিয়ন্ত্রণ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি, এমন অনেক কারনেই দিনশেষে আয়ব্যায়ের হিসাব মিলাতেই হিমশিম খেতে হয় ব্যবসায়ীদের। অতিরিক্ত দামে মালামাল কিনে, মালামাল পরিবহন পথে জায়গায় জায়গায় চাঁদাবাজদেরকে চাঁদা দিয়েও যখন কাজ করিয়ে বড় বড় কম্পানি টাকা আটকে দেয়, কাজের ন্যায্য মূল্য পায় না তখন দিনশেষে সেভিংসে হাত দিতে হয় না মিলাতে পারা হিসাব মিলাতে। তাই মীরা তার সাথে দাঁড়ানোর জন্য অনেককেই পাশে পেয়েছে। তারা এই অরাজকতার শেষ চায়, ঝামেলাহীন ভাবে ব্যাবসা করতে চায়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা চায়।
এদিকে সায়নের বাবা আশফাকুজ্জামান শাকিল ক্ষুণাক্ষরেও টের পাননি যে মীরাকে ইগ্নোর করার ফল এত ভারী হবে। তিনি প্রথমটায় মীরার এ খবর শুনে বিশ্বাস করেন নি। পরে অফিসে জমাকৃত মনোনয়ন পত্রের থেকে খুঁজেে মীরার কাগজের ছবি যখন গোপনে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলো তাকে তখন তিনি নিশ্চিত হয়েছেন এ খবরে। রাগে তার মাথা গরম অবস্থা। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের ও বেশী সময় ধরে এ লাইনে তিনি জড়িত। গত দুই দু’বার নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে সাহস করেনি কেউ, বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন তিনি। আর আজ কিনা ত্রিশ বছরের ও কম বয়সী এক পুচকে মেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে। “একে একটা শিক্ষা দিতেই হবে”, তার – এমন ভাবনায় পানি ঢালে তার স্ত্রী। তিনি তার পাশে বলেন
: “মাথা গরম করো না, একবার ভেবে দেখো এটা ভালোই হবে তোমার জন্য, অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে খেলায় জেতা সহজ। তুমি এখানকার গডফাদার, আর ঐ মেয়ে দুইদিন ধরে নেমেছে ফিল্ডে, অভিজ্ঞতার ও তো একটা দাম আছে”
এরপর দীর্ঘ সময় আলাপ হয় স্ত্রীর সাথে। স্ত্রীর কথা মনে ধরে তার। আসলেই তো, এভাবে তো ভেবে দেখে নি তিনি।
পরদিন অফিসে আশফাকুজ্জামান শাকিলের নিশ্চিন্ত ভাব দেখে তার সেক্রেটারি হতবাক। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে তার ভীত হওয়ার কথা। তবে ব্যাপারটায় তিনি ভীত তো হনই নি বরং এনজয় করেছেন যেন এটা কোন সাপলুডু খেলা। গতকাল হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ছবিটা তিনি তার সেক্রেটারিকে দেখিয়ে বললেন-
: ” বীনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজিএমইএ এর পরবর্তী সভাপতি “আশফাকুজ্জামান শাকিল” নির্বাচিত” এবার বোধহয় এই দূর্নাম ঘুচবে আমার”
সেক্রেটারি বিষ্মিত হয়ে বলেন-
: “এটা কি আপনার প্ল্যান স্যার”
: “নাহ,
: ” স্যার তাহলে বয়স ইস্যু দেখিয়ে মনোনয়ন বাতিল করে দিই? কি বলেন?”
: ” নাহ্, কোন দরকার নেই, বরং ওর ইলেকশনে অংশ করাটাকে আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলতে পারো। এই মেয়েকে ভোট কে দিবে?, কি বোঝে ও বিজিএমইএ এর?
: “তাও ঠিক, তবে যেভাবে দল পাকাচ্ছে…
কথাটা শেষ করতে দেয় না আশফাকুজ্জামান শাকিল। তিনি কেমন যেন হেসে তার সেক্রেটারিকে বলেন-
: “যত গর্জে তত বর্ষে না নাদিম” তুমি বরং এক কাজ করো, তুমি ওর নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথটা মসৃণ করে দাও। ওকে কোন রকম সমস্যা যাতে ফেইস করা না লাগে সেদিকটা দেখো। সব ঘাট বেঁধে ওর সাথে আমি ভোটে বোঝাপড়া করবো। নির্বাচনটাকে শেষ হতে দাও, এরপর ওকে আমি হওয়ায় মিশিয়ে দিবো- এটা আমার প্রমিজ”
এদিকে মীরা প্রথম দিনের প্রচারণায় গতবারের সভাপতির দোষ, আর ওর সাথে করা অন্যায়ের ফিরিস্তি তুলে ধরেছে। এতে সাংবাদিকদের কৌশলী প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় ওকে। এক সাংবাদিক মীরাকে প্রশ্ন করে-
: “নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়াই কি আপনার নির্বাচনে অংশ নেয়ার মূল লক্ষ্য?”
এর উত্তর না দিতেই পাশ থেকে আরেকজন জিজ্ঞেস করে –
: “আপনার নির্বাচনী মোটিভ ব্যাক্তিগত, এতে করে ভোটারদের কি লাভ আপনাকে নির্বাচিত করে? তারা কেন ভোট দিবে আপনাকে?
মীরা ক্যামেরার সামনে কথা বলায় অনভ্যস্ত থাকায় এমন পরিস্থিতিতে কি উত্তর দিবে তা নিয়ে চিন্তায় পরে যায়। তবে অল্প কিছুটা সময় নিয়ে বলে –
: ” দেখেন নির্বাচন তো একতরফাই হয়েছে এত বছর, কোন একজনকে তো সামনে এগিয়ে আসতে হবে এ অপশক্তির বিরুদ্ধে। আমি প্রয়োজন মনে করেছি সামনে আসার, আমি আমার একার সমস্যার সমাধানে, কিংবা একার কথা বলতে এখানে আসি নি, আমি সব নিগ্রহের স্বীকার মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছি”
এরপর সাংবাদিকদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় মীরা।
গাড়িতে বসে বেস আপসেট ফিল করে ও। ওর বাবা একসময় বলতো নির্বাচনে নামতে মনের জোড় আর সাহস লাগে। কথাটা এক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে দাঁড়িয়েই টের পায় মীরা।
বাড়ি ফিরে থুম ধরে বসে থাকে। খুবতো ভালো কাটছিলো দিন। কিভাবে কখন সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে গেলো।
এসব ভাবতেই আবীরকে কল করার কথা ভবাে মীরা।
মনের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব চলছে ফোন করবে কি-না। কিছুক্ষণ ভাবনার পর আবীরকে ফোন দিয়েই দেয় মীরা,
একবার…
দুইবার…
তৃতীয়বার রিং হতেই কলটা রিসিভ করে আবীর। কল
রিসিভ করেই আবীর বলে-
: ” তুমি ব্যাবসায় কৌশলী তা জানতাম, কথা বলায় যে এত দক্ষ তা তো জানতাম না। এত বড় কবে হলে তুমি?”
মীরা অবাক হয় আবীরের এমন কথায়, প্রথমে ভেবেছিলো কল রিসিভ করবে না আবীর, কিংবা করলেও প্রথমটায় না চেনার ভাব করবে। ঢং করে জিজ্ঞেস করবে – ” কে? ” কিন্তু সহজ গলায় যা বলতেই ও কল করেছে, নিজ থেকেই তা বলছে, ছেলেটা কি জানতো যে কল করবো আমি- মনে মনে ভাবে মীরা। মীরা অবাক হওয়ার দমক সামলে বলে-
: “ধূর, এসব হবে না আমাকে দিয়ে, কথাটাই দেখলেন, আমার চেহারার কি বেহাল দশা ছিলো তা দেখেছিলেন?”
: “সবটাই দেখেছি আমি, এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতেই চোখ ছোট হয়ে গেছে তোমার, পরেরবার তো… ”
মুচকি হাসে মীরা, আসলেই প্রথম সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিতেই চোখ ছোট গেছে ওর, দ্বিতীয় জনের প্রশ্ন শুনে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলো ও চিন্তিত ভঙ্গিতে। এ কথাটা ভদ্রতার খাতিরে বলতে গিয়েও চেপে গেলো আবীর।
এরপর আবীর বললো-
: “তোমার ট্র্যাক ঠিকাছে, তুমি তো আর রাজনীতিবিদ নও। ঠিক হয়ে যাবে সব। ঢেঁকির নিচে মাথা দিয়ে এখন পাড়ের ভয় করলে চলবে? গো এহেড….
পরদিন নির্বাচনী প্রচারনায় পূর্ববর্তী সভাপতির দোষ ত্রুটির ফিরিস্তির পাশাপাশি এ খাতে নতুন কি কি করা যায় সেদিকে ফোকাস করেছে মীরা। উন্নত বিশ্বের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করেছে। যে দেশের কর্মচারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কেই জানে না তাদের জন্য এসব বিলাসিতা, এমন আবেগী কথাও বলে মীরা। মোটকথা ওর কৌশলী বক্তৃতা সকলকে মুগ্ধ করে।
এদিকে আবীরের পায়ে ইনফেকশন হয়ে খুব বাজে অবস্থা হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এই ইস্যুতে দুইবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ফোনের টুকরো টুকরো কথোপকথনে আবীর এসবের কিছুই বলে নি মীরাকে। বেচারী এমনিই পেরেশানীতে আছে ওকে বাড়তি টেনশন দিয়ে লাভ কি।
অবশেষে নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসে। আগের দিনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে পরিবেশ মোটামুটি স্বাভাবিক। চারদিকে উৎসব উৎসব রব। মীরা খুব সকালে নির্বাচন স্থলে পৌঁছে যায়। যাওয়ার আগে মীরা তিনটা ফোন করে। প্রথমটা মা’কে, দ্বিতীয়টা মুখলেস সাহেবকে, তৃতীয় কলটা করেন আবীরকে। মা দোয়া করে দিয়েছেন। বলেছেন হার জিত যাই হোক মনে সাহস রাখবি সবসময়।
মুখলেস চাচা মীরার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারটায় নাখোশ। কিন্তু তিনি মীরার বর্তমান পরিস্থিতির সবটা জানেন না। তার শরীরের অবস্থা ভেবে সবটা জানায়ও নি মীরা। তবুও তিনি নাখোশ কারন আসফাকুজ্জামান শাকিল ভয়ংকর লোক। প্রথম বার নির্বাচনের দিন প্রতিদ্বন্দ্বীকে আটকে রেখে, তার এজেন্টদেরকে বের করে ভোট কারচুপি করে জয়ী হয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়। লোকটার ব্যাবসা, বানিজ্য, বাড়িঘর সব নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। আজ চার বছর ধরে তিনি নিখোঁজ। বেঁচে আছেন কি ম*রে গেছে তাও জানে না তার পরিবার। এমন ভয়ংকর লোকের বিপরীতে তাই কেও দাঁড়ানোর সাহস পায় না, না পারে তার বিরুদ্ধে কিছু বলার। তবে মীরা যখন সাহস করে দাঁড়িয়েছে না জিতুক মীরা তবুও ও মানুষের মনে নির্বাচন হওয়ার আগেই জিতে গে। এটাই কম কি?
এর পরের কলটা করে মীরা আবীরকে। আবীর বলে-
: ” আমাদের জন্মের আগেই আমাদের জন্মকুণ্ডলী লিখে ফেলেছেন খোদা। এটা তুমি জানো?”
মীরা ছোট্ট করে একটা শব্দ করে-
: “হুম”
: ” তুমি দেশের ইতিহাসে বিজিএমইএ এর সর্বকনিষ্ঠ
সভাপতি হতে যাচ্ছো। এটা তোমার জন্মেরও বহু আগে লিখে ফেলেছেন খোদা৷ তোমার কাজ হচ্ছে সেখানে গিয়ে নিজের কুরসিটা বুঝে নিয়ে আসা”
উত্তরে স্মিত হাসে মীরা। এরপর আবীর বলে-
: “বেস্ট অফ লাক মীরা”
আবীরের মুখে নিজের নাম শুনে বুকে কেমন এজটা কমৃপন অনুভব করলো যেন মীরা। এমন না যে জীবনের প্রথম ওর নাম ধরলো আবীর। দুই বাড়ির মানুষ একত্রে হলেই দেখা হতো ওদের। কত কত দিন এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে আবীর ডেকেছে ওর নাম ধরে। তবে গত বারো বছরে আবীরের মুখে এ নামটা প্রথম শুনেছিলো ফিওনার বাসায়। আর দ্বিতীয়বার।
মনের সুনামিকে দমিয়ে রেখে বিদায় নেয় মীরা। আবীর বলে- “আপডেট জানিও, আমি অপেক্ষায় রইলাম “ছোট্ট করে “আচ্ছা ” বলে ফোন রাখে মীরা।
মীরা পৌছে দেখে পুরো হল ভর্তি মানুষে। একে একে আসে ওর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে। সকাল নয়টা থেকে শুরু হয় ভোট গ্রহণ। উৎসবমূখর পরিবেশে দুপুর তিনটা পর্যন্ত টানা ভোটগ্রহণ চলে। চারটায় শেষ হয়ে শুরু হয় ভোট গননা। দুপুর তিনটা থেকেই আবীর টিভির সামনে বসা। যদিও এটা সংসদ নির্বাচন না যে ফলাও করে প্রচার হবে খবর। কিংবা ভোট গননার আপডেট জানাবে। তবুও খবরটা জানতে বসে আছে মীরা ব্রেকিং নিউজের টাইটেল বারে।
খবর চলছে টিভিতে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেরোস। দেশের একঝাঁক বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমে এ সাফল্য অর্জন করেছে দেশ। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় খবর এটি। ফলাউ করে প্রচার করা হচ্ছে এ খবর।
এই খবর সেই খবর কত খবর হচ্ছে কিন্তু বিজিএমইএ এর নির্বাচনের কেন খবর নেই। পা-টা ভালো থাকলে ও ঠিল চলে যেতো সেখানে। কিন্তু নিজের পায়ে এখনো যে হাঁটতে পারে না তার জন্য এমন ইচ্ছে বিলাসিতা।
জগ থেকে পানি ঢালতেই নিউজ প্রেজেন্টর খবর পড়ে-
” উৎসব মুখর পরিবেশে শেষ হলো বিজিএমইএ এর দ্বিবার্ষিক নির্বাচন। দ্বিবার্ষিক এই নির্বাচনে ৭৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে সবচেয়ে বেশি ভোট (১১৮০) পেয়েছেন সম্মিলিত ফোরামের “জিনিয়া আবেদীন মীরা” তার প্রতিদ্বন্দ্বী আসফাকুজ্জামান শাকিল পেয়েছেন ৪৬৭ ভোট। “জিনিয়া আবেদীন মীরা” বিজিএমইএ এর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি হতে যাচ। আগামী ১২ ডিসেম্বর তিনি আগামী দুই বছরের জন্য সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন”
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
এত বড় খবরটা কাওকে নিজ থেকে বলতে হয় নি মীরাকে। একে একে প্রায় সবাই-ই অভিনন্দন জানাতে খোঁজ নিয়েছে মীরার। মীরা কারো কারে ফোন পেয়ে বেশ আবাক হয়ে যায়। কপট বিরক্ত হয়ে মীরা বলে- “এদেরকে খবর দিলো কে?”
তমা মিষ্টি হেসে মীরার দুই গাল টেনে বলে-
: ” আকাশে চাঁদ উঠলে কাওকে বলে দিতে হয় না, সকলেই দেখতে পায়”
মীরা মজা করে অবাক ভঙ্গিতে বলে-
: “দিনের বেলায় চাঁদ!”
তমা মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে-
: “আর কেন কোন স্বপ্ন ছোঁয়া বাকী তোমার মীরাপু”
উত্তরে মীরা লাজুক হাসি হাসে। মনে মন জপ করে একটা নামের।
সেখানকার সব কাজকর্ম শেষ করে বের হতে হতে রাত হয়ে যায়। সকালের সাথে ফোনে কথা হলেও একজন এখনো অভিনন্দন জানায়নি মীরাকে। সেই একজনটা হচ্ছে আবীর। ওর খুব ইচ্ছে করে এত রাত হওয়া সত্ত্বেও পুরান ঢাকায় গিয়ে আবীরের সাথে দেখা করে। যাবে কি-না তা ভেবে মনের মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব। এত রাতে যাওয়া ঠিক হবে কি? এদিকে এত রাত হওয়া সত্ত্বেও রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, এখান থেকে বেরুতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যাবে। হঠাৎ মীরার চোখ যায় রাস্তার ধারের ফুলের দোকানের দিকে। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হয় মীরা। পাশে থাকা তমা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফুলের দোকানের দোকানির সাথে কথা বলা শুরু করে মীরা। তমা ভাবতে থাকে “এত এত ফুলের বুকে গাড়ির ডিকিতে, তাও ফুল কিনতে নামলো কেন সে? ”
ফুল কিনে গাড়িতে আসতেই তমা জিজ্ঞেস করে –
: “টিউলিপ কি আবীর ভাইয়ার প্রিয় ফুল?”
মুচকি হেসে মাথা নাড়ে মীরা। এরপর আর কোন প্রশ্ন করে না তমা, রাত হওয়া সত্ত্বেও যেতে চায়না মীরার সাথে। কারন তমা জানে পুরান ঢাকার ঐ বাড়িটা মীরার জন্য ওর মায়ের পরে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।
তমা বাড়ির কাছাকাছি নেমে গেলো বাসা থেকে। ওকে বাসার কাছে ছেড়ে মীরা ড্রাইভারকে বললো তাকে শেয়ার করা লোকেশনে যেতে।মিনিট পনেরো পর মীরা পৌঁছে গেলো আবীরের বাড়িতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে মীরা বসার ঘরে বসলো, মিষ্টি আর ফুল পাশে রেখে সেবাহান চাচাকে দিয়ে খবর পাঠালো ওর আসার। একটু পরেই আবীর হুইল চেয়ারে করে নিজেই এলো মীরার কাছে। আবীরের এ অবস্থা দেখে মীরা হতবাক। বিস্ফারিত চোখে তাকায় মীরা আবীরের দিকে। খুব সম্ভবত ও মনে মনে বলছে “হুইল চেয়ার?”
: “না এক না, আচ্ছা এসব বাদ দেও, এত রাত করে কেন এলে?”
: “আজকের এই দিনে কত কত লোক অভিনন্দন জানালো আমাকে, এক আপনিই…”
: “ওরা আজ জেনেছে বলে আজ অভিনন্দন জানিয়েছে, আমি তো আমাদের শেষ দেখা হওয়ার দিনই বলে দিলাম ‘নিজের ঐ পদটা গিয়ে বুঝে নাও ”
উত্তরটা শুনে মীরা সোজা তাকায় আবীরের দিকে। আবীর মাথা নেড়ে সায় দেয় যে ও সত্যি বলছে।
মীরা পাশে থাকা টিউলিপের বুকেটা বাড়িয়ে দিলো আবীরের দিকে। তারপর বললো-
: “এটা আপনার জন্য ”
স্মিত হেসে সেটাকে গ্রহণ করলো আবীর। মীরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো সেই হাসিটা। এই ছেলেটা এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে?
গন্ধহীন ফুলের গন্ধ নেয়ার ভঙ্গিতে মুখের কাছে নেয় বুকেটাকে৷ যেন ফুল দিয়ে নাক ছোঁয়ানোর খেলা৷ যেন ফুল না আবীর নিচ্ছে মীরার স্পর্শ। ঠিক এই সময় মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় চার চোখের। দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় মীরা। আবীর মীরার দৃষ্টি গোটানোর তারাহুরো ভঙ্গি দেখে হেসে দেয়।
মীরা হঠাৎ অস্বস্তিতে পরে যায় যেন। আবীর এই অস্বস্তিটা কাটাতে বললো-
: “যাক অনেক বড় কাজ শেষ হলো তোমার”
কিছু সময় চুপ থাকে মীরা। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে-
: “এরচেয়ে বড় কাজ বাকী আছে একটা”
জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে আবীর অবাক হয়ে বলে-
: “কি কাজ?”
উত্তরে কেমন একটা চোখে আবীরের দিকে তাকায় মীরা। আবীর ওর তাকানো দেখে যেন কেঁপে উঠে হঠাৎ কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে।
কিছু সময় মৌন থেকে মীরা বিদায় নিতে চাইলে আবীর ওকে রাতে খেয়ে যাওয়ার জন্য বলে। মীরা উত্তরে বলে “দাওয়াতটা তোলা থাকলো”
রাত বেশী হওয়ায় আবীরও আটকালোনা মীরাকে। বসার ঘরের জানালা দিয়ে ওর গাড়িটার চলে যাওয়া দেখলো একমনে।
———————-
নির্বাচিত হওয়ার পর বেশকিছু ঝামেলায় পরতে হয় মীরাকে। বয়স, যোগ্যতা, অনভিজ্ঞতা, থাকা সত্ত্বেও
আশফাকুজ্জামান শাকিল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে
যতটা হালকা ভাবে নিয়েছিলো মীরাকে ঘটনা তার বিপরীতে ঘটে গেছে। নির্বাচনের আগে কোনরকম অভিযোগ না করলেও নির্বাচন পরবর্তী বেশ কিছু অভিযোগ আনেন তিনি জয়ী প্যানেলের বিরুদ্ধে। যদিও এসবের কিছুই ধোপে টিকে নি। কারন পৃথিবীর ইতিহাসে কোন পরাজিত প্রার্থীকেই বলতে শোনা যায় নি যে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে।
নির্বাচিত হওয়ার পর নিজ কাজের পাশাপাশি বেশ কিছু দায়িত্ব বেড়ে গেছে মীরার। নিজের ব্যবসায়িক কাজের চেয়ে এখন ওর পাওয়া পদবীর কাজটাই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জন্য। কারন নতুন কর্মক্ষেত্রের এ দুনিয়াটা ওর জন্য এক্কেবারে নতুন। যদিও মীরার সেক্রেটারি নাদিম মীরাকে অভয় দিয়েছে সব কাজ ওর জন্য সহজ করে দেয়ার।
ওয়েটা..
সেক্রেটারি নাদিম!
একটু অবাক হচ্ছেন তো?
অবাক হওয়ারই কথা। পালাবদলের খেলায় এত বড় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বদলে গেলেও সেক্রেটারি বদলায় নি। কারন সাবেক সভাপতি আসফাকুজ্জামান শাকিলের সেক্রেটারি নাদিম মাহমুদকে মীরা তার পদে বহাল রেখেছেন। কারন মীরার এই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে লোকটা। বলা ভালো ওর অবদান অনস্বীকার্য।
পূর্ববর্তী সভাপতি আসফাকুজ্জামান শাকিলের ক্ষমতার অপ-ব্যাবহারের শিকার শুধুমাত্র ব্যাবসায়ী মহলই নন। বরং বিজিএমইএ এর সংশ্লিষ্ট সকলের ভাগ্য বিধাতা যেন ছিলেন তিনি। কোন ব্যাপারের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনার কৌশলী হওয়ার চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেতো তার এবং তার ছেলের মন মর্জি। মনে মনে তাই এখানকার সকলেই ক্ষুব্ধ তার প্রতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এতদিন টিকে থাকায় চাইলেও কেউ মুখ খুলতে পারে নি। তার প্রতি সকলের জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ এই নির্বাচনের ফলাফল৷ সকলেই পরোক্ষ ভাবে চেয়েছে মীরার জয়। এত গুলো মানুষের দোয়া, পরোক্ষের চেষ্টা খোদা বিফলে যেতে দেন নি। সম্মানের সাথে জয়ী হয়েছে মীরা। অর্জন করেছে বিজিএমইএ এর সর্বকনিষ্ঠ সভাপতির খেতাবও।
আমাদের দেশের অর্থনীতিতে পোশাক খাত অনেক অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। বলা ভালো অর্থনীতির চাকা চালিয়ে রাখতে যতগুলো সেক্টর রয়েছে তার মধ্যে পোশাক খাত থেকে আয় হয় সিংহ ভাগ।
সেক্ষেত্রে এত বড় পদে যোগ্য লোক দায়িত্ব পালন করলে সে ক্ষেত্র উত্তোরোত্তোর উন্নতি হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে উন্নতিতো হয়ই না উল্টো এর অবনতি হচ্ছে প্রতিনিয়নত। এমনকি অযোগ্য লোক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তার ধ্বংস যে অনিবার্য তা উধাহরন হিসেবে গত কয়েক বছরের ড্যাটাই যথেষ্ট। এটা শুধু বিজিএমইএ এট সভাপতির ক্ষেত্রে না, বরং দেশের নেত্রীত্ব স্থানীয় পদগুলোর বেলাতেও পূর্বে এমন শত শত উধাহরন ছিলো। আমাদের ইংরেজি সাহিত্যে পড়া অর্থমন্ত্রী ছিলো, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) এর চেয়ারম্যান পদে ছিলো কৃষিবিদ। অযোগ্য লোকের ছড়াছড়ির ফিরিস্তি দিতে গেলে রাত কাবার হবে। সে গল্প করে লাভ নেই। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। সেসব গল্প এখন পুরোনে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের পথে। এখনকার মানুষ সচেতন, নিজ অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন শেষ। তবে দেশের সকল সেক্টর এখনো দূর্নীতি মুক্ত হয়ে ওঠেনি। একসময় মানুষ উন্নত দেশের চেয়ে দূর্নীতি মুক্ত একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন বেশী দেখতো। সে স্বপ্ন এখন পূরণের পথে। সেই দিন আর দূরে নেই যেদিন এই দেশ যোগ্য লোকের শাসনে নিজের যোগ্যতায়, শিক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে৷
এক সময় দেশের পোশাক খাত রপ্তানির শীর্ষে অবস্থান করেছিলো। কৌশলগত কিছু ভুল সিদ্ধান্তে সে স্থান হারাতে বসেছিলো দেশ। টেন্ডার বানিজ্য, এলসি ওপেনিংএ ব্যাংকি জটিলতা, চাঁদাবাজি, সহ এমন নানান জটিলতায় এ খাতের ব্যবসায়ীরা হুমকির মুখে পরেছিলো। এসকল বিষয় সামনে রেখে বেশ কিছু চ্যালেন্জ রয়েছে মীরার। তবে পূর্ববর্তীর করা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চায় মীরা। সকালের সাথে প্রভু-প্রজা সম্পর্ক না, করতে চায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যেখানে প্রত্যকের মতামত সমান ভাবে ভেবে দেখা হবে। তাহলেই তাদের সমস্যা গুলোকে সমাধান করতে পারবে। মীরা এসব চ্যালেন্জ মাথায় রেখেই পরবর্তী কর্মপন্থা সাজিয়েছে।
সে প্ল্যানের প্রথম কাজ হিসাবে মীরা জয়ী হওয়ার পর দেখা করেছে ওর পূর্বসূরির সাথে। কথা বলেছেন খোলাখুলি, যেন ওদের মধ্যে কোন শত্রুতা কোনদিনই ছিলো না।আশফাকুজ্জামান শাকিল মীরার আগমন প্রত্যশা করেননি। তবুও মীরা তার সাথে দেখা করেছে, বিনয়ের সাথে অভিজ্ঞ হিসেবে পরামর্শ এবং সহযোগীতা চেয়েছেন তার কাছে। এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। মীরা তার সাথে সাক্ষাৎ এর সময় বলেছে- আপনার সাথে আমার কোন ব্যাক্তিগত শত্রুতা নেই। ক্ষমতার পালাবদল নতুন কিছু না, তবে প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবার মতো বোকা আমি নই। প্রতিহিংসার মনোভাব কখনোই দেশ ও দশের উন্নয়ন করতে পারে না। ব্লেইম গেইমের শেষ এখানেই হোক৷
আশফাকুজ্জামান শাকিল ঠান্ডা গলায় বললো-
: “আমি কোন গেইম খেলি নি, তুমিই বলো তুমি কি এ পদের যোগ্য? ”
মীরা আত্নবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলে-
: “আপনি নিজেই কিন্তু এ স্বপ্নটা দেখেছিলেন একদিন। পার্থক্য শুধু তখন আমাকে অনুগ্রহ করতেন, এখন আমি নিজের যোগ্যতায় এ পদে বসেছি। আপনিই তো চেয়েছিলেন আমি এ আসনে অধিষ্ঠিত হই। এখন বলুন আপনি আপনার মামনিকে দোয়া করবেন না?”
আশফাকুজ্জামান শাকিল কেমন চিন্তিত হয়ে পরলেন। মীরা তাকে ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে রেখে ই বললো-
: “আগামীকাল আমি সভাপতি হিসেবে অফিসিয়ালি দায়িত্ব গ্রহণ করবো। আমি আপনার দোয়া চাই ”
আশফাকুজ্জামান শাকিল কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো মীরার এমন কথায়। তার মনের পাথর যেন গলতে শুরু করলো মীরার এমন আচরণে।
শত্রু বশীকরণে বেশ আগে থেকেই মীরা যে সিদ্ধ হস্ত।
এ আর নতুন কি। দিন শেষে একটু শান্তিতে থাকতে মীরার এ চেষ্টা ।
তার সাথে সাক্ষাৎ শেষে অফিসে ফিরলে সেক্রেটারি নাদিম বলে-
: “ম্যাডাম আমি আপনার জন্য নিজে কালার হয়ে গেলাম, আর আপনি গিয়ে দোয়া চেয়ে আসলেন? দিস ইজ নট ফেয়ার ”
রিভলভিং চেয়ারটায় হেলান দিয়ে মীরা বলে-
: ” তার কাছে দোয়া,সহযোগিতা চেয়েছি কিন্তু তাকে তার অন্যায়ের শাস্তি দিতে আমার কোন সাহায্য দরকার হলে আমি তা করবো না তা তো বলিনি”
সময় কাওকে ক্ষমা করে না নাদিম। তাকে শাস্তি দেয়ার আমি কেউ না, তবে ন্যায়ের পক্ষে থাকতে পিছুপা হবো না আমি।
সম্পর্ক উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই সকল ব্যাবসায়ীদের সাথে কুশল বিনিময়ের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন মীরা৷
যথাসময়ে সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। পোশাক খাতে বর্তমান চ্যালেন্জের বিষয়ে আলাপ হয়, আলাপ হয় এ খাতের সম্ভাবনা নিয়েও। ব্যাবসায়িক সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে কি কি প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হয় সে বিষয়েও জানায় ব্যবসায়ীরা। মীরা সকলকে অনুরোধ করে সমস্যা আর চ্যালেন্জ গুলোকে লিখিতভাবে জমা করতে। তাতে করে এসব বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকবে। সবশেষে মীরা এখানে নতুন হওয়ায় সকলের পরামর্শ এবং সহযোগীর আহ্বান করে।
উক্ত সভায় মীরার বিনি পয়সায় কেনা শত্রু মিলন ও ছিলো। সভায় একেবারে পিছনে বসেছিলো ও। যাতে ওকে না দেখায়। একসময়কার সহকর্মী, একসাথে যারা বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দিতো তাদের অনেকের সাথে দেখা হলো। তবে এত মানুষের মাঝে মিলনের নিজেকে আড়াল করার ব্যাপারটা মীরার চোখ এড়ায় নি। অপর দিকের সারিতে বসা ফ্লোরাও উসখুস করছে। ফ্লোরাকে মনে আছে আপনাদের?
ঐ যে গত কনফারেন্সে মীরাকে ছোট করতে চাওয়া উদ্যোক্তা মেয়েটা। ফ্লোরা যেন ঠিক মীরাকে এখানে মানতে পারছে না।
সভা ভাঙলে মীরা তার সেক্রেটারিকে দিয়ে মিলনকে ডেকে পাঠায়। সভা শেষে অনেকেই মীরার সাথে পার্সোনালি পরিচিত হতে এগিয়ে আসে৷ এদের মধ্যে রয়েছে ফ্লোরাও। ও নিজ থেকে এসে ক্ষমা চায় মীরার কাছে ঐদিনকার আপত্তিকর কথাবার্তার জন্য। মীরা ওকে হাগ করে বলে তুমি এসেছো আমি খুশি হয়েছি। আর ঐসব আমি কবে ভুলে গেছি। তুমিও ভুলে যাও বলে মীরা বাকীদের সাথে কুশল বিনিময় করে এগিয়ে যায় মিলনের দিকে।
মিলন বেচারা যেন গুটিয়ে গেছে ভেতর থেকে। ওকে এখন দেখে মনে হচ্ছে মাথা শরীরে ঢুকে গেছে। এমন ধাক্কা বোধহয় বেচারা জীবণেও খায় নি। কাছে দিয়ে মীরা একটা হাসি হেসে বলে-
: “কেমন বোধ করছেন মিলন ভাই”
মিলন মীরার দিকে চেয়েই চোখ নামিয়ে নিলো। যেন মীরা কোন দৃপ্তিমান সূর্য যার দিকে খলি চোখে তাকানে যায় না।
স্মিত হেসে মীরা বললো-
: “আপনাকে ধন্যবাদ”
বলে কিছু সময় মৌন থেকে মীরা আবারো বললো-
: “কেন জানেন? ” আপনারা জোট বেঁধে আমাকে টেনে নামাতে এতটা উদ্ধত না হলে আজ হয়তো এখানে থাকতে পারতাম না আমি ”
এবার মিলন কিছু একটা বলবার তাগিদ অনুভব করলো। মাথা অবনত রেখে ক্ষিণক্ষিনে গলায় বললো-
: “আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি খুবই দুঃখিত ”
: “ঠিক কোন কোন কারনে আপনি দুঃখিত মিলন ভাই?
আমার সংসার ভাঙার জন্য?
আমাকে ধ্বংস করার জন্য? নাকি
শেষ পর্যন্ত সায়নের সাথে যুক্ত হয়ে একটা নিরপরাধ মানুষকে এসবের মধ্যে জড়ানোর জন্য?
ক্ষণকালের বিরতির পর মীরা বলে-
: ” এক কাজ করুন মিলন ভাই, আপনি বরং নিজের কাছেই ক্ষমা চান। একটা অসহায় মেয়েকে টেনে নিচে নামানোর খেলা খেলতে খেলতে আপনি আপনার মনুষ্যত্ব খুইয়ে ফেলেছেন”
অসহায় চোখে তাকায় মিলন মীরার দিকে। আবারো ক্ষণকালের বিরতির নামে হল ঘরটায়। বেশ কিছু পর মীরা বলে-
: “আমার সাথে করা একের পর এক অন্যায়ের জন্য আপনাকে কঠিন শাস্তি দিবো আমি”
কথাটা শুনে চমকে যায় মিলন। কারন সত্যি সে ক্ষমতা মীরার এখন আছে। মুচকি হেসে মীরা বলে-
মাথা নত করে রাখে মিলন। চোখ বন্ধ করে ভবাতে থাকে মীরার প্রতি ওর করা ভুলের আমলনামা।
মীরা নিজের কন্ঠে কোমলতা এনে বলে-
: ” আমার অনেক কিছু করবার যুক্তিসঙ্গত কারন এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম, আপনি ভালো থাকবেন ”
বলেই ঘুরে হাঁটা দিতে নেয় মীরা। অস্ফুটে মিলন মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে-
: “আপনার কথা আমার মনে থাকবে মীরা”
ঘুরে মীরা মিলনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি হাসে। তারপর বেরিয়ে যায় সভাস্থল থেকে। মীরা চলে যাবার পরও মিলন আনমনে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সময়। সেখানকার স্টাফ ক্লিনিং এর জন্য এসে দেখে একটা ভাঙাচোরা, বিপর্যস্ত মনের লোক আনমনে দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে…
প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৯২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)
কাজকর্মে ডুবে আছে যেন মীরা। নিজের ব্যবসা, নতুন দায়িত্ব, মেয়ের স্কুল ভর্তির প্রস্তুতির তদারকি সবকিছু মিলিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার সময় নেই যেন ওর। অন্যদিকে
আবীরের ও খোঁজখবর নিতে হয় সময়ে সময়ে। মীরা আর আবীরের বেশীরভাগ কথাবার্তাই হয় টেক্সটে।কথা বলে জেনেছে পা’টার ইনফেকশন সেরেছে অনেকটা। হাঁটতে পারছে এখন আবীর।
সারা সপ্তাহ কাজে ব্যাস্ত থাকলেও শুক্রবারটা সময় পেলে যেতে চেষ্টা করে মীরা আবীরের পুরান ঢাকার বাড়িতে। গত শুক্রবার নূহা যেতো বায়না ধরায় যাওয়া হয়ে উঠেনি ঐদিকটায়। এসব শুনে আবীর অবশ্য বলেছিলো ওকে নিয়ে আসতে, কিন্তু মীরা কি এক অজানা কারনে নূহাকে নেয়না আবীরের বাড়িতে। এখন পর্যন্ত আবীর অনেকবার নূহাকে দেখতে চেয়েও সামনাসামনি দেখতে পারেনি নূহাকে।
মায়ের বাড়িতে মীরা-ইরা দু’বোন বেড়াতে যাওয়ার সময় একদিন ওদের মা জাহানারা আবীরকে দেখতে যাওয়ার সময় নিজ থেকে চেয়েছিলেন নূহাকে আবীরদের বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু মীরা নূহাকে যেতে দেয় নি। বেড়াতে না যেতে পেরে নূহার সে কি কান্না! বিরক্ত হয়ে ইরা জিজ্ঞেস করেছিলো-
: “সমস্যা কোথায় ঐ বাড়িতে গেলে? বাচ্চা মানুষ কিভাবে কাঁদছে… ”
মীরা তখন ইরার প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় নি। তবে রাতে ইরা শান্ত ভবে মীরাকে প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করলে মীরা ইরার চোখে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলে-
: “নূহা যদি জিজ্ঞেস করে আবীর কে? কি উত্তর দিবো আমি? বলবো যে আবীর তোমার আঙ্কেল? ”
বলেই উঠে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে যায় মীরা। ইরা ওর বোনের এই অর্ধেক কথার আগামাথা কিছুই না বুঝলেও বোন যে রেগে গেছে তা ঠিক বুঝে যায় ইরা, তাই ব্যাপারটা চেপে যায় ও।
কিন্তু মীরা মায়ের বাড়িত ওদের ঘরে এসে মনে মনে আওড়াতে থাকে “আরেহ্ শেষ পর্যন্ত আবীর যদি কন্ভেন্স হয় তাহলে? একবার বলবো আবীর তোমার আঙ্কেল হন, আরেকবার বলবো তোমার বাবা হন” এসব স্টুপিডিটির কোন মানে হয়। তাছাড়া নূহা যে ইঁচরে পাকা, ওকে যা না বলা হয় তাই বের করে ফেলে আর এসব….। সবকিছু সমাধানের সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায় নি, এত সহজে ওকে ছেড়ে দিবো আমি? ” যেন কথাগুলো মনে মনে বলছে না মীরা, জবাবদিহি করছে কাল্পনিক ইরার সাথে। সে রাতটা ওরা আড্ডায়, গল্পে ওর মায়ের বাড়িতেই কাটালো।
পরেরদিন খুব সকালে মীরার ঘুম ভাঙে। দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল হলেও শুরু হয় একটা খারাপ খবর শুনে। ওর ফ্যাক্টরির ম্যানেজার ফাহাদ খুব সকালে কল করেছে ওকে, এত সকালে ফোন করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ও-ই মীরাকে দিলো খবরটা। আর খবরটা হচ্ছে – “পিংক ক্লোজেট” ফ্যাক্টরির মালিক “মিলন মাহমুদ ” আ*ত্ন*হ*ত্যা করেছেন। খবরটা শুনে মীরা কেমন তব্দা খেয়ে যায়। বলে কি? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মীরা৷ বারবার মনে হচ্ছে ভুল শুনছে ও। কিংবা ইনফরমেশনে কোন গড়মিল রয়েছে। নামে নামে তো কত বিভ্রট হয় দুনিয়ায়৷ লোকটা ওর শত্রু তবুও তারতাজা একটা মানুষ এমনি হুট করে?
মীরা ফাহাদের কল রেখে কল করে মুনিয়া আপুকে। মুনিয়া আপু “রিদম অফ লাইফ” গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি জানান গত রাতেই তিনি খবরটা পেয়েছেন। তিনি জানালেন – মিলন সাহেবের স্ত্রী তার বাবার বাড়িতে ছিলেন। দুই দিন পর বাড়ি ফিরে দেখেন এ অবস্থা। এ কাজটা তিনি কখন করেছেন তা জানে না কেও। গত দুইদিন ধরে তিনি করো ফোন রিসিভ করছিলো না। পো*স্ট*ম*র্টে*ম করলে হয়তো মৃত্যুর আসল রহস্য জানা যাবে। পুলিশ তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে।
এদিকে সন্দেহজনক কিছু না পাওয়ায় পুলিশ মিলনের স্ত্রীকে আটকের পরদিনই ছেড়ে দেন। খবরটা পেয়ে মেয়েটার সাথে মীরা দেখা করতে যাবে যাবে করেও ব্যাস্ততায় যেতে পারে না। তবে দিন যত পার হতে থাকলো মৃ*ত্যু সংক্রান্ত কথাবার্তা ততো জানা গেলো চারপাশ থেকে। মীরার এক সময়কার সহকর্মী নিলুফার আপা গতকাল মীরাকে ফোন করে বললেন- কিছুদিন যাবৎ মিলন নাকি অপ্রকৃতস্থের মতো ছিলো। কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাসায়ই থাকতে সারাক্ষণ। কি যেন ভাবতো আনমনে”
মীরা তখন তাকে বললো-
: “স্বামীকে এমন অবস্থায় ফেলে মহিলা বাবার বাড়ি কেন গেলেন? না গেলেই কি হতো না?”
নিলুফা আপা বললেন-
: আরে বৌটার বাবা অসুস্থ, এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাই বাধ্য হয়ে গিয়েছিলো বাবার বাড়ি। তা কি আর কাছেপিঠে? সেই নেত্রকোনা, আসলে ওর ম*র*ন এভাবেই লেখা ছিলো, তা নাহলে….
এরপর নানান চিন্তায় মীরার দুটো দিন কেটে যায়। কেন জানি নিজেকে অপরাধী মনে হয় মিলনের এই দূর্ঘটনার জন্য। খুব খারাপ লাগতে থাকে মিলনের স্ত্রী ইভার জন্য। দোনোমোনো করেও অবশেষে মীরা দেখা করতে যায় মিলনের স্ত্রী ইভার সাথে। সম্পর্কের বর্তমান পরিস্থিতি যা-ই হোক ওরা পূর্বপরিচিত৷ এবং মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো এককালে। কিন্তু মাঝখানে রাজীব, মিলন৷ লোভ, লালসা আর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সম্পর্কটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সব ভুলে মীরা সেখানে গিয়েছিলো মানবতার কারনে।
মীরা সে বাড়িতে গেলে দরজা খোলে মিলনের স্ত্রী ইভা। অনিন্দ্য সুন্দরী ইভার সৌন্দর্য মীরার চেয়ে কম না। দুজনের পার্থক্য কেবল উচ্চতায়। মীরা বাঙালি মেয়েদের গড় উচ্চতার চেয়েও লম্বা। পাঁচ ফুট সাত, আর ইভা পাঁচ ফুট এক কি দুই হবে।
মীরাকে দেখে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলে ইভা। যেন মীরা ওর আপন কেউ আর মীরা যে আজ আসবে তার অপেক্ষায়ই ও বসেছিলো এতক্ষণ।
বসার ঘরটায় বসলো মীরা, ইভা নাশতা এনে মেহমানের মতো আপ্যায়ন করলো। এরপর মীরাই আলাপ শুরু করলো। ইভা কাছের লোকের মতো সবটা খুলে বললো মীরাকে। কিছুদিন ধরে মিলনের কথাবার্তা, চালচলনে অসংলগ্নতা, ওর বাবার হঠাৎ অসুস্থ হওয়া, হুট করে ওকে রেখেই বাড়ি যাওয়া, ওকে ফোনে না পাওয়া, পরদিন ঢাকায় ফিরে এসে এসব দেখা সব।
এরপর ওদের দু’জনের কথাবার্তা হলো আরো অনেক সময় ধরে । মীরা বললো কম, শুনলোই বেশী। কঠিন মনের মীরা যতটা ভঙ্গুর ভেবে স্বান্তনা দিতে এসেছিলো ইভাকে ততটাই ভঙ্গুর হয়ে ফিরলো ও সেখান থেকে। ইভার মধ্যে কোন দুঃখ, শোক তাপ কিছুই ছিলো না।
ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও এখনো বুঝতেই পারে নি কি হয়ে গেছে ওর জীবণে। মিলন আর যাই হোক স্ত্রীকে ভালোবাসতো। তবে ইভার সাথে কথা বলে এতদিনে আজ মীরা উত্তর পেয়েছে –
কেন মীরার অসহায়ত্ব দেখাই মিলনের এক মাত্র ইচ্ছে ছিলো?
কেন ওকে টেনে পথে নামাতে মরিয়া ছিলো মিলন?
দুই-দুটো দিন ঘোরের মধ্যে থাকে মীরা এসব। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে যার এতদিন গর্ব হতো সেই সৌন্দর্যের প্রতি ঘৃণা হতে শুরু করলো ওর। ঐ প্রশ্নের উত্তর গুলো ভাবতেই অনেক অসহায়বোধ করে মীরা। খুব করে মনে হয় সত্যি একজন মানুষ যত সফলই হোক একা জীবণ পাড়ি দিতে পারে না। মনের কথা বলার জন্য হলেও একজন মানুষ চাই তার।
আবীরের কথা খুব মনে পরে ওর। শুক্রবার হতে আরো দুইদিন বাকী৷ টুকটাক কথা হলেও প্রায় পনেরো দিন হতে চললো দেখা হয়না দুজনের। এদিকে কত কাজ জমে আছে ওর দুদিন বাড়িতে থাকার কারনে। এখনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে মীরার। দরকার পরলে ঘেরাটোপে থাকা কথা গুলোকে সরাসরি বলবে ও আবীরের কাছে – “আপনার কাছে আমি একটু ভরসার আশ্রয় চাই, আমার আপনাকে বড্ড প্রয়োজন”
সারাদিন কাজে ব্যাস্ত থাকলেও ডুবে থাকে ঐ ভাবনায়। দিনশেষে মন খুলে কথা বলার একজনের,
একটা নিরাপদ আশ্রয়ের। ঘড়ির কাটার মতো সময়টাকে যদি টেনে নিতে পারতো কিংবা কাস্টমাইজড করতে পারতো ফোনের তারিখ সেটিংস এর মতো, কত্ত ভালো হতো!
অবশেষে কাঙ্খিত দিনটি এসে উপস্থিত মীরার জীবণের দোরগোড়ায়। মনে চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো ও এই দিনটার। আজ একটা কিছু হবেই হবে। হয় এপাড় নায় ওপাড়। এমনি দোদুল্যমান রাখবে না ও আর দুজনের সম্পর্কটাকে। আজ ও আবীরের সম্মতি আদায় করে আনবেই আনবে।
মাজেদা খালা নূহাকে নিয়ে ওর মায়ের বাড়ি গেছে সকাল সকাল। ওর একটা কাজ আছে বলে তাদের পাঠিয়েছে মীরা।
তাদের বিদায় দিয়ে আলমারী খুলে লেভেন্ডার রঙের একটা সুতি শাড়ি বের করে ও। সাথে সাদা ব্লাউজ। কোন সাজসজ্জার ধার ধারে না ও। সুন্দর করে শাড়িটা পরে নেয়। মীরা ওর অবাধ্য চুল গুলোকে সোজা সীঁথি করে খোঁপা করে নেয়। চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা কালারের লিপস্টিক দেয় ও। কপালে ছোট্ট কালো টিপ পরে ও সাজসজ্জার সমাপ্তি ঘটায় ও। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে জুতার কাবার্ড থেকে স্লিপার একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পরে মীরা।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকাশায় বসে দুজনের কথোপকথন কল্পনা করতে থাকে ও। কি বলবে? কিভাবে বলবে তার মহড়া চলে মনে মনে। এসব ভাবতেই একটু পরে পর হাসছে ও। কৈশরে প্রেমে পরার অনুভূতির মতো একটা অনুভূতি তোলপাড় করে দিচ্ছে ওর ভিতরটাকে৷ অথচ এই লোকটাকে ও ত্যাগ করেছিলো একদিন।
এসব ভাবনায় ডুবতে ভাসতে ও পৌঁছে গেলো ওদের বাড়ির কাছে। রিকশার ড্রাইভারকে গলির ডিরেকশন বলে দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চুল, টিপ চেক করলো ও।
বাড়ির কাছে পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরলো ও। বাড়ির ভিতরে ঢুকে চোখ বুলালো গাছ, পাতা, আঙিনা আর টানা বারান্দাটা। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঠলো দোতলায়৷ প্রিয় সেই লোকটা কয়েক মূহুর্তের তফাৎ এ বসে আছে। কেমন চমকে যাবে ও মীরাকে দেখে। এসব ভাবতেই বসার ঘরের দিকে যায় মীরা। সোবহান চাচার মুখোমুখি হয় মীরা সেখানে যাবার আগেই। মীরাকে দেখে তিনি ভীষণ চমকে যান। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বলেন-
: “মামনি আপনে?”
: “এত চমকে যাচ্ছেন কেন চাচা, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভূত দেখছেন, আপনার চাচাকে খবর দেন, বলেন আমি আসছি”
সোবাহান চাচা অবাক ভঙ্গিতে বলে-
: “আবীর চাচায় আপনেরে বলে নাই কিছু?”
মীরা হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে বলে-
: “কি বলবে”
: “হেয় তো চিটাগাং গেছে আজ নয় দিন চললো, আপনে কিছু জানেন না?”
কথাটা শুনে মীরার পৃথিবী যেন দুলতে শুরু করলো। মনে মনে বললো- “কিহ্ আবীর ঢাকা ছেড়েছে আজ নয় দিন!? ”