Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 263



অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৪

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৪

নিত্যদিনের মতো সকাল হতেই কাজে লেগে পরলো জমিদার বাড়ির গিন্নিরা। উপমা জমিনে বসে রুটি বানাচ্ছে ছায়া ভাঁজছে। পাশেই বসে ফাতু সবজি কাটছে। তুলসী নিজ হাতে উটের মাংস রান্না করছেন আর তুলি তাকে সাহায্য করছে। গৃহে মেহমান এসেছে রান্নাবান্নার জড়তর দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সাইয়েরা মাত্র রসইকক্ষে পা রাখেন। মাংসের সুবাসে মন ভোরে উঠে তার। দৃষ্টি নত করে একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-কোনো মেহমান আসবে আজ?
-আসবে না এসেছে! ইয়াশার এসেছে গতরাতে। গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো হটাৎ বৃষ্টি হওয়ায় এখানে চলে এসেছে।
রুক্ষ স্বরে বলল তুলসী। সাইয়েরা থমথমে যায়। কোনো কাজ না পেয়ে ফাতুর সাথে সবজি কাঁটতে বসে। তুলসী রান্না শেষ করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
-অনেকদিন পর এসেছে ছেলেটা ভালোমতো আপ্যায়ন করতে হবে। কোনোরূপ ক্রুটি আমি দেখতে চাই না সকলে এটা মাথায় রেখো।

উপমা তুলসীর কথা শুনে নীরব ভণিতায় কাজ করতে থাকে। আজ আবার সোহরাবও আসবে। তাই উপমার মস্তিকে এখন অন্য চিন্তা ঘুরছে। রান্না শেষে ভোজনশালায় খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। উপমাকে খামখেয়ালি করতে দেখে ছায়া জিগ্যেস করে,
-তুমি ঠিক আছো উপমা?
-জি আপা।
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় উপমা। একে একে সবাই উপস্থিত হয়। সবার শেষে আসে ইয়াশার। মামাজানদের সাথে সাক্ষাৎ করে খাবারের জন্য বসে। ভৃত্যরা পরিবেশন করছে। মহিলারা কিনারে দাঁড়িয়ে দেখছেন। উপমা একদম পিছনে তাই ইয়াশারের দৃষ্টি তখনও তার ওপর পৌঁছায়নি।
খাওয়া শেষে অন্দরের ভিতরের বৈঠকখানায় বসে সকলের সাথে কথা বলছিলো ইয়াশার। তুলসীকে দেখে মুখে প্রশস্ত হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
-মামীজান ছোট ভাবিজানের সাথে পরিচয় করাবেন না?
-অবশ্যই করাবো। তাহেরা রে তোর ছোট ভাবিজানকে ডেকে নিয়ে আয়।

তাহেরা উপমাকে ডাকতে তার কক্ষে যায়। আসতে না চাওয়ার সত্ত্বেও মনের সাথে যুদ্ধ করে আসে উপমা। কাঁপা কাঁপা পায়ে সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নেমে আসে। রুমকি আর ইয়ামিনের সাথে দুষ্টামি করতে করতে তার নজর পরে সিঁড়ি দিয়ে আসা তরুণীর ওপর। ধীর পায়ে সামনে আসতেই ইয়াশারের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরে। চিত্তে কেমন জানো একটা চুর্ণবিচুর্ণ ধ্বনি শুনতে পায় সে। সকলের সামনে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকলেও মনের ভিতরে বৈশাখমাসের ঝড় চলছে সেটা শুধু উপমাই উপলব্ধি করতে পারছে।

তুলসী উপমাকে ধরে এগিয়ে নিয়ে এসে বলে,
-এইযে তোমার ছোট ভাবিজান ইয়াশার বাবা। উপমা ও হলো তোমার ফুঁপ্পাতো দেওর।
তুলসীর কথায় জমিনের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে সালাম দেয় উপমা। ইয়াশারও মুচকি হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
-ভালো আছেন ছোট ভাবিজান?
ইয়াশারের কণ্ঠের এক অন্যরকম টান অনুভব করলো উপমা। কোনোরকম শুকনো ঢোক গিলে বলে,
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাই।

__________________
দুপুরে উপস্থিত হয় সোহরাব। এতদিন পর ভাইকে পেয়ে দুইজনের কথার আর শেষ নেই। সন্ধ্যার পর তাহেরার কক্ষে গল্প করছিলো উপমা, ছায়া। এমন সময় কক্ষে উপস্থিত হয় ইয়াশার। তাকে দেখা মাত্রই তিনজন রমণী ঠিক করে বসে। ইয়াশার আগাগোড়া পরোক্ষ করে বলল,
-আমি কী ভুল সময়ে আসলাম?
-একদম না। ভিতরে আসো ইয়াশার ভাই।
তাহেরার কথায় ভিতরে প্রবেশ করে। চেয়ারে বসে ভাবুক স্বরে বলে,
-শুনলাম আগামীকাল নাকি চন্দ্রপুর গ্রামের স্কুল মাঠে মেলা বসবে! বড় ভাবিজান মনে আছে আমরা আগেরবার গিয়েছিলাম?
-হ্যাঁ। মনে আছে ভাই।
-চলেন তাহলে এবারও যাই। আমাদের নতুন ভাবিজানও দেখতে পারবেন এখানকার মেলা।
শেষের কথা বলে উপমার দিকে তাকায় ইয়াশার। মুখে কুটিল হাসি তার। উপমাকে জব্দ করার জন্য যে বার বার “ভাবিজান” বলছে সেটা ভালোই বুঝছে উপমা। তাই নিজ থেকেই বলল,
-আমি বেশি হাঁটাহাঁটি পছন্দ করি না ভাই তাই আপনারা নাহয় যেয়েন।
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায় উপমা। কিছু না বলে বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। তাহেরা বুঝতে পারলো না হটাৎ উপমার হলো কী!

যাওয়ার সময় বারান্দায় দেখা হয় সোহরাবের সাথে। একদম মুখোমুখি দেখা হওয়ায় ইতস্ততবোধ করতে থাকে উপমা। পাশ কাটিয়ে যেতে উদ্যত হতেই সোহরাব পিছন থেকে বলে উঠে,
-দাঁড়ান উপমা।
স্টান হয়ে দাঁড়িয়ে যায় উপমা। এক অদৃশ্য বন্ধনে পা’জোড়া থেমে যায় তার। সোহরাব এগিয়ে এসে দাঁড়ায় উপমার স্মুখীন। বুকে দু’হাত গুঁজে গম্ভীর স্বরে বলল,
-আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।
-শুনছি?
-থাক এখন নয় আগামীকাল বলি। এখন আসতে পারেন।

উপমার মেজাজ গরম হলো। সোহরাব কী তার সাথে কোনোভাবে মজা নিলো! বিয়ের এতদিন পর আজ প্রথম কথা বলেছিলো সে। একহাতের মুঠোয় শাড়ীর কুচি ধরে দ্রুত গতিতে চলে যায়। সোহরাব এক ধেনে তাকিয়ে রইলো উপমার যাওয়ার পানে। তার মনে হলো উপমা একটু বেশিই চিকন বাতাস আসলেই উড়ে যাবে! আনমনে হাসলো সে।

অশান্ত মনে কক্ষে পায়চারি করছে উপমা। রাতের খাবারের সময় সুযোগ বুঝে ইয়াশার তাকে ছাদে আসতে বলেছে। এখন সে চিন্তায় পরে গিয়েছে কিভাবে ইয়াশারের স্মুখীন দাঁড়াবে!গৃহের কেউ দেখলে বিরাট কেলেঙ্কারি লেগে যাবে। এখন সময় রাত দশটা। উপমার জানা মতে সকলেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দ্বার খুলে। বড় একটি ঘোমটা দিয়ে হাঁটা ধরে। যত সামনে এগোচ্ছে ততই হৃদপিন্ডে তোলপাড় বাড়ছে।
শেষ সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে আসতেই এক ধমকা হাওয়া ছুঁয়ে যায় উপমার সর্বাঙ্গ। কিছু দূরেই দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে তামাক ধোঁয়া উড়াচ্ছিলো ইয়াশার। উপমাকে দেখতে পেয়ে ওষ্ঠ থেকে সি’গা’রেট সরিয়ে ফেলে। বড় একটি হাসি দিয়ে বলল,
-ভাবিজান, আসেন আসেন দাঁড়িয়ে কেনো আছেন?
চোখ, মুখ খিঁচে দু কদম এগোয় উপমা। ইয়াশার এগিয়ে এসে নাটকীয় ভঙ্গিতে উপমা চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।
-মাশাআল্লাহ! শাড়ীতে তোমাকে সুন্দর লাগছে।
-আমি এসব শুনতে আসিনি ইয়াশার। আপনের যা বলার জলদি বলেন।
ওষ্ঠকোণে ক্রুটি হাসি ফুটতেই পরমুহূর্তেই সেটা গায়েপ হয়ে যায়। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উপমার ওপর। অতি অসহায় কণ্ঠে জর্জরিত হয়ে বলল,
-তুমি থেকে এখন আপনি! বাহ্! আমার সাথে এমনটা কেনো করলে হুমাশা?

এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট ছিল উপমার চিত্তকে দুর্বল করে দিতে। কী করুণ সেই কণ্ঠস্বর! উপমা সাবধান দৃষ্টিতে এদিকসেদিক তাকিয়ে বলল,
-আমি উপমা। আপনার হুমাশা মৃত্যুবরণ করেছে বহু আগেই।
-সেটা আমিও দেখছি! কী কমতি ছিল আমার ভালোবাসায়?
উপমা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। মস্তিকে উচ্চারণ করার মতো কোনো বাক্যই খুঁজে পেলো না সে। শুধুই নির্বোধ চোখে তাকিয়ে রইলো।ইয়াশার উপমাকে মৌন থাকতে দেখে ঈষৎ হেসে বলল,
-ভালোবাসো নিজের স্বামীকে? আপন করে নিতে পেরেছো?
-নির্বোধের মতো কথা বলিয়েন না ইয়াশার ভাই।
-ভাই না বলে আমার এই হৃপিন্ডে ছুরি ঢুকিয়ে দেও তবেও এতো পীড়া হবে না।
উপমা আর কঠিন্য বজায় রাখতে পারলো না।যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ইয়াশার আকস্মিক তার বাম হস্ত চেপে ধরে। উপমা চমকিত নয়নে তাকাতেই সহসা ইয়াশার তার দিকে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিগ্যেস করলো,
-এই কোমল হাত ছুঁয়েছে তোমার স্বামী? নাকি পুরো কায়াই নিজের চিহ্ন দিয়ে দিয়েছে?
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় উপমা। সে বুঝতে পারে ইয়াশার তার এবং সোহরাবের মধ্যকার সম্পর্ক জানতে চাচ্ছে। ক্রোধিত কণ্ঠে উপমা বলল,
-কথায় লাগাম টানুন ইয়াশার। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী।
-ভাইয়ের স্ত্রী পরে আগে তো আমার প্রিয়সী ছিলে সেটা তুমি কিভাবে ভুলে যাচ্ছ?
-আমাকে আমার থেকে ভালো তো আপনি চেনেন তাহলে আমাকে কেনো একের পর এক প্রশ্ন করছেন?
উপমা চলে যেতে পা বাড়ায়। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে শুনতে পায় অশোভনীয় একটি বাক্য। নিজের কানকে নিজেই যেনো বিশ্বাস করতে পারলো না সে।
ইয়াশার অসন্তোষে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
-তোমার স্বামী তোমাকে ছুঁবে, রজনী অন্ত করবে তোমার দেহের উত্তাপে! কিন্তু তোমার দেহ, মনে তো শুধু আমার অধিকার। কিভাবে আমি সয্য করবো তোমার গায়ে অন্যকারো ছোঁয়া? বলে যাও হুমাশা?
উপমা ঘাড় বাঁকিয়ে একবার পিছনে ফিরে। ছলছল আঁখিজোড়া দিয়ে পলকহীন ইয়াশারকে দেখে দ্রুত পায়ে চলে যায়। এক প্রকার দৌড়ে সিঁড়ি থেকে নেমে আসে। পিছনে তাকে ভুত তাড়া করেছে এমনই অবস্থা! গাল বেঁয়ে অবহেলায় অশ্রু গড়িয়ে পরছে। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে বক্ষস্থল। ছুটতে থাকা অবস্থায় মাথা থেকে সরে যায় শাড়ীর আঁচল। সুবিশাল বারান্দা আজ যেনো শেষ হচ্ছে না।
গ্রন্থাগার থেকে বই পড়ে নিজ কক্ষে যাচ্ছিলো সোহরাব। ঠিক সেই মুহূর্তেই সোহরাবের বুকে এসে ধাক্কা খেলো উপমা। সুঠাম, শক্ত মজবুত বুঁকের আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো উপমার। নিজের ক্ষুদ্র দেহখানি ঠিক রাখতে না পেরে চিৎ হয়ে জমিনে পরে যায় সে।
বৈদ্যুতিক হলুদ আলোয় সোহরাব স্পষ্ট উপমাকে দেখতে পেলো। এলোমেলো অবস্থায় উপমাকে দেখে কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো সে। অশ্রুসিদ্ধ লাল আঁখিজোড়া দিয়ে ভয়াত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে শরীর কম্পন পর্যবেক্ষণ করতে পারছে সে। সোহরাব দিকবেদিক ভুলে উপমাকে তুলতে যাবে তার পূর্বেই দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ায় উপমা। কোমরে ব্যাথা পাওয়ায় টান টান হয়ে দাঁড়াতে পারছে না তবুও সোহরাবকে উপেক্ষা করে পা আগে বাড়ায়।
কিঞ্চিৎ রাগ হলো সোহরাবের। চোয়াল শক্ত করে উপমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
-ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পারছেন না অথচ যাওয়ার জন্য এতো তাড়া! আমি বাঘ ভাল্লুক নই।
উপমা শিউরে উঠলো। শাড়ী ঠিক করে সরে দাঁড়ালো। ভয়জড়িত কণ্ঠে বলল,
-আমি ঠিক আছি।
-আমি একজন ডাক্তার। রোগীকে দেখেই বলে দিতে পারি সে অসুস্থ নাকি সুস্থ।
-আমার আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
কথা শেষ করতে দেরি স্থান ত্যাগ করতে দেরি নেই। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইলো সোহরাব। ক্রোধে হাত মুঠিবদ্ধ করে ফেললো। কয়েকবার বড় বড় নিঃশাস নিয়ে নিজ কক্ষে চলে যায়।
__________________
পরেরদিন সবার আগে ঘুম থেকে উঠে উপমা। কোমরের ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না সে। তাই ভাবলো কুসুমগরম পানি কোমরে ঢালবে তাহলে যদি একটু আরাম অনুভব হয়। আস্তে আস্তে হেঁটে রসইকক্ষে আসে। পানির কলসি উনুনে বসিয়ে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এখনও স্পষ্ট ভাবে আলো ফুঁটেনি। নীরব নির্জন জমিদার গৃহ।
পানি গরম হয়ে যাওয়ার পর উপমা পরে আরেক জ্বালায়। এই ভাঙা কোমরে কিভাবে নামাবে কলসি! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলসি নামানোর জন্য প্রস্তুত হয়। আচমকা কলসি বাঁকা হয়ে উপমা পায়ের পাতায় পানি পরতে নিবে ঠিক সেই সময়েই একজোড়া হাত এসে ধরে ফেলে কলসি। উপমা ভীত চোখে সামনে তাকায় ছায়া দাঁড়িয়ে। উনুন থেকে কলসি নামিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
-সাবধানে কাজ করবে তো এখনই গরম পানি পায়ে পরে যেত! লেগেছে কোথায়ও?
উপমা স্তব্ধ নয়নে শুধু তাকিয়ে রইলো। মাথা দু’পাশে নাড়ালো। ছায়া উপমাকে দেখে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,
-গরম পানি দিয়ে কী করবে? আর কোমরেই বা কী হয়েছে? আঘাত পেয়েছো?
-একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম তাই কোমরে ঢালতে গরম পানি করেছিলাম।
-ওহ।
ছায়া একজন ভৃত্যকে বলে পানি পুকুরপাড়ে দিয়ে আসতে। উপমা আর দাঁড়ালো না।
উপমা ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে বসে ভাবছে সেই সময়ের কথা। ছায়া কিভাবে জিগ্যেস করলো! কেমন একটা বড় বোন বড় বোন অনুভূতি হচ্ছে তার! মনে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। উপমা ভেবেছিলো সেদিন রাতের আক্রমণকারি ছায়া। তার স্বামীকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আজ ছায়ার প্রতি উপমার চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয়ে গেলো। সে শুধুই তাকে সন্দেহ করছিলো। ছায়ার প্রতি উপমার সম্মান আরো যেনো বেড়ে গেলো। মৃদু হেসে উপমা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, সে যে কাজের উদ্দেশ্যে জমিদার গৃহে ও সোহরাব মির্জার জীবনে এসেছে সে কাজ সম্পূর্ণ হলেই তাঁদের সকলের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাবে।
পুকুরপাড় থেকে আসার সময় গৃহের প্রবেশ দ্বারে দেখা হয় ইয়াশারের সাথে। ইয়াশার বেহায়াপানা নজরে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ইয়ামিনকে নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে যায়।
দুপুরে খাওয়ার সময় বাচ্চাকাচ্চারা মেলায় যাওয়ার বায়না করলো সোহরাবকে। তাঁদের সাথে সা’মিল হলো তাহেরা এবং ইয়াশার। সোহরাব প্রথমবার বারণ করলো। তাঁদের শত্রুর অভাব নেই। যদি মেলায় তাঁদের ওপর আক্রমণ করে তাহলে তাঁদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদেরও ভোগান্তি। তাহেরা তো ভাইজানের কাছে জেদ ধরে বসেছে যাবে তো যাবেই। ইয়াশার চোখ টিপ দিয়ে তাহেরাকে অভাবেই বায়না করতে বলে। তুলসীও বাচ্চাদের মন রক্ষার্থে সোহরাবকে যেতে বলল। অতঃপর সোহরাব রাজি হয় যাওয়ার জন্য। কিন্তু শর্ত ছিল সন্ধ্যার পূর্বে গৃহে ফিরে আসতে হবে আর সবাই একসাথে থাকতে হবে।
খুশিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় তাহেরা। উপমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-ছোট ভাবিজান, বড় ভাবিজান আপনারাও আমাদের সাথে যাবেন।
তুলসী বিরক্ত হলো মেয়ের কথায়। বাড়ির বউদের এতো কেনো মাথায় তুলতে হবে! ইয়াশার একই স্বরে বলল,
-অবশ্যই বড় ভাবিজানকে তো যেতেই হবে।
-আপনারা যান ইয়াশার ভাই। আমাদের তো ঢের কাজ আছে।
-সেটা পরেও করা যাবে ভাবিজান। বিকেলে আমরা সবাই মিলে মেলায় যাবো। দেওরের এইটুকু আবদার রাখবেন না?
ছায়া আর উপমা তুলসীর দিকে তাকায়। তুলসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে,
-হ্যাঁ বউমা তোমরাও যেয়েও। ঘুরে আসলে মনদিলও ভালো হয়ে যাবে।
সবার আড়ালে চোরা চোখে ছায়া সোহরাবের দিকে তাকায়। এই একটা মুখ আজ পর্যন্ত প্রাণভরে হাসতে দেখেনি সে। সবসময়ই কী মুখে রুক্ষ ভাব এনে রাখা প্রয়োজন! সোহরাব সবার সাথে রাগ দেখালেও আজ পর্যন্ত একবারও তার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলেননি। ছায়া আনমনে হেসে ফেলে।

_____________________
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে সকলে তৈরি হওয়া শুরু করে। উপমা নিজ কক্ষে হাটু মুড়ে বসেছিলো। তাহেরা তৈরি হয়ে উপমাকে ডাকতে এসেছিলো। বিছানায় বসে থাকতে দেখে কোমরে হাত দিয়ে বলল,
-ছোট ভাবিজান এখনও তৈরি হননি আপনি? ভাইজান তো সবাইকে নিচে ডাকছে।
-তাহেরা তোমরা যাও আমার একটু অসুস্থ লাগছে।
-আপনের সাথে যাওয়ার আশায় বসে আছি আমি। দোয়েয়া করে চলুন না।

উপমা পারলো না তাহেরাকে ফিরিয়ে দিতে। তাহেরা নিজ উদ্যেগে আলমিরা খুলে গোলাপি রঙের একটি কাতান শাড়ী বের করে। উপমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-এটা আপনাকে অনেক মানাবে।
-কিন্তু এই শাড়ী পরে আমি হাঁটতেই তো পারবো না!
-পারবেন পারবেন। দ্রুত উঠেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যে তাহেরা, উপমা নিচে আসে। ইয়ামিন দৌড়ে আসে উপমার কাছে। ত্বরিত দেখিয়ে বলে,
-আপনাদের দুইজনকে নিতে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। বাকি সবাই গৃহের বাহিরে।
উপমা মৃদু হেসে ইয়ামিনের গাল টেনে দিয়ে বলল,
-আমাদের ভালো ইয়ামিন বাবু। চলুন তাহলে এবার যাওয়া যাক।
-হ্যাঁ।

উঠানে দুইটা ঘোড়ার গাড়ি রাখা। ঘোড়া গুলোকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলো সোহরাব। উপমা শুনেছিলো জমিদার গৃহের সকলে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে যাতায়াত করে। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিল ঘোড়ার গাড়িতে উঠার। আজ বোধয় তার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! ইয়াশারের সাথে কথা বলছিলো ছায়া। উপমাকে দেখা মাত্রই তার আঁখিজোড়া সেদিকে আটকে যায়। সোহরাব ভুল করেও উপমার দিকে তাকালো না। প্রথম গাড়িতে বসলো ইয়াশার, ছায়া, তাহেরা আর সাইফা। ছায়া উস্কখুস্ক করতে থাকে। সে সোহরাবের সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু এখন যেহেতু বসে পরেছে তাই আর নামতে পারলো না। সোহরাবের ইশারায় গাড়ি চালক ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে যায়। দ্বিতীয় গাড়িতে বসলো উপমা, রোমানা, ইয়ামিন আর সোহরাব। একদম মুখোমুখি বসেছে সোহরাব ও উপমা। গাড়ি চলতে শুরু করলো আঁকাবাঁকা রাস্তায়। স্থির হয়ে বসতে পারছে না উপমা। বারে বারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। উপমার অবস্থা দেখে না চাওয়ার সত্ত্বেও সোহরাব উপমার একহাত ধরে ঘোড়ার গাড়ির ছোট জানালার ওপর রাখে যাতে সেখানটায় ভর দিয়ে আরাম করে বসতে পারে। উপমা আড়চোখে সোহরাবের দিকে তাকিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁদের গাড়ি থেমে যায়। উপমা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় তারা মেলায় এসে পরেছে। এতো ভীড় দেখে উপমার বাহিরে পা রাখতে মন চাইলো না। তবুও সবার দেখা দেখি বের হয়।
এক ঘন্টার মতো ঘুরাঘুরি করে, সকলে টুকটাক কেনাকাটা করে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। উপমা ইয়াশারের জন্য এমনেই বিরক্ত তাই সবার আগে সে-ই ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসে।
বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি চলতে থাকে। এখন এক গাড়িতে বসেছে ছায়া, উপমা, ইয়ামিন আর সোহরাব। আরেক গাড়িতে বাকি সবাই। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। মাটির রাস্তা ধরে পথ চলছে। ইয়াশারদের গাড়ি অনেক দূর চলে গিয়েছে। আচমকা ছায়া অসুস্থ হয়ে পরে। বমি করে দেয়। সোহরাব চালককে গাড়ি থামাতে বলে। উপমা ছায়াকে ধরে বাহিরে নিয়ে আসে। সোহরাবের ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে এখানে কিছু গন্ডগোল আছে। আরেকদিকে ছায়ার অবস্থা করুণ। বমি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পরেছে তার শরীর। সোহরাব সতর্ক চোখে আশেপাশে দেখে উপমার উদ্দেশ্যে বলল,
-আপনি ছায়াকে নিয়ে দ্রুত গাড়ির ভিতরে বসুন।
-কিন্তু আপায় তো বমি করেই যাচ্ছে। এমন্ত অবস্থায় গাড়িতে বসবে কিভাবে?
সোহরাব উপমাকে ধমকের স্বরে বলে,
-যেটা বলছি সেটা করুন উপমা।
উপমা মাথা নত করে ফেলে। ছায়াকে ধরে এক পা দু পা গাড়ির দিকে এগোতে নেয় এমন সময় উপমার ঠিক বামপাশ দিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটে যায় ব’ন্দু’কের গু’লি। নিশানা ভুল হওয়ায় কারো গায়েই লাগে না। আঁতকে উঠে উপমা। সোহরাব বুঝতে পারে এরা আর কেউ নয় মুহিব চৌধুরীর সৈন্যদল। ক্ষণেই তাঁদের তিনজনকে ঘিরে ধরে শত্রু। সোহরাব ওপর দিয়ে শক্ত অটল থাকলেও ভিতর ভিতর সে ভয় পাচ্ছে। সে কোনো চলচ্চিত্রের নায়ক নয় যে এতগুলো লোকের সাথে একাই যুদ্ধ করে বিজয়ী হবে। একা হলেও নাহয় পালিয়ে যাওয়া যেত কিন্তু বাকিদের কী হবে!
অপ্রস্তুত অবস্থায় সোহরাবের পানে তাকায় উপমা। সোহরাব ইশারায় তাকে বলে সুযোগ পেলেই যেনো গাড়িতে যেয়ে বসে। উপমা ধীরে মাথা নারায়। শত্রুগণ ঝাঁপিয়ে পরবে তার আগেই সোহরাব তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে নিজের বন্দুক বের করে। একে একে সই করতে থাকে। উপমার ভীত মুখশ্রী রূপ নেয় বিস্ময়। সোহরাবেরও বন্দুক আছে!
তাঁদের চোখে ফাঁকি দিয়ে সামনে যেতে নেবে তখনই একজন বাঁশ দিয়ে উপমার পিঠে আঘাত করে। ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আর্তনাদ করে উঠলো উপমা।
নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে উঁবু হয়ে মাটিতে পরে যায়। আরেক পাশে ছিটকে পরে ছায়া। সোহরাবের বন্দুকের গুলি শেষ প্রায়। তাকেও বাঁশ দিয়ে আঘাত করে। উপমা গাড়ির চালককে চোখের ইশারায় বলে একটা লাঠি তার দিকে এগিয়ে দিতে। চালক বুঝতে পেরে সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে উপমাকে একটি লাঠি দেয়। সোহরাব একবার আঘাত খাচ্ছে তো আরেকবার দিচ্ছে। সহজে হার মানার পাত্র সে নয়। উপমা লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কোমরে শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে সোহরাবের সাথে মিলে লোকদের ইচ্ছে মতো পিটাচ্ছে। সোহরাব ঠোঁটের পাশের র’ক্ত মুছে সহসা একবার উপমা পানে তাকায়। চালক সুযোগ বুঝে ছায়াকে ধরে গাড়িতে নিতে উদ্যত হয় তার আগেই বন্দুকের গুলি ছায়ার পিঠ চিরে বুক দিয়ে বেরিয়ে আসে। নিম্নস্বরে গো’ঙা’তে গো’ঙা’তে মাটিতে লুটিয়ে পরে নিথর দেহ। একবার উপমা তো একবার সোহরাব কে ডাকতে চাইলো কিন্তু কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো না। র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে ভূমিতল।
উপমা প্রথমে সেদিকে খেয়াল করেনি। এতক্ষনে দুইজনকে মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। তার শরীরও দুর্বল হয়ে পরে। পিছনে ঘোড়ার ডাক শুনতে পেয়ে উপমা পিছনে তাকায়। জমিদার গৃহের সৈন্যদল এসেছে। তাঁদের দেখতে পেয়েই পালিয়ে যায় সবকয়টা। সোহরাব ক্ষেপা বাঘের মতো গর্জন করছে। পরিহিত পাঞ্জাবী ছিঁড়ে জায়গায় জায়গায় র’ক্ত ভেসে উঠেছে। ভয়ংকর কোনো দানবের মতো লাগছে তাকে! উপমা দুর্বলচিত্তে ধপ করে জমিনে বসে পরে। বিধ্বস্ত দু’চক্ষু ছায়াকে খুঁজতে থাকে। একটু দূরেই অবচেতন হয়ে পরে আছে চালক। তার ঠিক পাশে নজর পরতে বীভৎস এক আর্তচিৎকার করে উঠলো উপমা।
-আপা!

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৩

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৩

জমিদার গৃহে নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজমান। গৃহের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে গুমোট ভাব স্পষ্ট। সময় ঘড়ির কাটায় চারটা পঞ্চাশ মিনিট। আঁতকে সকলের মনেই এক ভয় কাজ করছে। সোহরাব দেহরক্ষীদের নিয়ে বের হয়েছে আক্রমণকারির খোঁজ লাগাতে। ছায়া আর সাইয়েরা উপমার কক্ষে। তুলসীর মাথা ঘোরাচ্ছিলো তাই সে নিজ কামরায় চলে যায়। বাকিরাও যে যার স্থানে চলে যায়। ইয়ামিন আম্মার পাশে বসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘুমন্ত উপমাকে দেখছে। ছায়া উপমার হাতের দিকে তাকিয়ে ভাবছে সেই সময়ের কথা। সোহরাবের প্রশ্ন শুনে সকলে ভুত দেখার মতো করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ছায়াও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তুলসীর রাগ হয় পুত্রের কথা কর্ণপাত হতেই। বিবাহ করে দুইদিন হলো নতুন বউ এনেছে গৃহে। অথচ যার বউ সেই জিগ্যেস করছে মেয়েটা কে! তাহেরা ফোড়ন কেটে বলে,
-কী বলেন ভাইজান! তিনি আমাদের ছোট ভাবিজান গতকাল আপনি যাকে বিবাহ করেছেন।

সোহরাব নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। আম্মার দিকে ক্রোধে জর্জরিত করুণ নেত্রপল্লব নিক্ষেপ করেন। অতঃপর কিছু না বলেই চলে যায়। তুলসীর আত্মা কেঁপে উঠে সেই চাহনিতে। ভিতর ভিতর এক অজানা ভয় বাসা বাঁধে। জোর করে, ম’রার দোঁহাই দিয়ে বিবাহ তো করিয়েছেন কিন্ত এখন মেয়েটির কী হবে! বিবাহের দিনও কবুল বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একবার নতুন বউয়ের মুখটাও দেখেনি। এতো জেদ তার! তবে তার জন্য কী মেয়েটির উজ্জল ভবিষ্যত ধ্বংস হয়ে যাবে! আরেকদিকে রয়েছে ছায়া! বছর তিনেক আগে বেশ ধুমধাম করে একমাত্র ভাইজিকে নিজ পুত্রের স্ত্রী রূপে গৃহে নিয়ে আসেন। তখনও সোহরাব বিবাহ করতে রাজি ছিলেন না। নিজ জেদে বসে পুত্রকে বিয়ের পিঁড়িতে বসান।
সেই জিদ থেকে সোহরাব আজ পর্যন্তও ছায়াকে ভালোবাসতে পারেননি। অথচ ছায়া মেয়েটি কতই না ভালোবাসে ঐ এক’রোগা পুরুষকে! বিবাহের পর থেকে অনেক কম সময়ই গৃহে আসেন। বেশিরভাগ সময়ই শহরে নিজ চেম্বারে থাকেন। গ্রামে আসলেও ছায়াকে উপেক্ষা করে চলতেন যেটা সবার নজরেই পরতো।

কয়েকমাস যাবৎ অসুস্থ ছিল ছায়া। ডাক্তারের কাছে নিলে তারা বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা করতে দেন। সোহরাব সেই সময়টা ছায়ার সাথেই ছিল। পরীক্ষা করে ধরা পরে ছায়ার জ’রা’য়ু ক্যা’ন্সার হয়েছে। ডাক্তার বলেন অপারেশন করলে ছায়া আর মাতৃতের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন না। সবটা শুনেই সোহরাব তৎক্ষণাৎ অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। তুলসী এটা শুনার পর থেকেই অন্যরকম হয়ে যায়। মমতাময়ী শাশুড়িকে পরিবর্তন হতে দেখে ছায়া।

-বড় বউমা তুমি নাহয় এখন নিজ কক্ষে যেয়ে একটু বিশ্রাম নেও আমি এখানে থাকি।
সাইয়েরার কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ছায়া। ইয়ামিনকে দেখে নরম কণ্ঠে বলল,
-না ছোট আম্মা আপনি ইয়ামিনকে নিয়ে জান। ওর ঘুম পাচ্ছে।
-তুমি থাকবা?
-থাকি। আপনি যান।
সাইয়েরা চলে যায়। উপমার পাশেই শুয়ে পরে ছায়া।

মোরগের ডাকে জানান দিচ্ছে সকাল হয়ে গিয়েছে। জমিদার গৃহের সকলের ঘুম ছুটে গিয়েছে অনেক আগেই। সোহরাব, আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন ও তাঁদের বিশ্বস্ত ভৃত্য জসিম একসাথে বৈঠকখানায় বসে গতরাতের ঘটনার বিষয় কথা বলছেন। সোহরাব যতটুকু জানতে পেরেছেন গতকালের আক্রমণকারি তাঁদের শত্রুর গুপ্তচর ছিল। তাকে মনে করে আক্রমণ করেছিল উপমার ওপর। তাঁদের উদ্দেশ্যে ছিল সোহরাবকে আঘাত করা।
চায়ে চুমুক দিয়ে আলাউদ্দিন বলল,
-এটা মুহিব চৌধুরী ছাড়া অন্য কারো কাজ হতেই পারে না।
-ঠিক কইছেন বড় ভাই। ঐ বদমাইশেরই নজর আমাগো জায়গা-জমিনের ওপর।
-চাইলে এখনই ওকে ওর বাড়ির সামনেই পুঁতে রাখতে পারি কিন্তু শত্রুদের এতো সহজে পরাজিত করলে কী আর কোনো মজা আছে নাকি!
ভাইয়ের কথায় তাল মিলিয়ে প্রসন্ন হেসে সালাউদ্দিন বলল,
-কথা ঠিক। ওর পোলারে আমাগো মাইয়ার পিছনে লাগায়! টু’করা টু’করা কইরা কা’ইট্টা ওগো পোলারে ওগো কাছেই দিয়া আমু নে তখন মজা বুঝব।
শব্দ করে হেসে উঠে আলাউদ্দিন। সোহরাবকে অন্য ধেনে মগ্ন থাকতে দেখে আড়চোখে তার দিকে তাকায়। বক্ষস্থলে এক অজানা পীড়া অনুভব করছে সোহরাব। এই পীড়ার আরম্ভ কোথায়, অন্তর কোথায় কিছুই জানা নেই তার। এলোমেলো মস্তিকে এক শুভ্র রমণীর চিত্র এঁকে যাচ্ছে বার বার। ছায়ার প্রতি তার অন্যরকম অনুভূতি তৈরি না হওয়ার আরেকটা কারণ ছায়াকে সোহরাব বিবাহের পূর্বে বোনের নজরেই দেখতো। সেই অভ্যাস পরিবর্তন করতেই না কত হিমশিম খেতে হয়েছে তার!

-কোন ভাবনায় ঢুকে পরলে পুত্র?
আলাউদ্দিনের উচ্চারিত বাক্য কর্ণ পযন্ত পৌঁছাতেই নড়েচড়ে বসে সোহরাব। নিজ ওপর বিরক্ত হয়ে বলল,
-তেমন কিছুই নয় আব্বাজান। কে জ্বালাচ্ছে আমার বোনদের?
-ঐটা আমরাই দেখে নিবো নে।
-ঠিক আছে কিন্তু বোনদের বেলায় খামখেয়ালি করলে চলবে না আব্বাজান।
-তাহসিয়ার কী খবর? ভালো আছে তো সেখানে?
-ভালো থাকবে না কেন?
-না। এমনেই বললাম।
আলাউদ্দিন এদিকসেদিক পরোক্ষ করে ধীর কণ্ঠে সোহরাবকে বলল,
-পুত্র তোমার কী কোনো অসুবিধা হচ্ছে? তোমার আম্মা বলল তুমি বলে এখন পর্যন্ত ছোট বউর সাথে সাক্ষাৎ করোনি?
সোহরাবের রাগ হলো আম্মার ওপর। সব বিষয় কেনো সবাইকে জানাতে হবে! মুখে কাঠিন্য ভাব এনে বলে,
-বিবাহ করিয়েছে আম্মায় তো এখন সংসারও নাহয় সেই করুক।
আলাউদ্দিন জানতো সোহরাব তেড়া উত্তর দিবে। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে পুনরায় বলল,
-তোমার কী নিজের কোনো পছন্দ আছে আব্বা? থাকলে বলো আমাকে?
-যদি বলি আছে তাহলে আরেকটা বিবাহ করাবেন?
বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল সোহরাব। জসিম চোখের ইশারায় আলাউদ্দিনকে কিছু বলতে বারণ করলেন কিন্তু আলাউদ্দিন সম্মতি স্বরে বলল,
-অবশ্যই করাবো। জানো তো পুত্র মুসলিম পুরুষদের জন্য চারটা বিবাহ জায়েজ আছে।

আব্বার কথা শেষ হতেই গা কাঁপিয়ে হেসে উঠে সোহরাব। সালাউদ্দিন, আলাউদ্দিন একজন আরেকজনের পানে তাকায়। সোহরাবের নাটকীয় হাসি দীর্ঘক্ষণ রইলো না। হাসি হাসি মুখ রূপ নিলো অগ্নিমূর্তি। প্রচন্ড ক্ষোপের সাথে বলল,
-জায়েজ আছে বলে একটার পর একটা বিবাহ করতেই থাকবো? জানেন আব্বাজান আমি পূর্ণ বয়সে পা দেওয়ার পর শপথ করেছিলাম আর যাই হোক নারীর দিক দিয়ে আপনার মতো হবো না। কিন্তু দেখেন মাশাআল্লাহ! আমিও আপনার মতো দুইটা বিবাহ করে ফেললাম। এটাই বুঝি রক্ত! জমিদার বাড়ির পুরুষ শুধুই নারীর ব্যবসা করে কিছুদিন পর লোকজন এটাই বলবে আব্বাজান।
আলাউদ্দিন কিছু বলতে পারলো না। বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। জীবনে সর্বপ্রথম আজ তার পুত্র, তার সোহরাব তার সাথে এভাবে কথা বলল! বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় সোহরাব। গায়ে জড়ানো শার্ট ঠিক করে স্মিত হেসে বলল,
-আসি আব্বাজান এবং ছোট আব্বা।

সোহরাব সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়। আলাউদ্দিন থম মেরে বসে রইলো। জসিম অসহায় কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান কাইল রাইত থেকাই রাইগ্গা আছিলো। কিছু মনে কইরেন না খালুজান।
-দেখলি তোরা আমার পুত্র এই প্রথম আমার সাথে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলল!
-ভাইজান আমার তো মনে হয় সোহরাব আব্বার দুইনম্বর বউডাই সব নষ্টের মূল! বাড়িতে আইতে না আইতেই আপনেগো জগড়া বাঝাইয়া দিলো। অশুভ মাইয়া!
আলাউদ্দিন কিছু বলল না। তবে সালাউদ্দিনের কথায় কোনো এক যুক্তি খুঁজে পেলো সে।

____________________
প্রচন্ড পানির তৃস্নায় ঘুম ভেঙে যায় উপমার। আদৌ আদৌ আঁখিজোড়া খুলতেই শরীরের রনরনে ব্যাথার অনুভূতি হয়। মাথা থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত শিরশির করছে তার। রাতের কথা মাথা থেকে সরে যায়। উল্টো হয়ে শুয়েছিল উঠে বসতে উদ্যত হতেই পিঠের আঘাতের অসহনীয় ব্যাথায় চোখ, মুখ খিঁচে আর্তনাদ করে উঠলো,
-ওওও মা গো!

মাত্রই কক্ষে প্রবেশ করেছিলো ছায়া। উপমার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে চটজলদি করে এসে তাকে ধরে। সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দিয়েছে উপমা। উপমার পরনে ছিল সাদা রঙের ব্লাউজ দিয়ে কালো রঙের শাড়ী। ব্লাউজের বোতমের অংশ পিছনে দিয়েছিলো ছায়া যাতে ঘাঁ উন্মুক্ত রাখতে পারে। উপমাকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় বসিয়ে দেয়। পিঠের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সাদা ব্যান্ডেজ র’ক্তে লাল হয়ে আছে। তাহেরা, তুলসী কক্ষে আসতেই ছায়া তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,
-তাহেরা তোমার ভাইজানকে ডেকে নিয়ে এসো ওর ঘাঁ এর অবস্থা করুণ।
-এখনই ডাকছি।

তুলসী উপমার চোখের পানি মুছে দেয়। এতটুকু আঘাতেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সামনে কী হবে ভেবেই বিরক্ত উপমার ওপর। শাড়ীর আঁচল দিয়ে সুন্দর করে বক্ষবিভার্জন ঢেকে দেয়। উপমা কম্পিত ওষ্ঠজোড়া দিয়ে নিম্নস্বরে জিগ্যেস করে,
-রাতে আমার ওপর কে আঘাত করেছিলো? আর কেনো আঘাত করেছিলো?
-তুমি এখন চুপ থাকো ছোট বউমা। একটু শান্তভাবে বসো।

তাহেরার পিছু পিছু কক্ষে প্রবেশ করে সোহরাব। ছায়া নিজের ঘোমটা ঠিক করে সরে দাঁড়ায়। কী মনে করে যেনো ছায়া তুলসীকে বলে,
-আম্মাজান আপনে থাকুন আমার আবার রসইকক্ষে কাজ আছে।
-যাও।
সোহরাবের পাশ কাটিয়ে চলে যায় ছায়া। আড়ষ্ট কাটিয়ে উপমার দিকে দু পা এগিয়ে যায়। উপমা এতক্ষন খেয়াল করেনি সোহরাবকে অকস্মাৎ পুরুষালি সুগন্ধির সুবাস নাকে আসতেই মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। সেইদিনের অজ্ঞাত পুরুষকে চিনতে বেশ সময় লাগলো উপমার। এটা যে তার স্বামী সেটাও উপলব্ধি করতে পারলো উপমা।
স্বাভাবিক ভাবেই রোগীর চিকিৎসা করতে এগিয়ে এসেছিলো সোহরাব। তৎক্ষণাৎ উপমার বাঘিনীনেয় আঁখিজোড়া দেখে মস্তিককে হট্টগোল বেঁধে যায়। ঘনঘন কয়েকবার ভারী নিঃশাস ত্যাগ করে নিজেকে শান্ত করলো সোহরাব। সে একজন ডাক্তার। শত পুরুষ নারীর চিকিৎসা সে নিজ হস্ত ধারা করেছেন তবে আজ কেনো এমন অনুভূতি হচ্ছে!
উপমা চোখ খিঁচে বসে রইলো। সোহরাব নগ্ন পিঠে হাত লাগাতেই নিজ হাত মুঠিবোধ করে ফেলে উপমা। ত্বরিত গতিতে কাজ সম্পূর্ণ করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দেয়। এরই মধ্যে কেউ একটা বাক্যও ব্যয় করলো না। শেষ বারের মতো চোরা দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যায় সোহরাব।

_______________________
এরই মধ্যে কেটে যায় বেশ অনেক দিন। গৃহের সকলের সাথে তেমন ভাব না হলেও তাহেরা, সাইয়েরা ও বাচ্চাদের সাথে বেশ ভাব হয়েছে উপমা। আঘাতে সুস্থ হতেই এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে। সেই সময়টা ছায়া তার ভীষণ যত্নয়াদী করেছেন। তবে কোনো একটা অজানা কারণে উপমার কেনো জানি মনে হয় ছায়া যতটা ভালো বাহ্যিক রূপে ভিতরে তার ব্যতিক্রম! সকলের সামনে ভালো মানুষীর মুখোশ পরে ঘুরে এটাই আন্দাজ করছে সে। উপমা যেদিন প্রথম সোহরাবকে দেখলো তার ঠিক দুদিন পরেই শহরে চলে যায় সে। এতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই উপমার।

-ছোট ভাবিজান আসেন না কুতকুত খেলি।
উঠানে মোড়া পেতে বসেছিলো উপমা, তাহেরা। তাঁদের সামনেই সাইফা,রোমানা তাঁদের বান্ধবীদের নিয়ে কুতকুত খেলছিলো। উপমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে উক্ত কথাটা বলল। উপমা স্মিত হেসে বলল,
-তোমরা খেলো আমি বসে বসে দেখি।
-আসেন না ভাবিজান। আমরা দুইজন মিলে খেলবো অনেক মজা হবে।
বাচ্চাদের সাথে তাহেরাও আবদার করে বসলো। শেষে কী মনে করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় উপমা। বিকালবেলা সাধারণত তেমন কোনো পুরুষ বাসায় থাকে না। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে খেলতে রাজি হয় উপমা। সকলে খুশিতে চিৎকার করে উঠে। বারিবারি সকলে খেলতে থাকে।
আঠাড়শী কন্যা, গায়ে জড়ানো লাল রঙের সুতির শাড়ী। সুতির শাড়ীর পরায় দরুণ বকে তুলসী তাকে। জমিদারের গিন্নিরা পরিধান করবে ভারী কাজ করা কাতান, বেনারসি ও মসলিন শাড়ী! সেখানে উপমার এই সুতির শাড়ী পরিধান করা একদম অপছন্দ তার। কোমর সমান কালো খয়েরি সংমিশ্রনে কোঁকড়ানো কেশ বেনুনি করায় খেলার ফাঁকে ফাঁকে দুলছে। হলদে সাদা গায়ের বরণে লাল, কালো, খয়েরি রঙটা যেনো একটু বেশিই মানায়। অনেকটা চাকমাদের মতো ছোট ছোট আঁখিজোড়া, লম্বা খাড়া নাক তার সাথে পাতলা ঠোঁট সব মিলিয়ে উপমার সামনে নিজেকে অত্যাধিক অসুন্দর বলে মনে হলো ছায়ার। খানিক সময় ধরে জানালার ধাঁরে দাঁড়িয়ে উপমাকে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে পরোক্ষ করছিলো সে। কী হাসিখুশি প্রাণজ্জল মেয়েটি! বিবাহের চারদিনের মাথায়ই যে তার নববিবাহিত স্বামী তাকে রেখে চলে গিয়েছে তাতে তার একটুও আফসোস নেই।

সন্ধ্যার আজান কর্ণকুহর হতেই খেলা শেষ করে দ্রুত পায়ে গৃহের ভিতরে ঢুকে যায়। বৈঠকখানা পেরিয়ে ভিতরে সিঁড়িতে উঠে যাবে এমন সময় তাঁদের সামনে উপস্থিত হয় তুলসী। তাহেরাকে আদেশ স্বরে চলে যেতে বলে। উপমা মাথার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে পরে। তুলসী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উপমার পানে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,
-ভুলে যেয়েও না এ’বাড়ির বউ হয়ে তুমি গৃহে প্রবেশ করেছো। বাড়ির মেয়ে বাচ্চাদের সাথে মিলে খেলা তোমাকে সাজে? নিজের ব্যক্তিত্ব কেনো ছোট করছো?

উপমা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। বিবাহের পর পর উপমার মনে হতো মায়ের মতন একজন শাশুড়ি পেয়েছেন তিনি। তবে আজ তার কথা বলার ধরণ দেখে উপমার চিন্তা পরিবর্তন হয়ে গেলো। শাশুড়ি কখনোই মা হতে পারে না। তুলসী দম নিয়ে ফের বলল,
-আমার ছেলের সাথে তোমাকে বিবাহ করানোর একমাত্রই কারণ সেটা হলো তুমি তোমার সৌন্দর্য দিয়ে ওকে গৃহে আঁকড়ে রাখবা এবং আমাদের বংশধর দিবা। কিন্তু তুমি পারলে? সেই আগের মতোই শহরে চলে গেলো আমার ছেলে। আর তুমি বাড়ির মেয়েদের সাথে ড্যাংড্যাং করে খেলছো? মেয়ে মানুষ যদি তার রূপ, যৌবন দিয়ে সোয়ামীকে আকর্ষিত করতে না পারে, প্রেমে মশগুল করতে না পারে তাহলে তার সৌন্দর্যই বৃধা! আশা করি সবটা তুমি বুঝতে পেরেছো?

নীরবে হ্যাঁ বোধক মাথা নারায় উপমা। চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। তুলসী অনুমতি দিতেই উপমা নিজ কক্ষে এসে পরলো। দ্বার লাগিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরে। অশ্রুরা বাঁধ ভাঙে। বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। মনে যত বিষাদ জমেছিলো সব একসাথে উপচে পরছে যেনো!
__________________
রাতের খাবার শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে নিজ কক্ষে আসে উপমা। সহসা তার মনে ইচ্ছে জাগলো ছাদে যাওয়ার। এই বাসায় আসার পর থেকে যে কয়বার উপমার মন খারাপ ছিল তখন ছাদে গেলে খোলা হাওয়ায় নিঃশাস নিলে শান্তি অনুভব হয় তার। শাড়ীর কুচি ধরে সাবধানে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। ছাদে আসা মাত্রই মাথার আঁচল সরিয়ে ফেলে। আষার মাস চলে। এই গুমোট পরিবেশ, তো এই প্রকৃতির ভয়ংকর তান্ডব। আকাশ আলোকৃত করে কিছুক্ষন পর পর বীজলি চমকাচ্ছে। জমিদার গৃহের চারপাশে বড় বড় দানব আকৃতির গাছপালা বাতাসে মৃদু নড়ছে।
উপমা উৎফুল্ল হয়ে দুইহাত মেলে ঘুরতে থাকে। অধীর অপেক্ষা করতে থাকে কখন বর্ষণ হবে কখন তার এলোমেলো মনকে শীতল করে দিবে।

উপমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গগন কাঁপিয়ে বর্ষণরা উপমার রাতের সঙ্গী হতে এসে পরে। উল্লাসে হাত, পা নাচিয়ে এদিকসেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এক সময় হয়রান হয়ে ছাদের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে পরে। বড় বড় নিঃশাস নিতে থাকে চোখ বন্ধ করে। পিছনে ফিরে আঁখিজোড়া খুলতেই জমিদার বাড়ির সদর দ্বার দিয়ে অজ্ঞাত একজনকে ভিতরে আসতে দেখতে পায় উপমা। যত এগিয়ে আসছে ততো স্পষ্ট হচ্ছে অগন্ত। সহসা উপমা নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারলো না। চট করে নেত্রপল্লব বন্ধ করে ফেলে। বড় বড় নিঃশাস নিয়ে পুনরায় তাকায়। অস্পষ্ট স্বরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-ইয়াশার!

কাঁধে কলেজ ব্যাগ জড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চুবচুব হয়ে এগিয়ে আসছে একজন অজ্ঞাত যুবক। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি থেকে টপটপ পানি পরছে। সেটা ভীষণ বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুবকের। দুইহাত দিয়ে ললাটে থেকে মাথার পিছনে নিয়ে চুলের পানি ঝরিয়ে নেয়। অতঃপর দৌড়ে গৃহের ভিতরে চলে যায়।
উপমার সবটা কল্পনার মতো মনে হলো। সেই পুরুষ, সেই চলাফেরা, সেই মুখমন্ডল, সেই হাসি, সেই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, সেই সিগা’রে’টের পোড়া ওষ্ঠজোড়া! আর ভাবতে পারলো না উপমা। পিছনে ফিরে রেলিং এ পিঠ ঠেকিয়ে জমিনে বসে পরে। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-এমনটা করো না সৃষ্টিকর্তা, এমনটা করো না। আমি এখন অন্য একজনের স্ত্রী। সে সহ্য করতে পারবে না খোদা। আমাকে এতো বড় পরীক্ষায় ফেলো না। একটু দোয়েয়া করো আমার ওপর।

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০২

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০২

-আসতে পারি?

কক্ষের মধ্যে পায়চারি করছিলো উপমা।অতিকৃত নারীর কণ্ঠস্বর শুনে বাস্তবে ফিরে। সারাদিন বেশ কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। দুপুরের রান্না থেকে শুরু করে রাতের রান্নাও তাকেই করতে হয়েছে। অবশ্য সাহায্যের জন্য ফাতু আর তুলি ছিল। শাড়ীর আঁচল মাথায় দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। নরম স্বরে বলল,
-আসুন।

অনুমতি পেয়ে কামরার ভিতরে পা রাখে ছায়া। শাশুড়ির কথা রাখতে উপমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে সে। তাছাড়াও একসাথে যেহেতু থাকতে হবে মনে অসন্তোষ রেখেই বা কি লাভ! উপমার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার। এই রমণী এখন থেকে তার প্রিয় স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে! যে স্থান তার নসিবেও হয়নি। শুকনো গলায় উপমা বলল,
-আমি ছায়া। আপনের সাথে পরিচিত হতে পারিনি তাই এখন আসলাম।

উপমা পলকহীন তাকিয়ে রইলো ছায়ার পানে। কত সুন্দর মুখশ্রী! কী মায়াময়! এইরকম নারীকে কোন পুরুষ উপেক্ষা করে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে! অজান্তেই উপমার মন ভরে গেলো এতো শ্রী মুখ দেখে। তার মন চাইলো সর্বক্ষণ এই মুখের পানেই তাকিয়ে থাকতে।
উপমাকে কিছু বলতে না দেখে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় ছায়া। পুনরায় নরম কণ্ঠে বলে,
-আমি কী আপনাকে বিরক্ত করলাম?
-একদমই না। আমি আপনের ছোট বোনের মতোই আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।
-তোমার কী মন খারাপ পরিবারের জন্য?
-হ্যাঁ, আমার মার কথা মনে পরছিলো অনেক।
-আর বাবা? এবং অনন্যা সদস্যদের কথা মনে পরছে না?
-আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই।
-দুঃখিত আমি। আমাকে দেখে তোমার বিন্দু পরিমানও রাগ হচ্ছে না?
-আপনার সংসারে আমি এসেছি রাগ, ঘৃণা তো আপনার করা উচিত।

কিছু সময়ের জন্য ছায়া বাক্যহীন হয়ে যায়। কী বলবে ভেবে পেলো না সে। উপমা প্রশস্ত হেসে নমনীয় কণ্ঠে বলল,
-দাঁড়িয়ে আছেন কেনো বসুন আপা।

ছায়া বসলো না। একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। উপমা কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই ছায়া বলল,
-সতীনদের মধ্যে বোনের মতো সম্পর্ক শুধুই কাহিনী আর চলচ্চিত্রেই সাজে বাস্তব জীবনে নয়! সত্যি বলতে আমি তোমার ওপর রেগে নেই আর না তোমাকে ঘৃণা করি। কিন্ত আমি তোমাকে আমার বোন হিসেবেও মানতে পারবো না। আমার কিছু দায়িত্ব আছে তোমার ওপর আমি শুধু সেগুলো পালন করতেই এসেছি।

উপমা চুপ করে রইলো। ছায়ার কথা মোটেও খারাপ লাগছে না বরং নিজের ওপর তার ঘৃণা হচ্ছে। কিভাবে পারলো এক বিবাহিত পুরুষকে বিবাহ করতে! তার বুদ্ধিলোভ পেয়েছিলো বটেই এইরকম জঘন্য কাজ তার ধারা হয়েছে। ছায়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ফের বলল,
-আমার কথায় দুঃখ পেলে ক্ষমা করিও। আমি মানছি এখানে তুমিও নির্দোষ। তবুও কেনো তোমাকে আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে মানতে পারছি আমি নিজেও জানি না।
-আপনি উনার প্রথম স্ত্রী আপনার জায়গা আমি কখনই নিতে যাবো না। ভরসা রাখুন আপা।

ছায়া চোখ বন্ধ করে বড় নিঃশাস নিয়ে এদিক সেদিক তাকালো। উপমার কথা পরিবর্তন করে বলল,
-বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বউদের সকাল ভোরে উঠে নাস্তা বানাতে হয়। তাই আগামীকাল সকাল সকাল উঠে পড়িও নাহলে আম্মাজান আবার রাগ করবেন।
-জি ঠিক আছে।

ছায়া আর দাঁড়ালো না। নিঃশব্দে বড় বড় পা ফেলে কামরা থেকে চলে যায়। সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারে না কান্নারা সব যেনো গলাঅব্দি এসে পরেছে! উপমা বিছানায় বসে পুরো কামরায় চোখ বুলাচ্ছে। আচমকা বাহির থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ কর্ণকুহর হয় তার। ঘাবড়ে যায় উপমা। দ্রুত বসা থেকে উঠে জানালা বাহিরে উঁকি দেয়।
পর্দার আড়াল থেকে দেখতে পায় কয়েকজন বলিষ্ঠ দেহের ব্যক্তি দুইজন পুরুষকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝতে খানিকটা সময় লাগে উপমার। সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত একজন পুরুষ মোটা একটি বাঁশের টুকরো দিয়ে এক লোককে পিটাচ্ছে। এমন অমানবিক ভাবে তো মানুষ তার শত্রুকেও মারে না! মার খাওয়া লোকটা মাটিতে পরে ব্যথায় ছটফট করছে। উপমা আরো বেশি অবাক হলো এটা দেখে কেউ পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটাকে আটকাচ্ছে না। উপমার আঁখিজোড়া দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরে গাল বেয়ে। ধনী ব্যক্তিরা বুঝি এইরকম পাষান হয়!
এমন সময় গুনগুন গান গাইতে গাইতে কামরায় প্রবেশ করে তাহেরা। উপমাকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহেরা তার কাছে এসে দাঁড়ায়। উপমার চোখে পানি দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল,
-ভাবিজান আপনি কাঁদছেন কেনো?
-লোকটাকে এভাবে পেঁটানো হচ্ছে কেনো তাহেরা?
-ঐ লোকটা একজন অসৎ লোক। গ্রামের মেয়েদের সাথে খারাপ কাজ করে ধরা পরেছে তাই তো শাস্তি পাচ্ছে।

উপমা বিস্ময়বিমূঢ়। গাঢ় দৃষ্টিতে তাহেরার পানে তাকায় তো একবার সেই লোকটাকে দেখে। তাহেরা উপমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
-আপনি অনেক কোমল মনের মানুষ তবে সমস্যা নেই এখানে থাকতে থাকতে এইসবের অভ্যাস হয়ে যাবে ভাবিজান।
-লোকটাকে যে মারছে উনি কে? এতো পাষান মনের মানুষ হয়!

উপমার কথায় তাহেরার মুখ কালো করে ফেলে। ভেংচি কেটে গর্ব করে বলল,
-আমার সোহরাব ভাইজান আপনের সোয়ামি।

উপমা গোলগোল আঁখিজোড়া দিয়ে একবার তাহেরা তো একবার সোহরাবকে দেখছে। এক সময় হাতের বাঁশের টুকরোটা ফেলে দেয়। আঙুল দেখিয়ে কিছু বলে গৃহের ভিতরে চলে যায় সোহরাব। এতো উঁচুলম্বা দেহ দেখে উপমার মনে হলো সে কোনো মানুষ নয় বরং কাল্পনিক রাজ্যের এক দৈত্য বা রাক্ষস!
_________________

তীব্র ক্রোধে শরীর রিরি করছে সোহরাবের। ললাটের রগ নীল বর্ণ ধারণ করে ফুঁলে উঠেছে। গৃহের ভিতরে প্রবেশ করতেই তুলসী ছুটে আসে। সোহরাব ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। সাদা পাঞ্জাবীর জায়গায় জায়গায় রক্তের ছিটছিট দাগ লেগে রয়েছে। তুলসী আঁতকে ভীত কণ্ঠে বলল,
-শান্ত হও আব্বা শান্ত হও। এতো রাগ যে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়!

সোহরাব একই ভঙ্গিতে বসে রইলো। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে তুলির আনা পানির গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে সবটা শেষ করে ফেললো। ভুল করেও একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে না সোহরাব। এবারের মায়ের প্রতি জেদ, অভিমানের পাল্লাটা বেশ ভারী। তুলসী কাঁদো কাঁদো মুখ করে ছেলের পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলাতে যাবে তার পূর্বেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রুক্ষ স্বরধ্বনি তুলে তুলিকে জিগ্যেস করে,
-আব্বাজান কোথায়?

তুলি যমের মতো ভয় পায় সোহরাবকে। শুধু তুলি নয় গৃহের প্রত্যেকটা সদস্য হাড়ে হাড়ে কাঁপে সোহরাবের নাম শুনলে। কম্পিত স্বরে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই বৈঠকখানায় উপস্থিত হয় ছায়া।
-আব্বাজান গৃহে নেই।
সোহরাব দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ছায়ার ওপর। চোয়ালজোড়া শক্ত থেকে কঠিনতর হলো। ললাটে দুই আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
-আব্বাজান আসলে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন।
-ঠিক আছে। আসেন খাবার খেয়ে নিন দুপুরে তো খাননি।
-খিদে নেই।
-বড় আপা এসেছে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছুক তিনি।
-দেখা করে আসছি আমি।
ছায়া কথার উর্ধে কিছু বলতে যাবে তার আগেই স্থান ত্যাগ করে সোহরাব। ছায়া ছোট একটি নিঃশাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এ যেনো তার নিত্যদিনের অভ্যাস। অবহেলা পেতে পেতে এখন আর খারাপ অনুভব হয় না। বরং ভালোভাবে কথা বললেই অবাক হয় ছায়া।

রাতে তাহেরার সাথে কথা বলছিলো উপমা। কিছু মনে পরতেই তাহেরা আহাম্মকের নেয় নিজ মাথায় চাপর দিয়ে তাড়াহুড়া করে বলে,
-ওহ আমি তো বলতে ভুলেই গিয়েছি! বড় আপা এসেছে। আম্মাজান আপনাকে নিচে ডেকেছে ভাবিজান।
-চলো।
তাহেরার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উপমা তাহেরাকে প্রশ্ন করে,
-ফুপ্পিজানের কোনো সন্তান নেই তাহেরা?
-আছে তো। একটা ছেলে সন্তান মাত্র সেও শহরে থেকেই পড়াশোনা করছে। গ্রামে আসতে ততটা পছন্দ করেন না তিনি।
-ওহহ! তোমার ভাইজান কী কাজ করেন?
-ভাইজান একজন ডাক্তার। শহরে তার নিজস্ব চেম্বার আছে। আবার আব্বাজানের সাথে গ্রাম দেখাশোনাও করেন।

উপমা আর কিছু বলল না। যতবার গৃহের আনাচে কানাচে নজর পরেছে ততবার বিমোহিত হচ্ছে সে। এতো সুন্দর বাড়ি কিভাবে হয়! দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ করা বিভিন্ন ধরণের নকশার কাজ। পুরো জানো এক রাজপ্রাসাদ! সদর দরজা দিয়ে ঢুকার পর বৈঠকখানা। সেখানে বাড়ির পুরুষরা বসে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করে। অন্দরের ভিতরে আরেকটি বৈঠকখানা। সেখানে পরিবারের সকলে মিলে আলাপ করেন। দুইপাশে দুই সিঁড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। দ্বিতীয় স্তরে অনেক গুলো কামরা এবং সুবিশাল একটি গ্রন্থাগার। সোহরাব অবসর সময়ে বই পড়তে পছন্দ করেন তার জন্যই বানানো হয়েছে।

তুলসীর কক্ষের স্মুখীন আসতেই উপমা ভিতর থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পান। তাহেরা ভিতরে চলে যায়। উপমা একটু ভীত হয়ে কামরার ভিতরে পা রাখেন। তারনা বাবার বাসায় বেড়াতে এসেছেন বেশ কিছু দিন ধরে। তুলসীর সাথে ভাব তার। উপমাকে দেখা মাত্রই কণ্ঠে টান দিয়ে বলল,
-এইরে তুলিকা, তোর ছোট ভাবিজান এসে পরেছে রে।

উপমা মাথা নত করে তাকায়। বিছানায় তুলসীর পাশে শ্যামবর্ণের একজন অচেনা নারী বসে আছে। কোলে ছোট একটি মেয়ে বাচ্চা। তুলসী উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-ছোট বউ ও হলো তোমার স্বামীর বড় বোন তোমার ননাস।

উপমা ভদ্রতার খাতিরে সালাম দেয়। তুলিকা সালামের উত্তর দিয়ে মুখ বাঁকায়। উপমাকে দেখে তার তেমন একটা পছন্দ হলো না এমনই ভাবভঙ্গি। ছায়া বিছানায় বসে তুলিকার মেয়েকে নিয়ে দুষ্টামি করছিলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক পরোক্ষ করে টানটান কণ্ঠে তুলিকা বলল,
-চন্দ্রপুর গ্রামের পরবর্তী জমিদারের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তাকে কেনো জানি যাচ্ছে না। আম্মাজান আমার একমাত্র ভাইজানের জন্য তো আরো সুন্দরী মেয়ে পেতেন। শহুরের কোনো রূপসীকেও আনতে পারতেন!

উপমা আগের নেয় দাঁড়িয়ে রইলো। উপস্থিত তুলসী, ছায়া, তাহেরা ও মিনা মুখ ছোট করে ফেলে। তারনা মনে মনে খুশি হয়। সে এটাই আশা করেছিল। তুলিকা একটু অন্য স্বভাবের মানুষ। অহংকার আর দেমাগে পা নিচে পরে না জানো! ছায়া মৌন থাকতে পারলো না। হালকা হেসে উপহাস কণ্ঠে বলল,
-সবাই কী আর আপনের মতো সুন্দরী হয় আপা! মাশাআল্লাহ! কারো নজর না লাগুক। আর শহুরের মেয়ে বউ করে নিয়ে আসবেন দুদিন পরই দেখবেন আপনাদের আর গৃহের ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না!

তুলিকা তেঁতো হয়ে উঠে। তেজি স্বরে পাল্টা জবাব দিয়ে বলে,
-আমাদের গৃহে আমাদের ঢুকতে দিবে না ঐরকম সাহস এখনও কারো হয়নি ভাইয়ের বড় গিন্নি।
-হতেও তো পারে আপা! আগাম দিনের কথা কী আর আজ বলা যায়!

ছায়ার শেষ কথায় চুপসে যায় তুলিকার মুখমন্ডল। তুলসী এই একটা কারণেই বড় মেয়েকে একটু অপছন্দ করেন। কথায় ফোড়ন কেটে বলল,
-ছোট বউমা তুমি রসইকক্ষে যেয়ে সবার জন্য আদার চা করে নিয়ে এসো। কিছুক্ষন পর তোমার আব্বাজানরা আসবেন তাঁদের জন্যও করিও।
-জি আম্মাজান।
-দাড়াও উপমা আমিও তোমার সাথে আসছি।

ছায়ার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে যায় উপমা। ছায়া বিছানা থেকে নেমে সবাইকে বিস্ময় করে দিয়ে উপমার সাথে চলে যায়। তুলিকা অতিকৃত মুখ বাকিয়ে বলে,
-বাহ্! বেশ ভাব দেখছি দুই সতীনের মধ্যে!
-কিন্তু অত্যাধিক ভাব সম্পর্ক নষ্ট করতে সক্ষম।(তারনা)

তুলসী ধমক দিয়ে উঠে। চোখ রাঙিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য বলে,
-এতো বছরে যেটা আমি পারিনি সেটা ছায়া পেরেছে এতে আমাদের খুশি হওয়ার কথা নাকি পীরপিছে বদনাম করার! তোমারই আমার সংসারে কু’নজর লাগিয়ে দিচ্ছ দেখছি! হে খোদা, এদের বদনজর থেকে আমার পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখো।

_____________________
উপমা চা বানাচ্ছে ছায়া জানালা ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্য ঢোলে পরেছে পশ্চিম আকাশে। রক্তিম আভায় ঢেকে আছে চারপাশ। উঠানে এখনও গুটিকয়েক বাচ্চা খেলা করছে। দৈত্য রূপী তাল গাছ, নারিকেল গাছ ক্ষণে ক্ষণে মৃদু হাওয়ায় দুলছে। ছায়া আড়চোখে উপমার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অতি সাবধানে কাপে চা ঢালছে উপমা। তুলি বেনুনি নাচাতে নাচাতে রসইকক্ষে প্রবেশ করে।
-আব্বাজানরা আইসে চা নিয়ে যামু অহন?
-চা তৈরি হয়ে গিয়েছে এখনই দিয়ে এসো নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।
-আইচ্ছা ছোডু ভাবিজান।

তুলি চায়ের ট্রে নিয়ে চলে যেতে নেয় কি মনে করে জানো আবার ফিরে আসে। গদগদ করতে করতে বলে,
-আফনেরা মনে হয় আগের জনমে দুই বইন আছিলেন! আফনেগো চেয়ারা আর কথা দুইডাই এক।

তুলি চলে যায়। উপমা মুচকি হাসে। ছায়া বাহিরের দিকে তাকিয়েই উপমার উদ্দেশ্য বলল,
-তুমি তাহলে এখন কক্ষে যেয়ে বিশ্রাম নেও।
-আর কোনো কাজ নেই আপা?
-যা আছে আমি করি তুমি যাও।
-ঠিক আছে।

রজনীর শেষ প্রহর। ঘুমে মগ্ন জমিদার বাড়ির সকলে। আচমকা তন্দ্রা ভেঙে যায় উপমার। ইতস্ততভাবে জড়োসড়ো হয়ে এপাশ ওপাশ ফিরে পুনরায় ঘুমানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। আকস্মিক উপমা অনুভব করে তার কক্ষে সে বেতীত আরো একজন আছে। আঁতকে উঠে উপমার সর্বাঙ্গ। কম্পিত হতে থাকে বক্ষস্থলে। কোনোরকম সাহস সঞ্চয় করে শোয়া থেকে উঠে বসে। আঁধারে তলিয়ে আছে পুরো কক্ষ। অতি সর্পনে বিছানার পাশ থেকে পানির গ্লাসটি হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।
বিছানা থেকে নেমে সামনে অগ্রসর হবে ঠিক সেই মুহূর্তেই অজ্ঞাত উপমার ওপর আক্রমণ করে বসে। খোঁপা করা চুলের মুঠি চেপে ধরে। ব্যাথায় আওয়াজ করতে নিবে তার আগেই আরেক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। উপমা দুর্বল হয়েও দুর্বল হয় না। নিজেকে ছাড়ানো জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে। এতো শক্ত হাতের থাবার কাছে উপমার নিজেকে ক্ষীণ মনে হলো। পিছন থেকে অজ্ঞাত লোকের পায়ে লাত্থি মারে সে। খনিকের জন্য পিছিয়ে যায় অগন্ত। উপমা সুযোগ পেয়ে দৌড়ে দরজার কাছে যেতে নেয় তখনই অজ্ঞাত ব্যক্তি ছু’রি ঢুকিয়ে দেয় উপমার পিঠ বরাবর। ব্যাথায় আতনাদ করে উঠে উপমা। পুরো শরীর ঝাঁকিয়ে উঠে যেনো। দ্বিতীয়বার আঘাত করতে যাবে তার পূর্বেই উপমা হাতের গ্লাস দিয়ে বারি মারে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে। বারিটা অজ্ঞাত ব্যক্তির মুখে লেগেছে আঁধারে আন্দাজ করতে পারলো উপমা। ত্বরিতগতিতে দরজা খুলে বাহিরে এসে পরে উপমা। হাঁটার শক্তি অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে। দেয়াল ধরে তার কক্ষের পাশের কক্ষের দরজায় কিছুক্ষন বারি দিতে থাকে লাগাতার। শেষের টোকা দিতে গিয়ে ছিটকে পরে যায় উপমা। জমিনে লুটিয়ে পরে তার সর্বত্ত।

গাঢ় ঘুমে ডুবে ছিল ছায়া। সহসা এতো রাতে দরজায় বারির শব্দ কর্ণকুহর হতেই ঘুম উব্রে যায় তার। শাড়ীর আঁচল ঠিক করে বিছানায় উঠে বসে। কক্ষের বাতি জ্বালিয়ে ভীতগ্রস্থ পায়ে দরজা খুলে দেয়। অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু ঠাওর করতে পারলো না ছায়া তবে বুঝতে পারলো কেউ বারান্দার নিচে পরে আছে। বাতি জ্বালিয়ে আলোকৃত করে দেয় বারান্দা। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে নিচে তাকাতেই চিত্র কেঁপে উঠে ছায়ার। চিল্লিয়ে গৃহের সবাইকে ডাকতে থাকে। উপমার পাশে বসে তার মাথা নিজের পায়ের ওপর রেখে কয়েকবার ডাকে। গালে মৃদু চাপর দেয়। ঘোলাটে আঁখিজোড়া আদৌ আদৌ মেলে ছায়াকে দেখার প্রয়াস করে উপমা।
একে একে তুলসী, আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, তারনা, মিনা সহ আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী সাইয়েরা সকলে চলে আসে। হাতে তরল ঠান্ডা কিছু অনুভব করতেই ছায়া উপমার পিঠ থেকে নিজের হাত সামনে এনে ধরে। লাল রঙের তরল পদার্থ দেখে বিচলিত হয়ে পরে ছায়া সহ সকলে।তুলসী ছায়ার পাশে বসে পরে। বিলাপ স্বরে বলে উঠে,
-খোদা! ছোট বউমার এই অবস্থা কিভাবে হলো! বড় বউমা কে এতো পাষান ভাবে আঘাত করলো ছোট বউমাকে?
শাশুড়ির কথায় প্রতিউত্তরে ছায়া বলল,
-আমি ঘুমিয়ে ছিলাম হটাৎ দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পেয়ে দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে আসি। তারপর বিধ্বস্ত অবস্থায় ওকে এখানে পরে থাকতে দেখি আম্মাজান।

চোখের চশমা হাত দিয়ে ঠিক করে উপস্থিত হয় সোহরাব। তৎক্ষণাৎ ছায়ার সকল কথা শুনতে পায় সে। ছায়ার কোলের মেয়েটিকে দেখে তার মনে পরে যায় আজ সকালের সেই মেয়েটির কথা। এ তো সেই মেয়েই! সোহরাব কিছু না ভেবে গম্ভীর মুখে সবাইকে উপেক্ষা করে এগিয়ে আসে। নিজ মায়ের ওপর বিরক্ত হলো সে। এখানে মেয়েটির পিঠ থেকে রক্ত ঝরছে সেখানে তার আম্মা একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে! চোয়াল শক্ত করে বলল,
-আগে উনার চিকিৎসার প্রয়োজন তারপর নাহয় আপনারা বিলাপ পারেন!
উপমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গর্জে উঠে আলাউদ্দিনের উদ্দেশ্যে বলল,
-আব্বাজান আপনি দেহরক্ষীদের নিয়ে গৃহের বাহিরে যেয়ে দেখেন কে মরণের ভয় নিয়ে জমিদার গৃহে পা রেখেছিলো।

নিচে ঝুঁকে পাঁজা কোলে তুলে নেয় উপমাকে। তাহেরা উপমার কামরা দেখিয়ে দিলে সোহরাব বিছানায় শুয়ে দেয় তাকে। তাহেরাকে তার কক্ষ থেকে চিকিৎসা বাক্স এনে দিতে বললে দ্রুত পায়ে তাহেরা এনে দেয়। বিচলিত ভঙ্গিতে সোহরাব উপমাকে উল্টো করে শুইয়ে দেয়। সাদা রঙের ব্লাউজ তরল পদার্থের লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মোটামোটি ভালোই জখম হয়েছে পিঠে। লম্বাঠে চামড়া ছিঁ’ড়ে মাং’স বের হয়ে গিয়েছে। পরিপক্ক হাতে উম্মক্ত পিঠে মলম লাগিয়ে আপাদত রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য ব্যান্ডেজ করে দেয়। যদি কাজ না হয় তবে আগামীকাল হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে রোগীকে ভেবেই উঠে দাঁড়ালো সোহরাব। কক্ষের বাহিরে আসতেই কয়েকটা চিন্তিত মুখশ্রী দেখতে পায়। আলাউদ্দিন এবং সালাউদ্দিন দেহরক্ষীদের নিয়ে পুরো বাড়ি তল্লাশি করতে গিয়েছেন। কার এতো বড় দূরসাহস জমিদার আলাউদ্দিনের পুত্র বধূর ওপর আক্রমণ করেন!

তুলসী মরা কান্না জুড়ে বসে। সোহরাবের প্রখর দৃষ্টি ভুল করেও একবার মায়ের দিকে যাচ্ছে না।তুলসী কোনোরকম অশ্রুকণা মুছে জিগ্যেস করে,
-এখন কেমন আছে? বেশি আঘাত পায়নি তো আব্বা?
-মোটামোটি বেশ আঘাত পেয়েছে। আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি তারপরও যদি রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয় তবে হাসপাতালে নিতে হবে।

ছায়া মূর্তি হয়ে বসে ছিল। সোহরাবের শেষের কথা শুনে মাথা উঠিয়ে দৃষ্টিপাত করে। ধীর কণ্ঠে বলল,
-আমি কী তাকে একবার দেখতে পারবো?
-হ্যাঁ পারবেন। রোগীর পাশেই থাকার প্রয়াস করবেন। যখন তার জ্ঞান ফিরবে উত্তেজিত হতে বারণ করবেন।
-আচ্ছা।

ছায়া কক্ষের ভিতরে পা রাখবে এমন সময় সোহরাবের প্রশ্ন শুনে তার পা জোড়া নিজ থেকেই অবস হয়ে যায়। পাঞ্জাবীর হাতা ঠিক করতে করতে কঠিন স্বরে বলে,
-মেয়েটা কে? কোনো আত্মীয়র মেয়ে নাকি?

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০১

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#সূচনা_পর্ব

– দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া কী খুবই জঘন্য কাজ? আমি কী তাহলে ভয়ংকর কোনো পাপ করেছি? মানুষ নিজ স্বার্থের জন্য তো বহু পাপেই লিপ্ত হয় আমিও নাহয় তাঁদের দলেই রয়ে গেলাম!

মনে মনে উক্ত উক্তিটি বলল বিছানায় বসে থাকা নারী মূর্তি। কাঁচা ফুলে সজ্জিত কামরায় মোমের ক্ষীণ আলোয় লাল কারুকাজ করা দোপাট্টার আড়ালে এক নমণীয় মুখশ্রী ভেসে উঠেছে। হাঁটুভেঙে মাথা নিচু করে বসে আছে বিছানায়। দুনিয়ার যাবতীয় চিন্তা জানো তার মস্তিকে খেলছে! বেশ কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে নবস্বামীর অপেক্ষায়। তবুও করো আসার নামগন্ধও নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে মাথার দোপাট্টা সরিয়ে ফেলে রমণী। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে কামরার সবগুলো মোম নিভিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আঁধারে ঢেকে যায় সর্বত্ব। পশ্চিম পাশের জালানা দিয়ে আসা উজ্জল চাঁদের আলোর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বিছানায় শুয়ে পরে সে। এক দৃষ্টিতে মাথার ওপর চলন্ত বৈদুতিক পাখার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকে নিজের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা।

– আমি উপমা। আমি এবং আমার মা এই গ্রামেই থাকি। আমার বাবা মারা গিয়েছে আরো বছরখানেক আগে। আমার মা গ্রামেরই একটি স্কুলের শিক্ষিকা। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় মা ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই। আজ আমার বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। এটাকে বিবাহ নয় শুধু চুক্তি বলে হয়তো! আমার থেকে তাঁদের চাওয়া পাওয়া শুধু তাঁদের বংশধর তারা পুত্রবধূ চায় না। শুনেছি গ্রামের জমিদার নাকি আমার শশুর। অনেক নামডাক তার! ভীষণ ভালো মানুষ তাই সবাই অনেক শ্রদ্ধা করেন তাকে। আমার শাশুড়ি গ্রাম্য মেলায় প্রথম আমাকে দেখেছিলেন কিছুদিন আগে। তার মনে ধরে আমাকে তাই তো পরেরদিনই আমাদের বাসায় আমার জন্য বিবাহের প্রস্তাব দেন। আমার মা রাজি ছিলেন না। তার মেয়ে কারো দ্বিতীয় স্ত্রী হোক এটা কোনো ভাবেই মা মানতে পারছিলেন না। আমার মা আবার অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার কি হবে এইসব ভেবে শেষে উপায় না পেয়ে বিবাহের পিঁড়িতে বসতে হলো আমায়। স্বামী নামক মানুষটিকে আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি। সত্যি বলতে দেখার ইচ্ছে প্রসনও করছি না। আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী রূপে এই অন্দরমহলে পা রেখেছি ভাবতেই কেমন জানো অস্থিরতা কাজ করছে।হয়তো আমিই একমাত্র নারী যে নিজ ইচ্ছায় নিজের বাকি জীবন কুরবান করে দিয়েছে! আমার সতীন, আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রীকে এক পলক দেখার ভীষণ ইচ্ছে আমার।

ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে ঢোলে পরে উপমা। বেনুনী করা কেশগুচ্ছ বিছানার এক পাশে পরে থাকে অবহেলায়। লাল পাড়ের সাদা শাড়ী অন্ধকার রাজ্যেও জানো চাঁদের আলোর মতো কিরণ ছড়াচ্ছে। হতেও পারে এই আঁধার উপমা নামক রমণীর জীবন থেকে সকল আঁধারকে সাথে করে নিয়ে যাবে! দিয়ে যাবে এক আলোকৃতময় প্রভাত!

__________________
অন্ধকারে আচ্ছন্ন পুরো অন্দরমহল। দক্ষিণ দিক থেকে গুনগুন এক ভোতিক শব্দ ভেসে আসছে। জানো কোনো অশুভ আত্মা নিজের বহুদিনের কষ্ট উজাড় করছেন! সুবিশাল কামরায় এলোমেলো অবস্থায় জমিনে হাঁটুমুড়ে বসে আছে এক ব্যক্তি। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিটি হলো এক নারী মূর্তি। জমিনে ছড়িয়ে আছে কেশমুঠি ও গায়ে জড়ানো শাড়ীর আঁচল। নিঃশাস আটকে যাচ্ছে কান্নার কারণে তবুও থামার নাম নেই। এক সময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মৃদু স্বরে বিড়বিড় করে বলে,
– কেনো আমার সাথে এমন করলেন খোদা? কার ক্ষতি করেছিলাম আমি? কোন দোষের এত বড় শাস্তি আমাকে দিলেন? আমি যে সহ্য করতে পারছি না দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তাকে আমি ভালোবাসি আর কেউ জানুক বা না জানুক আপনি তো জানেন? সে আমাকে কেনো কোনোদিনও ভালোবাসলো না? এতদিন তাও সে শুধু আমার ছিল সেটা ভেবেই আমি ভীষণ সুখী ছিলাম কেনো আমার সুখ ছিনিয়ে নিলেন আপনি?

আঁখিজোড়া বন্ধ করে বড় বড় নিঃশাস নিতে থাকে রমণী। কান্না গুলো তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। হাত পা শিরশির করছে। বেশিক্ষন বসে থাকতে পারলো না সে। সহসা জমিনে মাথা এলিয়ে দিলো। আঁখিজোড়া বন্ধ রেখেই ফুঁফাতে ফুঁফাতে বলল,
– আপনার জীবনে এক কেনো হাজারো নারী আসলেও আমার ভালোবাসার এক বিন্দুও তারা বাসতে পারবে না সোহরাব মির্জা। আপনি আমার জীবনের শ্রেষ্ট প্রিয় আর আমি আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ অপ্রিয়! হ্যাঁ, আমিই সেই নারী যে নিজের অজান্তেই এক সুদর্শন পুরুষের প্রেমে উম্মাদ হয়ে ত্যাগ করেছি নিজের জীবনের সর্বসুখ।

_________________

গ্রামের অভ্যন্তরে জমিদার সালাউদ্দিন মির্জা তার সহ পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ছেলে মেয়ে মিলিয়ে ছয় সন্তানের পিতা সে। প্রথম স্ত্রী তুলসী। তার গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে চার মেয়ে ও এক পুত্র। তুলিকা মির্জা, সোহরাব মির্জা, তাহসিয়া মির্জা , তাহেরা মির্জা , সাইফা মির্জা। তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাইয়েরা এক ছেলে সন্তানের মাতা। ইয়ামিন মির্জা তার নাম। ক্ষমতাবান ও রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ সালাউদ্দিন। নিজ কর্ম ও নিজ দায়িত্বের প্রতি দৃঢ় কঠোর সে। তার ক্ষমতার কাছে পরিবার পরিজন সব কিছুই জানো তুচ্ছ! একমাত্র আদরের পুত্র সোহরাব মির্জা তার কাছে পুরো দুনিয়া সমতুল্য। মেয়ে সন্তানের পর অধয্য হয়ে পরে সালাউদ্দিন ঠিক তখনই জন্ম হয় সোহরাবের। অত্যাধিক আদর দিয়ে নিজ মতো করে গড়ে তুলেছেন পুত্রকে। সালাউদ্দিনের এক ভাই ও এক বোন আছে। ভাই আলাউদ্দিন মির্জা। দুই মেয়ে তার। রোমানা আর রুমকি। বোন তারিনাকে শহরে বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু ভাইদের অতি আদরে বেশিরভাগ সময়ে বাবার বাসায়ই থাকেন। এক পুত্র তার। বাহির থেকে দেখতে জমিদার বাড়ি যেমন সুখী পরিবার ভিতর থেকেও জানো এক সত্যি সুখী পরিবার। হয়তো শুধু অসুখী ছায়া আর তুলসী মির্জা!

ভোরের আলো ফুটতেই হৈচৈ লেগে পড়েছে জমিদার বাড়িতে। রসইকক্ষে রান্নার জড়তর। বাড়ির আনাচে কানাচে পরিষ্কার করতে নেমেছে গুঁটি দুইয়েক ভৃত্য। জমিদার বাড়ির বউরা নিজ হাতে রান্না করতে পছন্দ করেন। তাঁদের মতে খাবারের স্বাদ তখনই দ্বিগুন হয় যখন বাড়ির কর্তিরা নিজ হাতে রান্না করে। এখন রসইকক্ষে নাস্তার আয়োজন করছেন তুলসী ও আলাউদ্দিনের স্ত্রী মিনা। বাড়ির বাহিরে রাজ্যত্ব জমিদারের আর বাড়ির ভিতরে রাজত্ব তাঁদের। সংসারের প্রত্যেকটা কাজ তুলসী মির্জার হুকুমেই সম্পূর্ণ হয়।
-তুলি গরম পানির কলসিটা এগিয়ে দে। বাড়ির আরো সদস্য কোথায়? বেলা পরে যাচ্ছে অথচ এক এক নয়াব-জাদিদের ঘুম ভাঙ্গে না নাকি!

রনরণে কণ্ঠে কথাটা বলে তুলসী। কঠোর মুখভঙ্গি করে আটা মতছে আর কিছু একটা বিড়বিড় করছে। তুলি ও ফাতুসি বাড়ির বিশ্বস্ত কাজের লোক। দুইজনই কম বয়সী। রসইকক্ষের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব তাঁদের। তুলি কাঁচুমাচু হয়ে এক কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস হচ্ছে না তার। ফাতুসি আবার চঞ্চল স্বভাবের। জমিনে বসে সবজি কাঁটতে কাঁটতে এক ফাঁকে বলে উঠে,
-ছোডু মুখে বড়ো কথা কিছু মনে কইরেন না আম্মাজান কিন্তু ভাবিজান আর ফুবুজান তো প্রতিদিনই মেল্লা দেরি কইরা উডে! হেরা চায় আফনেরেই বান্দী বানাইয়া কাম করাইতে।

কথা শেষ করে জিভ কামড় দিয়ে উঠে ফাতুসি। কি বলে ফেললো নিজের কপাল নিজেরই চাপড় দিতে ইচ্ছে করছে তার। তুলসী কিছুক্ষন চুপচাপ থাকলো। পরমুহূর্তে শাসানো কণ্ঠে বলল,
-তুই মুখ বন্ধ রাখ ফাতু। আমার কাজে সাহায্য কর মাথায় বিষ ঢুকাতে না। আর তুলি বড় বউরে ডেকে আন।
-আইচ্ছা আম্মাজান।

তুলি তাড়াহুড়া করে রসইকক্ষ থেকে বের হতে যাবে আচমকা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে নিচে পরে যায়। সামনে না দেখে কোমর ধরে বিলাপ স্বরে বলে,
-ওমাআ গো! আমার কোমর ভাইঙ্গা গেলো গো! আম্মাজান আমি আর দাঁড়াইতে পারবাম না গো। মইরা গেলাম গো!

তুলসী সহ উপস্থিত সকলে বিরক্ত হলো। ধমকের স্বরে তুলসী বলল,
-নাটক বন্ধ করে উঠে দাঁড়া।

তুলি চট করে আঁখিজোড়া খুলে ফেলে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে দেখে দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়ায়। মুখে হাঁসি ফুঁটিয়ে বলে,
-আফনেরেই ডাকবার গেতাছিলাম ভাবিজান।

প্রতিউত্তরে ছায়া অর্থাৎ সোহরাব মির্জার প্রথম স্ত্রী কিছু বলল না। উনুন থেকে গরম পানির কলসি অতি সাবধানে জমিনে নামিয়ে রাখলো। মাথা থেকে আঁচল সরে যাওয়ায় সেটা পুনরায় ঠিক করে তুলসীর সাথে রুটি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরল। তুলসী আড়চোখে ছায়ার পানে তাকায়। ধবধবে মুখশ্রী ফুঁলে আছে। আঁখিজোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হয়তো রাতে কান্না করেছে! কাজের ফাঁকে ছায়া গম্ভীর কণ্ঠস্বরে তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– গরম পানির কলসিটা তোর বড় ভাইজানের কক্ষে দিয়ে আয়।
-প্রতিদিন না আফনে দিয়া আহেন ভাবিজান আইজ আমি যামু!

বেখেয়ালি কথাটা বলে ফেলে তুলি। ছায়া কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করল না। পুনরায় একই কণ্ঠে বলল,
-যেটা বলেছি সেটা কর।
-আইচ্ছা।

তুলি যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তার আগেই রুটি ভাজতে ভাজতে তুলসী বলে,
-আসার সময় তোর ছোট ভাবিকে নিচে আসতে বলিস।
-ছোডু ভাবি? ওহ হো! আইচ্ছা ডাইকা দিমু নে।

বড় ভাইজানের কক্ষে কলসি দিয়ে এসে তুলি ছোট ভাবি অর্থাৎ উপমাকে যে কক্ষে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায়। খানিকটা বিরক্ত হয়ে কক্ষের দরজায় বারি দেয়। দুই তিনবার বারি দেওয়ার পর দরজা খুলে যায়। কক্ষে প্রবেশ করে তুলির সর্বপ্রথম নজর পরে ফুলে সজ্জিত অগোছালো বিছানার ওপর। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উপমা। সাদা রঙের লাল পাড়ের শাড়ীটা এলোমেলো হয়ে অর্ধেক জমিনে পরে আছে। তুলি মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে উপমার স্মুখীন দাঁড়ায়। উপমাকে তার অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছে। গ্রামে সাধারণত এতো লম্বা মেয়ে কমই দেখা যায়। গালে হাত দিয়ে ভাবুক স্বরে বলল,
-আফনে তাইলে বড় ভাইজানের ছোডু গিন্নি?

উপমা নিঃশব্দে শুধু তাকিয়ে থাকল তুলির পানে। কতই বা বয়স হবে মেয়েটির? হয়তো ষোলো কী সতেরো কিন্তু আচরণ মুরুব্বিদের মতো!
-কী হইলো কন আফনেই কী ছোডু ভাবি?
-আপনার নাম কী?
-আমার নাম হইলো তুলি। আফনে আমারে তুই বইলাই বুলাইতে পারেন।
-ঠিক আছে।
-আফনের শাশুড়ি আফনেরে তৈয়ার হইয়া নিচে গেতে কইসে।

উপমা হালকা মাথা নাড়ালো। কিছু বলতে চেয়েও দ্বিধায় বলতে পারছে না। তুলি উপমার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলে,
-কিসু কইবেন? কিসু লাগবো আফনের?
-আমাকে পড়ার জন্য একটা শাড়ীর ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?
তুলি জানো অবাক হলো উপমার কথায়। বিস্মিত নয়নে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আলমিরার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,
-ওইটার ভিতরে জামা আছে।
-ওহ! ঠিক আছে।

তুলি চলে যায়। উপমা ধীর পায়ে আলমিরা খুলে সবুজ রঙের একটি শাড়ী নিয়ে পরে নেয়। কিন্তু এখন মুখ কিভাবে ধোঁত করবে! কামরায় কোনো গোসলখানা নেই। ভোর সকালে জানালা দিয়ে সে মহলের বাহিরে একটা বাঁধানো পুকুর দেখেছিল। কিছু সংখ্যক মহিলা কাজ করছিল। হয়তো সেখানে যেয়েই মুখ ধুতে হবে। উপমা বড় একটি নিঃশাস নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পরে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বিশাল বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। শাড়ীর কুচি ধরে এক পা দু পা করে নিচে নামছে। উপমার জানা মতে এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা অনেক তবুও এতো নির্জন নীরব কেনো?

শেষ সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামার পূর্বেই তুলসী ছুটে আসে উপমার কাছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপাদমস্তক পরোক্ষ করে শান্ত স্বরে বলে,
-আমার সাথে এসো ছোট বউ।

উপমা মাথা নাড়িয়ে টু-শব্দ না করে তুলসীর পিছু পিছু চলতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে উপমার পানে তাকায় তুলসী। ঢোক গিলে আমতা আমতা করে জিগ্যেস করে,
-তোমার স্বামী কাল রাতে তোমার কক্ষে গিয়েছিল কী?
-না।

উপমার উত্তর শুনে নিরাশ হলো তুলসী। বাড়িতে বাঁধানো দুটি পুকুর। একটায় মহিলাদের গোসলের ব্যবস্থা করা আরেকটায় পুরুষদের। পুকুর পাড়ে আসতেই মাথা তুলে সামনে তাকায় উপমা। তুলসী আদেশ স্বরে বলে,
-জমিদার বাড়ির মেয়ে বউরা এখানে গোসল করে। এখন তুমি মুখ হাত ধুঁয়ে রসইকক্ষে এসে আমাকে সাহায্য করো।
-জি।
-আমাকে সবাই আম্মাজান বলে ডাকে তুমি ও সেটাই বলো।
-ঠিক আছে আম্মাজান।

তুলসী চলে যায়। পা থেকে জুতোজোড়া খুলে নরম পায়ে ঘাটে যায় উপমা। আশেপাশে তাকিয়ে মাথা থেকে আঁচল সরিয়ে ফেলে। পানির দিকে হালকা ঝুঁকে বসে। দুই হাতের মুঠো ভরে পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে, হাত-পা ও ধুয়ে নেয়। আঁচল টেনে মুখশ্রী মুছে নেয়। মসলিন কাপড়ের শাড়ী পরিহিত সে। হাতে এক জোড়া স্বর্ণের ভারী বালা। বিয়ের দিন তুলসী তাকে এই বালা সহ পাথরের নাকফুল দিয়েছিল। কিছুক্ষন হাতের বালায় চোখ বুলিয়ে সামনে এগোয়। বড় ঘোমটা দিয়ে অন্দরের ভিতরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে ছুটে আসে দুইজন অচেনা মেয়ে। উপমা আন্দাজ করল একটি মেয়ে তার বয়সী আরেকজন দশ বারো বছরের হবে। দুইজনের চোখ মুখে চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়ছে জানো! রমণী জড়িয়ে ধরে উপমাকে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
– আসসালামু ওলাইকুম ছোট ভাবিজান।
– ওলাইকুম আসসালাম।
– আমি আপনের তিননম্বর ননদ। আমাকে তাহেরা বলে ডাকতে পারেন আর ও হলো ছোট আব্বার মেয়ে আপনের আরেক ননদ রোমানা।

উপমা ওপর নিচ মাথা নাড়ালো। তাহেরা উপমার থুতনি ধরে মাথা উঁচু করে পুরো মুখে নজর বুলিয়ে প্রশংসনীয় কণ্ঠে বলে,
– মাশাআল্লাহ! আমার আম্মাজানের পছন্দ আছে বলতে হবে!

উপমা কিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারল না। উপমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাহেরা তার হাত ধরে টেনে রসইকক্ষে নিয়ে যায়। একটার পর একটা কথা বলছে সে। উপমা ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে। এতো জলদি কেউ কিভাবে একজন অচেনা মানুষের সাথে এতো মিশে যায়!

রসইকক্ষে পা রাখতেই তুলসী আড়চোখে উপমার দিকে তাকায়। তাহেরা উপমাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। উপমা মাথা উঁচু করে লক্ষ্য করল কয়েকজন নারী মিলে কাজ করছে একসাথে। তার শাশুড়ির সাথে দুইজন মধ্যবয়স্ক মহিলা রুটি বানাচ্ছে আর একজন ভাঁজছে, দুইজন রমণী জমিনে বসে সবজি কাটছে, আরেকজন রমণী মাংস রান্না করছে যেটার সুবাসে রসইকক্ষ মৌ মৌ করছে!
-ছোট বউ এসো। আজ রসইকক্ষে তোমার প্রথমদিন তাই দুপুরের রান্নাটা সম্পূর্ণ তুমি রাঁধবে।

শাশুড়ির কথায় ধেন ভাঙে উপমার। দ্রুত পায়ে তুলসীর কাছে এগিয়ে যায়। মৃদু স্বরে বলল,
-ঠিক আছে আম্মাজান।

তুলসীর মুখে হাসি ফুটে। রসইকক্ষে উপস্থিত সকলের সাথে উপমার পরিচয় করিয়ে দেয় শুধু ছায়া বাদে। অতঃপর ছায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-বড় বউ আমি চাই ছোট বউকে তুমি তোমার অবিকল বানাবে। ও এই বাড়িতে নতুন! বাড়ির নিয়মকানুন সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিবে তাকে।
-জি আম্মাজান।

উপমা বুঝতে পারে এই রমণী তার সতীন। নিস্পলক কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল সেদিকে। রান্নাবান্না শেষ হলে সকলে ব্যস্ত হয়ে পরে খাবার টেবিলে খাবার সাজাতে। উপমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে। একে একে বাড়ির পুরুষদের আগমন ঘটলো। বড় ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকালো বাড়ির বউরা।

উঁচ্চালম্বা বলিষ্ঠ দেহের মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ বসতেই তার সাথে বাকি পুরুষরাও বসে পরে। স্বাস্থবান, আধো পাঁকা চুল, মুখে গম্ভীর ভাব ইনি হলেন উপমার শশুর সালাউদ্দিন মির্জা। পাশেই বসা তার ছোট ভাই আলাউদ্দিন। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে পুরুষদের খাওয়া হলে তারপর মহিলারা নিজ নিজ খাওয়া শেষ করেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ঠুকিয়ে তাহেরা উপমাকে তার কামরায় নিয়ে যায়। কামরা ভর্তি মানুষ দেখে বিচলিত হয়ে পরে উপমা। তাহেরা তাকে ধরে বিছানার এক পাশে বসিয়ে দেয়। সকলে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে উপমার দিকে। একজন তো বলে উঠলো,
-আমাদের ছোট ভাবিজান অনেক সুন্দরী!
-চুপ করো ইয়ামিন ভাই।

তাহেরার কথায় মুখে আঙুল দিয়ে চুপটি করে বসে থাকে ইয়ামিন নামের ছোট বালক। তাহেরা একে একে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় উপমাকে। তুলিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে সে এখন তার শশুরবাড়িতে আছেন। তাহসিয়া একটু অন্য ধাঁচের মানুষ। পরিবারের সকলের অমতে গিয়ে শহরে থেকে ডাক্তারি পড়ছে সে। তাহেরা মেটিক পাস করে আর পড়াশোনা করেনি। সাইফা ও রোমানা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ইয়ামিন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। আর রুমকি এখনও ছোট তাই পড়াশোনা করে না। তাছাড়াও তাঁদের পরিবারে কে কে আছে সেটাও বলে তাহেরা। উপমা প্রথমে একটু অস্বস্তি অনুভব করলেও ধীরে ধীরে তার সবাইকে ভীষণ ভালো লাগে। তাহেরা খুব জলদিই তার সখি হয়ে উঠে। সবার বিষয় জানার পরও উপমার একবারও ইচ্ছে জাগলো না স্বামীর নামক মানুষটির বিষয় কিছু জানার। সকালে নাস্তা করার সময়ে দেখেনি তাকে। তাহেরা কথায় কথায় একসময় বলে,
-ছোট ভাবিজান ভাইজানের সাথে দেখা হয়েছে আপনের?

উপমা খানিক সময় নিয়ে দুপাশে মাথা নারায়। তাহেরা বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে বলল,
-কি বলেন! কাল যাকে বিবাহ করলেন আজও তাকে দেখলেন না?
উপমা কথা পরিবর্তন করে তারা দেখিয়ে বলে,
-আমাকে আম্মাজান দুপুরের রান্নার দায়িত্ব দিয়েছে তাহেরা আপা আমি নাহয় এখন আসি।
-ঠিক আছে। আর আমাকে শুধু তাহেরা বলবেন। আপা আমার বড় দুইজনকে বলিয়েন ভাবিজান।

উপমা স্মিত হেসে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আঁচল দিয়ে ভালো মতো মাথা ঢেকে সামনে এগোয়। এতো বড় মহলের মতো বাড়ি কোন দিক রেখে কোন দিন যাবে ভেবে পায় না উপমা। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই অসাবধানতার কারণে শাড়ীর সাথে পা লেগে জমিনে পরে যেতে নেয় সে। কোনোরকম দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়।
পিছনে ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে খুশি হয়ে বুকে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। কত লজ্জাজনক বেপার! কারো চোখে পরলে সরমে মরে যেতে হতো ভেবেই সামনে তাকায় উপমা। ক্ষণেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায় তার। মুহূর্তেই কয়েক পলক ফেলে পুনরায় তাকায়। অচেনা একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে উপমার থেকে ঠিক সাত হাত দূরে। গাঢ় দৃষ্টি তার উপমাতেই নিবদ্ধ। রুদ্ধদার অবস্থা জানো! উপমা আর দাঁড়ালো না। শাড়ীর আঁচল ধরে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মুখ গোমড়া করে বিরক্তের উঁচু সীমায় পৌঁছে উপমা মনে মনে বলল,
-কেমন নির্লজ্জ পুরুষ বাবা! একজন অচেনা বেগানা নারীর পানে কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকে! কী ভয়ংকর চাহনি তার! স্রষ্টা এইরকম পুরুষের স্মুখীন আর আমাকে নিও না দোয়েয়া করে।

<<<চলবে?

আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ১০(শেষাংশ)|
লাবিবা ওয়াহিদ

নির্মল ফিরলো পরেরদিন। নুহাশ সাহেব এদিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন প্রণয়ার বিয়ে দিবেন। এ কথা শোনার পর থেকে প্রণয়ার খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। সারাক্ষণ সে কান্নাই করে যাচ্ছে। সে বিয়ে করবে না, ফাহিমাকে বারবার বলেছে বাবাকে বোঝাতে। কিন্তু ফাহিমা মেয়েকে এই পর্যায়ে বিয়ের ব্যাপারে বোঝাতে লাগলেন। তাঁর নিজেরও মনে হয় না নুহাশ সাহেব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বরং মেয়েকে বাঁচাতে এর চাইতে ভালো উপায় হতেই পারে না।

কান্নারত প্রণয়া উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। মজিব হাতে রাইফেল নিয়ে প্রণয়াকে কঠিন নজরদারিতে রেখেছে। নির্মল প্রণয়াকে দেখে এগিয়ে আসে। প্রণয়া নির্মলকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। সে আড়ালে চোখ-মুখ ভালো করে মুছে নেয়। নির্মল প্রণয়াকে দেখে বলল,
–“আজ ভার্সিটি যাননি?”

প্রণয়া নাক টেনে নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। প্রণয়াকে চুপসে যেতে দেখে নির্মল অবাক হলো। কিছু কী হয়েছে? নির্মল প্রশ্ন মনে দমিয়ে রাখল না। অস্থিরচিত্তে প্রশ্ন করলো,
–“কী হয়েছে প্রণয়া? সব ঠিক আছে তো?”

প্রণয়া এবার মাথা তুলে তাকায়। তার ফোলা চেহারা দেখে নির্মল ঘাবড়ে যায়। প্রণয়া নাক টেনে গলায় সামান্য ভয়-ডর ছাড়াই বলল,
–“আপনি যদি কখনো জানেন আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি, সেটা আপনি কীভাবে নিবেন নির্মল সাহেব?”

নির্মলকে নির্বাক হওয়ার জন্য বুঝি এই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিল। নির্মল একই স্থানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে প্রণয়ার দিকে। নির্মল অস্ফুট স্বরে বলল,
–“এটা কী করে সম্ভব?”
–“মন-ভালোবাসার ওপর কোনো মানুষের হাত থাকে না।”
–“ভালোবাসা হওয়ার আগেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্যি মানুষের আছে।”

প্রণয়া হাসল এ কথা শুনে।
–“এর মানে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন?”

–“তুমি যা বলছ তা শুনে এড়িয়ে যাওয়াটাই যে স্বাভাবিক, প্রণয়া।”
নির্মল নিজের অজান্তেই “তুমি” সম্বোধনে চলে এসেছে। যা শুনে প্রণয়া আবারও হাসলো।

–“আমি তো ভুল কিছু বলিনি। আমাকে ভালোবাসলে কী হয়? আমি কী এতই খারাপ?”

–“তুমি আমার ধরা-ছোয়ার বাইরের একজন। যাকে নিয়ে কখনো কিছু ভাবিইনি তাকে কীভাবে ভালোবাসা সম্ভব?”
–“কেন সম্ভব হতে পারে না?”

নির্মল চুপসে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“তোমাকে ভালোবাসা মানে নুহাশ চাচার বিশ্বাস ভাঙা। যে আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে তার বিশ্বাস ভঙ্গ আমি কী করে করি?”

প্রণয়ার অধর থেকে হাসি সরলো না। সে হঠাৎ বলল,
–“আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে নির্মল সাহেব। আর আপনাকে জ্বালাতন করব না।”

নির্মল চোখ তুলে তাকালো প্রণয়ার দিকে। প্রণয়ার বলা কথাগুলো কেন যেন বুকের বা পাশটায় দমকা ধাক্কা দিল। প্রণয়া চলে যেতে নিলেও থেমে যায়। পিছে ফিরে বলল,
–“আপনি মিথ্যা বলতে কাঁচা নির্মল সাহেব। আপনার চোখ জোড়া আপনার গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে। আপনার চোখের সামনেই আমি আরেকজনের বউ হবো, চ্যালেঞ্জ করে গেলাম।”

প্রণয়া হনহন করে চলে গেল ভেতরে। আর নির্মল সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আহত চোখে চেয়ে রইলো প্রণয়ার যাওয়ার পানে। তার এত বুক ফাটছে কেন? সেও কী তবে নিজের অজান্তে আবেগে পা দিয়ে ফেলল? দিলেই বা কী? প্রণয়া এবং তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। স্ট্যাটাস, টাকা-পয়সা সব দিক থেকেই। প্রণয়ার মতো আদরের দুলালীকে সে কোন মুখে নিজের ভাঙা ঘরের জন্য চাইবে? সেই মুখ নির্মলের না কখনো ছিল, আর না এখন আছে।

নির্মল এক সপ্তাহের মাঝেই নুহাশ সাহেবের বাজারের কাছাকাছি যেই জমিটা ছিল সেটার সব কাগজ-পত্র ঠিক রেখে বায়না করার পরপর কিনে নেয়। ওই জমিটাও চা বাগানের মাঝামাঝিতে। জমিতে একটা ভাঙাচোরা ঘর আছে। সেটাকে ভেঙে সুন্দর মতন টিনের দুই রুম হয়ে যাবে। নির্মল পরিকল্পনা মাফিক সব গুছিয়ে ফেলে। টাকা এখনো হাতে ভালো রকমই আছে। সেটা দিয়ে টিনসেট ঘর তোলা অসম্ভব হবে না। তাই চিন্তা করল তিন-চার মাস পরেই সে এখানে বাড়ির কাজটা ধরে ফেলবে।

জমির জন্য দৌড়-ঝাপের মাঝে প্রণয়াকে সে একদিনও দেখেনি। প্রণয়া যেন তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একে তো প্রণয়া ওরকম এক বিদঘুটে চ্যালেঞ্জ করে গেছে তার উপর সেদিন থেকেই নজর সীমানায় বাইরে রয়েছে। নির্মল যেন ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থিরতায় ভুগছে।

নুহাশ সাহেব অনেকদিন যাবৎ একটা চিন্তা-ভাবনায় আছেন। সেটা এখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি, আবার করারও সৎ সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। এই সিদ্ধান্তটা তার নিজেরই। প্রণয়ার বিয়ে সম্পর্কে। এজন্য সে একদিন দাওয়াত করল নির্মল এবং নীলুফাকে তাদের বাড়ি। সেই দাওয়াতে এতদিন গা ঢেকে থাকা প্রণয়ার না চাইতেও নির্মলের সামনে আসতে হয়। প্রণয়াকে দেখে নির্মল যেন স্বস্তি পায়।

প্রণয়া আড়াল থেকে প্রতিদিনই নির্মলকে দেখেছে, যা নির্মল ধরতে পারেনি। প্রণয়া অনেকটা ইচ্ছাকৃতই এই কাজগুলো করেছে যাতে নির্মল তার ভেতরকার অনুভূতি বোঝার সময় পায়। একা প্রণয়া আর কত পাগলামি করবে? এবার নাহয় নির্মল বুঝুক, প্রণয়ে বিরহের ব্যথা।

সবাই একই সাথে খাবার খেতে বসল। প্রণয়া নিজ থেকে নির্মলের পাতে খাবার দেয়। নির্মল প্রণয়ার দিকে তাকাতেই প্রণয়া যেন চোখের ভাষায় বোঝালো,
–“একদিন এভাবে ভালোবাসায় ঋনি করে দিয়েছিলেন। আজ আমি ঋন মিটিয়ে দিলাম, শোধবোধ।”

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারতেই নুহাশ সাহেব নির্মল এবং নীলুফাকে নিয়ে বাইরে বসলেন। স্বভাবসুলভ দাঁত খুঁচিয়ে নুহাশ সাহেব গলা খাঁকারি দিলেন। পরপর নীলুফারের উদ্দেশে বললেন,
–“ভাবী, আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।”
–“এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না ভাইজান। কী বলতে চান বলুন, অনুমতির কী আছে?”

ফাহিমা প্রণয়াকে নিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রণয়া চলে যেতে চেয়েছিল কয়েকবার, কিন্তু ফাহিমা তাকে জোর করে থামিয়ে রেখেছেন। ফাহিমা হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন নুহাশ সাহেব কী বলতে চাইছেন। এজন্য ফাহিমা প্রণয়াকেও সঙ্গে ধরে রেখেছেন।

নুহাশ সাহেব কিছুটা ইতঃস্তত হয়ে বললেন,
–“দেখেন, আপা। আমি নির্মলকে কখনো নিজের ছেলের চাইতে কম ভাবিনি। তাই এই বিপদে হয়তো নির্মলই আমায় সমাধান দিতে পারবে।”

–“কিসের সমাধান ভাই? বুঝলাম না।”

–“জানি আমি নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছি, তবুও বলছি.. আপনার আপত্তি না থাকলে নির্মলের সাথে আমি প্রণয়ার বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”

এ কথা শুনে নির্মল, নীলুফা উভয়েই বিস্মিত। প্রণয়াও তার জায়গায় স্থির হয়ে যায় বাবার মুখে এমন এক কথা শুনে। সে কী স্বপ্ন দেখছে? নীলুফা অস্ফুট স্বরে বললেন,
–“কিন্তু ভাই..”

–“আমি আপনাদের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত নই ভাবী। এমন নির্মল লাখে একটা। নির্মলকে যতবারই দেখি ওর বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম। এছাড়াও সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল একজন ছেলে। একজন বাবা তার মেয়ের ভালোর জন্য সব করতে পারে। আপনাদের মতো করে ভালো আমার মেয়েকে কেউ রাখতে পারবে না। ভালোবাসার মতো সুখ অন্যের কাছে পাইনি আমি, যতটা আপনাদের দেখে পাই। আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না ভাবী। আমার একমাত্র মেয়েকে নির্মলের হাতে তুলে দিয়ে নির্ভার হতে চাই।”

নীলুফা বললেন,
–“প্রণয়া মা আমার ঘরে নির্মলের বউ হয়ে আসবে এটা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার ভাইজান। আমার এতে আপত্তি নেই, তবে বিয়ে যেহেতু ছেলে-মেয়ের, তাদের মত আছে কি না সেটা জেনে নিন। প্রণয়া কী আমার ছোটো ভিটেতে থাকতে পারবে?”

ফাহিমা এই পর্যায়ে বেরিয়ে এলেন। হাসি-মুখে বললেন,
–“সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না আপা। আমার মেয়েটা বরাবরই ভালোবাসার কাঙাল। কেউ তাকে একটু ভালোবাসা দিলে সে সব পরিস্থিতিতে তাদের ঢাল হয়ে যায়। নির্মল বাবা, তুমি রাজি তো?”

নির্মল এতে বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল,
–“জি চাচী। আপনাদের সিদ্ধান্ত আমার ভালোর জন্যই।”

নুহাশ সাহেব স্ব-গলায় “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলেন। প্রণয়া বহুদিন পর ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করল। খুব খুশি সে, খুব। আল্লাহ’র নিকট বুকভরে শুকুরিয়া জ্ঞাপন করল।

বিয়ে এক সপ্তাহ পর। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হবে, কোনোরকম আয়োজন ছাড়াই। নির্মল বলেছে প্রণয়াকে সে এক কাপড়েই ঘরে তুলতে চায়। প্রণয়ার নিজেই অমূল্য রত্ন, যাকে নুহাশ সাহেব তার হাতে তুলে দিচ্ছেন। এর চাইতে বেশি কিছু নির্মলের চাওয়া নেই। একটি সুতাও সে প্রণয়ার সঙ্গে নিতে রাজি নয়। দেনমোহরের ব্যাপারেও নির্মল জানায়,
–“আমি আমার সামর্থ্য অনুসারে দেনমোহর নির্ধারণ করতে চাই চাচা।”

নুহাশ সাহেব রাজি হলেন। নির্মল যেন মুগ্ধতায় আটকে ফেলেছে তাঁকে। কী বিচক্ষণ বুদ্ধির প্রমাণ দিচ্ছে সে। প্রণয়া আসলেই বিয়েতে অমত করেনি। সে নীরবে শুধু সবটা মেনে নিয়েছে।

বিয়ের আগে নুহাশ সাহেব আনোয়ারের পাট চুকিয়ে নিলেন। কঠিন মামলা দিয়েছেন আনোয়ারকে। এছাড়া ওসি নুহাশ সাহেবের পরিচিত। তাই তাকে ভালো ভাবেই বললেন যাতে করে আনোয়ার সহজে জেল থেকে ছাড়া না পায়।

বিয়ের আগেরদিন ঘরোয়া ভাবে কয়েকজন মিলে প্রণয়ার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে দেয়। পিয়াসাও এসেছে প্রণয়ার হলুদে। পিয়াসা মিষ্টি হেসে বলল,
–“যাক, অবশেষে নির্মল দাদার বউ হতে চলেছ তুমি!”

প্রণয়া হাসলো। হেসে বলল,
–“ভাগ্যিস তুমি সেদিন এসে জাদুকর সাহেবকে সব বলে দিতে বললে। না মানলে রাগও দেখাতে বললে। জায়গামতো লেগে গিয়েছে তোমার বুদ্ধি। আর মাঝখান দিয়ে বাবাও সবটা গুছিয়ে দিলেন।”

–“ভাগ্য তোমাদের একসঙ্গে জুড়ে ছিল বলেই এমনটা হয়েছে প্রণয়া। সেসব কথা ছাড়ো, তোমায় হলুদ মাখাই আসো!”

বিয়েটা খুব সুন্দর, সাদা-মাটা ভাবে হয়ে যায়। প্লাবন তো সেই খুশি নির্মলকে দুলাভাই হিসেবে পেয়ে। সে একাই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে,
–“নির্মল ভাইয়া আমার দুলাভাই, আমাকে রোজ চিপস খাওয়াবে। আমার সাথে খেলবে, ঘুরতে নিয়ে যাবে, কী মজা!”

———————-
নির্মলের ঘরে বউ সেজে বসে আছে প্রণয়া। বিয়ে উপলক্ষ্যে নির্মল বেশ কিছু ফার্ণিচার কিনে ঘর ভরে ফেলেছে। যাতে করে বউ এসে খালি ঘর না দেখে। প্রণয়া হেসে ফেলে নির্মলের এই কাজে। প্রণয়া একমনে চেয়ে রইলো হাত জুড়ে থাকা মেহেদীর দিকে। এই মেহেদী একমাত্র নির্মলের নামে।

এমন সময়ই নির্মল ঘরে প্রবেশ করে। প্রণয়া নড়েচড়ে বসল। নির্মল নিঃশব্দে গিয়ে প্রণয়ার পাশে বসল। স্ত্রী রূপে প্রণয়ার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আওড়াল,
–“চ্যালেঞ্জ দিয়ে কী লাভ হলো? বউ তো শেষমেষ আমারই হলে। চ্যালেঞ্জ করে হেরে গেলে।”

প্রণয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে রইলো। মুখ ফুটে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। নির্মল একটা স্বর্ণের আংটি বের করল। প্রণয়ার হাত ছুঁয়ে নিজের হাতে আগলে সেটা তার অনামিকায় পরিয়ে দিল। প্রণয়া নির্মলের স্পর্শ পেল এই প্রথম। প্রথম স্পর্শে সে কিছুটা শিউরে উঠল। প্রণয়ার কেঁপে ওঠা নির্মল টের পেয়ে আলতো হেসে বলল,
–“আমার সামান্য হাত ধরায় এমন লজ্জা, ভালোবাসি বলতে গিয়ে লজ্জা করেনি?”

প্রণয়া মাথা নিচু করে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“আমি তো তাও বলেছি, আপনি তো বলেননি।”

–“বলতে হবে?”
প্রণয়া জবাব দিল না। এর মাঝে হুট করে কারেন্ট চলে গেল। ঘর এবার ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। প্রণয়া চমকে এদিক ওদিক তাকাতেই গালে উষ্ণ স্পর্শ পেল। পরপর কপালেও সেই একই স্পর্শ। প্রণয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলো। নড়াচড়ার শক্তিটুকু সে হারিয়ে ফেলেছে যেন। কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়তেই প্রণয়ার পিলে চমকে ওঠে। থরথর করে কম্পিত প্রণয়া সরে যেতে চাইলে নির্মল তাকে টেনে একই জায়গায় বসিয়ে দেয়। নির্মল ঘোরের মধ্যে আওড়াল,
–“ভালোবাসি তোমাকে, বউ। জানা নেই কীভাবে, কবে তোমাতে হৃদয় হারিয়ে বসলাম। তবে আমার সবটা জুড়ে শুধু তুমি-ই আছ, থাকবে। তোমাকে ঘিরে আমার সুন্দর জীবনের সূচনা হলো। আগলে রেখো আমাকে।”

বেশ কিছুটা সময় কেটে যায় তাদের ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। তখনো কারেন্টের দেখা নেই। প্রণয়া এবার মুখ খুলল,
–“শুনুন?”
–“শুনছি, প্রণয়া।”
–“পাটি আছে?”
–“আছে, কেন?”
–“লাগবে।”
–“এখনই?”
–“হুঁ।”

প্রণয়া পাটি নিয়ে বাইরের উঠোনে এলো। এখন গভীর রাত। বাইরে বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। প্রণয়া উঠোনে পাটিটা বিছিয়ে দিল। নির্মল ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনো ধরতে পারছে না, প্রণয়া ঠিক কী করতে চাইছে? প্রশ্নও করেনি সে, প্রণয়াকে নিজ ইচ্ছেতে ছেড়ে দেয়। প্রণয়া পাটিতে বসে বলল,
–“আসুন।”

নির্মল পাটিতে গিয়ে বসল। প্রণয়া আকাশের পানে চেয়ে পাটিতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। নির্মলও তাকে অনুসরণ করল। প্রণয়া দেখছে আকাশ আর নির্মল দেখছে প্রণয়াকে। তা বুঝতে পেরে প্রণয়া বলল,
–“চাঁদের দিকে তাকান। মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে আকাশে, কত কাছাকাছি লাগছে।”

নির্মল ভ্রু কুচকে বলল,
–“তাই তো দেখছি।”

–“আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে তো বলিনি, বলেছি আকাশের চাঁদ দেখতে।”

–“আকাশের চাঁদ তো অনেক দেখেছি, এবার আমার ঘরের চাঁদকে দেখতে দাও।”

এ কথায় প্রণয়া লজ্জা পেল। প্রসঙ্গ বদলে বলল,
–“আমাদের দেখা কিন্তু এই আলো-আঁধারিতেই হয়েছিল, মনে আছে?”
–“হুঁ, প্রথম দেখাতেই আমাকে চোর বানিয়ে দিয়েছিলে। ভুলব কেমন করে?”
নির্মলের কথায় প্রণয়া হেসে ফেলল।
–“চোর তো আপনি অবশ্যই। প্রণয়াকে তার নিজের থেকে চুরি করেছেন।”
–“কিছু চুরি যদি ভালো থাকার কারণ হয় তাহলে আমি চোর-ই ভালো। তোমায় চুরি করেছি বলেই তো আজ তুমি আমার পাশে।”
–“আপনি কী জানেন, আপনি প্রণয়ার ‘জাদুকর সাহেব’?”
নির্মল গভীর নজরে তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়া সেই নজরে নজর মেলাতে পারল না। আকাশ পানে নজর ঘুরালো। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই প্রণয়া আনমনে বলল,
–“আপনি গান জানেন?”
–“হুঁ, শুনতে চাও?”

প্রণয়া মাথা নাড়ায়। নির্মল এক হাতে প্রণয়াকে আগলে নিয়ে আকাশের তীরে চেয়ে আপন সুরে গান ধরলো,

“জীবন এত সুখের হলো
আমার পাশে, তুমি আছ তাই
এক জীবনে, এর চেয়ে বেশি
আমার যে আর চাওয়ার কিছু নাই।
তোমার আমার ভালোবাসা শেষ হওয়ার নয়
শুধু তোমায় কাছে চায় এ-ই হৃদয়।
ওগো তোমায় নিয়ে আমি পাড়ি দিয়ে
যেতে চাই সুখের-ই দেশে হারিয়ে।”

—সমাপ্ত।

আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০৯

0

‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০৯|
লাবিবা ওয়াহিদ

সেদিনের পর থেকে প্রণয়ার দিনগুলো বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকেই কাটছে। বই একেক করে শেষ করার পর তার বইয়ের প্রতি আরও নেশা কাজ করে। বই পড়া রীতিমতো প্রণয়ার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রিয় মানুষের দেওয়া প্রিয় অভ্যাস হারাতে দেয় কী করে? তাইতো নুহাশ সাহেবের কাছে গিয়েও বলল তার আরও বই চাই।

নুহাশ সাহেব মেয়ের চাওয়ায় ভীষণ খুশি হলেন যেমন, তেমনই নির্মলের প্রতি তার সন্তুষ্টি আরও যেন বেড়ে যায়। শুনেছেন নির্মলই নাকি উপন্যাসের বই তাঁর মেয়েকে উপহার দিয়েছিল। নুহাশ সাহেব এতে হেসে জানান বইয়ের লিষ্ট দিতে, উনি আনিয়ে দিবেন।

সে কথা শুনে প্রণয়ার মুখ-চোখে আনন্দাভাব ফুটে ওঠে। সেই আনন্দ নুহাশ সাহেব চোখ জুড়িয়ে দেখেন। মেয়ে যে সারাদিন একা শুয়ে বসে কাটান সেটা নুহাশ সাহেব খুব করে বুঝেন। এ নিয়ে বেশ চিন্তিতও ছিলেন তিনি। আদরের মেয়েটা একাকিত্বে না জানি ভুল পথে চলে যায়। যদিও তিনি প্রণয়াকে চিনেন, তবুও। বাবা-মায়ের সন্তানকে ঘিরে দুশ্চিন্তা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। আর এই মুহূর্তে নির্মলই তাকে স্বস্তিটা দিলো।

প্রণয়া চিন্তা করছিল, সে বইয়ের যুগে নতুন। তার জানা নেই, কোন বই ভালো? পড়লে স্বস্তি দিবে? সে তো এসবের কিছুই জানে না। তাই ভাবলো এবারও নির্মলের পছন্দে বই কিনবে।

বিকালে প্রণয়া ঝুল বারান্দায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছে। দুই হাতে মেলে ধরে আছে একটি বই। গোটা গোটা বাংলা অক্ষর পড়ার ফাঁকে আনমনে আকাশের পানে চাইছে। এই মুহূর্তে সে যেই বইটা পড়ছে তার একতরফা প্রেমের কাহিনীটা প্রায় প্রণয়ার মতোই। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে গল্পের নারী চরিত্রটা তার ভালোবাসাকে পায়নি। প্রকাশই করতে পারেনি, তার আগেই ভালোবাসার মানুষটা অন্য একজনের ভাগ্যে লিখে গেছে। এটা পড়ার পর প্রণয়ার ভেতরটা বারংবার কেমন মুঁচড়ে উঠছিল, ক্ষণে ক্ষণে নাক টানতে শুরু করে দেয়। অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রু জমে যায়। তার মনে হচ্ছে যেন মেয়েটার জায়গায় সে আর ছেলেটা নির্মল।

এই প্রথম বুকভরা হাহাকার, না পাওয়ার ভয় প্রণয়া অনুভব করলো। এতদিন যাবৎ শুধু ভালোবাসাটাই বুঝেছে, কিন্তু আগামী ভবিষ্যৎ যে কতটা কঠিন হতে চলেছে সেটা প্রণয়া ভাবতে চাইছে না। ছোটো ছোটো সুখগুলো হারিয়ে ফেলার কথা ভাবলেও তার দম বন্ধ হয়ে আসে। আচ্ছা, নির্মলের দিক থেকে সাড়া আসলে কী খুব ক্ষতি হতো?

সেদিন অত্যন্ত মন খারাপের কারণে নির্মলের সামনে অবধি গেল না সে। রুমের লাইট বন্ধ করে অন্ধকারে চুপ করে শুয়ে রইলো। বাইরে থেকে যখন প্লাবনের সঙ্গে নির্মলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসত প্রণয়ার মন চাইত ছুটে বাইরে যেতে৷ একপলকের জন্য নির্মলকে দেখা জরুরি। কিন্তু আজকের এই জরুরি অনুভূতিকে সে দাঁতে দাঁত চেপে দমিয়ে রাখল।

পরেরদিন নিত্যদিনের মতো করেই নাস্তার টেবিলে বসেছে সবাই। প্লাবনের চোখ তখনো ঘুমে ভার। ফাহিমা জোর করে উঠিয়েছে। প্লাবন এতে চরম বিরক্ত। আজ তার স্কুলে যাওয়ার একদমই নিয়্যত নেই। আজ একটা পরীক্ষা আছে স্কুলে, ক্লাস টেস্ট। ক্লাস টেস্টের নাম শুনলেই যেন তার গায়ে জ্বর আসে। তাই সে যেকোনো ভাবেই মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে রাজি করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মা সুঁচের ন্যায় সোজা। তাকে টলানো সহজ নয়। তবুও আজ সে হাল ছাড়বে না ভেবে নেয়।

নুহাশ সাহেব খেতে খেতে উষ্কখুষ্ক প্লাবনকে পরখ করে নিলেন। ভেবে-চিন্তে বললেন,
–“কী ব্যাপার প্লাবন? স্কুলের পোশাক পরোনি কেন?”

প্লাবনের কিছু বলার আগেই ফাহিমা বললেন,
–“ছাড়েন ওকে। এই ছেলের সবসময় যত বাহানা!”

নুহাশ সাহেব চুপ থাকলেন। প্লাবন বলল,
–“বাবা শোনো, আমি কিন্তু এখন মামার বাসায় যেতে চাই না। রোজ নির্মল ভাইয়ার কাছে পড়ছি। তাহলে আমি একদিন স্কুলে না গেলে কী হয়? রোজ রোজ এত পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে স্কুল যেতে ভালো লাগে না বাবা। আজকে যাব না, মাকে বলো না!”

নুহাশ সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন। প্লাবন এক বুক আশা দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে। নুহাশ সাহেব খাবার চিবুতে চিবুতে বললেন,
–“আচ্ছা, আজ যাওয়া লাগবে না। ফাহিমা, ওকে আর জোর করিও না আজ। এছাড়া নির্মলও দুদিন পড়াতে আসবে না।”

নির্মলের কথা শুনে প্রণয়ার গলায় খাবার আটকে গেল। কোনোরকমে গ্লাসভর্তি পানি খেয়ে নিল সে। ফাহিমা অবাক কণ্ঠে বললেন,
–“কেন আসবে না?”

প্রণয়াও একই ভাবে কৌতুহলী। নুহাশ সাহেব বললেন,
–“বাজারের কাছাকাছি একটা জমি আছে না একটা? ওটা তো অনেকদিনই খালি পড়েছিল। বিক্রি করব করব করে আর করা হয়ে উঠছিল না। ওটা নির্মল নিবে বলল।”

ফাহিমার অবাকের সুর পালটালো না। বললেন,
–“তাহলে সুনামগঞ্জ গেছে কেন?”
–“দোকান একটা আর একটা জমি বিক্রি করবে, সেসব ঝামেলা আর কাগজপত্র গোছাতেই গিয়েছে। সেখান থেকে সব ঝামেলা মিটিয়েই এখানে জমি কেনার কাগজপত্রে হাত দিবে।”

ফাহিমা বললেন,
–“হোক তাহলে সব ধীরে-সুস্থে। ছেলেটা অল্প বয়সে অনেক দুঃখ সয়েছে। এছাড়াও নির্মল এখন বিয়ের উপযোগী। পাত্রীপক্ষ তো আর ওকে খালি পকেটে মেয়ে দিবে না তাই না? হয়তো সব ভেবেই নীলুফা আপা নির্মলকে সব বলেছেন। সেদিনও আপা বলল নির্মলকে বিয়ে দিতে চান, কিন্তু ঝামেলার প্যাচে পড়ে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।”

প্রণয়ার গলা দিয়ে খাবার নামলো না একদম। একে তো নির্মল নেই, কেমন শূন্য শূন্য লাগছে, এমন অবস্থায় মায়ের এই ধরণের কথাবার্তা। প্রণয়া যেন স্বস্তিতে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারছে না। কান্না দলা পাকিয়ে গলায় এসে জমেছে। এই প্রথম প্রণয়া উপলব্ধি করল তার এবং নির্মলের অবস্থানের ব্যাপক ফারাক। যাকে সমাজ উঁচু-নিচু নাম দিয়েছে।

প্রণয়া শক্ত হয়ে চেয়ে রইলো খাবারের প্লেটে। একটা রুটির অর্ধেক খেয়েছে মাত্র, তবুও পেট খুদায় জ্বলছে না। নুহাশ সাহেব এবার প্রণয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
–“তোমার বই কেনার কী খবর? টাকা তো নিলে না!”

প্রণয়া কথা বলার শক্তি পেল না। মুখ খুললেই যেন কেঁদে ফেলবে ভাব। ঘনঘন পলক ফেলে কান্নার দমক থামিয়ে প্রণয়া বলল,
–“নির্মল ভাইয়া আসুক, আগে। তার থেকে লিষ্ট নিয়ে তোমাকে জানাব।”

–“আচ্ছা, মা। জানিয়ে দিয়ো।”

প্লাবন সারাদিন টিভিতে কার্টুন দেখে, বাইরে বাইরে ঘুরে বেরিয়ে কাটালো। আর প্রণয়া ঘর ছেড়েই বেরুলো না তেমন। দুপুরে চোখ-মুখ ধুঁয়ে নিচে যেতেই দেখলো নীলুফাকে ফাহিমা নিয়ে এসেছেন। নির্মল নেই, এজন্য তিনি আজ রাতটা নীলুফাকে তাদের সাথেই রাখবেন জানালেন। শুধু আজকের রাত নয়, নির্মল না ফেরা অবধি ফাহিমা নীলুফাকে এ বাড়ি থেকে নড়তেই দিবেন না বলে জানালেন।

নীলুফাকে দেখে প্রণয়ার বুকের ভারী ভাব আবারও বেড়ে গেল। আচ্ছা, ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টটা এত তীব্রতর কেন? ভালোবাসা না পেলে কেন ভেতরটা গুমরে ওঠে? প্রণয়া কেন নিজেকে সামলাতে পারছে না? ক্ষণিকের জন্য দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করলো সে।

——————-
কয়েকদিন কেটে গিয়েছে। নির্মল এখনো ফিরেনি। দোকান, জমি বিক্রি করতে গেলে প্রায়ই ঝামেলার কবলে পড়তে হয়। নির্মলও সেসব খুঁটিনাটি ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। সেগুলো একা হাতে সামাল দেওয়াই তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে গিয়েছে। এজন্য নুহাশ সাহেবের অনুরোধে প্রণয়ার মামাও তাকে সাহায্য করছেন।

প্রণয়া ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে খালি অটর অপেক্ষা করছে। তার পাশে রয়েছে পিয়াসা। পিয়াসা এবং সে একসঙ্গেই বাড়ি ফিরবে। প্রণয়ার উদাসীন মুখ চোখ এড়ায় না পিয়াসার। এজন্য জিজ্ঞেস করল,
–“প্রণয়া, তুমি কী ঠিক আছ?”

প্রণয়া চমকে তাকায় পিয়াসার দিকে। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,
–“ঠিক না থাকার কী আছে?”

পিয়াসা তবুও বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। প্রণয়া তাড়া দিল অটোর জন্য। সে ভার্সিটির সামনে থাকতে চাচ্ছে না। কিন্তু পিয়াসা অপেক্ষা করতে বলল। এর মাঝেই হঠাৎ প্রণয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো সেই কুৎসিত মানসিকতার লোক। তাকে দেখে প্রণয়া অনেকটা ঘাবড়ে যায়। এর মাঝে বেশ কয়েকদিন এই লোক প্রণয়ার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে, তাকে বাজে কথা বলেছে।

লোকটা এদিক সেদিক না চেয়েই চোখ ভরা কাম নিয়ে বলল,
–“নাহ রে ময়না, তোরে বিয়া না কইরে থাকা যাচছে না। তোরে আমার লাগবই।”

পিয়াসাও চমকালো এই লোকের কথা শুনে। লোকটার চোখ জুড়ে থাকা লালসা তারও চোখ এড়ালো না। সে প্রণয়াকে টেনে এগোতে এগোতে বলল,
–“কিছুদূর হেঁটেই যাই নাহয়।”

প্রণয়া স্বভাবতই সেরকম বান্ধবী বানাতে পারেনি। উপরে উপরে সবার সাথে মোটামুটি ভাব। কিন্তু এই মুহূর্তে পিয়াসা যেভাবে তাকে সুরক্ষিত করল ভাবতেই প্রণয়া অনেকটা নরম হলো পিয়াসার প্রতি। পিয়াসা সাহসী, এসব লোককে সে ভালো মতোনই শায়েস্তা করতে পারে। এজন্য টুকটাক প্রণয়া তার উপর গলে ছিল। আজকের মতো পরিস্থিতিতে পিয়াসা যেভাবে তার ঢাল হলো, তাতে প্রণয়া পিয়াসাকে বন্ধু ভাবা শুরু করে দিল অনেকটাই। ওদিকে পিয়াসা ধরে নিল প্রণয়ার মন খারাপের কারণ এই বাজে লোকটা। নিশ্চয়ই বেশ কিছুদিন যাবৎ তাকে উত্ত্যক্ত করছিল?

অটো প্রণয়ার গলিতে থামতেই পিয়াসাও তার সাথে নেমে গেল। এই ব্যাপারে নুহাশ সাহেবকে জানানো জরুরি। প্রণয়াও আটকালো না। নিজে বলতে না পারুক, আরেকজন তো বলছে। এ-ই বা কম কিসের?

———————–
প্রণয়া দুদিন যাবৎ ভার্সিটি যায়নি। বলা বাহুল্য নুহাশ সাহেবই যেতে দেননি। সেদিন পিয়াসার মুখে সব শুনে সে হতভম্ভ হয়ে পড়েছিল। লোকটার নাম আনোয়ার। বউ পি*য়ে তালাক দেওয়ার গুঞ্জন পুরো দমে ছড়িয়ে আছে। সেই থেকে আনোয়ারকে সবাই বাঁকা চোখেই দেখে৷ এছাড়াও আনোয়ারের মধ্যে দোষের অভাব নেই। গাঞ্জা টানে, জুয়া খেলে, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করেছে এরকম বহু রেকর্ড আছে তার। নুহাশ সাহেব এতদিন চায়ের টং কিংবা বাজারে ভাসা ভাসা শুনেছিল এই লোকের কথা। সঙ্গে কিছুদিন যাবৎ এও শুনেছেন আনোয়ারের শক্ত নজর পড়েছে প্রণয়ার উপর। নুহাশ সাহেব ব্যাপারটা আমলে নেননি। এখন পিয়াসার মুখে যা শুনলো তাতে এই ব্যাপার আমলে না নিয়েও থাকা যাচ্ছে না।

নুহাশ সাহেব এবং ফাহিমা সমান তালে চিন্তিত মেয়েকে নিয়ে। মেয়েকে সবসময় চোখে চোখে রাখছেন তারা। এমনকি প্রণয়াকে বাড়ির সামনের উঠোনেও যেতে দিচ্ছেন না। মজিব সবসময় কড়া নজরদারির সাথে বাইরের বেতের সোফায় বসে থাকেন। হাতে থাকে নুহাশ সাহেবের বাবার এক রাইফেল। এটার খুব যত্ন নিতেন নুহাশ সাহেবের বাবা। বাবার পর নুহাশ সাহেব এটার রক্ষণা-বেক্ষণ করেন। তাইতো আজ অবধিও এটা নতুনের মতো চকচক করছে।

এতকিছুর মধ্যে বিরক্ত শুধু প্রণয়া। সামান্য তিল যে তাল অবধি গড়াবে কে জানত? এখন যেন ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে। ঘরে যত বন্দী থাকছে নির্মলের ভাবনাও তাকে আরও গাঢ় করে আষ্ঠেপৃষ্ঠে রাখছে। কয় দফা যে কেঁদেছে সেটা শুধু সেই বলতে পারবে। ওদিকে নির্মলও আসছে না। কেন আসছে না? প্রণয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেমন।

ফাহিমা মেয়ের চিন্তায় প্রায় অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন। তার উপর নুহাশ সাহেবকেও কেমন চিন্তিত দেখছেন। স্বামীর মুখে শুনেছেন আনোয়ারের সাথে উনার পথে দেখা হয়েছে। দেখা হতেই নাকি আনোয়ার নুহাশ সাহেবকে তার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেন। এতে নুহাশ সাহেবের গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল। নুহাশ সাহেব সাফ গলায় বারণ করলেও আনোয়ার তাকে ঠান্ডা মাথায় মেয়েকে নিয়ে হুমকি দিয়ে চলে যায়। এমতাবস্থায় নুহাশ সাহেবও মেয়ের সুরক্ষা নিয়ে দারুণ চিন্তিত। সে চাইলেই মামলা দিয়ে আনোয়ারকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারবেন বহুদিন, কিন্তু আশেপাশে অনেক আনোয়ার ঘুরা-ফেরা করছে। নুহাশ সাহেব কয় আনোয়ার থেকে বাঁচাবেন মেয়েকে?

ফাহিমা একপ্রকার বাধ্য হয়ে তাঁর বড়ো ভাই অর্থাৎ প্রণয়ার মামাকে বিস্তারিত জানান। নুহাশ সাহেবের আত্নীয় বলতে তেমন কেউ নেই যে তিনি এই বিপদে পরামর্শ নিবেন। জটিল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তা বুঝতে পেরেই ফাহিমা বড়ো ভাইকে অনুরোধ করলেন যেন নুহাশ সাহেবের সাথে কথা বলে একটা সিদ্ধান্তে আসে। এভাবে ভয়ে ভয়ে তো আর দিন কাটানো যাচ্ছে না।

বোনের কথা চিন্তা করেই মামা আসলেন শ্রীমঙ্গল পরেরদিন। মুখোমুখি নুহাশ সাহেবের সাথে বসে আলোচনা করলেন এ বিষয়ে। নুহাশ সাহেব বিস্তারিত জানাতেই মামা বললেন,
–“আমার কাছে একটা সমাধান আছে নুহাশ।”

নুহাশ সাহেব যেন আশার আলো দেখতে পান। অস্থিরচিত্তে বললেন,
–“কী ভাইজান?”

মামা থেমে বললেন,
–“প্রণয়াকে বিয়ে করিয়ে দাও। বয়স অনুযায়ী মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। তাই এই বিপদে বিয়ের চাইতে ভালো সমাধান আর নেই। বিয়েটা দিয়েই ওই জা*য়ারের নামে সোজা মামলা করে দিবা। তুমি চাইলে আমি চেনা-জানার মধ্যে ছেলে দেখতে শুরু করে দেই। কী বলো?”

চলবে—

আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০৮

0

‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০৮|
লাবিবা ওয়াহিদ

নীলুফার সময়গুলো কাটে প্রায় একা একাই। শুয়ে, বসে, হাঁটা-চলা করে, ফাহিমার সাথে এভাবেই। বাসার সামনে হাঁটার জন্য জায়গা আছে। এখানে পায়চারী করলেই মন ফুরফুরে হয়ে যায়। তবুও এই একাকিত্বে স্বামী, সন্তানকে খুব মনে পড়ে। না চাইতেও আনমনে স্মৃতিচারণ করতে শুরু করে দেয় অতীত জীবনের। সোনালি দিনগুলো ভাবতে গিয়ে আপনমনেই হেসে উঠেন তিনি। নিজের সেই বাড়ি, সংসার সব তার মাথায় নাড়া দিয়ে ওঠে। সারাজীবন এক জায়গায় কাটিয়ে জায়গা বদলে তিনি খুব একটা খুশি হয়েছেন তেমনটাও নয়। অধিকাংশ নারীরাই চায় তার শেষ জীবনটা ভালোবাসার মানুষটার স্মৃতি নিয়ে তার বাড়িতে কাটাতে। তেমন চাওয়াটা নীলুফারও ছিল কিন্তু ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল না।

নীলুফার চুলোয় রান্না বসিয়ে আনমনেই ভাবছিলেন সেসব। হঠাৎ পেছন থেকে মেয়েলি গলা শুনে পেছন ফিরে তাকাল। প্রণয়া দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজায়। তাকে দেখে নীলুফার মুখের হাসি চওড়া হলো।
–“আরে, প্রণয়া মা। এসো এসো।”

প্রণয়া ত্রস্ত পায়ে ভেতরে আসল। চুলোর কাছে-পিঠেই আরেকটা মোড়া ছিল। সেটা নিজের পাশে রেখে প্রণয়াকে বসতে ইশারা করলেন। প্রণয়াও হেসে বসে পড়ল। সময়টা এখন দুপুর।

প্রণয়া বসতে বসতে বলল,
–“প্রায় একাই থাকেন এখানে, তাই ভাবলাম আপনাকে একটু সময় দেওয়া যায়।”

নীলুফা হাসল। কড়াইয়ে খুন্তি নেড়ে বললেন,
–“ভালো করেছ। আসবে, তুমি আসলে খুব ভালো লাগবে আমার। কী খাবে বলো? দুপুরে আমাদের সাথে ভাত খাবে কেমন?”

প্রণয়া চোখ বড়ো করে বলল,
–“আরে না, না আন্টি। আমি খেয়েই এসেছি। আর কিছু খাব না।”

–“এ আবার কেমন কথা? এসেছ, আর বলছ খাবে না?”
নীলুফা জোরাজুরি করতে লাগল। আর প্রণয়া বেকায়দায় পড়ে যায়৷ তবুও নীলুফাকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে রাজি করায়।

প্রণয়া মিনমিন গলায় বলল,
–“নির্মল ভাইয়া কী দুপুরে বাসায় আসে?”

“ভাইয়া” সম্বোধন করা প্রণয়ার জন্য কিছুটা কষ্টসাধ্য। কিন্তু তবুও, নির্মল তার থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো। চাইলেও তাকে নাম ধরে ডাকাটা ভালো দেখাবে না। এজন্য বুকে পাথর চেপেই এই শব্দটা উচ্চারণ করতে হয়েছে তাকে।

নীলুফা বললেন,
–“হ্যাঁ, তবে মাঝেমধ্যে আসতে পারে না। নুহাশ ভাইয়ের সাথেই থেকে যায়।”

প্রণয়া উত্তরে “ওহ” বলল। সে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটালো নীলুফার সাথে। নীলুফা মানুষটার সাথে বেশ সহজেই মিশে গেছে প্রণয়া। প্রণয়া মোটেও মিশুক নয়। একা থাকার দরুন প্রথম প্রথম কারো সাথেই সে মিশতে পারে না। তার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। নীলুফারা এসেছে প্রায় মাস দুয়েক হয়ে গিয়েছে। তাই মেশাটা কঠিনও ছিল না।

বিকালে প্রণয়া যখন উঠোনে পায়চারী করছিল তখনই নির্মল আসে। প্রণয়া ঘাড় বাঁকিয়ে নির্মলের দিকে তাকালো। আজ নির্মল দুপুরে খেতে আসেনি। এটা সে নজরে রেখেছিল বলেই বুঝতে পেরেছে। নির্মল স্মিত হেসে বলল,
–“সবসময় কী আকাশ এবং চায়ের সঙ্গেই আলাপন করেন? আর কোনো এক্টিভিটিস নেই?”

প্রণয়া অবাক হলো নির্মলের কথায়। একই সাথে মনে করারও চেষ্টা করল, আর কোনো এক্টিভিটিস তার আছে কিনা? কিন্তু এই মুহূর্তে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। তাই মুখ ছোটো করে প্রণয়া বলল,
–“না।”

নির্মল শুনলো নীরবে। তাদের কথার মাঝেই কিছু পর্যটক এলো। মজিব আশেপাশে নেই। কাজে কোথাও গিয়েছে হয়তো। এবারে প্রায় সাত থেকে আটজন ভার্সিটির ছেলে-মেয়ে এসেছে এখানে ছবি তুলতে, চা বিলাস একটু ঘুরে বেড়াতে। পর্যটকরা বাড়ি দেখে প্রতিবারের মতোই প্রশংসা করলো এবং ছবি তুলল। তবে এবার ঘটনা ভিন্ন হলো।

একজন মেয়ে আসল নির্মলের সাথে ছবি তোলার পারমিশন চাইতে। তা দেখে প্রণয়ার মনে হলো কেউ যেন যত্নের সাথে তার গা জুড়ে সুঁচ বিঁধিয়ে দিচ্ছে। প্রণয়া নাক-মুখ ঘুচে গম্ভীর হয়ে মেয়েটাকে দেখে চলেছে। মেয়েটা দেখতে সুন্দর-ই বলা যায়। পরেছে রঙিন কূর্তি এবং ডেনিম জিন্স। রিবন্ডিং করা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে আছে, আবার চুলে গুঁজে রেখেছে রঙিন সানগ্লাস।

এরকম একটা মেয়ে নির্মলের সান্নিধ্যে এসেছে কোন সাহসে প্রণয়া সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। অবশ্য নির্মল হাসি-মুখেই ছবি তুলতে বারণ করে দিলো। মেয়েটাকে এতে নিরাশ হতে দেখা যায়, আর প্রণয়াকে খুশি। মেয়েটার বন্ধুমহল থেকে একটা ছেলে চা বিলাস সম্পর্কে জানতে চাইলো। নির্মল যতটুকু জানে তা স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করল। এভাবে কিছুটা ভাব হয়ে যায় তাদের সাথে নির্মলের। প্রণয়া মুখ বাঁকিয়ে মিনমিন করে বলল,
–“আবারও কথার জাদু প্রয়োগ করছে মানুষের উপর।”

নির্মল এবার তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়ার অস্পষ্ট কথা শুনতে পায়নি বলেই তাকিয়েছে। প্রণয়াও কিছুটা চমকে ওঠে নির্মলের তাকানো দেখে, ভুলবশত কিছু শুনে ফেলেনি তো? নির্মল বলল,
–“কিছু বললেন?”
প্রণয়া ঘনঘন মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ কিছু বলেনি।

নির্মল ওদের সাথে কথায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় কীভাবে প্রণয়াকেও খেয়াল করল ভাবতেই প্রণয়ার অবাক লাগছে। নির্মলের পাশের মেয়েকে যেন এতক্ষণে খেয়াল করল সবাই। প্রণয়া পেছন দিক ফিরে নিজেকে প্রায় আপাদমস্তক শাল দিয়ে আবৃত করে রেখেছে। তাই বোঝার সাধ্য নেই যে সে অল্প বয়সী মেয়ে। প্রণয়াকে লক্ষ্য করে একজন ছেলে নির্মলের উদ্দেশে বলল,
–“ভাই কী এখানে দাঁড়িয়ে প্রেম করছিলেন নাকি? মনে হচ্ছে ভুল সময়ে এসে পড়লাম।”

এ কথা শুনে তাদের মধ্যে একজন মেয়ে মুগ্ধ গলায় বলল,
–“হায়, চা বিলাসে প্রেম। ব্যাপারটা কত সুন্দর।”

নির্মল হেসে তাদের ভুল ভাঙাতে বলল,
–“তেমন কিছু নয়। আমাদের মধ্যে প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই।”

প্রণয়া ওদের কথা শুনে ভালো লাগায় এক মুহূর্তের জন্যে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল। পরমুহূর্তেই আবার নির্মলের কথা শুনে ধপ করে জমিনে এসে পড়ল। মুখটা মলিন করে চা বাগানের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু শুধুই স্বপ্নে ভাসছিল সে। তবুও, কিছু স্বপ্ন স্বস্তির, ভালো লাগার। ভালো লাগার স্বপ্নে কে না ভাসতে চাইবে?

ওরা বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি। যাওয়ার আগে সেই ছবি তুলতে চাওয়া মেয়েটা নির্মলের কাছে ফেসবুক আইডি বা মোবাইল নম্বর চেয়ে বসলো। প্রণয়া তখন নাক কুঁচকে তাকায় নির্লজ্জ মেয়েটার দিকে। কী পরিমাণের নির্লজ্জ হলে অল্প সময়ের পরিচিত ছেলের থেকে এভাবে নাম্বার চায়?

বিরক্তি ধরে রাখতে না পেয়ে প্রণয়া এতক্ষণে মুখ খুলল,
–“আমরা সাধা-সিধে পাহাড়ি মানুষজন। আমাদের এখানে কোনো মেয়ের, ছেলেদের থেকে নাম্বার চাওয়াটা ভালো চোখে দেখে না। তাই আপনার এই নাম্বার চাওয়াটাও আমি ভালো চোখে দেখছি না। চা বিলাস ঘুরেছেন, ছবি তুলেছেন, এবার আসতে পারেন!”

ছেলে-মেয়েগুলো একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। নির্মলও নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো প্রণয়ার দিকে। প্রণয়া প্রত্যেকের নজর অবজ্ঞা করে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। সেই মেয়েটা কিছুটা লজ্জিত হলো বোধ হয়। নির্মলকে “দুঃখিত” প্রকাশ করে বন্ধুমহল মিলে চা বিলাস প্রস্থান করলো। নির্মল তাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে প্রণয়ার দিকে তাকালো।

ফিচেল হেসে বলল,
–“প্লাবন বলেছিল আপনার মধ্যে চাপা রাগ এবং বিরক্তি ছাড়া অন্য কোনো রূপ সে দেখেনি। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইতাম না, আজ নিজ চোখে দেখে বিশ্বাস হলো।”

–“কেন? বিরক্ত প্রকাশ করা পাপ নাকি?”

–“একদম না। নিজের ভালো-মন্দ অনুভূতিদের চেপে না রেখে প্রকাশ করা ভালো। নয়তো বুকের মধ্যে খসড়া কথার পাহাড় জমে যায়। তখন দমবন্ধকর, জটিল অবস্থা তৈরি হয়।”

প্রণয়ার বিরক্তি কেটে গেল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“মেয়েটা অহেতুক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছিল, আমার এই ধরণের গায়ে পড়া মেয়ে পছন্দ নয়।”

–“যার প্রকৃতির সাথে মধুর সম্পর্ক, তার কাছে এই ব্যাপারগুলো ভালো লাগবে না, স্বাভাবিক।”

প্রণয়া আহত অনুভব করলো নির্মলের কথায়। এর মানে কী প্রণয়া ওভাবে না বললে নির্মল সত্যি সত্যি তাকে নাম্বার দিয়ে দিত? বুক পোড়া অনুভূতির সাথে অভিমানী গলায় বলল,
–“আমি কী আপনাদের মধ্যে কাঁটা হয়ে গেলাম নাকি? আমি কিছু না বললে বুঝি নাম্বার দিয়ে দিতেন?”

প্রণয়ার কথায় নির্মল হেসে ফেলল। হাসি কোনো রকমে থামিয়ে বলল,
–“আমি এটা বুঝাইনি, প্রণয়া। সত্যি বলব?”
–“বলুন।”
–“আমারও এই ধাচের মেয়ে একদম পছন্দ নয়। থাকুন, আমি বাসায় যাই। একটু পর তো দেখা হচ্ছেই।”

প্রণয়া যেন প্রাণ ফিরে পেল। নির্মল চলে গেলেও অজস্র ভালো লাগায় প্রণয়া বুদ হয়ে রইলো। মোহ যেন কাটছেই না তার।

———————–
কিছুদিন পর নির্মল হুট করে এক বাদামী প্যাকেট ধরিয়ে দেয় প্রণয়ার হাতে। প্রণয়া প্যাকেট ধরেই বুঝল দারুণ ভারী সেটা। কৌতুহলী গলায় বলল,
–“কী আছে এতে?”

নির্মল মুচকি হেসে বলল,
–“কিছু উপন্যাসের বই। যার প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আছে সে অনায়াসেই বইয়ের পাতায় মিশে যেতে পারবে।”

প্রণয়া লাজুক হেসে চটজলদি প্যাকেট খুলতে শুরু করে দেয়, উপন্যাসের বই তাও কি না নির্মলের দেওয়া উপহার? প্রণয়া শত আনন্দের ভীড়ে নির্মলকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যায়। নির্মল আবার বলল,
–“অবসর সময়গুলো বই পড়ে কাটাবেন নাহয়, একঘেয়েমি লাগবে না।”

নির্মল চলে আসতে নিলে প্রণয়া তাকে পিছুডাক দিলো। নির্মল পিছে ফিরে তাকাতেই প্রণয়া হেসে বলল,
–“ধন্যবাদ।”

নির্মল উত্তরে মুচকি হেসে চলে গেল। প্রণয়া বইয়ে চোখ বুলিয়ে আপনমনে বলল,
–“ধন্যবাদ, জাদুকর সাহেব। আপনাকে দেওয়া জাদুকর সাহেব নামটা ভুল দেইনি, আপনি আসলেই আমার মন ভালো করে দেওয়ার প্রেম জাদুকর।”

চলবে—

আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০৭

0

‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০৭|
লাবিবা ওয়াহিদ

সেদিনের ঘটনা প্রণয়াকে বেশ নাড়িয়ে তুলেছিল। এজন্য সে প্রায় সপ্তাহখানেক কলেজ যায়নি। কেউ অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করেনি, প্রণয়াও কারো সাথে মুখ ফুটে এরকম একটা ঘটনা বলতে পারছিল না। কোথাও দ্বিধা কিংবা জড়তা কাজ করত বলে।

প্রণয়ার স্বপ্নগুলোও আজকাল দু ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। কখনো ওই লোকের কুৎসিত রূপ স্বপ্নে ধরা দিচ্ছে আবার কখনো রাজকুমার স্বরূপ নির্মল এক সুন্দর, অমায়িক প্রেমিক রূপে স্বপ্নে ধরা দিচ্ছে। নির্মল আসে আলো হয়ে, আর সেই কুৎসিত লোকটা আসে আঁধারের নিকৃষ্টতম রূপ হয়ে। মাঝেমধ্যে দুস্বপ্ন দেখে আতঙ্কে প্রণয়ার ঘুম ভেঙে যায়।
প্রেমে পড়ার উপলক্ষ্যে দিনগুলোকে খুশির সাথে পালন করার কথা ছিল তার, কিন্তু সুখের সঙ্গে সেই নেতিবাচক ঘটনা তাকে বারংবার অন্যমনস্ক করে তুলছে।

বিকালে প্রণয়া গায়ে শাল জড়িয়ে উঠোন জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আজকে দুপুরের পর থেকেই আকাশ কিছুটা মেঘলা। রোদের রেশ নেই, আকাশও কেমন মলিন হয়ে আছে যেন। বিশাল চা বাগানের সঙ্গে যেন প্রণয়ার নীরব আলাপন চলছে। হাতে এক কাপ চা। তবে চুমুকের কারণে চায়ের কাপে চা অর্ধেক গিয়ে ঠেকেছে। মজিব সদর দরজার মুখে থাকা ছাউনির নিচে পেতে রাখা বেতে চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে।

নিরবিলি চা বিলাসের বাইরেই শুকনো পাতার শব্দ হলো। যেন কেউ চা বিলাসের দিকেই আসছে। মজিব ততক্ষণে ভেতরে চলে যায় ফাহিমার ডাক পড়ায়। প্রণয়া কান খাড়া করে সেই শব্দ শুনতে পেতেই পিছে ফিরে তাকাল। নির্মল আসছে। আজ তার হাতে কিছু হিসাবের খাতা আর চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। দিন কিছুটা মেঘলা হওয়ার দরুণ বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে আশপাশ জুড়ে। কোমল সেই হাওয়া গা ছুঁয়ে দিলেই কেমন ভালো লাগায় জড়িয়ে যায় প্রণয়া। নির্মলকে এই সুন্দর সময়ে চোখের দেখা দেখতে পেয়ে তার ভালো লাগার মাত্রা হুঁ হুঁ করে বেড়ে গেল।

নির্মল কাঠের ছোটো দরজাটা পেরিয়ে আসতেই উঠোনের ডানপাশে তাকাল। কিছুটা দূরেই প্রণয়া দাঁড়িয়ে তার দিকেই দিকে। প্রণয়া ধরা খেয়েছে দেখে আর নজর ফেরালো না। নির্মলও এগিয়ে গেল প্রণয়ার দিকে। নির্মলের এগিয়ে আসা দেখে প্রণয়ার পা জোড়া সেখানেই অসাড় হয়ে এলো। নির্মল প্রণয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
–“সবুজ সামাজ্যের সঙ্গে আলাপ চলছে নাকি?”

প্রণয়া অল্প করে হাসল। বলল,
–“তা চলছে টুকটাক।”

–“কলেজ যাচ্ছেন কবে?”

প্রণয়া গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“আগামীকাল যাব।”

নির্মল আলতো হাসল। দূর-দূরান্তের চা বাগানে নজর বুলিয়ে বলল,
–“ঠিক আছে, তাহলে আমাকে জানিয়ে দিবেন নাহয়।”

–“আবার সেদিনের মতো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না তো?” প্রণয়া মুখ ফসকেই বলে ফেলল এই কথাটা।

নির্মল সৌজন্যের সাথে হেসে বলল,
–“আপনি অনুমতি দিলে বেতের সোফাতে বসেই অপেক্ষা করব।”

প্রণয়ার বলতে ইচ্ছে করল, “আপনার অপেক্ষার আগেই দেখবেন আমি আপনার অপেক্ষায় বসে আছি জাদুকর সাহেব। এ তো সামান্য গন্তব্যে একসাথে যাওয়ার অপেক্ষা, প্রেমের অপেক্ষা যে আমার তরফ থেকেই শুরু। আপনি চাইলে আপনার সমস্ত অপেক্ষা আমি নিজের নামে করে নিব, শুধু আপনি আমার সান্নিধ্যে থাকলেই চলবে।”

সেই টুকটাক কথাই চলল দুজনের মাঝে। নির্মল বাড়ি চলে যেতেই ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো মজিব। মজিবকে এতটা উঁশখুঁশ করতে দেখে প্রণয়া ডাকল মজিবকে।

–“মজিব চাচা, এভাবে ছুটছেন কেন?”

মজিব বললেন,
–“প্লাবন বাবা যে খেলতে গেছে এখনো আসার খবর নাই। সন্ধ্যাও তো হয়ে আসতেছে। স্যার আসবে না পড়াতে? এজন্যে তোমার মা আদেশ করসেন, প্লাবনকে যেখানেই পাব সেখান থেকেই যেন ধরে আনি।”

প্রণয়া এ কথা শুনে চায়ে চুমুক দিল। চা শেষ করে বলল,
–“তাহলে আস্তে-ধীরেই যান চাচা। প্লাবন নতুন টিচার পেয়ে এখন আর ফাঁকি দেয় না। কিছু দূর এগোতেই দেখবেন প্লাবন এলোমেলো পায়ে দুলে দুলে আসছে।”

——————-
প্রণয়া নিজের কথা রেখেছে। নির্মল আসার আগেই প্রণয়া তৈরি হয়ে তার অপেক্ষায় বসে ছিল। নির্মল লম্বা লম্বা পায়ে বাড়ির সামনে আসতেই দেখল প্রণয়া ছাউনির নিচে বেতের সোফায় বসে আছে। প্রণয়া চেয়েই ছিল নির্মলদের ঘরে যাওয়ার পথটার দিকে। তাই সে চট করে উঠে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। নির্মল প্রণয়ার দিকে চেয়ে বলল,
–“আমার কী আজ দেরী হয়ে গেল?”
–“মোটেই না। আমি তো সবেই এসে বসলাম।”
–“ওহ, তাহলে চলুন নাহয়।”

যখন দুজন চা বাগানের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে যাচ্ছিল তখন প্রণয়া হঠাৎ নীরবতা ভেঙে মৃদু গলায় বলল,
–“আপনার কাছে এই চায়ের সাম্রাজ্য কেমন লাগে?

নির্মল চট করে তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়া এতে নজর ঘুরিয়ে ফেলল। নির্মল পরমুহূর্তেই চা বাগানে চোখ বুলিয়ে বলল,
–“এই সৌন্দর্য চোখ জোড়া মুগ্ধ এবং মনজুড়ে অনুভব করতে পারে, এছাড়া ভাষায় কীভাবে এই সৌন্দর্যের অনুভব বর্ণনা করব তা আমার জানা নেই।”

প্রণয়া মুগ্ধ হয়ে শুনল নির্মলের কথা৷ কী দারুণ করে কথা বলে। কথা, কাজ দুটিতেই কেমন বশ করে ফেলে। না জানি আগে কত মেয়ে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে? এই প্রশ্নটা করার খুব ইচ্ছে করলেও ইচ্ছেকে প্রধান্য দিতে পারল না প্রণয়া। হঠাৎ এই অস্বাভাবিক প্রশ্নে না জানি জাদুকর সাহেব প্রণয়াকে নিয়ে কীরকম ধারণা মনে পুষে ফেলে। তাই প্রণয়া রিস্ক নিল না।

আজও ইটের সরু রাস্তায় অটো দাঁড় করানো দেখল তারা। নুহাশ সাহেব আগেই মজিবকে দিয়ে অটো ঠিক করিয়ে রেখেছে। আজ মজিব অবশ্য অটোর পাশেই দাঁড়িয়ে। ওদের দুজনকে দেখে মজিব হালকা হাসি দিয়ে বললেন,
–“তোমরা চলে আসছ? আজকে অটো পাইতে একটু দেরী হয়ে গেছিল আমার। তোমরা যাও, ভাড়া দিয়ে দিছি। আমিও আসি!”

বলেই মজিব চলে গেলেন। প্রণয়া পিছে উঠতে নিতেই দেখল আজও দুই সিটের অটো। প্রণয়া মুচকি হেসে উঠে বসল। নির্মল একটু ঘাড় কাত করে দেখে নিল অটোর ভেতর। নির্মল তাই বলল,
–“আচ্ছা, আমি তবে চালকের সাথেই বসছি।”

–“একদম না। সামনের ঝাকুঁনি বেশ কঠিন। আমি নিজেই তো আতঙ্কে থাকি, পিছে এসেই বসুন।”

নির্মল আগের দিনের মতোই কিছুটা জড়তা নিয়ে প্রণয়ার পাশে বসল৷ প্রণয়া নির্মলের সান্নিধ্য চাইছে এমন নয়৷ সেই রাস্তাটা আসলেই বাজে ধরণের ভাঙা৷ ভাঙা রাস্তায় তীব্র ঝাঁকুনি দুই একজন অটো থেকে পড়ে গিয়েছে এরকম রেকর্ডও আছে সেই পথটায়। এ নিয়েই প্রণয়ার মনে সঙ্কা। আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন, চিন্তা থাকবেই। তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রণয়ার এই দুশ্চিন্তার জন্যেই সহজে নির্মলকে সামনে বসতে দিতে চাচ্ছে না।

ভার্সিটি পৌঁছাতেই প্রণয়া অটো থেকে নেমে আশেপাশে সতর্ক নজর ফেলল। নির্মল অটোতে বসেই প্রণয়াকে ডাকল।
–“আজ কখন ক্লাস শেষ হবে?”

প্রণয়া সময় বলল। নির্মল বলল,
–“আচ্ছা, আমি তাহলে তখনই আসব নাহয়।”
প্রণয়া গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“কী দরকার কষ্ট করে আসার?”

–“কষ্ট কিসের? আমার জন্য তো ভালোই হচ্ছে, পথঘাট চিনতে পারছি। এখন ভেতরে যান, দেরী হচ্ছে।”

প্রণয়া ভার্সিটিতে প্রবেশ করে পিছু ফিরে তাকাল। নির্মল তখনো ঠায় একই স্থানে বসে। নির্মলকে তার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকতে দেখে প্রণয়ার মনের আকাশে রংধনু দেখা দিল। সে প্রচন্ড আনন্দের সাথে ভেতরে চলে গেল। কে বলেছে ভালোবাসলে বড়ো প্রাপ্তির প্রয়োজন হয়? ভালোবাসার অমূল্য সুখগুলো যে ছোটো ছোটো যত্ন, মুহূর্তের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। ভালোবাসার লুকানো সুখগুলো উক্ত মানুষকে ছুঁয়ে দিলে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ‘সে’।

সন্ধ্যার পরপর যখন নির্মল এলো প্লাবনকে পড়াতে, তখন প্রথমবারের মতো নির্মলের জন্যে নিজ হাতে চা বানাতে হাত লাগায় প্রণয়া। নির্মলকে ঘিরে তার বুকে লালিত অনুভূতি যেদিন থেকে নিজের কাছে প্রকাশ পায়, সেদিন থেকেই নিজের সাধাররণ আচরণে আমুল পরিবর্তন খেয়াল করে সে। প্রেমের হাওয়ায় যেন এক নিমিষেই আবারও সে কিশোরীতে পরিণত হয়েছে৷ কিশোরী অবস্থাতেও এরকম পাগলাটে ভাবনায় অস্থির ছিল না প্রণয়া। ইদানীং কী হলো, কে জানে?

ফাহিমা রান্নাঘরে আসতেই দেখলেন মেয়ে চায়ের জন্য চুলোয় পাতিল বসিয়েছে। তা দেখে ফাহিমা ভ্রু কুচকে বললেন,
–“আমি তো চা বানিয়ে রেখেছি, নতুন করে বানাচ্ছিস কার জন্য?”

প্রণয়া নির্লিপ্ত গলায় বলল,
–“কিছুটা চা হাত ফসকে পড়ে গিয়েছে। বাকি যতটুকু ছিল, আমি খেয়ে ফেলেছি।”

ফাহিমা হতাশ নজরে তাকাল মেয়ের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“দেখে-শুনে কাজ করতে পারিস না? এত অকর্মা কেন?”

–“চা বানাচ্ছি তো, আস্তে বলো। নয়তো উপরে শব্দ চলে যাবে।” মিনমিন করে বলল প্রণয়া।

–“তাই উচিত, শুনুক সবাই। তুই কতটা বেপরোয়া, অকর্মা সেটা সবাই শুনুক। আমার কতগুলো চা নষ্ট করলি তুই!”

–“চায়ের মাঝেই বাস করছ, চা পাতা লাগলে দুই একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসবা। ঝগড়া করছ কেন?”

ফাহিমা রাগের বশে কথার খেই হারালেন। বিড়বিড় করে দ্রুত চলে গেলেন রান্নাঘর ছেড়ে। প্রণয়া ততক্ষণে চায়ে মনোযোগ দিল। প্রণয়া কিছু পারুক বা না পারুক, তার চা বানানোর হাত দারুণ। একবার তার হাতের চা খেলে সেই চায়ের স্বাদ একদম মুখে মিশে যাবে, কিছুতেই ভোলার মতো নয় সেই স্বাদ। যথারীতি নাশতা নির্মলকে দিয়ে আসল সে।

————–
ঘন্টাখানেক লাগিয়ে প্রণয়া বাইরে সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে বসে রাতের আকাশ দেখছে। আকাশে এক টুকরো চাঁদ দেখা যাচ্ছে। আজকের আকাশ বেশ পরিষ্কার। গুড়ি গুড়ি কিছু তারাও দেখা যাচ্ছে। একমনে যখন চাঁদের রূপের রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল তখন হঠাৎ পেছন থেকে প্রিয় পুরুষের ভারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
–“প্রণয়া!”

প্রণয়া চমকে পিছে ফিরে তাকায়। মাথা উঁচিয়ে চাইতেই দেখল নির্মল দাঁড়িয়ে। প্রণয়া চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–“জি?”

নির্মল বলল,
–“চা টা কী আপনি বানিয়েছেন?”

চায়ের কথা শুনে প্রণয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। মিনমিন করে বলল,
–“হ্যাঁ।”

প্রণয়া অস্বস্তিতে পড়ে যায়। না জানি আনমনে কোনো ভুল করল কি না চায়ে। শখের মানুষের জন্য নিজ উদ্যোগে কিছু করতে গেলে তার পছন্দ হবে কিনা এই ভেবে নানান দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে হয়, যা এই মুহূর্তে প্রণয়ার ক্ষেত্রে হচ্ছে। সে মুখ ছোটো করে জামার কিছুটা অংশ খামচে ধরেছে।

প্রণয়ার ভাবনার উলটোটাই হলো। নির্মল স্মিত হেসে প্রশংসার সুরে প্রণয়াকে বলল,
–“দারুণ চা বানান আপনি। চা বানানো একটা আর্ট, আপনি সেই আর্টে চমৎকার দক্ষ। আমার তো আপনাকে ফুল রেটিং দিতে ইচ্ছে করছে।”

প্রণয়ার চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। চোখ নামিয়ে অধর প্রসারিত করে প্রণয়া বলল,
–“ধন্যবাদ।”

–“আরেক কাপ চায়ের বায়না করে গেলাম। যখন খুশি খাওয়াতে পারেন। চায়ের রাজ্যে এসে চা কে ‘না’ করে দেওয়া ঘোর অপরাধ। আজ আসছি, কেমন?”

প্রণয়া আলতো মাথা নাড়ায়। নির্মল যেতে নিয়ে আবার থেমে যায়।
–“কাল যাবেন কলেজ?”
–“না।”
–“ঠিক আছে। তবে এই ঠান্ডায় বাইরে থাকবেন না, সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। জ্বর-টরের কবলে পড়তে পারেন, ভেতরে চলে যান।”

নির্মল চলে যেতেই প্রণয়ার অধর জুড়ে থাকা হাসি আরও প্রসারিত হলো। সে আকাশের পানে চেয়ে আপনমনে গুনগুনিয়ে গান গাইল। নির্মলের ছোটো ছোটো যত্ন কিংবা প্রশংসা, প্রণয়াকে দিনকে দিন আরও দুর্বল করে দিচ্ছে তার প্রতি। কেমন সুখ সুখ অনুভূতিতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলছে সে। নির্মলের কথামতোন প্রণয়া বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। বাধ্য মেয়ের মতো ভেতরে চলে গেল।

চলবে—

আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০৬

0

#আকাশ_তীরে_আপন_সুর
|পর্ব ০৬|
লাবিবা ওয়াহিদ

দাওয়াতের দিনটা বেশ ভালো কাটছে নুহাশ সাহেবের। নীলুফার হাতের রান্নার পুরানো স্বাদ বহুদিন পর পেল। পোলাও, ঝাল ঝাল মুরগি ভুনা, সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস, এক পদের মাছ, চা, শুঁটকি, শিদল ভর্তা.. সব মিলিয়ে দুর্দান্ত আয়োজন। নুহাশ সাহেব বেশ ভোজন রসিক মানুষ৷ তিনি আঙুল চেটে খেলেন। খাওয়ার সময় রসিক স্বরে স্ত্রীকে বলছেন নীলুফার থেকে এটা ওটা শিখে নিতে৷ ফাহিমাও তাতে অভিমানী স্বরে উত্তর দিচ্ছে। ফাহিমার অভিমানী গলা শুনলে সবাই হেসে উঠছে।

এই হাসি-মজার মধ্যে শুধু দম আটকে যাওয়া পরিস্থিতি প্রণয়ার। নির্মলকে কোণা চোখে, আড়চোখে প্রায়ই লক্ষ করেছে। নির্মল যখনই প্রণয়ার কাছেপিঠে থাকছে, প্রণয়ার চেপে রাখা ভালো লাগার অনুভূতি সর্বাঙ্গ জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই অনুভূতি নিয়ন্ত্রণহীন হলো নির্মল যখন নিজ উদ্যোগে তার পাতে পোলাও দিতে চেয়ে বলল,
–“পোলাও আরও দিব? ঝোল লাগবে?”

প্রণয়া তখন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, নিব না কিছু।”

নির্মল তাও এক চামচ পোলাও দিল, সঙ্গে ঝোল মাংস। প্রণয়ার মনে হলো নির্মল যেন ভালোবেসেই প্রণয়াকে এগুলো দিল। তার নিজ থেকে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি প্রণয়ার নেই। বরং নির্মল সেই যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে প্রণয়াকে নির্মল ঋনি করে দিলো নিজের অজান্তেই।

সেদিন দাওয়াতের পর্ব শেষ হলো আছরের আযানের সময়। নুহাশ সাহেব নির্মলের কাঁধ চাপড়ে ওদের বিদায় জানিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসেন। প্রণয়া তো বাড়ি ফিরেই নিজের রুমে চলে যায়। তার আগে হাত-মুখ ধুয়ে সোজা ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে তার খসখসে শব্দ শুনে। ভ্রু কুচকে পিটপিট করে চোখ মেলতেই দেখল প্লাবন চেয়ারে বসে আপেল কামড়ে খাচ্ছে। ঘরের লাইট জ্বালানো, আর নজর প্রণয়ার পানেই। প্রণয়া শোয়া ছেড়ে উঠে বসল। চোখ কচলাতে কচলাতে নিচু গলায় বলল,
–“লাইট জ্বালিয়ে কী করছিস এখানে?”

প্লাবন আপেল চিবুতে চিবুতে বলল,
–“মা বলল তোমাকে ডেকে তুলতে। কিন্তু তোমাকে দেখে ডাকতে ইচ্ছা হলো না, তাই বসে আছি।”

প্রণয়া আড়মোড়া ভেঙে প্লাবনের দিকে তাকাল। আগের মতোই গলা নামিয়ে বলল, “উদ্ধার করে দিছেন।”
প্লাবন দাঁত কেলালো।

কেটে যায় বেশ কিছুদিন। এর মাঝে প্রণয়ার সাথে অকল্পনীয় এক ব্যাপার ঘটে। সেদিন কলেজের জন্য প্রণয়া তৈরি হয়ে নাস্তা করতে বসেছিল। নুহাশ সাহেব খেতে খেতে হঠাৎ নীরবতা ভাঙলেন। বললেন,
–“আজ প্রণয়া নির্মলের সাথে কলেজ যাবে। আমার কিছু কাজ থাকায় তোমাকে এগিয়ে দিতে পারব না।”

এরকম একটা কথা শুনে প্রণয়ার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না যেন। বহু কষ্টে খাবারটা গিলে বলল,
–“আমি তো প্রতিবারই একা যাই বাবা। তুমি যেতে না পারলে তো সমস্যা নেই। আর..”

প্রণয়ার কথার মাঝে ফোড়ন কাটলেন নুহাশ সাহেব। ভারী গলায় বললেন,
–“আমার কথাই শেষ। আগেরটা আগের হিসেব। এখন আমি না গেলেও তুমি নির্মলের সঙ্গেই যাওয়া আসা করবে। আজ কলেজ ছুটি হবে কখন, আমাকে জানিয়ে দিয়ো। আমি নির্মলকে পাঠিয়ে দিব।”

প্রণয়া বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। তটস্থ হয়ে ভাবতে লাগল সমস্ত ব্যাপারটা। এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করল আজ কলেজ যাবে না। কিন্তু তৈরি হওয়ার পর কলেজ না গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না? উলটো নির্মলকেই উলোট পালোট সন্দেহ করতে পারে। মনের দোটানায় ফেঁসে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হলো প্রণয়া।

নাস্তা সেরে বেরিয়ে আসতেই দেখল উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে নির্মল। এক হাতে কাঠের বেড়ার একাংশ চেপে সে চেয়ে আছে চায়ের সাম্রাজ্যে। পিঠমুখী নির্মলকে দেখে প্রণয়া নিজের ভেতরে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাচ্ছে যেন। সিঁড়ির দুই ধাপ পার করে কিছুটা এগিয়ে প্রণয়া হালকা গলা খাঁকারি দিল, নিজের উপস্থিতি জানান দিতে। নির্মল পিছ ফিরে তাকাল। নেভি ব্লু শার্টে নির্মলকে দেখে প্রণয়া নজর সরিয়ে ফেলল। প্রণয়া মিনমিন করে বলল,
–“বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে গিয়ে বসতে পারতেন। শুধু শুধু অপেক্ষা করালাম।”

নির্মল আলতো হেসে বলল,
–“তেমন কিছু না, আমি এখানেই ঠিক ছিলাম।”

নির্মল থামল। প্রণয়া কোণা চোখে আরেকবার দেখল নির্মলকে। নির্মল প্রণয়ার দিকে তাকাতেই প্রণয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। নির্মল বুঝতেই পারল না প্রণয়া চেয়েছিল তার পানে। নির্মল বলল,
–“চলুন যাওয়া যাক।”

চা বাগানের আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে অবশেষে দুজন সরু, ইটের রাস্তায় এসে পৌঁছালো। ক্ষণিক সময় পরপর শা শা শব্দে কিংবা হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে কিছু অটো রিকশা বা অন্যান্য গাড়ি। প্রণয়া মেইন রাস্তায় আসতেই দেখল তাদের জন্য একটি অটো দাঁড়িয়ে আছে। তবে এটা দুই সিটের অটো রিকশা। নিশ্চয়ই নুহাশ সাহেব ঠিক করেছেন। প্রণয়া ত্রস্ত পায়ে অটোতে উঠে বসতেই দেখল নির্মল চালকের পাশে বসতে চাচ্ছে। তা দেখে প্রণয়া থামালো। মৃদু গলায় বলল,
–“পিছে সিট আছে। আমার পাশে বসতে পারেন।”

নিজের কথায় নিজেই চমকালো প্রণয়া। সে কী বলে ফেলল নির্মলকে? মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে এলো তার। নির্মল হাসল। বলল,
–“আপনি-ই বসুন পিছে। আমি ঠিক আছি, প্রণয়া।”

নির্মলের গলায় নিজের নাম শুনে প্রণয়া মোমের মতো গলতে শুরু করল। তবুও নির্মলকে যেহেতু একবার বলেই ফেলেছে, জোর করা প্রয়োজন। প্রণয়া আবারও বলল,
–“প্লিজ। সামনে ভাঙা রাস্তা আছে, আপনার সমস্যা হবে। আসুন।”

নির্মল স্থির নজর রাখল প্রণয়ার পানে। যদিও প্রণয়া অন্যদিকে ফিরে বলেছে, তবুও ঢের অনুভব করতে পারল সেই দৃষ্টি। নির্মল মিনিট এক সময় নিয়ে প্রণয়ার পাশে গিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে দম যেন গলায় আটকে গেল৷ বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। নির্মল উঠে বসতেই অটো চলতে লাগল আর প্রণয়া শক্তি হয়ে বসে রইলো। ফিরেও তাকাল না নির্মলের দিকে। নির্মলও চুপ। বেশ কিছুটা পথ পেরোতেই নির্মল জিজ্ঞেস করল,
–“আমি বসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো প্রণয়া?”

একরাশ ভালো লাগা, অস্বস্তিতে মোহিত হয়ে প্রণয়া বলল,
–“আমি ঠিক আছি, আপনি ব্যস্ত হবেন না।”

প্রণয়ার কথা ফলে যায়। বেশ অনেকটা পথ এগিয়ে পেরোতেই ভাঙা রাস্তার সম্মুখীন হলো। সে কী ভয়াবহ ঝাকুনি। এই পর্যায়ে দুজনই বেশ সতর্ক থেকেছে। তবে সবসময় সতর্কতা বজায় থাকলেও কিছু অসতর্কতার কাণ্ড ঘটে যায় অচিরেই। এই যেমন নির্মলের বাহুর সঙ্গে প্রণয়ার বাহু স্পর্শ করেছে কয়েকবার। এই অসহ্য অনুভূতি প্রণয়া কাকে বোঝাবে? সে নিজেকে বোঝাতেই যে অক্ষম।

স্বপ্নের মতো কেটে যায় পুরো দিন। ফেরার সময় প্রণয়া একজন রাখাইন মেয়ের সাথে আসছিল। মেয়েটার সাথে তার গাঢ় বন্ধুত্ব নেই, তবে ক্লাসমেট। তবে প্রণয়া জানে, এই মেয়েটা প্রেম করে। প্রায়ই একটি ছেলের সাথে ভার্সিটির আশেপাশে দেখা যায় তাকে। যেহেতু সে প্রেম করে, সেহেতু ইনিয়ে বিনিয়েও প্রণয়া নিজের কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে পারবে চিন্তা করল। এজন্য প্রণয়া সেই মেয়েটা অর্থাৎ পিয়াসাকে জিজ্ঞেস করল,
–“আচ্ছা, যদি কোনো ছেলেকে দেখলে নিজের মধ্যে অস্বাভাবিক অনুভূতি নাড়া দেয় তাকে কী ধরা হয়?”

পিয়াসা হাসল। প্রণয়ার দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
–“শুধু একজনের জন্য এরকম অনুভূতি আসলে তাকে ভালোবাসা বলে। কেন, কাউকে মনে ধরেছে নাকি?”

প্রণয়া থমকায়, চোখ কপালে তুলে ঘনঘন মাথা নেড়ে তুখোড় অস্বীকার করে বলল,
–“একদম না। কীসব যে বলছ না তুমি!”

পিয়াসা তবুও হাসতে লাগল। প্রণয়া এতে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। শেষমেষ কি না সে প্রেমে পড়ল, ভালোবেসে ফেলল নির্মলকে? কিন্তু কয়েকদিনের দেখা-সাক্ষাৎ এ এটা কী করে সম্ভব? পিয়াসা শুধু শুধুই ভয় দেখাচ্ছে তাকে।

নির্মল বলেছিল ছুটি হয়ে গেলে একা একা না ফিরতে। নির্মলই এসে তাকে নিয়ে যাবে। যদি সময়মতো পৌঁছাতে নাও পারে তবে অপেক্ষা করতে বলেছে। প্রণয়া নির্মলের কথার নড়চড় হয়নি। সে বাধ্য মেয়ের মতো ভার্সিটির গেটের বাইরে একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নির্মলের। আশেপাশে পথে নজর বুলিয়ে নির্মলকে খুঁজছে। প্রেমে পড়লে নাকি অপেক্ষাও মধুর হয়। সেই মধুর অপেক্ষা যেন প্রণয়া উপলব্ধি করলেও সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে যায়। পিয়াসাও না, প্রণয়ার কানে একদম বিষপোকা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। এই বিষপোকার আরেক নাম প্রেম পোকা৷ এই মুহূর্তে বিষকেই তার মধুর লাগতে শুরু করেছে, কী বাজে অবস্থা!

ভার্সিটির সামনের রাস্তা অনেকটা বাজারের মতো। এখানে মুদি দোকান, পোশাকের, বিভিন্ন অলংকারের, খাবারের এবং খাতা-পত্রের দোকানে ঠাসা। মূলত ভার্সিটি বলেই এখানটা বেশ জাকজমক। অবশ্য দুই একটা টঙের দোকানও আছে। সেখানে প্রায় সব বয়সী পুরুষদের দেখা যায়। কেউ চায়ের কাপে আড্ডার আসর বসায় আবার পাহাড়ি বখাটে ছেলেরা মেয়ে দেখতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়।

প্রণয়ার সামনে হঠাৎ এক ত্রিশের উর্ধ্বে বয়সী লোক এসে দাঁড়ায়। পানের প্রভাবে দাঁত লাল করে ফেলেছে একদম। সেই দাঁত বের করে হেসে বলল,

–“প্রথম দেখাতেই মনটা কাইড়া নিছিলা, এহন সামনা-সামনি দেইখা মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে। আছ কিমুন ময়না?”

প্রণয়ার গা ঘিনঘিন করে উঠল এই লোকের অসৎ চাহনি দেখে। অসৎ চিন্তা-ভাবনার সাথে বাজে মন্তব্যও। প্রণয়ার ভয়ে মুখ ছোটো হয়ে গেল। কোনোরকমে পা চালিয়ে লোকটার দৃষ্টি সীমানার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল। লোকটা প্রণয়ার পিছু নেয়নি, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁত কপাট বের করে প্রণয়ার যাওয়ার পানেই চেয়ে আছে সেই লোক।

প্রণয়া কিছুটা পথ এগিয়ে গেল। আশেপাশে নির্মলকে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে লাগল। এই পথ ধরেই নির্মল আসবে। তাই নির্মল আসলে তাকে অবশ্যই সে দেখতে পাবে। হলোও তাই। মিনিট দুয়েকের মাঝে নির্মল অটো নিয়েই আসছিল। পথে প্রণয়াকে দেখে সে অটো নিয়েই থামল। অটো থেকে নেমে প্রণয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল,
–“এ কী প্রণয়া? আপনাকে না বললাম কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে? হেঁটে আসলেন কেন এই অবধি?”

প্রণয়া শুকনো হাসি দিল। নির্মলের চোখ জোড়া প্রণয়ার সুরক্ষা জানান দিচ্ছে। পুরুষে, পুরুষে কতটা ভিন্নতা। কেউ নারীকে দেখে কামনার চোখে আর কেউ নারীকে দেখে সম্মানের চোখে। নির্মলের চোখে উজাড় করা সুরক্ষা, ভরসা দেখে প্রণয়া কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভুলে গেল। সত্য চেপে মিনমিন করে বলল,
–“শরীর ভালো লাগছিল না। তাই কিছু পথ এগিয়ে এসেছি।”

নির্মল আর কথা বাড়ায় না। গলা খাদে নামিয়ে প্রণয়াকে রিকশায় উঠতে বলল। প্রণয়াও কথা না বড়িয়ে উঠে বসে। এবার নির্মল পাঁচ সিটের অটো এনেছে। তাই দুজনে প্রায় মুখোমুখি-ই বসে বাড়ির পথে রওনা হলো।

চলবে—

আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০৫

0

‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০৫|
লাবিবা ওয়াহিদ

সেদিনের পর থেকে ফাহিমা যেন অঘষিত এক দায়িত্ব দিয়ে দিল প্রণয়াকে। সেটা হচ্ছে, নির্মল আসলেই তাকে নাশতা দিয়ে আসবে প্রণয়া। হলোও তাই। প্রণয়া দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের আদেশ মেনে নিল, আর ফাহিমা তখন টিভির শব্দ কমিয়ে নিজের মতো করে সিরিয়াল দেখতে বসেন।

প্রণয়া অবশ্য একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। সে প্রায় যে-বারই নাস্তা নিয়ে গিয়েছে প্লাবন সেবারই মুখস্থ পড়া দিচ্ছে। যার ফলস্বরূপ প্রণয়া তার পড়ায় ব্যঘাত না ঘটিয়ে অপেক্ষা করত তার পড়া শেষ করার। অপেক্ষা করতে গিয়ে সে নির্মলের দিকে আনমনে চেয়ে থাকে৷ প্লাবনের পড়া শেষ হতে হতে চা ঠান্ডা হয়ে যায়, আর প্রণয়া প্রতিবারের মতো ছুটে গিয়ে ঠান্ডা চা গরম করে আনে। এতে প্রণয়া বিরক্ত হয়। এজন্য দুইদিন সে চায়ের বদলে ট্যাঙের সরবত দিয়েছে। আর চা নিয়ে গেছে নির্মল আসার পরপরই। তবে প্রণয়া একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে। তার চোখ জোড়া বারবার নির্মলের দিকে চলে যায়। চোখ জোড়াও বুঝি আজকাল কথা না শোনার পণ করেছে? প্রণয়া খিঁচে চোখ বুজে চোখ জোড়াকে শাসায়,
“এত অবাধ্য কেন তোরা?”

চোখ জোড়া তবুও অবাধ্যপণা ছাড়েনি। এজন্য নির্মল আসলেই প্রণয়া নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকত। তাতেও কাজ হত না। তখন বুকের ভেতরটা কেমন জৈষ্ঠ্যের তপ্ত দুপুরের ন্যায় খাঁ খাঁ করতে লাগে। বুকজুড়ে হাহাকার, ব্যাকুলতা আর চোখ জোড়ার অঢেল তৃষ্ণা। এই লক্ষণগুলো আজকাল ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলছে প্রণয়াকে। অনুভূতিগুলো প্রণয়ার জন্যে সম্পূর্ণ নতুন এবং অদ্ভুত। এজন্য সে অনুভূতিগুলোর ঘাড় ধরে তাদের নাম জানতে পারছে না।

আশেপাশে এমন কেউ-ও নেই যার সাথে ভেতরে চেপে রাখা কথাগুলো প্রকাশ করতে পারবে। কারো সাথে বললে হয়তো এর সমাধান হতো? অস্থিরচিত্তে ঘুরে বেড়ানো প্রণয়ার হঠাৎ শুক্রবারে দাওয়াত পড়ল নির্মলদের বাসায়। অবশ্য প্রণয়া একা নয়, তার পুরো পরিবারের। নুহাশ সাহেবও সেই দাওয়াত হাসিমুখে গ্রহণ করলেন।

আজ জুম্মার দিন, তাইতো নুহাশ সাহেব সকাল সকাল মজিবকে পাঠালেন তাদের স্থানীয় বাজারে, ভালো দেখে ফল-মূল এবং মিষ্টি দই আনার জন্য। নুহাশ সাহেব সবসময়ই দু’হাত উজাড় করে উপহার দিতে পছন্দ করেন। কারো বাসায় দাওয়াত পড়লে তো কোনো কথাই নেই। হাত ভরে উপহার নিয়ে তবেই দাওয়াতে যান। ব্যাপারটা অনেকের কাছে যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনই অবাকের।

অবশ্য একদিক দিয়ে চা বিলাসের সদস্যরা ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যবতী। আশেপাশে পিঠ-পিছে সমালোচনা করার মতো কোনো প্রতিবেশি নেই। দূর দূরান্ত অবধি বাড়ি-ঘরও দেখা যায় না। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে রাঙানো চা বাগান। আবার অন্য দিক দিয়ে নুহাশ সাহেবের একটাই আফসোস, প্রতিবেশি কিংবা সেরকম আত্নীয় আশেপাশে না থাকায় তিনি দু’হাত ভরে বাজার করতে পারেন না। এবার অবশ্য ভাগ্য সহায় হলো তাঁর। নিজের মতো আপ্যায়ন করার মতো নীলুফাকে এবং নির্মলকে পেয়েছেন।

দুপুরের দিকে গোসল সেরে ভেজা চুল পিঠময় ছড়িয়ে প্রণয়া বসে ছিল ঝুল বারান্দায়। মূলত রোদ পোহানোর উদ্দেশ্যেই সে বারান্দায় এসে বসেছে। একটু আগেই গামছা দিয়ে চুলের পানি ছাড়িয়েছে। এখন ভেজা চুল নরম বাতাসে মৃদু উড়ছে। কিন্তু এসবে প্রণয়ার ধ্যান নেই। সে এক নজরে চেয়ে আছে অদূরে। এক জোড়া পাখি অদূরে চায়ের পাতার মাঝে খুনশুঁটিতে মেতেছে। দৃশ্যটা চমৎকার লাগল তার চোখে। পরপরই মস্তিষ্কে হানা দিল নির্মলের চশমা পরা কিংবা চশমা ছাড়া স্নিগ্ধ মুখ। যার ফলস্বরূপ প্রণয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। সেই ভাঁজে বিচরণ করছে বিরক্তি।

এখন জুম্মার সময়। বাড়িতে মা, মেয়ে ব্যতীত আর কেউ নেই। বাকিরা সবাই নামাজের জন্য মসজিদে গিয়েছে। নিচ থেকে ভেসে আসছে ফাহিমার ডাক। ফাহিমা উঁচু গলায় প্রণয়াকে বারবার তৈরি হতে বলছেন। প্রণয়া তৈরি না হলেও মায়ের ডাকে নিচে গিয়ে সোফায় বসে থাকল। তা দেখে ফাহিমা বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। সময় কেটে যেতে লাগল। এর মাঝে হাজির হলো নুহাশ সাহেব এবং প্লাবন। তাদের পেছন পেছন এসেছে মজিব। নুহাশ সাহেব এসেই তাড়া দিয়ে বললেন,
–“দ্রুত চলো। আপা হয়তো অপেক্ষা করছেন।”

ফাহিমা মেয়ের নামে নালিশ করতে চেয়েও করলেন না। প্রণয়াও সেই সুযোগ না দিয়ে বলল,
–“তোমরা আগে আগে যাও। আমি পিছেই আছি।”

ফাহিমা প্রণয়ার হাতে তালা দিয়ে বললেন,
–“প্লাবন। বোনের সাথে আসবে।”

প্লাবনের কপাল কুচকে গেল মায়ের কথা শুনে। নুহাশ সাহেবও সম্মতি জানিয়ে বললেন,
–“হ্যাঁ, তাই ভালো। মেয়েকে তো একা রেখে যেতে পারি না। ফাহিমা, মজিব চলো। আমরা বরং আগেই যাই। পথে আবার নির্মলকেও দেখলাম না৷ আগে আগে চলে আসল নাকি?”

নুহাশ সাহেব প্লাবনকে প্রণয়ার কাছে রেখে বাকিদের সাথে নিয়ে চলে গেলেন। মজিবের মুখে আজ তৃপ্তির হাসি। ভালো-মন্দ খাবারের ডাক পড়লে কোন মানুষ অখুশি থাকবে?

প্লাবন প্রণয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজের পেটের দিকে তর্জনী দেখিয়ে বলল,
–“আমার পেটটা কতটা গুড়গুড় শব্দ করছে তা কী জানো আপু? ভেজা কাপড়ের মতো মুঁচড়াচ্ছে খুদায় আর তুমি এখানে এখনো বসে আছ? কেন? বসে থাকার ইচ্ছে হলে একাই বসে থাকতে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে কেন বসতে হবে? তোমার পেট না থাকলেও আমার আছে।”

প্লাবনের এলোমেলো কথায় চোখ রাঙায় প্রণয়া। কিন্তু প্লাবনের খুদার দম বেশি। প্রণয়ার চোখ রাঙানোতেও কাজ হলো না। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই প্রণয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“বাইরে যা। আমি আসছি!”

প্লাবন খুশিতে গদগদ হয়ে দ্রুত চলে গেল বাইরে। কিছু সময় পরপর আবার ডাকছে প্রণয়াকে।
–“ও আপু, হয়েছে তোমার? আর কতক্ষণ? যাবা নাকি আমি একা চলে যাব?”

প্রণয়া মূলত বসেছিল চুল শুকানোর জন্য কারণ ভেজা চুল বাঁধা সম্ভব না। আবার চুল না বাঁধলেও ওড়নার নিচে দিয়ে চুল বেরিয়ে থাকবে যা প্রণয়ার ভীষণ অপছন্দের। এখন প্লাবনের তাড়াতে প্রণয়ার এই অপছন্দের কাজটাই করতে হচ্ছে। যথাসম্ভব চেষ্টা করল ভেজা চুল ওড়নার আড়ালে রেখে বেরিয়ে গেল। প্রণয়ার সদর দরজায় তালা লাগানোর সময় প্লাবন নিজেই চলে গেল। এখান থেকে এখানে মাত্র এক মিনিটের পথ, এটুকু নিশ্চয়ই প্রণয়ার সঙ্গে আসতে হবে না। প্রণয়া তালার দিকে চেয়েই বলল,
–“প্লাবন, নড়বি না কিন্তু। একসাথে যাব।”

কিন্তু পেছন থেকে কোনো সাড়া এলো না। আসবে কী করে যদি না সাড়া দেওয়ার কেউ না থাকে? প্রণয়া তালা লাগিয়ে পিছে ফিরতেই দেখল প্লাবন নেই। প্রণয়ার কিছুটা রাগ হলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। সিঁড়ির এক ধাপ পার হতেই নির্মলকে দেখল সবে সে চা বিলাসে প্রবেশ করছে। হাতে তার কিছু ফলের প্যাকেট।

প্রণয়াকে দেখামাত্রই নির্মল স্মিত হাসল। নির্মল সাদা পাঞ্জাবি এবং কালো এক টুপি পড়েছে। কেন জানি না নির্মলকে চোখের সামনে দেখেই প্রণয়ার বুকের বা পাশটা অস্বাভাবিক ঢিপঢিপ শব্দ তুলছে। এতে সে অপ্রস্তুতবোধ করল। নির্মল এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
–“এখন যাচ্ছেন নাকি? তবে একা কেন?”

প্রণয়া এবার নড়াচড়ার শক্তি পেল। সে নির্মলদের বাসার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
–“আমি একটু পরেই বের হলাম।”

প্রণয়া জানত নির্মল ফিরেনি। কিন্তু নির্মলের ফেরাটা যে প্রণয়ার বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হবে কে জানত? নির্মল বলল,
–“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমার সঙ্গে আসুন।”

দুজন পাশাপাশি, পায়ে পায়ে ধাপ মিলিয়ে হাঁটছে। প্রণয়া এতে কেন যেন স্বস্তি, অস্বস্তির মিশ্র অনুভূতিতে জড়িয়ে গেল। নির্মলকে নিয়ে এক নিষিদ্ধ অনুভূতিও অনুভব করল সে।

প্রণয়া হঠাৎ প্রশ্ন করতে চাইল, “আপনি কেন আমায় ‘আপনি’ সম্বোধন করেন? প্রথমদিন ছোটো নই বলায়?”

কিন্তু আফসোস প্রণয়া উচ্চারণ অবধিও করতে পারল না সেসব। তবুও অন্যকিছু জিজ্ঞেস করল,
–“ফিরতে দেরী হলো যে?”

–“মসজিদ থেকে বেরিয়ে একটু বাজারে গিয়েছিলাম। এজন্যই ফিরতে একটু দেরী হলো। তবে আপনাকে দরজার মুখে দেখে মনে হলো না আহামরি দেরী করেছি।”

শেষ কথাটা বলে নির্মল শব্দহীন হাসল। আর প্রণয়ার কান তখন অকারণে গরম হয়ে রয়। অথচ প্রণয়ার কান জোড়া ভেজা চুলে লেপ্টে ছিল। যার ফলস্বরূপ সে চুপসে গেল। নির্মল একপলক তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়ার ভেজা চুল মুখের দু’ধারে অল্প বিস্তর বেরিয়ে আছে। মুখ জুড়েও তার স্নিগ্ধতার রেশ। নির্মল চোখ ফিরিয়ে নিল। চলে এসেছে তারা।

~ চলবে