Thursday, June 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 262



অপ্রিয় জনাব পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১৪ (অস্তিম পর্ব)

গ্রামের জমিদার হার্টঅ্যাটাক করে মারা গিয়েছে শুনে সকলে জমিদার গৃহে এসে উপস্থিত হয়। আশেপাশের গ্রামের লোকরাও আসে। সকলেই আপসোস করলো। কেউ কেউ দুঃখিত হলো। শুধু গৃহের মানুষদেরই কোনো দুঃখ কষ্ট নেই। তুলসী অসুস্থ মানুষ। এটা শোনার পর আগের ভঙ্গিতেই বিছানায় পরে রইলো। সাইয়েরার নিলিপ্ত ভঙ্গি। অনেক চেয়েও এক ফোঁটা অশ্রুও তার চক্ষু থেকে বের হলো না। ইয়াশার এসেছে। ছায়াও মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহেরার কাছে। তাহেরা, তুলিকা, তারনা কান্না করছে। তাহেরা আব্বাজান বলে চিৎকার করছে। সোহরাব অনুভূতিহীন।

ভোরে গৃহে আসে সে। ছায়া জেগেছিলো তখন। সোহরাব পিতার কক্ষে যেতেই জমিনে পরা পিতার বীভৎস মরাদেহ দেখতে পায়। চিত্ত কেঁপে উঠে তার। আর্তনাদ করে উঠে। ছায়াও দৌড়ে আসে। আলাউদ্দিনকে দেখে বমি করে দেয় সে। সোহরাব সবটা লক্ষ্য করে বুঝতে পারে তার পিতাকে বিষ দেওয়া হয়েছে। আর এটা কে করেছে সেটাও বুঝতে পারে সোহরাব। সেই মুহূর্তে জ্বলে উঠা ক্রোধ দমিয়ে রাখে। গ্রামের সবাই যদি জানতে পারে আলাউদ্দিনকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে তাহলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যাবে। পুলিশও আসতে পারে তদন্ত করতে। তাই সোহরাব হার্টঅ্যাটাক বলে বিষক্রিয়ার কথাটা লুকিয়ে ফেলে।

ছায়া সোহরাবের মৌনের পরিনাম বুঝতে পেরে দৌড়ে উপমার কক্ষের দ্বারে তালা লাগিয়ে চাবি নিজের বিছানার নিচে রেখে দেয়। যাই হয়ে যাক আজ সে উপমার কক্ষের চাবি দেবে না। সোহরাবকে উপমার কোনো ক্ষতি করতে দিবে না।
আলাউদ্দিনকে গোসল দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কবরস্থানে। উপমা আর নিজের কক্ষ থেকে বের হতে পারলো না। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আলাউদ্দিনের মৃত দেহ সকলের সামনে দেখার।
দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো। কবর দিয়ে সকলে ফিরে আসলেও সোহরাব মাত্রই গৃহে এসেছে। এলোমেলো পায়ে সদর দ্বার পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সকলে যার যার কক্ষে। হটাৎ সোহরাবের মনে পরে উপমার কথা। মস্তিস্ককে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে। সকাল থেকে উপমাকে সে বাহিরে দেখেনি। উপমার ভয়ংকর অবস্থা করবে ভেবে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের কক্ষে না যেয়ে সোজা উপমার কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। তার পিতাকে যেভাবে কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছে তার থেকেও দ্বিগুন কষ্ট দেবে উপমা কে। মনে মনে শপথ করলো উপমাকে মারবে না। জিন্দা রেখেই জাহান্নামের অনুভূতি অনুভব করাবে।
ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরলো সোহরাব। ভয়ংকর হয়ে উঠলো তার কৃষ্ণবর্ণ চেহারা। উপমার কক্ষের স্মুখীন ঝুলন্ত তালা দেখে তার রাগ আরো বেড়ে গেলো। ফোঁস ফোঁস নিঃশাস ছেড়ে মনে মনে ভাবলো তালা কে দিতে পারে। অতঃপর পা বাড়ালো ছায়ার কক্ষের দিকে।

আজও বাহিরে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আকাশ মাটি কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে। বিছানার মধ্যখানে বসেছিলো ছায়া। সোহরাব শব্দ করে তার কক্ষে প্রবেশ করে। ছায়া মাথা তুলে তাকায়। সে যেনো সোহরাবের আশায়ই ছিল। মুখে অমায়িক হাসি দিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ায় ছায়া। আজ আর মাথায় ঘোমটা দিয়ে নেই। বড় বড় চুলগুলো অগোছালো হয়ে পরে আছে পিঠে, কোমরে। সোহরাব এগিয়ে এসে ক্রোধে রণরণে কণ্ঠে বলল,
-চাবি দেও।
ছায়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল সোহরাব একদিন তাকে তুমি বলে সম্বন্ধ করবে। আজ সেই ইচ্ছে তো পূরণ হলো তবে অসময়ে! মুচকি হাসলো ছায়া। সোহরাবের ছায়াকে পাগল মনে হলো। অকারণেই হাসছে ছায়া। সোহরাব পুনরায় বলল, -চাবি দেও।
-ছেড়ে দিন না এইসব। উনি উনার শাস্তি পেয়ে গিয়েছে আপনিও ভালো হয়ে যান না। আমাদের অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই নাহয় সব ভুলে যান।
অনেকটা ব্যথার্ত কণ্ঠে বলল ছায়া। সোহরাবের বিরক্ত লাগছে ছায়ার এহেন কথা। তাকে শান্ত স্বরে আবারও বলল,
-আমাকে চুপচাপ চাবি দেও।
-আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি সোহরাব। আমার আপনাকে নিয়ে যে অনেক স্বপ্ন!এভাবে আমার স্বপ্ন ধ্বংস করে দিবেন না।

সোহরাব এবার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ছায়ার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দেয়। তাল সামলাতে না পেরে জমিনে বসে পরে যায় ছায়া। গালে হাত দিয়ে করুণ নজরে তাকিয়ে থাকে সোহরাবের পানে। কী ভয়ংকর লাগছে লোকটাকে!কোনো জংলী জা’নো’য়ার! সোহরাব কক্ষের আনাচে কানাচে চাবি খুঁজতে থাকে। কোথাও না পেয়ে চিৎকার করে উঠে। চোখ বদ্ধ করে ফেলে ছায়া। কোনোরকম শরীরে শক্তি জোগাড় করে উঠে দাঁড়ায় সে। সোহরাব হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করছে। তার কাছে আসে। হাতের দু বাহু চেপে ধরে চিবিয়ে বলল,
-জলদি বল চাবি কোথায় রেখেছিস তুই?
শুকনো ঢোক গিললো ছায়া। শেষে সোহরাবের এইরকম রুপও তার নসিবে ছিল ভাবতেই কান্নারা গলায় এসে ঠেকলো। ছায়া শান্ত স্বরে বলল,
-ওকে মারবেন না দোয়েয়া করে।
ছায়া বিছানার নিচ থেকে চাবি নেয়। ধীর পায়ে হেঁটে সোহরাবের স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। ছলছল নয়নে মন ভরে একবার সোহরাবকে দেখে নেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে চাবি এগিয়ে দেয়।
সোহরাব ছোঁ মেরে চাবি নিয়ে নেয়। ছায়াকে কিছু বলতে উদ্যত হবে তার পূর্বেই ছায়া সোহরাবের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। সোহরাব ছায়াকে ছাড়ানোর প্রয়াস করে আকস্মিক এক সময় সোহরাবের মুখ থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
সোহরাবের বুক থেকে লাল রঙের তরল পদার্থ গড়িয়ে পরে তলিয়ে গেলো জমিন মুহূর্তেই। চোখ বড় বড় হয়ে আছে। শব্দ করে সোহরাবের বুক থেকে রক্তাক্ত ছু’রি বের করে ছায়া দূরে সরে যায়। ধপাস করে জমিনে পরে গেলো সোহরাব। ছু’রি নিচে ফেলে ছিটকে আরেকটু দূরে সরে গেলো ছায়া। হটাৎই তার কী হলো দৌড়ে এসে সোহরাবের পাশে বসে পরলো। সোহরাব বড় বড় শ্বাস ত্যাগ করছে ছায়ার দিকে তাকিয়ে। ছায়া আজ একটুও কাঁদলো না। সযত্নে সোহরাবের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে। করুণ কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-আপনাকে আমি মারতে চাইনি আমার অপ্রিয় জনাব। একসময় যে আপনি আমার খুব প্রিয় ছিলেন!আমি ভাবতেও পারিনি কোনো একদিন আপনি আমার এতো অপ্রিয় হয়ে উঠবেন! আপনার ভয়ংকর রুপ আমার সহ্য হয় না জানেন? আমি জানতাম না ভালো সোহরাবের পিছনে একটা নিকৃষ্ট সোহরাবও রয়েছে। আমি আপনাকে অনেক ঘৃণা করি। অনেক। চিন্তা করবেন না আমাদের সন্তানকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। তাকে একজন ভালো মানুষ বানাবো।
যন্ত্রনায় তড়পাতে থাকলো সোহরাব। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলো জমিন সহ ছায়ার শাড়ী। কাঁপা কাঁপা হাতে ছায়া সোহরাবের পুরো মুখে হাত বুলালো। সত্যি আজ তার একটুও কান্না আসছে না। কষ্টে চিত্ত ফেঁটে যাচ্ছে তবুও তার কাঁদতে মন চাইছে না। ছায়া শেষ বারের মতো সোহরাবের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-আমার স্বপ্নে আমাদের এইরকম পরিণতি ছিল না! খোদা আপনার ওপর দোয়েয়া করুক। প্রিয় না হলেও শ্রেষ্ঠ অপ্রিয় মানুষ হিসেবে আপনি আজীবন আমার মনে গেঁথে থাকবেন।

উঠে দাঁড়ায় ছায়া। হাতে চাবি নিয়ে উপমার কক্ষে যায়। দরজা খোলার সাথে সাথেই উপমা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ছায়াকে দেখে ধক করে উঠলো তার বক্ষস্থল। বিচলিত হয়ে ছুটে যায় ছায়ার কাছে। শাড়ীতে রক্ত দেখে আত্মা কেঁপে উঠে তার। ছায়ার গালে হাত দিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-তোর শাড়ীতে রক্ত কিসের? তুই ঠিক আছিস তো ছায়া?
ছায়া বড়ই ক্লান্ত স্বরে বলল,
-আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল উপমা। আমি বাঁচতে চাই, আমার সন্তানকে একজন ভালো মানুষ বানাতে চাই। আমাকে অনেক দূরে নিয়ে চল।
-সোহরাব,,,,
উপমাকে সম্পূর্ণ কথা বলতে দিলো না ছায়া। তার পূর্বেই বলল,
-মেরে ফেলেছি তাকে। কোনো কীটপটঙ্গের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ভবিষ্যতে আরেক আলাউদ্দিন মির্জাকে দেখতে চাই না আমি।
উপমা থমকে গেলো। কণ্ঠণালী দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না তার। ছায়া অসহায় ভঙ্গিতে উপমার দুইহাত চেপে ধরে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-খোদার দোহাই আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল উপমা।
-তুই তোর বাবার বাসায় চলে যা ছায়া এদিকটা আমি দেখি।
উপমার শান্ত কণ্ঠস্বর। ছায়া ত্বরিত গতিতে বলল,
-না। আমি অনেক দূরে চলে যেতে চাই কারো সাথে যোগাযোগ রাখবো না। তুইও আমার সাথে যাবি। আমাকে একা ছাড়িস না উপমা।
উপমা খানিকটা সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলো। বড় বড় পা ফেলে আলমিরা খুলে ছায়াকে একটা শাড়ী ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-শাড়ী পরিবর্তন কর। সেখানে আমাদের জন্য কেউ সংসার সাজিয়ে বসে নেই!আমাদের কিন্তু কষ্ট করতে হবে তুই রাজি?
-আমার সন্তানের জন্য আমি সব করতে রাজি। তুই শুধু আমার পাশে থাকিস।
_________________________

“দশ বছর পর,,,,,,,,,,,,,

-সোহাইব মির্জা স্ট্যান্ডআপ
পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস চলছিল। হটাৎ ম্যামের কথায় সবাই চুপ হয়ে যায়। এই ম্যামকে সবাই ভীষণ ভয় পায়। কেমন রাগচন্ডা! সবসময়েই এই ম্যামের মুখে রাগ লেগেই থাকে। শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত কয়েকজন বালক বালিকা আস্তে আস্তে বলল,
-সোহাইব আজ গিয়েছে! আজ না ম্যাম ওকে ওর আম্মুকে নিয়ে আসতে বলেছিলো!
কথার পাল্টায় আরেকজন বলল,
-আমি ওকে গতকাল বলেছিলাম বেশি দুষ্টামি করিস না ম্যাম শুনলে বকবে। কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না।
-আমার তো ভীষণ খারাপ লাগছে ওর জন্য। বেচারা এখন অনেক বকা শুনবে।
দুঃখী দুঃখী মুখ করে কথাটা বলল একজন বাচ্চা মেয়ে। সকলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
ম্যাম শ্রেণীকক্ষে কোথায়ও সোহাইবকে না দেখে পুনরায় উঁচু স্বরে বলল,
-সোহাইব কী আজ আসেনি ক্লাসে?
সোহাইবের বন্ধু মুখ ফুটে বলতে যাবে সোহাইব আজ স্কুলে আসেনি তার আগেই দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছোট একটি ফুটফুটে বালক বলল,
-ম্যাম আসতে পারি?
ম্যাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বালকটিকে পরোক্ষ করলো। দেখতে কত শান্ত ভদ্র মনে হয়! কী মায়া মুখটিতে! অথচ আচরণ আস্ত একটা বাঁদরের মতো! ম্যামের নজর পরলো সোহাইবের পাশে দাঁড়ানো একটি রমণীর ওপর। সেলোয়ার কামিজ, মাথায় হিজাব পরনে তার। শ্রী মুখশ্রীতে মোটা কালো ফ্রেমের একটি চশমা। ম্যাম তাকে দেখে এগিয়ে গেলো। হালকা হাসি দিয়ে বলল,
-আসসালামু ওলাইকুম হুমাশা ম্যাম।
-ওলাইকুম আসসালাম। আপনি সোহাইবকে তার পেরেন্ট’স নিয়ে আসতে বলেছিলেন ম্যাম?
নম্র স্বরে বলল হুমাশা মির্জা। সোহাইব তার হাত ধরে আছে। ভীত চাহনি তার। শ্রেণীকক্ষে তার বন্ধুরা চোখের ইশারায় দুষ্টামি করছে। সোহাইব তাঁদের ভেংচি কাটে।
ম্যাম কক্ষ থেকে বের হয়ে হুমাশাকে নিয়ে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়ায়। বিরক্ত কণ্ঠস্বরে বলল,
-সোহবাইব কাল আবার একটা ছেলেকে মেরেছে হুমাশা ম্যাম।
হুমাশা রাগী চোখে সোহাইবের দিকে তাকায়। সোহাইব মাথা নাড়িয়ে অকপটে বলে,
-আমি তাকে মারতে চাইনি খালামুনি। ঐ সিয়াইম্মা মিয়াইম্মা আমাকে কুকু’রের বা’চ্চা বলে বকা দিয়েছিলো তাই তো আমি তাকে মেরেছি। এভাবে ডিসুম ডিসুম দিয়েছি।
শেষের কথাটা অনেকটা অভিনয় করে বলল সোহাইব। হুমাশা তার দিকে একটু ঝুঁকে গালে হাত দিয়ে বলল,
-বাবা এভাবে কাউকে মারতে নেই। সে তোমাকে বকা দিয়েছিলো তুমি ম্যামকে বলতে পারতে। এভাবে তাকে মেরে তুমি কিন্তু খালামুনিকে অপমানিত করছো!
দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেলে সোহাইব। মাথা নত করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে,
-সরি খালামুনি আর করবো না এমন।
-আমার সোনা বাচ্চা। তোমার সাথে কেউ বাজে ব্যবহার করলে তুমি ম্যামকে বলবা নাহয় আমাকে বলবা। ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
সোহাইব কানে হাত দিয়ে ম্যামের দিকে তাকায়। অনুতপ্ত স্বরে বলল,
-ম্যাম আপনাকেও সরি।
ম্যাম মৃদু হেসে সোহাইবের মাথা হাতিয়ে দেয়। তারপর হুমাশাকে বলে,
-আপনার ভাগ্নে টা এমন তার সাথে আমি রাগ করে বা উঁচু স্বরে কথাই বলতে পারি না!দেখলেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চায়।
হুমাশা স্বচ্ছ হাসলো। আগলে ধরলো সোহাইবকে। ম্যাম পুনরায় বলল,
-আপনি কলেজে আসছেন না কেনো ম্যাম? আপনার ছাত্রছাত্রীরা আমাকে আপনার কথা জিগ্যেস করে।
-একটু অসুস্থ কিছুদিন ধরে সুস্থ হলেই আসবো।
আরো কিছুক্ষন কথা বলল দুইজন অতঃপর হুমাশা সোহাইবকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আজ তাঁদের অনেক স্পেশাল একটি দিন। চলন্ত রিকশায় বসে সোহাইব বলল,
-খালামুনি দেখো কী সুন্দর ফুল! আম্মু অনেক পছন্দ করবে।
হুমাশা মুচকি হাসলো। রিকশা থেকে নেমে পরলো দুইজন। ফুল বিক্রেতাকে বলল ফুল দিতে। সোহাইব আশেপাশে তাকিয়ে মানুষজন দেখছিলো। সহসা তার নজর পরে সামনে তাঁদের দিকেই অগ্রসর হওয়া কয়েকজন ছেলে আর মেয়ের দিকে। কপাল কুঁচকে ফেলে ছোট বালক। বিড়বিড় করে বলল,
-উড়ি মা! আমার না হওয়া বাবা তো তার হাতির মতো বন্ধুদের নিয়ে এদিকেই আসছে!
সোহাইব জলদি লুকিয়ে পরলো হুমাশার পিছনে। হুমাশা সামনে তাকাতেই ফিক করে হেসে উঠলো। তার বন্ধুদের দল এদিকেই আসছে। আসতে আসতে একজন যুবক বলে উঠলো,
-প্রফেসর হুমাশাকে তো এখন দেখাই যায় না! তা আমাদের ভয়ে আবার ঘরের ভিতর লুকিয়ে থাকে নাকি!
হুমাশা গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। নিদ্রান আর সহিফা নামক দুইজন হাসতে হাসতে এগিয়ে হাসলো হুমাশার কাছে। সহিফা জড়িয়ে ধরলো হুমাশাকে। উৎকণ্ঠে বলল,
-কেমন আছিস জান? কতদিন পর দেখা হলো।
-ভালো ছিলাম না বাঁদরদের সাথে দেখা হয়ে ভালো হয়ে গেলাম।
নিদ্রান হুমাশার মাথায় চাপর মারলো। এই দুইজন হুমাশা ওরফে উপমার কলেজের জীবনের বন্ধু। এখনও তারাই তার বেস্টফ্রেন্ড। আরো কয়েকজন ছিল সবার সাথে কথা বলল। নিদ্রানের এক পর্যায় নজর পরলো ছোট সোহাইবের দিকে। তাকে টেনে নিয়ে আসে হুমাশার কাছ থেকে। দুইগাল চেপে দিয়ে বলল,
-মাই চ্যাম্প, মায়ের মতো গোলুমলু হয়ে যাচ্ছ দেখি!
সোহাইব বিরক্ত হলো। মুখ ফুটে কিছু বলল না। নিদ্রান হুমাশার হাতে ফুলের তোড়া দেখে জিগ্যেস করে,
-ফুল কার জন্যে?
-কেমন প্রেমিক পুরুষ তুই বেটা! প্রিয়তমার জন্মদিন মনে রাখিস না!
-আসলে ভুলে গিয়েছিলাম।
অপরাধী স্বরে বলল নিদ্রান। সোহাইব তখন ফট করে বলে ফেললো,
-যাও যাও আঙ্কেল, তোমার মতো মনভুলা লোকের সাথে আম্মুর বিয়ে দেবো না।
সকলে একসাথে হেসে উঠলো সোহাইবের কথা শুনে। হুমাশা সবাইকে বলল সন্ধ্যার পর তাঁদের বাসায় আসতে। ছোটোখাটো আয়োজন করেছে। তারপর তারা তাঁদের বাসায় চলে গেলো।

কয়েকবার কলিংবেল বাজাতেই এক নারীমূর্তি দরজা খুলে দেয়। সোহাইব ছুটে তাকে জড়িয়ে ধরলো। রমণী গিলগিল করে হেসে ফেললো। হুমাশা তাকিয়ে দেখতে থাকলো মা ছেলেকে। এই নারীর এখন ত্রিশের ওপরে বয়স অথচ সেই দশ বছর আগের মতোই শ্রী মুখশ্রী! হুমাশা মনে মনে হাসলো আর বলল, “এনার সৌন্দর্য আর কমবে না। ওহে সোহরাব মির্জা তুমি বড়ই দুর্ভাগা! এতো সুদর্শন নারী তোমাকে জান প্রাণ দিয়ে চাইলো অথচ তুমি সর্বদা তাকে উপেক্ষা করেই গেলে!”
হুমাশা হালকা কাশির নাটক করতেই সোহাইব মাকে ছেড়ে দেয়। ছায়া উঠে দাঁড়ায়। সোহাইব আর হুমাশা মিলে ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয় ছায়ার নিকট। বড় একটি হাসি উপহার দিয়ে দুইজন একসাথে বলল,
-শুভজন্মদিন সোহাইবের আম্মু।
ছায়া গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। অতঃপর হাসি মুখে ফুলের তোড়া নিয়ে বলল,
-ধন্যবাদ আমার প্রিয় মানুষ।

ক্লান্ত হয়ে নিজের কক্ষে আসে হুমাশা। মাথার হিজাব খুলে শান্ত হয়ে বসে বিছানায়। ঠান্ডা মস্তিকে ভাবতে থাকে সেইদিন রাতের কথা।
সেইদিন রাতে আর কোনোদিক ভাবে না হুমাশা। দরকারি কিছু জিনিস সাথে নিয়ে ছায়াকে নিয়ে বেরিয়ে পরে জমিদার গৃহ থেকে। ছায়ার কাছে মোটামোটি ভালো অংকের টাকাই ছিলো। সেগুলো নিয়ে তারা ঢাকায় চলে আসে। হুমাশা তার ফ্লাটে আসে। বিয়ের পূর্বে সে যেখানে থাকতো সেখানে এসে তার জমানো কিছু টাকা পয়সা ছিল। তার পালিত বাবার কিছু জমিজমা ছিল। তার পড়াশোনার জন্য সেগুলো বিক্রি করে টাকা এনে দিয়েছিলো তাকে। সেই টাকা নিয়ে তারা অন্য জায়গায় চলে যায়।
হুমাশার বন্ধু বান্ধব তাঁদের অনেক সাহায্য করে। নিদ্রান বড়োলোক বাপের একমাত্র ছেলে। ছায়াকে প্রথমদিন দেখেই মন দিয়ে ফেলে তাকে। পাগল প্রেমিক হয়ে উঠে চোখের পলকে। সে-ই তাঁদের থাকার ফ্লাট খুঁজে দেয়। হুমাশা টিউশন করতে থাকে কোনোরকম নিজের পড়াশোনা স্টার্ট করে। নিদ্রান, সহিফা টাকা দিয়েও তাঁদের অনেকভাবে সাহায্য করে। ছায়াও বাচ্চা হওয়ার পর টুকটাক ছাত্রছাত্রী পড়াতো। বেচারা নিদ্রান ছায়ার সবটা জেনেও তাকে অনেক ভালোবাসে। কয়েকবার প্রপোসও করেছিলো। শেষে একবার ক্রোধে ছায়া তাকে চড় মারে। অনেক কান্নাকাটি করে বলে তারা যাতে শুধু বন্ধু হয়েই থাকে এর বেশি কিছু না। সে আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না নিজের ছেলেকে নিয়েই থাকতে চায়।

এভাবেই দিন চলে যায়। পড়াশোনার শেষ পর্যায় নিদ্রানের সাহায্যে হুমাশা কলেজে প্রফেসরের জব পেয়ে যায়। তারপর আর সে ছায়াকে কিছু করতে দেয়নি। ছায়ার কাজ শুধু সোহাইবকে দেখাশোনা করা আর তাঁদের জন্য রান্না করা। কয়েকটা বছর দুর্দিনের পর এখন তাঁদের জীবনে সুখের শেষ নেই। জমিদার গৃহের আর কারো সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ রাখেনি। ইয়াশার, তাহসিয়ার সাথেও না। ছায়াও তার পরিবার স্বজনের সাথে যোগাযোগ করেনি।
নিদ্রান এখনও একতরফা ভালোবাসে ছায়াকে। ছায়ার সমবয়সী হওয়ার সত্ত্বে এখনও বিয়ে করেনি। ছায়া তাকে রিজেক্ট করেছে এতে তার একটুও আপসোস বা ক্ষোপ নেই। ভালোবাসলে পেতেই হবে এটা ভুল! দূরের থেকেও ভালোবাসা যায়।
________________________
সন্ধ্যার পর হুমাশা আর সোহাইব মিলে তাঁদের ঘরের ড্রইংরুম সুন্দর করে সাজায়। ছায়াকে ঘরবন্দি করে রাখে তখন। হুমাশা নিজ হাতে বাহারি রকমের খাবার রান্না করে। যেটার ঘ্রাণে তাঁদের পুরো ফ্লাট মৌ মৌ করছে। সোহাইব তাকে টুকটাক সাহায্য করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই উপস্থিত হয় হুমাশার বন্ধুগণ। নিদ্রান চোরা চোখে প্রেয়সীকে খুঁজতে থাকে। সহিফা হুমাশাকে পরিবেশন করতে সাহায্য করে। সাত আটজন মিলে হুমাশাদের ফ্লাট মাতিয়ে নিয়েছে একদম! সোহাইব দরজা খুলে মাকে নিয়ে আসে।
লাল রঙের শাড়ী পরিহিত ছায়াকে দেখে চিত্ত ধক ধক করতে থাকে নিদ্রানের। ছায়া খুশিতে পুলকিত হয়ে উঠলো। ছেলের গালে চুমু খেলো। কেক কাট করলো। সোহাইব হুমাশা একসাথে নাচলো। হুমাশার সকল বন্ধুরা একে একে ছায়াকে গিফট দিলো। সবকিছু দেখে ছায়া হাসতে হাসতে শেষ। সবার গিফট দেওয়া হলে নিদ্রান আসে। ছায়ার হাতে গিফট ধরিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলে,
-অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে।
-ধন্যবাদ নিদ্রান।
নিদ্রান মাথার পিছনে হাত দিয়ে মুচকি হাসলো। এতো খুশির মধ্যে ছায়ার মনে পরলো তার অপ্রিয় পুরুষটির কথা। তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ তিনটে পুরুষ। তার বাবা যে সারাজীবন একটা পুত্রের আশার তাকে অবহেলা করে চলেছে। তার স্বামী ছিল এক পুরুষ। যে তাকে সারাজীবন দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে রাখতো। আর এখন তার পুত্র তার জানের টুকরা, যে তার হাসিখুশি থাকার কারণ। তাকে কিভাবে খুশি করবে, কিভাবে হাসাবে সেই মনস্থিরেই থাকে!
সব কিছুর উর্ধে ছায়ার শ্রেষ্ট পাওয়া হুমাশার মতো একজন বেস্টফ্রেন্ড অথবা বোন। এই মানুষটার জন্যেই সে এখন এখানে আছে। তার এই সুখনীরের মূলই হুমাশা মির্জা। যদি আজ হুমাশা না থাকতো তাহলে হয়তো সে কখনই সুখী হতে পারতো না! হুমাশাকে সে বলেছিলো আরেকটা বিয়ে করে নিতে। কিন্তু হুমাশা তাকে বলেছিলো আমি আমার পরিবার পেয়ে গিয়েছি আর বিবাহ করবো না। প্রতিউত্তরে ছায়া আর কিছুই বলতে পারে নাই।
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ছায়া। হুমাশা, সোহাইব উঁচু স্বরে ডাকছে তাকে। কী সুন্দর সবাই মিলে নাচছে। কত হাসিখুশি সকলের মধ্যে! হুমাশার জন্যে ছায়াও কতগুলো ভাইবোনের মতো বন্ধুবান্ধব পেয়েছে।
সোহাইব দৌড়ে এসে মাকে টেনে নিয়ে যায় সকলের মধ্যে। হুমাশা, সহিফা, নিদ্রান, সোহাইব বাকি সকলে ছায়ার চারোপাশে গোলগোল ঘুরে গানের সাথে নাচতে থাকে।
ছায়ার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। সকলের আড়ালে চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে তার। এটা যে সুখের অশ্রু! বিড়বিড় করে বলল,
-মাশাআল্লাহ! আমার স্বপ্নের সংসার! কারো নজর লাগুক। খোদা আমার মানুষ দুইজনকে এভাবেই সবসময় হাসিখুশি রেখো। আমার সকল সুখও তুমি তাঁদের দিয়ে দিও।

____সমাপ্ত____

অপ্রিয় জনাব পর্ব-১৩

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১৩

রাতে দ্বার লাগিয়ে কক্ষে মোমবাতি জ্বালিয়ে একটা কাগজ নিয়ে বিছানায় বসে উপমা। যেদিন তুলি মারা গেলো সেদিন রাতে কী মনে করে যেনো উপমা তুলির কক্ষে গিয়েছিলো। সহসা তার নজর যায় চকির পাশের কপাটে। প্রথম কপাট খুলে তেমন কিছুই পায় না। দ্বিতীয় কপাট খুলতেই কয়েকটা বইয়ের নিচে একটা কাগজ লুকানো পায়। সম্ভবত চিঠিটা তার জন্যেই লিখেছিলো! তুলি মোটামোটি পড়ালেখা পারতো। ছায়া তাকে অবসর সময়ে অনেক কিছুই শিখিয়েছিলো। উপমা সেইসময় আর কাগজটা খুলে না। চুপচাপ সেটা নিয়ে নিজ কক্ষে এসে পরে।

কয়েকবার সে চিঠিটা পড়েছে। হাতের লেখা বুঝতে অনেক কষ্ট হয়েছিলো তার। প্রথম যেদিন চিঠিটা পরলো সেদিন স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষন বসেছিলো উপমা। অবিশ্বাস ভঙ্গিতে বার বার চোখ বুলিয়েছিল। আজ আবারও সেই চিঠিটা নিয়ে বসেছে। কম্পিত হাতে চিঠিটা খুলে সামনে ধরে। সেটায় আধো আধো হাতে লেখা ছিলো,

“আমি জানি না আমার এই পত্র কার হাতে পরবো যদি আপনের হাতে পরে তাইলে ছোডু ভাবিজান মন দিয়া পইড়েন। আমারে মন্দ ভাইববেন না। আমি আত্মহত্যা করতাম না। কোনো মানুষেরই মরতে মন চায় না। আমরাও মন চায় নাই ভাবিজান। আমার মরার পিছনে হুদা সোহরাব মির্জা দায়ী। তারে আপনেরা ভালা ভাইববেন না। আলাউদ্দিন মির্জা হইলো ফুটাইন্না শয়”তান আর হেয় হইলো ভিতর ভিতর শয়”তান। হের বাপের কুকর্ম ঢাকতে সন্ধ্যার পর হেয় আমার কাসে আইছিলো। আমারে কইসে আমি আমার সন্তানরে মাইরা ফালাই নাইলে হেরা আমারে মাইরা ফালাইবো। আমি ভাইজানরে অনেক ভালা জানতাম। হেই আমারে এইডা কইবো আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমি যহন কইলাম আমার সন্তানরে আমি মারুম না। আমি আমার সন্তান রে নিয়ে মেল্লা দূরে চইলা যামু তহন হেয় রাইগ্গা উঠে। অহনই আমার কক্ষ থেকা বাইর হইসে আমারে ধমকাইয়া। আমি আমার সন্তানরে মারতে চাই না ভাবিজান। আমি যদি পারতাম আমি নিজেই আলাউদ্দিন মির্জার খাওনের বিষ মিলাইয়া দিতাম। আমি বাইচ্চা থাকনের কোনো আশাই খুইজ্জা পাইতাসি না। আমি আত্মহত্যা করলেও খোদা আমারে মাফ করবো না আবার সন্তান রে মারলেও মাফ করবো না। আমার লেগা মইরা যাওনই ভালা। আলাউদ্দিন মির্জা আর সোহরাব মির্জা রে আপনেরা চাইরেন না ভাবিজান। হেগো উচিত শাস্তি দিয়েন। আমার মন কয় আপনে পারবেন ভাবিজান।
আমার হাতে আর বেশিসময় নাই। একটু পরই আমি গলায় ফাঁসি দিমু। নিজের খেয়াল রাইখেন আপনেরা। ”

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো উপমা। চিঠিটা নিজের আলমিরায় লুকিয়ে রাখলো। বুক ভার ভার লাগছে তার। মস্তিক জ্বল জ্বল করছে প্রতিশোধের নেশায়। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
-জুলুমকারীকে আল্লাহও মাফ করবেন না তাঁদের কী একটুও মৃত্যু ভয় নেই! কী ভয়ংকর শাস্তি হবে তাঁদের!

প্রথমদিন সোহরাবকে দেখে তার মনে হয়েছিলো পিতা খারাপ হলেও পুত্র ভালো হয়েছে। কী সুন্দর তার ব্যবহার। ধীরে ধীরে সময় গেলো উপমার চিন্তাও পরিবর্তন হয়ে গেলো। বর্তমান সোহরাবের একের পর এক নতুন রুপ দেখে হতবাক হয়ে পরছে উপমা। সে কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে ছায়াও সোহরাবকে এড়িয়ে চলছে। সোহরাবের কোনো কাজই সে করে না। নিজের মতো খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরে। উপমার সাথেও দরকার ছাড়া বেশি কথা বলে না। সোহরাব কেমন যেনো চোখে চোখে রাখে তাকে। অনেকদিন ধরে শহরে যায় না।
উপমা ধীর পায়ে আলমিরা খুলে একটি কাগজের পুটলি বের করে। ভিতরে কালো রঙের কিছু জিনিস। সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে। বাঁকা হাসে উপমা।

নিত্যদিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে রসইকক্ষে আসে উপমা। সাইয়েরা আগের থেকেই কাজ করছিলো। ফাতুকে একা দেখে বুকে পীড়া অনুভব করলো উপমা। কেমন একটা হাঁসফাঁস করে উঠলো তার মনে। কোনোরকম নিজেকে শক্ত করে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
-ছোট আম্মা আব্বাজানের পছন্দের খাবার কী? তার সাথে মন্দ ব্যবহার করে আমার মনটা কেমন যেনো উস্কখুস্ক করছে তাই ভেবেছি তার প্রিয় কিছু রান্না করে মনকে শান্ত করবো।
উপমার কথা শেষ হতেই রসইকক্ষে পা রাখে ছায়া। উপমার কথা শুনে কপাল কুঁচকে যায় কিছুটা। সাইয়েরার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়? অনেকটা বিরক্ত নিয়েই বলল,
-মাংসের কোরমা আর রুটি তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার।
-ওহ!তাহলে আজ আমি এটাই রান্না করবো আব্বাজানের জন্য।

ছায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ফাতুকে জিগ্যেস করলো,
-তোর ভাইজান এখনও ঘুম থেকে উঠলো না ফাতু?
-ভাইজান তো ভোরবেলাই শহুরে চইল্লা গেছে বড় ভাবিজান। হের বলে গুরুত্বপূর্ণ কাম আছে আবার আইয়া পরবো।
ফাতুর কথায় উপমার মুখের হাসি আরো বড় হলো। ছায়া ভিতর ভিতর আঁতকে উঠলো উপমার হাসি দেখে। তার মনের ভয় সোহরাবের জন্য নয় বরং উপমার জন্য। সোহরাবের প্রতি সেইদিন রাত থেকে কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না ছায়ার। সোহরাবের ওপর থেকে মন বিষিয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু উপমার যদি কিছু হয়ে যায়! ক্রোধে সোহরাব যদি উপমাকে কিছু করে ফেলে!
না আর ভাবতে পারলো না সে। মস্তিকে বেশি চাপ দিলেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে তার। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। একবার অসহায় দৃষ্টিতে উপমাকে দেখে রসইকক্ষ থেকে প্রস্থান করে।

উপমা ইয়ামিনকে ডাকতে উঠানে এসেছিলো দুপুরে। ইয়ামিন দুষ্টামি করতে করতে ছুটে যায় সদর দ্বারে। উপমাও তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে। কোথায় থেকে তাহসিয়া এসে উপমার হাত ধরে পুকুরপাড়ে নিয়ে যায়। আকস্মিক তাহসিয়ার এহেন আচরণের মানে বুঝলো না উপমা। চমকিত হয়ে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই তাহসিয়া চাপা কণ্ঠে বলল,
-আমি মাত্রই শুনলাম আলাউদ্দিন মির্জা তোকে মারার পরিকল্পনা করছে উপমা। তুই এখান থেকে চলে যা।
-আমি চলে যেতে আসিনি তাহসিয়া।
তাহসিয়ার কণ্ঠে অস্থিরতা কাজ করছে। উপমার জন্য ভীত সে। করুণ কণ্ঠে বলল,
-তুই পারবি?
-আলবাদ পারবো।
অনেকটা আত্মনির্ভর হয়ে কথাটা বলল উপমা। তাহসিয়ার মাথা থেকে একটু দুশ্চিন্তা কমলো। শান্ত স্বরে বলল,
-তুই যা মন চায় কর। আলাউদ্দিন মির্জা মারা গেলে ভুলেও আমাকে জানাবি না। কাউকে বলবিও না আমাকে জানাতে। বুঝতে পারছিস?
তাহসিয়া শেষের কথাটা কম্পিত কণ্ঠে বলল। যতই ঘৃণা করুক রক্তের টান আছে না!একটু তো কষ্ট হবেই।
তাহসিয়া পুনরায় বলল,
-আমি দুপুরের পর চলে যাচ্ছি। আমাকে প্রয়োজন হলে টেলিফোন করবি।
-আচ্ছা।
_________________________

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো। মনের মধুর্য মিশিয়ে আলাউদ্দিনের সব প্রিয় প্রিয় খাবার রান্না করেছে উপমা। নিজ হস্তে আলাদা আলাদা করে খাবার বেড়ে তুলসী, সাইয়েরা আর ছায়ার কক্ষে পাঠিয়ে দেয়। যেহেতু পুরুষ শুধু আলাউদ্দিন একাই তাই খাবার সে একাই খাবে। ভোজনশালায় আজ ভৃত্যদের সাহায্যে নিলো না উপমা। নিজেই টেবিলে সুন্দর করে সকল খাবার পরিবেশ করে।
মুখ থেকে হাসি আজ যেনো সরছেই না তার। পরিবেশ করা শেষ হলে সযত্নে শাড়ীর আঁচল থেকে সেই কাগজের পুটলিটা বের করে। কাগজের সবটুকু পদার্থ মাংসের কোরমায় দিয়ে দিলো। তারপর ভালোভাবে মিশিয়ে সরে দাঁড়ালো।
একজন পুরুষ ভৃত্যের সাথে কথা বলতে বলতে ভোজনশালায় উপস্থিত হলো আলাউদ্দিন। উপমা ঘোমটা ধরে নত মাথায় দাঁড়িয়ে রইলো। উপমাকে দেখে আলাউদ্দিন বড় একটি হাসি দিলো। এতো এতো খাবারের পদ দেখে অবাক হয়ে বলো,
-এতো খাবার আজকে?
উপমা খানিকটা অপরাধী মুখ করে তাকালো আলাউদ্দিনের পানে। অনুতপ্ত স্বরে বলল,
-আমি সেইদিন আপনার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছিলাম আব্বাজান। তাই ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্যে আপনার জন্যে এইসব করেছি।
আলাউদ্দিন হাসলো। উপমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আলাউদ্দিনের ছোঁয়া অনেক কষ্টে সহ্য করলো উপমা। চেয়ারে বসে আলাউদ্দিন জিগ্যেস করলো,
-নিজ হাতে রান্না করেছিস আম্মা?
-জী আব্বাজান। এখন আপনার পছন্দ হলেই আমার স্বার্থক।

আলাউদ্দিন প্রসন্ন হলো। উপমা তার সত্যিটা জানেনা ভেবে খুশিতে পুলকিত হয়ে উঠলো তার মন। চাতক মন প্রহর গুনছে। কখন আলাউদ্দিন খাবার খাবে কখন তার শেষ চাওয়া পূরণ হবে! গরম গরম রুটির সাথে মাংসের কোরমা মুখে পুরে আলাউদ্দিন। প্রশংসনীয় স্বরে বলল,
-বাহ্! তুখোড় হয়েছে কোরমাটা।
পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো উপমার সুশ্রী মুখ।
একে একে সব খাবার শেষ করে আলাউদ্দিন। তৃপ্তির ঢেঁক তুলে। খাওয়া শেষ হতেই হাসিমুখে নিজ কক্ষে চলে যায়।
উপমা তার যাওযার পানে তাকিয়ে গুনগুন গান গাইতে শুরু করে। এখন অপেক্ষা করতে থাকলো আলাউদ্দিন মির্জার শেষ পরিণতি দেখার।

অশান্ত মন নিয়ে বিছানায় শুয়িত ছায়া। মন অস্থির হয়ে আছে তার। অকারণেই কেমন বিতৃষ্ণা লাগছে। ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। অস্থির মনকে বুঝ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকলো সে।

আজ অমবস্যার রজনী। পূর্ব আকাশে চাঁদটি মৃদু মৃদু করে নিজের উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। চন্দ্রের অস্পষ্ট আলোতে দেখা যাচ্ছে নারী কাঠামো ধপ ধপ পা ফেলে গৃহের পিছনের দিকে যাচ্ছে। কালো রঙের শাড়ীতে তিমিরের সাথে নিজেকে লুকানোর প্রয়াস মাত্র। গৃহের পিছনে নিদিষ্ট একটি খোলা জানালার স্মুখীন এসে পা’জোড়া থেমে যায় নারী মূর্তির। আলাউদ্দিন নিচ তলার একদম কিনারের কক্ষটিতে থাকে। পুকুরপাড়ে এই কক্ষের একটি জানালা আছে। শয়”তানের বিনাশ নিজ নয়নে দেখতে লুকিয়ে এখানে এসেছে উপমা। ভাগ্যক্রমে জানালা খোলাই ছিলো। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে জানালার ভিতরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

আয়েস করে বেতের চেয়ারে বসে বই পড়ছিলো আলাউদ্দিন। কক্ষের দ্বার খোল। সে সবসময় দ্বার খোলা রেখেই ঘুমায়। এখনও আলাউদ্দিনকে স্বাভাবিক দেখে পিলে চমকে যায় উপমা। কলিজা ধক ধক করছে তার। হটাৎই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় আলাউদ্দিন। শ্যামবর্ণ গায়ের রুপ হটাৎই পরিবর্তন হয়ে যায়। হাতের বই জমিনে পরে যায়। উপমার অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটলো তবে। মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো তার। আলাউদ্দিন সামনে পা বাড়াবে তার পূর্বেই ধপাস করে জমিনে পরে যায়। বিষক্রিয়ার প্রভাবে জমিনে পরে ছটফট করতে থাকে। গলা চেপে ধরে চিৎকার করতে চায় কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না।
উপমা এই সুন্দর মুহূর্ত স্মুখীন দাঁড়িয়ে দেখে উপভোগ করতে চাইছে। তাই সে সেখানে থেকে গৃহে ফিরে আসে। ধুরুম ধুরুম পা ফেলে আলাউদ্দিনের কক্ষে উপস্থিত হয়। উপমাকে দেখে একটু আশা পায় আলাউদ্দিন। গোঙাতে গোঙাতে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-আমা আমাকে বাঁচা মা। আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। আমার হৃদপিন্ড পুড়ে যাচ্ছে। বাঁচা আমারে।

উপমা দ্বার লাগিয়ে এগিয়ে গেলো আলাউদ্দিনের নিকট। শক্ত চোয়াল মুখশ্রী। আঁখিজোড়া বেয়ে এক ফোঁটা দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরছে তার। এই অশ্রুকণা আলাউদ্দিনের জন্য নয়। অভাবেই আগুনে পুড়ে তড়পাতে তড়পাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার বাবা, মা, বড় ভাই। কত কষ্ট হয়েছিলো তাঁদের! জেন্ত মানুষ একটু একটু করে আগুনে পুড়েছিল তাঁদের সম্পূর্ণ শরীর! কী যন্ত্রনাই না হয়েছিলো!
দুঃখে আর ক্রোধে আলাউদ্দিনের পাশেই বসে পরে উপমা। শান্ত স্বরে বিচলিত হয়ে বলল,
-অনেক কষ্ট লাগছে আব্বাজান?
আলাউদ্দিন কোনো উত্তর দিতে পারলো না। পেটে হাত দিয়ে গড়গড় করে বমি করে দিলো। উপমার দুঃখিত মুখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন হয়ে গেলো। ক্রোধে চিৎকার করে বলল,
-তুই মানুষ না অমানুষ। তোর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমি। তোর কোনো অধিকার নেই বেঁচে থাকার। আজ তোর জন্যে আমি পিতা মাতা হারা। তোর জন্যে আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি। আমাকে এতিম করে দিয়েছিস তুই জা’নো’য়ার।

ডুকরে উঠলো উপমা। আরেকটু ঝুঁকে বসলো স্মুখীন আলাউদ্দিনের শেষ পরিণতি ভালোভাবে দেখতে। বড় নিঃশাস নিয়ে বলল,
-আগুন লাগানোর পর সেইদিন তুইই এসেছিলি না আমার বাবার কাছে! কী বলেছিলি জানি? ওহ হ্যাঁ, এই জমিদার বাড়ি তোর!তুই ছাড়া অন্যকাউকে রাজ করতে দিবি না। হুমায়ুদ্দিন মির্জাকে সহ পরিবার ধ্বংস করে দিবি! তাঁদের নাম নিশাসও রাখবি না। এটাই তো বলেছিলি? আমার বাবা এতো করে বলল আমাদের বাঁচাও ভাইজান তুই তখন কী করলি! সদর দ্বার লাগিয়ে চলে গেলি। দেখ আজ তোর শেষ পরিণতি দেখ আলাউদ্দিন মির্জা। হুমায়ুদ্দিন মির্জার অংশই আজ তোকে শেষ করছে। জানিস তোর এইরকম করুণ অবস্থা দেখে আমার যে কী শান্তি লাগছে। আমার চিত্তে অনেক বছর পর বর্ষণ নেমেছে আজ!

বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আলাউদ্দিন। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই চিরকালের জন্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে।
উপমার আরো অনেক কিছু বলতে মন চাচ্ছিলো কিন্তু কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। কাঁপতে থাকলো তার পুরো শরীর। উপমা শেষ বিড়বিড় করে বলল,
-ওপারে ভালো থাকবেন আব্বাজান। আমার বাবার সাথে দেখা হলে বলবেন আমি তার প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছি। তার হুমাশা সফল হয়েছে।
পাগলের মতো বিলাপ পারলো কিছুক্ষন উপমা। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এলো আলাউদ্দিন মির্জার। সারাজীবনের জন্য নিঃশাস ত্যাগ করলো সে।
উপমা এলোমেলো অবস্থায় উঠে দাঁড়ালো। মুখে তার হাসি অথচ চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় কক্ষের বাহিরে আসে। কাঁপা কাঁপা পায়ে পুকুরপাড়ে যেয়ে রাতের আঁধারে কিছুক্ষন সাঁতার কেটে নিজের কক্ষে যেয়ে ঘুমিয়ে পরে।
_______________________

অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাতের পর এক উজ্জ্বল সকাল এলো উপমার জীবনে। বাহিরে মানুষের কান্না আর বিলাপের শব্দে সুন্দর ঘুমটা ভেঙে যায় তার। হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। মুখে তার সুন্দর একটি হাসি। সুন্দর একটি দিনকে সুন্দর একটি হাসি উপহার না দিলেই নয়!
অনেক আনন্দ অনুভব হচ্ছে তার বাহিরের মানুষের কান্না শুনে। শাড়ী ঠিক করে বড় একটি ঘোমটা দেয়। আয়নার স্মুখীন দাঁড়িয়ে মুখে একটু দুঃখী দুঃখী ভাব আনে। গ্লাস থেকে এক ফোঁটা পানি নিয়ে চোখে ছিটিয়ে নকলি অশ্রু বানিয়ে নেয়। কোমর দুলিয়ে হেঁটে দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা খোলার চেষ্টা করে বুঝতে পারে ঐপাশ থেকে কেউ তার কক্ষের দরজা লাগিয়ে রাখছে।
ভ্রু কুঁচকে যায় উপমার। তার কক্ষের দরজা কে লাগাতে যাবে! কেনোই বা লাগিয়েছে? এইরকম নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে উপমার মস্তিকে।

>>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-১২

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১২

সোহরাবের সহ্য হলো না উপমার ঘৃনীত ভরা চাহনি। তাই গটগট করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো রাতের অধারে। উপমা কাঁপা কাঁপা পায়ে দ্বার লাগিয়ে বিছানায় যেয়ে বসে। বক্ষস্থলে ভয়ংকর পীড়া অনুভব হচ্ছে তার। নিঃশাস আটকে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে তার। তার সকল কষ্টের কারণ ছায়া। পরিবার স্বজন থাকতেও উপমার কাছে ছায়া কে সবথেকে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। যার সব থাকতেও কিছুই নেই।
যে স্বামীর কথা ভেবে তার দিন শুরু হয় রাত শেষ হয় সেই স্বামীর বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই তার জন্য। স্ত্রী নাহয় পর মানুষ তবে সন্তান? সন্তান তো নিজের হয়। নিজের অংশের হয়!
আর কিছু ভাবতে পারলো না উপমা। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পরে। ছায়াকে কিভাবে সবটা বলবে মনে মনে সেটা ভাবতে থাকে।

ঘুম আসছিলো না তাই হাঁটতে হাঁটতে উপমার কক্ষে এসেছিলো ছায়া। দরজা খোলা দেখে ভিতরে পা রাখবে তখনই সে সোহরাবের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মনে মনে ভাবে হয়তো আজ উপমার সাথে রাত্রিযাপন করবে তাই চিত্তের পীড়া নিয়ে নিজ কক্ষে যেতে উদ্যত হয়। সামনে এক পা বাড়াবে তার পূর্বেই কঠিন চড়ের ধ্বনি তার কানে এসে ঠেকে। মন বিচলিত হয়ে পরে। তাই দ্বারের ওপরপাশে লুকিয়ে দাঁড়ায় সবটা শোনার জন্য। অবশ্য তাঁদের স্বামী স্ত্রীর কথা শোনা ছায়ার জন্য অনুচিত। তবুও একটু অনুচিত করতে ঝুঁকে পরলো সে।

একে একে উপমা আর সোহরাবের সব কথাই শুনতে পায় ছায়া। সোহরাবের শেষের কথা শুনে বুক ধক করে উঠে তার। কেউ ধারালো ছু’রি দিয়ে তার চিত্ত দুই খন্ড করে ফেলছে এমনই অনুভূতি হচ্ছে ছায়ার। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলো না সে। পেটে হাত দিয়ে জমিনে বসে পরলো এলোমেলো ভাবে। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
-ছি ছায়া!ছি! এইরকম নিকৃষ্ট, জঘন্য মস্তিকের মানুষকে তুই ভালোবাসিস! আমার তো তোর ওপরই ঘৃণা হচ্ছে! সে তোকে দিনের পর দিন অবহেলা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়নি তবুও তুই ভেবেছিলি সে এখন তোকে ভালোবাসে! সে ভালোবাসা চিনেই না।

নিজের সত্তাকে ইচ্ছে মতো বকে মনে রাগ মেটালো ছায়া। সোহরাবের বের হওয়ার আগেই স্থান ত্যাগ করলো। আজ ছায়া একটুও কাঁদলো না। মনকে অনেক বুঝ দিলো। নিজের অনাগত সন্তানের জন্য হলেও তাকে কঠোর হতে হবে। আর সোহরাব সোহরাব করে মর’বে না সে। দরকার পরলে সোহরাবকেই মা’রবে!

________________________

চারদিকের ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। ধরণী উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে দিলো সূর্য। বিভোর ঘুমে অবচেতন ছিল উপমা। বদ্ধ চোখে সূর্যের আলো পরতেই কিঞ্চিৎ বিরক্তে মুখ অন্যদিক করে ফেললো সে। সহসা চোখ খুলে ফেললো উপমা। কপাল কুঁচকে বিছানায় উঠে বসলো। শাড়ী ঠিক করে দরজা খুলে পুকুরপাড় চলে যায়। মুখ হাত ধুয়ে গৃহে ভিতরে প্রবেশ করে। রসইকক্ষে আসতেই দেখে ছায়া আর সাইয়েরা রান্না করছে। ফাতুকে একা সবজি কাটতে দেখে টনক নড়ে উঠে উপমার।
কিছুটা বিচলিত হয়ে ফাতুকে জিগ্যেস করে,
-তুলি কোথায় ফাতু?
-কক্ষের ভিতরেই। আমি কাইল রাইতে আম্মাজানের লগে ঘুমাইছি। সকালে তুলিরে ডাকতে গেছিলাম ঐ দরজা খুলে নাই।

ছায়া উপমা দুইজন ভীতগ্রস্থ হয়ে একে ওপরের দিকে তাকায়। উপমা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে তুলির কক্ষের দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। কয়েকবার ডাকে। ভিতর থেকে কোনো শব্দ আসে না। এতক্ষনে সকলে এসে জমা হয়েছে তুলির কক্ষের সামনে। উপমা কয়েকজন পুরুষ ভৃত্যদের নিয়ে এসে দরজা ভেঙে ফেলে। কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করতে আত্মা কেঁপে উঠলো তার। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পাখার সাথে গলায় ফাঁ’স দিয়ে ঝুলছে তুলি।
ছায়া ভিতরে এসে এইরকম দৃশ্য দেখে ঠিক থাকতে পারলো না। তখনই মাথা ঘুরিয়ে পরে গেলো জমিনে। উপমা জ্বলন্ত চোখে একবার তুলির মৃত দেহ দেখছে তো একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আলাউদ্দিন মির্জাকে দেখছে। সোহরাব লক্ষ্য করলো উপমার চাহনি। জেন্ত কবর দিয়ে ফেলবে এমনই তার ভাবভঙ্গি।

বাহিরের মানুষদের আর জানানো হলো না। তুলির তেমন কোনো আত্মীয় নেই আবার জমিদার গৃহের মানুষদের নামে দুর্নাম হবে তাই নিজেরা নিজেরাই কবর দিয়ে দেওয়া হলো। এতকিছুর পরও আলাউদ্দিন কিছুক্ষন চেঁচামেচি করলো গৃহের দরজা ভাঙার জন্য। একটা মানুষের প্রাণ যে চলে গেলো এতে তার কোনোরূপ মাথা ব্যাথা নেই। আজ সাইয়েরার রাগ হলো স্বামীর ওপর। এতটা নিচু মানসিকতার মানুষ কিভাবে হয়! তাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবসময় মৌন থাকা ব্যক্তিটি আজ বলে উঠে,
-এতটাও পাষান হইয়েন না। আপনারও মেয়ে আছে। যদি আজ তুলির জায়গায় তারা কেউ এমন করতো তাহলেও কী আপনি ঐ একটা দরজার জন্যেই চেঁচামেচি করতেন?

উপমার চাতক মন খুশিতে নেচে উঠে সাইয়েরার কথায়। তবে সেই খুশি বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। আলাউদ্দিন বৈঠমখানায় সকলের সামনেই সপাটে চড় বসিয়ে দেয় সাইয়েরার গালে। তাল সামলাতে না পেরে জমিনে পরে যায়। আলাউদ্দিন বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কিছু গালি দিয়ে পাশ থেকে মোটা একটি বাঁশের টুকরো নিয়ে সাইয়েরাকে মারতে উদ্যত হয়। মারবে তখনই বাঁশ ধরে ফেলে উপমা। ক্রোধে মাথা তুলে উপমার দিকে তাকায় আলাউদ্দিন। উপমা বাঁশ সহ তাকে ঢেলে দূরে সরিয়ে দেয়। আলাউদ্দিন বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে থেকে উপমাকে বলে,
-তোমার সাহস কত বড় বেয়াদপ মেয়ে। আমার কাজে বা হাত ঢুকাও!
-আপনার সাহস কত বড় সকলের সামনে ছোট আম্মাকে আপনি এভাবে মারছে!
আলাউদ্দিন চিৎকার করে উঠে। গর্জে সোহরাবকে বলে,
-তোমার বউকে এখান থেকে নিয়ে যাও সোহরাব। এই বেয়াদপ মেয়েকে আমি দেখতে চাই না।
সোহরাব একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। উপমা আলাউদ্দিন থেকেও শত গুনে চেঁচিয়ে বলল,
-বেয়াদপ ভালো আপনার মতো জঘন্য নিকৃষ্ট লোক ভালো নয়।
আলাউদ্দিন উপমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলতে যাবে তখনই হাত ধরে ফেলে উপমা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-ভুলেও আমার ওপর হাত তোলার সাহস করতে যাবেন না। আমি কিন্তু ভীষণ বেয়াদপ। বড় ছোট বিবেচনা করবো না একদম হাত ভেঙে দেবো।

আলাউদ্দিন ক্রোধে কাঁপছে। সোহরাবের উদ্দেশ্যে বলে,
তুমি কী এখনও তোমার বউকে কিছু বলবে না সোহরাব। যদি আমার পুত্র হয়ে থাকো তাহলে এই অসভ্য মেয়ে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে দেও।
সোহরাব তখনও বুকে হাত গুঁজে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। উপমা রাগে নিজের হাতের চুরি খুলে ফেলে। ধপ ধপ পা ফেলে সোহরাবের স্মুখীন যেয়ে দাঁড়ায়।
উপমা সোহরাবকে বলে,
-শুধু স্ত্রীকে মারতে পারলেই পুরুষ হওয়া যায় না।যে পুরুষ অন্যায় দেখেও মহিলাদের মতো মৌন থাকে তাকে কোনোভাবেই পুরুষের কাতারে ফেলতে পারি না আমি।

তারপর হাতের চুরি দুইটা সোহরাবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে বলল,
-একটা আপনি পরিয়েন আরেকটা আপনার আদরের শ্রদ্ধেয় পিতাকে পরিয়ে দিয়েন। তাহলে যদি আমার চাতক মন শান্ত হয়।
কথা শেষ করে উপমা সাইয়েরাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছায়ার কক্ষে চলে যায়।
উপমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তেঁতো হয়ে উঠলো আলাউদ্দিন। ফোঁস ফোঁস করে বলল,
-এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমি তোমাকে? এভাবে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কথা শোনা আর পিতার অপমান শোনা একজন আদর্শ পুত্রের কাজ নয়।
-আপনি আর একটি কথাও বলিয়েন না আব্বাজান।

আলাউদ্দিন হতবাক। পুত্র তাকেই ধমকাচ্ছে!হতভম্ব হয়ে বলল,
-তুমি আমার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলছো!ঐ দুইদিনের মেয়ের জন্য!
সোহরাব কিছু বলল না। হাতের চুরি গুলো ছিটকে দূরে ফেলে দিলো। তারও রাগ হচ্ছে। ক্রোধে মাথা কাজ করছে না তার। নিজের চুল দুইহাতে মুঠি করে ধরে বলল,
-উপমা কোনো সাধারণ মেয়ে না আব্বাজান। নিজের ভালো চান ওর সাথে লাগতে যেয়েন না।
-তুমি বলতে চাইছো এখন আমি একটা মেয়েকে ভয় পাই? মেয়ে কে?
সোহরাব নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সামনের কাঠের চেয়ার গুলো তুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দূরে ফেলে দেয়।
আলাউদ্দিনও একটু ভয় পেয়ে যায় ছেলেকে দেখে। ভীত হয়ে উঠে তার মন। কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-কে ঐ মেয়ে?
-হুমায়ুদ্দিন মির্জা আপনার ছোট ভাইয়ের মেয়ে ও।
না চাওয়ার সত্ত্বেও রাগের মাথায় সত্যিটা বলে ফেলে সোহরাব। আলাউদ্দিন শরীরের ভার হারিয়ে ধপ করে জমিনে বসে পরে। বিড়বিড় করে বলে,
-হুমাশা! কিন্তু ও জীবিত কিভাবে!

_________________________

ছায়ার জ্ঞান ফিরেছে মাত্রই। উপমা কোনোরকম খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়। ছায়া কিছু বলছে না উপমাও চুপ। নীরবতায় কেটে যায় অনেক সময়। বড় নিঃশাস নিয়ে উপমা বলল,
-আলাউদ্দিন মির্জার সাথে আমার ছোটোখাটো দ্বন্দ্ব হয়েছে।
-কিভাবে?
উপমা সবটা বলে। ছায়া পুনরায় চুপ হয়ে যায়। উপমা শুকনো ঢোক গিলে বলে,
-সোহরাব সব জেনে গিয়েছে। কাল রাতে আমার কক্ষে এসেছিলো।

উপমা সম্পূর্ণ কথা শেষ করবে তার পূর্বেই ছায়ার কক্ষের দরজায় ঠোকার শব্দ শুনে চুপ হয়ে যায়। কান্নারত্ব মুখে কক্ষে প্রবেশ করে আলাউদ্দিন মির্জা। উপমাকে এমন ভাবে দেখছে যেনো কত বছর পর নিজের অতি আপনজনকে দেখছে। উপমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ন্যাকা কান্না করে বলল,
-ওরে আমার আম্মা রে!তুই আমার আম্মা আমাকে আগে বলিসনি কেনো? আমার হুমায়ুদ্দিনের অংশ রে!তুই জানোস না সোহরাবের মুখে তোর আসল পরিচয় শুনে আমার মনে হলো আমার ছোট ভাই ফিরে এসেছে!

উপমা কিছুই বুঝলো না। তার মানে সোহরাব তার পরিচয় বলে দিয়েছে। মনে মনে ভয় পেলেও খুশিই হলো উপমা। আলাউদ্দিনের ভালো রুপটা বেশ উপভোগ করছে সে। আলাউদ্দিন উপমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
-তাইতো বলি আমার আম্মার মতো মুখশ্রী, আমাদের বংশেরই তেজ কেনো মেয়েটার মধ্যে!আল্লাহ তোরে বাঁচিয়ে রাখুক মা।
উপমা ততক্ষনে কিছুই বলতে পারলো না। আলাউদ্দিন আরো কিছু বলে চলে যায়। কী ভালো!কী অমায়িক রুপ তার!

আলাউদ্দিন যেতেই হেসে ফেললো উপমা। ছায়াও তার সঙ্গী হলো। উপমা ধীর কণ্ঠে বলল,
-কত ভালো চাচাজান আমার!
-যাক আর অভিনয় করতে হবে না।
-হ্যাঁ। বিরক্ত হয়ে গিয়েছি আমি।
-তুই না কী বলতি?
ছায়ার কথায় উপমা খানিকটা সময় নিলো। তার কী সব বলে দেওয়া উচিত নাকি উচিত না ভাবতে থাকে সে। উপমার মনোভাব বুঝতে পারে ছায়া। শান্ত স্বরে বলল,
-আমি তোর সাথেই আছি উপমা। যদি সোহরাবের প্রাণ নিতে হয় তাহলেও পিছু ফিরবো না আমি। সোহরাব ও তার পিতার মতো অমানুষের রুপ ধারণ করেছে। আমার সন্তানের যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে!আমি আমার সন্তানকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।

উপমা চুপচাপ শুনলো। বুঝার প্রয়াস করলো ছায়ার কষ্ট। যদি ছায়া জীবনে সুখী হতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম সোহরাবের সঙ্গ ত্যাগ করাই উচিত বলে মনে করলো উপমা। ছায়া বলল,
-তাহলে এখন পরবর্তী ধাপ কী?
উপমা স্মিত হাসলো। বলল,
-পরবর্তী ধাপই শেষ ধাপ।
-আমার আম্মাজানের জন্য একটু মায়া হয় আবার যখন ভাবি সে আমার সাথে কী করেছে তখন রাগও হয়।
উপমা ছায়ার কাঁধে হাত রাখলো। সান্ত্বনার স্বরে বলল,
-আমরা তো আছি চিন্তা নেই।

আরো কয়েকদিন কেটে যায়। সোহরাব আর শহরে যায়নি এই কয়দিনে। আলাউদ্দিনও অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। উপমার মুখোমুখি হলেই ভালোভাবে কথা বলে। যেটা দেখে একা একাই হাসে উপমা। বিকালে ছাদ থেকে জামাকাপড় নিয়ে পিছনে ফিরতেই সহসা কেউ একজন ছুটে এসে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো উপমাকে। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠে সে। সামনের জন আর কেউ নয় বরং তাহসিয়া।
সোহরাবের মুখে উপমার আসল পরিচয় শুনে শহর থেকে ছুটে আসে গ্রামে।
এক পর্যায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তাহসিয়া। মুখ দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারে না। উপমা তাকে আগলে ধরে শান্ত স্বরে বলল,
-আমি বুঝতে পারছি না তুই এভাবে কান্না করছিস কেনো তাহসিয়া!এতদিন পর আমাকে দেখলি কোথায় খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরবি কী!
-তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই উপমা। তুই ছায়াকে নিজের সত্যিটা বলেছিস কিন্তু আমাকে বলিসনি!
-আমি ছায়াকেও বলতে চাইনি। আমাকে খারাপ ভাবিস না।

দুইজন একসাথে ছায়ার কক্ষে এসে বসে। তাহসিয়া চোখ মুছে গম্ভীর স্বরে বলল,
-তুই জানিস না হুমাশা এতগুলো বছরে কতকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তোকে আমরা অনেক মনে করেছিলাম।
-আমিও তো করেছিলাম।
-কিভাবে বাঁচলি তুই ঐ রাতে? আর কেউ কী বেঁচে নেই?
তাহসিয়ার প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় উপমা। শান্ত স্বরে বলতে শুরু করে,
-সেদিন রাতে আগুন ভয়াবহ হতেই বাবা আমাকে অনেক কষ্টে গৃহের বাহিরে নিয়ে আসে।একজন ভৃত্যকে দিয়ে বলে যদি ফিরে আসতে না পারে তাহলে আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। অতঃপর বাবা আবার ভিতরে চলে যায়। ভাইজান আম্মা তখনও ভিতরে ছিল। বাবা আর তাঁদের বাঁচাতে পারে না নিজেও ফিরে আসে না। তাই ভৃত্য আমাকে তাঁদের বাসায় নিয়ে চলে যায়। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। আমাকেই নিজের মেয়ের মতো বড় করে।

-তুই আমাদের তোর আসল পরিচয় আগে বললেই পারতি। আমরা সবাই অনেক খুশি হতাম।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল তাহসিয়া। উপমা কিছু বলবে তার আগেই ছায়া বলল,
-ও বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি বারণ করেছিলাম। তাও তো আজ সবাই জেনেই গেলো ওর আসল পরিচয়!
তাহসিয়া সন্দেহ স্বরে বলল,
-কেনো বারণ করেছিলেন বড় ভাবিজান?
ছায়ার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যায়। মুখোভঙ্গি কঠিন করে বলল,
-সত্যিটা শুনতে পারবে তো?
-মানে?
ছায়ার উপমার পানে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
-সেইদিন রাতে আগুন লাগেনি লাগানো হয়েছিলো।
তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না তাহসিয়ার মুখশ্রীতে। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
-আমি জানি। ভাইজান আর আলাউদ্দিন মির্জার কথা শুনেছি আমি। কয়েকবার ভাইজানকে বলেছিলাম মেরে ফেলো এই জঘন্য লোককে। কিন্তু ভাইজান উল্টো আমাকেই বকেছিল। এমন কোনো মানুষ নেই যার সাথে সে অন্যায় করে নাই।
উপমা ছায়া দুইজনই উল্টো চমকে গেলো। তাহসিয়াও সব জানতো। উপমার মনে হয়েছিলো তাহসিয়াও সোহরাবের মতো পিতার হয়ে কথা বলবে। কিন্তু তাহসিয়ার কথা তাঁদের চিন্তা পরিবর্তন করে দেয়। ক্রোধে জর্জরিত কণ্ঠে তাহসিয়া পুনরায় বলল,
-শুধুমাত্র জন্মদাতা না হলে আজ তার প্রাণ আমার হাতেই যেত!

>>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-১১

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১১

শরীরের প্রতিটা লোমকূপ কেঁপে উঠলো ছায়ার। উপমার মাথায় রাখা হাতটাও তিরতির করে কাঁপছে। কিছু বলতে যেয়েও বার বার কথা গুলিয়ে ফেলছে সে। উপমা নীরবে ছায়ার উত্তর শোনার আশায় চোখ বন্ধ করে আছে। অনেক সময় অতিবাহি হয়ে যায় তবুও ছায়া কিছু বলতে পারে না মূর্তির মতো বসে থাকে। উপমা আগের ভনিতায় নিজেই বলতে শুরু করে,
-চুপ হয়ে গেলি কেনো? তোর কী এখন ভয় করছে ছায়া?
ছায়া আড়চোখে দরজার দিকে তাকায়। তারপর উপমার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
-কথাবার্তা বুঝে শুনে বল কেউ এসে শুনে ফেললে সর্বনাশ। এখনও তুই অন্তিম সময়ে আসিস নি উপমা।
উপমা উঠে বসে। তার ভিতরের সত্তা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। মন অস্থির হয়ে আছে। বড় বড় নিঃশাস নিয়ে খানিক সময় নীরব থাকলো। ছায়ার মুখটা বিষণ্ণ হয়ে আছে। তা দেখে অসহায় কণ্ঠে বলল,
-আমি যে পারছি না আর!আমি পারছি না আর মুখোশ পরে থাকতে। সবকিছু ভীষণ অসহ্য লাগছে আমার। এতো নিকৃষ্ট মানুষ কিভাবে হয়!মানুষ নয় অমানুষ সে।
শেষের কথাটা ক্রোধে বলল উপমা। ছায়াও ভীত হয়ে পরলো উপমার মুখশ্রী দেখে। ঠান্ডা মানুষ রাগলে আসলেই ভয়ংকর হয়ে উঠে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছায়া উপমাকে বলল,
-এখন যদি তুই হার মেনে পিছনে সরে যাস তাহলে এইরকম আরো অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে রে উপমা। নিজেকে শক্ত রাখ। ভুলে যাস না নিজের অস্তিত্ব।
-আমার তোর জন্য মায়া হয়। ভীষণ মায়া হয়!
ছায়া শুকনো ঢোক গিললো। উপমার শান্ত স্বরে বলা কথায় মস্তিক চুর্ণবিচুর্ণ করে দিলো ছায়ার। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো।নিমিষেই চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
-একজন স্ত্রী, পুত্রবধূ হওয়ার পূর্বে আমি একজন নারী আর একজন মানুষ। তুই জানিস না উপমা আমার জীবনের কত বড় একটা অধ্যায় তুই। উনাকে আমি ভলোবাসি কিন্তু আমি কিভাবে ভুলে যাই তুই যে আমার উনার পূর্বের প্রিয় মানুষ। আমার আপন মানুষ।
বলে ছায়া উদ্বিগ্ন হয়ে উপমাকে জড়িয়ে ধরলো। ভীষণ শক্ত করে যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। দুঃখের মধ্যেও প্রসন্ন হাসলো উপমা। শান্ত কণ্ঠে বলল,
-আপা বলতে বলতে এখন সত্যি আমার তোকে বড় আপাই মনে হয়!

ছায়া হালকা শব্দ করে হাসলো। উপমা আর কিছুক্ষন কথা বলে চলে যায়। নিজ কক্ষে আসার পথে তার দেখা হয় ইয়ামিনের সাথে। দৌড়ে এসে উপমার স্মুখীন দাঁড়ায় সে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-ছোট ভাবিজান বাঁচাও আম্মা মারছে আমাকে।
উপমা বুঝতে পারলো আবার কোনো দুষ্টামি করেছে ইয়ামিন। তার ছোট ছোট হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
-ভাবিজান আছে না কেউ কিছু বলবে না। তা আপনি কী দুষ্টামি করেছিলেন?
ইয়ামিন ভীত চোখে তাকিয়ে বলে,
-একটা ছেলেকে মেরেছিলাম সেটা আম্মা দেখতে পেয়ে ভীষণ রেগে আছে।
-এটা কিন্তু একদম ভালো নয় ইয়ামিন বাবু। যারা মানুষকে মারে তারা মন্দ লোক। পঁচা লোক।
হাঁটতে হাঁটতে উপমা ইয়ামিনকে নিয়ে নিজের কক্ষে চলে আসে। উপমার কথায় কিছুক্ষন সময় নিয়ে ভাবুক হয়ে ইয়ামিন বলল,
-তাহলে আব্বাজানও কী মন্দ লোক? সে তো আম্মাকে প্রতিদিন মারে। আবার বকাও দেয়। আম্মাকে অনেক কাঁদায়ও।

সাত বছরের বালকের মুখে এইরকম একটি বাক্য শুনে সহসা চমকে উঠে উপমা। চমকিত নয়নে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। উপমার থেকে কোনো কথা না শুনে ইয়ামিন পুনরায় বলে,
-বলো না ভাবিজান আব্বাজানও কী মন্দ লোক?
ক্ষিপ্ত মেজাজকে ঠান্ডা করে উপমা। নিজেকে শান্ত করে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-সে ভালো হোক খারাপ হোক সে আপনার আব্বাজান ইয়ামিন। আর আব্বাজানকে নিয়ে এইরকম বলতে নেই।
উপমার কথায় বাচ্চা ইয়ামিনের কী হলো সে জানেন না হটাৎই ফুঁপিয়ে উঠলো ইয়ামিন। উপমা বিছানায় উঠে বসে ইয়ামিনের গালে হাত দিয়ে বলে,
-বাচ্চা কী হয়েছে আপনার? আমার কথায় খারাপ লেগেছে?
-আমি আব্বাজানকে অনেক অপছন্দ করি। বড় হলে আমি আম্মাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।
উপমা খানিকটা হাসলো। ঐ লোককে কেউই পছন্দ করে না। এই ছোট বাচ্চাও আলাউদ্দিনকে অপছন্দ করে ভেবে তাচ্ছিল্যা হাসি হাসলো উপমা।
-ছোট ভাবিজান তুমিও যাবে আমাদের সাথে?
-কেনো যাবো না!আমরা সকলেই অনেক দূরে চলে যাবো। ঠিক আছে?

খুশিতে হাত তালি দিলো ইয়ামিন। সোহরাবের দেওয়া চকলেট উপমা ইয়ামিনকে ধরিয়ে দেয়। বসে বসে সেটা খেতে খেতে একের পর এক প্রশ্ন করছে উপমাকে। উপমা মৃদু হেসে উত্তর দিচ্ছে আবার তার সাথে মজা করছে।
– ভাবিজান আম্মা বলেছেন আমি নাকি চাচা হতে যাচ্ছি?
-হ্যাঁ, আপনার থেকেও একটা ছোটু বাবু আসবে বাসায়।
-সত্যি! বাবু কী তোমার এখানে?
ইয়ামিন উপমার পেট দেখিয়ে কথাটা বলল। উপমা ত্বরিত গতিতে বলে,
-না। আপনার বড় ভাবিজানের পেটে বাবু।
-অনেক মজা হবে আমরা বাবুকেও সাথে নিয়ে যাবো।
-আচ্ছা।

__________________________
পূর্বের আকাশে সূর্য ঢোলে পরেছে বেশ আগে। চারদিকে একেবারে অন্ধকার নেমে এলো। আকাশ গুড়ুম গুড়ুম শব্দ তুলে ডাকছে। রসইকক্ষে রাতের রান্না করছিলো উপমা। জানালা দিয়ে দেখতে পায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পরা শুরু হয়েছে। বাতাসের দাপটে কাঠের জানালা বারে বারে শব্দ তুলছে। হাত বাড়িয়ে জানালা লাগাতে যাবে সেইসময় তার নজর পরে উঠানের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে সোহরাব দৌড়ে আসছে। আজ তো সোহরাবের আসার কথা ছিল না। এইসময় হটাৎ সোহরাবকে দেখে মুখ কঠিন্য হয়ে যায় তার। কোনোরকম জানালা লাগিয়ে কাজে মন দেয়।
গৃহের সদর দ্বারে পা রাখতেই আকাশ কাঁপিয়ে বজ্রপাত ঘটলো। মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চলে যায়। অন্ধকারে ঢেকে যায় গৃহের প্রত্যেকটা কক্ষ। বৈঠকখানায় এসে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলো না সোহরাব। ফাতু বলে ডাক দিতেই উপমা মোম নিয়ে উপস্থিত হয়। বৃষ্টিতে ভেজার ফলস্বরূপ ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে সোহরাব। বড় বড় নিঃশাস নিচ্ছে। আজ তাকে অন্যরকম লাগছে। আঁখিজোড়া লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কৃষ্ণবর্ণ কায়ায় রক্তিম নেত্রপল্লব। একটু বেশিই ভয়ংকর লাগছে তাকে। উপমা বিস্মিত ভনিতায় বলল,
-আপনি! হটাৎ এইসময়ে আসলেন!
-কিছু দরকারি ছিল।
সোহরাব নিলিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উপমার পানে। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে মোম নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়।
উপমা স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে তীব্র ভয় ধাক্কা দিচ্ছে তাকে।

রাতে আর বিদ্যুৎ আসে না। মোমের ক্ষীণ আলোয় খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয় সকলে। ছায়ার সাথে একবারও কথা বলেনি সোহরাব। উপমা ছায়া দুইজনই বেশ অবাক। তবে সোহরাব কী তাঁদের কথা জেনে গেলো! এতো কিছুর মধ্যে উপমাকে আরো চিন্তিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল ফাতুর একটি বাক্য। তুলি ভীষণ অসুস্থ। বিছানা থেকেও উঠতে পারছে না। উপমা তাকে দেখে আসে। নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে আসে। মেয়েটা কেমন ভয়ে নেতিয়ে গিয়েছে। অথচ বিকালেও কত স্বাভাবিক ছিল! উপমা আজ আর ছায়ার কক্ষে যায়নি রাতে। সোহরাব গৃহে আছে। যদি তাকে কোনোরূপ সন্দেহ করে।

বাহিরের বর্ষণ কমার নাম নেই। আরো ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর হচ্ছে আবহাওয়া। উপমার মনে কু ডাকছে। তার মন বলছে আজ কোনো অনুচিত বা দুর্ঘটনা ঘটবেই। তাই নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখছে। সকল কাজ শেষ করে নরম পায়ে নিজ কক্ষে প্রবেশ করে উপমা। অন্ধকারে মাথার ঘোমটা সরিয়ে ফেলে। দ্বার লাগিয়ে হাতের ম্যাচ দিয়ে মোম জ্বালিয়ে পিছনে ফিরতেই ভয় পেয়ে যায় সে। বড় বড় চোখ করে বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে। সোহরাব তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে।
এখন পর্যন্ত সোহরাব তার সাথে অনেক কমই রাত কাটিয়েছে। আর যে কয়বার উপমার কক্ষে এসেছে তার মা বা ছায়ার কথা রাখতে। জোর-জবরদস্তি উপমার কক্ষে আসলেও এখন পর্যন্ত সোহরাব তার বিছানায় বসে বা শোয়নি। কক্ষে বড় একটি বেতের বসোনি আছে সেটার মধ্যেই ঘুমায় সে। কিন্তু আজ সোহরাবকে নিজ কক্ষে আর নিজ বিছানায় দেখে উপমার বক্ষস্থল মৃদু কাঁপছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস করে মাথায় ঘোমটা তুলে নেয়। হালকা হেসে বলল,
-আপনি এখানে? কোনো দরকার ছিল কী?
-কেনো আমার স্ত্রীর কক্ষে আমি আসতে পারি না কী?
অনেকটা রসিকতার স্বরে কথাটা বলল সোহরাব। মুখে বাঁকা হাসি তার। কিছু বলতে যেয়েও গলা আটকে এলো উপমার। সামনে পা বাড়ানোর সাহস হলো না তার। সোহরাব পাঞ্জাবী ঠিক করে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ায়। মৃদু পায়ে এগিয়ে আসে উপমার কাছে। উপমার চারদিক ঘুরে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে তাকে। হাত মুঠি করে দাঁড়িয়ে আছে উপমা। ভিতর ভিতর তার রাগ হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। সোহরাব বলল,
-আমার আম্মাজানের পছন্দ আসলেই তুখোড়!
কেমন অপরিচিত কণ্ঠস্বর। কেমন অপরিচিত ভঙ্গিমা। উপমা বুঝতে পারলো না সোহরাব হটাৎ এতো পরিবর্তন কেনো হলো! কী চলছে তার মনে?

সোহরাব কোমল হাতে উপমার মাথার কাপড় সরিয়ে ফেলে। তখনও স্থির উপমা। সোহরাব নিজ হস্ত ধারা উন্মুক্ত করে দেয় উপমার খোঁপা করা কেশ। এই প্রথম উপমাকে খোলা চুলে দেখলো সোহরাব। তার সাথে উপমার চোয়াল শক্ত মুখশ্রী। বেশ হাসি পেলে তার। কয়েকটা চুল উপমার কপাল বেয়ে মুখে এসে ছড়িয়ে পরছে। সোহরাব খুবই যত্নের সাথে সেটা সরিয়ে দেয়। উপমার নিজেকে অধম মনে হচ্ছে। সোহরাব কী তার স্বামীর অধিকার ফলাতে এসেছে বুঝতে পারছে না সে।
সোহরাব উপমার থুতনি ধরে মাথা উঁচু করে। সোহরাবের চাহনি আজ অন্যরকম। উপমার মুখ আরো কঠিন্য হয়ে উঠলো।
-এতো আবেদনময়ীকে আমি এতদিন কিভাবে উপেক্ষা করেছিলাম! কত নির্বোধ আমি!

সোহরাবের ওষ্ঠ উপমার নিকট অগ্রসর হতেই ছিটকে দূরে সরে যায় উপমা। খানিকটা বিরক্ত নজরে তাকিয়ে সোহরাব বলল,
-কী হলো? দূরে সরে গেলেন কেনো?
-আমি একটু অসুস্থ অনুভব করছি।
অকপটে জবাব উপমার। শেষে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো তাকে। সোহরাব তাতেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। উপমা পিছনে ফিরে কক্ষের দ্বার খুলতে উদ্যত হবে তখনই সোহরাব তাকে পিছন থেকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরে। অনেকটা ঘাবড়ে গেলো উপমা। সোহরাবকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। সোহরাব কোনোভাবেই ছাড়লো না। বরং রুক্ষ কণ্ঠে বলল,
-অসুস্থের মিথ্যে বাহানা দিয়ে লাভ নেই।
ক্রোধে ফেঁটে পরলো উপমা। হাতের মোমটা ততক্ষনে জমিনে পরে গিয়েছে।সোহরাব তার ঘাড়ে নিজের ওষ্ঠধরের ছোঁয়া বসাতে যাবে সেই মুহূর্তেই উপমা পিছনে ফিরে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে শব্দ করে সোহরাবের গালে চড় বসিয়ে দেয়। রাগে কাঁপতে থাকে তার শরীর। অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠে তার মুখ।
নিলিপ্ত ভঙ্গিতে হাসলো সোহরাব। এই চড়ে তার কিছুই হয়নি। জানালা দিয়ে আসা বজ্রপাতের আলোয় সোহরাব স্পষ্ট দেখতে পেলো উপমার রাগী মুখ। বাঁকা হেসে কিছুটা দূরে সরে গেলো সে। শান্ত স্বরে বলল,
-এতো ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় হুমাশা মির্জা।

ফোঁস ফোঁস শব্দ করে শ্বাস ত্যাগ করছে উপমা। শরীরের শিরায় শিরায় জ্বলছে তার। চাপা নিঃশাস ফেলে সোহরাব বলল,
-চলে যাও তুমি।
আকস্মিক উপমা প্রশ্ন করে উঠলো,
-কিভাবে আমার পরিচয় জানলেন আপনি?
-তোমার ওপর আমার প্রথমদিন থেকেই সন্দেহ ছিল। যেদিন ছোট আব্বা মারা গেলো সেইদিন আমার সন্দেহ আরো গাঢ় হয়। শহরে গিয়ে তোমার খোঁজ নেই। ইয়াশার তোমাকে একসাথে কথা বলতে দেখি আমি। তারপর শহরে গিয়ে ইয়াশারের পিছু নিয়ে জানতে পারি তুমি আর ও একসাথে পড়ছো। তুমি শহরে থাকো গ্রামের মা বাবা তোমার আপন হয়। আরো খবর নিয়ে জানতে পারি তোমার দুইটা জন্মনিবন্ধন। একটায় নাম হুমাশা মির্জা যেটা সব জায়গায় দেওয়া আরেকটায় তোমার নাম উপমা উর্মি। উপমা উর্মিতে সবকিছুই ভুল দেওয়া ছিল।

এক দমে সবটা বলে দেয় সোহরাব। উপমা অবাক হলো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। সোহরাব একটু থেমে আবারও বলল,
-জমিদার গৃহ থেকে বহু দূরে চলে যাও। যেখানে ছিলে সেখানে চলে যাও।

সোহরাবের মুখে এইরকম কথা শুনে বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো উপমা বুক। অবিশ্বাস নজরে কয়েকপলক তাকিয়ে তাচ্ছিল্যা কণ্ঠে বলল,
-ভয় পাচ্ছেন আমাকে? দোয়েয়া করে বলিয়েন না আপনি আলাউদ্দিন মির্জার সাথে ছিলেন অথবা আপনি সব জেনেও চুপ করে আছেন!
-আর যাই হোক সে আমার জন্মদাতা। শত চেয়েও আমি পারিনি তার বিরুদ্ধে যেতে আর না চাইবো তার কিছু হোক। আর আমি এটাও চাই না তোমার কিছু হোক। আমার প্রিয় একজন মানুষের অংশ তুমি। এভাবে নিজের বাকিটা জীবন নষ্ট করো না। আলাউদ্দিন মির্জা তোমার সত্যিটা জানার পর তোমাকে জীবিত রাখবেন না উপমা।

গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলো উপমা। সোহরাবের কথায় অনেক বেশি মজা পেলো সে। সোহরাব চোয়াল শক্ত করে ফেলে। পছন্দ হলো না উপমার হাসি। প্রতিশোধের নেশায় জ্বলে উঠলো উপমা।
-প্রিয় মানুষ! সত্যি হুমায়ুদ্দিন মির্জা আপনার প্রিয় ছিল?
সোহরাব কিছু বলতে পারলো না চুপ করে রইলো। উপমা শক্ত কণ্ঠে বলল,
-আমি নিজেকে নিয়ে ভয় পাই না। যে অন্যায় করে সে শাস্তি পায়। আপনাকে নিয়ে ছায়ার অনেক স্বপ্ন। আপনি আমার কাজের মধ্যে আসবেন না সোহরাব মির্জা আমি চাই না ছায়ার অনাগত সন্তান পিতা হারা হোক। অনেক কষ্টে আমি মনস্থির করেছি ছায়ার জন্য হলেও আপনাকে আমি কিছুই করবো না।

উপমা যেমন নিজের কথায় অটল তেমনই সোহরাবও। একই ভঙ্গিতে বলল,
-ছায়া আর তার সন্তানের চেয়েও আমার পিতা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের প্রাণ দিয়ে দিবো তবুও তার কিছু হতে দেবো না।
উপমা বিস্ময়বিমূঢ়। সে ভুলেই গিয়েছিলো যার রক্তই খারাপ সে ভালো কিভাবে হবে! আবার আপসোসও হলো ছায়ার জন্য। এতো ভালোবাসার পরিনাম মেয়েটা কিছুই পেলো না। ঘৃণায় ভরা চাহনি নিক্ষেপ করে উপমা শুধু একটি শব্দই উচ্চারণ করতে পারলো।
-ছি!

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-১০

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১০

-এভাবে বলতে নেই আপা। যাই হোক সে আপনাদের আম্মা হয়।

উপমার কথায় মৌন হয়ে যায় তাহসিয়া। তাহেরা হটাৎ খেয়াল করে উপমার গলার ঠিক নিচে লম্বা একটা কাঁটা দাগ। সবসময় ঘোমটা দিয়ে থাকার ফলে এই দাগ কখন তাঁদের নজরে পরেনি। তাহেরা হালকা করে ছুঁয়ে প্রশ্ন করে উঠলো,
-এটা কিসের দাগ ভাবিজান?
তাহেরার প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় উপমা। সাথে সাথেই আঁচল দিয়ে গলা সহ মাথা ঢেকে ফেলে। ততক্ষনে তাহসিয়াও দাগ খেয়াল করে ফেলেছে। দুইজনই প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে উপমার পানে। উপমা স্মিত হাসার চেষ্টা করে বলে,
-তেমন কিছুই না। একবার ব্যাথা পেয়েছিলাম সেটারই দাগ।
তাহেরা বুঝার ভান করে মাথা নারায়। তাহসিয়ার কেনো জানি উপমার কথা বিশ্বাস হলো না। সন্দেহ নজরে তাকিয়ে রইলো। উপমা চোরা চোখে সেই দৃষ্টি দেখে মিনমিনে স্বরে বলল,
-এতো চুপচাপ করে আছো কেনো? তাহেরা তোমাদের শৈশবকালের কিছু ঘটনা বলো শুনি?
শৈশবের কথা শুনে তাহেরার মুখ খুশিতে ভরে উঠে। সে বলল,
-আমার শৈশবকাল অনেক আনন্দময় ছিল। আম্মাজানের আদর, আব্বাজানের বকুনি, ভাইজান ও বোনদের ভালোবাসা সব মিলিয়ে দারুণ ছিল সেই সময়টা। কিন্তু ছোট আপার শৈশবকাল আমার দেখা ততো ভালো ছিল না। আপা তার আদরের বড় আব্বাজানকে হারালো, তার প্রাণপ্রিয় সখিকে হারালো, তারপর আবার তার বিবাহ হয়ে গেলো।
শেষের কথায় জিব কামড় দেয় তাহেরা। কথায় কথায় কী সব বলে ফেললো সে। তাহসিয়া রেগে তাহেরাকে বলল,
-তোকে বলেছি আমার বিষয় কিছু বলতে? এতো বেশি বলিস কেনো তুই?

তাহসিয়া রাগে বসা থেকে উঠে চলে যায়। উপমা নীরব দর্শকের মতো সবটা দেখছিলো। তাহেরার মন খারাপ হয়ে যায়। তাই কথায় ফোড়ন কেটে বলল,
-তা আপনার শৈশবকালের কিছু বলুন ভাবিজান। পরিবারের বিষয় কিছু বলুন শুনি।
উপমা একবার তাকালো তাহেরার দিকে। তারপর আঁখিজোড়া বন্ধ করে বলে,
-আমার শৈশব মানেই এক অফুরন্ত ভালোবাসা। এক গল্পের কাহিনী। এক আনন্দময় অনুভূতি। আবার সেই আনন্দময় অনুভূতি মাঝে মাঝে ভীষণ পীড়াদায়ক অনুভূতিও হয়ে দাঁড়ায়।
-মানে?
-মানে তেমন কিছুই না। আসলে আমার স্পষ্ট মনে নেই শৈশবের কথা।
উপমার কথায় তাহেরা চুপ হয়ে যায়। উপমা শান্ত হয়ে বলল,
-আচ্ছা, বড় আব্বা মানে? আব্বাজানের কী আরো ভাই ছিল?
-হ্যাঁ ভাবিজান। আব্বারা তিন ভাই এক বোন ছিল। আব্বাজান সবার বড় তারপর আমার বড় আব্বা তারপর ছিল ছোট আব্বা। হুমাউদ্দীন মির্জা ছিল তার নাম।
উপমা ভাবুক হয়ে সবটা শুনলো। কথার পাল্টা জবাবে বলল,
-তাহলে এখন উনি কোথায়? উনার পরিবারই বা কোথায়?
তাহেরা দুঃখি মুখ করে ফেলে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-আমাদের আরেকটা বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে বড় আব্বা দাদাজান দাদিজানকে নিয়ে থাকতো। দাদাজান দাদিজান মারা যাওয়ার নয়দিনের মাথায় একদিন ঐ বাড়িতে আগুন লেগে যায়। সেই আগুনেই পুড়ে মারা যায় বড় আব্বা আর তার পুরো পরিবার। আমাদের আরো দুইজন ভাইবোন ছিল। সরফরাজ মির্জা আর হুমাশা মির্জা। সরফরাজ ভাই ছিল ভাইজানের সমবয়সী। আর হুমাশা আপা ছিল তাহসিয়া আপার এক মাসের ছোট। হুমাশা, তাহসিয়া আপা আর ছায়া ভাবিজান বান্ধবী ছিল।
বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো উপমা। তাহেরার কথায় ভীষণ অবাক হয়েছে এমনই ভনিতা তার। ভ্রূজোড়া কুঁচকে আগ্রহী কণ্ঠে জিগ্যেস করে,
-আগুন কী অসাবধানতায় লেগেছিলো নাকি কেউ শত্রুতা করে লাগিয়েছিল?
-আমি সঠিক জানি না ভাবিজান। তবে সবাই বলে অসাবধানতায় লেগেছিলো।
-ওহ।

আলাপ পর্ব শেষ হতেই তাহেরা চলে যায়। কক্ষের দরজা লাগিয়ে বিছানায় এসে বসে উপমা। মাথার ঘোমটা খুলে শাড়ীর আঁচল বক্ষস্থল থেকে সরিয়ে ফেলে। বড় আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। মৃদু প্রসারিত হয় তার ওষ্ঠজোড়া।তাচ্ছিল্যর হাসি ফুটে উঠে তার কোমল মুখশ্রীতে। আয়নায় ভেসে উঠে তার গলার লম্বা কাঁটা চিহ্ন। বুকে, পেটে অনেক আগের পোড়া কালো দাগ। উপমা সেই দাগে হাত বুলিয়ে কাঠিন্য স্বরে বলে,
-চিন্তা নেই, একে একে সকলেই তার কর্মের ফল পাবে।

শেষ রাতে কেউ একজন উপমার কক্ষের দরজায় মৃদু স্বরে ঠোকা দেয়। প্রথমে বুঝতে পারে না উপমা যখন বুঝে দ্রুত দরজা খুলে দেয়। হাতে কিছু একটা নিয়ে ইয়াশার দাঁড়িয়ে আছে তার কক্ষের বাহিরে। উপমা হালকা হেসে এদিকসেদিক তাকিয়ে বলল,
-যেটা আনতে বলেছিলাম এনেছো সেটা?
ইয়াশার মুখ ফুটে কিছু বলল না। একটা কাগজের পুটলি ধরিয়ে দেয় উপমার হাতে। উপমা বড় একটি হাসি দেয়। খুশি হয়ে বলে,
-আমি জানতাম তুমি আমাকে নিরাশ করবে না। অনেক বেশি ধন্যবাদ তোমাকে আমার এতো বড় উপকার করার জন্য।
-তুমি জানো তো তুমি কী করতে যাচ্ছ? সোহরাব ভাই কিন্তু তোমাকে ছাড়বে না!
-নির্বোধ!তোমার মনে হয় আমি তোমার ভাইকে ভয় পাই? নিজের কাজ করে তার চোখের সামনে দিয়ে আমি উড়ে যাবো জনাব কিছুই করতে পারবে না।
বাঁকা হাসে উপমা। ইয়াশার জানে উপমার ধারা সব সম্ভব তবুও তার ভয় করছে। যত যাই হোক একসময় ভালো বেসেছিলো এই নারীকে। ইয়াশারকে কিছু বলতে না দেখে উপমা নিজেই বলল,
-আমি জানতাম ইয়াশার তুমি অন্তুত আমাকে বুঝবে। আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল এটা। তোমার সাথে বিবাহ করে সংসার করা নয়!তুমি ভালো কাউকে পাবে। তাহসিয়া বানুর মতো! একজন বন্ধু হিসেবে আমাকেও তুমি আজীবন পাশে পাবে যদি বেঁচে থাকি। এখন যাও কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ।

দরজা লাগিয়ে দেয় উপমা। ইয়াশার কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে চলে যায়।
________________________

পরেরদিনই ইয়াশার তাহসিয়া চলে যায়। তাহেরা কিছুদিন থেকে তারপর তার স্বামীর বাসায় চলে যায়। তুলসীর অবস্থা আগের থেকে আরো বেশি খারাপ। রসইকক্ষে রান্না করছিলো উপমা আর সাইয়েরা। মিনা তার দু মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। এখানে থাকলে তার নাকি বেশি কষ্ট লাগে তাই তার বাবা এসে তাকে নিয়ে গেছে। উপমা রান্না করছিলো আর আড়চোখে তুলিকে দেখছিলো। চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটা কিছুদিন ধরে কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আগের মতো কথা বলে না, হাসাহাসি করে না। সর্বাক্ষণ ভয়াত মুখ করে রাখে। কোনো বিষয় নিয়ে কী সে ভয় পাচ্ছে! উপমা তুলিকে কয়েকবার জিগ্যেস করেছিল কোনো সমস্যায় আছে কী না। কিন্তু তুলি তাকে তেমন কিছুই বলেনি। ফাতু সবজি কাটতে কাটতে বলল,
-ছোডু ভাবিজান আরো কাডুম?
-না।
ইয়ামিন ডাকায় সাইয়েরা তার কাছে ছুটে যায়। উপমা তুলিকে দেখে বলল,
-তুলি আজ বিকালে আমরা দড়িলাফ খেলবো নে। তুমি খেলবা?
তুলি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নত করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাতু বলে,
-ঐ কী খেলবো!ওর তো শরীরই ভালা না।
তুলি চোরা চোখে ফাতুকে চুপ থাকতে বলে। উপমা সেটা খেয়াল করে। রান্নায় মনোযোগ দিয়ে বলে,
-কেনো কী হয়েছে তুলির? তাছাড়াও আমি বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি ও চুপচাপ।
-কী হইসে কয় না ভাবিজান। খালি বমি করে আর চিৎ হইয়া বিছানায় পইড়া থাকে।
উপমার ভ্রুধয় কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে গেলো। সহসা কিছু পলক তাকিয়ে থাকলো তুলির দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-কাজ শেষে তুমি আমার কক্ষে আসবা তুলি।
-আইচ্ছা ভাবিজান

রান্না শেষে খাবার নিয়ে তুলসীর কক্ষে আসে উপমা। এই নারীকে দেখলে তার ভীষণ মায়া হয়। শেষ সময়ে এসেও শান্তি পেলো না সে। কিন্তু একটা কথা আছে না মানুষ তার কর্মের ফল পায়! মানুষ ছাড় দিলেও আল্লাহ পাপীদের ছাড় দেন না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে।
তুলসী আধো আধো চোখ খুলে উপমা দেখে। উপমা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসায় তাকে। নিজের হাত দিয়েই খাবার খাইয়ে দিতে থাকে। খেতে খেতে তুলসী বলে,
-বড় বউমা কেমন আছে? বাচ্চা ঠিক আছে ছোট বউ?
-হ্যাঁ আম্মাজান। আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন অনাগত নাত-নাতির সাথে খেলবেন না।
তুলসী নিঃশাস ছাড়ে। বড়ই আফসোস সেই নিঃশ্বাসে। ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-আমি আমার জীবনে অনেক বড় পাপ করেছিলাম গো ছোট বউমা। একজন নির্দোষকে যে হত্যা করে সে পাপী আর যে সেই পাপের কথা জেনেও নিজ স্বার্থের কথা ভেবে চুপ থাকে সে হলো তার থেকেও বড় পাপী। আমি মনে হয় মইরা যামু গো ছোট বউ।

উপমা স্বাভাবিক ভনিতায় তুলসীর মুখ মুছে দেয়। স্মিত হেসে বলে,
-এইরকম কথা বলবেন না আম্মাজান। বরং যে সত্যি পাপী তার জন্য দোয়া করুন। সৃষ্টিকর্তা যাতে কম শাস্তি দিয়েই তাকে নিজের কাছে নিয়ে যান।
উপমার ঠান্ডা স্বরে বলা কথায় মৃদু কেঁপে উঠে তুলসী। কিছু একটা ছিল উপমার কথায়। আঁতকে উপমার পানে তাকিয়ে থাকে শুধু।

দুপুরের পর তুলি উপমার কক্ষে আসে। শাড়ী ভাঁজ করছিলো উপমা। তুলিকে দেখে দ্বার লাগিয়ে ভিতরে আসতে বলে। তুলি আজ ভয় পাচ্ছে উপমাকে। কাঁপাকাঁপি হাতে দরজা লাগিয়ে ভিতরে যেয়ে দাঁড়ায়। উপমা নিজের কাজ করতে করতেই প্রশ্ন করে,
-কী হয়েছে তোমার? কেউ কিছু বলেছে?
তুলি কিছু বলতে পারলো না। ঠোঁট কাঁপছে তার। উপমা এবার রেগে যায়। ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হয়ে রুক্ষ স্বরে বলল,
-আমাকে ক্রোধিত করো না তুলি। ভালোয় ভালোয় উত্তর দেও?
তবুও কিছু বলল না তুলি। উপমা বুঝলো তুলি এভাবে বলবে না ওকে ভয় দেখাতে হবে। তাই উপমা তৎক্ষণাৎ তুলির গলা চেপে ধরে নিজের একহাত দিয়ে। ভীত তুলি কেঁদে দেয়। উপমা ছেড়ে দেয় তুলিকে। বড় বড় নিঃশাস নিতে থাকে সে। তুলি উপমার পায়ের কাছে বসে পরে। দু পা চেপে ধরে হাউমাউ কেঁদে উঠে। উপমা নিজেকে শান্ত করে তুলির সাথে নিচে বসে। তুলির দু কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-তুলি দেখো আমি তোমার বড় বোনের মতো। ভয় না পেয়ে কী হয়েছে বলো আমাকে?
-আমারে হেয় মাইরা ফালাইবো। মাইরা ফালাইবো।
উপমা কিছুই বুঝলো না তুলির কথা। কে মেরে ফেলবে!কার কথা বলছে তুলি! তুলির গালে হাত দিয়ে করুণ স্বরে বলল,
-আমি আছি তো তোমার সাথে। তুমি শুধু আমাকে বলো।
-আ আমি গর্ভবতী ছোডু ভাবিজান।
ঝাঁকি দিয়ে উঠে উপমার শরীর। নয়নজোড়া বড় বড় হয়ে যায়। আকস্মিক তার হাত কাঁপতে থাকে। কম্পিত কণ্ঠে জিগ্যেস করে,
-সন্তানের বাবা কে?
-এডা আমি কইতে পারুম না ভাবিজান। মাফ করেন আমারে।
-তুলি বিশ্বাস করো আমাকে। আমি তোমার ভালো চাই।
তুলি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল,
-আপনের শশুর আব্বা।

________________________

সন্ধ্যার পর ছায়ার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে উপমা। কিছুক্ষন কথা বলে দুইজন। উপমাকে গম্ভীর থাকতে দেখে ছায়া প্রশ্ন করে,
-আমাদের হাস্যজ্জ্বল মেয়ে উপমার কী হয়েছে আজকে?
অনেকটা শয়তানির ছলে বলল ছায়া। উপমা মূর্তির মতো বসে রইলো। এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে। এবার ছায়া একটু চিন্তিত হয়ে পরলো। উপমার গালে হাত দিয়ে বলে,
-উপমা এইরকম লাগছে কেনো তোমাকে?
-তুলি অন্তসত্ত্বা আপা। তাও আবার আলাউদ্দিন মির্জার সন্তান তার গর্ভে!
পিলে চমকে যায় ছায়া। বিস্মিত স্বরে বলল,
-কী!কী বলছো তুমি?
থর থর করে কাঁপছে উপমা। ছায়া উপমার হাত ধরে তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,
-নিজেকে শান্ত রাখো উপমা। এই পর্যন্ত এসে এখন ধয্যহারা হলে চলবে না। শয়তানদের যে বিনাশ করতে হবে।
উপমা ধপ করে ছায়ার পায়ের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পরে। চক্ষু দিয়ে এক ফোঁটা দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরছে তার। ছায়া উপলব্ধি করতে পারছে উপমার চিত্তের পীড়া। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। উপমা আজ আর মুখোশের আড়ালে নিজেকে লুকাতে পারলো না। খানিকটা সময় নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
-আমি যদি এতো পীড়া সহ্য করতে না পেরে মারা যাই তাহলে আমার হয়ে তুই আমার প্রতিশোধটা নিয়ে নিবি না ছায়া? পারবি না এই হাত দিয়ে তোর গুছানো সংসার ধ্বংস করতে? বল?

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৯

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৯

রাতের ঝড়ের তান্ডবে গাছপালা ভেঙে পরে আছে উঠানে। শীতল আবহাওয়া। বাতাসের সাথে ভেজা মাটির ঘ্রান নাকে আসছে। মাত্রই ঘুম ভেঙেছে ছায়ার। সোহরাবের কক্ষে গোসলখানা আছে। ছায়া এলোমেলো পায়ে বিছানা থেকে নেমে গোসলখানায় ঢুকে পরে। লম্বা সময়ে গোসল নিয়ে গতকালের শাড়ীই পুনরায় পরে নেয়। গোসলখানা থেকে বের হয়ে একবার ঘুমন্ত সোহরাবকে দেখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় সে। দোতালার বারান্দায় মিনাকে কান্নারত্ব অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছায়া পিলে চমকায়। মাথায় আঁচল তুলে এগিয়ে যায়। শান্ত স্বরে জিগ্যেস করে,
-ছোট আম্মা কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেনো? ছোট আব্বা বকেছে?
মিনা ছায়াকে দেখে আরো ভেঙে পরে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মিনার ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে উপমা, তাহেরা, তারনা। সবাইকে দেখে সাহস পেয়ে বলল,
-কাল রাতে তোমাদের ছোট আব্বা কক্ষে আসেনি। গৃহে এসেছিলো রাতের খাবার খাওয়ার পর কোথায় চলে গেলো আমি জানি না।
ছায়া সহ সকলে চিন্তিত হয়ে পরলো। তুলসীও এসে পরেছে। এতো কিছুর মধ্যে তুলসীর নজরে পরে ঘোমটার আড়ালে ছায়ার ভেজা কেশ। সবাই মিনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ছায়া দৌড়ে সোহরাবের কক্ষে আসে। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে সবটা বলে। সোহরাব উদাম গায়ে শার্ট জড়িয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। আলাউদ্দিন আর সে গৃহের বাহিরে খুঁজতে থাকে। সৈন্যদল পাঠিয়ে দেয় সালাউদ্দিনের খোঁজে। চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠানে দাঁড়াতেই একজন সৈন্য ভয়াত অবস্থায় দৌড়ে আসে। মাথা নত করে বলল,
-জনাব গৃহের পিছনে ছোট মালিকের মৃত লাশ পাওয়া গিয়েছে।

সৈন্যর কথায় দৌড়ে সেখানে যায় সোহরাব। সালাউদ্দিনের নিথর দেহ পরে আছে মাটির ওপর। লাল র’ক্ত মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। সোহরাব ভূমির ওপর বসে সালাউদ্দিনের শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করে দেখলো সে আর জীবিত নেই। সোহরাব একবার ওপরে তাকালো। ওপর থেকে পরার জন্য অতিরিক্ত রক্তখরণেই মৃত্যুবরণ করেছেন সালাউদ্দিন।
জমিদার গৃহে শোকের ছায়া ভর করে। হামাগুড়ি দিয়ে কান্না করছে মিনা। তুলসীও কান্নায় ভেঙে পরেছে। একে একে আত্মীয়স্বজন আসছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা আসছে। উপমা রুমকি আর রোমানাকে নিয়ে তাহেরার কক্ষে বসে আছে। মেয়েদুটি ভীষণ কান্না করছে। রুমকিকে কোলে নিয়ে তার মাথা বুকে চেপে ধরে রেখেছে। কেনো জানি সে রুমকির মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। একদিন সেও এভাবে কান্না করেছিল।

মাটি দিয়ে এসে গৃহে প্রবেশ করে সোহরাব। মোটামোটি আত্মীয়স্বজন সকলেই চলে গিয়েছে শুধু হাতে গোনা কয়েকজন আছে। মিনা ক্ষণে ক্ষণে কান্না করছে তাকে কেউ আটকাতে পারছে না। সোহরাব সবাইকে উপেক্ষা করে সেই বদ্ধ কক্ষে আসে। দ্বার খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। জমিনে ধুলোয় কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখতে পেলো সোহরাব। এগিয়ে যেয়ে দেয়ালচিত্রের স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন নিজ আঙুল দিয়ে স্পর্শ করেছে চিত্র। সবটা ভালোভাবে পরোক্ষ করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় সে।

______________________
এরই মধ্যে কেটে যায় চার মাস। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে জমিদার গৃহে। আগের মতো হৈচৈ আর নেই। সবসময় নীরব হয়ে থাকে গৃহ। তাহেরার বিবাহ হয়ে গিয়েছে। বেশ সুখেই আছে সে। তুলসী অসুস্থ হয়ে পরেছে বিছানায়। একদিন আলাউদ্দিনের সাথে তার তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায় আলাউদ্দিন তাকে মারধর করে। তারপর থেকে অসুস্থ সে। এটা নিয়ে সোহরাব আর আলাউদ্দিনের মধ্যে বিশাল ঝগড়া লেগেছিলো। রাগ করে সোহরাব আজও তার আব্বাজানের সাথে কথা বলে না। মিনা সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকে। হাসে না, বেশি কথা বলে না। সাইয়েরা, উপমা আর ছায়াই গৃহের সকল কাজ করে। সাইয়েরার দায়িত্ব যেনো বেড়ে গিয়েছে।

সোহরাব কয়েকবার গ্রামে এসেছিলো। এখন আর সে তার স্ত্রীকে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না। একরাত ছায়ার সাথে কাটালে আরেক রাত উপমার সাথে কাটায়। উপমার সাথে এখনও তার স্বামী স্ত্রীয় সম্পর্ক তৈরি হয়নি কিন্তু দুইজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। ছায়ার মতো চুপচাপ নয় সে। সোহরাবের সাথে অনেক কথা বলে সে।
ছায়া আর সোহরাবের মধ্যে সম্পর্ক এখন শুধু স্বামী স্ত্রী নয় প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে দুইজনের মধ্যে। সোহরাব উপলব্ধি করতে পারে ছায়া তাকে পছন্দ করে তেমনই সে এটাও বুঝতে পারে ছায়ার প্রতি তার অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে।

কয়েকদিন যাবৎ ছায়া অসুস্থ। মাথা চক্কর দিয়ে পরে যায়, ঘন ঘন বমি হয়, শরীর দুর্বল মনে হয়। উপমা ছায়াকে কয়েকবার বলেছে সোহরাবের সাথে শহরে যেয়ে পরীক্ষা করে আসতে। তাছাড়াও উপমা আন্দাজ করছে ছায়া অন্তসত্ত্বা। কিন্তু ছায়া এটা মানতে নারাজ। ডাক্তার যে বলল সে মা হতে পারবে না তাহলে এখন কিভাবে হবে সে! আজ সোহরাব আসবে গ্রামে। উপমা ভালো ভালো রান্না করছে তার জন্য। রান্না শেষ হলে ইয়ামিন, রোমানা, সাইফা, রুমকিকে পড়াতে বসে বৈঠকখানায়। সকলের জানামতে সে মেট্রিক পাশ তাই মোটামোটি ভালোই পড়ায়।

-এখন যে দুষ্টামি করবে তাকে কিন্তু আমি সত্যি পিটুনি দেবো বলে দিলাম।

উপমার কথায় ভয়ে আরষ্ঠ হয়ে পড়ায় মনোযোগী হয় সকলে। এমন সময় গৃহের সদর দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে সোহরাব। ভাই বোনদের দেখে হেসে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-বাহ্!আমার ভাইবোনরা দেখছি তাঁদের শিক্ষিকাকে ভীষণ ভয় পায়!
সোহরাবের কথায় সকলে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। ছুটে যায় সোহরাবের কাছে। সোহরাব সবাইকে একটা করে চকলেট দেয়। সকলে খুশিতে পড়া বাদ দিয়ে বাহিরে চলে যায়। সোহরাব এগিয়ে এসে উপমাকে একটি চকলেট ধরিয়ে দেয়। উপমা ভাবুক হয়ে জিগ্যেস করে,
-আমিও কী বাচ্চা নাকি!
-অবশ্যই। আমাদের বাড়ির সবথেকে বড় বাচ্চা।
সোহরাবের কথায় উপমা চমৎকার একটি হাসি উপহার দেয় তাকে। সোহরাব হাতের চিকিৎসা ব্যাগ উপমাকে ধরিয়ে দিয়ে বসে পরে। উপমা সযত্নে সেটা নিয়ে অস্থির হয়ে বলল,
-যান গিয়ে আগে আম্মাজানকে দেখে আসুন তারপর আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।
-ঠিক যাচ্ছে।

সোহরাব উঠে তার আম্মাজানের কক্ষে চলে যায়। উপমা চিকিৎসা ব্যাগ নিয়ে এসে সোহরাবের কক্ষে রেখে দেয়। নিজ কক্ষে এসে আলমিরা খুলে একটি শাড়ী বের করে দ্রুত পায়ে পুকুর পাড়ে চলে যায়।
অসুস্থ অনুভব করায় বিছানায় শুয়িত ছিল ছায়া। সোহরাব অনুমতি না নিয়েই ভিতরে প্রবেশ করে। ছায়া ভাবলো হয়তো উপমা এসেছে তাই চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
-উপমা যাও তো তুমি। তুমি যেরকম ভাবছো সেইরকম কিছুই না। বারে বারে বলে আমার মনে কোনো আশা সঞ্চয় করিও না।
সোহরাব বুকে দু’হাত গুঁজে এগিয়ে আসে ছায়ার কাছে। কপালে হাত দেয় তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে। ছায়া ত্বরিতগতিতে বদ্ধ আঁখিজোড়া খুলে ফেলে। সোহরাবকে দেখে ধরফড়িয়ে উঠে বসে। সোহরাব একটু দূরে সরে যায়। গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করে,
-শরীর অসুস্থ? এভাবে ভয় পেলেন কেনো?
-তেমন কিছুই না। আমি ঠিক আছি।

সোহরাব কিছু বলল না তাকিয়ে রইলো শুধু। ছায়া অপ্রস্তুত ভনিতায় বলল,
-আপনি এসে জামাকাপড় পরিবর্তন করেননি? কখন এসেছেন?
-বেশ কিছুক্ষন আগেই।
-গোসল করে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।
-হুম।
ছোট উত্তর দিয়ে কক্ষ থেকে প্রস্থান করে সোহরাব। ছায়া কয়েকবার বুকে ফুঁ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উপমা পুকুরপাড় থেকে গৃহে প্রবেশ করছিলো এমন সময় তার সাক্ষাৎ হয় আলাউদ্দিনের সাথে। ভদ্রতার খাতিরে উপমা ঘোমটা টেনে বলল,
-আব্বাজান খাবার খেয়ে বাহিরে যেয়েন।
-হুম।
উপমা মাথা নত করে গৃহের ভিতরে প্রবেশ করে। আলাউদ্দিন একমনে চেয়ে থাকে উপমার যাওয়ার পানে। যতবার সে উপমার মুখশ্রী দেখেছে ততবার তার মনে হয় এই মুখ সে আগেও কয়েকবার দেখেছে। এই মেয়ে সামনে থাকলে কেমন যেনো একটা টান অনুভব করে আলাউদ্দিন। রক্তের টান।
_____________________
খাওয়া দাওয়ার পর্ব ঠুকিয়ে উপমা সোহরাবের কক্ষে আসে। একে একে ছায়ার শরীরের অবস্থা সবটা বলে দেয় সে। সোহরাব নীরবে সব শুনে বিকালেই ছায়াকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। উপমা মনে মনে দোয়া করতে থাকে যাতে সে যেটা ভাবছে সেটাই হয়। ছায়াকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে দেখেছে এবং শুনেছে সে। মাঝে মাঝে তো তারই মায়া হয় নাজুক মেয়েটার ওপর। এইটুকু সুখ তো তারও পাওনা। সে বিবাহের পর থেকেই তেমন কোনো কষ্ট করেনি। ধীরে ধীরে সে তার পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে যাচ্ছে। এখন ছায়া আর সোহরাবের একটা সন্তান হোক আর তার শেষ পরিকল্পনা সফল হোক তারপরই সে নিজ গন্তব্যে চলে যাবে।

সন্ধ্যার পর গৃহে আসে সোহরাব ও ছায়া। উপমা নিজ কক্ষ থেকে দৌড়ে বৈঠকখানায় আসে। চেয়ারে বসে কান্না করছে ছায়া। থেমে থেমে শরীর কাঁপছে তার। ছায়ার কান্না শুনে সাইয়েরা মিনা চলে আসে। উপমা ছায়াকে জড়িয়ে ধরে বিচলিত হয়ে সোহরাবকে জিগ্যেস করে,
-কী হয়েছে? আপা কান্না করছে কেনো? ডাক্তার কী বলেছে?
সোহরাবও কিছু বলতে পারলো না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে শুধু ছায়াকে দেখছে। উপমার বুকে মাথা রেখে কম্পিত কণ্ঠে ছায়া বলল,
-উপমা সৃষ্টিকর্তা আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। আমার দুঃখের দিন শেষ হলো বোধয়!
-মানে?
-তুমি যেটা বলেছিলে সেটাই হয়েছে। আমি অন্তসত্ত্বা।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না উপমা। খুশিতে তার চোখেও পানি চলে এসেছে। কয়েকমাসে তার ছায়াকে সত্যি নিজের বড় বোন বলে মনে হয়। ছায়া যে তার স্বামীর প্রথম স্ত্রী এটা ভুলেই যায় উপমা। ছায়াও ছোট বোনের মতো আগলে রাখে উপমাকে। উপমাও সেই ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছায়ার চোখের পানি মুছে দেয়।
-দূর বোকা মেয়ে এভাবে কাঁদে! আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আপনি। আজ তো খুশির দিন। আনন্দের দিন জমিদার বাড়িতে।

অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া বাড়ি মুহূর্তেই আলোতে ভরে উঠে। সকলের মনে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। তুলসী এই সংবাদ শোনার পর কিছুক্ষন অনেক কেঁদেছেন। সন্তান হয়না বলে পুত্রকে দ্বিতীয় বিবাহ করিয়েছিলেন অথচ আজ তাঁদের গৃহে খুশির সংবাদ তো এলো তাও আবার পুত্রের প্রথম স্ত্রী ধারাই। ছায়ার কাছে মাফও চেয়েছেন তিনি। ছায়া তাকে ক্ষমা করে দেয়। যে ভুল তিনি করেছেন এখন সে চাইলেও সেটা পরিবর্তন করতে পারবেন না। তাই অভিমান করে থাকা অনুচিত।
পরেরদিন খবর শুনে সকলে জমিদার গৃহে আসে। ছায়ার মা বাবা আসে। তাহসিয়া ইয়াশারও আসে। অনেকেই অবাক হয় উপমাকে দেখে। এই মেয়ের বিন্দুমাত্র ক্ষোপ নেই। কী সুন্দর আপন বোনের মতো ছায়ার পিছনে লেগেই থাকে। তাহসিয়ার মন ভালো হয়ে উঠলো উপমার এমন ব্যবহার দেখে। না চাওয়ার সত্ত্বেও সোহরাবকে হাসপাতালে চলে যেতে হয়েছে। উপমার ওপর ছায়ার সকল দায়-দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন সোহরাব। উপমা সেইসময় মজার ছলে বলেছিলো,
-ঠিক আছে আপার দায়িত্ব আজ থেকে আমার। নিজের প্রাণ দিবো তাও আপার কিছু হতে দেবো না। কিন্তু এর ফলস্বরূপ সন্তানের নাম আমি রাখবো। রাজি?
উপস্থিত সকলে হেসে ফেলে উপমার কথায়। সোহরাব কিছু বলবে তার পূর্বেই ছায়া বলে,
-শুধু নাম কেনো আমার সন্তানকেও তোমার নিজ সন্তান ভেবে পালতে হবে উপমা। যাই হোক আরেক মা তুমি! ভুলে যেও না।
_______________________

ছায়ার কক্ষ থেকে বের হয়ে নিজের কক্ষে যাচ্ছিলো উপমা। বারান্দায় তার ইয়াশারের সাথে দেখা হয়। মুচকি হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ইয়াশার। উপমা খুশি হয় ইয়াশারের পরিবর্তন দেখে। অতীত ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। যে ব্যক্তি অতীত ভুলতে পারে না সে কখনই জীবনে আগে বাড়তে পারে না।
তাহেরার সাথে দেখা হলে দুইজন মিলে উপমার কক্ষে যেয়ে বসে। তাহেরা তার সংসারিক বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ পারছে। তাঁদের কথার মধ্যেই কক্ষে প্রবেশ করে তাহসিয়া। তাহেরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-তাহেরা তোর স্বামী টেলিফোন করতে বলেছিলো তোকে।
তাহেরা বিরক্ত হয়ে বলল,
-পরে করবো নে। ভিতরে আসো আপা। বসো আমাদের সাথে, কথা বলো।
গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ তাহসিয়া মৃদু পায়ে এগিয়ে যেয়ে বিছানায় বসে পরে। উপমা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তাহেরা প্রসন্ন স্বরে বলল,
-আপা তুমি শহরে থাকো সেখানে কত সুদর্শন। কাউকে কী তোমার মনে ধরে না? পারো তো একজনকে আমার বোন জামাই করে দিতে!
তাহসিয়া তাহেরার পিঠে চাপর মারে। গম্ভীর স্বরে বলে,
-বিবাহের পর তোর মুখ থেকে বেশি বুলি ফুটছে। অসভ্য মেয়ে।

তাহেরা হাসতে হাসতে উপমার ওপর গড়াগড়ি খায়। তাহসিয়া আড়চোখে উপমার পানে তাকায়। শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
-আপনার কী একটুও হিংসে হচ্ছে না বড় ভাবিজানের প্রতি?
-একদমই না। সে এইসকল সুখ পাওয়ার অধিকারী। আর হিংসের কোনো কারণই আমি দেখছি না! একদিন তার সন্তান হবে একদিন আমারও হবে।
তাহসিয়া আর কিছু বলল না। তাহেরা আরো অনেক বিষয় প্রশ্ন করে উপমাকে। উপমাও সুন্দর ভাবে সবটার উত্তর দেয়। কথায় কথায় একসময় তাহেরা বলল,
-আম্মাজানের জন্য আমার ভীষণ কষ্ট লাগছে। সে এখন সুস্থ থাকলে খুশিতে গৃহের আনাচে কানাচে ঘুরতো। বড় ভাবিজানের কত যত্ন করতো!
তাহেরার কথায় তেঁতো হয়ে উঠে তাহসিয়া। রুদ্ধ শ্বাস ছেড়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
-আম্মাজানের সাথে যেটা হয়েছে সেটা সে নিজ কর্মের ফলস্বরূপ পেয়েছে।

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৮

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৮

আজ তাহেরাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। যেহেতু তাহসিয়া বিবাহের জন্য প্রস্তুত নয় তাই তাকে আর জোর করা হয়নি। আলাউদ্দিন তার এক বন্ধুর ছেলেকে পছন্দ করেছেন মেয়ের জন্য। তাই আজ মেয়েকে দেখে সমন্ধ ঠিক করে যাবেন। গৃহের কর্তিরা রসইকক্ষে রান্নার কাজে ব্যস্ত। উপমা আর ছায়া তাহেরার কক্ষে। আজ সে কী পরবে, কিভাবে কথা বলবে সব শিখিয়ে দিচ্ছে দুই ভাবি। ছায়া এখন অনেকটা সুস্থ। আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করতে পারে। নিজের যাবতীয় কাজ নিজেই করতে পারে। শুধুই ভারী কাজ করা নিষেধ।
তাঁদের কথার মাঝেই তুলিকা কক্ষে প্রবেশ করে। উপমা হাত বাড়িয়ে তার মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। দুই বছরের কী আদুরে মেয়েটি। তুলিকা আরাম করে বসে ছায়াকে বলল,
-আমার ভাই কী আজ আসবে না?
-সেটা আমরা কিভাবে বলবো আম্মাজানকে জিগ্যেস করা উচিত ছিল।
-আমার ভাইয়ের নসিবেই তোমাদের মতো দুইজন বউ জুটেছিলো! একজন তো তাকে পিতা সুখই দিতে পারলো না! আরেকজন তো ভুলেই গিয়েছে আমার ভাই যে তার স্বামী! তোমাদের স্ত্রী হিসেবে কিছু দায়িত্বও তো আছে নাকি।

ছায়ার মুখ ছোট হয়ে যায়। উপমা তুলিকার কথা উপেক্ষা করে তুলিকার মেয়েকে নিয়ে খেলতে থাকে। তুলিকার রাগ হলো উপমার ওপর। রুক্ষ স্বরে বলল,
-তা উপমা আমার ভাই কী তোমার সাথে রাত কাটায় না? বিবাহের বেশ দিন তো হয়ে যাচ্ছে এবার সুসংবাদটাও শুনিও।
-ভাই ভাবীর গোপন কথা জানতে চান বড় বোন হিসেবে আপনার একটুও সরম করলো না বড় আপা?
থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো তুলিকা। ছায়া মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। তুলিকা রাগ দেখিয়ে নিজের মেয়েকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। ছায়া আর উপমা শব্দ করে হেসে উঠলো।

ছেলে পক্ষ আসার আগেই সোহরাব বাসায় আসে। জামাকাপড় পরিবর্তন করে নিচে নেমে আসে। ছায়া দোতালায় দাঁড়িয়ে নতুন প্রেমে পরা নাবালিকার মতো তাকিয়ে থাকে। সোহরাব হাতের আধুনিক ঘড়িতে সময় দেখে সদর দ্বারের পানে তাকায়। হটাৎ কী মনে করে তার দৃষ্টি যায় দোতালার বারান্দায়। চোখাচোখি হয়ে যায় দুইজনের। সাদা ব্লাউজ দিয়ে হাল্কা গোলাপি রঙের শাড়ী পরেছে ছায়া। অনেক বেশি শ্রী লাগছে তাকে। লাজেরাঙা হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে ছায়া। মৃদু হাসলো সোহরাব।

চেঁচামেচি করতে করতে দৌড়ে আসে ইয়ামিন। সোহরাবের পিছনে লুকিয়ে দুষ্টামি কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান ভাইজান আমাকে বাঁচান ভাবিজান থেকে।
ইয়ামিনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই তার পিছু পিছু ছুটে আসে উপমা। পরিহিত লাল শাড়ী ঘোমটা ধরে রেখেছে একহাত দিয়ে। তার কোলে তুলিকার মেয়ে তন্দ্রা। খুশিতে হাতে তালি দিয়ে খেলছে সে। উপমা সোহরাবকে খেয়াল করে না। ইয়ামিনকে ধরতে উদ্যত হবে তখনই সোহরাব ইয়ামিনকে নিজের কোলে তুলে নেয়। উপমা সোহরাবকে দেখে দু কদম পিছিয়ে যায়। মুখের হাসি নিভে যায়। ইয়ামিন সোহরাবের কোলে বসে ভেংচি কেটে বলল,
-এখন আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। তুমিও পারবে না ছোট ভাবিজান।
-ভাই আমার এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন কেনো? যদি পরে ব্যাথা পেতেন তাহলে আমাদের কী হতো!
প্রশ্ন করে সোহরাব। ইয়ামিন দুঃখিত স্বরে বলল,
-দুঃখিত ভাইজান। আর করবো না।
-এইতো আমার লক্ষী ভাই।
ইয়ামিনের গালে চুমু দিয়ে নিচে নামিয়ে দেয় তাকে। উপমা চলে যেতে নেবে তখন সোহরাব বলে উঠলো,
-মেহমান যাওয়ার পর আপনার সাথে আমার কথা আছে। আমার কক্ষে আসবেন।
_______________________

ছেলে পক্ষ আসলো। সযত্নে তাঁদের গৃহে নিয়ে আসা হলো। খাতিরযত্নে কোনো কমতি রাখলো না। উপমা ছায়া কেউই তাঁদের সামনে গেলো না। তাহেরাকে নিচে আনা হলো। বেশ পছন্দ হলো তাঁদের মেয়েকে। ঠিক হলো আজ থেকে আটদিন পর ঘরোয়া ভাবে বিবাহ পড়ানো হবে তাঁদের। বেশি মানুষকে আমন্ত্রণ করা হবে না। পারিবারিক ভাবেই অনুষ্ঠিত হবে। দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলো মেহমান।
উপমা নিজ কক্ষে শুয়ে ছিল। একজন ভৃত্য এসে তাকে বলল সোহরাব তাকে নিজ কামরায় ডেকেছে। বিছানা থেকে উঠে শাড়ী ঠিক করে দাঁড়ালো উপমা। মনকে কঠিন্য করে সোহরাবের কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। দরজার সামনে এসে ভিতরে প্রবেশ করতে তার মন উস্কখুস্ক করতে থাকে। মৃদু ঠোকা দিতেই ভিতর থেকে সোহরাবের ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেলো।
-ভিতরে আসুন।

উপমা মাথা নত করে ভিতরে ঢুকে। আগের থেকেই ছায়া আর সোহরাব উপস্থিত ছিল কক্ষে। নিজেকে অপ্রস্তুত মনে হলো উপমার। দু পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
-আমাকে ডেকেছিলেন?
-হ্যাঁ।
সোহরাব একবার ছায়া তো একবার উপমার পানে তাকায়। প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর স্বরে বলল,
-আমার হতবুদ্ধির কারণে আজ আপনি আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে পরেছেন। এখন আপনার নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবনও আছে। আমি যাচ্ছি না আমার জন্য আপনার ভবিষ্যত নষ্ট হোক। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন আপনার ইচ্ছা জানতে চাই আমি।
উপমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ছায়া ভীত দৃষ্টিতে উপমার দিকে তাকিয়ে আছে। সোহরাব পুনরায় বলল,
-আমি আপনাকে তালাক দিতে চাচ্ছি। তালাকের পর আপনি কোথায় থাকবেন, আপনি পড়াশোনা করবেন নাকি আরেকটা বিবাহ করবেন সবকিছু নিজ দায়িত্বে আমি সম্পূর্ণ করবো সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। এখন আপনি কী চাচ্ছেন?
উপমা মাথা নত রেখেই শান্ত স্বরে বলল,
-আমার মা আমাকে বহু বিবাহ অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের শিক্ষা দেয়নি। আপনাকে বিবাহের পূর্বেই আমি জেনেছি আপনার প্রথম স্ত্রী আছেন। সবটা জেনেই বিবাহে আবদ্ধ হয়েছি আমি। আমার তালাক চাই না। আব্বাজান যেভাবে তার দুই সহধর্মিনীকে সমান অধিকার দিয়ে থাকছেন আপনিও সেটাই করতে পারেন। তাছাড়াও আপা আপনার প্রথম স্ত্রী। তাকে একটু বেশি মর্যাদা দেওয়া হবেই আমার তাতে কোনোরূপ অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি তালাক চাই না।

উপমার কথায় মনে মনে প্রসন্ন হলো ছায়া। সে এই উত্তরই আশা করেছিল উপমার থেকে। সোহরাব কিঞ্চিৎ অবাক স্বরে বলল,
-আপনি সবটা জেনে শুনে বলছেন তো উপমা।
-অবশ্যই। তবে একটা কথা, আমি আপনার প্রথম স্ত্রীর মতো ততো ভালো আর চাপা স্বভাবের মেয়ে নই। কাজ কাজের জায়গায় স্ত্রী স্ত্রীর জায়গায়। স্ত্রীদের স্ত্রীয় অধিকার থেকে আপনি বঞ্চিত করতে পারবেন না। এটা মাথায় রাখবেন।
থমথমে উপমার সবটা কথা শুনলো সোহরাব। এই মেয়ের কাজের সাথে কথাও ধারালো। মনে মনে ভাবলো সে। উপমার কথায় তাল মিলিয়ে ছায়াও বলল,
-জমিদারদের দুইটা তিনটা স্ত্রী হবেই কিন্ত তাঁদের সবাইকে সমান অধিকার দিতে হয়। উপমাকে নিয়ে আমারও কোনো অসুবিধা নেই। বরং আমার মন বলছে আমার শেষ জীবনে উপমাকেই আমার ভীষণ প্রয়োজন হবে!
-ঠিক আছে। আপনাদের কথাই রইলো। আমি যেহেতু আজই শহরে ফিরে যাবো তাই আপনার মনের কথা জেনে নিলাম উপমা। এখন তাহলে আসতে পারেন।
উপমা আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো।

বিকাল থেকে কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হয়েছে। আশেপাশে গাছগাছালি ভয়ংকর ভাবে নড়ছে বাতাসে।দূর থেকে দেখলে মনে হবে আরেকটু হলেই বিশাল গাছগুলো ভেঙে পরবে। বিছানায় বসে দোয়াদুরুত পড়ছিলো তুলসী। আলাউদ্দিন কক্ষে প্রবেশ করে চিন্তিত হয়ে কিছু একটা খুঁজে চলছে। তুলসী আড়চোখে তাকিয়ে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে,
-কিছু খুঁজছেন?
-না। তুমি তোমার কাজ করো আমার কাজে নাক গলাতে এসো না।
-আমাকে বলুন আমি খুঁজে দেই।
রেগে যায় আলাউদ্দিন। চাঁপা স্বরে গর্জন করে বলল,
-মহিলা মানুষদের পুরুষের কাজে বা হাত না ঢুকালে হয় না নাকি! নিজের কাজ করো তুমি।
বিরক্তে মুখ বাঁকায় তুলসী স্বামীর এইসব বাণী তার নিত্যদিনের অভ্যাস এখন। তাই গায়ে লাগতে না দিয়ে আবারও বলল,
-তাহেরাকে বিবাহ দিচ্ছেন আপনার বন্ধুর ছেলের সাথে। যদি সে পুত্রও আপনার মতো হয় তাহলে যে আমার মেয়েটার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হয়ে আলাউদ্দিন তুলসীর দু’গাল চেপে ধরে নিজের বলিষ্ঠ হাত ধারা। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
-তোর মতো ছোটোলোক রে বিবাহ করে আমি কোনো বা’লটাও পাইনি সেখানে তোর মেয়ের রাজ কপাল আমার বন্ধুর ছেলের বউ হবে। আর যখন বিপদে পরি তখন আমার এই গোয়েন্দা বন্ধুই আমার কাজে আসেন। যদি তার সাথে আত্মীয় সম্পর্ক হয়ে যায় তাহলে আমার আর চিন্তাই নাই।
-ঐরকম দুর্নীতি কাজ করবেনই কেনো বিপদে পরবেনই বা কেনো? নিজ স্বার্থের জন্য আমার মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট করিয়েন না। পায়ে ধরি আপনের।
-মা”গীর জীর মুখ এখন বেশি চলছে দেখছি!কে রে পুত্রকে দুইটা বিবাহ করে, গৃহে দুইটা বউ এনে সাহস বেড়ে গিয়েছে নাকি?
তুলসী আর কিছু বলতে পারলো না। কারণ সে জানে বেশিকিছু বলতে গেলেই জুলুম শুরু। আলাউদ্দিন ছেড়ে দেয় তুলসীকে। পাঞ্জাবী ঠিক করে বলল,
-তোর যোগ্য স্থান হলো আমার পায়ের তলানিতে সেটা ভুলে যাস না। মুখে মুখে তর্ক করবি একদম মুখ ভেঙে দেবো।
_______________________
প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সোহরাব আর শহরে যেতে পারেনি। রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় বসে মনোযোগ দিয়ে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো সে। সোহরাব খাওয়া শেষে কক্ষে আসার পূর্বে ছায়াকে বলেছিলো তার জন্য একটু আদার চা করে নিয়ে আসতে। এই প্রথম সোহরাব তার কাছে কিছু আবদার করলো। মনের মাধুর্য মিশিয়ে চা তৈরি করে নিয়ে আসেন ছায়া। মনের ভুলে সোহরাবের বিনা অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ফেলে সে। সোহরাব কাগজ থেকে মুখ তুলে ছায়ার পানে তাকায়। ছায়া এগিয়ে এসে নিম্ন স্বরে বলল,
-ক্ষমা করবেন অনুমতি না নিয়েই এসে পরলাম।
-অসুবিধা নেই।
চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে ছায়া বলল,
-আপনার চা।
সোহরাব কাপটা নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। ছায়া না দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সোহরাব নরম গলায় বলল,
-যদি আপত্তি না থাকে কিছুসময় আমার সাথে কাটাতে পারেন।
বুক ধকধক করে উঠলো ছায়ার। এলোমেলো হয়ে গেলো মস্তিক। নিজের আত্মসম্মানকে কিনারে রেখে বিছানার একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে পরলো। হাত পা তিরতির করে কাঁপছে ছায়ার যেটা সোহরাব ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে। হাতের কাগজ দেখিয়ে বলে,
-আমার একটা রোগীর ক্যান্সার ধরা পরেছিল। তাকে পরীক্ষা করতে বলেছিলাম এটা তারই ফলাফল।
ছায়া নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না। তার একবার সরমে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে, নিজের আত্মসম্মানের কথা ভেবে এখানে থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আবার সোহরাব তাকে কেনো এতো উপেক্ষা করে সেটা ভেবে সোহরাবকে ইচ্ছে মতো মারতেও মন চাচ্ছে। মনের সকল ভাবনা মনেই রেখে কাঁপাকাঁপি কণ্ঠে বলল,
-ওহ! আপনি কী মেয়ে মানুষেরও চিকিৎসা করেন?
-একজন ডাক্তারের কাছে কোনো নর-নারী নেই। সকলেই শুধুমাত্র রোগী।
-বুঝলাম। একজন ডাক্তার হওয়ার জন্যে তো আপনাকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। কিভাবে এতো পড়াশোনা করলেন? আমার তো পড়াশোনার প শুনলেও বিরক্ত লাগতো।
ছায়ার প্রশ্নে শব্দ করে হেসে ফেলে সোহরাব। ছায়ার নিজেকে বেকুব বলে মনে হলো। কিন্তু যখনই সোহরাবের স্বচ্ছ হাসিতে নজর পরলো মুগ্ধতায় ভরে উঠলো তার মন। বেহায়া চিত্ত ভিতর থেকে বলে উঠলো, “এই হাসি মিশ্রিত মুখটি দেখতে দেখতেই যেনো আমার জীবন শেষ হয়ে যায়।”
সোহরাব কোনোরকম হাসি থামিয়ে স্থির হয়ে বসে। মুখে গম্ভীর্যতা এনে বলল,
-আমার ছোটকাল থেকেই পড়াশোনার প্রতি এক অন্যরকম ভালোবাসা। আমার অনেক বেশি প্রিয় এক ব্যক্তির স্বপ্ন ছিল আমাকে তার মতোই ডাক্তার বানাবে। অতঃপর বড় হলাম তার স্বপ্ন পূরণই হয়ে উঠলো আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভালো লাগে আমার অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা দিতে।
-বাহ্! কে ছিল সেই প্রিয় ব্যক্তি?
-ছিলেন, ছিল আজীবন আমার মনে সে থাকবে।
ছায়া ভাবুক হয়ে বলল,
-ওহ আচ্ছা।
-জী। আপনিও যে এইরকম নির্বোধ প্রশ্ন করতে পারেন আমার ভাবনার বাহিরে ছিল!
ছায়া একটু লজ্জা পেলো। মনে মনে বলল,”আপনার এই অমায়িক হাসির জন্য আমি শতবার নির্বোধ হতেও রাজি অপ্রিয় জনাব। দুঃখিত আমার প্রিয় জনাব যে কখনই আমার অপ্রিয় হতেই পারে না। ”

সোহরাব আড়চোখে তাকালো ছায়ার পানে। কথার ফাঁকে অজান্তেই তার বার বার দৃষ্টিপাত হচ্ছে ছায়ার সাথে। মনে এক অস্থিরতা কাজ করছে। সব কিছুর উর্ধে সেও তো একজন পুরুষ। নিদিষ্ট একটা চাহিদা তো তারও আছে। কতকাল নিজের পুরুষত্বকে দমিয়ে রাখবে সে।
সোহরাবের বেসামাল দৃষ্টি দেখে গলা শুকিয়ে যায় ছায়ার। বেশিক্ষন সেই দৃষ্টির পানে তাকিয়ে থাকলে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বসবে সে। কম্পিত কণ্ঠে ছায়া বলল,
-আমি তাহলে এখন আসি।
ছায়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনে এক পা বাড়াবে পিছন থেকে সোহরাব তার একহাত চেপে ধরে। ছায়া বড় বড় নিঃশাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। পিছনে না ফিরেই ভয়াত কণ্ঠে বলল,
-আটকাবেন না আমাকে। আর বেশিক্ষন থাকলেই যে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।
-স্বামীর সনিকটে আসায় যদি সর্বনাশ হয় তাহলে একটু সর্বনাশ নাহয় করলেন।

আজ আর ছায়া পারলো না সোহরাবকে ফিরিয়ে দিতে। বেহায়া মন হার মেনে নিলো। এক পা ও নড়লো না জায়গা থেকে। অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে এভাবে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি ছায়া। বাহিরে ঝড়ের ভয়ংকর তান্ডব ভিতরে দু নর-নারীর নিঃশাসের। এক পর্যায় চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরলো ছায়ার। এতো দুঃখের পরও এই সুখটুকু যে তার নসিব হয়েছে এতেই সে নিজেকে ভাগ্যবতী বলে গণ্য করছে।
_______________________
অন্যদিকে রাত্রির আঁধারে বড় ঘোমটা দিয়ে বের হয়েছে উপমা। তার উদ্দেশ্যে সেই বদ্ধ কক্ষ। ভারী পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঙ্ক্ষিত কক্ষের দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে একটি চাবির গুচ্ছ। তুলসীর শাড়ীর আঁচল থেকে অতি কৌশলে চাবিরগুচ্ছ চুরি করেছিলেন তিনি। একে একে সবকয়টা চাবি দিয়ে তালা খোলার প্রয়াস করতে থাকে। বারান্দায় শেষ কিনারে বিশাল বড় একটি জানালা। বাহিরে ঝড়োয়া বাতাস, বজ্রপাত হচ্ছে। চারদিক আলোকিত করে বিজলি চমকাচ্ছে। একসময় একটি চাবি দিয়ে খুলে যায় তালা। চমৎকার হাসি ফুটে উঠে উপমার মুখে। যেই চাবি ধারা তালা খুলেছে সেটা শব্দ করে চুমু দেয়। অনেক বছর ধরে দরজা লাগিয়ে রাখার ফলস্বরূপ খোলার সময় অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতেই শব্দ করে খুলে যায় দরজা। ধুলোবালিতে কেশে উঠে উপমা। আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে সামনে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই নজরে পরলো না তার। মনের কোনে অজানা ভয়ও করছে তার। হাতে করে একটা মোম আর দিয়াশলাই নিয়ে এসেছিলো সে। খানিকটা সময় নিয়ে মোম ধরিয়ে মৃদু আলোয় ভিতরে পা রাখে। কেমন এক গন্ধ উপমার নাকে এসে বারি খেলো। জঘন্য গন্ধ! মোমের ক্ষীণ আলোয় উপমা স্পষ্ট দেখতে পেলো সোহরাবের কক্ষের মতোই এই কক্ষ। কক্ষের প্রত্যেকটি রাজকীয় আসবাবপত্রের ওপর ধুলো জমে আছে। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলো। পুরো কক্ষে নজর বুলাতে যেয়ে তার আঁখিজোড়া আটকে যায় দুইটি দেয়ালচিত্রে। কম্পিত পা’জোড়া এগিয়ে নিয়ে যায় সেদিকে। প্রথম চিত্রে দেখা যাচ্ছে অনেক সদস্য নিয়ে একটা পারিবারিক ছবি। এতগুলো মুখের মধ্যে কয়েকটা মুখ উপমার কাছে চেনা মনে হলো। আলাউদ্দিন, তার ছোটভাই আর তুলসী এই তিনজনকে। ছবিটা যেসময় তোলা হয়েছে সেইসময় তারা বয়স্ক ছিলেন না মধ্যম ছিলেন। নিচে দাঁড়ানো পাঁচজন বাচ্চাকে দেখতে পেলো উপমা। তিনজন মেয়ে দুইজন ছেলে। একজন মেয়ে সবার বড় তারপর দুই ছেলে বাকি দুই মেয়ে একই সমান। উপমা হাত বাড়িয়ে চিত্রে উপস্থিত একজনকে স্পর্শ করলো। আঙুল ধুলোয় মেখে যায় তার। ওষ্ঠজোড়া থেমে থেমে কাঁপছে। কখন যে উপমার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত শুরু হয়েছে সে নিজেও জানে না।
পাশ ফিরে দ্বিতীয় চিত্রে চোখ বুলায়। একটি সুখী পরিবার দেখতে পায় সে। স্বামী স্ত্রী আর তাঁদের দুই সন্তান। নিজেকে শক্ত রাখতে পারলো না উপমা। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে বড় নিঃশাস নেয়।কক্ষের সাথে লাগানো একটি ছোট বারান্দাও আছে উপমার জানা মতে। মোমের আলোয় ধীর পায়ে আগে বাড়তে নিবে আচমকা পিছন থেকে এক হাত তার মুখ চেপে ধরে। উপমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। কৌশলে নিজ পা ব্যবহার করে লোকটার পায়ে লাত্থি দেয়। উপমাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে যায় লোকটা। মোম ততক্ষনে জমিনে পরে নিভে গিয়েছে। অজ্ঞাত লোকটা পুনরায় এগিয়ে এসে উপমার গলা চেপে ধরে নিজের দুই হাত দিয়ে। মাথার ঘোমটা সরে যায় উপমার। জানালা দিয়ে আসা বজ্রপাতের ক্ষীণ আলোয় উপমা দেখতে পায় সামনের জন আর কেউ নয় আলাউদ্দিনের ছোট ভাই সালাউদ্দিন।

মুহূর্তেই উপমা হিংস্র হয়ে উঠলো। শাড়ী ধরে পা দিয়ে লাত্থি দিলো সালাউদ্দিনের বুক বরাবর। ছিটকে পরে যায় সালাউদ্দিন। উপমার হিংস্র রূপ দেখে তার চোখে ভেসে উঠে অতীতের কিছু চিত্র। সেই হিংস্র চাহনি, সেই তেজি মুখশ্রী! অন্ধকারে হাতিয়ে আক্রমণ করার জন্য কিছু খুঁজতে থাকে উপমা। সালাউদ্দিন হো হো করে হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে বিকৃত মুখে চেঁচিয়ে বলে,
-মা”গী তোরে আমি ঐদিন কইছি না আমাগো বাড়ির ঝামেল্লা থেকা দূরে থাকবি!এতো বড় কলিজা কে তোর? মরার ভয় নাই তোর মনে?
-মরার ভয় তো আপনার নেই দেখছি!সেদিন রাত্রে আমি বলেছিলাম আমার বিষয় কিছু জানার চেষ্টা করবেন না। যেইদিন আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন সেদিনই আমার হাতে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত।
সালাউদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উপমার চুলের মুঠি চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে বলল,
-বে”শ্যা মা”গীর জী কী ভাবছিলি তুই লুকাইয়া জমিদার গৃহে ঢুকবি আমরা কেউ তোরে চিনুম না। আমি জাইন্না গেছি তুই কে! এখনই আমি ভাইজানরে যাইয়া কইয়া দিমু। সোহরাবরে বানাইয়া কমু তুই আমাগো শত্রুর দলের মানুষ। তারপর দেখবি ওরা তোরে কী করে।
উপমা হাসলো। ভয়ংকর শব্দে করে হাসলো। জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো সালাউদ্দিনকে। একজন মহিলার মধ্যে এতো শক্তি কিভাবে আসলো!ভীত হয়ে পরলো সালাউদ্দিন তবুও প্রকাশ করলো না। অসুরের শক্তি অনুভব করলো উপমা নিজের মধ্যে। বিজলি চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সেই আলোয় উপমা কক্ষের খোলা বারান্দায় চলে গেলো দৌড়ে। মনে মনে ভয়ংকর খেলায় মেতেছে সে। সালাউদ্দিন উপমাকে ধরতে তার পিছু পিছু যায়। বারান্দায় কোনো ঘেরাও নেই। এখান থেকে ঠিক নিচে মাটির ভূমি।গাছপালা দিয়ে ভরা। সালাউদ্দিন তেড়ে এসে বলতে থাকে,
-মায়ের মতো হুদাই নিজের কষ্ট বারাইস না। ভাইজান তোকে ছাড়বে না।
উপমা কিছুই বলল। পাশেই একটা কাঠের তৈরি চেয়ার রাখা ছিল। সালাউদ্দিন তার নিকট আসতেই কিঞ্চিৎ সময়ের মধ্যে হিংস্রতায় গর্জে চেয়ার তুলে সেটা দিয়ে বারি মারে সালাউদ্দিনের মাথায়। নিজের মনের রাগ, শরীরের বল প্রয়োগ করে আঘাত করায় সালাউদ্দিন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো না। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে অসাবধানতায় বারান্দা দিয়ে নিচে পরে যায়।

বৃষ্টির তেজ আরো বেড়ে গেলো। উপমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো কয়েক ফোঁটা। পলকহীন নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো উপমা। পৌঁশাচিক আনন্দ অনুভব করলো সে। অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে শুধু দানব আকৃতির গাছগুলো ছাড়া। এলোমেলো কোঁকড়ানো কেশ পিঠ বুকে এসে ছড়িয়ে পরছে। আঁচল নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাওয়ায় ধুলছে কেশরাশি। বিধ্বস্ত উপমাকে এখন যে কেউ দেখলেই ভয় পেয়ে যাবে। সর্বাক্ষণ মাথায় ঘোমটা পরা কোমল নারীর এইরকম বীভৎস রূপও হয় সেটা ভাবার বাহিরে! বর্ষণের সাথে তাল মিলিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো উপমা।
-আম্মা।
অঝোরে কেঁদে উঠলো সে। বর্ষণের শব্দে ক্রন্দনধ্বনি চাঁপা পরে গেলো। বিড়বিড় করে উপমা বলল,
-যে প্রতিশোধের আগুনে আমি দিনরাত পুড়ছি সেই আগুনে একে একে সবাইকে পোড়াবো আমি। আজ থেকে শুরু হলো আমার র’ক্তের খেলা। নির্বোধ সালাউদ্দিন মির্জা! এই হাত কত শয়তানের প্রাণ নিয়েছে আর তুমি এসেছিলে এই আমি কে মারতে! তুমি তোমার পাপের শাস্তি পেয়ে গিয়েছো এবার তোমার আপনজনদের পালা। হুমাশা যে পর্যন্ত নিজে না চাইবে সে পর্যন্ত কারো সাধ্য নেই তার পরিচয় জানার।

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৭

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৭

পড়ন্ত বিকেলে পুকুরপাড়ের ঘাটে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে উপমা। শুধু বসে আছে বললে ভুল হবে মাটিতে কিছু একটা আঁকিবুকি করছে। যেখানে সবাই বৈঠকখানায় বসে আলাপ করছে সেখানে উপমা এখানে এসে বসে আছে। তার বিরক্ত, অস্বস্থি লাগে সকলের সাথে। কিছুক্ষন আগেই তার সোহরাবের সাথে দেখা হয়েছিল। সন্দীহ নজরে তাকিয়ে সোহরাব তাকে প্রশ্ন করে,
-মেয়ে কে আপনি? কোন উদ্দেশ্যে জমিদার গৃহে পা রেখেছেন?
বক্ষপিঞ্জরা কেঁপে উঠে অজানা ভয়ে। মিনমিনে স্বরে উপমা জবাব দেয়,
-আমি উপমা। আর কোনো পরিচয় নেই আমার।
-গ্রামের কোনো সাধারণ মেয়ে পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে মারপিট করতে পারে না আমার জানা মতে!
-এটা আপনার ভুল ধারণা। মেয়েরা শুধু মার খাওয়ার জন্য জন্ম হয়নি দেওয়ার জন্যেও হয়েছে।
-তা এতো তেজি, আত্মনির্ভরশীল মেয়ে নিজের আত্মরক্ষার কথা ভেবে একজন বিবাহিত পুরুষকে বিবাহ করতে রাজি হয়ে গেলো! বিষয়টা কেমন জটিল হয়ে গেলো না!

বুকে হাত গুঁজে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে কথাটা বলল সোহরাব। মুখে রসিকতা ভাব যেনো। উপমা চোরা চোখে তাকিয়ে বলে,
-আপনার কোনোভাবে আমার ওপর সন্দেহ হচ্ছে সেটা বললেই তো পারেন।
-সন্দেহ হতে পারে না কী? আমাদের তো শত্রুর অভাব নেই। হতেও পারে আপনি তাঁদের মধ্যে কারো গুপ্তচর!
-আমি আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না!
কিঞ্চিৎ বিস্ময় চোখে তাকালো উপমা। সোহরাব আর কিছু বলল না। পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ধপ করে নিঃশাস নিলো উপমা। এই মানুষটাকে ভীষণ ভয় করে তার। মুখে কেমন যেনো গম্ভীর্যতা! যখনই সামনে থাকে তখনই উপমার মনে হয় এই বুঝি ধরা পরে গেলো।

গৃহের ভিতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে উঠে দাঁড়ায় উপমা। শাড়ী ঠিক করে মাথায় বড় একটি ঘোমটা দিয়ে গৃহের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

-আপনাকে আমি আমার জন্য ভাবা অথবা আমার জীবনের কোনো বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার দেইনি মনে রাখবেন।
গৃহের ভিতরে পা রাখতেই তাহসিয়ার মুখে উক্ত বাক্যটি শুনতে পায় উপমা। বৈঠকখানায় উপস্থিত আলাউদ্দিন, তুলসী, মিনা, তরনা, তাহেরা, তুলিকা। উপমা দু পা এগিয়ে যায়। তাহসিয়া রাগে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরেছে। আলাউদ্দিন তার কথার পাল্টা জবাবে বলেন,
-মুখ বন্ধ করো তাহসিয়া। তুমি ভুলে যেয়েও না আমি তোমার পিতা।
-আপনাকে আমি কখনই পিতা রূপে দেখি না। আপনি কারো পিতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে তাহসিয়া। তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আলাউদ্দিন ক্রোধে উঁচু স্বরে বলল,
-দিন দিন বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছ তুমি। এই একটা কারণেই আমি তোমাকে শহরে পাঠাতে চাইনি। ছোট বোনের বয়স হয়ে যাচ্ছে তারও তো বিবাহ দিতে হবে। কেনো বিবাহের জন্য রাজি হচ্ছ না তুমি?
-কী চাচ্ছেন আপনি? আপনার মতো আমরাও দুইটা তিনটা বিবাহ করে আপনার মুখ উজ্জ্বল করি?
তুলসী মৃদু কেঁপে উঠলো মেয়ের কথা শুনে। সে জানতো তাহসিয়াকে বিবাহের কথা বললে সে এটাই বলবে। আলাউদ্দিন ফোঁস করে নিঃশাস নেয়। কিছু বলতে যাবে সেইসময় সিঁড়ি বেয়ে আসতে সোহরাবকে দেখতে পায়। সোহরাব শান্ত স্বরে সবটা পরোক্ষ করে বলল,
-তাহসিয়া যেহেতু বিবাহের প্রতি ইচ্ছুক না তাই তাকে জোর করবেন না। জোর করে সবকিছু হয় না আব্বাজান।

তাহসিয়া স্থান ত্যাগ করলো সেই মুহূর্তে। আলাউদ্দিনও সদর দ্বার দিয়ে বাহিরে চলে গেলো। সোহরাব বোনের পিছু পিছু চলে যায়। উপমা সবটা দেখে নিজ কক্ষে যেতে নিবে সেইসময় তাহেরা বলল,
-ছোট ভাবিজান বড় ভাবিজান আপনাকে ডেকেছিল।
-ঠিক আছে।
উপমা নরম পায়ে হেঁটে ছায়ার কক্ষের স্মুখীন এসে দাঁড়ায়। ভিতরে প্রবেশ করার আগেই ছায়া অস্থির হয়ে জিগ্যেস করে উঠলো,
-এইরকম চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো কেনো উপমা?
উপমা এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। শান্ত ভনিতায় বলল,
-তাহসিয়া আপা আর আব্বাজানের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিলো।
-ওহ! এটা আর নতুন নয়।
-আচ্ছা আপা তাহসিয়া আপা এইরকম কেনো? তার কী পূর্বে বিবাহ হয়েছিলো?

ছায়া এদিকসেদিক তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে। উপমার প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ বলল,
-হ্যাঁ, ওর আগে বিবাহ হয়েছিলো। আমি আর তাহসিয়া সই ছিলাম ছোটকাল থেকে। তাহসিয়া ভীষণ পড়ুয়া ছিল। বয়স যখন সতেরো তখন জোর খাঁটিয়ে বিবাহের পিঁড়িতে বসানো হয় তাকে। ওর স্বামী ভালো ছিল না। লোভে পরে বিবাহ করে তাহসিয়াকে। তারপর দিনের পর দিন তার ওপর অত্যাচার করে, জুলুম করে। জেদের কারণে এই বাসায়ও আসতো না। একদিন তাহসিয়া ফাঁ’সি দেওয়ার প্রয়াস করে কিন্তু পারে না তার শশুর দেখে আটকে ফেলে। সেইদিনের পর থেকে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরে সে। উনি যখন গ্রামে আসেন সবটা জানতে পেরে তাহসিয়াকে নিয়ে আসেন। আব্বাজান তাহসিয়াকে অনেক বকাঝকা করেন স্বামীর বাসা থেকে চলে আসার জন্য। সোহরাব রাগে সেইসময় বোনকে নিজের সাথে করে শহরে নিয়ে যান। আর তার বাকি পড়াশোনা শেষ করতে সাহায্য করেন।

সবটা শুনে স্তব উপমা। বাবারা এমনও হয়! কই তার বাবা তো আপন বাবা ছিল না তবুও তাকে কত ভালোবাসা দিয়েছিলো! উপমার মুখ ভঙ্গি দেখে ছায়া গম্ভীর স্বরে বলল,
-জমিদাররা তাঁদের প্রজাদের জন্য যত ভালো বাহ্যিক রূপে সাজেন তাঁদের ভিতরের রূপ ঠিক ততই কুৎসিত থাকে। তাঁদের কথায় গলে যাওয়া মানে নিজের সর্বনাশ নিজেই করা।
উপমা কিছু বলল না। ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে রইলো। ছায়া কথায় ফোড়ন কেটে স্মিত হেসে বলল,
-যাক গে তুমি এত কিছু মস্তিকে নিও না। নিজেকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করো।
-জি আপা।
উপমা উঠে চলে যেতে উদ্যত হতেই ছায়া পুনরায় চোরা চোখে তাকিয়ে বলল,
-উনি তোমাকে সন্দেহ করছে উপমা! তালাক দেওয়ার কথাও বলেছিলো।
উপমা পিছনে ফিরে হাসলো। হাসিটা ছিল কিছুটা রহস্যময় এবং তীক্ষ্ণ।
-সেটা আমিও বুঝতে পেরেছি আপা। আপনার উনিটা দেখতে বোকাসোজা মনে হলেও উনি ভীষণ চতুর।
-সাবধানে থেকো।
_________________________
চেয়ারের ওপর মোম বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে বই পড়ছিলো ছায়া। সারাদিন শুয়ে থাকার ফলস্বরূপ রাত্রি তার ঘুমের নামমাত্র নেই। রাতে মোম জ্বালিয়ে বই পড়া তার অন্যতম প্রিয় এক অভ্যাস। সহসা লাগানো আধখোলা দরজা সম্পূর্ণ খুলে যাওয়াতে বিস্মিত দৃষ্টি সেদিকে নিবন্ধ করে। ছায়াকে অবাক করে দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে সোহরাব। মোমের ক্ষীণ আলোয় ছায়া গোলগোল আঁখিজোড়া দিয়ে সোহরাবের নত মুখশ্রী দেখতে থাকে। মনে মনে বলে উঠলো,
-এতো মায়া কেনো ঐ শ্যামবর্ণ পুরুষের মুখে!

সোহরাব ভিতরে প্রবেশ করে পাঞ্জাবীর বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে দেয় ছায়ার নিকট। ছায়া প্রশ্নবোধক দৃষ্টি একবার সোহরাব তো একবার কাগজটার দিকে যাচ্ছে। সোহরাব বিষয়টা লক্ষ্য করে বলল,
-নিন এটা।
-কিসের কাগজ?
-উপমা নামক বহুরূপী নারীর বাসা থেকে এই কাগজটা আমি পেয়েছিলাম।
ছায়া কিছু না বলে কাগজটা এক প্রকার কেড়ে নেয়। খুলতে যাবে তার পূর্বেই সোহরাব রুক্ষ হেসে বলল,
-উনি নিজেকে চালাক ভাবেন। জমিদার গৃহে পর মানুষদের প্রবেশ করা নিষিদ্ধ বলে একবারে নিজের পরিচয় লুকিয়ে জমিদারের পুত্রের স্ত্রী রূপে প্রবেশ করলেন! বেশ বেপারটা!

ছায়া কিছু বলা প্রয়োজন বলে মনে করলো না। কাগজটা খুলে মোমের আলোর স্মুখীন ধরলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলেন গোল গোল আকৃতি করে জমিদার বাড়ির সকল সদস্যের নাম লেখা। মধ্যে সোহরাবের নাম বড় করে চিহ্নিত করা। কয়েকজনের নামের ওপর আবার লাল কালি দিয়ে বৃত্ত ভরাট করা।
ছায়া শুকনো ঢোক গিললো। সোহরাবের গম্ভীর চাহনি ছায়ার ওপর নিবদ্ধ। মেয়েটাকে কখনই এতো কাছে থেকে দেখা হয়নি তার। হাসপাতালে কিছুদিন একসাথে থাকায় কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিয়ের পর কখনই সে গ্রামে তিনদিন কী চারদিনের বেশি থাকেনি। ছায়ার সাথে সময় কাটানোও হয়ে উঠেনি। তবে কী অনেকদিন একজনের সাথে থাকলে তার মায়ায় পরে যেতে হয়! তাহলে কেনো এই বিবাহের এতো বছরে একবারও প্রয়াস করলো না সম্পর্কটা ঠিক করার? সে পুরুষ সে তো সব কিছুই জোর করে করতে পারে। তবে জোর করে কী ছায়ার মন পেতো!ছায়া যে তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না! কথাগুলো ভাবলো সোহরাব!

বিবাহের পর থেকেই সোহরাব উপমার ওপর নজরদারি করছেন। কোনো একটা বিশেষ কারণে মেয়েটা তার মস্তিকে চেপে বসেছিল। তার উপমাকে সন্দেহ হয় তাইতো বিশেষভাবে খেয়ালে রাখেন তাকে।

ছায়া কেমন ভীত নজরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহরাব আরেকটু এগিয়ে আসলো। ছায়ার থুতনি ধরে মাথা ওপরে তুললো। অসুস্থ থাকায় কিছুটা মলিন মুখশ্রী। সোহরাবকে দেখে আঁতকে উঠলো ছায়া। কেমন শব্দহীন ভয়ংকর হাসি! সোহরাব ছায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-নিজেকে এতোটাও ভালো প্রকাশ করিয়েন না। শত্রুরা ভালো রূপ দেখিয়ে চুর্ণবিচুর্ণ করে যাবে তখন সহ্য করা কঠিন হয়ে পরবে। আমাকে ঘৃণা করুন ঘৃণার জায়গায়, তবে নিজের স্বামীকে অন্য কাউর হাতে তুলে দেওয়ার মতো মহৎ কাজ করতে যাবেন না।
-তাহলে আপনি কিভাবে স্ত্রী রেখে মায়ের কথায় অন্য এক মেয়েকে বিবাহ করলেন? সেইসময় কী আপনার মনে ছিল না আমি আপনার স্ত্রী এখনও বেঁচে আছি? মায়ের মনরক্ষার্থে স্ত্রীর চিত্তে আঘাত করেছেন আপনি। আম্মাকে ভালোবাসা তার কথা মেনে চলা মন্দ কাজ নয়। তবে মায়ের কথায় নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্ত্রী বেঁচে থাকার সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ করা আমার মতে পুরুষ নয় কাপুরুষের কাজ!

এক স্বরে সবটা বলে দম নিলো ছায়া। মনের যত ক্ষোপ ছিল সব বের করে ফেললো। ভারী মনটাও একটু হালকা হলো বোধয়। সোহরাব একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো ছায়ার দিকে ঝুঁকে। তাঁদের বিবাহের পর এই প্রথম ছায়া তার মনের কথা, মনের ক্ষোপ তার সাথে খুলে বলেছে। হোক সেটা রাগে বা অভিমানে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে সোহরাব। অতি ক্ষীণ সময়ের হাসি। কঠিন্য স্বরে বলল,
-ধরে নিলাম আমি কাপুরুষ, আমি পুরুষের কাতারে পরি না। তবে আমাকে আপনি নিজের সহধর্মি হিসেবে মানেন? মানতে পেরেছেন আমি আপনার স্বামী?
সোহরাবের প্রশ্ন শুনে শীতল হাওয়ায় ছায়ার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। অবস হয়ে গেলো শরীরে প্রত্যেকটি অঙ্গ। মন বলছে ছায়া আজ মনের সকল কথা সোহরাবকে বলে দে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারলো না সে। সোহরাব ছায়ার মুখ আরেটু উঁচু করে। সোহরাবের গরম নিঃশাস ছায়ার চোখ মুখে উপচে পরছে। প্রিয় পুরুষকে এতো কাছে ছায়ার স্বপ্নের মতো লাগছে। অস্থির হয়ে আঁখিজোড়া বন্ধ করে ফেলে। সোহরাব ছায়ার অবস্থা দেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
-একজন আদর্শ স্বামীর বেশিকিছু চাওয়া পাওয়া নেই তার স্ত্রীর কাছ থেকে। রাতে কাজ থেকে আসার পর স্ত্রীর হাসি হাসি মুখটি দেখবে। সযত্নে খাবার বেড়ে নিজ উদ্যেগে খাইয়ে দিবে। সকালে ঘুম ভাঙবে স্ত্রীর ডাকে। সে নিজে শার্টয়ের বোতাম লাগিয়ে দিবে। নাস্তা করিয়ে সদর দ্বার পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। একটু আরেকটু টেলিফোন করবে। বাসায় দেরি করে আসলে অস্থির হয়ে যাবে। অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে রাখবে। সেই অভিমান ভাঙবে স্বামীর ভালোবাসাময় ছোঁয়ায়। আমারও কিন্তু এর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না। বিবাহের প্রথম রাতে আমি সেটা বলেছিলাম কারণ সেইসময় আমি আম্মাজানের ওপর ক্রোধিত ছিলাম। একদিন না একদিন আমি আপনাকে স্ত্রী রূপে ঠিকই মেনে নিতাম। কিন্তু আপনিই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন আমার কাছ থেকে। এখন বলুন যে ব্যক্তি আমার নৈকট সহ্য করতে পারে না, আমাকে সহ্য করতে পারে না আমি কিভাবে তার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করবো?

বড় বড় শ্বাস নেয় সোহরাব। ছায়াকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। পাঞ্জাবী ঠিক করে বলল,
-এখন উপমা আমার জীবনে আসার পর থেকে আমি যেভাবে আপনার পরিবর্তন দেখছি এটা যদি আমাদের বিবাহের পূর্বে দেখতাম তাহলে আমাদের মাঝে দেয়াল তৈরি হতো না ছায়া। আর শুধু আপনার কাছে না, নিজের কর্মের জন্য আজ আমি নিজের নজরেও কাপুরুষ।

চলে যায় সোহরাব। একবার যদি পিছনে ফিরে ছায়ার কান্নারত্ব মুখের পানে তাকাতো তাহলে হয়তো তার মনে সকল ভাবনাই ধ্বংস হয়ে যেত। বুঝে যেত এই নারী কত কষ্টে তাকে উপেক্ষা করে আসছে গত তিনবছর ধরে। কত বেদনা তার অন্তরে।
_________________________

রাত্রের মধ্যভাগ। এলোমেলো অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে উপমা। আচমকা বিদ্যুৎ চলে যায়। ওপরের চলন্ত পাখা বন্ধ হয়ে যায়। প্রচন্ড গরমে তন্দ্রা ভেঙে যায় তার। ঘামে চুবচুব অবস্থা। আঁখিজোড়া মেলে আশেপাশে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই ঠাওর করতে পারলো না। পাশে হাতিয়ে দেখলো তাহেরা আছে কী না। স্থান ফাঁকা দেখে উপমা বুঝলো রাতে তাহেরা তার সাথে ঘুমাতে আসেনি। অন্যপাশ ফিরে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করে উপমা। ঘুম না আসায় পুনরায় সোজা হয়ে শুয়ে পরে। আচমকা একজোড়া বলিষ্ঠ হাত উপমার গলা চেপে ধরে। চোখ খুলে ফেলে উপমা। অন্ধকারে হাত দুটি ছাড়ানোর চেষ্টা করে নিজ গলা থেকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। নিঃশাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। এক সময় আঁখিজোড়া উল্টে আসে উপমার। ঠিক সেই ক্ষণেই বিদ্যুৎ চলে আসে। ঘুমানোর আগে উপমা বাতি নিভায়নি যার দরুণ কক্ষ আলোকিত করে জ্বলে উঠে বৈদ্যুতিক বাতি। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় কোনোরকম তাকায় উপমা। সামনের জনকে দেখে বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে যায় সে। চমকিত নয়নে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশাস নিতে থাকে।

>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৬

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৬

-না এটা হতে পারে না। উনার সংসারে উনাকে যে প্রয়োজন! আমি খনিকের মেহমান মাত্র এই গৃহের।

উপমাকে স্থির ভাবে ধরে রাখতে পারছে না তারা। এহেন পাগলের মতো আচরণ করতে দেখে সাইয়েরা আচমকা উপমার গালে চড় দিয়ে বসে। মুহূর্তেই চোখ খুলে ফেলে উপমা। হাঁসফাঁস করতে থাকে। গলা শুকিয়ে আসে তার। বড় বড় চোখ করে আশেপাশে তাকায়। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করছে। মাথা ব্যাথায় একদম ফেটে যাচ্ছে। ডানপাশে ফিরতেই তাহেরাকে শুয়িত অবস্থায় দেখতে পায় উপমা। শরীরের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসতে যাবে তখনই পিঠে ভয়ংকর ব্যাথা অনুভব করে। আধশোয়া হয়ে বসে গতরাতের কথা ভাবতে থাকে। তার মা আর নেই দুনিয়ায়। সম্পূর্ণ একা সে। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় নিঃশাস নিলো কয়েকবার। চোখের শেষ অশ্রুটুকু মুছে নিজেকে কঠিন করতে লেগে পরে। একের পর এক বুঝ দিতে থাকে নিজেকে।
তাহেরার ঘুম ভাঙতেই উপমাকে আধশোয়া অবস্থায় দেখে ত্বরিত উঠে বসে। উপমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-ছোট ভাবিজান আপনি ঠিক আছে? আমি আপনার জন্য ভীষণ চিন্তিত ছিলাম।
-আপা কেমন আছে?
তাহেরা চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। সে ভেবেছিলো প্রথমে তার মায়ের কথা জিগ্যেস করবে। অবাক স্বরেই বলল,
-আল্লাহর রহমতে বড় ভাবিজান ভালো আছে। কিন্তু এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
তপ্ত নিঃশাস ছাড়লো উপমা। তারপর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
-আমার মাকে কবর দেওয়া হয়েছে?
-হ্যাঁ, রাতেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। খোদা তাকে বেহেশতবাসি করবেন।

উপমা মনে মনে আমিন বললেন। তাহেরা বিছানা থেকে নেমে পরে। আলমিরা খুলে একটা সুতির শাড়ী বের করে উপমার হাতে দিয়ে বলল,
-এটা পরে নেন ভাবিজান। আমি আপনার জন্য খাবার আর ঔষধ নিয়ে আসছি।
তাহেরা চলে যায়। উপমা কিছুক্ষন শাড়ীটির পানে তাকিয়ে থেকে ধীরেসুস্থে পরতে শুরু করে।

তুলসী আর মিনা হাসপাতালে গিয়েছে। সাইয়েরা ইয়ামিন আর রুমকিকে খাইয়ে দিচ্ছে। রসইকক্ষে কাজ করছে তুলি, ফাতু। তাহেরা খাবারের থালি নিয়ে সিঁড়িতে পা দিবে তার পূর্বেই তার নজর পরে উপমার ওপর। কোমর ধরে সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে আসছে সে। সুন্দর মুখটি অতিরিক্ত কান্নার ফলে সবসময়ের মতো শ্রী দেখাচ্ছে না। তাহেরা বলল,
-আপনি কষ্ট করে কেনো আসলেন ভাবিজান আমিই তো যাচ্ছিলাম।
-আমি আগের থেকে একটু ভালো অনুভব করছি তাই নিজেই আসলাম। এসো দুইজন মিলে খেয়ে নেই তারপর হাসপাতালে যাবো।
-কিন্তু আপনি নিজেই তো অসুস্থ আম্মাজান আপনাকে যেতে বারণ করেছেন।

উপমা চুপ হয়ে গেলো। তাহেরাকে নিয়ে ভোজনশালা গিয়ে চেয়ারে বসে পরে। তাহেরা খেতে খেতে বলল,
-জানেন ভাবিজান প্রথমদিন থেকেই আপনাকে দেখলে আমার কেমন যেনো আপন আপন অনুভূতি হয়।

উপমা স্মিত হাসলো। ধীর কণ্ঠে বলল,
-রক্তের টান বলে তো একটা কথা আছে!
-মানে?
তাহেরা উপমার কথার মানে বুঝলো না। নির্বোধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। উপমা আর কিছু বলল না।
বাহির থেকে হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজ শুনে বুক কেঁপে উঠলো উপমার। চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত অন্দরের দ্বারে যেয়ে দাঁড়ায়। বাঁশের সাথে বেঁধে তিনজনকে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে সোহরাব। পরনে নতুন একটা পাঞ্জাবী। ঘামে সেটাও ভিজে যাচ্ছে। চোখ, মুখে ছড়িয়ে পরছে হিংসতা। গতকাল এই লোকগুলোও ছিল তাঁদের ওপর আক্রমণকারিদের সাথে। হয়তো সৈন্যদল এই তিনজনকেই ধরতে পেরেছে। সোহরাব শেষ বারের মতো তাঁদের জিগ্যেস করলো,
-বল হারা’মজা’দা তোদের কে পাঠিয়েছিল? সহজেই উত্তর দে মুক্তি পাবি আমাকে বেশি ক্লান্ত করলে তোদের পরকালে পাঠাতে আমার এক মিনিটও সময় লাগবে না।

একজনও মুখ ফুটে কিছু বলল না। উপমার মায়া হলো লোকগুলোর ওপর কিন্তু তারা যা করেছে তাঁদের সামনে এই মারও ক্ষীণ। গৃহের ভিতরে চলে যায় উপমা। তাহেরা তাকে বলে,
-মধ্যরাতে ভাইজান গৃহে এসেছেন। শত্রুর দলের লোকদের পাওয়া গেছে শুনে খুশি হয়েছিল তিনি। ভোর থেকে তাঁদের মুখ থেকে কথা বের করার প্রয়াস করছেন। কিন্তু কেউই কিছু বলছে না।
-ওহ।
_____________________
কেটে যায় পনেরোদিন। যত দিন এগোচ্ছে তত সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে উপমার। মায়ের মৃত্যুর শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যখনই মনে পরে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। ছায়াকে সাতদিন আগে গৃহে আনা হয়েছে। সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে তাকে। উপমা প্রতিদিন সময় করে একবার ছায়াকে দেখে আসে। ইয়াশার শহরে চলে গিয়েছে। তার আর তাহসিয়ার সামনে পরীক্ষা।যাওয়ার আগে শেষ একবার উপমার সাথে কথা হয়েছিল ইয়াশারের। সোহরাবও ছয়দিন আগে চলে গিয়েছে। ছায়ার জন্য বেশ অনেকদিন গৃহে থেকেছে। সে একজন ডাক্তারও। এতদিন ছুটি কী আর মানায় তাকে।

রাতে খাওয়া শেষ করে নিজ কক্ষে যাচ্ছিলো উপমা। কী মনে করে ছায়ার কক্ষের স্মুখীন পা’জোড়া থেমে যায় তার। একা একা কী করছে ছায়া সেটা দেখার ইচ্ছে জাগলো মনে। ইচ্ছেকে আর দমিয়ে রাখলো না উপমা। দরজা মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
-আসতে পারি?

শুয়ে শুয়ে বই পরছিলো ছায়া। উপমার আগমনে খুশি হলো সে। একা একা কক্ষে নিজেকে মৃত লা’শ মনে হয় তার। প্রশস্ত হেসে বলল,
-এসো এসো।
এগিয়ে আসতে আসতে উপমা বলল,
-আপনাকে বিরক্ত করলাম নাতো আপা?
-একদম না। আমি ভীষণ একা অনুভব করছিলাম।
উপমা হাসলো। ছায়া উপমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-বসো আমার পাশে।
উপমা বসলো। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আরাম করে বসলো। ছায়া বলল,
-মায়ের জন্য খারাপ লাগে?
-যখনই মনে পরে আমার বুঁকের বা’পাশে ভীষণ পীড়া অনুভব হয়।
-আমার জ্ঞান ফেরার পর তার কথা শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম আমি।
উপমার হাসি হাসি মুখ রূপ নিলো ব্যথার্ত। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-আগে তো তাও মনে হতো দুনিয়ায় আমি একা নই আমার মা আছে। এখন যখনই মনে পরে আমি সম্পূর্ণ একা কলিজা কেঁপে উঠে আমার।
ছায়া উপমার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
-এটা বলো না। তুমি একা কোথায় আমি তোমার বড় বোন রূপে পাশে আছি না?
উপমা হালকা হাসলো। হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। ছায়া নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে বলল,
-উফফ আমিও না! কী সকল কথা নিয়ে বলেছি।
-আপা আমাকে আপনাদের বিবাহের কাহিনী শুনান না।
-শুনবে?
ছায়া যেনো আগ্রহ পেলো উপমার কথা শুনে। নিজ জীবনের সুন্দর মুহূর্তের কথা বলতে কার না ভালো লাগে! উপমা প্রতিউত্তরে ফের মাথা নারায়। ছায়া চলন্ত পাখার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে তার জীবন কাহিনী।

-বুঝের বয়স হওয়ার পর থেকে আমি সোহরাবকে চিনতাম, দেখতাম। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান হলেই আমরা একজন আরেকজনের বাসায় বেড়াতে যেতাম বা তারা আসতো। যখন আমার বয়স পনেরো তখন আমি অনুভব করি সোহরাবের প্রতি আমার কোনোরকম ভাইয়ের অনুভূতি হয় না এক অন্যরকম অনুভূতি তার প্রতি আমার। সর্বক্ষণ মন চাইতো তার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করি। তাকে নয়নের সামনে বসিয়ে রাখি। ঐ কৃষ্ণবর্ণ পুরুষকে আমার চোখে অত্যাধিক সুদর্শন মনে হতো। মনে হতো তার চেয়ে সুদর্শন পুরুষ এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সে ছিল একরোগা মানুষ। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না। বেশি হাসতো না।
আমার অন্য বোনরা যখন জানতে পারলো উনার প্রতি আমার প্রেম প্রেম অনুভূতি তখন তারা আমাকে নিয়ে মজা করে। তৃস্কার স্বরে বলে ছায়া রে তুই আর পুরুষ পেলি না ভালোবাসার জন্য কোথায় ও কালাচান, কোথায় তুই সাদাচাঁদ। তাঁদের সেই কথায় আমার কিশোরী মন ক্ষুন্ন হয়। এক সপ্তাহ তাঁদের সাথে কথা বলিনি। আমার অনেক সময় মন চাইতো সোহরাবকে আমার মনের কথা বলি কিন্তু তাকে দেখলেই ভয়ে হাত পা কাঁপতো। সময় যেতে থাকে তার সাথে আমার অনুভূতি গুলোও বিশাল বড় আকারে রূপ নেয়। আমি সব কিসমতের ওপর ছেড়ে দিলাম। হঠাৎই একদিন ফুপ্পিমা মানে আমার আম্মাজান আমার জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিলেন আম্মা আব্বার কাছে। সেইদিন আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দময় দিন ছিল।
সকলের মতামতে আমাদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়। তখন আমার বয়স বিশ আর উনার বয়স সাতাশ। বিবাহের প্রথম রাতে বোন, ননদরা মিলে ফুলে সজ্জিত কক্ষে বসিয়ে দিয়ে যায় আমাকে। প্রিয়তমকে নিজের করে পাওয়ার হাজারো স্বপ্ন দেখতে থাকি আমি বসে বসে। আমাকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি। কিছুসময় পরই তার আগমন ঘটে কক্ষে। ভুল করেও একবার আমার দিকে তাকায় না। নিজের মাথার পাগড়ি খুলতে খুলতে গম্ভীর স্বরে বলে, “পোশাক পরিবর্তন করে শুয়ে পড়ুন আপনি “। তার মুখ থেকে আপনি শুনে মেজাজ গরম হয়ে যায়। বিবাহের আগে সে কখনই আমার সাথে কথা বলেননি। আমি বড় ঘোমটা তুলে তাকে বলি,”আজ আমাদের বিবাহের প্রথম রাত”। প্রতিউত্তরে সে যা বলেছিলো সেটা আমি আজ পর্যন্তও ভুলতে পারিনি। “আমি আপনাকে আগে আমার বোনের নজরে দেখতাম এখন এতো জলদি আপনাকে স্ত্রীর নজরে দেখতে পারছি না আমি। আর আমার মনে হয় না আমি কখন আপনাকে মন প্রাণ থেকে স্ত্রী মানতে পারবো ছায়া “। সেইসময় আমার ছোট মন ভয়ংকর ভাবে ভেঙে যায়। সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। সারারাত কান্না করতে করতে শেষ হয় আমার। তারপর নিজের সাথে নিজেই ওয়াদা করি বেহায়ার মতো তার কাছে নিজের স্ত্রীয় অধিকার চাইবো না। যেদিন সে মন থেকে আমাকে ভালোবাসবে, আমাকে নিজের করে চাইবে সেদিনই আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। অতঃপর সেই দিন আর আসলো না।

শেষের কথাটা বলতে গলা আটকে যায় ছায়ার। একটানা এতক্ষন কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। উপমা পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলে মাথা উঁচু করে এক চুমুকেই সবটুকু পানি শেষ করে ফেলে। ছায়া বড় একটি নিঃশাস নিয়ে বলল,
-একটা গোপন কথা শুনবে উপমা?
-হুম হুম।
-সোহরাবের সাথে আমার আজ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক হয়নি।

আকস্মিক কথায় চমকে ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে উপমা। অবাক স্বরে বলে,
-কিন্তু আম্মাজান তারপর সবাই যে বলছিলো আপনার আর বাচ্চা হবে না?
-উইযে মাত্রই বললাম না নিজেকে আর বেহায়া হিসেবে তুলে ধরবো না। বিবাহের পর সোহরাব গৃহে বেশি একটা আসতো না আর আসলেও সকলের অগোচরে রাতে আমি অন্য কক্ষে যেয়ে ঘুমাতাম। বিবাহের ঠিক ছয়মাসের মাথায় সোহরাব একদিন রাতে আমাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আমিও প্রেমিক পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে বশ হয়ে যাই। কিন্তু সে যে নিজ ইচ্ছায় আমাকে কাছে টেনে নেননি সেটা বুঝতে পেরে আমি অন্য কক্ষে চলে যাই। তারপর আর আমাদের মধ্যে তেমন কিছু হয়নি। কেউ সন্তানের কথা জিগ্যেস করলে বলতাম আমার কারণে হয় না। তারপরই আমার ক্যান্সার ধরা পরলো। যেই মিথ্যে বলতে বলতে আমি এইপর্যন্ত এসেছিলাম শেষে সেই মিথ্যেই সত্যিতে রূপান্তরিত হলো। ডাক্তারই বলল আমি আর মা হতে পারবো না।

উপমা স্তব্ধ নয়নে সম্পূর্ণ কথা শুনলো। ছায়া রুদ্ধ শ্বাস ত্যাগ করে বলল,
-জানো উপমা এই সবকিছুর মধ্যে আমি উনার দোষ দেখি না। সে কয়েকবারই আমাকে কাছে টেনে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই বাধা দিয়েছি। সে হয়তো মনে করে আমি তাকে পছন্দ করি না। জোর-জবরদস্তির সংসার করছি। তাই নিজেকে আরো দূরে সরিয়ে নেন আমার কাছ থেকে।
-আপনি উনাকে নিজের মনের কথা কখনই বলেননি আপা?
চটজলদি প্রশ্ন করে বসে উপমা। ছায়া স্মিত হেসে বলে,
-কখনই না। আমি ভীষণ চাপা স্বভাবের মানুষ। নিজ মনের কথা যে পর্যন্ত নিজ মুখে না বলি সে পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারে না। বিবাহের আগে বা পরে কখনই উনি বুঝতেও পারেননি আর আমিও বুঝানোর প্রয়াস করিনি। বিবাহের প্রথম রাতে তার কথা আমার আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিলো। তবুও আমার আম্মা আর আম্মাজান জানে উনার প্রতি আমার অনুভূতি। এই কয়দিন হাসপাতালে ছিলাম প্রতিদিন তাকে দেখতাম,তাকে অনুভব করতাম, তার আমার প্রতি যত্ন, রাতের পর রাত আমার সিউরে বসে থাকা, সবকিছুই আমার জন্য স্বর্গীয়সুখ ছিল।

এভাবেই একজন আরেকজনের জীবনের কাহিনী বলে একসাথেই পার করলো পুরো রাত। উপমার আর নিজ কক্ষে যাওয়া হলো না। ছায়া প্রথমদিন উপমাকে বলেছিলো সে কখনোই উপমাকে নিজের বোন হিসেবে মানতে পারবে না। অথচ আজ তারা দুইজন দুইজনের বোনের থেকেও উর্ধে!
______________________
জমিদার গৃহ ভরে উঠলো সকাল হতেই। তুলিকা ও তারনা এসেছে বেড়াতে। দুইদিন ছুটি নিয়েছিল সোহরাব তাই তাহসিয়াকে নিয়ে সেও এসেছে। সকালের নাস্তা করে বৈঠকখানায় বসেছে সবাই। উপমা তুলি আর ভৃত্যদের নিয়ে দ্বিতীয় স্তরের বদ্ধ সবকয়টা কক্ষ পরিষ্কার করাচ্ছে। গৃহে যেহেতু মেহমান এসেছে তাই বেশি কক্ষের প্রয়োজন। একদম কিনারের একটা কক্ষ উপমা সবসময়ই তালাবদ্ধ দেখেছে। তাই আজ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এই কক্ষটি খুলে দেখবেন। কেনো সবসময় বন্ধ রাখা হয়! তালায় হাত দিতেই তুলি বলে উঠলো,
-ছোডু ভাবিজান এই ঘর পরিষ্কার করবার দরকার নাই।
-কেনো? আর কেনোই বা এই কক্ষ সবসময় বন্ধ রাখা হয়?
তুলি আমতা আমতা করে বলল,
-আমিও জানি না কেল্লেগা বন্ধ।
উপমা সন্দীহান নজরে তুলিকে দেখে কক্ষের সামনে থেকে সরে যায়। পিছনে ফিরে তাহসিয়াকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে উপমা। তাহসিয়া পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো উপমা তাকে ডাক দেয়। থেমে যায় তাহসিয়া। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
-আপা ভালো আছেন?
-আপনার মনে হয়না আপনি বেশি আধিখ্যেতা দেখাচ্ছেন?
তাহসিয়ার কথা শুনে উপমা চুপসে যায়। তাহসিয়া কিছু না বলেই চলে যায়। উপমা বুঝে উঠতে পারে না কিসের জন্য এই মেয়ের এতো রাগ সবার ওপর। শুধু তার সাথেই নয় সোহরাব বেতীত গৃহের প্রত্যেকটা সদস্যের সাথেই সে এইরকম ব্যবহার করেন। তার আব্বাকে তো সে দু’চোখে সহ্যই করতে পারেননা। ভাবাভাবি শেষ করে কাজে মন দেয় উপমা।

সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষ করে সোহরাব ছায়ার কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। আধশোয়া অবস্থায় বসে ছিল ছায়া। সোহরাবকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরে। মাথায় আঁচল তুলতে নিলে সোহরাব গম্ভীর স্বরে বলে,
-সমস্যা নেই শান্ত হয়ে বসুন।
ছায়া তাকালো সোহরাবের পানে। স্বরে টান এনে বলল,
-তা জমিদারের পুত্র সোহরাব মির্জা আমার কক্ষে এসেছেন কোনো বিশেষ কারণে?
সোহরাব মুখে গম্ভীর্যতা ফুঁটিয়ে তোলে শান্ত রইলো। এদিকসেদিক তাকিয়ে বলল,
-আপনি এখন কেমন বোধ করছেন? আগের থেকে একটু ভালো?
-অনেক ভালো। সোহরাব মির্জা জিগ্যেস করায় এখন আরো ভালো হয়ে উঠলাম।
সোহরাব চোখ তুলে তাকালো। খানিক সময়ের ব্যবধারে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। দৃঢ়তার সাথে বলল,
-আমার প্রতি অনেক ঘৃণা আপনার মনে?
-একদমই না। আপনাকে ঘৃণা বা ভালোবাসা কোনোটার প্রতিই ইচ্ছুক নই আমি। উপমা মেয়েটাকে কেনো উপেক্ষা করছেন? ও আপনার স্ত্রী সেটা কেনো ভুলে যাচ্ছেন আপনি?
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সোহরাব। সে দৃষ্টির দিকে কিঞ্চিৎ তাকিয়ে মাথা নত করে ফেললো ছায়া। কয়েক পল নীরবতা কাটিয়ে সোহরাব শান্ত ভণিতায় বলল,
-এখন আপনার কথা মতো কাজ করতে হবে আমায়?
-শুধুই বললাম। আমি ঐরকম স্ত্রী নই যে নিজের স্বামীকে বলবে তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আপন করে নিতে। আমি আবার ঐরকম নারীও নই যে অন্য একটি নারীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করা দেখে চুপ থাকবে।

অকারণেই ছায়ার কথায় তেঁতো হয়ে উঠলো সোহরাব। শান্ত চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ছায়ার কথা ভ্রুক্ষেপ না করে চলে যেতে নিলে কী মনে করে যেনো আবার পিছনে ফিরে তাকায়। ছায়া ছলছল আঁখিজোড়া সেইসময় তার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। খনিকের জন্য দৃষ্টি মিলন ঘটে গেলো দুইজনের। সোহরাব ঈষৎ হেসে বলল,
-একজনকে নিজের সাথে জড়িয়ে তার জীবন নষ্ট করেছি আর কাউকে নিজের সাথে জড়াতে ইচ্ছুক নই আমি। সেইসময় আম্মাজানের কথায় জ্ঞানশূন্য হয়ে বিবাহ করেছিলাম। এখন শান্ত মস্তিকে ভেবেছি তাকে তালাক দিয়ে দেবো আমি। তারপর আম্মাজান আমাকে চিরকালের জন্য গৃহ থেকে বিদায় নিতে বললে আমি মাথা পেতে সেটা মেনে নিবো।

গটগট পায়ে চলে গেলো সোহরাব। কম্পিত নয়নে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। নিজের বক্ষস্থল চেপে ধরে মৃদু হাত দিয়ে। নেত্রপলব বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
-কয়েক বছর পূর্বেও সেই আঁখিজোড়ায় আমি আমার জন্য সর্বনাশ দেখেছিলাম আজও তাই দেখলাম! আপনাকে ঘৃণা করা যে আমার সাধ্যে নেই। তবে ধীরে ধীরে আপনি আমার অপ্রিয় হয়ে উঠছেন জনাব।

>>>>চলবে।

অপ্রিয় জনাব পর্ব-০৫

0

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_০৫

সন্ধ্যা পরেছে। আঁধারে ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিধ্বস্ত অবস্থায় উপমা ছুটে যায় ছায়ার নিথর দেহের কাছে। শব্দ করে জমিনে বসে পরলো। ছায়ার দেহ নিজ কোলে নিয়ে কয়েকবার ডাকলো। মৃদু চাপর দিলো গালে। সোহরাব ততক্ষনে তাঁদের কাছে চলে এসেছে। ছায়ার হাতের শিরা পরীক্ষা করে দ্রুত তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কয়েকজন থেকে বাকি সৈন্যদল ছুটে পরলো শত্রুর তালাশে। সোহরাব যাওয়ার পূর্বে তাঁদের উদ্দেশ্যে বলল,
-আমাদের সাথে দুইজন চলো আর দুইজন গৃহে যাও। গৃহের সবাইকে বলবে আমরা ছায়াকে নিয়ে শহরে যাচ্ছি ওর অবস্থা শোচনীয়। বাদ বাকি তোমরা তাঁদের পিছু নেও।

গৃহের বৈঠকখানায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে সকলে। তুলসী থেমে থেমে কাঁদছে। একবার ছায়ার জন্য তো একবার নিজ পুত্রের জন্য বুক ধকধক করছে তার। তার ওপর মায়া হচ্ছে উপমা নামক যুবতীর জন্য। কিছুক্ষন আগেই খবর এসেছে উপমার আম্মা আর দুনিয়ায় নেই। বিকালে ঘুমিয়েছিল বেশ সময় ঘনিয়ে আসার পরও যখন উঠছিলো না তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা তাকে ডাকতে আসে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় মাটির ঘরের চকিতে অবচেতন হয়ে পরে আছে সে। কয়েকবার ডাকলো সকলে মিলে। যখন দেখলো কোনো সাড়াশব্দ নেই তখন কাঠের দ্বার ভাঙতে হলো। গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা এগিয়ে এসে শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করে দেখলো সে আর জীবিত নেই। যেহেতু তাঁদের পরিবারের আর তেমন কোনো সদস্য নেই তাই গ্রামবাসীরা জমিদার গৃহে খবর পাঠালো।
এখন উপমাকে বলতে তো হবেই। তাই ইয়াশার আর আলাউদ্দিন ত্বরিতগতিতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেছেন।

তাহেরা আম্মার পাশে বসে ভাঙা স্বরে বলল,
-আম্মাজান আমার ভাবিজানদের জন্য চিন্তা হচ্ছে। ছোট ভাবিজান কিভাবে সয্য করবে তার আম্মার মৃত্যুর খবর!
-আমিও সেটাই ভাবছি রে মা। ছায়ার আম্মা আব্বা রওনা দিয়েছে। মেয়ের এই অবস্থায় কোন আম্মা আব্বার বসে থাকতে মন চায়!
ফুঁপিয়ে উঠে তুলসী। মিনা তার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সাইয়েরা ইয়ামিনকে নিয়ে বসে আছে। সেইসময় সোহরাবদের গাড়িতে সেও ছিল। মারামারি, র’ক্ত দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে সে।
-আম্মাজান নিজেকে শক্ত করো। দেখিও বড় ভাবিজানের কিছু হবে না।
আম্মাকে জড়িয়ে ধরে তাহেরা। তুলসী এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়। বিলাপ স্বরে বলল,
-তোর কথাই যেনো আমার খোদা রাখে মা।

হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছে সোহরাব। ললাটে, ওষ্ঠে বিন্দু বিন্দু র’ক্ত জমে শুকিয়ে আছে। পাতানো বসনিতে বসে আছে উপমা। পিঠের আঘাতটা মোটামুটি ভালোই লেগেছে যার জন্য সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে পারছে না সে। উপমার মস্তিকে বারবার ভেসে উঠছে ছায়ার চিত্র। মন বলছে আজ নিশ্চই কোনো খারাপ কিছু হবে। অকারণেই অস্থির অনুভব করছে উপমা। বুক ভার ভার লাগছে তার।

-ভাইজান।
অপরিচিত নারীর কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় উপমা। সুশীল পোশাক পরিহিত, মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা বেনুনি করা কেশ বুকে ছড়িয়ে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা স্বচ্ছ মুখশ্রী। মুখের গড়ন অনেকটা সোহরাবের মতোই মনে হলো উপমার।
সোহরাবের দিকে এগিয়ে এসে চিন্তিত, ভয়াত কণ্ঠে বলল,
-ভাইজান আপনে এই অবস্থায় এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন! দ্রুত আসেন মুখ পরিষ্কার করে ঔষধ লাগিয়ে নিন।
-এগুলো তেমন কিছু না বোন।
পাশে ফিরতেই সোহরাবের নজর পরে এলোমেলো অবস্থায় বসে থাকা উপমার পানে। তাহসিয়াকে দৃঢ় স্বরে বলল,
-তুমি বরং উনাকে নিয়ে যাও। পিঠে বড়োসড়ো আঘাত পেয়েছেন।
-কে সে? আর বড় ভাবিজানের শরীর এখন কেমন?
-ডাক্তার কিছু বলেনি এখন পর্যন্ত। আর উনি উপমা।

তাহসিয়া আর কিছু জিগ্যেস করলো না। উপমা নাম শুনেছে সে তাহেরার মুখে। অকারণেই এই মেয়ের ওপর অনেক রাগ তার। কেনো সেটা সেও জানে না। ভাইয়ের কথা মতো এগিয়ে যায় উপমার কাছে। আগাগোড়া পরোক্ষ করে বলল,
-আপনি আসুন আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন।
-আমি ঠিক আছি।
খানিকটা বিরক্ত হলো তাহসিয়া। দেখাই যাচ্ছে ঠিক নয় তবুও কেনো বলছে ঠিক আছে! বিরক্তমাখা গম্ভীর স্বরে বলল,
-তর্ক আমার পছন্দ নয়। আসুন দ্রুত।
উপমা উঠে দাঁড়ালো। তরুণীর কথা শুনে সে বুঝে গিয়েছে এটা সোহরাবের বোন তাহসিয়া। তার মতোই গম্ভীর আর রুক্ষ স্বভাবের মানুষ। তাহসিয়ার সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো সেই সময় উপস্থিত হয় ইয়াশার আর আলাউদ্দিন। উপমা দ্রুত এলোমেলো শাড়ী ঠিক করে মাথায় ঘোমটা তুলে। ইয়াশার সোহরাবের উদ্দেশ্যে বলল,
-ভাইজান ঠিক আছে আপনারা?
-এইতো।
ছোট উত্তর দেয় সোহরাব। ইয়াশার দুর্বলচিত্তে একবার উপমা একবার সোহরাবকে দেখে শান্ত স্বরে বলল,
-ছোট ভাবিজানকে এখন আমাদের সাথে যেতে হবে ভাইজান।
ইয়াশারের কথার আগামাথা বুঝলো না সোহরাব ও উপমা। উপমা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলো। সোহরাব প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-মানে? সেও সুস্থ নয় চিকিৎসার প্রয়োজন এখন কিভাবে যাবে?
-ছোট ভাবিজানের আম্মা মারা গিয়েছে ভাইজান।
কম্পিত ধ্বনি উচ্চারণ করে কথাটা বলল ইয়াশার। বাক্য শেষ হতেই ধপ করে জমিনে বসে পরলো উপমা। মস্তিক কেমন ফাঁকা হয়ে বক্ষস্পন্দন থেমে গেলো তার। ঝাপসা নয়নে ইয়াশারের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু।
তাহসিয়ার ভীষণ মায়া হলো মেয়েটির ওপর। এমনিতেই তো দুর্বল ছিল, এখন এইরকম একটি বাক্য শুনে মেয়েটি সম্পূর্ণ ভেঙে পরেছে। সোহরাব নিস্পলক উপমার পানে তাকায়। মনের ভিতরের ঝড় বুঝার প্রয়াস করলো মাত্র মা হারা মেয়েটির।

সোহরাব এগিয়ে আসতে নিলে উপমা সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। যে মেয়ে কিছুক্ষন পূর্বে ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলো না সেই মেয়ে এখন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনের পীড়ায় কী মানুষ শরীরের পীড়ার কথা ভুলে যায়! ভাবলো সোহরাব। উপমা ভীতিকর ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলুন।

চমকিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি তুলে উপমাকে দেখলো সোহরাব। রুদ্ধ শ্বাস ছেড়ে ইয়াশারকে বলল,
-তাকে নিয়ে যাও ইয়াশার। আমি এখানে থাকি।
-ঠিক আছে ভাইজান।
-ভাইজান আমিও যাই তাঁদের সাথে?
তাহসিয়ার কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নারায় সোহরাব। যাওয়ার পূর্বে সোহরাবের কথা মতো তাহসিয়া উপমাকে জোর করে একটা ব্যাথার ঔষধ খাইয়ে দেয়। অতঃপর তারা বেরিয়ে পরে। হাসপাতালে রয়ে যায় সোহরাব আর আলাউদ্দিন।

______________________
নিজ গৃহের দ্বারে পা রাখতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে উপমার। যেই বাড়ি সবসময় নির্জন নীরব থাকতো আজ সেই বাড়িতে মানুষের সমাগম। উপমাকে দেখে সকলে দূরে সরে যায়। রাস্তা বানিয়ে দেয় তার যাওয়ার জন্য। তাঁদের ছোট উঠানের মধ্যখানে পাটিতে শুয়িত মাকে দেখে বুকের পাঁজরে ব্যাথা অনুভব করলো। হাত পা গুটিয়ে মায়ের মৃত দেহের পাশে বসে পরে। নরম স্বরে ডাকলো,
-মা, ও মা। উঠো না মা। দেখো তোমার মেয়ের বুকে ব্যাথা করছে অনেক, মনে হচ্ছে কেউ ছু’রি চালাচ্ছে। তুমি না তোমার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারো না! উঠো না।

অঝোরে কেঁদে দিলো উপমা। মায়ের বুকে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকলো। আশেপাশে দাঁড়ানো সকলে করুণ নয়নে দেখতে থাকলো সদ্য এতিম হওয়ার মেয়ের বেদনা। কয়েকজন নিম্নস্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলো,
-মাইয়াডারে বিয়া দিয়া ভালো করছিলো নইলে অহন কী হইতো।
-হো। এতিম যুবতী মাইয়াডারে বেডারা নিজে গো ভোগের জিনিস বানাইতো।
তাঁদের কথায় তাল মিলিয়ে আরেকজন বলল,
-কিন্তু মাইয়ার জামাইর বাড়ি থেইকা কেউ আহে নাই? হুনছিলাম জমিদারের বড়ো পুলার লগে বিয়া দিছিলো।
-হো। বুঝো না বুইন(বোন), বড়োলোক গো কাসে(কাছে) কী আর গরিব গো দাম আছে নি।
-তাও তো মাইয়াডার রাজ কপাল!কয়জনের নসিব এমন ওহে।

উপমা বুক থেকে মাথা তুলে কাপড় সরিয়ে মুখ দর্শন করে। গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-মা গো তুমি তো জানো তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই। আজ স্বার্থপরের মতো তুমিও আমাকে রেখে চলে গেলে! একা আমি কী করবো? কার সাথে মনের কথা বলবো? কে আমাকে আদর করে ভালো ভালো বুঝ দিবে?

নিঃশাস নিলো উপমা। মায়ের ললাটে চুম্বন করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-আমি জানি আমি তোমার নাড়ি ছেঁড়া ধন নই, তুমি আমায় জন্মও দেওনি, তবুও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার যে শেষ নেই মা। মা শব্দের মানেই যে আমি তোমাকে বুঝি। কেনো আমাকে এতো ভালোবাসা দিয়েছো মা? কেনো নিজের প্রতি এতো দুর্বল করেছো আমায়? দেখো তোমার তিলে তিলে তৈরি করা কঠিন, বর্বর মেয়েও আজ চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে পরেছে।

ব্যথাহত হয়ে আর্তচিৎকার করে কান্না করতে থাকলো উপমা। ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেলো। সকলের বক্ষ কেঁপে উঠলো উপমার ক্রন্দনরত্ব স্বরে। তাহসিয়ার মতো কঠিন চিত্তের মানুষও দাঁড়িয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
উপমা নিজের দুইগাল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল,
-মা গো ছেড়ে যেও না আমায়। একা করে দিও না।

আকাশের চাঁদটাও আজ উপমার দুঃখে দুঃখিত। কিছুক্ষন পর পরই সাদা মেঘের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলছে। একসময় কাঁদতে কাঁদতে উপমার চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। শরীরের ভার হারিয়ে লুটিয়ে পরলো জমিনে।
________________________

রাত কয়টা বাজে জানা নেই। দম বন্ধ, হাঁসফাঁস অবস্থায় আঁখিজোড়া খুলে ফেলে উপমা। মাথায় ভারী বস্তা রয়েছে এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। ঘোলাটে নয়নে আশেপাশে তাকায়। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় উপমা বুঝতে পারে সে জমিদার গৃহে নিজ কক্ষে শুয়ে আছে। চট করে উপমার মনে পরে যায় তার মা আর পৃথিবীতে নেই পরকাল গমন করেছেন। ডুকরে উঠে সে। তৎক্ষণাৎ বিছানায় উঠে বসে।
পাশেই বসা ছিল তাহেরা আর সাইয়েরা। উপমাকে বিছানার নিচে নামতে দেখে তাহেরা তাকে ঝাপ্টে ধরে। উপমা পাগলের মতো কাঁদতে থাকে। তাহেরাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে বলল,
-আমি আমার মায়ের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে যেতে দেও। আটকিও না আমায়।
তাহেরাও উপমার সাথে কান্নায় ভেঙে পরে। সাইয়েরা উপমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-নিজেকে সামলাও বউমা। তোমার আম্মাকে কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বেহেশতবাসি হবেন। এখন না কেঁদে আল্লাহকে ডাকো আম্মার জন্য দোয়া পড়ো।

সাইয়েরার কথা মানতে পারলো না উপমা। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হঠাৎই তার নাকে গোলাপজলের ঘ্রাণ আসে। বাহিরে কয়েকজনের আজহারী, ক্রন্দনধ্বনি কর্ণকুহর হয় তার। উপমার কান্না থেমে যায়। র’ক্তলাল ফোলা ফোলা নেত্রপল্লব নিক্ষেপ করে সাইয়েরার ওপর। তাহেরা তাকে বুকে জড়িয়ে আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। উপমা কম্পিত স্বরে বলল,
-আ আপা, আপা কেমন আছে?
সাইয়েরা চোখ মুছে নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,
-বড় বউমা আর বেঁচে নেই মা।

>>>চলবে।