Tuesday, August 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 262



আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-২১+২২

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২১( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripte

পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢোলে পড়েছে। থেকে থেকে প্রকৃতি তার ঠান্ডা বাতাস মেলে ধরছে। চারিদিক অন্ধকার হতে লাগলো। রাস্তা ঘাটে কৃত্রিম লাইট গুলো এক এক করে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। গাড়ির মধ্যে চিত্রা কে জাপ্টে ধরে আছে তুষার। কতক্ষণ ব্যাপি ধরে আছে জানা নেই। সময় টা যেনো থমকে গেছে। আশেপাশে যে অন্ধকার হয়ে আসছে সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। হঠাৎ আকস্মিক গাড়ির হর্ণে তুষারের ভ্রম ভাঙে। আশেপাশে একবার চোখ বুলায়। চিত্রা গুটিশুটি হয়ে তুষারের শার্টের কলার এক হাত দিয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। তুষার চিত্রার চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠে-
-“ যন্ত্রণা কমেছে?
চিত্রা চোখ মেলে তাকায়। বুকে মাথা রেখেই উপর নিচ মাথা ঝাকায়। যার মানে কিছুটা কমেছে।
-“ এভাবেই থাকবেন নাকি বাসায় ফিরবেন? রাত হচ্ছে।

চিত্রা চট করে মাথা তুলে সোজা হয়। আশেপাশে চোখ বুলোয়। অলরেডি অন্ধকার হয়ে এসেছে। ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করে সময় দেখে নিলো। শুষ্ক ঠোঁট দুটো জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল-
-“ বাসায় ফিরবো আমি,একটু পৌঁছে দিন না।
তুষার সময় ব্যায় করলো না আর গাড়ি স্টার্ট দিলো।
-“ এসির পাওয়ার টা একটু কমিয়ে দিন না ঠান্ডা লাগছে ভীষণ।

তুষার এসির পাওয়ার একদম লো করে দিলো। চিত্রা সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ফের চোখ বন্ধ করে ফেললো। তুষার আড়চোখে একবার দেখে নিলো।
-“ আপনার যন্ত্রণার কথাটা আমায় জানালেন না তো চিত্রা।
-“ বুকটা ফেড়ে দেখানো গেলে দেখিয়ে দিতাম। মুখ থেকে কথা গুলো বের হতে চাইছে না। শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে।

চিত্রা চোখ বন্ধ রেখেই কথাটা বলে। তুষার চিত্রার ডান হাতের উপর নিজের বা হাত রাখে।
-“ আপনার জীবনে আসাটা কি বড্ড দেরি হয়ে গেছে আমার?
চিত্রা চোখ মেললো। সিটে মাথা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে স্মিত হেসে বলল-
-“ আপনি জীবনে আরো কয়েকটা বছর আগে আসলে জীবনটা এখনকার থেকে আরো সুন্দর হতো। আমার অনুভূতি গুলো পূর্ণতা পেত। আমার ভালোবাসা ভালো লাগার প্রথম পুরুষ হতেন আপনি।

তুষার গম্ভীর হলো। চিত্রার বা হাত উচু করতেই চোখ গেলো অনামিকা আঙুলে। কয়েকদিন আগে এই আংটি টা নিজ হাতে পড়িয়ে দিয়েছি। হাত টায় চুমু খেয়ে বলল-
-“ কাউকে ভালোবেসে ঠকে গেছেন মিস চিত্রা? যদি ঠকে থাকেন তাহলে শুকরিয়া আদায় করবেন দু রাকাআত নফল নামাজ পড়ে।

চিত্রা নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। পলকহীনভাবে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ খারাপ লাগছে না?
তুষারের অকপট জবাব-
-“ একটু ও না।
-“ আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।
-“ কেনো? আপনার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ হতে পারি নি সেজন্য?

চিত্রা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। তুষার ইশারায় চিত্রা কে কাছে আসতে বললো। চিত্রা কিছুটা তুষারের দিকে চেপে বসলো। তুষার নিজের কাঁধ দেখিয়ে সেখানে মাথা রাখতে বললো। চিত্রা বাধ্য মেয়ের মতন তুষারের কাঁধে মাথা রাখলো। তুষার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল-
-“ কাকে ভালোবেসে ঠকে গেছেন সেটা আজ শুনতে চাই না। কোনো একদিন নিরালায় বসে আপনার দুঃখবিলাসের গল্প শুনবো কেমন?আর আমি আপনার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ হতে পারি নি তো কি হয়েছে,শেষাংশে তো শুধু আমিই থাকবো৷ প্রথম পুরুষ, নারী যে কেউই হতে পারে কিন্তু শেষাংশে সবাই যেতে পারে না। আমি আপনার শেষাংশের উপসংহার। এই আমিতেই আপনার মুক্তি।

চিত্রা প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। চুপ রইলো। ঠিকই তো বলেছে,সবাই তো সূচনায় আসে কিন্তু উপসংহারে তো আর সবাই থাকতে পারে না।

তুষার চিত্রা দের বাসার সামনে গাড়ি থামায়। চিত্রা বাড়ির দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। পেছনে ঘুরে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ সাবধানে যাবেন।
তুষার মাথা নাড়ালো। কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলে-
-“ নফল নামাজ টা মনে করে পড়ে নিবেন।
চিত্রা প্রশ্নাতীত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-“ নফল নামাজ কেনো?
-“ ঐ যে তখন বললাম নফল নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করবেন।
-“ আচ্ছা পড়বো। আসি।

চিত্রা চলে গেলো। তুষার চিত্রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

আজও সেই চায়ের টঙয়ের দোকানের সামনে বেঞ্চ টাতে বসে অপেক্ষা করছে রাতুল অধরার জন্য। অধরা তাড়াহুড়ো করে টঙের দোকানে এসে দাঁড়িয়ে অপরাধীর ন্যায় বলে-
-“ খুব কি অপেক্ষা করালাম আপনায়?
রাতুল স্মিত হেঁসে বলে-
-“ খুব একটা করতে হয় নি।
রাতুল গলা ছেড়ে দোকান দার কে বলল-
-“ মামা দুকাপ মালাই চা দিন।
ইশারায় রাতুল অধরাকে বেঞ্চে বসতে বললো। অধরা গায়ের চাদর ভালো করে জড়িয়ে ধরে বসে বেঞ্চ টাতে। দোকানদার দুকাপ চা রাতুল আর অধরার কাছে এনে বলে-
-“ এই যে মামা আপনাগো চা নেন।
রাতুল সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে একটা কাপ উঠিয়ে অধরার দিকে বাড়িয়ে দেয়। অধরা চায়ের কাপ হাতে নেয়। রাতুল নিজের কাপ টা উঠিয়ে সেটায় চুমুক বসায়। চা খেতে খেতে রাতুল অধরাকে জিজ্ঞেস করে, –
-“ আপনার ফিউচার প্ল্যান কি অধরা?
অধরা চা খাওয়া থামিয়ে দিলো। দৃষ্টি আকাশ পানে রেখে বলল-
-“ অনেক পড়াশোনা করা।নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তোলা।
রাতুল ফট করে বলে উঠে –
-“ বিয়ে করার প্ল্যান নেই?
অধরা তপ্ত শ্বাস ফেললো। কাপে থাকা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল-
-“ জীবন কি একা চলে? চলে না তো। জীবনে চলার পথে একটা সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। আর যেদিন মনে হবে মনের মত কাউকে পেয়ে গেছি সেদিন অবশ্যই বিয়ে করবো।
-” কেমন সঙ্গী চান?
-“ খুব সাধারন সঙ্গী চাই, নির্ভেজাল সহজসরল প্রকৃতির। যে রোজ নিয়ম করে একটু ভালোবাসবে আমায়।
-“ একটু না রোজ নিয়ম করে আপনায় অনেকটাই ভালোবাসবো মিস অধরা।
রাতুলের বিরবির করে বলা কথাটা অধরার কান অব্দি পৌঁছালো না।
-“ কিছু বললেন?
-“ হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-“ হুম করুন।
-“ কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?

অধরা চুপ হয়ে গেলো। মুখে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। চশমা টা ঠেলে বলল-
-“ জ্বি।
মুহূর্তে মুখ খানা চুপসে যায় রাতুলের।
-“ খুব ভালোবাসেন?
-“ হুমম।
-“ বিয়ে করবেন নিশ্চয়ই তাকে?
-“ না।
রাতুলের মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টে যায়।
-“ না কেনো?
-“ কখনও কি দেখেছেন বামুন কে চাঁদের নাগাল পেতে? সে হচ্ছে আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা হাজার লক্ষ তারার মাঝে এক চাঁদ। তাকে ছোঁয়া যায় না সেখানে ধরা তো দূর।
-“ নিজেকে এতো মূল্যহীন ভাবছেন কেনো? আপনি কারো কাছে এক মূল্যবান কোহিনূর।
-“ হয়তো।
-“ আচ্ছা চা তো শেষ। তবে বাসায় ফেরা হোক। আপনার ড্রাইভার এসেছে?
-“ না।
-“ আমি পৌঁছে দিয়ে আসলে কোনো সমস্যা হবে?
-“ না সমস্যা হবে না বরং উপকার ই হবে।
-“ আচ্ছা চলুন তাহলে।

-“ এই ছোট প্যাকেট এক কাপ কফি দাও তো।

তৃষ্ণা কফি খাচ্ছিলো। রাফিকে তার থেকে কিছুটা দূরে বসে কথাটা বলতেই আড়চোখে তাকায়। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলে-
-“ রান্না ঘরে গিয়ে দেখেন বেচে আছে হয়তো কফি। নিয়ে খান।
রাফি ভ্রু কুঁচকায়।
-“ আশ্চর্য তুমি গিয়ে আনতে পারছো না?
-“ আমি খাচ্ছি।
-“ আমিও তো খাবো।
-“ আমি কি আটকিয়েছি?
-“ আটকাও নি তবে এনেও তো দিচ্ছো না। বিয়ের পর স্বামী কফি খেতে চাইলে এভাবেই না করে দিবে মুখের উপর?
-” না গরম কফি এনে মুখের ভেতর ঢেলে দিব। সে শুধু গিলবে।
-“ আচ্ছা যাও যাও এখন কফি নিয়ে আসো৷ বিয়ের পরে কি করবে না করবে পরের টা পরে দেখা যাবে।

তৃষ্ণা তার আধখাওয়া কফির মগটা রাফির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ কফিটা খেতে পারবেন?
-“ তোমার আধখাওয়া কফি টা আমি খাবো কেনো?
-“ ওয়াজ মাহফিলে যে হুজুর রা বলে শুনেন নি? আধখাওয়া কোনো কিছু খেলে মহব্বত বাড়ে।
-“ সেটা তো স্বামী স্ত্রী এর ক্ষেত্রে। কাজিনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

মুহুর্তে তৃষ্ণার মুখের আকৃতি পরিবর্তন হলো। কফির মগটা শব্দ করে সেন্টার টেবিলে রেখে বলল-
-“ তো আমাকে হুকুম না করে আপনার ফরমায়েশ খাটার জন্য বিয়ে করে বউ নিয়ে আসেন চাচার ছেলে ভাই।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২২( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ তোকে না বললাম আজ ভার্সিটি যেতে না। রিয়াদ আর সিমি আসছে,তুই বাসায় না থাকলে বিষয় টা কেমন দেখায় বলতো?

চিত্রা ভার্সিটি তে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো আর তখনই চয়নিকা বেগম কথাটা বলে উঠেন। চিত্রা একবার চয়নিকা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ওদের আসার জন্য কি আমার ভার্সিটির ক্লাস মিস দিতে হবে? এমনিতেই তো বিয়ের জন্য কয়েক দিন যেতে পারবো না।
-“ সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আজকের দিন টা না যা। খুব তো আহামরি ক্ষতি হবে না।
চিত্রা বিরক্ত হলো। কাটকাট গলায় বলল-
-“ আমার যে কি ক্ষতি টা হবে তা যদি জানতে তাহলে আর এটা বলতে না। যাই হোক তোমার কথা রাখছি ভার্সিটি যাচ্ছি না।
চিত্রা রুমে চলে গেলো ব্যাগ নিয়ে। চায়নিকা বেগম রান্না ঘরে গেলে রিয়াদের জন্য রান্নার ব্যাবস্থা করতে।

চিত্রা রুমে এসে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে তৃষ্ণাকে জানিয়ে দিলো সে আজ ভার্সিটি যেতে পারবে না। তৃষ্ণা কথাটা শুনে সে ও বলে দিলো সেও আজ তাহলে যাবে না।

দুপুরের শেষ প্রহরে আহমেদ বাড়িতে রিয়াদ ও তার স্ত্রী সিমির আগমন ঘটে। সিমি সম্পর্কে চিত্রার মামা তো বোন আর রিয়াদ সম্পর্কে খালাতো ভাই। সিমি বাড়িতে ঢুকেই চয়নিকা বেগম কে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে পড়ে। রিয়াদ চয়নিকা বেগমের সাথে কুশলাদী করে জিজ্ঞেস করে –
-“ চিত্রা কোথায়,আর খালু কোথায়?
চয়নিকা বেগম চিত্রার ঘরের দিকে ইশারা করে বলে-
-“ চিত্রা ওর রুমে আর তোর খালু সে তো তার কাজে।
-“ চিত্রা আপু এখনও রুম থেকে বের হলো না আমাদের দেখতে?
মন খারাপ করে কথাটা বলল সিমি। চায়নিকা বেগম হেসে বলেন-
-“ হয়তো ঘুমিয়েছে। তোদের গলার আওয়াজ শুনলে নিশ্চয়ই আসতো।
রিয়াদ আর সিমি কে তাদের জন্য রুম দেখিয়ে দেয়। রিয়াদ একবার চিত্রার রুমের দিকে তাকিয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায়।

চিত্রা ঘুমায় নি মূলত ইচ্ছে করেই রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানায় থম মেরে বসে আছে। সে চাইছে না রিয়াদের মুখোমুখি হতে। এই ছেলের থেকে যথাসাধ্য দূরে থাকার চেষ্টা করবে চিত্রা।

প্রান্তিকের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে তুষার রাতুল। তুষার আজ রাতুল দের বাসায় গিয়েছিল। রাতুলের মা কে পার্সোনালি ইনভাইট করতে তার বিয়ের। যেহেতু হাতে বেশি সময় নেই,কিছু কাছের মানুষকে তুষার নিজে গিয়েই ইনভাইট করছে। রাতুলের মা রোমিলা বেগম তুষারের পছন্দ অনুযায়ী সব খাবার রেঁধেছিলেন। তুষার রাতুল আর রোমিলা বেগম তিনজনে দুপুরের ভোজন সেরে নেয়। টুকটাক আলাপচারিতা করে তিনটের দিকে চলে আসে। তুষারের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে রাতুল বলে উঠে –
-“ আমি যদি তোর কাছে কিছু চাই ফিরিয়ে দিবি আমায় তুষার?

তুষার ভ্রু কুঁচকায়।
-“ সাধ্যমতো চেষ্টা করবো যেনো না ফেরাতে হয়।
রাতুল স্মিত হাসে।
-“ সাধ্যের বাহিরে কিছু চাইবো না।
-“ তাহলে ফেরানোর প্রশ্নই আসছে না।
-“ ভরসা দিচ্ছিস?
-“ না আশ্বাস দিচ্ছি।
-“ তোর বিয়ে টা মিটে যাক তোর কাছে, না না তোদের কাছে একটা প্রস্তাব রাখতে চাই।

তুষার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে রাতুলের পানে চাইলো। কিছু একটা আন্দাজ করলো। বুঝতে পারলো কি পারলো না তা বুঝা গেলো না।

-“ আজ ভার্সিটি ছিলো না তোমার?
তৃষ্ণা কে এই দুপুরে বাসায় দেখে অবাক হয়ে বলে রাফি। মূলত তৃষ্ণার বাসায় ফিরতে বিকেল হয়। সেখানে আজ দুপুরে বাসায়। সকালে ব্যাবসার কাজে ভোরেই চলে যেতে হয় অফিসে। সেখানে আজ প্রচুর কাজ করতে হয়েছে সামির খাঁনের অবর্তমানে। কাজ শেষে টায়ার্ড হয়ে বাসায় ফিরতেই সোফায় তৃষ্ণা কে উক্ত কথাটা বলে। তৃষ্ণা রাফির ঘামার্তক মুখ টার দিকে একবার তাকিয়ে বলে-
-“ যাই নি ভাইয়া।
-“ কেনো?
-“ আমার ভাবি যায় নি তাই আমিও যাই নি ভাইয়া।

রাফি গলার টাই টা ঢিলে করতে করতে সোফায় বসে বলে-
-“ প্লিজ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও না।
-“ জ্বি ভাইয়া এনে দিচ্ছি।
কথাটা বলে তৃষ্ণা রান্না ঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি গ্লাসে ঢেলে সেটায় নরমাল পানি মিক্স করে রাফির সামনে ধরে বলে-
-“ নিন ভাইয়া আপনার পানি।
রাফি গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা খেয়ে নেয়। প্রান টা জুড়িয়ে গেলো রাফির। খুব তেষ্টা পেয়েছিল। খালি গ্লাস টা সামনে থাকা টেবিলটায় রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তৃষ্ণার দিকে। এতো সুন্দর করে তার কথা বলার ধরন মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। তার উপর যা বলছে কেমন বাধ্য মেয়ের মতো সব শুনছে।
-“ চাচি কোথায়?
-“ ভাইয়া মা তো লিনা আন্টিদের বাসায় গেছে ইনভাইট করতে।
-“ তুমি গেলে না যে? তোমার লিনা আন্টির ছেলে বোধহয় হা-হুতাশ করছে তুমি যাও নি বলে।

তৃষ্ণা লজ্জা পাওয়া মুখশ্রী নিয়ে বলে-
-“ একদম ঠিক ধরছেন ভাইয়া। তুর্য কেবলই ফোন করে হাহুতাশ করছিল ভাইয়া আমি কেনো গেলাম না সেজন্য। ভাইয়া আমার যাওয়া উচিত ছিলো তাই না বলুন?
-“ কি তখন থেকে প্রত্যেক লাইনে লাইনে ভাইয়া ভাইয়া করে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ভ্যা ভ্যা করে চলছো ইডিয়েট।

রাফি আচমকা এক রাম ধমক দিয়ে বসলো তৃষ্ণা কে। তৃষ্ণা তার ত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলে-
-“ ভাইয়া আপনি তো আমার ভাইয়া লাগেন,আর বয়সেও বড়। তো আমি তো আপনায় ভাইয়াই ডাকবো তাই না? ছ্যাইয়া তো আর ডাকতে পারি না।

তুষার বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ ছ্যাইয়া না ডাকতে পারো প্লিজ ভাইয়া ডেকে মাথা গরম করিয়ো না।
-“ তাহলে কি নাম ধরে ডাকবো?বলবো এই রাফি শুনুন এভাবে?

এরমধ্যে তৃষ্ণার ফোন বেজে উঠে। তৃষ্ণা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে হাসে। সেটা রাফির নজরে পরে। সন্দেহাতীত হয়ে বলে-
-“ কে ফোন দিছে?
-“ লিনা আন্টির ছেলে তুর্য।
-“ তুর্য না তোমার বয়সে বড়। ভাই কেনো ডাকো না?
-“ ধূরু কি বলেন তাকে কি আর ভাইয়া ডাকা যায়? ভাইয়া ডাকলে তার হার্টে ব্যাথা করে। আমি জেনেশুনে কারো হার্টে ব্যাথা দি না।
-“ এদিকে ক্ষণে ক্ষণে আমায় ভাইয়া ডেকে ডেকে হার্টের ভেতর জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছো আর বলছো জেনেশুনে ব্যাথা দাও না।

রাফি বিরবির করে কথাটা বললো । তৃষ্ণার কর্ণধার অব্দি পৌঁছালো না।
-“ কি বিরবির করছেন ভাইয়া?
রাফির চোখ মুখ শক্ত হলো
-“ কিছু না,আর একবার ভ্যা ভ্যা করে ভাইয়া ভাইয়া বলে কান ঝালাপালা করলে চড়িয়ে দিব গাল লাল করে।
-“ এক মিনিট হ্যাঁ ফোনটা না হয় কেটে যাবে। কথাটা বলে নেই ভাইয়া।

তৃষ্ণা ফোনটা রিসিভ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রাফি রাগান্বিত হয়ে তাকালো তৃষ্ণার পানে। তৃষ্ণার সেদিকে খেয়াল নেই। বাহিরে বের হয়ে বাগানের দোলায় বসে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে সালাম। তৃষ্ণা সালামের জবাব দেয়।
-“ কেমন আছো তৃষ্ণা?
তৃষ্ণা মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আপনি?
-“ এই তৃষ্ণা খাবার টা গরম করে দাও ক্ষিদে পেয়েছে খুব।

কথাটা বলতে বলতে রাফি এসে তৃষ্ণার সামনে দাঁড়ায়। তৃষ্ণা রাফির পানে তাকিয়ে বলে-
-“ ভাইয়া আপনি তো পোশাক পাল্টান নি। আগে ফ্রেশ হোন আর খাবার টেবিলেই আছে খেয়ে নিন। দেখছেন তো ইমপোর্টেন্স কথা বলছি।
রাফি সূচালো দৃষ্টি দিয়ে তৃষ্ণা কে পরখ করলো। ফোনটা কেঁড়ে কে’টে দিয়ে বলে-
-“ একটা মানুষের ক্ষুধার থেকে কথা বলাটা কখনই ইমপোর্টেন্স হতে পারে না।
তৃষ্ণা রাফির থেকে ফোন টা কেঁড়ে নিয়ে বলে-
-“ আমি কি খাবার ধরে বসে আছি নাকি খাবার সব লুকিয়ে রেখেছি। আপনার ক্ষুধা পেয়েছে গিয়ে খান।
-“ তুমি চলো বেড়ে দিবে। এ বাড়ির ছেলেরা কখনও খাবার নিজ হাতে বেড়ে খায় না এটা নিশ্চয়ই অজানা নয়।
-“ না এ বাড়ির ছেলেরা তো লাটসাহেব তারা কেনো নিজ হাতে ভাত বেড়ে খাবে। হাত তো লজ্জায় মিইয়ে যাবে ভাত বেড়ে খেলে যত্তসব।

কথাটা বলে হনহন করে চলে যায় তৃষ্ণা। রাফি তৃষ্ণার পেছন পেছন যায়।

-“ এড়িয়ে চলছো আমায়? কিন্তু এড়িয়ে চলে কোনো লাভের লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

চিত্রা সন্ধ্যা হওয়ায় রুম থেকে বের হয় মাগরিবের নামাজ টা পড়ে। এই সন্ধ্যা বেলায় সব সময় হালকা পাতলা নাস্তা করার অভ্যাস তার। আজ ও ব্যাতিক্রম হবার নয়। রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে আসে একটু নুডলস রান্না করতে। রিয়াদ বসা ছিলো বসার ঘরে। চিত্রা কে রান্না ঘরে আসতে দেখে। সিমি তখন রুমে ঘুমে ব্যাস্ত। রিয়াদ রান্না ঘরে ঢুকে,চিত্রা বলে এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে। চিত্রা শুনেও না শোনার ভান করে নুডুলস টা রান্না করে বাটিতে ঢেলে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে হাক ছেড়ে তার মা’কে ডেকে বলে রিয়াদ কে যেনো কফি বানিয়ে দেয়।

রিয়াদের ইগো তে লাগলো। তখন শক্ত মুখে কথাটা বলে উঠে। চিত্রা রিয়াদের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ হু আ’র ইউ ম্যান? কোনো প্রিন্স চার্মিং নাকি কোনো বিল গেটস যে আপনাকে ইগনোর বা এভয়ড করা যাবে না।
-“ ইউ নো হু আই অ্যা’ম ইউর।
-“ ইয়াহ আই নো। বোনের স্বামী দুলাভাই।
রিয়াদ চোখ টিপ দিয়ে বলল-
-“ দ্যাট’স লাইক অ্যা গুড গার্ল। রিমেম্বার শালি অর্ধেক ঘরওয়ালি ইউ নো?
চিত্রার ইচ্ছে করলো গরম নুডলস টা রিয়াদের মুখে চেপে ধরতে। রিয়াদ যদি ওর রিলেটিভ না হতো তাহলে এতক্ষণে চড়িয়ে গাল লাল করে দিত ফাজিল ছেলের।
চিত্রা আর ব্যাক্য ব্যায় না করে নুডুলস টা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসে।

অধরা বেলকনি তে বসে ছিলো ইজি চেয়ারে। হাতে তার হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বই টি। বইটা মনোযোগ সহকারে পড়ছে সে। ছোট্ট একটা ছেলে স্বামী,শ্বাশুড়ি আর দেবর নিয়ে সুরাইয়ার ছোট্ট সংসার।সংসারে তেমন অভাব ছিল না। মাস শেষে পাওয়া বেতন দিয়ে বেশ চলে যেত।সুরাইয়ার ছোট ছেলের নাম ইমন।ইমনের বাবা একদিন অফিস করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।ইমনের বাবা হারিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ইমনের মায়ের বলা হয়ে উঠেনি আর তাদের আলোকিত করে আরেকজন নতুন সদস্য আসতে চলেছে।এভাবে অনেকদিন কেটে গেল ইমনের বাবার খোঁজ নেই।কোনো পরিবারে শিশুর আগমন হলে মনে হয় যেন ঘর আলোকিত হয়, কিন্তু সুরাইয়ার মনে হয়েছিল সে আরও ঘর আঁধার করে দিয়েছে।সুরাইয়ার মনে এক ভ্রান্ত ধারনা জন্মালো এই ছোট্ট শিশুটিই নাকি তার বাবা হারিয়ে যাওয়া এবং সকল অশান্তির কারণ।ছোট্ট শিশুটির নাম রাখা হয় সুপ্রভা।কিন্তু এই সংসারের মায়ায় ছোট্ট মেয়ে সুপ্রভা নিজেকে আর বেশিদিন আষ্টেপৃষ্ঠে রাখতে পারিনি। ছোট সুপ্রভাকে যখন মা বললো তুই মরতে পারিস না!ছাদে গিয়ে লাফ দে।সুপ্রভা তাই করলো,মনে হচ্ছিলো বারবার বলি এই ভুলটা করো না!কিন্তু সেই ছোট্ট সুপ্রভা তাই করলো। অভিমানি ছোট্ট মেয়েটি জানল না, বুঝল না।এই পৃথিবীতে তার জন্যে কত ভালবাসাই না জমা ছিল।

সুপ্রভা যখন মারা গেলো, তখন অধরা খেয়াল করলো মনের অজান্তেই চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমেছে। এই নিয়ে চার থেকে পাঁচ বার পড়ে হয়ে গেলো অধরার হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বইটা। প্রতিবারই সুপ্রভার মৃত্যু অংশ টুকু পড়া কালিন তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। অধরার ভাবনাগুলো কেমন যেন প্রতিবার ঝাপসা হয়ে আসে। কতই না বিচিত্র মানুষের জীবন। লেখকের কয়েকটা কথা ভীষণ ভালো লেগেছে।

ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই
আমার ঘর ভর্তি চাঁন্দের আলো
ধরতে গেলেই নাই………..!”

হুমায়ূন আহমেদের ভাষ্যমতে,
পৃথিবী শূন্যস্থান পছন্দ করে না।
তিনি বলতেন,কিছু না কিছু,কেউ না কেউ
শূন্যস্থান পূর্ণ করে দেয় কিংবা দখল করে নেয়।

অধরা আনমনে আকাশ পানে তাকিয়ে বইটা বুকে জড়িয়ে বলল-
-“ আমার শূন্য স্থান ও একদিন পূর্ণ হবে। পৃথিবী নিজ দায়িত্বে পূর্ণ করবে সেই শূন্য জায়গা। আমি অধির আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে আছি যে।

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-১৯+২০

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৯( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ এই ছ্যামড়ি রাফি ভাইকে সব বলে দিছিস কেনো?
চিত্রা খেতে বসেছিল তৃষ্ণার ফোন পেয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই কথাটা বলে উঠে তৃষ্ণা। চিত্রা মুখে নুডলস নিতে নিতে বলে-
-“ ছেলেটা তো ফ্রট। তোর ভালোবাসা বুঝে না আবার অন্য মেয়ে নিয়ে ঘুরাঘুরি করে। তোর কষ্ট হচ্ছিল দেখেই তো কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম।

তৃষ্ণা মাথায় হাত দিলো।
-“ সেজন্য তুই বলে দিবি?
-“ হ্যাঁ।
-“ গাঁধি একটা তুই জানিস।
-“ আশ্চর্য গাঁধি বলছিস কেনো?
-“ রাফি ভাই তো জেনেই গেলো আমি তাকে ভালোবাসি।
-“ তাতে কি তুই ইগনোর করবি।
-“ সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিছে।
নুডলস টুকু আর মুখে নিতে পারলো না চিত্রা। অবাক হয়ে শুধালো-
-“ কিহ! এই ছেলের ক্যারেক্টর এমন ঢিলা কিউ বেহনা? খাঁন বাড়ির ছেলেরা এমন ও হয়?
-“ চপ। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম ঐ মেয়ের সাথে রাফি ভাইয়ের রিলেশন আছে কিন্তু না। ঐ মেয়ের অলরেডি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ঐ মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের সাথে।
-“ তুই তো নিজেই একটা গাঁধি আবার আমাকে বলিস। না জেনে না শুনে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে কেটে বুক ভাসালি। আর আমিও আহাম্মকের মতো ঐ ছেলেরে যাতা বললাম।
-“ এখন আমি কি করবো সেটা বল।

চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো।
-“ তুই কি করবি মানে?
-“ ঐ যে বললাম প্রস্তাব দিছে বিয়ের।
-“ নাচতে নাচতে হ্যাঁ বলে দে গিয়ে।
-“ ধূরু মজা করিস না। বল না কি করবো?
-“ আমি জানি নাকি তুই কি করবি। তোর মন যেটা বলে সেটা কর।
-“ আচ্ছা এখন রাখি পরে ফোন দিব নি।

তৃষ্ণা ফোন কেটে দেয়। চিত্রা নুডুলস টা খেয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই চয়নিকা বেগম ডেকে উঠে। চিত্রা চয়নিকা বেগমের রুমে ঢুকে। চয়নিকা বেগম মেয়ে কে বিছানায় বসতে বলে।
-“ তোর খালা,মামি, মামা সবাই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চলে আসবে। রিয়াদ আর ওর বউ পরশু আসবে। পরশু বরং ভার্সিটি যাস না। অনেক গুলো বছর পর আসছে ওরা।

মুহুর্তে মুখটায় ঘোর আমাবস্যা নেমে আসলো চিত্রার। হাস্যোজ্জ্বল মুখ টায় ভিড়লো কালো অতীত। অনুভূতি রা পাগলপড়া হলো। দম টা বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। মনে পড়ে গেলো কিছু অতীত নামক বিষাক্ত অধ্যায়। কোনো রকমে জবাব দিলো-
-“ আমি আসছি মা শরীর টা ভালো লাগছে না।

চিত্রা চলে গেলো। চয়নিকা বেগম মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিলো।

চিত্রা ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় থম মেরে বসে রইলো। স্টাডি টেবিলের সামনে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা পুরোনো একটা ডায়েরি বের করে। ডায়রি টার দিকে চেয়ে আনমনে বলে উঠে,
-“ অতীত টা আজও তাড়া করে বেড়ায়। কিচ্ছু ভুলি নি আমি,সব মনে আছে। এবার আসছেন আমার শহরে। যন্ত্রণা কে আমন্ত্রণ জানান। লাইফ টা আপনার হ্যাল হয়ে যাবে। একই যন্ত্রণায় আপনিও পুড়বেন যেই যন্ত্রণায় পুড়েছি আমি চারটা মাস।

ডায়েরি টার প্রথম পৃষ্ঠা বের করে সেখানে আজকের তারিখ টা লিখে রাখলো চিত্রা। তারপর ডায়েরি টা বন্ধ করে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেয়। ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ট্যাপ ছেড়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়। মন মস্তিষ্ক শীতল করে বিছানায় পা তুলে বসে।

বাহির থেকে ভেসে আসে কলিং বেলের আওয়াজ। চয়নিকা বেগম চিত্রা কে ডেকে বলেন দরজা টা খুলতে। চিত্রা রুম থেকে বের হয়ে দরজার কাছে আসে। পরপর কলিং বেল বাজায় চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গেলো।
-“ আরে বাবা আসতেছি তো। এতো বেল বাজানোর কি দরকার।

কথাটা বলে চিত্রা দরজা খুলে দেয়। মুহুর্তে ভেসে উঠে আরহামের মুখশ্রী। চিত্রা দরজায় হাত দিয়ে একটু মুখ বের করে বলে-
-“ আরে আপনি আমাদের বাসায় কেনো। আপনার বাসায় কি জায়গা নেই নাকি থাকার।
-“ আন্টি আঙ্কেল কোথায়?
-“ বাবা বাসায় নাই। আর মা ঘুমায়।

কথাটা বলা শেষ হতে না হতেই আরহাম চিত্রার হাত চেপে ধরে। টান দিয়ে বলে-
-“ চলো আমার বাসায়,বিয়ে করবো আমরা।
চিত্রা আরহামের থেকে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে-
-“ আরে পাগল নাকি আপনি। আমি অলরেডি অর্ধেক ম্যারিড। লজ্জা করে না একজন হাফ অর্ধেক মেয়েকে বিয়ে করার কথা মুখে আনতে।
-“ হাফ হয়েছো আমিই না হয় পুরোপুরি করবো।
-“ এই যে আমার পায়ের জুতা চিনেন,এই জুতা দিয়ে এমন একটা বারি দিব না একদম আমাকে বিয়ে করার ভূত মাথা থেকে পালাবে।
-“ আহ এতো কথা না বলে চলো। তোমার বাপ চলে আসলে তোমাকে নিয়ে যেতে দিবে না।
-“ কে এসেছে রে চিত্রা?

চয়নিকা বেগমের ডাক শুনে চিত্রা জোরে বলে-
-“ তোমার মেয়ের জামাই হতে এসেছে টোকাই, দেখে যাও।
চয়নিকা বেগম রুম থেকে বের হলেন। দরজার কাছে এসে আরহাম কে দেখে বলে-
-“ এই ছেলে তুমি আমাদের বাসায় কেনো? বের হও বলছি।

আরহাম চিত্রার হাত টেনে চলে যেতে নিলে চয়নিকা বেগম বলে উঠে-
-“ এই আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
-“ আপনিই তো বললেন বের হতে। তাই চলে যাচ্ছি।
-“ আরে আমার মেয়েকে ছাড়ো। ওর বাবার কানে গেলে তোমার কি হবে বুঝতে পারছো?
-“ আর মা আরেকটু বলো তুষারের কানে গেলে ওর কি অবস্থা হবে। কলি’জা কে’টে ভুনা করে খাবে।
-“ আমি কাউকে ভয় পাই না।
আরহামের ওভার স্মার্ট সেজে বলা কথাটা ঠিক হজম হলো না চিত্রার। মুখে আঙুল দিয়ে বলে-
-“ সিরিয়াসলি?
-“ হ্যাঁ।
চিত্রা রুমে ঢুকে নিজের ফোন টা নিয়ে তার বাবার নম্বরে কল দিয়ে বাহিরে এসে বলে-
-“ হ্যালো বাবা তোমার ঐ বিরোধী দলের আরহাম এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে। আমি কি চলে যাব? নাকি এবার কিছু একটা করবে।

সাহেল আহমেদ সাভার নিউ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখানকার রাস্তার পাশে বসা দোকানগুলোর মালিকের সাথে কথা বলছিলো। পকেটে থাকা ফোন টা বেজে উঠায় ফোন রিসিভ করতেই তার মেয়ে গড়গড় করে কথাটা বলে উঠে। কপালে চিন্তার দু ভাজ পড়ে। উৎকন্ঠা হয়ে বলে-
-“ উল্টা পাল্টা কিছু করছে না তো?
-“ আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে। যাব চলে?
-“ আমি আসছি।

চিত্রা কান থেকে ফোন টা নামিয়ে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ বাবা আসতেছে আর আমি চুলায় খুন্তি পুড়া দিয়ে এসেছি।
আরহাম অবাক হয়ে বলে-
-“ খুন্তি পুড়া দিয়ে এসেছো কেনো?
-“ খুন্তি পুড়া দিয়ে দাগ বসাবো। জীবনেও আর চেয়ারম্যান বাড়ির মুখো যেনো আসতে না দেখি সেজন্য।

আরহাম এক ঢোক গিললো। বেশি হিরো গিরি দেখাতে এসে না আবার মানসম্মান যায়।
সাহেল আহমেদ তড়িঘড়ি করে বাসায় আসেন। সদর দরজার সামনে আরহাম কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাজখাঁই গলায় বলে-
-“ এই ছেলে আমার বাসায় কি তোমার? আর দারোয়ান তোমায় ঢুকতে দিলো কি করে।
আরহাম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল-
-“ ঘুষ দিয়ে ঢুকছি।
চিত্রা তার বাবার গলার আওয়াজ শুনে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বলে-
-“ কেমন দারোয়ান পুষো বাবা তুমি যে সে ঘুষ দিলে ঢুকতে দিয়ে দেয় বাসায়। আর এই বেলেহাজ ছেলের লাজলজ্জা তো কিছুই নেই। দু ঘা দিয়ে দিতো পারো না ছেলেপেলে লাগিয়ে।
-“ আরহাম দেখো অশান্তি করো না চলে যাও। তুমি জানো তোমার বাবার আর আমার মাঝে রেষারেষি অনেক।
-“ আপনার মেয়ে টাকে দিয়ে দিন আঙ্কেল নিয়ে চলে যাই।

চিত্রা গরম খুন্তি নিয়ে আরহামের মুখের সামনে ধরে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার,এই ছেলের মাত্রাতিরিক্ত পাগলামি তে।
-“ আর একবার আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দেখ এই খুন্তি তোর পিঠে পড়বে। তোর মতো পাগল দুটো দেখি নি আমি।

সাহেল আহমেদ মেয়েকে টেনে দূরে সরে নিয়ে আসে। এরমধ্যে বাহির থেকে গাড়ির আওয়াজ আসে। সাহেল আহমেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তুষার এসেছে,আসার আগে ছেলেটা কে বলে এসেছে সব।

তুষার গাড়ি থেকে নামে। চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে রাগে। রাতুল তুষারের নামার পর গাড়ি থেকে নামে। তুষার বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখে সদর দরজায় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভেতরে সাহেল আহমেদ মেয়েকে ধরে রেখেছে। চিত্রার হাতে খুন্তি,ছাড়া পাবার জন্য ছোটাছুটি করছে। তুষার কে দেখতে পেয়ে সাহেল আহমেদ মেয়েকে ছেড়ে দেয়। চিত্রা ছাড়া পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে তুষারকে।

চিত্রা এবার সব রাগ ক্ষোভ নিয়ে তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ এই আপনার হবু বউকে এই ছেলে ডিস্টার্ব করে রাস্তাঘাটে। আজ বাসা অব্দি চলে এসেছে। আপনি চুপচাপ মেনে নিবেন? মে’রে ওর হাত পা ভে’ঙে ফেলতে পারবেন না?

তুষার চিত্রার দিকে তাকালো। রেগে বোম হয়ে আছে। শান্ত কন্ঠে বলে-
-“ আপনি এটাই চান?
-“ হ্যাঁ, এই ছেলে হুটহাট শরীর স্পর্শ করে। হাত ধরে টানাটানি করে।
তুষার চুপচাপ শুনলো। হাত দুটো শক্ত করে মুঠো করলো। রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। আরহামের দিকে শীতল চাহনি নিয়ে তাকিয়ে বলে-
-“ আপনি চিত্রা কে স্পর্শ করার আগে অনুমতি নিয়েছিলেন?
আরহাম ঢোক গিলে। তুষারের নাম আগেও শুনেছে। ছেলেটার রাগ ক্ষমতা তাদের থেকেও বেশি। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে-
-” না।
সহসা তুষার তার শক্তপোক্ত হাত দিয়ে আরহামের গালে চড় বসিয়ে দেয়। চড়ের ভার সইতে না পেরে দু কদম পিছিয়ে যায় আরহাম। রাতুল টেনে ধরে তুষার কে। ফিসফিসিয়ে বলে-
-“ করছিস টা কি। কন্ট্রোল ইউর সেলফ।
রাতুল এগিয়ে গেলো আরহামের দিকে। আরহামের কলার ধরে বলে-
-“ বয়স কম তোমার,বাবার কথায় না নেচে এসব থেকে দূরে থাকো। তাতেই তোমার মঙ্গল। আর যার দিকে লেলিয়ে দিয়েছে তোমার বাবা সে কিন্তু তুষারের অক্সিজেন সো অক্সিজেন নিয়ে টানাটানি করলে তোমার অক্সিজেনই কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে। এবার বাসায় যাও।

আরহাম কে বিন্দু মাত্র নড়তে না দেখে তুষার রাতুলের দিকে তাকায়। রাতুল ইশারায় শান্ত থাকতে বলে।
-“ কি হলো যাচ্ছো না কেনো? আরো খেতে চাও তুষারের শক্তপোক্ত হাতের চড়?

আরহাম ডানে বামে মাথা নাড়ালো।
-“ তাহলে বাসায় যাও। বাবার কথায় না নেচে ভালো হও।
আরহাম একবার সবার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। চিত্রা শব্দ করে শ্বাস ফেলে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। সাহেল আহমেদ তুষারকে আর রাতুল কে সোফায় বসতে বলে। তুষার আর রাতুল সোফায় বসে। চয়নিকা বেগম রান্না ঘরে যান কফি বানাতে।
-“ আঙ্কেল চিন্তা করবেন না আর দ্বিতীয় বার এ বাড়ি মুখো আর চিত্রা মুখো ও হবে না।
-“ ছেলেটাকে নিজের সুবিধার জন্য জাস্ট ইউজ করছে আকবর।
-“ আমি সামলে নিব।
সাহেল আহমেদ তপ্ত শ্বাস ফেলেন। চয়নিকা বেগম কফি এনে রাতুল তুষার কে দেয়। রাতুল তুষার কফিটা খেয়ে চলে আসতে নেয়। সদর দরজায় আসতেই দেখে চিত্রা ও তার পেছন পেছন এসেছে। তুষার চিত্রার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে-
-“ নিশ্চিন্তে ঘুমান,আপনার চাওয়া পূরণ হবে।
চিত্রা তুষারের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তুষার গাড়িতে উঠে বসতেই রাতুল বলে উঠে –
-“ ছেলেটাকে আর কিছু করিস না তুষার। লাস্ট চান্স দে। এরপর কিছু করলে আটকাবো না।
-“ রক্তে টান লেগেছে?
রাতুল নিশ্চুপ হয়ে যায়। তুষার গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে-
-“ লাস্ট চান্স দিলাম। এরপর রক্ষে নেই।

রাতুল মাথা নাড়ায়। তুষার গাড়ি চালাতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরনগর আসতেই রাতুল গাড়ি থেকে নেমে যায়। তুষার রাতুল কে বিদায় জানিয়ে চলে যায়।
রাতুল চুপচাপ হাঁটতে থাকে। বারবার কানে বাজছে তুষারের বলা কথা “ রক্তে টান লেগেছে?” সত্যি কি তাই?। কথাটা আনমনে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখে অধরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে শরীরে চাদর জড়াতে জড়াতে হেঁটে আসছে। এই ভার্সিটি তে পড়ে অধরা রাতুল জানে। কিন্তু রাতে অধরা কে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হয়। দ্রুত হাঁটা ধরে অধরার কাছে যায়। অধরার নাম ধরে ডেকে উঠে।

অধরার আজ দেড়ি হয়ে গেছে। সামনে ভার্সিটি তে প্রোগ্রাম। সেটা নিয়ে ডিসকাশন করতে করতে রাত হয়ে গেলো। আকস্মিক নিজের নাম ধরে কারো ডাকার শব্দে পাশ ফিরে দেখে রাতুল এগিয়ে আসছে। অধরা চোখের চশমা টা ঠিক করে বলে-
-“ রাতুল ভাইয়া আপনি!
-“ হ্যাঁ আমি। আপনি আজ এখনো এখানে কেনো?
-” ভার্সিটির প্রোগ্রাম সামনে সেটা নিয়েই আলোচনা করতে করতে দেরি হয়ে গেলো।
-“ গাড়ি এনেছেন?
-“ হ্যাঁ ড্রাইভার আঙ্কেল এসেছে নিতে।
-“ আচ্ছা সাবধানে যাবেন।
-“ জ্বি। আপনি বাসায় যাচ্ছেন?
-“ হ্যাঁ।
-“ আচ্ছা আপনি ও সাবধানে যাবেন।
-“ আচ্ছা খুব কি তাড়া আছে আপনার বাসায় যাওয়ার?

অধরা হাত ঘড়িটায় টাইম দেখে বললো-
-“ কেনো?
-“ না মানে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য সময় হবে?
অধরা আশেপাশে তাকালো। সাত টা বাজে। অধরার ও খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল। রাতুলের বলা অফার টায় রাজি হয়ে বলল-
-“ হ্যাঁ খাওয়া যেতেই পারে। ভিষণ চা খেতে ইচ্ছে করছিলো। ভেবেছিলাম বাসায় গিয়ে খাবো। তবে এখান কার চা টা বেশ পছন্দের আমার।
-“ তাহলে চলুন ঐ টঙের দোকান থেকে খাওয়া যাক।
অধরা স্মিত হেঁসে বলে-
-“ নিশ্চয়ই।

অধরা আর রাতুল পাশাপাশি হাঁটে। চারিপাশে বইছে শীতল ঠান্ডা বাতাস। সেই শীতল ঠান্ডা বাতাস অধরা আর রাতুলের শরীরে মিশে যাচ্ছে। কয়েক কদম এগিয়ে এসে সেই টঙের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। রাতুল দোকান টার ভেতর ঢুকে মাটির কাপে দু কাপ মালাই চা নিয়ে আসে। এক কাপ অধরার হাতে ধরিয়ে দেয়। টঙের সামনে থাকা বেঞ্চ টায় বসে পড়ে দু’জনে। অধরা ফু দিয়ে একটু একটু চা মুখে নেয়। রাতুল চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অধরার কে আড়চোখে দেখে। মেয়েটার মাঝে কিছু তো একটা আছে যেটা রাতুল কে ভীষণ ভাবে টানে।

মেয়েটাকে উচ্চস্বরে কখনো হাসতে দেখে নি,সাজতে ও দেখে নি। যখনই দেখা হয়েছে তখনই এমন সাদামাটা ভাবেই দেখেছে। অধরাকে বেশির ভাগ সাদা রঙের পোষাকেই দেখেছ রাতুল। এই তো আজও সাদা রঙের গোল জামা পড়েছে। বরাবরের মতো আজও সাইডে সিঁথি করে চুল গুলো বেণি করেছে। মুখে কোনো রকম প্রসাধনীর ছিটেফোঁটা নেই। একদম শুভ্র পরি। অধরা নাম না রেখে শুভ্রতা রাখা উচিত ছিলো নাম।

-“ ভাইয়া আসি তাহলে আজ।
অধরার কথায় ঘোর ভাঙে রাতুলের। রাতুল কাপের দিকে তাকিয়ে দেখে খাওয়া শেষ। দোকানে বিল দেওয়ার জন্য যেতে চাইলে অধরা বাঁধা দিয়ে বলে-
-“ আমি বিল দিয়ে দিছি ভাইয়া,আপনাকে দিতে হবে না।

রাতুল কিছুটা রাগ নিয়ে বলে-
-“ আপনি কেনো দিছেন বিল। আমি খেতে নিয়ে এসেছি আমি বিল টা আমার দেওয়ার কথা।
-“ আরেক দিন না হয় আপনি দিবেন বিল। আজ আসি বরং,অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।
-“ তারমানে আরেক বার আমাদের চা খাওয়া হবে একসাথে?
-“ কেনো নয়। ইনশাআল্লাহ হবে।
-“ আশ্বাস দিচ্ছেন তাহলে?
-“ জ্বি।
-“ সাবধানে যাবেন, আল্লাহ হাফেজ।
-“ আপনিও, আল্লাহ হাফেজ।

অধরা চলে যায়। রাতুল অধরার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। দৃষ্টির অগোচরে যেতেই রাতুল নিজের বাড়ির পথে হাঁটা ধরে।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২০( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripte

-“ কি ব্যাপার আজ এতো প্রানউচ্ছাস দেখাচ্ছে কেনো? প্রেমে টেমে পড়েছিস নাকি?

রোমিলা বেগমের কথায় কোনো ভবান্তর হলো না রাতুলের। ডাইনিং টেবিলে বসে ফলের ঝুড়ি থেকে আপেল নিয়ে সেটায় কামড় বসালো। রোমিলা বেগম রাতুলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফের বলে-
-” কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছিস না কেনো?
রাতুল আপেল টা শেষ করলো। ফলের ঝুড়ি থেকে এবার একটা আঙুর তুলে নিয়ে বলে-
-“ প্রানউচ্ছাস থাকলেই যে সে প্রেমে পড়বে এটা কোথায় লিখা আছে?
-“ কোথাও নেই লিখা আমি নিজে থেকেই বললাম।
-“ তেমন কিছুই না মা।
-“ ওহ্ তোকে দ্বারা যে এসব হবে না আমার আগেই বুঝে নেওয়া উচিত ছিলো।
-“ হয়েছে তোমাকে আর এঁটো থালাবাসন ধুতে হবে না। আমি ধুয়ে রাখবো নি তুমি গিয়ে ঘুমাও রাত হয়েছে অনেক।

রোমিলা বেগম এঁটো থালাবাসন গুলো বেসিনের সামনে নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন-
-“ এসব কাজ ছেলেদের নয়। কত করে বলছি বিয়ে কর বিয়ে কর। কথাই কানে নিচ্ছিস না। সারাদিন তো এদিকে ওদিকে একাজ ওকাজ করিস,আমি বৃদ্ধ মানুষ বাসায় একা থাকি,আমারও তো একাকিত্ব লাগে।তুই বিয়ে করলে তো আমি একটা সঙ্গী পাই। যার সাথে সারাদিন গল্পগুজব করে এক সাথে মিলেমিশে কাজ করতে করতে দিনটা পাড় করতে পারবো। একটু মায়ের কষ্ট টা বুঝবি না তুই? তুই ছাড়া আমার আর কে আছে বলতো?

শেষের কথাগুলো বলার সময় রোমিলা রহমানের গলা ধরে আসছিলো। রাতুল রান্না ঘরের বেসিনের সামনে গিয়ে পেছন থেকে রোমিলা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বলে-
-“ তোমার কি খুব আফসোস হচ্ছে একটা ছেলের বউয়ের জন্য?
রোমিলা বেগম প্লেট ধুতে ধুতে বলেন-
-“ হুমম।
-“ আচ্ছা বেশ তুষারের বিয়েটা হওয়ার পরই আমি তোমার জন্য বউমা নিয়ে আসবো।

রোমিলা বেগম প্লেট ধোয়া বন্ধ করে পেছনে ঘুরে উৎকন্ঠিত হয়ে বলে-
-“ সত্যি!
রাতুল রোমিলা বেগমের কাঁধ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রান্না ঘর থেকে বের হতে হতে বলে-
-“ হ্যাঁ সত্যি। এবার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। বাকি কাজ গুলো আমি করছি।
রোমিলা বেগম বাঁধ সেজে বলে-
-” তুই বিশ্রাম নে ওগুলো আমি শেষ করে যাচ্ছি।
-“ আমি তো বললাম আমি করবো তুমি যাও।

রোমিলা বেগম চলে গেলেন। রাতুল থালাবাসন গুলে ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে উপর করে রাখে। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখে নেয়। দশটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। ফোনটা ফের পকেটে ঢুকিয়ে ড্রয়িং রুমের লাইট নিভিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

-“ তোর গাল এমন লাল হয়ে আছে কেনো? মনে হচ্ছে কেউ থাপ্পড় মেরেছে।
আরহাম বাসায় এসে নিরবে সোফায় বসতেই আকবর কথাটা বলে উঠে। আরহাম আকবরের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে-
-“ তোমার জন্য ই তো থাপ্পড় পড়লো আমার গালে। কেনো বলেছিলে চিত্রা কে তুলে আনতে?
-“ তোর জন্য ই তো বলেছিলাম। ওদের বাসায় তো চিত্রা আর ওর মা ছাড়া কেউ ছিলো না তাহলে।
-“ চিত্রা ফোন করেছিলো ওর বাবাকে।
-“ তুই বাঁধা দিস নি?
-“ বাঁধা কেনো দিবো?
আকবর ছেলের উপর ক্ষুব্ধ হলেন। কিছুটা চিৎকার করে বললেন-
-“ আহাম্মক তুই সোজা চিত্রা কে নিয়ে চলে আসবি। তা না করে ঐ মেয়েকে ফোন করার জন্য সময় দিয়েছিস গাধা।
-“ একদম গাধা বলবা না।
-“ মেরেছে টা কে তোরে?
-“ এমপির ছেলে তুষার।
-“ আর তুই চুপচাপ মাইর খেলি? পাল্টা দিতে পারিস নি?
-“ এমনিই চাপাটা ব্যাথা করছে তারউপর কি নিজের মুখ টাকে বিকৃতি করার জন্য যেচে নিজের উপর বিপদ ডেকে আনবো নাকি?
-“ তুই চিত্রা কে চাস না তাহলে?
-“ মাইর গুতা খেয়ে চাই না। তুমি যদি পারো তাহলে এনে দাও।

কুয়াশায় জড়ানো চারিপাশ। কুয়াশার জন্য সামনে থাকা কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। সকাল টা শুরু হয় এমন ঘন কু্য়াশায় প্রকোপ শীতে আর দুপুর গড়াতে না গড়াতেই গরমের মাত্রা বাড়ে। আবার সন্ধ্যা হলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকে চলে আসে।
চিত্রা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ফজরের সময় উঠেছিল টাংকির পানি তখন বরফের মতো ঠান্ডা ছিলো। সেই পানি দিয়ে ওজু করতে গিয়েই শরীর জমে উঠেছিল ঠান্ডায়। ওজু শেষে ফজরের নামাজ আদায় করে সূরা ইয়াসিন পড়ে বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।

হঠাৎ বালিশের তলে থাকা ফোনটা বেজে উঠায় বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে চিত্রা। ঘুমঘুম চোখে বলিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে রিসিভ করে কানে নেয়।

-“ বিয়ে করছো শুনলাম?
কথাটা কর্ণকুহর হতেই সমস্ত ঘুম উবে যায় চিত্রার। কান থেকে ফোনটা সামনে এনে নম্বর টা দেখে নেয়। আজ তিনটা বছর পর সেই চিরচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। একটা সময় এই নম্বর থেকে একটা ফোন পাওয়ার আসায় গভীর রাত অব্দি জেগে থাকতে। আর আজ সময়ের ব্যাবধানে সেই নম্বরের থেকে আসা ফোন কলটা হৃদয় টাকে বিষাদে রূপান্তরিত করছে। চোখ মুখ শক্ত করে চিত্রা জবাব দেয়-
-“ বিয়ের খবর যেহেতু শুনেছেন সেহেতু বিয়েটা আমি করছি এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
-“ অস্বাভাবিক লাগলো আমার কাছে। তিন বছরের মধ্যেই মুভ অন। হাউ?

ঘৃণায় চিত্রার চোখ মুখ জ্বলতে শুরু করলো। বিশ্রী রকমের ভাষাও মুখ থেকে বের হতে চাইলো। কিন্তু পরক্ষনে নিজেকে সামাল দিয়ে শুধালে-
-“ আপনি যদি তিন বছর আগেই সব শেষ করে মুভ অন করতে পারেন তাহলে আমি কেনো পারবো না? আমার কি আপনার শোকে প্রতি নিয়ত দুমড়ে মুচড়ে উঠার কথা ছিলো নাকি?

ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসলো। হাসি টা চিত্রার শরীরে কাঁটার মতো বিধলো।
-“ আমি তেমন টাই ভেবেছিলাম। যেই মেয়ে পাগলের ন্যায় আমায় ভালোবাসে সেই মেয়ে বিয়ে করবে ভাবনাতে আসেই নি।

চিত্রা কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে-
-“ ভালো বেসেছিলাম, মানে অতীতে। আপনার মত নিকৃষ্ট মানুষ কে যে আমি ভালোবেসেছিলাম কথাটা মনে পড়লেই রাগ হয় প্রচন্ড নিজের উপর।
-“ এখন কি ভালোবাসো না?
-“ জীবনে সব চাইতে যদি বেশি ঘৃণা কাউকে করি সেটা আপনি।
-“ হাস্যকর চিত্রা বিয়ে করে নিলেই কি তার জীবন থেকে রিয়াদ নামক নাম টা মুছে যাবে? নো নেভার। আসছি আমি।
-“ সহ্য ক্ষমতা সাথে করে নিয়ে আসবেন। এবার কিন্তু চিত্রা সব কড়ায় গণ্ডায় ফেরত দিবে।
-“ রিয়াদের সহ্য ক্ষমতা প্রচুর। দেখলে না তোমার ন্যাকা মামাতো বোন কে কি করে সহ্য করছি দিনের পর দিন।
-“ আপনার সাথে কথা বলার মতো রুচি নেই আমার।

কথাটা বলে দুম করে ফোনটা কেটে দেয় চিত্রা। রাগে মাথার চুল গুলো দু হাত ধরে চেপে ধরে। এক দমকা হাওয়ার মতো এসেছিল এই রিয়াদ। আর জীবনের সব শান্তি সুখ অশান্তি অসুখে পরিনত করে দিয়েছে। এখন আবার যখন সব ভুলে নিজেকে নিয়ে ভাবছে তখন আবার নিজের অস্তিত্ব জানাতে চলে আসছে। কথায় আছে না পৃথিবীর ছিয়ানব্বই শতাংশ মানুষই প্রথমে ভুল মানুষকেই ভালোবাসে।
-“ আমার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল আপনি। প্রথম অনুভূতি ছিলেন আপনি আমার। আর আপনার থেকেই বাজে ভাবে ঠকে গেছি আমি। আপনাকে মানুষ বলতে রুচিতে বাঁধে আমার। আপনি মানুষরূপী অমানুষ। আপনার চোখের সামনেই এই চিত্রা সুখে শান্তিতে সংসার করবে। আপনি নিজেও চিনতে পারবেন না তিন বছর আগের চিত্রা আর এখনকার চিত্রার মধ্যে কত মিল অমিল।

-“ রাফি ভাই কাল আপনি আমায় একটা কথা বলেছিলেন,উত্তর টা শুনবেন না?

রাফি বাগানের দোলনায় বসে ফোন স্ক্রোল করছিল। পাশ থেকে তৃষ্ণার কথা শুনে পাশ ফিরে। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে-
-“ কি বলেছিলাম আমি?
তৃষ্ণার হাস্যজ্বল মুখটা মুহূর্তে চুপসে গেলো।
-“ ভুলে গেছেন? কাল রাতে যে ড্রয়িং রুমে আমায় বললেন।
রাফি তৃষ্ণার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকিয়ে বলে-
-“ আমার ঠিক মনে পড়ছে না কি বলেছিলাম তোমায়। আচ্ছা কি বলেছিলাম আমি তোমায়?

তৃষ্ণা পারে না তো এবার কেঁদে দিতে। চোখে অলরেডি পানি এসে পড়েছে। এবার শুধু টুপ করে গাল বেয়ে পড়ার বাকি। গলা ধরা কন্ঠে বলে উঠলো-
-“ সত্যি মনে পড়ছে না?
-“ না।
-” আপনি ভীষণ পঁচা রাফি ভাই।

কথাটা বলে রাগে হনহন করতে করতে চলে গেলো তৃষ্ণা। রাফি তৃষ্ণার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে হোহো করে হেসে উঠলো। ভারি মজাই লাগছে তৃষ্ণা কে কনফিউজড, রাগাতে।

তুষারের মুখোমুখি বসে আছে আকবর। আকবরের চোখ মুখ দিয়ে যেনো আগুন ঝড়ছে। তুষার সেদিকে তাকিয়ে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ চোখ মুখে ঠান্ডা জল টা ঢেলে দিন। বয়স হচ্ছে আপনার অযথা এই সো কোল্ড রাগ আমার সামনে বহিঃপ্রকাশ করবেন না।

আকবরের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসলো। হাত শক্ত করে বলল-
-“ সাহস হয় কি করে তোমার আমার ছেলেকে চড় মারার?

তুষারের কপালে দু ভাজ পড়লো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
-“ আপনার ছেলের সাহস হয় কি করে চিত্রা কে স্পর্শ করার? ভদ্রতা শেখাতে পারেন নি ছেলেকে। অপ্স সরি আপনার নিজেরই তো ভদ্রতা নেই ছেলেকে কি শিক্ষা দিবেন।
আকবর এবার হুংকার দিয়ে বলে উঠে-
-“ মুখ সামলে কথা বলো তুষার।
তুষার হাতে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বলে-
-“ গলার স্বর নিচু করুন। বয়সের জন্য খুব একটা ভালো না।
-“ থ্রেট দিচ্ছো?
-“ মোটেও না। আপনার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় ট্রাস্ট মি আমার নেই। আপনি আসতে পারেন।
-“ অপমান করছো?
-“ যার মান নেই তার আবার কিসের অপমান। যাইহোক নিজে যেমন দয়া করে ছেলেকে তেমন বানাবেন না। ছেলে হারালে কিন্তু তারজন্য দায়ী থাকবেন আপনি।

আকবর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। তুষারের কেবিন থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আকবর এদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন সামনে তুষারের অফিস টা দেখে ভেতরে ঢুকেন ছেলেকে চড় মারা নিয়ে কিছু কটাক্ষ শুনাতে। কিন্তু পারলেন আর কই তুষারের কটাক্ষ কথা শুনে শরীরে জ্বালা ধরে গেলো।

রাতুল কেবলই অফিসের মধ্যে ঢুকছিল, আকস্মিক সামনে আকবর কে দেখে দৃষ্টি মাটিতে নিবন্ধন করে। এদের মত কিট দের দৃষ্টি নিয়ে দেখা মানে নিজের দৃষ্টি কে কলুষিত করা। রাতুল আলগোছে আকবর কে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আকবর রাতুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আকবরের মনে হলো রাতুল তাকে যেনো ইচ্ছে করে উপেক্ষা করে চলে গেলো।

রাতুল তুষার কেবিনে এসে গম্ভীর কন্ঠে বলে-
-“ লোকটা এখানে এসেছিল কেনো?
তুষারের কাটকাট জবাব-
-“ যেচে অপমান হতে।
-“ অপমান বুঝে নাকি সে।
রাতুলের বলা তাচ্ছিল্যের কথা শুনে তুষার আর কিছু বললো না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাতুল নিজ থেকেই তুষার কে বলে-
-“ তুষার অধরার নম্বর হবে?
তুষার ভ্রু কুঁচকায়।
-“ ওর নম্বর দিয়ে কি করবি?
-“ দরকার ছিলো।
-“ ০১৭৯৯******।
-“ ধন্যবাদ।

ভার্সিটি শেষে জাহাঙ্গীরনগরের পদ্মবিল পুকুর টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অধরা। তার এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পড়াশোনা। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কথাগুলো ভাবতেই হঠাৎ বেগে থাকা ফোন টা বেজে উঠে। অধরা ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখে আননোন নম্বর। রিসিভ করবে কি করবে না এ নিয়ে দ্বিধায় রইলো। ফোনটা কেটে যেতেই স্বস্তি পেলো অধরা। স্বস্তি টা স্থায়ী হলো না। ফোনটা দ্বিতীয় বার বেজে উঠলো।

অধরা মনে দ্বিধা সংশয় নিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো। ফোনের ওপায় থেকে ভেসে আসলো সুমধুর কন্ঠে সালাম। অধরা সালামের জবাব দিলো। ওপাশ থেকে ভেসে আসলো –
-“ আমি রাতুল বলছি। কেমন আছেন?
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
-“ জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আজ ফ্রী আছেন? বাসায় ফিরবেন কখন?
-“ কালকের মতো হয়তো দেরি হতে পারে। কিন্তু কেনো?
-“ আমি আসতাম তাহলে। আমি আসলে মাইন্ড করবেন? আপনার সাথে আরেক কাপ চা খাওয়ার ইচ্ছে জাগছে।

অধরা স্মিত হাসলো। চশমা টা চোখ থেকে খুলে বলল-
-“ না মাইন্ড করবো না।
-“ তাহলে আসবো অপেক্ষা করবেন?
-“ জ্বি।
-“ আচ্ছা রাখি তাহলে।

রাতুল ফোন কে’টে দিতেই অধরা ফোন ব্যাগে ভরে ফেলে। পদ্মবিলের দিকে তাকিয়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে চলে যায়।

-“ আজ এমন মন মরা কেনো আপনি? কিছু হয়েছে?
ভার্সিটি শেষে আজ তুষার এসেছে চিত্রা কে নিতে। তুষার এসে থেকেই খেয়াল করছে চিত্রার নিরবতা। সচারাচর তুষার চিত্রা কে নিরব খুব কম দেখেছে বললে ভুল হবে নিরব থাকতেই দেখে নি। চিত্রা দৃষ্টি সামনে চলতে থাকা চলন্ত গাড়ি গুলোর দিকে রেখে আনমনে বলে-
-“ আপনি আমার জীবনে আসতে দেরি করলেন কেনো এমপি মশাই? তিনটা বছর আগে দেখা দিলে কি খুব ক্ষতি হতো?
তুষার আড় চোখে তাকালো। চিত্রার আনমনে বলা কথাটায় কিছু একটা ছিলো। গাড়িটা সাইডে পার্ক করে পুর্ণ দৃষ্টি চিত্রার পানে দেয়। চিত্রা হঠাৎ গাড়ি থামায় হকচকিয়ে উঠে। তুষারের দিকে তাকাতেই দেখে তুষার তার দিকে তাকিয়ে আছে। তুষারের চোখের চাহনি শীতল।
-“ কি হয়েছে আপনার আজ? এমন নিরব নিস্তব্ধতা কেনো? আপনার ঐ চঞ্চল স্বভাব টা আমার যে বড্ড পছন্দের। কালকের ঘটনা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?
তুষারের কথা গুলো চিত্রার হৃদয়ে বইতে থাকা অশান্ত ঝড় টাকে কিছুটা শান্ত করলো। আশ্বস্ত ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। যার মানে সে ঐ বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না।
চিত্রা এদিক ওদিক তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বলে-
-“ একটু পানি হবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে।
তুষার গাড়িতে থাকা পানির বোতল টা বের করে। চিত্রার সামনে ধরতেই চিত্রা পানির বোতল টা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়। চিত্রার শরীর বেয়ে তরতর করে ঘাম ঝড়ছে,অথচ গাড়িতে এসি চলছে। তুষারের মোটেও ভালে লাগছে না। হৃদয় জুড়ে বইছে অশান্ত হাওয়া। চিত্রার বাহু চেপে চিত্রা কে নিজের কাছে এনে বলে-

-“ সমস্যা টা খুলে বলুন না।
তুষারের অসহায়ত্ব ভরা কন্ঠে বলা কথাটা শুনে চিত্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
-“ আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন এমপি মশাই? হৃদয় টায় খুব রক্তক্ষরণ হচ্ছে অদ্ভুত এক যন্ত্রণায়। নিঃশ্বাস মনে হয় থেমে যাবে…
চিত্রা আর কিছু বলতে পারলো না। তুষার শক্ত করে চিত্রা কে জড়িয়ে ধরলো।

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-১৭+১৮

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৭( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ মিস অধরা আপনি কাঁদছেন কেনো?

অধরা ছাঁদে দাঁড়িয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছিলো। তৃষ্ণা কিছুক্ষণ আগে ফোন করে জানিয়েছে আগামী মাসের ১০ তারিখে বিয়ে। আজ থেকে ঠিক ১২ দিন পর। কথাটা শোনামাত্র অধরার বুক ফেটে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসছিলো। তৃষ্ণা কে তাড়া দিয়ে ফোন কেটে ছাঁদে চলে আসে। বাড়িতে কেউ নেই এখন মন খুলে চিৎকার করে কাঁদতে পারবে। কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অধরা। আকাশের পানে তাকিয়ে বলে উঠল-
-“ বিধাতার তরে আপনাকে চাওয়া তো কোনো কমতি আমি রাখি নি তুষার ভাই তবুও কেনো বিধাতা এমন নিষ্ঠুরতম কাজ করলো আমার সাথে? একই শহরে,একই বাড়িতে থাকছি অথচ আপনার শহরে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ করা হলো। কেনো বলতে পারেন? ভালবাসলে এতো কষ্ট পেতে হয় কেনো বলুন না? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা ক্রমাগত কেউ ধারালো ছু’রি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে, আপনাকে অন্যের পাশে দেখলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে টাও ম-রে যাচ্ছে। আপনাকে পাবো না জানলে কখনই আপনাকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস আমি দেখাতাম না। চোখ দুটো অনেক অবাধ্য জানেন তো আপনার কথা মনে আসলেই কারনে অকারণে পানি গড়িয়ে পড়ে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি বলবো এই আপনাকে আমি প্রচন্ড রকমের ভালোবেসেছিলাম আর এখনও বাসি।

অধরা তড়িঘড়ি করে পাগলের ন্যায় উঠে বসলো। অবস্থা তার বিধ্বস্ত। ওড়নার শেষ অংশ টুকু দিয়ে চোখের জল মুছে নিলো। পেছন ঘুরে দেখলো রাতুল ছাঁদের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাতুল কে এই সময় বাসায় দেখে ভীষণ অবাক হয় অধরা। অধরা কে কিছু বলতে না দেখে রাতুল আবার বলে উঠে –
-“ আপনি কাঁদছিলেন কেনো মিস অধরা?
অধরা কিছুটা ভয় পেলো। কান্না করার সময় কি রেখে কি বলে ফেলছে সেটা যদি রাতুল শুনে থাকে আর তুষার কে যদি বলে দেয় তখন তো আরেক বিপত্তি।
-“ আ আমি কান্না করি নি।
রাতুল স্পষ্টতার সাথে বলল-
-“ আমি কান্নার শব্দ শুনেছি। আর ছাঁদে এসে কান্না করতেও দেখলাম তবুও মিথ্যা কেনো বলছেন? আপনার আম্মাকে খুব মনে পড়ছে?
অধরা মাথা উপর নিচু করে জানালো হ্যাঁ। রাতুল স্মিত হেঁসে বলে-
-“ আম্মার কথা মনে পড়লে এভাবে কাঁদবেন না মিস। আপনার আম্মা উপর থেকে দেখে কষ্ট পাবে। নামাজ পড়ে দোয়া করবেন,মনে থাকবে?
অধরা মাথা নিচু করে জবাব দেয়-
-“ হুমম।
-“ আচ্ছা এই প্যাকেট টা নিন। তুষার আসলে দিয়ে দিবেন। এটা দিতেই এসেছিলাম আপনাকে।

অধরা অবাক হয়ে বলে-
-“ আমাকে?
-“ হুমম। তুষার বললো আপনি বাসায় আছেন। তাদের সাথে যান নি,আপনার কাছে যেনো দিয়ে যাই।
-“ আচ্ছা ভাইয়া আসলে দিয়ে দিব।
-“ আজ আসি তাহলে।
-“ জ্বি।

রাতুল উল্টো ঘুরে ফের কিছু একটা মনে পড়তেই আবার সামনে ঘুরে।
-“ মিস অধরা আপনাকে একটা কথা বলি?
-“ জ্বি বলুন।
-“ কখনও ঐ চোখ জোড়া থেকে খুব সহজে জল গড়িয়ে পড়তে দিবেন না। ওটা অনেক মূল্যবান।

রাতুল চলে গেলো। অধরা রাতুলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। রাতুল দৃষ্টি সীমার বাহিরে যেতেই হাতে থাকা প্যাকেট টার দিকে তাকিয়ে রুমে চলে আসে।

তৃষ্ণা গাড়ির ভেতর বসে মা দাদির সাথে বকবক করে চলছে। তুষারের বিয়েতে কি করবে কিভাবে সাজবে সব। রাফি ড্রাইভ করছে আর লুকিং গ্লাসে তৃষ্ণা কে দেখে চলছে। অন্য গাড়িতে তুষার তার বাবা চাচা আর দাদা। তৃষ্ণা কথা বলার সময় লুকিং গ্লাসের দিকে তাকাতেই দেখে রাফি তাকিয়ে আছে।
-“ রাফি ভাই সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান লুকিং গ্লাসে না তাকিয়ে।

রাফি দৃষ্টি সরালো। গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিলো। তৃষ্ণা তাকে ভালোবাসে কথাটা জানার পর থেকেই রাফির ইচ্ছে করছে তৃষ্ণা কে সামনে বসিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে- কবে কবে কেঁদেছ আমার জন্য। কিন্তু পারছে না। তুষারের বিয়ে টা হলেই নিজের মনের কথা তৃষ্ণা কে জানাবে। তারপর? তারপর একদম নিজের করে নিবে।

চিত্রা নিজের রুমে বসে লজ্জায় লাল নিল হচ্ছে। কয়েকদিন পর তার বিয়ে কথাটা মনে পড়তেই লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছে। চয়নিকা বেগম মেয়ের রুমে এসে মেয়েকে এমন লজ্জা পেতে দেখে বলে-
-“ কয়েক দিন আগেই না বলছিলি বিয়ে করবি না এ ছেলে কে তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো?
চিত্রা মুখটাকে স্বাভাবিক করলো।
-“ আগে ছিলাম না রাজি তাতে কি এখন তো আমি রাজি।
-“ সেজন্য ই তো জানতে চাইছি হঠাৎ কি এমন হলো।
-“ ম্যাজিক হয়েছে মা ম্যাজিক।
-“ কিসের ম্যাজিক?
-“ ব্লাক ম্যাজিক। তুষার খাঁন আমায় ব্লাক ম্যাজিক করেছে।
-“ সেটা কি?
-“ উফ মা কালো যাদু।
-“ সত্যি?
-“ আমি কি মিথ্যা বলি বলো? তুষার খাঁন এমন যাদু টোনা করলো যে আমি নাই করতে পারলাম না।
-“ যাক যাই করে হোক রাজি তো হলি এটাই অনেক।
-“ হুমম আমি ভদ্র মেয়ে তোমাদের, তাই চুপচাপ মেনে নিয়েছি।
-“ হুম আমার লক্ষী মেয়ে, আমাদের জ্বালিয়েছো এবার ও বাড়ি গিয়ে জ্বালাবে। কাপড় পাল্টে খেতে আয়।

ড্রয়িং রুমে বসে আছে খাঁন বাড়ির সবাই। তানিয়া বেগম চা বানিয়ে সবার হাতে হাতে দিলো। তরিকুল খাঁন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল-
-“ তুষারের বিয়ের পর অধরা দিদি ভাই এর বিয়ের সিরিয়াল তারপর….
-“ তারপর না দাদু তার আগেই আমার বিয়ের সিরিয়াল, ব্রো এর পর।

রাফির কথা শুনে সামির খাঁন কেশে উঠে। তরিকুল খাঁন হেঁসে বলে-
-“ আর একটু বড় হও। বছর দু এক যাক।
রাফি ভ্রু কুঁচকালো।
-“ আমি কি বড় হই নি? আজ বিয়ে দিলে কাল বাচ্চার বাপ হবো।
-“ পছন্দের কেউ আছে নাকি?
রাফি তৃষ্ণার দিকে তাকালো। তৃষ্ণা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ সরিয়ে জবাব দিলো-
-“ হ্যাঁ আছে। ব্রো এর বিয়ের জন্য বলতে পারছি না।
-“ কোন বংশের মেয়ে?
-“ উচ্চ বংশের ই মেয়ে প্যারা নিয়ো না পছন্দ হবে তোমাদের।

তৃষ্ণার মনটা আবার ছোট হয়ে গেলো। লোকটা আবার কাকে পছন্দ করে?

-“ বয়স তো কম হচ্ছে না তোর, তুষারের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অথচ তুই বিয়ে নিয়ে কিছু বলছিস না,কিন্তু কেনো? বিয়ে কি করবি না? নাতিনাতনির মুখ দেখবো না আমি?

রাতুল বাসায় আসতে না আসতেই তার মা রোমিলা বেগম কথাটা বলে উঠে। রাতুল তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে-
-“ আহ মা রোজ রোজ এই বিয়ে নিয়ে কথা শুনতে শুনতে কান টা পঁচে গেলো। মনমতো মেয়ে পাই নি পেলে জানাবো।
-“ কেমন মেয়ে পছন্দ বল আমি খুঁজছি।
-“ সাদাসিধে সাংসারিক মেয়ে। খুঁজে পেলে জানিয়ো। এবার খেতে দাও ক্ষিদে পেয়েছে।
রোমিলা বেগম খাবার বেড়ে দিলো। রাতুল চুপচাপ খাবার খেলো। রোমিলা রহমান ঘটককে ফোন দিয়ে বলে দিলো এমন মেয়ে খোঁজার জন্য।

-“ ভাইয়া আসবো?
তুষার ল্যাপটপে কাজ করছিলো। অধরার কথা শুনে দরজার পানে চেয়ে বলে-
-“ হুমম আয়।
-“ রাতুল ভাই প্যাকেট টা দিয়ে গেছে। আপনায় দিতে বলেছে।
-“ ওহ্ হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। ধন্যবাদ এনে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।
অধরা একপলক তুষারের দিকে তাকায়। সাথে সাথে তুষারের ফোন বেজে উঠে। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করে লেখা চিত্রা সাথে ব্লাক লাভ ইমোজি।
দুমড়ে মুচড়ে উঠলো অধরার বুক। মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না আর,অন্যের দখলদারি সে। তার সবটা জুড়ে বিস্তার থাকবে চিত্রা নামক রমণীর। তার সুখ দুঃখ ভালোবাসা সবটার অংশীদারি অন্য কেউ। তুষার ফোন টা নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। অধরা সেদিকটায় একবার চেয়ে বিরবির করে বলে-
-❝ অতঃপর শখের পুরুষ আপনি আমার হৃদয়ে থাকবেন আর অন্য কারো ভাগ্যে। ❞

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৮( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ ঘন্টাখানেক ও হয় নি আপনাদের বাসা থেকে এসেছি এর মধ্যেই মিস করা শুরু করলেন মিস চিত্রা?
কথাটা শুনে চিত্রা ফিক করে হেঁসে উঠলো। ফোনটা কানে নিয়ে জানালার কাছে এসে বলে-
-“ আপনার তৃষ্ণায় বড্ড তৃষ্ণার্ত যে আমি এমপি মশাই। চট করে ফোন টা কেটে ফট করে ভিডিও কল দিন তো।

তুষার ফোন কেটে দিলো। চিত্রা ফোন টা হাতে নিয়ে একবার জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। চিত্রা রিসিভ করলো। ফোনটা মুখ বরাবর নিয়ে তুষারের পানে তাকালো।
-“ তৃষ্ণা কি কমলো ম্যাডামের?
-“ ছুঁয়ে দেখতে পারলে ভালো লাগতো।
-“ ছুঁয়ে দেখার জন্য আর কয়েক টা দিন অপেক্ষা করুন মিস।
-“ অপেক্ষারা এতো দীর্ঘ হয় কেনো বলতে পারেন?
-“ অপেক্ষা তো সবাই করতে পারে না,আর অপেক্ষার ফল যে মিষ্টি হয় সেজন্য।
-“ বুঝলাম।
-“ কি বুঝলেন?
-“ আপনি আমার অপেক্ষারত পুরুষ।
-“ শখের,ভালোবাসার, পছন্দের পুরুষ নই?
-“ উঁহু, আপনি আমার অপ্রিয়, অপছন্দের পুরুষ।

তুষার চুপ হয়ে গেলো। চিত্রা তুষারের নিস্তব্ধতা দেখে বলে-
-“ চুপ হয়ে গেলেন কেনো? জিজ্ঞেস করুন কেনো?
-“ কেনো?
-“ প্রথম অপ্রিয় যার মধ্যে প্রিয় শব্দ টি বিরাজমান। দ্বিতীয়ত অপছন্দের যার চার শব্দের মধ্যে তিনটিই শব্দ পছন্দ বিরাজ করছে। প্রথম দেখায় আপনি আমার পছন্দের প্রিয় কোনোটাই ছিলেন না। আস্তে ধীরে হয়েছেন। সেক্ষেত্রে দুটো নেগেটিভ শব্দ কে আমি পজিটিভ ভেবে জুড়ে নিয়েছি। আর শখের ভালোবাসার পুরুষ তো সবাই হয়ে থাকে,যেমন ধরুন না আমি কারো শখের নারী বা আপনি কারো শখের পুরুষ। শখের জিনিস গুলোর নাগাল পাওয়া যায় না। শখের জিনিস গুলো দূর থেকে সুন্দর। কিন্তু আপনি তো আমার নাগালের মধ্যে এক আমিতে সীমাবদ্ধ সেখানে আপনি শখের কি করে হন? আপনি আমার শুদ্ধতম পুরুষ। আর বিয়ের পর হবেন আদর্শ স্বামী।

তুষার চিত্রার কথা গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। মেয়েটা জায়গা ভেদে নিজেকে খুব দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে। তুষারকে ফের নিশ্চুপ থাকতে দেখে চিত্রা বলে উঠে –
-“ আমি আপনার কাছে কেমন নারী জনাব?
তুষার অকপটে বলে উঠে-
-“ শখের নারী।
-“ কেনো?
-“ আপনার ভাষ্যমতে তো শখের জিনিস গুলো ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকে,কিন্তু আমি সেই ধরাছোঁয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে আপনাকে পেয়েছি,সেক্ষেত্রে তো আপনি আমার শখের তরে পাওয়া প্রাপ্তি।
,-“ ভালোবাসেন আমায়?
কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো চিত্রা। তুষার স্মিত হাসলো।
-“ এটা না হয় বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার।
-“ কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিব।
-“ ডিনার করে ঘুমান। একটা ফোনকল এসেছে আর্জেন্ট।

চিত্রা আচ্ছা বলে ফোন কেটে দেয়। তুষার ফোনের স্কিনে রাতুলের মায়ের নম্বর দেখে ফোন টা রিসিভ করে সালাম দেয়। রাতুলের মা রোমিলা বেগম সালামের জবাব দেয়।
-“ তুষার খালা কে তো ভুলেই গেছিস বাপ,অনেক দিন হলো আসিস না।
-“ রাগ করবেন না খালা ব্যাস্ততার জন্য যেতে পারি নি। ইনশাআল্লাহ দিন কয়েকের মধ্যে দেখা করে আসবো। আপনার শরীরের কি অবস্থা?
-“ শরীরের কথা আর জিজ্ঞেস করিস না বাপ।
-“ কেনো খালা শরীর কি আবার খারাপের দিকে গেছে? রাতুল কিছু বললো না তো।
,-“ মুখ পোড়া আর কি বলবে। মুখ পোড়ার জন্য ই তো শরীর আমার খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুই তো ওর বন্ধু ওকে বিয়ে করানোর জন্য রাজি করাতে পারিস না কেনো?
-“ মেয়ে দেখুন খালা রাতুল কে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।
-“ তার পছন্দ মত তো মেয়ে পাচ্ছি না।
-“ কেমন মেয়ে পছন্দ?
-“ সাদাসিধে সাংসারিক শান্তশিষ্ট মেয়ে।

তুষার ভাবনায় ডুব দিলো। এমন মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। তার দেখায় এমন মেয়ে তো নেই।
-“ আচ্ছা খালা রাতুলের বিয়ের দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিন।
-“ ঠিক আছে।

-“ আপনি বারবার এভাবে আড় চোখে তাকিয়ে থাকেন কেনো?
তৃষ্ণা কোমরে হাত গুঁজে কথাটা বলে। রাফি ফোন স্ক্রোল করছিল আর তৃষ্ণা টিভি দেখছিল। টিভি দেখা কালিন তৃষ্ণা খেয়াল করেছিল রাফি বারবার আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছিল তৃষ্ণার। তাই আর না পেরে বসা থেকে উঠে কথাটা বলে। রাফি ফোন টা পকেটে ঢুকায়।
-“ তারমানে তুমিও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?
তৃষ্ণা ভরকে যায়। মুখে দৃঢ়তা এনে বলে-
-“ আমি কেনো আপনার দিকে তাকাবো।
-“ তাহলে বুঝলে কি করে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম?
-“ আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলতে একটা ব্যাপার আছে।
-“ ওহ্ আচ্ছা।
-“ ওহ্ আচ্ছা কি? এভাবে তাকান কেনো?
-“ ভালো লাগে তাই।
-“ আমার অস্বস্তি হয়।
-“ অন্য মেয়ের দিকে তাকালে স্বস্তি পাবে?
-“ মানে?

রাফি নড়েচড়ে বসে। হাত দুটো একত্রে করে বলে-
-“ মানে টা ভীষণ সিম্পল। আমি অন্য মেয়ের দিকে তাকালে ভালো লাগবে তোমার?
তৃষ্ণা এদিক ওদিক চেয়ে বলে-
-“ খারাপ লাগার কি আছে।
-“ কষ্ট লাগবে না?
-“ কষ্ট কেনো লাগবে।
-“ ওমা কষ্ট লাগবে না? শুনলাম রিয়ার সাথে একটু হেঁসে কথা বলেছিলাম দেখে কেঁদেকেটে বিধ্বস্ত হয়েছিলে।

তৃষ্ণা তড়িৎ গতিতে রাফির পানে তাকালো। আমতা আমতা করে বলল-
-“ কি কিসব ব বকে যাচ্ছেন তখন থেকে। আমি কেনো কাঁদবো?
-“ ভালোবাসো না আমায়?

রাফির করা প্রশ্নে তৃষ্ণার নিশ্বাস থেমে যাবার উপক্রম। গলা শুকিয়ে আসলো ক্রমান্বয়ে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো।
-“ মাথা ঠিক নেই আপনার। কি রেখে কি বলছেন নিজেই জানেন না।
-“ স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে আমি ঠিক আছি। প্রশ্ন করেছি কুইকলি অ্যান্সার দাও,ইউ লাভ মি?
-“ নো।

রাফি ভ্রু কুঁচকালো।
-“ রিজেক্ট করলে আমার মত সুদর্শন পুরুষ কে?
তৃষ্ণা মুচকি হাসলো –
❝নারী সুদর্শন কাউকে চায়না, চায় কেউ একজন তাকে কঠিন ভাবে ভালোবাসুক.!❞
-“ তারজন্য অনুমতি লাগে। দিবে আমায় সেই অনুমতি?
-“ আপনি কি গার্লফ্রেন্ড কে প্রপোজ করার জন্য প্র্যাকটিস করছেন?
-“ মোটেও না।
-“ তাহলে?
রাফি তপ্ত শ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বলল-
-“ ওয়েল আমি শুদ্ধ ভাষায় বলছি। উইল ইউ ম্যারি মি তৃষ্ণা খাঁন?

তৃষ্ণা হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। রিয়াক্ট করতে ভুলে গেছে। লোকে বলে না অতি শোকে পাথর হয়ে যায় মানুষ। তৃষ্ণা ও তেমন টা হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে সে। রাফি নিজ থেকে তাকে প্রস্তাব দিচ্ছে আর সেটা বিয়ের! মাথা ভনভন করে উঠলো। হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না। রাফির দিকে তাকাতেও পারছে না,ঠাই হয়ে দাড়াতেও পারলো না। দৌড়ে নিজের রুমে ছুটে আসলো।

রাফি তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।

-“ কিরে তোর মা বিয়ের জন্য পাত্রী দেখছে রাজি হচ্ছিস না কেনো?

পার্টি অফিসের মিটিং শেষ করে বাহিরে বের হয়ে কথাটা বলে তুষার। রাতুল দৃষ্টি সামনে রাস্তায় চলতে থাকা চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আম্মা নিশ্চয়ই তোকে এসব নিয়ে আমায় বলতে বলেছে তাই না।
-“ খালা সেভাবে বলে নি আমিই নিজ থেকে বলছি তোকে। ভালোবাসিস কাউকে?
রাতুল চোখ দুটো বন্ধ করলো। মুহুর্তে ভেসে উঠলো অধরার বিধ্বংসী রূপ। ফট করে চোখ মেলে তাকালো। তুষার উত্তর না পেয়ে আবার বলে উঠল-
-“ কি হলে বলছিস না কেনো? ভালোবাসিস কাউকে?
-“ কাউকে ভালে লাগা কি ভালোবাসা হয়?
রাতুলের আনমনে বলা কথাটা শুনে তুষার পূর্ণ দৃষ্টি দেয় রাতুলের দিকে।
-“ কাউকে ভালো লাগে তোর?
-“ কিছুটা তেমনই।
-“ মেয়েটা জানে?
-“ না।
-“ জানাস নি কেনো?
-“ সাহস হচ্ছে না।
-“ কেনো?
-“ আমার মতো ছেলের সাথে কি তারা মেয়ে দিবে?
-“ তুই কম কোন দিক দিয়ে?
-“ সব দিক দিয়েই।
-“ তুই সব দিক দিয়েই সুদর্শন।
-“ আজকাল কেউ সুদর্শন খুঁজে না তুষার। সবাই দায়িত্ববান কাউকে চায়।
-“ তোর চেয়ে দায়িত্বশীল আর কেউ আছে নাকি? আমি নিজেও এতোটা দায়িত্বশীল নই যতটা তুই।
-“ বাসায় যা এবার,সকাল থেকে অনেক খাটাখাটুনি করেছিস। সামনে বিয়ে এনজয় কর। এদিক টা আমি সামলে নিব।
তুষার স্মিত হাসে। রাতুল কে জড়িয়ে ধরে বলে-
-“ আমার ডান হাত তুই। তুই ছাড়া আমি বড্ড অচল।

তুষার চলে গেলো। রাতুল পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখে নিলো। আজ গরম পড়েছে যার দরুন গরম লাগছে। রাতুল একটু দূরে থাকা বট গাছের ছায়াতল দেখে সেখান টায় চলে যায়। কিছুক্ষণ বসে থাকায় হুট করে আকাশ টা পরিবর্তন হয়। ঝলমলে রোদ থেকে হালকা কালো হতে শুরু করে আকাশ টা। আকাশ টাও পারে বটে মুহুর্তে মুহুর্তে বদলে যেতে। আচ্ছা মানুষ ও তো হুট করে বদলে যায় তাই না?
আচ্ছা মেয়েটা কি ভালোবাসবে আমায়? নাকি প্রত্যাখ্যান করবে। নাকি ভুল বুঝবে কোনটা?

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-১৪+১৫+১৬

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৪
#Raiha_Zubair_Ripte

রাস্তার ধারে ব্লাক কালারের হুডি পড়ে কানে ফোন নিয়ে ব্লাক কালারের গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে প্রেয়সীর বেলকনির দিকে তাকিয়ে আছে এক প্রেমিক পুরুষ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সী কে তার দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকতে দেখে মুখের হাসি চওড়া হয়। জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে শুধায়-

-“ কি হলো বললেন না তো রাগ কি ভেঙেছে?
-“ যদি বলি আপনার প্রেয়সীর রাগ এখনও ভাঙে নি তাহলে কি করবেন প্রেমিক পুরুষ?
-“ রাগ ভাঙানোর ব্রত করবো।
-“ তা এতো রাতে রাস্তার পাশে এভাবে দাঁড়ানো কেনো? বাসায় আসুন।
-“ বাসায় আসার অধিকার টা তো এখনও দেন নি। যখন হবে তখন আসতে বলবেন।
-“ বাসায় আসার জন্য অধিকার লাগে নাকি?
-“ অবশ্যই লাগে।
-“ শীত লাগছে না?
-“ না।
-“ বাসায় চলে যান,রাত অনেকটা হলো তো।
-” তৃষ্ণা তো মিটলো না,এখনই চলে যাব!
-“ কিসের?
-“ আপনাকে দেখে তৃষ্ণা মিটে নি আমার।
-“ তো প্রেমিক পুরুষ কি করলে তৃষ্ণা মিটবে?
-“ আপনার বেলকনি থেকে কিছু ভালোবাসা ছুঁড়ে দিন। আমি সেটা বুকপকেটে ভরে নিয়ে যাব।

মুহুর্তে ফোনের ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসলো। চিত্রা হাসছে।
-“ হাসবেন না মিস চিত্রা।
চিত্রা হাসি থামিয়ে দিলো। কন্ঠে বিষণ্নতা এনে বলল-
-“ আমার হাসির আওয়াজ কি বাজে? নাকি হাসলে বাজে দেখায় কোনটা?
-“ আপনার হাসির শব্দ আমার বুকের বা পাশ টায় এসে বারি খায়। খুব যন্ত্রণা দেয় তখন।
-“ আচ্ছা বুঝে গেছি এখন বাসায় চলে যান কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে।
-“ সত্যি চলে যাব?
-” হুমম।

তুষার মিনিট কয়েক ফোন ওভাবেই ধরে রেখে কেটে দেয়। চিত্রা তখনও ঠাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রয়। তুষার একবার চিত্রার দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরে গাড়িতে উঠতে নিবে এমন সময় চিত্রা পেছন থেকে তুষার কে ডাক দেয়।
-“ বুকপকেট খালি করে বাসায় ফিরবেন?
কথাটা বলেই চিত্রা ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দেয়। তুষার মৃদু হেসে ছুঁড়ে দেওয়া অদৃশ্য ফ্লায়িং কিস টা হাত বাড়িয়ে মুঠোয় বন্দী করে। মুঠো করা হাত টায় নিজের ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে সেটা হুডির পকেটে ভরে।
-“ সাবধানে যাবেন।

-“ এই মেয়ে তোমার বয়ফ্রেন্ড টা কে?
তৃষ্ণা পড়ার টেবিলে বসে মাথায় এক হাত ঠেকিয়ে বই পড়ছিলো। রাফির কথা শুনে বইয়ের থেকে মুখ সরিয়ে রাফির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ কাকে কি বলছেন?
-“ বাংলা কথা বুঝো না?
-“ বয় ফ্রেন্ড মানে ছেলে বন্ধু ?তো ছেলে বন্ধু বললেই পারতেন। বয়ফ্রেন্ড বলার দরকার কি? বাই দ্যা ওয়ে আমার ছেলে বন্ধু নেই।
-“ চুপ। চাচি যে বললো তুমি প্রেম করে বেড়াচ্ছো।
-“ তো আপনার চাচি কে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন ছেলেটা কে।
-“ তুমিই বলো ছেলেটা কে?
-“ আমি তো জানি না।
-“ মিথ্যা বলছো কেনো?

তৃষ্ণার মুখ জুড়ে এবার রাগ উড়ে আসলো। কিসের প্যাচাল পারছে তখন থেকে। কথা বলার কোনো ওয়ে পাচ্ছে না দেখে কি এসব হযবরল বলে আমার মাথা হযবরল করতে চাচ্ছে?
-“ আপনার কাজ নেই ভাই?
-“ হুমম আছে। তোমার বয়ফ্রেন্ড কে খুঁজার কাজ এখন।
তৃষ্ণা বিরক্ত হয়ে শব্দ করে বইটা বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আমার শ্বাশুড়ির পেটে আছে সে। যান গিয়ে খুঁজে নিয়ে আসেন।
-“ হ্যাঁ তা না হয় খুঁজবো…. কথাটা বলার পরই রাফির টনক নড়ে। “ মজা করছো আমার সাথে?
-“ ওমা মজা কেনো করবো?
-“ রিলেশন করো না কারো সাথে?
-“ না।

তৃষ্ণার সোজাসাপ্টা জবাব শুনে রাফি ভ্রু কুঁচকালো।
-“ কেনো?
-“ কেনো আবার কি?
-“ রিলেশন কেনো করো না?
-“ কারন আমি যারে পছন্দ করি সে অন্য কাউকে পছন্দ করে তাই।
-“ সত্যি?
-“ হ।
-“ কষ্ট হয় তখন?
তৃষ্ণা তপ্ত শ্বাস ফেলে। যারে ভালোবাসে তার কথাই তারে বলছে।
-“ কলিজা ফেটে যায় তখন।
রাফি বিরবির করে বলে –
-“ যাক ফেটে আমি জোরা লাগিয়ে নিব সমস্যা নাই।
-“ কিছু বললেন?
-“ না,পড়াশোনায় মনোযোগ দাও,ওসব হারাম ভালোবাসার জন্য কষ্ট পেয়ো না। তোমার জন্য হালাল অপেক্ষা করছে।

তৃষ্ণা সরু চোখে তাকায় রাফির দিকে। রাফি হাসি উপহার দিয়ে চলে যায়।

—————————-

ক্লাস রুমে মনমরা হয়ে বসে আছে তৃষ্ণা । পাশেই চিত্রা তৃষ্ণা কে পর্যবেক্ষণ করে চলছে।
-“ কিরে এমন মন মরা হয়ে বসে আছিস কেনো,কি হইছে?
-“ আমার জামাই ম’রছে তাই এমন মনমরা হয়ে বসে আছি। আর কোনো প্রশ্ন?
-“ আবার ছ্যাকা খাইছিস?
-“ না।
-“ তাইলে? বলিস নাই তোর কাজিন কে? আচ্ছা তোর কোন কাজিন রে তুই ভালোবাসিস? ছেলেটা আমার দেবর নাকি ভাসুর?
-“ দেবর হয় সম্পর্কে তোর। আমার চাচার ছেলে।
-“ তোর চাচি কে আনলি না কেনো সেদিন? তাহলে মহিলা টাকে পটিয়ে তোর আর ঐ ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতাম।
-“ চাচি বেঁচে নেই। মা-রা গেছে বছর পাঁচেক হলো। ক্যান্সার হয়েছিল।
-“ ওহ্ সরি।
-“ তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়িতে চলে আয় বোইন।
-“ গাধির ঘরে গাঁধি আমায় না বলে তোর ভাইকে বল।
-“ আচ্ছা আজ বলবো মাকে। আর কাল তো দাদান আসবে।
-“ কোথা থেকে?
-“ হজ্জ থেকে। তারা আসলেই মেবি বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে তোদের।
-“ আচ্ছা চল এবার বাসায় যাওয়া যাক। ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না।
চিত্রার কথায় তৃষ্ণা সায় দেয়। দুই বান্ধবী ক্লাস পালিয়ে বেরিয়ে যায় ভার্সিটি থেকে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। টুকটাক কথাও বলতে থাকে। কথা বলার একপর্যায়ে তৃষ্ণা সামনে তাকাতেই দেখে রিয়া আর অচেনা এক ছেলে হাত ধরে হাঁটছে। ছেলেটা কিছু একটা বলছে আর রিয়া হেঁসে চলছে তো কখনো ছেলেটার কাঁধে মাথা রাখছে। ফটাফট ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে তৃষ্ণা কয়েকটা ছবি তুলে রিয়ার।

রাফি কে সাবধান করা লাগবে। ভালোবাসার মানুষ টিকে না পাক জীবনে তাই বলে জেনেশুনে ক্ষতি তো হতে দিতে পারে না।

চিত্রা নিজের বাসার মোড়ের দিকে আসতেই তৃষ্ণার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তৃষ্ণা ফোনটার দিকে তাকায় বারবার। তার রাফি ভাই রিয়ার সত্যি টা জানলে কিভাবে রিয়াক্ট করবে? কষ্ট পাবে নিশ্চয়ই খুব যেভাবে সে পায়।

——————–

-“ ভাই ওর তো শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে কি করবো এবার?

লিমনের কথা শুনে তুষার বলে উঠে –
-“ বাংলোর পেছনে কবর দিয়ে দাও। রাতুল কোথায়?
-“ ভাই তো নেই, আপনার বাসার উদ্দেশ্যে চলে গেছে।
-“ ওহ্ আচ্ছা, তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা যেনো ফুলফিল হয়।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৫( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripte

-“ জ্বি কাকে চাই?

দরজায় কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে ছিলো রাতুল। হঠাৎ দরজা খুলেই এমন প্রশ্ন শুনে ভেতর পানে তাকায়। মুহূর্তে দেখতে পায় অতি সাদামাটা শুভ্র এক রমণী কে। রমণী টাকে সে চিনে,একটু ভালো করেই চিনে। নিজের দৃষ্টি সংযত করে রাতুল জবাব দেয়-
-“ আমি রাতুল। তুষারের বন্ধু।
অধরা দরজা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে সরে দাঁড়ায় রাতুল কে ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার জন্য। রাতুল একপলক আবার অধরার দিকে চেয়ে ভেতরে ঢুকে। সোফায় বসে তুষারকে মেসেজ দেয়। অধরা ওড়নার কোনা হাতে প্যাচাতে প্যাচাতে বলে-
-“ চা আনবো নাকি কফি?
রাতুল নড়েচড়ে বসে। হালকা কেশে বলে-
– কফি উইদাউট সুগার।

অধরা রান্না ঘরে চলে যায়। সুগার ছাড়া কফি বানাতে শুরু করে। তুষার রাতুলের মেসেজ পেয়েই নিচে নেমে আসে। রাতুলের পাশে বসে বলে-
-“ কাজ কতদূর এতিমখানার?
-“ গাথনির কাজ ধরা হয়েছে।
-“ ইকবালের লোক বাঁধা দিয়েছিল?
-“ এখনও অব্দি দেয় নি।
-“ বাঁধা দেওয়ার মত দুঃসাহস আর দেখানোর মত ভুল সে করবে না।
-“ মাস কয়েক পর নির্বাচন মাথায় আছে তো?
-“ হুম।
-“ বুঝেশুনে পা ফেলতে হবে। হুটহাট একে ওকে ধরে এনে ধুম ধাম মে’রে ফেলিস না।
-“ আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে ছেড়ে দিব না। আমি নিজে থেকে যাই না ওদের কাছে, ওরা নিজেই মৃ’ত্যুর কাছে আসে।

-“ আপনাদের কফি।

অধরার কথার আওয়াজে চুপ হয়ে যায় তুষার,রাতুল। তুষার কফির মগ টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ রুমে যা এখন।
অধরা বাধ্য মেয়ের মতো চলে যায়। রাতুল কফি চুমুক দেওয়ার সময় একবার অধরার যাওয়ার পানে তাকায়।

-“ কাল তুই একবার এতিম খানার ওখানে যাস তুষার। রহমান চাচা যেতে বলেছেন।
-“ হ্যাঁ যাব। আজ রাতের ফ্লাইটে দাদাজান আর দাদিজান আসছে।
-“ ওহ্ ভালো খবর।

দুপুরে আজকাল শীতের মধ্যে ও তীব্র গরম পড়ে। হেঁটে আসা হলে শরীর ঘেমে যায়। গরম আসছে তার সিম্পল গরম ভাব এখনই দিয়ে দিচ্ছে সূর্য্যি মামা। তৃষ্ণা ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে। মাথায় রয়েছে হাজার ও চিন্তা ভাবনা। বাসায় ঢুকে সোজা নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। কাঁধের ব্যাগ টা বিছানায় রেখে আলমারি থেকে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়। বেলকনি তে গিয়ে ভেজা জামা কাপড় ছড়িয়ে দিয়ে রুমে আসে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে মনে মনে ভাবে-“ ভালোই হয়েছে, আমাকে ভালোবাসলে কি এখন তুই রাফি ছ্যাকা টা খেতি বল? খেতি না তো। কথায় বলে না ভালো জিনিস মানুষের চোখে পড়ে না,সেই অবস্থা হলো তোর। হে আমাকে ভালোবাসলে কোনো ছেলের হাত ধরে ঢলাঢলি করা তো দূর চেয়েও তাকাতাম না। কতটা লয়্যাল আমি জানিস? বেডা তুই ব্যাতিত আমি কোনো ছেলেকে কখনও ঐ নজরে দেখিই নি। আল্লাহ ছাড় দেয় ছেড়ে দেয় না।আমাকে কষ্ট দেওয়ার ফল এবার তুই পাবি।

কথাটা বলে নিজেকে প্রিপেয়ার্ড করে। যা সে দেখেনি সেটাও বানিয়ে বানিয়ে বলবে। মাথায় ওড়না টা দিয়ে সোজা রাফির ঘরের দিকে ছুটে তৃষ্ণা।
-“ রাফি ভাই আপনার তো সংসার ভাঙলো বলে।

রাফি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছিল। তৃষ্ণার এমন কথা শুনে ফোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দরজার পানে দেয়। রাফি শোয়া থেকে উঠে বসে বলে-
-“ মানে?
তৃষ্ণা রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে-
-“ মানে আপনার জন্য চমক আছে। আপনি জানেন আজ আমি কি দেখেছি?
রাফি ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কি দেখছো?
– “ ওয়েট দেখাচ্ছি।

কথাটা বলে তৃষ্ণা ফোনের গ্যালারি থেকে রিয়া আর রায়ানের পিক টা বের করে বলে-
-“ জানি কষ্ট পাবেন ভাই,রাগ হবে কিন্তু সত্যি তো মানতেই হবে। আপনাকে ঠকানো হচ্ছে যা আপনি ডিজার্ভ করেন,

রাফি তৃষ্ণার পানে তাকায়। তৃষ্ণা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে বলে-
-“ মিস্টেক আপনি মোটেও এটা ডিজার্ভ করেন না।
রাফি তৃষ্ণার হাত থেকে ফোন টা নেয়। তৃষ্ণা সেটা দেখে মনে মনে হেসে বাহিরে দুঃখি দুঃখি ভাব করে বলে-
-“ আমি মোটেও আপনাকে এটা দেখিয়ে হার্ট করতে চাই নি। কিন্তু কি করবো আপনার অগোচরে রিয়া আপু অন্য একটা ছেলের সাথে এমন মেলামেশা করছে ভাবা যায়?

রাফি পিক টা জুম করে দেখে বলে-
-“ আরে এটা তো রায়ান।
তৃষ্ণা রকেটের গতিতে জিজ্ঞেস করে-
-“ আপনি চিনেন এই ছেলেটাকে?
-“ হ্যাঁ।
,-“ দেখছেন ওরা দুজনই কিভাবে আপনায় ঠকালো। এরজন্য ই ফ্রেন্ডের সাথে রিলেশন করতে হয় না। আপনার সাথেও করছে আবার ঐ লোকের সাথেও করছে।

রাফি তৃষ্ণার কথার একটার ও মানে বুঝলো না। কি করে বেড়াচ্ছে, কে কাকে ঠকাচ্ছে?
-“ তখন থেকে কি ভুলভাল বকে যাচ্ছ?
-“ আমি একটুও ভুলভাল বলছি না ভাই। সত্যি টা তুলে ধরতে চাচ্ছি। চোখ কান খোলা রাখুন। পরে কিন্তু পস্তাবেন।
-“ এই মেয়ে চড়িয়ে গাল লাল করবো,কিসব বলছো। খুলে বলো আর তা না হলে আমার রুম থেকে বিদায় হও।
তৃষ্ণা রাফিকে ভেঙচি কেটে বলে-
-” আমি কি আপনার রুমে থাকতে আসছি নাকি। আপনার গার্লফ্রেন্ড যে অন্য বেডার লগে ভেগে যাচ্ছে সেদিকে কি খেয়াল রাখেন?
-“ আমার গার্লফ্রেন্ড কে?
-” আপনাকে আমি এখন কার পিক দেখালাম?
-” রিয়ার।
-“ তাহলে কি দাঁড়াল?
রাফি বিষয় টা বুঝার চেষ্টা করলো। বিষয়টা বুঝতেই তার মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হল। মুখ থেকে সুস্পষ্ট হলো–“ হোয়াট…. ইডিয়ট রিয়া আমার গার্লফ্রেন্ড?
-“ আমি জানি তো আপনার গার্লফ্রেন্ড কিন্তু মেয়েটা আপনি থাকাকালীন ঐ ছেলের সাথে এমন ঢলাঢলি করে ক্যান?

রাফি দাঁতে দাঁত চেপে বলে-
-“ কারন ওর হবু হাসবেন্ড ও তাই।
কথাটা তৃষ্ণার কর্ণকুহর হতেই তৃষ্ণা বিস্ময়ের সাথে বলে-
-“ কিহ! আপনাকে ছেড়ে ঐ ছেলেকে বিয়ে করছে?
-“ বিয়েটা তো রায়ানের সাথেই হবার কথা।
-“ কেনো ভাই আপনি কি ঐ ছেলের থেকে কোনো অংশে কম নাকি? ঐ ছেলের থেকে তো আপনি বহুত সুন্দর।
-“ তাতে রিয়ার কি? ও ওর বয়ফ্রেন্ড কে বিয়ে করছে। সেখানে আমি সুন্দর নাকি অসুন্দর ও সেটা দেখবে কেনো?
-“ আপনি রিয়া আপুর বয়ফ্রেন্ড না?
-“ না জাস্ট ফ্রেন্ড।

তৃষ্ণা কথাটা শুনে রিয়াক্ট করা ভুলে গেছে। ওরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড না জাস্ট ফ্রেন্ড। আর আজকাল জাস্ট ফ্রেন্ড নিয়ে ও তো কতকিছু বের হয়। রাফি তৃষ্ণা কে চুপ থাকতে বলে উঠে-
-“ আর কিছু বলার বাকি আছে আমার মাথা খারাপ করার জন্য?
তৃষ্ণা রাফির হাত থেকে নিজের ফোন টা নিয়ে নেয়।
-“ আপনারা জাস্ট ফ্রেন্ড?
-“ হুম।
-“ কোনো কিছু নেই আপনাদের মধ্যে?
-“ থাকবে না কেনো আছে?
,-“ বন্ধুত্ব।

ওহ্ ভালো। কথাটা বলে তৃষ্ণা চলে আসে রাফির রুম থেকে। রাফি তৃষ্ণার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফোন টিপতে শুরু করে।

এয়ারপোর্টে বাহিরে মুখে মাক্স পড়ে ব্লাক হুডি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। অপেক্ষা করছে তার দাদা-দাদির জন্য। তরিকুল খাঁন তার প্রানপ্রিয় স্ত্রী তাসলিমা খাঁনের হাত শক্ত করে ধরে এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তুষার দৃশ্য টা দেখলো। একদিন সে আর চিত্রা ও এভাবে হজ্জ করে ফিরবে। মুহুর্ত টা কল্পনা করতেই মুখে হাসিরা এসে হানা দিলো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দাদা আর দাদির দিকে এগিয়ে গেলো। তরিকুল খাঁন কে জড়িয়ে ধরে সালাম দেয়। তরিকুল খাঁন সালামের জবাব দেয়। তুষার তরিকুল খাঁন কে ছেড়ে দিয়ে তাসলিমা খাঁন কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে-
-“ কেমন আছেন দাদিজান? হজ্জ যাত্রা কেমন হলো?
-“ আলহামদুলিল্লাহ দাদু ভাই সব ভালো ছিলো।
-“ তো চলুন বাসায় যাওয়া যাক। সবাই অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৬( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ মিস চিত্রা দাদাজান আর দাদিজান এসেছে। আপনাকে আজ তারা দেখতে যাবে। হয়তো ডেট ও ফিক্সড করে ফেলবে। আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?

তুষারের বলা কথাটা ফোনের এপাশে থাকা রমণীর মনে অজানা এক অন্যরকম অনুভূতির বীজ বপন হলো। ডেট ফিক্সড করা মানেই তো বিয়ে। অতঃপর তাড়া পাশাপাশি এক সাথে মৃ’ত্যুর আগ অব্দি থাকবে। তুষার চিত্রার থেকে আশা স্বরূপ উত্তর না পেয়ে ফের শুধায়-
-“ আপনার কি আপত্তি থাকবে? তাহলে সবাই কে যেতে মানা করবো।
চিত্রা অনুভূতি গুলো সাইডে রেখে কম্পিত গলায় বলে-
-“ আমার আপত্তি নেই।
তুষার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
-“ তৈরি হয়ে থাকবেন।
-“ আপনি আসবেন?
-“ চেষ্টা করবো যাওয়ার।
-“ ইচ্ছে নেই বুঝি আসার?
-“ আছে ভীষণ, আপনাকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখার ভীষণ।
-“ তো প্রেমিক পুরুষ কাজকর্ম সব আজকের জন্য এক সাইডে ফেলে চলে আসুন,অপেক্ষা করাবেন না?
-“ তুষার রা অপেক্ষা করায় না মিস,অপেক্ষা করে।
-“ কিন্তু বিষয় টা তো বরাবরের ন্যায় উল্টোই হয়। আমি অপেক্ষা করি আপনার জন্য।
-“ বিয়ের পর থেকে বরাবরের ন্যায় আমিই করবো।
-“ কথা দিচ্ছেন?
-“ আস্ত আমি টাকেই তো দিয়ে দিয়েছি। সেখানে কথা দেওয়ার কথা বলছেন।
-“ শাড়ি পড়তেই হবে?
-“ পড়লে তো মন্দ হয় না।
-“ আচ্ছা বেশ পড়বো। আপনার জন্য শুধু। ভালো ভালো কমপ্লিমেন্ট করবেন।
-“ যথা আজ্ঞা বেগম সাহেবা।

-“ চিত্রা কই তুই এদিকে আয় তাড়াতাড়ি।
চয়নিকা বেগমের ডাক শুনে চিত্রা তুষার কে বলে বলে-
-“ আম্মু ডাকছে পরে কথা হবে সাথে দেখাও।
তুষার ফোন কান থেকে নামালো। তরিকুল খাঁন তুষারের রুমে ঢুকে।
-“ দাদাজান আপনারা আজ যেতে পারেন।
তরিকুল খাঁন তুষারের কাঁধে হাত দিয়ে বলে-
-“ ঠিক আছে,কথাবার্তা ফাইনাল করে আসবো?
-“ হুমম।
-“ নির্বাচনের আগেই নাতবউ ঘরে আনতে চাই। এবার বড়সড় হাঙ্গামা হতে চলছে।
-“ ভয় পাচ্ছেন?
-“ ভয় পাওয়াই কথা কিছুটা। হালিম সরকার আর আকবর এক জোট হয়েছে যে।
-“ রিলাক্স থাকুন।

-“ কি হয়েছে মা ডাকছো কেনো?
-“ ও বাড়ি থেকে ওরা আসবে আজ। কোনো রকম বাহানা না করে রেডি হবি সময় মতো।
-“ ঠিক আছে।
চয়নিকা বেগম তপ্ত শ্বাস ফেললেন। মেয়ের তার বাধ্য হয়ে গেছে। যখন যা বলছে সব শোনার চেষ্টা করছে। বিষয় টা মন্দ লাগছে না। সাহেল আহমেদ বাহির থেকে খাবার অর্ডার দিয়েছে। স্ত্রীর পক্ষে একার এতো জনের জন্য এতো আইটেমের খাবার বানানো পসিবল না। চয়নিকা বেগম আর কাজের বুয়া মিলে বসার ঘর টা পরিষ্কার করে।

চিত্রা রুমে এসে সবুজ কালারের একটা জামদানী শাড়ি বের করে। শাড়ি টা কিনেছিল বস্ত্র শিল্প মেলা থেকে। কেনার পর আর পড়া হয় নি,প্যাকেট সমেত আলমারি তে তুলে রেখেছিলো। আজ পড়বে পছন্দের শাড়ি টা পছন্দের মানুষের জন্য।

শাড়ি টা পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হালকা সেজে নেয়। চুল গুলো হাত খোপা করে তাদে বেলি ফুলের মালা গুঁজে দেয়। হাতে সবুজ আর কালো রঙের কাঁচের চুড়ি পড়ে। গলায় সবুজ কালারের একটা সীতা হার। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে টিপ। শেষ তার তৈরি হওয়া।

-“ অধরা আপু তুমি এখনও রেডি হওনি কেনো?
তৃষ্ণা অধরা কে ডাকতে এসে দেখে অধরা বিছানায় পূর্বের ন্যায় শুয়ে আছে।
-“ শরীর টা ভালো লাগছে না। তোরা চলে যা।
তৃষ্ণা তড়িঘড়ি করে অধরার সামনে দাঁড়ায় কপালে হাত বুলিয়ে বলে-
-“ জ্বর এসেছে নাকি?
-“ না আসে নি। মাথা ব্যাথা করছে।
-“ যেতে পারবে না?
-“ না বোন, তোরা চলে যা।
-“ মা তো তোমায় নিয়ে যেতে বলছে।
-“ মামি কে বলিস আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া সেখানে বড়রা কথা বলবে আমি গিয়ে কি করবো।
-“ তবুও..
-“ তোরা যা বোন।

তৃষ্ণা আর কথা বাড়ালো না,অধরা কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওর শরীর তেমন একটা ভালো না। নিচে নেমে তানিয়া বেগম কে জানালো বিষয় টা। তানিয়া বেগম আর জোর করে নি। তামিম খাঁন, রাফি,চয়নিকা বেগম,তৃষ্ণা, তরিকুল খাঁন,তাসলিমা খাঁন,সামির খাঁন, বেরিয়ে যায় চিত্রা দের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সাহেল আর চয়নিকা বেগম তুষারের বাড়ির লোকদের আপ্যায়ন করায় ব্যাস্ত। তৃষ্ণা সেই সুযোগে চিত্রার রুমে চলে যায়। চিত্রা খাটে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। তৃষ্ণা কে রুমে ঢুকতে দেখে বলে-
-“ দেখতো আমায় কেমন লাগছে?
-“ বাহ মাশা-আল্লাহ ভাবিজান জোশ লাগছে।
চিত্রা হেসে বলে-
-“ তোর ভাই হার্ট অ্যাটাক করবে না?
তৃষ্ণা চিত্রার পাশে বসে বলে-
-“ ভাইয়া থাকলে তো হার্ট অ্যাটাক করবে।
হাসি গায়েব হয়ে গেলো চিত্রার।
-“ উনি আসেন নি?
-“ না।
-“ কেনো?
-“ আসার জন্য রেডি হয়েছিল কিন্তু পাকিজা এতিমখানার কাজ ধরেছে না? সেখানে কি একটা সমস্যা হয়েছে সেজন্য গেছে।
চিত্রার মুহূর্তে রাগ উঠলো। রাগ টা কমানোর চেষ্টা করে বলে-
-“ তোর ভাই কি বিয়ের পর ও এমন করবে?
-“ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারছি না৷ কতবড় দায়িত্ব আমার ভাইয়ের কাঁধে, ভাইয়ের কত জায়গায় ছুটাছুটি করতে হয়। আমার ভাইটার উপর রাগ দেখাবি না,সাপোর্ট দিবি।
-“ ঘর থেকে বের হতে দিব না তোর ভাই কে। ঠ্যাং ভে’ঙে রেখে দিব।
-“ চপ বজ্জাত মেয়ে।
-“ যতোই যাই বলিস না কেনো। তোর ভাইকে ফোন দিয়ে বল সে সামনে না থাকলে আমি তোর ফ্যামিলির কারোর সামনেই যাব না।
-“ মজা করিস না চল।
-“ আমি মজা করছি না সিরিয়াসলি বলছি তোর ভাই ওখানে না থাকলে আমি যাবো না।
-“ আরে ভাই কাজ শেষ হলেই চলে আসবে।
-“ তখনই যাব।

তৃষ্ণার ইচ্ছে করলে চিত্রা কে ঠাটিয়ে চড় দিতে। তার ভাইয়ের জীবনটা তচনচ করে ফেলবে এ মেয়ে। তৃষ্ণা সাইডে গিয়ে তুষারের নম্বরে কল করে। তুষার হসপিটালে বসে আছে। এতিমখানায় কাজ করা কালিন এক মিস্ত্রির হাতের উপর ইট পড়ে হাত থেঁতলে গেছে। খবর টা পেয়েই তুষার ছুটে আসে। লোকটাকে নিয়ে এনাম মেডিকেলে ভর্তি করায়। তুষার ফোনটা রিসিভ করে।
-“ ভাই তুমি না আসলে চিত্রা বাবা দাদাদের সামনে যাবে না বলে দিছে।
-“ আসছি আমি।

কথাটা বলেই তুষার ফোন কেটে দেয়। তৃষ্ণা চিত্রার সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আসতেছে ভাই,এবার হ্যাপি?
চিত্রা গাল ভর্তি হাসি নিয়ে বলে-
-“ অননননেক হ্যাপি।
তুষার হসপিটালের বিল পে করে লিমন কে সব দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে আসে হসপিটাল থেকে। গাড়িতে উঠে সোজা ড্রাইভ করে চিত্রা দের বাসায় আসে। মেয়েটাকে অলওয়েজ সে অপেক্ষা করায়। ভেতর বাহির দুটোকেই তার সমান ভাবে ম্যানেজ করা শিখতে হবে।

চিত্রা রুমের জানালা দিয়ে তুষার কে দেখলো। মূলত গাড়ির শব্দ পেয়েই জানালার সামনে দাঁড়িয়েছে। লোকটার শরীরে সাদা কালার পাঞ্জাবি। ফাস্ট টাইম লোকটাকে ব্লাকের বাহিরে অন্য রঙ পড়তে দেখলো। অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে। হাতে ব্লাক ঘড়ি ঘন চুল গুলো সুন্দর ভাবে পরিপাটি, চোখে সানগ্লাস। আহ একদম নজর কাড়া লুক। চিত্রার ইচ্ছে করলো চেয়ে থাকতে কিন্তু তৃষ্ণার জন্য পারলো না। তৃষ্ণা চিত্রা কে টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাহিরে নিয়ে গেলো।

তুষার সবেই সোফায় বসেছে চোখ ঘুরাতেই সামনে তাকাতে থমকে যায়। সবুজ কালারের জামদানী শাড়িতে পরিহিত রমণী কে দেখে। রাফি তুষারের হাত চেপে ধরে বলে-
-“ আরে ব্রো এমন ভাবে তাকিয়ে আছো কেনো৷ একটু তো লজ্জা আনো।
তুষার রাগান্বিত হয়ে তাকালো রাফির পানে। রাফি চুপ হয়ে গেলো। চিত্রা কে সোফায় এনে বসায় তৃষ্ণা। চিত্রা সবাইকে সালাম দেয়। তাসলিমা খাঁন চিত্রার মুখের ঘোমটা সরিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে উঁচু করে বলে-
-“ বাহ মাশা-আল্লাহ আমার নাতবউ টা।
চিত্রা লজ্জা পেলো। তরিকুল খাঁন চিত্রার নাম ও কিসে পড়ে তা জিজ্ঞেস করলো। চিত্রা বিনয়ের সাথে সব বললো। তামিম খাঁন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তানিয়া বেগম হ্যান্ড ব্যাগ থেকে দুটো বক্স বের করেন। একটা বক্স তাসলিমা খাঁন নেয়। বক্স টা খুলে, বক্সে থাকা বালা দুটো নিয়ে চিত্রার সামনে ধরে বলে-
-“ দিদি ভাই হাত টা দাও তো।
চিত্রা হাত বাড়িয়ে দিলো। তাসলিমা খাঁন বালা দুটো চিত্রার হাতে পড়িয়ে দিলো।
-“ বাহ সুন্দর খাপেখাপে লেগেছে বালা দুটো।
তামিম খাঁন আংটির বক্স টা তুষারের হাতে দিয়ে বলে-
-“ পড়িয়ে দাও চিত্রার হাতে।
তুষার আংটি টা নিয়ে চিত্রার হাতে পড়িয়ে দেয়। চিত্রা ভেবেছিল তুষার হয়তো সবার অগোচরে তার প্রশংসা করবে, কিন্তু না চুপচাপ আংটি টা চিত্রার বা হাতের অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দিয়েই হাত ছেড়ে দিছে।

সাহেল আহমেদ চিত্রার হাতে একটা আংটি দিয়ে বলে তুষারের হাতে পড়িয়ে দিতে। চিত্রা আংটি টা হাতে নিয়ে তুষারের দিকে হাত বাড়ায়। তুষার তার হাত টা বাড়িয়ে দেয়। চিত্রা আংটি টা তুষারের হাতে পড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলে-
-“ অর্ধেক নিজের নাম বসিয়ে দিলাম আপনার জীবনে। কয়েক দিন পর পাকাপোক্ত ভাবে বসিয়ে দিব।

তুষার নৈঃশব্দ্যে হাসলো। তরিকুল খাঁন তুষার আর চিত্রা কে একান্তে কথা বলার জন্য বলল। চিত্রা এটারই অপেক্ষায় ছিলো। তরিকুল খাঁন বলা মাত্রই চিত্রা তুষারের দিকে তাকায়। তুষার বসা থেকে উঠতেই নিজেও বসা থেকে উঠে। সাহেল আহমেদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ছাঁদে চলে যা।

চিত্রা আর তুষার ছাঁদে চলে আসে। ছাঁদে আসতেই চিত্রা কোমরে হাত গুঁজে বলে-
-“ এই তাকান আমার দিকে।
তুষার চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ হুমম তাকালাম।
-“ কমপ্লিমেন্ট কই?
-“ উমমম আপনাকে নিয়ে কমপ্লিমেন্ট করার জন্য আমার ডিকশনারি তে কোনো ওয়ার্ড খুঁজে পাচ্ছি না, এটা কি আমার দোষ বলুন?
-“ মোটেও আপনার দোষ না আমারই দোষ,আপনার কাছে কমপ্লিমেন্ট আশা করা।
-“ আপনাকে এক বাক্যে বলি ❝ পূর্ণতা ❞
চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো।
-“ এতো নাম থাকতে পূর্ণতা কেনো?
-“ কারণ আমার অপূর্ণতা গুলো আপনি পূর্ণতা করে নিয়ে আসছেন আমার জীবনে।
-“ মানে?
-“ বুঝবেন না। সময় হোক বুঝে যাবেন।

-“ ব্রো হলো কথা বলা?
রাফি ছাঁদে উঠতে উঠতে কথাটা বলে। চিত্রা রাফির দিকে তাকিয়ে তুষার কে ফিসফিস করে বলে-
-“ এই ছেলেটা আপনার কি হয়?
-“ আমার কাজিন। সামির চাচার ছেলে।
-“ আপনার বাবা রা কয় ভাই বোন?
-“ দুই ভাই এক বোন। ফুপি মা-রা গেছে অনেক আগেই। অধরা কে দেখেছেন না? ও ফুপির মেয়ে।
-“ তৃষ্ণা কাকে ভালোবাসে?
-“ রাফিকে।
রাফি এগিয়ে আসছিলো চিত্রা দের দিকে। চিত্রা তুষারের কথাটা শুনে রাফির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ এই আপনি এতো পঁচা কেনো?
রাফি চিত্রার কথা শুনে হতবিহ্বল হয়।
-“ কি করছি আমি ভাবি?
-“ কি করেন নি মানে কি? আপনাকে দেখে তো ভালোই মনে হয়,কিন্তু আপনি এতো বডের হাড্ডি কেনো?
-“ আমি বদের হাড্ডি? আমি কি আপনাদের রোমান্টিক মোমেন্টে এসে পড়েছি বিধায় এসব ট্যাগ দিচ্ছেন?
-“ না। আমাকে কি পাগল মনে হয়।
-“ কিছুটা তেমনই মনে হচ্ছে (বিরবির করে বলে) ভাবি করছি টা কি সেটা বলেন।
-“ আমার ফ্রেন্ড কে কাঁদান কেনো?
-“ আপনার কোন ফ্রেন্ড কে আমি কাঁদিয়েছি?
-“ যে আপনাকে ভালোবাসে। আর আপনি কি না তার ভালোবাসা না বুঝে অন্য মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
-“ কে আমাকে ভালোবাসে। আর আমি কার ভালোবাসা না বুঝে অন্য মেয়ে নিয়ে ঘুরি।
-“ আমার ননদের।
-“ আবার ননদ বলছেন কেনো? আপনার ননদ তো তৃষ্ণা।
কথাটা বলেই রাফি নিশ্চুপ হয়ে যায়।
-“ হ্যাঁ তৃষ্ণাই,তৃষ্ণার কথাই বলছি।

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-১২+১৩

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১২ ( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ )
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ কি ব্যাপার ইদানীং তুমি এতো চুপচাপ কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে তোমার?

তৃষ্ণা ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে সুর্যাস্ত দেখছিলো। মন ভালো নেই। মন ভালোই বা থাকে কি করে? ভালোবাসার পুরুষ কে অন্য নারীর পাশে দেখলে কারোরই মন মেজাজ ভালো থাকে না।
তৃষ্ণা কে কথার প্রতিত্তোরে চুপ থাকতে দেখে রাফি ফের জিজ্ঞেস করলো-
-“ বললে না তো তোমার এতো পরিবর্তন কিসের জন্য?
তৃষ্ণা দৃষ্টি ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে চেয়ে বলে-
-“ আমার কোনো পরিবর্তন ঘটে নি রাফি ভাই। অযথা আমাকে নিয়ে না ভাবলেই খুশি হবো।

রাফি ভ্রু কুঁচকাল।
-“ অবশ্যই ঘটেছে তোমার মধ্যে পরিবর্তন। কারন টা বলো কুইক।
-“ হুকুম করছেন?
-“ যদি মনে করো হুকুম তাহলে হুকুমই।
-“ বলবো না।
-“ বলতে হবেই।
তৃষ্ণা ছাঁদ থেকে নেমে যেতে নিবে এমন সময় রাফি তৃষ্ণার হাত টেনে ধরে। তৃষ্ণা রাফির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে।
-“ চেষ্টা করে লাভ নেই। রাফি নিজ থেকে হাত না ছাড়াতে দিলে তুমি হাত ছাড়াতে পারবে না। সো বৃথা চেষ্টা করো না।
-“ হাত টা ছেড়ে দিন রাফি ভাই।
তৃষ্ণা গমগম মুখের কথা রাফি শুনেও না শোনার ভান করে।
-“ আগে বলো সমস্যা টা কি তোমার? বয়ফ্রেন্ড ছ্যাকা দিছে নাকি লাইফ নিয়ে হতাশায় ভুগছো?
-“ আপনাকে নিয়ে দ্বিধায় ভুগছি।
তৃষ্ণার বিরবির করে বলা কথাটা রাফির কান অব্দি ক্লিয়ার ভাবে পৌঁছালো না।
-“ স্পষ্ট করে বলো।
-“ হাত ছাড়ুন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রুমে সন্ধ্যা বাতি জ্বালাতে হবে।
-“ অধরা আছে জ্বালানোর জন্য।
-“ আর আপনি আমাকে জ্বালানোর জন্য?
-“ যেটা ভাবো।
-“ আমি তো কত কিছুই ভাবি।
-“ আর কি কি ভাবো?
তৃষ্ণার টনক নড়ে উঠলো। আবেগের বশে সব বলে দিতে বসেছে। মনের কুঠিরে রাখা লুকায়িত ভালোবাসা কখনও তৃষ্ণা সম্মুখে আসতে দিবে না। রাফির হাত আগলা হতেই তৃষ্ণা রাফির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ছাঁদ থেকে নেমে আসে।

ছাঁদ থেকে নেমে সোজা ড্রয়িং রুমে আসতেই অচেনা এক ছেলেকে সোফায় বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ছেলেটার এখনও তৃষ্ণা কে খেয়াল করে নি,ছেলেটা ফোনে মুখ ডুবিয়ে কিছু দেখতে ব্যাস্ত। তৃষ্ণা ছেলেটার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ এই কে আপনি?
আকস্মিক কথার আওয়াজ কানে আসতে ধরফরিয়ে উঠে ছেলেটা। বুকে ফু দিয়ে দারুন হাসি উপহার দিয়ে বলে-
-“ আমি লিমন,তুষার স্যার আসতে বলেছেন।
রাফি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তৃষ্ণা আর লিমন কে পর্যবেক্ষণ করে। লিমনের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে-
-“ কে আপনি?
লিমন ইতস্ত হয়,কেবলই তো পরিচয় দিলো আবার জিজ্ঞেস করছে।
-“ লিমন আমার নাম।
রাফি লিমনের মাথা থেকে পা অব্দি চোখ বুলায়।
-“ আপনিই সেই নতুন লোক?
-“ জ্বি।
-“ ব্রো আসতে বলেছে?
-“ হ্যাঁ।

রাফি তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ব্রো কে গিয়ে বলো লিমন এসেছে।
তৃষ্ণা চলে যায়। লিমন তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। রাফি বিষয় টা খেয়াল করে গলা খাকড়ি দেয়। লিমন দৃষ্টি সংযত করে। লিমনের পাশে বসে বলে-
-“ যার তার পার্সোনাল জিনিসে নজর দিতে নিই মিস্টার লিমন।

লিমন বুঝলো না রাফির কথার মানে।
-“ ঠিক বুঝলাম না।
-“ সময় হোক বুঝে যাবেন।
-“ লিমন ফাইল টা এনেছো?
তুষার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কথাটা বলে। লিমন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফাইল টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ জ্বি স্যার,রাতুল ভাই এই ফাইল টা দিয়েছে।
তুষার লিমনের হাত থেকে ফাইল টা নিয়ে চোখ বুলায়। পাকিজা রোডের ওখানে একটা এতিমখানা বানানোর প্ল্যান করছে তুষার। সব প্রায় কমপ্লিট, এখন শুধু কাজ ধরা বাকি বিল্ডিং এর। তুষার ফাইলটায় সাইন করে ফাইল টা আবার লিমনের কাছে ব্যাক করে। লিমন ফাইল টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ এবার আমি আসি স্যার?
তুষার থমথমে গলায় বলে –
-“ লাফাঙ্গারের অবস্থা কি?
-“ বেশি ভালো না।
-“ শরীর থেকে জান বের হয়ে গেলে জাস্ট মাটির ত’লে পুঁ’তে রেখে দিবে।

লিমন এক ঢোক গিলে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে বের হয়ে যায়।
-“ ভাবি যদি কখনও তোমার এই ভয়াবহ রূপের কথা জানতে পারে তখন কি হবে ব্রো?
-“ তুই না বললে জানবে কি করে?
-“ বাই এনি চান্স আমি না বললেও যদি কোনো ভাবে যেনে যায় তখন?
-“ বিয়ের পর জানলে আই ডোন্ট কেয়ার। বিয়ের আগ অব্দি ওর কানে কোনো ভাবে এসব যাওয়া চলবে না।
-“ বিয়ে টা কবে হবে তোমার? তোমার পর তো আমার পালা। তোমার বিয়ে যত দেরিতে হবে আমার বিয়ে তত পিছাবে। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে রাস্তা ক্লিয়ার করো।

তুষার বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে-
-“ তোর বিয়ে করার জন্য তর না সইলে এখনই কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আয় কেউ আটকাবে না।
-“ সবার আগে তুমিই না আটকাও বিয়ে করতে গেলে আবার।

বিরবির করে কথাটা বলে রাফি। তানিয়া বেগম তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ সেই কবে থেকে শুনতেছি আমার তুষারের বিয়ে, কিন্তু বাপ এখনও তো মেয়ের বাড়ি যেতে দিলো না তর বাবা। বিয়ে কি হবে না নাকি আমার ছেলের?
-“ তুমি কবে দেখতে যেতে চাও মেয়ে? মেয়ে কিন্তু তোমার পরিচিত।
-“ মেয়ে আমার পরিচিত! কার মেয়ে?
-“ সাহেল আঙ্কেলের মেয়ে। চিনো তো?
-“ আরে হ্যাঁ তোর বাবার বন্ধু। মেয়েটার সাথে এখনও অব্দি দেখা হয় নি। আমি বাপ কালই দেখতে যেতে চাই পুত্র বঁধু কে।
-“ ওকে তুমি অধরা আর তৃষ্ণা গিয়ে দেখে আসো।
-“ ঠিক আছে আমি কালই যাব।
অধরা উপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। বুক টায় কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। সবার মতো নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে অধরা পারে না। বরাবরই সে নিশ্চুপ শান্ত প্রকৃতির। মতামত বলতে তার কিছু নেই,সে নির্বাক শ্রোতার ন্যায় শুধু দেখে যায়। মামারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে এটাই তো অনেক। সেখানে আগ বাড়িয়ে নিজের জন্য কিছু চাওয়া মানে লোভী প্রমাণ করা। তুষার নাম পুরুষ টি অধরার জীবনে শখের পুরুষ হিসেবেই থেকে যাবে। শখের জিনিস গুলো সবসময় ধরাছোঁয়ার বাহিরে থাকে। তুষার ও তার ধরাছোঁয়ার বাহিরে।

———————

তৃষ্ণা রেডি হয়ে বসে আছে,মন তার কিছুটা ফুরফুরে লাগছে। ভাইয়ের বউ দেখতে যাবে বলে কথা। শত মন খারাপেও ভালো লাগছে। রেড কালারের একটা গ্রাউন পড়েছে। হালকা পাতলা সেজেছে। অধরা চুপচাপ বসে আছে। পড়নে তার ব্লাক কালারের সেলোয়ার-কামিজ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মনে তার বিষণ্ণতা, শখের পুরুষের হবু বউ দেখতে যাচ্ছে। তার মত হতভাগ্য কারো আছে নাকি? না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে এসব থেকে দূরে সরে থাকতে।

তৃষ্ণা আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিয়ে বলে-
-“ অধরা আপু চলো যাওয়া যাক।
অধরার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে। মাথা নাড়িয়ে তৃষ্ণার পেছন পেছন বেরিয়ে যায়। ড্রয়িং রুমে তানিয়া বেগম রেডি হয়ে বসে আছেন। অধরা তৃষ্ণা আসতেই মেয়ে দুটো কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাসায় ছেলেরা নেই,ড্রাইভার কে বলে গিয়েছিল তুষার চিত্রা দের বাসায় পৌঁছে দিতে। ড্রাইভার তুষারের কথা মতো তাদের চিত্রা দের বাসায় পৌঁছে দেয়। তানিয়া বেগম তৃষ্ণা আর অধরা কে নিয়ে বাসায় ঢুকে কলিং বেল বাজাতেই চয়নিকা বেগম দরজা খুলেন। সাহেল আহমেদ বলেছিলেন ও বাড়ি থেকে তুষারের মা বোনেরা আসবে চিত্রা কে দেখতে। সেজন্য চিনতে বেগ পেতে হলো না।
হাসি মুখে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। তানিয়া বেগম মেয়েদের নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। চয়নিকা বেগম কুশলাদি করলো তাদের সাথে। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি ফল এনে তাদের সামনে রাখলো। তানিয়া বেগম চয়নিকা বেগম কে বললেন তার পুত্র বঁধু কে নিয়ে আসার জন্য। চয়নিকা বেগম সায় জানিয়ে মেয়ের রুমের দিকে গেলো। চিত্রা শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে বসে আছে। শাড়ি পড়ে থাকাটা অস্বস্তিকর। চয়নিকা বেগম শাড়ির আঁচল টেনে মেয়ের মাথায় দিলো। চিত্রা বিরক্তি তে কিছু বলতে নিবে তার আগেই চয়নিকা বেগম বলে উঠে-
-“ নম্র ভদ্র হয়ে থাকবে।
চিত্রা এক হাত দিয়ে মাথার আঁচল টেনে ধরে রাখে। চয়নিকা বেগম চিত্রা কে ধরে বাহিরে নিয়ে যায়। তৃষ্ণা মায়ের সাথে গল্প করতে করতে সবেই একটা মিষ্টি মুখে তুলতে নিচ্ছিলো সামনে তাকাতেই সেই মিষ্টি আর মুখে তুলা হলো না। হা করে তাকিয়ে রইলো সামনে। সামনে ঘোমটা টেনে শাড়ি পড়ে চিত্রা আসছে! সম্ভব কি করে? তার ভাইয়ের তো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছিল চিত্রা কি তাহলে সত্যি তার ভাইকে পটিয়েছে! তানিয়া বেগম তৃষ্ণা কে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে-
-“ গাধার মতো হা করে আছিস কেনো মুখ বন্ধ কর মশা ঢুকবে তা না হলে।
তৃষ্ণা মুখ বন্ধ করলো। চিত্রাকে ধরে সোফায় বসায় চয়নিকা বেগম। চিত্রা মাথা নিচু করে রেখেছে যার কারনে সে এখনও তৃষ্ণার মুখ দেখতে পারে নি। তানিয়া বেগম চিত্রার থুতনিতে ধরে চুমু খেয়ে বলে-

-“ মাশা-আল্লাহ আপনার মেয়েটা।
তৃষ্ণা সামনে বসে থাকা ভদ্র মহিলার কথা শুনে মাথা তুলে তাকিয়ে হাসতেই মুখের হাসি সব গায়েব হয়ে যায়। তৃষ্ণা তাকিয়ে আছে তার দিকে। চিত্রা তৃষ্ণা কে আকস্মিক দেখে মুখ থেকে বের হয়ে আসে-
-“ তৃষ্ণা তুই এখানে?
তানিয়া আর চয়নিকা বেগম মেয়েদের মুখের দিকে তাকায়।
-“ তুমি তৃষ্ণা কে চিনো মা?
তানিয়া বেগমের কথা শুনে চিত্রা বলে
-“ জ্বি আন্টি। তৃষ্ণা আর আমি একই ভার্সিটি তে পড়ি। কিন্তু তৃষ্ণা কি আপনাদের রিলেটিভ হয়?

তৃষ্ণা এক ঢোক গিলে। তানিয়া বেগম হাসতে হাসতে বলে-
-“ রিলেটিভ কি গো মেয়ে আমি তৃষ্ণার মা,তোমার ননদ ও।

চিত্রার মাথা ভনভন করে। তৃষ্ণার মা কি তাহলে তুষারের কাকি নাকি ফুপি নাকি খালা?
-“ আপনি আমার কি হন সম্পর্কে?
-“ শ্বাশুড়ি।
-“ আপন?
-“ হ্যাঁ, আপন না তো কি নকল হবো নাকি।
-“ কিন্তু আন্টি আমার তো তৃষ্ণার ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয় নি। এই তৃষ্ণা বল না তোর ভাইয়ের না বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বিয়ে তো তুষারের সাথে।
তৃষ্ণার মাথাও ভনভন করছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
-“ তুষার তো আমারই ছেলে। তৃষ্ণার ভাই।
কথাটা কর্ণকুহর হতেই যেনো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য নামক কিছু শুনলো। এদিকে অধরা এক ধ্যানে চিত্রার পানে চেয়ে আছে। মেয়েটার শ্যাম বর্ণ গায়ের রং,ঠোঁট জোড়া গোলাপের পাপড়ির মতো। চোখ দুটো টানাটানা, মুখে জুড়ে একটা কিউট কিউট ভাব। হাসলে গালে টোল পড়ে। মেয়েটাকে এক বাক্য শ্যামকন্যা বলা চলে। চিত্রার থেকে অধরার গায়ের রং ধবধবে সাদা। চিত্রার থেকে হাইট বেশি। সাদামাটা খুব,বই পড়ুয়া, ঘরকুনো সাংসারিক। মেয়েটাকে দেখে তার মন থেকে একটাই কথা ভেসে আসছে-
-“ আমার শখের পুরুষ কে যে নারী পাবে নিঃসন্দেহে সে নারী ভাগ্যবতী। মেয়ে তুমি ভীষণ ভাগ্যবতী আমার শখের পুরুষ কে পেয়ে। তোমার মতো সৌভাগ্য নিয়ে জন্ম আমার হয় নি তাই তো তাকে জীবনে পেলাম না। আর তুমি না চাইতেই তাকে পেয়ে যাচ্ছো। মেয়ে তোমাকে মাঝে মাঝে বড্ড হিংসে করবো,কারন তুমি আমার শখের পুরুষের বড্ড পছন্দের নারী।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১৩( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ তুই সব জানতি আগে থেকেই তৃষ্ণা তাই না যে তোর ভাইয়ের সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? এর জন্য ই বলি তুই কেনো তোর ভাইয়ের পিক নম্বর আমায় কখনও দিস নি আর পরিচয়ই করিয়ে দেওয়ার কথা বললে সবসময় বিভিন্ন বাহানা দেখাতি। এবার বুঝলাম আসল বিষয় টা। কিন্তু তোর থেকে মোটেও এমন মিথ্যা ব্যাবহার আশা করি নি আমি।

চিত্রার বলা কথার প্রতিত্তোরে তৃষ্ণা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। সে তো নিজেই এসব জানতো না। এখন চিত্রা কে বললেও বিশ্বাস করবে না। তার ভাই ও তাকে এভাবে ঘোল খাওয়ালো!
-“ চিত্রা আমি তো তোকে সারপ্রাইজড দিতে চেয়েছিলাম। তুই তো আমার ভাইয়ের হবু বউ এটা আগে থেকেই জানতাম। ভাইয়া বলতে নিষেধ করেছিল তাই বলা হয় নি।

তৃষ্ণা কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট। ইচ্ছে করেই মিথ্যা বললো। তার ভাইয়ের না বলার জন্য এমন বাজে ভাবে ফেঁসে গেলো। এবার তার ভাই কেও ফাঁসিয়ে দিল তৃষ্ণা। চিত্রা মুখটা গম্ভীর করে বলে-
-“ একটু আকার ঈঙ্গিত দিয়ে বলতি।
-“ আরে বোকা মেয়ে আকার ঈঙ্গিত তো দিয়েই ছিলাম। বলেছিলাম না আমার ভাই তার হবু বউকে ভীষণ ভালোবাসে। আর তুই বিয়ে ভাঙার জন্য টিপস্ চেয়েছিলি আমি কি দিয়েছি বল?
-“ না।
-“ এ জন্য ই তো দেই নি।
-“ তুই তো তোর পরিচয় ও লুকিয়েছিস।
-“ ঐ যে বললাম ভাইয়ার নিষেধাজ্ঞা ছিলো।
-“ তোর ভাই আমাকে আগে থেকে চিনতো?
-“ আরে হ্যাঁ ফাস্ট দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেছে ভাই।
চিত্রার গাল লাল হয়ে গেলো। অধরা মাথা নিচু করে চুপচাপ দুই বান্ধবীর কথা শুনছে। ড্রয়িং রুমে বসে কথাবার্তা বলছে চয়নিকা বেগম আর তানিয়া বেগম। সবার সামনে পরিস্থিতি উল্টো দিকে যাচ্ছিল দেখে তৃষ্ণা চিত্রা কে নিয়ে রুমে আসে।

-“ তুমি ভীষণ মিষ্টি দেখতে চিত্রা।
চিত্রা অধরার পানে তাকালো। তৃষ্ণার থেকে জানা হয়েছে এটা ওর কাজিন। অধরার পাশে বসে লাজুক হেঁসে বলে-
-“ আপু তোমার ভাইয়ের পাশে মানাবে আমায় খুব তাই না? সে সুদর্শন আর আমি মিষ্টি।
কথাটা অধরার বুকে তীরের বেগে এসে বিঁধল। ব্যাথা যুক্ত হৃদয় নিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে-
-“ একদম পারফেক্ট হয়ে মানাবে।
-“ আসো তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি।
চিত্রা অধরা কে জড়িয়ে ধরলো। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অতি সন্তপর্ণে সবার অগোচরে অশ্রু টুকু মুছে নিলো।
-“ তুমি খুব সুখী হবে দেখো।
চিত্রা অধরা কে ছেড়ে দেয়।
-“ দোয়া করো আপু।
-“ সর্বদা করে যাব।

————-

-“ দাদাজান আপনারা ফিরবেন কবে?
-“ এই তো দাদু ভাই সপ্তাহ খানের মধ্যে ফিরবো তোমার দাদিজান কে নিয়ে।

তরিকুল খানের কথায় ভাবান্তর হলো তুষার। হজ্জ করতে গিয়েছে তরিকুল খাঁন ও তার স্ত্রী তাসলিমা খাঁন।
-“ সঠিক ডেট বলতে পারবেন না দাদাজান?
-“ আজ তো ২২ তারিখ ২৭ তারিখে হয়তো টিকিট। কোনো সমস্যা হয়েছে?
-“ না দাদাজান আপনাকে আর দাদি জান কে ২৭ তারিখ একটা সারপ্রাইজ দিব।
-“ কি সারপ্রাইজ তুষার?
-“ বলে দিলে সারপ্রাইজ আর সারপ্রাইজ থাকে কি করে?
-“ সেটাও ঠিক। এবার ফিরে কিন্তু ঘরে একটা নাতবউ চাই।
-“ তার জন্য দেশে ফিরতে হবে।
-“ ফিরছি তাহলে ২৭ তারিখ।
-“ জ্বি সাবধানে ফিরবেন।

তুষার তার দাদার সাথে কথা বলে সামনে তাকাতেই দেখে তৃষ্ণা তার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তুষার সেদিকে একপলক তাকিয়ে বলে-
-“ ফিরলি কখন।
-“ এখনই।
-“ কিছু বলবি?
-“ রুমে ঢোকার পারমিশন দাও আগে।
-“ আয়।
-“ তুমি চিত্রা কে বিয়ে করছো আগে বলো নি কেনো ভাইয়া?
-“ ভেবে দেখ তো কখনও জিজ্ঞেস করেছিস কি না মেয়ে টা কে যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?
তৃষ্ণা ভেবে দেখলো। আসলেই সে কখনও জিজ্ঞেস করে নি।
-“ না। কিন্তু আমি যখন বললাম চিত্রার বিয়ে ঠিক হয়েছে তখন তো বলে দিতে পারতে।
-“ কি বলে দিতাম,বিয়ে ভাঙার টিপস্?
-“ না সেটা না এই যে ছেলেটা তুমিই।
-“ মনে রেখেছি বিষয় টা পৃথিবীতে একমাত্র তুই সেই বোন যে তার ভাইয়ের বিয়ে ভাঙার জন্য তার হবু বউকে টিপস দিতে চেয়েছিল।
-“ আচ্ছা বাদ দাও। তোমার এই বিষয় লুকানোর জন্য কতটা বিব্রতিকর পরিস্থিতি হয়েছিল। চিত্রা আর আমি দু’জন দু’জনকে দেখে জাস্ট হতবিহ্বল। কোনোরকমে মিথ্যা বলে বুঝ দিয়ে এসেছি।
-“ গুড।
তৃষ্ণা হতাশ হলো। গুড কেনো বললো তার ভাই? জিজ্ঞেস তো করবে বাহবা দিবে তা না করে গুড বলছে। দ্যিস ইজ ঠু মাচ ব্যাপার হলো।
-“ তোমার গুড তোমার কাছেই রাখো ভাই লাগবে না আমার।

কথাটা বলে তৃষ্ণা চলে যায়। রাফি তুষারের রুমে আসছিল তৃষ্ণা কে বের হয়ে যেতে দেখে বলে-
-“ কি হয়েছে?
তৃষ্ণা দাঁড়ালো। কোমরে হাত গুঁজে বলে-
-“ আমাকে দেখলেই কি হয়েছে এটাই কেনো বের হয় আপনার মুখ দিয়ে? আর কোনো শব্দ নাই আপনার ডিকশনারিতে?
রাফি ভ্রু কুঁচকালো তৃষ্ণার কথায়।
-“ আমার ডিকশনারি তে অনেক শব্দ আছে,কিন্তু সেগুলোর ভার তুমি সইতে পারবে না মেয়ে।
-“ মশকরা করছেন আমার সাথে?
-“ মোটেও না।
-“ তাহলে এটা বলছেন কেনে?
-“ সত্যি ই তো বললাম। আমার ডিকশনারি তে থাকা শব্দ গুলো একবার মুখ থেকে বের হলে মেয়ে তোমার সুস্থ ভাবে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে। সো সেগুলো ডিকশনারি তেই চাপা বদ্ধ থাকুক।
-“ আজাইরা প্যাচাল সরেন সামনে থেকে।
তৃষ্ণা রেগেমেগে বসার ঘরে যায়। তানিয়া বেগম সোফায় রিলাক্স মুডে বসে। তৃষ্ণা গিয়ে তানিয়া বেগমের পাশে বসতেই তানিয়া বেগম ফুরফুরে মেজাজে বলে উঠে –
-“ তোর দাদা দাদি আসলেই আমি তুষারের বিয়ে ঠিক করবো। পুত্র বঁধু ঘরে নিয়ে আসবো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নাতিনাতনির মুখ দেখবো। এর আগে একটা কাজ করবো।
তৃষ্ণা রাগান্বিত চেহারা নিয়েই বলে-
-“ কি কাজ করবা?
-“ আরে তোর ও তো বিয়ে দেওয়া লাগবে। তুষার টা শেষ হলে তার পর তোর বিয়ে আর তা না হলে রাফির বিয়ে।
-“ আমি বিয়ে টিয়ে করবো না মা। রাফি ভাই কে বিয়ে দাও।
-“ ওমা কেনো? ব্রেকআপ হয়ে গেছে নাকি তোর?
তানিয়া বেগমের অবাক হয়ে বলা কথাটায় তৃষ্ণার মুখ হতবিহ্বল হয়।
-“ ধূর কিসের ব্রেকআপ, মা হয়ে কি বলো এসব।
-“ আরে মা তো কি হয়েছি,আমার মতো মা পাবি নাকি বলতো? দেখ যদি ঐ ছেলেটার সাথে তোর ব্রেকআপ হয় তাহলে বল মা আমি ছেলেটার সাথে কথা বলবো।
-“ কোন ছেলের কথা বলছো তুমি?
-“ এখন ছেলেটাকে চিনতেও পারছিস না তুই? স্বীকার কর মা, আমি সবসময় তোকে সাপোর্ট করবো।
-“ তুমি আমার মাথা টা আউলিয়ে দিয়ো না মা। একেই যা হযবরল কান্ড ঘটছে তার উপর তুমি কিসব বলে যাচ্ছো মাথায় কিছু ঢুকছে না।

তৃষ্ণা বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। তানিয়া বেগম ভাবনায় পড়ে গেলো,মেয়ে তার অতি শোকে এমন হয়ে গেলো নাকি? রাফি তানিয়া বেগমকে একা একা বিরবির করতে দেখে এগিয়ে বলে-
-“ কি ব্যাপার চাচি একা একা কি বিরবির করছো?
-“ আমার তৃষ্ণা টা বুঝি পাগল হয়ে যাবে রে।
-“ তোমার মেয়েতো পাগল করে অন্য কে। সেখানে তোমার মেয়ে নিজে পাগল হবে কেনো?
-“ আর বলিস না মেয়ে আমার প্রেম করে,আমি মা হয়ে বললাম তাকে সবসময় সাপোর্ট করবো তার বিনিময়ে সত্যি টা বলবি,ও বললোই না।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই রাফির মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে যায়। হাস্যোজ্জ্বল মুখ চুপসে গম্ভীর হয়।
-“ তৃষ্ণার বয়ফ্রেন্ড আছে?
-“ আরে হ্যাঁ। দেখতে শুনতেও নাকি সুন্দর।
-“ তুমি কি ওর বিয়ে দিতে চাইছো?
-“ তৃষ্ণা হ্যাঁ বললে দিয়েই তো দিবো।
-“ তোমার মেয়ে কি বললো?
-“ সে বিয়ে করবে না। হয়তো মনমালিন্য চলছে দুটোর মাঝে।

রাফি ওহ্ বললো,আর মনে মনে ভাবতে লাগলো,এর জন্যই কয়েকদিন যাবত তৃষ্ণার মধ্যে এতো পরিবর্তন এসেছে!বয়ফ্রেন্ড ছ্যাকা দিয়েছে। বাহ ভালোই তো। তলেতলে রিলেশন করলো আর সে জানতেও পারলো না! দেখে নিবে তৃষ্ণার সো-কোল্ড বয়ফ্রেন্ড কে রাফি। রিলেশন করা জন্মের মতো শিখিয়ে দিবে। কিভাবে করতে হয়।

——————–

-“ এই আপনি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন,তৃষ্ণার ভাই আপনি আমাকে বলেন নি কেনো? আমি একদিক দিয়ে আপনাকে বিয়ে না করার কত প্ল্যান করছি আর অন্য দিকে বলেছি তৃষ্ণার ভাই কে ভালোবাসি। জেনেশুনে শুধু মজা নিয়েছেন।

চিত্রার বলা কথার প্রতিত্তোরে তুষার কিছুক্ষণ চুপ রইলো।
-“ ইচ্ছে করেই বলি নি।
-“ কিন্তু কেনো?
-“ এমনি।
-“ কাজ টা মোটেও ঠিক হয় নি।
-“ জানি তো।
-“ রেগে আছি আপনার উপর ভীষণ। রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করুন পুরুষ।
-“ বেলকনিতে একবার আসুন।
-“ এত রাতে বেলকনিতে গিয়ে কি করবো?
-“ আহ আসুনই না।

চিত্রা ফোন কানে নিয়েই বেলকনিতে যায়। প্রথমে আকাশ পানে তাকিয়ে নিচে তাকাতেই চোখ জোড়া আটকে যায় ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ টাকে দেখে।
-“ প্রেয়সীর কি রাগ ভাঙলো এই অধম কে দেখে?

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-১০+১১

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১০( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ দেখলেন তো হলো টা কি? ছুরি টা যদি হাতে না লেগে সোজা পেটে গিয়ে লাগতো তখন কি হতো? আর আপনাকে কে বলছে আমাকে বাঁচাতে? ছুরি টা এসে লাগলে আমার শরীরেই লাগতো, হিরো গিরি করার কি খুব দরকার ছিলো? যদি বড়সড় কিছু হত তখন কি হত?

তুষার হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। চিত্রা একাই বকবক করছে। তুষার সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস চিত্রার সামনে ধরে বলে-
-“ আগে দম নিন,ক্লান্ত হয়ে গেছেন পানি খান।
চিত্রা চুপ হয়ে যায়। পানির গ্লাস টা সাইড টেবিলে রেখে দেয়। তুষার কে ঐ সময় ওমন র’ক্তপাত অবস্থায় দেখে প্রচুর ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। বুকের বা পাশটায় কেমন চিনচিনে ব্যথা করছিলো। নিজেকে কোনো রকম সামলে তুষারের কাছে দৌড়ে চলে আসে৷ তুষার হাত থেকে ছুরি টা ফেলে দিয়ে হাত চেপে র’ক্ত বন্ধ করতে ব্যাস্ত। চিত্রা পড়নের ওড়নার শেষ প্রান্ত থেকে অংশ টেনে ছিঁড়ে তুষারের হাত বেঁধে দেয়।

অতিরিক্ত ভয়ে চিত্রার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিলো না। শুধু সারা শরীর ভয়ে বারংবার কেঁপে উঠছিলো। ওড়নার অংশ টা তুষারের হাতে বেঁধে দিতেই তুষার চিত্রার ভয়ার্তক কাঁপা শরীর টা দেখে চিত্রার মাথা টা বুকের সাথে চেপে ধরে।
-“ ভয় পাচ্ছেন কেনো মিস চিত্রা? ভয় পাবেন না। আছি তো আমি,কিচ্ছু হবে না আপনার।
চিত্রার এবার ডুকরে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করলো। সে তো নিজেকে নিয়ে কখনও ভয় পায় না। তার নিজের জন্য লোকটা আঘাতপ্রাপ্ত হলো। চিত্রা তুষারের বুক থেকে মাথা সরিয়ে আনে। চোখ থেকে বেয়ে পড়া জল টুকু আড়ালে মুছে নিয়ে বলে-
-“ এখানে আর এক মুহুর্ত ও নয়,চলুন হসপিটালে। ডক্টর দেখাতে হবে। খুব ব্যাথা করছে তাই না? ইশ কতখানি কে’টে গেছে, জ্বলছে খুব?
-“ হ্যাঁ জ্বলছে খুব। তবে হাতে নয় এই যে এইখান টায়।

চিত্রা তুষারের হাত থেকে মুখের দিকে তাকাতেই দেখে তুষার বুকের বা পাশে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। চিত্রা বুকে হাত দিয়ে বলে-
-“ এখানেও কে’টেছে? দেখান না আমায়।
-“ এই কাটা দেখা যাবে না মিস। আপনার চোখের জলের কারনে জ্বলছে এখান টায়।
টুপ করে জল গড়িয়ে পড়লো চিত্রার গাল বেয়ে।
-“ ঐ যে দেখুন আবার টুপ করে পড়ছে আর যন্ত্রণা টা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

চিত্রা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল-
-“ আমার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। কি করবো? আপনাকে এই অবস্থায় দেখে আমার দুনিয়া থমকে গিয়েছিল।
-“ তাই বলে কাঁদবেন মিস চিত্রা? এটা তো সামান্য আঘাত এতেই এমন নেতিয়ে পড়লেন! যদি বড় কিছু হয় তখন নিজেকে সামলাবেন কি করে?
-“ এর জন্যই আমি আপনায় বিয়ে করতে চাই নি। দেখুন প্রথম ঘুরতে এসেই কি হলো। বাকি জীবন কি করে নিশ্চিন্তে থাকবো আমি। আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে ম’রেই যাব দেখে নিয়েন।
-“ হুঁশশ, বাজে কথা বলবেন না। আমার আগে আপনার মৃ’ত্যু নেই।
-“ আপনি সব জান্তা নাকি?
-“ উঁহু তবে ভরসা দিতে পারি, আপনার কোনো ক্ষতি আমি হতে দিব না।
-“ সেজন্যই আজ আমার জন্য নিজের প্রাণ দিতে বসেছিলেন।
তুষার স্মিত হেঁসে শুধালো-
-“ বেশি বুঝেন কেনো চলুন হসপিটালে যাই।

——————–

-“ ব্রো বাসায় চলো। আর ভাবি চলুন আপনায় বাসা ছেড়ে আসি।
রাফির কথা শুনে ঘোর ভাঙে চিত্রার। হসপিটালে এসে তুষার রাফিকে কল করেছিল।
-“ আপনি উনাকে ঠিকমতো বাসায় নিয়ে যাবেন। গাড়ি চালাতে দিবেন না। আর আমি অটো করে বাসায় চলে যেতে পারবো।

তুষার রুষ্ট হলো চিত্রার কথা শুনে।
-“ একদম না। আপনি আমাদের সাথেই যাবেন। অসুস্থ দেখতেই পাচ্ছেন। কথা বাড়াবেন না।

চিত্রা চুপ হয়ে যায়। রাফি আগে আগে হাটে আর পিছনে চিত্রা তুষার। চিত্রা বারবার আড়চোখে তুষারকে দেখে চলছে।
-“ এভাবে আড়চোখে বারবার কেনো দেখছেন? সামনে তাকিয়ে হাঁটুন তা না হলে পড়ে যাবেন তো।

চিত্রা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। গাড়ির কাছে আসতেই চিত্রা পেছনের সিটে বসে পড়লো। তুষার রাফিকে ইশারায় গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে নিজেও পেছনের সিটে বসলো। চিত্রার বাসার সামনে আসতেই চিত্রা গাড়ি থেকে নেমে যায়। গাড়ির জানালা দিয়ে তুষারকে বলে-
-“ বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবেন। ডক্টরের দেওয়া মেডিসিন টাইম টু খাবেন। আর পৌঁছে আমাকে কল দিবেন। আমার ফোন নম্বর আছে? না থাকলে নোট করুন ০১৯৫০০*****। আর এই যে ড্রাইভার দেখেশুনে গাড়ি চালিয়ে বাসায় যাবেন। ভাইয়ের খেয়াল রাখবেন।
রাফি মাথা নাড়ায়। চিত্রা আরেকবার তুষারের দিকে চেয়ে বাসায় চলে যায়। তুষার গাড়ি থেকে নেমে রাফিকে নামতে বলে। রাফি গাড়ি থেকে নামতেই তুষার ড্রাইভিং সিটে বসে। ইশারায় পাশে বসতে বলে রাফিকে। রাফি বিনাবাক্যে পাশে বসতেই তুষার গাড়ি স্টার্ট দেয়।

ভার্সিটি থেকে ফিরেই থম মে’রে আছে সোফায়। মনে তার বিষাদের হাওয়া কোনো কিছুতেই মন বসছে না। বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরতেই দেখে সদর দরজা দিয়ে রাফি আসছে আর পেছন পেছন তুষার। রাফিকে দেখেই বিষাদরা আরো প্রকোপ হয়ে জেঁকে বসলো। পরক্ষনেই তুষারের দিকে তাকিয়ে ব্যান্ডেজ করা হাতে চোখ পড়তেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। বসা থেকে উঠে ভাইয়ের কাছে হন্তদন্ত হয়ে যায়।
-“ ভাই হাতে ব্যাথা পেলে কি করে?
তৃষ্ণার কথা শুনে রান্না ঘর থেকে তানিয়া বেগম বের হয়ে আসে। ছেলের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে থমকে যায়।
খুন্তি সমেত তুষারের দিকে এগিয়ে এসে বলে-
-” হাতে চোট পেলি কি করে তুষার?

মা বোন কে অস্থির হতে দেখে আস্বস্ত করে বলে-
-“ ঐ একটু অসাবধানতার জন্য কে’টে গেছে।

তানিয়া বেগম সন্দেহান দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ মিথ্যা বলছিস না তো? ব্যান্ডিস খোল আমি দেখবো।
-“ আহ চাচি তুমিও না। ব্যান্ডেজ যদি খোলারই হতো তাহলে ব্যান্ডেজ কেনো করা হয়েছে?
-“ ব্যান্ডিজ যখন করা হয়েছে তারমানে আঘাত টা ঘুরতরই রাফি ভাইয়া। মা কে হযবরল বুঝিয়ো না। ভাই খুব লেগেছে?
তুষার তৃষ্ণার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলে-
-“ না টুনুই বেশি লাগে নি। চিন্তা করিস না। আর মা তুমি রান্না চুলায় রেখে এসেছো বোধহয়। আমি ঠিক আছি,আমার জন্য এক কাপ কফি পাঠিয়ো।

কথাটা বলে তুষার আর রাফি উপরে চলে যায়।
-“ ব্রো অঘটন টা ঘটলো কি করে?
তুষারের সোজাসাপটা জবাব-
-“ জানি না।
-“ জানবে না? যতদূর চোখ যায় ততদূরই তো খোলা মাঠ ছিলো তাহলে ছুরি টা আসলো কোথায় থেকে? চিন্তার বিষয় তো।
-“ হুমম।
-“ তোমার অনুমতি ছাড়া তো ওখানে কেউ প্রবেশ করতে পারে না তাহলে কেউ ঢুকলো কি করে?
-“ দেখ ভাই রাফি এসব প্রশ্ন করে আর জ্বালাস না আমায়,প্রথমবার তোর ভাবি কে নিয়ে ঘুরতে গেছি আর কোথাকার কোন গোলামের পুত এসে আমার রোমান্টিক শীতল পরিবেশ টাকে গরম করে দিলো!

তুষারের রাগান্বিত কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে যায় রাফি। রোমান্টিক মুহূর্ত নষ্ট হওয়ায় সে রেগে আছে। অথচ একটুর জন্য যে প্রান যেতে বসেছিল সেটার জন্য ভাবছে না! ভালোবাসা এতো টা অন্ধ করে দিতে পারে?
-“ ব্রো পরিবেশ গরম হবার জন্য এতো রাগ করছো? অথচ প্রান টাই তো খোয়াতে বসেছিলে।
-“ তুই বুঝবি না এমন মুহুর্ত কারো জন্য নষ্ট হলে কতটা রাগ লাগে। আগে কাউকে ভালোবাস ভাই তারপর দেখিস কেমন লাগে।
-“ এই নাকি তুমি আমাদের ভাবি এমপি ব্রো? এমপিদের এতো ফিলিংস থাকতে নেই শুনেছি।
তুষার রাগী চোখে তাকালো।
-“ এমপিরা কি রক্তে মাংসে মানুষ না নাকি? ওদের ফিলিংস থাকতে মানা কে বলছে? যে বলছে তাকে সামনে আন।
-“ আরে ব্রো চেইতো না চেইতো না। মুড ঠিক করো,আমি বরং আসি।
রাফি যেতেই তুষার পকেট থেকে ফোন বের করে। একটা নম্বরে কল লাগিয়ে বলে-
-“ লাফাঙ্গার টার এ টু যেট হিস্ট্রি আমার চাই। ওর কলিজা টা জাস্ট দেখতে চাই কত বড় হয়েছে। ও চিনতে ভুল করেছে তুষার খাঁন কে। ওর মৃ’ত্যু অনিবার্য।

———–

-“ মা ঠিক আছিস তো তুই?

কথাটা বলতে বলতে হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের রুমে ঢুকে সাহেল আহমেদ। চিত্রা তুষারের একটা ফোন কলের অপেক্ষায় বসে ছিলো। সাহেল আহমেদের কথা শুনে বসা থেকে উঠে বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে-
-“ আমি একদম ঠিক আছি বাবা অস্থির হয়ো না।
সাহেল আহমেদ মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-“ তামিমের থেকে শুনলাম তোদের উপর কেউ আক্রমণ করেছিলো।
-“ হ্যাঁ।
-“ কে দেখেছিস তাকে?
-“ না বাবা। কোথা থেকে যেনো ছুরি টা চলে আসলো। এমন খোলামেলা জায়গায় এটা ঘটলো বিষয় টা কত অদ্ভুত তাই না?
-“ হুম। বিরোধী দলেরই কাজ এটা। ওদের একটা শিক্ষা না দিলেই চলবে না। তুই বরং রেস্ট নে আমি আসছি।

চিত্রা ফোন হাতে নিয়েই অপেক্ষা করে। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে নিজের নম্বর না দিয়ে লোকটার নম্বর আনলে তাকে এমন গলা কা’টা মুরগির মতো ছটফট করতে হতো না।

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব১১ ( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ )
#Raiha_Zubair_Ripti

অন্ধকার রুমে হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে ২২ বছরের এক যুবক কে। শরীর জুড়ে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ফুটে আছে। যার দরুন ব্যাথায় শরীর নাড়াতে পারছে না। দরজা ঠেলে ব্যাথার্তক হাত নিয়ে প্রবেশ করে তুষার। পড়নে তার ব্লাক কালারের হুডি,মুখে রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত রাগ,চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে সামনে নেতিয়ে পড়ে থাকা আগন্তুক কে। তুষার ইশারা কিছু বললো,সাথে সাথে এক লোক ছোট বলতিতে রাখা ঠান্ডা জল লোকটার গায়ের উপর ছুড়ে মারলো। লোকটা ধরফরিয়ে উঠলো সাথে সাথে শরীরে ব্যাথার টান অনুভব করলো। মুখ দিয়ে আহ নামক শব্দ বের হলো। তুষার এগিয়ে গিয়ে আগন্তুক লোকটার চুল গুলো টেনে ধরলো। লোকটা ব্যাথা সইতে না পেরে চোখ মেলে তাকালো। হাত পা বাঁধা যার জন্য ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে তুষারের থেকে ছাড়াতে পারলো না।
-“ তোর কলিজাটা আজ আমি দেখতে চাই ফারহান। কি ভেবেছিস আমি তোকে ধরতে পারবো না? তুষারের বা হাতের খেল তোকে খুঁজে বের করা মুর্খ ছেলে।

ফারহান ব্যাথার্তক শরীর নিয়েই বহুত কষ্টে মুখ থেকে আওয়াজ বের করে বলল-
-“ ভুল হয়ে গেছে আমার।
ফারহানের চুল ছেলে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে
-“ ভুল! এটাকে ভুল বলে? তোকে আমি লাস্ট একবার চান্স দিয়েছিলাম ভুলে গেছিস? মানুষ বারবার ভুল করে না, জেনেশুনে অন্যায় করে। আর তুই তো পাপ করেছিস। চিত্রা কে মা’রতে চেয়েছিস, আমার কলিজা আমার থেকে দূরে করতে চেয়েছিলি, আমি তোর কলিজা আজ তোর থেকে দূরে সরাবো।

কথাটা বলে পকেট থেকে ব্লে’ট বের ফারহানের হাতে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। ফারহান গলা কা’টা মুরগির মত ছটফট করতে থাকে। চেয়ার থেকে এখন র’ক্ত গুলো ফ্লোরে টপটপ করে পড়তে শুরু করেছে।তুষারকে থামতে না দেখে রাতুল এগিয়ে আসে। তুষারের হাত ধরে টেনে সরিয়ে বলে-
-“ ম”রে যাবে তো ছেলেটা, ছেড়ে দে। আর তোর শরীর ও তো ভালো না।
তুষার ফারহানের দিকে রাগী দৃষ্টি নিয়ে চিৎকার করে বলে-
-“ বন্ধুর জন্য প্রাণ উতলে উঠছে তোর? ও বিশ্বাস ঘাতক ভুলে যাস না।
রাতুল একবার ফারহানের দিকে তাকিয়ে নম্রস্বরে বলে-
-“ আমি কিচ্ছু ভুলি নি তুষার। সব মনে আছে।

তুষার মাথা ঘুরে একবার তাকালো ফারহানের দিকে । ব্লে’টের পোস দেওয়ার ফলে হাতের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে পরছে। রুমের মধ্যে থাকা লিমন নামের এক ছেলের গা গুলিয়ে উঠলো। মুখ চেপে ওয়াও বলতেই তুষার সেদিকে রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। ছেলেটা ভয়ে চুপসে গেলো।

এই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ও তুষারের শরীর বেয়ে ঘাম বের হচ্ছে। প্রচন্ড আকারে খেপেছে এ ছেলে আজ। শান্তশিষ্ট থেকে সোজা সাইকো তে পরিনত হলো। তুষার এগিয়ে এসে চেয়ার টায় সজোরে লা’ত্থি মারে। চেয়ার সমেত ঠাস করে ফ্লোরে পড়ে যায় ফারহান।

তুষার রুমের মধ্যে থাকা লিমন রাতুলের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলে-
-“ মরিচের গুঁড়ো দিয়ে ভালো করে মিক্সড করবি। একফোঁটা জল খাবার কিছু যেনো না পায়। আর ঐ হালিম সরকার কে খবর পাঠাবি তুষার একবার ওর দিকে তাকালে ওর কিন্তু বাঁচা বড় দায় হয়ে যাবে।

রাতুল তপ্ত শ্বাস ফেলে তুষারের যাওয়ার পানে তাকিয়ে। লিমনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে তুষার যা বললো তা করতে। লিমন এক ঢোক গিললো,হাতের অবস্থা দেখেই পেট মোচড় দিয়ে উঠছে আর তারা কি না ঐ হাতে মরিচের গুঁড়ো মেশাতে বলছে! কি মারাত্মক এরা।
লিমন কে এখনও নড়তে না দেখে রাতুল ফের তাড়া দিয়ে বলে-
-“ কি বলা হয়েছে কানে যায় নি? তাড়াতাড়ি কর।
লিমন ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বলে-
-” ভাই কাজ টা কি আমাকেই করতে হবে? আমার কেমন যেনো লাগছে,দেখেন গা শিউরে উঠছে। হাতের দিকে তাকাতেই পেট মোচড় দিচ্ছে। অন্য কাউকে বলুন না।

তুহিন ফারহানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ মরিচের গুঁড়ো টা তো আনতে পারবে? নাকি সেটাও অন্য কাউকে দিয়ে আনাতে হবে?
লিমন তার হলদেটে দাঁত গুলো বের করে হেঁসে বলে-
-“ না ভাই আমিই আনতেছি।

লিমন মরিচের গুঁড়োর প্যাকেট এনে রাতুলের হাতে দেয়। রাতুল কেঁচি দিয়ে প্যাকেট টা কে’টে উপর থেকে ফারহানের মাংস খসে পড়া হাতে ঢালতে থাকে।
ফারহান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে। আকুতি মিনতি করে মরিচের গুঁড়ো না ঢালতে। বারবার বলে-
-“ বন্ধুত্বের দোহাই লাগে এবারের মতো ছেড়ে দে রাতুল।

ফারহানের সম্পূর্ণ কথাকে অগ্রাহ্য করে মরিচের গুঁড়ো ঢালতে থাকে রাতুল। বন্ধুত্বের থেকেও কর্তব্য দামি রাতুলের কাছে। গুঁড়ো টা ঢালা শেষ হতেই রাতুল বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। লিমন এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে রাতুলের দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না বন্ধুর সাথে কেউ কি করে এমন অমানবিক নিষ্ঠুর অত্যা”চার করতে পারে? লিমন আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে-
-“ ভাই ও আপনার ফ্রেন্ড? স্যার এসব করতে বললো আর আপনি করলেন?
রাতুল একবার ফারহানের দিকে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে কাটকাট গলায় বলে-
-“ বিশ্বাসঘাতক রা কখনও বন্ধু হয় না। বন্ধুত্বের শব্দ ওদের জন্য না।
-“ মানে?
-“ মানে টানে কিছু না। নতুন এসেছো এ জগতে এসব নিজ চোখে দেখার সহ্যক্ষমতা তৈরি কর ছেলে। আর ভুলেও বিশ্বাসঘাতকতা করো না তাহলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।

———————-
-“ রেগে আছেন মিস চিত্রা? ভীষণ ভীষণ সরি বাসায় এসেই কল দিতে না পারায়।
ফোনের ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসলো না। প্রিয়তমা যে ভীষণ অভিমান করে কথা বলছে না এটা বুঝতে সময় লাগলো না।
-“ কথা বলবেন না মিস চিত্রা? খুব কি অভিমান হয়েছে আমার উপর? একটু কি দয়া বর্ষণ করা যায় না এই অধমের উপর? আপনার নিরবতা যে ভিষণ পিড়া দিচ্ছে।

চিত্রা তুষারের এমন আকুতি ভরা কথা শুনে অভিমান গুলো কে সযত্নে তুলে এক সাইডে রাখলো। সেই কখন থেকে ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলে তুষারের ফোনের। পাক্কা চারঘণ্টা পয়তাল্লিশ মিনিট তেরো সেকেন্ড পর ফোন করলো। প্রথম রিং হতেই ফোনটা রিসিভ করে, মন বলছিলো এটা তুষারের ফোন। ইচ্ছে ছিলো খুব বকে দিবে কিন্তু তুষারের ভয়েস শুনতেই মাথায় পাকিয়ে রাখা সব শব্দ রা নিখোঁজ হয়ে যায়
-“ আপনার কি উচিত ছিলো না আমাকে পৌঁছে জানানোর? আমি যে অপেক্ষা নিয়ে বসে আছি আপনার কলের।
অতিরিক্ত রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তুষার। একটু ও মনে ছিলো না চিত্রা কে ফোন করার। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলে ফারহান কে হাতে পাওয়ার। তাই তো দুই ঘন্টার মধ্যে লোক দিয়ে ফারহান কে তুলে এনেছে। রাগ টা ফারহানের উপর ঝেড়ে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতেই মনে পড়ে প্রিয়তমা তার ফোন কলের অপেক্ষায় আছে। তাই তো তড়িঘড়ি করে ফোন করলো।

-“ সেজন্য বিগ সরি,প্লিজ রাগ করবেন না। আসলে বাসায় এসে একটু ঘুম পেয়েছিল (ডাহা মিথ্যে কথা) ঘুমানোর ফলে আপনায় ফোন করতে পারি নি।

চিত্রা বিষয় টা ভেবে দেখলো। সত্যিই তো তার শরীর অসুস্থ, তার বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন বেশি ফোনের থেকে।
-“ এখন শরীরের অবস্থা কেমন?
তুষার কে’টে যাওয়ার হাতের দিকে তাকালো। বা হাতের ব্যাথাটা আগের তুলনায় বেড়েছে। চিত্রা চিন্তিত হবে বলে শুধায়-
-“ আগের থেকে কিছুটা বেটার ফিল করছি। ডিনার করেছেন রাতে?
-“ না আপনি?
-“ তাড়াতাড়ি ডিনার করুন, রাত প্রায় অনেক হলো তো।
-“ দশ টা পনেরো বাজে মাত্র।
-“ এটা মাত্র না,,তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়ুন।
চিত্রা কথা বাড়াল না, বুঝে নিল তুষার অসুস্থ তাই আর কথা বলার চেষ্টা করলো না।

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে রাফি। আড়চোখে তৃষ্ণা কে দেখে চলছে।মেয়েটা মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। পাশে যে কেউ তাকে বারংবার দেখছে সেটা যেনো তার মাথার আশেপাশে ও ভিড়ছে না। রাফি টিভির দিকে দৃষ্টি নিয়ে দেখলো মেয়েটা আমাদের রাণী নামের একটা নাটক দেখছে,স্টার জলসা নামের চ্যানেলে। রাফি এসবের দিকে চোখ বুলিয়ে তৃষ্ণার হাত থেকে টান মেরে রিমোট নিয়ে নেয়।

তৃষ্ণার ব্যাঘাত ঘটে। বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে রাফির দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রাফি ভীষণ অবাক হলো। সে ভেবেছিল রিমোট কেড়ে নেওয়ায় তৃষ্ণা রিয়াক্ট করবে। কিন্তু পুরোপুরি ধারনা বদলে দিয়ে নিরবে চলে গেলো। অধরাকে আসতে দেখে রাফি প্রশ্ন করে বসলো-
-“ তৃষ্ণার কি কিছু হয়েছে অধরা?
অধরা পানির জগটা নিয়ে বলে-
-“ মনে তো হলো কিছু হয়েছে। দুপুরে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। চোখ মুখ ফুলো ছিলো। মামি কারন জিজ্ঞেস করলে বলে নি।

অধরার কথা শুনে রাফির ভ্রু জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো।

#চলব

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-৮+৯

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৮( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ শুনো চিত্রা আমি চাইছি তোমার সাথে তুষারের বিয়ে টা খুব শীগ্রই দিতে। আরহাম কে দিয়ে ভরসা নেই যখন খুশি তোমার ক্ষতি করতে পারে। তুষারের কাছে থাকলে অন্তত তোমার ক্ষতি হবে না। আর আমি দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে পারবো।

কথাটা বলে লম্বা একটা শ্বাস ফেললো সাহেল আহমেদ। তুষারের সাথে কথা বলেই তিনি বিয়ের ব্যাপারে এগিয়েছেন। তুষার জানিয়েছেন দিন কয়েকের মধ্যে সে চিত্রা কে বিয়ে করতে চান। এর জন্য চিত্রার সাথে আলাদা করে কথাও বলতে চান। সন্ধ্যার দিকে তুষার আসবে।

সাহেল আহমেদ মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে যে একটা কথা বললো সেটা মনে হয় মেয়ের কানে ঢুকে নি আর ঢুকলেও কথাটা কে গ্রাহ্য করে নি। চিত্রার এমন খামখেয়ালি ভাবসাব দেখে কিছুটা রুষ্ট হলেন সাহেল আহমেদ।
-“ আমি কি বলেছি কথাটা কি কানে ঢুকেছে?
চিত্রা টিভির রিমোট দিয়ে টিভিটা বন্ধ করে বলে-
-“ আচ্ছা বেশ বিয়ে দিতে চাইছো আমি করবো। তবে আমার শর্ত আছে।
সাহেল আহমেদ ভ্রু কুঁচকালো মেয়ের কথা শুনে।
-“ কি শর্ত?
-“ তুষার কে রাজনীতি ছাড়তে হবে।
-“ তুমি ভালো করেই জানো তুষার রাজনীতি ছাড়বে না। সামনে ওর কাঁধে কতবড় দায়িত্ব একবার ভেবে দেখেছো? সমাজের দুরস্ত মানুষের জন্য এখনও কত কিছু করা বাকি।
-“ সমাজের মানুষের ভালো করতে গিয়ে যে তোমাদের সাথে খারাপ ঘটে তার দায়ভার কি সমাজের লোকেরা নেয়? তোমরা সমাজের ভালোর জন্য এতো কিছু করো জাস্ট একটা ভুল করে দেখো সেই সমাজই তোমাদের টেনেহিঁচড়ে নিচে নামিয়ে আনবে। ভুলে যাবে তারা তাদের জন্য কি কি করেছো তোমরা।
-“ আহা নেগেটিভ চিন্তা করছো কেনো? পজিটিভ ভাবো। বাংলাদেশে আরো কতো চেয়ারম্যান এমপি আছে তারাও তো সমাজের দেশের মানুষের জন্য কাজ করছে। রাজনীতি মানেই খারাপ না মা,বুঝার চেষ্টা করো।
-“ কিন্তু বাবা…
-“ আর কোনো কিন্তু করো না মা তোমার ভালোর জন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাবা হিসেবে তো আমি তোমার খারাপ হবে এমন কিছু করবো না। বিশ্বাস রাখো আমার উপর। রিকুয়েষ্ট করছে তোমার বাবা ফিরিও না।
-“ আচ্ছা ভেবে দেখবো।
কথাটা বলেই চিত্রা বসা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। সাহেল আহমেদ হতাশ হন। চয়নিকা বেগম চায়ের কাপ এনে সাহেল আহমেদের সামনে রেখে বলে-
-“ বেশি চিন্তা করো না। ঠিক রাজি হয়ে যাবে চিত্রা।

সাহেল আহমেদ ভাবান্তর হয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসায়। চয়নিকা বেগম স্বামীর দিকে চেয়ে থাকেন।

চিত্রা রুমে এসে পায়চারি করছে। তার বাবা অনেক টা হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলেছে। এবার না করা মানে বাবা কে অপমানের সাথে সাথে কষ্ট ও দেওয়া। কিন্তু বিয়ে টাও তো করতে ইচ্ছে করছে না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
এরমধ্যে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে পেছন ফিরে বলে-
-“ কে?
-“ আমি চিত্রা দরজা খুল।
চিত্রা তার মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দেয়। চয়নিকা বেগম হুড়মুড়িয়ে চিত্রার রুমে ঢুকে চিত্রা কে তাড়া দিয়ে বলে-
-“ ওড়না টা নিয়ে চটজলদি ছাঁদে যা।
চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো মায়ের কথা শুনে।
-“ ছাঁদে যাব মানে!
-“ হ্যাঁ তুষার এসেছে,তাড়াতাড়ি যা, ছেলেটা অপেক্ষা করছে।

চিত্রা ওড়না টা গায়ে জড়িয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। ছাঁদে পা রাখতেই ছাঁদে থাকা কৃত্রিম আলোয় দেখতে পেলো, ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন পুরুষ, পকেটে হাত দিয়ে।
চিত্রা সেদিকটায় তাকিয়ে এগিয়ে গেলো। তুষারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তুষার আড়চোখে একবার তাকালো চিত্রার দিকে।
আকাশে আজ থালার মতো ইয়া বড় রূপালী চাঁদ টা তার সকল আলো পৃথিবীর মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। কৃত্রিম আলো না থাকলেও এই ঘুটঘুটে আঁধারে তা আলোর ন্যায় কাজ করবে।
-“ আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নই। তাই যা বলার ডিরেক্টলি বলছি। বিয়ে তে রাজি হয়ে যান।

চিত্রা দৃষ্টি সামনে রেখেই জবাব দিলো-
-“ এটা বলার জন্য এখানে এসেছেন?
তুষার অকপটে বলে দিলো-
-“ না।
-“ তাহলে?
-“ যদি বলি আপনাকে একনজর দেখার জন্য এসেছি,বিশ্বাস করবেন মিস চিত্রা?

কথাটা চিত্রার সর্বাঙ্গ দেহের মাঝে যেনো বিচরণ করলো। কথাটার মধ্যে যেনো নেশা মেশানো ছিলো।
-“ আ আমাকে দেখার জন্য এসেছেন? কিন্তু কেনো?
-“ শুনলাম আজ কেউ আপনায় বিরক্ত করেছিলো।
-“ কে বললো আপনায়?
-“ বাতাসে চলে এসেছে। বাহিরে এতো ঘুরাঘুরি করেন কেনো একা একা?
-“ আমি একা ছিলাম না তো।
-“ সাথে কেউ ছিলো?
-“ হ্যাঁ।

তুষার ভ্রু কুঁচকালো।
-“ কে ছিলো সাথে?
-“ ফ্রেন্ড তৃষ্ণা। ও আজ ভীষণ কেঁদেছে।

তুষারের ভ্রু মসৃণ হয়। তার বোন কেঁদেছে বাট হোয়াই?
-“ কেঁদেছে কেনো আপনার ফ্রেন্ড?
-“ ঐ যে জেলাস হয়ে।
-“ কিসের জন্য জেলাস?
-“ ওর ভালোবাসার মানুষ টিকে অন্য রমণীর পাশে দেখে ওর কলিজা ফাডি যাচ্ছিলো। আপনিই বলুন কাউকে ভালোবাসলে কি সেটা চেপে রাখতে হয়? হয় না তো বলে দিতে হয়। তৃষ্ণা ওর কাজিন কে ভালোবাসে। কিন্তু ওর কাজিন জানে না।

তুষার বিষয় টা বুঝলো। তার বোন রাফিকে ভালোবাসে। কাজিন বলতে একমাত্র রাফিই।
-“ আপনি কাউকে ভালোবাসেন মিস চিত্রা?
চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেললো।
-“ না বাসি না…. আরে হ্যাঁ ভালোবাসি। তৃষ্ণার ভাই কে বললাম না সেদিন।

চিত্রা সত্যি বলতে গিয়ে পরক্ষণে মনে পড়লো সেদিন বলেছিলো তৃষ্ণার ভাই কে ভালোবাসে। তুষার চিত্রার কথা শুনে নৈঃশব্দ্যে হাসে।
-“ বিবাহিত ছেলেকে কেনো ভালোবাসতে গেলেন?
চিত্রা ভরকে যায়। নিজেকে ঠিক করে বলে-
-“ মানে?
-“ মানে এই যে তৃষ্ণার ভাইয়ের তো হবু বউ আছে। যাকে সে প্রচন্ড লেভেলের ভালোবাসে। সে তো আপনাকে পাত্তাই দিবে না।
চিত্রা সরু চোখে তাকিয়ে বলে-
-“ জানলেন কি করে?
-“ তুষার খাঁনের হবু বউ কাউকে ভালোবাসবে আর তার সম্পর্কে তুষার জানবে না এটা হয় নাকি।
-“ কিন্তু আপনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না।
-“ কেনো আমি কি দেখতে খারাপ?
-“ না না আপনি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। কিন্তু রাজনীতি করছেন যে।

-“ ট্রাস্ট মি আমার রাজনীতির জন্য আপনাকে কোনো সাফার করতে হবে না।
-“ আমি আমার জন্য চিন্তা করি না।
-“ তাহলে?
-“ আপনাদের জন্য।
-“ আমাদের জন্য চিন্তা করে আপনার প্রেশার লো করতে হবে না মিস চিত্রা। আমরা পাকাপোক্ত ভাবেই রাজনীতির মাঠে নেমেছি। চোখ কান সব সময় খোলা থাকে। আপনি বরং আমার রাতে বাড়ি ফেরার সঙ্গী হয়ে যান। যার কাছে বাহিরের যানজট পেড়িয়ে একটু মুক্ত ভাবে শ্বাস ফেলা যাবে।
-“ তাহলে আমাকে পটানোর চেষ্টা করুন। সময় এক সপ্তাহ আপনার আগামী হবু এমপি সাহেব। যদি পারেন তাহলে আমি রাজি।
তুষার মুচকি হাসলো। চুল গুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল-
-“ তুষার কে পটানোর জন্য মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর আপনি বলছেন আপনাকে পটাতে?
-“ কারন আমি স্পেশাল।
-“ জ্বি সাথে দামী ও।

চিত্রা হেঁসে ফেলে। চিত্রার হাসি দেখে তুষার চিত্রার দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটার হাসির প্রেমে পড়েছিল প্রথম দেখেই। হাসলে সুন্দর গালে টোল পড়ে। চিত্রা নিজের হাসি থামিয়ে তুষারের দিকে তাকায়। তুষার কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পুরো দৃষ্টি তুষারের দিকে দেয়। আজও পড়নে ব্লাক কালারের শার্ট। বড্ড কৌতূহল হলো জানার জন্য। এমপি সাহেব কি ফকির নাকি। শার্ট কেনার টাকা নেই নাকি।
-“ আচ্ছা এমপি সাহেব আপনার কি টাকা নেই?
চিত্রার মুখে হঠাৎ করে এমন কথা শুনে বিভ্রান্ত হলো।
-“ কেনো?
-“ না মানে আপনি সবসময় একই শার্ট কেনো পড়েন? আপনার সাথে যতবার দেখা হলো ততবারই এই কালো শার্টই পড়নে দেখেছি।
-“ আমার সব শার্ট টি-শার্ট ব্লাক কালারের সেজন্য এমনটা মনে হচ্ছে।
-“ তাই বলে সব?
-“ হুমম।
-“ আপনি ব্লাক লাভার?
-“ জ্বি হ্যাঁ। আপনার ব্লাক পছন্দ না?
-“ হাল্কা পছন্দ।
-“ তাতেই চলবে।
-“ বাসায় যাবেন না?
-“ হুমম। বিয়েতে রাজি আপনি?
-“ বললাম না আগে পটাতে,আমাকে সময় দিতে তারপর রাজি হবো। জীবন একটাই, জীবনসঙ্গী কে যাচাই বাছাই করে নিতে হবে।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৯( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ তুষার ভাই আপনি কি কেথাও যাবেন?
তুষার সোফায় বসে জুতা পড়ছিলো। অধরার কথা শুনে জুতার ফিতা লাগাতে লাগাতে বলে-
-“ হ্যাঁ যাব,তৃষ্ণাদের ভার্সিটিতে। কেনো?
অধরা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট টা ভিজিয়ে বলে-
-“ না মানে আমাকে একটু ভার্সিটি তে ড্রপ করে দিতেন।
তুষার বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোফা থেকে ফোন টা হাতে নিয়ে প্যান্টের পকেটে ভরে বলে-
-“ রহিম কে বলে দিচ্ছি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

অধরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। তুষার নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

ভার্সিটির ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা আর তৃষ্ণা। তৃষ্ণা মূলত দাঁড়িয়ে আছে চিত্রার হবু হাসবেন্ড কে দেখার জন্য। বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন চিত্রার হবু হাসবেন্ড এর দেখা মিললো না তখন হাত ঘড়ি টায় সময় দেখে নিয়ে চিত্রা কে বলে-
-“ দোস্ত তুই আজ এনজয় কর জিজুর সাথে। আমি অন্য দিন দেখা করবো নি।
চিত্রা একবার সামনের গেটের দিকে তাকায়। লোকটা বলেছিল আসবে। তাহলে আসছে না কেনো?
-“ আচ্ছা সাবধানে যাস।
তৃষ্ণা চিত্রার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। চিত্রা ক্যাম্পাসে থাকা হিজল গাছের নিচে বসে পড়ে। না জানি তার এমপি মহাশয় কখন আসবে। আদতে আসবে নাকি?
প্রায় মিনিট দশেক পর নিজের সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে ঘামার্তক শরীর নিয়ে মুখে মাক্স পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। চিত্রা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আরে এমন ঘেমে গেছেন কেনো? কার দৌড়ানি খেয়েছেন?
তুষার আশেপাশে তাকিয়ে বলে-
-“ আগে গাড়িতে চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছি না।

চিত্রা আশেপাশে তাকালো।
-“ ওমা কেনো এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে কি হবে?
-“ তেমন কিছুই হবে না আমার, যা হবার আপনারই হবে।
-“ কি হবে?
-“ জ্বলন।
-“ হোয়াই?
-“ দেখছেন না মাক্স পড়ে আছি। যদি মাস্ক খুলি আপনার সতিন হবার জন্য কিছু মেয়ে দৌড়ে চলে আসবে।

-“ ওহ্ আচ্ছা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি সেলিব্রেটি। আপনার ফ্যান ফলোয়ার গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। তা ভাবি এমপি মহাশয়, এমপি হওয়ার আগেই এতো লেট করলেন কেনো আসতে? আমার ফ্রেন্ড যে আপনাকে দেখতে না পেয়ে চলেই গেলো।
-“ আজ দেখা হয় নি তো কি পরের বার হবে দেখা। আর আসার পথে পার্টি অফিসে একটু ঝামেলা হয়েছিল সেটাই মিটমাট করতে খানিকটা দেরি হলো।
-“ তাহলে এখন কোথায় যাব আমরা?
-“ চলুনই না। তারপর ভাবা যাবে কোথায় যাওয়া যায়।
চিত্রা কোমরে হাত দিয়ে বলে-
-“ মাঝ পথে আবার আমাকে ফেলে ইমার্জেন্সি তে চলে যাবেন না তো?

তুষার হেঁসে ফেলে। যা মাক্সের কারনে চিত্রার নজরে আসে না।
-“ ইমার্জেন্সি আসলেও মিস আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে তারপর যাব।
-“ গুড এবার চলুন।

রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলছে আনমনে তৃষ্ণা। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে,রাফিকে মনের কথা বলাটা ঠিক হবে কি না। যদি রিজেক্ট করে তখন কি হবে? কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই মনটা বিষাদে ভরে গেলো। আকস্মিক ভাবে রাস্তার উল্টোপাশে চোখ যেতেই দেখে রাফি কে। মুহুর্তে চোখ মুখে আনন্দ রা এসে হানা দেয়। রাফি ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে ফুল কিনছে। তৃষ্ণার ইচ্ছে করলো রাফিকে ডাক দিতে। কিন্তু পরক্ষণে রাফির পাশে রিয়াকে দেখে দু চোখ নোনা পানিতে টইটম্বুর করলো। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হলো। মাথা ভনভন করলো,পা দুটো অবশ হয়ে আসলো।

তড়িঘড়ি করে একটা রিকশা ডাক দিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো। আর একটু ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোনো একটা কান্ড সে করে বসতো। রিকশায় উঠে বসতেই চোখের পানি গুলো বাঁধ ভাঙা নদীর মতো উপচে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বুকের বা পাশ টায় চিনচিনে ব্যথা করলো৷ ইচ্ছে করলো হৃদপিণ্ডটা টেনে বাহিরে বের এনে টুকরো টুকরো করে কে’টে জিজ্ঞেস করতে, কেনো লোকটাকে ভালোবাসিস এতো।

একহাতের তালু দিয়ে চোখ মুছছে আর অন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রেখেছে। চিৎকার করে কান্না করা সম্ভব নয়। রিকশাওয়ালা একটু পর পর তৃষ্ণার দিকে তাকাচ্ছে। তৃষ্ণা বিষয় টা বুঝতে পেরে নিজেকে ঠিক রাখার প্রয়াস চেষ্টা করলো।

রাফি ফুলের দোকান থেকে ফুল গুলো নিয়ে রিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-
-“ আই থিংক ফুল গুলোতে হবে তোর?
রিয়া ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে ফুল গুলো নাড়িয়ে বলে,-
-“ হ্যাঁ হবে। ধন্যবাদ দোস্ত।
-“ শুধু ধন্যবাদে চিঁড়া ভিজবে না। বিয়ের দাওয়াত চাই।
রিয়া লাজুক হেঁসে বলে-
-“ হ্যাঁ দোয়া করিস রায়ানের চাকরি টা হয়ে গেলেই করে ফেলবো।
-“ দোয়া করি সুখী হ। সাবধানে বাড়ি ফিরিস,বাই।

খোলা মাঠ, যতদূর চোখ যায় ততদূর শুধু মাঠ আর মাঠ। এর সীমানা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তার জানা নেই। হয়তো সামনে কিছুটা এগিয়ে গেলে এর সীমানা দেখা যাবে। মাঠের একপাশে রয়েছে ছোট্ট একটা নদী। নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা রঙের রাজহাঁস। নদীর ঠিক পাশেই আছে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। চিত্রার চোখ মুখ জুড়ে মুগ্ধতা। শহর থেকে খানিকটা দূরে এতো সুন্দর জায়গা থাকতে পারে এ যেন কল্পনাতেও ছিলো না।
তুষার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার প্রিয়তমার মুগ্ধতাকে দেখছে।

এই জায়গা টা ভীষণ পছন্দের তুষারের। মন খারাপ হলেই এখানে এসে একাকী বসে থাকে। মুহূর্তে প্রকৃতি যেনো নিজ দায়িত্বে মন ভালো করে দেয়। চিত্রা কে প্রথমবারের জন্য নিয়ে আসার জন্য মনে হলো এর থেকে সুন্দর জায়গা আর দুটো নেই।
চিত্রা তুষারকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু উঁচু করে জানায়, কি দেখছেন ওভাবে?
তুষার এগিয়ে আসে চিত্রার দিকে। চিত্রার কাছে এসে চিত্রার মাথার বদ্ধ চুল গুলো উন্মুক্ত করে দেয়। মুহুর্তে এক দমকা হাওয়া এসে চিত্রার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। চিত্রা বিরক্ত হয়ে কিছু বলবে এমন সময় তুষার বলে উঠলো-
-“ এবার বেশ লাগছে।
চিত্রা সামনে আসা চুল গুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে-
-“ চুল গুলো কেনো খুললেন? দেখুন বিরক্ত করছে তো।
-“ চুলগুলো কে বদ্ধ রেখেও তো আপনি মিস তাদের বিরক্ত করছিলেন। এদের মুক্ত বাতাসে মেলে দেওয়া উচিত। তাদের ও একটা স্বাধীনতা আছে।
চিত্রা আড়চোখে তুষারকে পরখ করে বলে-
-“ আপনার ভাবসাব সুবিধার ঠেকছে না এমপি মহাশয়।
-“ হয়তো।
-“ আচ্ছা এই জায়গাটা কাদের? ভীষণ সুন্দর।
-“ এই জায়গাটা আমার। একটা সময়ে এটা আমার আপনার মিলে আমাদের হবে।
লাস্টের কথা শুনে শরীরে কিছুটা অনুভূতি মিশ্রণ হলো। সেই সাথে কিছুটা লজ্জা। একজন পুরুষের মুখে থেকে কিছু বাক্য শুনলে আপনা-আপনি কিছু অনুভূতি ক্রিয়েট হয় শরীরে যেমনটা চিত্রার ক্ষেত্রে হলো। আমাদের মানে তুষার আর সে মিলেই তো আমাদের নামক স্বত্বা টাকে তৈরি করবে।
চিত্রা কে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকতে দেখে তুষার বলে উঠে –
-“ কোথায় হারিয়ে গেলেন?
চিত্রা ভাবান্তর হয়ে জবাব দিলো-
-“ আমাদের নামক শব্দটায়।
পরক্ষণেই মনে পড়লো কি বলে ফেললো সে। তুষার হাসলো। মেয়েটার মাঝে অনেক রূপ। কখনও বোকাসোকা,কখনও আত্মসম্মান প্রখর, কখনও লাজুকলতা। যাকে বলে পরিস্থিতি মতো নিজেকে চেঞ্জ করা গিরগিটি। গিরগিটি টা নেগেটিভ কিছু বুঝানোর ক্ষেত্রে সচারাচর ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু চিত্রার ক্ষেত্রে এটা নেগেটিভিটির কিছু বহন করছে না।

তুষার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে চিত্রার দিকে তাকাতেই মুখের সকল হাসি মুহুর্তের মধ্যে আকাশে ঢাকা অমাবস্যার রাতের কালো আঁধারের মতো হয়ে যায়। মনে হলো জীবনের দামী জিনিসটাকে সে হারানোর পথে। ধরালো ছুড়ি টা কাছে আসতেই হেঁচকা টানে চিত্রা কে পাশে ফেলে দেয় তুষার। সাথে সাথে ধারালো ছুড়ি টা এসে তুষারের বা হাতে এসে বিঁধে।
আকস্মিক ভাবে ধাক্কা খাওয়ায় চিত্রা হুমড়ি খেয়ে সবুজ ঘাসের মধ্যে পড়ে যায়। তুষারের মুখ থেকে মৃদু আহ জাতীয় শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তুষার বা হাত চেপে ধরে রেখেছে। আর হাত বেয়ে টুপ টুপ করে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-৬+৭

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব ৬( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ দেখ তৃষ্ণা তুই তোর ভাইকে বলবি আমায় যেনো হেল্প করে। একটু হেল্প করলে তেমন আহামরি ক্ষতি হবে না।

তৃষ্ণা এবার বিরক্ত হলো চিত্রার কথা শুনে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-
-“ এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে চিত্রা। আমার ভাইয়ের সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া নেই। সে জীবনেও তোকে সাহায্য করবে না,তার অতো সময়ই নেই। তার চেয়ে বরং তুই তোর ফ্যামিলি বা ঐ ছেলেকে বুঝা। আর তোর বাবা তো তোর ভালো ছাড়া মন্দ হতে দিবে না,বিষয় টা বুঝ বোন।

চিত্রা তৃষ্ণার বিপরীতে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। মেয়েটা রেগে আছে কথার ধরন দেখেই বুঝলো। আপাততঃ নিজের প্যারা টাকে সাইডে রেখে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
-“ কি হয়েছে তোর রেগে আছিস কেনো?
তৃষ্ণা নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চেষ্টা করলো। আস্তে করে জাবাব দিলো-
-“ না কিছু হয় নি।
চিত্রার বিশ্বাস হলো না। কিছুতো হয়েছেই যার জন্য রেগে আছে।
-“ কি হয়েছে কুইকলি সেটা বল। মিথ্যা বলবি না।

তৃষ্ণার এবার ভীষণ কান্না পেলো। চোখ দিয়ে টুপ করে দু ফোঁটা অশ্রু ও গড়িয়ে। নাক টা টেনে নিলো। ফোনের ওপাশে থাকা চিত্রা বুঝে গেলো মেয়েটা কাঁদছে।
-“ তৃষ্ণা কাঁদছিস কেনো? কি হয়েছে বল না।
তৃষ্ণা চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু টুকু সন্তপর্ণে মুছে নিয়ে বলে-
-“ দোস্ত ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
-“ কিসের জন্য?
-“ ভালোবাসার মানুষ টিকে অন্য নারীর পাশে দেখে।
-“ মানে?
তৃষ্ণা এবার ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে আসলো। বেলকনি থেকে স্পষ্ট রাফিকে বাগানে দেখা যাচ্ছে। রাফির পাশে রয়েছে অতি সুন্দরী এক রমণী। চোখ সরানো দুষ্কর। বাগানে থাকা দুই যুগল মানব-মানবীর দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ তুই তো জানিস আমি একজন কে ভালোবাসি।
-“ হ্যাঁ তোর কাজিন কে তাই তো?
-“ হ্যাঁ, জানিস লোকটা বুঝেই না আমি যে তাকে এতো ভালোবাসি। বুঝলে কি আর আমার সামনে অন্য নারীর সাথে এতো হাহা হিহি করতে পারতো বল? ভীষণ পীড়া দিচ্ছে ইয়ার,দম বন্ধ লাগছে।
-“ এক কাজ কর আমার বাসায় চলে আয়।
-“ ইচ্ছে করছে না।
-“ তাহলে এড্রেস দে আমি চলে আসি।
তৃষ্ণার টনকনড়া দিলো। চিত্রা কে তো তাদের বাসায় আনাই যাবে না। আর মুখের উপর না ও করতে পারবে না। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে বলল-
-“ ভার্সিটির পাশে থাকা পার্কে আয়। মনটা ফ্রেশ করবো।

চিত্রা ঠিক আছে বলে ফোনটা কেটে দেয়। আলমারি থেকে জিন্স প্যান্ট আর নেভি ব্লু কালারের টপস বের করে গলায় ওড়না নিয়ে মুখে মাক্স পড়ে বেরিয়ে যায়।

তৃষ্ণা মিষ্টি কালারে একটা কুর্তি পড়ে,চোখে গাড়ো কাজল দিয়ে চুল গুলো কে খোলা রেখে হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়। অধরা রুমে আসছিলো হঠাৎ তৃষ্ণা কে এভাবে বের হতে দেখে প্রশ্ন করে-
-“ কোথায় যাচ্ছিস?
তৃষ্ণা একপলক অধরার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ মানসিক শান্তি খুঁজতে।
অধরা বুঝলো না তৃষ্ণার কথার মানে। ফের কিছু বলতে নিবে তৃষ্ণা সেই সময় টুকু না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়। বাগানে এসে আড়চোখে একবার রাফি আর রিয়া নামের রমণীর দিকে তাকায়। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠতেছে বারংবার। রিয়া রাফির ফ্রেড। ওরা একসাথে একই ভার্সিটি তে পড়াশোনা করেছে। রিয়ার সাথে কথা বলার একপর্যায়ে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে তৃষ্ণা যাচ্ছে। রাফি ভ্রু কুঁচকালো এই সময়ে কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন টা করে কিছুটা তাড়াতাড়ি করে হেঁটে তৃষ্ণার সামনে দাঁড়িয়ে বলে-

-“ কোথায় যাচ্ছো?
তৃষ্ণা তাকালো না। দৃষ্টি সামনে থাকা গাড়ির দিকে রেখেই বলে-
-“ শান্তি খুঁজতে যাচ্ছি।
রাফি ভ্রু কুঁচকালো –
-“ কিসের শান্তি?
-“ মানসিক শান্তি।
-“ মানসিক শান্তি খুজতে বাহিরে যেতে হয়?
-“ আমার যেতে হয়। কারন বাসার মধ্যে আজকাল অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে আর কার্বনডাইঅক্সাইড বিপুল পরিমানে দেখা যাচ্ছে। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে।
-“ যাচ্ছো কোথায় সেটা বলো।
-“ আপাতত জানি না কোথায় যাচ্ছি। দু চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই যাব।
-“ কথা গুলো এমন বাঁকা বাঁকা কেনো? সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পারো না? বাড়ির মেয়ে তুমি, তুমি কোথায় যাচ্ছো না যাচ্ছো জানতে হবে তো নাকি।

তৃষ্ণার এবার রাগ হলো ইচ্ছে করলো রাফির চুল গুলো টেনে দিতে। রাগের জন্য চোখে জলের কারনে ঝাপসা দেখতে লাগলো। একটু দূরে থাকা রিয়া নামের মেয়ে টা এসে রাফির পাশে দাঁড়ালো। দু’জনকে পাশাপাশি দেখে রাফির দিকে ছলছল নয়নে একবার তাকালো। তারপর বিনা বাক্যে চলে গেলো। রাফি স্পষ্ট দেখলো তৃষ্ণার চোখ পানিতে টইটম্বুর করছে। কিন্তু কেনো? কি হয়েছে ওর?

পার্কের একটা বেঞ্চে বসে আছে চিত্রা আর তৃষ্ণা। তৃষ্ণা একটার পর একটা টিস্যু দিয়ে চোখ নাকের পানি মুছছে আর হেঁচকি তুলে কান্না রোধ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। চিত্রা এই প্রথম তৃষ্ণা কে কান্না করতে দেখছে,ওর নিজের ও খারাপ লাগছে তৃষ্ণার জন্য। আর মনে মনে খুব রাগ হলো তৃষ্ণার কাজিনের উপর। বেশ খানিকটা সময় কান্না করার দরুন চোখ ফুলে গেছে তৃষ্ণার। চিত্রা তৃষ্ণার মাথায় হাত রেখে বলে-
-“ অনেক তো হলো কান্না করা এবার শান্ত হ। দেখ চোখ মুখ ফুলে গেছে।

তৃষ্ণার চিত্রার হাত চেপে বলে-
-“ আমি কন্ট্রোল করতে পারছি না নিজেকে। যতোবার ওদের এক সাথে দেখার কথা মনে পড়ছে ততবারই আমার ঠেলে কান্না পাচ্ছে। ঐ লোকটা বুঝে না কেনো আমি যে তাকে ভালোবাসি। সব ছেলে বুঝে কেউ তাদের কে ভালোবাসলে ঐ গাধা কেনো বুঝে না। সবসময় শুধু শাসন আর জ্ঞান। আমি কি ওর কাছে জ্ঞান চাইছি নাকি শাসন চাইছি? আমি তো একটু খানি ভালোবাসা চাইছি।
-“ চেয়েছিস?

চিত্রার কথায় তৃষ্ণা চুপ হয়ে যায়। সে তো রাফিকে বলেই নি যে সে তাকে ভালোবাসে। পরক্ষণে তৃষ্ণার মন বলে উঠলো কেনো সে বলবে?রাফির কি উচিত না নিজে থেকে বুঝে নেওয়ার?
-“ ভালোবাসা চাইতে হবে কেনো? ও সব বুঝে এটা বুঝে না কেনো?
-“ সবাই সব বুঝে না। তাদের বলে বুঝাতে হয়,বলে দেখ,জানা তাকে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে।
-“ যদি রিজেক্ট করে তখন? আমি ম-রেই যাব।
-“ ধূর পাগলি কি বলিস এসব। পজিটিভ ভাব নেগেটিভ না ভেবে।
-“ তাহলে কি বলে দিব?
-“ বলে দেওয়াই শ্রেয় আমার মতে। নাহলে অবসরে আফসোস হবে দ্বিধায় ভুগতে হবে।
-“ আচ্ছা তাহলে খুব শীগ্রই জানাবো আমি তাকে।
-“ হু।
-“ আচ্ছা তাহলে বাড়ি যা আমিও বাড়ি যাই।
-“ আচ্ছা যা তাহলে।

তৃষ্ণা চিত্রা কে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। চিত্রা ঠাই বসে রয় বেঞ্চে। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা খুব পোড়ায়। ভাগ্যিস এই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয় নি। কথাগুলো ভেবে তপ্ত শ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হ্যান্ড ব্যাগটা বেঞ্চ থেকে হাতে নিয়ে সামনে এগোতেই আকস্মিক ভাবে কেউ একজন তার সামনে দাঁড়ালো। হঠাৎ এভাবে সামনে দাঁড়ানোর জন্য কিছুটা ভয় পেয়ে যায় চিত্রা। চোখ তুলে তাকাতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে। কপালে দু ভাজ পড়ে।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৭( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ আপনি এখানে কেনো? কি চাই?কোন মতলবে এখানে এসেছেন?

চিত্রার সামনে থাকা লোকটা মুচকি হাসলো। চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে বলে-
-“ একসাথে একই প্রশ্ন এতো ভাবে ঘুরিয়ে বলছো কেনো?দম নাও আগে।

চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো। সাইড কাটিয়ে চলে যেতে নিলে লোকটা আবার চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ালো।
-“ আরে চলে যাচ্ছো কেনো হৃদয়হরণী।
চিত্রা এবার রেগে গেলো কিছুটা। হাতে থাকা হ্যান্ড ব্যাগ টা দেখিয়ে বলে-
-“ এই ব্যাডা হৃদয়হরণী মানে কি হ্যাঁ, এই যে মেয়েদের হ্যান্ড ব্যাগ চিনেন এটা দিয়ে বারি মে-রে গাল লাল করে দিব,ফালতু লোক কোথাকার।

লোকটা চিত্রার হ্যান্ড ব্যাগ টা চিত্রার হাত থেকে এক ঝটকায় টেনে নেয়। ব্যাগটার দিকে ভালো করে চেয়ে থেকে বলে-
-“ ব্রেন্ডের ব্যাগ।
চিত্রা ব্যাগ টা টান দিয়ে নিয়ে বলে-
-“ ইয়েস ব্যান্ডের ব্যাগ এটা ৫০০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। বুঝুন তাহলে এটা দিয়ে আপনার মুখে একটা বারি দিলে কতোটা জোরে লাগবে।

লোকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে-
-“ তাই তো বিষয় টা তো একদম ভেবে দেখি নি। হৃদয়হরণী হৃদয় নিয়ে ফেলার চিন্তা ভাবনা করছে নট ব্যাড।

লোকটার কথা শুনে চিত্রার গা জ্বলে উঠলো। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলে-
-“ দেখুন আরহাম একদম আমাকে রাগাবেন না। বলেছি না আপনাকে আমার চোখের সামনে না আসতে। আসছেন কেনো?
-“ তোমাকে দেখতে।
-“ লজ্জা করে না অন্যের বউকে দেখতে আসতে? বেলেহাজ লোক কোথাকার।
-“ অন্যের বউ মানে?

চিত্রা বাম হাতের অনামিকা আঙুলে থাকা ডায়মন্ডের রিং টা দেখিয়ে বলে-
-“ দেখুন সি এটা কি?
আরহাম রিং টার দিকে তাকিয়ে বললো-
-“ আংটি।
-“ রাইট, এটা আংটি তবে ডায়মন্ডের। এমপি তামিম খান কে নিশ্চয়ই চিনেন? তার একমাত্র ছেলে তুষার খাঁনের হবু বউ আমি। সো নেক্সট টাইম আমাকে দেখতে আসতে হলে আমার হাসবেন্ডের থেকে পারমিশন নিয়ে আসবেন।

কথাটা বলে চিত্রা চলে আসতে নিলে পেছন থেকে আরহাম বলে উঠে –
-“ কবে এই অকাজ টা হলো? খবর টা কানে আসলো না কেনো?
চিত্রা পেছন ফিরে বলে-
-“ আপনার কান থাকলে তো আপনার কানে যাবে কথাটা। আর এটা অকাজ নয় এটা হচ্ছে শুভ কাজ মানে ফরজ কাজের একটা অংশ। বিয়েতে দাওয়াত দিব দামি গিফট নিয়ে এসে রোস্ট পোলাও খেয়ে যাবেন সাথে আমাকে আর আমার হাসবেন্ড কে দোয়া করে যাবেন যাতে কোনো আধপাগল এসে আমাদের চোখের সামনে না জুটে।

কথাটা বলে চিত্রা হাঁটা শুরু করে। মনে মনে ভাবলো-
-“ ভাগ্যিস আজ আসার পথে আংটি টা পড়েছিলাম। না হলে এতো সুন্দর মিথ্যা বানোয়াট কথা বলতাম কি করে? লোকটার চামড়া তো গন্ডারের মতো দেখছি। একে তো আমার বাবার শত্রু তার উপর আমার বাবা কে মারার প্ল্যান করে আর আমার সামনে ছ্যাচড়ামি করে। হৃদয়হরণী হৃদয়হরণী করিস না? তোর হৃদয় টা কে”টে কালা ভুনা করে খাবো।

-“ বাবা চিত্রার বিয়ে ঠিক হয়েছে ঐ এমপির ছেলের সাথে আর আমার কানে কথাটা আসতে এতো দেরি হলো কেনো?

আকবর হোসাইন সোফায় বসে তার দলের চ্যালাপেলার সাথে কথা বলছিলো। আকস্মিক ছেলের কথা শুনে কথার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে।
-“ সাহেলের মাইয়ার বিয়ে ঠিক হইছে!
-“ হ্যাঁ। তুমি যে বলছিলা চিত্রার বিয়ে আমার সাথে হবে। এখন কি হচ্ছে এটা?
-“ সত্যি?
-“ আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি?
আকবর ভাবান্তর হলো। ছেলেকে আস্বস্ত করলো সে কিছু একটা করবে।

তুষার সবেই বাড়ি ফিরেছে। ড্রয়িং রুমের সোফায় সাহেল আহমেদ কে সেদিক টায় এগিয়ে যান। সাহেল আহমেদ কে সালাম দেয়। সাহেল আহমেদ সালামের জবাব দিয়ে বলে-
-“ তা রাজনীতি কেমন লাগছে তুষার?
তুষার স্মিত হেঁসে বলল-
-“ জ্বি আঙ্কেল বেশ ভালোই লাগছে।
-“ সামনের নির্বাচনে আমার বদলে তুষার কে দাঁড় করাবো সাহেল। বয়স হচ্ছে, আমার অবর্তমানে তুষারই হবে আগামী এমপি।
-“ হ্যাঁ কথাটা মন্দ না। তা তুষার এখন থেকেই নিজেকে প্রিপিয়ার করো। সামনে অনেক বড় দায়িত্ব কাঁধে আসতে চলছে।
তুষার বিপরীতে কিছু বললো না। সাহেল আহমেদ টুকটাক আরো কথা বলে তুষারদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।

-“ মা বাবা কোথায়?
চিত্রা বাসায় এসে তার মা কে হাক ছেড়ে ডাকে। চয়নিকা বেগম মেয়ের ডাক শুনে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বলে –
-“ কেনো কি হয়েছে? বাবা কে ডাকছিস কেনো হঠাৎ?
-“ জানো আজ কি হয়েছে?
-“ কি হয়েছে না বললে জানবো কি করে?
-“ জানো আজ ঐ ছেলে এসেছিল।
চয়নিকা বেগম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে –
-“ কোন ছেলে?
-“ বেলেহাজ আরহাম।
-“ কিছু বলেছে?
-“ বলার সুযোগ দিলে তো বলবে। তড়িঘড়ি করে চলে আসছি। বাবা আসলে বলবে ঐ ছেলে যেনো আমার সামনে আর না আসতে পারে সেই ব্যাবস্থা করতে।

কথাটা বলে চিত্রা নিজের রুমে ঢুকে যায়। সাহেল আহমেদ বাসায় ফিরতেই চয়নিকা বেগম কথাটা বলেন। সাহেল আহমেদ ভাবনায় পড়ে যায়। ঐ ছেলে মোটেও সুবিধার নয়। ভয় হচ্ছে না জানি কবে মেয়ের সাথে উল্টাপাল্টা আচারণ করে বসে।

কিছুটা ভয় আর সংকোচ নিয়েই তুষার কে ফোন করে। তুষার নিজের রুমে ছিলো। সাহেল আহমেদের ফোন পেয়ে অবাক হয়। ঘন্টা দুয়েক আগেই তো গেলো। ফোনটা রিসিভ করতেই সাহেল আহমেদ বলে উঠে –
-“ তুষার তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?
হঠাৎ শুরুতে সাহেল আহমেদের এমন কথা শুনে কিছুটা ভরকে যায়। সন্দেহান হয়ে বলে-
-“ কি হয়েছে আঙ্কেল? এনি প্রবলেম?
-“ হ্যাঁ। তুমি তো জানো আমি চিত্রা কে নিয়ে কতোটা দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকি। আজও নাকি আকবরের ছেলে এসে চিত্রা কে বিরক্ত করে গেছে। বিষয় টা এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই তুষারের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়।

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-৪+৫

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৪( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ কি ব্যাপার বিয়েতে রাজি হচ্ছো না কেনো?
চিত্রা ভার্সিটি থেকে ফিরতেই কথাটা বলে উঠে সাহেল আহমেদ। চিত্রা একবার বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁধের ব্যাগ টা সোফায় রেখে বাবার থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে বসে বলে-
-“ আমি কেনো বিয়েতে রাজি নই তার কারন টা তো তোমার জানার কথা আব্বু।
সাহেল আহমেদের কপালে দু ভাজ পড়লো। চক্ষুশূল দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ রাজনীতি?
-“ হ্যাঁ।

মেয়ের হ্যাঁ জবাব পেয়ে কপাল মসৃন হলো। নড়েচড়ে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ তুমি নিজের ভালো কেনো বুঝতে চাইছো না চিত্রা? তুষারের থেকে ভালো কেউ তোমায় রাখতে পারবে না। আল্লাহ না করুক আমার বিরোধী দলের লোকেরা যদি আমার কিছু করে বসে তখন তোমাদের কি হবে ভেবে দেখেছো? তুষার তোমায় তাদের থেকে প্রটেক্ট করতে পারবে। আমি মা-রা গেলেও এটা ভেবে শান্তি পাবো যে আমার মেয়ের মাথার উপর একজন আছে। যে আমার মেয়েকে সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে।

চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো।
-“ সে কি সুপারম্যান যে আমাকে সব রকমের বিপদ থেকে রক্ষা করবে? উল্টো তোমাদের নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমি হার্ট অ্যাটাক করে মা-রা যাবো। তাই বলছি আমি তাকে বিয়ে করবো না মানে করবো না।

কথাটা বলে ব্যাগটা নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় চিত্রা। সাহেল আহমেদ তপ্ত শ্বাস ফেলেন। মেয়েকে কি করে রাজি করাবে ভেবে পাচ্ছেন না।

চিত্রা রুমে এসে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে তৃষ্ণা কে ফোন দেয়।

তৃষ্ণা সোফায় বসে স্টার জলসা চ্যানেলে নাটক দেখছে। পাশেই বসে আছে তৃষ্ণার মা তানিয়া বেগম। সোফার সামনে থাকা টি-টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠায় বিরক্তিবোধ করলো তৃষ্ণা। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো বেটার হাফ লেখা। তানিয়া বেগম সন্দেহান দৃষ্টি নিয়ে আড়চোখে তাকালো। তৃষ্ণা ফোনটা কানে নিয়ে সাইডে চলে যায়।
-“ কিরে কোনো সমস্যা হয়েছে?
চিত্রা বেলকনিতে থাকা চেয়ারে বসে বলে-
-“ সমস্যা তো সেই একটাই। তোকে বললাম তোর ভাইকে আমায় দে তা না হলে সাহায্য করতে বল।
তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কি সাহায্য?
-“ তোর ভাইকে বল আমার বয়ফ্রেন্ড হতে। মানে আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তাকে তোর ভাইকে দেখিয়ে বলবো এটা আমার বয়ফ্রেন্ড আমরা একে ওপরকে ভালোবাসি। দুজন দুজনকে না পেলে ম’রেই যাব।
-“ এতে লাভ কি?

-“ আশ্চর্য এতেই তো লাভ। একটা ছেলে তো আর জেনেশুনে এমন মেয়েকে বিয়ে করবে না। তো ছেলেটা বিয়ে ভেঙে দিবে আর আমি তোর ভাইকে থ্যাংকস বলে দিব। আর এরমধ্যে যদি তোর ভাইয়ের সাথে আমার ক্যামিস্ট্রি জমে যায় তাহলে তোর ভাইয়ের হানি হয়ে যাব। তোর ভাইকে বল না আমায় হেল্প করতে।
-“ পাগল নাকি! আমার ভাইয়ের কি ঠেকা পড়ছে তোমারে সাহায্য করার।
-“ এমন করিস কেনো। বলেই দেখ না,একটা মেয়েকে হেল্প করলে তেমন ক্ষতি তো হবে না তোর ভাইয়ের।
-“ ক্ষতি হবে না মানে তোর সাথে সাথে আমার ভাইয়ের ও বিয়ে ভাঙবে।
-“ আরে ভাঙবে না। তুই তোর ভাইয়ের নম্বর টা দে আমায় আমি হেল্প চাইবো।
-“ ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া ভাই তার নম্বর কাউকে দিতে না করছে।
-“ তো আহাম্মকের মতো ফোন কানে নিয়ে আছিস কেনো যা অনুমতি নিয়ে আয়।
-“ ভাই বাসায় নেই ঐ পার্টি অফিসে..
তৃষ্ণা পুরো কথা শেষ করলো। এখনই তো সব বলে দিচ্ছিলো।
-“ বাসায় নেই পার্টি অফিস মানে কি?
-“ ঐ আসলে আজকে অফিসে ছোটখাটো পার্টি সেখানেই। আমি রাখি এখন ভাই ফিরলে অনুমতি নিয়ে নম্বর দিব নি।

কথাটা বলে ফোন কেটে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে তৃষ্ণা। কথার তালে তালে বলেই ফেলছিলো। ফোন টা আবার আগের জায়গায় রেখে টিভিতে মনোযোগ দিতেই পাশ থেকে তানিয়া বেগম বলে উঠে –
-“ তা তোর বেটার হাফের বাসা কোথায়? পরিবারে কে কে আছে?
তৃষ্ণা দৃষ্টি টিভিতে রেখেই বলে-
-“ হেমায়েতপুর বাসা। বাবা মা আর ও।
-“ আর ভাই বা বোন নেই?
-“ না।
-“ মাশা-আল্লাহ। তা দেখতে শুনতে কেমন?
-“ সুন্দর।
-” কতদিন ধরে চিনিস?
-“ মাস চারেক হবে।
-“ পছন্দ করিস?
-“ হ্যাঁ।
তানিয়া বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে আদুরে কন্ঠে বলে-
-“ ভেবে চিন্তে সামনে আগাস তোর মা সবসময় তোর পাশে আছে।৷ আর সব কথা আমার সাথে শেয়ার করবি। কিচ্ছু লুকাবি না। পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনিস না।

তৃষ্ণা মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। হা করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পালিয়ে যাবে কেনো সে? মায়ের হাত মাথা থেকে সরিয়ে বলে-
-“ কি বলো? চুপচাপ টিভি দেখতে দাও।

তানিয়া বেগম মেয়ের থুতনিতে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে চলে যায়। মনে তার অনেক কল্পনা জল্পনারা ঘুরপাক খাচ্ছে।

রাত আটটার দিকে তুষার তার বাবার সাথে বাসায় ফিরে। সোজা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়। ব্লাক টি-শার্ট পড়ে নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে চেয়ার টেনে বসে। প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করার দরুন দুপুরে খাবার সময় হয়ে উঠে নি। তানিয়া বেগম ছেলে আর স্বামী কে খেতে দেন।তুষার খাবার টা খেয়ে নিজের রুমে যেতেই তৃষ্ণা পেছন থেকে ডেকে উঠে। তুষার দাঁড়িয়ে যায়। চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে -কি?

তৃষ্ণা তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ ভাই একটা অনুমতি চাই।
তুষার ফোন স্ক্রোল করতে করতে বলে-
-“ কিসের জন্য?
-“ আসলে আমার ফ্রেন্ড চিত্রা তোমার ফোন নম্বর চাচ্ছে তাকে কি দিব তোমার ফোন নম্বর?
তুষারের দৃষ্টি ফোন থেকে এবার তৃষ্ণার উপর পড়লো। ফোনটা হাতে রেখে দু হাত বুকে গুঁজে বলে-
-“ আমার ফোন নম্বর দিয়ে তোর ফ্রেন্ড কি করবে?
-“ সেটা তো জানি না। বললো ইমার্জেন্সি দরকার। দিব?
তুষার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে-
-“ আচ্ছা দে।

কথাটা বলে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় তুষার। তৃষ্ণার অনেক টা অবাক হয়। ভেবেছিলো ভাই তার ডিরেক্ট মানা করে দিবে। কিন্তু অনুমতি দেওয়াতে মাথা চক্কর খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

তৃষ্ণা নিজের রুমে এসে চিত্রা কে মেসেজে তুষারের নম্বর সেন্ড করে পাঠিয়ে দেয়।

চিত্রা তৃষ্ণার পাঠানো নম্বর টার দিকে একবার চেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। যে করেই হোক তৃষ্ণার ভাইকে সে পটিয়ে হলেও বিয়ে ভাঙার জন্য রাজি করাবে।

অধরা তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে ফের বই পড়ার দিকে মনযোগ দিয়ে বলে-
-“ কি চলছে?
তৃষ্ণা ফোনটা বিছানায় রেখে অধরার পাশে থাকা চেয়ার টা টেনে বসে বলে-
-“ কি চলবে?
-“ এই যে ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিস।
-“ ওহ্ আর বলো না। তোমায় সেদিন বললাম না আমার ভার্সিটিতে একটা মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে।
-“ কার কথা বলছিস?
-“ আরে ঐ যে কিউট মেয়ে টা শ্যামলা চেহারার। নাম টা গেস করো তো?
-“ উমমম চিত্রা?
-“ হ্যাঁ। মেয়েটা বিয়ে ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

অধরা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো-
-“ কার?
-“ ওর নিজের।
-“ ওহ্ তা বিয়ে ভাঙতে চাচ্ছে কেনো?
-“ আর বলো না। ছেলে পছন্দ না ওর।
-“ পরিবার কে বুঝিয়ে বললেই হয়।
-“ সেটারই চেষ্টা চালাচ্ছি।
-“ আচ্ছা যা ঘুমিয়ে পড়।
-“ আচ্ছা গুড নাইট।

তুষার বারবার নিজের ফোনের দিকে তাকাচ্ছে একটা ফোন কল আসবে সে আশায়। কিন্তু এতো আশা রেখেও কোনো লাভ হলো না। চিত্রার নম্বর থেকে তার ফোনে কোনো কলই আসছে না। অধৈর্য হয়ে তার ইচ্ছে করলো চিত্রার ফোনে গিয়ে নিজের ফোন নম্বরে কল দিতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। আজকের জন্য রূপকথার সেই আলাদীনের চেরাগের দৈত্যকে খুব মনে পড়ছে। চেরাগ টা তার কাছে থাকলে কি খুব ক্ষতি হতো? দৈত্যেকে বলতো চিত্রার ফোনে ঢুকে একটা ফোনকল না হোক মিসড কলই দিতে।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৫( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ আসসালামু আলাইকুম, আপনি তৃষ্ণার ভাই?

তুষার চিত্রার ফোন কলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে যখন ঘুমের ঘোরে চলে যাচ্ছিল প্রায় তখন হুট করে ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। তুষার তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নেয়। মনে হচ্ছিল এক সেকেন্ড দেরি হলেই ফোন কল আর ওপাশ থেকে আসবে না। ফোনের স্কিনে জ্বলজ্বল করে উঠলো ব্লাক হার্ট সাথে লেখা গাধা। গাধা নাম টা একটু আগেই লিখেছে,তার কান্ডকারখানা এখন গাধার মতোই লাগছে তুষারের কাছে। চিত্রার ফোন নম্বর আগে থেকেই তুষারে কাছে ছিলো। চিত্রার নম্বর টা পেয়েছে তৃষ্ণার বদৌলতে তুষার মাস চারেক আগেই। তখন নম্বর টা সেভ করেছিলো প্রেয়সী দিয়ে। আর এখন সেটা বদলে গাধা। নিজেকে স্বাভাবিক করে মুখে গম্ভীর্যতা এনে বলল-
-“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। জ্বি আমি তৃষ্ণার ভাই। আপনি কে বলছেন?
তৃষ্ণা মুখে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দিলো-
-“ ভাইয়া আমি তৃষ্ণার ফ্রেন্ড।

চিত্রার মুখে ভাইয়া ডাক শুনে তুষারের কপালে দু ভাজ পড়লো। ডাকটা বড্ড বেমানান লাগছে চিত্রার মুখে শুনতে।
-“ কোনো দরকার?
-“ জ্বি ভাইয়া। আপনার সাথে কি একটু দেখা করা যাবে?
-“ সময় হবে না। কিছু বলার থাকলে বলুন না হলে ফোন কেটে দিলাম।
-“ আচ্ছা ভাইয়া তাহলে রেখে দেন ফোন।

তুষার ভেবেছিলো চিত্রা বলবে কথা। কিন্তু না মেয়েটা উল্টো বলছে রেখে দিতে। কিছুটা রাগ হলো। রাগান্বিত চেহারা নিয়েই টুকুস করে ফোন কেটে দিলো তুষার। চিত্রা ফোন টা মুখের সামনে এনে নম্বর টার দিকে চেয়ে রইলো। এ ছেলের কথার ধরন শুনে মনে হলো প্রচুর রাগী। একে দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করবে কি করে ভেবেই চিন্তামগ্ন হলো।

তুষার মিনিট কয়েক ফোনটার দিকে চেয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করলো। এক সময় রাগ টা শীতল হয়ে গেলো। মন মেজাজ স্বাভাবিক মাত্রায় এনে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

-“ কি ব্যাপার রাফি ভাই হুটহাট এভাবে সামনে এসে পড়েন কেনো?

তৃষ্ণা বাগানে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছিলো। মুখের থুথু ফেলতে গিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে রাফি এসে দাঁড়িয়েছে। আর একটু হলেই মুখের থুথু তার শরীরে ফেলতো। মুখের থুথু সাইডে ফালায়। রাফি ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ সাইডে কেনো ফেললে আমার শরীরে ফেলতে। বাগানে দাঁড়িয়ে কেউ ব্রাশ করে? ওয়াশরুম নেই তোমার রুমে?
তৃষ্ণা বাগানে থাকা দোলনায় বসে। দাঁড়িয়ে থেকে কোমড় ধরে এসেছে,না বসলেই নয়।
-“ ওয়াশরুম আছে রাফি ভাই কিন্তু..
-“ কিন্তু কি?
-“ বাগানে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করলে যেই শান্তি পাওয়া যায় ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করলে সেই শান্তি পাওয়া যায় না।
রাফির ইচ্ছে করলো ঠাটিয়ে এক রাম ধমক দিতে। ইচ্ছে টাকে মনের মধ্যে রেখেই আস্তে করে বলে-
-“ বাসার ভেতরে যাও,বাহির থেকে লোকজন আসবে যখন তখন।
-“ তাতে আমার কি?
-“ ঠেটামি করছো কেনো? কথা বললে শুনো না কেনো?
-“ আপনি কি আমার কথা শুনেন? আমি কেনো আপনার কথা শুনবো?
-“ তুমি বড় না আমি বড়?
-“ আপনি বড়।
-“ তাহলে কথা কার শোনা উচিত?
-“ আপনার।
-“ একটা থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিবো। আবার মুখে মুখে তর্ক করে।

তৃষ্ণা দোলনা থেকে লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাফির দিকে আগ্নেয়গিরি ভরা দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ এই আপনি আমাকে ধমকাচ্ছেন কেনো? আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো আপনি বলার কে?৷ নেক্সট টাইম এভাবে কথা বলবেন না আমার সাথে।

কথাটা বলে তৃষ্ণা চলে যায়। তানিয়া বেগম বাগানে আসছিলেন বেগুন গাছ থেকে বেগুন নিতে। মেয়েকে রেগেমেগে যেতে দেখে দুশ্চিন্তা হয়। আবার হাতে ফোন দেখে কিছুটা আন্দাজ করে রাফির পাশে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ হ্যাঁ রে রাফি আমার মেয়েটা এমন রেগেমেগে গেলো কেনো? ফোনে কারো সাথে ঝগড়া করেছে?

রাফি ভ্রু কুঁচকালো চাচির কথা শুনে।
-“ না ফোনে কার সাথে ঝগড়া করবে?
-“ তাহলে রেগেমেগে গেলো কেনো?
-“ মাথার তাড় ছিঁড়ে গেছে তোমার মেয়ের তাই।
-“ দেখছো, আমার মেয়ের মাথার তাড় ছিঁড়ে ফেলার জন্য কি তাহলে বেটার হাফ দায়ী?
-“ কিসের বেটার হাফের কথা বলছো চাচি?
-“ ও তেমন কিছু না তুই থাক আর ঐ বেগুন গুলো নিয়ে আয় বাবা আমি চললাম।

তানিয়া বেগমের যাওয়ার পানে তাকালো রাফি। কি বললো কিছুই বুঝলো না।

চিত্রা রাস্তার পাশ ঘেঁষে আনমনে হাঁটছে। আর মনে মনে কিছু একটা ভেবে চলছে। হঠাৎ জলতেষ্টা পাওয়ায় রাস্তার ধারে থাকা একটা দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে। দোকানদার কে পানির দাম দিয়ে পানির বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে পানি খায়। পানি খাওয়ার মাঝে হঠাৎ পানি মুখের ভেতর না পড়ে মুখসহ নাকের মধ্যে ঢুকে যায়। গলায় পানি আটকে নাক মুখ থেকে পানি ছিটকে পড়ে যায়। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো। সমান তালে কাশতে থাকে চিত্রা। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পায়। আর মৃদু স্বরে বলছে -আস্তে। আওয়াজ টা কানে আসতেই চোখ মেলে তাকায় আর দেখতে পায় চোখের সামনে রুমাল নিয়ে বাড়ানো হাত। চিত্রা রুমাল টা হাতে নেয়। নাকের পানি সহ মুখে থাকা পানি মুছে নেয়। শেষে নাক টাকে জোরে টেনে নাক পরিষ্কার করে রুমাল টা বাড়িয়ে দেয়।

তুষার একবার রুমালের দিকে তো আর একবার চিত্রার দিকে তাকায়। চিত্রা এখনো তুষারের দিকে তাকায় নি। রুমাল টা এখনও না নিতে দেখে চিত্রা পাশ ঘুরে বলে-
-“ আরে রুমাল টা নিন।

কথাটা বলে মুখের দিকে তাকাতেই দেখে তুষার ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তুষার কে নিজের সামনে দেখে ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রয় চিত্রা। পরক্ষণে রুমালের দিকে চেয়ে বলে-
-“ রুমাল টা নিন। আর আপনি এখানে কেনো?

তুষার রুমাল টার দিকে চেয়ে বলল-
-“ রুমালের কাজ শেষ রুমাল আর আমার লাগবে না।
চিত্রা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুমালের দিকে ভালো করে তাকাতেই দেখে রুমালে কিছুক্ষণ আগে নাক পরিষ্কার করার ইয়েটা লেগে আছে। লোকটা এর জন্য ই রুমাল টা নিতে চাইছে না। এই ছেলেকে তো বিয়ে না করার আরেকটা রিজন পেলো। যে ছেলে সামান্য সর্দি দিয়ে জড়ানো রুমাল নিতে চাইছে না সে ছেলে কে বিয়ে কোনো মতেই করা যাবে না।

তুষার যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নোংরা জিনিস সে একদমই সহ্য করতে পারে না। ভালোবাসলেই তার সব কিছু সে টলারেট করবে এমন শুদ্ধ পুরুষ সে নয়। তুষার কে চুপ থাকতে দেখে চিত্রা ফের বলে উঠে –
-“ আহাম্মকের মতো চেয়ে থাকবেন না। সামান্য তো সর্দি ই লেগেছে রুমালে তাই বলে রুমাল টা নিবেন না। বাসায় গিয়ে না হয় হুইল পাউডার দিয়ে ধুয়ে নিতেন।
-“ হুইল পাউডার দিয়ে না হয় আপনিই ধুয়ে রুমাল টা ব্যাক করবেন মিস চিত্রা।
-“ সেটা বললেই তো হতো।
-“ সামান্য পানি খেতে গিয়েই এতো কান্ড করে বসলেন!
-“ আপনি এখানে কেনো?
-“ শ্বশুরের মেয়েটাকে দেখতে আসছি।
চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ আপনার রাজনীতি নাই নাকি?
-“ আশ্চর্য রাজনীতি করলে বলেন তারা সময় দিতে পারে না। আবার সময় দিলে বলেন রাজনীতি নেই নাকি।
-“ আমার তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে পাম টাম দিয়ে বিয়ে করার চেষ্টা করছেন।
-“ বাহ মাথায় বুদ্ধি বলে তাহলে কিছু আছে দেখছি।
-“ মানে?
-“ মানে টানে কিছু না। আপনার গাড়ি কোথায়?
-“ আনি নি আজ।
-“ কেনো?
-“ এমনি।
-“ আচ্ছা আমার গাড়িতে চলুন বাসা অব্দি ড্রপ করে দেই।
-“ না না আপনার গাড়িতে আমি যাবো না।
-“ হুয়াই?
-“ আমার ইচ্ছে তাই।
-“ কথা না বাড়ালেই কি চলছ না? এখান থেকে বাসায় যেতে তো অনেক্ক্ষণ লেগে যাবে চলুন।

চিত্রা মনে মনে ভাবলো আসলেই বাসায় যেতে কিছুটা দেরি হবে যেতে। আর লোকটা সাথে এখন গেলে বিয়ে ভাঙা নিয়ে কিছু একটা ফন্দি আটা যাবে। চিত্রা রাজি হয়ে গেলো। তুষার গাড়িতে গিয়ে বসতেই তুষার রাস্তার ওপাশে থাকা তার ছেলেপেলে দের ইশারায় কিছু বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। তুষার গাড়ি স্টার্ট দিতেই চিত্রা বলে উঠে –
-“ শুনুন না একটা কথা বলার আছে।
তুষার গাড়ি চালাতে চালাতে বলে-
-“ হুম বলুন শুনছি।
-“ বলছি কি জানেন আমি না একটা ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসি। ছেলেটাও আমায় ভালোবাসে। আমরা কেউ কাউকে ছাড়া নিজেদের ভাবতেই পারি না। বুঝতে পারছেন বিষয় টা?

তুষার আড় চোখে গম্ভীর মুখে চিত্রার দিকে তাকালো।
-“ ছেলেটা কে?
চিত্রা ভাবলো হয়তো তুষার সব জানলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিবে। কথাটা ভেবেই মনে মনে লুঙ্গি ড্যান্স করে ফেললো।
-“ আমার ফ্রেন্ডের ভাই।
-“ নাম কি ফ্রেন্ডের?
-“ তৃষ্ণা।

নাম টা শুনেই তুষারের ভ্রু কুঁচকানো কপাল মসৃণ হয়। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে। ফের প্রশ্ন করে-
-“ কতদিনের রিলেশন আপনাদের?
-“ ফাইভ ইয়ার্স।
তুষার বিষম খেলো। মুখের সামনে হাত নিয়ে বলে-
-“ নাম কি ছেলেটার?
চিত্রা থেমে যায়। কি নাম বলবে এবার? সে তো তৃষ্ণার ভাইয়ের নাম টা জানে না। চিত্রা কে নাম বলতে না দেখে বলে-
-“ কি হলো বলুন নাম কি ছেলেটার?

তুষার ফের করা প্রশ্নে এবার চমকে উঠলো চিত্রা। তৃষ্ণার নামের সাথে নাম মিলিয়ে বলল-
-“ তাসকিন,তাসকিন আহমেদ তৃষ্ণার ভাইয়ের নাম।

তুষারের হো হো করে হাসতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু ইচ্ছে টা বহুত কষ্টে আটকে রাখলো।
-“ ওহ্ আচ্ছা বুঝলাম। তা ছেলেটা কে আপনি বিয়ে করতে চান?
-“ হ্যাঁ আমরা দু’জন দুজন কে বিয়ে করতে চাই।
-“ আচ্ছা বেশ। তা আমাকে এসব শুনিয়ে কি করাতে চান?
-“ ঐ তো চাইছি বিয়েটা আপনি ভেঙে দিবেন।
-“ আপনাদের দুজনের ভালেবাসার জন্য আমি কেনো বিয়ে ভাঙবো?
-“ কারন আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। একজনের সম্মতিতে কখনও বিয়ে টিকে থাকে না।

কথাটা চিত্রা যতোটা সহজে বলেছে ততটাই ভারী লাগলো কথাটা তুষারের কাছে। মনে বিষন্নতারা এসে হানা দিলো।
-“ আচ্ছা আমি আপনার কথা রাখবো। বিয়ে ভাঙবো তবে শর্ত আছে।
-“ কি শর্ত?আপনি যা বলবেন আমি তাই মানবো।
-“ আপনার প্রেমিক কে আমার সামনে এনে দাঁড় করাবেন। তার মুখ থেকে সব শুনে আমি বিয়েটা ভেঙে দিবো।

চিত্রার মুখ বেলুনের মতো চুপসে গেলো।যখনই একটু আশার আলো দেখে তখনই কিছু না কিছু অন্ধকার এসে সেই আলো কে ডুবিয়ে দেয়।

চিত্রা কে চিন্তামগ্ন দেখ তুষার ডেভিল মার্কা হাসি দেয়। চিত্রা জীবনেও পারবে না তৃষ্ণার ভাই তাসকিন কে তার সামনে আনতে। আর না সে বিয়ে ভাঙবে।

#চলবে?

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-০৩

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৩( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ তা মেয়ে কেমন লাগলো তুষার,পছন্দ হয়েছে?
তুষার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছিলো। হঠাৎ বাবার কথা কানে আসতেই পেছন ফিরে দেখে তার বাবা তামিম খাঁন আর চাচা সামির খাঁন। তুষার স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো-
-“ হ্যাঁ হয়েছে।
তামিম খাঁন স্বস্তি পেলেন। ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন-
-“ চিত্রা কে রাজি করাতে কিন্তু অনেকটা বেগ পোহাতে হবে তোমায় পারবে তো?
-“ সেটা না হয় আমার উপর ছেড়ে দাও।

সামির খাঁন ভাই আর ভাইস্তার কথা শুনে বলে-
-“ আমি বুঝতে পারছি না ভাইজান সাহেল ভাইয়ের মেয়েকেই কেনো তুষারের বউ করে আনতে হবে? শুনলাম মেয়েটা রাজনীতি বিদ্বেষ।
তামিম খাঁন ইশারায় চুপ থাকতে বললেন ভাইকে। যার অর্থ সে এটার উত্তর পরে দিবে। সামির খাঁন চুপ রইলো।
-“ তুমি অনুমতি দিলে আমরা বিয়ের দিকে এগোবো।
তুষার একপলক বাবা চাচার দিকে তাকিয়ে ফোন নিয়ে বাহিরে যেতে যেতে বলে-
-“ বিয়েটা এখন হচ্ছে না,মেয়ে পুরোপুরি রাজি নয়। আগে রাজি হোক তারপর।

তামিম খাঁন আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই তুষার সেখান থেকে প্রস্থান করলো। সামির খাঁন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ভাইজান বললে না তো সাহেল ভাইয়ের মেয়েকেই কেনো তুষারের বউ করতে চাইছো?
তামিম খাঁন সামিরের দিকে তাকায়। দু ভাই রুম থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তামিম খাঁন বলেন-
-“ কারন আমার ছেলে চায় সেজন্য।
-“ তুষার চায় মানে?
-“ এসব নিয়ে মাথা ঘামাস না, ব্যাংক কলোনির সামনে রাস্তার কাজ টা কতদূর?
-“ প্রায় শেষের পথে।
-“ আচ্ছা যা এবার ঘুমিয়ে পড়,রাত অনেক টা হয়েছে।

সামির খাঁন সম্মতি জানিয়ে নিজ রুমে চলে যায়। তামিম খাঁন নিজের রুমে ঢুকতেই দেখে তার বোনের মেয়ে অধরা এদিক টায় আসছে। হাতে তার পানির জগ। তামিম খাঁন রুমে না ঢুকে ঠাই দাঁড়িয়ে রয় সেখান টায়। অধরা তার কাছাকাছি আসতেই তামিম খাঁন মৃদু হেসে বলে-
-“ এখনও ঘুমাও নি যে?
অধরা পানির জগটা দেখিয়ে বলে-
-“ পড়াশোনা করছিলাম। পিপাসা অনুভূত হওয়ায় পানি খেতে গিয়ে দেখি জগে পানি নেই। তাই পানি নিতে আসলাম,পানি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়বো।
-“ তৃষ্ণা ঘুমিয়েছে?
-“ হ্যাঁ অনেক্ক্ষণ আগেই সে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে।
-“ ওহ্ আচ্ছা। পানি টা নিয়ে তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো,শুভ রাত্রি।
-“ জ্বি শুভরাত্রি।

অধরা কিচেন রুমে এসে বেসিন থেকে জগে পানি ভরে রুমে আসার পথে দেখে বাড়ির সদর দরজায় আবছা মানুষের ছায়া। আসার সময় খেয়ালে আসে নি যে সদর দরজা টা খোলা। অধরা কৌতূহল হয় আবছা ছায়ার মানুষটিকে দেখার। জগ হাতে নিয়ে টিপটিপ পায়ে দরজার সামনে আসতেই দেখে তুষার ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। তুষার কে দেখে ঠাই দাঁড়িয়ে রয় অধরা।

তুষার ফোনে কথা বলে পেছন ফিরতেই অধরা কে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। ফোন টা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলে-
-“ এতো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
তুষারের কথায় ভ্রম কাটে অধরার। মাথা নিচু করে বলে-
-“ আসলে পানি নিতে এসে দেখি সদর দরজা খুলা তাই।
-“ এবার রুমে যা। রাত অনেক হয়েছে।

অধরা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। অধরার যখন পনেরো বছর বয়স তখন থেকে অধরা তার মামার বাসায় থাকে। অধরার মা মারা যায় অধরার তখন বয়স তেরো। অধরার বাবা অধরার মা মারা যাওয়ার মাস কয়েক বাদেই আবার বিয়ে করেন। সৎ মা খুব একটা সুবিধার ছিলো না। কারনে অকারণে অধরার উপর অত্যাচার করতো। তামিম খাঁনের কানে কথাটা আসা মাত্রই ভাগ্নি কে নিজের কাছে নিয়ে আসে। সে থেকে অধরা এখানেই থাকে। দ্বিতীয় বার আর বাবার বাড়ির ত্রিসীমানায় যায় নি।

অধরা যেতেই তুষার সদর দরজা আটকিয়ে নিজের রুমে যায়। বিছানায় গিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পকেট থেকে ফোন টা বের করে। ফোনের গ্যালারিতে ঢুকে মাস্ক পড়া চিত্রার একটা ছবি বের করে বলে-
❝ তোমার শহর শেষ বসন্তের ফুল ফোটার অপেক্ষায়-
তীব্র শীতের শেষে চেয়ে আছি আমি তোমার প্রতিক্ষায়!❞ আই হোপ প্রতীক্ষা টা খুব একটা দীর্ঘ হবে না প্রেয়সী।

-“ কিরে দোস্ত দুলাভাই কে কেমন লাগলো?
চিত্রা ভার্সিটি তে আসতে না আসতেই তৃষ্ণার এমন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মন খারাপ করে তৃষ্ণার পাশে বসে বলে-
-“ ছেলেটা ভালোই দেখতে শুনতে বাট আমি বিয়ে করতে চাই না।
তৃষ্ণা চিত্রার কথা শুনে অবাক হয়ে বলে-
-“ ওমা এটা কেমন কথা? দেখতে শুনতে ভালো তাহলে বিয়ে কেনো করবি না?
-“ রাজনীতি করে। তুই তো জানিস আমি রাজনীতি পছন্দ করি না। তুই কিছু একটা করে প্লিজ আমাকে বিয়ে ভাঙার টিপস্ দে।

তৃষ্ণা ভাবান্তর হয়। তৃষ্ণার ফ্যামিলিও রাজনীতি করে। চিত্রার সাথে তৃষ্ণার পরিচয় মাস চারেক হবে। যেদিন থেকে শুনলো চিত্রা রাজনীতি বিদ্বেষ সেদিন থেকেই তৃষ্ণা তার ফ্যামিলির কথা লুকিয়েছে। চিত্রা জানে তৃষ্ণার বাবা একজন বিজনেসম্যান। দু’জন ভালো ফ্রেন্ড হলেও কেউ কখনও কারো বাসায় যায় নি। তৃষ্ণা চিত্রার কাঁধে হাত রেখে বলে-
-“ আচ্ছা চিন্তা করিস না কিছু একটা বুদ্ধি বের করবো। আর হ্যাঁ একটা কথা।
-“ হুমম কি?
-“ আমার ভাইয়ের ও বিয়ে ঠিক হচ্ছে।

চিত্রা অবাক হয়ে তাকায় তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণার হাত ধরে বলে-
-“ দোস্ত একটা কথা বলি?
-“ হ্যাঁ বল।
-“ বলছি কি আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হচ্ছে তার সাথে তোর হবু ভাবি কে দে। আর আামকে তোর ভাইয়ের সাথে নে প্লিজ প্লিজ দোস্ত।

তৃষ্ণা চিত্রার হাত নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে-
-“ আমার ভাইকে কেনো বিয়ে করবি ইয়ার?
-“ বিয়েটা ভাঙার জন্য। তোর ভাই তো আর রাজনীতি করে না। আর আমিও তো দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ তাই না বল? তোর ভাইয়ের নিশ্চয়ই আমাকে পছন্দ হবে।
-“ আমার ভাইয়ের হবু বউকে সে খুব পছন্দ করে বোইন। আমার ভাই তোমাকে পছন্দ করবে না। বাদ দাও আমার ভাইয়ের চিন্তা। তার থেকে তোমার হবু জামাইয়ের সাথে তোমার বিয়ে ভাঙার বন্দবস্ত করবো প্যারা নিয়ো না।
-“ তুই তো তোর ভাইয়ের ছবি দেখালি না আমায়?
তৃষ্ণা বিষম খায়। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে-
-“ না দেখাই ভালো বোইন। সামনে তো বিয়ে তখন একেবারে দেখে নিস।

চিত্রা ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। পড়াশোনার পাশাপাশি বিয়ে ভাঙার জন্য ও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

ভার্সিটির শেষে চিত্রা আর তৃষ্ণা বাহিরে এসে ভেলপুরি খায়। এরমধ্যে দূর থেকেই বাড়ির গাড়ি দেখে তৃষ্ণা চিত্রা কে বলে-
-“ দোস্ত বাসায় সাবধানে যাস আমার গাড়ি চলে এসেছে।
চিত্রা সামনে তাকিয়ে দেখলো ব্লাক কালারে একটা প্রাইভেট কার। কিছুটা দূরে দাঁড় করানো। তৃষ্ণা চিত্রার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তৃষ্ণা উঠে বসতেই তুষার একপলক চিত্রার দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তৃষ্ণা চিত্রার বলা তখনকার কথা স্মরণ করে। তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ভাই জানো তোমাকে না আমার ফ্রেন্ড দেখতে চায়।
তুষার গাড়ি চালাতে চালাতে বলে-
-“ দেখিয়েছিস?
-“ না।
-“ গুড।
-“ জানো ওর বিয়ে ঠিক হচ্ছে বাট ও রাজি না। ও বলে কি জানো?

তুষার একবার তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে ফের সামনে তাকিয়ে আগ্রহী হয়ে বলে-
-“ কি বলে?
-“ বলে কি-না, তোমার সাথে ওর বিয়ে দিতে আর আমার ভাবির সাথে ওর হবু বরের বিয়ে দিতে।

তুষারের ভীষণ হাসি পেলো। কিন্তু বাহিরে সেটা প্রকাশ করলো না। গম্ভীর কন্ঠে বললো-
-“ তুই রাজি হয়েছিস?
-“ না ভাইয়া। আমি বলেছি আমার ভাই তার হবু বউকে ভীষণ ভালোবাসে। তার চেয়ে আমি ওকে ওর বিয়ে ভাঙার টিপস্ দিব।

কথাটা তুষারের কর্ণকুহর হতেই তুষার জোরে ব্রেক কোষে। অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকায়। এটার তার বোন? একদিকে ভাইয়ের বিয়ের জন্য এক্সাইটেড অন্য দিকে অজান্তেই তার ভাবিকেই বিয়ে ভাঙার জন্য টিপস্ দিচ্ছে।

তৃষ্ণা হঠাৎ ভাইকে এভাবে গাড়ি থামাতে দেখে বলে-
-“ কি হলো ভাইয়া?
তুষার নিজেকে সামলিয়ে কাট কাট গলায় বলে-
-“ কিছু না। অন্যের বিয়ে ভাঙার জন্য তোকে এতো মাথা ঘামিয়ে টিপস্ দিতে হবে না। যতোই টিপস্ দিস না কেনো বিয়ে ভাঙতে পারবি না।

তৃষ্ণা হঠাৎ ভাইয়ের রেগে যাওয়ার মানে বুঝলো না।

#চলবে?