অপ্রিয় জনাব পর্ব-১২

0
214

#অপ্রিয়_জনাব
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#পর্ব_১২

সোহরাবের সহ্য হলো না উপমার ঘৃনীত ভরা চাহনি। তাই গটগট করে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো রাতের অধারে। উপমা কাঁপা কাঁপা পায়ে দ্বার লাগিয়ে বিছানায় যেয়ে বসে। বক্ষস্থলে ভয়ংকর পীড়া অনুভব হচ্ছে তার। নিঃশাস আটকে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে তার। তার সকল কষ্টের কারণ ছায়া। পরিবার স্বজন থাকতেও উপমার কাছে ছায়া কে সবথেকে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। যার সব থাকতেও কিছুই নেই।
যে স্বামীর কথা ভেবে তার দিন শুরু হয় রাত শেষ হয় সেই স্বামীর বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই তার জন্য। স্ত্রী নাহয় পর মানুষ তবে সন্তান? সন্তান তো নিজের হয়। নিজের অংশের হয়!
আর কিছু ভাবতে পারলো না উপমা। বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পরে। ছায়াকে কিভাবে সবটা বলবে মনে মনে সেটা ভাবতে থাকে।

ঘুম আসছিলো না তাই হাঁটতে হাঁটতে উপমার কক্ষে এসেছিলো ছায়া। দরজা খোলা দেখে ভিতরে পা রাখবে তখনই সে সোহরাবের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মনে মনে ভাবে হয়তো আজ উপমার সাথে রাত্রিযাপন করবে তাই চিত্তের পীড়া নিয়ে নিজ কক্ষে যেতে উদ্যত হয়। সামনে এক পা বাড়াবে তার পূর্বেই কঠিন চড়ের ধ্বনি তার কানে এসে ঠেকে। মন বিচলিত হয়ে পরে। তাই দ্বারের ওপরপাশে লুকিয়ে দাঁড়ায় সবটা শোনার জন্য। অবশ্য তাঁদের স্বামী স্ত্রীর কথা শোনা ছায়ার জন্য অনুচিত। তবুও একটু অনুচিত করতে ঝুঁকে পরলো সে।

একে একে উপমা আর সোহরাবের সব কথাই শুনতে পায় ছায়া। সোহরাবের শেষের কথা শুনে বুক ধক করে উঠে তার। কেউ ধারালো ছু’রি দিয়ে তার চিত্ত দুই খন্ড করে ফেলছে এমনই অনুভূতি হচ্ছে ছায়ার। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলো না সে। পেটে হাত দিয়ে জমিনে বসে পরলো এলোমেলো ভাবে। বিড়বিড় করে আওড়ালো,
-ছি ছায়া!ছি! এইরকম নিকৃষ্ট, জঘন্য মস্তিকের মানুষকে তুই ভালোবাসিস! আমার তো তোর ওপরই ঘৃণা হচ্ছে! সে তোকে দিনের পর দিন অবহেলা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়নি তবুও তুই ভেবেছিলি সে এখন তোকে ভালোবাসে! সে ভালোবাসা চিনেই না।

নিজের সত্তাকে ইচ্ছে মতো বকে মনে রাগ মেটালো ছায়া। সোহরাবের বের হওয়ার আগেই স্থান ত্যাগ করলো। আজ ছায়া একটুও কাঁদলো না। মনকে অনেক বুঝ দিলো। নিজের অনাগত সন্তানের জন্য হলেও তাকে কঠোর হতে হবে। আর সোহরাব সোহরাব করে মর’বে না সে। দরকার পরলে সোহরাবকেই মা’রবে!

________________________

চারদিকের ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। ধরণী উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে দিলো সূর্য। বিভোর ঘুমে অবচেতন ছিল উপমা। বদ্ধ চোখে সূর্যের আলো পরতেই কিঞ্চিৎ বিরক্তে মুখ অন্যদিক করে ফেললো সে। সহসা চোখ খুলে ফেললো উপমা। কপাল কুঁচকে বিছানায় উঠে বসলো। শাড়ী ঠিক করে দরজা খুলে পুকুরপাড় চলে যায়। মুখ হাত ধুয়ে গৃহে ভিতরে প্রবেশ করে। রসইকক্ষে আসতেই দেখে ছায়া আর সাইয়েরা রান্না করছে। ফাতুকে একা সবজি কাটতে দেখে টনক নড়ে উঠে উপমার।
কিছুটা বিচলিত হয়ে ফাতুকে জিগ্যেস করে,
-তুলি কোথায় ফাতু?
-কক্ষের ভিতরেই। আমি কাইল রাইতে আম্মাজানের লগে ঘুমাইছি। সকালে তুলিরে ডাকতে গেছিলাম ঐ দরজা খুলে নাই।

ছায়া উপমা দুইজন ভীতগ্রস্থ হয়ে একে ওপরের দিকে তাকায়। উপমা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে তুলির কক্ষের দ্বারের সামনে এসে দাঁড়ায়। কয়েকবার ডাকে। ভিতর থেকে কোনো শব্দ আসে না। এতক্ষনে সকলে এসে জমা হয়েছে তুলির কক্ষের সামনে। উপমা কয়েকজন পুরুষ ভৃত্যদের নিয়ে এসে দরজা ভেঙে ফেলে। কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করতে আত্মা কেঁপে উঠলো তার। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পাখার সাথে গলায় ফাঁ’স দিয়ে ঝুলছে তুলি।
ছায়া ভিতরে এসে এইরকম দৃশ্য দেখে ঠিক থাকতে পারলো না। তখনই মাথা ঘুরিয়ে পরে গেলো জমিনে। উপমা জ্বলন্ত চোখে একবার তুলির মৃত দেহ দেখছে তো একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আলাউদ্দিন মির্জাকে দেখছে। সোহরাব লক্ষ্য করলো উপমার চাহনি। জেন্ত কবর দিয়ে ফেলবে এমনই তার ভাবভঙ্গি।

বাহিরের মানুষদের আর জানানো হলো না। তুলির তেমন কোনো আত্মীয় নেই আবার জমিদার গৃহের মানুষদের নামে দুর্নাম হবে তাই নিজেরা নিজেরাই কবর দিয়ে দেওয়া হলো। এতকিছুর পরও আলাউদ্দিন কিছুক্ষন চেঁচামেচি করলো গৃহের দরজা ভাঙার জন্য। একটা মানুষের প্রাণ যে চলে গেলো এতে তার কোনোরূপ মাথা ব্যাথা নেই। আজ সাইয়েরার রাগ হলো স্বামীর ওপর। এতটা নিচু মানসিকতার মানুষ কিভাবে হয়! তাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে সবসময় মৌন থাকা ব্যক্তিটি আজ বলে উঠে,
-এতটাও পাষান হইয়েন না। আপনারও মেয়ে আছে। যদি আজ তুলির জায়গায় তারা কেউ এমন করতো তাহলেও কী আপনি ঐ একটা দরজার জন্যেই চেঁচামেচি করতেন?

উপমার চাতক মন খুশিতে নেচে উঠে সাইয়েরার কথায়। তবে সেই খুশি বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। আলাউদ্দিন বৈঠমখানায় সকলের সামনেই সপাটে চড় বসিয়ে দেয় সাইয়েরার গালে। তাল সামলাতে না পেরে জমিনে পরে যায়। আলাউদ্দিন বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কিছু গালি দিয়ে পাশ থেকে মোটা একটি বাঁশের টুকরো নিয়ে সাইয়েরাকে মারতে উদ্যত হয়। মারবে তখনই বাঁশ ধরে ফেলে উপমা। ক্রোধে মাথা তুলে উপমার দিকে তাকায় আলাউদ্দিন। উপমা বাঁশ সহ তাকে ঢেলে দূরে সরিয়ে দেয়। আলাউদ্দিন বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে থেকে উপমাকে বলে,
-তোমার সাহস কত বড় বেয়াদপ মেয়ে। আমার কাজে বা হাত ঢুকাও!
-আপনার সাহস কত বড় সকলের সামনে ছোট আম্মাকে আপনি এভাবে মারছে!
আলাউদ্দিন চিৎকার করে উঠে। গর্জে সোহরাবকে বলে,
-তোমার বউকে এখান থেকে নিয়ে যাও সোহরাব। এই বেয়াদপ মেয়েকে আমি দেখতে চাই না।
সোহরাব একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। উপমা আলাউদ্দিন থেকেও শত গুনে চেঁচিয়ে বলল,
-বেয়াদপ ভালো আপনার মতো জঘন্য নিকৃষ্ট লোক ভালো নয়।
আলাউদ্দিন উপমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলতে যাবে তখনই হাত ধরে ফেলে উপমা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-ভুলেও আমার ওপর হাত তোলার সাহস করতে যাবেন না। আমি কিন্তু ভীষণ বেয়াদপ। বড় ছোট বিবেচনা করবো না একদম হাত ভেঙে দেবো।

আলাউদ্দিন ক্রোধে কাঁপছে। সোহরাবের উদ্দেশ্যে বলে,
তুমি কী এখনও তোমার বউকে কিছু বলবে না সোহরাব। যদি আমার পুত্র হয়ে থাকো তাহলে এই অসভ্য মেয়ে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে দেও।
সোহরাব তখনও বুকে হাত গুঁজে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। উপমা রাগে নিজের হাতের চুরি খুলে ফেলে। ধপ ধপ পা ফেলে সোহরাবের স্মুখীন যেয়ে দাঁড়ায়।
উপমা সোহরাবকে বলে,
-শুধু স্ত্রীকে মারতে পারলেই পুরুষ হওয়া যায় না।যে পুরুষ অন্যায় দেখেও মহিলাদের মতো মৌন থাকে তাকে কোনোভাবেই পুরুষের কাতারে ফেলতে পারি না আমি।

তারপর হাতের চুরি দুইটা সোহরাবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে বলল,
-একটা আপনি পরিয়েন আরেকটা আপনার আদরের শ্রদ্ধেয় পিতাকে পরিয়ে দিয়েন। তাহলে যদি আমার চাতক মন শান্ত হয়।
কথা শেষ করে উপমা সাইয়েরাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছায়ার কক্ষে চলে যায়।
উপমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তেঁতো হয়ে উঠলো আলাউদ্দিন। ফোঁস ফোঁস করে বলল,
-এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমি তোমাকে? এভাবে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কথা শোনা আর পিতার অপমান শোনা একজন আদর্শ পুত্রের কাজ নয়।
-আপনি আর একটি কথাও বলিয়েন না আব্বাজান।

আলাউদ্দিন হতবাক। পুত্র তাকেই ধমকাচ্ছে!হতভম্ব হয়ে বলল,
-তুমি আমার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলছো!ঐ দুইদিনের মেয়ের জন্য!
সোহরাব কিছু বলল না। হাতের চুরি গুলো ছিটকে দূরে ফেলে দিলো। তারও রাগ হচ্ছে। ক্রোধে মাথা কাজ করছে না তার। নিজের চুল দুইহাতে মুঠি করে ধরে বলল,
-উপমা কোনো সাধারণ মেয়ে না আব্বাজান। নিজের ভালো চান ওর সাথে লাগতে যেয়েন না।
-তুমি বলতে চাইছো এখন আমি একটা মেয়েকে ভয় পাই? মেয়ে কে?
সোহরাব নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সামনের কাঠের চেয়ার গুলো তুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দূরে ফেলে দেয়।
আলাউদ্দিনও একটু ভয় পেয়ে যায় ছেলেকে দেখে। ভীত হয়ে উঠে তার মন। কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-কে ঐ মেয়ে?
-হুমায়ুদ্দিন মির্জা আপনার ছোট ভাইয়ের মেয়ে ও।
না চাওয়ার সত্ত্বেও রাগের মাথায় সত্যিটা বলে ফেলে সোহরাব। আলাউদ্দিন শরীরের ভার হারিয়ে ধপ করে জমিনে বসে পরে। বিড়বিড় করে বলে,
-হুমাশা! কিন্তু ও জীবিত কিভাবে!

_________________________

ছায়ার জ্ঞান ফিরেছে মাত্রই। উপমা কোনোরকম খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়। ছায়া কিছু বলছে না উপমাও চুপ। নীরবতায় কেটে যায় অনেক সময়। বড় নিঃশাস নিয়ে উপমা বলল,
-আলাউদ্দিন মির্জার সাথে আমার ছোটোখাটো দ্বন্দ্ব হয়েছে।
-কিভাবে?
উপমা সবটা বলে। ছায়া পুনরায় চুপ হয়ে যায়। উপমা শুকনো ঢোক গিলে বলে,
-সোহরাব সব জেনে গিয়েছে। কাল রাতে আমার কক্ষে এসেছিলো।

উপমা সম্পূর্ণ কথা শেষ করবে তার পূর্বেই ছায়ার কক্ষের দরজায় ঠোকার শব্দ শুনে চুপ হয়ে যায়। কান্নারত্ব মুখে কক্ষে প্রবেশ করে আলাউদ্দিন মির্জা। উপমাকে এমন ভাবে দেখছে যেনো কত বছর পর নিজের অতি আপনজনকে দেখছে। উপমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ন্যাকা কান্না করে বলল,
-ওরে আমার আম্মা রে!তুই আমার আম্মা আমাকে আগে বলিসনি কেনো? আমার হুমায়ুদ্দিনের অংশ রে!তুই জানোস না সোহরাবের মুখে তোর আসল পরিচয় শুনে আমার মনে হলো আমার ছোট ভাই ফিরে এসেছে!

উপমা কিছুই বুঝলো না। তার মানে সোহরাব তার পরিচয় বলে দিয়েছে। মনে মনে ভয় পেলেও খুশিই হলো উপমা। আলাউদ্দিনের ভালো রুপটা বেশ উপভোগ করছে সে। আলাউদ্দিন উপমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
-তাইতো বলি আমার আম্মার মতো মুখশ্রী, আমাদের বংশেরই তেজ কেনো মেয়েটার মধ্যে!আল্লাহ তোরে বাঁচিয়ে রাখুক মা।
উপমা ততক্ষনে কিছুই বলতে পারলো না। আলাউদ্দিন আরো কিছু বলে চলে যায়। কী ভালো!কী অমায়িক রুপ তার!

আলাউদ্দিন যেতেই হেসে ফেললো উপমা। ছায়াও তার সঙ্গী হলো। উপমা ধীর কণ্ঠে বলল,
-কত ভালো চাচাজান আমার!
-যাক আর অভিনয় করতে হবে না।
-হ্যাঁ। বিরক্ত হয়ে গিয়েছি আমি।
-তুই না কী বলতি?
ছায়ার কথায় উপমা খানিকটা সময় নিলো। তার কী সব বলে দেওয়া উচিত নাকি উচিত না ভাবতে থাকে সে। উপমার মনোভাব বুঝতে পারে ছায়া। শান্ত স্বরে বলল,
-আমি তোর সাথেই আছি উপমা। যদি সোহরাবের প্রাণ নিতে হয় তাহলেও পিছু ফিরবো না আমি। সোহরাব ও তার পিতার মতো অমানুষের রুপ ধারণ করেছে। আমার সন্তানের যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে!আমি আমার সন্তানকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।

উপমা চুপচাপ শুনলো। বুঝার প্রয়াস করলো ছায়ার কষ্ট। যদি ছায়া জীবনে সুখী হতে চায় তাহলে সর্বপ্রথম সোহরাবের সঙ্গ ত্যাগ করাই উচিত বলে মনে করলো উপমা। ছায়া বলল,
-তাহলে এখন পরবর্তী ধাপ কী?
উপমা স্মিত হাসলো। বলল,
-পরবর্তী ধাপই শেষ ধাপ।
-আমার আম্মাজানের জন্য একটু মায়া হয় আবার যখন ভাবি সে আমার সাথে কী করেছে তখন রাগও হয়।
উপমা ছায়ার কাঁধে হাত রাখলো। সান্ত্বনার স্বরে বলল,
-আমরা তো আছি চিন্তা নেই।

আরো কয়েকদিন কেটে যায়। সোহরাব আর শহরে যায়নি এই কয়দিনে। আলাউদ্দিনও অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। উপমার মুখোমুখি হলেই ভালোভাবে কথা বলে। যেটা দেখে একা একাই হাসে উপমা। বিকালে ছাদ থেকে জামাকাপড় নিয়ে পিছনে ফিরতেই সহসা কেউ একজন ছুটে এসে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো উপমাকে। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠে সে। সামনের জন আর কেউ নয় বরং তাহসিয়া।
সোহরাবের মুখে উপমার আসল পরিচয় শুনে শহর থেকে ছুটে আসে গ্রামে।
এক পর্যায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তাহসিয়া। মুখ দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করতে পারে না। উপমা তাকে আগলে ধরে শান্ত স্বরে বলল,
-আমি বুঝতে পারছি না তুই এভাবে কান্না করছিস কেনো তাহসিয়া!এতদিন পর আমাকে দেখলি কোথায় খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরবি কী!
-তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই উপমা। তুই ছায়াকে নিজের সত্যিটা বলেছিস কিন্তু আমাকে বলিসনি!
-আমি ছায়াকেও বলতে চাইনি। আমাকে খারাপ ভাবিস না।

দুইজন একসাথে ছায়ার কক্ষে এসে বসে। তাহসিয়া চোখ মুছে গম্ভীর স্বরে বলল,
-তুই জানিস না হুমাশা এতগুলো বছরে কতকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তোকে আমরা অনেক মনে করেছিলাম।
-আমিও তো করেছিলাম।
-কিভাবে বাঁচলি তুই ঐ রাতে? আর কেউ কী বেঁচে নেই?
তাহসিয়ার প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় উপমা। শান্ত স্বরে বলতে শুরু করে,
-সেদিন রাতে আগুন ভয়াবহ হতেই বাবা আমাকে অনেক কষ্টে গৃহের বাহিরে নিয়ে আসে।একজন ভৃত্যকে দিয়ে বলে যদি ফিরে আসতে না পারে তাহলে আমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। অতঃপর বাবা আবার ভিতরে চলে যায়। ভাইজান আম্মা তখনও ভিতরে ছিল। বাবা আর তাঁদের বাঁচাতে পারে না নিজেও ফিরে আসে না। তাই ভৃত্য আমাকে তাঁদের বাসায় নিয়ে চলে যায়। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। আমাকেই নিজের মেয়ের মতো বড় করে।

-তুই আমাদের তোর আসল পরিচয় আগে বললেই পারতি। আমরা সবাই অনেক খুশি হতাম।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল তাহসিয়া। উপমা কিছু বলবে তার আগেই ছায়া বলল,
-ও বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি বারণ করেছিলাম। তাও তো আজ সবাই জেনেই গেলো ওর আসল পরিচয়!
তাহসিয়া সন্দেহ স্বরে বলল,
-কেনো বারণ করেছিলেন বড় ভাবিজান?
ছায়ার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে যায়। মুখোভঙ্গি কঠিন করে বলল,
-সত্যিটা শুনতে পারবে তো?
-মানে?
ছায়ার উপমার পানে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
-সেইদিন রাতে আগুন লাগেনি লাগানো হয়েছিলো।
তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না তাহসিয়ার মুখশ্রীতে। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলল,
-আমি জানি। ভাইজান আর আলাউদ্দিন মির্জার কথা শুনেছি আমি। কয়েকবার ভাইজানকে বলেছিলাম মেরে ফেলো এই জঘন্য লোককে। কিন্তু ভাইজান উল্টো আমাকেই বকেছিল। এমন কোনো মানুষ নেই যার সাথে সে অন্যায় করে নাই।
উপমা ছায়া দুইজনই উল্টো চমকে গেলো। তাহসিয়াও সব জানতো। উপমার মনে হয়েছিলো তাহসিয়াও সোহরাবের মতো পিতার হয়ে কথা বলবে। কিন্তু তাহসিয়ার কথা তাঁদের চিন্তা পরিবর্তন করে দেয়। ক্রোধে জর্জরিত কণ্ঠে তাহসিয়া পুনরায় বলল,
-শুধুমাত্র জন্মদাতা না হলে আজ তার প্রাণ আমার হাতেই যেত!

>>>>চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে