প্রিয় ভুল পর্ব-১৫+১৬+১৭+১৮

0
177

#প্রিয়_ভুল
লেখা: #মাহবুবা_মিতু
পর্ব: ১৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

টুম্পাকে নিয়েই সেদিন বিকেলে ডক্তার দেখতে গেলো মীরা। বেরুতে দেরি হওয়ায় এসে দেখে ওর সিরিয়াল চলে গেছে অলরেডি। বিরক্ত হয়ে বসে পরলো মীরা। টুম্পা পায়চারী করছে। মীরা টুম্পাকে এত ভালো বাসলেও সবসময় মীরার থেকে দূরত্ব রেখে চলে। এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দূরত্ব। যতই ভালো বাসুক তিনি টুম্পার আশ্রয়দাতা তা ও সবসময় মনে রাখে।

মীরাও এ দূরত্ব ঘুচাতে চেষ্টা করে না। ওর ভয় পাছে মনের সব দুঃখ কষ্ট বলে ফেলে ওকে। তাছাড়া মীরার মনে হয় ওদের সম্পর্কে এ দূরত্বটা জরুরী। দু’জন আন্তরিক ভঙ্গিতে চললেও মীরাও আচরণে কিছুটা গাম্ভীর্য রাখার চেষ্টা করে। ও যে টুম্পাকে কতটা পছন্দ করে বা ভালোবাসে তা বুঝতে দিতে চায় না মীরা। ভয় হয় ওর, রাজিবের মতো টুম্পাও যদি সুযোগ নেয় এ অকৃত্রিম ভালোবাসার। “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় ” তাই এ ভালেবাসাটাকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখে।

মীরাকে টুম্পা ওয়েটিং স্পেসে বসিয়ে বললো-
: ” আপা ক্লান্ত লাগছে খুব, ক্যান্টিন থেকে কফি খেয়ে আসি। মীরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে যেতে বললো টুম্পাকে। অন্য কেও এ কথা বললে মীরা বলতো আহারে কষ্ট দিলাম তোকে। কিন্তু মীরা তা চেপে গেলো। ফোনটাকে ব্যাগে রেখে চারপাশে তাকাল মীরা। প্রত্যেক রোগীর সাথে তাদের হাসবেন্ড এসেছে। একমাত্র মীরা আর আরেকটি মেয়ের সাথে হাসবেন্ড নেই।

মীরা এসেছে টুম্পাকে নিয়ে, আর ঐ ছোট্ট মেয়ে খুব সম্ভবতঃ ওর মা’কে নিয়ে এসেছে। মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হলো মীরা। এত ছোট মেয়ে যার নিজেরই খেলার বসয় শেষ হয় নি, সে আবার মা হতে চলেছে। বাল্য বিবাহ ব্যাপারটা গ্রামেও এখন দেখা যায় না। আর শহরে এমনটা চোখে ঠেকলো মীরার।

মেয়েটা নিছকই ছেলেমানুষ। বার বার বোরকার খিমার খুলে মুখ বের করছে, আর ওর মা রাগারাগি করে তা ঢেকে দিচ্ছে। মেয়েটার তাতে ভাবান্তর নেই যেন। মহিলাও নিকাব দিয়ে পুরো শরীর আবৃত করে রেখেছেন। বোরকা পরার অনভ্যস্ততায় তার বুক উন্মুক্ত, যত চেষ্টা তার সবই মুখ ঢাকতে।

তার আচরনে প্রকাশ পাচ্ছে অস্বস্তি ও। নিজের খেলার বয়সে মা হয়েছে মেয়ে। এটাই যে তার অস্বস্তির কারন তা ঠিক বুঝতে পারছে মীরা। পেশাকে-আশাকে তাদেরকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মনে হলো মীরার। মহিলার হাতের লুই-ভিটন ব্যাগটা অরিজিনাল। সেইম এই ব্যাগটা রাজিবের এক ব্যাবসায়িক বন্ধু মীরাকে ওদের এনিভার্সেরিতে উপহার দিয়েছিলো।

একটু পর একটা লোক এসে সেই সম্ভ্রান্ত মহিলাকে কি যেন বললো রাগি রাগি চেহারা করে। মেয়েটার ‘বাবা’ ‘বাবা’ ডাকে বুঝতে পারলো সে মেয়েটির বাবা। ধাক্কা লাগলো মীরার তাকে দেখে। তিনি পুরোদস্তর ফর্মাল পোশাকি। মীরা পাঞ্জাবী, দাঁড়ি, টুপি আশা করেছিলেন মেয়ের বাবার কাছ থেকে। এমন একটা পরিবারের মেয়েকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিলে? কেমন খটকা লাগলে মীরার৷

রোগী বাকী তিনজন। সবশেষে মীরার সিরিয়াল। তাই চারপাশ দেখায় মনোযোগী মীরার কেমন যেন উদ্ভট লাগলো পুরো ব্যাপারটা। ঐ ছোট্ট মেয়েটা আইসক্রিম খাচ্ছে। খুব সুন্দর দেখতে মেয়েটা। ধূসর চোখ, কাটা নাক, ঠোঁট। কি চলছে ওর ছোট্ট শরীরটার ভিতরে তা নিয়ে ওর যেন কোন বিকার নেই। এই মেয়েটার বর’কে পেলে বকে দিত মীরা। ও না হয় অবুঝ, যে এ কাজ করতে পেরেছে সে নিশ্চয়ই অবুঝ না। একটু সময় দিতে পারতো মেয়েটাকে।

অবশেষে মেয়েটার সিরিয়াল এলো। মেয়েটা রুমে যাওয়ার আগে কি মনে করে যেন ছুয়ে দিলে মীরাকে। মীরা কেমন পুলক অনুভব করলো ওর স্পর্শে, মেয়েটার ধূসর চোখে চোখ রেখে একটা হাসি বিনিময় করলো মেয়েটার সাথে।

আধঘন্টার মতো সময় চলে গেলো। তারা বের হওয়ার কোন নাম নেই।অধৈর্য মীরা উঠে হাঁটা শুরু করে। টুম্পা জিজ্ঞেস করলো ক্ষুধা লেগেছে কি না। মীরা না বলায় একটা নিরিবিলি জায়গায় বসলো টুম্পা। অবশেষে বের হলেন তারা।

মীরা রুমে প্রবেশ করলেই দেখলেন ডাক্তার এতটাই চিন্তামগ্ন যে মীরার আগমন তার দৃষ্টিগোচর হয় নি। মীরা চেয়ার টেনে বসাতে সে শব্দে তার চেতনা ফিরলো যেন। দ্রুত একটা কৃত্রিম হাসি টেনে নিলেন অভিবাদন জানাতে। মীরা বসে তার ফাইলটা এগিয়ে দিলো। সবরকম চেকাপ ফাইল দেখে ডাক্তার জানিয়েছেন এভরিথিং ইজ ফাইন। একটা আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখাতে বলা হলো। আল্ট্রাসাউন্ড ব্যাপারটা নিয়ে মীরা খুব কিউরিয়াস। কি বাবু হবে যদি জানা যায়। সেখানে গিয়েও দেখা হলো সেই দম্পতির সাথে। মেয়ের আল্ট্রা করে রিপোর্টের অপেক্ষায় তারা। মীরার আল্ট্রাসাউন্ডে জানা গেলো ওর গর্ভের বাচ্চাটা মেয়ে বাবু। খুব খুশি হলো মীরা।

যদিও রাজিবের এসবে কোন ইন্টারেস্ট নেই। প্রথম দিকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো মীরা তখন বলতো- প্রথম বাচ্চা আল্লাহ যা দিয়ে খুশি, আমিও তাতেই খুশি। মীরা কিন্তু একথা শুনতে চায় নি। মীরা ভেবেছিলো মেয়ে বাবু নিয়ে রাজিবের কোন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটবে হয়তো ওর কথায়। কিন্তু তা না হওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলো ও। বাচ্চাটা তো রইলোই না। এবার আর এসব জিজ্ঞেস করার মানসিকতা, পরিস্থিতি কোনটাই ছিলো না। তবে মীরা মনে মনে একটা মেয়ে চাইতো খোদার কাছে৷ তাতে যদি ঘরমুখো হয় রাজিব।

রিপোর্ট আনতে আনতে ডাক্তারের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ায় আগামীকাল আসা ছাড়া কোন উপায় নেই। তাই রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলো ওরা। রিকশায় বসে বসে মাথায় কেবল ঐ বাচ্চা মেয়েটার অস্বাভাবিক প্রেগ্ন্যাসি, মা-বাবার আতঙ্কিত মুখ আর ডাক্তারের চিন্তামগ্নতা ভাবাচ্ছে। গাণিতিক ক্যালকুলেশনে যার রেজাল্ট খুবই খারাপ কিছু দাঁড়ায়। মেয়েটা কারো লালসার শিকার নয় তো?
এসব ভাবনা চারপাশ থেকে জেঁকে ধরে মীরাকে। মীরা এসব ভাবতেই পেটে হাত দিয়ে ওর অনাগত মেয়ের ভবিষৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরে। আর মনকে বুঝায়, না এরকম কিছু হয় নি। এত নিষ্পাপ চেহারার বাচ্চা মেয়ে কারো লালসার শিকার হতে পারে না । নিশ্চয়ই এটা ওদের দু’জনের ভালোবাসার ফল৷

বাসায় ফিরে টুম্পাকে এক কাপ চা দিতে বলে মীরা।টুম্পার পরীক্ষা চলে এসেছে, মীরা তাই চা নিয়ে আসার সময় টুম্পাকে বললো-
: ” তুই আগামী এক মাস লাঞ্চ এর পর বাসায় চলে আসবি, এ এক মাস মন দিয়ে পড়বি শুধু। পিয়াসা যেন না বলে, যে তোকে দিয়ে শুধু কাজই করিয়েছি”
টুম্পা বললো-
: “আপা বিকেল বিকেল ফিরলেও হবে, লাঞ্চ এর পর আসা লাগবে না”
: ” তুই কথা কম বল”
: ” আপা, সামনে ইদ, অফিসে এ সময় কাজের চাপ বেশী থাকে, আপনি প্লিজ আমাকে ভরসা করুন। আমি বিকেলে এসে সব শেষ করতে পারবো।
: ” ঠিক তো?”
মৃদু হেসে টুম্পা বলে-
: ” হ্যা”
বলে টুম্পা নিজের ঘরে চলে গেলো। টুম্পা এ ফ্ল্যাটের একেবারে ভিতরের দিকের স্টোর রুমের পাশের ঘরটাতে থাকে।

মীরার প্রথম সন্তান মেয়ে এ কথাটা কাওকে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। খুশি ভাগ করে নেয়া যাকে বলে। কিন্তু কাছেপিঠে কাওকে পেলো না কথাটা বলার মতো। এত বড় এ পৃথিবী, পাঁচশ কোটি মানুষ এ পৃথিবীতে। কিন্তু এ খুশির খবরটা বলার মতো মানুষ ওর নেই। চোখটা ভিজে উঠলো মীরার এসব ভেবে। পরক্ষণেই ভাবলো আজ অনেক খুশির দিন। মীরার চাওয়া পূর্ণ হতে চলছে। আজ কোন কান্নাকাটি করবে না ও। ফোনটা নিয়ে রাজিবকে ফোন করে বললো তাড়তাড়ি বাড়ি ফিরতে। রাজিব বললো ও কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে।

বিছানায় শুয়ে মেয়েদের সুন্দর নামের তালিকা খুঁজছে মীরা গুগল থেকে। মেয়ে যেহেতু তাই বাবার নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখবে বলে ঠিক করলো মীরা। হঠাৎ মনে হলো পিয়াসাকে কল করে জানাবে ব্যাপারটা। পিয়াসর সাথে অনেকদিন কথা হয় না। এরপর বেশ কিছু সময় পিয়াসার সাথে কথা হলো মীরার। পিয়াসা মেয়ে হওয়ার কথাটা শুনে খুশি হলো ভীষণ। বললো আসছে বুধবার ও আসবে মীরাকে দেখতে। দীর্ঘ কথা শেষ করে মিরার খেয়াল গেলো ডায়েরির পাতায়। সেখন থেকে কতগুলো নাম প্রথমিক ভাবে ঠিক করলে মীরা-

রাকা অর্থ পূর্ণিমা
রাইকা অর্থ প্রিয়
রেহনুমা অর্থ পথ প্রদর্শক
রাজিবের মতামত নিয়ে আরো কিছু নাম ভেবে কোন একটা ফিক্সড করে ফেলবে বলে ঠিক করে মীরা।

রাজিব সে রাতে সত্যি জলদি ফিরে আসে। সাথে নিয়ে আসে মীরার প্রিয় চিকেন বারবিকিউ পিৎজা উইথ এক্সট্রা চিজ। রাজিবকে ভীষণ রকম এক্সাইটেড দেখা যায়। রাজিব জানায় ওরা এগারোজন মিলে “ড্রিম ইলাভেন” নামে একটা প্রেজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছে। এ প্রোজেক্ট তার দীর্ঘ পথযাত্রা শেষ করবে তখনই যখন এগারো জনের প্রত্যেকের একটি করে ফ্ল্যাট আর একটি করে লাক্সারি গাড়ির মালিক হবে। আপাততঃ ওরা এগারেজন টাকা একত্রে করে একটা মিচুয়াল বিজনেসে ইনভেস্ট করবে। সেখন থেকে আসা প্রফিট জমিয়ে জমি কিনবে৷ ধীরে ধীরে বাড়ির কাজ শুরু হবে। একটা সময় পর নিজেদের লাক্সারিয়াস ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট আর গাড়ি হবে। রাজিবকে বেশ উচ্ছাসিত দেখায় বলে মীরা মনোযোগের সাথে কথাগুলো শুনে রাজিবের। বিজনেস প্ল্যান পছন্দ হয় মীরার। কিন্তু কাদের সাথে শুরু করছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। এসব নিয়ে এখন কথা বলা ঠিক হবে না। কারন মীরা জানে খতিয়ে দেখার খাতিরে করা প্রশ্ন গুলোতে বিরক্ত হয়ে রাজিবের মুড নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এসব এড়িয়ে যায় মীরা। এসব কথা পরে হবে। এখন না হয় এই সুখেই ভাসা যাক দুজনে। অনেকদিন পর মীরাকে খুব খুশি দেখায় সবকিছু মিলিয়ে।

পিৎজা খেতে খেতে মীরা রাজিবকে বলে আজকের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। রাজিবও মনোযোগ দিয়ে শুনছে মীরার কথা। সবশেষে মীরা রাজিবকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” বলো তো কে আসছে আমাদের ঘরে?
মা নাকি বাবা?
একটু ভেবে রাজিব চেয়ার থেকে নেমে মীরার পেটে কান পেতে কিছু একটা অনুভব করতে চেষ্টা করলো। প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও ব্যাপারটা ভীষণ আনন্দ দেয় মীরাকে। ঠিক এমন সময় রাজিব বাবু একট কিক্ করে উঠে। খুশিতে রাজিব কান্না করে দেয়। মীরাও কেঁদে ফেলে রাজিবের উচ্ছাস দেখে।
: ” মীরা এটা আমার সন্তান। আমি বাবা হতে যাচ্ছি, ও আমাকে বাবা বলে ডাকবে?”
অশ্রুসিক্ত চোখে মীরা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় রাজিবকে।

: ” এই কিক্ টা আমাকে প্রথম বারের মত অনুভব করালো – ” I’m going to be Baba….!”

রাজিব মীরার হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে চুমু খায়। রাজিব এভাবেই পায়ের কাছে বসে থাকি খানিকটা সময়।

মীরা ভাবে বড়রা ঠিকই বলে-” বাচ্চা সত্যি বাহির মুখী বরদেরকে ঘরমুখো করে” জীবণকে এমন ভাবে কখনো হয়তো উপলব্ধিই করে নি রাজিব। এখন থেকে করবে হয়তো। মীরা রাজিবের মাথায় চুমু খায় একটা। আর মনে মনে বলে- “জীবন সুন্দর ”

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব: ১৬
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পরদিন বিকেলে মীরা আবার গেলো হসপিটালে রিপোর্ট দেখাতে। শুধুমাত্র রিপোর্ট দেখাবে বলে বেশী বেগ পেতে হলো না। ডাক্তারের এসিস্ট্যান্ট সিরিয়াল ছাড়াই ভিতরে যেতে ইশারা করলেন। মীরার রিপোর্ট সবই নরমাল। কিন্তু রক্তে হিমোগ্লোবিন ভীষণ কম। খাওয়া দাওয়ায় যত্ন নিতে বললেন ডাক্তার। নতুন কি একটা ঔষধ লিখে দিলেন রক্ত বৃদ্ধির জন্য । বিশেষ কিছু মাছ, সবজি, ফল সাজেস্ট করলেন সাথে এও বললেন দিন পনেরো পর যেন আবার আসেন ভিজিটে।

আজকে মীরার সাথে রাজিব এসেছে। প্রেগ্ন্যাসির এই দীর্ঘ জার্নিতে আজ প্রথম বার ওর সাথে এলো রাজিব। তার উপর এত দ্রুত কাজ শেষ হওয়ায় মীরা মনে মনে ভাবে দুজন মিলে অনেক দিন বসা হয় না কোথাও। কাজ আর টাকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ভালোবাসার তারটা কোথায় যেন আলগা হয়ে গেছে। আজ দুজনে নিরিবিলি বসবে কোথাও, অনেক কথা বলবে দু’জনে।

সেখান থেকে বেরুতেই একদল লোকের জটলা দেখা যায় হসপিটালের পার্কিং-এর সামনে। সামনে একটা স্ট্রেচার, খুব সম্ভবতঃ কেও মা’রা গেছে। মীরা ব্যাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেখনে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না ও। তবে একজন মহিলা মাটিতে গড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো মতো কাঁদছে তা লোক জর হওয়া সত্ত্বেও বোঝ যাচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের কেও কেও কাঁদছে। হসপিটালে আনাগোনা লোকগুলোর কেও কেও উঁকি দিচ্ছে। মীরা এ সময়ে এসব এড়িয়ে যেতে চায়। তাই সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পার্কিং থেকে রাজিবের বাইক বের করবার অপেক্ষা করে মীরা। এমন সময় হঠাৎ সিকিউরিটির লোক এসে সেখানে থাকা সবাইকে সরিয়ে দেয়। সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে ও কিন্তু কান বন্ধ করার উপায় তো নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশ কিছু কথা শুনতে পেলো মীরা। ক্রন্দনরত মহিলা নিজেকে দুষছেন এ মৃ’ত্যু’র জন্য।

প্রিয়জনের বিয়োগ এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শোক। দুনিয়ায় অর্থ, সম্পদ, বাড়ি গাড়ি সব চলে গেলে, হারিয়ে ফেললেও তা ফিরিয়ে পাওয়া সম্ভব। শুধু মাত্র প্রিয় জন, কাছের মানুষ ম’রে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাদের কষ্টটাকে অনুভব করতে পারলো মীরা। চোখ বন্ধ করে মন থেকে দোয়া করলো মৃতের জন্য৷ আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশত নসীব করেন।

এমন সময় রাজীব গাড়ি নিয়ে এসে হর্ণ দেয় একটা মীরার মনযোগ আকর্ষণের জন্য। বাইকের পেছনে সাবধানে উঠে বসে মীরা। রাজিবের বাইকটা যখন গাড়িটার সামনে দিয়ে পার হচ্ছিল হঠাৎ বাতাসে স্ট্রেচারে থাকা মৃতের মুখ থেকে চাদরটা সরে গেলো। যেন মীরাকে দেখতেই তার চাদর সরিয়ে মুখ বের করা। মীরা এক মুহূর্তের জন্য ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়।
গতকালের সেই বাচ্চা হবু মা’টা । যে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিলো হসপিটালে। মীরা দ্রুত চারপাশে তাকালো আরো ওর সন্দেহের সমীকরণ মিলাতে। অবশেষে মীরা মেয়েটার বাবাকে দেখলো সিঁড়িতে বসে কাঁদছে, হঠাৎ দেখে চিনতে পারে নি মীরা তাকে। তার গায়ের কাপড় দেখে তাকে চিনলো মীরা। এরকম একটা শার্ট রাজিবের জন্য কিনেছিলো মীরা। তাই ও দ্রুত ক্যাচ করতে পারে লোকটাকে । এতক্ষণ তাকে চেনাই যাচ্ছিল না, এই শার্ট টার জন্য চিনতে পারলো।

একদিনে লোকটার বয়স এক যুগ বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। মলিন চেহারা, ক্লান্ত দৃষ্টি, উস্কেখুস্কো চুল। এ-সব মিলিয়ে তাকে বড় অচেনা মনে হচ্ছিল মীরার। আর মাটিতে লুটিয়ে কান্না করা মহিলাটি কি ঐ মেয়ের মা। পাশে পরে থাকা লুই ভ্যাটনের সে ব্যাগটা যেন সাক্ষী দিচ্ছে মীরাকে যে- মীরা এ সে-ই তুমি যাকে ভাবছো।

তিনি আজ আর নিজেকে লুকাতে বোরকা পরেন নি। নিজেকে লুকিয়ে রাখার ব্যাস্ততা শেষ করে চলে গেলো মেয়েটি। দামী সুতি থ্রিপিস গায়ে তার। তাই দুজনকেই চিনতে সমস্যা হচ্ছিল এতক্ষণ মীরার।

মীরার মাথায় কতগুলো চিন্তা ঘুরছে এখন। লম্বা পার্কিং পেরিয়ে গাড়িটা যখন মীরার দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পরলো তখন মীরার মাথায় থাকা সমীকরণটা মিলে গেলো পুরোটাই।

গতকালের ভাবনাই ঠিক ছিলো। মেয়েটাকে কোন লো’লু’প পশু তার লা’ল’সার শিকার করেছে।

হসপিটাল থেকে বেরুবার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মীরা রাজিবকে বলেছিলো ধানমন্ডি লেকে নিয়ে যেতে। সে হিসেবেই গাড়ি চালাচ্ছে রাজিব৷ হঠাৎ মীরা রাজিবকে বললো –
: ” বাসায় চলো রাজিব, আমার শরীরটা ভাল্লাগছে না”
: ” কেন কি হলো হঠাৎ? ”
: ” না, কিছুনা, বাসায় চলো প্লিজ”
রাজিব ভুল পথে ইউটার্ন নিয়ে বাড়ির রাস্তায় গাড়ি ঘুরালো। জিজ্ঞেস করলো শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটালে ঘুরাবো?
: ” না, না বাসায় চলো তুমি, আমি ঠিক আছি”

মীরা বাড়ি ফিরে কেবল সেসব কথাই ভাবতে লাগলো। ইচ্ছে হচ্ছিল এ নরপশুটাকে খু’ন করতে। এরা কেন এমন অমানুষ। এদের ভিতরে কি হৃদয় বলে কিছু নেই? তাদের পুরোটা শরীরই কি কা’মে ভরা?

পাশে বসে থাকা রাজিব জিজ্ঞেস করলো –
: ” মীরা কি হলো হঠাৎ? বাইরে বসবে বলে ঠিক করেও চলে এলে ”

মীরা ক্রুদ্ধ চোখে তাকালে ওর দিকে, এই যে মানুষটা, এও তো পুরুষ। এ-ও তো সুযোগ সুবিধা মতো কাওকে একলা পেলে ঠিকই খুবলে খাবে।

মীরার চোখে তাকিয়ে রাজিব বললো-
: ” রেগে আছো কেন? আমি কি কোন ভুল করেছি ”
মনে মনে রাজিব ভাবতে লাগলো- ” ও এত কেন রাগান্বিত, কেও কি কিছু বললো ওকে?
(ঐ যে একটা কথ আছে না- ঠাকুর ঘরে কেরে? আমি কলা খাই না। তেমনি….)

মীরার রাজিবের চিন্তিত মুখ দেখে ভাবনার ঘোর কাটলো। স্বাভাবিক হয়ে বললো-
: ” তোমাদের পুরুষদের তো হৃদয় বলে কিছুই নেই। মেয়েদেরকে একদলা মাংস ছাড়া কিছুই ভাবতে পারো না, তাই না?”
: ” কি বলছো এসব তুমি”
: ” ঠিকই বলছি আমি”
: ” তোমাকে কে বলেছে এসব, নাম বলো একেবারে পুতে ফেলবো শালাকে”
: ” কে কি বলবে, আমি সব বুঝি ”
বলেই কাঁদতে থাকে মীরা। রাজিব ভ্যাবাচেকা খেয়ে মীরার কাছে এসে ওকে ধরতেই কান্নার স্রোত যেন আরো বাড়ে, সে অবস্থায়ই বলে-
: ” তোমাদের পৌরুষ শুধু মেয়ে মানুষ দেখলেই জেগে উঠে, তোমরা একবারও ভাবো না সে মেয়েটা কি এসবের উপযুক্ত নাকি না, আজ যে মেয়েটা মরলো, এমন কত মেয়ে প্রতিদিন তোমাদের মতো লোকের লালসার বলি হয় তার খোঁজ কে জানে? আমি খুব করে চাইতাম আমার একটা মেয়ে হোক। কিন্তু এ সমাজে মেয়েরা নিরাপদ না, এমনকি পরিবারেও না। ঐ মেয়েটার সাথে এমন কাজ করেছে ওরই আপন চাচাতো ভাই, মেয়ের মা তাই বলছিলে কেঁদে কেঁদে”
বলেই মুখ চেপে কাঁদতে থাকে মীরা।

রাজিব বুঝতে পারে মীরা হসপিটালের ঐ মেয়ের মৃ’ত্যু’র বিষয়ে কথা বলছে এতক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বুক থেকে পাথর নামে যেন ওর।

স্বান্তনার স্বরে রাজিব বললো-
: ” সবাই কি এক? ”
: ” তোমরা সবাই এক ”

আর কোন কথা বাড়ায় না রাজিব। এখন তর্ক করার সময় না। ভেবেই শুইয়ে দেয় মীরাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
: ” এজন্যই মন খারাপ? ”
বেশ কিছু সময় পর শান্ত হয়ে মীরা হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।
: ” এসব ভেবো না, ঘুমিয়ে পরো”

কাঁথা টেনে পাশ ফিরে চোখ বুঝে মীরা। চোখ দুটে বুঝতেই ওর চোখে ভেসে উঠে গতকালের সেই মেয়েটির ওকে ছুঁয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি। আর কানে বেজে উঠে – থার্টি সেভেন – নুহা । মেয়েটির নাম ছিলো নুহা।
কি সুন্দর, নিষ্পাপ মেয়েটি। কতই বা বয়স হবে ওর, এ বয়সেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হলো এক অমানুষের লালসার জন্য। চোখ বেয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে মীরা৷ কি ভেবে যেন হঠাৎ চোখ দুটো খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে রাজিবকে বলে-
: ” শোন আমাদের মেয়ে হলে ওর নাম রাখবো নুহা, কেমন? ”

চোখ কুঁচকে রাজিব হাতের ফোনটাকে নামিয়ে কিছু সময় চেয়ে থাকে মীরার দিকে। মীরা যেন অজানা কোন ভাষায় বললো কিছু ওকে। এরপর বলে-
” ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও তো ” বলে ফোনটাকে পাশে রেখে মীরার গা ঘেঁষে শুয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে রাজিব। আরামে চোখ বুঁজে আসে মীরার।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ১৭

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙে মীরার। সূর্য তখনো উঠে নি। চারদিকে কেমন মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। নিচে তাকিয়ে দেখে নিচের গাছের পাতাগুলো নেচে উঠছে বাতাসের দাপটে। উপর থেকে তাকালে মনে হয় নিচে সবুজের পারাবার। সামনে তাকালে দূরে থাকা রেললাইন দেখ যায়। তার শব্দ কেবল গভীররাতেই পাওয়া যায়। উচুতে বাসা থাকার এই এক মজা। এক দৃশ্যে এসব দেখে নেয়া যায়।

বারান্দার গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাস ধরতে চেষ্টা করে মীরা। কিন্তু বাতাস অনুভব করা যায় মাত্র, একে কি ধরা যায়? কাছেই আছে কিন্তু অদৃশ্য। রাজিবকে ও ওর বাতাসের মতো মনে হয়। তাই তো সেদিন ও রাজিবকে বলেছিলো- ” তুমি কাছেই আছো আমার, কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পারছি না ”

ভালোবাসা ভাগ্য বরাবর খারাপ মীরার। বিয়ে হতে না হতেই রাজিবের কত বড় অসুখ ধরা পরলো। অসুখ হওয়ার আগে যে কটাদিন ছিলো সেই দিনকটাই মীরার জীবণের সবচেয়ে মধুময় দিন ছিলো৷ এরপর নববধূ মীরা স্বামীকে বাঁচাতে কত কি না করে ছিলো। রাজিব সুস্থ হলেও ওকে বেশ খানিকটা সময় দিয়েছিলো মীরা।

রাতের বেলা পাশে শুয়ে থাকা রাজিব, রাজিবের উন্মুক্ত পিঠ, শরীরের গন্ধ, জাগিয়ে তুলতো মীরার আদিম প্রবৃত্তি। ধৈর্য ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে মীরা। এমন কি রাহাতের কাছ থেকেও শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলো ও। আল্লাহ সহায় ছিলো বলে এমনটা পেরেছিলো । শেষ পর্যন্ত রাহাত খুব ভালো বন্ধু রূপে আবির্ভাব হয়েছিল ওর জীবণে। মীরার ফিরিয়ে দেওয়া সেই দুই-লক্ষ টাকা রাহাত ফেরত দিয়েছিলো মীরাকে৷ বলেছিলো
: ” এটা তোমাদের জন্য আমার পক্ষ হতে উপহার ”
প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিলো না মীরা। এত অল্প বয়সে জীবণে এত বড় বড় চমক পেয়েছে ও জীবণে যে কেমন হতবাক হয়ে ছিলো আগে থেকেই। তাই ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগে ওর। যদিও টাকাটা মীরা রেখে চলে এসেছিলো শেষ পর্যন্ত। রাহাতকে ছোট্ট করে বলেছিলো – ভেবে জানাবে ৷

মীরার ভয় ছিলো এটা আবার কোন নতুন ফন্দি না তো রাহাতের। মাস খানেক পর মীরার কোচিং-এর ঠিকানায় একটা চিঠি আসে। সে খামে ছিলো একটা চিঠি, আর তার ভেতরে আরো একটা খাম। খামের নাম ঠিকানা দেখে মীরা ব্যাগে রেখে দিয়েছিলো খামটা। এখানে এটা পড়া ঠিক হবে না তা ভেবে। বাড়ি ফিরেও চিঠিটা পড়বার সুযোগ হচ্ছিলো না মীরার। সেদিন রাজিব সিলেট যাচ্ছিলো ওর এক বন্ধুর সাথে। সুস্থ হলে সেখানে যাবার নিয়ত করেছিলো রাজিব। যাওয়ার কথা মীরারও ছিলো। কিন্তু দুজন গেলে খরচ বেশি হবে তাই মীরা বলেছিলো –
: ” টাকাপয়সার সমস্যা যেহেতু, তুমি একাই যাও। নিয়ত করেছিলে তুমি, আমার না গেলেও হবে”
রাজিব আহত চোখে তাকিয়ে ছিলো মীরার দিকে।।সান্ত্বনার সুরে মীরা বলেছিলো-
: “মন খারাপ করো না লক্ষ্মীটি, পরিস্থিতি তো বুঝতে হবে তাই না? আমাদের যখন অনেক টাকা হবে আমরা দুজনে একসাথে অনেক ঘুরবো, কেমন?”

টাকা মীরার জীবণে এসেছিলো ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসায় হাত ধরে ঘুরাঘুরিটা আর হয় নি। যত বার ওরা এদিক সেদিক ঘুরতে গিয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ওদের ব্যাবসা। তো সে রাতে মীরা রাজিবকে বিদায় দিয়ে, ঘরের সব কাজ শেষ করে বের করেছিলো চিঠিটা। মনে উদ্বেগ উৎকন্ঠা, কি লেখা আছে এতে? মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ছিলো মীরা।

প্রিয় মীরা,
চিঠিটা যখন তোমার হাতে পৌঁছোবে ততদিনে আমি
পৌঁছে গেছি তোমার থেকে যোজন যোজন দূরের দেশ ইংল্যান্ডে। সব কাজ শেষ করে রাতের অবসরে তুমি যখন চিঠিটা পড়ছো আমার এখানে তখনো রাত হয়নি হয়তো, আমি তখন ব্যাস্ত হয়তো আমার কাজে। এ শহরে সবাই ব্যাস্ত। কারো সময় নেই দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে খোঁজ নেয় করো৷ কেমন আছো? এ কথাটাও তারা হাঁটা চালু রেখে জিজ্ঞেস করে। উত্তর যখন দিই তখন হয়তো সেই শব্দ গুলো তার শ্রুতি সীমার বাইরে চলে যায়। তাই ইশারায় কুশল বিনিময়ই একমাত্র ভরসা। এসব জানা আমার।

কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। চিঠি আমি জীবনেও লিখি নি। এ লেখাটা চিঠি কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে আমার। এটাকে আমার আত্মা পক্ষ সমর্থন ও বলতে পারো। যাকগে শোন তাহলে-

আমাদের বাড়িতে যখন উঠেছিলো চোখের সামনে তোমাদের ভালোবাসাময় জীবণ দেখে হিংসার আগুনে জ্বলছিলাম আমি। রাস্তার একটা ছেলে রাজিব, কি ছিলো ওর? বেতনই বা কত ছিলো ? তবুও কেন ওর এত সুন্দর স্ত্রী, এত সুখ? সহ্য করতে কষ্ট হতো খুব। এত কেন সুখী ওরা? সব থেকেও আমি কেন অসুখী? তাই তো তোমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তোমাকে আমার করে পেতে চেয়েছিলাম। রাজিবের চিকিৎসার অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতে চেয়েছিলাম তোমাকে।

আমি অনেক বড় একটা অন্যায়ের শুরু করেও তার শেষ করতে পেরেছিলাম খারাপ কিছু ঘটার আগেই। তাই কৃতজ্ঞতা ইশ্বরের কাছে। আমি ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘড়ে’ চাপাচ্ছিলাম আর একটু হলেই। সেই অন্ধকারে আমাকে পথ দেখিয়ে ছিলো লোরা নামের বন্ধু রূপি সেই মেয়েটা। দোষটা আমারই ছিলো আমিই সবজির বাজারে গিয়ে হয়তো বই খোঁজার মতো ভুল করেছি। অপাত্রে ভালোবাসা খুঁজেছি, কষ্টও পেয়েছিলাম ভীষণ। যার তাড়না আমাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিলো। ভালোবাসার ফোয়ারা নিয়ে আমার পাশেই যে কেও ছিলো, তা খেয়ালই করি নি আমি কোন দিন । তুমি জেনে খুশি হবে যে আমি আমার সেই দুঃসময়ের বন্ধু যে সেই স্কুল থেকে আমাকে আগলে রেখেছিলো এতটা বছর ধরে তাকে আমি স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেছি। তার ভালেবাসার টানেই আমি চলে এসেছি এ দূরদেশে। তুমি হয়তো এখন ভাবছো এত জলদি ভালোবাসাবাসি হয়ে গেলো। লোরা তো আগে থেকেই ভালোবাসতো আমায়, ওর দিক থেকে এ্যাফোর্ট শতভাগ আগে থেকেই, নতুন করে যা করতে হয়েছে তা হলো আমার দিক থেকে তার অনুভব করা। টানা একটা মাসের প্রতিটি রাত শুধু আমি লোরার একটা কথাই শুধু ভেবেছি। অভিমানী কন্ঠে সে একদিন বলেছিলো- ” দুনিয়াটা এমন কেন রে? কেও পায় না আবার কেও চায় না ”

ওর এ কথা বলার কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি আমাকে অনেক ভালোবাসে ও। এরপর আমার ভেতরে ও পরিবর্তন হতে শুরু করে। কিন্তু তা খুবই ধীর গতির হওয়ায় টেরই পাই নি। একসময় লক্ষ্য করলাম কেমন সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা হচ্ছে ভিতরে। কি, কেন, কিভাবে কোন উত্তরই নাই আমার কাছে। হঠাৎ এক রাতে ঘুম ভেঙে গেলো। শত চেষ্টায় ও আর ঘুম এলো না। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো সে যন্ত্রণা। সংকোচ, দ্বিধা একপাশে সরিয়ে ফোন করলাম ওকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই ঘুম মাখা এক কন্ঠ হ্যালো বলেছিলে। তারপরই বলেছিলাম – “লোরা বিয়ে করবি আমাকে? ”
কি বলছি আমি তা ভাবতে হয়তো একটু সময় লেগেছিল লোরার । ঘটনার আকস্মিকতায় নেশ কিছু সময় চুপ থেকে ফোনটা কেটে দিয়েছিলো ও। এত বছর যাকে এক মনে চেয়েছে, সে আজ নিজে ধরা দিয়েছে। ব্যাপারটা হজম করা কি চাট্টিখানি কথা? এপাশ থেকে আমিও ফোন করেই যাচ্ছি, ধরছিলো না ও। উপায় না দেখে চলে গিয়েছিলাম ওর বাড়ির সামনে। কারন পরদিন বিকেলেই ওর ইংল্যান্ড যাবার ফ্লাইট। পড়াশোনা আমার কিছু না হলেও বন্ধুরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ও ওখানে অনার্স-মাস্টার্স করে দেশে ফিরছিলো চাকুরী বাকরির চেষ্টা করতে। সুবিধা করতে না পারায় সেখানেই ফিরে যাচ্ছিল পিএইচডি করতে। আমি কোন সময় নিতে চাই নি। সরাসরি বাবা-মাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। সে যাত্রায় ওর যাওয়াটা পিছিয়ে গেলো পনেরো দিন। নিকটবর্তী শুক্রবারে বিয়ে করি আমরা। তুমি যেদিন আমার বাড়িতে এসেছিলে টাকা ফেরত দিতে তখন আমি “বিবাহিত” ছিলাম। লোরা চলে গেছে বিয়ের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে৷ পাছে জয়েনিং ডেট মিস হয়ে যায়। এদিকে আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম ওর সাথে থাকার জন্য। দেশে ফিরবো কিনা জানিনা, হয়তো ফিরবো, হয়তো না। অনেক বললাম নিজের কথা। এবার শোন কি বলি-

কেমন আছো তোমরা? আশাকরি ভালোই আছো। ভালো থাকো এ দুআ করি। চিঠির ভিতরে আরেকটা খাম রয়েছে। সেখানে একটা চেক রয়েছে দু’লক্ষ টাকার। এ টাকাটা তোমাদের নতুন জীবণ শুরু করার জন্য আমার পক্ষ হতে উপহার। এটা দিয়ে কিছু করার জন্য নতুন করে শুরু করো। আমি জানি তুমি পারবে। যে মেয়ে শূন্য হাতে স্বামীর চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে পারে, সে পারবে না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। তোমার স্বামী সম্পর্কে কিছুই বলবো না আমি। তবে একটা কথা সেদিনও বলেছিলাম এখনো বলবো- ভুল করেছো তুমি, ইউ ডিজার্ভ বেটার দেন……

ভালো থেকো মীরা৷ তোমার জীবণ ভালোবাসাময় হোক, এ দোয়াই করি ইশ্বরের কাছে।

ইতি,
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী রাহাত

সে রাতে মীরা চিঠির শেষ লাইন কয়টার মর্ম না বুঝলেও সাত বছরের সংসার জীবণে তার সত্যতা পেয়েছে ধীরে ধীরে।

এটা সত্যি যে মীরা পেরেছে। রাহাতের দেয়া সেই টাকা দিয়ে শুরু করা ব্যাবসা আজ আলোর মুখ দেখেছে। কিন্তু মীরার জীবণ ভালোবাসাময় হয় নি শেষ পর্যন্ত। এজন্য মীরা নিজেকে দোষী ভাবে।
মনে মনে আবীরকে কষ্ট দেয়াটা অপরাধবোধ জাগায় ওর মনে। তা না হলে কেন এমন হবে?

” যার সাথে ভুল হয় সে একটা সময় তা কাটিয়ে উঠে কোন না কোন ভাবে। কিন্তু যে ভুল করে অপরাধবোধ তার পিছু জীবণেও ছাড়ে না ”
অপরাধবোধ মীরার পিঁছু ছাড়ে নি। ও যত গতি বাড়াচ্ছে সামনে এগিয়ে যেতে, অপরাধবোধও তত গতিতে ওর পিছু ছুটছে। আচ্ছা এর থেকে মুক্তির কি কোন পথ নেই?

ভাবনায় ছেদ পরে ফোন কলের শব্দে। কাছে গিয়ে দেখে কারখানা থেকে ফোন এসেছে। রাজিবকে ডেকে তুলে তৈরী হয়ে যেতে বলে মীরা। আজ ও একটু দেরিতে যাবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজিব ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়। মীরা বিছানায় শুয়ে থাকে। রাতে ঘুম হয় না ওর। এটা নতুন রোগ না ওর। এ রোগের জন্ম হয়েছিলো এক শীতের ভোরে। সে গল্পটা ভুলে থাকতে চায় মীরা। কারন সেটা এত নোংরা গল্প যে- এসব আর ভাবতে চায় না ও। তবুও সে সকাল রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ওর, যত চেষ্টাই করে সেই ঘটনা কিছুতেই পিছু ছড়ে না ওর। একটু অবসর পেলেই ধেয়ে আসে ওর দিকে তেড়ে।

চলবে…..

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব: ১৮
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ঘটনাটা প্রায় বছর খানেক আগের। আট দশটা শীতের সকালের মতো সেদিন ও কুয়াশার স্তর ভেদ করে সূর্যের আলো প্রবেশ করেছিলো পৃথিবীর বুকে।
ঘাস লতাপাতায় কুয়াশার শিশির হয়ে আছড়ে পরা কণাগুলো রোদের তাপে বিলিন হওয়ার পথে। বাড়ির পাশে মসজিদের পেছনে কবরস্থান হওয়ায় বেশ গাছপালা ঘেরা জায়গাটি। সেই সুবাদে পাখিদের আনাগোনা এখানটায় চোখে পরার মতো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও পাাখির কলতানে ঘুম ভাঙে মীরার। ঘুম থেকে উঠে মীরা পাশে তাকিয়ে দেখে রাজিব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে ওকে অনেক সুন্দর দেখায়। ওর দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি হাসে মীরা। এ হাসি খোদার তরে কৃতজ্ঞতার হাসি।

সাবধানে খাট থেকে নামে মীরা। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়। ঘুমানোর সময় শব্দ করা রাজিবের অপছন্দ তাই।

রান্নাঘরে গিয়ে নাশতা তৈরী করতে করতে রাজিব উঠে পরে ঘুম থেকে। কোন মতে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পরে ও। যদিও আজ সকাল সকাল কাপড়ের রোল ঢোকার কথা কারখানাতে, এ সময় একজন থাকতে হয় মাল ঠিকঠাক বুঝে নিতে। তবুও আজ যেন রাজিবের খুব তাড়াহুড়ো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সকাল সড়ে আটটা মাত্র। ব্যাপারটা মীরা স্বাভাবিক ভাবেই নেয়।

রাজিবকে বিদায় দিয়ে পরটা রোল করে চা দিয়ে খাচ্ছিলো ও, আর অফিসের ফোনটাতে পেইজের নোটিফিকেশন চেক করছিলো। এক কাস্টমারের সাথে কথা বলা শেষে অর্ডার কনফার্ম হলে নাম ঠিকানা কপি করে লিখে রাখে প্যাডে। এই স্লিপটাই প্রোডাক্টের ব্যাগে স্ট্যাপলার করে পাঠানো হবে তাদের ঠিকানায়। তবে ইদানীং টুম্পার পরামর্শে সেগুলোকে কিপ নোটে সেইভ করে রাখে মীরা। ওর পরামর্শ হলো এই কাস্টোমার গুলোকে একমাস পরে ফোন দিয়ে ড্রেসের ব্যাপারে মতামত জানবো আমরা। তাদের রিভিউ ও জানা হবে, একটা ভালো সম্পর্ক ও তৈরী হবে পেইজ আর কাস্টমারের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমার রিপিট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। ওর কথাটা হালকা ভাবে নিলেও পরে কাজে এসেছিলো। ইতিমধ্যে একটা ফেসবুক কমিউনিটি তৈরী হয়ে গিয়েছে ওদের বিজনেস পেইজের নামে। যারা পেইজ থেকে কেনাকাটা করে তারা রিভিউ দেয় সেখানে৷ আর রিভিউ পোস্ট করলেই পরবর্তী অর্ডারের ডেলিভারি চার্জ ফ্রী করে দেয়া হয়।

এই এক ট্রিক মীরার বিজনেসটা অনলাইন প্লাটফর্মে শক্ত একটা জায়গা তৈরি করে নেয়। শুরুটা কঠিন হলেও ঐ সব রিভিউ দেখে গ্রুপের অনেক মেম্বার অর্ডার করতো। কেও কে পেইজ থেকে ছবি নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করতো ড্রেসের ডিটেইলস জানতে। অনেকে যারা ইতিমধ্যে ড্রেসটা নিয়েছেন তারা মতামত জানাতো। টুম্পার এই এক আইডিয়া ব্যাবসার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো।

নাশতা খাওয়া শেষ হলেও মীরা অবাক হয় টুম্পা এখনো উঠে নি। শরীর খারাপ কিনা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে লক করা। এমনিতে টুম্পা দরজা লক করে না। এ বাড়ির কোন দরজাই রাতে লক করা থাকে না। মীরা উল্টো হাতে ঠকঠক করে বেশ কয়েকবার টোকা দেয়। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে আপা উঠেছি আমি….

ওর ঘুম ভেঙেছে দেখে সেখান থেকে ফিরে আসে ও। দুপুরের রান্নার জোগাড় করে কি একটা কাজে ওর রুমে আসতেই দেখে দরজা তখনও আটকানো। তৎক্ষনাৎ ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে , কিছু হলো কি মেয়েটার?

তরকারির চুলার আঁচ কমিয়ে টুম্পার ঘরে আবারো নক দেয় মীরা।
টুম্পা..
টুম্পা……

: “আপা আমি জেগেই আছি”
: “শরীর খারাপ?
: “গেইট খোল ”

বেশ কিছু সময় পর গেইট খুলে টুম্পা। মলিন মুখ, রাত জাগা চোখ দুটি ফোলা। ওর এ অবস্থা দেখে মীরা জিজ্ঞেস করে –
: ” কি হইছে? বাড়িতে কোন খারাপ খবর?”
না সূচক মাথা নেড়ে নিচে তাকিয়ে থাকে ও।
: ” শরীর খারাপ? ”
আবারো মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দেয় টুম্পা।
অধৈর্য স্বরে মীরা জানতে চায়-
: “তো কি হয়েছে বলবি তো?”
ফ্লোরে বসে পরে কাঁদতে থাকে টুম্পা। মীরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় টুম্পার এমন আচরণে।ওর কাছে বসে মীরা ওর মুখ তুলতে চেষ্টা করে বলে-
: ” কি হয়েছে বল, না বললে বুঝবো কি করে?”
কান্না যেন থামেই না। তখন টুম্পার মীরাদের কাছে আসার মাস ছয়েকও হয় নি। হোম সিকনেস বলে একটা কথা আছে। মীরা প্রাথমিক ভাবে ভেবে নেয় সেটাই হয়তো। ওকে ওর বিছানায় বসিয়ে মীরা ধমকের সুরে বলে-
: ” কাঁদবিই কি শুধু? নাকি বলবিও কিছু? ”
মীরার ধমকে কাজ হয়। টুম্পার কান্নারত কন্ঠে বলে-
: ” ভাইয়া….”
: ” ভাইয়া কি? বকেছে রাজিব তোকে?”
মাথা নেড়ে না বলে টুম্পা। মীরার হাত ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে –
: ” কি হয়েছে বল আমাকে?”
বেশ কিছু সময় নেয় টুম্পা। এ সময়টুকুতে মীরার মাথায় চলতে থাকে জটিল সমীকরণের হিসাব। কয়েকটা সম্ভাব্য উত্তর ওর তৈরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু টুম্পা যা বলেছে তা ওর সমীকরণের যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ এর বাইরের কিছু। নিজের কানকে প্রথমে ভুল মনে করে মীরা। কিন্তু টুম্পা যখন ওর কান্নার কারনের বিশদ ব্যাখ্যা বলতে শুরু করে মীরার মনে হয় পাহাড় থেকে কেও ওকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। কাজের আপা এসেছেন হয়তো। সেখান থেকে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে উঠে গেইট খুলে দেন মীরা৷ তিনি ঘরে ঢুকলে সেখান থেকে টুম্পার ঘরে ঢুকে সাবধানে দরজাটা লক করে দেয় মীরা। বিপদ সংকুল জাহাজের দিশেহারা নাবিকের মতো দেখায় তখন মীরাকে। বিশাল ঝড়ে আছড়ে পরার অবশ্যাম্ভী পরিনতি জেনেও চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করে-
: ” এর আগেও কি এমন হয়েছিল? ”
মাথা নেড়ে না জানায় টুম্পা।
: ” ওর সামনে বলতে পারবি এ কথা?”
মাথা নেড়ে হ্যা বলে ও। কি একটা ভেবে টুম্পাকে কাছে টেনে আদর করে মীরা। বলে-
: ” তোকে আমি শক্ত মেয়ে ভাবতাম, তুই তো বেশ বোকা ”
আরেক দফা কান্না শুরু হয় ওর। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
: ” এত আবেগী হলে জীবণ চলবে না, উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে কারখানায় যা। একটা অর্ডার রিসিভ করেছি আমি, ঠিকানা লেখ আছে গিয়েই পাঠিয়ে দিবি, দুপুরের আগেই যেন পৌঁছে যায় সেটা”

বলেই সেখান থেকে চলে আসে মীরা। ওর কাছে নিজেকে শক্তিশালী পরিচয় দিলেও, তরকারি টা কাজের আপাকে দেখতে বলে নিজের ঘরে ঢুকে সোজা বাথরুমে চলে যায় ও। বেসিনের আয়নাতে চোখ রেখে টুম্পার বলা কথাগুলো মাথাতে গোছায় ও। তারপর হঠাৎ ওর দুচোখ বেয়ে পানির ধারা পরতে থাকে। মুখ চেপে কান্না করে মীরা। কান্নার শব্দ যাতে বাইরে না বের হয় তাই দ্রুত পানির ট্যাপ ছেড়ে খালি বালতি পেতে দেয়।

ওর বিশার গোসল ঘরের মেঝেতে শুয়ে পরে ও। বসে থাকার শক্তি নেই যেন। আজ প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করে মীরা সত্যিই ওকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়াটা অনেক বড় ভুল ছিলো ওর।

কতক্ষণ শুয়ে ছিলো সেভাবে খেয়াল নেই মীরার।
“” গত রাতে ওর এক বন্ধুর বৌভাতের দাওয়াত ছিলো। এর সাথে নতুন বন্ধুত্ব রাজিবের। ব্যাবসা সূত্রে পরিচয়। তাই তাকে চিনে না মীরা। এই প্রথমবার মীরাকে রাজিব সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে নানান ব্যস্ততায় এটেন্ড করা হয় নি ওর নতুন বন্ধু বান্ধবের দাওয়াতে। সত্যি বলতে রাজিবও জোড় করে বলে নি কখনো, মীরারও ইচ্ছে হয় নি সব মিলিয়ে যাওয়া হয় নি এর আগে।

তো মীরা শাড়ি পরে ছিলো, আর রাজিব সুট বুট। যেমন সুন্দরী মীরা, তেমনি রাজপুত্রের মতো রাজিব। দু’জন সে অনুষ্ঠানের শান বাড়িয়েছে যেন। এমন কেও নেই যে ওদের দিকে দেখে নি। অতি নাকউঁচু মানুষটাও আড় চোখে দেখেছে ওদেরকে। রাজিবের তৈরী এ পরিচিত মহলে সবার সুন্দর সুন্দর মন্তব্য আর প্রশংসার বন্যায় ভাসছেন দুজনে। উপস্থিত সকলের মধ্যে এক মহিলা কেমন কন্ঠে যেন রাজিবকে জিজ্ঞেস করলো –
: ” রাজিব উনি তোমার ওয়াইফ?”
রাজিব কিছু একটা বলতে গেলে মীরা রাজিবের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে রাজিবের হাত দু’হাতে চেপে ধরে বলে-
: ” হুম, রাজিব আমার হাসবেন্ড, এবং ওর কোথাও কোন শাখা নেই ”
কথাটা শুনেই অট্টহাস্যে ফেটে পরে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই। মীরার মুখেও চোরা হাসি। এসে অবধি দেখছে এই মহিলার ছোট নাই বড় নাই এর ওর গায়ে ঢলে পরছে, কথা বলছে গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে। মায়ের বয়সী মহিলা রাজিবকে বলছে তুমি করে আর মীরাকে উনি। তাই মহিলাকে একটু শায়েস্তা করবার এ সুযোগটা হাতছাড়া করলো না মীরা।

মহিলা মুখ কেমন করে, হাসিতে যোগ দিলেন। যদিও হাসিটা মেকি ছিলো। তার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক খুব সম্ভবতঃ উনি মহিলার হাসবেন্ড তিনি বললেন-
: ” তোমার ওয়াইফ তো দেখছি যেমন- সুন্দর তেমনি প্রতুৎপন্নমতি, মাশাল্লাহ তোমরা রাজযোটক। দোয়া করি আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুন।

মীরা এ দুটি শব্দ প্রথমবার শুনলো, রাজিবকে কথাটা বলায় রাজিব বললো আগে বাংলার প্রফেসর ছিলেন। এসব ছেড়ে এখন ব্যবসায়ী বনে গেছেন।

সেখানে গিয়ে আরো অনেকের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। আরো দেখা হয় “পলাশ গার্মেন্টস” এর সেবাহানের সাথেও । লোকটার সাথে ঐ মহিলাও ঢলাঢলি করছে। ব্যাপারটা রাজিবকে বললে ও বলে-
: ” এ মহিলা ডেঞ্জারাস জিনিস, বারে যায় নিয়মিত জানো?”
: ” জানবো কি করে, আমি তো তোমার মতো বারে যাই না নিয়মিত , তাই না? ”
কথাটা শুনে চোখমুখ কেমন শক্ত হয়ে যায় রাজিবের। খুব সম্ভবতঃ রাজিব ভাবছে এ খবর মীরা পেলো কোথায়?

মীরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে চলো বর বৌর সাথে ছবি তুলে আসি। কেমন একটা আমতা আমতা ভাব করে মীরার পিছু পিছু গেলো রাজিব। ছবি তোলা শেষ হলে মীরার এক বান্ধবী নায়রার সাথে দেখা হয়। অনেক বছর পর দেখা। এ অনুষ্ঠানের বৌ নায়রার কাজিন হয়। মীরা পরিচয় করিয়ে দেয় রাজিবকে। একটু পর রাজিব বলে-
” তোমরা কথা বলো, আমি আসছি, এক্সকিউজ মি”

মীরা এতদিন পর পরিচিত কাওকে পেয়ে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে। দুজনেই স্কুল ফ্রেন্ড ছিলো।
নায়রা কথা প্রসঙ্গে মীরাকে জিজ্ঞেস করলো –
” আমি সোমার কাছে অনেক আগে শুনেছিলাম তুই নাকি ইন্টার পরীক্ষার আগে পালিয়ে বিয়ে করেছিস, ও ভীষণ দুঃখ করেছিলো। বলেছিলো ছেলে নাকি তোর উপযুক্ত না৷ নোভার ওর বর নিয়ে যা গরিমা, বাব্বাহ্। বর নিয়ে বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা আমার কাছে ফালতু লাগে বুঝলি? ঘরে দুজন চুলাচুলি করে আর ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে – “মেইড ফর ইচ আদারস্”, হুহ্ লেইম পিপল।

মীরা কিঞ্চিৎ অহং এর সুরে বলে-
: ” হুম, যাই বলিস তোদের সবার মধ্যে আমার বরই সবচেয়ে সুন্দর, মাশাল্লাহ” তোদের গেটটুগেদার এর ছবি দেখেছি আমি, লাবিবার সাথে এড আছে আমার। সে সুবাদে দেখেছি।

উত্তরে নায়রা বলে-
: “হুম, তাই তো দেখছি, তোর বর দেখলে ওর দম্ভ ভাঙবে বুঝলি ”

এরপর বেশ কিছু সময় কথা বলে দুজন, সংসার, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। একটা সময় ওর বর ডাকলে চলে যায় নায়রা, ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করে দুজনে। বলে কথা হবে নি ফেসবুকে। ওকে..?

এরপর মীরা রাজিবকে খুঁজতে থাকে৷ শেষে ওকে পায় ড্রিংকস সেকশনে। সেখানে বসে বেশ কয়েক জন ড্রিংস করছে। সাথে রাজিবও।

চোখমুখ শক্ত করে মীরা তাকায় রাজিবের দিকে। রাজিব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত উঠে পরে। মীরা দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে পার্কিং এ অপেক্ষা করে।

রাজিব সুবোধ বালকের মতো বাইক মীরার সামনে দাঁড় করায়। গাড়িতে বসে মীরা রাজিবকে কিছুই বলে না। রাজিব আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে-
: ” সবাই চেপে ধরলো তাই হালকা…”
: “হইছে আর সাধু সাজতে হবে না”
রাগত কন্ঠে বলে মীরা। সে যাত্রায় কিছুই বলে না মীরা। আজ ওর মনটা খুশি। তাই এসব নিয়ে কোন কথা তুললো না। অনেক রাত হওয়ায় মীরা ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে। রাজিব ও ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আসে। মীরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে।

রাজিব ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করলে মীরা ঘুম ঘুম কন্ঠে নিষেধ করে। নিষেধ করা সত্ত্বেও রাজিব গা ঘেঁষে আরো কাছে আসে মীরার। এলোমেলো ভাবে ছুঁয়ে দিতে থাকে ওকে। মীরা রাজিবের হাত আটকে রাখে ওর পেটের কাছে, কিন্তু রাজিব সেখানেও মীরার শরীরকে জাগিয়ে তুলতে তান্ডব শুরু করে।
মীরা ভীষণ রেগে যায় ওর এমন আচরণে। আজ সারাদিন ও দৌড়ের উপর ছিলো। রাজিব জোর করায় দাওয়াতে গিয়েছিলো ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও। সত্যি বলতে মীরা একটু বেশীই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলো।
রাজিব তাই রাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর-ই কি রাজিব….. “”

টুম্পার কন্ঠে সংবিৎ ফিরে ওর। উঠে মুখে পানি দিয়ে বেরুতেই খেয়াল হয় জামাকাপড় সব ভিজা। টুম্পাকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে-
: ” ড্রয়ার থেকে কাপড় দে তো টুম্পা, একেবারে ভিজে গিয়েছি”
টুম্পা কাপড় দিলে মীরা আড়ালে থেকে বলে-
: ” নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পর, আমার আসতে আজকে একটু লেট হবে”

কাপড় বদলে ঘরে ফিরে দেখে টুম্পা বেরিয়ে গেছে। ফোনটা হাতে নেয় মীরা রাজিবকে কল করার উদ্দেশ্যে। একবার রিং হতেই কি একটা ভেবে কেটে দেয় মীরা। ভাবে কথাগুলো ফোনে বলার চেয়ে সামনাসামনি বলাই ভালে হবে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে