Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 268



আলো অন্ধকারে পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১২)

১.
জাফর জানালার কাছে বালিশ নিয়ে উবু হয়ে বই পড়ছেন। বসন্তের এই সকাল বেলাটা বড্ড সুন্দর। সামনের মেহগনি গাছের পাতাগুলো সব কেমন করে ঝরে পড়ছে। বাতাস এলেই বৃষ্টির ফোঁটার মতো হলুদ বাদামি পাতাগুলো ঝরে পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা স্বর্গীয় দৃশ্য। চেয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। এর আগে কখনও এমন করে এইসব দেখা হয়নি। নিজেকে সত্যিই সুখী মনে হয়।

সকালের নাস্তা সেরেছেন কিছুক্ষণ হলো। কাজের মেয়েটা এসে কাটাকুটি শুরু করেছে। দিলশাদ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে নরমাল হবার জন্য রেখে দিয়েছেন। শুক্রবার ছুটির দিন হলেই এখন পোলাও মাংস রান্না হয়। মনের অজান্তে এই একটা দিনের জন্য এখন অপেক্ষা করেন। খেতে খুব ভালো লাগে। অথচ আগে এমন হতো প্রতিদিনই মাংস থাকত, অথবা রিচ ফুড। অরুচি হয়ে গিয়েছিল। এখন খাওয়াটাও একটা ছকে বাঁধা পড়েছে। দিলশাদ হিসেব করে সুনিপুণ গৃহিণীর মতো সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওর হাতে সব ছেড়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত একটা জীবন এখন। আগে নানা দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হতো না। এখন জীবনের চাহিদা কমেছে সাথে দুশ্চিন্তাগুলো। চাহিদাগুলো আবর্জনার মতো ছিল। অপ্রয়োজনীয় সব ব্যাপার জীবন থেকে ছেঁটে ফেললে জীবনটা যে এত স্বস্তির হয় তা আগে বোঝ যায়নি।

ভাবনার এই পর্যায়ে চায়ের কাপ হাতে দিলশাদ রুমে ঢোকেন। একবার গলা বাড়িয়ে দেখেন, তারপর হেসে বলেন, ‘তোমার দেখি বেশ ভালোই গল্প পড়ার নেশা হয়েছে। জহির ছেলেটা তোমার সর্বনাশ করে দিল।’

জাফর উঠে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘জানো দিলশাদ, যখন ইউনিভার্সিটি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন শীর্ষেন্দুর এই ‘পার্থিব’ বইটা সবে বেরিয়েছে। দাম অনেক ছিল। আমি টিউশনের টাকা বাঁচিয়ে এই বইটা কিনেছিলাম। পুরো একটা সপ্তাহ বুঁদ হয়ে শুধু পড়েছিলাম। জীবনবোধের এক অসাধারণ গল্প। আমরা ভাবি জীবনের সবকিছু বোধহয় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু সব যে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আর সব কাজ শেষ করবারও দরকার নেই। প্রতিটি মানুষের জীবন একটা অসমাপ্ত কাহিনী। তাই জীবনপাত করে জীবনের সব অংক মেলানোর কোনো দরকার নেই। জানো, আমাদের যে সবকিছু এক রাতের আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেল তাতে আমার এখন আর কোনো আফসোস নেই। আমি প্রথম দিকে খুব ভাবতাম, কেন এমন হলো। কিছুতেই মানতে পারতাম না। মনে হতো সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমার সব কেড়ে নিলেন। আমি প্যারালাইজড হয়ে কতটা দিন বিছানায় পড়ে রইলাম। মেয়েটা জীবনের শুরুতে এমন করে ঠকে গেল। খুব হতাশ লাগত।
তোমার উপর দিয়ে সব ঝড়ঝাপটা গেল। তারপর একটা সময় যখন সব থিতু হলো তখন আমি দেখলাম আমি অনেক কিছুই ফিরে পেয়েছি। মেয়েটা কেমন লক্ষ্মী হয়েছে, নিজে টিউশন করে করে আজ অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছে এখন। এখনই ভালো ভালো চাকরির অফার পাচ্ছে। আরুশকে নিয়ম করে পড়াত। ছেলেটাও দেখো কী সুন্দর ইউনিভার্সিটিতে ভালো একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছে। তুমি আমাদের সবাইকে কেমন করে আগলে রেখেছ। পরিবারের একটা মায়ার বাঁধন আমি টের পাই। আগের দিন থাকলে এই যে একজন আরেকজনকে পরম মমতায় দেখে রাখা সেটা এমন করে হয়তো হতো না।

দেখো, আমি এখন ছুটির দিনগুলোতে একটু আয়েশ করে গল্পের বই পড়ছি। আগের দিনগুলো থাকলে আমি হয়তো এখন কোনো জাগতিক বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। মানুষের এই জাগতিক ব্যস্ততা যে তার মনের ভালো থাকার উপাদানগুলো কেড়ে নেয় সেটা বুঝতেই পারে না। তাই বলি, আমি সত্যিই পেয়েছি অনেকই, হারিয়েছি কম।’

দিলশাদ তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। একটা ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিলেন যেন। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তুমি একদম আমার মনের কথাটাই বলেছ। ক’টা মাস ধরে আমারও এমন মনে হয়। মেয়েটা একটা ধাক্কা খেয়েছে বটে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে দারুণ করে। এই ধাক্কাটা ওকে সামনের জীবনে চলতে খুব সাহায্য করবে। আমার শখের গহনাগুলো বিক্রি করতে হয়েছে কিন্তু এখন মনে হয় তার বিনিময়ে আমি তোমাদের অনেক কাছে পেয়েছি। এই যে তুমি চাকরির পয়সা বাঁচিয়ে আমার জন্য মাঝে মাঝে শাড়ি নিয়ে আসো এটাতে একটা মায়া আছে, ভালোবাসা আছে। যেটা আমি লাখ তিনেক টাকার হীরের আঙটি কিনে পাইনি। আমাদের জীবন যুদ্ধে তুমি যে অমন চাকরি করতে গিয়েছ সেটা আমাদের সম্মানিত করেছে। নিজের সব ইগোকে গলা চাপা দিয়ে শুধুমাত্র পরিবারের জন্য তুমি যে ভূমিকা রেখেছ, আমরা সবাই সত্যিই আপ্লুত। মনের টান আরও বেড়েছে।’

জাফর মাথা নাড়ে। আজ সকালটা দারুণ একটা আত্ম-উপলব্ধির সকাল হলো।

দিলশাদ আবদারের গলায় বলে, ‘আচ্ছা, শোন না, অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। এবার চলো, সবাই মিলে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি। ট্রেনে যাব, ট্রেনে করে ফিরে আসব। খুব একটা খরচ হবে না। আমি আর আরুশ মিলে হিসেব করেছি। আর নওরিনের মনটা ফ্রেশ হবে। মেয়েটা ইদানিং কথা কম বলে। কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। একটু ঘুরে এলে ওর মন ভালো হবে।’

জাফর মাথা নাড়েন। একটা সময় বছরে নিয়ম করে বিদেশ যেতেন ঘুরতে। কক্সবাজারও যাওয়া হয়েছে, তবে প্লেনে করে। ট্রেনে করে যাওয়াটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।

আগ্রহের সাথে বলেন, ‘চলো ঘুরে আসি। অনেক দিন এক জায়গায় থাকতে থাকতে হাত পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। আচ্ছা একটা কাজ করা যায়, ওই জহির ছেলেটাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই? বেচারার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। কতটা বছর আরুশকে টানা পড়াল। আরুশও ওকে ভীষণ পছন্দ করে।’

দিলশাদ একটু বিরক্ত গলায় বলেন, ‘আমরা ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি সেখানে বাইরের একটা ছেলে থাকা ঠিক হবে? না মানে বলছিলাম মেয়ে তো এখন বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে। এমন সম্পর্কহীন একটা ছেলেকে সাথে করে নিয়ে গেলে নানান জনে নানান কথা বলবে।’

জাফর মুচকি হেসে বলে, ‘সম্পর্ক করে নিলেই হয়। শুনলাম ছেলেটা নাকি ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি হয়ে যাবে। না হলেও একটা ভালো কিছু নিশ্চয়ই করবে। এমন ভালো একটা ছেলে হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে?’

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এমন এতিম একটা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে? নওরিনের সাথে এমন চালচুলোহীন একটা ছেলের বিয়ে কী করে হয়?’

জাফর দার্শনিক গলায় বলেন, ‘আমার কিন্তু একটা সময় সব কিছু ছিল। গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, আত্মীয়স্বজন – কোনো কিছুর কমতি ছিল ন। কিন্তু ভাগ্যের ফের দেখো, এই আমার আজ কিছুই নেই। কাছের মানুষেরাও আজ দূরে। এক রাতের আগুনে সব শেষ হয়ে যায়। তাই বলে কি তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছ? ছেলেটা ভালো, ওর জাগতিক ঐশ্বর্য না থাকতে পারে, কিন্তু মনের ঐশ্বর্য আছে। ভেবে দেখতে পারো, অবশ্য নওরিন কী ভাবছে সেটাও জানা দরকার।’

দিলশাদ একটু থমকান। এভাবে তো ভেবে দেখা হয়নি। বিপদে কাছের মানুষকে কাছে পাননি। নিজেরাই নিজেদের যুদ্ধটা করে গেছেন। জহির ছেলেটা সেই প্রথম থেকেই ওদের সাথে। কোনোদিন একটা উল্টোপাল্টা কিছু করেনি। নওরিনও হয়তো ওকে পছন্দ করে। মানুষের আসলে কী চাই? একটা ভালো মানুষ।

ভাবনার এই পর্যায়ে আরুশ রুমে ঢোকে। অভিযোগের গলায় বলে, ‘আম্মু, আপু বলছে কক্সবাজার যাবে না।’

দিলশাদ ঘুরে তাকান। ছেলেটা কত লম্বা হয়ে গেছে। এখনই পাঁচ ফুট আট। কী সুন্দর গায়ের রঙ, চোখ দুটো ভাসা ভাসা। মুগ্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাই? দাঁড়া, আমি রাজি করাব তোর আপুকে।’

আরুশ এবার বাবার পাশে গিয়ে বসে।

দিলশাদ উঠে গিয়ে নওরিনের রুমে যান। দরজার কাছে এসে থমকে তাকান। জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে নওরিন। হাতে একটা বই। মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। কী বিষণ্ণ মুখ! দিলশাদের বুক ধক করে ওঠে। মেয়েটা আবার কষ্ট পেলো না তো?

পায়ে পায়ে এগিয়ে যান। কাছে যেতেই ও মুখ তোলে। দিলশাদ নরম গলায় বলে, ‘কী পড়ছিস?’

নওরিন হাসার চেষ্টা করে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘জীবনানন্দের কবিতা।’

দিলশাদ আগ্রহের গলায় বলে, ‘আমাকে শোনাবি একটু?’

নওরিন ঘাড় কাৎ করে বলে, ‘আচ্ছা। এটা জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটা।’

দিলশাদ একটু চমকায়। কিন্তু ওকে বুঝতে দেয় না।

নওরিন বিষাদ গলায় পড়তে শুরু করে –

“আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক”

পড়তে পড়তে নওরিনের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে৷ দিলশাদ মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেই ও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা শুন্যতা দিনে দিনে গ্রাস করে নিয়েছে। যে মানুষটাকে এত করে চায় সেই মানুষটার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস নেই। অতীতের অন্ধকার বার বার পিছু টানে, কিছুতেই যে সেই মানুষটার কাছে পৌঁছুতে দেয় না।

২.
আজ দুপুরের আগেই ক্লাশ শেষ হয়ে গেল। অথচ আজ সারাদিন ক্লাশ হবার কথা। ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র শিক্ষক মারা যাওয়াতে হঠাৎ করেই সব ছুটি হয়ে গেল। নওরিন ক্লাশ ছেড়ে রাস্তায় নামে। বসন্তের একটা মাতাল বাতাস এসে ওর কপালের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। মনটা কেমন হু হু করে ওঠে। আজ কতটা দিন জহিরের সংগে কথা হয় না৷ নিজের মনের সংগোপন এই বেদনা যে কাউকে বলবার না। নিজের সেই বিষাক্ত ইতিহাস নিয়ে ও কী করে জহিরের সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়ায়? সেদিন বাসায় একগাদা মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। মাস্টার্সের নাকি রেজাল্ট হয়েছে। অনার্সের মতো এবারও ফার্স্ট হয়েছে। নওরিন সেদিন শুকনো মুখে অভিনন্দন জানিয়েছিল শুধু। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অনেকগুলো সাদা চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে সামনে দাঁড়াতে। কিন্তু সাহস হয়নি। জহিরও কোনোদিন ওর সামনে এসে জোর করে জানতে চাইল না কেন ও দূরে সরে গেল। উলটো জহির নিজেও দূরে দূরেই থাকে। এড়িয়ে চলে।

ভাবতে ভাবতে আনমনে রাস্তার মাঝখানে চলে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে সাইকেলের ট্রিং ট্রিং শব্দে মনের অজান্তেই লাফ দিয়ে সরে যায়। আর তখনই টের পায় স্যান্ডেলের ফিতে ছিড়েছে। বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যেতেই অবাক হয়ে দেখে জহির সাইকেল থামিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

জহির তাড়াহুড়ো করে নীলক্ষেতে যাচ্ছিল। কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করতে হবে। আর হঠাৎ করেই এই বিপত্তি। কিন্তু এমন করে নওরিনের সাথেই আবার একই ঘটনা ঘটবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি।

ও সাইকেল নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আজকেও স্যান্ডেলের ফিতে ছিড়ে গেছে? সাইকেলে উঠে বসুন।’

নওরিন আজ আর দ্বিরুক্ত করে না। সাইকেলের পেছনে উঠে বসতেই জহির প্যাডেলে চাপ দেয়। কোথা থেকে একটা বাতাস এসে জহিরের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল। জহির টের পায়, বহুদিন পর বুকের কোথাও পুড়তে থাকা জায়গাটায় ঠান্ডা জল পড়ল।

নিমাই দাদাকে ইউনিভার্সিটির গেটেই পাওয়া যায়। ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আজকেও বুঝি ফিতে ছিড়ে গেল?’

জহির হাসে, তারপর বলে ভালো করে সেলাই করে দাও নিমাই দাদা, আর যেন কখনো না ছোটে। তুমি বাঁধনগুলো এত আলগা করে দাও কেন, শক্ত করে বাঁধতে পারো না?’

নিমাই ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘এবার এমন বাঁধন বাধব আর কোনদিন ছুটবে না।’

নওরিন মাথা নিচু করে। একটা ভালো লাগা ওকে ঘিরে যাচ্ছিল। একটা মানুষকে এত ভালো লাগে সেটা সেই মানুষকে বলতে না পারার কষ্ট যে কত বড় শুধু ওই জানে।

জুতো মেরামতি শেষে নওরিন টাকা বের করতেই জহির বাধা দিয়ে বলে, ‘আজকে না হয় আমিই দিলাম।’

নওরিন কিছু বলে না। দাম মিটিয়ে ওরা একটু এগোতেই, নওরিন বলে, ‘আমি তাহলে যাই আজ?’

জহির মন খারাপ গলায় বলে, ‘চলে যাবেন? আচ্ছা ঠিক আছে যান। আমার কাছে আপনার একটা জিনিস রয়ে, গিয়েছিল।’

নওরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কী জিনিস?’

জহির ব্যাগ থেকে জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা সমগ্র বের করে বলে, ‘এটা আপনার জন্য কিনেছিলাম কয়েক বছর আগে। কিন্তু দেওয়া হয়নি। আমি প্রতিদিন এটা ব্যাগে নিয়ে ঘুরি। যদি কোনদিন আপনাকে দেবার সুযোগ হয়। কেন যেন আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অথচ আপনি এই পৃথিবীতেই থাকেন। যে পৃথিবীতে আপনি থাকেন সেই পৃথিবীতে আমি আপনাকে খুঁজে পাই না, একটু কাছে পাইনা। নওরিন আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি যেদিন আমার হলে গেলেন আমার সেই জ্বর দেখতে আমার মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে একজন মানুষ হলেও আমার আপন আছে। জানেন তো, এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আপনাকে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। একজন কেউ তো আমায় মায়া করে। কিন্তু সেদিন আপনাদের বাসায় আমি যখন বললাম আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি আপনি খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন। আপনি হয়তো আশা করেননি এমনটা। কী করব বলুন তো? আমাকে ছেড়ে যে সবাই চলে যায়। প্রিয় বাবা মা চলে গিয়েছেন। এখন আপনিও যদি চলে যান আমি বাঁচি কী করে বলুন তো?’

নওরিন কান্না সামলাতে পারে না। ফাল্গুনের এক বুক কেমন করা দুপুরবেলা পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আটকানো গলায় বলে, ‘সেদিন আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। আপনি যখন বললেন বললেন এই পৃথিবীতে আপনার কেউ নেই আমি কান্না আটকাতে পারিনি। ইচ্ছে হয়েছিল আপনাকে ঝাপটে বুকের ভেতর রেখে দেই। কিন্তু আমার যে একটা অন্ধকার অতীত আছে। আমি সেই অতীত নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াতে চাইনি, আপনাকে ঠকাতে চাইনি কোনদিন। একটা ছেলের সাথে আমার প্রেম ছিল, সে আমাকে ঠকিয়েছে। ভীষণভাবে আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল। শরীরের ক্ষুধা মিটিয়ে আমাকে ঠকিয়ে সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। আপনি বলুন, এই অতীত নিয়ে কি করে আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই? ভালোবাসার মানুষের সাথে ছলচাতুরি করা যায়?আমি যে আপনাকে ভালোবাসি।’

জহির এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে আকুল গলায় বলে, ‘ বোকা মেয়ে একটা, এমন করে এতটা বছর কষ্ট চেপে রাখতে আছে? কাউকে ভালোবাসলে শুধু তার ভালোটা ভালবাসতে নেই, তার খামতিগুলো নিয়েও ভালোবাসতে হয়। এই যে তুমি আমার এতিমখানায় বড় হওয়া নিয়ে উল্টো কষ্ট পাচ্ছ, আমার জন্য মায়া হয়েছে এটাই তো ভালোবাসা। তুমি যে এমন কষ্ট পেয়েছ এখন সেটা জেনে আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে বুকে লুকিয়ে রাখি।’

জহির যে মনের অজান্তে ওকে তুমি করে বলছে সেটা বুঝি ও খেয়াল করেনি। কোথাও একটা কোকিল ডেকে ওঠে। তাতে করে পুরো পৃথিবীর সব ফুলের বাগানে ফুল ফোটে, বসন্তের আগমনের ঘোষণা দেয়।

ঢাকা শহরের রাজপথে একটা মেয়ে একটা ছেলের সাইকেলের পেছনে বসে ঘুরতে থাকে। আর একটা হাত দিয়ে পরম মমতায় ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে রাখে।

পথচলতি যারাই ওদের দেখে তারাই কেমন থমকে যায়, বুকের ভেতর কেমন একটা নরম মায়া টের পায়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই দৃশ্য দেখলে আপনাদেরও চোখে জল আসবে।

সমাপ্ত

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-১১

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১১)

১.
নভেম্বর মাসে এমন ঘোর বর্ষাকালের মতো বৃষ্টি নামবে কে জানত। জহির তীরবেগে সাইকেল চালায়, তাও শেষ রক্ষা হয় না। নওরিনের বাসায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভিজে এক সা হয়ে যায়। প্রথম এই বাসায় যখন আসে তখন নওরিনের আম্মুকে দেখে ও খুব অবাক হয়েছিল। ওদের পুরো পরিবারটা যেন এই বাসার সাথে যায় না। মনে হচ্ছিল একটা গোলাপ বাগান ভুল করে রুক্ষ মরুভূমিতে এসে পড়েছে। বোঝায় যায় এরা একসময় ভীষণ বড়োলোক ছিল। যেদিনই পড়াতে আসে সেদিনই নওরিনের আম্মু যত্নের সাথে নাস্তা দেন। কথাবার্তাও মার্জিত। নওরিনের ভাই আরুশ ছেলেটাও খুব ভালো। দারুণ ইংরেজি বলে।

সাইকেলটা গ্যারেজে রেখে ও এবার ভেজা চুলে আঙুল চালায়। এহ, ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে। শার্টটাও ভিজে গেছে। এ অবস্থায় উপরে যায় কী করে?
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শরীর শুকানোর চেষ্টা করে। তারপর লিফট চেপে নওরিনদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে কলিং বেল চাপে।

নওরিনের আজ হঠাৎ করেই তলপেটে খুব ব্যথা করছিল। অনেক দিন পর ব্যথাটা ফিরে এল। পিরিয়ড হবার আগে ব্যথা হয় কিন্তু এতটা হয় না যেটা আজ হচ্ছে। হঠাৎ করেই ওর অনেক দিন আগের সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। আহনাফের দেওয়া ওষুধ খাবার পর এমন তীব্র পেট ব্যথা হয়েছিল। ভাবতেই একবার গা শিউরে ওঠে। নওরিন হাঁটু দুটো পেটের কাছে ভাঁজ করে কুঁজো হয়ে শুয়ে পড়ে। বাইরে আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে।

ঠিক এমন সময় কলিং বেল বাজার শব্দ হয়। নওরিন বিরক্ত হতে যেয়েও থমকায়। জহির ভাই আসার কথা। ইশ, ও একদমই ভুলে গিয়েছিল। কোনোমতে শরীরটা টেনে ওঠে। তারপর ঠোঁট চেপে ব্যথাটা সামলায়। দরজা খুলেতেই অবাক চোখে চেয়ে দেখে জহির ভাই কাকভেজা।
ও চঞ্চল গলায় বলে, ‘ইশ! আপনি একদম ভিজে গেছেন। ভেতরে আসুন, আমি একটা টাওয়েল দিচ্ছি।’

জহির একটা অপ্রস্তুত হাসি দেয়। সোফায় বসতে যেয়েও বসে না, ভিজে যাবে। একটু পর নওরিন একটা শুকনো টাওয়েল দিতেই জহির ভালো করে মাথা মুছে ফেলে। তারপর গলা, ঘাড় মুছে টাওয়েলটা ফেরত দিতেই নওরিন দুঃখিত গলায় বলে, ‘আপনাকে বলতে ভুলেই গেছিলাম আরুশ আজ বাসায় নেই। হঠাৎ ওকে নিয়ে আম্মু ডাক্তারের কাছে গেছে। আপনি বসুন একটু। চা খাবেন তো?’

জহির মাথা নাড়ে, ‘চা খাব।’

নওরিন রান্নাঘরে যেয়ে চুলো জ্বালে। তারপর হাড়িতে পানি চাপিয়ে চুলার আগুন বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত হাতে চা পাতা, চিনি আর গুড়ো দুধের কাচের বয়ামগুলো নিচে নামায়। কেমন টগবগ করে পানি ফুটছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা কথা মনে হয়। আর সেটা মনে হতেই একটা অস্বস্তি ওকে ঘিরে ধরে। বাসায় কেউ নেই। সেদিনও আহনাফের বাসায় কেউ ছিল না। আর ও ওকে….। কথাটা মনে হতেই ওর পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। একটা ভয়, আতংক ওকে গ্রাস করতে থাকে। চুলোয় পানি টগবগিয়ে ফুটছে। সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।

নওরিন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বেডরুমে যায়, তারপর দরজা বন্ধ করে থরথর করে কাঁপতে থাকে। একটা সময় দরজায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে, হাঁটু দুটো পায়ের কাছে ভাঁজ করে নিয়ে আসে৷ বাইরে সশব্দে বাজ পড়তেই ও চমকে ওঠে দু হাঁটুতে মুখ ঢাকে।

জহির ভ্রু কুঁচকে ভাবে, চা বানাতে এতক্ষণ লাগে! একবার গলাখাঁকারি দিয়ে নওরিনের নাম ধরে ডাকে। কিন্তু কোন সাড়া মেলে না। কোনো ঝামেলা হলো না তো?

কথাটা মনে হতেই জহির উঠে দাঁড়ায়, তারপর দূর থেকে রান্নাঘরে একবার উঁকি দেয়। কেউ নেই! উলটো একটা পোড়া গন্ধ আসছে। ধক করে ওঠে বুকটা। দৌড়ে ও রান্নাঘরে গিয়ে দেখে চুলোয় একটা হাড়ির পানি শুকিয়ে পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। দ্রুত ও চুলোটা বন্ধ করে। তারপর বেরিয়ে এসে উঁচু গলায় ডাকে, ‘নওরিন, তুমি ঠিক আছ তো?’

আশেপাশে তাকাতেই একটা রুমের দরজা বন্ধ দেখতে পায়। কী মনে হতে ও দরজায় একটা টোকা দেয়, ‘নওরিন, তুমি ভেতরে? ঠিক আছ তো?’

নওরিন মুখ নিচু করে বসেছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা দেবার সাথে নিজের নাম শুনে চমকে ওঠে। জহির ভাইও আহনাফের মতো!!

জহির আবার ডাকতে যেয়ে থমকে যায়। হঠাৎ করেই ওর একটা কথা মনে হয়, মেয়েটা বাসায় একা। আচ্ছা মেয়েটা ওকে ভয় পেয়ে বেডরুমে দরজা বন্ধ করে বসে রয়নি তো? কথাটা মনে হতেই নিজের গালে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করে। এই সামন্য জ্ঞানটুকু ওর নেই কেন? ও এবার দ্রুত বাসা থেকে বের হয়। আসার সময় দরজার অটোলক টেনে বের হয়ে পড়ে। তারপর নওরিনকে একটা মেসেজ করে, ‘আমি চলে যাচ্ছি। রান্নাঘরে হাড়িটা পুড়ে গেছে। আমি সরি, বুঝতে পারিনি তুমি ভয় পাচ্ছিলে। বাসায় কেউ নেই জেনেও আমার ভেতরে যাওয়া উচিত হয়নি।’

মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ হতেই নওরিন মুখ তোলে। বাইরের ঘরে থেকে কোনো শব্দ আসছে না। জহির কি এখনও ওঁত পেতে বসে আছে? কথাটা মনে হতেই শিউরে ওঠে। আম্মুকে একবার ফোন দেবে? কথাটা মনে হতেই হামাগুড়ি দিয়ে উঠে যেয়ে মোবাইলটা হাতে নেয়। মোবাইলটা খুলতেই দেখে জহিরের মেসেজ। মেসেজটা পড়ে, পড়তেই থাকে। চোখ ভিজে আসে নওরিনের। একটা অনুশোচনা ঘিরে ধরতে থাকে। ছি:! কী ভুল ভাবনা ও ভাবছিল এতক্ষণ! মনটা কদর্য হয়ে গেছে।

ঠিক এমন সময় বাইরে কলিংবেলের শব্দ হয়। নওরিন দ্রুত চোখমুখ মুছে বেডরুমের দরজা খুলতে খুলতেই আরেকবার কলিংবেল বেজে ওঠে।

নওরিন দরজা খুলতেই আরুশকে নিয়ে দিলশাদ ভেতরে ঢোকেন। তারপর বিরক্ত গলায় বলেন, ‘কী রে, এতক্ষণ লাগল দরজা খুলতে? জহির ছেলেটাকে দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। ও কি বাসায় এসেছিল?’

নওরিন নিচু গলায় বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, এসেছিল। আরুশ নেই শুনে চলে গেল।’

দিলশাদ অবাক গলায় বলে, ‘ওকে এই বৃষ্টির মধ্যে চলে যেতে দিলি? বসতে বলতি। আশ্চর্য মানুষ তো তুই। দিন দিন বড়ো হচ্ছিস আর ভদ্রতা জ্ঞান কমছে।’

আম্মুর এই বকাটা কেন যেন খুব ভালো লাগতে থাকে নওরিনের। সেই সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল চালিয়ে চলে যাওয়া ছেলেটার জন্য বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা মায়া হতে থাকে। ঠিক এমন করে আর কারও জন্য কখনও মায়া হয়নি।

পরের দু’দিন ও কিছুতেই জহিরকে খুঁজে পায় না। লাইব্রেরির সেই সিটটা খালিই পড়ে থাকে। নওরিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বসে থাকে। একবার মনে হয় ফোন দেই, কিন্তু সেদিনের ওর অমন নিচু মনের চিন্তার জন্য একটা সংকোচ হতে থাকে। কিন্তু তৃতীয় দিনও যখন জহিরের দেখা পায় না তখন বাধ্য হয়েই ও ফোন দেয়৷

ওপাশ থেকে জহিরের দূর্বল গলা পাওয়া যায়, ‘কেমন আছেন আপনি? ভালো তো?’

নওরিন উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনার কী হয়েছে? এই ক’দিন ক্যাম্পাসে আসেননি কেন?’

জহির একটা কাশি দিয়ে বলে, ‘আপনাদের বাসা থেকে আসার পর থেকেই ভীষণ জ্বরে পড়লাম। সেইসাথে কাশি। ভালো হলেই আরুশকে পড়াতে যাব।’

নওরিন অনুশোচনায় মরে যেতে থাকে। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেই এমন হলো। ও নরম গলায় বলে, ‘আপনি কোন হলে থাকেন? আমি একটু আসি? নামতে পারবেন?’

জহির হলের নামটা বলতেই নওরিন আর এক মুহুর্ত দেরি করে না। একটা রিক্সা নিয়ে চলে যায় ওর হলে। কিন্তু কাছে এসেই থমকে দাঁড়ায়। এর আগে কখনও ছেলেদের হলে আসেনি। ও জড়তা নিয়ে ফোন দিতেই জহির বলে, ‘আপনি ওয়েটিং রুমে একটু বসুন, আমি নামছি।’

একটু পর জহির আসে। গালে ক’দিনের না কামানো দাড়ি, গায়ে একটা কালো শাল পেঁচানো। কাছে আসতেই ও উঠে দাঁড়ায়, নির্নিমেষ চেয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বুকের ভেতর আবেগের ঢেউটা সামলায়। নরম গলায় বলে, ‘আমার জন্য আপনার এমন জ্বর হলো। সরি।’

জহির তাকিয়ে দেখে পরির মতো একটা মেয়ে কী একটা আকুলতা নিয়ে ওর মুখের পানে তাকিয়ে আছে। ও লজ্জিত গলায় বলে, ‘আরে না, আপনি সরি হবেন কেন। ওইদিন আমিই বোকার মতো কাজ করেছি। তবে আপনার কাছে কিন্তু এক কাপ চা পাওনা।’

নওরিন ফিক করে হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘আপনি একটু কষ্ট করে হেঁটে ওই চায়ের দোকানটায় যেতে পারবেন? একটু আদা লেবু চা খেলে ভালো লাগত।’

জহির উঠে দাঁড়ায়, ‘চলুন, আমারও খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল। আপনি এসে ভালো হয়েছে।’

নওরিন ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি সুস্থ হয়ে উঠলে আপনার সাইকেলে করে একদিন আমাকে ঘোরাবেন?’

জহির হাসে, ‘আচ্ছা। আবার কখনও আপনার পায়ের স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গেলে আমাকে ফোন দেবেন। সেদিন আপনাকে সাইকেলে উঠিয়ে নিমাইয়ের কাছে নিয়ে যাব।’

নওরিন এবার হাসে, ‘তাহলে তো একদিন ইচ্ছে করেই জুতোর ফিতে ছিড়তে হয়। আচ্ছা, আপনি আমাকে জীবনানন্দের একটা কবিতার বই কিনে দিয়েন তো।’

জহির মাথা নাড়ে। কেন যেন ওর খুব ভালো লাগছে আজ।

নভেম্বরের মাসের মাঝামাঝি এক সকালে পিঠে নরম রোদ্দুর মেখে ওরা চায়ে চুমুক দিতে থাকে। না, তেমন করে আর কোনো কথা হয় না। জহির টের পায় ওর জ্বরটা সেরে যাচ্ছে, সেটা আদা চায়ের কারণে নাকি নওরিন এমন করে পাশে বসে থাকাতে সেটা ঠিক বোঝা যায় না। আর নওরিনের মনে হয়, অনেক দিন পর একটা অসুখ সারল ওর। আহনাফের কারণে যে বিশ্বাস একবার ভঙ্গ হয়েছিল সেই বিশ্বাসটা আজ ও জহিরের কারণে আবার নতুন করে ফিরে পেল। পৃথিবীতে সব মানুষ পশু না, কিছু মানুষ সত্যিকারেরই মানুষ।

২.
আরুশ রেজাল্ট কার্ড হাতে হতভম্ব হয়ে বসে আছে। বিলকিস ম্যাডাম যখন প্রথম দশজনের পরই ওর নাম ধরে ডাকল তখনও ও বসে ছিল। পরে নিলয়ের কনুইয়ের খোঁচায় ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। ম্যাডাম ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাফ ইয়ারলিতে ভালো করলে তো তুমিই ফার্স্ট হতে। বাসায় ভালো করে পড়বে।’

সেই থেকে রেজাল্ট কার্ড হাতে ও বসে আছে। যে বাংলায় ও গতবার ফেল করেছিল সেই বাংলায় ও সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলোতেও ভালো হয়েছে। ইশ, আম্মু এবার অনেক খুশি হবে। আর আপু? আপু নিশ্চয়ই আজ চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে।

স্কুল ছুটি হতেই ও বেরিয়ে পড়ে। তারপর বাসায় এসে প্রথমে আম্মুর হাতে রেজাল্ট কার্ড দেয়।

দিলশাদ রান্না করছিলেন। আজ আরুশকে স্কুল থেকে আনতে যেতে পারেননি। ওর হাতে রেজাল্ট কার্ড দেখেই বুক ধুকপুক করছে।

তারপর দ্রুত চোখ বোলাতেই থমকে যান। অবিশ্বাসের গলায় বলেন, ‘তুই এগারোতম হয়েছিস? কী করে? গতবার না বাংলায় ফেল করলি?’

কথাটা বলে এবারের বাংলার নম্বর দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান, বিস্মিত গলায় বলেন, ‘তুই বাংলায় ৯১ পেয়েছিস!! জহির ছেলেটা দেখি জাদু জানে।’

দিলশাদ এবার দুই হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। কপালে চুমু খান। ইশ, কী যে ভালো লাগছে! গতবার যখন ফেল করল তখন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আল্লাহ বুঝি শুধু কষ্টই লিখে রেখেছেন কপালে। আজ কোনো কষ্ট নেই।

বিকেলে নওরিন বাসায় ফিরতেই আরুশ চুপিচুপি আপুর কানে কানে বলে, ‘আপুউউউ, আমি বাংলায় একানব্বই পেয়েছি, ক্লাশের সর্বোচ্চ নম্বর এটাই।’

নওরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর চিৎকার করে বলে, ‘কী বললি! তুই সত্যিই বাংলায় এত ভালো করেছিস?’

আরুশ এবার মিটিমিটি হেসে পেছন থেকে রেজাল্ট কার্ড বের করে আপুর হাতে দেয়। এই সময় দিলশাদও নাস্তা নিয়ে রুমে ঢোকেন।

নওরিন রেজাল্ট কার্ড দেখে চিৎকার করে বলে, ‘তুই তো অসম্ভব কাজ করেছিস আরুশ।’

দিলশাদ নাস্তা নামিয়ে বলেন, ‘জহির ছেলেটা খুব ভালো। ওকে একদিন রাতে আমাদের সাথে খেতে বলিস।’

নওরিন কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘আর আমি যে কষ্ট করে ওকে অন্যান্য সাবজেক্ট পড়ালাম তার বুঝি কোনো দাম নেই?’

দিলশাদ এবার হেসে বলেন, ‘আগে তো কোনোদিন ভাইকে নিয়ে পড়াতে বসতি না। সারাক্ষণ নিজের রুমে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকতি। অথচ দেখ, এবার তুই আর জহির ওকে পড়ালি বলেই না ও কত ভালো করল।’

নওরিনের হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়ে যায়। আগে এমনই ছিল। আরুশের জন্য আলাদা করে টিচার রাখা থাকত। ওর জন্য আলাদা। তখন ওর পড়া নিয়ে ও ভাবতই না। কিন্তু এখন তো ওদের আলাদা করে প্রাইভেট টিচার রাখার অত পয়সা নেই। তাই বাধ্য হয়েই নিজে পড়িয়েছে। আর আরুশ এমন ভালো একটা রেজাল্ট করল! এই আনন্দের দেখা ও আগে কখনও পায়নি।

নওরিন আরুশকে কাছে টেনে বলে, ‘এখন তো তুই ক্লাশ নাইনে। এই দুটো বছর ভালো করে পড়তে হবে। তোর ফিজিক্স আর ম্যাথ আমিই পড়াব। অন্য সাবজেক্টে টিচার লাগতে পারে। তুই ভাবিস না, আমিই ব্যবস্থা করব সব।’

দিলশাদ স্নেহের চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কী লক্ষ্মী একটা মেয়ে হয়েছে। অথচ এই মেয়েটা একটা সময় ওই আহনাফের সাথে…। কথাটা ভাবতেই বুক মোচড় দিয়ে ওঠে।

উঠে যাবার সময় বলে, ‘নওরিন, জহিরকে ওর রেজাল্টের কথা জানিয়ে দিস। বড্ড ভালো ছেলে।’

নওরিন বুকের ভেতর একটা মায়া টের পায়। আর সেটা জহিরের জন্য। ওর কথা মনে পড়লেই মন কেমন নরম হয়ে আসে। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই নওরিন থমকে যায়। আচ্ছা, ও যে জহিরের দিকে এমন করে ঝুঁকে পড়ছে সেটা কি ঠিক হচ্ছে? হ্যাঁ, জহিরের চোখেও ও মায়া দেখেছে। কিন্তু জহির যখন জানবে ওর একটা অন্ধকার অতীত আছে তখন কি এই মায়াটা ঘৃণায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে না? সেটা হলে যে ভীষণ কষ্ট পাবে ও। মিছেমিছি কষ্ট পাবার কোনো মানে নেই। নিজের ভালো লাগাটুকু নিয়ে ও দূরে সরে যাবে, মনের দিক থেকে।

ক’দিন পর এক রাতে জহিরকে যখন খেতে বলে, ও উচ্ছ্বসিত হয়ে রাজি হয়। জহির ভাই সেদিন পাঞ্জাবি পরে দাওয়াতে আসে। আরুশের জন্য একটা গল্পের বই উপহার এনে ওর হাতে দেয়, তারপর বলে, ‘স্কুলের পড়ার পাশাপাশি গল্পের বইও পড়তে হবে, বুঝেছ?’

জাফর হেসে বলে, ‘হ্যাঁ জহির, এটা ঠিক বলেছ। আমাদের সময়টাতে তো আমরা গল্পের বইই বেশি পড়তাম। আহা কী নেশা ছিল।’

জহির উৎসাহের সংগে বলে, ‘আংকেল, আপনাকে আমি ভালো ভালো বই এনে দেব।’

জাফর প্রাণ খুলে হাসেন, তারপর বলেন, ‘নিয়ে এসো। এখন তো রাতে সময় পাই। ছুটির দিনগুলোতেও সারাদিনই বিছানায় গড়াগড়ি। বই পড়ার কথা বলে ভালো করেছ। সময়টা কাজে লাগবে।’

আজ টেবিলে ওরা সবাই একসাথে খেতে বসেছে। দিলশাদ পাশ থেকে একটু পোলাও আর মাংস তুলে দিতে দিতে বলে, ‘তোমার বাবা মা, ভাই বোন কারা কারা আছে? এতদিন পড়াতে আসো জানাই হয়নি।’

জহির পোলাও মুখে দিতে দিতে বলে, ‘আমি এতিমখানায় বড়ো হয়েছি। আমার কেউ নেই আন্টি।’

নওরিন ওর উলটো পাশের চেয়ারে বসে খাচ্ছিল। ও আসা অবধি একবারও সামনে যায়নি। এই এখন খেতে বসার আগে হালকা করে একটু কথা হয়েছে। এখন ওর মুখে এই কথাটুকু শুনে ওর হাত থেমে যায়। জহিরের কেউ নেই! এটা তো জানত না ও। সেভাবে কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। একটা কষ্ট টের পায় বুকের ভেতর।

দিলশাদ ব্যথিত গলায় বলে, ‘আহারে! কেউ নেই তোমার! একদম একা তুমি?’

জহির হাসে, ‘এই যে আপনারা আছেন। আমি এজন্যই মানুষের সাথে বেশি করে মিশি। এই পৃথিবীর সবাই আমার আপনজন। আমি হয়তো সেভাবে কারও আপনজন হয়ে উঠতে পারব না। কিন্তু অন্যরা সবাই আমার আপন।’

কথাটা বলে নওরিনের দিকে একবার ও তাকায়। মেয়েটার আজ কী হয়েছে? বাসায় আসা অবধি ওর দিকে তাকায়নি তেমন করে। কথাও বলেনি। কেমন যেন একটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো? বাবা মা সামনে তাই এমন?

নওরিনের কেন যেন কান্না পাচ্ছে। ও প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্না আটকানোর। একটা সময় সেটা না পেরে ও উঠে দাঁড়ায়। দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ও কোনোমতে বলে, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি পরে খাব।’

জহির মন খারাপ করে মুখ নিচু করে খেতে থাকে। নওরিন ওর এতিমখানায় বড় হওয়ার কথা শুনে উঠে চলে গেল? যে মেয়েটা এক বুক মায়া নিয়ে সেদিন জ্বরের সময় ওকে দেখতে গেল সেই মেয়েটা এমন হৃদয়হীন হতে পারে? বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু এটাই হয়তো বাস্তবতা। এতিমখানায় বড়ো হওয়া ছেলেকে মায়া করা যায়, কিন্তু ভালোবাসা যায় না।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-১০

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১০)

১.
জহির মন দিয়ে “সেলিম আল দীনের নাটক ও চরিত্রের মনস্তত্ত্ব” এর উপর শাহাদৎ রুমনের লেখা একটা বই পড়ছিল। ঠিক এমন সময় কেউ এসে পাশে দাঁড়ায়। মুখ তুলতেই অবাক হয়ে দেখে সেই মেয়েটা।

নওরনি একটা চেয়ার টেনে পাশে বসতে বসতে বলে, ‘কেমন আছেন?’

জহির মাথা নেড়ে বলে, ‘ভালো আছি। আপনার জুতো ভালো আছে তো?’

নওরিন আজ রাগ হয় না, ফিক করে হেসে বলে, ‘আমি ভালো আছি, আমার জুতোও ভালো আছে।’

জহির মাথা নেড়ে বলে, ‘বলুন, আজ কোন কবিতা বুঝিয়ে দিতে হবে।’

নওরিন রহস্যের গলায় বলে, ‘পুরো একটা বই বুঝিয়ে দিতে হবে। আমাকে না, আমার ছোট ভাইকে।’

জহির বুঝতে না পেরে বলে, ‘সেটা কী রকম?’

নওরিন ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার ছোট ভাই এতদিন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ত। এবারই প্রথম বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ও আমার মতোই বরাবরই বাংলায় খারাপ। ক্লাশ এইটে অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষায় ফেল করেছে। আপনি তো টিউশন করান, যদি পড়াতেন।’

জহির জিজ্ঞেস করতে যেয়েও করে না, কেন ইংরেজি মিডিয়াম থেকে বাংলা মিডিয়ামে এল। নিশ্চয়ই আর্থিক কোন একটা ব্যাপার।

ও মাথা নেড়ে বলে, ‘এটা তো সুখবর। আসুন মিষ্টি খাই।’

কথা শেষ করেই পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে। নওরিন এই চকলেটটা দেখেছে, দুই টাকা দাম। ও ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই জহির ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘এই চকলেটটা পকেটে রাখি। খুব ক্ষুধা পেলে মাথা ঘোরায়। আমার বিজ্ঞান বিভাগের বন্ধুরা বলেছে ব্রেনে গ্লুকোজের অভাব হলেই নাকি এমন হয়। তার পর থেকে এই চকলেটটা পকেটে রাখি। নিন, মুখ মিঠা করুন।’

নওরিন একবার চকলেটের দিকে তাকায়, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘লাগবে না। আচ্ছা, একটা কথা জানার ছিল। ইয়ে মানে আপনি পড়াতে কত করে নেন?’

জহির ওর বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নেয়। চকলেট পকেটে পুরতে পুরতে বলে, ‘শ্রেণিভেদে আমার সম্মানী আলাদা আলাদ হয়।’

নওরিন ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘সেটা কী রকম?’

জহির একটু ঝুঁকে এসে বলে, ‘ধরুন, শিল্পপতি অথবা বড়ো সরকারি কর্মকর্তা যাদের অবস্থান অভিজাত এলাকায়, তাদের জন্য উঁচু দর হাঁকি। আবার মধ্যবিত্তের জন্য আরেকরকম। আর যারা একেবারেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে তাদের কাছ থেকে না নেবার চেষ্টা করি। আমি নিজেও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ তাই চাইলেও ওদের সবাইকে ফ্রি তে পড়াতে পারিনা। আপনি যে শ্রেণীতে পড়েন সেভাবেই আমার পড়ানোর সম্মানীটুকু দেবেন।’

নওরিন অস্ফুটে বলে, ‘আমাদেরও খুব বেশি একটা সামর্থ্য নেই। আমি একটা টিউশন পেয়েছি তাই সাহস করলাম আমার ভাই আরুশের জন্য একজন শিক্ষক রাখতে। অন্য বিষয়গুলো আমিই দেখিয়ে দেই। কিন্তু বাংলাতে এসেই গোলমাল হয়ে যায়।’

জহিরের মন খারাপ হয়ে যায়। কিছুটা হয়তো আঁচ করতে পারে কেন ওর ভাইকে হঠাৎ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছাড়িয়ে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করাল।

ও গাঢ় গলায় বলে, ‘আপনি ভাববেন না। আমি আপনার সব গোলমাল ঠিক করে দেব।’

নওরিন কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর বিদায় নেবার গলায় বলে, ‘এই যে এটা আমাদের বাসার ঠিকানা। আর এটা আমার ফোন নম্বর। আপনি কাল থেকে আসবেন?’

জহির ওর ফোন নম্বর সেভ করে বলে, ‘হ্যাঁ, কাল বিকেলে আসব। আপনি থাকবেন তো?’

নওরিন মাথা চুলকে অসহায় গলায় বলে, ‘এই রে, ঝামেলা হয়ে গেল। আমার তো কাল টিউশনে যেতে হবে। আচ্ছা আমি আম্মুকে বলে যাব, সমস্যা হবে না।’

কথাটা বলে নওরিনের হঠাৎ করে মনে হয় আম্মুকে তো কিছু বলা হয়নি। ভেবেছিল টিউশনের বেতন পেয়ে তারপর বলবে। নাহ এবার আম্মুকে সব খুলে বলতেই হবে, আর দেরি করা যাবে না।

নওরিন উঠতে উঠতে বলে, ‘আপনি বেরোবেন না?’

জহির হঠাৎ করেই বইটা বন্ধ করে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো কথা বলেছেন। আমার একটা জায়গায় যেতে হবে, খুব জরুরী। চলুন আমিও নামছি।’

নামতে নামতে নওরিন হালকা গলায় বলে, ‘কোন সমস্যা হয়েছে? বললেন যে খুব জরুরী?’

জহির গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনার আমার জুতোর কুশলী কারিগর নাকি খুব অসুস্থ। যাই দেখে আসি, আর কয়টা টাকা দিয়ে আসি।’

নওরিন অবাক গলায় বলে, ‘আপনি সেই নিমাই মুচীকে দেখতে যাচ্ছেন?’

জহির মাথা নাড়ে, তারপর সাইকেলে উঠে ওর দিকে হাত নেড়ে জোর প্যাডেল চেপে রাস্তায় মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে থাকে। নওরিন সেই হারিয়ে যাওয়া ভীড়ের ভেতর নীল শার্ট পরা অদ্ভুত ছেলেটাকে খুঁজতে থাকে।

নওরিন বাসায় ফিরতেই দেখে আম্মু মন খারাপ করে জানালার পাশে বসে আছে। আম্মু আগে কত সুন্দর পরিপাটি হয়ে থাকত। এখন গায়ের জামাটা এলোমেলো হয়ে আছে। চুলগুলো ঠিক করে সেট করা নেই। আম্মুকে কখনও ও এলোমেলো দেখেনি। কিন্তু দিন দিন সব আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর্থিক সংগতি ওদের সবকিছু এলোমেলো করে দিল।

আম্মু ওকে দেখতে পেতেই আকুল গলায় বলে, ‘নওরিন, তুই এসেছিস! আচ্ছা, আরুশ যে বাংলায় ফেল করেছে তুই জানিস?’

নওরিন মনে মনে থমকায়। আম্মু জেনে গেছে? ও সামলে নেবার গলায় বলে, ‘আম্মু, এটা কোনো ব্যাপার না। ও তো সবে নতুন একটা স্কুলে এল। আর বাংলায় আমিও দূর্বল ছিলাম তো। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ওর জন্য একজন বাংলার টিচার ঠিক করেছি। উনি কাল বিকেল থেকে আসবেন।’

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘টিচার রেখেছিস? মাসে তো অনেকগুলো টাকা যাবে।’

নওরিন সান্ত্বনা দেবার গলায় বলে, ‘ওর টিউশনের বেতন আমি দিয়ে দেব।’

দিলশাদ থমকানো গলায় বলে, ‘তুই দিবি কী করে?’

নওরিন এবার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আগে বলো তুমি রাগ করবে না?’

দিলশাদ নরম গলায় বলে, ‘আচ্ছা, রাগ করব না। বল তো এবার।’

নওরিন নিচু গলায় বলে, ‘আম্মু, আমি একটা টিউশন পেয়েছি। আমাদের এই বাসা থেকে কাছেই। কাল বিকেল থেকে পড়াতে যাব। জানো ওরা কত দেবে? বিশ হাজার টাকা!’

দিলশাদ কেমন হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকেন। নওরিন টিউশনি করাবে! ওদের আদরের মেয়ে সংসারের খরচ চালাতে টিউশনি করাতে যাবে? কষ্টে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। যে মেয়েকে এত আদরে এত যত্নে বড়ো করেছেন আজ তাকে এমন জীবন যুদ্ধে নামতে হলো?

চোখ ভিজে আসে। ধরা গলায় বলেন, ‘মাগো, আমাদের ক্ষমা করে দিস। আমাদের জন্য তোকে এমন টিউশনি করতে হচ্ছে।’

নওরিন এবার কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘আম্মু, টিউশনি করা খারাপ কিছু না। আমার ইউনিভার্সিটির অনেক ছেলেমেয়েই টিউশনি করে মাস খরচ চালায়। অনেকের চেয়ে আমরা এখনও অনেক ভালো আছি। আসলে এতদিন যে আভিজাত্য আমরা ভোগ করেছি সেখান থেকে এখন এই পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। না হলে কিন্তু কখনোই জীবনটা এমন করে বুঝতে পারতাম না। জানো মা, যেদিন টিউশনটা পেলাম সেদিনই বাবার চাকরি হলো। তুমি খেয়াল করেছ কি-না জানি না, বাবার চোখেমুখে একটা যুদ্ধজয়ের আনন্দ ছিল। আমারও সেদিন আনন্দ হয়েছিল খুব। আরুশের জন্য একজন টিচার রাখতে পারব, এটা খুব স্বস্তি দিয়েছিল। এই যে আমরা পরিবারের সবাই একসাথে যুদ্ধটা করছি তাতে কিন্তু দারুণ একটা তৃপ্তি কাজ করছে। এমন বিপদে না পড়লে কখনও বুঝি এমন করে পরিবারের এই মায়ার বন্ধনগুলো বুঝতেই পারতাম না। ভালোবাসি আম্মু তোমাকে, বাবাকে।’

দিলশাদ আর পারেন না, দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, ‘আমার সোনা মা, আমার জানসোনা। তুই ঠিক বলেছিস। তোর বাবার মতো মানুষ নিজের সব ইগো বিসর্জন দিয়ে শুধু আমাদের জন্যই চাকরি করছে। ভাবতে পারিস একবার? যে মানুষটা একটা সময় ক্ষমতার টেবিলের যেপাশে মালিকপক্ষ বসে সে পাশে ছিল। আজ সেই মানুষটা শুধু আমাদের জন্যই করজোড়ে টেবিলের অন্যপাশটায় কর্মচারীদের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব কষ্ট হয় তোর বাবার জন্য, তোদের জন্য। কিন্তু সেইসাথে এই ঘটনাগুলো সংসারের হারিয়ে যাওয়া মায়ার নতুন করে সন্ধান দিয়ে যায়।’

অনেকদিন পর একটা চেপে রাখা কষ্ট বের হবার পথ পায়। দিলশাদের মন হালকা হয়ে যায়। জীবনের মায়ার স্বাদ যে এত মধুর সেটা আজকের আগে কখনও এমন করে বোঝা হয়নি।

২.
নেস্ট বায়িং হাউজের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এহতেশামুল হক বিরক্তির সংগে সামনে রাখা একটা কোটেশন পেপারের দিকে তাকিয়ে আছেন।

মুখ তুলে ক্ষিপ্ত গলায় বলেন, ‘জাফর সাহেব, আপনি তো দেখি আমাদের বায়িং হাউজের বিজনেসটা আপনার গার্মেন্টস এর মতো ধ্বংস করে দেবেন। আপনাকে না দুইটা ফ্যাক্টরির নাম বলে দিলাম। ওদের কাছ থেকে এবার টি-শার্ট বানিয়ে নেব। আপনি সেই দু’টো ফ্যাক্টরি বাদ দিয়ে নতুন যে নাম দিয়েছেন তার কোটেশন প্রাইসও তো বেশি।’

জাফর বুঝতে পারছে না ইনি এত ক্ষেপে গেল কেন? ও তো কোম্পানির ভালোর জন্যই এটা করেছে। জাফর বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘স্যার, আপনি যে দু’টো নাম দিয়েছিলেন ওগুলোর কাজের মান অতটা ভালো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি।’

এহতেশামুল মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘আপনি তো সব জানেন। ভাববেন না আপনি এমডি স্যারের কাছের লোক বলে আপনি আমার অর্ডার ভায়োলেট করবেন। যান, এটা ঠিক করে নিয়ে আসুন।’

কথাটা শেষ করে কোটেশন পেপারটা বিরক্তির সাথে ঠেলে দেন।

জাফর একটা রাগ টের পায়। এই লোকটা সেই প্রথম থেকেই ওকে সহ্য করতে পারে না। এই যে এতক্ষণ ধরে রুমে এসেছে একবারও বসতে বলেনি। ইচ্ছে করেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জীবনে কখনও এমন হয়নি যে কারও সামনে এমন কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। উলটো সবাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। দিন কেমন করে পালটে যায়!

জাফর অপমানটা হজম করে। রাগ করলে যে চলবে না। এই চাকরিটা যে অনেক মূল্যবান এখন।
কাগজটা নিয়ে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে যেয়ে বসে। তারপর ওর টিমের একটা ছেলেকে ডেকে বলে, ‘সুমন, আগের কোটেশনটাই দাও। স্যার তাই চাচ্ছেন।’

সুমন ছেলেটা অনেকদিন ধরেই এই অফিসে আছে। জাফর নামে এই মানুষটাকে ও চেনে। কাজের সূত্রে এর আগে এক দু’বার ওনার গার্মেন্টসে যেতে হয়েছিল। এমন শিল্পপতি একজন মানুষ এখন এখানে চাকরি করছে, এটা ভাবতেই মায়া হয়।

সুমন বিনয়ের সংগে বলে, ‘স্যার, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।’

বিকেলে যখন এমডি এর সাথে মিটিং শুরু হয় তখন তামজিদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এহতেশাম সাহেব, এই ফ্যাক্টরি থেকেই কাজ করাবেন এবার? কোন ঝামেলা নেই তো?’

এহতেশাম তেলতেলে গলায় বলে, ‘না, স্যার কোনো ঝামেলা নেই।’

তানজিম এবার জাফরের দিকে ফিরে বলেন, ‘জাফর ভাই, আপনার কী মত?’

জাফর একবার এহতেশামের দিকে তাকায়, তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘স্যার, এই দুটো ফ্যাক্টরি সবচেয়ে কম প্রাইস কোটেশন করেছে, কিন্তু আমি জানি এদের কাজের মান ভালো না। এর নিচে যে দুটো ফ্যাক্টরি আছে ওরা এক সেন্ট বেশি দিলেও ওদের কাজের মান অনেক ভালো৷ আর আমি চেষ্টা করলে এই এক সেন্টও কমাতে পারব। কারণ ওরা যে ফ্যাক্টরি ওভারহেডের হিসেব দিয়েছে ওখানে ইচ্ছে করলেই কমানো যাবে।’

তানজিম মনোযোগ দিয়ে সবগুলো কোটেশন দেখে, তারপর বলে, ‘আমারও তাই মনে হয়। জাফর ভাই, আপনি ওদের সাথে বসে ওই এক সেন্ট কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। এই দায়িত্ব আমি আপনাকেই দিলাম। ফ্যাক্টরির ফাঁকফোকর আপনিই ভালো জানেন।’

এহতেশামুল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে জাফরের দিকে তাকায়। এই লোকটা ওর সব প্ল্যান ভেস্তে দিল। আগের দু’টো ফ্যাক্টরি ওর আত্মীয়ের ছিল। ওরা ভালো একটা কমিশনও দিত ওকে। এই লোকটার জন্য পারা গেল না।

মিটিং শেষে সবাই চলে গেলে তানজিম অভিযোগের সুরে বলে, ‘জাফর ভাই আপনি আমাকে স্যার কেন বলেন?’

জাফর এবার স্নেহের সুরে বলে, ‘চাকরির পেশাদারিত্বটা আমি মেনে চলি। যে সম্বোধন তোমার শোনা উচিত সেটাই বলি। খুব ভালো কাজ করেছ আজ। প্রথমে যে দুটো ফ্যাক্টরির নাম ছিল, ওদের কাজের মান ভালো না।’

তানজিম হেসে বলে, ‘জাফর ভাই আমি সব জানতাম। আমার কাছে একটা খবর আছে, এই ফ্যাক্টরি দুটো এহতেশামুল হকের আত্মীয়দের। তাই উনি চাচ্ছিলেন ওরা কাজ পাক। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জাফর ভাই। আপনি তখন বলাতে সিদ্ধান্ত নিতে আমার সুবিধা হয়েছে। আপনি থাকলে আমি অনেক ভরসা পাই। কিন্তু আপনাকে যে সম্মান দেওয়ার কথা সেটা আমি দিতে পারছি না। একটা বছর যাক, আপনার স্যালারিটা আমি ঠিকঠাক করে দেব। আপাতত আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনাকে প্রতিমাসে গাড়ির ফুয়েল বাবদ ১৫ হাজার টাকা বাড়তি দেব। আর সেটা আজ থেকেই পাবেন।’

জাফর মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। তারপর বিদায় নিয়ে ওর ডেস্কে ফিরে আসতেই দেখে একাউন্টসের ছেলেটা একটা খাম হাতে দাঁড়িয়ে আছে। খামটা হাতে দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনার এ মাসের ফুয়েল এলাউন্স।’

হঠাৎ করে এতগুলো টাকা হাতে পেয়ে জাফরের মন ভালো হয়ে যায়৷ সেই সাথে একটা কথা ভেবে হেসেও ফেলেন। আগে হলে মাত্র এই ক’টা টাকা পেলে কখনও কি খুশি হতেন? মানুষের চাহিদা তার অবস্থার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, ভাবেন জাফর।

সেদিন বাড়ি ফেরার পথে একবার আড়ঙয়ে ঢোকেন। শাড়ির সেকশনে এসে একটা মসলিন শাড়ি পছন্দ করেন। হালকা পেঁয়াজ কালারের জমিন, পাড়ে গাঢ় খয়েরী কাজ করা। ওর শেষ জন্মদিনে একটা দামী শাড়ি কিনতে যেয়েও পারেননি। আজ এই হঠাৎ করে পাওয়া টাকার পুরোটা দিয়ে শাড়ি কিনে ফেলেন।

বাসায় ফিরতেই দিলশাদ হইচই শুরু করে দেন, ‘এত দাম দিয়ে শাড়ি কিনেছ! ইশ, টাকাগুলো নষ্ট করলে। আমাদের কি আগেরমতো অঢেল টাকা আছে? কবে যে তুমি বুঝবে। এই শাড়ি আমি পরব না। কাল আমি এটার বদলে এই টাকায় আমদের সবার জন্য জামা কাপড় কিনে নিয়ে আসব।’

জাফর দূর্বল গলায় বলার চেষ্টা করেন, ‘এবারের মতো এটা থাকুক না। একবারই তো কিনে দিলাম।’

নওরিনও বাবাকে সমর্থন করার ভঙ্গিতে বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু। এটা দয়া করে ফেরত দিও না। শাড়িটা কী সুন্দর!’

দিলশাদ তবুও গজগজ করতে থাকেন।

রাতে জাফর যখন ঘুমোতে যান তখন অবাক চোখে দেখেন দিলশাদ নতুন শাড়িটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে বলে, ‘দেখো তো কেমন দেখাচ্ছে আমাকে?’

বহুদিন পর আগের সেই দিলশাদকে যেন ফিরে পান। সেই আভিজাত্য, পরিপাটি একজন মানুষ। ও কাছে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

দিলশাদ ওর বুকে মুখ গুঁজে বলে, ‘তুমি এমন পাগলামো করো। ছেলে মেয়ের জন্য কিছু না এনে আমার জন্য নিয়ে এলে। এটা কিছু হলো।’

জাফর ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘ওদের জন্য আগামী মাসে নিয়ে আসব। হঠাৎ করেই কিছু টাকা বাড়তি পেলাম, তাই নিয়ে এলাম।’

দিলশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন ইচ্ছে করলেই একবারে সবার জন্য ভালো কিছু কেনা যায় না।

দিলশাদ সে রাতে জাফরের বুকের ভেতর মুখ রেখে ঘুমিয়ে থাকেন। একটা কথা হঠাৎ করেই মনে হয়, এই যে জাফর হঠাৎ করে ওর জন্য একটা শাড়ি নিয়ে এল তাতে যে সুখটা পেলেন সেই সুখ আগে কখনও পাননি। দামি শাড়ি আগেও পরেছেন কিন্তু এমন করে ভালো কখনোই লাগেনি।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৯

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৯)

১.
বিলকিস ম্যাডাম অস্টম শ্রেণির ক্লাশে ঢুকেই হুংকার ছাড়েন, ‘ Boys, no talk in bangla in my class.’

অষ্টম শ্রেণির এই শাখাটা ইংরেজি ভার্সন ছাত্রদের জন্য। বিলকিস ম্যাডাম সাইন্স পড়ান। খুব কড়া শিক্ষক। ওনাকে দেখলেই আরুশের ভয় লাগে। অবশ্য শুধু ওনাকে না, এই স্কুলের সব শিক্ষকরা যেন কেমন। কথায় কথায় ধমক দেন। অথচ আগের স্কুলে এমন ছিল না। আরুশ তাই ইচ্ছে করে পেছনের বেঞ্চে বসে। সেই নিলয় নামের যে দুষ্ট ছেলেটা ভর্তি পরীক্ষার সময় ওকে পটলা বলেছিল, ওরও এই স্কুলে ভর্তির সুযোগ হয়েছে। ওর সাথেই বেশি খাতির আরুশের। একসাথে দু’জনে পেছনের বেঞ্চে বসে। আজও বসেছিল।

বিলকিস ম্যাডামের হুংকার শুনে নিলয় দুষ্ট হাসি হেসে মুখ ভেংচে বলে, ‘নো বাংলা টক টক।’

ওর বলার ভঙ্গিতে আরুশ হেসে ফেলে। আর তখনই বিপত্তিটা হয়।

বিলকিস ম্যাডাম কড়া চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, ‘You, why laugh? Tell me in English.’

গত কয়েক মাসে এই প্রথম ম্যাডাম ওকে দাঁড় করাল। আরুশ একটা ঢোঁক গিলে দাঁড়ায়, তারপর আমেরিকান একসেন্টে বলে, ‘Nothing serious, madam. We are discussing the cartoon we watched last night.’

বিলকিস ম্যাডাম থমকান। ক্লাশের সবাই ওর দিকে ঘুরে তাকায়। ম্যাডাম কাছে এসে সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, তারপর গম্ভীরমুখে বলেন, ‘Your English is better. Sit down and be attentive in the class.’

আরুশ বসে পড়ে। ম্যাডাম টেবিলে ফিরে যেয়ে ক্লাশ শুরু করেন। নিলয় হিহি করে হেসে বলে, ‘একদম থোতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেছে। তুই এত ভালো ইংরেজি কোথায় শিখলি?’

আরুশের হঠাৎ করেই আগের স্কুলের কথা মনে পড়ে যায়। ওখানে মিসরা খুব আদর করত। আর ওনাদের ইংরেজি উচ্চারণও খুব সুন্দর ছিল। আরুশের তাই এখানে এসে সব সোজাই লাগে। কিন্তু বাংলা ক্লাশ এলেই সব কেমন গোলমেলে হয়ে যায়। আজ সকালেই বাংলা পরীক্ষার খাতা দিয়েছে। আর যথারীতি ও ফেল করেছে। সেই তখন থেকেই ওর মন খারাপ। আম্মুকে কথাটা বলবে কী করে?

সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরেই আরুশ বাংলা নিয়ে পড়তে বসে। কিন্তু অনেকগুলো শব্দের অর্থ ও বোঝেই না। এই যে কবিতাটা –

“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে”

এটার মানে কী? ধানসিঁড়, শঙ্খচিল, কার্তিক, নবান্ন – কোনটাই ও বোঝে না। অসহায় চোখে আপাত এই কঠিন কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এমন সময় নওরিন পেছন থেকে ওকে এমন হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘এই আরুশ, কী হয়েছে রে? বাংলা বই বের করে বসে আছিস কেন?’

আরুশ একবার দরজার দিকে তাকায়, কেউ নেই। ও নওরিনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আপু, আমি হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় বাংলায় ফেল করেছি।’

নওরিন চমকে বলে, ‘কীহ! বাংলায় ফেল করেছিস?’

আরুশ মাথা নিচু করে থাকে। নওরিন ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘আম্মু জানে?’

আরুশ মাথা নাড়ে, ‘বলিনি আম্মুকে।’

নওরিন চিন্তিত গলায় বলে, ‘বাংলা তোর জন্য কঠিন হবে এটা ঠিক আছে। তুই পড়েছিস ইংরেজি মিডিয়ামে। আমারও খুব ঝামেলা হতো বাংলা নিয়ে। মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতাম। কিন্তু তাই বলে ফেল করিনি কখনও। তুই তো একদম গাড্ডায় গেছিস। আচ্ছা, আমি যতটুকু পারি দেখিয়ে দেব। দেখি কী পড়ছিস, নিয়ে আয়।’

আরুশ এবার আগ্রহের সংগে বাংলা বইটা নিয়ে আসে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপু, এই পয়েমটা বুঝতে পারছি না। ধানসিঁড়ি মিনিং কী?’

নওরিন চোখমুখ কুঁচকে বলে, ‘ধান মানে রাইস আর সিঁড়ি মানে স্টেয়ার। বুঝেছিস?’

আরুশ চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছ এটা হলো a stair of rice? বাংলা এই poet এর এমন অদ্ভুত ইচ্ছে হয় কেন?’

নওরিনের হঠাৎ করেই সেই বাংলায় পড়া ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায়। ওই ছেলেটাও অদ্ভুত ছিল। আচ্ছা, আরুশের জন্য ওকে রাখা যায়? ও তো টিউশন করায়। কিন্তু ওকে রাখতে গেলে বাড়তি যে টাকাটা লাগবে সেটা নেই। নওরিন ভেবেছিল খুব সহজেই টিউশন পেয়ে যাবে, কিন্তু এখনও তেমন কোনো ব্যবস্থা হয়নি। নাহ, একটা টিউশন যোগাড় করতেই হবে। আর সেই টাকা দিয়ে জহির ছেলেটাকে আরুশের জন্য রাখতে হবে।

কথাটা মনে হতেই নওরিনের আফসোস হয়, ছেলেটার ফোন নম্বর রাখা হয়নি। অবশ্য বাংলা ডিপার্টমেন্টে গেলেই খুঁজে বের করা যাবে। বলেছিল তো সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অবশ্য আরেকটা জায়গায় সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। নওরিন প্রায়ই লাইব্রেরিতে যায় বই তুলতে। মাঝে মাঝে ওখানে বসে পড়ে। ও খেয়াল করেছে জহির লাইব্রেরির দক্ষিন পাশটায় একটা নির্দিষ্ট টেবিলে প্রায়ই বসে বসে কী যেন পড়ে। নওরিন ইচ্ছে করেই এতদিন কাছে যায়নি। দেখা যাবে আবার আলাপ জুড়ে দেবে। কিন্তু এখন তো বিপদ। আরুশ যেমন করে ফেল করল মা জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে।

পরদিন ইউনিভার্সিটি যেয়ে নওরিন ক্লাশ শেষে সরাসরি লাইব্রেরিতে চলে আসে। এখন দুপুরের খাবারের সময়। ভেতরটা তাই ফাঁকা। নওরিন একটু খুঁজতেই জহিরকে পেয়ে যায়। সেই জানালার পাশে চেয়ারে বসে আছে। জানালা দিয়ে ঝুঁকে বাইরে কী যেন দেখছে।

নওরিন কাছে গিয়ে ছোট করে একটা কাশি দেয়। জহির ঘুরে তাকিয়ে অবাক গলায় বলে, ‘আরে, আপনি। আপনার জুতো ভালো আছে তো? ওটা আর ছিঁড়ে যায়নি তো?’

নওরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মানুষ কাউকে সে কেমন আছে সেটা জিজ্ঞেস না করে জুতোর কথা জানতে চাইতে পারে? অবিশ্বাস্য।

ও একটা চেয়ার টেনে বসে। তারপর ডান পা মেলে দিয়ে বলে, ‘আপনার মুচী আসলেই কুশলী। একদম ঠিকঠাক আছে।’

জহির দাঁত বের করে হাসে, ‘খুব টেনশনে ছিলাম। অত বড়ো মুখ করে নিমাই দাদার কাছে নিয়ে গেলাম আর যদি জুতো ছিঁড়ে যেত তাতে যে ভারী নিন্দে হতো।’

নওরিন ওর কথা বলার ধরণ দেখে হাসে। তারপর বলে, ‘আপনি প্রায়ই এই সিটটায় বসে থাকেন কেন?’

জহির চোখ কুঁচকে বলে, ‘আপনি খেয়াল করেছেন? কই আমি তো আপনাকে দেখিনি।’

নওরিন হেসে বলে, ‘আমিই ইচ্ছে করে আসিনি। আপনি যেমন ধ্যানীর মতো বসে থাকেন, আপনার ধ্যানভঙ্গ করলে দেখা যাবে মুনি ঋষিদের মতো অভিশাপ দিয়ে দেবেন।’

জহির চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘আপনি আবার এসব জানেন নাকি? যেমন বিদেশীদের মত বাংলা বলেন দেখে মনে হয় আপনি এগুলো জানেন না।’

নওরিন লাজুক হেসে বলে, ‘আসলে জানিনা, মুখস্ত বলি। আচ্ছা বলুন তো আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই ধানসিঁড়ি মানে কী? ধানের সিঁড়ি? সিঁড়িতে ধান বিছিয়ে রাখা?’

জহির হো হো করে হেসে ওঠে। তাতে করে আশেপাশের গুটিকয়েক ছেলেমেয়ে যারা ছিল তারা ফিরে তাকায়। এমন মজার কথা এর আগে কখনও শোনেনি ও।

জহির এবার নিচু শব্দে হাসতে থাকে। কিছুতেই হাসি থামে না। আর এদিকে নওরিনের ফর্সা গালটা লাল হতে থাকে। সেই সাথে রাগ লাগতে থাকে। ইশ, কেন যে এই ছেলেকে এটা জিজ্ঞেস করতে গেল। এখন পন্ডিতি ফলাবে।

জহির হাসি থামিয়ে একবার জানালা দিয়ে নিচে তাকায়, তারপর ওর দিকে ফিরে বলে, ‘এই সিটটায় বসলে আমার নিচে রাখা সাইকেলটা দেখতে সুবিধা হয়। চোরে নেবে না, তাও একটু পর পর চেয়ে দেখি। এই সাইকেল আমার কাছে মহামূল্যবান।’

নওরিন মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা এবার বুঝেছি কেন এই একটা কোণে আপনি প্রতিদিন বসেন।’

তারপর সংকোচ নিয়ে বলে, ‘কবিতার লাইনটা বুঝিয়ে দেবেন না?’

জহিরের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘এটার মানে জেনে আপনি কী করবেন? পরীক্ষায় তো আসবে না।’

নওরিনের রাগ উঠে যায়, ঝাঁঝালো গলায় বলে, ‘সামান্য একটা লাইন জানতে চাইলাম আর আপনি এত পেঁচাচ্ছেন। নাহ, আমারই ভুল হয়েছে আপনাকে জিজ্ঞেস করা।’

কথাটা বলে ও উঠে যেতে নিতেই জহির নরম গলায় বলে, ‘ধানসিঁড়ি হলো একটা নদীর নাম, ঝালকাঠি জেলায় অবস্থিত। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর বিখ্যাত রূপসী বাংলা কবিতায় এই নদীটির কথা বলেছেন। ধানসিঁড়ি নদী প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক। তাই কবি বার বার এই নদীর তীরে ফিরে আসতে চেয়েছেন।’

নওরিন মনের অজান্তে কখন বসে পড়েছে ও নিজেও জানে না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। জহির এখন যেন কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে। গলায় আবেগ নিয়ে পুরো কবিতাটা আবৃত্তি করে যায়। আর ফাঁকে ফাঁকে ওকে বুঝিয়ে দেয়। নওরিনের হঠাৎ করেই মনে হয় ও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ধানসিঁড়ি নদীর তীরে, অথবা শঙ্খচিল হয়ে, অথবা শালিক হয়ে। এত মায়া থাকতে পারে কবিতায়!

২.
‘তুমি এর আগে কখনও ‘ও লেভেলে’ পড়িয়েছ?’, জিজ্ঞাসু গলায় বলেন ইফতেখার আহমেদ। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার।

নওরিন দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘না, এটাই প্রথম।’

ইফতেখার হতাশ গলায় বলেন, ‘কিন্তু আমি তো একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক চেয়েছিলাম। আর ইচ্ছে করলেও ‘ও লেভেলের’ ম্যাথগুলো করানো যায় না। যারা স্কুল, কলেজ দুটোই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে তারাই ভালো পারে। তুমি স্কুল, কলেজে কোথায় পড়েছ?’

নওরিন নিচু গলায় ওর স্কুল আর কলেজের নাম বলতেই ইফতেখার আহমেদ চমকে তাকান। মুখ দিয়ে বিস্ময় ধ্বনি বের হয়ে আসে। চোখের চশমা খুলে অবাক গলায় বলেন, ‘কী বললে! তুমি এমন বিখ্যাত স্কুল, কলেজে পড়েছ?’

নওরিনের কেন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। ওর স্কুল, কলেজের নাম শুনে অনেকেই চমকায়।

ইফতেখার আন্তরিক গলায় বলেন, ‘খুব খুশি হলাম শুনে। তুমি খুবই ব্রাইট একটা মেয়ে। তুমি আমার মেয়েকে পড়ালে আমি খুব খুশি হব। ম্যাথের পাশাপাশি আরেকটা সাবজেক্টও যদি পড়াতে খুব ভালো হতো। টাকা নিও ভেব না, আমি তোমাকে বিশ হাজার টাকা দেব।’

নওরিন মনে মনে চমকে ওঠে। ক’দিন আগেই এই এলাকার দেয়ালে কয়েকটা ‘পড়াতে চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে এমন করে পেয়ে যাবে ভাবেনি। আর এতগুলো টাকা দেবে এরা এটা কল্পনাতীত। এখন আরুশের জন্য একটা বাংলা শিক্ষক রাখা যাবে। এতদিন টাকার জন্যই জহিরকে পড়াতে বলেনি। আম্মুকে একটা রান্নার বুয়া রেখে দিতে হবে। এক লহমায় ও অনেককিছু ভেবে ফেলে। পরিবারের জন্য একটা কিছু করতে পারার আনন্দ ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠে।

নওরিন কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘থ্যাংকিউ আংকেল। আমি কাল থেকে পড়াতে আসব।’

নওরিন উঠে দাঁড়াতেই ইফতেখার কৌতুহলী গলায় বলেন, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

নওরিন থমকায়, সম্মতির গলায় বলে, ‘জ্বি বলুন।’

ইফতেখার আহমেদ কপাল কুঁচকে বলেন, ‘তুমি যে স্কুল কলেজের নাম বললে সেসব জায়গায় পড়তে অনেক টাকা লাগে। আর যারা ওখানে পড়ে তারা আর্থিকভাবে বেশ ভালোরকম সচ্ছল হয়। আমি ধরেই নিচ্ছি তোমার পরিবার সচ্ছল। তাহলে তুমি টিউশন করতে চাচ্ছ কেন?’

নওরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘হ্যাঁ আংকেল, আপনি ঠিক ধরেছেন। একটা সময় আমাদের সব ছিল। একটা অসম্ভব দূর্ঘটনা আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। তাই সব আর আগেরমতো নেই। তাই টিউশন করতে আসা। আমি কাল বিকেলে আসব।’

কথাটা বলে ও আর দাঁড়ায় না। চলে যায়। ইফতেখার আহমেদ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকেন। এমনও হতে পারে মানুষের!

নওরিনের মন খারাপ লাগছে। একটা সময় কতটা বিত্ত বৈভবে বড়ো হয়েছে। আর আজ টিউশনের জন্য মানুষের দ্বারে দাঁড়াতে হচ্ছে। জীবন কতটা কঠিন এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

বাসায় ফিরতেই দেখে বাবা আর আরুশ ড্রয়িং রুমে বসে আছে। টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট। আজ কোনো বিশেষ দিন? ও জিজ্ঞাসু গলায় মাকে মিষ্টির কথা জিজ্ঞেস করতেই দিলশাদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর। আমার কথা তো শুনবে না।’

নওরিন বাবার পাশে যেয়ে বসে। বাবার মুখটা এখন দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চার মতো। বাবা আবার কী করল?

নওরিন ফিসফিস করে বলে, ‘বাবা, মিষ্টি এনেছ কেন?’

জাফর খান একবার দিলশাদকে দেখে নেয়। তারপর ওর দিকে ঘুরে নিচু গলায় বলে, ‘আমার একটা নতুন চাকরি হয়েছে। ভালো বেতন দেবে। আমাদের আর টানাটানি থাকবে না।’

বাবার চোখেমুখে একটা উচ্ছ্বাস। নওরিন টের পায় কোথায় যেন একটা কষ্ট হচ্ছে। বাবা চাকরি করবে! এখন বুঝতে পারে আম্মু কেন মন খারাপ করে আছে।

নওরিন বাবার হাতটা ধরে বলে, ‘বাবা, আর ক’টা দিন পরে চাকরি করতে। তোমার শরীর তো এখনও ভালো না।’

দিলশাদ এবার উঁচু গলায় বলে, ‘আমিও সে কথাই বলছিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা।’

জাফর মিনমিন গলায় বলে, ‘খুব একটা ঝক্কির চাকরি না। তানজিমের অফিসেই বসতে হবে। ওদের আমার অভিজ্ঞতাটা দরকার। আমি বেছে দেব কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে ভালো মানের প্রোডাক্ট পাওয়া যাবে। আর ওগুলোর তদারিকও আমিই করব। ছেলেটা খুব ভালো, এখনও আমাকে সম্মান করেই কথা বলে। আর একটা ব্যাপার, আমি বাসায় বসে থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাব। কাজের মধ্যে থাকলে বরং ভালো থাকব।’

এটা অবশ্য ঠিক কথা বলেছে জাফর। বেতনটা যদিও আগেরকার সময়ের সাথে তুলনা করলে কিছুই না। তবে এখনকার জন্য অনেক। মাসে সত্তুর হাজার টাকা দেবে ওরা। এই টাকাট যে কী সাহায্য হবে! না হলে গাড়িটা বিক্রি করে দিতে হতো। গাড়িটা থাকলে একটু হলেও ভরসা পান।

দিলশাদ এবার পাশে যেয়ে বসেন, তারপর নরম গলায় বলে, ‘তুমি যদি মনে করো ভালো থাকবে তাহলে যাও, আমি না করব না। তুমি সুস্থ থাকলেই আমরা খুশি। এত বড়ো একটা বিপদ গেল কাছের কেউই এগিয়ে আসেনি। অথচ একটা সময় সবাই কোনো না কোনো ছুতোয় সাহায্য নিয়েছে। মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত টাকাই সব।’

জাফর ওর হাতের উপর আলতো করে চাপ দিয়ে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে মন খারাপ কোরো না। আসলে একেকজনের যুদ্ধ একেকরকম। আমাদের যুদ্ধটা আমরা সবাই মিলে লড়ে জীবনযুদ্ধে জিতে যাব।’

নওরিনের ভীষণ ইচ্ছে করে ওর নতুন টিউশন পাবার কথাটা বলে। জীবন যুদ্ধে আম্মু বাবার সাথে ও-ও যে দাঁড়িয়েছে সেটা বলে।

কিন্তু বাবার জন্য এমনিতেই আম্মুর মন খারাপ। ওর টিউশনি পাবার কথা শুনলে হয়তো আরও মন খারাপ হবে। তার চেয়ে একেবারে মাস শেষে আম্মুর হাতে টাকা দিয়ে তারপর বলবে। দৃশ্যটা ভাবতেই ওর কেমন যেন লাগে।

আচ্ছা, ওই জহির ছেলেটাকে বাংলা পড়াতে বললে পড়াবে তো? কী সুন্দর করে সেদিন কবিতা পড়ছিল!

সেদিন রাতে নওরিন ঘুমিয়ে যাবার আগে জীবনানন্দের কবিতাটা আবার পড়ে। ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখে ও খুব সুন্দর একটা নদীর পাড়ে চুল খুলে শাড়ি পরে বসে আছে। একটা শঙ্খচিল উড়ে উড়ে ওকে চক্কর কাটছে। ও হাত বাড়াতেই পাখিটা হাতে এসে বসে। আর পাখিটার মুখ কেমন করে যেন সেই জহির ছেলেটার মুখের মতো হয়ে যায়।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৮

0

#আলো অন্ধকারে (পর্ব ৮)

১.
গোলাম দস্তগীর স্যার প্রিন্সিপাল অফ মার্কেটিং কোর্সের ক্লাশ নিচ্ছিলেন। নওরিন মনোযোগ দিয়ে নোট নিচ্ছিল। ঠিক এমন সময় পেছন থেকে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো ওর সামনে এসে পড়ে। এখানে ভর্তি হবার পর থেকেই কেন যেন ছেলেরা ওর পিছু নিয়েছে। সবাই প্রেম করতে চায়। এমন কি সিনিয়র ভাইয়ারাও যেচে এসে কথা বলে। তাতে করে ক্লাশের মেয়েরা উলটো ওর শত্রু হয়ে গেছে। ও খেয়াল করে দেখেছে বেশিরভাগ মেয়ে ওকে সহ্য করতে পারে না। কাছের বন্ধু বলতে এখন পর্যন্ত একজনই। রেণু নাম মেয়েটার। ও খুব আফসোস করে, ইশ, তোর মতো যদি গায়ের রঙ আমার থাকত। বেচারি ওর গায়ের রঙ নিয়ে খুব চিন্তিত থাকে। বলে আমার তো চেহারা সুন্দর না আবার গরীব, আমার কোনোদিন বিয়েই হবে না। সেদিন নওরিন কষে ধমক দিয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে সেটাই বুঝিয়েছিল ওকে।

পেছন থেকে এবার আরেকটা ছোট্ট কাগজের টুকরো এসে পড়ে। নওরিন এবার কাগজের টুকরো দুটো নিয়ে খোলে। একটাতে লেখা ‘হেই মুডি, কেন এত রুডি?’
আরেকটাতে লেখা, ‘হেই ক্লিওপেট্রা, একটু সময় দেবে এক্সট্রা?’

মাসখানেক ধরে এই নামগুলোতেই ওকে ডাকে ছেলেগুলো। মুডি অথবা ক্লিওপেট্রা। সত্যি বলতে ওর কারও সাথে কথা বলতেই ভালো লাগে না। বিশেষ করে ছেলেদের সাথে। আহনাফের সাথে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার পরে ও হয়তো আর কারও সাথে সহজ হতে পারবে না। বিশেষ করে ছেলেদের সাথে। কিন্তু তাতে করে যে ও দিন দিন বড্ড একাকী হয়ে যাচ্ছে। ওরও ইচ্ছে হয় ক্লাশের সবার সাথে মজা করতে। সহজ একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে।

আচ্ছা, এদের এই দুষ্টুমিগুলো ও সিরিয়াসলি না নিলেই তো হয়। ওরা যেমন মজা করছে ও-ও তেমন মজা করবে। কী মনে হতে ও চিরকুটগুলোর পেছনে নীল বলপেন দিয়ে উত্তর লিখে।

‘হাতের লেখা জঘন্য, আগে হ্যান্ড রাইটিং ঠিক করো।’

দুটো চিরকুটেই একই লেখা লিখে। তারপর একবার সামনে ডায়াসে স্যারের দিকে তাকায়। স্যার এখন বোর্ডে লিখছেন। নওরিন পেছন দিকে না ঘুরে চিরকুট দুটো উল্টো দিকে ছুড়ে মারে। পেছন থেকে একটা বিস্ময় ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। তাতে করে গোলাম দস্তগীর স্যার পর্যন্ত ঘুরে তাকান, গম্ভীরমুখে বলেন, ‘এনি প্রবলেম?’

পুরো ক্লাশ চুপ, কারও মুখে কোনো কথা নেই। শুধু পেছনের ছেলেগুলো মিটিমিটি হাসছে। স্যার ঘুরে আবার পড়াতে শুরু করতেই পেছন থেকে ফিসফাস শোনা যায়।

ক্লাশ শেষে স্যার বেরিয়ে যেতেই পেছন থেকে একটা কোরাস শোনা যায়, ‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকা বাঁকা, ভালো না হাতের লেখা, আসো যদি মধুর ক্যান্টিনে আবার হবে দেখা গো বন্ধু, আবার হবে দেখা।’

নওরিন পেছনে ফিরে ওদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। এমন অদ্ভুত গান ও জীবনে প্রথম শুনল। এবার ছেলেগুলোও হেসে ফেলে। ওরা কাছে এসে যার যার নাম বলে৷ তমাল, সেলিম, রনি। তারপর আবদারের গলায় বলে, ‘আজ থেকে তুই আমাদের বন্ধু। ঠিক আছে?’

নওরিনের কেন যেন খুব ভালো লাগে। ও হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, বন্ধু তো। কিন্তু তোমরা যা দুষ্ট!’

ওরা হা হা করে হাসে। তারপর তমাল ছেলেটা বলে, ‘বন্ধুকে তুমি না, তুই বলতে হয়। আচ্ছা, আজ আমরা ক্লাশে শেষে এটা সেলিব্রেট করব। টিএসসিতে যেয়ে লাঞ্চ করব।’

নওরিন মাথা নেড়ে সায় দেয়।

ক্লাশের অন্য মেয়েরা অবাক হয়ে আজকের কান্ডটা দেখছিল। এই মেয়ে এই ক’টা মাস কথাই বলেনি। আজ একদম ঢলে ঢলে পড়ছে। তাও ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার সাথে।

রেণু কাছে এসে মিটিমিটি হাসে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘দারুণ কাজ করেছিস আজ। বাঁদরগুলোকে কী সুন্দর ঠিক করে ফেললি!’

নওরিন হাসে, ‘হঠাৎ করেই মনে হলো ওরা যা করে আমিও তাই করব ওদের সাথে।’

রেণু ওকে সমর্থন দেবার গলায় বলে, ‘একদম ঠিক করেছিস।’

সেদিন সবগুলো ক্লাশ শেষে তমাল ওরা এসে আবদার ধরে, ‘চল, টিএসসি যাই। খেয়ে দেয়ে আড্ডা দেব।’

নওরিন বেজার গলায় বলে, ‘আজ একটু বাসায় যেতে হবে। কাল খাব, ঠিক আছে? তোরা এই ফাঁকে হাতের লেখা প্রাকটিস কর।’

ওরা আরেকদফা হাসে। নওরিনও হাসে। কেন যেন আজ অনেকদিন পর একটু মন খুলে হাসল। ওদের সেই বাড়িটা ছেড়ে আসার পর এই ছোট্ট বাসায় ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল সবার। বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। আম্মু কোনো অভিযোগ না করলেও নওরিন বুঝতে পারে কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে চারদিকে একটা দমবন্ধ অবস্থা।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নওরিন এবার হাঁটতে থাকে। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগে ওর। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। ঠিক এমন সময় একটা “ট্রিং ট্রিং” আওয়াজ পেতেই ও ঘুরে তাকায়, চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ওর। একটা সাইকেল হুড়মুড় করে ওর গায়ে পড়ল বলে। তড়িৎবেগে লাফ দিয়ে পাশে সরে যেতেই ছেলেটা সাইকেলসমেত পড়ে যায়। আশপাশ থেকে একটা হাসির রোল ওঠে।

সাইকেল চালানো ছেলেটা একটা বিরক্তির শব্দ করে। টেনে সাইকেলটা তুলে দাঁড় করায়। তারপর ওর সামনে এসে চোখমুখ কুঁচকে বলে, ‘আপনার লাগেনি তো?’

নওরিন ছেলেটার দিকে তাকায়, লম্বাটে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলগুলো হয়তো এখনই এলোমেলো হলো। পরনের কালো প্যান্টে ধুলো লেগে আছে।

নওরিন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, ‘না, আমি ঠিক আছি।’

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ঠিক নেই তো। আপনার ডান পায়ের জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গেছে।’

নওরিন চমকে এবার পায়ের সাদা রঙের জুতোটার দিকে তাকায়। আরে তাই তো, এটার তো ফিতে ছিঁড়ে গেছে। হায় হায়, এখন হাঁটবে কী করে!

ছেলেটা ওর মুখের অসহায়ত্বটা টের পায়।

গম্ভীরমুখে বলে, ‘জুতো খুলে ফেলুন। সামনেই একজন কুশলী মুচী আছেন, খুব ভালো সেলাই করেন।’

নওরিন অবাক গলায় বলে, ‘জুতো খুলে খালি পায়ে যাব কী করে?’

ছেলেটা এবার একটা রিক্সা দাঁড় করায়, তারপর বলে, ‘নিন, জুতো হাতে নিয়ে উঠে পড়ুন। আমার সাইকেল অনুসরণ করে পিছু পিছু আসতে থাকুন।’

নওরিন অসহায় চোখে ওর ছেঁড়া জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে জুতো হাতে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসে। তাও ভালো ছেলেটা ওর সাইকেলে উঠে বসতে বলেনি। কিন্তু ছেলেটা অমন বইয়ের ভাষায় কথা বলছে কেন, অনুসরণ করে?

নীল সাদা চেক শার্ট পরা ছেলেটা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সাইকেল চালাচ্ছে আর একটু পর পর ফিরে দেখছে ও ঠিকঠাক আসছে কি-না।
অল্প কিছুদূর এগোতেই সাইকেলটা থামে। রিক্সাওয়ালাকে থামতে বলে ও ভাড়া বের করে। তারপর খালি পায়ে জুতো হাতে নেমে দাঁড়ায়। কেমন অদ্ভুত লাগছে।

একজন ছোটোখাটো বয়স্ক মানুষ রঙ চটে যাওয়া সবুজ শার্ট পরে ধ্যানীর মতো একটা জুতো পালিশ করছিল। লোকটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা উঁচু গলায় বলে, ‘নিমাই দাদা, এক জোড়া ভালো স্যান্ডেল দাও। আর ওনার ছিঁড়ে যাওয়া জুতোটা ভালো করে সেলাই করে দাও যাতে কিছু বোঝা না যায়।’

মুচী লোকটা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসে। তারপর এক জোড়া হলুদ রঙের স্যান্ডেল এগিয়ে দেয়। নওরিন নাক কুঁচকে একবার দেখে। ইশ! কেমন ময়লা জুতোটা। কিন্তু আর কোনো উপায়ও নেই। ও জুতোটা দিয়ে স্যান্ডেল পায়ে দাঁড়ায়। তখন হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, জীবনে কখনও ও ভাবেনি জুতো ছিঁড়ে গেলে সেটা আবার সেলাই করে পরবে। তাও রাস্তার মুচীর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। একটা সংকোচ ঘিরে ধরে ওকে।

ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ান। ওর সময় লাগবে। কিন্তু এমন করে সেলাই করে দেবে যে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না এটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। এই যে দেখেন আমার এই পাদুকা জোড়া। কম করে চার বার নানান জায়গায় সেলানো হয়েছে, বোঝা যায়?’

নওরিন ছেলেটার বাড়িয়ে দেওয়া পায়ের দিকে তাকায়। বাটা কোম্পানির সেই আদি ডিজাইনের লালচে খয়েরী স্যান্ডেল। বার বার পালিশ করাতে আগের রঙটা নেই। পরিবর্তে একটা ক্যাটকেটে রঙ। তবে এটা সত্যি, কোথাও সেলাইয়ের চিহ্ন নেই।

নওরিন এবার সরে এসে গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। বেশ ভালো গরম পড়েছে। ও মুখ মুছে বলে, ‘হ্যাঁ, তাই তো। একদমই বোঝা যায় না। আচ্ছা, এই সাইকেলটা আপনার?’

ছেলেটা এবার মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমার। কেন বলুন তো?’

নওরিন একটু সংকোচ নিয়ে বলে, ‘ক্যাম্পাসে কেউ এমন সাইকেল চালিয়ে ঘুরে আমার ধারণা ছিল না। আপনি কি স্টুডেন্ট?’

ছেলেটা বিস্মিত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ! আমি বাংলা বিভাগে পড়ি, দ্বিতীয় বর্ষ। আমার নাম জহির রায়হান। আর সাইকেল থাকলে খুব সুবিধে। পরিবেশ বান্ধব বাহন। এই দ্বিচক্রযানে চড়ে আমি পুরো ঢাকা শহর চক্কর কেটে বেড়াই।’

নওরিন বুঝদারের মতো মাথা নাড়ে, ‘এজন্যই বুঝি তখন কুশলী মুচী শব্দ ব্যবহার করেছেন। আর স্যান্ডেলকে পাদুকা বলছেন।’

জহির এবার হো হো করে হাসে। তারপর বলে, ‘আপনাকে উচ্চারণ শুনে কেমন বিদেশি বিদেশি মনে হচ্ছিল। তাই ইচ্ছে করেই কঠিন বাংলা শব্দগুলো বলছিলাম। আপনার নাম কী? কোন ডিপার্টমেন্ট?’

নওরিন সপ্রতিভ গলায় বলে, ‘আমি নওরিন। আইবিএ তে, ফার্স্ট সেমিস্টার।’

জহির চোখ গোল গোল করে বলে, ‘আপনি তো তাহলে দারুণ মেধাসম্পন্ন মানুষ। আপনার পাদুকা সেবা করতে পেরে আমি ধন্য।’

নওরিন হাসতে যেয়েও থেমে যায়। তারপর মুখ গম্ভীর করে জুতো সেলাই দেখতে থাকে।

জহির একটু থমকায়। মেয়েটা কিছু মনে করল?

একটু পর ও সাইকেলের স্ট্যান্ড উঠিয়ে বলে, ‘আমার একটা টিউশনি আছে। আপনি জুতো সেলাই হয়ে গেলে ওকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দেবেন।’

জহির এবার মুচীর দিকে ফিরে বলে, ‘ও নিমাই দাদা, এর কাছে থেকে বেশি নিও না। আমার খুব পরিচিত মানুষ।’

কথাটা বলে জহির আর দাঁড়ায় না। প্যাডেলে জোর চাপ দিয়ে ঘুরঘুর করে চাকা ঘুরিয়ে চলে যায়। নওরিন অবাক চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ কথাটা কী বলল? ওর খুব পরিচিত মানুষ?

জুতোটা সেলাইয়ের পর ওর হাতে যখন দেয় তখন ও দেখে একদম ঠিকঠাক। সুতোটা জুতোর রঙের সঙ্গে মিশে বোঝা যাচ্ছে না। টাকাটা দিয়ে ও রিক্সা নেয়। ছেলেটা অমন হুট করে চলে গেল। ওর শেষ কথায় না হেসে মুখ গম্ভীর করে রেখেছিল সেজন্য হয়তো মন খারাপ করেছে। বলল টিউশনি আছে, তাই চলে গেল। টিউশনির কথা মনে হতেই ও একটু চঞ্চলতা অনুভব করে। একটা টিউশন ওরও দরকার। কিন্তু কী করে সেটা করতে হয় জানা নেই। ওদের এই নতুন ভাড়া বাসাটার গলিতে কয়েকটা ‘পড়াতে চাই’ বিজ্ঞপ্তি ও দেখেছে। এমন কিছু কাগজ চুপিচুপি লাগিয়ে দেবে নাকি?

২.
দিলশাদ একটা চপিং বোর্ডে কুচিকুচি করে পেঁয়াজ কাটছিলেন। কিছুক্ষণ কাটতেই চোখ দুটো পেঁয়াজের ঝাঁজে বন্ধ হয়ে আসে। একটু সরে চোখ দুটো টেনে ঝাঁজ সামলান। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কতদিন পর এসব করছেন ঠিক মনে নেই। এই নতুন বাসায় এসে একটা ছুটা বুয়া খুব সহজেই অল্প বেতনে পাওয়া গেছে। কিন্তু রান্নার লোক খুঁজতে গিয়ে দেখেন কম করে ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ করতে হবে। এই টাকাটা হিসেবে ধরা ছিল না। ভেবেছিলেন রান্নার কাজটা নিজেই করে ফেলবেন। কিন্তু এখন করতে যেয়ে টের পাচ্ছেন কাজটা ভীষণ কষ্টের। তিনবেলা রান্না করতে গিয়ে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন যে কারও সাথে ভালো করে কথাই বলতে পারছেন না।

ঠিক এই সময় জাফর একটা ভাত রান্নার হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় চাপান। তা দেখে দিলশাদ একটু মেজাজ খারাপ গলায় বলে, ‘এই গরমের দিনেও তোমার গরম পানি লাগে? গরম পানি নিতে গিয়ে তো একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। আর এই সকাল সকাল তুমি গোসল করছ কেন? দুপুরে গোসল করো, তখন এমনিতেই সূর্যের তাপে পানি গরম থাকে।’

আগে সুইচ টিপলেই গরম পানি বেরোত৷ এই নতুন বাসায় এসে গিজার লাগানো হয়নি এখনও। এই সামান্য বিলাসিতাটুকুও ছাড়তে হয়েছে। হায়রে জীবন!

জাফর সংকুচিত হয়ে যায়। স্ট্রোকটা করার পর কেন জানি ওর শীত লাগে বেশি। ঠান্ডা পানি গায়ে পড়লেই শরীর ছনছন করে। কিন্তু সেটা আর বুঝিয়ে বলা হয় না দিলশাদকে। বেচারা এত কষ্ট করছে যে রান্নাটাও ওকে করতে হচ্ছে।

জাফর কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘আজ একটু বেরোব ভাবছিলাম। যে বায়িং হাউজটার সাথে সবচেয়ে বেশি কাজ হতো ওদের অফিসে যাব। দেখি কোন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি কি-না।’

দিলশাদ থমকে তাকায়। খারাপ হয়ে যায়। জাফর চাকরি করবে!! কথাটা কেমন যেন বেমানান শোনায় কানে। একটু আগে কড়া গলায় কথা বলার জন্য কষ্ট লাগে।

ও কাছে এসে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, ‘আরেকটু সুস্থ হয়ে নাও, তারপর না হয় বেরিও।’

জাফর মাথা নাড়ে, ‘আমি এখন একদম ফিট। গোসল করেই বেরোব।’

দিলশাদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি বাথরুমে যাও। আমি গরম পানি দিচ্ছি।’

গোসল সেরে জাফর বহুদিন পর অফিস যাবার জামা কাপড় পরেন। শেষ যে ব্লেজারটা কিনেছিলেন সেটা চাপিয়ে বের হন। দিলশাদ কেমন একটা চোখে চেয়ে থাকে। আজ কতদিন পর মানুষটা এমন অফিস যাবার জামা কাপড় পরল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় ওদের সব কিছু আগেরমতোই আছে। হয়তো একটা দু:স্বপ্ন দেখছেন এতদিন।

এমন সময় নাকে ভাতের পোড়া গন্ধ আসতেই ছুটে গিয়ে চুলা অফ করেন। সব পুড়ে যায় ওর!

জাফর গোসল সেরে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ে। দিলশাদ খেয়ে যেতে বলেন কিন্তু এত সকালে দুপুরের খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না।

জাফর যখন ‘নেস্ট বায়িং হাউজ’ এ এসে পৌঁছান ততক্ষণে দুপুর একটা। অসময়ে চলে এলেন। এখন লাঞ্চের সময়। এই অফিসটায় এর আগে অনেকবারই এসেছেন।

গাড়িটা গেটে থামতেই সিকিউরিটি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কার কাছে যাবেন?’

জাফর স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলেন, ‘তামজিদ হাসান সাহেবের কাছে যাব।’

সিকিউরিটি সালাম দিয়ে গেট খুলে দেয়। এই সিকিউরিটি মনে হয় নতুন এসেছে। না হলে ওকে দেখেই চেনার কথা ছিল।

রিসেপশনের মেয়েটা অবশ্য ওকে দেখেই চিনতে পারে। দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বসায়। তারপর ইন্টারকমে ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে, তারপর বলে, ‘স্যার তো লাঞ্চে আছেন। এলেই আপনার আসার কথা বলব। আপাতত যে একটু অপেক্ষা করতে হয়।’

জাফর মাথা নেড়ে সায় দেয়। অন্য সময় হলে ভেতরে ওদের এমডির রুমে নিয়েই বসাত।

ঘণ্টাখানেক পর যখন ডাক পড়ে ততক্ষণে জাফরের ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। দিলশাদ বার বার খেয়ে আসতে বলেছিল। ভেবেছিল খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু ঢাকা শহরে আজ যেন ট্রাফিক জ্যামটা বেশি ছিল।

জাফর একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন। তাতে ক্ষুধাটা একটু কমে। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকতেই তামজিদ চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়ায়।

আন্তরিক গলায় বলেন, ‘জাফর ভাই, কতদিন পর আপনাকে দেখলাম। আপনি এখন সুস্থ আছেন দেখে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আপনি এতক্ষণ বাইরে বসেছিলেন কেন? আমাকে একটা বার মোবাইলে ফোন করতেন। নিশ্চয়ই লাঞ্চ করেননি। দাঁড়ান আমি লাঞ্চের কথা বলছি। আপনি আগে খেয়ে নিন।’

জাফর হেসে বলে, ‘অসুবিধে নেই তামজিদ। পরে খাব। তোমার কাছে জরুরি একটা দরকারে এসেছি।’

তামজিদের নিখুঁত কামানো গালের মাংসপেশি একটু শক্ত হয়। ওকে বসতে বলে বলেন, ‘হ্যাঁ, বলুন না জাফর ভাই।’

জাফর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘তামজিদ, তুমি তো জানোই আমি এক রাতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। বাড়িটা ছিল সেটাও দিয়ে দিতে হলো। একটা ভাড়া বাসায় ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠেছি। অল্প যা ইন্টারেস্ট পাই তাই দিয়ে কোনোমতে চলে। নতুন করে বিজনেস শুরু করব সেই টাকা নেই, মনের সাহসও নেই। একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল।’

তামজিদ ভেবেছিল জাফর ভাই হয়তো টাকা ধার চাইতে এসেছেন। কিন্তু উনি যে চাকরি চাইতে পারেন এটা ওর ধারণাতেই ছিল না। একটু ভেবে বলে, ‘জাফর ভাই, আমাকে ক’টা দিন সময় দিন। আপনাকে তো হাবিজাবি কাজ দেওয়া যায় না।’

জাফর ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে৷ এগুলো কথার কথা। ও সামনে ঝুঁকে এসে বলে, ‘তামজিদ, হাবিজাবি চাকরি হলেও আমি করব। এই আমার সিভি।’

তামজিদ একটু অপ্রস্তুত হয়, লজ্জিত গলায় বলে, ‘ভাই, এমন লজ্জা দিয়েন না। আপনার মতো মানুষ চাকরির জন্য সিভি দিচ্ছে এটা যেমন কষ্টের তেমন ভয়েরও। আমারও তো এমন হতে পারত! জাফর ভাই আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রি আপনাকে একটা সুসংবাদ দেব।’

জাফর ওর হাত চেপে ধরে, কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘একটু তাড়াতাড়ি কোরো।’

সেদিন তামজিদের অফিস থেকে লাঞ্চ করেই ও বেরোয়।

গাড়িতে উঠতেই শরীর কেমন ছেড়ে দেয়। খুব ক্লান্ত লাগছে। আজ নিজের সাথে একটা যুদ্ধে জিতেছেন। আর সেটা হলো নিজের মনের ইগোটাকে পায়ের তলায় চেপে ধরে ভিখিরির মতো চাকরি চাইতে এসেছেন। পরিবারের প্রিয় মানুষদের আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে, ওদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৭

0

#আলো অন্ধকারে (পর্ব ৭)

১.
আরুশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল, ক্লাশ এইটের ভর্তি পরীক্ষা। যদি পরীক্ষা ভালো হয় তাহলে নতুন এই স্কুলে পড়তে পারবে। আর আম্মু খুব করে চাচ্ছে এই স্কুলটায় ও যেন ভর্তি হতে পারে। আরুশ ভেবে পায় না আম্মু এমন পচা একটা স্কুলে কেন ওকে ভর্তি করতে নিয়ে এল। বেঞ্চগুলো কাঠের, পুরনো। কেমন উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো। খাতা রাখলে অসমান হয়ে যাচ্ছে। ফ্লোরে ছেঁড়া কাগজ, ধুলোবালি। জানালার কাচ ভাঙা, দেয়ালের রঙ উঠে গেছে। এমন ছিরিছাঁদহীন একটা স্কুলে ওকে নাকি ভর্তি পরীক্ষায় টিকতেই হবে।

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন পেছন থেকে একটা ছেলে নিচু গলায় ডাক দেয়, ‘ওই পটলা, তোর খাতাটা বাম দিকে সরা। আর তোর হাত সরা খাতার উপর থেকে।’

আরুশ অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকায়। এই ছেলেটা ওকে পটলা বলছে কেন?

ঠিক এই সময় ক্লাস রুমে গার্ড দিতে আসা মাঝবয়সি একজন শিক্ষিকা কড়া গলায় ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ছেলে, পেছন ফিরে কথা বলছ কেন?’

আরুশ ভয়ে কেঁপে ওঠে। দ্রুত সামনে তাকায়, তারপর মাথা নিচু করে লিখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পরীক্ষা শেষ হবার ঘন্টা বাজে। আরুশ খাতাটা গুছিয়ে বেঞ্চের উপর রাখে। সেই ম্যাডাম একে একে সবার খাতা নিয়ে বলেন, ‘আগামী মাসের এক তারিখে রেজাল্ট দেওয়া হবে। যারা টিকবে তারা ভর্তির জন্য টাকা নিয়ে আসবে।’

ম্যাডাম ক্লাশ থেকে বের হতেই সেই পেছনে বসা ছেলেটা ওর পেটে খোঁচা মারে, ‘ওই পটলা, তোরে যে বললাম খাতা দেখাইতে, দেখাইলি না কেন?’

আরুশ একটু ভয় পায়, ও থতমত গলায় বলে, ‘ম্যাডাম না করলেন তো। আর তুমি আমাকে পটলা ডাকছ কেন, আমার নাম আরুশ।’

ছেলেটা হো হো করে হেসে ওঠে, তারপর মুখ ভেঙচে বলে, ‘আমাকে পটলা ডাকছ কেন? তুই এত শুদ্ধ করে কথা বলিস ক্যান? আমার নাম নিলয়। এই স্কুলে টিকলে তোর সাথে আবার দেখা হবে।’

আরুশ এবার একটু সহজ হয়, ‘ওকে, থ্যাংকিউ নিলয়। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল।’

নিলয় এবার হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘এই, তুই কী রে! আমাকে থ্যাংকিউ দিচ্ছিস কেন। আর আমাকে তুমি তুমি করে বলছিস কেন। তুই করে বলবি।’

আরুশ মাথা নাড়ে, তারপর ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই মাকে দেখতে পায়।

কাছে যেতেই দিলশাদ উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘কী রে, পরীক্ষা কেমন হলো? এখানে টিকবি তো?’
আরুশ মুখ গোল করে বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, আমি কোয়ালিফাই করব। ইংরেজিগুলো তো খুব ইজি ছিল। আর ম্যাথ একটু টাফ ছিল, কিন্তু আমি পেরেছি।’

দিলশাদ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। এই স্কুলটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদম কাছেই। আর এটাতে ইংরেজি ভার্সন আছে। তাতে করে আরুশের খাপ খাইয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। ইতোমধ্যে নওরিনের ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। দু’জনের পড়ার জায়গাটা কাছাকাছি না হলে যে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আরুশ এই স্কুলে টিকে গেলেই এখানে একটা বাসা দেখতে হবে। ব্যাংক থেকে ওদের এই ক’টা মাস সময় দিয়েছে। এর মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। দিলশাদ হিসেব করে দেখেছে ব্যাংকের লোন শোধ করে হাতে যা থাকবে তা দিয়ে মাসে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো পাওয়া যাবে। এত অল্প টাকা দিয়ে ঠিক কী করে চালাবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আরুশের আগের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। তাতে বড়ো একটা খরচ বাঁচে। নওরিনের পেছনেও খুব একটা খরচ হবে না। জাফরের ফিজিওথেরাপিতে খরচটা বেশি। অবশ্য ওর অনেক উন্নতি হয়েছে এই ক’টা মাসে। এখন অনেকখানি হাঁটতে পারে। ইশ, নিজেদের বাসাটা অন্তত যদি থাকত! ইদানিং মাঝে মাঝেই ভীষণ ভয় লাগে। মনে হয় সব হারিয়ে ফেলবেন। এমন আর্থিক নিরাপত্তার ভয় জীবনে কোনোদিনই ছিল না।

আরুশ এবার তাড়া দেয়, ‘আম্মু, ক্ষুধা পেয়েছে।’

দিলশাদ সম্বিৎ ফিরে পান, মাথা নেড়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, চল। বাসায় যেয়ে ভাত খাবি।’

আরুশের ভীষণ অভিমান হয়। আম্মু যেন কেমন হয়ে গেছে। এত কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে আসলো আর ওকে বার্গার খেতে বলল না। কতদিন বাইরে খেতে যায় না। এখন সেই বাসায় যেয়ে ভাত খাও। আরুশ মন খারাপ করে গাড়িতে উঠে পড়ে।

সেদিন বাসায় ফিরে রাতের বেলা দিলশাদ হিসেব করতে বসেন। পাশে নওরিন। জাফরকে ইচ্ছে করেই ডাকেন না। মানুষটা এমনিতেই দুশ্চিন্তায় থাকে। নওরিনকে ইদানিং সব কথা শেয়ার করেন যাতে করে মেয়েটা সংসারের বাস্তব চিত্রটা বুঝতে পারে।

দিলশাদ একটা একটা করে খরচের কথা বলছেন আর নওরিন সেটা খাতায় লিখছে –

আরুশের স্কুল ৫০০০টাকা
আরুশের টিউশন ১০০০০ টাকা
নওরিনের যাতায়াত ৩০০০ টাকা
হাতখরচ ২০০০ টাকা
সংসার খরচ ৪০০০০ টাকা
ফিজিওথেরাপি ১০০০০ টাকা
বাসা ভাড়া ৩০০০০ টাকা
গাড়ি খরচ ৩০০০০ টাকা
অন্যান্য ১০০০০টাকা

মোট এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা।

অংকটার দিকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। এত টাকা লাগবে? এর মাঝে কেউ যদি অসুস্থ হয়? নতুন জামা কাপড় লাগবে, তার খরচ আছে। ব্যাংকে যা সেভিংস আছে সেখান থেকে সব মিলিয়ে এক লাখ টাকা ত্রিশ হাজার পাবেন মাসে। কিন্তু এখানে তো এখনই এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা দেখাচ্ছে।

নওরিন মায়ের অসহায়ত্বটা টের পায়। লিস্টে একবার চোখ বুলিয়ে বলে, ‘আম্মু, আরুশকে আমি পড়াব। ওর টিউশনের দশ হাজার টাকা বাদ দাও। আর আমার জন্য যে পাঁচ হাজার টাকা আছে ওটাও বাদ দাও। আমি টিউশন করব, তাতে করে তোমার মোট পনের হাজার টাকা তো বাঁচবেই সাথে আমি যা পাব তা যোগ হবে। ভেব না আম্মু, আমরা ঠিকঠাক চলতে পারব।’

দিলশাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা কবে কবে বড়ো হয়ে গেল। ও টিউশন করবে!! এত দূর ভেবে ফেলল মেয়েটা?

ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, ‘তোর টিউশন করতে হবে না, ব্যাংকে এখনো অনেক গহনা আছে। লাগলে ওগুলো বিক্রি করে ফেলব। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা কর।’

নওরিন মায়ের আদর নিতে নিতে ভাবে, আম্মু যতই না করুক ওকে কিছু একটা করতেই হবে।

পরের মাসের এক তারিখে আরুশকে নিয়ে দিলশাদ দুরুদুরু বুকে সেই স্কুলটায় যায়। নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। ব্যাকুল চোখ ‘আরুশ খান’ নামটা খুঁজে বেড়ায়। তারপর যখন ওর নামটা লিস্টে দেখেন তখন যেন পরীক্ষা পাশের আনন্দ হয়।

সেদিনই আরুশকে ভর্তি করিয়ে বাসায় ফেরেন। বড়ো একটা চিন্তা গেল। এখন বাসা দেখতে হবে। ভাবনাটা ভাবতেই কেমন গুটিয়ে যান। কখনও বাসা ভাড়া করতে হবে ভাবেননি।

সপ্তাহখানেক পর একদিন দুপুরের পর দিলশাদ বের হন। ড্রাইভার ছেলেটা আজিমপুর এলাকায় কয়েকটা বাসা দেখে রেখেছে। এখানেই আরুশের নতুন স্কুলটা।

দিলশাদ প্রথম যে বাসাটায় যান সেটা একটা ফ্ল্যাট বাসা। গেটে দারোয়ান আছে। জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘তিন তলায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া হইব। দেখবেন? মালিক উপরের ফ্ল্যাটে থাকে। পছন্দ হইলে হেরে ডাক দিমু।’

দিলশাদ মাথা নেড়ে বলেন, ‘আচ্ছা, আগে দেখে নেই।’

লিফটে করে ওরা উপরে চলে আসে। দারোয়ান বেল বাজাতেই একজন বুড়োমতো মহিলা দরজা খুলে দেন। দারোয়ান একবার অনুমতি নেবার গলায় বলে, ‘নতুন ভাড়াটিয়া, বাসা দেখতে আসছে।’

বুড়ো মহিলা সরে জায়গা করে দেন। দিলশাদ দারোয়ানের পিছু পিছু ভেতরে ঢোকেন। পুরো বাসাটা এত ছোট! একটা ধাক্কা খান। বহুদিন এমন ছোট বাসায় ঢোকা হয়নি। একটা বেড রুম মোটামুটি বড়ো। বাকিগুলো বেশ ছোট। দুটো ছোট বারান্দা আছে। দিলশাদ বার বার হিসেব করছিল কী করে ওর সব আসবাবপত্র এই ছোট বাসায় ধরাবেন?

দেখা শেষে নিচে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত ছোট বাসা! এর ভাড়া কত?’

দারোয়ান চোখ কপালে তুলে বলে, ‘তিন বেডরুমের পনেরশ স্কোয়ার ফুটের বাসা আপনি ছোট কইলেন? এইটার ভাড়া মাসে ত্রিশ হাজার টাকা। গ্যাস, বিদুৎ, সার্ভিস চার্জ আলাদা।’

দিলশাদের কপালে ভাঁজ পড়ে, ‘এত বেশি? আচ্ছা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার্ভিস চার্জ মিলিয়ে কত পড়বে?’

দারোয়ান ঠোঁট উলটে বলে, ‘তা সব মিলাই আটত্রিশ হাজার টাকা তো পড়বই। আর দুই মাসের বাসা ভাড়া এডভান্স দিতে হইব।’

দিলশাদ মনে মনে একটা ধাক্কা খান। বাসা ভাড়া বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা ধরে রেখেছিলেন। এই ছোট বাসা, এটার পেছনে বাড়তি আরও আট হাজার টাকা খরচ হবে?

দারোয়ান জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘মালিকের সাথে কথা বলবেন?’

দিলশাদ একটু ভাবেন। বাসাটা আরুশের স্কুলের একদম কাছাকাছি। তাছাড়া এটার নিরাপত্তা বেশ ভালো। একটু ভেবে বলেন, ‘ঠিক আছে তোমার মালিকের সংগে কথা বলব।’

দারুণ নিচে থেকে ইন্টারকমে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ফ্ল্যাটের মালিক উপরে যেতে বলেন।

দিলশাদ দারোয়ানের সাথে আবার লিফটে করে উপরে ওঠে। বেল বাজাতেই মাঝবয়সী টাক মতো একটা লোক দরজা খুলে ওকে ভেতরে যেয়ে বসতে বলে।

দিলশাদ ভেতরে ঢুকতেই একটা ধাক্কা খান। দেয়ালে কটকটে হলুদ রঙ, সিলিং জুড়ে ভারী কাঠের কাজ। এই দিনের বেলাতেও সিলিং থেকে লাল, নীল রঙের স্পট লাইট জ্বলছে।

বাড়িওয়ালা লোকটা ওর সামনের সোফায় বসে।

ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি বাসা ভাড়া নিবেন? আপনার সাথে পুরুষ মানুষ কেউ নাই?’

দিলশাদ কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বলে, ‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না। পুরুষ মানুষ কেউ নেই মানে?’

বাড়ির মালিক হামিদ পাটোয়ারী এবার গম্ভীর মুখে বলেন, ‘আপনারা কে কে থাকবেন বাসায়?’

দিলশাদের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। বাসা ভাড়া নিতে এসে এমন ইন্টারভিউ দিতে হবে এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।

ও গম্ভীর মুখে বলে, ‘আমি, আমার স্বামী, আর এক ছেলে, এক মেয়ে। আর কিছু জানার আছে আপনার?’

হামিদের সুর এবার নরম হয়, ‘বাহ হ্যাপি ফ্যামিলি। কোন সমস্যা নেই, দুই মাসের বাসা ভাড়া এডভান্স দিয়ে উঠে পড়ুন। বাসা ছাড়ার দুই মাস আগে আগে অবশ্যই জানাবেন। আচ্ছা আপনার হাসবেন্ড কী করেন?’

দিলশাদক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটাও আপনাকে বলতে হবে?’

হামিদ এবার নরম গলায় বলে, ‘আসলে হয়েছে কী জানেন, যাকে তাকে তো ভাড়া দেওয়া যায় না। দেখা যায় কোন কাজকর্ম করে না এমন মানুষকে ভাড়া দিলে ভাড়াটা ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। এই বাসা ভাড়া দিয়ে আমার মাসের খরচ চলে।’

দিলশাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনার বাসা ভাড়া আপনি ঠিক সময়মতো পেয়ে যাবেন। কিন্তু বাসা ভাড়াটা কমাতে হবে। আর আমার গাড়ি আছে গ্যারেজও লাগবে।’

হামিদ একটু ভাবেন। মহিলাকে দেখে সম্ভ্রান্ত ঘরের বলে মনে হয়। ভাড়াটিয়া হিসেবে ভালো হবে। একটু ভেবে বলেন, ‘বাসা ভাড়া কমাব না। কিন্তু গ্যারেজ ভাড়া যে দু’হাজার টাকা সেটা দিতে হবে না। যদি বাসা নেন তাহলে সাতদিনের মধ্যে এডভান্স করে উঠে পড়ুন।’

দিলশাদ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এখানে আট হাজার টাকা বেশি লাগল, কিন্তু বাসাটা ভালো। আরুশের স্কুলের একদম কাছ। কিছু গহনা বিক্রি করতেই হবে, উপায় নেই। ও হামিদ সাহেবকে জানিয়ে যায় সাত দিনের মধ্যেই যোগাযোগ করবে।

সেদিন বাসায় ফিরে এসে জাফরকে সব খুলে বলে। জাফর শুধু শুনে যান, কোন কথা বলেন না। একটা অক্ষম রাগ টের পান। মন খারাপ গলায় বলেন, ‘তোমাদের সবাইকে আমি কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আমার দায়িত্ব ছিল তোমাদের সুখে রাখা। পারলাম না, আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

দিলশাদ ওর হাত ধরে ফেলে। তারপর নরম গলায় বলে, ‘কথাটা ভুল। দায়িত্বটা তোমার একার না, আমারও। আমাদের এই পরিবারের সবার দায়িত্ব। আমরা সবাই মিলে ভালো থাকার এই লড়াইটা লড়ব।’

পরদিন দিলশাদ পুরো বাড়ির সব আসবাবপত্রের একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলেন। তাতে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি জিনিস ফেলে যেতে হবে। ফ্রিজ আছে চারটা – দুটো ডিপ, দুটো নরমাল। তিন সেটা সোফা। একটা বড়ো ওয়াশিং মেশিন। দিলশাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে প্রয়োজনীয় সব কিছুর লিস্ট আলাদা করেন। বাকিগুলো দারোয়ানকে বলেন বিক্রি করার জন্য।

সেই মাসের শেষে খান প্যালেসের সামনে ঢাউস একটা ট্রাক এসে থামে। চার পাঁচজন শ্রমিক গোছের লোক হইহই করতে করতে মালামাল ওঠাতে থাকে। তাতে করে প্রায় পুরোটা দিন লেগে যায়।

সেদিন ছিল ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখ। ওরা যখন খান প্যালেস থেকে বের হয় তখন শীতের শেষ বিকেল। একটা ঠান্ডা হাওয়ায় জাফর খান কেঁপে ওঠেন। একবার পেছন ঘুরে নিজের হাতে গড়া ঐশ্বর্যের দিকে তাকান। কষ্টে বুকের পাঁজর ভেঙে যায় যেন। দিলশাদ শক্ত করে ওর হাত ধরে বলেন, ‘এই ঐশ্বর্য এখন আমাদের না। ওদিকে আর তাকিও থেকো না। তাতে শুধু আফসোসই বাড়বে।’

জাফর কেমন পরাজিত মানুষের মতো বাম পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসেন। পেছনের সিটে আরুশ মন খারাপ করে বসে আছে। নওরিন জানালার দিকে তাকিয়ে কান্না লুকাচ্ছে। দিলশাদ নিচের ঠোঁট চেপে কান্নাটা সামলান। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। গেট দিয়ে বের হবার সময় দারোয়ান আমির মিয়া লম্বা একটা সেলাম ঠুকে।

ধীরে ধীরে গাড়িটা খান প্যালেস থেকে দূরে সরে যেতে যেতে একসময় পথের বাঁকে হারিয়ে যায়। জীবনের এই বাঁকে এসে এমন করে সব হারিয়ে ফেলবেন সেটা এই পরিবারের কেউ কখনও জানত না। শুধু বিধাতা জানতেন।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৬

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৬)

১.
ইদানীং ভোর বেলায় ঘুম ভাঙে নওরিনের। ওর পায়ের কাছেই বড়ো একটা জানালা। এ পাশটা ফাঁকা, কয়েকটা নারকোল গাছ আছে। নওরিন শুয়ে শুয়ে বাইরে ভোর হওয়া দেখে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে শুনতে মনটা উদাস হয়ে যায়। ওর শুধু একটা কথা মনে হয় যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখত সব আগেরমতো হয়ে গেছে। বাবা গার্মেন্টসে যাচ্ছে, আম্মু সেজেগুজে বাইরে শপিংয়ে যাচ্ছে, ও আগেরমতো শুদ্ধ থাকত! কিন্তু কিছুই আগেরমতো নেই। নিজেকে কেন যেন অপবিত্র মনে হয়। বাবা মাকে কষ্ট দিল শুধু শুধু। মরে যেতে ইচ্ছে করে।

আহনাফ আর যোগাযোগ করেনি। আম্মুও আর কেসটা নিয়ে কিছু বলে না। উলটো বলল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু ও কি পারবে?

নওরিন আড়মোড়া ভেঙে ওঠে। হাত মুখ ধুয়ে লিভিংয়ে যেতেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে ও থমকে দাঁড়ায়। বাবা হুইলচেয়ার ছেড়ে সুস্থ মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও ভীষণভাবে পা কাঁপছে, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কী করে সম্ভব হলো! ও এক দৌড়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, উত্তেজিত গলায় বলে, ‘বাবা! তুমি দাঁড়াতে পারো!?’

জাফর দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চাদের মতো মাথা নিচু করে হাসে। তারপর ধপ করে হুইলচেয়ারে বসে পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘গত কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা হচ্ছে৷ আমি সাহস করে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই দেখি পারছি। দেখিস, এক মাসের মধ্যে আমি ঠিক আগেরমতো হাঁটতে পারব।’

বাবার চোখেমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে যায় কথাটা বলতে বলতে। নওরিন জড়িয়ে ধরে বলে, ‘পারবে তো বাবা। তুমি আবার আগেরমতো সব করতে পারবে।’
জাফর ষড়যন্ত্রের গলায় বলে, ‘তোর আম্মুকে আগেই বলিস না। একদিন হঠাৎ করে ওর সামনে দিয়ে হেঁটে যাব। কী যে অবাক হবে ও!’

নওরিনের এবার আগ্রহ বাড়ে, ও একটু ভেবে বলে, ‘বাবা, সামনের মাসে আম্মুর জন্মদিন। সেদিন যদি আম্মুকে এই সারপ্রাইজটা দিতে পারো তাহলে খুব ভালো হয়।’

জাফর মেয়ের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায়, তারপর দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘আমি কি পারব?’

নওরিন উৎসাহের সাথে বলে, ‘অবশ্যই পারবে বাবা। আমার তো এখন ভোরেই ঘুম ভেঙে যায়। আম্মু আর আরুশ তো বেলা করে ওঠে। আমি তোমাকে প্রাকটিস করাব প্রতিদিন।’

জাফর সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কখনও মেয়ের সাথে এমন করে মেশা হয়নি। মেয়েটা এখনও বাচ্চা আছে। আর ওর এই ছোট্ট মেয়েটার সাথে এমন একটা বাজে কিছু হয়ে গেল! কষ্ট টের পান বুকের ভেতর।

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘তুই ভর্তির প্রস্তুতি ঠিকঠাক নিচ্ছিস তো?’

নওরিন মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ বাবা, নিচ্ছি। কিন্তু কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া দরকার। বাবা, আম্মুকে কি একটু বলবে আমাকে কিছু টাকা দিতে? বাসায় বসেই অনলাইনে কোচিং করব, খুব বেশি টাকা লাগবে না। এখন আপাতত বারো হাজার টাকা হলেই হবে।’

জাফরের বুক ভেঙে যায়। যে মেয়েকে আড়াই কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে পড়তে পাঠাতে চেয়েছেন, আজ সেই মেয়ে মাত্র বারো হাজার টাকা চাইতে সংকোচ বোধ করছে। এতটা গরীব হয়ে গেলেন!

নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলান। তারপর বলেন, ‘আচ্ছা, আমি তোর মাকে বলব।’
সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন ভোরে ওরা দু’জন চুপিচুপি হাঁটার অনুশীলন করতে থাকে। জাফরের ভীষণ কষ্ট হয়, কিন্তু মেয়ের মুখ চেয়ে কষ্টটা হজম করেন। এক পা বেশি হাঁটতে পারলেই সে কী খুশি মেয়েটা! একটা কথা মনে হয় জাফরের। নওরিনকে এর আগে কত দামি দামি উপহার এনে দিয়েছেন। কিন্তু কখনও এমন মন থেকে খুশি হতে দেখেননি। অথচ আজ মেয়েটার মুখ দেখে ঠিক টের পান ও কতটা খুশি হচ্ছে। মেয়ের এই আনন্দিত মুখ বার বার দেখবার জন্য জাফর এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে যান।

দিলশাদের জন্মদিনের কয়েকদিন আগে এক সকালে জাফর যখন পুরো এক মিনিট একা একা হাঁটতে পারেন সেদিন নওরিন ছুটে এসে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘বাবা, তুমি ভালো হয়ে যাচ্ছ।’

জাফর মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোর জন্যই সব সম্ভব হলো। আমার লক্ষ্মী মেয়ে তুই।’
নওরিনের কেন যেন কান্না পাচ্ছে, ও কি আগের মতো লক্ষ্মী মেয়ে আছে?

জাফর ওকে ছেড়ে এবার হুইলচেয়ারে বসে একটু জিরোয়৷ তারপর চিন্তিত গলায় বলে, ‘আচ্ছা, তোর মাকে জন্মদিনে কী কিনে দেওয়া যায় বল তো? প্রতিবার একটা না একটা কিছু দেই। আমার কাছে কিছু টাকা আছে ওটা দিয়েই কিনব।’

নওরিন একটু ভেবে বলে, ‘আম্মুকে একটা শাড়ি কিনে দাও। দাঁড়াও আমি মোবাইল আনছি। অনলাইনেই অনেক শাড়ির পেজ আছে। সেখান থেকেই একটা অর্ডার করতে পারবে।’

জাফর উৎসাহের গলায় বলে, ‘বাহ, এটা ভালো বুদ্ধি। আমি তো নিজে কোনোদিন শাড়ি কিনিনি। এবারই প্রথম কেনা হবে। তোর আম্মু খুশি হবে।’

নওরিন ওর মোবাইলটা এনে কতগুলো শাড়ি বাছাই করে বাবাকে দেখায়। জাফর ভালো করে শাড়িগুলো দেখে, তারপর বলে, ‘সবগুলোই তো সুন্দর লাগছে। তুই বল কোনটা নেব?’

নওরিন একটু চিন্তা করে বলে, ‘এই বটল গ্রিন শাড়িটা সুন্দর, এটা নাও বাবা।’

জাফর মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা এটাই অর্ডার দে৷ কিন্তু এটার দাম কত?’

নওরিন এবার সংকুচিত গলায় বলে, ‘বাবা, এটা পনের হাজার টাকা।’

জাফর থমকে তাকান। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করছে। ওনার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে। দিলশাদ সব টাকা ব্যাংকে রাখে। ওর তো কোনো হাতখরচ নেই এখন। তাই হাজার পাঁচেক টাকা ওর কাছে দিয়ে রেখেছিল। জাফর ভেবেছিল এই দিয়ে ভালো একটা শাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।

জাফর দমে যাওয়া গলায় বলে, ‘আচ্ছা, চার পাঁচ হাজারের মধ্যে কিছু নেই?’
নওরিনের ভীষণ মায়া হয় এই অসহায় বাবাটার জন্য। ওর মনে পড়ে না বাবা কখনও কম দামি কিছু কিনেছে কখনও। সেই বাবা আজ কম দামে শাড়ি খুঁজছেন।

নওরিন ওর মন খারাপ ভাবটা বুঝতে না দিয়ে কৃত্রিম উৎসাহের গলায় বলে, ‘আছে তো বাবা। দাঁড়াও আমি বের করছি।’

নওরিন কিছুক্ষণ ব্রাউজ করে এবার অনেকগুলো শাড়ি বের করে। জাফর সেসব শাড়ি দেখেন, কিন্তু কোনোটাই আগেরগুলোর মতো লাগে না। নাহ, কম দামি জিনিস কিনতে পারবেন না।

মুখ ভার করে বলেন, ‘থাক বাদ দে। এবার জন্মদিনে না হয় আমার এই ভালো হওয়াটাই ওকে উপহার দিলাম। তুই ভালো দেখে একটা কেক আর কিছু ফুল অর্ডার দিয়ে দিস, তাতেই হবে।’

নওরিন ব্যথিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আর জাফর একটা অক্ষমতার কষ্ট টের পান বুকের ভেতর। মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয় অথচ মেনে নিতে হয়।

ক’দিন পর যেদিন দিলশাদের জন্মদিন সেদিন বিকেলে বাসায় একটা কেক আসে। দিলশাদ অবাক গলায় বলেন, ‘এই কেকের অর্ডার কে দিল? আর হঠাৎ করে কেক কেন?’

আরুশ, নওরিন মিটিমিটি হাসে। জাফর অন্যমনস্ক ভাবে টিভির দিকে তাকিয়ে মুখ লুকান।

দিলশাদ এগিয়ে যেয়ে কেকের বাক্সটা খুলতেই থমকে যান। আজ ওর জন্মদিন! একদম ভুলেই গিয়েছিল। এত ঝামেলা গেল ক’টা দিন যে নিজের কথা একদম ভুলে গিয়েছিলেন। এরা ঠিক মনে রেখেছে। হঠাৎ করেই ক্লান্ত মনটা ভালো হয়ে যায়।

আরুশ, নওরিন আর জাফর এবার সুর করে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’।

নওরিন ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর আদুরে গলায় বলেন, ‘তুমি দূরে কেন? হুইলচেয়ারটা নিয়ে এখানে আসো। কেকটা কাটি।’

নওরিন ঝট করে একবার বাবার দিকে তাকায়। বাবাকে কি একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে? ভয় পাচ্ছে বাবা?

ও সামনে এগিয়ে যায়, তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি পারবে বাবা।’

জাফর একবার মেয়ের দিকে তাকায়, লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর এক পা দু’ পা করে দিলশাদের দিকে এগিয়ে যায়।

দিলশাদ কেকটা বাক্স থেকে খুলে টি টেবিলের উপর রাখতে যেয়ে থমকে দাঁড়ান। হতবিহ্বল হয়ে জাফরের হেঁটে আসার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছেন।

সবার প্রথমে আরুশ চিৎকার করে ওঠে, ‘বাবা হাঁটছে!!!’

দিলশাদ হাতে ধরে থাকা কেকটা কোনোমতে নামিয়ে রেখে, কাঁপা গলায় বলেন, ‘তুমি হাঁটতে পারছ!’

জাফর ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। পেছন থেকে নওরিন হাত তালি দিয়ে বলে, ‘সাবাশ বাবা। তুমি পেরেছ।’

জাফর দিলশাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। পেছনে লুকিয়ে রাখা একটা লাল গোলাপ হাতে নিয়ে ওর সামনে ধরে। তারপর কাঁপা গলায় বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে দিলশাদ।’

চোখে বাধভাঙ্গা জল নামে। সৃষ্টিকর্তা বুঝি এতদিনে ওর প্রার্থনা শুনলেন। ফুলটা নিয়ে ওর হাত ধরে বসান, তারপর ভেজা চোখে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি সত্যিই হাঁটতে পারছ! ইশ, কী যে ভালো লাগছে।’

জাফর বুকের ভেতর একটা মন ভালো করা হাওয়া টের পায়৷ দিলশাদ কী ভীষণ খুশি হয়েছে!

ও আবেগের গলায় বলে, ‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি। নওরিন আমাকে প্রতিদিন প্রাকটিস করিয়েছে আজকের দিনটার জন্য। এটাই এবার তোমার জন্মদিনের গিফট। আর কিছু দেবার সামর্থ্য নেই যে আমার।’

দিলশাদ ওর হাত চেপে ধরে, তারপর ভাঙ্গা গলায় বলে, ‘তুমি নিজের পায়ে হাঁটতে পারছ, এর চেয়ে বড় উপহার আমার জীবনে আর কিছু নেই। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।’

সেদিন সত্যিই একটা অন্যরকম জন্মদিন পালন করেন দিলশাদ। এই যে আজ জাফর হেঁটে এসে ওকে একটা লাল গোলাপ ফুল দিল এর মূল্য বুঝি ওই পাঁচ তারকা হোটেলে পালন করা জন্মদিনে ডায়মন্ডের গলার হার দেবার চেয়েও বহুগুণে মূল্যবান কিছু। দিলশাদের হঠাৎ করেই মনে হয়, জীবনে হারিয়েছেন অনেক কিছুই, কিন্তু এমন কিছু অমূল্য জিনিসের সন্ধান পেলেন যেটা আগের স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো কখনও পেতেন না।

২.
নওরিনের হাত পা কাঁপছে। বিশ্বাস হচ্ছে না, বার বার মেরিট লিস্টটা দেখছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এর এডমিশন টেস্টে একদম প্রথম দিকেই ওর নাম জ্বলজ্বল করছে। চারপাশে ছেলেমেয়েদের ভীড়, চিৎকার-চেচামেচি – কিন্তু কিছুই ওর কানে ঢোকে না। ও ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসে। আম্মু উৎকন্ঠা নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।

দিলশাদ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে চমকে ওঠেন। সাদা মুখটা কেমন রক্তশুন্য। ওকে এমন হতবিহ্বল দেখাচ্ছে কেন? লিস্টে নাম নেই বুঝি? আহারে, মেয়েটা কখনও এমন প্রতিযোগিতায় নামতে হবে ভাবেনি। ভেবেছিল ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলে যাবে। না হলে অন্য ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে মেয়েকে টাকা খরচ করেই পড়াতেন। কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে দেশেও বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সুযোগে রইল না। এখন এই পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলো ভরসা। ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো করেছিল। ভেবেছিলেন টিকে যাবে। কিন্তু এখানেও যদি ওর না হয় তাহলে মেয়েটা যে একদম শেষ হয়ে যাবে।

দিলশাদ একটু এগিয়ে গিয়ে মেয়ের হাত ধরেন, তারপর নরম গলায় বলেন, ‘ভেঙ পড়িস না। অন্য ইউনিটগুলোতে ভালো করে পরীক্ষা দে।’

নওরিন ফিসফিস করে বলে, ‘আম্মু, আমি একুশতম হয়েছি।’

দিলশাদ চমকে ওঠেন। ওর হাত ধরে শক্ত একটা ঝাঁকুনি দেন, চিৎকার করে বলেন, ‘কী বলছিস তুই! সত্যি?’

দিলশাদের চিৎকারে আশেপাশের মানুষজন কৌতুহলী দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। সেদিকে দিলশাদের সাথে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। মেয়েকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান। উচ্ছ্বসিত গলায় বলেন, ‘তুই সত্যিই চান্স পেয়েছিস? তাও একদম প্রথম দিকে? ইশ কতদিন পরে একটা সুসংবাদ পেলাম।’

নওরিনের বুকের ভেতর চেপে থাকা এতদিনের একটা অপরাধবোধ আজ যেন উধাও। ও যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছে। এই স্বর্গীয় আনন্দের দেখা ও টাকা দিয়ে পড়তে গেল কখনোই পেত না। আম্মু খুশি হয়েছেন, বাবাও নিশ্চয় অনেক খুশি হবে। ওর জন্য ওনারা কত কষ্ট পেলেন। সেই কষ্টের এই শোধটুকু দিতে পেরে নিজেকে আজ অনেকটা হালকা লাগে।

দিলশাদ ওকে নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখেন। নওরিন অবাক হয়ে দেখে, কত কত প্রাণোচ্ছল ছেলেমেয়ে। আর কী বিশাল ক্যাম্পাস! এতদিন শুধু মুখেই শুনে এসেছে। তেমন করে কোনোদিন আসা হয়নি। কেন জানি ওর ভালো লেগে যায় ক্যাম্পাসটা।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা টিএসসির পাশে ডাসের সামনে এসে বসে৷ দিলশাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বার্গার খাবি? সকালে কিছু খাসনি তো।’

নওরনি বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে। ইশ কী মজা লাগছে আজ আম্মুর সাথে ঘুরতে।

দিলশাদ দুটো বার্গার আর কফি নেয়। কেন যেন আজ নিজেও সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেছেন। এমন পা ঝুলিয়ে বার্গার খেতে খুব ভালো লাগছে যেন পৃথিবীতে কোনো কষ্ট নেই, যন্ত্রণা নেই।

বার্গার শেষ করে কফি নেন। চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই মন খারাপ হয়ে যায়। মেয়ের সাথে একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলেছেন। ঠিক মিথ্যে না কথাটা লুকিয়েছেন। এই অপরাধবোধ প্রতিদিন কুড়ে কুড়ে খায়।

দিলশাদ একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘মাগো আমি তোর কাছে একটা অপরাধ করেছি। পুলিশ আহনাফকে গ্রেফতার করেছিল। ওরা তখন বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে সমঝোতা করতে চাইল। না হলে ওরা আদালতে নোংরা সব কথা বলবে তোকে নিয়ে। আমি তোর কথা ভেবেই কেসটা থেকে সরে এসেছি। টাকাটা না নিলে খুব ভালো হতো। কিন্তু পারিনি। হাতে একদম নগদ টাকা ছিল না। তাই এমন নিচু একটা কাজ করতে হলো। তুই তোর এই অক্ষম মাকে ক্ষমা করে দিস।’

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে দিলশাদের চোখ ভিজে যায়।

নওরিন অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ কোনো কথা যোগায় না মুখে। তারপর মায়ের একটা হাত শক্ত করে ধরে বলে, ‘আম্মু, তুমি কোনো অপরাধ করোনি। আমার বোকামির জন্য তোমাকে ওদের সামনে এমন মাথা নিচু করতে হলো। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।’

দিলশাদ এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। আশেপাশের মানুষজন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেন একজন মাঝবয়েসী নারী কাঁদছে, সাথে একজন অপূর্ব সুন্দর তরুণীর চোখেও জল।

সেদিন বাসায় ফেরার সময় ওরা মিষ্টি কেনে। দিলশাদ একগুচ্ছ ফুল নেন। বাসায় ফিরতেই দেখেন বসবার ঘরে একজন অপরিচিত মানুষ বসে আছেন, সাথে জাফর, মুখটা কেমন অন্ধকার। দিলশাদ নওরিনের খবরটা বলতে যেয়েও চুপ হয়ে যায়। ইশারায় নওরিনকে ভেতরে চলে যেতে বলে।

জাফর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘উনি হানিফ মাহমুদ। ওই যে আমাদের যে ব্যাংকে লোন ছিল সেখানে আছেন। আমাদের লোনের বিপরীতে অনেকগুলো টাকা ইন্টারেস্ট এসেছিল। ওনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মওকুফ হয়নি। টাকাটা দিতে হবে।’

দিলশাদ অস্ফুটে বলেন, ‘কত টাকা?’

জাফর নিচু গলায় বলেন, ‘পাঁচ কোটি চুয়ান্ন লাখ টাকা।’

দিলশাদের হঠাৎ করেই মাথাটা ঘুরে উঠে। এত টাকা কোথায় পাবে ওরা?

ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। তারপর জাফরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এখন উপায়? আমাদের কাছে তো কোনো টাকা নেই। আমরা কোর্টে একটা প্রেয়ার দেই এটা মওকুফের জন্য।’

ব্যাংকের লোকটা এবার মুখ খুলে, ‘ম্যাডাম সেটাও করা হয়েছিল। আমি স্যারকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম। ব্যাংক তখন আপনাদের এই বাড়ির কথা তুলেছিল যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকার মতো। আদালত তখন এই বাড়ি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের আদেশ দিয়েছেন।’

রুমের ভেতর যেন একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়।

দিলশাদ হতবাক গলায় বলেন, ‘কী বলছেন এসব? এই বাড়িটা ছাড়া আমাদের যে আর কিছুই নেই। এভাবে আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবেন আপনারা?’

লোকটা মাথা নিচু করে ফেলে।

জাফর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘দিলশাদ, ওনাদের কোনো দোষ নেই। ব্যাংকও তো একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমি ঠিক করেছি বাড়িটা বিক্রি করে দেব। আর এত বড়ো বাসা মেইনটেইন করা অনেক খরচের। আমরা অন্য কোথাও ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব।’

দিলশাদ বিমূঢ় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত ভাড়া থাকতে হবে! জীবনে কখনও কি এটা ভেবেছিলেন? সৃষ্টিকর্তা এত নিষ্ঠুর হলেন? এভাবে একের পর এক সব কেড়ে নিলেন?

ভেতর থেকে নওরিন কথাগুলো শুনতে পায়। আরুশ বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকে কী হয়েছে। নওরিন ওকে শক্ত করে ধরে রাখে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৫

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৫)

১.
নওরিন হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় নিঃসাড় পড়ে আছে। চোখ দু’টো বন্ধ। মৃদু নিশ্বাসের সাথে বুক উঠানামা করছে, তাতে করে বোঝা যায় বেঁচে আছে। দিলশাদ বেগম ভেবে পান না ওর এই ফুলের মতো মেয়েটার কে এত বড়ো সর্বনাশ করল। ডাক্তার বলেছেন অল্পের জন্য বেঁচে গেল। ঠিক কত ব্যাগ রক্ত লেগেছে ওর হিসেব নেই। জাফর পাগলের মতো করছিল। উত্তেজনায় হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে যেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে উলটো মাথায় জোর ব্যথা পেয়েছে। দিশেহারা একটা অবস্থা। নওরিনকে হাসপাতালে নেবেন না জাফরকে সামলাবেন। জীবন এত দুঃসহ হয়ে গেল কেন? কী পাপ করেছিলেন যে তার শাস্তি পেতে হচ্ছে?

ভোরবেলা একটা কোনো একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ইশ! ভাগ্যিস ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উঠে প্রথমেই আরুশের রুমে একবার গিয়েছিলেন। তারপর নওরিনের রুমে যেতেই মনে হলো মরে যাবেন। নওরিন অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, আর পুরো বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওর আর্তচিৎকারে রান্না করার মেয়েটা ছুটে এসেছিল। জাফর কী করে হুইলচেয়ারে একা একা চড়ল সেটা ও বলতে পারবে না। দিলশাদের শুধু মনে হচ্ছিল ওর মেয়েটা মরে যাচ্ছে। ওকে পাঁজাকোল করে ওরা দু’জন নিচে নামিয়ে গাড়িতে তুলেছিল। তারপর নিজেই চালিয়ে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। আহারে জীবন! আর কতবার ওর বুকে ছুরি চালাবে? প্রথমে জাফরের এমন ভয়ংকর বিপদ সাথে স্ট্রোক আর তারপর মেয়েটার সংগে এমন অসম্ভব একটা ঘটনা ঘটল। এটা ধামাচাপা দেবেন কী করে?

নওরিন চোখ মেলে তাকায়। দিলশাদ ঝুঁকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কেমন লাগছে মা? এখন মাথা ঘোরানোটা কমেছে?’

নওরিন বিষণ্ণ হাসে, দূর্বল গলায় বলে, ‘আম্মু, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার খারাপ মেয়ে।’

দিলশাদ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘চুপ, আর কিচ্ছু বলিস না। তুই বেঁচে আছিস এটাই আমার বড়ো পাওয়া। আমি আর কিছুই চাই না।’

নওরিন বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। বিবেকের যন্ত্রণা। বাবা মা বুঝি এমন হয়! এত বড়ো অপরাধ করেও আম্মু ওকে নির্দ্বিধায় বুকে টেনে নিয়েছেন।

মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আম্মু, বাবা আর আমাকে আদর করবে না, তাই না?’

নওরিন নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলান, ভাঙা গলায় বলে, ‘মাগো, আমরা সবাই তোকে আদর করব। তুই যে তোর বাবার প্রথম সন্তান। তুই যখন হলি তখন তোর বাবা কী খুশিই না হয়েছিল। মানুষকে ডেকে ডেকে মিষ্টি খাইয়েছে। তুই শুধু ভালো হয়ে উঠ মা।’

নওরিনের দু’চোখ বেয়ে তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে। সেই তপ্ত জল ওর ঠান্ডা গালে একটা মায়ার উষ্ণতার স্পর্শ বুলিয়ে দেয়।

এমন সময় কেবিনে একজন পরিপাটি চেহারার বয়স্ক গাইনি ডাক্তার ঢোকেন, সাথে একজন নার্স। দিলশাদ সোজা হয়ে বসেন। দ্রুত হাতে চোখের জল মুছে একটু হাসার চেষ্টা করেন।

নিজের পরিচয় দেন, ডা. সায়মা। বেডের কাছে এসে হেসে নওরিনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী অবস্থা তোমার? আজ ভালো লাগছে তো?’

নওরিন বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। ডাক্তার সাহেব রিপোর্টগুলো দেখে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নাড়েন। পাশ থেকে দিলশাদ জিজ্ঞাসু গলায় বলেন, ‘আপা, ওকে ছাড়বেন কবে?’

সায়মা একটু ভেবে বলে, ‘কালকেই নিয়ে যেতে পারবেন। এখন সব ঠিকঠাক।’

তারপর নওরিনের দিকে ফিরে নরম গলায় বলে, ‘কিন্তু মামণি, তুমি তো আমাদের ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছিলে। নিজে নিজে এমন করে ওষুধ খেতে আছে? বিপদের কথা সবার আগে তো বাবা মাকে জানাতে হয়। এই যে দেখো, যে বন্ধুটার জন্য তুমি আজ এমন বিপদে সে কিন্তু একবারও তোমার খোঁজ নেয়নি। মনে রেখো, পৃথিবীতে বাবা মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। যা হবার হয়ে গেছে। এখন সব ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’

নওরিনের মুখটা বুকের কাছে লেগে আসে। কোথায় এই মুখ লুকাবে? এখন সবাই যে ওকে এমন করে উপদেশ দেবে।

ডাক্তার সাহেব চলে যেতেই দিলশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুই যদি একবার আমাকে বলতি! আচ্ছা, এবার আমাকে বল, কে করেছে এটা? কার সংগে তোর এত গভীর সম্পর্ক ছিল যে আমি জানতেই পারলাম না?’

নওরিন জানত এই প্রশ্নটা আসবে। গতকালই আহনাফকে মেসেজ করে জানিয়েছিল ও হাসপাতালে ভর্তি। আহনাফ মেসেজটা সিন করেছে কিন্তু কিছুই বলেনি। পরে আবার মেসেজ দিতে যেয়ে দেখে মেসেজ যাচ্ছে না। কল করতে যেয়েও একই অবস্থা। তার মানে ওকে ব্লক করে রেখেছে আহনাফ! ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ আহনাফ সত্যিই ওকে ভালোবাসেনি। ওর কথা আর লুকিয়ে লাভ নেই। যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। ভেবেছিল চুপিচুপি সব ঠিক করে ফেলবে। কিন্তু পারল না। উলটো সেই চুপিচুপি কথাগুলো বড্ড বেশি শব্দ করে চারপাশে আলোড়ন তুলে ফেলেল।

ও নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আহনাফ।’

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটা সেই গাড়ির বিজনেস করে করিমুল্লাহ সাহেবের ছেলে না?’

নওরিন মাথা নাড়ে।

দিলশাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘তুই ওদের বাসায় কেন গিয়েছিলি?’

নওরিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর জবাবদিহিতার ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করার জন্য ওর ওখানে গিয়েছিলাম। একশ ডলার টাকা ওই আমাকে দিল তো, তাই।’

দিলশাদ চোখ বড়ো বড়ো করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিন নওরিন টাকা চেয়েছিল, ইচ্ছে করেই দেননি। বিদেশে পড়া এখন সম্ভব না সেটা ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। অথচ মেয়ে ওর কথা শুনল না? দিলশাদের হঠাৎ করেই রাগ হয়ে যায়। এই আহানাফ ছেলেটাকে প্রথম থেকেই অপছন্দ। আর সেকথাটা ওকে বার বার বলেছিলেন। কিন্তু তখন মেয়ে কথা কানে নেয়নি। আর পরিবারটাও খুব একটা ভালো না। কাঁচা টাকা হয়েছে, তার গরম দেখায়। এদের শিক্ষা দিতে হবে। আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

দিলশাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘কাল আমরা থানায় যাব। তুই আমার সাথে যাবি।’

নওরিন বুঝতে না পেরে বলে, ‘থানায় কেন আম্মু?’

দিলশাদ কঠিন গলায় বলেন, ‘ওই বদমাশ লাফাঙ্গা ছেলেটার নামে রেপ কেসের মামলা দেব। ওকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।’

নওরিন কাতর গলায় বলে, ‘না আম্মু, প্লিজ এটা করো না। তাতে করে আমার সব বন্ধুরা ব্যপারটা জেনে ফেলবে। আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না।’

দিলশাদ রাগী গলায় বলে, ‘তুই কি ভাবিস এই খবর কারও জানতে বাকি আছে? তুই যখন সুস্থ হয়ে বাসায় চলে যাবি তখন ওই ছেলেই সবাইকে ডেকে ডেকে তার এই কীর্তির কথা রঙ চড়িয়ে বলবে। তারপর আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করবে। এদের প্রথমেই শাস্তিটা দিয়ে দিতে হয়।’

নওরিন চেয়ে থাকে। আম্মু ঠিক কথাই বলছেন। আহনাফের তো কিছুই হলো না। ও ওকে ভোগ করেছে। এখন দেশের বাইরে পড়তে চলে যাবে। ওকে কোনোদিন বিয়েও করবে না। আর সবার কাছে ওর সাথে ঘটে যাওয়া কুৎসিত ঘটনাটা রসিয়ে রসিয়ে বলবে। কথাটা মনে হতেই ওর সারা শরীরে আগুন ধরে যায়। শক্ত গলায় বলে, ‘আম্মু, আমি যাব তোমার সাথে থানায়।’

২.
করিমুল্লাহ মানুষটা ছোটখাটো। মানে সর্ব অর্থেই ছোটখাটো। হাত দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট, চোখ দুটো ছোট ছোট, কানগুলোও। মাথাটাও ছোট্ট নারকোলের মতো গোল। কিন্তু একটা জিনিস করিমুল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা একটু বেশিই দিয়েছেন। আর সেটা হলো বুদ্ধি। না হলে পাঁচ বছরের মাথায় ঢাকার নামীদামী সব গাড়ি ব্যবসায়ীকে হঠিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারতেন না। আরেকটা বড়ো গুণ আছে করিমুল্লাহর, যেকোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। এই যে এখন যেমন। বাসায় পুলিশ এসেছে আধা ঘণ্টা আগে। এরা লিভিংরুমে বসে আছে, আহনাফকে নাকি গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। অপরাধও গুরুতর, রেপ কেস। নাহ, ছেলেটা ডোবাবে।

করিমুল্লাহ ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন, ‘আমাকে শুধু তুই একটা কথা বল, ওই মেয়ে নিজে থেকে এই বাসায় এসেছিল?’

আহনাফ মাথা নিচু করে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। আমি ওকে ভালোবাসি, বলেওছিলাম পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব।’

করিমুল্লাহ ভ্রু কোঁচকায়, পাশে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার ছেলে তো দেখি নিজের বিয়েও ঠিক করে রেখেছে। তা মেয়ে ভালোই পছন্দ করেছিলি। বড়ো ব্যবসায়ী জাফর খানের মেয়ে। কিন্তু এখন তো কিচ্ছু নেই ওদের। তুই বিয়ে করতে চাইলেও আমি রাজি না।’

আহনাফের মা সালেহা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘ওই বজ্জাত মেয়েকে ও বিয়ে করবে? অসম্ভব। যে মেয়ে আমার ছেলের নামে রেপ কেস দেয়, এ তো ভবিষ্যতে আমাদের নামেও নির্যাতনের কেস দেবে।’

আহনাফ এবার কান্না গলায় বলে, ‘বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমিও ওকে বিয়ে করব না। ও আমার নামে এত জঘন্য একটা কেস দিতে পারল!’

করিমুল্লাহ মাথা নাড়েন, ‘যাক, বাস্তবতাটা বুঝেছিস। এখন রেডি হয়ে চল, থানায় যেতে হবে।’

সালেহা আর্তনাদ করে বলে, ‘তুমি এসব কী বলছ, থানায় যাবে মানে?’

করিমুল্লাহ কঠিন গলায় বলেন, ‘অপরাধ করলে তার শাস্তি পেতে হয়।’

সালেহা এবার কান্না জুড়তেই করিমুল্লাহ কঠিন ধমক দেন, তারপর বলেন, ‘আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। রাতে ফিরতে দেরি হবে। তুমি পোলাও মাংস রান্না করো, এসে খাব।’

সালেহা হতভম্ব গলায় বলেন, ‘ছেলে জেলে যাচ্ছে আর তুমি বলছ পোলাও মাংস রান্না করতে? খেতে পারবে তুমি?’

করিমুল্লাহ হেসে বলেন, ‘তুমিও খাবে, সাথে তোমার ছেলেও।’

কথাটা বলে আর দাঁড়ান না। দ্রুত রেডি হন। প্রিয় বাদামি রঙের সাফারি স্যুটটা পরে নেন। এই ড্রেসটা কেন জানি খুব আত্মবিশ্বাস দেয় করিমুল্লাহকে। একটা ধোপদুরস্ত ভাব আসে। তা করিমুল্লাহ সবসময় এমন থাকতে পছন্দ করেন। বড়ো বড়ো ক্লায়েন্ট আসে, তারাও পরিপাটি মানুষ পছন্দ করে।

লিভিং রুমে আসতেই ওসি মহসিন সাহেব উঠে দাঁড়ায়, বিগলিত গলায় বলে, ‘স্যার, আপনার ছেলেকে তাহলে নিয়ে যাই এখন?’

করিমুল্লাহ মাথা নেড়ে বলেন, ‘ওসি সাহেব, আমি আমার গাড়িতে ওকে নিয়ে বের হচ্ছি। আপনারা আমার পেছন পেছন আসেন। বোঝেন তো, বাসা থেকে পুলিশের গাড়ি চড়ে ছেলে বেরোলে আর মান সম্মান থাকে না।’

ওসি মহসিন মধুর গলায় বলে, ‘কিন্তু স্যার এই নিয়ম তো নাই। ধনী গরীব সবার জন্য আইন সমান। ওনাকে পুলিশের গাড়িতেই যেতে হবে।’

করিমুল্লাহ হাসেন, ‘আপনি বৃহস্পতিবার রাতে আসামিকে গ্রেফতার করতে এসেছেন। তার মানে হলো আপনি দুটো দিন ওকে অনায়াসে থানায় আটকে রাখতে পারবেন। তাতে করে দর কষাকষির সুযোগ থাকে। আইনের দাড়িপাল্লাটা আমার দিকে একটু হেলিয়ে দিতে যা লাগে আপনাকে আমি তাই দেব। চলুন এবার।’

শেষ কথাটা একটু শক্ত গলাতেই বলেন।

থানায়া পৌঁছুতে খুব বেশি একটা সময় লাগে না। ওসি মহসিন খাতির করেই ওদের বসায়। তারপর চিন্তিত গলায় বলে, ‘স্যার, এখন কী করব আপনি তাই বলেন।’

করিমুল্লাহ ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘শুনুন মহসিন সাহেব, ছেলে মেয়েরা এই বয়সে প্রেম করে, ভালোবাসে। তাতে এক দুটো ভুল হয়ে যায়। যা হয়েছে ওই মেয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। আর সে আমার বাসায় এসেছে। তাকে তো জোর করে উঠিয়ে আনা হয় নাই। ঘটনার এতদিন পর কেন তারা মামলা করল?’

মহসিন একটু গম্ভীর গলায় বলে, ‘স্যার, মেয়েটাকে আপনার ছেলেই ওই এবরশনের ওষুধ খেতে বলেছিল। তাতে মেয়েটা মরতে বসেছিল।’

করিমুল্লাহ ওর দিকে তাকায়, তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘এটা খুব দুঃখজনক। আপনি ওদের থানায় আসতে বলেন, আমি ওদের কাছে ক্ষমা চাব।’

মহসিন একটু অবাক গলায় বলে, ‘আপনি ক্ষমা চাইলেই উনি মেনে নেবেন?’

করিমুল্লাহ মিটিমিটি হেসে বলেন, ‘আপনি দেখেন মেনে নেয় কি-না। ক্ষমা চাওয়ার নানান ধরন আছে। আপনি শুধু আসতে বলেন।’

মহসিন মাথা নাড়ে। এই লোক ভীষণ ধুরন্ধর। এ ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। ইশ, ভেবেছিল এই কেস থেকে অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নেবে, তা বোধহয় হলো না। আবার একে খেপিয়েও কাজটা করা যাচ্ছে না। এর হাত অনেক লম্বা।

দিলশাদ সবেমাত্র নওরিনকে রাতের খাবার খাইয়েছেন। ঠিক তখন থানা থেকে ফোন আসে, আহনাফ গ্রেফতার হয়েছে। খবরটা শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। বারান্দায় এসে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলেন। জাফরকে আপাতত কিছুই বলেনি। শুনলে ও হয়তো উলটো অসুস্থ হয়ে যাবে। বাসায় ফিরে আসার পর থেকে সারাক্ষণ মেয়ের পাশে পাশে। নওরিনও কেমন পালটে গেছে। যে মেয়ে এতদিন বাবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকত সেই মেয়ে এখন বাবার পাশেই বসে থাকে। জাফর কিছু বলে না, শুধু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

ওপাশ থেকে ওসি মহসিন যখন থানায় যেতে বলে তখন দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কেন, থানায় আসতে হবে কেন?’

মহসিন বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘ম্যাডাম, এটা কেসের নিয়ম। আসামি গ্রেফতার হলে বাদীপক্ষকে সেটা সনাক্ত করে দিতে হয়।’

দিলশাদ একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আমি আসছি।’

ঘন্টাখানেক পর দিলশাদ এসে পৌঁছে। করিমুল্লাহ উঠে দাঁড়ায়, সালাম দিয়ে বলে, ‘ভাবি, আমি করিমুল্লাহ, আহনাফের বাবা।’

দিলশাদ কড়া চোখে একবার তাকায়, তারপর ওসি সাহেবের দিকে ফিরে বলে, ‘আসামি কোথায়? চলুন আপনার সনাক্তকরণের কাজ শেষ করি।’

মহসিন তেলতেলে হাসি দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আপনি একটু বসুন। একটু কথা বলতে হবে।’

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কিসের কথা আবার?’

এবার করিমুল্লাহ বিনয়ের সাথে বলে, ‘ভাবি, ছেলে মেয়ে দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। তারা ভুল করে ফেলছে। তাই বলে তাদের তো আমরা ফেলে দিতে পারি না। আহনাফকে আপনার নিজের ছেলে মনে করে ক্ষমা করে দেন। ওদের সামনে পুরো জীবনটা পড়ে আছে।’

দিলশাদ মুখ কঠিন করে বলে, ‘ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন? আপনার ছেলে জোর করে কাজটা করেছে। আর সেটা রেপ কেস।’

করিমুল্লাহ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, ‘আপনার মেয়ে স্বেচ্ছায় আমার বাসায় এসেছিল। যা হয়েছে দু’জনের সম্মতিতেই।’

দিলশাদ চিৎকার করে বলে, ‘কী হয়েছে না হয়েছে আমি জানি না। আপনার ছেলের জন্য আমার মেয়ে মরতে বসেছিল। আপনার গুণধর ছেলে আমার মেয়েকে ওষুধ কিনে দিয়েছিল তার প্রমাণ আছে। তাই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে আপনার ছেলে অপরাধী কি-না।’

করিমুল্লাহ লম্বা একটা নিশ্বাস নেন, তারপর নিচু গলায় বলেন, ‘আপনাদের একটা মার্সিডিজ গাড়ি ছিল না?’

দিলশাদ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর কপাল কুঁচকে বলে, ‘হ্যাঁ, তো?’

করিমুল্লাহ নাক টেনে বলে, ‘ওটা আমরা কিনে নিয়েছিলাম। আমার তো গাড়ির ব্যবসা। অনেকেই বিপদে পড়ে গাড়ি বিক্রি করে। তাই বলছিলাম কী আপনার তো এখন বিপদ চলছে। শুধু শুধু কোর্ট-কাচারি করে এতগুলো টাকা নষ্ট করার কোন মানে নেই। তার চেয়ে আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। নওরিন মামনি তো বিদেশে পড়তে যেতে চায়, আমি ওর পড়ার জন্য দশ লাখ টাকা দিচ্ছি। ওরা দুজনেই একসাথে পড়তে গেল।’

দিলশাদ চেয়ে থাকে। এই লোকটা ওকে কেসটা আপোষ করার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে। তাও একদম ঠান্ডা মাথায়। দিলশাদ কেটে কেটে বলে, ‘আপনার টাকায় আমার মেয়ে বিদেশে পড়তে যাবে না। আর আপনার ছেলে জেলেই থাকবে, সেও বিদেশে যেতে পারবে না।’

করিমুল্লাহ চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর গম্ভীর মুখে বলেন, ‘আদালতে কেস উঠলে একটা সময় আমার ছেলের জামিন হবেই। কিন্তু আপনার মেয়ের নামে যে বদনাম জুটেছে সেটা কি ঘুচবে? আর আদালতে আমার উকিল যখন ধর্ষণের বর্ণনা শুনতে চাবে তখন সেটা আপনার মেয়ে নিতে পারবে তো? ভেবে দেখবেন। আর টাকাটা আমি দ্বিগুণ দেব। বিশ লাখ টাকা দেব, আপনি কেস উঠিয়ে নেন। আর তা না হলে আমি আমার পথে এগোব। আপনার কাছে যেমন কিছু প্রমাণ আছে তেমনি আমার কাছেও আছে। আপনার মেয়ে আমার ছেলের কাছ থেকে একশ ডলার নিয়েছে। আমি বলব আপনার মেয়ে টাকার বিনিময়ে এসব করে। তখন বুঝবেন কেস করার মজাটা।’

দিলশাদ শিউরে ওঠে। সামনে বসা লোকটাকে এখন বিষাক্ত সাপের মতো মনে হচ্ছে। যেকোনো সময় মরণ ছোবল দিতে পারে।

দিলশাদ গম্ভীর গলায় বলে, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। ওসি সাহেব, আপনি কেসটা আদালতে তোলার ব্যবস্থা করুন। আমি এখন বাসায় যাব।’

করিমুল্লাহ উঠে দাঁড়ায়, ‘ঠিক আছে, বাসায় যেয়ে ভাবুন। আমার ফোন নম্বর আপনাকে দিয়ে রাখছি, ভেবে আমাকে জানাবেন।’

দিলশাদ করিমুল্লাহর দিকে একবার কঠিন চোখে তাকায়, তারপর বেরিয়ে পড়ে।

দিলশাদ চলে যেতেই ওসি মহসিন বলে, ‘স্যার, তাহলে কী করব এখন?’

করিমুল্লাহ কপাল কুঁচকে একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘হাতে তো এখনও দু’দিন সময় আছে, দেখা যাক কী হয়।’

সেদিন রাতে করিমুল্লাহ যখন বাসায় ফেরেন পোলাও মাংসের একটা সুঘ্রাণ পান। কিন্তু সেই ঘ্রাণটায় কেন জানি আজ মাথা ধরে যায়। সালেহা বার বার আকুল গলায় ছেলের কথা জানতে চান। সেদিন রাতে ওদের কারও খাওয়া হয় না।

এদিকে দিলশাদ বাসায় ফিরতেই জাফর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘এত রাতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’

দিলশাদ গম্ভীর গলায় বলে, ‘কাজ ছিল। তুমি ঘুমাও। আমি আজ নওরিনের সাথে ঘুমোব।’

জাফর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। একটা সময় ও এমন গলায় কথা বলত। ব্যবসার কাজে প্রায়ই ফিরতে রাত হতো। তখন দিলশাদ জানতে চাইলে অতটা ভেঙে বলত না। দিন কেমন পাল্টে যায়, মানুষ অক্ষম হয়ে গেলে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। একটা হীনমন্যতা জাফরকে ঘিরে ধরে।

সেদিন সারারাত দিলশাদের ঘুম আসে না। করিমুল্লাহ লোকটা ভয়ংকর মানুষ। একটা আগুন ওর সব কেড়ে নিয়েছে। এখন এই আগুন না আবার ওর মেয়েকেও কেড়ে নেয়। এরা যদি নোংরামি করে ওর মেয়ের নামে ওই কুৎসিত কথাটা চালু করে দেয়? আর সাংবাদিকরাও যদি লিখে টাকার বিনিময়ে…’

কথাটা ভাবতেও পারে না দিলশাদ। এই কথা একবারও যদি নওরিনের কান পর্যন্ত পৌঁছায় ও বাঁচবে না। সাথে সাথে সুইসাইড করে ফেলবে। দিলশাদ বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। কেমন বুক ধড়ফড় করছে। নাহ, এদের সাথে লড়াটা বোকামি। এরা ওর সব কেড়ে নেবে। এমনিতেই হাসপাতালে নওরিনের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। গহনাগুলো বিক্রি করে নগদ টাকা যা পেয়েছিল তার প্রায় সবটুকুই শেষ। হাত একদম খালি। টাকার কথা মনে হতেই দিলশাদ একটু ভাবে। তারপর সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।

বাইরে ফজরের আজান দিচ্ছে। দিলশাদ করিমুল্লাহ সাহেবের ফোনে একটা মেসেজ পাঠায়। তারপর ওজু করে নামাজে দাঁড়ায়। এখন কেন যেন মনটা শান্ত লাগছে।

করিমুল্লাহর আজ ফজরের নামাজের ওয়াক্ত ছুটে গেছে। কোনোদিন এমন হয় না। রাতে ভালো ঘুম হয় নাই, তাই দেরি করে ঘুম ভাঙল। মন খারাপ নিয়ে ওজু করে কাজা নামাজে দাঁড়ান। নামাজ শেষে অনেকক্ষণ দোয়া করেন। তারপর কী মনে হতে মোবাইলটা হাতে নিতেই একটা মেসেজ দেখতে পান।

মেসেজটা খুলে পড়তেই মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে সালেহাকে ডাক দেন। সালেহা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। বিহবল গলায় বলেন, ‘এই তুমি এমন পাগলের মতো চিৎকার করছ কেন?’

করিমুল্লাহ খুশি গলায় বলে, ‘কালকের বাসি পোলাও মাংস গরম করো। আমরা সবাই একসাথে খাব।’

সালেহা বুঝতে না পেরে বলে, ‘কী বললে? সেটা কী করে সম্ভব?’

করিমুল্লাহ রহস্যের গলায় বলে, তোমার এত কিছু বুঝতে হবে না। আমি বাইরে যাচ্ছি আহনাফকে নিয়ে আসতে। আর আমার চেক বইটা দাও তো।’

সালেহার কেমন সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগে। সত্যিই আহনাফ আজ বাড়ি ফিরে আসবে?

সেদিন আহনাফ ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে আসে। বাবা মায়ের সাথে একসাথে বসে বাসি পোলাও মাংস খুব মজা করে খেতে থাকে।

আর দিলশাদ বিশ লাখ টাকার একটা চেক সন্তর্পণে নিজের ওয়ারড্রব এর ড্রয়ারে তালা দিয়ে লুকিয়ে রাখে। এই জীবনে এই চেকের কথা ও কাউকেই বলতে পারবে না। করিমুল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে যে উনি এই টকা লেনদেনের কথা যেন কাউকে না বলেন। নগদ টাকার ভীষণ দরকার ছিল। দিন দিন ওর মনে একটা ভয় ঢুকে যাচ্ছিল, জাফর বুঝি আর কোনদিন আগের মতো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে, সামনে অনেক খরচ। আর টাকা ছাড়া যে সেগুলো সবই অসম্ভব। তাই শেষ পর্যন্ত টাকার কাছে নতি স্বীকার করতে হলো। পৃথিবীতে মানুষ আসলে ভীষণ অসহায়। মানুষের ক্ষুধা পায়, অসুখ হয় – তার জন্য প্রতিটি মুহুর্তে অর্থের জোগান লাগে। বেঁচে থাকার জন্য কত কী-ই না করতে হয় মানুষকে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৪

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৪)

১.
মে মাসের প্রথমেই আজ কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। তাতে করে আশেপাশের গাছের এক দুটো শাখা এসে লনের উপর কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে। জাফর খান জানালা দিয়ে চেয়ে আছেন। পড়ে থাকা গাছের ভাঙা ডালটা যেন নিজেই। হঠাৎ করে কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই ওর সবকিছু ভেঙেচুরে অবহেলায় মাটিতে ফেলে দিয়েছে। গত মাসে ফ্যাক্টরিটা বিক্রি করে দিতে হলো। আজ প্রিয় মার্সিডিজ গাড়িটা নিতে লোক আসবে। ড্রাইভারের বেতন, তেল খরচ, মেইনটেন্যান্স – সব মিলিয়ে লাখ টাকার মতো খরচ মাসে। এখন এটা পোষা মানে হাতি পোষার মতো।

জাফর গভীর আগ্রহ নিয়ে লনের এককোণে পার্ক করে রাখা প্রিয় গাড়িটা দেখতে থাকেন। আজ গাড়িটা ঝকঝক করছে। ড্রাইভার জামাল কেমন মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাফরের অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হচ্ছে। শেষবারের মতো গাড়িটায় চড়তে ইচ্ছে করছে। দিলশাদকে ডেকে বলবেন?

এমন সময় দিলশাদ কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। তারপর সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘মন খারাপ কোরো না। প্রিমিও গাড়িটা তো রয়েই গেল। মার্সিডিজ গাড়িটা বিক্রি করার দরকার ছিল। এখন একটা গাড়ি থাকলেই চলবে। আমাদের এখন অনেক ভেবেচিন্তে চলতে হবে। তুমি সুস্থ হও এটাই এখন বড়ো চাওয়া।’

একটু পর গাড়ি নিয়ে যাবার জন্য একজন আসেন। এরা গাড়ির দাম আগেই মিটিয়েছেন। একজন নতুন ড্রাইভার জামালের কাছ থেকে চাবি বুঝে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। তারপর স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে বের হয়ে যায়। পেছনে জামাল শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। জাফরের মনে হয় উনি জানালা দিয়ে একটা সিনেমা দেখছেন। টাইটানিক ডুবছে, আর সেটা খুব দ্রুতই ডুবছে।

দিলশাদ সেদিন হিসেব করতে বসেন। সঞ্চয়পত্র, গাড়ি বিক্রির টাকা সব মিলিয়ে দু’কোটি টাকার মতো ব্যাংকে আছে। তাতে করে সব কেটেকুটে মাসে দেড় লাখ টাকা পাওয়া যাবে। এর মধ্যেই সব খরচ সামাল দিতে হবে। বড়ো খরচের মাঝে এখন আরুশের স্কুলের খরচ। ওর তিনটা টিউশনের মাঝে ম্যাথটা রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। নওরিনকে বলতে হবে এখন থেকে আরুশের পড়াটা দেখিয়ে দিতে। এটা হলে মাসে বিশ হাজার টাকা খরচ বেঁচে যায়। এরপর নিচের দারোয়ান এর বেতন, খাওয়া-দাওয়া মিলে হাজার বিশেক টাকা খরচ আছে। একে বাদ দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আপাতত ক’টা দিন থাকুক। সেদিনের অমন শ্রমিকদের আক্রমণ ওকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। এখন অবশ্য সেই সমস্যা নেই।

রান্নার বুয়াটা নিয়েও ভাবতে হবে। এর বেতন পনের হাজার টাকা। আর অন্যান্য খরচ তো আছেই। কিন্তু এতদিক সামলে রান্নার কাজ কি পারবেন? নাহ, হাজেরাকে রাখতেই হবে।

এরপর জাফরের ফিজিওথেরাপির খরচ। এটাও অনেক। আচ্ছা, ও কি আর আগেরমতো উঠে দাঁড়াতে পারবে না?

দিলশাদ চিন্তিত মুখে ক্যালকুলেটর চেপে অংকটা দেখেন। সব মিলিয়ে এক লাখ উনচল্লিশ হাজার টাকা খরচ মাসে। একদম টায়টায়। কোনো মাসে একটু বেশি খরচ হলেই লোন করতে হবে। কেমন যেন দিশেহারা লাগে দিলশাদের। দমবন্ধ হয়ে আসে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে ব্যাংকের ভল্টে পঞ্চাশ থেকে ষাট ভরির মতো স্বর্ণ আছে। ওখান থেকে অল্প কিছু স্বর্ণ বিক্রি করবে? একটু ভাবে দিলশাদ। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

নওরিনকে ডেকে রেডি হতে বলে। তারপর জাফরের কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘আরুশ বাসায় রইল। আমি নওরিনকে নিয়ে একটু ব্যাংকে যাই।’

জাফর মাথা নাড়ে। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। অক্ষম রাগে দাঁতে দাঁত ঘষেন। এই দুঃসময়ে ওর অসুস্থতাটা অভিশাপ মনে হয়। ওরা চলে যায়। বাড়িটা কেমন নিঝুম এখন।

একটু পর আরুশ একটা ছোট লাল বল নিয়ে এসে ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘বাবা, এটা ছুড়ে মারতে পারবে?’

কিছুদিন ধরে এই খেলাটা শুরু করেছে আরুশ। হয়তো দিলশাদ ছেলেকে বুঝিয়েছে বাবা এটা ছুড়ে মারতে পারলেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু জাফর একবারও বলটা ছুড়ে মারতে সফল হয়নি।

আজ আবার বলটা বাম হাতের মুঠোতে পুরেন। তারপর শরীরের সব শক্তি এক করে হাতটা তোলার চেষ্টা করেন। টের পান শরীর কাঁপছে, ঘেমে যাচ্ছেন। দাঁতে দাঁত চেপে বাম হাতটা একটু তুলে ধরেন। তারপর বলটা ছুড়ে মারতেই পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে যায়।

আরুশ ছুটে এসে বলটা হাতে নেয়। চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করছে। ও চিৎকার করে বলে, ‘বাবা! আজ পেরেছ তো! নাও, আবার মারো।’

ছেলের উত্তেজনা দেখে জাফরের মনটা ভালো হয়ে যায়। ইশ, যদি খুব জোরে বলটা ছুড়ে মারতে পারতেন। তাতে করে বুঝি ওর সব আগেরমতো হয়ে যেত।

জাফর এবার বলটা শক্ত করে ধরার চেষ্টা করেন। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে হাতটা উঁচু করার চেষ্টা করেন। হাতটা কেমন কাঁপছে। এবার আর দেরি না করে বলটা মুঠো ছাড়া করেন। বলটা এক সেকেন্ডের কম সময় বাতাসে ভাসে, তারপর পা থেকে এক ফুট দূরে গিয়ে বলটা পড়ে।

আরুশ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, ‘ওয়েল ডান বাবা।’

জাফর মনের ভেতর বাচ্চাদের মতো একটা আনন্দ টের পান। পারছে ও, একটু একটু করে পারছে। নাহ, এতদিন ও তেমন করে চেষ্টাই করেনি। এখন থেকে ও সুস্থ হবার চেষ্টা করবে। তারপর আবার আগেরমতো সব ঠিকঠাক করে ফেলবে। দিলশাদের উপর ভীষণ চাপ যাচ্ছে। এত কিছু ও এক হাতে সামলাতে পারবে তো?

২.
‘সেনকো’ জুয়েলার্সের ম্যানেজার আলমাস আজ সকাল থেকেই অলস বসেছিলেন। এখন পর্যন্ত তেমন করে বেচাকেনা হয়নি। স্বর্নের যে দাম বেড়েছে তাতে করে মানুষজন বুঝি গহনা বানানো কমিয়ে দিয়েছে।

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন দিলশাদ খান সাথে নওরিনকে ভেতরে ঢুকতে দেখে। আলমাসের মুখে হাসি ফোটে। উঠে সামনে এগিয়ে যান, আন্তরিক গলায় বলেন, ‘ম্যাডাম, অনেক দিন পর আসলেন আমাদের এখানে। আপনি আমাদের ভি আই পি কাস্টমার। আপনারা না এলে যে আমরা না খেয়ে মারা যাব। এই বাবলু, দুইটা কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে আয়। আর কিছু খাবেন ম্যাডাম? আর মামণি তুমি অন্য কিছু খাবে?’

দিলশাদ মনে মনে সংকুচিত হয়ে যান। এখান থেকেই প্রায় সব গহনা নেওয়া। এরা তাই খুব খাতির করে। দিলশাদের মনে পড়ে না এখান থেকে কখনও খালি হাতে গিয়েছেন। ছোট্ট একটা আংটি হলেও নিয়েছেন। অথচ আজ!

দিলশাদ একবার নওরিনকে জিজ্ঞেস করে অন্য কিছু খাবে কি-না। ও মাথা নেড়ে না করে। মেয়েটা ইদানিং কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। খেতে চায় না। সারাক্ষণ নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। নিজেদের হঠাৎ এই বিপর্যয় হয়তো ও মেনে নিতে পারছে না, ভাবেন দিলশাদ।

দিলশাদ এবার ম্যানেজার আলমাসের দিকে তাকিয়ে সংকুচিত গলায় বলে, ‘আসলে এবার কিনতে আসিনি। আমার হঠাৎ করে একটা জরুরি প্রয়োজনে এই গহনাগুলো বিক্রি করতে হবে। আমি রশিদ নিয়ে এসেছি। আপনি কি একটু দেখবেন এখানে ঠিক কতটুকু গহনা আছে?’

আলমাস অবাক হয়ে দিলশাদ ম্যাডামের বাড়িয়ে দেওয়া গহনার বক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইনি এর আগে যতবারই এসেছেন ততবারই দামি গহনা কিনে নিয়ে গেছেন। অন্য কাস্টমারদের মতো গহনার মজুরি নিয়ে ঝোলাঝুলি করেননি। সেই মানুষ আজ গহনা বিক্রি করতে এসেছেন?

নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম। আমরা তো এই সার্ভিসটা দেই। আমাদের এখান থেকে কেনা গহনা আমরা ন্যায্যমূল্যেই কিনে নেই। আমি ওজন দিয়ে দেখছি।’

দিলশাদ ছোট্ট করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। ব্যাপারটা এত সহজ হবে ভাবেননি।

ওজন দেওয়া শেষ হতেই আলমাস হাসিমুখে জানান, ‘ম্যাডাম, পাঁচ ভরি আট আনা। একটু কম আছে অবশ্য। আট আনা ধরেই হিসেব করছি।’

সব মিলিয়ে আলমাস যখন সাড়ে চার লক্ষের কাছাকাছি টাকা ওর হাতে দেয় তখন ও অবাক হয়ে যায়। ভেবেছিল ওরা অর্ধেক দাম দেবে।

দিলশাদ কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘থ্যাংকিউ, আলমাস সাহেব।’

আলমাস হাত কচলে বলে, ‘ম্যাডাম, এরপর যদি বাকি গহনাগুলো বিক্রি করেন তাহলে আমার কাছেই এসেন। আমি আপনাকে সর্বোচ্চ দামটাই দেব।’

দিলশদ মাথা নেড়ে নওরিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গাড়িতে উঠে বলেন, ‘কী রে, তুই তো আজ সকালেও কিছু খাস নি। কিছু খাবি?’

নওরিন মাথা নেড়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে থাকে। একটা দুশ্চিন্তা ক’দিন ধরেই ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তিন দিন আগেই ওর পিরিয়ডের ডেট ছিল। এবার হয়নি। বার বার ও ওয়াশরুমে যেয়ে দেখেছে, কোনো লক্ষণই নেই এবার। দিন যত গড়াচ্ছে ওর বুকের ভেতর কেমন শুকিয়ে আসছে। ও কী তবে কনসিভ করে ফেলল! ভাবনাটা ভাবতেই শরীর হিম হয়ে আসে। এসি গাড়ির ঠান্ডা বাতাসে ও আরও গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে।

৩.
ভোরের আলো এখনও ফোটেনি। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই হয়তো সূর্য উঠবে। নওরিন বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমে রুমের দরজাটা বন্ধ করে। তারপর ওয়ারড্রব এর ভেতর কাপড়ের নিচ থেকে একটা প্রেগন্যান্সি ডায়াগনস্টিক কিট বের করে। একবার তাকায়। কাল আহনাফ এটা কিনে দিয়েছে। বলেছে আগে পরীক্ষা করে দেখতে।

নওরিন ওয়াশরুমে যেয়ে ইউরিন স্যাম্পল নিয়ে কাঁপা হাতে কিটটা ডোবায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। একটা দাগ ওঠেছে। মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে আরেকটা দাগ যেন না ওঠে। নিচের ঠোঁট জোরে কামড়ে ধরে ও নির্নিমেষে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। ঝাপসা চোখে দেখে আরেকটা দাগ স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও জ্ঞান হারাব। পুরো পৃথিবী যেন দুলে উঠছে। দ্রুত ও সামনের দেয়াল ধরে বাথরুমের ফ্লোরে বসে পড়ে। কেমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ওর।

বুক কাঁপিয়ে কান্না আসছে। ফিসফিস করে ও বলে, ‘আম্মু তুমি কোথায়, আমার ভীষণ ভয় করছে।’

বেড রুমের দরজায় শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। নওরিন উঠে বসে। খেয়াল করে ঘড়িতে সকাল আটটা। এতক্ষণ এই বাথরুমের ফ্লোরেই ঘুমিয়েছিল ও!

দ্রুত উঠে পড়ে। গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘আম্মু, খুলছি।’

দরজা খুলতেই যেতেই হঠাৎ হাতে থাকা প্রেগন্যান্সি কিটটার দিকে চোখ পড়তেই ও থমকায়। দ্রুত ওয়ারড্রব খুলে কাপড়ের ভাঁজে জিনিসটা লুকিয়ে ফেলে। তারপর কুঁচকে যাওয়া জামাটা দু’হাতে ঠিক করে নিয়ে এবার ও দরজা খোলে।

দিলশাদ বিরক্ত গলায় বলে, ‘সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কাছি, খুলছিস না কেন। তোর বাবার একটা ওষুধ রেখেছিলাম তোর রুমে। আর তোকে বলেছি না দরজা বন্ধ করে ঘুমাবি না?’

গজগজ করতে করতে দিলশাদ ওর রুমে টেবিলের উপর থেকে একটা ওষুধের প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে যান।

নওরিন বিছানায় এসে বসে। কী করবে ও এখন? আহনাফ কী ঘুম থেকে উঠেছে? কাল ও বলেছিল টেস্ট করেই ওকে জানাতে। একবার ফোন করে, রিং বেজে বেজে কেটে যায়। আবার ফোন দেয় ও। এবার ওর ঘুম জড়ানো গলা পাওয়া যায়, ‘কী রে, এত সকালে ফোন দিয়েছিস কেন?’

নওরিন অবাক হয়ে খেয়াল করে আহনাফ টেস্টের কথা ভুলে গেছে। ও একটা ঢোঁক গিলে বলে, ‘আহনাফ, আমি প্রেগন্যান্ট।’

আহনাফ এসি ছেড়ে পাতলা একটা কাঁথা গায়ে ঘুমিয়েছিল। নওরিনের কথায় ওর ঘুম ছুটে যায়। ও চিৎকার করে বলে, ‘কী বললা! তুমি প্রেগন্যান্ট!’

ওর গলার স্বর ভীষণ কর্কশ শোনায়। নওরিন লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক শুনেছ। সেদিন অমন জোর করে আদর করলে, আমি কত বার না করেছি। এখন বলো আমি কী করব?’

আহনাফের তলপেট কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। ও তোতলানো গলায় বলে, ‘একবারেই কেউ এমন করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়?’

নওরিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তার মানে তুমি কী বলতে চাচ্ছ? আমি অন্য কারও সাথে শুয়েছি? এর দায় তোমার। বাসায় সবাইকে বলো, আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে।’

আহনাফ এবার ভয় পায়। বিপদটা যে ওর দিকে ঘুরে আসতে পারে সেটা বুঝতে পারে। ও বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘নওরিন, এখন বাসায় বিয়ের কথা বললে বাবা ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের করে দেবে। আর তুমি কি ভুলে গেলে আমি আর তুমি বিদেশে পড়ার জন্য এপ্লিকেশন করলাম, তাতে লেখা ছিল আমরা অবিবাহিত। এখন বিয়ে করলে তো ঝামেলা।’

নওরিন দিশেহারা গলায় বলে, ‘আমি কিছু বুঝি না। তুমি বিয়ে না করলে আমি আত্মহত্যা করব।’

আহনাফ আতংকিত গলায় বলে, ‘এসব কী বলছ তুমি! একটু মাথা ঠান্ডা করো। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। কিন্তু তুমিও ভালো করে ভেবে দেখো এই বাচ্চা তুমি রাখতে চাও কি-না? আমাদের এখন ফূর্তি করার বয়স। এখন কি তুমি বাচ্চা নিয়ে ক্যালাসের মতো বসে থাকবা?’

নওরিন থমকায়। আহনাফ ঠিক কথা বলেছে। ও ভাবতেই পারে না একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ও বসে আছে। জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তাহলে কী করব?’

আহনাফ একটু ভেবে বলে, ‘আমি শুনেছি এবরশনের ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এটা খেলেই নাকি সব আবার আগেরমতো ঠিক হয়ে যায়। দাঁড়াও, আমি আজকেই ওষুধের দোকানে কথা বলে নেই। তুমি বিকেলে আমাদের সেই রেস্টুরেন্টে একবার আসো। আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব।’

বিকেলে নওরিন যখন ওদের প্রিয় রেস্টুরেন্টে পৌঁছে ততক্ষণে আহনাফ চলে এসেছে। ওকে দেখেই কাছে এগিয়ে একটা হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘লাভ ইউ বেবি। তুমি একদম ভেব না। আমি ওষুধ নিয়ে এসেছি। ওরা বলল এটা নাকি খুব নিরাপদ। আর তোমার তো মাত্র ক’টা দিন হয়েছে। এটা খেলেই তুমি একদম ক্লিন হয়ে যাবে।’

নওরিন বসতে বসতে বলে, ‘সত্যি? আমার কিছু হবে না তো আবার?’

আহনাফ জোর গলায় বলে, ‘কিচ্ছু হবে না। আর আমি আছি তো তোমার পাশে। আমি তোমাকে ভালোবাসি নওরিন। কিন্তু এখন আমরা বাবা মা হলে আমাদের নিজের জীবনটা এনজয় করতে পারব না।’

নওরিন মাথা নিচু করে বসে থাকে। স্যুপ আসে, সাথে অন্থন। আহনাফ নিজে একটা বাটিতে স্যুপ বেড়ে দেয়। নওরিন অস্ফুটে বলে, ‘আহনাফ, চলো না বিয়ে করে ফেলি। আমাদের প্রথম বাবুটাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে না।’

আহনাফ একটু থমকায়। বিরক্ত গলায় বলে, ‘কেন শুধু শুধু জটিল করছ? ওষুধ খাবে, ব্যাপারটা ক্লিন হয়ে যাবে। আমাদের এখনও পড়াশোনা শেষ হয়নি। অনেক পথ যাওয়া বাকি। আর বাবা মা কেউই এটা মেনে নেবেন না।’

নওরিনের চোখ ভিজে যায়। কেন ও এমন করল। মা জানতে পারলে কী করবে ওকে? আর বাবা? ওদের এমন দুর্দিনে ও এমন একটা কাজ করতে পারল? এটা জানলে উলটো আরও অশান্তি হবে। বাবা হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার চেয়ে চুপিচুপি ওষুধটা খেয়ে ফেলাই ভালো।

নওরিন চোখ মুছে বলে, ‘আচ্ছা, খাওয়ার নিয়মটা আমাকে বুঝিয়ে দাও।’

আহনাফ এবার আগ্রহের সাথে বুঝিয়ে দিতে থাকে। নওরিনের মনে হয় ওকে মৃত্যুর পথ বাতলে দিচ্ছে আহনাফ।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নওরিন ওষুধটা খায়। তারপর টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অনেকক্ষণ কিছু ঘটে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।

সেদিন নওরিনের ঘুম ভাঙে শেষ রাতে, তলপেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে। আর সেই সাথে টের পায় বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ও দ্রুত উঠে বসতেই মাথাটা কেমন ঘুরিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। সারা শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে সেই সাথে তীব্র একটা কাঁপুনি। নওরিন বিছানা হাতড়ে একটা কাঁথা গায়ে দেয়। নাহ, তাও ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু রক্ত বন্ধ হচ্ছে না কেন? ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। দুটো প্যাড পরতে হতো। কিন্তু কিছুতেই ও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। ও কি মরে যাচ্ছে? আম্মু, বাবা আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাদের খারাপ সন্তান। ছোট্ট আরুশ, ভাইটা আমার ক্ষমা করে দিস।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

আলো অন্ধকারে পর্ব-০৩

0

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৩)

১.
বৈশাখ মাসের আজ দ্বিতীয় দিন। কিন্তু গরম পড়েছে জ্যেষ্ঠ মাসের। জাফর খান একবার মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকান। জোর হাওয়া দিচ্ছে, কিন্তু গরম হাওয়া। এই বাসা সেন্ট্রাল এসি করা। আজ এসি চলছে না। কেন চলছে না সে নিয়ে অবশ্য জাফর খান কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। দিলশাদ কিছুদিন ধরেই এমন করছে, হয়তো খরচ বাঁচাতে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে বসা মানুষগুলোর দিকে তাকান – ফ্যাক্টরি ম্যানেজার মহিবুর, ব্যাংকের লোক, দলিল লেখক আর হালিমুজ্জামান সাহেব যিনি আজ ওর ফ্যাক্টরিটা কিনতে এসেছেন। সেদিন ওর ফ্যাক্টরির শ্রমিকেরা যখন বাসার মূল দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল ঠিক তখন পুলিশ এসে উপস্থিত হয়েছিল। ওদের লাঠিচার্জ করে সরিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু জাফর খান আর ঝুঁকি নিতে চাননি। ওদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন দু’মাসের মধ্যেই সবার বকেয়া বেতন মিটিয়ে দেবেন। কেন জানি সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলেন। আগুনে ওর সব পুড়েছে। কিন্তু এখন যে ওর প্রাণের চেয়ে প্রিয় মানুষদের জীবন সংশয়। কেন যেন আগের সেই সাহসটা আর নেই। ভীতু একজন মানুষ হয়ে গেছেন। তিনমাস হয়ে গেছে এখনও অচল হওয়া হাত পা সচল হয়নি। মাঝখান দিয়ে ওর ফিজিওথেরাপি দিতে জমা টাকাগুলো জলের মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে। খুব সংকোচ হয় ইদানিং।

ইতোমধ্যেই সবাইকে চা দেওয়া হয়েছে। একেকজন একেক কথা বলছে। পেঁয়াজের দাম কেন কমছে না, রাস্তায় কী ভীষণ জ্যাম থাকে – এইসব হাবিজাবি কথা। জাফর খান ওদের গল্পের সাথে তাল মেলাতে পারেন না, বার বার খেই হারিয়ে ফেলেন।

ঠিক এমন সময় রেজিস্ট্রি অফিস থেকে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক এসেই তাড়াহুড়ো করে বলেন, ‘কই, দলিল রেডি?’

দলিল লেখক মনিরুল ইসলাম তেলতেলে হাসি দিয়ে বলে, ‘সেই কখন থেকে রেডি কইরা বইসা আছি। আপনি এখন খালি আঙুলের ছাপ নেন।’

লোকটা ব্যাগ থেকে কালির প্যাডটা বাড়িয়ে দেন।

মনিরুল জাফর খানের দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘স্যার, বাম আঙুলটায় কালি লাগাইয়া এইহানে ছাপ দেন।’

জাফর অসহায় চোখে একবার তাকায়। মনিরুল ঠিক বুঝতে পারে না। এমন সময় ভেতর থেকে দিলশাদ আসতেই সবাই সালাম দেয়। দিলশাদ এসে জাফরের অচল বাম হাতটা তুলে ধরে।

তারপর একবার ওর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে, ‘আঙুলের ছাপ যে দিতে হবে। ভেবে দেখো, এখনও সময় আছে। তুমি না চাইলে আজ থাক।’

জমি কিনতে আসা হালিমুজ্জামান ঢোঁক গেলেন, তাড়াহুড়ো করে বলেন, ‘ভাবি, এখন কিন্তু জমির দাম বেশি আছে। আমারও হাতে টাকা আছে। পরে আপনারা বিক্রি করতে চাইলেও কিন্তু আমি নিতে পারব না।’

জাফর এবার কষ্ট করে বলে, ‘দিলশাদ, আঙুলের ছাপ নাও।’

দিলশাদ ঠোঁট কামড়ে চোখের জল আটকান। এমন করে এতদিনের কষ্ট করে গড়ে তোলা ব্যবসাটা বিক্রি করে দিতে হবে?

বুড়ো আঙুলটা কালির প্যাডে চেপে ধরেন। তারপর হলুদ রঙের দলিলের পাতায় কালো ছাপ পড়ে। বুকটা কেঁপে ওঠে জাফরের। হঠাৎ করেই নিজেকে নিঃস্ব লাগে। এতদিন তাও “দিলশাদ গার্মেন্টসটা” কাগজে কলমে ওর ছিল। আজ যে একেবারে অন্যের হয়ে গেল। আজ থেকে ওর কোনো অধিকারই রইল না। সত্যিকারের নিঃস্ব হয়ে গেল ও।

দিলশাদ ওর মনের অবস্থাটা টের পান। একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেন।

ওদিকে হালিমুজ্জামান আঙুলের ছাপ দিয়ে বেশ জোরের সাথে বলেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’।

কেউ একজন সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে থাকে। হালিমুজ্জামান একটা বড়ো অংকের চেক অন্য একটা ব্যাংকের নামে সই করে দেন। এই ব্যাংকেই জাফর খানের প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকার মতো ঋণ ছিল।

ব্যাংকের লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘স্যার, আমরা নিরুপায়। এতগুলো টাকা লোন ছিল আপনার। আমি তাও চেষ্টা করব আপনার ইন্টারেস্ট এর টাকাগুলো মওকুফ করতে। ব্যাংক তো মূল টাকা পেয়েই গেছে।’

জাফর খান গম্ভীরমুখে মাথা নাড়েন। এই ব্যাংকের লোকদের বিশ্বাস নেই। মূল টাকা নিয়েই ক্ষান্ত দেবে তেমন মনে হয় না।

হালিমুজ্জামান এবার সামনে এসে ঝুঁকে ওর হাত ধরে বলে, ‘ভাই, আপনার জন্য দোয়া করি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আপনি মন খারাপ করবেন না। আমার গার্মেন্টস মানে আপনার গার্মেন্টস। যখনই মন চাইবে চলে আসবেন। দুই ভাই মিলে অনেক গল্প করব।’

জাফর হাসার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেটা ঠিক হাসির মতো হয় না।

ওরা সব একে একে বিদায় নেন। শুধু মহিবুর থেকে যায়।

সবাই চলে যেতেই মহিবুর দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ম্যাডাম, ব্যাংকের লোন শোধ করে আর পঞ্চাশ লাখ টাকা আছে। এখান থেকে বকেয়া বেতন মেটাতে প্রায় চুয়াল্লিশ লাখ টাকা লাগবে। আর বাকি ছয় লাখ টাকা আমি আপনার একাউন্টে জমা করে দিচ্ছি।’

বুকটা কেঁপে ওঠে দিলশাদের। মাত্র নগদ ছয় লাখ টাকা হাতে থাকবে! তাও আগে কিনে রাখা সঞ্চয়পত্রে হাত পড়েনি এখনও। দু’জনের নামে মোট কোটি খানেক টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা ছিল। কখনও ভাবেনি এই টাকা থেকে পাওয়া ইন্টারেস্টের উপর ভর করে সংসার চালাতে হবে।

মহিবুর চলে যায়। দিনের আলো নিভে রাতের আয়োজন শুরু হয়। দিলশাদের হঠাৎ করেই মনে হয় ওদের জীবনে অন্ধকার রাত শুরু হলো।

২.
রেণু গুন গুন করে কাঁদছে। দিলশাদ যতই বোঝান ততই রেণুর কান্নার দমক বেড়েই চলছে। তাতে করে ওর গালের রোজ ধুয়ে মুখ মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ে সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকত। বাসায় ওর কাজ ছিল মেহমান আসলে আপ্যায়ন করা। দেখতে শুনতে মেয়েটা স্মার্ট ছিল। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা রপ্ত করেছে। কিন্তু ওকে এখন আর রাখার সামর্থ্য নেই দিলশাদের। শুধু এই অল্প কাজের জন্য মাসে আট হাজার টাকা বেতন পেত। আর থাকা খাওয়া, জামা কাপড় ফ্রি তো পেতই। কিন্তু ওকে রাখা এখন বিলাসিতা।

দিলশাদ এবার ধমক দেন, তারপর বলেন, ‘রেণু, কান্না বন্ধ কর। কাল তুই এই বাসা থেকে চলে যাবি। আর এখানে তোর এক মাসের বেতন আছে, এটা রাখ।’

রেণু চোখ মুছে বলে, ‘ম্যাডাম, আমারে বেতন দিতে হইব না। শুধু পেটে ভাতে রাইখেন।’

দিলশাদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোকে পেটে ভাতে রাখার অবস্থাও আমাদের নেই। কিছু মনে করিস না, বুঝিসই তো কী একটা বিপদ আমাদের।’

রেণু এবার বুঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, ‘ম্যাডাম, আমি কাইলই চইলা যামু। আর এই টাকাটা লাগব না। আপনাগো এমন বিপদে এই টাকা আমি নিতে পারি না।’

দিলশাদের হুট করেই রাগ উঠে যায়। সামান্য কাজের মেয়ে ওকে আজ দয়া করছে! কর্কশ গলায় বলেন, ‘টাকা রাখ। এত গরীব হয়ে যাইনি যে তোর কাছ থেকে দয়া ভিক্ষা করতে হবে। কাল সকালে যেন তোকে চোখের সামনে না দেখি।’

রেণু হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। ম্যাডাম কখনও রাগারাগি করত না। বিপদে পড়ে ম্যাডামের মাথার গোলমাল হয়ে গেছে।

দিলশাদ রাগে গজগজ করতে করতে বারান্দায় চলে যায়। জাফর অনেকক্ষণ ধরেই বারান্দায় একা বসা। ওর কাছে এসে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘রেণু পর্যন্ত আজ দয়া দেখাতে চায়, দেখেছ কী সাহস!’

জাফর বুকের ভেতর একটা কষ্ট টের পান। ও ডান হাতে দিলশাদের হাত চেপে ধরে অস্পষ্ট গলায় বলেন, ‘তোমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সব একা সামলাতে।’

দিলশাদ মাথা নেড়ে বলে, ‘সেটা কোনো সমস্যা না। আমি মোটামুটি হিসেব করে ফেলেছি। কিছু খরচ কমিয়ে ফেলতে হবে। ভাবছি আরুশকে সামনের বছর কাছের একটা সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি করে দেব। ওর স্কুলের বেতন, টিচারের খরচ প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। ভাগ্যিস নওরিনের এ লেভেল শেষ। ওকে বলব পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির চেষ্টা করতে।’

জাফর বিড়বিড় করে বলে, ‘কিন্তু ও ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চেয়েছিল।’

দিলশাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, উঁচু গলায় বলেন, ‘তোমারও দেখি মাথার ঠিক নেই। এই অবস্থায় এখনও তুমি ওসব আকাশ কুসুম ভাবছ?’

রাগ করে উঠে পড়েন। লিভিংয়ে যেতেই মেয়ের মুখোমুখি হন। নওরিন মায়ের মুখ চেয়ে বলে, ‘আম্মু, আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে পারবে?’

দিলশাদ চোখমুখ শক্ত করে বলেন, ‘নওরিন, তুমি এখন বড়ো হয়েছ। নিশ্চয়ই আমাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছ এখন। আগে মাসে মাসে যে হাত খরচের টাকা পেতে এখন থেকে সেটা আর পাবে না।’

নওরিন মুখ নিচু করে বলে, ‘কিন্তু আম্মু টাকাটা যে আমার খুব দরকার। আমি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করব, তার জন্য এপ্লিকেশন বাবদ এই টাকাটা এখন লাগবে। দাও না প্লিজ।’

দিলশাদের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়, চিৎকার করে বলেন, ‘তুই আর তোর বাবার কোনো বাস্তব জ্ঞান নেই। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পড়বে! এহ, একটা পয়সা নেই সংসার চালানোর আর সে ইয়েলে পড়বে। কান খুলে শুনে রাখ, দেশে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রিপারেশন নে।’

কথাটা বলে দিলশাদ আর দাঁড়ান না। গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে যান।

নওরিনের চোখ জলে ভরে যায়। আম্মু কখনও ওকে বকা দেয়নি। টাকা নিয়ে তো নয়ই। ওরা কী খুব গরীব হয়ে গেছে?

ঠিক এই সময় ওর বন্ধু আহনাফের ফোন আসে, ‘কী রে, তুই এপ্লিকেশন করবি না? কালই তো লাস্ট ডেট। কথা ছিল তুই আর আমি একসাথে একই ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করব।’

নওরিনের কেন জানি ভীষণ কান্না পায়। ও ফোনটা কেটে দেয়। ওপাশ থেকে আহনাফ বার বার ফোন দিতে থাকে। কিন্তু নওরিন কিছুতেই ফোন ধরে না।

আরুশ মন দিয়ে পড়ছিল। একটু আগেই আম্মু আপুকে বকেছে। ইদানিং অল্পতেই আম্মু বকা দেয়। আরুশের খুব ভয় করে। তাই ও আজ কিছু বলার আগেই বই নিয়ে বসেছে। পড়তে পড়তে আরুশ হঠাৎ করেই বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। নিচের লনটা অন্ধকার। রাতে তো লনটায় নানান রঙের আলো জ্বলে। বাতিগুলো নষ্ট হয়ে গেল? আম্মুকে জানানো দরকার। কথাটা মনে হতেই ও উঠে দাঁড়ায়। তারপর খুঁজতে খুঁজতে আম্মুকে রান্নাঘরে দেখতে পায়।

কাছে যেয়ে উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘আম্মু, লনের বাতিগুলো জ্বলছে না, বাইরে অন্ধকার।’

দিলশাদ হতাশ চোখে ছেলের দিকে তাকান। এই বাসার কেউ কি বুঝবে না ওরা গরীব হয়ে গেছে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘এখন থেকে অন্ধকারই থাকবে। তুই তোর পড়া কর গিয়ে।’

আরুশ আর দাঁড়ায় না। মাথা নেড়ে ওর পড়ার রুমে চলে আসে। আম্মুর মুখে হাসি নেই। সেই যে বাবা অসুস্থ হলো তারপর থেকে আম্মু কেমন যেন হয়ে গেছে।

রাত একটার দিকে নওরিন আহনাফের ফোন ধরে। ওপাশ থেকে ওর ব্যাকুল গলা পাওয়া যায়, ‘কী রে, সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি, ধরছিসই না। কাল কিন্তু লাস্ট ডেট।’

নওরিন রাগের গলায় বলে, ‘তুই কর, আমি করব না। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

ওপাশ থেকে আহনাফ হা হা করে হেসে ওঠে, ‘কী বললি! তুই দেশে পড়াশোনা করবি?’

নওরিন কঠিন গলায় বলে, ‘আমাদের এখন সেই সামর্থ্য নেই। আজ আম্মুর কাছে মাত্র দশ হাজার টাকা চেয়েছিলাম এপ্লিকেশন করার জন্য। দিতে পারল না। ভেবেছিলাম হয়ে গেলে তখন না হয় ওদেশে যেয়ে স্টুডেন্ট লোন ব্যবস্থা করে ফেলতাম। বাবার অনেক আত্মীয়-স্বজন ওখানে থাকেন। কিন্তু দেখ, মাত্র দশ হাজার টাকার জন্য আমি এপ্লিকেশনটাই করতে পারলাম না। অথচ আমার SAT স্কোর ১৬০০। আমি নিশ্চিত স্কলারশিপ পেতাম।’

ওর শেষ কথাতে দু:খ ঝরে পড়ে।

আহনাফ একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘তুই তোর পেপারগুলো নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আয়। টাকার ব্যবস্থা আমি করব।’

নওরিন অবিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘তুই সত্যিই বলছিস?’

৪.
নওরিনের বুক কাঁপছে। মাত্রই এপ্লিকেশনটা সাবমিট করল। আহনাফ শেষ পর্যন্ত টাকার ব্যবস্থা করেছে। আনন্দে ও আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে, ‘থ্যাংকিউ মাই লাভ।’

আহনাফ সুন্দর একটা পারফিউমের ঘ্রাণ টের পায়। ওর রেশমের মতো নরম চুলে হাত বোলায়। নওরিন দেখতে একদম পুতুলের মতো সুন্দর। গায়ের রঙ দুধে আলতা। ইচ্ছে করে আদর করে মেরে ফেলে। কথাটা মনে হতেই একটা উত্তেজনা টের পায়। ও শক্ত করে ওকে বুকে চেপে ধরে। তারপর মুখটা কাছে টেনে নিয়ে পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে। নওরিন প্রথমে একটু থমকে যায়, তারপর ও সাড়া দেয়। আহনাফ ওর এত বড়ো একটা উপকার করল।

নওরিন টের পায় আহনাফ ওকে ঠেলে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে। এই রুমের দরজাটা বন্ধ। ও একটু বাধা দেবার চেষ্টা করতেই আহনাফ জোর করে ওকে শুইয়ে দেয়। তারপর ওকে চুমু খেতে খেতে বলে, ‘তোকে একটু দেখব প্লিজ। কতবার ভিডিও কলে দেখতে চেয়েছি, দিস নি।’

এই বলে ও ওর জামা খোলার চেষ্টা করতেই নওরিন ওর হাত ধরে বলে, ‘আজ থাক। আরেকদিন।’

আহনাফের চোখমুখ কেমন লালচে। ও পাগলাটে গলায় বলে, ‘আজকেই। আর বিদেশে পড়তে গেলে তো তখন এমনিতেই তুই আমার বউ হয়ে থাকবি।’

কথাটা বলেই ও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাগলের মতো বুকে গলায় মুখ ঘষতে থাকে। নওরিন টের পায় ও ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। একটা অজানা নিষিদ্ধ সুখের হাতছানি ওকে কোথায় যেন নিয়ে যায়।

সেদিন বাসায় ফিরে নওরিন অনেকক্ষণ শুয়ে থাকে। সারা গায়ে একটা আরামদায়ক আলস্য। একটা সুখ ওকে যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আবার সেইসাথে একটা কথা মনে হয়, আহনাফ ওকে টাকা দিয়ে সাহায্য করল বলেই কি আজ ওকে ও বাধা দিল না? অথচ এর আগে অনেকবারই এমন আদরের কথা বলেছে কিন্তু ও শক্ত ছিল। তাহলে কি ও আজ টাকার বিনিময়ে..

কথাটা ভাবতেই ওর বমি পায়। মুহূর্তে ওর সব সুখ উবে যায়। একটা অপরাধবোধ ওর সারা শরীরে ঘৃণার পাঁক মাখিয়ে দেয় যেন।

নওরিন সেদিন রাতে অনেকক্ষণ গোসল করে। বার বার ধুয়েও শরীরটা যেন পরিস্কার হয় না। কেন যে আজ ও মায়ের কথা না শুনে ওর বাসায় গেল?

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর