আলো অন্ধকারে পর্ব-০৬

0
165

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৬)

১.
ইদানীং ভোর বেলায় ঘুম ভাঙে নওরিনের। ওর পায়ের কাছেই বড়ো একটা জানালা। এ পাশটা ফাঁকা, কয়েকটা নারকোল গাছ আছে। নওরিন শুয়ে শুয়ে বাইরে ভোর হওয়া দেখে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে শুনতে মনটা উদাস হয়ে যায়। ওর শুধু একটা কথা মনে হয় যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখত সব আগেরমতো হয়ে গেছে। বাবা গার্মেন্টসে যাচ্ছে, আম্মু সেজেগুজে বাইরে শপিংয়ে যাচ্ছে, ও আগেরমতো শুদ্ধ থাকত! কিন্তু কিছুই আগেরমতো নেই। নিজেকে কেন যেন অপবিত্র মনে হয়। বাবা মাকে কষ্ট দিল শুধু শুধু। মরে যেতে ইচ্ছে করে।

আহনাফ আর যোগাযোগ করেনি। আম্মুও আর কেসটা নিয়ে কিছু বলে না। উলটো বলল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু ও কি পারবে?

নওরিন আড়মোড়া ভেঙে ওঠে। হাত মুখ ধুয়ে লিভিংয়ে যেতেই অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে ও থমকে দাঁড়ায়। বাবা হুইলচেয়ার ছেড়ে সুস্থ মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও ভীষণভাবে পা কাঁপছে, কিন্তু দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কী করে সম্ভব হলো! ও এক দৌড়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, উত্তেজিত গলায় বলে, ‘বাবা! তুমি দাঁড়াতে পারো!?’

জাফর দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চাদের মতো মাথা নিচু করে হাসে। তারপর ধপ করে হুইলচেয়ারে বসে পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘গত কয়েকদিন ধরেই ব্যাপারটা হচ্ছে৷ আমি সাহস করে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই দেখি পারছি। দেখিস, এক মাসের মধ্যে আমি ঠিক আগেরমতো হাঁটতে পারব।’

বাবার চোখেমুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে যায় কথাটা বলতে বলতে। নওরিন জড়িয়ে ধরে বলে, ‘পারবে তো বাবা। তুমি আবার আগেরমতো সব করতে পারবে।’
জাফর ষড়যন্ত্রের গলায় বলে, ‘তোর আম্মুকে আগেই বলিস না। একদিন হঠাৎ করে ওর সামনে দিয়ে হেঁটে যাব। কী যে অবাক হবে ও!’

নওরিনের এবার আগ্রহ বাড়ে, ও একটু ভেবে বলে, ‘বাবা, সামনের মাসে আম্মুর জন্মদিন। সেদিন যদি আম্মুকে এই সারপ্রাইজটা দিতে পারো তাহলে খুব ভালো হয়।’

জাফর মেয়ের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায়, তারপর দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘আমি কি পারব?’

নওরিন উৎসাহের সাথে বলে, ‘অবশ্যই পারবে বাবা। আমার তো এখন ভোরেই ঘুম ভেঙে যায়। আম্মু আর আরুশ তো বেলা করে ওঠে। আমি তোমাকে প্রাকটিস করাব প্রতিদিন।’

জাফর সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কখনও মেয়ের সাথে এমন করে মেশা হয়নি। মেয়েটা এখনও বাচ্চা আছে। আর ওর এই ছোট্ট মেয়েটার সাথে এমন একটা বাজে কিছু হয়ে গেল! কষ্ট টের পান বুকের ভেতর।

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘তুই ভর্তির প্রস্তুতি ঠিকঠাক নিচ্ছিস তো?’

নওরিন মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ বাবা, নিচ্ছি। কিন্তু কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া দরকার। বাবা, আম্মুকে কি একটু বলবে আমাকে কিছু টাকা দিতে? বাসায় বসেই অনলাইনে কোচিং করব, খুব বেশি টাকা লাগবে না। এখন আপাতত বারো হাজার টাকা হলেই হবে।’

জাফরের বুক ভেঙে যায়। যে মেয়েকে আড়াই কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে পড়তে পাঠাতে চেয়েছেন, আজ সেই মেয়ে মাত্র বারো হাজার টাকা চাইতে সংকোচ বোধ করছে। এতটা গরীব হয়ে গেলেন!

নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলান। তারপর বলেন, ‘আচ্ছা, আমি তোর মাকে বলব।’
সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন ভোরে ওরা দু’জন চুপিচুপি হাঁটার অনুশীলন করতে থাকে। জাফরের ভীষণ কষ্ট হয়, কিন্তু মেয়ের মুখ চেয়ে কষ্টটা হজম করেন। এক পা বেশি হাঁটতে পারলেই সে কী খুশি মেয়েটা! একটা কথা মনে হয় জাফরের। নওরিনকে এর আগে কত দামি দামি উপহার এনে দিয়েছেন। কিন্তু কখনও এমন মন থেকে খুশি হতে দেখেননি। অথচ আজ মেয়েটার মুখ দেখে ঠিক টের পান ও কতটা খুশি হচ্ছে। মেয়ের এই আনন্দিত মুখ বার বার দেখবার জন্য জাফর এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে যান।

দিলশাদের জন্মদিনের কয়েকদিন আগে এক সকালে জাফর যখন পুরো এক মিনিট একা একা হাঁটতে পারেন সেদিন নওরিন ছুটে এসে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘বাবা, তুমি ভালো হয়ে যাচ্ছ।’

জাফর মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোর জন্যই সব সম্ভব হলো। আমার লক্ষ্মী মেয়ে তুই।’
নওরিনের কেন যেন কান্না পাচ্ছে, ও কি আগের মতো লক্ষ্মী মেয়ে আছে?

জাফর ওকে ছেড়ে এবার হুইলচেয়ারে বসে একটু জিরোয়৷ তারপর চিন্তিত গলায় বলে, ‘আচ্ছা, তোর মাকে জন্মদিনে কী কিনে দেওয়া যায় বল তো? প্রতিবার একটা না একটা কিছু দেই। আমার কাছে কিছু টাকা আছে ওটা দিয়েই কিনব।’

নওরিন একটু ভেবে বলে, ‘আম্মুকে একটা শাড়ি কিনে দাও। দাঁড়াও আমি মোবাইল আনছি। অনলাইনেই অনেক শাড়ির পেজ আছে। সেখান থেকেই একটা অর্ডার করতে পারবে।’

জাফর উৎসাহের গলায় বলে, ‘বাহ, এটা ভালো বুদ্ধি। আমি তো নিজে কোনোদিন শাড়ি কিনিনি। এবারই প্রথম কেনা হবে। তোর আম্মু খুশি হবে।’

নওরিন ওর মোবাইলটা এনে কতগুলো শাড়ি বাছাই করে বাবাকে দেখায়। জাফর ভালো করে শাড়িগুলো দেখে, তারপর বলে, ‘সবগুলোই তো সুন্দর লাগছে। তুই বল কোনটা নেব?’

নওরিন একটু চিন্তা করে বলে, ‘এই বটল গ্রিন শাড়িটা সুন্দর, এটা নাও বাবা।’

জাফর মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা এটাই অর্ডার দে৷ কিন্তু এটার দাম কত?’

নওরিন এবার সংকুচিত গলায় বলে, ‘বাবা, এটা পনের হাজার টাকা।’

জাফর থমকে তাকান। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করছে। ওনার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে। দিলশাদ সব টাকা ব্যাংকে রাখে। ওর তো কোনো হাতখরচ নেই এখন। তাই হাজার পাঁচেক টাকা ওর কাছে দিয়ে রেখেছিল। জাফর ভেবেছিল এই দিয়ে ভালো একটা শাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।

জাফর দমে যাওয়া গলায় বলে, ‘আচ্ছা, চার পাঁচ হাজারের মধ্যে কিছু নেই?’
নওরিনের ভীষণ মায়া হয় এই অসহায় বাবাটার জন্য। ওর মনে পড়ে না বাবা কখনও কম দামি কিছু কিনেছে কখনও। সেই বাবা আজ কম দামে শাড়ি খুঁজছেন।

নওরিন ওর মন খারাপ ভাবটা বুঝতে না দিয়ে কৃত্রিম উৎসাহের গলায় বলে, ‘আছে তো বাবা। দাঁড়াও আমি বের করছি।’

নওরিন কিছুক্ষণ ব্রাউজ করে এবার অনেকগুলো শাড়ি বের করে। জাফর সেসব শাড়ি দেখেন, কিন্তু কোনোটাই আগেরগুলোর মতো লাগে না। নাহ, কম দামি জিনিস কিনতে পারবেন না।

মুখ ভার করে বলেন, ‘থাক বাদ দে। এবার জন্মদিনে না হয় আমার এই ভালো হওয়াটাই ওকে উপহার দিলাম। তুই ভালো দেখে একটা কেক আর কিছু ফুল অর্ডার দিয়ে দিস, তাতেই হবে।’

নওরিন ব্যথিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আর জাফর একটা অক্ষমতার কষ্ট টের পান বুকের ভেতর। মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয় অথচ মেনে নিতে হয়।

ক’দিন পর যেদিন দিলশাদের জন্মদিন সেদিন বিকেলে বাসায় একটা কেক আসে। দিলশাদ অবাক গলায় বলেন, ‘এই কেকের অর্ডার কে দিল? আর হঠাৎ করে কেক কেন?’

আরুশ, নওরিন মিটিমিটি হাসে। জাফর অন্যমনস্ক ভাবে টিভির দিকে তাকিয়ে মুখ লুকান।

দিলশাদ এগিয়ে যেয়ে কেকের বাক্সটা খুলতেই থমকে যান। আজ ওর জন্মদিন! একদম ভুলেই গিয়েছিল। এত ঝামেলা গেল ক’টা দিন যে নিজের কথা একদম ভুলে গিয়েছিলেন। এরা ঠিক মনে রেখেছে। হঠাৎ করেই ক্লান্ত মনটা ভালো হয়ে যায়।

আরুশ, নওরিন আর জাফর এবার সুর করে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’।

নওরিন ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর আদুরে গলায় বলেন, ‘তুমি দূরে কেন? হুইলচেয়ারটা নিয়ে এখানে আসো। কেকটা কাটি।’

নওরিন ঝট করে একবার বাবার দিকে তাকায়। বাবাকে কি একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে? ভয় পাচ্ছে বাবা?

ও সামনে এগিয়ে যায়, তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি পারবে বাবা।’

জাফর একবার মেয়ের দিকে তাকায়, লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর এক পা দু’ পা করে দিলশাদের দিকে এগিয়ে যায়।

দিলশাদ কেকটা বাক্স থেকে খুলে টি টেবিলের উপর রাখতে যেয়ে থমকে দাঁড়ান। হতবিহ্বল হয়ে জাফরের হেঁটে আসার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছেন।

সবার প্রথমে আরুশ চিৎকার করে ওঠে, ‘বাবা হাঁটছে!!!’

দিলশাদ হাতে ধরে থাকা কেকটা কোনোমতে নামিয়ে রেখে, কাঁপা গলায় বলেন, ‘তুমি হাঁটতে পারছ!’

জাফর ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। পেছন থেকে নওরিন হাত তালি দিয়ে বলে, ‘সাবাশ বাবা। তুমি পেরেছ।’

জাফর দিলশাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। পেছনে লুকিয়ে রাখা একটা লাল গোলাপ হাতে নিয়ে ওর সামনে ধরে। তারপর কাঁপা গলায় বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে দিলশাদ।’

চোখে বাধভাঙ্গা জল নামে। সৃষ্টিকর্তা বুঝি এতদিনে ওর প্রার্থনা শুনলেন। ফুলটা নিয়ে ওর হাত ধরে বসান, তারপর ভেজা চোখে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি সত্যিই হাঁটতে পারছ! ইশ, কী যে ভালো লাগছে।’

জাফর বুকের ভেতর একটা মন ভালো করা হাওয়া টের পায়৷ দিলশাদ কী ভীষণ খুশি হয়েছে!

ও আবেগের গলায় বলে, ‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি। নওরিন আমাকে প্রতিদিন প্রাকটিস করিয়েছে আজকের দিনটার জন্য। এটাই এবার তোমার জন্মদিনের গিফট। আর কিছু দেবার সামর্থ্য নেই যে আমার।’

দিলশাদ ওর হাত চেপে ধরে, তারপর ভাঙ্গা গলায় বলে, ‘তুমি নিজের পায়ে হাঁটতে পারছ, এর চেয়ে বড় উপহার আমার জীবনে আর কিছু নেই। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।’

সেদিন সত্যিই একটা অন্যরকম জন্মদিন পালন করেন দিলশাদ। এই যে আজ জাফর হেঁটে এসে ওকে একটা লাল গোলাপ ফুল দিল এর মূল্য বুঝি ওই পাঁচ তারকা হোটেলে পালন করা জন্মদিনে ডায়মন্ডের গলার হার দেবার চেয়েও বহুগুণে মূল্যবান কিছু। দিলশাদের হঠাৎ করেই মনে হয়, জীবনে হারিয়েছেন অনেক কিছুই, কিন্তু এমন কিছু অমূল্য জিনিসের সন্ধান পেলেন যেটা আগের স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো কখনও পেতেন না।

২.
নওরিনের হাত পা কাঁপছে। বিশ্বাস হচ্ছে না, বার বার মেরিট লিস্টটা দেখছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ এর এডমিশন টেস্টে একদম প্রথম দিকেই ওর নাম জ্বলজ্বল করছে। চারপাশে ছেলেমেয়েদের ভীড়, চিৎকার-চেচামেচি – কিন্তু কিছুই ওর কানে ঢোকে না। ও ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসে। আম্মু উৎকন্ঠা নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।

দিলশাদ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে চমকে ওঠেন। সাদা মুখটা কেমন রক্তশুন্য। ওকে এমন হতবিহ্বল দেখাচ্ছে কেন? লিস্টে নাম নেই বুঝি? আহারে, মেয়েটা কখনও এমন প্রতিযোগিতায় নামতে হবে ভাবেনি। ভেবেছিল ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলে যাবে। না হলে অন্য ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে মেয়েকে টাকা খরচ করেই পড়াতেন। কিন্তু এখন এমন অবস্থা যে দেশেও বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সুযোগে রইল না। এখন এই পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলো ভরসা। ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো করেছিল। ভেবেছিলেন টিকে যাবে। কিন্তু এখানেও যদি ওর না হয় তাহলে মেয়েটা যে একদম শেষ হয়ে যাবে।

দিলশাদ একটু এগিয়ে গিয়ে মেয়ের হাত ধরেন, তারপর নরম গলায় বলেন, ‘ভেঙ পড়িস না। অন্য ইউনিটগুলোতে ভালো করে পরীক্ষা দে।’

নওরিন ফিসফিস করে বলে, ‘আম্মু, আমি একুশতম হয়েছি।’

দিলশাদ চমকে ওঠেন। ওর হাত ধরে শক্ত একটা ঝাঁকুনি দেন, চিৎকার করে বলেন, ‘কী বলছিস তুই! সত্যি?’

দিলশাদের চিৎকারে আশেপাশের মানুষজন কৌতুহলী দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। সেদিকে দিলশাদের সাথে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। মেয়েকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খান। উচ্ছ্বসিত গলায় বলেন, ‘তুই সত্যিই চান্স পেয়েছিস? তাও একদম প্রথম দিকে? ইশ কতদিন পরে একটা সুসংবাদ পেলাম।’

নওরিনের বুকের ভেতর চেপে থাকা এতদিনের একটা অপরাধবোধ আজ যেন উধাও। ও যে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছে। এই স্বর্গীয় আনন্দের দেখা ও টাকা দিয়ে পড়তে গেল কখনোই পেত না। আম্মু খুশি হয়েছেন, বাবাও নিশ্চয় অনেক খুশি হবে। ওর জন্য ওনারা কত কষ্ট পেলেন। সেই কষ্টের এই শোধটুকু দিতে পেরে নিজেকে আজ অনেকটা হালকা লাগে।

দিলশাদ ওকে নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখেন। নওরিন অবাক হয়ে দেখে, কত কত প্রাণোচ্ছল ছেলেমেয়ে। আর কী বিশাল ক্যাম্পাস! এতদিন শুধু মুখেই শুনে এসেছে। তেমন করে কোনোদিন আসা হয়নি। কেন জানি ওর ভালো লেগে যায় ক্যাম্পাসটা।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা টিএসসির পাশে ডাসের সামনে এসে বসে৷ দিলশাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বার্গার খাবি? সকালে কিছু খাসনি তো।’

নওরনি বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে। ইশ কী মজা লাগছে আজ আম্মুর সাথে ঘুরতে।

দিলশাদ দুটো বার্গার আর কফি নেয়। কেন যেন আজ নিজেও সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেছেন। এমন পা ঝুলিয়ে বার্গার খেতে খুব ভালো লাগছে যেন পৃথিবীতে কোনো কষ্ট নেই, যন্ত্রণা নেই।

বার্গার শেষ করে কফি নেন। চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই মন খারাপ হয়ে যায়। মেয়ের সাথে একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলেছেন। ঠিক মিথ্যে না কথাটা লুকিয়েছেন। এই অপরাধবোধ প্রতিদিন কুড়ে কুড়ে খায়।

দিলশাদ একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘মাগো আমি তোর কাছে একটা অপরাধ করেছি। পুলিশ আহনাফকে গ্রেফতার করেছিল। ওরা তখন বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে সমঝোতা করতে চাইল। না হলে ওরা আদালতে নোংরা সব কথা বলবে তোকে নিয়ে। আমি তোর কথা ভেবেই কেসটা থেকে সরে এসেছি। টাকাটা না নিলে খুব ভালো হতো। কিন্তু পারিনি। হাতে একদম নগদ টাকা ছিল না। তাই এমন নিচু একটা কাজ করতে হলো। তুই তোর এই অক্ষম মাকে ক্ষমা করে দিস।’

শেষ কথাগুলো বলতে বলতে দিলশাদের চোখ ভিজে যায়।

নওরিন অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ কোনো কথা যোগায় না মুখে। তারপর মায়ের একটা হাত শক্ত করে ধরে বলে, ‘আম্মু, তুমি কোনো অপরাধ করোনি। আমার বোকামির জন্য তোমাকে ওদের সামনে এমন মাথা নিচু করতে হলো। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।’

দিলশাদ এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। আশেপাশের মানুষজন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেন একজন মাঝবয়েসী নারী কাঁদছে, সাথে একজন অপূর্ব সুন্দর তরুণীর চোখেও জল।

সেদিন বাসায় ফেরার সময় ওরা মিষ্টি কেনে। দিলশাদ একগুচ্ছ ফুল নেন। বাসায় ফিরতেই দেখেন বসবার ঘরে একজন অপরিচিত মানুষ বসে আছেন, সাথে জাফর, মুখটা কেমন অন্ধকার। দিলশাদ নওরিনের খবরটা বলতে যেয়েও চুপ হয়ে যায়। ইশারায় নওরিনকে ভেতরে চলে যেতে বলে।

জাফর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘উনি হানিফ মাহমুদ। ওই যে আমাদের যে ব্যাংকে লোন ছিল সেখানে আছেন। আমাদের লোনের বিপরীতে অনেকগুলো টাকা ইন্টারেস্ট এসেছিল। ওনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মওকুফ হয়নি। টাকাটা দিতে হবে।’

দিলশাদ অস্ফুটে বলেন, ‘কত টাকা?’

জাফর নিচু গলায় বলেন, ‘পাঁচ কোটি চুয়ান্ন লাখ টাকা।’

দিলশাদের হঠাৎ করেই মাথাটা ঘুরে উঠে। এত টাকা কোথায় পাবে ওরা?

ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। তারপর জাফরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এখন উপায়? আমাদের কাছে তো কোনো টাকা নেই। আমরা কোর্টে একটা প্রেয়ার দেই এটা মওকুফের জন্য।’

ব্যাংকের লোকটা এবার মুখ খুলে, ‘ম্যাডাম সেটাও করা হয়েছিল। আমি স্যারকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম। ব্যাংক তখন আপনাদের এই বাড়ির কথা তুলেছিল যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকার মতো। আদালত তখন এই বাড়ি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের আদেশ দিয়েছেন।’

রুমের ভেতর যেন একটা বোমা বিস্ফোরণ হয়।

দিলশাদ হতবাক গলায় বলেন, ‘কী বলছেন এসব? এই বাড়িটা ছাড়া আমাদের যে আর কিছুই নেই। এভাবে আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নেবেন আপনারা?’

লোকটা মাথা নিচু করে ফেলে।

জাফর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘দিলশাদ, ওনাদের কোনো দোষ নেই। ব্যাংকও তো একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমি ঠিক করেছি বাড়িটা বিক্রি করে দেব। আর এত বড়ো বাসা মেইনটেইন করা অনেক খরচের। আমরা অন্য কোথাও ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব।’

দিলশাদ বিমূঢ় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত ভাড়া থাকতে হবে! জীবনে কখনও কি এটা ভেবেছিলেন? সৃষ্টিকর্তা এত নিষ্ঠুর হলেন? এভাবে একের পর এক সব কেড়ে নিলেন?

ভেতর থেকে নওরিন কথাগুলো শুনতে পায়। আরুশ বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকে কী হয়েছে। নওরিন ওকে শক্ত করে ধরে রাখে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে