বধূবরণ পর্ব-০১

0
300

#বধূবরণ
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
#সূচনা_পর্ব

কেমন হয়েছে জানাবেন!ভ

‘চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে বাল্যবিবাহ করেছে’-
মুহূর্তেই কথাটা ছড়িয়ে গেল পুরো সীমান্তপার গ্রামে। দলে দলে লোকেরা জমা হচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে। এতে অবশ্য মহিলাদের সংখ্যার আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। চেয়ারম্যান বাড়ির ছোট ছেলে সাঈদ বসার ঘরে বসে আপেল চিবুচ্ছে আরাম করে। বাইরে তার বউকে নিয়ে এত কোলাহল মাতামাতি যে তার খুব একটা ভালো লাগছে না সেটা তার ফুলে উঠা নাক দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। সাঈদ এর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে হৈমী। দাঁড়িয়ে আছে বললেও ভুল হবে, বলা উচিত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। হৈমী অসহায় চোখে সাঈদের দিকে চেয়ে রইল। চিন্তায় আপাতত অস্থির সে। আব্বা হয়তো বাড়ি থেকে লাঠি নিয়ে ছুটে আসছেন তাঁকে মেরে ফেলার জন্যে। বাড়িতে গেলে আম্মার হাতে উদোম কেলানি খেতে হবে ভাবতেই গা রীতিমত জমে যাচ্ছে হৈমীর। হৈমী অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে, একটাপর্যায়ে সাঈদ পা নামিয়ে সোফায় সোজা হয়ে বসে ধমকে বলল,
-এই তুই দাঁড়ায় আসস কেন তুই? সোফা নাই আমার ঘরে? বস!

হৈমী তীক্ষ চোখে সাঈদের দিকে তাকাল। পরপর রোবটের মত সোফায় বসে পরল। পাশ থেকে সাঈদের আম্মা ধমকে উঠেন,
-এই তুই ওরে বকস কেন? সাহস বেড়ে গেছে? এমনিতেই বিয়ে করে আনসোস ওরে এই বয়সে। বাইরে তোর বাপ মাইনসের লগে যুদ্ধ করে। চেয়ারমেনের পোলা এত ভালো কাজ করছে, মানুষ তো চিল্লাইবই। একদম চুপ করে বসে থাক বজ্জাতের জাত!

সাঈদ এসব কথা শুনলে তো! সে আরামে আরেকটা আপেল ফলঝুরি থেকে নিয়ে চিবুতে থাকল।

রাতে হৈমীর আব্বা এলেন চেয়ারম্যান বাড়ি। চিন্তায় মুখ কালশিটে পরে গেছে তার। হৈমী তার আব্বাকে দেখে গুটিসুটি মেরে সাইদের মায়ের পেছনে লুকিয়ে পরে। হৈমীর আব্বা এবিং চেয়ারম্যান ওবায়দুল্লাহ মুখোমুখি বসে। দুজনের চোখেই হতাশা ভাব। ছেলে মেয়েদের এমন কাজে দুজনেই যারপরনাই লজ্জিত। কিছুক্ষণ পর সাঈদ উপরের সিঁড়ি বেয়ে ঘুমঘুম চোখে নিচে নেমে আসে। নিজে বড় এক সোফায় বসে টান দিয়ে হৈমীকেও নিজের পাশে বসিয়ে দেয। হৈমী হতবম্ব। লজ্জায় দিশেহারা। মিনমিন করে মাথা নত করে বলে,
-আব্বার সামনে এসব কী ধরনের আচরণ? লজ্জা নাই?বেহায়া পুরুষমানুষ!

সাঈদ অবাক হবার ভান করে বলল,
-লজ্জা? কীসের জন্যে পাব? তোকে কী আমি সবার সামনে চুমু খেয়েছি? নাকি খোলা দরজায় পরিবার পরিকল্পনা করছি? আমি তো যথেষ্ট ভদ্র পোলা হয়েই বসে আছি তোর বাপের সামনে! তাও তোর হচ্ছে না? অসভ্যতা কাকে বলে তাহলে দেখিয়ে ফেলি?

হৈমী অসহায় চোখে চেয়ে দেখল সাঈদকে। তারপর বিড়বিড় করে গালিগালাজ করতে করতে সরে বসতে চাইল খানিক। অথচ সঙ্গেসঙ্গে সাঈদ কোমরে চিমটি কেটে নিজের সঙ্গে পুনরায় চেপে ধরে রাখল। হৈমী কোমরের চিনচিনে ব্যথায় স্তব্ধ হয়েই রয়ে গেল।

দূর থেকে হৈমীর আব্বা মেয়েছেলের কাজ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কথা তুললেন,
-দেখুন চেয়ারম্যান সাহেব, ছেলেমেয়ে যা করার করে ফেলেছে। বিয়ে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। আল্লাহর হুকুম। তবে আজকে আমি মেয়ে ঘরে নিয়ে যাব। সংসার করার মত আমার মেয়ে ততটা বড় হয়ে যায়নি এখনো।

ওবায়দুল্লাহ আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। সাঈদের মুখের অঙ্গভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে এখানে একটা বো -ম ব্লা- স্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাঈদ কিছু বলার জন্যে মুখ খুলবে তার আগেই ওবায়দুল্লাহ একদমে বলে উঠেন,
-আমি রাজি। মেয়ে আপনি ঘরে নিতে পারেন। আমরা নাহয় দু তিন বছর পর ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দেব। চিন্তা নেই।

সাঈদ কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। পরপর নাক ফুলিয়ে বলে উঠে,
-আনবিলিভেবল। আমার বউ আমি দিচ্ছি না। মগের মুল্লুক নাকি?

হৈমী এবার লজ্জায় সাইদের হাঁটুতে বেশ জোরেসরে অগোচোর চিমটি কাটল। সাঈদ ব্যথায় আহ্ বলে আওয়াজ করলে সবার চোখ এসে পরে সরাসরি সাঈদের দিকে। হৈমী অপ্রস্তুত হয়ে পরে। সাঈদ হাটু ঘষে হৈমীর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে বলে,
-কিছু না, পোকা কামড় দিয়েছে। আম ফাইন। ইউ গাইজ কন্টিনিউ!

সবাই আবার কথা বলায় মন দিল। শেষপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, হৈমীকে ঘরে দেওয়া হবে। বছর খানেক পর, হৈমীর বিশ বছর হবার পর বিয়ে আবার ধুমধাম করে দেওয়া হবে তাদের। ব্যাস। সাঈদ তাৎক্ষণিক সোফা ছেড়ে উঠে ধূপধুপ পা ফেলে উপরে চলে গেল। হৈমী অসহায় মেয়ে হয়ে এসব দেখল তাকিয়ে। সেই যে গেল,এখন অব্দি তার মুখদর্শন করা যায়নি তথাপি।

হৈমীরা আজ রাতে খেয়ে তারপর বাড়ি যাবেন। রাতে খাবার টেবিলে সাঈদকে অনেকবার ডাকা হল। উপরের বদ্ধ রুমের ভেতর থেকে সাঈদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিল থেকে হৈমীকে তুলে পাঠানো হোল সাঈদের ঘরে।

দরজাটা ভেতর থেকে লক। হৈমীর হাতে সাঈদের মায়ের ধরিয়ে দেওয়া সাইদের রুমের চাবি। এ ঘরে সাঈদ যখনই থাকে, দরজা লক থাকে। আর ঘরের চাবি থাকে একমাত্র সাঈদের মায়ের হাতে। আঁচলের কোণে বেধে রাখেন তিনি চাবির ঝোঁটা!

বদ্ধ ঘরের ভেতর সাঈদের সাড়াশব্দ না পাওয়া গেলেও হৈমী জানে, সাহেব রেগেমেগে আ গু নের ফু ল কি বনে আছেন! তাঁকে ঘাটতে গেলেই হৈমীর ম র ন। তুলে এক আ ছা ড় দেবে সে হৈমীকে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কোনো।
তবুও হৈমী ঘরে ঢুকল। সাঈদকে হাতে বেধে নিয়ে যাওয়ার আদেশপ্রাপ্ত সে। আদেশ অবশ্য শিরোধার্য! হৈমী ঘরে ঢুকেই হা। জিনিসপত্রের একই বিগিদিস্তা অবস্থা। ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হায়রে! মায়া লাগে না মানুষটার এটুকু? এভাবে কেউ এত দামি জিনিস ভাঙে? পর্দাটাও হ্যাঙ্গার থেকে খুলে নিচে পরে আছে। কাচের ফুলদানি ভেঙে টেলিফোনের পাশে অসহায় অবস্থায় পরে। আহা! কী মনোরম দৃশ্য! মন চাচ্ছে, হৈমীকে নয়, সাইদকে ধরে আ ছা ড় দেওয়া উচিত এসব কাজের জন্যে। কিন্তু কার সাধ্য? চেয়ারম্যান বাড়িতে সাঈদ রেগে যাওয়া মানে, হুলস্থুল কান্ড। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ার সুবাধে সাঈদ সবার বড্ড আদুরে। আদরের পরিমাণ এতই বেশি যে, কেউ সাঈদের দিকে আঙুল তুললে ওবায়দুল্লাহ নিজে তাকে শা সি য়ে আসেন। বড় ছেলে আবার বড্ড ভদ্র। ছোটটাই হয়েছে যত অসভ্যের জাত!

হৈমী প্রথমে মেঝে যা পারে কিছুটা পরিষ্কার করে রাখল। পর্দা হেঙ্গারে ঝুলিয়ে টাঙিয়ে দিল। টেলিফোন ঠিকঠাক করে টি টেবিলের উপরে রাখল। শুধু কাচের জিনিসে হাত দিল না। হাত কেটে গেলে সাঈদ মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে নির্ঘাত! এবার বিছানায় ঘুমন্ত সাঈদের পানে তাকাল। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মহাশয়। উদোম গা। ব্লাঙ্কেট কোমর অব্দি ঢেকে রেখেছ। পিঠে ভাসমান ফুলে ফেঁপে উঠা মাস্যাল! ইস! বান্দা হট আছে! হৈমী নিজের চিন্তায় নিজেই হকচকিয়ে উঠল। দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হল। অর্থাৎ হবার ভান করল। জলজ্যান্ত এমন আইটেম সামনে থাকলে কেউই ঠিক থাকবে না। হৈমী বুঝে পায় না, তার মধ্যে সাঈদ কী দেখল? এতটা, ঠিক এতটা পাগল কী দেখে হল? হৈমীর মধ্যে পাগল করার মত কিছুই নেই, সত্যি কিছু নেই। অথচ হৈমী জানে, পুরো গ্রামের মেয়েরা সাঈদ বলতে উন্মাদ! এক কথায়, জান হাজির! তার ঘোলা চোখ, আকর্ষণীয় দেহের মাস্যাল, সুদর্শন মুখ। সবকিছুই নজরকারা। তারপরও কেন হৈমী? হৈমীই কেন? কার কেউও তো হতে পারত! হৈমী নিজের অবাস্তব চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমন্ত সাইদের পাশে এসে বসল। হালকা স্বরে ডাক দিল,
-উঠুন, এই যে? শুনছেন। আপনার মা খেতে ডাকছেন আপনাকে। উঠুন!

সাঈদ এর মধ্যে কোনো নড়চড় দেখা গেল না তেমন। ডাকতে ডাকতে হাল ছেড়ে দিয়ে হৈমী মুম ফুলিয়ে বসে রইল পাশে।
এক পর্যায়ে কী মনে করে সাঈদের ঘন চুলে হাত দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বড্ড নরম স্বরে বলল,
-উঠবেন না? আমি চলে যাচ্ছি!

হৈমী উঠে চলে যেতে নিলে হঠাৎ সাঈদ টান দিয়ে হৈমীকে বিছানায় শুইয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। আচমকা আতঙ্কে হৈমী কই মাছের ন্যায় ছটফটিয়ে উঠল যেমন। গলায় ঠোঁটের ছোয়া পাওয়ার সাথেসাথে সেই ছটফটানি কমে গেল। চোখ খিঁচে সুড়সুড়ি হজম করার চেষ্টা করে বলল,
-ছাড়ুন, আমার দেরি হচ্ছে!

সাঈদ শুনে না, বরং হৈমীর গলায় ক্রমাগত নাক ঘষে উইস্কি স্বরে বলে,
-প্লিজ ডোন্ট গো, না! আই ওয়ানা ফিল ইউ এভ্রি সেকেন্ড অব মাই লাইফ,হৈমন্তী!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে