বধূবরণ পর্ব-০৩

0
278

#বধূবরণ-৩য় পর্ব
#অবন্তিকা_তৃপ্তি

-হৈমীরে, তোর গলার তিলে এটা কী লাভ বাইট দেখছি আমি?

হৈমী কথাটা শোনামাত্রই স্কুলের সাদা ওড়না গলায় ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে কলম দিয়ে খাতায় আঁকিবুকি করতে করতে বলল,

-উহু! কালকে রান্না করার সময় মাটির চুলো থেকে আ গু নে র ফুলকি এসে পড়েছে! সেরকম কিছু না!

নিশি শুনে, বিশ্বাস হল না কথাটা নিশির। সে আরেকটু এগিয়ে এসে হৈমীর গলা থেকে ওড়না সরাতে নিলে হৈমী তাৎক্ষণিক দূরে সরে গেল। কথা ঘুরিয়ে বলল,

-শুনলাম তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। রাজীব জানে?

নিশি এবার মুখ ভার করে বসল। একহাত বেঞ্চের উপরে রেখে মাথাটা হাতের উপরে ঠেস দিয়ে রেখে চাইল হৈমীর দিকে। তারপর বলল,

-হাঁ এসেছিল। সাঈদ ভাই সব সামলে নিয়েছেন আবার। রাজিবকে কল করে আমাদের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। রাজীব এসে তো সেইরকম একটা কান্ড ঘটালো বাড়িতে। বাবাকে হাতেপায়ে ধরে আমাদের বিয়ের জন্যে রাজি করাল।

হৈমী অবাক হয়ে গেল। কাল রাতেই তো ও বাড়ি থেকে এলো হৈমী। সাইদের মুখে তো তেমন কোনো কথা শুনেনি। তার বান্ধুবির সঙ্গে খাতির দেখাচ্ছে, অথচ তাকেই মুখ খান দিয়ে বলল না? অ স হ্য পুরুষ!

হৈমী বললো,

-তা আমরা তোর বিয়ে খাচ্ছি তাহলে খুব দ্রুত! কী বলিস?

কথা বলে আনন্দে নিশির শরীরের উপর কৌতুকপূর্ণ হেসে ঢলে পরল হৈমী! নিশি মুখ ভেংচালো। হৈমীকে সোজা করিয়ে আবার জায়গায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

-উহু বাছাধন, এখন নয়! আরও দু বছর পর।রাজীব চাকরি পেলে তবেই আব্বা বিয়ে দেবেন নচেৎ নয়!

-সে আর কী? রাজীব চাকরি পেতে আর কতদিন! ঠিক পেয়ে যাবে। দেখা যাবে, দু বছরের আগেই আমরা তোর বিয়ে খেয়ে নিয়েছি।

নিশি লজ্জা পেয়ে হাসল। তারপর হুট করে কিছু মনে পরে গেল যেমন নিশির। বলে উঠল,

-অ্যাই হৈমী! আসার সময় দেখলাম সাঈদ ভাই তার চ্যালাপ্যালাদের নিয়ে মাছু গুন্ডা কে শা সা চ্ছে। কলার ধরে রাগে চিৎকার চেচামেচি করছে। তুই কী কিছু বলেছিস ঊনাকে?

হৈমী আঁতকে উঠল। সাঈদ শহর থেকে গ্রামে ফিরলে, রোজ এমন কোনও না কোনও ঘটনা ঘটেই। হৈমী গ্রামের ঘটা কিছুই তাঁকে বলে না। অথচ হৈমীর অসুবিধার কথা তার সবসময় নখদর্পণে থাকে বটে। কিভাবে জানে সে, এতদিন হৈমী জানত না। এখন জানে। ওই রাজীবের একটা ছোট ভাই আছে। নাম হারুন। তাকে রোজ হৈমী নিজের সামনে পেছনে দেখতে পায়। হৈমীর ধারণা সে হৈমীর উপর সাইদের কথামতো নজর রাখে। এখানকার সব খবরাখবর সে সাইদকে ট্রান্সফার করে। হৈমী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বইখাতা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,

-আমার ঠেকা পরেনি তাকে এসব বলতে। জেনেছে নিশ্চয়ই সাঙ্গপাঙ্গ থেকে।গ্রামে এলেই মা রা মা রি করা যেন একটা অভ্যাস হয়েছে তার। যেন মজাদার কোনো অভ্যাস। ছিঃ।

নিশি হইহই করে উঠল যেমন। মেয়েটা একদম সাইদের ব দ না ম শুনতে পারে না। যেন সাঈদকে নয়, কেউ সাইদের ব দ না ম করে স্ব য়ং নিশির গায়ে আ গু ন লাগিয়ে দিয়েছে। সেটাই হল এবারও। নিশি এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল,

-ধুর ওমন বলিস না। সাঈদ ভাই তোকে ভালো——

-চুপ। আর তার হয়ে সাফাই গাইবি না একদম। মা ই র লাগাব ধরে। ছুটি হয়ে গেছে, বাড়ি যাবি চল।
________________________
একদিন পর, দুপুরে তখন হৈমী ঘরে পড়াশোনা করছে। হঠাৎ ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফোন বেজে উঠল হৈমীর। ফোনটা বেশ আগে সাইদের দেওয়া। তখন অবশ্য সাঈদ ততটা লাগামছাড়া ছিল না। কথাবার্তায় হৈমীর সাথে বড্ড সভ্য ব্যবহার করত। আর এখন? পুরোই অ স ভ্যে র জাত! কথাবার্তায় বেলাজ ব্যবহার উপচে পরে যেমন। হৈমী আসপাশ ভালো করে দেখে নিল। কেউ নেই। আশপাশে কেয়াকেও দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয় খেলতে গেছে। হৈমী উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বদ্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ফোন কানে ধরল! ওপাশ থেকে হাই-হ্যালোর কোনও ধার ধরতে দেখা গেল না সাঈদকে। সরাসরি জানানো হল,

-বাড়ির বাইরে আছি, ২ মিনিটের মধ্যে আয়। আর হিজাব বেধে আসবি। স্টাইল করে না, সবকিছু ঢেকে আসবি। সবকিছু মানে সবকিছুই!

হৈমী রেগে গেল খানিক। তবে রাগ প্রকাশ না করে বলল,

-আমি আসব না। আব্বা বাইরে চাল শুকাচ্ছেন। দেখতে পেলে মা ই র লাগাবেন আমাকে।

-তুই আসবি আর এক্ষুনি আসবি! নাহলে আমিই ভেতরে আসছি! আসব?

হৈমী তড়িগড়ি করে বলল,
-না, আসা লাগবে না আপনার। আমি আসতেসি! দাঁড়ান আপনি!

-ওকে। হিজাবের কথা ভুলবি না।

হৈমী ফোন কেটে দিল। কী বলে বের হবে ভাবছে বসে বসে। পরে ভাবল, নিশির কথা বলে যাওয়াই যাবে। হৈমী চটজলদি জামা পাল্টে হিজাব বেঁধে নিল। দরজা খুলে বের হয়ে উঠোনে বাবার কাছে আসল। হৈমীর বাবা শাহেদ হাত দিয়ে চাল মেলে দিচ্ছেন মাদুরে। হৈমীকে এতো সেজেগুজে বেরুতে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন,

-কই যাচ্ছ?

-আব্বা, ওই নিশির ভাতিজির জন্যে আজকে ঘরোয়াভাবে সিন্নি করা হচ্ছে ওদের বাড়ি। নিশি আমাকে দাওয়াত দিয়েছে।

শাহেদ আশেপাশে তাকালেন। একটু দূরে কালো বাইকের মধ্যে সাঈদ হেলান দিয়ে ফোন দেখছিল। শাহেদ সেটা দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। মেয়ে কথা লুকাতে শিখে গেছে। বাহ! বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন ঘুরতে চাইছে, ঘুরুক। তার এখন এসব অদেখা করে যাওয়ার সময়। নাহলে যে জামাই পেয়েছেন মেয়ের জন্যে। বাধা দিলে দেখা যাবে পুরো গুষ্টিসমেত তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়িতে। শাহেদ গম্ভীর গলায় বললেন,

-ঠিকাছে যাও। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসবে। মাগরিবের নামাজ ঘরে এসে পড়ো যেন।

-জি আচ্ছা আব্বা!

হৈমী বাড়ির উঠোনের গাছপালা সব হাত দিয়ে সরিয়ে সাঈদের পাশে এসে দাড়াল। সাঈদ হৈমীকে দেখে হৈমীর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়েই ফোন পকেটে রাখল। দুহাত জিন্সের পকেটে পুড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল হৈমীর দিকে। তারপর দুহাতে হৈমীর কোমর পেঁচিয়ে ধরে হৈমীর কাঁধে মুখ লুকাল। হৈমী আচমকা আচরণে থরথর করে কেপে উঠল যেমন। দুহাতে সাঈদকে ঠেলে দেবার চেষ্টা করলে সাঈদ হৈমীকে চেপে ধরে কাঁধে মুখ লুকানো অবস্থায় ফিসফিস করে বললো,

-অ্যাই মিসড ইউ হৈমন্তী! ব্যাডলি, ইউ নো?

সাঈদের নেশালো কথা শুনে শিরশির করে উঠল হৈমীর সারা গা! সঙ্গে সাঈদের মাতাল স্পর্শ। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে হৈমী। হৈমী খুব কষ্টে মুখ খুলে,

-আব্বা দেখবেন। ছাড়ুন।

সাঈদ তাৎক্ষণিক ছাড়ল না। কিছুসময় নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার পর তারপর ছাড়ল। বাইকে উঠে ইঞ্জিন চালু করে বলল,

-উঠে বস, আমরা আজকে সারাদিন ঘুরব। পারলে রাতটাও হোটেলে কাটিয়ে নেব, কী বলিস? আমার বাচ্চাদের আসার ব্যবস্থা করতে হবে না?

হৈমী বাইকের পেছনে বসতে যাচ্ছিল। সাঈদের কথা শুনে বুকে ফুঁ দিয়ে দ্রুত দু পা সরে দাড়াল। সাঈদ হৈমীর রিয়েকশন দেখে হেসে উঠল শব্দ করে। তারপর আঙ্গুলের ডগা হৈমীর কপালে রেখে ছোট্ট করে গু তো দিয়ে বলল,

-ব দে র হাড্ডি। উঠে বস। আমরা খাওয়া দাওয়া করতে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি।

হৈমী শ্বাস ফেলল এবার। সাইদের কাঁধে হাত রেখে বাইকে চেপে বসল। সাঈদ শো করে বাইক চালু করল। বাইকের স্পিড বড্ড বেশি। হৈমীর হিজাব খুলে যাচ্ছে বাতাসের ঝাপটায়। হৈমী একসময় প্রশ্ন করল,

-আমরা আজকে এভাবে ঘুরছি কেন?

সাঈদ পাশের আয়নায় হৈমীর মুখের দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-আমি চলে যাচ্ছি। এবার ফিরতে এক মাসের উপরে লাগবে।

হৈমী কথাই বলতে ভুলে গেল যেন। এত দ্রুত চলে যাচ্ছে? এলো তো সবে পাঁচ দিন হল। হৈমী আনমনে প্রশ্ন করল,

-এক মাস কেন? প্রতিবার তো ১৫ দিনেই চলে আসেন!

সাঈদ হৈমীর কথা শুনে বাকা চোখে তাকাল। ঠোঁটে দুষ্ট হাসি রেখে বলল,

-হঠাৎ আমার প্রতি এত মায়া? আর ইউ গোয়িং টু মিস মি?

হৈমী সঙ্গেসঙ্গে মুখ ভেঙ্গাল। দ্রুত অপরপাশে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

-উহু, মোটেও না।

মিথ্যা বলেছে হৈমী। সে বড্ড মিস করে সাঈদ যখন শহরে চলে যায়। প্রতিবার পাঁচ দশদিনের কথা বলে ১৫ দিনেও আসে না গ্রামে। আর এবার স্বয়ং বলছে এক মাস। তার মানে যাবে বেশ কদিন, ফিরবে না। কষ্টে হৈমীর বুকটা জ্বা লা করতে লাগল। তবুও হৈমী স্বীকার করলো না। প্রকাশ করল না সাঈদের সামনে। নাহলে লাগামছাড়া সাঈদ এ যাত্রায় তাকে মুক্তি দেবে না। বেলাজ কথা দিয়েই খু ন করে ফেলবে হৈমীর ছোট্ট মনটা!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে