Thursday, August 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1999



ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৯

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

O.T চলছে , আর বাহিরে ইরফানের বুকটা খা খা করছে । কেন যে এত ঘুম এলো তার আর কেন যে বেলী তাকে ডাকলো না । বেলীর খুব কষ্ট হচ্ছে এইভেবে বার বার চোখ জোড়া তার পানিতে ভরে উঠছে । নিজের কাছে নিজেকে খুব খারাপ মনে হচ্ছে তার কাছে । পাগল পাগল লাগছে তার সব কিছু ।
বেলীর মা ইরফানের পাশে বসে আছে । ইরফান বেলীর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

– ভেতরে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে , তাই না মা ?

ইরফানের কথায় বেলীর মা মনে মনে ভেঙে পড়লেও জামাইয়ের সামনে নিজেকে কঠিন অবস্থায় রেখেছেন যাতে জামাই ভেঙে না পড়ে । দৃঢ় কন্ঠে তিনি বলেছেন ,

– মা হইতে গেলে কষ্ট করন লাগে বাবা , ধৈর্য ধরো বাবা । আল্লাহ পাক আছেন তো । তিনি একটা দিক করবোই ।
– আমার ভালো লাগছে না কিছুই । আমি যে কেন এত ঘুম দিলাম ।
– এইডা কি কও বাবা , ঘুমাইবা না কি দাড়াইয়া থাকবা নাকি । যা হইছে তা হওয়ার আছিলো তাই হইছে । আল্লাহরে ডাকো ।

শ্বাশুড়ির কথায় খানিকটা শান্ত হয় ইরফান । তবুও তার মন আর রুহ পড়ে আছে O.T তে । ইরফান চুপ করে বসে তো আছে কিন্তু তার ভেতরের ঝড় কেবল সে একাই সামলে নিচ্ছে ।

অন্যদিকে , O.T তে প্রায় ১ ঘন্টা সময় নিয়ে নিয়েছে ডক্টর । ব্লিডিং হয়ে যাওয়াতে সমস্যা হয়েছে । আর তাছাড়া বেলীর শরীর অনেকটাই দুর্বল যার কারণে বেলীর রেসপন্স খুব কম । তাই ডক্টর তার সর্বোচ্চ চেষ্টা প্রয়োগ করেছেন এইখানে । যাতে বাচ্চা এবং মা দুজনেই বেঁচে বাহিরর বের হতে পারে ।

বিগত দেড় ঘন্টা যাবত O.T করে অবশেষে পৃথিবীর মুখ দেখে বেলীর মেয়ে । সর্বোচ্চ চেষ্টার ফলাফল অবশেষে বেলী এবং তার সদ্য নবজাতক মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে । বাচ্চাকে ক্লিন করে বাহিরে বের করে আনে নার্স ।
নার্সের হাতে বাচ্চা দেখে ইরফানের জানে যেন পানি আসে । নার্স বাচ্চাকে এগিয়ে দিয়ে বলে ,

– কে নিবেন কোলে ?

বেলীর মা তখন নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

– বাবুর বাবার কোলে দেন ।

নার্স ইরফানের দিকে বাচ্চাকে এগিয়ে দেয় । নার্সের হাতে বাচ্চা দেখে ইরফানের হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে যায় । এতটুকুন একটা জান এই এতটুকুন একটা শরীরে । একদম ছোট ছোট হাত পা , ছোট ছোট আঙুল । হাই তুলছে বার বার বাচ্চাটা ।
এমতাবস্থায় বেলীর মা ইরফানকে বলে ,

– কোলে লও বাবা , তোমার মেয়েরে কোলে লও ।

শ্বাশুড়ির কথায় ইরফান তার মেয়েকে কোলে নেয় । মেয়ে বাপের কোলে উঠে হাত পা ছুড়ে , হাই তুলে , টিপ টিপ করে চায় । মেয়েকে কোলে নিয়ে ইরফানের পুরো শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে যায় । ইরফানের চোখ বেয়ে অনায়াসে পানি ঝড়ে যায় । অনুভূতিগুলো হয়তো এমনি হয় । সন্তানের বাবা হওয়ার হয়তো এটাই হয় । বাবা হওয়ার অনুভূতি হয়তো এমনটাই হয় । নিজেকে তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী মনে হচ্ছিল ইরফানের । কারণ এই মুহুর্তে তার হাতে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ছিল । মেয়েকে কোলে নিয়ে ইরফানের বেলীর কথা মনে পড়ে যায় । সে তখনই নার্সকে জিজ্ঞেস করে ,

– বেলী কেমন আছে ? মানে আমার স্ত্রী সে কেমন আছে ।
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে । আরেকটু পরেই কেবিনে দেয়া হবে তাকে ।

নার্সের কথায় কলিজা ঠান্ডা হয় ইরফানের । সে মেয়েকে নিয়ে চেয়ারে বসে যায় ।

– আমার মা কেমন আছে ? কেমন আছে আমার আম্মাজান ।

মেয়েকে কোলে নিয়ে কত কথা ইরফানের । কিচ্ছুক্ষণ পরেই ইরফান তার শ্বাশুড়ির কোলে দেয় বাচ্চাকে । বেলীর মায়ের এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি । যেই বেলীকে আতুর ঘরে জন্মের পর এইভাবে কোলে নিয়েছেন আজ সেই বেলীর মেয়েকে হাসপাতালের করিডোরে এইভাবে কোলে নিয়েছেন । নানীদের এই জিনিসগুলো খুব ভাগ্য করে আসে । প্রথমে নিজের সন্তানকে কোলে নেয়ার স্বাদ তারপর সেই সন্তানের সন্তানকে কোলে নেয়ার স্বাদ । এ যেন আত্মা জুড়িয়ে যাওয়া এক অনুভূতি ।

বেলীকে প্রায় ২০ মিনিট পর কেবিনে দেয়া হয় । জ্ঞান পুরোপুরি ভাবে ফিরে নাই তার । চোখ তার ঘুমের রাজ্যে । একটা পরিষ্কার কেবিনে বেলীকে রাখা হয়েছে । তার এক পাশে পাশাপাশি দুইটা বেড আরেক পাশে একটা দোলনা রাখা হয়েছে । বেলী সেখানে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে । বাচ্চাও তার নানীর কোলে আছে । ইরফান বেলীর দিকে চেয়ে আছে , ইরফান বসে থেকেই বুঝে গেছে ঘুমন্ত বেলীর শরীরটা কতটা ক্লান্ত । পুরো শরীরের ক্লান্তটা বেলীর চেহারায় ভর করেছে ।

প্রায় এক ঘন্টা পর পুরোপুরি ভাবে বেলী সেন্সে আসে । সকাল টা যে কোন দিক দিয়ে হয়ে আছে তা কেউই বুঝতে পারে নি । সকাল হওয়ার পরে ইরফান তার বাবাকে ফোন করে জানায় । অফিসে বসকে মেইল করে দেয় , তার ছুটি লাগবে । সে যে বাবা হয়েছে । অন্যদিকে কয়েকজন কলিগকে ফোন করে সু-খবর জানিয়ে দেয় ইরফান । অবশ্য সেই কয়েকজন কলিগ সবটাই জানে । বেলী কে , রুবি কে , কিন্তু তারাও প্রথমে ইরফানকেই কথা শুনিয়েছে । না দেখেও বেলীকেই সাপোর্ট করেছে । অফিসের অন্যান্য কলিগরা এত কিছু জানেও না । তাই তাদের খোলসা করে কিছুই বলার নেই ইরফানের ।

বেলীর জ্ঞান ফেরার পর ইরফানকে সামনে দেখতে পায় সে । ইরফানকে দেখে খুশিতে হেসে দেয় বেলী । O.T রুমেই বেলীকে তার বাবুকে দেখানো হয়েছিল একবার । তবুও ইরফানকে জিজ্ঞেস ,

– বাবুকে দেখছো ?

ইরফান হাসি মুখে জবাবও দেয় ,

– হ্যাঁ দেখছি ।
– কেমন হয়েছে দেখতে ?
– বেলীর ঘরে আরেক বেলী , ছোট্ট বেলী ।

বেলীর মা নাতনিকে কোলে নিয়ে এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ায় । আর বলে ,

– তোর মেয়ে মাশা-আল্লাহ একেবারেই চুপচাপ রে বেলীফুল ।
– মাশা-আল্লাহ বলো মা ,

এটা বলতে যা দেরি , আম্মাজান এইযে চিৎকার শুরু করছে । ছোট কন্ঠে ওয়া ওয়া করে তার কান্না শুরু । এই কান্না জানান দিচ্ছে যে তার ক্ষুধা পেয়েছে । বড় হয়ে গেলে তো মাকে বকে দিতো এখন তো সে এতই ছোট যে মা বলতে পারে না তাই ওয়া ওয়া করে জানান দিচ্ছে মা আমার ক্ষুধা পেয়েছে ।

মায়ের বুকের প্রথম শালদুধের স্বাদ সব নবজাতকের প্রাপ্য থাকে । বেলীর বাচ্চাটাও গলা ফাটাচ্ছে তার জন্যে । বেলীর মা ইরফানকে একটু বাহিরে যেতে বলে , শ্বাশুড়ির কথায় ইরফান উঠে বাহিরে যায় । এর ফাঁকে বেলী তার সদ্য নবজাতককে দুধ দেয় ।

অন্যদিকে আজ ইরফান পরিপূর্ণ । আজ তার সংসার পরিপূর্ণ । স্বয়ংসম্পূর্ণ সে , বেলী আজ তাকে দুনিয়ার সেরা সম্পদ উপহার দিয়েছে । বেলী এক মহান আত্মত্যাগী নারী । যে কিনা তার এই এতটুকু জীবনে নিজের সবটা বির্সজন দিয়েছে ইরফানের কাছে । বেলী সেই নারী যে কিনা ইরফানের মারধর ইরফানের রাগ সব সহ্য করে নিজের মাঝে ধারণ করে নিয়েছিল অনায়াসে । নিজের বক্ষে ধারণ করেছিল সব ব্যাথা সব যন্ত্রণা । তবুও মুখ ফুটে কিছুই চায়নি সে । বেলীর ধৈর্যশীলতা আজ তাকে সব টা দিয়েছে । ইরফানের ভালোবাসা , একটা সাজানো সংসার , একটা ফুটফুটে সন্তান সব পেয়েছে ।

১০ দিন পর বেলীকে আর তার মেয়েকে বাসায় আনা হয় । পুরো বাসা পরিষ্কার করে রেখেছে মিনু । এই ১০ দিনের মাঝে মিনু হাসপাতালে মোট ১৫ বার গেছে । এমনও দিন গেছে দিনে ২ বারও গিয়েছে সে । সে বেলীকে খুব ভালোবাসে তেমন ভালোবাসে বেলীর সংসারকে আর এখন সব কিছুর উর্ধ্বে ভালোবাসে বেলীর সন্তানকে । মা ছাড়া তার মুখে কথাই রোচে না এখন । মিনু চায় সারাক্ষণ বেলীর বাচ্চা তার কাছে থাকুক ।

গ্রাম থেকে ইরফানের বাবা এসেছেন । বেলী আর ইরফানের বাচ্চার নাম করণ হবে সাথে মিলাদ হবে । কিছু মেহমানও দাওয়াত করে ইরফান । শুক্রবার যথারীতি জুমার পরে মিলাদ হয় ইরফানের বাসায় । মসজিদের বড় হুজুর ইরফানকে ডেকে বাচ্চার নাম কি রাখবে জিজ্ঞেস করেন , মানে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কোন নাম আছে কিনা , তখন ইরফান বেলীকে জিজ্ঞেস করতে রুমে যায় । বেলী তখন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসা । ইরফানের কথায় বেলী তার বাচ্চার দিকে তাকায় । কোরআন শরীফে একটা শব্দ বার বার পড়েছে বেলী । জান্নাত , তাই মেয়ের নাম দিয়েছে সে ” জান্নাতুল ইকরা ” । বেলীর কথা অনুসারে মেয়ের ভালো নাম রাখা হয় ” জান্নাতুল ইকরা ” ।

বাবার নামের সাথে মিল রেখে ডাক নাম রাখা হয় ” ইন্নি ” । সারা ঘর এখন মেতে থাকে ইন্নিতে । কখনো বেলী কখনো ইরফান কখনো মিনু । মিনুতো চোখে হারায় ইন্নিকে । বেশিরভাগ সময় ইন্নি মিনুর কাছে থাকে । অফিসে যাওয়ার আগে ইরফানের ইন্নিকে দেখাই লাগে ।

ইন্নি মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর , যেন এক মিষ্টি পরী । যে দেখে তারই কোলে নিতে ইচ্ছে করে । দুধে আলতা রঙ তার , জিবটা বের করে তা তা করে । বাবাকে চিনে সে ভালো মত , মায়ের ওড়নার নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলে সে । মিনুর মুখে যদি একবার মা ডাক শুনে ইন্নি লাফিয়ে উঠে । হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে সারা ঘর খেলে ইন্নি আর তা তা করে । কলিংবেলের শব্দ পেলেই ইন্নি মায়ের আঁচল ধরে টানে , বা,,,,,, বা,,,,,,বা,,,,,বা,,, করে বুঝাতে চায় তার বাবা এসেছে । বেলী তখন ইন্নিকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দেখে । দরজায় ইরফানকে দেখলেই খিলখিলিয়ে হেসে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় ইন্নি । এর মানে বাবাকে জানান দিচ্ছে তাকে কোলে নিতে ।

ইন্নির বয়স ৬ মাস । একটু একটু দাঁড়ায় ইন্নি । বেলী আর ইরফানের বাঁচার অনুপ্রেরণা ইন্নি । ঘরে ইন্নির খেলনার অভাব নেই । ইরফান অফিস থেকে আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই তার রাজকুমারীর জন্যে । সুখের কমতি নেই এই ঘরে । বেলীর জীবন আজ কানায় কানায় পূর্ণ । ইরফানের অনেক ভালোবাসা আর সুখের মাঝে ইন্নিকে নিয়ে বেশ আছে বেলী ।

পরদিন সকাল বেলা বেলী ইরফানের জন্যে নাস্তা বানাচ্ছিল রান্নাঘরে । ইরফানের পাশে ইন্নি শুয়ে শুয়ে হাত পা ছুড়ছে । ইরফান ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়েছে । বেলী আর ইরফানের মেয়ে ইন্নি অনেক শান্ত হয়েছে । ক্ষুধা লাগা আর ব্যাথা পাওয়া ছাড়া সে কাঁদে না ।

ইরফান ব্লেজার পরতে পরতে ইন্নিকে ডাকে ,

– আম্মাজান , ও আম্মাজান ।

ইন্নি কি বুঝেছে কে জানে । ইরফানের মুখে আম্মাজান ডাক শুনে ইন্নিও সেই সাথে তাল মেলায় ।

– তা,,,,,, তা,,,,,,

ইরফান আবারও ডাকে ,

– আম্মাজান , ও আমার আম্মাজান , আমার আম্মাজানটা কি করে ।

ইন্নি তখন ইরফানের কথা শুনে তা তা করতে করতে বিছানার একদম কর্ণারে চলে আসে । দু’হাত এগিয়ে দিয়ে বাবাকে ইশারা করে ,

– বা,,,,,,,,বা,,,,,,বা,,,,,,বা,,,,,,

ইরফান আয়নায় ইন্নিকে দেখে দ্রুত গিয়ে কোলে নেয় ইন্নিকে ।

– আম্মাজান পেকে গেছে । আমার আম্মাজান পেকে গেছে ।।

ইরফান ইন্নিকে কোলে রেখেই বেলীকে ডাকতে থাকে । আর বেলীও তখন সব কাজ রেখে দৌড়ে চলে আসে রুমে ।

– কি হলো ,
– টাই টা ঠিক করে দেও ।
– নিজেই ঠিক করে নেও ।

ইরফান ইন্নিকে শিখিয়ে দেয় মাকে ডাকতে । ইন্নি যেন কত কিছু বুঝে । সেও বাবার কথা মত মাকে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকে ,

– মাহ,,,,,,,মাহ,,,,,মাহ,,,,, আ,,,আ,,,,

বেলীও মেয়ের কথায় হাসিমুখে ভেতরে ঢুকে যায় । ইরফান ইন্নিকে খাটে বসিয়ে রেখে বেলীর কোমড় জড়িয়ে ধরে । বেলী পরম মমতায় ইরফানের টাই ঠিক করে দেয় । ইরফান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি । বেলীর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে দেয় ।

মায়ের কপালে চুমু দেয়ায় ইন্নি খিল খিল করে হেসে দেয় আর হাত তালি দেয় । ইরফান আর বেলী ইন্নির হাসি দেখে নিজেরাও হেসে দেয় । তখন ইরফান ইন্নিকে কোলে নিয়ে বলে ,

– মাকে চুমু দেয়ায় আম্মাজান আমার খুশি হয়ে গেছে । বাবা চুমু দেই আম্মাজানকে ?

এই বলে ইন্নির গালে চুমু দেয় ইরফান । আর ইন্নি ” তা,,,,,তা,,,,” করে হেসে দেয় ।

এ যেন এক ভরা এবং পরিপূর্ণ সংসার । ইরফান বেলীর সুখের সংসার যেখানে ইন্নি নামের এক ফেরেশতা ইরফান বেলীর সুখের স্থায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে ।

.
.

চলবে…………………

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৮

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

হাত পা ফুলে গেছে বেলীর । শরীরে জোর নেই বললেই চলে তবুও সে মনের দিক থেকে শক্ত আছে । আর এক এক সময় বাবু ভেতরে ফুটবল খেললে তো বেলীর দফা রফা হয়ে যায় । ইদানীং বাবু ভেতরে ভালোই খেলাধুলা করে । সে হয়তো খেলে মজা পায় কিন্তু এদিকে উপরে বেলীর অবস্থা খারাপ হয় ।

রাতে বেলী শুয়ে আছে , ঠিক শুয়ে আছে বললেও ভুল হবে খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে বসে আছে । ইরফান বেলীর পা গুলো বালিশের উপর তুলে দিয়েছে । কিন্তু বেলীর মনে শান্তি নেই । কারণ আজ অফিস থেকে আসার পর ইরফানকে অন্যরকম লাগছিল যা বেলীর চোখে সহজেই পড়ে যায় । অন্যান্য দিন ইরফান বেলীর সাথে কথা বলে , হাসিখুশি থাকে কিন্তু আজ একদম অন্যমনস্ক । কিছু তো একটা হয়েছে যা বেলীর মন ধরতে পেরেছে । আস্তে করে উঠে গিয়ে অতি সাবধানে হেটে হেটে ইরফানের পাশে গিয়ে বসে বেলী । ইরফান গালে হাত দিয়ে লেপটপ দেখছে । ইদানিং ইরফানও কেন জানি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে । ছেলের বাপ হবে নাকি মেয়ের হবে কে জানে তবে বাপ মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর হয়ে গেছে সাথে মাও । পেটে হাত দিয়ে ইরফানের পাশে বসে বেলী । ইরফান এতটাই মগ্ন আছে যে বেলী যে তার পাশে এসে বসেছে তার কোন ধারণাই নেই । এতেই বেলী আরও বুঝে গেছে যে ইরফানের কিছু তো একটা হয়েছে । বেলী আস্তে করে ইরফানের কাঁধে ধরে ।

– কাজ করতেছো ?

বেলীর হাতের স্পর্শ আর মুখের কথা শুনে অত্যন্ত শান্ত নজরে ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকায় । বেলীর চেহারার মাঝে এক অসাধারণ আকর্ষণ আছে যা অন্যের মন মানষিকতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে বেশি সময় নেয় না । হালকা মিষ্টি হেসে বেলীর গালে স্পর্শ করে উত্তর দেয় ,

– একটু বাকি আছে ,
– কি হয়েছে তোমার ?
– কোথায় কি হয়েছে ?
– লুকিও না , তোমার কিছু তো হয়েছে , বলো না কি হয়েছে ?
– আরে নাহ রে পাগলী , কিছুই হয়নি । আমি ভালো আছি ।
– মিথ্যা কেন বলো ,

বেলীর মনটা ছোট হয়ে যাক ইরফান চায় নি । আবার বেলীকে মিথ্যাও বলতে চাচ্ছে না সে । তাই বাধ্য হয়ে সত্যিটাই বলে দেয় সে ।

– আজকে অফিস থেকে বের হয়ে যখন আসতে যাবো তখন একজনকে দেখলাম ।
– কাকে দেখলা ?
– রুবিকে ,

রুবির কথা শুনে ধক করে বুকে একটা মোচড় দিয়ে উঠে বেলীর । হঠাৎ রুবির সাথে দেখা । কি চায় রুবি এখন ? নানান চিন্তা এক নিমিষেই বেলীর মুখে ভেসে ওঠে । যা ইরফানের মনে দাগ কাটতে এক মিনিটও লাগে নি । ইরফান বুঝে গেছে এত কিসের চিন্তায় ডুবে গেছে বেলী । মুখে না বললেও ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে তাও ইরফানের জানা আছে । আলতো করে বেলীকে বুকে টেনে নেয় ইরফান ।

– ইরফান বেলীফুলেরই থাকবে । সে আর দ্বিতীয়বার অন্যপানে যাবে না । সে ভালোবাসে তার এই সহজ সরল বেলীফুলকে । যে কিনা তাকে এক নতুন প্রাণের সন্ধ্যান দিয়েছে । আমি ভালোবাসি আমার বেলীফুলকে ।

ইরফানের কথা গুলো শুনে বেলীকে ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় । নিশ্চুপ মুখ করে শুধু চোখ থেকে পানি ঝড়াচ্ছে বেলী । কিচ্ছু বলছে না সে । বেলীর এই অসাধারণ কিছু আচরণ যা ইরফান চাইলেও অদেখা করতে পারে না । আরও জড়িয়ে নেয় সে বেলীকে ।

– কেঁদো না , আমি রুবিকে দেখেছি অন্যভাবে । নতুন বিয়ে করেছে । গত দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছে তার । ছেলে নাকি তার পূর্ব পরিচিত । রুবি সেই লেভেলের মেয়ে যে কিনা সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়ে যায় । তার থেকে নোংরা আর কা-পুরুষ তো আমি যে কিনা,,,,,,,,,,,,,,

ইরফানকে আর কিছু বলতে দেয় নি বেলী । ইরফানের মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় সে ইরফানকে । ইরফান চুপ করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় । বেলীও কাঁদতে থাকে মুখ বুঝে । এর মাঝেই ইরফান বেলীর ভারী পেটে হাত রাখে আর বলে ওঠে ,

– আম্মাজান আমার কেমন আছে গো ?

চোখ মুছে ইরফানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে সেও বলে ,

– লাথি মারে তোমার আম্মাজান ।
– হা হা হা , ওমেন্স ফুটবল টীমে ভর্তি করাবো আম্মাজানকে ।
– আর আমায় যে যন্ত্রণা দেয় তার বেলায় ?
– তাকে আসতে দেও আর তুমি সুস্থ হও , সব যন্ত্রণা সুখে পরিণত করে দিবো ।
– হুপ ,
– হা হা হা ,

ইরফানের হাসিটা মাশা-আল্লাহ । এক পলকে চেয়ে আছে বেলী ইরফানের দিকে । ইরফান দিন দিন অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে যাচ্ছে আর অনেক সুন্দরও । এরই মাঝে ইরফান বলে ওঠে ,

– আর তো কয়েকটা দিন । তারপর আম্মাজান চলে আসবেন আমার ।
– আল্লাহ পাকের দোয়ায় ।
– হুম ,

হ্যাঁ বেলী আর ইরফানের মেয়ে হবে । লাস্টবার আল্ট্রা করিয়েছিল তারা । সেখানেই ডক্টর সুনিশ্চিত করেছেন যে তাদের মেয়ে হবে । ইরফান অনেক খুশি তার মেয়ে হবে বলে । হঠাৎ করেই বেলী দুই হাতে পেট চেপে হালকা চিৎকার করে ওঠে ,

– মাগোওওও ,,,

ইরফান বেলীর চিৎকার শুনে আৎকে উঠে । হট করেই বেলীকে ধরে ফেলে সে ।

– কি হয়েছে বেলী ,
– লাথি মারলো , উফফফফ ।
– তাই ?
– উফফফফ ,
– অনুভূতি কেমন বেলী ?
– এ এক অজানা অনুভূতি , এই অনুভূতিটুকু না হয় আমারই থাক ।
– কেন , আমাদের হওয়া যায় না ?
– হ্যাঁ , তাও যায় । এই অনুভূতিটুকু না হয় আমাদেরই থাক ।
– হ্যাঁ থাক আমাদের হয়ে , এখন চলো ঘুমাবে ।
– তোমার কাজ ?
– শেষ , চলো ।
– চলো ।

ইরফান বেলীকে ধরে উঠায় । পেট টা বেশ বড় হয়ে গেছে । নয় মাস চলছে বেলীর পেট তো বড় হবেই । বিছানায় নিয়ে গেছে ইরফান বেলীকে । আলতো করে শুইয়ে দেয় সে বেলীকে ।

– পা ব্যাথা করে ?
– মাজা থেকে শুরু করে পায়ের আঙুলের মাথা অবদি । এত ব্যাথা আর কি ফুলে গেছে দেখছো ।
– আমি টিপে দেই ?
– আরে নাহ , লাইট অফ করে আমার পাশে আসো । ঘুমাও ,
– তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ।
– তুমি পাশে আসো , আমি তোমার বুকে হাত দিয়ে রাখবো না হয় ঘুম আসবে না ।

বেলীর কথায় হাল্কা হেসে ইরফান লাইট অফ করে বেলীর পাশে এসে শুয়ে যায় । ইরফান শোয়ার পর বেলী কাত হয়ে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে । কিন্তু ইরফানকে নিজেকে ধরতে দেয় না বেলী । কেউ ধরলে নাকি বেলীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । তাই চুপ করেই ইরফান এক হাত দিয়ে বেলীর হার ধরে আর অন্য হাতে বেলীর চুলে বিলি কেটে দেয় যাতে বেলী ঘুমিয়ে যায় । এক সময় বেলী আসলেই ঘুমিয়ে যায় । বেলীর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে ইরফানও ঘুমিয়ে যায় ।

ভালোবাসা গুলো এখানে আস্তে আস্তে ধরা দেয় সুখ রুপে । যা এসেছে ইরফান আর বেলীর মাঝে ।

শেষ রাতের দিকে বেলীর চিৎকার শুনে ইরফানের ঘুম ভেঙে যায় । বিছানায় বসে ইরফান বেলীকে দেখতে পায় না । হঠাৎ ওয়াসরুমের দিকে নজর দেয় ইরফান । শব্দ সেইখান থেকেই আসে । ইরফানের কলিজায় আর পানি নেই । ধুপ ধাপ করে তাড়াহুড়ো করে নেমে ওয়াসরুমের কাছে যায় ইরফান । ওয়াসরুমের দরজা খোলা ছিল । ইরফান ভেতরে ঢুকে যায় , দেখে বেলী ফ্লোরে বসে আছে । প্রচন্ড কাঁদছে মেয়েটা । ইরফান কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না । এই মুহুর্তে তাকে পাগল পাগল লাগছিল । ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীকে তোলার চেষ্টা করে । বেলী উঠতে পারছে না । ইরফান প্রায় কেঁদেই দিয়েছে ।

– মাকে ডাকো , মাকে ডাকো ।

বেলীর মুখ থেকে মায়ের কথা শুনে ইরফানের মাথায় আসে তার শ্বাশুড়ির কথা । ইরফান বেলীকে বলতে শুরু করে ,

– তুমি একা একা কেন আসলা ?
– আহহহ , মাকে ডাকো আহহহ
– আমাকে ডাকলা না কেন ?
– তুমি ঘুমাচ্ছিলে , মাকে ডাকো ,
– হু ,

ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীর মাকে ডাকে । জামাইয়ের মুখ থেকে এই খবর শুনে বেলীর মা দৌড়ে আসে । মেয়েকে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে বেলীর মা কেঁদে দেয় ।

– কেমনে পড়ছত রে মা ,
– মা ধরো আমারে ,
– হায় হায় গো , জামাইরে ডাকলি না কিলিগা ।

ইরফান আর বেলীর মা মিলে বেলীকে তুলে । বেলীর লেবার পেইন উঠে গেছে । বেলীকে উঠানোর সাদা টাইলসের দিকে নজর যায় ইরফানের । ফ্লোরে রক্ত দেখে আৎকে উঠে ইরফান । ওর মুখ দিয়ে আচমকাই বের হয়ে যায় ,

– মা , রক্ত,,,,,,,,,,,

ইরফানের কথা শুনে বেলীর মা ফ্লোরে তাকায় সাথে বেলীও । বেলীর রক্ত ছুটে গেছে । বেশিক্ষন অপেক্ষা করা যাবে না । যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে তাকে । এইদিকে ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা বেলী বার বার চিৎকার করে উঠে । মিনু চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে আসে । বেলীর মা কোন রকম বেলীর মেক্সি পালটে দেয় আরও কিছু জামা কাপড় নিয়ে নেয় । মিনুও কেঁদে দেয় বেলীকে দেখে ।

ঘড়িতে রাত প্রায় সাড়ে ৩ টা । এত রাতে এই বিপদ । কথায় আছে বিপদ সব সময় রাতেই আসে । রাতেই এসেছে বিপদ । ভয়ানক বিপদ যা উলটে পাল্টে দিচ্ছে ইরফানকে । বেলীর কান্না তার কলিজায় গিয়ে লাগছে । পেট ধরে বার বার চিৎকার করছে বেলী । কোন রকম সি এন জি একটা নিয়ে হাসপাতাল রওনা দেয় ইরফান । মিনুকে বাসায় রেখে গেছে সবাই । মিনু বার বার বলেছে যাবে সাথে । কিন্তু বাসা খালি থাকায় তাকে আর নিয়ে যায়নি ইরফান । বেলীর মা বেলীকে জড়িয়ে রেখেছে আর পাশে ইরফান বসা । যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল যাচ্ছে তারা ।

ব্যাথার যন্ত্রণায় বার বার ইরফানের হাতটা চেপে ধরে বেলী । কোন রকম হাসপাতালে নিয়ে যায় বেলীকে । ডক্টর তখন অফ ডিউটিতে ছিল । তাকে ফোন করে আনানো হয় । সে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দেয় ।

– কিভাবে পড়েছে ?
– হয়তো পিছলে গিয়ে ,
– হয়তো , আপনি কোথায় ছিলেন ? ব্লাড ছুটেছে , নার্স O.T রেডি করেন এক্ষুনি ।

নার্স ডক্টরের কথায় দ্রুত O.T রেডি করতে চলে গেছে । ১৫ মিনিটের মাথায় বেলীকে O.T তে নিয়ে যাওয়া হয় । যাওয়ার সময় বেলী খুব কেঁদেছে ইরফানকে ধরে । অনেক কেঁদেছে নিজের মাকে ধরে । ডক্টরের তাড়াহুড়োয় বেলীকে O.T তে নিয়ে যাওয়া হয় ।

এইদিকে ইরফানের শরীর কাঁপা শুরু হয়ে যায় । বেলীর রক্ত দেখে আর ব্যাথা দেখে ইরফান হতভম্ব হয়ে আছে । ইরফান পাগলের মত করতে থাকে । এই সময়ে ভরসা একমাত্র আল্লাহ পাক আর বেলীর মা । বেলীর মা বার বার বড় খতমের দোয়া পাঠ করছেন আর জামাইকে সান্তনা দিচ্ছেন । এরই মাঝে O.T রুমের লাইট টা জ্বলে উঠে । আর ইরফান তা দেখে নিজের হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় ।

.
.

চলবে…………………

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৭

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

দেখতে দেখতে সুখে শান্তিতে কেটে যায় ৬ টা মাস । এর মাঝে প্রায় কয়েকবার বেলী অসুস্থ হয়ে গেছে । ইরফানের শান্তি বলতে এই ৬ মাসে সব গায়েব । মিনু একা হাতে অনেকটাই সামলে নিয়েছে সবটা । এই বাসায় একমাত্র মিনু-ই সেই ব্যাক্তি যার উপর ইরফান আর বেলী চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে । মিনু যদি তাদের বিষও দেয় তারা অনায়াসে বিষটাও খেয়ে নিতে রাজি । মিনু এতটাই বিশ্বস্ত তাদের কাছে ।

গ্রাম থেকে বেলীর মাকে আনা হয়েছে । বেলীর শরীর ভালো যাচ্ছে না ইদানীং । মিনুও পারে না আর তাই বেলীর মাকে আনানো হয়েছে ।

এখন বেলীর ৭ মাস প্রায় শেষ হতে চললো । শরীর আস্তে আস্তে ভারী হয়ে যাচ্ছে । বসলে আর তার উঠতে মন চায় না আর শুলে তো উঠতেই চায় না । আগের থেকে অনেকটা সুন্দর হয়ে গেছে বেলী । মেক্সি পরে এখন । ইরফান নিজে পছন্দ করে কাপড় কিনে এনে দেয় । বেলী কখনো দামী দামী কাপড়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না । তাই তার কথা অনুযায়ী ৬০ টাকা গজের কাপড়ই কিনে এনে দেয় ইরফান । আর মিনুকে দিয়ে নিচে মোড়ের মাথার দর্জির দোকার থেকে সেলাই করিয়ে আনে বেলী । বেলী এখন যা পড়ে তাই-ই ভালো লাগে বেলীকে । প্রায় সব রং-ই বেলীকে মানায় ।

ইরফানও বেশ সিন্সিয়ার হয়ে গেছে । এই ৭ মাসে কম করে না হলেও প্রায় ২৫ বার ডক্টরের কাছে নিয়ে গেছে বেলীকে । বেলীর প্রবলেম একটাই বেলীর রক্তের প্লাটিলেট অনেক কম । তাই ১৫ দিন কি ১ মাস পর পর বেলীকে বাসায় এসে সেলাইন পুষ করে দিয়ে যাওয়া হয় । এইসব কিছু ইরফান নিজেই দেখাশুনা করে ।

ইরফান মোটেও চায় না বেলীর একটুও অযত্ন হোক । সে বেলীকে কোন রকম অযত্ন করে না এবং অযত্নে রাখেও না । বেলীর জামা-কাপড় থেকে শুরু করে বেলীর মাথার চুল অবদি পরিপাটি দেখতে চায় সে ।

আর বেলী সে ইদানীং বড় বেশিই খুতখুতে হয়ে গেছে । অল্পতেই রেগে যায় , বিরক্ত হয় , আবার মাঝে মাঝে কাঁদে । তার মন এক এক সময় এক এক রকম থাকে । তাই ইরফান বেচারাও বেলীর কথায় হা/না করে । বেলীর সব কথা-ই ইরফান অনায়াসে শুনে নেয় । ইরফান অনেক এঞ্জয় করে এই সময়গুলোকে । কারণ সে বাবা হতে চলেছে ।

আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে ইরফান । বিকেলের দিকেই চলে এসেছে সে । বেলী তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল । ইরফানকে গেইটের ভেতরে ঢুকতে দেখে বেলীর বুকে মোচড় দিয়ে উঠে । ইরফান কলিংবেল দেয়ার আগেই বেলী গিয়ে দরজা খুলে দেয় । বেলীর এইভাবে দরজা খুলে দেয়া দেখে ইরফানও অনেকটা অবাক । ইরফান হাসি মুখে বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দেয় , আর বলে

– আজকে একেবারে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছো যে ?
– তুমি এখন এই সময়ে বাসায় ?
– চলে আসলাম ।
– শরীর ভালো তো ?
– আলহামদুলিল্লাহ ।

ইরফান ভেতরে গেলে বেলী দরজা লাগিয়ে দেয় । ইরফান বদলে গেছে । শুধু বদলে যায় নি অনেকটাই বদলে গেছে । নামাজ পড়ে ৫ ওয়াক্ত । ১ ওয়াক্ত নামাজ সে কাযা করে না । অফিসেও নামাজ আদায় করে নেয় । ইরফান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বেলীকে জিজ্ঞেস করতে থাকে ,

– মা কি করে ?
– শুয়ে আছে ,
– আর মিনু ?
– মিনুও মায়ের সাথে আছে ।
– মায়ের সাথে মিনুর ভালো জমেছে ,
– হ্যাঁ অনেকটা ।

ভেতরে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে বসে ইরফান । এইখানেও বেলীর সমস্যা ।

– ফ্যান ছাড়লা কেন ?
– বাহিরে থেকে আসছি , একটু হাওয়া লাগুক গায়ে ।

বেলী বিরক্তিকর চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে । ইরফান বুঝে যায় বেলীর বাতাসে সমস্যা হচ্ছে । তাই নিজ থেকেই ফ্যান অফ করে দেয় ।

রাতে খাবার খেয়ে বেলী রুমেই হাটাহাটি করছে আর ইরফান বিছানায় বসে লেপটপে কাজ করছিল । বেলী রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা অবিদি এইভাবেই হাটাহাটি করতে থাকে । আর তার কিছুক্ষন পর বিছানায় এসে ইরফানের পাশে বসে সে । ইরফানের কাঁধে হাত দিয়ে ইরফানকে ডাকতে থাকে সে ,

– শুনছো ,,,,,?
– হু বলো ,
– দেখো না পা গুলা কেমন ফুলে গেছে ।

বেলীর পায়ের দিকে তাকায় ইরফান । আসলেই পা গুলা ফুলে গেছে বেলীর । ডক্টর গতবার বলেছিলেন হাতে পায়ে পানি নামবে । হয়তো তাই ফুলে গেছে । ইরফান লেপটপ অফ করে দেয় । দিয়ে বেলীর দিকে ফিরে ।

– এটা কিছু না , স্বাভাবিক ব্যাপার । ভয় পেও না ।
– পায়ের কামড়ানি কাকে বলে ,
– ব্যাথা বেশি করছে ?
– হু ,
– টিপে দেই ?
– আরে নাহ , লাগবে না ।

ইরফান বেলীর কথা আমলে না নিয়ে বেলীকে শুইয়ে দেয় আর বেলীর পাগুলো টিপতে থাকে ।

– আমার জন্যে যে মানুষটা এত করতে পারে তার এই সময়ে তার সেবা না করলে আমি তো কাফের থেকেও খারাপ হয়ে যাবো বেলী । তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ।

ইরফানের কথায় বেলী শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে । ইরফান যে এত বদলে যাবে সে ভাবে নি । একজন আদর্শ মানুষ এবং একজন আদর্শ স্বামী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইরফান । হয়তো এমনি করে একদিন নিজেকে আদর্শ বাবা হিসেবে গড়ে তুলবে । হালকা মুচকি হাসি দিয়ে বেলী চোখে ঘুম নামায় । আর ইরফান বেলীর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বেলীর পা গুলো টিপতে থাকে ।

আল্লাহ পাকের এক অদ্ভুত লিলা চলে এই ধরায় । সেই লিলা চলে মনুষ্য জীবনে । মনুষ্য এক জীবনে সব পায় না । আবার অনেকে এক জীবনে সব পাওয়াগুলো না চাইতেই পেয়ে যায় । বেলীও ঠিক তেমন এক মনুষ্য যে এক জীবনে বহুত কিছু হারিয়েছে । হারিয়েছে তার বাবাকে , হারিয়েছে এক সহজ সরল মানুষের ভালোবাসা । এক বুক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে এসেছিল সে । সেখানে পাওয়া হয়নি স্বামীর ভালোবাসা । একদিন হুট করেই আল্লাহ পাক কেন জানি তার ঝোলা পরিপূর্ণ কর‍তে থাকে । তারপর তার গর্ভে আসে এক নতুন প্রাণ । আল্লাহ পাক তার সব টুকু নেয়ামত এক সাথে বেলীর ভাগ্যে ঢেলে দিয়েছেন । এ হয়তো বেলীর পাওনা ছিল । এভাবেই হয়তো আল্লাহ পাকের নেয়ামত আদায় করে নিতে হয় উপরওয়ালার কাছ থেকে ।

আজ ৯ মাসে পড়েছে বেলীর প্রেগন্যান্সির । এই মাসের লাস্টের দিকে ডেট পড়েছে । শরীরের কন্ডিশন ততটা ভালো না বেলীর । নরমাল সম্ভব না তাই সিজারিয়ান করাতে হবে । বেলী যথেষ্ট শক্ত আছে , ভয় পাচ্ছে ইরফান । কারণ বেলীর শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নেই । গতকাল কোরআন খতম করেছে বেলী । ইরফান মসজিদে মিলাদ দিয়েছে । যে নারী সন্তানসম্ভবা অবস্থায় কোরআন খতম করে তার সন্তান একজন নেককার মানুষ হোন । হয়তো বেলীও এমনটাই চায় ।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বেলী । হঠাৎ করেই পুরনো সব কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার । আজ ইরফানকে বেলীফুল আনতে বলেছে বেলী । ইরফান বার বার করে জিজ্ঞেস করার পরেও বেলী কিছু বলেনি । আজ রাতে সে সাজবে । বন্ধ ঘরে ইরফানের সামনে আজ আবার সাজবে সে । সেই সাদা শাড়িটা পরে খোঁপায় বেলীফুলের মালা পরবে সে । অবশ্য এর কারণ আছে । সেদিন রাতে একবার ইরফান বলেছিল ,

” বেলী , আবার সেই সাদা শাড়িটা পরবা ? শাড়িটায় অনেক সুন্দর লাগে তোমায় ”

তাই ভাবছে আজ একবার পরবে তবে এক পেচ বাঙালি ভাবেই পরবে । তাই বেলীফুল আনতে বলা ইরফানকে ।

ইরফান বেলীফুলের মালাটা এনে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে । রাতে খাবারের পর ইরফানকে প্রায় ৩০ মিনিট রুমের বাহিরে দাড় করিয়ে রেখেছে বেলী । ইরফান প্রায় বিরক্ত হয়ে গেছে। এইভাবে এতক্ষন ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাকি ? তারপর দরজায় নক করে সে ,

– বেলী , এই বেলী ,
– হুউউউউ
– তোর হু আমি বের করবো , দরজা খোল ফাযিল ,
– হি হি হি ,
– বেলী শরীর খারাপ তোমার আর তুমি দরজা আটকে রাখছো । এইগুলা কি ফাইযলামি বেলী ।
– এক মিনিট ,
– এক সেকেন্ডও না , দরজা খুলো ।

তার কিছুক্ষণ পর বেলী দরজা খুলে ইরফানের সামনে দাঁড়ায় । ইরফান আর দরজার ভেতরে ঢুকতে পারেনি । সে সেখানেই ফিট হয়ে যায় বেলীকে দেখে । এ যেন এক সাদা অপ্সরা তার ঘরে । একেবারে বাঙালি নারী বেলী । মাথায় খোঁপা করে বেলীফুলের মালাটা গুজে দিয়েছে । চোখে কাজল , ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক । এক পেচ করে শাড়ি পরে ভরা পেটে দাঁড়িয়ে আছে বেলী । ইরফান যেন ঘোরের মাঝে চলে গেছে বেলীকে দেখে । হঠাৎ করেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় ,

” বেলীফুল ”

বেলী মুচকি হেসে ইরফানের হাত ধরে তাকে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় । তারপর দরজাটা লাগিয়ে দেয় সে । ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে এক পলকে । এরই মাঝে বেলী ইরফানকে বলে উঠে ,

– কেমন লাগছে ?
-……………..
– এই , কি দেখো এইভাবে ,
– অসাধারণ , মাশা-আল্লাহ । আমার বউ একেবারেই সাদা পরী লাগছে ।
– এইবার গান শুনাও ।

বেলীর এমন অদ্ভুত আবদারে অবাক ইরফান । বার বার না করছে সে , সে তো গান পারে না , কি গান গাইবে । বেলী আরও জেদ করে ,

– তুমি গাইবে না ?
– আমি পারি না তো ,
– না পারলেও গাও , আমি শুনবো

প্রায় কয়েকবার না না করা হয়ে গেছে ইরফানের । কিন্তু বেলী শুনছেই না । তারপর ইরফান চাপা গলায় গান শুরু করে । সাদা শাড়িতে বেলীকে অত্যন্ত সুন্দর লাগছিল । অনেকটা দেবীর মত । বেলীকে দেখে ইরফান সেই দারুণ গানটা তার গলায় ধরে ,

” এই রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা
আকাশটার সাথে নেই জানা শোনা
আমি তোর প্রেমেতে অন্ধ
ছিল চোখ কান সব বন্ধ
থেমে গেছে জীবনের লেনাদানা
সেই পুরনো রাস্তাটায় আজ একা হেটে যাই
হচ্ছে না হিসাবের বনিবনা
এখন এমনি করে ভালো কেমনি করে বাসি
অন্য কোন পাখিকে
তার চেয়ে ভালো ছিল তুই নিজ হাতে খুন করে
যেতি
আমাকে……………….”

মুগ্ধ নয়নে এক হাতে ইরফানের কাঁধ ধরে অন্য হাতে নিজের ভারী পেটে হাত দিয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করে বেলী । আজ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে । এই নিঃশ্বাসে আছে শুধুই শান্তি । বেলীর কোমড় আঁকড়ে ধরে আপন মনে গান গাইছে ইরফান । এ যেম এক অসাধারণ মুহুর্ত । এ যেন এক ভালোবাসার মুহুর্ত । এ যেন এক স্পর্শকাতর অনুভূতি যা মনকে অনায়াসেই ছুয়ে যায় ।

.
.

চলবে…………………………

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৬

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

মেডিকেলে বসে আছে বেলী আর ইরফান । অফিসের এক কলিগকে বলে দুই ঘন্টার ছুটি নিয়েছে বেচারা । ইদানীং অফিসে প্রচুর কাজের চাপ বেড়ে গেছে তার । প্রমোশন হওয়া মানেই কাজের চাপও বেড়ে যাওয়া । ইরফান বেলীর পাশে বসে আছে । বার বার বেলীর দিকে চোখ যাচ্ছে তার । হিজাব পরে ভালোই লাগে বেলীকে । তবে মুখটা অনেক শুকনা লাগছে বেলীর । অবশ্য না লাগার-ই কথা , আজকে তিনটা দিন খাওয়া কি জিনিস সে ভুলেই গেছে । বেলী এমন এক নারী যার দিকে নজর দিলে চোখ সহ পুরো শরীর শান্ত হতে বাধ্য ।
ইরফানের মাথায় বেলীর বলা কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে ।

– মান্থ মিস হয়ে গেছে , তার মানে কি ওর বাবু হবে ?

মনে মনে বলতে থাকা কথাগুলো বার বার ইরফানের মনকে অস্থির করে দিচ্ছিলো ।
আবারও সে ভাবনার মাঝে ডুব দেয় ।

– সাহেব ভাইয়ের ওয়াইফের বাবু হলো কয়েকমাস আগে ৷ বেচারা অনেক চিন্তিত থাকতো দেখতাম । অবশ্য তার ওয়াইফকে দেখার মানুষের অভাব নেই কিন্তু ও-কে কে দেখবে । ওর তো আমি ছাড়া কেউ নেই এইখানে ।

ইরফান চুপ করে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে । অপেক্ষা ইউরিন টেস্ট এর রেজাল্টের । মেডিকেলে আসার পরেই গাইনিকোলোজিস্ট ডক্টর বললেন আগে ইউরিন টেস্ট করানোর জন্যে । তাই ডক্টরের কথা মত আগে টেস্ট করিয়েছে বেলী । রিপোর্ট সরাসরি ডক্টরের কেবিনেই দেয়া হয় । আর এইখানে বেলী আর ইরফানকে কেবিনে যেতে বলে এক নার্স । নার্সের কথায় বেলী আর ইরফান পা রাখে ডক্টরের কেবিনে । ডক্টর দুজনকে সামনে বসিয়ে রেখে সব কথা ক্লিয়ার করে নেয় ।

– ডেট মিস হয়েছে কবে নাগাদ ?

ডক্টরের প্রশ্নে অনেকটাই সংকোচবোধ করছিলো বেলী সাথে ইরফানও । ইরফান টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীও চুপচাপ । তখন ডক্টর আবার বলেন ,

– দেখুন এইভাবে চুপ থাকলে কিভাবে হবে ? কথা তো বলতে হবে কারণ আমি প্রশ্ন করবোই , আর উত্তর না দিলে আমি বুঝবো না কিংবা বুঝাতে পারবো না । তাই চুপ করে না থেকে কথা বলতে হবে , কেমন ?

অতঃপর বেলী আর ইরফান ডক্টরের কথাতে অনেকটা সংকোচ মুক্ত হয় । ডক্টর নাসিমা পারভীন আবারও প্রশ্ন করেন বেলীকে ,

– ডেট মিস হয়েছে কবে নাগাদ ?

তখন বেলীই উত্তর দেয় ,

– এই মাসেই ।
– কিন্তু আপনি তো কনসিভ করেছেন প্রায় এক মাস হবে । মানে প্রায় এক মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে ।

ডক্টরের কথায় বেলী ইরফান দুজনেই অবাক । ইরফানের মনে কিসের যেন এক শীতল বাতাস বয়ে গেলো । সে বাবা হবে , তারও বাবু হবে । বেলী যে তাকে এত ভালো খবর দেবে সে ভাবে নি । তখন বেলী আবার বলে ওঠে ,

– কিন্তু আমি তো গত মাসেও,,,,,,,,,,,,,,,,
– হ্যাঁ হয় অনেক সময় এমন , এটা ব্যাপার না । এখন বলুন কি সমস্যা হয় আপনার ?

তখন বেলী তার সমস্ত সমস্যার কথা বলতে শুরু করে দেয় ,

– আমি খেতে পারি না , গন্ধ লাগে শুধু , এমন কি যেই রান্না আমি করতাম সেই রান্নাও এখন আর করতে পারি না । শুধু গন্ধ লাগে সব কিছুতে ।
– বমি কেমন হয় ?

তখনই ইরফান বলে ওঠে ,

– আসার সময়ও বমি করে আসছে । খাবার তো মুখেই তুলতে পারে না । পানি ঢেলে ভাত খায় তাও যদি পেটে থাকে । খেয়েই ফেলে দেয় সব ।
– আসলে প্রেগন্যান্সির সিমটমই এইসব । সমস্যা নেই আমি মেডিসিন দিয়ে দিবো , খাওয়াতে থাকুন আর ওনার শরীর তো অনেক দুর্বল । এইভাবে থাকলে তো পরে ব্লাড দিতে হবে । ওনার ব্লাডের প্লাটিলেটও কম ।
– কি করতে হবে এখন ?
– মেডিসিন দিয়ে দিবো , আর বেশি বেশি খেতে হবে । বমি হবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু খেতে হবে ।

বেলী চুপ করে না থেকে নিজেই আবার বলতে শুরু করে ,

– আমার তো সব কিছু থেকে গন্ধ আসে । আমি তো খাবারের কাছেই যেতে পারি না ।
– এটা বললে তো হবে না । খেতে হবে না হয় বাবু ভালো থাকবে না ।

ডক্টরের সাথে কথা বলে বেলীর জন্যে ওষুধ কিনে দুজনে মিলে রিক্সায় উঠে যায় । রিক্সায় উঠা মাত্রই ইরফান রিক্সাওয়ালাকে সাবধানে রিক্সা চালাতে বলে দিয়েছে । বেলী চুপ করে আছে । মনের মধ্যে এক অস্থিরতা কাজ করছে । সে মা হবে , তার ভেতর আরেকটা জীবন । আরেকটা শরীর একটু একটু করে বেড়ে উঠবে । এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি । অন্যদিকে ইরফান কি করবে না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না । এটা রাস্তা না হলে সে লাফাতো । সে বাবা হবে , ভাবতেই প্রাণ তার জুড়িয়ে যাচ্ছে । এমন সময় বেলীর হাতে হাত রাখে ইরফান । ইরফানের হাতের স্পর্শ পেয়ে বেলী ইরফানের দিকে তাকায় । ইরফান চাপা হাসি দিয়ে বেলীকে দুই চোখ টিপ দেয় । ইরফানের এই আচরণে বেলীও মুচকি হাসি দেয় । বেলীর হাসিয়ে যেন হাজারো প্রশান্তি বিরাজ করে । ইরফান তখনই মোবাইলে তার বসের কাছে মেইল করে দেয় সে আজ অফিসে আসতে পারবে না কারণ তার ওয়াইফ অসুস্থ । ইরফান খবরটা শুনার পর একদম অন্যরকম হয়ে গেছে । সে আজ অফিসে যাবে না , তার ইচ্ছে করছে না অফিস যেতে । আজ সারাদিন সে বাসাতে থাকবে । বেলীর কাছে থাকবে । ৫ মিনিট পর ইরফানের মেইলের উত্তর আসে । বস ছুটি দিয়ে দিয়েছে । এখন শুধু বাসায় যাওয়ার অপেক্ষা । বেলীকে চুপ থাকতে দেখে ইরফান বলে উঠে ,

– কি হলো চুপচাপ যে ?
– এমনি ,
– কিছু খাবা ?
– উহু ,
– হায়রে , তোমার খাবারে কি সমস্যা । ডক্টর কি বলছে শুনছো তুমি ?
– আমার ভালো লাগছে না ।
– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,
– আমার না কেমন জানি লাগছে ?
– কেন কি হয়েছে আপনার আবার ,
– কিছু না ,
– শরীর খারাপ আমার , কেমন জানি লাগে আপনার , এটা কোন কথা ?

ইরফান চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীও তখন চুপ হয়ে যায় । বেলী তখন আবারও বলতে শুরু করে ,

– আমি ভাবছি মিনুর কথা ,
– কেন , ও আবার কি করলো ?
– পুরা বাসা মাথায় তুলবে ,
– হা হা হা ।

বাসায় এসে ইরফান আর বেলী দুজনেই রুমে চলে যায় । মিনু তখন কাজে ব্যস্ত ছিল তাই তেমন কিছু বলে নি । বেলী ভেবেছে ইরফান হয়তো আবার কিছুক্ষণ পরেই আবার বেরিয়ে যাবে । কিন্তু বেলী তো জানে না যে ইরফান ছুটি নিয়ে নিয়েছে আজকে । বেলী রুমে গিয়ে হিজাব খুলে ফ্যানটা ছেড়ে একটু ফ্যানের নিচে দাঁড়ায় । ইরফান তখনই দরজাটা আস্তে করে লাগিয়ে দেয় । তারপর বেলীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে । এইভাবে ইরফানকে জড়িয়ে ধরতে দেখে বেলীও অবাক হয়ে যায় । বেলী সেখানে চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান বেলীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকে টেনে নেয় । বেলীর মাথায় চুমু দিয়ে আরও নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে তার বেলীফুলকে । বেলীও তখন পরম যত্নে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে । বেলীকে খাটে বসিয়ে দেয় ইরফান । ঠোঁটে দুজনেরই হাসির চিহ্ন । ইরফান তখন বেলীর পেটে হালকা করে ছুয়ে দেয় আর বলে ,

– বেলী এখানে আমাদের বাবু আছে ?
– হু ,
– আমি বাবা হবো ,
– হু ,
– কেউ আমায় বাবা / আব্বু এইসব বলে ডাকবে ,
– হু ,
– বেলী তুমি কি জানো তুমি আমায় কতটা সুখ দিয়েছো । সত্যিই নিজেকে আজকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে । আমার মত মানুষের কপালে এত সুখ আছে ।
– কেন থাকবে না , আর আপনি অফিসে যাবেন না ?
– বেলী , আর ভালো লাগে না আপনি আজ্ঞে । এইবার বন্ধ করো । যার তার সামনে আপনি আপনি বললে কেমন শুনায় ।
– তো কি বলতাম ,
– কেন তুমি বলা যায় না ?

বেলী তখন নিজের মাথাটা নিচু করে রাখে । তখন ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে বলে ,

” আজকে তোমার মুখ থেকে তুমি বের করেই ছাড়বো আমি ”

যেইভাবা সেই কাজ , ইরফান চেপে ধরে বেলীকে । খাটে শুইয়ে দেয় সে বেলীকে । আর নিজেও সাইড থেকে বেলীর উপর উপুর হয়ে শুয়ে যায় । বেলীর দিকে আপন মনে চেয়ে আছে সে । বেলীর নজরও ইরফানের দিকে ।

– তুমি করে বলো ,

ইরফানের কথায় বেলী অন্যদিকে ফিরে তাকায় । ইরফান তখন বেলীর গালে ধরে বেলীকে তার দিকে ফিরায় ।

– তুমি করে বলতে বলছি ,
– তুমি তো মুখ দিয়ে আসে না ।
– বললেই আসবে , বলো ।
– আসে না তো ,
– আজকে কিন্তু এইভাবেই আটকে রাখবো ,
– এহহহহহহ ,
– হু , তুমি বলো ।
– আমি আপনি করেই বলি ,
– নাহ , তুমিই বলতে হবে ।
– আমি তুমি করে বলতে পারি না তো ।
– বাবুর মা যদি এত ত্যাড়া হয় তাহলে আমার বাবুটার কি হবে , সেও ত্যাড়া হবে ।
– এহহহহ , আমার বাবু লক্ষী হবে ।
– তাহলে তুমি করে বলো ।

ইরফানের অনেক জোড়াজুড়ির পর বেলী বাধ্য হয় ইরফানকে তুমি করে বলতে । অবশেষে তার মুখ থেকে তুমি বের করে আনে ইরফান । এরই মাঝে দুজন কিছুক্ষণ হাসি-ঠাট্টাও করে নেয় । ইরফান হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে যায় । সে বেলীর গালে তার এক হাত দিয়ে স্পর্শ করে । ইরফান তখন হঠাৎই কিছু কথা বলা শুরু করে । বেলী এক ধ্যানে ইরফানের কথা গুলো শুনতে থাকে ।

– বেলী জানো , আমি না জন্মের পর মাকে দেখি নাই । বাবার কাছে শুনেছিলাম আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মা মারা গেছেন । আমি ধরতে গেলে অনেকটাই মা হারা ছিলাম । সেই আমার সন্তান হবে ।

কথা গুলো বলার সময় ইরফানের চোখ বেয়ে পানি পড়ে যায় । ইরফানের চোখের পানি দেখে বেলীর কলিজায় কামড় পড়ে যায় । বেলী আলতো করে ইরফানের গালে ধরে । শান্তনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার ।

– আমাদের সন্তান মা বাবা দুজনকেই পাবে ইনশাআল্লাহ ।

বেলীর কথায় ভরসা পায় ইরফান । চোখের পানি গুলো মুছে বেলীকে জড়িয়ে ধরে ইরফান আর নিজের মনের মধ্যে জমাট বাঁধা কিছু কথা বলতে থাকে সে ,

– আচ্ছা মেয়ে বাবু হবে নাকি ছেলে বাবু হবে ?
– আমি কি করে বলবো ,
– তোমার কি বাবু চাই ?
– আল্লাহ পাক যা দিবে তাতেই খুশি । আপনার কি চাই ?
– আবারও আপনি ??
– আচ্ছা , ঠিকাছে তুমি । তোমার কি চাই ?
– একটা মেয়ে বাবু ঠিক তোমার মত ।
– যদি ছেলে বাবু হয় ?
– তাহলেও ক্ষতি নেই । আল্লাহ পাক যা দিবেন তাতেই খুশি ।
– ওহ ,
– আচ্ছা বাবুর ছোট ছোট হাত পা হবে আর ও অনেক নরম তুলতুলে হবে তাই না ।
– আগে তাকে আসতে দেও ভালো ভাবে । সে আসুক আগে ।

ইরফানকে হাসি মুখে কথা গুলো বলে বেলী । এমন সময় বেলী আবার বলে উঠে ,

– অফিস যাবা না ?
– ছুটি নিয়ে নিছি , আজকে তোমার সাথে কাটাবো ।
– আমি তো ভালো আছি ।
– বেলী প্লিজ নিয়ম করে মেডিসিন গুলো নিতে হবে ।
– হ্যাঁ খাবো ।

এমন সময় মিনু বাহির থেকে চিৎকার করতে থাকে ,

– বাইরের তেন আইয়াই ভিত্রে ঢুইক্কা গেছে , না বুঝি মিনুরেও কই মিনুর কি চিন্তা অয় না ? থাউক গিয়া আমি কিডা , আমি তো কামের মাইয়া ।

বেলী আর ইরফান ভেতর থেকে মিনুর কথায় খিল খিল করে হাসে । তারপর ইরফান উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় । মিনু তখন সোফা গুছাচ্ছে । ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে মিনুকে উদ্দেশ্য করে ইরফান বলে ,

– মিনু তোর মনা আসবে রে , মিষ্টি খাওয়া তোর ভাই ভাবীকে ।

এমন কথায় মিনু চোখ বড় বড় করে তাকায় ।

.
.

চলবে…………………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৫

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকালের দিকে রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলো বেলী । মিনু খেয়াল করছে বেলী নাকে কাপড় দিয়ে রান্না করছে । বেলীর চোখ মুখের অবস্থা ভালো না । তার কিছুক্ষণ পরেই সে মিনুকে বলে ,

– মিনু ,,,
– জ্বে ভাবী ,
– ডিমটা পোস করো তো ,
– আপনেই করেন ভাবী , আমার ডিম পোস সুন্দর অয় না । পরে ভাইয়ে রাগারাগি করে ।
– আরে করো তো , আমার ভালো লাগছে না ।
– আপনে এমন নাকে কাপড় দিয়া থুইছেন কিত্তে ?
– গন্ধ আসতেছে ,
– ও মা এডি কয় কি হেতি ? কই গন্ধ , কিয়ের গন্ধ । ভাবী কি সব কন আপনে ?
– তুমি ডিম টা পোস করবা কিনা ?

বেলীকে রাগতে দেখে মিনু তাড়াহুড়ো করে ডিম ভেজে টেবিলে দিয়ে আসে । মিনুর কেমন কেমন জানি লাগছে , বেলী এইভাবে আছে কেন ? এরই মাঝে বেলী দুপুরের খাবার রান্নার জন্যে পেঁয়াজ কাটতে থাকে । ওমনি বেলী চেঁচিয়ে ওঠে ।

– মিনু , করো কি ?
– আবার কিয়াচ্ছি ,
– পেঁয়াজ সরাও আমার সামনে থেকে ,
– আল্লাহ গো কি কইতাছেন এইসব আপনে ?
– গন্ধ লাগে সরাও এইগুলা ,

এই কথাটা বলতে দেরি আছে কিন্তু বেলীর বমি করতে দেরি নাই । রান্নাঘরের বেসিন এর মধ্যে গর গর করে বমি করে দেয় সে । মিনু বেলীর বমি করা দেখে তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসে । বেলী চোখে মুখে পানি দিয়ে মিনুর দেয়া পানি খেয়ে নেয় । মিনুর সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে যায় ।
এরই মাঝে রুম থেকে ইরফানের ডাক পড়ে । পানির গ্লাস রেখে চোখ মুখ মুছে বেলী রুমে যায় । ইরফানের ফরমায়েশ , বেলীকে টাই বেঁধে দিতে হবে । বেলী আর কথা না বাড়িয়ে টাই বেঁধে দেয় ইরফানের । ইরফান বেশ বুঝতে পারছে বেলীর হয়তো শরীর ভালো নেই । তাই নিজেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় আর বলে ,

– শরীর কি বেশি খারাপ লাগে ?
– হ্যাঁ , অনেক খারাপ লাগতেছে ।
– আজকে তো অফিসে যেতে হবে , কাল দেখি ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো ।
– আরে ধুর , লাগবে না । এমনিই ঠিক হয়ে যাবে । আপনি আসেন খেয়ে নিন ।
– চলো ।

নাস্তার টেবিলে আরেক কাহিনী । ইরফান নাস্তা করছে আর বেলী নাকে হাত দিয়ে বসে আছে । ইরফান নাক দিয়ে কয়েকবার স্মেল নেয় পরে বেলীকে জিজ্ঞেস করে ,

– তুমি নাকে হাত দিয়ে বসে আছো যে ?
– গন্ধ আসে ,
– কই থেকে গন্ধ আসে । আমি তো এমন কিছুই পাচ্ছি না ।
– আমি পাইতেছি , আপনি খেয়ে নেন । আমি রুমে যাই ,
– কি রুমে যাই , তুমি খাবা না ।
– উহু ইচ্ছা করতেছে না ।
– আরে শুনো ,,,,,,, এই বেলী

ইরফানের কথায় পাত্তা না দিয়ে বেলী রুমে গিয়ে শুয়ে থাকে । রান্নাঘর থেকে মিনু সবটাই খেয়াল করে । ইরফান নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায় । পুরো টেবিল গুছিয়ে মিনু বেলীর কাছে যায় । রুমে গিয়ে দেখে বেলী তখন মোবাইলে তার মায়ের সাথে কথা বলছে । তাই মিনু রান্নাঘরে এসে বাকি কাজ গুলো সেড়ে নেয় । অন্যদিকে বেলী তার মায়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ,

– হ্যাঁ মা বলো ,
– কথা দেখি এমনে কইতাছস ,
– মা শরীরটা ভালো না ,
– কি হইছে ,
– কি জানি মা , বুঝতেছি না তো । মাথা ঘুরাচ্ছে , বমি আসে ।
– তেতুল খা , পেশার লো মনে হয় ।
– হু , আচ্ছা মা রাখি ।
– জামাই কই ?
– অফিসে চলে গেছে ।
– আইচ্ছা রাখ ,

মায়ের সাথে কথা বলে বেলী আবারও শুয়ে থাকে । শান্তি পাচ্ছে না সে শরীরে । কেমন জানি লাগছে তার কাছে ।

কিছুক্ষণ পর আবারও বেলীর মায়ের ফোন আসে । বেলী ফোন রিসিভ করে কানে নেয় ।

– হ্যালো , কি গো মা , আবার ফোন দিলা যে ?
-……………………
– কি দব বলো মা , আরে নাহ এমন কিছুই না মা ।
-…………………
– মা এইসব কিচ্ছুই না । রাখি আল্লাহ হাফেজ , নিজের যত্ন নিও ।

বেলী ভ্রু গুলো কুচকে ফোনটা কেটে দেয় । তার পর পরই মিনুকে ডাক দেয় সে , তার ডাকে মিনু বেচারিও দৌড়ে চলে আসে ,

– জ্বে ভাবী ডাকছিলেন ,
– মিনু , শুনো না একটু ,
– জ্বে ভাবী কন কি কইবেন ।
– সোনা পাখি আজকে একটু নিজে রান্না করো না । আমার খুব খারাপ লাগতেছে । ভিষন মাথা ঘুরাচ্ছে , মনে হয় উঠে দাঁড়ালেই পড়ে যাবো ।
– আইচ্ছা ভাবী আমিই রান্না কইরা ফালামু , আপনে শুইয়া থাকেন ।
– ঠিকাছে রে পাখি । আর শুনো ,
– জ্বে ,
– দরজাটা আটকে দিও , আর রান্নাঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে তুমি রান্না করো যাতে গন্ধ এই রুম অবদি না আসে ।

মিনুর কাছে কেমন কেমন জানি লাগছে বেলীর কথাটা । এতদিন পর এই প্রথম বেলী এমন সব কথা বলছে । মিনু চুপ করে বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলী আবারও মিনুকে ডাক দেয় ।

– মিনু , এই মিনু ,,,,,,,
– জ্বে ভাবী ,
– কি বললাম বুঝছো ?
– আইচ্ছা ,
– তাহলে দরজাটা আটকাও ,
– আইচ্ছা ।

বেলীর রুমের দরজা আটকে দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে মিনু রান্নাঘরে যায় । তারপর নিজে নিজেই বলতে থাকে ,

– আমাগো বাইত এক ভাবীরে দেখছিলাম এমন কত্তে । হেতির সব কিছুর ভিত্রেই গন্ধ লাগতো । বমি করতো কতক্ষণ পরে পরে । খাইতো না এমন কি রানতোও না । এহন দেহি বেলী ভাবীরও এই রোগে পাইছে ।

প্লেট বাটি মাজতে মাজতে মিনুর একটা কথা মনে পড়ে যায় ।

– ওরে ওরে , হের মাসখানেক পরেই তো মনায় অইলো । ও আল্লাহ তাইলে কি বেলী ভাবীর বাচ্চা অইবো ?

মিনু প্লেট বাটি বেসিনের উপরে রেখেই দৌড় দেয় বেলীর রুমে । বেলী তখন বিছানায় এক পাশ হয়ে শুয়ে আছে । মিনু গিয়ে বেলীর সামনের দিকে নিচে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে । তারপর বেলীকে ডাক দেয় সে ।

– ভাবী , ও ভাবী ,,,,,,,

মিনুর ডাকে বেলী চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে মিনুর দিকে তাকায় । বেলী বুঝতে পারে মিনু হয়তো তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে । কারণ মিনুর চোখে মুখে কেমন যেনো অনেক আগ্রহ দেখা যাচ্ছিলো তখন । বেলী মিনুর গালে হাত দিয়ে হালকা হেসে বলে ,

– কিছু বলবা মিনু ?
– একখান কতা কইতাম চাই ,
– বলো , আমি শুনতেছি ।

বেলীর কথায় মিনু নড়ে চড়ে বসে । বেলীর হাতটায় নিজের হাত রাখে মিনু । তারপর বলে ,

– কতা ডা হইলো গিয়া আমাগো বাইত এক ভাবী আছিল , হেতিও আপনের মতই করতো ।
– কি করতো ?
– এইযে আপনি এহন যা করতাছেন ?
– আমি কি করলাম আবার ?
– এইযে এইসব কিছু ,
– কি বলছো , কিছুই বুঝতেছি না আমি ।
– মানে হইলো গিয়া ভাবী , আমাগো বাইত যেই ভাবী আছিলো হেতিও আপনার মত গন্ধ গন্ধ করতো , খাইতো না আবার রানতোও না । হের মাস খানেক পরেই মনায় অইছে ।
– কে হইছে , মনা কে ?
– মানে বাচ্চা আরকি আমি আদর কইরা মনা কই ।
– এটা আমায় বলে কি লাভ হলো তোমার , ভাবী গো ভাবী , নিশ্চয়ই আমনেরও বাচ্চা অইবো ।

বেলী মিনুর কথা শুনার পর কতক্ষণ মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপরে কি যেনো চিন্তা করে । আর তারপর অত্যন্ত শান্ত গলায় মিনুকে বলে ,

– তুমি গিয়ে রান্না করো , এই সব বিষয়ে পরে কথা বলবো । কেমন ?
– ভাইয়েরে কইয়েন ডাক্তারের কাছে নিয়া যাইতে ।
– আচ্ছা বলবো , তুমি গিয়ে রান্না করো ।
– কি রানতাম ,
– যা মন চায় , তবে তোমার ভাইয়ের জন্যে রুই মাছ ভুনা করে রাখিও ।
– আচ্ছা ,
– দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাও ,
– আইচ্ছা ভাবী ,

বেলী কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে মিনুর কথা গুলো অনুধাবন করতে থাকে । কিছুক্ষণ আগেও বেলীর মা ফোনে ঠিক কথাই গুলো-ই বলে ছিলেন । কিন্তু বেলী তখন কথা গুলো আমলে নেয় নি । কি করবে না করবে সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না । চিন্তাটা মাথার মধ্যে চেপে বসে আছে । বেলী উচ্চ শিক্ষিত না বলেও একেবারে মূর্খও নয় । তাই ইউটিউবে সার্চ করে অনেক কিছুই দেখে নেয় । তখন তার খেয়াল হয় , তার এই মাসে মান্থ মিস হয়ে গেছে । এইসব চিন্তায় তার শরীর আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে । কাকে বলবে কার কাছ থেকে পরামর্শ নিবে কিছুই জানে না সে । না নিজে বের হয় বাসা থেকে না পরিচিত কেউ আছে । যা করতে হয় ইরফানই করে দেয় । এখন শুধু অপেক্ষা রাতের । ইরফান আসলে তাকে সবটা খুলে বলবে বেলী ।

রাত প্রায় ৯ টা নাগাদ ইরফান বাসায় আসে । আজ কেন যেনো অনেক খুশি সে । বেলীর জন্যে ফুচকা নিয়ে আসছে আজকে ইরফান । ইরফানকে খুশি দেখে বেলী তার কারণ জানতে চায় ,

– আজ এত খুশি কেন ?
– আমি যাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না বেলী ।
– কি হয়েছে ,
– ৬ মাসের মাথায় আরেকটা প্রমোশন ।
– সত্যিইই ,,,,,,
– সত্যি , আজকেই স্যার কেবিনে ডেকে নিলেন , আর আজকেই সব বললেন ।
– যাক আলহামদুলিল্লাহ , আল্লাহ পাকের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া ।
– এইসবই তোমার নামাজ আর দোয়ার ফল ।
– আপনারে বলছে , শুনেন আল্লাহ পাকের কাছে চাওয়াও লাগে আবার নিজের প্রচেষ্টাও লাগে । আমি চেয়েছি তা ঠিক আর এতে আপনারও প্রচেষ্টা ছিল তাই আপনার ভাগ্যে তা এসেছে ।

বেলীর কথার যথার্থতা বুঝতে পারে ইরফান । বেলীর দিকে এক নজরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মনে মনেই বলতে শুরু করে দেয় সে ,

– এই নারীর আমলেই আল্লাহ পাক আজ আমার ঘরে এবং আমার কর্মজীবনে এত সাফল্য এনে দিয়েছেন । আল্লাহ পাক আমার ভাগের সমস্ত হায়াত তুমি এই নারীর ভাগে দিয়ে দিও ।

অপরদিকে বেলীও মনে মনে বলতে থাকে ,

– আল্লাহ পাক তোমার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই । তুমি এইভাবেই আমার সংসার স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখো এবং আমার চুল এর অধিক হায়াত তুমি আমার স্বামীকে দান করো ।

তারপর বেলীকে ফুচকা খেতে বলে ইরফান ওয়াসরুমে ঢুকে যায় । কিন্তু এইসব কথার মাঝে বেলী ইরফানকে আসল কথাই বলতে ভুলে যায় । তার যে কিছু কথা বলার ছিল ইরফানকে ।

রাতে খাবার পরে ইরফান শুয়ে আছে । কিছু একটা ভাবছে সে । বেলীর কি হয়েছে ? রাতের খাবার সময়েও একই কাহিনী করেছে বেলী । কোন তরকারি নেয় নি সে । শেষে পানি দিয়ে ভাত মেখে খেয়েছে । বেলী তখম ও-পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে । বেলীর মনেও খচ খচ করছে কিভাবে বলবে ইরফানকে । কিন্তু না বলেও উপায় নেই তার । কারণ এখানে ইরফান ছাড়া তার পরিচিত আর কেউই নেই তার । মিনু এইসব কিছুই বুঝে না কারণ সে অবিবাহিতা । তবুও যতটুকু জ্ঞানে এসেছে তাই বলেছিল মেয়েটা দুপুরে ।

বার বার ইরফানকে বলতে চাইছে সে কিন্তু লজ্জার কারণে বলতেও পারছে না কিছু । ওইদিকে ইরফানের মনে বেলীকে নিয়ে হাজারটা চিন্তা হচ্ছে । আজকে সকালে এমন করলো , মিনুর থেকে শুনেছে দুপুর বেলা রান্নাও সে করে নাই আর এখনও খাবার খেতে গিয়ে এমন করলো । তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বেলীকে ডাকে ইরফান ।

– বেলী , এই বেলী

বেলী তখনও সজাগ ছিল । ইরফানের ডাকে হু বলে সাড়া দেয় সে ।

– এইদিকে ফিরো তো ।

তখন সে ইরফানের কথায় ইরফানের দিকে ঘুরে যায় ।

– কি হয়েছে তোমার , আমায় বলবা একটু ?
– কই কি হয়েছে ?
– আজকে দুপুরে রান্না করো নাই , খাবারও খাও নাই , এখনও এমন করলা । কি হয়েছে ?

ইরফানের কথায় বেলী সাহস পায় । তখন সে বলা শুরু করে ,

– আমার না কেমন কেমন জানি লাগে , সব কিছু থেকে গন্ধ আসে ।
– কিসের গন্ধ , বাসা তো কত পরিষ্কার ।
– জানি না , তবে আমার একটা কথা আছে ।
– হ্যাঁ বলো ,
– এইদিকে আসেন ,
– আর কত আসবো ,
– আরও কাছে আসেন ,
– কি ব্যাপার , আজকে এত কাছে ডাকছো যে , খুন করার প্ল্যান আছে নাকি ?
– উফফফ , এখানে আসেন ,
– আচ্ছা বলো ,

তারপর ইরফানের কানের কাছে গিয়ে বেলী তার মান্থ মিসের কথা জানিয়ে দেয় । সাথে বেলীর সব অসুবিধার কথাও বলে দেয় এবং দুপুরে মিনুর বলা কথাগুলোও বলে দেয় । এইসব শুনে ইরফান সোজা শোয়া থেকে উঠে বসে যায় । ইরফানকে এইভাবে বসতে দেখে বেলীও বসে যায় ।

– কি হলো ,
– সত্যিই কি মিস হয়ে গেছে ?

বেলী তখন মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে । তখন ইরফান মুচকি হেসে বেলীকে জড়িয়ে ধরে আর বলে ,

– কাল সকালেই মেডিকেল নিয়ে যাবো , কেমন ?
– হু ,
– এখন ঘুমিয়ে যাও ।

ইরফান বেলীর কপালে চুমু দিয়ে বেলীকে শুইয়ে দেয় । আর বেলীও শুয়ে যায় ।

অপেক্ষা কাল সকালের । মেডিকেল গিয়ে কি হবে বাকিটা আল্লাহর হাতে ।

.
.

চলবে……………………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৪

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকালের দিকে বেলী নিজ হাতে সব কিছু করে । নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত সে । বেলীর শ্বশুর আজ চলে যাবেন গ্রামে । ওনার জন্যেও রান্না করতে হবে । এদিকে ইরফানেরও অফিস আছে । সব মিলিয়ে প্রচুর ব্যস্ত সে ।
সকালের নাস্তার ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে বেলী । স্বামী এবং শ্বশুর উভয়ের জন্যে নাস্তা রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে বেলী । মিনুও হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে বেলীকে । অন্যদিকে সকালে ইরফান রেডি হবে , তবে সে তার প্রয়োজনীয় জিনিস খুৃঁজে পাচ্ছে না । সেখানেও বেলীকে তলব করে সে । বেলী আবার রান্নাঘরের কাজ ফেলেই দৌড় দেয় ইরফানের কাছে । সব মিলিয়ে ঘুড়ির মত উড়তে হয় বেলীকে সকালের সময়টা । ইদানীং ইরফান বেলী ছাড়া কিছুই বুঝে না এবং বুঝতেও চায় না । তার সব কিছুতেই বেলীকে চাই । বেলী না হলেই তার চলেই না অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মত (তীর ছাড়া যেমন তাদের চলেই না) তেমনি ইরফানের বেলাতেও তাই হয়েছে । ইরফানের ডাকে সে রুমে আসে ।

– ডেকেছিলেন ?
– জ্বি আপনি কোথায় থাকেন ।
– আপাতত রান্নাঘরে ছিলাম ।
– আমার ওয়ালেট কোথায় ?
– ড্র‍য়ারে ,
– আমার লাল ফাইলটা কোথায় ?
– ড্রয়ারে কালকে তো নিজেই রাখলেন ।
– ওহ ,
– এইবার যাই ?
– নাহ , টাই বেঁধে দিয়ে যাও ।

ইরফানের ছোট ছোট আবদার গুলো বেলীকে বড্ড বেশি বিরক্ত করে তবুও সে চুপ করে থাকে । বহু কষ্টের পর ইরফানের ভালোবাসা পেয়েছে সে । এই ভালোবাসা হারাতে চায় না বেলী । তাই লক্ষী মেয়ের মত ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে ইরফানের বুকের উপরে হাত উঠিয়ে ইরফানের টাই ঠিক করে দেয় বেলী । আর ইরফান মনে হয় এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিল । ঝট করেই বেলীর কোমড় জড়িয়ে ধরে ইরফান । বেলী একটু নড়ে ওঠে ইরফানের এইভাবে ছোয়াতে ।

– কি হলো , কারেন্টের শক খেলে নাকি , এইভাবে কেঁপে উঠলা যে ?
– আমি তো বুঝতে পারছি ?
– কিহ ,
– আপনি এইসব করার জন্যেই আমায় দিয়ে টাই বাঁধান ।
– হা হা হা
– আবার হাসে ,
– হাসবো না , তো কি করবো কান্না করবো ?
– বেহায়া ,
– কিহহহ , আমি কি ?
– বেহায়া ,
– আর ?
– বেশরম ,
– আর ,
– বেলাজা
– সেটা কি ?
– যাদের লাজ-লজ্জা নাই ।
– হুপ ,
– এইবার তো ছাড়েন , নাস্তা করবেন কখন চলেন ।
– বাবা এসেছেন ডাইনিংয়ে ?
– তখন তো দেখি নাই , এখন এসেছেন কিনা জানি না ।
– হু ,

বেলী খেয়াল করে ইরফানের মুখটা মুহুর্তের মাঝেই কালো হয়ে যায় । ইরফানের নিশ্চয়ই কিছু মনে পড়ে গেছে তাই হয়তো হঠাৎ করেই মন টা খারাপ হয়ে গেছে । বেলী ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ,

– কি হয়েছে ?
– কিছু না ,
– বাবার কথা মনে গেছে , তাই তো ?
– নাহ , তেমন কিছু না ।
– বাবা যা বলেছেন সেটা ভুলে যান । হয়তো তিনি মনের কষ্টে বলে ফেলেছেন ।
– জানি আমি , অপরাধ করেছি আমি । তাই তো শুনতেও হয়েছে আমায় ।
– হয়েছে তো , বাদ দিন না । চলুন খেতে চলুন ।
– তুমি যাও আমি আসছি ।
– আচ্ছা ।

নাস্তার টেবিলে একপাশে রহমান আলী আরেক পাশে ইরফান বসে আছে । বেলীও পাশে বসা আছে ইরফানের । নাস্তার টেবিলে শুধুই নিরবতা বিরাজ করছে । ইরফানের নজর দিকে , সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না তার বাবার দিকে । আর রহমান আলীও তাকায় নি ইরফানের দিকে । এক পর্যায়ে ইরফানকে উদ্দেশ্য করে রহমান আলী বলে উঠে ,

– আজকে নজর নিচু করতে হচ্ছে কেন তোমায় ?
-…………..

বাবার কথায় একদম চুপ হয়ে যায় ইরফান । তার মুখে কোন কথা নেই । কাজই করেছে সে এমন । কথা বলবে কিভাবে সে । রহমান আলী দম নিয়ে আবারও বলা শুরু করে দেয় ।

– জীবনে এমন কিছু কাজ করতে হয় যেই কাজের জন্যে মাথা উঁচু হয় এমন কাজ করা উচিত নয় যেই কাজের জন্যে নিজের মাথা এবং নজর দুটোই নিচু হয় । তুমি আজকে যা করছো তাতে তুমি যদি অনুতপ্ত হও তাহলে আলহামদুলিল্লাহ , আর না হলে কিছুই করার নাই আমার । যেখানে বেলীর মত একটা মাটির দলারে তুমি এত কষ্ট দিছো সেখানে তোমার থেকে আমি আর কি আশা করতে পারি । আমি রহমান আলী যে লোকটা কামরাঙ্গিরচরের সব বিচার করি আজ সেই আমার ছেলেই কিনা এত জঘন্য পাপ করছে । তুমি বাইচা গেছো এটা শহর বইলা এটা যদি গ্রাম হইতো তাহলে তোমারে সবাই জুতার মালা গলায় পরিয়ে গ্রাম ছাড়া করতো

রহমান আলীর কথা গুলো সোজা বুকে গিয়ে লাগে ইরফানের সাথে বেলীরও । বেলীর নজর ততক্ষনাৎ ইরফানের দিকে যায় । বেলী বেশ বুঝতে পারছে ইরফানের খাওয়া ভেতরে যাচ্ছে না । ইরফান হয়তো এখনি না খেয়েই উঠে যাবে , তাই বেলীই তার শ্বশুরের কথার মাঝে কথা বলে উঠে ,

– বাবা খাওয়ার সময় এইসব বাদ দিন । খাওয়া দাওয়া করুন বাবা ।
– এইভাবে ধামা-চাপা কতদিন দিবা বউমা । তোমাকে নরম পেয়েই তো আজকে এই কাজ করতে সাহস পাইছে । আর তুমিও তো কম যাও না বউমা । এতকিছু হয়ে গেছে মুখ থেকে একটা আওয়াজ পর্যন্ত বের করো নাই ।
– বাবা আওয়াজ বের করলে কি হতো । কথায় আছে আল্লাহ পাক যা করেন বান্দার ভালোর জন্যে করেন । সব কিছুর পরেও আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা । তাই এইসব কথা বাদ দিন , যা হয়েছে ভুলে যান বাবা ।

ছেলের বউয়ের কথা শুনে রহমান আলী কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন । তারপর আবার বলেন ,

– বেলীর মাকে সব জানাতে হবে আমাকে ।

এই কথা শুনার পর বেলী আর ইরফান এক সাথে রহমান আলীর দিকে তাকান । বেলীর বুকে আচমকাই কামড় পড়ে যায় ।

– বাবা ভুলেও যাতে আমার মায়ের কানে যাতে এইসব না যায়৷। আমার মা মরেই যাবে বাবা ।
– তাই বলে এত বড় সত্যি জানাবো না আমি ওনাকে ?
– না বাবা ,
– কি বলো এইসব তুমি । এখন জানাইলা না ভালো কথা কিন্তু পরবর্তীতে যদি তোমার মা অন্য কারো মাধ্যমে জেনে যায় তখন কি করবা ।
– জানবে না বাবা ,
– যদি জানে তখন কি করবা ?
– যদি শব্দটার কোন অর্থ নেই বাবা , বাদ দিন এখানেই সব মাটি চাপা দিয়ে দিন । আমি চাই না আমার মা কষ্ট পাক আমি চাইনা আমার স্বামী আমার মায়ের চোখে ছোট হয়ে যাক ।

বেলীর কথায় শেষ বারের মত ইরফানকে ক্ষমা করে দেন রহমান আলী । বাবা হয়ে নিজের সন্তানকেও ছাড় দেয়ার পাত্র নন রহমান আলী । ওনার কাছে যে অন্যায় করবে সেই অপরাধী এইবার হোক সে নিজের ছেলে আর হোক সে বাহিরের অন্য কেউ । এইবারও হয়তো ইরফানকে চরম শাস্তি দিতেন তিনি । কিন্তু একমাত্র ছেলের বউয়ের জন্যে তিনি থেমে গেলেন । বেলীর আকুতি মিনুতি তার হাত পায়ে শিকল পরিয়ে দেয় । তাই তিনি এইবার ক্ষমা করতে বাধ্য হয় হোন তার ছেলে ইরফানকে ।

দুপুরের পরেই খাওয়া দাওয়া করে ঢাকা ত্যাগ করেন রহমান আলী । বেলীকে মন ভরে দোয়া করে বাসা থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান তিনি । আর এইদিকে আবার একা হয়ে যায় বেলী । যদিও ইরফান অফিসে থেকেই দুই থেকে তিন বার ফোন করে কথা বলে বেলীর সাথে । যতটা পারে বেলীকে নিজের কাছে রাখতে চায় সে । বেলীকে যতটা সম্ভব ভালো রাখা যায় যতটা সম্ভব আদরে রাখা যায় তার সবটুকু খেয়াল রাখে ইরফান ।

এভাবেই কেটে যায় প্রায় এক মাস ,
বেলীর সংসারে সুখের অভাব নেই । তার সংসারের আনাচে কানাচে ভালোবাসারা এখন লুটোপুটি খেলে । ভালোবাসা গুলো দুহাতে কুড়িয়ে নিয়ে আজ বেশ সুখে আছে বেলী আর ইরফান ।
দুজনার সংসারে সুখের কমতি নেই এখন । এর মাঝে রুবি আর ইরফানের জীবনে বিঘ্ন ঘটায় নি । রাজু নামের অতীতটাকে বেলী ভুলে গিয়ে নিজের স্বামীর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করায় ব্যস্ত ।

ইদানীং বেলীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না । কিছুই খেতে পারে না সে । যা খায় তাই মনে হয় বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে । শরীরটা খুব খারাপ লাগায় অসময়ে শুয়ে থাকে বেলী । ইরফান অফিস থেকে এসে বেলীকে শুয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে ,

– বেলী , এই বেলী ?
– কি হলো আবার ,
– তোমার কি হয়েছে , শুয়ে আছো যে ?
– আমার শরীরটা ভালো লাগছে না , তাই শুয়ে আছি । কিছু লাগবে ?
– নাহ থাক , তুমি শুয়ে থাকো । আমি ফ্রেশ হয়ে নেই ।
– হু ।

বেলী অসুস্থ শুনলেই ইরফানের কলিজায় কামড় পরে । বেলীকে অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে ইরফানের ভেতর টা কু ডাকতে শুরু করে দেয় । ওয়াসরুমে বেলীকে নিয়ে ভাবতে থাকে ইরফান । এরই মাঝে বেলী অনেক জোরে জোরে ওয়াসরুমের দরজায় নক করে ।

– আরে খুলেন দরজা টা , বাথরুমে এতক্ষণ কি করেন হ্যাঁ ?
– আরে ভাই , বের হচ্ছি এক মিনিট ।
– কেমন লাগে মেজাজ টা এখন । আপনি কি কাথা বালিশ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন নাকি , বের হোন ।

বেলীর কথায় ইরফান কোন রকম টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে ওয়াসরুমের দরজা খুলে । ইরফাম দরজা খুলেও স্থির হয় নি ওমনি ইরফানকে নামার সুযোগ না দিয়ে বেলী ওয়াসরুমের ভেতরে ঢুকে যায় । বেলীর এমন তাড়াহুড়ো দেখে ইরফান খানিকটা বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে পাশেই । বেলী ভেতরে ঢুকেই বমি করে দেয় । দাঁড়িয়ে বমি করতে করতে এক সময় বসে পড়ে সে । ইরফান বুঝতে পারে বেলীর খুব কষ্ট হচ্ছে , তাই ইরফান পানির কল ছেড়ে দেয় আর বেলীর মাথার দু’পাশে চাপ দিয়ে ধরে রাখে । বেলীর প্রচন্ড বমি বেগ হচ্ছে । বমির বেগে তার চোখের পানি বের হয়ে গেছে তবুও বেগ কমছে না । ইরফান তখন হালকা পানি হাতে নিয়ে বেলীর মাথায় দেয় । শরীর অত্যন্ত খারাপ লাগছিল বেলীর । নিজে উঠতে পারবে না তাই ইরফানকেই বলে ,

– আমায় ধরেন , উঠান আমায় । শরীরে জোর পাচ্ছি না আমি ।

ইরফান বেলীকে ধরবে কি , সে তো হা হয়ে আছে বেলীর হঠাৎ কি হলো যে একেবারে বমি করে দিলো । এই চিন্তায় সে শেষ হয়ে যাচ্ছে ।

.
.

চলবে……………………

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩৩

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৩
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সময়ের সাথে সাথে পুরানো ক্ষত গুলো মিশে যায় । কিন্তু সেই ক্ষতের যন্ত্রণার রেশটুকু যেতে যেতেও থেকে যায় । বেলী সব ভুলে ইরফানের সাথে সেইভাবেই মিশে গেছে যেভাবে চুম্বক লোহাকে আটকে রাখে । ইরফানের বাবা কয়েকবার বেলীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন । এমনকি তিনি এই কথাতেও উপনীত হয়েছেন যে তিনি শুধুমাত্র বেলীকে তার মেয়ে হিসেবে পরিচিত করবেন এবং ওনার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তিনি বেলীকে দিয়ে দিবেন তবে তার আগে গ্রামে বিচার সভা বসিয়ে সবাইকে সব কিছু জানিয়ে বেলীর সাথে ইরফানের তালাক করিয়ে দিবেন । কারণ তিনি বেলীর এই অবস্থার জন্যে একমাত্র নিজেকে দায়ী করেন ।

একজন বাবা কতটা অসহায় হয়ে গেলে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা সেই বাবা-ই জানেন । ইরফানের অপরাধ এতটাই বেশি ছিলেন যে রহমান আলী বেলীর সামনেই বলেছিলেন ,

– দুনিয়াতে এত ভালো মানুষরা মরে যায় আল্লাহ পাক এই এর মত দুই একটা শয়তান এই দুনিয়াতে রেখে দিছে ।

শ্বশুরের কথা শুনে বেলীর আত্মাটা কেঁপে ওঠে ।

– বাবা কি বলেন এইসব আপনি ? আপনি আমার বিধবা হওয়াটা দেখতে পারবেন তো বাবা ? আর যেখানে আমি সব ভুলে গেছি আপনিও ভুলে যান বাবা । আর সব থেকে বড় কথা বাবা , মানুষটা তার সব ভুল বুঝতে পারছে । যে মানুষ তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয় তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত । বাবা ক্ষমা করা মহৎ গুন । ও-কে ক্ষমা করে দিন বাবা ।

ছেলের বউয়ের কথা শুনে রহমান আলী অনেক অবাক । এ কেমন নারী , যে কিনা এত কিছু সহ্য করার পরেও বলে ক্ষমা করে দেয়ার কথা ।

– তুই এই শয়তানটারে ক্ষমা করে দিতে কিভাবে বলস মা ?
– বাবা , সে মানুষ । তাকে শয়তান বলবেন না । আমার স্বামী সে বাবা । এইসব বলবেন না দয়া করে ।
– দেখলা তো ইরফান , যে তোমার সম্পর্কে সামান্য কটু কথা শুনতে পারে না সেই মেয়েটারে তুমি দিনের পর দিন এইভাবে এত বাজে ব্যবহার কিভাবে করছো তুমি ?

বাবার কথায় ইরফান আরও মাটিতে মিশে যাচ্ছে লজ্জায় । পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে দেখে বেলী তার শ্বশুরকে বুঝিয়ে শুনে অন্য রুমে পাঠিয়ে দেয় । আর ইরফান তখন রুমে গিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায় ।

হাতের টুকটাক কাজ সেড়ে রুমে চলে আসে বেলী । এসে দেখে ইরফান শুয়ে আছে । বেলীর মন বলছে ইরফান ভালো নেই । সে আজ তার বাবার কাছে সব স্বীকার তো করে নিয়েছে কিন্তু সেই সাথে সে ভিষণ লজ্জিত তার সব অপরাধের জন্য । তাই বেলী আর বাড়তি কোন কথাতে যায় নি । চুপ করে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে ইরফানের পাশে । আজ ইরফান ওপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে । অন্যান্য দিন ইরফান তার দিকে মুখ করে ঘুমায় । কিন্তু আজ বিপরীত হলো । এই বিপরীতের কারণ হয়তো কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা ।

জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে যায় যার উপর সবার হাত থাকে না তেমনি ইরফান আর বেলীর জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটিও আপত্তিজনক । তবে আপত্তিজনক হলেও এটাই হয়তো নিয়তি ছিল । হয়তো এটাই তাদের দুজনার ভাগ্যে লিখা ছিল ।

আজ বেলীর মনটা বড় কাতর হয়ে আছে । ইরফান যদি এইভাবে থাকে তাহলে সেদিন তার মন বড়ই বিচলিত থাকে । আজ বেলীও অপরপাশে মুখ করে শুয়ে আছে । বৈশাখীর ঝড় আজ বেলীর অন্তরে বয়ে যাচ্ছে ।

রাতের মধ্যাংশে বেলী কিছু অনুভব করতে পারে । কেউ একজন তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে । বেলীর পিছন দিকটা কেউ একজন জড়িয়ে ধরে আছে । হাতের স্পর্শ বলে দিছে এ হাতের ছোয়া অন্য কারো না । এ হাতের স্পর্শ তার বরের ।

ইরফান বেলীকে জড়িয়ে আছে । ইরফানের হাতটা সরিয়ে নিয়ে ইরফানের দিকে ঘুরে শোয় বেলী ।
শান্ত নয়নে ইরফান চেয়ে আছে বেলীর দিকে ।

– কি হয়েছে ? কি দেখছেন ,
– তোমাকে ,
– ওইদিকে মুখ করে শুইলেন কেন আজকে ?
– ভালো লাগছিল না ।
– শরীর খারাপ ?
– উহু ,
– তাহলে ?
– আমি কি আসলেই শয়তান ?
– উহু , মানুষ কখনো শয়তান হয় না ।
– বাবা কি বললো , শুনলা না ?
– বাবা হয়তো কষ্ট পাইছে তাই বলে ফেলছে , আপনি কষ্ট পাইয়েন না ।

বেলীকে শোয়া অবস্থায় জড়িয়ে নেয় ইরফান । বেলীও ইরফানকে জড়িয়ে নেয় ,

– বেলীফুল কিভাবে পারিস রে তুই ?
– কি কিভাবে পারি ?
– এইযে এত উদার কিভাবে হোস ?
– আমি উদার না , আমি পারি না কারো সাথে খারাপ আচরণ করতে আর আপনার সাথে তো একদমই না । কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি ।
– কতটা বাসিস ভালো ?
– অনেকটা ,
– আয় না , আজকে মিশে যাই ?
– মিশেই তো আছি আমি আপনার সাথে ,
– আরও মিশতে হবে ,
– তাহলে মিশিয়ে নেন ।

রাতের গভীরতায় দুজন মানুষের ভালোবাসা গুলো আরও গভীর হয় ।
কিছু রাগ কিছু অভিমান সব কিছুই মিলিয়ে যায় একটু ভালোবাসার ছোয়ায় ।

– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,
– আরেকটা বেলী আসলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে ?

কাপড় বিহীন লজ্জা চোখে ইরফানের মুখের দিকে তাকায় বেলী । ইরফানের মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কথাটা শুনে বেলীর কলিজাটা এক লহমায় শান্ত হয়ে যায় ।

– কি হলো , বল , আমাদের দুজনের মাঝে আরেকজন আসলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে ?

বেলী আর কিছু বলতে পারে নি সেই মুহুর্তে । শুধু দুইহাত দিয়ে ইরফানকে জড়িয়ে নেয় আর ইরফানের বুকে নিজের মুখ লুকিয়ে নেয় ।

.
.

চলবে………………………..

[ আসসালামু আলাইকুম ,
কিছু কথা , আসলে ইদানীং অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি । জানি এই গল্প নিয়ে সবাই অপেক্ষায় থাকেন । বিশ্বাস করেন আমারও ভালো লাগে না আপনাদের অপেক্ষা করাতে । কিন্তু কি করবো বলেন , শরীর আস্তে আস্তে অবনতির দিকে যাচ্ছে । একটার পর একটা লেগেই আছে । তার উপর আরেক বড় দায়িত্ব মাথার উপর । আর তা হচ্ছে প্রকাশিতব্য উপন্যাস নিয়ে যা এইবার অমর একুশে গ্রন্থ মেলা ২০২০ এ প্রকাশিত হতে চলেছে । উপন্যাসের প্রথম প্রুফরিডিং এর কপি হাতে এসে গেছে । এখন এটাতেও আমায় সময় দিতে হবে । আশা রাখবো সবাই বুঝবেন । আর দোয়া করবেন । গল্প ছোট হলে দয়া করে কেউ কিছু মনে নিবেন না । হয়তো এখন থেকে রেগুলার দিতে পারবো না । কারণ আমায় প্রুফরিডিং এর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে । তাই সব কিছু আজকেই জানিয়ে দিলাম । আশা রাখবো সবাই বুঝবেন এবং সহযোগিতা করবেন । আর অবশ্যই দোয়া করবেন আমার জন্যে । কারণ আপনাদের দোয়া-ই আমার একমাত্র ভরসা ।

আসসালামু আলাইকুম ?? ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩২

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সুখময় মুহুর্ত গুলো অতিবাহিত হতে বেশি সময় লাগে না । আল্লাহ পাক হয়তো এই নিয়ম গুলো এইভাবেই করে দিয়েছেন । যেমন বিপদের রাত অনেক দীর্ঘ হয় , সেই রাতের ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার যেন প্রকৃতিকে গ্রাস করে নেয় । কিন্তু রাত যতই গভীর হোক না কেন এক সময় না এক সময়ে ভোরের আলো তো ফুটে উঠেই । ঠিক তেমনটাই এইখানে , বেলীর দুঃখের দিন গুলো দীর্ঘ হলেও এখন সুখের দিন গুলো অনায়াসেই পার হয়ে যাচ্ছে ।

সব মিলিয়ে প্রায় দুইমাস পেরিয়ে গেল । ইরফান আর রুবির মিউচুয়াল ডির্ভোস হয়ে গেছে । তাদের দুজনের মধ্যে এখন আর কোন রকম যোগাযোগ নেই । কিন্তু তবুও কোথাও যেন ইরফানের মনে শান্তি নেই । কিছু একটা যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত । বেলীর ব্যাপারে সে খুব পজেসিভ । যেন বেলীকে সে চোখে হারায় । বেলীর শরীরের একটু আঘাত যেন তার কলিজাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় । বেলী মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না , এটা ইরফানের ভালোবাসা নাকি পাগলামি । না হয় কোন পুরুষ কোন নারীকে এতটা ভালোবাসতে পারে ?

যেই পুরুষ আগে দিন রাত তার স্ত্রীকে মারধর করতো আজ সেই পুরুষ সেই স্ত্রীকেই চোখে হারায় । এতটাই চোখে হারায় যে রাতের মিলনেও বেলীর মুখের উফফফফ শব্দটাও তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে স্তব্ধ করে দিতে বাধ্য করে । সে ভালোবাসে তার বেলীফুলকে । বেলীও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক । অস্বাভাবিক থাকারও কারণ নেই । বেলীও যে ভালোবাসে তার বরকে । কোন শর্ত ছাড়াই ভালোবাসে সে তার বরকে । জীবনের গল্প গুলো যদিও ছবির মত হয় না । আবার অনেক সময় ছবিকেও হার মানিয়ে নেয় ।

ইরফান বেলীকে আবার পড়াশোনা শুরু করতে বলে । সে নিজের করা ভুল গুলো শুধরে নিয়েছে অনেকটাই । এইবার বেলীকে পড়াশোনাও করাতে যায় সে ,

– বেলী ,,,,,,,,?
– হু ,
– তুমি কেন মানছো না ?
– কি মানছি না ?
– এইযে পড়াশোনা করতে চাইছো না , কেন ?
– এখন আর ভালো লাগে না এইসব ।
– তুমি তো প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিলে ।
– যা বন্ধ হয়ে গেছে তা শুরু করতে চাই না ,
– এটা কিন্তু ঠিক না ।
– আমি এভাবেই ভালো আছি , এইসবে আর টানবেন না ।
– আমি বুঝলাম না এতে তোমার সমস্যা কোথায় ।
– ঘুমিয়ে পড়ুন , অনেক রাত তো হলো ।

বেলী এইসব বিষয়ে কোন কথাই বলতে চায় না । তাই সবটাই এড়িয়ে যায় । বেলীর কেন জানি পড়াশোনায় অনিহা চলে আসছে ।

গ্রাম থেকে ইরফানের বাবা এসেছ । আজ প্রায় অনেক দিন পর তিনি এলেন এই শহরে । জমি নিয়ে কিছু কাজ ছিল আবার ছেলে ছেলের বউকেও দেখার ইচ্ছা ছিল । তাই দুটো কাজই সম্পন্ন করেছেন তিনি । কথায় আছে শেষ ভালো যার সব ভালো তার । রুবির বিদায় হওয়া , আর তার পর পরই ইরফানের বাবা তার বাসায় আসা সব কিছুই একটা গোলকধাঁধা ।

রাতে খাবার পর , বেলীকে আর বাবাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসে ইরফান । আজকে ইরফান কিছু কথা বলতে চায় তার বাবাকে । তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য সে আজ অনুতপ্ত । সে যেমন বেলীর কাছে অপরাধী , তেমন সে তার বাবার কাছেও অপরাধী । ওইদিক থেকে দেখতে গেলে সে তার বাবার কাছে আরও বেশি অপরাধী কারণ সে তার পিতার সু-পূত্র হয়ে উঠতে পারে নি । নিজের করা কৃতকর্মের জন্য হয়তো আখিরাতে তার পিতাকেও হাশরের ময়দানে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে । তাই আগেই সে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে চায় তার বাবার কাছ থেকে ।

ইরফান তার বাবার সামনে মাথা নিচু করে বসে । মিনুও পাশে দাঁড়িয়ে আছে । বেলী মাথায় ওড়না পরে ইরফানের বাবার পাশেই বসা তার মাথা নিচু হয়ে আছে । বেলীর মনে ঠিক খবর হয়ে গেছে , ইরফান কি বলবে তার বাবাকে । বেলী শুধু ভয় পাচ্ছে , এটা ভেবেই ভয় পাচ্ছে যখন তার শ্বশুর এইসব শুনবেন তখন কি হবে ।

এদিকে রহমান আলী মানে ইরফানের বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন । তার মন তাকে জানান দিয়ে দিয়েছে যে তার ছেলে হয়তো কোন অপরাধ করেছেন , যার জন্যে তার নজর আজ নিচু হয়ে আছে ।

– ইরফান , নজর নিচে কেন ? কিছু একটা শুনার জন্যেই তো আমাকে এইখানে বসানো হয়েছে । সেটা কি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– ইরফান ,,?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– বউমা , কি হইছে ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– দুজনেই চুপচাপ , কেন ?

ইরফানের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না । অন্যদিকে , ভয়ে বেলীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি বের হচ্ছে । ইরফানের স্তব্ধতা যেন অনেক কিছুই ইংগিত করছিল । তবুও রহমান আলী আবার প্রশ্ন করেন ,

– ইরফান , কি হইছে ?

বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত করে মুখ দিয়ে কথা বের করে ইরফান ,

– বাবা , আমি কয়েকটা কথা বলবো । আপনাকে শুনতে হবে ।
– হ্যাঁ , শুনতেই তো আছি ।
– বাবা কিছু অপরাধ করছি , যার কখনো ক্ষমা হয় না । জানি না এই মেয়েটা কিভাবে আমায় ক্ষমা করে দিছে ।

আঙুল তুলে বেলীকে উদ্দেশ্য করে ইরফান কথা গুলো বলে । বেলীর চোখে তখন পানি । মিনুও পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয় । কারণ মিনুর সামনে তখন তার রাগী ইরফান ভাই ছিল না । তার সামনে তখন একজন অনুতপ্ত নিঃস্ব অসহায় পুরুষ বসেছিলেন । যার মুখটা দেখলে যে কারোই মায়া হয়ে যাবে । তার থেকেও বড় ভয়টা হচ্ছে সে তার বেলী ভাবীর কাছে শুনেছিল রহমান সাহেব অনেক রাগী মানুষ । কারোই জানা নেই , এইসব শুনার কি রিয়েকশন হবে । এইসবের মাঝে রহমান আলী আবারও বলে ওঠে ,

– কি এমন অপরাধ করছো তুমি ?
– বলতেছি বাবা ,

তারপর বেলীকে ঢাকা নিয়ে আসার পর থেকে রুবিকে ডির্ভোস দেয়ার দিন পর্যন্ত সমস্ত কিছু বলে দেয় ইরফান তার বাবাকে । এমন কি বেলীকে মারধরের বিষয়টাও বলে দেয় সে তার বাবাকে । ইরফানের বাবা তার ছেলের কথা শুনে স্তব্ধ । ওনার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । রাগ কিনা জানা নেই কিছু দুঃখে ওনার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে । বেলীও চাপা কান্নায় ব্যস্ত । মিনুও মুখে হাত দিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে । ইরফানের কথা না বলাই ভালো কারণ সে তখন তার বাবার পায়ে ধরে নিজের দোষ গুলো বর্ণনা করছিল তার কাঁদছিল । ইরফান তখন মিনুকে উদ্দেশ্য করে বলে ,

– বাবা আমার সব অত্যাচারের সাক্ষী ছিল এই মিনু । আমি বেলীকে মেরে আধমরা করে রেখে যেতাম এই মিনুই ও-কে সামলে নিয়েছে । মিনুর অনেক রাগ আমার প্রতি । হয়তো অনেক বকা বাধ্যও করেছে আমাকে ।

মিনু এইসব শুনছিল আর চোখের পানি ফেলছে । রহমান আলী শুধু নিচের দিকে চেয়ে আছে । তারপর ইরফান আবারও বলে ,

– বাবা , আমি অনেক অপরাধ করছি । হয়তো এই অবরাধের ক্ষমা হয় না । আমি আপনার সু-পূত্র হতে পারি নাই বাবা । আপনার আদর্শে নিজে গড়ে তুলতে পারি নাই । আমায় ক্ষমা করে দিন বাবা ।

ইরফানের কথায় রহমান আলী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দিলেন । তারপর দু’হাত এক করে বেলীর দিকে এগিয়ে আসলেন । তখন কেন জানি ওনার-ই নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল ।

– মাগো , আমি ভুল করছি গো মা । আমি বুঝতে পারি নাই যে আমি আমার কথার দাম রাখতে গিয়ে এক এতিমকে এক নরপিশাচের হাতে তুলে দিছি । আমায় মাফ কর মা ।

নিজের বাবার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে ইরফানের কলিজাটা যেন ফেটে যাচ্ছিল । বেলীও ঢুকরে কেঁদে দেয় । ইরফান তখন তার বাবার পা জোড়া আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । তখন রহমান আলী পা ঝাড়া দিয়ে ওঠে ,

– খবর দার , তোমার ওই পাপী হাতে আমার পা ধইরো না । আমি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি । আমার শরীর অপবিত্র কইরো না তুমি ।
– বাবা,,,,,,,?
– কে বাবা , কিসের বাবা । আমার কোন ছেলে নাই ।
– বাবা ,,,,,,,?

রহমান আলী তখন বেলীকে বলতে শুরু করে ,

– তুই আমার কাছে চলে গেলি না কেন রে মা ? তোকে কে বলছে এই পশুর কাছে থাকতে । আমরা দুইজনে এক বাড়িতে থাকতাম । আর ওই মেয়ে কেন তালাক দিলো ? তুই কেন দিলি না মা , তুই কেন দিলি না । কেন এই পশুর কপালে লাত্থি মাইরা আমার কাছে আসলি না রে মা ?

রহমান আলীর কথায় বেলী অবাক হয়ে যায় ।

– বাবা আপনি এইসব কি বলেন ?

রহমান আলী একদম ভেঙে পড়েছেন । তার নিজের ছেলে এত জঘন্য অপরাধ করতে পারবে তা ওনার জানা ছিল না । চোখের পানি মুছে ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন ,

– তোমার মায়ের কাছে কথা দিছিলাম , সেই কথা রাখতে পারি নাই আমি , তুমি মানুষ হলে না তুমি অমানুষই রয়ে গেলা । তোমার মায়ের শরীরে আমি কখনো ফুলের টোকা লাগাই নি আর সেই তুমি আমার ছেলে হয়ে এই ফুলের মত এতিম মেয়েটাকে মারছো । আমি আল্লাহ পাকের কাছে কি জবাব দিবো । আমি হাশরের ময়দানে এই নিষ্পাপ মেয়ের বাবার কাছে কি জবাব দিবো ?

তখন তিনি বেলীকে আবারও বললেন ,

– মারে এর কপালে লাথি মারলি না কেন রে মা ।

শ্বশুরের কথায় বেলী তখন একটা কথাই বলে ,

– যে নিজ কর্মে অনুতপ্ত তাকে কিভাবে দূরে ঠেলে দিবো বাবা ? সে আমার সব কিছু বাবা । আমি পারি নাই , আমি পারি নাই বাবা ।

.
.

চলবে……………………..

গল্পের আগের সবগুলো পর্বের লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে।

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩১

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩১
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

বেলীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে । কতদিন পর রাজু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সেই চিরচেনা মুখ তার সামনে দাঁড়িয়ে । আগের থেকে বেশ বদলে গেছে সে , চোখে চশমা পড়ে এখন । অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে রাজুর দিকে । আর রাজু চেয়ে আছে তার সেই চিরচেনা কালচে ফুলের মুখের দিকে । কতটা বদলে গেছে মেয়েটা । দুচোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই পানি গুলো গড়িয়ে পড়ে যায় বেলীর ।

– কেমন আছিস রে বেলীফুল ?
– ভালো , আপনি ?
– হ্যাঁ ভালোই আছি , কেমন ভালো আছি দেখতেই তো পাচ্ছিস ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– চোখে পানি কেন ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই পানির কারণ কি আমি ? নাকি হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা , কোনটা ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

রাজুর কোন কথার জবাবই বেলী দেয় নি । বেলীর নিরবতা আর চোখের পানিই বেলীর বলতে না পারা কথা গুলো বলে দিচ্ছে । বেলীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল রাজুর । তাই আবারও শুরু করে সে ,

– অনেক দিন পর দেখলাম তোকে । এইদিকে কি মনে করে ?
– আমি এইখানের কিছুই চিনিনা , মিনুর সাথে আসছিলাম ।
– মিনু কে ?
– আমাদের বাসাতেই থাকে ।
– তোর জামাই কেমন আছে ?
– আলহামদুলিল্লাহ ,
– তুই সুখে আছিস তো ?

রাজুর ভেতর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটা কথাই বেলীর অন্তরে গিয়ে লাগে । কি করতে যে সে এখানে এসেছিল আর কেনই যে রাজুর সাথে দেখা হয়ে গেল । এটা ভেবেই কষ্টে বুক ফাটে তার । সুখ নামক জিনিসটাই তো তার জীবনে ছিল না । সুখটা তার জীবনে হুট করেই চলে আসে । তাই আর বেশি কিছুই মুখে আসছে না তার ।

– কিরে , বললি না তো ?
– কি ?
– সুখে আছিস তো ?
– দেখে কি মনে হয় ?

বেলীর কথা শুনে রাজুর সব কথা গুলো যেন থমকে যায় । তার মানে বেলী ভালোই আছে । খুব সুখে আছে । এরই মাঝে বেলী বলে উঠে ,

– আপনার কি খবর ? বিয়ে শাদী করছেন ?
– নাহ ,
– ওহ , করে নিন । এভাবে আর কত দিন ?
– করতে তো চেয়েছিলামই , পারলাম আর কই ।

রাজুর ইংগিত বুঝতে বেলীর সময় লাগে নি । মিনু টাও যে কেন আসছে না । তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারলে ভালো হতো ।

– দোয়া করি সুখে থাক , ভালো থাক ,
– হু ,

রাজু কেন জানি পিছনে ফিরে হাটা শুরু করে দেয় । আর একবারের জন্যেও বেলীর দিকে তাকায় নি । হয়তো তারও বুঝা হয়ে গেছে তার কালচে ফুল এখন অন্যের হয়ে গেছে । এক বুক হাহাকার নিয়ে চলে যাওয়া রাজুর পথপানে চেয়ে আছে বেলী ।

এর পর পরই মিনু চলে আসে । বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিনু তার ভ্রু কুচকে তাকায় বেলীর দিকে ।

– ও ভাবী ,,,,
-,,,,,,,,,,
– ভাবী , ও ভাবী,,,,,,,,
– হু ,
– কি গো , ইরাম আতকাইয়া উঠছেন কেন ?
– কোথায় ছিলে এতক্ষন ?
– আর কইয়েন না যেই ভিড় আছিল গো ভাবী ।
– চলো বাসায় যাবো ,
– খাইবেন না ? আমি এত্ত কষ্ট করে আনলাম ।
– খাবো তবে বাসায় গিয়ে , বাসায় যাবো এখন ।
– ভাবী আপনের শরীর ঠিকাছে নি ?
– হ্যাঁ , চলো ,
– আইচ্ছা চলেন ।

অন্তরে তার কি ঝড় বইছে শুধু সে-ই জানে । কোন রকম বাসায় পৌঁছে রুমে চলে যায় বেলী । বুকে প্রচন্ড রকম ব্যাথা অনুভব হচ্ছে তার । দরজাটা লাগিয়ে পাশেই ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে বেলী । বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার । পাগল পাগল লাগছিল নিজের কাছে । দৌড়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে বেলী । বালিশ চেপে ধরে চাপা আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে বেলী ।

– আজ কেন ? ইয়া খোদা আজ কেন আবার সে সামনে এলো । আসা টা কি খুব প্রয়োজন ছিল ? আমি তো নিজেকে সেই কবেই গুছিয়ে নিছিলাম , যেদিন ওনার ঘরে আসছিলাম । সব তো মেনেই নিছিলাম , তাহলে আজকে আবার কেন আল্লাহ । এই কোন খেলা খেলছেন আল্লাহ । আমি তো ওনাকে ভালোবাসি তাহলে রাজু ভাই আবার কেন এলেন আল্লাহ পাক । আল্লাহ পাক আমি সব ভুলতে চাই । সবটাই ভুলতে চাই ।

বেলী কখন যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায় সে নিজেও বুঝতে পারে নি ।

ইরফান প্রায় ১৫ মিনিট যাবত দরজা ধাক্কাচ্ছে । কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আরও জোরে জোরে দরজায় নক করে । মিনুও প্রায় কেঁদেই দিছে । এতক্ষন যাবত ইরফান দরজা ধাক্কাচ্ছে খুলার নামই নেই বেলীর । ইরফানের কলিজায় কে যেন ছুড়ি দিয়ে কোপাচ্ছিল মনে হচ্ছে । সে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল । একমাত্র ভাড়া বাসা বলেই দরজাটা ভাঙতে পারেনি । বেলীর কানে আচমকাই নিজের নামটা যাওয়ায় লাফ দিয়ে উঠে ঘুম থেকে ।
খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় বেলী । বেলী দরজা খুলার সাথে সাথে ইরফান ভেতরে ঢুকে পড়ে রুমের মধ্যে । সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বেলীকে সে । চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে ইরফানের । বেলীকে এইভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে মিনু সেখান থেকে সরে যায় আর বেলীর তো প্রায় দম বন্ধ হয়েই আসছে ইরফান অত্যন্ত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে ।

– দরজা বন্ধ করছো কেন তুমি , হ্যাঁ , আমি সেই কতক্ষন যাবত দরজায় নক করছি ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হইছে তোমার , এই সময় তো কখনো ঘুমাও না তুমি ?
– একটু ছাড়েন , দম আটকে আসছে আমার ।

বেলীর কথায় ইরফান বেলীকে হালকা করে দেয় । বেলীর সামনে আজ যেন এ এক অন্য ইরফান দাঁড়িয়ে আছে । যার দুটো ভয়ার্ত চোখে শুধু বেলী নিজেকেই খুজে পায় । বেলীকে হারানোর ভয়টা কেন যেন তাকে খুব পোড়াচ্ছে । ইরফান পাগলের মত বেলীকে চুমু খেতে থাকে । কপালে , গালে , হাতে , চোখে কোথাও কমতি রাখে নি । যেন মনে হচ্ছিল তার সামনে একটা বাচ্চা শিশু দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান বেলীকে আবারও জড়িয়ে নেয় নিজের মাঝে । বেলীকে পাগলের মত আদর করে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় সে ।

– কি হলো , তোমার কি হইছিল ?
– কিছু না তো ?
– আমি খুব ভয় পাইছিলাম ।
– কেন , কি ভাবছিলেন ? মরে গেছি ?

বেলীর মুখ থেকে মরা শব্দটা শুনে ইরফানের বুকে কামড় পড়ে যায় । বেলীর মুখটা সাথে সাথেই চেপে ধরে ইরফান ।

– ঘুরিয়ে এক থাপ্পড় মারবো কিন্তু বেলী , কি সব বলো ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– আমি আমার জীবন থাকতেও তোমাকে হারাতে পারবো না । আর বার বার মরার কথা কেন বলো যখন জানো যে এটা আমি শুনতে পারি না ।

বেলী ইরফানের কথা শুনছে আর ঘড়িতে দেখছে । রাত প্রায় ১০ টার বেশি বাজে । বেলীর আজ কি হয়েছিল এতক্ষন ঘুমিয়েছে সে । আর ইরফান এত ডাকার পরেও সে শুনতে পায় নি ।

রাতে খাবার পর দুজনেই শুয়ে আছে । ইরফানের আজ মনটা ভালো নেই । কেমন যেনো ছটফট করছিল । আজ বিকালে এডভোকেটের চেম্বারে রুবিও এসেছিল । সেখানে দেখা হয় দুজনের । অবাক করার বিষয় ছিল রুবি এমন ভাব করছিল যেন সে ইরফানকে চিনেই না অথচ এই রুবিই ইরফানকে প্রেশার ক্রিয়েট করেছিল বিয়ে করার জন্যে । রুবির সাথে রুবির বাবাও ছিলেন সেখানে । রুবি তার এডভোকেটকে জানিয়ে দিয়েছে সে মিউচুয়াল ডির্ভোস চায় , সাথে কাবিনের সব টাকা । ওদের বিয়ের সময় ইরফান প্রায় ১০ লাখ টাকা কাবিন করেছিল , যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ টাকা ইরফান বিয়ের দিনই উশুল করে দিয়েছিল । রইল বাকি ৭ লাখ টাকা তা ইরফান তাকে নগদ দিবে বলেছে । আজ পেপারে সাইন করতে রুবির হাত কাপে নি বরং তাকে খুশিই লাগছিল । ইরফানের নিজেকেও হালকা লাগছে আজ । হয়তো দুই মাস পড়ে একেবারেই ডির্ভোস হয়ে যাবে তাদের । রুবি শুধু লাষ্টে কিছু কথা বলে গেছিল । যা ইরফানের বুকের মধ্যে তুফান শুরু করে দিয়েছে সেই বিকাল থেকেই । যখন রুবি তাকে বলেছিল ,

– মিষ্টার মাহমুদ , আমার এক্স হাজবেন্ড আমার টাকাটা পাই পাই বুঝে নিতে চাই আমি ।
– পেয়ে যাবে ।
– আর হ্যাঁ , ওয়েট এন্ড ওয়াচ , বেলীও তোমার জীবনে থাকবে না ।
– রুবি,,,,,,,
– ডোন্ট শাউট , বেলী নামক কাটা আপনা আপনিই ঝরে যাবে । শুধু মিলিয়ে নিও । তোমার সুখের ঘরে অতি শীঘ্রই গ্রহণ লাগবে । অভিশাপ দিলাম ।
– রুবিইইই ,,,,,,,,,

রুবি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় । তবে রুবির পক্ষ থেকে রুবির বাবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় । ভদ্রলোকও মেয়েকে নিয়ে ফেঁসে গেছেন ।

তাই তো আজ বেলীকে এইভাবে দরজার ওপারে দেখে তার কলিজায় পানি ছিল না । ইরফান হুট করেই বেলীর দিকে ঘুরে যায় । বেলী তখন ঘুমাচ্ছিল , বেলীকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল । ইরফান তার হাতটা দিয়ে বেলীর গাল স্পর্শ করে ।

– আমি তোকে হারাতে পারবো না । কখনোই না , তবুও কেন জানি রুবির বলে যাওয়া কথা গুলো শুনে খুব ভয় লাগছে । এই প্রথম আমি খুব ভয় পাচ্ছিরে বেলী । তুই আমার হৃদয় মাঝে থাকা সেই ছোট্ট পাখি যাকে আমি আমার অন্তিম নিঃশ্বাস অবদি আগলে রাখতে চাই । তবুও কেন জানি বুকটা বার বার কেঁপে ওঠে আমার । আমি তোকে হারাবো না তো ?

ইরফানের মন বলছে এইসব । কিন্তু চোখ বলছে অন্যকিছু ।

– আমি ভালোবাসি রে বেলী তোকে , অনেক ভালোবাসি ।

.
.

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩০

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

দুই দিন পর ,

সকাল বেলা বেলী আর মিনু রান্নাঘরে কাজ করছে । ইরফান অফিসে যাবে । নাস্তা গুলো তাড়াতাড়ি টেবিলে দিতে হবে । তাই যত দ্রুত সম্ভব হাত চালায় বেলী । এরই মাঝে মিনু বলতে শুরু করে ,

– ভাবী,,,,,,?
– হু ,
– আমারে একখান কতা কন দেহি ?
– হু বলো ,
– আইচ্ছা ভাবী , শয়তানি ডা ,,,,,,,
– আহহহহহ মিনু , ওনার নাম আছে । নাম ধরে বলো ।
– আইচ্ছা আইচ্ছা , রুবি আফাই কই এহন তো আর হেতি আমাগো ভাইয়ের কেউ লাগে না । ভাবী আন্নের কি মনে অয় , হেতি এত তাত্তাড়ি ডিফোস কিসের জন্যে দিবার চায় ।
– ওইটা ডিফোস না , তুমি বাংলাতেই বলো তালাক আর কি ।
– ওই তো অইলো একডা তালাক আর তুলাক । তা হের মাতায় কোন ভূত সোয়ার অইছে আল্লাহ মালুম ।
– তোমার ভাই অনেক চিন্তিত , জানি না কি হতে চলেছে । রুবি আপু কেন যে এইসব করতে গেলো ।
– ভাইয়ে চিন্তিত নাকি আপনে চিন্তিত আপনের সতীন বিদায়ের দুঃখে ।
– কাজ করো তো ,
– মায়া দয়া মাইনষের লাই রাখিয়েন বুজ্জেন নি শয়তানের লাই মায়া দয়া রাখি লাভ নাই । আস্তারা অসিভ্য আছিল ।
– আহহহহ মিনু ,
– আহহহহ উহহহহ কইরেন না তো ভাবী , আমি তো ভাবছিলাম বড় মজ্জিদে ১০০ টাহা দিমু । আপদ বিদায় হইতাছে ।
– এইসব বলো না মিনু , আল্লাহ পাকের লীলাখেলা আমরা কেউই বুঝি না । তিনি কার ভাগ্যে কি রেখেছেন তাও আমাদের প্রত্যেকের কাছে অজানা । এইসব আমরা কেউই জানি না , কেউই বুঝি না ।
– জানতাম চাইও না , বুঝবারও চাই না । আমি খালি বুঝি আপদ বিদায় হইতাছে , এডাই শান্তি আমার ।

মিনুকে দেখে বেশ খুশিই লাগছিল । মনে হচ্ছিল মিনু যেনো এমন একটা দিনের জন্যে অপেক্ষা করছিল । মিনু এই বাড়িতে আসে রুবি আসার ঠিক এক মাস পর । ইরফানের একটা কাজের বুয়ার প্রয়োজন ছিল যদিও তখন বেলীই ছিল তার চোখে বুয়া । তবুও রুবির কথায় আরও একটা বুয়ার প্রয়োজন আছে তাই ইরফান কার সাথে যেন যোগাযোগ করে মিনুকে নিয়ে আসে । কিন্তু মিনু সেই প্রথম থেকেই কেন জানি রুবিকে পছন্দ করতো না । তার কেন জানি বেলীকেই ভালো লাগতো । আর সব থেকে খারাপ লাগা যদি তার থেকে থাকে তা ছিল ইরফানের বেলীকে মারধর করা । বেলীকে এক রক সময় দেখে মিনুও কাঁদতো ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিনু আবারও বলতে থাকে ,

– শয়তান এইডা ঘরে আছিল ঘরে হারাদিন ঝগড়া লাইগা থাকতো , শয়তান এইডা এক ওয়াক্ত নামাজ তো পড়েই না , তার উফ্রে ভাইয়েরে এইডা সেইডা কইয়া আপনেরে ফিডা খাওয়াইতো । এহহহ খবিশ মাতারি , যহন দেখছে ভাইয়ে আমার বেলী ভাবীরে ভালাবাসে থহনই হের জ্বলন শুরু । দেখছেন নি ভাবী আমি কইছিলাম না , ভাবী আল্লাহ আছে একজন । শয়তানের বিচার এমনেই করে আল্লাহ । শয়তান এমনেই মরে । ওহন মরুক নাইলে জাহান্নামে যাউক , আমাগো কি ।
– মিনু বাদ দাও , তোমার ভাই শুনলে কি ভাববে ।
– কচুর ছড়া ডা আছে না ? হেই কচুর ছড়াডা ভাববো । এক্কেবারে ভালা হইছে ভাইয়েও মুক্তি পাইবো এই ডাইনীর হাত থিকা ।

মিনুর বক বক নন-স্টপ চলতেই আছে । বেলী আর কথা বাড়ায় নি । সমস্ত নাস্তা এনে টেবিলে সাজিয়ে দেয় । সাড়ে ৮ টা বেজে গেছে । ইরফান এলো বলে ।

তার পর পরই ইরফান চলে আসে । বেলী সব সাজিয়ে আগেই রেখে দিয়েছে । ইরফান শুধু বসবে আর খাওয়া শুরু করবে । বেলী এমনি , সব কিছু ইরফানের হাতের কাছে এনে রাখবে । যাতে ইরফানের কিছু নেক্সট টাইম চাইতে না হয় । এই জন্যই হয়তো খাওয়ার সময় ইরফানের বেলীকেই লাগে ।

– বেলী ,
– জ্বি ,
– তুমিও বসে যাও ,
– নাহ আপনি খেয়ে নেন ।
– নাহ সমস্যা নাই , এক সাথে বসেই খাই ।
– আচ্ছা ।

ইরফানের কথা গুলো খুব সহজেই মেনে নেয় বেলী । কেন জানি হাজারো চেষ্টা করলেও বেলী ইরফানের দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারে না । ইরফান ওই রকমই মানুষ , যার কথা বলা , যার চাল চলনে পাগল বেলী যদিও সে মুখ কিছুই স্বীকার করে না । বেলী যে ইরফানকে চোখে হারায় আর সে যে ইরফান বলতে অজ্ঞান এটা ইরফানও বেশ ভালো বুঝতে পারে তাই নিজেও তেমন কিছু বলে না । তবে সে রাতে রুবির সাথে জিদ করে বেলীকে বকে দিয়েছে ইরফান । সে নিজের বলা কথার জন্যে খুব লজ্জিত । তার উপর কিছু শব্দ ব্যবহার করেছিল বেলীর সামনে । তার মুখ থেকে সব থেকে বাজে শব্দটাই বেলীর জন্য ছিল যা হলো লাথাতে লাথাতে নিচে ফেলে দিবে । কিন্তু সে কি করতো , তার মাথা কাজ করছিল না তখন । তার উপর বেলীর এমন মানবদরদী কথা যা তার একদম পছন্দ হয় নি । যার জন্যই মুখ থেকে বেরিয়ে গেছিলো । এখন খুব খারাপ লাগছে ইরফানের । তাই নিজ থেকেই সে রাতের টপিকটা তুলে ইরফান ,

– বেলী ,
– হু ,
– রাগ করে আছো ?
– নাহ , একদম নাহ ।
– সে রাতের জন্যে দুঃখিত বেলী ।
– বাদ দিন , আসলে আমি,,,,,,,
– আপনি খুব চিন্তায় ছিলেন আর আমিই বোকার মত আবল তাবল বলে যাচ্ছিলাম , আপনার জায়গায় আমি থাকলেও এমনটাই হতো ।
– ক্ষমা করে দাও , প্লিজ ।
– ছিহ , কি সব বলেন । এইসব বলবেন নাহ ।

ইরফান আর বেলী নাস্তা খাওয়ার সময় ইরফানের মোবাইলে ফোন আসে । অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসায় একটু দ্রুতই ফোনটা রিসিভ করে নেয় ইরফান ।

– হ্যালো ,
– হ্যালো , ইরফান মাহমুদ ?
– জ্বি ইরফান মাহমুদ , কে বলছিলেন ?
– আমি এডভোকেট রাশেদ বলছিলাম ।
– জ্বি বলুন ,
– মিসেস রুবি মাহমুদ ডির্ভোস ফাইল করেছিলেন , আপনি কি আমার চেম্বারে আসবেন নাকি আমি আপনার বাসায় পেপার পাঠাবো ?

বাসায় এই পেপার আসলে বেলী আবার ডিপ্রেশনে পড়ে যাবে । এইসব ঝামেলা সে বেলীর আশেপাশেও দেখতে চায় না আর । অন্যদিকে বেলী সামনে থাকায় ক্লিয়ারলি কথাও বলতে পারছে না । তাই বুদ্ধি করে ঘুরিয়ে কথা বলে দেয় ।

– নাহ নাহ , আমিই আসবো আপনার চেম্বারে ।
– আর ইউ সিউর মিষ্টার মাহমুদ ?
– ইয়ায়ায়া আই এম সিউর ,
– ওকে , থ্যাংকস ।
– কখন আসতে হবে ?
– বিকেল ৪ টায় ।
– আচ্ছা , ধন্যবাদ ।

চেম্বারের কথা শুনে চোখ তুলে ইরফানের দিকে তাকায় বেলী ।

– আপনি কি অসুস্থ ?
– কই না তো ,
– তাহলে যে বললেন চেম্বারে যাবেন ।
– হা হা , বোকা মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবো আমি । এই বোকা চেম্বার কি শুধুই ডক্টরের হয় । আমরা যারা বড় বড় পজিশনে থাকি তাদের যেই কেবিন থাকে তাকেও চেম্বার বলে ।
– ওহ ,
– বুঝলা এখন ?
– হু ,
– এক স্যার ফোন করেছিলেন , বিকেলে ওনার চেম্বারে যেতে হবে ।
– ওহ ,

এইসব বলে কথা কাটিয়ে দেয় ইরফান । রুবি তাহলে তার কথাই রেখেছে । সে তার মতই করেছে । যা বলেছিল ঠিক তাই করেছে সে । অবশেষে ডির্ভোস ফাইল করেই দিয়েছে ।

– ভালোই হলো , আবেগ দিয়ে আর কত দিন আটকে রাখতাম । এর থেকে ভালো বিবেক খাটিয়ে সবটা মিটিয়ে নিবো ।

মনে মনে চিন্তা করতে থাকা ইরফানের গলা দিয়ে নাস্তা নামছে না ।

বেলীর নজর ইরফানের দিকে । কি যেন ভাবছিল ইরফান , তবে সাহস হয় নি কিছু জিজ্ঞেস করার । ইরফান আর তেমন বেশি কিছু বলে নি । ফোন রাখার কিছুক্ষণ পরই ইরফান বেরিয়ে যায় । বেলী আবার একা বাসায় । ইদানীং মন তার বড্ড বেশি ইরফান ইরফান করে । ইরফান চলে যাওয়ার পর বেলী চুপ করে সেখানেই বসে থাকে । হঠাৎ করেই ফোন বেজে ওঠে তার । ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইরফানের নাম্বার ।

– কি হলো , এই মাত্রই তো বের হলো , কিছু ভুলে গেছে নাকি ?

ভাবতে ভাবতে ফোন টা রিসিভ করে কানের কাছে নেয় বেলী ।

– হ্যালো বেলী ,
– হু ,
– তোমার রুমে যাও , গিয়ে জানালার পাশে দাড়াও ,
– আচ্ছা ।

বেলী দৌড়ে নিজের রুমে যায় আর রুমের জানালার পাশে দাঁড়ায় । নিচে তাকিয়ে দেখে ইরফান মোবাইল কানে দিয়ে উপরে তাকিয়ে আছে ।

– আমার দিকে তাকাও একবার ,

ইরফানের কথায় জানালা দিয়েই সে ইরফানের চোখের দিকে তাকায় ।

– বলেন ,
– কেন ফোন দিছি জানো ?
– উহু ,
– বলি ?
– হু ,
– ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি অনেকটা বেশিই ভালোবাসি ।

ইরফানের বলা কথাটুকু বেলীর শরীরে কেমন যেনো এক দোলা দিয়ে গেল । পুরো শরীর যেন মুহুর্তের মাঝেই ঠান্ডা হয়ে গেলো বেলীর । ঠোঁটের কোণে না চাইতেও মিষ্টি হাসি এসে গেছে তার ।

– কি হলো , কিছু বলো ?
– কি বলবো ,
– আমি যা বলেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে যা বলার তাই বলো ।
– আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো হারাতে চাই না । আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো মন পাগলের মত আপনাকে চায় । আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো আমি আপনার জন্যে মরিয়া হয়ে যাই । আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো আমি আপনার মাঝে বসত করতে চাই । এইসব যদি ভালোবাসা হয় , তাহলে বলবো হ্যাঁ , আমি ভালোবাসি , আমি আপনাকে ভালোবাসি ।

বেলী লাইন কেটে জানালার পাশ থেকে সরে যায় । বেলীর কথাগুলো ইরফানের বুকের ঠিক মাঝ বরাবরটায় গিয়ে লাগে । এমন ভাবেই লাগে যে তার ঘরে থাকা জলজ্যান্ত বেলীফুলের ঘ্রাণটা তার নাক অবদি এসে গেছে । মুচকি হেসে গন্তব্যস্থলে রওনা দেয় ইরফান ।

– ইয়া রাব্বুল আলামীন আমি কি আসলেই মানুষ ? নাকি এখন মানুষ হয়েছি নাকি তখন অমানুষ ছিলাম ? যেই মেয়েটার সরল মনটা আজও আমাকেই চায় কোন শর্ত ছাড়াই তাকেই কিনা আমি ,,,,,,,,,,,, আল্লাহ পাক আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন ।

নিজের দোষ গুলো মনে করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় ইরফান । হয়তো আল্লাহ পাকেরও একই ইচ্ছা এইবার অন্তত সব কিছু ঠিক হোক । রুবি নিজ থেকেই সরে যাচ্ছে , এটাই খটকা লাগছিল ইরফানের কাছে । তার ভাবনা অনুযায়ী রুবি এত সহজে জায়গা ছাড়ার পাত্রী নয় । কিন্তু এত সহজেই সব ছেড়ে দিলো এটাই ভাবাচ্ছে ইরফানকে । রুবি অন্য প্ল্যান করে নি তো ? তবে আজ বাকিটা এডভোকেটের চেম্বারে গেলে বুঝতে পারবে সে ।

বিকালের দিকে মিনু অনেক জোর করছিল বেকীকে নিয়ে বের হতে । মিনু বেলীরে নিয়ে এক জায়গায় যেতে চায় । আর তা এখনি । আর তাছাড়া ইরফানও বাসায় নি । এই সুযোগেই সে বেলীকে নিহে বের হতে চায় । কিন্তু বেলী তো বের হবে না আর ইরফানকে না জানিয়ে কখনোই না । আর তাছাড়া বেলী বাহিরে বের হওয়া পছন্দ করে না । কিন্তু মিনুও জোর করছে ,

– ভাবী আইয়েন না গো পিলিজ
– হা হা , পিলিজ কি ওটা প্লিজ
– ওই একই যেইহানে ১১ হেইহানেই ১২ , হউক পিলিজ আর হউক পুলিজ , লন
– দেখো মিনু আমার ভালো লাগে না ।
– আরে আইয়েন , আপনেরে আইজ্জা ঝালমুড়ি খাওয়ামু আমি ,
– বাহ বাহ
– সইত্য খাওয়ামু , লন ।

মিনু অনেক ভালোবেসে বলছিল , তাই বেলীও আর না করতে পারে নি । তবে বেলী ইরফানকে ফোন দিয়ে দেয় । তখন ঘড়িতে ৪ টা বেজে ২০ মিনিট । ইরফান তখন এডভোকেট রাশেদের চেম্বারে কথা বলছিল । এমন সময়তেই বেলীর ফোন যায় ইরফানের ফোনে ।

– এক্সকিউজ মি ,
– ইয়ায়ায়া সিউর ,

ইরফান সাইডে বেলীর ফোন রিসিভ করে ।

– হ্যাঁ বেলী বলো ,
– আপনি কি ব্যস্ত ? আমি কি বিরক্ত করলাম ?
– নাহ বলো , কিছু বলবা ?
– শুনুন না , মিনু অনেক জোর করছে বের হওয়ার জন্যে ।
– কোথায় যাবে সে আবার ?
– জানি না , বলে এইদিকে নাকি একটা পার্ক আছে আবার বলে ঝালমুড়িও খাওয়াবে ।
– হা হা , ওর কাছে টাকা আছে ?
– কি জানি ?
– হ্যাঁ , পাশেই একটা পার্ক আছে , মিনু ওইটার কথাই বলতেছে । তা যাও না ওর সাথে ঘুরে আসো ।
– যাবো ?
– হ্যাঁ যাও বেশি দূরে না পাশেই । আর বিকেল টাইম ঘরে বসে কি করবা , যাও ঘুরে আসো ।
– আচ্ছা , তাহলে রাখি ।
– আচ্ছা আমার আজকে দেরি হবে । ৯/১০ টা বেজে যাবে , টেনশন নিও না , কেমন ?
– হু ।

ইরফান ফোন রেখে দিলে বেলী রাডি হয়ে মিনুর সাথে বের হয় । মিনু খুব খুশি আজকে , সে তার বেলী ভাবীর সাথে বের হয়েছে আজকে । এটাই তার কাছে আনন্দের ছিল । হাটতে হাটতে তারা পার্কে চলে আসে । এখানে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করে , আবার প্রেমিক প্রেমিকারাও আসে । বসে বসে গল্প করে তারা । প্রায় অনেক্ষন মিনু আর বেলী একটা বেঞ্চের উপর বসে বসে গল্প করছিল । এক সময় মিনু বলে উঠে ,

– ভাবী ওই দেহেন ঝালমুড়ি , খাইবেন নি ?
– ধরো টাকা নিয়ে যাও ,
– এহহহহহ কিল্লিগা , আমার দারে আছে ।
– এটা নেও ,
– বা গো ভাবী আপনে আমারে বইন মানেন না ?
– মানি তো ,
– তাইলে আমিই আইজ্জা আপনারে খাওয়ামু ,
– আচ্ছা , যাও নিয়ে আসো ।

বেলীর কথায় মিনু দৌড়ে ঝালমুড়ি আনতে যায় । বেলী তখন খানিকটা একা হয়ে যায় । সামনে বাচ্চারা খেলাধুলা করছিল আর বেলীও তা দেখছিল । হঠাৎ করে কে যেন পিছন থেকে ডাক দেয় বেলীলে ।

– বেলীফুল ,,,,,,,,,,,,,,?

সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে বিচলিত হয়ে বেলী পিছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় । আর ঠিক তখনই বেলীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখতে থাকে বেলী ।

– রাজু ভাই,,,,,,,,,,,,,??

.
.

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,