Thursday, August 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1998



এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৮

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৮
লেখনিতে: চৈত্র রায়

১৫
,
,
,
বিয়ে টা হয়ে গেলো……. মা-বাবা কে ছেড়ে বাপেরবড়ির পাট চুকিয়ে বউ হয়ে এই বাড়িতে এলাম…… বউ….. আমি বউ….. আমার পাশের দারিয়ে থাকা মানুষটার সহধর্মিণী…… আর চৌকাঠের ওপারে দারিয়ে থাকা মানুষ গুলো আমার বিবাহ সূত্রে পাওয়া নতুন স্বজন…….. প্রতিটা মানুষের সাথে আলাদা আলাদা সম্পর্কে বাধা পড়ে গেছি আজ এই তিন শব্দের কবুল উচ্চারণের সাথে সাথে…… কি অদ্ভুত মানব জীবন…… গতকাল ও ওরা আমার শুধুমাত্র পরিচিত ছাড়া কেউ ছিলো না…… কাধে কোন দায়িত্ব ছিলো না….. নিজেকে অন্যের কাছে ভালো রাখার কোন চেষ্টা ছিলো না…… কারো ঘরের বউ ছিলাম না…… একটাই পরিচয় ছিলো আমি আমার মা-বাবার সন্তান……. কিন্তু আজ সেই সব সম্পর্ক ছাপিয়ে গেলো এই নতুন সম্পর্কের কাছে…… হায়রে মেয়ে মানুষ…… কতো রঙিন জীবন…… ভ্যাগিস মেয়ে হয়ে জন্মালাম…. নইলে তো মেয়েদের রঙের দুনিয়ার আফসোস থেকে যেতো……
,
,
,
বেশ তোড়জোড় করেই আমাকে বরণ করা হলো…… এবং সদর দরজায় ই জানিয়ে দেওয়া হলো আমি যেন যম ঠাকুরের মাকে আম্মু বলে ডাকি…… তার সাথে সাথে ওনার বড় বোন, ভাবি ছোট্ট বাচ্চা টা পর্যন্ত আমায় বলে দিচ্ছেন তাদের আমি কি বলে ডাকবো…… বরণ শেষ করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো……. তাদের পক্ষের খুব একটা আত্নীয় স্বজন ছিলো না…… মেয়ের বাড়ি কাছে হওয়ায় বেশির ভাগ ই বিয়ে এটেন্ড করে চলে গেছেন….. বাকি যারা আছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই যম ঠাকুরের বন্ধু বান্ধব আর কলিগ…. কলিগ বলতে সবই হচ্ছে কলেজের স্যার….. ওনি তো আর নতুন চাকরি তে এখনো জয়েন করেনি….. বাদবাকি সবাই মুরুব্বি গোছের……
,
,
,
বরণের পালা চুকিয়ে আম্মু আর বড় আপু আমাকে তাদের ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালেন…… আমাকে প্রায় মাঝখানে বসিয়ে তারা সবাই খোশ গল্পে মেতে উঠলো…… অনেকেই পরিচিত হচ্ছেন….. হাতে উপহার দিচ্ছেন…… যম ঠাকুরের কলিগ মানে যাদের আমি এতো দিন স্যার বলে ডেকে এসেছি তারা আমাকে একেকজন ভাবি বলে ডাকছেন আর হাসছেন….. এদিকে লজ্জায় আমি পারিনা মাটির ভেতর ঢুকে যাই……একজন স্যার তো বলেই দিলেন এখন আর তুলিকে কিছু বলা যাবে না….. আফটার অল সাদাফ স্যারের বউ বলে কথা…… কেন যেনো এই কথাটা বার বার মাথায় খেলছিলো….. সাদাফ স্যারের বউ….. আম্মু আর মেঝভাবি আমাকে আর সেখানে বেশি সময় রাখলেন না…..
,
,
,
তবে সেদিন সন্ধ্যায় আমি যেই সাদাফ নামের মানুষ টা কে দেখেছিলাম সে আমার এতো দিনের দেখা মানুষ টা থেকে ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা…… এতো হাস্যোজ্জ্বল….. প্রাণোচ্ছল আমি আগে কখনো ওনাকে দেখি নি….. ওনার বন্ধুরা যখন আমার সাথে আড্ডা দেবার জন্য ভেতর রুমে এলেন তখন মেঝো ভাবি গিয়ে যম ঠাকুরকে ডেকে আনলেন…… ওনাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন নাও ভাই তোমার বউ পাহাড়া দাও আমার একটু কাজ আছে আম্মা ডাকছে….. বলেই ভাবি চলে গেলেন….. এতো গুলো ছেলে মানুষের মাঝে বেশ আনইজি ফিল করছিলাম…… ওনি আমার পাশে এসে বসতে নিলেই ওনার এক বন্ধু ওনাকে টেনে উঠিয়ে দিলেন…..
,
,
,
———- এই তুই সর তো….. এতো দিন তো আশে পাশে বসেই পড়িয়েছিস…… বাকি জীবন ও বসবি….. এখন সর….. আমরা একটু বসি…..
,
,
——— বললেই হলো…… পাশের জায়গা আমি ছাড়ছি না….. এতোদিনের কোলে পিঠে করে মানুষ করা বউ আমার….. তোরা বললি আর আমি জায়গা ছেড়ে দিলাম….এতোই যখন পাশে বসার শখ তাহলে বিয়ে করে নিজের বউয়ের পাশে গিয়ে বস….. আমার বউয়ের পাশে কি যা ভাগ…… সোফায় বসতে বসতে….
,
,
——— কম দুঃখে কি ভাবির পাশে বসতে বলছি….. ভাবির তো একটাও বোন নাই….
,
,
——— আমার শ্বশুর _শ্বাশুড়ি অনেক স্মার্ট বুঝলি….. অনেক সচেতন…… এক কাজ কর তুলির ফোপাত বোন আছে একটা ক্লাস ফাইবে পড়ে….. ছোট মানুষ নিজের মতন গড়ে পিঠে নিবি…
,
,
——— এখন আব্বা শুনার বয়স ভাই….. গড়ে পিঠে নেবার দিন শেষ……. তোর কপাল ভালো তুই ভাবিরে পাইছিস….. তবে ভাবি আপনার মা_ বাবা কিন্তু আমাদের সাথে অনেক বড় নাইনসাফি করেছে……
,
,
,
ওনাদের এক একটা কথা শুনে আমি শুধু বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছি….. মেঝ ভাবি, বড় আপু এখনো কেনো এদিকে আসছেন না….. এদিকে সবাই এমন সব কথা বলছে যে খুব লজ্জা পাচ্ছি…… যম ঠাকুর তো দিব্যি আয়েশ করে বসেছে….. আমার পেছনের ব্যাক কুশনের উপর হাত মেলিয়ে…… কি হাসি তার মুখে….. অথচ এতো দিন….. হাতে গুনে গুনে হিসেব করে হাসতেন…… কি গম্ভীর তার ভাবমূর্তি….. অথচ এই মানুষ টা যে এতো রসিক আজ না দেখলে জানতাম ই না।।অবশেষে বড় আপু এসে আমাকে নিয়ে গেলেন…….
,
,
,
হাতের কব্জিতে বেশ ব্যাথা করছে….. তখন সাজানোর সময় গয়না গুলো পড়াতে গিয়ে ক্যানেলাতে লেগেছিল……. পরে অবশ্য ক্যানেলা খুলেই গয়না পড়িয়ে দিয়েছিলো……. আম্মু নিজে বসে থেকে আমি ফ্রেশ হয়ে আসার পর মাছ ভাজি দিয়ে সাদা ভাত খাইয়ে দিয়েছেন……. মেডিসিন গুলো এখনো নেওয়া হয় নি….. কোন ব্যাগে ভরে দিয়েছে খুজে পাচ্ছি না….. তবে খাবার পেটে পড়ার পর পর ই গা গুলাচ্ছে….. পাতলা পায়খানা বন্ধ হয়ে এখন আবার এই উপদ্রব শুরু হয়েছে….. উফফফ আর ভাল্লাগে না……. এখানে এখন বমি করে ভাসালে কি একটা অবস্থা হবে….. ধুর….
,
,
,
খাওয়ার পর মেঝো ভাবি আমাকে আম্মুর রুমেই রেডি করিয়ে দিলেন…… লাল টকটকে একটা সুতি টাঙ্গাইল শাড়ি…… কানে ছোট্ট দুল আর হাতে বিদেশি দুটো চুড়ি…… এগুলো পাঠিয়েছেন ওনার বড় ভাই মানে আমার বড় ভাসুর……. দুল গুলো দিয়েছেন মেঝো ভাবি আর বড় আপু দিয়েছেন একটা সিম্পল হাফ নেকলেস……. চুল বাধার সময় বড়ো আপু জিজ্ঞেস করলেন….. তুলি চুল খোপা করে দিবো নাকি বেণি!!!! আমি চুল বেধে ঘুমাতে পারি না বলেই বলে দিলাম খোপা করে দিতে পরে নাহয় খোপা খুলে বালিশে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমানো যাবে……আপু বেশ সুন্দর করে খোপা করে দিয়ে তাতে ফুল গুজে দিলেন……
,
,
,
১৬
,
,
,
আমাকে রাত দশটার দিকে যম ঠাকুরের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো……… খাটে বসিয়ে দিয়েই দরজা ভেজিয়ে আপু আর ভাবি চলে গেলেন……. বাইরে থেকে বেশ হাসাহাসি শুনা যাচ্ছে……সবাই এক সাথে দল পাকিয়ে হাসছেন যেনো বড়সড় কোন জয়ের ঘোষণা দিচ্ছে টেলিভিশনে…… বেশ হাসতে হাসতেই ওনি রুমে ঢুকে দরজা লক করলেন………. আমি ততক্ষণে ঝিমুচ্ছি গালে হাত দিয়ে মাথায় ঘুমটা টেনে…… দরজা লকের আওয়াজ শুনে ঝিমনি কেটে গেলো……. ঘোমটার আড়াল থেকেই দেখলাম ওনি হাত ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখছেন আর টেবিলে রাখার পানির গ্লাসেএ উপর থেকে ঢাকনা ফেলে ঢকঢক আওয়াজ করেই পানি টা শেষ করলেন……. আমি বিছানা থেকে নেমে ওনার সামনে গিয়ে দারালাম….. আমাকে ওনার কাছে আসতে দেখে আমার দিকে ফিরে দারালেন…… আমি ও আর সময় নষ্ট না করে ঝটপট সালাম করে নিলাম…….. চারদিন ধরে মুরুব্বীরা আমার মাথা ঠুকে ঠুকে এই কিথা বলে দিয়েছেন……
,
,
,
——— কি ব্যাপার সালাম তো করেছই….. ওখানে বসে আছো কেন!!! পা টিপে দেবে নাকি বলেই হাসতে লাগলেন…..
,
,
,
আমি আর কাল বিলম্ব না করে উঠে দারালাম…… ওনারা তো বলে দিয়েছিলেন সালাম করে বসে থাকতে বর নাকি ধরে ওঠাবে কিন্তু যম ঠাকুর তো কিছুই করলো না…….. আমার এতো ভাবনা চিন্তার মাঝখানেই ওনি ঘুমটা তুলে দিলেন…….
ওনার দিকে তাকাতেই আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন ওয়াশরুম টা কিন্তু রুমের অইপাশে…… কথাটা শুনেই আমি মুখ কালো করে মাথা নিচু করে রাখলাম…..

চলবে…..

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৭

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৭
লেখনিতে: চৈত্র রায়

১৩
,
,
,
বাথরুমে আসা যাওয়ার পরিমান বেশ কিছুটা কমে এসেছে…… সকালের দিকে স্যালাইন শেষ করিয়ে মা আর সাদাফ ভায়ের মা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন ডাক্তার এর কাছে…… ওনি বিয়ের কাপড় দিয়ে আর যান নি….. শুনেছে মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন আমাকে তাই তিনিও রয়ে গেছেন সাথে যাবে বলে……. এদিকে আমার অবস্থা কাহিল….. এ বলছে এটা কর…. এটা খা…. সেটা খা….. কিরে পেটের কি অবস্থা!!! আজকে কয়বার গেলিরে!!! ছাদে উঠতে পারবি নাকি একটা পট কিনে আনবো বাজার থেকে!!!! যাকে বলে একধরনের অসুস্থ মশকরা….. ছোট বড় যে যেভাবে পারছে করে যাচ্ছেন…… একটা সুতি থ্রিপিস পড়ে রেডি হয়ে নিলাম…..বাবা গেটের কাছেই সিএনজি নিয়ে এলেন…… মা আর আমার হবু শাশুড়ী প্রায় ধরে ধরেই সিএনজি পর্যন্ত নিয়ে এলেন…… এ দেখে আবার নতুন মশকরা তে মেতে উঠলো সবাই….. আহারে কনে আমাদের হাগতে হাগতে দূর্বল হয়ে গেছে….. আচ্ছা যা তোকে বিয়েতে এক কার্টুন স্যালাইন ই দিবো উপহার হিসেবে…… ছি ছি এই দিন ও আমার দেখার ছিলো!!! অন্য সবাই ঠিক আছে কিন্তু সাদাফ ভায়ের মায়ের সামনে ও এগুলা বলতে ওরা ছাড়লো না…… আর যাই হোক সম্পর্কে তো শ্বাশুড়ি নাকি!!! লজ্জাই পারি না দৌড়ে পালাই…..ওরা আমাকে কোনদিকেই ছাড়লো না……ওদের মশকরা তে পাত্তা না দিয়ে চলে আসতে নিলেও শুরু করে…. কিরে তুলি কই যাস!!! আবার পাইছে নাকি!!! কিরে এবার গেলে কইবার হবেরে!!! হাফ সেঞ্চুরি হইছে নাকি!!! এই তাইলে কিন্তু সেলিব্রেশন হবে আর সব খরচ দিবে ওর জামাই কি বলো সবাই!!! ভাবা যায় এগুলা….. আহত চাতক পাখির মতন আমি তাদের হাসি দেখি আর ভাবি যদি সত্যি সত্যি টাকা চেয়ে বসে!!!আচ্ছা সাদাফ ভায়ের কাছে গিয়ে কি বলবে!!! সাদাফ ভাই তুলি হেগে সেঞ্চুরি করেছে টাকা দিন আমারা সেলিব্রেশ করবো…… সাদাফ ভাই কি টাকা দিবেন!! ছি ছি কি সব ভাবছি এগুলো!!! মগজ ঘিলু সব মনে হয় হাগতে হাগতে টয়লেছে ফেলে এসেছি…… সব দোষ ওদের…… সময় আমারও আসবে…. হুঅঅঅঅ
,
,
,
সিএনজিতে উঠে বসার পরই খেয়াল করলাম কোত্থেকে যেন সাদাফ ভাই হাওয়ায় মতো উড়ে এসে সামনে ড্রাইভার এর সাথে বসে পড়লেন…… আমার অবস্থা তখন হায় হায়!! ওনিও কি সাথে যাবেন নাকি!! রাস্তা ঘাটের যা একটা অবস্থা আমার যদি রাস্তাতেই বাথরুম পায়!! তাহলে কিভাবে কি করবো….. এমনিতেই অস্বস্তিতে ছিলাম ওনার মা যাবেন বলে….. বাড়ি থেকে বের হবার আগেও কতো বার করে বললেন টুকি চিন্তা করিস না…. ঠিক হয়ে যাবি…. সিএনজিতে উঠার আগেতো বলছিলেন টুকি মা লজ্জা পাস না বাথরুম পেলে কিন্তু বলিস……ওফফফফফ ভাল্লাগে আর….. এর উপর মরার উপর খারার ঘায়ের মতো ওনি এসে জুটলেন…… দুজনের মাঝখানে বসিয়ে দিলেন আমাকে…… ডাক্তারের কাছে যাবার পর সিরিয়ালে বসে আছি…… সাদাফ ভাই কার সাথে দারিয়ে যেনো করিডরে কথা বলছেন…… জিন্সের সাথে হালকা বেগুনি রঙের একটা স্টাইপের গেঞ্জি পড়েছেন….. পায়ে কালো বেল্টের চটিজুতা….. এক কাত হয়ে দাড়িয়েছেন….. বা হাতটা বুকের সাথে ঠেকিয়ে তার উপর ডান হাতের কনুই রেখে থুতনিতে এক এক করে বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে চেপে যাচ্ছেন……. মাঝে মাঝে হাসছেন আবার মাঝে মাঝে গম্ভীর মুখে কথা বলছেন…… ওনার গতিবিধি দেখতে দেখতেই সময় পার করছিলাম যাকে বলে……. এর মধ্যেই আমাদের ডাক এলো…… ভেতরে ঢুকার সময় দোয়া দারুদ পড়েই ঢুকলাম….. যেনো সাদাফ ভাই না ঢুকেন…… আল্লাহ আমার কথা শুনলেন….. সাদাফ ভাই আমার সাথে ঢুকলেন না….. এদিকে ডাক্তার আমার মান সম্মান এর পোস্ট মর্টেম করতে এক এক করে প্রশ্ন করেই চলেছে…… আমার ইতস্তত হয়ে যাওয়া দেখে বারবার বলছেন যেনো কোন কিছু না লুকাই…… এদিকে আমার কথা শুনে ওনি বললেন যে মেডিসিন লিখে দিচ্ছি তবে ওনি বেশ দূর্বল পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে….. স্যালাইন দিতে হবে আরও তিনটের মতন…… মেডিসিন নেবার পর ও যদি অবস্থার পরিবর্তন না হয় তাহলে হসপিটালে এডমিট করাতে হবে….. আর ঘুম যেনো পরিপূর্ণ হয়……..
,
,
,
ডাক্তারের কথা গুলো শুনে মা বেশ বিরক্ত আমার উপর…….. সাদাফ ভাই মায়ের হাত থেকে প্রেসক্রিপশন টা নিয়ে আবার ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলেন……. মা আমাকে রেগেমেগে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন সত্যি করে বলতো তুলি রাস্থা থেকে কোন গু গোবর খেয়েছিস!!!! আমি কাদোকাদো হয়েই বললাম যে পরীক্ষা দেবার পর কি আমি বাইরে বেরিয়েছি নাকি!!! তাহলে কোত্থেকে কি আবার খাবো…….. বাকিটা সাদাফ ভায়ের মা সামলে নিলেন….. নয়তো মা আমাকে ধোলাই টা আজ ভালো মতোই দিতো……প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর সাদাফ ভাই বেরিয়ে এলেন…… ততক্ষণ আমি দাড়িয়ে না থাকতে পেরে ওখানে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়লাম….. কি করবো বেশি সময় দারিয়ে থাকতে পারি না….. হাত পা যেনো ছিড়ে পড়বে এমন অবস্থা…….. এতো ক্লান্ত লাগে বলার বাইরে….. মা আর শ্বাশুড়ি আমার সামনেই দারিয়ে ছিলো……. সাদাফ ভাই বেরোনো মাত্রই তারা জিজ্ঞেস করতে লাগলো ডাক্তার কি বলেছেন…… সাদাফ ভাই আমার দিকে একবার তাকালেন….. আমি ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলেই চোখাচোখি হয়ে গেলো…….. একেবারে নির্লিপ্ত চাহনি যাকে বলে…… আমার থেকে নজর সরিয়ে ওনাদের আসস্ত করে বললেন যে দূর্বলতা টা বেশি……. যা মেডিসিন দিয়েছে আশা করা যাচ্ছে কাজ হবে…..
,
,
,
মায়েদের সাথে কথা বলে মেডিসিন কিনতে যাচ্ছেন বলে আমাদের সেখানে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলেন…….. ওখানে বসেই আমার বেশ ঝিমুনি চলে এলো…….. এর মধ্যেই মা আর সাদাফ ভায়ের মা ধুত্তুরি শাশুড়ী মিলে কথা বলছেন……. ওনাদের কথায় আমার জন্য চিন্তা স্পষ্ট………. মা ততক্ষণে ওনাকে বলে দিয়েছেন সাদাফ ভায়ের প্রতি আমার কাপাকাপি লেবেলের ভয়ের কথা…… জবাবে সেদিন ওনি মাকে আস্বস্ত করলেন……… এর মধ্যেই সাদাফ ভাই চলে এলেন……. মা আমাকে ডেকে দিলেন…….
,
,
,
সিএনজি তে ওঠার পর সাদাফ ভাই আমার হাতে একটা মাম পানির ঠান্ডা বোতল ধরিয়ে দিয়ে বললেন এতে গ্লুকোজ দেওয়া আছে বাড়ি যেতে যেতে যেনো ফিনিশড হয়ে যায়…….আমার সাথে ওনার কথা হলো প্রায় ছয় দিন পর….. যদিও জবাবে আমি কিছু বলি নি……. চুপচাপ হাতে বোতল নিয়ে বসে ছিলাম…….. ওনি কথাটা বলেই সামনে বসে পড়লেন……… এবার আর আমি মাঝামাঝি বসি নাই….. একপাশে বসেছি….. সাদাফ ভাই ব্যালেন্স করার জন্য তাদের পেছনের গ্রিল্টায় বাহাত গুজে দিলেন…… হাতটা ছিলো একেবারে আমার চোখ বরাবর……. কোন কাজ না পেয়ে একেবারে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলাম……… আমাকে আর মাকে আমাদের গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে ওনারা সেই সিএনজি করেই চলে গেলেন……..
,
,
,
১৪
,
,
,
গায়ে হলুদের শাড়ি পড়াতে পড়াতেই সাদাফ ভাইদের বাড়ি থেকে লোকজন চলে এলেন হলুদ নিয়ে…… ওনার বোন আর মেঝ ভাবি ফুলের গয়না নিয়ে সোজা আমার রোমে চলে এলেন……. তারাও আমায় দেখে একচোট আফসোস করতে লাগলেন…….. আমার তো নিজেরই নিজেকে দেখে আফসোস হচ্ছিলো সেখানে তাদের আফসোস করা বড় কিছু না……
,
,
,
ঘরের সাজ আর তেমন কি!! কিন্তু বিয়ে নিয়ে যতটা ভাবনা ছিলো তার কিছুই হচ্ছে না….. কি করে হবে!! নিজেকে আয়নায় দেখতেই ইচ্ছে করতো না…… হাতের ক্যানেলা বজায় রেখেই তারা একে একে সব গয়না পড়িয়ে দিলেন….. গোলাপ আর গাদা ফুলের গয়নার মাঝে নিজেকে যখন আয়নায় দেখলাম তখন বেশ অচেনা লাগছে…… পাচ মিনিট আগের আমির সাথে এখনকার আমির কোন মিল ই নেই…… মুখের আভাটাই যেনো পালটে গেছে…… সাজের পর যেই দেখছে সেই বলছে বিয়ের ছিড়ি উঠেছে মেয়ের…… মা বাবাকে সালাম করে ছাদে চলে এলাম….. এখানেই হলুদের আয়োজন করা হয়েছে…… একে একে সবাই আসছেন হলুদ দিচ্ছেন…… ছেলের বাড়ির লোকজন ও হলুদ দিয়ে বেশ হই হুল্লোড় করে গেলো…… সেদিন শিমুল ভাই ও এসেছেন তার বউকে নিয়ে….. শাম্মি তো সকালেই চলে এসেছিলো….. শিমুল ভাইকে দেখে কেন যেনো কষ্ট লাগছিল তবে সেটা বড্ড ফিকে…… সাদাফ ভায়ের বোন আর ভাবি যাবার সময় বারবার করে বলে গেলেন আমাকে যেনো এখানে বেশি সময় আটকে না রাখে…… ওনারা আসার সময় নাকি সাদাফ ভায়ের মা পইপই করে বলে দিয়েছেন……
,
,
,
হাতের মেহেদী কিছুটা শুকানোর পরই আমি নিচে চলে আসি…. কেননা শরীর আর কুলাচ্ছিলো না….. বিছানা টা বড্ড টানছে…… মেহেদী দেবার আগে শাড়ি পালটে নিয়েছিলাম তাই হাতের পিঠে পেপার রেখে শুইয়ে পড়েছি…… বেশ কিছুক্ষন আগেই মা আমাকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন দিয়ে গেলো…… তাজ্জব ব্যাপার হলো দুপুরের পর আর বাথরুম পায় নি….. তবে বমি হয়েছে দুবার…… এখনো পাচ্ছে….. তাই নাড়াচাড়া না করে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম…….
,
,
,
ঘুম থেকে উঠে দেখি শাম্মি আর আমার বাকি বন্ধবিরা মিলে খুটিয়ে খুটিয়ে মেহেদী তুলে দিচ্ছে…… এর মধ্যেই নানি এসে মেহেদীর রঙ দেখে দুষ্টুমি করতে লাগলেন….. হাতের রঙ দেখে আমি নিজেই তাজ্জব একেবারে কালচে খয়েরি হয়ে গেছে…… নানির সাথে বাকিরা ও দুষ্টুমি তে তাল মেলাতে শুরু করে দিলেন……এই রঙ নাকি আমার প্রতি বরের ভালোবাসার প্রতিক…… কথা খানা শুনেই কেন যেন আমার বেশ হাসি আসছিলো….. যম ঠাকুর আর ভালোবাসা!!!! হা হা হা……
,
,
,
সকালে নাসতা খাবার পর ও আমাকে স্যালাইন নিতে হয়েছে…… স্যালাইন শেষ হবার পর পরই গোসল করাতে নিয়ে গেলো সবাই…… হাতে একেবারে সময় কম…… সাড়ে দশটা বেজে গেছে স্যালাইন শেষ হতে….. বরযাত্রী নাকি নামাজ শেষ করেই চলে আসবেন…… এদিকে আকাশ গুমোট হয়ে আছেন…… বাবা তো চিন্তায় অস্থির…… খাওয়া দাওয়ার সময় যেনো বৃষ্টি হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা না হয়……
,
,
,
এদিকে আমাকে সবাই মিলে আস্তেধীরে সাজাচ্ছে…… কড়া জাম কালারের একটা জামদানী শাড়ি…… তারউপর একই রঙের সুতোর কাজ…… এতো হালকা….. খুব পছন্দ হয়েছে আমার….. যাকে বলে সাধারনের মাঝে অসাধারণ…… দুটো বাজার আগেই যম ঠাকুরের বরযাত্রী এসে গেলো…… বর এসেছে শুনে সব দৌড়ে গেলে ও আমার বান্ধবীরা আমার কাছ ছাড়া হলো না……. এগুলো মাঝে মাঝে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে আসছে…… এবার বাধলো বিপত্তি…… বর বরণ করার জন্য কোন মেয়ে নাই….. সব ছেলে দারিয়ে আছে ওখানে…… কেননা আমার পরিবারে আমিই একমাত্র মেয়ে এর উপর ফুপিদের মেয়েরাও ছোট প্রাইমারি স্কুলের গন্ডিই এখনো এক্টাও পার করে নি…….. এদিকে ভয়ে আমার বান্ধবী গুলাও বের হচ্ছে না…… আর যাই হোক সাদাফ স্যার!!! একেকটা ওনার নাম বলছে আর কাপছে…… এগুলো তো নাম শুনেই এমন করছে….. অথচ আমি থাক আমি অভাগী নাহয় পোড়াকপালি….. আমার কথা বাদ……. এদিকে বাবা খুব রাগারাগি করছে বরযাত্রী বরনের জন্য গেইটে দারিয়ে আছে কিন্তু কোন মেয়েই সেখানে যাচ্ছে না….. বাবার চিল্লাচিল্লি শুনে ওখানে যাবার ভয়ে একজন দরজার আড়ালে আর দুইটা বাথরুমে ঢুকে পড়লো…… আমার তো বেশ লাগছিলো….. বরণের কি দরকার….. যমঠাকুর চেলাপেলা নিয়ে ফেরত যাক……
,
,
,
অবশেষে শিমুল ভাইয়ের বউ সবগুলো কে টেনে হিচড়ে বের করে বর বরণ করতে নিয়ে গেলেন……. সবার খাওয়া দাওয়া শেষে কাজি নিয়ে আমার রুমে ঢুকলেন…… ওখানেই আমার কলেমা পড়ে কবুল বলিয়ে রেজিস্ট্রিতে সিগনেচার নিলেন…… কেমন যেনো ভোতা ভোতা অনুভূতি……. বিশ্বাস ই হচ্ছে না একটু আগে আমি কবুল বলেছি…. রেজিস্ট্রিতে সাইন করেছি…… কেমন যেনো সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে…… ছেলের সাইন হবার পর সবাই মুনাজাত করে মুখ মিষ্টি করলেন……. এর কিছুক্ষন পরেই ওনার মা,বোন, ভাবি এসে আমার দেনমোহর নগদে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন……. সবার মুখেই ওনার প্রশংসা……. আরও অবাক হলাম তখন যখন শুনলাম বিয়ের জন্য একটি টাকাও তিনি বাবাকে খরচ করতে দেন নি……..
,
,
,
যাবার কিছু ক্ষন আগে আমাকে যম ঠাকুরের পাশে নিয়ে বসানো হলো……. মা – বাবা এসে আমাদের চার হাত এক করে দিয়ে কাদতে শুরু করলেন……. এদিকে আমি যেনো শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম ভেতরে ভেতরে……. বাবা আমায় জড়িয়ে ধরলেন….. পেছন থেকে মা ও আমার পিঠে মাথা রেখে কাদতে শুরু করলেন……. বাবাকে বার বার বলছিলাম ও বাবা আমি যাবো না….. বাবা তুমি ওনাদের বুঝিয়ে বলো না….. বাবা-মা, মামা- খালা সবাই বেশ বুঝিয়ে চোখ জল মুছিয়ে আমায় গাড়িতে তুলে দিলেন………
,
,
,
বাবা দেশে আসার পর ওনার মা আমাদের স্বপরিবারে খাবারের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন কিন্তু আমি আসি নি….. তাল বাহানা করে নাকচ করেছিলাম…… অথচ আজ এই বাড়ির দোয়ারে দারিয়ে আছি বউ হয়ে……. আসলে ভাগ্য ব্যাপারটাই অদ্ভুত………
,
,
,
চলবে…..

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৬

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৬
লেখনিতে: চৈত্র রায়

১১
,
,
,
বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে মুরুব্বি রা সবাই দোয়া দারুদ পড়ে আর দেরি করলেন না….. আকাশে মেঘ করেছে….. যেকোনো মূহুর্তে বৃষ্টি নেমে পরবে…… শিমুল ভাই তার বিদেশ থেকে আনা ক্যামেরা দিয়ে আমার আর সাদাফ ভাইয়ের বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন….. দুজনই সোফায় বসা…… লজ্জায়….. অভিমানে মাথাই তুলতে পারছিলাম না….. যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি জেগে জেগে সেই আজ আমার সামনে বসে আছে অন্য জনের সাথে স্মৃতি গড়ে দিতে….. অথচ এই পাশে বসা মানুষটাই আমার কাছে অবাঞ্চিত…. তাকে আমি চাই নি….. ঘুনাক্ষরে ও না….. চোখ ফেটে কান্না চলে এলো যখন শিমুল ভাই বললেন তুলা এদিকে একটু হাসি হাসি করে তাকা….. ভাইয়া ইফ ইয়ো ডোন্ট মাইণ্ড মাঝখানের গ্যাপ টা ছবিতে ভালো লাগছে না…. সাদাফ ভাই আমার গা ঘেষে বসলেন না তবে মাঝখানের দূরত্ব টা বেশ কমিয়ে সুন্দর করে বসলেন…… শিমুল ভাই আবার বললেন তুলা তোর মুখ টাই দেখা যাচ্ছে তাকা জলদি আমার হাটু ব্যাথা করছে এইভাবে বসে থাকতে থাকতে …… তখন আমার কি হলো জানি না।।।।। দু হাতে মুখ চেপে হু হু করে কেদে উঠলাম…..
,
,
,
মুরুব্বি রা সবাই আশেপাশেই ছিলেন….. কান্না শুনে সবাই এদিকে চলে এলেন…… বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন….. কিন্তু আমার কান্না থামার নামই নেই…… আমি বাবাকে না ধরে তখনও কেদে যাচ্ছি….. খুব অভিমান হচ্ছিলো তখন সবার উপর…… কাউকেই সহ্য হচ্ছিলো না আমার…… শিমুল ভাই কে আমি অবিশ্বাস্য ভাবে সহ্য করতে পারছিলাম না তখন …… কেনো ওনি আমার ছবি তুলবেন সাদাফ ভায়ের সাথে….. ওনাকে কি আমি আমার মাথার দিব্যি দিয়েছি যে ওনি যা বলবে আমাকে তাই করতে হবে!!! ওনি কেন এলেন আমাদের বাসায়….. এই লোকটা কেনো এলো….. ওনি আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছে…. আমার মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে…… ওনি এখনো কেন যাচ্ছে না….. কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দ ও বের হলো না…… ততক্ষণে হেচকি উঠে গিয়েছে আমার….. বাবা কোন ভাবেই আমাকে শান্ত করতে পারছেন না….. মা এলেন সাথে সুফিয়া খালাকে নিয়ে….. আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন……. যাওয়ার আগে সাদাফ ভায়ের মা আর বোন এলেন….. আমাকে বেশ বোঝালেন…… ভয় পেতে বারন করলেন….. মেয়ে যখন হয়েছি তখন বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতেই হবে….. আমি চুপ ছিলাম সেদিন….. অনেকক্ষণ কান্না করার কারনে মাঝেমধ্যে ফুপিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলাম কিন্তু চোখে কোন জল ছিলো না…..
,
,
,
রাতে মা বাবা দুজনেই আমার রুমে এলেন…… রাগটা তখন ধরে রাখতে পারি নি আর….. জুড়ে দিলাম চিল্লাচিল্লি…… একপর্যায়ে বলেই দিলাম আমার মতামত না নিয়ে কেন তারা বিয়ে ঠিক করলেন…… মা বেশ বিরক্ত নিয়ে জানতে চাইলেন আমি কেন এই বিয়েতে রাজি না তার যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শাতে….. আমিও বলে দিলাম…. সাদাফ ভাইকে আমি কখনো সেই ভাবে দেখি নি….. জবাবে মা বললেন সাদাফ তুমাকে পড়াতেন তাকে তুমি অন্য চোখে কেন দেখতে যাবে….. তাছাড়া সাদাফ ছেলে হিসেবে ভালো তাই তুমার বাবা আর আমি তোমার জন্য তাকে ঠিক করেছি……এখানে তোমার ভাবা ভাবির কি আছে তাই তো বুঝতে পারছি না….. অন্য কোন কথা থাকলে বলো….. আমি না দমে আবার বললাম সাদাফ ভাই অত্যন্ত রাগি….. ওনাকে আমার ভয় করে….. পড়ানোর এক ঘন্টাই আমার কাছে দুযোখের মতোন লাগে….. সেখানে সারা জীবন আমি কিভাবে থাকবো!!!! মা মুচকি হেসে উঠলেন…… আমার কাছে এসে আমার হাতটা তার কোলের উপর রেখে বললেন তোমার বাবার রাগ সম্পর্কে আশা রাখি তোমার ধারনা আছে…. কি আছে না!! আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম….. আমাকে দেখে কী মনে হয় আমি তোমার বাবার সাথে অসুখি!!! আমি এবার মাথা নাড়ালাম ডানে বামে হেলিয়ে…… মা আবার ও বললেন সাদাফ কে তুমি একজন শিক্ষক হিসেবেই জানো…. এর বাইরে গিয়ে সে তোমার সাথে মিশে নাই বলেই তুমি এতো ভয় পাচ্ছো…..এবার বাবা ও আমার পাশে বসলেন…. আমার মাথাটা তার বুকে নিয়ে বললেন তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান তুলি….. তোমার জন্য বিন্দু পরিমান খারাপ টা ও আমরা মেনে নিতে পারবো না…… আশা করি এই ভরশা টা তুমি আমাদের উপর রাখো…..
,
,
,
আর কিছু বলতে পারলাম না সেদিন…… বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুধু এই টুকুই বললাম আমাকে এতো দ্রুত পর করে দিচ্ছো কেন তুমরা!!! আমাকে ছাড়া একা থাকতে পারবে তো…. আর বলতে পারলাম না….. হাউ মাউ করে বাবাকে ধরেই কান্না জুড়ে দিলাম…… বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন……. বাবার চোখের জল টা আমি সেদিন দেখতে পাই নি….. তবে মাকে দেখেছি আমার হাত খানা নিজের দু হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে কাদছেন…… এই কান্না টা আমার জন্য….. আমার প্রতি তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ…… নিজের জন্য অন্যের চোখে জল ঝড়তে দেখার মধ্যে নাকি আলাদা একটা প্রশান্তি আছে কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট…….. ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে…….. বারবার মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে গেলেই আমি তাদের থেকে দূরে চলে যাবো……. এই মানুষ গুলো পর হয়ে যাবে…….মা-বাবা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে গেলেন…….. রাতে খুব বৃষ্টি হলো……. সারারাত ই সিলিং এরদিকে তাকিয়ে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ টা শুনেছি…….
,
,
,
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে খবর টা পাড়া পড়সি জানাজানির সাথে সাথে আরও একটা বিষয় সবাই যেনে গেলো……. সেটা হচ্ছে লোকমুখে রচিত আমার আর সাদাফ ভায়ের প্রেমের কাহিনি……. এবং এই কাহিনি রচনাতে তারা একাধারে সংযোজক,প্রযোজক এবং সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছে বিনা বেতনে……. তাদের ভাষ্যমতে সাদাফ ভায়ের সাথে পড়ানোর সূত্র থেকেই নাকি আমাদের প্রেম….কতো কত মানুষ আমাদের এক সাথে ঘুরে বেড়াতেও দেখেছেন…… এখন হয়তো কোন কেলেংকারী হয়েছে তাই মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে মাস্টারের সাথে…….
,
,
,
আমাদের অবাক করে দিয়ে চাচা-চাচিকে ও দেখলাম সেই কথায় তাল মেলাতে….. কথা ছিলো ওনাদের ছেলের সাথে বিয়ে দেবার কিন্তু তা না করে এমন তাড়াহুড়ো করে মাস্টারের সাথে বিয়ে দেবার তো নিশ্চয়ই কোন বড়সড় কারণ আছে…… আমি এসব শুনে শুধু হেসেছিলাম…… তাদের সন্দেহ তো যুক্তিসঙ্গতই…… সাদাফ ভাইয়ের সাথে আমি কতবারই বাইরে গিয়েছি তবে সেটা আমার প্রয়োজনে আর সাদাফ ভাই গিয়েছেন তার দায়িত্ব থেকে…….বাবা সেদিন সাদাফ ভাইদের আবার ডাকালেন এবং তাদের সব খুলে বললেন কারণ তিনি চান না পরে এই সব কথার জের টেনে তার মেয়ে কষ্ট পায়…..
,
,
,
১২
,
,
,
আংটি পরিয়ে যাবার দুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছে আমার ভয়াবহ রকমের পেট খারাপ……. দিনে রাতে কতো বার বাথরুমে ছুটছি তার কোন হিসেব নেই…. বলতে গেলে বাথরুম দৌড়াতে দৌড়াতে আমার উর্ধশ্বাস প্রায়…… প্রথম দিন বাসায় আর কিছু জানালাম না….. ভাবলাম ঠিক হয়ে যাবে….. কিন্তু না ঠিক তো দূরে থাক যাওয়া আসার পরিমাণ আরও বেরে গেলো…… সেদিন সাদাফ ভাইয়ের মা ফোন করে জানালেন আমাকে নিয়ে নাকি শপিংয়ে বের হবেন……. কিন্তু আমি আমার ঘড় থেকে মেইন দরজা পর্যন্তই যাবার সাহস পাচ্ছি না…… একটু হাটাহাটি করলেই বাথরুম ধরে যায়….. উপায় না পেয়ে মাকে খুলে বললাম…….. আমি অসুস্থ শুনে তারা কাল যাবে বলে জানালেন……. মা ও আশায় ছিলেন আমি সুস্থ হয়ে যাবো কালকের আগেই….. কিন্তু মরার পেট খারাপ আর আমায় ছাড়লো না….. ডাক্তার দেখিয়ে ও কোন কাজ হচ্ছে না……… কারণ পাকস্থলী গরম হয়ে হজমে সমস্যা হচ্ছিলো…….. উপায়ন্তর না দেখে মা তাদের সব খুলে বললেন…….. মান সম্মান ধূলিসাৎ……..
,
,
,
আমাকে ছাড়াই শপিং করে সব জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন…… গয়না টা জুয়েলার্স থেকে এখনো দেয় নি বলে তারা আবার গয়না পড়ে নিয়ে আসবেন……. এদিকে আমার পাতলা পায়খানা থামার নাম নেই….. পানি শূন্যতা দেখা দিয়েছে তার সাথে দূর্বলতা তো আছেই……. ডাক্তার দেখে স্যালাইন প্রেসক্রাইব করে গেলেন চারটে…… একজন কম্পাউন্ডার এসে বাসাই আমার হাতে ক্যানেলা ফিট করে দিয়ে স্যালাইন চালু করে দিয়ে গেছেন…..
,
,
,
এদিকে বাসায় আত্নীয় স্বজন আসা শুরু করে দিয়েছে…… যে আমাকে দেখছেন সেই আফসোস করছে…. আর মায়ের তিনবেলা খাবার খাওয়ানোর সময় কান্নাকাটি তো আছেই…….. খাওয়া দাওয়া ওর স্যালাইন চিড়া,কলা আর ডাল বাদে কিছুই না….. চোখের নিচে কালি পড়ে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছি যাকে বলে……. শাম্মি তো এসেই বলতে শুরু করেছে কিরে বিয়ের কনে বিয়ের টেনশনে হাগতে হাগতে তো দেখি সিরিয়ার অভুক্ত প্রানীতে পরিণত হয়েছিস…… শাম্মির কথা পাত্তা না দিয়ে সেদিন কাচুমাচু করতে করতে বাথরুমে ঢুকেছিলাম……… এর মধ্যেই স্যালাইন রত অবস্থায় আমার হবু শ্বাশুড়ি এসে আমাকে দেখে গয়না দিয়ে গেলেন….
,
,
,
বিয়েবাড়িতে সবাই মজার মজার খাবার খায় আর আমি চিড়া কলা খাই সাথে স্যালাইন….. গায়ে হলুদের দিন সকালেও কম্পাউন্ডার এসে স্যালান অন করে গেছে……. আমার সূচনীয় অবস্থা দেখে সাদাফ ভায়ের মা ধুর শ্বাশুড়ি সকালে এসে নতুন করে শপিং করে দিয়ে গেলেন…… আর বলে গেলেন বিয়ে গায়ে হলুদে যেনো এখান থেকেই শাড়ি পড়ি….মনে মনে একটা বড় হাফ ছাড়লাম….. ওসব ভাড়ি কিছু পড়তে হবে না বলে…….
,
,
,
গায়ে হলুদের দিন সকালের পর থেকে আমার অবস্থা কিছুটা ভালো কিন্তু তারপরও মা কোন রিক্স নিলেন না….. নিজে দারিয়ে থেকে ডাবের পানি নাহয় স্যালাইন খাইয়ে যাচ্ছেন…….. আর ঘর ভর্তি মেহমানের সামনেই জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন আবার বাথরুমে গিয়েছি কি না…… গেলে কয়বার!!! পায়খানা কেমন হয়ে ছে….. আমি যঅতই মাকে আস্তে কথা বলতে বলি ততই মা ক্ষেপে যায়।।।।। গায়ে রোগ নিয়ে ভদ্রতা নাকি তার ধাতে নেই…… আমি চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাই আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি

,
,
,
চলবে…….

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৫

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৫
লেখনিতে: চৈত্র রায়

০৯
,
,
,
সাদাফ ভায়ের মা আসার তিন দিন পর সাদাফ ভাই পড়াতে এলেন……..ওনিও সাথে করে মিষ্টি আনলেন…… তার নতুন চাকরির কথা আবার নতুন করে আমাদের জানালেন….. তার এই কাজ থেকে আমরা বেশ বুঝতে পারলাম সাদাফ ভাই তার মায়ের করা কোন কাজ সম্পর্কেই জানেন না……..বাবা সেদিন আলাপ চারিতার ফাকে বুদ্ধি করে তাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নিলেন…….আমার পরিক্ষা চলার কারণে সাদাফ ভাই বলে গেলেন এখন থেকে রোজ আসবে….. মা নতুন চাকরির কথা জানতে চাইলে জানালেন যে ওটার জয়েনিং আরো দুইমাস পর….. শান্তি নাই….. শান্তি কোন কিছুতেই নাই….. আগে পরাতেন সপ্তাহে পাঁচদিন যাও এই কয়দিনের ছুটিতে বেশ আরামে ছিলাম এখন তো মনে হচ্ছে ছাই চাপা দিয়ে ধরবে….. জয়েনিং টা দুই মাস পর কেন দিলা আল্লাহ….. কেন কেন কেন!!!! এতো দু:সংবাদের মধ্যে যখন হঠাৎ করে মনে পড়লো সাদাফ ভায়ের সাথে বিয়ে কথাটা তখন যেনো বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো……. তাও আশার কথা হচ্ছে বাবা খোজ খবর নিবেন…… আল্লাহ ভরসা….. কিছু একটা হয়ে ব্যাপার টা বাদ হয়ে যাক…… সেদিন রাতে বাবা মায়ের সাথে কথা বলে ঠিক করলেন সকালেই তিনি সাদাফ ভাইদের গ্রামে যাবেন পরিচয় গোপন করে……
,
,
,
বাবা যথারীতি তার কথা অনুসারে খুব সকালে বেরিয়ে গেলেন…… কি হচ্ছে এসব!!!! দিব্যি তো ছিলো সবকিছু…… আমি তো আমার কষ্ট নিয়ে বেশ ছিলাম…… না আর ভালো লাগছে না কোন কিছু….. এদিকে সাদাফ ভাই ও রোজ আসছেন পড়াতে….. পড়ার অমনোযোগীতার জন্য রোজ ধমক খাচ্ছি…… কি করবো….!!! আমার সব কিছুতেই অশান্তি লাগছে….. ইচ্ছে করছে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে কোন একদিকে চলে যাই…..৷ এখনি বিয়ে দেবার কি হলো আমাকে সেটাই ভেবে পাই না…… এই নিয়ে মায়ের সাথে খুব কথা কাটাকাটি হলো…… মাকে দেখলাম ডায়নিং টেবিলে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাদছে….. কাদুক….. দুনিয়ায় আর ছেলে পেলো না….. সাদাফ ভাই ই জুটলো তাদের কাছে!!! আর আমারও যা কপাল!! সুখ আছে নাকি কপাল ফাটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে…… বাবা ফিরে এলেন তিনদিনের মাথায়….. হাত- পা ব্যাথা আর জ্বর নিয়ে….. তিনি খোঁজ নেবার কোন কমতি রাখেন নি….. এমন খোঁজ ই নিয়েছেন যে একেবারে জ্বর বাধিয়ে এসেছেন……. মা বাবাকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন আবহাওয়ার জন্য নাকি এমন হয়েছে তারউপর পুকুরে গোছল করেছেন……
,
,
,
রাতে ড্রয়িং রুমে বসেই মা- বাবা কথা বলা শুরু করলো….. রূপসী শীতলক্ষ্যা নদীর থেকে এক কিলোমিটার দূরে সাদাফ ভাইদের বাড়ি…… বাড়ি থেকে বাজার দশ মিনিটের রাস্থা…… সাদাফ ভায়ের বাবা ছিলেন সেখানকার হাই স্কুলের হেডমাস্টার আর তার সাথে সাথে বাজারে তাদের নিজস্ব ভিটায় ছিলো মুদির দোকান……. এখন সেখানে মার্কেট করে দেওয়া হয়েছে।।।।।। এক সারিতেই নাকি ২০ টা দোকান….. সবই সাদাফ ভাইদের……. সাদাফ ভাইদের বাড়ির কথা বলার সময় বাবার চেহারার ঝলক টাই অন্যরকম ছিলো…… আটানব্বই ডিসিমের পুরো রাড়িটা একেবারে দেখলে মনে হয় যেনো পুরানো দিনের রাজপ্রাসাদ…… অই বাড়ির ছাদে দারিয়ে নাকি শীতলক্ষ্যা নদী স্পষ্ট দেখা যায়….. বাড়ির পেছনের দিকে বাধানো পুকুর…… দুপাশে ফসলি জমি…. যা ইজারা দেওয়া আছে…….. বাড়ির মূল ফটকে বাগান…… দুজন ভাড়াটিয়া দেওয়া হয়েছে বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য….. তবে সাদাফ ভায়ের মা হচ্ছে ওনার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী…… ওনার প্রথম স্ত্রী মারা যান ছোট ছেলেকে জন্ম দিতে গিয়ে…. তারপর থেকেই সাদাফ ভায়ের মা সেই পরিবার সামলে আসছেন……. সাদাফ ভায়ের দশমাস বয়সেই সাদাফ ভায়ের বাবা মারা যান….. তখন থেকেই একা হাতে তিনি চার ছেলে মেয়ে মানুষ করে সংসার সামলে আসছেন…… বড় ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে ডেনমার্ক আছেন……. মেয়ে দ্বিতীয়…… তাকে বিয়ে দিয়েছেন যশোর…… জামাই নামি দামি শিল্পপতি…… সাদাফ ভায়ের বড় যিনি তিনি আছে রাজশাহী…… সেখানেই বিয়ে করে সেটেল হয়েছেন…… কারণ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর…….. ছুটি কাটাতে বাড়ি আসেন প্রায় সবাই….. আর সাদাফ ভাই ভাই বোনদের মধ্যে ছোট……. ওই এলাকায় সাদাফ ভায়ের মায়ের বেশ সুনাম রয়েছে……….. কারণ প্রথম সংসারের ছেলেমেয়েদের কখনো পর ভাবেন নি….. আর ছেলেমেয়েরা ও তাকে সবসময় মূল্যায়ন করে গেছেন…… ,
,
,
,
এতো সব শুনে আমি বেশ হতাশ হলাম….. শেষ রক্ষা তাহলে আর হলো না…… আমি মনে হয় আল্লার প্রিয় হয়ে গেলাম খুব জলদি…… তখনি আশার আলো জ্বালিয়ে মা বললেন সবই তো ঠিক আছে সাদাফ ছেলে মানুষ তার ও তো একটা মতামত আছে….. আমি আপার সাথে কথা বলি এই ব্যাপারে কি বলো!! বাবাও মায়ের কথায় সায় দিলেন…….
আমি তো পারি না লাফিয়ে ফ্লোর ফাটিয়ে ফেলি…. কারণ আর যাই হোক সাদাফ ভায়ের মতন একজন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে আমার মতন গাধিকে বিয়ে করবেন না…… কত ভালো চাকরি তার কতো ভালো দেখতে…… ওনার কি মেয়ের আকাল পড়বে নাকি…… ইশশশ শুধু শুধুই এতোদিন টেনিশন করে গেলাম……
,
,
,
১০
,
,
,
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা ও শেষ হলো আর এতো দিনের মধ্যে বিয়ে নিয়ে কোন কথাই বাড়িতে শুনি নি…..এর মধ্যেই মা শিমুল ভাই আর নতুন বউকে দাওয়াত দিলেন সাথে তাদের পরিবার কে…… এই উপলক্ষে সাদাফ ভাইদের ও দাওয়াত দিলেন সাথে চাচাদের ও….. মোট কথা নিকটতম আত্নীয় স্বজন যারা আছেন তাদের সবাইকেই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে…… শুক্রবার হওয়ার সবাই উপস্থিত হলো…… শিমুল ভাই আর তার বউকে দেখে মনে হলো আমার চেয়ে মনে হয় এই মেয়েকেই তার পাশে বেশি মানিয়েছে……তাদের এতো হাসি খুশি দেখে নিজের ও ভালো লাগছিলো….. যাক ভালোলাগার মানুষ টা ভালো আছে এতেই আমি খুশি…… সাদাফ ভাইরা আসলেন তার কিছুক্ষণ পর…….. সেদিন সাদাফ ভায়ের বোন ও এসেছিলেন…… আন্টি আর আপু আগে ঢুকলেন….. সাদাফ ভাই ঢুকলেন একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে……. পিচ্ছিটা দেখতে ছিলো পুরাই আপুর মতোন…..খুব ফর্সা না তবে বেশ মায়াবী চেহারা….. চুল গুলো মাঝারি।।।।। ঝুটি করা…… একটা সাদা ফ্রক….. আমিতো পারি না খেয়ে ফেলি….. না পেরে সুফিয়া খালাকে দিয়ে সাদাফ ভায়ের কাছ থেকে আনিয়ে কোলে নিলাম…….. সাদাফ ভায়ের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক ই হলাম একদম ফরমাল লুকে…….. কালারফুল একটা স্টাইপের শার্ট আর কালো প্যান্ট…… অফিস থেকে সোজা চলে এসেছেন মনে হয়…. পরে মনে পড়লো আজ তো শুক্রবার…. আর মাথা ঘামালাম না…… একে একে সবার খাওয়া হলো….. আমরা মেয়েরা বসলাম একসাথে পরে…… বেশ হাসি ঠাট্টা করতে করতে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম…… কিন্তু এরপর যে এতো বড় চমক আমার জন্য৷ অপেক্ষা করছিলো আমি ঘুনাক্ষরে ও টের পেলাম না…….
,
,
,
অনেকটা ঘোষণা করার মতোন করেই সাদাফ ভায়ের মা আমায় আন্টি পরিয়ে দিলেন…….. সাদাফ ভায়ের বড় বোন বেশ কয়েকটা গিফট আর শপিং দিলেন…….. মা বাবা ও সাদাফ ভাইকে চেইন পরিয়ে দিলেন……. সাথে শার্ট-প্যান্ট এর কাপড় দিলেন………. আমি একদম স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম……. একবার সাদাফ ভায়ের দিকে তাকালাম……. ওনাকে দেখে আমার খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে…… তাহলে ওনি কি রাজি হয়ে গেছেন!!! কেমন যেনো স্বপ্ন স্বপনই লাগছে সব কিছু……. সুফিয়া খালা আর শিমুল ভাইয়ের বউ মিলে আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন…… একটু পড়েই শাম্মি খুশিতে গদ গদ হয়ে ভেতরে ঢুকলেন…… দোস্ত সামনের শুক্রুবারেই তোমার কেল্লাফতে…….. ভাইয়াকে আমার খুব পছন্দ হয়েছেরে….. ইশ আমি আগে দেখলে তো আমিই বিয়ে করে নিতাম…….
,
,
,
চলবে……

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৪

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৪
লেখনিতে: চৈত্র রায়

,
,
০৭
,
,
বিকেলে একদিন ছাদে দাড়িয়ে রাস্থার মানুষ জন দেখছিলাম…… দূর থেকেই দুজন মহিলা কে দেখে খুব পরিচিত মনে হলো……… একটু কাছে আসতেই চিনতে পারলাম এযে শাম্মি আর আন্টি….. এক দৌড়ে রুমে এসে চুলটুল আঁচড়ে ফিটফাট…… চোখে কাজল টানতে টানতেই বুঝতে পারলাম সুফিয়া খালা দরজা খুলে দিয়েছেন…… ছুটির দিন হওয়ায় মা সেদিন বাসায় ই ছিলেন…….. বাবা বেড়িয়েছিলেন কি একটা কাজে যেনো…… বরাবরের মতোই শাম্মি রুমে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো…… এমন একটা ভাব ধরেছি যেনো তাকে দেখে খুব অবাক হয়েছি আমি…… আন্টি ডেকে আমাকে তার পাশে বসালেন……. ব্যাপার টা তে কেমন একটা বউ শ্বাশুড়ি গন্ধ পাচ্ছিলাম……. আমাকে অবাক করে আন্টি মাকে বলতে শুরু করলেন….
,
,
,
——— আপা শাম্মি আর তুলিকে আমি কোনদিন আলাদা ভাবে দেখি নাই
,
,
কথাটা শুনেই আমি চাতক পাখির মতন বসে আছি…..অবশেষে আমার ভাবনা আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে
,
,
——— তুলিকে আমার খুব পছন্দ আপা…… আমার বড় ভায়ের ছেলের জন্য তুলিকে নিয়ে যেতে যাই……ছেলে খুব ভালো আপা…. এক্সপার্ট ইমপোর্ট এর বিজনেস…. চার পাঁচটা দেশতো ঘুরেও এসেছে……
,
,
——— তুলির বাবা আসুক….. কথা বলি….. তাছাড়া আমাদের কোন তাড়াহুড়ো নেই আপা…. মেয়ে পড়ছে পড়তে থাকুক….. তা শাম্মির জন্য দেখবো নাকি পাত্র কি বলেন আপা!!!
,
,
——— সে আর বলতে আপা….. অবশ্যই দেখবেন….. তবে এবছর আর ধরবো না….. বিয়ে কতো ঝামেলা আগে একটা শেষ করি…… ও আপা যার জন্য আসা…… শিমুলের বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের মাসের দুই তারিখ….. হাতে গুনে বারো দিন সময় হাতে আছে…… গুনধর ছেলে আর মেয়ে দেখার ফুরসত দেয় নি……
,
,
——— কি বলেন আপা….. শিমুল তো কতো শান্ত স্বভাবের
,
,
——— সে তো আপনার আর আমার সামনে…… তবে ছেলের পছন্দ আছে….. মেয়ের যেমন রূপ তেমনি গুণ…… চিটাগং মেডিক্যাল এর ছাত্রী…… এবার ইন্টার্নি করছে….. মেয়ের মামার বাড়ি আবার পুরান ঢাকা….. আমার ছোট ননদের বাড়ির সাথে মেয়ের মামার বাড়ি….. সেখান থেকেই তাদের ছয় বছরের পরিচয়…….. এবার বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতেই সব খুলে বললো….. ছেলের পছন্দেই পছন্দ…. সংসার যখন ওরা করবে আমরা অযথা বাধা দিতে যাবো কেনো….
,
,
,
আন্টি আর শাম্মি সেদিন আরও আধ গন্টার মতন ছিলেন…… আমি তাদের পাশে বসে শুধু নির্বাক শ্রুতা ছিলাম…… শিমুল ভায়ের বিয়ের ব্যাপারেই টুকিটাকি আলাপ করছিলেন তারা…… কতো আশা নিয়ে বসেছিলাম হয়তো আমার আর শিমুল ভাইয়ের বিয়ের কথা বলবেন কিন্তু না তারা তো তার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছেন…… ছয় বছরের প্রেম তাদের….. কই একদিন ও তো দেখলাম না তার সাথে কোন মেয়েকে….. অবশ্য আমি দেখার অপেক্ষায় তো আর কোন কিছু থেমে থাকবে না…… মেয়েও নাকি অপ্সরী….. যেমন রূপ তার তেমনি গুণ….. নিজে ইঞ্জিনিয়ার বউ ডাক্তার আর কি লাগে…… সেই তখন থেকে অনবরত এই সব ভাবনা মাথায় খেলেই যাচ্ছে….. আর হুট হাট যখন তখন কান্না পাচ্ছে….. কতো স্বপ্ন ছিলো শিমুল ভাইকে নিয়ে…… না কিছুই হলো না……
,
,
,
আজকাল রাস্থাঘাটে প্রায়ই শিমুল ভাইকে দেখি…… কখনো হাত ভর্তি বাজার বা কখনো রাস্থার মোড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে চা খেতে খেতে আড্ডায়…… অইদিনের পর একদিন সকাল বেলা শিমুল ভাই দুহাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির…… গুছানো চুল গুলো সামিনে কিছুটা ঝুকে পড়েছে….. কমলা শেডের একটা শার্ট পড়েছে…… শার্টের বুকে পিঠে ঘামে একদম লেপ্টে আছে…… আমি মাত্র গোসল শেষ করে ভেজা জামা নিয়ে ছাদে যাচ্ছিলাম…… শিমুল ভাইকে দেখেই কেমন যেনো পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো…… ওনাকে বরাবরই বাজারের ব্যাগ হাতে আমার কাছে জামাই জামাই লাগতো….. ওনি বাজার করে ঘেমে নেয়ে আসবেন আমি পানির গ্লাস ওনার হাতে দিয়ে ব্যাগের বাজার গুলো একে একে খুলে দেখবো…… নাহ এমন কিছুই হলো না……. ধ্যান ভাংলো বাবার ডাকে…… রাস্থায় শিমুল ভাই নাকি জোর করে বাবার হাত থেকে বাজার নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন…… আমি আর সেখানে দারালাম না….. সুফিয়া খালাকে ডেকে দিয়ে দ্রুত ছাদে চলে এলাম…….
,
,
,
আজকাল বড্ড স্বপ্ন দোষ হচ্ছে…… প্রায়ই দেখি শিমুল ভাইকে…… কখনো মাথায় চটি মেরে বলছে কিরে তুলা আমার বউ দেখতে কেমন!!! আবার কখনো দেখছি শিমুল ভাই একটা সুন্দর মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় ঘুড়ছেন….. আমি সেই রিক্সার পিছনে দৌড়াচ্ছি……আবার কখনো দেখছি বউ সেজে বসে আছি কিন্তু শিমুল ভাই অন্য একজন কে নিয়ে এসে বললেন তুলা তুই এই ছেলেকে বিয়ে কর খুব সুখী হবি…. আমি চাইতেও কিছু বলতে পারি না….. খুব জোর করি, চেষ্টা করি কথা বলার কিন্তু পারি না……. এক ধরনের আঠালো জাতীয় কিছু একটা দিয়ে মুখ ভর্তি থাকে….. শিমুল ভাই চলে যায়….. একবারো পেছন ফিরে তাকায় না…… এরকম স্বপ্ন দেখে বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি….. এরপর সারারাত বিছানার এপাশ ওপাশ…. বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি কিন্তু ঘুম আর আসে না ….. আগে শিমুল ভাইকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখতে চাইতাম কিন্তু স্বপ্নে তিনি আসতেন না…… কিন্তু যখন এলেন তখন সব উলটা পালটা করে দিয়ে গেলেন……. অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে দিনকে দিন…….. সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে শিমুল ভাইকে দেখলাম এক মেয়েকে সাথে করে রিক্সায় যাচ্ছে……. সবুজ রঙের একটা গেঞ্জি পড়া….. লোকটাকে যতই দেখি ততই ভালোলাগে আর সাথে সাথেই অস্থিরতা টা দশ গুন বেশি হয়ে যায়…….. পাশে বসা মেয়েটাকে ও দেখলাম…… সুন্দর বললেও ভুল হবে একে…… এক কথায় অনন্য…….. দুজনকে বেশ মানিয়েছে…… না চাইতেই চোখ ওদের দিকে চলে যাচ্ছে…….. এতো কান্না পাচ্ছে…… ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে শিমুল ভাইয়ের কলার ধরে বলি আপনি এই মেয়েটাকে কেন পাশে বসিয়েছেন!!!!! কেনো এতো হেসে হেসে কথা বলছেন ওর সাথে…… এসব দেখে তো আমার কষ্ট হচ্ছে শিমুল ভাই….. আমি তো আপনাকে ভীষণ রকমের পছন্দ করি….. অথচ আপনি এই মেয়েটাকে ছয় বছর ধরে ভালোবাসেন……. মানলাম এই মেয়ে অনেক সুন্দর শিমুল ভাই আপনি তো সেদিন ও আমায় বলেছিলেন আমি সুন্দর হয়ে গেছি….. আমাকে তো আপনি সবার থেকে আলাদা ভাবে তুলা ডাকতেন……… আপনি তো আমার প্রথম ভালোলাগা শিমুল ভাই…….. এলোমেলো ভাবে ভেবেই যাচ্ছি এসব………. কিন্তু কোন কোল্ কিনারা পাচ্ছিলাম না ভাবনার…….. সামনে তাকাতেই দেখলাম জ্যাম ছাড়িয়ে তাদের রিক্সা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে……. কেন যেনো মনে হচ্ছিলো এইভাবেই শিমুল ভাই আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছেন…….. অপরিনত বয়সের প্রথম প্রেম আর বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে খুব আশায় ছিলাম যে আমার ভ্যাগ্যে যদি তিনি থাকেন তাহলে একভাবে না একভাবে আমি তাকে পাবোই……… কিন্তু তেমন কিছুই হলো না…….. বেশ জাকজমক ভাবেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো……..ততোদিনে আমিও বেশ বুঝতে পারলাম যে আমার একতরফা ভালোলাগা তাদের এতো বছরের ভালোবাসার কাছে খুবই সাদামাটা আর তুচ্ছ……
,
,
,
শিমুল ভাইয়ের বিয়ের কিছু দিন পরেই আমার দুজন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেলো আর বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টা মা বাবার চিন্তায় জোগ হলো………. বেশ কিছু দিন ধরে সাদাফ ভাই আগের মতোন সময় দিয়ে পড়াতে পারছেন না……. ঘন ঘন ছুটি নিচ্ছেন…… পড়ায় যাতে পিছিয়ে না পড়ি সেজন্য বেচের সাথে পড়াতেন বিকেলে……… পড়ানো শেষে আবার সাদাফ ভাই আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে যেতেন………. দেখতে দেখতে ইন্টার প্রথম বর্ষের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়ে গেলো……… এর মধ্যেই সাদাফ ভায়ের মা এক গাদা মিষ্টি আর ফলমূল নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলেন…… আইস্ক্রিমের প্যাকেট টা আমার হাতে দিয়ে বললেন টুকি নে এটা তোর জন্য……. মা তো একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন এতো সব কিসের জন্য……..মায়ের প্রশ্নের তোপে না টিকতে পেরে বলেই দিলেন যে সাদাফ ভায়ের কাস্টমস এ খুব ভালো চাকরি হয়েছে………. বাবা সেদিন বাসায় ই ছিলেন……. সবাই খুব খুশি সাথে আমিও এতো দিনে যম ঠাকুরের কাছ থেকে রক্ষা পাবো বলে…… মা তো হাসতে হাসতে বলেই দিলেন…..
,
,
,
——— আমিতো ভেবেছিলাম কি না কি…… সাদাফের বিয়ে ঠিক হলো নাকি আবার…..
,
,
——— তো দাও তোমার মেয়েকে সাদাফের বউ করে নিয়ে যাই……. ছেলে বিয়ে করানোর জন্য তো আমি এক পায়ে রাজি এখন……..
,
,
——— সাদাফ কে আমারও খুব পছন্দ…… (মা)
,
,
——— ভাই আপনি কি বলেন!!! ছেলে তো আমার থেকে বেশি আপনারাই জানেন…….. আপনার মেয়ে আমার কাছে আমার মেয়ে হয়েই থাকবে….. এই কথা আমি আপনাকে দিচ্ছি……
,
,
——— আপা আমি একটু ভেবে চিন্তে দেখি…..
,
,
——— তা তো অবশ্যই ভাই……. আপনি চাইলে খুজ খবর ও নেন আমাদের দেশের বাড়িতে……… আমি আপনাকে ঠিকানা ও দিয়ে দিবো…….
,
,
,
ওদের তিনজনের কথা শুনে আমার আর মনে করে ভয় পেতে হলো না…… আত্নার পানি তো কবেই শুকিয়ে গেছে……. কই ভাবছিলাম এতো দিনে যম ঠাকুরের কাছ থেকে মুক্তি পাবো তা না…… এরা সবাই যড়যন্ত্র শুরু করে দিলো…… সাদাফ ভায়ের সাথে বিয়ে!!!! এক দেড় ঘন্টা ই তো আমার কাটে না….. আত্না হাতে নিয়া পড়তে বসি….. সেখানে বিয়ে!!! তাদের কি আমার আত্নার ভয় নাই নাকি……
,
,
,
রাতে খাবার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে শুনতে পেলাম মা বাবাবা একপ্রকার ঝগড়াঝাটি করছে…… যা আমার এতোখানি বয়সে আমি কখনো দেখি নি……. বাবা মাকে খুবই ভালোবাসেন আর কোন কাজ করার আগে সে ব্যাপারে মায়ের পরামর্শ সবার আগে নেন…… তাহলে কি নিয়ে তিনি এতো ক্ষেপেছেন…….একটু মনোযোগ দিতেই শুনতে পেলাম……… বাবার ইচ্ছা আমার চাচাতো ভাই রিয়াদের সাথে বিয়ে দেবার…… বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকবে….. আর তাছাড়া রিয়াদ এবার ঢাকা মেডিকেল থেকে কার্ডিওলজি তে ইন্টার্নশিপ করছে…… ব্রাইট ফিউচার এমএস করতে দেশের বাইরে যাবে……কিন্তু মা এতে রাজি না…… পরিবারে আত্নীয়তা করলে সম্পর্কে ফাটল ধরে…… মা সেটা কোনমতেই চায় না…… আর তাছাড়া রিয়াদের সেটেল হতে আরও চারপাচ বছর……… সে তুলনায় সাদাফ ভাই এস্টাবলিশ……. ঢাকার নিজস্ব বাড়ি…… পরিবারে ও কোন ঝামেলা নাই…….. তার উপর কতো ভালো চাকরি…… মেয়েও তাদের কাছে থাকবে…… সব শেষে বাবা মায়ের যুক্তির কাছে হার মেনে ঠিক করলো সাদাফ ভায়ের দেশের বাড়িতে যাবেন তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে আর এই ব্যাপারে যেনো তাদেরকে কিছুই না বলা হয়…… এক মাত্র মেয়ে তার….. পাঁচটা দশটা না…… দশটা জিনিস বিচার বিবেচনা করে ঠিক মনে হলে তবেই কথায় আগাবেন তিনি…..
,
,
,
চলবে…..

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব___০৩

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব___০৩
লেখনিতে: চৈত্র রায়

,
,
০৫
,
,
সাদাফ ভাই মায়ের হাতে ডাব ধরিয়ে দিয়ে যাবার পর থেকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে করতে মুখের ফেনা তুলে ফেলেছে মা একেবারে…… আমার কাছে উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন….. হ্যারে তুলি তুই কি মাথা ঘোরে পড়ে গিয়েছিলি কলেজে!!! কিরে তোর মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন!!! এই তুই ছাতা নিয়ে যাস নি কেন!!! তোর যে রোদের তাপে প্রবলেম হয় তুই জানিস না!!! এখন তোর পিছনে ছাতা নিয়ে ছুটার জন্য আমার মানুষ রাখতে হবে নাকিরে…. হ্যা!! বিরতিহীন ভাবে বকেই চলেছে….. থামাথামি নেই উফফফফফ
,
,
সাদাফ ভাই আমাকে পড়াতে এলেন পরের দিন বিকেলে……. বিছানায় গল্পের বই নিয়ে পড়তে পড়তে সবে মাত্র চোখ টা লেগে এসেছিলো প্রায়….. এমন সময় সুফিয়া খালা এসে বলে গেছেন যে সাদাফ ভাই এসেছে….. কথাটা শুনে বেশ বিরক্ত হলাম….. ইচ্ছে করছে না বিছানা ছেড়ে উঠি…… রাতে মাথা ব্যাথার জন্য ঘুমাতে পারি নি….. সব ঘুম যেনো এখন ভর করেছে আমার….. কোনমতে হেলেদুলে চোখে পানি ছিটিয়ে পড়ার রুমে চলে গেলাম…… বেশ ভয় করছে কালকের ঘাড় তেড়ামির জন্য….. নাজানি কি শাস্তি দেয় আবার……বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পড়ানো শুরু করলেন….. কিছুক্ষণ পড়িয়ে লিখতে দিলেন…… লিখছি এমন সময়….
,
,
,
——— বন্ধবিদের প্রেম করতে সাহায্য করা দোষের কিছু না….. এইরকম সাহায্য আমি নিজেও অনেক করেছি…… হাত দুটো মুঠো করে মুখের কাছে ঠেকিয়ে
,
,
——— দোষের না হলে আমার রোদে দারিয়ে থাকা ত্রিশ মিনিট ফেরত দিন…… হাতের কলম খাতার উপর রেখে
,
,
——— ছাব্বিশ মিনিট ছিলো…… এক কাজ করো কাল কলেজ ছুটির পরে আমার সাথে দেখা করো ছাব্বিশ মিনিট রোদে দার করিয়ে রাখবো
,
,
——— কেনো!!!
,
,
——— তুমিই না বললে রোদে দারানোর সময় টা ফেরত দিতে
,
,
,
বলেই জোড়ে হেসে উঠলেন….. নিজের কথায় নিজেই ফেসে গিয়েছি তাই কথা না বাড়িয়ে লিখায় মনোযোগ দিলাম….. লিখতে লিখতে একেবারে ঝিমুনি এসে গেছে প্রায়…… লিখতে লিখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাই নি…… ঘুম ভাঙার পর বেশ চমকে গেলাম….. এতোক্ষন টেবিলে বসে বসেই ঘুমুচ্ছিলাম…… সাদাফ ভাই!!!! তার চেয়ারে তাকাতেই দেখলাম চেয়ার ফাকা…. আর তার সাথে আমার পড়ার টেবিল টাও গোছানো……. আড়মোড়া ভেঙে খাতা অফ করতেই দেখলাম কোনায় গোটা গোটা করে লিখা….. আর যেনো টেবিলে ঘুমাতে না দেখি…… ইশশশ কি লজ্জা কি লজ্জা…. আমি সাদাফ ভায়ের সামনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম….. লজ্জায় দুহাতে মুখ ডেকে বসে রইলাম কিছুক্ষণ…..
,
,
,
এর মধ্যেই সাদাফ ভাই মায়ের কাছে ফোন করে তিন চার দিনের ছুটি নিলেন……. আমাকে আর পায় কে তখন…… বাধন হারা ঘাস ফড়িং এর মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছি এই চারদিন।।।।।কিন্তু সাদাফ ভাই এলেন পুরো সাত দিন পর……পাঁচদিনের মাথায় শাম্মী আমার ছোট বেলার বান্ধবী এসে মাকে রাজি করিয়ে দুদিনের জন্য নিয়ে গেলেন……. বৃহস্পতিবার হওয়ায় মা আর বাধ সাধেন নি……. শনিবার সকালে মা শাম্মিদের বাড়ি ফোন দিয়ে জানালো সাদাফ ভাই নাকি বিকালে পড়াতে আসবেন……. আন্টি সেদিন আমায় দুপুরে কোন মতেই না খাইয়ে ছাড়লেন না………. শাম্মিদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি পৌছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছে……. শাম্মীর বড় ভাই শিমুল ভাইয়া সেদিন আমাকে বাড়ি দিয়ে গিয়েছে…… বাসার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখি সাদাফ ভাই আর মা বসে কথা বলছে….. শিমুল ভাইয়া মাকে সালাম দিতেই জড়িয়ে ধরলেন……. কতকাল পরে দেখা….. আগেতো শিমুল ভাই রোজ আমাদের বাসায় আসতেন শাম্মি কে নিতে…… পড়াশোনার জন্য ভাইয়া আমেরিকা চলে যায়….. আজ প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা…… আদর করা জায়েজ…… শিমুল ভাইকে দেখে আমিও বেশ অবাক হয়েছিলাম…… সাথে খুশিও…… খুশি হবো না কেন!! প্রথম ভালোলাগা বলে কথা…… অবশ্য এ-ব্যাপারে শিমুল ভাইয়া বা শাম্মি কেউই কিছু যানে না…… ভাইয়া যখন আমেরিকা যায় তখন আমি ক্লাস সেভেনে……. যাওয়ার দুদিন আগে আণ্টিকে নিয়ে এসে মায়ের সাথে দেখা করে গেছে…… কত রাত যে কেদেছি ভাইয়াকে আর সামনে দেখতে পাবো না ভেবে…….মায়ের সাথে ভাইয়ার খুব ভাব…. কি সুন্দর করে হাসি দিয়ে কথা বলে…… ভাইয়ার নাকের ডগায় লাল তিলটা….আমেরিকা যাবার পর তো আরো ফর্সা হয়ে গিয়েছেন…….. সাথে স্মার্ট ও…… কি সুন্দর নিচের ঠোঁটের নিচে হালকা নিম দাড়ি……. সব গুলো দাত বের করে যখন নিশব্দে হাসে উফফফফ….. এই হাসিতে তাকায় থাকলেও ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে……. শিমুল ভাই আমাকে প্রথম দেখেই মাথায় চটি মেরে বললো কিরে তুলা তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না….. এতো সুন্দর কি খেয়ে হলিরে….. আমাকে আর পায় কে….. ভাইয়া আমাকে সুন্দর বলেছে…… এই তিন দিন ভাইয়া আমাকে যতোবারই তুলা ডেকেছে ততোবারই আমি হেসে হেসে মনে মনে বারংবার বলেছি শিমুলের তুলা…..
,
,
,
শিমুল ভাইয়া আমেরিকা থেকে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে এসেছে……মা বিয়ের কথা সবে মাত্র জিজ্ঞেস করেছে….. অমনিই সাদাফ ভাই দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে নিয়ে পড়ার রুমে চলে এলেন…….. পড়ায় কি আর মন বসে তখন!!! মা অইদিকে ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা বলছে….. পারিনা কান্টাকে সতেরো ইঞ্চি বড় করে মায়ের পাশে রেখে আসি…. ইশসসস….. সাদাফ ভায়ের হুঙ্কারেই বাস্তবে ফিরে এলাম…… খেয়াল করে দেখি ওনি আমার খাতা খুলে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে….. খাতার যে পৃষ্ঠায় ওনি বাড়ির কাজ লিখে দিয়ে গিয়েছিল এখনো সেই পৃষ্ঠাই বহাল আছে…… একটা কলমের দাগ ও পরে নি…… পড়ার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম…… কয়েক ঢুক গিলে সাদাফ ভায়ের দিকে তাকাতেই উনি খেপে গিয়ে টেবিলে এক থাবা দিয়েই একে একে আমার সাতদিনের রুটিন পাই টু পাই বলছেন……. মা এই কুটনামি টা যে করেছেন আমি ২০০% শিউওর……. চুপ করে থাকায় খাতা রোল করে কয়েকটা বারি ও খেলাম মাথায়…… সেদিন সাদাফ ভাই দেড় ঘন্টা পড়িয়েছে আর এই পুরু সময় টাই আমাকে বকে গিয়েছে….. আমার অবস্থা তখন ভেজা বিড়ালের মতো…….
,
,
,
সাদাফ ভাই যাবার পর মা রাতে আমার মাথায় তেল দিতে দিতে সাদাফ ভায়ের বাড়ি যাবার ব্যাপারটা বললেন…… ওনি আসলে এই ছুটি টা নিয়েছে তার মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য…..আমাদের কলেজের পেছনে ওনার বাবার করে যাওয়া একটা দুতলা বাড়ি আছে….. এতোদিন সেখানে ভাড়া ছিলো…….. সাদাফ ভায়ের এক ভাই ডেনমার্ক আছেন আর আরেক ভাই রাজশাহী….. বোনের বিয়ে হয়ে গেছে…… ওনার মা বাড়িতে একা থাকেন বলেই সাদাফ ভাই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন…….. এখন ওই বাড়িতেই নাকি ওঠেছেন….. গোছ গাছ করার জন্যই সাদাফ ভাই এতো দিন আসতে পারে নি….. সাদাফ ভাই ঢাকায় ছিলেন!!! এর জন্যই তো কেমন পট পট করে সব বলছিলেন………
,
,
,
এদিকে মা সাদাফ ভায়ের মাকে আর ওনাকে একদিন দুপুরে দাওয়াত দিলেন…… খুবই সাদামাটা একজন মানুষ…… আসার সময় পিঠা, নাড়ু, আমলকির আচার আরো কতোকি নিয়ে এলেন…… সাদাফ ভাই দেখতে ঠিক ওনার মায়ের মতোই হয়েছেন……. একই হাসি, একই চোখ…… দুজন মানুষ কে যে কেউ কিছুক্ষণ দেখলেই বলতে পারবে দুজনের মধ্যে কতটা ভালোবাসা আছেন…… সাদাফ ভাইয়ের মা সাদাফ ভাইকে বাবু বলে ডাকেন….. সেদিন খাবার টেবিলে জানলাম ব্যাপার টা….. ডাকটা শুনেই পেট ফেটে হাসি আসছিলো….. ওনাকে আদর করে বড়জোর যম ডাকা যায়….. বাবু!!!! হি হি হি
,
,
,
মা সাদাফ ভাইদের নিয়ে টেবিলে বসে পড়লেন…….. আমি ভয়ে আর সেদিকে আগালাম না…… ওবাবা….. এই যম ঠাকুরের সামনে গলা দিয়ে আমার খাবার নামবে না আর যাই হোক…… কিন্তু ওনার মা আমাকে জোড় করে বসিয়ে দিলেন….. সাথে সাদাফ ভাই ও বললেন….. আর না বসে যাই কই…..
,
,
,
০৬
,
,
,
সাদাফ ভায়ের মায়ের সাথে মায়ের খুব ভাব জমে গেছে….. আজকাল মা যেখানেই যায় ওনাকে সাথে করে নিয়ে যায়….. মাঝেমধ্যে ও কম্পলেক্সে ও ওনাদের আড্ডা চলে…..সকালে এক সাথে হাটা….. ঘুড়েফিড়ে বাজার করা…… আমার জন্য এটা সেটা বানিয়ে আনা….. এভাবেই যাচ্ছে দিনগুলো…… এর মধ্যেই বাবা ফোন করে জানালেন তিনি দেশে ফিরছেন কয়েকদিনের মধ্যেই……. সেই ক্লাস এইটে পড়া কালীন বাবাকে দেখিছি……. দিনগুলো যেনো কাটছিলো না আমার কবে বাবাকে পাবো……অবশেষে বাবা আসলেন….. দেখে চেনায় যাচ্ছে না…. একেবারে শুকিয়ে গেছেন…… বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রাগী মুডেই বলে দিলাম আর তাকে ছাড়ছি না….. বাবা আমার কথা শুনে বেশ হাসলেন….
,
,
,
বাবা এসেছে বলে আত্নীয় স্বজন সবাই কম বেশ আসছে দেখা করতে….. আমি তখন বাবার আনা গিফট আর চকলেট ভাগাভাগি করাতে ব্যাস্ত….. আম্মু সাদাফ ভায়ের সাথে আব্বুর পরিচয় করিয়ে দিলেন……. সাদাফ ভাইকে দেখলাম বেশ হাসি হাসি মুখ করেই কথা বলছেন……. লোক্টাকে হাসলে এতো ভালো লাগে অথচ তিনি হাসেই না….. এই তিন বছরে আমি বেশ হাতে গুনে বলতে পারবো ওনি কয়বার হেসেছেন………. সেদিন আব্বু নিজ হাতে সাদাফ ভাইকে টাইটানিক এর একটা ঘড়ি দিয়ে ব্যাবহার করতে বলেছেন……. একদিন সময় করে মা আব্বু কে সাদাফ ভায়ের মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন…… এর মধ্যে একদিন সাদাফ ভায়ের মা এসে আমাদের স্বপরিবারে নিমন্ত্রণ করে গেলেন দুপুরের খাবারের জন্য………. বেশ যাচ্ছিলো দিনগুলো……. সব কিছুতেই যেনো আনন্দ লাগে…… রাস্তা ঘাটে আবারো সেই আগের মতো শিমুল ভাইকে দেখি….. মাঝেমধ্যে কথা হয়…… আবার কখনো কখনো দূর থেকেই তাকিয়ে থাকি…….. উনার সব কিছুই যেনো ভালো লাগে আজকাল নতুন করে…… হাত নাড়িয়ে কথা বলা…… চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া….. টুপি পরে মসজিদে নামাজ পড়া….. সব……. আচ্ছা এতো ভালো লাগে ক্যান মানুষটাকে!!!???
,
,
,

চলবে…….

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৩

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৩
লেখনিতে: চৈত্র রায়

,
,
০৫
,
,
সাদাফ ভাই মায়ের হাতে ডাব ধরিয়ে দিয়ে যাবার পর থেকে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে করতে মুখের ফেনা তুলে ফেলেছে মা একেবারে…… আমার কাছে উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন….. হ্যারে তুলি তুই কি মাথা ঘোরে পড়ে গিয়েছিলি কলেজে!!! কিরে তোর মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন!!! এই তুই ছাতা নিয়ে যাস নি কেন!!! তোর যে রোদের তাপে প্রবলেম হয় তুই জানিস না!!! এখন তোর পিছনে ছাতা নিয়ে ছুটার জন্য আমার মানুষ রাখতে হবে নাকিরে…. হ্যা!! বিরতিহীন ভাবে বকেই চলেছে….. থামাথামি নেই উফফফফফ
,
,
সাদাফ ভাই আমাকে পড়াতে এলেন পরের দিন বিকেলে……. বিছানায় গল্পের বই নিয়ে পড়তে পড়তে সবে মাত্র চোখ টা লেগে এসেছিলো প্রায়….. এমন সময় সুফিয়া খালা এসে বলে গেছেন যে সাদাফ ভাই এসেছে….. কথাটা শুনে বেশ বিরক্ত হলাম….. ইচ্ছে করছে না বিছানা ছেড়ে উঠি…… রাতে মাথা ব্যাথার জন্য ঘুমাতে পারি নি….. সব ঘুম যেনো এখন ভর করেছে আমার….. কোনমতে হেলেদুলে চোখে পানি ছিটিয়ে পড়ার রুমে চলে গেলাম…… বেশ ভয় করছে কালকের ঘাড় তেড়ামির জন্য….. নাজানি কি শাস্তি দেয় আবার……বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পড়ানো শুরু করলেন….. কিছুক্ষণ পড়িয়ে লিখতে দিলেন…… লিখছি এমন সময়….
,
,
,
——— বন্ধবিদের প্রেম করতে সাহায্য করা দোষের কিছু না….. এইরকম সাহায্য আমি নিজেও অনেক করেছি…… হাত দুটো মুঠো করে মুখের কাছে ঠেকিয়ে
,
,
——— দোষের না হলে আমার রোদে দারিয়ে থাকা ত্রিশ মিনিট ফেরত দিন…… হাতের কলম খাতার উপর রেখে
,
,
——— ছাব্বিশ মিনিট ছিলো…… এক কাজ করো কাল কলেজ ছুটির পরে আমার সাথে দেখা করো ছাব্বিশ মিনিট রোদে দার করিয়ে রাখবো
,
,
——— কেনো!!!
,
,
——— তুমিই না বললে রোদে দারানোর সময় টা ফেরত দিতে
,
,
,
বলেই জোড়ে হেসে উঠলেন….. নিজের কথায় নিজেই ফেসে গিয়েছি তাই কথা না বাড়িয়ে লিখায় মনোযোগ দিলাম….. লিখতে লিখতে একেবারে ঝিমুনি এসে গেছে প্রায়…… লিখতে লিখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টেরই পাই নি…… ঘুম ভাঙার পর বেশ চমকে গেলাম….. এতোক্ষন টেবিলে বসে বসেই ঘুমুচ্ছিলাম…… সাদাফ ভাই!!!! তার চেয়ারে তাকাতেই দেখলাম চেয়ার ফাকা…. আর তার সাথে আমার পড়ার টেবিল টাও গোছানো……. আড়মোড়া ভেঙে খাতা অফ করতেই দেখলাম কোনায় গোটা গোটা করে লিখা….. আর যেনো টেবিলে ঘুমাতে না দেখি…… ইশশশ কি লজ্জা কি লজ্জা…. আমি সাদাফ ভায়ের সামনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম….. লজ্জায় দুহাতে মুখ ডেকে বসে রইলাম কিছুক্ষণ…..
,
,
,
এর মধ্যেই সাদাফ ভাই মায়ের কাছে ফোন করে তিন চার দিনের ছুটি নিলেন……. আমাকে আর পায় কে তখন…… বাধন হারা ঘাস ফড়িং এর মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছি এই চারদিন।।।।।কিন্তু সাদাফ ভাই এলেন পুরো সাত দিন পর……পাঁচদিনের মাথায় শাম্মী আমার ছোট বেলার বান্ধবী এসে মাকে রাজি করিয়ে দুদিনের জন্য নিয়ে গেলেন……. বৃহস্পতিবার হওয়ায় মা আর বাধ সাধেন নি……. শনিবার সকালে মা শাম্মিদের বাড়ি ফোন দিয়ে জানালো সাদাফ ভাই নাকি বিকালে পড়াতে আসবেন……. আন্টি সেদিন আমায় দুপুরে কোন মতেই না খাইয়ে ছাড়লেন না………. শাম্মিদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি পৌছাতে প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছে……. শাম্মীর বড় ভাই শিমুল ভাইয়া সেদিন আমাকে বাড়ি দিয়ে গিয়েছে…… বাসার ড্রয়িং রুমে ঢুকেই দেখি সাদাফ ভাই আর মা বসে কথা বলছে….. শিমুল ভাইয়া মাকে সালাম দিতেই জড়িয়ে ধরলেন……. কতকাল পরে দেখা….. আগেতো শিমুল ভাই রোজ আমাদের বাসায় আসতেন শাম্মি কে নিতে…… পড়াশোনার জন্য ভাইয়া আমেরিকা চলে যায়….. আজ প্রায় পাঁচ বছর পর দেখা…… আদর করা জায়েজ…… শিমুল ভাইকে দেখে আমিও বেশ অবাক হয়েছিলাম…… সাথে খুশিও…… খুশি হবো না কেন!! প্রথম ভালোলাগা বলে কথা…… অবশ্য এ-ব্যাপারে শিমুল ভাইয়া বা শাম্মি কেউই কিছু যানে না…… ভাইয়া যখন আমেরিকা যায় তখন আমি ক্লাস সেভেনে……. যাওয়ার দুদিন আগে আণ্টিকে নিয়ে এসে মায়ের সাথে দেখা করে গেছে…… কত রাত যে কেদেছি ভাইয়াকে আর সামনে দেখতে পাবো না ভেবে…….মায়ের সাথে ভাইয়ার খুব ভাব…. কি সুন্দর করে হাসি দিয়ে কথা বলে…… ভাইয়ার নাকের ডগায় লাল তিলটা….আমেরিকা যাবার পর তো আরো ফর্সা হয়ে গিয়েছেন…….. সাথে স্মার্ট ও…… কি সুন্দর নিচের ঠোঁটের নিচে হালকা নিম দাড়ি……. সব গুলো দাত বের করে যখন নিশব্দে হাসে উফফফফ….. এই হাসিতে তাকায় থাকলেও ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগে……. শিমুল ভাই আমাকে প্রথম দেখেই মাথায় চটি মেরে বললো কিরে তুলা তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না….. এতো সুন্দর কি খেয়ে হলিরে….. আমাকে আর পায় কে….. ভাইয়া আমাকে সুন্দর বলেছে…… এই তিন দিন ভাইয়া আমাকে যতোবারই তুলা ডেকেছে ততোবারই আমি হেসে হেসে মনে মনে বারংবার বলেছি শিমুলের তুলা…..
,
,
,
শিমুল ভাইয়া আমেরিকা থেকে তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে এসেছে……মা বিয়ের কথা সবে মাত্র জিজ্ঞেস করেছে….. অমনিই সাদাফ ভাই দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাকে নিয়ে পড়ার রুমে চলে এলেন…….. পড়ায় কি আর মন বসে তখন!!! মা অইদিকে ভাইয়ার সাথে বিয়ের কথা বলছে….. পারিনা কান্টাকে সতেরো ইঞ্চি বড় করে মায়ের পাশে রেখে আসি…. ইশসসস….. সাদাফ ভায়ের হুঙ্কারেই বাস্তবে ফিরে এলাম…… খেয়াল করে দেখি ওনি আমার খাতা খুলে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে….. খাতার যে পৃষ্ঠায় ওনি বাড়ির কাজ লিখে দিয়ে গিয়েছিল এখনো সেই পৃষ্ঠাই বহাল আছে…… একটা কলমের দাগ ও পরে নি…… পড়ার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম…… কয়েক ঢুক গিলে সাদাফ ভায়ের দিকে তাকাতেই উনি খেপে গিয়ে টেবিলে এক থাবা দিয়েই একে একে আমার সাতদিনের রুটিন পাই টু পাই বলছেন……. মা এই কুটনামি টা যে করেছেন আমি ২০০% শিউওর……. চুপ করে থাকায় খাতা রোল করে কয়েকটা বারি ও খেলাম মাথায়…… সেদিন সাদাফ ভাই দেড় ঘন্টা পড়িয়েছে আর এই পুরু সময় টাই আমাকে বকে গিয়েছে….. আমার অবস্থা তখন ভেজা বিড়ালের মতো…….
,
,
,
সাদাফ ভাই যাবার পর মা রাতে আমার মাথায় তেল দিতে দিতে সাদাফ ভায়ের বাড়ি যাবার ব্যাপারটা বললেন…… ওনি আসলে এই ছুটি টা নিয়েছে তার মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য…..আমাদের কলেজের পেছনে ওনার বাবার করে যাওয়া একটা দুতলা বাড়ি আছে….. এতোদিন সেখানে ভাড়া ছিলো…….. সাদাফ ভায়ের এক ভাই ডেনমার্ক আছেন আর আরেক ভাই রাজশাহী….. বোনের বিয়ে হয়ে গেছে…… ওনার মা বাড়িতে একা থাকেন বলেই সাদাফ ভাই তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন…….. এখন ওই বাড়িতেই নাকি ওঠেছেন….. গোছ গাছ করার জন্যই সাদাফ ভাই এতো দিন আসতে পারে নি….. সাদাফ ভাই ঢাকায় ছিলেন!!! এর জন্যই তো কেমন পট পট করে সব বলছিলেন………
,
,
,
এদিকে মা সাদাফ ভায়ের মাকে আর ওনাকে একদিন দুপুরে দাওয়াত দিলেন…… খুবই সাদামাটা একজন মানুষ…… আসার সময় পিঠা, নাড়ু, আমলকির আচার আরো কতোকি নিয়ে এলেন…… সাদাফ ভাই দেখতে ঠিক ওনার মায়ের মতোই হয়েছেন……. একই হাসি, একই চোখ…… দুজন মানুষ কে যে কেউ কিছুক্ষণ দেখলেই বলতে পারবে দুজনের মধ্যে কতটা ভালোবাসা আছেন…… সাদাফ ভাইয়ের মা সাদাফ ভাইকে বাবু বলে ডাকেন….. সেদিন খাবার টেবিলে জানলাম ব্যাপার টা….. ডাকটা শুনেই পেট ফেটে হাসি আসছিলো….. ওনাকে আদর করে বড়জোর যম ডাকা যায়….. বাবু!!!! হি হি হি
,
,
,
মা সাদাফ ভাইদের নিয়ে টেবিলে বসে পড়লেন…….. আমি ভয়ে আর সেদিকে আগালাম না…… ওবাবা….. এই যম ঠাকুরের সামনে গলা দিয়ে আমার খাবার নামবে না আর যাই হোক…… কিন্তু ওনার মা আমাকে জোড় করে বসিয়ে দিলেন….. সাথে সাদাফ ভাই ও বললেন….. আর না বসে যাই কই…..
,
,
,
০৬
,
,
,
সাদাফ ভায়ের মায়ের সাথে মায়ের খুব ভাব জমে গেছে….. আজকাল মা যেখানেই যায় ওনাকে সাথে করে নিয়ে যায়….. মাঝেমধ্যে ও কম্পলেক্সে ও ওনাদের আড্ডা চলে…..সকালে এক সাথে হাটা….. ঘুড়েফিড়ে বাজার করা…… আমার জন্য এটা সেটা বানিয়ে আনা….. এভাবেই যাচ্ছে দিনগুলো…… এর মধ্যেই বাবা ফোন করে জানালেন তিনি দেশে ফিরছেন কয়েকদিনের মধ্যেই……. সেই ক্লাস এইটে পড়া কালীন বাবাকে দেখিছি……. দিনগুলো যেনো কাটছিলো না আমার কবে বাবাকে পাবো……অবশেষে বাবা আসলেন….. দেখে চেনায় যাচ্ছে না…. একেবারে শুকিয়ে গেছেন…… বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রাগী মুডেই বলে দিলাম আর তাকে ছাড়ছি না….. বাবা আমার কথা শুনে বেশ হাসলেন….
,
,
,
বাবা এসেছে বলে আত্নীয় স্বজন সবাই কম বেশ আসছে দেখা করতে….. আমি তখন বাবার আনা গিফট আর চকলেট ভাগাভাগি করাতে ব্যাস্ত….. আম্মু সাদাফ ভায়ের সাথে আব্বুর পরিচয় করিয়ে দিলেন……. সাদাফ ভাইকে দেখলাম বেশ হাসি হাসি মুখ করেই কথা বলছেন……. লোক্টাকে হাসলে এতো ভালো লাগে অথচ তিনি হাসেই না….. এই তিন বছরে আমি বেশ হাতে গুনে বলতে পারবো ওনি কয়বার হেসেছেন………. সেদিন আব্বু নিজ হাতে সাদাফ ভাইকে টাইটানিক এর একটা ঘড়ি দিয়ে ব্যাবহার করতে বলেছেন……. একদিন সময় করে মা আব্বু কে সাদাফ ভায়ের মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন…… এর মধ্যে একদিন সাদাফ ভায়ের মা এসে আমাদের স্বপরিবারে নিমন্ত্রণ করে গেলেন দুপুরের খাবারের জন্য………. বেশ যাচ্ছিলো দিনগুলো……. সব কিছুতেই যেনো আনন্দ লাগে…… রাস্তা ঘাটে আবারো সেই আগের মতো শিমুল ভাইকে দেখি….. মাঝেমধ্যে কথা হয়…… আবার কখনো কখনো দূর থেকেই তাকিয়ে থাকি…….. উনার সব কিছুই যেনো ভালো লাগে আজকাল নতুন করে…… হাত নাড়িয়ে কথা বলা…… চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া….. টুপি পরে মসজিদে নামাজ পড়া….. সব……. আচ্ছা এতো ভালো লাগে ক্যান মানুষটাকে!!!???
,
,
,

চলবে…….

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব__০২

0

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব__০২
লেখনিতে: চৈত্র রায়

০৩
,
,
,
সাদাফ ভাই চলে গেলেন আসার ঘন্টা খানেক পরেই…….. নিজেকে খুব খারাপ মনে হচ্ছিলো……. এতো গুলো মিথ্যা আমি কিভাবে দিনের পর দিন বলে গেলাম সেটাই ভেবে পেলাম না…….. বার বার শুধু ভেতর থেকে একটা কথাই কানে আসছিলো সাদাফ ভায়ের কাছে আমায় মাফ চাইতে হবে….. আশ্চর্যজনক ভাবে আমি আমার অপরাধ বোধে এতোই জর্জরিত ছিলাম যে মারের ব্যাপার টা রীতিমতো ভুলেই গেলাম…..অথচ মা যখন রেগে দুই চার ঘা লাগাতেন তা নিয়ে আমি কতো কিছুই না করতাম…… নিজের দোষ থাকা স্বত্তেও সুদূর প্রবাসী বাবার কাছে বিচার দিয়ে মাকে হেস্তনেস্ত করতাম…… কিন্তু তখন মাথায় শুধু সাদাফ ভায়ের কাছে মাফ চাইতে হবে এই কথা ছাড়া আর কিছুই আসছিলো না…….
,
,
,
সেদিন সন্ধ্যায় প্রচুর ঝর হলো সাথে বৃষ্টি ও…… মা ফোন দিলো ঠিক ঝড় শুরু হবার পরেই…… সারাদিন জার্নি করে নানির কাছেই ছিলেন…… ফোন দিতে ভুলে গিয়েছেন বলেই এখন দেওয়া…… কি দিয়ে খেয়েছি….. সুফিয়া খালা আছে কি না….. কি করছি……রাতে দরজা জানালা ভালো করে যেনো বন্ধ করে ঘুমাই…… এতো সব কথার উত্তর যখন ভাবলেশহীন ভাবে দিচ্ছিলাম আনমনে ঠিক তখনি মা বললেন সাদাফ ভাই নাকি একবার ফোন দিয়েছিলেন……… কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে মা নাকি ধরতে পারেন নি….. কথা টা শুনেই ভেতর টা শুকিয়ে গেলো…… সাদাফ ভাই মাকে ফোন দিয়েছে!!!! কেন!!! ওনি কি আর পড়াবেন না বলে ফোন দিয়েছিলেন!!!
,
,
,
সেদিন রাতে হাড় কাপিয়ে জ্বর এলো আমার…… রোলারের প্রত্যেকটা আঘাত যেনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরির রুপ ধারণ করেছে…… সারা গায়ে এতো ব্যাথা যে নিশ্বাস টা ও জোরে ফেলতে পারছি না…… মায়ের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন থেকেই খারাপ লাগছিলো……. সুফিয়া খালা আমার এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন…… তিনি উপায়ন্তর না দেখে ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ছুটে গেলেন আমার চাচির কাছে…… আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পরই আমার চাচার বাসা…… চাচি সুফিয়া খালাকে বকতে বকতে আমার ঘরে এলেন…… এমন অবস্থায় আমাকে একা রেখে যাবার জন্য…… চাচি মাথায় পানি ঢেলে চুল মুছে….. হাতের তালু পায়ের তালু মুছে দিলেন…… শরীর মুছে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমার নায়ের উপর আর কিছুই করতে পারেন নি….. ধোয়া উঠা গরম ভাত আলুভাজি আর ডাল দিয়ে মাখিয়ে খাইয়ে দিয়ে প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলেন……….রাতে চাচি আমার সাথেই ঘুমালেন……. শরির ব্যাথায় সারারাত ই চোখের জল পরেছে….. অথচ যেই আমার চোখের জলের এতো সংকট…..
,
,
,
পরদিন ও জ্বরের জন্য চাচি আমায় স্কুলে যেতে দিলেন না….. সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে হাত মুখ ধুইয়ে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে গেলেন…….. আমাকে সাথে করেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই যায়নি…….. মাকে খুব মনে পড়ছিলো……… চাচি বলেছিলেন ফোন দিয়ে জানাতে কিন্তু আমিই জানাই নি অযথা চিন্তা করবেন…… সামান্য জ্বর ই তো…… সেরে যাবে…..দুপুরে ও চাচি খাবার নিয়ে এলেন……
,
,
,
আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকেলে সাদাফ ভাই আবার পড়াতে এলেন……. আমি তখন আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম পাশ ফিরে…… সুফিয়া খালা এসে জানিয়ে গেছে সাদাফ ভাইয়ের কথা…… পড়ার ঘরে যাবার আগে ভালো করে চাদরের মতো ওড়না টা দিয়ে নিলাম……. তারপর একপ্রকার পা খোড়াতে খোড়াতে সাদাফ ভায়ের সামনে গেলাম….. সাদাফ ভায়ের চেয়ার টা একেবারে দরজা বরাবর…… ঢুকতে গিয়েই চোখাচোখি হয়ে গেছে…… আমাকে মাথা মুড়িয়ে চাদরের মতন ওড়না নিতে দেখে ওনি বেশ অবাক ই হলেন…… তিনি তখন টেবিলের উপর আমার পরীক্ষার খাতা গুলো ঘাটছিলেন…..দরজা থেকে টেবিলে বসা পর্যন্ত আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন…… সাদাফ ভায়ের সামনে সেই মূহুর্তে নিজেকে খুব বড়সড় চোর মনে হচ্ছে…… কোনভাবেই স্বাভাবিক হয়ে মাথা তুলতে পারছিলাম না……. এদিকে সাদাফ ভাই ও কিছু বলছিলেন না…… তারপর একপ্রকার তোতলাতে তোতলাতেই ওনার কাছে মাফ চাইলাম….. আর এমন হবে না বলে কথা ও দিলাম……. আমি সাহস নিয়ে এতো কথা বলার পর ও সাদাফ ভাই কিছু বললেন না….. বেশ কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন…….. এবং সেটা খুব স্পষ্ট ভাবেই আমি শুনতে পেলাম……
,
,
,
——— দেখো তুলি তোমাকে আমি পড়ায় আজ ৩৪ দিন….. এতো দিন আমি তুমাকে সত্যিই গাধি দ্যা গ্রেট ভাবতাম…….. আর আমার এই ভাবনাটার জন্ম তুমিই দিয়েছো……তুমি এই একমাসে পড়াশোনাতে আমাকে কোন প্রকার ই হেল্প করো নি……. যা পড়া হয়েছে সেটা আমি তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছি……গনিত আর বিজ্ঞান ছাড়া বাদবাকি সব সাবজেক্ট এ তোমার মার্ক ৭৫-৮০ উপরে……… সেখানে তুমি গনিতে পেয়েছো ৭ আর বিজ্ঞানে ১১……. আর যাই হোক ইংরেজিতে ৮৫ মার্ক পাওয়া স্টুডেন্ট গাধা হতে পারে না…… মেইবি আ’ম নট পার্ফেক্ট ফর ইয়োর স্টাডি গাইডার…… আর গতকাল তোমাকে এভাবে মারা আমার ঠিক হয় নাই….. আসছি
,
,
——— সাদাফ ভাই…. না…. স্যার….. আই প্রমিস….. আই উইল শেয়ার উইথ ইউ মাই এব্রি উইকনেস রিলেটেড মাই স্টাডি…..
,
,
——— প্রমিস!!!!
,
,
——— প্রমিস
,
,
——— কাল টেবিলের উপর বই যেভাবে দেখে গিয়েছি ঠিক সেইভাবেই আছে…… কোন পড়াশোনাই করো নি সারাদিন!!!!
,
,
——— সাদাফ…… কাল সন্ধ্যা থেকেই তুলির জ্বর…….. দুপুরের দিকে ও বেশ জ্বর ছিলো…….. আজকে স্কুলে ও যেতে দিই নাই…… আপাও বাড়ি নেই….. আজ বাবা ওকে বকো না…..(চাচি)

,
,
,
সাদাফ ভাই আর সেদিন পড়ালেন না…….. কিন্তু অনেক ক্ষন পড়কশোনার ব্যাপারে আলোচনা করলেন……… আমার কাছ থেকেও মতামত নিলেন………. যাকে আমরা বলি সুস্থ আলোচনা……….. এই আলোচনা থেকে একটা সুবিধা হলো আর তা হলো আমি ওনার সাথে কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছি…….সেদিনের পর সাদাদ ভায়ের কাছে আমার আর মার খেতে হয় নি…….. খুব রেগে গেলে মাথায় খাতা রোল করে দু চারটে দিতেন দাত খিচিয়ে ………. তাতে বরং আমার আরাম ই লাগতো………… আমার ছোট ছোট ভুলএ বেশ রেগে যেতেন…….. দাতে দাত চেপে আবার বুঝাতেন……. একবার না পারলে একশো বার দেখাবো কথাটা আমি উসুল করেই ছাড়লাম…….. এমনও হয়েছ্এ একটা ম্যাথ ওনি আমাকে একঘন্টায় ছাব্বিশ বার বুঝিয়েছেন কিন্তু করতে গিয়ে আবার ভুল করেছি……. তখন নিজের কাছে নিজেরই খারাপ লাগতো……. এতো গাধা অঙ্কে আমি কি করে হলা……সাদাদ ভাই তখন দাতে দাত চেপে চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস ফেলে নিজের রাগ সংবরণ করে আবার নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করতেন……. মাঝেমাঝে আমি হাল ছেড়ে দিলে বলতেন তুমি হাল ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়ছি না…… এর শেষ আমি করেই ছাড়বো…….. সেদিন থেকে সাদাফ ভায়ের চায়ের পাশাপাশি আমার জন্য হলুদ মেশানো গরম দুধ বা বাদামে ফেটা দুধ বা কখনো হরলিক্স পড়ার সাথে যোগ হলো……. আর এসব হচ্ছিলো সাদাফ ভায়ের ই কথা অনুসারে……. আমাকে সময় ও বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন…… আমার প্রতি সাদাফ ভায়ের পরিশ্রম দেখে মা নিজে থেকেই তার বেতন বাড়িয়ে দিলেন……. বিজ্ঞানের জন্য ও ওনি নানান ট্রিক শিখিয়েছেন আমাকে……. খুব কঠিন গুলো নিজে মুখে মুখে পড়িয়ে মুখস্ত করিয়ে দিতেন…… আর বাকি গুলো গল্প আকারে থিম মাথায় ঢুকিয়ে দিতেন……… সাহিত্য নিয়েও মজার মজার তথ্য গুলো বলতেন……..
,
,
,
পরের পরীক্ষায় গনিতে পেলাম ৪৯ আর বিজ্ঞানে ৬৭…….. রেজাল্ট দেখে সবচেয়ে খুশি আমি সাদাফ ভাইয়ের মুখেই দেখেছিলাম……. গম্ভীর মানুষটাকে হাসলে যে এতো সুন্দর লাগে সেদিন আরচোখে প্রথম দেখলাম… দেখতে দেখতে এসএসসি দিয়ে দিলাম……ততোদিনে সাদাফ ভাই অনার্স কম্পলিট করে সিটি কলেজে চাকরি পেয়েছেন……… ফাস্ট ক্লাস রেজাল্ট শুনে মা সাদাফ ভাইকে ডেকে আনিয়ে কলেজ ভর্তির দায়িত্ব টা ও দিয়ে দিলেন……. সাদাফ ভাই নিজে আমাকে নিয়ে সিটি কলেজে ভর্তি করে দিলেন…….কলেজে ভর্তির পর ও সাদাফ ভায়ের কাছে পড়া বহাল রইলো……… আমার সবকিছুতেই সাদাফ ভাইয়ের মতামত আবশ্যক………. মাও আমার ব্যাপারে সাদাফ ভায়ের উপর নির্ভরশীল খুব….. আর আমার সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করা সাদাফ ভায়ের মৌলিক অধিকার হয়ে গেছে ততোদিনে…… তুলি এভাবে চলবা…… ভালোভাবে কথা বলবা…… এমন করলে কেন!! আজকে ওখানে দেখলাম কেন….. এই সময় বাইরে কেন!! ফোনে এতো কথা কিসের……খাওয়া দাওয়া করো না কে!!
সবকিছু মানে সবকিছু তে…… মা,ও আমার সবকিছু সাদাফ ভাইকে বলে দেয়…… কবে যানি বলে আজকে এতো বার শ্বাস ফেললে কেন!!! কোনকিছু করতে গেলে মা বাবা কি বলবে তা মাথায় আসে না…… সাদাফ ভাই জানলে আস্ত রাখবে না এই কথাটাই মাথায় ঘুরে……..
,
,
,
০৪
,
,
,
কলেজ থেকে দুইজন বান্ধবি মিলে বাড়িতে না জানিয়ে জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম….. অনেকটা জংলা টাইপের ছিলো তখন…… বন্ধবি দুজন তখন আমাকে আশেপাশে থাকতে বলে নিজেদের প্রেমিকের সাথে হাতে হাত রেখে ঘুরতে চলে গেলো……. রাগে দুঃখে নিজের মতোন হাটা ধরলাম…… খবিশ গুলোর মনে এই চলছিলো জানলে কখনো আসতাম না…… তবে নিরিবিলি এতো সুন্দর পরিবেশ পেয়ে শয়তান গুলোকে মাফ করে দিয়েছিলাম………….. আনমনে নিজের মতন গাছপালা হাতরে ঘুরেফিরে দেখছিলাম সব……. সামনে তাকিয়েই দেখি সাদাফ ভাই কার সাথে যেনো কথা বলছেন আর সিগারেট ফুকছেন……..সেদিনই প্রথম জানলাম সাদাফ ভায়ের সিগারেট খাবার কথা…….আমি ওনাকে দেখে কেটে পড়ার আগেই ওনি আমাকে দেখে ফেললেন……… তারপর সামনের লোক্টাকে কি যেনো বলে আমার সামনে এসে দারালেন……
,
,
,
——— তুমি এখানে কি করছো!!!!
,
,
এই কথা বলার সাথে সাথেই সাদাফ ভাইয়ের নাক মুখ ফোড়ে সিগারেটের ধোঁয়া আমার মুখের উপর এসে পড়লো……… সিগারেটের স্মেল একদম মুখে চলে গিয়েছে…… মনে হচ্ছে আমিই খেয়েছি সিগারেট………. উত্তর না পেয়ে সাদাফ ভাই দাত খিচিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসতেই আমি সাইড হয়ে হরহর করে বমি করে দিলাম……………… থেমে থেমে দুই দফায় বমি করতেই ওনি আমাকে টেনে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেন…… বার কয়েকবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কার সাথে এসেছি কিন্তু আমি মুখ খুলে নি কিভাবে করবো!!! হারামি গুলো গাছের আড়ালে দারিয়ে সমানে কান ধরে আকুতি মিনতি করে যাচ্ছে ইশারা ইঙ্গিতে…….. কারণ সাদাফ ভাই জানতে পারলে একেবারে পিলে চটকে দিবে……. কলেজের বাঘা স্যার বলে তো আর এমনে এমনে খ্যাতিমান না তিনি….. জবাব না পেয়ে টানা ত্রিশ মিনিট কড়া রোদে দার করিয়ে রেখেছে…… আর নিজে গিয়ে ছাউনির নিচে বসে রয়েছে……. ঘামে একেবারে নেয়ে গেছি…….. রোদে চোখ অন্ধকার দেখছি…….. দয়া হলো ওনার টেনে আমাকে ছাউনির নিচে নিয়ে গেলেন…….. প্রথমে নড়তে না চাইলে…….
,
,
,
——— ঘাড় দেখালে একদম ঘাড় ভেঙে এখানে পুতে রেখে দিবো বলে দিলাম……. কেউ টের ও পাবে না…………. চুপচাপ বসো এখানে……
,
,
,
আমাকে রেখেই ওনি সামনের দিকে চলে গেলেন…… বেশ কিছুক্ষন পর দুহাতে ডাব নিয়ে ফিরে এলেন….. একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন জলদি শেষ করতে…….আমার তখন কি হলো জানি না…… ডাব হাতে দেওয়া মাত্রই ফেলে দিলাম…… অন্য ডাব টা হাতে নিয়ে দশ মিনিট বসে রইলেন তিনি……. আমি তখনো দারিয়ে আছি ঠাই….. এদিকে রোদের ঝিলিক নিস্তেজ হয়ে আকাশে মেঘ করছে……. সাদাফ ভাই আমার হাত ধরেই ছাউনি থেকে বের হয়ে এলেন……. আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম…….. তিনি আর কিছু বললেন না……. উনার পিছু পিছু হেটে ভার্সিটি গেইট আসি সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলেন………. কলিং বেল চাপতেই মা দরজা খুলে দিলেন……. আমি সোজা ঘরে ঢুকে দরজার পিছনে চলে গেলাম…….
,
,
,
——— সাদাফ…. ভেতরে আসো
,
,
——— না খালাম্মা….. আমার কাজ আছে একটু….. এতে স্যালাইন গুলা আছে তুলিকে খাইয়ে দিবেন….. আসসালামু আলাইকুম……. মায়ের হাতে ডাবটা দিয়ে..
,
,
——— আলাইকুম আসসালাম
,
,
,
,
চলবে….

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে ১

0

০১
,
,
,
সাদাফ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় টা আহামরি কোন বিশেষ ঘটনা সাপেক্ষে নয়……. ক্লাস নাইনে ওঠার পর আগের গৃহ শিক্ষকের অন্য জেলায় সরকারি চাকরি হবার সুবাদে ওনাকে রাখা হয়…… তখন তিনি আমার চাচাতো ভাই রিয়াদকে পড়াতেন…….. সেবছর রিয়াদ এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাদাফ ভায়ের কাছে পড়ার ইতি টেনেছিলো……… বাড়ি থেকে দূরে এসে নিজের খরচে তিনি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকস নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন……. সেই সময় পুরাতন টিউশনির অবসান মানেই আর্থিক টানাপোড়ন……..তখন আমাকে পড়ানোর প্রস্তাব টা ছিলো তার কাছে মেঘ না চাইতেই জলের মতোন……
,
,
,
রিয়াদ মানে আমার চাচাতো ভাই যবে থেকে শুনেছে সাদাফ ভাই আমাকে পড়াবেন তখন থেকেই আমাকে তার রাগ সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিচ্ছিলো…… সেই সুবাদে সাদাফ ভাই তখন আমার কাছে ছোট খাটো একটা যমের মতোন……মানুষটাকে না দেখেই শুনে শুনে ভয় পাওয়া যাকে বলে……. অঙ্ক আর বিজ্ঞানের দূর্বলতার জন্য এই দুটোকে মেজর সাবজেক্ট হিসাবে দিয়ে বাকি গুলো পড়া দেওয়া আর নেওয়ার মতোন করে তাকে রাখা হয়েছে……ব্যাক্তিগত ভাবে সাদাফ ভাই ছিলো বেশ গম্ভীর, চুপচাপ এবং ভয়ংকর রাগী স্বভাবের…… যদি ও সবকিছু রিয়াদের থেকেই শুনা……
,
,
,
ছাত্রী হিসাবে খুব তুখোড় না হলেও গাধা ছিলাম না একেবারে……. গণিত বুঝতে বেশ সময় লাগতো আর বিজ্ঞান!!! এই বাবাজি তো আমাকে মনে হয় কোন জন্মে সহ্যই করতে পারতো না….. সব কিছু একেবারে মাথার উপর দিয়ে রকেট গতিতে ছুটে যেতো……কোন মতেই তাকে আমার মনে ধরে রাখা সম্ভব ছিলো না……. এই দুই সাবজেক্টে পাশ করার সব ক্রেডিট আমার আগের শিক্ষকের…… সারাবছর গুনে গুনে ইম্পর্টেন্ট অংক গুলা করাতে করাতে একেবারে মুখস্থ করিয়ে দিতো…… তাই পাশ মার্ক চলে আসতো কোন রকমে……
,
,
,
সাদাফ ভাই যেদিন আসলো সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো…… এক ঝাক বর্ষা ছাতার উপর নিয়ে ওনি আমাকে পড়াতে এলেন…….. প্রথম দিনই আমাকে বলেছিলেন…. রিয়াদ আমাকে সাদাফ ভাই বলে ডাকে….. চাইলে তুমি সাদাফ ভাই ও বলতে পারো বা স্যার ও ডাকতে পারো…..আমিও জগাখিচুড়ি বানিয়ে কখনো কখনো দুইভাবেই ডাকতে শুরু করি……….. শিক্ষক হিসাবে সাদাফ ভায়ের কোন তুলনা নেই…… একটা মানুষ এতো কিছু কি করে জানে…… ওনাকে দেখে আমার রীতিমতো হিংসা হতো……. কিন্তু এতো ভালো শিক্ষক পেয়েও পড়াশোনায় আমার কোন উন্নতি হচ্ছিলো না…….সে যখন করাতো বুঝতাম সামনে করতে বললে করেও দিতে পারতাম কিন্তু বাসায় হোমওয়ার্ক করতে নিলেই সব খেয়ে ফেলতাম………. সব ভুলে একাকার…..ব্যাপারটা হচ্ছিলো আমার ভয় থেকে…… কারণ বুঝানোর সময় যেই প্রশ্ন গুলো মনে আসতো সেগুলো ভয়ের কারণে মনেই থেকে যেতো মুখে আর আসতো না…..যথারীতি আমার বাড়ির কাজ তাকে দেখাতে পারতাম না আর ভুলে যাবার কারনে সামনে করতে ও পারতাম না……
,
,
,
বাবা কাজের সূত্রে দীর্ঘদিন যাবত সৌদিতে আছেন……. মা ও স্থানিয় হেলথ ককমপ্লেক্স এ চাকরি করতেন……. আর কোন ভাই বোন না থাকায় আমি বাড়িতে একা বলে একজন মহিলা রাখা হয় আমার জন্য……. সে আর তার চার বছরের ছেলে এসে সারাদিন থাকতো……… তার সাথে বাড়ির কাজ ও করতো…….. পড়া না পাড়ায় বিচার দেবার জন্য কোন গার্ডিয়ান না পেয়ে প্রথম দু চার দিন বেশ বুঝিয়ে শুনিয়ে দাত খিচিয়ে পড়ালো……. এর জন্য তিনি রিতীমত ছোট খাটো যম থেকে বেশ বড়সড় যমে রুপান্তরিত হলেন আমার কাছে…..এবং শেষ পর্যন্ত ব্যাপার টা বেতে গিয়ে ঠেকেছে আর তার সাথে সাথে আমার কপালে জুটেছে একটা গাধার উপাধি…… হাতের পিঠে বেতের নাচন ক্রমেই বাড়ছিলো দিনকে দিন……… উপায় না পেয়ে শুরু করলাম চোখ বুঝে অংক মুখস্থ করা….. যেনো তেনো মুখস্থ না পুরাই তোতাপাখি………. এই দূরাবস্থার কথা মাকেও জানাতে পারছিলাম না…….. সব শেষে দোষ গিয়ে পড়বে আমার ঘারে…..
,
,
,
সাদাফ ভাই আমাকে পড়াতে শুরু করার মাস খানেক পরেই স্কুলে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো…… সব পরীক্ষা ভালো দিলেও গনিত পরীক্ষায় যা মুখস্ত করে গিয়েছি তার থেকে শুধুমাত্র কমন পড়লো তেরো নাম্বার…… দেখাদেখির সুযোগ ও পাচ্ছিনা।।।।।। যা গার্ড দিচ্ছিলো….. উফফফফ….. আর বিজ্ঞান যে কি লিখেছি….. বেশ চিন্তায় ছিলাম স্যার না অজ্ঞান হয়ে যায়…….. এ তো গেলো খাতার খবর…….. পরীক্ষার অংক প্রশ্ন দেখেতো সাদাফ ভাই বেজায় খুশি…… একমাসে যতোটুকু করিয়েছেন তার থেকেই নাকি ৫৬% কমন পড়েছে……আমি তো সেদিন ওনার মুখে এই কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম…….
,
,
——— এই তুলি ৯ নং কোশ্চেন টাতে কিন্তু নাম্বার পালটে দিয়েছে তুমি দেখে করেছো তো!!! প্রশ্ন টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে…….
,
,
,
প্রশ্ন হাতে নিয়ে আমার অবস্থা হয়েছে” অভাগা যেদিকে চায় সাগর ও শুকিয়ে যায়” এর মতোন……কমন ই পড়েছিল তেরো নাম্বার……… এর মধ্যে বজ্জাত স্যার নাম্বার চেঞ্জ করে দিলো!!!! ১০ টা নাম্বারই গেলো!!! উফফফফ
,
,
——— কি হলো!!!
,
,
——— জ্বি স্যার…
,
,
,
০২
,
,
,
যথারিতি পরীক্ষার দুই সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হলো খাতা দেখানো………… গ্রীষ্মের ছুটির জন্য সব খাতা একবারে একদিনেই দিয়ে দিলো……… সবগুলোর খাতার নাম্বার গুনে দেখলেও অংক আর বিজ্ঞান বাবাজীদের খাতা পেয়ে আমার অবস্থা নব বধুর মতো…….. খাতা পেয়ে যে ব্যাগে ভরেছি আর ভুলেও খুলে দেখিনি……
,
,
,
স্কুল থেকে গিয়ে কান্নাকাটি করে মাকে রেজাল্ট দেখালাম……….প্রথমে রাগারাগি করলেও আমার কান্নাকাটির তোরে মেনে নিলেন…… যতই হোক তার একমাত্র সন্তান আমি……. বাবাও ছিল দূর প্রবাশে……. বুকে জড়িয়ে বেশ বুঝালেন আর বললেন পরের বার যেনো এমন না হয়……সাদাফ ভাই তখন আমাকে সপ্তাহে পাঁচ দিন পড়াতেন…… শুক্রুবার সহ…….. রেজাল্ট জানানোর দিন কি এক ঝামেলার জন্য ওনি আসতে পারেন নি……. তাই মাকে ফোন দিয়েছিলেন জানালেন আর মা ও তাকে জানিয়ে দিলো রেজাল্টের কথা……. তাদের ফোনের কথা বলার সময় আমি সামনের সোফায় ই বসে ছিলাম….. পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে নূপুরের আওয়াজ শুনছিলাম…….. কিন্তু মা যেই রেজালটের খবর টা দিলো আমার আত্নার পানি এমনেই উবে গিয়েছে……এদিকে রাতেই খবর এলো নানির পা পিছলে পরে কোমড়ের হার সরে গেছে……. মা কান্নাকাটি করে বাবাকে ফোন দিলেন…….. ঠিক হলো রিয়াদ নয়তো চাচা মাকে নিয়ে যাবেন………. আর আমি বাড়ি থাকবো সুফিয়া খালার সাথে….. সকালে মা চলে গেলেন…….. আমাকে আদর করে কপালে চুমু দিয়ে….. আর খালাকে বলে গেলেন আমি যা খেতে চাই তাই যেনো রান্না করে দেয়…… রাতেও যেনো তিনি আমার কাছে থাকেন…..
,
,
,
সেদিন আর স্কুলে যাই নি…….. মায়ের ফিরতে দুদিন…….. বিকেল চারটের দিকে সাদাফ ভাই পড়াতে এলেন….. মূলত উনি আসেন পাঁচটার দিকে……..আমাকে পড়িয়ে গিয়ে নাকি কোথাও যাবেন তাই জলদি আসা…… এসেই সবার আগে পড়লেন আমার রেজাল্ট নিয়ে……. আমি পড়ার টেবিলে না বসে দারিয়ে থেকেই ব্যাগ থেকে একটা একটা করে খাতা খুলে তার হাতেই দিচ্ছিলাম সব শেষে বিজ্ঞান আর অংক খাতা হাতে নিয়ে উনি থ হয়ে বসে আছে…… বার কয়েক খাতা ঘেটে দেখলেন……. প্রথমত মুখ না খোলার কারনে বা হাতে পেন্সিল দিয়ে হাত চেপে ধরে বেশ কয়েকবার মোচড় দিলেন……… তার শত সহস্র প্রশ্নের তোপে আমার অংক মুখস্তের কাহিনি বলতে বাধ্য হলাম……তারপরের যেই মানুষ টা ছিলো সেটা আর যাই হোক সাফাদ ভাই ছিলো না……. ছিলো এক মানুষ খেকো হিংস্র জন্তু……………. ওনি বার বার বলছিলেন একবার না বুঝলে একশো বার বুঝাবো কেন আমি এসব করলাম…….. আমার চুপচাপ থাকাতে ওনার রাগে আরও ঘি পড়লো………. রোলার নিয়ে বেশ মারলেন………… হাতে, পিঠে, পায়ে……. এতো মার খেয়েও আমার চোখে কোন জল ছিলো না……. কি করবো….. কান্না আমার একদম আসে না…… শক্ত হয়ে দারিয়ে ছিলাম…….. মার যে একেবারে খাই নি তা না কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সেদিনের মতো মার আমি আমার বাকি জীবনে খাই নি…… সাদাফ ভায়ের হাতের রোলার টা সেদিন পড়ার টেবিলের উপর ঢিল ছুড়ে ফেলে ওনি চলে গিয়েছিলেন………… এতো মার খেয়েও বাকা রোলার টার দিকে তাকিয়ে আমার কাওন রাগ হলো না……. উল্টো ভেতর থেকে একটাই কথা বাজছিলো……. সাদাফ ভাইয়ের কাছে আমার মাফ চাইতে হবে……. আমি ওনাকে মিথ্যা বলেছি…… মাফ চাইতে হবে……
,
,
,
চলবে….

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে
লেখনিতে: চৈত্র রায়

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

অন্ধকার রুম , চারদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে । ভালোবাসা গুলো আজ পালিয়ে গেছে । এখানে না আছে ভালোবাসা , না আছে অনুভূতি । অনুভূতিরা আজ এখানে মৃত ।

ঘড়ির কাটাতে রাত ১০ টা বেজে ১৫ মিনিট । ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটা রুম চুপচাপ হয়ে আছে । এখানে চাপা আর্তনাদ আর যন্ত্রণা । তবুও বেঁচে থাকতে হচ্ছে । সম্পদ বলতে এখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই । আছে শুধুই এক নিঃস্ব দীর্ঘশ্বাস । যা নিয়ে বেঁচে থাকা বড্ড কঠিন ।

বারিধারায় অবস্থিত এই ফ্ল্যাটে আজকাল আর হাসির গুনগুন শব্দ শুনা যায় । সব স্মৃতি যে আগের ফ্ল্যাটে ফেলে এসেছে সবাই । এই ফ্ল্যাটে শুধুই কান্না আর কষ্ট । এই ফ্ল্যাটে শুধুই হাহাকার । এই ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে শুধুই অন্ধকার এখন ।

জীবন থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নিতে হয় । এক জীবনে মানুষ হয়তো সবটা পায় না , জীবন প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে । বদলে যায় স্বপ্ন গুলো , বদলে যায় দিন গুলো । কিন্তু বদলায় না স্মৃতি গুলো ।

ভালোবাসা যেখানে আর হার মানতে বাধ্য হয় অভিমানের কাছে । ভাগ্য যেখানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় ভালোবাসাকে । ভাগ্য যেখানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কিছু রক্তের বাঁধনকে । ভাগ্য যেখানে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আলোকে ।

অনেক অভিমান হয় এই ভাগ্যের উপর । কিন্তু এখানে না পারা যায় অভিমান পুষে রাখতে । না পারা যায় আল্লাহকে ভুলে থাকতে । না পারা যায় ৫ ওয়াক্ত নামাজ থেকে বিরত থাকতে । কথায় বলে আল্লাহ নাকি যা করেন ভালোর জন্যে করেন । কিন্তু আল্লাহ ভালো কর‍তে গিয়ে তার বান্দাদের চরম কষ্টের সামনে ফেলে দেন । তখন সেই আল্লাহ পাককেই প্রয়োজন পড়ে সেই কষ্ট গুলো ভুলে থাকার জন্যে ।

এমতাবস্থায় ফোন বেজে ওঠে , হাতে নিয়ে দেখতেই পরিচিত এক নাম্বার । রিসিভ করে কানে নেয়া ,

– হ্যালো ,
– কেমন আছো ?
– বেঁচে আছি কোন রকম ,
– যা হয়েছে ভুলে যাও । কষ্ট আঁকড়ে আর কত দিন বেঁচে থাকবে ।
– ওর পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলছে ।
– ডক্টর কি বলে ?
– ব্রেইনে সমস্যা , মানষিক ভাবে ভেঙে পড়ায় এই অবনতি ।
– একটা বছর তো এইভাবেই কেটে গেলো ।
– তবুও উন্নতি দেখছি না ।
– তোমার গলা ধরে গেছে যে , কাঁদছিলে নাকি ?
– আল্লাহ পাক আমাকে কান্না দিয়েছে এখন তো কান্না ছাড়া উপায় দেখিনা ।
– আফসোস করে কি হবে আর , সে তো ফিরে আসবে না ।
– আমার পাপের ফল নিষ্পাপ প্রাণটা পেলো ।
– ও-কে সামলে রেখো , এখন তো পাগলামি করলে হবে না । এই সময় আরও রিস্ক হয়ে যাবে ব্যাপারটা ।
– তাই তো ২৪ ঘন্টা লোক রাখা আছে । মা আছেন , সাথে বুয়াও আছে ।
– আগামী কাল তার দ্বিতীয় জন্মদিন , তাই না ?
– মনে রেখেছো তাহলে তুমি ?
– আমিও তো কম পাপ করি নি ।
– এমন যন্ত্রণা যাতে আল্লাহ পাক আমার শত্রুকেও না দেয় । যাই হোক মেহেরাব কেমন আছে ?
– ভালো আছে , তার বাবার সাথে খেলছে ।
– মেহেরাবকে নিয়ে আর এসো না এখানে , আর সেইদিনের জন্যে আমি দুঃখিত ।
– ছিহ , কি সব বলো তুমি । আমি মানছি আমি খারাপ আমি জঘন্য , তাই বলে মায়ের মন বুঝবো না ? আমিও বুঝি একজন মায়ের শোকটা কত বড় আর কত কঠিন হতে পারে ।
– আচ্ছা ভালো থেকো । আল্লাহ হাফেজ
– হু , আল্লাহ হাফেজ , ও-কে দেখে রেখো ।
– হু ,

লাইন কেটে চোখের চশমা টা খুলে চোখের পানি মুছে নেয় সে । মানুষ বদলায় , কারণে অকারণে বদলায় । ভালো খারাপ হয় আবার খারাপ ভালো হয় । এই নারীটিও হয়তো ভালো হয়েছে এখন । বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে তার । তবুও সে শক্ত হয়ে আছে ।

অন্ধকার রুমে লাইট জ্বালিয়ে রুমটি আলোকিত করে সামনে এসে বসেন এক বয়স্ক লোক । বয়স্ক লোকটিও অনেকটা আধ-মরা হয়ে আছেন । শোক সামলাতেও এক বছর লেগে গেছে , তবুও সামলে উঠছে না । ছেলের পাশে এসে বসে ছেলের কাঁধে হাত রাখেন রহমান আলী । আজকাল স্পর্শটা বড্ড বেশি চেনা হয়ে গেছে । হাতের স্পর্শতেই বুঝে যায় তার বাবার হাত ।

চোখের পানি মুছে বাবার দিকে নজর তুলে তাকায় ইরফান । হ্যাঁ , অন্ধকার রুমে বসে থাকা নিঃস্ব মানুষটা আর কেউ নন , সে ইরফান । জনাব ইরফান মাহমুদ । ছেলের চোখে পানি দেখে নিজেকে সামলে নেন রহমান আলী ।

– আজকেও এইভাবে বইসা আছো ?

বাবার কথায় হতভাগ্যদের মত তাকিয়ে থাকে ইরফান । কি বলবে , কি করবে জানা নেই তার । তবুও কথা বলে সে ,

– কি করবো আর ,
– বেয়াইন বললো আজকে নাকি পাগলামি বেশি করছে ।
– রোজ রোজ বেড়েই যাচ্ছে ।
– এই সময় এমন পাগলামি ভালো না , ক্ষতি হবে পরে ।
– দেখছি কি করতে পারি ।

এমন সময় রাবেয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ড্রইং রুমে আসেন । আবেয়া বেগমকে দেখে ইরফানও বুঝে যায় আবারও হয়তো সে কিছু করেছে । রাবেয়া বেগম এসে ইরফানের সামনাসামনি বসে ।

– বাবা শান্ত করতে পারি না তো ,
– কি করেছে আবার মা ?
– খাওন খায় না তো ।
– আচ্ছা আমি যাচ্ছি আপনি এইখানেই থাকেন ।
– তুমি গেলে সব ঠিক হইবো , যাও বাবা যাও ।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইরফান । পা বাড়ায় ভেতরের রুমের দিকে । তার জানা নেই কি করে শান্ত করবে ভেতরে থাকা সেই মানুষটাকে । সাহস করে রুমে পা দেয় ইরফান । ভেতরে থাকা মানুষটা তখন কাপড় চোপড় গুছাচ্ছে আর বিড়বিড় করছে ।

ইরফান সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তার । ইরফানকে দেখে সামনে অবস্থিত নারীটির মুখে হাসি ফুটে উঠে । ইরফানের দুই হাত ধরে ইরফানের খুব কাছে চলে আসে সে ।

– তুমি আসছো ,,,, আসছো তুমি । দেখো না , জামা কাপড় গুলা রাখার জায়গা নাই । এত বড় বাসা এত বড় রুম কিন্তু এই টুকুন ছোট ছোট জামা গুলা রাখার জায়গা নাই , এটা হয় কখনো বলো তুমি ।
ভালো হয়েছে তুমি আসছো । মাকে বকা দিয়ে দেও তো , আমি তখনই এইগুলা গুছাই তখনই মা খালি আসে । আমার এই টুকুন ইন্নির সাথে মায়ের কিসের এত রাগ আমি বুঝি না । নানীরা নাতনিদের কত্ত আদর করে আর আমার মা সে আমার এইটুকুন ইন্নিটাকে সহ্য করতেই পারে না ।

৫ মাসের ভরা পেটটা নিয়ে ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি আর কেউ নয় । সে ইরফানের বেলীফুল । তার বেলীফুলটা আজ মানষিক রোগী । তার বেলীফুলটা আঘাত আঘাত পেতে পেতে আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে । বেলীকে দেখলে ইরফান নিজেকে আর সামলাতে পারে না । আপনা আপনি চোখ দিয়ে তার পানি আসতে থাকে ।

মানষিক রোগটা আস্তে আস্তে বড় আকার ধারণ করছে বেলীর মাঝে । বেলীর মানষিক রোগটা ধরা পড়ে ইন্নির মৃত্যুর পর থেকেই । হ্যাঁ , ইন্নি আর নেই । ইরফান বেলীর ছোট ইন্নিটা আজ আর এই দুনিয়ায় নেই । আজ থেকে এক বছর আহে প্রচন্ড জ্বর , জন্ডিস আর নিওমোনিয়ায় শেষ হয়ে গেছে তাদের ছোট পরীটা ।

ইরফান বেলীকে কিভাবে শান্ত করবে ভেবে পাচ্ছে না । আজ মিনুটাও নেই । মিনু থাকলে অন্তত বেলীকে সামলে নিতে পারতো । ইরফান চোখের পানি মুছে হাসিমুখে বেলীর গলা জড়িয়ে ধরে ।

– কি হয়েছে আজ আমার বেলীফুলের ? মায়ের উপর রাগ হয়েছে বুঝি ।
– হবে না কেন বলো , মা ইন্নির জামা গুলা সরাতে কেন চায় । ইন্নি কাঁদে মা কি তা বুঝে না ।

বেলী মানতেই চায় না ইন্নি আর নেই । তার ছোট মা টা যে আর নেই তা সে বুঝতেই চায় না এবং মানতেই চায় না । বেলী শেষ কেঁদেছিল ইন্নিকে যখন গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় । আর তার পর দিন থেকেই আবারও নরমাল হয়ে যায় । কতবার বলা হয়েছে ইন্নি আর নেই । ইরফান আর সামলাতে না পেরে বেলীকে টেনে হিচরে ইন্নির কবরের সামনে পর্যন্ত নিয়ে দাড় করিয়েছে । কারণ , তখন বেলীর মেন্টাল পজিশন খুব খারাপ ছিল ।

আর সেইদিনই বেলী প্রথম ইরফানের গায়ে হাত তুলে । কথা গুলো হুট করেই মনে পড়ে যায় ইরফানের । নিজেকে সংযত রেখে ইরফান বেলীকে খাটে বসায় । ঠান্ডা মাথায় শান্ত গলায় বেলীকে বুঝাতে শুরু করে ,

– এইযে দেখো , আমার দিকে দেখো । এইযে তোমার পেটে যে এখন ইন্নি আছে । তুমি যে এমন করো সে তো দেখছে সব । তা মা কারো কথা শুনে না , খায় না । এইগুলা কি ভালো কাজ ?

ইরফানের কথায় নিজের পেটে হাত রাখে বেলী । সে বিশ্বাস করে তার পেটের মধ্যে চলে গেছে ইন্নি । মাথার সমস্যাটা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে , সব আজেবাজে চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে তার ।

– হ্যাঁ , ঠিক ঠিক । তুমি তো ঠিক বলছো । ইন্নি তো দেখতেছে সব । আমি এত রেগে যাই কেন ?
– হ্যাঁ , সেটাই তো । বুঝেও কেন অবুঝের মত করো বেলী । কেন খাও না । ইন্নিকে আনবা না আবার ?
– ইন্নিটা আসলে এমন মাইর দিবো , কেন যে আবার পেটের ভিতরে চলে গেলো ।
– আচ্ছা আমরা এক সাথে মারবো তাকে । এখন খেয়ে নেও । ডক্টর না বলছে না খেলে ইন্নি আসবে না । ইন্নিকে আনতে হলে খেতে হবে তো ।
– এই খাবার গুলাতে গন্ধ আসে তার জন্যে খাই না ।
– গন্ধ লাগবে না । তুমি খাও । দেও আমি খাইয়ে দেই ।
– দেও দেও তুমিই খাইয়ে দেও । না হয় ইন্নিটাও কাঁদবে ।

বেলীকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ইরফান । ৫ মাস শেষ হতে চললো তার । তার খেয়ালই নেই সে আবার মা হতে চলেছে । গত ছয়মাস আগে সেই রাতের মিলনের ফল আজকের এই অনাগত সন্তান । বেলীর মাথায় হাত রেখে অতীতে ডুব দেয় ইরফান ।

ইন্নির সেদিন প্রচুর জ্বর এসেছিল । পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার । হাসি খুশি বাচ্চাটা আস্তে আস্তে চোখের সামনে নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে দিন দিন । পাগল প্রায় বেলী তখন দিন রাত মেয়ের সেবায় নিয়োজিত । ডক্টর বলে নিওমোনিয়া হয়েছে । মাথা আরও খারাপ হয়ে যায় বেলী আর ইরফানের । ১ মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা শেষ করে ইরফান । এই ডক্টর না ওই ডক্টর , এই মেডিসিন না ওই মেডিসিন । কিছুই বাদ রাখে নি ইরফান । বেলী দিন রাত হত্ত্বে দিয়ে পড়ে থাকতো জায়নামাজে । সন্তানের আরোগ্য কামনায় ।

চোখের সামনে ইন্নির শেষ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি তারা । এক সময় বেলী খেয়াল করে ইন্নির চোখ মুখ হলুদ আকার ধারণ করেছে । বেলী জানতো এইসব জন্ডিসের লক্ষন । আবার ইন্নিকে নিয়ে দুজন ছুটে ডাক্তারের কাছে ।

হ্যাঁ , যা ভেবেছিল তাই হয়েছে । ইন্নির জন্ডিস হয়েছে এবং তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে । পাগল প্রায় বেলী ইরফান তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় । তাদের দুজনের জীবনে ফেরেশতা হয়ে আসা ইন্নিকে আর হাসতে দেখা যায় না । সারাক্ষণ কান্নার উপরে থাকতো বাচ্চাটা । ইরফান অফিস থেকে ফিরে এসে ইন্নির মুখ থেকে বা,,,,,,,বা,,,,, ডাক শুনে না । হাত বাড়িয়ে ইরফানের কোলে মাঝে সাঝে আসে ইন্নি । মিনুও কোলে কোলে রাখে ইন্নিকে ।

একদিন দুপুরে বেলী ইরফানের পাশে এসে বসে । সেদিন ইরফানের ছুটি ছিল ।

– শুনছো ?
– হু বলো ,
– ইন্নিটার শরীর আবার খারাপ হয়েছে । এখন তো কিছুই মুখে দিচ্ছে না ।
– বুঝতেছি না কি করবো ।
– মা তো তাবিজ দিলো , কই কিছুই হচ্ছে না ।
– এইসব তাবিজে বিশ্বাস নেই আমার ।
– আরেকজন শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখালে ভালো হতো না ?
– হ্যাঁ , খবর নিয়েছি । একজন আছেন , ওনার কাছে কাল নিয়ে গেলে কেমন হয় ?
– তাহলে তাই-ই করো
– আচ্ছা , টেনশন নিও না । আল্লাহর রহমতে ভালো হয়ে যাবে আমার আম্মাজান ।

পরদিন ,
ইরফান আর বেলী ইন্নিকে নিয়ে সেই ডক্টরের কাছে যান । ডক্টরও সব চেক-আপ করে মেডিসিন দেয় । সব নতুন মেডিসিন দেয় তিনি । আশার আলো দেখতে পায় ইরফান আর বেলী ।

বেলী ডক্টরের কথা অনুযায়ী ইন্নিকে নিয়মিত সব মেডিসিন দিতে থাকে । কোন রকম অনিয়ম করে নি সে তার সন্তানকে সুস্থ করতে । আর সময়ের সাথে সাথে আল্লাহর অশেষ রহমতে ইন্নি কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে । পরীর মত ইন্নি তখন আবার হাসতে থাকে , খেলতে থাকে । বাবাকে দেখলেই মায়ের পিছনে গিয়ে লুকায় । ছোট ছোট পা গুলো দিয়ে হেটে হেটে ইরফানকে ছোয়ার চেষ্টা করা তার নিয়মিত রুটিন ছিল । মায়ের ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে খিল খিল হাসতে থাকে ইন্নি । তার এই হাসির শব্দে প্রাণ ফিরে পায় ইরফান আর বেলী ।

ইরফান আর বেলী তাদের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে তাদের ইন্নিকে আগলে রাখে । সারাক্ষণ ইন্নি ইন্নি আর ইন্নি । পুরো বাসা ইন্নিতেই মগ্ন থাকে ।

ইন্নি সুস্থ হওয়ার ১ সপ্তাহ পর , ইরফান ইন্নি আর বেলীকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় । ইন্নিকে নিয়ে বিনা টেনশনে ইরফান আর বেলী দুহাতে সুখ গুলো কুড়িয়ে নেয় । সেখানেই হঠাৎ করে রুবির সাথে দেখা হয়ে যায় । বেলী ইরফান আর ছোট ইন্নিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় রুবি । অত্যন্ত সহজ ভাবেই বুঝে যায় তাদের সাথে থাকা ছোট বাচ্চাটা হয়তো ইরফান আর বেলী তাদেরই সন্তান । ইন্নি দেখতে এতটাই সুন্দর ছিল যে , যে দেখবে সেই পাগল হয়ে এক বার অন্তত কোলে নিতে চাইবে । রুবিও তখন প্রেগন্যান্ট । প্রেগন্যান্সির ৬ মাস চলছিল তার । নিজে এক নারী হয়ে অতীতে আরেক নারীকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল । কিন্তু বেলী কখনো কিছুই বলেনি রুবিকে । সেইদিক থেকে রুবি কৃতজ্ঞ বেলীর কাছে ।

ইন্নিকে দেখে রুবি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি । ততক্ষণে ইরফানকে প্রশ্নও করে বসে সে ।

– এটা তোমার মেয়ে ইরফান ?

তখন ইরফানও একটু অবজ্ঞার স্বরে জবাব দেয় ।

– হ্যাঁ , আমার আর বেলীর সন্তান ও ।

ইন্নি তখন বেলীর কোলে থেকে টুকুর টুকুর করে রুবিকে দেখছিল । পিংক কালারের ফ্লাপি ফ্রক পরে মাথায় পিংক কালারের দুইটা ক্লিপ দিয়ে একটা পরীর মত দেখাচ্ছিল ইন্নিকে । রুবি তখন একটা আবদার ছুড়ে মারে ইরফানের দিকে ।

– আমি কি একটু কোলে নিতে পারি ও-কে ?
– নাহ , খবরদার না । আমার সন্তানের আশেপাশেও আসবে না তুমি ।
– ইরফান,,,,,,,?

রুবিকে এইভাবে বলে ভালো করেনি ইরফান ৷ এটা বেলীর ধারণা । তখন বেলীই ইরফানকে বলে ইন্নিকে রুবির কোলে দেয় । রুবির কোলে গিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ইন্নি ।

রুবি এক নাগারে অনেক গুলা চুমু দেয় ইন্নিকে । অচেনা বলে ঠোঁট ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কেঁদে দেয় ইন্নি । পরে বেলীই বলে ,

– মা এটা আন্টি , কাঁদে না মা ।

এইদিকে ইরফানের খুব বিরক্ত লাগছিল । তবুও বেলীর জন্যে চুপ করে ছিল সে । সেইখান থেকেই ইন্নির প্রতি রুবির একটা টান চলে আসে । ইন্নিকে বেলীর কোলে দিয়ে রুবি সেখান থেকে চলে যায় ।

কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা হয়তো ভেঙে গিয়েই সুধরে যায় । যদি মানুষ গুলোর ভালো হয় তাহলে সেই সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়াই উত্তম । যেমন টা ইরফান আর রুবি । হয়তো তাদের সম্পর্কটা ততটুকুই ছিল যতটুকু তারা ভোগ করেছিল ।

সেদিনের মত তারা ঘুরে বাসায় চলে আসে । বাসায় এসেই ইন্নি মিনুর দিকে হাত বাড়ায় । তার এখন মিনুর কোলে চড়ার শখ হয়েছে । মিনুও কোলে তুলে নেয় ইন্নিকে ,

– মা আমার কোলে আইতে চায় । কি গো মা , আজকে কতখানি ঘুরছেন । কতখানি ঘুরছেন ।

মিনুর কাছে ইন্নিকে দিয়ে ইরফান আর বেলী রুমে যায় । সেদিন বেলীকে অন্য রকম লাগছিল । এক বাচ্চার মা হয়ে যেন রূপ তারও বেড়ে গেছে । বেলীকে একটু একা ভাবে নিজের করে পেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো ইরফানের । রুমে ঢুকেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় ইরফান । নিজেদের মাঝে একটু একাকীত্বের প্রয়োজনও আছে । তা নিজেদের মাঝে হালকা কোয়ালিটি টাইমটাও স্পেন্ট হয়ে যায় । এই ইরফান এখন অনেক বদলে গেছে । এই ইরফানের দুনিয়া এক দিকে । আর তার বেলী এবং ইন্নি এক দিকে । খুব ভালোবাসে এই দুইটা মানুষকে সে ।

সুখের অন্ত ছিল না এখানে । কিন্তু গ্রহণ লাগে পরদিন সন্ধ্যায় । রাতে ইন্নিকে খাইয়ে দুজনে মিলে ইন্নিকে নিয়ে খেলা করে ইন্নিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় । কিন্তু কে জেনেছিল এই ঘুম টাই তার শেষ ঘুম ছিল । রাতের পর আর চোখ খুলে নি পিচ্চি পরীটা ।

পরদিন প্রায় ৯ টা বেজে যায় । ইরফানের অফিস যাওয়ার টাইম হয়ে যায় । কিন্তু তখনও ইন্নি উঠেনি ঘুম থেকে । তারা ভেবেছিল হয়তো এভাবেই ঘুমিয়ে আছে তাদের ছোট পরী । কিন্তু ছোট পরীর ভেতরের প্রাণ টা যে আর নেই সেইদিকে নজর দেয় নি কেউই । ইরফানকে নাস্তা করতে দিয়ে বেলী ইন্নির কাছে যায় । গিয়ে ইন্নিকে মা বলে জড়িয়ে ধরতেই বেলী শিউরে উঠে । ততক্ষণে ইন্নির ছোট শরীরটা একদম ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে । বেলী কয়েকবার মা মা করে ডাকে , আর তারপর নাকের কাছে হাত দিতেই দেখে তার ছোট পরীর নিঃশ্বাস আর পড়ছে না । বেলী আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নাই । এক চিৎকার দিয়ে উঠে ইন্নি বলে । সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায় বেলী ।

ইরফান খাবার ফেলে দৌড়ে চলে আসে রুমে আর তার সাথে মিনুও । বেলীকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে ইরফানের বুকে এক কামড় পড়ে যায় । সে কাকে ধরবে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না । মিনু তখন দৌড়ে গিয়ে ইন্নিকে ধরে । ইন্নিকে অনেক ডাকে কিন্তু ছোট জানটা সেভাবেই পড়ে থাকে । মিনুও মা বলে এক চিৎকার দেয় । ইরফান যেন দিশেহারা , কি করবে না করবে । পুরুষ মানুষ খুব কম কাঁদে , কিন্তু যখন কাঁদে তখন বুক ফাটিয়ে কাঁদে । মাথায় বুদ্ধি করে ডক্টরকে ফোন দেয় সে । প্রায় আধা ঘন্টার পর ডক্টর আসে । পাশের ফার্মেসির এক লোকও আসে । ডক্টর এসে ইন্নিকে মৃত ঘোষণা করে দেয় । আর বেলীকে দেখে বলে , শকড এর জন্যে সেন্সলেস হয়ে গেছে ।

ইন্নির মৃত্যুর খবর পেয়ে ইরফানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । কাল রাতেও তো তারা দুজন মিলে ইন্নির সাথে খেললো । দুজনে মিলে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে । ইরফান পুরো পাগল হয়ে গেছে । মুহুর্তের মাঝেই ইরফানের চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায় । মিনুর বুক ফাটা কান্না । ইন্নির নিথর শরীরটা বিছানায় সেইভাবেই পড়ে আছে । দুপাশে ছোট ছোট কোল-বালিশ দিয়ে মাঝে পুতুলের মত ঘুমিয়ে আছে ছোট পরীটা ।

বেলী জ্ঞান ফেরার পর ইন্নিকে বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরে রেখেছিল । পুরো পাগল পাগল করছিল । ইরফানকে এই অবস্থায় ভেঙে পড়লে হবে না । শক্ত থেকে সবটা সামলাতে হবে তাকে । ইরফান ছুটি নিয়ে । বাড়িতেও ফোন করে বলে দিয়েছে ইরফান । ইন্নিকে তার দাদার বাড়িতে শায়িত করা হবে ।

এইদিকে সব সামলে নিয়ে ঢাকা থেকে বেলী , মিনু আর ইন্নির লাশ নিয়ে রওনা দেয় ইরফান । বাড়িতে বেলীর মায়ের আহাজারি আর ইরফানের বাবার হাহাকার পড়ে যায় ।

জার্নি শেষ করে অবশেষ বাড়িতে এসে পৌঁছায় ইরফান । গাড়িতেও বেলী ইন্নিকে বুকে চেপে ধরে রাখে । নিজের কাছ থেকে একটুও আলাদা করেনি নিজের সন্তানকে বেলী ।

যে কান্না করে নাই সেও ইন্নিকে দেখে কান্না করেছে । ইন্নি ছিলই এত সুন্দর । বেলীর কোল থেকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্নিকে । ইন্নিকে তার কোল থেকে নিয়ে যাওয়ার পর আরও একবার অজ্ঞান হয়ে যায় বেলী । ইরফান তখনও মূর্তির মতই ছিল । অন্যদিকে ইন্নির জন্য কবর তৈরি করে রাখা হয় । দাদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নাতনির কবর করিয়েছেন ।

বেলীর কপালে সুখ আসলেও সন্তান সুখ সয় নি । ইন্নি তাকে ছেড়ে চলে গেছে সে মানতেই পারেনি । তার সন্তান আর নেই সে মানতেই পারেনি । খাটে করে নিয়ে যাওয়ার সময় খাট ধরে রাখে বেলী । ইরফানের পা পর্যন্ত ধরে । শ্বশুরের পা ধরে বসে থাকে । সেইদিন সমস্ত লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে সমস্ত পুরুষের সামনে মাথার কাপড় ছাড়া খাট ধরে রাখে বেলী । তখন বেলীর মুখে শুধু একটাই কথা ,

– আমার ইন্নি , আমার ইন্নি । আমার ইন্নিকে নিয়েন না । আপনাদের পায়ে ধরি আমি ।

ইরফানের বুকে জড়িয়ে ধরে একবার ,
আবার পা জড়িয়ে ধরে রাখে সে ।

– তোমার দুইটা পায়ে ধরি ওরে নিও না । তুমি এত নিষ্ঠুর কিভাবে হও । ও তো তোমারও মেয়ে । নিও না নিও না ।

– ও বাবা , বাবা । ওরে নিয়েন না বাবা আমি আপনার পায়ে ধরি বাবা । আমার ইন্নি , আমার ইন্নি , আমার মা , ওরে দিয়ে দেন বাবা ।

সন্তান হারা পাগল বেলীকে তখন কেউই সামলাতে পারেনি । ইরফান তখন নিজের বুকে নিয়ে নেয় বেলীকে । তারপর ইশারা দিয়ে দেয় খাট নিয়ে যাওয়ার জন্যে । তারপর ইরফান বেলীকে অন্যদের কাছে দিয়ে কবরের কাছে চলে যায় । কবরে নেমে নিজ হাতে নিজের সন্তানকে কবরে শুইয়ে দেয় ইরফান ।

সেদিন আর কেউই বেলীকে আটকে রাখতে পারেনি । নিজের হাতে নিজের চুল টেনে ছিড়েছে সে । ইরফানকে দেখে ইরফানের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বেলী ।

– আমার মেয়েকে এনে দেও । এনে দেও আমার মেয়েকে । এক্ষুনি এনে দেও ।

বেলীর এমন পাগলামি দেখে ইরফান নিজের বুকে পাথর রেখে বেলীকে বুঝায় যে ইন্নি আর নেই । তবুও শুনে নি বেলী । সহ্য করতে পারেনি ইরফান । টানতে টানতে গোরস্তানের কাছে নিয়ে যায় সে বেলীকে । হাত দিয়ে দেখায় তাদের ছোট পরীর কবর ।

– ওইযে দেখো , দেখো ভালো করে । ওইখানে ঘুমিয়ে আছে আমাদের ইন্নি । ও আর নেই । নেই ও , কেন বুঝতে চাও না । আমার এই হাতে , এই হাতে ও-কে শুইয়ে দিয়েছি ওইখানে । কেন বুঝো না । এই টুকুন শরীরটা কাফনে মুড়ে রেখে আসছি সারাজীবনের জন্য ও-কে ।

বেলী আর শুনতে পারেনি ইরফানের কথা গুলো । কষে এক থাপ্পড় মেরে দেয় ইরফানের গালে । সেদিন গ্রামের অনেকেই বেলীর পাগলামি দেখছিল । সবাই দেখেছে বেলী আর নিজের মাঝে নেই ৷

এই শোকের মাতম শেষ করে প্রায় ১ সপ্তাহ পর বেলীকে নিয়ে ঢাকা ফিরে ইরফান । মিতু তো সাথেই ছিল । তাদের সাথে বেলীর মাও আসে । কারণ বেলীকে সামলানো ইরফান অথবা মিতুর একার পক্ষে সম্ভব না । তাই বেলীর মাকেও নেয়া হয় ।

ঢাকায় ফিরে বাসার আনাচে কানাচে ইন্নিকে খুজতো বেলী । ইন্নির বালিশ ইন্নির জামা কাপড় গুলো নাকের কাছে ইন্নির শরীরের ঘ্রাণ নিতো বেলী । আর রাতে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে আবল তাবল বলতো । আস্তে আস্তে বেলীর মানষিক রোগ দেখা দেয় । ইরফান ঠিক করে এই বাসা ছেড়ে দেবে । কারণ বেলী এখানে থাকলে আরও পাগল হয়ে যাবে । এক জীবনে পিতৃশোক আর সন্তানশোক পেয়ে বেলী আপনা আপনিই ঝরে গেছে । হ্যাঁ ইরফানের বেলীফুল ঝরে গেছে ।

এই ঘটনার এক মাসের মাথাতেই ইরফান বাসা চেঞ্জ করে বারিধারায় চলে আসে । দিন যেতে থাকে আর বেলীর পাগলামি বাড়তে থাকে ৷ এরই মাঝে একদিন রুবি নিজ থেকে ইরফানের সাথে যোগাযোগ করে । ইরফানের সাথে যোগাযোগ করে সব শুনে হতবাক হয়ে যায় রুবি । বিশ্বাসে আনতে পারেনি সে , যেই পরীকে সে কোলে নিয়েছে সেই পরীটা আর নেই ।

মাস ঘুরতে থাকে , সময় যেতে থাকে । কিন্তু বেলীর উন্নতি হয় না আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে । বেলীকেও ডক্টর দেখানো হয় । সবার একই কথা সে মানতেই পারছে না তার সন্তান মারা গেছে । সে সন্তানশোকে নিজের সব খুইয়ে ফেলেছে । এক রকম মানষিক রোগে ভুগছে সে । অন্যদিকে রুবির কোল জুড়ে এক ছেলে আসে । যার নাম রাখা হয় মেহেরাব ।

দুজনের মাঝে ভালোবাসাটা ফিকে পড়ে যায় । প্রতিটা দিন বহু কষ্টে পার করতো ইরফান । অসুস্থ বেলীকে সামলাতে আর পারছিল না সে । মিনুর বাবার অবস্থা খারাপ থাকায় সেও এখানকার সব মায়া ত্যাগ করে নিজ গ্রামে ফিরে যায় । একদিন রাতে বেলী নিজ থেকে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে ।

– আমার ইন্নি চাই , ইন্নিকে এত ডাকি আসে না কেন আমার কাছে । কেন আসে না । বলতে পারো ?
– ইন্নি আছে । তোমার কাছেই আছে ।
– তুমিও আমায় ভালোবাসো না আর ? তুমিও বদলে গেছো ।
– আমি বদলে যাই নি বেলী ।
– আমায় একটু ভালোবাসবা ? ঠিক আগের মত ।
– তুমি চাও আমি তোমাকে ভালোবাসি ?
– হ্যাঁ , তবে তাড়াতাড়ি ভালোবাসা লাগবে ইন্নি না হয় চলে আসবে । একটু ভালোবাসো না আমাকে ?

চোখের পানি মুছে বর্তমানে ফিরে আসে ইরফান । ইরফান চেয়ে আছে বেলীর দিকে । বেলী শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে । হঠাৎ করেই ইরফানের নজর যায় বেলীর পেটে । সেদিন রাতে তাদের দুজনের মিলনের ফসল আজ বেলীর পেটে । হয়তো আবারও আরেক ইন্নির জন্ম হবে এই গর্ভ থেকে ।

খারাপ লাগছিল রুবির জন্যে । তখনকার ফোনটাও রুবিরই ছিল । গত কয়েকদিন আগে স্বামীকে বলে বেলীকে দেখতে এসেছিল সে । সাথে তার ছয়মাস বয়সী মেহেরাবকেও নিয়ে এসেছে । কিন্তু বেলী মেহেরাবকে দেখেই ইন্নি ভেবে নিয়ে নেয় । রুবির কোল থেকে নিয়ে নেয় সে বাচ্চাকে । অনেক কষ্টে তিন জন মিলে বাচ্চাকে তার কাছ থেকে ছুটিয়ে রুবির কোলে দেয় । যদিও এই রুবি আর আগের রুবি নেই । আল্লাহ পাক চাইলে কি না হয় । শয়তানও ভালো হয়ে যায় । রুবিও ভালো হয়ে গেছে । আজ যেন ইরফানের চোখের পানি থামছেই না । আগামীকাল ইন্নির দ্বিতীয় জন্মদিন । বেঁচে থাকলে হয়তো সারা ঘর মাতিয়ে রাখতো ।

ইরফান বুঝে যায় । এটা তারই কৃতকর্মের ফল । আল্লাহ পাক নেই কে বলেছে ? আল্লাহ পাক আছেন । ইরফানের করা পাপের ফল স্বরূপ আল্লাহ পাক তার কাছ থেকে তার সব থেকে প্রিয় জিনিসটাই নিয়ে নেয় । বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ইরফান । আজ তার নজর আকাশের দিকে । আকাশের বুকে খোঁজার চেষ্টা করছে তার ছোট পরীকে ।
তখন অজান্তেই নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কিছু কথা ,

– আমার বেলীফুল আজ ঝরে গেছে । আমার চোখের সামনে সে ফুল ঝরে গেছে । আমি চাইলেও তাকে সতেজ করতে পারছি না । আমি হেরে গেলাম । আমার অনুভূতি গুলাও হেরে গেছে । আমার আশ্বাসটাও হেরে গেছে । মাঝ থেকে অভিমান গুলা জিতে গেছে । ভালোবাসা নামের ছোট খেলায় আজ আমি হেরে যাওয়া খেলোয়াড় । আমার এই জন্মের করা পাপের ফল আমি এই জন্মতেই পেলাম । আমার সন্তান । যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি । আমার বেলীফুল যাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি । যে আজ বেঁচে থেকেও মৃত । যে আজ দুনিয়া বুঝে না । আল্লাহ আমায় কেন নিলে না । আমায় নিয়ে আমার সেই ছোট আম্মাজানটাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে না ।

কিছু আর্তনাদ চাপা হয় । কিছু কান্না বুক ফাটা হয় । বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইরফান কাঁদছে । যেই কান্না আল্লাহর কান অবদি পৌঁছাচ্ছে কিনা তার জানা নেই । হয়তো জীবন এটাই হয় । হয়তো নিজ কৃতকর্মের ফল এইভাবেই ভোগ করতে হয় ।

জীবন পাতায় চোখ দিয়ে
ভালোবাসা আপন করে
চলে যেতে পারলে ক্ষতি কোথায়

নিজের পাপের ফল যখন
নিজেকেই ভোগ করতে হয়
তখন সব কিছু উলটে যায় হেথায়

আর এইভাবেই কিছু ফুল ঝরে যায়
আর এইভাবেই হয়তো থেকে যায় মুকুল
আর এইভাবেই হয়তো প্রত্যেক বেলী হয়ে যায়
ঝরে যাওয়া বেলীফুল

★★★ সমাপ্ত★★★