Tuesday, August 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1980



তোকে চাই❤ (সিজন-২)part: 73

0

তোকে চাই❤
(সিজন-২)part: 73
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

সাহেলের সাথে জেনি আর হ্যারিও স্টলে ঢুকলো। একটি বড় টেবিল ঘিরে বসে আছে সবাই। জেনী বারবারই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ডায়েরির বর্ননা অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষকে চেনার চেষ্টা করছে সে। স্টলে ঢুকতেই প্রথমে দুটো বাচ্চার উপর নজর পড়লো জেনির। বাচ্চাদুটো ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে আর হুটহাট হেসে উঠছে। জেনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বাচ্চাদুটোর চেহারা এক কিন্তু কোথাও যেন সামান্য একটু পরিবর্তন আছে। কিন্তু পরিবর্তনটা ধরতে পারছে না জেনি। তাদের পাশেই বসে আছে লাল পাঞ্জাবী পড়নে আরেকটি ছোট্ট ছেলে। এতো বাচ্চা বয়সেই চোখে-মুখে দারুন গাম্ভীর্যতা। জেনি আর হ্যারি চেয়ার টেনে বসতেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো সাহেল,

— গাইস? আজকের জন্য ওরা আমাদের গেষ্ট। ওর নাম লুইস হ্যারিসন আমার ফ্রেন্ড পিটারের ছোট ভাই। আর উনি হচ্ছেন, জেনিফা কিংস্টোন —– হ্যারির উডবি।

হ্যারি-জেনিকে একগুচ্ছ মিষ্টিহাসি উপহার দিয়ে ওয়েলকাম জানালো সবাই। সাহেল বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,

— হ্যারি এন্ড জেনি? আমাদের বাচ্চাপার্টির সাথে পরিচিত হও। সেইম ডিজাইনের যে দুইটা বাচ্চা বসে আছে ওদের নাম আদ্র এন্ড রোদ্র। দু’জনেই প্রচুর দুষ্ট। ওদের চেনার উপায় হলো চুল আর টোল। একজনের চুল হালকা কুকরানো আর অন্যজনের গালে টোল। বাচ্চারা? আন্টিকে হাই বলো।

আদ্র- রোদ্র চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। হ্যারির মতো বাদামি চুলের শুভ্রমানব হয়তো এর আগে দেখে নি তারা। তবে পরমুহূর্তেই বিনা কারনেই হেসে উঠে দু’জনে একসাথেই বললো,

— হাই আন্টি এন্ড আংকেল।

জেনি মিষ্টি করে হাসলো। সাহেল এবার পাশে বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

— এটা হলো আমার ছেলে যদিও স্বভাবগুলো একদমই আমার মতো নয়। বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে গম্ভীর এবং টিপটাপ। সবকিছুই পার্ফেক্ট চায় তার। উনিশ থেকে বিশ হলেই রাগে বাড়ি মাথায় তুলে নেন ইনি।

ছেলেটা বাবার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেওয়ায় বাবার প্রতি চরম বিরক্ত সে। সাহেল ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,

— বাবা? আন্টি আংকেলকে নিজের নাম বলো।

ছেলেটির কুঁচকানো ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো। গম্ভীর মুখে বললো,

— হাই, মাই নেইম ইজ সাদাফ। নাবিল আল সাদাফ।

জেনি- হ্যারি দু’জনেই চমকে উঠলো। আড়াই বছরের পিচ্চি এতোটা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে! কিভাবে? সাহেল এবার শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

— আর ইনি হচ্ছেন আমাদের প্রিন্সেস, শুভ্রতা।

শুভ্র খুব মনোযোগ দিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিলো। নিজের নাম শুনে চোখ তুলে তাকালো সে। কথায় কোনো উৎসাহ না পেয়ে আবারও পাউরুটিতে মনোযোগ দিলো সে। পাশের চেয়ারে বসা শুভ্র মেয়ের দিকে ঝুঁকে এসে বললো,

— আম্মু? আন্টিকে সালাম দাও।

শুভ্রতা আবারও মুখ তুলে তাকালো। জেনিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে নিয়ে দু’একবার চোখ পিটপিট করে মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,

— আছছামুয়াইকুম।

সাথে সাথেই পাশ থেকে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো আদ্র-রোদ্রের একজন,

— বোন? আছছামুয়াইকুম নয় আসসালামু আলাইকুম। তুই সবসময় ভুল করিস। সুন্দর করে বল।

শুভ্রতা এবার ভাইদের দিকে তাকালো। চোখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ জেনির দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের ভারি পল্লব কাঁপিয়ে আবারও বলে উঠলো,

— আছছামুয়াইকুম।

পাশে বসে থাকে ওই লাল পাড়ের সাদা শাড়ির মেয়েটা এবার মিষ্টি হেসে পরম আদরে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললো,

— আমার মা টা….

মায়ের আদর পেয়ে মায়ের দিকে তাকালো শুভ্রতা। চুল টেনে মায়ের মুখটা নিচু করে এনে সে-ও কপালে চুমু দিয়ে বলে,

— আমাল মা তা!

সবাই হেসে উঠে এবার। জেনিরও শুভ্রতা নামের মেয়েটার কপাল,গাল সব জায়গা চুমুতে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাচ্চারা অপরিচিত ব্যক্তির অহেতুক আদর সহজভাবে নেয় না। তাই নিজের ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পরিষ্কার বাংলায় বললো,

— ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো শুভ্রতা?

শুভ্রতা তাকায়। মুখ টিপে হেসে বলে,

— আমি ভায়ো আচি। তুমি কেমন আচো?

জেনি জানালো সে ভালো আছে। শুভ্রতা আবারও পাউরুটি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কেউ ভালো থাকলে তার বিপরিতে কিছু বলতে শেখানো হয় নি তাকে। অতএব, এখন অযথা কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই তার। আবারও কথা শুরুর আগেই খাবার চলে এলো টেবিলে। প্লেটে মচমচে ইলিশ মাছ ভাজা দেখে সেদিকে হাত ইশারা করে বললো সে,

— আম্মু? ওতা খাবো।

— ওটা ঝাল মা। ওটা খেলে তোমার জিভ জ্বলবে। ওটা খাওয়া যাবে না৷

শুভ্রতা একবার চোখ বড় বড় করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারও প্লেটটির দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মায়ের কথা বিশ্বাস করে নিতেই অভ্যস্ত সে। মা যেহেতু বলেছে এটা ঝাল তারমানে এটা ভয়ানক ঝাল। সাহেল আর কারো সাথে পরিচয় না করিয়ে দেওয়ায় আশাহত হলো জেনি। সে কি সরাসরি রোদের কথা জিগ্যেস করবে? নাকি চুপ থাকবে? জেনির দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই একটা মেয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছছে সে। গায়ে বাঙালীদের মতো করে পড়া লাল-সাদা শাড়ি। পেটটা অস্বাভাবিক বড়। জেনি বুঝতে পারছে মেয়েটি প্রেগনেন্ট। তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শন পুরুষ। মেয়েটি সবার দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,

— আমাকে রেখেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন আপনারা? কি স্বার্থপর!

কথাটা বলে মুখ কালো করে পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকালো সে। রাগী গলায় বললো,

— শেষমেষ তো আনলেই মেলায় তাহলে এতো ঢং করলে কেন? আমি কতোকিছু মিস করে ফেলেছি। ধেৎ! ভালো লাগে না।

শুভ্র হেসে বললো,

— কিছুই মিস করো নি চিত্রা। খাবার তো একদমই না। তবে আমি কিন্তু শিশির ভাইকে সাপোর্ট করবো। এই অবস্থায় খাওয়ার লোভে দৌড়ে আসাটা একদমই উচিত হয় নি তোমার।

সবাই মুখ টিপে হাসলো। সাহেল বললো,

— সত্যিই। এতো খাই খাই করলে কি চলে চিত্রা? কন্ট্রোল!

চিত্রা এবার রাগে লাল। এদের সবাইকে খুব কঠিন কিছু কথা শুনাতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হুট করেই প্রশ্ন করলো জেনি,

— রোদ কোথায়?

“রোদ কোথায়?” কথাটা যেন বিস্ফোরণ ঘটালো। সবার হাসি হাসি মুখটা বিলীন হয়ে তাতে জমা হলো রাজ্যের বিস্ময়। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্রর মুখটাও গম্ভীর।লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়া মেয়েটাও অবাক চোখে একবার শুভ্র তো একবার জেনির দিকে তাকাচ্ছে। সবার এমন রিয়েকশনে জেনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। একটা ঢোক গিলে আবারও প্রশ্ন করলো,

— রোদ কোথায়?

বিস্ময় কাটিয়ে জেনির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠলো সাহেল,

— রোদের নাম কি করে জানেন আপনি?

জেনি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,

— আমি রোদের সাথে দেখা করতে চাই৷ উনার সাথে দেখা করতেই এতোটা দূর এসেছি আমি। ও কি বেঁচে আছে?

বিস্ময় ভাবটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো সবার। একটা মেয়ে ইউএস থেকে শুধুমাত্র রোদের সাথে দেখা করতে আসবে বিষয়টা বড্ড গোলমেলে লাগছে তাদের। সাদা শাড়ি পড়া মেয়েটা মৃদু গলায় বলে উঠলো,

— আমিই রোদ। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না। কোথাও দেখেছি বলেও মনে হচ্ছে না।

” আমিই রোদ ” এই একটি কথাতেই যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো জেনির। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে।হ্যারি চুপচাপ বসে আছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও কোনো ভাবাবেগ নেই তার। অন্য একটা কথা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। কথাটা শুনলে জেনি কেমন রিয়েক্ট করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না সে। জেনি অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— আপনি রোদ? সত্যিই রোদ?

রোদ খানিকটা থতমত খেয়ে বললো,

— হ্যাঁ।কিন্তু কেন?

জেনি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে রোদ-শুভ্রকে দেখে নিলো। ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে রোদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

— এটা আপনার?

রোদ বেশ অবাক হলো। ডায়েরিটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিজের ব্যাগ থেকে সেইম একটা ডায়েরী বের করে টেবিলে রাখলো সে। জেনি বিস্ফারিত চোখে দুটি ডায়েরিতে চোখ বুলিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো,

— সেইম ডায়েরি! তাহলে এটা কি আপনার নয়?

#চলবে…

( এক্সট্রা পার্ট দিবে বিকেলে বা রাতে। লেখার মতো মন নেই এখন। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।)

তোকে চাই❤ (সিজন-২)part: 72

0

তোকে চাই❤
(সিজন-২)part: 72
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি আর জেনি। সবকিছুই গোলকধাঁধার মতো লাগছে তাদের। কোনদিকে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অবশেষে একটি গাড়ি ভাড়া করে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছালো তারা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো খেতে গিয়ে। কোন খাবার কেমন হবে জানা নেই তাদের। বাঙালী খাবার টেস্ট করতে গিয়ে খাবারের চেয়ে পানি খেয়েই মন ভরাতে হয়েছে তাদের। হ্যারি মিনিটে মিনিটে শুধু একটা কথায় বলে চলেছে,

— এই দেশের মানুষ এতো ঝাল কি করে খায়? টেরিবল।

সেদিন আর বের হয় নি ওরা। এতোদূর জার্নি আর রাস্তায় ২/৩ ঘন্টার জ্যামে সিদ্ধ হয়েই যায় যায় অবস্থা তাদের। রাতে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে পরের দিন, ১২ এপ্রিল সকাল ১১ টার দিকে শুভ্রকে খোঁজার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো তারা। তাদের কাছে না আছে ছবি না আছে কোনো পরিচয়। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা নাম, “আবরার আহমেদ শুভ্র”৷ একটা নামকে পুঁজি করে কি একটা মানুষকে খুঁজে বের করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব, হয়তো নয়। তবে চেষ্টা করতে দোষ কি?ঢাকায় সরকারী বেসরকারি মিলে মোট ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এতো বাজে ভাবে জ্যামে আটকে থেকে ২৫ টি ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ নেওয়া তাদের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভবের পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। তারউপর সবকিছুই তাদের অপরিচিত। প্রথমদিনে কোনোরকম দুটি ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতেই প্রায় রাত নেমে এলো। আমেরিকায় বসে বসে ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলো ক্রমেই তা সাপের পা দেখার মতো অসম্ভব হয়ে উঠলো। রাত কাটিয়ে ভোর হলে আবারও বেরিয়ে পড়লো ওরা। ঢাকা শহরের মাঝেই তিনটি ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়ে একটি শুভ্র খোঁজে পেলো তারা। খুশিতে লাফিয়ে উঠেও মুহূর্তেই খুশিটা মাটি হয়ে গেলো তাদের যখন শুনলো লোকটির নাম আবরার আহমেদ নয় আরিফুল রহমান শুভ্র। জেনির সেই মুহূর্তে লোকটির চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। ব্যাটা,দুনিয়াতে কি আর কোনো নাম ছিলো না? শুভ্র নামটাই রাখতে হলো? সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার দিকে ঢাকার একটি পার্কের কাছে গিয়ে বসলো ওরা। তখনই বেশ অদ্ভুত একটি জিনিস চোখে পড়লো। কিছু ছেলেমেয়ে দল বেঁধে রঙের কৌটো হাতে রাস্তায় পেইন্ট করছে। হ্যারি অবাক হয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে উঠলো,

— জেনি? কি করছে ওরা? রাস্তাস পেইন্ট করছে কেন?

জেনির নিজেরও তেমন একটা ধারনা ছিলো না। তাই সামনে এগিয়ে একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— এক্সকিউজ মি?

ছেলেটি ফিরে তাকিয়ে বললো,

— জি বলুন।

— আচ্ছা, রাস্তায় এভাবে রঙ করা হচ্ছে কেনো?

— ফরেনার?

— ইয়াহ।

— ওহ,ওয়েলকাম টু আওয়ার কান্ট্রি। কাল পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ…

জেনি হেসে বললো,

— আমি বুঝতে পেরেছি। বাংলা বছরের প্রথম দিন তাই তো?

ছেলেটি হাসলো। বললো,

— হ্যাঁ। কাল সারা দেশজুড়েই উৎসব। আপনারাও এড হতে পারেন। এই দিনে প্রায় সব মেয়েরাই শাড়ি পড়ে আর ছেলেরা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া। আপনারা চাইলে ট্রাই করতে পারেন। ভালো লাগবে। রমনায় বিরাট মেলা হবে কাল।

জেনি ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে এলো।
হ্যারিকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে সেখান থেকে উঠে পড়লো ওরা। কাল পহেলা বৈশাখ,সরকারি ছুটি। অর্থাৎ, কাল কোনো ভার্সিটিই খোলা থাকবে না। সারাটা দিন ফাঁকা যাওয়ার থেকে নিজেকে বাঙালীদের মতো শাড়িতে মোড়ালে কেমন হয়? জেনি মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে শাড়ি পড়বে। হ্যারিকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে জোড় করেই নিজের জন্য শাড়ি আর হ্যারির জন্য লাল পাঞ্জাবি কিনে নিলো সে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো পরের দিন সকালে। কিছুতেই শাড়ি পড়তে পারছে না জেনি, এখন উপায়? নিজে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হ্যারিকে ডাকলো সে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। উল্টো ঝামেলা আরো বেড়ে গেলো। অবশেষে হোটেলের একজন মেয়ে কর্মচারীকে ম্যানেজ করে শাড়ি পড়তে হলো জেনির। হোটেল থেকে বেরিয়ে রিক্সা নিলো জেনি। “রিক্সা” নামক জিনিসটা তাদের দু’জনের জন্যই একদম নতুন। তবুও এই ভয়ানক জিনিসে চেপেই মেলা পর্যন্ত পৌঁছালো ওরা। রমনায় গিয়ে তাদের বিস্ময় যেন আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো। এতো মানুষ আর এতো রঙ-বেরঙের সাজ! চারদিকটা যেন বাহিরী রঙের মেলা। মেলাটা কিছুক্ষণ ঘুরে দেখার পরই বিস্ময়কর এক কান্ড ঘটলো। হাজারো বাঙালীর ভীরে কেউ একজন হ্যারির নাম ধরে ডাকলো। এমন একটা জায়গায় নিজের নাম শুনে অনেকটায় চমকে গিয়েছিলো হ্যারি। নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়েই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। লাল-সাদা পাঞ্জাবী গায়ে একটি ছেলে এগিয়ে এসে বললো,

— হ্যারি? তুমি এখানে?

— হেই অ্যাশ! কেমন আছো তুমি?

ছেলেটি হাসলো। জেনি ওদের থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। চারপাশে তাকিয়ে মানুষজন দেখছে সে। এতো এতো মানুষের মাঝেও একজায়গায় চোখ আটকে গেলো তার। ওর থেকে এক/দুই হাত দূরে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর কালো রঙের ধুতি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছেলে। কোলে দেড়-দুই বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির গায়ে লাল রঙের ফ্রক। সিল্কিচুলগুলো দুপাশে ঝুঁটি করা। সামনের কিছু চুল এসে পড়েছে কপালে। চেহারাটা বাবার মতো হলেও গায়ের রঙটা উজ্জল শ্যামা। বড় বড় চোখদুটো ঘন পল্লবে ঢাকা। হাতে একটি চিপসের প্যাকেট। ছেলেটি বাচ্চার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতেই হাতের চিপসটা বাবার হাতে দিয়ে সে ও ঠিক একই কাজ করলো। বাবার কপালে পড়ে থাকা সিল্কচুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিলো। মেয়ের কাজ দেখে হেসে উঠলো ছেলেটি। সাথে সাথেই যেন চমকে উঠলো জেনি। রোদ তার ডায়েরিতে যেভাবে বর্ননা করেছিলো ছেলেটির হাসিটা ঠিক সেই রকম। তেমনি বাঁকা দাঁত আর থুতনিতে সেই কালো তিল। জেনি আরো একপা এগিয়ে এসে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো। ঠিক তখনই একটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো তাদের পাশে। মেয়েটি মোটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়েছে। মেয়েটার শাড়ি পড়ার ধরনটা অন্যরকম। জেনির মতো কুঁচি দিয়ে শাড়ি পড়ে নি সে। পিঠে পড়ে আছে একরাশ লম্বা চুল। তাতে গাঁথা তিনটি লাল গোলাপ। মেয়েটির গাঢ় কাজল চোখ আর পাতলা ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টক মুখে একটা প্রতীমা প্রতীমা ভাব এনে দিয়েছে যেন। একদম স্বচ্ছ, শীতল রূপ। মেয়েটি পাশে দাঁড়াতেই বাচ্চা এবং বাবা দু’জনের মাঝেই অদ্ভুত প্রাণোচ্ছলতা খেলে গেলো। ছেলেটি পাশে দাঁড়ানো মেয়েটির কানের পাশে চুল গুঁজে দিয়ে কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে মুচকি হেসে বললো,

— একদম রসগোল্লা লাগছে।

বাচ্চাটি কিছুক্ষণ চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থেকে বাবার মতোই তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে কানে চুল গুঁজে দিয়ে টুপ করে চুমু দিয়ে দিলো কপালে। বাবাকে কপি করে বললো,

— এয়দম অসগোল্লা লাগচে।

বিস্মিত বাবা-মা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেই হেসে উঠলো। বাচ্চাটিও খিলখিল করে হেসে উঠলো। কি অদ্ভুত! চেহারাটা বাবার মতো হলেও হাসলে কোথাও যেন একদমই মায়ের মতো লাগে তাকে। সৃষ্টিকর্তা কি অদৃশ্য ধাঁধা তৈরি করে দিয়েছেন চারপাশে। ওদের কান্ড দেখে একা দাঁড়িয়েই খিলখিল করে হাসছিলো জেনি। হঠাৎ করে পেছন থেকে ডেকে উঠলো হ্যারি,

— জেনি? একা একা হাসছো কেন?

জেনি হাসিমুখেই বললো,

— নাথিং।

হ্যারি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর পাশের ছেলেটিকে ইশারা করে বললো,

— জেনি? ইনি হচ্ছেন অ্যাশ। আমার বড় ভাইয়ের ফ্রেন্ড। ক্যালিফোর্নিয়ায় কিছুদিন একসাথেই পড়াশোনা করেছেন উনারা।৷আর অ্যাশ? ও হচ্ছে জেনি, আমার বাগদত্তা।

জেনি হালকা হেসে স্পষ্ট বাংলায় বললো,

— হ্যালো ভাইয়া।

ছেলেটি বিস্মিত কন্ঠে বললো,

—- আপনি বাংলা জানেন?

জেনি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো কেউ,

— ওই সাহেল? আদ্র-রোদ্র কই? দেখছিস ওদের?

জেনি চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখলো সেই সাদা পাঞ্জাবি পড়নে ছেলেটাই কথা বলে চলেছে। ততোক্ষণে হ্যারিও ভ্রু কুঁচকে এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করে দিয়েছে। “সাহেল” নামটা কেমন পরিচিত লাগছে তার। কিন্তু তাদের আরো কিছুটা চমকে দিয়ে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

— শুভ্রতাকে নিয়ে ফার্স্ট স্টলটাতে ঢুকে যা। ওখানেই লাঞ্চ করবো সবাই। ভেতরে নাবিলা,রুহান, সাব্বির সবাই আছে। বাচ্চারাও আছে।

জেনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। “শুভ্রতা” আর “শুভ্র” কাছাকাছি। তবে কি? জেনির ভাবনার মাঝেই হাত বাড়ালো সাহেল। হাসিমুখে বললো,

— হ্যালো,আমি আশরাফ আল সাহেল। হ্যারির জন্য নামটা একটু কঠিন বলে ও আমাকে অ্যাশ বলে ডাকে। বাট আপনার জন্য কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে না।

জেনি টোটালি শকড হয়ে তাকিয়ে আছে। কয়েকসেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— হাই! আমি জেনিফা কিংস্টোন।আচ্ছা? একটু আগে যে আপনার সাথে কথা বললেন, উনি কে? না মানে,পরিচিত লাগছিলো খুব।

সাহেল স্বাভাবিক গলায় বললো,,

— ও আমার ফ্রেন্ড। ওর নাম শুভ্র।আপনার সাথে কোথায় দেখা হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছি না।

জেনি হাসলো,

— হয়তো অন্যকেউ হবে। দুজনের মাঝে গুলিয়ে ফেলিছি আমি। এনিওয়ে,, আপনারা বোধহয় এখন লাঞ্চ করবেন। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ট আমরা দু’জন কি আপনাদের সাথে জয়েন হতে পারি?

— ইয়াহ, অফ কোরস্। আমি এখনই রিকুয়েস্ট করতাম আপনাদের। প্লিজ আসুন। আপনারা দু’জন জয়েন করলে আরো খুশি হবো আমরা। বিশেষ করে বাচ্চারা…প্লিজ কাম।

খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে জেনির। অবশেষে শুভ্রকে খুঁজে পেয়ে গেছে সে এতো সহজে খুঁজে পাবে ভাবতেই পারে নি জেনি। আচ্ছা? শুভ্রকে তো পেলো। তাহলে রোদ কোথায়? ওই মেয়েটাই কি রোদ?বেঁচে আছে? নাকি মারা গেছে? নাকি অন্যকাউকে বিয়ে করে নিয়েছে শুভ্র??

#চলবে,

তোকে চাই❤ (সিজন-২)part: 71

0

তোকে চাই❤
(সিজন-২)part: 71
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ বৃষ্টির দিকে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালো জেনি। টেবিলের উপর রাখা ডায়েরিটি হাতে তুলে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। পাশের রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো ভেতরে। ষাটোর্ধ্ব একজন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধা বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাছে পানি দিচ্ছেন। সাদা গায়ে হালকা রঙের গাউন। বাদামী রঙের চুলগুলো এসে ঠেকেছে কাঁধে। জেনি মুখে হাসি টেনে নিয়ে মাথা হেলিয়ে বলে উঠলো,

— হ্যালো গ্র্যানি?

বৃদ্ধা ফিরে তাকালেন। চোখে-মুখে স্নেহময় হাসি ফুটিয়ে বললেন,

— হ্যালো ডিয়ার! ভেতরে এসো।

জেনি ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলো। বৃদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— কি করছিলে গ্র্যানি?

— গাছের পরিচর্চা করছিলাম। দেখো তোমার মতোই ফুটফুটে একটি ফুল ফুটেছে গাছে।

জেনি হাসলো। পা দুলিয়ে বললো,

— বাবা কোথায় গ্র্যানি?

বৃদ্ধা হাতের কাজ শেষ করে জেনির পাশে গিয়ে বসলেন। জেনির গালে আলতো ছোঁয়ে দিয়ে বললেন,

— তোমার বাবা ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে, ডিয়ার।

জেনি আবারও জিগ্যেস করলো,

— আর দাদু?

— তোমার দাদু যে দু’দিনের জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছেন সেটা তো তুমি জানো সুইটহার্ট তবু কেন জিগ্যেস করছো?

জেনি এবার পেছন থেকে ডায়েরিটি বের করে গ্র্যানির সামনে রাখলো। ডায়েরির দিকে ইশারা করে বললো,

— গ্র্যানি? তুমি কি এই ডায়েরিটি সম্পর্কে কিছু জানো? এটা আমি বাবার স্টাডি রুমের এককোণা থেকে উদ্ধার করেছি। হোয়াট ইজ দ্যা হিস্ট্রি অব দিস ডায়েরি?

জেনির গ্র্যানি ক্যাথেরিন কিংস্টোন ডায়েরিটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন। ভেতরের লেখাগুলো তার বোধগম্য নয় বলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। কপাল কুঁচকে চিন্তিত মুখে বললেন,

— আমি এই ডায়েরিটা আগে কখনো দেখি নি। তোমার বাবা এই ডায়েরি সম্পর্কে আমায় কিছু বলে নি জেনি। আই এম সো সরি ডিয়ার বাট এখানে কি লেখা আছে?

জেনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্যাথেরিনের দিকে তাকিয়ে দুর্বল হাসি দিয়ে বললো,

— ইট’স ওকে গ্র্যানি। আমি বাবাকে জিগ্যেস করে নিবো। এখানে একজনের লাভস্টোরি লেখা আছে গ্র্যানি। অসাধারণ একটা লাভ স্টোরি বাট..

— বাট?

— বাট এখানে এন্ডিংটা নেই। আমি এর এন্ডিংটা জানতে চাই। কি হয়েছিলো তারপর? আচ্ছা গ্র্যানি? হোয়াট ইজ লাভ? ইজ ইট আ ম্যাজিক?

ক্যাথেলিন জেনির ডানহাতের উপর স্লাইট করে আদরমাখা গলায় বললেন,

— ইয়েস ডিয়ার। ইট’স লাইক আ ম্যাজিক। যখন তুমি কাউকে ভালোবাসতে শুরু করবে তখন ম্যাজিকের মতোই তার চারপাশের সবকিছুই ভালো লাগবে তোমার। এই সুন্দর ফিলিংসটার জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি হয়ে যাবে তুমি।

জেনি খানিকটা ঝুঁকে এসে বললো,

— গ্র্যানি? তুমি কি জানো? “ফিলিংস” শব্দটির খুব মিষ্টি একটি বাংলা শব্দ আছে। আর সেই শব্দটি হলো “অনুভূতি” বাংলা ভাষাটা কি মিষ্টি তাই না?

ক্যাথেলিন হাসলেন। সস্নেহে জেনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

— সবার কাছেই তার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ মিষ্টি লাগে। আমার মাদারল্যাঙ্গুয়েজ ইংলিশ তাই এটাই আমার বেশি ভালো লাগে। তবে বাংলা ভাষাটাও মিষ্টি। তোমার দাদু মাঝে মাঝেই বলেন আমার শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু জেনি? তোমার ল্যাঙ্গুয়েজ তো ইংলিশ তবু তুমি বাংলাকে এতো পছন্দ করো কেন?

জেনি হাসলো। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— বিকজ বাংলা ইজ মাই ফাদার ল্যাঙ্গুয়েজ।

ক্যাথেরিনও হেসে উঠলেন। জেনি ঘড়ি দেখে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে গ্র্যানিকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— ওকে বাই গ্র্যানি। আমার এখন ক্লাস আছে। সি ইউ ইন দ্যা আফটারনুন।

কথাটা বলেই দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলো জেনি। ক্যাথেরিন স্নেহভরা নীল চোখে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

— বাই। স্টে হ্যাপি মাই চাইল্ড।

বাইরে টিপটাপ বৃষ্টি। জেনি গোলাপী রঙের ছাতা হাতে হেঁটে চলেছে। পিঠে ঝুলাছে কলেজ ব্যাগ। পরনে লেডিস জিন্স এন্ড হোয়াইট টপস। ঘন কালো চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। জেনির পুরো নাম জেনিফা কিংস্টোন। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লসএঞ্জেলস সিটিতে বসবাস করে জেনি। আমেরিকার পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া অন্যতম একটি অঙ্গরাজ্য। আবহাওয়ার দিক থেকে চমৎকার একটি স্টেট। শীতকালে তীব্র শীত নয়, আবার গরমকালে অত্যধিক গরম নয়। ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়াকে নাতিশীতোষ্ণ বলা চলে। অনেকটা আমাদের দেশের বসন্তকালের মতো। তবে এখানকার আবহাওয়া খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। অনেকটা ষোড়শী তরুণীর মনের মতো আনপ্রেডিকটেবল। ষোল বছর বয়সী তরুনীর মন বুঝা যেমন দায় ঠিক তেমনি ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়েদার বোঝাও কষ্টসাধ্য। কথায় আছে এদেশের থ্রি-ডব্লিউ যে কোন মুহূর্তে চেঞ্জ হতে পারে। প্রথম ডব্লিউ হলো “ওয়েদার” যা ঘন ঘন পরিবর্তন হয়। দ্বিতীয় ডব্লিউ হলো “ওয়ার্ক অর্থাৎ চাকরী” সকালে আছে তো বিকেলে নেই অর্থাৎ, সকালে কাউকে হায়ার করা হয়েছিল বাট বিকেলেই ফায়ার হয়ে গেছে। তৃতীয় ডব্লিউ হলো “ওয়াইফ”। ওয়াইফদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। আজকে আছে তো কালকে নাও থাকতে পারে। যা জেনির বাবা “কার্লোস কিংস্টোনের” ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জেনির মাকে কখনো দেখে নি জেনি। গ্র্যানির কাছে শুনেছে তার মা নাকি তাকে জন্মের পর পরই বাবার কাছে ফেলে গেছেন। বাবাকে কখনো মা নিয়ে প্রশ্ন করে না জেনি কারণ সে জানে বাবা তাতে কষ্ট পান। এইতো উনিশটি বছর কেটে গেলো, কার্লোস এখনও তার স্ত্রিকেই ভালোবাসেন। কার্লোসের বাবা একজন বাঙালী কিন্তু মা আমেরিকান ক্যাথেরিন। দেখতে পুরোপুরি আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ হলেও বাবার মতোই অসম্ভব সুন্দর বাংলায় কথা বলে কার্লোস। সেই সুবাদে মেয়ে জেনিকেও বাংলা লিখতে এবং বলতে শিখিয়েছে। তার ধারনা গায়ে আমেরিকান হওয়ার ট্যাগ লাগলেও তার উৎপত্তি বাংলার ওই শিকড়ে। জেনিও তাই বিশ্বাস করে তাইতো ছবির মতো ঝকঝকে একটি শহরে বসবাস করেও তার মন চাই বাংলার মাটি ছোঁয়ার। দাদু বলে সেই মাটির নাকি আলাদা গন্ধ থাকে। বাতাসের আলাদা স্বাদ আর বৃষ্টির আলাদা ছন্দ থাকে। কার্লোস ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির স্ট্যাটিস্টিক প্রফেসর। আর তার বাবা একই ভার্সিটির কেমিস্ট্রির রিটায়ার্ড প্রফেসর। জেনি ভার্সিটিতে পৌঁছাতেই ঝড়ের বেগে একটি সাইকেল এসে থামলো ঠিক তার সামনে। জেনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চোখে-মুখে বিরক্তিভাব স্পষ্ট। জেনি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,

— হ্যারি? একদম বিরক্ত করবে না। আজ মন ভালো নেই আমার।

হ্যারির মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেলো। সে জেনিকে মোটেও বিরক্ত করে নি। হ্যারির পুরো নাম, “লুইস হ্যারিসন”। বন্ধুমহলে হ্যারি বলেই পরিচিত সে। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ । সুঠাম দেহ, মাথায় একঝাঁক বাদামী চুল। গাঢ় নীল রঙের উজ্জল দুটো চোখ। হ্যারি সাইকেল থেকে নেমে দৌড়ে জেনির পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। জেনি বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই মিষ্টি করে হাসলো সে। জেনি কিছু বললো না। মন খারাপ ভাব নিয়েই ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো সে। রোদ-শুভ্রর লাভস্টোরি পড়তে বসে সকালের ব্রেকফাস্ট করা হয়নি তার।জেনি বসতেই তারপাশে ধপ করে বসে পড়লো হ্যারি। চোখদুটো ছোট ছোট করে বলে উঠলো,

— তোমার মন খারাপ কেন জেনি?

জেনি বিরক্ত হয়ে বললো,

— তাতে তোমার কি? যাও এখান থেকে।

হ্যারি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,

— টুমি আ..আমার সাটে শেয়ার করটে পা..পা..হোয়াট ওয়াজ দেট?

জেনি রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,

— দেট ওয়াজ “পারো” । যা পারো না সেটা বলতে গিয়ে ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট কেন করো হ্যারি? বাংলা বলা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু শুধু বিকৃতি করবে না আমার রাগ লাগে।

হ্যারি অপরাধী গলায় বললো,

— আমি চেষ্টা করছি জেনি। তোমার গ্র্যান্ডপা’স মাদারল্যাঙ্গুয়েজ আসলেই অনেক মিষ্টি। শুনতে অনেক ভালো লাগে আমার। ট্রাস্ট মি।

জেনি কিছু বললো না। চুপচাপ ক্রোনাট ও চকলেট চিপসে মনোযোগ দিলো সে। হ্যারি চিজ বার্গারে কামড় দিয়ে আবারও বলে উঠলো,

— কি হয়েছে জেনি? বলো আমায়। আই ওয়ান্ট টু নো।

জেনি চকলেট চিপসে কামড় বসাতে বসাতে বললো,

— আমার রোদ আর শুভ্রর জন্য টেনশন হচ্ছে। ওরা কি বেঁচে আছে? ওদের বাচ্চাটার কি হয়েছে?

হ্যারি খাওয়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,

— রোওড কে? আর শোওবরোই বা কে?

জেনি মাথা তুলে তাকালো। কড়া গলায় বললো,

— ঠিক করে উচ্চারণ করো হ্যারি। এতো সুন্দর নামগুলোকে কি রকম বিশ্রীভাবে উচ্চারণ করছো তুমি।

হ্যারি অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,

— সরি! বাট নামগুলো একটু বেশিই কঠিন। এনিওয়ে, ওরা কে সেটা তো বলো।

জেনি এবার ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে টেবিলে রাখলো। হ্যারি ডায়েরিটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে ঠোঁট উল্টে বললো,

— এসব কি লেখা এখানে?

— এটা বাংলায় লেখা। বাবার স্টাডি রুম থেকে পেয়েছি। এখানে রোদ নামের একটি মেয়ের লাভ স্টোরি লেখা। রোদ-শুভ্র আর দ্যা লাভ বার্ডস্। ওরা বাংলাদেশে থাকে। অনেক কিউট লাভস্টোরি বাট এন্ডিংটা নেই…আই এম ভেরি কিউরিয়াস এবাউট দ্যা এন্ডিং।

— এটা রিয়েল লাইফ স্টোরি?

জেনি খেতে খেতে বললো,

— আমার তো তাই মনে হয়। তুমি শুনবে?

হ্যারি আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়লো। জেনি ডায়েরিটি খুলে বাংলা লেখাগুলোকে ইংলিশে ট্রান্সলেট করে শুনাতে লাগলো। দেখতে দেখতে ক্লাস টাইম শেষ হয়ে এলো। কিন্তু হ্যারি জেদ ধরে বসে রইলো বাকিটা সে আজই শুনবে। অবশেষে দু’জনে মিলে চলে এলো লসএঞ্জেলসের ফিফথ ও সিক্সথ স্ট্রিটের মাঝে নিউহ্যামশায়ারে জেনিদের বাসায়। গ্র্যানির সাথে দেখা করে বাবা ফিরলেই তাকে জানাতে বলে নিজের রুমে ঢুকে আবারও ডায়েরিতে মনোযোগ দিলো তারা । রাত ৮ টার দিকে পড়া শেষ করে হ্যারির দিকে তাকাতেই চিন্তিত মুখে বলে উঠলো হ্যারি,

— হোয়াট নেক্সট? এখন কি হবে জেনি?আই মিন তারপর কি হয়েছিলো?

জেনি দুঃখী দুঃখী গলায় বললো,

— জানি না। আই থিংক বাবা জানেন। বিকজ ডায়েরিটা তার কাছেই ছিলো।

তখনই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। দরজা ঠেলে মাথা হেলিয়ে বলে উঠলো ক্যাথেলিন,

— তোমার বাবা ফিরেছে সুইটহার্ট।

জেনি হ্যারি দুজনেই লাফিয়ে উঠলো। দুজনেই দৌঁড়ে গেলো কার্লোসের রুমের দিকে।কার্লোস মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। মেয়েকে এভাবে দৌঁড়ে আসতে দেখে অবাক হলো সে। বিস্ময় নিয়ে বললো,

— কি হয়েছে প্রিন্সেস? তুমি ঠিক আছো?

জেনি হন্তদন্ত করে বাবার দিকে ডায়েরিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

— এই ডায়েরিটা তুমি কোথায় পেয়েছো বাবা?

কার্লোস ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে নিয়ে বললো,

— এটা কি আমার কাছে ছিলো প্রিন্সেস?

— হ্যা বাবা। এটা তোমার স্টাডি রুমের ডানপাশের তাকটা থেকে পেয়েছি আমি।

কার্লোস কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

— আমার তো মনে পড়ছে না, মা।

এবার পাশ থেকে হ্যারি বলে উঠলো,

— মনে করার চেষ্টা করুন, স্যার।

কার্লোস হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,

— হেই হ্যারি! কেমন আছো?

— আপনি ডায়েরির ব্যাপারটা মনে করতে পারলে ভালো থাকবো। নয়তো খুব খারাপ।

কার্লোস ভ্রু কুঁচকে বললো,

— এতোটা জরুরি? ওকে আই এম ট্রায়িং।

জেনি আর হ্যারি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কার্লোস খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠলো,

— এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা?

— তাড়াতাড়ি মনে করো না বাবা, প্লিজ!

মেয়ের অস্থিরতা দেখে মনে করার চেষ্টা করলো কার্লোস। খানিকবাদে বলে উঠলো,

— এটা আমি ইন্ডিয়ার কোন এক হাসপাতালের ময়লার ঝুড়ি থেকে তুলে ছিলাম।

জেনি আর হ্যারি একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথেই চেঁচিয়ে উঠলো,

— হোয়াটটট!!

কার্লোস হঠাৎ চিৎকারে চমকে উঠে বললো,

— হ্যাঁ। এটুকুই মনে আছে আমার। কোন এক সার্ভে তে ইন্ডিয়ার হসপিটালগুলো পরিদর্শন করতে গিয়ে ময়লার ঝুড়িতে পাই এটা। পানির বোতল ফেলতে গিয়ে দেখি একজন নার্স কিছু ময়লা ঝুড়িতে ঢালছেন। ওখানে এই ডায়েরিটাও ছিলো। কেন যেন তুলে নিয়েছিলাম কিন্তু পড়া হয়ে ওঠেনি কখনো।

হ্যারি মাথা চুলকে বললো,

— এটা কতোদিন আগের কথা?

কার্লোস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,

— দু’বছর হবে।

হ্যারি এবার ফিসফিস করে বললো,

— তারমানে রোওড এর বেবি বেঁচে থাকলে এখন তার দু’বছর?

জেনি কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। কার্লোস পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিলো না সে। কার্লোস কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে হঠাৎ দেখলে আমেরিকান বলে মনেই হয় না। বাঙালীদের মতো হলুদ ফর্সা গায়ের রঙ। মা-বাবা দুজনেই আমেরিকান হলেও জেনির চোখের পুতুলী দুটো ঘন কালো। শরীরের গঠনটাও বাঙালী মেয়েদের মতো তুলতুলে।এই মেয়েটার মধ্যেই কার্লোসের জীবন। প্রচন্ড ভালোবাসে মেয়েটাকে।

জেনি বেডে মন খারাপ করে বসে আছে। হ্যারি এদিক ওদিক পায়চারি করছে। হঠাৎ পায়চারী থামিয়ে দিয়ে জেনির সামনে দাঁড়িয়ে উজ্জল মুখে বলে উঠলো সে,

— আচ্ছা? তোমার তো বাংলোডেশে যাওয়ার শখ। আমরা যদি স্টোরিটার এন্ডিং খুঁজতে বাংলোডেশে যাই তাহলে কেমন হয়?

জেনি চোখ তুলে তাকালো। হ্যারি সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

— এটা কি খুব বাজে আইডিয়া? ওকে, দেন ফরগেট ইট।

জেনি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

— এটা দারুন আইডিয়া বাট ওদের খুঁজে পাবো কিভাবে?

হ্যারি কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

— ইট ইজ সো ইজি। লুক, শোওবরো প্রফেসর ছিলো। আর তারা বাংলোডেশের একটি নির্দিষ্ট শহরে থাকতো। ওর জবটাও সেই শহরেই ছিলো। একটা শহরে কয়টা ভার্সিটি থাকতে পারে? আমরা যদি শহরের সবগুলো ভার্সিটিতে খুঁজ নেই তাহলে শোওবরোকে পেয়ে যেতেও পারি। না পেলেও ডিটেইলস তো পাবো। আর কিছুই না পেলেও এটলিস্ট বাংলোডেশ ঘুরা হয়ে যাবে।হোয়াট ইউ ছে?

মুহূর্তেই জেনির ঠোঁটের কোণায় হাসি ফোঁটে উঠলো। দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,

— পেরেন্টসদের কিভাবে রাজি করানো যায় তার জন্য একটা অসাধারণ প্ল্যান লাগবে হ্যারি। তারসাথে পাসপোর্ট!! নেক্সট উইক উই আর গুয়িং টু বাংলাদেশ!!!

হ্যারি দাঁত বের করে হেসে বললো,

— আই হ্যাভ আ প্ল্যান। নাও গেট রেডি ফর মিশন বাংলোডেশ!!!

#চলবে..

তোকে চাই❤ (সিজন-২)part: 70

0

তোকে চাই❤
(সিজন-২)part: 70
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

ডক্টরের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভারি শরীরটা নিয়ে হাঁটতেও কষ্ঠ হচ্ছে আমার। এই মুহূর্তে যে মানুষটির কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে তিনি হলেন শুভ্র৷ সারাটাক্ষণ বুকে আগলে রাখা মানুষটি আজ এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমার পাশে নেই। এর থেকে অসহায় পরিস্থিতি কি আদৌ কোনো মেয়ের হতে পারে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটু এগিয়ে যেতেই সাহেল ভাইয়ার কন্ঠ কানে এলো,

— ডক্টর? এর কি কোনো সমাধান নেই। ইউ আর আ ডক্টর! ডক্টর হয়ে এভাবে গিভ আপ করতে পারেন না। একটা জীবনের সাথে অনেকগুলো জীবন জড়িয়ে থাকে ডক্টর। কারো জন্য কারো জীবন থেমে না থাকলেও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। একটু আগে যে ছেলেটাকে অটি থেকে বের করলেন সেও পারবে না।

— আমি আপনাদের ইমোশন বুঝতে পারছি। আমার ক্যারিয়ারে অনেককেই প্রিয়জন হারাতে দেখেছি। হাহাকার করতে দেখেছি। পারলে আমি সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতাম কিন্তু সেই শক্তি সৃষ্টিকর্তা আমাদের দেন নি। বো..

উনাদের কথার মাঝেই ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি৷ হাসিমুখে বললাম,

— হ্যালো ডক্টর।

ডক্টর কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে জোরপূর্বক হাসলেন। বললেন,

— হ্যালো। প্লিজ সিট।

আমি বসলাম। একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে উঠলাম,

— ডক্টর? আমার এক্সাক্ট প্রবলেমটা কি? এর কি কোনোই চিকিৎসা নেই? প্রায় সব রোগেরই চিকিৎসা আছে তাহলে…

ডক্টর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো সামনে রেখে বলে উঠলেন,

— আপনার যে সমস্যাটা সেটা হলো অ্যানিউরিজম। অ্যানিউরিজম শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। মস্তিষ্কের ভেতরের ধমনিতে এক ধরনের অ্যানিউরিজম দেখা যায় যাকে ‘বেরি অ্যানিউরিজম’ বলা হয়। এ ক্ষেত্রে ধমনী বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। অ্যানিউরিজম ফেঁটে না যাওয়া পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু আশঙ্কা থাকে না। চিকিৎসকরা অস্ত্রপাচারের মাধ্যামে অ্যানিউরিজমের চিকিৎসা করে থাকে। কিন্তু যদি অ্যানিউরিজম ফেঁটে যায় তাহলে চিকিৎসকের হাতে কিছু করার থাকে না। এসব ক্ষেত্রে কিছু রোগী সাথে সাথেই মারা যায় আবার রক্তপাত অর্থাৎ ব্লিডিং এর পরিমান কম হলে কিছু রোগী কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে থাকে। সেদিক থেকে আপনি লাকি বিকজ আপনারও সেইম সমস্যা হলেও আপনার হাতে কিছু সময় আছে। কিন্তু সরি টু ছে, আমাদের হাতে করার মতো কিচ্ছু নেই।

সাহেল ভাইয়া বললেন,

— হঠাৎ করে এমন একটা সমস্যা কেন হলো? এক্সিডেন্টের জন্য?

— অ্যানিউরিজম কি কারণে হয় তার সঠিক তথ্য এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা যায় না বললেই চলে তাই মানুষ ব্যাপারটাকে আমলে নেন না। এমনও হতে পারে আগে থেকেই উনার অ্যানিউরিজম ছিলো কিন্তু বুঝতে পারেন নি। আজ ফেঁটে যাওয়ায় ব্যাপারটা ওঠে এসেছে। অ্যানিউরিজম হলে নর্মাল কিছু সমস্যা দেখা যায় যেমন, মাথা ব্যাথা, শরীরের দুর্বলতা, চোখে বেশি দেখা নয়তো কম দেখা, শরীরের অসাড়তা, কথা বলা অথবা মনোযোগ দেওয়ায় সমস্যা ইত্যাদি। হয়তো এসব উনি ফিল করেছেন কিন্তু তেমন গুরুত্ব দেন নি। অ্যানিউরিজম মাঝে মাঝে পরিবারের মেডিকেলহিস্ট্রির ওপর ভিত্তি করেও হতে পারে। অর্থাৎ, বংশগতও বলতে পারেন। পরিবারে আগে কারো হয়ে থাকলে পরবর্তীতে অন্যকারো হওয়ার সম্ভবনাটা বেশি থাকে।

আমার চট করেই দাদুর কথা মনে পড়ে গেলো। দাদুও এমন কিছু কারণেই মারা গিয়েছিলেন। তখন ছোট ছিলাম বলে ব্যাপারটা পুরোপুরি জানি না। তাহলে কি! কথাটা ভেবে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই বলে উঠলাম আমি,

— ডক্টর? আমি ডেলিভারি করাতে চাই। অ্যানিরজমে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আপনি বলেছেন কিছু সময় আমার হাতে আছে। এই সময়টুকু আমি আমার বাচ্চাকে দিতে চাই। ডক্টর প্লিজ ডু ইট ফার্স্ট।

ডক্টর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুঃখী দুঃখী গলায় বললেন,

— সরি ডিয়ার। তুমি আমার মেয়ের বয়সী তাই তুমি করেই বলি। তোমার আরেকটা সমস্যা আছে।

কথাটা শুনে হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো আমার। না জানি কি শুনতে হবে এখন। তবু দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করে বললাম,

— কি সমস্যা, ডক্টর?

বয়স্ক ডক্টরটি আমার দিকে আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট টি এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

— তোমার “অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম” এর সমস্যাও দেখা দিয়েছে।

আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। একটা ঢোক গিলে নিয়ে বললাম,

— মানে?

ডক্টর একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

—“অ্যাবডোমিনাল অ্যাওর্টিক অ্যানিউরিজম ” এই অবস্থায় পেটের মধ্যের বড় রক্তনালী ফুলে বেলুনের মতো হয়ে যায়। বেলুনের মতো অংশটা ফেঁটে না যাওয়া পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু সমস্যাটা হলো অ্যানিউরিজম কখন ফেঁটে যাবে সেই সম্পর্কে আগাম জানা ডক্টরদের পক্ষ এখনও সম্ভবপ্রায় হয়ে ওঠে নি। অ্যানিউরিজম ফেঁটে গেলে প্রচুর রক্তপাত হয়। তাকে বলে ইনটারনাল ব্লিডিং।এসময় প্রচুর রক্ত লাগে এবং দ্রুত অপারেশন করে রক্তনালী মেরামত করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হয়। না হলে রোগী বাঁচানো সম্ভব হয় না। অপারেশন করলেও বাঁচার সম্ভাবনা শতকরা ৫০ ভাগের বেশি না। আর তোমার পেটেও ট্রিপল-অ্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু সেটা এখনো ফাঁটে নি তবে ফুলে আছে। আমরা রিস্ক নিয়ে অপারেশন করতে পারতাম যদি তুমি প্রেগনেন্ট না হতে। আমার ডাক্তারী জীবনে এমন কোনো কেইস দেখি নি আমি। একসাথে দু’জায়গায় অ্যানিউরিজম ধরা পড়া রোগী আমার ক্যারিয়ারে তুমিই প্রথম। তারপর তুমি প্রেগন্যান্ট। তোমার ব্লাডপ্রেশারের অবস্থাও ভালো না। এই রোগটি বৃদ্ধদের বেশি হয় তারপর হয় প্রাপ্ত বয়স্কদের কিন্তু সেদিক থেকে তুমি একদমই তরুনী। সত্যি বলতে এই সমস্যা আমাদের সামনে সম্পূর্ণই নতুন। এটা হয়তো আমাদের ব্যর্থতা কিন্তু সত্য এটাই আমরা কিছু করতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের দেশে অ্যানিউরিজম রোগটি খুব কম দেখা যায় আর যেগুলো হয় সেগুলো আমরা সহজেই হ্যান্ডেল করতে পারি বাট তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো, ইউ আর ডিফারেন্ট ওয়ান। আমাদের কাছে ভালো ডক্টর থাকলেও এই নতুন উপসর্গের সাথে পেরে উঠার মতো টেকনিক আমাদের নেই।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। পুরো দুনিয়াটা যেন ঘুরছে আমার। প্রথমত মাথা ব্যাথা তারউপর এতোসব কিছু! ডক্টর এবার উঠে দাঁড়ালেন। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বললেন,

— আই এম সরি ডিয়ার। আমি পারলে অবশ্যই সাহায্য করতাম তোমায়। তার থেকে যতক্ষণ সময় তোমার কাছে আছে ততক্ষণ সময় তোমার প্রিয়জনদের সাথে বাঁচার চেষ্টা করো। কালেক্ট সাম বিউটিফুল মোমেন্ট ডিয়ার।

আমি জল টলমলে চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

— কোনো কি উপায় নেই ডক্টর? আমাকে নয় আমার বাচ্চাটাকে বাঁচানোর একটা উপায় বলুন ডক্টর। প্লিজ! আমার কয়েকঘন্টার বিউটিফুল টাইমের থেকে আমার বাচ্চাকে ৬০ বছরের একটা বিউটিফুল জীবন দিতে পেরে আমি বেশি খুশি হবো ডক্টর। আমার বাচ্চার জীবনটাকে শুরুর আগেই এভাবে গিভ আপ করতে দিতে পারেন না। ওকে বাঁচতে হবে। এই পৃথিবীতে আসতে হবে। পৃথিবীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিতে হবে। খিলখিল হাসিতে চারদিক মুখরিত করতে হবে। কষ্ট পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে আমায় একবার হলেও মিস করতে হবে। আমার না পাওয়া সময়টুকুও ওকে পেতে হবে। আমার পুরো না করা স্বপ্ন আমার হয়ে ওকে পূরণ করতে হবে৷ ওর বাবাকে সামলাতে হবে। এই পৃথিবীতে আমার কয়েকঘন্টার চেয়ে ওর আসাটা বেশি প্রয়োজন ডক্টর। ওর বাবার জন্য ওকে বড্ড প্রয়োজন ডক্টর। তারজন্য আমার এই কয়েকটা ঘন্টা তো আমি হাসতে হাসতে কুরবান করতে পারি। প্লিজ ডক্টর, কিছু একটা উপায় তো হবে। প্লিজ!

ডক্টর কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,

— আই এম নট সিউর বাট তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো। এই একটা উপায় ছাড়া আর কোনো উপায়ই চোখে পড়ছে না আমার।

আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,

— কি উপায়?

ডক্টর আবারও চেয়ারে বসলেন। আমার চোখে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন,

— ডক্টর সিংহানিয়া সেনের নাম শুনেছো? ওয়ার্ল্ড হেল্থও বেশ কিছু বছর কাজ করেছেন উনি। তার একটা টিম অ্যানিউরিজম নিয়ে রিসার্চ করছে। উনি যে টিম লিড করছেন সেখানে আমি সহ আমেরিকা,ভারতীয় আর দুটো দেশের মোট ১০ জন ডক্টর কাজ করছেন। উন্নত বিশ্বে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্দান্ত আধুনিকায়ন সত্ত্বেও এ ধরনের রোগীদের শতকরা ৭৫ জনেরও বেশি অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাই এই রিসার্চটা বেশ গুরুত্বও পাচ্ছে। একবছর ধরে আমরা অ্যানিউরিজমের রুগীদের উপসর্গগুলো, ডিফিকাল্টিজগুলো অবজার্ভ করছিলাম। অবশেষে খুবই অদ্ভুত একটা কেইস সামনে এলো। আমি তোমার মেডিক্যাল রিপোর্টস ডক্টর সেনের কাছে মেইল করেছি। উনি রিপোর্ট দেখে অবাক হয়েছেন। এবং তোমার প্রতি বেশ ইন্টারেস্টেট। কিন্তু তারজন্য তোমায় কোলকাতা যেতে হবে। দে আর রেডি ফর ইউ…

— কিন্তু ডক্টর আমার পাসপোর্ট নেই। তাছাড়া টাইমও নেই। পাসপোর্ট ভিসার ঝামেলায় অনেক সময় লাগে। আপনি নিশ্চয়…

ডক্টর হাসলেন। টেবিলে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলে উঠলেন,

— তোমার রাজি হওয়াটা ম্যাটার করে মাই ডিয়ার। বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ প্রয়োজনে একদিনে পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়। আর তোমার ব্যাপারটা তো আরো বিশেষ। জানি তোমার কাছে একদিন সময়ও নেই। বাট আমাদের কাছে ইন্টারন্যাশনাল পারমিশন আছে। অর ডক্টর সেনের মতো ডক্টররা রিসার্চে সফল হওয়ার জন্য সব করতে পারেন। আর এই রিসার্চটাকে একটু বেশি গুরুত্ব সহকারেই দেখছেন উনি। তোমার ওদেরকে যতটা প্রয়োজন তারথেকে বেশি ওদের তোমাকে প্রয়োজন। বিকজ ইট ইজ আ ডিফারেন্ট কেইস ইন সিক্সটি ইয়ারস্। তাই তোমাকে সঠিক সময়ে কোলকাতা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এবং প্রয়োজন দুটোই ওদের।এই রিসার্চের পেছনে ওদের অনেক টাকা খরচ হচ্ছে তাই তোমাকে ওরা নেওয়ার ব্যবস্থা করবেই সেটা আইন মেনে হোক বা না মেনে। বুঝতে পারছো নিশ্চয়? (কথাটা বলে মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসলেন) তবে, তাদের একটা শর্ত আছে।

ভাইয়া বললো,

— কি শর্ত, ডক্টর?

— ওরা মিসেস. আহমেদকে নিজ দায়িত্বে কোলকাতা নিয়ে যাবে। অপারেশনের দায়িত্বও ওদের বাট অপারেশন সাকসেসফুল না হলে তারজন্য তারা দায়ী নয়। তারা আপনাদের কাছে কোনো জবাবদিহিও করবে না।(আমার দিকে তাকিয়ে) তুমি মৃত্যুপথযাত্রী তাই তোমাকে নিয়ে রিসার্চ করতে চাই তারা। এতে তুমি তো মারা যাবেই তোমার সন্তানও মারা যেতে পারে আবার বেঁচেও যেতে পারে। ইউ নো, ফিফটি ফিফটি চান্স। এখন তুমি ডিসাইড করবে তুমি যাবে কি যাবে না। তোমার উপসর্গটা ডিফারেন্ট বলেই এই চান্সটা তুমি পাচ্ছো। এটা তোমার বাচ্চার জীবনের জন্য গোল্ডেন চান্স হতে পারে। এখন তু..

আমি কিছু না ভেবেই বললাম,

— আমি রাজি।

ডক্টর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

— ওকে দেন। আমি ওদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। তুমি মানুষিকভাবে প্রস্তুত হও। তিনঘন্টার মধ্যে তুমি কোলকাতায় থাকবে। ফ্যামিলির সাথে সময় কাটানোর জন্য তোমার হাতে দু’ঘন্টা সময় আছে। এই দু’ঘন্টায় সব ব্যবস্থা করে ফেলবো আমরা। দু’ঘন্টা পর কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া হবে। ঢাকা থেকে কোলকাতা একঘন্টার পথ। আই থিংক, কোনো সমস্যা হবে না। এনিওয়ে, আপনাদের কারো কাছে পাসপোর্ট বা ভিসা নেই? তাহলে কেউ মিসেস. আহমেদের সাথে যেতে পারতেন। সাপোর্ট হিসেবে। এমন কেউ কি আছে?

সাহেল ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট তো আমার, শুভ্র, অভ্র ভাই, আঙ্কেল আর নাবিলার আছে। শুভ্রদের বিজনেসের একটা শাখা আছে ওখানে। আর নাবিলার ফ্যামিলি তো ওখানেই স্যাটেল। ওর বাবা কোলকাতায় বাংলাদেশ এম্বেসীতে আছেন। সো এদের মাঝে,শুভ্র ছাড়া যে কেউ যেতে পারবে। ইটস নট আ ম্যাটার।

— সবাই তো যেতে পারবেন না। শুধু একজন এলাউড। আপনারা ডিশিসন নিন কে যাবেন। আমি ওদের সাথে কথা বলছি।

হসপিটালের করিডোরে মাথানিচু করে বসে আছি। এতোক্ষণে সবাই চলে এসেছে হসপিটালে। বাবা,মা, ভাইয়া, আপু সবাই মরা কান্নাজুড়ে দিয়েছে। হয়তো আমিই একমাত্র মেয়ে যে নিজের মৃত্যুতে সবার কান্না, আহাজারি দেখে তারপর মরতে যাচ্ছি। ওদের কান্না দেখে আমারও বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু তারথেকেও বেশি বিরক্তি হচ্ছি। এই দুটো ঘন্টা কি কেউ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না? আমি চোখ তুলে ওদের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,

— কাঁদতে ইচ্ছে করলে আমার সামনে থেকে যাও। আমাকে বিরক্ত করবে না। জাস্ট গো…

সবাই ধীরে ধীরে চুপ হয়ে গেলেও মা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতেই থাকলেন। একবার বিরক্ত হলেও আবার ভাবলাম, থাক কাঁদুক। মায়ের কাঁদার অধিকার আছে। যে আমি দু’দিন আগেও অবুঝের মতো ব্যবহার করতাম সে আজ নিজের বাচ্চাটার জন্য একা একা যুদ্ধে নেমে যাচ্ছি আর মা তো ২০ বছর ধরে আগলে রেখেছে আমায়। এই কান্নার অধিকার তার আছে। সবার সামনে শক্ত থাকলেও শুভ্রর কেবিনে গিয়ে ওর ঘুমন্ত মায়ামাখা মুখটা দেখে নিজেকে আটকাতে পারলাম না আমি।উনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। যে মানুষটি আমার একফোঁটা চোখের জল সহ্য করতে পারতেন না তিনি আজ কতো নিস্তব্ধ। আমি এমন পাগলের মতো কাঁদছি তবু একটিবার তাকিয়ে দেখছেন না আমায়। হায়রে সময়! যে মানুষটার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছি আজ তার জন্য একটা ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারছি না। আজ আমার সব আছে শুধু সময়টাই নেই। বুক থেকে মাথা তুলে উনার মুখটা অসংখ্য ভেজা চুমুতে ভরিয়ে তুলললাম। উনি যদি জেগে থাকতেন তাহলে নিশ্চয় হাসিমুখে বলে উঠতেন,

— ছি রোদপাখি। আমার মতো ইনোসেন্ট ছেলের সাথে এমনটা করতে পারলে তুমি? আমার ভার্জিনিটি হাফ শেষ করে দিলে তুমি।

কিন্তু আজ উনি নিশ্চুপ। একদমই নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ উনার কাছে থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। উনার পাশে থাকলেই দুর্বল হয়ে পড়বো। তাছাড়া উনার জ্ঞান ফেরার সময়ও হয়ে এসেছে প্রায়। উনার জ্ঞান ফেরার আগেই চলে যেতে হবে আমায় নয়তো কি করবেন উনি কে জানে? বাইরে বেরিয়ে আদ্র-রোদ্রকে কিছুক্ষণ আদর করে কিছুক্ষণ মার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলাম। কিছুক্ষন পর আমাকে ডাকা হলো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই নার্সের কন্ঠ কানে এলো। কোনো ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

— ডক্টর? ২৪৪ এর প্যাশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।

মুহূর্তেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। শুভ্র জেগে গেছে। ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। হাতে যে সময় নেই। শুভ্রর তার রোদকে শেষবারের মতো দেখার ভাগ্য হলো না। যখন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলাম তখন সাথে ছিলো সবসময় সঙ্গে থাকা আমার ব্যাগ আর সাহেল ভাইয়া। তারসাথে এক আকাশ আশা, হতাশা, কষ্ট আর অনিশ্চয়তা। যাত্রা শুরুর আগে দেশটাকেও প্রচন্ড রকম মিস করছিলাম আমি। দেশের মাটি, ধুলিকনা,বাতাস আর সবচেয়ে হেটিং ট্রাফিক জ্যাম সবই যেন অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো চোখে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেই সব জিনিস এতো সুন্দর হয়ে ওঠে কেন? বেঁচে থাকতে এতো লোভ জাগে কেন? মনে হয়, আগে জানলে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে দেখে নিতাম সব,,আরেকটু মন ভরে বেঁচে নিতাম!! কোলকাতায় হসপিটালে পৌঁছাতেই ডক্টর সেন এসে দেখা করলেন। মোটামুটি বৃদ্ধ একজন লোক। চোখে চশমা। মুখে ভদ্রলোক ভদ্রলোক ভাব। মুখে স্মিত হাসি। আমায় দেখেই চোখদুটো চকচক করে উঠলো তার। ডক্টরদের উৎসাহ দেখে বুঝতে পারলাম তারা আমাকে প্যাশেন্ট নয় একটা প্রজেক্ট হিসেবে দেখছে। নিজের মনে হাসলাম…নিজেকে জড়বস্তু ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না এখন তবু যদি বাচ্চাটা বাঁচে। শুভ্রর প্রিন্সেসটা বাঁচে! নার্সরা অপারেশনের জন্য রেডি করে দিলেন। মাথায় আর শরীরে বেশ কিছু ইনজেকশন লাগালেন। এই অবস্থায় নাকি প্রচুর শ্বাসকষ্ট হয় তাই এই ব্যবস্থা। আমাকে বলা হলো আধাঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে। আধাঘন্টা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ সাহেল ভাইয়া এসে ডাকলেন,

— সানশাইন?

আমি চোখখুলে তাকালাম। মুহূর্তেই জলে ভরে গেলো চোখ। শুভ্র! সাহেল ভাইয়া উনাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সাথে আছেন অভ্র ভাইয়া। উনাকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন তারা। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। অনেক প্রশ্ন ঘুরে বেড়ালেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে না। থাকুক না কিছু না জানা। শুভ্রর লাল হয়ে যাওয়া ফোলা চোখদুটো টলমল করছে। একদম শান্ত হয়ে বসে আছেন উনি। আমার শুভ্রকে কি এতো শান্ত হিসেবে মানায়? একদমই না। উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতটা নিজের গালে চেপে ধরে কাঁপা গলায় বলে উঠলেন,

—আমি বাঁচতে চাই রোদপাখি। তোমার সাথে বাঁচতে চাই। তুমি তো আমায় বুঝো,বলো? আল্লাহর কাছে কেন এমন দোয়া করেছিলে রোদ? তুমি খুব সার্থপর রোদ, একটাবার আমার কথা ভাবো নি। একটাবারও না। আই ওয়ান্ট ইউ। আমার তোকে চাই রোদপাখি। প্লিজ! যদি কেউ আমায় কোনো শর্ত দিয়ে বলতো এর বিনিময়ে তোমায় আমি পাব তবে আমি তাই করতাম রোদ। আল্লাহ তোমাকে আমার পাজর দিয়ে বানালেন অথচ আমার হায়াত তোমাকে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা কেন করলেন না বলো তো। এভাবে মেরে দিলেন আমায়।

কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কাঁদছেন উনি। উনাকে কখনোই এভাবে কাঁদতে দেখি নি আমি।উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে উনার মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। দুঃখ-কষ্টের ভারগুলো স্বার্থপরের মতো উনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বললাম,

— আপনি এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। সহ্য হয় না আমার। আমি থাকবো না তো কি হয়েছে? আপনার প্রিন্সেস তো থাকবে। দেখবেন ওর মাঝে আমার সবটা থাকবে, সব। ওর জন্য আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমার বাচ্চাটা তো এই পৃথিবীতে এতিমের মতো বেঁচে থাকতে পারে না। আপনি তাকে পৃথিবীর সব হ্যাপিনেস এনে দিবেন। ওকে জানতে হবে ওর বাবা ওকে কতো ভালোবাসে। ওকে জানতে হবে ওর বাবা ওর মাকে কতো ভালোবাসতো। আমাদের ভাঙা স্বপ্নটা পূরণ করতে হবে তাকে।ওর জন্য আপনাকে বাঁচতে হবে। প্রমিজ করুন আমায়….

সেই মুহূর্তেই দু’জন ডক্টর কেবিনে ডুকলেন। পাঁচ মিনিট পর আমাকে অপারেশ থিয়াটারে নিয়ে যাওয়া হবে। শুভ্র তাঁদেরকে রিকুয়েস্ট করলেন যেন তাকে অপারেশন থিয়েটারে থাকতে দেওয়া হয়। সে আমার শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত আমায় পাশে থাকতে চান। ডক্টররা চলে যেতেই আমার দিকে তাকালেন শুভ্র। কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

— সরি রোদপাখি। আমি তোমার কথা রাখতে পারবো না।

আমি ফিসফিস করে বললাম,

— আপনাকে পারতে হবে। বাঁচতে হবে।

উনি বললেন,

— সম্ভব নয়।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর দশ মিনিট পর অজ্ঞান করা হবে আমায় তারপর শেষ হবে আমার জীবন। শুভ্র আমায় দেখতে পেলেও এই দশটা মিনিটই উনাকে আমার শেষ দেখা….অনুভব করার শেষ সীমা।

এখানটাতেই শেষ হয়েছে লেখা। জেনি আরো কিছু পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখলো কিন্তু আর কোনো লেখায় খুঁজে পেলো না সে। পেছনের সবগুলো পেইজই ফাঁকা। ডায়েরীটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে কাঁচের জানালার বাইরের শহুরে বৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলো সে। কি নিস্তব্ধ বৃষ্টি! চারদিকে শব্দ নেই শুধু বৃষ্টির সাদা নির্মল জল। জেনির মাথায় হাজারও প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোদের মৃত্যুর পর কি হয়েছিলো শুভ্রর? ডক্টররা কি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পেরেছিলো? আর শুভ্র কি বেঁচে আছে এখনও?

#চলবে….

(কিছু অপ্রাসঙ্গিকতার জন্য ৭০ পার্টটি রি-পোষ্ট করা হলো। আশা করছি গল্পকে গল্প হিসেবেই নিবেন। বাস্তব জীবন আর গল্প এক হয় না। আর গল্পে কো-ইনসিডেন্ট থাকে বলেই এটা গল্প। ধন্যবাদ)

তোকে চাই❤ (সিজন-২) part: 68

0

তোকে চাই❤
……. (সিজন-২) part: 68
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

সকাল আটটা কি নয়টা বাজে। কারো হাসাহাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। জোর করে চোখদুটো খুলে পাশ ফিরে তাকালাম। রুম একদম ফাঁকা। আওয়াজটা ড্রয়িং রুম থেকে আসছে বুঝতে পেরে আবারও চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম আমি। কয়েক মিনিট পর ভারি মাথা নিয়ে উঠে বসে ওড়নাটা গায়ে পেচিঁয়ে চলে গেলাম নিচে। শুভ্র, মামু, মামানি,আপু, অভ্র ভাইয়া,দিদা সবাই মিলে হাসাহাসি করছেন। আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকালো। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

— এনি প্রবলেম? কি হয়েছে?

আমার কথায় মামানি এগিয়ে এলেন। গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন,

— আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না রে রোদ। এই বছরটা খুব লাকি আমার জন্য। দু’ দুটো নাতি পেয়েছি। এখন আরো একজন আসছে। এতোদিনের ফাঁকা ঘরটা পুরো করে দিলি তোরা দুই বোন। সুখী হ মা।

দিদাও এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। কপালে চুমু দিয়ে বলে উঠলেন,

— ছোট নাতবউ? বড় নাতবউয়ের চেয়ে সবকিছুতেই তো তুই ডাবল। কথাতে, কান্নাতে,হাসিতে,দুষ্টামিতে তো অতিথির বেলায়ও ডাবলই হবে,তাই না? রানু? তুই বরং সবকিছু চার সেট করে কিনে রাখ বুঝলি?

দিদার কথায় আবারও হেসে উঠলো সবাই। আমি লজ্জা লাল মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মামুও মুচকি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এমন সময় কোথা থেকে সাহেল ভাইয়া এসে শুভ্রকে হুট করেই জড়িয়ে ধরলেন। পিঠে কয়েকটি চড় থাপ্পড় দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললেন,

— বাহ দোস্ত! আজ না খুব শান্তি শান্তি লাগছে। কনগ্রাচুলেশন বস। আজ থেকে দুই বন্ধু মিলে দুঃখের গল্প করবো। ভাবতেই এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে।

শুভ্র অবাক হয়ে বললেন,

— মানে? দুঃখের গল্প! কিসের দুঃখ।

সাহেল ভাইয়া হেসে বলে উঠলেন,

— কিসের দুঃখ সেটা তো আজ থেকেই জানতে পারবি। বউ কতো প্যারাময় হতে পারে তা এই দশমাসে বুঝে যাবি। আমি তো এই পাঁচমাসেই শেষ! জীবন বের করে ফেলছে বন্ধু।

নাবিলা আপু সাহেল ভাইয়ার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাহেল ভাইয়ার কথায় ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,

— সাহেল? তুমি কি বলতে চাইছো? আমি তোমাকে জ্বালাই?

সাহেল ভাইয়া হাসলেন। নাবিলা আপুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

— আমি কি বলেছি তুমি জ্বালাও? এই শুভ্র? আমি এমন কিছু বলেছি? আমার বউয়ের মতো লক্ষ্মী বউ এই তৃভূবনে নেই বুঝলি? সে আমাকে একটুও জ্বালায় না। তার তো শুধু রাত দুটোয় আইসক্রিম,ফুসকা,চটপটি,কাবাব,চিপস, কুলফি ইত্যাদি ইত্যাদি খেতে হচ্ছে করে। রাত ৩/ ৪ টার সময় লুডু খেলতে ইচ্ছে করে। মাঝরাতে হুট করেই মরাকান্না করতে ইচ্ছে করে। মাংস রান্না করলে বমি করে ভাসিয়ে দিয়ে তার মাছ খেতে ইচ্ছে করে। মাছ রান্না করলে মাংস খেতে ইচ্ছে করে। মাঝরাতে ৫/৬ বার করে বেডশিট চেঞ্জ করতে ইচ্ছে করে। বাগানে গেলে ফুল চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে। আর…

সাহেল ভাইয়ার কথায় মুখ চেপে হেসে উঠলো সবাই। নাবিলা আপু রাগী গলায় বললেন,

— সাহেল! এতো জ্বালায় তোমায়? বেশ, এখন থেকে কিচ্ছু বলবো না। হ্যাপি?

সাহেল ভাইয়া মুচকি হেসে নাবিলা আপুকে নিজের কাছে দাঁড় করিয়ে বলে উঠলেন,

— আরে রাগ করে না। মজা করছিলাম তো। আমার বউটা আসলেই অনেক লক্ষ্মী।

মামু,মামানি, দিদা হালকা হেসে আমাদের রেখে যার যার রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি শুভ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বলে উঠলেন উনি,

— বাট আই উইল ম্যানেজ সাহেল। তোর জন্য নতুন হলেও আমার জন্য নতুন না।

উনার কথায় তিনজনেই চোখ বড়বড় করে তাকালাম। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে একসাথেই বলে উঠলাম,

— মানে?

শুভ্র থতমত খেয়ে বলে উঠলেন,

— তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি তো রোদের কথা বলছিলাম। ও তো সবসময়ই এমনসব কাজ করে এটা তো নতুন কিছু না, এটাই বুঝাতে চাইছিলাম।

আমরা তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে একসাথেই বলে উঠলাম,

— ওওওওওও।

শুভ্র যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একটু আধটু কথা বলে সবাই মিলে সোফায় গিয়ে বসতেই দৌঁড়ে এলো চিত্রা। ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে মেরে আমাকে টেনে দাঁড় করিয়েই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক্সাইটমেন্টে গলা বন্ধ হয়ে আসছে তার। তবুও লাফাতে লাফাতে বলে উঠলো,

— আমি বলেছিলাম, তখন তো থাপ্পড় লাগাইলি। এখন মিললো তো? মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমাও কাজে লাগে বুঝলি? এনিওয়ে, আই এম সো হ্যাপি জানু। আমার বেস্টুর বেবি হবে। উফফ, আমার তো নাচতে ইচ্ছে করছে। এই শোন? আমি বরং কাজ করি। বাচ্চাদের নাম ঠিক করে ফেলি। পাঁচটা ছেলের নাম আর পাঁচটা মেয়ের নাম। ছেলের নামগুলো “র” দিয়ে হবে আর মেয়ের নামগুলো “শ” দিয়ে হবে। দা…

চিত্রার এক্সাইটমেন্টের মাঝেই বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন সাহেল ভাইয়া,

— পাঁচটা পাঁচটা কেন?

উনার কথায় রেশ ধরে আমিও বললাম,

— হ্যাঁ। পাঁচটা কেন?

চিত্রা সোফায় আরাম করে বসলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

— কেনো? কাল রাতে শুভ্র ভাইয়াই তো ফোনে বললো। “দশটা বাচ্চার নাম ঠিক করো চিত্রা। পাঁচটা মেয়ে, পাঁচটা ছেলে। কেবল তো শুরু কয়েকদিন পর দেখবে ভাগ্নে ভাগ্নি কোলে নেওয়ার জন্য কোনো হাত অবশিষ্ট থাকছে না। কেউ গলায় ঝুলে আছে তো কেউ পিঠে। দারুন না? ”

সবাই একসাথে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র সবার দিকেই একবার করে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— হোয়াট?

কেউ কিছু বললো না। সাহেল ভাইয়া হাসি চেপে বলে উঠলেন,

— নাথিং! ১০ টা কনগ্রাচুলেশন ভাই। আগেই দিয়ে রাখলাম পরে যদি এতো এতো ভাস্তে ভাস্তির ভীরে তোকে খুঁজে না পাই।

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ছোট্ট করে বললেন,”দাঁড়া তুই…” এটুকু বলতেই অট্টহাসি দিয়ে দৌঁড় লাগালেন সাহেল ভাইয়া আর তার পিছু নিলেন শুভ্র। ওদের যাওয়ার দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই আবারও বকবক শুরু করলো চিত্রা। বই থেকে প্রেগনেন্সির উপর পাঁচ-ছয়টা বই বের করে বিজ্ঞদের মতো লেকচার দিতে লাগলো। আমি আর নাবিলা আপু শুধু অবাক চোখে তাকিয়েই রইলাম।

?

আজ নাবিলা আপুর ডেলিভারি। সবাই হসপিটালে গিয়েছে। আমার পাশে মাধবী আর রাহেলাকে বসিয়ে দিয়ে দশ মিনিট আগে শুভ্রও বেরিয়েছেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে। জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমি। চারদিকে শেষ বিকেলের নরম আলো। সূর্যটাও পশ্চিমের দিগন্ত ছুঁই ছুঁই করছে। আমি চোখ বন্ধ করে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। দেখতে দেখতে প্রেগনেন্সির পাঁচ পাঁচটি মাস কেটে গেলো। আমাদের জীবনের পাতা থেকে সময়গুলো কতো তাড়াতাড়িই না হারিয়ে যায়। এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই অবাক চোখে দেখতে থাকি আমি। কেমন অদ্ভুত দেখতে লাগে আমায়। বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় এই ছোট্ট পেটটাতে আস্ত একটি জীবন টিকে আছে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে! এই পাঁচ মাসে শুভ্রকে খুব একটা জ্বালায়নি আমি। কারণ প্রেগনেন্সি জনিত তেমন কোনো প্রবলেমই হয় নি আমার। বমি,মুড সুয়িং, খাবারে অরুচি খুব কমই হয়েছে আমার। শুধু একটা জিনিস বেশি বেশি হয়েছে তা হলো ঘুম। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোনোই প্রতিদিনের রুটিন হয়ে উঠেছে আমার। তেমন কোনো সমস্যা না হলেও অফিসের কাজ কমিয়ে দিয়েছেন শুভ্র। এখন চারটার মাঝেই বাসায় ফিরেন উনি। আদ্র-রোদ্রও বেশ বড় হয়ে গিয়েছে এখন। বসে থাকতে পারে, একজন আরেকজনকে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে চড় থাপ্পড়ও মারতে পারে। আপু আর চিত্রা প্রায় সারাক্ষণই আমার আশেপাশে থাকে এখন। চিত্রা প্রতিদিন বিকেলেই বাসায় এসে হাজির হয়। আমায় নিয়ে হাটাহাটি করে। তার ধারনা এই হাঁটাহাঁটিটা খুবই প্রয়োজন আমার নয়তো দিনদিন ফার্মের মুরগীর মতো ফুলে যাবো। ফোনের টোন কানে আসতেই ঘোর কাটলো আমার। জানালার বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটির দিকে তাকালাম। মাধবী দৌঁড়ে এসে ফোনটা হাতে দিয়ে গেল আমার। আমি মুচকি হেসে ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে আগ্রহী কন্ঠে বলে উঠলেন শুভ্র,

— নাবিলার ছেলে হয়েছে রোদপাখি। মাশাআল্লাহ, বেশ কিউট হয়েছে। যদিও সব ছোট বাচ্চাকে আমার কাছে এক রকমই দেখতে লাগে।

— আলহামদুলিল্লাহ! আপনি আমায় সাথে নিলেন না কেন, বলুন তো? সবাই তো দেখে নিলো বাবু আমিই শুধু রয়ে গেলাম। কোলেও নিতে পারলাম না।

— মন খারাপ করছো কেন? এখানে এসেই কি লাভ হতো? নাবিলার নর্মাল ডিলেভারি হয়েছে কয়েক ঘন্টা পর রিলিজ করে দিবে। আসলে শুধু শুধু জার্নি হতো আর টেনশন করতে। হসপিটালের বাতাসটাই অসুস্থ বুঝলে? হসপিটালে ঢুকলে সুস্থ মানুষেরও নিজেকে মহারোগী বলে বোধ হয়। না এসেই ভালো করেছো, বুঝলে?

— হয়েছে। ফাউল লজিক দিতে হবে না। পিচ্চির কয়েকটা ছবি পাঠান আমি দেখবো। আর হ্যাঁ, বাসায় ফিরেই বাবু দেখতে নিয়ে যাবেন আমায়, প্রমিজ?

শুভ্র হাসলেন। হাসিমুখেই বললেন,

— ওকে প্রমিজ। বাট কাল সকালে। এই অবস্থায় রাতে তোমায় নিয়ে বের হচ্ছি না আমি।

— কিন্তু….

— নো আর্গিউমেন্ট। সকালে মানে সকালে। এখন বাই, রেস্ট নাও।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলাম। দিন যত বাড়ছে হুটহাট রাগটা ততই যেন বেড়ে যাচ্ছে আমার। চুলগুলো দু’হাতে হাতখোপা করে ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম আমি। পা দুটো বেশ ব্যাথা করছে আমার। এ এক নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে আমার। সন্ধ্যা হতেই দু পায়ে অসম্ভব রকম ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। এটা কি প্রেগনেন্সির কারণেই হয়? কে জানে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মাধুবী-রাহেলা কে রুম থেকে চলে যেতে বলে শুয়ে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ পরই ঘুম ছুঁটে গেলো আমার। ঘুমের মাঝেও কারো গভীর দুটো চোখ তাড়া করছিলো আমার। চোখ মেলে তাকাতেই শুভ্রকে চোখে পড়লো। আমাকে তাকাতে দেখে মুচকি হেসে বললেন,

— শরীর কেমন?

আমি দুর্বল হাসি দিয়ে বললাম,

— পা ব্যাথা করছে।

উনি কপাল কুঁচকে তাকালেন। তারপর কি ভেবে বললেন,

— দাও, আমি টিপে দিচ্ছি।

কথাটা শুনেই লাফিয়ে উঠলাম আমি। উনি অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,

— কি হলো?

—পায়ে হাত দিবেন না। দূরে বসুন।

উনি আরো কয়েকগুণ বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন,

— কেনো?

— আমার ভালো লাগে না তাই। প্লিজ পায়ে হাত দিবেন না। আমার অস্বস্তি লাগে।

— জাস্ট শাট আপ রোদু।

— আ আমার মাথা ব্যাথা করছে। পা ব্যাথা করছে না। আপনি আমার মাথাটা টিপে দিন তো। আহ! কি মাথা ব্যাথা।

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমি আড়চোখে তাকাতেই হেসে উঠলেন উনি। আমি চুপচাপ তাকিয়ে আছি। উনার আকাঁবাঁকা দাঁতের টুল পড়া হাসি। ইশ! কি সুন্দর করে হাসেন উনি। উনার হাসিটা দেখলেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। মনে হয়, এই বুঝি শেষ হলো দিন। ফুরিয়ে এলো বেলা! কেমন একটা অদ্ভুত চিনচিনে ব্যাথা সারা বুকজুড়ে….

#চলবে….

তোকে চাই❤ (সিজন-২)part: 67

0

তোকে চাই❤
(সিজন-২)part: 67
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা❤

?

সোফায় পা গুটিয়ে বসে আছি আমি। আমার সামনে বিছানায় উবু হয়ে বসে আছে চিত্রা। আদ্র-রোদ্রর গলায় “A” আর “R” লেখা দুটো লকেট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে করে কে আদ্র আর কে রোদ্র তা সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমাদের সবার কাছে বাবুদুটোকে এক মনে হলেও আপু দৃঢ় কন্ঠে বলছে তারা জমজ হলেও চেহারা এক নয়। দু’জনের মাঝে কিছুটা অমিল আছে। আমার আর চিত্রার কাছে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাই বাচ্চাদেরকে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে চিত্রা। আদ্র রোদ্রর চেয়ে ৩ মিনিটের বড়, এই কথাটাও আপু থেকেই জেনেছি আমরা। ডক্টর বলেছিলো, কিন্তু কে আদ্র আর কে রোদ্র সেটাই যেখানে বড় প্রশ্ন সেখানে বড় ছোট নির্ণয় করা একরাশ কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আপু কিভাবে যেন ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। কিভাবে ধরলো কে জানে? আদ্র- রোদ্রর সাথে দুষ্টুমি করতে করতেই কানে এলো শুভ্রর ডাক। চিত্রাকে গবেষনা চালিয়ে যেতে বলে আমাদের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম আমি। দরজার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই দুনিয়া ঘুরে এলো আমার। দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলাম আমি। মাথা ঘুরানোর ব্যাপারটা শুভ্রকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। কোনভাবে বুঝতে পারলেই শুরু করবে চিৎকার, “খাও না ঠিকমতো হেন তেন কতো কিছু।” অথচ এই দুসপ্তাহ ধরে আমি বেশ নিয়ম করেই খাবার আর ঔষধ খেয়ে চলেছি। তবুও এই দুর্বলতা পিছুই ছাড়ছে না। রুমে ঢুকতেই শুভ্রর গোমড়া মুখটা চোখে পড়লো। মুখ কালো করে জুতো আর মোজা খুলছে সে। আমি সামনে দাঁড়াতেই অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো সে,

— কি লাভ হলো, বলো? এতো পরিশ্রম করে লাভ টা কি হলো?

উনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি৷ কনফিউজড হয়ে বলে উঠলাম,

— মানে? কিসের কথা বলছেন আপনি?

শুভ্র বাম পায়ের জুতোটাও ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বলে উঠলো,

— আপনার রেজাল্টের কথা বলছি। এতোকষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে ৩. ৭১?

শুভ্রর কথায় চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার। ৩.৭১? বলে কি? জামাইয়ের কাছে পড়ে এতো ইম্প্রোভমেন্ট হয়েছে ভাবতেই পারছি না আমি। বুকের ভেতর থাকা মনটা রীতিমতো লাফালাফি শুরু করেছে। আমার মনের অবস্থা “ভেরি হ্যাপি” টাইপ হলেও শুভ্রর মুখটা “ভেরি স্যাড” টাইপ হয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ক্লাস সিক্সের ম্যাথ এক্সামে সবাই যেখানে হান্ড্রেট পেয়েছে সেখানে সে পেয়েছে জিরো। বর যেখানে এতো কষ্ট পেয়েছে সেখানে আমার এতো খুশি খুশি ভাব মানায় না। তাই মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব আনার প্রচেষ্টা চালালাম। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না কারণ যখনই দুঃখ দুঃখ ভাব আনার চেষ্টা করি তখনই মনের মধ্যে খুশি নামক ভাইরাসগুলো লুঙ্গিডান্স মারে। তবুও যথাসম্ভব মন খারাপ ভাব নিয়ে বলে উঠলাম,

— মাত্র ৩.৭১? এতো কম! সরি…. নেক্সট টাইম ভালো করবো।

শুভ্র এ বিষয়ে কিছু বললো না। শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বললো,

— তোয়ালেটা দাও। ফ্রেশ হবো।

আমি তোয়ালে নিতে সোফার দিকে এগিয়ে যেতেই আবারও মাথা ঘুরে গেলো আমার। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। আশেপাশে ধরার মতো কিছু না থাকায় ফ্লোরে গিয়ে পড়লাম আর খাটের কোনাটা লাগলো মাথায়। শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়েই দৌড়ে এলো শুভ্র। আমার কপালে খানিকটা ফুলে উঠেছে। উনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই বরফ আনতে ছুটলেন। কপালে বরফ ডলতে ডলতে প্রশ্ন করলেন,

— আবারও খাবারে অনিয়ম করছো? ঔষধও নিশ্চয় খাচ্ছো না? এক্চুয়েলি কি চাও তুমি? বলো প্লিজ। টেনশনে রেখে মেরে ফেলতে চাও আমায়? আজকের এই ইন্সিডেন্টটা যদি সিঁড়িতে বা রাস্তায় হতো তখন বাঁচতে তুমি? নাকি আমি বাঁচতাম? তুমি খুবই কেয়ারলেস একটা মানুষ রোদ। এতোটা কেয়ারলেস হলে চলে না। তুমি দু’বছরের বাচ্চা নও। সবকিছু তোমাকে বলে বলে করাতে হবে কেন?

উনি এক নিঃশ্বাসে বকে চলেছেন আমায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছেন না। তবুও এক ফাঁকে ফট করেই বলে ফেললাম আমি,

— আমি নিয়মিত খাচ্ছি এবং ঔষধও নিচ্ছি। আমার মনে হয় ঔষধ গুলো কাজ করছে না।

শুভ্র এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম,

— আমি সত্যি বলছি। মামানিকে জিগ্যেস করুন না। আধ ঘন্টা পর পর কিছু না কিছু খাচ্ছি। ভালো না লাগলে জোর করেই খাচ্ছি। ঔষধও নিচ্ছি। তবুও বারবার মাথা ঘুরাচ্ছে।

— বারবার? সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কতোবার হয়েছে?

— ৫/৬ বার।

— তাহলে আমায় বলো নি কেন, ডাফার। এনিওয়ে,সব ঠিক থাকার পরও এতো দুর্বলতার কারণ কি? আঙ্কেল তো বলেছিলো এক সপ্তাহে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু এখন তো দু’সপ্তাহ চলছে।

নিজের মনেই কথাগুলো বলে চুপ করলো শুভ্র। কিছুক্ষণ ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— তোমার লাস্ট পিরিয়ড হয়েছে কবে?

উনার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। মুহূর্তেই ভীষণ অস্বস্তির মাঝে পড়ে গেলাম আমি। শুভ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন,

— কি হলো? বলো। লাস্ট ডেট কবে ছিলো?

আমি ইতস্তত করে বলে উঠলাম,

— মনে নেই। তবে ৩/৪ মাস হবে হয়তো।

আমার কথায় কেশে উঠলেন শুভ্র। শান্ত গলায় বললেন,

— তুমি কতোটা কেয়ারলেস তার প্রমাণ স্পষ্ট। এতোদিন ধরে পিরিয়ড হচ্ছে না তোমার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই?

এটুকু বলে থামলেন উনি। মাথা চুলকে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

— তুমি কি প্রেগনেন্ট?

উনার কথায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো আমার। ডান হাতটা অটোমেটিক পেটের উপর গিয়ে স্থির হলো। আমি ড্যাবড্যাব করে পেটের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই কি আমি প্রেগনেন্ট? কথাটা ভাবতেই শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগছে। শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

— উঠতে পারবে? পারলে উঠে রেডি হয়ে নাও। হসপিটালে যাবো।

শুভ্রর গম্ভীর মুখ দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি তবে কি শুভ্র বেবি চাচ্ছে না? অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে শুভ্রর সাথে হসপিটালে চললাম আমি। সব শুনে ডক্টরও প্রেগনেন্সি টেস্ট করার জন্য সাজেস্ট করলো। আলট্রাসনোগ্রাফি শেষ করে বাসায় ফিরেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। যখন জাগলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। বিছানার এক কোণে ফাইল হাতে মাথা নিচু করে বসে আছে শুভ্র। মুখটা অসম্ভব রকম গম্ভীর তার। আমাকে উঠে বসতে দেখেই ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

— বেবি আসছে।

কথাটা শুনে যেখানে খুশিতে লাফিয়ে উঠার কথা ছিলো সেখানে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। শুভ্রর গম্ভীর মুখটা আমার সব খুশিই যেন চুষে নিয়েছে কোনো অন্ধকার গহ্বরে। আমি একটা ঢোক গিলে ফাইলটা হাতে নিলাম। সাথে সাথেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো শুভ্র। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ এতো গাম্ভীর্যতা কেন? উনি তো বাচ্চা পছন্দ করেন তাহলে? প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ফাইলটা বেড সাইড টেবিলে রেখে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ পরই ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ হলো। কোমরে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ আর ঘাড়ে কারো ঠোঁটের স্পর্শটাও প্রকট আকার ধারণ করলো। বিরবির করে বলে উঠলো,

— আই লাভ ইউ রোদু। জীবনটাকে আজ হঠাৎ করেই অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আমি বাবা হচ্ছি! ভাবতে পারছো তুমি? আমাকেও কেউ আধো আধো স্বরে “বাবা” বলে ডাকবে। কালো বড় বড় দুটো চোখ, ভুবন ভুলানো হাসি আর নরম তুলতুলে ছোট্ট শরীর থাকবে তার। ইশ! রোদ, এতো আনন্দ যে ধরে রাখতে পারছি না আমি। আমার প্রিন্সেসকে কিভাবে বুঝাবো যে আমি তার আগমনের খবরে প্রচন্ড রকম খুশি…প্রচন্ড! বেশি খুশি আর বেশি দুঃখে মানুষ নাকি অনেকটা স্তব্ধ হয়ে যায়? আমারও আজ একই অবস্থা রোদপাখি।

আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখে পানি টলমল করছে যেন চোখদুটোতে আস্ত দুটো বিল নিয়ে শুয়ে আছেন উনি। আমি মিষ্টি হেসে উনার বুকে হাত রেখে বলে উঠলাম,

— কিভাবে জানলেন প্রিন্সেস আসছে? প্রিন্সও তো হতে পারে।

— কি জানি? কেন জানি মনে হচ্ছে প্রিন্সেস আসছে তবে যেই আসুক আই এম অলওয়েজ হ্যাপি। আমি তো এটা ভাবছি, তুমি একমাসের প্রেগনেন্ট হওয়ার পরও ডক্টর আঙ্কেল ধরতে পারলেন না কেন? অদ্ভুত না, ব্যাপারটা?

আমি কিছু বললাম না। চোখ জোড়ায় আবারও ঘুম নেমে আসছে। মনে হচ্ছে, কতোদিন ঘুমোয় না আমি।

#চলবে…

(রি-চেইক করা হয়নি। ঘুম পাচ্ছে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন প্লিজ)

ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ১১

2

তত
#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-১১
Writer:ইশরাত জাহান সুপ্তি

সন্দেহপ্রবণ স্ত্রীর যাবতীয় গুণ আমার মাথার কোন ফোকর দিয়ে প্রবেশ করলো ব্যাপারটা ভাবনার বিষয়।এখন আমি কি শুধু ভাববো না সন্দেহ করবো এই কনফিউশনও আমাকে আরেক ভাবনায় ফেলে দিল।ইদানিং আমি খুবই সন্দেহে ভুগছি।নিদ্র আনমনে একটু মুচকি হাসলো তো আমার সন্দেহ হয়,ল্যাপটপে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তো আমার সন্দেহ হয়।এই সন্দেহের পোকা তা দেখি ভালো ভাবেই আমার মাথায় নিজের রাজত্ব বিস্তার করে চলেছে!
একে দ্রুতই কীটনাশক দিয়ে বিলুপ্ত করতে হবে।কিন্তু কিভাবে?নিজের কাছে ভাবতেও অবাক লাগছে যে আমি কিনা মনে মনে একশবার ঐ মেয়ের পায়ে ধরে রাজী হবার জন্য আকুতি মিনতি করেছি সেই আমিই কিনা এখন সেই মেয়ের রাজী হয়ে যাওয়া নিয়ে ভয়ে মরছি।ইদানিং নিদ্র বেশিই ল্যাপটপটা টিপাটিপি করে আর মুচকি মুচকি হাসে।একটু যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবো তারও কোনো উপায় নেই লক দিয়ে রাখা।কই আগে তো কখনও দেয়নি।এখন আমার বেশ ভয় হচ্ছে ঐ মেয়ের সাথে তার প্রেম গড়ে উঠেনি তো!হুট করে নবীন প্রেম যুগল আমার সামনে এসে বলবে না তো ‘আমি আমার ইচ্ছেকন্যাকে পেয়ে গেছি ইচ্ছে পূরণ করার জন্য।’তুমি এবার ফুটো তোমার কাজ শেষ।’

ব্লাক শার্টের উপর ব্লু ব্লেজার স্যুট পড়ে নিদ্র তার ঘন কালো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।আবার পারফিউমও লাগাচ্ছে।এত পারফিউম লাগানোর কি দরকার আর এত ফিটফাট হয়েই বা অফিসের যাওয়ার কি!সে অফিসে কাজ করতে যাচ্ছে নাকি অডিশন দিতে যাচ্ছে।তাকে যে কি পরিমাণ সুন্দর লাগছে সেদিকে কি তার কোনো খেয়াল আছে!
আচ্ছা ঐ মেয়েটার সাথে আবার দেখা করতে যাচ্ছে না তো?

-‘আজকে ভার্সিটি আওয়ারের পর আমি তোমাকে পিক করতে আসবো।হসপিটালে যেতে হবে।

-‘হসপিটালে কেন যাবো?ঐ মেয়ে কি ডাক্তার?

আমার হঠাৎ উদ্বিগ্ন গলায় চেঁচিয়ে বলা কথা শুনে নিদ্র হাতে ঘড়ির বেল্ট লাগানো বন্ধ করে ভ্রু ভাঁজ করে বলল,’কোন মেয়ে ডাক্তার?কি বলছো?’

নিজের উদ্ভট কথার ধরণ বুঝতে পেরে আমি হকচকিয়ে বললাম,’না না কিছু না,আমি বলছিলাম যে হাসপাতালে কেন যাবো?’

-‘কদিন ধরে যে বলছো তোমার মাথা ব্যাথা হচ্ছে তার জন্য একটি চেকআপ করাতে?’

-‘আরে ওটা তো এমনিই মাইগ্রেনের সমস্যা।আমার ছোটোবেলা থেকেই আছে।এর জন্য আবার ডাক্তার দেখানোর কি দরকার।’

-‘যা বলছি শুনো।এতো কথা বলো না।’

-‘কিন্তু আজকে আমি যেতে পারবো না।আমার এক্সট্রা ক্লাস আছে।’

নিদ্র ল্যাপটপটা অফিস ব্যাগে ভরে যেতে যেতে বলল,’ওকে,তবে কালকে যাবো।’

নিদ্র চলে গেলে পাশ থেকে কুশন টা কোলের উপর উঠিয়ে আমি একরাশ বিরক্তিতে মুখ ফুলিয়ে রইলাম।হসপিটালে যেতে আমার একদম ভালো লাগে না।নিদ্র যে এমন করে না!একটু কিছু থেকে কিছু হলেই ডাক্তার ডাকো,হসপিটালে চলো।মুখে বিরবির করে বললাম,ভালো লাগে না।

এর মাঝে রহিমা খালা একটি লাল বালতি আর ন্যাকরা নিয়ে এসে সরাসরি ফ্লোর মুছতে মুছতে বলল,’কি ভাল লাগে না ভাবী সাব?’

মধ্যবয়স্কের রহিমা খালাকে আমরা খালা বলে ডাকলেও সে ছেলে মানেই ভাইজান আর মেয়ে মানেই সবাইকে ভাবী সাব বলে ডাকবে।এদিক দিয়ে মাকে যেমন ভাবী সাব বলে ডাকে আবার আমাকেও ভাবী সাব বলে ডাকবে।
আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রহিমা খালাকে বললাম,’কিছু না।’
নাহ্!এত ইনসিকিউরিটি নিয়ে থাকা যায় না।কি করে জানবো ঐ মেয়ে রাজী হয়ে গেল কিনা?
সামনে তাকিয়ে দেখি রহিমা খালা একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে ঘষে ঘষে ফ্লোর পরিষ্কার করছে।যেন ঐ মেঝে তার পরম শত্রু, এর পিঠের ছাল তুলতে না পারলে রহিমা খালার আজ নিস্তার নেই।
কথায় আছে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে।এই মুহুর্তে আমার রহিমা খালাকে মনে হচ্ছে একজন জ্ঞানী খড়কুটো।এই পরিস্থিতি বিষয়ে রহিমা খালার থেকে একটু বুদ্ধি নিলে মন্দ হয় না।রহিমা খালা ফ্লোর মুছতে মুছতে আমার কাছেই এসে পড়েছে,আমি সোফার উপর দুই পা তুলে গুটিশুটি মেরে একটু ঝেড়ে কেশে বললাম,

-‘আচ্ছা,রহিমা খালা ধরো একটির মেয়ের স্বামী বিয়ের আগে অন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করতো..ঐ মেয়েটা তখন মানে নাই…তারপর…তারপর ঐ ছেলেটা ঐ মেয়েকে বিয়ে করে কিন্তু তাদের বিয়েটাও একটু অন্যরকম ভাবে হয়েছে তারপর এখন আবার আগের মেয়েটা রাজী হয়ে গেছে এখন তাহলে ঐ মেয়েটা মানে ছেলেটার স্ত্রী এখন কি করবে?’

আমি আমার অগোছালো ভাঙা কথাগুলো কোনোমতে প্রকাশ করে রহিমা খালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।তাকে বোঝাতে পারলাম কিনা কে জানে!
রহিমা খালা তার শত্রুর পিঠের ছাল তোলা বন্ধ করে বিজ্ঞের মত গভীর দৃষ্টিতে আমার কথা শুনে যাচ্ছে।আমার কথা শেষ হলে সে তার বাজখাঁই গলায় বলল,’কোন মাইয়ার কথা কইতাছেন ভাবী সাব?’

-‘আহা খালা!কোন মাইয়া সেটা জানতে হবে না,তোমাকে ধরতে বলছি ধরো।’

ভাবীসাব ঐ মাইয়াডা এহন কি আর করবো ওর জামাইরে আটকায় রাখবো।’
আমি বিমর্ষ গলায় বললাম,’তুমি বুঝতে পারছো না খালা,তাদের বিয়েটা তো একটু অন্যরকম….

খালা আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,’আমি ওতো বুঝি বা ভাবী সাব,আমার সোয়ামী যদি এমন করত তাইলে আমি আমার সোয়ামীরে তো আটকাইতামই,সাথে ঐ শাকচুন্নিরেও ঝাটা পিটাইয়া খেদাইতাম।বিয়া এমনে হোক আর ওমনে,বিয়া তো বিয়াই।এইডা কি পুতুল খেলা।আমি থাকতে আমার সোয়ামী অন্য মাইয়ার কাছে যাইবো কেন!আমি হের বিয়া করা বউ।’

গম্ভীর গলায় কথাটা বলেই রহিমা খালা আবার তার শত্রুর পিঠের ছাল তোলায় মনোযোগ দিলেন।তার কথায় আমি বিষ্ময়ে হতবাক।
এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে তার হাত থেকে এই ঘর মোছার ন্যাকড়া ফেলে দিয়ে তাকে কোনো প্রফেসরের চেয়ারে বসিয়ে দেই।কি সুন্দর কথাটাই না বললেন!
সত্যিই তো আমি কেনো তাদের মাঝে থেকে সরে যাবো।আমি নিদ্রর বিয়ে করা বউ।বিয়েটা কি ছেলেখেলা নাকি!আমাকে বিয়ে করার আগে নিদ্রর ভাবা উচিত ছিল।এখন বিয়ে যখন করেছে তাই আমিও আর নিদ্রকে ছাড়ছি না।আর ঐ শাকচুন্নিকেও কিছুতেই ফিরে আসতে দিব না।কিছুতেই না….

খুব সুন্দর একটি লাল রঙের শাড়ি পড়ে আমি বেরিয়েছি নিদ্রর অফিসের উদ্দেশ্য।আজ একটু সাজগোজও করেছি।উদ্দেশ্য নিদ্রকে চমকে দেওয়া।ড্রাইভার আঙ্কেলের ডাকে আমি বাইরে তাকিয়ে দেখলাম অফিসে চলে এসেছি।বিশাল বড় অফিস।রিসিপশনিস্ট মোয়েটির কাছে জেনে নিলাম নিদ্রর কেবিন কোনটা।কেবিনের দরজা খুলতেই দেখলাম,একটি অতি সুন্দরী মেয়ে নিদ্রকে পুলি পিঠা অফার করছে আর বলছে আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।ন্যাকা!
মেয়েটি নিদ্রর পি.এ। আমি বুঝি না অফিসের পি.এ কি সবসময় সুন্দরী মেয়েরাই হয়!
আচ্ছা এই মেয়েটাই যদি নিদ্রর পছন্দ করা মেয়েটা হয়!
আমি আশঙ্কাজনক ঢোক গিলে দ্রুত বেগে ছুটে নিদ্রর পিঠা ছোঁয়ার আগেই ওর সামনে গিয়ে আমি পিঠা হাতে নিয়ে নিলাম।আর তাড়াতাড়ি খেতে খেতে একটু বিব্রতকর হাসি দিয়ে বললাম,
‘আমার পুলি পিঠা খুব পছন্দ।’
এরপর পুরো টিফিন বক্সটাই হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।
আমার এই অদ্ভুত কর্মকান্ডে পিছনে নিদ্র ভ্রু কুঁচকে আর সামনে পি.এ সুন্দরী হা করে রয়েছে।
আমি আরেকটু টেনে হাসি দিয়ে বললাম,
‘পিঠাটা মোটামুটি ভালোই হয়েছে।নেক্সট টাইমও আমাকেই দেবেন,আপনার স্যার পিঠা খায় না।’

মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে ঘাড় নাড়িয়ে চলে গেল।আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে পিছনে ঘুরতে গিয়ে নিদ্রর বুকে মৃদু্ ধাক্কা খেলাম।আমি এক পা পিছনে গেলে নিদ্র দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রু ভাঁজ করে বলল,
-‘তোমাকে কে বলেছে আমি পিঠা খাই না?’
আমি একটু চোরের ভঙ্গিতে হেসে বললাম,’আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল।’
সে পিছনে ঘুরে টেবিলে থাকা ফাইলগুলো একত্রিত করতে করতে আফসোসের সুরে বলল,’হায় রে আমার কপাল!অন্যের বউরা অফিসে আসে স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে আর আমার বউ অফিসে এসে তার স্বামীর খাবার খেয়ে ফেলে!
তার কথায় আমারও নিজের গালে একটা চড় মারতে ইচ্ছা করলো।চড় না মারলেও অন্তত একটা গালি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,সত্যিই তো কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে আসতাম নিদ্রর জন্য নিজের হাতে।নিদ্র টিফিন বক্সের ঢাকনাটা খুলে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।আমি একটু একটু মুচকি হেসে মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে বলতাম,’আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।’
নিদ্রও আমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করত।ব্যপারটা কতটা রোমান্টিক হতো!

নিদ্র আমায় মাথায় একটা টোকা দিয়ে আমাকে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনলো তারপর স্বভাবমতই ভ্রু কুঁচকে বলল,’আজকে এমন নতুন বউ সেজে আসা!ব্যাপার কি?’
আমি বিরবির করে বললাম,’আমি তো নতুন
বউ-ই।’
-‘কি?
-‘না কিছু না।আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’
সে ফাইলের থেকে মুখ না তুলেই বলল,’যেমন তুমি দেখতে তেমনই।’
আমি এত সুন্দর করে সেজে এসেছি আর তার এমন ঠিক মতো না দেখেই ঠান্ডা মার্কা কথা শুনে আমার মেজাজটাই চঙ্গে উঠে গেল।এই সুন্দর মানুষরা কি একটু অন্যের প্রশংসাও করতে পারে না।
আমি রাগ চেপে বললাম,’ভালোই লাগছি দেখতে।আমি নিজের প্রশংসা নিজেই করতে পারি।আমি তো আপনার মতো আর ধলা লম্বুশ না যে প্রশংসা করতেও মুখ ব্যাথা করবে।’

এবার সে ফাইল থেকে মুখ তুলে বলল,’তুমি আমাকে কি বললে! আমি ধলা লম্বুশ?
এর জন্যই বলি তুমি বাংলা ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট হয়েও শব্দের সঠিক ব্যবহার করতে পারো না,এটাকে বলতে হয় টল,হট,হ্যান্ডসাম।তোমার কোনো আইডিয়া আছে কতগুলো মেয়ে আমার জন্য পাগল হয়ে আছে?’

তার শেষোক্ত কথাটুকুতে আমার প্রাণপাখি পাখা ঝাপটানো শুরু করে দিল।সুন্দর ছেলে বিয়ে করার জ্বালা এবার আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।একারণেই বলতাম সুন্দর ছেলে বিয়ে করবো না।কিন্তু কপালে জুটলো তো জুটলো শুধু সুন্দর না চরম সুন্দর!এখন ভুগো!
এতগুলো মেয়ের মাঝে সে কোন মেয়ের জন্য পাগল তা আমি জানবো কিভাবে!

আচমকা কিছু মনে পড়ার ন্যায় সে বলল,
-‘সুপ্তি তুমি আজকে ভার্সিটি যাওনি।আমাকে যে বললে তোমার এক্সট্রা ক্লাস আছে আজ হসপিটালে যেতে পারবে না।তার মানে মিথ্যা বলেছো?

আমি রেগে মুখ ফুলিয়ে বললাম,বেশ করেছি মিথ্যা বলেছি।আরো একশবার বলবো।আমাকে নিয়ে আপনার কিছু বলতে হবে না।আপনি আপনার পিছনে পাগল মেয়েদের নিয়ে ভাবুন।’

কথাটি বলে দুমদাম করে ভাব নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু আর ভাব নিতে পারলাম কই!
শাড়ির সাথে পা পিছলে পিছনে সোজা নিদ্রর উপরে পড়লাম।আবার ঠিক হয়ে হাঁটা দিতে যাবো বলে সামনে আগাতেই চুলে টান পড়ল।আমি আহ বলে চোখ ঘুরিয়ে বুঝতে পারলাম তার শার্টের বোতামে আমার চুল আঁটকে গেছে।আজকেই শ্যাম্পু করেছিলাম,চুলগুলো এখন বেজায় সিল্কি হয়ে পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।এদেরকে থামানো যে এখন মুশকিল।নিজে নিজেই চুল ছাড়ানোর মহা চেষ্টা করলাম কিন্তু পিছন দিক থেকে উল্টা হওয়ায় পারলাম না।এদিকে নিদ্র মহাশয় নির্বিকার ভঙ্গিতে টেবিলের সাথে দু হাত ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুখে শিস বাজিয়ে যাচ্ছে।তার সামনে তার বুক সমান লম্বা একটি অসহায় মেয়ে যে তার কালো সুগন্ধি কেশ নিয়ে আটকা পড়েছে এদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই।

আমি বিরক্তি ছাপিয়ে বললাম,’একটু ছাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেনো?চোখে দেখছেন না নাকি!’

সে মারাত্মক ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,’কেনো তুমিই তো বলেছো তোমাকে নিয়ে আমাকে কিছু না ভাবতে,তাই তো কিছু করছি না।আমাকে ডিস্টার্ব করো না তো,আমি এখন আমার পেছনে পাগল মেয়েদের নিয়ে ভাবছি।’

তার মুখে আবারো মেয়েদের কথা শুনে আমি রেগে বসলাম।কিছু মুহুর্ত সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম।ভাবলাম সে নিজেই বিরক্ত হয়ে ছাড়িয়ে দেবে।কিন্তু এখন দেখি তার মধ্যে কোনো ভাবান্তরই নেই।তার আগের ভাবটাই বিরাজমান।নিদ্রর পুরো কেবিন গ্লাসের হওয়ায় বাইরে থেকে সবকিছু আবছা দেখা যায়।এদিকে আমাদের দুজনকে এভাবে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাইরে স্টাফরা মুখ টিপে মুচকি মুচকি হাসছে যা আমার চোখ এড়ালো না।
আমি লজ্জায় চোখ মুখ লাল করে নরম গলায় বললাম,প্লিজ ছাড়িয়ে দিন না।আমি কি এভাবে সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি!

-‘থাকলে থাকতে পারো।আই অন্ট মাইন্ড।’

-‘বাইরে সবাই দেখে হাসছে আপনার কি একটুও লজ্জা শরম নেই?’

-‘নাহ্!আমার ওতো লজ্জা শরম নেই।’

-‘পরিস্থিতির কোনো গতিবেগ না পেয়ে আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলাম,’প্লিজ চুল ছাড়িয়ে দিন।আর কখনো ওভাবে কথা বলবো না।’

এবার বোধহয় তার একটু মায়া হলো,আলতো হাতে তার শার্টের বোতাম থেকে আমার চুল ছাড়িয়ে দিল।আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
একটু গলা কেশে বললাম,’দেখুন,এখন থেকে কোন মেয়ে কিছু দিলে আপনি খাবেন না।’

নিদ্র আমার দিকে একটু ঝুঁকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,’কেনো?কোনো মেয়ের হাতের কিছু খেলে তোমার কি?’
আমি একটু ঢোক গিলে তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে কাঁচুমাচু গলায় বললাম,’আমার আবার কি?’

-‘তাহলে আমিও খাবো।’

আমি আবারো রাগ করে বললাম,-‘না,আপনি খাবেন না।’

-‘আর যদি খাই।তবে?’

আমি কোনো প্রতিউত্তর খুঁজে না পেয়ে উত্তর হাতরাতে হাতরাতে শেষমেষ বললাম,’তবে…তবে আমি এখন এখানে চিৎকার দিব।’
কথাটা বলে চিৎকার দিতে উদ্যত হলেই নিদ্র দ্রুতবেগে আমার মুখ চেপে ধরে বলল,’তোমার মাথার তার কি আজকে ছিঁড়ে গেছে?’

এই বলে নিদ্র আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেল।অফিসের সবকয়টা সুন্দরী মেয়েগুলো চোখ গোলগোল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।সবার সামনে নিদ্রর আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ায় আমি তো মহা খুশি।এতটুকু প্রায়োরিটিতেই যেন আমি খুশির প্লাবনে ভেসে গেলাম।

নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি বরাবরই মানুষের টান বেশি থাকে।আমার জন্য এখন রান্নাঘর নিষিদ্ধ জেনেও এই মুহুর্তে রান্নাঘরের প্রতি আমার প্রচুর ঝোঁক বেড়ে গেছে।মাথায় হাত খোপা করে রান্নাঘরের কড়াই,খুন্তি নাড়িয়ে চারিয়ে কঠিন মনোযোগ নিয়ে আমি খিচুড়ি রান্না করছি,নিদ্রর জন্য।অফিসে খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতে না পারায় বাসায় সেই ক্ষতিপূরণের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।আর বর্ষার রাতে খিচুড়ির চেয়ে শ্রেষ্ঠ খাবার কিছু হতেই পারে না।খিচুড়ি প্রায় শেষের দিকেই।উত্তেজনায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি।বারবার চেক করছি সবকিছু ঠিকঠাক মতো দিলাম কিনা।কি সুন্দর সুঘ্রাণ বেরিয়েছে!
আমি এখনো চেখে দেখিনি।সবাই আগে খাবে তারপরই আমি খাবো।যদিও কৌতুহল বারবার উপচে পড়ছে কেমন হয়েছে জানার জন্য।স্নিগ্ধ টেবিলে বসে বসে প্লেট নাড়াচাড়া করছে।আমার রান্নার জন্যই আজকে সবার খাওয়ায় একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় নিদ্র নিচে এসে রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,’আজকে এটা কে রান্না করছে?খেতে পারবো তো!’
আমি একটা ভেংচি কেটে পড়নের লাল পেড়ে অ্যাশ রঙের সুতি শাড়ীর আচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলাম।তারপর গ্যাস বন্ধ করে খিচুড়ি নামানোয় মনোযোগ দিলাম।
খিচুড়ি রান্না করতে গিয়ে তেলের ছিটেয় হাতটাও খানিক পুড়ে ফেলেছি।সেই হাত সামলিয়েই
গরম গরম খিচুড়ি সবাইকে নিজ হাতে বেড়ে দিলাম।মা আমাকেও বসতে বলল কিন্তু আমি পরে খাবো বললাম।
খিচুড়ির প্রশংসা সবাই করলো কিন্তু আমার দুটি কর্ণ যার শ্রবনের অপেক্ষায় আছে সে নিশ্চুপ।চুপচাপ মাথা নিচু করে শুধু খেয়ে যাচ্ছে।আমি বারবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখ তুলে তাকাবার অপেক্ষা করতে লাগলাম কিন্তু তার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।একসময় খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল।আমার চোখ ছলছল করে উঠল।মা আমাকে এবার খেতে বলল,’আমি চলে আসলাম।খিদেটাই যে মরে গেল!

একটু আগে বৃষ্টি হলেও এখন মেঘ সরিয়ে আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে।একগুচ্ছ চাঁদের আলোর চারিপাশে তবুও মেঘের ছড়াছড়ি।গম্ভীর আকাশের মুখে যেন চাঁদ এঁকে দিতে চাইছে এক চিলতে হাসি।আকাশের বিষন্নতা কাটানোর জন্য তবুও তো চাঁদ আছে কিন্তু আমার বিষন্নতা কাটবে কি করে।একরাশ বিষন্নতা যে আমায় জেঁকে ধরেছে।
একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে রেলিংয়ে রাখা হাতের উপর দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়ল একটি সুন্দর হাত আমার হাতের উপর তার স্পর্শ এঁকে দিল।হাত থেকে চোখ উঠে মুখের দিকে চলে যেতেই এই আবছা অন্ধকারেও বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা নিদ্র।
ঠিক সেই সময়েই আমার হাত খোপাটাও খুলে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে গেলে।যেন সেখানে আগে থেকেই কঠিন বন্দোবস্ত করে রাখা নিদ্র এলেই তাকে বাঁধন ছেড়ে উন্মুক্ত হতে হবে।
আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো স্পর্শে পোড়া স্থানে মলম লাগিয়ে দিতে লাগল।কিছুক্ষণ একরাশ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হাত ছেড়ে বলে উঠল,
-‘আমার মন পুড়িয়ে পেটকে শান্তি দিতে চাই না,বুঝেছো!’
কেন যেন মনে হল তার চেহারায় এই মুহুর্তে এক অদ্ভুত আবেগ খেলা করছে।যা এই আবছা আলোয় এই মুহুর্তে আমি ধরতে পারছি না।

আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু তার আগেই হাতের উপর একগুচ্ছ কদম ফুল রেখে তিনি বলে উঠলেন,’বর্ষায় রমণীর হাতর খিচুড়ির চাইতেও তার হাতে একগুচ্ছ কদমফুল দেখতেই যে আমি বেশি ভালোবাসি।’

কথাটি বলে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে তিনি নেমে যেতে লাগলেন।বাইরে আবারো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তিনি বাগানে মেশানো রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।চাঁদকে ঢেকে মেঘেরা আবারো পুরো আকাশে নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছে।বর্ষার আকাশের হাব ভাবের কোনো ঠিক নেই যেমনটি ইদানিং আমার মনের।

চলবে,

অতন্দ্রিলার রোদ (পর্ব:৭ – বাসর)

2

#অতন্দ্রিলার_রোদ
লেখা : শঙ্খিনী

পর্ব ৭ : (বাসর)

বাসর হবে রোদের বাড়িতে। বাসর নিয়ে কম বয়সী মেয়েদের উৎসাহের সীমা নেই। এগার-বারো‌ বছর বয়সী একটা মেয়ে বাসর ঘরের খুঁটিনাটি সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অবশেষে অতন্দ্রিলাকে বাসর ঘরে রেখে যাওয়া হলো। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। খাটে গাঢ় নীল রঙের চাদর বিছানো, গোলাপ এবং বেলি ফুল দিয়ে সাজানো।
খাটের ডান পাশের টেবিলে ফুলদানি, ফুলদানিতেও গোলাপের গুচ্ছ। লাল রঙের গোলাপ অতন্দ্রিলার পছন্দ নয়। তার পছন্দ কালো গোলাপ।
খাটের বাম পাশে আরেক টেবিল। সেখানে, পেস্তা বাদাম দেওয়া দুধের এক অদ্ভুত শরবত। শরবতটা যে রেখেছে তাকে এখন অতন্দ্রিলার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, “এক গ্লাস শরবত রেখেছেন কেন? জানেন যে ঘরে দুজন মানুষ থাকবে! দু গ্লাস রাখলে কি ক্ষতি হতো?”
অতন্দ্রিলার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু শরবতটা কার জন্যে রাখা ব্যাপারটা নিশ্চিত না হয়ে খাওয়া যাচ্ছে না।
শরবতের পাশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। এই জিনিসটাও অতন্দ্রিলার ভীষন অপছন্দের।
যে মিষ্টি রেখেছে তার উচিত ছিল মিষ্টির পাশাপাশি ঝাল কিছুও রাখা।

অতন্দ্রিলার তৃষ্ণা বেড়ে গেল। তাই সে এবার খাট থেকে উঠলো। ঘরের কোনায় প্রকাণ্ড এক উঁচু ধরনের টেবিল। এই টেবিলে অবশেষে পাওয়া গেল পানির জগ। অতন্দ্রিলা পানি খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল।
অতন্দ্রিলার চোখ পড়ল এক বিশাল বুকশেলফের দিকে। এত বই এক জীবনে পড়ে শেষ করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে তার।

বুকশেলফের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো একদিকে, রবীন্দ্রনাথের বইগুলো একদিকে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলো একদিকে। মজার ব্যাপার হলো বুকফেলফে এই তিনজন লেখক ছাড়া আর কারো বই নেই।
হয়তো এনারা রোদের প্রিয় লেখক। ইরার প্রিয় লেখকও হতে পারে।

বুকফেলফটা খোলাই ছিল। অতন্দ্রিলা একটা বই নিল, হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ হিমুর বিয়ে’। বইটি অতন্দ্রিলা সারা জীবনে ২৩ বার পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারই পড়ার সময় নতুন মনে হয়।
অতন্দ্রিলা বইটা খাটে রাখল।

হঠাৎ চোখ পরল খাটের পেছনের দেয়ালে। ইনিই তাহলে ইরাবতী! তিনি দেখতে কিছুটা রাজারানীদের মত। অতন্দ্রিলা আরো ভালো করে দেখল। কে ইনি? বাংলা সিনেমার নায়িকা নন তো? না, না। বাংলা সিনেমার নায়িকারা এত রূপবতী হয় না!

এ বাড়িতে অতন্দ্রিলার বন্ধু হতে পারে এমন মানুষ নেই। ফিরোজা সুন্দর মনের মানুষ, তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কিনা এ বিষয়ে ক্ষীণ সন্দেহ আছে অতন্দ্রিলার। আর রোদ! রোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে বলে মনে হয় না।
বন্ধুত্ব হতে পারে এমন একজন মানুষকেই খুঁজে পেল অতন্দ্রিলা, সে হলো ইরা।

অতন্দ্রিলা ইরার ছবিটার সামনে দাড়িয়ে বলল, “বুবু, এতদিনে আমার নাম নিশ্চই শুনেছেন। তারপরও আবার বলছি, আমার নাম অতন্দ্রিলা। আমার সঙ্গে আপনার রোদের বিয়ে হয়েছে। তবে আপনি কিন্তু একদম চিন্তা করবেন না! আপনার রোদ আজীবন আপনারই থাকবে। তাকে আপনার থেকে কেড়ে নেওয়ার কোনো শখ আমার নেই। আর আমি কিন্তু আপনাকে বুবু ডাকবো। সিনেমায় দেখেছি, নায়কের দ্বিতীয় স্ত্রীরা প্রথম স্ত্রীকে বুবু বলে সম্বোধন করে।”

রোদ অতন্দ্রিলাকে বিয়ে করেছে অনিচ্ছায়, মায়ের কথা রাখতে। তাই বাসর ঘরেও খানিকটা দেরি করে আসবে। প্রথমে সে চাইবে অন্য ঘরে ঘুমাতে, পরে ফিরোজা অনেকক্ষণ ধরে অনুরোধ  করবেন। প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে রাজি হয়ে আসবে বাসর ঘরে। 
অনেকটা সময়ের মামলা। অতন্দ্রিলার ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পরতে, কিন্তু সেটা অভদ্রতা হবে। তাই ঘাপটি মেরে বসে বইটা পরছে। বইয়ের প্রথম পাতায় কলম দিয়ে গোটা গোটা করে লেখা, “রোদের মত ঝলমল রোদকে, ইরা”।
তারমানে বই পড়ার নেশাটা রোদের।

ঘন্টাখানেক পর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। অতন্দ্রিলার নাকে এলো এক পারফিউমের গন্ধ। গন্ধটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
এই একই গন্ধটা পেয়েছিল যখন রোদকে তার পাশে বসানো হয়েছিল। তাহলে অবশেষে মহাশয় এলেন।

রোদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই
         অতন্দ্রিলা বইয়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “আপনি কিছু বলার আগে জানিয়ে রাখি, এ ঘরে কিন্তু গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে!”
         রোদ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “গোপন ক্যামেরা?”
          “শুধু ক্যামেরাই না সাউন্ড রেকর্ডারও আছে।”
           “তুমি জানলে কি করে?”
           “ওইযে একটা বাচ্চা মেয়ে ছোটাছুটি করতে, ওর মুখে শুনেছি। ক্যামেরা খাটের পেছনে, ফুলের আড়ালে। আর সাউন্ড রেকর্ডার খাটের নিচে। আপনি প্লিজ এগুলো বন্ধ করে দেবেন? আমি এখন বইটা রেখে উঠতে পারবো না।”
          রোদ ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার বন্ধ করতে করতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অতন্দ্রিলাকে বলল, “তুমি যখন আগে থেকেই জানতে তখন বন্ধ করলে না কেন?”
           “ইচ্ছে করেই বন্ধ করিনি। আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আপনার বোনেরা কতটা অভদ্র।”
রোদ খানিকটা অবাক হলো। বাহ্! মেয়েটা তো বেশ ভালোই সত্য কথা বলতে পারে।
           
রোদ অতন্দ্রিলার সামনে এসে বসল। অতন্দ্রিলা মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে।
            রোদ শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।”
             “বলুন শুনছি।”
             “দেখো, আমাকে আমার মা জোড় করে বিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমাকে কোনো রকম আশায় রাখতে চাই না বলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না।”
             অতন্দ্রিলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি কি আপনাকে বলেছি যে আপনার ভালোবাসা না পেলে আমি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবো?”

রোদ চেয়েছিল অতন্দ্রিলাকে চমকে দিতে। অতন্দ্রিলা বেশ ভালোই চমকে ওঠে। কিন্তু ১ ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে রোদের সামনে চমকে না ওঠার অভিনয় করে। এটা অতন্দ্রিলার এক ধরনের খেলা।
চমকে ওঠার পাশাপাশি অতন্দ্রিলার বেশ রাগও হয়েছে। রাগ হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। অতন্দ্রিলা তার বাবার বাড়ি ছেড়ে, আজ প্রথম এ বাড়িতে এসেছ। প্রথম দিনেই রোদের উচিৎ হয়নি এত বড় একটা কথা তাকে বলা। দু তিন দিন সময় নিয়ে বলতে পারতো। এটা সাধারন ভদ্রতা।
অতন্দ্রিলার এত বড় একটা কথা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করা মেনে নিতে পারছে না রোদ।
রোদ আশা করেছিল অতন্দ্রিলা কাঁদবে কিংবা হয়তো ভাঙচুর করবে।

        রোদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “না বলোনি।”
        “তাহলে?”
        “তাহলে কি?
         অতন্দ্রিলা বলল, “তাহলে আপনি এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন? আমি জানি আপনি আপনার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসেন। আপনি তাকে আজীবন ভালো বেসে যাবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিংবা আপত্তি থাকা উচিত নয়।”
         রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “উচিত নয়? তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো তো?”
          “বুঝতে না পারার কি আছে? বাংলাতেই  তো বললেন! আপনি ঘুমিয়ে পরতে পারেন, আমার জন্যে অপেক্ষা করে লাভ হবে না। আমি বইটা শেষ করেই ঘুমাবো।”

রোদ হতভম্ব হয়ে গেল। একটা মেয়ের বাসর ঘরে এমন কথা শুনে, এত সহজে কি করে তা মেনে নিলো! ইরা হলে তো এতক্ষণে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়ত।

(চলবে)

প্রিয় হবু শাশুড়ী আম্মা- মাইসারা মেঘ

0

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০

চিঠি নং.২

প্রিয় হবু শাশুড়ী আম্মা,
ভালোবাসা ও সালাম নেবেন,
কেমন আছেন জিজ্ঞেস করবো না,কারণ এ বয়সে এসে এত চাপ নিয়ে কারোরই ভালো থাকার কথা নয়,সেটা আমার জানা আছে।আর সত্যি বলতে আমি আপনার ব্যাপারে একটু বেশীই জানি।
তাই বলে ভাববেন না আমি আবার আপনার ছেলেকে ভালোবাসি।
আপনার ছেলের প্রতি আমার লোভ নেই।

বিশ্বাস করুন হবু শাশুড়ী আম্মা আপনার ছেলের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই।আপনাকে খুব বেশী ভালোবাসতে চাই বলেই আমি আপনার ছেলের বউ হতে চাই।

আপনি যখন পাশের বাসার কাকিমার সাথে ঝগড়ায় হেরে যান আমার একটুও ভালো লাগে না তখন,খুব করে মন চায় আমিও গিয়ে ঝগড়ায় পা দেই,কিন্তু তার জন্য তো একটা অধিকারের প্রয়োজন পড়ে বলুন!

বিশ্বাস করুন হবু শাশুড়ী আম্মা আপনার ছেলের প্রতি সত্যিই আমার কোনো লোভ নেই,শুধু মাত্র আপনাকে ঝগড়ায় জিতিয়ে দেবার জন্যই আমি আপনার পুত্রবধু হতে চাই,কোমরে কাপড় গুজে আমরা বউ শাশুড়ী ঝগড়া করবো,তখন দেখবেন ওই দজ্জাল কাকিমা কিছুতেই আমাদের দু’জনের সঙ্গে পেরে উঠবে না।

আপনি যখন রান্না করতে গিয়ে গরমে ঘেমে ধোঁয়ায় হাঁপিয়ে উঠেন বিশ্বাস করুন তখন আমার ভীষণ কষ্ট হয়, মন চায় ছুঁটে গিয়ে আপনাকে রান্নার পিড়ি থেকে তুলে দিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত হাতে ধরিয়ে দেই,কড়া সুরে বলি “আপনাকে কতদিন মানা করেছি এসব কাজ আপনি করতে আসবেন না,এসব করার জন্য তো আমি আছিই” আর বাকি রান্নাটাও আমিই সারিয়ে নিই।
কিন্তু সেটার জন্যও তো একটা অধিকারে দরকার আছে তাই না!

কোথায় এই বয়সে আপনার পায়ের উপর পা তুলে আয়েস করে কাটিয়ে দেবার কথা অথচ আপনি কিনা এসব রান্না বান্না হাড়ি পাতিল নিয়ে পড়ে রয়েছেন।
বিশ্বাস করুন হবু শাশুড়ী আম্মা আপনার ছেলের প্রতি আমার আসলেই কোনো লোভ নেই,আপনার হাতের কাজে সাহায্য করার জন্যই আমি কেবল আপনার ছেলের বউ হতে চাই।

আপনি যখন বিকেলে বিষন্ন মনে একা একা ছাদে বসে থাকেন তখন আমার খুব কষ্ট হয়,অথচ এই সময়ে এক হালি নাতিনাতনি নিয়ে খেলার সময় আপনার।
বিশ্বাস করুন হবু শাশুড়ী আম্মা আপনার ছেলের প্রতি আমার একদম-ই কোনো লোভ নেই,শুধু একাকীত্ব এবং নাতিনাতনির অভাব গুছে দেবার জন্যই আমি আপনার পুত্রবধূ হতে চাই।

দয়া করে আপনার ছেলেকে একটু বুঝান হবু শাশুড়ী আম্মা,সে কিনা একটা বিদেশি ঢঙ্গি মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
আমার কদর একটুও বুঝতে চাইছে না।ওই আলালের ঘরের দুলালী কখনোই এসব কাজ পারবে না হবু শাশুড়ী আম্মা।
আপনার দুঃখে ভরা ক্লান্ত চেহারার মায়া জড়ানো অনুভূতি সে কখনোই উপলব্ধি করতে পারবে না গো হবু শাশুড়ী আম্মা।

আমি আপনার কষ্ট আর সইতে পারছি না হবু শাশুড়ী আম্মা,অতি অপেক্ষায় দিন পার করছি,কবে আপনি এসে অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে ঘটা করে ঘরে তুলে নেবেন আমায়!
দয়া করে আর দেরী করবেন না,এবার অন্তত আপনার বিশ্রাম নেয়া অতি প্রয়োজন হবু শাশুড়ী আম্মা।

ভালো থাকবেন।
ইতি আপনার হবু পুত্রবধূ।

ভালোবাসার দেবী অলকা রানী-shanzida tasniim rito

0

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
চিঠি নং-২

ভালোবাসার দেবী অলকা রানী,
হ্যাঁ তোমাকে আমি এই নামেই ডাকবো আপুনি। কুশল বিনিময়ের প্রয়োজনই দেখছি না কারণ তোমার সাথে আমার রোজ প্রচুর কথা হয়। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে এতো কথা বলি তাহলে চিঠি লেখার প্রয়োজন হলো কেন, তাইতো? উত্তরটা হলো, আমি সবাইকে জানাতে চাচ্ছি যে একদম অপরিচিত একটা মানুষ এতো দ্রুত আপন কীভাবে হতে পারে যে তার সাথে নিজের একান্ত গোপন কোথাও আলোচনা করতে কুন্ঠাবোধ হয় না।
আপুনি,
তুমি নিজেই একবার আমাকে বলেছিলে যে তুমি নিজেও বিশ্বাস করতে না যে অনলাইন জগতে কেউ এতো আপন হতে পারে। এটা অবশ্য আমি এখনও বিশ্বাস করি না কারণ সামনা-সামনি বসে নিজে হেসে আরেকজনের হাসি দেখার সৌভাগ্য এখানে পাওয়া যায় না। তবুও আমরা কিন্তু অনেক আপন। ধন্যবাদ গল্পপোকাকে যার মাধ্যমে আমি তোমাকে পেয়েছি। পেয়েছি আরও দুষ্টু-মিষ্টি অনেক গুলো মানুষ কিন্তু তোমার আন্তরিকতা অন্যরকম ছিল। আমি জানি না আর কার কাছে তুমি প্রিয় বা আপন কিন্তু আমার কাছে তুমি বিশেষ একজন।
আমার প্রিয় ডিকশনারি,
তোমার কাছ থেকে যে কতকিছু শিখেছি। তুমি একদম হাতে ধরে আমার বানান ঠিক করিয়েছো। ভুল গুলো সুন্দর করে শুধরে দিয়েছো। আমি যেকোনো লেখা শেষে তোমার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হই আমার লেখা ঠিক আছে কি না দেখানোর জন্য। কই আর কারোর কাছে তো যাই না। কেন? কারণ আর কেউ তোমার জায়গাটা নিতে পারেনি।
প্রিয় আপুনি,
তুমি সব সময় আমার পাশে থেকেছো একদম বড় বোনের মতো। প্রয়োজনে শাসন করেছো, রাগ করেছো, বকা দিয়েছো কিন্তু ভালোবাসার মাত্রাটা বরাবরই অন্যরকম ভাবেই রেখেছো। কেউ কিছু বললে অজান্তেই আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছো। জানো, আমার খুব হিংসা হয় তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসছো দেখলে কিন্তু কিছু বলতে পারি না কারণ তোমার মত অসাধারণ একজন মানুষ শুধু একজনের ভালোবাসার প্রাপ্যতা রাখে না। তুমি একদম আমার বড় বোনের মতোই আমাকে আগলেছো কতবার তার হিসেব নেই।
এখন আসো একটা গোপন কথা বলি, আমার বড় বোনকে আমি তোমার কথা বলেছিলাম। সে যে কি পরিমাণ খুশি হয়েছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আপু বলেছে যাক আমার বোনটার একটা সঙ্গী তো হয়েছে আমার অভাব পূরণ করার মতো। আচ্ছা আপুনি, আসলেই কী কারোর অভাব পূরণ করা সম্ভব? তোমাকে আমি যতবার প্রশ্ন করেছি, “তুমি না থাকলে আমাকে কে শুধরে দিতো?” তুমি ততবারই উত্তর দিয়েছো, “হয়তো অন্য কেউ।” তাহলে আমাকে বলো যে সেই অন্য কেউ আমার জীবনে না এসে তুমি কেন আসলে?
আপুনি,
বিশ্বাস করো তুমি যেভাবে প্রতিটা প্রতিযোগিতার খোঁজ দাও, আমি লিখতে না চাইলে বারবার আমার লেখার প্রতি তৃষ্ণা জাগানোর চেষ্টা করো এটা তুমি ছাড়া আর কেউ করবে না, করতো না। আশা করছি এতক্ষনে প্যাঁচাল পড়ে বুঝতে পেরেছো কেন চিঠি লিখেছি। খ্যাতিমান ব্যক্তিরা বলে গিয়েছেন কারোর প্রশংসা সামনা-সামনি করতে হয় না। এতো কথা তো মেসেজে বলা যায় না তাই সব চেয়ে সঠিক, অনিন্দ্য আর উত্তম পন্থা বেছে নিলাম। ভালো করেছি না আপুনি?
যাইহোক, বেশি কথা না বলি। দোয়া করি তুমি আরও বড় পাঠক হও। তোমার সহযোগিতার হাত আমার মতো হাজারও নতুন লেখক/লেখিকাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। তুমি এমনই হাস্যজ্জল, মিশুক, আপন হয়ে থাকো সবার মাঝে।

ইতি
তোমার প্রীতু