আলো ও সাবিত কে রেখে সবাই বেরিয়ে গেল। আলো সাবিত বলে কান্না শুরু করলো। তারপর সাবিত দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল।
উহ লাগছে তো দেখনা তুমি।
>> ওহ সরি আমি তো মনে করেছিলাম তোমাকে হারিয়ে ফেললাম।
কেন বিয়ের সাজে বেরিয়ে ছিলে। তখন তোমার আমার কথা মনে পড়ে নি। আমি নাহয় ওয়াদা বদ্ধ ছিলাম। তুমি তো রাইমা সাথে কেমন ঢলাঢলি করে ঘুরে বেড়িয়েছ।
>> তাও তো তোমার জন্য। যান আমি তো পাগল হয়ে গেছিলাম। আবির কে মাঝ রাস্তায় রেখে আমি নেমে গিয়েছিলাম। আর তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে আসলে। তোর জন্য শুধু তোর জন্য ঐ ভ্যাবলি টার সাথে ঢেং ঢেং করে ঘুরে ছিলাম। তোর উপর রাগ করে। কিন্তু মাঝখানে আমি যে এমন কষ্ট সহ্য করব তা ভাবতেই পারিনি।
হ্যাঁ তুমি তো একাই কষ্ট সহ্য করেছ আমি সহ্য করিনি। এটাই বলতে চাচ্ছ তো তুমি।
একদম নয় আপনি তো এই রাজ্যের রানী। মাফ করবেন আমার সাহেবা।
দুজনের অভিমান মিটে গেল। এর মধ্যেই আসীম চৌধুরী ও রাবেয়া খাতুন চলে আসলেন।
আসীম চৌধুরী সাবিত ও আলোর কাছে ক্ষমা চাইলেন।
আলো বলল মেয়ের কাছে বাবা কোন দিন অন্যায় করতে পারে না। আপনি তো আমার বড় বাবা।
সন্ধ্যা বেলায় সবাই চলে যায় আরাভ দের বাড়িতে। শুধু সাবিত থেকে যায়।
এভাবেই সাত দিন চলে যায়। সাত দিনের পর আলো হাসপাতালে থেকে ছাড়া পায়।
আলোকে আরাভ জোর করে রেখে দেয় ওদের আবার বিয়ে হবে তাই।
দশ দিন পর আবার বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। এই দশ দিন সাবিত ও আলোর সাত যুগের মত কাটে।
বিয়ের দিন ইশা গেট আটকায় নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে গেট ছাড়ে।
অবশেষে কাজী বিয়ে পরিয়ে দেয়। আবার বিয়ে টা বৈধ হয়ে যায়। বিয়ের সব কাজ শেষে আলো সহ সবাই গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
যেদিন এসেছিলেম মাথা নিচু করে
সেদিন চলে গিয়েছিলেম লুকিয়ে
তবে আজ আসছি ফের মাথা উঁচিয়ে
নতুন করে বৈধতা নিয়ে।
অবশেষে বাড়ির নিয়ম মিটিয়ে আলোকে দিয়ে আসা হয় বাশরে। আজ যে তার পূর্ণ বাসর।
সাবিত মনে মনে ভাবছে, আজ থেকে আর নয়কো লুকিয়ে যেতে হবে মানসপ্রিয়ার কাছে। আজ তো সবার সামনে পেলাম বৈধতা মোর মানসপ্রিয়ার সনে।
আবির : ভাই যা ভাবি ওয়েট করছে। বিড়াল কিন্তু মেরে দিস।
রাইমা রিয়া দুজন হো হো করে হেসে উঠলো। সাবিত দৌড়ে সেখানে থেকে বাঁচল।
সাবিত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আলোর হাতে টাকা দিয়ে বলল তোমার পাওয়া পাওনা মোহরানা আদায়। আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। তার আগে চল দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। আমাদের এক করার জন্য।
নামাজ আদায় করল সাবিতের ইমামতিতে। নামাজ আদায় করে নামাজের পাটিতে। সাবিত আলোকে বলল জীবনের প্রথম ঝড় গেল। আরো অনেক ঝড় আসতে পারে, তবে আর আমার কথা বাইরে যাবে না। বাবা মা কে তাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন করবে। তাদের অসম্মান হবে এমন কোন কাজ যেন না কর। একজন আদর্শ বউমা হবে।
যথার্থ বলেছ প্রিয়। আমি আমার জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টাই নিহিত রব।
আচ্ছা আলো বিড়াল কই আবির যে বলল।
ধ্যাত কি যে বলছ তুমি। বলেই আলো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সাবিতের কানে কানে বলল। তারপর বলল এটা কে বলে। ঐ তোমাদের লেখক মহাশয় কিন্তু জানেনা।
আচ্ছা ঠিক আছে আর আপনারা যান কাল নতুন কোন গল্পে দেখা হবে।
>> জ্বী আপনি কে বলছিলেন। এরমধ্যে আবার সাবিত চিল্লাচিল্লি শুরু করে আলো আলো আলো।
আচ্ছা কার গলা শোনা যাচ্ছে, বলুন আলো বলে যে চিল্লাচ্ছে।
>> আসলে আমার ভাবী চাচাতো বোন দুটোই। আসলে বাবা ভাইকে জোর করে বিয়ে করাচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে ও চলে যায় বিয়েটা আমি করি। বাড়িতে এসে ও আলোকে পায় নি তাই পাগল প্রায়। সারাদিন আলোর নাম জপ করেছে।
ওহ আচ্ছা আপনি ওকে নিয়ে ঢাকা সিটি হাসপাতালে চলে আসুন। আলো আছে সেখানে।
>> কি হয়েছে আলোর বলুন। কি হয়েছে ওর। আচ্ছা আমরা আসছি। বলেই ফোন কেটে দিল।
এই সাবিত ওঠ ভাই আলোর কাছে যাব। রিয়া ও রাইমা তোমরা তৈরি হয়ে নাও। মা তোমার যাওয়ার দরকার নেই।
আমার আলোর কি হয়েছে। ও কি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। না ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি বাঁচতে পারব না। আলো কোথায় তুমি দেখে যাও এরা কি বলছে। বলেই হাসতে শুরু করলো আবার কান্না।
আবির : চল এভাবেই তোকে নিয়ে যেতে হবে। বলেই ওরা বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্যে হাসপাতাল।
*********
আদি আহির দুজন দুপাশে বসে আছে আলোর। ইশা ইলমা আরাভ বসে আছে।
আদি : আচ্ছা ও তো দেখতে পুরো তারার মতো তাই না আহির।
আহির : হ্যাঁ ভাইয়া। পুরোটা কিন্তু বোনটা যে অকালে জান্নাতে পথে পাড়ি দেবে জানতাম না।
আদি : আচ্ছা আলো তুমি, আমি আর আহির তিনজন এক বয়সী হব। এভাবেই চুপ করে থেকো না।
আচ্ছা আমার সাবিত আসবে কতক্ষন। ভাইয়া ও কি বিয়ে করে ফেলেছে। আমায় ভুলে গেছে তাই না।
আরাভ : না বোন। আবির ঐ বিয়ে করেছে। সাবিত সহ ওরা আসছে।
ভাইয়া তুমি আমাকে সান্তনা দিচ্ছ তাই না।
আরাভ : তোর কি তাই মনে হয়। সত্যিই তাই রে বোন।
এর মধ্যেই ডাক্তার এসে পড়ে আলোকে দেখে বলে উঠল ইয়াং লেডি ভাগ্য করে এমন পরিবার পেয়েছ। যারা কাল সারারাত ওটির বাহিরে বসে ছিল। আর স্যালাইন খুলে দিচ্ছি ওকে আধা ঘন্টা পর হালকা গরম পানীয় কিছু খাইয়ে ফল দেবেন।
আর ইয়াং লেডি তুমি ও তোমার স্বামী আমার চেম্বারে আসবে সুস্থ হলে বুঝেছ।
আর ওর স্বামী কোথায় উনাকে দেখছি না
আরাভ : আসছে ওরা দুরে থাকে । তাই আসছে।
ডাক্তার চলে গেল। আরাভ আদি আহির কে উদ্দেশ্য করে বলল যা হালকা গরম রং চা নিয়ে আয়। আর কয়েক রকমের ফল আনবি।
আদি আহির একসাথে বলে উঠল যাচ্ছি ভাইয়া।
*********
এই তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস। আমি আমার আলোকে পাব। এই বোন আবির না খুব পেকে গেছে তুই বল পাব।
রিয়া : ভাইয়া আমরা আলোর কাছে যাচ্ছি।
এই বেয়াদব মেয়ে আলো কি ভাবী বল।
রিয়া : ঠিক আছে ভাইয়া, আমরা ভাবীর কাছে যাচ্ছি।
রাইমা আবির কে বলছে শুনছ আলো আপার কি হয়েছে কিছু কি বলেছে।
আবির : না কিছু বলেনি, তবে যেতে বলেছে। আলো ভর্তি আছে সেখানে।
********
রাবেয়া খাতুন আসীম চৌধুরী কে বলছে আর কত খেলবে। নিজের ছেলের সাথেও এই খেলা খেলতে পারলে। নিজে প্রেমে ব্যর্থ হলে তাই এই ভাবে খেলছ। তবে শুনে রাখ ছেলে মেয়ে ও বৌমারা ফিরলে তাদের সব বলে দিবো।
এই রাবেয়া আমি শুধরে নেবো আমি তো জানতাম না যে সাবিত আলো কে বিয়ে করেছে। না হলে কোন দিন এমন করতাম না। কারণ প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় যন্ত্রণা সহ্য করতে কত কষ্ট তা আমি জানি। আর তোমাকে কিছু বলতে হবে না। চল আমরা যাব হাসপাতালে।
*******
আদি আহির দুজন দুপাশে আলো কে খাইয়ে দিচ্ছে। আলো চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই আবির আরাভ কে ফোন করে বলে যে ওরা কোথায় আছে। আরাভ কেবিন নাম্বার বললে। আবির বলে যে ওরা এসে পড়েছে।
আবির কিছু না বলে উপরে যাচ্ছে। সাবিত তার পিছুপিছু যাচ্ছে। কেবিনের সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লো।
সাবিত সহ ভিতরে ঢুকল। আলো যখন সাবিত কে দেখল, আলোর চোখ থেকে পানি, বের হওয়া শুরু করলো। কারণ সাবিত পাগলের মতো এসেছে। সবসময় হাসিখুশি ছেলে ও কেমন চেহারা হয়েছে। শুধু বলল সাবিত।
আলোকে দেখে সাবিত রেগে গেল। আদি আহির দুজন দুপাশে বসে আছে আলোর। এই তোমরা কে আমার আলোর কাছে বসে আছো কেন। সরে যাও বলছি , সরে যাও।
সাবিত ওরা আমার ভাই। সাবিত বলে উঠল তোর ক্লাস পড়ে নিচ্ছি। এই বজ্জাতের কাঁদি আমার বউয়ের পাশে কি। সর বলছি।
সাবিত দা তোমার স্বভাব বদলে যায় নি। ও আমার একমাত্র ফুফাতো বোন। এখন তো বুঝবে। “”শালার কত জ্বালা””।
চুপ
“”আদি আদি আদি বজ্জাতের কাঁদি আদির নাই ঘর আমার বউয়ের পাশে থেকে সর””
আলো ও সাবিত কে রেখে সবাই বেরিয়ে গেল। আলো সাবিত বলে কান্না শুরু করলো। তারপর
ডাক্তার : কেমন করে যে বলব আরাভ সাহেব। আপনার বোনের একটা অপারেশন করাতে হবে এবং তা এখনি।
আরাভ : তো করুন এত দেরী করছেন কেন।
ডাক্তার : তাতে সমস্যা আছে। তার জন্য তো বলছি।
আরাভ : এতেও সমস্যা, পুরোপুরি খোলাশা করে বলুন।
ডাক্তার : আপনি জানেন মেয়েদের বয়ঃসন্ধি কালের সময়। কিছু সমস্যা দেখা দেয়। আবার কারো তা পরেও দেখা দেয়। এই মেয়েটার শারীরিক, যে জিনিসটা মেয়েদের হয় তা নিয়মিত হত না। সেজন্য সেখানে ইনফেকশন হয়ে গেছে। তাই অপারেশন করাতে হবে। তাই হয়তো পড়ে বেবী নাও হতে পারে। আবার আল্লাহর রহমতে হতেও পারে। এবার বুঝতে পারছেন। অপারেশন না করালে পরে তা ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বন্ড সই করুন। যদি পরে সমস্যা হয় তাহলে আমরা বা কতৃপক্ষ দায়ী নয়।
আরাভ : হে আল্লাহ মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিবে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিও আল্লাহ। আচ্ছা আপনারা অপারেশন ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার আচ্ছা ঠিক আছে। বলেই ওটি রেডি করতে বলল।
******
সাবিত পাগলের মত বের হয়েছে। পাগলের মত খুঁজে যাচ্ছে কিন্তু পায়না। সাবিতের মনে হচ্ছে সময় ও যেন ওর সাথে খেলা করছে। কোথায় পাব আলো কে আল্লাহ তুমি সহায় হও। মা তো বলল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে আমিও যাব। সেখানের অফিসে যোগ দেব।
রাতের বেলা সাবিতের মনে শুধু বারবার খেলে যাচ্ছে তার মাঝে কি পেলাম। তাইতো কবিতার শব্দ গুলো আওড়াতে থাকে।
পথ চলতে চলতে
কি জানি কি কথা ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম,
রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে
কিজানি কি স্বপ্ন দেখে এ বুকে ব্যাথাই পেলাম ।
তোমায় ভেবে ভেবে
মনের অজান্তেই আমার দুচোখে পানি আসে,
আমি ভুলে গেলেও
এ মনটা তোমাকে আজও যে কত ভালবাসে ।
ঐ চাঁদ দেখতে গিয়ে
আমি তোমার ঐ চাঁদ মুখ দেখে ফেলেছিলাম,
ফুলের ঐ মধু নিতে
আমি ভ্রমর হয়ে উড়ে যেতে ডানা মেলেছিলাম ।
শুধু আমার জন্য
তোমার ঐ মনের কোথাও একটু জায়গা রেখ,
কাছে নাইবা আস
শুধু ঐ দূর হতে দয়া করে আমাকে একটু দেখ ।
আমি কি দেখেছি
তোমার মধ্যে কি পেয়েছি কখনও ভেবে পাইনা,
মনে ও প্রাণে ভাবি
তোমাকে ছাড়া এ জীবনে আর কিছুই চাইনা।
কাল সকালে বের হব। সকালেই ঘুম আসবে না। আলো তুমি কোথায়
***********
পুরো দশ ঘণ্টা পর ডাক্তার অটি থেকে বেরিয়ে বলল যে অপারেশন সাকসেসফুল। আল্লাহ তাআলা সহায় ছিলেন যেইটা ভয় পেয়েছিলাম সেটা হয় নি। রোগীকে বেডে দেওয়া হয়েছে জ্ঞান ফিরলে দেখা করবেন।
এমন সময় আবার আরাভের ফোন বেজে উঠলো ওহ তোরা এসে গেছিস। সিটি হাসপাতালে আয় তাড়াতাড়ি। এসে বাকিটা শুনবি।
ইলমা : আদি আর আহির কি চলে এসেছে। কতক্ষন লাগবে ওদের আসতে।
আরাভ : চলে আসছে। রিয়া সহ কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমার খুব ভয় করছে ইলমা। যখন আলো শুনতে পাবে তার ভবিষ্যৎ এর কথা কি হবে তখন কেমনে সামলাব।
ইলমা : জানো আরাভ একজন নারী, তখনই পরিপূর্ণ, যখন সে মা হয়। এই দেখো আমার দিকে। কত চেষ্টা করছি তবুও মা হতে পারছি না।
আরাভ : দেখ ইলমা সবার ভাগ্যে তো সব সুখ হয় না। আলোকে দেখ কত কষ্ট সহ্য করেছে। তবুও তো বেঁচে আছে। কষ্ট সবার সামনে প্রকাশ করে না।
ইলমা : কষ্ট জান কষ্ট সহ্য হয় না। বলেই বিড়বিড় করে বলতে শুরু করল। আমি জানি তুমি কষ্ট প্রকাশ কর না। কিন্তু কষ্ট পাও তো।
********
সাবিত ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখে আলো ওকে বলছে।
আমাকে কষ্ট দিতে চাও?
দাও!
আমি কষ্ট নিতেই এসছি।
আমাকে কাঁদাতে চাও?
কাঁদাও!
আমি কাঁদতেই এসেছি।
আমাকে হারাতে চাও?
হারাও!
আমি হারতেই এসেছি।
আমাকে সাগরে ভাসাতে চাও?
ভাসাও!
আমি ভাসতেই এসেছি।
আমাকে পোড়াতে চাও?
পোড়াও!
আমি পুড়তেই এসছি।
আমাকে বুকে টেনে নাও
নিবে না?
আমি সবকিছু সয়েই এসছি
সাবিত ঘুমের ঘোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। বাড়ির সবাই চমকে উঠে সাবিতের ঘরে আসলো। এসে দেখে সাবিত কান্না করছে। আর কিছু বলছে না। আলো আলো বিলাপ করছে।
রাবেয়া খাতুন স্বামীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন হয়েছে শান্তি তোমার। এই বাড়িতে এসে ভাইয়ের মত দেবর হারিয়ে ছি হারিয়ে ফেলেছি আরেক বাবা কে। ছেলে হারানোর মত শোক নিতে পারব না। আমার ছেলেটা এমন করতে থাকলে পাগল হয়ে যাবে।
সাবিত এবার হাসতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর কান্না। আলো আয় কই তুই জানিস না তুই বুকে মাথা না দিলে ঘুম আসে না। আয় তাড়াতাড়ি আয় বলে পাগলের মত আচরণ করতে লাগলো।
আবির : সাবিত এই সাবিত এমন কেন করছিস। আলো কে খুঁজতে হবে।
সাবিত : হাহা হা কোথায় খুঁজে পাবি তাকে একটু আগে ও আমাকে বলে গেছে। আমি হারিয়ে যাব হারাব। শান্তি তে থাকুন।
যাই বল তাই আলো আমার নাই। কোথায় গেলে পাব তারে বলে যাওনা ভাই। এভাবেই বিলাপ করতে লাগলো।
******
সাবিত দা বলেই চিৎকার করে উঠল আলো।
আরাভ দৌড়ে এসে বলল কি হয়েছে বোন।
ভাইয়া আমার সাবিত দা কে এনে দাও ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
তোমাকে জিততে হবে
মনে রেখো ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে!
মেয়ে বলে যারা অবহেলা করেছিল, তাদের জবাব দিতে হবে। (আরাভ)
ইলমা : রাত হয়েছে যাও ঘুমিয়ে পড়। আর ননদীনি আগের কথা চিন্তা করে মাথা খারাপ করবে না।
ঠিক আছে ভাবী। আমি যাচ্ছি উপরে।
আর শোন আগামী এক তারিখ থেকে জয়েন করবি। একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে। এটা নিজের বাড়ি মনে করবি।(আরাভ)
আচ্ছা ভাই ঠিক আছে। তবে আমি আপাতত সবার সাথে এমপ্লয়ি হিসেবে কাজ করতে চাই। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে না।
সেটা তোর ইচ্ছে বোন। সবসময় সাহস, উদ্দাম নিয়ে কাজ করতে হবে। লড়াই করে যেতে হবে। হারিয়ে দিতে হবে সবাই কে।(আরাভ)
মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত থাকলে পারব ইনশাআল্লাহ। যদি এটা তার ইচ্ছে হয়। তাহলে যথাযথ ভাবে পালন হবে।
আচ্ছা সারাদিন প্রচুর পরিমাণে মনোকষ্টে ভুগেছিস। এখন যা ঘুমিয়ে পড়।(আরাভ)
আচ্ছা ঠিক আছে বলে যে রুমে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই রুমে আসলাম। আজ বড্ড বাবা মায়ের অভাব লাগছে।
আজ রাতটা আবারো নির্ঘুম রাতের তালিকায় যোগ হবে। হে বিধাতা কেন এমন হয় আমার সাথে। প্রথমে মা তারপর বাবা। তারপর আগলে রেখেছিল দাদু। সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনিও চলে গেলেন।
ভালো তো বেসেছিলাম বৈধ ভাবে। তবুও হারাতে হল। কিন্তু কেন, কে এই জবাব দিবে। ভেবে পাচ্ছি না।
☘️
ভেবেছিলাম পেলাম তারে এই অবেলায়,
হারিয়ে যে ফেলব আবার সেই কি ভাবা যায়।
পেলাম যখন পূর্ণ করে,
হারিয়েছি আবার শুন্য হয়ে।
তবে কেন পেলাম তারে।
****
ভুলে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু পারছি না কেন জানিনা। আজ বড্ড বেশি পড়ছে মনে তার কথা গুলি। কোন এক কবি তার কবিতায় লিখেছেন।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো
বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি,
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ
জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না।
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই
তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের
সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই
বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার
ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো
বেশি ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে
আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ
থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও
জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে
আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো
ভালোবেসেছি তোমাকে।
কিন্তু ভালোবেসে কি হবে আর পাব না হয়ত আর। রাত তো নির্ঘুম যাবে। পরদিন সকালে নাস্তার পর হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় আলো। কি হবে তার। ইলমা খুব জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলেন।
আরাভ এসেই কোলে তুলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হল।
ডাক্তার আলোকে দেখার পর আরাভের উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো।
পেশেন্ট কি হয় আপনার।
আমার বোন হয় কি হয়েছে বোনের বলেন ডাক্তার।
ডাক্তার :
********
সাবিত বাড়ি ফিরে জানতে পারে আলো নেই। চিৎকার দিয়ে পরে যায়। আর বিলাপ করে আমার জন্য আজ তুমি বাড়ি ছাড়া। কোথায় গেলে তুমি। আমি না হয় বলেছিলাম বলবে না কাউকে বিয়ের কথা। কেন অধিকার দেখালে না। কেন চলে গেলে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিল। রিয়া সাবিত কে থামিয়ে সাবিতের রুমে নিয়ে যায়।
সাবিত কে দেখে বাড়ির সবাই কান্না করে। সাবিত তো হাসিখুশি ছেলে। একদম চুপ হয়ে গেছে। সাবিত সারারাত রুমে থেকে বের হয়নি।
সকাল বেলা রুমে থেকে বের হয় স্বাভাবিক ভাবেই। সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কিন্তু আসীম চৌধুরী সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সাবিত রাতেই বুঝতে পেরেছে।
সাবিত তার মাকে বলল মা আমি আলো কে খুঁজতে বের হব। রাতে ফিরতে পারি না ও পারি।
বলেই বেরিয়ে চলে গেল।
*******
ডাক্তার : পেশেন্টের সমস্যা যেমন আছে।
এর মধ্যেই নার্স এসে বলল স্যার রোগীর জ্ঞান এসেছে একটু দেখেন আবার।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও। আমি যাচ্ছি। আচ্ছা আরাভ সাহেব আমি দেখে এসে বলছি।
ইলমা : কি সমস্যা অনেক কিছুর পর পেয়েছ ওকে। ফুপির চিহ্ন ও। আর হারাতে দিবে না বল। যান ওকে আমি হিয়ার জায়গা দিয়েছি। হিয়ার মত ওকে হারাতে পারব না।
আরাভ : শুধু তুমি না প্রিয়। আমিও যে ওকে হারাতে পারব না। এর মধ্যেই আরাভের ফোন বেজে উঠলো।
ওপার থেকে : ,,,,,,,,,
আচ্ছা সাবধানে আসিস।
,,
ডক্টর তখন তো বললেন না কি হয়েছে বলুন কি সমস্যা। (আরাভ)
রাতের খাবার পর “আলো” মাথা নিচু করে বসে আছে। আর উৎসুক হয়ে বসে আছে আরাভ(ইশার ভাই) ইলমা(ইশার ভাবী)।
এবার বল বোন, তোমার সমস্যা কি, কেন এই বয়সেই বেরিয়ে এসেছ একা। বোন বললাম রাগ করনা, তোমার বয়সী এক বোন ছিল আমার। (আরাভ)
না ভাইয়া বোন বলেই ডাকবেন। আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। (আলো)
সেটা দেখা যাবে ক্ষণ আগে তোমার সমস্যা বল।
আচ্ছা তাহলে শুনেন আমার অতীত। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি।
বাবা যখন ঢাকায় ভার্সিটিতে পড়ত। তখন প্রেম শুরু হয়। আসলে মা ছিল বাবার বন্ধুর বোন। নানু এই প্রেম মেনে না নেওয়ায় বিয়ে করেছিলেন লুকিয়ে। জানেন মা খুব কাঁদত। নানার মৃত্যুর সময় বড় মামা তাকে নানুর লাশ দেখতে পর্যন্ত দেয় নি। বড় মামা মনে করতেন নানুর মৃত্যুর জন্য দায়ী মা। মামারা ছিল দুই ভাই। ছোট মামা ছিল বাবার বন্ধু।
বাবা মা গাজীপুর ব্যাক করে। সেখানে গিয়ে পড়ে আরেক ঝামেলায়। দাদা সেখান থেকে বের করে দেয়। বাবার বড় ভাই ছিল, তিনি চাননি যে বাবা সে বাড়িতে থাকুন। কারন তাদের পরিবারের কেউ প্রেম করে বিয়ে করে না।
তাই একটু দূরে ছোট এক ঘর ভাড়া নেন তাতে ছোট করে সংসার পাতেন। কি করবে বাবা মা ভেবে পাচ্ছিল না। বাবা শিক্ষিত হয়েও সেদিন রিকশা চালানো শুরু করে। মা টিউশনি করাত। এভাবেই চলত সংসার। হঠাৎ করে একদিন বাবা কাজ থেকে বাড়িতে ফিরলে। আমার আগমনের খবর দেয়। বাবা সেদিন খুশিতে মিষ্টি বিলি করেছিলেন পুরো বস্তিতে।
দশ মাস পর আমি পৃথিবীতে আসি। আস্তে আস্তে আমি বড় হতে থাকি।
সুখের ছোঁয়ায় দিন কাটত। অভাব ছিল, কিন্তু ভালবাসার অভাব হয় নি। সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ করে একদিন যেই বস্তিতে থাকতাম, সেখানে আগুন লাগে। আমি স্কুলে ছিলাম। তখন ক্লাস নাইনে পড়তাম। মেহবুবা নামের এক ম্যাডাম ছিল তিনি আমাকে বলেন। আলোরে তাড়াতাড়ি চল বস্তিতে আগুন লেগেছে। ম্যাডামের বাড়ী ছিল আমাদের বাড়ির পাশে।
সেদিন মা আগুনে পুড়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, মা সেদিন আমাকে করে যায় এতিম। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংসারের অভাব বেড়ে যায়।
জানেন এর কিছুদিন পর বাবা আমার হাতে, একটা চিঠি ও ঠিকানা দিয়ে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আসলে বাবা মা কে খুব ভালোবাসতেন। প্রেমের বিয়ে ছিল যে। তাই মায়ের অকাল মৃত্যু বাবা মেনে নিতে পারে নি। বাবা আমাকে বলেছিল যে সাহস করে বাঁচার স্বপ্ন দেখবি। মেয়ে বলে যে তুই অবহেলার পাত্রী হবি , সেটা মেনে নিবি না কোনদিন।
বাবা মারা যাওয়ার পর পাঁচদিন মেহবুবা ম্যাডামের কাছে ছিলাম। তারপর বাবার দেওয়া ঠিকানায় পাড়ি জমালাম। যেখানে ছিলাম সেখানে থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে। একা যাওয়া সম্ভব ছিল না। মেহবুবা ম্যাডাম সেদিন পৌঁছে দিয়েছিলেন বাড়ির সামনে পর্যন্ত। ভিতরে যাননি, জানিনা কেন জাননি।
বাড়ির সামনে গিয়েও জানতাম না। ভবিষ্যতে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। বাড়িটা চার তলা বিশিষ্ট একটি রাজমহলের মত। বাড়ির সদর দরজার একটি নামফলক দেখলাম। তা দেখে চমকে উঠলাম কারন মায়ের কাছে শুনেছিলাম, দাদার নাম ইরাব চৌধুরী। এখানে ইরাব মহল। বাবা বলেছিলেন ইনার কাছে চিঠিটি পৌঁছে দিতে।
কলিং বেল বাজালাম দরজা খুলে দিল একজন মধ্যবয়সী মহিলা। পোশাকে আধুনিকতার ছোঁয়া। আমাকে বলেছিল কাকে চাই। আমি বলেছিলাম ইরাব চৌধুরী আছেন। মহিলা বললেন ওহ বাবার কাছে এসেছ। ভিতরে আসো, বলেই ভিতরে নিয়ে গেল। আমাকে সোফায় বসতে বলে তিনি ভিতরে গেলেন। আমি বাড়িটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছিলাম। কি সুন্দর পেইন্টিং, কারুকাজ, এক একটা ওয়ালে প্রকৃতির সাথে মিল রেখে চিত্র অঙ্কন।
কিছুক্ষণ পর তিনি আমার কাছে আসলেন। উনার চেহারায় গাম্ভীর্য আছে। থাকবে না কেন চৌধুরী মানুষ। কে তুমি, কাকে চাই।
আমি বললাম বাবা এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। চিঠিটা দিলাম, চিঠিটা দ
নেওয়ার সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে।
তিনি চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলেন। চিঠিটা পড়ার পর তিনি চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করলেন। চিঠিটায় লেখা ছিল,,
প্রিয় বাবা,
তুমি সর্বদা আমার কাছে শ্রদ্ধার ছিলে, ছিলে ভালবাসার। খুব বিশ্বাস করতে আমায় হয়তোবা তোমার সেই বিশ্বাস রাখতে পারিনি। তাই তুমি বলেছিলে এই শহরে থেকেই যেন , তোমার মুখোমুখি না হই। এটাই আমার শাস্তি। আমি আমার শাস্তি পেয়েছি বাবা। হয়ত পরিবারের কারো কাছে আত্মার আত্মীয় ছিলাম না। তাই সেদিন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমি আমার কথা রেখেছি। রিকশা চালিয়ে সংসার চালিয়েছি। কারণ সব সার্টিফিকেট নিয়ে নিয়েছিলে। অভাব ছিল কিন্তু ভালবাসার অভাব হয়নি। কিন্তু কথায় আছে না বেশি সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়না। আমারও বেলায় ঠিক তাই হয়েছে। এক দূর্ঘটনায় তোমার অস্বীকৃত বউমা মারা যায়। সেদিন জানতাম যে আমিও অল্প কয়েক দিনের মেহমান এই পৃথিবীর। মরণব্যাধি ক্যান্সার যে আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। আমি মরলে সবাই খুশি থাকবে। কিন্তু আমার রাজকন্যার কি হবে। এ যে আমার অভাবের ঘরের আলো। তাই যেদিন জানতে পারলাম যে হয়ত আর একমাস বাঁচব না। সেজন্য আপনার নিকট এই পত্রটা লিখলাম। আমি মারা গেলে আমার মেয়েটার আর কেউ থাকবে না। তাই নাতনি হিসেবে মেনে নিতে না পারলে, কাজের মেয়ে হিসেবে রাখবেন। তবুও ওকে পড়াশোনা করাবেন। বড় কোন প্রতিষ্ঠানে না পড়ালেও সরকারী গুলোতে ভর্তি করিয়ে দিবেন। ওকে দেখবেন, আমি আমার কথা রাখলাম এই জীবদ্দশায় আপনার দেখা দেইনি। আমার লাশও আপনাকে দেখতে হবে না। আমার মৃত্যুর পর ও যাবে তার আগে কোনদিন যাবে না।
ইতি,,
আপনার অযোগ্য সন্তান।
উনার কান্নার শব্দ শুনে সবাই ছুটে এলেন। একজন শক্ত গোছের মানুষ বললেন বাবা কি হয়েছে। তিনি বললেন আমার আদি আর বেঁচে নেই।হে আল্লাহ আমার আগে আমার সন্তান কে কেন নিয়ে গেলে।
ঐ মানুষ টা বললেন বাবা তুমি অযথা বাড়াবাড়ি করছ। ও তো তোমার কাছে অনেক আগে মারা গেছে।
দাদু বলেছিলেন সন্তান, কাছে না থাকলে, কত যন্ত্রণার সেটা তুই বুঝবি না। আমার আদি বলেই আবার কান্না শুরু করলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি শান্ত হয়ে বললেন। বড় বৌমা আমার পাশের ঘরটায় আমার ছেলের অংশের থাকার ব্যবস্থা করে দাও। ও আমার পাশে পাশে থাকবে। সেদিন সবাই খুশি হলেও একজন খুশি হননি। তিনি আমার চাচা।
এভাবেই দিন কাটত আমার এভাবেই এইচএসসি গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স কোর্সে ভর্তি হই হিসাববিজ্ঞান নিয়ে।
অনার্স কোর্সে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর বাড়িতে যেন উৎসব শুরু হয়েছে। আমি রিয়াকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে তার বড় দুই ভাই আসছে। আমি বললাম ওহ আবির দা সাবিত দা বাবা বলেছিলেন উনাদের নাম। রিয়া বলল হ্যাঁ।
বিকেলে তারা দুজন ফিরলে আমি রান্না ঘরে থাকি। আমি বাইরে আসি না। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় বের হতেই হয়। সবার নাস্তা দিতে। সেই সময় একজন আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। রিয়া বলে উঠল সাবিত ভাইয়া হা করে আছিস কেন। আমি নাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। এই তো কাহিনী ভাইয়া।
আরাভ : তারপরের টা শুনতে চাই। বল বোন বল।
আচ্ছা তার কিছুদিন পর দাদু মারা যায়। আমি তখন ৩য় বর্ষে পড়ি । তারপর আমি যেন ঐ বাড়িতে পার্মানেন্ট কাজের বুয়া হয়ে যাই। তখন শুধু চাচী মা আমাকে ভালোবাসত। একদিন রাতের বেলা হঠাৎ করে আমার ঘরে কেউ ঢুকে। আমি চিৎকার দিতে চাই কিন্তু পারিনা। কারণ,,,
চলবে,,,,,,,
#তার_ইচ্ছে
#পর্ব_৪
#মাসুদ_রানা_তাসিন
একদিন রাতের বেলা হঠাৎ করে আমার ঘরে কেউ ঢুকে। আমি চিৎকার দিতে চাই কিন্তু পারিনা। আমার মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে। আমি লাইট জ্বালালে দেখি সাবিত দা।
আমি বললাম সাবিত দা এত রাতে এখানে আমার ঘরে কেন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।
সাবিত দা বলল আমি পরোয়া করি না।
আমি পরোয়া করি, আমি একজন মেয়ে। সমাজে নানা ধরনের অবস্থায় মুখোমুখি হই।
তো কি হয়েছে, যেটা বলতে এসেছি তোকে আমি ভালোবাসি । জানিনা তোর উত্তর কি হবে, তবে ভালোবাসতে হবে তোকে আমাকে।
ভালবাসা আমার ডিকশনারি তে নেই। আমি ভালোবাসবো বিয়ের পর। তাই এই কথাটা আমাকে বলতে আসবেন না। যান এখন এখান থেকে।
সেদিনের মত চলে গেল সাবিত দা। আর আসেনি কোনদিন। আবির দা রিয়া যেমন স্নেহ করতেন তার থেকে আমাকে সম্মান করতেন। কারণ তিনি জানতেন সাবিত দা আমাকে ভালবাসত।
এভাবেই কাটত সবার অবহেলায় দিন গুলো। শেষ বর্ষের শেষ পরীক্ষার আগের দিন, আমার একজন বান্ধবী বলে বাড়িতে বলতে, যে কাল ওদের বাড়িতে থাকতে হবে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে ও জানতাম না যে আমার সাথে কি ঘটতে চলেছে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সুখী আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। কাজী অফিসের সামনে নামে। আমার অনুমতি ছাড়াই সেদিন আমার সাথে সাবিত দার বিয়ে হয়। সেদিন তার মাথায় হাত রেখে ওয়াদা করান যে আমি কোনদিন কাউকে বলতে পারব না। উনি সময় হলে বলবেন। এটা “”তার ইচ্ছে””।
জানেন সেদিন মত না থাকলেও স্বামীর হক আদায় করেছিলাম। পরের দিন বাড়িতে গেলে উনি এমন ভাব ধরলেন যেন আমাকে চেনেন না। কিন্তু আমি তার সদ্য বিবাহিতা বউ। এভাবেই দিন কাটত আমার। খুব ভালোবেসে ফেলি তাকে। হয়ত পবিত্র বন্ধনের জোর। প্রতিদিন তার ছোঁয়ায় রাতে ঘুম আসত। তার ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙত।
একদিন সকালে আমার চাচা আসীম চৌধুরী সাবিত দা কে আমার ঘর থেকে বেরুতে দেখে।
পরে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। বলে তোর ঘরে থেকে সাবিত বের হল কেন।
আমি কিভাবে বলব বড় বাবা। আমিতো জানি না।
এভাবেই কয়েক দিন পর হাতে নাতে ধরা খায় সাবিত দা সেদিন আমি ঘুমে বিভোর ছিলাম।
চাচা সাবিত দা কে বলছে, আমি কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি। তুই ভোরে বের হচ্ছিস। এই ঘর থেকে কিন্তু কেন।
সাবিত দা কিছু না বলে চলে যান। কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পরে, তিনি যে রুমে অফিসের কাজ করেন। আমাকে বলল আমি তো তোর বাবার মতো। আমি আমার বন্ধুকে কথা দিয়েছি। সাবিতের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেব। সামনের মাসেই বিয়ে। যদি এ বিয়ে না হয় এ পরিবারের বদনাম। আর তোর সাথে কি সম্পর্ক জানিনা। তোর পায়ে ধরি তুই এই বাড়ি থেকে চলে যা। আমাদের মুক্তি দে।
আমি সাবিত দা বিয়ের দিন চলে যাব এখান থেকে। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন। বলেই চলে আসলাম।
তারপর থেকেই সাবিত দা এর সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করি। এক বন্ধুর সাহায্যে তার চোখে খারাপ হয়ে যাই। তবুও সবার সামনে কোনদিন তিনি বিয়ের কথা বলেন নি। মনে করেছিলাম তিনি বলবেন না তিনি বলেন নি। সবার মত তিনিও খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেন। একসময় তিনিও বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দেয়। তারপর থেকে ঐ মেয়েটার সাথে আমার সামনে খুব ধলাধলি করেন।
আবির দা বলেছিলেন যে আমি যেন ঐ বাড়িতে থাকি।
একসময় আমি সহ্য করতে না পেরে, তাকে বিয়ে করতে বারণ করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু চাচাকে দেওয়া ওয়াদা রক্ষা করার জন্য বলতে পারিনি। সেদিন বুক ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারিনি।
কোন মেয়েই তার স্বামীর ভাগ দিতে পারবে না। সেই জন্য সাবিত দা যখন বিয়ে করতে যায়। তারপর বাবা মায়ের ছবি আর মায়ের গয়না নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর এখানে।
এমা ভাইয়া আপনি কাঁদছেন কেন। আমার মত হয়ত কেউ কষ্ট সহ্য করে নি । তাও আপনি কাঁদছেন। দেখেন আমি না কাঁদছি না। কান্না টা বিদায় জানিয়ে দিয়েছি।
এই মেয়ে তোর মায়ের নাম জোহরা তাই না।
আমি তো একবার ও আপনাকে বলিনি, আপনি জানলেন কি করে।
আরে পাগলী আমি জানব না কেন। উনি যে আমার ফুপি আমার আরেক জন মা ছিলেন। জানিস বাবা তার জীবদ্দশায় তোদের অনেক খুজেছে। চাচা তোদের বাড়িতে গিয়েছিল কিন্তু অনেক অপমান করে। জাদিদ কে রেখে চাচা মারা যায়। আবিদ ও জাদিদ দু’জনেই তাড়াতাড়ি আসবে। তোকে পেয়ে আমরা আমাদের ফুপুর উত্তর সুরী কে পেয়েছি। তোকে হারাব না। তুই হবি আয়াজ গ্রুপ অফ কোম্পানি ৩০% মালিক। তোকেও ব্যবসা সামলাতে হবে।
ননদীনি মেয়ে বলে তোকে যারা অবহেলা করেছিল তাদের কোম্পানি কে পিছনে ফেলতে হবে।
পারব আমি পারতে হবে। সবাইকে জবাব দেওয়ার সময় এসে গেছে।
***
এই দিকে আবিরের সাথে বিয়ে হয়।আসীম চৌধুরী বাড়ি ফিরে আলোকে ডাকতে শুরু করেন।
আলো এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কথাটা বলল রাবেয়া বেগম।
আবির বলে উঠল ভাবী চলে গেছে মানে। তখন আবিরের ফোন বেজে উঠল। সাবিত ফোন করেছে। আবির শুধু বলল বাড়ি আয়। বিয়েটা আমার হয়েছে। সমস্যা নেই চলে আয়।
ধবধবে সাদা পিঠ দেখিয়ে কি নিজেকে, পুরুষের আকর্ষণের কেন্দ্র করতে চাস। আর কতজন কে আকর্ষিত করবি। এর থেকে রাস্তায় নেমে যা। তাহলে খদ্দের পেয়ে যাবি। কোন কোন দিন একসাথে দুই, চার জন পেয়ে যেতে পারিস। এটা তো চাস তুই। (সাবিত)
আর কিছু বলার আছে আপনার। যদি না বলার থাকে তাহলে চলে যান। আমি কেমন করে থাকি তাতে আপনার কি। আরেকটা কথা সাবিত চৌধুরী আমার বিষয়ে নাক না গলিয়ে হবু বউয়ের কথা ভাবুন। (আলো)
চুলের মুঠি ধরে ফেললাম, কি বললি তোর তো সাহস কম না। আমার বাড়ি থেকে আমাকে যেতে বলছিস। তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস, আমাদের বাড়ির আশ্রিতা তুই। আমাদের বাড়িতে থাকতে কোন বিপদ হলে সব আমাদের ঘাড়ে আসবে। (সাবিত)
সত্যিই কি আমি আশ্রিতা সাবিত দা। হতে পারি না হলে কি আর হবে। চিন্তা করবেন না বেশিদিন আর এই আশ্রিতার দায়িত্ব পালন করতে হবে না। (আলো)
আহ কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে নাকি যে যাবি। (সাবিত)
না থাকলে রাস্তায় নেমে যাব তোমার ভাষায়। সমস্যা নেই, কাল আপনার বিয়ে যান ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল হয়ত বেশি ঘুম নাও হতে পারে। (আলো)
বেশি কথা বলিস না। তুই কি সত্যিই চাস যে বিয়েটা আমি করি। (সাবিত)
আমার চাওয়া আর না চাওয়ায় কি এসে যায়। প্লীজ কোন অতীত মনে রাখবেন না। অতীত কাউকে সুখে থাকতে দেয় না। দেখুন না বাবা মা যদি বর্তমানে বেঁচে থাকত তাহলে আমাকে আশ্রিতা হয়ে থাকতে হত না।(আলো)
এই চুপ কর তোর এই ন্যাকামি ভাষন শোনার ইচ্ছে আমার নেই। থাক কাল আবার ঢেং ঢেং করে বিয়েতে যাস না। তোকে আমার একদম সহ্য হয় না। (সাবিত)
আচ্ছা যান ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি ঘুমাব। কাল সকালে অনেক কাজ আছে। সাবিত দার বিয়ে বলে কথা। (আলো)
কিছু না বলে চলে আসলাম। এই মেয়েটা কি বুঝতে পারে না। যে আমি তাকে ভালবাসি এটা কি ও বুঝতে পারে না। ওর কি সত্যিই আগের সব নাটক ছিল। ঘুমিয়ে পড়ি কাল নাহয় দেখা যাক কি হয়। (সাবিত)
বাবা,মা কেন আমাকে একা করে চলে গেলে। কেন আমাকে মামার ঘাড়ে দিয়ে গেলে কেন কেন। কোথায় যাব আমি, কোথাও যাওয়ার কি জায়গা আছে আমার। আর ভাবতে পারছি না। তবে এই জায়গা ছেড়ে চলে যাব। না হলে কেমন করে তার সংসার দেখব। (আলো)
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে, টেবিলে সার্ভ করেই রেডি হয়ে আসল আলো। ছোট ফুপি ছোট ফুপি কোথায় তুমি। তোমার দেরি করে খেলে সুগার বেড়ে যাবে। চাচা চাচী আজ যে তোমাদের বাড়িতে বিয়ে সে কি মনে আছে। আবির দা সাবিত দা রিয়া কোথায় সবাই খেয়ে নাও। তোমাদের খাবার টেবিলে দিয়ে দিলাম। বলেই চলে আসলাম। (আলো)
কিছুক্ষণ পর আবির দা আমার ঘরে আসলো। ওহ আবির ও সাবিত দু’জনেই টুইন।
আলো এটা কি করছিস। তুই কি ভাইকে ছেড়ে থাকতে পারবি। আর যা হয়েছে তা কি ভুলে যেতে পারবি। (আবির)
আবির খারাপ মেয়েরা সব কিছুই করতে পারে। পাশ থেকে সাবিত বলে উঠল।
আবির দা আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আর বিয়ে শেষ হলে এই খারাপ মেয়েকে দেখতে হবে না। কারণ ওয়াদার বরখেলাপ করতে পছন্দ করে না আলো। আর যাই হোক কারো আশ্রিতা হয়ে থাকবে না। (আলো)
ওহ তাহলে কোথায় যাবি বোন। কিছু কি ভেবেছিস । (আলো)
দেখ আরো কাউকে জুটিয়ে ফেলেছে। এদের মত মেয়েরা সব করতে পারে। (সাবিত)
আপনারা এখন যান এখান থেকে। আমি পোশাক বদল করব। বলেই ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কারণ আজ এই বাড়িতে খুশির দিনে কাউকে আমার কান্না দেখাতে চাই না।
এই আলো ওয়াদা ভুলে যাস না। ওয়াদা ভঙ্গ করা মসজিদ ভাঙ্গার সমান। আর যেটুকু স্মৃতি আছে তা দিয়ে বাকি জীবনটা না হয় কাটিয়ে দিবি। (মনে মনে)
বিকেলে যথারীতি সবাই চলে গেল বিয়ে বাড়িতে। যেহেতু রাতে গুছিয়ে রেখেছিলাম। তাই বেরোতে সমস্যা হবে না। আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
তোমাদের কিছু নেই নি, ছোট মা। চলে যাচ্ছি এখানে থাকলে কষ্ট বাড়বে ছোট মা। তোমার ছেলেকে শান্তি তে যে সংসার করতে হবে ছোট মা। (আলো)
এটা উত্তর না। কোথায় যাবি, আর কেন বা যাবি। (রাবেয়া খাতুন)
জানিনা তবে ঠিক হয়ে যাবে। আপাতত ঢাকা যাব। বলেই বেরিয়ে আসলাম। (আলো)
গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী হচ্ছি হয়ত নতুন করে বাঁচার জন্য।
চলবে,,,,,,
#তার_ইচ্ছে
#পর্ব_২
#মাসুদ_রানা_তাসিন
গাজীপুর থেকে ঢাকামুখী হচ্ছি হয়ত নতুন করে বাঁচার জন্য।
ঢাকায় তো নামলাম, কি করব এখন। কোথায় যাব, কি করব, কিছু ভাবতে পারছি না। আল্লাহ আমি কোন পাপ করেছিলাম, যে এমন বিপদের মুখে পরছি বারবার। সব হারিয়ে তো আজ নিঃস্ব।
আত্মহত্যা যদি পাপ না হত। তাহলে হত আজ এই ব্রীজ থেকে লাফিয়ে নদীতে ডুবে যেতাম। কিন্তু কি করব মৃত্যুও হয়ত আমাকে চায় না। সন্ধ্যা। হয়ে আসছে চারদিকে তো অন্ধকার হয়ে আসছে। কোথায় যাব আমি।
পাশেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। এক ভদ্রলোক মধ্যবয়সী বেরিয়ে আসল। এই যে।
আমাকে বলছেন কি।
> এখানে কি তুমি ছাড়া অন্য কেউ আছে। কত লাগবে। দেখে তো মনে হয় নতুন। কত লাগবে, দশ দেব বউ পাঁচ দিন বাড়িতে নেই।
কি বলছেন এসব। মাথা খারাপ নাকি আপনার। দেখতে তো বাবার বয়সী। লজ্জা করে না আপনার।
> চুপ ……. ডেমাক দেখে তো মনে হয়। চল বিছানায় আরো বেশি দেব। তোদের মত মেয়েদের চেনা আছে।
ভাষা সংযত করুন। একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকলেই যে প্রষ্টিটিউট হবে, এটা কেন ভাবেন। নিজের তো মেয়ে আছে সব মেয়েকে তো মেয়ের চোখে দেখেন।
> ঢং না করে বল কত লাগবে। চল , বেশি দেব সমস্যা নেই। বলেই হাত ধরে টানতে লাগলো।
সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সাহস তো কম না আপনার। আপনি আমার হাত ধরার দুঃসাহস দেখালেন। দুইটা ঠাস ঠাস ঠাস ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলাম। বাবার বয়সী চাচা বললাম কানে যায়নি। না আরো কয়েকটা লাগবে। একটা মেয়ে এভাবে রাস্তায় হেঁটে গেলে। যে সে বেশ্যা বা পতিতা হবে সেটা ভাবেন কেন।
লোকটি কিছু না বলে চলে গেল। পেছনে থেকে একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল কি হয়েছে বোন।
আমি খুলে বললাম। মেয়েটা অভয় দিয়ে বলল। তার সাথে যেতে। তার বড় ভাই, ভাবী আর সে থাকে। আমি শুধু রাত টা থাকার জন্য যাচ্ছি। না জানি এই বয়সে আর কত বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।
মেয়েটার সাথে যাচ্ছি কোন বিপদ কি হবে। ভেবেই কুল পাচ্ছি না। আজ বড্ড মনে পড়ছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সেই উক্তিটি
>>”যাকে কোনোদিন কেউ রাখেনি কোনো গৃহের আশ্রয়ে
ভালোবেসে বুকে নিয়ে চিরকাল তাকেই বলেছি প্রেম
প্রিয়তম তীর্থভূমি”।<<
*********
অন্যদিকে মাঝপথে সাবিত আবির কে বলছে।
আবির এই মুহুর্তে তুই একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পারিস। ভাই তুই তো জানিস আমি আলো কে ছাড়া বাঁচব না। গাড়ি টা থামা আমি নেমে যাব। বিয়ের সমস্যা মিটে গেলে আমি চলে আসব।
>> কিন্তু দা, এখন আমি বাবাকে কি বলব জানিস তো, বাবাকে বাড়ির সবাই কেমন ভয় পায়। আমি কি করবো বল। আচ্ছা নেমে যা। যা হওয়ার হবে তার ইচ্ছে তেই।
আচ্ছা বাড়িতে সব সামলে নিস। আমি দিন পনের পরে ফিরে আসব। আর আমার নতুন নাম্বারে ফোন দিস। আচ্ছা তোরা যা।
****
রিয়া আবির কে ফোন দে, এত দেরী করছে কেন সাবিতের ফোন বন্ধ। আমার এবার খুব টেনশন হচ্ছে। (আসীম চৌধুরী)
রিয়া : আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন করছি, বলেই ফোন বের করে ফোন করল।
হঠাৎ আবিরের ফোন বেজে উঠলো। আবিরের এতক্ষণে ঘোর ভাংল । কিন্তু কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আবিরের ও হয়েছে তাই। তবুও ফোন রিসিভ করে ফেলল।
>> হ্যালো, ভাইয়া তোরা কতদুরে আছিস। বাবা খুব টেনশন করছে।
>>} বোন সমস্যা হয়েছে, ভাইয়া পালিয়েছে। ভাইয়া ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে নেই, হাওয়া হয়ে গেছে। কি হবে এখন, আমি ভেবে পাচ্ছি না।
>>যা হওয়ার হবে তুই তাড়াতাড়ি আয়।
******
আলো সহ মেয়েটা একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কলিং বেল চাপ দিতে দরজা খুলে গেল।
একটা মহিলা এই বজ্জাতের হাড্ডি এক থাপ্পর দিয়ে দাঁত ভেঙে দেব। তোকে তো বলা হয়েছে মাগরিবের আগে বাড়িতে চলে আসবি। দেখ রিশা তোর জন্য তোর ভাই আমাকে কতটা বকা দিয়েছে।
রিশা : উফ মিসেস আজাদ আপনি একেবারেই ড্রামাকুইন। দেখেন এক মেয়ে বিপদে পড়েছে তাই দেরি হয়েছে।
তোমার সাথে তো একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়ে তোমার নাম কি?
আমি আমার নাম বললাম “আহিয়া জান্নাত আলো”।
নাম টা ভারি মিষ্টি। তোমার কিসের বিপদ শুনি একটু।
রিশা : ভাবী সামনের রাস্তায় ব্রীজ আছে সেইখানে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন কুপ্রস্তাব দিচ্ছিল। মধ্যবয়সী সেই জানোয়ার টাকে কঠিন শিক্ষা দিয়েছে। যাওয়ার জায়গা নেই তাই নিয়ে এসেছি।
ভালো কাজ করেছ আমার ননদীনি। যাও আলোকে নিয়ে তোমার রুমে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করো। তোমার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর তোমার ভাইয়া সহ এই মেয়েটার কথা রাতে শুনব।
“শুনুন!”, অন্যরকম গলায় অতন্দ্রিলা বলল।
রোদ বলল, “হুঁ, বলো।”
“আমাকে বলা হয়েছে এ বাড়িতে আমার কিছু প্রয়োজন হলে আপনাকে জানাতে। আমি কি জানাতে পারি?”
“অবশ্যই পারো।”
“আমার একটা নকশিকাঁথা প্রয়োজন?”
রোদ ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কি প্রয়োজন?”
“নকশিকাঁথা! নকশিকাঁথার সূক্ষ্ম সেলাইয়ের স্পর্শ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমার ঘুম আসেনা। ছোটবেলায় অবশ্য দাদি আমার জন্যে নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। কিন্তু এখন তার বয়স হয়েছে, চোখে ভালো দেখেন না। তাই সেলাইও করতে পারেন না। সেজন্যে এখন বাইরে থেকে কিনতে হয়।
তো! জোগাড় করতে পারবেন তো?”
রোদ মুগ্ধ হয়ে অতন্দ্রিলার কথাগুলো শুনছিল। বেশ সুন্দর করেই একটা বিষয় বর্ণনা করতে পারে মেয়েটা। ইরা এটা পারতো না। কথা বলার মাঝে বারবার থেমে যেত সে।
রোদ বলল, “অবশ্যই পারবো অত।”
অতন্দ্রিলা বেশ অবাক হলো। লোকটা এত সহজে তাকে অত ডাকল কি করে!
অতন্দ্রিলা কঠিন গলায় বলল, “শুনুন, আপনি আমাকে অত ডাকবেন না। আমার পুরো নাম অতন্দ্রিলা। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ আছেন যাদের আমি পছন্দ করি। শুধু তারাই পারবে আমাকে অত ডাকতে। কখনো সুযোগ হলে খেয়াল করে দেখবেন, আমার নিজের বড় বোনও আমাকে অত ডাকে না। কারন আমি তাকে পছন্দ করি না।”
“তো কি বলে ডাকে?”
“আপা চেষ্টা করে আমাকে কিছু না ডাকতে। বেশির ভাগ সময় তিনি আমাকে ‘এই শোন’ বলে সম্বোধন করে।”
রোদ আহত গলায় বলল, “ঠিকাছে। তোমার নকশিকাঁথার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।”
“অনেক ধন্যবাদ।”
আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। রোদের ইচ্ছা ছিল সারাটাদিন ঘরে বসেই কাটিয়ে দেবে। কিন্তু যেই ইচ্ছা ভঙ্গ করে রোদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরল।
বেশ রাগ হচ্ছে তার। রাগ হওয়ার কারনটা অতন্দ্রিলা।
এত রূপবতী মেয়ে, কি মিষ্টি গলার স্বর, সে কি করে বলে, “আমাকে অত ডাকবেন না। আমার পছন্দের মানুষেরাই আমাকে অত ডাকতে পারে।” সে কি ভেবেছে, অত ডাকতে পছন্দের মানুষ হতে হয়।
তাকে অত ডাকার অনেকগুলো কারণ আছে।
অতন্দ্রিলা নামটা বেশ বড়, উচ্চারণটাও কঠিন। তাই রোদ তাকে ‘অত’ বলে সম্বোধন করেছে। এটা একটা কারণ হতে পারে।
আবার অতন্দ্রিলা এখন তার স্ত্রী। প্রায় এক সপ্তাহ হলো রোদ তাকে বিয়ে করেছে। তাই স্বামী হিসেবে ডাকনাম ধরে ডাকতেই পারে রোদ।
রোদ বাড়ি থেকে যাওয়ার পর পরই ফিরোজা অতন্দ্রিলার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেন।
চিঠিটা বেশ পুরনো। চার বছর আগে লেখা হয়েছে। চিঠির প্রেরক ইরা।
অতন্দ্রিলা বেশ আন্দাজ করতে পারছে চিঠিতে কি লেখা। শাশুড়ির সামনে ইরার চিঠি পড়ার কোনো অর্থ নেই। তাই অতন্দ্রিলা সেটা নিয়ে বারান্দায় এল। চিঠিটা এমন –
প্রিয়তমেষু,
তুমি অতি হৃদয়বতী একটি মেয়ে। হৃদয়বতী বলছি কারন, তুমি রোদের অতীত জানার পরেও তাকে বিয়ে করেছ। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি ইরাবতী। বর্তমানে বসে আছি হসপিটালের বেডে। আমার কাছে বেশি সময় নেই আমি বুঝতে পারছি। আর কয়েকদিন পর আমার অপারেশন হবে। তাই আগেভাগেই তোমাকে এই চিঠি লিখে রাখছি।
আমি জানিনা আজ থেকে কত দিন, কত মাস কিংবা কত বছর পর তুমি আমার এই চিঠি পড়ছ। আমি এও জানিনা, তুমি কোন পরিস্থিতিতে রোদকে বিয়ে করে। নিজের ইচ্ছায় নাকি চাপের মুখে পরে। যে সময়ে, যে পরিস্থিতিই থাকো না কেন তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার। সেগুলোই বলছি।
আমি চলে যাওয়ার পর হয়তো রোদ আমাকে কখনোই ভুলতে পারবে না। সারাটা জীবন হয়তো আমার চলে যাওয়ার কষ্টটা বয়ে বেড়াবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তুমি পারবে ওকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে। দয়া করে ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। দেখবে একদিন ও তোমাকে অনেক ভালোবাসবে। তুমিই একদিন হবে ওর পৃথিবী। শুধু একটু সবুর করো।
আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, একদিন তোমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে। তোমাদের মেয়ের নাম দিলাম ‘রাত্রি’। নামটা পছন্দ না হলে রাখার দরকার নেই। কিন্তু ও সবসময় আমার কাছে রাত্রি হয়ে থাকবে, ইরার রাত্রি।
আরও একটা কথা, জীবনে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নগুলো পূরণ না করেই মরে যেতে হচ্ছে। রোদ আমার সেই স্বপ্নগুলোও পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি পারো, তাহলে দয়া করে আমার স্বপ্নগুলো পূরণ কোরো। কি সেই স্বপ্নগুলো , তা তোমাকে এ বাড়ির প্রকৃতিই বলে দেবে। আমি আর না-ই বললাম।
ভালো থেকো, রোদকে ভালো রেখো। তাহলে আমিও ভালো থাকবো।
ইতি,
ইরাবতী।
পড়া শেষ করে অতন্দ্রিলা চিঠিটা ভাঁজ করে যত্নসহকারে আলমারিতে তুলে রাখল।
ইরার ছবিটার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, “তুমি যদি এখন এখানে থাকতে, তাহলে নিশ্চই আমাকে ধমক দিয়ে বলতে তোমাকে ‘তুমি’ করে ডাকতে। তাই আমি এখন থেকে তোমাকে তুমি করেই ডাকবো। তোমার কথার মধ্যে একটা অস্পষ্টতা ছিল। তোমার স্বপ্নের কথা এ বাড়ির প্রকৃতি আমাকে বলবে কি করে? প্রকৃতির কান আছে না মুখ? যাইহোক ব্যাপার না, আমি ঠিকই খুঁজে বের করবো তোমার স্বপ্নগুলো। তুমি চিন্তা কোরো না বুবু।”
ইরার হাতের লেখা গোটা গোটা, লেখার ধরনও সুন্দর। এই মানুষটার নির্ঘাত ডাইরী লেখার অভ্যাস ছিল। আর সেই ডায়রীতেই হয়তো ইরা তার স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।
অতন্দ্রিলা জরিনাকে খরব দিল। জরিনা আজকাল আনন্দেই আছে। এ বাড়িতে আসার পর আফার জন্যে কফি বানানো ছাড়া তেমন কোনো কাজই করতে হয়নি তাকে।
জরিনা ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে বলল, “আফা, ডাকছেন আমারে?”
“হুঁ। একটা কাজ করবো, তোমার সাহায্য লাগবে।”
“সাহাইয্য আবার কি আফা? কামে আপনের হাতই দেওন লাগবো না, সব আমার ওপরে ছাইরা দেন!”
“সব কাজ তোমার ওপরে ছেড়ে দিতে পারতাম যদি তুমি শিক্ষিত হতে। আমরা এখন এই বুকসেলফের সমস্ত বইগুলো নামাবো। একটা ডায়রী খুঁজতে হবে।”
“কি কন আফা! এতডি বই নামাইবেন কেমনে? ডায়রী লাগবো, খালাম্মারে কইলেই তো হয়!”
“ওনাকে বলতে হবে না। চলো তো জরিনা কাজ শুরু করি। রোদ সাহেব চলে এলে তো আর পারবো না।”
“আফা! এত আয়োজন কইরা ভাইজান আপনেরে বিয়া করছে, আফনে তারে সাহেব ডাকেন কেন? আফনে কি তার অপিসে কাম নিসেন?”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল,“ইচ্ছা হয়েছে, তাই ডাকি। তুমি চাইলে তুমিও ডাকতে পারো। ডাকবে?”
জরিনা এবং অতন্দ্রিলার কাজ খুব একটা কঠিন হলো না। প্রথম তাকের বইগুলো সরাতেই পেছনের দিকে পেয়ে গেল একটা ডাইরি। ডাইরির কভারে লেখা ‘২০১৬’।
অতন্দ্রিলা ডাইরিটা খুলল। বেশির ভাগ মানুষ ডাইরি লেখা শুরু করলেও কিছুদিন পর তা বন্ধ করে দেয়। ইরাও তার ব্যতিক্রম নয়।
ডাইরির প্রথম কয়েকটা পাতা ছাড়া সম্পূর্ণ ডায়রি ফাঁকা।
ইরার লেখার ধরন একটু ভিন্ন। প্রতিটা পাতায় সে দিনে কি কি করেছে তা তিন-চার লাইনে লেখা।
ডায়রির প্রথম পাতা এরকম –
৩।২।১৬
আজ ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছি।
আবহাওয়া ভালো ছিল।
রান্না করেছি কাঁচা টমেটো দিয়ে কৈ মাছ।
ঠিক করেছি বাগানে গোলাপ ফুলের গাছ লাগাবো।
রোদ বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফিরেছিল।
প্রথম পাতা থেকেই বোঝা যায় এই মানুষটার জীবনের মুখ্য বিষয়গুলো ছিল সময়মতো ঘুম থেকে উঠা, রান্না করা এবং রোদ। এছাড়াও তিনি হয়তো প্রচুর স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন।
অতন্দ্রিলা পাতা উল্টায়, পরের পাতাটা এমন –
৪।২।১৬
রাতে ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখেছি।
বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল।
ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।
সারাদিন আকাশে মেঘ ছিল, রাতের দিকে বৃষ্টি হয়।
রোদ আজ আবারো সিগারেট খেয়েছে, ওর এই ব্যাপারটা এখনো ঠিক করতে পারলাম না।
রান্না করিনি, বিরক্ত লাগছিল।
অতন্দ্রিলার ধারনা রোদের সিগারেট খাওয়াটা ইরার বিরক্তির কারণ ছিল না। বিরক্তির কারন ছিল ঠিকমতো ঘুম না হওয়া।
পরের পাতা –
আজকে সকাল জুড়ে একটা প্ল্যান করলাম। প্ল্যানটা হলো, একটা স্কুল করবো। শান্তিনিকতনের মতো আবাসিক স্কুল। সেখানে থাকবে না কোনো বাঁধা-ধরা সিলেবাস, না থাকবে পড়ার চাপ। বাচ্চারা খেলতে খেলতে পড়বে, খেলতে খেলতে শিখবে। পরীক্ষায় বাচ্চারা যদি নিউটনের তৃতীয় সূত্রকে একটি রাজারানীর গল্পের মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করে তাও তারা নম্বর পাবে। পরীক্ষায় বাচ্চাদের উপস্থাপনের ভঙ্গি মুখ্য ব্যাপার নয়। বাচ্চারা আসলেই পড়ার বিষয় বুঝতে পরলো কিনা, সেটা মুখ্য বিষয়। আমার স্কুলের নাম হবে ‘ইরাবতীর ইশকুল’। নামটা সুন্দর না, কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে।
অদ্ভুত তো! এই পাতায় কোনো তারিখ নেই, দিনে কি কি করলো তাও নেই। আছে শুধু একটি সুন্দর পরিকল্পনার কথা।
রোদ বাড়িতে ফিরল বেলা চারটায়।
হাসিখুশি ভঙ্গিতে অতন্দ্রিলার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “এই নাও তোমার নকশিকাঁথা।”
অতন্দ্রিলা হাত বাড়িয়ে বলল, “ধন্যবাদ আপনাকে। তখন এমন হুট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কেন? আমার কথায় রাগ করে?”
“তেমন কিছু না।”
“কেউ আমার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আমি কিন্তু বুঝতে পারি। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আছে।”
“কেমন অভিজ্ঞতা?”
“বাবা আমার ওপর রাগ করে মাসে দুই থেকে তিনবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফিরে আসতেন। এখন আমি নেই, মা আছে। তাই বাবা নির্ঘাত মায়ের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে বেরিয়ে যাবেন।”
“১×২×৩=৬ আবার ১+২+৩=৬। গুণফল এবং যোগফল এক মানেই যে দুটো এক জিনিস তা কিন্তু নয়, কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। তেমনি তোমার বাবার বেরিয়ে যাওয়ার এবং আমার বেরিয়ে যাওয়ার কারনও কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে।”
“বাহ্! অংকের মাধ্যমে কঠিন ব্যাপারকে সহজ করে বলাটা ভালো লাগলো তো। আচ্ছা যাইহোক, এখন আপনি খেতে আসুন। প্রচণ্ড ক্ষুদা পেয়েছে, আপনার জন্যে না খেয়ে বসে আছি।”
“কেন? তুমি খেয়ে নিলেই পারতে।”
“আমি খাইনি তার কারন আছে। আপনি আমার ওপর রাগ করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিলেন। আমার নিশ্চই উচিৎ হবে না এই পরিস্থিতিতে আপনাকে রেখে খেয়ে ফেলা। আমার উচিৎ হবে আপনার রাগ ভাঙিয়ে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসা। এবং আমি তাই করলাম।”
অতন্দ্রিলার রান্না ভালো, বেশ ভালো। তবে ইরার মত ভালো নয়। কিন্তু ভালোমত শিখতে পারলে ইরাকেও ছড়িয়ে যেতে পারে সে।
আজ রান্না করেছে সরিষা বাটা দিয়ে মুরগি। রেসিপিটা অতন্দ্রিলার জানা ছিল না। তাই রান্নার সময় অসংখ্য বার ফোন করতে হয় শায়লাকে।
শায়লা এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলেন, “মেয়েরা বিয়ের আগে মায়ের কাছ থেকে রান্না শুনে শুনে খাতায় লিখে রাখে। অবশ্য তোর সেটা করার সময় কোথায়? রেসিপিগুলো লিখে রাখলে আলতুফালতু প্রতিবেদন লিখবে কে?”
অতন্দ্রিলা শীতল গলায় বলে, “বিয়ের আগে মায়ের আছ থেকে শুনে শুনে খাতায় রান্না লিখে রাখে সেইসব মেয়েরা, যারা সর্বক্ষণ মাকে কাছে পায়।”
রোদ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। অতন্দ্রিলার ইচ্ছা করছে তার সঙ্গে গল্প করতে। তাও আবার গাণিতিক গল্প, কিন্তু গল্প করার মত ঘনিষ্ঠতা বোধ হয় তাদের মধ্যে নেই।
রোদদের বাড়ির সামনের বাগানটা প্রকাণ্ড। বাগান বললে ভুল হবে, সেটা আসলে বাজার। বিশাল বাগানের একদিকে শাক সবজির গাছ, অন্যদিকে চৌবাচ্চায় চাষিত মাছ। অতন্দ্রিলার কথা, “বাগান হলো ঘুরে বেড়াবার জায়গা, মন খারাপ থাকলে একা বসে কিছুটা সময় কাটাবার জায়গা। এখানে বাজার খুলে রাখবার কোনো অর্থ হয় না।”
তিন জন মালি এবং দুজন মালিনী দল বেঁধে সকাল সকাল চলে আসে গাছগুলোর পরিচর্যা করতে।
আজ ভোরে অতন্দ্রিলা একজন মালিনীকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ে গোলাপের চারা কিনতে।
লাল, হলুদ, সাদা এবং কালো গোলাপ মিলিয়ে ২৭টি চারা কেনা হয়েছে, টব কেনা হয়েছে, জৈব সার কেনা হয়েছে।
চারাগুলো রোপন করার সময় একজন মালিনী এল অতন্দ্রিলাকে সাহায্য করতে।
মালিনী চিন্তিত গলায় বলল, “ম্যাডাম আপনি এগুলো লাগাতে পারবেন না। আমাকে দিন আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
অতন্দ্রিলা বলল, “অনেক ধন্যবাদ। আমি একাই পারবো।”
“কিন্তু ম্যাডাম এতগুলো চারা লাগাতে আপনার অনেক কষ্ট হবে।”
“ম্যাডাম ম্যাডাম করছো কেন? আমি তোমাকে চাকরি দেইনি, আবার তোমার চাকরি কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। কাজেই আমাকে আপা ডাকলেই চলবে। আর এই চারাগুলো রোপন করার দায়িত্ব একজন আমাকে দিয়েছেন, শুধুমাত্র আমাকে। তাই কাজটা আমাকেই করতে দাও।”
মালিনী হতাশ মুখে চলে গেল।
অতন্দ্রিলা সাবধানে চারাগুলো রোপন করছে।
টবে প্রথমে কিছুটা গাছের মাটি দিতে হয়, এরপর সেই গাছের মাটির ওপর কিছুটা সার মাটি।
২৭ টা টবের জন্যে এভাবে মাটি প্রস্তুত করা ধৈর্য্যের ব্যাপার, অতন্দ্রিলা যথেষ্ট ধৈর্য্যশীল মানুষ।
রোদ অতন্দ্রিলার পাশে এসে দাড়িয়েছে। অতন্দ্রিলা তাকে খেয়াল করেনি। তাই অতন্দ্রিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে রোদ কাশল।
কাশির শব্দ শুনে অতন্দ্রিলা তার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার কাজ শুরু করল।
অতন্দ্রিলা ক্ষীণ গলায় বলল, “আচ্ছা আপনি কেমন মানুষ? আপনার স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল এই বাগানে গোলাপ ফুলের গাছ লাগানোর। কিন্তু সেটা তিনি করে যেতে পারেননি। তাই বলে আপনিও এতগুলো বছরে গোলাপ গাছ লাগাননি কেন?”
রোদ আহত গলায় বলল, “আমি জানি না ইরার এই অসম্পূর্ণ ইচ্ছা সম্পূর্ণ করে তুমি কি প্রমাণ করতে চাইছ। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রেখো, তুমি কিন্তু কখনোই ওর জায়গাটা নিতে পারবে না।”
“ইরাবতীর অসম্পূর্ণ ইচ্ছাগুলো আমার সম্পূর্ণ করার উদেশ্য আপনাকে খুশি করা বা তার জায়গা দখল করা, এই চিন্তাচেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারন আমি ইরাবতীর অন্যান্য সকল স্বপ্নগুলোও পূরণ করবো।
“কেন জানতে পারি?”
“আমি প্রকৃতির প্রতিনিধি। আমাকে প্রকৃতি পাঠিয়েছে ইরাবতীর ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে।”
ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আমি আর সাফা কফি খাচ্ছি।নাহ!কফি শুধু আমি খাচ্ছি আর সাফা গালে হাত দিয়ে কফি সামনে নিয়ে বসে আছে।সে আজ বিরহের অতল সাগরে ডুবে আছে।কাল রাতে সাফার ব্রেকআপ হয়েছে।এই নিয়ে পাঁচ বার হল।প্রত্যেকবার ব্রেকআপের কারণ হয় তামিম ভাইয়ার সাফাকে আফা ডাকা।ওদের দুজনের ভেতর ঝগড়া শুরু হলেই নাকি ভাইয়া শুধু সাফাকে আফা বলে ঝগড়া করে।এইবার সাফাও তামিম ভাইকে খালু বলে ডেকেছে।প্রত্যেকবারের মত এবারও আমি চেহারায় সিরিয়াস ভাব এনে ওদের ব্রেকআপ হিস্টরি শুনে যাচ্ছি।অথচ পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে।কিন্তু হাসিটাকে তো কন্ট্রোলে আনতেই হবে,বেস্ট ফ্রেন্ডের পঞ্চম প্রেম বিচ্ছেদ বলে কথা।
-‘সুপ্তি,বলতো এবার আমি ঠিক করেছি কিনা!সবসময় ঝগড়া হলেই আফা বলে ডাকবে কেনো!আমিও বলে দিয়েছি খালু।এবার একেবারে ফাইনাল ব্রেকআপ।’
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখে হাত দিয়ে হাম দিয়ে বললাম,’কতবার ব্রেকআপ করলে ঠিক ফাইনাল ব্রেকআপ হয় আমাকে একটু বলতো?’
-‘তুই কি আমার সাথে মজা করছিস।আমি কিন্তু সিরিয়াস!’
-‘কতো সিরিয়াস তা আমার জানা আছে!এখনই তো তামিম ভাই আসবে আর ধেই ধেই করে তার সাথে নাচতে নাচতে চলে যাবি!ছেলেদের না অতো পাত্তা দিতে হয় না।পাত্তা দিলে এদের ভাব বেড়ে যায়।’
সাফা আমার কথা কিছুক্ষণ হা করে শুনে বলল,’তুই কি নিদ্র ভাইকেও পাত্তা দেস না?’
আমি একটু ভাব নিয়ে আয়েশ করে বসে বললাম,’অফকোর্স দেই না।সেই তো আমার পেছন পেছন ঘুরে,আমাকে কখনো দেখেছিস তার পেছনে ঘুরতে!’
মনে মনে আল্লাহর কাছে একশবার মাফ চেয়ে নিলাম এত বড় মিথ্যা কথা বলার জন্য।নিদ্র আমার পেছনে ঘুরবে কি আমাকেই তো আদেশ দিয়ে ডেকে নিয়ে তার পেছনে ঘুরায়।আর সেই ধলা লম্বুশকে পাত্তা না দিয়ে আবার উপায় আছে!ধমক দিয়েই তো কান ঝালাপালা করে দিবে।
সাফা মনোযোগ সহকারে আমার কথা শুনে যাচ্ছে।আজকে নিজেকে পুরো জ্ঞান বিশারদ মনে হচ্ছে।তাই চেহারায় জ্ঞানী ভাবটা আরেকটু টেনে এনে বললাম,বুঝলি সাফা,ছেলেদের না সবসময় হাতের মুঠোয় রাখতে হয়।আমিও তো তাই করি।নাহলেই দেখবি অন্য আরেকজনকে ধরে নিয়ে এসেছে।’
-‘তাই নাকি সুপ্তি!তোমার হাত তো দেখি অনেক বড়!আমার মত ছয় ফুট লম্বা মানুষকেও হাতের মুঠোয় ভরতে পারো।’
পেছন থেকে নিদ্রর গলার আওয়াজে আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম।একটু ঢোক গিলে কাচুমাচু করে পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখি নিদ্র আমার চেয়ারের উপর দুই হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে বললাম,’আমি তো এমনিতেই সাফাকপ এক্সামপল দিচ্ছিলাম।সিরিয়াস কিছু না।’
সাফা বলতে লাগল,’আরে তুই তো এইমাত্রই বলছিলি নিদ্র ভাইকে তুই পাত্তা……
আমি চোখ গরম করে সাফাকে বাকি অংশটুকু বলা থেকে আটকালাম।এরইমধ্যে আগমন ঘটলো তাদের পুরো গ্যাংয়ের।ভার্সিটি থেকে বের হয়েও তারা এখনো ভার্সিটির টান ছাড়তে পারেনি।সপ্তাহে এক দুইবার আসবেই।আর যখন আসবে সব ফ্রেন্ডরা মিলে যোগাযোগ করে একসাথেই আসবে।তামিম ভাইকে দেখে সাফা একটা মুখ ভেংচি দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।তামিম ভাইও তাই দেখে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো।
পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে নিদ্র বলল,’কিরে আজকে নিউ লাভবার্ড দের আবার কি হল?’
সোহেল ভাই বলে উঠল,’এরা অলরেডি পাঁচ বার ব্রেকআপ করে ফেলেছে আর তুই এদের নিউ লাভ বার্ড বলছিস।’
-‘এখনো তো সিক্স মানথও হয়নি।তো এদেরকে নিউ বলবো না তো আর কি বলবো!’
তারপর তামিম ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল,’কিরে দোস্ত,তুই কি বিয়ের আগে ব্রেকআপের সেন্চুরি করে রেকর্ড গড়ার ধান্দায় আছিস নাকি?’
নাঈম ভাই বলে উঠল,’দোস্ত ঐ দায়িত্ব আর তামিমের কষ্ট করে নিতে হবে না।আমার প্রিয়তমা অলরেডি সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে সঁপে নিয়েছে।উঠতে বসতে ব্রেকআপ!’
নাঈম ভাইয়ার কথা শুনে তানিয়া আপু তার হাতে একটি জোড়ে চিমটি কেটে বলল,’পটর পটর তো ভালোই করতে পারো,কাজের কাজ তো করছো না।একসপ্তাহের মধ্যে যদি তোমার পরিবারকে আমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে না পাঠাও তাহলে দেইখো তোমারে কি করি!বুড়ি হইয়া বইসা এনার জন্য অপেক্ষা করছি আর এই ছোট্ট খোকা এখনো মার সামনে কোনো কথাই বলতে পারে না!’
তাদের দুজনের কান্ডে আমরা সবাই হেসে দিলাম।
নিদ্র একটু নকল আফসোসের সুরে বলে উঠল,’তোরা যাই বলিস আমি কিন্তু এবার সাফার পক্ষে,পার্টনারের মুখে ভাইয়া,আফা শুনতে যে কেমন লাগে আমি বুঝি।’
সাফা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে নিদ্রর দিকে তাকালো।আমি চোখ কুঞ্চিত করে রইলাম।
তামিম ভাই বললো,’আরে আমি তো ওর নামের সাথে আফা ডাকতে ভালো লাগে তাই বলি।আর ও যে আমাকে খালু বললো তার বেলায়!’
আমি খিলখিল করে হেসে বললাম,’ভাইয়া আপনারা আগে কোন সম্পর্কে নিজেদের বাঁধতে চান তা ঠিক করুন।গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড থেকে আপনাদের অন্য সম্পর্কেই দেখি বেশি ইন্টারেস্ট।’
নিদ্র বলল,’সাফা,তুমি একটা কাজ করো তোমার জন্য তোমার একমাত্র ভাবীর বাড়ি থেকে যে তার খালাতো বা মামাতো সামথিং এমনই কোন বিয়ের প্রস্তাব এসেছে সেটা এক্সেপ্ট করে ফেলো।বয়সে তো তামিমের সে বড় ভাই হবেই তাই তামিমের যে তোমার এতো আফা ডাকার শখ সেটা না হয় ভাবীর পরিবর্তে ও ডাকতেই পারে!’
নিদ্রর কথায় সাফাও উৎসাহিত হয়ে তামিম ভাইকে চোখ ঘুরিয়ে বোঝাল ও তাই করবে।
তামিম ভাই সাফার হাত ধরে উঠিয়ে নিদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,’শালা,তুই কি আমার বন্ধু নাকি শত্রু!এখানে থাকলে তুই দেখি আমার প্রেমের বারোটা বাজিয়ে দিবি।’
এই বলে তামিম ভাই সাফাকে নিয়ে বাইরে চলে গেল।তানিয়া আপু হাসতে হাসতে নিদ্রকে বলল,
-‘নিদ্র মামু তুমি তো দেখি প্রেম জোড়া লাগানোয় বড্ড এক্সপার্ট হয়ে গেছো।’
নিদ্র একটু নকল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’হুম,নিজেরটা পারি না তাই অন্যেরটাই না হয় করি।’
কথাটি শুনে আমার পিত্তি জ্বলে গেল।নিশ্চয়ই ঐ মেয়েটাকে নিয়ে আফসোস করছে!
তারা দলবেঁধেই আবার চলে গেল প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে।তাদের রেজাল্ট এখনো বের হয়নি।সবাই এখনো বিন্দাস ঘুরছে।শুধু নিদ্রই এক্সাম শেষ হওয়ার পাঁচ ছয় দিন পরেই অফিসে জয়েন করেছে।খুব রেসপন্সিবল ছেলে কি না!
তারা সবাই চলে গেলে আমিও একটু ওয়াশরুমে গেলাম।বের হওয়ার মুখে আমার এক বছরের সিনিয়র রুমা আপুর সাথে দেখা।সে আমার হাতে একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল,’এটা একটু নিদ্র ভাইকে দিয়ে দিও।তুমি তো তার সাথে বেশি থাকো।সময় বুঝে দিয়ে দিও কিন্তু!’
কথাটি বলে সে ব্লাশ করতে করতে চলে গেল।আমার আর নিদ্রর বিয়ের কথা আমার ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ড ছাড়া কেউ জানে না।সবাই শুধু জানে আমার বিয়ে হয়েছে কিন্তু কার সাথে হয়েছে সেটা সবারই অজানা।অতঃপর কৌতুহলকে দমিয়ে রাখতে না পেরে আমি খামের ভেতর হাত ঢুকাতেই বেরিয়ে এলো একটি চিঠি।চিঠিটি পুরো পড়ে আমার চোখ ছানাবড়া।এতো দেখি খাঁটি বাংলা ভাষার প্রেমপত্র।আমিই হয়তো প্রথম নারী যাকে কিনা তার স্বামীর প্রেমপত্র বিলি করার দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে।চিঠির ভেতর নিদ্রকে সে তার জান,প্রাণ,কলিজা,গিলা,ফ্যাপসা সবই বানিয়ে ফেলেছে।রাগে আমার সর্বাঙ্গ দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল।ইচ্ছে করছে এই চিঠিটা কুঁচি কুঁচি করে ছিড়ে বাথরুমের কমোডে ফেলে দেই।আমার বরকে প্রমপত্র দেওয়া!আর তাও নাকি দেবো আমি!কচু দেবো!
এই জন্যই তো সুন্দর ছেলে বিয়ে করতে চাইনি।চারপাশে মধুমক্ষিকার মতো সব ভনভন করে উড়ে।একেই বলে কপাল,যা চাইবো না তাই হবে।কে বলেছিল তাকে এত সুন্দর হতে।একটু কম সুন্দর হলে কি হতো!
চিঠিটাকে ব্যাগে ভরে আমি হনহনিয়ে ক্যান্টিনে ফেরত আসলাম।বাড়ি যাওয়ার পথে এটাকে পঁচা পুকুরে ফেললে তবেই আমার শান্তি।
ক্যান্টিনে এসে দেখি এখনও সাফা ফেরত আসেনি নিশ্চয়ই এখনও প্রেম করছে।সোমা আপুকে আসতে বলেছিলাম কিন্তু তার ক্লাস আছে আসতে পারবে না।এখন আমি একা একা বসে কি করব!আমার তো আর প্রেম করার মতো কেউ নেই!
গালে দুই হাত দিয়ে বসে ভাবছিলাম।হঠাৎ নিদ্র এসে আমার সামনে চেয়ার টেনে বসলো।চোখ থেকে কালো সানগ্লাসটা খুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’কি হয়েছে এমন পেত্নীর মতো মুখ করে রেখেছো কেনো।’
আমি মনে মনে বললাম,’হ্যাঁ,আমি তো পেত্নীর মতোই এখন লাগবো আর ঐ মেয়ে হলো অপ্সরা!’
-‘তোমার সব ক্লাস শেষ হলে তোমাকে আজকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।’
আমি চমকে উঠে বললাম,’ডক্টরের কাছে!আজকে আমার এক্সট্রা ক্লাস আছে।’
-‘হ্যাঁ,ডক্টরের কথা শুনলেই তোমার এক্সট্রা ক্লাস শুরু হয়ে যায়।এক্সট্রা ক্লাস থাকলে সেটা বাদ দিয়ে দাও তোমার এক্সট্রা ক্লাস আমি পরে নিয়ে নেব।’
আমি বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে রইলাম।
সোমা আপু হঠাৎ এসে নিদ্রকে বলল,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া,ভালো আছেন।’
নিদ্র হেসে সালামের জবাব নিয়ে বলল,’আমার ভালো থাকার খবর পরে শুনো,তুমি যার খবর জানতে এসেছো সে এখন সেকেন্ড ফ্লোরে।’
সোমা আপু মুচকি হেসে যেতে উদ্যত হলে আমি বললাম,’তুমি না বললে তোমার ক্লাস আছে।এখন এসেছো কিভাবে।’
সোমা আপু কিছু না বলে মুচকি হেসে চলে গেল।আমি পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম,’এখন আবার কই যাও?’
নিদ্র আমাকে থামিয়ে ধমক দিয়ে বলল,’এই তুমি সবসময় কাপলদের প্রেমে ডিস্টার্ব করতে চাও কেনো?’
আমি তার মুখ ফুলিয়ে রইলাম আর মনে মনে কটমটিয়ে বললাম,’হ্যাঁ,এখন আমার জন্য ঐ মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারছে না যে তাই আমাকে ডিস্টার্ব মনে হচ্ছে!’
-‘পারবো না!আমি কি আপনার বাদামের খোসা ছাড়ানোর জন্যই জন্ম নিয়েছি যে সবসময় আমাকেই খোসা ছাড়াতে হবে।আপনার গার্লফ্রেন্ডকে গিয়ে বলুন।’
কথাটি বলেই জিভে কামড় দিলাম।সত্যি সত্যিই যদি এখব ঐ মেয়ের কাছে চলে যায়!
পরক্ষণেই গলা নরম করে বললাম,’আচ্ছা আমি আনতে যাচ্ছি।আপনি বসুন।’
চেয়ার ছেড়ে উঠতেই মনে হল আমি ভার্সিটি আসার সময় গেটের কাছে আসতেই নিদ্রর নামে অফিস থেকে একটা সাদা এনভেলাপ এসেছিলো।সে বাসায় না থাকায় আমাকেই রিসিভ করতে হয়।আমিও তাড়াহুড়োর জন্য ব্যাগে নিয়ে চলে এসেছি।আমি ঘুরে ব্যাগ থেকে এনভেলাপটা বের করে তার হাতে দিয়ে দিলাম।তারপর চলে গেলাম বাদাম আনতে।
ফিরে এসে দেখি নিদ্র খামের ভেতরের কাগজটা মেলে আনমনে তাকিয়ে মুখটা থমথমে করে রেখেছে।
আমি গিয়ে বললাম,’কি হয়েছে?’
সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বিষন্ন মুখে বলল,’তোমার কি সত্যিই কিছু যায় আসে না?একটা মেয়ে তোমার হাজবেন্ডকে লাভ লেটার দিল আর তুমিও তাকে দিয়ে দিলে!’
কথাটি বলে সে কাগজটি টেবিলের উপর রেখে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আহত মুখে চলে যেতে লাগল।
তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একঝাঁক উদাসীনতায় আমার মন ছেয়ে গেল।আমি তাকে চিঠিটি দিতে চাইনি।তবুও….
এই প্রথম হসপিটালে আসলাম একা একা।এমনিতে আমাকে ধরে বেঁধে তারপর হসপিটালে আনতে হয়।হসপিটালে আসতে আমার একদমই ভালো লাগে না।নিদ্রকে হসপিটালে আসা নিয়ে অনেক ঘুরিয়েছি।সে আমার উপর রাগ এবং বিরক্ত,হসপিটালে আসা নিয়ে ঘুরানোর জন্য আর সেদিনের সেই চিঠির জন্য।কথা বলে ঠিকই কিন্তু মুখটা ভার করে।তাই তাকে আর না রাগানোর জন্য আমি নিজে নিজেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি চেকআপ করাতে।সব চেকআপ শেষে হসপিটাল থেকে বের হচ্ছি ঠিক তখনই একজনের ধাক্কা খেলাম।আমার ধাক্কা লাগায় তার হাতের ব্যাগ খুলে সব কিছু পড়ে গেছে।আমি দ্রুত স্যরি বলে তাকিয়ে দেখলাম মিথি আপু।আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে সে ফ্লোর থেকে সব উঠাতে লাগল।আমিও আবার স্যরি আপু বলে পড়ে থাকা জিনিস উঠিয়ে দিতে গেলাম।কিন্তু সে আমার হাত ছিটকিয়ে সরিয়ে দিয়ে সবকিছু উঠিয়ে নিল।আমি আবারো বললাম,’স্যরি আপু,আমি আসলে দেখতে পারিনি।’
সে খুব রুক্ষ স্বরে বলল,’থামো তো,এসব নাটক আমার সামনে করতে আসবে না।’
-‘আপু আমি সত্যি ইচ্ছে করে করিনি।’
-‘হ্যাঁ,তুমি তো ইচ্ছা পূরণ করো শুধু বড়লোক সুন্দর ছেলেদের ফাসানোর জন্য।’
তার কথায় আমি খুবই অবাক হলাম।বললাম,
-‘আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলছেন কেনো?’
-‘কেনো বলছি এখন কিছুই বুঝতে পারছো না।এরকম ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে তুমি নিদ্রকেই পটাতে পারবে আমাকে না।তোমার জন্য আমি নিদ্রকে পেলাম না।নিদ্র তো কোনো মেয়েদের দিকেই ফিরে তাকাতো না।তোমার থেকেও তো আমি ডাবল সুন্দর তবুও আমার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করলো না।বিয়ে করলো কি না তোমাকে!কি জাদু করেছো একটু বলো তো।এখনকার জুনিয়র মেয়েরা তো আবার অনেক ফাস্ট।তোমাদের মতো মেয়েরা তো ভার্সিটিতে আসার আগেই বড়লোক সিনিয়রদের পটানোর একেকটা ধান্দা আয়ত্ত করে আসে।’
-‘কিছু মানুষের মন মানসিকতা যে কতটা নিচ আর জঘন্য হয়ে থাকে সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না।শুধুমাত্র আপনি সিনিয়র বলে আপনাকে রেসপেক্ট করে কিছু বলছি না।’
কথাটি বলে আমি দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে চলে আসলাম।সে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল,’তোমার এত বড় সাহস আমার সাথে এভাবে কথা বলো।তোমাকে তো আমি প্রথম থেকেই উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম যদি না শুধু নিদ্র তোমাকে ভালোবাসতো!’
গাড়ির দরজা অর্ধেক খোলা অবস্থায় আমি থমকে গেলাম তার শেষোক্ত কথাটি শুনে।এক মুহুর্তের জন্য মনে হল মাথাটা যেনো হ্যাং হয়ে গেল।আবারো পিছনে ঘুরে দেখলাম মিথি আপু এতক্ষণে চলে গেছে।তারপর কিভাবে কিভাবে বাড়ি আসলাম তার কিছু মনে নেই।বারবার মনে হচ্ছে আমি কিছু ভুল শুনলাম না তো!
কেমন যেনো স্তব্ধ হয়ে রয়েছি।ড্রাইভার চাচার ডাকে চমকে উঠে দেখি বাড়ি ফিরে এসেছি।ধীর স্তব্ধ পায়ে রুমে আসতেই দেখি নিদ্রর পড়ার টেবিলে,আশেপাশে বইয়ের স্তুপ এলোমেলো হয়ে রয়েছে আর তারপাশে রহিমা খালা মুখে কাপড় বেঁধে পুরবো বইগুলো ঝাড়ছে।
আমাকে দেখে রহিমা খালা কাছে এসে বলল,’ভাবী সাব দেহেন নিদ্র ভাইজান পুরান বইখাতা সব নামাইছিলো যেগুলা লাগবো না হেগুলি বাইর করার লেইগা।অহন হের মোবাইলে অপিস থিকা ফোন আইসে দেইখা তাড়াতাড়ি চইলা গেছে।আপনি এহন দেইখা রাহেন আমি গেলাম।’
আমি এসব দেখবো কি!আমি তো নিজেই এখন ঘোরের মধ্যে আছি।সেই ঘোরের মধ্যে থেকেই হঠাৎ চোখে পড়ল বইয়ের স্তুপের মাঝে একটি নীল রঙের ডায়েরি।কৌতূহল বশত সেটাকে টেনে বের করে ডায়েরির পাতা চোখের সামনে খুলে ধরলাম।সেখানে সুন্দর গুটি গুটি হাতে কালো কালিতে লেখা……….
প্রিয় অভিমান
আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য তোমায় আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। তুমি বড় অদ্ভুত এক অনুভূতি।মা দেখা যায় না।ধরা যায় না। তবুও তোমার কবলে পড়ে প্রতিদিন ধ্বংস হয়ে যায় হাজারো সম্পর্ক।কেনো জানো। কারণ তুমি যে বড্ড খারাপ।একবার কোনো মানুষের মধ্যে তোমার উপস্থিতি বিরাজ করলে তা আর দমিয়ে রাখা যায় না।সদ্য অংকুরিত চারা গাছের মতো সে বারতেই থাকে আপন মনে। অভিমান সম্পর্কের দুরত্ব বড়ায়।জানো কথা টা আগে অনেক শুনেছি কিন্তু কখনো বিশ্বাস করিনি।হয়তো বিশ্বাস করিনি বলেই আমার জীবনের সাথে জড়িয়েছে তোমার অস্তিত্ব।আর তোমার জন্যই আজ আমার সম্পর্কের মাঝে এতোটা দুরত্ব।ভালোই তো ছিলাম তবে কেনো দেখা দিলে আমার জীবনে।কেনো এক মুহূর্তে এলোমেলো করে দিয়ে গেলে আমার সাজানো জীবন টাকে।আজ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি তার একটা মেসেজের আসায়। কিন্তু পাই না কোনো মেসেজ।কেনো জানো, কারণ আমি একদিন তার থেকে চলে এসেছিলাম অভিমান করে।কোনো যোগাযোগ রাখিনি তার সাথে।আজ আমিও চাই তাকে একটা বার মেসেজ দিয়ে বলি “প্লিজ ফিরে এসো আমার জীবনে।আসো দুজনে স্বপ্ন গুলোকে আবার সাজাই। আবারও রংধনুর সাতটি রঙে রাঙিয়ে যাক আমাদের দুজনের জীবন” কিন্তু পারিনি আজও বলতে।ঐ যে তুমি তো আছো এই হৃদয়ের মধ্যে বসে। মেসেজ টাইপ করেও ডিলিট করে দেই শুধু তোমার জন্য। মনের মধ্যে যে তুমি জমাট বেঁধে আছো ঘন কুয়াশার মতো।মা সম্পূর্ণ আচ্ছাদন করে আছে আমার মন কে।তোমার জন্যই তো আজ এতো কিছু। মনের মধ্যে তুমি আছো বলেই তো আজও তাকে একটা ফোন বা মেসেজ দেয়া হয়নি।বার বার তুমি মনে করিয়ে দাও যে তুমি আমার মধ্যে কতটা রাজত্ব তৈরি করে নিয়েছো।যতবার ভাবি তার কাছে ফিরে যাবো ততোবারই ভেতর থেকে তুমি বলে উঠো “কেনো তুই যেচে তার কাছে ক্ষমা চাইতে যাবি। দোষ কি তার ও কম ছিলো।সে কেনো আগে তোর কাছে আসবে না।কেনো তোর মান ভাঙ্গাবে না”
ব্যাস আবারও ফোন টা রেখে দেই হাত থেকে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতি টা মুহূর্ত যে তার জন্য দুমরে মুচড়ে উঠে।সে কথা তার অজানাই থেকে যাবে আজীবন।হয়তো কোনো এক স্তদ্ধ দুপুরের ঝুম বৃষ্টির শব্দে প্রবল ভাবে দেখতে মন চাইবে তাকে।তখন না হয় পুরোনো সেই ডাইরির পাতার ভাঁজে স্বযত্নে লুকিয়ে রাখা তার ছবি টা বের করে নয়ন ভরে দেখে নেবো তাকে।হয়তো সেদিনের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজলের স্রোত সে দেখতে পাবে না। কিন্তু তবুও আমি তাকে ফোন করবো না। কারণ আমার মাঝে যে বিরাজ করছো তুমি।আর বেশি কিছু বলবো না। শুধু বলবো তুমিই পারো সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরাতে।তাই তো তুমি মহান।আর তোমার স্বীকার আমার মতো কিছু অবলা প্রাণ।ভালো থেকো।বিরাজ করো মানুষের অন্তরে বাড়িয়ে তোলো সম্পর্কের দুরত্ব। কিন্তু যেদিন তোমায় ছাপিয়ে দুটি হৃদয় আবার এক হবে সেদিন হবে তোমার হাড়।