Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1974



লতাকরঞ্চ (১৪)

0

লতাকরঞ্চ (১৪)

শাড়ি পরে আসলাম। ওটাকে আমি শাড়ি বলেই মানি। এটা তো শাড়ির মতই। সবাই আবার এটাকে কি বলে? লেহেঙ্গা! আমার আবার এই টাইপের ড্রেসের শখ ছিলো বহুদিনের। সিনেমায় পরেনা নায়িকারা?
কি দারুণ লাগে দেখতে…
আমি আবার টিভি দেখলে সারাক্ষন শুধু 9xM চ্যানালটা দেখি। গানের চ্যানেলগুলোই সারাক্ষন দেখি। আমার ফোনটা ভালোনা তাই আর কি করা.. আব্বাতো নতুন ফোন কিনেও দিবেনা।

ওখানের সব লেটেস্ট গানগুলো আমার চোখ ধাঁধায়। কোনোটাই এড়িয়ে যায়না চোখ। সবগুলোই দেখি।
একদিন লিমা আপু এসে বলেছিলো,
– তুই ও যে এসব দেখিস; আমার না বিশ্বাস হয়না।
এই বলে তীব্র নিন্দা হাসি হাসছিলো।

কালুকে চা আনার জন্য পাঠিয়েছিলাম।
কালু দেখতে ভীষণ কালো।
নিগ্রোদের মত সীমাহীন কালো মুখ আর সাদা ধবধবে দাঁতের খিলখিল হাসি দিয়ে বলেছিলো,
~ আফা, লতা আফায় কিন্তু আমারে ও দেখতে দেয়। সাইডে বইস্যা বইস্যা দেহি! আমার আবার হিন্দি গান দেখতে হেব্বি লাগে। হেহ্ হে!

লিমা আপু কালুকে একদম পছন্দ করেনা।
সেদিন বলেছিলো,
– তোরে বলছি না? আমরা যখন কথা বলবো তখন সেই কথার মধ্যে কখনো না ঢুকতে। বেয়াদব। মনিব চিনিস না? কেন যে আম্মা এগুলারে তাড়ায় না। যত্তসব।

অথচ আপু জানেনা.. কালুর আম্মা মৃত্যুশয্যায় ছিলো তখন।

আমার হাতে টাকা থাকলেই তাকে আমি ২০০/৩০০ করে দিয়ে দিতাম। চিকিৎসার খরচটা এমনিতে আব্বাই দিতো।

কালু আমাদের বাড়িতে কাজ করতো রোজগারের জন্য কারণ তার আব্বা নেই। সে বলে আমাদের এই বাড়ি নাকি তার নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। তাই সারাক্ষন এখানেই থাকে। এখানে আমাদের কাজ করে দিতেই নাকি ওর ভালো লাগে। সারাদিন আমাদের বাড়িতেই কাজ করে,
তাই মায়ের সেবা করতে পারতোনা ঠিকঠাক মত। কালুর আম্মা খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন।
অসুস্থতার পর স্ত্রীকে দিয়ে ডাক্তার দেখাতো নিজের মাকে, মাঝেমাঝে নিজেও নিয়ে যেত।

কিন্তু আসলে তার স্ত্রী একটা টাকা ও তার শাশুড়ি মায়ের জন্য খরচ করতোনা। সবটা নিজে গ্রাস করতো আলতা,স্নো,লিপস্টিক কিনে কিনে।
কালুর বউকে নাকি মাঝে মধ্যে কালো চশমা পরেও দেখা যায় রাস্তাঘাটে।
আমি নিজেও দেখছি কয়েকবার।
ঐ মহিলা এই চশমা পরে বাজারেও নাকি যায়.. সবজি কিনতে যায়, মাছ বাজারে যায়.. এই চশমা পরেই। ক্যাটরিনার “কালা চশ্মা” গানটা তার খুব পছন্দের তো তাই।

অথচ কালু কত কষ্ট করে কাজ করে, রোজগার করে। তার মায়ের জন্য কত টাকা যে দেয় তার বউকে। সেটা হিসেবের বাইরে।

মহিলার গ্যাস্ট্রিক আলসার ছিলো। গায়ে গুটি গুটি খোস-পাঁচড়াও উঠেছিলো । যত্ন, ভালো ট্রিটমেন্ট পেলে এই রোগ থেকে কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেরে উঠা যায় সাধারণত। অযত্নে,অনাদরে এভাবেই ছিলো দিনের পর দিন।

অবশ্য কিছুদিন পরেই কালুর আম্মা মৃত্যুবরণ করেছিলো।

লিমা আপু আর মঞ্জু ভাইয়ার এনগেইজমেন্ট পার্টি হচ্ছে। বেশ ধুমধাম করেই করছে মঞ্জু ভাই। আমার বোনটাকেও দারুন লাগছে।

আমাকে আম্মা ডেকে বললো,
– যা তুই তোর আপুর কাছে যা। ওর আন-ইজি ফিল হতে পারে। ওর যা যা লাগবে শুনে আমাকে জানাবি।

আমি আপুর পাশে গেলাম।
গিয়ে দেখলাম প্রান্ত ভাই কি যেন বলতেছে..
আমি যেতেই প্রান্ত ভাই কথা ঘুরিয়ে ফেললো।
আমি অবাক হলাম।
কি এমন কথা থাকতে পারে উনাদের যেটা আমার সামনে বলা যাবেনা?

আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্রান্ত ভাই একবার ও আমার দিকে তাকাচ্ছেনা।
এইযে এত কষ্ট করে সাজুগুজু করে আসলাম..

আমি আপুকে বললাম,
– কিছু লাগবে তোর?
আপু মুখে প্রাণবন্ত হাসি রেখে বললো,
– আরে আরে! লতা! তুই এটা পরেছিস! ভালোই লাগছে! আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি বললাম,
– অনেক সুন্দর।
প্রান্ত ভাই বললো,
– নি:সন্দেহে লতার চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে।
আমি বললাম,
– তা জানি। বলা লাগবেনা।

প্রান্ত ভাই গম্ভীর স্বরে বললো,
– সেই তো পরেছিস-ই! তাহলে এতক্ষন এত বাহানা করার কি দরকার ছিলো? পরবিই যখন তখন তো এত ‘না না করার তো দরকার ছিলোনা, তাইনা?
আমি বললাম,
– না। পরতে চাইনি। সবাই মিলে যা শুরু করছিলো, বিশেষ করে আব্বা আর কিশোর ভাই তো….

প্রান্ত ভাই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– থাক! হইছে, বুঝছি।

তারপর সে প্যান্টের পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে, হেঁটে যেতে যেতে মিনমিনিয়ে বলতে লাগলো,
– আগেই জানতাম পরবে। যতসব ঢং। এমন একটা ভাব মনে হয় যেন.. অবশ্য না পরে যাবে কই, স্পেশাল মানুষ দিয়েছে কিনা…

আমি কথাটা শুনলাম।
কিন্তু কোনো রিএকশনের প্রয়োগ দেখালাম না।

বুঝলাম না, এটা বললো কেন।
আমি এটা পরায় কি তার পাকা ধানে মই পড়লো?
না তো! তাহলে তার সমস্যাটা কি?
_____________
________

আপুর কাছ থেকে এসে আমি একটা মোটামোটি রকমের নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসলাম।
অনেক কিছু মাথার ভিতরে ঘুরঘুর করছে।

অনেক মানুষজন।
মনে হচ্ছে যেন বিয়ে বাড়িতে আসছি।
মঞ্জু ভাই পারেও বটে..
এনগেইজমেন্ট করতেছে একেবারে বিয়ের মত ঘটা করে।
বিয়ে না জানি কেমন করে করে করবে আল্লাহ জানে!

হঠাৎ কারো স্পর্শ পেলাম।

শোভা আপুর ভাই এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।
মানুষটার হাব-ভাব ভালো না।
চোখ-মুখে কেমন যেন একটা শয়তানি শয়তানি ভাব।

আমি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালাম।
রুডলি জিজ্ঞেস করলাম,
– গায়ে হাত দিলেন কেন?
উনি বললো,
– তোমাকে সেই কতক্ষন পর্যন্ত ডাকতেছি কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছিনা। তাই…

আমি বললাম,
– আমাকে ডাকতেছেন মানে? আপনি আমার নাম জানেন নাকি?
উনি হাসি দিয়ে বললো,
– না মানে… আমি এক্সকিউজ মি,এক্সকিউজ মি করছিলাম একচুয়েলি। এনিওয়েজ, আই এম আবির। ইয়্যু?

– তাই বলে আপনি আমাকে ছুঁয়ে দিবেন? তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।

– আই লাভ ইয়্যু।

– কি!
– ওহ্, সরি সরি! আসলে তোমার ড্রেসটা খুব সুন্দর!

– তো আই লাভ ইয়্যু বললেন কেন?
– নোহ্! আই লাভ ইয়্যুর ড্রেস! হিহ হি! আই মিন ইট!
– আচ্ছা। ধন্যবাদ।

– তোমার নামটাও খুব সুন্দর। লতা, তোমার নাম। তাইনা?
– জানিনা।
এই বলে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম।

তখনি উনি আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেললো।

আমি আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়লাম! থরথর করে কাঁপুনি উঠলো সারা গায়ে।

বিস্মিত চোখে বললাম,
– ছাড়েন। হাতটা ছাড়েন বলছি।
ছেলেটা বললো,
– নাহ্ গো! সারাজীবনের জন্য ধরলাম! হিহ্ হি হি!

আমার কান্না এসে যাচ্ছে।
সহসা আমার চোখে জল আসেনা।
এত জোরে হাতটা ধরে আছে যে মনে হচ্ছে আমার হাতটাকে কেউ বুঝি কুচি কুচি করে কেটে ফেলছে।

– হাত ছাড়েন। হাতটা ছাড়েন বলছি।
– তুমি ভাবছো আমি তোমাকে চিনিনা? তোমার ও তো চেনার কথা! হিহ্ হি হি।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।
লোকটা আমাকে চেনে!
আমারো অবশ্য চেনা চেনা লাগছিলো প্রথম যখন দেখছিলাম।

নিরিবিলি এক সাইডে বসে আছি তাই কেউ দেখছেও না।
চিৎকার করবো যে তাও করতে পারছিনা।
সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে।

প্রচণ্ড ব্যাথা লাগছে হাতে।

চলবে..

(পরবর্তী পর্বে টুইস্ট আসছে..)

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

লতাকরঞ্চ (১৩)

0

লতাকরঞ্চ (১৩)

প্রান্ত ভাই এই কালো মেঘে ঢাকা ঘোমড়া মুখ নিয়েই আমার কাছে আসলো আর বললো,
” লতা, তোর সাথে শোভা এটা খুব খারাপ করেছে। একদম ঠিক করেনি। তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস, তাই না? ”

আমি তখন মোবাইলে শোভা আপুর ঐ মাইকেল ভাইয়ের খোঁজ করছিলাম। কিন্তু প্রান্ত ভাইয়ার এসব কথাবার্তা শুনে খুব হাসি পেলো। হাসি দিয়ে দিলাম।
উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– হাসছিস যে?

কোনো কথা নাই। মিটিমিটি হাসি দিয়ে যাচ্ছি। হাসিটা মূলত ইগ্নোর করার এক প্রপঞ্চময়ী(মায়াময়) ধাপ।

ভাই আবার বললেন,
– শোন, তোর হাসিটা একদম ভালোনা। কুৎসিত, কিম্ভুতকিমাকার টাইপ। সো, এত হাসিস না আমার সামনে।

আমি আরো বাড়িয়ে দিলাম মিটমিটে হাসির পুরুত্ব।

উনি রেগে যাচ্ছেন। আমি জানি।
কিন্তু আমার মনে এখন ডোন্ট কেয়ার, ডোন্ট কেয়ার ভাব। যার আমার অপমানে অপমান বোধ হয়না তার প্রতি আমার ফিলিংস তো দূর তার ত্রিসীমানাতেও আমি নিজেকে রাখতে চাইনা। বয়সের একটা সময়সীমা থাকে যে সময়টা আবেগে টইটুম্বুর থাকে।
আমার বয়সটা সেখানেই আটকা পড়ে বন্দি ছিলো এতদিন। তাই বুঝে উঠতে পারিনি, কে গিনি সোনা আর কে নয়।

উনি আবার বললেন,
– আমি কি বলছি তুই শুনছিস?
– হুঁ।
– কথা না বলে একদম হাসবিনা। আমি তোর সাথে মজা করতে বা হিজিবিজি কিছু করতে আসিনি। আমি আমার ইতস্তবোধটা প্রশমন করতে আসছি শুধু।

– হুঁ। কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলে যান। আমার একটু তাড়া আছে।
– এতক্ষন কি বললাম শুনিস নাই?

– হুঁ। ওগুলো কোনো কথার পর্যায়ে পড়ে বলে আমি মনে করিনা। ইম্পর্টেন্ট কিছু বলার থাকলে বলেন আর নয়তো আসেন।
– বাহ্! কথা তো শিখেছিস ভালোই!

আমি কিছু না বলেই চোখ ঘুরিয়ে নিলাম।

– আচ্ছা শোন, তুই ভাবিস না যে আমি এখন সিনেমা বা নাটকের ডায়লগ বলবো,
” সরি,লতা! আমি শোভার হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। প্লিজ তুমি কিছু মনে কোরোনা। ”
(কো- বাংলা শুদ্ধ বানান,প্রমিত। করোনা না হয়ে তাই কো রো না)

– আচ্ছা।
– আমি সরি বলবোনা আর চাই ও না বলতে।
এইসব সরি-টরির কোনো মানেই হয়না আসলে।
আমি রেগেই বললাম,
– আমাকে জ্ঞান দেওয়া এবার বন্ধ করে কাজের কথায় আসুন। প্লিজ।
– হোয়াট!

– হ্যাঁ। আমার জন্য এটা কোনো ধরা-বাঁধা বা রুলস নয় যে নিয়ম করে যদ্দিন দেখা হবে তদ্দিন শুধু ঝগড়াঝাঁটি আর জ্ঞান আরোহণ করতে হবে বা করেই যাবো আপনার কাছ থেকে। এনাফ ইজ এনাফ!

– ওহ্। যাক, এটাই বলার ছিলো যে সরি বলে আসলে কোনো শব্দ হয়না, হওয়া উচিত না। সবকিছুর সমাধান এই ছোট একটা এক বাক্যে নিহিত থাকার কোনো মানে হয়? হয়না।
শোভার ফল্টের জন্য শোভা ক্ষমা চাইবে, ওর হয়ে আমি কেন! সরি ইট কান্ট বি। নাউ ইট’স হার গো।
এনিওয়েজ, সাহিত্যিক মানুষের সাথে তো হাত ধরে রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত আসতে পারিস আর আমি সামান্য জ্ঞান দিলেই দোষ?
তোর তো দেখছি সাহিত্যিক মানুষ বেজায় পছন্দ! তাহলে?

আমার জাস্ট বিরক্ত লাগছে। জাস্ট অসহ্য।
কিছুই বলার ইচ্ছা হচ্ছে না।

ইচ্ছা হচ্ছে ঠাঁস করে গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলি,
” এই আমি কখন হাত ধরাধরি করে রেস্টুরেন্টে আসছি? কিশোর ভাইয়ার সাথে আসছি ঠিক আছে; কিন্তু কোন পরিস্থিতে আসছি? কার জন্য এমনটা হলো? ”

ভাই আবার বেহায়ার মত বললো,
– আসলে আমি শোভাকে বলেছিলাম তোর কাছে সরি বলে অসমাপ্ত কাজটা সেরে ফেলতে কিন্তু………..
সারাক্ষন শুধু শোভা শোভা শোভা! এই একটাই নাম! আহ্, কি প্রেম! বিরক্তিকর।

আমাকে দূর থেকে কিশোর ভাই ইশারা দিলো উনার কাছে যাওয়ার জন্য।

আমি প্রান্ত ভাইয়ের মুখে এইসব শুনতে একদম ইন্টারেস্টেড না। তাই উনাকে তোয়াক্কা না করে সোজা দৌঁড়ে চলে গেলাম কিশোর ভাইয়ার কাছে।_____________
________

” তোমার কি ড্রেসটা পছন্দ হয়নি লতা? ”
কিশোর ভাই সোজা এটা বলে দিলো।
আমি কাঁচুমাঁচু করে বললাম,
– আরে না! কি বলেন! পছন্দ না হওয়ার কি আছে? আর আপনার পছন্দতো খুব সুন্দর। তা আমি জানি।
– কিভাবে জানো?
– আপনার বেশভূষায়।
– যেমন?
– এইযে এখন আপনি যে শার্টটা পরে আছেন, সাদা আর আকাশীর মিশ্রনে.. এটা কি কম নয়?
– মানে? তোমার এটা ভালো লাগছে?
– হ্যাঁ। আমার সাদা আর আকাশী কালার খুব পছন্দ।

কিশোর ভাইয়ার চোখ চকচক করছে।
মনে হচ্ছে উনি খুশিতে এখন পাঁচতালা থেকে লাফ দিবেন। অথবা পারেতো আমাকেই কোলে তুলে ফেলবেন।

আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– ভাইয়া এসব কি হচ্ছে? আমাকে প্লিজ একটু খুলে বলবেন?
– কেন? তুমি কি এখনো কিছুই জানো না?
– না।
– আরে, তোমার লিমা আপু আর মঞ্জু ভাইয়ের এনগেইজমেন্ট পার্টি আজকে। এই আরকি।
– তো এইটার জন্য আপনি সবাইকে জামা-কাপড় কিনে দিলেন কেন?

– ওহ্! আসলে আমার চাকরিটা অকল্পনীয়ভাবে প্রস্পার করেছে এবার। একটা এসাইনমেন্ট নিয়ে তুমুল খেটেছিলাম, মূলত এইজন্যই আমি বেশ কিছুদিন যাবৎ লাপাত্তা ছিলাম। এমন ও আছে যে আমি টানা ৭৬ ঘন্টা শুধু কাজ করে গেছি ল্যাপটপে। ঐ তিনদিন অফিস বন্ধ ছিলো। আমিও ভুলে গেছিলাম। যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয়নি। কাজের চাপে কিছু খেয়াল ও করিনি। শুধু একটা মিল্ক শেডের বিস্কুটের প্যাকেট আর পানিই ছিলো আমার সম্বল।

যাইহোক, আমি সফল হয়েছি। সারা বাংলাদেশে টোটাল তিনজন বিজয়ী হয়েছে। তন্মধ্য আমি দ্বিতীয়। অবশ্য বিদেশে যাওয়ার অফার পেয়েছি অন্য একটা এপ্লিকেশনের জন্য। সেটা পরে দেখা যাবে…

আমি মনে মনে বললাম,
– আল্লাহ! বিদেশ চলে যাবেন! আমিওতো এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাই। বাহ্!

ভাইয়া বলেই যাচ্ছে,

– বস খুশি হয়ে তার পাশের জায়গাটা এখন আমাকে দিয়ে দিয়েছে।
বেতনে এখন বেড়ে তিনগুন হয়ে গেছে। তাই ভাবলাম সবার জন্য কিছু আনবো তকমা বা গিফটস্বরুপ। তারপর আবার মঞ্জু ভাইয়ের মুখে শুনলাম এই সারপ্রাইজ পার্টির কথা। দুইয়ে দুইয়ে চার মিললো। মঞ্জু ভাইকে আমি অনুরোধ করলাম যেন জামা-কাপড়ের ভারটা নির্দ্বিধায় আমার উপর ছেড়ে দেয়। উনি মানলেন, শুধু আজকের জন্য। উনিও কিনে রাখছে। কিন্তু আমার অনুরোধেই..

আমি বললাম,
– ভাইয়া আপনাকে আমার একটা কথা বলার ছিলো।

– কি?

– এখন আসি।

– কোথায় যাচ্ছো? কথাটা বলে যাও।

– আরে, আপ্নারা সবাই তো ঠিকি সেজেগুজে আছেন! আর আমি! আমার অবস্থা দেখেন! বেশিক্ষন লাগবেনা। ৩০মিনিট।

– কি যেন বলার ছিলো?

– পরে এসে বলবো।
___________

প্যাকেট খুলে দেখলাম একটা চিরকুট।
সেখানে লেখা:

” কেমন হইছে এখানেই জানিয়ে দিও। আমার পছন্দ একদম ভালোনা,আমি জানি। তবুও… সত্যিটাই বলবা। সমস্যা নেই।
কিশোর। ”

ড্রেসটা পরে আসলাম।
কালারটা সাদা আর আকাশী কালারের মধ্যে।
আকাশী কালারের জমিন আর সাদা কালারের আঁচলের এক অসম্ভব বেশি সুন্দর একটি শাড়ি টাইপ লেহেঙ্গা।
চলবে..

#ফারজানা_রহমান_তৃনা

লতাকরঞ্চ (১২)

0

লতাকরঞ্চ (১২)

” আম্মা দেখেন না, ওরা সবাই চলে আসছে। আপনি তাড়াতাড়ি যান। ”
লিমা আপু কথাটা বলেই দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে।
আমিও দৌঁড়াচ্ছি। কিন্তু কেন দৌঁড়াচ্ছি তা জানিনা।

সব ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে এসব?

একজন কালো চশমা পড়া, সাদা পাঞ্জাবী পরুয়া, সাদা ধবধবে রঙের দাঁড়ি ওয়ালা লোককে দেখতে পাচ্ছি। সাথে একজন সাদা চুলওয়ালা বৃদ্ধা।

এরা কে?

কিছুক্ষন পর কেউ একজন এসে হাত ধরে তারপর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আপু, কেমন আছো?
আমি হা করে তাকিয়ে আছি!
আরে এ তো রাফা!

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
– ওমা! তুমিও এখানে?
– হ্যাঁ আপু!
– কি করো এখানে? কেন আসছো?
– আ…আমি… তো…
– তুমিতো… কি??
– কেন আপু? আমি এখানে আসায় তুমি খুশি হওনি?

উফ!
এভাবে জিজ্ঞেস করাটা একদম উচিত হয়নি।
মেয়েটার সাথে আমি সবসময় সহজ-সরল ব্যবহার করি। খুব পছন্দ করে ও আমায় , আমি যে করিনা তা না। আমিও করি। কারণ ও খুব মিশুক, ভালো আর চঞ্চল একটা মেয়ে। কিন্তু আজ মনে হয় একটু বেশিই রুড হয়ে যাচ্ছি ক্রমস!

ঢোঁক গিলে চোখ উপরে তুলে হাত নাচিয়ে নাচিয়ে নিজেকে রিলেক্স করছি আর আস্তে করে বলছি,
কুল ডাউন লতা, কুল ডাউন!

দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ধীরে,সুস্থে বললাম,
– সরি ডিয়ার! আসলে, আমি গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছি। তাই মাথাটা ঠিক নেই।
তারপর আবার বললাম,
– ওকে! একটু ক্লিয়ার করে বলোতো কেন আসছো এখানে? এটা জানা আমার জন্য খুব জরুরি। প্লিজ সবটা বলো।

রাফা হেসে হেসে বললো,
– জানিনা আমি আপু। আমাকে শুধু বলা হইছে রেডি হয়ে আসতে, তোমাদের বাড়ির ইনভাইটেশন আছে। আমি রেডি হলাম, আসলাম। ব্যস! এসে দেখি বাসা না,এটা রেস্টুরেন্ট! আর কিছুই জানিনা আপু!

আমি খুব বিরক্ত হলাম।
মেয়েটা কোনো কাজেই আসলোনা। ধুর!
_____________
________

কিছুক্ষন পর আরো চারজন আসলো।

তন্মধ্য একজন চুল ছেড়ে দিয়ে সামনের দিকটা ফুলিয়ে রাখছে জিরাফের গলার মত করে(উদাহরণস্বরুপ-পাহাড়) ,
লম্বা লম্বা কাশ্মিরী দুল দিয়ে, ভ্রুগুলো সুতার মত চিকন করে প্ল্যাক করে, ঠোঁটে টাটকা লাল লিপস্টিক দিয়ে…

এককথায় ডাইনীর মত সেজে আসছে। শাড়িটাও একদম টিস্যু টাইপ, আর ব্রাইট কাজ করা, কাজগুলোই দাম বহন করে। পাথরের, স্ট্রিমার টাইপ একদম মিহি সুতার কাজ।

তার পাশেই শোভা আপুকে দেখতে পেয়ে সুনিশ্চিত হলাম যে মাকা বেটি হে ইয়ে।

যেমন মা, তেমন তার সন্তান।

একজন ভদ্র লোককে দেখলাম সাথে। একজন মাইকেল কেও দেখলাম। মাইকেলটাকে চেনা চেনা লাগতেছে। কোথায় যেন আগে ‘দেখছি দেখছি বলে মনে হচ্ছে। উনারা টোটাল চারজন।
নির্ঘাত এরা শোভা আপুর ফ্যামিলি।

একদম তাই! আমার ধারণাটাই ঠিক!
শোভা আপু দৌঁড়ে এসে আম্মাকে বললো,
– আন্টি, এইযে আমার মাম্মাম আর ডেড আর ছোট ভাইটা আসছে।

ছোট ভাইটা যে কে…
ছেলেটা আমার দিকে তাকাচ্ছেই না।
কিন্তু আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে।
খুব চেনা মুখ!
কে এইটা!
_____________
________

মঞ্জু ভাইকে একটু আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে আজ।

ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ঘোলাটে।
কিছুক্ষন পর আমাদের বলা হলো ভেতরের রুমে যেতে। গেলাম।
তারপর বললো লিপ্টে করে পাঁচতালায় যেতে।
আসলাম। তারপর বলা হলো, পর্দা সরিয়ে ভিতরে যেতে। গেলাম।
এই গেলাম-আসলাম-গেলামই করতেছি সেই কখন থেকে! কিন্তু…

পর্দা সরিয়েই,

ওয়াও!

কি সুন্দর ডেকোরেশন!
মঞ্জু ভাইয়ের কাজ।
ডাক্তার মানুষ, বাবার আলালের ঘরের দুলাল।
কিশোর ভাইও হেল্প করেছে কিছু।
প্রান্তিক ভাইয়ের নাকি পকেট খালি তাই দিতে পারেনি।

রেস্টুরেন্টের শেয়ারে আছে মঞ্জু ভাইয়ার আব্বা। তাই এত সময় অপচয়ের পর ও কোনো বাধা-বিপত্তি বা সমস্যা হয়নি।

দোতালায় রেস্টুরেন্ট।
পাঁচতালায় আবার কমিউনিটি সেন্টারের শেয়ারে আছে মঞ্জু ভাইয়ারা। ওটা শেয়ার না, মূলত উনারাই মালিক, নামমাত্র কেউ কেউ ইনভলভ হয়েছিলো। মঞ্জু ভাইয়ার বাবা সেকালের ইঞ্জিনিয়ার। টাকা-পয়সার অভাব নেই মাশাল্লাহ্!
তবুও জেঠা, কাকা, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইদের জড়াতে হয়েছে। আরো নানান সাংসারিক ঝামেলা..

যাক গে,
কমিউনিটি সেন্টারের একটা রুমে ডেকোরেশন করার ব্যবস্থা করেছিলো মঞ্জু ভাই, হাতে হাত রেখে হেল্প প্লাস সব একুরেটলি চয়েস করা, হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি..
সবই কিশোর ভাই করেছে।
___________

লিমা আপুকে অনেকক্ষন দেখিনা।
বুঝলাম না।

মঞ্জু ভাই না হয় লিমা আপুর জন্য এত সব আয়োজন করেছে। কিন্তু কিশোর ভাই কেন সবাইকে জামা-কাপড় কিনে দিতে গেলো?
আমি চেয়ার টেনে ধঁপাস করে বসে পড়লাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
– আল্লাহ, আমাকে কেউ কিছুই বলতেছেনা! কেন?
কি হচ্ছে আর কি হতে চলেছে? কিছুই বুঝতেছিনা!

কিছুক্ষন পর…

আব্বা এসে চোখ গরম করে বললো,
– তোর কানে কি কথা যায়না নাকি?
আমি কি ফকির? কি পরে আছিস এসব? যা বলতেছি। বলদ।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।

ভাবতেছি,
– বাহ্! প্রান্ত ভাই ও বলদ বলে, আব্বাও। প্রান্ত ভাইও রাগারাগি করে, আব্বাও! দুজনের কি মিল।

দুচোখ আশেপাশে ঘুরাচ্ছি। কাকে দেখা যায়, কে কি করছে…দেখার জন্যই এদিক-সেদিক চোখ ঘুরাচ্ছি।

হঠাৎ আবিষ্কার করলাম,
প্রান্ত ভাই দূর থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে তার কালো ভাব ছেঁয়ে আছে।

কি হলো ব্যাপারটা!
তবে কি এখনি বৃষ্টি নামবে?
ঐ বৃষ্টির নামই কি “হঠাৎ বৃষ্টি” বলে কিছু একটা হয়?

চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

লতাকরঞ্চ (১১)

0

লতাকরঞ্চ (১১)

কিশোর ভাই উদ্যত হয়ে শোভা আপুকে বললো,
– স্কাউনড্রেল। ভুল হতেই পারে। তারজন্য এরকম একটা বিহেভিয়র আশা করা যায়না! এত বড় সাহস হয় কি করে তোমার?

প্রান্তিক ভাই বললো,
– শোভা তুমি এটা ঠিক করোনি। সামান্যই তো!
আমি চোখ উপরে তুলে একবার আড়চোখে সেই হৃষ্টপুষ্ট যুবকটাকে দেখে নিলাম।

কিশোর ভাই আমাকে বললো,
– চলো আমরা অন্য রেস্টুরেন্টে যাবো। এর চেয়েও ভালো, ফার্স্ট ক্লাস কোনো রেস্টুরেন্টে যাবো। দেখা যাক, কার দৌঁড় কতদূর।
আমি মিনতি করে বললাম,
– না ভাইয়া। আমাকে বাড়িতেই নিয়ে চলেন। আমি বাড়িতে যাবো। প্লিজ।
– না। তুমি যাবা। দ্যটস ফাইনাল।
– দোহাই আপনার। আসলে আমার সাথে এসব যায়না। তাছাড়া আমার এসব বড়লোকি কাজ-কারবার ভালোও লাগেনা। সরি। আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলেন ভাইয়া। বিনিময়ে আপনার একটা চাওয়া পূর্ণ করবো।

খুশিতে ভাইয়ার চোখ চকচক করছে! মনে হচ্ছে এইমাত্র বুঝি কোটি টাকার লটারি জিতেছে এই মানুষ! মুখে হাসি রেখেই বললো,
– সত্যি?
– হুঁ।
– আচ্ছা, আমার সেই একটা চাওয়া হচ্ছে…
তুমি আমার সাথে যাবা। ব্যস।
____________
________

কিশোর ভাই আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
আমি একবার তাকিয়ে দেখলাম প্রান্ত ভাই এখনো বিজি উনার নষ্ট হয়ে যাওয়া সেই শার্ট নিয়ে।
শোভা আপু খাচ্ছে আর ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি রেখে, ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে অদৃশ্যভাবেই আমাকে বলছে,
– কি, কেমন দিলাম?

আমি চলে গেলাম।
অন্য রেস্টুরেন্টে যাবো।
কিশোর ভাইয়ের আবদার বলে কথা!
গাড়িতে যাচ্ছি। আমদের বাড়ি শহরতলী থেকে বেশি দূরে নয়।

ফোনের রিংটোন হচ্ছে। কিশোর ভাই বললো,
ফোন তুলতে হবেনা। আমি যাদের যাদের জানানোর সবাইকেই জানিয়ে দিয়েছি। এখন খামোখা অন্য কেউ বিরক্ত করবে; তুমিও উল্টাপাল্টা বলে বসবা। কারণ মাথা গরম আছে।
আজতো ৬-০২-২০।
আমি বললাম, হুঁ।

ভাইয়া বললো,
– সামনে তো ভ্যালেন্টাইন ডে আসছে। কোনো প্ল্যান আছে?
– কিসের প্ল্যান?
– প্রান্তকে নিয়ে।
সারা পথ আর ফিরেও তাকালাম না। চুপচাপ পাড়ি দিলাম সারাপথ।
উনি কি বুঝাতে চাইলেন জানিনা। তবে মনে হচ্ছে প্রান্ত ভাইকে নিয়ে যে আমি ভিতরে ভিতরে জ্বলে-পুড়ে যাই এটা হয়তো উনি ধরতে পারছে।
লজ্জ্বার আর অন্ত-শেষ রইলোনা।

•°•

আমি প্ল্যান করে রেখেছি।
এই কথা বলার জন্য আমি তাকে চরম শাস্তি দিবো। কিছুই খাবোনা। এক-দু চামচ চেখে রেখে দিবো। শুধু স্বাদ নিরূপণের জন্য একটু..
তাছাড়া দরকার নেই আমার।
রেস্টুরেন্টে পৌঁছে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম!
কি মুশকিল!

সেখানে আব্বা, আম্মা, লিমা আপু, ফুফু,ফুফা,কালুসহ সবাই উপস্থিত!
ব্যাপার কি?
এরা এখানে কি করে আর কেনই বা আসছে?
______________
__________

ওদিকে প্রান্ত ভাইকেও দেখা যাচ্ছে।
লাল শার্ট ছেড়ে এখন হালকা বেগুনী কালারের শার্ট পড়েছে। শোভা আপুকে দেখা যাচ্ছেনা। কোথায় আছে এই ঢাকাইয়্যা,ফ্যাশনাবল নারী তা আমার বোধগম্য নয়। তবে প্রান্ত ভাইয়ের আশেপাশে নেই.. অলৌকিক দৃশ্য!
প্রান্ত ভাইতো এক-কথায় চোখে হারায় ঐ মেয়েটাকে।

আমি কিশোর ভাইয়ের দিকে তাকালাম একবার।
উনি মৃদ্যু হেসেই যাচ্ছে।
•°•
লিমা আপুর কাছে গেলাম।
জিজ্ঞেস করলাম,
– আপু কি হচ্ছে এখানে? তোরা এখানে আসবি আমাকে আগে বলিসনি কেন?

আপু হেসে দিলো।
আমার প্রচন্ড রাগ হলো।
আমি সিরিয়াস একটা কথা জিজ্ঞেস করলাম আর ও কথাটাকে ফেলনা মনে করে ইগ্নোর করলো!
তারপর আমি মজা নিয়ে বললাম,
– কিরে, তোর আর মঞ্জু ভাইয়ের এনগেইজমেন্ট বুঝি এখানেই হবে?

আম্মা উঠে এসে তাড়াতাড়ি বললো,
– এই নে লিমা। যা এটা গিয়ে লতাকে পরিয়ে আন। তাড়াতাড়ি করিস।

আমি বুঝতেছিনা এসব কি হচ্ছে!

আমি যেটা পরে আছি ওটায় কি অসুবিধা?
আর রেস্টুরেন্টেই কেন আমার ড্রেস চেইঞ্জ করতে হবে!

সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি ড্রেস চেইঞ্জ করবোনা মানে করবোনা। ব্যস!

কিশোর ভাই এসে বললো,
– থাক না লিমা। ও যখন চাচ্ছেনা তখন ঠিক আছে। বাদ দাও। ও এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দর। এমন সাদামাটা সৌন্দর্য আজকাল পাওয়া দূর্লভ।
এই বলে উনি গিয়ে আব্বার পাশে বসলেন।
লিমা আপু ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে মুখে ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে বললো,
– কিরে?

আমি লিমা আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
– ড্রেসটা কে দিয়েছে রে?
আপু বললো,
– কে আবার! কিশোর।
আমি হা করে বললাম,
– কি!!!
আপু বললো,
– মুখ বন্ধ কর! শুধু তোকে না, বাড়ির সবাইকেই দিয়েছে। এত আশ্চার্যান্বিত হওয়ার কি আছে, হুম?
আমি লজ্জ্বা পেয়ে গেলাম।
জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা, নতুন জামা পরে খেতে আসছোস সবাই। তাহলে খাচ্ছিস না কেন? আর খাবারই বা কই?

আপুর চোখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে কোনো খুশির সংবাদ আছে।

আপু আম্মাকে খুব উত্তেজিত হয়ে বলতেছে,
-আম্মা দেখেন, দেখেন! ওরা চলে আসছে!

আমি লিমা আপুকে টান দিয়ে নিয়ে আসলাম আমার কাছে।
আপু স্লিপ কেটে পড়ে গেলো!
মঞ্জু ভাই দৌঁড়ে এসে খানিক বিরক্তি নিয়ে বললো,
– লতা! এখনো বাচ্চাই আছো!
এই বলে আপুকে উঠিয়ে নিলো ভাইয়া!

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
” আহ্! কি প্রেম! ”
পিছন থেকে কোথা থেকে যেন প্রান্ত ভাই এসে বললো,
” আহ্! কি ভালোবাসা! ”
চলবে..

( নতুন জায়গায়,নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে একটু হিমসিম খাচ্ছি যদিও; তবুও আপনাদের ভালোবাসার #লতাকরঞ্চ কে বাঁচিয়ে রাখছি জাঁকজমকপূর্ণভাবে! বাই দ্য ওয়ে, কালকে কারা কারা বইমেলায় যাচ্ছেন?)

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

লতাকরঞ্চ (১০)

0

লতাকরঞ্চ (১০)

সকালে উঠে দেখলাম ফুফু ঘোমড়া মুখ করে বসে আছে। ব্যাপারটা কি তা আন্দাজ করার জন্য আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম। আম্মা বললেন আব্বার সাথে নাকি ফুফুর কিসব কথা কাটাকাটি হয়েছে সেজন্য সকালে। তাই সকাল থেকে দানাপানিটাও মুখে না তুলে এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে আছে ফুফু। ফুফা ব্যবসার কাজে প্রতি সপ্তাহে দুবার করে রাজশাহী যান। আজ ও গিয়েছে। প্রান্তিক ভাই ও বাড়িতে নেই, বন্ধু- বান্ধব নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে।
শোভা আপুও বাসায় গিয়েছে নিজ কর্মে।

আমি আম্মাকে বললাম,
– আব্বা সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। ফুফু এখনি কি এমন গুরুতর কথা বলে যে আব্বা রেগে গিয়ে তাকে কথা শোনাবে? আর আপনিই বা থাকেন কোথায়? আব্বার এখন এগুলো সব মানা জানেন না? উত্তেজিত হওয়া, জোরে কথাবার্তা বলা পুরোপুরিভাবে নিষেধ।

আম্মা তরকারি রান্না করছে। নারকেল দিয়ে মাছের ঝোল। বললেন,
– জানিনা রে। তোর আব্বা আর তোর ফুফুর যে মাঝেমাঝে কি নিয়ে এত ঝামেলা হয়… সত্যিই জানিনা। আমাকে বলেনাতো তোর আব্বা,জানবো কি করে? আর কিছু জিনিস জানি যেগুলো তোকে বলা নিষেধ।

আমি জানতাম আমাকে বলা নিষেধই হবে। কারণ আমি ছোট মেয়ে না? তাই আমার জন্য সব না না আর না! আম্মাকে রেগে মেগে বললাম,
– ধেৎ! কিছুই জানতে চাইবো না আর।
এই বলে চলে আসলাম।

বারান্দায় চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম।
চেয়ার টেনে বসবো তখনি দেখলাম লিমা আপু ফোন কানে দিয়ে উদাসভঙ্গীতে কথা বলছে।
আমি তাড়াতাড়ি চা নিয়ে আবার চলে এলাম নিজ রুমে।

এসে দেখি শোভা আপু বসে আছে আমার রুমে।
আমি তোয়াক্কা না করে হুমায়ূন আহমেদের “কে কথা কয়” বইটা হাতে নিয়ে আবার রুম ছাড়তে যাচ্ছিলাম। তখন শোভা আপু বললো,
– এই লতা! দাঁড়াও তো! শুনো, আজকে প্রান্তিক না আমাকে ট্রিট দিবে! উফ! আমি খুব এক্সাইটেড!
আমি বললাম,
– হুঁ।
– আবার হুঁ?
– না, কেন?
– আজ আমার জন্মদিন তাই! সকালে বাড়িতে গিয়েছিলাম একটু আগে আসলাম। আর আমার মাম্মামকেও তোমার আব্বা দাওয়াত করেছে বিয়েতে। জানো? ইনভাইটেশন কার্ড দিয়ে আসলাম।
– হুঁ।
– আচ্ছা শোন, আজকে বিকেলে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি।
– হুঁ।
– বার বার হুঁ হুঁ করবা না তো। হুমায়ূনের বই পড়ে পড়ে একদম হুমায়ূনই তৈরী হচ্ছো দিনকে দিন।
যাক গে, প্রশ্ন হচ্ছে তুমি যাবা?
– না আপু।
– কেন?
– কাজ আছে। আমি যাচ্ছি।
– তুমি তো বড় স্বার্থপর মেয়ে হইছো! একাই চা খাচ্ছো, আমাকে একটা অফারতো এট-লিস্ট করতে পারতা নাকি!
– সরি। আমি আপনার জন্য নিয়ে আসছি,ওয়েট।
উনি হাসি দিয়ে বললেন,
– না। দাঁড়াও দাঁড়াও! আমি তোমার মত অত চা-টা খাইনা। স্কিন প্রব্লেম করে তো তাই।

আমি আবার হুঁ বললাম।
উনি নোটিস করেছে কিনা জানিনা। তবে এক প্রকার চাপিয়ে দিয়েই বললো,
– তুমি ড্রেস-আপ নিয়ে রেডি থাকবা। আমরা একসাথেই বেরোবো। কিশোর যখন আছে কিশোর ও যাবে। ওকেও বলবা রেডি হয়ে থাকতে। কেমন?
______________
__________

আমরা এখন বসে আছি একটা রেস্টুরেন্টে। বাংলাদেশে মেবি হেপ্টা স্টার হোটেলটা নেই নয়তো ওখানেই হয়তো নিয়ে যেত প্রান্ত ভাই উনার জীবনান্তকে। হালকা নীলাভাব আলো আর সামান্য ফ্যাকাসে অন্ধকার ভাবটা আমার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে। কি অসহ্যকর! দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একদম। এত নিরিবিলি জায়গা…
আমাদের বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটাও এর থেকে অনেক ভালো।

খাবার দিলো।
চাইনিজ আর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে চিকেন দিয়ে কি কি যেন রান্না করে আনছে। কাঁচা মাংশই মনে হচ্ছে লবণ, হলুদ ছাড়া কষিয়ে সুন্দরমত কয়েকটা টমেটো, ধনে পাতা, পেঁয়াজ কলি দিয়ে সাজিয়ে উপরে সস দিয়ে সার্ভ করে নিয়ে এনেছে এরা!
বাহ্! সুন্দর!
আমি কাটা চামচ দিয়ে খেতে পারিনা।
হাত দিয়েই খাওয়া পড়েনা তেমন। কোনোদিন আম্মা খাওয়ায় তো কোনোদিন আব্বা।

সামনে বসে আছে কিশোর ভাই, তার পাশে প্রান্তিক ভাই। আর আমার পাশে বসে আছেন মহারাণী ভিক্টোরিয়া ওরফে শোভা আপু।

আমি চামচ বসাতেই মুরগীর একটা পিস উড়ে চলে গেলো প্রান্ত ভাইয়ার পকেটে!

ছি:! ছি:! ছি:! লজ্জ্বায় তো আমার মাথা হেট!
মুরগীটা পকেটে যাওয়ার আগে ভাইয়ার শার্টের কিছু অংশে বিচ্ছিরি কালার লেপ্টে দিয়ে গিয়েছে।
ভাই হাউমাউ করে কেঁদেই দিচ্ছিলো কারণ ওটা উনার ব্রেন্ডের শার্ট!

প্রান্ত ভাইয়া রক্তচক্ষু নিয়েও ফিসফিস করে বললো,
– ঐ বলদ! এটা কি করলি? তুই কি গাঁধা নাকি?
এই বলে হাপিত্যেশ জুড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
হায় আল্লাহ! এখন কি হবে! এটাতো আমার…

হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখলাম আমার প্লেটে কেউ পানি ঢেলে দিচ্ছে। চোখ নিচে নামিয়ে দেখলাম হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই!
শোভা আপু আমার প্লেটে পানি ঢেলে দিয়েছে।
কেন?
আমি কেন এই গর্হিত কাজটা করলাম। কেন প্রান্ত ভাইয়ার ইমেজটা নষ্ট করেছি তাই আমার এখন খাওয়া বারণ।

প্রান্ত ভাই শোভা আপুকে বলছে,
– এই, কি হলো এটা? এটা কি করলা? কেন করলা?

শোভা আপু স্ট্রেইটলি বলে দিলো,
– তুমি চুপ থাকো। যা করছি ঠিক করছি।
একটা সাবস্ট্যান্ডারড মেয়ে। রেস্টুরেন্টে ঠিকমত খেতে পর্যন্ত পারেনা। এ নাকি আবার.. যাও, গেট লস্ট। তোমার খেতে হবেনা। স্টুপিড কোথাকার।

আসলে সদ্য প্রান্ত ভাইয়ার যে শার্টটা আমি নষ্ট করলাম সেটা উনারই(শোভা আপুর) দেওয়া। গিফট করেছিলো উনি। কে জানে হয়তো শোভা আপুর গায়ের এই দামী ওয়েস্টার্ন লং স্কার্টটাও প্রান্ত ভাইয়ের দেওয়া।
হতেই পারে, অসম্ভব কিছু না।

আমি এই অপমান দেখে চুপসে আছি একদম।
তখন প্রায় রাত ঘনিয়ে আসছে।
শোভা আপু চলে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে।
আমি যে অপমান গায়ে মেখে চলে যাবো মুখ ভেঙচিয়ে, তার সুযোগ ও নেই। কারণ আমি একদম কিচ্ছু চিনিনা।

কেউ একজনকে তো লাগবে।
তাছাড়া হুটহাট কোনো অপ্রীতিকর ডিসিশন আমি কখনোই নেই না। আমার ধৈর্য্য আর আস্তে আস্তে ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতাটা অনেকের নিকটই ঈর্ষণীয়।

আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে ধুমধাম মেরে দিয়েই চলে যেত। কিন্তু আমি আস্তে করে মিনিয়েমিনিয়ে বললাম,
– এত রাতে একা একা কিভাবে যাবো? আপনারা সবাই খান, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। তাছাড়া এখান থেকে আমি বাড়িও চিনি না।

শোভা আপু বললেন
– প্লিজ! ডু দ্যট।
আমি উঠে পড়লাম।
সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আপুর পানি ঢালার দৃশ্যটা সবাই_ই দেখেছে। সবার দৃষ্টি এখন সার্কাসের জোকারে দিকে। মানে আমি, আমার দিকে।

খাওয়াটা যে পন্ড হলো এতে আমার বিন্দুমাত্র ও আক্ষেপ নেই কারণ খাবারটা এক কথায় জঘণ্য ছিলো। ভালোই হইছে এক হিসেবে। এই অখাদ্য-কুখাদ্য তো আর আমায় খেতে হলোনা!কিন্তু অপমানটা বেশিই হয়ে গেছে একদম।

কিশোর ভাই শোভা আপুকে বললো,
– এক্সকিউজ মি মিস শোভা। আপনি বোধ হয় খুব অহংকারী তাইনা?
শোভা আপু হা করে তাকিয়ে আছে।
কিশোর ভাই বললো,
– ভদ্রতা বলে একটা জিনিস হয়। জানেন সেটা কি?

চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

লতাকরঞ্চ (৯)

0

লতাকরঞ্চ (৯)

কিশোর ভাই এসে বললো,
– লতা, প্রান্তিক.. আন্টি সুস্থ আছেন আল্লাহর রহমতে। দেখে আসো যাও।
প্রান্তিক ভাই আমার কাছে এসে একবার না পারতে বললো,
– চল লতা।
কিশোর ভাই হাতের আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে ঠোঁট, নাকে হাত দিয়ে ঘষলো।

আমার হাত-পা অসার হয়ে গিয়েছে। কেমন যে লাগতেছে বলতেও পারতেছিনা কাউকে। মনে হচ্ছে এখনি যদি উঠে দাঁড়াই তাহলে ধঁপাস করে হয়তো পড়ে যাবো।
প্রান্তিক ভাই আমাকে কথাটা বলে নিজেই চলে গেলো। আমাকে যে একটু ধরে উঠাবে, নিয়ে যাবে…না..

কিশোর ভাই ও লিমা আপু, ফুফা, ফুফুর সাথে চলে গেলো। আমি উত্তেজিত, অসম্ভব বেশি খুশি। কিন্তু দৌঁড়ে যে চলে যাবো সেই শক্তিটুকু ও নেই দেহে।

খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।
উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো।
পড়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি দেখলাম কারো হাত আমার কোমরে এসে পড়েছে।
কিশোর ভাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
আমিও বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছি।
সিনেমায় যখন এই সিনটা আসে যে নায়িকা পড়ে যায়, নায়ক এসে পিছন থেকে ধরে.. আমি এটা নিয়ে সবসময় ব্যাঙ্গ করতাম আর হাসতাম এই বলে যে হাউ ক্যান ইট বি পসিবল.. আর এখন সেই ব্যাঙ্গমী আমার জীবনেও ঘটে গেলো।

কিশোর ভাই বললো,
– তোমার অবস্থা খুব খারাপ লতা। খুব দূর্বল তুমি। তোমাকে কিছু খেতে হবে। আগে আন্টিকে দেখে আসো তারপর আমি ব্যবস্থা করতেছি।
আমি কিছুই বললাম না।
কেবিনে ঢুকলাম কিশোর ভাইয়ার হাত ধরে।
মঞ্জু ভাই ট্রিটমেন্ট করেছে আম্মার।
মঞ্জু ভাই বলতেছে,
– অতিরিক্ত মানসিক আঘাত পেয়েছে বলেই এই অবস্থা।
আর বেশিক্ষণ দেরী হলে স্ট্রোক ও হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ।
ঊনাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষন ঘুমাক।

লিমা আপু মঞ্জু ভাইকে বার বার বলতেছে,
– আম্মার যেন কিছু না হয় দেখবেন। আপনি আব্বার কাছে যান। এখনি যান।

আমি শুধু শুনে যাচ্ছি।
আমার হিতাহিত জ্ঞান নেই।
মাথা ঘুরাচ্ছে।

কিশোর ভাই আমাকে আম্মার পাশেই একটা জায়গায় এনে শুইয়ে দিয়েছে। প্রান্তিক ভাইকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। শোভা আপু আসেনি আমাদের সাথে, বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে কালুসহ। নিশ্চয়ই প্রান্তিক ভাই বাড়িতে চলে গিয়েছে শোভা আপুর একাকিত্বের সঙ্গী হওয়ার জন্য।
কিছুক্ষন পর দেখলাম, না। প্রান্তিক ভাই আবার এসে ঢুকেছে।

প্রান্তিক ভাই ফুফুকে বলতেছে,
– আম্মা আপনার শরীরের উপর আর প্রেশার দিবেন না। চলেন আমার সাথে বাড়ি চলেন। এখানকার খাবার ভালোনা, আমি আমাদের সবার জন্য খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। রাতে দিয়ে যাবে।

ফুফু বলতেছে,
– আরে, কি বলিস! কোথায় যাবো! এখানে এই অবস্থা আর আমি কিনা বাড়িতে চলে যাবো! আমার ভাই হার্ট এট্যাক করেছে, ভাবী অসুস্থ। ভাইঝিটা এভাবে নুইয়ে গিয়েছে সেখানে…
তুই বরং যা। শোভা মেয়েটা একা আছে। আবার রাতে একবার এসে দেখা করে যাস।

প্রান্তিক ভাই বললো,
– আবার আসবো মানে? আমি কি ডাক্তার নাকি? আমি এসেই বা কি করতে পারবো! আপনি যদি বলেন তাহলে আমি লতাকে নিয়ে যেতে পারি বাড়িতে। ও কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

ফুফা এসে বললো,
– হ্যাঁ ওটাই ভালো রুজিনা।(বড় ফুফুর নাম) প্রান্তিক লতাকে নিয়ে চলে যাক। এখানে আমরা কয়জনের দেখাশোনা করবো? লতা চলে গেলেই বরং ভালো হবে। প্রান্তিকের সাথে ওকে পাঠিয়ে দাও।

এই বলে লিমা আপুকে ডাক দিলো ফুফা।
লিমা আপু গেলো।
লিমা আপুকে বলা হলো আমাকে গাড়ি উগ্ধি(অবধি) পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
আপু এসে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
– কিরে লতা? বেশি খারাপ লাগতেছে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, – না।

আপু বললো,
– ফুফু, ফুফারা বলছে তোকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে। প্রান্তিকের সাথে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বলতেছে। যাবি?
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম,- না।

আপু আবার বললো,
– দেখ এখানে আমরা কয়জনের খেয়াল রাখবো বলতো? আব্বার কোনো ভালো খবর এখনো পাইনি। তাছাড়া আম্মা এত অসুস্থ। এর উপর তুই ও..

আমি লিমা আপুকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়ালাম।
আপু বুঝতে পেরে মাথা নিচে ঝোঁকালো।
আমি ঝাপ্টে ধরে বললাম,
– আপু,প্লিজ আমাকে পাঠায়ে দিস না। আমি এখানেই থাকবো। এইতো ঠিক হয়ে গিয়েছি দেখ।

পিছন থেকে প্রান্তিক ভাই এসে বললো,
– ঠিক হয়ে গিয়েছিস মানে? এত তাড়াতাড়ি ঠিক হলিটা কিভাবে? না মানে কারো হাতের স্পর্শে কি আপনা-আপনিভাবেই ঠিক হয়ে গেছিস নাকি অন্য কোনো মতলব? এই, নাকি সবই নাটক করছিস?

আমি কিছুই বলতে পারলাম না শুধু তাকিয়ে রইলাম স্থির দৃষ্টি নিয়ে। উনি কেন সবসময়ই আমার সাথে এই ব্যবহার করে?

লিমা আপু রেগে গিয়ে বললো,
– প্রান্তিক। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। এরকম ব্যবহার কেন করতেছো তুমি ওর সাথে?
ও নাটক করতেছে মানে? আরে আমাদের পরিবারের এমন একটা দুর্দশা এখন। সেখানে ও এখন এখানে বসে বসে নাটক সিনেমা করবে? না মানে তুমি এগুলো ভাবোটা কিভাবে, আমাকে বলবা প্লিজ? আর ওর শরীরের অবস্থা ওকে দেখলেই তো বুঝা যায়। নেহাত কিশোর এসে ধরেছিলো বলে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়নি। আর তুমিতো তোয়াক্কা না করেই আগে আগে চলে আসছো। বলি,বোনটা কার? কার দরদ থাকবে বেশি, তোমার না কিশোরের? আর আমিই তো কিশোরকে পরে পাঠাইছিলাম, কারণ আম্মা আমার হাত ছাড়েনা। নয়তো আমিই যেতাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর শরীর ঠিক নেই। তোমায় বলছিলাম লতার সাথে সাথে থাকার জন্য। তুমি তো বললা দরকার নেই, তোমার নাকি ভালো লাগেনা।

প্রান্তিক ভাই বললো,
– লিমা… এই হচ্ছে তোমার একটা বিকট সমস্যা। অতিরিক্ত বুঝো। আমি জানি ওর শরীর খারাপ। তাইজন্যই বলতেছিলাম ও আমার সাথে চলুক। ওখানে খালি হাতে বসে আছে শোভা,কালু। আমিও আছি। আমরা ওর দেখাশোনা করতে পারবো। তোমরা এদিকটা সামলাও।
তাছাড়া আমার ও গা ম্যাঁচম্যাঁচ করতেছে, আমার ও বিশ্রাম দরকার।

লিমা আপু বললো,
– বেশি বুঝে বসে থাকো তুমি।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এই লতা তুই কি যাবি ওর সাথে? নাকি আপুর কাছেই থাকবি?
আমি বললাম,
– যাবোনা। এখানেই থাকবো।
কিশোর ভাই এসেছে।
হালকা কিছু খাবার সাথে নিয়ে এসেছে।
আমার গলা দিয়ে এইসব খাবার এখন নামবে না তবুও জোর করে স্যুপ, গ্লুকোজ খাওয়ানোর জন্য তাগিদ দিলো কিশোর ভাইয়া -আপুকে।
বললো,
– লিমা, তুমি ওকে এগুলো জোর করে খাওয়াও। আমি আন্টিকে দেখছি।

এই বলে কিশোর ভাই আমার অসুস্থ আম্মাকে খাবারগুলো খাইয়ে দিচ্ছে। আমি একবার চোখ খুলে দৃশ্যটা উপভোগ করলাম।

দেখে খুব ভালো লাগতেছে।
আপু আমাকে খাইয়ে দিলো।
এইমধ্যে কখন যে প্রান্ত ভাইয়া লাপাত্তা হয়ে গেলো জানিনা।

কিছুক্ষন পর মঞ্জু ভাই এসে বললো,
– আব্বা আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন।

আমরা কিছুদিন আব্বার কাছেই থাকলাম।
আম্মা আল্লাহর রহমতে সুস্থ।
কিশোর ভাইকে এইমধ্যে একবার জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার কারণ কি।
উনি বললেন, সময় হোক। জানতে পারবা।
______________
_________

অত:পর বাড়িতে ফিরলাম সবাই মিলে।
বাড়িতে ফিরে দেখলাম ফুফু-ফুফা বেজায় চিন্তিত।
আব্বার এ অবস্থা তারপরেও প্রান্ত ভাই আর শোভা আপুর বিয়ের কথা তুললো।

প্রান্তিক ভাই কি এসবের কিছুই জানেনা?

লিমা আপুর বিয়ে ঘনিয়ে আসছে।
আমি মেহেদী, সাজগোজ, পিঠাপুলির দায়িত্ব নিলাম। এসব হালকা-পাতলা জানি তাইজন্য।
শোভা আপু জানিয়ে দিলো,
সে সাজগোজের ব্যাপারটা দেখবে।
আমি একবার গিয়ে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– শোভা আপুকি যাবেনা?
আম্মা বললেন,
– না। ও তো একেবারেই এ বাড়িতে চলে আসতেছে মনে হয়।

চলবে….

( আমার অন্যান্য ছোট গল্পগুলো পড়ার ইচ্ছা আছে?)

#ফারজানা_রহমান_তৃনা

লতাকরঞ্চ (৮)

0

লতাকরঞ্চ (৮)

আম্মার রুমে গিয়ে আম্মার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। টপ টপ করে চোখের জল পড়ছে। আম্মা আবার অতিরিক্ত ডিপ্রেসড একজন মানুষ তাই আম্মাকে কোনোভাবেই এই চোখের জল দেখানো যাবেনা। আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করতেছি। কিন্তু কোনো ফায়দা হলোনা। আম্মা কাঁথায় সুঁচ বসাচ্ছিলো। এই ফাঁকে কখন যে দেখে নিলো আমার চোখে জল তা জানা নেই।
– কি হলো মা? কেউ কিছু বলেছে?

আমি চোখের জল মুছে বললাম,
– না আম্মা। এমনিতেই। চোখের মধ্যে কি যেন একটা পড়েছে মনে হয়..
আম্মা বললেন,
– চশমাটা খুলছিস কেন তুই? তুই না কম দেখিস? খুলে রাখিস কেন?

আম্মা কি আর জানে যে আমি শোভা নামের মেয়েটার সাথে মনের অজান্তেই পাল্লা দিয়ে আসতেছি।
গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া চশমা পড়িইনা এখন।
কারন শোভা নামের মেয়েটা আমার চেয়েও বেশি আধুনিক; সুন্দরী ও বটে। চশমা না লাগিয়েও তো আজ কত কথা শুনায়ে দিলো উনি।
আম্মা বললেন,
– লতা?
– হুঁ।
– শোভা নামের মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
– ভালো।
– প্রান্তিকের সাথে কেন আসছে এ বাড়িতে, এ ব্যাপারে কিছু জানিস? প্রান্তিক কিছু বলেছে তোকে?
– না।

– তোর বড় ফুফুতো এই মেয়েটাকে বউ করে আনার ফন্দি আঁটতেছে… জানিস?

আম্মা আরো বললেন,
-অবশ্য মেয়েটা খারাপ না।
এখনকার যুগে এরকমই হয়, ঢাকাইয়্যা তো..
তোর আব্বার কিন্তু পছন্দ হয়নি, জানিস?
তোর বড় ফুফু চাইতেছে লিমার বিয়ের সাথে সাথে প্রান্তিকের বিয়েটা ও সেরে নিতে। কিন্তু প্রান্তিক কিছুই বলছেনা। গাঁধা তো তাই। ঐ মেয়েকে কেন এ বাড়িতে নিয়ে আসছে, তা কি আমরা বুঝিনা নাকি! আমরাতো কচি খুকি না।
নিশ্চয়ই দুজন-দুজনকে পছন্দ করে, তাই ঐ মেয়েটাকে একদম বাড়িতে পর্যন্ত নিয়ে আসছে। কই এতদিন তো কাউকে আনেনি!
কিরে কথা বলছিস না যে?

আমি বাকরুদ্ধ।
অবিশ্বাস্যরকমভাবে কোনো কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে।
আম্মা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
– তোরা কেউই কি আমাকে সময় দিতে পারিস না? যার সাথেই একটু কথা বলি, সেই এরকম অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। ওদিকে তোর আব্বাকে দেখ! উনিতো সারাবাড়িতে হৈ চৈ শুরু করে দিয়ে; সব মাথায় তুলে নিয়েছে এই এক বিয়ে-বিয়ে করে। আর লিমাতো এখনো ঘুম থেকেই উঠতে পারলোনা।

আমি বললাম,
– হুঁ। যা ইচ্ছা বলেন শুধু প্রান্তিক ভাইকে নিয়ে কিছু বলবেন না।
আম্মা বললো,
– কেন? তোর কি সমস্যা?
– ভালো লাগেনা তাই।

আম্মা অপ্রতিভ কিউরিসিটি নিয়ে বললো,
– হ্যাঁ রে লতা? একটা কথা বলি…
– হুঁ।
– তোর কিশোরকে কেমন লাগে, মা? ছেলেটা খুব ভালো.. তোর আব্বার ও ভীষণ পছন্দ হয়। আমারতো হয়ই।
আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম,
– তো?
আম্মা অস্বাভাবিকভাবে বললেন,
– বিয়ে করবি ছেলেটাকে?

আমি কিছু বললাম না।
আম্মা তাড়া দিচ্ছে।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি শুনলাম বাইরের রুম থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ ভেসে আসতেছে।

দৌঁড়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু আম্মার কোমরে ব্যাথা, খাট থেকে নামতে কষ্ট হয় তাই আম্মাকে নিয়েই এলাম। পাশের রুমেই অনেক মানু্ষের ভীড়। প্রান্ত ভাই ও আছে। কি হয়েছে?

তাড়াতাড়ি করে হট্টগোল ছাড়িয়ে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো আমার।
আব্বা হা করে, চোখ খোলা রেখে একদম সটান হয়ে শুয়ে আছে!
বমি করতেছে কিছুক্ষন পর পর।
সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে বার বার। মনে হয় যেন এইমাত্র কেউ পানি ঢেলে দিয়ে গিয়েছে। এদিকে মুছতেছে আবার সেই একিরকমভাবে ঘেমে ভিজে যাচ্ছে।
_____________
________

আব্বার হার্ট-এট্যাক হয়েছে।
বড় ফুফা তড়িঘড়ি করে এম্বুলেন্স খবর দিয়েছে।
হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আব্বাকে।
এম্বুলেন্সে আব্বার পাশেই আমি বসেছিলাম।
আব্বার খুব কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারতেছি।

আম্মার অবস্থা ও ভালো না।
কথা ও বলেনা, কাঁদে ও না।
চুপচাপ তাকিয়ে আছে শুধু, দৃষ্টি স্থির করে।
কিন্তু আম্মাকে নিয়ে পড়ে থাকার সময় এখন কারোরই নেই। বাড়িতে আমরা অল্প ক’জন
মানুষ। সবাই পড়ে আছি আব্বাকে নিয়ে।

আমি সেদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম যে আমি আব্বার খুব প্রিয়। আম্মার হাত, লিমা আপুর হাত কারোটাই ধরেনি।
শুধু বুকের ব্যাথাটা মারাত্বক হয়ে উঠলে আমার হাতটা ঝাপটে ধরে।
এত শক্ত করে চেপে ধরে যে আমার কষ্ট হয়ে যায়…ব্যাথা পেয়ে যাই।

আব্বা অক্সিজেন মাস্ক নাক থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
– মা, আ_আ_আমিতো তোদের কিছু করে দিয়ে যেতে পারলাম নারে, মা…
আমি মাস্কটা ঠিক করে দিলাম আর বললাম,
– সব ঠিক আছে আব্বা। আপনি এত চিন্তা কইরেন না।
আমার সারা শরীর শুধু কাঁপতেছে।
ভীষণ ভালোবাসি এই মানুষটাকে।

•°•

দুই-দুইটা মেয়েকে সম্প্রদান না করেই একজন বাবার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা যে কতটা কষ্টের হতে পারে; তা কেবল ঐ বাবারাই বলতে পারবে, যারা অসময়ে চলে গিয়েছে বা যায়..

আব্বা আবার শ্বাসকষ্ট নিয়েই মাস্ক খুলে বললেন,
– একটা কথা রাখবি?
আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
– আপনার সব কথাই তথাস্থ আব্বা। আগে শুধু আপনি সুস্থ হয়ে উঠেন।
আব্বা আবার বললেন,
– রাখবি?
আমি বললামা,
– হ্যাঁ হ্যাঁ।

আব্বা শান্ত হয়ে আটকে আটকে বললেন,
– কিশোরকে আমি তোর পাশে দেখতে চাই মা।

কথাটা ভালো করে খেয়ালই করলাম না।
তাড়াহুড়োর মধ্যে বলে দিলাম,
– আব্বা আপনি যা চাইবেন, তাই হবে। এখন আপনাকে আল্লাহর দোহাই আপনি অক্সিজেন মাস্কটা আর খুইলেন না।
আব্বা খুশি হয়ে গিয়েছে।
চোখে জল এসে গিয়েছে সে খুশিতে।

কিছুক্ষন পর মাথায় এলো।
হায় আল্লাহ!
আমি এটা কি বলে ফেললাম!

আব্বাকে হসপিটালে ভর্তি করানোর পর দেখলাম আম্মা কেন জানিনা কোনো কথা বলতেছেনা..
কোনো সাড়া- শব্দ ও নেই।
আমি আম্মাকে ঝাঁকানি দিয়ে বললাম,
– আম্মা, আম্মা? কথা বলেন না কেন?
আম্মার কোনো সাড়া -শব্দ নেই।

প্রান্ত ভাই এই-সেই বলে কিন্তু আমি ভ্রুক্ষেপই করলাম না। ঐ লোকটার সাথে সকল দেনাপাওনা চুকে গিয়েছে আমার। সহ্যই হচ্ছেনা তাকে এই মুহূর্তে।

হঠাৎ কিশোর ভাইয়ের কন্ঠ পেলাম!
উনি এসে আমায় বললো,
– তুমি এখানে বসো শান্ত হয়ে। আমি আন্টিকে দেখতেছি।

কিশোর ভাই খবর পেয়েই চলে এসেছে।
এসেই আমার কাছে চলে এসেছে।
আমার সারা দুনিয়া অন্ধকার লাগতেছে।
আব্বাকে ভর্তি করিয়ে এসে দেখি আম্মা অসার হয়ে গিয়েছেন।

কিশোর ভাই আর প্রান্ত ভাই মিলে আম্মাকে কেবিনে নিয়ে গেলেন।

চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা

লতাকরঞ্চ (৭)

0

লতাকরঞ্চ (৭)

” এক্সকিউজ মি! আমি যদি ভুল না করি তাহলে তুমিই লতা,তাইনা? ”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। ছাদে,বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া আর গুনগুনিয়ে গান গাওয়া আমার আঁতাত বলতে গেলে। কিন্তু এই মেয়েলী কণ্ঠ কোথা থেকে ভেসে আসলো তা দেখার জন্য পিছনে তাকাতেই আবিষ্কার করলাম বিদঘুটে সেই অসহ্য নারী, শোভাকে। মেয়েটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম,
– জ্বী। আমিই লতা। ভালো আছেন?
— ভালো। তুমি আমাকে চিনো?
– হুঁ।
— কিভাবে?
– বলতে ইচ্ছা করতেছেনা। চিনি, ব্যস এতটুকু জেনেই খুশি থাকেন। চা খাবেন?
চা খাওয়ার অফারটা মন থেকে করার একদমই ইচ্ছা ছিলো না। তবু ও যে কেন করলাম…
ইচ্ছা করতেছে বারান্দার গ্রিলগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।

উনি বললেন,
– এইতো চা। তোমার প্রান্তিক ভাই এনে দিয়েছে।
কথাটা শুনে এবার কানের পাশের মাছিদের ভনভন আওয়াজটা আরো দৃঢ় হলো।
আমি কিছুই বললাম না শুধু বললাম,
– হুঁ।
চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই চা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে শোভা আপু।

শোভা আপু বললো,
– এই তুমি এত নীরস কেন? তখন থেকে আমিই বকবকিয়ে যাচ্ছি। আর এই হুঁ,হ্যাঁ ছাড়া কি আর কোনো কথা বলতে পারোনা নাকি? প্রান্তিক তো বলছে তুমি নাকি সেই ছটফটে মেয়ে। ইঁচড়েপাকা নাকি। কিন্তু আমি তার কোনো লক্ষণই দেখতেছিনা।
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।
আস্তে করে হুঁ বলতে গিয়েও বললাম না।

উনি আবার বললো,
– এই শোনো একটু মর্ডান হও বুঝছো? আর সেন্টার সিঁতা দিয়ে বিণুনি করে রাখছো কেন? গ্রাম্য কালচার। থ্রি পিস ছাড়া আর কিছু কি পরোনা? আচ্ছা শোনো আমি যখন আসছি তখন আমার সঙ্গ দাও বুঝলা? অনেক কিছুই শেখার আছে তোমার। লম্বা লম্বা এমন থ্রি-পিস,বিণুনির চল আছে নাকি এখন? যাই হোক, কোথায় পড়ো?
আমি আস্তে করে বললাম,
– কলেজে অনার্স পড়ি। এবার সেকেন্ড ইয়ারে উঠবো।

শোভা আপুকে আমার একদমই পছন্দ হচ্ছেনা। ইচ্ছা করতেছে পিছন থেকে হাত দুটোকে ঝাপটে ধরে চ্যাঙধোল করে, ঠাঁস করে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে, পার্মানেন্ট মার্কার পেন দিয়ে কিছুক্ষন আঁকিবুঁকি করি উনার মুখে। নিজের কৃত্রিম সৌন্দর্যবর্ধনতা নিয়ে বড্ড বেশি বড়াই উনার। বিরক্তিকর। আশ্চর্য! আমি কি আপনার কাছে কোনো সাহায্য প্রাথর্না করেছি? উজবেক কোথাকার!

শোভা আপু চলে যাচ্ছে।
ওহ্! বোঝাটা অবশেষে বিদায় হচ্ছে।
আবার দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ফিরে এসে বললো,
– এই লতা! একটু মোবাইলটা রাখোতো! আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি। অল্পকিছুক্ষনের জন্য। নিচেই আছি।
আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলাম।
চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি,
আমার বানানো চা প্রান্তিক ভাই কোন সাহসে শোভা নামের মেয়েটাকে দেয়!

নিচে প্রান্ত ভাইকে দেখা যাচ্ছে।
লাল কালারের শার্ট পড়ে হয়তো গাছ-গাছালি দেখছে হেঁটে হেঁটে। ব্যস্ত মানুষ। কানে সবসময় মোবাইল দিয়েই রাখে..
লাল শার্টে দারুণ মানায় ভাইয়াকে।
এতদিন খেয়াল করিনি ব্যাপারটা।
ইচ্ছা করতেছে এখনি গিয়ে একটা উইশ করতে।

ইশ!
যদি আজকে এই শোভা আপুটা না আসতো তাহলে ভাইকে একটা মেসেজ দিতাম। বিলের ধারে বসে উনার, “লতা তোর পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে” টাইপের কিছু বিরক্তিকর কথা শুনতাম।

কিন্তু সব পণ্ড হয়ে গেলো।
যাবো নাকি একবার? গিয়েই বলে দিবো,
” ভাইয়া শুভ জন্মদিন। কি খাওয়াবেন? ”

ভাইয়া মিটমিটিয়ে হাসবে আর আমি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো…

এসব ভাবনা-চিন্তার মোহে খেয়ালই করিনি যে শোভা আপু প্রান্তিক ভাইয়ের সাথেই হাঁটছে এখন…

আহ্!
কি মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিচ্ছে দুজন।
শোভা আপুও লাল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে আছে…
দুটি লাল মানুষ হেঁটে যাচ্ছে।
চোখের সামনে নিজের একান্ত প্রিয় মানুষটাকে যখন অন্য কারো সাথে দেখা যায়… তখন যে কি নিদারুণ কষ্ট হয় তা শুধু তারাই বুঝবে যারা এই কষ্টটা ফেস করেছে কখনো।

•°•

শোভা আপুর ফোনের লক জানা থাকলে একবার মেসেঞ্জারে গিয়ে ঢু মেরে আসতাম।
কিন্তু লক জানা নেই।
পাশের একটা বাটনে চাপ পড়ে গেলো চায়ের কাপের হাতে নিতে গিয়ে..

মোবাইলে আলো জ্বলে উঠতেই দেখতে পেলাম,
প্রান্ত ভাই আর শোভা আপুর খুব অন্তরঙ্গ একটি ছবি ওয়ালপেপারেই দেওয়া।

এভাবে ওয়ালপেপারে এরকম একটি ছবি কেন বা কিসের জন্য দেওয়া তা বুঝতে আর আমার বাকি নেই।
____________
_______

ঐদিনের মত আজকের রাতটাও কঠিন হয়ে গিয়েছে… আজকের রাতটা দীর্ঘ মনে হচ্ছে।

কিশোর ভাইয়ের সঙ্গ দরকার।
কিন্তু সেও তো নিঁখোজ…
আচ্ছা আমি এত অসহায় কেন?

•°•

শোভা আপু কিছুদিন থাকবে।
এমনিতেই বান্ধবী সেজে আমাদের বাড়িতে এসেছে থাকতে। আব্বা প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে আম্মা তাকে মানিয়ে নিয়েছিলো।

এদিকে লিমা আপু আর মঞ্জু ভাইয়ের বিয়ের দিন ও ঠিক হয়ে যাচ্ছে।

সবাই বিয়ের শপিং নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু আমার মনে চলছে হাহাকার।

নিজের বোনের বিয়েতে মানুষের কত প্ল্যান থাকে।
আর আমার…

ভাবতেছি বিদেশে চলে যাবো।
কাকার কাছে।
এদিকে লিমা আপুর বিয়েটা হয়ে যাক, কোনোমতে ইয়ার ফাইনালগুলো সারি, বছর যাক, তারপর শোঁ করে…
লন্ডন।

পারলেতো এখনি চলে যাই..
কিন্তু সম্ভব না।

সেখানে বসে বসে প্রান্ত ভাই আর শোভা আপুর প্রেম কাহিনী শুনবো,দেখবো কিন্তু কিছুই করতে পারবোনা।
মজা হবে খুব!
____________

” চোখের জলেরা মানেনা বাঁধা, জানে না ক্ষণ, বুঝেনা কে তার আসল প্রিয়জন। ”

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর ভার বুঝি আমার পিঠে এসে পড়েছে…
মায়ের কাছে যেতে হবে।
কালুকে দিয়ে ফোনটা পাঠিয়ে দিলাম।
মায়ের রুমে ঢুকার আগে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে যাচ্ছিলাম তাই প্রান্ত ভাইয়ের সাথে খেয়ে গেলাম এক ধাক্কা। ভাই এখানে কি করছে তা আমার জানা নেই। আমার এখন শুধু একটাই লক্ষ্য আমি উনার মুখ দর্শন করতেও চাইনা।
আমি নিজেকে ছাঁড়িয়ে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছি।
ভাই তখন পিছন থেকে বললো,
– লতা? যাবি ঘুরতে? শোভা, তুই আর আমি?
আমি না সূচকভাবে মাথা নাড়ালাম। চলে যাচ্ছি দৌঁড়ে…
উনি বললো,
– লতা, এই লতা? কোথায় যাচ্ছিস! আমিতো তোর জন্যই আসলাম, তোকে নিতেই এলাম এখানে।
তুই যাবিনা আমাদের সাথে?
আমি শুনলাম কিন্তু কোনো উত্তর দিলাম না।
আম্মার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললাম।
চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা

লতাকরঞ্চ (৬)

0

লতাকরঞ্চ (৬)

অনেকদিন হলো কিশোর ভাই আমাদের বাড়িতে আসেনা। আব্বা এ নিয়ে পাঁচ,ছয়বার কল করেও তাকে আমাদের বাড়িতে আনাতে পারলোনা। তার সাথে আমার কিছুদিন ফোনে কথা হয়েছিলো এখন তাও হয়না। জানিনা কি হয়েছে তার। এদিকে লিমা আপু আবার আরেক কাহিনী শুরু করে দিয়েছে। ওর সমস্যা হচ্ছে, ও ওর মাথায় নির্দিষ্ট কোনো একজনকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনা। হয়তো ওর সমস্যা হয় বা অন্যকিছু।

যখনি কথা হবে তখনি নানান ছেলের নানান কাহিনী বলবে। জানিস লতা, এই ছেলের এটা ভালো লাগছে, ঐ ছেলেটার এটা ভালো লাগেনি…ইত্যাদি ইত্যাদি!
মানে ওর এক-এক জনের এক-একটা জিনিস ভালো লাগে। নির্দিষ্ট একজনের মধ্যেই সে তার সবগুলো চাওয়ার সমাহার দেখতে পায়না, এটাই তার সবচেয়ে বড় দু:খ বা অপ্রাপ্তি বলা যায়।
•°•
লিমা আপু দেখতে আমার চেয়ে ফর্সা,মর্ডান। আমি ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটাই মর্ডান করে রেখেছি নিজেকে। খুব বেশিও না আবার খুব কম ও না। দুটোর মাঝামাঝি। এক কথায় চলনসই। আসলে, আমাকে আল্লাহ যতটুকু দিয়েছে ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি.. অনেক অসহায়দের তো তাও দেয়নি।
আপু প্রায়ই বলে,
– এই গাঁধা তুই একটু পার্লারে আমার সাথে যেতে পারিস না? হেয়ার ট্রিটমেন্ট, মুখে ফেসিয়াল করাতে পারিস না?
আমি মনে মনে বলি,
ধুর তুমিই করো ওসব..অতো সময় নেই আমার। তোমারতো কতজনই আছে,আর আমার? হাহ্ হা।

আপুর বর্তমান ক্রাশ আশিক ভাইয়া। উনি আপুর চেনাজানা। কিভাবে যেন তাদের পরিচয় প্লাস মেকি প্রেম-ভালোবাসা হয়ে গিয়েছিলো তা আমার বোধগম্য নয়। অবশ্য হওয়ার কথাও না। কারণ আপু সব শেয়ার করেনা আমার সাথে। নিতান্তই অল্পকিছু করে তাও একদম হিডেন কিছু না। ভুলেও বলে না ওসব। এতদিন আশিক ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিলো এখন আর নেই। কিন্তু আপুর বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আপু তাকে পছন্দ করে নিয়েছিলো। ব্যাপারগুলো আমি জেনে যাচ্ছি কিভাবে সেটা বলছি..

আপুর ফোন সর্বদাই সাইলেন্ট থাকে।
কিন্তু একদিন টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সোফায়..
সেদিন ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো না।
তাছাড়া ছোট বোন-ভাইদের কাছে কোনোভাবেই বড় ভাইবোনদের ফোনের সিকিউরিটি কোড গোপন থাকে না; রাখা সম্ভবই না! এটা তারা যেভাবেই হোক, জেনে নেয়। আর আমি তো আমিই। আমিও কোনো না কোনোভাবে জেনে নিয়েছিলাম। তা আর বলছি না। তারপর,
আপু ঘুমানোর কিছুক্ষন পরেই আপুর ফোনে পর পর কয়েকটা কল,মেসেজ আসতে লাগলো।
আমি আর ভদ্র সেজে বসে থাকতে পারিনি ফলফ্রসূ ঢুকেই পড়েছিলাম। মিনিটখানেকের মাঝেই ঘটনাচক্র ক্লিয়ারড…

আশিক ভাইয়ের ছোট বোন আবার লিমা আপুর ক্লাসমেট। সেই সুবাদে আপু মাঝেমধ্যে রাত কাটাতে যায় সেখানে। জানিনা এই রাতটা আসলে কিভাবে কাটে। আমাদের বলে যায় বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত আছে তাই যাচ্ছে; আসলে যে কিসের দাওয়াত বা কাজ সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। আব্বাকে আগে ভয় পেলেও এখন মুখে মুখে তর্ক করে আপু।

যখন আব্বা আম্মা আপুকে বুঝাতে যায় তখন আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আমাকে এখনো দুধের বাচ্চা বলেই তারা মানে।
তাই গজাননের কোলের সেই ভাইয়ের ন্যায় আমাকে ও আড়ালে রেখেই তাদের সব কথাবার্তা- কাজকর্ম চলে। এটা অসহ্যকর। আমিও এডাল্ট, আমিও বড় হয়েছি! এটা কেন তারা বুঝেনা?

তবুও কৌতূহলপরবশ হয়ে মাঝেমধ্যে গিয়ে কান রাখি দরজার পাশে। যদি কিছু শোনা যায়…
কিন্তু আমার আব্বা এতটাই চালাক যে উনারা মিনমিনিয়েই কথা বলে, হয়তো বকেও এভাবেই। মিনমিনিয়ে। আমার ধারণা আব্বার এই মিনমিনিয়ে বকার মাঝে কিছু কমাঙ্ক ও চিৎকার ধ্বনি যোগ করা উচিত। তবেই না আপু শান্ত হবে। কই আমার বেলায় তো এমন না! চিৎকার করে বকাঝকা করে, তখন অবশ্য আমি কানে হেডফোন দিয়ে রাখি। আর আমার সামনে এত লুকোচুরি কেন? আমি কি বাইরের মানুষ?

পরিবারের কোনো ডিসিশনেই আমাকে গণনা করা হয়না দেখে আমি নিজেকে খুব ছোট মনে করি।
প্রতিবাদ করতে গেলে ও শুনি বকাঝকা।

কালুকে দিয়ে এখন আমি সব কথা জেনে নিচ্ছি। লিমা আপুর কির্তীকলাপ সবই কিন্তু কালু জানে। কারণ তাকে তো আর আড়াল করে রাখা যায় না। আমার আব্বা আম্মার বড়ই বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক এই কালু। ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে কাজ করে সে। তাছাড়া কালুর চোখ-কান খোলা থাকে সসবসময়ই। আমি ডাকি কুমড়োপটাস, যদিও সে অতটা মোটা নয়।বাতাসের সাথে পড়ে যাওয়ার মতই একজন মানুষ।

হাস্যকর ব্যাপার হলো,
কালুর একটা বউ ও টিকে না। কারণ সবার সামনে সে ভালোই সেজে থাকে। কিন্তু বউদের সাথে যে কি হয় মানে এডজাস্ট করতে পারেনা বেচারা। ঝগড়াঝাঁটি মারামারি পর্যন্ত চলে যায়। শুধু যে সেই মারে তা কিন্তু নয় সে নিজেও কিন্তু খায়। চিকনা-চাকনা তো তাই…কত মলম, ঔষধ যে সাপ্লাই দিয়েছি আমরা…
এখন ৩ নাম্বার জন হয়তো আছে। তাও শুনেছি বিবাদ চলছে.. যেকোনো সময়ই পাখি পগারপারে। (মানে বউ পালাবে)

কালুই খবর এনে দেয়, দিচ্ছে।
লিমা আপু এই এই কাজ করেছে আর এখন এই এই কাজ করবে। লিমা আপুর সাথে আশিক ভাইয়ার মনমালিন্য চলতে চলতে এখন ব্রেক-আপ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আশিক ভাই ক্যারেক্টারলেস। যাকেই একটু বেশি আকর্ষণীয় দেখে তার প্রতিই তার লোভাতুর দৃষ্টি চলে যায়। আপু অনেক চেষ্টা করেও পাল্টাতে পারেনি। আশিক ভাইকে সম্প্রতি একটা ইভটিজিং কেসের জন্য এরেস্ট করা হয়েছে; কে জানে কাল হয়তো করা হবে ধর্ষণের জন্য!

তাই নাকি লিমা আপু আবার আব্বাকে জানিয়েছে যে সে মঞ্জু ভাইকে বিয়ে করতে রাজি। মঞ্জু ভাই সবটাই জেনে গিয়েছিলো অবশ্য। তবুও আব্বার কথা শুনে সে খুশিতে টলমল হয়ে গিয়েছিলো। কারণ সত্যিই হয়তো লিমা আপুকে ভালোবাসে সে।
___________
______

প্রান্ত ভাইকে নিয়ে আমার এখন আর দু:শ্চিন্তা হয়না। কারণ উনার তো আবার শোভা নামের কেউ একজন আছে…
অবশ্য আমার কিই বা আছে। কিছুই নেই।
তাছাড়া আমার মনে এখন কেউই নেই।
সেদিনের পর থেকে বুঝেছিলাম যে প্রান্ত ভাইয়ের প্রতি আমার দূর্বলতা ছিলো। কিন্তু এখন আর তাও নেই। আসলে আমি কি? আমি কিচ্ছু না।
আমার সাথে কাউকেই যায়না। এটাই সত্যি। কথাগুলো ভাবছি আর বিষণ্ণতায় ভুগছি।

প্রান্ত ভাই ও নেই, কিশোর ভাইতো নিঁখোজই।
জানিনা কিশোর ভাই কেন এভাবে উধাও হয়ে গেলেন তবে আমি তাকে খুব করে চাচ্ছি এই মুহূর্তে। কত কথা জমা হয়ে গিয়েছে। কাকে বলবো এসব? আর কে_ই বা শুনবে আমার এসব (কষ্ট, দু:খ আর না বলা কাহিনীগুলো) এতটা গুরুত্ব দিয়ে; যতটা গুরুত্ব দিয়ে শুনতো কিশোর ভাই… সবসময় সে ধৈর্য্য ধরে সবটা শুনবে। তারপর প্রাণসঞ্চারণী এমন এক-একটা কথা বলে দিবে যেটা ক্রমশ হৃদয়ে দোলা দিতে থাকবে। লোকটার কি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে!

•°•

ব্লকটা খুলে দিলাম প্রান্ত ভাইয়ার।
অনেকদিন পর আবার উঁকি মেরেছি তার ঝাঁকঝমকপূর্ণ একাউন্টে।
সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে শোভা নামের মেয়েটির একাউন্ট পেলাম।
তার একাউন্টে ঢুকেই তার প্রোপাইলে আবিষ্কার করলাম প্রান্ত ভাইকে!
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আচ্ছা, আমি শোভার একাউন্টে আছি না প্রান্ত ভাইয়ের একাউন্টে আছি?

ভালো করে দেখলাম নামটা, ” তাসনুভা শোভা ” -ই একাউন্ট নেইম। কই নাতো! এটাতো শোভার একাউন্ট_ই!
আশ্চর্য! এই মেয়ে ভাইয়ার ছবি স্ব-প্রোপাইলে এভাবে দিয়ে রাখলো কেন! রাখার অর্থই বা কি!
কত ঢং যে আরো দেখতে হবে….কে জানে…

ক্যাপশন দেখে আরো চমক পেলাম।
” শুভ জন্মদিন জানপাখি “(পাশে লাভ ইমুজি)
– এটা লিখা।

•°•

ওহ্হো!
আজ তাহলে এই রাগী ভাইটার জন্মদিন!
বেশ বেশ!
আহারেএ..!
যাই গিয়ে উইশ করে আসি।
টাইপ করলাম, ” Happy Birthday “।
পাঠানোর জন্য চাপ দিবো অমন সময় কালু এসে ডাক দিলো।
– আফা, আমনেরে ডাকে। কইছে অখনই যাইতেন।

আব্বার রুমে ঢুকেই আমি আশ্চার্যান্বিত হয়ে পড়ি। একি!
দেখলাম আব্বার পাশেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বসে আছে শোভা নামের মেয়েটা। এই মেয়েটা এখানে আসলো কোন সুখে!

প্রান্ত ভাই কোথায়!
কোথাও দেখছিনা কেন!
নিশ্চয়ই শোভাকে বিয়ে করবে বা করতে চায় এটা জানানোর জন্য এসেছে!
চলবে…

ধন্যবাদ। ]

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

লতাকরঞ্চ (৫)

0

লতাকরঞ্চ (৫)

” শোনো আমার না কিশোর ছেলেটাকে দারুণ লাগে। ছেলেটা খুবই ভালো; আর আমার লতাটার সাথেও ওকে খুব ভালো মানায়। তুমি কি বলো লিমার আব্বা? ”
আম্মা, আব্বাকে উদ্দেশ্য করে এ কথাটি বলার পর আব্বা বললো,
– তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু শুধু তোমার পছন্দ হলেই তো চলবে না। লতার ও তো পছন্দ হতে হবে। মেয়ে কি এ ব্যাপারে কিছু বলেছে তোমাকে?
আম্মা উত্তর দিলেন, “না।”

আব্বা পেপারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন,
– এজন্যই আমি ওদের বাধা দেইনা। কারণ আমার কিশোরকে খুব পছন্দ হয়। যেহেতু ওদের মধ্যে মিল আছে অনেক; তাছাড়া ইদানিং মেশামেশি ও করছে সেহেতু আমাদের আগে আগেই প্রস্তুতি নিয়ে নিতে হবে। বুঝলে শানু? আগে আগেই হালকা বন্দোবস্ত করে রাখার জন্য তৈরী হয়ে নেওয়া উচিত আমাদের। বড় মেয়েতো নাক-চুল কাটলোই এবার একে নিয়েই শেষ ভরসা। ছোট মেয়েটাকে ভালোভাবে বিদায় করতে পারলেই হয়।

আম্মা বললেন,
– কিন্তু লিমার কি হবে.. বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়েই ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে?
আব্বা গম্ভীরভাবে বললো,
– শোনো লতার মা, লিমার ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে চাইনা। বেয়াদব তৈরী হয়েছে একটা। আমার লজ্জা করে ওকে মেয়ে বলে মেনে নিতে।
আম্মা চুপ হয়ে গেলেন ।
___________

লিমা আপুর সাথে মঞ্জু ভাইয়ের মেলামেশা খুব গভীরে চলে যাওয়ায় পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে নানান বাজে মন্তব্য করে গিয়েছিলো আব্বা-আম্মাকে। তাই আব্বা নিজেই চুপিচুপি, সবার অজান্তে মঞ্জু ভাইয়ের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠায়, প্রস্তাব ও গৃহিত হয়। বিয়ের দিন-ক্ষণ ও ঠিক হয়ে যায় চুপিচুপি। এসব অনেক আগের কথা, নিরিবিলিই ঘটেছে সব।

বিয়ের আলোচনাটা আমার সামনে হয়নি তাই এই ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। তাছাড়া, বাড়ির সবচেয়ে ছোট বলে এসব বিষয়ে কেউ আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন ও মনে করেনা..
অথচ আমি ভাবতাম আপু করে না… শুধু মঞ্জু ভাই_ই পছন্দ করে। কিন্তু আসলে যে এতদূর… তা জানা ছিলো না।

সেদিন শপিং করে আসার পরের দিন থেকে লিমা আপু লাপাত্তা। দুদিন পর ফিরে এসে বললো,
– আব্বা আমি মঞ্জুকে বিয়ে করতে পারবোনা। তুমি ওদের মানা করে দাও।
রক্তচক্ষু নিয়ে রমিজ সাহেব(আব্বা) বললেন,
– কি! তোর এত বড় সাহস! হঠাৎ কি এমন হলো যে বিয়ে করতে পারবিনা? এই, তুই আমার মেয়ে? এই শানু(আম্মা) এইটা কে? এটা আমাদের লিমা তো?

এ দুদিন নাকি আপু উনার বন্ধুর বাসায় ছিলো।
বিশ্বাস করা যায়? কসম করেও বলছে কিন্তু এগুলো কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আব্বা বললেন,
– বন্ধু? তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে আর তুই কিনা বন্ধুর বাসায় রাত কাটাস? ছি:! ছি:! লিমা, আমাদের ফ্যামিলিতে এসবের রেকর্ড নেই। দোহাই তোর তুই এমন করিস না। আর এই কথা কাউকে বলিস না আর। আমি মঞ্জুর সাথেই তোর বিয়ে দিবো। এটাই শেষ কথা।
লিমা আপু আর কিছু বলেনি।
কে জানে তার মনে মনে এখন কি চলে….

_________

” কিরে, শুনলাম আজকাল নাকি খুব ঘুরাঘুরি, কথা বলাবলি হচ্ছে? তো মনে এত আনন্দ কেন বলতো? কি মজা তোর, তাইনা? ”
প্রান্ত ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনে আমার হাত থেকে কপালকুণ্ডলা নামের বইটা পড়ে গেলো। হঠাৎ করে এসে এভাবে বলার কি কারণ থাকতে পারে!
না তাকিয়েই বললাম,
– হুঁ।

প্রান্তিক ভাই বললো,
– হুঁ মানে? শুনলাম কিশোরের সাথে আজকাল একটু বেশিই মিশামিশি করিস?
ডিরেক্ট বলে দিলাম,
– হ্যাঁ করি। আপনার কোনো সমস্যা আছে এতে?
প্রান্তিক ভাই হেসে বললো,
– ধুর! আমার আবার সমস্যা! এত ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ভাবার এত সময় আছে নাকি আমার! ছুটি কাটাতে আসছিলাম আর সেই সুবাদে কতজনের যে কত কি দেখে ফেলতে হচ্ছে…
আচ্ছা কিশোর কি প্রতি সপ্তাহেই দৌঁড় দিয়ে চলে আসে নাকিভএ বাড়িতে? আচ্ছা, ওর কি আর কোনো কাজকর্ম নেই?

আমার ইচ্ছা করছেনা প্রান্ত ভাইয়ের সাথে কথা বলতে।
পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় প্রান্ত ভাই বললো,
– ন্যাকামি। এসব বয়সের দোষ। আর মামাও যে কেন শাসন করে না এই মেয়েটাকে.. আমি বুঝিনা। একদমই গেছে পুরোদমে।

লতা বললো,
– আপনার পার্সোনাল কোনো ব্যাপার নিয়ে আমি আপনার দিকে আঙুল তুলি? আপনার আম্মাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেছি কোনোদিন? তাহলে আপনার এত বড় সাহস হয় কি করে! আপনি আমার পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে সমালোচনা করছেন তাও আবার আমার সামনেই?

প্রান্ত ভাই এরপর আর কিছুই বললো না।
সোজা রুম ছেড়ে চলে গেলো।
উনি চলে যাওয়ায় স্বস্তি পেলাম।
সারাক্ষন শুধু রাগারাগি আর গায়ে আগুন ধরানোর মত কথাবার্তা!
ফ্লোর থেকে বইটা তুলে নিয়ে আবার পড়া শুরু করলাম। বইটা কিশোর ভাই দিয়েছে । দারুণ লাগতেছে পড়তে…
____________

কিশোর ভাই আর আমার বিয়ের কথা আব্বা-আম্মার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এটা কিশোর ভাই বা আমি কেউই জানতাম না।
তাছাড়া ভাই এ সপ্তাহে আসেনি তাই আমার ও এক সপ্তাহের জমানো সব কথাগুলো বলা হয়ে উঠেনি।

একদিন সকালে উঠে ছাদে যেতে খুব মন চাইলো।
এক কাপ গরম,কড়া কফি বানিয়ে নিয়ে গেলাম সাথে করে।

গিয়ে কিছুক্ষন প্রকৃতি দেখতেছিলাম। সুন্দর দৃশ্য। খুব ভালো লাগতেছে…
– কিরে লতা? অত:পর বিয়েটাই করে ফেলছিস? এত তাড়াতাড়ি? আমার আগেই? এত তাড়াতাড়ি পর হয়ে যাবি?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রান্ত ভাইয়ের মুখে এসব আজগুবি কথা শুনে হেসেই দিলাম।
হাসির ছলেই বললাম,
– বিয়ে! আমি! হাহ্ হা হা…
•°•
প্রান্ত ভাই বললো,
– শোন লতা। আমার উপরে তোর অনেক রাগ, তাইনারে?
শুনে রইলাম অন্য দিকে তাকিয়ে…

আবার প্রান্ত ভাই বললো,
– শোন না… বাইরের চাকচিক্যময়তা দেখে, প্রকাশভঙ্গী দেখে নিজেকে বিলিয়ে দিসনা। একটু আবেগকে সরিয়ে বিবেককে ঠাঁই দে।

আমি এই কথাটার মানে কিছুই বুঝলাম না।
হঠাৎ এতদিন পর এসে কি বলছে এসব!
আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম,
– বুঝলাম না। একটু কি বুঝিয়ে বলবেন?

উনি আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে বললো,
– খুব কফি খেতে ইচ্ছা করছে। একটু কফি দিবি?

আমি বললাম,
– অবশ্যই ভাইয়া। কিন্তু আমি চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলেছি। আপনি দাঁড়ান। এক্ষুনি আরেক কাপ নিয়ে আসতেছি।
উনি বললো,
– না। না। এত কষ্ট করতে হবেনা থাক।
আমি যেতে যেতে বললাম,
– গরমই আছে, ফ্লাক্সে রাখছিলাম তো,তাই। ৩ মিনিট! যাবো আর আসবো।
•°•
কফি বানিয়ে নিয়ে আসলাম।
এসে দেখি ছাদের কোথাও কেউ নেই।
আমি আর কি করবো..
কফির মগটা হাতে নিলাম… খেতে নিলাম…
চুমুক দিতেই অবিষ্কার করলাম এক হাস্যকর, অদ্ভুত জিনিস।
আমার মগে কোনো কফিই নেই।
কেউ খেয়ে নিয়েছে পুরোটা…

চলবে…

( নতুন মোড় শুরু হলো গল্পের। ভালো না লাগলে অবশ্যই বলবেন। অবশ্যই ভালো কিছু দেওয়ার প্রত্যাশা আছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবেনা ইনশাল্লাহ্। আর আপনারা এই ধারাবাহিকটা প্রতিদিন চাচ্ছেন; তাই একটু ছোট ছোট করেই দিবো। অতএব, পর্ব ছোট হওয়া নিয়ে দয়া করে কেউ আক্ষেপ প্রকাশ করবেন না। গল্পের ধারা ও মান এবং আপনার ভালো লাগা- না লাগার মত মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকবো।ধন্যবাদ। )

#ফারজানা_রহমান_তৃনা