আমার হৃদয় জ্বলছে জলন্ত মোমের ন্যায়। জ্বলতে জ্বলতে একসময় কয়লায় পরিণত হচ্ছে। আবার ব্যস্ত শহরের কোলাহলে কিছুটা নিভে যাচ্ছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিচ্ছে এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। আমি আজ একা হয়ে এই সমুদ্রবিলাস করছি। এখানে নেই কোনো আনন্দ, নেই কোনো অনুভুতি। শুধুই আছে অপলক দৃষ্টি। কোথায় যেন একনজরে তাকিয়ে আছি। সমুদ্রে নাকি তুমি হীনা ভাবনায়? ঠিক জানি না।
আব্বু! জানি না কেমন আছ সেই অচেনা দূর প্রদেশে?
কতটা দিবস আজ তুমিহীনা!
ভাবনার আড়ালে মনে হচ্ছে ; এই বুঝি তুমি আমার পাশে বসে আছ। হালকা কাশি দিয়ে আমাকে আদুরী বলে গানের সুর তুলছ। আমি তাকাতেই তুমি হাওয়া হয়ে যাও। আমার সাথে এ কেমন লুকোচুরি আব্বু? এ কেমন লুকোচুরি!
নির্ঘুম শত শত মাইল দূর হতে কে বাজায় ভায়োলিন ক্লিষ্ট করুণ বেহালার সুর?
তুমি?
এটা কি তুমিই আব্বু?
তুমি যদি নাই বা হও; তাহলে কেন আমার বারংবার মনে হচ্ছে আদুরী বলে প্রবল গতিতে কেউ সুর তুলছে চিরচেনা একটি গানের। আমি সেই সুরকেন্দ্র তওয়াফ করতে থাকি। আব্বু! তোমার একটুখানি পরশ পাবার আশায়।
আব্বু! তুমি হীনা এই ব্যস্ত শহরে আমার প্রতিটি রজনী কাটছে গম্ভীরমুখে। সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের বিছানায় বেদনাতুর মন শোয়ালে ক্লান্ত পিঠ ঠেকালেই আব্বু তোমায় স্বপ্নে দেখি।
স্বপ্নেই তোমার সাথে প্রতিত্তোর করি –
আমি ভালো আছি আব্বু। তুমি আছ তো আমার কাছে আব্বু? কত কাছে? এই স্পর্শ, এই হাত কি সত্যিকার তোমার স্পর্শ আব্বু?
তুমি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার মুখ গুমরো করে ফিরে যাও সেই অচেনা প্রদেশে। যেখানে এই আমিটার প্রবেশের অনুমতি নাই। আমার অভিমান হয় ভীষণ। সেদিন আর খাওয়া হয় না। তুমি জানতে আব্বু! কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে গেলে আমি তাদের খুব করে বকি। আর তুমি এজন্যই আমাকে বকতাড়ুয়া বলে ডাকতে। তাহলে কেন আজ তুমি মুখগুমরে বসে থাক? কেন আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনা?
আব্বু ও আব্বু! তুমি কেন আসো না ফিরে?
কতদিন রঙিন ঘুড়ি আকাশে উড়ানো হয় না। জানো আব্বু! সেই বকুল তলায় নাটাই হাতে তোমার আদুরী আজও অপেক্ষা করে তুমি আসবে বলে। বড় ফাঁকি দিচ্ছ আমার সাথে।
তুমি আবার ফিরে আস। কথা দিচ্ছি আমি একটুও বকাবকি করবো না। জারুলতলায় বসে দু’জনে রঙিন রঙিন গল্প করব। ডায়েরি হাতে নিয়ে এলোমেলো শব্দ লিখে দু’জনেই হাসিতে মেতে উঠবো। আর আমাদের হাসাহাসি দেখে বৃদ্ধ রহিমকাকু পাগলবসুর দল বলে আখ্যায়িত করবে। হাহা কি মজাটাই না হবে তখন!
আব্বুরে কতদিন তোমাকে স্পর্শ করি না। অথচ ভালোবাসি, বলা হয় না। অথচ তোমাকে স্মরণ করতে করতে নিষ্ঠুর ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়, তবুও তুমি আসো না। বড় নিষ্ঠুর হয়ে গেছ যে তুমি!
বিবেকের জানালায় তোমার এই নিষ্ঠুরতার প্রশ্নেরা ঝাপটা দিয়ে যায়। মনে চায়…
এই সোনালী রোদ্দুর পেরিয়ে চলে যায় সেখানে; যেখানে তুমি চুপিচুপি আমার সাথে লুকোচুরি খেলেই যাচ্ছ। তোমাকে ধরে কান টেনে দিয়ে বলব, এই যে বুড়োর ছেলে আমাকে কেন এত জ্বালাচ্ছ?
কিন্তু তা আর বলা হবে না। তোমার সাথে অভিমানে আমার দিনের প্রভাত কেটে যায় । বিকেলবেলা ডায়েরি হাতে নদীপাড়ে গা এলিয়ে বসি ঠিক তোমার মত করে। তোমায় নিয়ে লিখতে বসি। আমার কলমের কালি শেষ হয়ে যায়। তবুও আমার অভিযোগের বাণী শেষ হয় না।
জানো আব্বু! তুমি হীনা এই শহরে অনেক মানুষ আছে। তবুও এরা আমার বন্ধু হয় না। বিশ্বাস জন্মে না। এই শহর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে তুমি নাই বলে। আমাকে নিয়ে যাও আব্বু তোমার শহরে। আমি চেয়ে আছি তোমার পথপানে। অপেক্ষায় আছি আমি, সেই চিরচেনা অবারিত প্রান্তর অভিমুখে তুমি আসবে বলে।
তুমি এসে ছুঁয়ে দাও কপোল, নিয়ে যাও তোমার সেই অচেনা প্রদেশে। ভালো থাকব আমরা দু’জন। হাসিতে আবারো মেতে উঠবো।
আব্বুরে! “এই ব্যস্ত শহরে তুমি হীনতায় বারংবার তোমার সেই একটি বাক্য মনে পড়ে; “দূর ফেলে আসা দিনে ভালো থেকো স্বপ্নের স্মৃতিরা।”
প্রিয় মাতৃভূমি,
ভূমি আমার, আজকের এই বিদেয় বেলায় তোমায় বেশ মনে পড়ছে।আজ এক স্নিগ্ধ গোধূলী রাঙানো সন্ধ্যায় আমি তোমার বুকে শায়িত হবো।তুমি কী আমাকে তোমার বুকে জড়িয়ে নিবে? একটিবার?
হে ভূমি আমার, আমায় তুমি অনেক দিয়েছো। জন্মের পর থেকে আমি শুধু তোমার থেকে নিয়েই এসেছি। কখনোই বলতে পারিনি তোমাকে,”এবার একটু কম করো আমার জন্য”। তুমি আমাকে তোমার আহুতগুলোতে এতোই মজিয়ে দিয়েছিলে,আমার কখনো মনেই হলোনা তোমায় একটা বার বলি, “কেমন আছো আমার প্রিয় মাতৃভূমি!” তুমি জানো কী? তোমার সৌন্দর্য্যে আমি ছিলাম প্রতিটি মুহূর্ত মনোমুগ্ধকর! বিদায় বেলায় কী তোমায় বলতে পারি সত্যিই আমি তোমার গর্ভে জন্মে বড় ভাগ্যবতী? তোমার সৌন্দর্য কখনোই আমি বলে শেষ করতে পারবোনা। আমি প্রতিবার শুধু তোমার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে চাতক পাখির অনুরূপ বসে ছিলাম। তোমার বুকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে কখনো খারাপ কিছু করেছি আবার কখনো বা ভালো কিছু। এই যে দেখোনা, তোমার এত সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করছি অথচ সেই তো দিনশেষে তোমার উত্তাল নদীতে ঝাঁপিয়ে ফেলতাম হাতের নোংরা বস্তুগুলো! আমায় তুমি ক্ষমা করো ভূমি! প্রতিনিয়ত তোমায় বড় কষ্টে ফেলেছি আমি। তবে আমি আজ মৃত্যুর বুকে শায়িত হয়ে শুধুই গর্ব করবো। হ্যাঁ প্রিয় মাতৃভূমি আমার! আমি তোমার গর্ভে জন্মে গর্বিত, আমি আজ তোমার বুকে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে শায়িত হবো তার জন্যে আমি গর্বিত! ভালোবাসি ভূমি আমার।তোমায় তো সেই জন্মের পর থেকে ভালোবাসি!
বেলাশেষে আজ আমার বড় গান গেয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার মাতৃভূমি!
সে যে আমার মাতৃভূমি!”
তুমি আমার প্রিয় ছিলে,আছো এবং থাকবে। ছিলে বলতে বুঝায় অনেক কিছু। অনেকেই বলবে, আগে ছিলো বর্তমানে নেই। তুমিও নিশ্চয়ই এটাই ভাবছো? জানতাম আবার আমাকে ভুল বুঝবে। বরাবর এই ভুল ভাবনাটাই ছিলো তোমার আমার সম্পর্ক পতনের হয়েও না প্রিয়। আমার কাছে ছিলে বলতে বুঝায় আগের থেকেও আরো বেশি আরো কাছের মানুষ। কাছের মানুষদের তো প্রিয় বলে। আর তুমি কতখানি প্রিয় আমার সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আচ্ছা, আছো বলতে তোমার ধারণা কি? আমার ধারণা হলো আছো মানে অবিরাম ধারায় যে নদীর বয়ে যায় সেটা। নদীতে যতক্ষণ পানি থাকবে ততক্ষণে নদী তার স্বাভাবিক গতিতে বয়ে যাবে। আমিও ঠিক তেমনি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তুমি আমার প্রিয়’র তালিকায় থাকবে। শুনো, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো চিঠি পড়ে? হয়ে না প্রিয়। জানি আমি উল্টা পাল্টা লিখি। তারপরও তুমি যে আমার অত্যাচার সহ্য করো সেটাই অনেক। থাকবে বলতে তুমি কি বুঝো আমি তা জানি না। আর জানতেও চাইবো না। এটা আমার নিজস্বতা। যতদিন এই পৃথিবীতে আমার শ্বাস থাকবে ততদিনে তুমি আমার অস্তিত্বে বিরাজমান থাকবে প্রিয়। প্রিয় জানো আজকাল বড্ড এই গানটা শুনতে ইচ্ছা করে।
“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।”
গানটা সাথে মনে হয় আমি একদম মিশে আছি। তোমার মাধ্যমেই তো আমি আজ এতো ভাবুক হয়েছি প্রিয়। তোমার কাছে মনের কথা বলি। অনেক সময় রাত পাড় হয়ে যায়। তারপরও তুমি আমার অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছো। কলমের গুঁতা খাচ্ছো দিন দিন। সাথে তো তোমায় ফ্রিতে কালো কালি খাওয়াই। তারজন্য তোমার কৃতজ্ঞতা নেই। জানি থাকবেও না। যাও আজকের মতো তোমার সাথে আড়ি প্রিয়। কাল আবার তোমার কাছে আসবো। ডায়েরি প্লিজ রাগ করো না। কাল আসবো কথা দিলাম প্রিয়। আচ্ছা ডায়েরি তোমায় যে প্রিয় বলে সম্বোধন করি তাতে তোমার কেমন লাগে? থাক কাল এই প্রশ্নের জবাব দিও।
আজ তোমাকেই চিঠি লেখার কথা কেন মনে এলো বলোতো?আমি তো তোমার কাছেই থাকি,তাহলে চিঠি কেন?আসলে অনেক গুলো কথা বলার ছিল জানো তো।সেগুলো তোমায় বলব বলে লিখছি কি?জানি না,হয়তো কোনোদিন দেখতে পাবে,কিন্তু আমি নিজে কখনো তোমার হাতে দিয়ে উঠতে পারব না চিঠিটা।আমি তো বড্ড অগোছালো,চিঠিটাও সবার মত গুছিয়ে লিখতে পারি না।কখনো তো কাউকে লিখিনি এভাবে।কিন্তু তুমি তো মা,আমি জানি ঠিক বুঝে নেবে।
সেবারে হাসপাতালের ডাক্তার ম্যাডামরা যখন স্কুলের সেমিনারে এককোণে ‘ প্রিয় মা ‘ লেখা সবুজ চিঠির কাগজ দিলেন সবাইকে,সেবারেও ওনাদের কথায় চিঠি লিখেছিলাম তোমায়।কিন্তু কিছুই লিখতে পারিনি প্রায়,কারণ ওটা তো তোমার হাতে দিতে হয়েছিল লেখার পর।
অবাক হচ্ছো মা?কিন্তু কি করবো বলো,আমি যে এরকমই,তুমি তো জানো।জানিনা কেন এমন অক্ষম আমি যে কোনোদিন তোমায় জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি,”মাগো,তোমায় বড্ড ভালোবাসি।”কোনোদিনও তোমার অসুখে জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারিনি,”মা তোমার কী কষ্ট হচ্ছে?কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে?” বোঝার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করেছে,কিন্তু তবুও তোমার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছি,জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারিনি।কখনো জিজ্ঞাসা উঠতে পারিনি,”মা,ওষুধটা খেয়েছ?”
অথচ দেখো,আমার অসুখে তুমি রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছ। জ্বর হলে অরুচির মুখে খাওয়া নিয়ে হাজার ঝামেলা করেছি,তোমার উপর কত চেঁচামেচি করেছি।আমার সব রাগ অভিমান হাসিমুখে মেনে নিয়েছ তুমি।যখন ভুল করেছি,শাসন করতে গিয়ে রাগের মাথায় মেরেছ আমায়।আবার খানিক পরে আমার ক্ষতে,কালশিটেতে মলম আর বরফ লাগিয়েছো,তখন তোমার দুচোখে অবিরাম বৃষ্টি ঝরে চলেছে।আমি তো অনেক অভিমান করেছি,কিন্তু কখনো তোমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলা হয়ে ওঠেনি,”কেঁদো না গো মা,তোমার ভালোবাসা আর স্নেহের স্পর্শেই যে আমার সব যন্ত্রণা মুছে গেছে,আর একটুও ব্যাথা নেই।” না,আমি বলে উঠতে পারিনি।
আমি বড্ড খারাপ,তাই না?সবার তো কত্ত গুণ, কত কি পারে সবাই,আমি তো কিছুই পারি না।তবু তোমার আর বাপির চোখে আমিই সেরা থেকেছি সবসময়,গুণের ঘাটতিতে অন্যদের ভালোবাসায় খামতি হয়,কিন্তু তোমাদের ভালোবাসা যে সব বিচারের উর্ধ্বে,একটুও কম হয়নি।আর আমি?মনে জমে থাকা কথাগুলো অব্দি নিজের মাকে বলে উঠতে পারিনি,এতটাই অপদার্থ!
কিন্তু বলেছি জানো তো,অন্যভাবে।তোমার মনে আছে সেই একদিনের একলা দুপুরটার কথা?আমি স্কুলে,বাপি কাজে,আর তুমি নির্জন মধ্যাহ্নে ঘরে বসে আমার চুড়িদার রিফু করতে করতে তোমার প্রিয় গানটা শুনছো।তোমার সবসময়ের সেই প্রিয় গান,’ তুমি আমার মা,আমি তোমার মেয়ে’।শুনতে শুনতে তোমার চোখ ছলছলে হয়ে উঠছে।’মেয়ে যে তুই লালন শুধুই করছি আমি রে,পরের ঘরে যাবার জন্যে তা কি বুঝিস নে ‘ লাইনটা আসতেই তোমার চোখে বাঁধ রইল না আর,মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে ঝরঝর করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলে তুমি।তখনও জানতে পারোনি, দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে নিজের কান্নার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি।স্কুলের তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গিয়েছিল,বাড়ি এসে ঘরে প্রবেশ করতে গিয়েই তোমায় দেখে থমকে গিয়েছিলাম।তোমার প্রিয় গানকে ‘ সেকেলে গান ‘ বলে অনেক ব্যঙ্গ করেছি,কিন্তু সেদিন গানটা নাড়িয়ে দিল ভিতর থেকে,না চাইতেও কান্না ঠেলে উঠে এলো গলা থেকে।যখন এলো, ‘ মাগো তুমিও তো মা এসেছিলে তোমার মা কে ছেড়ে ‘ আর পারলাম না আমি,দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তোমার বুকে।তুমিও আবেগ আটকাতে পারলে না আর,মা মেয়েতে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।আমার চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটা ঝরে পড়তে পড়তে আকুলস্বরে বলছিল সেদিন,” মা,বাপি তোমাদের বড্ড ভালোবাসি গো,আমি তোমাদের ছেড়ে কোত্থাও যেতে চাই না।তোমাদের ছোট্ট রাজকুমারী হয়েই থাকতে চাই।”
তুমি শুনতে পেয়েছিলে মা ওদের কথা?
আমার জন্মদিনে ধান দূর্বায় আশীর্বাদ করতে গিয়ে তুমি আর বাপি কেঁদে ফেলেছিলে যখন,সামনে রাখা হলুদজলে আরো একজোড়া চোখের নোনাজল চুপিচুপি টপটপ করে মিশছিল। ওগুলোয় অনেক কথা লেখা ছিল জানো তো?তুমি পড়তে পেরেছিলে মা?
এই দেখো, কী বলতে কী কথায় এসে যাচ্ছি।আসলে তোমায় এত কথা বলার আছে যে কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ করব বুঝেই উঠতে পারছি না।
সব বলতেই পারব কি?বলা,না বলা সবেই তো তুমি।আমার ভ্রূণ হয়ে আসার পর ন মাস দশ দিনের সম্পূর্ণ নীরব দিনগুলো তোমার মাঝে,আমার বলা প্রথম শব্দেও তুমি।আমার লেখা প্রথম অক্ষরেও তুমিই মিশে।আমার সারাদিন তুমিময়,তুমি এত ব্যাপ্ত যে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বাক্য জুড়েও তোমায় নিয়ে লিখে শেষ হবে না।অথচ এমনি নিঃশব্দে আত্মত্যাগ করে যাও যে বুঝতেই পারিনি।নাকি বুঝতে পেরেও তার স্বীকৃতি দিয়ে ওঠা হয়নি কখনো?ইচ্ছে তো হয়েছে,তোমার চোখের জল দুহাত দিয়ে মুছিয়ে দিতে,ক্লান্তির ঘামে ভেজা তোমায় হাওয়া করে দিতে।কিন্তু না,করে ওঠা হয়নি আর,কিছু বলেও ওঠা হয়নি,অব্যক্ত রয়ে গেছে সব। দেখেছো,আবেগে আমার শব্দগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে,লিখতে গিয়ে কেঁদে ফেলছি বারবার।তুমি যে আমার জীবনের ধ্রুবতারা। স্পেশাল করে কিছু বলতে না পারলেও তোমার এই মুখচোরা,অপদার্থ,অকর্মণ্য মেয়েটা তোমায় সত্যিই বড়ো ভালোবাসে গো।তুমি যখন ‘মা’ বলে ডাকো,সত্যি সত্যি তোমার মা হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।অনেক ভুল করি জানি,কিন্তু দেখো,একদিন ঠিক মানুষের মত মানুষ হয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল করব আমি।এখনও তো অনেক কিছু না বলা থেকে গেলো,জানি অনুভবে বুঝে নেবে তুমি,নিও।
কয় জন্ম হয় জানি না,যতই হোক,তুমি সবজন্মে আমার মা হয়ে এসো,যেন আমি তোমার মত দুর্গার কোলে লক্ষ্মী সরস্বতী না হলেও অপদার্থ সাধারণ মেয়ে হয়ে জন্মাতে পারি।
প্রিয়,
ভালোবাসা নিও,
জানি ভালোবাসা কারো ইচ্ছে গড়া পুতুল নয়,এটি বলে কয়ে হয়না সেই সত্য আমি বরাবরই মেনে নিয়েছি।তাইতো তোমার যাবার পথে বাঁধা হয়ে দাড়াইনি কখনো।তবে আজকাল নিজেকে বড্ড বেশী একা মনে হয় গো।কেনো জানি না অল্পতেই খুব ভেঙে পড়ি।
আমার অনুভূতি গুলো আমি ঠিক গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারি না জানো তো,যদি পারতাম তবে হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসকেও হার মানাতো।
আর পারিনা বলেই হয়তো আজ তুমি দুরে সরে রয়েছো।
আমি বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক কেমন করে বললে আমার বলাটা স্বার্থক হবে।
মাঝে মাঝে কেনো জানি খুব কান্না পায়, জানি না কেনো!
বুকের ভেতর জমে থাকা অভিমান গুলো হয়তো চোখের জল নামে পরিচিত হতে চায় নতুন করে,কেনো চায় তাও জানি না।
বাঁচা মরার হিসেব করতে করতে ফুরিয়ে যাওয়া ছোট্ট জীবনে মানুষের কত কিছুই না চাওয়ার থাকে,তেমনি আমারো কিছু চাওয়া ছিলো তোমাকে ঘিরে,খুব বেশী কিছু না তো, শুধু আমার চুলের ভাজে দু’টো বেলী গুজে দেবার জন্য তোমার ওই হাত দু’টি-ই তো চেয়েছি আমি।
কেননা তোমার হাতের ছোঁয়ায় আমার হৃদয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির শিহরণ জাগায়,জানি না এই অনুভূতির নাম কি!শুধু জানি বিষন্ন মনে একলা বিকেলে আমি তোমার কাঁধেই মাথা রাখতে চাই।
আমার হৃদয়ের অতীব গভীরে, যে অস্পৃশ্য অবিনশ্বর রুহ আছে, সেই রূহ এর প্রতিটি বিন্দু থেকে তোমাকে ভালোবাসি আমি। তুমি আমার প্রসারিত বাহুডোরে না আসো, যদি আমাকে তুমি নিজেকে দিতে না চাও, তবু আমার সব কিছু তোমার। আমার সর্বস্ব দিয়েই আমি তোমাতে হারাতে চেয়েছি খুব করে ভালোবাসতে চেয়েছি।চেয়েছি বললে ভুল হবে বরং চাই, ভালোবাসি।
যে ভালোবাসার গভীরতা মাপতে গেলে তুমি নিজেই তলিয়ে যাবে সে গভীরতায়।কিন্তু আপসোস! তুমি সেটা কোনোদিন-ই চাওনি।
আমি বলবো না তুমি ফিরে এসো,আমার ভালোবাসার জোরেই তুমি ফিরে আসবে, তোমাকে ফিরে আসতেই হবে, সে তুমি চাও বা না চাও। তুমি জানোনা ভালবাসার মানে কি!
ভালোবাসার মানে হচ্ছে অমর একটি সুর, যে সুরের স্বরলিপি রচনা করবো আমি,আর সেই সুরে সুর মেলাবে তুমি।
তুমিই একদিন বিশ্বাসে ভর দিয়ে ডানা মেলে তুলে আনবে আকাশের রঙ, মেঘের কালিমা মুছে প্রজ্বলিত করবে শিখাময় সূর্যের মুখ। আমিও অপেক্ষা করবো।তুমি একদিন সব জড়তা আর নৈরাশ্যবাদের সংশয় মাড়িয়ে সাজাবে সহনশীলতা, সাম্য আর ভালোবাসার মিলন-মেলা।
এ আমার স্বপ্ন নয়, আত্মবিশ্বাস ।
তাই তো কান্না গুলোকে লুকিয়ে রেখে হাসিমুখে অপেক্ষায় থাকি নতুন ভোরের সূচনা ঘটার।
যে ভোরের শিশিরস্নাত ঘাসের বুকে পা ডুবিয়ে হেটে যাবো কোনো এক অচেনা শহরে।
আমি সেই প্রত্যাশা নিয়েই অপেক্ষার প্রহর গুনছি অবিরত।
ভালো থেকো প্রিয়।
ইতি তোমার আগামীর বেঁচে থাকার নিশ্বাস।
মুখের একটি ছোট্ট কথাও যে মানুষকে মেরে ফেলতে পারে তা আমি আজ প্রথম বুঝতে পারলাম।নিদ্রর মুখে এই কথাটি শুনে আমি পুরো স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।যেই মানুষটি আমার মুখে আলাদা হওয়ার কথা শুনে আমাকে খুন করে ফেলার কথা বলেছিল আজ সে নিজে আলাদা হতে চাইছে।আমার ঠিক এই মুহুর্তে কি বলা উচিত আমি জানি না।বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।শুধু নির্বাক দৃষ্টি নিরব অশ্রু বর্ষণ করে যাচ্ছে।আমার ঘোর কাটলো নিদ্রর পেছন থেকে আসা ছিপছিপে গড়নের একটি সুন্দরী মেয়ের ডাকে।মেয়েটি প্রথমে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ও এসে পড়েছে?’
তারপর আমার সামনে এসে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,’হায়! আমি রাইশা,নিদ্রর ফিয়ান্সে।’
মেয়েটির মুখে ‘নিদ্রর ফিয়ান্সে’ কথাটি শুনে আমার মাথাটা ঘুরে উঠল।হাত পা যেনো অবশ হয়ে আসছে।একদৃষ্টিতে শুধু নিদ্রর দিকে তাকিয়ে রইলাম।অথচ তার কোনো ভাবান্তর নেই।আমার নিরব দৃষ্টি তাকে কত কথা বলে যাচ্ছে,সে কি তা শুনতে পাচ্ছে না? সে না আমাকে আমার থেকেও
বেশি বুঝতে পারে?তবে কি সাত মাসের দূরত্ব সব পাল্টিয়ে দিল….সব…!
সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরত আসতে আমি বাঁধ সাধলাম।সে তো আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ডিভোর্স করাতে,আমাদের সম্পর্কের ইতি টানতে,তবে আমি কেনো যাবো!বলে দিলাম মুখের উপর আমি ফেরত যাবো না।কিন্তু আমার বলা না বলায় কি!
সেই মুহুর্তেই এক প্রকার টেনেটুনে জোর করেই সে আমাকে ঢাকা নিয়ে আসলো।কষ্ট তো হলো সবথেকে বেশি তখন,যখন আমি গাড়িতে তার পাশে বসতে নেই আর সে আমাকে হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে পেছনে বসতে বলে।কারণ এখন আর তার পাশে আমার জায়গা নেই।এখন তো তার ফিয়ান্সে আছে।
কষ্টে জর্জড়িত মন নিয়ে আমি পেছনে বসে পড়লাম।সারা রাস্তায় গাড়ির ব্যাক মিররে তাকে দেখতে লাগলাম,কিন্তু সে একবারের জন্যও সেখানে দেখলো না।ঘন্টার পর ঘন্টা সময় গাড়িতে কাটিয়ে একসময় নিদ্রর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালাম।আজ সাত মাস পর এই বাড়িতে আবার আসলাম।সবকিছুই এক অথচ মনে হচ্ছে কোথায় যেনো কিছু বদলে গেছে।চিরচেনা স্থানে অচেনার ঘ্রাণ আসছে।এক ধরণের জড়তা আমাকে আঁকড়ে ধরল।কতদিন পর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করবো,কতদিন পর দেখবো আবার সেই প্রিয় মুখগুলো।কিন্তু প্রিয় মুখগুলোর সাথে সেখানে কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন,কিছু অসন্তুষ্ট ভরা অভিযোগ।কিভাবে মুখোমুখি হবো সেসবের।নিদ্রর পেছনে মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু হয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলাম।আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখি সবাই শক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমার আব্বু আম্মুও সেখানে উপস্থিত।তাদের দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।আব্বু ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।ছলছল চোখে অপরাধী দৃষ্টি নিয়ে অস্ফুট স্বরে আব্বু বলতেই ঠাস করে একটা চড় পড়লো আমার গালে।এই প্রথম আব্বু আমাকে চড় মারলো।গালে হাত দিয়ে আমি অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলাম।
আব্বু রাগ অশ্রু মিশ্রিত চোখে বলতে লাগলো,
-‘খুব বেশি বড় হয়ে গেছিস তাই না?এখন আর আমাদের কাউকে প্রয়োজন পড়ে না।একা একাই নিজে নিজে চলতে পারিস!’
আম্মু এসে আমার হাত শক্ত করে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে বলতে লাগলো,
-‘কি করে পারলি সুপ্তি,আমাদেরকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে।আমাদের কথা তোর মাথায় একটুও আসলো না।তোকে না পেয়ে আমাদের অবস্থা কেমন হয়েছিলো জানিস!তোর যদি কিছু হয়েও থাকতো তাহলে আমরা কি সব মরে গিয়েছিলাম যে তোর চিকিৎসা করাতে পারতাম না।একবারো তখন ভেবে দেখেছিলি তোকে হারিয়ে আমাদের অবস্থা কেমন হবে!এত বড় কাজ তুই করলি কিভাবে?’
নিদ্রর বাবা মাও আমাকে একই কথা বললো।আমি শুধু নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম।
বলার মত যে কিছু নেই,আজ আমি সবার কাছেই অপরাধী।এই মানুষগুলোকে আমি হারানোর তীব্র কষ্ট দিয়েছি।
কিছুক্ষণ পরে সবাই একে একে আমার সামনে থেকে সরে গেল।আমি সোফায় বসে বসে এখনো নিরবে চোখের জল ফেলছি।পাশে তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে স্নিগ্ধ মুখ কাঁদো কাঁদো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম,’তুইও কি আমার সাথে কথা বলবি না?’
-‘তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে ভাবু।তুমি জানো আমরা কত কষ্ট পেয়েছি।তোমার জন্য কত কান্না করেছি।আর ভাইয়া তো……
-‘স্নিগ্ধ!……..
পেছন থেকে নিদ্রর ধমক শুনে স্নিগ্ধ কথা অসম্পূর্ণ রেখেই দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে যায়।
নিদ্র একবার আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে শক্ত মুখে তাকিয়ে পেছনে ফিরে চলে যেতে উদ্যত হয়।কিন্তু আমি দৌঁড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে তার একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলি,
-‘নিদ্র,আমাকে প্লিজ মাফ করে দিন।আমি এমন ভুল আর কক্ষনো করবো না।শুধু একবার বলুন আপনি আমাকে যা বলেছিলেন তা সব মিথ্যা।আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করছেন না,আমাদের ডিভোর্স হবে না।’
নিজের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি বললেন,
-‘কেনো তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না! আমি আবার নতুন করে যেনো জীবন শুরু করতে পারি।এখন তো আমি সেটাই করছি।
নাউ ইউ মাস্ট সুড বি হ্যাপি।’
-‘নিদ্র আমাকে আপনার যেই শাস্তি দেওয়ার দিন।যতই কঠিন শাস্তি হোক আমি হাসি মুখে মেনে নিবো।কিন্তু এই বিয়ে আপনি করবেন না,প্লিজ করবেন না।আমি তো বাড়ি ছেড়ে এই কারণে গিয়েছিলাম যেনো….
আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই সে হঠাৎ রেগে আমাকে শক্ত করে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
-‘যেনো কি?যেনো আমি খুব ভালো থাকতে পারি!
আমাকে রেখেছো তো,খুব ভালো রেখেছো!
এখন আরেকটু ভালো করে দাও।এই বিয়েটা হবে,দু দিন পরই হবে।আর এই বিয়ের সাক্ষী হবে তুমি।তুমি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তাই না?আমার কত ভালো চাও তাই এতটুকু তো আমার জন্য করতেই পারো।’
কথাটি বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে সে চলে গেল।আমি দৌঁড়ে গিয়ে আব্বু আম্মু আর নিদ্রর বাবা মার কাছে চলে গেলাম।আব্বুর হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম,
-‘আব্বু উনি নাকি আবার বিয়ে করবেন?আব্বু তুমি একটু তাকে বলো না বিয়েটা না করতে।আমি তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।’
-‘কেনো এতদিন কিভাবে বেঁচে ছিলি?ছেলেটাকে তুই যেই কষ্ট দিয়েছিস তার জন্য তুই আর অন্য কোনো অজুহাতই দেখাতে পারিস না।নিদ্র এতকিছুর পর এবার নিজের ভালো থাকার একটি উপায় খুঁজে নিয়েছে,আমরা সবাই ওর সঙ্গে আছি।’
নিজের বাবা মাই যেখানে আমার সাথে নেই সেখানে আমার বলার কি থাকতে পারে।নিজেকে আজ একা লাগছে,বড্ড একা।এখন মনে হচ্ছে এর থেকে মরে গেলেই ভালো হতো।নিদ্রকে ছাড়া বেঁচে থেকেই বা কি হবে।সেই তো আমাদের আলাদা হতেই হচ্ছে।কেনো করছে ভাগ্য আমার সাথে এমন!
-‘সুপ্তি।’
পেছন থেকে সোমা আপুর গলা শুনে তাকিয়ে দেখলাম সোমা আপু আর সাফা এসে বাগানে দাঁড়িয়ে আছে।দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।তারাও আমাকে ধরে কাঁদলো।সাফা বললো,
-‘তুই এমন কেনো করলি সুপ্তি?সবাইকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি মজা পেয়েছিস বলতো।তোর কোনো ধারণাও নেই সবাই কতটা চিন্তা করেছে যে তুই ঠিক আছিস কিনা!’
সোমা আপু বলল,
-‘সবার কথা বাদ দে।নিদ্র ভাইয়ার কি অবস্থা হয়েছিলো তুই জানিস?পাগল হয়ে গিয়েছিলো,পুরো পাগল!
তোকে কোথায় কোথায় না খুঁজেছে।তোকে খুঁজে না পেয়ে ভাইয়া কেমন ছটফট করেছে।সারাদিন ছোটাছুটি করতো।পুলিশের কাছে রিপোর্টও করে।এক পুলিশ অফিসার একবার বলে দিয়েছিলো যে হয়তো তুই কোনো অ্যাক্সিডেন্টে মারা যেয়ে বেওয়ারিশ হয়ে গেছিস।এই কথায় নিদ্র ভাইয়া সেই পুলিশ অফিসারের কলার ধরে তাকে মারতে যায় সবাই জোর করে ঠেকিয়ে রাখে।সারাদিন তোকে খুঁজে বেরিয়ে না পেয়ে গভীর রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতো।এসব আমাকে রাফি বলেছে।ছোটো থেকে ওরা বন্ধু,নিদ্র ভাইয়া খুব শক্ত ছেলে বলেই ওরা জানে।কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি।প্রথমে তো কোনো ধারণাও ছিলো না তুই এমন কেনো করলি।সেদিন তোর উদ্ভট আচরণ আর তার পর গায়েব হয়ে যাওয়া সব কিছু সবাইকে চরম বিভ্রান্তে ফেলে দেয়।তারপর আমরা নিদ্র ভাইয়াকে বলি তুই সেদিন তাকে তোর ভালোবাসার কথাই বলতে চেয়েছিলি।তারপর নিদ্র ভাইয়ার এড্রেসে তোর ডক্টরের সেই রিপোর্ট আর সেই চিঠি আসে।তারপরই সবকিছু সবার কাছে ক্লিয়ার হয়ে যায়।
এটা জানার পর থেকেই সে তোর উপর অনেক রেগে যায়।তুই নিদ্র ভাইয়াকে অনেক কষ্ট দিয়েছিস,এত সহজে সে তোকে মাফ করবে না।’
সাফা বলল,
-‘আর সুপ্তি,এটা কেমন কথা!তোর যদি সেই রোগ সত্যিই হয়ে থাকতো তাহলেই তুই এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবি!কোনো চেষ্টা না করেই?কখনো ভেবে দেখেছিস আল্লাহ না চাক এগুলো যদি সত্যি হতো তাহলে নিদ্র ভাইয়া নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতো কি না।কোনো পরিস্থিতিতেই কখনো এভাবে হাল ছেড়ে দিতে হয় না।’
আমি চোখের পানি মুছে বললাম,
-‘আমি মানছি আমি ভুল করেছি।তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।এখন সে এটা কেনো করছে,অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইছে।আমি সত্যি এটা মানতে পারবো না।’
সোমা আপু বললো,
-‘নিদ্র ভাইয়াকে তো তুই চিনিস,সে একটা একবার ঠিক করে ফেললে আর পিছু হটে না।’
-‘সুপ্তি তুমি এখানে শুয়ে পড়লে কেনো?’
-‘আপনিই তো বলেছিলেন আমার যেখানে ঘুমানোর ইচ্ছা আমি সেখানেই ঘুমাতে পারি।’
তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
-‘সেটা তো কাল বলেছিলাম।তাহলে গতকাল রাতে আমার পাশে শুয়ে ছিলে কেনো?’
-‘কারণ কাল রাতে আমি ভয় পেয়েছিলাম তাই।আজকে তো আর পাচ্ছি না।তাই এখন থেকে আমি সোফাতেই ঘুমাবো।’
-‘গতকাল যেমন ঘুমিয়েছো এখন থেকে সেভাবেই ঘুমাতে হবে।আমার পাশে ঘুমিয়ে আমার অভ্যাস করালে কেনো?এখন তো আমার একা একা আর ঘুম আসবে না।পাশে একজন কাউকে দরকার।এখন তুমি অভ্যাস করিয়েছো তাই তুমিই পূরণ করবে।’
কালো প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে কি অবলীলায় ব্যাপক মুডে তিনি কথাগুলো বললেন।আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম।মামা বাড়ির আবদার যেনো!যেনো তার সব ‘দরকার’কে
পূরণ করার এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই আমার এই পৃথিবীতে জন্ম হয়েছে।হুহ!
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
পঁচিশ বছর একা ঘুমিয়েও আপনার অভ্যাস হয়নি আর এখন একরাতেই আপনার অভ্যাস হয়ে গেলো?’
তিনি মুচকি হেসে ঘাড় নারিয়ে সায় দিলেন।
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
-‘তাহলে আপনার এই অদ্ভুত অভ্যাসকে ডিপ ফ্রিজে প্যাকেট করে রেখে দিন।আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।আমি ঘুমোলাম।’
কথাটি বলে আমি চোখ বন্ধ করে হালকা পাশ ফিরলাম।হঠাৎ সে আমাকে কোলে তুলে নিল।আমি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে রাখলাম।সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে একটি চোখ টিপ দিল।তারপর ধপ করে বিছানায় নিয়ে ছেড়ে দিল।আর নিজেও পাশে শুয়ে পড়লো।
আমি আড়মোড়ে আবার উঠতে গেলেই বলে উঠলো,
-‘খবরদার!আর এক বিন্দুও নড়াচড়া করবে না।নয়তো এবার কিন্তু দড়ি নিয়ে এসে বেঁধে রাখবো।’
এই বাড়িতে আমার দ্বিতীয় রাত্রির এই মিষ্টি ঘটনার কথা মনে পড়তেই অশ্রু চোখেও ঠোঁটের কোনাে একটা হাসি ফুটে উঠলো।আজ সাত মাস পর নিদ্রর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে এমন আরো ছোটোখাটো মিষ্টি স্মৃতি মাথায় ভেসে উঠতে লাগলো।রুমটা কি অগোছালো হয়ে আছে।
এমন গোছালো ছেলের রুম এভাবে হঠাৎ অগোছালো হয়ে উঠলো কিভাবে!
নিজে গিয়ে সব গুছিয়ে দিতে লাগলাম।সব গোছানো শেষে বিছানাটা গোছানোর জন্য হাত দিতেই নিদ্র এসে হাতে হেঁচকা টান দিয়ে বাঁধা দিল।রুক্ষ স্বরে বলল,
-‘কে বলেছে এসবে হাত দিতে।আমার জিনিস যেমন পড়ে আছে তেমনই থাকতে দাও।এখন গোছাতে এসেছো কেনো?ছেড়ে যাওয়ার সময় মনে ছিল না?’
-‘তবে সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার আমাকে আর একটা সুযোগ দিন।’
নিদ্র আমার হাত ছেড়ে পিছনে ঘুরে বলল,
-‘এখান থেকে চলে যাও,এই রুমে আর আসবে না।এই রুমে এখন আর তোমার কোনো অধিকার নেই।’
নিদ্রর মুখের এই কথায় খুব কষ্ট পেলাম।বিকেলে যখন আব্বু আম্মু চলে যেতে নিল তখন অভিমান করে আমিও সাথে গাজীপুরে চলে আসলাম।কেনো থাকবো ঐ বাড়িতে?নিদ্র তো বলেই দিল তার রুমে আমার আর কোনো অধিকার নেই।যদি তার রুমেই না যেতে পারি তবে সেই বাড়িতেই থেকে কি লাভ!
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাতেই দেখতে পেলাম আমাদের তিনতলা বিশিষ্ট গোটা বাড়িতে সাজগোজ চলছে।মনে হচ্ছে কোনো বিয়ে হতে যাচ্ছে।গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে আম্মুকে প্রশ্ন করলাম,’এসব কি?’
আমার প্রশ্নের জবাব দিল আব্বু।বলল,
-‘নিদ্রর বিয়ে এখানে হবে।আমার মেয়েই যেহেতু ওঁকে এত কষ্ট দিয়েছে তাই ওর বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব আমি নিয়েছি।আশা করি তুমি বুঝে গেছো।’
আব্বুর কথা শেষ হতে না হতেই পেছনে দু তিনটে গাড়ি এসে থামলো।গাড়ি থেকে নিদ্র বাবা মা সব বন্ধুরা নামলো আর সবার পেছনের গাড়ি থেকে নিদ্র আর রাইশা নামের মেয়েটি নামলো।তাদের দুজনকে একসাথে দেখে খুব ব্যাথা লাগলো বুকে।নিচের ঠোঁট কামড়ে অভিমান চোখে আব্বুর দিকে একবার তাকিয়ে আমি একছুটে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।দরজা বন্ধ করে খুব কাঁদতে লাগলাম।প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে আব্বু আম্মুর উপর।কেউ আমার আপন না,কেউ না।সবাই পর।এতবড় শাস্তি আব্বু নিজের মেয়েকে দিতে পারলো!কোনো বাড়িতেই আমার একটু ঠাঁই নেই।এখানেও নিদ্রর বিয়ে!
আমি মরে যাবো তবুও পারবো না তাকে চোখের সামনে অন্য কারোর হতে দেখতে।সবাই যেনো আমাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছে।
পুরো রুম জুড়ে কালো নিকষ অন্ধকার।রাতের গভীরতার সাথে সাথে যেন রুমের অন্ধকারও গভীর হচ্ছে।ঠিক আমার জীবনের মতো।বাইরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।মাঝে মাঝে আকাশ মৃদু গর্জে উঠছে।আবারো কি অদিনে বৃষ্টি নামবে।
বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এলাম।খোলা বারান্দার কার্ণিশ ছুঁয়ে বাতাস মৃদু শো শো শব্দ করে আমার সামনের চুল উড়িয়ে দিচ্ছে।বারান্দার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে বসে বাইরের আকাশ দেখতে লাগলাম।পুরো আকাশ ধীরে ধীরে মেঘের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে।বাইরে টাঙানো নিদ্রর বিয়ের মরিচ বাতিতে অন্ধকারটা আবছা হয়ে আছে।
আমাদের এই তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ির নিচের দুতলায় আমরা থাকি।আর উপরের তলা ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়।তবে এখন কোনো ভাড়াটিয়া না থাকায় উপরের তলা খালিই পড়ে আছে।সেখানেই নিদ্রদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।আমার রুমটি দোতলায়।এই যে আমার সরাসরি মাথার উপরের ছাঁদটির উপরেই নিদ্রর রুম।সেখানে নিদ্র আছে।মাত্র এক ছাদের ব্যবধান তবুও কি দূরত্ব!
আমাদের এখনকার সম্পর্কের মত।উদাসী মনে উদাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আনমনে গেয়ে উঠলাম,
মেরে দেহলীজ ছে হোক্যার
বাহারে যাব্ গুজারতী হে…
ইহা কেয়্যা ধূব কেয়্যা সাবান
হাওআয়ে ভি বারাসতে হে….
গানটির বেদনাদায়ক সুর গুলো অনবরত গিটারে তুলে নিদ্র যেনো নিজের কষ্টকেই ফুটিয়ে তুলছে।তার এই বেদনার সুর আমার কষ্টকেও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে।বুকের বা পাশে খুব তীক্ষ্ণ ব্যাথা হচ্ছে,খুব।তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত যেনো মনে এসে আমাকে ছুড়ি ঘাত করে যাচ্ছে।আকাশও যেনো প্রবল রেগে বারবার গর্জে উঠছে। বুকে হাত দিয়ে আমি শুধু বসে বসে নির্ঝরে নিরব চিৎকারে কাঁদতে লাগলাম।
♪♪মারজাভান…আ…আ….মারজাভান…♪♪
নিদ্রর গিটারের বেদনা ভরা সুরে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে চারিপাশকেও যেনো ব্যাথিত করে তুললো।সেই ব্যাথার আঘাতেই যেনো ঝরঝর করে তুমুল বেগে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো।আমি কষ্ট মিশ্রিত অশ্রু চোখে সেই জলধারার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম।কেনো যেনো মনে হল এই বৃষ্টি মাথার উপর বাইরে বাড়িয়ে দেওয়া নিদ্রর প্রসারিত হাতকে ছুঁয়ে আমার সম্মুখে ঝরছে।আমিও হাতটা বাড়িয়ে দিলাম সেই উন্মুক্ত জলধারায়।হয়তো পেলেও পেতে পারি এই গগন বর্ষিত ধারার সঙ্গতে সেই প্রিয় হাতের অস্পৃশ্য স্পর্শ।
কেমন আছে নিদ্র?ভালো আছে তো?ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া সত্যিই কি ভালো থাকা যায়?
আমি যেমন এখানে পৃথকের যন্ত্রণায় ছটফট করছি,নিদ্রও কি এতটাই কষ্ট পাচ্ছে?যন্ত্রণা লাঘবের জন্য যে ঘৃণার বীজ আমি তার অন্তরে বপন করে এসেছি তা কি একটু হলেও কাজ করেছে?
প্রশ্নে ঝুরি বদ্ধ হওয়া শ্বাসরুদ্ধ মনকে হালকা করতে ট্যাক্সির জনালার কাঁচ নামিয়ে দিলাম।মাথাটা গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে সকালের ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ দেখতে লাগলাম।পাহাড়ী এলাকার আকাশ দেখতে একটু বেশিই সুন্দর।এখানে কোনো নির্ভেজাল থাকে না,থাকে না কলকারখানা,যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। শুধু থাকে চারিপাশ জুড়ে সবুজ প্রকৃতির স্নিগ্ধতা।জানালা দিয়ে মৃদু মৃদু শীতল বাতাস আসছে।আজ শীতলতাটা যেনো একটু বেশিই।চাদরটা আনমনে গায়ে আরেকটু টেনে নিলাম।হেমন্তের পাট চুকিয়ে প্রকৃতি এখন শীতের আগমনের অপেক্ষায় নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।প্রকৃতির এই আকস্মিক পরিবর্তন মানুষ নিতে পারে না,জ্বর,ঠান্ডায় পড়ে অসুস্থ হয়ে পরে।
পরিবর্তন ব্যাপারটাই এমন।হঠাৎ করে হজম হতে চায় না।যেখানে প্রকৃতির অহরহ দেখা পরিবর্তনই মানুষ নিতে পারে না সেখানে পরিবর্তনটা যদি হয় হঠাৎ,অপ্রত্যাশিত তাহলে তো মানুষ সহ্যই করতে পারে না।চোখের সামনে হয়ে উঠে সব ধোঁয়াশা।সবকিছুকেই মিথ্যা মনে হয়।যেমনটি সেদিন হয়েছিল নিদ্রর।
চোখের সামনে আমার হঠাৎ এতবড় পরিবর্তন সেদিন উনিও মেনে নিতে পারেননি।যে মেয়েটি হালকা সাজে কখনো শাড়ি,সেলোয়ার কামিজ ছাড়া কিছু পরেনি সেই মেয়েটিই সেদিন একটু বেশিই আধুনিক ওয়েস্টার্ন পোশাকে তার সামনে এসেছিল।গাড় মেকআপের তলে নিজেকে ঢেকে তার ঈষৎ কোঁকড়া চুলগুলোও হেয়ার স্ট্রেইট মেশিনের বৈদ্যুতিক উত্তপ্ততায় পাল্টিয়ে ফেলেছিল।সকাল থেকে এক টানা সময় অফিসে কাটিয়ে ক্লান্ত মুখে পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরেছিল সে।রুমে প্রবেশ করেই আমার এরূপ অবস্থা দেখে খয়েরী শার্টের গলায় ঝুলা টাই হাত দিয়ে টেনে একটু ঢিলা করে ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বলেছিল,
-‘সুপ্তি,তোমার চুলগুলো কি সোজা করে ফেলেছো নাকি?আগের ধরণটাই তো বেশি ভালো লাগতো।’
চেহারায় এক নীচ অহংকারী ভাব নিয়ে রুক্ষ গলায় আমি জবাব দিলাম,
-‘কেন এখন এটাও কি আপনার থেকে জেনে করতে হবে?আমার নিজের বলতে কি কোনো পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারবে না।’
নিদ্র নরম গলায় বলল,
-‘আমি সেটা বলতে চাইনি।আমি তো জাস্ট…..
তার কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম,
-‘হ্যাঁ!আপনি তো জাস্ট নিজের মত গুলো অন্যের উপর জোড় করে চাপিয়ে দেন।আপনার কাছে তো আপনার নিজের স্বার্থ ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুই যায় আসে না,তাই না!’
সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,
-‘তোমার আজকে হয়েছে কি?কিসব বলছো,তোমার শরীর ঠিক আছে তো?’
তার মুখে “শরীর ঠিক আছে তো শুনে” আমার ভেতর থেকে কান্না বেড়িয়ে আসতে চাইলো কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে পেছনে ঘুরে শক্ত হয়ে বললাম,
-‘এসব ফেক কেয়ার দেখানো বন্ধ করুন।যেটা করা দরকার সেটা তো কিছু করছেন না।আর কতদিন এমন মিথ্যা বিয়ের বোঝ আমাকে টানতে হবে।আপনার ঐ মেয়ে মানবে কি না মানবে সেসব নিয়ে তো আর আমি ঠ্যাকা না।আমার এই জঞ্জাল আর ভালো লাগছে না।’
সে হঠাৎ প্রচন্ড রেগে বেড সাইডে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা তুলে মেঝেতে আছাড় মারল।ঝনঝন শব্দে ল্যাম্পটি চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।প্রচন্ড শব্দে আমি কেঁপে উঠে তার দিকে ঘুরে বললাম,
-‘এসব রাগ দেখিয়ে আবার আমাকে দমিয়ে রাখতে চাইছেন!আমার এখন এসবে কিছু যায় আসে না।’
নিদ্র দ্রুত আমার কাছে এসে তার দুই হাত আমার গালে রেখে ছলছল চোখে চোখ রেখে শক্ত মুখে বলল,
-‘সত্যিই কি তোমার কিছু যায় আসে না।তবে কি আমি যা বুঝেছিলাম সব ভুল ছিল?’
রাগ আর চাপা কষ্টে তার ক্লান্ত মুখটি লাল হয়ে গেছে।চোখ থেকে যেকোনো সময় অশ্রু বিন্দুটি গড়িয়ে পড়ল বলে।তাকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার।ইচ্ছে করছিলো তার ক্লান্ত,কষ্টে বিবর্ণ মুখটা বুকে জড়িয়ে ধরি।সেই চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলা যে অসম্ভব।
তাই এক ঝটকায় নিজের থেকে তার হাত সরিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললাম,
-‘আপনি কি বুঝেছেন না বুঝেছেন তা আমি কি জানি!আমি শুধু এতটুকু জানি যে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি এই ফেক ড্রামা করতে করতে।ব্যাস!এবার আমি আলাদা হতে চাই।’
আমার কথাটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নিদ্র তার দুই হাত দিয়ে আমার কাঁধ খুব শক্ত করে ধরে এক ঝটকায় তার কাছে টেনে রাগে চোখ মুখ খিচে বলল,
-‘চুপ!একদম চুপ।একদম খুন করে ফেলবো আলাদা হওয়ার কথা বললে।’
-‘ভালো!এভাবে শুধু জোরই করতে থাকুন।প্রয়োজনে আমাকে বিয়ে করে আপনার সাথে থাকতে জোর করছেন,কাল হয়তো প্রয়োজনে জোর করে শরীরটাও ভোগ করে নিবেন!’
আমার কথায় নিদ্র চরম বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছি! বলে আমাকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।তার ধাক্কায় আমার পা গিয়ে পড়ল ভাঙা ল্যম্পের টুকরোয়।
পা কেটে গর গর করে সেখান থেকে রক্ত বেরোতে লাগল।তবুও যন্ত্রণা তো হচ্ছে এই বুকের ক্ষতে,এর কাছে অতটুকু ক্ষত যে কিছুই না।
সোফার উপর পা গুটিয়ে বসে বসে কাঁদতে লাগলাম।সারাদিন পর মানুষটা ক্লান্ত মুখে বাড়ি ফিরেছিল।এখনো নিশ্চয়ই কিছুই খায়নি।আর আমার জন্য তাকে এখন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো।আর কিই বা করতাম আমি।আমি যে নিরুপায়।ভাগ্য যে আমাকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছে।কোনো দোষ না করেও সেই খেলার অংশীদার যে তাকেও হতে হবে।আমিও যে তাকে সেই নরক যন্ত্রণায় ফেলতে যাচ্ছি।আমি তা চাই না,কেনো পাবে নিদ্র এই শাস্তি কোনো অপরাধ না করেও?নিদ্রকে আমি জীবন্ত লাশ বানিয়ে রাখতে রেখে যেতে পারবো না।
আমি জানি,নিদ্র আমাকে ভালোবাসে,চরম মাত্রায় ভালোবাসে।আজ যদি আমি মরে যাই সেই ধাক্কা সে কখনোই সামলাতে পারবে না।তীব্র,তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় তাকে ভুগতে হবে আজীবন।ভালোবাসার পরিবর্তে এত বড় শাস্তি তাকে আমি দিতে পারবো না।তাই ঘৃণার আশ্রয় নিয়ে একটু হলেও যদি তার মন থেকে সরতে পারি।আমাকে ঘৃণা করে হলেও যদি সে আমাকে ভুলতে পারে,আবার সাজিয়ে নিতে পারে জীবন অন্য কারো সাথে।
‘আফা,এই সুন্দইরা ফুল নিতান?’
পাঁচ,ছয় বছরের পাহাড়ী একটি বাচ্চা মেয়ে জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে পাহাড়ি এলাকার জংলী ফুলগুলো আমাকে সাধছে।পেটের দায়ে বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে হয়তো অন্যদের মতো আভিজাত্য ফুলগুলো এরা পায় না।জঙ্গলের তরতাজা ফুলগুলো সংগ্রহ করিয়েই ভাগ্যের জোড়ে বেড়িয়ে পড়ে,যদিও পেলে পায় দু একটি জংলী ফুল ক্রেতা।
আমি হাত বাড়িয়ে বেগুনি রঙের সুন্দর ফুলগুলো নিলাম।
-‘নাম কি তোমার?’
মেয়েটি তীক্ষ্ণ রোদের থেকে হাত দিয়ে চোখকে আড়াল করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
-‘মিয়াংনু।’
-‘বাড়ি কোথায় তোমার?’
মেয়েটি তার ছোট্ট হাত বাড়িয়ে পুবের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের দিকে ইশারা করলো।বুঝতে পারলাম মেয়েটির বাড়ি সেখানের কোনো এক পাহাড়ের গায়ে।সে রোজ সেখান থেকে শহুরে রাস্তায় নেমে আসে ফুল বিক্রির জন্য।
-‘স্কুলে যাও?’
মেয়েটি হাসি মাখা মুখে ঘাড় নাড়িয়ে না বলল।
-‘তোমার বাবা মাকে বলবে তোমাকে আলোর ঝর্ণা নামের সংগঠনের কাছে নিয়ে যেতে।সেখানে বিনা টাকায় তুমি পড়ালেখা করতে পারবে।’
-‘হাছা।’
আমি মাথা নাড়িয়ে মৃদু হেসে মেয়েটিকে আশ্বাস দিলাম।পার্স থেকে দুশো টাকা বের করে মেয়েটির হাতে গুঁজে দিলাম।মনে হল মেয়েটিকে বিরাট বিপাকে ফেলে দিয়েছি।সে শুকনো মুখে হাতের মুঠোয় খুচরো দুই,পাঁচ টাকার নোট নাড়াচাড়া করছে।আমি মৃদু হেসে বললাম,
-‘তোমাকে ভাংতি দিতে হবে না।তোমার ফুলগুলো আমার অনেক পছন্দ হয়েছে তাই বেশি পছন্দের জন্য বেশি টাকা। বুঝেছো?’
মেয়েটি খুশি মনে দ্রুত ঘাড় নেড়ে এক ছুটে সেখান থেকে সরে আবার অন্য গাড়ির কাছে গেল।গাড়ির সামনে ভেড়ার পাল চলে আসায় ছোটোখাটো জ্যাম লেগে গিয়েছিল।দু মিনিটের মধ্যেই আবার ছুটে গেল।ঢাকা শহর হলে এই জ্যাম ছুটতে অন্তত দু ঘন্টা লেগে যেত।গাড়ি আবার ধীর গতিতে চলতে শুরু করলে আমি হাতে থাকা খোলা পার্স টা লাগাতে নিলাম।কিন্তু পারলাম না,আমাকে থমকে যেতে হল।খোলা পার্সের মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি ছোট্ট নীল চিরকুট।এক কোণা বের করে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে।বলতে চাইছে আমি আছি।
ছলছল চোখে চিরকুটটি বের করে তাতে লেখা শব্দগুলো মুহূর্তের মধ্যেই কয়েকবার পড়ে নিলাম।মুখস্ত হয়ে গেছে প্রতিটি শব্দ,তবুও বারবার পড়তে কতই না ভালো লাগে।কি যাদু মেশানো আছে এই শব্দে।দু লাইনের ছোট্ট নীল চিরকুট অসংখ্য বার পড়ে ফেলেছি তবুও যেনো হয়না পড়া।
নিদ্র আর আমার সেই দুটি গোলাপ ফুলের বাসর রাত।ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলেও সেদিন ঠিক করেছিলাম সারা রাত ঘুমাবো না।পাছে সকালে তার ঘুম ভাঙতে দেরি না হয়ে যায়।তাকে যে সবার উঠে পড়ার আগেই চলে যেতে হবে।নয়তো কেউ দেখে ফেললে কি সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে যাবে!জানালার বাইরে ছিল মস্ত বড় পূর্ণিমার চাঁদ আর আমার চোখের সামনে ছিল একটি চাঁদপানা ঘুমন্ত মুখ।অপলক চোখে দেখতে দেখতে মাঝ রাত হয়ে গেলেও কিভাবে যেনো একসময় চোখটা লেগে এসেছিল।সেই চোখ খুললো সকালের তীব্র রোদের আলোয়।ধরফরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছিলাম।রোদের তীব্রতা দেখেই অনুমান করে নিয়েছিলাম বেলা কতদূর।ভয়,আশঙ্কা নিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে যাকে খুঁজছিলাম তাকে আর নজরে পড়ল না।শুধু চোখে পড়ল মাথার কাছে সেই দুটি গোলাপের একটি গোলাপের নিচে ভার দিয়ে রাখা একটি নীল চিরকুট।হাত বাড়িয়ে নিয়ে কৌতুহলী চোখে কপাল ঈষৎ ভাঁজ করে চিরকুটটি পড়ে দেখলাম তাতে লেখা,
‘এই ঘুমকন্যা,তোমার বালিশে কি কোনো ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রেখেছো?মাথা ছোঁয়াতেই ঘুম।নয়তো ঘুম কি তাতো এক ঘুম চোর আমাকে ভুলিয়েই দিয়েছিলো!’
লেখাটি পড়ে আনমনেই আমার ঠোঁটের কোণায় একটি মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিল।হাত বাড়িয়ে সেই গোলাপটিও তুলে নিয়েছিলাম।একটি গোলাপ সে নিয়ে আমার জন্য আরেকটি রেখে গেছে।এমন অদ্ভুত অদ্ভুত ছোট ছোট ভালোবাসা মাখা পাগলামোগুলো তার মাথায় আসে কিভাবে কে জানে!
সে কি জানতো তার মতো আমিও সেই গোলাপটি সন্তর্পণে রেখে দিবো শুকিয়ে যাবার পরও?
যেমনটি সেও রেখেছো আমাদের বাসরের এই ক্ষুদ্র চিহ্ন তার ডায়েরীর ভাঁজে।
সত্যি!আমাকে সে আমার থেকেও বেশি জানতো।কিন্তু হয়তো সে এটা জানতো না আমি এই চিরকুটটিও রেখে দিবো।সেদিন সেই শুকনো ফুল আর নীল চিরকুট আমি কেনো আনমনে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম জানি না।কিন্তু এখন এই দূরত্বে এই চিরকুটটি আমায় বড্ড সামলিয়ে রাখে।তার স্মৃতিতে বিভোর হয়ে তাকে কাছে পাওয়ার তুমুল অস্থিরতা যখন আমাকে গ্রাস করে ফেলে প্রচন্ড জ্বালাতে থাকে তখন এই ছোট্ট কাগজের টুকরোটিই আমার স্বস্তির অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।কাগজের উপড়ে কালো কালিতে লেখা গোটা গোটা অক্ষরগুলো বারবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে তার স্পর্শ অনুভব করতে থাকি।কখনো বুকে জড়িয়ে তো কখনো গালে ছুঁয়ে রেখে চোখের জল অনবরত ফেলতে থাকি।
আজ সাত সাতটা মাস আমাকে এভাবেই কাটাতে হয়েছে।শুনেছি মৃত্যুর কথা শুনলে সেই সময়গুলো নাকি খুব দ্রুত কেটে যায়।কিন্তু আমার সময়গুলো কেনো কাটতেই চায় না।এই সাত মাস আমার কাছে সাতটা বছরের মত মনে হয়েছে।এখন শুধু মনে হয় দ্রুত মৃত্যু এসে পড়ুক।আর ডক্টরও দেখায়নি আমি।নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শুধু শুধু মিথ্যা আশা নিয়ে হসপিটালের দরজায় দরজায় ঘুরে নকল স্বান্তনা নিতে চাই না।
নিদ্রকে ছাড়া সময় কাটাতে যে খুব কষ্ট হয়।শরীরের অসুস্থতা আমি বুঝতেই পারি না,মনের অসুস্থতাই যে আমাকে মেরে ফেলছে।
কিন্তু যতই কষ্ট হোক নিদ্রর কষ্ট কম করার জন্য আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতেই হবে।
সেদিন কাটা পা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি আমার পায়ে ব্যান্ডেজ করা।বুঝতে আর বাকি রইলো না এই কাজটা কার।
তখনই বুঝতে পারলাম এই তীব্র ভালোবাসায় ঘৃণা কখনোই জায়গা করতে পারবে না।ঘৃণারও অত শক্তি নেই।আমাকে আরো বড় কিছু করতে হবে। তাই কোনো এক রাতের আঁধারে পাড়ি দিয়েছিলাম সবাইকে ছেড়ে কোনো অজানা পথে।আমার মৃত্যুটা কেউ না দেখুক।সেই ভয়ংকর বিভীষিকার সাক্ষী কোনো আপনজন না হোক।
নিজেকে লুকাতে এই সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় এসে পৌঁছালাম।জীবন সত্যিই সবাইকে সব কিছু শিখিয়ে দেয়।সেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা অবুঝ মেয়েটিও আজ অনেক কিছু বুঝতে শিখে গেছে।অপরিচিত শহরে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছে।এখানেই একটি আলোর ঝর্ণা নামের এনজিওতে এখন আমি জব করি।পাহাড়ি এলাকার গরীব বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে এই এনজিও টি কাজ করে।
খুব ভোরেই বের হয়ে এনজিওর হেড অফিসে যেতে হয়েছিলো একটা দরকারি কাজে।দু তিন ঘন্টা সেখানে পেরিয়ে এখন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।দেখতে দেখতে বাড়ির সামনে এসে পড়লাম।আমার বাসা শহরের শেষ প্রান্তের দিকে।
একটি ছোটো দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে আমি একা থাকি।
ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে কাঠের ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সামনে দৃষ্টি যেতেই আমার পা মেঝের সাথে আটকে গেলো।অস্ফুট স্বরে শুধু গলা দিয়ে বেরোলো “নিদ্র।”
সোফার উপর এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে নীল শার্ট গায়ে শক্ত মুখে নিদ্র বসে ছিল।
আমার গলা থেকে বের হওয়া অস্ফুট আওয়াজে সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে আসতে লাগলো।তাকে দেখে আমি পুরোই স্তব্ধ হয়ে গেছি।বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।খুশি আর শঙ্কার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
সে ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার মুখের উপর কিছু কাগজ ছুঁড়ে মারলো।আমি হতভম্ব হয়ে কাগজগুলো মাটি থেকে কুঁড়িয়ে সম্পূর্ণটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কাগজগুলোর একটি আমার মেডিকেল রিপোর্ট আরেকটি হসপিটাল থেকে ক্ষমা চেয়ে লেখা একটি এপোলজি লেটার।
সেখানে লেখা আমার ব্রেইন টিউমার হয়নি।হসপিটালের অন্য পেশেন্টের সাথে আমার রিপোর্ট এক্সচেন্জ হয়ে যাওয়ায় এমন মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে।হসপিটালের এতবড় অবহেলার জন্য তারা আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।আমার আসল রিপোর্টে দেওয়া আমার মাথা ব্যাথা নরমাল মাইগ্রেইনের সমস্যাই ছিলো।
নিজের চোখকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!সত্যিই তো আমি তো এটা ভেবেই দেখিনি আমার সত্যিই ব্রেইন টিউমার হয়ে থাকলে এতদিনে তো আমার অবস্থা খুব খারাপ হবার কথা।মনের কষ্টেই আমি এতটা বিভোড় ছিলাম যে এসবে কোনো লক্ষ্যই রাখিনি।
এক মুহুর্তের জন্য খুশি হয়ে নিদ্রর দিকে তাকালাম।কিন্তু পরমুহুর্তেই তার কথা শুনে আমার সমস্ত খুশি উধাও হয়ে গেলো।পায়ের নিচ থেকে কেউ যেনো মাটি কেড়ে নিল।
কারণ সে বলল,
-‘হুট করে যে উধাও হয়ে গেছো,আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আসোনি কেনো?তুমি বেঁচে থাকতে তো আর আমি আরেকটা বিয়েও করতে পারবো না।আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে,এবার আমাকে ডিভোর্স দিয়ে উদ্ধার করো!’