Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1858



অনুভূতি পর্ব ৩১

0

অনুভূতি
পর্ব ৩১
মিশু মনি
.
৪৮.
মেঘালয় হোটেলে ফিরে ওর বন্ধুদেরকে রুমে ডেকে নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে বললো অরণ্য ও দুপুরের ব্যাপারটা। সবাই শুনে রীতিমত রাগে ফুঁসতে লাগলো। অরণ্য’র সাধু চেহারার আড়ালে ওরকম বাজে একটা মানসিকতা লুকিয়ে ছিলো চিন্তাই করা যায়না। ওরা আর কখনো অরণ্য’র মুখ ও দেখতে চায়না, পুরুষ নামের কলঙ্ক একটা।
মেঘালয় অরণ্য’কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “দোস্ত তুই কোথায়? তোকে রুমেও পেলাম না আর লবিতেও পেলাম না।”
– “দুপুর তোদের সাথে কমফোর্ট ফিল করছিলো না রে,সেজন্য ওকে নিয়ে আমি একাই বেড়িয়ে পড়েছি। তোরা তাহলে তোদের মত বেড়িয়ে পড়। কিছু মনে করিস না কেমন?”
– “আচ্ছা,ভাবির দিকে খেয়াল রাখিস।”
কথাটা বলেই মেঘালয় কল কেটে দিয়ে তাকালো বন্ধুদের দিকে। ওরা জানতে চাইলো ভাবির খেয়াল রাখা বলতে মেঘালয় কি বুঝিয়েছে? মেঘালয় বললো, “অরণ্য বলেছে দুপুর নাকি আমাদের সাথে ঘুরতে কমফোর্ট ফিল করেনা। সেজন্য ও দুপুরকে নিয়ে একাই বেড়িয়ে পড়েছে। হোয়াট দা…”
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো। ওর বন্ধুরাও শব্দ করে হাসতে লাগলো। দুপুর অরণ্য’র সাথে থাকলে তো বেড়াতে যাওয়ার প্রশ্ন আসে। সে তো ইতিমধ্যে ঢাকার পথে পাড়ি দিয়েছে। আর মেঘালয়ের সাথে সে কেমন ফিল করে সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই। কতটা বিশ্বাস করলে একজন অচেনা ব্যক্তিকে এভাবে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার শেয়ার করা যায়? এটা কারো বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেজন্য ওরা অরণ্য’র কথা ভেবে হাসতে লাগলো।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে ওরা রেস্টুরেন্টে চলে আসলো। মিশু রৌদ্রময়ীকে দেখেই ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে বললো, “এইযে বিয়ের কনে,সেদিন তো খুব ভাব নিচ্ছিলে। আমি এত এত করে গল্প করতে চাইছিলাম আর তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিলে না। এখন কি করবে শুনি? এখন কি এই মিশুর সাথে কথা না বলে থাকতে পারবা হুম?”
মেঘালয়ের বন্ধুরা মিশুর এমন ছেলেমানুষি দেখে হাসলো। রৌদ্রময়ী বুঝে গেছে মেয়েটা অনেক মিশুক। নামেও মিশু আর কাজেও মিশুক। রোদ মিশুকে জাপটে ধরে বললো, “সরি বোন। সেদিন খুব মন খারাপ ছিলো।”
– “জানি জানি। তুমি খেয়েছো?”
মিশুর এমন সরলতা দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সবাই। সায়ান মেঘালয়কে বললো, “দ্যাখ মনেহচ্ছে মিশু নিজের বোনকে পেয়েছে। কি খাতির দেখেছিস?”
মিশু বললো, “বিডির সব মেয়েই আমার বোন।”
এরপর সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করার পর বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। একটা লেগুনা ঠিক করে নেয়া হলো ওদেরকে পৌছে দেয়ার জন্য। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে ওরা লেগুনায় উঠে পড়লো। লেগুনার রীতিমত ঝাঁকুনি শুরু হয়ে গেছে। ঝাঁকুনির ঠেলায় মিশু হো হো করে হাসছে। সায়ান বললো, “আমরা তাহলে চিল শুরু করে দেই কি বলো ফ্রান্স?”
মিশু বললো, “আমি ফ্রান্স নই আমি ফরাসী।”
আরাফ বললো, “তোর চিল শব্দটা শুনে আমার একটা জোকস মনে পড়ে গেলো। একটা ছেলে চিল আর একটা মেয়ে চিলের বিয়ে হয়েছে। তো বাসর রাতে ছেলে চিল মেয়ে চিলকে বললো, “ডার্লিং এখন আমরা চিল করবো। চিইইইল…”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। রোদ ও হেসে ফেললো। সত্যিই দুপুর ঠিকই বলেছে। মেঘালয়ের বন্ধুরা খুবই ভালো আর মজার। অনেক ফানি সবাই।
পূর্ব বললো, “আজকে আমরা একটা খুব ভালো কাজ করেছি। আজকে আমরা দুজন পবিত্র মনের মানুষকে এক করে দিয়েছি। একটা সুন্দর জুটি বেঁধে দিয়েছি, একটা স্বার্থপরের হাত থেকে ভালো একটা মেয়েকে উদ্ধার করেছি। আমাদের রৌদ্রময়ী আপুকে এখন এখন বিনোদনের ব্যবস্থা করে মন ভালো করে দেয়াটা আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব। আজকে আমাদের আর কোনো দুঃখ নেই, সো জাস্ট এনজয়।”
মিশু হঠাৎ বলে উঠলো, “ডিয়ার লিসেনার্স, গুড মর্নিং টু অল। আপনারা টিউন করে আছেন ‘অনুভূতি’ এফ.এম ভালোবাসা পয়েন্ট টু। আপনাদের সাথে আছি আমি Rj মিশু। গল্প হবে, আড্ডা হবে, আর হবে অস্থির কিছু গান। তার আগেই আমরা নিয়ে নিচ্ছি একটা ছোট্ট টুইং ব্রেক। টুইংগ্যা ট্যাটাং টুইংগ্যা ট্যাটাং টুইং।”
সবাই হেসে ফেললো মিশুর কথা শুনে। কিন্তু মেঘালয় অবাক হয়ে গেলো। মেয়েটা সত্যিই Rj দের মত করে বলেছে। আর মিশুর ভয়েসের সাথে একদম খাপে খাপে মিলে গেছে জকির কাজটা। ওর ভয়েস টা খুবই মিষ্টি আর আবেগ মিশ্রিত, কন্ঠের ওঠানামা টাও একদম ভেতরে কাঁপন তুলে দেয়ার মত।
মিশু একটা ধাক্কা দিলো মেঘালয়কে। মেঘালয় চমকে উঠে বললো, “হুম মুশু বলো।”
– “তোমরা এমন কেন বলতো? আমাকে মিশমিশ, ম্যাশ,মুশ,মশা,মুশু আর কত কি বলো। আমার নামটা কত্ত সুইট না? এইগুলা বলো কেন?”
সায়ান বললো, “তোমার কিউটনেস দেখলে আপনা আপনি বেড়িয়ে আসে নামগুলা।”
– “আমার আবার কি দেখলে? আমিতো তোমাকে কিছু দেখাই নি।”
লজ্জায় সায়ান মাথা চুলকাতে লাগলো। সবাই মিটিমিটি হাসছে। মিশু বললো, “ফিরে এলাম ছোট্ট টুইং ব্রেক থেকে। এবার চলে যাচ্ছি গানে। এখন আমাদের মাঝে গান পরিবেশন করবে মেঘালয় আহমেদ। মিউজিকে থাকছে অনুভূতি ব্যান্ড দল। লেটস স্টার্ট।”
মেঘালয় গান আরম্ভ করে দিলো,
“আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে, হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
সবাই হেসে উঠলো। হেসে ওর বন্ধুরাও যোগ দিলো মেঘালয়ের গানে। মেঘালয় আবারো শুরু করলো,
“আ আ ওরে ভাই, একদিন গেলাম সিনেমা দেখতে,
আর রিক্সা থেকে নেমে দেখি হলে একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে,
হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটির চোখে আমার চোখ পড়েছে…
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে….”
আ আ ওরে ভাই, হাউজফুল কোনো টিকিট নাই,
ব্লাকে দশ টাকার টিকিট বিশ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে কোনো রকম ভিতরে গিয়ে বসলাম,
হঠাৎ দেখি পাশের চেয়ারে সেই মেয়েটি আমার পাশেই বসেছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…
আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে, হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
সবাই হাসছে হাত তালি দিচ্ছে আর মেঘালয়ের গানের শেষ লাইনের সাথে তাল মিলাচ্ছে। দারুণ জমে গিয়েছে গানটা। মেঘালয় খুব সুন্দর করে গাইছে আর ওরা মিউজিক দিচ্ছে। যখন সবাই একসাথে গাইতে আরম্ভ করে, তখন আরো বেশি মজা হচ্ছে।
মেঘালয় আবারো শুরু করলো,
“আ আ ওরে ভাই, সিনেমা আরাম্ব হয়ে গেলো,রাজ্জাক শাবানা যখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো,
তখন আমার বুকের ভেতর ধুপধাপ শুরু হয়া গেলো,
আহা! আমি যদি প্রেম করতে পারতাম!
তখন দেখি পাশের সিটে বসা সেই মেয়েটি আমাকে চিমটি মেরেছে…”
এই পর্যন্ত গাওয়ার পর মিশু দুই নখ দিয়ে ইয়া জোরে মেঘালয়ের হাতে একটা চিমটি কেটে দিলো। মেঘালয় লাফিয়ে উঠে বললো, “উফফ!”
সবাই গানের সাথে তাল মিলাচ্ছে,
“টিকাটুলির মোরে একটা হল রয়েছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে।”
মেঘালয় শুরু করলো,
“আ আ ওরে ভাই, আমি মেয়েটিকে বললাম,
তোমার নাম কি? বলল মালতী বিবি,
আহা গো, মালতী বিবি বলেই,
সেই মেয়েটি একটা ফক্লা হাসি দিয়েছে…
হলে নাকি এয়ারকন্ডিশন রয়েছে…”
“আরে টিকাটুলির মোড়ে একটা হল রয়েছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
“আ আ ওরে ভাই, সিনেমা শেষ হওয়ার পথে,
রজ্জাক ভীলেইন যখন ধুপ ধাপ মাইরপিট,
আবার শাবানা এসে রাজ্জাকে বলল,
আমি তোমার চিরদিনের সাথী,
তখন দেখি পাশের সিটে বসা মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে…”
গানের এই জায়গায় এসে মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো। সবাই হাসতে শুরু করে দিলো। কিন্তু গান চলতেই লাগলো।
“আ আ ওরে ভাই, সিনেমা শেষ হয়া গেলো,
বাইরে আসলাম রিক্সা নিলাম,
হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটি দৌড়ে এসে,
আমার রিক্সার ভেতরে চেপে বসেছে,
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
“আ আ ওরে ভাই, মেয়েটি বলল আমাকে
ডার্লিং খুভ খুধা পেয়েছে,
গেলাম মস্তফা হোটেলে,
খুব পোলাও কোর্মা খাইলাম,
হঠাৎ দেখি বয় একটা ৫০০ টাকার বিল এনেছে,
বিলটা দেখে তখন আমার মাথা ঘুরেছে…
হলে নাকি এয়ার কন্ডিশন রয়েছে…”
এ পর্যন্ত গাওয়ার পর সবাই রিমিক্স শুরু করে দিলো। মিশুর যা আনন্দ হচ্ছে। ওর বন্ধুরা গানের সাথে সুর মিলিয়ে গাইছে। আর হাত তালি দিচ্ছে। রোদ হেসেই কুটিকুটি।
মেঘালয় আবারো গাইতে লাগলো,
“আ আ ওরে ভাই, মেয়েটি বলল ডার্লিং
আজকের মত চলে যাই,
বলে চলে গেলো..
আমি বাড়ি এসে রিক্সা থেকে নেমে,
রিক্সা ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি,
মেয়েটি আমার পকেট মেরে চলে গিয়েছে….”
গানের শেষ লাইনেই চরম বিনোদন। মেঘালয়ের সুরের সাথে ওর বন্ধুদের সুর মিলে এমন একটা হারমনি হচ্ছে যে, মন খারাপ থাকার কোনো সুযোগ ই নেই। শেষ লাইনের পর লেগুনার ড্রাইভার আর হেলপার ও শব্দ করে হাসতে লাগলো। লম্বা গান গাওয়ার পর সবাই থামলো। লেগুনার ড্রাইভার বললো, “মামারা তো পুরাই ফাটাই দিসেন।”
পূর্ব সবার মধ্যে একটু বেশিই দুষ্টু। ও জিজ্ঞেস করলো, “কি ফাটালাম মামা?”
ড্রাইভার হাসতে হাসতে বললো, “মামা গলা ফাটিয়ে গান গাইসেন।”
– “ও আচ্ছা। আমি আবার ভাবলাম কি না কি অজান্তেই ফাটিয়ে ফেলছি।”
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। রৌদ্রময়ী শব্দ করে হাসতে হাসতে পূর্ব’র কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়লো। রৌদ্রময়ীর শরীরে একটা মাদকতাময় গন্ধ। নাকে এসে লাগতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো পূর্ব’র। মেয়েদের গায়ে বুঝি এত সুন্দর ঘ্রাণ থাকে! আগে অজানা ছিলো ব্যাপার টা।
ও একা একাই মুখ টিপে হাসতে লাগলো। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, “কিরে পূর্ব তুই একা একা হাসছিস কেন? আমাদেরকেও বল একটু, আমরাও হাসি।”
পূর্ব খুবই পাজি। ও মজা করে বললো, “পূর্বে রোদ উঠেছে।”
বলেই চোখ মারলো মেঘালয়কে। মেঘালয় পূর্ব’র সোজাসুজি সামনে বসেছে। ও খেয়াল করেছিলো ব্যাপারটা। শব্দ করে হেসে উঠলো ও। বাকিরা কেউ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মেঘ হাসছিস যে? বল না তোরা হাসছিস কেন?”
মেঘালয় বলল, “পূর্বে রোদ উঠেছে। সেজন্য হাসছি।”
মিশু মাথা বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো, “আজকে একটু বেশিই রোদ উঠেছে বাইরে। কিন্তু রোদ তো সবসময় পূর্ব দিকেই ওঠে। এতে হাসার কি হলো? আজকে তো আর পশ্চিম দিকে উঠেনাই।”
পূর্ব আর মেঘালয় হাসছে মুখ টিপে। রৌদ্রময়ী বুঝতে পেরেছে ওরা কি বুঝাতে চাইছে। লজ্জায় ওর ইচ্ছে করছিলো শাড়ির আচঁলে মুখটা লুকিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকতে। পূর্ব রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কি রাগ করছো বা কিছু মনে করছো? কিছু মনে করোনা,আমরা খুব ফ্রেন্ডলি। ভাব্বে এখানে আমরা সবাই একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। মিশু যেমন আমাদের সবার বন্ধু,তুমিও সেরকম ভাব্বে। তাহলে এনজয় করতে পারবে।”
রোদ হাসার চেষ্টা করলো। আসলেই তাই। সবাইকে আপন ভাবতে পারলে তবেই আনন্দ করা সম্ভব। মনের মেঘটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। মন ভালো হয়ে গেছে ওর। এই কয়েক দিনের কষ্টের কথা একদম ভূলে গিয়েছে কয়েক মুহুর্তের জন্য।
রোদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুম।”
আরাফ রোদকে বললো, “সহজ হোন আপু। সহজ হোন, কঠিন হয়ে বসে থাকলে আমিও কঠিন হবো কিন্তু। আমি গোমরামুখো মানুষ একদম ই দেখতে পারিনা। মুখ কালো করেছেন দেখলে ধাক্কা দিয়ে লেগুনা থেকে ফেলে দিবো।”
মিশু বললো, “আরাফ ভাইয়া কি আর কিছু পারো না? গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া ছাড়া?”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু একটা মোক্ষম জবাব দিয়েছে। এই ছেলেটা সবসময় বন্ধুদেরকে গাড়ি থেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দিতে চায়। এবার ঠিক হয়েছে।
মিশু বললো, “রোদকে গাড়ি থেকে ফেলে দিবেন কিভাবে? আজকে পূর্বদিকে রোদ উঠেছে। ”
পূর্ব হাসতে হাসতে বললো, “তোমার নাম মিশু না রেখে মশা রাখা উচিৎ ছিলো। মশার মত সারাক্ষণ ভনভন করো খালি।”
মিশু বললো, “মশার মত কামড়াই ও।”
কথাটা বলেই থতমত খেয়ে গেলো। মেঘালয় জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফেললো। মেয়েটার মুখে কিচ্ছু আটকায় না। ওর বন্ধুরা হাসছে। রৌদ্রময়ীর এখন মনটা একদম ভালো হয়ে গেছে। এদের সাথে থাকলে মন ভালো না হয়ে উপায় আছে? দুপুর ওকে রেখে গিয়ে বেশ করেছে। এখন ইচ্ছে করছে আজীবন এদের সাথে থেকে যাই।
মেঘালয় সবার অগোচরে মিশুর পিঠের পিছন দিক দিয়ে ওর কোমরে হাত রেখে হাতটা আস্তে আস্তে উপরে তুলতে লাগলো। মিশু শিউড়ে উঠে চোখ রাঙাল ওর দিকে। মেঘালয় খুব পাজি, মিশুকে থামিয়ে দিতে ওস্তাদ। খুব খারাপ একটা। মিশু চেঁচিয়ে বললো, “ধাক্কা দিয়ে লেগুনা থেকে ফেলে দিবো। ”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো মিশুর দিকে। লেগুনায় সবাই একসাথে মুখোমুখি হয়ে বসার কারণে বেশ ভালো হয়েছে। একে অপরের দিকে তাকাতে পারছে, গল্প করতে পারছে সবাই মিলে। গান গাওয়ার ও সুবিধে হয়েছে। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, “কাকে ফেলে দিবা ম্যাশ ভাবি?”
– “কাউকে না। আরাফ ভাইয়ার অসুখটা আমাকেও ধরেছে।”
– “ও আচ্ছা। কাউকে ফেলে দেয়ার দরকার হলে আরাফকে বলো। ও লেগুনার দরজায় দাড় করিয়ে পিছনে একটা লাত্থি দিয়ে বাইরে ফেলে দিবে।”
– “কাউকে ফেলে দেয়ার দরকার নাই। অবশ্য কখনো পূর্বদিকে না উঠে, পশ্চিম দিকে রোদ উঠলে রোদকে ফেলে দেয়া যেতে পারে।”
রৌদ্রময়ী চোখ বড়বড় করে তাকালো মিশুর দিকে। কি বলেরে এই মেয়েটা! সাংঘাতিক মেয়ে বটে। মুখে কিচ্ছু আটকায় না একদম। পূর্ব না হয় বলতেই পারে অনায়াসে, তাই বলে সেও বলবে? অবশ্য এজন্যই মিশুকে সবার চেয়ে একটু আলাদা মনেহয়। সবাই অনায়াসে সবকিছু বলতে পারেনা, যে গুনটা মিশুর আছে।
লেগুনার ঝাঁকুনিতে একেকজনের অবস্থা করুণ। সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো। গায়ে ব্যথা অবস্থা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সিলেটের রাস্তাগুলোর একদম করুণ দশা, বিশেষ করে বিছানাকান্দি ও জাফলং এ যাওয়ার রুটটা। একদম হাড় হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। মিশুর বেশ মজা লাগছে। কারণ মেঘালয় ওকে বাহুর বন্ধনে ধরে রেখেছে যাতে পড়ে না যায়। মেঘালয় এভাবে ধরে রাখলে ভাঙা চূড়া কোনো ব্যাপার ই না। রৌদ্রময়ী বারবার গাড়ির ঝাঁকুনিতে পূর্ব’র কাঁধের উপর ওর মাথাটা গিয়ে পড়ছে। চুল পূর্ব’র মুখের উপর এসে উড়ছে। পূর্ব বেশ উত্তেজিত, দারুণ উপভোগ করছে ও ব্যাপার টা।
৪৯.
ঘাটে পৌছে লেগুনা থেকে নেমে নৌকায় এসে উঠলো ওরা। গন্তব্যস্থল বিছানাকান্দি। মিশু আনন্দে লাফাচ্ছে, ওর খুবই মজা লাগছে। মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসলো। আর বাকিরা ওদের পিছনে। মিশু সবার সামনে মেঘালয়কে নিয়ে বসেছে। নৌকা ছেড়ে দিলে মেঘালয় ওর হাত ধরে এনে এক কোনায় বসিয়ে দিলো। পানিতে পা নামিয়ে দিয়ে মেঘালয়ের হাত ধরে বসে রইলো মিশু। পানি পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে,খুব আনন্দ হচ্ছে।
মেঘালয় একহাতে ওকে ধরে রেখেছে। বাকিরা গান শুরু করে দিয়েছে,
“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও রবে আমার..
স্তব্ধ সময় টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার…”
গানের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে নদী। নৌকার ভটভটির শব্দ ছাড়িয়ে গানের আওয়াজ অনেক দূর চলে যাচ্ছে। নদীতে থাকা অন্য নৌকার যাত্রীরা মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছে ওদের নৌকার দিকে। রৌদ্রময়ীর ও খুব আনন্দ হচ্ছে এখন। বাতাসে চুল উড়ছে, আঁচল উড়ছে। ভালো লাগছে খুব। এদিকে পূর্ব রীতিমত জ্বলছে, কারণ রোদের চুল উড়ে এসে ওকে মাতাল করে দিচ্ছে। মেয়েটার চুলের গন্ধও অপূর্ব। শুধুমাত্র এই মাদকতাময় ঘ্রাণ দিয়েই বোধহয় প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে মেয়েটা।
হঠাৎ একটা পাহাড়ের মত কিছু দেখতে পেয়ে মিশু আনন্দে লাফিয়ে উঠে মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলো, “ওটা কি?”
– “মেঘালয়।”
– “ওই যে দেখতে পাচ্ছো, একটা ইয়া বড় আকাশের সমান পাহাড়। ওটা কি?”
– “মেঘালয়।”
– “আরে ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে, গাঢ় সবুজ আর কি সুন্দর! ওটার কথা বলছি। কি ওটা?”
– “মেঘালয়।”
মিশু ভয়ংকর রেগে বললো, “একদম ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিবো। ইয়ার্কি করা হচ্ছে আমার সাথে। বারবার জানতে চাচ্ছি ওটা কি আর উনি বলছে মেঘালয়। রাগ ওঠেনা বলো?
আরাফ বলল, “কি জানতে চাচ্ছো মিশু?”
– “ওই যে ওই পাহাড়ের মত জিনিসটা দেখা যাচ্ছে যে, ওটা কি?”
– “ওই পাহাড়ের মত জিনিস টার নামই তো মেঘালয়।”
– “কিহ! ওটার নাম মেঘালয়!”
– “হ্যা, আমরা এখন মেঘালয়ের কাছেই যাচ্ছি।”
মিশু লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। মেঘালয় তো সঠিক জবাব ই দিয়েছে, ওটা মেঘালয়ই। কিন্তু মিশু ভেবেছিলো মেঘালয় বুঝি মজা করছে ওর সাথে। এখন লজ্জায় ওর মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “ওটা মেঘালয় বিশ্বাস হচ্ছিলো না তাইনা?”
মিশু বললো, “আমি কি আর জানি এখান থেকে মেঘালয় দেখা যাবে, তাছাড়া মেঘালয় নামে কিছু আছে সেটা আমার মনেই ছিলোনা। সত্যিই আমার মেঘালয় আর ওই মেঘালয় দুটোই খুব সুন্দর! দুটোই অনেক বিশাল আর ভয়ংকর সুন্দর!”
মেঘালয় বললো, “এক্ষুনি তো আমাকে নদীতে ফেলে দিতে চাইছিলে।”
মিশু লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। নদী থেকে মেঘালয়ের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে পাগল হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো ওর। হা করে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। বাতাসে এলোমেলো ভাবে চুল উড়ছে, মেঘালয় শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে। মিশু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে ওই বিশাল মেঘালয়ের দিকে, আর মিশুর মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে মিশুর দিকে।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩০

0

অনুভূতি
পর্ব ৩০
মিশু মনি
.
৪৬.
রোদ বলতে আরম্ভ করলো,
“আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো বাড়ি থেকে। অরণ্য’র বাবা আমার বাবার ভালো বন্ধু, উনি চেয়েছিলেন আমাদের পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করতে। সেজন্যই বিয়ে পর্যন্ত আসা। আমি আগেই অরণ্যকে দেখেছিলাম কিন্তু অরণ্য আমাকে দেখেনি। ও দেখেছিলো দুপুরকে। আর ভেবেছিলো দুপুরের সাথেই ওর বিয়ে। তাই ওর বাবার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলো। আমাদের প্রায় এক সপ্তাহের মত শুধুমাত্র ফোনেই কথা হয়েছে। তারপর বিয়ের দুদিন আগে আমরা আলাদাভাবে বাইরে দেখা করি। আমাকে অরণ্য’র পছন্দ হয়নি। কিন্তু সে ব্যাপারে কিছুই ও আমাকে বলেনি। ঠিকমত ফোন ধরত না আর। আমি ভাবতাম বিয়ের ঝামেলায় হয়ত ব্যস্ত আছে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে ও আমাকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করে বলে, ‘যেভাবে পারো বিয়েটা আটকাও। তোমাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি জানতাম না তুমি এমন দেখতে। আমি চাই, আমার বউ অন্তত আমার চেয়ে ফর্সা হোক। তোমাকে বিয়ে করলে সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না। অযথা দুজনের লাইফে তিক্ততা বাড়ানোর কোনো মানে হয়না। যেভাবে পারো বিয়েটা আটকাও।’ সেদিন অরণ্য’র কথা শুনে আমার ইচ্ছে করছিলো মাটির ভেতর ঢুকে যাই। আমিও ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আর এক সপ্তাহে অনেক স্বপ্নও দেখে ফেলেছিলাম। সব কষ্ট মেনে নিয়েও ওকে বলেছিলাম যেন নিজেই ওর বাবাকে বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে। ও বলেছিলো, ‘আমার বাবাকে বললে আমাকে মেরে ফেলবে নয়ত ত্যাজ্য করবে।আব্বু খুব রাগী।’ আমি ওকে অনেক কিছুই বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও মাত্র একটা কথা বলে আমাকে চিরতরে থামিয়ে দিয়েছে। ওর কথাটা ছিলো, ‘তুমি কি চাও তোমার স্বামী ঘরে তোমাকে রেখে অন্য মেয়ের কাছে যাক? যদি চাও তাহলে বিয়ে করো।”
নিখিল হতবাক হয়ে তাকালো রোদের দিকে। রোদ চোখ মুছে বললো, “একটা মেয়ের জন্য এরচেয়ে বড় অপমান আর হয়না রে নিখিল। যার সাথে রাত পোহালেই আমার বিয়ে,সে আমাকে বিয়ের আগের রাতে বলছে তুমি কি চাও তোমার স্বামী অন্য মেয়ের কাছে যাক? এটা কতটা অপমানের ভাবতে পারিস নিখিল?”
নিখিল রোদের হাত ধরে বললো, “কাঁদিস না প্লিজ। শক্ত হ রোদ। তুই এসব বাবাকে বলিস নি কেন?”
রোদ বললো, “আংকেলের সাথে আব্বুর খুব ভালো সম্পর্ক। আব্বু সারাক্ষণ বলতো ওনার কাছে সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। আমি যদি এসব আব্বুকে বলতাম, আব্বু জনসম্মুক্ষে অরণ্য আর ওর বাবাকে অপমান করতো। আমিতো একটু হলেও অরণ্যকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। আমি চাইনি আমার জন্য ও অপমানিত হোক। কি করবো কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিয়ে হলেও আমি দাম্পত্য জীবনে কখনোই সুখী হতাম না। আর বিয়ে ভাঙতে চাইলে আব্বুকে বলতেই হবে, সেটাও পারছিলাম না। আমার ইচ্ছে করছিলো সুইসাইড করতে তাও পারিনি। অতটা সাহস আমার নেই। আমি সারারাত আর বিয়ের দিন সারাটা দিন কেঁদেছি, সন্ধ্যায় এমন অবস্থা হলো যে আর কিছু চিন্তাই করতে পারছিলাম না। চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো হয়ত। কিছুতেই কি করবো মাথায় কাজ করছিলো না আমার। অরণ্য সন্ধ্যার পর কল দিয়ে বলেছিল, ‘দোহাই লাগে তুমি বাড়ি থেকে চলে যাও। সেটাই আমাদের দুজনের জন্য ভালো হবে। আমার তখন মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ, আমি সত্যি সত্যিই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পাগলের মত ছুটতে থাকি। আমি তখন বুঝিনি সে দুপুরকে বিয়ে করার জন্যই আমাকে পালাতে বলেছিল। জানলে আমি বাড়ি থেকে চলে যেতাম না নিখিল। বিশ্বাস কর আমাকে।”
রোদ আর কথা বলতে পারছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। অরণ্য রোদের হাত ধরে বললো, “একটু বোকামি করে ফেলেছিস। তোর উচিৎ ছিলো বাবাকে সবকিছু খুলে বলা। তাহলে একটা সমাধান হয়েই যেতো।”
রোদ বললো,”আমি ওর আর ওর বাবার সম্মানের কথা ভেবেছি, আমার বাবার সম্মান নিয়ে ভাবিনি। আমার চিন্তা করার মত অবস্থা ছিলোনা। তুই তো জানিস আমি লাইফে কখনো রিলেশনে জড়াইনি, জীবনে প্রথম অরণ্যকেই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আমার সমস্ত স্বপ্ন নিমেষেই চুরমার হয়ে গেছে। আর এভাবে কেউ কখনো আমাকে অপমান করবে আমি সেটা ভাবিনি।”
রোদ কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লো নিখিলের কাঁধে। নিখিল ওকে ধরে বললো, “এখন তো আমার মাথা কাজ করছে না। দুপুর কখনোই আমাকে ছেড়ে অরণ্যকে নিয়ে সুখী হতে পারবে না। আর এখন সবচেয়ে বড় কথা, অরণ্য ছেলে হিসেবে ভালো হলে কি হবে ওর তো চাহিদা দুপুরের শরীরের প্রতি। বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই ও দুপুরকে এত কেয়ার করছে। তার হাতে কিভাবে দুপুরকে ছেড়ে দেই আমি? আমি যে ওকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ওরকম একটা লোকের হাতে ওকে ছেড়ে দিতে আমার ঘৃণা হচ্ছে।”
রোদ কান্না থামিয়ে মাথা তুলে বললো, “তোদের ভালোবাসা একদম পবিত্র ছিলো। আমার মতে তুই গিয়ে ওকে নিয়ে আয় সেটাই ভালো হবে। আমার ভূলের জন্য তোরা প্লিজ লাইফটা নষ্ট করিস না। তুইও আজীবন পুড়বি,দুপুর ও কখনো সুখী হতে পারবে না। সবকিছু জেনেও কি তুই ওকে অরণ্য’র সাথে থাকতে দিবি?”
নিখিল একটু চুপ থেকে বললো, “আমি দুপুরকে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভাবছি, হঠাৎ কথাটা শুনলে তোর বাবা নিজেকে সামলে নিতে পারবেন তো?”
রোদ নিশ্চুপ হয়ে গেলো। রাগ হচ্ছে ওর নিজের প্রতি। অরণ্য’র ভালোর কথা ভাবতে গিয়ে নিজের বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ও। ভালোবাসা এমন ই হয়,বিবেক বোধ লোপ পেয়ে যায় ধীরেধীরে। এখন অনুশোচনা করেও লাভ হবেনা। দুপুরকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।
নিখিল বললো, “আমি যতদূর জানি, আংকেল দুপুরকে খুবই আদর করেন। দুপুরকে অনেক বিশ্বাস করেন উনি। দুপুর যদি গিয়ে সবটা ওনাকে বুঝিয়ে বলেন তাহলে নিশ্চয়ই উনি বুঝবেন। তখন আর কষ্ট নিয়ে থাকবেন না, আর তোকেও ঠিকই বুঝবেন উনি।”
রোদ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ঠিক বলেছিস। আমার ভূলের জন্য এতকিছু হচ্ছে। আমার ভূলটা তুই শুধরে দিবি প্লিজ? তুই দুপুরকে নিয়ে গিয়ে বাবার কাছে সবকিছু বুঝিয়ে বলবি।”
– “চিন্তা করিস না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি,আংকেল নিজে থেকে তোকে ডেকে বাসায় নিয়ে যাবে দেখিস।”
– “তাই যেন হয় রে। মান সম্মান যা যাবার তা তো গেছেই, দুপুরের লাইফটা নষ্ট করিস না। খুব ভালো মেয়ে ও।”
নিখিল রোদের হাত ধরে ওকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বললো। ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে অনেকটা চিন্তা দূর হলো রোদের। নিখিল ওর বন্ধু শিহাবকে কল দিয়ে বলল ওর গাড়িটা নিয়ে নিখিলকে সিলেট রেখে আসতে পারবে কিনা।
শিহাব বললো, “হুট করেই সিলেট কি জন্য?”
– “তোকে আমি যেতে যেতে সব বলবো। বাসে গেলে অনেক সময় লাগবে, কিন্তু আর একটা সেকেন্ড ও দেরি করার ইচ্ছে আমার নেই। প্লিজ দোস্ত চলনা যাই।”
– “আমিতো মনিহারে,মুভি দেখছি। গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে আসছি।”
– “শো শেষ হবে কখন? অনেক রাত তো হয়েই গেলো, এত রাতে হলে তুই? আমার দম বন্ধ হয়ে আসতাছে দোস্ত। আমাকে যেতেই হবে।”
– “আচ্ছা হাফ এন হাওয়ার টাইম দে। তুই রেডি হয়ে মোড়ে আয়, আমি ওকে বাসায় রেখে আসছি।”
নিখিল ফোন রেখে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি বের হচ্ছি। এখানকার এক ফ্রেন্ড আসবে গাড়ি নিয়ে।”
নিখিল রুমে এসে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। রোদ ওর রুমে এসে বিছানার উপর বসে আছে। ওর চোখ এখনো ভেজা। নিখিল রেডি হতে হতেও ওকে অনেক কিছু বোঝালো। বড় বোনকে ডেকে সিলেট যাওয়ার কথা বুঝিয়ে বললো নিখিল। তারপর যখন বের হতে যাবে রোদ এসে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমাকে নিয়ে যাবি নিখিল?”
নিখিল রোদের দিকে তাকালো। রোদ বললো, “আমার বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসবে। টেনশন হবে খুব। তোরা তো গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিস, আমাকে সাথে নিয়ে যা। আবার তোর ফ্রেন্ডের সাথে না হয় ফিরে আসবো। তোরও এতটা পথ ভালো লাগবে না। আমরা দুজন কথা বলতে বলতে যেতে পারবো।”
নিখিল একটু ভেবে বললো, “আচ্ছা শাড়িটা বদলে আপুর একটা ভালো শাড়ি পড়ে আয়। আপুর তো জামাও নেই,সব শাড়ি।”
রৌদ্রময়ী শাড়ি বদলে একটা ভালো শাড়ি পড়ে আসলো। বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বেড়িয়ে পড়লো সিলেটের উদ্দেশ্যে।
ওরা পুরোটা রাস্তা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলো। নিখিল রোদ আর শিহাব মিলে প্লান করে ফেললো দুপুরকে নিয়ে ও সোজা ঢাকায় চলে যাবে। বিয়ে করে তারপর রোদের বাবার সামনে গিয়ে হাজির হবে। এই কটা দিন রোদকে নিখিলের বোনের বাসায় থাকতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বাবা নিজে থেকে ডেকে নেয়ার পর রোদ বাসায় ফিরবে, তার আগে নয়। দুপুরকে হারানোর পরও আবার ফিরে পাওয়ার উত্তেজনায় উত্তেজিত হয়ে রইলো নিখিল। রোদ শুধু প্রার্থনা করছে সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়।
৪৭.
হোটেল থেকে বের হওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলো দুপুর ও অরণ্য। লবিতে এসে মেঘালয়দের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অরণ্য গিয়ে একটা সোফায় বসে পড়েছে। দুপুরের বসতে ইচ্ছে করছে না। ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে।
আজকে মেঘলয়রা হোটেল ছেড়ে দেবে। সেজন্য ওদের একটু সময় লাগছে বের হতে। হঠাৎ চোখ ঘুরাতেই একটা সোফায় নিখিলকে দেখে চমকে উঠলো দুপুর। ওর সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। নিখিল এখানে বসে আছে এটা কিভাবে সম্ভব! রাতেই তো ওর সাথে কথা হলো। সত্যি সত্যি চলে এসেছে ও! ভাবতেও পারছে না দুপুর। এখন কি করবে? হাত পা কাঁপতে লাগলো ওর।
নিখিল ইশারায় ফোনে কথা বলার ইংগিত দিলো। দুপুর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অন করলো। একটা মেসেজ এলো নিখিলের নাম্বার থেকে, “tomar sathe onek kotha ache. any how hotel theke ber hoba. amake ektu somoy dao please.khub important.”
দুপুর গিয়ে অরণ্য’কে বললো, “আমার সানস্ক্রিন টা একটু নিয়ে আসবেন রুম থেকে? আজ বাইরে খুব রোদ উঠবে মনেহচ্ছে।”
অরণ্য হেসে উঠে দাঁড়াল। দুপুর সোফায় বসে বললো, “আমি এখানে বসছি। নিয়ে আসুন একটু কষ্ট করে। বউয়ের সেবা যত্ন করতে হয় একটু।”
বলেই হাসার চেষ্টা করলো। ব্রান্ডের নাম শুনে নিয়ে অরণ্য দ্রুত লবি থেকে বেড়িয়ে রুমের দিকে যেতে লাগলো। দুপুর ইশারায় নিখিলকে বাইরে বের হতে বলে লবি থেকে বের হলো। ওর পিছনে নিখিল ও উঠে বেড়িয়ে আসলো। এক ছুটে এসে লিফটের সামনে দাঁড়ালো। নিখিল এসে ওকে নিয়ে লিফটে ঢুকেই বোতাম টিপে দিলো। দুপুরের দিকে এক পলক চেয়েই ওর হাত টেনে ধরে বুকে জাপটে ধরলো। এত কষ্টের পর নিখিলকে দেখতে পেয়ে দুপুর ও নিজেকে সামলাতে পারলো না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
হোটেল থেকে বেড়িয়ে এসে গাড়িতে উঠতে বললো দুপুরকে। দুপুর সংকোচ করছিলো উঠতে। নিখিল বলল, “অনেক কথা আছে। ওঠো।”
দুপুর গাড়িতে উঠে বসামাত্রই ডানপাশে রৌদ্রময়ীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। নিখিল গাড়িতে ওঠামাত্র শিহাব গাড়ি স্টার্ট দিলো। দুপুর একবার নিখিলের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার রোদের দিকে তাকাচ্ছে। ওর চোখ কপালে উঠে গেলো একেবারে। কি হতে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর কোথায় এসে দাঁড়ালো দুপুর বুঝতে পারলো না। গাড়ি থেকে নেমে একটা পার্কের মতন জায়গায় চলে এলো ওরা। বেঞ্চিতে দুপুরকে বসিয়ে নিখিল একদম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সবটাই বুঝিয়ে বললো দুপুরকে। সব শুনে কান্নাভেজা চোখে রোদের দিকে তাকালো দুপুর। নিজেকে সামলাতে পারলো না কিছুতেই। বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
কান্নাকাটি থামলে নিখিল দুপুরকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি আমার হাত ধরতে চাচ্ছো দুপুর?”
প্রশ্নটা সরাসরি হৃদপিন্ডে গিয়ে আঘাত করলো দুপুরের। এই ছেলেটাকে ছাড়া বাঁচার কথা চিন্তাও করতে পারতো না ও। কিন্তু এখন যে ও অন্য কারো স্ত্রী। একটা বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছে সে, হাজার চাইলেও অরণ্য এখন ওর স্বামী। তাকে ফেলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? করুণ চোখে নিখিলের দিকে তাকালো দুপুর।
নিখিল জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো? তুমি না চাইলে জোড় করবো না। তবে আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই। কিন্তু তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিৎ। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?”
ভালোবাসা শব্দটা শুনে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলো দুপুর। ভালোবাসার জন্য চরম স্বার্থপরতাও করা যায়। নিখিলের মত করে অরণ্য এ জীবনেও ওকে ভালোবাসতে পারবে না। তাছাড়া সবকিছু শোনার পর অরণ্য’র সাথে সংসার করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ওর নেই। বরং ঘৃণা হচ্ছে অরণ্য’র প্রতি। রোদের মত একটা মেয়েকে যে এভাবে অপমান করতে পারে, সে আর যাই হোক কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।
দুপুর এগিয়ে এসে নিখিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “হারানোর যন্ত্রণা কতটুকু জানো না? এই কয়টা দিনে আমি হারে হারে বুঝেছি। হারিয়েও আবার ফিরে পেয়ে কি করে ফেরাই তোমায়?”
সবকিছুর সমাধান তো হয়েই গেলো। রোদ ভয় পেয়েছিলো দুপুর আসতে আপত্তি জানায় কিনা সেটা ভেবে। এখন আর চিন্তা নেই। বাবার সাথে দুপুর মুখোমুখি হলে সবই ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। রোদ দুপুরের হাত ধরে বললো, “তোরা খুব সুখী হবি দেখিস।”
দুপুর বললো, “সবই ঠিক আছে। কিন্তু এখনি বাসায় যাওয়া যাবে না। অন্তত কটা দিন আমাদের গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। এখনি অরণ্য আমাদের দেখা পেলে একটা ঝামেলা বাঁধবে।”
কথাটা একেবারে খারাপ বলেনি। কোথাও উঠতে পারলে বেশ হতো। তারপর বাবাকে সেখানেই ডেকে নিয়ে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু নিখিলকে গ্রামের লোকজনের সামনে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। এলাকাবাসী নানান কথা বলবে। কিন্তু থাকার মত কোনো জায়গা তো দরকার। ভাবতেই দুপুরের মিশুর কথা মনে পড়ে গেলো। মিশু বলেছিলো মেঘালয় একটা বাড়ি দিয়ে দিয়েছে ওকে। ওর বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন নিরাপদে থাকা যাবে। মিশু আর মেঘালয়ের মত কাউকে জীবকে দেখেনি দুপুর। ওরা খুবই অন্যরকম একটা জুটি, ওদেরকে বুঝিয়ে বললে একটা ভালো উপায় বের হবে।
দুপুর নিখিলকে কথাটা বলতেই নিখিল রাজি হয়ে গেলো। দুপুরের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করা যায়। রাতে যখন মিশুর ফোনটার সাথে ফোন বদল হয়ে গিয়েছিলো, তখন মিশুর ফোন থেকে দুপুর নিজের নাম্বারে কল দিয়েছিলো একবার। তারমানে মিশুর নাম্বার ওর ফোনে আছে।
দুপুর ফোন বের করে দেখল অরণ্য অসংখ্যবার কল দিয়েছে। ও মিশুর নাম্বার টা নিখিলের ফোনে তুলে নিয়ে নিজের ফোন একেবারে বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলো। তারপর মিশুর নাম্বারে একটা টেক্সট পাঠালো, “আমি দুপুর। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে, কিন্তু অরণ্যকে বুঝতে দিওনা আমি মেসেজ পাঠিয়েছি। মেসেজ দেখে থাকলে সাইডে এসে কল ব্যাক করো।”
কিছুক্ষণ পরেই মিশুর নাম্বার থেকে কল এলো। দুপুর মেঘালয়কে ফোন দিতে বললে মিশু মেঘালয়ের হাতে ফোন দিলো। মেঘালয় বললো, “হ্যালো।”
– “ভাইয়া আমি দুপুর। আপনারা এখন কোথায়?”
– “আমরা এখনো রুমে। এখন বের হবো। তোমরা কি লবিতেই আছো?”
– “আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। আপনি কি একটু কষ্ট করে আসতে পারবেন? আসলে সবকিছু খুলে বলবো। কিন্তু দয়া করে কাউকে বুঝতে দিবেন না আমি ফোন দিয়েছিলাম।”
কথা শেষ করে মিশুকে রুমে রেখে দুপুরের নাম্বার টা নিজের ফোনের ডায়ালে নিয়ে মেঘালয় হোটেল থেকে বেড়িয়ে এলো। নানান প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। গাড়ি নিয়ে দ্রুত এসে হাজির হলো ওদের কাছে। কিন্তু রৌদ্রময়ীকে দেখে আরো একটু অবাক হলো মেঘালয়। তারমানে একটা জট এই মেয়ের সাথেই আছে। রৌদ্রময়ীও বিস্মিত হলো মেঘালয়কে দেখে। ওদেরকে ট্রেনে দেখেছিলো ও। ওর সাথে থাকা মেয়েটা খুব করে এসে আলাপ জমাতে চাইছিল। সেই মেয়েটাই তাহলে মিশু! চমকালো রৌদ্রময়ী।
সবকিছু শোনার পর মেঘালয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “একদম ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনারা আমার বাসায় গিয়ে উঠতে পারেন। বাড়ি একদম ফাঁকা। যেকোনো হেল্প লাগলে শুধু একবার স্মরণ করবেন আমাদের।”
দুপুর মেঘালয়ের হাত ধরে বললো, “আমার কোনো ভাই নেই। আজ থেকে তুমি আমার ভাই। তোমাকে দেখেই আমার হিংসে হচ্ছিল, আর নিখিলকে কল দিয়ে কাল কান্নাকাটি করেছিলাম। নয়ত ওকে সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলতাম।”
মেঘালয় হাসলো। রৌদ্রময়ী দুপুরের বোন সেটা কালকেই ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। আর রোদের সাথে অরণ্য’র বিয়ের কথা ছিলো, কিন্তু রোদ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কারণে দুপুরের সাথে বিয়ে হয়েছে সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলো মেঘালয়। আজকে সমস্ত জট খুলে গেলো।
মেঘালয় বললো, “নিশ্চিন্তে চলে যাও বোন। মিশুর মুখে আমার গল্প শুনে বিশ্বাস করে আমাকে ডেকে এনে এসব শেয়ার করলে তাতেই আমি অনেক বেশি সন্তুষ্ট। এরকম বিশ্বাস আজকাল কে কাকে করে? হাজার হলেও আমি অরণ্য’র বন্ধু।”
– “আপনার মত মানুষ হয়না মেঘালয় ভাইয়া। পৃথিবীর সব মানুষ যদি আপনার মত হতো!”
– “তোমরা তাহলে এখনি বেড়িয়ে পড়ো। আমি আম্মুকে জানিয়ে দিবো, চাবি পাঠিয়ে দিবে। আর বিয়ে পড়ানো সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতায় আমাকে কল দিও। আর হ্যা, টাকার দরকার হলে লজ্জা না পেয়ে জাস্ট একটা ছোট্ট মেসেজ দিবা ওকে?”
নিখিল এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মেঘালয়কে। এরকম ছেলেও পৃথিবীতে আছে! শিহাব ও জড়িয়ে ধরলো মেঘালয়কে।
মেঘালয় রৌদ্রময়ীকে বলল, “আপনার মানসিক অবস্থা ভালো নেই এখন। একা একা ওনার বোনের বাসায় গিয়ে কি করবেন? তারচেয়ে বরং আমাদের সাথে এখানে তিনটা দিন থেকে যান। আমরা আজকে হোটেল ছেড়ে দিচ্ছি। চা বাগানে পুরো বাংলোটাই আমাদের জন্য। থাকার কোনো সমস্যাই হবেনা।”
দুপুর উচ্ছ্বসিত হয়ে রোদকে বললো, “আপু, মিশুর মত একটা চমৎকার মেয়ে কোথাও পাবিনা। আর ওনার সব বন্ধুরাই এত ভালো আর মজার। তোর খুব ভালো লাগবে, মনটা ভালো হয়ে যাবে দেখিস।”
রোদ বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে। আমি তাহলে থেকে যাই। তোরা নিজেরা সাবধানে থাকবি।”
এতক্ষণে হাসি ফুটে উঠলো রোদের মুখে। নিখিল ও দুপুর বিদায় নিয়ে চলে গেলো শিহাবের গাড়িতেই। অন্য কোথাও থেকে ঢাকার গাড়িতে উঠবে ওরা। আর মেঘালয় রৌদ্রময়ীকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে ওকে বসিয়ে রেখে নাস্তা দিতে বললো। তারপর নিজের ফোনটা ওর হাতে দিয়ে বললো, “এটা আপাতত আপনার কাছে রাখুন। ফোন খুব দরকারি। আমি এক্ষুনি হোটেলে যাবো আর ওদেরকে নিয়ে চলে আসবো।”
রোদ খুব অবাক হলো মেঘালয়ের উদারতা দেখে। এতকিছুর পর আবার নিজের দামী মোবাইল টাও ওর হাতে দিয়ে যাচ্ছে। এতটাও বিশ্বাসী কেউ হয়? সত্যিই দুপুর ঠিকই বলেছে। মিশু অনেক ভাগ্য করে এমন একজন মানুষ পেয়েছে। দুপুরের হিংসে হওয়ার কারণ যথার্থ। এমন একজনকে পেলে সুখী না হয়ে উপায় আছে?
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৯

0

অনুভূতি
পর্ব ২৯
মিশু মনি
.
৪৪.
মেঘালয় ও মিশু দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে। মিশুর পাগলামি দেখে হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে মেঘালয়। মিশু রাক্ষসের মত তেড়ে এসে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মেঘালয়কে, মেঘালয় ভাবে বোধহয় খুব জোরে ঘুষি বসাবে ওর নাকে। কিন্তু না, মিশু ঘুষি দিতে এসে হাতটা মেলে আলতো করে মেঘালয়ের থুঁতনিটা টিপে ধরে বললো, “ভাত দে নয়ত মানচিত্র খাবো থুক্কু হাত দে নয়ত ঘাড় মটকাবো।”
মেঘালয় হাত বাড়িয়ে দেয়, মিশু ওর হাত ধরে মটকানোর চেষ্টা করে হাতটা তুলে হাতের পিঠে চুমু দেয়। মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠে। বাচ্চাদের মত খেলা শুরু করেছে মেয়েটা। হাস্যকর থ্রেড দেয়, “সেচ্ছায় হৃদসমর্পণ করো নয়ত চুমু ছুড়তে বাধ্য হবো।”
মেঘালয় বললো, “হৃদয় সমর্পণ করবো না। আপনি হুমকি কার্যকর করুন।”
এরপর মিশু সত্যি সত্যি যা ছুড়তে চেয়েছে, সেটা ছুড়তে আরম্ভ করে। মেঘালয় ওর অত্যাচারে রীতিমত সুখের সমুদ্রে ভাসছিলো। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করলো। মিশু বিরক্ত হয়ে বললো, “এই সময়ে কে এলো বলোতো? ভাল্লাগেনা।”
মেঘালয় দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কে?”
ওপাশ থেকে দুপুরের গলা শোনা গেলো, “আমি দুপুর। একটু দরজা টা খোলা যাবে?”
মেঘালয় লাফিয়ে বিছানার উপর উঠে শুয়ে পড়ল। মিশুকে বললো, “তুমি যাও।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে দরজা খুলতে চলে গেলো। সামান্য একটু খুলে মাথা বাড়িয়ে বললো, “ভাবি কি হইছে?”
দুপুর ওর হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “আমাদের দুজনের একই ফোন আর একই কভার। ভূলেই ফোনটা বদল হয়ে গেছে। তোমার টা আমার ব্যাগে চলে গিয়েছিল।”
– “ওহ আচ্ছা। থ্যাংকস ভাবি।”
– “আমার ফোনটা মনেহয় তোমার ব্যাগে, ওটা একটু দাও। বাসায় কথা বলবো তো।”
– “একটু কষ্ট করে দাঁড়ান নিয়ে আসছি।”
মিশু ওর ফোনটা নিয়ে দ্রুত গিয়ে ব্যাগ খুলে দুপুরের ফোনটা বের করলো। দরজার একটু ফাঁক দিয়েই বিছানায় শুয়ে থাকা মেঘালয়ের শরীর চোখ এড়ালো না দুপুরের। মেঘালয় উপুর হয়ে শুয়ে আছে, খালি গায়ে। ওর ফর্সা পিঠে অজস্র ঠোঁটের চিহ্ন। অমন প্রশস্ত আর আকর্ষণীয় পিঠ টায় লাল লিপস্টিকের দাগ দেখেই ভেতরে কাঁপন ধরে গেলো। দুপুরের ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। ও চোখ ফিরিয়ে নিলো।
মিশু ফোন নিয়ে এসে যখন হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিলো ওর দিকে, দুপুর একবার মিশুর আপাদমস্তক তাকালো। গেঞ্জি ও কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া মিশুকে সন্ধ্যায় দেখা শাড়ি পড়ার মিশুর থেকে একদম আলাদা লাগছে। তখন দেখে একজন পরিপূর্ণ স্ত্রী মনে হয়েছিলো, আর এখন মনেহচ্ছে উচ্ছল কিশোরী। ঝর্ণার মত উচ্ছল মেয়েটিকে প্রকৃতি নিজ হাতে গড়েছে। রূপ যেন উপচে পড়ছে পুরো শরীরে। আর চোখে মুখে একটা অপার্থিব সুখের নেশা লেগে আছে। অসম্ভব ঘোর ওই চোখে। মিশুকে দেখে এখন যে কেউ বলবে, এই মেয়েটা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে। এত সুখী বোধহয় কেউ কক্ষনো হয়না। মুখে প্রসন্ন হাসি, চুলগুলো এলোমেলো,আকর্ষণী
য় চেহারাটা টি শার্টে আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। লাজ রাঙা চিবুক গোলাপি আভা ধারণ করেছে। এত সুখী কেন এই মেয়েটা?
ফোন নিয়েই দুপুর আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। ওর কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে মেঘালয় ও মিশুকে এরকম অবস্থায় দেখে। আত্মা ফেটে কান্না আসতে চাইছে। মনেহচ্ছে গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হিংসা, ক্ষোভ,হারানোর কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা, অরণ্য’কে মেনে নেয়ার চাপ, নিখিলকে জোর করে সরানো সবকিছু মিলে এত বেশি কষ্ট হচ্ছে যা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না।
দুপুর ছুটতে ছুটতে এসে সিঁড়ির কাছে এসে থামলো। ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়ে হাফাতে লাগলো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে ওর ভেতরে। অন্যরকম একটা যন্ত্রণা মাথায় যেন পিন ফুটাচ্ছে। দুপুর নিখিলকে কল দিয়ে ফেললো।
নিখিল রিসিভ করামাত্রই দুপুরের কান্নার শব্দ শুনতে পেলো। হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। নিখিল হতবাক হয়ে গেলো ওর কান্নার শব্দ শুনে। বললো, “দুপুর কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?
দুপুর কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছে না। কোনমতে একটু সামলে নিয়ে বললো, “নিখিল,আই লাভ ইউ।”
নিখিল নির্বাক! হঠাৎ দুপুরের মুখে এই কথাটা তাও আবার এমন সিচুয়েশনে, অকল্পনীয় লাগছে ওর কাছে। নিশ্চুপ হয়ে রইলো ও।
দুপুর বললো, “নিখিল, আমি তোমার। আমি শুধুই তোমার। আমার শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ তোমার। নিখিল আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে প্লিজ।”
আচমকা এমন কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো নিখিল। ওর ভেতরের চাপা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে দুপুর?”
দুপুর বললো, “আমি তোমাকে অজস্র কামড় দিতে চাই। তোমার গলা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠ, বুক সবখানে। দাগ বসিয়ে দিবো আমি। নিখিল প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও। প্লিজ নিয়ে যাও আমাকে।”
নিখিল দুপুরের এমন পাগলামি কথাবার্তা শুনে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। দুপুর কখনোই এ ধরণের কথাবার্তা বলেনা। আজকে তার কি হলো হঠাৎ করে? নিখিলের মুখে কথা ফুটছে না।
দুপুর বললো, “আমিও মিশুর মত সুখী হতে চাই। আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
– “মিশু কে?”
দুপুর বললো, “মিশু মেঘালয়ের স্ত্রী। জানো মেঘালয় ওকে কত ভালোবাসে? আজকে পাক্কা দুই ঘন্টা মিশুর মুখে ওর আর মেঘালয়ের ভালোবাসার গল্প শুনেছি আমি। মিশুর কি পরিমাণ কেয়ার করে জানো না। ওদেরকে দেখলে মনেহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ওরা। আমার সহ্য হচ্ছেনা নিখিল। এমনিতে সবদিক থেকে মানসিক চাপ, আর এখন এমন যন্ত্রণা হচ্ছে যে আমার নিজের শরীরটা ব্লেড দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আমার ও খুব ইচ্ছে করছে মেঘালয়ের মত তোমার গলায় অজস্র দাগ করে দেই।”
নিখিল বললো, “এসব পাগলামি কেন করছো? তুমি কোথায় এখন?”
দুপুর বললো, “আমি হোটেলের সিঁড়িতে। আমি রুমে যাবো না। ওই লোকটাকে আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। আমি গাড়িতে উঠে ফাঁকি দিয়ে স্লিপিং পিল খেয়েছিলাম। পুরোটা রাস্তা ঘুমিয়েছি আমি। আর হোটেলে ফিরেই মিশুদের সাথে বাইরে বেড়িয়ে গেছি। আমার একদম ই ওই লোকটার সাথে একটা সেকেন্ড কাটাতে ইচ্ছে করছে না।”
নিখিল বললো, “সেদিন তো এসব ভাবোনি। আমি এখন কি করবো তুমি বলো? তুমি তো আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদছ, আমি কার কাছে বলবো আমার কষ্টের কথা?”
– “আমার ইচ্ছে করছে রৌদ্রময়ীকে খুন করে ফেলতে। ওর মত বড় বোন দুনিয়াতে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। কোনোদিনো সামনে পেলে ওকে খুন করে ফেলবো।”
দুপুর খুব অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। শুনতে খারাপ লাগছে নিখিলের। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই যে করার নেই আর। দুপুরকে সান্ত্বনা দেয়ার মত কোনো শব্দও খুঁজে পাচ্ছেনা ও।
দুপুর বললো, “মিশুকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। মিশুকে একটু আগে দেখে ইচ্ছে করছিলো ওর চুল টেনে ধরে গলা টিপে মেরে ফেলি ওকে।”
নিখিল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “এভাবে বলছো কেন? মিশুর কি দোষ? অন্যকে দেখে এভাবে হিংসে করতে হয়না দুপুর। তুমি তো এমন ছিলে না।”
দুপুর বললো, “আমার পুরো শরীরে কষ্ট হচ্ছে নিখিল। তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট, সারাজীবনের মত হারানোর কষ্ট, অরণ্যকে মেনে নেয়া,রোদের এই কাজ সবকিছু আমাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে যাচ্ছে। আমি এই কটা দিন পাথর হয়ে ছিলাম। আজ মিশু আর মেঘালয়কে দেখে আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে নিখিল। সহ্য করতে পারছি না আমি। প্লিজ আমাকে খুন করে রেখে যাও।”
-“পাগলামি করোনা দুপুর,রুমে যাও। তুমি এখন হোটেলে, মাথায় রাখো সেটা। কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলো না। অরণ্য’র একটা প্রেস্টিজ আছে।”
দুপুর চুপ করে গেলো। কথাটা সত্যি কিন্তু প্রচণ্ড তিক্ত লাগছে শুনতে। ও বলল, “আমার কথা শুনে রাগ হচ্ছে তাইনা? আমাকে এখন ঘৃণা করো তুমি?”
– “কি উলটা পালটা বলছো এসব? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, যাও রুমে যাও।”
– “হ্যা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেও পারতাম না। সেই আমি কিভাবে আছি ভাবতে পারো?”
– “বুঝতে পারছি। এখন রুমে যাও, সিঁড়িতে বসে এসব কথাবার্তা বলছো? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?”
– “আমাকে এখন আর সহ্য হয়না বললেই পারো। ফোন রেখে দাও ”
– “অযথা ভূল বুঝছো দুপুর। তোমাকে ভালোর জন্য বলছি রুমে যাও।”
– “আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কষ্ট হচ্ছে বলে তোমাকে ফোন দিলাম আর তুমিও এমন করছো?”
নিখিল কিছু বলতে চাচ্ছিলো তার আগেই কল কেটে গেলো। এরপর কল ব্যাক দিয়ে দেখলো নাম্বার বন্ধ। নিখিলের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছিলো। দুপুর এমন একটা মেয়ে, যে নিখিলকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে চাইতো না। পাগলের মত ভালোবাসতো ও নিখিলকে। এইতো সেদিন, নিখিলের মেসে রান্না হয়নি, ও দুপুরবেলা অব্দি না খেয়ে ছিলো। দুপুর কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলে ও বললো, “রান্না হয়নি আজকে। আমি ঘুমাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে খাবো।”
– “এখনি যাও প্লিজ।”
– “আমার এখন একদম ই ভালো লাগছে না। মেজাজ খারাপ লাগছে, আজকে রুম থেকে মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে। রুমমেটরা সবাই বাসায় চলে গেছে, আমি মানিব্যাগ রেখে গোসলে গিয়েছিলাম। এসে আর পাইনি।”
– “ফোন নিয়ে যায়নি শুধু মানিব্যাগ নিয়ে গেছে?”
– “তার হয়ত শুধু টাকাই দরকার ছিলো। সেজন্য মানিব্যাগ নিয়ে গেছে। এখন হাতে একটা পয়সাও নাই, আব্বু টাকা পাঠাবে তারপর নীচে নামবো।”
কথাটা শুনে দুপুরের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন বিকেলে আবারো নিখিলকে কল দেয় ও। নিখিল রিসিভ করলে বলে, “তুমি একটু গুলিস্তান আসতে পারবা?”
– “কেন?”
– “আমি গুলিস্তানে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। একটু রিক্সা নিয়ে চলে আসবা প্লিজ? রিক্সাভাড়া আমি দিয়ে দিবো।”
হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিখিল বলল, “তুমি দাড়াও আমি আসছি।”
দ্রুত পাগলের মত ছুটে চলে এসেছে নিখিল। এসে দেখে ফ্লাইওভারের নিচে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে দুপুর দাঁড়িয়ে। তিন বাটির টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার রান্না করে এনেছে। নিখিল দৌড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেন আসছো এত কষ্ট করে?”
– “তুমি সকাল থেকে না খেয়ে আছো আর আমি বুঝি খেতে পারি? তোমার বাবা কখন টাকা দেবে সেই আশায় বসে থাকবো?”
– “আল্লাহ! সেজন্য তুমি মুন্সিগঞ্জ থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে গুলিস্তান আসবা? তুমি কি পাগল দুপুর?”
দুপুর হেসে টিফিন বাটিটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিলো, “বেশি কিছু রাঁধি নাই। পোলাও আর দেশী মুরগি রানছি। খুব তাড়াতাড়ি রান্না করছি তো, হয়ত ভালো হয় নাই।”
– “তুমি খাইছো?”
– “না, আমি বাসায় গিয়ে খাবো। আগে তুমি খেয়ে নিও পেট ভরে। রাতেও খাবা, আর বেশি হইলে ফ্রিজে রাইখো। কালকে সকালে খাইতে পারবা। অনেক গুলা পোলাও দিয়া দিছি।”
বলেই দাঁত বের করে হাসলো দুপুর। নিখিল হা করে চেয়ে রইলো ওর দিকে। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে নিখিল মুগ্ধ হয়ে ওর পানে চেয়ে আছে, চোখে পানি এসে যাচ্ছিলো নিখিলের। দুপুর একটা ৫০০ টাকার নোট নিখিলের বাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আর যাই করো, খাওয়াদাওয়া ঠিকমত কইরো। এইটা রাখো। আমি যাই, বাড়ি যাইতে রাত হবে এম্নেতেই।”
কথাটা বলেই দুপুর নিখিলের সামনেই মাওয়ার বাসে গিয়ে উঠলো। নিখিলের কথা বলা কিংবা হাত পা নাড়ানোর শক্তিটাও ছিলোনা। মাঝেমাঝে এরকম হুট করেই একদম বাকরুদ্ধ করে দেয়ার মত কাজ করে দুপুর। সারপ্রাইজের চেয়ে বেশি কিছু থাকলে সেটাই হতে হয়। দুপুর দিব্যি হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলো, আর জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাত নাড়ছিলো। সেই মায়াবী মুখখানার দিকে তাকিয়ে নিখিলের নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। কত যত্ন করে দুপুর রান্না করে আবার কষ্ট করে দিয়েও গেলো, নিজে কিচ্ছু খায়নি সকাল থেকে। নিখিল না খেলে কখনোই ও খায়না। আবার ৫০০ টা টাকাও হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো। এমন কেন মেয়েটা? এত ভালোবাসতে হয় বুঝি!
নিখিলের সেদিন পায়ের নিচে শিকড় গজানোর মত অবস্থা হয়েছিল। অনেক্ষণ নড়াচড়া করতে পারেনি ও। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিলো হাইওয়ের দিকে। দুপুর মাত্র তিন/চার মিনিটের জন্য এসেছিলো, অথচ আকাশ সমান কিছু অনুভূতি দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। যে মেয়েটা এভাবে ওকে ভালোবাসতো, নিখিলকে ছাড়া একটা মুহুর্ত ওর চলতো না। সে কিভাবে নিখিলকে ছাড়া থাকবে?
দুপুর কক্ষনো বাবার অবাধ্য হয়নি। বড় বোন রৌদ্রময়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতো। বাসায় আসতো অনেক দিন পরপর। দুপুর ই নিজে রান্না করে ওর বাবাকে খাওয়াতো, খুব ভালোবাসে ও বাবাকে। বাবা বিয়ে করতে বলার পর আর কোনোকিছুই মাথায় আসেনি ওর, অন্তত বাবার সম্মান তো রক্ষা হবে। বাবার জন্য নিজের জীবনটাও দ্বিধা করবে না দুপুর। সেখানে একটা বিয়েই তো, নাহয় বাকি জীবনটা কষ্ট করেই কাটলো। তবুও বাবার মুখে একটু হাসি থাকুক। এই ভেবেই দুপুর বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে নিখিলের শূন্যতাটুকু। যদিও নিখিলের জন্য দুপুরই বেশি পাগল ছিলো, তবুও দুপুর খুব করে অনুভব করতে লাগলো নিখিলের শূন্যতা। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁঁচবে দুপুর?
৪৫.
ছাদে বসে বসে সিগারেট টানতে টানতে এসব ই ভাবছে নিখিল। রৌদ্রময়ী হঠাৎ এসে পিছনে দাঁড়ালো। ছাদে সুন্দর চাঁদের আলো ছড়িয়েছে। নিখিল সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে দিচ্ছে ভুসভুস করে। কাকে যেন কল দিয়ে কথা বলতে লাগলো। রোদ একটা কথা শুনতে পেলো,
– “একটা বোতল হলেই চলবে। চাঁচড়া মোড়ে আয়,আমি যাচ্ছি।”
রোদ কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কই যাবি তুই? কিসের বোতল?”
নিখিল জবাব দিলো না। সিগারেট টানটেই লাগলো। এমন ভাব করতে লাগলো যেন রোদকে ও চেনেনা। রোদ বলল, “তুই নেশা করবি নিখিল? ছি,আমি ভাবতেও পারছি না তুই নিখিল এভাবে চেঞ্জ হয়ে গেছিস।”
নিখিল হাতের সিগারেট সহ ই এসে দুহাতে গলা টিপে ধরলো রৌদ্রময়ীর। সিগারেটের আগুন রৌদ্রময়ীর বাম গালের নিচে কানের দিকে লেগে পুড়ে যাচ্ছিলো, যন্ত্রণায় মুখটা কুঁচকে গেলো রোদের। ও তবুও টু শব্দটিও করলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হতে মরে যাওয়ার ই ইচ্ছে হচ্ছে ওর। নিখিল গলা টিপে মেরে ফেলুক তো।
নিখিল ওর গলা ছেড়ে দিয়ে সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর ধপ করে বসে পড়লো ছাদের উপরেই। দুহাতে নিজের চুলগুলো টানতে টানতে বলল, “আমি পাগল হয়ে যাবো। এত স্ট্রেস আর নিতে পারছি না। আমার লাইফটা দুপুরকে ছাড়া অচল। ও ছাড়া কে আমার একটু কেয়ার করবে? সারা দুনিয়া খুঁজলেও ওরকম একটা দুপুর আমি কোথাও পাবো না।”
রোদের গালটা জ্বালা করছে ভীষণ। সিগারেটের আগুন খুবই তীব্র। জ্বলছে আর খুব খারাপ লাগচে রোদের। তবুও ও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। নিখিল আপনমনেই বলে যেতে লাগলো, “ওরে আমি যা কিছু দিতাম, ও বলতো তুমি নিজের কাজে লাগাও।আমার জন্য কক্ষনো কিচ্ছু কিনবা না। অথচ নিজে টাকা জমিয়ে আমারে পাঞ্জাবি, শার্ট গিফট করতো।আমারে বলতো, তুমি ভার্সিটিতে পড়ো। কত মানুষের সাথে মেলামেশা করতে হয়। তোমার অনেক গুলা জামাকাপড় দরকার।আমি বলতাম আমি নিজেই কিনতে পারি। তুমি পছন্দ করে দাও। দুপুর বলত,পাঞ্জাবীতে আমার কষ্টের আবেশ মিশে থাকবে। এটা গায়ে থাকলে আমারে কখনোই ভূলতে পারবা না।”
নিখিলের কথা শুনতে শুনতে গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে রোদের। দুপুর খুব ভালো একটা মেয়ে সেটা ও জানে। কিন্তু নিখিলকে এতটা ভালোবাসতো সেটা জানা ছিলোনা ওর। দুপুরকে জিজ্ঞেস করলে কখনোই বলতো না ওর কারো সাথে সম্পর্ক আছে।
রোদ এসে নিখিলের পাশে বসলো।
নিখিল বললো, “জানিস রোদ ও আমারে একদিন ও কাপড় কাঁচতে দিতো না। আমি কাপড় কাঁচতে পারতাম না ভালোমতো। সেজন্য ও জেদ করতো, কয়দিন পরপর আমার সব জমানো ময়লা কাপড় ব্যাগে ভরে ওরে দিয়ে আসতাম, আর ও সব সুন্দর করে ধুয়ে লণ্ড্রী করে আমারে দিতো। এত ভালোবাসত মেয়েটা আমারে। কখনো কখনো আমারে বলতো হলের সামনে বাইর হও। আমি বাইরে গিয়া দেখতাম দুপুর আসছে। বলতো, তোমার জন্য সরষে ইলিশ রান্না কইরা আনছি। তোমার খুব পছন্দের না? ওর কথা শুনে আমি কান্না কইরা ফেলতাম রে রোদ। মেয়েটা আমারে ছাড়া বাঁচলেও আমি পারবো না। মুন্সিগঞ্জ থেকে এক পলক দেখার জন্য ও আমার হলের সামনে এসে দাঁড়াই থাকতো।”
নিখিল হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো এসব বলতে বলতে। ভালোবাসা রা হয়ত এমনই হয়। দুপুরের সমস্ত পাগলামি গুলোকে শুধু পাগলামি ই মনে হতো নিখিলের। আজকে ওর অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারছে ওকে হারানোটা জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হয়ে গেলো।
রোদ আর চুপ করে থাকতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে হুট করেই নিখিলের পা ধরে বললো, “আমাকে মাফ করে দে নিখিল। আমার জন্য তোদের এই অবস্থা হলো।”
নিখিল পা থেকে দুপুরের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর প্রতি আমার অভিযোগ নেই। ভাগ্যে যা ছিলো তাই তো হয়েছে।”
– “আমি যদি জানতাম দুপুরের সাথে অরণ্য’র বিয়ে হবে তাহলে কখনোই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতাম না।”
অরণ্য’র নাম মুখে নিতেই নিখিল আবারো ভেঙে পড়লো। একটু আগে দুপুর ফোন দিয়ে যা যা বলেছে সবই বলে ফেললো রোদকে। সব শুনে রোদ বললো, “তুই তাহলে ওর কাছে যা। ওকে নিয়ে আয় ”
নিখিল রেগে বললো, “পাগলের মত কথা বলবি না। তোর বাবার সম্মানের জন্যই দুপুর বিয়েটা করছে। এখন আমি ওরে নিয়ে এলে যেটুকু বাকি আছে তাও যাবে।”
রোদ কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমার অপরাধের জন্য তোদের পবিত্র ভালোবাসা আর দুটো লাইফ এভাবে নরক হয়ে যাবে আমি সেটা মানতে পারবো না। আমার ভূলের জন্য আমাকে অনুতপ্ত হতেই হবে। যা হবার হবে, তুই গিয়ে ওকে নিয়ে আয় প্লিজ। পায়ে পড়ি তোর।”
নিখিল নির্বাক হয়ে গেলো রৌদ্রময়ীর কথায়। সে নিজে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে,আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাকি নেই? তাহলে পালালো কার কাছে যাওয়ার জন্য? দুপুরের বিয়ে হয়ে গেছে সেটা শুনে তখন থেকে গম্ভীর হয়ে গেছে,এখন আবার বলছে দুপুরকে নিয়ে আসতে। রোদের সমস্যাটা কোথায়?
নিখিল রোদের হাত ধরে বললো, “দয়া করে কি বলবি কেন তুই বাড়ি থেকে পালালি?”
রৌদ্রময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “হুম। আজকে আর না বলে থাকতে পারবো না রে। সবটা তোকে জানাতেই হবে। আর তুই ওকে গিয়ে নিয়ে আসবি প্লিজ?”
নিখিল কৌতুহলী হয়ে তাকালো রোদের দিকে। চাঁদের আলোয় রোদের কান্নাভেজা কন্ঠ শুনে মায়া লাগছে ওর। রোদের গাল পুড়ে গিয়ে জ্বালা করছে তবুও ও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তিনটা মানুষের ভেতরে যে দহন চলছে, বাহ্যিক আগুনের চেয়েও সেটার যন্ত্রণা কয়েক গুন বেশি।
রোদ বলতে আরম্ভ করলো-
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৮

0

অনুভূতি
পর্ব ২৮
মিশু মনি
.
৪৩.
দুপুরের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো মেঘালয়ের। মেয়েটি দিব্যি হাসিখুশি ছিলো, বোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার মুখ এমন আষাঢ়ে আকাশের মত হয়ে গেলো কেন? কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে।
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দুপুরের মুখের দিকে। দুপুর দ্রুত চিন্তা করছে কি উত্তর দেবে সে? যদি মিথ্যে বলে তবে ব্যাপারটা বাজে হয়ে দাঁড়াবে। হতে পারে মিশু তার বোনকে কোনোভাবে চেনে। অস্বীকার করলে মিশু ওকে মিথ্যাবাদী ভাব্বে। দুপুর একটু ভেবে উত্তর দিতে যাবে এমন সময় অরণ্য বললো, “না, ওর কোনো বোন নেই।”
মিশু আর কিছু বললো না। দুজনের বিকৃত মুখ দেখেই মনেহচ্ছে ব্যাপার টা গোলমেলে। কোথাও একটা গোপন রহস্য আছে যেটা ওরা লুকাতে চাইছে। অযথা কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। মেঘালয় ঠিক একই কথাই ভাবছিলো। অরণ্য হানিমুনে এসেছে, তারমানে হয়ত দুদিন আগেই অরণ্য ‘র বিয়ে হয়েছে। ঠিক সেদিন ই বিয়ের কনে পালিয়ে এসে ট্রেনে উঠেছিলো। এদের মাঝে একটা যোগসূত্র নিশ্চয়ই আছে। সেসব আর জিজ্ঞেস করে ওদেরকে বিবৃত করার কোনো মানেই হয়না। ওরা যে মিথ্যে বলছে সেটা দুপুরের গম্ভীর মুখ দেখেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
মেঘালয় কথা ঘুরানোর জন্য বললো, “কবে আসলি এখানে?”
অরণ্য হাসার চেষ্টা করে বললো, “কিছুক্ষণ হলো পৌছেছি। তোরা?”
– “আমরা আজকে সকালেই এসেছি। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগে আগে ফিরলাম। এখন আবার একটু বেরোবো।”
অরণ্য জানতে চাইলো, “এখন কোথায় ঘুরতে যাবি আবার? রাত তো হয়েই এসেছে প্রায়।”
মেঘালয় জবাব দিলো, “একটা কাজ আছে। চা বাগানের মালিকের সাথে মিটিং আছে একটু। ”
অরণ্য মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ও আচ্ছা। ডিনার তো বাইরেই করবি তাইনা? আমরা একসাথে ডিনার করতে পারি?”
মেঘালয় বললো, “অবশ্যই। আমার সাথে আরো তিনজন ফ্রেন্ড আছে। সবাই একসাথে ডিনার করতে পারবো। তো তোরাও চলনা আমাদের সাথে। একটু ঘুরেফিরে একেবারে ডিনার করেই হোটেলে ফিরবো।”
অরণ্য দুপুরের দিকে তাকিয়ে বললো, “না রে। জার্নি করে এসে টায়ার্ড হয়ে গেছে দুপুর। দুপুরে রাত নেমেছে। এখন আর বাইরে যাবো না।”
দুপুর অরণ্য’র কথার মাঝখানে বলে উঠলো, “আমি একদম ঠিক আছি। রুমে বসে থাকতে বরং ভালো লাগছে না। যাই না ঘুরে আসি? আমি আর ভাবি মিলে গল্প করবো আর আপনারা কথা বলবেন।”
দুপুর নিজে থেকে যেতে চাইছে বলে অরণ্য আর না করলো না। কফি খাওয়া শেষ করে ওরা বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। দুপুর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। মিশুর সাথে গল্প করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবুও কেন যেন সহজ হতে পারছে না। কিন্তু মিশুর সাথে খুব গম্ভীর মানুষ ও ঠিকই গল্পে মেতে উঠতে বাধ্য। মিশু যে পরিমাণ বকবক করতে থাকে, না চাইলেও মুড আপনা আপনি চালু চলে যায়। দুপুর ও মিশুর রাতারগুলে ভ্রমণের গল্প শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলো। দুদিন পর দুপুরকে এরকম স্বাভাবিক ভাবে হাসতে দেখে অরণ্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
মেঘালয় কে বললো, “তোর বউয়ের শুধু রূপ নয়,গুন ও আছে দেখছি।”
মেঘালয় হেসে হেসে বললো, “আমার বউয়ের কি দেখলি তুই??”
– “আহা! যেটুকু দর্শনীয় সেটুকুই দেখেছি। দ্যাখ আমার বউয়ের সাথে কেমন গলায় গলায় ভাব জমিয়েছে যেন ওরা মায়ের পেটের বোন।”
বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো। মেঘালয় ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, “ঠিকই আছে। আমরা তাহলে ভায়রা ভাই।”
অরণ্য বললো, “উহু, তোর বউ মানে আমার বউ,আর আমার বউ মানেই তো তোর বউ তাইনা?”
মেঘালয় অরণ্য’র কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “উহুম না। তোর বউ মানে আমার বউ,আর আমার বউ মানে তোর ভাবি।”
দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলো। মিশু ও দুপুর ওদের ফিসফিস কথাবার্তা আর উচ্চস্বরে হাসতে দেখে ওরাও হাসলো। যাক, ঘুরতে এসে একটু আনন্দ হলে সেটাও অনেক। বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই সারাক্ষণ কান্না পেত দুপুরের।
গাড়ির কাছে এসে মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। একটু চাপাচাপি করে বসতে হবে দোস্ত। কষ্ট হবে না তো?”
অরণ্য বললো, “তোর বউকে তো আমার মানুষ মনেই হয়না।”
মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অরণ্য’র দিকে তাকালো। মানুষ মনেহয় না মানে? মিশু কি তাহলে?
অরণ্য বললো, “না মানে মিশুকে আমার বারবি ডল বারবি ডল লাগে। ওকে তো অনায়াসে কোলের উপর বসিয়ে নিয়ে যেতে পারিস।”
মিশু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। মেঘালয়ের বন্ধুরা অনেক দুষ্টমি করলেও এত বেশি ফাজলামি কখনো করেনা। অরণ্য একটু গভীর টাইপের কথাবার্তা বলে,শুনতে কেমন যেন লাগে। ছেলেটার মুখে কিচ্ছু আটকায় না। মেঘালয় ইয়ার্কির মোক্ষম জবাব দিতে সত্যি সত্যিই মিশুকে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। মিশুর ইচ্ছে করলো লজ্জায় মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না ও। মেঘালয় ওকে কোলের উপর বসিয়ে পাশের সিটে অরণ্যকে বসতে বললো। অরণ্য’র পাশে দুপুর বসে পড়লো। সামনের সিটে বাকি তিনবন্ধু বসে গেলো। আরাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে। ছোট্ট একটা গাড়ি হওয়ায় বসতে কষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু মেঘালয়ের এই গাড়িটাই খুব পছন্দের।
মিশু মেঘালয়ের কোল থেকে নেমে পাশে বসলো। মেঘালয় ওর চোখের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু চোখ রাঙাল ওকে। কিন্তু মেঘালয়ের দৃষ্টি খুব গভীর। ভেতরটা কেঁপে উঠলো মিশুর। ও দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
গন্তব্যস্থলে পৌছে গাড়ি থেকে নেমে মিশু ও দুপুরকে একটা টেবিলে বসতে বলা হলো। ওরা দুজন সেখানে বসে কফি খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠলো। আর মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা তাদের জরুরি আলাপ সারতে অন্য টেবিলে মিটিং এ বসে গেছে। অরণ্য’র যদিও কোনো কাজ ছিলোনা, তবুও ও মেঘালয়ের সাথেই সেখানে বসেছে। ওরা কথা বলছিলো আর অরণ্য ফাঁকে ফাঁকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিলো দুপুরের দিকে। দুপুর সেটা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে রইলো। ও মিশুর সাথে মিশে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। মিশু মেয়েটা অনেক ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার বলা যায়। জগতের যত সব অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা ওর মগজে কিলবিল করে। সেসব বলে বলে অন্যের মাথা ধরিয়ে দেয় ও। শুনতে যে খারাপ লাগে তাও না, বরং বেশ মজা লাগে সেসব আজগুবি কথাবার্তা। সচরাচর এমনটা তো দেখা যায় না। দুপুর ও মেতে উঠলো ওর সাথে। আস্তে আস্তে মন খারাপ ভাবটা কেটে যেতে আরম্ভ করেছে।
মিটিং শেষ হলে রেস্টুরেন্ট এ চলে এলো ওরা। খাবার টেবিলে বসেও মিশু ও দুপুর গল্প করছিলো। মেঘালয় মিশুর বকবকানি শুনে হাসছে আর ভাবছে, মেয়েটা আজীবন যেন এমনি থাকে। খাবার চলে এলে ওরা খেতে আরম্ভ করলো। মিশু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা তোমরা কেউ ব্যাঙ খেয়েছো?”
মেঘালয় কেশে উঠলো, “ব্যাঙ কেউ খায় নাকি?”
মিশু উৎসাহ নিয়ে বললো, “কেন? বর্ষাকালে আমাদের এলাকায় বাড়ির আশেপাশে কত ব্যাঙ পাওয়া যায়। আমরা সেগুলা ধরে ধরে রান্না করে খাই। এত্ত টেস্ট লাগে, ইয়াম্মি।”
সবাই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। পূর্ব ফাজলামি করে বললো, “মঙ্গা এলাকার লোকরা আরো কত কিছুই খাবে।”
মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “আমাকে মোটেও মঙ্গা এলাকার লোক বলবা না।”
– “মঙ্গা এলাকার লোকেদের কি বলবো তাহলে? সারাবছর খরা আর দূর্ভিক্ষ লেগেই থাকে।”
– “রংপুর সবচেয়ে শান্তির এলাকা। আমাদের এলাকার মানুষ খুব সরল আর মানুষকে খুব ভালোবাসতে পারে। সাজেক থেকে ঘুরে এসে তোমাদের সবাইকে আমি রংপুর নিয়ে যাবো। দেখে এসো আমাদের গ্রামের মানুষ গুলি কত সরল।”
পূর্ব হেসে বললো, “ব্যাঙ খেয়ে খেয়ে সরল হয়েছে তাইনা?”
মেঘালয় বললো, “মিশুকে ক্ষেপাচ্ছিস কেন তুই?”
– “ক্ষেপালাম আর কোথায়। সত্য কথাই বলেছি। দূর্ভিক্ষ এলাকার লোক। সে সবসময় বিজনেস প্লান মাথায় নিয়ে ঘোরে। রাতারগুলে গিয়েও চাটনি বেচে আর বলে এক পিছ তিন টাকা। সেটা আবার ফ্রিতে দিয়ে বলে,এমনি দিছি। এমনির আরেক নাম তিন টাকা।”
সবাই মুখ টিপে হাসলো।
সায়ান বললো, “তোর মত গুবলেট নাকি? সে সারাক্ষণ বিজনেস প্লান নিয়ে ঘোরে, তার মগজ অলটাইম সক্রিয়। তোদের মত না। তোরা শালা ইচ্ছেকৃত ভাবে আমার ব্রেকাপ ঘটালি।”
সবাই অবাক হয়ে তাকালো। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “ব্রেকাপ হয়ে গেছে সিরিয়াসলি?”
সায়ান মুখ কাচুমাচু করে বললো, “হুম। হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় কল দিয়েছিলাম, বললো তুই তোর ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়াই থাক। গালি দিয়ে আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেছে। আমিও যা বলার বলেছি।”
আরাফ বলল, “আমাকে তোর থ্যাংকস জানানো উচিৎ। তোকে আমি ফকির হওয়ার হাত থেকে বাঁচাইছি।”
মেঘালয় বললো, “দোস্ত মন খারাপ করিস না। সাজেক থেকে ফিরে মিশু আমাদের রংপুর নিয়ে যাবে। সেখানকার সহজ সরল হাবাগোবা মেয়েদের মধ্যে একটাকে বেছে নিস। আজীবন তোকে মাথায় তুলে রাখবে। আমার একটা সুইট শালীকাও আছে।”
মিশু ক্ষেপে কাটা চামুচ তুলে মেঘালয়ের মুখের সামনে ধরে বললো, “তুমি বলতে চাচ্ছো আমি সহজ সরল হাবাগোবা মেয়ে?”
– “নাহ, আমি বলতে চাচ্ছি রংপুরের সব মেয়েই হাবাগোবা, শুধু আমার বউটা বাদে।”
সবাই শব্দ করে হাসলো। পূর্ব বললো, “ঠিকই বলছিস তবে উলটা করে। সঠিক উত্তর হবে, রংপুরের সব মেয়েই চতুর শুধু তোর বউটাই হাবাগোবা।”
এরপর টেবিল সুদ্ধ সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। রেস্টুরেন্টের অন্য টেবিলে বসা লোকজনরা ওদের দিকে তাকাচ্ছে অবাক হয়ে। কত সুন্দর হাসাহাসি করতে করতে খাবার খাচ্ছে ওরা। সাথে আবার চারজন সদ্য বিবাহিত তরুণ তরুণী! আহা! কি সুখী ওরা!
সবাই যখন হাসছিলো মেঘালয় সবার অগোচরে এক হাত দিয়ে মিশুর কোমরে হাত রেখে ওকে একটু কাছে টেনে নিলো। কানের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললো, “তোমাকে আজ এত আকর্ষণীয় লাগছে কেন? আমিতো চোখ ফেরাতে পারছি না।”
মিশু মুখ বাঁকা করে ফিসফিস করেই জবাব দিলো, “আমি তো সহজ সরল হাবাগোবা মেয়ে। আমাকে আবার সুন্দর লাগে?”
– “তোমার সরলতার জন্যই তুমি পবিত্র দেখতে। কিন্তু আজকে কেন জানি খুব বেশি স্মার্ট দেখাচ্ছে তোমায়। সবার চেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে। স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী মনেহচ্ছে। আমার তো মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”
– “থাক, বাড়াবাড়ি রকমের কিছু বলতে হবেনা। গুতো মেরে সরি বলতে এসেছে। মন ভুলানো হচ্ছে?”
মেঘালয় ফিসফিস করে বললো, “সত্যিই তোমাকে একদম এত্ত বেশি সুন্দর লাগছে যে তোমার ভাষায় খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে খরছে।”
– “আমি মোটেও অতটা সুন্দরী নই।”
– “যেমন আছো, তাতেই তো আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে।”
– “কই? আমিতো ঠিকই দেখতে পাচ্ছি মাথা সোজাই আছে। ঘুরছে না তো।”
মেঘালয় মিশুর কোমরে আলতো চাপ দিয়ে গভীর ভাবে ওর চোখের দিকে তাকালো। ফিসফিস করে বললো, “আজকে হোটেলে ফিরে তোমার খবর ই আছে।”
মিশুর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে খেতে আরম্ভ করলো। কিন্তু মিশু আর একটুও খেতে পারছে না। রীতিমত পা কাঁপছে। মেঘালয়ের গভীর দৃষ্টি একদম হৃদয়ে পৌছে গেছে ওর। টেবিলের নিচে সবার আড়ালে মেঘালয় মিশুর পায়ের উপর পা রাখলো। আরো কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো মিশু। কিন্তু যখন ই পা একটু সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, মেঘালয় আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে পায়ের পাতা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ওর পা। মিশুকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। লাজুক রাঙা হয়ে উঠেছে ওর মুখটা। খাবার তুলে মুখে দেয়ার মত শক্তিটাও পাচ্ছেনা। মেঘালয় এমন কেন?
দুপুর মিশুর পাশেই বসেছে। এদিকে সবাই নানান রকম ইয়ার্কি ফাজলামি করছে আর হাসছে। দুপুর একবার নিচের দিকে তাকাতেই মিশু ও মেঘালয়ের পায়ের খেলা চোখে পড়লো ওর। মিশু পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও পারছে না। পায়ে পা রাখার অনুভূতি ও এত সুখকর হতে পারে সেটা ও প্রথম অনুধাবন করলো আজ। দুপুর কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। অন্যরকম কষ্ট অনুভূত হচ্ছে ওর। মিশুর বয়স মাত্র আঠারো। একজন সদ্য বেড়ে ওঠা তরুণী হিসেবে খুব সুখী ও। একইসাথে মিশু একজন পরিপূর্ণ প্রেমিকা, একজন স্ত্রী, একজন অর্ধাঙ্গিনী। দুপুরের ও ইচ্ছে করছে মিশুর মত সুখী হতে। একজন প্রেমিকা হতে, একজন স্ত্রী হতে। আজ যদি অরণ্য’র জায়গায় নিখিল থাকতো, তবে দুপুর ও নিঃসন্দেহে মিশুর মত উচ্ছল থাকতো। এসব ভেবে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
সায়ান মিশুর প্লেটের দিকে চেয়ে বললো, “ম্যাশ ভাবি তো কিছুই খাচ্ছেন না। ওনাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?”
মিশু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু তবুও ওকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিলো। মেঘালয় বললো, “তোমার ম্যাশ ভাবি গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে।”
– “কি হইছে ওর? কিসের চিন্তা?”
মেঘালয় মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো, “সে চিন্তা করছে টেবিলের নিচে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা।”
মিশু এই কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। কিন্তু মেঘালয়ের বন্ধুরা সবাই আরেক দফা হেসে নিলো এটা নিয়ে। সবাই হাসছে তো হাসছে ই। কারো আর হাসি থামছে না। মিশু মনেমনে ভাবছে, সবাই খুব খারাপ। শুধু হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। আর খুব পঁচা পঁচা ফাজলামি করে। আজকালকার দিনের ছেলেরা খুব সাংঘাতিক। মারাত্মক রকমের ইয়ার্কি করে শুধু।
হোটেলে ফেরার সময় পর্যন্ত সবাই হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো। ফিরে এসে যে যার রুমে চলে গেলো। মিশু রুমে এসে বসে আছে, মেঘালয় ওকে রেখে একটু পূর্বদের সাথে কথা বলতে গেছে। কালকেই এই হোটেল ছেড়ে দেয়া হবে। আগামী দুদিন ওরা চা বাগানের বাংলোয় থাকবে। সেসব নিয়ে কথা বলে এসে রুমে ঢুকলো।
রুমে ঢুকতেই মিশু মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলো, “আমার এত ঘোর ঘোর লাগে ক্যান মেঘমনি?”
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৭

0

অনুভূতি
পর্ব ২৭
মিশু মনি
.
৪১.
রাতারগুলে নৌকায় ওঠার সময় লাইফ জ্যাকেট পড়তে হলো মিশুকে। মেঘালয় ওকে জ্যাকেট পড়িয়ে দিয়ে হাত ধরে নৌকায় তুললো। নৌকায় পা রাখতেই নৌকা দুলে উঠলে মেঘালয় শক্ত করে ধরে ফেললো ওকে। ঘাটে থাকা মাঝি আর সমস্ত ট্রাভেলার্স হা করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। মেঘালয় বারবার বলছে, “একটু সাবধানে পা ফেলো মিশু, এইদিকে পা দিওনা,এইখানে পা রাখো, পড়ে যাবা একটু সাবধানে।” এই টাইপের কথাবার্তা আর ওর মিশুকে আগলে রাখার ধরণ দেখে লোকজন বুঝে গেছে ছেলেটা মেয়েটাকে কতটা ভালোবাসে।
একজন মহিলা তার স্বামীকে বললো, “দেখেছো কিরকম কেয়ার করে? সব মেয়েই এরকম কেয়ার চায়। সারাজীবন সাধনা করে হয়ত এরকম জীবনসঙ্গী পাওয়া যায়।”
কথাটা মিশুর কানে লাগলো এসে। কেবলই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো ওর।সবাই যেভাবে চেয়ে আছে তাতে খুব লজ্জাও লাগলো। নৌকায় বসে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ওর পাশে বসে মেঘালয় ওর হাত ধরে রেখেছে। বাকি তিনজন পিছনের দিকে বসেছে। নৌকা ছেড়ে দিলো।
নৌকায় দুজন মাঝি। একজন বয়স্ক লোক আরেকজন ওনার ছেলে। ছেলেটি নিতান্তই ছোট। বয়স এগারো/বারো হবে হয়ত। সে দিব্যি গায়ের জোরে নৌকার দাড় বাইছে। ধীরেধীরে বনের ভেতর প্রবেশ করলো ওরা। মিশুর চোখ বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেলো। পানির রঙ একদম গাঢ় সবুজ, আর সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। জংগলের ভেতর দিয়ে ক্রমশই নৌকা ভেতরে ঢুকছিলো। মিশু আনন্দে লাফিয়ে ওঠার মত অবস্থা। নতুন নতুন কিছু গাছ, গাছের ও অন্যরকম একটা গন্ধ আছে। প্রাণভরে ও গাছের গন্ধ নিতে লাগলো। পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে নৌকা বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফরেস্টের গভীরে ঢুকে রীতিমত গা ছমছম করতে লাগলো। নিচেও সবুজ পানি, মাথার উপরেও ঘন গাছের ডালপালা বিস্তৃত হয়ে আছে, দুপাশেই ঘন জংগল। বেশ থ্রিলিং লাগছে মিশুর কাছে। ও শিহরিত হয়ে উঠছে বারবার। আর মেঘালয় চেয়ে আছে ওর মুগ্ধ চোখের দিকে। মিশুকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে মুগ্ধ হলে, আর সবচেয়ে বেশি স্নিগ্ধ লাগে স্নানের পর।
বনের গভীর থেকে গভীরে নৌকা প্রবেশ করছে। দুপাশের ডালপালা এসে গায়ে লাগছে। একদম ঘন জংগলে ঢোকার পর মেঘালয় বললো, “মামা একটু দাঁড়ান তো।”
মাঝি দাড় বাওয়া বন্ধ করতেই মেঘালয় আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে মিশুকে তুললো। মিশুকে একটানে বুকে নিয়ে বললো, “পূর্ব ক্যাপচার।”
পূর্ব টুক করে ক্যামেরায় ক্লিক করে নিলো। ঘন সবুজের মাঝে দুজন সুখী মানুষ একে অপরের দিকে চেয়ে আছে! মিশু মেঘালয়ের বুকে ভর দিয়ে মাথাটা উপর দিকে তুলে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। মিশুর গলায় আবার চাটনি ও ঝুলছে। পূর্ব বললো, “চাটনিকন্যা চাটনি গুলা রেখে একটা ছবি তুলুন প্লিজ। হাস্যকর লাগছে।”
মিশু চাটনি গুলো গলা থেকে নামিয়ে নৌকায় ফেললো। মেঘালয় মিশুর কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নিলো। এক হাত মেঘালয়ের বুকের উপর, আরেকহাত মেঘালয়ের গলায় জড়িয়ে ধরে রেখে মিশু তাকালো গাছের দিকে আর মেঘালয় তাকিয়ে রইলো মিশুর দিকে। পূর্ব ছবি ক্লিক করে নিলো। তারপর খুশি খুশি গলায় বললো, “এই বছরের সেরা ছবি দোস্ত।”
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে বসালো ওকে। নৌকা আবারো চলতে শুরু করলো। মেঘালয় মাঝিকে বললো, “মামা কি রাগ করছেন?”
মাঝি হাসলো, “না মামা রাগ করিনাই।”
মেঘালয় হেসে জবাব দিলো, “আমার বউ হয় মামা। গত পরশু আমাদের বিয়ে হইছে।”
– “সুন্দর মানাইছে আপনাদের। আল্লাহ নিজে আপনাদের একজনরে আরেকজনের জন্য বানাইছে।”
মিশু লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। মেঘালয় বললো, “মামা আরো বিরক্ত করবো। কিছু ফটোশুট করবো। রাগ করবা মামা?”
– “না, আমার রাগ নাই।”
নৌকার ছোটমাঝি অর্থাৎ বাচ্চা ছেলেটি হঠাৎ গান গাইতে শুরু করলো। ওর গানের গলা শুনে সকলকে একবার মুগ্ধ হতেই হলো। মেঘালয় ও ওর বন্ধুরাও যোগ দিলো সাথে। এরকম একটা ছোট বাচ্চা এত সুন্দর গান গাইতে পারে ওরা ভাবতেও পারেনি। আরাফ পুরো গান সহ বনের দৃশ্য ভিডিও করে নিলো।
নৌকা বাক নেয়ার সময় মেঘালয় বিভিন্ন স্টাইলে মিশুর ছবি তুলে নিলো। মিশুর ও ছবি তুলতে খুবই ভালো লাগে। ও নানান পোজ দিয়ে ছবি তুলছে।মেঘালয় বললো, “আমি কখনোই এত ছবি তুলিনা। আজকে তুলছি কারণ এগুলা স্মৃতি হয়ে থাকবে। কোনো একদিন আমাদের বাড়িতে ভক্তরা আসবে ঘুরতে, বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে এই ছবিগুলো স্মৃতি হয়ে ঝুলবে। ক্যাপশনে থাকবে, “বিয়ের পরদিন প্রথম মধুচন্দ্রিমা”
পূর্ব বললো, “দোস্ত মধুচন্দ্রিমার মত কিছুই তো করলি না।”
– “পাবলিকের সামনে করবো নাকি? আজব তো।”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু লজ্জায় লাল থেকে নীল,নীল থেকে বেগুনী হতে লাগলো। ওর লাজুক চেহারাটা ফটাফট ক্যামেরায় ধারণ করছে পূর্ব। ওদের অজান্তেই দুজনের অনেক ছবি তুলে নিলো ও। মিশুকে সবাই ভীতু ভেবেছিলো, ও সেরকম একটুও নয়। ছবি তোলার সময় বারকয়েক নৌকা দুলে উঠেছিলো।মিশু পড়েও যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো কয়েকবার। অন্য মেয়ে হলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বন মাথায় তুলতো। মিশু দিব্যি উৎফুল্ল হয়ে বসে আছে। ওর বরং আফসোস হচ্ছে কেন পড়ে গেলো না সেটা ভেবে। পড়লে এই সবুজ জলের গন্ধটাও গায়ে মেখে নিতে পারতো। এসব ভাবছে আর চাটনি খেয়ে যাচ্ছে অনবরত।
রাতারগুলের ভেতরে যে টাওয়ারটা আছে সেখানে এসে নৌকা দাড় করালো। মেঘালয় হাত ধরে মিশুকে উপরে তুললো। অনেক উঁচু টাওয়ার। সবাইকে নিচে দাড় করিয়ে পূর্বকে নিয়ে একদম চূড়ায় উঠে গেলো ও। বেশি মানুষ উঠলে টাওয়ার দুলে উঠে,কেঁপে ওঠে। তাই বাকিরা নিচেই রইলো। মিশু সবকিছু উপভোগ করছে একদম ভেতর থেকে। মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে ইচ্ছে করছে ওর। উপরে উঠেও দুজনের অসংখ্য ছবি তুললো পূর্ব। একদম চূড়ায় মিশু মুগ্ধ হয়ে বনের দিকে চেয়ে আছে আর মেঘালয় পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে। নেমে আসার পর বাকিরা উপরে উঠলো আর মেঘালয় ফাঁকা নৌকায় শুয়ে মিশুকে বুকে নিয়ে ছবি তুললো। অনেক ট্রাভেলার্স ইমপ্রেসড ওদের এনার্জি আর প্রেম দেখে।
বেশ কিছুক্ষণ প্রাণভরে শ্বাস নিলো ওরা। মিশু বিস্ময়ে কথাই বলতে পারছে না। অনেকে মিশুর গলায় ঝোলানো চাটনি দেখে অবাক হয়ে থাকতো। মিশু তাদেরকে বলতো, “চাটনি খাবেন? তিন টাকা পিছ।” যাকে বলা হতো সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতো একদম। মিশু একটা চাটনি ছিড়ে তাদের হাতে দিয়ে দিতো। সে টাকা বের করতে গেলে ও বলতো, “টাকা লাগবে না। এমনি দিছি। এমনির আরেক নাম তিন টাকা।”
সবাই আরো বেশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতো। “এমনির আরেক নাম তিন টাকা” এরকম বাক্য এ জনমে কেউ শোনেনি বোধহয়। মেঘালয়ের বন্ধুরা মিশুর কথাবার্তা আর কাণ্ড দেখে মজা পাচ্ছিলো। পুরো বনটা নৌকায় ঘোরার পর ধীরেধীরে আবারো ঘাটের দিকে ফেরা হলো। মিশুর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওর মুখটা ছোট্ট একটু হয়ে গেছে।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে মিশুমনি?”
– “আমার ওই বনের ভেতর থেকে যেতে ইচ্ছে করছিলো। একদম ই ফিরতে ইচ্ছে করছে না।”
– “আহারে বাচ্চাটা। মন খারাপ করে না সোনামণি। আমরা যতক্ষণ ভেতরে ছিলাম, এতক্ষণ কেউ ওখানে থাকেনা রে। মামাকে কতক্ষণ বসিয়ে রাখলাম দেখোনি? এর বেশি সময় ওখানে থাকে কেউ?”
মিশু মুখটা কালো করে বসে রইলো। সবই বুঝতে পারছে তবুও ওর মন খারাপ লাগছে। মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। কিন্তু পাবলিক প্লেসে সেটা সম্ভব না। মিশুর মন খারাপ করা চেহারা দেখে ওর ও খারাপ লাগছে। ঘাটে ফেরার আগেই মেঘালয় মাঝিকে কিছু বখশিশ দিয়ে দিলো। যেটা ঠিক করা হয়েছিলো সেটা নিয়েই অনেকে দরদাম করে, সেখানে এক্সট্রা বখশিশ পেয়ে মাঝি খুশি হয়ে গেলেন। ঘাটে ফিরেই মেঘালয় দেড়ি না করে মিশুকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
সায়ান এক বোতল পানি এনে দিলো। মিশু পানি খেয়ে সিটে চুপচাপ বসে রইলো। মেঘালয় দুহাতে ওর মুখটা ধরে বললো, “এই পাগলী, মন খারাপ করে থাকবা? তুমি জানো না তুমি এরকম গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে আমার ও মন খারাপ হয়ে যায়?”
মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, “সবকিছু এত সুন্দর কেন? বেশি সুন্দর দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি কেমন যেন হয়ে যাই।”
– “কাল তোমাকে আরো সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাবো পাগলী। কাল একদম সকাল সকাল বের হবো, সারাটা দিন তুমি সেখানে প্রকৃতির কোলে বসে থাকবা।”
মিশু আর কিছু বললো না। পূর্বরা গাড়ির কাছে আসছে দেখে ও সোজা হয়ে বসলো।
গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে ওর মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো। বিকেল গড়িয়ে এসেছে। খাবার খেয়ে পান্থুয়ামাই চলে গেলো ওরা। কিন্তু সময়ের অভাবে বেশিক্ষণ থাকা হলোনা। মিশুর মনটা একটু ভালো হতে শুরু করেছিলো, আবারো খারাপ হয়ে গেলো। ও কোনো কথা না বলে একদম গম্ভীর হয়ে বসে রইলো।
৪২.
হোটেলে ফিরে মিশুকে ফ্রেশ হতে বলে পূর্ব’র সাথে কথা বলার জন্য ওদের রুমে গেলো মেঘালয়। রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে একজন ডাকলো, “আরে মেঘালয় না?”
মেঘালয় পিছন তাকাতেই খুশি হয়ে উঠলো – অরণ্য!
অরণ্য মেঘালয়ের ছোটবেলার বন্ধু ছিলো। কলেজে ওঠার পর সবাই যে যার মত আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো ওদের। মেঘালয় গিয়ে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কেমন আছিস বন্ধু?”
– “ভালো,ইন ফ্যাক্ট খুব ভালো। হানিমুনে এসেছি দোস্ত।”
– “সত্যি! কংগ্রাচুলেশনস বন্ধু।”
– “অনেক দিন পর দেখা। তুই কি ট্যুরে এসেছিস?”
মেঘালয় মাথা চুলকে বললো, “হুম ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে এসেছি। তোর ভাবিও আছে।”
অরণ্য হেসে বললো, “ভাবি কোথায়?”
– “রুমে, ফ্রেশ হচ্ছে। মাত্র বাইরে থেকে ফিরলাম তো। তোর বউকে দেখাবি না?”
– “হোয়াই নট? হাজার হলেও দোস্ত। তোর বউ মানেই তো আমার বউ,আমার বউ মানে তোর বউ।”
মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। অরণ্য বললো, “ভাবিকে নিয়ে আমাদের রুমে আয়। এইতো এটাই আমাদের রুম।”
– “ওকে,তুই গিয়ে কফি বানাও। আমরা আসছি।”
অরণ্য হাসতে হাসতে মেঘালয়ের রুমের বিপরীত রুমটায় ঢুকে গেলো। মেঘালয় রুমে ঢুকে দেখলো মিশু গুনগুন করে গান গাইছে আর চুল আচড়াচ্ছে। চুল ঠিকমত মুছতেই পারেনি আর আচড়াচ্ছে দেখে ও রেগে বললো, “তোমাকে ভেজা চুল আচড়াতে বারণ করেছিলাম।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে বললো, “ইস! ভূলেই গিয়েছিলাম।”
– “আচড়েছো ভালো করেছো। এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা। চলো ওর বউকে দেখে আসি।”
মিশু উঠে দাঁড়াল। মেঘালয় এগিয়ে এসে তোয়ালে নিয়ে মিশুর চুলগুলো ভালো মত আচড়ে দিয়ে বললো, “কিচ্ছু পারেনা সোনামণিটা। চোখে কাজল দাও।”
মিশু চোখে কাজল দিতে গিয়ে একচোখে মোটা, আরেক চোখে পাতলা হয়ে গেলো। মেঘালয় নিজেই সেটা ঠিক করে দিলো। তারপর শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে হালকা মেকাপ করিয়ে একদম পুতুলের মত দেখাচ্ছিলো মিশুকে। মেঘালয় বললো, “উফফ যা লাগছে না। আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
– “তোমার বন্ধুর আবার মাথা খারাপ যেন না হয়।”
– “সেটাই ভাবছি। এই আমরা তো আবার বের হবো। তাড়াতাড়ি আসো।”
অরণ্য’র দরজায় নক করতেই ও দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানালো। মিশু মেঘালয় ভেতরে ঢুকে দুপুরকে দেখে একদম হতবাক! একদম একইরকম দেখতে একটা মেয়েকে ট্রেনে দেখেছিলো ওরা। নতুন বউয়ের সাজে দেখেছিলো। সেই মেয়েটাই কি? নাহ, একটু পার্থক্য আছে। ওই কনের চেয়ে এই মেয়েটা একটু বেশি ফর্সা। ট্রেনে দেখা মেয়েটা একটু শ্যামলা ছিলো। কিন্তু চেহারার গড়নে অদ্ভুত মিল। মেঘালয় ও মিশু একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
দুপুর বললো, “বসুন আপনারা।”
মিশু ও মেঘালয় থতমত খেয়ে চেয়ে আছে। মিশু রৌদ্রময়ীর সাথে কথাও বলেছে। কথা বলার সময় মেয়েটার মুখের ভঙ্গি যেমন হয়,এই মেয়েটার ও ঠিক সেরকম হচ্ছে। মিশু হেসে বললো, “ভাবি তো অনেক সুন্দর দেখতে।”
দুপুর হাসার চেষ্টা করলো। মিশু সবার সাথে খুব অনায়াসেই মিশে যায়। ও গিয়ে দুপুরের পাশে দাঁড়িয়ে দুপুরকে রীতিমত জড়িয়ে ধরলো। মেঘালয়ের মিশুর এই জিনিস টাই খুব পছন্দ। সবাইকে দ্রুত আপন করে নেয় মেয়েটা। মিশু হেসে হেসে বললো, “সত্যিই ভাবি আপনি খুব সুন্দর। অরণ্য ভাইয়া কি সুন্দর একটা বউ পেয়েছে!”
অরণ্য হেসে জবাব দিলো, “আপনি কিন্তু একদম পুতুলের মত দেখতে। দেখলেই কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে।”
অরণ্য’র মুখে এমন কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মিশু। মেঘালয় ও অরণ্য হেসে উঠলো। মিশু লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দুপুর বললো, “সত্যি বলেছে কিন্তু। তোমাকে দেখলেই গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে। একদম খুকুমণি খুকুমণি চেহারা। শাড়ি পড়ে ঠিক রাজকন্যাটি লাগছে।”
মিশু হাসলো। মেঘালয় মাথা চুলকালো লজ্জা পেয়ে। দুপুর মিশুকে বললো, “সরি বোন। তুমি বলে ফেলেছি। আসলে তুমি দেখতে এমন পিচ্চি, আপনি বলতেই ইচ্ছে করেনা। আর এত আপন আপন লাগে, আপনি বলা যায় বলো?”
মিশু দুপুরকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি করেই বলুন। আমার ভালো লাগছে শুনতে।”
অরণ্য দু কাপ কফি এগিয়ে দিলো মেঘালয় ও মিশুর দিকে। মেঘালয় সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিলো। মিশু দুপুরকে নিয়ে বিছানার উপর বসেছে। অরণ্য ও মেঘালয় হাসাহাসি করছে। মিশু দুপুরকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আপনার কি আপনার মত দেখতে কোনো বোন আছে?”
চমকে উঠলো দুপুর। অরণ্য ও মাথা তুলে তাকালো মিশুর দিকে। কারো মুখে কোনো কথা ফুটছে না। দুপুরের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো হঠাৎ।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৬

0

অনুভূতি
পর্ব ২৬
মিশু মনি
.
৩৯.
আট টার দিকে হোটেল থেকে বেড়িয়ে পড়লো ওরা।
বাইরে এসে রেস্টুরেন্ট এ নাস্তা করে প্রথমেই গেলো হযরত শাহজালাল (রহ:) এর মাজারে। ভেতরে ঢুকে মিশুকে নিচে দাড় করিয়ে রেখে ওরা উপরে মাজার দেখতে চলে গেলো। মাজারে মহিলাদের ঢোকা নিষেধ। মিশু নিচে ঘুরেঘুরে কবুতর, পুকুর, নামাজের জায়গা, আর নিচে শুয়ে থাকা লোকজন দের দেখছিলো। একজন গার্ড টাইপের কেউ এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে লাঠি দিয়ে মেরে ঘুমিয়ে থাকা লোকজন দের তুলে দিচ্ছে।
মেঘালয় পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “ম্যাম।”
মিশু পিছন ফিরতেই মেঘালয় হাসলো। বললো, “আসুন।”
বাইরে বের হয়ে রাস্তার দুপাশে অনেক দোকান দেখতে পেলো মিশু। একটা দোকান থেকে মেঘালয় হালুয়া কিনে দিলো ওর হাতে। দুপাশের দোকান গুলো দেখতে দেখতে মিশু হালুয়া খাচ্ছিলো আর রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো। গাড়িতে উঠে মিশু সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার জন্য অনুনয় করতে লাগলো। মেঘালয় ওকে বসিয়ে দিয়ে নিজেই ড্রাইভ করতে লাগল। একমাত্র মেঘালয় ই এদিকের রাস্তা চেনে। বাকিরা চেনেনা।
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
– “রাতারগুল।”
– “রাতারগুল আবার কি? কি আছে সেখানে?”
– “রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট।”
– “সোয়াম্প ফরেস্ট আবার কি?”
– “বাংলাদেশে দুটো বিখ্যাত বন আছে শোনোনি? ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আর সোয়াম্প ফরেস্ট?”
মিশু লাফিয়ে উঠে বললো, “ওহ বুঝতে পেরেছি। আমরা এখন সেখানে যাচ্ছি? খুব মজা হবে।”
– “হুম, অনেক মজা হবে।”
মিশু একটু কি যেন ভেবে বললো, “আচ্ছা শুনেছি ওই ফরেস্ট টা পুরোটাই জলের উপর? আমরা যখন ভেতরে ঢুকবো আমার পায়জামা ভিজে যাবে না?”
সবাই হেসে ফেললো মিশুর কথা শুনে। একদম বাচ্চাদের মতন কথাবার্তা। মেঘালয় হেসে জবাব দিলো, “আমরা তো পায়ে হাঁটবো না রে পাগলী। আমরা নৌকায় পুরো বনটা ঘুরবো।”
– “ইস! কত্ত মজা হবে তাহলে।”
ওর এমন শিশুসুলভ কথাবার্তা শুনে বাকিরা হাসছিলো। মজা লাগছে শুনতে। পূর্ব বললো, “ভাবি ওখানে কিন্তু গাছে সাপ ঝুলে ঝুলে থাকে। আমরা যখন নৌকা নিয়ে জংগলের ভেতর ঢুকবো, টুপ করেই একটা সাপ আপনার কোলের উপর পড়বে।”
মিশু অবাক হয়ে মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি! তাহলে তো আরো মজা হবে। আমি সাপ কোলে নিয়ে বসে থাকবো আর তুমি সায়ান ভাইয়ার ক্যামেরা দিয়ে আমার একটা ছবি তুলে দিবা আচ্ছা?”
সবাই আবারো হেসে উঠলো। পূর্ব ভেবেছিলো সাপের কথা বললে মিশু হয়ত আঁৎকে উঠবে। কিন্তু মিশুর আরো মজা লাগছে সেটা শুনে। সত্যিই মেয়েটা এখনো বড্ড ইনোসেন্ট।
মেঘালয় একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাড় করালো। বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে বেশ সুন্দর। মিশু একবার জানালা দিয়ে মাথা বের করে সেদিকে তাকালো। তারপর মেঘালয় কে জিজ্ঞেস করলো, “আমরা এই বাড়ির ভেতর দিয়ে জংগলে ঢুকবো?”
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “না রে পাগলী। বাড়ির ভেতর দিয়ে কখনো জংগলে ঢোকা যায় বুঝি? তোমার কি মনেহয় এর ভেতরে নদী আর বন আছে?”
মিশু লজ্জা পেয়ে গেলো। সত্যিই তো! বাড়ির ভেতরে কিভাবে বন থাকতে পারে। কি যে বোকার মত প্রশ্ন করে সে! নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো। মেঘালয় একজনকে কল দিয়ে কথা বললো। তারপর মিশুকে বললো, “এটা নায়ক সালমান শাহ এর বাড়ি।”
– “কোন সালমান শাহ?”
– “বাংলাদেশে একজন ই জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ ছিলেন।”
– “তুমি আমার এমন ই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন,সেই সালমান শাহ?”
– “হ্যা, সেই সালমান।”
মিশুর চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো। আর ওকে দেখে বাকি চারজন হেসেই খুন। বেশি আনন্দে মেয়েটা একেবারেই ছোট বাচ্চাদের মতন হয়ে যায়। কি বলে না বলে কোনো বোধ থাকেনা। মেঘালয় গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হলো। বাকিরাও নেমে দাঁড়ালো।
একজন লোক এসে মেঘালয়ের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন, “আরে মেঘালয় যে! অনেক দিন পর।”
– “ফ্রেন্ডস দের নিয়ে ঘুরতে চলে এলাম। কেমন আছেন?”
লোকটি হাসিমুখে কথা বলতে লাগলেন। উনি বোধহয় শুধু পূর্বকেই চেনেন। পূর্ব’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছো?
ওরা বেশিক্ষণ দেড়ি করলো না। এমনিতেই বেলা দশটা বেজে গেছে। রাতারগুল পৌছাতে দুপুর প্রায় হয়েই যাবে। বিকেলে আবার চা বাগানে মিটিং আছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দিতে হলো। মিশু অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। গাড়ি থেকে চা বাগান দেখতে পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে। মেঘালয়ের হাত চেপে ধরে বললো, “এত্ত সুন্দর কেন!”
মেঘালয়ের খুবই ভালো লাগছে মিশুকে দেখে। যে মানুষ টার মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা নেই, প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে যে অভিভূত হয়না, তাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়ে আনন্দ নেই। মিশুর উচ্ছ্বসিত মুখ, আনন্দে বারবার লাফিয়ে উঠা, উত্তেজনায় হাত তালি দেয়া সবই মেঘালয়কে মুগ্ধ করছে প্রতি মুহুর্তে। ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য যদি মিশুকে দেখিয়ে আনতে পারতাম!
মিশু বললো, “আমার কি ইচ্ছে করে জানো? ওই যে গামছার মত ড্রেসগুলো পড়ে, পিঠে একটা বালতির মত ঝুড়ি ঝুলিয়ে চা বাগানে চা পাতা তুলি। আমাদের একটা ছোট্ট সুন্দর সোনামণি হবে, তাকে গামছায় বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে আমি চা বাগানে চা পাতা তুলবো। কেমন মজা হবে বলোতো?”
মেঘালয় হেসে ফেললো। সায়ান বললো, “কোনোকালে কোনো মেয়ের এরকম ইচ্ছে হয় আমার জানা ছিলোনা।”
মিশু বললো, “আমার খুব হয়। আমার ইচ্ছে হয় পাহাড়ের উপর গিয়ে জুম চাষ করি, কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে জমি চাষ করবো। অনেক কষ্ট করবো, অনেক পরিশ্রমী হবো। তারপর অনেক দিন বাঁচবো।”
পূর্ব চোখ দুটো বড়বড় করে বললো, “কেয়া বাত হ্যায়! দারুণ দারুণ ইচ্ছে তো তোমার মিশু। আর কি কি ইচ্ছে আছে বলোতো শুনি?”
মিশু আগ্রহী হয়ে বলতে লাগলো, “আমার ইচ্ছে করে পাহাড়ের উপর গিয়ে একটা ঘর বানিয়ে থাকি। আমাদের অনেক অভাব থাকবে, আমি আর মেঘ কষ্ট করে রোজগার করে আনবো। তারপর মজা করে খাবো। মেঘ অনেক দূর থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে আনবে, আমি জুম চাষ নিয়ে ব্যস্ত থাকবো। আবার ইচ্ছে করে মেঘের দেশে একটা ঘর বানিয়ে থাকি। ঘুম থেকে উঠে যখনি বাইরে এসে দাঁড়াবো, মেঘ উড়ে এসে আমাদের ছুঁয়ে যাবে।”
মেঘালয় বললো, “বাড়ি বানিয়ে থাকাটা হয়ত সম্ভব না। তবে সাজেকে মেঘের দেশে নিয়ে যাবো তোমায় একদিন। ঘুম থেকে উঠে যখন বাইরে এসে দাঁড়াবে, তুলোর মত মেঘ এসে তোমাকে শীতল স্পর্শ দিয়ে যাবে।”
– “আচ্ছা। তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবা হ্যা?”
– “হুম তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবো।”
পূর্ব জিজ্ঞেস করলো, “ভাবি আর কি কি ইচ্ছে আছে বলেন না শুনি। আপনার ইচ্ছেগুলো একদম ইউনিক। লাখ টাকায় ও কেনা যাবেনা। বলেন শুনি?”
মিশু একটু নড়েচড়ে বসলো। পিছন ফিরে ওদের দিকে তাকিয়ে পা দুটো সিটের উপর তুলে বসলো। মেঘালয় মিশুর বসার স্টাইল দেখে মুখ টিপে হাসলো। অন্যকেউ ওর সামনে এভাবে বসার সাহস হয়ত পাবেনা। আর ওর চারপাশের সবাই খুব বেশি ভদ্র সবসময়। মিশু কোনোকিছু না ভেবেই পা উপরে তুলে বসলো সেটা মেঘালয়ের কাছে অন্যরকম লাগাটাই স্বাভাবিক। নিঃসংকোচ আচরণ বরাবর ই ওকে মুগ্ধ করে।
মিশু বললো, “আমার না পাহাড়ের প্রতি খুব টান। পাহাড়ের উপর একটা পিঠার দোকান দিতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা মেঘ,পাহাড়ে পিঠা বিক্রি হবে?”
মেঘালয় বললো, “কেন হবেনা? পাহাড়ের উপর হাজার হাজার ট্রাভেলার্স ঘুরতে আসে। তারা পিঠা কিনে কিনে খাবে।”
– “বিদেশি রাও আসে? বিদেশিরা তো দুই টাকার পিঠা খেয়ে আমাদের দশ টাকা দিয়ে যাবে। তখন আমাদের অনেক গুলা টাকা হবে।”
সায়ান বললো, “তোমার বরের এমনিতেই অনেক গুলা টাকা আছে মিশু। সারাজীবন পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খেতে পারবা।”
মিশু একবার মেঘালয়ের দিকে তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার রেডিমেড কিছু ভালো লাগেনা। কিছু প্রস্তুত আছে,সেটা ভোগ করতে একটুও আরাম পাইনা আমি। বরং নিজে প্রস্তুত করে সেটা ভোগ করার মাঝে অন্যরকম আনন্দ। বাপের টাকায় ফুটানি মারার চেয়ে নিজে দু টাকা ইনকাম করে কষ্ট করে চলাটাও শান্তি।”
সবাই লজ্জা পেয়ে গেলো। মেঘালয় মুচকি হাসলো মিশুর জীবন দর্শন দেখে। মেয়েটা যেমন সরল,তেমনি তেজীও। কোনোকিছুর জন্য কারো উপর নির্ভর করতে রাজি নয়। আমার যা আছে, আমি তাই নিয়েই সুখী। অন্যের কাছে ফ্রিতে কিছু নিয়ে আলগা সুখের কোনো মানেই হয়না। এসব ভেবে ভেবে মেঘালয় হাসছিলো। মিশু জিজ্ঞেস করলো, “এই আমার না খুব আচার খেতে ইচ্ছে করছে।”
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এখন সে আচার কোথায় পাবে? পূর্ব ফাজলামি করে বললো, “ভাবির কি বমি বমি পাচ্ছে?”
– “না, আমার জার্নিতে বমি আসেনা।”
– “মাথা ঘুরাচ্ছে?”
– “না, আমার কখনো মাথা ঘুরায় না।”
– “ওহ শিট, কোথায় ভাবলাম আমরা আংকেল হবো।”
বলেই সবাই হেসে উঠলো। মিশু এই ইয়ার্কির আগাগোড়া কিচ্ছু বুঝতে পারলো না। ইহকালে কেউ কখনো ওর সাথে এরকম ফাজলামি করেনি। আচার খাওয়ার সাথে আংকেল হওয়ার কি সম্পর্ক মাথাতেই ঢুকলো না। সবাই হাসছে আর মিশু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় ও ফ্রেন্ড দের দিকে তাকিয়ে হাসছে। মিশু যে এই সাধারণ ফাজলামিটা ধরতে পারেনি সেটা দেখে আরো মজা লাগছে সবার।
মিশু মেঘালয়ের দিকে ফিরে বললো, “এখানে কোথাও আচার পাওয়া যাবে না?”
ওরা আবারো হেসে উঠলো। মিশু জিজ্ঞেস করলো, “হাসছো কেন তোমরা?”
মেঘালয় বললো, “তুমি বাংলা সিনেমা দেখো না? সিনেমায় বাড়ির বউরা আচার খেলে স্বামী আর শ্বাশুরিরা কি বলে জানো না?”
মিশু মুখ বাঁকা করে বললো, “সিনেমা দেখার সময় কখনো পাইনি। ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেকটা সেকেন্ডকে আমি কাজে লাগাতাম। যেটুকু অবসর পেয়েছি, বিদেশি উপন্যাস পড়েই কাটিয়েছি।”
সবাই চুপ হয়ে গেলো। আনন্দময় শৈশব হয়ত মিশুর ছিলোনা। নিজে যদিও বাচ্চা স্বভাবের,তবুও সময়ের ব্যাপারে সবসময় ই খুব সিরিয়াস ও। ইচ্ছে পূরণের বেলায় যেকোনো উদ্ভট কাজ করা যেতে পারে, কিন্তু সময়কে সবসময় কাজে লাগানো চাই।
সায়ান বললো, “মিশুর একটা জিনিস দেখে আমি খুব অবাক হই। আমরা সচরাচর যেসব বলাবলি করি,ও সেসব জানেনা। আবার আমরা যেসব কল্পনাও করিনা, ও সেসব নিয়ে ভাবে।”
মেঘালয় বললো, “এটা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। আল্লাহ মেয়েটাকে যে কি দিয়ে বানাইছে! জগতের সব উদ্ভট চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খায়।”
মিশু বললো, “আমি আবার কি উদ্ভট চিন্তা করলাম?”
– “পাহাড়ের উপর পিঠার দোকান দেয়ার চিন্তাটা কি উদ্ভট নয়?”
– “আহা! আমি তো অল্প কয়দিন ব্যবসা করবো। পনেরো দিন পিঠা বেচবো। তারপর আবার অন্য ব্যবসা।”
পূর্ব বললো, “এরা দুটোই সবসময় ব্যবসার চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘোরে।”
বলেই হেসে উঠলো। সবাই মিলে হাসাহাসি করতে করতে রাতারগুলের কাছাকাছি পৌছে গেলো। গাড়ি থেকে নেমে দোকান থেকে একগাদা চাটনি কিনে মেঘালয় মিশুর হাতে ধরিয়ে দিলো। মিশু চাটনি গুলো গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে বললো, “আমরা জংগলের ভেতরে গিয়ে চাটনি বেচবো। যারা আমাদের মত ঘুরতে এসে আচার খেতে চাইবে, তারা আমার কাছে চাটনি কিনে কিনে খাবে। এক পিছ তিন টাকা।”
পূর্ব সবাইকে দাড় করিয়ে কোমরে হাত রেখে বললো, “সাধে কি বললাম এরা সবসময় ব্যবসার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরে? রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের ভেতরে গিয়ে সে নাকি আচার বেচবে?”
সবাই আরেক দফা হেসে নিলো এসব নিয়ে। মিশুও খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
৪০.
ফোনের স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো দুপুরের। নিখিল!
ও রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “হ্যালো।”
ওপাশ থেকে নিখিলের কর্কশ গলা ভেসে আসলো, “রিসিভ করতে এত সময় লাগে?”
ভয় পেয়ে গেলো দুপুর। নিখিল কখনো এভাবে রাগ দেখায়নি ওকে।আর এখন তো ও অন্য কারো স্ত্রী। গত দুদিন নিখিলের সাথে কোনোরকম কথাও হয়নি। আজকে হঠাৎ কি হলো ওর?
নিখিল বললো, “বরের সাথে প্রেম নিয়ে ব্যস্ত ছিলে বুঝি?”
– “নিখিল, তুমি এভাবে কেন কথা বলছ?”
– “তোমার সাথে আর কিভাবে কথা বলা উচিৎ?”
– “এরকম বিহ্যাভ দেখানোর জন্য কল দিয়ে থাকলে ফোন রাখো।”
– “রাখবো। তার আগে শুনি মহারাণীর নতুন জীবনটা কিভাবে শুরু হচ্ছে?”
নিখিলের কথা বলার স্টাইল দেখে রাগ হলো দুপুরের। ও বললো, “খুব ভালো ভাবেই শুরু হচ্ছে। আমার বর আমার অনেক কেয়ার করে।”
– “তা তো করবেই। সুন্দরী বউ পেয়েছে না? তার তো আর রৌদ্রময়ীর দরকার ছিলো না, তার দরকার ছিলো তোমাকে। সে তো কেয়ার করবেই।”
– “নিখিল, ভাষা এমন করছো কেন?”
– “তাছাড়া? তোমার শ্বশুরঘরের লোকরাও তো অনেক কেয়ার করে তাইনা? করবেই তো। তাদের তো একজন পুত্রবধূ দরকার ছিলো, স্পেশালি রৌদ্রময়ীর কোনো দরকার ছিলোনা।”
দুপুরের মেজাজ রীতিমত খারাপ হতে শুরু করেছে। ও সবকিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু বিনা কারণে খারাপ আচরণ একদম ই সহ্য করতে পারেনা। বললো, “নিখিল তুমি দয়া করে ফোনটা রাখো। আর রাগ ঝাড়ার জন্য ফোন দিওনা প্লিজ।”
– “আমি রাগ গুলো কাকে দেখাবো তাহলে? তোমার কি কিছুই করার ছিলোনা? আমি তোমার বাবাকে ভালো করেই চিনি। তুমি যদি তাকে একবার বলতে বিয়েতে তোমার মত নেই তবে উনি কখনোই তোমাকে জোর করে অরণ্য’র সাথে বিয়ে দিতো না।”
দুপুর রেগে বললো, “এই জন্য রেগে আছো? দেখো, হয়ত আমি চাইলেই বিয়েটা ভাংতে পারতাম। কিন্তু সেই মুহুর্তে আমার কাছে আমার বাবার সম্মান টাই সবচেয়ে বড় ছিলো। বাবার মুখের উপর না বলে দেয়ার মত শক্তিটা পাইনি আমি।”
– “আমি কি তোমার অযোগ্য ছিলাম? আমাকে বিয়ে করলে তোমার বাবার সম্মান নষ্ট হয়ে যেত? আমি তো চেয়েছিলাম গিয়ে তোমার বাবার হাতে পায়ে ধরে তোমাকে চাইতে। আমাকে বারণ করেছিলে কেন?”
– “নিখিল,আমার জায়গায় নিজেকে দাড় করিয়ে একবার ভাবো। আশাকরি উত্তর পেয়ে যাবা। গত দুদিন যাবত পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি আর তুমি ফোন দিয়ে আমাকেই রাগ ঝারছো?”
কণ্ঠটা হঠাৎ নরম হয়ে গেলো নিখিলের। ও বললো, “আমি তোমার সাথে চরম খারাপ আচরণ করতে চাই দুপুর। যাতে করে খুব সহজেই আমার প্রতি তোমার বিতৃঞ্চা চলে আসে আর আমাকে ভূলে যেতে পারো।”
দুপুর হাসার চেষ্টা করে বললো, “তোমার ধারণা ভূল। যত খারাপ কাজ করেই আমার সামনে আসোনা কেন, দুপুর কখনো তোমাকে ভূলতে পারবে না। তোমার জায়গাটা আজীবন তোমার। সেখানে খারাপ আচরণ করে অযথা আমাকে কষ্ট দিওনা নিখিল।”
নিখিলের কান্না পেয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “হুম। ভালো থেকো।”
– “আর আগামী তিনদিন আমাকে কল দিওনা। এই তিনদিন অরণ্য হয়ত প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমার সাথে থাকবে।”
– “হানিমুনে যাচ্ছো?”
প্রশ্নটা শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো দুপুরের। হানিমুন নিয়ে কত্ত প্লান ছিলো নিখিলের সাথে। নিখিল বলেছিলো ওকে দার্জিলিং নিয়ে যাবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিয়ে আনবে। রিসোর্টের বিছানায় শুয়ে নিখিলের বুকে মাথা রেখে দূরের হিমালয় দেখবে ও। সব স্বপ্ন নিমেষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
নিখিল বললো, “আচ্ছা রাখছি দুপুর। নিজের খেয়াল রেখো।”
– “তুমিও। আর প্লিজ সিগারেট খেও না।”
– “আমার জন্য চিন্তা করাটা বাদ দিও দুপুর। আমি চেষ্টা করবো যাতে কখনো তোমাকে ফোন না দেই।”
– “ফোন দিও। আগামী তিনটা দিন দিওনা।”
– “কোথায় যাচ্ছো?”
– “সিলেটে যাচ্ছি। নূরজাহান গ্রান্ডে উঠবো। একদিন ট্যুরে গিয়ে ওই হোটেলে শুয়ে শুয়ে আমাকে ভিডিও কল দিয়েছিলে। কি পরিমাণ কষ্ট হবে আমার ভাবতে পারো নিখিল?”
– “আচ্ছা যাও। সাবধানে থেকো।”
শেষ মুহুর্তে গলাটা ভিজে উঠলো দুপুরের। ফোন রেখে আয়নার দিকে তাকালো ও। চোখ মুছলো শাড়ির আঁচলে। এই চোখের জল কাউকে দেখাতে চায়না ও। একটু বাদেই অরণ্য এসে বেড়িয়ে পড়ার জন্য তাগাদা দিলো। লাগেজ নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে দুপুরের সামনে দাঁড়ালো। টিস্যু পেপার নিয়ে দুপুরের কাজল ঠিক করে দিতে দিতে বললো, “একটু নিজের কেয়ার করতে পারো না? বড্ড অগোছালো তুমি।”
দুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বেড়িয়ে পড়লো ওরা সিলেটের উদ্দেশ্যে।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৫

0

অনুভূতি
পর্ব ২৫
মিশু মনি
.
৩৮.
মেঘালয় মিশুকে সিটে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখলো। ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “তুমি ঘুমোও।”
মিশুর মোটেও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। মেঘালয় জোর করে ওকে ঘুম পাড়াতে চাইছে। বারবার বলছে, “কালকে সারাদিন ঘুরতে হবে। তুমি ঘুমাও সোনামণি।”
বাধ্য হয়েই ও ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে রইলো। মেঘালয় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘালয় ওকে জিজ্ঞেস করলো, “ঘুমাইছো?”
মিশু কোনো সাড়া দিলো না। জেগে আছে বুঝতে পারলে মেঘালয় আবারো জোর করে ঘুম পাড়াতে চাইবে। সেজন্যই ও চুপ করে রইলো।
মেঘালয় যখন বুঝতে পারলো মিশু ঘুমিয়ে গেছে তখন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে এসি বাড়িয়ে দিলো। ব্যাকসিট থেকে হাত বাড়িয়ে চাদর নিয়ে মিশুর গায়ের উপর দিয়ে দিলো। তারপর আবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশুর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে ছেলেটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এভাবে কেয়ার করতে হয় বুঝি? মানুষ নাকি দুই অবস্থায় পড়লে কান্না করে। অধিক সুখে আর অধিক কষ্টে! ইদানীং মিশুর শুধু সুখেই কান্না পায়। এমন করে কেউ কেয়ার করলে সুখী না হয়ে উপায় আছে!
সায়ান জিজ্ঞেস করলো, ” ভাবি ঘুমাইছে?”
মেঘালয় জবাব দিলো, “হুম, বাচ্চাটা ঘুমালো।”
– “হা হা হা, বাচ্চাটা? রাতেও কি বাচ্চাটা বাচ্চাটাই ছিলো?”
– “কথায় বলেনা ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে? বাচ্চা তো সবসময় বাচ্চাই। সে কি বাসর ঘরে হুট করে বড় হয়ে যাবে নাকি?”
পূর্ব বললো, “যাই বল,মিশুর মত আনাড়ি বউ পাওয়াটাও সৌভাগ্য। মেয়েটা কিচ্ছু বুঝেনা। হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়ে দিবি,প্রেম শেখাবি, তারপর দেখবি তোর চেয়েও বেশি বেশি করে তোকে ভালোবাসবে।”
মেঘালয় হেসে বললো, “আমার এতেই হবে। সবসময় যে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসাই লাগবে এমন টা তো নয়। মিশু আজীবন এমন পাগলী আর অবুঝ থাকুক না। আমি একাই না হয় ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসা দিয়েই সবটুকু উসুল করে নিবো।”
আরাফ বললো, “সে কি তোকে ভালোবাসে না? লাইফের প্রথম প্রেমে পড়েছে তো, আস্তে আস্তে দেখিস কেমন পাগল হতে শুরু করে।”
মেঘালয় বললো, “আমি চাইনা ও পাগল হোক। ও আমার পাগলী হয়েই থাকুক। তবে ও আমাকে একটু দূরে সরিয়ে দিলেই কেমন যেন আমার মাথা খারাপ হয় যায় রে। আজকে ও আমাকে রেগে বলেছে, আমাকে একা থাকতে দাও কিছুক্ষণ। যাও এখান থেকে। বিশ্বাস কর বাইরে এসে আমি কান্না করে ফেলছি। মেঘালয়ের সমস্ত নিয়ম ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। আমি আমার নিয়মের বাইরে গিয়ে যত সব কাণ্ড করে ফেলছি।”
সায়ান বললো, “এরকম ই থাকিস আজীবন। মিশুর জন্য এটা খুব জরুরি। মানুষ বড় হলে নাকি চেঞ্জ হয়ে যায়। তুই আবার ওই নিয়মের মধ্যে ঢুকে যাস না যেন। তাহলে তোকে নিয়ে যত প্রাউড ফিল করি, সব ভেস্তে যাবে আমাদের।”
মিশুর চোখ থেকে পানি পড়ছে। মেঘালয় আর ওর বন্ধু বান্ধবদের কথা শুনে আরো সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। মেঘালয়ের মত একজনকে পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক ভাগ্য করে ওকে পেয়েছে মিশু। এসব ভেবে ভেবে কান্না এসে যাচ্ছে। মেঘালয় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরামে চোখ বুজে রইলো ও।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। ঘুম ভাংলে চোখ কচলে উঠে বসলো। মেঘালয় বললো, “ঘুম হলো মহারাণী’র? আর কিছুক্ষণ ঘুমাতে।”
মিশু মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে বললো, “আর ঘুম আসছে না।”
কথাটা বলা শেষ হতে না হতেই আবারো ঘুমিয়ে গেলো। মেঘালয় হাসলো। পাগলী একটা। এক হাতে ওকে ধরে রইলো মেঘালয়। হাতটা মিশুর কাঁধের উপর দিয়ে নিয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেঘালয় একটু নড়তেই মিশু রেগে বললো, “এত নড়াচড়া করো কেন?”
মেঘালয় হেসে ফেললো। প্রায় এক ঘন্টা যাবত ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আর মেঘালয় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে আবার মেঘালয়কেই ঝাড়ি মারে? হা হা হা।
হাসি চেপে গেলো মেঘালয়। পাগলিটা ঘুমাক আরাম করে। কাঁধটা একটু সোজা করে নিতে পারলে ভালো হতো তবুও আর একবার ও নড়লো না মেঘালয়। গাড়ির গান ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিশু ঘুমাচ্ছে বলে সবাই নিরবতা পালন করছে। মেঘালয় সিটে হেলান দিয়ে মিশুকে জাপটে ধরে ঘুমিয়ে গেলো।
গাড়ি ব্রেক কষতেই ঘুম ভাংলো মেঘালয়ের। একটা দোকানের সামনে এসে গাড়ি দাড় করিয়েছে। মেঘালয় কারণ জিজ্ঞেস করতেই সায়ান বললো, “দোস্ত চা খেয়ে আসি। খাবি?”
– “ইচ্ছে তো করছে। মিশু ঘুমাচ্ছে,ওর ঘুম ভাঙাবো না।”
– “আচ্ছা এনে দিচ্ছি।”
ওরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে গেলো। মেঘালয় বসে রইলো মিশুকে ধরে। মিশু একদম ওর বুকে মাথা রেখে গলা ধরে বাচ্চাদের মতন গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। দোকানের বারান্দায় লাইট জ্বলছে, লাইটের আলো এসে পড়েছে মিশুর মুখে। ঘুমন্ত মুখটা দারুণ আদুরে দেখাচ্ছে। কিছু চুল এসে পড়েছে মুখের উপর, আরো বেশি মায়াবতী লাগছে মেয়েটাকে। মেঘালয় অপলক ভাবে চেয়ে রইলো।
মিশু নড়েচড়ে উঠে চোখ মেললো। হাই তুলে বললো কোথায় আমরা?
– “বুঝতে পারছি না। দোকানে তো কোনো সাইনবোর্ড ও নেই। ওরা আসলে জিজ্ঞেস করে নিবো। তবে ঢাকা ছেড়েছি অনেক আগেই ”
– “ওরা কি বিড়ি খেতে গেছে?”
মেঘালয় হেসে বললো, “হুম। একটু আধটু খায় আরকি।”
– “তুমি খাওনা কেন?”
– “আমি আগে মাঝেমাঝে খেতাম। এখন আর ছোঁবো না।”
– “কেন ছোঁবে না?”
– “বারে, নিকোটিন নিলে আয়ু কমে যায়। আমিতো আর তাড়াতাড়ি মরতে চাইনা। আমি মরে গেলে এই পাগলী টাকে ভালোবাসবে কে?”
– “তাহলে আগে খেয়েছো কেন?”
– “আগে কি জানতাম আমার এমন একটা লক্ষী বউ জুটবে? জানলে তো কখনোই খেতাম না।”
– “অনেক আয়ু কমিয়ে ফেলছো। ধরে মাইর দেই?”
– “আচ্ছা দাও।”
– “নাহ, এরকম মিষ্টি ছেলেটাকে মারতে ইচ্ছে হয়?”
বলেই মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। মেঘালয় বললো, “আরো একটু ঘুমাও মিশমিশ।”
– “নাহ। এখন ঘুমালে অন্যায় হয়ে যাবে। আমি জার্নিতে কখনোই ঘুমাই না।”
– “সেজন্যই তো সেদিন ট্রেনে আমার বুকের উপর পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যি! ছি আমি কি নির্লজ্জ!”
– “অবশ্য ঘুমিয়েছো বলেই আরো পাগল হয়ে গেছি। তোমার ঘুমন্ত মুখে একটা মায়া আছে।”
পূর্ব এসে গাড়ির পাশে দাঁড়ালো। মেঘালয় জানালা খুলে দিলো। পূর্ব এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললো, “ভাবির ঘুম ভেঙেছে? ভাবি কি খাবেন আপনি?”
– “চুমু”
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো মিশু। ও মোটেও এটা বলতে চায়নি। এমনকি এটা চিন্তাও করেনি। তবুও কেন যে এটাই বেড়িয়ে এলো মুখ দিয়ে! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। পূর্ব হেসে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। তারপর দোকানের দিকে চলে গেলো। মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর সামনে এটা বলতে হলো?”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে বুঝিয়ে বললো। ওর একদম ই অজান্তে মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেছে কথাটা। লজ্জায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। মেঘালয় হাসছে মুখ টিপে। পাগলি একটা মেয়েকে নিয়ে কি যে করবে!
মিশু বললো, “একটু বাইরে নামতাম।”
– “এখানে নামা যাবেনা।”
– “কেন যাবেনা?”
– “শহরের বাইরে চলে এসেছি, একলা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই রিস্কি হয়ে যাবে। তার উপর আমরা চারজন ই ছেলে।”
– “তাহলে তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়তে বলো।”
মেঘালয় জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে ওদেরকে ডাকলো। সায়ান একটা পলিথিন ব্যাগ ভর্তি খাবার এনে দিলো মেঘালয়ের হাতে। মিশু চেয়ে দেখে সেটার ভেতর দুটো চিপস,কয়েকটা চকোলেট, দই,বিস্কুট, কেক আরো কি কি যেন। ও অবাক হয়ে বললো, “এগুলা কে খাবে?”
সায়ান বললো, “তোমার জন্য।”
– “আমি এত্তগুলা খাবো? আমি কি ছোট মানুষ? এগুলা তো ছোট মানুষ খায়।”
সায়ান হেসে ফেললো। ব্যাগটা দিয়ে গাড়ির ভেতর চেপে বসলো। এবার ও মেঘালয়ের পাশেই বসেছে। পূর্ব ও আরাফ এসে সামনে উঠে পড়লো। এবার গাড়ি ড্রাইফ করে পূর্ব। পাশের সিটে আরাফ বসেছে। মিশু ব্যাগটা নিয়ে ইতিমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ও মেঘালয়কে বললো, “তোমরা সবাই এত্ত ভালো কেন!”
মেঘালয় উত্তরে হাসলো। মিশু একটার পর একটা খেতে শুরু করেছে। মেঘালয় ও চিপস নিচ্ছে একটু পরপর। সায়ান মেঘালয়কে বললো, “দোস্ত গান ধরছিস না কেন?”
মিশুও সাথে যোগ দিয়ে সায়ানকে গান গাইতে বললো। মিশুর কথা শুনে মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো। সাথে ওর বন্ধুরাও যোগ দিলো,
“যার সনে যার ভালোবাসা..
যার সনে যার ভালোবাসা,
তারে ছাড়া প্রাণ বাঁচেনা…
পিরিতি এই জগতে জাতি কূলের ধার ধারেনা… পিরিতি..ই..ই
পিরিতি এই জগতে জাতি কূলের ধার ধারেনা… পিরিতি..ই..ই
এক জাইত্যা লতা আছে বাইতে বাইতে উঠে গাছে,
গাছ মরিলে লতা মরে, তবু লতায় গাছ ছাড়েনা…
পিরিতি এই জগতে জাতি কূলের ধার ধারেনা…”
গান শেষ করতেই মিশু হাত তালি দিয়ে বললো, “খুব সুন্দর করে গেয়েছো।”
মেঘালয় বললো, “তোমার জন্য ছিলো। আমি হচ্ছি সেই লতা,আর তুমি হচ্ছো গাছ। গাছ মরলে লতাও মরবে তবুও লতা গাছ ছাড়বে না।”
মিশু হেসে উঠলো- “গানটা সত্যি সুন্দর ছিলো! আরেকটা গান শুনাবা?
মেঘালয় আবারো গান ধরলো। একটার পর একটা গান চলতেই লাগলো। চারবন্ধু মিলে একসাথে গাইছে। মিশু জানালায় মাথা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে আর গান শুনছে। মেঘালয়ের হাতের মুঠোয় ওর হাত। মিশুর যে কি পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা হয়ত সম্ভব নয়। ও বারবার খুশিতে মেঘালয়কে জাপটে ধরছে। মেঘালয় ওর উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে হাসছে।
ভৈরবে এসে গাড়ি থামাল ওরা। রাত আড়াইটা বাজে। রেস্টুরেন্ট এ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে এসে একটা টেবিলে বসে গেলো নাস্তা করতে। মিশুর একটুও খিদে পায়নি। তবুও মেঘালয় জোর করে খাওয়ালো ওকে। খাওয়া শেষ করে আবারো গাড়ি স্টার্ট দিলো। এবার সায়ান ড্রাইভ করছে। আরাফ মেঘালয়ের পাশে এসে বসে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, পূর্ব সামনের সিটে বসেই ঘুম। সায়ান ড্রাইভ করছে গান ছেড়ে দিয়ে।
মিশু মেঘালয়কে বললো, “আমি একটা কথা বলি তুমি কি রাগ করবা?”
– “না, বলো।”
মিশু বললো, “তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। একটু ঘুম দরকার না বলো? আমি বরং সামনের সিটে গিয়ে সায়ান ভাইয়ার সাথে বসে গল্প করি আর রাস্তা দেখতে দেখতে যাই? আমার বাইরেটা দেখতে খুব ভালো লাগে। এখানে বসে তো ভালোমতো দেখাই যায়না। আর আমি কথা বলতে থাকলে সায়ান ভাইয়ার ও ঘুম আসবে না। সবাই ঘুমাচ্ছো, সে একা একা গাড়ি চালাচ্ছে।”
মেঘালয় বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে, সামনে গিয়ে বসো।”
পূর্ব পিছনে এসে মিশুর সিটে বসলো। আর মিশু ড্রাইভারের পাশে অর্থাৎ সায়ানের পাশে বসে ননস্টপ রেডিওর মত কথা বলতে শুরু করলো। মেঘালয় হাসছে ওর কথা শুনে। এভাবে বকবক করলে সায়ানের কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। বেচারার ভূলেও ঘুম আসবে না। সায়ান শুধু মাথা ঝাঁকাচ্ছে আর গল্পের সাথে তাল মিলাচ্ছে। মেঘালয় সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। বাকিরা ঘুমিয়ে পড়তেই মিশু সায়ানের সাথে বকবকানি চালিয়ে যেতে লাগলো।
হোটেলে এসে পৌছল সকাল ছয়টার একটু আগেই। মিশু বাইরে নেমে দাঁড়ালো। বাকিদের ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। মেঘালয় নেমে এসে মিশুকে জিজ্ঞেস করলো, “জার্নি কেমন লাগলো?”
– “খুব ভালো। সামনের সিটে বসতে দারুণ মজা তো। সবকিছু সুন্দর দেখা যায়! আমিতো আর একটুও ঘুমাই নি। তোমার ঘুম হলো?”
মেঘালয় মিশুর কানেকানে বললো, “স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। ‘মিশু রাজ্যের রাজকন্যা’ স্বপ্নে এসে প্রেম বুনছিলো।”
– “ওহ আচ্ছা।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে লাগলো। ওরা হোটেলের ভেতরে ঢুকে লিফটের কাছে চলে এলো। লিফটে পূর্বরা তিনজন সহ আরো কয়েকজন উঠলো। মেঘালয় মিশুকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। পরেরবার মিশুকে নিয়ে লিফটে উঠলো মেঘালয়। এবার শুধু ওরাই দুজন ভেতরে। মেঘালয় একটানে মিশুকে বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে এক হাতে ওর মাথাটা চেপে ধরে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। মিশুর পেটে হাত রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিতে দিতে ওকে উপরে তুলে গভীর আবেশে চুমু খেতে লাগলো।
লিফট থেকে বের হয়ে রিসিপশনিস্টের কাছে এসে মিশু লজ্জায় চোখ মেলতেই পারছিলো না। রুমের চাবি নিয়েই ওরা একসাথে রুমে চলে এলো। দুটো রুম পাশাপাশি। সায়ান, পূর্ব ও আরাফ একরুমে ঢুকে গেলো। মেঘালয় বলে দিলো “আট টায় দরজায় নক করবি।”
রুমে ঢুকে দরজা লক করেই মিশুকে কোলে তুলে এনে বিছানায় ফেলে দিলো মেঘালয়। মিশু লজ্জায় নীল বর্ণ ধারণ করলো। ও দুহাতে মুখ ঢেকে আঙুলের ফাঁক দিয়ে মেঘালয়কে দেখতে লাগলো। মেঘালয় লাগেজ খুলে জামাকাপড় বের করে নিয়ে বললো, “ওঠো, এখন কোনো আদর নয়। গোসল করে রেডি হয়ে নিবে আসো।”
মিশু লজ্জা পেয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলো, সেই মুহুর্তে মেঘালয় আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। একে অপরের মাঝে মিশে যেতে লাগলো। নরম তুলোর বিছানায় তলিয়ে গেলো দুজনে।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৪

0

অনুভূতি
পর্ব ২৪
মিশু মনি
.
৩৭.
মেঘালয় গুনগুন করে গান গাইছে। ওর কণ্ঠে কিছু একটা মিশে আছে, শুনলেই ভেতরটা কেঁপে যায়। গান শুনে মিশুর আরো কষ্ট হচ্ছে। মিশুকে আনমনা হয়ে ভাবতে দেখে মেঘালয় গান থামিয়ে এসে ওর পাশে বসলো। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ ছলছল করছে।
মেঘালয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে মিশু?”
মিশু ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো, “কিছু হয়নি তো।”
-“তোমাকে আপসেট দেখাচ্ছে কেন?”
– “আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও মেঘ।”
– “কেন? কিছু হয়েছে তোমার?”
– “আমি একা থাকতে চাইছি। যাও এখান থেকে।”
মেঘালয় বেশ অবাক হয়ে গেলো। মিশুকে কখনো এমন দেখায় নি। আর এইরকম কথাও কখনো ও বলেনা। ওর রীতিমত চিন্তা শুরু হয়ে গেলো মিশুর জন্য। খুব খারাপ লাগল তবুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। মিশুর খুব কান্না পাচ্ছে হঠাৎ। কেন এরকম লাগছে ও নিজেও জানেনা। মেঘালয়ের প্রতি কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে ওর। এই সন্দেহ টুকু ও করতে চায়না। ভেতরে কেমন যেন আজেবাজে চিন্তা আসছে, নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। মেঘালয়ের ব্যাপারে এতকিছু জানার পর আগে ওর প্রতি যেমন মনোভাব ছিলো,এখন আর সেরকম নেই। এখন রহস্যজনক লাগছে ছেলেটাকে। এটাই সবচেয়ে বাজে ব্যাপার। একবার মনে সন্দেহ ঢুকে গেলে মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতেই থাকে।
মেঘালয় করিডোরে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে আছে। ওর চোখে পানি এসে গেছে। বুকটা চিনচিন করছে। মিশু একটু দূরে সরিয়ে দিলেই ওর খুব কষ্ট হতে থাকে, কেন এমন হয় নিজেও জানেনা। মিশুর সামান্য কষ্টটুকুও ওর উপর বিশাল চিন্তার প্রভাব ফেলে। গতরাতে ওকে থাপ্পড় দেয়ার পর মেঘালয়ের ইচ্ছে করছিলো নিজের হাতটাই কেটে ফেলে, কেন মিশুকে এভাবে আঘাত করে ফেললো সে! এখনো খুব কষ্ট হচ্ছে মিশুর কষ্ট দেখে। মেয়েটা কি এখনও ওকে আপন ভাবতে পারেনি?
মিশুর ভেতর থেকে ঠেলে কান্না আসছে। আর চেপে রাখতে পারছে না। মেঘালয়কে ছাড়া ওর চলবেই না, অযথা ওকে অবিশ্বাস করে নিজেকে পোড়ানোর কোনো মানে হয়? এক ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো ও। এসে দেখলো মেঘালয় করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। মিশু ছুটে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। চোখাচোখি হতেই দুজনের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কারো আর মুখ ফুটে কিছু বলতে হলোনা। দু ফোটা অশ্রুই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। মিশু মেঘালয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মেঘালয় ও ওকে বাহুর বন্ধনে শক্ত করে ধরে রইলো।
মিশু বলল,”তোমার ব্যাপারে এমন কোনো জিনিস যেন না থাকে যেটা আমি জানিনা। আমাকে সবকিছু জানাবা, কিচ্ছু লুকোবে না। নতুন কিছু জানতে পারলে আমার মনে চিন্তা আসে।”
– “আর তুমিও আমার উপর যত রাগই আসুক,কক্ষনো আমাকে এক মুহুর্তের জন্যও দূরে চলে যেতে বলবা না। সবসময় আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তুমি কষ্ট পেলে আমার ও কষ্ট হয় মিশু।”
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। মেঘালয় বেশ বুঝতে পারছে মিশুর প্রতি ওর দূর্বলতা কতখানি বেড়ে গেছে। ছেলেটা খুব শক্ত,কখনো ওর চোখে জল আসেনা। আজ এসে গেলো সামান্য একটু কারণে। কখনো মিশু দূরে ঠেলে দিলে মেঘালয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো সবাই মিলে। মেঘালয় মিশুকে রুমে নিয়ে দুজনে খুনসুটি চললো অনেক্ষণ ভর। সন্ধ্যায় ওই কান্নাকাটির পর্বটার পর থেকে দুজনে খুব সহজ হয়ে গেছে। এমন একটা বিশ্বাস জন্মেছে একে অপরের প্রতি যে,কেউ কক্ষনো কাউকে ঠকাবে না। খুবই আপন মনেহচ্ছে দুজনার দুজনাকে।
নতুন কিনে নিয়ে আসা একটা ড্রেস পড়ে সাজুগুজু করে নিলো মিশু। মেঘালয় চেক শার্টের সাথে জিন্স পড়লো। রাত এগারো টার দিকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা।
গাড়িতে উঠে গান ছেড়ে দিলো। মিশু বসেছে জানালার পাশেই। বেশ প্রশস্ত সিট। মেঘালয় মিশুর পাশেই বসেছে। পুরো সিটটাই ফাঁকা। তবুও ওদের পাশে কেউ বসেনি। আরাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে, পূর্ব ও সায়ান ওর পাশেই চাপাচাপি করে বসেছে। মেঘালয় অনেকবার করে বলেছে ওর পাশে বসার জন্য,কিন্তু কিছুতেই ওরা রাজি হয়নি। পিছনের সিট পুরোটাই নবদম্পতিকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কষ্ট করেই সামনের আসনে গিয়ে বসেছে। মিশু শুধু মুখ টিপে হাসছে ওদের কার্যকলাপ দেখে।
পূর্ব ও সায়ান খুবই দুষ্টু। নানান রকম ফাজলামি আর দুষ্টুমিতে মেতে থাকে সবসময়। গাড়িতে বসার পর থেকেই ইয়ার্কি করে যাচ্ছে। মেঘালয় ও মাঝেমাঝে ওদের সাথে যোগ দিচ্ছে। আর এদিকে একটু পরপর আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে মিশুর কোমল শরীর টা। মেঘালয়ের উষ্ণ হাতের স্পর্শে বারবার শিহরিত হয়ে উঠছে মিশু। জার্নির সাথে নতুন এক সুখ যুক্ত হয়েছে। গাড়ির ভেতরে এসি আছে তবুও মিশুর জন্য জানালা খোলা রাখতে হলো। ও খোলা জানালায় মাথা রেখে বাইরে চেয়ে থাকে অপলক ভাবে, চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে। খুবই এনজয় করে ও ব্যাপার টা। আর মেঘালয় ওর মুগ্ধ চোখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে।
মিশুর চুল উড়ে এসে মেঘালয়ের মুখে পড়তেই মেঘালয় ওর কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “সারাজীবন যেন তোমার চুলের গন্ধ ঠিক এমন ই থাকে। চুলের গন্ধে ঘুম এসে যায় আমার।”
– “হুম। এবার তো বলো আমার চুলের গল্পটা? সেই কবে থেকে ওয়েট করে আছি। চুলের গল্পটা শুনবো বলে। এখনো কি বলা যাবেনা?”
মেঘালয় মিশুর মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে বললো, “আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হলো, তারপর থেকেই প্রতি রাতে আমি স্বপ্নে দেখতাম একটা মেয়ে এলো চুল ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের তীর ঘেষে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটির মুখ কখনো দেখতে পেতাম না। কিন্তু চুল, হাঁটার স্টাইল সবই কেমন পরিচিত লাগতো। একদম সমুদ্রের কাছ দিয়ে হাঁটতো মেয়েটা। যখন বিশাল ঢেউ এসে মেয়েটির উপর দিয়ে তীরে আছড়ে পড়তো, আমি ভয় পেতাম। এই বুঝি সমুদ্র তার ভেতরে টেনে নিয়েছে মেয়েটিকে। কিন্তু না, ঢেউ নেমে যেতেই দেখতাম মেয়েটি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। তার কিছুই হয়নি।”
মিশু অবাক হয়ে শুনছিলো। বললো, “তারপর? তারপর কি হলো?”
মেঘালয় বললো, “আমি ঘুমালেই এটা দেখতাম আর অবচেতন মনে সারাক্ষণ এটা ঘুরপাক খেতেই থাকতো। আমার খুব অসহ্য লাগতো। ফ্রেন্ড সার্কেল আর পরিচিত যত মেয়ে আছে, সবার চুল আমি দেখেছি। কারোর ই চুল ওরকম নয়। মিশু সেদিন স্টেশনে যখন তুমি ওভারব্রিজের নিচে বসেছিলে,তখন তোমার মাথায় ওড়না দেয়া ছিলো। কিন্তু তুমি যখন হেঁটে হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠলে, তখন ওড়না মাথায় ছিলোনা। আমার স্বপ্নের মেয়েটার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছিল তোমার চুল আর হাঁটার ভঙ্গিটা। আমি কেমন যেন ফিল করছিলাম তোমার প্রতি, কিচ্ছু ভাবতে পারিনি। সেজন্যই ছুটে এসে ট্রেনে উঠেছিলাম।”
মিশুর চোখেমুখে মুগ্ধতা আর বিস্ময়! রূপকথার গল্পের মত লাগছে। ও মুচকি হেসে বললো, “আমি এটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম। তুমি কেন ওভাবে ট্রেনে গিয়ে উঠলে? আমার এরকম অনেক অভ্যেস আছে। হুটহাট করে এখানে সেখানে চলে যাওয়াটা আমার স্বভাব। কিন্তু তুমি কেন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করবা? এসব ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করে ফেলেছিলাম।”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “প্রথম দিন তোমার ভেজা চুল দেখেছিলাম, বৃষ্টিস্নাত চেহারা। আমার মনেহয় বিধাতা উপর থেকেই আমাদের জুটিটা ঠিক করে দিয়েছেন। এজন্যই আমার অবচেতন মন সারাক্ষণ তোমাকে নিয়েই ভাবতো। আর মানুষের অবচেতন মন সারাক্ষণ যা কল্পনা করে, মানুষ সেটাই স্বপ্নে দেখে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যি!”
মেঘালয় জবাব দিলো, “হুম। আমি পাগলের মত সবার চুল খুঁজে বেড়িয়েছি যে কার চুলগুলো দেখতে অমন হবে। আমাকে সারাক্ষণ ভাবাতো স্বপ্নটা। আমি সত্যিই ভাবতে পারিনা তুমি কিভাবে হুট করেই আমার জীবনে এসে সবকিছু দখল করে নিলে।”
মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “এত সুখ কি কপালে সইবে গো আমার?”
পূর্ব উত্তর দিলো, “ভাবি না সইলে আমাদের একটু ভাগ দিয়েন। আমরা সুখ খুঁজে খুঁজে মরি কিন্তু পাইনা।”
ওরা তিনজন হেসে ফেললো। মিশুর লজ্জা লাগলো খুব। ও লজ্জায় মুখ লুকালো মেঘালয়ের বুকে। জোড়ে জোরেই বললো, “আমার সমস্ত টুকু দিয়ে আমি শুধু মেঘালয়কেই সুখী করতে চাই। আমার জীবন চলে যাক।”
সায়ান বললো, “মেঘ ভাগ্য করে বউ পেয়েছিস দোস্ত। ভাবছি আমিও একটা কচি মেয়েকে টুপ করেই বিয়ে করে ফেলবো। কিন্তু ভয় লাগে, এখনকার যা মেয়েরে ভাই। আমাকে ইচ্ছেমত নাচাবে, বাপের দেয়া প্রাণটা অকালেই ঝড়ে যাবে।”
মেঘালয় হেসে বললো, “মনের মত একজন সঙ্গিনী পেলে লাইফটা যে কি পরিমাণ সুখের লাগে দোস্ত! উফফ বোঝাতে পারবো না।”
– “আমরা বুঝতেও চাইনা। এমনিতে তোর প্রেম দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি। আর কিছু বলিস না ভাই।”
– “আহা শোননা। আজকে তো একসাথে সুইমিংপুলে নেমেছিলাম। মিশুর পা দুটো আমার কাঁধের উপর তুলে নিয়ে…”
সায়ান চেঁচিয়ে উঠলো, “ভাই প্লিজ থাম। আমার দহন বাড়াস না। এসব শুনলে আমার প্রেম প্রেম পায়।”
মেঘালয় ও মিশু হেসে উঠলো। মেঘালয় ওকে জ্বালানোর জন্য বললো, “রাতটা যা ছিলো না দোস্ত, উফফ আমার আফসোস হচ্ছে আগে ক্যান বিয়ে করিনি।”
সায়ান তেলেবেগুনে জ্বলে গেলো। পিছন ফিরে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভাবি আছে বলে মুখ খারাপ করতে চাচ্ছিনা। ভদ্র ছেলেটাকে অভদ্র বানাস না বলে দিলাম।”
– “আহা! তুই না রুমে সিসি ক্যামেরা লাগাবি বলছিলি। শোন না।”
সায়ান আরো ক্ষেপে গেলো, “এসব বলবি না। আমার প্রেম প্রেম পায়। শুধু প্রেম প্রেম না, আমার বিয়ে বিয়ে পায়।”
– “হা হা হা, বিয়ে করে ফেল। হুট করে বিয়ে করার মজাই আলাদা।”
– “সবাই তো আর মিশু না যে দুম করেই একটা কাজ করে ফেলবে। আমার গার্ল ফ্রেন্ডকে বললে বলে, “বাপের টাকায় গার্ল ফ্রেন্ড চালাও, সপ্তাহে একদিন শপিং করাই দিতে পারো না। আমার হাত খরচের টাকা বাসা থেকে নিতে হয়, আবার বলে কিনা বিয়া করবো। থাপ্পড় চেনো?”
গাড়ি সুদ্ধ সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো। পূর্ব বললো, “তার হাত খরচের টাকা বাসা থেকে নেবে না তো কি তোর কাছ থেকে নেবে? তুই বল, হাত খরচের টাকা দিলে বউকেই দিবো। আগে বিয়ে করো, তারপর দিচ্ছি।”
সায়ান মুখ কাচুমাচু করে বললো, “বলছিলাম রে। আমাকে বলে , তারমানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনা। তুমি ভেবেছো সবকিছু নিয়ে আমি ভেগে যাবো? সেজন্যই ভয়ে বিয়ে করতে চাও?”
সবাই আবারো হেসে উঠলো। পূর্ব জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি বললি?”
– “আমি বলেছিলাম হ্যা এই ভয়টাই পাই। সেজন্যই বিয়ে করবো। তারপর লেগে গেলো তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়া মেটাতে ওকে একটা শাওমি সেট গিফট করতে হইছে।”
পূর্ব সায়ানের কাঁধের উপর একটা মাইর দিলো। বাকিরা সবাই অট্টহাসি শুরু করে দিলো। আরাফ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিলো। ও এবারে মুখ খুললো, “দোস্ত, তোদের রিলেশন মাত্র আড়াই মাসের। এরমধ্যে কি কি দিছিস?”
সায়ান উত্তর দিলো, “আমি ওরে আইফোন দিছি, ওর রাউটার বিল,ওয়াইফাই বিল, মোবাইল রিচার্জ, চারবার শপিং করাই দিছি, দুইটা শাড়ি, বান্ধবীর বিয়ের গিফট, গত সপ্তাহে একটা শাওমি, আমার ক্যামেরাটা নিয়ে সে ট্যুরে গেছিলো এখনো ফেরত দেয় নাই, দিবে কিনা আমি তাও শিওর না। আর ট্যুরে গেছিলো ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে, সেই টাকাটাও আমি দিছি। ওরে এতবার বলছি আমার সাথে ট্যুরে যাওয়ার জন্য,সে যাবেনা। নিজের বেলায় ষোলআনা আদায় করে,আর আমার বেলায় দুই আনা। একটা চুমু অব্দি দিতে দেয়না, তিনঘন্টা গাল ফুলিয়ে বসে থাকার পর একটা চুমু নিতে হয়।”
সবাই এত জোরে হেসে উঠলো যে আরাফ গাড়ি চালাতেই পারলো না। ও গাড়িতে ব্রেক কষলো। সায়ানের এই খবর গুলো ওরা জানতো না। ওরা শুধু জানতো সায়ান মেয়েটাকে আইফোন গিফট করেছে। কিন্তু তার এত চাহিদার কথাগুলো ওরা নতুন শুনছে।
ও জিজ্ঞেস করলো, “তোর DSLR ওর কাছে?”
– “হুম। ট্যুরে যাওয়ার সময় নিয়ে গেছিলো।”
– “ওর বাসা কোথায় যেন?”
– “কেন?”
– “গাড়ি ঘুরাচ্ছি, ওর বাসার সামনে ওরে বল ক্যামেরা নিয়ে দাড়াই থাকতে। বলবি সিলেট ট্যুরে যাচ্ছি, ক্যামেরা লাগবে।”
– “আমি পারবো না।”
– “টাকা কি বানের জলে ভেসে আসছে? বাপের কাছে কান্নাকাটি করে ক্যামেরা কিনে নিয়ে গ্রিডি ফার্মারের কাছে ফেলে রাখছে। আমি গাড়ি ঘুরাচ্ছি, এড্রেস বল।”
– “অনেক রাত হইছে, এখন ওরে ডিস্টার্ব করবো না থাক।”
– “তুই যদি ক্যামেরা না নিস, তোরে গাড়ি থেকে লাত্থি দিয়া ফালাই দিবো।”
মিশু মেঘালয়ের কাঁধে হাত রেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওদের বন্ধুদের কাণ্ডকারখানা দেখে মজা লাগছে ওর। আরাফের রাগ দেখে বাধ্য হয়ে সায়ান ওর প্রেমিকার বাসার ঠিকানা বলে দিলো। গাড়ি ঘুরাতে হলোনা। যেই রোড ধরে যাচ্ছে সে রোডের সামনেই ওর বাসা। বন্ধুদের চাপে পড়ে সায়ান মেয়েটাকে কল দিয়ে বাসার সামনে থাকতে বললো। বোধহয় ফোনে অনেক কথা কাটাকাটি ও হলো। সায়ান বলল, ক্যামেরা না নিলে গাড়ি থেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দিবে। সেটা শুনে বোধহয় মেয়েটি ক্ষেপে গেছে। বাসার গেটে এসে দুবার হর্ন দিতেই সে ক্যামেরা হাতে বের হলো।
মেয়েটি ক্ষেপে আছে সায়ানের উপর। গাড়ির জানালা দিয়ে মিশু মাথা বাড়িয়ে হেসে বললো, “আপু আসুন সিলেট যাই।”
মেয়েটি আরো রেগে গেলো। নিশ্চয়ই মনেমনে ভাবছে মেয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আর রেগে যাচ্ছে। সায়ান ভয়ে ভয়ে বলল, “ওর নাম মিশু, মেঘালয়ের বউ।”
মেয়েটি রাগত অবস্থাতেও হাসার চেষ্টা করলো। আরাফ বললো, “সরি আপু। এত রাতে বাসার নিচে নামানোর জন্য দুঃখিত।”
– “ইটস ওকে, ভেতরে এসে বসুন আপনারা।”
– “থ্যাংকস আপু, আপনি চলুন আমাদের সাথে সিলেট থেকে ঘুরে আসি।”
– “বাসায় ম্যানেজ করতে পারবো না। আপনারা যান।”
বলেই সে ভেতরে চলে গেলো। সায়ানের দিকে একবার তাকালো ও না। আরাফ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বললো, “ছোটলোকের মত কাজ করলাম তাইনা পূর্ব?”
– “হুম, মাঝেমাঝে ইচ্ছেকৃত ছোটলোকি করতে হয়। এত রাতে ওকে নিচে নামানোর জন্য মেয়েটি বিরক্ত। এটাই ওদের শেষ দেখা আর কালকে নিশ্চিত ব্রেকাপ।”
সায়ান বললো, “এটা কি ঠিক করলি তোরা?”
আরাফ গলা চড়িয়ে বললো, “যার এত চাহিদা মেটানোর পরও সেই মেয়ে বলে বাসা থেকে হাত খরচের টাকা কেন নিতে হয়? আর বিয়ে করতে চাইলে করবে না। বিয়ে করে হাজব্যান্ডের কাছে হাতখরচ নিক তাতে আপত্তি নেই। সে নির্লজ্জের মত বয় ফ্রেন্ডের কাছে টাকা নিবে আবার বিয়ে করতে চাইলে থাপ্পড় লাগাবে সেরকম গার্ল ফ্রেন্ড পোষার কোনো দরকার নাই। প্রেম করবি ভালো কথা, এত চাহিদা কেন?”
– “তুই চাইছিস আমি ওর সাথে ব্রেকাপ করি?”
-“হ্যা। এরপর কি হয় দেখ। আমরা বাপের টাকা চলি ভালো কথা। বাসায় মিথ্যে বলে টাকা নিয়ে তাদের চাহিদা মেটাই আর তারা এভাবে বলবে কোন সাহসে? আমার গালে থাপ্পড় লাগাতে চাইলে উলটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম।”
আরাফের রাগ দেখে সায়ান আর কথা বাড়ালো না। আরাফ খুব রাগী। রেগে গেলে চড় থাপ্পড় কিল ঘুষিও বসাতে পারে। তারচেয়ে সে নিশ্চিতে গাড়ি চালাক, সেই ভালো।
মিশু বললো, “সায়ান ভাইয়া, মন খারাপ করবেন না। সবকিছুর একটা সীমা থাকা দরকার, একটা রিলেশনশিপে যাওয়া মানে এই নয় যে সমস্ত কিছু ছেলেকেই বহন করতে হবে। আমি মেঘালয়ের স্ত্রী হওয়ার পরও ওর কাছে আজকে শপিং করিয়ে নিতে আমার খারাপ লাগছে। আমি কোনোকিছুর জন্য কখনো কারো উপর ডিপেন্টেড ছিলাম না। ছোট ছোট গিফট দিলে সম্পর্ক ভালো থাকে, তাই বলে আড়াই মাসে এতকিছু! একটু বেশি হয়ে গেছে।”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আমি তো তোমার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছি মিশু। অন্তত আমার কাছে সংকোচ করোনা। আমি তোমার স্বামী।”
– “স্বামী বলেই সমস্ত দায় ভার তোমার? আমি মানতে পারবো না। আমি নিজেও রোজগার করবো যতটুকু পারি। বসে বসে খাওয়া অভ্যেস আমার নেই। যতদিন আমার দেহে কাজ করার সামর্থ্য আছে, আমি করবো। বাঁধা দিতে পারবা না।”
মেঘালয় মিশুর চুলের উপর একটা চুমু দিয়ে বললো, “এজন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। তুমি তথাকথিত মেয়েদের থেকে আলাদা। আমার পাগলী টা।”
মিশু মেঘালয়ের খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে নিজের গাল ঘষতে লাগলো। ছেলেটাকে ছাড়া কিছুতেই ও বাঁচতে পারবে না। বিধাতা যেন কখনো কোনো অজুহাতে ওদের আলাদা না করেন।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২৩

0

অনুভূতি
পর্ব ২৩
মিশু মনি
.
৩৬.
মেঘালয় বলল, “ইনি হচ্ছেন আকাশ আহমেদ, আমার একমাত্র বাবা, আর ইনি হচ্ছে মিসেস আহমেদ,আমার গর্ভধারিণী মা।”
বলেই বাবা মায়ের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো, “আর আমি হচ্ছি তাদের একমাত্র ছেলে,মেঘালয় আহমেদ।”
মিশু মেঘালয়ের বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মেঘালয়ের মা অবাক হয়ে একবার মিশুর দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার তাকাচ্ছেন ওনার স্বামীর দিকে। মেঘ কি বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না। উনি মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই বিয়ে করে ফেলেছিস? সত্যি বিয়ে করেছিস? আমাদের না জানিয়ে?”
মেঘালয় হেসে জবাব দিলো, “আম্মু, তোমার জন্য এই পুতুলটাকে পছন্দ করে এনেছি। দেখো তো ভালো লাগে কিনা? তোমার ভালো লাগলে তবেই না বিয়ে পর্যন্ত আগাবো তাইনা? কি করে ভাবলে তোমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলবো?”
আম্মু মেঘালয়ের কান টেনে ধরে বললেন, “পাজি ছেলেটা। এভাবে বললে ভয় লাগে না? এই মেয়েটাকে দেখার জন্যই রোজ রোজ সুপার শপে যাওয়া হতো তাইনা?”
– “উম আম্মু। কানটা ছাড়ো, লাগছে তো।”
– “লাগুক, সুপার শপে এত সুন্দর পুতুল পাওয়া যায় আমার তো জানা ছিলোনা।”
মিশু হাসলো। মেঘালয় কত সুন্দর সবকিছু সামাল দিলো। এখন যদি মিশুকে ওনাদের পছন্দ হয় তাহলে তো বিয়ের ব্যবস্থা ওনারাই করবেন। মিশু তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যদি বিয়ের কথাটা সরাসরি বলতো তাহলে মা অনেক কষ্ট পাবেন সেটা ওনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তখন ওনাদের আচরণ এরকম নাও হতে পারতো।
ওর বাবা মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। মিশুকে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কি তোমার মা?”
– “মিশু মনি।”
-“দেখতেও খুকি খুকি,নামটাও খুকি খুকি।”
মেঘালয় বললো, “আব্বু ওর স্বভাব,আচরণ সবই বাচ্চা স্বভাবের। ছেলেমানুষি ভাবটা এখনো যায়নি।”
মিশু লজ্জা পেলো খুব। মেঘালয় মাকে জাপটে ধরে বললো, “আমি কি তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করতে পারি বলো? আমিতো জানি, আমি বিয়ে করতে চাইলে তুমি নিজেই বিয়ে পড়িয়ে দিবে।”
মা ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “হুম আমার লক্ষী ছেলেটা। বউ তো পছন্দ হয়েছে,এবার তবে বিয়ের আয়োজন করি?”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “সেকি! এত তাড়াতাড়ি কেন?”
– “তোকে পর্বত থেকে দূরে রাখার এই একটাই উপায়।”
মেঘালয় মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, “সেজন্য এই বাচ্চা ছেলেটাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইছো? বিয়ে হলেই তো আমি পর হয়ে যাবো। তখন মিশু আমাকে তোমার কাছে ঘেষতেই দেবেনা।”
মিশু ক্ষেপে বললো, “আমি দিবো না? এখন কি দিচ্ছি না? আমার উপর একদম দোষ চাপাবেন না বলে দিচ্ছি।”
মিশু গিয়ে মেঘালয়ের মায়ের পাশে বসলো।বললো, “আপনার ছেলেটা আমাকে মিছেমিছি দোষ দিচ্ছে। আমাকে দেখে কি আপনার ডাইনি মনেহয়? রাক্ষসী রানী কটকটির মত আমার চেহারা?”
মা মিশুর এমন সরলতা দেখে মুগ্ধ হলেন। উনি মিশুর গাল টেনে দিয়ে বললেন, “গালদুটো কি গোলাপি! বাচ্চাদের মতন। এই পুতুলটাকে পেলি কই মেঘ?”
বলেই উনি মিশুকে আদর করে দিলেন। মিশুও ওনার আদর পেয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ভাগ্যিস মেঘালয় বাসায় বিয়ের কথাটা জানায় নি। জানালে হয়ত এখন যেমন মিশুকে আদর করে বুকে টেনে নিয়েছেন, তখন সেটা করতেন না। বরং খুব আঘাত পেয়ে দূরে সরিয়েও দিতে পারতেন। মেঘালয়ের বুদ্ধি আছে বলতে হবে। কিভাবে সবকিছু সামলে নিলো!
মেঘালয় উঠে গিয়ে ওর বাবার পাশে বসলো। বাবা ওর কানে কানে বললেন , “রাতে কি এখানেই ছিলি নাকি?”
মেঘালয় ফিসফিস করে জবাব দিলো, “না, সায়ানের বাসায় ছিলাম। বলেছি তো।”
বাবা আবারো ফিসফিস করে বললেন , “আমাদেরকে হুট করেই এখানে আসতে বললি তাই ভাবলাম, হয়ত ওকে নিয়ে এখানেই থাকিস। তা, বিয়ে টিয়ে করে ফেলিস নি তো?”
– “ধুর আব্বু, কি যে বলোনা।”
– “বিয়ে ছাড়াই একসাথে থাকিস? কিভাবে সম্ভব?”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “মানে! একসাথে থাকবো কেন?”
বাবা ফিসফিস করে বললেন, “গলায় দাগ দেখতে পাচ্ছি। মাফলার সরে গিয়ে কামড়ের দাগ উঁকি দিচ্ছে।”
মেঘালয় কাশি দিয়ে উঠলো। গলার মাফলারটা ঠিক করে কাশতেই লাগলো। বাবার হাতে ধরা খেয়ে গেলো একদম। কি লজ্জার ব্যাপার! লজ্জায় মাথা তুলতে পারলো না ও। বাবার কানেকানে বললো, “একটু আধটু তো এমন হয়ই আব্বু। বোঝো না?”
– “হা হা হা, সবই বুঝি। ঠোঁট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
মেঘালয়ের ইচ্ছে করলো লজ্জায় এক ছুটে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পালিয়ে যায়। বাবার সাথে সবসময়ই ও খুব ফ্রি। তাই বলে এভাবে লজ্জায় পড়তে হবে ভাবেনি কখনো। বাবা বললেন , “লিভ টুগেদারের চিন্তা ভাবনা ভূলেও করিস না। বিয়ের ইচ্ছে হলে বলিস। মেয়ে পছন্দ হয়েছে খুব, আমাদের এনাফ সেবা যত্ন করতে পারবে। অনেক ভালো একটা মেয়ে।”
মেঘালয় বাবার কানেকানে বললো, “তোমাদের সেবা যত্ন করতে পারলেই হলো? আমার পারবে কিনা সেটাও দেখতে হবে তো।”
বাবা মেঘালয়ের মাথায় একটা চাটি মেরে বললেন, “আপনার চেহারায় যে পরিমাণ আলো ঝিকমিক করছে, তাতে আমাদের কিছু বুঝতে বাকি নেই।”
– “আব্বু, প্লিজ আর লজ্জা দিওনা। আমার পছন্দ কেমন সেটা বলো?”
– “তোর পছন্দের উপর আমার ষোলআনা নির্ভরতা আছে। যেটা খাটি তুই সেটাই নিবি আমি জানি। তবে ভেবেছিলাম মেকাপ আর লিপস্টিক মাখা কোনো হাই লেভেলের মডার্ন মেয়েকে দেখবো,কিন্তু এ তো দেখছি একেবারে ন্যাচারাল বাঙালী মেয়ে।”
– “আমার পছন্দ বাবা।”
এতক্ষণ দুই বাবা ছেলে ফিসফিস করে কথা বলছিলো। মিশু আর ওর মায়ের মধ্যে ইতিমধ্যে ভাব জমে গেছে। মেঘালয় সেদিকে তাকিয়ে ওর বাবাকে বললো, “আব্বু মিশুর একটা থাকার জায়গা লাগবে। এ শহরে ওর থাকার কোনো জায়গা নেই। এখন দায়িত্ব তোমার কাছে ট্রান্সফার করলাম, তুমি কি করবা করো।”
– “তোর প্রেমিকা কোথায় থাকবে সেই চিন্তা আমার কেন? সিস্টেমে বিয়ের কথা বলছিস সেটা বুঝতেই পারছি।”
বলেই বাবা হেসে উঠলেন। মেঘালয় ও হাসতে হাসতে বললো, “আব্বু, খুব মজা নিচ্ছো? সিরিয়াসলি শোনো,আমরা তো কেউ এ বাড়িতে থাকিনা। আমাদের এখানে আসতে আরো মাস ছয়েক দেরি হবে। এতদিন ও এখানেই থাকুক না।”
বাবা একটু কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “থাকতে পারে। কিন্তু একা একা এখানে কিভাবে থাকবে? ওর ফ্যামিলি কোথায়?”
– “কেউ নেই ওর। এখন আমি আর তোমরাই ওর সব।”
– “ওহ আচ্ছা, তাহলে এখানেই থাকুক। একটা কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দিস। সে দেখাশোনা করবে।”
মেঘালয় বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “উফফ আব্বু, ভালোবাসি তোমাকে। আম্মুকে বুঝিয়ে বলো ব্যাপার টা।”
– “সে না হয় বলবো। এখন লাঞ্চ করবো কি বাইরে? নাকি খাবার নিয়ে আসবি?”
– “বাইরে লাঞ্চ করবো। লাঞ্চ করে আমরা একটু বের হবো। আর আজকে রাতে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে সিলেট যাচ্ছি। কয়েকটা দিন থেকে আসবো, তুমি একটু সবকিছু সামলে নিও আব্বু প্লিজ।”
বাবা আবারো মেঘালয়ের কানের কাছে এসে বললেন , “বন্ধু বান্ধব মিলে যাচ্ছো? নাকি হানিমুনে যাচ্ছো?”
মেঘালয় ক্ষেপে গিয়ে বললো, “খুব মজা নিচ্ছো। দেখো, নিরীহ পেয়ে আমার সাথে এভাবে মজা নিবা না।”
– “নিরীহ? হা হা হা।”
বাবা হাসতে লাগলেন। মেঘালয় ও হাসছে মুখ টিপে। এদিকে মিশু আর মা কিসব ব্যাপার নিয়ে যেন আলাপ করছে। হয়ত মিশুর ফ্যামিলি আর পড়াশোনা এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন। মেঘালয় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। বাবা মায়ের উপর ওর ভরসা ছিলো যে তারা ওর পছন্দকে গুরুত্ব দিবেন। আর নিজের উপর এতটুকু ভরসা ছিলো যে,সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় সামলাতে পারবে। মিশুকে যে কেউ পছন্দ করবে সেটার জন্য ওর প্রতি ষোলআনা ভরসা করা যায়। সবাইকে খুব দ্রুত আপন করে নিতে পারে ও। ফাইনালি, বাসার ঝামেলাটা মিটে গেলো কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই! উফফ!
বাবা উঠে করিডোর দিয়ে হাটতে হাঁটতে অন্যদিকে গেলেন। আম্মুকেও সাথে নিয়ে গেলেন। মেঘালয় এই সুযোগে একটু এগিয়ে এসে মিশুর কাঁধে মুখ গুঁজে বললো, “এখন থেকে এই বাড়িটা তোমার।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “আমার মানে!”
– “তুমি এখানেই থাকবা।”
– “এটা কার বাড়ি?”
মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, “আমি ভার্সিটিতে উঠেই আব্বুর সাথে একটা বিজনেস শুরু করেছিলাম। যদিও আব্বুই সব সামলায়, আমার শুধু শেয়ার ছিলো। ওই বিজনেস থেকে একটা পয়সাও কখনো নেইনি,সবটাই জমিয়ে রেখেছিলো। সেটার টাকায় এই বাড়িটা কিনেছি। আমার বোন তো ইউল্যাবে পড়ে,ওর ক্যাম্পাস ওই বাসা থেকে কাছে। সেজন্যই এখানে থাকা হয়না।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “কত্ত বুদ্ধি তোমার! সবকিছু সামলাও কিভাবে?”
মেঘালয় মাথায় আঙুল দিয়ে বললো, “এই মগজের খেলা সব। আজকে বাবার এতদূর আসার পিছনে আব্বুর ব্রেইনটাই কাজ করেছে। আব্বুর ফ্যামিলি’র অবস্থা ভালো ছিলোনা।”
– “আমি কি একাই থাকবো এখানে?”
– “ভেবেচিন্তে কাউকে ঠিক করে দেবো, সে বাসার কাজ করতে তোমাকে হেল্প করবে। আর আমিতো প্রায়ই আসবো।”
– “তুমি যখন আসবা, যাবা, পাবলিক তখন দেখবে না?”
– “নাহ। আমিতো রাতের অন্ধকারে আসবো আমার বউয়ের কাছে।”
বলেই মিশুর গলায় মুখ গুঁজে দিলো। মিশু বললো, “তুমি আসলেই খুব খারাপ। তোমার মাথায় খুব শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল কিলবিল করে।”
মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। মিশুকে জাপটে ধরে বললো, “কয়েকটা দিন যাক, আব্বু আম্মু নিজে থেকেই আমাকে তোমাকে বিয়ে করতে বলবে। সেজন্যই সিস্টেমে ওদের সাথে দেখা করিয়ে দিলাম। আমাদের ওই বাড়িতে দেখা করালে আব্বু আম্মুর কাছে স্বাভাবিক লাগতো সবকিছু। যেহেতু তাদেরকে এখানে ডেকে এনেছি, এখন ওনারা চিন্তা ভাবনা করবেন আমাদেরকে নিয়ে।”
– “কি বুদ্ধি! তুমি চাইছো ওনারা নিজে থেকে বিয়ের ব্যবস্থা করুক? তুমি তাদেরকে বলবা না?”
– “এইতো বুঝেছো। আমি চাচ্ছি আব্বু আম্মু নিজে থেকে আমাকে বলুক বিয়েটা করে ফেলতে। আর তারা যেন নিজে থেকে তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে রাখে। এখানে একা একা ফেলে রাখবে না কখনো, আব্বু দায়িত্ববোধ ব্যাপার টা খুব মেনে চলে।”
মিশু মেঘালয়ের দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “তোমার মাথায় খুব কুটনি বুদ্ধি। কুটনি বুড়া একটা।”
– “হা হা হা। আর তুমি কুটনি বুড়ি।”
– “তুমি বাবা মায়ের সাথে দেখা করাবে বলোনি কেন?”
– “হুট করেই তাদের সামনে দাড় করালে তোমাকে কতটা নার্ভাস লাগে,সেটা দেখার জন্য। মজা লাগছিলো।”
মিশু মেঘালয়ের বুকে দুটো কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, “সাধে কি বলি তুমি খুব খারাপ? আমি নার্ভাস হচ্ছিলাম আর তুমি মজা পাচ্ছিলে সেটা দেখে। অবশ্য আমি একদম সারপ্রাইজড! এই বাড়ি, তোমার রুমের সৌন্দর্য, সুইমিংপুল, ফাইনালি বাবা মায়ের সাথে দেখা করা, সবটাই আমার জন্য গ্রেট সারপ্রাইজ ছিলো। যদিও প্রথম থেকেই তুমি আমাকে সারপ্রাইজড করে দিচ্ছো।”
মেঘালয় হাসলো। মিশুর মুগ্ধ চোখ দেখতে ওর খুবই ভালো লাগে। সেজন্যই সারপ্রাইজ দিতে চেষ্টা করে ও। মুগ্ধ হলে মিশুর চেহারায় একটা পবিত্র ভাব চলে আসে যেটা মেঘালয়কেও মুগ্ধ করে দেয়। সেজন্যই তো এতকিছু করা!
মিশু বললো, “সেই কবে থেকেই শুধু সারপ্রাইজ দিচ্ছো। একজন সেলিব্রেটি এত সহজে কারো সাথে মিশতে পারে সেটা জানতাম না। আর তুমি আবার আমার মত সরল একটা মেয়ের প্রেমে পড়লে। এ সবই সারপ্রাইজ! তুমি গান গাও সেটা জানতাম না, তুমি বিজনেস করো সেটাও জানতাম না। সত্যি আমি এতবার অবাক হই যে অবাক হতে হতে একবার দুম করেই হয়ত হার্ট এটাক হয়ে যাবে আমার।”
মেঘালয় হেসে বললো, “তোমার মুগ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করে মিশু পাগলী, তোমার সরলতা আমাকে আকৃষ্ট করে।”
– “এখন ছাড়ো, আব্বু আম্মু এসে পড়বে। তুমি না বলেছিলে আমার চুলের একটা গল্প আছে। সেটা বলো।”
– “সেটা আরেকদিন বলবো।”
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে ভদ্রছেলের মতন সোজা হয়ে বসলো। আব্বু আম্মু চলে আসলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। মিশুর সাথে বসে অনেক্ষণ গল্প করলেন ওনারা। তারপর সবাই একসাথে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন। রেস্টুরেন্টে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বাবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো মেঘালয়। গাড়িটা সিলেটে নিয়ে যাবে, কিছুদিন থাকতে হবে এছাড়াও অনেক ব্যাপার নিয়ে কথা হলো। বাবার কাছে চাওয়ার আগেই তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে দিলেন মেঘালয়ের হাতে। মেঘালয় আব্বুকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেলো।
মিশুকে নিয়ে মার্কেটে এসে দুটো ড্রেস কিনলো ওর জন্য। একটা শাড়ি,দুটো কামিজ,গেঞ্জি, প্যান্ট এসব কিনে নিয়ে সায়ানদের বাসায় ফিরলো। মিশু একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। ওর এখন চিন্তা হচ্ছে মেঘালয়কে নিয়ে। ছেলেটাকে যত সময় যাচ্ছে,ততই ওর রহস্যময় লাগছে। মেঘালয়ের চোখেও রহস্য খেলা করে। মিশু ভেবেছিলো মেঘালয় ধনী পরিবারের সন্তান,কিন্তু এতটা ধনী সেটা কল্পনাও করেনি। এতকিছু থাকার পরও সে নেভারল্যান্ডে যাওয়ার সময় সিএনজিতে কেন নিয়ে গেলো? তার নিজেরই তো গাড়ি আছে। সবসময় পলওয়েল কারনেশনের মত শপিং কমপ্লেক্সে সে কেনাকাটা করে, বড়বড় মার্কেট গুলোতেও দেখি সবাই ওকে চেনে। সে কেনই বা মিশুর শপে রোজ রোজ গিয়ে হাজির হতো? মাঝরাতে স্টেশনে হাটাহাটি করা, দুম করেই ট্রেনে গিয়ে ওঠা এগুলো তো বাচ্চাদের কাজ। মেঘালয় কেন এসব করে! রহস্য রহস্য! ছেলেটাকে এখন বড্ড রহস্যজনক লাগছে। মিশু গালে হাত দিয়ে ভাবছে মেঘালয়কে নিয়ে। যে বাড়িতে নিয়ে গেলো সেটা তো ফাঁকাই ছিলো, তবুও সায়ানদের বাসায় বিয়ে পড়ালো। এত এত প্রশ্ন মিশুর মাথায় জড়ো হচ্ছে যার কূলকিনারা কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা ও।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ২২

0

অনুভূতি
পর্ব ২২
মিশু মনি
.
৩৪.
রৌদ্রময়ীকে নাস্তা এনে দিয়ে নিখিল বললো, “এখন যাবি কোথায়?”
– “জানিনা রে।”
নিখিল একটু কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, “দুটো দিন এখানে থাক। তারপর দেখা যাবে।”
রোদ বেশ অবাক হয়ে গেলো। নিখিলের বুকের ভেতর কেমন দহন চলছে সেটা ও বেশ ভালো করেই জানে। বুঝতে পারছে সবই। ছেলেটার চেহারা একরাতেই কেমন করুণ হয়ে গেছে। তবুও কত সুন্দর ভাবে বলছে থেকে যেতে।
নিখিল বললো, “কি ভাবছিস? খেয়ে নে।”
– “তুই খেয়েছিস?”
– “আমি খাবো না,রুচি নেই খাওয়ার।”
রোদ জানে নিখিল কেন খেতে চাইছে না। নিখিল কে জোর করে খাওয়াতে পারলে হয়। যদিও ওর নিজের ও খেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও নিখিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, “খেয়ে নে প্লিজ।”
– “বাদ দে।আমি খাবো না,ভালো লাগছে না খেতে।”
– “নিখিল প্লিজ,তুই না খেলে আমিও খাবো না।”
নিখিল একবার রাগত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “ঢং আমার একদম ই ভালো লাগেনা। চুপচাপ খেয়ে নে।”
রোদ আরো জোরালো গলায় বললো, “তুই না খেলে আমি খাবো না একবার বলেছি।”
– “আমার উপর কিসের অধিকার খাটাচ্ছিস তুই?”
– “কোনো অধিকার খাটাচ্ছি না, মানবতার খাতিরে খেতে বলছি।”
– “যে বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে ছোট বোনের লাইফটা শেষ করে দেয় তার আবার মানবতা।”
কথাটা খুব খারাপ লাগলো রোদের। তবুও কিছু মনে করলো না। এখন এই কথাটা বারবার শুনতে হবে ওকে। তবুও মুখ বন্ধ রাখতে হবে। এখন কিছুতেই মুখ খোলা যাবেনা, কিছুদিন যাক তারপর নিখিলকে সব বলে দিবে ও।
নিখিল দেখলো রোদ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তারমানে এই মেয়ে খাবেনা। প্রচুর জেদি একটা মেয়ে। কি যেন ভেবে নিখিল নিজেও এক প্লেট খাবার নিয়ে এসে ওর পাশে বসে খেতে শুরু করলো। ওর খাওয়া দেখে রোদ হেসে খেতে শুরু করলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুই বন্ধু মিলে টুকটাক কথাকাটি আর ঝগড়াও হলো। অনেক কিছু নিয়ে যুক্তি তর্কও হলো। নিখিল বারবার করে শুনতে চাইছে কেন বাড়ি থেকে পালালো রোদ? কিন্তু রোদ কিছুতেই সেটা বলতে চাইছে না। কটা দিন সময় নিয়ে তারপর বলবে বলছে। বাধ্য হয়েই আশা ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো নিখিল।
রোদ একাই বসে রইলো বিছানার উপর। এখানে কয়টা দিন আপাতত নিশ্চিন্তে থাকা যাবে, তারপর ঢাকায় চলে গেলে ভালো হবে। কিন্তু কি করবে সে গিয়ে? চাকরী পেতেও তো সময় লাগে,সুযোগ লাগে।
বসে বসে এসব চিন্তা করতে লাগলো।
৩৫.
নাস্তার পর্ব শেষ করেই মেঘালয় মিশুকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। ওর বন্ধুরাও ব্যাগ গুছানোর জন্য যে যার বাড়িতে চলে গেলো। বিকেল অব্দি ঘুমিয়ে সবাই সন্ধ্যায় চলে আসবে ব্যাগ নিয়ে। কিন্তু মেঘালয় মিশুকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে এটা কাউকেই জানালো না। এমনকি মিশুকেও জানালো না। মিশু খুব কৌতুহলী হয়ে উঠছে। মেঘালয় নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে আর ও পাশে বসে আছে।
গাড়ি এসে থামলো একটা চমৎকার বাড়ির সামনে। মেঘালয় গাড়ির দরজা খুলে মিশুকে নামতে বললো। গাড়ি থেকে নেমে অনেক্ষণ মিশু চেয়ে রইলো বাড়িটার দিকে। ডিজাইন, রং, গ্লাস সবমিলিয়ে অন্যরকম সুন্দর একটা বাড়ি! এটা আবার কার বাড়িতে নিয়ে এলো মেঘ? বাড়িটার সৌন্দর্য দেখেই তো মিশু নির্বাক হয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধতা চেপে রাখতে পারছে না।
মেঘালয় ওর হাত ধরে বাড়ির প্রধান দরজায় আসলো। দরজায় এসে চাবি দিয়ে লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। পুরো বাড়ির সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত। সাজসজ্জা অনেক আকর্ষণীয়! কিন্তু বাড়িটা কার কিছুতেই বুঝতে পারছে না মিশু। মেঘালয়ের বাড়ি তো মোহম্মদপুরে, আর মিশু নিজেই ওর বাড়ি চেনে। একদিন ওর বাড়ির সামনে দিয়েই বাইকে করে মেঘালয় মিশুকে বাসায় পৌছে দিয়ে এসেছে। তাহলে এটা আবার কার বাড়ি!
মিশু দুবার জিজ্ঞেস করলো মেঘালয়কে। কিন্তু মেঘালয় কোনো উত্তর দিলো না। মিশুকে কোলে তুলে নিয়ে একটা রুমে এসে দরজা আটকিয়ে দিলো। মিশুকে বিছানার উপর বসিয়ে দিতেই অনেক দূর নিচে তলিয়ে গেলো ও। অবাক হয়ে বললো, “এত সফট বিছানা!”
মেঘালয় ঝাঁপিয়ে পড়লো মিশুর উপর। অনেক্ষণ ধরে দুজনের খুনসুটি চলতে লাগলো। একে অপরকে বালিশ দিয়ে মারামারি করছে, একটা বালিশের তুলো ইতিমধ্যে পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। বালিশের তুলো উড়িয়ে মারামারি করতে এত ভালো লাগে আগে জানতো না মিশু। ও তুলা গুলো দুহাতে তুলে মেঘালয়ের মাথার উপর দিয়ে দিলো। মেঘালয়ের মাথা,চুল,মুখ শার্ট সব তুলা দিয়ে একাকার হয়ে গেছে।
মিশু এগিয়ে এসে মেঘালয়ের কলার টেনে ধরে ওকে কাছে নিয়ে বললো, ” এটা কার বাড়ি বলছো না যে? বাড়ির লোকজন সবাই কোথায়?”
– “ওহ হো, দাড়াও একটা ফোন করে আসি।”
মেঘালয় বাইরে গিয়ে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। কি এমন কথা যা মিশুর সামনে বলা যায়না! কৌতুহল চেপে গেলো মিশু। মেঘালয় এসে বললো, “বাইরে যাবো।”
মিশুর জানতে ইচ্ছে করছে কোথায় যাবে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। মেঘালয় আলমারি খুলে একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার এনে দিয়ে বললো, “পড়ে নাও দ্রুত।”
– “এগুলো তো তোমার মনেহচ্ছে। আমি কেন পড়বো?”
– “উফফ পড়ো তো। তাড়াতাড়ি।”
মিশু থতমত খেয়ে গেছে। গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে দেখলো অনেক ঢোলা ঢোলা লাগছে। আর প্যান্ট টা হচ্ছে না কিছুতেই। সেটা পড়ে খুবই হাস্যকর দেখাচ্ছে মিশুকে।
মিশু মুখটা কাচুমাচু করে বললো, “কিরকম বাজে দেখাচ্ছে! ছি, তুমি কেন পড়তে দিলা এটা?”
মেঘালয় মিশুকে দেখে হেসেই খুন। মেঘালয়ের গেঞ্জির ভিতর ঢুকে যাওয়ার মত অবস্থা ওর, এত বেশি ঢোলা আর লম্বা। প্যান্ট পড়ে আরো হাস্যকর লাগছে। মিশু মুখটা বিকৃত করছে দেখে মেঘালয় হো হো করে হাসছে। মেঘালয় বললো, “খারাপ লাগছে?”
– “রাগ লাগছে।”
– “তাহলে খুলে ফেলে দাও। খালি গায়ে আসো।”
– “ছি,…”
মিশুর মুখ দেখে আবারো হেসে উঠলো মেঘালয়। তারপর ওকে কোলে তুলে নিয়ে হাটতে শুরু করলো। মিশুকে বললো চোখ বন্ধ করে রাখো। একদম খুলবা না। মিশু দুহাতে চোখ চেপে ধরে আছে। খুব হাসি পাচ্ছে,রাগও হচ্ছে। এই টি শার্ট পড়া অবস্থায় কারো সাথে দেখা হয়ে গেলে সে নির্ঘাত হাসবে। বলবে মেঘালয়ের বউটা খুব বাজে দেখতে। এসব ভেবে ভেবে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে মিশুর। কিন্তু মেঘালয় কি করতে চাইছে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।
মেঘালয় মিশুকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো, “এবার চোখ খোলো।”
মিশু চোখ খোলামাত্রই বিস্ময়ে ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো! সুইমিংপুল! একদম নীল রঙের পানি, তরঙ্গ খেলা করছে উপরে, চারিদিকে সবুজ গাছপালায় ঘেরা! উফফ এত্ত সুন্দর কেন!
মিশু খুশিতে মেঘালয়ের হাত চেপে ধরে বললো, “পুল! আমি জীবনেও কখনো এরকম পুল সামনাসামনি দেখিও নি। এত সুন্দর সুইমিংপুল কিভাবে হয়? ন্যাচারাল লাগছে, চারদিকে এত ঘন গাছ!”
মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, “বউ নিয়ে রোমাঞ্চ করবো তো, সেজন্য এত ঘন করে গাছ লাগানো হয়েছে।”
– “তুমি খুব খারাপ! বাজে বাজে খুব বাজে একটা লোক।”
মেঘালয় হাসতে হাসতে দুইপা পিছিয়ে গেলো। মিশু অবাক হয়ে সবকিছুর সৌন্দর্য দেখছে। সত্যিই পানিগুলো একদম নীল, মাথার উপরে নীলাকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশে তুলোর মত মেঘ উড়ছে। খুব ভালো লাগছে মিশুর। এমন সময় মেঘালয় পানিতে লাফিয়ে পড়লো। ঝাপ দিয়েই একদম সাঁতরানো আরম্ভ করে দিয়েছে। মিশু হা করে চেয়ে চেয়ে দেখছে। নীল পানির ভেতরে মেঘালয়ের মুখটা যখনি উকি দিচ্ছে,অন্যরকম ভালো লাগা ছেয়ে যায় ভেতরে। মেঘালয় কিছুক্ষণ সাতরিয়ে মিশুর সামনে এসে ওকে নামতে বললো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডাকছে ওকে। কিন্তু মিশু চেয়ে আছে মেঘালয়ের রোমশ বুকের দিকে। ছেলেটা কখন খালি গা হয়ে লাফ দিয়েছে খেয়াল ই করেনি মিশু। কিন্তু ওর খোলা বুকে লোমগুলো ভিজে ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে। চুলগুলো ভিজে গেছে, চুল থেকে গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। হাতের লোমগুলোও ভিজে হাতের সাথে লেপ্টে গেছে। এত সুন্দর কেন মেঘালয়! মিশু মুগ্ধতা লুকিয়ে রাখতে পারছে না।
মেঘালয় ওর হাত টেনে ধরে কোলে তুলে নিয়ে সুইমিংপুলে নামালো। মিশু ওর কোলেই দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে দেখছে মেঘালয়কে। ঘোর লেগে যাচ্ছে ওর। মেঘালয় সত্যিই অনেক সুন্দর! মেঘালয়ের শরীরে বিন্দু বিন্দু লেগে লাগা সমস্ত জল গুলো খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
মিশু বললো, “আমার হিংসে হচ্ছে মেঘ।”
– “কেন?”
– “এই পানিগুলোর কত সৌভাগ্য, তারা তোমার চোখে, গালে, মুখে, ঠোঁটে সবখানে লেগে আছে। আমি পারছি না।”
মেঘালয় একদম অবাক হয়ে গেলো মিশুর কথায়। ওর চোখের মায়ায় তলিয়ে যাচ্ছে মেঘালয়। চোখে চোখ রেখে বললো, “এত ঘোর কেন তোমার চোখে?”
– “আমার এত ঘোর ঘোর লাগে ক্যান মেঘ?”
– “তোমার ও কি পানির মত আমার চোখে,গালে ঠোঁটে সবখানে লেগে থাকতে ইচ্ছে করে?”
– “হুম।”
মেঘালয় মিশুকে নিয়ে পানির ভেতর তলিয়ে গেলো। মিশু ওর কোলে,মনেহচ্ছে শূন্যে ভেসে আছে ও। মেঘালয়ের স্পর্শ অনুভব করছে তীব্রভাবে। আর সুখের অন্য এক রাজ্যে প্রবেশ করছে দুজনে। আবেশে চোখ বুজে আসে মিশুর। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসে। মেঘালয় ওকে জড়িয়ে রেখেছে, আটকে রেখেছে দুহাতে আর ঠোঁটের কোমল বাঁধনে। মিশুর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, মেঘালয় ওকে আবার ভাসিয়ে তুললো পানির উপরে। মেঘালয়ের গায়ের উপর ভর দিয়েই মাথাটা উপরে তুলে হাফাতে লাগলো মিশু। ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। মিশু চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। এতক্ষণ মেঘালয় ঠিক কি কি করেছে বুঝতে পারেনি ও। কিন্তু কেবলই মনেহচ্ছে, এত সুখ সুখ লাগে কেন!
মেঘালয় মিশুর মুখের উপর নেমে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো, “ঠিক আছো?”
মিশু কথা বলতে পারলো না। মেঘালয় তীরে এনে ওকে পুলের শানের সাথে ঠেস দিয়ে দাড় করিয়ে দিয়ে মিশুর দুই পা নিজের দুই কাঁধের উপর তুলে নিলো। মেঘালয়ের কাঁধের উপর পা তুলে দিয়ে দুহাতে ওকে হালকা করে ধরে রইলো মিশু। মাথাটা ভেসে আছে পানির উপরে। মিশু চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সাদা মেঘের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে আর প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। মেঘালয় দুহাতে ওকে আকড়ে ধরে আছে, আর ও দুইপা মেঘালয়ের কাঁধের উপর তুলে দিয়ে আরামে পানির উপর শুয়ে আছে।
স্বাভাবিক হওয়ার পর মেঘালয় বললো, “কেমন লাগছে মেঘবতী?”
মিশু এগিয়ে এসে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে ওর রোমশ বুকে নাক ডুবিয়ে বললো, “আগে জানতাম দম বন্ধ হয়ে আসলে মানুষের কষ্ট হয়। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতিটাও সুখের হতে পারে এটা আজ প্রথম জানলাম। এত সুখ সুখ লাগে কেন মেঘ?”
মেঘালয় শক্ত করে মিশুকে জড়িয়ে ধরে রইলো। মিশুকে পিঠের উপর নিয়ে পুরো পুল সাতরিয়ে আসলো একবার। মিশু পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়ার পর আবারো ওকে নিয়ে জলের ভেতর ডুব দিলো মেঘালয়। মিশু সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে আলগা হয়ে পুরো ভরটাই মেঘালয়ের উপর দিয়ে দিয়েছে। মেঘালয় ওর কোমল দেহটাকে নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে শুরু করে দিয়েছে। মিশুর কেবলই মনেহচ্ছে সে স্বপ্নের রাজ্যে ভাসছে।
এভাবে কতক্ষণ চলে গেলো কেউই বলতে পারেনা। মেঘালয় মিশুকে কোলে নিয়ে যখন তীরের দিকে আসলো তখন ও মিশুর চোখ বন্ধ। মেঘালয় মিশুর মুখটা একহাতে ধরে বললো, “মিশু, আমি কি অন্যায় করে ফেলেছি?”
মিশু মেঘালয়কে জাপটে ধরে বললো, “আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না বলে দিচ্ছি। তুমি আমাকে ফেলে কক্ষনো মুহুর্তের জন্যও দূরে যাবেনা।”
মেঘালয় হেসে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। বললো, “যাবো না রে পাগলী। ছেড়ে গিয়ে এত ভালোবাসবো কাকে?”
মিশু আস্তে আস্তে চোখ মেললো। এখনো ওর চোখে ঘোর, মায়া! ওর চোখের দিকে তাকালেই তো খুন হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয় মেঘালয়ের।
মিশু একা উঠতে পারলো না। মেঘালয় টেনে তুললো ওকে। তারপর আবারো ওকে কোলে নিয়ে বাসার ভিতরে গিয়ে ঢুকলো। বাথরুমে মিশুকে ঢুকিয়ে দিয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে দিলো।
মিশু ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখে মেঘালয় একটা ব্লাক শার্ট ও প্যান্ট পরে বডি স্প্রে দিয়ে একদম জেন্টলম্যান সেজে বসে আছে। কে বলবে এই ছেলেটা একটু আগে কি পরিমাণ ভালোবাসার অত্যাচার চালিয়েছে ওর উপর? মিশু এসে বিছানার উপর বসতেই অনেক দূর তলিয়ে গেলো। এত সফট বিছানায় কিভাবে কেউ ঘুমায় ভাবতে পারেনা ও।
মেঘালয় একটা শাড়ি ও ব্লাউজ এনে দিয়ে বললো, “এটা পড়ে নাও।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “কোথায় পেলে এটা? কার শাড়ি?”
মেঘালয় প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওকে যত্ন করে শাড়ি পড়িয়ে দিলো। মিশু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা সাজুগুজু করে নিলো। ব্লাউজটা একদম ফিট হয়ে গেছে। ও বারবার জানতে চাইছে এটা কার বাড়ি? বাড়িতে কোনো লোকজন নেই কেন? মেঘালয় কোনো প্রশ্নের উত্তর ই দিলোনা। শুধু হাসলো।
মিশু সাজুগুজু করে সোফার উপর বসে রইল চুপ করে। মেঘালয় আলমারি খুলে কি যেন দেখছে। বিছানার উপরে অনেক গুলো টাকা রাখলো। মিশু হা করে চেয়ে আছে সেদিকে। মেঘালয় একটা রুমালের মত মাফলার জাতীয় কিছু গলায় বেধে বললো, “দাগ গুলো দেখা যাচ্ছে?”
– “না।”
মেঘালয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। মেঘালয় মিশুকে রুমেই বসতে বলে দরজা খুলতে চলে গেলো। মিশু একাই বসে রইলো চুপচাপ। রুমটা অনেক সুন্দর, শুভ্রতা ছেয়ে আছে পুরো রুমে। কার বাড়ি এটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না ও।
মেঘালয় এসে মিশুর হাত ধরে ওকে বসার ঘরে নিয়ে আসলো। বসার ঘরে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ও মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। ওনারা এইমাত্র অফিস থেকে ফিরলেন সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয় মিশুকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, “তোমাদের পুত্রবধূ।”
মিশুর চোখ কপালে উঠে গেলো কথাটা শুনে। তারমানে এনারা মেঘালয়ের বাবা মা! আর এত বিশাল আর সুন্দর বাড়িটা মেঘালয়ের নিজের! অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু। মেঘালয় তো বলেছিলো এখনি বাসায় বিয়ের কথা জানাবেই না। তাছাড়া এটা কিভাবে ওর বাড়ি হতে পারে! সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
চলবে..