Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1857



অনুভূতি পর্ব ৪১

0

অনুভূতি
পর্ব ৪১
মিশু মনি
.
৬৪.
সায়ান হেডফোনে গান শুনছে আর জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। বাসের ভেতর রাতের নিরবতা নেমেছে,অন্ধকার বাসে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। এলোমেলো হাওয়া আর এই রাতের জার্নির মাঝে কি যেন একটা আছে। খুব মন কেমন করছে ওর। দীর্ঘ সময় ধরে একা একা আছে, গার্ল ফ্রেন্ডটা সেই যে চলে গেলো এরপর আর কারো সাথে বন্ধুত্ব ও হলো না। এতদিন তো বেশ ভালোই কেটেছে,আজ কেন যেন ইচ্ছে করছে কাউকে একটু ভালোবাসি বলতে। একটু খুনসুটি হয়না কতদিন!
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে, একাকীত্ব ভর করেছে এসে। ও একমনে গান শুনতে লাগলো। একটা গানও ভালো লাগছে না। একটার পর একটা গান বদলাচ্ছে। আরাফ ওর অস্থিরতা দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে তোর কি হইছে? এমন দেখাচ্ছে কেন?”
– “না কিছু হয়নি।”
– “গঞ্জিকা খাবি?”
– “ধুর ফাজলামি করিস না তো। ভাল্লাগছে না। বিড়ি ধরাতে পারলে ভালো হতো।”
– “প্রেম করতে মঞ্চাচ্ছে?”
সায়ান হেডফোন খুলে রেখে বললো, “বুঝলি ক্যামনে? আমার খুব একা একা লাগছে দোস্ত। কত্তদিন কেউ কেয়ার করেনা। এইযে জার্নি করছি,একজন যদি ফোন দিয়ে বলত একটু সাবধানে যেও। এই লাইনটাকে খুব মিস করছি।”
আরাফ হেসে বললো, “মিশুর মত কাউকে পেলে তোর জন্য চেষ্টা করে দেখতাম।”
– “বিদ্যা?”
আরাফ রেগে বললো, “ওই ন্যাকা মেয়েটা? প্রতি সেন্টেন্সে সেন্টেন্সে তোকে বেয়াদব বলবে। ওরকম মেয়ের দরকার নাই কোনো।”
সায়ান হাসলো। সেই যে সিলেটে বিদ্যার সাথে পরিচয় হলো। এরপর আর কখনো দেখা বা কথা হয়নি। ঢাকায় আসার পর ওকে ওর বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আসার পথেও মেয়েটা অজস্রবার বেয়াদব বলেছে ওকে। ভাবলেই হাসি পায়। জগতে অদ্ভুত প্রজাতির কিছু মেয়ে আছে!
আরাফ বললো, “এক কাজ করতে পারিস।”
– “কি কাজ?”
– “প্রেম কর একটা।”
– “আবার?”
-“ন্যাড়া একবার বেলতলায় যায় এটা সত্য,কিন্তু একবার বেল পড়েছে বলে আবারো পড়বে এমন কোনো কথা নাই বুঝলি?”
সায়ান হেসে বললো, “আমাকে তোর ন্যাড়া মনেহয়? বাই দা ওয়ে,প্রেমিকা পাবো কই? সব তো ভক্ষক।”
– “চোখ দুটো খুলে খোজ। বন্ধ করে খুঁজলে তো পাবিনা। সবসময় সার্চিং মুড অন রাখ। চিরুনি অভিযানে নেমে পড়।”
– “তুই তো দুই বছর যাবত সিংগেল, একেবারে রেকর্ড করে ফেললি। তুইও এবার একটা প্রেম কর।”
দুই বন্ধু হেসে উঠলো একসাথে। এই বিষয়টা নিয়ে দুজনে কথা বলতে লাগলো। ওদের পিছনের সিটে রোদ ও পূর্ব কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। পাশের সিটে সামনে নিখিল ও দুপুর আর তাদের পিছনের সিটে মিশু ও মেঘালয়। এরকম সুন্দর জুটির সাথে এই দুটো অভাগাকে নিতান্তই হাস্যকর দেখাচ্ছে। ওদের কষ্ট হবেনা কেন? মিশু হেসেই লুটোপুটি খাচ্ছে মেঘালয়ের বুকের উপর। ওর হাসির শব্দ এই সিট থেকেও শোনা যাচ্ছে। এদিকে নিখিল ও দুপুর ফিসফিস করে প্রেম করছে। না চাইলেও চোখ কান একটু হলেও শুনতে ও দেখতে পায়। মনটাকে কতক্ষণ ধরে রাখা যায়? হিংসে না হলেও হতাশা আর একাকীত্ব মুহুর্তের জন্য হলেও ভর করে। দুই বন্ধু মিলে এইসব নিয়েই কথা বলছে।
সায়ান মনের সার্চিং মুড অন করে দিয়েছে। মেয়ে খুঁজতে কতদিন লাগে কে জানে! তারপর আবার তার পিছনে ঘুরাঘুরি, প্রেম হওয়া উফফ কত্ত দেরি। এমন সময় বাসটা থেমে গেলো হঠাৎ। একটা কাউন্টার থেকে দুজন মেয়ে বাসে উঠলো। সায়ান ও আরাফ একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে ফিসফিস করে বললো, “চল দোস্ত এই দুটোর উপর দুজনে ক্রাশ খাই।”
আরাফ বললো, “ইয়ার্কি করে নাকি সিরিয়াসলি?”
– “ইয়ার্কি করে খাই। যদি স্বাদ ভালো হয়,আবার সিরিয়াসলি খাবো নে।”
বলেই দুজনে হেসে উঠলো। বাসের লাইট জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়ে দুটো নিজের সিটে গিয়ে বসলো। মিশু ও মেঘালয়ের পিছনের সিটে বসেছে ওরা। দুইবোন মনেহচ্ছে,চেহারায় মিল আছে।
আরাফ বললো, ” লাইফটা যদি তাহসানের নাটক হতো, তবে নির্ঘাত ওদের সাথে আমাদের প্রেম হতো।”
– “তুই কি ভাবছিস ওরা তোর জন্য আজো সিংগেল আছে?”
– “না থাকলেও হয়ে যেত। আমি তাহসানের নাটকের কথা বলেছি।”
– “মিশুকে বল একটা ব্যবস্থা করে দিবে।”
আরাফ একবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে ডাকলো, “এই মিশু।”
মিশু মাথা হেলিয়ে তাকালো আরাফের দিকে। সায়ানের মুখে দুষ্টুমি হাসি দেখে ও বুঝতে পেরেছে এরা কিছু একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি আঁটছে। ও জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাইয়া?”
আরাফ বললো, “চাঁদে যেতে মনচাচ্ছে রে। একটা উপায় বের করে দে না।”
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরাফের দিকে। আরাফ এত সহজ হয়ে গেছে কবে থেকে? অবশ্য মিশুর সাথে রেগুলার ওর চ্যাটিং হয়, প্রায়ই কথা হয় হোয়াটস অ্যাপে। এটা কি মিশুর গুনেই সম্ভব হলো! ও অবাক হয়ে এতদিনের চির পরিচিত বন্ধুটির দিকে চেয়ে আছে।
আরাফ বললো, “বহুদিন জোৎস্না দেখিনা রে।”
– “বেদের মেয়ে জোৎস্না?”
– “না, চাঁদের মেয়ে জোৎস্না।”
মিশু হেসে উঠলো ওর জবাব শুনে। আরাফ মিশুদের পিছনের সিটে বাঁকা চোখে তাকালো। খেয়াল করলো মেয়েদুটো ওর দিকেই চেয়ে আছে। আরাফ একটু মুখ টিপে হেসে বললো, “আমাকে একটা জোৎস্না জোগাড় করে দে না ভাই।”
মিশু বললো, “জোৎস্নাই লাগবে? ছকিনা হলে হবেনা?”
আরাফ জবাব দিলো, “অমাবস্যা হলেও হবে বোন। ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে লাগবে। পারলে নেটে সার্চ দে।”
কথাটা বলেই আরাফ আবারো তাকালো মেয়েদুটোর দিকে। ওরা এখনো চেয়ে আছে। আরাফ সোজা হয়ে বসলো। একটু হলেও কাজ হয়েছে। যদিও মেয়েদুটোর সাথে নিজে থেকে কথা বলা বা লাইন মারার বয়সটা আর নেই। আরাফ সায়ানের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ফোনে ভাইব্রেট হচ্ছে দেখে চেক করে দেখলো মিশু মেসেজ দিয়েছে, “আমি খুঁজে দিচ্ছি। আমার আইডিতে একটা স্ট্যাটাস মারলেই তোমার জন্য একগাদা মেয়ে বেড়িয়ে আসবে।”
আরাফ রিপ্লাই দিলো, “একটু তাড়াতাড়ি দে না বোন।”
বাসের লাইট আবারো নিভিয়ে দেয়া হলো। দুই বন্ধু গল্পে মেতে উঠেছে। সায়ানের মনটা এখন ভালো। আগের মত একা একা লাগছে না মোটেও। মিশু টুকটাক মেসেজ দিচ্ছে আরাফকে। মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, “তোমাকে একটা গিফট দিতে হবে মনেহচ্ছে।”
মিশু দুহাতে মেঘালয়ের গলা জাপটে ধরে বললো, “কি জন্য?”
– “এইযে আমার বন্ধুটাকে স্বাভাবিক করে ফেলেছো একদম।”
– “তোমার বন্ধুরা আমাকেও যে অনেক কিছুই শিখিয়েছে।”
– “যেমন?”
– “কিভাবে কনসিভ করতে হয়?”
– “হোয়াট!”
মেঘালয় চেঁচিয়ে উঠলো। মিশু খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, “আহা রাগ করোনা। সায়ান ভাইয়া আমাদের বিয়ের দিনই আমাকে বলেছিলো কথাটা। ভালোর জন্যই বলেছে। তুমি রেগে যেওনা আবার।”
– “আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
মিশু হেসে উঠলো। মেঘালয় ওর পেটে হাত দিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে বললো, “তুমি পুরোটাই শুধু আমার। কক্ষনো এর বিন্দুমাত্র ভাগ যেন কেউ না পায়।”
– “আজব! আমি আবার কার হতে যাবো? আচ্ছা মেঘ,তুমি কখনো কারো প্রেমে পড়োনি?”
মেঘালয় একটু কাশলো। এই প্রশ্ন কখনো করেনি মিশু। আগে তো নিতান্তই বাচ্চা স্বভাবের ছিলো। এতকিছু বুঝতো না। আজকাল অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে,তাই সাংঘাতিক সব প্রশ্নও করতে শিখে গেছে। মিশু বললো, “বলোনা মেঘমনি,তোমার প্রেমের গল্প বলো।”
– “শুনতেই হবে? আজকের দিনে না শুনলে হয়না?”
– “ছ্যাঁকা খেয়েছিলে?”
মেঘালয় বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ওর মুখটা খুবই করুণ দেখাচ্ছে। মিশু অন্ধকারেও আবছায়া করুণ মুখটা দেখে শিউড়ে উঠলো। মেঘালয়ের অতীত নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই ওর। তবুও কেন যে প্রশ্নটা করতে গেলো! যখনি কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেঘালয় বললো, “আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো।”
– “কি হয়েছে তার? চলে গেছে?”
– “যেতে বাধ্য হয়েছে।”
– “তুমি তাকে বাধ্য করেছো? নাকি ছেড়ে দিয়েছো?”
মেঘালয় মিশুর মাথাটা নিজের বুকে নিয়ে চেপে ধরলো। তারপর ধীরেধীরে বলতে শুরু করলো, “আমার সাথে ওর পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, তারপর রিলেশন। ও ছিলো খুব বেশি স্মার্ট। যদিও অতবেশি স্মার্ট মেয়েদেরকে আমার পছন্দ নয়। তবুও যেহেতু ভালো ফ্রেন্ডশিপ ছিলো, ও আমাকে প্রপোজ করায় আমি না করতে পারিনি। অবশ্য অনেক মেয়েই প্রপোজ করতো আমায়। কিন্তু ওর গুরুত্বটা একটু বেশি ছিলো। ওর জন্য অনেক ছেলে লাইন ধরে থাকতো, কিন্তু ও আমাকে ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দিতো না। এজন্যই আমার ওকে বেশি ভালো লাগতো।তারপর প্রেম শুরু হয়..”
মিশু কৌতুহলী হয়ে উঠলো ক্রমশই। দারুণ একটা প্রেম ছিলো তো মেঘালয়ের। ও অন্ধকারেই মেঘালয়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করে বললো, “তারপর?”
মেঘালয় বললো, “ও খুব ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়তো। আর অনেক সময় বাইরে বের হলেই দেখতাম ক্লিভেজ বের করে রেখেছে। আমি খেয়াল করলেই ঢেকে ফেলতো। আমার একদিন প্রচণ্ড রাগ হলো ওর উপর। রেগে বললাম, এটা কেমন স্মার্টনেস তোমার? এই নোংরামি আমি সহ্য করবো না। ও আমার কাছে মাফ চাইলো। বললো আর কখনো এরকম করে বাইরে বের হবেনা। আমি মাফ করে দিলাম। এরপর আবারো একদিন দেখলাম ওরকম করে বেড়িয়েছে। আমার রাগ চড়ে গেলো একদম। দিনদিন নোংরামির সীমা অতিক্রম করে ফেলছে। ওকে বলতেই ও বলল,তোমার জন্যই ওটা বের করে রাখি।”
মিশু চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না। একটু পর মেঘালয় আবারো বললো, “এই একটা জিনিস নিয়েই প্রচণ্ড রকম ঝগড়া হতো ওর সাথে। ওর কাছে স্মার্টনেস মানেই ছিলো শরীর প্রদর্শন করা। আমার নিজের ভূলের জন্য আফসোস হচ্ছিলো। এরকম একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়ালাম কিভাবে সেটার জন্য নিজের উপর নিজেরই রাগ হতো। ওর বেয়াদবি আমার অসহ্য লাগতে শুরু করেছিলো। আমি আস্তে আস্তে কথা কমিয়ে দিতে লাগলাম।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “তারপর?”
মেঘালয় বললো, “আমি যত সরে আসি,ও তত কাছে এগিয়ে আসে। দিনরাত ফোন দিতে থাকে। বারবার মাফ চায় আমার কাছে। আমি মাফ করে দিলাম আবারো। বললাম, তৃতীয়বার আর মাফ করবো না। ভালো জামাকাপড় কিনে দিলাম। বলে দিলাম এখন থেকে এসব পড়ে বের হবা। অত বেশি আপডেট হওয়ার দরকার নাই। ও সেটা করলো কয়েকদিন। কামিজ পড়ে ভার্সিটিতে আসতো, চুল বাঁধতো সুন্দর করে। এরপর আমার সাথে আবারো কথা ঠিকমত শুরু হলো। কিন্তু একদিন হঠাৎ একটা রেস্টুরেন্টের দোতলায় আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে গিয়ে ওকে একটা ছেলের সাথে দেখতে পাই। আমি তখন ওকে কিছু বলিনি। বাসায় ফিরে ও নিজেই আমাকে ফোন দিয়ে বলল ছেলেটা ওর কাজিন ছিলো। আমি সেটাই মেনে নিলাম। এটা নিয়ে আমার অভিযোগ নেই, আমার অভিযোগ ছিলো ওর ড্রেস আপ নিয়ে। সেদিন ওকে আবারো জিন্স ও শার্টে দেখেছি। শার্ট পড়েছো ভালো কথা,কিন্তু আবারো ক্লিভেজ বের করে রাখছে। আমার রাগের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আমি রাগে চোটে ওকে কি বলেছি নিজেও জানিনা। সে নিজে থেকেই সরে গেছে আমার লাইফ থেকে। আমাকে মুখ দেখানোর মত মুখ হয়ত ওর ছিলোনা।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মিশু বললো, “সবই তো বুঝলাম কিন্তু এই ক্লিভেজটা কি সেটাই তো বুঝলাম না।”
মেঘালয়ের হাসি পেলো প্রশ্নটা শুনে। ও মিশুকে একটু সোজা করে বসিয়ে স্পর্শ করে দেখিয়ে দিলো ক্লিভেজ কাকে বলে। মিশু লজ্জায় মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বললো, “অত বাজে মেয়েও আছে আমাদের দেশে?”
– “তুমি দেখছি কিছুই জানোনা। আজকালকার মেয়েরা কতটা নোংরামি করে ভাবতেও পারবা না। এদের কাছে স্মার্টনেস মানেই হচ্ছে শরীর প্রদর্শন করে বেরানো।”
– “আজকালকার ছেলেরা তো ওসবই পছন্দ করে। তুমি আবার করোনা কেন?”
মেঘালয় বললো, “আমার ফ্যামিলি আমাকে সেই শিক্ষা দেয়নি। কাউকে ঠকানোর মানসিকতা নেই বলে পরপর দুবার আমি ওকে মাফ করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সে ভালো হয়ে যাবে। অবশ্য আগে যদি বুঝতাম ও ওরকম তবে রিলেশনশিপ হতোনা। প্রেম হওয়ার আগে সে দিব্যি ভালো মানুষ ছিলো।”
– “উম বুঝেছি এবার। ভালোই হয়েছে,নয়ত আমি তোমাকে পেতাম না।”
মেঘালয় বললো, “হুম। আমিও এই পুতুলটাকে পেতাম না। অবশ্য ব্রেকাপের পরই নিয়ত করেছিলাম, জীবনে কখনো এত অতি আধুনিক মেয়েকে বিয়ে করবো না। এদের ফ্যাশনেই সময় চলে যায়,ভালোবাসা আর কেয়ারনেসের সময় কই ওদের?”
মিশু বললো, “এজন্যই তো বলি,মেঘালয়ের পেছনে এত মেয়ে ঘোরে অথচ সে কেন আমাকে এত ভালোবাসে!”
মেঘালয় বললো, “তুমি আমার লক্ষী একটা বউ যে তাই। পিচ্চি মেয়েটাকে নিজে হাতে কলমে সবকিছু শিখিয়ে দিলাম,মানুষ করলাম, এতে কি কম আনন্দ?”
মিশুর বড্ড সুখ সুখ লাগছে। ও মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। ছেলেটা এত্ত ভালো কেন! আজীবন যেন এভাবেই থাকে। নয়ত মরেই যাবে ও।
৬৫.
খাগড়াছড়িতে ওরা বাস থেকে নামলো সকালবেলা।
সায়ান ও আরাফ ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাংলে মেয়েদুটোকে আর দেখতে পেলোনা। আগেই কোথাও নেমে পড়েছে হয়ত। ফাজলামি করে মিশুকে বললো, “ক্রাশ দুটো মরে গেলো?”
মিশু বললো, “ভেবো না তোমরা। আমি চিরুনি অভিযানে নেমেছি। দুজনের জন্য দুটো পুতুল জোগাড় করবো।”
সায়ান বললো, “আমার পুতুল দরকার নাই। মেয়ে দরকার। আমি কি বাচ্চা যে পুতুল খেলবো?”
একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সবাই। চান্দের গাড়ি এসে হাজির। মেঘালয় মিশুর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ওকে গাড়িতে উঠতে বললো। মিশু মাথা বাড়িয়ে নিয়ে গাড়ির ভেতরটা দেখে নিলো। তারপর আনন্দে লাফাতে লাফাতে গাড়িতে উঠে বসতে গেলো। সায়ান ও আরাফ ছাদে উঠছে দেখে মিশু মুখটা ছোট্ট একটু করে বললো, “আমিও উঠতাম ছাদে।”
মেঘালয় একবার সবার মুখের দিকে তাকালো। বাকিরা ভেতরে বসে গেছে। মিশুর ছাদে ওঠার কথা শুনে ওরও ছাদে উঠতে ইচ্ছে করছে। পাহাড়ি রাস্তায় ছাদে যাওয়ার মজাই অন্যরকম। ডিফেন্সে কোনো ঝামেলা না করলেই হয়। ও মিশুকে ধরে ছাদে তুলে দিলো। মিশু ওঠার পর আরাফ ও সায়ান ভেতরে গিয়ে বসলো। ছাদে শুধুমাত্র ওরা দুজন। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর মিশুকে শক্ত করে ধরে রইলো মেঘালয়। মেয়েটা ভয় পেতে পারে। মিশুও শক্ত করে ধরে আছে মেঘালয়কে। গাড়ি ছেড়ে দিলো সাজেকের উদ্দেশ্যে।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৪০

0

অনুভূতি
পর্ব ৪০
মিশু মনি
.
৬৩.
“তুমি ছুলে জল আমি বৃত্ত হয়ে থাকছি,
দু মুঠো বিকেল যদি চাও ছুড়ে দিচ্ছি”
লাইন দুটো দেখে বেশ চমকালো মিশু। ভার্সিটি থেকে ফিরে রুমে ঢুকেই দেখে দেয়ালে কাগজে ঝুলছে লেখাটা। আর বিছানার উপর একটা প্যাকেট রাখা, উপরে ফুল দেয়া। মিশু বেশ অবাক হলো! এগিয়ে এসে ফুলগুলো নিয়ে গন্ধ শুকলো,তারপর প্যাকেট টা হাতে নিয়ে খুললো। খোলামাত্র আরো বেশি মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেলো ওর চোখেমুখে। একটা নীল শাড়ি, সাথে ব্লাউজ ও আছে। ছোট্ট প্যাকেটে নীল চুড়ি, কানের দুল,টিপ। মিশুর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। উপরে একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা, “অগ্নিলাকে দ্রুত দেখতে চাই”। মিশুর মনটা মুহুর্তেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। সমস্ত শরীরে মেঘালয়ের প্রেমের বীজ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
ছুটে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিলো। তাড়াতাড়ি শ্যাম্পু করে নিয়ে গোসল শেষ করে তোয়ালে গায়ে পেঁচিয়ে রুমে আসল। এসে দেখলো মেঘালয় সোফায় বসে আছে। নীল পাঞ্জাবিতে দারুণ শুভ্র দেখাচ্ছে ওকে। কপালের উপর ভেজা চুলগুলো এসে লুটিয়ে পড়েছে। মিশুর ইচ্ছে করছে গিয়ে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে। ও একটু একটু করে এগোতে লাগলো। মেঘালয় দুইপা এগিয়ে এসে মিশুর কোমরে হাত দিয়ে ওকে বুকে টেনে নিলো। মিশু বুক ভরে ঘ্রাণ নিয়ে বলল, “নিউ বডি স্প্রে?”
– “ইয়াপ, জানো তোমাকে দারুণ আবেদনময়ী দেখাচ্ছে।”
– “আর তোমাকে বিপজ্জনক রকমের হ্যান্ডসাম লাগছে।”
– “খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে না?”
মিশু মুচকি হেসে বললো, “এত বড় সারপ্রাইজ হঠাৎ? তোমার না আরো দুদিন পর আসার কথা?”
– “ঘড়ির কাটা এগিয়ে এসেছে ৪৮ ঘন্টা।”
– “যাও, দুষ্টুটা। শাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার।”
– “এবার সেটা পরিধান করে আমাকে ধন্য করুন মহারাণী।”
মিশু মেঘালয়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে শাড়ি পড়ে নিলো দ্রুত। চোখে কাজল টেনে নিলো। মেঘালয় ওর পায়ের কাছে বসে পায়ে আলতা দিয়ে দিলো। তারপর ডান পা তুলে পায়ের উপর চুমু এঁকে দিলো। মিশু আজ বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। মেঘালয় এত সারপ্রাইজ কেন দিচ্ছে আজ!
মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তোমায়।”
– “ইস! আর বলতে হবেনা।”
– “হ্যা, এবার আসো তাড়াতাড়ি খেয়ে নেই। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।”
মিশু মেঘালয়কে নিয়ে খাবার টেবিলে চলে এলো। খাবার খেতে খেতে দুজনাতে গল্প হলো কিছুক্ষণ। মিশু গল্প শুনাচ্ছে ভার্সিটি’র ফ্রেন্ড দের নিয়ে। অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে ওর। তাদের গল্প বলতে বলতে খাওয়া শেষ করে নিলো। মেঘালয় গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মিশুকে আজ বড্ড বেশি অপূর্ব দেখাচ্ছে! এত মায়াবী কেন মেয়েটা?
মিশু খাওয়া শেষ করে বসে বসে বকবক করেই চলেছে। মেঘালয় ওকে নিয়ে এসে রুমে ঢুকলো। মিশুকে বিছানায় বসিয়ে রেখে মিশুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মিশু বকবক করছে আর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেঘালয় মুগ্ধ হয়ে শুনছে শুধু। গল্প করেই সন্ধ্যা পার করে দিলো। সন্ধ্যা পেরোবার পর মেঘালয় বললো, “মিশু, বাইরে বের হবো। চলো।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “এখন! পুরোটা বিকেল বাসায় কাটিয়ে এখন বাইরে? বাইরে ডিনার করার চিন্তা আছে নাকি?”
– “আহা! চলো তো তাড়াতাড়ি।”
মিশুর কাঁধে হাত রেখে ওকে নিয়ে মেঘালয় বাইরে বেড়িয়ে এলো। মিশু বললো, “রোদ আপুকে বলে যাবো না?”
– “আমরা যেখানে যাচ্ছি,রোদ সেখানে আগে থেকেই বসে আছে।”
– “ওহ আচ্ছা। যাচ্ছিটা কোথায় বলবা তো?”
– “উহু, গেলে দেখতে পাবা।”
মিশু ক্রমশই উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। আজ মেঘালয় এত চমকে দিচ্ছে কেন! ছেলেটা মাঝেমাঝে এমন সব কান্ড করে। আজকের বিকেলটা অনন্য একটা বিকেল ছিলো। মেঘালয়ের মাথাটা কোলের উপর নিয়ে বসে বসে গল্প করার সৌভাগ্য অনেক দিন হয়নি। আজ মন খুলে কথা বলেছে ও মেঘালয়ের সাথে।
মেঘালয় মিশুর পাশেই বসলো। আজ ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে। সেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। মিশু বারবার তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। ওর চোখেমুখে কৌতুহল। গাড়ি অনেক্ষণ ধরে চলছে, গন্তব্যে পৌছাচ্ছে না এখনো। মিশু উত্তেজনায় ছটফট করছে শুধু, কোথায় যে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না কিছুই। মেঘালয় ওকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। মিশু বারবার জিজ্ঞেস করছে রোদ কোথায়? কিন্তু মেঘ জবাব দিলোনা।
একটা শো রুমের সামনে এসে গাড়ি থামলে মিশু অবাক হয়ে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। নামার পর সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারলো এটা বাস স্ট্যান্ড। ও মেঘালয়ের পাঞ্জাবি খামচে ধরে বললো, “এখানে কেন?”
সামনে একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। মিশুকে বাসের দরজায় এনে বাসে উঠতে বললে ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বাসে উঠে পড়লো। উঠেই ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। সামনের কয়েকটা সিটে ওর সব পরিচিত ব্যক্তিরা। সায়ান,আরাফ, পূর্ব ও রোদ, নিখিল দুপুর সবাই। ও অবাক হয়ে বললো, “কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বললো, “আমরা সাজেক যাচ্ছি।”
মিশু আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। এত জোরে লাফালো যে বাসের সব যাত্রীরা ওর দিকে তাকালো। মিশু রীতিমত ডান্স দিতে দিতে এসে মেঘালয়ের হাত ধরে ফেললো। ও উত্তেজনায় কাঁপছে, কথাই বলতে পারছে না। দুম করেই সেই মেঘের দেশ সাজেক! উফফ মেঘ ছুঁয়ে দেখা হবে! আনন্দ আর উত্তেজনায় মিশুর পুরো শরীর কাঁপছে, চোখে পানি এসে গেছে।
মেঘালয় এর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে সিটে বসলো। মিশু কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “কাপড়চোপড় নিয়ে যাবো না?”
– “আমাকে অতটা অকর্মা বর ভাবো? তুমি ভার্সিটিতে থাকা অবস্থায়ই লাগেজ গুছিয়ে রোদের রুমে রেখে এসেছিলাম। ও নিয়ে এসেছে।”
মিশু আনন্দে মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো। ওর চোখে পানি এসে গেছে। ঢোক গিলে বললো, “আমরা এখন সত্যিই খাগড়াছড়ি যাচ্ছি? অনেক পাহাড় দেখতে পারবো?”
– “হুম পারবা।”
– “আমরা গিয়ে থাকবো কোথায়?”
– “সব ঠিক করা হয়ে গেছে বাবুই, এত টেনশন করতে হবেনা।”
– “সাজেকে পৌছাবো কিসে করে? শুনেছি ওখানে একটা টেম্পুর মত গাড়িতে যেতে হয়?”
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “চান্দের গাড়ি। সেটাও ঠিক করা হয়ে গেছে বউসোনা।”
মিশু আনন্দে আবারো লাফানোর চেষ্টা করলো, “আচ্ছা তাহলে আমরা সত্যিই সাজেক যাচ্ছি?”
– “হ্যা রে বাবা,সত্যি যাচ্ছি।”
মিশু মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বললো, “তুমি খুব ভালো মেঘ, আই লাভ ইউ মেঘমনি। আই লাভ ইউ।”
মেঘালয় মিশুর চুলে একটা আলতো চুমু দিয়ে বললো, “ভালোবাসি মিশু।”
মিশুর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেঘালয় এত সারপ্রাইজ কেন দিচ্ছে আজ? ছেলেটা খুব বেশি পাগল। কেন যে এত ভালোবাসে! মিশু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ফেলছে ওকে। বাস ছেড়ে দিয়েছে, লাইট নিভিয়ে দিতেই মিশুর আরো আনন্দ হতে লাগলো।
জানালা পুরোটা খুলে দিয়ে মিশু মেঘালয়ের মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে গল্প করতে লাগলো।
– “আচ্ছা মেঘমনি, আমি কি পাহাড়ের উপর থেকে মেঘ ছুতে পারবো?”
– “আমাদের কটেজ থেকেই ছুতে পারবা। রুম থেকে বাইরে বের হলেই ছুতে পারবা।”
মিশু মেঘালয়ের পাঞ্জাবির বুক পকেট খামচে ধরে বললো, “ইস! আমাদের ঘরের জানালা খুললে ঘরে মেঘ ঢুকে যাবেনা?”
– “উম পাগলীটা আমার, কত মেঘ ছুতে পারো তাই দেখার জন্য যাচ্ছি। তুমি ছোঁবে আর আমি দেখবো।”
– “আচ্ছা খুব মজা হবে। ইস! আমার তো সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে গো।”
– “কি যে বলো। আমার মিষ্টি পাগলীটা।”
মেঘালয় মিশুর মাথাটা নিজের কাঁধে নিলো। বাস অন্ধকার, দারুণ বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। মিশু মেঘালয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “রাস্তায় চান্দের গাড়ি থেকে মেঘ দেখা যাবেনা?”
– “সাজেকে গিয়ে দেখতে পারবা। রাস্তায় পাবেনা।”
– “ওহ আচ্ছা। আমাকে পিছন দিক থেকে ধরে রাখবা,আচ্ছা?”
– “তোমাকে বুকের মাঝখানে ধরে রাখবো। আর দুজনে একসাথে মেঘ গায়ে মাখবো।”
মিশু উৎফুল্ল হয়ে বললো, “আমরা মেঘ দিয়ে ভাত খাবো হ্যা?”
– “হ্যা খাবো।”
– “সাথে এক টুকরো আকাশ আর পাহাড় ও থাকবে।”
– “হুম থাকবে।”
– “আমি পাহাড়ের গন্ধ নিবো, মেঘের গন্ধ নিবো, আকাশের বিশালতা নিবো।”
মেঘালয়ের খুব ভালো লাগছে এসব শুনতে। ও আরেকটু উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য বললো, “কেমন হবে বলোতো, আমি সারারাত তোমাকে জ্বালিয়ে ভোরবেলা ঘুমুতে দিয়েছি। যদি আমি খুব ভোরে তোমার ঘুম ভাঙাই? তুমি বিরক্ত হয়ে চোখ মেলবে। চোখ মেলতেই বিছানা থেকে বাইরে চোখ চলে যাবে। চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে, সবখানে মেঘ লেগে আছে। মেঘেরা উড়ে উড়ে আসছে, চারিদিকে শুধু মেঘ আর মেঘ। পুরো পাহাড়ের গায়ে মেঘ লেগে আছে, আর তোমার ও পুরো শরীরে মেঘ লেগে আছে।”
মিশু প্রায় কেঁদে ফেলার মত অবস্থা হয়ে গেলো। এত সুখ কেন! এত সুখ কেন! মেঘালয়ের বুকটা খামচে ধরে রইলো ও। সুখে কান্না আসছে, সুখে ভেসে যাচ্ছে ও। এত সুন্দর কেন সবকিছু? সবখানে মেঘ, পুরো পাহাড়ের গায়ে মেঘ লেগে থাকবে, মিশুর পুরো শরীরেও মেঘ লেগে থাকবে। উফফ! ভাবতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
মিশু মেঘালয়কে জোরে জোরে খামচে ধরছে। মেঘালয় গান গেয়ে উঠলো গুনগুন করে,
“তোমায় ছোঁবে বলে,আদর করবে বলে,
উড়ে উড়ে আসে এলোমেলো কিছু গান..
ডেকে যায় তোমার আঁচল ধরে..
তুমি ছুলে জল,আমি বৃত্ত হয়ে থাকছি..
দু মুঠো বিকেল যদি চাও ছুড়ে দিচ্ছি..”
মিশু মেঘালয়ের হাতে চিমটি দিতে দিতে বললো,”আজকাল গানগুলোও খুব কেমন যেন! গানেও আদর করে দিতে চায়! আর অনুপম রায়ের কণ্ঠে এই শব্দগুলা শুনলে বুকটা আরো ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
– “হুম। আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলো প্লিজ এই লাইনগুলা অনুপম দার গলায় শুনলে আমার দারুণ ফিল হতো। আর ভাবতাম কবে যে একটা ভালোবাসা হবে আমার।”
মিশু হেসে বললো, “সে আমার অজানা নয়। আচ্ছা মেঘমনি, আমরা গিয়ে থাকবো কোথায়? তাবুতে নাকি রুমে?”
– “কাঠের ঘরে থাকবো বউসোনা।”
মিশু উত্তেজিত হয়ে বললো, “ইস! কাঠের ঘরের প্রতি আমার কঠিন রকম দূর্বলতা গো। দোতলায় থাকবো? মেঘ এসে আমাদের গায়ের উপর দিয়ে যাবে? আমার চোখ মুখ ঠোঁট সব ভিজিয়ে দিয়ে যাবে?”
– “তুমি চাইলে মেঘ এখনি এগুলা সব করতে পারে।”
মিশু মেঘালয়ের বুকে কিল বসিয়ে বলল, “খুব খারাপ তুমি।”
– “বারে, এতকিছুর পরও আমি খারাপ?”
মিশু হেসে ওর বুকে মাথা রেখে বললো, “তুমি তো আমার মেঘমনি। আমার কলিজার টুকরা।”
– “আমি একটা টুকরা? আর বাকি টুকরা গুলা কে কে?”
– “কিহ! তুমি খুব পাজি।”
মেঘালয় হো হো করে হাসতে লাগলো। মিশু ক্ষেপে যাচ্ছে। মেঘালয় বললো, “তোমার চুলের গন্ধে আমার ঘুম এসে যায় মিশমিশ। এত নেশা কেন তোমার চুলের গন্ধে?”
– “যাও আর বলতে হবেনা। পাজি লোকটা, দুষ্টু একটা।”
– “আমাদের বাচ্চাটা কিন্তু আমার মত পাজি হবে।”
– “না, আমার মতন ভালো হবে।”
– “তুমি তো বোকা। আমাদের বাবু কখনো বোকা হবেনা।”
মিশু ক্ষেপে বললো, “আমি বোকা?”
– “প্রমাণ চাও?”
কথাটা বলেই মেঘালয় মিশুর ঠোঁট চেপে ধরলো দুই ঠোঁট দিয়ে। ছেড়ে দিতেই মিশু ওর বুকে মাথা রেখে জাপটে ধরলো। মেঘালয় বলল, “দেখেছো তোমাকে ঘায়েল করা কত সহজ?”
মিশু জোরে জোরে দুটো কিল দিয়ে বললো, “যাও খারাপ টা।”
সামনের সিটে নিখিল ও দুপুর বসেছে। নিখিল পিছন দিকে মুখ করে না তাকিয়েই বললো, “এখনো তোমাদের প্রেম দেখি বিয়ের প্রথম দিনের মতই আছে।”
মেঘালয় বললো, “না। মেঘালয়ের মেঘালয়া পুরনো হয়ে গেছে। আমি জোর করে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি।”
মিশু মেঘালয়কে আবারো মাইর শুরু করে দিলো, “আমি পুরনো হয়ে গেছি? আমি পুরনো হয়ে গেছি?”
মাইর খেয়ে মেঘালয় বললো, “না না। আমার মেঘালয়া সবেমাত্র নাবালিকা থেকে কৈশোরে পদার্পণ করছে। থার্টি সিক্স টুয়েন্টি ফোর থার্টি সিক্স।”
নিখিল হেসে উঠলো। মিশু ক্ষেপে জানালা দিয়ে বাইরে মাথা বের করে দিলো। মেঘালয় টেনে এনে ওর মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে বললো, “বাইরে মাথা রাখবা না।”
মিশু ওর কাঁধে মাথাটা গুঁজে দিয়ে হাত ধরলো মেঘালয়ের। মেঘালয় মিশুর আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে বললো, “কতবার তোর বাড়ি গিয়ে গিয়ে ফিরে এলাম, আমার মতে তোর মতন কেউ নেই।”
– “আমার মতেও তোমার মতন কেউ নেই মেঘ।”
– “মেঘের দেশে নিয়ে যাচ্ছি তোমায়-
পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে নক্ষত্রের ছায়া, মেঘালয়ার চোখে মেঘালয়ের মায়া।”
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৯

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৯
মিশু মনি
.
৬১.
আজ মেঘালয়ের বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী।
ওনারা মিশুকে নিয়ে যেতে বলেছেন বাসায়। মিশু সাজগোজ করে বসে আছে, মেঘালয় আসবে ওকে নিতে। মাঝখানে অনেক গুলো দিন কেটে গেছে ওর বন্ধুদের কারো সাথে দেখা হয়নি। আজ অনেক দিন বাদে সবার সাথে দেখা হবে ভেবে মিশুর খুব আনন্দ হচ্ছে। রৌদ্রময়ী ও শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলো। কালো শাড়িতে ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
মেঘালয়ের সাথে এখন তিনদিন পরপর মিশুর দেখা হয়। আজকেও তিনদিন পর দেখা হতে যাচ্ছে। একদিন দেখা হওয়ার পর বাকি তিনটা দিন মিশু খুব প্রতীক্ষায় থাকে। অবশ্য মিশুর চেয়ে মেঘালয়ের বেশি চিন্তা হয় মিশুর জন্য। ওর ইচ্ছে করে সারাক্ষণ মিশুকে আগলে রাখতে। কিন্তু সেটা তো আর হয়ে ওঠে না। বড্ড মন কেমন করে ওর।
মেঘালয় মিশুকে দেখেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। কানে ফিসফিস করে বললো, “দিনদিন তোমার ফিগার তো কোকাকোলার মতন হয়ে যাচ্ছে।”
মিশু মুখটা কালো করে বললো, “টাইগার কেন নয়? আমার তো টাইগার এনার্জি ড্রিংকস বেশি পছন্দ। টাইগার ক্যান কিংবা স্পিড অথবা স্পিরিট।”
মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। মিশুর কোমরে হাত রেখে এগিয়ে এসে কানেকানে বললো, “সেগুলা তো আর তোমার ফিগারের মতন না। একমাত্র কোকাকোলাই মেয়েদের ফিগারের আকারের মতন করে বানানো হয়েছে।”
মিশু লজ্জায় মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বললো, “কি খারাপ তুমি! এভাবে কেউ বলে!”
– “হুম,আমার ই তো বউ। আমি বলবো না?”
– “যাও, খারাপ একটা লোক।”
– “অবশ্য তোমাকে এখনো নিতান্তই বাচ্চা বাচ্চা লাগে। থার্টি সিক্স,টুয়েন্টি ফোর, থার্টি সিক্স হতে আরো বছর খানেক লাগবে।”
– “মানে!”
মেঘালয় দুষ্টুমি হাসি হেসে বললো, “সেসব একটু ক্রিটিক্যাল অংক। এখন বুঝবা না, আগে বড় হও তারপর বুঝবা।”
বলেই শব্দ করে হাসতে লাগলো। আর মিশু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষেপতে লাগলো। কি বাজে একটা লোক! সারাক্ষণ জ্বালায় ওকে। অথচ এই লোকটাকে দেখার জন্যই তিনটা দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে ও। মেঘালয় কাছে এলে সময় গুলো খুব দ্রুত কেটে যায়,আর মেঘালয় যখন দূরে থাকে সময় যেন কাটতেই চায়না। সুখের সময় গুলো বড্ড বেশি দ্রুত চলে যায়।
মেঘালয় মিশুর গলায় মুখ ডুবিয়ে ইচ্ছেমত আদর করে দিচ্ছে। মিশু উত্তেজনায় ছটফট করছে শুধু। আজ থেকে চার মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে,তখন কিছুই বুঝত না মিশু। অথচ আজকাল মিশুই অপেক্ষা করে থাকে কখন একটু মেঘালয়কে একান্তভাবে কাছে পাবে।
মেঘালয় বাথরুমে ঢুকে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। মিশু সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগলো। মেঘালয়কে আজকাল পেলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করেনা। এত কম সময়ের জন্য ছেলেটা কেন আসে? সাজেকে যাওয়ার প্লান ছিলো সেই বিয়ের আগ থেকে, অথচ এখনো যাওয়া হয়ে উঠলো না। বিয়ে আর সিলেট ট্যুরের খরচের ঝাকিটা সামলে নিতেই কয়েকদিন কেটে গেছে। তার উপর নতুন সংসার, ভার্সিটিতে ভর্তি সবকিছু করতেই অনেক টাকা চলে গেছে। মেঘালয়ের রেগুলার রিহার্সাল থাকে, নতুন নতুন এলবামের জন্য গান করাতে ব্যস্ত থাকে ও। আর মিশু ভার্সিটিতে যায়,ক্লাস করে বাসায় ফিরে শুয়ে বসে বই পড়ে সময় কাটায়। এত সুখের জীবন ভালো লাগেনা। একটু কষ্ট না থাকলে জীবনকে জীবন মনেই হয়না।
রেডিও প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব যখন মিশুকে দেয়া হয়েছিলো মিশু খুব নিঁখুত ভাবে করে দিয়েছে। মেঘালয় আগেই ওকে সবকিছু দেখিয়ে এনেছে, টানা এক সপ্তাহ কঠিন সব প্রাক্টিস করতে হয়েছে। রেজাল্ট ও ভালোই হয়েছে। এখন যেকোনো একদিন মিশুর প্রথম জকির ডিউটি শুরু হবে, সেই অপেক্ষাতেই আছে ও। মেঘালয় আশাবাদী, মিশু একদিন নামকরা রেডিও জকি হবে। কিন্তু মিশুর আর কিছুই ভালো লাগেনা এখন, ওর শুধু সারাক্ষণ মেঘালয়কে নিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। সেই চার মাস আগে মেঘালয়ের যে অবস্থা হয়েছিলো, এখন ওর সেরকম হচ্ছে। সবসময় মেঘালয়কে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মেঘের এখন সময় নেই।
মেঘালয় বাইরে এসে মিশুকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো, “কি ভাবছো?”
মিশু উঠে এসে মেঘালয়ের কলার টেনে ধরে ওর বুকে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। আদুরে গলায় বললো, “আমাকে ৩৬ ঘন্টা সময় দিবা মেঘ?”
মেঘালয় মিশুর পেটে হাত রেখে ওকে টেনে আরো কাছে নিয়ে বললো, “৩৬ ঘন্টা শরীরে শরীরে খেলা হবে?”
– “উফফ এভাবে বলো কেন? শিউরে উঠি আমি।”
– “শিহরণ বইয়ে দেয়ার জন্যই তো বলি। হঠাৎ এই আবদার?”
– “তুমি আজকাল বড্ড বেশি ব্যস্ত থাকো। আমার একা একা সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে বসে টিভি দেখা ছাড়া আর কাজ নেই। এভাবে আমার ভালো লাগেনা। তিনটা দিন পর তুমি আসো, তাও একটা রাতের জন্য। সেটা চোখের পলকে কেটে যায়।”
মেঘালয় হেসে বললো, “সেটাই তো ভালো। প্রতিদিন কাছে পেলে এত সুখ হবেনা।”
– “জানি। কিন্তু সবসময় একসাথে থাকলে তোমাকে খাইয়ে দিতে পারতাম, একসাথে বসে টিভি দেখা,গল্প করা সবকিছু করতে পারতাম। তুমি আজকাল সারাদিনে একবার কলও দেয়ার সময় পাওনা।”
মেঘালয় হেসে বললো, “আহারে! আমার বউটার অভিমান হয়েছে বুঝি?”
– “হবেনা? রাতে ফ্রি হয়ে কল দাও সেই ১২ টার পর। তখন তুমি প্রচণ্ড টায়ার্ড থাকো, আমার খারাপ লাগে তোমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে। সেজন্য দশ মিনিট কথা বলেই রেখে দেই। এতে আমার সুখ হয়না মোটেও। কতদিন একসাথে বসে গল্প করিনা ভাবো তো?”
-“বুঝেছি, একটানা ৩৬ ঘন্টা আদর করতে হবে সেটা না বলে এখন আমাকে রূপকথা শুনাচ্ছো।”
– “তুমি খুব খারাপ। অতকিছু চাইনা,তুমি অনেক্ষণ আমার সামনে বসে থাকো তো আমি দেখি।”
– “আজকে আমাদের বাসায় যাচ্ছো তো, সারারাত দেখবা।”
– “একদম একান্তই আমার করে,নিজের মত করে।”
মিশুর মন খারাপ করা মুখটা দেখে মেঘালয় ওর নাকটা টেনে দিয়ে বললো, “তুমি Rj হয়ে গেছো, এখন ডিউটি শুরু হোক তারপর দেখবো এত সময় পাও কই?”
– “আমি কখনোই এত ব্যস্ততা দেখাবো না। যতটা তুমি দেখাও।”
মিশুর অভিমানী গলা শুনে মেঘালয় হেসে ফেললো, “আচ্ছা তবে কি করতে হবে বলো? ৩৬ ঘন্টার কর্ম অবরোধ দিয়ে তোমার সামনে বসে থাকতে হবে?”
– “সাজেকে….”
কথাটা বলেই থামলো মিশু। মেঘালয় চোখ নাচিয়ে বললো, “উম ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছো তো।”
– “হ্যা, আমার ডিউটি শুরু হওয়ার আগেই একটা ট্যুর দিয়ে আসি।”
– “ট্যুর বলছো কেন? বলো হানিমুন। চারমাস পর হানিমুন। আহ! কি সুখ!”
মিশু মেঘালয়ের বুকে দুটো কিল বসিয়ে বললো, “তুমি দিনদিন বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছো। পাজি লোকটা।”
মেঘালয় হো হো করে হাসলো। মিশুর অভিমানী গলার কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছে। ও মনেমনে প্লান করে ফেললো সবকাজে বিরতি দিয়ে তিনটা দিন সাজেক থেকে ঘুরে আসতে। সত্যিই অনেক দিন থেকে কাজ নিয়ে এতবেশি ব্যস্ত ছিলো ও, মিশুর সাথে একাকী ভাবে সময় কাটানোই হয়নি। মেয়েটার মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সবকিছুর আগে মিশু,কাজ জলে যাক। মিশুকে দুম করেই একটা সারপ্রাইজ দিয়ে দেবে ও।
মিশু ও রোদকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ও। দুপুর এখন নিখিলের সাথে থাকে। গত সপ্তাহে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দুপুর ও অরণ্য দুজনের বাবাকেই বাসায় ডেকে এনে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছে ওরা। অবশ্য পুরো ক্রেডিট টাই মেঘালয়ের। মেঘালয় সবকিছু ম্যানেজ না করলে এত তাড়াতাড়ি হয়ত তালাকের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হতোনা। সবকিছু ভালোভাবেই মিটে গেছে। অরণ্য দুপুরের কোনোরকম খোজ পায়নি,ঝামেলা করা তো দূরের কথা। মেঘালয় মনেমনে ভাবছে সাজেকে গেলে ওদেরকেও নিয়ে যেতে হবে। সদ্য বিয়ে হয়েছে ওদের,বিয়ের পর একটা হানিমুন হয়ে যাক।
৬২.
মেঘালয়ের মা মিশুকে দেখেই খুশি হয়ে উঠলেন। একমাত্র ছেলের একমাত্র প্রিয়জন, মেয়ের মত না দেখলে মেঘালয় কষ্ট পাবে। কয়দিন পর মিশু এ বাড়ির ই বউ হবে, অযথা দূরে রেখে লাভ ই বা কোথায়?
মিশু একটা শাড়ির প্যাকেট মায়ের হাতে দিয়ে বললো, “আপনাকে আজকে আমি বিয়ের কনে সাজিয়ে দিবো। আর বাবাকে বর সাজিয়ে দিবো।”
মা হেসে বললেন, “দিও। কিন্তু বাসর ঘর না সাজালে আমি বউ সাজবো না মোটেও।”
সবাই হা হয়ে গেলো এরকম কথা শুনে। মিশু ভেবেছিলো মা হয়ত লজ্জায় লাল হয়ে যাবেন। কিন্তু মায়ের এমন উত্তর শুনে ওর হাসি পেলো। ওর হাসি দেখে সবাই হাসতে লাগলো। মেঘালয়ের মা মিশুকে বললেন, “আগে একটু নাস্তা করে নাও সবাই মিলে। তারপর যা করার করো।”
নাস্তার টেবিলে বসে সবাই চিল্লাচিল্লি করে নাস্তা খাচ্ছে। অনেক দিন পর মিশুকে পেয়ে সায়ান আর পূর্ব দারুণ খুশি। মেয়েটাকে ছাড়া আড্ডা জমেই না যেন। মিশু নতুন Rj হয়েছে, সেই ট্রিট নিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিলো ওরা। দীর্ঘদিন পর পূর্ব রোদকে দেখতে পেয়ে একটু উত্তেজিত। মনেমনে একটু ফিলিংস জন্মেছিলো ওর প্রতি। সেই কনসার্টের রাতের পর মাত্র একদিন দেখা হয়েছিলো, সেরকম কথা হয়নি। তারপর আজকে দেখা। আজও একটু একটু অন্যরকম ফিল কাজ করছে ভেতরে।
মা মিশুকে জোর করে করে নাস্তা খাওয়াচ্ছেন। মিশু বললো, “আমার আম্মুও আমাকে এত আদর করেনা হয়ত।”
– “আমি কি তোমার আম্মু নই? নাকি শুধু নামের আম্মু?”
– “আপনি আমার মা। আমার কলিজার টুকরা।”
বলেই ওনাকে জড়িয়ে ধরলো মিশু। মেঘালয় তো সবসময় কাজে ব্যস্ত থাকে। মিশুর একা একা লাগলেই ও এসে শ্বাশুরি মায়ের সাথে গল্পে মেতে উঠতো। দুজনের বেশ গলায় গলায় ভাব জমে গেছে। উনি মিশুকে বললেন, “এবার তো নিজের একটা পরিচয় হতে চলেছে তোমার। এখন ওটা তোমার ক্যারিয়ার প্লাস প্রফেশন ও। এবার তোমার মা আর বোনকে ঢাকায় নিয়ে এসো ”
মেঘালয় বললো, “আমিও তাই ভাবছিলাম। ওনাদেরকে এখানে নিয়ে এসে রাখুক।”
মিশু করুণ দৃষ্টিতে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। ওর তো বাসায় একা একা থাকতে হয়। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে। তবুও মাকে নিয়ে আসার কথা ভাবেনা ও। কারণ ওরা এখানে এসে থাকলে মেঘালয় আসবে কিভাবে? তখন যদি মেঘালয়ের সাথে এইটুকু সময় ও একসাথে থাকা না হয়,মিশু মরেই যাবে। তিনদিন পর দেখা হয়েও ওর কত কষ্ট হয়। একেবারেই না হলে মেনে নেয়া যাবেনা।
মেঘালয় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপার টা অনুধাবন করতে পেরেছে। ও ইশারায় বুঝালো, “আমি তো আছি, চিন্তা করোনা।”
মিশু মাথা ঝাঁকাল। নাস্তা শেষ করে নিয়ে ও মাকে শাড়ি পড়ে দিলো। একদম নতুন বউয়ের মতন সাজগোজ করিয়ে দিলো। মেঘালয়ের বাবা এখনো বাসায় ফেরেন নি। এদিকে সবাই মিলে আনন্দ, হৈ চৈ করতে লাগলো। পূর্ব বারবার তাকাচ্ছে রোদের দিকে। মিশু ওদিকে মাকে নিয়ে রুমে সাজুগুজু করিয়ে দিচ্ছে আর মেঘালয় এদিকে বন্ধুদের সাথে প্লান করে ফেললো সাজেকে যাওয়ার। অনেক দিন থেকে সবাই মিলে একসাথে সময় কাটানো হয়না। সায়ান,পূর্ব,আরাফ,রোদ, দুপুর এদেরকে নিয়ে একটা পরিবারের মতন হয়ে গেছে। পরিবারটাকে ছাড়া সাজেকে গিয়ে কি আনন্দ হবে? মিশু শুনলে নিশ্চয়ই আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিবে।
মিশু একাই ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজিয়ে দিলো। কাউকে আসতেও দিলোনা রুমে। মেঘালয় মনেমনে ভাবছে, মেয়েটা আসার পর থেকেই ব্যস্ত। রুম থেকে বের হওয়ার ই সময় পাচ্ছেনা। কোথায় ভাবলাম সারাক্ষণ ওর সামনে বসে থাকবো, সেটা আর হলোনা। মিশুর জন্য এখন মন কেমন করছে ওর। যত দ্রুত সম্ভব সাজেকে যেতে হবে। আচ্ছা, পরশু গেলে কেমন হয়?
সায়ান সম্মতি দিয়ে বললো, “সেটাই ভালো হবে। তবে কেউ মিশুকে কিছু বলবো না আগেই, ওর জন্য এটা একটা গ্রেট সারপ্রাইজ হবে।”
মেঘালয়ের মনটাও আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ও আর স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। সাজেকে যাওয়ার সমস্ত প্লান সেরে ফেললো সবাই মিলে। চাঁদা ঠিক করা হলো, দুপুর আর নিখিলকেও ফোন দিয়ে দাওয়াত করা হলো সাজেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ওদের সদ্য বিয়ে হয়েছে তাই ওদের চাঁদাটা ওরা বন্ধুরা সবাই মিলে দেবে ঠিক করা হলো।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৮

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৮
মিশু মনি
.
৫৯.
মিশু বাইরে আসতেই করিডোরে মেঘালয়কে দেখতে পেলো। মেঘালয় ওর হাত ধরে ওকে নিয়ে একটা গ্যালারিতে ঢুকে গেলো। সবাই প্রোগ্রামে গান শুনতে ব্যস্ত। মেঘালয় মিশুর চোখ মুছে দিয়ে বললো, “কাঁদছিলে কেন তুমি?”
মিশু বললো, “তোমাকে ওরকম ফর্মাল ভাবে দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছিলো”
মেঘালয় আচমকা জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। মিশুও শক্ত করে হাতের বাঁধনে ওকে ধরে ফেললো। ছেড়ে দেয়ার পর আশেপাশে তাকিয়ে মিশু বললো, “ভাগ্যিস এখানে কেউ নেই। তুমি এমন পাগল কেন বলোতো? যদি কেউ দেখে ফেলতো তাহলে তো নির্ঘাত মিডিয়ায় চলে যেতো। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতামাতি শুরু হয়ে যেতো।”
মেঘালয় বললো, “আমি আর কক্ষনো গান গাইবো না। কক্ষনো কিচ্ছু করবো না। লোকজন যেন আমাকে না চেনে। আমি সাধারণ একটা মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু কেন?”
– “আমি তোমাকে ছেড়ে একটা মুহুর্ত থাকতে পারিনা। যখন তখন তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না, দেখতে পারবো না, ছুতে পারবো না। লোকজন সেলিব্রেটির কাতারে ঢুকে দিয়ে সেসব নিয়ে মজা নেবে। সেলিব্রেটিরা স্বাধীনভাবে প্রেম ও করতে পারেনা। আমি চাইনা এই সুনাম,যশ। আমার চাইনা কিচ্ছু।”
মিশু হেসে ফেললো।মেঘালয় সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। ও হাসতে হাসতে বললো, “এরকম বললে কি হবে? আমিতো চাই তুমি অনেক বড় হও।”
– “হুশ, আমার লাগবে না ওসব। আমি তোমাকে নিয়েই থাকতে চাই,আর কিচ্ছু চাইনা।”
– “আল্লাহ! এই প্রখর আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন মেঘালয়ের এ কি হাল! সে প্রেমে পড়ে পুরাই পাগল হয়ে গেছে। তার মাথা গেছে।”
মেঘালয় মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আমি প্রেমের নতুন ইতিহাস রচনা করে যাবো বলেছি না? রোমিও জুলিয়েটের মতন আমাদের প্রেম কাহিনী লোকে জানবে।”
– “যাও, অত লাগবে না। তুমি এখন পাগলামি ছাড়ো।”
এমন সময় একজন লোক এদিকে আসায় মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে ছিটকে সরে দাঁড়ালো। লোকটি কাছে এসে বললো, “আরে মেঘালয় না?”
তারপর ভ্রু কুঁচকে মিশুর দিকে তাকালো। মেঘালয়ের সাথে দুটো কথা বলেই লোকটি চলে গেলো। মিশু বললো, “এখানে আবার সিসি ক্যামেরা লাগানো নেই তো?”
– “থাকলে থাকবে। আমার বউকে আমি যখন খুশি ভালোবাসবো। কার কি?”
মিশু হো হো করে হেসে উঠলো- “মেঘমনি, শীঘ্রই আমাকে পাগলের ডাক্তারি শিখতে হবে মনেহচ্ছে।”
– “হু,তুমি আমার মিসির আলী। তুমি একটা করে ডোজ দিলেই হবে।”
মিশু হাসতে হাসতে বললো, “আমি মিসির আলী? হা হা হা।”
মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে মিশুকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত আদর করে দিতে। কিন্তু পারছে না কিছু করতে। ওর মাথা গরম হয়ে উঠেছে। রাগ হচ্ছে কোনো অজানা কারণে। মিশুর হাত ধরে ওকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো। বের হওয়ার সময় মিশুর হাত ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে হাঁটতে লাগলো। ব্যাগ নিচে রেখে যেতে হয়েছিলো। মিশু ব্যাগ নিচ্ছিলো আর মেঘালয় দাঁড়িয়ে থেকে রাগে ফুঁসছিলো। সেখানে বসে থাকা গার্ডরা মেঘালয়কে কিছু জিজ্ঞেস করতেই ও রেগে রেগে উত্তর দিচ্ছিলো। মিশু বুঝতে পারছে না মেঘালয়ের এত রাগ কোথ থেকে আসলো?
বাইরে বের হয়ে রাস্তায় চলে এলো সোজা। মিশু ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে অথচ ওর হাত ধরতে পারছে না ভেবে মেঘালয় রাগে লাল হয়ে গেলো। মিশু শুধু হো হো করে হাসছে। একটু আগে স্টেজে ফর্মাল ড্রেসে গান গাওয়া মেঘালয় আর এই মেঘালয়ের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। ওই মেঘালয় একজন আর্টিস্ট, আর এই মেঘালয় একজন প্রেমিক!
মিশু হাসছে আর ওর পাশে হাটছে। মেঘালয় হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলার পর বললো, “শালার ড্রাইভার এখন মোহম্মদপুরে।”
মিশু হাসতে হাসতে বললো, “তোমার হয়েছে কি হঠাৎ বলোতো? এরকম পাগলামি কেন করছো?”
– “আমাকে পাগলা কুত্তা কামড়িয়েছে।”
– “হা হা হা।জলাতঙ্ক হয়েছে?”
– “না, আমার রোগের নাম মিশুয়াসক্তি। মানুষের যেমন মাদকাসক্তি হয়, আমি সেরকম মিশু আসক্ত হয়ে পড়েছি। আমার এখন নেশাদ্রব্য লাগবে। যারা নেশাখোর, তারা নেশাদ্রব্য না পেলে এরকম পাগল হয়ে ওঠে।”
মিশু আবারো হেসে উঠলো। মেঘালয়কে চিনতে ওর সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। হাইওয়েতে প্রচুর ভিড়। এই কোলাহলময় জায়গায় একদম ই ওর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছে না এসব। ও মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কোথায় যেতে যাও এখন?”
– “কোথায় বলতে? আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও?”
মেঘালয় দুহাতে মাথা চুলকাতে লাগলো। আজকে ওর কনসার্ট, আর সেখানে বাইরে দাঁড়িয়ে এরকম পাগলামি কেন করছে বুঝে উঠতে পারছে না মিশু। মেঘালয় ঠিক আছে তো? পাগলামি করছে ভীষণ। মিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে। মেঘালয় সামনে তাকিয়ে বললো, “ওটা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় না?”
– “হ্যা, কেন?”
– “আসো মেডিকেলে যাবো।”
মিশু থতমত খেয়ে বললো, “মেঘ তুমি ঠিক আছো? মেডিকেলে কেন যাবা?”
– “মর্গে যাবো মর্গে। মেডিকেলে মানুষ কেন যায়? অসুস্থ হলে যায়। আমি এখন অসুস্থ হয়ে গেছি তাই আমাকে যেতে হবে।”
মিশুর এখন চিন্তা হচ্ছে মেঘালয়ের জন্য। এরকম পাগলামি ও কেন করছে আজকে? কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি তো? মুখটা গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে রইলো ও।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “মেডিকেলে যাবা না?”
– “আজব তো, মেডিকেলে গিয়ে আমরা করবো টা কি?”
– “আচ্ছা তাহলে যেতে হবেনা। আমি একাই যাবো।”
মেঘালয় একটা রিক্সা ডেকে বললো, “মামা শিল্পকলায় যাবেন?”
তারপর রিক্সায় উঠে পড়লো। মিশু থতমত খেয়ে সাথে রিক্সায় উঠে পড়লো। মেঘালয় বললো মেডিকেলে যাবে আবার রিক্সাকে বললো শিল্পকলায় যাবে। কি হচ্ছে ওর ভেতরে? এত রেগে আছে যে কিছু জিজ্ঞেস করাও যাচ্ছেনা। মিশু শুধু চুপচাপ চেয়ে আছে ওর দিকে। মেঘালয়ের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে।
রিক্সাকে দ্রুত যেতে বললে উনি খুব দ্রুত চালাতে লাগলেন। রাস্তার এপাশে অসংখ্য ফুলের দোকান। মেঘালয় একগাদা ফুল কিনে নিলো সেখান থেকে। মিশু ওর আচরণে অবাক হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় আবারো এসে রিক্সায় উঠে রাগে ফুঁসতে লাগলো। রিক্সা শিল্পকলায় এসে থামলে ও ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মিশুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। লিফটের ভেতর মিশুকে কাছে টেনে নিয়ে এত জোরে বুকে চেপে ধরলো যে মিশুর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো। এবার বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে মিশু। মেঘালয় কি সত্যিই কোনো সমস্যায় ভুগছে?
লিফট থেকে বেড়িয়ে একজনকে কল দিতেই গ্যালারির দরজা খুলে একজন মহিলা বের হলেন। মেঘালয়ের মায়ের মতই দেখতে উনি। মেঘালয়কে দেখে জিজ্ঞাস করলেন, “কিরে তোর কনসার্ট কেমন হলো?”
– “কনসার্টের গুল্লি মারি। আমি ছেড়ে দেবো এসব।”
উনি অবাক হয়ে একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে মেঘালয়কে বললেন, “মাথা খারাপ হয়েছে তোর? এরকম দেখাচ্ছে কেন তোকে?”
– “গাড়ির চাবিটা দাও।”
– “চাবি দিচ্ছি,কিন্তু বলবি তো কি হয়েছে?”
– “আমার এই শহরে একদম দম বন্ধ হয়ে আসছে। আচ্ছা, কোন দেশে গেলে কেউ আমার দিকে তাকাবে না বলোতো?”
উনি অবাক হয়ে বললেন, “এটা কেমন কোয়েশ্চেন মেঘ? লোকজন তোর দিকে কেন তাকাবে না? তুই যেখানেই যাবি সেখানেই লোকজন তোর দিকে তাকাবে। কি হয়েছে বলবি?”
– “চাবি চেয়েছি,চাবিটা দাও। আমাদের শালার ড্রাইভার এখনো বাড়িতে। বারবার বলেছি তাড়াতাড়ি এসে থাকতে। সে এখনো আসেনাই। চাবি কি দিবা? নাকি চলে যাবো?”
মহিলাটি থতমত খেয়ে ভেতরে ঢুকে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে এনে মেঘালয়ের হাতে দিলেন। বললেন, “ভেতরে আয়। মিটিং হচ্ছে আমাদের।”
– “মিটিং এর গুল্লি মারি। আমি এমন এক জায়গায় চলে যাবো যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না। কেউ না।”
– “তাহলে জংগলে যা।”
– “ভালো আইডিয়া তো। এবার জংগলেই চলে যাবো। অসামাজিক হয়ে যাবো। আর এইযে মেয়েটাকে দেখছো, এটা আমার বউ। সময় পেলে তোমার বাসায় নিয়ে যাবো। আজকে সময় নেই।”
– “বউ!”
– “হ্যা, আমার জিন্দেগি ওলট পালট করে দিয়েছে মেয়েটা। ওর ভয়েস খুব মিষ্টি। তুমি ওকে গান শেখাবা? ও গান গাইবে, আর আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ে যাবো।”
– “হঠাৎ এই ইচ্ছে কেন? আর তুই কেন এরকম বিক্ষিপ্ত হয়ে আছিস আমাকে বলতো?”
– “সেলিব্রেটি অন মাই ফুট, ফালতু লাগছে লাইফটা। যেখানে কেউ চেনেনা, সেখানে গিয়ে আরামে বাস করবো।”
মহিলাটি কি ভাবলেন কে জানে। উনি মিশুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা মেঘের কি হয়েছে বলোতো? ও এরকম কেন করছে? উদ্ভট আচরণ। এরকম কখনো দেখায়নি ওকে।”
মিশু চিন্তিত মুখে বললো, “আমি তো জানিনা। নিজেও বুঝতে পারছিনা হঠাৎ এরকম কেন করছে।”
– “আচ্ছা, আমার বাসায় এসো তখন আলাপ হবে,মেঘালয় রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়। ওকে রাগিও না।”
মিশু ঘাড় বাঁকিয়ে আচ্ছা বললো। মেঘালয় সেখান থেকে চলে এলো। মিশু থতমত খেয়ে চলে এলো ওর পিছুপিছু। মেঘালয় বলল,উনি আমার মেজো খালামনি। মিশু কোনো শব্দ করলো না। মেজো খালামনি খুব ভালো মনের আর মিশুক মানুষ সেটা ওনার কথা শুনেই বোঝা গেছে। কিন্তু মেঘালয় হঠাৎ এরকম আচরণ করছে যে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মিশুর। মেজো খালামনির সাথে একটু ভালো মতো দেখা করিয়ে দিলেও পারতো।
খুব দ্রুত গাড়ি চালালো মেঘালয়। গাড়িতে একটাও কথা বললো না মিশুর সাথে। মিশুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। শুধু হা হয়ে দেখছিলো মেঘালয়ের অদ্ভুত রূপটাকে।বাসায় ফিরে গাড়ি থেকে নেমে কোলে করে মিশুকে রুমে নিয়ে এলো। মিশু চোখ বড়বড় করে মেঘালয়কে দেখছে। ওকে বিছানায় জোরে ছুড়ে ফেলে দিয়েই দুহাতে মিশুর গলা টিপে ধরে বললো, “আজকে তোকে আমি খুন করে ফেলবো ”
এত জোরে গলা টিপে ধরায় মিশুর জিভ বেড়িয়ে এলো। মেঘালয় কি সাইকো হয়ে গেলো হঠাৎ করে? এরকম কেন করছে বুঝে আসছে না কিছুতেই। দুহাতে গায়ের জোরে মিশুর গলার টিপে ধরেছে যে আরেকটু হলে মরেই যাবে মিশু। মিশু দুহাত দিয়ে মেঘালয়ের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।
মেঘালয় নিজে থেকেই হাত ছেড়ে দিয়ে হাফাতে লাগলো। মিশুর গলায় এত জোরে টিপে ধরেছিলো যে দাগ হয়ে গেছে। মিশু নিজের গলায় হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। মেঘালয় মিশুকে এক হাতে বুকে টেনে নিয়ে আরেকহাতে ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিলো। মুখটা করুণ করে বললো, “ইস! দাগ বসে গেছে। খুব ব্যথা পেয়েছো তাইনা?”
মিশু অবাক হয়ে গেছে একদম। গলা টিপে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করে আবার জিজ্ঞেস করছে ব্যথা পেয়েছে কিনা! এ কেমন আচরণ?
মেঘালয় মিশুর গলায় ঠোঁট রেখে গভীরভাবে চুমু দিলো। অনেক্ষণ ওকে বুকে চেপে ধরে থাকার পর ছেড়ে দিয়ে মেঘালয় একটু শান্ত হলো। কিন্তু ওর চোখেমুখে এখনো রাগ। মিশুর চোখে পানি এসে গেছে। ও জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে তোমার মেঘ? আমাকে কেন মেরে ফেলতে চাইছো?”
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে বললো, “তুমি কেন সায়ানের হাত ধরে বসেছিলে? সায়ান কেন তোমার গাল ছুঁয়ে দিলো?”
মিশু একটু বেশিই অবাক হলো। মেঘালয়কে সত্যিই চিনতে পারছে না ও। সায়ান ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। একটু হাত ধরলে কি হয়েছে তাতে? আর তাছাড়া মিশু কিংবা সায়ানের কারোরই অন্য কোনো লক্ষণ ছিলোনা। ওরা একে অপরকে ভাই বোনের মতই দেখে। মেঘালয় কি সেটা জানেনা?
মেঘালয় বললো, “তুমি জানো না তোমাকে আর কেউ টাচ করলে আমি সহ্য করতে পারিনা। ওর হাত ধরে বসে ছিলে,ওর বাহু ধরেছিলে শক্ত করে। ও তোমার গাল ছুঁয়ে দিবে কেন? বের হওয়ার সময় তোমার কাঁধে হাত রাখবে কেন?”
মিশু বললো, “সায়ানের তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা। ও তোমার বন্ধু। আমার ভাইয়ের মতন।”
মেঘালয় দুহাতে মিশুর হাত ধরে বললো, “আমি মানতে পারিনা আর কেউ তোমাকে ছুঁয়ে দেখলে। আমার অসহ্য লাগে।”
– “তুমি পাগল হয়ে গেছো এটা কি বিশ্বাস করো মেঘ?”
– “হুম হয়তবা হয়ে গেছি। তুমি আমার মাঝে নেশা ধরিয়ে দিয়েছো। আমার যখন তখন তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পারিনা। বাইরে গেলে লোকজন তাকিয়ে থাকে কেন?”
– “লোকজন তো তাকিয়ে থাকবেই। আমাদের সমাজে এরকম কিছুর প্রচলন নেই।”
– “কোন সমাজে আছে? আমি সেখানে চলে যাবো। বাইরে গিয়ে থাকতে পারবা?”
– “দেশের বাইরে? তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো মেঘ। তোমার মাথা নির্ঘাত খারাপ হয়ে গেছে। একবার বলছো সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষ হয়ে যাবা, আরেকবার বলছো দেশের বাইরে চলে যাবা।”
মেঘালয় মিশুর বুকে মাথাটা গুঁজে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমাকে কখনো কষ্ট দিওনা মিশু। আমি তোমাকে ছাড়া আর কোনোকিছুই ভাবতে পারছি না। আমার সবকিছু জুড়ে তুমি বিরাজ করছো। আমাকে একটু আগলায় রাখবা?”
মিশুর চোখে পানি এসে গেছে। মেঘালয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। যে মানুষ টার ব্যক্তিত্বের জন্য সবাই ওকে শ্রদ্ধা করতো, আজ সে মানুষ টা ওর কাছে দূর্বল হয়ে গেছে। ভালোবাসা কি এমন ই? একজন আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন মানুষ কেও শিশুসুলভ বানিয়ে দেয়। মেঘালয় একদম দূর্বল হয়ে গেছে ওর প্রতি। ওর নিজের বলতে আর কিচ্ছু নেই। সমস্ত কিছুই উৎসর্গ করে দিয়েছে মিশুর তরে।
মিশু মেঘালয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিজের মাঝে টেনে নিতে লাগলো মেঘালয়কে। আজকের এ মিলন সত্যিই খুব সুখের হবে। মেঘালয় এখন সম্পূর্ণ রুপে মিশুর। আর মিশুও নিজেকে পুরোপুরিভাবে শেষ করে দিতে চায় মেঘালয়ের মাঝে। যেন এখন থেকে দুজন মিলে একটা মানুষ হয়ে বাঁচতে পারে। কেউ কাউকে এতটাও ভালোবাসতে পারে!
৬০.
দেখতে দেখতে মাস দুয়েক কেটে গেছে।
মিশু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ও রৌদ্রময়ী আর দুপুর মিলে একসাথে বাসায় থাকে আর মেঘালয় নিজের বাড়িতে থাকে। সারাক্ষণ ফোনে কথা,মেসেজিং, একটু ভিডিও কল এভাবেই প্রেম চলছে ওদের। সপ্তাহে একদিন লং ড্রাইভে যাওয়া, দুটো রাত একসাথে কাটানো, খুনসুটি, ভালোবাসা সবমিলিয়ে দিনকাল বেশ ভালোই চলছে। পুরো ব্যাপার টাকে মিশুই গুছিয়ে এনেছে। মেঘালয় ক্রমাগত মিশুতে আসক্ত হয়ে সবকিছু থেকে দূরে সরে আসছিলো। মিশু নিজে বুদ্ধি খাটিয়ে ওকে নিজের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। যে সম্পর্কে দুটো মানুষ একইসাথে ক্যারিয়ারে ভালো করতে থাকে,সেটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী সম্পর্ক। মেঘালয়ের সেই কনসার্টের রাতের পাগলামোর কথা ভেবে এখনো হাসি পায়। ভাগ্যিস মিশু একটু গুছিয়ে নিয়েছে,নয়তো সবকিছু সত্যি সত্যিই ছেড়ে দিয়ে ফেলত একেবারে। প্রেম একটা সাংঘাতিক জিনিস, এটা কখনো খারাপের দিকে নিয়ে যায়,আবার কখনো ভালোর দিকে।
এখন বেশ ভালোই উন্নতি হচ্ছে। নিয়মিত রেডিও তে গান গাইছে মেঘালয়। আর্টিস্ট দের সাথে উঠাবসা হচ্ছে, নতুন নতুন গান করছে। বাবার বিজনেসেও মাঝেমাঝে একটু হাত লাগায়। যদিও বাসায় এখনো জানেনা ওর বিয়ের ব্যাপারটা। মিশুর সাথে চুটিয়ে প্রেম চালাচ্ছে শুধু এটুকুই জানে। বাইরের জগতে মেঘালয়ের বেশ সুনাম ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরেধীরে।
আজ রাতে মেঘালয় মিশুর কাছে আসবে। মিশু খুব সুন্দর করে সাজুগুজু করে বসে আছে। রোদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর হাসছে। রোদ এখন মেঘালয়ের বাবার অফিসে চাকরী করে। যে চাকরীটা মিশুর হবার কথা ছিলো, সেটা রৌদ্রময়ী করছে। দিনশেষে বাসায় ফিরলে দুজনে মিলে বেশ খানিক্ষণ আড্ডা চলে।
মেঘালয় ফিরলে মিশু ছুটে চলে গেল দরজা খুলতে। দরজা খোলার পর মেঘালয় চোখ বড়বড় করে বললো, “বাব্বাহ! চুল গুলো বেশ বড় হয়ে গেছে দেখছি।”
মিশু হেসে বলল, “সবই বড় হয়েছে। ওজন বেড়েছে।”
মেঘালয় আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কোথাও কেউ আছে কিনা। তারপর মিশুকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। মিশু ওর গলা জড়িয়ে ধরে রইলো দুহাতে। তিনদিন পর দেখা হলো মেঘালয়ের সাথে। অবশ্য রোজ রোজ দেখা হওয়ার চেয়ে এইযে কয়দিন পরপর দেখা করা আর এইযে সংসার সেটাও একটা মজার ব্যাপার। মেঘালয়ের পরিবার ছেলেকে নিয়ে কোনোরকম মাথা ঘামায় না। যদি একটু রক্ষণশীল হতো, তবে হয়ত এভাবে লুকিয়ে সংসার জমানো সম্ভব হতোনা।
মেঘালয় মিশুকে কোলে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। মিশু দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “জানো আজকে একটা প্রপোজাল পেয়েছি।”
– “সিরিয়াসলি? কোথায়? কে দিলো?”
– “ভার্সিটিতে। একটা বড় ভাইয়া। অনেক আগ থেকে ফলো করে আমায়। আজকে সরাসরি প্রপোজাল দিয়েছে।”
– “দিনদিন তো একদম তামিল নায়িকার মতন হয়ে যাচ্ছো। আরো কত কিছুই দেবে। এরপর কে এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় সেই ভয়েই আমি তটস্থ হয়ে থাকি।”
মিশু মেঘালয়ের কোলে মাথা রেখে বললো, “আমার সতীত্ব তো তুমিই হরণ করেছো। এ মিশু তো শুধুই তোমার।”
– “হুম, আমার পাগলীটা”
মিশু মেঘালয়ের কোলে মাথা রেখে ওর মুখটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়। ইচ্ছে করছে গিলে খেয়ে ফেলি। আচ্ছা সন্ধ্যায় অনেক বার ফোন দিলাম ধরলে না কেন?”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “একটু ব্যস্ত ছিলাম। তখন রেডিওতে প্রোগ্রাম শেষ করে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটা Rj Hunt হবে সেটা নিয়ে কথা বলছিলো সবাই।”
– “Rj Hunt আবার কি?”
– “একটা প্রোগ্রাম, অনেক নতুন Rj নিয়োগ দেবে। যারা এপ্লাই করবে তাদের কিছু টেস্ট হবে, প্রোগ্রাম হবে এইসব আরকি।”
মিশু ওর গলায় ঝুলে বললো, “আমার না খুব Rj হতে ইচ্ছে করে।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “সিরিয়াসলি!”
– “হুম, আমার ও ওরকম রেডিওতে বকবক করতে ইচ্ছে করে।”
মেঘালয় বলল,”আগে বলোনি কেন? তোমার তো ট্যালেন্ট আছে, সিলেটে লেগুনায় শুনে আমি ইমপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি বরং একটা এপ্লাই করে রাখো। যা যা শিখিয়ে দিতে হবে,আমি শিখিয়ে দিবো। একদিন সেন্টারে নিয়ে গিয়ে সবকিছু দেখিয়ে আনবো। হয়ে যাবে টেনশন করতে হবেনা।”
মিশু উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো একেবারে। মেঘালয়ের গলা দুহাতে ধরে বললো, “সত্যি! আমি কি পারবো? খুব এক্সাইটেড লাগছে তো।”
– “বাসায় প্রাক্টিস করবা, আমি তো আছি ই।”
মিশু খুশিতে মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “ইস! তুমি এত ভালো কেন? তোমাকে ইচ্ছে করে একদম খেয়ে ফেলি। আমিতো ভাবতেও পারছি না Rj Hunt এ কি কি হবে! আমি পারবো কিনা, কিসব টেস্ট ফেস্ট হবে। উফফ তবুও এক্সাইটেড লাগছে। যদি হয়ে যাই, কত্ত মজা হবে বলোতো!”
মেঘালয় হেসে বললো, “হুম। তখন তোমার প্রোগ্রামে গিয়ে আমি গান গাইবো। তুমি একজন প্রফেশনাল Rj হিসেবে কথা বলবা,কিন্তু মনেমনে আমিতো জানবো তুমি আমার বউ। লুকিয়ে লুকিয়ে চুমুও খাবো আর কেউ তো জানবেই না এই শিল্পীটা কত্ত পাজি।”
মিশু মেঘালয়ের বুকে দুটো কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি আসলেই খুব খারাপ। এত সুন্দর দেখায় কেন তোমাকে? আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
মেঘালয় দুষ্টমি ভরা হাসি দিয়ে তাকালো মিশুর দিকে। আর মিশু ওর বুকে মুখ লুকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৭

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৭
মিশু মনি
.
৫৭.
বেলা বাড়তে বাড়তে মিশুর জ্বর কমে এলো। মেঘালয় যেভাবে সেবা যত্ন করছে তাতে জ্বর ভালো না হয়ে উপায় আছে?
নাস্তা করার পর সবাই বেড়িয়ে পড়লো লালাখালের উদ্দেশ্যে । মিশু একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। আজকে ওদের মধ্যে বিদ্যাই সবচেয়ে বেশি বকবক করছে। ওর বকবকানি দেখে আরাফের বিরক্ত লাগছে ভীষণ। যে মানুষ টা সারাক্ষণ অনবরত বেয়াদব, মূর্খ এসব বলতে থাকে তার উপর বিরক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওর চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
আজ রাতেই ঢাকায় ফিরবে ওরা। সবাই মিলে একসাথে গাড়িতে যাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় সেজন্য মেঘালয় বাসার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে সিলেটে চলে আসতে বললো। মিশু আজকে বাসে যেতে চাচ্ছে। ড্রাইভার এসে গাড়ি নিয়ে যাবে আর ওরা বাসেই যাবে ঠিক করে ফেললো। আরো একটা দিন থেকে যেতো কিন্তু মিশুর শরীর ভালো নয় আর মেঘালয়ের কনসার্ট থাকায় আজকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
লালাখালে গিয়ে নৌকায় করে পুরোটা ঘুরে এলো ওরা। এক জায়গায় নেমে চা বাগানে যাওয়া হলো। মিশু বাদে বাকিরা সবাই ঝাপাঝাপি করে গোসল করলো আর ও নৌকায় বসে থেকে দেখলো। লালাখাল থেকে বিকেলের দিকেই রওনা দিলো ওরা।
সিলেটে পৌছে খাবার খেয়ে নিয়ে বাংলোয় ফিরলো। মিশুর আবার জ্বর এসে গেছে তাই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কিছু ওষুধ নিলো মেঘালয়। বেড়িয়ে এসে মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে মিশুকে অনেক কিছু কিনে দিলো। মিশু একদম চুপসে গেছে, জ্বর আর মাথা ব্যথার জন্য ও চুপচাপ হয়ে গেছে অনেক। মিশু’র বারবার মনে পড়ছে মেঘালয়ের সাথে দেখা হওয়ার পর যেদিন নেভারল্যান্ডে যাওয়া হয়েছিলো সেদিন টার কথা। সেদিন ও ওর শরীরে জ্বর ছিলো।
বাংলোয় ফিরে বসে বসে চা আড্ডার সাথে সূর্যাস্ত উপভোগ করলো ওরা। সন্ধ্যার পর আজকেও কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বসে গল্প করা হল। কিন্তু আজকের আড্ডা বেশি জমলো না। মিশুকে ছাড়া সবকিছু কেমন যেন নিরামিষ লাগে। কোথাও যেন এতটুকু আনন্দ ও নেই। আগের দিনগুলোতে যেমন আনন্দ হয়েছিলো আজকে সেরকম হচ্ছেনা। মিশুর অসুস্থতার প্রভাব সবার মাঝেই পড়েছে। ঢাকায় ফিরেই একজন ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে ওকে। নিশ্চয় ই অন্য রোগের উপসর্গ এটা।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মিশুর মাথায় তেল মালিশ করে চুল বেঁধে দিলো মেঘালয়। ওকে এখন খুব আনমনা দেখাচ্ছে। মেঘালয় যত্ন করে ওর গা মুছে দিলো, গায়ে লোশন মেখে জামাকাপড় পড়িয়ে দিলো। হালকা সাজগোজ ও করিয়ে দিলো। মিশু শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছে একটা মানুষের ভালোবাসার ধরণ আরো কত রকমের হতে পারে!
বাসে মিশু ও মেঘালয় একসাথে বসলো। পূর্ব ও রোদ একসাথে বসেছে। বিদ্যার সাথে সায়ান ছাড়া আর কারোর ই ভাব হয়নি,তাই বিদ্যাকে সায়ানের পাশেই বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আরাফ একাই বসে হেডফোনে গান শুনতে লাগলো।
পুরোটা রাস্তা মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমালো। মেঘালয় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশু যতক্ষণ ঘুমিয়েছে,মেঘালয় ওর মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে মাথা টিপে দিয়েছে ওর। মাঝপথে গাড়ি থামলে মেঘালয় মিশুকে রীতিমত কোলে নেয়ার মত দুহাতে তুলে ধরে বাস থেকে নামালো। হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন হা করে দেখছিলো। রেস্টুরেন্টে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা বাথরুম। মহিলাদের ওদিকে ছেলেদের ঢোকার নিয়ম নেই। মেঘালয় মিশুকে রোদের হাতে তুলে দিয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর বন্ধুরা অবাক হয়ে দেখছিলো এই মেঘালয়কে। এরকম করেও কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে! মিশু ছাড়া মেঘালয় যেন একদম বাঁচতেই পারবে না। মিশু বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলে মেঘালয় আবারো ওর হাত ধরে নিয়ে এসে মিশুর মুখ ধুইয়ে দিলো। পুরো রেস্টুরেন্টের লোকজনের দৃষ্টি এখন মেঘালয়ের উপর। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেদিকে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মিশুর শরীর দূর্বল, ও একা একা এসব করতে পারবে না এটাই মেঘালয়ের কাছে সবচেয়ে বড়।
মিশু মুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসলো। খাবার এসে গেলে সবাই নিচু হয়ে খেতে লাগলো আর মেঘালয় নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে মিশুকে তুলে খাওয়াতে লাগলো। পূর্ব বললো, “মিশু অসুস্থ না হলে আমরা বোধহয় বুঝতেই পারতাম না মেঘালয় ওর এত কেয়ার করে!”
মেঘালয় কারো কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনলো না। ও মিশুকে তুলে খাওয়াতে লাগলো। মিশু জ্বরের প্রকোপে খেতেই পারছে না। খাবার গিলছে একটু একটু করে। মেঘালয়কে খেতে বললে ও দুবার মুখে দিলো শুধু। পাশেই শো কেসে মিষ্টি সাজিয়ে রাখা দেখে মিশু বললো, “আমি মিষ্টি খাবো।”
মেঘালয় গিয়ে এক কেজি মিষ্টি এনে দিলো ওকে। মিশু এক বসাতেই হাফ কেজি তুলে তুলে খেলো। কাউকে একটা দিলো ও না। মেঘালয় অনেক খুশি হয়েছে। যাক, তবুও তো পেট ভরা থাকবে। মিশুর যে মিষ্টি এত পছন্দ সেটা ওর জানা ছিলোনা। মিষ্টি পেলে মিশু সবকিছু ভূলে যায়।
খাওয়া শেষ হলে মেঘালয় ওকে হাত ধরে নিয়ে আবারো গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। একজন লোক বলে উঠলো, “দুনিয়াতে আর কারো বোধহয় বউ নাই, হায়রে প্রেম।”
কথাটা সবার কানে এসে লাগলো। দুজন লোক হাসাহাসি করছে। মেঘালয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। কারো কথায় ওর কিছু যায় আসেনা। কিন্তু আরাফ গিয়ে রীতিমত লোকটার কলার টেনে ধরার মত অবস্থা। পূর্ব ও সায়ান ওকে টেনে ধরে বাসে নিয়ে গিয়ে তুললো। নয়ত লোকটা নির্ঘাত আরাফের হাতে মাইর খেত।
বাসে উঠে মিশু বললো, “তুমি সবসময় আমার এত কেয়ার করো, এরকম পাগলামি কেন করো বলোতো? লোকজন তাকিয়ে থাকে।”
– “তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ ভাত গিলবো? সেটা আমাকে দিয়ে হবেনা। কে কি বললো দেখার বিষয় না আমার।”
– “আমাদের সমাজে এরকম দেখলে লোকজন হাসাহাসি করবে বোঝোনা?”
– “করুক। আমি প্রেমের নতুন ইতিহাস রচনা করে যাবো। দেশের লোকরা হাসলে যে দেশে লোকজন কেউ কারো দিকে তাকায় না সেই দেশে গিয়ে তোমাকে নিয়ে থাকবো।”
মিশু হাসিতে ঢলে পড়বো। মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি তোমার সাথে মিশতে মিশতে বড় হয়ে যাচ্ছি আর তুমি আমার সাথে থেকে থেকে মিশুর মত বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো।”
মেঘালয় মিশুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “জানিনা রে। আমার কেবলই মনেহচ্ছে পুরো দুনিয়া চলে যাক। শুধু তুমি থাকো, আর কাউকে লাগবে না আমার।”
– “তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছো মেঘমনি।”
মিশু ওর বুকে মাথা রেখে হেসেই কুটিকুটি। বাসের লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্ধকার বাসে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরবতা নেমে এলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাস নিস্তব্ধ। দু একটা জানালা খোলা, সেগুলো দিয়ে শিরশিরে বাতাস আসছে। মিশু চাদর গায়ে দিয়ে মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। অন্ধকারে মেঘালয়ের মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। মিশু ওর মুখটা ধরে বললো, “এত ভালোবাসলে আমি তো হুট করেই হারিয়ে যাবো ”
মেঘালয় ওর মুখের উপর হাত দিয়ে বললো, “এইসব ফালতু কথা আর একবার বললে আমিই তোমাকে খুন করে ফেলবো। ”
মিশু আবারো হেসে উঠলো। মেঘালয় সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। কেমন ছেলেমানুষি করছে। প্রেমে পড়লে সবাই বুঝি এরকম পাগল হয়। মিশু অন্ধকারে নিচু হয়ে ঠোঁট দিয়ে মেঘালয়ের ঠোঁট স্পর্শ করলো।
৫৮.
দুদিন পর
আজ মেঘালয়ের কনসার্ট। কনসার্টে সবাই মিলে চলে এসেছে। এক সাড়িতে মিশু, পূর্ব,সায়ান, আরাফ, দুপুর, নিখিল আর রোদ সবাই বসেছে। সবাই মিলে এমন একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে যেন ছোটবেলা থেকেই একসাথে আছে ওরা সবাই। মিশুর সাথে সবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই দুদিন তো দুপুর আর রোদ মিশুর মাথায় পানি ঢেলে দেয়া থেকে শুরু করে,রান্না করা, খাওয়ানো সব কাজে মেঘালয়কে সাহায্য করেছে। যদিও মিশুর জন্য মেঘালয় একাই যথেষ্ট।
ঢাকায় ফিরে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো ওষুধ খেয়ে মিশু একদম সুস্থ হয়ে গেছে। এই দুদিন মেঘালয় সবসময় ওর সাথেই বাসায় ছিলো। নিজে তুলে খাইয়েছে, সবসময় খেয়াল রেখেছে মিশুর দিকে। রিহার্সেলে মাত্র একবার গিয়েছিলো। একবার রিহার্সাল করে কিভাবে গান গাইবে এটা নিয়েই সবাই টেনশনে ছিলো। গ্যালারি ভর্তি দর্শক দেখে মিশুর মুখ হা হয়ে গেলো। মেঘালয়কে অনেকেই চেনে। সবাই ওর সাথে কথা বলছিলো। মিশু শুধু দূর হতে খেয়াল করছিলো ওকে। আজকে মেঘালয়কে অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। ইচ্ছে করে গিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখি!
প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেলো। মেঘালয় স্টেজে উঠেই সর্বপ্রথম মিশুর দিকে তাকালো। মিশু ক্রমাগত উত্তেজিত হয়ে উঠছে। বারবার সায়ানের হাত চেপে ধরছে ও। সায়ান মিশুর মুগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছে। ছলছল করছে ওর চোখ।
মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“কতবার তোর আয়না ভেঙেচূরে ঘুরে তাকাই,
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই,
কতবার তোর কাঁচা আলোয় ভিজে গান শোনাই,
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই…”
মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো ওর গান আর গানের লিরিক। কেবলই মনেহচ্ছিলো কথাগুলো ওকে ই উদ্দেশ্যে করে বলা হচ্ছে। মেঘালয় গভীর আবেগ নিয়ে গানটা গাইছে। মিশুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। সায়ান বুঝতে পেরে একবার মুছে দিলো ওর চোখ। মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “মিশু..”
– “মেঘালয়ের মাঝে এত মায়া কেন সায়ান ভাইয়া?”
– “সেটা আমিও ভাবি।”
মেঘালয় এই মুহুর্তে গাইছে,
“তোর উঠোন জুড়ে বিশাল অংক,
কষতে বারণ ছিলো তাই..
কিছুই বোঝা গেলো না প্রায়…”
মিশু কেঁদে ফেললো এবার। সায়ানের হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলো। সায়ান মিশুকে বাঁধা দিলো না। ও চুপ করে রইলো। মেঘালয়ের কণ্ঠে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছে। প্রথমে টিএসসিতে হওয়ার কথা ছিলো, এখন প্রোগ্রাম হচ্ছে মিউজিয়ামের অডিটোরিয়ামে। পুরো গ্যালারি ভর্তি দর্শক। সবাই স্তব্ধ হয়ে গান শুনছে। গান যেন নয়,মেঘালয়ের কণ্ঠে আবেগের স্রোত নেমেছে। এই গানটা শেষ করে মেঘালয় অন্য আরেকটা গান ধরলো।
এবার উকিল মুন্সির ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটা আরম্ভ করলো। কিন্তু ওর গানের রাগ রাগিণীর টান শুনে ভেতরটা কেঁপে যাওয়ার মত অবস্থা হলো। বারি সিদ্দিকী যেভাবে রাগিণীতে সুর দিয়েছেন, মেঘালয় ও ঠিক সেভাবে দম বন্ধ করে টান দিলো। শুনে কেমন যেন বিষণ্ণতা ছেঁয়ে যায় ভেতরে।
গানটা শেষ করার পর মিশু চোখ মেলে খেয়াল করে দেখলো মেঘালয়ের চোখে জল। মিশুর ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে মেঘালয়ের পাশে বসে ওর চোখ মুছে দিতে। শান্ত হয়ে ও বসে থাকার চেষ্টা করেও পারলো না। সায়ানের বাহু চেপে ধরে রইলো শক্ত করে।
এরপর আরো দুটো গান গাইলো মেঘালয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যেকটা গানই আলাদা রকমের। একই কণ্ঠে চার রকমের গানে সুর দিয়ে গ্যালারি মাতিয়ে তুললো। শেষের গানে, “তোর চাঁদে যাওয়া হলোনা, তোর ফর্সা হওয়া হলোনা” গানটা বেশ জমে উঠলো। মেঘালয় নেমে আসার পর ছেলে মেয়েরা ওর সাথে গিয়ে ছবি তুলতে লাগলো। মেঘালয় দু মিনিট ছবিতে পোজ দিয়েই হাফিয়ে উঠলো। এসব সেলিব্রেটি টাইপের কাজকর্ম ওকে দিয়ে হবেনা, ওকে দিয়ে শুধু ভালোবাসা বাসিই হবে। দ্রুত হল থেকে বেড়িয়ে সায়ানকে ফোন দিয়ে বললো মিশুকে নিয়ে বাইরে বের হতে।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৬

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৬
মিশু মনি
.
৫৫.
সায়ান ও বিদ্যা হাঁটতে হাঁটতে চা বাগানে চলে এলো। বাগানের পাতাগুলো চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় চিকমিক করছে। সায়ান বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে বিদ্যার দিকে। মেয়েটি দিব্যি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। এ কেমন মেয়েরে বাবাহ! এত রাতে কেউ ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হয়?
বিদ্যা বললো, “এই ছেলে তোমার নাম কি?”
– “সায়ান।”
– “সায়ান সায়ানা। তোমার বউয়ের নাম হবে সায়ানা। তোমার বউটা হবে খুব সেয়ানা।”
সায়ান হেসে ফেললো ওর কথায়।বিদ্যা একটু করে এগোচ্ছে আর নিচু হয়ে চা পাতার ঘ্রাণ নিচ্ছে। এটা তো মিশুর ই প্রতিফলন মনেহচ্ছে। মিশুও পাহাড়ে গিয়ে গাছপালার গন্ধ নেয়,মাটির ঘ্রাণ নেয়। দুজনেই একই ধাচে গড়া। সায়ান হা করে বিদ্যার চাল চলন খেয়াল করছে। বিদ্যা বললো, “বলোতো আজকে চাঁদের আলো এত কম কেন?”
– “চাঁদের আলো বেশিই আছে। আজকে কুয়াশা পড়েছে বলে আলো কম মনেহচ্ছে।”
– “আমার সাথে সায়েন্স কপচাপা না। সাহিত্য কপচাও।”
– “বুঝলাম না। এর সাথে সায়েন্স আর সাহিত্যের কি সম্পর্ক?”
– “তুমি যেটা বললা সেটা সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা হয়ে গেলো না? সাহিত্যের ভাষায় বলো, “বিদ্যা আজ তোমার রূপের কাছে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে গেছে।”
সায়ান হো হো করে হেসে উঠলো। বিদ্যা ভ্রু কুচকে বললো, “হাসছো কেন? ভূল বলেছি?”
– “না, বিদ্যা আজ তোমার রূপের কাছে চাঁদের আলো ম্লান হয়ে গেছে।”
– “এবার ঠিকাছে। এভাবেই প্রেম হয়।”
সায়ান আবারো হেসে উঠলো। কুয়াশা পড়েছে দারুণ। মৃদু জোৎস্নায় কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে দুজনে চা বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াতে লাগলো। সায়ানের ভয় হচ্ছে পোকা মাকড় নিয়ে। কিন্তু বিদ্যার এ নিয়ে কোনো ভয় নেই। সে দিব্যি গুনগুন করে গান গাইছে আর হাঁটছে।
মেঘালয়ের হঠাৎ ঘুম ভাংলে দেখলো মিশুর শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মিশু রীতিমত কাঁপছে। ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলো মেঘালয়। মিশুর কপালে ও গলায় হাত দিয়ে জ্বর অনুভব করে দেখলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে লাগেজ খুলে থার্মোমিটার বের করলো। মিশুর শিয়রে বসে জ্বর মেপে দেখে চিন্তায় পড়ে গেলো মেঘালয়। হুট করেই এত জ্বর এসে গেছে মেয়েটার। সন্ধ্যা থেকেই হয়ত জ্বর জ্বর লাগছিলো, কিছু বলেনি তখন। ওর মুখটা শুকনা দেখাচ্ছিলো। বিছানাকান্দি থেকে ভেজা গায়ে ফিরেছে, নৌকায় বাতাস লেগেছিলো গায়ে। গতরাতেও ঝরনা স্নান করে ভেজা কাপড়ে ফিরেছে। এজন্যই হয়ত ঠাণ্ডা লেগে গেছে মেয়েটার। ও দ্রুত ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করলো। টুকটাক জ্বর,সর্দি, মাথা ব্যথার ওষুধ কোথাও গেলে সাথে নিয়ে যায় ও। এক গ্লাস পানি এনে মিশুকে একটু তুলে ধরে ওষুধ খাইয়ে দিলো। মিশু ওকে আলগা করে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার হাত পা ঝিমঝিম করছে মেঘ।”
ওষুধ খাইয়ে দিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলো মেঘালয়। গায়ের উপর ভালো মতো কম্বল টেনে দিলো। তারপর হাতে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে দিয়ে বললো, “ভালো লাগছে এখন?”
মিশু জ্বরের ঘোরে বললো, “গা টা কেমন যেন করছে। ব্যথা করছে। পায়ে বেশি ব্যথা করছে। খুব ঝিমঝিম করছে।”
মেঘালয় ওর পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিতেই মিশু বললো, “বর কখনো বউয়ের পা টিপে দেয়? দিওনা দিওনা।”
মেঘালয় বললো, “আমি ওসব নিয়ম মানিনা। তুমি আমার কাছে জগতের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
মিশু আর কিছু বললো না। জ্বরের ঘোরে কিছু বলতেও পারছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। মেঘালয় বসে বসে ওর পা টিপে দিতে লাগলো। পা দুটো সুন্দর করে টিপে দিচ্ছে আর মিশু আরামে ঘুমোচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কে জানে।
আবারো মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো। মেঘালয় এখনো ওর পায়ের কাছে বসে পা টিপছে। মিশুর অতটা খেয়াল ছিলোনা। ঘোরের মাঝেই ও পা ঝাড়া দিতেই মেঘালয়ের বুকে লাত্থি দিয়ে ফেললো। মেঘালয় আচমকা এরকম পরিস্থিতিতে পড়েও নিজেকে সামলে নিলো। কিন্তু মিশু ওকে লাথি দিয়ে ফেলেছে বুঝতে পেরে ব্যস্ত হয়ে বিছানার উপর উঠে বসলো। মেঘালয়ের বুকে খুব জোরে লেগেছে। ও বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। মিশু এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে বসে দুহাতে মেঘালয়ের মুখটা ধরে বললো, “আমি এটা কি করলাম! আমি বুঝতে পারিনি মেঘমনি। তুমি কি ব্যথা পেয়েছো? সরি মেঘ।”
মেঘালয়ের বুকে লাথিটা একটু জোরেই লেগেছে। তবুও ও ব্যাপারটা হজম করার চেষ্টা করলো। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, “তুমি একটা পাগলী। এটা তো একটা এক্সিডেন্ট, আমি কিছু মনে করিনি।”
– “তুমি ব্যথা পাওনি?”
– “না রে পাগলী টা। ব্যথা পাইনি একটুও।”
– “সত্যি তো?”
– “সত্যি, একদম সত্যি।”
মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে যে জায়গাটায় লাথি লেগেছিলো সেখানে মাথা রেখে বললো, “আমাকে মাফ করে দাও মেঘ। আমি বুঝতে পারিনি তুমি এখানে বসে আমার পা টিপছ। আমার অতটা হুশ ছিলোনা।”
মেঘালয় মিশুকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিলো। নিজে বসে রইলো ওর মাথার কাছে। মিশুর মাথাটা ওর কোলের উপর নিয়ে বললো, “ভূলে যাও এ ব্যাপারটা। ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। আর তুমি ইচ্ছেকৃত ভাবে লাথি দিলেও আমি কখনো কিছু মনে করবো না। তুমি পুরো টাই আমার। তোমার মাথাটা যদি আমার বুকে জায়গা পায়,পা কেন পাবে না? তুমি তো আমার ই।”
মিশু কেঁদে ফেললো কথাটা শুনে। উঠে বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেঘালয় ওকে উঠতে দিলোনা। মিশু মেঘালয়ের একটা হাত বুকে চেপে ধরে বলতে লাগলো, “এত ভালো কেন তুমি! এত সুন্দর করে কিভাবে ভাবো? আমি বারবার আঘাত করে ফেলি তোমায়। আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে।”
– “একদম এই কথা বলবা না। তুমি আমার লক্ষী একটা বউ। এবার ঘুমোও তো। শরীর কেমন লাগছে এখন?”
– “ভালো।”
– “জ্বর একটু ও কমেনি। তুমি ঘুমোও তো মিশু।”
মেঘালয় উঠে গিয়ে একটা বাটিতে করে পানি ও রুমাল নিয়ে এলো। রুমাল ভিজিয়ে মিশুর কপালে দিয়ে দিলো। তারপর বললো, “এখন চুপচাপ শান্ত মেয়ের মত ঘুমোও। ওষুধ খেয়েছো, এবার দেখবে জ্বর পালাবে। আর না পালালেও আমি জোর করে জ্বরকে তাড়িয়ে দিবো।”
মাথায় জলপটি দিয়ে দেয়াতে মিশুর খুব আরাম লাগছে। কপাল ও চোখের উপর মেঘালয় রুমাল ভিজিয়ে রেখে দিয়েছে। এখন আরামে চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে। মিশু কি যেন বললো বোঝা গেলো না। ঘুমে ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘালয় বারবার রুমাল ভিজিয়ে জলপটি দিয়ে দিচ্ছে। মিশু ঘুমের ঘোরে বললো, “আমার শরীরে শুধু তোমার প্রেমের বীজ থাকবে,কোনো অসুখ বিসুখের বীজ তুমি থাকতেই দেবেনা। তুমি খুব…”
শেষে কি বললো বোঝা গেলো না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে মিশু। মেঘালয় হাসলো। পাগলী একটা মেয়ে। বুকের যে জায়গাটায় মিশু লাথি দিয়েছে সেখানে হাত রেখে মনেমনে বললো, “শরীরে কত আঘাত দিতে পারিস দে। কখনো বুকের ভেতরে আঘাত দিস না মিশু। আমি তোকে খুব বেশি ভালোবাসি। তোর দেয়া আঘাত আমি সহ্য করতে পারবো না।”
মেঘালয়ের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ও মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনেমনে প্রার্থনা করতে লাগলো যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় মিশু। ওর শরীর অসুস্থ থাকলে মেঘালয়ের ও কষ্ট হবে। মেঘালয় তোয়ালে ভিজিয়ে মিশুর শরীরটা মুছে দিলো।মিশু এখন আরামে ঘুমোচ্ছে। আর মেঘালয় ওর মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একটু পরপর জলপটি ভিজিয়ে আবারো কপালে দিয়ে দিচ্ছে।
সায়ান ও বিদ্যা অনেক্ষণ হাটাহাটি করলো একসাথে। বিদ্যার স্কুল জীবনের নানান মজার মজার গল্প বলছে ও। সায়ান শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনছে। বিদ্যা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। বড় ভাইয়া ভার্সিটিতে ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। বাবা মা সবাই ওকে খুবই আদর করে আর আদরে আদরে ও একদম বাদর হয়ে গেছে এসব গল্প বলতে লাগলো সায়ানকে। সায়ান ও হেসে হেসে নানান প্রশ্ন করতে লাগলো।
– “আচ্ছা বিদ্যা, বেয়াদব বলাটা কি তোমার মুদ্রাদোষ?”
– “আমার কোনো দোষ নেই। যে বেয়াদব তাকে বেয়াদব তো বলবো ই তাইনা?”
– “তুমি জানো মেঘালয় কত বড় মনের একজন মানুষ? ওর মত মহান ব্যক্তি আর একটাও দেখিনি আমি আমার লাইফে। তুমি আর কক্ষনো ওকে এভাবে বলবে না। সম্মান দেখিয়ে কথা বলবা।”
– “উনি কোন থানার চৌকিদার?”
– “বিদ্যা, এভাবে বড়দের বলতে হয়না। মেঘালয় একজন মাউন্টেউনার।”
– “মাউন্টেইনার রা তো কালা কুচকুচে হয়। মেঘালয় এত ফর্সা কেন?”
– “আজব প্রশ্ন করো। ও কয়েক বছর যাবত আর অভিযানে যায়না। আন্টি ওকে যেতে দেয়না। সেজন্য ফর্সা হয়ে গেছে আবার। কিন্তু যেবার হিমালয় থেকে ফিরে এসেছে, আমরা কেউই ওকে দেখে চিনতে পারিনি। গায়ের রঙ একদম চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিলো।”
– “এত তাড়াতাড়ি সে আবার ফর্সা হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই ফর্সা হওয়ার নাইট ক্রিম ইউজ করে?”
– “হা হা হা। হাসালে আমায়। ও যেরকম পরিবেশে থাকে, তাতে গায়ের ময়লা এমনিতেই কেটে যায়। এর জন্য ফর্সা হওয়ার ক্রিম ইউজ করতে হয়না।”
– “ওহ আচ্ছা। যাক ভালো, একজন বড় মানুষকে বেয়াদব বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছি আমি।”
– “এটা কি গর্ব করার মত কিছু?”
– “অবশ্যই গর্ব করার মতই কিছু। মেঘালয়কে কেউ কখনো এই গালিটা দেয়নি। যেটা প্রথম আমি দিয়েছি ”
– “তুমি ওকে শুধু মেঘালয় বলবে না। মেঘালয় ভাইয়া বলে ডাকবা।”
– “উনি আমার কেমন ভাই? আমার বাপের একটাই মাত্র ছেলে।”
– “সবসময় নিজের ভাইকেই ভাই বলতে হয়? প্রত্যেক মুসলিম একে অপরের ভাই।”
– “তাহলে তো মেঘালয় আমার বাপের ও ভাই। আমার তাকে চাচা ডাকা উচিত। আপনি ও তাহলে আমার চাচা।”
সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “তা বুঝাইনি। বয়স অনুযায়ী কাউকে ভাইয়া ডাকতে হয়,আর কাউকে আংকেল ডাকতে হয়। বুঝেছো? আমাদের বয়স অনুযায়ী আমাদের কে তুমি ভাইয়া ডাকবা।”
– “ওহ আচ্ছা। বুঝেছি। এবার তাহলে ফিরে যাই আসুন। আমার ঠাণ্ডা লাগছে।”
দুজনে আবারো বাংলোর দিকে ফেরার জন্য পা বাঁড়ালো। সায়ানের হাসি পাচ্ছে বিদ্যার পাগলামি ভরা কথাগুলো শুনতে শুনতে। মেয়েটা পারেও বটে।
৫৬.
মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো আবারো। ও চোখ মেলে দেখলো মেঘালয় এখনো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ও বললো, “মেঘমনি।”
– “হুম মিশু সোনা।”
– “তুমি ঘুমোও নি?”
– “তোমাকে এই অবস্থায় রেখে কিভাবে ঘুমাই বলো? তোমার কেমন লাগছে এখন?”
মিশু একটু উঠে বসার চেষ্টা করলো। মেঘালয় ওকে উঠে বসতে সাহায্য করলো। মিশু উঠে মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো দুহাতে। আস্তে আস্তে বললো, “সারারাত এভাবে বসে থাকবা? কয়টা বাজে?”
মেঘালয় ঘড়ি দেখে বললো, “প্রায় চারটা।”
– “আমার কান্না পাচ্ছে মেঘ।”
মেঘালয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন মিশু?”
মিশু বললো, “অনেকে বাবা মায়ের থেকেও এরকম সেবা পায়না। আমিতো কখনোই পাইনি। আমার অসুখ হলে মাথায় পানি ঢেলে দেয়ার মত কেউ ছিলোনা। ছোটবোন তো তার মত ব্যস্ত, আর আম্মু তো অসুস্থ। আজকে প্রথম কেউ আমার এভাবে সেবা করলো। সারারাত বসে জলপটি দিয়ে দিলা, পা টিপে দিলা, মাথা মালিশ করে দিচ্ছো। এভাবে কেউ আমাকে ওষুধ খাওয়ায় নি, আমার অসুখ হলে নিজেকেই ওষুধ কিনে এনে তারপর খেতে হতো।”
মিশু আঁকড়ে ধরে আছে মেঘালয়কে। মেঘালয় বললো, “তোমার সেবা করতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনেহচ্ছে মিশু। আমি তোমাকে যত ভালোবাসি, তত কম মনেহয়।”
-“এত ভালোবাসো কেন মেঘ? তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি,মাথায় আঘাত পেয়েছো। আজকে আবার বুকে লাথি দিয়েছি। সেদিন ট্রেনে কতগুলা হিংস্র আচড় দিয়েছি। কত আঘাত দেই আমি তোমাকে। অথচ তুমি আমাকে কত্ত ভালোবাসো!”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ভালোবাসলে বাসার মতই বাসবো, যেন আমার প্রিয় মানুষ টার লাইফে আর কারো ভালোবাসার প্রয়োজন না পড়ে।”
– “আমি কি তোমার এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?”
মেঘালয় মিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “যোগ্যতা আমি বুঝিনা। আল্লাহ তোমাকে পাইয়ে দিয়েছেন, এতে তার কাছে লাখ লাখ শোকরিয়া। আমি সুখী তোমাকে পেয়ে,এটাই সবচেয়ে বড়। তোমাকে আমার পাশে মানাচ্ছে কিনা সেটা আমার দেখার বিষয় না।”
মিশুর চোখে পানি এসে গেলো। মেঘালয় বুঝতে পেরে ওর চোখ মুছে দিয়ে বললো, “আমার শুধু একটাই চাওয়া তোমার কাছে, সবসময় আমার পাশে থেকো। কখনো যদি একটুও আড়াল হও,আমি পাগল হয়ে যাবো।”
মিশুর সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এত ভালবাসা পেয়েও কি কখনো আড়াল হওয়া যায়? জীবনটাই তো উৎসর্গ করা যায় এই মানুষ টার জন্য। অজান্তেই লাথি দিয়ে ফেলাটা খুব অপরাধ হয়ে গেছে। মিশুর খুব খারাপ লাগছে সেজন্য। কথাটা আরেকবার বলতেই মেঘালয় বললো, “আমি ভূলেই গেছি ব্যাপারটা। তুমি এখনো সেটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছো?”
– “সরি মেঘমনি।”
– “একদম মন খারাপ করে থাকবা না। তোমার অসুখ তাড়াতাড়ি সেরে যাক।”
– “তুমি আমার শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নাও না।”
মেঘালয় শিউড়ে উঠলো মিশুর কথায়। পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো ওর। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। অজান্তেই মেঘালয় এই পাগলী টাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে সেটা কি ও বোঝে? কখনো কি বুঝবে মেঘালয় ওকে কতটা ভালোবাসে? ওর মুখে হাসি ফোটাতে, ওকে একটু আনন্দ দিতে সবকিছু করতে রাজি ও। মিশু কি জানে সে কথা?
মিশু মেঘালয়ের কলার টেনে ধরে বললো, “তোমাকে ছাড়া আমি অপূর্ণ মেঘালয়। আমাকে পূর্ণ করে দিয়েছো তুমি।”
মিশুর জ্বর কমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভোর হতে শুরু করেছে। দুটো সুখী মানুষ একে অপরকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে, এ তো সুখের কান্না!
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৫

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৫
মিশু মনি
.
৫৪.
রাস্তায় একটা মেয়ে মরে পড়ে আছে। উলটা হয়ে শুয়ে আছে, বাম হাতটা গায়ের নিচে পড়েছে। কেমন যেন ভয় লাগছে দেখলেই। মেয়েটার সামনে লম্বা ঘন চুল বিস্তৃত হয়ে আছে। চুল দেখে সেটা মুখ নাকি পিঠ বোঝার উপায় নেই। দেখলেই ভয় লাগছে।
মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে বললো, “তুমি বসো আমি দেখে আসি।”
মিশু ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো, “না,আমি তোমাকে যেতে দিবো না। অন্য কেউ যাক।”
মেঘালয় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাচ্চাদের মত করোনা। আমি দেখে আসি। আরাফ, পূর্ব তোরাও চল।”
মিশু ও রোদকে লেগুনায় বসিয়ে রেখে ওরা সবাই নেমে পড়লো। লেগুনার ড্রাইভার ও নেমে পড়লো। সবাই টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। অনেক সময় এরকম দূর্গম নির্জন রাস্তায় বিপদের ফাঁদ ও ফেলে রাখা হয়। সেরকম কিছু কিনা বুঝতে পারছে না কেউ। সবার মধ্যে মেঘালয় একটু বেশি সাহসী। ও সবার আগে আগে যাচ্ছে। বাকিরা পিছনে। মিশু মাথা বাড়িয়ে দেখছে সামনে তাকিয়ে। মেয়েটির কাছে যাওয়ার পর মেঘালয় বসে উপুড় হয়ে ভালোভাবে দেখে বললো, “এর তো কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি। একদম নিঁখুত। কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে নাকি?”
সবাই এসে উপুড় হয়ে দেখতে লাগলো। সত্যিই মেয়েটির গায়ে কোনো ক্ষত নেই, আর রাস্তায় ও কোনো রক্ত নেই। মেয়েটি এক্সিডেন্ট করেনি করেনি এটা নিশ্চিত। তবে কি হয়েছে? মেঘালয় মেয়েটির হাত ধরে নাড়ি পরীক্ষা করে বললো, “একদম সুস্থ স্বাভাবিক। বোধহয় সেন্সলেস হয়ে গেছে।”
মেয়েটিকে ওরা সবাই মিলে ধরাধরি করে এনে লেগুনায় বসিয়ে নিলো। মেয়েটির হাত পা একদম ঠাণ্ডা বরফের মত হয়ে গেছে। মুখ থেকে চুল সরিয়ে দেখলো ফুটফুটে রূপবতী একটি মেয়ে। চেহারায় চাঁদের আলো ঝিকমিক করছে। সবাই ইমপ্রেসড তার রূপ দেখে!
মিশু প্রথমেই বললো, “জিন্স ও টপস না পড়ে শাড়ি পড়লে একে যা লাগতো না!”
মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “এরকম অবস্থায় একটা মানুষ কে দেখে তোমার শাড়ি পড়ানোর কথা মনে পড়লো?”
– “শুধু শাড়ি না, আরো অনেক কিছুই মনে পড়ছে। একে সব রঙের শাড়িতে মানাবে না। একদম ধূসর, ছাই কালার, কচি কলাপাতা রঙ এসবে মানাবে। কমলা রঙ ভালো শুট করবে।”
– “হয়েছে এবার এর সেবা যত্ন করো।”
মেঘালয় মিশু ও রোদের মাঝখানে মেয়েটিকে বসিয়ে দিলো। বোতল থেকে পানি ঢেলে ওর মুখে ছিটিয়ে দিলো। মিশু ও রোদ মেয়েটিকে চাদরে ঢেকে দিয়ে হাত পা মালিশ করতে লাগলো। ওদের উত্তাপে আর পানির স্পর্শে চোখ মেলে তাকালো সে। চোখ বড়বড় করে বললো, “চলে গেলো, চলে গেলো।”
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি চলে গেলো?”
– “আমার গাড়ি চলে গেলো।”
বলেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেললো। সবাই একদম হতভম্ব! সায়ান বললো, “এরকম ন্যাকা ন্যাকা করে কান্না করো কেন? কাঁদলে ভালো করে কাঁদো।”
মেয়েটি সায়ানের বুকে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বললো, “ইউ বেয়াদব। আমি ন্যাকা ন্যাকা করে কান্না করি? আমি ন্যাকা ন্যাকা করে কান্না করি?”
সবাই আবারো থ। সায়ান বুক চেপে ধরে বলল, “মেয়ে মানুষ না দজ্জাল? এভাবে কেউ ঘুসি মারে? আমিও একটা মারি দেখো তো কেমন লাগে?”
সবাই মুখ টিপে হাসলো। মেয়েটি অ্যাঅ্যা করে কেঁদে দিলো। আরো হাসি পাচ্ছে সবার। সায়ান বললো, “সরি। কাঁদেনা মধুর মা, কাঁদেনা।”
মেয়েটি চোখ মুছে উৎসুক হয়ে বললো, “আমার বাপের নাম মধু আপনি কিভাবে জানলেন?”
সবার হাসি পাচ্ছে। মিশু বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো মেয়েটিকে পেয়ে। দারুণ একটা মেয়ে তো। কথায় কথায় ভ্যা ভ্যা করে কাদে। মিশুর কান্না পেলেও কখনো এরকম ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিতে পারেনা। মেয়েটি একটু এক্সট্রা কিউট!
ও বললো, “কে তুমি নন্দিনী? রাস্তায় মরে পড়ে ছিলে কেন?”
মেয়েটি আবারো ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বললো, “আমি মরে পড়ে ছিলাম? আমাকে কেন মরা মানুষ বলছো অ্যাএএএএএ..”
সবাই হেসে উঠলো। লেগুনা ছেড়ে দিয়েছে। মিশু মেয়েটির চোখ মুছে দিয়ে বললো, “কাঁদেনা বাবুটা। একদম কাঁদেনা। কাঁদলে তোমাকে ভালো দেখায় না। হাসবে, তাহলে সুন্দর দেখাবে।”
মেয়েটির বোধহয় বিশ্বাস হলো মিশুর কথা। ও বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে। আর কাঁদবো না। কিন্তু আমার লেগুনায়ায়ায়ায়া…”
– “কি হয়েছে লেগুনার?”
– “আমি ট্যুরে এসেছিলাম। আমার গাড়ি আমাকে ফেলে চলে গেছে..”
– “গাড়ি কিভাবে চলে যায়? তুমি খেয়াল করোনি?”
মেয়েটি বললো, “আমি ঝরনায় গোসল করে ভেজা কাপড়ে যাবো কিভাবে ভাবছিলাম। সেজন্য একটা থামি কিনে নিয়েছিলাম। থামিটা পড়ার জন্য বাথরুমে ঢুকেছিলাম। বের হয়ে গিয়ে দেখি লেগুনা ছেড়ে চলে গেছে। আমার ভ্যানিটিব্যাগ ওদের সাথেই গেছে। আমার কাছে ফোন ও নাই। আর ওদের কারো নাম্বার আমার মুখস্থ ও নাই। আমি লেগুনার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারিনা।”
মেঘালয় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “তাহলে এই কথা। আমরা তো ভেবেছিলাম তুমি মরা লাশ।”
মেয়েটি আবারো ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো, “আমাকে লাশ বলছো কেন বারবার? তোমরা খুব খারাপ।”
মিশু বললো, “আমি খুব ভালো। শোনো, তোমার ভয়ের কিছু নেই। সিলেটে ফিরে তোমার হোটেলে তোমাকে রেখে আসা হবে। টেনশন করোনা একদম।”
– “হ্যা, তুমি খুব ভালো। লক্ষী একটা মেয়ে। আমার খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দিবা?”
সায়ান বললো, “নির্লজ্জ মেয়ে। বসতে দিলে শুইতেও চায়। ঘুষি মেরে আবার খাবার চাচ্ছে হুহ।”
মেয়েটি রেগে বললো, “আমি কখন শুতে চেয়েছি? আপনি চরম বেয়াদব একটা ছেলে। সবার থেকে বেয়াদব। আরো একটা ঘুষি দেয়া দরকার আপনাকে।”
– “আমি বেয়াদব? থাপ্পড় খাবা মেয়ে ”
মেয়েটি আবারো ভ্যা করে কান্না করে দিলো। মেঘালয় বললো, “সায়ান রাগিস না। ও বাচ্চা মেয়ে। আমাদের দলে আরো একটা বাচ্চা যোগ দিলো।”
মেয়েটি বললো, “আমাকে দেখে কোন এংগেল থেকে আপনার বাচ্চা মনেহয়? সবকিছুর সাইজ বড়দের মতন। আপনি আমাকে বাচ্চা বলছেন কেন? আপনি ও বেয়াদব।”
মেঘালয় এগিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “এই মেয়ে, সাহস তো কম না। আমাকে বলো বেয়াদব। চেনো আমাকে?”
– “আপনি আবার কোন থানার চৌকিদার?”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মেঘালয় রেগে বলল, “মামা লেগুনা থামান তো। একে নামিয়ে দেন। এই মেয়ে নামো, নামো লেগুনা থেকে।”
মেয়েটি আবারো ভ্যা করে কান্না করতে করতে বললো, “আপনি সত্যিই খুব খারাপ। চরম বেয়াদব একটা ছেলে। আমার মতো অবলা মেয়েকে লেগুনা থেকে নামিয়ে দিচ্ছেন। রাত হয়ে গেছে, কত রকম বিপদ আপদ হতে পারে। আপনাদের বিবেকবোধ বলতে কিচ্ছু নাই।”
মেঘালয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ওকে গাড়িতে তুলে আনা হলো ভালোর জন্যই। আবার এসব বলছে! আজব। মেয়েটির মাথায় গণ্ডগোল নেইতো? নাকি নিতান্তই বাচ্চামেয়ে?
মেঘালয় বললো, “তোমার মত কচি খুকিকে কে ট্যুরে নিয়ে এসেছিলো? নাক টিপলে দুধ বের হবে।”
মেয়েটি রেগে বললো, ‘আপনি শুধু বেয়াদব ই নন,চরম মূর্খও। কি টিপলে কি বের হয় তাও জানেন না। নাক টিপলে দুধ বের হবে কিভাবে? নাক টিপলে সর্দি বের হবে।”
সবাই থ! এবার আর কারো মুখে কোনো কথা বের হলোনা। উত্তরে কি ই বা বলা যায়? মেয়েটি বাচ্চাদের থেকেও ছোট কিছু থাকলে সেটাই। ন্যাকা,একে কিছু বলা যায়না।
মেয়েটি বললো, “আপনার মত ছেলেদের কক্ষনো বিয়ে হবেনা। মেয়েদেরকে সম্মান দিতে জানেন না, অবলা মেয়েকে লেগুনা থেকে নামিয়ে দিতে চান,থাপ্পড় দিতে চান। এজন্যই আপনারা গার্ল ফ্রেন্ড পান না।”
মেঘালয় ক্ষেপে গিয়ে একটা হেচকা টান দিয়ে মিশুকে নিজের পাশে বসিয়ে নিলো। মেয়েটি মিশুর হাত ধরে বলল, “তুমি এই খারাপ লোকটার পাশে বসবেনা।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। মেঘালয় কাছে টানলে মিশুর না গিয়ে উপায় আছে? মিশু মেঘালয়ের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। মেঘালয় মেয়েটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে মিশুর কাঁধে মাথা রেখে ওর গালের সাথে গাল ঘষতে ঘষতে বললো, “আই লাভ ইউ মিশমিশ।”
মিশু মেঘালয়ের মুখ ধরে বললো, “আই লাভ ইউ টু মেঘমনি।”
মেয়েটি খুব ক্ষেপে গেলো। রেগে রেগে বললো, “তোমরা সবাই খারাপ। বাজে ছেলে মেয়ে। গাড়ি থামাও,আমি নেমে যাবো।”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সবাই ভালো করেই জানে এই রাস্তায় পিচ্চি মেয়েটি কখনোই নামবে না। তবুও বলা যায়না। যেরকম মেয়ে, নেমে যেতেও পারে। মেঘালয় বললো, “মামা লেগুনা থামান তো।”
মামা লেগুনা দাড় করালেন। মেঘালয় বলল, “নামো যাও। নেমে যাও গাড়ি থেকে।”
মেয়েটি নেমে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো যতদূর চোখ যায় শুধু জংগল আর জংগল। আর ঝিঝির ডাকে ভৌতিকতা বিরাজ করছে সবখানে। ও ভয়েই লাফিয়ে উঠে লেগুনায় উঠে বসে বললো, “না নামবো না। আপনাদের সাথে যাবো। এখানে নামলে আমাকে ভূতেরা চিবিয়ে চিবিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবে।”
সবাই হেসে উঠলো শব্দ করে। মেঘালয় গায়ের উপর চাদর টেনে নিয়ে একই চাদরের ভেতর দুজন ঢুকে দুষ্টুমি, খুনসুটি করতে লাগলো। বাইরে থেকে কিছু বোঝা না গেলেও ওদের মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি দেখে ঠিকই অনুমান করা যায়। কেউ কিছু মনে করলো না। সবাই নিজেদের মতন ফোন টেপাটিপিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মেয়েটি একাই একটা চাদর গায়ে দিয়ে মুখ গোমরা করে বসে আছে। বারবার তাকাচ্ছে মেঘালয় আর মিশুর দিকে। আর রীতিমত ক্ষেপে যাচ্ছে।
মেঘালয় মিশুর কানেকানে ফিসফিস করে নানান কথা বলে তারপর মিশুও ফিসফিস করে জবাব দেয়। মেয়েটি দেখতে দেখতে ক্ষেপে যাচ্ছিলো।ওর একদম অসহ্য লাগছে মিশু ও মেঘালয়কে। মেয়েটি ক্ষেপে মিশুকে বললো, “এই ছোট মেয়েটা, তুমি এত বেহায়া কেন? এভাবে বড়দের সামনে এরকম প্রেম করছ লজ্জা করছে না?”
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হা করে তাকাল। মিশুও হতভম্ব। সায়ান বললো, “ওরা হানিমুনে এসেছে। এখন ওদের মধুচন্দ্রিমা। ওরা প্রেম করবে না তো আমরা প্রেম করবো?”
মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বললো, ” ও আচ্ছা। এইটুকুন বাচ্চাকে বিয়েও দিয়েছে! মূর্খ গার্ডিয়ানস।”
সবাই থতমত খেয়ে গেলো। মেয়েটি বারবার বেয়াদব, মূর্খ, বেহায়া, এই টাইপের গালি দিচ্ছে। সমস্যা কি ওর? মেঘালয়কে চরম বেয়াদব বলায় মিশুর খুব রাগ হয়েছিলো। পুঁচকে মেয়ে বলে কিছু মনে করেনি। তবে সবাই বেশ মজা পাচ্ছে। হাস্যকর লাগছে ওর কথা বলার স্টাইলটা। বাচ্চাদের মতন করে কথা বলে।
মেয়েটি বললো, “কার কার বিয়ে হয়েছে?”
সায়ান মেঘালয়কে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ওরা দুজন বাদে আমরা সবাই সিংগেল।”
– “ও আচ্ছা। তোমরা কিন্তু আমাকে কেউ লাইন মারবে না। আমি এখনো অনেক ছোট, এত তাড়াতাড়ি আমি প্রেম করবো না। কেউ প্রেমে পড়বে না আগেই বলে দিচ্ছি। আগে বড় হবো, তারপর ওসব।”
সবাই মুখ টিপে হাসলো। আরাফ বললো, “তোমার প্রেমে পড়ার কিসের ঠেকা পড়ছে শুনি?”
– “আমার মত সুন্দরী দেখলে সবার মাথা এমনিতেই ঘুরে যায়। তাছাড়া এই ছেলেটা কিভাবে যেন তাকাচ্ছে। আমি আরো শুরুতেই ওকে ঘুষি মেরেছি। প্রেম কিন্তু এভাবেই শুরু হয়। ঘুষি থেকে শুরু হতেও পারে।”
সায়ান থতমত খেয়ে বললো, “থাপ্পড় লাগাবো একদম। আমি কখন তোমার দিকে তাকালাম? যে আমার চেহারা, তার নাম আবার পেয়ারা। ঘটি ডোবেনা, নামে তালুকদার।”
– “আমার নাম তালুকদার নয়।”
– “নাম কি তোমার?”
– “আমার নাম বিদ্যা ”
মেঘালয় বললো, “ও আচ্ছা। সেজন্যই তখন থেকে আমাদের মূর্খ, বেয়াদব এসব বলে যাচ্ছো।”
– “বেয়াদবি করলে বলবো না? আর হ্যা, তুমি অত বড় একটা লোক এরকম বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করেছো কেন? কচি কচি মেয়েদের খুব ভালো লাগে তাইনা? আজকালকার ছেলেরা খুব খারাপ।”
– “কাকে বাচ্চা মনেহচ্ছে তোমার? আচ্ছা কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
– “আমি ক্লাসে কেন পড়বো? আমাকে অতই বাচ্চাবাচ্চা লাগে? আমার চুল দেখেছেন কত বড়?”
সবাই হাসলো। মেয়েটির চুল সত্যিই অনেক লম্বা। কিন্তু চুল লম্বা তো পাঁঁচ বছরের বাচ্চার ও হতে পারে। তাই বলে সে কি বড় হয়ে যায়? আসলেই এই মেয়েটা এখনো অনেক ছোট। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কিসে পড় তুমি?”
– “আমি এইবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে উঠেছি। কলেজে পড়ি।”
– “ওরে বাবা! কলেজে পড়ে!”
সবাই এমন ভাব করলো যেন খুব বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। বিদ্যা এবার খুশি হয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, “এই ছোট মেয়েটা কোন ক্লাসে পড়ে?”
মেঘালয় বললো, “এই ছোট মেয়েটা আমার ওয়াইফ,মিসেস মেঘালয়। সে অনার্স ফাস্ট ইয়ারে।”
বিদ্যা চোখ কপালে তুলে বললো, “আল্লাহ! এত বড়। আমিতো ভেবেছিলাম ক্লাস নাইন টেনে পড়ে। দেখতে তো একদম টিং মিং।”
সবাই হেসে ফেললো। সায়ান এবার আড়চোখে তাকালো। মিশুর জমজ বোন মনেহচ্ছে মেয়েটাকে। মিশু যেমন একটু বেশিই কিউট, এটাও সেরকম। মিশুর চেয়ে আরো বেশি খুকি।
সায়ানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিদ্যা বললো, “বলেছিলাম না আপনি কিভাবে তাকিয়ে থাকেন। তখন তো বিশ্বাস হয়নি। এখন দেখছেন কেন? এভাবে তাকিয়ে থাকলে প্রেম হয়। আর আমি চাইনা আপনার মত থার্ড ক্লাস ছেলের প্রেমে পড়তে। এরকম কত শত ছেলে আমার পিছে পিপড়া আর মৌমাছির মতন ঘুরঘুর করে যেন আমি মধু।”
– “নাহ, আপনি তো মধুর মা।”
– “মধু আমার বাপের নাম। শোনেন,আপনি কিন্তু খুব লুচ্চা।”
সায়ান হেসে বললো “এভাবে ছেলেদের গালি দিতে ওরা প্রেম তো দূরে থাক, তোমার ধারে কাছেও ঘেষবে না। মুখে লাগাম দাও বুঝলে।নয়ত কপালে বর জুটবে না।”
– “ইহ,কত ছেলে লাইন লেগে আছে। আপনার মত ছেলে ছেলেকে লুচ্চা বলেছি এটা আপনার ভাগ্য। আপনাকে তো একেবারে মিশা সওদাগরের মতন লাগে।”
তারপর আরাফের দিকে তাকিয়ে বললো, “আর আপনাকে গাংগুয়ার মতন লাগে।”
আরাফ জিজ্ঞেস করলো, “গাংগুয়া যেন কে?”
সবাই হেসে উঠলো। মেয়েটি যা মুখে আসছে সবাইকে গালি দিয়ে যাচ্ছে। শুনতে শুনতে মেজাজ খারাপ হয়ে উঠছে আবার ভালো ও হচ্ছে। কখনো রাগ ওঠে, কখনো হাসি পায়। মেঘালয়কে এই জীবনে কেউ প্রথমবার বেয়াদব বলেছে সেটা নিয়ে খুব হাসাহাসি হলো।
বাংলোয় ফিরে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলো সবাই। খাওয়া দাওয়ার পর সায়ান গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার জন্য বললো। বিদ্যাকে ওর হোটেলে রেখে আসা হবে। কিন্তু গাড়ির কাছাকাছি এসে বিদ্যা বললো, “এখন গিয়ে তো লাভ হবেনা। হোটেলে তো আমাকে থাকতে দেবেনা।”
সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
বিদ্যা বললো, “আমাদের আজকেই ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা ঢাকার পথে পারি দিয়েছে।”
“সেটা এতক্ষণ বলোনি কেন? তুমি এখন যাবে কোথায়?” -উদ্বিগ্ন হয়ে মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো। বিদ্যা বললো, “আমি এখন আপনাদের সাথে থাকবো। আপনারা যেদিন চলে যাবেন আমিও যাবো।”
অচেনা একটা পাগলী মেয়েকে এভাবে রাখতেও ভরসা পাচ্ছেনা মেঘালয়। তার উপর মেয়েটি একদম অবুঝ। অনেক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো কি করা যায়। বিদ্যার কাছে নাম্বার নিয়ে ওর বাবাকে কল দিয়ে কথা বলিয়ে আশ্বস্ত করলো মেঘালয়, মিশু ও রোদ। বিদ্যা নিজেও কথা বলে বাবাকে নিশ্চিত করে দিলো। ওর বাবা বললেন উনি এসে মেয়েকে নিয়ে যাবেন সিলেট থেকে। মেঘালয় নিজের পরিচয় দিয়ে দেয়ার পর উনি একটু নিশ্চিত হয়েছেন। সবকিছু মিটমাট হয়ে গেলে যে যার রুমে শুতে গেলো। বিদ্যাকে ঘুমাতে দেয়া হলো রৌদ্রময়ীর সাথে।
কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি ই ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটি। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বিছানার উপর থ মেরে বসে রইলো। রোদের দিকে অনেক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। ওর মাথায় এখান শয়তানী বুদ্ধি খেলা করছে। ঘুম আসছে না কিছুতেই।
বারান্দায় বের হয়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ও। বাইরে খুব সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে। চাঁদের আলো আর কুয়াশা মিলে অন্যরকম সৌন্দর্য ধারণ করেছে প্রকৃতি। বিদ্যা চুপচাপ খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে একদম নড়াচড়া বিহীন ভাবে। একটু পরেই সায়ান বাথরুমে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে বের হলো। সায়ানের দরজার সামনেই পিছন দিকে ফিরে বাইরে চেয়ে আছে বিদ্যা। বাংলোয় এসে বিদ্যা মিশুর জামা পড়ে নিয়েছে। পিছনে লম্বা চুল গুলো পিঠ জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে। সায়ান দরজা খুলেই ওকে দেখে ভয়ে ঢোক গিললো। যখন বুঝতে পারলো এটা বিদ্যা ও এসে পাশে দাঁড়ালো।
বিদ্যা সায়ানকে দেখে বলল, “কিরে বেয়াদব ছেলেটা, একটা মেয়েকে একলা দেখেই এসে দাড়াতে হবে?”
সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে বেয়াদব মনে হয় তোমার?”
– “সব এঙ্গেল থেকে। আয় বাইরে যাই, হেঁটে আসি। যাবি? ”
সায়ান থতমত খেয়ে ঢোক গিললো। ওরা নিশ্চয়ই কোনো ভূত পেত্নী তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। কোনো স্বাভাবিক মেয়ে এরকম হতে পারে? আজব ক্যারেকটার একটা। এত রাতে সে নাকি বাগানে যাবে হাঁটতে!
বিদ্যা বললো, “যাবানা? না গেলে এইখানে খাম্বার মত দাঁড়াইয়া থাকো, আমি যাই হেঁটে আসি।”
বলেই বারান্দা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলো। সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা নিয়ে নিজেও নেমে পড়লো। কোনো একটা অচেনা শক্তি যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। হা করে চেয়ে আছে বিদ্যার দিকে, আর অপ্রকৃতস্থের মত পিছুপিছু যেতে লাগলো।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৪

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৪
মিশু মনি
.
৫২.
ঢাকায় পৌছে নিখিল ও দুপুর সরাসরি মেঘালয়ের বাসায় চলে এলো। আকাশ আহমেদ চাবি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুপুর চোখ বড়বড় করে বললো, “ওমা! এত সুন্দর বাড়ি! রীতিমত প্যালেস!”
নিখিল ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই মেইন দরজা লক করে দিলো। ওরা বাইরে থেকে খেয়েই এসেছে। ফ্রেশ হয়ে দুপুর রুমে আসার পর নিখিল বাথরুমে চলে গেলো।
নিখিল বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখলো দুপুর বিছানায় শুয়ে আছে। ওর শাড়ি হাঁটু অব্দি উঠে থাকার কারণে ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। ও এসে বললো, “শাড়ি ঠিক করে নাও।”
দুপুর শাড়ি ঠিক করতে করতে বললো, “তো কি হয়েছে? তুমি আর আমি ই তো। আর কে বা আছে এই বাড়িতে?”
– “এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি দুপুর। এমন কোনো কিছু করোনা যাতে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।”
দুপুর এসে নিখিলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “উম, কবে বিয়ে করবো আমরা?”
নিখিল দুপুরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাশে বসলো। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, “আরো অনেক সময় লাগবে। এটা সিনেমা নয় যে আজকে বিয়ে করলা, কালকে ডিভোর্স দিয়ে আবার পরশু আরেকজন কে বিয়ে করলা।”
দুপুর বাচ্চাদের মতন মুখ করে বললো, “এভাবে বলছো কেন?”
নিখিল হেসে বললো, “সরি লক্ষিটি। আমি ভাবছি সবকিছু নিয়ে। আরো অনেক সময় লাগবে সবকিছু সামলে নিতে। প্রথম কাজ হচ্ছে তোমার বাবা আর অরণ্য’র বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে সবকিছু বুঝিয়ে বলা। এজন্য ও কিছুদিন সময় দরকার। আমরা এখানে কিছুদিন থাকার পর ওনাদেরকে ডেকে এনে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। আমি কোনো ঝামেলা পছন্দ করিনা। সবকিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে যাক সেটাই চাই। সেজন্য সময় আর ধৈর্য দরকার।”
দুপুর জিজ্ঞেস করলো, “তারপর কি হবে?”
নিখিল বললো, “ওনারা নিজে থেকে তোমার আর অরণ্য’র তালাকের ব্যবস্থা করবে। আমাদেরকে কিছুই করতে হবেনা। আমাদের একটাই কাজ সেটা হচ্ছে ওনাদেরকে ভালোমতো বুঝিয়ে বলা। আর আমার দ্বিতীয় দায়িত্ব, এর মধ্যে একটা চাকরী জুটিয়ে ফেলা। আমি চাকরী পেয়ে গেলে বাসায় জানাবো তোমার কথা। ততদিনে সবকিছু আশাকরি ঠিকঠাক হয়ে যাবে, আমি পালিয়ে বিয়ে করতে চাইনা দুপুর। বাবা মা তোমাকে সম্মানের সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যাক সেটা চাই।”
দুপুর নিখিলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি এত ব্রিলিয়ান্ট কেন শুনি? এরই মধ্যে এতকিছু ভেবেও ফেলেছো? এজন্যই এত ভালোবাসি তোমায়।”
– “ভালোবাসো ভালো কথা। গলায় বাঁদরের মত ঝোলাঝুলি করছো কেন?”
– “ইস! এরকম করছো? যাও,আমি অরণ্য’র কাছেই চলে যাবো। তুমি খারাপ। আমাকে একটুও ভালোবাসো না।”
নিখিল দুপুরকে বুকে নিয়ে বললো, “এখানে কান পেতে শোন তো ভেতরে কি বলে? এই কটা দিন আমার কি অবস্থায় গেছে জানিস?”
– “হুম জানি। আমি না জানলে আর কে জানবে?”
– “এবার লক্ষী মেয়ের মত ঘুমাও তো তুমি।”
দুপুর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, “ঘুমাবো? সারারাত জেগে জেগে গল্প করবো ভাবলাম।”
– “মাইর দিবো তাহলে। এমনিতেই এই কদিনে চেহারার অবস্থা বারোটা বাজিয়ে ফেলেছো। এখন তুমি শুয়ে একটা ঘুম দিবা। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবা।”
– “আর কিচ্ছু করবো না?”
– “না, আর কিচ্ছু করবো না।”
– “সিরিয়াসলি? থাকতে পারবা তুমি?”
নিখিল হেসে বললো, “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখি। একদিন তোমার আপুকে বিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সারারাত তোমার বিছানায় ছিলাম মনে পড়ে? সারাটা রাত তুমিই ছটফট করেছো, আমি স্বাভাবিক ছিলাম। তোমাকে শুধু বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছি। আর কিচ্ছু করিনি।”
– “এত ভালো হলে চলে?”
– “বারে, খারাপ হলেও দোষ আবার ভালো হলেও দোষ?”
দুপুর হেসে ফেললো। বললো, “নাহ ঠিকাছে। এতকিছুর পরেও তোমাকে পাচ্ছি সেটাই অনেক। এখন আমি তোমার জন্য এক যুগ অপেক্ষা করতে পারবো। শুধু আমার সামনে বসে থাকো। আমি শুধু দেখবো আর থাকবো।”
নিখিলের বুকে মাথা রেখে মাথাটা উপরে তুলে ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো দুপুর। আর কোনোকিছুর প্রয়োজন ই তো নেই, এই মানুষ টা সারাক্ষণ চোখের সামনে বসে থাকলেই যথেষ্ট। আর কি ই বা চাই? একটা জীবন এভাবে দেখে দেখেই পার করে দেয়া যাবে।
৫৩.
সকালে মিশুর ঘুম ভাংলেও শুয়েই রইলো ও। মেঘালয় বলে দিয়েছে যেন ওকে ফেলে না ওঠা হয়। আগে ঘুম ভাংলেও শুয়ে থাকতে হবে। মিশু মাথাটা তুলে মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকালো। জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদের ঝিলিক এসে মেঘের মুখের উপর পড়েছে। কি দারুণ দেখতে লাগছে মেঘালয়কে! ফর্সা মুখে লাল রোদ পড়ে কেমন রাঙা হয়ে উঠেছে চেহারাটা। ঘন ঘন দুটো ভ্রুয়ের নিচে দুটো টানা চোখ, চোখের পাপড়ি গুলোও খুব ঘন আর সুন্দর। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো একটু বড় হয়ে গেছে। শুভ্রতা ছেয়ে আছে গালে, নাকে মুখে। কি সুন্দর গোলাপের পাপড়ির মতন ঠোঁট! নাকটা লম্বা, গলাটা একটু বেশিই ফর্সা। গলা থেকে বুকের দিকে নামলে পাঞ্জাবির উপরের বোতাম টা খোলা রাখলে যতটুকু জায়গা দেখা যায়, মেঘালয়ের ওই জায়গা টুকু পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্য মনেহয়। ফর্সা বুকে দু একটা লোম উঁকি দেয়, কি যে মায়া লাগে!
মিশু অনেক্ষণ এভাবে চেয়ে চেয়ে এসব ভাবতে লাগলো। মেঘালয় চোখ মেলে তাকালো। মিশুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মিশুর কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে বললো, “সুপ্রভাত মিষ্টি মিশু।”
মেঘালয়ের উষ্ণ স্পর্শে মিশু আবেশে চোখ বুজে ওর বুকে মাথা রেখে বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে লাগলো। যেন ওর হার্টবিট প্রতি স্পন্দনে বলছে, “মিশু ভালোবাসি তোমাকে, ভালোবাসি মিশু।”
মিশু আলগা হাতের আলতো বাঁধনে আঁকড়ে ধরে রইলো ওর প্রিয় মানুষ টাকে।
বাংলোর পাহারাদার সকালে গরম গরম ফুলকো লুচির সাথে তরকারী রান্না করেছেন। সাথে গরম চা ও। মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা একসাথে বসে নাস্তা করে নিলো। এরপর বেড়িয়ে পড়া হলো ঘুরতে যাওয়ার জন্য। আজকের গন্তব্যস্থান জাফলং। জাফলং এর রাস্তাও খুব খারাপ। লেগুনায় ওঠার সময় পূর্ব ও রোদ পাশাপাশি বসলো। তাই দেখে মিশু বললো, “আজকে পূর্বে দারুণ রোদ উঠবে।”
সবাই মুচকি হাসলো। মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসে মিশুকে সবার শেষে বসতে দেয়া হলো যাতে রাস্তা দেখতে দেখতে যেতে পারে। জাফলং এর রাস্তাটা খারাপ হলেও দেখতে সুন্দর। মেইন রোড ধরে যাওয়ার সময় অনেক সুন্দর চা বাগান, পাহাড় আর এক সাড়িতে তিনটা ঝরনাও দেখতে পাওয়া যায়। মিশুর আবার ঝরনার প্রতি খুবই দূর্বলতা। কিন্তু একটাই সমস্যা, রাস্তায় প্রচণ্ড ধূলা। আজকে মিশু একটা রাউন্ড ফ্রক জাতীয় ড্রেস পড়ায় ওকে একদম পুতুলের মত লাগছে। ওদের সবাইকে একসাথে দেখলে সবার আগে মিশুর দিকে নজর যাচ্ছে, নিতান্তই ছোট্ট বাচ্চা মনেহচ্ছে ওকে। মেঘালয় সিটে বসে একহাতে ওকে ধরে রইলো।
গতকালের লেগুনা টাই আজকেও নেয়া হয়েছে। ড্রাইভারের সাথে বেশ খাতির জমে গেছে। উনি বললেন,”মামারা আজকেও গান ধরেন।”
পূর্ব দুষ্টুমি করে বললো, “অবশ্যই মামা। আপনাকে খুশি করার জন্য আজকে আমি পেট ভর্তি করে খায়া এনার্জি বাড়াইয়া আনছি। আজকেও ফাটাইয়া দিবো মামা।”
ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসলেন। পূর্ব সবার উদ্দেশ্যে বললো, “গান শুরু করা যাক তবে। মেঘ দোস্ত, সাব তেরা গানটা ধর। ওকে ফ্রেন্ডস, লেটস স্টার্ট।”
“Na jiya zindagi ek pal bhi
tujshe hoke judaa sun zara
bin tere mujshe naaraaz tha dil
tu mila hai toh hai keh raha…”
“Main toh tere rang mein
rang chuka hoon
bas tera ban chuka hoon
mera mujhme kuch nehi sab tera…”
গানের মাঝখানে মিশু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “ধেৎ একদম মজা হচ্ছেনা। মজা হচ্ছেনা, মজাই হচ্ছেনা। ঝাকানাকা গান ধরো। কালকের মত মজার গান শুরু করোনা কেন?”
পূর্ব বললো, “লুঙি কো উঠানা পাড়েকা?”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু বললো, “না, সানি রকস। মেরে পিছে হিন্দুস্থান হ্যায়। নয়ত আজ ব্লু হ্যায় পানি পানি সানি সানি।”
সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। মেঘালয় মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিলো। মিশু চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। ওর ও হাসি পাচ্ছে। ও সরল মনে বললেও সবাই হাসবে এটাই স্বাভাবিক। বলার আগে কি আর বুঝতে পেরেছে সবাই হাসবে, বুঝলে তো আর বলতো না। গান তো গানই,এখানে এভাবে হাসার কি আছে?
মেঘালয় কণ্ঠে যথাসম্ভব আবেগ ঢেলে দিয়ে গেয়ে উঠলো,
“এক্সকিউজ মি ওয়ান্না লাভ ইউ লাভ ইউ,
এক্সকিউজ মি ওয়ান্না টাচ ইউ টাচ ইউ”
পুরো লেগুনা জুড়ে সবাই হেসে উঠলো। মিশুর ইচ্ছে করছিলো লজ্জায় মেঘালয়ের বুকের ভেতর গিয়ে লুকায়। সবাই হাসছে কেন অযথা? সবাই খুব খারাপ। ও লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। পিংক কালার পুতুলের মত ড্রেস পড়ে এমনিতেই চেহারায় একটা গোলাপি আভা চলে এসেছে। এবার লজ্জায় আরো গোলাপি হয়ে গেলো।
রোদ মাথা নিচু করে হাসছে। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পূর্ব গান গাওয়ার সাথে সাথে পা নাচাচ্ছে। ওর পা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো রোদ। ফর্সা আর পায়ের নখগুলো বেশ সুন্দর, পরিষ্কার। ওর পা নাচানোর মাঝেও একটা আর্ট ফুটে উঠছে, দারুণ লাগছে দেখতে। ওরা এখন সানি সানি গানটা গাইছে। সবাই মিলে একসাথে রিমিক্স দিয়ে গাইছে আর হাতে তালি বাজাচ্ছে। সবার মুখে হাসি লেগে থাকলেও গানটা দারুণ হচ্ছে।
গানের ফাঁকেফাঁকে মেঘালয় মিশুর দিকে তাকাচ্ছিলো। মিশু হাত তালি দিচ্ছে কিন্তু চেয়ে আছে বাইরের দিকে। ওর মুখে হাসি। মেঘালয় যতটা ভালো, ঠিক ততটাই দুষ্টু। এমন ভাবে গাইছে যে মুখে আপনা আপনি দুষ্টুমি হাসি চলেই আসে।
মেঘালয় গেয়ে উঠলো,
“আমি ফাইসা গেছি, আমি ফাইসা গেছি,
আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়…
আমার দিলের চোট বোঝেনা কোনো হালায়..”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু এবার মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা আবার কেমন গান? এ জন্মেও এমন গান শুনিনি।”
মেঘালয় আবারো গাইলো,
” সকাল বিকাল রাইত দুপুর বউয়ে দেয় ঠেলা
কয়, ‘বউ পুষার মুরদ নাই তয় বিয়া করছোস ক্যালা?”
আবারো হাসতে লাগলো সবাই। মেঘালয় সত্যিই খুব দুষ্টু। পাজির পা ঝাড়া, সারারাত মিশুকে জ্বালিয়ে মারে আবার এখনো শুরু করেছে। খুব পাজি একটা।
লেগুনার ড্রাইভার বললো, “মামা ঠিকই কইছেন। বউয়ের এই ঠেলা প্রত্যেকদিন। বউ পোষার মুরদ না থাকলে বিয়ে করছ ক্যান? জীবনটা বরবাদ হয়া গ্যালো।”
পূর্ব বললো, “গেবন শ্যাষ। আহারে গেবন, আহা গেবন,জলে ভাসা মরা মাছ যেমন।”
মিশু বলল, “ঠিকই বলছো। মরা মাছ জলের উপর ভাসতে ভাসতে গন্ধ ছড়ায়। সেই একই দশা হয়েছে জীবনের।”
আরাফ বলল,”কে বলছে জীবন কঠিন? জীবন অনেক সহজ। পানির অপর নাম জীবন, তাহলে জীবনের আরেক নাম পানি। জীবন পানির মত সহজ ”
সবাই হাসলো। মেঘালয় অবাক হয়ে খেয়াল করলো আরাফের রাগ আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। ছেলেটা মিশুর সংস্পর্শে আসার পর থেকে অনেক সহজ হতে শুরু করেছে। মিশুকে বলতে হবে সবসময় ওর সাথে থাকতে আর বেশি বেশি বকবক করতে। তাহলে ছেলেটা একদম আগের মত হয়ে যাবে। মেঘালয় মিশুর কানে কানে বুঝিয়ে বললো ব্যাপার টা। মিশু হেসে ফিসফিস করে বলল, “আচ্ছা হয়ে যাবে। তুমি টেনশন করোনা।”
রাস্তা দিয়ে আসার সময় দূর থেকে মেঘালয় মিশুকে একটা ঝরনা দেখিয়ে দিলো। গাঢ় সবুজের মাঝখানে একটু সাদা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে,সেটাই ঝরনা। এতদূর থেকে দেখার মাঝেও অন্যরকম ভালো লাগা আছে। মিশু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ঝরনার দিকে। এরপর আরো একটা ঝরনা দেখতে পাওয়া গেলে মেঘালয় সেটাও দেখালো ওকে। তিনটা ঝরনাই যখন একসাথে দেখতে পেয়ে মিশু আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠলো। এইতো বাচ্চাটার পাগলামি শুরু হয়ে গেলো। নানান প্রশ্নে মাতিয়ে তুললো মেঘালয়কে।
রাস্তায় একবার লেগুনা দাড় করিয়ে সবাই নেমে প্রাণভরে শ্বাস নিতে লাগলো। জায়গাটা অনেক সুন্দর। চারদিকে শুধু ঘন গাছ,জংগল,চা বাগান,পাহাড় এসবই চোখে পড়ছে। মিশু মুগ্ধতার ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। বারবার মেঘালয়ের হাত চেপে ধরছে ও। কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখা, ছবি তোলাতুলি, চা খাওয়ার পর আবারো লেগুনা ছেড়ে দেয়া হলো।
কিন্তু একদম জাফলং এর কাছাকাছি এসে শুরু হয়ে গেলো ঝাঁকুনি। রাস্তার অবস্থা মারাত্মক রকমের খারাপ। ধূলা, ভাঙা চূড়া রাস্তায় লেগুনা রীতিমত হেলেদুলে যাচ্ছে। সবাই টুকটাক গল্প করছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আড্ডা বেশ জমে গেছে। এভাবে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ওরা পৌছে গেলো। লেগুনা থেকে নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো জাফলং এর পথে। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে ডাউকি আর মেঘালয়ের সৌন্দর্য দেখলো ওরা। ডাউকির সাদা সাদা ছোট ছোট ঘরগুলো দূর থেকে দেখতে দারুণ লাগছে। মিশুর ইচ্ছে করছে সেখানে ছুটে চলে যায়।
ডাউকির দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে ও মেঘালয়ের হাত ধরে হাঁটছিলো। নূড়ি পাথর, কাচ, গুড়ি বালি, উঁচু নিচু টিলা, পাহাড় সব পেড়িয়ে ওরা এসে নদীর তীরে দাঁড়ালো। চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মিশু অন্য এক জগতে ডুবে গেছে। নৌকায় করে জাফলং এ এসে কিছুক্ষণ সময় কাটালো ওরা। নেমে হেঁটে হেঁটে মায়াবী ঝরনায় যাওয়ার জন্য আবারো হাঁটা ধরলো। জাফলং এ আর আগের মত পাথর নেই। শুধু পানি ই চোখে পড়ছে। মেঘালয়ের হাত ধরে মায়াবী ঝরনায় যাওয়ার সময় মিশু পাশের পাহাড় আর ঝাউ জংগল দের সাথে কথা বলছে। পাহাড়ের সাথে কথা বলতে দেখে সবাই হাসছিলো। কিন্তু মিশুর অন্যদিকে মনোযোগ নেই। ও পাহাড় দেখছিলো আর কথা বলছিলো। নিচু হয়ে গুড়ি গুড়ি বালির সাথে কথা বলছিলো। পাথরের সাথে, আকাশের সাথেও কথা বলছিলো। মেঘালয় শুধু অবাক হয়ে এই পাগলির পাগলামি দেখছিলো। মায়াবী ঝরনায় পৌছে ওরা ঝরনা স্নান করে নিলো। মিশু ঝরনার পানি গুলোর সাথেও কথা বলছিলো।
জাফলং ছেড়ে বের হলো রাত্রিবেলা। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। মৃদু কুয়াশা পড়েছে। শীত শীত লাগছে সবার। জাফলং এ পূর্ণিমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এসব নিয়ে গল্প করতে করতে লেগুনা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলো শহরের দিকে। রাত নেমেছে অনেক আগেই। মেঘালয় তিনটা চাদর এনেছিলো। একটা ও আর মিশু গায়ে দিলো, একটা আরাফ ও সায়ান আর অন্য চাদরটা রোদকে একাই দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু রোদ চাদর টা সায়ানের গায়ের উপরেও ফেলে দিলো। একে অপরের শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছিলো।
মেঘালয় চাদরের ভেতর দিয়েই মিশুকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখায় মিশুর একটু ও ঠাণ্ডা লাগছে না। এরকম একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ায় নিজেকে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো ওর। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে লেগুনা দাঁড়িয়ে পড়লো। ওরা জিজ্ঞেস করলো, “মামা কি হলো? গাড়ি থামালেন কেন?”
ড্রাইভার উত্তর দিলো, “সামনে দেখেন ওইটা কি?”
সবাই উঁকি ঝুঁকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো। রাস্তার দিকে তাকানো মাত্রই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো সবার। রৌদ্রময়ী শিউড়ে উঠলো। মিশু ভয়েই মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরলো।
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩৩

0

অনুভূতি
পর্ব ৩৩
মিশু মনি
.
৫১.
রাত্রিবেলা সবাই মিলে আড্ডায় বসেছে। বাংলোর সামনে কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চারিদিকে বসে সবাই মিলে আগুন পোহাচ্ছে আর গল্প করছে। মৃদু কুয়াশা পড়েছে চারিদিকে, আজ আবার পূর্ণিমা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় চা বাগানের পাতাগুলো চকচক করছে। পুরো বাগান একদম নিস্তব্ধ। সুবিশাল চা বাগানের পাশে আবার ঘন ঝোপ জংগল। রাতের নির্জনতা আরো বেশি তীব্র হয়ে উঠেছে। ঝিঝির ডাক কানে আসছে। এরকম পরিবেশে কাঠখড়িতে আগুন লাগিয়ে আগুন পোহানো আর আড্ডা দেয়ার মাঝে অন্যরকম একটা আনন্দময় উত্তেজনা কাজ করছে সবার মধ্যে।
মিশু ও মেঘালয় পাশাপাশি বসেছে। মিশুর পাশে রৌদ্রময়ী ও সায়ান। পূর্ব ঠিক রোদের সামনে মুখোমুখি হয়ে বসেছে। এভাবে বসার কারণে সরাসরি চোখ চলে যাচ্ছে রোদের দিকে। পূর্ব অজান্তেই বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। নিজেও জানেনা এতবার তাকাচ্ছে ও। কিন্তু রৌদ্রময়ী বুঝতে পারছে পূর্ব বারবার ওকে খেয়াল করছে। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।
সায়ান গিটারে টুংটাং সুর তোলার চেষ্টা করছে। মিশু ও রোদ দুজনে গল্প করছিলো এতক্ষণ। গিটারে মিউজিক ওঠার পর ও থামলো। মেঘালয় ই প্রথমে গান শুরু করলো,
“সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই
বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই
একলা রাধে জল ভরিতে যমুনাতে যায়,
পিছন থেকে কৃঞ্চ তখন আড়ে আড়ে চায়..
জল ভর, জল ভর রাধে ও গয়ালের ঝি
কলস আমার পূর্ণ করো রাধে বিনতি..
কালো মানিক হাত পেতেছে চাঁদ ধরিতে যায়,
বামন কি আর হাত বাড়ালেই চাঁদের দেখা পায়?
কালো কালো করিস না লো ও গয়ালের ঝি,
আমায় বিধাতা করেছে কালো আমি করবো কি?”
এই লাইনটা গাওয়ার সময় মেঘালয়ের গলায় অন্যরকম কম্পন হলো। কণ্ঠের ওঠানামার সাথে গানের লিরিকটা মিশে একদম অন্যরকম লাগছিলো। গানের কথাগুলো যেন রোদকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া হচ্ছে। রোদ মাথা নিচু করে আগুনের দিকে চেয়ে আছে। ওর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। পূর্ব খেয়াল করলো রোদের চোখের পানি। ইশারায় মেঘালয়কে থামতে বলল ও। মেঘালয় থামলো না। গাইতে গাইতে হুট করেই এক গান থেকে অন্য গানে চলে গেলো। পূর্ব হাসলো মেঘালয়ের গান বদলানো দেখে। আর কেউ কিছু বুঝুক না বুঝুক মেঘালয় সবকিছু বুঝে ফেলে। ও অন্য একটা গান শুরু করে দিলো,
“আমি ভাবতে পারিনি তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ…”
“আমি থামতে পারিনি তোমার গালে নরম দুঃখ আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ..”
পূর্ব মুচকি হাসলো। রোদ চোখ তুলতেই ওর সাথে চোখাচোখি হলো। এবার গানটা একদম ঠিক আছে। মেঘালয় গেয়েই যেতে লাগলো। মিশু নিষ্পলক ভাবে চেয়ে আছে মেঘালয়ের পানে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। আস্তে আস্তে কি ও মেঘালয়ের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? প্রেমে পড়ার অনুভূতি কি এমন হয়? বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়। কেমন কেমন যেন লাগতে থাকে সবসময়। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে,ছুতে ইচ্ছে করে। এত কাছে থেকেও এক ধরণের বিষণ্ণতা ছেয়ে যায় সবসময়।
মেঘালয় গান শেষ করতেই সায়ান মিশুকে বললো, “ম্যাশ ভাবি এবার আপনি গান গেয়ে শোনাবেন।”
মিশু লাফিয়ে উঠলো, “আমি! না না না।”
– “বারে, সেদিন ডান্স দিলে আর আজকে গান শোনাতে পারবা না? গান গাইতেই হবে। শুরু করো তো।”
সব বন্ধুরাই মিশুর গান শোনার জন্য জোড় করতে লাগলো। এমনকি রোদ ও মিশুকে অনুরোধ করছে একটা গান শোনানোর জন্য। মিশু করুণ চোখে মেঘালয়ের দিকে চাইলো। মেঘালয় তো ডান্স দেয়াতে রেগে গিয়েছিলো, আজকেও কি রেগে যাবে নাকি? থাক, গাওয়া যাবেনা।
মেঘালয় নিজেই ওকে বললো, “সবাই এত করে বলছে একটা গান শুনাচ্ছো না কেন মিশু? শোনাও”
মেঘালয় ও দুবার বললো। মিশুর আর ভয় হচ্ছেনা। রাত বেড়ে যাচ্ছে, মাথার উপর কুয়াশা পড়ে ভিজে যাচ্ছে চুল। সামনে আগুন, গোল হয়ে বসে আছে বন্ধুরা। সবাই নিশ্চুপ,রাতের নির্জনতা বিরাজ করছে সবার মনে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ঝিঝি ডাকছে,চা বাগানের অন্যরকম একটা শব্দ আছে। কেমন যেন ভৌতিকতা বিরাজ করছে। রাতের পোকারা ডাকছে, নির্জনতা কানে এসে বাজছে। সবমিলিয়ে অদ্ভুত মুগ্ধতা ছড়িয়েছে সবখানে। মিশু চোখ বন্ধ করে গান গাইতে আরম্ভ করলো,
“কার্নিশে ভূল,অবেলা বকুল
থাকো ছুঁয়ে একুল ওকুল..
থাকো ছুঁয়ে শহুরে বাতাস,
ছুঁয়ে থাকো নিয়ন আকাশ..
আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন,
অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন..
আহারে জীবন, আহা জীবন..
জলে ভাসা পদ্ম যেমন…”
মিশুর কণ্ঠে অদ্ভুত মায়া। খুব অনুভূতি নিয়ে গাইছে গানটা। ওর গলার স্বরের সাথে রাতের নির্জনতা মিশে গিয়ে বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে সবার। গানের প্রত্যেকটা শব্দ ও এমনভাবে উচ্চারণ করছে যে সবাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। যার যত সুপ্ত ব্যথা আছে,সব ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। রোদের চোখ ছলছল করছে। বাকিরা একদম স্তব্ধ।
মিশু গেয়েই চলেছে,
“আহা পারতাম,যদি পারতাম..
আঙুল গুলো ছুঁয়ে থাকতাম..
বিষাদেরই জাল টালমাটাল,
এ কোন দেয়াল, এ কোন আড়াল
ছাই হয় গোধূলি কারে যে বলি..
এ কোন শ্রাবণ আজ বয়ে চলি…
আহারে জীবন, আহা জীবন..
জলে ভাসা পদ্ম যেমন…”
মিশুর চোখ বন্ধ। কিন্তু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কাঠখড়ির আগুনের আলোয় চিকচিক করছে ওর গাল। ওর মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে থেকে মেঘালয়ের বুকের চিনচিন ব্যথাটা আরো বেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই সবাই নস্টালজিক হয়ে পড়েছে। মিশু গানটা গেয়েই যাচ্ছে। ওর গাল বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। বাকিরাও সবাই হঠাৎ ই কেমন যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। এই গানটা তো ওরা অনেক বার শুনেছে,কিন্তু আজকে মিশুর গলায় শুনেছে কেমন যেন বুকটা ব্যথা করছে। পুরনো লুকানো কষ্টগুলো জেগে উঠছে সব।
সবার আগে আরাফ উঠে দাঁড়ালো। ওর ও খারাপ লাগছে এভাবে বসে থাকতে। আরাফ উঠে হেঁটে চলে গেলো। মিশু চোখ বন্ধ করে গেয়েই যাচ্ছে। রোদ ও আর বসে থাকতে পারলো না। ওর এখন কাঁদতে হবে, যেকোনো কোথাও গিয়ে সবার আড়ালে বসে কাঁদতে হবে ওকে। কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারছে না ও। রোদ উঠে যাওয়ার পর পূর্ব ও চিন্তিত মুখে রোদকে অনুসরণ করলো। মেঘালয় অবাক হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলো। সায়ান একাই বসে থাকবে কিভাবে তাই সেও উঠে এলো। ওর গায়ে থাকা চাদর টা মেঘালয়কে দিয়ে ইশারায় মিশুকে পড়িয়ে দেয়ার কথা বলে সায়ান ও চলে গেলো। এখন খোলা আকাশের নিচে আগুনের পাশে শুধু মিশু আর মেঘালয় ই বসে রইলো।
“মেঘে মেঘে জমে আজ বেদনার বাঁধ,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে থেকে থেকে জলের নিনাদ…”
মেঘালয় মিশুর কাঁধে হাত রাখলো। মিশু চোখ মেলে তাকালো। মেঘালয় ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “মিশু, ভালোবাসি তোমাকে।”
মিশু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মেঘালয় ওকে বাঁধা দিলো না। কোনো অচেনা ব্যথা নাড়া দিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরেছে ও। তাই আর কোনো শব্দও করলো না। মিশু অনেক্ষণ ধরে কান্না করার পর চোখ মেলে তাকালো। অবাক হয়ে বললো, “সবাই গেলো কোথায়?”
– “তুমি সবাইকে ইমোশনাল করে দিয়েছো। কেউ কারো চোখের জল কাউকে দেখাতে চায়না।”
– “কি বলো? আমার না হয় কষ্ট হচ্ছে,সবার কেন হবে? সবার ই কি কষ্ট আছে?”
– “সবার ই নিজস্ব কিছু বেদনা আছে মিশু। কারো কম,কারো বেশি। কিন্তু কষ্ট সবার ই ভেতরে চাপা আছে।”
মেঘালয় মিশুকে বুকে আলতো করে চেপে ধরে চাদর টা দুজনের গায়েই দিলো। একটা চাদরের ভেতরে দুজনে গুটিসুটি মেরে বসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রইলো। মাথার উপর টুপটুপ করে কুয়াশা পড়ছে। রাত বেড়ে অনেক হয়েছে। কিন্তু এই নির্জনে এভাবে জড়াজড়ি করে বসে থাকতেও সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। সাথে একটা নীল বেদনাও ছেয়ে আছে।
মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেঘমনি।”
– “হুম বলো। আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবো মিশু।”
মিশু একটু সময় নিলো। চোখ মুছে ওর বুকে আরো একটু মুখ গুঁজে দিলো। হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে ওর বুকে মাথা রেখে বলে যেতে লাগলো।
“আমার সাথে সবসময় এমন কেন হয়? আমি সেই কৈশোর থেকেই বারবার এই জিনিস টার সম্মুখীন হই। আমাকে তো ছোটবেলা থেকেই রোজগার করে করে খেতে হয়। জানো,যখন আমি কারো কাছে কাজের জন্য যাই। কতজন আমাকে কত রকম বাজে প্রস্তাব দেয়? একদিন এক কর্মকর্তার কাছে দেড় ঘন্টার মত বসে ছিলাম যেন ওই প্রজেক্টের কাজে আমাকে কর্মী হিসেবে নেয়। কিন্তু দেড় ঘন্টা পর সবাই চলে গেলে আমাকে একা পেয়ে উনি বললেন, ‘এত সুন্দর শরীর থাকতে এভাবে কাজের জন্য বসে থাকা লাগে? সন্তুষ্টির বিনিময়ে সন্তুষ্টি। খুব বাজে উক্তি করেছিলো। এরকম প্রায় ই হয় আমার সাথে। শুধু আমার সাথেই সবাই কেন এমন করে মেঘালয়?”
মেঘালয় নিশ্চুপ। মুখে কথা আসছে না। মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আছি তো। আর কেউ কখনো এভাবে বলার সাহস পাবেনা মিশু।”
মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আর হয়ত পাবেনা। কিন্তু আমার ভেতরে যেগুলো চাপা পড়ে আছে এসব তো কখনো মুছবে না আমার মাথা থেকে। লোকাল বাসে উঠলে দু একটা ছেলে পিছনে হাত বুলিয়ে চলে যায়, বুকে পেটে হাত দিয়ে চলে যায়। ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবা, সেখানেও এরকম লাঞ্চনার শিকার হতে হয়। একবার বাড়িতে কেউ ছিলোনা, এক কাজিন এসে সুযোগ নিলো। আমার সাথেই কেন এমন হয়? আর কারো সাথে তো এমন হয়না। আমার সাথে কেন সবসময় এমন হয়?”
মিশু অঝোর ধারায় কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে মেঘালয়ের শার্ট খামচে ধরে বললো, “আমি আর কিছু বুঝি বা না বুঝি ধর্ষিতা কিভাবে হয় সেটা ঠিকই বুঝি। আর শরীরের দিকে সবাই কিভাবে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।আমার যে আর কোনো উপায় ও নেই। আমার বাবা নেই, মা অসুস্থ। আমি যদি নিজে রোজগার না করি, আমার মা বোন না খেয়ে মরবে। আর যদি রোজগারের জন্য বাইরে বের হই, অফিসেও জামার নিচ দিয়ে কেউ শরীরে হাত দেবে। এসবের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভাবি, আমি বাইরে বের হবোনা, সারাদিন ঘরে বসে থাকবো। তাহলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের।”
মেঘালয়ের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মিশুর ভেতরে এত চাপা কষ্ট জমে ছিলো ওর জানা ছিলোনা। এতটুকু বয়সেই এরকম যন্ত্রণা গুলো নিয়ে মেয়েটা বেঁচে আছে কিভাবে? আর কোনোদিনো এক বিন্দু কষ্টকেও মিশুর ধারেকাছে পৌছাতে দেবেনা মেঘালয়। এতে নিজের জীবন চলে যায় যাক।
মেঘালয় মিশুকে শক্ত করে ধরে বললো, “আমি এখন তোমার সব। আমাকে নিয়ে বাঁচবা, আর কক্ষনো এরকম কিছু তোমার সাথে ঘটবে না।”
মিশু মেঘালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি না হয় একটা মিশুর দায়িত্ব নিলে। সারাদেশে এমন হাজার হাজার মিশু আছে যাদেরকে পেটের দায়ে রোজগার করতে নামতে হয়েছে। কিন্তু মানুষ তাকে সুযোগ পেয়ে সিচুয়েশনে ফেলে ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। এরকম মিশুদের কান্না দেখার মত কেউ নেই।”
মেঘালয় বললো, “আমি জানি। আমার ইচ্ছে করতো সব দুঃখী মেয়ের জন্য কিছু করি। কিন্তু সেটা তো হয়ে ওঠেনা। সবার জন্য কিছু করতে না পারি, একটা মানুষের মুখে তো হাসি ফোটাতে পারি। পারিনা?”
– “তুমি খুব ভালো মেঘালয়, খুব ভালো।”
– “আমি খারাপ। আমিও ট্রেনের ভেতর কন্ট্রোল হারিয়ে তোমাকে চুমু খেয়ে ফেলেছিলাম।”
মিশু বললো, “সে জন্যই তো তুমি ভালো। এই ছোট্ট একটা ভূলের জন্য তুমি আর কোনোকিছু না ভেবেই সেদিন ই আমাকে বিয়ে করে ফেললে। শুধুমাত্র এই ছোট্ট পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে, আমার কান্নার মূল্য দিতে। আর কোন ছেলে ই বা এটা করবে?”
মেঘালয় মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চোখ মুছে দিলো। একই চাদরে দুজনে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো অনেক্ষণ। রাত বেড়ে যাচ্ছে, মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে মিশুকে কোলে তুলে নিলো। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিলো ভালোমতো। মিশু ওর গলা ধরে রইল দুহাতে। মেঘালয় ওকে নিয়ে রুমের দিকে পা বাঁড়ালো। দূর থেকে ওদেরকে এভাবে দেখলো রোদ ও পূর্ব। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মিশু মেঘালয়ের দিকে চেয়ে ছিলো নিশ্চুপ হয়ে। মেঘালয় ওর চোখ মুছে দিয়ে বুকে চেপে ধরে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল,মিশু অঝোর ধারায় কাঁদছিল। এসব দেখে রোদের ও ইচ্ছে করছিলো এভাবে কারো বুকে মাথা রেখে কাঁদতে পারতো যদি!
এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পূর্বই প্রথম কথা বললো, “রোদ।”
রোদ চমকে উঠে বললো, “হুম, আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?”
– “তোমাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তুমি একা থাকলেই তোমার আপসেট লাগবে।”
– “আমার মনটা আপনারা অনেক ভালো করে দিয়েছেন। সবসময় মন ভালো করে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকলে তো সারাক্ষণ আমাকে পাহারা দিতে হবে।”
– “তা হোক। সারাক্ষণ পাহারা দিলেও যদি একটা মানুষের মন ভালো রাখা যায় সেটাই বা কম কিসে বলো? মেঘালয় নিজের সবটুকু দিয়ে ওই মেয়েটার সমস্ত কষ্ট দূর করে দিতে পারলে আমি কেনই বা শুধু মনটা ভালো রাখতে পারবো না বলো?”
রোদ হাসার চেষ্টা করে বললো “আপনারা অনেক ভালো। আমার লাইফে আমি কক্ষনো এরকম মানুষ দেখিনি।”
পূর্ব বললো,”আমি ছোটবেলা থেকেই মেঘালয়ের সাথে বড় হয়েছি। আমরা চার বন্ধু একসাথে আছি প্রায় ছ বছর হলো। কেউ কাউকে ছাড়িনি মুহুর্তের জন্যও। আর অন্য কারো সাথে এত ভালো বন্ধুত্বও করিনি। কারণ কারো সাথে আমাদের এরকম মনের মিল হতোনা। সবাই শুধু নিজের স্বার্থ খোঁজে। একমাত্র মেঘালয়, সায়ান আর আরাফ কেই দেখেছি যারা কক্ষনো নিজের স্বার্থের কথা ভাবেনা।”
রোদ বললো, “সত্যিই আপনারা অনেক ভালো।”
পূর্ব আকাশের দিকে তাকালো। কুয়াশার মাঝেও চাঁদের সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে। দেখতে খুবই ভালো লাগছে। ও বললো, “রোদ তোমার জোৎস্না ভালো লাগে?”
– “হুম খুব ভালো লাগে। আমার অমাবস্যা এখন বেশি ভালো লাগে। সারাবছর যদি অমাবস্যা লেগে থাকতো তাহলে খুবই ভালো হতো।”
রোদের কথায় অভিমান মেশানো। পূর্ব বুঝতে পেরে বললো কথা ঘুরানোর জন্য বললো, “আচ্ছা আজকে বিছানাকান্দিতে গোসল করতে কেমন লেগেছে বলো?”
– “খুবই ভালো। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে যা আনন্দ হচ্ছিলো!”
এমন সময় আরাফের গলা শোনা গেলো। পূর্ব ও রোদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আরাফ বারান্দায় এসে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আরাফের রাগ মিশ্রিত গলা শুনে রোদ ভয় পেয়ে বললো, “ওনার এত রাগ কেন?”
পূর্ব বললো, “ওই ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। একটা মেয়েকে খুবই ভালোবাসতো ও। একদিন কোনো কথাবার্তা ছাড়াই মেয়েটি রাতে ফোন দিয়ে বললো, আজকে আমাকে দেখতে এসে একেবারে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি করে ফেলেছে। আমি অনেক কান্নাকাটি করেও, অনেক কিছু বলেও কিছুতেই বিয়েটা আটকাতে পারিনি। তারপর থেকে মেয়েটির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ওর। মাঝেমাঝে মেয়েটি ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলতো আরাফ আমি তোমাকে খুব মিস করি। আরাফ অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। মেয়েটি একদিন ফোন দিয়ে জানালো ওর বিয়েও হয়ে গেছে। এখন স্বামীর বাসায় থাকে। আরাফের সাথে টোটালি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ওর। কষ্ট সহ্য করতে করতে ছেলেটা যখন সামলে উঠেছে, তখন একদিন হঠাৎ প্রকাশ পেলো মেয়েটির আসলে বিয়ে বা রেজিস্ট্রি এসব কিছুই হয়নি। মেয়েটি একটা ছেলের সাথে নতুন রিলেশনে জড়িয়েছে আর আরাফের সাথে ব্রেকাপ করার জন্য বিয়ে নামক মিথ্যে কথাটা বলেছে।”
রোদ অবাক হয়ে বললো, “এরকম মেয়েও জগতে আছে! অদ্ভুত। আপনারা খোজ নিতে পারেন নি?”
– “মেয়েটির বাসা দূরে ছিলো। তাছাড়া আলাদা করে যাচাই করার তো দরকার নেই,কারণ গার্ল ফ্রেন্ডকে আরাফ খুবই বিশ্বাস করতো। কে জানতো এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এভাবে ধোঁকা দেবে।”
রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পূর্ব বললো, “এরপর থেকেই আরাফ কেমন যেন বদমেজাজি হয়ে গেছে। মেয়েদেরকে সহ্যই করতে পারতো না। অনেক দিন পর এখন মিশুকে দেখে একটু একটু করে ওর রাগটা কমে যাচ্ছে। মিশুকে দেখে ওর নাকি মেয়েদের প্রতি ধারণাটা একটু বদলেছে।”
– “জীবন টা এত বিচিত্র কেন?”
পূর্ব বললো, “বিচিত্র বলেই তো এটা জীবন। বিচিত্র না হলে তো এটাকে জীবন বলা যায়না। বিচিত্রতা আছে বলেই জীবনে সুখের স্বাদ টুকু উপলব্ধি করতে পারি।”
চলবে..

অনুভূতি পর্ব ৩২

0

অনুভূতি
পর্ব ৩২
মিশু মনি
.
৫০.
বিছানাকান্দিতে পৌছে মিশুর আনন্দ যেন আর ধরেই না। মেঘালয়ের হাত ধরে ও ছপ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে বালিতে এসে এসে উঠলো। জুতোজোড়া নৌকাতেই খুলে রেখে এসেছে। মেঘালয়কে রেখেই মিশু ভো দৌড় শুরু করে দিলো। সব বন্ধুরা ওর কর্মকাণ্ড হা হয়ে দেখছে।
মিশু এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে আর মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পিছনে বিশাল প্রশস্ত নদী, সামনে ডানেও মেঘালয় আর বামেও মেঘালয়। সামনে যত দূর চোখ যায়,মেঘালয়ের বিস্তৃত পাহাড় গুলোই চোখে পড়ে। গাঢ় সবুজে চোখ ধাধিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। দূরে একটা ঝরণাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মিশু ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে গিয়ে স্রোতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। স্রোতে পা ডুবিয়ে দিয়ে কয়েকবার লাফালো। মেঘালয় ও ছুটতে শুরু করেছে,এভাবে লাফালে তো পাথরে পা কেটে যাবে।
মিশু লাফাতে লাফাতে ক্লান্ত হয়ে ধপ করে একটা পাথরের উপর বসে পড়লো। তারপর হাফাতে হাফাতে পানি ছিটাতে আরম্ভ করলো। শীতল পানির স্রোতে পা ডুবিয়ে কি যে শান্তি লাগছে! মেঘালয় ছুটে এসে ওর পাশেই পাথরে বসে পড়লো।
মিশু আনন্দের ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। সমানে পানিতে লাফাচ্ছে। পানির নিচে মৃদু লাল,নীল কত রঙের নুড়ি পাথর! পাথর গুলো তুলে তুলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বিছানাকান্দির পানি একদম স্বচ্ছ। দূরের ঝরনার দিকে তাকিয়ে মিশু মেঘলয়কে বললো, “ওইখানে যাওয়া যাবেনা?”
– “না রে পাগলী। ওটা অনেক বেশি দূরে। এখান থেকে ঝরনা কত্ত ছোট দেখাচ্ছে দেখছো না?”
– “মেঘমনি, আমার আনন্দে কান্না করতে ইচ্ছে করছে গো। আমি একটু কান্না করি?”
মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “কাঁদবে? দুজনে একসাথে জলে নামার পর কান্না করিও।”
– “এখন কাঁদবো না?”
– “এখন কাঁদলে লোকজন হা করে তাকিয়ে থাকবে। দুজনে একসাথে পানিতে নেমে ডুবে বসে থাকবো, তখন আমার বুকে মাথা রেখে কান্না করো।”
– “ইস! আইডিয়াটা ভালো। তখন আমি অনেক গুলা কান্না করবো আচ্ছা?”
– “আচ্ছা অনেক গুলা কান্না করো। এখন কেঁদো না। এখন গা ভিজিও না, আসো আগে লাঞ্চ করে নেই।”
– “লাঞ্চ কই করবা? এখানে কে ভাত রেঁধে বসে আছে তোমার জন্য?”
মেঘালয় হেসে মিশুর একটা হাত তুলে নিয়ে পিছন দিকে দূরে কয়েকটা দোকান দেখিয়ে দিয়ে বললো, “ওই যে চালা গুলো দেখতে পাচ্ছো? ওইখানে আমার জন্য ভাত রেঁধে বসে আছে। চলো।”
– “এখনি তো খিদে পায়নি গো। আর এত তাড়াতাড়ি খাওয়ার কি আছে?”
– “পানিতে নেমে কান্না করবে না?”
– “আমি কি চার পাঁচ ছয় ঘন্টা ধরে কাঁদবো নাকি? অল্প একটু কাঁদবো।”
– “তুমি না বললা অনেক গুলা কান্না করবা?”
– “অনেক গুলা কান্না অল্প কয় মিনিটেই সেরে ফেলবো। বেশিক্ষণ কান্না করা যায়? এত সুন্দর জায়গায় বেশিক্ষণ কান্না করা যায়না।”
– “ও আচ্ছা, তবুও এখন আমাদের খেয়ে নেয়া উচিৎ। আমরা একটু পর পানিতে নামবো, ভেজা শরীরে তো আর খেতে ভালো লাগবে না।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “তা ভালো বলেছো। আসো তাড়াতাড়ি খেয়ে আসি।”
মিশু পানি থেকে পা তুলে পাথরের উপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে দ্রুত দোকানের দিকে যেতে লাগলো। ওর সাথে যে মেঘালয় আছে সেটা ভূলেই গিয়েছে বোধহয়। মেয়েটা বেশি সুখের মুহুর্ত গুলোতে একদম বাচ্চা স্বভাবের হয়ে যায়। এখনো তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনিতেই সবসময় শিশুসুলভ আচরণ ফুটে উঠে ওর আচরণে, আজকে আরো বেশি ফুটে উঠেছে। মেঘালয়ের বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করছে। চারিদিকে এত ভালো লাগা কেন!
মিশু দ্রুত হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা পা উপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠলো। মেঘালয় কাছে গিয়ে বলল, “ব্যথা পেলে? এজন্যই তোমার আমার হাত ধরে সাথে সাথে চলা উচিৎ। এত ছুটোছুটি করলে তো হবেনা, পা ভেঙে বসে থাকবা তখন আর কোনো মজাই হবেনা।”
মিশু মুখটা কাচুমাচু করে বললো, “আচ্ছা আমার হাত ধরে ধরে আসো তাহলে।”
– “আমি তোমার হাত ধরে যাবো নাকি তুমি আমার হাত ধরে যাবা?”
মিশু হেসে ফেললো। ওর বন্ধুরা এসে উপরেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ আর জলের ধারে আসেনি। ওদের কাছে গিয়ে মেঘালয় বললো, “আগে খেয়ে নেই।”
সায়ান বললো, “এই বাচ্চাটাকে সামলাস কিভাবে তুই?”
মেঘালয় হাসলো। মিশুর কোনো মনোযোগই নেই ওদের প্রতি। ও অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পায়ের নিচে গুড়িগুড়ি বালি আর পাথর। খালি পায়ে হাঁটলে পায়ের তলায় কেমন সুড়সুড়ি অনুভূত হয়। মাথার উপর স্বচ্ছ নীলাকাশ, তিনদিকেই মেঘালয় আর একদিকে প্রশস্ত নদী। সবকিছু এত সুন্দর কেন!
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে ধরে ওকে নিয়ে চালা দেয়া রেস্টুরেন্টের কাছে চলে এলো। ওকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে খাবার অর্ডার দিয়ে আসলো। মিশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। ও বসে বসে টেবিলে ঢোল বাজাতে লাগলো। কোনোদিকে ওর হুশ নেই। সবাই হা করে চেয়ে আছে ওর ঢোল বাজানোর দিকে। দুই হাতে সমান তালে টেবিলে ঢোল বাজিয়ে চলেছে।
মেঘালয় এসে দেখলো এই কাণ্ড! সবাই হতবাক আর মিশু তবলা বাজায়! পাগল হয়ে গেছে নাকি মেয়েটা? ও এসে মিশু পাশের চেয়ারে বসে বললো, “কি করছো? ঢোল বাজাচ্ছো কেন?”
– “ঢোল কই পেলাম? আমিতো টেবিল বাজাচ্ছি।”
হতবাক হয়ে চেয়ে থাকা মুখ গুলো হেসে উঠলো। মেঘালয়ের ও হাসি পেলো। ও হাসি থামিয়ে বললো, “টেবিল বাজাচ্ছো কেন?”
– “হাত আছে, ইচ্ছে হয়েছে তাই বাজাই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও বাজাও।”
– “যা ইচ্ছে হবে তাই করতে হবে?”
– “হ্যা, কয়দিন ই বা বাঁচবো। যা ইচ্ছে হবে তাই করতে হবে।”
মেঘালয় মিশুর কানের কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো, “আমার ইচ্ছে করছে তোমার নিচের ঠোঁটে একটা ছোট্ট কামড় দিতে।”
মিশুর শরীর শিউরে উঠলো। মুখের হাসি মুহুর্তেই মিলিয়ে গেলো ওর। চোখ রাঙিয়ে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি এত খারাপ কেন? দেখছো আমি একটু অন্য জগতে চলে গেছি এখন আমাকে থামানোর জন্য এসব বলবা?”
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মেঘালয় লজ্জা পেয়ে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেতে শুরু করলো। মিশুও খাবার খাওয়া আরম্ভ করেছে। মেঘালয় মিশুর কানেকানে বললো, “তুমি রেগে গেলে আরো বেশি মিষ্টি দেখায়। তখন তোমার নাভীতে….”
কথা শেষ করতে পারলো না। মিশু দুটো ঘুষি দিতেই মেঘালয় চেয়ার সুদ্ধ পিছনে উলটে পড়ে গেলো। পাশের টেবিলের লোকজন তাকাচ্ছে ওদের দিকে। আর মেঘালয়ের বন্ধুরা একদম থ!
মেঘালয় ও মিশুর এমন আচরণে একদম অবাক। ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। মিশু বললো,”আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আরাফ ভাইয়ার। সে সারাক্ষণ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চায়। তার ইফেক্ট আমার উপর পড়েছে।”
সবাই হাসলো। মেঘালয় উঠে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। আর কোনো কথাই বললো না। একদম চুপচাপ মাথা নিচু করে খেতে আরম্ভ করেছে। সবাই দেখছে ব্যাপারটা সংকোচ জনক। অন্যরাও খেতে লাগলো। এদিকে মেঘালয়ের মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে। পিছনে উলটে পড়ে একটা পাথরের উপর মাথাটা পড়ায় খুব আঘাত পেয়েছে মাথার পিছন দিকে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিলো না। যথাসাধ্য চেষ্টা করলো স্বাভাবিক থাকার জন্য। তবুও ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। মেঘালয়ের চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। ও দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা হজম করার চেষ্টা করছে।
সায়ান মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, “মেঘ তুই ঠিক আছিস?”
মেঘালয় এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিলো। সায়ানের প্রশ্ন শুনে চোখ মেলে তাকালো। মিশুও প্রশ্ন শুনে চমকে তাকালো মেঘালয়ের দিকে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠলো মিশুর। এমন দেখাচ্ছে কেন মেঘালয়কে? সে কি মিশুর আচরণে কষ্ট পেলো?
মিশু খাওয়া বন্ধ করে মাথা নিচু করে ভাবছে। এরকম রিয়েক্ট করাটা উচিৎ হয়নি। নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী মনেহচ্ছে। এখন সবার সামনে কিছু বলাও যাবেনা। খাওয়া শেষ হলে কথা বলতে হবে। কিন্তু এখন তো আর খেতেই পারবে না ও।
আরাফ জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি ব্যথা পেয়েছিস মেঘ?”
মেঘালয় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আরে না। তোরা অযথা ভাবছিস। আমি একদম ঠিক আছি।”
মিশু পিছন ফিরে তাকালো মাটির দিকে। ছোট্ট পাথরটা দেখেই ও বুঝে গেছে মেঘালয় সেটাতেই পড়ে আঘাত পেয়েছে। মনটা চরম খারাপ হয়ে গেলো। মেঘালয়ের চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি করে বলোতো মেঘ তুমি ব্যথা পাওনি?”
মিশুর চোখের দিকে তাকালে মেঘালয় কিচ্ছু লুকাতে পারেনা। ও বলল, “এমন কিছু না। সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছি।”
মিশুর কান্না এসে যাচ্ছে। কেন এরকম আচরণ করলো ও? এই ছেলেটা ওকে কত ভালোবাসে,কত্ত খেয়াল রাখে। আর ও শুধুশুধু কষ্ট দিয়ে ফেললো। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।
মেঘালয় বললো, “আমার অভ্যেস আছে এসবে। যখন হিমালয়ে যেতাম, কত বড় বড় বিপদে পড়েছি। তুষারঝড়ের মত অনেক বড় বড় বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি। এ আর কি এমন। বাদ দে, খা তোরা সবাই।”
সবাই খেতে শুরু করেছে। মিশু খাচ্ছেনা দেখে মেঘালয় বললো, “তুমি খাচ্ছো না কেন? আরে পাগলী আমি রাগ করিনি। আমি কতবার বেস ক্যাম্পে গিয়েছি তুমি জানো? আমার এসব সামান্য আঘাতে কিছু হয়না।”
– “মাথায় না হয় সামান্য আঘাত পেয়েছ, আমার আচরণে ভেতরে যে আঘাতটা পেয়েছো সেটার কি অভ্যেস আছে?”
মিশুর প্রশ্নে টেবিলের সবাই মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। মিশুর চোখ ছলছল করছে। কেউ কিছু বললো না। মেঘালয় হেসে বললো, “তুমি আমার বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কলিজাটা টেনে বের করে নাও, তবুও আমার একটুও কষ্ট হবেনা। আমার লাইফটাই তো তোমার। খেয়ে নাও নয়ত আমিও খাবোনা।”
মেঘালয় মিশুর মুখে খাবার তুলে দিলো। মিশু এবার কেঁদেই ফেললো একেবারে। মেঘ বললো, “এখনি কান্না করছো কেন? তুমি না বললা পানিতে নেমে অনেক গুলা কান্না করবা? এখন সব কান্না শেষ হলে তখন কাঁদবা কি?”
বলেই হেসে ফেললো। মিশুও হাসলো। রৌদ্রময়ী মুগ্ধ হয়ে ওদের দুজনকে দেখছে। কিভাবে মেঘালয় এই বাচ্চা মেয়েটাকে এতটা ভালোবাসতে পারে? কাউকে পরোয়া করছে না, লোকজনের সামনেই ওকে তুলে খাওয়াচ্ছে। অন্য কোনো ছেলে হলে তো রেগে আর মিশুর সাথে কথাই বলতো না। মেঘালয় মিশুর সমস্ত কিছু সহ্য করে যায়। অদ্ভুত একটা মানুষ!
খাওয়া শেষ করে ওরা পাশের দোকানগুলোতে এলো। হরেক রকমের কসমেটিক্স বিক্রি হচ্ছে। মিশু অবাক হলেও আগের মত স্বাভাবিক হতে পারছে না। মন খারাপ লাগছে খুব। ওরা টুকটাক কেনাকাটা করতে লাগলো। মেঘালয় বারবার মিশুকে বলল, “যা মন চায় নাও।” তবুও মিশুর কোনো ভাবান্তর নেই। ও কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মনেহচ্ছে মেঘালয় ই বোধহয় ওকে ঘুষি মেরে ফেলে দিয়েছিলো। মেঘ দিব্যি হেসে হেসে জিনিসপত্র দেখছে আর ও বিষণ্ণ হয়ে আছে।
মিশু একা একা হাঁটতে হাঁটতে স্রোতের দিকে যেতে লাগলো। মেঘালয় এসে ওর পাশে হাঁটতে লাগলো। দুজনে এসে একসাথে পানিতে নামলো। মেঘালয় হাঁটুজলে পা ডুবিয়ে মিশুকে এসে ওর পাশে বসতে বলল। কিন্তু মিশু ওর কথা শুনলো না। ও একাই এগিয়ে যেতে লাগলো গভীর স্রোতের দিকে। মেঘালয় বলল, “ওদিকে যেওনা, ওখানে স্রোত বেশি।”
মিশুর কোনোই ভাবান্তর নেই। ও কেমন যেন স্থবির হয়ে গেছে। মেঘালয় ওর পিছুপিছু যেতে লাগলো। মিশু একটা পাথরে আঘাত পেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়,তবুও থামলো না। একটা একটা করে পাথর ডিঙিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ওদিকে স্রোতের গভীরতা বেশি। মেঘালয় এত করে ডাকছে তবুও শুনছে না। গিয়ে সামনে একটা গর্তে লাফিয়ে পড়লো। বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো মেঘালয়ের। আবার ব্যথা পেলো না তো? কি যে করে মেয়েটা। শুধুশুধু দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।
দুপাশে বড় বড় পাথর আর মাঝখানে একটু গভীর, মিশু সেখানে ডুবে শুধু নাক আর চোখ বের করে চেয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। পুরো শরীর টা পানির নিচে। স্রোত ওকে ঠেলে নিয়ে যেত চাইছে কিন্তু পাথরে পা ঠেলে বসে আছে ও। দুপাশেই বড় বড় পাথর থাকায় পাথরের সাথে আটকে আছে। ও যে খুব মজা পাচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চোখে হাসির ঝিলিক। স্বচ্ছ পানিতে বসে আছে পা দুটো একসাথে জড়ো করে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয় নেমে পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়লো। মেঘালয়ও ডুবে গেলো প্রায়, শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকলো। মিশু শুধু নাক আর চোখ কান বের করে রেখেছে। পুরো শরীরটাই পানির নিচে। এদিকে কেউ নেই, শুধু ওরাই দুজন।
মেঘালয়কে পাথরে হেলান দিয়ে বসতে দেখে মিশু এসে ওর কোলের উপর বসে পড়লো। মেঘালয়ের বুকে হেলান দিয়ে ডুবে রইলো দুজনে। এদিকে বরফ শীতল জলের স্পর্শে শরীর শিউড়ে উঠছে দুজনের। মেঘালয় পানির নিচেই শক্ত করে মিশুকে জাপটে ধরে রইল। মিশু পাথরের আড়ালে মেঘালয়ের মাথাটা আচমকা ঠেস দিয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। মিশুর এরকম কাজে একদম অবাক হয়ে গেলো মেঘালয়। সেজন্যই মেয়েটা এত দূরে এসে ডুবে বসে আছে, এতক্ষণে স্পষ্ট হলো ওর কাছে। মেঘালয় চোখ খুলে রেখেছে, মিশুর চোখ বন্ধ। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেঘালয় ওর ঠোঁটে একটা ছোট্ট কামড় দেয়ার পর মিশু ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসল।
মেঘালয়ের চোখে চোখ রেখে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “সরি মেঘালয়। আর কক্ষনো এভাবে তোমাকে আঘাত করবো না। সরি, আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।”
বলেই দুহাতে নিজের কান ধরে বসে রইলো। মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “এত বড় একটা সারপ্রাইজের পরও কি আর রাগ করে থাকা যায়?”
মিশু এসে ওর বুকে মাথা রেখে ডুব দিয়ে রইলো অনেক্ষণ। তারপর মাথা তুলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো, “দম আটকে আসছিলো উফফ। পানি গুলো জলের মত ঠাণ্ডা।”
– “হা হা হা, পানি আবার জলের মত ঠাণ্ডা হয় কি করে?”
-“মেঘালয় যেভাবে মিশুর মত মিষ্টি, সেভাবে।”
মেঘালয় আবারো হেসে উঠলো। মিশু ওর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বুকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। মেঘালয় পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে, আর মিশু ওর বুকে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। দুজনেই একসাথে আকাশ দেখছে। আকাশ ঘন নীল, সাদা তুলোর মতন মেঘ উড়ছে। মিশু এক মেঘালয়ের বুকে হেলান দিয়ে আরেক মেঘালয় দেখছে। পিছনে মেঘালয়, ডানে মেঘালয়, বামেও মেঘালয়। যার বুকে হেলান দিয়ে কোলে বসে আছে, সেও মেঘালয়। আর মাথার উপর উড়ছে মেঘ আর মেঘ। আহ! কি অদ্ভুত সুখ!
অনেক্ষণ পানিতে এভাবে ভেসে ভেসে আকাশ দেখলো। আস্তে আস্তে এদিকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। এতক্ষণ এখানে কেউ ছিলোনা। লোকজনের সামনে এভাবে শুয়ে থাকা যায় না। মেঘালয় মিশুকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে আসলো। দুজনে একটা পাথরের উপরে বসে একে অপরের পিঠে হেলান দিয়ে বসে বসে বিছানাকান্দির মুগ্ধ করা সৌন্দর্য দেখতে লাগলো। যত বিকেল হচ্ছে, স্রোত তত বেড়ে যাচ্ছে।
রৌদ্রময়ীর একজন ভালো সঙ্গী জুটে গেছে, পূর্ব। বাকিরা যখন জলের ভেতর শুয়ে আকাশ দেখছিলো পূর্ব তখন রোদের সাথে বসে গল্প করছিলো। রোদ পাথরে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে অনেক্ষণ গল্প করলো ওর সাথে। পূর্ব’র কিছু ছবি তুলে দিলো, পূর্ব ওর অনেক ছবি তুললো, বাকিদের ছবিও তুললো। মিশু আর মেঘালয় দূরে হারিয়ে গিয়ে পানিতে ডুবে প্রকৃতি আর প্রেমের নেশায় মেতেছে। আর ওরা সবাই মিলে হাসি ঠাট্টা, দুষ্টুমি, পানি ছুঁড়োছুড়ি করতে লাগলো। রোদের মন এখন একদম ভালো। রোদ নিজেও অনেক্ষণ পানিতে শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশ দেখতে খুবই ভালো লাগে ওর। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো।
মেঘালয় মিশুকে বলল, “চলো এবার ওদের কাছে যাই। অনেক্ষণ এখানে বসে আছি।”
-“আমার ইচ্ছে করছে আজীবন এখানে থেকে যাই।”
মেঘালয় হাসলো। হাত ধরে মিশুকে টেনে তুলে আস্তে আস্তে হেঁটে ওর বন্ধুদের দিকে আসতে লাগলো। অনেক্ষণ পাথরের উপর বসে গল্প করেছে ওরা, একে অপরকে পানি আর পাথর দিয়ে মারামারি করেছে। মিশুর মজার মজার কথা শুনে বিভোর হয়ে রইলো মেঘালয়।
সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ওরা নৌকায় করে আবারো ঘাটের দিকে ফিরছিলো। আজকের দিনটা অন্যরকম একটা দিন ছিলো। সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বিছানাকান্দির সৌন্দর্য একদম মোহনীয় হয়ে উঠে। মিশু বারবার বলতে লাগলো, “পাথর কেন খাওয়া যায় না? বালি কেন খাওয়া যায়না? মেঘালয় কেন খাওয়া যায়না?”
পূর্ব বলল, “মেঘালয় খাওয়া যায়।”
সবাই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। নৌকায় ফেরার সময় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নদীর শীতল হাওয়ায় শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। তার উপর ভেজা কাপড়ে সবাই বসে আছে। শিরশির করে ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে গায়ে। শরীর ফুড়ে যেন বাতাস ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে। মেঘালয় মিশুকে ধরে রইলো। ওর উষ্ণ স্পর্শে মিশুর একটুও শীত করছে না। কিন্তু বাকিদের অবস্থা করুণ। রোদ রীতিমত ঠাণ্ডায় কাঁপছে। মেঘালয় সবকিছুতে অভ্যস্ত। সে পর্বতারোহণে গেলে কত ঠাণ্ডা সইতে হয়। হিমালয়ের বরফে জমে যাওয়ার মত অবস্থা হয়ে যায় একেবারে।
চলবে..