Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1855



কনফিউশন পর্ব ১৭+১৮

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৭+১৮

কাব্য সেই যে গেলো, এখনো আসেনি। তাকে ফোন করার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই রশ্নি কল করলো।
“হ্যালো ভাবী।”
“কতদূর গেলি?”
“বলতে পারছি না।”
“সাবধানে যাস।”
“হুম।”
“তুই ফিরে এসে আর একা থাকতে হবে না। তুই আসলেই আমি বাবুকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে যাবো।”
আরশি খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আর বাবুর জন্য একটা সুন্দর দেখে নাম রাখিস তো।”
“আচ্ছা।”
“রাখি, পরে আবার ফোন করবো।”
“শোনো ভাবী।”
“হ্যাঁ বল।”
“একটা অপছন্দের মানুষকে কি ভালোবাসা যায়?”
রশ্নি হেসে বললো,
“ভালোলাগা তাহলে ভালোবাসা হয়েই গেলো?”
“জানিনা, তবে ব্রেইন থেকে তাকে এক মূহুর্ত সরাতে পারছি না।”
“আমি সেই ভাগ্যবান মানুষটার ব্যাপারে জানবো কবে?”
“দেরি আছে।”
“অপেক্ষা যে সয়না সখি।”
“ভাবী আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাওনা।”
“সম্ভব রে বাবা সম্ভব। ব্যাপারটা আসলে এমন না যে মানুষটাকে পছন্দ নয়, হয়তো তার কোনো স্বভাব বা অভ্যাস অথবা বিহেভিয়ার তোর পছন্দ না। সেক্ষেত্রে ভালোবাসা তো আর আটকে রাখা যাবে না।”

কাব্য একটানা ৪ টা সিগারেট খেয়ে দেখে প্যাকেটে আর একটামাত্র সিগারেট আছে। সেটাও ধরিয়ে খালি প্যাকেট টা ফেলে দিলো। ঠিক তখনই আরশি ফোন করলো।
“হ্যালো।”
“আপনি কোথায় চলে গেলেন?”
“আছি আশেপাশেই।”
“কেবিনে আসুন।”
“কিছুক্ষণ পর আসি। স্মোক করেছি। এখন গেলে তোমার মাথাব্যথা হবে।”
আরশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কী করে জানলেন?”
“তিরা বলেছিল।”
আরশি চুপ। কাব্য বললো,
“কি করছো?”
“কিছু না।”
“সামনে একটা স্টেশনে ট্রেন থামবে। আমি নামবো, তোমার জন্য কিছু আনবো?”
“লাগবে না।”
“চিপস?”
“আছে।”
“চকলেট?”
“চকলেট খাই না।”
“জুস?”
“বোতলের জুসও খাইনা।”
“তাহলে কিছুই খাবে না?”
আরশি হেসে বললো,
“আমি যা খাই সবই আছে আমার কাছে।”
“ঠিকাছে। স্টেশন এসে গেছে, রাখছি।”
“আচ্ছা।”
কাব্য নেমে কতোগুলো চকলেট কিনলো। জীবনে কোনোদিন সিগারেট খেয়ে চকলেট খায়নি সে। কিন্তু এখন তো খেতেই হবে। নাহয় আরশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। ধুর হুট করে এতোগুলো সিগারেট খাওয়া উচিত হয়নি। হাতের আধখাওয়া সিগারেট টা ফেলে দিলো কাব্য। তারপর চকলেট মুখে দিয়ে ট্রেনে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলো, সে আরশির জন্য যা করেছে তা কখনো কারো জন্য করেনি, এটাই ধ্রুবসত্য। তাই আর ভাববে না এ ব্যাপারে। সব সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিলো, যা হবার হবে। বেশি ভাবতে গেলেই পাগল পাগল লাগে।

কাব্য আরো ঘন্টাখানিক ট্রেনের মধ্যে ঘুরেফিরে আরো কিছু চকলেট খেয়ে কেবিনে গেলো। দরজায় টোকা দেয়ার সাথে সাথেই কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। পরেরবার একটু জোরেই টোকা দিলো। এরপর আরশি এসে দরজা খুললো। আরশির চোখে ঘুম, চুলগুলো এতক্ষণ খোঁপা করা ছিলো এখন খোলা। কাব্য বললো,
“ঘুমিয়েছিলে?”
আরশি বললো,
“ঘুম আসছিলো, আপনার আসতে দেরি হবে শুনে দরজাটা লাগিয়ে একটু শুয়েছিলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।”
“ধুর জানলে এখন আসতাম না। ঘুমের বারোটা বাজলো তোমার!”
“কিছু হবেনা।”
“আবার ঘুমোও নাহয়। ভোরে উঠেছো।”
“লাগবে না। আপনার ঘুম পাচ্ছে না?”
“আমার তো ঘুম আসলে ঘুমিয়ে নেবো।”
আরশি আর কিছু বললো না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জানালায়। কাব্য মুগ্ধ চোখে দেখছিলো আরশির সদ্য ঘুম ভাঙা মুখ। আর ওই এলোচুলে আরশি যতটা অনাড়ম্বর ততোটাই সুন্দর! ভাগ্যিস এই সময়েই ফিরেছিলো কাব্য নাহয় সব মিস করে যেতো।
কাব্যর মনে হলো এই দৃশ্য সে বারবার দেখতে চায়। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে হুট করেই একটা ছবি তুলে ফেললো। আরশি চমকে তাকাতেই কাব্য বললো,
“সরি পারমিশন নিতে গেলে এতো সুন্দর ছবিটা পেতাম না।”
কাব্য ক্যামেরাটা এগিয়ে দিলো। আরশি ক্যামেরা হাতে নিলো না, দূর থেকেই ছবিটা দেখলো৷ দেখে লজ্জা পেয়ে গেলো! আরশির এই লজ্জায় লাল হওয়াটা কাব্যর চোরাচোখ এড়ালো না। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছো?”
“হুম তবে সহনীয়।”
কাব্য হেসে ফেললো। তারপর আচমকাই জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তুমি সবসময় এমন সাদা টাইপের কাপড় পরো কেন?”
“সাদা কোথায়? এটা তো লেমন কালার।”
নিজের গায়ের জামাটা দেখিয়ে আরশি বললো।
“এটা লাইট লেমন কালার, তোমাকে সবসময় সাদা অথবা হালকা আকাশী এইসব রঙের কাপড় পরতেই দেখি। কখনো লাল পরোনা?”
“না।”
“কালো?”
“না।”
“মেরুন, ডার্ক ব্লু অর বটল গ্রীন?”
“না।”
“গাঢ় কোনো রঙই পরোনা?”
“না।”
“কেন?”
আরশি নিচের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
“লজ্জা লাগে।”
কাব্য এতোটা অবাক হলো যে কথা বলতেই ভুলে গেলো। একটা অল্প বয়সী মেয়ের গাঢ় রঙ পরতে লজ্জা কেন লাগবে এটাই বুঝতে পারছিলো না সে।

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৮

লাঞ্চ করার পর সিগারেটের জন্য অস্থির লাগছিলো কাব্যর। কেবিন থেকে বের হয়ে ট্রেনের ভেতর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আসলো। লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলো পরবর্তী স্টেশন আসতে দেরি আছে। কাব্য চিন্তা করলো, ভালোই হলো আরশির সামনে আর সিগারেট খাওয়া লাগলো না। এসব ভেবে যখন কেবিনে ফিরছিলো ঠিক তখনই একটা হকার সামনে পড়লো। সে কাব্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“মামা সিগারেট লাগবো?”
“না।”
হকার চলে যাচ্ছিলো। কাব্য তার দিকে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললো,
“দাঁড়ান মামা। একটা বেনসন দেন।”
হকার একটা সিগারেট দিতেই কাব্য বললো,
“না থাক বেনসন লাইট দেন।”
হকার আবার সিগারেট বদলে দিতেই কাব্য সেটাকে ধরিয়ে জানালার কাছে চলে গেলো। সিগারেটে একটা টান দিতেই কাব্যর প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। সাথে সাথেই তার মনে হলো, সে কেন সিগারেট খাচ্ছে? কেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারছে না? এটা মনে হতেই সিগারেট টা নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো। এরপর একটা চকলেট খেয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কেবিনে ফিরলো। আরশি একটা বই পড়ছিলো। কাব্যকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“চা খাবেন?”
“ফ্লাস্কে চা এতোক্ষণ গরম থাকে নাকি?”
“না। তবে আমি গরম করেই খাবো। আপনি খেলে বলুন।”
“অবশ্যই খাবো। চা সিগারেটে আমার কোনো মানা নেই। কিন্তু কীভাবে গরম করবে?”
“সে চিন্তা আপনার না করলেও হবে।”
আরশি তার চায়ের ফ্লাস্ক টি বের করলো। কাব্য আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলো। আরশি তার ব্যাগ থেকে একটি স্টিলের ছোটো মগ ও লাইটারও বের করলো। তারপর মগে চা ঢেলে লাইটার জ্বালিয়ে মগের নিচে ধরলো। কাব্য হেসে বললো,
“হোয়াট এন আইডিয়া!”
আরশি বললো,
“আমি ট্রেনে কোথাও গেলে এভাবেই চা গরম করি। এই মগ আর লাইটার টা শুধু এজন্যই।”
কাব্য মুগ্ধ চোখে দেখছিলো সবকিছু। চা গরম হতেই আরশি ফ্লাস্কের কাপে ঢেলে কাব্যকে দিলো। কাব্য চায়ে চুমুক দিয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই একটা জঙ্গল মতো জায়গা দেখতে পেলো যেখানে অনেক বড় বড় ঘাস জন্মে আছে। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“আরশি তোমার তো স্টিফেন কিং পছন্দ তাইনা?”
“আপনি কী করে জানলেন?”
“সেদিন তোমার অর্ডারকৃত বই দেখে বুঝেছিলাম যেদিন তুমি আমাকে আঙ্কেল ডেকেছিলে।”
আরশি হেসে ফেললো। ওই হাসিটার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“স্টিফেন কিং এর ‘ইন দ্যা টল গ্রাস’ পড়েছো?”
“না, এটা পড়া হয়নি। আরো কয়েকটাই বাকী। ধীরে ধীরে পড়বো।”
“অসাধারণ শ্বাসরুদ্ধকর একটা বই। বাইরে তাকাও দেখো কত বড় বড় ঘাস এই জায়গাটা দেখে বইটার কথা মনে পড়ে গেলো।”
“মিল আছে?”
“হুম। একটা প্রেগন্যান্ট মেয়ে তার ছোটো ভাইকে নিয়ে গাড়ি করে এক শহর থেকে অন্য একটা শহরে যাচ্ছিলো। রাস্তার পাশে এরকম বড় বড় ঘাস ছিলো। এর থেকেও বড় ঘাস অবশ্য, মানুষের উচ্চতার থেকেও বেশি। ৬/৭ ফুট হবে। তো তারা হঠাৎ ঘাসের ভেতর থেকে একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পায়। বাচ্চাটা ঘাসের ভেতরে হারিয়ে গেছে, বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিলো বাচ্চাটাকে বের করে আনবে। এরপর দুই ভাইবোন মিলে ঘাসের ভেতর ঢোকে। বাচ্চাটার কান্নার শব্দ পায় কিন্তু বাচ্চাটাকে খুঁজে পায় না। খুঁজতে খুঁজতে দুইজন দুই দিকে চলে যায়। বাচ্চাটাকে খুঁজে না পেয়ে যখন ওরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তখন ওরা এমন দূরত্বে ছিলো যে দুজন দুজনার কথা শুনছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না, মানে কাছেই। তো ওরা ঠিক করলো ওয়ান টু থ্রি বলে একসাথে লাফ দেবে। লাফ দিয়ে দেখলো ওরা একদম কাছেই। তো দুজন দুজনের দিকে হেঁটে গেলো। এরপরও দেখতে পাচ্ছে না বলে আবার লাফ দিলো। এরপর দেখে ওরা দুজন দুজনের থেকে অনেক অনেক দূরে।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“ওহ মাই গড!”
“ইন্টারেস্টিং না?”
“খুব। এরপর কী হলো?”
“পুরোটা আমি বলে দিলে আর মজা থাকলো কী? নিজে পড়ে নিও।”
“ধ্যাত তাহলে এইটুকু বললেন কেন?”
কাব্য হেসে বললো,
“ওইযে ঘাস দেখে মনে পড়লো।”

আরশি ও কাব্যকে নিতে তিরা এলো স্টেশনে। আরশি ট্রেন থেকে নামতেই তিরা দৌড়ে এসে আরশিকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর যখন কাব্য নামলো তিরা চেচিয়ে উঠলো,
“আব্বাজান কি অবস্থা? মেয়ের বিয়েতে আসলা অবশেষে।”
কাব্য হেসে বললো,
“বাবা ছাড়া মেয়ের বিয়ে হয় কখনো?”
“যাই হোক এসব ঢঙ আবার আমার ফ্যামিলির সামনে করো না। আমি বলেছি তুমি আমার বন্ধু। আর তুমি যে আরশির সাথে এসেছো এটাও বলা যাবে না।”
“না বললাম।”
“গুড বয়।”

রাতের ঘুমানোর সময় তিরা আরশিকে যাদিদ সম্পর্কে নানান রকম কথা বলছিলো কিন্তু কোনোটাই আরশির কর্ণপাত হচ্ছিলো না। সারাক্ষণ শুধু ওই একজনের চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করছে। মানুষটার হাসি, মানুষটার কথা বলা, মানুষটার হাঁটাচলা সবকিছু কেবলই চোখে ভাসছে। কীভাবে তার অমন দারুণ একটা ছবি তুলে ফেললো, কীভাবে সিগারেট ছাড়ার কারণে মাকে অজুহাত বানালো, কীভাবে গল্প বলছিলো সবকিছুই যেন এখনো ঘটছে৷ এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। আচ্ছা কাব্যরও কী এমন হচ্ছে? ইশ জানার যদি কোনো উপায় থাকতো!

অনেক রাতে ফোন আসতেই আরশির ঘুম ভেঙে গেলো। কাব্যর একটা ফোন বা মেসেজের জন্য অপেক্ষা করছিলো আরশি। কিন্তু আসেনি অথচ এতো রাতে ফোন করলো! তিরা ঘুমিয়ে পড়েছে তবুও আরশি বারান্দায় গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো,
“হ্যালো।”
“সরি ঘুম ভাঙালাম।”
“সমস্যা নেই, বলুন”
“আসলে ঘুম আসছে না।”
আরশির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো৷ সে হাসিটাকে লুকিয়ে বললো,
“কেন?”
“মেবি জায়গা বদলের জন্য।”
“আচ্ছা।”
“বাদ দাও এসব৷ এবাড়ির যে অবস্থা! এতো আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বললে হয়তো তোমার জন্য সমস্যা হবে।”
“তা তো একটু হবেই।”
“এজন্যই ফোন দিলাম একটা দরকার ছিলো।”
“কী চা?”
কাব্য হেসে বললো,
“না সেতো আন্টি দিয়েছেনই।”
“তাহলে?”
“আমি তিরার জন্য গিফট কেনার সময় পাইনি। কালকে সন্ধ্যায় হলুদ, দিনটাতো আছে। ভাবছি কাল গিফট কিনবো।”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু কী কিনবো? আই হ্যাভ নো আইডিয়া। কী দিলে তিরা খুশি হবে?”
“শাড়ি গয়নার চেয়ে বেশি খুশি আর কিছু দিয়ে করতে পারবেন না।”
“তাহলে শাড়ি দেই?”
“দিন।”
“তোমার কি একটু সময় হবে আমার সাথে মার্কেটে যাওয়ার?”
“আমি!”
“হ্যাঁ। না মানে আমি তো খুলনায় এই প্রথম কিছুই চিনিনা আর তিরার কি ধরনের শাড়ি পছন্দ তাও জানিনা। তুমি একটু সাথে গেলে ভালো হতো।”
“আমি এক্ষুণি বলতে পারছি না। আমি তো একটু রিসার্ভড থাকি এজন্য ফুপী কিছুক্ষণ পরপরই আমার খোঁজ নেন। আমি ঠিক আছি কিনা, কিছু লাগবে কিনা। আর তিরাও আছে। আমি কী বলে বের হবো? আপনার সাথে যাচ্ছি এটা বলা যায় না কারণ আমি সাধারণত কারো সাথে কোথাও যাইনা।
“না পারলে জোরাজুরির কিছু নেই।”
“তবে সুযোগ হলে নিশ্চয়ই যাবো।”
“আচ্ছা।”

সকালবেলা নাস্তা শেষ করে আরশি টেবিলেই বসে ছিলো। কারণ তিরা ও কাব্য তখনো নাস্তা করছিলো। মনজিলা বেগম ড্র‍য়িং রুমে হলুদের কাপড়চোপড় বিতরন করছিলেন। হঠাৎ আরশির কাছে এসে হলুদের শাড়ি গয়না দিয়ে বললেন,
“এইনে মা হলুদের শাড়ি গয়না।”
আরশি বললো,
“ফুপি আমি এসব পরতে পারবো না। আমি সালোয়ার কামিজ এনেছি। ওগুলোই পরবো।”
কাব্যর একটুর জন্য গলায় খাবার আটকালো না। একথা শুনে অবাক হলো যে আরশি বোনের হলুদে শাড়ি পড়বে না! মনজিলা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
“কী বলছিস তুই? সবাই একরকম কাপড় পরবে। আর তুই বুড়ী সেজে বসে থাকবি?”
“সরি ফুপি প্রথমত শাড়ি পরা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি পারিও না। কোনোদিন দেখেছো শাড়ি পড়তে? তার উপর বেগুনি রঙের! অসম্ভব!”
“তুই এমন আনসোস্যাল কেন বলতো? একটা বিয়ে বাড়িতে এসে এরকম সাদা সাদা জামা পরে ঘুরছিস! আবার অনুষ্ঠানেও যাবি এসব পরে? অথচ তোর বয়সী মেয়েরা দেখ কত সুন্দর কাপড়চোপড় পরে সেজেগুজে ঘুরছে। আর তুই সুতির একটা জামা পরে কাজের মেয়েদের মতো মাথার উপর একটা খোঁপা বেঁধে ঘুরছিস! একটু সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে শেখ মা।”
কাব্য এসব কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। এরকম পরিবারে এরকম কিছু সে আশা করেনি। একটা ইন্ট্রোভার্ট মেয়েকে আনসোস্যাল কেন বলে মানুষ? আর কে কীভাবে চলবে এটা তো একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তিরা মাকে বললো,
“থাক না মা। ওর যেভাবে ভালো লাগে সেভাবেই থাকুক।”
“কেন? এক্সিডেন্ট কি মানুষের জীবনে হয় না?”
আরশি আর এক মূহুর্ত সেখানে থাকলো না। আস্তে করে উঠে ঘরে চলে গেলো। তিরা এবার রেগেমেগে বললো,
“মা কী দরকার তোমার ওকে এসব কথা বলার? তাও আবার সবার সামনে। তুমি এরকম করো বলেই ও আমাদের বাসায় আসতে চায় না। এবার আমার বিয়ে বলে না এসে পারেনি। এই দুটো দিন ওকে অশান্তি দিওনা প্লিজ। অনুষ্ঠানের এক কোণায় পরে থাকে ও। তবুও মানুষের সামনে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগলে বলে দিও ওকে তুমি চেনো না।”
“তোরা শুধুশুধু আমার উপর রেগে যাস। আমার ভাইয়ের মেয়ে, আমি তো ওর ভালোর জন্যই বলি নাকি?”
“এতো ভালো ভাবা লাগবে না তোমার।”
মনজিলা বেগম মন খারাপ করে চলে গেলো। সাথে সাথেই কাব্য তিরাকে বললো,
“এক্সিডেন্ট মানে? কী এক্সিডেন্ট হয়েছিল আরশির?”
তিরা আমতা আমতা করে বললো,
“ইয়ে মানে.. আমি..”
তিরার কিছু বলতে হলো না। তার আগেই তার চাচাতো বোন এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“কীরে এখনো গিলছিস? ওঠ তো কত কাজ বাকী একটু পরেই পার্লারে যেতে হবে।”

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ১৫+১৬

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৫+১৬

বাসায় ফিরেও আরশি মন খারাপ করে বসে রইলো। আজ পর্যন্ত কেউ কখনো ওর না হাসার কারণ জানতে চায়নি। শেষে গিয়ে এমন একজন জানতে চাইলো যাকে ভেবে সে দিনরাত পার করে দেয়! কীভাবে টের পেলো মানুষটা যে তার হাসি পায় না এজন্য কোনো কারণ থাকতে পারে? কই তার ভাই ভাবী ছাড়া এমন করে তো কেউ ভাবেনি এর আগে তার জন্য?

কিছুক্ষণ পর কাব্য মেসেজ পাঠালো,
“ট্রেনের ডিটেইলস তো দিলে না।”
আরশি টিকিট দেখে রিপ্লাই দিলো,
“সুন্দরবন এক্সপ্রেস, ভোর ৬ টা ২০ মিনিটে ছাড়বে। ঘ বগি, সিট নং ১৬-১৯।”
কাব্য রিপ্লাই দিলো,
“কাব্য পৌঁছে যাবে।”
আরশি এবার লিখলো,
“আপনি বোর হবেন আমার সাথে যেতে।”
“কেন?”
“আমি বোরিং মানুষ। অত কথা বলতে পারিনা।”
“কথা শুনতে তো পারো?”
“হুম।”
“আমার কথা শুনতে আপত্তি নেই তো?”
“না।”
“তাতেই হবে।”
“আচ্ছা।”

আরশির ইচ্ছে করছিলো আরো কিছুক্ষণ মেসেজিং চলতে থাকুক কিন্তু কাব্য আর কোনো মেসেজ দিলো না। আরশি এই প্রথম একটা অদ্ভুত কাজ করলো৷ সে কাব্যর ফেসবুক একাউন্টে ঢুকলো। কাব্যর ছবিগুলো জুম করে করে দেখতে লাগলো। আজ পর্যন্ত সে কখনো কাব্যর চোখের দিকে তাকায়নি। এই প্রথম তাকালো তাও ছবিতে। সাথে সাথেই লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তিরা ঠিক বলেছিলো কাব্যর চোখে অদ্ভুত একটা মায়া আছে। কিন্তু চাহনিটা এতো অসভ্য টাইপের যে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। আরশি বাস্তবে সম্ভাবত কখনোই এই মানুষটার চোখের দিকে তাকাতে পারবে না!

আজ আর সময় কাটছে না। আরশি টের পেয়েছে সে উপরে আসার পরপরই কাব্য বেরিয়ে গেছে। সারাদিন অপেক্ষা করতে লাগলো। কান সজাগ রাখলো কখন গেট খোলার শব্দ হবে, কখন কাব্য আসবে আর সে দোতলার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখবে। কিন্তু রাত হয়ে গেছে এখনো কাব্য এলো না। সাহিল বাড়ি ফিরলে অবশ্য আরশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো অতটা আর নজর রাখতে পারলো না। রাতে শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ গেট খোলার শব্দ শুনতে পেলো আরশি। দৌড়ে জানালার কাছে গেলো। কাব্য এসেছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার কথা আর মনে রইলো না আরশি। সে খোলা জানালা দিয়েই দেখতে লাগলো। কাব্য ভেতরে ঢুকতেই উপরে চোখ পড়লো, অমনি আরশিকে দেখতে পেলো। দেখেই যখন ফেলেছে আরশি আর লুকালো না। তবে অস্বস্তি লাগছিলো। কাব্য আরশিকে দেখে হাসলো কিন্তু এই হাসির বিনিময়ে যে হাসি দিতে হয় তার অভ্যাস আরশির নেই। সে যেমন গোমড়ামুখে দাঁড়িয়ে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। কাব্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরশি জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিয়ে কাব্যকে মেসেজ দিলো,
“দাঁড়িয়ে আছেন যে? ভেতরে যান। রাত অনেক হয়েছে।”
কাব্য ভেতরে গিয়ে ফোন করলো আরশিকে। কাব্যর ফোন কল দেখে আরশির হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। গলা শুকিয়ে গেলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো। অবশেষে যখন ফোনটা ধরলো কাব্য বললো,
“তুমি ঘুমোওনি যে? ভোরে উঠতে হবে না?”
“ঘুম আসছিলো না তাই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনি এত রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলেন যে?”
“অফিসে আজ আমার ইভনিং শিফট ছিলো। তার উপর ছুটি ম্যানেজ করতে গিয়ে আরো দেরি হয়ে গেলো।”
“ওহ।”
“ব্যাগ গোছানো শেষ?”
“হ্যাঁ আপনার?”
“এখন গোছাবো।”
“আচ্ছা।”
এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। দুজনেই যেন কথা খুঁজে চলেছে। একসময় কাব্যই বললো,
“কাল অত ভোরে উঠবে কী করে?
“আমি ভোরে উঠতে পারি। আজান দেয়ার আগে আগে আমার ঘুম ভেঙে যায়।”
“গ্রেট, তুমি তাহলে ফোন করে আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিও।”
“আচ্ছা।”
“কখন বের হবে তোমরা?”
“পৌনে ছয়টায় স্টেশনের জন্য রওনা হবো।”
“তাহলে আমাকে সোয়া পাঁচটায় উঠিয়ে দিও।”
“ঠিকাছে।”
“রাখি তাহলে।”
“আচ্ছা।”
আরশির মন ভরছিলো না। ফোন রেখে দিলো কেন কাব্য?

রাতে খাওয়াদাওয়া করার পর কাব্য সিগারেটের প্যাকেটটা খুলে গন্ধ শুঁকে রেখে দিলো। ইদানীং সে একটু পর পর এই কাজ করে। আগে তার প্রতিদিন দুই প্যাকেট সিগারেট লাগতো। যেদিন আরশিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় এলো সেদিন রাতে জেদ করে পুরো প্যাকেট সিগারেট এক রাতেই শেষ করেছিলো। কিন্তু পরদিন সকালে তার মনে হলো এই জেদ মূল্যহীন জেদ। এমন করে সিগারেট খেলে সে কখনোই আরশির কাছে যেতে পারবে না। কিন্তু সিগারেট একদম ছেড়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তাই কমিয়ে দিয়েছে। সেই ঘটনার পরদিন সকালে কাব্য যে প্যাকেট টা কিনেছিলো সেটা এখনো শেষ হয়নি। এখন শুধু ঘুম থেকে উঠে একটা খায়, দুপুরে খাওয়ার পর একটা খায় আর রাতে ঘুমানোর আগে একটা খায়। কাব্য যে টাকা আয় করে তা তার ৭৫% টাকা তার সিগারেটের পেছনেই চলে যেতো। বাসা ভাড়া সেমিস্টার ফি সব বাড়ি থেকে আসতো। সেদিন সে তার মাকে ফোন করে বললো,
“মা আমাকে সামনের মাস থেকে আর বাসাভাড়ার টাকা টা পাঠিও না। সেমিস্টারের শুরুতে শুধু সেমিস্টার ফি দিলেই হবে।”
মা অবাক হয়ে বললেন,
“সেকী বাবু বাসাভাড়া না পাঠালে ভাড়া দিবি কোত্থেকে খাবি কী?”
“আমি তো একটা চাকরি করি তাইনা? ছোটো হলেও করি তো। সেই টাকায় বাসাভাড়া আর খাওয়া হয়ে যাবে।”
“সত্যি বলছিস?”
“হ্যাঁ যদি আবার লাগে, যদি চাই একদম দেবে না।”
“এসব কী বলছিস তুই?”
“মা তুমি কি চাও আমি সিগারেট ছেড়ে দেই?”
“সেতো ছোটোবেলা থেকেই চেয়ে আসছি।”
“তাহলে টাকাপয়সা এতো দিওনা।”
“ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার! ঠিকাছে দেবো না। চাইলেও দেবো না।”
সিগারেট না খেয়ে থাকতে যদিও খুব কষ্ট হয় কাব্যর তবুও মূল্যবান কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ত্যাগ তো করাই যায়।

আরশিকে ট্রেনে তুলে দিয়ে সাহিল চলে গেলো। সাহিল চলে যাওয়ার পর কাব্যকে ফোন করার কথা আরশির। কিন্তু আরশি ফোন করলো না। ওর কেমন যেন ভয় করছিলো। তাই ট্রেন ছাড়ার পরেই ফোন করলো কাব্যকে। কাব্য ফোন ধরেই বললো,
“ভাইয়া চলে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কি তাহলে আসবো?”
“না করলে ফিরে যাবেন?”
কাব্য হেসে বললো,
“হুম তাই বলে তিরার বিয়ে মিস করবো না। বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে চলে যাবো।”
“থাক আসুন।”
কাব্য আবারো হেসে ফোন রেখে দিলো। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে চলে এলো। আরশি বসে ছিলো নীচের বার্থের জানালার পাশে। কাব্য আরশির উল্টোপাশে মুখোমুখি বসলো। তাকে দেখে সবসময়ের মতোই আরশির হাত পা কাঁপতে লাগলো। অকারণেই হাত ঘামতে থাকলো। কাব্য ব্যাগ খুলে পাশে রাখলো। তারপর হেসে বললো,
“সাহিল ভাইয়া যদি জানতে পারে তাকে ফাঁকি দিয়ে তুমি একটা অপরিচিত ছেলের সাথে ৪৪৯ কিলোমিটার রেলপথ অতিক্রম করতে যাচ্ছো তাহলে কী হবে?”
আরশি হেসে বললো,
“নো আইডিয়া।”
কাব্য মুগ্ধ চোখে আরশির হাসি দেখলো। তার ইচ্ছে করছিলো এই হাসি নিয়ে কিছু বলতে কিন্তু পাছে গতকালের মতো হাসিটা মিলিয়ে যায় তাই আর বললো না কিছু। এতো তাড়া কীসের?
আরশি জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ট্রেন চলছে তার নিজস্ব গতিতে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে ইঠ কাঠের বড় বড় দালান, ফ্লাইওভার। কেবলমাত্র এইসব কিছু সাক্ষী রয়ে গেলো আরশির আজব কিছু অনুভূতির। একদিকে তার প্রচন্ড ভালো লাগছিল আগামী ৯/১০ ঘন্টা কাব্যর সাথে থাকতে পারবে বলে, আরেকদিকে প্রচন্ড নার্ভাস লাগছিলো এটা ভেবে যে কীভাবে এতোটা সময় সে কাব্যর সাথে থাকবে? এই অনুভূতি অসহনীয়! কী অদ্ভুত! একই মনে একই মানুষের জন্য বিপরীত দুইরকম অনুভূতি কী করে হয়?

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৬

“আমি মোটেও কোনো অপরিচিত ছেলের সাথে যাচ্ছিনা।”
কথাটা আরশি সেই জানালায় তাকিয়েই বললো। কাব্য একটু অবাক হলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আরশি আবার একই টপিকে কথা বললো তাই। সে বললো,
“তাই? কাব্য ছেলেটা তোমার পরিচিত?”
“হুম।”
“কীভাবে?”
“সে অনেকভাবে আমার পরিচিত। প্রথমত, সে আমার ভাইয়ের বন্ধুর ভাই। দ্বিতীয়ত, সে আমার প্রতিবেশী, আমার ঘরের ঠিক নিচের ঘরটাতেই সে থাকে। আবার আমাদের গ্রামের বাড়ি একই জেলায়। এবং সে আর আমি একই রাজ্যের বাসিন্দা, সেই রাজ্য বইয়ের রাজ্য। তার উপর আর সে আমার ছোটোবোনের এক্স ক্রাশ!”
শেষ কথাটা শুনে কাব্য হাসতে হাসতে শুয়ে পড়লো। আরশির ঠোঁটে মুচকি হাসি, বাঁকা চোখে দেখছে কাব্যকে।

তিরার ফোন এলো আরশির মোবাইলে। কাব্য কিছুতেই হাসি থামাতে পারছিলো না তাই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। আরশি ফোন ধরলো,
“হ্যালো।”
“জানেমান কতদূর?”
“বলতে পারছিনা। ঢাকা ছাড়িয়েছি কিছুক্ষণ হলো।”
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়। আমার যে কী অবস্থা জানিস তো না। কত কথা তোকে বলতে না পেরে পেট ফেটে মারা যাচ্ছি। মালটা আমাকে পাগল করে ফেলেছে, কি ভাব জানিস না! সবসময় ছেলেদের ভাব দেখে মেজাজ খারাপ করিনা আমি? আর ওর ভাব দেখলে বারবার ক্রাশ খাই।”
“মাল? মাল কাকে বলছিস তুই?”
“মানে যাদিদ।”
“তিরা হি ইজ ইওর উডবি হাজবেন্ড!”
“উফ তো কি হয়েছে? তোর এই শাশুড়ি গিরি বন্ধ কর তো। শোন কাব্য আসছে তোর সাথে?”
“তুই ওনাকে আমার সাথে আসতে বলেছিস কেন?”
“আরে বাবা ছেলেটা এতোদূর থেকে একা আসবে নাকি? তুই তো একাই আসছিস তোর সাথে আসলে ক্ষতি কী?”
“কোনো ক্ষতি নেই।”
“কোথায় সে আসছে নাকি?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা সাবধানে আয় তোরা। আমি রাখছি।”
“আচ্ছা।”

কাব্য কেবিনের বাইরে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালো। সিগারেটের প্যাকেট টা খুলে গন্ধ শুঁকে রেখে দিচ্ছিলো ঠিক সেই সময়ে কাব্যর মনে হলো সিগারেটের পাকেট টা কথা বলে উঠলো,
“বেঈমান, প্রতারক, মীরজাফর। গতকাল রাতেও খাসনি। আজ সকালেও খাসনি। শেষ পর্যন্ত তুই আমাকে ছেড়েই দিচ্ছিস সামান্য একটা…”
কাব্য বিড়বিড় করে বললো,
“চুপ একদম চুপ। সামান্য একটা কী? তুই সামান্য, তোর বাপ সামান্য! আরেকবার গলাবাজি করলে একদম গলা টিপে মেরবো ফেলবো। শালা এতদিন আমার কতো টাকা খসিয়েছিস হিসাব দে আগে।”
পাশেই একটা মেয়ে তাকিয়ে ছিলো কাব্যর দিকে। এভাবে সিগারেটের প্যাকেটের সাথে কথা বলতে দেখে মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেললো। পাগল ভাবলো না তো ওকে আবার! কাব্য দ্রুত কেবিনের দিকে গেলো। নক করতেই আরশি বললো,
“আসুন।”

কাব্য ভেতরে ঢুকে আবার আগের জায়গায় বসলো। আরশি ভেবেছিলো এই ফাঁকে কাব্য একটা সিগারট খেয়ে আসবে। কিন্তু একদমই সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছেনা আরশি। সকালেও পায়নি। তাই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন?”
কাব্য অবাক হয়ে বললো,
“কই না তো।”
“সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছিনা।”
“কমিয়ে দিয়েছি।”
অবাক হলো আরশি,
“হঠাৎ?”
“না মানে আমার মা সিগারেট খাওয়া একদম পছন্দ করেনা। আসলে দোষ তো আমার না। দোষ হচ্ছে বড় ভাইয়ের। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন সেই আমাকে সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছে। তাকে দেখতাম অনেক স্টাইল করে সিগারেট খায়, একদম হিরোদের মতো লাগে। এটা দেখেই ইন্সপায়ার হই। এরপর আস্তে আস্তে নেশা হয়ে যায়। মা আমাদের দুজনকে এতো মারতো তাও আমরা ছাড়তে পারতাম না। শুধু মা কেন দাদা, দাদী, বাবা সবাই মারতো। একসময় থেকে ভাইকে আর কেউ মারে না, কিন্তু মা আমাকে এখনো মারে! সবসময় এই নিয়ে মা আর আমার রাগারাগি চলে। মাঝেমাঝে মায়ের জন্য মায়া হয়। অনেকবারই ছাড়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু একেবারে ছাড়তে পারিনা তাই কমিয়ে দিয়েছি। কমাতে কমাতে কখনো যদি ছাড়তে পারি!”
“ওহ আচ্ছা।”
“যাই হোক ফোনে কথা বলার সময় তোমার বোন কাকে মাল বলছিলো?”
একথায় কী যে হলো আরশি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কাব্য খেয়াল করলো ব্যাপারটা কিন্তু বলে যখন ফেলেছে ফিরিয়ে তো নিতে পারবে না তাই বললো,
“সরি আমি তোমাদের কথা শুনতে চাইনি। আমি কেবিনে ফিরছিলাম ঠিক তখনই শুনলাম তুমি ওকে জিজ্ঞেস করছো কাকে মাল বলছিস? পরে এটা শুনে আমি আবার ফেরত চলে গেছি।”
আরশি চুপ। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কাব্য বললো,
“কাকে বলছিলো?”
“ওর হবু বরকে বলছিলো।”
কাব্য হেসে দিলো। বললো,
“জব্বর বৌ পাচ্ছে কিন্তু ছেলেটা! আচ্ছা তিরা যার যার উপর ক্রাশ খায় সবাইকেই এরকম কিছুনা কিছু উপমা দেয় তাইনা?”
আরশি মুচকি হেসে বললো,
“হুম।”
“সেদিন আমাকে বলছিলো সে নাকি একবার এক হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলো তখন এক ইন্টার্নি ডাক্তারের উপর ক্রাশ খেয়েছিলো। তাকে নাকি টসটসে বলতো।”
আরশি এবার হেসে ফেললো। কাব্যর দিকে তাকানোর সাহস নেই৷ একভাবে এতোক্ষণ নিচেও তাকিয়ে থাকা যাচ্ছেনা তাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কাব্য মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো আরশির সে হাসি। এই হাসি দেখলে বুকের ভেতরটা এমন অস্থির হয়ে যায় কেন বোঝেনা সে৷ কাব্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার বোন আমাকে কী বলতো? যখন আমার উপর ক্রাশ খেয়েছিলো?”
আরশির মনে পড়তেই আবারো অজানা কারণে লজ্জা পেলো। হাসিও বেড়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে সে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে বাইরে তাকিয়ে রইলো। কাব্যর ইচ্ছে করছে আরশিকে আরো আরো লজ্জা দিক। কারো লজ্জামাখা মুখ এতো সুন্দর হয়! কিন্তু এই মুহুর্তে সেটা এক ধরনের মানসিক অত্যাচার হয়ে যাবে যেহেতু আরশি তার কেউই না। শুধু বললো,
“বলো না।”
আরশি না তাকিয়েই বললো,
“আমি বলতে পারবোনা প্লিজ। আপনি তিরাকেই জিজ্ঞেস করে নেবেন। ও বলে দেবে।”
“আচ্ছা ঠিকাছে।”

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। এরপর আরশি বললো,
“চা খাবেন?”
“হ্যাঁ চা তো একটু খেতেই হবে। একটু পরেই হয়তো চা ওয়ালা আসবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।”
আরশি ব্যাগ থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করলো। কাব্য দেখে বললো,
“বাপরে বাপ চা বানিয়ে এনেছো?”
“আপনার চাওয়ালার জন্য অপেক্ষা করা আমার কর্ম নয়।”
আরশি ফ্লাস্কের ঢাকনার কাপে চা ঢেলে কাব্যকে দিলো। কাব্য বললো,
“তুমি আগে খাও।”
“আপনি আগে।”
“না তুমি।”
“আপনি আমার সাথে যাচ্ছেন সুতরাং আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে।”
আরশির শান্ত গলায় একটুখানি ঝাঁজ দারুন লাগলো কাব্যর। তাই আরশির কথাই মেনে নিলো। চা খেয়ে কাপ ফেরত দিতেই আরশি সেটাতে আবার চা ঢেলে নিজে খাওয়া শুরু করলো। কাব্য অবাক হয়ে দেখলো আরশি কাপটা না ধুয়েই নিজের জন্য চা ঢেলে নিলো। সে খুব ভালোভাবেই জানে মেয়েরা কখন এই কাজ করে। তনিকাও তার খাওয়া কাপে চা খেতো, তার খাওয়া গ্লাসে পানি খেতো। তার আধখাওয়া সব খাবারও খেতো। এমনকি তার আধখাওয়া সিগারেটেও টান দিতো। এই সবকিছুতেই তনিকা রোমান্টিসিজম খুঁজে পেতো। কাব্য বললো,
“আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি?”
আরশি মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই বেরিয়ে গেলো কাব্য। ট্রেনের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা বাতাসে ভালো লাগার কথা কিন্তু লাগছে না। অমনি একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটে টান দিতে মাথাটা কিছুটা কাজ করতে লাগলো। ভাবতে লাগলো সে কি এমন কিছু করেছে বা করে যাতে আরশির মনে হয় যে কাব্য তার প্রতি দুর্বল? আরশিকে বোঝা দায় তবুও আরশি তাকে চান্স দিচ্ছে এটা ঠিক। আরশি কেন তাকে চান্স দিচ্ছে? আরশি কি দূর্বল হয়ে পড়েছে? আরশির কি তার জন্য বিশেষ কোনো অনুভুতি আছে? নাকি আসলে সবকিছুই স্বাভাবিক। সেই বেশি ভাবছে?
পরক্ষণেই আবার ভাবলো সে যা করে আরশির জন্য, আরশিকে দেখার জন্য, আরশিকে জানার জন্য; এসব আসলে সে কেন করে? আরশির প্রতি তার অনুভূতি টা ঠিক কী? এটা বুঝতে তার কতদিন লাগবে? হাতের সিগারেট টা শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরালো কাব্য!

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ১৩+১৪

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৩+১৪

আরশি বাসায় ঢুকে কাপড়ও বদলালো না। রাতে খেলোও না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কিছু ভালো লাগছে না। সিগারেটের গন্ধে টিকতে পারছিলো না বলেই তো জানালা খুলে দিয়েছিলো আরশি। তাতে দোষের কী হলো? আর একটা কথাও কেন বললো না কাব্য? সে কি জানেনা আরশি এতো কথা বলতে পারে না। কাব্য যদি বলে তবেই কথা হবে, সে যতটুকু বলবে ঠিক ততটুকুই! তারপরেও কথা বললো না কেন? পরক্ষণেই আরশি আবার ভাবলো, না বললে না বলুক। এমনিতেই তাকে পছন্দ না আরশির। সে যত দূরে থাকবে ততই ভালো। কিন্তু একটা জিনিস আরশি বোঝেনা তার সাথে দেখা হলো এতো ভালো লাগে কেন? তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেই বা এতো ভালো লাগে কেন? তার ওভাবে তাকিয়ে থাকা, তার কথা বলা সবকিছুই কেন ওকে টানে? এসবের জন্য তো মানুষটা পছন্দের হওয়া চাই। কিন্তু আরশির তো তাকে একদম পছন্দ না। তাহলে কেন এমন হয়? ভালো লাগা আর খারাপ লাগা দুই ধরনের অনুভূতিই কি একটা মানুষের জন্য থাকা সম্ভব?

সারারাত কাব্যর ঘুম হলো না। খুব অস্থির লাগলো। দশ মিনিট পর পর সিগারেট খেতে লাগলো। আরশির সাথে দেখা হবে বলে সেই সন্ধ্যা থেকে সিগারেট খেলো না। তাতে লাভ কী হলো? সেই তো আরশি সিগারেটের গন্ধ পেলোই। অথচ কাব্য চাইছিলো আজ অন্তত সে সিগারেটের গন্ধ না পাক। আরশির অনুভূতিটা যদিও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না সে। আরশি হাসে না, কথা বলে না। তার দিকে সরাসরি তাকায়ও না তাই ওর ভেতরে কি চলছে বোঝা মুশকিল। কিন্তু নিজের অনুভূতি নিয়ে এতো কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে কেন? একবার মনে হচ্ছে আরশির প্রতি যত অনুভুতি তা ভালো লাগার অনুভূতি, সারাজীবন ঘরের মানুষ বানিয়ে নিতে চাওয়ার অনুভূতি। আবার মনে হচ্ছে সবটাই কেবল মোহ, ওকে জানার আগ্রহ। কাব্য নিজেকে বোঝাতে লাগলো, “সময় নিতে হবে কাব্য, সময় নে। তনিকার বেলায় যে ভুল করেছিস আরশির বেলায় তা করিস না। আরশি অনেক ছোটো এখনো, অনেক সময় আছে হাতে। তাড়াহুড়ো করে আবার কোনো ভুল করিস না।”

যাদিদের বাড়ি থেকে তিরাকে দেখতে এসেছে। তিরা তৈরি হয়ে ছটফট করতে লাগলো কখন তাকে পাত্রপক্ষের সামনে নেয়া হবে। সে জানে সে সুন্দরী যেকোনো পাত্রপক্ষ তাকে দেখে পছন্দ করবে। কিন্তু যদি এরা পছন্দ না করে? যাদিদকে পাবেনা তাহলে! ভাবতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যখন তাকে পাত্রপক্ষের সামনে নেয়া হলো সে বাঁকা চোখে যাদিদকে দেখে নিলো। কিন্তু হায় যাদিদ তো একবারো তাকাচ্ছে না! নাকি তার মতো প্রথমেই চুরি করে দেখে নিয়েছে যা সে টের পায়নি! দুই পক্ষেরই পছন্দ অপছন্দ মতামত সব মিলে গেলো। যাদিদ ও তিরার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার জন্য তাদেরকে একা কথা বলতে দেয়া হলো। তিরা তো খুশিতে বাকবাকুম করতে লাগলো। যাদিদ সামনাসামনি ছবির থেকেও বেশি স্মার্ট। তিরার ইচ্ছে করছে যাদিদকে স্কচটেপ দিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে রাখতে, যাতে সারাক্ষণ দেখতে পারে!

কথা বলার জন্য যাদিদ ও তিরাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। দুজন পাশাপাশি হাঁটছিলো। যাদিদ প্রথম প্রশ্নটাই করলো এমন,
“এত অল্প বয়সে বিয়ে করছেন যে? পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই?”
যাদিদের গম্ভীর গলায় এই প্রশ্ন শুনেই তিরার কপাল কুঁচকে গেলো। সে যথাসম্ভব কপাল সোজা রেখে দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো,
“বিয়ের সিদ্ধান্ত আমার বাবা মায়ের৷ আমি তাদের কথার উপর কথা বলিনা। পড়াশোনা বিয়ে হয়ে গেলেও করবো আমি। সেকথা আমার বাবা মাকে বলেছি।”
“আপনার কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছে।”
তিরা ঘাবড়ে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো।
“সবাই বলে আমার কন্ঠস্বর শুনলে নাকি মনে হয় খুব চেনা কেউ।”
“সেসব যারা বলে আপনাকে পটানোর জন্য বলে। আমার তো আপনাকে পটানোর প্রয়োজন নেই। আমি চাইলেই আপনাকে পেতে পারি।”
ছেলের ভাব দেখে তিরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। বললো,
“আমি না চাইলেও পেতে পারেন?”
“হ্যাঁ কারণ আপনি একটু আগেই বলেছেন আপনি আপনার বাবা মায়ের কথার উপর কথা বলেন না।”
যাদিদের একথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলো তিরা। ছেলে তো আরশির মত বুদ্ধিমান। কথার পিঠে কথা ঢেলে কুপোকাত! তিরা আবার মজে গেলে যদিদপ্রেমে। যাদিদ জিজ্ঞেস করলো,
“আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চান আপনি?”
তিরার নিজেকে চিনতে এবার অসুবিধা হচ্ছিলো। যে মেয়ের মুখের আগায় কথা থাকে সে কিনা এখন একটা প্রশ্নও খুঁজে পাচ্ছে না যাদিদকে করার মতো? তিরা বললো,
“আস্তে আস্তে জেনে নেব। যা জানা খুব জরুরি তা নিশ্চয়ই আমার বাবা মা জেনে নেবেন।”
“আপনি তো দেখছি একদম ড্যাডি’স গার্ল!”
তিরা চুপ। তবে বাঁকা চোখে দেখছে যাদিদকে। যাদিদ আবার বললো,
“আমার ছুটি শেষের দিকে। হাতে সময় খুব কম। কিছু জানার থাকলে জেনে নিন। আমরা রাজী হলে কিন্তু সামনের সপ্তাহেই বিয়ে।”
তিরার হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সিগারেটের বিজ্ঞাপণের সেই বিশেষ ক্ষতির কথাগুলো। জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি সিগারেট খান?”
“না।”
“মদ খান?”
“মাঝেমাঝে খুব রেয়ার।”
“গার্লফ্রেন্ড ছিলো কোনো?”
“হ্যাঁ।”
“ব্রেকাপ হলো কেন?”
“সেইম এজ ছিলাম। আমি যখন স্টুডেন্ট তখন তার বিয়ে হয়ে গেছে।”
“আপনাদের এখনো যোগাযোগ আছে?”
“না। সে এখন দুই বাচ্চার মা। আপনার বয়ফ্রেন্ড ছিলো কোনো?”
“না।”
“আমাকে বিয়ে করছেন কি একদমই বাবা মায়ের ইচ্ছেয়? নাকি আমাকে দেখে ভালো লেগেছে বলে? নাকি আমার ভালো জব আছে বলে?”
“প্রথম দুটো কারণে।”
“গট ইট। আপনার আর কিছু জানার আছে?”
“আপনি কি ঘুমের মধ্যে নাক ডাকেন?”
“সম্ভাবত।”
তিরা আতঙ্কিত চোখে তাকালো। যাদিদ বললো,
“যখন কেউ ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে তখন তার বুকে হাত বুলিয়ে দিলে নাক ডাকা থেমে যায়।”
“ওহ আচ্ছা। আপনার কোনো বদ অভ্যাস নেই?”
“আছে।”
“কী?”
“ঘুমের মধ্যে গায়ে পা তুলে দেই।”
“আপনার ওজন কতো?”
এই প্রথম যাদিদ হাসলো। তারপর বললো,
“ঘাবড়ানোর মতো নয়।”

চলবে…।।

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৪

তিরা বেলা করে ঘুমুচ্ছিলো। ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। বিরক্ত মুখে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো তিরা কারণ যাদিদ ফোন করেছে! গলা খাকারি দিয়ে, পানি খেয়ে ঘুম দূর করার চেষ্টা করলো। এরপর ফোন ধরলো,
“হ্যালো।”
যাদিদ বিস্ময়ের সাথে বললো,
“এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছো তুমি আমার বৌ হবে কীভাবে?”
“না না ঘুমাচ্ছি না আমি।”
“তোমার ভয়েস শুনে কানাও বলে দিতে পারবে তুমি ঘুমাচ্ছিলে।”
“না কিছুক্ষণ আগে উঠেছি। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের সাথে কাজ করেছি তো তাই নাহলে এমনিতে আমি সকালেই উঠি বিশ্বাস করো।”
“কী কাজ করছিলে?”
“বিয়ে বাড়িতে কত কাজ থাকে!”
তিরা মনে মনে বললো,
“আমি যে শাড়ি ট্রায়াল দিতে দিতে অর্ধেক রাত পার করেছি তা তোমাকে কী করে বলি যাদিদ?”
যাদিদ বললো,
“আচ্ছা শোনো বিয়ের শপিং এ বেরিয়েছি। মা আর আপুকে বলছিলাম তোমাকে সাথে নিতে। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। হবু বৌকে সাথে নিয়ে শপিং করার ট্রেন্ড নাকি আমাদের বংশে নেই। যাই হোক, আমাকেই বলে দাও বিয়েতে শাড়ি পরতে চাও নাকি লেহেঙ্গা? আর কী রঙ? আমি সেভাবে পছন্দ করে নেব।”
তিরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। ছেলেটাকে যতটা রসকষহীন মনে করেছিলো ততটা সে না। বললো,
“শাড়ি পরবো, বেনারসি। রঙ টা তুমি পছন্দ করে দিও।”
“আচ্ছা।”
“আর কসমেটিকসের ক্ষেত্রে কি ব্র‍্যান্ড পছন্দ?”
তিরা গড়গড় করে বলে দিলো কোন জিনিস কী ব্র‍্যান্ড ব্যবহার করে। যাদিদ বললো,
“থামো থামো এসব জিনিসের নাম বাপের বয়সে শুনিনি। এতো মনে রাখতে পারবো না। সব লিখে মেসেজ করো।”

আরশি বাগানে গাছে পানি দিচ্ছিলো। কাব্য তাকে পছন্দ করে জানার পর থেকে বুয়াকে দিয়ে বাগানের গাছে পানি দেয়াতো। এখন থেকে আবার নিজেই দেবে ঠিক করেছে। এই সুযোগে যদি কাব্যর সাথে প্রতিদিন একবার দেখা হয় ক্ষতি কী? যদিও আরশি জানেনা কাব্য কোন দিন কখন বাসায় থাকে। কাল যখন পানি দিতে এসেছিলো কাব্য বাসায় ছিলো না। আজ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। জানালা যখন খোলা থাকতেও পারে।

নিজের কার্যকলাপে নিজেই অবাক হচ্ছে আরশি৷ কাব্যর সামনে যাতে পড়তে না হয় তাই সে নিজেকে একপ্রকার গৃহবন্দী করে রেখেছিলো। একমাস পর দেখা হতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। এখন সে নিজেই চায় বারবার কাব্যর সাথে দেখা হোক। তাহলে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে কাব্যকে? এতো তাড়াতাড়ি কাউকে ভালোবাসা যায় তাও অপছন্দের কাউকে? তিরা যখন এসব জানতে পারবে তখন কি কষ্ট পাবে? কষ্ট পাওয়ার কথা না কারণ তিরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তারই পছন্দের কারো সাথে। কিন্তু কাব্য তাকে রেখে আরশিকে পছন্দ করলো এটা ভেবে কষ্ট পাবে না তো? ঠিক তখনই কাব্য জানালা দিয়ে ডাকলো,
“এইযে ডাক্তার আপা..”
আরশির হাসি পেলো৷ হাসি আটকে সে পিছনে ফিরলো। স্বাভাবিকভাবে বললো,
“এখনো ভর্তিও হইনি।”
“তাতে কি চান্স তো পেয়েছো। অফিসে যখন শুনলাম গতকাল মেডিকেলের রেজাল্ট দিয়েছে তখনই মনে হচ্ছিলো বাসায় এসে মিষ্টি খাব। কিন্তু এক্সপেক্ট করেছিলাম মিষ্টিটা তুমি নিয়ে আসবে।”
“সারাদিন আমি বাসায় একা ছিলাম। রাতে সাহিল ভাইয়া ফেরার সময় মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো। কেউ তার বোনকে রাত ১০ টার সময় একটা ছেলের বাসায় মিষ্টি নিয়ে পাঠাবেনা নিশ্চয়ই?”
কাব্য হাসলো৷ আরশি আবার গাছে পানি দিতে লাগলো। কাব্য বললো,
“আমি বাগানে এলে মাইন্ড করবে?”
আরশি না তাকিয়েই বললো,
“আসুন বেঁধে রেখেছে কে?”

কাব্য ঝটপট স্যান্ডেল পড়ে বাগানে এলো। আরশি হেঁটে হেঁটে সব গাছে পানি দিচ্ছিলো। কাব্য আরশির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“তিরার বিয়ে তো শুক্রবার। খুলনা যাচ্ছো না?”
আরশি তাকালো না, গাছে পানি দিতে দিতেই বললো,
“হ্যাঁ আমি তো কালই যাচ্ছি। সাহিল ভাইয়া বৃহস্পতিবার যাবে। আফসোস ভাবী যেতে পারছে না। বাবুর তো মাত্র এক সপ্তাহ হলো এখনই ওকে নিয়ে কোথাও যাওয়া যাবে না।”
“একা যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ।”
“আমাকে নেবে তোমার সাথে? মানে এতোটা পথ একা জার্নি করাটা কষ্টকর, তোমার জন্যও আমার জন্যও।”
আরশি জানেনা তার কী হলো! কাব্যর এই এতটুকু কথায় বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঝড় বইতে শুরু করলো। পা দুটো এমনভাবে কাঁপতে লাগলো যে দাঁড়িয়ে থাকা দায়! বললো,
“আপনি কি যাচ্ছেন নাকি তিরার বিয়েতে?”
“হ্যাঁ তিরা তো আমাক খুব রিকোয়েস্ট করেছে যাওয়ার জন্য। আমি যখন বললাম আমি তো চিনিনা তখন বললো তোমার সাথে যেতে। তোমাকে কিছু বলেনি?”
“না ও তো যাদিদ ভাইয়া আর বিয়ের শপিং নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত। কথা কম হয়েছে।”
“যাই হোক এখন বলো তো নেবে কিনা তোমার সাথে?”
“কিন্তু সাহিল ভাইয়া তো আমাকে ট্রেনে তুলে দেবে। একসাথে কী করে যাবো?”
“সমস্যা কী সেদিন তো সাহিল ভাইয়া তোমাকে হসপিটাল থেকে আমার সাথে বাসায় পাঠালো।”
“হসপিটাল থেকে বাসায় পাঠানো আর ঢাকা থেকে খুলনা পাঠানো এক না।”
“আচ্ছা তাহলে আলাদা আলাদা যাবো। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর একসাথে হবো। যদি শুধুমাত্র তোমার আপত্তি না থাকে। বাকীসব আমি ম্যানেজ করে নেবো।”
আরশির এতো জোরে হার্টবিট হচ্ছে যে মনে হচ্ছে কান ফেটে যাবে। কাব্য সব টের পেয়ে যাচ্ছে না তো? পালাতে হবে এক্ষুণি এখান থেকে পালাতে হবে। আরশি বললো,
“ঠিকাছে। টিকেট দেখে ট্রেনের ডিটেইলস আমি আপনাকে জানিয়ে দেবো।”
একথা বলে আরশি চলে যাচ্ছিলো। কাব্য থামালো,
“আরশি..”
আরশি দাঁড়ালো। কাব্য বললো,
“এক্ষুণি দিও। তোমার সাথে তো আর সিট পাব না আমি বরং ওই ট্রেনেই দুটো টিকেট কেটে ফেলি। এসি স্লিপার নিব?”
“আপনার টিকেট করতে হবে না। ভাইয়া পুরো একটা কেবিন নিয়েছে আমার জন্য। একা যেতে হবে যেহেতু অপরিচিত মানুষদের মধ্যে যাওয়া আমার কর্ম নয়।”
“একটা কেবিন মানে চারটা টিকেট করেছে ভাইয়া? এই টাকায় তুমি প্লেনে যেতে পারতে।”
“আমি ট্রেন জার্নিটা খুব উপভোগ করি তাই।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি চলে যাচ্ছিলো। পেছন পেছন কাব্য। সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই কাব্য আবার ডাকলো,
“আরশি..”
আরশি ঘুরে তাকালো৷ কাব্য বললো,
“চা খাবে? আমার বানানো?”
আরশি হুট করেই কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কাব্যরও তাড়া নেই, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে উত্তরের জন্য। আরশির খুব ইচ্ছে করছে কাব্যর হাতের চা খেতে, কাব্যর কোনো বই নিয়ে এসে তার বুকমার্কের লেখাগুলো শতশতবার পড়তে! আরো বেশি ইচ্ছে হয় কাব্যর সামনে অনন্তকাল থাকতে, ইচ্ছে হয়ে কাব্যর বাসায় যেতে, কাব্যর ব্যবহৃত সবকিছু ঘেঁটেঘুঁটে দেখতে। কেন এসব অসভ্য ইচ্ছেগুলো হয় আরশির? আরশি কিছু বললো না, চুপচাপ কাব্যর ফ্ল্যাটে ঢুকলো৷ কাব্য সদর দরজা খোলাই রাখলো। আরশির ব্যাপারটা ভালো লাগলো। কাব্য বললো,
“তুমি বসো। আমি চট করেই চা টা বানিয়ে আনি।”
কাব্য রান্নাঘরে চলে গেলো। আরশি আশেপাশে সবকিছু দেখতে দেখতেই হঠাৎ অ্যাস্ট্রেতে চোখ পড়লো। আরশি অবাক হয়ে দেখলো মাত্র একটা ফিল্টার! অথচ আগের যেদিন এসেছিলো এই সময়েই এসেছিলো এবং অ্যাস্ট্রেতে ভর্তি সিগারেটের ফিল্টার দেখেছিলো। হঠাৎ আরশি খেয়াল করলো আজ কাব্যর গা থেকে আগের মতো উৎকট সিগারেটের গন্ধ আসছে না। ঘরেও তেমন সিগারেটের গন্ধ নেই। সে কি তবে সিগারেট খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে? যে ছেলে ওই হারে সিগারেট খায় তার পক্ষে কি সিগারেট খাওয়া কমানো সম্ভব? সিগারেটের প্যাকেটটা সেন্টার টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে। আরশি প্যাকেট টা খুললো। প্যাকেট ভর্তি সিগারেট! ঠিক তখন শুনতে পেলো কাব্য বলছে,
“সিগারেট খাবে?”
কাব্য চা নিয়ে ঢুকছিলো। ঢুকেই আরশিকে সিগারেটের প্যাকেট খুলে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাব্য একথা জিজ্ঞেস করলো। আরশি লজ্জা পেয়ে হেসে বললো,
“না না।”
আরশি প্যাকেট টা আবার রেখে দিলো। কাব্য আরশির মুখোমুখি বসতে বসতে বললো,
“এইতো হাসলে সুন্দর লাগে। হাসোনা কেন তুমি?”
একথায় আবার আরশির মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর মুখ করে উঠে বুকশেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাব্য বুঝলো এসব প্রশ্ন এত দ্রুতই করা যাবে না। চায়ের কাপ নিয়ে আরশির কাছে গিয়ে বললো,
“চা নাও।”
আরশি চা নিতে নিতে কাব্য টপিক চেঞ্জ করার জন্য জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তিরার রেজাল্টের খবর কী?”
“ও তো মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়নি।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি চায়ে চুমুক দিয়েই বললো,
“আমার মতো করে বানিয়েছেন?”
“চেষ্টা করেছি, কতদূর হয়েছে বলতে পারছিনা।”
“অনেকটাই হয়েছে নাহলে তো একথা বলতে পারতাম না যে আমার মতো করে বানিয়েছেন।”
কাব্য হাসলো। আরশি চা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই দোতলার বেল বাজলো। দরজার সামনে গিয়ে দেখে গেটের বাইরে বুয়া দাঁড়িয়ে। আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজ আসি। এই বুয়া চাচ্চু ফুপি সবার বাসায় কাজ করে। আমাকে এখানে দেখলে গল্প বানিয়ে ফেলবে।”
কাব্য কিছু বলার আগেই আরশি দোতলায় চলে গেলো গেটের চাবি আনতে। কাব্য বিড়বিড় করে বললো,
“শালার বুয়া আসার আর সময় পেলো না!”

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ১১+১২

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১১+১২

আরশি ঘরে ঢুকে কার্টন টা রেখে বসলো। পরক্ষণেই কী মনে হতে জানালার কাছে গেলো। লুকিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকালো। কাব্য এখানো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কী যেন ভাবছে আর মুচকি হাসছে। আরশি যখন তাকে আঙ্কেল বলে ডাকলো তখন তার চেহারাটা হয়েছিল দেখার মতো। আরশি সে দৃশ্য ভাবছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো। আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“নিজেকে খুব চালাক ভাবা হয় তাইনা? এখন কেমন লাগছে?”

আরশি চলে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কাব্য৷ আরশি বেশ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী সেটা সে আন্দাজ করেছিলো তাই বলে এতোটাও আশা করেনি! অবশ্য এভাবে বোল্ড আউট হয়ে তার প্রচন্ড ভালো লাগছে। অবশেষে কাউকে তো পাওয়া গেলো যে তাকে বোল্ড করার ক্ষমতা রাখে৷ যদিও তারা দুজন দু প্রান্তের মানুষ। এক হওয়া অসম্ভব তবুও কোনো ছ্যাঁচড়ামি না করতেই আরশি যখন সব বুঝেই গেছে এবার কাছাকাছি আসাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। সেই কবে থেকে ফেসবুক আইডি থাকা স্বত্তেও সে একটা মেসেজ বা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিতে পারেনি এতোদিন। ফোন নাম্বার থাকা স্বত্তেও একটা কল করতে পারেনি। এই কাজগুলো করা তার জন্য খুবই কঠিন। তারচেয়ে সামনাসামনি কথা বলা হাজারগুণ সহজ। মনে মনে বললো,
“আরশি যতোই তুমি আঙ্কেল বলো কোনো সমস্যা নেই। আমি বিশেষ কিছু চাইনা, শুধু তোমার ব্যাপারে একটু জানতে চাই।”
ঘরে ঢুকে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বিড়বিড় করে বললো,
“তোর আর আমার মাঝে আরকোনো বাধা রইলো না রে৷ আরশি আর যাই হোক কখনো তোর সতীন হবে না।”

সন্ধ্যায় রশ্নির সাথে দেখা করতে গেলো আরশি। রশ্নির এতো প্রিয় সব খাবার পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো। বললো,
“এতোকিছু কীভাবে একা করলি? মাঝেমাঝে ভাবি তুই আমার ননদ না আমার শ্বাশুড়ি! এতো লক্ষী কেন তুই?”
“তুমি যে আমার মায়ের মতো ভাবী। কতোকিছু করেছো আমার জন্য। তাই তোমার এই সময়ে তোমার জন্য কিছু করতে ই আমার কষ্ট হয়না।”
আরশি নিজ হাতে রশ্নিকে খাইয়ে দিলো। সাহিল এতক্ষণ এ ঘরেই ছিল। কিন্তু এখন বের হয়ে কোথাও গেলো। সেই সুযোগ টাই কাজে লাগালো আরশি। হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
“আচ্ছা ভাবী তিরা আর আমার মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?”
ভাবী বললো,
“তোরা দুজন দুরকম সুন্দর।”
“না এমন কূটনৈতিক উত্তর দিলে হবে না। একদম স্ট্রেইটকাট বলো। তোমার উত্তরে আমি কষ্টও পাবো না, আনন্দিতও হবো না। একটা কনফিউশন ক্লিয়ার করা দরকার তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“কীসের কনফিউশন?”
আরশি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“তা তোমার না জানলেও তো হবে তাইনা?”
রশ্নি হেসে বললো,
“বলতে না চাইলে বলতে হবে না।”
“ঠিকাছে। তাহলে এবার বলো কে বেশি সুন্দরী?”
“তিরা বেশী সুন্দরী। কারণ সে নিজেকে সুন্দর রাখে। তুই যদি নিজেকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করতি তাহলে তোদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তা বলা কঠিন হয়ে যেতো।”
“এটাও স্ট্রেইটকাট উত্তর হলো না ভাবী।”
রশ্নি হেসে বললো,
“তিরা বেশি সুন্দরী।”
আরশি বললো,
“থ্যাংকস এবার এটা বলো তো কোনো ছেলের কাছে যদি দুটো অপশন থাকে। একটা তিরা আরেকটা আমি তাহলে কি তিরাকে না পছন্দ করে আমাকে পছন্দ করা সম্ভব?”
ভাবী অবাক হয়ে বললো,
“ওহ মাই গড! হুজ দ্যা লাকি বয়? আমার ননদের মুখে প্রথম কোনো ছেলের কথা শুনলাম।”
“ধ্যাত ভাবী বেশি ভেবে ফেলছো। যা জিজ্ঞেস করলাম তা বলো না।”
“অবশ্যই সম্ভব। তিরা শুধু সুন্দর। আর তুই গুণী বুদ্ধিমতী। এখন যার যেটা লাগবে সে তো সেটাই বেছে নেবে তাই না?”
“আমার কেন যেন বিশ্বাস হয়না কেউ তিরাকে রেখে আমাকে পছন্দ করবে!”
“বলনা ছেলেটা কে? প্রোপোজ করেছে?
“না করেনি। তবে পছন্দ করে সেটা বুঝতে পেরেছি। আর এটাও বুঝিয়ে দিয়েছি তাকে আমার পছন্দ না।”
“পছন্দ না মানে? কি বলছিস? এবাড়িতে এসে কতটুকু পেয়েছি তোকে আমি। কখনো কোনো ছেলের কথা শুনলাম না। আর আজ শুনছি তাও অপছন্দের কারো কথা? এটা সম্ভব না। পছন্দ না হলে আমাকে তুই সেই ছেলের কথা কখনো বলতি না আরশি, আমি তোকে ভালো করে চিনি। সত্যি কথা বল।”
“তাই? কিজানি বুঝতে পারছি না। তবে সে আমাকে পছন্দ করে এটা জানার আগে আমি তাকে নিয়ে এক সেকেন্ডও ভাবিনি৷ অথচ সে আমাকে পছন্দ করে এটা জানার পর থেকে আমি প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে শুধু তার কথাই ভাবছি!”
ভাবী খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো,
“আরশি তুই তো প্রেমে পড়ে গেছিস!”
আরশি খানিক লজ্জা পেয়ে বললো,
“ইশ না। অমন ছেলেকে আমি কখনো ভালোবাসতে পারবো না।”
“কেমন ছেলে দেখতে ভালো না?”
“না দেখতে মনে হয় ভালোই।”
“মনে হয় মানে? ভালো করে দেখিসনি?”
“ভালো করে কীভাবে দেখবো সরাসরি তাকাতে লজ্জা করেনা আমার?”
“আচ্ছা দেখতে ভালো হলে আর কী সমস্যা? ব্যবহার খারাপ?”
“না না।”
“আনস্মার্ট?”
“না বরং বেশি স্মার্ট, তার পাশে আমিই বেমানান। তিরা হলে ঠিক ছিলো।”
“ধুর ধুর। যেটা বলছি সেটা শোন ছেলে কি ছ্যাঁচড়া?”
“একদম না, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর..”
“আর?”
“খুব ট্যালেন্টেড। তার কিছু লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। এত সুন্দর ভাবনা আজকালকার ছেলেদের থাকতে পারে আমার জানা ছিলো না।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো।”
“কিচ্ছু হলো না ভাবী। আমরা দুজন দুই প্রান্তের মানুষ। তাছাড়া তাকে আমার ভালো লাগে না।”
“এতো গুণগান গাইছিস আর বলছিস ভালো লাগে না?”
“সম্ভাবত জীবনে প্রথম আমাকে কেউ পছন্দ করেছে বলে আমার উত্তেজিত মস্তিষ্ক তাকে ভাবাচ্ছে। তাই সারাক্ষণ তাকে ভাবছি। তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সামনে যেতে ভয় পাচ্ছি। এরকমটা হয় ভাবী আমি পড়েছি।”
রশ্নি কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। আরশি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ না হলেও তারচেয়ে অনেক বুদ্ধিমতী, নিশ্চয়ই সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে। তবে সে চায় আরশি কারো প্রেমে পড়ুক, সুখ দুঃখের অনুভূতির সাথে পরিচিত হোক। ওর সব বিষন্নতা নীরবতা কেটে যাক আজীবনের জন্য।

তিরা ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে সিনেমা দেখছিলো। হঠাৎ তিরার বাবা মনোয়ার সাহেব এসে মেয়ের পাশে বসলেন। তার হাতে একটা খাম ছিল সেটা পাশেই রাখলেন। তিরা খেয়ালও করলো না। মনোয়ার সাহেব বললেন,
“মামনি টিভি দেখছিস?”
তিরা চমকে উঠে বললো,
“ও বাবা তুমি।”
“ভয় পেলি কেন?”
তিরা দাঁত কেলিয়ে বললো,
“ভূতের সিনেমা দেখছি তো এজন্য।”
“মামনি সকালে আমি বেরিয়ে যাওয়ার আগ তো তুই ঘুম থেকেই উঠিস না। তাই ভাবলাম কথাটা এখনই সেড়ে ফেলি।”
“কি কথা বাবা বলোনা।”
“মেয়ে একটু বড় হলেই সব বাবা মায়েরা বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়।”
“ঠিক বাবা। আমার অনেক বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।”
“আমরা তো আর অমন বাবা মা নই।”
তিরা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তোমরা তো সেরা বাবা মা।”
“কিন্তু মামনি দারুণ একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তোর জন্য।”
তিরা চমকে সরে গেলো। মনোয়ার সাহেব বললো,
“ছেলে নেভিতে চাকরি করে। তোর মতোই অল্প বয়স, একটু বড়। বাবা মা এখনই বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে।”
তিরা রেগেমেগে বললো,
“বাবা তুমি এই কথা বলার জন্য এতক্ষণ ধানাই পানাই করেছো! ছি বাবা।”
মনোয়ার সাহেব নরম স্বরে বললেন,
“আহা রেগে যাচ্ছিস কেন মা? ছেলেটাকে আমাদের দারুণ পছন্দ হয়েছে। তুই একবার সবকিছু দেখ, তোরও পছন্দ হবে।”
“আমি এখন বিয়ে করবো না।”
মনে মনে বললো,
“বিয়ে করলে বাকী ক্রাশগুলো খাবো কীভাবে বাবা?”
মনোয়ার সাহেব বললেন,
“একবার ছবি তো দেখ।”
তিরা চিৎকার করে বললো,
“আমি এখন বিয়ে করবো না করবো না করবো না।”
তিরার চিৎকারে মনোয়ার সাহেবের কানের পর্দা ফাটার জোগাড়। তিনি দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর খামটা তিরার চোখে পড়লো। খামটা খুলে একটা বায়োডাটা আর কয়েক কপি ছবি পেলো। তিরা তার পরবর্তী ক্রাশটা সেখানেই খেয়ে ফেললো। তার ধারণা সে এত সুন্দর ছেলে জীবনেও দেখেনি৷ বয়সও একদম কম। তিরা দ্রুত সব আবার খামে ঢুকিয়ে যেখানে ছিলো সেখানেই রেখে দিলো। এরপর বাবার কাছে গেলো। গিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
“সরি বাবা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আমার এখন খুব খারাপ লাগছে।”
মনোয়ার সাহেব মৃদুস্বরে বললেন,
“ঠিকাছে মামনি কোনো সমস্যা নেই। আমার তো অভ্যাস আছে। তুই যতদিন খুলনা থাকিস আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি।”
“আমি সত্যিই সরি বাবা। আচ্ছা তুমি ছেলের ছবি দেখাও। বায়োডাটা দাও। আমি সব দেখে ভেবেচিন্তে কাল সিদ্ধান্ত জানাবো।”
মনোয়ার সাহেব খুশি হয়ে ছবি আর বায়োডাটার খাম খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু মনে করতে পারলেন না কোথায় রেখেছেন। তিরা যে মনে করিয়ে দেবে তাও তো সম্ভব না তাহলে তো বাবা বুঝেই ফেলবে যে ছেলেকে দেখে তার মেয়ের মাথা ঘুরে গেছে। তিরা বললো,
“ঠিকাছে বাবা তুমি খুঁজে রেখো আমি সিনেমাটা শেষ করি।”
তিরা ড্রয়িং রুমে গিয়ে হঠাৎ খামটা দেখার ভান করে বললো,
“এই খামটা কীসের বাবা? এটাই কি বায়োডাটা?”
মনোয়ার সাহেব এসে দেখলেন সে খামটা এখানেই ফেলে গিয়েছিলেন।
“হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই তো। নে মা সব দেখে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবিস।”
“ঠিকাছে। তুমি রাগ করোনি তো বাবা?”
“না মা রাগ করিনি।”
মনোয়ার সাহেব এবার নিজেই মেয়ের সাথে সিনেমা দেখতে শুরু করলেন। তিরার কপাল ঠুকে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেন সে সিনেমা দেখতে বসেছিলো। উফফ কখন সিনেমাটা শেষ হবে আর সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটাকে প্রাণভরে দেখতে পারবে?

দুপুরবেলা আরশি গোসল করে বেরিয়েছে। তার পরপরই কলিং বেল বেজে উঠলো। আরশি বারান্দায় গিয়ে দেখলো গেটে কেউ নেই৷ ঘরে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে?”
দরজার ওপাশ থেকে কাব্যর গলা পাওয়া গেলো,
“আমি।”
আরশি অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বাসায় কেউ নেই যাকে দিয়ে দরজা খোলানো যায় বা কাব্যর সাথে কথা বলতে দেয়া যায়। এই মুহুর্তে বাসায় আরশি একদম একা। দরজা খোলাটা কি ঠিক হবে? অবশ্য কাব্যকে আর যাই হোক খারাপ তো মনে হয়না। তাছাড়া কাব্য নিশ্চয়ই কোনো দরকারে এসেছে নাহয় দোতলা পর্যন্ত আসতো না। অগত্যা তার নিজেরই খুলতে হলো। আরশি দরজা খুলে বের হলে কাব্য তাকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। দিন দুনিয়া ভুলে হা করে চেয়ে রইলো। সদ্য গোসল করে বের হওয়া আরশিকে অন্যরকম লাগছে। মুখটা স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠময়। আরশি অস্বস্তি কাটিয়ে বললো,
“বলুন কি দরকার?”
কাব্য বললো,
“সরি অসময়ে বিরক্ত করতে এসেছি। আসলে একটু পানি ছাড়তে হবে। অফিস ফিরে দেখি পানি নেই৷ গোসল করা জরুরি।”
“সেকি! পানি আছে তো। আমি তো মাত্রই গোসল করে এলাম।”
“নিচে তো পানি নেই।”
“আচ্ছা দাঁড়ান ছাদে গিয়ে নিচের পাইপের চাবি চেক করি।”
“আচ্ছা।”
আরশি ছাদে গেলো, কাব্য গেলো পেছন পেছন। ছাদে গিয়ে দেখে সত্যিই নীচের চাবি বন্ধ। আরশি চাবি খুলে দিয়ে বললো,
“সরি চাচার বাসা থেকে বাচ্চারা এলে ছাদে খেলে তো অনেক সময় না বুঝেই চাবি ঘুরিয়ে রাখে।”
“ইটস ওকে, কোনো সমস্যা নেই।”
আরশি আর কথা বাড়ালো না, দোতলায় নেমে গেলো। কাব্যও চলে গেলো নিচে।

আরশি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার শরীর কাঁপছে। কাব্যর সামনে গেলে এমন লাগে কেন? ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেলো আরশি। তারপর যেন হঠাৎই তার মনে পড়লো গত দুদিনের মধ্যে চাচাতো ভাইবোনেরা তো কেউ ছাদে খেলতে আসেনি! তাহলে চাবি কে বন্ধ করলো? হায় আল্লাহ! কাব্য নিজেই কি চাবি বন্ধ করেছিল পানি না থাকার ছুঁতোয় আরশির সাথে দেখা করতে? আগের ভাড়াটিয়া থাকতে চাচাতো ভাইবোনেরা প্রায়ই এই কাজ করতো তাই আরশি স্বাভাবিকভাবে সেটাই ধরে নিয়েছিলো। অথচ কাব্য ওকে এভাবে ঘোল খাইয়ে গেল? আরশির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে বললো,
“অসভ্য ছেলে কোথাকার। তোমাকে এর দ্বিগুণ ঘোল খাওয়াবো আমি!”

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১২

তিরা ঘরের দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে খামটা খুলে বসলো। ছেলেটা লম্বা ৬ ফিট, ফরসা গায়ের রঙ, দেখতে বলিউডের নায়কদের মতো। হাসিটা এত সুন্দর যে তিরার মনে হলো এই হাসি দেখতে দিলে ভাত খেতে না দিলেও হবে। এত সুন্দর একটা ছেলেকে বাবা তার বিয়ের জন্য দেখছে! মনে মনে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তিরা। ছেলেটার নাম যাদিদ। বয়স ২৪। তিরার মাথায় একটা দুষ্টুমি এলো। যাদিদকে ফোন করে একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ওর নাম্বার থেকে ফোন করা যাবে না, ওর নাম্বার নিশ্চয়ই তাকে দেয়া হয়েছে বা হবে। তিরার একটা এক্সট্রা সিমের বিশেষ বক্স আছে। সেখান থেকে এক্সট্রা সিম নিয়ে মোবাইলে ঢুকিয়ে নিলো। এরপর যাদিদের নাম্বার খুঁজতে গিয়ে বেকুব হয়ে গেলো। নাম্বারের পাশে ব্রাকেটে লেখা বাংলাদেশে যখন থাকে তখন সে এই নাম্বার ব্যবহার করে। মিশনে থাকাকালীন তাকে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যাবে। সবগুলোর লিংক দেয়া আছে। তিরা ঝটপট সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে ঢুকে যাদিদের প্রফাইলের প্রতি ইঞ্চি ঘেঁটে ফেললো। তিরা আরো মুগ্ধ হলো। তিরা জানেনা যাদিদ এখন কোথায় তবুও কল করে ফেললো, দেখা যাক পাওয়া যায় কিনা। রিং হতে লাগলো। তার মানে সে এখন বাংলাদেশেই আছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো,
“হ্যালো..”
এক হ্যালোতেই তিরার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, ছেলের কন্ঠস্বরও দেখি সুন্দর! তিরা বললো,
“হ্যালো যাদিদ।”
“কে বলছেন প্লিজ?”
তিরা ঢং করে বললো,
“আমাকে চিনতে পারছো না?”
“আপনার সাথে এর আগে আমার কথা হয়নি। সুতরাং আপনাকে আমার চেনার কথা নয়, পরিচয় দিন।”
“আমি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড। ব্রেকাপ হয়েছে বলে এভাবে ভুলে গেলে? আমার সাথে কাটানো সব মধুর মধুর স্মৃতি তুমি ভুলে গেছো!”
“আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের ভয়েস আমি চিনি। আমার বাবা বিয়ের জন্য যেসব জায়গায় বায়োডাটা ছড়িয়েছে আপনি সম্ভাবত তাদের মধ্যে কেউ হবেন!”
তিরা অবাক হবে না কষ্ট পাবে বুঝতে পারলো না। যাদিদের গার্লফ্রেন্ড ছিলো? পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝালো, ‘তোরও বয়ফ্রেন্ড ছিলো তিরা। বিয়ের আগে এগুলো কোনো ব্যাপার না।’ যাদিদ বললো,
“বিয়ের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত আমার বাবা মা নেবেন৷ সুতরাং আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো। বিরক্ত করতে খুব বেশি ইচ্ছে করলে তাদেরকে করুন। তাদের ফোন নাম্বারও দেয়া আছে।”
যাদিদ লাইনটা কেটে দিলো। তিরা তখনো ফোন হাতে বসে রইলো।

আরশি চা খেতে খেতে বই পড়ছিলো। তিরার ফোন এলো তখনই। আরশি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তিরা বললো,
“জানেমান! আমি তো মরে গেছি। তুই যে তিরার সাথে কথা বলছিস সে মৃত তিরা।”
আরশি হেসে বললো,
“আবার ক্রাশ খেয়েছিস?”
“শুধু ক্রাশ না, এবার আমি ক্রাশ, আকাশ, বাতাস সবকিছু খেয়ে ফেলেছি!”
আরশি হেসে বললো,
“ছেলেটা কে?”
“যাদিদ। আল যাদিদ ইব্রাহিম।”
“বাহ সুন্দর নাম।”
“আরু আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে।”
“তুই যার উপর ক্রাশ খাস তাকেই তোর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম মনে হয় তিরা।”
“নো আরু নো, এবার ব্যাপার ভিন্ন। বাবা এক ছেলে দেখেছেন আমার বিয়ের জন্য। ছবি আর বায়োডাটা দেখেই আমি শেষ! ছেলে নেভি অফিসার। অথচ বয়স মাত্র ২৪। আমি তার উপর ভীষণভাবে ক্রাশ খেয়েছি!”
আরশি বললো,
“ওয়াও! ফ্রুটফুল ক্রাশ!”
“একদম। একটু আগে কথাও বলেছি। যদিও আমার পরিচয় দেইনি। উফফ কন্ঠটা এতো সুন্দর! এতো সুন্দর করে কথা বলে! জীবনে যত ক্রাশ খেয়েছি তার মধ্যে সেরা ক্রাস যাদিদ। ওকে তো বিয়ে করতেই হবে আরু।”
“পড়াশোনার কী হবে?”
“সে আমি জানিনা। আর আমি তো তোর মতো ভালো স্টুডেন্টও নই। এতো পড়াশোনা করে কী হবে?”
আরশি তিরার কথায় হাসতে লাগলো।

হঠাৎ সাহিলের ফোন পেয়ে আরশি হাসপাতালে গেলো। রশ্নির ব্যথা উঠেছে। রশ্নির বাড়ির লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়েছে। সাহিল অফিস থেকে এসেছে। হাসপাতালে সারাদিন অপেক্ষা করতে হলো। সন্ধ্যার পর রশ্নির মেয়ে হলো। সবাই বলছে মেয়ে দেখতে নাকি তার ফুপীর মতো হয়েছে। এ কথা শুনে আরশির লজ্জা লাগলো। সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের দেখলে বোঝা যায় না সে কার মতো হয়েছে, একটু বড় হলে বোঝা যায়। তবুও আরশি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, দেখতে ওর মতো হয়েছে হোক কিন্তু ওর মতো ইন্ট্রোভার্ট যাতে না হয়। ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের অনেক রকম জ্বালা থাকে।

আরশির ঘুম আসছিলো তাই ক্যান্টিনে গেলো কফি খেতে। কফি খেয়ে ফিরে আসতেই সাহিল বললো,
“আরশি আমার তো যেতে অনেক রাত হবে। তুই বরং বাসায় চলে যা।”
“তোমার সাথেই নাহয় গেলাম।”
“আমার দেরি হবে। আবার ঠিক নেই আজ নাও যেতে পারি। তুই অনেকক্ষণ ছিলি ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুই বরং চলে যা।”
“ঠিকাছে ভাইয়া। আমি তাহলে ভাবীর সাথে আরেকবার দেখা করে আসি।”

আরশি ভাবীর সাথে দেখা করতে কেবিনে ঢুকতেই কাব্যর মুখোমুখি পড়ে গেলো। আরেকটু হলেই ধাক্কা লেগে যেতো। কাব্য আরশিকে বাঁকা চোখে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলো। আরশি ভাবীকে বললো,
“এ কালা চণ্ডীদাস আবার এখানে কেন এসেছে?”
রশ্নি খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
“বাবুকে দেখতে এসেছে। একী নামে ডাকিস তুই ওকে? দেখতে পারিস না কেন?”
“তিরা থাকলে দেখতে কেমন ক্ষেপে যেতো।”
রশ্নি হেসে দিল। আরশি বললো,
“অবশ্য সে রিসেন্টলি আবার ক্রাশ খেয়েছে।”
রশ্নি আবারো হেসে বললো,
“সেকী! ওর চণ্ডীদাসের কী হবে?”
আরশি হেসে বললো,
“চণ্ডীদাস বাদ। এবারেরটা অবশ্য ফ্রুটফুল ক্রাশ। ফুপাজান ওর বিয়ের জন্য ছেলে দেখেছেন, সেই ছেলের ছবি দেখেই ক্রাশ খেয়েছে।”
“উফ পারেও মেয়েটা!”
“আচ্ছা ভাবী আমি আজ উঠি। কাল সকাল সকাল চলে আসবো।”
“আচ্ছা সবধানে যাস। চাচীকে অলরেডি ফোনে বলে দিয়েছি বাসায় যেতে। তোর ভাইয়া না ফিরলে চাচী আমাদের বাসাতেই থাকবে।”
“আচ্ছা।”
আরশি কেবিন থেকে বের হতেই সাহিল বললো,
“আরশি তোর একা যেতে হবে না। কাব্য বাসায় যাচ্ছে, ওর সাথেই চলে যা।”
“আমি একা যেতে পারবো ভাইয়া।”
“কাব্য তো বাসায়ই যাচ্ছে। তুই একা কেন যাবি? ওর সাথে গেলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। রাত একদম কম হয়নি।”
“ঠিকাছে।”
আরশি আর কথা বাড়ালো না৷ কে জানে বেশি আপত্তি করলে সাহিল কি না কি ভেবে বসে! আরশি কাব্যকে বললো,
“চলুন।”
কাব্য বললো,
“হ্যাঁ চলুন।”
সাহিল কাব্যকে বললো,
“এই কাব্য তুই আরশিকে আপনি আপনি বলিস?”
কাব্য আমতা আমতা করে বললো,
“হ্যাঁ।”
“কেন? ওকে তুই করে বলবি। অবশ্য হঠাৎ করে তুই বলতে সমস্যা হতে পারে সেক্ষেত্রে তুমি বল। ছোটো একটা মেয়েকে আপনি বলিস এটা কেমন কথা!”
কাব্য বললো,
“আসলে ভাইয়া সেভাবে কথাই হয়নি কখনো।”
“একই বাসায় থাকিস আর পরিচয় নেই! কি আজব তোরা। যা পরিচয় হতে হতে বাসায় যা।”

আরশি ও কাব্য লিফটে উঠলো। লিফটে আপাতত আর কেউ নেই। আরশি দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, লিফটের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাব্য। আরশির মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝিমঝিম করছে। কেন যেন কাব্যর সাথে যাওয়াতে ওর ভালো লাগছে। আবার কাব্যর সাথে যাওয়াতেই খুব অস্বস্তি লাগছে। হাত পা কাঁপছে। কাব্য সরাসরি তাকিয়ে আছ আরশির দিকে। আরশির এই অবস্থা দেখে কাব্য ঠিক করলো আজ পুরো রাস্তা ও আরশির দিকে তাকিয়ে থাকবে। এতোদিন লুকিয়ে দেখতো। ধরা তো পড়েই গেছে, এখন আর লুকোচুরির কোনো দরকার নেই। এখন বেহায়া হবে, চরম বেহায়া।

কাব্য উবার কল করেছে। গাড়ি এখনো এসে পৌঁছয়নি। হাসপাতালের সামনেই গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলো তারা। কাব্য টিস্যু বের করে আরশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আপনি ঘামছেন।”
আরশি টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। এর মধ্যেই গাড়ি এসে গেলো। ওরা গাড়িতে উঠলো। গাড়ি চলতে শুরু করতেই কাব্য আরশিকে বললো,
“পানি খাবেন?”
“নো থ্যাংকস।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে ছিলো আর আরশি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। কাব্য আবার বললো,
“সাহিল ভাইয়া অবশ্য জানেনা, আমি অনুমতি ছাড়া কাউকে তুমি করে বলিনা। সে বড়ই হোক আর ছোটো!”
আরশি যেদিকে তাকিয়ে ছিলো সেদিকেই তাকিয়ে বললো,
“আপনার ইচ্ছে হলে বলবেন। সবারই বাক স্বাধীনতা আছে, আমি তো কাউকে আটকে রাখিনি।”
“তোমার অনুমতি দেয়ার কৌশল টা কিন্তু দারুণ লাগলো।”
আরশি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রাখলো। হাসলেই ধরা পড়ে যাবে। আবারো কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কাব্যই আবার বললো,
“শুনলাম তিরা বিয়ের প্রস্তাব আসা পাত্রের উপর ক্রাশ খেয়েছে!”
আরশি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“কার কাছে শুনলেন?”
“তিরার কাছেই শুনলাম।”
“আপনার তিরার সাথে কথা হয়?”
“হ্যাঁ। আমরা তো বন্ধু।”
“হুম আপনারা তো আবার আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের মতো ভালো বন্ধু।”
কাব্য হো হো করে হেসে দিলো। আরশি একটা কথাও কাব্যর দিকে তাকিয়ে বলছে না। কিন্তু কাব্য আরশির দিকেই তাকিয়ে আছে। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“ওটা বিশ্বাস হয় তোমার?”
“আমার বিশ্বাসে কী যায় আসে?”
“তবু বলো।”
“যার নিজেরই বয়স ২০/২১ তার মেয়ের বয়স কীভাবে ১৯ হয়?”
“মেয়ে নয়, এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে!”
আরশি এবার মুচকি হাসলো। কাব্য বললো,
“আমার বয়স ২২।”
“আন্দাজ কাছাকাছিই করেছি।”
“তা ঠিক।”
আরশি এবার ড্রাইভারকে বললো,
“ভাইয়া এসিটা বন্ধ করে দিন, জানালা খুলবো।”
ড্রাইভার এসি বন্ধ করতেই আরশি জানালা খুলে দিলো। কাব্য খানিক ভেবে বললো,
“সিগারেটের গন্ধে সমস্যা হচ্ছিলো?”
আরশি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। কাব্য বললো,
“বাবু দেখতে যাব বলে হাসপাতালে ঢোকার আগে খাইনি। তুমি সাথে আছো বলে বের হয়েও খাইনি।”
আরশি এবারো কাব্যর দিকে তাকালো না। বললো,
“হাসপাতালে বোঝা যাচ্ছিলো না। কিন্তু এখানে বন্ধ জায়গায় কাছাকাছি বসে আছি তো, গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।”
কাব্য হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। বাড়ি পৌঁছতে আর পাঁচ মিনিট লাগলো। এই পাঁচ মিনিটে কাব্য আর একটা কথাও বললো না। দুজনে চুপচাপ গাড়ি থেকে নামলো। সিঁড়ি পর্যন্ত একসাথে এলো। আরশি দোতলায় চলে গেলো। কাব্য নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। এই এতক্ষণ দুজন মানুষ আর একটি কথাও বললো না।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ৯+১০

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৯+১০

তিরা বেশিরভাগ দিন সকাল ও দুপুরের খাবার একসাথে খায়। আজও হয়েছে তাই। দুপুরে খাওয়ার পর আরশি টেবিল গোছাচ্ছিলো। তিরা বসে বসে মুরগীর হাড্ডি চিবুচ্ছে। আরশি সব গুছিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বললো,
“তিরা আমি বলেছিলাম না তোর কালা চণ্ডীদাস তোর জঘন্যতম চয়েজ?”
“হ্যাঁ। তুই তো সবসময় ওর দোষ ধরার জন্য বসে থাকিস।”
“লোকটা ভয়ঙ্কর সিগারেটখোর, অসভ্যও বটে তবে আজ তার সম্পর্কে একটা অন্য ব্যাপার জানলাম।”
তিরা অতি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী সেটা?”
“এই লোকটা তোর ক্রাশলিস্টের একমাত্র ব্রিলিয়ান্ট লোক!”
“সত্যি?”
তিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই হাতের ধাক্কা লেগে প্লেটটা ছিটকে সরে গেলো। হাড্ডিগুলো আরশির সদ্য পরিস্কার করা টেবিলের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়লো। আরশি চোখ গরম করতেই তিরা বললো,
“আমি সব পরিস্কার করে দেব সোনা। তুই বলনা
কীভাবে বুঝলি চণ্ডীদাস ব্রিলিয়ান্ট? বলনা বলনা।”
আরশি তিরার প্লেটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে টেবিলটা আবার মুছতে মুছতে বললো,
“ওইযে বইটা পড়তে এনেছিলাম না?”
“হ্যাঁ।”
“ওটাতে কিছু বুকমার্ক ছিল৷ যেসব পৃষ্ঠায় বুকমার্ক ছিল সেসব চ্যাপ্টার সম্পর্কে তার মতামত ওই বুকমার্ক গুলোতে লিখে রেখেছিলো। আমি ওগুলো দেখে অবাক হয়ে গেছি। অনেক নলেজ আছে তার। আজকালকার ছেলেদের এত উন্নত ভাবনা! এটাও কী সম্ভব?”
একথা বলে আরশি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট ধোয়া শুরু করলো। তিরা প্লেটটা আবার টেবিলে রেখে আরশির পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকলো। খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে বললো,
“তার মানে তুই ফটোশ্যুটে যেতে রাজী?”
আরশি বিরক্ত হয়ে বললো,
“একথা কখন বললাম?”
“বলতে হবে কেন? তুই তো এতদিন কাব্যকে খারাপ বলতি, আজ ভাল বলছিস তার মানে যেতে আপত্তি নেই এটা আমি বুঝে নিয়েছি।”
“আমি আগে তাকে খারাপ বলিনি। বলেছি তাকে আমার পছন্দ না। আর আজও ভালো বলিনি। তার একটা গুণ চোখে পড়েছে সেটাই বলেছি। ভালো মন্দ বিচারের আমি কে?”
“তার মানে যাবি না?”
“না যাবো না। এই বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর প্লেটটা আবার কোথায় রাখলি? ওটা নিয়ে আয় ধুয়ে ফেলি।”
তিরা মুখ কালো করে প্লেট আনতে গেলো।

সন্ধ্যাবেলা তিরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাব্যর সাথে ফোনে কথা বলছিলো। আরশি যাতে আর কাব্যকে লোকটা বলতে না পারে তাই কাব্যর আসল বয়সটা জানা দরকার। তাই সে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা কাব্য তোমার বয়স কতো বলো তো?”
“হঠাৎ বয়স জানতে হবে কেন তোমার?”
“আমার লাগবে।”
কাব্যর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এতো দিন এমন একটা সুযোগই তো সে খুঁজছিলো। বললো,
“কত আর? আমি কি অত বুড়ো নাকি? এবার ৩৬ হবে মাত্র।”
“কী বলো এতো বয়স তোমার?”
“এ আর এতো কোথায়? পুরুষ মানুষের এই বয়স একটা বয়স হলো? সময়মতো বিয়ে দিলে তোমার বয়সী মেয়ে থাকতো আমার। তাই বলে নাতি নাতনি তো আর থাকতো না।”
“কি বলছো এসব তুমি!”
“কেন কি বললাম?”
তিরা আহত কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার মেয়ের বয়সী?”
“হ্যাঁ আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। সেই এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের বয়স এখন ১৯ বছর। সেই মেয়েটা তো আমারও হতে পারতো। কিন্তু তখন বাবা রাজী হলো না তাই আর বিয়ে করা হলো না। তোমার বয়স কত?”
“আমার ১৮।”
“আরে তুমি তো আমার মেয়ের থেকেও ছোটো।”
তিরা চমকে উঠে বললো,
“তোমার মেয়ে মানে!”
“মানে এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে।”
“ওহ। আচ্ছা কাব্য সত্যি কথা বলো তো। আমি তোমার বন্ধু নই?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। আমি তো আমার মেয়ের সাথে বন্ধুর মতোই মিশি।”
“তোমার মেয়ে?”
“এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের কথা বলছি। তুমিও আমার মেয়ের মতো। তুমিও আমার বন্ধু এজন্যই তো তোমাকে আমি তুমি করে বলার পারমিশন দিয়েছি। এজন্যই তো তোমাকে আমি দুবছরের বাচ্চা বলে ডাকি।”
তিরার মাথা ঘুরছে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তুমি মাত্র অনার্সে কেন পড়ো?”
“ওইযে গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গেলো? এজন্য দেবদাস হয়েছিলাম বহুবছর। এজন্য পড়াশোনায় গ্যাপ পড়ে গিয়েছিলো। এখন সার্টিফিকেট নেই বলে ভালো বিয়ে হচ্ছে না। এজন্য বাবা মা জোর করে আবার পড়াশোনা শুরু করিয়েছে।”
“ওহ! আচ্ছা এখন তাহলে রাখি। আরু ডাকছে।”
“ঠিকাছে।”

ফোন রেখে কাব্য হেসে ফেললো। আর ওদিকে তিরা ভাবতে লাগলো, কাব্য এসব কী বললো? কাব্যর বয়স ৩৬? তাহলে আরশি ঠিকই ধরেছিল? সে একটা ছেলে নয়, একটা লোক? এবার তিরার খেয়াল হলো কাব্য কখনো তাকে নিজ থেকে মেসেজ দেয়নি, ফোন দেয়নি। সে যেমন আগ্রহ নিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতো কাব্য কখনো তার ব্যাপারে সেসব জিজ্ঞেস করেনি। মেয়ের চোখে দেখতো বলেই এতোদিন ধরে এরকম ছিল তাদের সম্পর্ক! আর সে এতো গাধা এই ব্যাপারটুকু বুঝতে পারলো না! সত্যিই তো মেয়ের চোখে না দেখলে তো আর দুবছরের বাচ্চা বলতো না। ভাগ্যিস তিরা কখনো মুখ ফসকে কাব্যকে ক্রাশ খাওয়ার কথাটা বলে ফেলেনি! গুলিটা একদম কানের পাশ দিয়ে গেছে!

বারান্দা থেকে তিরা যখন ঘরে এলো আরশি তখন চুলে তেল লাগাচ্ছিলো। তিরার গোমড়া মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল কেন? কোনো খারাপ খবর? কার সাথে কথা বলছিলি?”
তিরা আরশির সামনে বসে ঠোঁট উলটে বললো,
“আরু তোর কি মনে হয় কাব্যর বয়স কত হবে?”
“দ্যাখ ছেলেদের বয়স ধরা মুশকিল। শুকনা পাতলা ছেলেদের বয়স ধরা আরো মুশকিল। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করছিস কেন কী হয়েছে?”
“আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি রে। যদিও কেউ জানেনা তবুও নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে।”
“কী হয়েছে সেটা তো বলবি।”
“ভাগ্যিস আমি কাব্যকে ক্রাশ খাওয়ার কথাটা বলিনি।”
“বললে কী হতো?”
“কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।”
“কীসের কেলেঙ্কারি?”
“কাব্য আমাকে মেয়ের চোখে দেখে। ওইযে দুবছরের বাচ্চা বলে? এজন্যই বলে।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“কী যা তা বলছিস? মাথা ঠিকাছে তোর?”
তিরা এবার কাব্যর সাথে ওর পুরো কনভার্সেশনটা আরশিকে বললো। সব শুনে আরশি স্থির হয়ে বসে রইলো। তিরা বললো,
“আমি এখন কী করবো?”
“কিছুই করতে হবে না। খুলনা গিয়ে ঘুরে আয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“সত্যি?”
“কোচিং এর কেমিস্ট্রি স্যারের কথা ভুলে গেছিস?”
“কোন কোচিং?”
“নাইনে পড়ার সময় আমরা যে স্যারের কাছে কোচিং এ কেমিস্ট্রি পড়তাম? স্যারকে দেখে ক্রাশ খেয়ে ফেললি। স্যারও ভাব জমালো। দুদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো? তারপর জানলি সে বিবাহিত? তার বৌ এসে তোকে ঝাড়লো!”
“ওহ হ্যাঁ তুই সেই ফালতুটার কথা বলছিস? আমার খেয়াল ছিলো না।”
“তার বেলায়ও সব কথা জানার পর তুই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলি। কিন্তু দুদিন পর তো ভুলে গেলি। এটাই স্বাভাবিক। এই লোকটাকেও ভুলে যাবি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কালই খুলনা যাবো। দেখি অনলাইনে টিকিট আছে কিনা।”
“যাওয়ার আগে বইটা ওনাকে ফেরত দিয়ে যাস।”
“কেন তুই বরং ফেরত দিয়ে আরো বই নিয়ে আসিস। এখন তো ছুটিই।”
“কেন বাজারে কি বইয়ের অভাব?”
“তা না।”
“এটা কোথাও পাচ্ছিলাম না৷ ওনার কাছে পেয়ে এনেছি৷ তাই বলে সব বই আনতে হবে কেন?”
“আচ্ছা আমি দিয়ে দেব।”
তিরা অনলাইনে টিকিট খুঁজতে লাগলো।

আরশির মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে। সন্ধ্যে থেকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে সে। সে এতদিন ভেবেছে শুধু তিরা নয় কাব্যও তিরার প্রতি আগ্রহী। কাব্যর প্রথমদিনের চায়ের দাওয়াত থেকে শুরু করে বুয়া খোঁজার ছুঁতোয় দোতলায় আসা, বাজার তুলে দেয়া সবকিছুই তিরার সাথে দেখা করার জন্য করেছে বলে ভেবেছে। কিন্তু আজ সে যে নাটক করলো তা ভাবাচ্ছে আরশিকে। তিরা সহজ সরল মেয়ে, ওকে বোকা বানানো কাব্যর মতো ছেলের কাছে মামুলি ব্যাপার। কিন্তু আরশিকে বোকা বানানো এতো সহজ না। আরশি স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে কাব্য সব বানিয়ে বলেছে। তিরা ইদানীং খুব বেশি এগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছিলো কাব্যর প্রতি। হয়তো সে কারণেই কাব্য আজ তাকে এসব আবোলতাবোল বুঝিয়ে দিলো। যাতে তিরা সরে যায়। তার মানে কাব্য তিরার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু তাহলে এতদিন কাব্য কেন এসব করেছে? আরশির জন্য? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তিরাকে রেখে কেউ তাকে কেন পছন্দ হবে? তিরা তার চেয়ে সুন্দরী, স্মার্ট, প্রাণবন্ত। তিরার সঙ্গ যেকোনো মানুষকে আনন্দ দেয়। অপরদিকে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখা শামুকের মতো, অনুভূতি প্রকাশ করতে জানেনা, মানুষের সাথে মিশতে জানেনা। দেখতে খারাপ না হলেও তিরার মতো সুন্দরী তো নয়ই বরং কাউকে আকৃষ্ট করার মতো কিছু তার মধ্যে নেই। সেই চেষ্টাও সে কখনো করেনি। আজ পর্যন্ত জোর করেও কেউ তাকে সাজাতে পারেনি। গাঢ় কোনো রঙের জামাও তাকে কেউ পরাতে পারেনি কখনো। সে কখনো পার্লারে যায় না। সে চুল কাটে না, ব্রু প্লাগ করে না। এসবে তার লজ্জা লাগে৷ কলেজ, কোচিং সবখানে বন্ধুরা তাকে আম্মা, দাদী এসব নামে ডাকে। ঠিক বন্ধু নয়, আরশির নিজের কোনো বন্ধু নেই। তিরার বন্ধুরাই আরশির বন্ধু। আরশি যাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা বলে না। তারাও বলে না। আরশির সঙ্গ তেমন কেউই পছন্দ করে না। কারণ সে বোরিং।
আরশিও নিজেকে উপন্যাসের নায়িকার জায়গায় ভাবতে পারেনি কখনো। বড়জোর নায়িকার বান্ধবী, বোন বা ননদের যে চরিত্র থাকে তার সাথে সে নিজেকে মেলাতে পারে। সাহিল, রশ্নি আর তিরা বাদে এই দুনিয়াতে আর কারো সাথেই কোনো সম্পৃক্ততা নেই আরশির। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে, আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে তাকে পছন্দ করেনি। ভালোবাসার কথা বলেনি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বখাটেরাও তার দিকে তাকায় না। অথচ তিরা যেখানেই যায় ভুরি ভুরি প্রোপোজাল পায়। সব ছেলেরা যেমন মেয়েকে সঙ্গী হিসেবে চায় তিরা ঠিক তেমন। সবাই তিরাকে পছন্দ করে। সেই তিরাকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে কাব্য তার সংস্পর্শে আসতে চেয়েছিলো এটা সে কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু যুক্তি তো এটাই বলছে। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে তার।

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১০

তিরা খুলনা চলে গেছে এক মাসের বেশি হয়ে গেলো। ভর্তির আগে সম্ভাবত আর আসবে না। সারাদিন আরশির একা একা কাটে। এখন রান্না খাওয়া ছাড়া আর কিছু যেন নেই আরশির জীবনে। ওহ হ্যাঁ আরেকটা কাজ আছে, রশ্নি ও তিরার সাথে ফোনে কথা বলা। কিন্তু কোথাও যেতে উচ্ছে করেনা। পাশেই চাচার বাসা। চাচাতো ভাইবোনেরা আছে তবুও সেখানে যেতে ইচ্ছে করে না। একমাত্র রশ্নির কাছে যেতে তার ভালো লাগে তবুও অন্যের বাসায় যাওয়াতেও তার অস্বস্তি। সেখানে গেলে রশ্নির সাথে ঘরের মধ্যে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না৷ সবাই হয়তো অহংকারী ভাবে। তাই সেখানেও যাওয়া হয় না। নতুন যেসব বই ছিলো সেসবও পড়া শেষ। গতকাল অনলাইনে কিছু বই অর্ডার করেছে যা এখনো এসে পৌঁছোয়নি। বই অবশ্য নীলক্ষেতে গিয়ে কিনে আনা যেতো কিন্তু সে বের হতে চায় না৷ কেন যেন মনে হচ্ছে বের হলেই কাব্যর সামনে পড়তে হবে। এই লোকটার সামনে সে আর কখনো পড়তে চায় না। এমনকি এই কারণে সে গত একমাস ধরে বাজারেও যায় না। যা যা লাগবে সাহিলকে বলে ফেরার সময় নিয়ে আসতে। আরশি জানেনা এভাবে কতদিন আড়ালে থাকতে পারবে। একই বাসায় যখন থাকে কোনো না কোনোদিন তো দেখা হয়েই যাবে৷ তখন কী হবে? কীভাবে মুখোমুখি হবে তার? তার চেয়ে দেখা না হোক। আরশি একদম চায় না দেখা হোক!

দুপুরে রান্না করছিলো আরশি। আজ সাহিল সন্ধ্যেবেলায় ওকে নিয়ে রশ্নির কাছে যাবে। যাওয়ার সময় আরশি রশ্নির জন্য তার প্রিয় কিছু খাবার নিয়ে যাবে। এজন্যই এতো আয়োজন। রান্নার মাঝেই বেল বেজে উঠলো। এই অসময়ে আবার কে এলো! আরশি বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখে যে বইগুলো অর্ডার করেছিলো সেগুলো এসে গেছে। ডেলিভারি ম্যানকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে এসে চুলা নিভিয়ে টাকা নিয়ে নিচে নামলো।

দোতলার বেলের আওয়াজ শুনেই কাব্য দরজা খুলে বের হলো। বের হওয়ার সময় ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হলো। ভানটা এমন করতে হবে যে সে বাইরে থেকে এসেছে। আরশি নিচে নামার আগেই কাব্য মূল ফটকের তালা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো। গত একটা মাস কাব্য যতক্ষণ বাসায় ছিলো ততক্ষণই খেয়াল রেখেছে কখন দোতলার বেল বাজে। না এবাড়িতে সাহিল ছাড়া কেউ আসে! আর না আরশি বাসা থেকে বের হয়! এই এক মাসে একটা বারও আরশিকে দেখতে পায়নি সে। একদিন কাব্য বাসা ভাড়া দিতে গেলো। সাহিল তাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করলো। দুজন একসাথে বসে একটা ক্রিকেট ম্যাচের কিছু অংশও দেখলো কিন্তু আরশির সাথে দেখা হলো না। একবার গলার আওয়াজ শুনলো শুধু। আরশি সাহিলকে ডাকলো, সাহিল ভেতরে গিয়ে চা নাস্তা নিয়ে এলো। আরশিকে না দেখতে পেয়ে যে কাব্য মরে যাচ্ছে ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু না দেখতে পেয়ে চোখের তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে তাই বারবার তার চোখ খুঁজে ফিরেছে আরশিকে।

কাব্য যখন ডেলিভারি ম্যানের হাত থেকে বইয়ের কার্টন টা হাতে নিয়ে ইনভয়েসে দেখছিল আরশি কি কি বই অর্ডার করেছে তখন আরশি এলো। কাব্যকে দেখেই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গেলো তার ভেতরে। সে খুব করে চাইছে যেন সে স্বাভাবিক থাকতে পারে। আরশি ডেলিভারি ম্যানকে বললো,
“কত হয়েছে?”
“৯৩৯০। ম্যাম সরি ‘গড অফ স্মল থিংস’ বইটি দিতে পারিনি। একদম শেষ মুহুর্তে প্যাকিং এর সময় দেখি বইয়ের ভেতর একটা পাতা ছেঁড়া। এই মুহুর্তে আমাদের স্টকে বইটি নেই৷ আবার স্টক করলে আমরা যোগাযোগ করব।”
“ঠিকাছে।”
আরশি ডেলিভারি ম্যানকে ৯৫০০ টাকা দিলো। ডেলিভারি ম্যান বললো,
“চেঞ্জ নেই ম্যাম?”
“লাগবে না রেখে দিন।”
ডেলিভারি ম্যান চলে যেতেই আরশি গেটে তালা দিচ্ছিলো। এতক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আরশিকে দেখছিলো কাব্য। আজও সে এলোমেলো, কোঁচকানো সুতির জামা আর আধ কোঁকড়া চুল হাতখোপায় বাঁধা। ঘেমে-নেয়ে একাকার! ফরসা মুখ লাল হয়ে আছে। রান্না করছিলো বোধহয়। আরশি সবসময় থাকেই এমন যে দেখলেই ঘরের কেউ ঘরের কেউ অনুভূতি হয়। এতো মায়া কারো মুখে থাকে কী করে? কাব্যর চোখের তৃষ্ণা মিটেছে, মিলেছে মনের শান্তিও। এক মাস না দেখার অভাব যেন এক দেখাতেই পূরণ হয়ে গেলো। আরশি তালা দিয়ে ফিরে তাকাতেই কাব্য এবার কার্টনের ইনভয়েসের দিকে তাকিয়ে বললো,
“গুড চয়েজ! বাই দ্যা ওয়ে ‘গড অফ স্মল থিংস’ বইটি আমার কাছে আছে। আপনি বরং নিয়ে পড়ুন।”
আরশি স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“না থাক। আগে যেগুলো নিয়েছি সেগুলো পড়ে নিই। তাছাড়া বইটি আমি আমার কালেকশনে রাখতে চাই।”
“আচ্ছা।”
আরশি কার্টনটার দিকে হাত বাড়াতেই কাব্য বললো,
“বইগুলো অনেক ভারী। আমি উপরে তুলে দেই?”
“থ্যাংকস, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমিই পারবো।”
“আমি নিয়ে দিলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি আঙ্কেল।”
কাব্যর মুখটা হা হয়ে গেলো। অবাক হয়ে বললো,
“হোয়াট! আমি আঙ্কেল?”
আরশি মুখটা স্বাভাবিক রেখে বললো,
“আপনি তিরার বাবার মতো হলে আমার তো আঙ্কেলই হবেন তাইনা?”
“ওয়েট ওয়েট!”
কাব্য বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,
“শুনুন তিরা আমার সাথে কথা বলতো আমিও বলতাম। আমি প্রতিবেশি হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ওর সাথে মিশতাম। বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিলো। সেই বন্ধুত্বও তিরাই চেয়েছিলো। আমার দিক থেকে ব্যস এটুকুই। কিন্তু তিরা খুব দ্রুত আমার উপর ফল করছিলো। ও যে পরিমাণ ফাস্ট যেকোনো সময় আমাকে প্রোপোজ করে দিতো। এবং তখন না করা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকতো না। তখন কষ্ট কে পেতো? আমি? কষ্টটা তখন তিরা পেতো। ও যাতে সিরিয়াস হয়ে অনেকদূর এগিয়ে পরে কষ্ট না পায় সেজন্য কিছু মিথ্যে বলে আমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি যে ওর সাথে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব না। যখন কাউকে গ্রহণ না করা যায় তখন তাকে ভালোবাসার কথা বলার সুযোগই দিতে নেই।”
“বাহ! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে এতো দারুন একটা জিনিস শেখাবার জন্য!”
আবারও অবাক কাব্য,
“আমি কী শেখালাম?”
“এইযে শেখালেন যখন কাউকে গ্রহণ না করা যায় তখন তাকে ভালোবাসার কথা বলার সুযোগই দিতে নেই। আমি ভালোবাসার ব্যাপারে একদমই অনভিজ্ঞ। এটা হয়তো ভবিষ্যতে আমার কাজে লাগবে!”
আরশি বইয়ের কার্টন টা কাব্যর হাত থেকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। কাব্য বিস্ময়ে সেখানেই স্থির হয়ে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো এই অসম্ভব বুদ্ধিমতী মেয়েটির দিকে।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ৭+৮

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৭+৮

আরশি খানিক জিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছিলো। তিরা বাধা দিয়ে বললো,
“একী তুই এখন রান্নাঘরে কেন যাচ্ছিস?”
“রান্না করতে যাচ্ছি।”
তিরা হাসি হাসি মুখ করে বললো,
“তুই বাজার থেকে এতো কষ্ট করে এলি। তুই রেস্ট নে। আজকের রান্না আমি করবো।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“কে করবে?”
“কেন আমি।”
“আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে?”
“ধ্যাত! আমি কি একটা দিন আমার ভাইবোনকে রান্না করে খাওয়াতে পারি না?”
“পারিস কিন্তু ইতিপূর্বে এই ঘটনা কখনো ঘটেনি তো তাই হজম করতে কষ্ট হচ্ছে!
” তুই চুপচাপ বসে থাক। আজ রান্না আমি করবো।”
তিরা চলে গেলো রান্না করতে। আরশির হাতে কোনো কাজ ছিলো না তাই ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটি পড়তে বসলো। পরীক্ষা ছিলো বলে বইটি এর আগে দু এক পাতা করে পড়েছে। এখন থেকে একদম মন ভরে পড়তে পারবে।

কাব্য মোটামুটি চিন্তায় পড়ে গেছে। এতদিন তার আরশিকে দেখতে ভালো লাগতো তাই দেখতো। কিন্তু আজ তাকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে এটা শুধুই ভালোলাগা না। সে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে আরশিতে। সারাদিন শুধু আরশির ভাবনাই ঘুরে ফিরে আসছে। আরশি কি তাহলে ভালো লাগার চেয়েও বেশিকিছু? কিন্তু আরশির তো তার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। অবশ্য থাকার কথাও না যেহেতু আরশি জানে তার বোন কাব্যর ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। বোন যাকে পছন্দ করে আরশির মতো মেয়ে তার দিকে ফিরেও তাকাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। তাই তার প্রতি তিরার আগ্রহটা কমাতে হবে। তিরাকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে দিতে হবে কাব্য তার ব্যাপারে আগ্রহী নয়।

দুপুরে খেতে বসে আরশি তিরাকে বললো,
“কোত্থেকে শিখলি এতো ভালো রান্না?”
তিরা খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি ভালো হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস?”
“আরে না। সত্যি ভালো হয়েছে। এর আগে কখনো ভালো হয়েছে বলেছি?”
তিরা হেসে বললো,
“না।”
“আমি শুধু শুধু মিথ্যে বলিনা।”
“তা অবশ্য আমি জানি।”
“আচ্ছা তিরা এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“চল আমরা ভাবীকে একবার দেখে আসি৷ গতমাসে তো পড়া পড়া করে একবারও যেতে পারলাম না।”
“চল কবে যাবি?”
“কাল সকাল সকাল চলে যাব। সারাদিন ভাবীর কাছে থেকে রাতে ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। একসময় তিরা বললো,
“আরু আমার একটা আবদার আছে। তোকে পূরণ করতেই হবে। মানে কোনোভাবে না করা যাবে না।”
“ও আচ্ছা! আজকের এই রান্নাবান্না তাহলে ঘুষ ছিলো?”
“হ্যাঁ।”
আরশি হেসে বললো,
“আচ্ছা বল কি কথা। সাধ্যের মধ্যে হলে আমার ছোট্ট বোনের আবদার অবশ্যই পূরণ করবো।”
“তোর সাধ্যের মধ্যেই।”
“আচ্ছা তো বল।”
“আমি আর তুই একটা ফটোশ্যুটে যাবো।”
“ধুর এইসব ছবি টবি তুলতে আমার একদম ভালো লাগেনা তিরা।”
“যাবিনা?”
“সাথে যেতে পারি তবে আমাকে ছবি তোলার জন্য জ্বালাবি না। তুই তুলিস।”
“থ্যাংকস আরু আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলতে পারবি না।”
“কোথায় যাবি ছবি তুলতে?”
“সেটা কাব্য ঠিক করবে।”
“ফটোগ্রাফার কি তোর কালা চণ্ডীদাস?”
“হ্যাঁ। দারুন ছবি তোলে কাব্য।”
“আমি যাবো না।”
তিরা অবাক হয়ে বললো,
“মাত্র না বললি যাবি?”
“তুই তো আগে বলিসনি যে ওই লোকিটার সাথে ছবি তুলতে যাবি।”
“তুই বারবার লোকটা লোকটা বলিস কেন? ওকে তো দেখতে আমাদের বয়সীই লাগে। বয়স তো জানিনা কিন্তু পড়াশুনার হিসেবে ও আমাদের থেকে ৩ বছরের বড় মাত্র।”
“সাড়ে তিন বছর হবে।”
“হোক। তুই ওকে আর একবারও লোকটা বলবি না খবরদার বলে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা। আমি জানতাম না ওনার সাথে যাচ্ছিস তাই রাজী হয়েছিলাম। ওনার সাথে আমি কোথাও যাবো না।”
“কেন? ও কি তোকে খেয়ে ফেলবে?”
“না আমি যাব না কারণ ওনাকে আমি অপছন্দ করি।”
“অপছন্দ করার কারণ?”
“প্রথমত, সিগারেটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না। বেশিক্ষণ এই গন্ধের মধ্যে থাকলে আমার মাথাব্যথা হবে। তুই ভালো করেই জানিস আমার মাইগ্রেন আছে।”
“এর সমাধান আছে তুই দূরে দূরে থাকবি। আর কোনো কারণ আছে?”
“আছে। দ্বিতীয়ত, উনি প্রচন্ড অসভ্য। এতো অসভ্যতা তুই তো হেসে উড়িয়ে দিস কিন্তু আমি হজম করতে পারিনা।”
“ছেলেরা তো একটু অসভ্য হবেই। নাহলে সে ছেলে বোরিং।”
“এজন্যই আমি ছেলেদের সাথে মিশি না।”
“আচ্ছা ধর তোর এরেঞ্জ ম্যারেজ হলো। তোর স্বামী কাব্যর চেয়ে বেশি সিগারেট খায়। কাব্যর চেয়েও বেশি অসভ্য, তখন তুই কী করবি?”
“এরকমটা হওয়ার চান্স নেই কারণ আমি সব জেনেশুনেই বিয়ে করবো।”
“হাহ। এতো কথা আমি জানিনা। আমার সাথে যেতে হবে ব্যাস। আমি একা যেতে পারবো না ওর সাথে।”
“একা যেতে পারবি না কেন? তুই কি বাসরঘরেও ওর সাথে আমাকে নিয়ে যাবি?”
“ধুর কয়দিন টেকে তার নাই ঠিক আর তুই আছিস বাসরঘর নিয়ে!”
“তুই সেদিন বিধবা হওয়ার কথা চিন্তা করলি যখন আমি তোর বাসরঘরের কথা চিন্তা করলে সেটা খুব একটা বেশিকিছু না।”
“এত কথা শুনতে চাইনা আরশি। আমি ছবি তুলতে যাবো তোর আমার সাথে যেতে হবে।”
“আমি যাবো না।”
“তুই যাবি।”
“আমি যাবো না। তুই ভালো করেই জানিস আমি এক কথা একবার না বলে দিলে তা আর হ্যাঁ হয়না।”
তিরা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরশি চুপচাপ খেতে লাগলো।

তিরা ও আরশিকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো রশ্নি। দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তোরা আসবি বললি না যে?”
তিরা বললো,
“সারপ্রাইজ!”
আরশি বললো,
“কেমন আছো ভাবী আম্মু?”
“ভালো। তোদেরকে খুব মিস করছি। অনেক কষ্ট হচ্ছে না তোদের?”
তিরা বললো,
“কষ্ট কোত্থেকে হবে? তোমার মত আরেকজনকে যে রেখে এসেছো। আরশি ঠিক তোমার মতো করেই সংসারটা সামলায় জানো?”
রশ্নি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো
“তাতো হবেই। বাচ্চাটা কত লক্ষী।”
আরশি হাসলো। তিরা বললো,
“ওকে আর বাচ্চা বলোনা৷ এই বয়সেই সে বুড়ো হয়ে গেছে। একটা ফটোশ্যুটে যেতে বললাম। তার সেকী ভাব সে যাবেই না।”
“ওমা কেন আরশি যাবিনা কেন?”
“ওর কালা চণ্ডীদাসের সাথে ও যাক। আমি কেন যাবো?”
ভাবী অবাক হয়ে বললো,
“কালা চণ্ডীদাস টা কে আবার? তিরার বয়ফ্রেন্ড না কতো ফরসা।”
আরশি হেসে বললো,
“ওটা কবেই বাদ!”
রশ্নি হেসে বললো,
“এ আবার কে?”
তিরা বললো,
“ভাবী তুমি আরশির কথায় নাচছো? কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“আচ্ছা সরি সরি ছেলেটা কে?”
“তুমি চেনো তাকে।”
“আমি চিনি! কে?”
“আমাদের নীচতলায় যে ভাড়াটে এসেছে সে।”
“ওমা কাব্য!”
“হ্যাঁ।”
“ছি ছি আরশি কাব্যকে তুই এভাবে পছাচ্ছিস? কতো সুইট একটা ছেলে!”
আরশি বললো,
“কীভাবে সুইট বলো এতো সিগারেট খায় যে আমার ওনাকে দেখলে ঘেন্না লাগে।”
রশ্নি হেসে বললো,
“হ্যাঁ তা একটু সিগারেট বেশি খায়। তবে ছেলেটা সত্যি ভালো। মনে নেই তোর ভাইয়া আর আমি যে সেইন্ট মার্টিনস আইল্যান্ড গেলাম? তখন কক্সবাজারে যতদিন ছিলাম ওদের বাসায়ই তো থাকতে হলো। তখনই কাব্যর সাথে পরিচয়।”
তিরা বললো,
“দেখেছিস ভাবী ঠিক চিনেছে ওকে। আর তুই হুদাই ওকে খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করিস সবসময়।”
“খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করবো কেন ও কি আমার শত্রু? আমার যা মনে হয় আমি শুধু তাই বলি।”
রশ্নি বললো,
“তবে তিরা ছেলে সিগারেট কিন্তু সত্যিই বেশি খায়। এক সন্ধ্যার এক্সাম্পল দেই শোন। আমরা বীচে যাব। আমি, সাহিল, অনন্ত, অনন্তর বৌ, কাব্য আর কাব্যর ছোটো ভাই অর্নব এই কয়জন বেরিয়েছি। অনন্ত গাড়ি বের করছে। গাড়িতে ওঠার আগে কাব্য বলে কি তোমরা ওঠো আমি একটা সিগারেট খেয়ে নিই, গাড়িতে উঠলে তো আর খেতে পারবো না। এরপর সিগারেট খেয়ে উঠলো। বীচে যেতে জাস্ট ১৫ মিনিট লেগেছে, গাড়ি থেকে নেমে আবার সিগারেট খেলো। আমরা এক ঘন্টা ডেক চেয়ারে বসে কাটালাম। আমি গুনেছি সে ওই এক ঘন্টায় ৫ টা সিগারেট খেয়েছে। এরপর গেছি কাঁকড়া খেতে। কাব্য বলে, তোমরা বসো অর্ডার দাও আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি। এরপর সিগারেট খেয়ে এসে কাঁকড়া খেলো। কাঁকড়া খেয়ে বেরিয়ে আবার সিগারেট খেলো। এরপর আমরা বার্মিজ মার্কেট ঘুরলাম, কেনাকাটা করলাম ততক্ষণে আরো দুটো খেলো। এরপর হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম তখন আবার বলে, তোমরা ওঠো আমি একটা সিগারেট খেয়ে নিই। বুঝতে পারছিস এক সন্ধ্যায় সে কতগুলো সিগারেট খেয়েছে?”
তিরা চোখ বড় বড় করে বললো,
“ও ভাবী তাহলে তো সত্যিই বিপদ!”
“কীসের বিপদ? কচুর বিপদ। কাব্য কত দারুণ একটা ছেলে জানিস? আর ওর ফ্যামিলির মতো ফ্যামিলি সব মেয়ের স্বপ্ন। কাব্যর মা যে কতো অসাধারণ তুই কল্পনাও করতে পারবি না। এমন শাশুড়ী পেলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে যেকোনো মেয়ের। দুদিন থেকে আমি মায়ায় পড়ে গেছি। ওই সিগারেট একটা সমস্যা হলো? ছাড়িয়ে ফেলবি। সিগারেট খেলে চুমু খেতে দিবিনা। ব্যাস সিগারেট ও ছাড়বে ওর বাপ ছাড়বে।”
আরশি হেসে ফেললো। তিরার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো,
“ভাবী এইজন্যই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। এইসব বুদ্ধি আমার মাথায় জীবনেও আসবে না।”
এরপর আরশিকে দেখিয়ে তিরা আবার বললো,
“আর তোমার এই বুড়ী বোরিং ননদের মাথায় তো আরো এসব বুদ্ধি আসবে না। ও এতদিন আমাকে শুধু ভয় দেখিয়েছে কাব্যর সিগারেট খাওয়া নিয়ে। ভালোবাসার কিচ্ছু বোঝেনা ও।”
রশ্নি আরশিকে টেনে বুকে নিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই এই খবরদার আমার ননদকে বুড়ী বোরিং বলবিনা। আমার ননদ যেমন আছে তেমনই খুব ভালো আছে। একদিন এক রাজপুত্র এসে ওকে ভালোবাসা বোঝাবে। তখন ও সব বুঝবে।”
তিরা গাল ফুলিয়ে বললো,
“ও এখন আমি পর হয় গেলাম।”
রশ্নি বুকের আরেক পাশে তিরাকে টেনে নিয়ে বললো,
“না তো। তুইও তো আমার ননদ। আমার তিরিং বিরিং ননদ।”

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৮

রাতের বেলা আরশি ও তিরা বাড়ি ফিরলো। গেটের সামনে নামতেই দেখতে পেলো কাব্য গেটের ভেতরে, গেটে তালা দিচ্ছে। তিরা বললো,
“কাব্য তালা দিও না।”
কাব্য তাকাতেই দুই বোনকে দেখতে পেলো। আরশি ভাড়া দিচ্ছিলো। তিরা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কাব্য ওদেরকে দেখে আবার তালাটা খুলে দিলো। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“কোত্থেকে এলে?”
তিরা বললো,
“ভাবীকে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি কোত্থেকে এলে?”
“অফিস থেকে। রশ্নি ভাবী কেমন আছে?”
“খুব ভালো আছে।”
“ভাবীর তো বোধহয় ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে তাই না?”
“আর দুমাস বাকী।”
কাব্য ও তিরা গেটের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলো। আরশি ঢুকে যখন তালা দিচ্ছিলো, কাব্য অবাক হয়ে দেখতে লাগলো আরশিকে। ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে গেলেও কেউ এভাবে যায়? ভাল জামা পড়েছে ঠিকাছে কিন্তু কোনো সাজগোজ নেই? এইতো তিরা কত সুন্দর সেজেগুজে আছে। সাজলে তো মেয়েদের সুন্দর লাগে তাহলে আরশির কেন নিজেকে সুন্দর করার কোনো চেষ্টা নেই? তাও ভাগ্য ভালো চুলটা খোঁপা থেকে ঝুটিতে নেমেছে। কিন্তু বাকীসব এমন কেন? এত সুন্দর ঠোঁটে একটু লিপস্টিক অন্তত দিতে পারতো? লিপস্টিকেরা ধন্য হয়ে যেতো! ওই কাকচক্ষু জ্বলের দিঘির মত চোখে একটু কাজলের ছোঁয়া তো লাগাতে পারতো। কাজলেরা ধন্য হয়ে যেতো! পরক্ষণেই কাব্য ভাবলো ভালো হয়েছে আরশি সাজেনা। সাজলে তো আর নিজেকে রক্ষা করা যেতো না। এমনিতেই প্রতিবার দেখায় কেমন অস্থির অস্থির লাগে!

আরশি তালা লাগিয়ে আর অপেক্ষা করলো না। জানে তিরা এখন কাব্যর সাথে কথা বলবে তাই একাই উপরে চলে গেলো। কাব্য নিরাশ হলো। দাঁড়িয়েছিল কার জন্য আর হলো কী! কাব্য নিজের ফ্ল্যাটের দিকে যেতে যেতে বললো,
“কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছো যে? উপরে যাবে না?”
কাব্যর ফ্ল্যাটের সামনে থেকেই দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি শুরু হয়েছে। তিরাও কাব্যর সাথে সিঁড়ি পর্যন্ত গেলো। তারপর বললো,
“খুব খারাপ একটা খবর আছে কাব্য।”
“কী খবর?”
“আমাদের ফটোশ্যুটে যাওয়া হচ্ছে না।”
“কেন?”
“আরশি যেতে চাচ্ছে না।”
নীরবে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো কাব্য। আরশি যাবে না সেটা খারাপ খবর বটে। তবে তারচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে আরশি যাবে না বলে যাওয়াটাই ক্যান্সেল হলো। তিরার সাথে একা না যাওয়ার জন্য এখন অজুহাত তৈরি করতে হবে না। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“আরশি যাবে না কেন?”
“বোরিং মেয়েটা কোথাও যায় নাকি? আজকাল এমন মেয়ে দুনিয়াতে আছে বলো যার কিনা ছবি তুলতে ভালো লাগে না? আর কেউ না থাকলেও আমাদের আরশি আছে। ওর ছবি তুলতে ভালো লাগে না। বললাম যে ঠিকাছে তোর তুলতে হবে না তুই আমার সাথে চল শুধু তাও যাবেনা, যত্তসব! আরে বাবা সিগারেট কি দুনিয়াতে তুমি একা খাও? কত মানুষই তো খাচ্ছে। আরশি প্রতিদিন যে বাতাস গ্রহণ করছে সেই বাতাস কি সিগারেটের ধোয়ামুক্ত নাকি?”
কাব্য কিছুটা ভয় পেয়ে বললো,
“কেন আরশির কি সিগারেটে কোনো সমস্যা আছে?”
“হ্যাঁ ওতো সিগারেটের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না। বেশিক্ষণ এই গন্ধের মধ্যে থাকলে বা ওর পাশে বসে কেউ সিগারেট খেলে ওর মাথাব্যথা হয়, মাইগ্রেনের ব্যথা। মাইগ্রেনের ব্যথা মাঝেমাঝে এমন প্রকট হয় যে আরু বমি করে দেয়।”
কাব্যর নিজেকে সাঁতার না জানা জলে পড়া কোনো প্রাণীর মত মনে হলো। প্রচন্ড হতাশ হলো। বললো,
“ও আচ্ছা। ঠিকাছে তুমি উপরে যাও তিরা। সারাদিন অফিস করে এসেছি তো, প্রচন্ড টায়ার্ড এখন আমি। ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিই।”
“আচ্ছা কিন্তু বলো রাতে ফোন করলে বিরক্ত হবে না তো?”
কাব্য কাচুমাচু হয়ে বললো,
“আজ না তিরা। আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। কাল কথা হবে।”
তিরা মন খারাপ করে বললো,
“ওকে।”
পরক্ষণেই তিরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো,
“এই কাব্য চিকেন খাবে? আমি নিজ হাতে রান্না করেছি।”
“নাহ আমি ডিনার করে এসেছি। আরেকদিন খাবো।”
“ওকে।”

তিরা উপরে চলে গেলে কাব্য ভেতরে ঢুকলো। লাইট ফ্যান চালিয়ে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললো। মোবাইল, সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ধুপ করে বসে পড়লো সোফায়। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ভাবতে লাগলো, তার মানে আরশি ও তার মাঝে বিশাল এক বাধা হয়ে দাঁড়াবে তার প্রাণের সিগারেট! ওকে পেতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে? সাথে সাথেই কাব্য ব্যথাতুর চোখে তাকালো সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। প্যাকেট টি যেন কথা বলে উঠলো,
“ছি কাব্য এতো বছর ধরে আমি তোর সঙ্গী। তোর স্কুলের টিচারের বেতের বারি, বাবার বেল্টের বারি, মায়ের ডালঘুটনির বারি, দাদীর ঝাটার বারি, কোনোকিছুই আমাকে তোর থেকে আলাদা করতে পারলো না। আর আজ সামান্য একটা মেয়ের জন্য তুই আমাকে ছাড়ার কথাও ভেবে ফেলেছিস? এত পাষান তুই?”
কাব্যর বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। মাথাটা খানিক ঠান্ডা হলো। এবার মাথাটা কাজ করতে লাগলো। আরশি অনেক ভালো অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। ওর মতো হারামী আরশির যোগ্য না। তাছাড়া এমনও হতে পারে আরশি ওর সাময়িক মোহ। সুতরাং এতো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কাব্য এখন থেকে দোয়া করবে আরশি যেন আরশির মতোই একটা লক্ষী ছেলে পেয়ে যায়। প্রয়োজনে সাহিল ভাইয়ার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে নিজে ছেলে খুঁজবে আরশির জন্য। তবে হ্যাঁ আরশির বিষন্নতার কারণ তো তাকে জানতেই হবে। বন্ধু হিসেবে নাহয় জেনে নেয়া যাবে কোনো একদিন। কিন্তু আরশি তো ওর বন্ধুও হবে না। এক কাপ চা হাতে ধরিয়ে সবসময় ভেতরে চলে গেছে। একসাথে বসে এক কাপ চাও কোনোদিন খায়নি। কারণটা এতদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছে। আচ্ছা তাহলে নাহয় বড় ভাই হিসেবে.. নাউজুবিল্লাহ সে আর যাই হোক আরশির বড় ভাই হতে পারবে না। এটা ভাবনাতেও অসম্ভব। সে নাহয় ভাইয়ের বন্ধুর ছোটোভাই বা প্রতিবেশী হিসেবেই একদিন জেনে নেবে ওই স্নিগ্ধ মুখের বিষন্নতার কারণ। ওটা তাকে জানতেই হবে! ফ্রেশ হয়ে রান্না বসাতে গেলো কাব্য। নাহয় খিদেয় পেট লেগে যাবে পিঠের সাথে।

রাত বেশি হয়নি কিন্তু ক্লান্ত থাকায় তিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরশি তখনো ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটি পড়ছিলো। পৃষ্ঠা ওলটাতেই একটা কাগজের বুকমার্ক পেলো। বুকমার্কটি হাতে বানানো। মজার ব্যাপার হচ্ছে বুকমার্কটিতে কিছু লেখা রয়েছে। আরশি আগ্রহ নিয়ে লেখাগুলো পড়লো। বইয়ের ওই পাতায় যে অংশটুকু আছে তা পড়ে কাব্য নিজের অনুভূতিগুলো বুকমার্কের উপরে লিখেছে। কাব্যর অনুভূতিগুলো আরশিকে অন্যভাবে ভাবতে শেখালো। দারুণ লাগলো ব্যাপারটা। আরশি তো এভাবে ভাবেনি। ধীরে ধীরে আরশি পরবর্তী পাতাগুলো চেক করলো। মাঝেমাঝেই এরকম বুকমার্ক দেয়া। সবগুলোতেই কিছু না কিছু লেখা। আরশি অন্য বুকমার্কগুলো আগেই পড়লো না। কাহিনীর সাথে না পড়লে মজা পাওয়া যাবে না। তাই তুমুল আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়তে লাগলো পরবর্তী বুকমার্কের অপেক্ষায়, সেটাতে কি লেখা আছে তা পড়ার জন্য।

আরশির যখন বইটি পড়া শেষ হলো তখন সকাল ৭ টা বাজে। তিরা তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। রশ্নি বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে সাহিল সাধারণত বাইরে নাস্তা করে। কিন্তু আরশি ভাবলো জেগে যখন আছে আজ সাহিলের জন্য নাস্তা বানাবে। আরশি উঠে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে সাহিলকে ডাকলো খেতে আসতে। সাহিল অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিলো। আরশি নাস্তা বানিয়েছে শুনে বললো,
“তুই কষ্ট করে নাস্তা বানাতে গেলি কেন? অফিসের ক্যান্টিন থেকে তো প্রতিদিন খেয়ে নিই।”
“আজ জেগে ছিলাম ভাইয়া। তাই ভাবলাম বানিয়ে ফেলি।”
“আচ্ছা কষ্ট করে বানিয়েছিস যখন তখন খেয়েই ফেলি চল।”
খেতে বসে সাহিল জিজ্ঞেস করলো,
“ভাবীকে কেমন দেখলি?”
“ভালোই তবে মনে হচ্ছে ভাবী আমাদের নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করে। আমি বুঝিয়ে বলেছি যে আমরা ভালো আছি। কতটুকু বুঝেছে তা অবশ্য জানিনা। তুমিও একটু বুঝিয়ে বলো।”
সাহিল খেতে খেতে বললো,
“বলেছি কাজ হয়না। যতদিন না সে নিজে আসছে ততদিন নিশ্চিন্ত হবে না। বাদ দে। পরীক্ষা তো শেষ এখন তিরার সাথে যাবি নাকি খুলনা?”
“কেন?”
“ঘুরতে।”
“না।”
“কেন? ফুপী বারবার বলছিল তোকে যাতে তিরার সাথে পাঠিয়ে দেই।”
আরশি নিজের প্লেটে খাবার নিতে নিতে বললো,
“ফুপী আমাকেও বলেছে তবে ভাইয়া আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আমি এ বাড়িতেই বেশ আছি। এখানেই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। আমি কোথাও যাবো না।”
আরশি খেতে শুরু করলো। সাহিল কিছুক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। কি করলে যে আরশি একটু খুশি হবে তা বুঝে উঠতে পারে না সে। কোনো কিছুতেই আরশি পুলকিত হয়না, বিচলিতবোধ করে না। কোনো কিছুই যেন ওকে ছুঁতে পারে না। আরশি কি আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না?

সাহিল চলে গেলে আরশি তিরাকে ডাকলো। কিন্তু তিরার ওঠার নাম নেই। আরশি বিছানার উপর পড়ে থাকা বইটা খুলে বুকমার্কগুলো আবার পড়লো। ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে তার কাছে। বুকমার্কগুলো যখন আবার গুছিয়ে রাখছিলো তখন একটি বুকমার্ক সে খুঁজে পেলো না যেটা তার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিলো। হন্যে হয়ে বিছানা, বালিশ, খাটের নীচ সব জায়গায় খুঁজে ফেললো কিন্তু কোথাও পেলো না। এটা কোনো কাজ হলো? কারো এত সুন্দর সৃষ্টি এভাবে হারিয়ে ফেললো সে? এত দায়িত্বজ্ঞানহীন তো সে নয় তবে কীভাবে জিনিসটা হারিয়ে ফেললো! বইটা আজ ফেরত দিয়ে দেবে আর আজই এমন একটা ঘটনা ঘটলো! এরপর আর বই ধার আনার মত মুখ থাকবে না তার।

নিচে ঘুটঘুট শব্দ শুনে আরশি বুঝতে পারলো কাব্য জেগেছে। ঘড়িতে বাজে ৯ টা। খুব বেশি সকাল নয়। এখন একজন মানুষকে ফোন দেয়াই যায়। ফোন দিয়ে মাফ চেয়ে নেয়া উচিৎ। নাহয় বই ফেরত দেয়ার সময় খুব লজ্জা লাগবে। আরশি তিরাকে ডাকলো। তিরার ওঠার নাম নেই। বাধ্য হয়ে নিজেই তিরার মোবাইল থেকে কাব্যকে কল করলো। কিন্তু তিরার মোবাইলে ব্যালেন্স না থাকায় কল গেলো না। এবার নিজের মোবাইলে নাম্বারটা তুলে ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো কাব্য,
“হ্যালো আসসালামু ওয়ালাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আরশি বলছি।”
কাব্য বিশাল আকারের একটা ধাক্কা খেলো। যে মেয়ে দেখা হলেও প্রয়োজন ছাড়া ওর সাথে কথা বলে না সেই মেয়ে ওকে ফোন করেছে! তার উপর আরশির কাছে ওর নাম্বার থাকার কথা নয়। তিরার কাছ থেকে নিয়েছে হয়তো। বিস্ময় ও কৌতূহল লুকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আরে আরশি! কি ব্যাপার কেমন আছেন?”
“ভালো আছি৷ তবে আমি একটা গন্ডগোল করে ফেলেছি।”
“কী হয়েছে?”
“মাফ করবেন আপনার ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটিতে যে বুকমার্কগুলো ছিলো সেখান থেকে একটি বুকমার্ক আমি হারিয়ে ফেলেছি।”
“এটা কোনো ব্যাপার না। ওগুলো শুধুমাত্র সাময়িক মনের ভাব প্রকাশের জন্য লেখা। নিজের হাতের লেখার প্রতি আমার আবার খুব মায়া তাই রেখে দিয়েছি।”
“আইডিয়া টা দারুন।”
“থ্যাংকস। এটা আমার একটা শখ বলতে পারেন।”
“আপনি সত্যি রাগ করেননি তো? আপনার শখের একটা জিনিস হারিয়ে ফেললাম!”
“একদম না। আমার শত শত বইয়ের সবগুলোতেই এরকম বুকমার্ক আছে। শত শত বুকমার্ক লিখেছি। কোথায় কী লিখেছি এখন নিজেরও মনে নেই। সেখান থেকে দু চারটি হারালে কিছুই যাবে আসবে না। নিশ্চয়ই বুকমার্কটি ভালো কিছুর জন্যই হারিয়েছে।”
“মানে?”
“জানেন না যা হয় ভালোর জন্যই হয়?”
“হুম। ঠিকাছে রাখি তাহলে। ভালো থাকবেন।”
“আচ্ছা, আপনিও ভালো থাকবেন।”
ফোন রাখতেই কাব্যর চোখ পড়লো সিগারেটের প্যাকেটের দিকে। ওর মনে হলো প্যাকেট টা বলছে,
“ওরে মুখপোড়া হারামজাদা! আবার যাচ্ছিস ওদিকে!”
কাব্য বিরক্ত হয়ে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। সিগারেটে একটা টান দিয়ে নাম্বারটা সেভ করলো।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ৫+৬

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৫+৬

রাতে ঘুমানোর সময় তিরা বললো,
“আরু সাহিল ভাইয়া আমাদের সাথে এমন করছে কেন বল তো।”
“কেমন করছে?”
“এইযে প্রতি উইকেন্ডে বৌয়ের কাছে চলে যাচ্ছে। এতবড় বাড়িতে আমাদের দুই বোনের একা বুঝি ভয় করে না?”
“দুজন মানুষ একা কীভাবে হয়? ওর বৌ প্রেগন্যান্ট। তার কাছে ও যাবে না? বাচ্চার প্রতি সব দায়িত্ব কি শুধুই মায়ের?”
“তাহলে ভাবী গেলো কেন?”
“ভাবীর দেখাশোনা করার কেউ এবাড়িতে নেই বলেই ভাবী ওবাড়িতে গেছে। আমাদের পক্ষে কি সম্ভব সবসময় ভাবীর খেয়াল রাখা?”
“আমাদের বুঝি ভয় করেনা?”
“আমার করেনা।”
“আমার করে।”
আরশি মুখ টিপে হেসে বললো,
“তোর ভয় কী? তোর কালা চণ্ডীদাস তো আছেই।”
তিরা এবার ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“তুই কী রেসিস্ট রে আরশি! এভাবে একটা মানুষকে কালো বলে অপমান করছিস!”
“অপমান কেন করব? কালোকে কালো বললে বুঝি অপমান হয়ে যায়?”
“হুহ। ওর চোখ দেখেছিস? আর ওর ঠোঁট? আর ওর হাসি?”
“ওমা পরপুরুষের এতদিকে তাকাবো কেন? আমি ছেলেদের চোখের দিকে তাকাই না। শুধু চোখ কেন ছেলেদের স্পেসিফিক কিছুই আমি দেখিনা তোর মত।”
“জানি জানি দেখলে তো এতদিনে একটা জুটে যেত।”
“আমি জোটাতে চাইনা।”
“হুহ পান্তাভাত একটা। শোন কাব্যর সবকিছু রাজপুত্রের মত। শুধু রঙটাই একটু কালো।”
আরশি হেসে শুয়ে পড়লো। তিরা অনলাইনে ঢুকলো। কাব্যকে যদি একটু পাওয়া যায়। যেভাবেই হোক ফোন নাম্বার নিয়ে নিতে হবে। ছেলেটা অনলাইনে একদম আসেনা।

কাব্য অন্ধকারে বাগানে হাঁটছিলো, অন্ধকার কেন যেন ওর খুব ভালো লাগে। অন্ধকারের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, সেই ভাষাটা পড়তে ইচ্ছে করে। আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভেতরে যেতে যেতে ভিজেই যাবে মনে হচ্ছে হঠাৎ উপর থেকে আসা শব্দ শুনে তাকালো কাব্য। আরশি জানালা লাগাচ্ছে। আরশিকে দেখলেই কেন ভেতরটা ওলট পালট লাগে? কাব্য অন্ধকারে তাই কাব্যকে দেখতে পেলো না আরশি। কিন্তু কাব্য আরশিকে দেখলো। মন ভরে দেখলো। এই মনই পুরোপুরি তাকে আরশির দিকে ঠেলছে। কিন্তু কাব্যর মস্তিষ্কের সাহস হচ্ছেনা সেদিকে আগাতে। কাব্যর কি এই বাসাটা ছেড়ে দেয়া উচিৎ?

বৃষ্টির ছাটা এসে ঘর ভিজিয়ে দিয়েছে। জানালা লাগিয়ে আরশি ঘরের পানিটুকু মুছে ফেললো। নাহয় কখন দেখা যাবে তিরা এই পানির মধ্যে পা পিছলে পড়ে যাবে। আরশি হাত ধুয়ে যখন ঘরে ঢুকলো তিরা আচমকা হাসতে হাসতে বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ে গেলো। আরশি দৌড়ে এসে তিরাকে ওঠাতে ওঠাতে বললো,
“আরে কীভাবে পড়ে গেলি তিরা? ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও?”
তিরা হাসছে তো হাসছেই কোনো কথা বলতে পারছে না। আরশি এটুকু বুঝতে পারলো যে ব্যাথা পায়নি। ব্যাথা পেলে এভাবে হাসতো না। তিরাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“ধুর পাগলের মতো শুধু হাসছেই। তুই হাসতে থাক, আমি ঘুমোলাম।”
তিরা এবার বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,
“এই না না। দেখ কাব্য ফেসবুকে কী স্ট্যাটাস দিয়েছে। ওর স্ট্যাটাস দেখে হাসতে হাসতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।”
আরশি ওড়নায় হাত মুছে মোবাইলটা নিয়ে দেখলো কাব্য স্ট্যাটাস দিয়েছে,
“আপনারা সবাই স্ত্রীগমন করুন, আবহাওয়া ভালো আছে।
শুভ বৃহস্পতিবার!”
আরশি স্ট্যাটাস টা দেখে মোবাইলটা বিছানার উপর ফেলে বললো,
“ছি! অসভ্য! একটা মানুষ কীভাবে পাবলিক প্লেসে এসব কথা বলে? কে কী করবে না করবে সেটা কি ওনাকে জিজ্ঞেস করে করতে হবে?”
“ধুর আরু তুই শুধু শুধু নেগেটিভলি নিচ্ছিস৷ কাব্য তো ফান করে এই পোস্ট টা দিয়েছে।”
“কচুর ফান। শোন তুই আগেরটাকে রিজেক্ট করেছিলি না এক মাস প্রেমের মাথায় রুমডেটে ডেকেছিল বলে? এই অসভ্য ছেলে প্রেমের এক সপ্তাহের মধ্যে রুমে ডাকবে। মিলিয়ে নিস।”
“ধ্যাত কী বলছিস এসব!”
“চুপ থাকবি প্লিজ আম্মা? আমি এখন ঘুমুবো। তোর এই কাব্যগান বন্ধ কর।”
বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করেও ঘুম আসছিল না আরশির। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল। একটা মানুষ এতটা অসভ্য হয় কী করে?”

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৬

কাব্য ইচ্ছে করেই চালাকিটা করলো। বাসা ভাড়া দিতে গেলো সাহিল বেরিয়ে যাওয়ার পর। বারান্দা দিয়ে নজর রাখছিল সাহিল কখন বের হয়। যাতে এক উসিলায় দুবার দোতলায় যাওয়া যায়। সাহিল না থাকতে গেলে তিরা বকবক করে আটকাবে, চায়ের উসিলায় আরশিকে দেখা যাবে। আবার ভাড়া দিতে আরেকদিন যেতে পারবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় দরজা খুললো তিরা। এতক্ষণ ধরে বকবক করছে আরশির আসার নাম নেই। তিরাও চায়ের কথা তুলছে না। কাব্য বললো,
“আচ্ছা সাহিল ভাইয়া যখন নেই আমি পরে আসব।”
তিরা বললো,
“না না প্লিজ এসেছো যখন একটু থাকো। একা একা একদম ভালো লাগছে না।”
সুযোগ পেয়ে কাব্য জিজ্ঞেস করে ফেললো,
“একা কেন? আরশি কোথায়?”
“আরশি তো বাজারে গেছে। সাহিল ভাইয়া উইকেন্ডে ভাবীর কাছে গিয়েছিলো তো বাজার করতে পারেনি।”
“আরশি একা গেছে? তুমি গেলে না যে সাথে?”
“বুয়া আসবে যে তাই আমি বাসায় রয়েছি। একজনকে তো থাকতে হবে। আমি তো একা গেলে কিছুই কিনতে পারবো না। তাই আরশি গেছে। আরশি একা সব পারে।”
কাব্যর কেমন একটা মায়া হলো। এতো ছোটো বয়সে মেয়েটা সংসারের এতোকিছু শিখে গেছে! পরক্ষণেই খেয়াল হলো বাসায় কাব্য ও তিরা একা। কাব্য কিছুটা বিচলিতবোধ করলো। তিরা একটু পাগলাটে মেয়ে। ওর সাথে একা বাসায় থাকা মানে বিপদ, ভয়াবহ বিপদ। কাব্য বললো,
“তিরা আমার না ক্লাস আছে আজকে। আমাকে যেতে হবে। আরেকদিন কথা হবে।”
একথা বলে তিরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কাব্য উঠে দরজা খুললো। তিরা বললো,
“তুমি সবসময় এত তাড়া নিয়ে আসো কেন? সময় নিয়ে আসতে পারো না?”
“একদিন সময় নিয়ে আসবো।”
কাব্য তড়তড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো।

সিগারেটের ধোয়া ওড়াতে ওড়াতে বই পড়ছিলো কাব্য। যেটা ওর সবচেয়ে প্রিয় কাজ। এমন সময় দোতলার কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে কাব্যর মনে হলো আরশি কি এসেছে? বারান্দা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখলো আরশি অনেক বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উপরে তাকানো, সম্ভাবত তিরার বারান্দায় আসার অপেক্ষা করছে। আরশি আকাশী রঙের একটা সুতির সালোয়ার কামিজ পরা। কপালে ও নাকে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমে আছে, কয়েক ফোঁটা কপাল বেয়ে গড়িয়েও পড়লো। যথারীতি তার চুলগুলো একটা খোঁপা করা। সামনের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, সেগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো।
কাব্য অপলক চোখে আরশিকে দেখছিলো। কারো ঘর্মাক্ত, রোদে পোড়া, পরিশ্রান্ত মুখটাও এত সুন্দর হয়? কাব্যর হাতে সিগারেট ছিলো। অসাবধানে কখন আঙুলে সিগারেটের আগুন লেগে পুড়ে গেলো। ওদিকে আরশি উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তিরা নীচে আয় এত বাজার আমি একা উপরে তুলতে পারবো না।”
তিরা উপর থেকে বললো,
“রিক্সাওয়ালাকে বলনা একটু উঠিয়ে দিতে। এক্সট্রা টাকা দিয়ে দিস।”
কাব্য ঝটপট সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে নিভিয়ে ফেললো। এরপর দরজা লক করে বের হলো। আরশিকে পাশ কাটিয়ে গেটের দিকে চলে গিয়ে বাইরে যাবার ভান করলো। আরশি অবশ্য কাব্যর দিকে তাকালোও না। তিরাকে বললো,
“রিক্সাওয়ালা কি আমার জামাই লাগে রে যে আমি বললেই উঠিয়ে দেবে? রাজী হয়নি বলেই তো তোকে ডাকছি। চারটা ব্যাগ আমি কয়বারে তুলবো?।”
তিরা বললো,
“উফ কি যে করিস না তুই আরশি। একসাথে এতোকিছু আনার কি দরকার ছিলো? আমার সুন্দর হাতগুলোয় দাগ পড়ে যাবে না এত ভারী ভারী ব্যাগ তুললে?”
আরশি কিছু বলার আগেই কাব্য গেটের কাছ থেকে ডাকলো,
“আরশি..”
আরশি পেছনে ফিরতেই কাব্য বললো,
“আমি বাজারগুলো উপরে তুলে দেই?”
কাব্য কথা বলতেই চারপাশে সিগারেটের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো। আরশি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
“না না আমরা দুজনে মিলে তুলে ফেলতে পারবো।”
“কিন্তু তিরা তো আসতে চাচ্ছে না এমনটা শুনলাম। আমি তুলে দেই। গত মাসে তো সাহিল ভাইয়ার সাথেও বাজার তুলেছি উপরে। আমরা তো প্রতিবেশী। বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করব এটাই তো স্বাভাবিক।”
আরশির মনে হলো তিরার কষ্ট কমিয়ে দিতে চাইছে কাব্য। বললো,
“ঠিকাছে আপনি যদি পারেন।”
আরশি একটা ব্যাগ নিতে যাচ্ছিল তার আগেই কাব্য সবগুলো ব্যাগ দুহাতে তুলে হাঁটা শুরু করলো। আরশি বললো,
“আরে কী করছেন আপনি দুটো নিন, আমি দুটো নিই।”
“এটুকু ওজন আবার দুভাগ করতে হবে? আসুন তো আপনি।”
কাব্য তড়তড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। আরশি গেলো পেছন পেছন। ততক্ষণে তিরা নামতে যাচ্ছিলো। কাব্যকে বাজার নিয়ে উঠতে দেখে বললো,
“হাও সুইট!”
কাব্য তিরার কথায় হেসে দিলো। বাজারগুলো নামিয়ে রেখে দ্রুত বেরিয়ে আসছিলো, আবার তিরার বকবকানির চাপে পড়ার ভয়ে। হঠাৎ আরশি বললো,
“চা খেয়ে যান?”
কাব্য একথা শুনে খুব অবাক হলো। আরশি নিজ থেকে ওকে ডাকছে? এটাও কি সম্ভব? আজ অবধি একবার তো তাকালোও না! তিরা বলে উঠলো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ প্লিজ চা খেয়ে যাও।”
কাব্য পেছনে ফিরে বললো,
“চা সিগারেটে কখনো না করতে পারিনা!”
আরশি বললো,
“ভেতরে আসুন।”
একথা বলে নিজে ভেতরে চলে গেলো চা বানাতে। কাব্য ভেতরে ঢুকে ড্রয়িং রুমে বসলো। তিরা টিভি দেখছিলো, টিভিতে বিজ্ঞাপন হচ্ছে। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“কি দেখছো?”
“নাথিং একা বোর লাগছিল তাই বিজ্ঞাপন দেখছিলাম। আমার আবার বিজ্ঞাপন দেখতে খুব ভালো লাগে।”
“ওহ আচ্ছা।”
“আচ্ছা কাব্য আমাকে কিছু ছবি তুলে দাওনা। সেদিন ফেসবুকে তোমার ফটোগ্রাফি দেখলাম।”
“আমি তো মানুষের ছবি তুলিনা। প্রকৃতির ছবি তুলি।”
“এবার তুলবে। আউটডোর ফটোশ্যুট করবো। আমাদের দুই বোনের ছবি তুললে তোমার জাত যাবে না। আমরা প্রকৃতির মতই সুন্দর।”
কাব্য খানিক অবাক হলো তিরা আরশিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে? আর আরশিও কি সত্যিই যাবে? বললো,
“কোথায় ফটোশ্যুট করতে চাও?”
“প্লেস তুমি ঠিক করো। সকালে গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসা যায় এমন কোথাও। আমাদের সব এডমিশন টেস্ট মাত্রই শেষ হলো। এখন যেখানেই যাই সাহিল ভাইয়া কিছু বলবে না।”
“বাসা ফাঁকা রেখে সবাই মিলে গেলে কীভাবে হবে?”
“আরে না আমরা সবাই মিলে যখন কোথাও যাই তখন ছোটো মামার বাসা থেকে কেউ এসে থাকে। বাম পাশের বাসাটা আমার ছোটো মামার।”
“ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে কবে যেতে চাও জানাও যদি টাইমিং মিলে যায় তাহলে যাবো।”
কাব্য এভাবে বললো কারণ শেষে যদি আরশি না যায় তবে ও যাবে না। আর আরশি যদি যায় তাহলে তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!

টিভিতে তখন একটা সিনেমা শুরু হতে যাচ্ছিলো। তার আগে সিগারেট বিরোধী একটা শর্টফিল্ম দেখালো যেখানে বলা হচ্ছে, সিগারেট যৌন ক্ষমতা কমায়। তিরা কাব্যকে বললো,
“দেখেছো কতবড় ক্ষতি করছো নিজের। এবার সিগারেট টা ছেড়ে দাও।”
আরশি চা নিয়ে আসছিলো। ওদের কথার বিষয়বস্তু শুনে লজ্জা পেয়ে ফিরে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালো। ওদের এই বিষয়ে কথা বলা শেষ হলে যাবে বলে। কাব্য তখন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। প্যাকেটের গায়ে লেখা, ‘ধুমপান হৃদরোগের কারণ’। কাব্য তিরাকে প্যাকেট দেখিয়ে হেসে বললো,
“আমি যে সিগারেট খাই সেটা খেলে হৃদরোগ হয়। সুতরাং আমার চিন্তা নেই। যৌন ক্ষমতা কমার চেয়ে হৃদরোগ হওয়া ভাল।”
তিরা কাব্যর এই রসিকতায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। এদিকে আরশিরও হাসি পেয়ে গেলো। লোকটা কতবড় অসভ্য!

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ৩+৪

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩+৪

দোতলায় গিয়েই তিরা ওদের শোবার ঘরে চলে যাচ্ছিল। আরশি বলল,
“একদম ঘরে যাবিনা। তোর জন্য এতক্ষণ সময় নষ্ট করেছি এবার কাজ করবি আমার সাথে।”
তিরা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
“করতেই হবে?”
“হ্যাঁ করতেই হবে। আমি জানতাম তুই এসে পল্টি নিবি এজন্যই যেতে চাইনি।”
“আচ্ছা সরি বাবা! বল কি করতে হবে।”
“চাল ডাল ধুয়ে চুলায় বসিয়ে দে। আমি বাকীসব রেডি করি।”
তিরা চাল ধুতে ধুতে বলল,
“আচ্ছা আরশি তুই কি অবজার্ভ করলি?”
“তুই কি আমাকে অবজার্ভ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলি?”
“না কিন্তু এটাও একটা কারণ। কোথাও গেলে তুই সবকিছু যেভাবে অবজার্ভ করিস, এতকিছু তো আমার চোখে পড়ে না। এবার ঝটপট বলে ফেল তো কাব্যকে কেমন মনে হলো।”
আরশি পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলল,
“এটা তোর সবচেয়ে জঘন্যতম চয়েজ।”
তিরা আহত চোখে তাকিয়ে বলল,
“কী বলছিস? এমন কেন মনে হলো? তোর দলের লোক তো, অনেক বই পড়ে।”
“বই পড়লেই সে ভালো হয়ে গেল? ড্রয়িং রুমের সেন্টার টেবিলের উপর দেখেছিস অ্যাসট্রে ভর্তি সিগারেটের ফিল্টার? আর বুকসেল্ফের পাশের সোফাটা দেখেছিস একপাশে দেবে গেছে? তার মানে ওই সোফাটায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ে আর সিগারেট খায়।”
“সিগারেট তো অনেক ছেলেই খায়, এটা কি কোনো দোষ হতে পারে?”
“সবার খাওয়া আর এই ব্যাটার খাওয়া এক না। সে প্রচুর সিগারেট খায়। যে মানুষ পুরো ঘর এত পরিস্কার করে রেখেছে সে অনেকদিনের ফিল্টার অ্যাসট্রেতে জমিয়ে রাখবে না। তাই যতগুলো ফিল্টার ওখানে ছিল সবগুলো আজকের।”
“এত সিগারেট খেলে তো ও ক্যান্সার হয়ে মারা যাবে, আমি অল্প বয়সে বিধবা হব।”
আরশি অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুই তো রকেটের গতিতে ছুটছিস!”
তিরা চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল,
“শোন আমি ওর সিগারেট খাওয়া ছাড়িয়ে ফেলব দেখিস তাহলেই তো হয়।”
“তুই ভাতটা বসাবি প্লিজ?”
তিরা ভাত ও ডাল বসিয়ে দিয়ে আরশির সামনে এসে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে বলল,
“আমার কেন যেন ওকে খুব ভাল লেগে গেছে।”
“কারণ ওর গালে একটা কাটা দাগ আছে। এই জিনিসের প্রতি তোর অনেক দূর্বলতা। আজ পর্যন্ত যত গাল কাটা, কপাল কাটা ছেলে দেখেছিস সবার উপরেই তো ক্রাশ খেয়েছিস!”
তিরার চোখ নাচিয়ে বলল,
“সিরিয়াসলি কাব্যর গালে কাটা দাগ আছে?”
“এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী দেখলি? আমি তো বই চাওয়ার সময় একবার তাকাতেই দেখলাম!”
“দাঁড়া ফেসবুক থেকে ছবি দেখি।”
“একদম না। রান্না শেষ হওয়ার আগে একদম উঠবি না। সাহায্য করবি বলেই তোর সাথে নিচে গিয়েছি।”
অগত্যা তিরা মুখ কালো করে বসে রইলো।

কাব্য ক্লাস থেকে ফিরে মূল ফটকের তালা খুলছিল। ঠিক তখন চোখ পড়লো ছাদে। সূর্য ডুবে গেছে কিন্তু প্রকৃতিতে তার রেশ এখনো রেখে গেছে। ছাদের কার্ণিশে দুহাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। বাতাসে তার সাদা ওড়না উড়ছে। কাব্য অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আরশিকে দেখলো। আরশিও নড়ছে না, কাব্যও নড়ছে না। হঠাৎ কোত্থেকে তিরা দৌড়ে এলো আরশির কাছে। মোবাইলে কিছু দেখাতে দেখাতে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আরশি একবার তাকিয়ে দেখলো। হাসি হাসি মুখ করে তিরার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। এরপর হটাৎই তিরা আরশিকে টেনে ছাদ থেকে নিয়ে গেল। মেয়েটির নীরবতাই প্রতিনিয়ত মেয়েটির প্রতি আগ্রহী করে তুলছে কাব্যকে। যতবারই আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার চোখদুটি যেন কাকচক্ষু জলের দিঘি। এত গভীরতা কেন ওই দু’চোখে? কীসের এত বিষন্নতা? একটা কারণ সেদিন অবশ্য জানা গেছে৷ মেয়েটির বাবা মা নেই। সেজন্যই কি এত বিষন্ন দুঃখ ভারাক্রান্ত ওই চোখ নাকি অন্যকিছু?

সেদিন দুপুরেই তিরা কাব্যকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। কাব্য দেখেও ফেলে রেখেছিল। আজ এক্সেপ্ট করলো। তারপর সোজা চলে গেল ফ্রেন্ডলিস্টে। কিন্তু ফেন্ডলিস্ট হাইড করা। এরপর ছবিতে ঢুকতেই দুই বোনের একসাথে অনেক ছবি পেয়ে গেল। সব ছবিতেই তিরার ঠোঁটে লম্বা লম্বা হাসি ঝোলানো। কিন্তু আরশির মুখ স্বাভাবিক। বড়জোর হাসি হাসি মুখ। মেয়েটির মুখে হাসি নেই কেন? ছবিগুলোয় ট্যাগ করা আরশির আইডিও পেয়ে গেলো, আরশি মেহনাজ। আইডিতে ঢুকলো কাব্য। এখানেও কোনো হাসিমুখের ছবি নেই। ওই বিষন্ন ছবিগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল কাব্য। ওই বিষন্ন চোখের অনেক না বলা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে কাব্যর। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও নিজেকে থামালো কাব্য। তার মত ছেলের এত অল্পতেই কারো প্রতি এতটা আগ্রহী হওয়া উচিৎ না।

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৪

এডমিশন কোচিং এ আজ পরীক্ষা। তিরা ও আরশি দুইবোন রাতজেগে পড়েছে তাই বেলা করে ঘুমুচ্ছিলো। কাজের বুয়া আসায় আবার উঠতে হলো আরশিকে। সব কাজ একে বলে বলে করাতে হয়। নাহলে দেখা যায় ঠিকভাবে করেনি। তিরা এখনো ঘুমে। আরশিরও ঘুম ঘুম লাগছে। ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে সোফায় গা এলিয়ে দিল। এমন সময় কলিং বেল বাজলো। আরশি বারান্দায় গিয়ে কাউকে গেটের সামনে দেখতে পেলো না। ভেতরে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে?”
“আমি কাব্য।”
“একটু দাঁড়ান।”
আরশি ঘরে গিয়ে তিরাকে ডাকলো,
“তিরা এই তিরা তাড়াতাড়ি ওঠ। তোর কালা চণ্ডীদাস এসেছে।”
তিরা ঘুমে ভরা চোখ মেলে বলল,
“কে এসেছে?”
“তোর কাব্য। তাড়াতাড়ি ওঠ।”
তিরা লাফিয়ে উঠলো।
“এই অবস্থায় ওর সামনে যাব কী করে! হায় খোদা!”
“তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি দরজা খুলি।”
“বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস? তাড়াতাড়ি যা দরজা খুলে ওকে বসা।”
তিরা উঠে যতদ্রুত সম্ভব মুখ ধুয়ে, কাপড় পালটে কাজল ও লিপস্টিকে হালকা সাজগোজ করতে লাগলো।
ততক্ষণে আরশি গিয়ে দরজা খুলেছে। আরশির এলোমেলো চুল হাত খোঁপায় বাঁধা। কোঁচকানো জামা পড়া। ওড়নার কোণা মেঝে অবধি ঝুলছে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা তেলতেলে ফরসা মুখের বিষন্ন চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আছে। এই সবকিছু আচমকাই কাব্যর চোখে স্থিরচিত্র হয়ে আটকে গেলো। আরশি যেন নিজ ঘরের কেউ যাকে ঘুম থেকে উঠে দেখলেই প্রশান্তিতে ভরে যায় বুক। আরশির কথায় মোহভঙ্গ হলো কাব্যর,
“ভেতরে আসুন।”
ভেতরে গেলেই হয়তো তিরার সামনে পড়তে হবে তাই কাব্য বলল,
“না না আমি এখানেই ঠিক আছি। আমি আসলে একটা দরকারে এসেছিলাম।”
“দরকারের কথা কি ভেতরে এসে বলা যায় না?”
কাব্য কিছু বলার আগেই আরশির পেছনে এসে হাজির হলো তিরা। বললো,
“হাই কাব্য ভেতরে এসো না। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে কেন?”
প্রতিদিন কথা না হলেও তিরা এতদিনে ফেসবুক চ্যাটিং এ কাব্যর থেকে তুমি বলা আদায় করে নিয়েছে। কাব্য খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কাব্য ও তিরা ড্রয়িং রুমে বসলো, আরশি ভেতরে চলে গেলো। তিরা বললো,
“বলো না কী বলবে।”
“আসলে আমার কাজের লোক দরকার ছিল। ঘর পরিস্কার রাখাটা বড়ই ভেজালের কাজ। তোমাদের বুয়া কি আমার কিছু কাজ করে দেবে? আর করলে কত করে দিতে হবে এইসব জানতে এসেছিলাম।”
“ওহ বাট আই হ্যাভ নো আইডিয়া। আসলে এসব তো ভাবীর ডিপার্টমেন্ট। যেহেতু ভাবী এখন নেই সবকিছু আরশি সামলায়। দাঁড়াও ওকে ডাকি।”
তিরা আরশিকে ডাকতে রান্নাঘরে আসতেই আরশি বললো,
“তিরা ওনার চা নাস্তাটা নিয়ে যা। প্রথমবার আমাদের বাসায় এলো একদম খালি মুখে গেলে কেমন দেখায়।”
“তুই যখন যাচ্ছিস তুই নিয়ে যা না প্লিজ।”
“আমি কেন যাব? পুরো ড্রয়িংরুম সিগারেটের গন্ধে ভরে গেছে। তুই নিয়ে যা।”
তিরা হেসে বললো,
“কিন্তু তোকে যে যেতে হবে। কাব্য সাহায্য চাইতে এসেছে, যে সাহায্য আমার পক্ষে করা সম্ভব না।”
আরশি বিরক্ত মুখে চা নাস্তা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো। কাব্য বলল,
“আরে এসব কেন? আমি জাস্ট একটা দরকারে এসেছিলাম।”
আরশি কিছু বললো না। তিরা বললো,
“আরে এটা কি চা? এটা অমৃত! আরশির হাতের চা, খাও খাও নাহয় জীবনের সবচেয়ে বড় মিসটা করে ফেলবে।”
একথা বলে তিরা নিজের কাপটা তুলে নিলো। আরশি চায়ের কাপ কাব্যর হাতে তুলে দিতে দিতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“আপনি কি যেন দরকারের কথা বলছিলেন?”
কাব্য আরেকবার আরশিকে কাছ দেখার সুযোগটা
মিস করলো না। আরশি কাব্যর দিকে তাকালো না বলে ব্যাপারটা খেয়াল করলো না। কাব্য বললো,
“আপনাদের কাজের বুয়া কি আমার কিছু কাজ করে দিতে পারবে? যদি পারে তাহলে তাকে কত করে দিতে হবে?”
“ও আচ্ছা। আমাদের এলাকায় ছুটা বুয়াদের এক কাজ ৬০০ টাকা করে। ওনাকে এরকমই দিতে হয়। তবে কাজ করতে পারবে কীনা তা তো জানিনা। উনি এখন এখানেই আছে। আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।”
আরশি ভেতরে চলে গেল। কাব্য চায়ে চুমুক দিতেই কোথাও হারিয়ে গেলো। ঘন সুস্বাদু চা। এত সুন্দর চা পাতার ঘ্রাণ আজ অবধি কোথাও পায়নি সে। তিরা বললো,
“তোমার ক্লাস নেই আজ?”
“না আজ অফ ডে।”
“ও আচ্ছা। তুমি অনলাইনে এত ইরেগুলার কেন বলো তো?”
কাব্য হেসে বললো,
“অফলাইনেই অনেক কাজ থাকে। অনলাইনে আসার সময় পাইনা।”
“এত কী কাজ শুনি?”
কাব্য হেসে বলল,
“মুভি দেখা, বই পড়া, রান্না করা কত কাজ!”
“এত বই পড়ে কী হবে?”
“সেটা তো বই পড়লে বুঝতে। এই যেমন ধরো বই পড়লে আজ তুমি দুবছরের বাচ্চা থাকতে না। বয়সের সাথে সাথে বড়ও হতে।”
“ধ্যাত আমি তো বড়ই, পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি।”
“হুম বড় শুধু হাতে পায়ে।”
আরশি বুয়াকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বললো,
“কী কী কাজ করাবেন কথা বলে নিন। কাল থেকে শুরু করতে পারবে।”
কাব্য বুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঘর মুছতে হবে আর কাপড় ধুতে হবে। পারবেন?”
বুয়া বললো,
“হ পারমু তয় দুই কামে ২০০০ টেকা দেওন লাগবো।”
কাব্য অবাক হয়ে বললো,
“কেন? এক কাজ ৬০০ হলে দুই কাজ তো ১২০০ হওয়ার কথা।”
বুয়া বললো,
“হ তয় পোলা মাইনষেরা জনমের গিদর হয়। এগোর ঘরবাড়ি জামাকাপড় পরিস্কার করায় কষ্ট বেশি। সময়ও লাগে বেশি, এইল্লিগা টেকাও দেওন লাগবো বেশি।”
তিরা বললো,
“না না বুয়া ও অন্য ছেলেদের মতো না। ওর ঘরবাড়ি খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।”
বুয়া বললো,
“তয় অন্য মানুষ দেখুক।”
আরশি জানে কাজের লোক পাওয়া কত মুশকিল তাই বললো,
“বুয়া আমার কথা শোনেন। সব ছেলেরা তো একরকম না। তাছাড়া উনি একদম একা থাকে। একা মানুষের আর কয়টা কাপড় হয়? আর নীচের ফ্ল্যাটটাও খুব ছোটো, পরিস্কার করতেও সময় কম লাগবে। আপনি বরং কাল ওনার বাসায় কাজ করেন। আপনার যদি মনে হয় কাজ বেশি তবে উনি বাড়িয়ে দেবে। আর যদি মনে হয় কাজ স্বাভাবিক তাহলে ১২০০ ই নেবেন। ঠিকাছে?”
“আইচ্ছা তয় আরশি আফার কথাই থাকলো। কাইলকা কাম কইরা ডিসিসন লমু করমু কিনা। না করলে কাইলকার কামের টেকা কাইলকা দিয়া দিবেন।”
কাব্য কিছু বলার আগেই আরশি বললো,
“আচ্ছা ঠিকাছে।”
বুয়া চলে গেল তার নিজের কাজে। আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে বললো,
“মেনে নিন। সহজে কাজের লোক পাওয়া যায় না। তবে একদিন কাজ করলে সে আর বাড়তি চাইবে না।”
কাব্য জানতে চাইলো,
“কীভাবে বুঝলেন?”
“আপনার বাসায় তো আর এত কাজ নেই। সে তো ভেবেছে ব্যাচেলর বাসা অনেকজন মিলে থাকেন। বুঝতেই পারছেন।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি ভেতরে চলে যাচ্ছিলো। কাব্য ডাকলো,
“শুনুন..”
আরশি ঘুরে তাকালো। কাব্য বললো,
“আপনি সত্যি খুব ভালো চা বানান।”
“থ্যাংকস।”
“এটা কি সিলেট থেকে আনা কোনো বিশেষ পাতা দিয়ে বানানো?”
“না এটা মুদি দোকান থেকে কিনে আনা সাধারন কোনো ব্রান্ডের পাতা। কোন ব্রান্ড সেটা এখন মনে নেই।”
“তাহলে চা পাতার এই ঘ্রাণ টা? আমিও ঘন করে চা বানাই কিন্তু এই ঘ্রাণ টা তো থাকে না। যদি কিছু মনে না করেন আমাকে শেখানো যাবে?”
তিরা বললো,
“আরু কাব্যকে চা বানানোটা এবার শিখিয়ে দে। জানো কাব্য ও আমাকে অনেকবার চা বানানো শেখাতে চেয়েছে৷ আমি শিখিনি। শিখলেই তো সবাইকে বানিয়ে খাওয়াতে হবে। কী বিপদ হবে বুঝতে পারছো?”
তিরা কথাটা বলে খিলখিলিয়ে হাসলো। কাব্যও মৃদু হাসলো। আরশি বলল,
“এক কাপ চা বানালে দেড় কাপ পানি বসাবেন। পানি ফুটলে দুই চা চামচ পাতা দেবেন। চুলা কমাবেন না। সর্বোচ্চ আঁচে অল্প সময় জ্বাল দেবেন। দেড় কাপ থেকে আধা কাপ পানি শুকিয়ে এক কাপ হলে নামিয়ে নেবেন। এক কাপ চায়ে দুই চা চামচ গুঁড়ো দুধ আর চিনি নিজের স্বাদমতো দেবেন। চা বেশিক্ষণ জ্বাল দিলে পাতার ঘ্রাণ টা নষ্ট হয়ে যায়। আর অল্পক্ষণ জ্বাল দিলে কাচা পাতার গন্ধ থেকে যায়। তাই জ্বাল দেয়ার সময়ের পারফেকশন টা জরুরি।
“থ্যাংকস। এবার বুঝেছি।”
“ওয়েলকাম। আর আমি আপনার বইটা এখনই ফেরত দিতে পারছি না। সামনে এডমিশন টেস্ট তো তাই অল্প অল্প পড়ছি। ফেরত দিতে দেরী হবে।”
“কোনো সমস্যা নেই। ওটা আমার পড়া বই, এখন আবার পড়ার সম্ভাবনা নেই।”
“ঠিকাছে।”

আরশি ভেতরে চলে গেল। তিরা এবার নানান ধরনের গল্প শুরু করলো। কাব্য কী বলে উঠবে বুঝতে পারছিল না। কাব্য আরশির যত কাছে আসতে চায় আরশি যেন তারচেয়ে বেশি দূরে চলে যায়। তাই আরশির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তিরার বন্ধুত্ব দরকার। কিন্তু দিনদিন তিরা যেমন বিপজ্জনক ভাবে আগাচ্ছে তার দিকে তাতে সেফ জোনে থাকাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে কাব্য সরাসরিই বললো,
“আচ্ছা তিরা আজ তাহলে আমি উঠি। আবার আরেকদিন কথা হবে।”
“এক্ষুণি চলে যাবে মাত্রই তো এলে।”
“বাসায় অনেক কাজ ফেলে এসেছি। একা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়েই বুয়া খুঁজতে আসলাম। আমার রান্নাবান্না সব বাকী। জানোই তো আমি একদিন রান্না করি তিনদিন খাই। কাল তো ক্লাস আছে রান্নার সময় পাব না। তাই এনিহাও আজকেই করতে হবে।”
“আচ্ছা কাব্য এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“চলো আমি তোমাকে রান্না করে দেই। তোমারও কষ্ট করতে হলো না আর রান্না করতে করতে আমাদেরও গল্প করা হলো।”
“পাগল নাকি তুমি?”
একথা বলে কাব্য উঠে দরজা খুললো। তিরা বললো,
“কেন পাগল কেন হবো?”
কাব্য জোরে হেসে উঠে যেতে যেতে বললো,
“হায়রে মেয়ে! গ্রো আপ দুবছরের বাচ্চা।”
কাব্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। তিরা দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। সে কাব্যর কথাটা শুনলো কিনা বোঝা গেল না কারণ কাব্যর হাসি দেখলেই সে দিন দুনিয়া ভুলে যায়। একটাই কথা শুধু ভাবতে থাকে, এত সুন্দর করে কেউ কীভাবে হাসে!

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ১+২

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১+২

চায়ের কেটলি চুলায় বসালো আরশি। দশ মিনিট আগে তিরা ফোনে জানিয়েছে সে স্টেশন থেকে রিক্সা নিয়েছে। তার মানে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। এসেই বায়না ধরবে চা খাওয়ার। তিরার ধারণা যদি চা বানানোর কোনো প্রতিযোগিতা হতো তবে আরশি সেখানে চ্যাম্পিয়ন হতো।

কলিং বেল বাজতেই আরশি দৌড়ে গেল বারান্দায়। বাড়ির মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তিরা। তাকে দেখতে পেয়েই আরশি বলল,
“দাঁড়া আসছি।”
আরশি দৌড়ে নিচে নামলো। ছোটো বাগান পেড়িয়ে গিয়ে গেট খুলতেই তিরা ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো আরশিকে। আরশিও তিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“অবশেষে আসলি! আমি তো ভেবছিলাম এবার বাড়ি থেকে আসবিই না।”
“কি করব বল। এতদিন পর গেলাম কিছুদিন তো থাকতেই হয়। তার উপর আবার এখন পড়াশোনা নেই।”
আরশি তিরাকে ছেড়ে গেট লাগাতে লাগাতে বলল,
“এখনই পড়াশোনা সবচেয়ে বেশি।”
“ওহ বড়দের মত জ্ঞান দিস না তো। আর কতদিন দাদীমা থাকবি?”
তিরা আরশির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে পেছনের দিকে উলটো হাঁটছিল। আরশি বলল,
“তুই কতদিন বাচ্চা থাকবি?”
একথা বলে আরশি তিরার দিকে ঘুরতে না ঘুরতেই একটা ঘটনা ঘটলো। তিরা কাব্যর সাথে জোরেসোরে একটা ধাক্কা খেলো। কাব্য কোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে দ্রুত হেঁটে আসছিল, আর তিরাও উলটো হাঁটছিল তাই কেউই খেয়াল করতে পারেনি। তিরা প্রচন্ড ব্যাথা পেলো। ঝগড়া করার জন্য পেছনে ঘুরতেই কাব্য বলল,
“মাফ করবেন, আমি বেখেয়ালে হাঁটছিলাম। আপনি কি ব্যাথা পেয়েছেন?”
কাব্যকে দেখে আর তার কথা শুনে তিরার ব্যাথা কোথায় গায়েব হয়ে গেল। ছেলেটা জিন্স, পোলো টিশার্ট পড়া। লম্বা, ছিপছিপে শরীরের কালো দেখতে একটা ছেলে। কিন্তু কিছু একটা মুগ্ধ করে ফেলল তিরাকে যা সে ধরতে পারলো না। তিরা মৃদু হেসে বলল,
“ইটস ওকে। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
“আমি কাব্য। আমি এবাড়ির নিচতলাটা ভাড়া নিয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
ততক্ষণে আরশি এসে তিরার পাশে দাঁড়িয়েছে। সে বলল,
“ওহ আচ্ছা আপনি সাহিল ভাইয়ার বন্ধু অনন্ত ভাইয়ার ছোটোভাই?”
কাব্য তাকালো আরশির দিকে,
“জ্বী।”
তিরা হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমি তিরা। আপনার নিকটস্থ প্রতিবেশী। দোতলায় সাহিল ভাইয়াদের সাথেই থাকি। সাহিল ভাইয়া আমার মামাতো ভাই।”
কাব্য হ্যান্ডশেক করে বলল,
“পরিচিত হয়ে ভাল লাগলো।”
এরপর কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি?”
আরশি কিছু বলার আগেই তিরা বলল,
“ও আরশি, সাহিল ভাইয়ার ছোটো বোন।”
“আচ্ছা আজ তাহলে আসি। গরীবের বাসায় আপনাদের চায়ের দাওয়াত রইলো, দেখা হবে।”
তিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কাব্য বেরিয়ে গেল। তিরা মাটিতেই বসে পড়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো কাব্যর চলে যাওয়া পথের দিকে। ঠোঁটে একটা লম্বা হাসি ঝোলানো। আরশি তিরার হাত ধরে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল,
“এসব কী হচ্ছে?”
“জানেমান আমি ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি।”
“হোয়াট? এই ব্যাটার উপর?”
“প্লিজ ডোন্ট কল হিম ব্যাটা। হি ইজ সো কিউট!” আরশি হেসে বলল,
“উফ তুই না আজকাল যার তার উপর ক্রাশ খাওয়া শুরু করেছিস! চা বসিয়ে এসেছি। আমি গেলাম, তুই তাড়াতাড়ি উপরে আয়।”

ছাদে বসে চা খেতে খেতে তিরা আরশিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা ভাবী কোথায় রে?”
“ভাবী বাবার বাড়িতে গেছে। ওর ডেলিভারি ডেট কাছে চলে এসেছে না?। একেবারে বাবু হওয়ার পর আসবে।”
“ওহ।”
“তুই কোনো এডমিশন কোচিং এ যাবি কবে থেকে।”
“কাল থেকেই যাব ভাবছি, কাল ক্লাস আছে না?”
“হ্যাঁ। এত দেরী করে এলি! প্রথম কতগুলো ক্লাস মিস করলি!”
“সমস্যা নেই তুই তো ক্লাস করেছিস, তুই আমাকে বুঝিয়ে দিস।”
“তা দেয়া যাবে।”
“আচ্ছা আরশি ভাইয়া না বলেছিল কোনো ব্যাচেলর ভাড়া দেবে না! তাহলে এবার হঠাৎ দিল যে?”
“উনি তো অনন্ত ভাইয়ার ভাই, বাসা পাচ্ছিল না। অনন্ত ভাইয়া সাহিল ভাইয়াকে অনুরোধ করেছিল কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তখন ভাইয়াই তাকে বলে যে আমাদের নীচতলা খালি। আর উনি তো একা থাকে। ওইরকম দলবাঁধা ব্যাচেলর তো না।”
“ভাগ্যিস ভাড়া দিয়েছিল। নাহয় ওকে পেতাম কোথায়! কি সুন্দর নাম কাব্য! কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর ঠোঁট! উফফ উফফ আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে আমি তো মরে যাব জানেমান।”
“ধ্যাত তুই এই বুড়ো ব্যাটাকেও ক্রাশ খেতে ছাড়লি না! আমার জাস্ট হাসি পাচ্ছে।”
“এসব বললে হবে না। এ প্রজেক্টে তোর আমাকে সাপোর্ট দিতেই হবে।”
“কেন আগের প্রজেক্টের কী হলো?”
“ধুর ওটাকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। ১ মাস প্রেম করেই বলে রুমডেটে যেতে!”
আরশি হাসতে হাসতে বলল,
“যার তার উপর ক্রাশ খেয়ে প্রেম করলে এরকমই হবে।”
“শোন আগেরটা যা তা হলেও কাব্য কিন্তু যা তা না। আর তুই আজকেই সাহিল ভাইয়ার মোবাইল থেকে ওর নাম্বার চুরি করে দিবি।”
“আমি পারব না। এই কাজ তো একদমই পারব না। ধরা খেলে ভাইয়া আমাকে জবাই করে ফেলবে।”
তিরা কাচুমাচু হয়ে বলল,
“মানুষের অনুভূতির প্রতি তোর কোনো শ্রদ্ধা নেই কেন রে বোন?”
আরশি হেসে বলল,
“এক দেখাতেই এত অনুভূতি!”
তিরা খুব সিরিয়াস মুখ করে অনুরোধের সুরে বলল,
“তুই এটলিস্ট একটা প্রেম কর বোন। একটা প্রেম করলেই তুই এসব বুঝতে পারবি তার আগে বুঝবি না। আমি তোকে বেস্ট একটা ছেলে খুঁজে দেব।”
“এভাবে ছেলে খুঁজে আমি প্রেম করব না। ভালো লাগা থেকেও করবো না। কখনো যদি কারো প্রতি ভালবাসা হয়ে যায়, সেও যদি ভালবাসে তবেই প্রেম করব। সত্যিকারের প্রেম এত প্ল্যান করে হয়না তিরা। যখন হওয়ার এমনিতেই হয়ে যায়। কিছুতেই আটকানো যায় না। তুই ভাল লাগা থেকে প্রেম করিস বলেই তোর প্রেম টেকে না।”
“আজকাল প্রেম টেকানো বহু কঠিন রে।”
“বাদ দে তো এসব চল নিচে যাই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”

রাত ঘুমানোর সময় তিরা আবার বলল,
“আরু.. জানেমান.. প্লিজ আমাকে কাব্যর ফোন নাম্বারটা চুরি করে দে। তুই যা চাইবি আমি তাই দেব।”
“আমার মাথা খাচ্ছিস কেন তিরা? আমি এসব চুরি চামারির মধ্যে নেই। তোর ব্যবস্থা তুই করে নে।”
“এটাকে চুরি বলে না সোনা। প্লিজ কাজটা করে দে।”
“আমি পারব না। ভাইয়া টের পেয়ে গেলে কি জবাব দেব? আমি এটাও বুঝতে পারছি না কী আছে এই ছেলের মধ্যে? তুই এত দ্রুত প্রেমে পড়িস কীভাবে বল তো?”
“কী আছে মানে? বল কি নেই? এই ছেলে তো চরম সেক্সি হবে মামা।”
“ছি।”
“ছি ছি করিস না তো। ও একদম আমার মনের মত হবে দেখিস।”
“একবার দেখেই এতকিছু কীভাবে বুঝলি শুনি?”
“উফ আরশি আমি তো তোর মত অন্ধ না। আমি ছেলেদের দেখলেই বুঝে যাই কে কেমন! বয়স তো ১৮ হয়ে গেছে আর এখনো একটা বয়ফ্রেন্ড জোটাতে পারলি না! কী আছে তোর জীবনে? পান্তাভাত জীবন তোর। আর আমার জীবন দেখ, ইটস লাইক কাচ্চি বিরিয়ানি।”
“তোর কাচ্চি বিরিয়ানী নিয়ে তুই থাক। আমার পান্তাভাতেই চলবে। আর একবারো এইসব নাম্বার চুরি করার কথা বলবি না। এক ফ্লোর নিচেই থাকে। যখন ইচ্ছে গিয়ে কথা বলে আসবি। চায়ের দাওয়াত দিয়েছেই মনে নেই?”
“ওহ শিট! চায়ের দাওয়াতের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এইজন্য তোকে এত ভালবাসি।”
একথা বলতে বলতেই তিরা আরশিকে জাপটে ধরে গালে একটা চুমু দিল। আরশি হেসে ফেলল।

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২

তিরা যখনই নিচে যায় দেখে কাব্যর ফ্ল্যাটে তালা ঝোলানো। কাব্য বাসায় কখন থাকে এটাই সে বুঝতে পারছে না। এদিকে সাহিল ভাইয়ার ফোন থেকেও নাম্বার চুরি করাটা সম্ভব হয়নি।
ঘটনাটা ঘটলো শুক্রবার। শুক্র শনিবার সাহিলের অফিস নেই। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। গত শনিবার স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসার পর আর দেখতে যাওয়ার সময় পায়নি। তাই শুক্রবার সকাল সকাল স্ত্রীকে দেখতে চলে গেলো। ১০ টার দিকে তিরা গেল আরশির কাছে। আরশি ফ্রিজ থেকে কাঁচা মাছ তরকারি বের করছিল। তিরা অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
“আরু.. একী করছিস?”
“রান্নার আয়োজন করছি।”
“একটু পরে কর না, আমি তোকে সাহায্য করব।”
“কেন? দুপুরবেলা রান্নাঘরে গরম লাগে, সকাল সকাল রান্নাটা সেড়ে ফেললেই ভাল।”
“আচ্ছা যা পুরো রান্নাটাই আজ আমি করব।”
“ঘটনা কী? যাকে দিয়ে ভুতেও একটা কাজ করাতে পারে না সে আজ রান্না করতে চাইছে!”
“এখন কাব্যর বাসায় যাব সেজন্য। অন্যদিন থাকে না আজ নিশ্চয়ই থাকবে।”
“ও এই ব্যাপার! তো যা না। তাতে আমার রান্না আটকাবে কেন?”
“আরে বাবা একা যাব নাকি ওরকম একটা জোয়ান ছেলের কাছে? দুজন মিলে গেলে চিন্তা নেই। তোর ছোটো বোনের সেফটির দায়িত্ব তো তোরই তাই না?”
আরশি হেসে বলল,
“যাতে মাতাল তালে ঠিক। আচ্ছা চল।”
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তিরা জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা আরু.. তুই কাব্যকে এর আগে কখনো দেখেছিস?”
“না।”
“ও হ্যাঁ এজন্যই তো সেদিন কাব্য জিজ্ঞেস করছিল তুই কে। পরিচয় থাকলে তো আর করতো না।”
“তবে অনন্ত ভাইয়াকে দেখেছি। যখন সে ঢাকায় সাহিল ভাইয়ার সাথে একসাথে পড়াশোনা করতো তখন অনেকবার আমাদের বাসায় এসেছিল। অনেক আগের কথা অবশ্য।”
“ওহ। দেখ কাব্য আজ বাসায়।”
খুশিতে তিরার দাঁতগুলো সব বের হয়ে গেল। সামনে তিরা, পেছনে আরশি। দরজায় টোকা দেয়ার পরপরই কাব্য দরজা খুললো।
“একী আপনারা! আসুন আসুন, কি সৌভাগ্য।”
তিরা আরশি ভেতরে ঢুকলো। কাব্য তাদেরকে ড্রয়িং রুমে বসালো। তিরা বলল,
“আপনি কি সারাদিন বাইরেই থাকেন? এর আগেও এসেছিলাম আপনাকে পাইনি।”
কাব্য একবার আরশির দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“না না আমি এই দুদিন আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম। এমনিতে বেশিরভাগ সময় বাসাতেই থাকি। আমি একটু ঘরকুনো স্বভাবের লোক।”
আরশি কোনো কথা বলছে না। এদিক ওদিক দেখছে। কাব্যর চোখ বারবার তিরাকে পার করে চলে যাচ্ছে আরশির দিকে। সে খুব সাবধানে সেই চোখ আবার তিরার দিকে নিয়ে আসছে। কারণ কথা তিরার সাথে হচ্ছে। তিরা অবশ্য ব্যাপারটা ধরতে পারলো না। বলল,
“আপনি কী করেন?”
“আমি ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। পাশাপাশি ছোটোখাটো একটা জবও করছি।”
“কি জব করেন?”
“রেডিওতে।”
“আপনি আরজে?”
কাব্য হেসে বলল,
“আপনার কি ধারণা রেডিওতে আরজে ছাড়া আর কেউ কাজ করে না?”
“না তা নয়।”
আরশি এবার উঠে গিয়ে কাব্যর বিশাল এক বুক শেল্ফের সামনে দাঁড়ালো। খুব মনোযোগ সহকারে বইগুলো দেখছিল। কাব্য আরশিকে একনজর দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। তিরাকে বলল,
“আমি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করি।”
“ওহ আচ্ছা।”
“আপনারা কী পড়ছেন?”
“আমরা দুবোন এবার ভার্সিটিতে এডমিশন নেব।”
“দুজন একসাথেই পড়েন?”
“হ্যাঁ আমাদের সবকিছুই একসাথে।”
“দুজন সমবয়সী?”
“হ্যাঁ।”
“কে বড়?”
“আরশি আমার থেকে এক মাসের বড়।”
“আচ্ছা তিরা একটু অপেক্ষা করুন। আমি চা করে আনি।”
“আপনি চা করবেন কেন? আমাদের চায়ের রানী চা করবে। আরশি যেখানে যায় সেখানে কেউ চা করার দুঃসাহস করে না।”
আরশি ছোটো করে একটা ধমক দিল,
“তিরা!”
কাব্য বলল,
“আমি তাহলে দুঃসাহস টা করেই ফেলি। গেস্টদের দিয়ে কাজ করাই না আমি।”
“সর্বনাশ। আপনি যদি ওর হাতের চা না খান তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় মিস টা কিন্তু করে ফেলবেন।”
“আপনাদের বাসায় গিয়ে ওনার হাতের চা খাব। আপাতত আপনারা আমার বাসায় গেস্ট, আমার হাতের টাই খাবেন।”
“ওকে।”

কাব্য চা করতে রান্না ঘরে যেতেই আরশি তিরার মাথার চুল টান মেরে বলল,
“আমার কথা বলছিস কেন? নিজের কথা বল।”
“আরু দেখ তোর দুলাভাই কত গোছানো! ব্যাচেলর বাসা এত সুন্দর হয় আগে জানতাম না।”
আরশি মুখে বিরক্তি এনে আবার বই দেখতে লাগলো। তিরাও ঘুরে ঘুরে বাসাটা দেখে ফেললো। একফাঁকে বেডরুমও ঘুরে এলো। এরপর আবার ভদ্র মেয়ে সেজে সোফায় বসে রইলো।

কাব্য চা নিয়ে এসে প্রথমে তিরার হাতে চা তুলে দিলো। এরপির আরেকটা কাপ নিয়ে আরশির কাছে গেল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই আরশি কাপটা নিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ।”
কাব্য মাথা নেড়ে বলল,
“ওয়েলকাম।”
এরপর আবার ফিরে এলো তিরার কাছে। তিরা চায়ে চুমুক দিয়েই বলল,
“চা তো অসাধারণ হয়েছে। এত ভাল চা আমিও বানাতে পারি না।”
কাব্য হেসে বলল,
“থ্যাংকস।”
আরশি বুকসেল্ফের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চা খেল। ওদের আড্ডায় একবারের জন্যও এলো না। এদিকে তিরার আগ্রহের শেষ নেই, একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
“আপনার বাড়ি কোথায়?”
“কক্সবাজার।”
“আপনি কত ভাগ্যবান চাইলেই সমুদ্র দেখতে পাবেন!”
“আমার সমুদ্র ভালো লাগে না। হয়তো ছোটোবেলা থেকেই জিনিসটা এভেইলেবল ছিল সেজন্য। তবে আমার পাহাড় পছন্দ।”
“আমার সমুদ্র বেশি পছন্দ। আচ্ছা আপনার ফ্যামিলি কি কক্সবাজারেই থাকে? না এখানে একা থাকেন তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“হ্যাঁ আমার ফ্যামিলির সবাই ওখানেই থাকে।”
“আপনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?”
“বাবা, মা, দাদু, চাচ্চু, বড় ভাই, ছোটো ভাই, ভাবি।”
“জয়েন ফ্যামিলি?”
“হ্যাঁ বলতে পারেন। আপনাদের ফ্যামিলি?”
“আমার বাবা-মা আর ছোটো ভাই খুলনা থাকে। বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেছে সে অষ্ট্রেলিয়া থাকে। এখানে সাহিল ভাইয়া, ভাবি, আরশি আর আমি থাকি। মামা মামী তো নেই বেশ কয়েকবছর আগে মারা গেছেন।”
আরশি কড়া চোখে তাকালো তিরার দিকে। তিরা অস্বস্তিবোধ করছে, এভাবে কথাটা বোধহয় বলা উচিত হয়নি। আরশি যে এখানে আছে সেকথা খেয়ালই ছিল না তার। কাব্য বলল,
“সরি।”

আরশি বুকসেল্ফের সামনে দাঁড়িয়েই কাব্যর দিকে ঘুরে বলল,
“আমি কি ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটি ধার নিতে পারি?”
“শিওর। কেন নয়?”
“বইটি অনেকদিন ধরে খুঁজছি। নীলক্ষেতের কোনো দোকানেই নেই।”
“এটা খুব সম্ভাবত এখানে কোথাও পাবেন না। আমি কলকাতা থেকে এনেছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা।”
আরশি বইটি নামাতে চেষ্টা করছিল কিন্তু অনেক উঁচুতে থাকার কারনে সে নাগাল পাচ্ছিল না। কাব্য গিয়ে বইটি নামিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে এরকম আরো অনেক এক্সক্লুসিভ সব বই পাবেন।”
“হ্যাঁ তাই দেখলাম।”
“আপনার যখন ইচ্ছে নিয়ে পড়বেন।”
“থ্যাংক ইউ।”
তিরা দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এত বই কীভাবে পড়েন আপনারা?”
কাব্য বলল,
“কেন আপনি বই পড়েন না?”
“নাহ এত বোরিং জিনিসের সাথে সময় কাটানোর ধৈর্য আমার নেই।”
কাব্য অবাক হয়ে বলল,
“সিরিয়াসলি!”
“হ্যাঁ।”
আরশি বলল,
“তিরা এবার চল আমরা উঠি।”
“এখনই চলে যাব মাত্রই না এলাম?”
“তাহলে তুই থাক আমি যাই, রান্না করতে হবে। বুয়া আসার আগে রান্না শেষ না করতে পারলে ওকে দিয়ে আর রান্নাঘর পরিস্কার করানো যাবে না। পরে শেষে আমাকে করতে হবে।”
“আচ্ছা ঠিকাছে চল যাই।”
সিঁড়ির কাছে গিয়ে তিরা বলল,
“আপনার ফেসবুক আইডিটা দেয়া যাবে?”
কাব্য হেসে বলল,
“আফনান কাব্য।”
তিরা হেসে বলল,
“তিরা মেহজাবিন।”
কিন্তু ততক্ষণে আরশি দোতলার সিঁড়িতে উঠে গেছে। তার আইডি নামটা আর জানা হলো না কাব্যর।

চলবে…

অনুভূতি পর্ব ৫২ (শেষপর্ব)

1

অনুভূতি
পর্ব ৫২ (শেষপর্ব)
মিশু মনি
.
৮৫.
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। সেইসাথে ঠাণ্ডাও লাগছে বেশ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,ঝরো বাতাস ও বইছে। লোডশেডিং চলছে বলে পুরো বাড়িতে যেন আজ খুব তাড়াতাড়ি ই রাত নেমেছে। রাতের খাবার শেষ করে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে সবাই যার যার ঘরে শুতে গেলো। পূর্ব,আরাফ ও সায়ান একসাথে রুমে টুকটাক ড্রিংস করছে। মেঘালয় অন্ধকারে নিজের রুমে শুয়ে আছে।

মিশু ওর মা ও ছোটবোনের সাথে বসে কথা বলছিলো। ওরা শুয়ে পড়ার পর রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে চুপিচুপি মেঘালয়ের রুমে আসলো। বিকেলে মেঘালয় ওর বন্ধুরা মিলে বাইরে গিয়েছিলো কি সব কেনাকাটা করতে। ফিরেছে রাত্রিবেলা। ওর ফোন মিশুর কাছে ছিলো বলে আর কোনোভাবে কথাও হয়নি। রাতে খাবার টেবিলে বসেও কথা বলতে পারেনি, সবাই ছিলো সেখানে। খাওয়াদাওয়ার পর সব ডেকোরেশন আর দাওয়াতের কার্ড সবখানে পৌছেছে কিনা এইসব নিয়ে কথাবার্তা চলেছে বাবা আর ওদের সবার মাঝে। মিশু একটু সুযোগ পায়নি মেঘালয়ের সাথে কথা বলার। এখন সবাই শুয়ে পড়েছে, এটাই মোক্ষম সুযোগ।

মিশু আস্তে আস্তে মেঘালয়ের দরজায় এসে ধাক্কা দিলো। দরজা খোলাই ছিলো। মেঘালয় পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো মিশু ওর রুমে একবার আসবেই। তাই দরজা খোলা রেখেই শুয়ে পড়েছে। মিশু দরজায় ধাক্কা দিতেই ও মিশুর উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে রইলো। মিশু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো মিশু।

মেঘালয় খুব শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো মিশুর। কত মায়াবী একটা মুখ! অথচ এই ছেলেটাকে কতদিন ধরে কষ্ট দিয়েই এসেছে ও। এসব ভেবে আবারো অনুতপ্ত হলো ও। মেঘালয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো একবার। তারপর নিচু হয়ে মেঘালয়ের কপালে আলতো চুমু এঁকে দিলো। মেঘালয় খুব গভীরভাবে অনুভব করলো মিশুর স্পর্শ। শরীর শিউরে উঠলো ওর। কিন্তু তবুও চুপ করে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। একটুও নড়লো না। ওকে ঘুমাতে দেখে আর জাগালো না মিশু। প্রায় বছর খানেক হয়ে গেলো কতবার এই ছেলেটার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে ও! অথচ মনেহচ্ছে কখনো বোধহয় কাছেই পায়নি ওকে। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো এমন কেন? প্রতিটাদিন ই শুধু নতুন নতুন অনুভূতি কাজ করে ভেতরে।

মিশু অনেক্ষণ অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওর ঘুমন্ত দেহটাকে একবার ভালোকরে দেখে নিলো ও। চাদরটা গায়ে টেনে দিলো ভালোমতো। আরো একবার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে চেয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে। মেঘালয়ের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ও হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো “চোর চোর” বলে। আচমকা ওর চিৎকার শুনে ভয়ে আঁৎকে উঠলো মিশু। ফোনটা পড়ে গেলো হাত থেকে। ও মেঘালয়ের মুখ চেপে ধরে বললো, “এই এই আমি আমি।”

মেঘালয় চুপ করে গেলো কথাটা শুনে। মুখ থেকে মিশুর হাতটা সরিয়ে বললো, “তুমি! এতরাতে? আমিতো ভেবেছিলাম চোর। কেমন হতো যদি সবাই এসে তোমাকে উরাধুরা মাইর শুরু করে দিতো?”

মোবাইল টা হাত থেকে মেঝের উপর পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ফ্ল্যাশলাইট ও নিভে গেছে। অন্ধকারে কাছ ঘেষে বসে আছে দুজনে। মিশু আস্তে আস্তে বললো, “আমিতো ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে এসেছিলাম। লাইট হাত থেকে পড়ে নিভে গেছে।”
-“এতরাতে কেন? কেউ দেখলে কি ভাব্বে?”
-“যা খুশি ভাবুক।”
-“কি জন্য এসেছো সেটা বলো?”

মিশু আচমকা মেঘালয়কে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো, “মেঘ আমায় মাফ করে দিবা না? আরো কতক্ষণ এভাবে থাকবা?”

মেঘালয় কর্কশ স্বরে বললো, “এসব কি হচ্ছে? মাঝরাতে এরকম ন্যাকামির কোনো মানে হয়? যাও গিয়ে ঘুমাও।”

মিশু হুট করেই মেঘালয়ের মুখটা ধরে ওর ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভেতর নিয়ে নিলো। মেঘালয় আচমকা আক্রমণে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। মিশু বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর মুখটা ছেড়ে দিয়ে বললো, “আমায় ভালোবাসো মেঘ। প্লিজ, আগের মত হয়ে যাও।”
-“ভালো আবার কিভাবে বাসতে হয়?”
-“মেঘ,একটু আদর করবে আমায়?”
-“সেদিন রাতে বলেছি তো আর কক্ষনো ছুঁয়েও দেখবো না। মেঘালয় যা বলে সেটা করেই ছাড়ে। আজীবন এভাবেই সংসার করবা,কক্ষনো টাচ ও করবো না।”
-“কি বলো এসব? এত রাগ? প্লিজ এভাবে অভিমান করে থেকোনা। আমি তো তোমার ই মেঘালয়। শুধু তোমার। একটু ভূল না হয় করেই ফেলেছি, তাই বলে এভাবে আমায় কষ্ট দেবে?”
-“আমি কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না। যার কর্মফল সে নিজেই ভোগ করছে। ভাগ্যিস ভূলটা তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছে, দাগ যত গভীর হতো, তার কষ্টটাও তত বেশি হতো। মানুষের বিবেক তাকে ঠিকই একসময় দহন করে।”
-“মেঘ, সরি।”

মিশু মেঘালয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। কেঁদেই চলেছে মেয়েটা। তবুও মেঘালয় ওকে স্পর্শ করলো না। বরং খুব শান্ত গলায় আর ধীরেধীরে বুঝিয়ে বলতে লাগলো, “মিশু। আজকে দুটো কথা বলি তোমায়। মানুষের মন কখন কিভাবে বদলায় সেটা কেউই বলতে পারেনা। আজকে এখন আমরা যা দেখছি সকাল হতেই তার বিপরীত কিছুও দেখতে পারি। কার মাঝে কখন কি অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যায় কেউই বুঝতে পারেনা। কিন্তু সবসময় একটা কথা মনে রাখবা, আমি যেটা করছি এটা কার মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলবে? আমার আচরণটা কে কিভাবে নেবে? সহ্য হবেতো সবার?”

মিশু কিছু বললো না। ওর কান্না বেড়ে গেলো। ও শক্ত করে মেঘালয়ের হাত চেপে ধরে রেখেছে। মেঘালয় বললো, “যদি এটা চিন্তা করো তাহলে দেখবে কেউই কষ্ট পাবেনা তোমার থেকে। আর তুমি কোনো ভূল কাজও করতে পারবে না। আর যদি একান্তই নিজের দিকটা ভাবো তাহলে পারিপার্শ্বিক দিকগুলো অবশ্যই প্রভাবিত হবে তোমার দ্বারা। ব্যাপারটা এমন, তুমি শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা ভেবে কিছু করতে গেলে তোমার আপনজন রা তোমার কাছ থেকে আঘাত পাবে।এটাই স্বাভাবিক।”

মিশুর চোখের জলে মেঘালয়ের কোল ভিজে যাচ্ছে। তবুও মেঘালয় ওর চোখ মুছে দিলো না। বললো, “আমরা কত অদ্ভুত প্রজাতি ভাবতে পারো? কেউ কাউকে কখনো পুরোপুরি জানতে পারিনা। যেমন আমি এখনো তোমাকে পুরোপুরি চিনতে পারিনি। অথচ তুমি আমাকে অনেকটাই চিনে গেছো কারণ আমি কেবলমাত্র তোমাকেই আমার সবকিছু উৎসর্গ করে দিয়েছি। তবুও আমি কি বদলাতে পারিনা? আমিও বদলাতে পারি।”

মিশু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “তুমিও বদলে যাবে?”

মেঘালয় উত্তর দিলো, “আমি তো শুধু নিজের কথা ভাবছি না। আশেপাশে সবকিছুতে প্রভাবটা কেমন পড়বে সেটা চিন্তা করছি। আর বদলানো টা স্বাভাবিক সবার পক্ষে। কারণ মানব মন বড় অদ্ভুত। আমার এক দূর সম্পর্কের মামার দশ বছরের সংসার। খুব সুখের সংসার, অথচ হুট করেই মামি আমার মামা আর বাচ্চাকাচ্চা সবাইকে ফেলে আরেকজনের হাত ধরে চলে গেলো। কত অদ্ভুত না? একটা কাজিনের প্রায় চার বছরের সংসার। ভালোই চলছিলো। কোনো কারণ ছাড়াই সেদিন নাকি ওর হ্যাজব্যান্ড ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে।”

মিশু অবাক হয়ে বললো, “এমন কেন হয়?”

মেঘালয় বললো, “ওইযে বললাম শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা ভাবা। মামি যদি স্বামী, সন্তানদের উপর কেমন প্রভাব পড়বে সেটা ভাবতেন তাহলে কখনোই ওভাবে চলে যেতে পারতেন না। আর দুলাভাই যদি আপুর কথা চিন্তা করতো, আর যদি ভাবতো এই মহিলাকে এখন সবার কাছে কতটা লাঞ্চিত হয়ে সমাজে থাকতে হবে। এসব পারিপার্শ্বিক ব্যাপারগুলো কেমন প্রভাবিত হবে সেটা চিন্তা করলে দুলাভাই কখনো ডিভোর্স দিতোনা আপুকে। যে বদলায়,তার বিবেকবোধ কাজ করেনা ঠিকভাবে। সে ভাবে আমি যা করছি সেটাই ঠিক। অবশ্য প্রত্যেকেই যার যার কাজ ঠিক মনে করে। তোমার দিক থেকে তোমার কাজটাই ঠিক,আমার দিক থেকে আমার টা ঠিক।”

মিশুর কান্না থেমে গেলো। ও বললো, “হুম। শুধুমাত্র নিজের কথা ভাবলে এমনই হয়। কিন্তু যে সম্পর্কে দুজনই পারিপার্শ্বিক সবকিছুই চিন্তা করে,সবকিছুই বুঝে তবুও সেগুলো কেন আলাদা হয়। তারা কি জানেন না এরপর লোকজন কতটা সমালোচনা করবেন ওনাদের নিয়ে? সবকিছু জেনে বুঝেও কেন আলাদা হয় অনেকে?”

মেঘালয় হেসে বললো, “পরিবর্তনের সূচনা যেখান থেকে শুরু সেখানেই যাও। শুরুতে কেউ না কেউ কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে অপরজনের কথা না ভেবেই একটু একটু করে বদলে গেছে। অপরজন সহ্য করতে করতে আর পারছিলো না। এরপর শুরু হয় ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, মতের অমিল,একে অপরের উপর বিরক্ত হয়ে যাওয়া তারপর বিচ্ছেদ। আজকাল মানুষ গুলো বড্ড বেশি স্বার্থপর।”

মিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “সবাই যদি এভাবে ভাবতো। তুমি দূরে গিয়ে যেমন আমাকে উপলব্ধি করার সুযোগ দিয়েছো সবাই যদি এমন করতো।”
-“হা হা হা। সবার তো ভালোবাসা এক রকম না। তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে বলে আমার শূন্যতা তোমাকে পুড়িয়েছে। যে আমাকে ভালোবাসবে না, আমি দূরে যাওয়া কেন আমি মরে গেলেও তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগবে না।”

মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি কিন্তু তোমাকে না পেলে পাগল হয়ে যেতাম।”
-“আচ্ছা, যদি আমি দূরে গিয়ে কোনো এক্সিডেন্টে মরে যেতাম?”

মিশু মেঘালয়ের মুখের উপর হাত রেখে বলল, “ছি এসব কেন বলো? আর কক্ষনো বলবা না। তবে সত্যি সত্যিই তুমি যদি কোথাও হারিয়ে যেতে আমি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম।”

মেঘালয় আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। জড়িয়ে ধরলো মিশুকে। কতদিন পর মেঘের স্পর্শ পেয়ে অন্যরকম এক সুখ এসে স্পর্শ করে গেলো মিশুকে। বাইরে বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে। অন্ধকারে অনেক্ষণ একে অপরকে জড়াজড়ি করে বসে রইলো। তারপর মেঘালয় বললো, “এবার রুমে যাও। অনেক রাত হয়েছে। আর তো মাত্র কটা দিন, তারপর আজীবন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে।”
-“মেঘ,আমার মনেহচ্ছে আজকে সুখেই আমি মরে যাবো ”

মেঘালয় আরেকবার মিশুকে বুকে চেপে ধরে বললো, “আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা তোর নেই। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া।”

মিশুও স্বীকার করে সে কথা। ওর কান্নারা আজ বাধ ভেঙেছে যেন। কিছুতেই চোখের জল আটকাতে পারছে না। বুকটা ফেটে যেতে চাইছে। একদিকে মেঘালয়কে দূরে সরে যাওয়ার পর কাছে পাওয়ার আনন্দ,আরেকদিকে নিজের অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া। আনন্দ ও বিষণ্ণতা একসাথে কাজ করছে ভেতরে। ও মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে চাইছে, বুকে মুখটা গুঁজে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে ওকে। মেঘালয় ও মিশুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে রেখেছে। আজ বাইরেও বৃষ্টির জলে জগতের সব পাপ আর অনুশোচনা যেন নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে।

মিশু মাথা তুলে মেঘালয়ের মুখটা ধরে ওর নাকের সাথে নাক ঘষলো। মেঘালয় ও হুট করেই যেন ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গেছে,মিশুর সমস্ত চুল এলোমেলো করে দিলো হাত দিয়ে। দুজনে পাগলামি ও খুনসুটি করতে করতেই রাত পেড়িয়ে ভোর হয়ে গেলো। সকাল হওয়ার আগে আগে মিশু নিজের রুমে শুতে গেলো। এত বেশি শান্তি লাগছে ভেতরে যা বলে বোঝানো সম্ভব না।

৮৬.
দুটো দিন কেটে গেলো ব্যস্ততায়। সব আত্মীয় স্বজন রা আসতে শুরু করেছেন। মেঘালয় সারাক্ষণ ব্যস্ত বিয়ের আয়োজনে সাহায্য করতে। অফিসেও গিয়ে বসতে হচ্ছে, এ কারণে মিশুর সাথে সারাদিন দেখাই হলোনা। রাত্রিবেলা অফিস থেকে বাসায় ফিরলো মেঘালয়। মিশুর সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনে খুব সুন্দর করে হাসলো, কত প্রশান্তির ছাপ মিশে আছে সে হাসিতে। দুজনেই শুধু মনেমনে একটা কথাই ভাবলো, এত সুন্দর করে ও কেন হাসে!

এক টেবিলে বসে খাবার খেলেও দুজনাতে কথা হলো মাত্র দুবার। আর একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়েই সব কথা সেরে নিচ্ছে। খাওয়া শেষ হবার পর কিছুক্ষণ আড্ডা চললো সবার মধ্যে।মেঘালয় পূর্ব, সায়ান ও আরাফকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো আজকে। ওরা সবসময় সব ধরণের সহযোগিতা করেছে মেঘ মিশুকে। আর সব ট্যুরের সাথী হয়ে ট্যুর গুলোকেও দারুণ আনন্দদায়ক করে তুলেছিলো। ওদেরকে ছাড়া এই বিয়েটা যেন অপূর্ণই থেকে যেতো।

এদিকে নিখিল ও দুপুর খুব শান্ত অথচ সুখী এক দম্পতি হয়ে উঠেছে, যাদেরকে দেখলেই মনটা আনন্দে ভরে যায়। রৌদ্রময়ীর বিয়েটাও হয়ত আগামী মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে পূর্ব’র সাথে। আর সায়ান ও আরাফ? দুই অভাগার আর প্রেম করা হয়ে উঠলো না। ওরা এখনও মেঘালয়ের মিশুর মত একটা মিশু খুঁজে ফেরে। জগতে আরেকটা মিশু যদি পাওয়া যেতো! ওর বন্ধুরা সেই প্রথম থেকেই মিশুকে খুব বেশি আপন ভাবে। মিশু এমন একটা মেয়ে,যাকে আপন না ভেবে থাকাই যায়না।

আড্ডা শেষে যে যার রুমে শুতে গেলো। রিমিকার ব্যাপারটা শুনে মিশু প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে মেঘালয়ের সাথে। দুজনে পাশাপাশি দুই রুমে শুয়ে শুয়ে ফোনে মেসেজিং করতে লাগলো। রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। খানিকক্ষণ মেসেজে ঝগড়া চালিয়ে মেঘালয় লিখলো, “আজ খুব সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে বাইরে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছিলো তো এখন আকাশ একদম ঝকঝকে। চাঁদের আলোয় গাছের পাতা চিকচিক করছে।”

মিশু রিপ্লাই দিলো, “জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধু বিল্ডিং চোখে পড়ে। তোমার শহরে জোৎস্না দেখে একটুও মজা লাগেনা।”
-“আচ্ছা হানিমুনে কোথায় যাবা বলো? কোন পাহাড়ের চূড়ায় বসে জোৎস্না দেখতে চাও?”
-“পাহাড়ে না, গাজীপুরের কোনো এক জংগলে বসে দেখবো। ব্যবস্থা করা যায়?”
-“অবশ্যই যায়। মিশু, একটু সিঁড়ির কাছে আসবা? দেখবো তোমায়। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।”

মিশু হেসে “আচ্ছা” লিখে পাঠালো। একটু আগেই দেখা হলো তবুও নাকি দেখতে ইচ্ছে করছে! ও দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে চলে আসলো। মেঘালয় ও এসে আচমকা ওকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে সোজা ছাদে চলে গেলো। মিশু ওর গলা জড়িয়ে ধরে বারবার বলছিলো, “আমি নাকি হাতির বাচ্চা? আলুর বস্তা?”
-“এই হাতির বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে। তুই আমার অভ্যেস না?”

মিশু ক্ষেপে গিয়ে দুটো কিল বসালো মেঘালয়ের বুকে। মেঘালয় ছাদে গিয়ে মিশুকে দোলনায় বসিয়ে দিলো। মিশু অবাক হয়ে বললো, “ছাদের উপর দোলনা আছে? আমি জানতাম ই না। এ বাড়ির ছাদে কক্ষনো উঠিনি আমি।”
-“হুম,সারপ্রাইজড?”
-“অবশ্যই। চাঁদের আলোয় ছাদটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেঘ।”
-“আকাশের দিকে তাকাও।”

মিশু আকাশের দিকে তাকানো মাত্রই দেখলো ঝিকঝিক করা আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। সাদা সাদা মেঘ দারুণ লুকোচুরি খেলছে চাঁদের সাথে। এক্ষুনি ঢেকে দিচ্ছে চাঁদ কে,আবার এক্ষুনি মেঘের ফাঁক ফোঁকর দিয়েই উকি দিচ্ছে চাঁদ। ও মেঘালয়ের বুকপকেট খামচে ধরে বললো, “তুই আমার। আজীবন আমার থাকবি তো?”
মেঘালয় হেসে বললো, “হুম পাগলীটা।”

দোলনায় বসে মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে জোৎস্না উপভোগ করলো। সুখে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। আগামীকাল ওদের গায়ে হলুদ,রাতে বিয়ে আর পরশু বৌভাত। ইস! এত সুখ সুখ লাগছে।

মেঘালয় বললো, “মিশু পাগলী, ‘জল জংগলের কাব্য’ নামে একটা জায়গা আছে। জোৎস্না উপভোগের জন্য দারুণ একটা জায়গা। বিলের উপর টংঘরে বসে বসে দুজনে আঙুলে আঙুল রেখে জোৎস্না দেখবো। চাঁদের আলোয় বিলের জল চিকচিক করবে। কেমন হবে বলোতো, মাঝরাতে বিলের মাঝখানে নৌকায় শুয়ে চাঁদ দেখতে? তুমি আমার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে দুজনে একইসাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো। শিরশিরে বাতাস লাগবে গায়ে, নৌকা থেকে যেদিকে তাকাবা শুধু জল আর জল। মাঝেমাঝে রাতের নির্জনতা গ্রাস করবে পুরো জংগলটাকে। আকাশে থাকবে পূর্ণিমার চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি। এদিকে নৌকায় তুমিও আমার বুকে মুখ গুঁজে লজ্জার লুকোচুরি খেলবা।”

মিশু উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, “ইস! এমন ভাবে বললে সুখে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে মেঘমনি। জল জংগলের কাব্য? উফফ কবে নিয়ে যাবা আমায়?”
-“কালকে রাতে আমাদের বাসর,পরশু বৌভাত। তার পরের দিন যেতে হবে।”
-“মেঘমনি, আমাদের কতবার বাসর আর হানিমুন হবে বলোতো?”

কথাটা বলতে বলতে মিশু মেঘালয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিতে লাগলো লজ্জায়। মেঘালয় বললো, “আমাদের প্রত্যেকটা দিনই প্রেমের সূচনা, প্রত্যেকটা রাতই বাসর, প্রত্যেকটা পূর্ণিমাই মধুচন্দ্রিমা।”

মিশু হেসে বললো, “আর প্রত্যেকটা ট্যুরই হানিমুন এটা বাদ রাখলা কেন?”
-“হা হা হা। পাগলী, তুই বদলে গিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছিস জানিস?”
-“প্লিজ মেঘমনি,আর ওই কথা তুলো না। ওটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভূলে যাও। আমি তোমার মিশু পাগলী, শুধু তোমার তোমার তোমার।”
-“আর আমি বুঝি তোমার মেঘ পাগলা?”
-“উহুম, আমি মেঘালয়া আর তুমি মেঘালয়।”
-“ইস! বললেই হলো? তোমার যা হাইট, আমার পাশে দাড়ালে মনেহয় বিদ্যুতের খাম্বার পাশে বনমানুষ দাঁড়িয়ে আছো।”

মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “বারে এতদিন পর আমার হাইট নিয়ে কথা বললা? আমায় কে বিয়ে করতে বলছে শুনি? যাও সরো ওইদিকে ”

মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম হতেই মিশু পিছন দিক থেকে ওর শার্ট খামচে ধরে বললো, “এখন থেকে প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমার সাথে থাকতে হবে। এই বলে রাখলাম। একটু দূরে গেলেই ঠুস করে টেনে ধরে ঠাশ করে চড় মেড়ে ক্যাক করে গলাটা টিপে ধরে টুক করে মেরে ফেলবো।”

মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি যেন আর থামতেই চায়না। আকাশ, মেঘ, চন্দ্র সবাই যেন মেঘালয়ের সাথে হাসিতে যোগ দিয়েছে। ও হেসেই চলেছে। মিশু ওর বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে দুহাতে জাপটে ধরে রইলো।

৮৭.
মেঘালয় নিজের বিয়ে করা বউকে আরো একবার বিয়ে করলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের তারিখেই ওদের বিয়ে হয়েছিলো, শুধুমাত্র এক মাসের পার্থক্য। আগামী মাসের একইদিনে ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। ব্যাপারটা এমন যে, আগের মাসের এইদিনে প্রথম বিবাহবার্ষিকী আর পরের মাসের এইদিনে দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। বিয়ে পড়ানোর পর সব বন্ধু বান্ধবী মিলে প্রচুর হাসাহাসি চলছিলো এসব নিয়ে। বিয়ের একমাস পরেই ওরা বিবাহবার্ষিকী পালন করবে, যদিও মেঘালয়ের বন্ধুরা ছাড়া আর কেউই সেটা বুঝবেও না।

মেঘালয় ‘জল জংগলের কাব্য’ জায়গাটায় যাবে শুনে ওর বন্ধুরাও জেদ ধরলো যাওয়ার জন্য। তবে এবার ওরাই সবাই মিলে মেঘালয় ও মিশুর সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে। বিলের ধারে টংঘরে বসে কয়েক প্রকার পিঠা আর দেশী খাবার খেতে চাইলে সেখানে তো যেতেই হবে। আর রাত্রিবেলা নৌকায় শুয়ে জোৎস্না বিলাস তো কোনোভাবে মিস করাই যাবেনা!

মেঘালয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে ওরা আরেকবার শুভেচ্ছা জানালো বিয়ের। যদিও বিয়েটা অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে,তবুও আজকে সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পেলো। এতদিন বিয়েটা গোপন রাখার মত ক্ষমতা শুধুমাত্র মেঘালয়ের ই আছে। বন্ধুরা ওকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো।

মেঘালয় বিছানার কাছে আসতেই মিশু মাথার ঘোমটা টা এমন ভাবে খুলে ফেললো যে মেঘালয় ভয় পেয়ে গেলো। মিশু মুখটা বিকৃত করে বলল, আজকে যা গরম,যা দেখছি তাই হট লাগছে!”

মেঘালয় হাসিতে ফেটে পড়লো। ওর ডায়ালগ ওকে ই শোনানো হচ্ছে। মেঘালয় পা দুটো বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বললো, “বউ,আমার পা টিইপ্পা দেও। এক বছর আমি তোমার সেবা করছি। আজ তুমি আমার সেবা করো।”

মিশু খিলখিল করে হাসতে হাসতে মেঘালয়ের পা টিপে দিতে শুরু করলো। মিনিট দুয়েক পরেই মেঘালয় মিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, “পাগলী বউ আমার। বুকে কান পেতে শোন তো।”

মিশু ওর বুকে কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করলো। মেঘালয় বুকে চেপে ধরে রইলো ওর মাথাটা। বললো, “কিছু শুনতে পাও?”
-“হুম। প্রতিটা স্পন্দন বলছে, ভালোবাসি মিশু।”
-“আর আমি তোমাকে বুকে চেপে ধরে কি অনুভব করছি জানো?”
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
মেঘালয় বললো, “এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি।”

মিশু হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে মেঘের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো, “নেশা ধরে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। সত্যিই এ যেন অন্যরকম অনুভূতি।”

দুজন সুখী মানুষ একে অপরকে জড়াজড়ি করে বসে রইলো চোখ বন্ধ করে। কিন্তু কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। কেবলই মনেহচ্ছে দুজনে শুয়ে আছে নৌকায়। চারিদিকে জল আর জল,চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে জলের তরঙ্গ। শাপলা, পদ্ম রাও লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে এই জোৎস্না রাতে ওদের প্রেম দেখে। রাতের নির্জনতা ঘন হয়ে নেমে এসেছে চারিদিকে। দুজনে মুগ্ধ হয়ে আকাশ আর চাঁদ দেখতে দেখতে আবেশে চোখ বুজে এসেছে। একে অপরকে বুকে জড়িয়ে এখন শুধুই প্রশান্তি আর অনুভব করছে মায়াবী জোৎস্নায় এই স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি!