Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1854



কনফিউশন পর্ব ৩৭+৩৮

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৭+৩৮

যাদিদের চোখ থেকে যেন রক্ত ঝরছে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,
“এসব কী তিরা? তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম না তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল কিনা? কী বলেছিলে?”
তিরা চুপ করে আছে, কী বলবে কিছু মাথায় আসছে না। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে। যাদিদ আবার বলল,
“তোমাকে সরল ভাবতাম আমি এতদিন। কিন্তু তুমি যে এরকম মিথ্যেবাদী তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই ছবি দেখার পর, চিঠি পড়ার পর বিশ্বাস হয়েছে। এমন চিঠি তো তুমি আমাকেও লেখো।”
তিরা ভয়ে ভয়ে বলল,
“এত রাগ করছো কেন যাদিদ এসব তো আমার পাস্ট। প্রেজেন্ট তো না।”
“মানুষের পাস্ট থাকতেই পারে তিরা। তোমার পাস্ট নিয়ে আমার কোনো হেডেক নেই। পাস্ট আমারও আছে কিন্তু আমি সেটা লুকাইনি। বছরে একদিন দেখা হওয়া গার্লফ্রেন্ডের কথাও আমি তোমাকে বলেছি, জীবনে যাকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি, একটা চুমু খাওয়ারও সুযোগ পাইনি কোনোদিন। আর তুমি? আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করার পরেও তুমি আমার চোখের উপর মিথ্যে বললে? আমি যদি জিজ্ঞেস না করতাম, তাহলে এখন সব জানতে পারলেও আমার খারাপ লাগতো না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এটা ভেবে যে একটা মিথ্যেবাদীকে সরল ভেবে সংসার করছি আমি!”
“আমাকে মাফ করে দাও যাদিদ। এসব এত সিরিয়াসও ছিল না যে আমি তোমাকে বলব।”
“তাই বলে তুমি আমাকে মিথ্যে বলবে? মিথ্যে দিয়ে শুরু করবে নতুন জীবন? তোমার মিথ্যেটা এতই সত্যির মত ছিলো যে এই শকুনের চোখও সেটা ধরতে পারল না! আর সিরিয়াস ছিল না বলতে কি বোঝাতে চাইছ তুমি আমাকে? ছবিগুলো দেখো। চিঠিগুলোতে কি লিখেছিলে তা যদি ভুলে যাও তাহলে আবার পড়ো। পড়লেই বুঝতে পারবে তোমাদের সম্পর্ক কতটা সিরিয়াস ছিল তা আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা।”
তিরা চুপ। যাদিদ আবার বলল,
“তুমি বিয়ের পরেও কোনো একদিন কি স্বীকার করে নিতে পারতে না যে মিথ্যে বলেছিলে? আগে না বললেও অন্তত এই কদিনে আমরা তো অনেক ফ্রি হয়ে গেছি তিরা। তুমি বলতে পারতে। সব বাদ দিলাম। কিন্তু এই একটু আগেও যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তখনও অস্বীকার করলে? তখনও যদি বলতে তাহলে তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের কাছে আমাকে ছোট হতে হত না। ছেলেটা যখন আমাকে সব বলেছিল তখন আমি ওকে বলেছিলাম, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করিনা। আমার বউকে আমি চিনি। শুধুশুধু আমার সময় নষ্ট করবেন না। ছেলেটা তখন আমার কথা শুনে হাসছিল! আরো মজার ব্যাপার কি জানো সে প্রমাণ দিতে আমার বাসার সামনে পর্যন্ত চলে এসেছে। তোমার আরও অনেক প্রেমের কাহিনীই সে বলেছে তবে প্রমাণ দিতে পারেনি। আমি জানিনা কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে। অথচ তুমি যদি আমাকে আগেই সব বলতে তাহলে আমি ওকে বলতে পারতাম, আমি সব জানি এন্ড আই ডোন্ট কেয়ার।”
তিরার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। যাদিদ বলল,
“আর কী কী মিথ্যে বলেছ তিরা? এখন তোমার সবকিছুকেই আমার অভিনয় মনে হচ্ছে।”
“আর কোনো মিথ্যে বলিনি বিশ্বাস করো।”
“তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। একবার বিশ্বাস করে তোমার মিথ্যে ভালোবাসার জালে জড়িয়েছি। তবে আমার বলতেই হচ্ছে অনেক ভাল অভিনেত্রী তুমি। যার ভেতরে এতটুকু আবেগ অবশিষ্ট নেই তার ভেতরে ভালোবাসা জমিয়েছিলে তোমার এই অভিনয় দিয়ে!”
এবার তিরা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার ভালোবাসা মিথ্যে নয় যাদিদ।”
যাদিদ তাচ্ছিল্যভরে খানিক তাকিয়ে সরে গেল। দ্রুতহাতে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। তিরা যাদিদের কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি কি চলে যাচ্ছ?”
যাদিদ কোনো কথা বলল না। ব্যাগ গুছিয়ে কাপড় পালটে নিল। ওদিকে তিরা অনর্গল মাফ চেয়ে যাচ্ছে। একসময় যাদিদের হাত ধরে বলল,
“আরো দুদিন তোমার ছুটি আছে। যেওনা যাদিদ। প্লিজ।”
যাদিদ একটা কথারও উত্তর দিল না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হবে এমন সময় তিরা যাদিদের পা জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবেনা। আর কখনো মিথ্যে বলব না। যেওনা প্লিজ। আমাকে মাফ করে দাও।”
“আমি তোমার পাগল প্রেমিক না যে তোমার অন্যায় মাফ করে দেব। শোনো তিরা, এখন বের হচ্ছি। বাবা মায়ের সামনে নাটক করে নিজেকে এবং আমাকে আর ছোটো করবে না আশা করি।”
“মাফ করতে না পারো শাস্তি দাও। কিন্তু এভাবে চলে যেয়ো না প্লিজ। আরো দুদিন ছুটি আছে, এই দুদিন প্লিজ থেকে যাও।”
“আরো দুদিন তোমার সাথে থাকা তো দূরের কথা, তোমার মুখও দেখতে চাইনা আমি।”
যাদিদ এ কথা বলে বেরিয়ে গেল। তিরা পেছন পেছন গেল। যাদিদ বাবা মাকে ডেকে বিদায় নিল। সে যেহেতু কখনো মিথ্যে বলেনা তাই শুধুমাত্র এটুকু বলল এক্ষুনি যেতে হবে। কেন সেটা আর বলল না। বাবা মা ভেবে নিলেন যাদিদের হয়তো কল এসেছে, ইমার্জেন্সি ব্যাক করতে হবে। তিরাকে কাঁদতে দেখে ভাবলেন স্বামী চলে যাচ্ছে বলে মেয়েটা কাঁদছে। রেহানা তিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কেঁদোনা মা। যাদিদ আবার ছুটি ম্যানেজ করে ঠিক চলে আসবে দেখবে।”
ভেতরে ভেতরে কতকিছু হয়ে গেছে তা আর কেউ জানলো না।

তিরা কয়েকবার যাদিদকে ফোন করল। সে ফোন ধরলো না। তিরা কাঁদতে কাঁদতে রাত পার করে দিল। এখন ভোর। মাথা কাজ করছে না এখন আর। তিরা ছবি আর চিঠিগুলো নিয়ে বসলো। অয়নের সাথে তার কাপল ছবিগুলো দেখছে। তিরা তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অয়নের সাথেই তার সবচেয়ে বেশিদিন সম্পর্ক ছিল, প্রায় ৯ মাস। এই ৯ মাসে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তারা ডেটে যেতো। কত কত ছবি তুলেছে হিসেব নেই। ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল তিরা। ছবিতে অয়ন তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে এবং সে অয়নের গালে চুমু দিচ্ছে। এমন ছবি সে কবে তুলল? সবচেয়ে বড় কথা সে মনে করতে পারছেনা সত্যিই সে অয়নকে কখনো চুমু দিয়েছে কিনা! এই ছবি এডিটেড নয়তো? অনেকক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়লো সে সত্যিই অয়নকে চুমু দিয়েছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তিরা ছবিগুলো সব ছিঁড়ে ফেলল। তারপর চিঠিগুলো একটা একটা করে সব পড়লো। তখন তিরার নিজস্ব মোবাইল ছিল না বলে দুজনেই নিয়মিত চিঠি লিখতো। কত ভালোবাসার কথা একেকটা চিঠিতে লেখা। কেন সে এত ভালোবাসার কথা অয়নকে লিখেছিল? সে কি অয়নকে সত্যিই এতটা ভালোবাসতো? কই যাদিদের জন্য যেমন লাগে এমন তো অয়নের জন্য লাগেনি কখনো। শুধু অয়ন কেন কারো জন্যই লাগেনি। তাহলে চিঠিতে এত ভালোবাসার কথা কেন লিখেছিল? অয়নকে ক্রেজি করার জন্য? সারাজীবন খেলার ছলে সে ক্রাশ খেয়েছে, প্রেম করেছে, ব্রেকাপ করেছে৷ এই ব্যাপারগুলো যে এতটা সিরিয়াস হতে পারে সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। অথচ এসবই এখন তার জীবনে মৃত্যু ডেকে এনেছে। যাদিদের এমন মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া মৃত্যু ছাড়া কিছু না। হাতের চিঠিটা রেখে আরেকটা চিঠি পড়েই থমকে গেল তিরা। এই মুহুর্তে তিরার হাতে একটা বিশেষ চিঠি। অয়ন প্রথম তিরাকে জড়িয়ে ধরায় তার কেমন লেগেছিল, প্রথম চুমু খাওয়ার পর কেমন লেগেছিল সব অনুভূতি এই চিঠিটাতে তিরা লিখেছিল। এই চিঠিটাও যাদিদ পড়েছে? কীভাবে সহ্য করেছে সে?

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৮

যাদিদ বাসা থেকে বেরিয়ে হোটেলে এসে উঠেছে। তিরা একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, যাদিদ ফোন সাইলেন্ট করে ফেলে রেখেছে সামনেই। তিরার ছবিটা স্ক্রিনে ভাসছে। এই হোটেল থেকে তাদের বাসার একাংশ দেখা যায়। এখন প্রায় ভোর, তিরার ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। যাদিদ সারারাত ধরে তিরার ঘরে জ্বলে থাকা আলোর দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তিরার সাথে ওই ছেলেটার ছবি দেখে এবং চিঠি পড়ে যাদিদ নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তার ইচ্ছে করছিল তিরাকে মেরে ফেলতে। এতকিছু করে আবার সব গোপণ করেছে, মিথ্যে বলেছে! অথচ সে কতটা সরল ভেবেছিল তিরাকে! এতটা অভিনয় একটা মানুষ করে কীভাবে? আর সেইবা কেন মাত্র এক বছরে মেয়েটাকে এত ভালোবেসে ফেলল? বিয়ের প্রায় এক বছর হলেও একসাথে থেকেছে মাত্র ১৩ দিন। মেয়েটা মাত্র ১৩ দিনে কী দিয়ে এত পাগল করে ফেলল যে সবকিছু ভুলে গিয়ে এক্ষুনি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে! কি দিয়েছে? মিথ্যে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু না! অয়ন তিরাকে প্রথম চুমু খাওয়ার পর তিরা অনুভূতি লিখে কত লম্বা চিঠি লিখেছিল, ঠিক যেমনটা তাকে লিখতো তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম ৫ দিনের অনুভূতি! তিরা কি সবাইকেই এভাবে লেখে? তিরার কি সবার জন্যই এক ধরণের অনুভূতি হয়? সেতো কোনোদিন কোনো মেয়েকে ছুঁয়েও দেখেনি তবে তার কপালে এমন দশ ঘাটের জল খাওয়া এক মেয়ে জুটলো কেন? পরক্ষণেই যাদিদ নিজেকে ধিক্কার দিল তিরা সম্পর্কে এমন বাজে কথা ভাবার জন্য। এলোমেলো হয়ে গেছে আজ সে। বারবার মনে হচ্ছে তিরার একচ্ছত্র অধিকার তার নয়। সে অধিকার পাবার আগেও বহুজন এই অধিকার পেয়েছে! অসহ্য লাগছে সবকিছু। শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে হয় তিরাকে নয় নিজেকে!

তিরা বারান্দায় বসে আছে। বহুদিন পর অয়নের ফোন নাম্বারটা সে আনব্লক করলো। ফোন করতেই ওপাশ থেকে অয়ন বলল,
“আহ! তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।”
“কেন এমন করলে?”
“ঋণ শোধ করার জন্য।”
“কীসের ঋণ?”
“মাত্র ৩ বছর আগের কথা ভুলে গেছো? কেন ছেড়েছিলে আমাকে?”
তিরা চুপ। অয়ন বলল,
“কারণটা তুমি বলেছিলে তোমার বাসায় আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছে। তারা মেনে নেবে না। অথচ কারণটা ছিল তুমি তোমার কলেজের কোনো এক সিনিয়রের উপর ক্রাশ খেয়েছিলে। তুমি কারণটা না বললেও আমি জানতে পেরেছিলাম তিরা। কারণ আমি তোমার সাময়িক ক্রাশ থাকলেও তুমি ছিলে আমার ভালোবাসা। তোমার সব খোঁজখবর আমি রেখেছি। আমার পরে তুমি যতগুলো প্রেম করেছো সব জানতে পেরেছি। তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ডের কাছেই যাইনি আমি কারণ কী জানো? কারণ আমি জানতাম তারা কেউই পার্মানেন্ট না। সবাই আমার মত সাময়িক। তোমার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার অপেক্ষা যে এত জলদি শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি। তো মিসেস তিরা কেমন লাগছে এখন তোমার?”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো অয়ন! এটা তোমার কেমন ভালোবাসা? আমি তোমাকে ছেড়ে এসেছি কিন্তু কোনো ক্ষতি তো করিনি। তুমি কীভাবে পারলে আমার এতবড় ক্ষতি করতে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসতাম তিরা। যতটা ভালোবাসতাম এখন ততটা ঘৃণা করি।”
তিরা ফোন রেখে দিল। আর কিছু বলার বা জানার নেই। অয়নও আর ফোন দিল না। অয়নেরও সম্ভাবত ওকে আর কিছু বলার বা জানানোর নেই। তিরা ফোন হাতে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। তার যতগুলো বয়ফ্রেন্ড ছিল তার মধ্যে তিরা যতজনকে ছেড়েছে তারা সবাই যদি এভাবে যাদিদের কাছে এসে প্রমাণ দেয় তাহলে হয়তো এই বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা তার। সে কত বড় বড় ভুলের উপর জীবন পার করছিল তা ভাবতেই শিউরে উঠছে এখন!

তিরা লিখতে বসলো। আরশি তাকে চিঠি লিখতে বলেছে যাদিদের কাছে। এখনো নাকি সময় আছে সব কনফেস করার। তিরা গুছিয়ে বলতে না পারলেও গুছিয়ে লিখতে পারে। চিঠি লেখা তার বহুদিনের অভ্যাস। তাই আরশি লিখতেই বলেছে। তিরা জানে না ঠিক হচ্ছে নাকি ভুল তবে সে লিখে চলেছে..

যাদিদ,
জানিনা তুমি এই চিঠি পড়বে কিনা। হতে পারে আমার নাম দেখেই ছুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে তুমি পড়বে! তাই লিখছি। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বোকা একটা মেয়ে। কেউ ইচ্ছে করলেই আমাকে যেকোনো কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে। এটা তুমি নিজেও জানো। হয়তো এখন আর বিশ্বাস করো না।
যাই হোক, আমার একটা নেশা ছিল। ক্রাশ খাওয়ার নেশা। আমি প্রথম ক্রাশ খেয়েছিলাম বোধহয় ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। কোনো সুন্দর স্মার্ট ছেলে দেখলেই আমি ক্রাশ খেয়ে ফেলতাম। ক্লাসমেট, বন্ধু, পাশের বাসার ছেলে, দূরসম্পর্কের কাজিন, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে, কোচিং এর টিচার, বাসার টিচার, কলেজের টিচার, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, এমনকি বান্ধবীর চাচা মামাদের উপরেও ক্রাশ খেয়েছি আমি৷ ছেলেটা কে, কী করে, ভবিষ্যৎ কী কিছুই ভাবতাম না আমি। আমি সেকেন্ডের মধ্যে ক্রাশ খেয়ে ফেলতাম। আমি সুন্দরী তাই ক্রাশদের নজরে পড়তেও সময় লাগতো না। অয়ন ঠিকই বলেছে৷ আমি অনেকগুলো প্রেম করেছি। সবাই আমার ক্রাশ ছিল। আমি একজনের সাথে প্রেম থাকা অবস্থায় আরেকজনের উপর ক্রাশ খেয়েছি এমন ঘটনাও আছে। সবাই আমার ক্রাশ খাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করত। বিশ্বাস করো যাদিদ আমার জাস্ট এসব ভাল লাগতো তাই করতাম। ব্যাপারটা যে আসলে কতটা সিরিয়াস কখনো বুঝতে পারিনি। অয়নের সাথে আমার সবচেয়ে বেশিদিন সম্পর্ক ছিল। এছাড়া কোনো সম্পর্কই আমার এক মাস দু মাসের বেশি টিকতো না। আমি ক্রাশ খাওয়ার পর সবার ব্যাপারেই খুব উৎসাহী থাকতাম। কিন্তু কিছুদিন পর ওই ভালোলাগাটা আর কাজ করতো না। অন্য সম্পর্কে যাওয়ার পর আগেরটা ভুলে যেতাম, খুব অনায়াসেই। কখনো মনেও পড়তো না আর।
যাদিদ আমি বুঝতে পারছি তুমি ওই ছবি আর চিঠিগুলোর জন্য কি ভাবছো! কিন্তু বিশ্বাস করো আমার অয়নের সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। ইভেন কারো সাথেই না। এতটা সাহস বা ইচ্ছে কখনোই হয়নি। জানিনা আমার কথা তুমি বিশ্বাস করছো কিনা কিন্তু আজ এই চিঠিতে যদি একটা মিথ্যাও লিখি তাহলে যেন এই মুখ সত্যিই আর কখনো তোমাকে দেখাতে না পারি।
আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়ার প্ল্যান আমার বাবা মায়ের ছিল না। কিন্তু আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভাল না তুমি জানো। তাই বাবা মা তোমার মত পাত্র পেয়েই বিয়ের কথা বলল। আমি কিছুতেই বিয়েতে রাজী হচ্ছিলাম না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল বিয়ে করে ফেললে আমি ক্রাশ খাব কী করে? কিন্তু আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেদিনই ক্রাশ খেয়ে ফেলি। তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি একদম পাগল হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল তোমাকে বিয়ে করতে না পারলে আমার জীবন বৃথা। শুধু এইজন্য তুমি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল কিনা আমি মিথ্যে বলেছি। সত্যি বললে যদি বিয়ে না হয় এই ভয় ছিল আমার! আমি যদি জানতাম তুমি আমাকে দেখেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলে তাহলে হয়তো সেদিন মিথ্যে বলতাম না।
বিয়ের পর ৫ দিন ভালোবাসার উন্মত্ততায় কাটানোর পর যখন তুমি চলে গেলে আমি প্রায় পাগল হয়ে গেলাম। এত এত শূন্যতা জীবনে কখনো অনুভব করিনি আমি। তোমার জন্য আমার যেমন লাগতো কখনো কারো জন্য এমন লাগেনি। তখন বুঝলাম তুমি আমার জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। তখন বুঝলাম এর আগে কাউকেই ভালোবাসিনি আমি। আমি শুধু ভেবেছি ভালোবাসি। সাময়িক মোহ বা ক্রাশ থেকেই একেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে যেতাম।
তোমাকে যে সত্যিই ভালোবেসেছি তার আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে আমার শেষ ক্রাশ তুমি। আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হয়ে আসছে। এতদিনে আর কাউকে নজরেই লাগেনি। তোমাকে চোখে ভাসতো সবসময়। তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য, তোমাকে ভিডিও কলে একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম আমি৷ এমনটা আমার কখনো কারো জন্য হয়নি। তোমাকে ভালোবাসি যাদিদ। আর তাই আজীবন তোমার সাথেই থাকতে চাই। গতকাল তুমি মুখ ফিরিয়ে চলে গেছো। বলেছো আমার মুখ আর দেখতে চাওনা। আমি জানি তুমি রাগ করে বলেছো। আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য তুমি চলে গেছো। অন্যায়ের শাস্তি আমি মাথা পেতে নিলাম। যতদিন ধরে এই শাস্তি তুমি আমাকে দেবে আমি সহ্য করব। আমি জানি তোমার রাগ একদিন শেষ হবে, তখন তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। কারণ তুমি আমার স্বামী, আমাকে ভালোবাসো তুমি।
একবার মিথ্যে বলে অন্যায় করেছি। সত্য গোপণ করাটাও অন্যায়। তাই আজ গোপণ করে রাখা সব সত্যি বলে দিলাম। মাফ করে দিও যাদিদ। তিরা খুব খারাপ মেয়ে না।

চিঠি লিখে শেষ করেও পোস্ট করার সাহস হচ্ছিল না তিরার। অনেক ভাবনা চিন্তার পর সপ্তাহখানেক বাদে অবশেষে চিঠিটা পোস্ট করল। আর কোনো উপায়ও নেই। যাদিদ তার ফোন ধরেনা। শতবার ফোন দিলেও একবার ধরেনা!

আরো কিছুদিন পর যাদিদ ডিউটি শেষে নিজের ঘরে ফিরে চিঠিটা পেল। তিরার নাম দেখেই ঝটপট খুলে পড়তে শুরু করলো। পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর চিঠিটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিল।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ৩৫+৩৬

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৫+৩৬

আরশি কাব্য ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক নদীতে ঘুরছে। বড় একটা নৌকায় উঠেছে। নদীর ঢেউগুলো নৌকার গায়ে লেগে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। আরশি সেদিকে চেয়ে আছে। কাব্যর মা ফোন করায় কাব্য নৌকার অন্যপ্রান্তে গুলুইয়ের উপর বসে সে তার সাথে ফোনে কথা বলছে। শাহনাজ বেগম বললেন,
“কোথায় তোরা?”
“ঘুরতে এসেছি, আপাতত নদীতে। জানো মা ও জীবনে প্রথম শাড়ি পরেছে তাও আমার জন্য। আমি পছন্দ করি বলে।”
“দেখেছিস তুই কত ভাগ্যবান? কুলাঙ্গার ছেলে তুই যদি ওকেও কষ্ট দিয়েছিস মেরেই ফেলব তোকে। আচ্ছা বাবা সত্যি করে বল তুই ওর ব্যাপারেও কনফিউজড না তো?”
কাব্য হেসে বলল,
“১% কনফিউশনও নেই মা। আমি ওকে সত্যি ভালোবাসি। ওর সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। ওর প্রতি আমার যে অনুভূতি এটাই ভালবাসা, এটা তনিকার বেলায় ছিল না মা।”
“তাহলে ভালোবাসার কথাটা এখনো বলে দিচ্ছিস না কেন?”
“সব সম্পর্কে ভালবাসি বলাটা জরুরি না মা। আমি যেমন জানি সে আমাকে ভালোবাসে, তেমনি সেও জানে আমি তাকে ভালোবাসি। এখনকার সম্পর্কটা যে কত মিষ্টি তুমি জানোনা। আর সবচেয়ে বড় কথা ওকে এখন ভালোবাসার কথা বলতে গেলেই সম্পর্কটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তখন দুজনের জন্যই আগামী ৫ বছর দূরে থাকাটা কষ্টের হয়ে যাবে।”
“জানিনা বাপু, তোদের আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার বুঝিনা।”
কাব্য হেসে বলল,
“আচ্ছা এবার রাখো। মেয়েটা একা বসে আছে। রাতে কল দিচ্ছি।”
“আচ্ছা রাখ।”

কথা বলা শেষ করে কাব্য আরশির কাছে যেতেই আরশি বলল,
“তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে তাইনা?”
“হ্যাঁ। সব মায়েরাই তো তাদের সন্তানদের খুব ভালোবাসে।”
আরশি আনমনা হয়ে বলল,
“ঠিক বলেছ, আমার মাও আমাকে খুব ভালোবাসতো। আর বাবাও।”
কাব্য টের পেল আরশির বাবা মার কথা মনে পড়ে মন খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা-মা হারানো মানুষের জন্য আসলে সান্ত্বনা বানী কোনো কাজে লাগেনা। তাই কাব্য সেদিকে না গিয়ে চুপ করে রইল। আরশি বলল,
“জানো কাব্য আমি ছোটোবেলায় খুব চঞ্চল ছিলাম।”
“তাই!”
“হ্যাঁ যদিও ছোটোবেলা থেকেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলাম কিন্তু সারাক্ষণ শুধু খেলতে চাইতাম, একদম পড়তে বসতে চাইতাম না। বাবা মা দুজনেই আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। সেই আমিই কেমন শান্ত হয়ে গেলাম!”
কাব্য কিছু বলল না৷ শুধু তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে। আরশি হঠাৎ কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না আমি হাসি না কেন?”
“হুম।”
“আজকে তোমাকে বলব, শুনবে কাব্য?”
“অবশ্যই আরশি। তোমার সব কথা আমি শুনব যা যা বলতে চাও।”
“ছোটবেলায় আমরা কক্সবাজার থাকতাম। আমাদের বাড়ি ছিল চকরিয়াতে। সাহিল ভাইয়া পড়াশোনার জন্য এখানে থাকত। আমাদের ওখানে থাকার কারণ বাবা রাজনীতি করতেন।”
“শুনেছি আংকেল সংসদ সদস্য ছিলেন।”
“কার কাছে শুনেছ?”
“ভাইয়ার কাছে শুনেছি।”
“বাবা কীভাবে মারা গেছেন তা শুনেছ?”
“না।”
“আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। ঈদ করতে সবাই এক হয়েছি। ঈদের আগে আগে একদিন সবাই মিলে বাজারে গিয়েছিলাম। আমি খুব ছটফটে ছিলাম। বাবা মা যখন কেনাকাটা করছিলেন আমি দৌড়ে একটা খেলনার দোকানে ঢুকলাম। সাহিল ভাইয়া আমাকে ফেরাতে আমার পিছুপিছু এল। ভাইয়া আসতেই আমি বায়না করতে শুরু করলাম আমার এটা চাই, ওটা চাই। ভাইয়া তো আমার অনেক বড়, আমি যখন ফোরে পড়ি তখন ও পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতেও ঢুকেছে। ভাইয়া বলল যাওয়ার সময় আমার পছন্দের সব খেলনা কিনে দেবে। আমি কিছুতেই খেলনা না নিয়ে ফিরব না গো ধরে বসে থাকলাম। হঠাৎ দেখি বাজারের মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করেছে, অনেক চেচামেচি। ভাইয়া আমাকে নিয়ে দোকান থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম বাবাকে কিছু লোক কুপিয়ে মারছে।”
কাব্য আরশির কাঁধে হাত রাখলো। আরশি নীরবে কাঁদছে আর বলছে,
“চোখের পলকে ওরা বাবাকে কয়েক টুকরো করে ফেলল। হাত পা মাথা সব আলাদা। মা চিৎকার করছিলেন, ওরা মাকেও কুপিয়ে মেরেছে। আমি চিৎকারও করতে পারিনি! ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরে ছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই৷ অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হসপিটালে। ভয়ংকর এক ট্রমার ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। সাহিল ভাইয়া আমাকে ঢাকা নিয়ে আসে। আমি কাঁদতে পারতাম না, হাসতে পারতাম না। জগতের কোনো অনুভূতিই আমার ছিলো না। এত রক্ত দেখেছি যে রঙ আর দিনের আলো কোনোটাই সহ্য করতে পারতাম না। সারাদিন ঘর অন্ধকার করে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। কিছু খেতে পারতাম না। কত রাত যে কেটেছে আমার না ঘুমিয়ে তার কোনো হিসেব নেই। ভাইয়া বলল বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করলে তারা যেখানেই থাকুক সুখী হবে। তাদেরকে সুখী করার জন্য আমি দিন রাত পড়াশোনা করা শুরু করে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া শুরু করলাম। কারণ বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাকে ডাক্তার বানানো আর মায়ের আরেকটা স্বপ্ন ছিল আমাকে তিন বেলা ঠিকমতো খাওয়ানো।”
এ কথা বলে আরশি হাসলো। কাব্য চুপ। তারপর আরশিই আবার বলল,
“কিছুদিন পর ভাইয়া রশ্নি ভাবিকে বিয়ে করে আনে। ভাবি তখন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিল, ওকে খুব পছন্দ করতাম। আমার জন্যই ভাইয়ার অত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা। আমি সবার সাথে মিশতাম না।”
কাব্য এবার বলল,
“খুব কঠিন ছিল তোমার বড় হয়ে ওঠা।”
“হ্যাঁ খুব বেশি কঠিন, খুব বেশি বিষন্ন। যেখানে ভালোলাগার কোনো কিছুই নেই। যেখানে বেঁচে থাকাটাই অনেক কঠিন। মানুষজন আমাকে বুঝতে পারতোনা, এমনকি এখনো পারেনা। অন্য সব মেয়েদের মতো করেই আমার বয়স বেড়েছে, শারীরিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু জীবনটা অন্যসব মেয়েদের মত কাটেনি। আমার বোন তিরা আমার একমাত্র বন্ধু, যে সম্পূর্ণই আমার উল্টো। এছাড়া কখনো কোনো বন্ধু তৈরি হয়নি, কেউ আমার সঙ্গ পছন্দ করতো না, আমারো কাউকে ভালো লাগতো না। আমার জীবনের একমাত্র আনন্দের ঘটনা হচ্ছে আমার ভালো রেজাল্ট করা। এই একটা জিনিস আমাকে আনন্দ দিত, কারণ বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের পথ সুগম হচ্ছিল।”
কাব্য চুপ। আরশি আবার বলতে শুরু করল,
“এরপর একদিন কীযে হলো! কখনো কারো চোখে না পড়া এই মেয়েটা একজনের চোখে পড়ে গেলো। জীবনে প্রথম কেউ মেয়েটার বিষন্নতার কারণ জানতে চাইলো। জীবনে প্রথম একটা মানুষ মেয়েটার খুব কাছে চলে এলো, মেয়েটাকে হাসালো, কাঁদালো। অনুভূতিহীন মেয়েটাকে পরিচয় করালো অনেক অনুভূতির সাথে। মেয়েটার বেঁচে থাকাটা এখন আর আগের মত কঠিন নেই।”
কাব্য আরশির চোখ মুছিয়ে দিয়ে হাত ধরলো। তারপর বলল,
“যেভাবে তোমার কাছে এসেছি, সেভাবেই আজীবন তোমার কাছে থাকব আরশি। অনেক হাসাবো, অনেক কাঁদাবো।”
আবারো আরশির দু’চোখ উপচে জল পড়তে লাগলো। ঠোঁটে হাসি।

তিরা খুলনা পৌঁছলো বিকেলবেলা। প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলো সে, সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যায় শাশুড়ি রেহানা আলমের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তিনি বললেন,
“তিরা ওঠো কিছু খেয়ে নাও।”
“মা আমার ভালো লাগছে না। পরে খাব।”
“এবাড়িতে এরকম না খেয়ে তো থাকা যাবেনা। ঠিকমতো না খেয়ে না খেয়েই অসুস্থ হয়েছিলে তুমি। ওঠো খেয়ে নাও।”
তিরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলো। খেয়েদেয়ে ঘরে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় কলিং বেল বাজলো। রেহানা বললেন,
“দেখো তো তিরা কে এলো।”
তিরা দরজা খুলতেই দেখে যাদিদ দাঁড়িয়ে। স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি বুঝতে পারছেনা। যাদিদ তিরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“সারপ্রাইজ!”
তিরা সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ঘটনাটা এত আচমকা ঘটলো যে যাদিদ ধরতেও পারলো না। রেহানা ছুটে এলেন। যাদিদ তিরাকে ধরে কোলে তুলে ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিতেই রেহানা বললেন,
“আগেই বলেছিলাম সারপ্রাইজের দরকার নেই, ওকে বলে দেই।”
“ধুর মা তেমন কিছু হয়নি।”
যাদিদ তিরার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিতেই তিরা চোখ মেলে তাকালো। যাদিদকে এবং শাশুড়িকে হাসতে দেখে সে প্রচন্ড লজ্জা পেল। সে যাদিদের দিকে তাকাতেই পারছে না। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। রেহানা বললেন,
“তুমি তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। সারাদিন কিচ্ছু খেতে চাওনা, মাথা ঘুরে তুমি পড়বে না তো কি আমি পড়ব?”
তিরা উঠে বসলো। যাদিদ মুচকি হাসছে। রেহানা বললেন,
“এখন তোমার জন্য এক মগ দুধ গরম করে আনব, পুরোটা খেতে হবে।”
রেহানা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই যাদিদ তিরার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“এই পাগল কাম টু মি।”
তিরা ঝাপিয়ে পড়ল যাদিদের বুকে। মুহুর্তের মধ্যেই কান্নায় ভাসিয়ে দিল তাকে। যাদিদ তিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু দিলো।

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৬

তিরার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যাদিদ সত্যি এসেছে। যাদিদের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে নিজের গায়ে নিজে চিমটি দিল। একাজ সে ইতিমধ্যে অনেকবারই করেছে। প্রতিবারই সে ব্যাথা পেয়েছে এবং স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়েছে। যাদিদ মাত্র ১০ দিনের ছুটিতে এসেছে। অথচ এই মানুষটা যদি সারাজীবনের জন্য কাছে থাকতো তাহলে তার চেয়ে বেশি সুখী এই পৃথিবীতে একজনও আর থাকত না। যাদিদ হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলো তার পাগল বউ ঘুম বাদ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। সে তিরাকে কাছে টেনে নিলো। বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ঘুমাচ্ছ না কেন?”
তিরা যাদিদের বুকে মাথা রেখে বলল,
“এই ১০ দিন আমি একদম ঘুমাবো না। শুধু দেখবো তোমাকে। দেখতে দেখতে মুখস্ত, চোখস্ত, আত্মস্থ করে ফেলব।”
“চোখস্থ শব্দটা আবার কোত্থেকে পেলে?”
“জানি না।”
যাদিদ তিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“এত দেখতে হবে না। এখন ঘুমাও।”
“তুমিও ঘুমিও না।”
যাদিদ এবার হেসে দিল। বলল,
“এতো ভালোবেসে ফেললে কীভাবে আমাকে? অ্যারেঞ্জ ম্যারজে কেউ স্বামীর জন্য এত পাগল হয় আগে দেখিনি।”
“সো ইউ শুড ফিল প্রাউড।”
যাদিদ হেসে ফেলল। তিরার মুখটা ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,
“হুম প্রাউড ফিল করি তো, আর..”
“আর কী?”
যাদিদ তিরার ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
“অনেক ভালোবাসি তিরা।”
তিরা তৃপ্তির হাসি হাসলো। এমন করে কি আগে কখনো ভালোবাসি বলেছে যাদিদ? মনে করতে পারলো না সে। সত্যিই কাছে থাকলে মানুষটা একদম অন্যরকম, ঠিক মনের মতো।

আজ মাসের শেষদিন। কাব্যর বাসা ছাড়ার সময় এসে গেছে। আগামীকাল সে কক্সবাজার চলে যাবে। দুই সপ্তাহ পর সুইডেন যাওয়ার দিন ঢাকা এসে ফ্লাইট ধরবে। কাব্যরও গোছগাছ মোটামুটি শেষ। টুকটাক কিছু বাকি। সকালবেলা পিকআপ আসবে। কাব্য বইগুলো কার্টনে ভরছে, আরশি সাহায্য করছে। আরশি তেমন কোনো কথা বলছে না। কাব্য একাই বকবক করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ কথা একেকটা বই নিয়ে। আরশিকে চুপচাপ দেখে কাব্য হঠাৎ বলল,
“তোমার মন খারাপ আমি চলে যাচ্ছি বলে?”
আরশি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
“নাহ। মন খারাপ কেন হবে?”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ।”
“আমি ৫ বছর পর আবার আসব। এর মধ্যে কিন্তু আর আসতে পারব না।”
“জানি।”
“তবুও মন খারাপ হচ্ছে না?”
“নাহ। কেন মন খারাপ হলে খুশি হতে?”
কাব্য হেসে বলল,
“না। আমি চাই তুমি সবসময় খুশি থাকো। তোমার হাসিটা অনেক শান্তি দেয়।”
এবার আরশি হাসল। খুশি হয়েই হাসলো।

যাদিদ তিরা পাঁচ দিনের জন্য হানিমুনে গেল নেপালে। সেখান থেকে ফিরে একদিন রেস্ট নিল। ঘটনাটা ঘটলো তার পরদিন। সারাদিন দুজনে শপিং করলো, বাইরে খাওয়া-দাওয়া করল। সন্ধ্যার পরে তিরা শাশুড়ির সাথে রান্নাবান্নায় সাহায্য করছিল। হঠাৎ যাদিদ তাকে রান্নাঘর থেকে ডেকে নিয়ে গেল। বেডরুমে গিয়ে বলল,
“তিরা তুমি কি আমাকে কখনো কোনো মিথ্যে বলেছো?”
তিরা খুব স্বাভাবিকভাবেই হেসে বলল,
“না তো। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“ভাল করে ভেবে দেখো। বিয়ের আগে বা পরে কোনো ছোটো বা বড় মিথ্যে?”
“আমি তোমাকে মিথ্যে কেন বলব?”
“বলোনি?”
“না।”
“ঠিকাছে।”
যাদিদ এ কথা বলে কোথাও বেরিয়ে গেল। তিরা ভাবতে লাগলো যাদির এরকম কেন জিজ্ঞেস করল? অনেকক্ষণ ভাবার পর তিরার হঠাৎ মনে হলো যাদিদ বিয়ের আগে জিজ্ঞেস করেছিল তার বয়ফ্রেন্ড ছিল কিনা। সে বলেছিল নেই। কিন্তু এই কথাটা এতদিন পরে উঠলো কেন? তিরা সাথে সাথে আরশিকে ফোন করে সব বলল। আরশি বলল,
“আমি তোকে আগেই বলেছিলাম এসব নিয়ে মিথ্যে বলাটা ঠিক হবে না।”
“আমি তো ভয়ে সত্যিটা বলিনি যদি বিয়েটা না হতো?”
“সত্যিটা বললেও বিয়ে হতো তিরা। এখনকার যুগে বিয়ের আগে বয়ফ্রেন্ড থাকাটা খুব অস্বাভাবিক না। ভাইয়ার যে গার্লফ্রেন্ড ছিল সেটা তো সে অকপটে বলে দিয়েছে। তোরও বলা উচিৎ ছিল।”
“এখন কি করব? সত্যিটা বলে দেব?”
“অবশ্যই এক্ষুনি বলে দিবি।”
“কার কথা রেখে কার কথা বলব? কত্তগুলা বয়ফ্রেন্ড ছিল আমার তুই ত জানিস।”
“স্পেসিফিক্যালি কারো কথা বলতে হবেনা। জাস্ট বলবি বয়ফ্রেন্ড ছিল।”
“যদি ডিটেইলসে জানতে চায়?”
“বলবি এসব তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এসব নিয়ে আলোচনা করতে চাস না।”
“যদি রেগে যায়?”
“রাগলে রাগবে। গাধা তুই এইটুকু বুঝতে পারছিস না হঠাৎ ভাইয়া কথাটা কেন জিজ্ঞেস করল?”
“কেন?”
“নিশ্চয়ই কোনোভাবে কিছু জানতে পেরেছে!”
তিরা ভয় পেয়ে বলল,
“কি বলছিস তুই!”
“হতেই পারে। আচ্ছা ভাইয়া কি কথাটা রেগেমেগে জিজ্ঞেস করেছে নাকি স্বাভাবিক ছিল?”
“স্বাভাবিক ছিল।”
“আচ্ছা যাই হোক এখন সব বলে দে। একটা মিথ্যাকে লুকিয়ে রাখতে আরো ১০০ মিথ্যা বলতে হয়। সেই ১০০ মিথ্যা হয় ১০০০ বিপদের ফাঁদ। তুই এক্ষুনি সব বলে দে।”
“ঠিকাছে ও বাসায় ফিরলে সব বলে দেব।”
“আচ্ছা টেনশন করিস না। তুই নিজ থেকে সব বললে ইজিলি নেবে ইনশাআল্লাহ।”

কিন্তু যাদিদকে বলার সুযোগ পেল না তিরা। যাদিদ বাসায় ফিরেই তিরার মুখের উপর কিছু কাগজপত্র ছুঁড়ে মারলো। তিরার মুখে ধাক্কা খেয়ে সেগুলো মাটিতে পড়ে গেল। তিরা তাকিয়ে দেখে তার এক এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে কাপল ছবি এবং তার নিজ হাতে লেখা অসংখ্য চিঠি।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ৩৩+৩৪

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৩+৩৪

অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় কাব্য তিরা ও আরশির অপেক্ষায় ছাদে বসে ছিলো। আরশি যাওয়ার আগে তিনজনের জন্য চা করে নিলো সাথে থানকুনি পাতার বড়া। যখন তারা বের হবে ঠিক তখন রশ্নি বলল,
“মানুষ দুজন চা তিনকাপ কেন?”
আরশি হেসে বলল,
“কালা চন্ডীদাস আছেনা?”
ভাবি আঁৎকে উঠে বলল,
“এই তিরা তোর কিন্তু বিয়ে হয়ে গেছে।”
“উফ ভাবি। তুমি কী ভাবো আমাকে? কাব্যর এক্স গার্লফ্রেন্ডের আমার বয়সী মেয়ে আছে জানো তুমি?”
রশ্নি অবাক হয়ে বলল,
“মানে! কি বলে মেয়ে!”
তিরা আর দাঁড়ালো না। বের হয়ে ছাদের দিকে গেলো। আরশি বলল,
“পুরো কাহিনী আমি তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব।”

আরশি তিরা ছাদে যেতেই কাব্য তিরার দিকে চেয়ে বলল,
“সুস্বাগতম মামনি!”
তিরা হেসে বলল,
“ধব্যবাদ আব্বাজান।”
আরশি চা বড়ার ট্রে কাব্যর সামনে রাখতেই
“ওহ কি দারুন জিনিস নিয়ে এসেছে আমাদের ডাক্তারা আপা!”
আরশি কিছু বলল না। চুপচাপ বসলো। কাব্যকে বলতে হলোনা নিজেই বড়া নিয়ে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতেই কাব্য বলল,
“তিরা ফোনে কথা বলার সময় তোমার শেষ কথার টোনটা যেন কেমন কেমন শোনাচ্ছিল। ভাল নেই তুমি? ডিপ্রেসড?”
তিরা বড়া নিতে নিতে বলল,
“আর বলোনা। ভালোটা থাকব কীভাবে একা একা?”
“তো নেভি অফিসারকে বিয়ে করেছো, একা একাই তো থাকতে হবে। সেটা আগে বোঝোনি?”
“ওর জন্য যে এত খারাপ লাগবে সেটা আগে কীভাবে বুঝব বলো?”
“হাজবেন্ডের জন্য মেয়েদের খারাপ লাগবেই এটাই স্বাভাবিক।”
“হ্যাঁ কিন্তু এত ব্যস্ত থাকা, এত খারাপ ব্যবহার করাটা স্বাভাবিক না। যাদিদ যে এরকম করবে তা তো বিয়ের আগে জানতাম না।”
“কেন তোমাদের কি অনেকদিন পর পর কথা হয়?”
“না প্রতিদিনই কথা হয়।”
“প্রতিদিন খারাপ ব্যবহার করে?”
“না। শোনো তোমাকে ভেঙে বলি। আমাদের প্রতিদিনই অনেকক্ষণ করে কথা হয়। বেশিরভাগ দিন সব স্বাভাবিক থাকে তখন আমাদের মধ্যে কোনো প্রব্লেম হয়না। হঠাৎ দু একদিন এক মিনিটের জন্য কল দেয়, দিয়েই বলে তোমার হাতে এক মিনিট আছে, যা বলার এর মধ্যে বলো। আবার কোনোদিন কথা না বলেই ঘুমিয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে যাই আমার সাথে কথা না বললে ওর ঘুম আসে কীভাবে? আমার তো আসেনা। আবার কোনোদিন ২৪ ঘন্টায় সে এক মিনিটও বের করতে পারেনা আমার সাথে কথা বলার জন্য। এটা খুব আজব না? এরকম কিছু হলে আমি রিয়াক্ট করি। আমি খুব বেশি রিয়াক্ট করে ফেললে সে মাঝেমাঝে খারাপ ব্যবহার করে, মাঝেমাঝে আবার ফোন বন্ধ করে রাখে। আর সবচেয়ে বেশি যেটা করে সেটা হচ্ছে.. আমি চেঁচাতে থাকি কিন্তু সে কিছুই বলেনা, সাইলেন্ট হয়ে যায়। ড্যাম কেয়ার। কিছুই যায় আসেনা তার। আসলে কাব্য আমি ওর সাথে কথা বলার জন্য যতটা উতলা থাকি সে ততটা থাকে না।”
“হয়তো থাকে কিন্তু বোঝায় না।”
“উতলা থাকলে আবার বোঝাবে না কেন?”
কাব্য চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“এটাই হয়তো তার ন্যাচার।”
“সে উতলা থাকে না কাব্য। মাঝেমাঝে একটু কথা বলেই সে ঘুমানোর পায়তারা শুরু করে। সে কখনো আমাকে মিস করে না। কখনো তার আমাকে দেখতেও ইচ্ছে করেনা।”
“তুমি কী করে জানলে?”
“ভিডিও কলে কথা বলার কথা সবসময় আমিই আগে বলি।”
“একজন আগে বললেই তো হলো। তাছাড়া, তুমি আগে বলে হয়তো তার বলার আর সুযোগ রাখোনা।”
এবার তিরা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। কাব্যর শেষ কথাটায় যুক্তি আছে। আরশি চা নিয়ে তিরাকে বলল,
“চা নে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তিরা চা নিল। তিরাকে চিন্তিত দেখে কাব্য আবার বলতে শুরু করল,
“দেখো তুমি নিজেই বলছো প্রতিদিন কথা হয়। মাঝেমাঝে কম হয়। প্রতিদিন কথা হয় মানে সব ঠিকই আছে। হঠাৎ দুয়েকদিন তার অসুবিধা তোমাকেও বুঝতে হবে। হয়তো ডিউটি বেশি পড়ে যায়, হয়তো টায়ার্ড থাকে। যাদিদ হয়তো একটু বদরাগী তাই খারাপ ব্যবহার করে। এছাড়া আমি ওর আর কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছি না।”
“তুমি ছেলে মানুষ তো, ছেলেদের দোষ কীভাবে দেখবে?”
কাব্য তিরার কথা শুনতে শুনতে চায়ে আরেক চুমুক দিয়ে নিল। এরপর হেসে বলল,
“ব্যাপারটা একদমই এমন নয়। আমি কারো পক্ষ নিচ্ছিনা। দেখো তিরা আমার মনে হয় ভালোবাসা কোনো নিয়মের মধ্যে রাখার জিনিস না। তুমি যতো নিয়মের মধ্যে আনতে যাবে সম্পর্ক খারাপ হবে। সম্পর্ককে ফ্রিডম দাও।”
“সম্পর্ককে আবার ফ্রিডম দেয় কীভাবে?”
“ধরো তুমি একটা সম্পর্ক একভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছো তোমার নিজস্ব স্ট্রাকচারে। তখন তুমি সবকিছুকেই সেই স্ট্রাকচারে আনার চেষ্টা করবে। তখনই গন্ডগোলটা বাঁধবে। তারচেয়ে সম্পর্ককে যদি নিজের গতিতে চলতে দাও, কিছু জিনিস তোমার মনমতো না হলেও সম্পর্ক ভালো থাকবে। সম্পর্ক ভালো থাকলে তোমরা ভালো থাকবে। ইউ ক্যান ট্রাই ইট। উপরওয়ালা কিছু আমাদের হাতে দেননি। যেটা আমাদের হাতে দেননি সেটার কন্ট্রোল আমাদের না নেয়াই শ্রেয়। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সর্বপ্লাবী ভালোবাসা সবসময় সুখ এনে দেয় না।”
আরশি মুগ্ধ হয়ে শুনছে কাব্যর কথাগুলো। তিরা কিছুটা অবাক হচ্ছে, সে এভাবে কখনোই ভেবে দেখেনি। কাব্য বলল,
“যাদিদের কি পড়াশোনা শেষ?”
“না এখনো পড়ছে।”
“বোঝো তাহলে এতকিছুর মধ্যে ছেলেটার পড়াশোনাও আছে। পড়াশোনা না করলে তো সে ভালো পজিশনে যেতেও পারবে না।”
তিরা চুপ। কাব্য বলল,
“তুমি কি কখনো যাদিদকে জিজ্ঞেস করেছ সে সারাদিন কখন কি করে? তার ডেইলি রুটিন টা কেমন?”
“না ডিটেইলসে তো কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“একবার জিজ্ঞেস করে দেখো তো। আশা করি তার উত্তর শোনার পর বুঝতে পারবে সে কীভাবে তোমার সাথে কথা বলার সময় বের করে। কিছু কিছু সময় নিজের দিকটা কম ভেবে ওপাশের মানুষের দিকটা বেশি ভাবতে হয়।”
“আচ্ছা কাব্য সবসময় স্যাক্রিফাইস শুধু মেয়েদেরকেই কেন করতে হবে? কেন মেয়েদেরকেই সবকিছু বুঝতে হবে? কেন ছেলেরা কিছু বুঝবে না?”
“তাই তোমার মনে হয় শুধু তুমিই স্যাকরিফাইস করো? যাদিদ করে না?”
“একফোঁটা স্যাকরিফাইস যদি করতো নিজেকে ধন্য মনে করতাম।”
“যাদিদের স্যাকরিফাইস গুলো আমি বলি?”
“যাদিদ কোনো স্যাকরিফাইস করেনা। আর যদি করেও থাকে যাদিদের স্যাকরিফাইস গুলো তুমি কি করে বলবে?”
“বলি তারপর মিলিয়ে দেখো।”
“বলো।”
“প্রথমত, ছেলেটা বিয়ে করে মাত্র ৫ দিন পর নতুন বউকে রেখে চলে গেছে। এটা অনেক বড় একটা পেইন। ধরো একজন মানুষ কোথাও চলে যাচ্ছে। যাকে বা যাদেরকে রেখে যাচ্ছে তারচেয়ে বেশি পেইন যে চলে যাচ্ছে তার। যাদেরকে রেখে যাচ্ছে তাদের কাছে একটা শূণ্যস্থান তৈরি হচ্ছে। আর যে চলে যাচ্ছে সে নিজেই শূণ্য হয়ে যাচ্ছে। এটা তার একটা স্যাক্রিফাইস।
তিরা চুপ। তার কাপের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কাব্য চা শেষ করে কাপটা রেখে আবার বলল,
দ্বিতীয়ত, সে প্রতিদিন তার বউয়ের অভিযোগ শোনে। এরচেয়ে বড় স্যাক্রিফাইস আর কী হতে পারে বলো? আমি যতদূর জানি ডিফেন্স অফিসাররা বিয়ের পর প্রথমেই তার স্ত্রীকে ধৈর্য ধরতে শেখায়। তারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবসময় স্বামীকে কাছে পাবেনা এটা বোঝায়। যাদিদ কি এরকম কিছু তোমাকে বোঝায়নি?”
“বিয়ের পরেও বলেছে, আগেও বলেছিল।”
“তাহলে তো যাদিদ আরো এডভান্স। বিয়ের আগেই তোমাকে সব ধারনা দিয়ে রেখেছিল। তবুও তুমি রিয়াক্ট করো। তুমি বললেনা মাঝেমাঝে তুমি চেঁচাতে থাকো আর সে চুপ থাকে, ড্যাম কেয়ার?”
“হ্যাঁ।”
“যখন সে খারাপ ব্যবহার করে, সেটা তার নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে রাগ দেখানো। টিট ফর ট্যাট। কিন্তু যখন সে ফোন বন্ধ করে রাখে বুঝে নেবে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা, পাছে রাগ দেখিয়ে ফেলে তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। গিভ সাম রেস্পেক্ট যে সে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায় না। আর যখন চুপ থাকবে বুঝে নেবে সে তার রাগ কন্ট্রোল করে রাখছে, ফোন বন্ধ করে তোমাকেও টেনশন দিচ্ছে না। সো প্লিজ গিভ হিম লাভ। এটা তার একটা স্যাক্রিফাইস। এই স্যাক্রিফাইস টা শুধুই তোমার জন্য। তোমার বয়স কম বোঝো কম সেজন্য। সে কিন্তু এইক্ষেত্রে নিজের দিকটা একটু কম ভেবে তোমার দিকটা বেশি ভাবছে।”
কাব্যর কথাগুলো শুনে তিরা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কতবার সে এই বিষয়ে যাদিদকে ভুল বুঝেছে। আরশি তিরার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“আরে পাগল কাঁদিস না।”
কাব্য হাতের ইশারায় আরশিকে থামিয়ে বলল,
“ওকে কাঁদতে দাও।”
আরশি থেমে গেল। কাব্য তিরার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
“তৃতীয়ত, যাদিদ সদ্যবিবাহিত একজন শক্ত-সামর্থ্য পুরুষ। তার একটা ফিজিক্যাল নিড আছে। তার সেটাকেও কন্ট্রোল করে রাখতে হয়, এটাও তার একটা স্যাক্রিফাইস।”
তিরার কান্না আরো বেড়ে গেল। কাব্য বলল,
“চতুর্থত, ডিফেন্স অফিসাররা জব করেন না, তারা সার্ভিস করেন। তারা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, নিজের বাড়ি, ভালোবাসার সবকিছু ছেড়ে নিজের জীবন বাজি রেখে তারা চলে যায় দেশের জন্য সার্ভিস দিতে। এটা তাদের সবচেয়ে বড় স্যাক্রিফাইস যেটা মানুষের চোখেই পড়েনা, যেটাকে সবাই স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু এটা তাদের জন্য অনেক কষ্টের। টাকাপয়সা তো যেকোনো জবেই পাওয়া যায়, ব্যবসা করেও কামানো যায়। তাহলে তারা ডিফেন্স সার্ভিস কেন করতে যায় ভেবে দেখেছো কখনো? আমি নেভিতে দুবার ট্রাই করেছি দুবারই ট্রেনিং এর সময় বাদ পড়েছি। কী পরিমাণ কঠিন ট্রেনিং করানো হয় ইউ কান্ট ইমাজিন। শুধু নেভি কেন প্রত্যেক ডিফেন্সেই প্রচন্ড কঠিন ট্রেনিং দেয়া হয়। ডিফেন্স অফিসারদেরকে দেখলে আমার ভেতর থেকে একটা আলাদা সম্মান আসে। মনে হয় এরা তো ওই ট্রেনিং উতরে যাওয়া মানে নিজের আবেগ, অনুভূতি, মরার ভয় সবকিছুকে হার মানাতে পারা কোনো বীর। দে আর আওয়ার রিয়েল হিরো। শুধু এই জন্য হলেও প্লিজ রেস্পেক্ট হিম, লাভ হিম এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ড হিম। শুধু হাইট আর বডি দেখে ক্রাশ খেলেই হবেনা মিসেস তিরা মেহজাবিন। ধৈর্য সহকারে যাদিদের ছুটির জন্য অপেক্ষা করুন। ওই দিনগুলোতে দেখবেন এই বদরাগী মানুষটাই কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। স্বর্বপ্লাবী ভালোবাসা তখন আপনিও দেখাবেন।”
শেষ কথাটা বলে কাব্য হেসে ফেলল। তিরা এবার কাঁদতে কাঁদতেই ছুটে চলে গেল নীচে। আরশি উঠে পেছন পেছন যাচ্ছিলো, কাব্য হাত ধরে থামালো। ততক্ষণে আরশি সিঁড়িঘরের কাছে চলে গিয়েছিল। কাব্য বলল,
“এখন যাদিদকে কল করবে, সরি বলবে। এসবের মধ্যে তোমার থাকা লাগবে না। তুমি বরং অন্যকারো কাছে থাকো।”
আরশি সিঁড়িঘরে হেলান দিয়ে আশ্চর্য চোখে হেসে বলল,
“ইউ আর আ ম্যাজিশিয়ান।”
“ধুর।”
“সিরিয়াসলি কাল তিরা আসার পর থেকে আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু আমার বোঝানোতে কোনো কাজ হয়নি। এভাবে তো আমিও ভেবে দেখিনি।”
কাব্য আরশির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সিঁড়ঘরের হেয়ালে একটা হাত রাখলো। আরশির খুব কাছে গিয়ে চোখে চোখ রাখতেই সে চোখ নামিয়ে নিল। আকাশে মেঘগুলো সরে যাচ্ছে। মেঘের কন্ট্রোলে চাঁদের আলো কখনো কম কখনো বেশি। কাব্য সেই আলোয় আরশির মুখ দেখে বিমোহিত। কাব্য ডাকলো,
“আরশি।”
“শুনছি।”
“আমার চোখে তাকাও।”
আরশি তাকালো এবং সবসময়ের মত আবারো নার্ভাস হয়ে পড়লো। কাব্য বলল,
“নার্ভাস অর ডিসকমফোর্ট?”
আরশি চোখ নামিয়ে ঢোক গিলে বলল,
“জাস্ট নার্ভাস।”
“কেন?”
আরশি মাথা নেড়ে বলল,
“জানিনা।”
আরশির আবার সেই দম বন্ধ করা অনুভূতি হতে লাগলো। কাব্য বলল,
“যদি তোমার কেউ দূরে চলে যায়, তুমিও বোনের মতো পাগলামি করবে?”
আরশি কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি করি?”
“তার যদি রাগ হয়? সে যদি ফোন বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে তখন কি বুঝতে পারবে নাকি ভুল বুঝে ভাববে তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য করেছে?”
“সে এমনটা করবেই না। সে আমাকে সবচেয়ে বেশি বোঝে। যতটা এই পৃথিবীর আর কেউ বোঝেনা।”
কাব্য মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,
“জানো কতবড় একটা কথা বলেছো? বুকটা ফুলে ফেঁপে এক আকাশ সমান হয়ে গেল।”
আরশি তাকিয়ে রইল। খুব খুশি লাগছে তার। কেন যেন অনেক অনেক দিন পর তার চোখ ভিজে আসতে চাইছে। সে হঠাৎ দ্রুতপায়ে নিচে নেমে গেল।

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩৪

“আমাকে মাফ করে দাও যাদিদ। সত্যিই আমি সবসময় শুধু নিজের কথা ভেবেছি। তোমার দিকটা কখনো ভাবিনি আমি।”
“আচ্ছা তিরা আর কতবার এক কথা বলবে? সন্ধ্যায় তো মাফ চাইলে। এখন আবার? আমি তোমার দূরের কেউ নই, এত মাফ চাইতে হবেনা আমার কাছে। তুমি যদি পাগলামি কমাও, ধৈর্য ধরে থাকো আর আমাকে একটু বুঝতে পারো তাহলে আমরা খুব সুখী হতে পারব।”
“আমি আর কোনো পাগলামি করব না। সবকিছু বুঝব দেখো।”
যাদিদ হেসে বলল,
“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন একদম কান্নাকাটি না। হাসো তো একটু।”
“হাসলেও তুমি দেখতে পাবেনা।”
“পাব। আমি তিরাকে সবসময় দেখি।”
তিরা হাসলো। যাদিদ বলল,
“এইতো সুন্দর লাগছে। এবার লক্ষী মেয়ের মত আমার কথা শোনো।”
“বলো।”
“তুমি আগামীকাল খুলনা চলে যাবে।”
“আর কিছুদিন থাকি যাদিদ। এখানে আরশির সাথে সময় খুব ভালো কাটে।”
“হ্যাঁ সেজন্যই তুমি যেতে চাওয়ামাত্রই আমি যেতে দিয়েছি। কিন্তু তিরা বাবা মা ওখানে একা। আমার আর কোনো ভাইবোন থাকলে হয়তো তোমার উপর এত চাপ থাকতো না। কিন্তু যেহেতু নেই, বাবা মায়ের সব দায়িত্ব তোমাকে আমাকেই নিতে হবে। দুদিন তো থাকলে। আবার কিছুদিন পর গিয়ে থেকো। এখন ফিরে যাও প্লিজ।”
তিরার আবার মন খারাপ হয়ে গেল। যাদিদ জানে সে বাবা মায়ের কোনো খেয়ালই রাখতে পারেনা, উল্টো তারাই তিরার খেয়াল রাখে তবুও যাদিদ জোর করছে। যাদিদ সবসময় নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। যাই হোক, মানুষটাকে বোঝার প্রতিজ্ঞা যখন নিয়েছ তখন যত কষ্টই হোক চেষ্টা সে করবে। পরদিন সকালের বাসেই তিরা খুলনা চলে গেল।

রশ্নি আরশিকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। ভালোভাবে পিনও মারা হয়েছে। আরশি ঘরের ভেতর কয়েকবার হেঁটে দেখলো হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা। অসুবিধা না হলেও অস্বস্তি হচ্ছে। আরশি হুট করে বলে বসলো,
“আচ্ছা ভাবি শাড়ি টা খুলে যাবে না তো আবার?”
রশ্নি হেসে বলল,
“এত নার্ভাস কেন তুই? কোনোদিন তো তোকে এত নার্ভাস হতে দেখিনি।”
“ভাবি লজ্জা লাগছে আমার। তার সামনে এভাবে গেলে চোখ দুটো দিয়ে গিলে খাবে আমাকে। তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই যদি?”
রশ্নি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল,
“বাসা চেনে তো? কোলে তুলে নিয়ে আসতে পারবে?”
“ধ্যাত ভাবি!”
“তুই একটা পাগল আরশি। ছেলেরা তো দেখবেই। এটাই তাদের ন্যাচার। সামনে যাবি প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগবে, পরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ভাবি আমি না ওকে বলিনি শাড়ি পরব। আমি বরং খুলে ফেলি। জামা পরে যাই। শাড়ি পরা আমার কর্ম না। রাস্তার লোকজন কী ভাববে বলো?”
“কিছু ভাববে না। এমনকি কেউ খেয়ালই করবে না। শাড়ি ভিনগ্রহের পোষাক না সোনা। বাংলাদেশী পোষাক, সব মেয়েরাই পরে। এবার বেশি কথা না বলে গয়নাগুলো পরে নে।”
“না গয়না পরব না।”
“একটু সাজলিও না৷ গয়নাও পরবি না। একদম সাদামাটা লাগবে।”
“সেটাতেই আমাকে স্বাভাবিক লাগবে ভাবি। শাড়ি পরেছি এটাই অনেক।”
“তাহলে চুলটা অন্তত খোলা রাখ।”
“ঠিকাছে, তোমার এই কথাটা রাখলাম।”
রশ্নি হাসলো। কাব্যর ফোন আসতেই আরশি রশ্নির থেকে দূরে গিয়ে ফোন ধরল,
“বলো।”
“উবার ডেকেছি। গাড়ি অলরেডি বাসার নীচে পৌঁছে গেছে, আমি রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে উঠব। তুমি নামো।”
“আচ্ছা।”

রাস্তায় মাথায় যেতেই আরশি কাব্যকে দেখে ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলল। কাব্য বাইরে থেকে অতটা খেয়াল করল না। গাড়িতে উঠতেই হলুদ শাড়ি পরা আরশিকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। হা করে চেয়ে রইলো। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। আরশি আড়চোখে কাব্যকে দেখছে। কাব্য এবার চোখ ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। দুহাতে ঠোঁট চেপে ধরে হাসলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার নিজেই নিজের চুল টানলো। খুশিতে, উত্তেজনায় সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। আবার আরশির দিকে তাকালো। আরশি আড়চোখে তাকানো বন্ধ করল। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছে। ভাগ্যিস বসে আছে নাহলে যে কী হতো! কাব্য বলল,
“ধন্য আজ কাব্য।”
আরশি মুচকি হেসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তবে এটা পরে নিক।”
কাব্য প্যাকেট খুলে দেখে নীল রঙের পাঞ্জাবি। সাথে সাথে শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো৷ আরশি অবাক হয়ে বলল,
“এখানেই?”
কাব্য হেসে বলল,
“সো হোয়াট! একজন অসম্ভব সম্ভব করল।”
“যদি তাই তাহলে সেই একজনটা তুমি।”
কাব্য আবার হাসল। আরশি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। কাব্য শার্ট খুলে পাঞ্জাবি পরে নিল। তারপর আরশির একদম কাছে গিয়ে বসলো।
“আরশি।”
“বলো।”
“খুব খুশি হয়েছি, খুব। আমার মনে পড়েনা এত খুশি আমি শেষ কবে হয়েছিলাম!”
আরশি হাসলো। খুশিটা সে কাব্যর চোখেমুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কাব্যকে এত খুশি দেখে তার নিজেরও খুব খুশি লাগছে। কিছুক্ষণ পর কাব্য ফিসফিস করে বলল,
“তোমার হাতটা ধরতে দেবে?”
আরশি কাব্যর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“এমনভাবে অনুমতি চাইছো যেন আগে কখনো ধরোনি!”
“এখন যেভাবে ধরতে চাই সেভাবে ধরতে অনুমতি লাগে আরশি।”
আরশি এবারো তাকালো না। মুচকি হেসে বলল,
“অনুমতি দিলাম।”
কাব্য আরশির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। তারপর আরশির হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের হাতের আঙুলগুলো রাখলো। তারপর হাতটা ভালোভাবে ধরল। আরশির হাতটা উপরের দিকে রেখে সেই হাতে চেয়ে রইলো। তারপর বলল,
“কি অন্যরকম লাগছে না?”
“হ্যাঁ।”
“ভালো লাগছে?”
“হ্যাঁ।”
“কিরে ভাই সবকিছুতেই দেখি হ্যাঁ বলছো!”
আরশি হাসলো। কাব্য বলল,
“ধরে থাকব এভাবে?”
“হ্যাঁ।”
“ছেড়ে দেব?”
“না।”
“যাক তাহলে বোঝা গেল যে তুমি র‍্যান্ডমলি হ্যাঁ বলছিলে না!”
আরশি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল।

চলবে..

কনফিউশন পর্ব ৩১+৩২

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩১+৩২

বেশকিছুদিন ধরে তিরার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ঠিকমতো খেতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে যাদিদ তার মাকে বলেছে তিরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। তিরা যেতে চাচ্ছিলো না কিন্তু শাশুড়ী জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো। কোনো রোগ নেই তার, শরীর দুর্বল। ডাক্তারের কাছে গেলে কী হবে? যাদিদের কাছে গেলেই ঠিক হয়ে যেতো সব। অবশ্য মাঝেমাঝে তার মনে হয় মানসিক ডাক্তারের কাছে গেলে সম্ভাবত কাজ হবে। পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেছে সে। তার ইদানীং মনে হয় যাদিদ যাদিদ করেই সে মরবে। রাত্রেবেলা শুয়ে থেকে যাদিদের ফোনের অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে মাঝরাতে তিরা নিজেই ফোন করলো। প্রথমবার রিসিভ হলো না, দ্বিতীয়বারও রিসিভ হলো না। এবার খানিকটা চিন্তাই হচ্ছিলো। তিরা একটানা ফোন করতেই লাগলো। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে ঘুমন্ত কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“হ্যালো তিরা।”
তিরা খানিকটা অবাক হয়ে বললো,
“তুমি ঘুমুচ্ছো যাদিদ?”
“হুম।”
“হাও ইজ ইট পসিবল?”
যাদিদ চোখ ডলতে ডলতে বললো,
“হোয়াট?”
তিরা রেগে গিয়ে চিৎকার করলো,
“তুমি আমার সাথে কথা না বলে কী করে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে? তুমি জানো প্রতিদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি। তোমার সাথে কথা না বললে আমার ঘুম আসেনা।”
যাদিদের মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হলো। কিন্তু সে তিরাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“আই ওয়াজ টায়ার্ড তিরা। প্রতিদিনই তো আমি সময়মতো ফোন করি। ঘুমানোর আগে অনেকক্ষণ কথা বলি৷ একদিন নাহয় কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়েছি তাই বলে তুমি এভাবে রিয়াক্ট করবে?”
“অবশ্যই রিয়াক্ট করবো। তুমি জানো আমি তোমার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ঘুমুতে পারিনা। আমি জেগে বসে রয়েছি তোমার ফোনের অপেক্ষায়। আর ওদিকে তুমি নাক ডেকে ঘুমুচ্ছো! একবার আমার কথা ভাবলে না? আমার সাথে কথা না বলে তোমার ঘুম আসে কীভাবে? আমি তো ভাবতেই পারছি না।”
যাদিদ এবার সত্যি অবাক হলো৷ রাগের চেয়ে বেশি যেটা হলো সেটা হতাশা।
“তিরা তোমার আমার সম্পর্ক কি শুধুই ফোনে কথা বলার?”
“যাদিদ ত্যাড়া কথা বলবে না। এতোটা স্বার্থপর তুমি ছি!”
এবার যাদিদ একটু কঠিন হলো,
“শোনো তিরা সম্পর্ক যদি শুধুই ফোনে কথা বলা আর দেখা করার হয় তাহলে এই সম্পর্ক রাখার দরকার নেই৷ ইউ ক্যান ডিভোর্স মি।”
এবার তিরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো,
“এতবড় কথাটা তুমি বলতে পারলে যাদিদ?”
“এছাড়া আর কি বলবো? একদিন কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়েছি, এই ছোটো ব্যাপারটাকে তুমি এতবড় ইস্যু করে ফেলেছো যে ঘুম থেকে উঠিয়ে চেচামেচি করছো আমার সাথে। ইটস হার্টিং মি। তুমি কথা না বলে ঘুমাতে পারো না এটা তোমার সমস্যা, আমার তো এধরনের সমস্যা নেই। বিয়ের পর থেকে শুধু অভিযোগই শুনে যাচ্ছি। আমি কি কোনো অভিযোগ করেছি? তুমি শুধুই নিজেরটাই বোঝো তিরা। উল্টোপাশের মানুষের অবস্থা সম্পর্কে বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই। তোমার একদম উচিৎ হয়নি এখন বিয়ে করা। তোমার এখন রমরমা প্রেম করার সময়। রমরমা প্রেম মানে বোঝো? মানে হচ্ছে সারারাত কারো সাথে কথা হবে, প্রতিদিন দেখা হবে। এমনটা চাই এখন তোমার।”
তিরা চিৎকার করে উঠলো,
“যাদিদ মুখ সামলে কথা বলো।”
ওদিকে যাদিদও চিৎকার করলো,
“শাট আপ, আগে নিজেকে সামলাও স্টুপিড গার্ল।”
যাদিদ ফোন কাটলো এবং বন্ধ করে রেখে দিলো। তিরা আবার ফোন দিলো, বারবার ফোন দিলো। কিন্তু ফোন বন্ধ। তিরা কান্নায় ভেঙে পড়লো। যাদিদের কাছে থেকে এরকম ব্যবহার মেনে নিতে পারছে না। সে যাদিদের বিয়ে করা বউ। এই বাজেকথা গুলো না বললেই কি হতো না? বিয়ের পরের প্রথম ৫ দিনের যাদিদ আর এই যাদিদ কি এক মানুষ?

যাদিদ ফোন বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো। রাগে মাথাটা এতো গরম হয়ে রইলো যে সারারাতে আর ঘুমাতে পারলো না। রুমে ফিরে নিজের কাপড়টাও বদলায়নি সে, রাতে খায়নি পর্যন্ত। ভেবেছিলো তিরার সাথে কথা বলা শেষ করে তারপর খাবে। কিন্তু তিরাকে ফোন করবে বলে বিছানায় শুয়ে ফোন হাতে নিয়েই ঘুম। কখন ঘুমিয়েছে নিজেই টের পায়নি। এরপর ফোনটা হাত গড়িয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলো। এজন্যই তিরা এতোবার কল দেয়ার পরেও প্রথমে টের পায়নি যাদিদ। তিরার ব্যবহারে আজ সত্যিই হতাশ সে। একটা মেয়ে যে তার বিয়ে করা বউ, সে কেন তাকে বুঝতে পারবে না? ঘুম কীভাবে একটা অপরাধ হয়? ভালোবাসার মানুষ ঘুমালে তো বরং শান্তি লাগার কথা। সে তো তিরার দিকটা বুঝে বিয়ের পর থেকে প্রতিদিন তার অনেক পাগলামি সহ্য করে এসেছে, তাহলে তিরা কেন একদিন তার দিকটা বুঝতে পারবে না?

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩২

রশ্নি রান্না করছিলো। আরশি পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাবি আমাকে একটা হলুদ শাড়ি কিনে দেবে? সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ বানিয়ে দিতে হবে।”
শাড়ি আরশি নিজেও কিনতে পারে। কিন্তু রশ্নিকে বললে সে যে খুশিটা হবে সেটা মিস করতে চায় না আরশি। ননদের কথা শুনে রশ্নি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“তুই শাড়ি পরবি?”
“হুম।”
“সত্যি! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।”
আরশি হাসলো৷ রশ্নি বলল,
“আজ বিকেলেই যাব শাড়ি কিনতে।”
“আচ্ছা।”
রশ্নির যেন তর সইছিল না। দুপুরে খাওয়ার পরেই তৈরি হতে লাগলো। আরশি বলল,
“এত তাড়া নেই তো ভাবি।”
“অবশ্যই তাড়া আছে। ব্লাউজ বানাতে হবে না?আমার কতদিনের শখ তোকে শাড়ি পরা দেখব! যা যা তৈরি হয়ে নে।”

আরশি একটা বাদামী পাড়ের হলুদ শাড়ি কিনলো। তারপর ব্লাউজ বানাতে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে ননদ ভাবি দুজনে মিলে শাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। ঠিক তখন রশ্নি বলল,
“আমি কিন্তু আজও জানলাম না ছেলেটা কে?”
আরশি বুঝেও না বোঝার ভান করল,
“কোন ছেলেটা?”
রশ্নি হেসে বলল,
“যার জন্য অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে।”
আরশি হেসে বলল,
“হবে কেউ একজন।”
“আমি জানতে পারি না?”
“জানাব। যেদিন সে তার ভালোবাসার কথা আমাকে বলবে সেদিন আমি তোমাদের সবাইকে জানাব। তার আগ পর্যন্ত সে নাহয় শুধু আমার ভেতরেই থাকুক।”
“ঠিকাছে তোর যখন ইচ্ছে হবে বলিস। আমি অপেক্ষায় থাকব।”

তিরা আরো একটা নির্ঘুম রাত পার করে সকালে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই ফোনটা এলো। কাব্য ফোন করেছে। তিরা ফোন ধরে বলল,
“একী! এ কে ফোন করেছে আমাকে?”
“তোমার আব্বাজান।”
তিরা হেসে বলল,
“তা আব্বাজান হঠাৎ মেয়েকে মনে পড়ল?”
“আমি সুইডেন চলে যাচ্ছি।”
“ওমা তুমি আবার বিদেশে যাবে কেন?’
“পিএইচডি করতে।”
“বাবা রে এত পড়াশোনা করে কী করবে?”
কাব্য হেসে বলল,
“নাথিং।”
“আমার তো গ্রাজুয়েশন টাও আর করতে ইচ্ছা করে না।”
কাব্য আবারো হেসে বলল,
“আচ্ছা শোনো যে কারণে ফোন দিয়েছিলাম সেটা বলি।”
“বলো।”
“যাওয়ার আগে একবার দেখা হলে ভালো হতো না? এসোনা একবার ঢাকা। তুমি আমি আরশি আবার একসাথে, বেশ মজা হবে।”
“আরশিও অবশ্য অনেকবার আমাকে বলেছিলো ঢাকা যাওয়ার জন্য।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো, দুজন মানুষের কথা তো আর ফেলে দেয়া যায় না। চলে এসো।”
“কবে যাবে তুমি?”
“এই মাস এবাড়িতে আছি। এরপর বাসা ছেড়ে কক্সবাজার চলে যাবো। নেক্সট মান্থের লাস্ট উইকে ফ্লাইট। শেষ কদিন তো বাড়িতেই থাকতে হবে।”
“আচ্ছা তার মানে আসলে এই মাসেই আসতে হবে।”
“হ্যাঁ।”
“আমার অবশ্য কোনো পিছুটান নেই। গেলেই যেতে পারি। আমার স্বামী সংসার এসব হচ্ছে নামকোবাস্তে!”

আরশি সকালে গাছে পানি দিতে দিতে কাব্যর জানালায় উঁকি দিলো। কাব্য বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আজ অফিস নেই নাকি! আরশি হাতে পানি নিয়ে কাব্যর মুখে ছিটিয়ে দিলো। কাব্য সাথে সাথে চোখ মেলে তাকালো। ঘুম চোখে আরশিকে জানালায় দেখে হাসলো। বলল,
“গুড মর্নিং।”
“গুড মর্নিং। এখনো ঘুমুচ্ছো যে অফিস নেই?”
“আজ ছুটি নিয়েছি, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে।”
“সেকী! জ্বর নাকি?”
“নাহ।”
“এদিকে এসো দেখি।”
কাব্য উঠে হাই তুলতে তুলতে জানালার কাছে গেলো। যেহেতু বাসাটা একটু উঁচু, ওদিকে আরশি দাঁড়িয়ে আছে বাগানে নিচুতে তাই কাব্য হাটু গেড়ে বসলো। আরশি জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে কপালে হাত দিল। এরপর বললো,
“জ্বর নেই তো।”
“আমি জানি।”
“ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।”
“তোমার বাগানের কাজ শেষ?”
“নাহ। শেষ করে আসছি, বই নেব।”
“ওকে।”

কাব্য ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। চা বসিয়ে প্যানকেক বানানোর প্রস্তুতি নিলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আরশিকে দেখা যায়। সে এখন বিভিন্ন গাছের মাটি নিড়িয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো একটা খোঁপা করা কিন্তু সামনে কিছু চুল বেড়িয়ে এসে বারবার চোখের উপর পড়ছে। আরশি বারবার মাটিমাখা হাতের উল্টোপিঠের সাহায্যে চুলগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। কাব্য একটা শিষ দিতেই আরশি তাকালো। ইশারায় জানালার কাছে আসতে বলল। আরশি ওই অবস্থাতেই জানালার কাছে এসে বলল,
“কী?”
কাব্য জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে অবাধ্য চুলগুলোকে আরশির কানের পাশে ভালো করে গুঁজে দিল। আরশি আচমকা কেঁপে উঠলো, সুড়সুড়ি লাগলো কিন্তু কিছু বলল না। ভাললাগাটা খুব বেশিই ছিলো। কাব্য বলল,
“যাও কাজ শেষ করে এসো।”
আরশি কাজ করতে করতে ভাবছিলো কাব্য এতো খেয়াল করে কীভাবে? সারাক্ষণই কি তাকিয়ে থাকে তার দিকে?
আরশি কাজ শেষ করে সোজা কাব্যর রান্নাঘরে চলে এলো। কাব্য বলল,
“আচ্ছা এইযে তুমি হুটহাট আমার বাসার ভেতরে চলে আসো তোমার ভয় করে না?”
“তোমাকে কীসের ভয়?”
“ভয় আমাকে না, ধরো ভাবি যদি দেখে ফেলে?”
“দেখে ফেললে কিছুই হবে না, বলে দেব সব। আর আমার আসাতে যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে সরাসরি বলতে পারো। আর আসবো না।”
কাব্য শেষ প্যানকেকের গোলাটুকু হাতের সাহায্যে প্যানে ঢেলে দিলো। তারপর মাখা হাতটা আরশির গালে মুছে দিয়ে বলল,
“আসতেই হবে। সকাল বিকেল বারবার।”
আরশির মনে হলো এক্ষুণি তার দমবন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আবার দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
“এহহে এটা কী করলে?”
কাব্য কেকের গোলাগুলো আরশির গালে লেপ্টে দিতে দিতে বলল,
“স্পেশাল গালকেক!”
আরশি এবার হেসে ফেলল। কাব্য বলল,
“অবশ্য বেক হওয়ার জন্য গালটাকে গরম করতে হবে।”
আরশি কাব্যর হাতের বাহুতে থাপ্পড় মেরে বলল,
“অসভ্য কোথাকার।”
কাব্য হেসে বলল,
“কেন আমি কি বলেছি আমি গরম করব?”
“উফফ।”

আরশি এবার প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। বেসিনের সামনে গিয়ে গালটা ধুতে ধুতে ভাবছিলো,
“কি দারুণ হতো যদি এই স্পেশাল গালকেকটা ধুয়ে না ফেলতে হতো? যদি সারাজীবন রেখে দেয়া যেতো!”

কাব্য দুজনের জন্য চা ও প্যানকেক ট্রেতে সাজিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। আরশি তখন বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু দিয়ে গাল মুছছে। কাব্য বলল,
“এসো আমার সাথে খাও একটু।”
আরশি পিরিচ দিয়ে চা ঢেকে রেখে একটা প্যানকেক তুলে নিল। কামড় দিয়ে বলল,
“তুমি প্যানকেক জিনিসটা এতো ভাল বানাও কী করে বলোতো?”
“কাব্য খেতে খেতে বলল,
“প্রাকটিস। আচ্ছা আজ কী বই নেবে?”
“হিমুর বই, তুমি বেছে দাও। নীলপদ্মর মতো ভাল বই দেবে। কি পিচ্চি পিচ্চি বই! একসাথে কয়েকটা দাও।”
“যোহুকুম।”
কাব্য খেতে খেতেই বইগুলো বের করল। আরশি কোনোমতে চা শেষ করেই বলল,
“আচ্ছা আমি উঠি। বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আরশি বইগুলো নিয়ে চলে গেল। কিন্তু কাব্য তখনো আরশির গালে কেকের গোলা লেপ্টে দেয়ার মুহুর্তটায় বুঁদ হয়ে রইলো!

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ২৯+৩০

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৯+৩০

সেদিনের পর আরশি ও কাব্যর মধ্যে দূরত্ব মোটেও বাড়েনি বরং দুজনের ভেতরকার দুরত্ব যেটুকু ছিলো তারও খানিকটা যেন কমে এসেছে। তবে কয়েকমাস পর আরশির পরীক্ষা শুরু হওয়ায় কথাবার্তা কমে এসেছে। আরশি সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাতে ঘুমানোর আগে একবার কথা হয় শুধু৷ আজ আরশি পড়তে পড়তেই হঠাৎ কাব্যকে খুব মিস করতে লাগলো। কয়েকদিন হয়ে গেছে দেখা হয়নি, এখন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। পড়ায় আর মন বসাতে পারছে না। এক্ষুনি একবার দেখা করতেই হবে। কিন্তু রাত বাজে ন’টা। এখন কীভাবে দেখা করবে! এতো রাতে কী বলে বাইরে যাবে ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো কিছু বলেই যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ভাবী আমরিনকে ঘুম পাড়াচ্ছে, ভাইয়া তাদের ঘরে টিভি দেখছে। এখন কাউকে না বলেই চলে যাওয়া যাবে, ঘর লক করা দেখলে সবাই ভাববে সে ভেতরে বসে পড়ছে। রাতের খাবারের আগে কেউ ডাকবে না। কাব্যকে দেখে ফিরে আসা ১০ মিনিটের ব্যাপার মাত্র। কেউ টেরই পাবে না। আরশি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো এবং চোরের মত বেরিয়ে চলে গেলো নিচে।

কাব্য অফিস থেকে ফেরার সময় বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েছে। মাথা ধুয়ে কাপড় পাল্টে এক মগ চা নিয়ে বসেছে, কয়েক চুমুক খেতেই কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে আরশিকে দেখে কিছুটা চমকে গেলো কাব্য।
“আরে এতো রাতে তুমি?”
“ভেতরে আসতে বলো আগে, তারপর জিজ্ঞেস করো। কেউ দেখে ফেললে মিথ্যে বলতে হবে।”
কাব্য সরে দাঁড়াতেই আরশি ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর চায়ের দিকে চোখ পড়তেই বললো,
“চা খাচ্ছো, আমাকেও দাওনা একটু।”
“একটু বসো আমি বানিয়ে আনছি।”
“আরে বানাতে হবেনা। একটা কাপ নিয়ে এসো, এখান থেকেই একটু নেই।”
“এটা আমার খাওয়া চা।”
“তাতে কী? বিষাক্ত হয়ে গেছে ওটা?”
কাব্য হেসে কাপ আনতে চলে গেলো। কাপ আনতেই আরশি মগ থেকে অর্ধেক চা ঢেলে নিলো। এরপর বললো,
“এতো রাতে এসেছি একটা বিশেষ কারণে।”
“কী কারণ?”
“পড়তে পড়তে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। এখন ব্রেক দরকার, ভ্যারিয়েশন দরকার। তাই একটা গল্পের বই নিতে এসেছি।”
“পরীক্ষার মধ্যে গল্পের বই পড়বে?”
“হ্যাঁ ছোটো কোনো বই যা দুই তিন ঘন্টায় শেষ করে ফেলা সম্ভব। আগামী দুদিন আমার কোনো পরীক্ষা নেই।”
“ও আচ্ছা। ঠিকাছে নাও যেটা পছন্দ।”
“উহু তুমি সিলেক্ট করে দাও, ভাবছি তোমার হিমু পড়বো। কোনটা পড়া যায় বলো তো।”
“সিরিয়াসলি তুমি হিমু পড়বে? হিমু না তোমার সবচেয় অপছন্দের চরিত্র?”
“হ্যাঁ কিন্তু তুমি তো জোর দিয়ে বলেছিলে আমি নিশ্চয়ই হিমুর ভালো কোনো বই পড়িনি বলে হিমুকে ভালো লাগেনি। অথচ হিমু নাকি হুমায়ুন আহমেদ স্যারের অসাধারণ একটা চরিত্র। দাও দেখি ভালো লাগার মতো একটি বই।”
কাব্য হেসে বললো,
“দিতে পারি তবে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“যদি তোমার হিমুকে ভালো লাগে তাহলে তোমার হলুদ রঙের শাড়ি পরে আমার সাথে ঘুরতে যেতে হবে। আর আমি পরব নীল পাঞ্জাবি। তুমি হবে মেয়ে হিমু, আমি হবো ছেলে রূপা। রাজী?”
“না, আমি শাড়ি পরিনা।”
কাব্য মৃদু হেসে তাকিয়ে রইলো। আরশি চোখ ফিরিয়ে নিলো।

কাব্য হাসতে হাসতে বুকসেল্ফের কাছে চলে গেলো। আরশি পেছন থেকে অপলক চোখে দেখছে কাব্যকে। ইদানীং আরশির প্রায়ই মনে হয় কাব্যর চেয়ে হ্যান্ডসাম এন্ড কিউট ছেলে পৃথিবীতে আর একটিও নেই। কাব্যর কত ছবি যে আরশির ফোনে সেভ করা আছে এবং প্রতিদিন কতবার তা দেখা হয় তা যদি কাব্য জানতো লজ্জায় মরে যেতো আরশি।
কাব্য একটি বই এনে আরশির সামনে রাখলো। বইটির নাম ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’। আরশি বইটি হাতে নিলো, উল্টেপাল্টে দেখে আবার চায়ে মনোযোগ দিলো। এখন আর কাব্যর দিকে তাকানো যাবে না। কারণ সে এখন হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই ছেলেটাকে লুকিয়ে দেখা ছাড়া উপায় নেই। দেখা হলেই সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকে, যেন এই পৃথিবীতে আর কিছু দেখার নেই তার।

চা শেষ হতেই আরশি বললো,
“আমি এখন আসি কাব্য। কাউকে কিছু না বলে এসেছি।”
আরশি দরজার কাছে যেতেই কাব্য বললো,
“এই বইটা ভুলে রেখে যাচ্ছো।”
“ভুলে না ইচ্ছে করেই রেখে যাচ্ছি কারণ হিমুকে ভাল লেগে গেলে শাড়ি পরতে পারবো না।”
কাব্য হেসে বললো,
“তোমার অস্বস্তি হয় এমন কোনো কিছুতেই আমি কখনো জোর করি আরশি? আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম।”
আরশি বইটা নিতে নিতে বললো,
“তোমার শাড়ি অনেক পছন্দ তাইনা?”
কাব্য বইটা আরশির হাতে দিতে দিতে বললো,
“হুম। বাদ দাও ওসব। আপাতত এই বইটা পড়ো। পরীক্ষা শেষে হিমুর আরো কিছু বই দেবো।”
“আচ্ছা, এখন আসি।”
আরশি চলে গেলো। কাব্য দরজায় দাঁড়িয়ে আরশির চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। এতো মুগ্ধতা কেন এই মেয়েটার ভেতরে?

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৩০

কাব্য আগামী মাসে সুইডেন চলে যাচ্ছে, স্কলারশিপ পেয়েছে সে। সুখবরটা পেয়ে আরশির যতটা খুশি হওয়ার কথা ছিলো ততোটা হতে পারেনি সে। কাব্যর কাছে খুশি প্রকাশ করলেও খবরটা শোনার পর থেকেই তার মন খারাপ। আজকাল কাব্যকে ছাড়া একটা দিন কল্পনা করতে পারেনা সে। সে চায়নি কাউকে এতোটা ভালোবেসে ফেলতে আবার আটকেও রাখতে পারেনি নিজেকে। আজ আরশি ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে দেখে আকাশে মেঘ জমেছে, কাছেই হয়তো কোথাও ঝুমবৃষ্টি হচ্ছে। গাছ থেকে ঝরে যাওয়া মরা পাতাগুলো বাতাসে ছুটোছুটি করছে। এমন মেঘলা আবহাওয়া দেখে হঠাৎ করেই কাব্যর জন্য মন কেমন করে উঠলো তার। খোলা রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাব্যর হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করছে। যদিও সেটা কখনোই সম্ভব না। রাস্তা পার করার সময় কদাচিৎ তার হাত ধরে কাব্য, সেও এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে থাকে যেন একা রাস্তা পার হতে জানেনা। কিন্তু কাব্য কি পারে না পুরো রাস্তাটা তার হাত ধরে হাঁটতে?

কাব্য নিজের কাজ গুছিয়ে ফেললো। আজ সে হাফবেলা ছুটি নিয়েছে। কাল থেকে আরশির মেডিকেল কলেজ বন্ধ থাকবে। তাই সে বাসা থেকে বের হবে না। যেহেতু বাইরে দেখা হওয়া বন্ধ তাই আজকে একসাথে লাঞ্চ করে একসাথে বাসায় ফিরতে চায় কাব্য। কিন্তু সে ফোন করার আগেই আরশি ফোন করলো।
“হ্যালো কাব্য।”
“বলো আরশি।”
“তুমি কি ব্যস্ত?”
“তেমন না, কেন বলোতো।”
“তুমি ফ্রি থাকলে ঘুরতাম। ওয়েদার ডিমান্ড।”
কাব্য একটু মুচকি হাসলো। তারপর বললো,
“কোথায় আসবো?”
“আমি তোমার অফিসের সামনে আসবো?”
“তুমি উল্টো এতদূর আসবে কেন? ওইদিকেই বরং অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”

সারা বিকেল ঘুরে সন্ধ্যাবেলা যখন রিক্সায় করে বাসায় ফিরছিলো তখন কাব্য বললো,
“আজকে থেকে তো তুমি ফ্রি, হিমুর বাকী বইগুলো পড়ে ফেলো। নীলপদ্ম যখন ভালো লেগেছে, আমি যেগুলো দেবো সবগুলোই ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা আজ গিয়ে নিয়ে নেবো।”
“ঠিকাছে।”
হঠাৎ বৃষ্টি নামতে শুরু করলো, রিক্সাওয়ালা কাব্যর হাতে পর্দা দিতেই কাব্য সেটাকে মেলে দিলো। আরশি বললো,
“চলোনা আজ বৃষ্টিতে ভিজি।”
“ঠান্ডা লাগবে।”
আরশি হেসে বললো,
“ছুটি নিয়ে নিও। আমি নিয়মিত সেবা করতে যাবো।”
“কী সৌভাগ্য! কিন্তু আমি আপনার ঠান্ডা লাগার কথা বলছি ডাক্তার আপা।”
“কলেজ বন্ধ, এই ফাঁকে একটু ঠান্ডা লাগলে ক্ষতি কী?”
কাব্য হেসে পর্দা সরিয়ে দিলো, হুড ফেলে দিলো। বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো দুজনে। কিছুক্ষণ পর রিক্সাও ছেড়ে দিলো। হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরলো।

বাড়ি ফিরে দেখে বিদ্যুৎ নেই। কাব্য তার মোবাইলের টর্চ জ্বেলে ধরলো, আরশি উপরে উঠে গেলো। আরশি উপরে যাওয়ার পর কাব্য ঘরে ঢুকলো। কাপড়ও পালটানোর সুযোগ পেলো না তার আগেই আবার দরজায় টোকা পড়লো। দরজা খুলে দেখে আরশি দাঁড়িয়ে৷ কাব্য অবাক হয়ে বললো,
“কী ব্যাপার? ভেজা কাপড়ে আবার ফিরে এলে যে?”
“বাসায় কেউ নেই। আমার কাছে চাবিও নেই। ভাবিকে ফোন করলাম। ভাবি তাদের বাসায় গিয়েছিলো। ফিরছে এখন, কাছাকাছি চলে এসেছে।”
“ও আচ্ছা, তাহলে ভেতরে এসে বসো।”
আরশি ভেতরে ঢুকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাব্য বললো,
“বসো না।”
“কোথায় বসবো? সব ভিজে যাবে।”
“আরে ধুর, ভিজলেই কী?”
“না বসবো না, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।”
“আচ্ছা তাহলে কাপড় পালটাবে? আমার পাঞ্জাবি তোমার ফিট হবে, পরতে পারো।”
আরশির খুব ইচ্ছে করছিলো কাব্যর পাঞ্জাবি পরতে। কিন্তু তারচেয়ে বেশি লজ্জা করছিলো। বললো,
“দরকার নেই, ভাবি এক্ষুণি চলে আসবে।”
“আচ্ছা আলোর ব্যবস্থা করি তাহলে।”
কাব্য ভেতরে যাচ্ছিলো। আরশি সাহস করে কাব্যর হাত ধরে থামালো। বললো,
“আবছা আলো ভালো লাগছে।”
“মোম জ্বালাই অন্তত। তোমাকে দেখতেই তো পাচ্ছি না।”
এ কথায় আরশি লজ্জা পেয়ে হাতটা ছেড়ে দিলো। কাব্য মোম জ্বালিয়ে দিলো। কিন্তু মোমটা জ্বালানো বোধহয় ভুল হলো। মোমের আলোয় ভেজা কাপড়ে, ভেজা চুলে আরশিকে ঐশ্বরিক কোনো দেবীর মতো লাগছে। আরশির এই রূপে কাব্য এলোমেলো হয়ে গেলো। কাছে গিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
আরশির খুব অদ্ভুত লাগছে। সে চাইছিলো আরো কিছুক্ষণ কাব্যর সাথে থাকতে। সে চায় কাব্য তাকে দেখুক। অথচ এখন যখন কাব্য তাকে দেখছে, তার চোখ তুলে তাকাবার সাহস হচ্ছেনা। প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। কেন এমন হয়? কাব্য হঠাৎ বললো,
“আরশি তাকাও আমার দিকে।”
আরশি তাকিয়ে সাথে সাথেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। কাব্য বললো,
“তুমি কখনো আমার চোখের দিকে তাকাও না কেন বলোতো? সবসময় চোখে চোখ পড়লেই চোখ ফিরিয়ে নাও!”
“কই না তো।”
কাব্য আরশির গালে হাত রেখে মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“দেখি তাকাও।”
আরশির পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। আবার তাকালো। কিন্তু ওই চোখে তাকালে আরশির যেন কী হয়! সাথে সাথে আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছিলো। কাব্য এবার দুহাতে আরশির মুখটা ধরে বললো,
“প্লিজ তাকাও।”
আরশি আবার তাকালো। দুজন দুজনের চোখে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। আরশি অদ্ভুতভাবে কাব্যর চোখভরা ভালোবাসা আবিষ্কার করলো। কাব্যর কনফিউশন আছে কিনা জানেনা সে তবে আজ থেকে তার আর কোনো কনফিউশন নেই। এই চোখে আরো আগে তাকালো না কেন সে? তাহলে তো আরো আগেই জানতে পারতো কাব্য কতোটা ভালোবাসে তাকে।
কাব্যর ইচ্ছে করছে আরশিকে আরো কাছে টেনে নিতে। সে জানে এই মুহুর্তে সেটা অসম্ভব না। আরশি পাগলের মতো ভালোবাসে তাকে। কিন্তু সে তো খারাপ ছেলে তাই তাকে ভালোওবাসতে হবে খুব সাবধানে। ভালোবাসার সব বহিঃপ্রকাশ তার বেলায় খাটবে না। সে চায়না কোনোভাবে আরশি দূরে সরে যাক। এইযে আরশি তার জীবনের কালো অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জানার পরেও তাকে এতো বিশ্বাস করে, তার চোখে নিজেকে সপে দিয়েছে! একটা খারাপ ছেলের জীবনে এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? কাব্য আরশিকে ছেড়ে দিয়ে সরে গিয়ে বললো,
“ভাবিকে ফোন দাও, দেখো কতদূর এলো।”
আরশি ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগলো। যেন অনেকক্ষণ পর নিশ্বাস নিলো। কিন্তু এতোক্ষণ নিশ্বাস আটকে থাকতেও তার ভালো লাগছিলো। আরো কিছুক্ষণ তার নিশ্বাস আটকিয়ে রাখতে পারলো না কাব্য?
আরশি বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু মাথায় ভুত চাপলো, আবার ফিরে এলো কাব্যকে জড়িয়ে ধরবে বলে। কিন্তু কাব্যর সামনে এসে মনে হলো এটা কাব্যর তরফ থেকে হওয়া উচিৎ। একদিনে অনেক পাগলামি করেছে সে, আর নয়। কাব্য বললো,
“কিছু বলবে?”
“না।”
আরশি বেরিয়ে গেলো। আরশি চলে যাওয়ার পর কাব্যর খেয়াল হলো রশ্নি ভাবি তো এখনো আসেনি। মেয়েটা একা একা উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? এই ভেবে সিঁড়ির দিকে আগাতেই শুনতে পেলো রশ্নি ভাবি দরজা খুলে বলছেন,
“কীরে এতো দেরী হলো? ফোনেও পাচ্ছিলাম না তোকে। বাইরে এতো বৃষ্টি আমি তো খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”
“ফোন চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে ভাবি। বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলাম। পরে দেরি হচ্ছিলো বলে ভিজেই চলে এসেছি।”
“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে নে।”

কাব্য হেসে দিলো। তার মানে রশ্নি ভাবি বাসাতেই ছিলো। আরো কিছুক্ষণ একসাথে থাকার জন্য আরশি মিথ্যে বলেছে!

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ২৭+২৮

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৭+২৮

কাব্য মৃদু হেসে বললো,
“কারণ তনিকা চায় আমি তাকে ফোন করি, সে কেন এসব করছে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু আমি তা করবো না।”
কাব্যর হাসি দেখে আরশির খটকা লাগলো। প্রশ্ন করে বসলো,
“কিন্তু কেন করবে না?”
“কারণ আছে। আমি তনিকাকে ভালোবাসি না এ কথা জানার পর কিন্তু সে তার আত্মসম্মানের কারণেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। সে চলে যাওয়ার পর আমার সাথে আর একবারো যোগাযোগ করেনি। আমার সামনেও আসেনি। কখনো একটা ফোনও করেনি। এরপর শুনলাম সে বিয়ে করেছে। আমি তার এই আত্মসম্মানবোধকে শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু শ্রদ্ধাটা সেদিন চলে গেলো যেদিন সে বিবাহিত হওয়া স্বত্তেও আমার মাকে ফোন করে আমাদের কথা বলে দিলো। এখানেই তো সে তার আত্মসম্মান টা বিসর্জন দিলো। অথচ আত্মসম্মান টা যদি একটু অন্যভাবে বিসর্জন দিতো তাহলে হয়তো আরো সুন্দর সমাধান হতে পারতো। ধরো সেদিন যা ঘটেছিলো তার পরেও সে যদি সব ভুলে ফিরে আসতো, আমি যে তাকে গ্রহণ করতাম এটা সে জানতো। কিন্তু সে আসেনি। সে চাইলে পারতো আরেকটু সময় নিয়ে সবটা গোছাতে। আমি শুধুই নিজের অনুভূতিটুকু তার কাছে ক্লিয়ার করতে চেয়েছিলাম, তাকে ছাড়তে চাইনি। যেহেতু আমাদের সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলো সেহেতু আমি তাকে বিয়েও করতাম। সব বিয়েতে ভালোবাসা জরুরি নয়। কিন্তু সে খুব বিশ্রীভাবে তার আত্মসম্মান টা বিসর্জন দিলো।”
আরশি চুপ। কাব্য একটু থেমে আবার বললো,
“তনিকার প্রেগন্যান্সি চলছে। মনমতো স্বামী পেয়েছে। সে তার মতো করে ভালো আছে, কিন্তু আমি ভালো নেই। কারণ আমার মায়ের মনে অনেক কষ্ট তার ছেলেটা খারাপ বলে। ছোটোবেলা থেকে মায়ের কাছে আমি খারাপই ছিলাম। ক্লাস সিক্স থেকে সিগারেট খাই, কথা শুনিনা, নিজের মতো চলি। একমাত্র মেয়েঘটিত কোনো কেলেঙ্কারি আমার ছিলো না। এবার সেটাও যোগ হয়ে গেলো।”
আরশি চুপ। কাব্য একটু থেমে আবার বললো,
“তনিকা যদি বিয়ের আগে মাকে বলতো তাহলে আমি তার সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাইতাম কেন এমন করলো। কিন্তু বিয়ের পরে যখন বলেছে তখন আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পড়েনি। উত্তরটা আমার জানা।”
“উত্তরটা কী?”
কাব্য আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বলো তো কী হতে পারে?”
আরশি চোখ ফিরিয়ে নিলো। ছাদের কোনায় রাখা ফুলের টবের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বললো,
“ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এসব করেছে। ভুল যেহেতু আমার শাস্তিটা আমি মেনেই নিয়েছি।”
এ কথার পর আরশি আর কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। একসময় আরশি নীরবতা ভাঙলো,
“তোমার এসব কথা কে কে জানে?”
“মা আর তুমি।”
“আন্টিকে তো আর তুমি বলোনি?”
“না তনিকা যতটুকু বলেছে মা শুধু ততটুকুই জানে।”
“দোষ তো তোমার একার ছিলো না কাব্য। আন্টি তো সবটা না জেনে তোমাকে ভুল বুঝছে, তার ভুলটা ভেঙে দিচ্ছো না কেন?”
“জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ ভুল বুঝলে ভুলটা ভাঙাতে ইচ্ছে করে না আমার।”

আরশি খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কাব্য জোৎস্নাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো যার অর্থ আরশি অনেক ভেবেও বুঝতে পারলো না। এই দীর্ঘশ্বাসের কারণ জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করলো না আরশি। জিজ্ঞেস করলো অন্য কথা,
“তার মানে তুমি এসব গোপন কথা শুধু আমাকেই বলেছো?”
“হ্যাঁ।”
“হঠাৎ আমাকে কেন বললে?”
কাব্য এই প্রশ্ন শুনে আবারো আরশির চোখের দিকে তাকালো। আরশি চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকালো। কাব্য বললো,
“যার কন্ঠ শুনে আমার ঘুম ভাঙে, যার সাথে দিনের অনেকটা সময় কাটে, যার কথা শুনতে শুনতে ঘুমাই, তাকে আমার জীবনের অন্ধকার দিকটা জানানোর প্রয়োজন মনে করেছি।”
“তোমার কথায় মনে হচ্ছে আমি তোমার গুরুত্বপূর্ণ কেউ?”
“সন্দেহ আছে?”
“স্পষ্ট উত্তর দাও কাব্য। হ্যাঁ বা না।”
“হ্যাঁ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কেউ। নাহলে এতোকিছু তোমাকে বলতে যাবো কেন?”
“তাহলে যদি কখনো আমি তোমাকে ভুল বুঝি, আমার ভুলটাও ভাঙাবে না?”
কাব্য খুব স্বাভাবিকভাবেই মাথা নেড়ে বললো,
“নাহ।”
আরশি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,
“তুমি তো সাংঘাতিক মানুষ!”
“সেটাও তোমার জানা প্রয়োজন আরশি।”

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৮

তিরা অসময়ে যাদিদের ফোন পেয়ে চমকে উঠলো। যাদিদের জন্য সে আলাদা রিংটোন ব্যবহার করে। এই রিংটোন বাজলেই সে যেখানেই থাকুক পাগল হয়ে ছুটে আসে। ফোন ধরে অবাক হয়ে বললো,
“তুমি এ সময়ে?”
“একটা ভালো এবং একটা খারাপ খবর দিতে ফোন করলাম। যদিও দুটো রিলেটেড।”
“খারাপটা আগে বলো।”
“আমাকে সাবমেরিনে পোস্টিং দিয়েছে।”
“সাবমেরিন না পানির নিচে থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে থাকবে তুমি?”
“সবাই যেভাবে থাকে!”
“পারবে?”
“শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়। আমরা দেশের জন্য সব পারি।”
তিরা মনে মনে বললো,
“আর বৌয়ের জন্য কিছুই পারোনা। বিয়ে কেন করো তোমরা?”
কিন্তু মুখে এ কথা বলার সাহস নেই। বললো,
“এবার ভালো খবরটা দাও।”
“আমার প্রোমোশন হয়েছে। আর সেজন্যই সাবমেরিনে পোস্টিং হয়েছে।”
তিরা বললো,
“এটা! আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আসবে একবার।”
“কীভাবে আসবো? আমাদের কোনো ঈদ নেই, বাবা মা মারা গেলে বা সন্তান জন্ম নিলেও আমরা মুখ দেখতে ছুটে আসতে পারিনা। বিয়ের আগে এই সবকিছুর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছিলাম, তাই না?”
“তখন বুঝতে পারিনি এতোটা খারাপ লাগবে তোমাকে ছাড়া।”
যাদিদ হেসে বললো,
“ঠিকাছে তোমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হলো, এখন থেকে তুমি নিজেকে প্রস্তুত করো।”
তিরার খুব কান্না পেলো। কিন্তু কাঁদলে যাদিদ রেগে যায় তাই তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিলো। আজ হঠাৎ তিরার মনে হলো যাদিদের উপর ক্রাশ খাওয়া এবং এই বিয়ে তার জীবনের অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।

আরশি ছাদ থেকে চলে যাওয়ার আরো কিছুক্ষণ পর কাব্য নিচে গেলো। তার দেবে যাওয়া সোফাটায় অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে রইলো। কোনো বই পড়লো না, একটা সিগারেটও খেলো না। একা একা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলো শুধু। কাব্য কথাগুলো সামনাসামনি বলেছে যাতে আরশির অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারে যে সে ব্যাপার‍টা কীভাবে নিয়েছে। কিন্তু কথাগুলো শোনার সময় সে এতোটাই স্বাভাবিক ছিলো যে কারো বোঝার উপায় নেই তার মনের মধ্যে কী চলছিলো! শুধু একটা জিনিসই কাব্যর চোখে পড়েছে তা হলো লিভ টুগেদারের কথায় আরশি চমকে গিয়েছিলো তবে খুব সামান্য সময়ের জন্য। এটুকুতে কিছুই বোঝা যায় না। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। তবে সব কথা বলতে পেরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাগছে। এবার আরশি ওর জীবনে থাকুক বা দূরে সরে যাক, যেটা হবে সেটাকেই নিজের নিয়তি ভেবে নেবে কাব্য।

আরশি ছাদ থেকে ফিরতেই রশ্নি জিজ্ঞেস করলো,
“বাগানে গিয়েছিলি?”
“না ছাদে।”
“আজ কি সুন্দর জোৎস্না নারে?”
“হুম।”
“আমরিন ঘুমুচ্ছে, এই ফাঁকে নাস্তা বানিয়ে দেই। বল কী খাবি?”
“কিছু খাবো না।”
“শুধু চা খাবি?”
“চাও খাবো না।”
অবাক হলো রশ্নি,
“কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
এ কথা বলে আরশি নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো। রশ্নি বললো,
“কী হয়েছে?”
“কিছু না ভাবি। হঠাৎ ভাল্লাগছে না। আমার কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন।”
রশ্নি জানে বলার মতো কিছু হলে আরশি একবার জিজ্ঞেস করতেই তাকে বলে আর না বলার মতো কিছু হলে একশোবার জিজ্ঞেস করলেও বলে না। তাই আর জিজ্ঞেস করলো না। কাছে গিয়ে আরশিকে বুকে টেনে নিলো রশ্নি। আর সঙ্গে সঙ্গেই টের পেল আরশির শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে যা এতোক্ষণ ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছিলো না।! রশ্নি দরজা লাগিয়ে বের হয়ে গেলেও ভাবতে লাগলো এতো অস্থির হওয়ার মতো কী এমন ঘটেছে?

রশ্নি বের হয়ে যাবার পর আরশি আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলো ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্টে এতোক্ষণ কাব্যর সামনে স্বাভাবিক হয়ে বসে কথা বলছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্থির লাগছিলো তার। শরীরে শক্তি নেই। ভালো-মন্দ সব অনুভূতিগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
কাব্যর আগে গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে এবং তার সাথে শারিরীক সম্পর্কও থাকতে পারে এমনটা আরশি একরকম ভেবেই নিয়েছিলো। কিন্তু ঠিক লিভ টুগেদারের মতো একটা ব্যাপার হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে সে এইসব নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ এটা একে তো কাব্য-তনিকার ব্যক্তিগত ব্যাপার তার উপর অতীত। বরং সে চিন্তিত কাব্যর কনফিউশন নিয়ে। কাব্য কি তার ব্যাপারেও কনফিউজড? নাকি তার ব্যাপারটা আলাদা? যেরকম মেয়ে কাব্যর ভালো লাগে বললো, সেতো ওইরকম না। তার ধারেকাছেও না। তাহলে কাব্যর তাকে কী করে ভালো লাগলো? শুধু ভালো লাগাই না, কাব্যর শেষ কথাগুলো প্রমাণ করে যে কাব্য তাকে ভালোবাসে। তাহলে?
আরেকটা ব্যাপার নিয়েও চিন্তিত আরশি। সেটা হচ্ছে কাব্যর অভিমান। কাছের মানুষ ভুল বুঝলে ভুল ভাঙায় না! কাব্য যে কিছু ব্যাপারে এতোটা চাপা স্বভাবের সেটা এতোদিন বুঝতে পারেনি আরশি। সে নিজে চাপা স্বভাবের, সঙ্গীও যদি অমনই জোটে তাহলে তো ঝামেলা। দুজন দুজনকে ভুল বুঝে বসে থাকবে! তারপর মেটাবে কে?
তবে সব দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে প্রচন্ড রকমের এক ভালো লাগাও কাজ করছে। এক্স গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে এমন কেলেঙ্কারির কথা হবু গার্লফ্রেন্ডকে বলার মতো সাহস সবার থাকে না। কথাগুলো কাব্য নিজে না বললে কখনোই জানতে পারতো না আরশি। সবচেয়ে বড় কথা সে তনিকার দোষগুলো সামনে আনেনি। নিজের দোষগুলোই বলেছে। কাব্যর প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে আরশির। জীবনটা অনেক বড় এবং অনেক জটিল। একটা ভালো প্রেমিকের চেয়ে একটা ভালো মানুষ জীবনসঙ্গী হিসেবে অনেক বেশি শ্রেয়!
এতোদিন আরশি-কাব্যর যে একটা প্রেমবিহীন সম্পর্ক চলছিলো তাতে আরশির একটা সূক্ষ্ণ অপেক্ষা ছিলো, কাব্য কবে তাকে প্রপোজ করবে সেই অপেক্ষা। কিন্তু আজ আরশি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে কাব্য যদি প্রপোজ করে তবে সে তাকে সময় নিতে বলবে। কাব্য সময় নিয়ে সব কনফিউশন দূর করে তবে সামনে আগাক। তবে কাব্য বুদ্ধিমান ছেলে, সে হুট করে প্রপোজ নাও করতে পারে। তাই সে যদি নিজ থেকেই সময় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাতেও আপত্তি নেই। আরশির কোনো তাড়া নেই।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ২৫+২৬

0

কনফিউশন
পর্ব ২৫+২৬

সেই যে আরশি ভোরবেলা কাব্যর সাথে হাঁটতে বের হলো, এরপর থেকে সে আর নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখে না। প্রতিদিন আমরিনের সাথে খেলে, বাগানে যায়, ছাদে যায়। কদিন পর মেডিকেলে ভর্তি হলো। এরপর কী যেন হলো! প্রতিদিন কাব্যর সাথে কোনো না কোনো উসিলায় তার দেখা করা হতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আরশি মাঝেমাঝে কোনো উসিলা বের না করে অপেক্ষা করতো, কাব্য কী করে সেটা দেখার জন্য। এবং সেদিন কাব্য নিজেই উসিলা বের করে দেখা করতো। আরশির কী যে ভালো লাগতো! হতো অনেক গল্প। বেশিরভাগ গল্প হতো বই নিয়ে। এখন আরশি অনেক সহজ হয়ে গেছে কাব্যর সাথে। তার সাথে যতো কথা বলে তত কথা বোধহয় রশ্নি বা তিরার সাথেও বলেনি কখনো! কাব্যকে কিছু বলতে পারলে আর কাব্যর সবকথা শুনতে পারলেই যেন পার্থিব সব শান্তি মিলে যায় আরশির। এখন তাদের বাইরেই দেখা হয় বেশি। আরশি কাব্যকে তুমি করে বলে এখন। কাব্যর ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট। বিদেশে হায়ার স্টাডিজের জন্য স্কলারশিপের চেষ্টা করছে। ততদিন আগের চাকরিটাই করছে, তবে এখন ফুলটাইম করে। কাব্য প্রতিদিন অফিস থেকে বের হয়ে ফোন করে আরশিকে। আরশি বাইরে থাকলে একসাথে বাসায় ফেরে। এমনই একদিন রিক্সা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে কাব্য হঠাৎই জিজ্ঞেস করেছিলো,
“আরশি আমি তোমার তুমি হবো কবে?”
আরশি সেকথায় প্রথমে চমকে গেলেও পরে মৃদু হেসে বলেছিলো,
“তুমি হওয়াটা কি খুব জরুরি?”
“জরুরি নয়, তবে তুমি করে বললে আমার ভালো লাগবে। আমার মনে হয় তোমারও ভালো লাগবে। আমি না বললে তো কখনো তুমি বলবে না, তাই আমি বললাম।”
এরপর থেকে আরশি কাব্যকে তুমি করে বলে। প্রথমে কিছুদিন আপনি তুমি গুলিয়ে যেতো, এরপর একসময় তুমিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের কথা সবসময়ই মাথায় ঘোরে কাব্যর, নিজের অনুভূতি নিয়ে এখনো সে কনফিউজড, আরশি এবং সে দুই মেরুর মানুষ এটাও সে জানে তবুও কীভাবে যেন দুজন দুজনার কাছে চলে আসছে। যদিও সম্পর্কটা এখনো শুধুই বন্ধুত্বের। কিন্তু আরশি সামনে আসলে কাব্য নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। তখন সে কী বলে কী করে নিজেও জানেনা। আবার সামনে না আসলেও আনার জন্য উতলা হয়ে যায়। আরশিও সমানভাবেই উতলা হয় তার জন্য। এটা সে বোঝে। খুব ভালোও লাগে তার। যেহেতু এই সম্পর্কের দড়ি তার হাতে নেই, কেবল এগিয়েই চলেছে আপন গতিতে সেহেতু সম্পর্কটা অন্যদিকে মোড় নেয়ার আগেই সে আরশির কাছে নিজেকে পুরোটা তুলে ধরতে চায়। আরশি যদি তার সাথে নিজের জীবন জড়াতে চায় তাহলে পুরোটা জানা উচিৎ তার। পরে জানলে হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করেও সে এখনো পর্যন্ত তনিকার কথা বলতে পারেনি। সময় সুযোগ হয়ে উঠছে না।

যাদিদ যখন তার ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো, তখন ঘুমে চোখ বুঝে আসছে। কেবলই মনে হচ্ছিল এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ুক। কিন্তু একদিন ফোন না করলে অস্থির হয়ে যায় তিরা তাই বাধ্য হয়েই ফোন করলো। তিরা যেন মোবাইল হাতে তার অপেক্ষায় বসে থাকে। সবসময় একবার রিং হতেই ধরে ফেলে। সবসময়ের মতো আজও হুড়মুড়িয়ে বললো,
“হ্যালো।”
“হ্যালো, কেমন আছো?”
“যাদিদ ছাড়া তিরা কখনো ভালো থাকবে না।”
যাদিদ হেসে বললো,
“তোমার একটা ঘরজামাই বিয়ে করা দরকার ছিলো।”
“চুপ থাকো।”
“চুপ থাকলে ঘুমিয়ে পড়বো।”
“খেয়েছো?”
“হুম। তুমি?”
“পরে খাবো।”
“ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো। বাড়ি ফিরে যদি দেখি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছো, না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে তাহলে কিন্তু আরেকটা বিয়ে করবো।”
এ কথা শুনে তিরার মাথা গরম হয়ে গেলো। রেগেমেগে বললো,
“খুন করে ফেলবো তোমাকে তাহলে।”
যাদিদ হেসে বললো,
“তখন তো একটুও পাবেনা।”
“আমি না পেলে কাউকে পেতে দেবো না।”
যাদিদ এবার জোরে হেসে দিলো। তিরা বললো,
“সামনে থাকলে তো হাসো না, এখন এতো হাসি কোত্থেকে আসছে।”
“সামনে থাকলে তো এরকম পাগলের মতো রাগ দেখাও না, তাই এতো হাসি না।”
“আমার রাগ দেখে তোমার হাসি পায়?”
“পায়।”
“রাখলাম আমি।”
“রাখলে কিন্তু আর কলব্যাক করবো না, ঘুমিয়ে পড়বো।”
“তুমি এমন কেন যাদিদ?”
“কেমন?”
“বাদ দাও। কবে আসবে তুমি?”
“দেরি আছে রে বাবা। এক কথা কতোবার জিজ্ঞেস করবে?”
“আমার তোমাকে ছাড়া ভাল্লাগে না।”
যাদিদ আবার হেসে বললো,
“মাত্র ৫ দিন একসাথে থেকেই এই অবস্থা?”
“৫ টা দিন ইম্পরট্যান্ট নয়, আমার লাইফটা চেঞ্জ হয়ে গেছে তোমার সাথে বিয়ে হয়ে।”
“অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে বউরা এতো পাগল হয় আগে জানতাম না তো। ডিফেন্সের লোকদের কোনো পিছুটান থাকতে নেই। এজন্য ডিফেন্সে ঢোকার পর একটা প্রেমও করলাম না। অথচ আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করা বউই কিনা প্রেমিকাদের মত পাগলামি করছে! হায় আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।”
“এসব কী বলছো তুমি? তোমার তো খুশি হওয়া উচিৎ যে তোমার বউ তোমার জন্য পাগল।”
“আমি কখনোই চাইনা তুমি আমার জন্য পাগল হও। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো, এবার মন দিয়ে পড়াশোনা করো। ক্যারিয়ার গড়ো, এনজয় ইওর লাইফ। একটা মেয়ে কেন একটা ছেলেকে এতোটা গুরুত্ব দেবে যে তার অনুপস্থিতিতে মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে?”
“তুমি আমার ভালোবাসা চাও না?”
“চাই। যখন আমি বাড়ি থাকবো উজার করে ভালোবাসবে, যেমনটা আমি বেসেছি ওই ৫ দিন। কিন্তু যখন দূরে থাকবো কোনো পাগলামি চাইনা তিরা।”
“তাহলে এরপর যখন আসবে আমার পেটে একটা বাবু দিয়ে যাবে। একঅটা ছোট্ট যাদিদ আসবে। এরপর ওকে নিয়ে আমার সময় কেটে যাবে।”
“শিট! তিরা কী বলছো? তোমার এখন পড়াশোনা করার বয়স, বাচ্চা পালার বয়স হয়নি। পড়াশোনা শেষ করবে এরপর বাচ্চা নেবো।”
“আমি তাহলে এতদিন থাকবো কীভাবে?”
“বিয়ের আগে যেভাবে থাকতে।”
তিরার মনে পড়ে গেলো সে কীভাবে বিয়ের আগে উঠতে বসতে সকাল সন্ধ্যা ক্রাশ খেতো। কিন্তু এখন তো কাউকে ভালোই লাগে না। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ শুধু যাদিদ ঘোরে। এ কেমন ভালোবাসার জালে বন্ধী হয়ে গেলো সে? তিরার এতো অসহায় লাগছিলো যে সে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো। যাদিদ বললো,
“তিরা তুমি কি পণ করেছো প্রতিদিন ফোন রাখার আগে কাঁদবে? আর কতোবার বলবো কান্নাকাটি ভাল্লাগেনা আমার।”
“আমি জানিনা কীভাবে এতো ভালোবেসে ফেললাম তোমাকে।”
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি তিরা কিন্তু বাস্তবকে আমাদের মেনে নিতে হবে। এমন যদি হতো তুমি কাঁদলেই আমি চলে আসতে পারবো তাহলে নাহয় কাঁদতে, আমি মানা করতাম না। কিন্তু ব্যাপারটা তো এমন না। ওই একটা বাৎসরিক ছুটি ছাড়া আমাদের আর কোনো ছুটি নেই। তাই কান্নাকাটি করো না প্লিজ। তুমি কান্নাকাটি করলে আমার দূরে থাকাটা কষ্টকর হয়ে যাবে।”
যাদিদের মুখে ভালোবাসার কথা শুনলে এতো শান্তি লাগে তিরার কিন্তু ছেলেটা বলে না। আজকের মত অনেকদিন পর একদিন হঠাৎ বলে। অথচ তিরা প্রতিদিন বলতে থাকে৷ এমন কেন ছেলেটা?

বিকেলে আরশি পড়ছিলো এমন সময় কাব্যর ফোন এলো। ফোন ধরতেই কাব্য বললো,
“আরশি হেল্প মি।”
“কী হেল্প?”
“তুমি ডিম ভাজতে পারো?”
“না পারার কী আছে?”
“আমাকে একটা ডিম ভেজে দিয়ে যাবে প্লিজ?”
“ডিম তো তুমি নিজেই ভাজতে পারো!”
“এই মুহুর্তে পারছি না বলেই তোমাকে বলছি।”
আরশির মনে হলো এটা ওকে দেখার জন্য কাব্যর বানানো এক উসিলা। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। দ্রুতই সে বের হলো। এই উসিলাগুলো খুব ভালোবাসে আরশি! রশ্নিকে বাগানে যাবে বলতে গিয়ে দেখে সে আমরিনকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাই আর বলা হলো না। চলে গেলো নিচে।

কাব্যর ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো। আরশি ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে কাব্য বললো,
“আমি এখানে।”
আরশি সোজা রান্নাঘরে চলে গেলো। গিয়ে দেখে পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে কাব্যর হাত কেটে একাকার অবস্থা। ছুরি, চপিং বোর্ড রক্তে মাখামাখি। আরশি কাব্যর হাতের দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠে বললো,
“এতোখানি কাটলে কী করে?”
“মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছি। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে, তাড়াহুড়ো করছিলাম।”
“রান্নাবান্না করোনা? আর কিছু নেই খাওয়ার?”
“কাল বিজি ছিলাম, রাঁধতে পারিনি।”
“ফার্স্ট এইড বক্স আছে নাকি আমি নিয়ে আসবো?”
“আমি পরে ব্যান্ডেজ করে নেব, আগে খেয়ে নিই।”
“হাত থেকে এখনো রক্ত পড়ছে কাব্য।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আনতে হবেনা, ফার্স্ট এইড বক্স আমার আলমারিতেই আছে।”
আরশি দ্রুত পায়ে কাব্যর ঘরে ঢুকলো, পেছন পেছন কাব্য ঢুকলো। কাব্য বললো,
“ডান পাশের কাবার্ডের ২য় তাকে দেখো আছে।”
আরশি যখন আলমারিটা খুললো কাব্য তখন তার পাশেই দাঁড়ানো। ফার্স্ট এইড বক্সটা সরাতেই পেছনে একটা শাড়ি চোখে পড়লো আরশির। সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে শাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কাব্যর আলমারিতে শাড়ি কেন সেটা বুঝতে পারছেনা কিছুতেই। কাব্য কিছুটা ইতস্ততবোধ করলো। আরশি নিজের বিস্ময় লুকিয়ে বক্সটা নিয়ে বিছানায় বসলো। বললো,
“তাড়াতাড়ি এসো রক্ত পড়ছে।”
কাব্য চেয়ার টেনে আরশির সামনে বসলো। আরশি চুপচাপ কাব্যর হাত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলো। কাব্য বললো,
“শাড়িটা কার জানতে চাও না?”
আরশি না তাকিয়েই বললো,
“আমি জেনে কী করবো?”
“সত্যিই জানতে চাও না?”
“না। হবে হয়তো কারো।”
“আমি জানাতে চাই।”
“তাহলে বলো।”
“শাড়িটা কারো নয়, একজনের জন্য কিনেছিলাম। তাকে আর দেয়া হয়নি।”
কেন যেন আরশির বুকের ভার নেমে গেলো। বললো,
“ওহ আচ্ছা।”
“যার জন্য শাড়িটা কিনেছিলাম তার কথা তোমাকে বলতে চাই।”
আরশি হেসে বললো,
“তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের মা?”
কাব্য মৃদু হেসে বললো,
“ব্যাপারটা সিরিয়াস আরশি।”
“আচ্ছা শুনবো। কিন্তু তোমার তো ক্ষুধা লেগেছে, আগে খেয়ে নাও। ডিম টা আগে ভেজে দেই।”
এটা বলে আরশি রান্নাঘরে চলে গেলো। কাব্য গেলো পেছন পেছন। আগেও যতবার কাব্য বলতে চেয়েছে ততবার আরশিকে কেউ ডেকেছে অথবা আরশি অন্য কথা বলে কাব্যর বলার মুড নষ্ট করে দিয়েছে। এবার বলতেই হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আরশি ডিম ভাজছে। কাব্য পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“তোমার হাতে সময় আছে এখন?”
“না। অনেক সময় দরকার?”
“ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।”
“তাহলে রাতে ফোনে শুনিও।”
“না, ফোনে না। সামনাসামনি বলতে হবে।”
“তাহলে সন্ধ্যার পর ছাদে এসো, আজ জোৎস্নারাত।”
“আচ্ছা।”
আরশি প্লেটে ভাত আর ডিমভাজি নিয়ে কাব্যর হাতে দিয়ে বললো,
“আমি এখন আসি।”
“আচ্ছা।”

আরশি উপরে গিয়ে একটা বাটিতে মাছের তরকারি নিয়ে আবার নিচে গেলো। এবার দরজা লাগানো। বেল বাজাতেই কাব্য এঁটো হাতে দরজা খুললো। আরশি বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নাও।”
“আরে ধুর লাগবে না আরশি।”
“স্পেশাল কিন্তু, কলাপাতায় রেঁধেছি।”
কাব্য মুচকি হেসে বাটিটা নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে বললো,
“সরষে দিয়েছো?”
“হুম।”
“অস্থির ঘ্রাণ।”
আরশি হেসে বললো,
“খাও, আমি গেলাম।”
“সন্ধ্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কোনোভাবে ক্যান্সেল যাতে না হয় প্লিজ।”

চলবে…

কনফিউশন
পর্ব ২৬

আরশি ঘরে ঢুকে বুকে বালিশ চেপে বসে রইলো। ভয়ঙ্করভাবে বুক কাঁপছে তার। কাব্য কী বলবে? কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এক্স গার্লফ্রেন্ডের কথা বলবে। কাব্যর মতো ছেলের এক্স থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই এক্সের কথা সে আরশিকে বলতে চাচ্ছে এটা অস্বাভাবিক। তাহলে কি কাব্য কোনো সম্পর্কে যাওয়ার আগে পুরোনো সব বলে নিতে চায় যাতে পরে ঝামেলা না হয়? এ কথা ভাবতেই আরশির প্রচন্ড ভালো লাগলো। কাব্যর অনেক বদ অভ্যাস আছে এটা ঠিক কিন্তু সব ছাপিয়ে এই ছোটো ছোটো গুণগুলোই যে বারবার মুগ্ধ করে ফেলে আরশিকে!

যাক অবশেষে তনিকার কথা আরশিকে বলার সুযোগ পাওয়া গেলো। ফোনে বলার সুযোগ হয় অহরহ। কিন্তু কাব্য সামনাসামনি বলতে চায়। সব শুনে আরশির প্রতিক্রিয়া দেখতে চায় কাব্য। যেটা ফোনে বললে সেটা সম্ভব না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে এ কথাই ভাবছিলো কাব্য। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বিকেল থেকে সন্ধ্যা হতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছে। অপেক্ষা করা মুশকিল, যতটুকু হালকা লাগছে ততটুকুই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আরশি হয়তো এখন তাকে একরকম ভাবছে। তনিকার কথা শোনার পরে আরেকরকম ভাববে। তা ভাবুক। কাব্য যেমন মানুষ, তেমনটা স্পষ্ট থাকা উচিৎ আরশির কাছে।

সন্ধ্যার পর রশ্নি ও আরশি দুজনে একসাথে বসে চা খেলো। এরপর আরশি ছাদে গেলো। যেহেতু আরশি প্রায়ই ছাদে বা বাগানে হাঁটে তাই রশ্নি আর এ ব্যাপারে ভাবলো না। ছাদে যেতে যেতে আরশি কাব্যকে ফোন করতেই সে চলে এলো। আরশি বললো,
“এতো তাড়াতাড়ি এলে কীভাবে?”
“বাগানে ছিলাম।”
“ও আচ্ছা।”
আরশিদের ছাদে ছোটো একটা বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানেই বসলো দুজন। কাব্য বললো,
“আজকের চাঁদটা সুন্দর।”
“হ্যাঁ।”
জোৎস্নার ভেসে যাওয়া আলোয় শুভ্রের মতো আরশিকে দেখে কাব্য বিমোহিত হয়ে গেলো। মেয়েটাকে একেক সময় একেক রকম সুন্দর লাগে। এইযে আরশির হাসি হাসি সুন্দর মুখ, এটা তো একটু পরেই মিলিয়ে যাবে। তখন কি জগৎ সংসারের আর কিছু ভালো লাগবে কাব্যর? আজ কি তবে বাদ দেবে তনিকার কথা? কিন্তু আজ তো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলো, আরশিকে বলেছেও সে কথা। তবে কি আরেকদিন বলবে? কাব্য যখন এসব ভাবনায় বিভোর ছিলো তখন আরশি বললো,
“কী ভাবছো?”
“কিছু না।”
“কী যেন বলবে বলেছিলে?”
কাব্য ভাবলো যা হবার হবে, বলে দিক আজ। কাব্য বলতে শুরু করলো,
“হুম বলবো। ভাবছি কোনদিক থেকে শুরু করবো! সব এতো এলোমেলো!”
আরশি হেসে বললো,
“একদিক থেকে শুরু করলেই হয়।”
“আচ্ছা এলোমেলোভাবেই বলি৷ এসব গুছিয়ে বলা সম্ভবও না বোধহয়।”
“বলো।”
“মেয়েটার নাম তনিকা। গতবছর ওর সাথে আমার সম্পর্ক হয়। এর আগে আমার কারো সাথে কিছু ছিলো না, এটাই আমার প্রথম প্রেম বলতে পারো।”
“আচ্ছা।”
“তনিকার সাথে আমার পরিচয় এক বন্ধুর মাধ্যমে। আমাদের বন্ধুদের আড্ডায় আসতো। ছেলেদের সাথেই তার ওঠাবসা বেশি, মেয়েদের সাথে তার যায় না। মেয়েটা প্রচন্ড সাহসী ও জেদি। প্রকাশ্যে সিগারেট খায়, স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড, কোনো ন্যাকামি নেই, ভনিতা নেই, লজ্জা নেই, জড়তা নেই, একদম বোল্ড। আই লাইক দ্যাট টাইপ অফ গার্ল। আড্ডায় আসতো, প্রায়ই দেখা হতো, কথা হতো। এভাবেই ভালো লাগার শুরু। বুঝতাম সেও আমাকে পছন্দ করে। অল্প কয়েক মাসের পরিচয়েই আমাদের প্রেম হয়। পয়েন্ট টু বি নোটেড, আমিই তাকে প্রোপোজ করেছিলাম।”
আরশি হেসে বললো,
“এরকম মেয়ে সিনেমায় দেখা যায়।”
কাব্যও হেসে বললো,
“বাস্তবেও আছে তবে রেয়ার।”
“তারপর কী হলো?”
“মা আমার বেস্টফ্রেন্ড। মার কাছে আমি কিছুই লুকাই না। জীবনের প্রথম একটা প্রেম করছি, লুকানোর তো প্রশ্নই আসেনা। তনিকার ব্যাপারটা মায়ের সাথে শেয়ার করি। মা আবার অতি উৎসাহী। সে তনিকার সাথে কথা বলতে চাইলো। আমি কথা বলিয়ে দিলাম দুজনার।”
“বাহ।”
“ভালোই চলছিলো। তবে ঝামেলাটা হলো কিছুদিন পর। যখন আমরা লিভ টুগেদার শুরু করলাম।”
এবার আরশি চমকে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। কিছু কি বলা উচিৎ? নাকি চুপচাপ শুনে যাওয়া উচিৎ? অবশেষে আরশি বললো,
“কিন্তু আমাদের দেশে দুজন অবিবাহিত ছেলেমেয়ে একসাথে কীভাবে থাকতে পারে? এটা কি সম্ভব?”
“তনিকা হুট করে এসে থাকতে শুরু করে। জেদ ধরে সে যাবেনা। শেষে উপায় না দেখে বাড়িওয়ালাকে বলি বিয়ে করে ফেলেছি।”
আরশি এবার আর কিছু বললো না। কাব্য বলতে লাগলো,
“ধীরে ধীরে তনিকা আমার ব্যাপারে একটু বেশিই ক্রেজি হয়ে যাচ্ছিলো। ব্যাপারটা প্রথমে আমার ভালো লাগলেও পরে অস্বস্তিতে রূপ নিলো যখন সে আমার বাসায় এসে উঠলো।”
“তোমার ফ্যামিলির কেউ কখনো তোমার বাসায় আসতো না?”
“না, কক্সবাজারে বাবার কিছু হোটেল আছে তারই একটার ব্রাঞ্চ ঢাকায় আছে। কেউ এলে সেখানেই ওঠে।”
“ওহ আচ্ছা।”
“সমস্যা ফ্যামিলি বা পারিপার্শ্বিক কোনো দিক থেকে ছিলো না। সমস্যাটা আমাদের মধ্যেই তৈরি হয়েছিলো। কিংবা বলা ভালো আমার মধ্যে।”
আরশি চুপ। কাব্য বললো,
“মাসখানেক একসাথে থাকার পর আমি একটা জিনিস আবিস্কার করলাম তা হলো প্রতিবার ওর সাথে পারসোনাল টাইম স্পেন্ড করার পর আমি খুব বিষণ্ণবোধ করি। তখন আমার কিছু ভালো লাগে না। এরপর থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা করি।”
আরশি এবারো কিছু বললো না। কাব্য বললো,
“ব্যাপারটা তনিকাকে বলবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। সে কষ্ট পাক এটা আমি চাচ্ছিলাম না। সে হ্যাপি ছিলো আমার সাথে।”
আরশি এসবের সাথে পরিচিত না। কি বলবে জানেনা তাই চুপ করেই রইলো। কাব্য বললো,
“কিছুদিনের মধ্যে আরো কিছু জিনিস আবিস্কার করলাম যেমন, তনিকা যখন বাইরে থাকে এবং আমি একা থাকি তখন খুব ভালো থাকি৷ আবার আমি যখন বাইরে থাকি তখনও খুব ভালো থাকি। এরপর আমি ইচ্ছে করে লেট নাইট পর্যন্ত অফিস করতাম বা আড্ডা দিতাম যাতে আমি ফেরার আগে সে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবে আসলে আমি পারছিলাম না। এরমধ্যেই সেমিস্টার গ্যাপ এলো, তখন কক্সবাজার গিয়ে এক মাসের বেশি থাকলাম। এদিকে তনিকা পাগল হয়ে যাচ্ছিলো কবে ফিরব বলে আর আমি ওদিকে অযুহাত খুঁজতে থাকলাম কীভাবে আমার ঢাকা আসা আরো পেছানো যায়।”
আরশি বললো,
“খুবই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“প্রচন্ড।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। এরপর কাব্য বললো,
“যাই হোক, এরপর এক্সাম কাছাকাছি আসায় ঢাকা ফিরতে হলো। কিছুদিন পর আমি যা বুঝলাম তা হলো আমি তনিকাকে ভালোবাসি না, ভালোলাগে ওকে আমার। আর এই ভালোলাগাকেই ভালোবাসা ভেবে ভুল করে ফেলেছি আমি৷ তোমাকে বলেছি প্রপোজ আমি করেছিলাম। ভুলটা যেহেতু আমার সেহেতু এতদিন একসাথে থাকার পর সম্পর্কটা ভাঙতে চাচ্ছিলাম না। আমাদের দেশে অনেক স্বামী স্ত্রী তো ভালো না বেসেও একসাথে থাকে আমিও সেরকমই থাকার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু সেভাবেও আমি পারছিলাম না, হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আমি শুধু এই অভিনয়, পালিয়ে বেড়ানো এসব থেকে মুক্তি চাচ্ছিলাম। তাই তনিকার সাথে সব কথা শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিই। তার সব জানা দরকার। সব শুনে সে যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। সে কো-অপারেট করে থাকতে চাইলে থাকবে, চলে যেতে চাইলে চলে যাবে। তবে আমি সবকিছুর আগে তার কাছে মাফ চেয়ে নেই ভুলটা তো আমারই ছিলো।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী! সব শুনে তনিকা খুব বাজেভাবে রিয়্যাক্ট করে।”
“কিরকম?”
“ভুল বোঝে, রেগে যায়। ওর হাতের কাছে টেবিলে একটা কাচি ছিলো সেটা ছুঁড়ে মারে। ব্রেকাপ করে। তারপর ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়।”
“তোমার গালের কাটা দাগটা কী সেই কাচিতে কাটা?”
“হ্যাঁ।”
“এরপর আর যোগাযোগ করেনি?”
“করেছে তবে আমার সাথে নয়, আমার মায়ের সাথে।”
“আন্টির সাথে কেন?”
“মাকে সব বলেছে। মা আমাকে ভুল বোঝে এখনো। যতোবার দেখা হয় ততবারই সেসব কথা তোলে। তনিকার বিয়ে হয়েছে গতবছরই আমাদের ব্রেকাপের পর। কিন্তু তারপরেও আমার উপর ওর রাগ এখনো মেটেনি। তিরার বিয়ে থেকে আমি সোজা বাড়ি চলে গেলাম না?”
“হ্যাঁ।”
বাড়ি যাওয়ার পর কী হয়েছে তা সব বললো কাব্য। সব শুনে আরশি বললো,
“আন্টিকে কেন সব বললো?”
“জিজ্ঞেস করিনি?”
“কেন?”
কাব্য মৃদু হেসে বললো,
“কারণ সে চায় আমি তাকে ফোন করি, সে কেন এসব করছে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু আমি তা করবো না।”

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ২৩-২৪

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৩-২৪

যাদিদ চলে যাওয়ার সময় তিরা অদ্ভুত এক কান্ড করলো। সে সবার সামনে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো। ওদিকে এই ঘটনায় যাদিদ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। তিরার বয়স কম ঠিকাছে তাই বলে এমন অবুঝপণা করার মতো কম বয়স তো না। সে ডিফেন্সে চাকরি করে তাকে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হবে এমনটাই স্বাভাবিক। এসব জেনেই তিরা তাকে বিয়ে করেছে। তাহলে এখন কেন এসব অবুঝপণা? অন্যদিকে তিরার জন্য তার মায়াও হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই মেয়েটার আশেপাশেই থাকুক সারাক্ষণ! কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব না সেহেতু যাদিদ বাস্তবকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। তিরারও উচিৎ বাস্তবকে স্বীকার করে নেয়া।

আরশির ফোনটা বাজছে, তিরা ফোন করেছে। গতকাল থেকেই কিছুক্ষণ পরপর ফোন করছে কিন্তু আরশির এখন কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। তাই ফোন ধরছে না। কড়কড়ে দুপুরেও আরশি জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে রেখেছে। গত ৭ দিন ধরেই চলছে আরশির এই অন্ধকারবাস। সন্ধ্যা হলেও আরশি ঘরে আলো জ্বালায় না। এর মধ্যেই রশ্নি ঘরে ঢুকে বললো,
“আরশি ঘুমাচ্ছিস?”
আরশি তাকালো না, নড়লো না। যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবে থেকেই বললো,
“না ভাবী এসো।”
“তিরা ফোন করেছিলো আমাকে বলল তোকে নাকি অনেকবার ফোন করেছে? আমাকে বললো খুব নাকি জরুরি কথা আছে তোর সাথে!”
“কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
রশ্নি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ঠিকাছে তাহলে বলতে হবে না। আজকে আমার সাথে বের হবি একটু?”
“না, ভাল্লাগছে না।”
“বের হলে ভালো লাগতো, এভাবে বন্ধ ঘরে থাকলে কোনো চেঞ্জ আসবে না। এর আগেও তো প্রমাণ পেয়েছিস। তারচেয়ে চল কোথাও ঘুরে আসি।”
“ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
রশ্নি জানে আরশি নিজ থেকে এ অবস্থা থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে বের করতে পারবে না। তবুও চেষ্টা না করলে তো মনে শান্তি মেলে না!
“আচ্ছা রেস্ট নে, কিছু লাগলে আমাকে বলিস।”
রশ্নি চলে যাচ্ছিলো। আরশি ডেকে বললো,
“ভাবী শোনো..”
রশ্নি দাঁড়ালো। আরশি বললো,
“বাবুর ডাক নাম রেখেছি আমরিন, আমার নামের সাথে মিলিয়ে। ভালো নাম তোমরা রাখো।”
রশ্নি খুশি হয়ে বললো,
“বাহ খুব সুন্দর নাম তো! আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে।”
“আমরিনকে আমার কাছে দিয়ে যাবে কিছুক্ষণের জন্য?”
রশ্নি একথায় যে কতটা স্বস্তি পেলো তা বোধহয় সে ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না। সে সাথে সাথে গিয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে এলো।

রশ্নি আমরিন কে আরশির কোলে দিয়ে রান্নার অযুহাতে সামনে থেকে সরে গেলো। উদ্দেশ্য আরশিকে কিছুটা সময় নিজের মতো করে ভালো থাকতে দেয়া। কিন্তু রশ্নি অবাক হয়ে দেখলো আরশি আমরিনকে কোলে নিয়েই পর্দা সরিয়ে জনালা খুলে ঘর আলো করে দিলো। তারপর বিছানায় বসে চুপচাপ অনেকক্ষণ কোলে থাকা আমরিনের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলো। আরশির ভাবলেশহীন মুখ দেখে কারো বোঝার সাধ্য নেই সে আমরিনের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে বা আদৌ কিছু ভাবছে কিনা!

রাতেরবেলা আরশি তিরার ফোন ধরলো। তিরা জানে আরশি কেন ফোন ধরেনি। এমন পরিস্থিতিতে আরশি কারো সাথে কথা বলে না তাও সে জানে। আর এটাও জানে আরশির বর্তমান অবস্থার জন্য তার মা দায়ী। তাই ফোন কেন ধরেনি সেসব কথায় আর গেলো না। নিজের কথাই বললো।
“আরু প্লিজ হেল্প মি।”
তিরা কাঁদছিলো, কন্ঠ শুনেই বুঝলো আরশি। এবং প্রচন্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তা নাহয় করলাম কিন্তু তুই কাঁদছিস কেন?”
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। যাদিদকে ছাড়া এভাবে থাকতে পারবো না আমি। কী করবো আমি?”
“বুঝলাম না।”
“যাদিদ গত পরশু চলে গেছে। ওর ছুটি শেষ।”
“ছুটি শেষ বলেই তো এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলো, এটা তো তুই আগে থেকেই জানতি।”
“হ্যাঁ কিন্তু ও যাওয়ার পর এই দুটো রাত আমি একফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। দিনেও ঘুমাতে পারছি না।”
“কি বলছিস তোর তো কখনো ঘুমের সমস্যা ছিলো না!”
“ওকে ছাড়া আমি আর ঘুমাতে পারবো না।”
একথা বলে তিরা আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। আরশি অবাক হচ্ছে কারণ তিরা বড় হয়ে কখনো কিছুর জন্য কাঁদেনি। এতোগুলো ব্রেকাপ হয়েছে কখনো কোনো ছেলের জন্য দুদিনের বেশি আফসোস করেনি কান্না তো দূরের কথা আর আজ সে যাদিদের জন্য এভাবে কাঁদছে! আরশির তো এসব বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাই প্রথমে কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। পরে একটু ভেবে বললো,
“আচ্ছা শোন শান্ত হ, এতোদিন একসাথে ছিলি তো তাই খারাপ লাগছে, ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
“অভ্যাস হবেনা তার আগেই মরে যাবো। এভাবে একটানা না ঘুমালে মানুষ বাঁচেনা, জানিস আমার প্রেশার লো হয়ে কি অবস্থা হয়েছিলো গতকাল? আমি আর ঘুমাতে পারবো না বোন।”
“পারবি, আমি যখন ঘুমাতে পারি তখন তুইও পারবি। শুধু সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে!”
আরশির একথায় আচমকা তিরার কান্না থেমে গেলো। নিজেকে হঠাৎ ভাগ্যবতী মনে হলো কারণ ওর অবস্থা আরশির মতো নয়। সত্যিই তো আরশি ঘুমাতে পারলে তারও পারার কথা। তার মানে সত্যিই শুধু সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে! তিরা বললো,
“তুই ঠিকই বলেছিস। আমি জানতাম তোর কাছে কোনো না কোনো সমাধান থাকবেই। এজন্যই কাল থেকে তোকে জ্বালাচ্ছিলাম।”
“কোনো ঘুমের ওষুধ খাস না আবার। তিন-চার মাইল দৌড়া বা কয়েশো দড়িলাফ দে। ক্লান্ত হলে এমনিতেই ঘুম আসবে।”
“আচ্ছা।”
ফোন রাখার পর আরশি এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো। যে তিরা কখনো কাঁদে না সে যাদিদের জন্য পাগলের মতো কাঁদছে, সেই মানুষটার শূন্যতায় সে ঘুমাতে পারছে না। তার মানে তিরা যাদিদকে ভালোবেসে ফেলেছে। সত্যিকারের ভালোবাসা! এতোদিন শুধু সে প্রেমই করেছে, কাউকে সত্যি সত্যি ভালোবাসেনি। আরশি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেছে, ভালোবাসা কি এমনই উন্মত্ত? একজনের অনুপস্থিতিতে আরেকজনের ভেতর এমনই শূন্যতার সৃষ্টি হয়? কই কাব্যর অনুপস্থিতিতে তার ভেতরে তো কোনো শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি! এমনকি সেদিন ভাবী জিজ্ঞেস করার আগ পর্যন্ত মনেও পড়েনি কাব্যর কথা। তার মানে কি সে কাব্যকে ভালোবাসে তার এ ধারণাটা ভুল? তাহলে সে কাব্যকে এতো গুরুত্ব কেন দেয়? কাব্য তাকে ভালোবাসে বলে? অনেকক্ষণ চিন্তা করলো আরশি, এই প্রথম তার কোনো সমীকরণ মিলছে না!

সমীকরণে আরো গোলমাল লেগে গেলো পরেরদিন। যখন তার নামে একটা পার্সেল এলো। পার্সেলটা খুলতেই সে একটা বই পেলো, অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’। বইটির প্রথম পাতায় লেখা, ‘এক গুণমুগ্ধ নারীর জন্য আরেক গুণমুগ্ধ নারীর এই বইটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা।’
হাতের লেখাটা চিনতে কষ্ট হলো না আরশির। ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইটির ভেতরের বুকমার্কের লেখাগুলো পড়েছিল যে!

‘এক গুণমুগ্ধ নারীর জন্য আরেক গুণমুগ্ধ নারীর এই বইটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা।’
লেখাটায় বারবার হাত বোলাচ্ছে আরশি। এই দুটি বাক্যের ভেতর যেন অনেক না বলা কথা, বলতে চাওয়ার ব্যাকুলতা! না আসলে দুটি লাইনে নয়, দুটি শব্দে.. গুণমুগ্ধ নারী! মুহুর্তেই তার ফর্সা গালে লাল আভা জমে গেলো। কী ভীষণ লজ্জা যে লাগছে! এই মানুষটার সামনে কি আর কখনো যেতে পারবে সে? মানুষটা কি কক্সবাজার থেকে ফিরেছে? ফিরলে সে কি এতোদিন খুঁজেছিলো ওকে? খুঁজলে একবারো ফোন করেনি কেন?

চলবে…

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২৪

পার্সেলটা এসেছিলো বিকেলে। কিন্তু এখন অনেক রাত। ইতোমধ্যে ‘গড অফ স্মল থিংস’ বইটির বেশকিছু অংশ আরশির পড়া হয়ে গেছে কিন্তু এখনো প্রাপ্তিস্বীকার বা ধন্যবাদ দেয়নি। আরশির প্রতি কাব্যর ভালোলাগা তার কাজকর্মে আগে বোঝা গেলেও এই প্রথম সে সরাসরি কিছু বললো। গুণমুগ্ধ শব্দটা সাধারণ কিন্তু শব্দটাকে বিশ্লেষণ করলে তা আর সাধারণ থাকেনা। কাব্য লিখেছে সে আরশির গুণমুগ্ধ এটা ভাবতেই তার কী ভীষণ লজ্জা যে লাগে! যদি কাব্য সামনাসামনি কিছু বলে তখন আরশি কি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে তার সামনে? পরক্ষণেই মনে হলো, সে কি খুব বেশি ভেবে ফেলছে? কাব্য হয়তো শুধুই গুণমুগ্ধ, অন্যকিছু নয়। হয়তো সাধারণভাবেই লিখেছে। সেই অতিরঞ্জিত করে ভাবছে!

আরশি জানালা খুলে নিচে তাকালো, কাব্যর ঘরের লাইট জ্বলছে তার মানে সে জেগে আছে। আরশি ফোন করলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ধরলো। ধরেই হেসে বললো,
“কেমন গেল বার্থডে গার্লের দিন?”
“ভালো। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। এরচেয়ে সেরা উপহার আর হয়না।”
“মাই প্লেজার। জানি বই পেলেই তোমার সবচেয়ে ভালো লাগবে।”
“আপনি আমার জন্মদিন কীভাবে জানলেন?”
“দুপুরবেলা তোমাদের বাসায় যে দারুণ সব রান্নাবান্না হয়েছে তার কিছু অংশ আমার কাছেও এসেছে। ভাবিকে উপলক্ষ্য জিজ্ঞেস করতেই বললো আজ তোমার জন্মদিন।”
“ওহ আচ্ছা।”
“অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়না। বাসায় ছিলে না?”
“ছিলাম। বের হইনি কোথাও।”
“ঘরের জানালাও সবসময় বন্ধই দেখতাম।”
“আলো সহ্য করতে পারছিলাম না কিছুদিন।”
কাব্য অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো রঙ সহ্য করতে পারেনা, এখন আবার আলো! তবে কিছু বললো না। আরশি জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কক্সবাজার থেকে কবে ফিরলেন?”
“যেদিন গিয়েছি সেদিনই ফিরে এসেছি।”
“মাত্র একদিনের জন্য এতোদূর গিয়েছিলেন?”
“না তবে যাওয়ার পর খুব অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। খুব বিরক্ত লাগছিলো তাই চলে এসেছি।”
“একটানা অনেক জার্নি হয়ে গেল!”
“তা গেল অবশ্য। যাই হোক, আমরা কি একদিন দেখা করতে পারি আরশি?”
“হঠাৎ?”
“অনেকদিন দেখা হয়না তাই।”
“সকালবেলা হাঁটতে যাবো, যাবেন?”
“কোথায়?”
“কোথাও না, রাস্তায়।”
“ফোন করে উঠিয়ে দিও।”
“আচ্ছা।”

রশ্নি সকালবেলা সবার আগে উঠে চুলা জ্বালাবে। তাই আরশি চিরকুট টা চুলার উপরে চামচ চাপা দিয়ে রাখলো। চিরকুটে লেখা,
“আমার খুব হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করছে ভাবি। বাইরে হাঁটতে গেলাম। তোমরা ঘুমে তাই জাগালাম না।”
তারপর বেরিয়ে পড়লো। কাব্য তৈরি হয়ে নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আরশি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো কাব্য অবাক হয়ে দেখছিলো৷ এ কদিনে আরশির মুখে বিষণ্ণতা আরো বেড়ে গেছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো সব মিলিয়ে ওকে আগের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। নাকি অনেকদিন পর দেখেছে বলে কাব্যর দুচোখ তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে ভুলভাল দেখছে? নাকি আরশির সব রূপই কাব্যকে মুগ্ধ করে?

এই কাকডাকা ভোরে আরশি কাব্য ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। আরশি বাসা থেকে বের হয়ে এতদূর আসা পর্যন্ত একবারো কাব্যর মুখের দিকে তাকায়নি। কীভাবে তাকাবে, সেই তখন থেকে কাব্য অনবরত ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই ছেলেটার চোখে চোখ রাখার সাহস আরশির নেই। কিন্তু মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে করে। কাব্য বললো,
“সকালটা সুন্দর।”
“হুম।”
“কেউ যদি তোমাকে আমার সাথে দেখে ফেলে?”
“দেখলে কী হবে?”
“কিছুই হবে না?”
“না।”
“না হলেই ভালো।”
“আপনি সিগারেট একদম ছেড়ে দিয়েছেন?”
“কেন বলোতো?”
“গন্ধ পাচ্ছিনা!”
“চেষ্টা করছি। তিনবেলা তিনটা খাই। এছাড়া রাগ উঠলে, টেনশনে পড়লে বা একাকিত্ব অনুভব করলে একটু বেশি খাওয়া হয়। এই আরকি।”
আরশি হেসে বললো,
“আমার মনে হয় আপনি চাইলে ছেড়ে দিতে পারবেন।”
কাব্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আরশির হাসির দিকে। একটা মানুষের মৃদু হাসিই এতো সুন্দর। মানুষটার প্রাণখোলা হাসি কেমন হবে? কাব্য অপেক্ষা করছে আরশি কখন একবার তার দিকে তাকাবে। কাব্য ওই চোখে একবার চোখ রাখতে চায়, ওই চোখের ভাষাটা একবার পড়তে চায়। কিন্তু আরশি একবারো তার দিকে তাকাচ্ছে না।

দুজন একসাথে হাঁটছে কিন্তু তেমন কথা বলছে না। তবুও দুজনেরই খুব ভালো লাগছে। ধীরে ধীরে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। রিক্সা গাড়ী চলতে শুরু করেছে। ভির বাড়তেই আরশি বললো,
“চলুন ফেরা যাক। এক্ষুণি জ্যাম লেগে যাবে।”
“চলো।”

ফিরতে গিয়েই অঘটনটা ঘটলো। রাস্তায় হাঁটার জায়গা কম থাকায় আরশি কাব্য আগেপিছে হাঁটছিলো। আরশি সামনে, কাব্য তার পেছনে। হঠাৎ একটা অটোরিকশা তাদের পাশ দিয়ে এতো বেপরোয়াভাবে গেলো যে আরশির গায়ে ধাক্কা লেগে আরশি পড়ে গেলো। সাথে সাথে কাব্য চিৎকার করে উঠলো,
“এই মিঁয়া চোখ কি বাসায় রেখে আসছো? এতো তাড়া কীসের?”
এদিকে আরশি ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো। যখন চোখ খুললো তখন খেয়াল করলো তার জামার হাতাটা ছিঁড়ে গেছে। সাথে সাথে ওড়না দিয়ে হাতটা ঢেকে ফেললো। সে কখনো ফুল হাতা বা থ্রি কোয়ার্টার হাতা ছাড়া জামা পড়ে না। তাই এই অবস্থায় খুব অস্বস্তি লাগছে।

রিক্সা ততক্ষণে চলে গেছে। কাব্য আরশিকে ধরে উঠালো। একটা বন্ধ চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসিয়ে রিক্সা খুঁজতে লাগলো। কাব্য রিক্সা খুঁজছে, এদিকে ভয়ঙ্করভাবে আরশির বুক ধুকপুক করছে। নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। কাব্য একটু আগে তার হাতের বাহু ধরে তাকে উঠিয়েছে। এই স্পর্শ তাকে মেরে ফেলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

চলবে…

কনফিউশন পর্ব ২১+২২

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২১+২২

খন্দকার বাড়ির সবাই আজ বেশ খুশি কারণ কাব্য আজ অনেকদিন পর বাড়ি এসেছে। তাদের যৌথ পরিবারের সবাই একসাথে বসে খায়। একমাত্র এই ছেলেটা থাকেনা। আজ অনেকদিন পর সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খাবে তারই আয়োজন চলছিলো। সবাই টেবিলে চলে এলেও কাব্য এলোনা বলে আফতাব খন্দকার নিজেই গেলেন ছেলেকে ডাকতে। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখেন কাব্য সেখানে নেই। শাহনাজের কাছ থেকে শুনেছেন সকালে কাব্য এসেছে, সে ঘুমুচ্ছে। এরমধ্যেই আবার কোথায় গেলো? স্ত্রীকে ডাকতে ডাকতে কাব্যর ঘর থেকে বের হলেন তিনি,
“শাহনাজ কোথায় তোমার ছেলে? ঘরে তো নেই।”
শাহনাজ বেগমের বুক কেঁপে উঠলো। তনিকার কথায় কাব্য কি রাগ করে চলে গেলো? তিনি বললেন,
“দাঁড়াও ফোন করে দেখি কোথায় গেলো!”

কাব্যর বাস তখন কুমিল্লা পার করছে। তখনই মায়ের ফোন এলো। সে ফোন ধরে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো,
“বলো মা।”
“তুই কোথায়?”
“কুমিল্লা।”
“ওমা কুমিল্লা কী করিস?”
“ঢাকা যাই।”
“কাব্য! এটুকুর জন্য তুই আমার সাথে রাগ করে চলে গেলি? তোকে শাসন করার অধিকার কি আমার নেই?”
“তুমি শাসন করোনি মা। আর শাসন করার অধিকার তোমার অবশ্যই আছে।”
“এভাবে চলে গেলি একবার ভাবলি না তোর বাবাকে আমি কি বলবো? তুই এসেছিস বলে বাড়ির সবাই আজ কতো খুশি ছিলো!”
“আমি খুশি ছিলাম সকালে।”
“ফিরে আয় বাবা, দুটো দিন থেকে যা। আমি তোর বাবাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করি আপাতত।”
“কেন? আমি চলে আসায় বাবা রাগ করলে আমার উপর করবে তোমার তাতে কী?”
“উফ কাব্য তুই সবার খুশি নষ্ট করছিস।”
“বাবা কল দিচ্ছে কথা বলি। তুমি রাখো।”
মায়ের কল কেটে বাবার কল ধরতেই আফতাব খন্দকার বললেন,
“কী ব্যাপার কাব্য? শুনলাম তুমি বাড়ি এসেছো। তা কোথায় তুমি? খেতে বসবো অপেক্ষা করছি।”
“সরি বাবা আমি ঢাকা যাচ্ছি।”
“এতোদিন পর এলে দেখা না করেই চলে যেতে হলো কেন?”
“আমার বস এক্সিডেন্ট করেছে। খবর পেয়ে হঠাৎ চলে যেতে হচ্ছে। আমি কিছুদিনের মধ্যে আবার আসবো বাবা। সরি ফর টুডে।”
“ঠিকাছে।”
বাবার ফোন কেটে কাব্য আবার চোখ বন্ধ করলো। তার কপালের দুপাশের রগগুলো লাফাচ্ছে। ভেঙে ফেলতে মন চাইছে সবকিছু!

“আমরা হানিমুনে যাবো না?”
যাদিদ টিভি দেখছিলো। তিরার এ কথায় টিভি থেকে চোখ সরিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হানিমুনে যাবো কীভাবে আমার ছুটি শেষের পথে।”
“এখনো তো শেষ হয়নি। চলোনা দুদিনের জন্য কোথাও যাই।”
“না তিরা আর মাত্র দুদিনই ছুটি আছে। তিনদিনের দিন আমি চলে যাবো। শেষ দুদিন আমি আমার ফ্যামিলির সাথে কাটাবো।”
“তার মানে আমাদের হানিমুন হবেনা?”
“হবে। এরপরের ছুটিতে যখন আসবো তখন হানিমুনে যাবো।”
তিরার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। তবে সে আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। শুয়ে পড়লো।

আরশি শুয়ে ছিলো। সে ইদানীং খুব দুর্বল অনুভব করে। গায়ে একফোঁটা শক্তি পায়না। সারাক্ষণ শুয়ে থাকে। উঠে খেতে চায়না, গোসল করতে চায়না, ঘুমায় না৷ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আরশির যখন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা মনে পড়ে বা কেউ মনে করিয়ে দেয় তখন সে এমন হয়ে যায়। এই সময়গুলো রশ্নি একটু বেশি সময় দিতো আরশিকে, বেশি যত্ন করতো। কিন্তু এবার ছোটো বাচ্চা থাকায় অতটা পারছে না। সাহিল অফিস থেকে ফিরলে রশ্নি বললো,
“সাহিল বাবুকে একটু রাখবে আরশি সারাদিন কিছু খায়নি। বাবু যখন ঘুমিয়েছে তখন রান্নাবান্না করেছি। এরপর থেকে সে এতো জ্বালিয়েছে যে আমি আরশিকে খাওয়াবো সেই সুযোগটুকুও পাইনি।”
সাহিল বললো,
“আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে এসে বাবুকে রাখছি। কিন্তু তুমি একটু চাচীকে ডেকে নিতে।”
“আরশিকে এভাবে দেখলে চাচী বিরক্ত হয় সাহিল। নানান কথা বলে, ভালো লাগে না আমার ওসব। মাকে বলেছি কিছুদিন এখানে এসে থাকতে। মা কাল আসবে বলেছে।”
সাহিল রশ্নির পাশে বসে তার একটা হাত ধরে বললো,
“রশ্নি আমি তোমার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। আমাদের বিয়ের ৮ বছরেও আরশি ছোট বলে কখনো মা হতে চাওনি।”
“ধ্যাত আমি তো নিজেই ছোটো ছিলাম। একসাথে দুটো বাচ্চা কীভাবে সামলাবো তাই মা হতে চাইনি।”
“একই তো হলো! এখনো পর্যন্ত আরশিকে তার রক্তের সম্পর্কের আপনজনদের থেকেও তুমি বেশি বোঝো বেশি যত্ন নাও, কীভাবে পারো? গত ৮ বছরে সবাই ওর উপর বিরক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তোমার এতো ধৈর্য আসে কোথা থেকে?”
“আরশি আমার কাছে শুধু আমার ননদ নয় সাহিল। ও আমার মেয়ের মতো। ও আমাকে কতোটা ভালোবাসে কতোটা ভরসা করে তুমি জানোনা।”
“হয়তো জানিনা সত্যিই জানিনা তাই খুব অবাক লাগে।”

রশ্নি প্লেটে ভাত নিয়ে আরশির ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালো। লাইট জ্বলে উঠতেই আরশি উঠে বসলো। ভাতের প্লেট দেখে বললো,
“খেতে ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
“ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। নাহলে তুই অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি একা দুটো মেয়েকে সামলবো কী করে? নে হা কর।”
আরশি অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে শুরু করলো। খাওয়াদাওয়া, বেঁচে থেকে জীবনটাকে সামনের দিকে টেনে নেয়া এসব এতো কঠিন হয়ে পড়ে কেন মাঝেমাঝে? ভাত মাখতে মাখতে রশ্নির হঠাৎ সেই ছেলেটার কথা মনে পড়লো আরশি প্রায়ই যার কথা বলতো। তার কথা বলে যদি আরশিকে একটু হলেও সবকিছু থেকে দূরে রাখা যায় সে ভাবনা থেকেই রশ্নি বললো,
“আচ্ছা আমি আসার পর ওই ছেলেটার কথা তো আর একদিনও বললি না?”
আরশির হঠাৎ কাব্যর কথা মনে পড়লো। কী অদ্ভুত! একয়দিন কাব্যর কথা একদম মনে পড়েনি। কিন্তু কাব্যও তো কোনো মেসেজ বা ফোন দিলো না! সেই যে বাড়ি গেলো আর কোনো খোঁজ নেই! রশ্নি আবার বললো,
“কীরে কিছু বল।”
“মনে ছিলো না ভাবী।”
“কী মনে ছিলো না?”
“তার কথা।”
“তোদের নিয়মিত কথা হয় না?”
“না তো।”
“ছেলেটার সাথে পরিচয় হলো কোথায়?”
“পরে সব বলবো ভাবী যদি সত্যিই কিছু হয়। আমার কেন যেন মনে হয় কিছু হবে না।”

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২২

আরশি একটা লাল রঙের শাড়ি পরেছে। চুলগুলো খোলা। কোনো এক বনের ভেতর সে কাব্যর হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। আরশি কি হাসছে নাকি বিষন্ন সেটা বোঝার জন্য কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু বুঝতে পারছে না কারণ আরশির চুলগুলো তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মুখটা দেখার জন্য একটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ সে একটা বিশাল গর্তে পড়ে গেলো। আরশি কাব্যকে ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার দিলো। ঠিক সেই মূহুর্তেই কাব্যর ঘুমটা ভেঙে গেলো। লাফিয়ে উঠে বসলো। ঘাম হচ্ছে হঠাৎ! এ কী আজব স্বপ্ন দেখলো সে? এই স্বপ্নের অর্থ কী?

অদ্ভুত এক ঘ্যার ঘ্যার শব্দে তিরার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যে সে আবিস্কার করলো তার সেরা ক্রাশ বিকট শব্দে নাক ডাকছে। তিরা যাদিদের বুকে হাত বুলিয়ে দিলো। সাথে সাথেই তার নাক ডাকা বন্ধ হয়ে গেলো। তিরা আপনমনেই হেসে ফেললো। পরক্ষণেই আবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে কাল থেকে ঘুম ভাঙলে এই মানুষটাকে আর পাশে দেখতে পাবে না। কীভাবে কেটে গেলো বিবাহিত জীবনের পাঁচটা দিন! এই পাঁচ দিন সময় এতো দ্রুত কেন অতিবাহিত হলো?

স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে আর ঘুমোতে পারলো না কাব্য। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার, সাথে মাথাব্যথা। আরশি শাড়ি পরতে পছন্দ করে না, পছন্দ করেনা কোনো রঙও। যদিও তার নিজের শাড়ি খুব পছন্দ তবুও যেহেতু আরশির অপছন্দের কথা সে জানে, তার মস্তিষ্কের কখনোই আরশিকে শাড়িতে কল্পনা করার কথা নয়। সচরাচর আমরা যা ভাবি তাই নিয়েই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমাদের ভাবনার বাইরের বিষয় নিয়ে যখন স্বপ্ন দেখি তার একটা বিশেষ অর্থ থাকে। এই অর্থটা হয় কোনো বিশেষ ঘটনার আগমনী ইঙ্গিত। কাব্য এটা বিশ্বাস করে কারণ একাধিক বার সে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে।
সিগারেট ধরালো কাব্য। আপাতত সে এই স্বপ্নের অর্থ খোঁজার চেষ্টা করছে। প্রথমে তারা বনের ভেতর হাত ধরে হাঁটছিলো, এই দৃশ্য বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় তারা একই পথে হাঁটছে এটার অর্থ হতে পারে আরশি এবং সে দুজনেই দুজনার প্রতি আগ্রহী।
স্বপ্নে সে আরশির মুখটা দেখতে চাচ্ছিলো সে কিন্তু চুলের জন্য দেখতে পারছিলো না। এই দৃশ্যের অর্থ হতে পারে আরশিকে এবং আরশির বিষন্নতার কারণ জানার তার প্রবল আগ্রহ অথচ আরশি নিজের চারপাশে এমন এক দেয়াল তৈরি করে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে যার জন্য সে জানতে পারছে না। স্বপ্নে সে নিজে আরশির চুল সরিয়ে দেখতে পারতো, কিন্তু দেখেনি ঠিক যেমন বাস্তবে সে কখনোই আরশিকে জানার জন্য নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করেনা।
আরশিকে দেখতে গিয়েই সে গর্তে পড়ে গেলো। গহীন জঙ্গলে আরশি একা হয়ে পড়লো। এই দৃশ্যের অর্থ হতে পারে আরশিকে জানতে গিয়ে তার নিজের সাথে বড়ো কোনো দূর্ঘটনা ঘটবে, অন্যদিকে একই দূর্ঘটনায় আরশি গহীন জঙ্গলে একা হয়ে যাওয়ার মতোই কোনো বিপদে পড়বে।
এইটুকু আপাতত ক্লিয়ার কিন্তু আরশির পরনের লাল শাড়ির কোনো অর্থ এখনো খুঁজে পাচ্ছেনা কাব্য।

আসন্ন দূর্ঘটনা থেকে কাব্য যদি নিজেকে এবং আরশিকে বাঁচাতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে আরশির চিন্তা মাথা থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে। অনেক দূরে থাকতে হবে তার থেকে। কিন্তু ঢাকা ফিরে আসার পর গত চার-পাঁচ দিনে তার মস্তিষ্ক এতোটাই উত্তপ্ত ছিলো যে আরশিকে নিয়ে ভাবার সু্যোগ পায়নি সে। এ কদিনে সে একবারও আরশিকে দেখেনি কোথাও। এমনকি একটা মেসেজ বিনিময়ও হয়নি। আগের থেকে দূরত্ব বেড়েছে। তাহলে হঠাৎ এমন স্বপ্ন দেখার কারণ কী? মাথাব্যথায় মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে।

চলবে..

কনফিউশন পর্ব ১৯+২০

0

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১৯+২০

তিরা যখন পার্লারে যাচ্ছিলো আরশি তাকে ডেকে বললো,
“আমাকে তোর সাথে নিয়ে যা।”
তিরা অবাক হয়ে বললো,
“তুই পার্লারে যাবি?”
“না। বাইরে ঘুরবো। বাসায় ভালো লাগছে না। তুই শুধু সাথে নিয়ে বের হ। একা বের হতে দেবে না ফুপি।”
“একা ঘুরবি কোথায়?”
“রিক্সায় ঘুরবো, মার্কেটে ঘুরবো। এটা কোনো সমস্যা না। তুই নিয়ে চল।”

তিরা আরশিকে নিয়ে বের হলো। বের হতে হতেই আরশি কাব্যকে মেসেজ দিলো সে যাতে এক্ষুণি বের হয়ে নিউমার্কেটে গিয়ে অপেক্ষা করে। তিরা ও তার কাজিনরা পার্লারে ঢুকে গেলে আরশি চলে গেল নিউমার্কেট। কাব্য আগে থেকে এসে অপেক্ষা করছিলো। আরশি এলে দুজন একসাথে শাড়ির দোকানের দিকে যাচ্ছিলো কিন্তু কেউ কোনো কথা বলছিলো না। শাড়ির দোকানের ঢুকে কাব্য আরশিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তিরা কী ধরনের শাড়ি পছন্দ করে?”
“ওর কাতান খুব পছন্দ।”
“তাহলে একটা কাতানই পছন্দ করে নাও।”
অনেকগুলো কাতান শাড়ির মধ্যে আরশি তিরার জন্য একটা মেরুন কাতান শাড়ি বেছে নিলো। শাড়ি কেনা শেষে মার্কেট থেকে বেরিয়ে কাব্য বললো,
“আমরা কি এক্ষুণি বাসায় ফিরে যাবো?”
আরশি সেকথার উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলো,
“আপনি ঝাল খেতে ভালোবাসেন নাকি মিষ্টি?”
“মিষ্টি।”
“চলুন তাহলে আপনাকে বিখ্যাত ইন্দ্রোমোহন সুইটসের মিষ্টি খাইয়ে আনি।”
“সেটা কোথায়?”
“বড় বাজার। বেশি দূরে নয়।”

আরশি ও কাব্য যখন রিক্সায় করে মিষ্টি খেতে যাচ্ছিলো তখন কাব্য নানান রকম গল্প করছিলো কিন্তু আরশি শুধু হু হা করছিলো। এই কদিন আরশির যে কিছুটা হাসিখুশি ভাব ছিলো সেটা আজ সকাল থেকে নেই। আবার বিষন্নতায় ডুবে গেছে মেয়েটা। অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জানার জন্য আরশিকে অন্তত কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না।

এইযে কাব্যর সাথে রিক্সায় ঘোরা! আরশির জীবনে প্রথম কোনো ছেলের সাথে রিক্সায় ওঠা তাও আবার সেই ছেলেটা তার বিশেষ কেউ। গতকাল কত প্ল্যান করে রেখেছিলো আজকের এই বের হওয়া নিয়ে। প্ল্যানমতোই সব হচ্ছে অথচ কিছু অনুভব করতে পারছে না আরশি। মনে হচ্ছে না বিশেষ কিছু ঘটছে তার সাথে। কাব্য একটু পর পর তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে তাতেও কিছু যাচ্ছে আসছে না তার। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিচঢালা রাস্তায়! জীবনটা টেনে সামনের দিকে আগানো সবসময়ই তার জন্য কঠিন ছিলো। একটা মেয়ের জীবনে যত স্বাধীনতা প্রয়োজন, যত বিলাসিতা প্রয়োজন সবকিছু না চাইতেই তার ভাই ভাবি এনে হাজির করেছে তার সামনে। অথচ কখনো কোনোকিছুই তার কাছে বিশেষ মনে হয়নি। আরশি যখন বড় হচ্ছিলো, চোখের সামনে তিরা কত প্রেম করেছে অথচ তার কখনো কোনো ছেলেকে ভালো লাগেনি, প্রেম তো বহুদূরের কথা। কেউ নিজ থেকেও কাছে আসেনি তার। অথচ কাব্য দমকা বাতাসের মতোই হুট করে এলো তার জীবনে। কাব্যকে ঘিরে সবকিছুই কেমন যেন বিশেষ বিশেষ মনে হচ্ছিলো। অথচ আজ সকালের পর গোছানো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না।

শেষ পর্যন্ত গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গেলো না আরশি। মাথাব্যথার অজুহাত দিয়ে বাসায় ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকলো। অনুষ্ঠানে গিয়ে তিরার কাছে আরশির মাথাব্যথার কথা শুনে কাব্য তাকে ফোন করলো,
“হ্যালো।”
“শুনলাম তোমার মাথাব্যথা! সরি আরশি আমি তো জানতাম না আমরা তখন বের হবো। তাই একটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছিলাম।”
“আমি তেমন সিগারেটের গন্ধ পাইনি। আর আমার মাথাব্যথাও হয়নি। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ্য আছি৷ অনুষ্ঠানে যাবো না বলে মিথ্যে বলেছি।”
কাব্য অবাক হয়ে গেলো। আরশি চুপ, কাব্যও চুপ। কিছুক্ষণ পর আরশি বললো,
“আমার একা থাকা প্রয়োজন তাই যাইনি।”
কাব্য বললো,
“আচ্ছা থাকো তাহলে, আমি রাখছি।”
আরশি হঠাৎ কাব্যর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো, হাজারটা প্রশ্ন করে মাথা না খেয়ে ফেলার জন্য। এজন্যই কাব্য অন্যদের থেকে আলাদা!

বিয়ের দিন সকালে সাহিল এলেই আরশি তাকে বললো,
“ভাইয়া আমি তোমার সাথে আজই ফিরে যেতে চাই।”
“কেন? তোর না বৌভাত পর্যন্ত থাকার কথা?”
“ইচ্ছে করছে না।”
“ফুপি কি আবার তোকে কিছু বলেছে?”
“আমি বাসায় যাবো ভাইয়া।”
“ঠিকাছে আমি টিকিটের ব্যবস্থা করছি।”
“ফ্লাইটে যাবো। যতদ্রুত সম্ভব আমি বাসায় যেতে চাই।”
সাহিল এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। জানে আরশিকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। রশ্নিকে পেলে সে নিজেই সব বলবে। তাই বললো,
“আচ্ছা যেভাবেই হোক ফ্লাইটের টিকিটের ব্যবস্থা করছি।”

তিরার ফটোশ্যুটের ইচ্ছেটা এবার মিটিয়েই দিলো কাব্য। বিয়েতে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার থাকলেও কাব্য তিরা ও যাদিদের বেশকিছু এক্সক্লুসিভ ছবি তুলে দিলো। যাদিদ তার বন্ধুদের সময় দিতে একটু সরতেই তিরা কাব্যকে বললো,
“আব্বাজান মালটাকে দেখেছো ভালো করে?”
কাব্য হেসে বললো,
“একদম ঝাক্কাস মাল। মাথার চুল কিন্তু খাঁড়া বুইঝো মামনি। রাগ উঠলে কিন্তু ছিঁড়ে ফেলবে তোমাকে।”
“ধ্যাত কী বলো! রাগ নেই ওর অত। শুধু একটু ভাব আছে, বুঝোনা মাল তো!”
কাব্য হাসতে লাগলো।

বিয়ের অনুষ্ঠানে কাব্য পাঞ্জাবি পড়েছে। তাকে খুব সুন্দর লাগছে। আরশি দূর থেকে দেখেই ভাবছিলো কেন কাব্য তাকে পছন্দ করলো? সেতো বেমানান কাব্যর পাশে। কাব্য আশেপাশে আরশিকেই খুঁজছিলো। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেলো। আরশি একটা একটা অফ হোয়াইট কালারের কাজ করা জামা পড়েছে। এই প্রথম সে আরশিকে একটু জমকালো কোনো জামা পড়তে দেখলো তাও রঙিন নয়। কিন্তু আজও সাজেনি আরশি। কাব্যর কাছে আরশিকে এভাবেই খুব সুন্দর লাগে। তবে কাব্যর শাড়ির প্রতি অনেক দুর্বলতা। একদিন যদি শাড়ি পড়া দেখতে পারতো আরশিকে! শাড়িতে কেমন লাগবে এই মায়াময়ী মেয়েটাকে? আরশি নিজে এগিয়ে কথা বললো,
“খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ, তুমি?”
“খেয়েছি। তিরাকে বিদায় দেয়ার পরই আমি ভাইয়ার সাথে ঢাকা ফিরে যাচ্ছি।”
কাব্য অবাক হয়ে বললো,
“সত্যি? তোমার না বৌভাত পর্যন্ত থাকার কথা?”
“ভালো লাগছে না এখন আর।”
কাব্য আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না।

তিরা আজ মহাখুশি। এই প্রথম তার কোনো ক্রাশ খাওয়া সাকসেসফুল হলো! তার শ্বশুরবাড়ি খুলনা শহরেই। শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে তার চোখ ঝলসে গেলো। এত বড় এত সুন্দর বাড়ি ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। বাসরঘরে ঢুকেও তার একফোঁটা ভয় করলো না। পুরো ঘরটা এদিকে সেদিক ঘুরে দেখলো, কিন্তু কোথাও কোনো বিড়াল দেখতে পেলো না। বাসরঘরের বিড়াল মারার ব্যাপারটা নিয়ে সে কিছুটা চিন্তিত। এই বাসরঘরের বিড়াল টা যে কীভাবে মারতে হয় সে বিষয়ে কেউই তাকে খোলাসা করে কিছু বলেনি। যাকেই জিজ্ঞেস করে সেই শুধু হাসে। ওর আগেই যদি যাদিদ বিড়াল টা মেরে ফেলে তাহলে তো মহাবিপদ! তিরা যখন এসব ভাবছিলো যাদিদ তখন বললো,
“পাগলের মতো এদিক ওদিক কী খুঁজছো? এদিকে এসো।”
তিরা যাদিদের সামনে এসে দাঁড়াতেই যাদিদ তিরার একটা হাত ধরে বললো,
“প্রথমে আমি বিয়েতে রাজী ছিলাম না জানো তিরা?”
তিরা অবাক হয়ে বললো,
“কেন?”
“এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম না। বাবা মা অনেক মেয়ের ছবি আর বায়োডাটা দিলো কিন্তু কোনোটাই আমি দেখলাম না। অবশেষে তারাই কয়েকজনকে সিলেক্ট করলো যাদের দেখতে যেতে হবে। আমার প্ল্যান ছিলো মেয়ে দেখে গিয়ে বলবো পছন্দ হয়নি। কারণ বিয়ে করবো না বলে বাবা মাকে মানানো যাচ্ছিলো না। তারচেয়ে এটাই উত্তম পন্থা। তোমার আগে আমরা আরো ৪ টা মেয়ে দেখেছিলাম, প্রত্যেককে দেখে এসে বলেছি পছন্দ হয়নি। কিন্তু তোমাকে দেখতে গিয়ে আটকে গেলাম।”
তিরা এবার দ্বিগুণ অবাক হয়ে বললো,
“কেন?”
যাদিদ তিরার মাথায় একটা গাড্ডা মেরে বললো,
“বুদ্ধু কোথাকার! এতো সুন্দরী মেয়ে দেখলে কারো মাথা ঠিক থাকে? আমারো ছিলো না।”
একথায় তিরা কী যে লজ্জা পেলো! কখনো কোনো ছেলের কথায় লজ্জা লাগেনি তিরার। অথচ যাদিদের এই সামান্য কথায় এতো লজ্জা লাগলো কেন? যাদিদ বললো,
“আর যখন ছাদে কথা বলতে গেলাম এবং বুঝলাম আমি দুনিয়ার নাম্বার ওয়ান গাধা মেয়েটার সাথে কথা বলছি তখন তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম যে বিয়ে একেই করতে হবে। বোকা বৌ ভাগ্যবানের কপালে জোটে!”
তিরা একথায় আরো বেশি লজ্জা পেলো। যাদিদ বললো,
“রাগ করোনা আবার, গাধা বোকা কিন্তু খারাপ না। ভদ্র ভাষায় এদের বলে সহজ সরল। আজ থেকে তুমি আমার বৌ। তোমার সাথে এতো ভদ্রতা দেখিয়ে কী হবে?”
তিরা যাদিদের বুকে মুখ লুকালো। যাদিদ তিরাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার বোকা বৌ।”

চলবে..

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ২০

আরশি নিজের ঘরে ঢুকে শান্তি পেলো। দুনিয়ার আর কোথাও গিয়ে শান্তি পায় না সে। এই বাড়ির বাইরে সবকিছুই অন্যদের মনে হয়। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আরশির ঘুম এসে গেলো। প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে এমন সময় কাব্যর মেসেজ এলো। সে লিখেছে,
“পৌঁছেছো?”
আরশি রিপ্লাই দিলো,
“কিছুক্ষণ আগেই।”
“ওকে টেক রেস্ট।”
“আপনি কি করছেন?”
“অন দ্যা ওয়ে টু কক্সবাজার।”
“বাড়ি যাচ্ছেন হঠাৎ!”
“ছুটি নষ্ট করতে ইচ্ছে করলো না। কিছু পারসোনাল প্রব্লেমের কারণে অনেকদিন বাড়ি যাই না। তাছাড়া, ওখানে তুমি নেই তিরা নেই। বাকি সবাই আমার অপরিচিত। আমি একা কী করতাম?”
“সরি আমার জন্য মেবি আপনার প্ল্যান বরবাদ হলো।”
“ডোন্ট বি সরি। আমার তেমন কোনো প্ল্যান ছিলো না। খুলনা ঘুরে দেখতাম হয়তো একটু! সেটা পরেও কখনো করা যাবে।”

অর্নব গেট খুলে কাব্যকে দেখে জড়িয়ে ধরে খুশিতে চিৎকার করে উঠলো,
“মা দেখো ছোট ভাইয়া এসেছে!”
কাব্য অর্নবকে দেখে বললো,
“কি খবর মিস্টার ম্যাকগাইভার?”
অর্নব দাঁত কেলিয়ে বললো,
“বাবার ঘরের টিভি টা গতকাল খুলে ফেলেছিলাম। এজন্য বাবা আমাকে কি মার মেরেছে দেখ!”
অর্নব টি-শার্ট উঠিয়ে মারের দাগ দেখাচ্ছিলো। কাব্য হেসে বললো,
“তোর তো কলিজা কম বড় না। আর মানুষ পেলি না বাবার টা?”
“আর কোনো টিভি ফ্রি থাকে না।”
“বাদ দে এসব। তোর সাথে আমার কাজ আছে। এবার তোকে নিয়ে আমি একটা মিশনে যাবো।”
অর্নবের চোখ চকচক করে উঠলো,
“সত্যি ছোটো ভাইয়া? কোথায়?”
“সেটা পরে বলবো।”
অর্নব ফিসফিসিয়ে বললো,
“তোমার সাথেও আমার প্রাইভেট কথা আছে।”
শাহনাজ বেগম রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে ছেলেকে দেখে খুশিতে কথাই হারিয়ে ফেললেন। কাব্য কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
“মা কেমন আছো তুমি?”
“আসবি বললি না কেন?”
“সারপ্রাইজ দেব বলে।”
“চাইনা তোর এসব সারপ্রাইজ। সারাক্ষণ তোর সারপ্রাইজের অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু বছরে পাই কয়বার?”
“কেন দুই ঈদে তো আসি।”
“তোর পড়াশোনা শেষ হলে সোজা বাড়ি চলে আসবি। তোর মত ছেলের অতদূরে থাকার অধিকার নেই যে কিনা দুই ঈদ ছাড়া ফ্যামিলিকে মনে করে না।”
“ওমা মনে করিনা মানে? প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে না?”
“এতোকিছু জানিনা আমি। তুই পড়াশোনা শেষে এখানেই যা করার করবি। তোকে ঢাকা পাঠিয়ে আমি বড় ভুল করেছি।”
কাব্য হেসে বললো,
“আচ্ছা মা তা নাহয় সময় হলে দেখা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি ভাত খেতে দাও তো।”
“এই সকালবেলা তাড়াতাড়ি ভাত কোথায় পাবো? তুই ফ্রেশ হ। আমি ভাত বসাচ্ছি। হতে সময় লাগবে না।”

কাব্য খাওয়া শেষ করে ঘরে যেতেই পেছন পেছন গেলেন শাহনাজ বেগম। কাব্য বিছানায় শুতেই উনি গিয়ে পাশে বসলেন। কাব্য বললো,
“মনে হচ্ছে স্পেশাল কথা আছে?”
“তা তো আছেই।”
“বলো।”
“তনিকার সাথে তোর কথাটথা হয়?”
“ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে মা।”
শাহনাজ বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“কী বলছিস তুই? মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো?”
“হ্যাঁ।”
“তুই আমাকে একবারও বললি না?”
“বলার কী আছে মা? ব্রেকাপের পর ওর কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা নিয়েও আমি কেন মাথা ঘামাবো?”
“ওর ব্যাপারে মাথা ঘামিয়েছিলি কবে তুই? এতো লক্ষী একটা মেয়েকে কতো কষ্টই না দিলি!”
“মা দুনিয়ার সব মেয়েই তো তোমার কাছে লক্ষী।”
“না তনিকা অন্যরকম ছিলো। কাব্য রে আমার তো ভয় হয়, তনিকার অভিশাপে তোর আবার না বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়!”
কাব্য হেসে বললো,
“কেন? তোমার লক্ষী মেয়ে অভিশাপ কেন দেবে?”
“তো দেবেনা? ওর জীবনটা তুই নষ্ট করেছিস।”
“আমি ওর জীবন মরন কিছুই নষ্ট করিনি মা। দেখো গিয়ে কি সুন্দর বিয়ে করে সুখী হয়েছে। আবার নাকি বাচ্চাও হবে। তাহলে জীবন নষ্ট কীভাবে হলো? দোষ আমার একার না। দোষ ওরও ছিলো। আর ব্রেকাপও আমি করিনি, ওই করেছে।”
“তনিকা তো ব্রেকাপ করেছে। ওর জায়গায় আমি হলে তোকে খুন করতাম।”
“মা তুমি বেশি সেন্টিমেন্টাল। তনিকা আমাদের পারসোনাল কথাগুলো তোমাকে আংশিকভাবে বলেছে। এজন্য তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। ওর উচিত ছিলো বললে পুরোটা বলা।”
“তাহলে তুই পুরোটা বল।”
“আমি তো ওর মতো ডেস্পারেট না যে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য কার সাথে কী সম্পর্ক মাথা রাখবো না। সবাইকে সব বলে বেড়াবো।”
“আরে! বিয়ে না করে একটা মেয়ের সাথে স্বামী স্ত্রীর মতো থেকেছিস। মেয়েটার এতো বড় ক্ষতি করেছিস আর ও তোকে ছেড়ে দেবে? এসব জানার পর থেকে আমার তো তোকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে।”
“হ্যাঁ মা আমি অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছি ওর। আমি স্বীকার করছি। কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস করো তো ও কেন বাক্সপেটরা নিয়ে আমার বাসায় এসে উঠেছিলো? এর কোনো উত্তর যদি ওর কাছে থাকে তাহলে আমি এ বিষয়ে তোমার সাথে কথা কন্টিনিউ করবো নাহয় এই চ্যাপ্টার এখানেই ক্লোজ।”

চলবে…