Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1590



এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৬

0

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্বঃ০৬
#Arshi_Ayat

প্রিয়মের পরিচয় পেয়ে আকাশ মনে মনে ভয় পাচ্ছে।প্রিয়ম যদি সব জেনে যায় তবে এতোদিন যেটার ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হবে।

আকাশের বিচলিত মুখ দেখে প্রিয়ম আকাশের মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল”আমার পরিচয় তো জানলেন।এবার আপনার পরিচয় বলুন।আর এভাবে সিনক্রিয়েট করার কারণটাও বলুন।”

আকাশ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল”আমি রুহির হাজবেন্ড।আর ওর সাথে আমার একটু মনোমালিন্য হয়েছে।আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি।আপনি দয়া করে আমাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আসবেন না।”

এটা বলেই আকাশ রুহির হাত ধরে আবার টানতে লাগলে।টানতে টানতে রুহিকে জোর করে নিচতলায় নিয়ে আসলো।রুহি ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।প্রিয়মের মনে হচ্ছে এখানে বিষয়টা অন্যকিছু।আকাশকে কিছুতেই সুবিধার ঠেকছে না প্রিয়মের।প্রিয়মকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আনোয়ার সাহেব বললেন”প্রিয়ম,আমার মেয়েটাকে বাচাও।এই ছেলেটা আমার মেয়েটাকে শেষ করে দিচ্ছে।”অনেকটা অসহায় দৃষ্টিতে বললেন।প্রিয়ম নিচতলায় গিয়ে আকাশের সামনে গিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো।প্রিয়মকে দেখে আকাশ রেগে বলল”আপনাকে না বললাম আমাদের মধ্যে আসবেন না।সরুন সামনে থেকে।”

“আমি কি করবো না করবো সেটা আপনাকে জিগ্যেস করবো না ওকে?আর আপনি ওনার হাত ছাড়ুন।উনি যদি স্বেচ্ছায় যেতে চান তবে আমি আপনাদের আটকাবো না।কিন্তু এর আগে আপনি ওনাকে কোনো রকমের জবরদস্তি করতে পারবেন না।”

প্রিয়মের কথায় আকাশ রুহির হাত ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে ইশারা দিলো যেনো কোনোরকম ভেজাল না করে।রুহি আকাশের চোখ রাঙানিতে ভয় পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।প্রিয়ম এবার রুহিকে উদ্দেশ্য করে বলল”আপনি ভয় পাবেন না।আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন আপনি কি আপনার স্বামীর সাথে যেতে চান?”

রুহি পিছনে তাকিয়ে দেখলো ওর বাবা মা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।রুহি বাবা মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে প্রিয়মকে বলল”আমি যেতে চাই না ওর সাথে।ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চায়।ও বাচ্চাটা রাখতে চায় না।কিন্তু এই বাচ্চাটা আমি চাই।আপনি কিছু করুন।আপনি চলে গেলে ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে।”বলতে বলতেই রুহি কেঁদে দিলো।রুহির এভাবে সবকিছু ফাঁস করে দেওয়াতে আকাশের চেহারায় কাঠিন্য নেমে এলো।রাগে সব ভুলে গেলো।দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রুহির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো।বেশিদূর যেতে পারে দুইপা এগোনোর সাথে সাথেই ওর মুখে একটা ঘুষি পড়লো আচমকাই।আকাশ টাল সামলাতে না পেরে রুহির হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরে বসে পড়লো।প্রিয়ন শক্ত হাতের ঘুষিটা বেশ জোরেশোরেই লেগেছে আকাশের মুখে।আকাশের এমন অবস্থা দেখে রুহির খারাপই লাগছে কিন্তু সে কিছুই বলছে না।বলারই বা কি আছে!অন্যসময় হলে ঠিকই প্রতিবাদ করতো।কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা অন্য।পেছন থেকে আনোয়ার সাহেব আর রুনা বেগম রুহির সাথে এসে দাড়ালেন।রুহি মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কান্না করে দিলো।আর রুনা বেগম মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে রাখলেন।

আকাশ ঘুষি খেয়ে দুইমিনিটের মাথায় উঠে দাড়িয়ে যে-ই প্রিয়মকে আক্রমণ করতে যাবে প্রিয়ম আকাশের পেট বরাবর হাটু দিয়ে আঘাত করলো।আকাশ পেট ধরে দূরে সরে গেলো।প্রিয়ম আকাশের কাছে এসে ওর কলার ধরে বলল”পুলিশ এমনি এমনি হয় নি।সো যা করবি সাবধানে করবি।”

বলে প্রিয়ম আশেপাশে তাকিয়ে একটা দড়ি পেলো দাড়িটা দিয়ে শক্ত করে আকাশের হাত পা বেধে থানায় ফোন দিলো।
————————
অরুণী ক্যাম্পাসে এসে দেখলো প্রণয় বন্ধুদের সাথে দাত কেলাচ্ছে।অরুণী ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল”কি বলবেন বলেন।”

প্রণয় অরুণীর দিকে তাকিয়ে বন্ধুদের ইশারা দিলো চলে যাওয়ার জন্য।বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর প্রণয় বলল”কেমন আছো অরুণী?”

“ভালো।”

“জিগ্যেস করলে না আমি কেমন আছি?”

“প্রয়োজন মনে করি না।” অরুণী কাটখোট্টা ভাবে জবাব দিলো।

“তুমি এতো কঠিন কেনো অরুণী?”

“আমি এমনই।”

“একটু নরম স্বরে কথা বললে কি হয়?

” আমি বলতে পারি না।”

এতটুকু বলে অরুণী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলল”কিছু বললে তাড়াতাড়ি বলুন।আমার ক্লাস আছে।”

অরুণীর এমন ব্যাবহার প্রণয়কে কষ্ট দেয় কিন্তু তবুও প্রণয় হাসিমুখে মেনে নেয়।ওই যে কথায় বলে না ভালোবাসা মানুষকে সব কিছু শেখায়।তেমনই প্রণয়ের ক্ষেত্রেও হয়েছে।প্রণয় কষ্ট পেলেও মুখে হাসি বজায় রেখে বলল”আজ আমার জন্মদিন অরুণী।”

অরুণী ভেবে পাচ্ছে না তো জন্মদিন হলে ওকে বলার কি আছে?অরুণী তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলল”শুভ জন্মদিন।”

বলেই প্রণয়কে কিছু বলতে না দিয়ে হাঁটা ধরলো ক্লাসরুমের দিকে।প্রণয় মন খারাপ করে অরুণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

অরুণী যাওয়ার পরই প্রণয়ের বন্ধুরা চলে আসলো।বন্ধুরা সবাই জানে প্রণয় অরুণীকে ভালোবাসে।এটা নিয়ে প্রণয়কে প্রচুর খোঁচা মারে।এবারও ব্যাতিক্রম হয় নি।বন্ধুমহলের মধ্যে মিনহা প্রণয়কে খোঁচা মেরে বলল”দোস্ত তোর কি এমন বললো যে তোর মুখ এমন চুপসানো।”

প্রণয় মাথা নেড়ে বলল”বেশি বকবক করবি না।চল তোদের ট্রিট দেই।”

ট্রিটের কথা শুনে ফারদিন বলল”চল মামা চল।আজকে পুরা একবছরের খাবার একসাথে খাবো।”

ফারদিনের কথায় বাকি বন্ধুরাও হেসে দিলো।
——————
প্রিয়ম আকাশের হাত বেঁধে থানায় কল করে রিসাদকে আসতে বলল।রিসাদ হলো প্রিয়মের সহকারী।রিসাদ আসতেই প্রিয়ম ওকে থানায় নিয়ে লকাপে ঢুকাতে বলেছে আর ওর নামে একটা জিডি করতে বলেছে।রিসাদ আকাশকে আর দু চার ঘা লাগিয়ে নিয়ে গেলো।আকাশকে নিয়ে যেতেই প্রিয়ম আবার রুহিদের ড্রয়িং রুমে এসে বসলো।সামনে রুহি আর রুহির বাবা মা বসা।প্রিয়ম ই প্রথম শুরু করলো”আঙ্কেল ঘটনাটা যদি একটু খুলে বলতেন তবে ওকে শায়েস্তা করতে সুবিধা হতো।”

রুহি মলিন কন্ঠে বলল”আকাশ আর আমার বিয়ে তিনবছর আগে হয়।পরিবার থেকে সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় আমরা পালিয়ে বিয়ে করি।তারপর আর বাবা মার সাথে যোগাযোগ হয় নি।আকাশের বাসায়ই থাকতে শুরু করলাম।বিয়ের পরের দিনগুলো খুব একটা ভালো না গেলেও একবারে খারাপ যাচ্ছিলো না।তারপর আমাদের প্রথম বাচ্চা যখন আসে আমার গর্ভে তখন আকাশ বলল ও বাচ্চা রাখবে না।এখনো নাকি বাচ্চা নেওয়ার সময় হয় নি।আমার কাছে অনেক রিকুয়েষ্ট করে বাচ্চাটা এবোরশন করালো।সে বার আমি কিছু বলি নি।খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।একরকম ডিপ্রেশনেই পড়ে গেছিলাম।ওই ঘটনার প্রায় একবছর পর তিন চার দিন আগে জানলাম আমি আবার কন্সিভ করেছি।খবরটা আকাশকে জানানোর পর আকাশ আবার আগের মতো শুরু করলো সে এই বাচ্চাটা রাখবে না।আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার শুরু করলো।তারপর আমি যখন আমার জায়গায় অনড় ছিলাম তখন ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায় এবোরশন করানোর জন্য।সেটা আমি কোনোভাবে জানতে পেরে এক নার্সের সহযোগীতায় পালিয়ে আসি।আর এখন বর্তমানে এখানেই অবস্থান করছি।”
সবকিছু বলতে বলতেই ওর কপল বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।রুহি নিজেকে সামলে নিলো।প্রিয়ম আশ্বাস দিয়ে বলল”আপনি চিন্ত করবেন না।আপনার বাচ্চা ক্ষতি হবে না।আমরা আকাশের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করে রেখেছি।ও এখন আর আপনার বাচ্চার ক্ষতি করতে পারবে না।”
তারপর বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আনোয়ার সাহেবকে সালাম করে বলল”স্যার আসি।”

আনোয়ার সাহেব বলল”না বাবা একটু বসো।নাস্তা করে যাও।তোমার সাথে তো তেমন কথাই হলো না।”

প্রিয়ম হালকা হেসে বলল”স্যার আমি বাসা থেকেই নাস্তা করে এসেছি।আরেকদিন আসবো।এখন থানায় যেতে হবে।”

তারপর প্রিয়ম চলে যেতেই রুহি নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে বালিশ ধরে কাঁদতে লাগলো।আর আনোয়ার সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।রুনা বেগমও কিচেনে চলে গেলেন।
———————
অরুণী ভার্সিটির সামনে থেকে রিকশা নিলো রুহিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য।এখন বিকেল চারটা।সন্ধ্যা পর্যন্ত সে আর রুহি একসাথে ঘুরবে।

এদিকে প্রণয় অরুণীকে পুরো ভার্সিটি এরিয়া খুঁজেও পেলো না।ওর বন্ধুরা বলল অরুণী চলে গেছে।প্রণয়ের মন খারাপ হলো।প্রতিটাদিন অরুণী এমন করে।প্রণয়কে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।প্রতিদিনের মতো আজও প্রণয় মন খারাপ করে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

অরুণী রুহিদের বাসার সামনে এসে দরজা নক করতেই রুনা বেগম খুলে দিলেন।অরুণী মিষ্টি হেসে বলল”আন্টি রুহি কি করে?”

“শুয়ে আছে।সকাল থেকে কিছুই খায় নি।”

অরুণী রুহির ঘরের দিকে যেতে যেতে রুনা বেগমকে বলল”আন্টি দুই প্লেট ভাত দেন।আমিও খাই নি।আমি আর রুহী একসাথে খাবো।”

রুনা বগেম মুচকি হেসে কিচেনে চলে গেলেন।আর অরুণী রুহির ঘরে এসে দেখে রুহি চোখের ওপর হাত দিয়ে শরীর টান করে শুয়ে আছে।অরুণী রুহির মাথায় হাত দিতেই রুহি চোখ থেকে হাত সরিয়ে মলিন হেসে বলল”কখন আসলি?”

“মাত্রই।তুই নাকি সারাদিনে কিছু খাস নি?”

“আমার আবার খাওয়া!” রুহি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল।

“থাপ্পড়িয়ে তোর চাপার দাঁত ফেলে দেবো।না খেয়ে থেকে কি বোঝাতে চাস যে তোর মতো দুখী আর কেউ নেই?আরে খোঁজ নিয়ে দেখ তোর চেয়েও শত কষ্টে মানুষ হাসিমুখে বেঁচে আছে।তাহলে তুই কেনো পারবি না?তুই মানুষ না?আর না খেয়ে থাকলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?কেনো নিজের শরীর কে কষ্ট দিচ্ছিস আর এখন তো তুই একা নেই সাথে তোর বাচ্চাটাও আছে।নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস ওকেও দিচ্ছিস।এমন হলে এবোরশন ই করে ফেল।কি দরকার তোদের রেশা রেশির স্বীকার এই মাসুমকে করার।ওর তো কোনো দোষ নেই তবে ওকে কেনো কষ্ট দিবি?তোর ওকে কষ্ট দেওয়ার কোনে হক নেই।” অরুণী প্রচন্ড রেগে কথাগুলো বলল।তারপর ব্যাগ নেই রুহির ঘর থেকে চলে যেতে নিলেই রুহি দ্রুত উঠে অরুণীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল”সরি,আর এমন হবে না।আমি আর না খেয়ে থাকবো না।প্লিজ রাগ করিস না।কথা বল।”

অরুণী রুহির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল”ওয়াদা?”

“ওয়াদা।”
তারপর দুইবান্ধুবী কান্না করে দিলো।এর মধ্যেই রুনা বেগম খাবার নিয়ে চলে এলো।ওরা দুইজনই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে পড়লো।খাওয়ার মাঝখানেই রুনা বেগম অরুণীকে সকালের ঘটনাটা বলল।অরুণী সব শুনে দাত কিড়মিড় করে বলল”আমও থাকলে ওর যে কি করতাম আমি নিজেও জানি না।বেয়াদব, অসভ্য।”

আরো কিছুক্ষণ গালাগালি করে অরুণী খাওয়া শেষ করলো।তারপর দুইবান্ধবী বেরিয়ে পড়লো।
——————-
সারাদিনে আকাশের খবর না পেয়ে নাতাশা কিছুটা চিন্তিত!আকাশ কি কিছু করতে পারলো কি না কে জানে!

চলবে….

এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৫

0

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
#পর্বঃ০৫
#Arshi_Ayat

অরুণী রুহিদের বাসার সামনে এসে মাত্রই পৌঁছালো।সি এন জি ওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে ওপরে আসতেই দেখলো একটা ছেলে রুহিদের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে।মুখ দেখা যাচ্ছে না বলে অরুণী ছেলেটাকে চিনতে পারছে না।অরুণী আস্তে আস্তে ওপরে এসে ছেলেটার পাশে দাড়িয়ে দরজা নক করে ওর দিকে খেয়াল করলে।নাহ!ছেলেটাকে অরুণী চিনে না।অরুণী পরিচয় জানার জন্য বলল”হাই,আমি অরুণী।আপনি?”

“আমি প্রিয়ম চৌধুরী।” ছেলেটা মৃদু হেসে বলল।

“ওহ!আচ্ছা।”
এরমাঝেই রুনা বেগম দরজা খুলে দেওয়ায় অরুণী আর কিছু বলতে পারলো না।অরুণীকে দেখে রুনা বেগম বললেন”মা ভেতরে আসো।”

অরুণী ঘরে ঢুকে বলল”আন্টি রুহি কোথায়?”

“ঘুমাচ্ছে।সারারাত ধরে কান্না করেছে।সেইজন্য এখন ঘুমাচ্ছে।”

অরুণী রুহির ঘরের দিকে চলে গেলো।অরুণী চলে যাওয়ার পর রুনা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল”কে তুমি?”

“স্যার আছে?”

রুনা বেগম বুঝলেন ছেলেটাকে আনোয়ার সাহেবের কথা বলছে।কারণ আনোয়ার সাহেব প্রাইমারী স্কুলের হেড টিচার ছিলেন।এখন অবশ্য রিটায়ার্ড।এমন অনেকেই আসে তার সাথে দেখা করতে।রুনা বেগম দরজা থেকে সরে দাড়িয়ে বলল”আসো বসো।তোমার স্যার বাজারে গেছে।”

ছেলেটা এসে সোফায় বসলো।রুনা বেগম কিচেনে গেলেন চা বানাতে।রুনা বেগম যাওয়ার পর প্রিয়ম সামনের খবরের কাগজটা নিয়ে চোখ বুলাতে আছে আরম্ভ করলো।
——————
অরুণী রুহির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।রুহি এখনো ঘুমাচ্ছে! ঘুমালে রুহিকে নিষ্পাপ শিশুদের মতো মনে হয়।যেনো তার কোনো দুঃখ কষ্ট নেই।কিন্তু জেগে উঠলেই এই নিষ্পাপ মুখে হাজারো বিষন্নতা,আর কষ্টের চিহ্ন ফুটে ওঠে।

আরো কিছুক্ষণ রুহির মাথায় হাত বুলাতেই রুহি আস্তে চোখ খুললো।রুহিকে চোখ খুলতে দেখে বলল”যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”

রুহি হালকা একটা হাসি দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে আসতেই অরুণী বলল”রুহু আজকে আমরা ঘুরতে যাবো।ওকে।”

“না রে আমার কোথায় যেতে ভাল্লাগে না।” রুহি মলিন মুখে বলল।

“তোমার তো কোথাও যেতে ভাল্লাগে না।কিছু করতে ভাল্লাগে না।খালি কাঁদতে ভাল্লাগে।আমি তোর থেকে পারমিশন চাইছি নাকি?আমি বলছি আমরা যাবো তুই বিকেলে রেডি হয়ে থাকিস।”

রুহি অরুণীর হাত ধরে বলল”এতো ভালোবাসিস কেনো আমাকে?”

অরুণী ওকে জড়িয়ে ধরে বলল”জানি না।তবে সবসময় ভালোবাসবো।তাহলে এখন আসি।ভার্সিটির সময় হয়ে গেছে।”

“এখনি চলে যাবি?” রুহি মন খারাপ করে বলল।

“আরে জানু, আবার আসবো তো।তুই কিন্তু রেডি হয়ে থাকবি।”

“আচ্ছা।”
অরুণী রুহির থেকে বিদায় নিয়ে কিচেনে গিয়ে রুনা বেগমকে বলল”আন্টি আমি আসি।”

“সে,কি বসো আরেকটু নাস্তা বানিয়েছি নাস্তা করে যাও।” রানু বেগম শরবত ঢালতে ঢালতে বললেন।

“আরে না আন্টি।সত্যি বলছি আম্মু আসার সময় খাইয়ে দিয়েছে পেটে জায়গা নেই।এখন আসি।”

“আচ্ছা যাও।”
রুনা বেগম হাসি মুখে বলল।অরুণী ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো ছেলেটা এখনো বসে আছে।অরুণী একনজর তাকিয়ে চলে গেলো।কিন্তু প্রিয়ম একবারো তাকালো না কারণ সে একটা খবর পড়ছে খুব মনোযোগ দিয়ে।

কিছুক্ষণ পর আনোয়ার সাহেব বাজার করে ফিরে রুনা বেগমকে ডাক দিলেন।রুনা বেগম মাত্রই প্রিয়মের সামনে নাস্তা রাখতে না রাখতেই দরজার দিকে ছুট দিলেন।দরজা খুলতেই দেখলেন আনোয়ার সাহেবের দুইহাত ভর্তি বাজার।রুনা বেগম বাজারগুলো হাত নিয়ে কিচেনের দিকে চললেন।আর আনোয়ার সাহেব ভেতরে এসে সোফায় বসতেই দেখলেন বরাবরই সোফায় একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে।আনোয়ার সাহেবের ছেলেটাকে চেনাচেনা লাগলেও ঠিকভাবে চিনতে পারলেন না।প্রিয়ম আনোয়ার সাহেবকে সালাম দিয়ে বলল”স্যার কেমন আছেন?”

“কে তুমি?ঠিক চিনতে পারলাম না।চেহারাটা হালকা চেনাচেনা লাগছে।”

প্রিয়ম মুচকি হেসে বলল”স্যার আমি প্রিয়ম।”

প্রিয়ম ওর নাম বলতেই আনোয়ার সাহেব চিনে ফেললেন।অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিলো প্রিয়ম।কখনো প্রথম থেকে দ্বিতীয় হয় নি।যেবার এস এস সি দিয়েছিলো সে বছর এই জেলা থেকে যাদের বোর্ডে নাম ছিলো তার মধ্যে প্রিয়মও একজন।আনোয়ার সাহেব হেসে বললেন”কেমন আছো প্রিয়ম?”

“আলহামদুলিল্লাহ স্যার।তবে আমার জবাবটা কিন্তু পেলাম না।”

“কি?” আনোয়ার সাহেব ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন।

“আপনি কেমন আছেন?এটা জিগ্যেস করেছিলাম।”

আনোয়ার সাহেব একটু জোরে হেসে উঠলেন তার সাথে প্রিয়মও হাসলো।আনোয়ার সাহেব হাসি থামিয়ে বলল”আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছেন।তুমি এখন কি করো?”

“স্যার…….”

প্রিয়ম কিছু বলার আগেই দরজায় নক করলো কে যেনো।আনোয়ার সাহেব দরজা খুলতেই দেখলেন দরজার বাইরে আকাশ দাড়িয়ে আছে!আকাশকে দেখে আনোয়ার সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।চোখে কাঠিন্যতা ফুটে উঠলো।রাগী গলায় বলল”কি চাই এখানে?”

আকাশ জানে প্রথমেই রাগারাগি করা যাবে না।একটু ছলচাতুরী করতে হবে।তাই চোখমুখে কৃত্রিম অপরাধ বোধ ফুটিয়ে তুলে বলল”বাবা রুহি আছে ঘরে?”

আনোয়ার সাহেব ধমকে বললেন”আমাকে বাবা বললে কোন সাহসে?তোমার মতো কুলাঙ্গারের বাবা না হওয়াই ভালো।”

“বাবা আমাকে ক্ষমা করুন।আমি শুধু একটু রুহির সাথে কথা বলবো।”

আনোয়ার সাহেব আকাশের কোনোকথাই শুনছে না চিল্লাতে চিল্লাতে চলে যেতে বলছে।
.
.
বাইরে চেচামেচি শুনে রুহি বেরিয়ে এসে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলো আকাশ দরজার বাইরে দাড়িয়ে অনুরোধ করছে ভেতরে ঢোকার জন্য।রুহি গিয়ে বলল”কি সমস্যা?এখানে কেনো তুমি?”

“ক্ষমা করো রুহি।ফিরে চলো।আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমি আর কখনো এমন করবো না।আমাদের বাচ্চার যত্ন নেবো।”

রুহি আকাশের এমন মিথ্যাগুলো সহ্য করতে না পেরে ঠাস করে বাম গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল”তুই চুপ কর।তোর নোংরা মুখ দিয়ে একটা কথাও বলবি না।চলে যা এখান থেকে।”

এতক্ষণে আকাশের রাগ মাথায় উঠে গেলো।ও ওর আসল রুপে এসে রুহির হাত খপ করে ধরে বলল”তুই আমার সাথে যাবি।চল।”

রুহি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।আনোয়ার সাহেব আর রুনা বেগমও রুহির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আকাশ কিছুতেই ছাড়ছে না।
.
.
প্রিয়ম এতক্ষণ বসে বসে সব দেখলেও।এখন উঠে গিয়ে আকাশের সামনে দাড়িয়ে বলল”কে আপনি?এমন সিনক্রিয়েট করছেন কেনো?”

“আমি কে তোকে বলা লাগবে না।সামনে থেকে সর।”

প্রিয়ম আর কিছু বলল না আচমকা ঠাশ করে একটা চড়ে মেরে দিলো।চড় খেয়ে আকাশ বলদ হয়ে গেলো।রুহির হাতটা ছেড়ে দিলো।প্রিয়ম বলল”ব্যাবহার ঠিক করুন।তা নাহলে এর চেয়েও বেশি পড়তে পারে।”

আকাশ প্রিয়মের কলার টেনে ধরে বলল”কে রে তুই?”

প্রিয়ম বাঁকা হেসে পকেট থেকে আইডি কার্ডটা বের করে বলল”এসিপি প্রিয়ম চৌধুরী।”

আকাশ সাথে সাথে প্রিয়মের কলারটা ছেড়ে দিলো।
——————-
অরুণী ভার্সিটিতে এসেই লাইব্রেরিতে চলে গেলো।ওর দুটো বই প্রয়োজন।এখন বই দুটো খুঁজে নিবে।লাইব্রেরিতে এসে বইগুলো খুঁজতে লাগলো।একটা বই পেয়েও গেলো।অরুণী বইটা হাতে নিয়ে একটু দেখাট জন্য প্রথম পাতা উল্টাতেই দেখলো একটা খাম!অরুণী ভাবলো হয়তো এটা কেউ এমনিতেই রেখেছে কিন্তু অরুণী খামটা উল্টাতেই দেখতে পেলো কালো কালি দিয়ে গোটাগোটা অক্ষরে লিখা”অরুণী এটা তোমার জন্য।”

কি আছে চিঠিতে!অরুণী চিঠিটা হ্যান্ডব্যাগে রেখে।আরেকটা বই খুঁজতে লাগলো।সেই বইটাও পেলো কিন্তু এটাতেই একটা চিঠি।অরুণী এটাও রেখে দিলো।অরুণী ভেবেছে হয়তো কেউ ফাইজলামি করে রেখেছে।বই দুটো নিয়ে ক্লাস রুমে এসে বসলো।তারপর একটা বইখুলে পড়তে লাগলো।হঠাৎ একটা ছেলে এসে অরুণীকে ডাক দিলো।অরুণী বই থেকে মুখ তুলে বলল”জ্বী!”

“আপনাকে প্রণয় ভাই ডেকেছে ক্যাম্পাসে।”

অরুণী মনে মনে এটাই ভেবেছিলো।কারণ এই প্রণয় প্রতিদিন ওকে বিরক্ত করে।এতোবার মানা করার পরেও!এখন আবার কি জন্য ডেকেছে কে জানে।না গেলে ক্লাসে চলে আসবে।তাই অগত্যা অরুণীর যেতে হলো।

চলবে……

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)
চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৪

0

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
#পর্বঃ০৪
#Arshi_Ayat

রুহি ভয়ের চোটে থরথর করে কাঁপছে।রুহির মা রুনা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে কিন্তু সেগুলো একদমই রুহির কানে যাচ্ছে না।চোখের সামনে বারবার ভয়ংকর দৃশ্যগুলো ভাসছে।যা একটু আগেই স্বপ্নে দেখলো সে।এমন ভয়ংকর স্বপ্ন রুহি কখনো দেখে নি।এই স্বপ্ন রুহির ভেতর ভয়ের সৃষ্টি করলো।যদি স্বপ্নটা সত্যি হয়!রুহির ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো।রুহি মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল”মা,আকাশা আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দিবে না।মা ও আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে।”

রুনা বেগম রুহির মাথাটা আবারও বুকের সাথে চেপে ধরে বলল”কিচ্ছু হবে না।তুই একদম চিন্তা করিস না।আমরা আছি তো।”

মায়ের কথায়ও তেমন একটা ভরসা পায় না রুহি।আসলে ভয়টা এমন ভাবে জেঁকে বসেছে যে কোনো আশ্বাসেও কাজ হচ্ছে না।মনটা অশান্তই হয়ে আছে।
——————-
আকাশ সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলো নাতাশার চেম্বারে যাওয়ার জন্য।রুহির বিষয়ে একটা জরুরী কথা আছে।হাসপাতালে পৌঁছে নাতাশার কেবিনে গিয়ে দেখলো নাতাশা কার সাথে যেনো কথা বলছে আকাশকে দেখে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিয়ে বলল”খবর টবর কিছু পেলে?”

“না তেমন কোনো খবর পাই নি।কিন্তু একটা জরুরী আলাপ করতে এলাম।”

“বলো শুনি।”

নাতাশা আকাশকে বলতে বলে দুইকাপ কফি দিতে বলল।

“আচ্ছা নাতাশা বেবিটাকে মারার দরকার কি?ওকে ডিবোর্স দিয়ে দিলেই তো হয়।তারপর আমরা বিয়ে করে নেবো।”

নাতাশা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল”বেবিটাকে মারতেই হবে।কারণ ওই মেয়েটা বেবিটাকে দিয়েই তোমাকে ফাসাবে।”

“কিভাবে?” আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলল।

“বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার পর অবশ্যই ওর বাবার পরিচয় চাইবে তখন রুহি তোমার নাম বলবে।বায়োলজিক্যাল ভাবেতো তুমিই ওর বাবা।ব্যাস আর কি সম্পত্তির ভাগ দাও!আর তাছাড়াও বাচ্চাটা সব জায়গায় তোমার নাম ব্যাবহার করবে।যেটা আমি মানতে পারবো না।” শেষের কথাটা নাতাশা মুখে কাঠিন্য এনে বলল।
আকাশও নাতাশার কথাগুলো ভাবতে লাগলো।আকাশকে ভাবতে দেখে নাতাশা মনে মনে হাসলো আর বলল”’কোপটা একবারে জায়গা মতো পড়ছে।’

এরমধ্যেই কফি চলে এলো।আকাশ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল”তুমি ঠিকই বলেছো নাতাশা।আসলেই বাচ্চাটা রাখা ঠিক হবে না।আমি কালই ওদের বাসায় যাবো।আমার বিশ্বাস রুহি ওই বাসায় আছে।”

নাতাশা আর আকাশ এভাবেই আরো কিছুক্ষণ কথা বলল সাথে কফি শেষ করে উঠে পড়লো।নাতাশা আর আকাশ নিজেদের বাসায় চলে গেলো।

আকাশা বাসায় ফিরতেই আকাশের মা বলল”ওই মুখপুড়ি কি একবারে গেছে গা?”

“হুম।ওকে আমি ডিবোর্স দিবো।চরিত্র ভালো না ওর।কার না কার বাচ্চা আমার বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছে।”

আকাশের মা ছিঃছিঃ করতে করতে বলল”ঠিকই আছে।এসব নষ্টা মাইয়া লইয়া ঘর করা যায় না।তুই ভালো কাজ করছিস।”

আকাশ আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
—————————-
মাত্রই এশার নামাজ আদায় করে রুহি বিছানায় এসে বসলো।তারপর ডান হাতটা পেটের ওপর রাখতেই পানিতে দুঃচোখ ভরে গেলো।কিন্তু এতটুকুও শব্দ হয় নি।রুহি ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে কিন্তু লাভ হচ্ছে না অশ্রুগুলো তার ফর্শা কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।এতো কষ্ট সহ্য হচ্ছে না রুহির।
কিছুক্ষণ নিরবে অশ্রু ফেলে রুহি জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালো।দুইতলার ওপর বাসা হওয়ায় জানালার কাছে দাড়ালে রাস্তার অনেকটাই দেখা যায়।ল্যাম্পপোস্টের নিচে চলতি গাড়িগুলোকে তাকিয়ে রুহি।তবে ভাবছে অন্যকিছু!হঠাৎ রুহির ভাবনার সুতা ছিড়লো তার মায়ের ডাকে।রুহি পিছনে ফিরতেই দেখলো রুনা বেগম চা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।রুহি একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল”বাবাকে দিয়েছো?”

“হুম,দিয়ে আসলাম।এই নে তোরটা।”
রুহি মায়ের হাত থেকে হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে বলল”তুমি খাবে না?”

“খাবো তো।দাড়া নিয়ে আসি।”
রুনা বেগম কিচেন থেকে নিজের কাপটা নিয়ে এলেন।
রুহি ভাবছে কতোদিন পর মায়ের সাথে চা খাচ্ছে।প্রায় তিনবছর হয়ে গেছে।

আগে সন্ধ্যা হলেই রুনা বেগম চা বানাতেন তারপর আনোয়ার সাহেবকে তার চা টা দিয়ে মা মেয়ে একসাথে বসে চা খেতো।সেই চা খওয়ায় যে কতোটা তৃপ্তি ছিলো!তিনবছর পর আবার এই দিনটা এলো কিন্তু একটা জিনিস অবশ্য বদলেছে।তিনবছর আগে মা মেয়ে একসাথে চা খেতে বসলে অনেক গল্প হতো,হাসিঠাট্টা অনেককিছু কিন্তু আজ কিছুই হচ্ছে না সবকিছু যেনো নিরব হয়ে আছে।

চা খাওয়া শেষ হতেই রুনা বেগম উঠে দাড়িয়ে বললেন”চা টা শেষ কর।আমি আসছি তোর মাথায় তেল দিবো।চুলগুলো শুকনো হয়ে পাটকাঠি হয়ে আছে।কতোবছর ধরে তেল দিস না?”

রুহি মলিন হেসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল”মনে নেই।”

রুনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল”আমি আসছি।”

তারপর চলে গেলেন।রুহি চা খেতে খেতে কিছু একটা ভাবছিলো হঠাৎ কারো কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো।কথার আওয়াজটা আসছে সামনের রুম থেকে।রুহির বিষয়েই কিছু বলছে তাই রুহি কান খাড়া করলো শোনার জন্য।
.
.
নিচতলার ভাবি এসেছে রুহিদের বাসায়।আজকে সকালেই তার মেয়ের থেকে সবকিছু শুনে দেখা করতে এলো।রুনা বেগম তাকে বসতে দিয়ে বললেন”কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভাবি।আপনারা?”

“এইতো আল্লাহ ভালোই রাখছে।চা আনি আপনার জন্য?”

“না ভাবি আমি মাত্রই চা খেয়ে এলাম।”
মহিলাটা একটু থেমে আবার বলল”শুনলাম আপনার মেয়ে নাকি এসেছে।”
রুনা বেগম এমন কিছুই আন্দাজ করছিলো।তাই সাবলীল ভাবে বলল”হ্যাঁ ভাবি।”

“তা একবারের জন্যই এসেছে?নাকি আবার চলে যাবে।”

“একবারেরই জন্যই।ওর স্বামী ভালো না।”

“ওও,,আচ্ছা ওকে একটু ডাক দেন।দেখি।কখনো তো দেখি নাই।”

রুনা বেগম জানেন মহিলাটা কেমন।এখন গিয়ে আশেপাশের সবাইকে ছড়াবে।রুনা বেগমের মন সায় দিলো না রুহিকে ডাকতে।কে জানে ওর সামনে কোনো বেফাঁস কথা বলে দিলে!রুহির মন তো নরম সহ্য না করতে পেরে কান্না করবে।এমনিতেইতো সারাদিন কাঁদে।মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।কি অপরিসীম কষ্ট বুকে ধারণ করে আছে সেটা কেউ না বুঝলেও সে বোঝে।মা তো তাই!মায়েরা নাকি সন্তানের কষ্ট বোঝে।

রুনা বেগম মহিলাটাকে মিথ্যা বলে বিদায় করলেন।
রুহি ভেতরের ঘর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।এটাতো কিছুই না আর কয়দিন পর তো আরো অপমান সহ্য করতে হবে ভেবেই রুহির মন খারাপ হয়ে গেলো।

আমাদের সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের কে কোন চোখে দেখা হয় এটা আমরা সবাই জানি।একটা ছেলেকে কিন্তু এতো অপমান সহ্য করতে হয় না।ডিবোর্সের পর তারা অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করতে পারলেও কোনো ডিবোর্সী মেয়ের কপালে অবিবাহিত ছেলেতো দূরের কথা দুই তিনবার ডিবোর্সী ছেলেও নাক সিটকায়।
———————
আকাশ নাস্তা করে বের হলো রুহিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য।দুইদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে এই বাচ্চার ঝামেলা সরানোর জন্য তার ওপর আবার নাতাশার প্যারা তো আছেই।

কিন্তু রুহিদের বাসায় যাওয়ার আগে একবার নাতাশার সাথে দেখা করতে হবে।আকাশ সোজা এসে নাতাশা কেবিনে ঢুকলো।দেখে নাতাশা কার সাথে যেনো কথা বলছে ওকে দেখা তড়িঘড়ি করে ফোনটা কেটে দিয়ে বলল”ব্রেকফাস্ট হইছে?

“হ্যাঁ,তোমার?”

“হ্যাঁ হইছে।এখন কি ওই মেয়েটার বাসায় যাচ্ছো?”

“হ্যাঁ দুইদিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।”

“শোনো প্রথম গিয়ে মাফ টাফ চাবা।একটু কনভেন্স করার ট্রাই করবা।এতে যদি হয় তাহলে তো হলোই।আর না হলে জোরাজোরি করবা।তবে ওর বাচ্চা যাতে না বাঁচে।”

আকাশা নাতাশার কথায় সম্মতি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো রুহির বাসার উদ্দেশ্যে।কি জানি রুহির দুঃস্বপ্ন কি সত্যি হতে চললো আজ!
——————-
চা টা খেয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অরুণী।এখন যাবে রুহিদের বাসায়।মেয়েটা একদম ভেঙে পড়েছে।কিছুক্ষণ ওর সাথে গল্প করে তারপর ভার্সিটিতে যাবে।অরুণীর একদম কষ্ট সহ্য হয় না।রুহির জায়গায় যদি অরুণী থাকতো তবে আকাশ আর নাতাশার উচিত শিক্ষা দিতো।কিন্তু রুহিতো এগুলোর কিছুই করবে না।এতো শান্ত একটা মেয়ের কপাল টা এমন হলো ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে অরুণীর।চারদিকে এতো মন ভাঙার গল্প হচ্ছে দেখে অরুণীর ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই উঠে গেছে।অরুণীর মনে এটা নিয়ে ফিলিংস জাগে না।আশেপাশের এমন মনভাঙার গল্প গুলোই ওকে এমন শক্ত করেছে।অরুণী মাঝেমধ্যেই ভয় পায় যদি কেউ ওর সাথেই এমন করে তখন!

চলবে…….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৩

0

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
#পর্বঃ০৩
#Arshi_Ayat

রুহি সেই কখন থেকে কাঁদছে।মনে হচ্ছে আজকেই চোখ থেকে সব পানি ঝরিয়ে ফেলবে।কিন্তু ওকে এভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না।অরুণী রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল”এবার তো থাম।আর কতো কাঁদবি?কাঁদলে কি কিছু ঠিক হবে?অযথা চোখের পানি ঝরানোর কোনো মানেই হয় না রুহি।চোখের পানি মোছ।”

রুহি বাম হাতে চোখের পানি মুছতেই আবার পানিতে ভরে গেলো চোখের কার্নিশ।এবার আর রুহি মুছলো না অরুণী ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল”আর যেনো না কাঁদতে দেখি আমি।”

রুহি অরণীকে জড়িয়ে ধরে বলল”আমি কি করবো বল!আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে।আমি যে ওর প্রতারণা সহ্য করতে পারছি না।আমার ভাগ্যটা এতো খারাপ কেনো রে?”

“তার ভাগ্য খারাপ না রুহি।ভাগ্যতো তার খারাপ যে তোর ভালোবাসাকে অসম্মান করেছে।হতেও পারে একদিন এই ভালোবাসার জন্য সে ভীষণভাবে কাতর থাকবে কিন্তু তখন আর কোনো কিছু করার থাকবে না।”

অরুণী রুহির চোখ আবার মুছে দিয়ে বলল”বাবা মা কাছে যাবি?”

“কোন মুখে দাড়াবো তাদের সামনে বল?এতোটা কষ্ট যাদের দিয়েছি তারা কি আমাকে মাফ করবে?যাদের ভালোবাসাকে আমি অসম্মান করেছি তারা কি আমাকে মেনে নিবে?”রুহি ভেজা কন্ঠে বলল।

” বাবা মায়ের সামনে দাড়াতে কোনো মুখ লাগে না রুহি।ওনারা বাবা মা।বাবা মা এমন দুটো মানুষ যাদের হাজার শব্দেও ব্যাক্ত করা যায় না।হাজার অপরাধ করার পরও বাবা মা সন্তানকে মাফ করে দেয়।সেইজন্যই তারা বাবা মা।আর আমার বিশ্বাস এতোদিন পর আঙ্কেল আন্টি তোকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিবে না।”

“আমি যাবো অরু।অন্তত মাফটাও যদি পাই!” রুহি এটা বলে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
———————
বাসাবো তে এসে আকাশ একটা বাড়িতে গেলো কিন্তু সেখানে রুহিকে পেলো না।আকাশের যতোদূর মনে আছে রুহি এই বাড়ির কথাই বলেছিলো।ওর নাকি এখানে এক বান্ধবী আছে।নামটা মনে পড়ছে না আকাশের।এখন রুহিকে পাবে কোথায়?
আকাশ রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে রুহিকে কল করলো কিন্তু এখন ফোন বন্ধ বলছে!কি মসিবত!বাসাবো তে কয়েকটা বাসা খুঁজেও যখন রুহিকে পাওয়া গেলো না তখন আকাশ হতাশ হয়ে ফিরে গেলো।এভাবে খোঁজা সম্ভব না। নির্দিষ্ট ঠিকানা ছাড়া এতো বড়ো এরিয়াতে কোথায় খুজবে রুহি কে।

আকাশ চলে যাওয়ার দুই মিনিট পর অরুণী আর রুহি বের হলো যে বাড়িটা থেকে সেখানে দু’মিনিট আগেও আকাশ দাড়িয়ে ছিলো।বলা বাহুল্য এ যাত্রায় রুহির কপাল ভালো ছিলো।রুহি আর অরুণী রাস্তায় এসে অটো নিলো।গন্তব্য রুহির বাড়ি!
———————
আকাশ হতাশ ভঙ্গিতে নাতাশার কেবিনে ঢুকে নাতাশার চেয়ার বরাবর একটা চেয়ারে বসে পড়লো।নাতাশা এখন কেবিনে নেই।হয়তো হাসপাতালের কোনো ওয়ার্ডে আছে।আকাশ নাতাশাকে ফোন করলো।নাতাশা কল কেটে দিয়ে দু’মিনিটের মধ্যে কেবিনে চলে এলো।কেবিনে এসেই জিগ্যেস করলো”পেয়েছো মেয়েটাকে?”

“না পাওয়া যায় নি।ওর ফোনের লোকেশন ট্রেস করে জানতে পেরেছি বাসাবো তে আছে।আর বাসাবো তে ওর এক বান্ধবীর বাড়ি আছে।ভেবেছিলাম সেখানে গেলেই পাবো কিন্তু পেলাম না।তবে ও বাসাবোতেই
আছে।কিন্তু নির্দিষ্ট ঠিকানাটা জানি না।আর একটু আগেই ফোন বন্ধ করে দিয়েছে।”

“ইশ!এখন কি হবে?বলো?আমি জাস্ট আর চিন্তা করতে পারছি না।”

“কুল বেবি।এতো হাইপার হইয়ো না।ওকে আমরা ঠিকই পেয়ে যাবো।কাল একবার ওর বাসায় যাবো।দেখি সেখানে আছে কি না।”

“হুম তাই করো।আর ওকে তাড়াতাড়ি ডিবোর্স দাও।ওকে ডিবোর্স দিলেই আমাকে বিয়ে করতে পারবে।”

“একটু সময় দাও।আমি ওকে ডিবোর্স দিয়ে দেবো।”

নাতাশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন নার্স এসে বলল রোগীর কাছে যেতে হবে।নাতাশা চলে গেলো।নাতাশা যেতেই আকাশও উঠে গেলো।আজ আর অফিসে যাবে না।
——————
অনেক্ক্ষণ যাবত রুহি আর অরুণী রুহিদের বাসার দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে।দাড়িয়ে থাকার কারণ হলো রুহি ভয় পাচ্ছে।নিজেও নক করছে না অরুণীকেও করতে দিচ্ছে না।অরুণী এবার বিরক্ত হয়ে বলল”এবার কিন্তু মাইর খাবি রুহি।এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো?”

“যদি বাবা মা মাফ না করে তাহলে?” রুহি মলিন গলায় বলল।

“আরে ওনারা মাফ করে দিবে।আর যদিও মাফ না করে তবে পা ধরে বসে পড়বি যতক্ষণ পর্যন্ত মাফ না করে।”

রুহি অরণীর কথায় সম্মতি দিলো।অরুণী একবার রুহির দিকে তাকিয়ে দরজায় নক করলো।দুইবার নক করার পর একটা মেয়ে দরজা খুললো।ওদের দেখে বলল”কে আপনারা?আর কি চাই?”

অরিণী সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল”আমি অরুণী আর ও আমার বান্ধবী।বাসায় কি রুনা আন্টি আর আনোয়ার আঙ্কেল আছেন?”

“হ্যাঁ আছে।কিন্তু তাদের দিয়ে আপনার কাজ কি?”

“কাজ আছে বলেই বলছি।তাদের একটু ডেকে দিন।”

মেয়েটা ওদের দাড়াতে বলে ভেতরে চলে গেলো।এতক্ষণ সবকথা অরুণী বললেও রুহির মুখ দিয়ে একটা কথাও ফোটে নি।মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলো।

দু’মিনিট পর মেয়েটা সাথে করে রুহির মা কে নিয়ে এলো।রুহির মা দরজার সামনে রুহিকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।আর রুহিকে পায় কে।এমনিতেই সে কাঁদতে কাঁদতে শেষ তার ওপর আবার নিজের মা কাঁদছে তাই সেও কান্না ধরে রাখতে পারলো না।দুই মা মেয়ে এবার কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলছে।তবে দৃশ্যটা দেখার মতো।অরুণী আর দরজায় দাড়ানো মেয়েটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো মা মেয়ের কান্না।এই কান্নায় কতোটা আকুতি থাকতে পারে এটা কেবল তারাই জানে।

ঘর থেকে রুহির বাবা আনোয়ার সাহেব বলে উঠলো”কি গো কে এসেছে?

রুহির বাবার কথা শুনে রুহির মা রুহিকে নিয়ে ভেতরে গেলেন।সাথে অরুণী আর মেয়েটায় পেছনে এসে দাড়ালো।রুহিকে দেখে রুহির বাবা চোখ মুখ শক্ত জোরালো কন্ঠে বলল”ও এখানে কেনো?চলে যেতে বলো ওকে।”

বাবার কথা শুনে রুহি আরো কান্না পাচ্ছে।কান্না দলা পাকিয়ে আসছে ভেতর থেকে।রুহির মা আনোয়ার সাহবের পাশে বসে বলল”মেয়ের সাথে আর রাগ করে থাকবেন না।কথা বলুন ওর সাথে।”

“আমার ওর সাথে কোনো কথা নেই।” আনোয়ার সাহেব অন্যাদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল।

রুহি কান্না করতে করতে আনোয়ার সাহেবের পায়ের কাছে বসে ওনারা পা ধরে কান্না করতে করতে বলল”বাবা মাফ করে দাও প্লিজ।আমার খুব কষ্ট লাগছে।এভাবে চুপ করে থেকো না।যা শাস্তি দিবে মেনে নেবো কিন্তু মাফ করে দাও বাবা।দেখো তোমাদের কষ্ট দিয়ে আমিও ভালো নেই।আকাশ আমার সাথে প্রতারণা করেছে।তোমাদের সাথে প্রতারণা করার ফল আমি পেয়েছি।এবার যদি আমাকে মাফ না করো তাহলে কখনো নিজেকে মাফ করতে পারবো না।মাফ করবে না আমাকে?”

মেয়ের আর্তনাদে আনোয়ার সাহেবের এতো বছরের রাগ পানি হয়ে গেলো।মেয়েটা তার এতো কষ্টে আছে।ভাবতেই আনোয়ার সাহেবের বুক ভারী হয়ে গেলো।আনোয়ার সাহেব রুহিকে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।

আসলেই বাবা মা কখনো সন্তানের ওপর রেগে থাকতে পারে না।তারা সবসময় সন্তানের মঙ্গল চায়।সন্তানের কষ্ট অনুভব করতে পারে।পৃথিবীতে এই দুটো মানুষই সবসময় পাশে থাকে সন্তানের।আর এদের ভালোবাসা সবসময় স্বার্থবিহীন হয়।
.
.
অরুণী আর রুহি মিলে সবটা রুহির বাবা মা কে বুঝিয়ে বলেছে।সব শুনে রুহির বাবা রেগে বলল”ওই কুত্তার বাচ্চার কাছে আমি আমার মেয়ে আর দিবো না।কিছুতেই না।”

শুধু রুহির বাবাই না রুহির মাও প্রচন্ড রেগে গিয়েছেন।যে মেয়েকে ছোট বেলা থেকে অনেক আহ্লাদে বড়ো করেছেন তার সাথেই এমনটা মানতে পারছেন না।

কিছুক্ষণ আগে অরুণী চলে গেছে।রুহির বাবা মা থেকে যেতে বলেছিলো কিন্তু সে থাকে নি।তার বাবা মাও তার জন্য অপেক্ষা করছে
————-
অরুণী যাওয়ার পর রুহি নিজের ঘরে এলো।চারদিকে চোখ বুলাতেই দেখলো কিছুই পরিবর্তন হয় নি।সব আগের মতোই আছে।কোথাও একটু ময়লাও নেই।এতো দুঃখের মাঝেও অরুণী একটু হাসলো কারণ তার মা এখনো তার ঘরে এসে ঘরটা পরিস্কার করে যায়।যার জন্য মনেই হয় না এইঘরে অনেকদিন ধরে কেউ থাকে না।

রুহি জানালার সামনে গিয়ে জানালাটা খুলে দিলো।ঘরটা দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো।রুহি বিছানায় বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে রইলো।অতিরিক্ত কান্নার ফলে চোখগুলো লাল হয়ে আছে আর মাথাব্যথায় ফেটে যাচ্ছে।শরীর দুর্বল হওয়ায় তাড়াতাড়িই ঘুম চলে এলো।
—————–
একটু আগে রুহির বাসায় আকাশ এসেছে।এসেই ভাংচুর করছে।রুহির বাবা মা বাধা দিতে চাইলেও কাজ হয় নি।আকাশ রুহির চুলের মুঠি ধরে বলল”কি ভেবেছিস আমার থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবি?কখনো না।তোর বাচ্চা নষ্ট করবোই আমি।”

আকাশ রুহির চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো।রুহি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো”আকাশ!দয়া করো আমার বাচ্চাকে।ওকে মেরো না।আমি বা আমার বাচ্চা কখনো তোমার পথের কাটা হবো না।আমি সরে যাবো তোমার জীবন থেকে।তবুও তুমি আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দাও।আমি ওকে ছাড়া মরে যাবো।”

আকাশের মনে দয়া হচ্ছে না।সে রুহিকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো।
রুহির আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু পাষাণের মন গলছে না।

চলবে…..

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০২

0

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
#পর্বঃ০২
#Arshi_Ayat

রুহি নার্স রিতার পায়ের সামনে বসে কাঁদছে।ওর চোখের পানিতে নার্সের পা ভিজে যাচ্ছে।নার্স ওর সামনে বসে বলল”আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না তুমি বুঝতে চাইছো না কেনো?আমি তোমাকে সাহায্য করলে তোমার চাকরী চলে যাবে।”

রুহি কাঁদতে কাঁদতেই বলল”আপু প্লিজ একটু সাহায্য করুন।আমি আমার বাচ্চাটাকে চাই।আপু আপনিও তো কারো মা।আপনি তো জানেন একটা বাচ্চা জন্ম দিতে কষ্ট হয় মায়ের তবুও সে মা একটিবার বাচ্চার মুখ দেখলে সব ব্যাথা ভুলে যায়।আপু আমারও মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করতে ইচ্ছে করে।আমার মন চায় মা ডাক শুনতে।আমারোও আমার বাচ্চাটাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করে।আপু আমি পারবো না আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলতে।একটু দয়া করুন আপু।”

রুহির এমন করুণ আর্তনাদে রিতার মন নরম হলো।আসলেই তো একটা নারী মা হওয়ার মাধ্যমেই পূর্ণ হয়।আজ যদি রুহির জায়গায় সে থাকতো তখন কি পারতো নিজের বাচ্চাকে এভাবে বলি দিতে?রিতার শরীর শিউরে উঠলো!তারও একটা মেয়ে আছে।সারাদিন ডিউটি করে যখন বাসায় ফেরে তখন মেয়েটা দৌড়ে এসে আম্মু আম্মু বলে জড়িয়ে ধরে।তখন যেনো রিতার ক্লান্তিগুলো উধাও হয়ে যায়।একটা মায়ের কাছে তার বাচ্চার মুখ থেকে আম্মু ডাক শোনাটা যে কতোটা মধুর তা শুধু মায়েরাই জানে।
আর সে কি না একজন মা কে মাতৃত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছে।সেসময় রিতার বিবেক প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে উঠলো।এটা অপরাধ!এই অপরাধের ক্ষমা নেই।

রিতা রুহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল”আমি তোমাকে সাহায্য করবো বোন।যদি আজ আমার চাকরী চলেও যায় তবুও আমি এই পাপ করতে পারবো না।আমারও একটা মেয়ে আছে।”

রুহি কৃতজ্ঞতায় রিতাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।রিতা ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল”পালিয়ে যাও।আকাশ তোমার বাচ্চাকে বাঁচতে দিবে না।নাতাশা ম্যামের সাথে তার সম্পর্ক আছে।এখন সে তোমাকে চায় না।এইজন্যই বাচ্চা এবরশোন করতে এনেছে।এই বাচ্চা এবরশোন করলে আকাশ তোমাকে ডিবোর্স দিয়ে দিবে।”

নার্স রিতার কথা শুনে রুহির ভেতরটা তছনছ হয়ে গেছে।কি নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে এটা একমাত্র রুহিই জানে।
যে ভালোবাসার জন্য একদিন বাবা মা কে ছেড়ে এসেছিলো আজ সেই ভালোবাসার প্রতিদান যে এমন হবে রুহি ভাবতে পারে নি।তবে কি এটা বাবা মাকে কষ্ট দেওয়ার ফল!রুহির দুচোখ বেয়ে ঝর্ণা ধারা নামছে।অন্তত ভালোবাসার মানুষের কাছে এমন প্রতারণা মানতে পারছে না রুহি।এমুহূর্তে রুহির মনে হচ্ছে পৃথিবীতে ভালোবাসা নেই।সবাই স্বার্থপর!

নার্স রিতা রুহিকে একটা সাদা এপ্রোন পরিয়ে মুখের ওপর মাক্স পরিয়ে দিলেন।তারপর লিফটে চড়ে একবারে নিচতলায় এসে রুহিকে একবার জড়িয়ে ধরে বলল”যাও!কখনো ভেঙে পড়ো না।সবসময় মনে সাহস রেখে এগিয়ে চলো।”

রুহিও কৃতজ্ঞতা ভরা কন্ঠে বলল”আপু আপনার এই উপকার আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবো কথা দিলাম।”

তারপর রুহি হাসপাতাল থেকে জলদি বের হয়ে একটা অটোতে উঠে পড়ে।গন্তব্য অরুণীর বাড়ি!অরুণী ছোটবেলার বান্ধবী।আগে ওর বাড়ি গিয়ে ওর সাথে আলোচনা করবে বলে ঠিক করলো রুহি।
——————–
লিফট দিয়ে আবার চতুর্থ ফ্লোরে আসলো নার্স রিতা।তার এখন মনে মনে ভয় লাগছে।নাতাশা অনেক বদ মেজাজী।একবার জানতে পারলে রক্ষা নেই।চাকরীটাই চলে যাবে।এই চাকরী হারালে চলবে না।পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম সে ই।পরিবার বলতে পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আর সে।তিনবছর আগে একটা দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যায়।এরপর আর বিয়ে করে নি রিতা।একমাত্র মেয়েটাকে নিয়েই বেচে আছে।

রিতা নাতাশার কেবিনের সামনে এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে দিতেই দেখতে পেলো নাতাশা আকাশের কোলের ওপর বসে আছে।আর হেঁসে হেঁসে কথা বলছে।এভাবে প্রায় প্রায়ই দেখা যায় তাদেরকে।আর নাতাশার কেবিনে নক করে ঢুকতে হয়।তা নাহলে নাতাশা প্রচুর রেগে যায়।তাই রিতা সন্তপর্ণে দরজাটা চাপিয়ে দিলো।তারপর দুমিনিট অপেক্ষা করে দরজায় নক করলো।নাতাশা ভেতর থেকে বলল”ইয়েস কাম ইন।”

রিতা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো নাতাশা তার চেয়ারে বসে আছে আর আকাশ তার মুখোমুখি!বলা বাহুল্য রিতার জন্যই তারা দুজনে আলাদ হয়েছে।রিতা ভেতরে ঢুকে একবার আকাশ আর নাতাশার দিকে চেয়ে বলল”ম্যাম,মেয়েটা পালিয়েছে।”

নাতাশা চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে হাত দিয়ে টেবিলে বাড়ি দিয়ে বলল”হোয়াট!পালালো কিভাবে?”
নাতাশার সাথে আকাশও আতঙ্কিত হয়ে গেলো।

“ম্যাম,আমি ওকে বসিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম এনেস্থিসিয়া(অজ্ঞান করা হয় এটা দিয়ে।মেডিকেলের ভাষায় একে এনেস্থিসিয়া বলে।)আনার জন্য।কিন্তু এসে দেখি ও রুমে নেই।পুরো হসপিটাল খুঁজেছি কিন্তু নেই কোথায়।তারপর না পেয়ে আপনার কাছে এলাম।”

নাতাশা সবটা শুনে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো।আকাশ রাগের চোটে বলল”কাদের রাখো কাজে?একটা কাজও ঠিক করে করতে পারে না।এখন যদি কেস করে তাহলে তুমি আমি দুজনই জেলে যাবো।”

নাতাশা দাঁতে দাঁত চেপে রিতাকে বলল”আউট।”

রিতা কাচুমাচু করে বেরিয়ে পড়লো।রিতা যাওয়ার পর নাতাশা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল”এখন কি হবে আকাশ?”

“ওয়েট,আমি ওকে খুঁজে দেখছি।পেলে নিয়ে আসবো।”

“আচ্ছা যাও।”
আকাশ নাতাশার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।যে করেই হোক রুহিকে খুঁজে পেতে হবে।আকাশ রুহির ফোনে কয়েকবার ফোন করলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না।আকাশ ওর এক বন্ধুকে কল করে রুহির নাম্বারটা দিয়ে বলল লোকেশন ট্রেস করতে।
——————-
রুহি অরুণীর বাড়ির সামনে এসে ভাড়া দিয়ে দরজার সামনে এসে কড়া নাড়লো।দুই তিনবার নাড়ার পর অরুণী এসে দরজা খুলতেই দেখলো রুহি দাড়িয়ে আছে।অনেকদিন পর রুহিকে দেখেও একটু চিনতে ভুল করে নি অরুণী।প্রথমেই দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয় নি দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে।তারপর অরুণী রুহিকে ভেতরে এনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো।রুহির পাশে বসে বলল”কেমন আছিস?আমাকে ভুলেই তো গেছিস।”

“না রে তোকে কখনো ভুলি নি।তুই ভোলার মতো না।”

“সেইজন্যই তো এতো বছরেও একবার খোঁজ নিলি না।”

রুহি ভেজা কন্ঠে বলল”মাফ করে দে।”

অরুণী ওকে জড়িয়ে ধরে বলল”থাপ্পড় খেতে না চাইলে এসব ফর্মালিটি অফ কর।আকাশ ভাইয়া আসে নি?”

আকাশের কথা শুনে রুহি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।প্রিয় বান্ধবীর কান্না দেখে অরুণী বিচলিত কন্ঠে বলল”কি হয়েছে? কাদছিস কেনো?”

রুহি চোখের পানি মুছে বলল”আমি শেষ হয়ে গেছি অরু।ও আমাকে ভালোবাসে নি।”

“কি হয়েছে সেটাতো বলবি।”

রুহি প্রথম থেকে সব বলল।সব শুনে অরুণী দাঁতে দাঁত চেপে বলল”ওই জানোয়ারটার জন্য চোখের পানি ফেলাও উচিত না।তুই একদম কাদবি না।ওকে উচিত শিক্ষা দিবি।”

“আমি পারবো না রে।আমি ওকে ভালোবাসি।”

অরুণী রেগে বলল”ওই জানোয়ারের জন্য এখনো ভালোবাসা আছে।আমি অবাক হচ্ছি।”

রুহি কাঁদছে খুব।এতো বড়ো প্রতারণাটা আকাশ না করলেও পারতো।আর অরুণী বান্ধবীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।ছোটবেলা থেকেই রুহি ভিষণ আবেগ প্রবণ।অনেক ছোটছোট জিনিসেও তার মন খারাপ হয়ে যেতো।ছোটবেলার সারাক্ষণ অরুণীর সাথে থাকতো।দুজনে বোনের মতো।ইন্টার পর্যন্ত ছিলো কিন্তু আকাশের সাথে বিয়ের পর থেকে রুহি সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়।এতে রুহির দোষ দেওয়া যায় না সে স্বামীর আদেশ পালন করেছে।আজ এতো বছর পর রুহিকে আবার এভাবে দেখবে এটা অরুণী ভাবে নি।

সকাল থেকেই অরুণী বাসায় একা।বাবা মা আন্টির বাসায় গেছে।হঠাৎই কলিং বেলের শব্দ পাওয়ায় দরজা খুলতেই রুহিকে দেখবে তা ভাবে নি।হঠাৎ অরুণী কিছু একটা ভেবে বলল”রুহি তোর ফোন কই?”

রুহি চোখ মুছে বলল”এইতো এই ব্যাগে।”

অরুণী ওর ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখে আকাশের অনেকগুলো কল।সাথে সাথে অরুণী ফোন অফ করে দেয়।অরুণীর সন্দেহ হচ্ছে যদি আকাশ জানতে পারে রুহি এখানে আছে তবে বাচ্চার কোনো ক্ষতি করে দিতে পারে।
——————
রুহির লোকেশন ট্রেস করে জানা যায় রুহি বাসাবো তে আছে।আকাশ সেদিকেই রওনা হয়।বাসাবো তে রুহির এক বান্ধবী আছে।আগে তার বাড়িতেই খোঁজ নিবে আকাশ!

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০১

0

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম♥️
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

“আকাশ আমি পারবো না বাচ্চা নষ্ট করতে।এর আগেও তোমার জন্য একটা বাচ্চা নষ্ট করেছি।এবার তুমি আমাকে দিয়ে এটা করাতে পারবে না।”রুহি রেগে বলল।
“দেখো রুহি আমাদের এখনো বাচ্চা নেওয়ার সময় হয় নি।আর এই বাচ্চার খরচ আমি নিতে পারবো না।”

“কেমন বাবা তুমি?যে বাচ্চা বাচাতে চাও না।আর আমাদের বিয়ে তিনবছর হয়ে গেছে।আর কতো সময় লাগবে তোমার বলো?তোমার মা প্রতিটা দিন আমাকে বলে বাচ্চা হয় না কেনো?আমার কি কোনো সমস্যা আছে কি না।আমি কিছু বলি না।এই বাচ্চাটার কথা শুনলে মা অনেক খুশী হবে।তুমি প্লিজ বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে বলো না।” রুহি আকাশের দিকে হাতজোড় করে অনুরোধ করলো।

“না,কিছুতেই না।এই বাচ্চা রাখা সম্ভব না।আর মাকে আমি বোঝাবে।তুমি কালই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবে।”

“কখনো না।আমি মরে গেলেও যাবো না।”রুহি চিল্লিয়ে বলল।

আকাশের মেজাজ গরম হয়ে গেলো।আকাশ ঠাটিয়ে এক চড় মেরে রুহির চুলের মুঠি ধরে নিজের মুখের সামনে এনে বলল” আমিও দেখি তুই বাচ্চা কিভাবে রাখিস।”

এটা বলে রুহিকে সজোরে ছুড়ে ফেলে হনহনিয়ে চলে গেলো আকাশ!রুহি ড্রেসিং টেবিলের সাথে বাড়ি খেয়ে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা পেলো।প্রচন্ডে কষ্টে চোখ থেকে পানি বেরিয়ে পড়লো।তবে শারীরিক আঘাতে রুহির চোখ দিয়ে পানি বের হয় নি।আঘাতটা ভেতরের!যার ক্ষত কাউকে দেখানো সম্ভব নয়।

তিনবছর আগে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো আকাশ আর রুহি।দুজন দুজনকে ভিষণ ভালোবাসতো।সেই ভালোবাসার জোরেই বিয়েটা হয়েছিলো।তখন আকাশের সবে মাত্র চাকরী হয়েছিলো কিন্তু রুহি ইন্টার দ্বীতিয় বর্ষের ছাত্রী ছিলো।দুজনের চোখেই রঙিন স্বপ্ন ছিলো।কেউ কাউকে ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করতে পারতো না।হঠাৎ একদিন বিষয়টা রুহির পরিবারের সবাই জেনে যায়।আর রুহির বিয়ে ঠিক করে।কিন্তু রুহি সেদিন রাতেই আকাশের সাথে পালিয়ে যায়।তারপর আকাশের বন্ধুদের উপস্থিতিতে বিয়েটা হয়।প্রথম প্রথম আকাশের পরিবার সম্পর্ক মেনে নেয় নি কিন্তু পরবর্তীতে যখন দেখছে মেনে না নিলে তাদেরই ক্ষতি ছেলের কামাই খেতে পারবে না।তখন মেনে নেয়।তবে মেনে নিলেও রুহিকে কখনোই ভালো চেখে দেখে নি তারা।রুহি আসার পর বাড়ির চাকর গুলো তাড়িয়ে দিয়েছিলো।প্রথম দিন ওর শ্বাশুড়ি মা বলেছিলো’বউ হয়ে এসেছো এ বাড়িতে।সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।’

রুহি সেদিন মাথা কাত করে সম্মতি দিয়েছিলো যদি শ্বাশুড়ির মন পাওয়া যায় তাই।এরপর থেকে সারাদিন বাড়ির সমস্ত কাজ আর রাতে ভালোবাসার দাবি মেটাতে হতো।তবুও ভালোবাসার দোহাই দিয়ে সব মেনে নিয়েছিলো রুহি।সংসারের কাজে এতো ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো যে ইন্টার পরীক্ষার পর আর পড়াই হয় নি।এতোদিনের বাবা মার সাথে অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে রুহি কিন্তু তারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।রুহির অবশ্য খুব খারাপ লেগেছিলো।কোনো একদিন মনে পড়লেই রাতের অন্ধকারে শব্দহীন ভাবে কাঁদতে সে।এই নিয়ে কখনো আকাশকে কিছু বলে নি রুহি।তার কষ্ট গুলো একান্তই তার ব্যাক্তিগত সম্পদ।এগুলো কখনোই কারো কাছে শেয়ার করা যায় না।আর করলেও কেউ তা অনুভব করতে পারে না।

বিয়ের পর সময়গুলো ভালো খারাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো।হঠাৎ একদিন রুহি মথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় আকাশ ডাক্তার ডেকে এনেছিলো।ডাক্তার চেকাপ করে বলেছিলো বাড়িতে নাকি নতুন অতিথি আসবে।সেদিন যে কি আনন্দ হয়েছিলো রুহির।সেটা একমাত্র রুহিই জানে।কিন্তু সেদিম রুহির বিপরীতে আরেকজন অতিমাত্রায় দুঃখী হয়েছিলো।সে বাচ্চার খবর বাড়িতেও জানায় নি।সবাইকে বলেছিলো রুহির মাথা ব্যাথা ছিলো সেইজন্যই পড়ে গিয়েছিলো।আর রুহিকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে সে বার বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলে।রুহি মুখ বুজে সবটা মেনে নিয়েছিলো সেদিন।তারপর থেকে রুহি প্রতিদিন স্বপ্নে দেখে একটা বাচ্চা ছোট ছোট হাত দিয়ে ওর গাল স্পর্শ করে বারবার বলছে”আম্মু,আম্মু।”আর যতোবারই এই স্বপ্নটা রুহি দেখছে ততবারই রুহি ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বাঁচ্চাটাকে খুজছিলো।কিন্তু হায়!আশেপাশে কোনো বাচ্চা নেই।রুহির ব্যাথিত মাতৃ হৃদয় প্রবল বেদনায় জর্জরিত হয় প্রতি মুহুর্তে।নিজেকে এখনো মাফ করতে পারে নি রুহি।বাচ্চা নষ্ট করার পর থেকে রুহি আকাশের সাথেও কম কথা বলে।কেমন যেনো নিজেকে খুনী মনে হচ্ছে তার!
আজ একবছর পর আবারও আরেকজন আসতে চলছে তবুও আকাশ খুশী না।কিন্তু কেনো?এই প্রশ্নের উত্তর রুহির কাছে নেই।

রুহি চোখ মুছে উঠে দাড়ালো।তারপর ঘরের বাইরে আসতেই শ্বাশুড়ি হুংকার দিয়ে বলল”আমার ছেলেকে কি বলেছো তুমি?ও এভাবে রেগে বেরিয়ে গেলো কেনো?”

“মা আমি কিছুই বলি নি।আপনার ছেলে বাচ্চা রাখতে চায় না।আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু সে কোনোভাবেই বাচ্চা রাখবে না।মা আপনি তাকে একটু বোঝান না!” আকুতি ভরা কন্ঠে রুহি আবদার করলো আশা বেগমের কাছে।

কিন্তু তিনি বিরক্তি কন্ঠে বললেন”তোমার স্বামী তুমি বোঝাও।আমারে বলো কেনো?”

এটা বলে আশা বেগম মুখ ঘুরিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।রুহির চোখ ফেটে কান্না আসছে।কিন্তু কোথাও কিছু একটা বাধা দিচ্ছে সেজন্য কান্নাটা ঠেলে বাইরে আসতে পারছে না।

কোনরকমে নিজেকে সামলে রুহি ঘরের কাজে মনোনিবেশ করে।
—————
নিস্তব্ধ রজনী!রুহি পাশ ফিরে শুশে আছে।ওপাশে আকাশ শুয়ে আছে।এখন কয়টা বাজে রুহির হিসেব নেই।শব্দহীন কান্না কাঁদছে রুহি।কিছু সময় পর আকাশ ধীরে ধীরে রুহির কাধে হাত রাখলো।রুহি কোনোরকমে কান্না লুকিয়ে আকাশের দিকে ফিরলো।আকাশে কিছু না বলে নিজের বুকে আবদ্ধ করলে তাকে।কিছু সময় পর ছেড়ে দিয়ে রুহির হাত দুটো ধরে বলল”মাফ করে দাও রুহি।আমার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে।আমি একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি নিজের ভুল।আমরা বেবিটা রাখবো।”

রুহি আকাশের কথা শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।হুড়মুড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বলল”থ্যাংকিউ সো মাচ আকাশ।আমি জানতাম তুমি এমন করবে না।”

আকাশে হেসে রুহির কপালে চুমু দিয়ে বলল”তাহলে রেডি থেকো কাল সকালে তোমাকে চেকাপ করতে নিয়ে যাবো।দেখতে হবে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না?”

রুহি তৃপ্তির হাডি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।এই জীবনে বাবা মার পরে এই মানুষটাকেই সে এতো ভরসা করে।অতঃপর রাত বাড়ার সাথে সাথে দুজনের মাঝের শাররীক দুরুত্ব ঘুচতে লাগলো কিন্তু মনের দুরুত্ব সে কি ঘুচবে?
——————
রুহি একা হাতে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিলো।তারপর সবাই নাস্তা খাওয়ার পর নিজেও খেলো।আকাশ রুহিকে রুমে নিয়ে এসে বলল”রেডি হও তাড়াতাড়ি।তোমার চেকাপ করিয়ে অফিসে যেতে হবে।”

রুহি খুশী মনে রেডি হতে লাগলো।
অপর দিকে আকাশ বাইরে গিয়ে নাতাশা কে কল করলো।
“হ্যালো নাতাশা।”

“হ্যাঁ জানু বলো।”

“শোনো তোমার হসপিটালে আসছি রুহিকে নিয়ে।বাচ্চাটা এবোরশন করতে হবে।তুমি কি আছো?”

“ইয়াপ বেবি।তুমি শুধু নিয়ে আসো।বাকি কাজ আমি করছি।”

“ওকে।”
বলে আকাশ কল কেটে দিলো।রুহি রেডি হয়ে বাইরে আসতেই দেখলো আকাশ দাড়িয়ে আছে।রুহিকে নিয়ে রিকশায় উঠে হসপিটালে রওনা হলো।মনে মনে রুহি ভিষণ খুশী।নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।মা মা ফিলিং হচ্ছে।আর আকাশ ভেতরে ভেতরে জপছে যেনো সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হয়ে যায়।রুহি যদি এসবের কিছু ঘুণাক্ষরেও টের পেতো!
—————
রুহিকে নাতাশার চেম্বারে নেওয়া হলো।নাতাশা রুহিকে বসতে বলল।তারপর রুহিকে প্রশ্ন করলো”কতো মাস চলছে?”

“দুইমাস।”

“আচ্ছা।আপনাকে কিছু টেস্ট দিচ্ছি এক্ষুনি করে নিয়ে আসেন।”

নাতাশা কাগজে কি যেনো একটা লিখে একজন নার্সের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল রুহিকে নিয়ে যেতে।নার্সটা রুহিকে নিয়ে একটা কেবিনে এলো।তারপর একটা চেয়ারে বসতে বলল।নার্সটা কোনো দরকারে বোধহয় বাইরে চলে গেলো।রুহি চেয়ারেই বসে ছিলো।হঠাৎ টেবিলের ওপর থেকল একটা কাগজ রুহিট পায়ের সামনে এসে পড়লো।রুহি সেটা উঠিয়ে টেবিলে রাখতে গিয়ে কাহজের লেখাটায় নজর পড়লো।এটা তো ডাক্তার নাতাশার লেখা।রুহি লেখাটা পড়তেই তার রক্ত হবে হিমশীতল হয়ে গেলো।হাত পা কাঁপছে দ্রুত।কাগজে লেখা ছিলো

“রিতা আপা,রুহি নামের মেয়েটার বাচ্চাটা নষ্ট করে দিন।যেনো সে বুঝতে না পারে।প্রয়োজনে অজ্ঞান করে ফেলুন!”

চলবে…..?

কলঙ্ক পর্ব-১৩

0

#কলঙ্ক
#১৩তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


মেহরাব এলো বাবা ওদের বাড়ি থেকে আসার তিনদিন পর।ওর পরনে একটা নীল রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির উপর একটা ঘিয়ে রঙা চাদর।দেখতে ভীষণ সুদর্শন! অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার মতো ছেলে!
এই ছেলেকে দেখে কিছুতেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মনে হয় না। ওকে দেখে মনে হয় কল্পনার কোন রাজ পুত্তুর!সে যায়হোক এখন মূল গল্প বলি!
মেহরাব আসার পর ওর জন্য শরবত নিয়ে এলাম আমি।মা বললেন,’যা শরবত দিয়ে আয়।’
আমি এমন বোকা মেয়ে যে ওর হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দিতে গিয়ে ঝট করে খানিক শরবত ফেলে দিলাম ওর পাঞ্জাবির উপর।
সে আমার দিকে তাকিয়ে খানিক হাসলো।
আমি বললাম,:সরি!’
মেহরাব বললো,’সরি কেন?’
আমি লজ্জা মাখা গলায় বললাম,’আপনার পাঞ্জাবি ভিজিয়ে ফেলেছি বলে!’
মেহরাব তখন সরাসরি আমার মুখের উপর বলে দিলো,’আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।’
তখন বাবা মা কেউ এখানে নেই।আমি এই সুযোগে বললাম,’আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।যা শোনার পর আমায় পছন্দ তো দূরের কথা এ বাড়ি ছেড়ে কখন পালাতে পারবেন সেই সুযোগ খুঁজবেন।আমি ভাবছি আপনাকে নিয়ে পুকুর পাড়ে যাবো। ওখানে পুকুর পাড়ের সুপুরি বাগানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলবো। অবশ্য আপনাকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার আমার যথেষ্ট ভয় আছে। আপনি কী সাঁতার জানেন?’
মেহরাব অবাক হয়ে বললো,’পুকুর পাড়ের সাথে সাঁতারের কী সম্পর্ক?’
আমি বললাম,’সম্পর্ক আছে। আপনি যখন আমার মুখ থেকে কথাগুলো শুনবেন তখন শিউ্যর পুকুরে ঝাঁপ দিবেন।আর আসলে আমাদের পুকুরটা খুব গভীর। ওখানে ঝাঁপ দিলে সাঁতার ছাড়া গতি নাই।’
মেহরাব হাসলো।ওর দাঁত সরু এবং সাদা সাদা। সুন্দর মানুষের দাঁত হয় বাঁকা রোকা।ওর দাঁত সোজা। কোন ত্রুটি নেই।
সে হেসে বললো,’আপনি তো সাঁতার জানেন। আপনিই রক্ষা করবেন!’
আমি বললাম,’না। আমি সাঁতার জানলেও আপনাকে রক্ষা করবো না। আপনি সাঁতার জানেন কী না বলুন?’
মেহরাব আবার হাসলো। হেসে বললো,’গ্রামের সব ছেলে মেয়েরাই সাঁতার জানে। আমিও জানি।এমনকি আমার স্কুলের অনেক ছেলে মেয়েকেই আমি সাঁতার শিখিয়েছি!’
আমি আমতা আমতা করে বললাম,’তবে চলুন।’
মেহরাব বললো,’শিউ্যর।’

পুকুর পাড়ে ফাগুনের বাতাসে আম গাছের পাতা কাঁপছে। মুকুল থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ চড়াচ্ছে। মেহরাব বললো,’জায়গাটা দারুন!’
আমি বললাম,’আমার কথাগুলো শোনার পর স্বর্গকেও আপনার নরক মনে হতে পারে এই জায়গা তো তার তূলনায় নস্যি!’
মেহরাব খানিক চমকে উঠে বললো,’তাই!’
আমি বললাম,’হু।’
তারপর বলতে শুরু করলাম।
বললাম আমানের সাথে আমার সম্পর্কের কথা।গোপনে বিয়ে করার কথা। নিজের অনাগত সন্তানকে হত্যা করার কথা। ইউনিভার্সিটি হোস্টেলের ডাইনি পিয়ার কথা। এলিজার কথা। এবং আরো অনেকের কথা।
মেহরাব কথাগুলো শুনে কেমন কেঁপে উঠলো। সে তার চশমা খুলে আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’সবকিছু মেনে নিলেও একটা বিষয় কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারছি না?’
আমি ভয়মাখা গলায় বললাম,’কোন বিষয়টা?’
মেহরাব বললো,’এবরোশনের ব্যপারটা!কেন এমন করলেন আপনারা?একটা পবিত্র জীবন।একটা নিস্পাপ জীবন কী করে শেষ করে ফেললেন আপনারা!’
আমি এই কথার কোন উত্তর দিতে পারি না। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তিরতির করে।কান্না এসে যেতে চায়। কিন্তু কাঁদতেও পারি না!
মেহরাব তখন হুট করেই বললো,’আমি আপনাকে বিয়ে করবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
আমি চুপ করে রইলাম।
সে বললো,’কী শর্ত জানতে চাইবেন না?’
আমি বললাম,’বলুন।’
মেহরাব বললো,’আপনাকে আবার ফিরে যেতে হবে ঢাকায়। আবার পড়াশোনাটা রান করতে হবে।’
ওর কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ভয়ে কেঁপে উঠলো সমগ্র শরীর!কী সর্বনাশের কথা!এটা কোনভাবেই যে আর সম্ভব না।শুধু এই অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্যই যেখানে আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি আর উনি সেখানে বলছেন আমাকে আবার ঢাকায় যেতে হবে!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’এটা কখনোই সম্ভব না!’
মেহরাব বললো,’কেন সম্ভব না?’
আমি বললাম,’আমি ওখানে গেলে এমনিতেই মরে যাবো।ওরা আমায় নিয়ে তামাশা করতে করতে আমায় শেষ করে দিবে!’
মেহরাব হাসলো। হেসে বললো,’আর এখন যদি আপনি ঢাকায় না যান তবে আপনার কী হবে জানেন? আপনি আর কাউকেই বিয়ে করতে পারবেন না।ইভেন বাড়িতেও থাকতে পারবেন না।কারণ আপনার সম্পর্কে আমি সবকিছু জেনে গেছি। এখন যদি আপনি আমার কথা না শুনেন তবে আপনার বিষয়ে জানা কথা আমি সবার কাছে বলে দিবো!’
মেহরাবের কথা শুনে আমার নিজেকে এতো অসহায় মনে হলো!আমি ওর দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে তখন বললাম,’মেহরাব,প্লিজ আপনি আমার সাথে এতো বড়ো নিষ্ঠুরতাটা করবেন না।আমি সহ্য করতে পারবো না!’
মেহরাব আবার হাসলো। হেসে বললো,’আমি আপনার সাথে নিঠুর আচরণ করছি না।আমি আপনাকে উপযুক্ত করতে চাচ্ছি।আমি আপনার মাধ্যমে এদেশের হাজার হাজার নারীকে একটা শিক্ষা দিতে চাচ্ছি।আমি আপনাকে একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি।আমি চাই আপনি নারী জাগরণের নতুন দূত হোন।আমি চাই আপনি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হোন।আমি চাই আপনি আপনার ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটান।আমি চাই আপনি পরাজিত নয়,জয়ী হিসেবে আরেকবার গ্রামে ফিরুন। তারপর আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে।ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিয়ে হবে। এবং বিয়ের দিন আমি গলা ফাটিয়ে মানুষদের বলবো,আমি এমন এক মেয়েকে বিয়ে করছি যে ছিল তার সন্তান হত্যার সহযোগী।আমি আজ এমন এক মেয়েকে গ্রহণ করছি যে ছিল অন্যের স্ত্রী।আমি এমন এক মেয়েকে আমার নিজের করে নিচ্ছি যে অন্য একটা পুরুষের কাছে প্রতারিত হয়েছে। প্রতারিত মেয়েটা তার সহজাত মেয়েদের কাছে আরো বেশি প্রতারিত হয়েছিল, অবহেলা-অবজ্ঞার শিকার হয়েছিল। লজ্জিত হয়েছিল,কেঁদেছিল। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সে সংগ্রাম করে গিয়েছিল । সংগ্রাম করে সেই মেয়ে আজ সফল।সে আজ বিজয়ী।আমি আজ বিজয়ী এক মেয়েকে বিয়ে করছি,যে আজ সকল নারীর জন্য অনুপ্রেরণা!’
মেহরাবের এই কথাগুলো শুনে আমি ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলাম।আর আমি তখন বললাম,’আমি ঢাকা যেতে চাই। কিন্তু ওখানে পড়তে চাই না।অন্য একটা ইউনিভার্সিটিতে নতুন করে এডমিশন নিতে চাই। নতুন হোস্টেলে উঠতে চাই!’
মেহরাব বললো,’তাহলে আর এটা সংগ্রাম থাকবে না।সহজ কিছুই হবে।আর আপনাকে দেখে নারীরা অনুপ্রেরণাও পাবে না।আমি চাই আপনি সংগ্রাম করুন।যারা আপনাকে নিয়ে মজা করছে এক এক করে তাদের শিক্ষা দিন। আপনি যদি এক রাতে এলিজা আর তার বন্ধুদের শিক্ষা দিতে পারেন তবে অন্যদের কেন পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।মনে রাখবেন,মালালা কিংবা রোকেয়া ওরা কেউই একদিনে হয়ে যায় না। কিংবা সংগ্রাম ছাড়াও এদের কেউ চিনে ফেলে না। এদের কথা কেউ স্মরণ রাখে না। একজন রোকেয়া কিংবা মালালা হতে গেলে বৈরী আবহাওয়াতেও আপনাকে উড়তে শিখতে হবে।উত্থাল সমুদ্রে সাঁতরাতে জানতে হবে। সাঁতরে ঝাপটে ওপারে যেতে পারলেই আপনি সফল। ওখানেই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য আলো।আজ যারা আপনাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছে একদিন এই আপনাকে নিয়েই তারা গর্ব করবে। লোকেদের কাছে আপনার হোস্টেলের মেয়েরা কিংবা ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা বড় করে পরিচয় দিবে যে, আপনি ওদের কাছের কেউ। অর্থাৎ আপনার সফলতা ওদেরকেও আলোকিত করবে!’
মেহরাবের এতো সুন্দর সুন্দর কথার পরেও কিছুতেই না বলা যায় না। এমন আলোকিত একজন মানুষকে এভাবে ফিরিয়ে দেয়া যায় না। ফাগুনের বাতাস তখনও বইছে।সেই বাতাসে আমের মুকুল ঘ্রাণ চড়াচ্ছে।মেহরাবের পাঞ্জাবি তিরতির করে কাঁপছে। আমার শাড়ির আঁচল উড়ছে।কী যে ভালো লাগছে তখন।এই সময় ঠিক, মেহরাবের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,’মেহরাব,আমি আপনার শর্তে রাজি।’

___ প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত___


দ্বিতীয় অধ্যায় লিখবো আর মাস খানেক পর।আপাতত আমার পরীক্ষার জন্য লিখালিখি থেকে ছুটি নিচ্ছি। এতো দিন ধরে যারা কষ্ট করে আমার গল্প পড়েছেন তাদেরকে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা। ভালো থাকবেন সবাই।আর আমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করবেন কিন্তু!
__*__*__

কলঙ্ক পর্ব-১২

0

#কলঙ্ক
#১২তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার আগেই দরজায় টোকা পড়লো। এলিজা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
পিয়ার রুমমেইড ইলা এসেছে।ইলা আমার মোটামুটি কাছের বন্ধু।ওর সাথে এডমিশন টেস্টের কোচিং করেছিলাম একসাথে। সেই থেকে আমাদের পরিচয়। এরপর এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া। যদিও ওর সাবজেক্ট ভিন্ন।
ইলা এসে আমায় ডেকে ঘুম থেকে তুললো।
ঘুম থেকে উঠে চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে বিছানার উপর বসে বললাম,’ইলা কিসের জন্য এসেছিস?’
ইলা বললো,’দোস্ত, পিয়া যা বললো তা কী সত্যি?’
ইলার মুখ থেকে কথাটা শুনে মাথাটা আমার চক্কর দিয়ে উঠলো! তবে কী পিয়া তার কথামতোই কাজ করেছে?জনে জনে সবকিছু বলে দিয়েছে!
আমি কী আর উত্তর করবো এখন? কিছুই বলার নাই।চুপ করে নীচ দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।
ইলা বললো,’কিরে বল? এতো কিছু হয়ে গেলো আর তুই কিছুই জানাসনি আমায়!আমারচে কী পিয়া তোর আপন বেশি?’
এলিজা এবার কথা বললো।বললো,’ইলা আপু,তূর্ণা আপুর এমনিতেই মন খারাপ। আপনি এখন যান প্লিজ!’
ইলা ধমক দিলো এলিজাকে।বললো,’বড়দের কথায় তুই সুর মিলাচ্ছিস কেন?যা এখন তুই বাইরে যা।’
এলিজা চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল।
এবার ইলা আমার মুখোমুখি হলো। তারপর বললো,’জানিস পিয়া জনে জনে তোর বিষয়টা বলে দিয়েছে। এমনকি ইউনিভার্সিটিতেও অনেকেই জেনে গেছে। আমাকে তো একটু আগে মেসেঞ্জারে দুজন জিজ্ঞেস করলো ঘটনা সত্যি কি না!আমি বলেছি, কিছু জানি না।’
ইলার কাছে বসে থাকতে আমার খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে মরে টরে যেতে।সারা শরীর কেমন কাঁপছে আমার। আবার ঘামও হচ্ছে।মাথা বনবন করে ঘুরছে।চোখ জ্বলছে।কী করবো আমি কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
ইলা বসে থাকতে থাকতেই রুমে এলো আমার দু’ব্যাচমেট। পিংকি আর ইন্দ্রা।ওরা এসে ইলার মতো করেই কথা বললো। জিজ্ঞেস করলো ঘটনা সত্যি কি না?
আমি আগের মতই চুপ করে রইলাম।কারণ চুপ করে না থেকে তো কোন উপায় নাই।কী উত্তর করবো এদের কাছে!
ওরা আমায় নানা ভাবে জেরা করতে লাগলো।
ইন্দ্রা বললো,’তূর্ণা,ছেলেটার সাথে কী এখন তোর একদম যোগাযোগ নাই?’
ইলা উত্তর দিলো তার কথার।সে বললো,’ছেলে নাকি আমেরিকা চলে গেছে।শালা হারামী একটা। উড়াল দিছে মধু খেয়ে!’
পিংকি এমনিতে কথা কম বলে। কিন্তু আজ সেও মুখ খুললো।কথা বললো।সে বললো,’শালা সব ছেলেদের এই এক বদ অভ্যেস। মেয়েদের সাথে রিলেশন করে কোনমতে কনভিন্স করে ফেলতে পারলেই হলো।ছোঁয়াছোঁয়ি হয়ে গেলেই কেল্লাফতে!’
ইলা বললো,’ঠিক তাই।এদের বিলিভ করার চেয়ে একটা কাল সাপকে বিলিভ করা বেটার।’
তারপর ওরা তিনজন হেসে উঠলো।
ইন্দ্রা বললো,’এই আমাদের হাসা উচিৎ না। তূর্ণা ডিপ্রেশনে আছে।ওর মন ভালো না।চল আজ বিকেলে ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাই!’
ইলা বললো,’ঠিক আছে।চল যাই।’
আমি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,’আল্লার দোহাই লাগে বোন,তোরা এখন একটু এখান থেকে যা। আমার একটুও ভালো লাগছে না!’
ইলা বললো,’একা একা থাকলে তো আরও মন খারাপ থাকবে!’
আমি বললাম,’না।একা একাই বরং আমি ভালো থাকবো।যা প্লিজ তোরা এখান থেকে যা।’
ওরা তিনজন বিরক্ত মুখে রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আরো দুজন এলো।এই দুজনের মুখেও একই প্রশ্ন।সেই একই ধাঁচের কথা।
আমি এবারও চুপ। কিন্তু চুপ করে আর কতক্ষন থাকা যায়!
আস্তে আস্তে আমার রুমটা আর আমি যেন ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে গেলাম। এবার অন্য হোস্টেলে আমার যে বন্ধুরা ছিল তারাও খবর পেয়ে আসতে লাগলো। দুপুর বেলা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস রেখে বন্ধুরা আমায় দেখতে এলো। এদের মুখেও সেই একই ধরনের প্রশ্ন।কী সর্বনাশ!অতসব মানুষের সামনে নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছে আমার! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলতে!কী হবে এই অপমান নিয়ে বেঁচে থেকে?আজ থেকে তো আর রাস্তায়ও বের হতে পারবো না!স্যার ম্যামরাও জেনে যাবে। হয়তোবা জেনেও গিয়েছে এতোক্ষণে।আমি কী করে ওদের মুখ দেখাবো?

ভাবলাম সুইসাইড করবো। কিন্তু সুইসাইডও এখানে করা যাবে না।একের পর এক ট্যুরিস্টরা আসছেই।ট্যুরিস্ট স্পট দেখছে।দেখে আবার যেতে চায় না। এখানে বসে বসে কত কী যে তারা শুনতে চায়।আমান এমন করলো কেন হঠাৎ!বেবিটাকে নষ্ট না করলেই ভালো ছিল।বেবিটাকে নষ্ট করে অনেক বড় পাপ হয়েছে।এই পাপের কোন ক্ষমা নাই। আবার কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, এইসব ছেলেদের বিশ্বাস করতে নাই।প্রমাণ রাখতে হয়।পিক টিক তুলে রাখতে পারলি না!
আরেকজন বললো,’রেপড কেস করে দে।এটাই ভালো!’
এবার ওদের সামনেই উদ্ভট একটা কাজ করে বসলাম আমি। গতকালের মতো কালো বোরখা,মুজো , হিজাব আর নেকাবে নিজেকে আবৃত করলাম। তারপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে সোজা বেরিয়ে এলাম।
হোস্টেলের বারান্দায় অনেকেই আমায় ঘিরে ধরলো।ওরা আমায় ছাড়তে চায় না।যেন আমি চলে গেলে ওদের বিনোদনের ঘাটতি পড়ে যাবে!
আমি যখন বেরিয়ে যাবো তখন পিয়া আমার সামনে এলো। তারপর একবার চোখ মেরে আবার চলে গেল ওর ঘরের দিকে।
ওর চোখ মারাটা আমায় আর অতো কষ্ট দেয়নি।কারণ অমানুষের কোন কিছুতেই কিছু মনে করার নাই।যেমন মানুষ বলে না যে, কুকুর কাউকে কামড় দিলে তো আর তাকে কামড় দেয়া যায় না। সহ্য করতে হয়। আমিও সহ্য করলাম। সহ্য করে হোস্টেলের বারান্দা ফেরিয়ে একটা রিক্সা করে স্টেশনের পথ ধরলাম। রিক্সায় বসে থেকে অনেকবার মনে হয়েছে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি রাস্তায়। তারপর আমার উপর দিয়ে একটা বড় সড়ো মাল বোঝাই দেয়া ট্রাক কিংবা যাত্রী বোঝাই বাস চলে যাক।আমি ওই ট্রাক কিংবা বাসটার নীচে পড়ে চাপা পড়ে মরে যাই!
কিন্তু লাফাতে পারিনি! কেন জানি তখন কান্না পেতে লাগলো। বারবার মনে হতে লাগলো,মরতে আমি পারবো না।মৃত্যুকে আমি ভীষণ ভয় পাই! তখন নানান যুক্তি আসতে লাগলো আমার মাথায়।মনে হতে লাগলো,সোইসাইড করা তো মহাপাপ।সোইসাইড করলে তো চিরকাল জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে।আমি তো এই সামান্য কজনের অপমানে বুকে জ্বলতে থাকা আগুনটাই সহ্য করতে পারছি না। তবে কীভাবে পরকালের অত আগুন, সেই ভয়ংকর এবং কালো রংয়ের আগুন আমি সহ্য করবো!
পারবো না।আমি কিছুতেই এভাবে মরতে পারবো না!

বাড়ি ফিরতে রাত হলো। আমাকে এই রাত করে ফিরতে দেখে মা ভয় পেয়ে গেলেন।মা ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’কিরে?কী হয়েছে মা? এভাবে হুট করে চলে এলি যে?’
মার পেছন পেছন বাবাও এসে দাঁড়িয়েছেন।
আমি মার বুকের উপর এলিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলাম হাউমাউ করে।
মা আতংকগ্রস্ত গলায় বললেন,’কিরে?তূর্ণা কী হয়ছে তোর বল!বল মা!’
আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’মা,আমি আর ঢাকায় যাবো না! ওইখানে কোন ভালো মানুষ নাই! ওখানকার সব মানুষ নিষ্ঠুর!’
‘কী হয়েছে বল তো খুলে!’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,’মা,ওরা সবাই জেনে গেছে। উঠতে বসতে ওরা আমায় অপমান করে।আমি আর পারছিলাম না।মনে হচ্ছিল সোইসাইড করে মরে যাবো। কিন্তু আমি মরতে পারিনি মা। আমার ভয় করে মা!মরতে আমার ভয় করে!’
মা আমার মুখে আলতো করে চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,’কতো বড় সাহস তোর! মৃত্যুর কথা বলিস! তোকে কী বড় করেছি মরে যাওয়ার জন্য!আমি আগেই জানতাম এমন কিছু হবে। তোকে ঢাকায় যেতে এই জন্যই বারবার নিষেধ করেছিলাম।তোর ভাই শুনেনি। তুইও শুনিসনি। এখন কেমন হলো! আমার কপাল ভালো! আল্লাহ যে তোকে সহিহ সালামতে বাড়ি পর্যন্ত পৌছাইছে! আমার প্রাণ আমার বুকে ফিরাইয়া দিছে!’
তারপর মা আমায় ঘরে নিয়ে গেলেন।সে রাতেই বাবা মা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন এই কয়েকদিনের ভেতর তারা আমার বিয়ে দিবেন। এবং আমি যে এখন বাড়িতে কিংবা আমার যে বিয়ে হবে এই খবর কিছুতেই ভাইয়াকে শুনতে দিবে না তারা!

পরদিন সকাল বেলা বাবা ঘটককে খবর দিয়ে আনালেন। তারপর ঘটককে জিজ্ঞেস করলেন,’হরমুজ,ওই যে বারহাট্টার আলাপটা আনছিলে,যে ছেলেটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ওই ছেলে কী বিয়ে শাদি করে ফেলছে?’
হরমুজ ঘটক বললো,’জানতে হইবো ভাইজান।’
বাবা বললেন,’জেনে দেখো। বিয়ে করে ফেললে তো করেই ফেললো।আর যদি বিয়ে না করে তবে আবার আমার মেয়ের বিষয়ে আলাপটা করতে পারো।আমি নিজে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসবো। ছেলের বাড়ি দেখে আসবো!’
হরমুজ ঘটক বললো,’আইচ্ছা ভাইজান।’
বাবা হরমুজ ঘটককে পাঁচশো টাকার একটা নোট অগ্রীম বকসিস দিলেন। হরমুজ ঘটক কড়কড়ে টাকার নোট পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে বললো,’ভাইজান,বিয়া ছেলে করে নাই এখনও।’
বাবা অবাক হয়ে বললেন,’তাহলে আগে যে বললা কিছু জানো না তুমি?’
হরমুজ ঘটক পান চুন সুপুরিতে ক্ষয়ে যাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে বললো,’ইয়াদ ছিলো না ভাইজান।আইজকা আসি। ছেলের মার সাথে কথা বলে দেখি কী কই!রাজি হইলে আফনে যাইবেন তারার বাড়িতে।বিয়া হইবো এনশাল্লা মনে খাচ আশা রাখেন।’
বাবা হেসে বললেন,’আচ্ছা আশা রাখলাম।’
হরমুজ ঘটক লাজুক ভঙ্গি করে বললো,’ভাইজান এমনে না, কন এনশাল্লা আশা রাখলাম।’
বাবা হেসে উঠে বললেন,’ইনশাআল্লাহ,আশা রাখলাম।’
হরমুজ ঘটক চলে যাওয়ার পর বাবা মাকে বললেন,’আমেনা, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই বিয়েটা হবে!’
মা খুশিতে হেসে উঠে বললেন,’হয়ে গেলেই বাঁচি। আমার যে মেয়েটাকে নিয়ে কত টেনশন! রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারি না! ওইসব কথা লোকে জেনে গেলে কী যে হবে!ভাবতেই বুক কাঁপে!’
বাবা বললেন,’ঘটক খবর জানালেই আমি যাবো।দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ!’
মা বললেন,’তাই হোক তবে।’

ঘটক আমাদের বাড়িতে এলো দু’দিন পর রাতের বেলায়। ঘটকের মুখ মলিন।বাবা মনে হয় আশাহত হয়েছেন মনে মনে। তবুও হাসিমাখা মুখে বললেন,’খবর কী হরমুজ?’
হরমুজ ঘটক মুখ মলিন রেখেই বললো,’খবর ভালা আলহামদুলিল্লাহ।মেয়ের মা বলছে আফনি গিয়ে ছেলে দেইখা আসতেন।আফনের ইচ্ছা।যেকুনো দিন যাইতে পারইন।আফনে শিক্ষক মানুষ।শিক্ষক মানুষের মাইয়া তাদের ঘরের বউ হইবো এইটা শুইনা তারার বেকেই খুব আনন্দিত!’
বাবা বললেন,’তাই নাকি!’
বলেই পকেট থেকে আরেকটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে হরমুজ ঘটকের হাতে দিলেন। হরমুজ ঘটক লজ্জা মাখা ভাব করে টাকাটা হাতে নিলো। তবে এবার আর তার মুখ মলিন না।টাকা পেয়ে মুখে হাসি ফুটেছে।

বাবা গিয়ে দেখে এসেছেন ছেলেকে। ছেলের নাম আগেও বলা হয়েছিল। মেহরাব। যতোটুকু শোনা হয়েছিল তারচেয়েও নাকি বেশি সুন্দর দেখতে। বাড়ির লোক সকলও ভালো। বাবার খুব পছন্দ হয়েছে।বাবা বলেছেন, তাদের লোক সকল এসে দেখে যেতে। কিন্তু মেহরাবের মা বলেছেন,আমরা মেয়েকে দেখবো না। আপনার ঘর দোরও দেখবো না। ফরহাদ মাস্টারের মেয়ে আমার ঘরের বউ হবে এটাই আমার বিরাট পাওয়া!’
বাবা বললেন,’বিয়ের ব্যপারে আন্দাজে কাজ না করা ভালো!ছেলের উচিৎ মেয়েকে দেখা। আমার মেয়েরও তো পছন্দ আছে। দুজন দুজনকে দেখুক।কথা বলুক। পছন্দ হলে আলহামদুলিল্লাহ!’
বাবা কথা বলে চলে এলেন। বাড়িতে এসে বললেন, যেকোনো দিন ছেলে আসবে আমাদের বাড়িতে। আমাকে দেখবে। আমার সাথে কথা বলবে।
শুনে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম।ভয়ও হচ্ছিল খুব।ভয় হচ্ছে এই জন্য যে আমি একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।জানি না এমন সিদ্ধান্তের ফলাফল কতটা মন্দ হয়!

#চলবে

কলঙ্ক পর্ব-১১

0

#কলঙ্ক
#১১তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক


ওরা প্রায় বিছানার কাছাকাছি হতেই আমি ধরমড় করে বিছানার উপর উঠে বসলাম। আমাকে বসতে দেখেই ওরা কেমন থমকে গেল।একটা মেয়ে তো একেবারে দরজার কাছাকাছিই চলে গেল।
এলিজা তবুও বুক ফোলা ভাব নিয়ে আছে।
আমি হাঁটু দুটো ভাজ করে মাথার চুল ঠিক করতে করতে ঝাঁজালো গলায় বললাম,’কী?আয়।আয়না! এগিয়ে আয়!’
ওরা সব কজন ভয়ে চুপসে গেল।ভ্রু আর চুল কাটা মেয়ে দুটো এবার একেবারে বিড়াল সেজে গেছে।
আমি আবার বললাম,’আয়!আসিস না কেন এখন?’
এলিজা বললো,’আপনি কিন্তু আমার বন্ধুদের অপমান করছেন?আমি কিন্তু প্রভোস্ট ম্যামের কাছে কম্প্লেন করবো আপনার নামে?’
আমি বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বললাম,’কী কম্প্লেন করবি তুই আমার নামে?’
এলিজা বললো,’এটা কী আপনাকে বলতে হবে?’
আমার রাগ এবার মাথায় চড়ে বসলো। অনেক অপমান সহ্য করেছি।আর না।এই মেয়েগুলো বকে যেতে শুরু করেছে।সাহস বেড়ে গেছে এদের। এবার একটু শিক্ষা না দিলে অন্যসব বড় বোনদের সাথেও এমন বেয়াদবি করবে!
আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে এলিজার কাছে গেলাম এবং একহাতে ওর কান টেনে ধরে অন্য হাতে ওর গালে শক্ত করে দু দুটো চড় বসিয়ে দিলাম।চড় খেয়ে ও গালে হাত দিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। রুমের ভেতর ওর বন্ধুগুলো এতোক্ষণ যে এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা ততোক্ষণে দরজা খুলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।এলিজাও রুম থেকে বের হয়ে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেইনি। রুমের দরজা আটকে দিয়ে বলেছি,’এক পায়ে দাঁড়া।’
এলিজা বললো,’একপায়ে কেন দাঁড়াবো?’
আমি এবার ওর গালে আরো একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম,’দাঁড়া বলছি। নয়তো থাবরিয়ে চাপার সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব মেয়ে!’
এলিজা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো এবং এক পায়ে দাঁড়ালো।আমি এবার বললাম,’কান ধর।’
এলিজা কান ধরতে চায় না।
আমি ওকে ধমক দিলাম। এমন ভাবে ধমক দিলাম যেন আওয়াজটা বাইরে না যেতে পারে।
এলিজা ভয় পেলো। বুঝতে পারলো ও আমায় যা ভেবেছিল আমি আসলে তা না।
এলিজা কান ধরলো।
আমি এবার ওর দিকে চোখ লাল লাল করে তাকালাম। তারপর বললাম,’পিয়া তোর কাছে কী কী বলেছে?’
এলিজা চুপ করে থাকে।মুখ খুলে না।
আমি ওর কাছে গিয়ে মাথায় একটা জোরে চাটি মারতেই সে হড়বড় করে বলতে শুরু করলো।
বললো,’পিয়া আপু বলেছে, আপনি নাকি আমান ভাইয়ার সাথে মিছেমিছি বিয়ে করেছেন।মানে আপনার দু একজন বন্ধু জানে আপনি বিয়ে করেছেন কিন্তু আসলে এটা নাকি বিয়ে না।পিয়া আপুও নাকি বিষয়টা জানে।আর আপনি নাকি এই বিয়ের নাম করেই আমান ভাইয়ার সাথে হোটেলে হোটেলে রাত পাড় করতেন।এর পরেই নাকি আপনি কনসিভ করেন।কনসিভ করেছেন শুনে আমান ভাইয়া আপনার কাছ থেকে কেটে পড়ে।আর আপনি তখন অসহায় হয়ে এবরোশন করিয়ে নেন।’
‘কিন্তু তুই আমার সাথে এসব করছিলে কেন?তোর আমার সাথে শত্রুতা কী নিয়ে?’
এলিজা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’আপনি আমায় একটা চড় দিয়েছিলেন। সেদিন আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম!’
আমি তখন বললাম,’এই চড়টা সেদিন না দিলে তুই রেগুলার আমার সামনে বসে তোর বন্ধুর সাথে ওসব নোংরা ভাষায় কথা বলতি। বড়দের সামনে এভাবে কথা বলা যে অনৈতিকতা তা কোনদিন তোর বুঝে আসতো না! এভাবে তুই একদিন বকে যেতি।তোর ভালোর জন্যই সেদিন চড়টা তোকে দিয়েছিলাম।’
এলিজা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার শরীর কেমন কাঁপছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার ভেতর এখনও রাগটা আছে।সে আজকের এই অপমান কিছুতেই হজম করতে পারছে না।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,’শোন, তোকে একটা মাত্র চড় দিয়েছিলাম। কিন্তু এরচেয়ে অনেকগুণ বেশি আদরও তো করেছিলাম।আপন বোনের মতো দেখেছিলাম।নাকি আদর করিনি?আপন বোনের মতো দেখিনি?’
এলিজার চোখ ভিজে উঠলো।সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বললো,’আপু,আমি সরি!অতসব বুঝতে পারিনি আমি!’
আমি ওকে আমার পা থেকে তুলে এনে আমার বুকের কাছে ধরলাম। তারপর বললাম,’এলিজা,অন্যের কথা শুনে কখনো কিছু বিশ্বাস করতে নাই! তাছাড়া অন্যের খুঁত নিয়ে কখনো ঘাঁটাঘাঁটি করাও উচিৎ নয়।আজ তুই আমার খুঁত নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবি তো কাল বাদে পড়শু দেখবি তোর খুঁত নিয়ে অন্যজন দৌড়াদৌড়ি করছে। তখন তোর কেমন লাগবে বল?’
এলিজা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,’আপু,প্লিজ আমায় আর লজ্জা দিবেন না!’
আমি বললাম,’না। তোকে লজ্জা দেয়ার জন্য নয়। শিক্ষা দেয়ার জন্য বলেছি। এখন এক কাজ কর তুই।পিয়াকে ডেকে নিয়ে আয় এখানে!’
এলিজা সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এবং খানিক পরই পিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সে রুমে এলো।

পিয়া রুমে এসে বিরস মুখে বললো,’কিরে,আমায় খবর দিয়ে এখানে আনলে কেন?’
আমি মৃদু হাসলাম। তারপর বললাম,’তোর সাথে আমার শত্রুতা কী নিয়ে রে পিয়া?’
পিয়া বিরক্ত মুখে বললো,’এইসব বা*ল মার্কা আজাইরা কথা বলার জন্য আমায় এখানে ডাকিয়ে আনিয়েছিস?ফাউল!’
আমি আবার হাসলাম। হেসে বললাম,’বল।তোর সাথে শত্রুতা কী আমার?আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?’
পিয়া রাগ দেখিয়ে বললো,’মেজাজ কিন্তু বিগড়ে যাচ্ছে!খারাপ হবে কিন্তু!’
আমি আবার একই কথা বললাম।
বললাম,’বল। আমার সাথে কী নিয়ে শত্রুতা তোর বল!’
পিয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো।
আমি গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। তারপর বললাম,’তাহলে বলতে চাইচিস তোর সাথে আমার কোন শত্রুতা নাই?’
পিয়া ফুসফুস করতে করতে বললো,’না নাই। এখন হয়েছে?’
আমি বললাম,’না হয়নি। এখন বল,যেহেতু তোর সাথে আমার কোন শত্রুতা নাই তবে কেন তুই আমার বিষয়ে মিথ্যে কথাগুলো এলিজার কাছে বললি?’
পিয়া বললো,’যা বলেছি তা সত্যি। মিথ্যে কিছু বলিনি।তুই আমান না কামান‌ কী বা*ল নাম ছেলের।ওর সাথে তুই শুয়াশুয়ি করিসনি? পেটে বেবি নিয়ে ঘুরিসনি? বয়ফ্রেন্ড ছেড়ে চলে যাওয়ায় এবরোশন করাসনি?আরে শালা! উপকারের কথাটাও এভাবে ভুলে গেলি! তোকে তো আমিই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন!’
আমি বললাম,’মুখ সামলে কথা বল পিয়া।আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে ওসব করিনি। করেছিলাম আমার হাসব্যান্ডের সাথে।’
‘ও আচ্ছা।গুড।তাতে আমার কী?আমায় ডেকেছিস কেন?নাকি এখন শুনাতে চাস তোদের বাসর ঘরের কাহিনী?না এসব আমি শুনতে পারবো না!সময় নাই। পরীক্ষার ডেট হয়ে গেছে। এখন আমায় ছাড়!’
পিয়া চলে যেতে চাইলো।আমি ওকে যেতে দিলাম না।পথ রোধ করে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে বললাম,’তাহলে এলিজার কাছে এসব বলেছিস কেন?’
পিয়া হি হি করে হেসে উঠলো। হেসে বললো,’কোন আইনে লিখা আছে যে কারোর সম্পর্কে কিছু জানার পর তা অন্যের কাছে বলা যাবে না?’
আমার ভীষণ খারাপ লাগতে লাগলো। এবং রাগও উঠলো।আমি রাগ আর অভিমান মাখা গলায় বললাম,’ছিঃ পিয়া!তুই অতটা নীচ!অত নোংরা!’
পিয়া আমায় ধাক্কা দিয়ে বললো,’আর তুই?তুই কী রে বা*ল?তুই যে পেট বাঁধালি ওটা কী নেকের কাজ?সাওয়াব পাবি এতে?আর আমি একজনের কাছে বলেছি বলে পাপ করে ফেলেছি? আচ্ছা যা এই পাপ আমি আরো করবো।কাল দুপুরের আগেই দেখতে পাবি হোস্টেল আর ইউনিভার্সিটির হট নিউজ তুই!’
আমি চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে। ভয়ে ভয়ে বললাম,’পিয়া! আমার খুঁত নিয়ে কেন এসব করছিস?এতে তোর কী লাভ বল!প্লিজ যা হয়েছে তা ভুলে যা।আমরা তো বন্ধুই না?’
পিয়া আমায় ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে ফেলে দিয়ে বললো,’তুই আমার বন্ধু না,শত্রু।’
কথাটি বলে সে তার রুমের দিকে চলে গেল।
ও চলে যাওয়ার পর আমি বুকে প্রচণ্ড ব্যথা আর চোখ ভরা জল নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিক সময়ের জন্য নড়তেও ভুলে গেলাম।
এলিজা আমার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বললো,’আপু,কিচ্ছু হবে না।পিয়া আপু আপনাকে হুমকি দিয়েছে এমনি এমনি।আসলে ও কাউকেই কিছু বলবে না।বললে আগেই বলে দিতো।আর আমায় এমনিতেই বলেছে। হয়তো ভেবেছে আমি আপনার রুম মেইড। আপনার কাছ থেকে এমনিতেও আমি এক সময় সব জেনে ফেলবো!’
এলিজার কথা শুনেও আমার মন শান্ত হলো না। কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো।শরীর কাঁপতে লাগলো।মনে হলো আরেকটি ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য!

#চলবে

কলঙ্ক পর্ব-১০

0

#কলঙ্ক
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



সারাটা রাত আমার ঘুম হলো না।ঘুম হবে কীভাবে? মানুষ সবকিছু সহ্য করতে পারলেও অপমান সহজে সহ্য করতে পারে না!
বালিশের পেটে মুখ ডুবিয়ে সারা রাত ভর কাঁদলাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেল।মাথা ব্যথা হলো। সকাল বেলা বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে দেখি আমি কিছুতেই উঠতে পারি না। শরীর দূর্বল লাগে। আমার হঠাৎ করে মনে হচ্ছে আর না।আজকেই এখান থেকে আমার সরে যাওয়া উচিৎ। এখানে আরেকটা দিন থাকলে আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবো। বাঁচবো না!

বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম।জামাটা পাল্টে নতুন জামা পড়লাম। তারপর ব্যাগ থেকে কালো বোরখা টা বের করে পড়লাম। হাত পায়ে মুজো পড়লাম। হিজাব দিয়ে মাথা ঢেকে মুখে নেকাব পড়ে নিলাম। কাউকেই আর এই মুখ দেখাবো না।নিরবে নিভৃতে হোস্টেল ছেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াবো।চলে যাবো এখান থেকে চিরতরে।
কিন্তু তখন মনে কী যে এক খেয়াল এলো!মনে পড়ে গেল বাবার মুখটা।মার কথাগুলো।আমি বলেছি পারবো।পারতেই হবে যে আমায়!
তাছাড়া ট্রেনে বসে ভাইয়াকে কথা দিয়েছি আমি ভাইয়ার জন্য সব করতে পারি। এখন যদি হঠাৎ করে চলে যাই তবে ভাইয়া আর আমায় ভালোবাসবে না।আমার ছায়াটুকুও দেখতে পারবে না।বাবা মাকে কত বুঝিয়ে সুজিয়ে ভাইয়া রাজি করিয়েছে। এখন আমি বাড়িতে চলে গেলে ভাইয়া তো বাবা মার কাছেও ছোট হবে।আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,যতো কষ্টই হোক আমি করতে রাজি আছি। তবুও ভাইয়াকে বাবা মার কাছে ছোট করবো না!

পরিহিত বোরখাটা আবার খুলে ফেললাম।হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে দিলাম জায়গামতো। তারপর বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। বারবার এলোমেলো চিন্তা এসে যাচ্ছিলো মাথায়।আমি খুব চেষ্টা করছিলাম আমার ভ্রুণটাকে নিয়ে যেন কোন চিন্তা ভাবনা মনে না আসে! কিন্তু তবুও আসছিলো।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এবং খানিক সময় পরেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙলো সিগারেটের ধোঁয়া নাকে নিয়ে। চোখ মেলে দেখি রাত হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে আমি ঘুমিয়েছি। গতরাতে এলিজার যে চারজন বন্ধু এসেছিল ওরা আজকেও এসেছে। এদের সাথে আরো নতুন দুজন। এই মেয়ে দুটোকে দেখতে কেমন ছেলে ছেলে মনে হচ্ছে।পোশাক আশাক ছেলেদের মতো। চুলের স্টাইল বাজে! চোখের ভুরু মাঝখানে টান টান করে দু বার কাঁটা। যেন ওরা পশ্চিমা দেশগুলোর ফুটবল প্লেয়ার!

ওরা সিগারেট খাচ্ছে।স্ল্যাং ভাষায় কথাবার্তা বলছে। একজন আমাকে দেখিয়ে কী একটা নোংরা কথাও বলেছে।বাকী সব আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা কথাটা শোনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
আমি ভাবলাম আজ আর বিছানা থেকে উঠবো না। চুপচাপ ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকবো। তবে আর আমায় নিয়ে বেশি কিছু বলবে না। কিন্তু আমায় যদি একবার শুধু জাগ্রত দেখে তবে আমায় নিয়ে অনেক তামাশা করবে।কারণ ওরা সবাই জানে যে আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারবো না।কারণ প্রতিবাদ করলে ওরা সবকিছু প্রকাশ করে দিবে মানুষের কাছে।এটাই আমার দূর্বলতা।এই দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওরা এসব করছে!

কিন্তু ঘুমের ভান করেও রেহাই হলো না।ওরা একটা পরামর্শ করলো।চুল ছোট করে কাটা মেয়েদের একজন বললো,’দোস্ত,একটা গেইম খেলি চল!’
ওরা সবাই আগ্রহ ভরা গলায় বললো,’কী গেইম খেলবি?’
এলিজার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বললো,’তোর এই আপুকে একটু সাইজ করবো।তুই না বলেছিলে ও একদিন তোকে চড় মেরেছিলো।এর প্রতিশোধ নিবো।’
এলিজা বললো,’কীভাবে নিবি?’
‘তোরা ওর হাত পায়ে শক্ত করে ধরবি। একজন মুখেও চেপে ধরবি।আর আমি ওর সব জামা কাপড় টেনে টেনে খুলবো।’
ওর মুখ থেকে এমন কথা শুনে ওরা চোখ বড় বড় করে তাকালো। একজন বললো,’ধুর বা*ল!ওরে ন্যুড করলে কী হবে?ও কী ছেলে নাকি রে?নাকি আমরা ছেলে?’
চুল কাটা মেয়েটা হেসে বললো,’ওর কিছু পিক তুলবো। তারপর ওইগুলো মেমোরিতে রেখে ওকে প্রতিদিন জ্বালিয়ে মারবো। ওকে ব্ল্যাক মেইল করবো।দেখবি, তখন যা করতে বলবো স্ক্যান্ডাল ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে বেচারি সব করতে রাজি হবে!হি হি হি!’
ওদের প্রত্যেকেই কেমন করে যেন হেসে উঠলো। তারপর ওরা প্রস্তুত হয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার বিছানার দিকে ‌। ভয়ে আমার গা কাঁপছে।হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ওদের হাত থেকে আমার বাঁচার উপায় কী?আমি কী করবো এখন? আমার কী করা উচিৎ আসলে?

#চলবে