#কলঙ্ক
#৯ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
এলিজা কাছে এসেই বললো,’আপু কেমন আছেন আপনি?’
আমি মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।যাক বাঁচা গেল। তাহলে এলিজা এসবের কিছুই জানে না।আর ঘটনার দিন সে হোস্টেলে ছিল না।তার দাদির অসুস্থতার কারণে বাসায় ছিল। নয়তো সবকিছু জেনে যেতো!
মনে মনে আমি পিয়াকেও ধন্যবাদ দিলাম। ভাবলাম, আমি তাকে যা ভেবেছি আসলে সে এমন না। হয়তোবা সে কারোর কাছেই বিষয়টা বলেনি। শুধু শুধু আমার উপর রাগটা ঝেড়েছে।ওই যে আমাদের পুরনো দিনের ঝগড়া করার অভ্যেস,ওই অভ্যেস থেকেই এমনটা করেছে সে!
‘
কিন্তু রুমে গিয়েই দৃশ্যপট বদলে গেলো। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানা ঠিক করছি আমি। তখন এলিজা বললো,’আপু, ভাইয়া কী পরে কোন যোগাযোগ করেনি?’
ওর মুখ থেকে কথাটা শুনে ভেতরটা আমার কেঁপে উঠলো।মাথা কেমন ঘুরতে লাগলো।
আমি তবুও নিজেকে ঠিক রেখে বললাম,’কোন ভাইয়ার কথা বলছিস?’
এলিজা সামান্য হাসার ভাব করলো। তারপর বললো,’আপনার হাসব্যান্ড এর কথা বলছি!আমান না কী যেন নাম।ওই যে আপনাকে ফেলে রেখে কোথায় জানি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে?’
আমি চুপ করে গেলাম একেবারে। এখন আর কথা বলা যাবে না।পিয়ার প্রতি যে মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া পেশ করেছিলাম এর জন্য এখন দুঃখ হচ্ছে।আর মনে হচ্ছে,পিয়া শুধুমাত্র ঝগড়াটে মেয়ে নয়,ও একটা অমানুষ ।ওর সন্দেহ ছিল আমার প্রতি আগে থেকেই। এবং এমন একটা সুযোগই খুঁজছিলো সে। সেদিন এলিজা বাসায় চলে গেল, আমিও একা,সেন্সলেস হয়ে গেলাম।পিয়ার চোখেও পড়ে গেলাম সেন্সলেস অবস্থায়।সে নিয়ে গেল হসপিটালে।আর সবকিছু জেনে গেলো।ঝগড়া হয় ওর সাথে এর বেশি কিছু নয়।তাও যে এইসব ঝগড়া বড় কিছু নিয়ে তাও না।আর ঝগড়াও খুব বড় হয় না।এই সামান্য একটা বিষয়ের জন্য পিয়া আমার সাথে এমন করতে পারলো?না জানি আরো কত কী বাড়িয়ে বলেছে আল্লাহ জানে!
এলিজা আগে আমায় প্রচন্ড ভয় পেতো।ভয় পাওয়ার কারণ হলো ও যখন প্রথম প্রথম হোস্টেলে উঠলো তখন একদিন আমার সামনে ওর বন্ধুর সাথে ফোনে এমন একটা স্ল্যাং শব্দ বললো যা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল।আমি সেদিন নিজেকে সামলাতে না পেরে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম।চড় খেয়ে ও বোকার মতো তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।আমি তখন ওকে কাছে টেনে নিলাম।আদর করে বললাম,’বড় বোনদের সামনে এভাবে কথা বলা অভদ্রতা। এবং চরম বেয়াদবি।আর কখনো এমন করিস না!’
এলিজা লজ্জায় লাল হয়ে যেতে যেতে বলেছিলো,’সরি আপু!আর কখনো এমন হবে না!’
এরপর থেকে আমায় বড় বোন বলে সম্মান করে কথা বলতো। আমার সামনে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে চাইতো।কথা বললে আমার সাথে ভয়ে কাঁপতো।
ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েগুলোর এমন হয়ই।এরা একটা বছর ইউনিভার্সিটির সিনিয়রদের কাছে মুরগি হয়ে থাকে।না থাকতে চাইলেও এদের মুরগি করে রাখা হয়। এলিজার সাথে ওই ঘটনাটা ছাড়া আর কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি আমি। নিজের বোন ভেবে ওকে তুই তুকারি করি। নিজের জন্য কোন ভালো খাবার বাইরে থেকে আনলে ওকে না নিয়ে মুখে দেই না।আর এই মেয়েটাই আজ আমায় ঘা দিয়ে দিয়ে পঁচা কথা বলছে!
এলিজা এবার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,’আপু, আপনার প্রাগন্যান্সির কয় মান্থ হয়েছিল?’
আমি কথা বলি না।মাথা নত করে বিছানায় পা গুটিয়ে বসে থাকি।ও মিটিমিটি হাসে। তারপর আবার মুখ মলিন করে বলে,’রাগ পাচ্ছেন কেন? আপনি তো জানেন না।পিয়া আপু যখন বললো পাঁচ মাসের একটা বাচ্চাকে মেরে ফেলেছেন আপনি মানে এবরোশন করিয়েছেন শুনে এমন খারাপ লাগলো!আপু, আপনি কাজটা ভালো করেননি। আপনি কী জানতেন না বিবাহ ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে মিলিত হওয়া হারাম।হাদিসে আছে কোন মেয়ে যদি জেনা করে তবে পরকালে তার সাথে একটা আগুনের ফেরেশতা সেক্স করবে। তারপর মেয়েটা কনসিভ করবে। মেয়েটার পেটে আসবে একটা আগুনের বাচ্চা। সেই বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে কী হবে বুঝতে পারছেন?’
আমি ওর দিকে তাকাতে পারছি না। কিন্তু ওর সাহস মাপছি।ওর মুখে এসব নোংরা কথা কীভাবে আসছে?তাও আমার নাকের ডগায় বসে বসে বলছে!
কিন্তু আমি আর কী করবো? কথা বলতে গেলেই তো বিপদ। এমনিতেই সব গেলো।মান সম্মান চুলোয় গিয়েছে।তল্লাটে যে সিকিভাগ আছে তার রক্ষা করতে না পারলে সর্বনাশ হবে! বেঁচে থাকার শেষ সম্বল একেবারেই যে খুইয়ে যাবে!
‘
একদিন এখানে থাকার পর আমি বুঝতে পারলাম ঘটনাটা পিয়া আর এলিজা ছাড়া আর কেউ জানে না।ওরা জানাইনি।তাই অন্য কেউ কিছু বলেওনি। এমনকি সেদিন যে মেয়েটা হেসেছিল সেও কিছু জানে না।ও এমনিতেই হেসেছিল।
‘
এরচেয়ে খারাপ কিছু ঘটলো এর পরদিন। এলিজা তার তিনটে মেয়ে বন্ধু নিয়ে এলো ঘরে।এলিজাকে নিয়ে চারজন।ওরা রাতে এখানে থাকবে। এলিজা একটু পর বললো,’আপু, আপনি ঘুমিয়ে যান আজ সকাল সকাল।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কেন? আমার তো পড়াশোনা আছে।এক্সাম খুব কাছে!’
এলিজা কড়া গলায় বললো,’আপনাকে ঘুমোবার কথা বলেছি শুনেননি!যান।মশারি খাটিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’
আমি ধমকে উঠতে চেয়েছিলাম এলিজাকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই হোশ ফিরে এলো।মনে মনে ভাবলাম, সর্বনাশ করে ফেলেছিলাম তো!ওকে ধমক দিলে ও সারা হোস্টেল চিৎকার করে এক করে ফেলতো। তারপর সবাইকে বলে দিতো আমার বিষয়ে জানা সবকিছু!
আমি ওর কথা মেনে ধীরে ধীরে হেঁটে বিছানার কাছে গিয়ে মশারি খাটালাম। তারপর বিছানায় ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু চোখে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না।ওরা চারজন খুব জোরে জোরে চিল্লাপাল্লা করছিলো!
এলিজা হঠাৎ ওদেরকে বললো,’মামারা,তোদেরকে আজ একটা সারপ্রাইজ দিবো!’
ওরা অবাক হয়ে বললো,’কী?’
এলিজা তাড়াতাড়ি করে ওর ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট বের করলো। সাথে একটা দিয়াশলাইয়ের প্যাকেট।
বাকী তিনজন জিনিসটা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। কিন্তু ওদের থেকে একজন চাপা গলায় বললো,’এই,আপু মনে হয় এখনও ঘুমাননি!উনি দেখলে সর্বনাশ হবে!’
এলিজা ফিক করে হেসে উঠলো। হেসে ওই মেয়েটার নিতম্বে চাপড় মেরে বললো,’ও সজাগ থাকলেই কী আর ঘুমালেই কী বা*ল এসে যায় রে ?আমি ওর বাপের পয়সায় সিগারেট কিনি নাকি ও আমার মার পেটের বোন হয়?’
বাকী তিনজন ওর দিকে অবাক চোখে তাকায়। তারপর বুঝে ফেলে মুহূর্তে এই রুমে আমি কতটা অসহায় প্রাণী। এবার ওরা তিনজনও সমান তালে স্ল্যাং ভাষা ইউজ করতে থাকে।কী সব নোংরা নোংরা গল্প যে ওরা করে!
এবার চারজনে সিগারেট ধরায় একসাথে। এলিজা একাই তিন তিনটে সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে টান দেয়। তারপর ধুয়োটা আমার দিকে ছেড়ে দিয়ে একটা স্ল্যাং বাক্য ছুঁড়ে!
বাকী তিনজন একে অপরের উপর গড়াগড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে অট্টহাসি হাসে।
আর আমি শুয়ে থেকে মুখে শক্ত করে ওড়না চেপে ধরে কাঁদি।আর মনে মনে ঠিক করি কালই চলে যাবো আমি এখান থেকে। এখানে আর এক দন্ডও নয়। এখানে থাকলে পড়াশোনা তো দূরের কথা এমনিতেই মরে যাবো আমি।ওরা আরো বেশি কিছু করবে। কিন্তু আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারবো না। প্রতিবাদ করতে গেলেই তো ওরা আরো বাড়বে। তখন জনে জনে আমার নামে লাগিয়ে বাড়িয়ে ওইসব নোংরা কথা প্রচার প্রসার করবে!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০৯
কলঙ্ক পর্ব-০৮
#কলঙ্ক
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
মেয়েটি আমায় কিছুই বললো না । হেসে হেসে আমায় পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। তবে ওর এই চলে যাওয়াটাই আমায় আরো বেশি কষ্ট হলো।মনে হলো ওর এই হাসিটা স্বাভাবিক কোন হাসি নয়। এই হাসিটা রহস্যের।এই হাসিটা ও হেসেছে আমার প্রতি ঘৃণা ছুঁড়ে দিতে।ও আমার সামনে দিয়ে হেসে যেতে যেতে আমায় এটা বুঝিয়েছে যে আমি হাসার পাত্র।আমায় দেখে মানুষ এমনিই হাসবে।এটাই বরং স্বাভাবিক!
‘
আমার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ানক রকমের শকডটা খেলাম আমি।ঘরটা বাইরে থেকে লক করা।প্রতিটা রুমে দুজন করে থাকে এখানে। আমার রুমে থাকতো এলিজা।এলিজা কী এই রুম ছেড়ে দিয়েছে? ছেড়ে না দিলে তালাবদ্ধ কেন?
তারপর মনে হলো কী সব আবোল তাবোল ভাবছি আমি।ও হয়তো কোথাও গিয়েছে।আর কোথাও গেলে তো ঘরে তালা লাগিয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক!
‘
এই হোস্টেলটা অনেক শৃঙ্খল বদ্ধ।যা হবে ঘরের ভেতরেই।মেয়েরা আড্ডা মারুক আর ঝগড়া করুক সব রুমের ভেতরে। বাইরে কোন কিছু না।এমনকি কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলেই মেয়েরা বারান্দায় নামে এ ছাড়া সব সময় ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকে।
আমি তখনও দাড়িয়ে আছি আমার ঘরের সামনে। এখন ক্লান্তি লাগছে। মাগরিবের আজান পড়ে যাবে যাবে মনে হচ্ছে।ঘড়ি দেখেছি।এক ঘন্টা তেত্রিশ মিনিট ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।নড়ছিও না ভয়ে।কেউ দেখে ফেলে যদি ওসব কথা জিজ্ঞেস করে বসে তাই!
হাতে যে ফোন আছে সেই ফোনের দুটো সিম কার্ডই নতুন। পুরনো সিমকার্ড নষ্ট করে ফেলেছি। আমার ভয় ছিল যে কেউ যদি ওই নম্বরগুলোতে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে এসব ব্যপারে। হোস্টেলের ওরাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতো। তখন কী উত্তর দিতাম আমি? তাছাড়া ঢাকায় ফেরার কোন আশাও ছিল না আমার।মনে মনে বাবা মার সিদ্ধান্তই মেনে নিয়েছিলাম। এতো দিনে অন্যের ঘর সংসার সামলাতাম। হয়তো এখন এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে চুলোর ভেতর লাকড়ি গুঁজে দিতাম। চুলোর ঝাঁজালো ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে একটু পর পর খুক খুক করে খাশতাম!
‘
এতোক্ষণ যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো। আমার রুমের পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো সেই মেয়েটি যে আমায় হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল।ওর নাম পিয়া।পিয়া আমায় দেখে যেন একটা ধাক্কা খেলো। তারপর এক গাল হেসে বললো,’আরে দোস্ত তুই!আমি কী সত্যি দেখছি না মিথ্যে?বল বল,সত্যি সত্যি তোকে দেখছি?ইউ আর তূর্ণা, বেইবি?’
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। এবং দুঃখও হচ্ছে আমার।কথা বলতে পারছি না।কী বলবো না বলবো বুঝতে পারছি না।তাই আঙুল কুটছি। এমন হয় প্রথম প্রেমের বেলায়। প্রেমিকের প্রথম কথায় কোন উত্তর করতে না পেরে সব মেয়েরাই আঙুল কুটে।বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আমার হলো উল্টো।আমি একটা পরিচিত মেয়ের সামনেই এমন করছি।
পিয়া শব্দ করে হাসলো। তারপর আমার চোখের সামনে ওর হাত এ পাশ ও পাশ নাড়িয়ে বললো,’কিরে কথা বলছিস না কেন?ঘুমোচ্ছিস?ওহ সরি!তুই তো আর হরস না যে এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাবি!তুই হলি মানুষ।মানুষেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোতে পারে না। তবে প্রেমিকের গায়ের সাথে মিশে গেলে পারে।চার টেঙে দাঁড়িয়ে ঘুম। আহ্ কী আরাম!’
আমার চোখ জলে ভিজে উঠেছে।কান্না পাচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে ফিরতি ট্রেনটা ধরে সোজা বাড়ির দিকে ছুটে যেতে। ওদিকে এলিজাও আসছে না।
পিয়া আমার জলভরা চোখ দেখে বললো,’ওমা, চোখে যে জল এসে গেল একেবারে বেচারির!এই আমি কী তোকে মন্দ কিছু বলেছি রে?আমি কী বলেছি, তুই একটা ছেলের সাথে সেক্স করে প্রেগন্যান্ট হয়েছিস?বলেছি এসব? তারপর আবার এবরোশন করে হাত পা চোখ হার্ড নাক কান মুখ হয়ে যাওয়া একটা বেবিকে কসাই ডক্টর দিয়ে খুন করিয়েছিস!বলেছি?’
আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’প্লিজ পিয়া আমি তোর দুটো পায়ে পড়ি!তুই আমায় এভাবে লজ্জা দিস না!প্লিজ পিয়া প্লিজ!’
আমি কাঁদছি। মুখে ওড়না চেপে ধরে কাঁদছি।আর মনে মনে ভয় পাচ্ছি কেউ যদি হঠাৎ এসে দেখে ফেলে এভাবে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছি!
ভেবেছিলাম আমায় এভাবে কাঁদতে দেখে পিয়ার মায়া হবে।সে হয়তো আমায় সান্তনা দিবে। আমার সাথে আর দূর্ব্যবহার করবে না। কিন্তু এসবের কিছুই করলো না সে। মুখটাকে কেমন ভেংচি কেটে সে তার ঘরের দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো আমার মুখের উপর দিয়ে।আমি বোকার মতো ওর বন্ধ করা দরজার দিকেই তাকিয়ে রইলাম।
‘
দীর্ঘ তিন ঘণ্টা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর এলিজার নাগাল পেলাম। এলিজা আমার জুনিয়র। অবশ্য ডিপার্টম্যান্ট আলাদা।আমি পড়ি ইংরেজিতে।আর ও পড়ে ইলেকট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।ও আমায় দেখেই দূর থেকে ফিক করে হেসে উঠলো।ওর হাসি দেখেই আমার ভেতর ভয় জেগে উঠলো।মনে হলো এলিজাও আমায় নিয়ে মজা করে হাসছে।আমি যে ওদের কাছে ঘৃণার পাত্র তা হাসি দিয়ে দিয়ে ওরা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমায়!
এলিজা কাছে আসছে আর ওর হাসি বাড়ছে।মনে মনে নিজেকে আমি স্থির করে নিচ্ছি।পিয়া একটু আগে অনেক কিছু বলেছে। এখন বলবে এলিজা। আমাকে শুনতে হবে।আর হজম করে ফেলতেও হবে এসব। আমাকে কোন উত্তর দেওয়া যাবে না। আমার কান্না পাচ্ছে।আমি কী করে এই হোস্টেলে দিনগুলো পাড় করবো?একটা দিনই তো আমার কাটবে বলে মনে হচ্ছে না! এরচেয়ে তো বিয়ে করে অন্যের ঘর সংসার সামলানোই ভালো ছিল! ভাইয়ার কথা মানা আমার মোটেও উচিৎ হয়নি! ভুল করেছি আমি। আরেকটা বড় সড়ো ভুল করে ফেলেছি আমি!
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০৭
#কলঙ্ক
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
সাত-পাঁচ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম বাড়ি থেকে।যাওয়ার সময় মা খুব কাঁদলেন।আমায় জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে সুজিয়ে বললেন,’তোরে অনেকেই অনেক কিছু বলবো।তুই চুপচাপ শুনবি কিন্তু কোন কথা বলবি না।মনে রাখিস যে সহ্য করে সেই বড়ো।যে বলে সে কখনো বড় হতে পারে না!’
আমি বললাম,’তুমি টেনশন করো না তো একদম মা। আমাকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না।আমি ঢাকায় যাচ্ছি এখন শুধুমাত্র একটা উদ্দেশ্যে। এখন থেকে একটাই কাজ আমার। পড়াশোনা করা। নিজের ক্যারিয়ার গড়া।লোকের মন্দ কথা শোনার সময় আছে নাকি আমার!’
বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন একটু তফাতে। আমার এই কথাটা শোনার পর তিনি এগিয়ে এলেন আমার কাছে। এসে আমার একটা হাত মুঠো করে ধরলেন। তারপর সেই হাত তার বুকের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন,’আমার মন বলছে মা তুই বড় হবি।প্রতিষ্ঠিত হবি। হয়তো তোর অনেক বাঁধা আসবে।ঝড় ঝাপটা পোহাতে হবে।এসবে দমে গেলে চলবে না।বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারলেই মানুষ সফল।উঠতে না পারলে ব্যর্থ।ব্যর্থদের কেউ কখনো মনে রাখে না।এমনকি নিজ পিতাও না।সফলদের সবাই মনে রাখে। তাদের গুণগান গায়।পিতাও পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। এখন গ্রামের সবার কাছে তোর পরিচয় ফরহাদ মাস্টারের মেয়ে।আমি চাই তুই এমন জায়গায় যা যেন মানুষ আমার পরিচয় বলতে গিয়ে বলে অমুকের বাবা!’
আমি ভেবেছিলাম আর কাঁদবো না।বাড়ি থেকে শুকনো চোখ নিয়ে যাবো।আমি ভেবেছিলাম সেদিন রাতের পর থেকে আমার চোখের সব জল আপনা আপনি শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ফাগুনের আধো শীতল হাওয়ায় বাবার বুকে জলের মতো ঝাপটে পড়লাম আমি।বাবা আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন তার বুকের ভেতর। আমিও একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখির ছানার মতো বাবার পেকে সাদা হওয়া লোমশ বুকের ভেতর লুকিয়ে যেতে লাগলাম।আর কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়ে দিতে লাগলাম বাবার বুকের সাদা সাদা লোমের ক্লান্ত শরীর।
বাবাও হয়তো কাঁদছেন। ভেতরে ভেতরে।পুরুষরা এমনই।ওরা কাঁদে। ভয়ংকর রকম কাঁদে। কিন্তু কেউ দেখতে পায় না।ওরা মেয়েদের মতো চোখ ভিজিয়ে কাঁদে না। টপটপ করে গাল বাইয়ে জল ফেলে না নিচে।ওরা শব্দ করে কাঁদতে পারে না।ওরা কাঁদে লুকিয়ে চুরিয়ে। ওদের কান্নার শুরু শেষ বুকের ভেতর।আমি শুনতে পাচ্ছি এখন। খুব স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি বাবা কাঁদছে। তার বুকের ভেতর কান্নার শব্দ হচ্ছে।জল গড়িয়ে পড়ছে মনের চোখ থেকে।টপটপ, টপটপ শব্দ হচ্ছে সেই জল গড়িয়ে পড়ার।বাবারা এমন কেন? সন্তানকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকম ভালোবাসে।অথচ তার সন্তান কোনদিন তা বুঝতেই পারে না!
‘
ভাইয়া তাড়া দিলো। বললো,’তোমরা যা শুরু করছো ট্রেন তো মিস্ হবে!’
বাবা আমায় ছেড়ে দিলেন।হাতের পিঠে চুমু এঁকে দিয়ে বললেন,’যা মা যা।কাঁদিস না কেমন!মন খারাপ করিস না কখনো কোন কিছু নিয়ে।সব সময় ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখিস। ঠিকমতো নামাজ আদায় করিস।কেউ কখনো কটুকথা বললে তুই উত্তর দিস না সাথে সাথে।তুই বরং এইসব কথা এসে তোর আল্লার কাছে বলিস।জায়ানামাজে বসে ইচ্ছামতো কাঁদিস। শোন মা, মানুষের দরবারে কেঁদে কেটে একসাগর জল ফেলার চেয়ে আল্লাহর দরবারে এক ফোটা জল ফেলা বেশি উত্তম।আমি চাই তুই উত্তম কাজটাই করবি।আর জ্ঞানীরা কখনো ভুল করে না।তুই জ্ঞানী মানুষ। দ্বিতীয় ভুল তোর মাধ্যমে কিছুতেই হতে পারে না!’
আমি বাবাকে কথা দিলাম। বাবার হাত ধরে বললাম,’আমি আর ভুল করবো না বাবা ইনশাআল্লাহ!’
‘
ঝকঝক করে ট্রেন ছুটছে।আমি জানলার পাশে বসেছি। ভাইয়া আমার ও পাশে। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’তূর্ণা তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। কেমন সুখি সুখি দেখাচ্ছে। আচ্ছা তুই কী মনে মনে খুব আনন্দিত কোন একটা কারণ নিয়ে?’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,’অফকোর্স আনন্দিত।কারণ আমি তোর মতো এমন লক্ষ্মী একটা ভাই পেয়েছি এই জন্য।’
ভাইয়া বললো,’খুশি হলাম শুনে। আচ্ছা এখন শোন, ভাইয়ার জন্য তুই কী কী করতে পারিস বল তো?’
আমি আবার হাসলাম। এবার হাসলাম গাঢ় করে। কিন্তু শব্দহীন। তারপর বললাম,’সবকিছু করতে পারি।যা বলিস তাই করবো ইনশাআল্লাহ!’
ভাইয়া হাসলো। হেসে বললো,’যদি বলি ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে?’
আমি ঝটপট বলে দিলাম,’তাও পারবো।’
ভাইয়া এবার বললো,’উহু। এভাবে ঝটপট করে উত্তর দিলে তো হবে না।একটু ভেবে বলতে হবে। চিন্তা ভাবনা না করেই যে কথা বলে সে হলো গর্দভ।তুই জ্ঞানী মানুষ।জ্ঞানী মানুষ অনেক ভেবে চিন্তে কথা বলে।’
আমি এবার অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম। তারপর বললাম,’ভাইয়া,আমি জানি কারোর কথায় মরতে যাওয়া বোকামি। কিন্তু তোর প্রতি আমার যে ভালোবাসা আর সম্মান আছে তার জন্য আমি মরতেও কখনো দ্বিধা করবো না।’
ভাইয়া এবার আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বললো,’তোর কোন পরিবর্তন হয়নি।তুই কী করবি জানিস?আমান ফিরে আসলে ওকে আবার একসেফ্ট করে বসবি!’
আমানের নামটা শুনে ঘেন্নায় আমার মুখে থুথু জমে উঠলো।জানলা দিয়ে সত্যি সত্যি আমি একদলা থুথু ফেললাম। তারপর বললাম,’ভাইয়া,এই কুকুরটার নাম আর কখনো আমার সামনে উচ্চারণ করিস না।আমি ওকে একটা কুকুরের চেয়েও বেশি ঘৃণা করি!’
ভাইয়া হাসলো। হেসে বললো,’কিন্তু ও যখন ফিরে আসবে।দশটা মিথ্যে বলে তোকে সাতপাঁচ বোঝাবে। তখন তো একেবারে গলে যাবি।দরদ উথলে উঠবে একেবারে?’
আমি প্রায় কান্না করে দিলাম।টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ার আগেই ভাইয়া হাতের তালু বাড়িয়ে দিলো। কুড়িয়ে নিলো আমার চোখের জল।যেন এটা সাধারণ কোন জল নয়।যেন অমূল্য কোন রত্ন। ভাইয়া বললো,’আর কাঁদিস না।আমি বলছি তুই সাকসেস হবি।হবেই হবি ইনশাআল্লাহ!’
আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া হাসছে।হাসলে ভাইয়াকে অনেক সুন্দর লাগে!
‘
হোস্টেলের বারান্দায় পা ফেলতেই আমার বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠলো।বাড়ি থেকে গাড়ি থেকে নিয়ে আসা বাবা মা ভাইয়ার মোটিভেশন গুলো মুহূর্তে উবে গেল।ওই যে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছে একটা মেয়ে। মেয়েটার সাথে কোনদিন আমার কথা হয়নি। তবে সে এই হোস্টেলেই থাকে। আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সম্ভবত আমার ব্যাচমেট। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি গুলোতে পরিচয় টরিচয়ের ব্যপারগুলো অত গুরুত্ব পূর্ণ নয়। মেয়েটা হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে।যেন আমায় কিছু বলবে। আচ্ছা ও কী আমায় জিজ্ঞেস করবে বাচ্চাটার কী হলো? এমন ভাবে বলবে যে, এই, তোমার কী বেবি হয়েছিলো তূর্ণা? ছেলে না মেয়ে?
আমার কান্না এসে যাচ্ছে। ঠোঁট কেমন তিরতির করে কাঁপছে।নাকে সর্দি জমে উঠছে।আমি মাথায় ওড়নাটা ভালো করে টেনে দিয়ে মাথা নত করে হাঁটছি। আমার হাতে ব্যাগ।ব্যাগটাতে কয়েক সেট কাপড় ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। তবুও মনে হচ্ছে এই ব্যাগটার বিরাট ওজন। এই ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে আমার কষ্ট হচ্ছে।মেয়েটা আমার কাছে এসে গেছে। একেবারে কাছে এসে গেছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখন মুখ খুলবে। তারপর কথাটি বলবে।আমি কী ওর কথাটি সহজে নিতে পারবো?
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০৬
#কলঙ্ক
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
আমি ভাইয়ার দিকে তাকাতে চাইলাম।তার ডাকের সাড়া দিতে চাইলাম। কিন্তু সম্ভব হলো না।এর আগেই শরীর কাঁপতে লাগলো কেমন। তারপর সেন্সলেস হয়ে গেলাম আমি!
চোখ খুললো আমার ঘন্টা খানেক পর। চোখ খুলে দেখি আমি খাটের উপর শুয়ে আছি।মা আমার মাথায় পানি ঢালছে। বাবা খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে।আর ভাইয়া তখনও আমার হাত ধরে বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে।তার চোখ টলমল করছে জলে। আমার চোখের পাতা খুলতে দেখেই সে টপটপ করে চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল ছেড়ে দিলো। তারপর এই কান্নার মাঝেই হেসে ফেললো, শব্দহীন ভাবে।আর আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে বললো,’এখন কেমন লাগছে তূর্ণা?’
আমি কান্নামাখা গলায় বললাম,’ভালো।’
ভাইয়া একহাতে তার চোখ মুছতে মুছতে বললো,’আমার উপর রাগ করেছিস খুব না?’
আমি কেঁদেই ফেললাম এবার শব্দ করে।
ভাইয়া আমার চোখ মুছিয়ে দিলেন।
আমি ভেজা গলায় বললাম,’ভাইয়া,আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি।আসলে তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। তোদের কারোর কথাই তখন মনে আসেনি।একটা অন্ধ মোহে পড়ে একটা ছেলেকে ভালো ভাবে না জেনে না বোঝে এসব করা আমার ঠিক হয়নি!’
ভাইয়া মৃদু হাসলো। হেসে বললো,’ভুল করার পর ভুল যে বুঝতে পারে সে জ্ঞানী মানুষ।আর ভুল বুঝতে পারার পর যে ভুল শুধরে নিতে পারে সে মহৎ মানুষ!তুই তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস এই জন্য তুই জ্ঞানী মানুষ হিসেবে প্রমাণিত হলি। এখন এক কাজ কর।ভুলটা শুধরে নে।’
আমি মৃদু হাসলাম। হেসে বললাম,’আমি আর কোনদিন কাউকে সামান্য দুঃখও দিবো না। কোনদিন না। আমি তোমাদের সব কথা মেনে নিবো।’
মা বললেন,’তাহলে আজ থেকে কোন রকম দুশ্চিন্তা করা যাবে না। এবং তোর অতীতকে চিরতরে ভুলে যেতে হবে!’
আমি বললাম,’ভুলে যাবো মা।’
মা এবার ভাইয়াকে বললেন,’নেহাল,তুই আগামীকাল বারহাট্টা যাবি। ছেলেটাকে গিয়ে দেখে আসবি। ওদের বাড়িঘর,ফ্যামিলি সব দেখবি।আশ পাশের মানুষদের সাথে কথা বলে ছেলের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করবি। সবকিছু ভালো হলে ছেলেকে আসতে বলবি। সাথে মুরব্বিরাও আসবে।’
ভাইয়া মার কথার পর খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’তূর্ণার বিয়ে হবে না!’
বাবা মা দুজনেই চমকে উঠলেন।মা খানিক সময় হা করে থেকে সামান্য তুতলে বললেন,’মানে?কী বলতে চাইছিস তুই?’
‘বলতে চাইছি তূর্ণার বিয়ের সময় হয়নি এখনও।ওর অনেক পড়াশোনা করতে হবে। পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তারপর বিয়ে।’
মা মুখ ভেঙচিয়ে বললো,’বিয়ের বয়স এখনও হয়নি তুই বলতে চাইছিস?’
ভাইয়া বললো,’হুম।তাই।’
মা বললো,’তো সে নিজে নিজে যে বিয়ে করলো ওটা কী? বিয়ের বয়স না হলে সে বিয়ে করলো কীভাবে?’
ভাইয়া খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’মা,একটু আগে তূর্ণা কী বলেছে শুনেছিলে?’
মা অবাক হয়ে বললেন,’কী বলেছিলো?’
‘ও বলেছিলো সে ভুল করেছে।আর কখনও এমন ভুল করবে না। অর্থাৎ ও যে বিয়ে করেছে এটা তার ভুল।সত্যি সত্যি কোন বিয়ে নয়।’
মা বললেন,’তোর কী মাথা টাতা খারাপ হয়ে গেছে নাকি নেহাল? পাগলের মতো বকছিস! শোন, আজগুবি কথাবার্তা বাদ দিয়ে এখন ঘুমোতে যা।কাল সকালে নাশতা করে তুই ছেলের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবি।বুঝলে?’
ভাইয়া বললো,’বুঝেছি। আগামীকাল বারহাট্টা যাবো আমি। গিয়ে ছেলের সাথে কথা বলবো।বলবো,এই হারামজাদা,তোর সাহস কতো বড়ো!তুই আমার বোনকে বিয়ে করতে চাস?’
মা কপট রাগ দেখিয়ে এখান থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন,’ঢং হচ্ছে।ঢং!কাল কিংবা পড়শু যখন সব জানাজানি হবে তখন কেমন হবে?আর ঢাকায় তো এতোক্ষণে ওর সব বন্ধু বান্ধব সহপাঠীরা জেনে গেছে। ওদের সামনে আর কখনো যেতে পারবে ও?নাকি লাজ শরম জলের সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেলেছে একেবারে!’
কথাগুলো বলে মা এখান থেকে চলে গেলেন। এবার আমি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম।মার কথাগুলো মিথ্যে নয়।ঢাকায় আমার সাথে যে মেয়েটি হসপিটালে গিয়েছিল সে আমার ভালো বন্ধু নয়।ওর সাথে আমার শুরু থেকেই নানান কিছু নিয়ে অমিল।দিনে অন্তত তিনবার করে ওর সাথে ঝগড়া হতো আমার। তবুও বেচারি সেদিন কী মনে করে যে আমায় নিয়ে হসপিটালে গেলো তা আল্লাহ ভালো জানে!সে যায়হোক।মুদ্দাকথা হলো, আমার দোষ খুঁজে পেয়ে এতোক্ষণে বোধহয় সে হোস্টেল আর ক্যাম্পাসে প্রতিটি মানুষের কানে কানে পৌঁছে দিয়েছে। সম্ভবত গত কয়েকদিন হোস্টেল আর ইউনিভার্সিটির হট নিউজ ছিলাম আমিই!
ভাইয়া আমায় মুখ কালো করে শুয়ে থাকতে দেখে বললো,’কিরে মার কথায় মন খারাপ হয়েছে?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’উহু।’
ভাইয়া এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বললো,’তুই আগামী সপ্তাহে আমার সাথে ঢাকায় যাবি। আবার হোস্টেলে উঠবি।’
আমি ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ওরা যে সব জেনে গেছে!’
ভাইয়া বললো,’জেনে গেলে কী হয়েছে?তুই না বললি এটা তোর ভুল?তোর ভুল তুই বুঝতে পেরেছিস এবং তুই এখন ওসব পুরনো ব্যপার ভুলে যেতে চাস এটা তোর মহৎ কাজ।আর যারা তোর মহৎ কাজে বাঁধা দিবে, তোর নামে কুৎসা রটাবে এটাকে তুই দেখবি কেন?তোর তো পেছন ফিরে তাকাবার সময় নাই! তুই আগে বাড়বি। এগিয়ে যাবি শত্রুদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়ে।সব সময় মনে রাখবি তুই ভুল করেছিলে।এই ভুলটাকে যে করেই হোক তোর শুধরাতে হবে।বাবা মা আর ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।আজ যারা তোকে নিয়ে হোস্টেল আর ইউনিভার্সিটিতে হাসবে, তামাশা করবে তারাই একদিন তোর সফলতায় নিজে নিজে লজ্জিত হবে।’
আমি হেসে ফেললাম আনন্দে এবং এক ধরনের চাপা উত্তেজনায়।
ভাইয়া বললেন,’তবে মনে থাকে যেন সুযোগ একটাই। আবার নতুন কোন ভুল করা যাবে না এবং অতীতকে কোন ভাবেই টেনে আনা যাবে না সামনে!’
আমি বললাম,’তাই হবে।’
‘
সকাল বেলা মা ভাইয়াকে ডেকে বললো,’কিরে তোর না বারহাট্টা যাওয়ার কথা?’
ভাইয়া বললো,’কাল রাতেই তো বললাম তূর্ণা এখন বিয়ে করবে না। পড়াশোনা করবে।’
‘পড়াশোনা করে কী হবে?জজ ব্যারিস্টার?নাকি আবার আমার মুখ পুড়বে?’
ভাইয়া এবার মার কাছে গেল। পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে মার আঁচলে মুখ ঘসে বললো,’মা, তোমার মেয়েকে অনেক বুঝিয়েছি।সে এখন মেচ্যুয়ূর। এখন আর বাচ্চাদের মতো কোনো ভুল করবে না। আরেকটা কথা হলো, তুমি যে ওকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছো বিয়ের পর যদি আবার কোন সমস্যা হয়?যদি কোন কারণে ওদের সংসার ভাঙে? এখন তো অহরহ এমন হচ্ছে।ছেলে মেয়ের মধ্যে মিল হচ্ছে না,তো ডিভোর্স। কোন ভাবে ছেলে মেয়ের কিংবা মেয়ে ছেলের খারাপ কোন অতীত শোনে ফেললো।ওকে, ডিভোর্স। পুত্রবধূ শশুর শাশুড়ির মন মত হয়নি,হয়ে গেল, ডিভোর্স।তো, তোমার মেয়েকে যদি যোগ্য করে না বিয়ে দাও।যদি ওর নিজে কিছু করার যোগ্যতা না থাকে।যদি স্বামীর উপর নির্ভর করে থাকতে হয় তাকে। তবে কোন কারণে যদি আবার ওদের সংসার ভাঙে,ডিভোর্স হয় ওর তখন ভাবতে পারো ওর কী হবে?’
মা এবার চুপ মেরে যান।
বাবা বলেন,’নেহাল, এমন করে তো আমরা ভাবিনি বাবা!’
আমিও মনে মনে বলি, এমন করে তো আমিও কখনো ভাবিনি!
ভাইয়া এবার বলেন,’পড়াশোনা করে নিজেকে যোগ্য করে তুললে আল্লাহর রহমত কোন বিপদ এসে তাকে কাবু করতে পারে না। আজকাল যে মেয়েরা আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে তাদের মতো সুখি আর কেউ নাই।মা, তুমি তোমার মেয়েকে সুখি হওয়ার পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিও না!’
মা বললেন,’তোর কথাই যথার্থ।তুই যা বলবি তাই হবে।’
ভাইয়া বললেন,’তাহলে আগামী সপ্তাহেই আমি তূর্ণাকে নিয়ে ঢাকায় যাবো।ওর আরো দু মাস সময় আছে ফাইনাল এক্সামের।দু মাস পড়াশোনা করতে পারলে ও অনেক ভালো করবে।’
মা বললেন,’তাই যা। আগামী সপ্তাহেই যা।’
‘
এই সিদ্ধান্তের পরই একটা ভয় ঢুকে গেল আমার মনে। এই যে আমি আবার হোস্টেলে ফিরবো তখন কেমন হবে?ওরা যখন আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে ওসব মন্দ কথা বলবে তখন আমি সহ্য করতে পারবো তো?আর ইউনিভার্সিটিতেই বা কীভাবে যাবো? ছেলে মেয়েরা আঙুল তুলে দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে না,এই দ্যাখো প্রস্টিটিউট টা আসছে। শুধু এতো টুকু না এরচেয়ে খারাপ কথাও তো বলতে পারে! তখন? তখন সবকিছু আমি মেনে নিতে পারবো তো?সহ্য করতে পারবো তো সবকিছু?
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০৫
#কলঙ্ক
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
ভাইয়া বললেন,’মা,তোমরা আমার কাছে কী লুকাচ্ছো বলতো?’
মা থতমত খেয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না।কথা গুলিয়ে আসে।বাবা মাথা নত করে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে চলে যায়।
ভাইয়া এবার আমায় ধমক দেয়।বলে,’কী করেছিস তুই বল? কিসের জন্য তোকে পড়াশোনা বাদ রেখে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে বাবা মা?’
আমি কিছু বলার আগেই মা বলে উঠেন,’কিছু না। ওর মানসিক একটু সমস্যা হয়েছে।কী সব বানানো গল্প বলে বেড়ায়।’
ভাইয়া বললেন,’কী গল্প বলে?’
‘ওই যে একটু আগে কাঁদলো। কেঁদে কেঁদে বললো তার সন্তান মারা গেছে!’
ভাইয়া, যে কি না মার সাথে কোনদিন গলা উঁচু করে কথা বলেনি।সে আজ মাকে ধমক দিয়ে বললো,’মেয়েকে লায় দিয়ে দিয়ে এই পর্যন্ত নিয়েছো তাই না?ছেলেটা কে? কোন ছেলের সাথে এসব হয়েছে?’
মা চুপ মেরে যান। মুখে আঁচল চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন।
ভাইয়া এবার আমার কাছে আসে।এক চড় দিয়ে আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় বিছানার উপর। তারপর আবার চুল টেনে ধরে উঠিয়ে নেয় আমায় চোখ বড় বড় আর লাল করে তাকায় আমার দিকে। তারপর বলে,’ছেলেটা কে ছিল?’
আমি কথা বলতে পারি না। ভয়ে ভেতরটা কাঠ হয়ে যায়। প্রচন্ড তেষ্টা পায় হঠাৎ।
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে ভাইয়া আরেকবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আমায়। এবার আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়ি শক্ত মেঝেতে।পড়ে গিয়ে আমার হাত ছিলে যায়। ঠোঁট কেটে গিয়ে কাটা স্হান থেকে লাল টকটকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে।
মা দৌড়ে আসে আমার কাছে।আমায় ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
ভাইয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,’সত্যিটা না বললে আমি ওকে আজ মেরেই ফেলবো!’
বলে ভাইয়া আবার আমার দিকে ছুট নিয়ে আসতে উদ্ধত হয়। কিন্তু ভাইয়াকে মা আসতে দেয় না।বলে,’থাম তুই।সব বলছি।’
মা সবকিছু খুলে বলে ভাইয়ার কাছে।
ভাইয়ার রাগ এবার আরো বাড়ে।পাক ঘর থেকে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো বঁটি নিয়ে আসে সে।আর গর্জন করে বলতে থাকে,’তোকে আজ মেরেই ফেলবো আমি শুয়োর!তোর এতো বড় কলিজা?এতো বড় নষ্ট তুই!’
ভাইয়া পাগলের মতো ছুটে আসছে আমার দিকে।তার হাতে উদ্ধত দাঁড়ালো বঁটি।এক কোপ দিলেই শেষ।
একটু আগেও আমি ভেবেছিলাম, কোন ভাবে মরে যেতে পারলে ভালো হতো! কিন্তু এখন ভয় করছে।মনে হচ্ছে, মৃত্যু কঠিন জিনিস। এই মৃত্যুকে আযরাঈল নিজেও প্রচন্ড ভয় পায়!
মা চিৎকার করে বলছেন,’খবরদার বলছি নেহাল! খবরদার!আরেক পা এইদিকে আগাইলে থাপরাইয়া তোর দাঁত গুঁড়ো করে ফেলবো বদমাশ!’
কিন্তু ভাইয়া মাকে ভয় পাচ্ছে না।মার কথা সে কানেও তুলছে না।
মা এবার আমায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন।মারতে যদি হয় আগে মাকে মেরে তারপর আমায় মারতে হবে।
ভাইয়া উপায়হীন হয়ে বঁটিখানা দূরে ছুঁড়ে ফেললো। তারপর দেয়ালের কাছে গিয়ে নিজের মাথা দেয়ালের সাথে শক্ত করে ঠুকতে ঠুকতে কান্নাভেজা গলায় গর্জন করতে করতে বলতে লাগলো,’তূর্ণা,তোর মতন এমন লক্ষ্মী একটা মেয়ে কী করে এমন করতে পারে!তুই না ফরহাদ মাস্টারের মেয়ে? লজ্জা করে না তোর?এই মুখ এখনও বাবাকে দেখাস কী করে?মরে যেতে পারিস না?নাকি মৃত্যু আসে না তোর কাছে?’
ভাইয়া কাঁদছে। কাঁদছে আর দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকছে ।মাথা ঠুকার কারণে তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।লাল টকটকে রক্ত। দেখলেই ভয় ধরে যায়। আমার চোখ হঠাৎ যায় ভাইয়া যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ডানের খালি জায়গাটাই।ঠিক ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে আমার মৃত ভ্রুণ।তার দুটো চোখ উপড়ানো।মাথা থেঁতলানো। গায়ে ক্ষত বিক্ষত।দেখলেই ভয় ধরে।সে এসে কেমন করে তাকিয়ে আছে ভাইয়ার মুখের দিকে।
আমি ধমকের গলায় বললাম,’আবার এসেছিস এখানে?যা বলছি এখান থেকে।যা!’
ভ্রুণটা বললো,’যাবো না। মামাকে দেখতে এসেছি।আজ রাতে আমি মামার সাথে থাকবো। সারারাত মামার মুখে গল্প শুনবো।’
আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আবার।
মা আতংকে অস্থির হয়ে উঠে বললেন,’এই তূর্ণা,মা,মারে,কী হয়েছে তোর?’
আমি কথা বলতে পারছি না।গোঙাচ্ছি। গোঙাতে গোঙাতে অস্পষ্ট করে বলছি,’ও আবার এসেছে। আবার! ভাইয়াকে দেখতে এসেছে। মামার মুখের গল্প শুনতে চায় ও।’
আমার দাঁতের সাথে দাঁত লেগে আসছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি আমি সেন্সলেস হবো।
ভাইয়া দৌড়ে এলো আমার কাছে।তার ওই রাগ,ক্ষোভ অভিমান সব মুহূর্তে মাটির সাথে মিশে গেল।সে এসে হাঁটুগেড়ে বসে আমার একটা হাত টেনে নিলো তার কোলের উপর। তারপর আমার উপর অনেকখানি ঝুঁকে এসে কান্নাভেজা গলায় ডাকলো,’তূর্ণা,এই তূর্ণা!’
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম মুহূর্তে। ভাইয়া আমার কাছে এসেছে। আমার হাত ধরে মধুর গলায় ডাকছে আমায়!
আমি ভাইয়ার দিকে তাকাতে চাইলাম।ওর ডাকের সাড়া দিতে চাইলাম। কিন্তু সম্ভব হলো না!
এর আগেই সারা শরীর কেমন–
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০৪
#কলঙ্ক
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
তারপর মা চারদিকে ঘটকদের লাগিয়ে দিলেন। তিন মাসের ভেতর যে করেই হোক তিনি আমার বিয়ে দিবেন। ততদিনে আমার শরীরও ভালো করে সেড়ে উঠবে!
কিন্তু শরীর সাড়লেও কী আদৌও মন সেড়ে উঠতে পারবে?আমি কী ভুলতে পারবো আমার পুরনো স্মৃতিগুলো?
আজকাল আমানের কথা আর মনে পড়ে না।মনে পড়ে শুধু ওই দিনটির কথা।যেদিন আমার এবরোশন হয়েছিল। নিজের সন্তানকে খুন করেছিল ওরা আমার সামনে!
রাত প্রায় দুটো। হঠাৎ আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ইচ্ছে করে এমন করিনি। অনেক চেষ্টা করেছি এসব ভুলে থাকতে। চেষ্টা করেছি কান্নাটা চেপে রাখতে। কিন্তু সম্ভব হয়নি।
আমার কান্না শুনে মা চমকে গিয়ে জেগে উঠলেন।বাবা সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে আমার ঘরে এলেন।মা শুয়েছিলেন আমার সাথেই। তিনি আমার সাথেই থাকেন সব সময়।ভয় পান।না জানি আবার কখন গলায় দড়ি টড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি!
মা বললেন,’কী হয়েছে তূর্ণা?কী হয়েছে রে মা?’
আমি নাকে মুখে ওড়না চেপে ধরে কান্না লুকোতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না।যতোই কান্না লুকোতে চেষ্টা করছি ততোই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।
বাবা এসে বললেন,’দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?’
আমি কথা বললাম না।
মা আমার হাতে নাড়া দিয়ে বললেন,’তবে কাঁদছিস কেন?’
আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’ওকে ভুলতে পারি না মা! সব সময় মনে পড়ে!’
মা রাগত স্বরে বললেন,’যার জন্য এতো কিছু হয়ে গেলো ওকেই ভুলতে পারছিস না!তুই কী মানুষ?’
আমি বললাম,’না মা আমানকে নয়!’
মা বললেন,’তবে কাকে?’
‘যাকে আমরা হত্যা করেছি তাকে। আমার সন্তানকে।’
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আদর করে বললেন,’ঘুমিয়ে যাও মা।আর কেঁদো না। কাঁদলে শরীর খারাপ করবে।’
মা আমার সাথে হঠাৎ করে খুব ভালো ব্যবহার করলেন। হয়তোবা তিনি বুঝতে পারছেন আমার কষ্টখানি!
এই রাতের পর থেকেই আমার এক অদ্ভুত রোগ হয়ে গেল। এখন আমি সব সময় আমার পেটের অনাগত সন্তানকে দেখতে পাই।দেখতে পাই ওর অপুষ্ট শরীর জুড়ে ক্ষত বিক্ষত।চোখ গুলো উপড়ে ফেলা। মাথাটা থেঁতলানো। আমার ভয় করে। বুকের পাটা কাঁপতে থাকে ভীষণ ভাবে!
এই ভ্রুণটা আবার আমার সাথে কথা বলে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,’মা,মা,ওমা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।ওরা আমায় মেরে ফেলেছে। আমার খুব শখ ছিল পৃথিবীটা দেখার। আমার খুব শখ ছিল তোমাকে মা বলে ডাকার।ওমা,মাগো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে কেন তোমরা মেরে ফেললে?’
আমি কোন উত্তর দিতে পারি না।চুপ করে থাকি।
আমার ভ্রুণটা তখন অভিমান করে। অভিমানী গলায় বলে,’মা,আমি আল্লার কাছে তোমার নামে অভিযোগ করবো।বলবো, আমার মাও আমার খুনের সাথে জড়িত!’
আমি নিজের মাথাখানা দেয়ালের সাথে ঠুকতে থাকি। শক্ত করে ঠুকি। কপাল তখন ফুলে যেতে থাকে।লাল হয়ে উঠে। রক্ত জমে উঠে।মা পাক ঘর থেকে দৌড়ে আসেন।আমায় একপাশে টেনে নিয়ে বলেন,’এ কী করছিস তুই তূর্ণা? পাগল হয়ে গেছিস তুই?’
আমি কাঁদতে থাকি।ডুকরে ডুকরে কাঁদি। কান্নাভেজা গলায় বলি,’মা,ও এসেছিল আজ আমার কাছে!’
মা বলেন,’কে?কে এসেছিল?’
আমি বলি,’আমার ভ্রুণটা।ও এসে জবাব চাইছিলো!আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি মা।’
মা হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠেন। তিনি ভাবেন আমি বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তিনি ভয় পেতে থাকেন আমি কখন জানি আবার লোকে লোকে বলে বেড়াই আমার ভ্রুণ হত্যার কথা। গোপন বিয়ের কথা!
মা বললেন,’শান্ত হও মা। আগামীকাল তোমায় ময়মনসিংহ নিয়ে যাবো।ডাক্তার দেখাবো। তখন আর কেউ তোমার সামনে এসে তোমায় ভয় ডর দেখাবে না!’
আমি কাঁদতে থাকি।মার সাথে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না।
‘
ডাক্তারের কাছে আর আমায় নিয়ে যাওয়া হলো না।বাবা বললেন,’ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ নেই। ঘটকদের তাড়া দেও। বিয়ে হয়ে গেলেই সব ভুলে যাবে মেয়ে!’
মা বললেন,’তাই হোক। ভালো একটা ছেলে পেলেই বিয়ে ফাইনাল করে ফেলতে হবে।’
ঘটকদের পকেটেও কিছু কাঁচা পয়সা দেয়া হয়েছে।
ঘটকেরা এবার দ্রুত কাজ করছে। অনেকগুলো আলাপ জোগাড় করে ফেলেছে এরমধ্যে। কিন্তু বাবার পছন্দ শিক্ষকতার সাথে জড়িত এমন একটা ছেলে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলে সবচেয়ে ভালো।
‘
বাবার পছন্দ মতো ছেলে পাওয়া গেল। ছেলের নাম মেহরাব। খুব সুন্দর চেহারা।অতি আধুনিক। তবে অনেক নম্র ভদ্র।ছেলে আমাদের বাড়িতে আসার আগে ভাইয়া গিয়ে ছেলেকে দেখে আসবে। ছেলের বাড়ি ঘরও দেখবে। পছন্দ হলে ওদের আসতে বলবে।ওরা এসে আমায় পছন্দ করলে বিয়ে। আমাদের এখানেই বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হবে।
ভাইয়াকে খবর দেয়া হয়েছে। ভাইয়া আসবে এক দুদিনের ভেতর। আমার ভয় করছে।ভয় করছে এই জন্য যে ভাইয়াকে কিছুই শোনানো হয়নি। তাকে বাড়িতে খবর দিয়ে আনানো হচ্ছে একটা মিথ্যা কথা বলে।বলা হয়েছে যে বাবার অসুখ।এই জন্য তাকে বাড়িতে আসতে হবে। কিন্তু সে এসে যখন শুনবে আমার বিয়ে তখন তো সে মাকে বলবে,ওর বিয়ে মানে? পড়াশোনা রেখে বিয়ে কেন? ঘটনা কী?
মা অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে রেখেছেন। বাবার অসুস্থতার জন্য।বাবা ভয় পাচ্ছেন।যদি মরে টরে যান। এই জন্য মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়ের বর দেখে যেতে চান। অবশ্য বাবাকে এর জন্য কদিন অভিনয় করতে হবে। বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
‘
ভাইয়া এসে গেছে বাড়িতে।মা যা প্ল্যান করেছিলো সেভাবেই সব হচ্ছিল। ভাইয়া সব মেনেও নিয়েছিল। শুধু সে বাড়তি যা বলেছিলো তা হলো, আমার পড়াশোনা বন্ধ করা যাবে না। বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।
মা বললেন,তাই হবে।
কিন্তু ও আসার দিন রাতেই যে আবার আমার ভ্রুণ আমার সামনে এসে উপস্থিত হবে তা কে জানতো!
তখন রাত বারোটা।সবাই ঘুমিয়েছে কেবল।আমি ঘুমোতে যাবো ঠিক তখন দেখতে পেলাম আমার বিছানায় আমার ভ্রুণের থেঁতলানো শরীর খানা।
আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম,’যা।এখান থেকে যা বলছি!’
ও গেলো না। উল্টো কান্না জুড়ে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,’তুমি না আমার মা।মা হয়ে কীভাবে আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছো এখান থেকে?’
আমি বললাম,’কে তোর মা?এই যা বলছি এখান থেকে!’
ভ্রুণ গেলো না।সে বললো,’যাবো না।দেখি কী করে আমায় তাড়াও!’
আমি ওকে তাড়াতে গিয়ে খাট থেকে নীচে পড়ে গেলাম।পড়ে গিয়ে কোমড়ে অসম্ভব রকম ব্যথা পেয়েছি। সেই ব্যথা নিয়ে আমি গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলাম।
ভাইয়া সম্ভবত ঘুমায়নি তখনও।সে দৌড়ে এলো আমার ঘরে। পেছন পেছন মা এবং বাবাও।
ভাইয়া এসে বললো,’কী হয়েছে তূর্ণা?এ কী তুই নীচে কেন?’
আমি বোকার মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললাম,’ও এসেছিল আবার।ও এসেছিল। এসে বলেছে,মা, কেন আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছো তুমি?’
ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ব্যপারটার অনেকটাই অনুমান করে ফেললো।সে সন্দেহ মাখা গলায় বললো,’মা,তোমরা কী লুকাচ্ছো আমার কাছে বলতো?’
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০৩
#কলঙ্ক
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
বাবা কম্পিত গলায় মাকে বললেন,’আমেনা, তুমি না গোনাহ হবে এই ভয়ে একটা পিঁপড়াও মারো না এখন কী করে বলছো একটা রক্ত মাংসের আস্ত মানুষ মেরে ফেলতে?’
মা উত্তেজিত গলায় বললেন,’এখন সাত পাঁচ ভাবলে হবে না। আগে মান সম্মান রক্ষা হোক।মান সম্মান না বাঁচলে আবার কিসের জীবন!’
কথাগুলো বলে আবার মা কেঁদে উঠলেন।আর আমার পিঠে কিল বসিয়ে দিতে দিতে বললেন,’কেন এসব করলি তুই?কেন করলি?’
আমি চুপ করে আছি। এখন আর কাঁদতেও পারছি না।চোখ শুকিয়ে গেছে। তবে ভেতরটা কাঁদছে। খুব করে কাঁদছে।আর মনে পড়ছে আমানের কথা। আমানকে এখনও আমি পুরোপুরি দোষী ভাবতে পারছি না।ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।আমি বরং নানান যুক্তি দাঁড় করাচ্ছি।এমনও তো হতে পারে আমান নিজেকে যোগ্য করে তুলতে আমেরিকা চলে গেছে। ওখান থেকে অনেক টাকা পয়সা অর্জন করে দেশে আসবে। তারপর আমায় চমকে দিয়ে আমার সামনে এসে হুট করে উপস্থিত হবে। তারপর বলবে, চলো।
আমি বলবো, কোথায়?
সে বলবে, আমাদের বাড়িতে।
তারপর বাড়ির সবাই আমায় বরণ করে নিবে।আর এর কদিন পরই আমান আমায় নিয়ে আমেরিকায় উড়াল দিবে!
‘
আরেকটা দিন আমি মাকে নিয়ে হসপিটালে কাটালাম।বাবা গেলেন ফুলপুরে। ওখানে গিয়ে আমানদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজলেন। কিন্তু কোন ভাবেই ওদের খোঁজ খবর বের করতে পারলেন না । অবশেষে ব্যর্থ মানুষের মতো তিনি ফিরে এলেন হসপিটালে।
‘
ঠিক হলো এবরোশন করা হবে। আমার পেটের ভেতর থাকা বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলা হবে।মেরে ফেলা হবে ওকে।ভাবতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।মনে হচ্ছে এমন পাপ করার চেয়ে দোযখ লাভ অনেক ভালো!
আমি কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে মাকে বললাম,’ওমা,কী সব করতে চাইছো তোমরা?আমি মানবো না মা। কিছুতেই মারতে দিবো না ওকে!’
মা তার মুখটা ভেঙচিয়ে আমার গালে একটা শক্ত করে চড় দিয়ে বললেন,’হারামজাদি বেহায়া মাইয়া! লজ্জা করে না তোর এইসব বলতে! সন্তান জন্ম দিলে এই সন্তানের পরিচয় দিবি কী? মানুষ তো জানতে চাইবো সন্তানের বাপ কে?তুই কী বলবি?বাপ নাই?বাপ ছাড়া সন্তান জন্ম দিছস?তোর এই কলঙ্ক নিয়ে তুই কই যাবি?কে তোরে গ্রহণ করবো?’
আমি হাউমাউ করে কাঁদছি।আর নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলছি।
মা বললেন,’ভুল করার পর এইসব করে লাভ নাই। এখন ঠান্ডা হ।একটু পর নার্স আসবো।তোর এবরোশন হবে।এটাই ফাইনাল।’
বাবাও কিছু বলছেন না।চুপ করে আছেন। তাকে দেখে বোঝা যায় তিনিও নিরুপায়।সত্যি কথা বলতে বাবা মা দুজনেই একটা অনাগত সন্তানের জীবন নাশের চেয়ে তাদের কিংবা আমার ইজ্জত-সম্মান বাঁচানো নিয়েই ব্যস্ত!
আমি বাবাকে এবার ডেকে উঠলাম। কেঁদে কেঁদে বললাম,’বাবা,ও বাবা, তুমি মাকে বুঝিয়ে বলো না প্লিজ!আমি কী করে আমার এই ক্ষতিটা করবো?’
বাবা তার চোখ মুছতে মুছতে কেবিন থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন বাইরে।আমি জানি তিনি সত্যি সত্যি নিরুপায়।তার কিছুই করার নাই। কারণ তাকে সমাজে বসবাস করতে হবে।আর সমাজে বাস করতে হলে এমন দু চারটা প্রাণ নাশ কোন ব্যপার না! এইসব প্রাণ নাশের চেয়ে নিজেদের সম্মান বাঁচানো বেশি জরুরি!
‘
নার্স এসে গেছে।ওরা আমায় কোথায় যেন নিয়ে যাবে।অন্য কোন রুমে।ওখানেই এবরোশন করবে।আমি এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠেছি। মার হাতটা শক্ত করে ধরে অনুনয় করে বলছি,’ওমা,মাগো,ওমা, তোমার পায়ে পড়ি গো মা! তুমি আমার এই ক্ষতিটা করো না!’
মা কাঁদছেন। কেঁদে কেঁদে নার্সদের বলছেন,’যাও।তোমরা ওকে নিয়ে যাও।’
আমি জান প্রান ছেড়ে চিৎকার করে বললাম,’না।আমায় তোমরা নিয়ে যাবে না।’
ওরা আমার কথা শোনলো না।ওরা আমায় নিয়ে যেতে লাগলো টেনে টেনে।একটা নার্স আমার দিকে তাকিয়ে মুখটা কেমন করে উঠে বললো,’আকাম যখন করছিলেন তখন খেয়াল আছিলো না! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এখন আবার গলা ছাইড়া চিৎকার করেন!’
আমি বললাম,’চুপ করো বলছি।যা তা বলছো!’
ওই নার্স আমার দিকে তাকিয়ে তার কানে হাত দিয়ে বললো,’তাওবা তাওবা!আস্তাগফিরুল্লাহ! এই তো দেখি চোরের মায়ের বড় গলা।নষ্টামি করে পেট বাঁধাইলেন আপনি। এখন দোষ আমার!’
‘নষ্টামি করেছি মানে?’
‘নষ্টামি না করলে পেটে বাচ্চা আসলো কেমনে?গায়েব থাইকা?’
আমার যা রাগ পেলো এবার!আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম,’একদম চুপ করো স্টুপিড।’
নার্স মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠে অপর নার্সটিকে বললো,’মেডামের রাগ পাচ্ছে। আহারে আহারে!’
তারপর দুজন নার্সই হি হি হি করে হেসে উঠলো।
‘
আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটালের একটা পরিত্যক্ত এবং অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ওখানে এক গাইনি মহিলা ডাক্তার এসেছেন।এই ডাক্তারের মুখের ভাষা আরো বিচ্ছিরি!
আমার খুব খারাপ লাগছিলো তখন।ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল আমার নিজের সন্তানকে আমিই খুন করতে সাহায্য করছি! এই জন্য আমি কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার মহিলার পায়ে পড়ে গেলাম। বললাম,আপু,প্লিজ!আল্লার দোহাই লাগে, আপনি আমার অত বড় ক্ষতিটা করবেন না!’
ডাক্তার মহিলা ধমক দিয়ে বললেন,’চুপ।একদম চুপ। আপনার কোন কথা আমি শুনতে পারবো না। আপনার গার্ডিয়ান যা বলেছে তাই করতে হবে আমার!’
আমি কী করবো আর।চোখ বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।
‘
এবরোশন ব্যপারটা যতটা সহজ মনে করতাম আমি ততটা সহজ না। খুব কঠিন।ডাক্তার যখন কাজ শুরু করলো তখন আমার কষ্ট হচ্ছিল।ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম আমি।আর কেবল তখন মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে তো আমার সন্তানটা কষ্ট পাচ্ছে বেশি!জীবন্ত শিশুটাকে তো ওরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। এই শিশুর আর্তনাদ আমি শুনতে পাচ্ছি। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। সেই শিশুর কান্না কিংবা আর্তনাদ যেন আমার কানে না আসে তাই আমি
চিৎকার করতে লাগলাম।
ডাক্তার তখন ধমক দিলেন আমায়। বললেন,’চুপ করুন বলছি।’
কিন্তু আমি কিছুতেই চুপ করতে পারছিলাম না।ব্যথায় কঁকিয়ে উঠতে লাগলাম বারবার।
ডাক্তার এবার বললেন,’আপনাদের মতো মেয়েদের পৃথিবীতে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।বাপ মায়ের মুখে চুনকালি দিয়ে আবার চেঁচাচ্ছেন! তখন হুঁশ ছিল না যখন প্রেমিকের সাথে ওইসব করেছিলেন?’
আমি চাপা রাগ নিয়ে বলতে চাইছিলাম ,’আপনি ভুল বুঝছেন।আমি কোন প্রেমিকের সাথে নোংরামো করিনি।এই সন্তানের বাবা আমার স্বামীই!’
কিন্তু এই কথাটা আমি বলতে পারলাম না।এর আগেই তীব্র ব্যথায় আমার এক পাটির দাঁতের সাথে অপর পাটির দাঁত লেগে গেল।সারা শরীর কাঁপতে লাগলো।মনে হলো এক্ষুনি আমি সেন্সলেস হবো।এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমি সেন্সলেস হলাম!
‘
সেন্স ফেরার পর দেখি আমি সেই আগের কেবিনে। আমার সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।মাথা ভার হয়ে আছে। পেটে তীব্র ব্যথা।মা আমার সামনে বসে আছেন।বাবা বিছানার একপাশে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছেন।
কী মনে করে হঠাৎ পেটের উপর হাত দিলাম।আজ সকাল বেলায়ও যে পেটখানা ভরা ছিল সেই পেট এখন খালি!
আমি গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,’মা,আমি ওকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো!’
মা বিরক্ত মুখে বললেন,’আর ভালো লাগছে না কিন্তু। আরেকবার যদি সন্তান নিয়ে কিছু বলবি তবে কিন্তু তোকে এখানে ফেলে রেখে আমরা চলে যাবো!’
মার কথাটা শুনে ভয়ে আমার শরীরটা জমে উঠলো! আমার নিজের জন্মদাত্রী মা কীভাবে এমন নিষ্ঠুর একটা কথা বলতে পারলেন!
‘
হসপিটাল থেকে ছুটি দিলে মা বাবা আমায় নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। তারপর মা চারদিকে ঘটকদের লাগিয়ে দিলেন—–
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০২
#কলঙ্ক
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
বাবা-মা পাগলের মতো ছুটে এলেন হসপিটালে। আমার বাবা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। এমনিতে সীমাহীন ধৈর্য্য বাবার। কিন্তু আজ বাবা কেমন জানি পাগলের মতো হয়ে গেলেন। হসপিটালে এসেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,’কী হয়েছে আমার মার?কী হয়েছে?’
ডাক্তার সাহেব বললেন,’ভাই,অত উত্তেজিত হয়ে উঠছেন কেন?ভয়ের কিছু নাই। বরং
আপনার জন্য সুখবর আছে। আগে দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে আসুন গিয়ে। তারপর সুখবর শুনবেন।’
বাবা অবাক হয়ে বললেন,’মিষ্টি আনবো কেন?’
‘আগে নিয়ে আসুন না। তারপর বলছি। মেয়েকে নিয়ে টেনশন করবেন না।সে পুরোপুরি সুস্থ। মিষ্টি ছাড়া আপনাকে সুখবর দেয়া যাবে না!’
বাবা আলহামদুলিল্লাহ বলে মিষ্টি আনতে চলে গেলেন দোকানে।মা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তারের সামনে।
‘
বাবা মিষ্টি নিয়ে ফিরে আসার পর ডাক্তার বললেন,’আসুন। আমার সাথে আসুন আপনারা।’
বাবা-মাকে নিয়ে ডাক্তার আমার কাছে চলে এলেন। তারপর এসে বাবাকে বললেন,’আপনি নানা হতে যাচ্ছেন। এখন আলহামদুলিল্লাহ বলে মেয়েকে মিষ্টি খাইয়ে দিন!’
ডাক্তারের মুখ থেকে কথাটা শুনেই বাবার মুখটা কেমন মলিন হয়ে উঠলো। চোখ দুটো হয়ে উঠলো লাল,রাগী রাগী। সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট দুটো মাটিতে ঝপ করে পড়ে গেল।আর বাবা আমার কাছে এসে আমার দু গালে দুটো শক্ত চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,’ডাক্তার কী বলছে এসব?’
আমি চুপ করে রইলাম। শুধু চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ক’ফোটা গরম রংহীন জল।
বাবা আর কথা বললেন না।মিষ্টির প্যাকেটের মতো তিনিও ঝপ করে বসে পড়লেন ফ্লোরের উপর। এবার মা এলেন আমার কাছে। তারপর আমার চুল টেনে ধরে নাকে মুখে চড় বসিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন,’তুই আমার মেয়ে হয়ে এসব করেছিস আমি ভাবতেও পারছি না! ইচ্ছে করছে এক্ষুনি তোকে গলা টিপে মেরে ফেলি!’
ডাক্তার সাহেব এতোক্ষণ বিষয়টা বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু এখন ঠিকই বুঝতে পেরেছেন আসল ঘটনা।আসল বললেও ভুল হবে। তিনি হয়তো মনে মনে ধারণা করেছেন আমি বিবাহ বহির্ভূত কোন একটা ছেলের সাথে বেড শেয়ার করে কনসিভ করেছি।ডাক্তার সাহেবের মুখ কেমন লাল হয়ে যেতে দেখা গেল।
মা এবার আমার চুলে শক্ত করে টেনে ধরে বললেন,’কার সাথে এসব করেছিস বল?’
আমি কিছু বলতে পারছি না। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে।মা আমার মাথার চুল আরো শক্ত করে টেনে ধরেছেন।যেন টেনে টেনে আজ ছিঁড়েই ফেলবেন আমার মাথার সবকটি চুল!
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে মা আবার আমার গালে চড় বসিয়ে দিতে শুরু করলেন।
আমি এবার কেঁদে উঠলাম।
মা আমার মুখে তখন থুথু ছিটিয়ে দিয়ে বললেন,’হারামজাদি বেহায়া! লজ্জা শরম নাই তোর গলা ছাইড়া কান্নাকাটি শুরু করছস যে আবার!’
বাবা ফ্লোরের উপর বসা থেকেই মাথায় হাত দিয়ে টোকা দিতে দিতে বিলাপ করে বললেন,’এই কাজ করার আগে একটি বারও মনে পড়লো না তোর বাবার কথা?তোর বাবা যে এলাকার একজন আদর্শ শিক্ষক তা তো তুই ভালো করেই জানিস! মানুষ আমায় নিয়ে গর্ব করে বুক ফোলায়। চায়ের স্টলে আমায় ডেকে নিয়ে বসায়।চা বিস্কুট খেতে দিয়ে তারা বলে,স্যারের ছেলে মেয়ে দুইটা ফিরিশ্তার মতন।শহুরে থাইকা লেখাপড়া করে অথচ কী নম্র ভদ্র।দেখলেই মন গলে যায়।মন থাইকা আপনা আপনি দোয়া আসে!
এবার যখন ওরা শুনবে আমার মেয়ে বিয়ে শাদি ছাড়াই এই সর্বনাশ করেছে তখন এই প্রশংসা কোথায় যাবে?আমি মানুষের কাছে মুখ দেখাবো কী করে রে তূর্ণা? তূর্ণা কাজটা করার আগে তুই কী একটিবার ভেবেও দেখলি না তুই কার সন্তান!’
আমি কী করবো?কী বলবো? কাঁদছি।কান্নাছাড়া যে আমার কিছুই করার নাই এখন!
ডাক্তার সাহেব এবার বাবার একটা হাত ধরলেন। তারপর বললেন,’ভাই,মেয়েটা না হয় একটা ভুল করেই ফেলছে!এই যুগের মেয়েরা অত কিছু বুঝে না। তাছাড়া ওর বয়সটাই বা তেমন কী হয়েছে!বোঝ কম। এখন বিলাপ না করে,চিল্লাপাল্লা বন্ধ রেখে সমাধান খুঁজুন।এই দেশের মানুষ ভয়ংকর রকমের খারাপ।এরা যখন এরকম একটা ঘটনার আঁচ পাবে তখন দেখবেন সারা দেশে ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াবে।জনে জনে বলবে অমুক মাস্টরের মেয়ে এই কুকাম করছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’
ডাক্তার সাহেব ভুল বলেননি। কিন্তু তার কথাগুলো শুনেও আমার খারাপ লাগছে।আমি তো আর অবৈধভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে কিছু করিনি। বিয়ে করেছি। কিন্তু লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়েটা যে আমাদের সমাজের কাছে এখনও ভালো কিছু নয়।আর ভালো কিছু হবেই বা কী করে? এইসব লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ের ভবিষ্যতটাই বা কী?এই যে আমি লুকিয়ে বিয়ে করলাম। এখন আমার বর উধাও। বিসিএস দেয়ার নাম করে যোগাযোগ বন্ধ রেখে বর চলে গেছে আমেরিকা। পেটে দিয়ে গিয়েছে এক সন্তান। এখন এই সন্তানের ভবিষ্যতই বা কী?
‘
ডাক্তার কেবিন থেকে চলে গিয়েছেন। আমার শরীর এখন সুস্থ। মায়ের কাছে আমি সব বলেছি।বাবাও শুনেছেন সবকিছু।শুনে মা বলেছেন,’অত বড় সাহস করলি কীভাবে?কেন বিয়ে করেছিলে গোপনে? আমাদের জানাসনি কেন?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’ছেলে বেকার ছিল। তাছাড়া আমি মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। পড়াশোনার অনেক বাকি! আমায় নিয়ে তোমাদের কত স্বপ্ন—‘
আমার মুখ থেকে বাবা কথাটা কেড়ে নিলেন।বাবা বললেন,’স্বপ্ন।তোকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন।গোপনে বিয়ে করে আর অতবড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের স্বপ্ন তুই একেবারে পূরণ করে দিয়েছিস! বাহ্ মা বাহ্! তোকে নিয়ে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠছে!’
বাবা কথাগুলো বলে কেঁদে উঠলেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদার সময় বাবাকে কেমন বোকাসোকা দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে আল্লার দুনিয়ায় এমন ব্যথিত, অসহায় মানুষ আর দ্বিতীয়টি নাই!
মাও কাঁদছেন। কেঁদে কেঁদে বলছেন,’তোর ভাই নেহালকে এখনও কিছু শুনাইনি!ও যা রাগী শুনলে কী হবে ভাবতে পারছিস? তোকে গলা টিপে মেরে ফেলবে একেবারে! তারপর নিজেও মরবে!’
আমিও কাঁদছি। নাকেমুখে কাপড় চেপে ধরে কাঁদছি।
মা এবার বললেন,’ওই নম্বরটা দে।ফোন ধরিয়ে দে আমায়।ওই শুয়োরটার মার সাথে আমি কথা বলবো।দেখি কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছে সে!’
আমি ভয়ে ভয়ে ওই নম্বরে ফোন দিলাম। ফোনের সুইচ অফ।
মা রেগেমেগে আগুন হয়ে বললেন,’ওদের বাড়ির ঠিকানা বল। কোথায় ওদের বাড়ি?’
আমি খানিক সময় চুপ থেকে বললাম,’ময়মনসিংহের ফুলপুরে। কিন্তু ওরা ঢাকায়ই থাকে। মিরপুর একে ওদের বাসা।’
মা বাবাকে বললেন,’তুমি তূর্ণার কাছে থাকো।আমি মিরপুর থেকে আসছি। দেখে আসি ওই বেজন্মাটার মাকে!আর ওই কমজাত মেয়েটাকেও! নাগালে পেলে কান ধরে হারামজাদিকে এখানে নিয়ে আসবো!’
‘
মা সন্ধ্যা বেলায় গেলেন মিরপুর। ফিরে এলেন রাত বারোটার সময়।তার মুখ বিরস। শরীর জুড়ে ক্লান্তির ছাপ।মা এসে বেডের উপর ধপ করে বসে পড়ে বিলাপের করুন স্বরে বললেন,’নাই। মিরপুরে এদের কেউ নাই!’
বাবা বললেন,’কোথায় আছে কোন তথ্য বের করতে পারছো?’
‘না। বাসার মালিকও কিছু জানে না। শুধু জানে ওরা বাসা ছেড়ে দিয়েছে!’
বাবা আবার মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করতে করতে ধপ করে বসে পড়লেন।
মা বললেন,’অতকিছু ভাবলে আর হবে না। এলাকার মানুষ এখনও কিছু জানে না।সময় থাকতে একটা কিছু করতে হবে। তুমি বাড়ি থেকে আরো টাকা পয়সা আনাও।আজ রাতের ভেতর এবরশন করাতে হবে। তারপর হসপিটালে দু চারদিন থেকে ওকে সুস্থ করে ওকে নিয়ে গ্রামে চলে যাবো একেবারে।গ্রামে গিয়ে ওর বিয়ে দিয়ে দিবো!’
বাবা—
‘
#চলবে
কলঙ্ক পর্ব-০১
#কলঙ্ক
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক
গত দু মাস পর পর পিরিয়ড মিস্ করার পরই আমার সন্দেহ হলো।এরপর যখন খাওয়ায় অরুচি আর বমি শুরু হলো তখন বুঝতে আর বাকি রইল না যে কী ঘটতে যাচ্ছে। তবুও ফার্মেসি থেকে প্রেগন্যান্সি কীট এনে টেস্ট করলাম।কী সর্বনাশের কথা!যা ভেবেছি ঠিক তাই।কনসিভ করে ফেলেছি আমি!
এখন কী হবে আমার? বাসার কেউ জানে না আমার আর আমানের বিয়ের ব্যাপারে।গোপনে বিয়ে করেছি আমরা। শুধুমাত্র আমানের কাজিন (আমার বেস্ট ফ্রেন্ড)নিতু জানে বিষয়টা।ও নিজে সাক্ষীও ছিল আমাদের বিয়ের। আমানকে এই মুহূর্তে জানানো যাবে না।ওর বিসিএস পরীক্ষা।প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। কদিন পর রিটেন।আমান বলে রেখেছে কোন ভাবেই যেন ওকে ডিস্টার্ব করা না হয়। আমিও ডিস্টার্ব করতে চাই না কিছুতেই।কারণ এবার ওর বিসিএস টা হয়ে গেলেই সে বাসায় আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানাবে বলেছে। তখন আর তার পরিবার তাকে বাঁধা দিতে পারবে না।
‘
আড়াই মাস আগে আমাদের দেখা হয়েছিল।আমরা তখন একসাথে ছিলাম ওর এক বন্ধুর বাসায়।সেদিনই সে এসব বলেছিল। বলেছিল,’তূর্ণা, তুমি কী চাও না আমাদের সম্পর্কটা দ্রুত সবাই মেনে নিক?’
আমি বললাম,’চাইবো না কেন?আমি তো চাই আজকেই যদি সবাই মেনে নিতো!’
আমান মৃদু হেসে তখন বললো,’অত সহজে কেউ মেনে নেবে না। আমার বাবা মাকে তো চেনো না।মেরে টেং গুঁড়ো করে দেবে।তেজ্য করে ছাড়বে একেবারে আমায়।’
‘তবে কী কোনদিনই আমরা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানাতে পারবো না কাউকে?’
আমান আমায় তার কাছে টেনে বললো,’এই ব্যবস্থাইতো করছি জান। রাতদিন খাটা খাটুনি করছি। এবার প্রিলিতে টিকে গেছি। কদিন পর রিটেন। তুমি যদি দোয়া করো আর হেল্প করো তবে এসব রিটেন ফিটেনে টিকা কোন ব্যপার না!’
আমি ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
আমান এবার বললো,’আমায় সাহায্য করবে না তুমি?’
‘করবো। একশো বার করবো।তুমি আমার জন্য অতকিছু করছো আর আমি একটু সাহায্য করতে পারবো না তোমায়!’
‘হ্যা বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু আমাদের যোগাযোগ বন্ধ থাকবে।আসলে তোমার সাথে কথা বললে আমার মন সব সময় তোমার কাছেই পড়ে থাকবে। তখন আর পড়াশোনায় মন বসাতে পারবো না!’
আমি হেসে বললাম,’এই কথা। কোন ব্যপার না। তোমার জন্য আমি এরচেয়ে বেশি ত্যাগও স্বীকার করতে পারি!’
আমান তখন আমায় কাছে টেনে নিলো।আর কপালে, চিবুকে চুমু খেতে খেতে বললো,’আমি জানি তুমি পারবে। এই জন্যই তোমায় ভালোবেসেছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আমার আপন মানুষ করেছি!’
কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ভয় করছে।এতো বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেছে আর এই খবরটা ওকে না জানিয়ে পরে তো আবার বিপদে পড়বো না!
এর ভালো সমাধান দিতে পারবে নিতু।নিতুর সাথে কথা বললেই হবে।ও নিজেই তখন আমানের সাথে কথা বলবে। আমানকে বিষয়টা জানিয়ে রাখবে।জানানোর প্রয়োজন অনুভব না করলে জানাবে না!
সেদিন রাতেই আমি নিতুর নম্বরে ফোন করলাম।নিতুকে বললাম,’নিতু,তোর সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।তুই কাল সকালেই আমার হোস্টেলে আয়।’
নিতু বললো,’আমার একটু সমস্যা আছে।আমি পড়শুদিন তোর ওখানে আসবো।’
নিতু পড়শুদিনও এলো না।এলো আরো সপ্তাহ খানেক পরে।সে এসে বললো পরিবারের অনেক ঝামেলা ছিলো এই জন্য আসতে পারেনি।
আমি বললাম সমস্যা নাই। তারপর শুরু করলাম আসল কথা।
নিতু কে ডেকে নিরালায় নিয়ে বললাম,’নিতু,একটা সর্বনাশ তো হয়ে গেছে!’
নিতু বললো,’কী হয়েছে?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’আমি মা হতে যাচ্ছি!’
নিতু ফিক করে হেসে উঠলো। তারপর আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,’সিরিয়াসলি?’
আমি বললাম,’তো কী?তোর সাথে আমি ফান করছি!’
‘আমান জানে এসব?’
নিতু মুখ শুকনো করে কথাটা বললো।
আমি বললাম,’না। ওকে তো জানানো নিষেধ।ওর উপর এমনিতেই প্রেশার। পড়াশোনা। পরীক্ষা।কত টেনশন!’
নিতু আবার হেসে উঠলো। তারপর বললো,’ভালো করেছিস।না জানানোই ভালো। পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হয়ে রেজাল্ট শুনাতে এসে দেখবে বউ বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
নিতু আবার হাসতে লাগলো।
আমি বললাম,’নিতু,তুই কী মনে করিস আমানকে এই বিষয়ে কিছু জানানো উচিৎ?’
নিতু শুকনো গলায় বললো,’এটা তুই ভেবে দেখ।কারণ ওর ভালো ফলাফলের উপর তোদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তবুও তুই যদি চাস জানাতে তবে সমস্যা নাই। আমিও জানাতে পারি!’
আমি তখন বললাম,’না না। তবে আর এসব জানানোর প্রয়োজন নাই।সময় হলে এমনিই জেনে নিবে।’
নিতু আমার একটা হাত ধরে তখন আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’তুই আসলেই লক্ষ্মী মেয়ে। লক্ষ্মী মেয়েরা সব সময় স্বামীদের মঙ্গল কামনা করে!’
তারপর বিকেল বেলা নিতু চলে যাওয়ার আগে আমায় সান্তনা দিয়ে গেল।বললো,’তুই টেনশন করিস না। অবশ্য একটা ভয় আছে। কনসিভ যেহেতু করেছিস পেটের ভেতর বাচ্চা বড় হবে।আর বিয়ের ব্যাপারে যেহেতু তোর পরিবার কিংবা আমি ছাড়া আর কোন বন্ধু বান্ধব কিছু জানে না এই জন্য তোকে একটু লুকিয়ে থাকতে হবে। সমস্যা নাই।আমি বাসার ব্যবস্থা করে দিবো।’
নিতু এই কথা বলে সেদিন চলে গেল। কিন্তু এরপর থেকে আর তার সাথে কোন ভাবেই যোগাযোগ করা গেলো না।সময় যাচ্ছে। আমার পেট বড় হয়ে উঠছে। এবার তো মহা বিপদে পড়েছি। মানুষ ইদানিং কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে!না এখনও কেউ সরাসরি প্রশ্ন তুলেনি। কিন্তু তুলতে কতক্ষন! তাছাড়া বাড়িতেও কেউ জানে না। এবার যদি জেনে যায়!
আমার লুকোনো প্রয়োজন।নিতু বলেছিলো ও নিজে সবকিছু ব্যবস্থা করে দিবে। এখন তো তার নাগালও পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনের সুইচও বন্ধ!
এখন আমার টেনশন হচ্ছে। ভীষণ রকম টেনশন।কী হবে আমার।এই বিপদ থেকে আমি উদ্ধার পাবো কী করে?
‘
গতকাল দুপুর বেলা হঠাৎ করে আমার পাশের রুমের এক মেয়ে বললো,’এই শোন,তোর কী বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে নাকি?’
আমি শুকনো হাসি হেসে বললাম,’এমন মনে হলো কেন তোর?’
সে হেসে বললো,’তোকে না প্রেগন্যান্ট মেয়েদের মতো লাগছে!’
কথাটা বলে হাসতে হাসতে সে তার রুমের ভেতর ঢুকে গেল।
এবার তো আরও ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়েছি আমি।এই কথাটা একজন থেকে অন্যজনে ছড়াতে সময় লাগবে না।সময় লাগবে না দুশ্চরিত্রা উপাধি নিয়ে হোস্টেল থেকে বহিষ্কার হতেও!বাবা মার কাছ থেকে তো চিরদিনের জন্য তজ্য হতে হবেই!’
এবার আমি কোন উপায় না দেখেই আমানকে ফোন করলাম। পরপর দশবার ফোন করার পরেও সে ফোন রিসিভ করলো না। এগারো বারের সময় একজন বয়স্ক মহিলা ফোন রিসিভ করলো।আমি ভয় পেয়ে কেটে দিলাম।এর খানিক পর আবার ফোন দিলে ঠিক আগের মহিলাই ফোন রিসিভ করলো। আমি ভয় পেয়ে আবার ফোন কেটে দিলাম। তারপর আবার দিলে ঠিক একই মহিলা রিসিভ করলো।আমি এবার উপায়হীন হয়েই বললাম,’আন্টি,আমান আছে এখানে?’
মহিলা খসখসে গলায় বললো,’তুমি কে? আমানের কাছে কী প্রয়োজন?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’আন্টি,আমি আমানের বন্ধু।ওর সাথে পড়ি। আমাদের তো বিসিএস পরীক্ষা। ও আমার নোটটা নিয়েছিল আর কি!ওর কাছ থেকে এটা ফেরত নিতে চেয়েছিলাম। এই জন্যই ওকে প্রয়োজন!’
ওই মহিলা তখন ওপাশ থেকে রাগমাখা গলায় বললো,’ফালতু কথা বলার আর জায়গা পাওনা মেয়ে। আমার আমান আজ থেকে তিনমাস আগে আমেরিকা চলে গেছে।আর তুমি বলছো তোমরা একসাথে বিসিএস দিবে। তোমার কাছ থেকে সে নোট ধার নিয়েছে!’
ওপাশ থেকে মহিলার মুখ থেকে এই কথাটা শোনার পর আমার মাথা প্রচন্ড রকম ঘুরতে লাগলো।সারা শরীর জুড়ে কেমন মর ঘাম দিয়ে উঠলো। এবং তৎক্ষণাত আমার বমি হলো।বমির পর আমি এলিয়ে পড়লাম বিছানায়। আমার পাশের রুমের এক মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমায় হসপিটালে নিয়ে গেল।বাবা মাকেও সে ফোন করেছে।বাবা মা হসপিটালে আসছে।ডাক্তার আমায় দেখছে। টেস্ট দিয়েছে।আমি জানি একটু পর ডাক্তার কী বলবে। কিন্তু ভয় পাচ্ছি বাবা মার কথা ভেবে। তারা এসে যখন জানবে শহরে পড়াশোনা করতে এসে তাদের আদরের একমাত্র মেয়ে এখন প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছে তখন কী অবস্থা হবে তাদের? কিংবা আমার সাথেই তাদের আচরণ কিরকম হবে? হোস্টেলের সব কজন যখন বিষয়টা জানবে তখন?
‘
#চলবে
কতোটা চাই তোকে পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব
#কতোটা_চাই_তোকে💖
#Writer:—#TanjiL_Mim💖
#part:—23(শেষ)
.
.
🍁
“সময় কারো জন্য থেমে থাকে না’!!তেমনি মাইশা আর কাব্যের জীবনও থেমে ছিল না’!!খুনশুটি, ভালোবাসা, হাসি কান্না মিলে মিশে জীবন চলছে তাদের’!!
_____________________
“দেখতে দেখতে পুরো চার বছর কেটে গেছে মাইশা আর কাব্যের সংসারের’!!এই তিনবছরে অনেক কিছু বদলে গেছে’!!বদলে গেছে সময়’!!বদলে গেছে জীবন’!!তার সাথে বদলে গেছে দুটো মানুষের একসাথে পথ চলার ধরন’!!মাইশার এখন পড়াশোনা প্রায় কমপ্লিট করে ফেলেছে’!!আর কাব্যের এভাবে রাত জেগে পড়াশোনা করানোর ফলও খুব ভালো করে পেয়েছে’!!মাইশা আর তানিশা দুজন একসাথেই পড়াশোনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে’!!তবে পার্থক্য একটাই তানিশার এখনো বিয়ে করে নি আর মাইশা এক বাচ্চার মাও হয়ে গেছে’!!বিষয়টা কিছুটা মজাদার তাই না’!!আর মাইশা আর কাব্যের একটা দুই বছরে মেয়ে আছে’!!যার নাম রেখেছে “কাশ্মীরা”!!
.
.
.
.
.
🌼
“আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি’!!মূল উদ্দেশ্য হলো তৈরি হয়ে নিচে যাওয়া আজকে তানিশা আর দিহানের বিয়ের পাঁকা কথা বলবে সবাই’!!হুম তানিশা আর দিহান একে অপরকে ভালোবাসে’!!ভার্সিটিতে ঝগড়া করতে করতে কখন যে দিহান তানিশাকে ভালোবেসে ফেলেছে তা দিহান নিজেও জানে না’!!আর তানিশার কথা তো বাদই দিলাম মনু তলে তলে নিজেও যে দিহানের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল’!!কিন্তু মাইয়া ডা প্রকাশ করছিল না’!!একদিন রেস্টুরেন্টে ধরা পড়েছিল আমার আর কাব্যের সামনে’!!সেদিন সারাদিন শুধু তানিশা আর দিহানকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিলাম আমি’!!কাব্য প্রথমে একটু রেগে থাকলেও পরে মেনে নেয়’!!তারপর আমি আর কাব্য মিলেই ওদের কথা বাসায় বলে সব ঠিকঠাক করে দিলাম’!!সবাই রাজি’!!সাথে আমরাও খুশি তার সাথে তানিশা আর দিহানও!!দিহানের বাবাও একজন বিজনেস ম্যান’!!আর এখন থেকে দিহানও সেই কাজে যোগ দিবে’!!এতোদিন পড়াশোনা শেষ না করার জন্য ওদের বিয়েটা আঁটকে ছিল’!!আর এখন যখন দিহানও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে সেই সুযোগে তাদের বিয়েটাও দিয়ে দিবে মামুনি আর মামু থুক্কু মাই শশুড় আব্বা এন্ড শাশুড়ী মা!!
“হর্ঠাৎই আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল কাব্য’!!তারপর বলে উঠলঃ
———“আমার বউটা কি করছে……
———“কি আর করবে তৈরি হচ্ছে আজকে তানিশাকে দেখতে আসবে না দিহানেরা তাই একটু সাজগোছ করছি আরকি!!
“এমন সময় কেউ হাতে তালি দিয়ে বললোঃ
——-“কি মজা পাপা আম্মি কে জ..নি.য়ে ধ..রে..ছে….
“হুট করে কাশ্মীরার মুখে এমন কথা শুনে অবাক হলাম’!!একটু খানি পুচকি মাইয়া বলে কি??
——–“দেখছো মেয়েটা এখনি পেকে গেছে……
“এদিকে কাব্য কাশ্মীরার মুখে এমন কথা শুনে হেঁসে মাইশাকে ছেড়ে দিয়ে কাশ্মীরাকে কোলে তুলে নিল’!!তারপর বললোঃ
———“হুম একদম মায়ের মতো…..
——–“কি আমার মতো হয়েছে মটেও না বাবার মতো হয়েছে….
“এই নিয়ে শুরু হয়ে গেল আমাদের মধ্যে তর্কাতর্কি’!!এমন সময় হর্ঠাৎ দরজায় নক করলো আম্মু’!!তারপর বললোঃ
——–“দিহানেরা চলে এসেছে তাড়াতাড়ি আয় তোরা……
“আম্মুর কথা শুনে আমরাও আর কথা না বারিয়ে তাড়াতাড়ি করে নিচে চলে আসলাম’!!
_____________________
“নিচে নামতেই দেখলাম সোফাতে দিহান আর দিহানের বাবা মা আর দিহানের একটা বন্ধু বসে আছে’!!আমি আর না দাঁড়িয়ে সোজা তানিশার রুমের দিকে পা বাড়ালাম’!!আর কাব্য কাশ্মীরাকে নিয়ে দিহানদের কাছে যেতে লাগলো’!!
.
“গোলাপি রঙের একটা সুন্দর শাড়ি পড়েছে তৈরি হয়েছে তানিশা’!!চুলগুলো খোলা,চোখে কাজল সাথে হালকা মেকাপ সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে’!!আমি তানিশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললামঃ
——–“উড়ে দোস্ত তোকে দেখি হেব্বি লাগছে’!!আজকে তো মনে হয় দিহানের চোখই সরবে না…..
“আমার কথা শুনে তানিশা লজ্জায় মাখা মুখ নিয়ে বললোঃ
——–”যা তুই যে কি বলিস……
——–“সত্যি কথা বললাম গায়ে লাগালি না ঠিক আছে কোনো ব্যাপার না যখন সত্যি সত্যি এমনটা হবে তখন বুঝবি’!!যাগ গে এখন চল তোকে নিতে এসেছি…….
“এমন সময় শাশুড়ী মাও রুমে ঢুকে বললেনঃ
———“হয়েছে তোদের……
——–“হুম হয়েছে আম্মু দেখ তানিশা কি সুন্দর লাগছে না……
“বিনিময়ে মামুনি শুধু মুচকি হাসলো’!!আর তার এই হাসি দেখেই আমি উওর পেয়ে গেছি……
“তারপর আর কথা না বারিয়ে চুপচাপ তানিশাকে নিয়ে চললাম নিচে……
“সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছি আমরা’!!সামনের সোফাতেই দিহানেরা বসে আছে আর তার দু-দিকে মামু মানে শশুড় আব্বা’ আর আমার আব্বুও!!আব্বু আম্মু সকালেই এসেছিল’!!আর তাদের জন্য সামনে টেবিলে রাখা রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবার’!!আমি গিয়ে তানিশাকে বসিয়ে দিলাম দিহানের সোজাসুজি সোফাতে……!!আঙ্কেল আন্টি তানিশা দেখে খুশি হলেন তারপর ওর হাতে একটা আন্টি পরিয়ে দিল…….
“যা বলে ছিলাম তাই হলো দিহান তানিশার দিকে তাকিয়েই রয়েছে চোখ সরাচ্ছে না’!!আমি তানিশার কানের দিকে ঝুঁকে বললামঃ
———“কি বলেছিলাম ননদীনী তোমার জামাই তোমায় দেখলে আর চোখ সরাতে পারবে না….
“আমার কথা শুনে তানিশা এক পলক তাকালো দিহানের দিকে’!!দিহানের এমন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে তা দেখে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে ফেললো তানিশা’!!
.
“এদিকে দিহানের এইভাবে তাকানো দেখে দিহানের বন্ধু রনি বলে উঠলঃ
——–“দোস্ত এখনি যদি এই ভাবে ভাবির দিকে তাকিয়ে থাকিস তাহলে বাসর ঘরে করবি কি….
“হর্ঠাৎ করে রনির এমন কথা শুনে দিহান কাশতে আরম্ভ করলো’!!যা দেখে তাড়াতাড়ি করে দিহানের হাতে একটা জুসের গ্লাস দিয়ে বললামঃ
——-“রনি কিন্তু ঠিকই বলছে দিহান…..
“দিহান আমার কথা শুনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললোঃ
———“তুই ও শুরু করে দিলি মাইশা……
“দিহানের কথা শুনে আমি আর রনি দুজনেই হাসলাম’!!আমার পাশের সোফাতে কাব্য ছিল’!!আর কাশ্মীরা আব্বুর কোলে চুপটি করে বসে আছে…..!!কাব্য মনে হাসলো রনি দিহান আর মাইশার কান্ড দেখে…….
“খুব সুন্দর ভাবেই আজকের দিনটা কেটে গেল সব দিক বিবেচনা করে আগামী ১০ দিন পর তানিশা আর দিহানের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে’!!আমি তো মহা খুশি’!!বাড়িতে বিয়ে হবে শুনলেই ভিতর থেকেই একটা আনন্দতা প্রকাশ পায়!!যেমনটা এখন আমার পাচ্ছে…….
•
•
•
•
•
•
•
•
•
•
~ দেখতে❤️দেখতে❤️পুরো❤️দশদিন❤️কেটে❤️গেল❤️
“এই দশদিনে পুরো ব্যস্ত ছিলাম আমরা’!!শপিং করা থেকে শুরু করে বাড়ির সাজানো পর্যন্ত সবই আমি কাব্য, আপু আর রাসেল ভাইয়া মিলে করেছি….
“আপুরাও তানিশার বিয়ে লক্ষ্যে এসেছে কাব্য দের বাসায়’!!আর আপু আর রাসেল ভাইয়ার একটা ছেলে সন্তান হয়েছে’!!যার বয়স কাশ্মীরার থেকে অল্প কয়েক মাসের বড়……!!আর ওর নাম রাখা হয়েছে “সায়ান”!!দেখতেও খুব সুন্দর হয়েছে’!!!
_____________________
“একটা রুমে লাল বেনারসি পরিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে বসে রাখা হয়েছে তানিশাকে’!!একরাশ ভালোলাগা খারাপ লাগা দুটো একসাথে মিশে খিচুড়ি তৈরি হয়ে হচ্ছে তার মস্তিষ্কে’!!এমন সময় রুমে ঢুকলো মাইশা……
~ “তানিশার রুমে ঢুকতেই দেখলাম তানিশা মনমরা হয়ে বসে আছে’!!তবে এটা হওয়া স্বাভাবিক’!!আজকে একটা লাল রঙের জর্জেট শাড়ি পড়েছি আমি,,চুলগুলো খুলে দিয়ে সাথে একটু সাজ’!!হর্ঠাৎই তানিশা এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল!!তানিশার কাজে আমি অবাক’!!পরক্ষণেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসলোঃ
——–“কি হলো পাগলী এভাবে কাঁদছিস কেন??
———“তোদের ছেড়ে চলে যেতে হবে আজকে…..
——–“কতদূর আর যাবি কাছেই তো আছিস যখন ইচ্ছে হবে তখনি চলে আসবি…..
“কিন্তু আমার এই গল্প শুনে তানিশার মন গললো না’!!আরো উচ্চস্বরে কেঁদে দিল’ তানিশা’!!আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললামঃ
———“ধুর পাগলী এইভাবে কাদিশ না তোর মুখের মেকাপ সব নষ্ট হয়ে যাবে’!!
“এমন সময় রুমে ঢুকলো আম্মু মামুনি আর আপু’!!তানিশার কান্না দেখে তাদেরও মন খারাপ হয়ে গেল’!তারপর সবাই মিলে তানিশাকে শান্ত করতে লাগলো’!!
“ওদিকে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল কাব্য’!!তার মনটাও খারাপ আজকে ছোট্ট বোনটাকে এই ভাবে অন্যের হাতে তুলে দিবে’!!ভাবতে তারো খুব কষ্ট হচ্ছে’!!আজকে কাব্য একটা ব্লাক রঙের পাঞ্জাবি পরেছে,আর বরাবরের মতো চুল গুলো খুব সুন্দর করে সাজানো,,!!হর্ঠাৎই কি মনে করে কাব্য আর ভিতরে ঢুকলো না ওখান থেকেই চলে গেল……..
_____________________
“বেশ কিছুক্ষন পর সবাই মিলে তানিশাকে শান্ত করলাম’!!এমন বাহির থেকে খবর আসলো জামাই এসেছে সাথে আমরাও উওেজিত হয়ে বেরিয়ে গেলাম তানিশার রুম থেকে আর তানিশা চুপটি করে বসে রইল বিছানায়!!
.
“খুব সুন্দর ভাবেই তানিশার বিয়ের সব কাজ সম্পন্ন হলো’!!খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে বিয়ে পড়ানো পর্যন্ত সবই খুব সুন্দর ভাবে শেষ হলো’!!
.
“এখন বিদায়ের পালা’!!বরাবরের মতোই বিদায়ের কান্না কাটি শুরু হয়ে গেল’!!তানিশা আমায়,আপুকে শাশুড়ী মা সহ কাব্য জড়িয়ে ধরে প্রচুর কেঁদেছে’!!আমরা সবাই কাঁদলেও কাব্য নিজেকে যথা সম্ভব শক্ত করে রেখেছে’!!কারন ছেলেদের তো কাঁদতে নেই’!!শেষমেষ বহুত কান্না কাটি করার পর তানিশাকে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দিল কাব্য’!!আর ওরা বসার সাথে সাথে গাড়িও চলতে শুরু করলো’!!শশুড় আব্বু আর আব্বু দুজনে মিলেই অনেককিছু বলে দিহানকে সাথে দিহানের বাবা মাকে’!!তারাও বলে দিয়েছে এত চিন্তা করতে হবে না “আপনার মেয়ে আমার বাড়িতে মেয়ে হয়ে থাকবে”!!তারপর তারাও আব্বুদের জড়িয়ে ধরে গাড়িতে বসে পরলেন’!!একে একে সব গাড়ি চলে যেতে লাগলো’!!
[গল্পের আসল লেখিকার নাম TanjiL Mim]
“ধীরে ধীরে পুরো বাড়ি খালি হতে শুরু করলো’!!শুধু থেকে গেল আব্বু আম্মু আপু আর রাসেল ভাইয়া……
..
…..
“সন্ধ্যা_৭ঃ০০টা……..
“সোফায় বসে আছে কাব্য, আপু, রাসেল ভাইয়া মামু, মামুনি, আব্বু, আম্মু এমন সময় গরম গরম চা নিয়ে হাজির আমি’!!সবাই হেঁসে হেঁসে চা খেতে শুরু করলো’!!আমাদের থেকে কিছুটা দূরে সায়ান আর কাশ্মীরা খেলছে…….
“সবাই চা খাচ্ছে আর কথা বলছে’!!এমন সময় কাশ্মীরা দৌড়ে এসে কাব্যকে বললোঃ
———“পাপা দেখো ছান আমার সাথে খেনছে না…
“এমন সময় সায়ান এসে বললোঃ
———–“ও মিততা কতা বনছে…
“এমন সময় কাশ্মীরা সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললোঃ
———“আমি মিততা কতা বনছি (একটা রাগী লুক নিয়ে)
———-হুম (সায়ান)
“এই নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া শুরু’!!এক পর্যায়ে দুজনেই আবার থেমে গিয়ে আবার এক সাথে খেলতে শুরু করলো’!!
“এদিকে আমরা ওদের দুজনের কান্ড দেখে হাসলাম!দুজনে এখনি কিভাবে ঝগড়া করছে বাবা গো বাবা…….
“সবাই হাসলো একসাথে সাথে আমিও……..
…
….
~ রাত_১১ঃ০০টা………
“বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে কাব্য’!!মনটা তার ভীষণ খারাপ লাগছে তার বোনের জন্য’!!তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কাব্য’!!আর মাইশা বিছানায় বসে কাশ্মীরাকে ঘুম পারাচ্ছে’!!
“কিছুক্ষন পর হর্ঠাৎ করে কেউ পিছন থেকে কাব্যকে জড়িয়ে ধরলো কেউ’!!পরক্ষণেই কাব্যের বুঝতে বাকি রইলা এটা মাইশা ছাড়া আর কেউ নয়’!!হর্ঠাৎ কাব্য বলে উঠলঃ
———“ঘুমাও নি……
——–“না এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন??
———“এমনি কাশ্মীরা ঘুমিয়ে পরেছে…..
——–“হুম……
——–“চলো ভিতরে ঘুমাবে না……
——–“হুম ঘুমাবো তো…..
“আমি কাব্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম’!!কাব্যের চোখের দিকে তাকাতে অবাক আমি’!কারন কাব্যের চোখে পানি….
“আমি কাব্যকে জড়িয়ে ধরে বললামঃ
——–“তুমি কাঁদছো কেন???
——-“কই কাঁদছি না তো মনে চোখে কিছু একটা পড়েছে……
——–“মিথ্যা কেন বলছো তুমি তানিশার জন্য খারাপ লাগছে বুঝি’!!আরে খারাপ লাগার কিছু নেই দিহান খুব ভালো ছেলে আর তার চেয়েও বড় কথা হলো ওরা একে অপরকে ভালোবাসে’!!তাই প্যারা নাই চিল বেবি…..
“আমার কথা শুনে হাসলো কাব্য…..
“কাব্যের মুখে হাসি দেখে আমিও খুশি হয়ে গেলাম’!!তারপর কাব্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললামঃ
———“কতোটা সময় পার হয়ে গেছে না আমরা একসাথে আছি…..
“আমার কথা শুনে কাব্য আমাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ
———“হুম আর বাকি জীবনটাও এইভাবে কাটিয়ে দিবো একসাথে…….
——–“হুম সারাজীবন এই ভাবে এওতো এওতো ভালোবাসবে কিন্তু আমায়……
——–“আর তুই……
———“আর আমিও তো তোমায় এওতো এওতো ভালোবাসি কেন বুঝো না তুমি জামাই…..
“মাইশার কথা শুনে হাসলো কাব্য তারপর একে অপরকে খুব গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরল’!!আর তাদের এই ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে রইল রাতের আকাশটা,আকাশে থাকা চাঁদটা’!!!
“আর এভাবেই চলছে মাইশা কাব্যের জীবন’!!আর সবাই মাইশা কাব্যের জন্য দোয়া করো যাতে সবসময় এই ভাবে হাসি খুশি আর ভালোবাসা নিয়ে থাকতে পারে…….
~ সমাপ্ত…🌹🌹
❤️❤️❤️[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ’!!আর আশা করি সবারই গল্পটা খুব লেগেছে’!!হয়তো সবার মনমতো হয় নি তারপরও যথা সম্ভব চেষ্টা করেছি তোমাদের আমার বেষ্টটা দেওয়ার’!!গল্পটা কেমন লেগেছে সবাই কমেন্ট করে জানাবে’!!তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে নতুন কোনো গল্প নিয়ে’!!সবাই ভালো থাকো!!সুস্থ থাকো!!]😊😊😊
~ আল্লাহ_হাফেজ❤️
#TanjiL_Mim♥️